৩৬. রক্ত শপথ ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৬
প্রথম প্রকাশ মার্চ, ১৯৭৩
এক
ট্রেঞ্চের ভিতর গলা থেকে শরীরের নিচের অংশ। কেবল মাথাটা ট্রেঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেটে গেল রাত।
| রেডিম লাগানো হাতঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে। হরিণদিয়ার মসজিদ থেকে আর খানিক পরই আজানের সুস্পষ্ট ধ্বনি ভেসে আসবে।
বেতনা নদীর ওপারে অন্ধকার। ট্রেঞ্চের বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে অন্ধকার নদীটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিল রাসেল। অন্ধকারে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে কিছু। কিন্তু কুকুরগুলো আহে ওপারে। ট্রেঞ্চের ভিতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
কিন্তু কেন এই অপেক্ষা? মনে মনে কারণ খুঁজতে থাকে রাসেল। দুশ্চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ও। গত পাঁচদিন থেকে চুঁ-শব্দ নেই ওপার থেকে। অথচ গতকাল অবধি শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ওদের।
আজ সোমবার। গত বুধবার থেকে দলে দলে এসেছে পাঞ্জাবী সেনারা! তাদের সাথে এসেছে মর্টার, রকেট, মেশিনগান। গতকাল অবধি শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে শত্রুদের। রাসেলের হিসাব যদি ভুল না হয় তাহলে খান-সেনাদের সংখ্যা এখন, পাঁচশোর কম নয়।
অথচ নদীর এপারে মুক্তিসেনারা মাত্র ছয় জন। তবু কেন অপেক্ষা করছে ওরা? কেন আক্রমণ করছে না।
গত পরশু থেকেই এই প্রশ্ন ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে রাসেলকে। সঠিক উত্তর খুঁজে পায়নি ও।
শহীদ এদিকে নেই। উত্তরে গেছে সপ্তাহ খানেক আগে। কোন খবরও পাঠায়নি। অন্যান্য ফ্রন্ট থেকেও কোন খবরাখবর আসহে না। অথচ প্রতিদিন খবর আসার কথা। খবর আসে কুয়াশার ফ্রন্ট থেকেও। দারুণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে কুয়াশা দলবল, নিয়ে। তার কোন খবর নেই।
আগস্ট মাসেও সীমান্ত থেকে বেতনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকাটা দখলদার বাহিনীর অধিকারে ছিল। সেপ্টেম্বর মাসের পয়লা তারিখে শহীদ একদল নিয়ে সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে।
কমিশনে যোগ দিয়ে শহীদ মেজর হয়েছে। শহীদের অধীনেই কাজ করছে ওরা সবাই। শহীদ রাসেলকে কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে উত্তরের মুকুন্দপুর সীমান্ত অতিক্রম কুয়াশা ৩৬
করার নির্দেশ দেয়।
শহীদ সীমান্ত পেরিয়ে বেনাপোলে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। খান-সেনারা প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যায় রেলপথ ত্যাগ করে। রাসেল এবং তার অধীনস্থ মুক্তি সেনারা খান-সেনাদেরকে বিতাড়িত করে বেতনা নদীর অপর পারে পালাতে বাধ্য করে।
কমান্ডার শাজাহান শহীদের নির্দেশে সাতরাপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে সোজা পূর্বদিকে এগিয়ে যায়। সাতরাপাড়া থেকে পুবদিকের বেতনা নদীর দূরত্ব বারো-তেরো মাইল। মাত্র বারো ঘণ্টায় দখলদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে নদী
অতিক্রম করে প্রাণ বাঁচায়।
ফলে গোটা এলাকাটা দশ-বারো মাইল মুক্ত হয় সেপ্টেম্বর মাসের দুই তিন তারিখের মধ্যেই।
| এটা অক্টোর। গোটা সেপ্টেম্বর মাস এবং অক্টোবরের কয়েক দিন ধরে নদী পেরিয়ে শত্রু সেনাদের ঘাটিতে আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। কখনও রাতের অন্ধকারে। নদী পেরিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কখনও ঘন্টার পর ঘণ্টা এপার থেকে মর্টারের গোলা বর্ষণ করে শত্রুদেরকে নাজেহাল করা হয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের যুদ্ধ করা সত্ব হয়নি। কারণ সেপ্টেম্বর মাসের সাত তারিখ থেকে সব কটা ফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে শত্রুদের। এদিকে এতবড় মুক্তাঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর সংখ্যা সর্বসাকুল্যে মাত্র চলিশ জন। শত্রুদের মোট সংখ্যা হাজার তিনেক। এখন আরও অনেক বেশি। অবশ্য কুয়াশার দলবলকে বাদ দিয়ে মুক্তি বাহিনীর সদস্য চল্লিশ।
কেমন যেন থমথমে ভাব একটা। শান্ত কিন্তু গভর। অন্যান্য ফ্রন্টের অবস্থা জানা গেলেও রাসেল অনুমান করে যে সব ফ্রন্টেই অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে।
উত্তরে রাজনগর। শহীদ সেখানে গেছে সংঘর্ষের খবর পেয়ে। কমান্ডার তৈয়ব তার দলবল নিয়ে আছে ওখানে। সম্ভবত, যুদ্ধ চলছে বলে শহীদের দেরি হচ্ছে ফিরতে! মাত্র ছয় মাইল দূরে রাজনগর।
কিন্তু যুক্তিটা অচল। বুঝতে পারে রাসেল। মাত্র ছয় মাইল দূরে যুদ্ধ চললে শব্দ পাওয়া যাবেই। না, যুদ্ধ কোথাও চলছে না। সবগুলো ফ্রন্টই নিস্তব্ধ। গত কয়েক দিন কোন গোলাগুলির শব্দই কানে আসেনি।
এটা হরিণদিয়া গ্রামের শেষ প্রান্ত?
হরিণদিয়া লোকশূন্য বললেই হয়। গোটা গ্রামটায় দুজন বুড়ো, পাঁচজন প্রৌঢ়া, তিনটে বাচ্চা ছেলে-মেয়ে এবং একজন রুগ্ন যুবক ছাড়া আর কেউ নেই। আশপাশের অন্যান্য গ্রামগুলোর অবস্থাও প্রায় তাই। খবর নিয়ে আসা যাওয়ার মত লোক মেলে না। সায়ীদের কাউকে পাঠানোও অসম্ভব। কামাল যেতে চায়। কিন্তু রাসেল রাজি হয়নি।
নদীর ওপারে শত্রুদের ভিতর কেমন যেন একটা দৃঢ়তা লক্ষ্য করেছে রাসেল
ভলিউম ১২
ক’দিন থেকে। শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই। কিছু একটা করার কথা ভাবছে ওরা। মারাত্মক কিছুই হবে। পরিকল্পনাটা জানা সহজ নয়। কিন্তু অনুমান করা কঠিনও নয়।
•, সম্ভবত গোটা মুক্তাঞ্চলের উপর চারিদিক থেকে একই সময়ে আক্রমণ চালাবে। ওরা। জিরো আওয়ারের জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। তার আগে অবধি চুপচাপ আহে, থাকবে।
কান খাড়া হয়ে উঠল রাসেলের। অভ্যাসবশত ট্রিগারে চেপে বসল আঙ্গুল। একটু নড়ল স্টেনগানটা তারপর স্থির হলো। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে নদীটা রাসেল।
নদীর পানিতে শব্দ হয়েছে। হয়ত বড় মাছ মাথা তুলেছিল।
কামাল ভাই, সাবধান! ফিসফিস করে বলল রাসেল।
অন্ধকারে নদীর পানি দেখা যাচ্ছে না ভাল। কিন্তু অন্ধকারও অনেক রকম। কোথাও গাঢ়, কোথাও একটু হালকা।
দীর ওপর ভাসমান অবস্থায় গাঢ় একটুকরো অন্ধকার। এগিয়ে আসছে দ্রুত।
# বেতনা নদী। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি হলেও এখনও শুকিয়ে যায়নি। বিস্ময় বাধ মানছে না রাসেলের। গোলমাল হয়ে যাচ্ছে হিসেব। শত্রু বাহিনীর সংখ্যা এবং অস্ত্রবল কয়েকশো গুণ মুক্তি সেনাদের তুলনায়। অথচ চুপিসারে এপারে আসতে চাইছে কেন ওরা?
অবস্থা এবং অস্পষ্ট হলেও নদীর মাঝখানে গাঢ় কালো রঙের দ্রুত অগ্রসরমান বস্তুটি যে একজন মানুষ তাতে কোন সন্দেহ রইল না রাসেলের।
শত্রু আসছে। কিন্তু শত্রু মাত্র একজন। এ আর এক বিস্ময়।
তবে কি তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে শত্রু?
নদীর পাড় বলে কিছু নেই এপারে। নদীর যেখানে শেষ; ধান খেতের, পাট খেতের সেখানেই শুরু।
. পাট খেতের ভিতর ট্রেঞ্চ। সামনের ট্রেঞ্চে রাসেল। ডানে, পনেরো বিশ হাত দূরে সামাদ, তৈয়ব। পাঁচ হাত পিছনে কামাল একা। বায়ে ওদুদ। সামাদ এবং তৈয়বের কাছে মর্টার।
মালেক আছে গোলাবারুদ নিয়ে হরিণদিয়ায়।
নদী পেরিয়ে ডাঙায় উঠেছে শত্রু। লম্বা চওড়া প্রকাণ্ড দেহ। হাতে একটি এল, এম. জি.। কোন ভয় নেই লোকটার। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফাঁকা জায়গাটার উপর দিয়ে সোজা পাট খেতের দিকে এগিয়ে আসছে।
“ ব্যাপার কি! পলে পলে বিস্ময় বাড়ে রাসেলের। পাঞ্জাবীরা পৃথিবীর রো.গর্দভ তা দুনিয়ার মানুষ জানে। কিন্তু এতই গর্দভ। শত্রু এলাকায় কেউ অমন বুক ফুলিয়ে কুয়াশা ৩৬–
লম্বা লম্বা পা ফেলে যুদ্ধজয়ী বীরের মত হাঁটে?–
হাসি পেল রাসেলের। কিন্তু হাসতে পারল না। কেমন যেন খটকা লাগছে। রহস্য একটা আছে এর ভিতর। কিন্তু কি রহস্য?
| সোজা রাসেলের ট্রেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা। ট্রেঞ্চের পাশেই মাথা উঁচু করে শুয়ে রয়েৰে”রাসেল। ওর সামনে লম্বা সরু সরু পাট গাই কয়েকটা। কিন্তু অস্পষ্ট হলেও দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে ডোবা জায়গাটা।
এগিয়ে আসছে ছায়ামূর্তি। চমকে উঠল একটু রাসেল। কুয়াশা!
ছায়ামূর্তির হাঁটার ভঙ্গি দেখেই চিনে ফেলল রাসেল। কিন্তু কুয়াশা এল কিভাবে?
– নদীর ওপারে শত্রু। শত্রু এলাকা প্রায় পাঁচ মাইল অবধি বিস্তৃত। তারপর নৌঘটা। কুয়াশার এলাকা। নৌঘাটায় কুয়াশা রাজা। শত্রু আছে বটে নৌঘাটার চারিদিকে। কিন্ত কুয়াশা এবং কুয়াশার দলবল শক্তিকে প্রতিদিনই ধ্বংস করে দিচ্ছে বিপুলভাবে। প্রতিদিন কোন না কোন ফ্রন্টে শত্রুদল সম্পূর্ণ পরাজিত হচ্ছে। আবার রিইনফোর্সমেন্ট হচ্ছে অবশ্যি । কিন্তু কুয়াশাকে দমন করতে তারা আজ অবধি সফল হয়নিঃ প্রায় আট হাজার খান-সেনার কবর রচনা করেছে কুয়াশা এবং তার অনুগত অনুচরেরা। শত্রুপক্ষ কুয়াশার সাথে পেরে না ওঠার কারণ আছে।
যুদ্ধের অনেক আগে থাকতেই অদ্ভুত সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল কুয়াশা। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে তার গবেষণাগার ধ্বংস করে দেয়ায় অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক মারণাস্ত্র নষ্ট হয়ে যায় কুয়াশার। গত সাত মাস যুদ্ধ চলছে। এই সাত মাস দম ফেলবার মত সময়ও কুয়াশা পায়নি। তবু, এত কিছুর মধ্যেও দু’একটা অস্ত্র সে তৈরি করেছে। সে সব অস্ত্র দেখতে সামান্য হলেও কাজে এক কথায় অসামান্য। খান-সেনারা কুয়াশার সেই সব অস্ত্রের সামনে কোন মতেই পানি পাচ্ছে না হালে।
স্টেনগান হাতে ঝুলিয়ে ট্রেঞ্চ থেকে উপরে উঠল রাসেল। ‘কে, শহীদ?’– কুয়াশা হন হন করে এগিয়ে আসতে আসতে পাট খেতের নড়াচড়া দেখে বলে উঠল।
. আমি রাসেল।’’
পাটখেত থেকে বেরিয়ে এল রাসেল। বলল, ‘আপনি? হঠাৎ শত্রু এলাকা থেকে?’
বিস্ময় বাধ মানছে না রাসেলের। ‘শহীদ কোথায়?’ কুয়াশা রাসেলের সামনে এসে দাঁড়াল। রাসেলের একটি প্রশ্নের উত্তর দিল
ভলিউম ১২ ।
সে।
‘শহীদ ভাই উত্তরে গেছেন। কেন?
কুয়াশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রাসেল। বড় রহস্যময় মানুষ! মনে মনে কুয়াশা সম্পর্কে ভাল ও।
‘ওকে একটা খবর জানাতে এলাম।’
কলল কুয়াশা। একটু যেন চিন্তিত মনে হলো তাকে। বলল, “খবর পাঠিয়ে আনানো যায়?
না। খর থাকলে আমাকে দিয়ে যেতে পারেন। রাসেল এন্টু দৃঢ় করল কণ্ঠ। ‘মহুয়ারা বিপদে পড়বে দু’এক দিনের মধ্যেই। তাই খবরটা দিতে এলাম। আর কাউকে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু বিপদটা এমনই ভয়ঙ্কররূপ নিয়ে আসছে যে নিজেকেই আসতে হলো দায়িত্ব ছেড়ে।’
রাসেলের ঠিক বিশ্বাস হলো না কথাটা। | ‘মহুয়াভাবীরা তো ন্যাটাভিঙিতে। ওখানে আবার বিপদ কিসের?’ |
. কুয়াশা কলল, ‘বিপদ শুধু ওদের একার নয়। বিপদ তোমাদেরও। শুক্ররা গোটা মুক্তাঞ্চলের ওপর চারিদিক থেকে আক্রমণ চালাবে। মহুয়াদের এবং তোমাদের মাঝখানের পথ দখল করবে ওরা-মানে রাহিলীপোতায় ঘাটি করবে। শক্তিশালী ট্রান্সমিটার আছে আমার। ওদের কথাবার্তা ধরেছি। আগামীকাল কিংবা প্রও শুরু করবে ওরা জোড়েশোরে। ছয় হাজার শত্রু এক সাথে অ্যাডভান্স করবে।’
কি যেন ভাল কুয়াশা।
তারপর বলল, মহুয়াদেরকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলা দরকার। আমিই যেতাম। কিন্তু আজকেই ফিরে যেতে হবে আমাকে। আমার অনুচররা আমাকে হাড়া থাকতে পারে না। শহীদকে খরটা আজকেই পৌঁছে দিতে হবে। পারবে?’
| ‘চেষ্টা করব। শহীদ ভাইও নিশ্চয় শত্রুদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেন। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবেন তিনি। কিন্তু শত্রু এলাকার ভিতর দিয়ে এলেন কিভাবে আপনি, মি, কুয়াশা?
রহস্যময় এক টুকরো হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। বলল, ‘ইচ্ছা থাকলে সব হয়। ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম।’
পকেট থেকে টেনিস বলের চেয়ে কিছু ছোট দুটো গোল কালো জিনিস বের করল কুয়াশা। রাসেলের দিকে বাড়িয়ে দিল জিনিস দুটো সে।
কলল, রাখো এ দুটো। যেখানে ছুঁড়ে মারবে সেখানে পঞ্চাশ গজ জুড়ে আগুন জ্বলে উঠবে। রেখে দাও। কান্দে লাগবে।
হাত বাড়িয়ে জিনিস দুটো নিল রাসেল। লোহার মত ভারি জিনিস দুটো।
রাসেল হঠাৎ বলল, শহীদ ভাইকে সাবধান করে দেবার জন্যে প্রাণের ঝুঁকি ।! নিয়ে দল ছেড়ে চলে এসেছেন। কারণ কি? আত্মীয়তা, তাই না? তা আত্মীয়তার
কুশা ৩৬
জন্যেই আপনারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেননি। শহীদ ভাই এতবড় বুদ্ধিমান। এবং কৌশলী হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে গ্রেফতার করে পুলিসের হাতে তুলে দিতে পারেননি। অথচ পারা উচিত ছিল। শহীদ ভাই তো পারেনই, এমন কি আমিও পারতাম। কিন্তু আপনাদের মধ্যে আত্মীয়তাই বাদ সেধেছে।’
| চুপ করে রইল কুয়াশা।
তারপর কথা বলল সে। একটু যেন গম্ভীর শোনাল কুয়াশার কণ্ঠস্বর, শহীদ আমার আত্মীয়ই শুধু নয়, রাসেল। সে আমার বন্ধুও।’
রাসেল আবার কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশা বা ঘা দিয়ে বলল, ওসব কথা থাক রাসেল। আমার কথাগুলো ভাল করে শোনো। বিপদের খরটা বাস্তব। শহীদ যেন খবরটা আজকের মধ্যেই পায়। তুমি যদি খবরটা পৌঁছে দিতে না পার তাহলে সে দায়িত্বও নেব আমি।’
রাসেল বলল, ‘খবর আমি পৌঁছে দেব। কিন্তু যুদ্ধে তিনি এতই মগ্ন যে মহুয়া, ভাবীদের কথা ভাবার সময় পাবেন কিনা বলা মুশকিল।
আমার কথা বলে। তাহলেই কাজ হবে।’ চলে গেল কুয়াশা নদী পেরিয়ে।
নদীর ওপারে গাঢ় অন্ধকার। অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা। অবাক বিস্ময়ে নদীর অপর পাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল রাসেল। মানুষটা কি দুঃসাহসী। বিরাট এক শত্রু এলাকার ভিতর দিয়ে একাই চলে এসেছে সে। আবার একাই ফিরে যাচ্ছে।
| শহীদের জন্যে কুয়াশার বুকে মায়া, স্নেহ, ভালবাসা যে প্রচুর তাতে কোন সন্দেহ রইল না রাসেলের।
দুই পরদিনই রাসেলের খবর পেয়ে ফিরে এল শহীদ। শহীদের মুখে খবর শুনে গম্ভীর হয়ে উঠল রাসেল। কুয়াশা যেমন বলে গেছে তেমন ঘটনা ঘটার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে সবগুলো ফ্রন্টে।
গোলাগুলি গত কয়েকদিন ধরে একেবারে করেনি বললেই চলে শত্রু! অথচ সবগুলো ফ্রন্টেই শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ওদের।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা সবচেয়ে আগে করল রাসেল, আমরা অতিরিক্ত সাহায্যের আশা করতে পারি, শহীদ ভাই?’
শহীদ বলল, না। কারণ আমাদের এলাকাটা মুক্ত হয়েছে বেশ অনেকদিন হলো। শত্রুকে হটিয়ে দিয়েছি আমরা নদীর ওপারে। হাইকমান্ড জানে যে আমাদের শক্তি যথেষ্ট। তাছাড়া এখন আমাদেরকে সাহায্য করা সম্ভবও নয়। রীতিমত বড় একটা সংঘর্ষে জিতে এই এলাকায় ঢুকতে হবে মুক্তিবাহিনীকে। সাহায্যের আশা ছেড়ে দাও।’
৯৪
ভলিউম ১২
রাসেল বলল, সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। ওদের উদ্দেশ্য এখন পরিষ্কার। সব ক’টা ফ্রন্টে একযোগে আক্রমণ করবে ওরা। দেরি না করে আমাদের উচিত. প্রথমে আক্রমণ করা। ওদের কয়েকটা ঘাটিতে একই দিনে গেরিলা আক্রমণ চালাতে হবে।’
শহীদ একমত হলো। বলল, তা ঠিক। তবে লোক সংখ্যা আমাদের বড় কম। রাজনগরের কাছে বেতনা নদী পেরিয়ে কমান্ডার শাজাহান এবং জহির দীপাদিহিতে আক্রমণ চালাতে গিয়ে শহীদ হয়েছে।
রাসেল দাঁতে দাঁত চাপল, বলল, “শাজাহানকে কেড়ে নিয়েছে ওরা! বেশ, শহীদ ভাই, আমি যাব দীপাদিহিতে। সঙ্গে অদুদ থাকবে।’
শহীদ রাসেলের দুই চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। লাল হয়ে রয়েছে চোখ দুটো। আপত্তি করতে পারল না শহীদ। বলল, তাই যাও।’
আজ রাতেই যেতে চাই আমি! আপনি কি করবেন? মহুয়াডাবী…।’ শহীদ কলল, ‘বেশ। আমি আরও একটি দিন দেখব।’ রাজনগর এবং দীপাদিহি। বেতনা নদীর এপারে রাজনগর ওপারে দীপাদিহি। দুটোই ছোট গ্রাম।
গত পরও গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করার সময় শাজাহান এবং জহির ওপারে নিহত হয়েছে। খান-সেনারা দীপাদিহি থেকে সরে গিয়ে ঘাটি করেছে তেবারিয়ায়।
• সন্ধ্যার অনেক আগে রাসেল কামালকে সঙ্গে নিয়ে রাজনগরে পৌঁছুল। অদুদের বদলে কামালকে পাঠিয়েছে শহীদ। বলেছিল, আমি পারলে নিজেই যেতাম। কিন্তু আমাকে থাকতে হবে’গোরপাড়া অপারেশনে। হরিণদিয়ার ওপারেই গোরপাড়া।
রাজনগরে ছিল আসলাম, সাদেক আর জজ। ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে রাসেল সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।
সন্ধ্যার পর ক্রল করে নদীর প্রায় কিনারায় গিয়ে পৌঁছুল ওরা। পঁচিশ গজ পর পর ট্রেঞ্চ।
রাসেল এবং কামাল রইল একই ট্রেঞ্চে।
দীপাদিহি অন্ধকারে ডুবে আছে। শহীদের দেয়া বায়নোকুলার দিয়ে প্রায়। আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করার পরও কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেল না শত্রুদের।
সাদেকদের দেয়া রিপোের্টই ঠিক। দীপাদিহি ত্যাগ করে পিছিয়ে গেছে শত্রু। তেবারিয়ায় ঘাটি করেছে ওরা। দীপাদিহিতে হয় দু’একজন অবজারভার আছে। ট্রেঞ্চে।
রাসেল সিদ্ধান্ত নিল রাত দুটোর দিকে নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে ওরা। সঙ্গে যাবে কামাল। সাদেক এবং আসলাম শত্রুদেরকে ভুল বোঝাবার জন্যে মর্টার হুঁড়বে কুয়াশা ৩৬
৯৫
অবিরাম।
কিন্তু সব পরিকল্পনা তছনছ হয়ে গেল। রাত সাতটার পরই ঘটে গেল এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড।
প্রায় কাঁধ অবধি লম্বা চুল নেড়ে রাসেল বলল, ‘প্রেম? ভালবাসা? তা ভালবেসেছি বৈকি। প্রেমেও পড়েছি। স্বাধীনতাকে ভালবাসি আমি। দেশের প্রেমে পড়েছি।
হেসে ফেলল কামাল। বলল, সে তো খাঁটি কথা। দেশপ্রেম তো প্রায় সকলেরই আছে। কিন্তু আমি বলছিলাম…।’
রাসেল বাধা দিয়ে বলল, লীনার মত আমার কেউ আছে কিনা? নেই, কামাল ভাই, অভাগার তেমন কেউ নেই। ভালবাসা আমি পাইনি, প্রেয়সীরও নয়, বন্ধু বান্ধবেরও নয়। বাবার স্নেহ ভালবাসা…তাও আমি পাইনি। আমি যখন ছোট্টটি তখন বাবা মারা যান। আম্মা ছিলেন অন্ধ। তারই দরকার ছিল ভালবাসার। দিয়েছি। আম্মাকে আমি আমার চেয়েও বেশি ভালবাসতাম। আর বোনটি ছিল ছোট। বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই চাইত সে ভালবাসা। তাকেও দিয়েছি। বন্ধু বান্ধবদের সংখ্যা আমার নিতান্ত কম। কারণ কি জানেন, কামাল ভাই? সমবয়েসী ছেলেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, উদ্যম, সাহস এবং ন্যায়পরায়ণতা বড় কম। আমার মত কেউ নয়। জীবন সম্পর্কে আমার ধারণার সাথে আর কারও ধারণা মেলে না। মি, কুয়াশার সাথে আমার মনোগত বিরোধ লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়? কারণ কি জানেন? মি. কুয়াশা আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিরাট এক হিরো। তারা ওঁর সব কাজকেই অনুমোদন করে। আমি পারি না বলে তর্ক বাধে। এবং তর্কে তারা না পেরে আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায়। মি. কুয়াশা শ্রদ্ধার পাত্র। হাজার হোক প্রতিভাবান পুরুষ তিনি। কিন্তু বিপথগামী প্রতিভার যে-কোন অন্যায় কাজকে সমর্থন কাটা হীনমন্যতার পরিচয়। অন্তত আমি তাই মনে করি । বিজ্ঞানের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। খুব ভাল কথা শ্রদ্ধা করতে হয় তাকে। কিন্তু তাঁর সাধনার প্রয়োজনে টাকা সংগ্রহের পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত নয় কেন? কেন তিনি মানুষের জীবন। নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন?”
এপারে অন্ধকার। ওপারে অন্ধকার। আকাশে মিটিমিটি জ্বলছে তারা। শিয়াল ডাকছে দূরে কোথাও। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে গুলির শব্দ থেকে থেকে। নাইট বায়নোকুলার চোখে লাগিয়ে নদীর ওপারটা দেখছে রাসেল।
এক ব্যান্ডের পকেট রেডিও অন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরার চেষ্টা করছে আসলাম ডানদিকের ট্রেঞ্চে বসে। “ অকস্মাৎ পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল রাসেলের সর্বশরীর। সিফিস করে কলল, কামাল ভাই, নড়বেন না, খবরদার!
কি যেন অনুভব করছে রাসেল। এতটুকু মড়ছে না ও।কি যেন উঠে আসছে পা
৯’ও
ভলিউম ১২
থেকে উপর দিকে।
বিদ্যুতবেগে নুয়ে পড়ল রাসেল। অন্ধকারেই খপ করে ধরল কি যেন।
কি হলো। কামালের কণ্ঠে আশঙ্কা।
সিধে হয়ে দাঁড়াল রাসেল। ডান হাতে মোটা দড়ির মত কি যেন ধরা। মোচড় খাচ্ছে সেটা। :
সাপ। বলল রাসেল, ‘গর্ত থেকে বেরিয়ে আমার প্যান্টের ওপর দিয়ে উঠছিল। কি সাপ! কামড়াবে যে, ছেড়ে দিন। কি সাপ জানি না।
কথাটা বলে হেসে উঠল রাসেল। তারপর বলল, কামড়াবে কিভাবে? মেরে ফেলেছি!”
| ট্রেঞ্চের ভিতর বল দুজন। দেশলাই জ্বালল কামাল। আঁতকে উঠল ও, এ যে জাত সাপ, রাসেল! কেউটে!’
রাসেল উঠে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে মরা সাপটাকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আর একটু হলেই দিয়েছিল ঠুকরে! মরে যেতাম, এত সাধের প্রতিশোধ নেয়া হত না।
কামাল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, স্বাধীন হতে আর কতদিন লাগবে বলে তো রাসেল?’
‘পাঞ্জাবীগুলোকে এ বছরেই হয়ত ভাগিয়ে দেয়া যাবে বিদেশী রাষ্ট্রের সাহায্য পেলে। তা না হলে আরও হয় মাস সময় লাগবে। কিন্তু মানুষের মুক্তি হয়ত এত তাড়াতাড়ি হবে না। শোষণের বিরুদ্ধ সংগ্রাম আমাদের। একদল শোষককে তাড়াব, কে বলতে পারে আর এক দল শোষক আমাদের ঘাড়ে চেপে বসবে না। এ দেশের মানুষের মুক্তি আরও অনেক দেরিতে আসূর্বে কামাল ভাই।
মাল বলল, তার মানে তুমি বলতে চাও…! শ শ শ…!’ ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে বলল রাসেল।
দেখাদেখি কামালও কান পাতিল রাসেলের মত। বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা। স্টেনগানটা ট্রেঞ্চের উপরকার মাটিতে রেখে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে রাসেল।
ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে চিৎকারটা । ‘একটি মেয়ে! কামাল ফিসফিস করে বলল, পশুগুলো কোন গ্রাম থেকে ধরে এনেছে নিশ্চয়।
রাসেলও শুনেছে। কথা বলল না ও। অন্ধকারে চোখ দুটো প্রতিহিংসায় জ্বলছে রাসেলের। হঠাৎ দাঁতে সঁত চেপে রাসেল বলল, আমি যাব।’
কপাল থেকে চুল সরিয়ে বায়নোকুলারটা চোখে লাগাল রাসেল।
মিনিট খানেক পর প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু ট্রেঞ্চ থেকে এক লাফে উপরে উঠে ৭-কুয়াশা ৩৬
গেল রাসেল।
* কামাল বলে উঠল, যাওয়াটা উচিত হবে না রাসেল। বরং ক্ষতি হবে! রাত দুটোর সময় আমাদের প্রোগ্রাম।’
রাসেল ট্রেঞ্চের উপর থেকে বলল, মেয়েটিকে বাঁচিয়ে আনা হয়ত সত্যি অসম্ভব। কিন্তু বোনের সম্মান এবং প্রাণ বাঁচাতে হলে অসম্বকে সম্ভব করার চেষ্টা তো একমাত্র ভাইয়েরাই করতে পারে। আমি চললাম।
| ক্রল করে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে রু করে রাসেল।
কামাল পিছন থেকে বলে, ‘আমিও আসছি।
না। আমি একা যাব। আমি যদি ফিরে না আসি তাহলে আপনি রাত দুটোর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবেন।
১ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রাসেল। অন্ধকারে খু বেশি দূর দেখা যায় না। খানিক পরই হারিয়ে ফেলল কামাল রাসেলকে।
নদীতে মৃদু শব্দ হলো। শব্দ শুনে কামাল বুঝল রাসেল নদীতে নেমেছে।
নদীতে স্রোত। কলকল শব্দ হচ্ছে। কামাল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অনুমান করে নদীর দিকে। পাশের ট্রেঞ্চে আসলাম অফ করে দিয়েছে রেডিও। সেও উল্কণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।
সময় বয়ে চলে।
এতক্ষণে হয়ত রাসেল দীপাদিহির মাঝখানে চলে গেছে। অসহায় মেয়েটির চিৎকার ঠিক কতদূর থেকে এসেছিল বলা মুশকিল। দীপাদিহি থেকেই হয়ত।
তেবারিয়া প্রায় দেড় মাইল দূরে।
এখন আর মেয়েটির চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।
কিন্তু অকস্মাৎ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে এল, এম. জি. একটানা ঠা ঠা ঠা শব্দ।
ধক করে উঠল বুকটা কামালের। রাসেল বোধহয় রা পড়েছে।
আর কোন শব্দ নেই। আবার নেমে এসেছে নিঃস্তব্ধতা! চঞ্চল হয়ে উঠল কামাল। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু রাসেল নির্দেশ দিয়ে গেছে রাত দুটোর প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত করতে। রাসেলের নির্দেশ অমান্য করে কি নদীর ওপারে এই মুহূর্তে যাওয়া উচিত হবে?
| দ্রুত বয়ে যাচ্ছে সময়। এখুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্তত রাসেলের লাশটা উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারে না কি ওরা?
ভলিউম ১২
তিন
নদী পেরিয়ে সরাসরি তীরে না উঠে দীপাদিহি মসজিদে ঢুকে পড়েছে সিঁড়ি টপকে রাসেল। নদী থেকেই উঠে গেছে সিঁড়ির ধাপ। মসজিদে ঢুকে নাইট বায়নোকুলার দিয়ে আশপাশটা ভাল করে দেখে নিয়ে এগোবার রাস্তা ঠিক করে নেয় ও।
| দক্ষিণমুখো মসজিদ। পুবদিকের দেওয়ালের পাশ দিয়ে চলে গেছে গরুর গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত মেঠো পথ। অদূরেই একটি চারকোণা পুকুর। পথটা এসেছে নৈহাটি থেকে।
দীপাদিহি এবং তেবারিয়ার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় নৈহাটি। নৈহাটি কোন গ্রাম নয়। হাট। মঙ্গল এবং শনিবার হাট বসে। গত মাস তিনেক অবশ্য হাট বসেনি।
| নৈহাটি থেকে অনেকটা দক্ষিণে কৃষ্ণপুর। বেশ বড় গ্রাম।
দীপাদিহি থেকে তোরিয়া যাবার পথটা সহজ এবং অনেকটা নিরাপদ। চওড়া মেঠো পথ হাছাও জঙ্গল আহে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনায়াসে এগিয়ে যাওয়া। যায়। কিন্তু মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল রাসেলের। নৈহাটিই ওকে টানহে।
দীপাদিহি জ্বালিয়ে দিয়েছে শত্রুরা। বাঙ্কার করে ছিল গত পরশু অবধি। কিন্তু পিছিয়ে গিয়ে এখন আহে তেবারিয়ায়। অথচ মেয়েটির চিৎকার অদূর থেকে । আসতে পারে না। বড়জোর নৈহাটি হাট থেকে চিৎকার ভেসে আসতে পারে। নৈহাটির দিকেই যাবে ঠিক করল রাসেল। .. ..
চওড়া মেঠোপথের পাশে দুটো মাত্র বাড়ি। লোকজন নেই। একটি খেজুর গাছ রাস্তার ওপরই। কিন্তু রাস্তার পাশে ঘন লম্বা লম্বা ঘাস।
ঘাসের রাজ্য থেকে মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে আসে রাসেল। স্টেনগানটা শক্ত করে ধরা। বায়নোকুলার দিয়ে অদূরবর্তী হাটটা দেখতে গিয়েই পিছিয়ে আসে ও দ্রুত।
হাটের একটি দোকানের দরজা খোলা। দোকানে কয়েকজন লোক বসে রয়েছে। কিছু একটা করছে তারা। সম্বত মেয়েটির সর্বনাশই করছে। কিন্তু তা দেখে পিছিয়ে আসেনি রাসেল।
একজন লোক তীরবেগে ছুটে আসছে দূরের পথ দিয়ে। প্রায় শ দুয়েক গজ দূরে লোকটা। ছুটে আসছে না, যেন উড়ে আসছে। সাদা শট এবং ঢোলা সালোয়ার পরনে লোকটার। নিশ্চয়ই পাঞ্জাবী সেনা, সিভিল ড্রেসে।’
আরও পিছিয়ে গেল রাসেল। ব্যাপার কি? শত্রুদের মধ্যে এমন চঞ্চলতার কারণ?
পদশব্দ এবার শোনা যাচ্ছে।
ঘাসের ভিতর ঢুকে পড়েছে রাসেল। হাটের মধ্যবর্তী দোকানটার ভিতরকার
কুয়াশা ৩৬
লোকগুলো শুনতে পেয়েছে পদশব্দ। দোকানটার মাঝখানে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। ট্রেঞ্চ আছে দোকানটার ভিতরে।
তীরবেগে ছুটে আসছে লোকটা হাটের দিকে। হাটের ভিতর ঢুকেই লোকটা চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল একটি দোকানের ভিতর। শেষ মুহূর্তে তার হাতে একটি এল, এম, জি, দেখল রাসেল। রহস্যময় ব্যাপার। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি। হঠাৎ দেখা গেল আরও দুজন লোককে। একই পথে ছুটে আসছে দুজন লোক সবেগে।
প্রথম লোকটা হাটের প্রথমভাগের একটি দোকানে আত্মগোপন করে রয়েছে। তাকে ধরার জন্যেই সম্বত অপর লোক দুজন ছুটে আসছে।
নাইট বায়নোকুলার দিয়েও,ভাল দেখতে পাচ্ছে না রাসেল। অস্পষ্ট যা দেখা, যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে এ-লোক দুজনও পাঞ্জাবী। সাদা পোশাক পরা।
আত্মগোপনকারী লোকটার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে লোক দুজন। ওদের হাতে চায়নিজ স্টেনগান।
অকস্মাৎ আত্মগোপনকারী লোকটা আড়াল থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছু ধাওয়ারত লোক দুজনার উপর।
চোখের পলকে ধরাশায়ী হলো লোক দুজন। প্রথম লোকটার শক্তি-সামর্থ্য অন্য দুজনার তুলনায় অনেক বেশি। প্রথম ব্যক্তি তার শত্রুর একজনের তলপেটে প্রচণ্ড এক লাথি মেরেই দ্বিতীয়জনের নাক ব্রার ভীষণ এক ঘুসি চালাল।
লাথি খেয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিটকে পড়ল দূরে। নড়াচড়া করতে দেখা গেল না আর তাঁকে। তৃতীয় লোকটার বুকে চেপে বসেছে প্রথম লোকটি।..
দূর থেকে পরিষ্কার দেখা না গেলেও রাসেল বুঝতে পারল প্রথম লোকটি তার শত্রুর গলা টিপে ধরেছে বজ্রমুষ্টিতে। আক্রান্ত লোকটি চেষ্টা করছে নিজেকে মুক্ত করতে। কিন্তু ব্যর্থ সে চেষ্টা।, একমিনিট পরই উঠে দাঁড়াল প্রথম লোকটি। এগিয়ে গেল সে তার দ্বিতীয় শত্রুর দিকে।
লাথি খেয়ে লোকটা পড়ে গেছে। পড়েই আছে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল প্রথম লোকটা। অকস্ম, “ এল. এম. জি.র নল দিয়ে তীব্রবেগে ঘা মারল সে তার শক্রর মাথায়।
• ঘুরে দাঁড়াল এবার লোকটা। পিছন দিকে, দূরে, তাকাল সে একবার। তারপর সামনের দিকে পা বাড়াল।
এগিয়ে আসছে লোকটা এদিকেই।
এদিকে হাটের মধ্যবর্তী দোকানটার ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে তিনজন পাঞ্জাবী সৈন বেরিয়ে এসেছে। ক্রলিং করে দোকানের বাইরে বেরিয়ে আসছে এবার তারা ।
সাদা পোশাক পরা লোকটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। সে দেখতে পাচ্ছে না
১০০
*
ভলিউম ১২
সেনাগুলোকে। সেনা তিনজন-ক্রলিং করে অনেকটা এগিয়ে এসে হাটের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার সামনে একটি দোকানের আড়ালে এসে থামল। দ্রুত অগ্রসরমান লোকটি সেই পথেই এগিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক পা । মুখোমুখি হবে ওরা।
হল্ট!’
খান-সেনদের একজন আদেশ করল। রাস্তার পাশে তারা তিনজন। রাস্তার উপর লোকটা।
বিদ্যুৎ খেলে গেল রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়া লোকটার শরীরে। হল্ট শব্দ কানে ঢোকার সাথে সাথে থমকে দাঁড়িয়েছিল সে। তারপর মাত্র এক সেকেভের ব্রিতি । পরের সেকেন্ডেই দেখা গেল ঘুরে দাঁড়িয়েই এল, এম. জি.-র ব্রাশ ফায়ার করছে
মনে মনে লোকটার বিদ্যুতগতির প্রশংসা না করে পারল না রাসেল। অদ্ভুত ক্ষমতা।
| এক ব্রাশ ফায়ারেই তিনজন খান-সেনা খতম হয়ে গেছে।
পরিষ্কার হচ্ছে না ব্যাপারটা। শত্রুদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে নাকি?
লোকটা দেরি করল না। আবার দ্রুত এগিয়ে আসছে সে। এবার সে সরাসরি চওড়া মেঠোপথের দিকে অর্থাৎ রাসেলের দিকে এগিয়ে আসছে।
তৈরি হয়েই আছে রাসেল। চোখ-কান অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠল। শত্রু অদ্ভুত কৌশলী এবং শক্তিধর। মনে মনে নিজেকে হুঁশিয়ার করে দিল রাসেল সাবধান, রাসেল! | লোকটাকে থামার নির্দেশ দেয়াটা মারাত্মক আত্মঘাতী। নির্দেশ শুনে এক সেকেন্ডের মধ্যেই শব্দের উৎসের দিকে ব্রাশ ফায়ার করবে সে। অন্য উপায় দরকার।
কিন্তু লোকটাকে ধরে লাভই বা কি?
দ্রুত ভেবে নিল রাসেল। লাভই বেশি। রহস্যময় ব্যাপারটা জানা যাবে। শত্রু সেনাদের ঘটি সম্পর্কে তথ্য আদায় করা যাবে। সর্বোপরি একজন পরম শত্রুকে নরকে পাঠানো যাবে।
লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। মাত্র কয়েক হাত দূরে সে।
নিঃশব্দে বিড়ালের মত বেরিয়ে এল রাসল ঘাসের রাজ্য থেকে। স্টেনগানের নলটা লোকটার শির দাঁড়ায় ঠেকিয়ে চাপা কষ্টে নির্দেশ দিল ও, স্ট!
থমকে দাঁড়াল লোকটা। পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল তার সর্ব শরীর।
মুহূর্তে ভারি গলার হাসি শোনা গেল। ‘মিকুয়াশা! আপনি। কুয়াশা ৩৬
১০১
অবিশ্বাস ভরে বলে উঠল রাসেল। বিস্ময় বাধ মানছে না রাসেলের। গতকাল কুয়াশা ছিল পাঁচ ছয় মাইল পুবে আর আজ সে নৈহাটিতে।
। আমি কুয়াশা। তুমি একা নাকি? | রাসেল সামলে নিল নিজেকে দ্রুত। বলল, একাই। কিন্তু আপনি কেন এদিকে?”
কুয়াশার চোখমুখ গম্ভীর হয়ে উঠল একটু। বলল, “আর বলো না, ভাই! শহীদকে খবর দিতে এসে আটকা পড়ে গেছি। শত্রু এলাকার ভিতর দিয়ে পথ করতে পারছি না কোন মতে। অথচ ফিরতেই হবে আমাকে। তা না হলে আমার অনুরর শত্রু বাহিনীর ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে আমার খোঁজে এসে পড়বে। সেটা আমি চাই না। শত্রুপক্ষ প্রথমে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তাঞ্চলের ওপর আক্রমণ করুক আগে। তারপর আমরা পিছন থেকে…সে যাকগে। শহীদকে খবরটা দিয়েছিলে?’ | রাসেল কলল, “দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কথা পরে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, দয়া করে। ছুটে আসছিলেন কেন আপনি?
‘ডিনামাইট ফিট করে পালিয়ে আসছিলাম। ওদের ঘাঁটির বড় অংশটা উড়ে যাবে এখুনি। সলতেতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এসেছি। একজন দেখে ফেলেছিল। তাকে শেষ করে এসেছি। কিন্তু লাশটা দেখে ফেলেছে কেউ। তাই দুজন পিছু ধাওয়া করেছিল
রালে বলে, একটি মেয়ের চিৎকার শুনে আমি ওপার থেকে…।’
বাধা দিয়ে কুয়াশা বলে, ‘আমিও শুনেছি মেয়েটির চিৎকার। আরও মেয়ে ছিল ওখানে। এই মেয়েটি কেমন করে জানি না পালিয়ে চলে এসেছিল। তাকে আবার ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চোখমুখ গম্ভীর এ কঠিন আকার ধারণ করল রাসেলের। কলল, ঘাটিতেই ধরে নিয়ে গেছে তাহলে মেয়েটিকে? ঘটি তো উড়ে যাবে। মেয়েটি?
কুয়াশা কলল, উপায় ছিল না। চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারলাম না ওকে রে করে আনতে।
রাসেল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, এরকম অন্যায় আপনার অতীত জীবনের প্রায় প্রতিটি কাজেই ছিল, মি, কুয়াশা! প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হরণই করলেন চিরকাল।
• প্রাণের কোন মূল্য আপনি দেন না। যদি দিতেন তাহলে আমরা দস্যু বিপথগামী কুয়াশাকে পেতাম । পেতাম প্রতিভাবান একজন বিশ্ব বিখ্যাত মানব প্রেমিক বিজ্ঞানীকে।
| তুমি কালকের ছেলে। সব কথা বোঝে না। এখনও সেন্টিমেন্টের দাম দাও তুমি। তিনটে মেয়ে ছিল ওখানে। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আমি। দুজনকে মুক্ত করে নিরাপদ জায়ায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাকী একজনকে মুক্ত করতে গিয়েও পারলাম
ভলিউম ১২
। ইচ্ছা করলে প্রথম সুযোগেই শত্রু এলাকা ছেড়ে আমার এলাকায় চলে যেতে পারতাম আমি। তা যাইনি। শুধু মাত্র ওই একটি মেয়ের জন্যে।’
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল কুয়াশা।
তারপর বলল, “মেয়েটি মারা যাবে। দুঃখ হচ্ছে আমার। কিন্তু আমি বাস্তববাদী। একটি মেয়ের বদলে প্রায় দেড়শো শত্রুকে খতম করার ব্যবস্থা করেছি। যথেষ্ট নয়? এটা যুদ্ধ। কথাটা ভুলে যেয়ো না রাসেল।
কুয়াশার কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ। অস্বীকার করতে পারল না. রাসেল।
চার তেবারিয়ার শত্রু ঘাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হলো ঠিক। কিন্তু পরদিনই আবার নতুন একদল ‘ শক্ত ঘাঁটি করল নৈহাটিতে। সংখ্যায় তারা পাঁচ শোরও বেশি।
শহীদ ডেকে পাঠাল পরদিন দুপুরে রাসেলকে। কিন্তু মহা সমস্যায় পড়ে গেছে রাসেল । তেবারিয়ার শক্ত ঘাঁটির উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছিল বিরাট আর এক শক্ত বাহিনী। তারা পৌঁছেছে সেদিনই সকালে। তেবারিয়ার ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন দেখে তারা কামান, মর্টার হুঁড়তে খুঁড়তে নৈহাটিতে এসে ঘাঁটি করেছে। কিন্তু গোলাগুলি বর্ষণ থামেনি। অবিরাম চলেহে। পাল্টা জবাব দিচ্ছে সাদেক এবং জজ।
আসলাম সাদেক এবং জজকে রেখে যেতে বলেছে শহীদ। শত্রুবাহিনীর মতিগতি খুব খারাপ। ওরা তিনজন কি করবে? অতশত ভাবলে চলে না। দুপুরে মুষলধারে গোলাগুলি বৃষ্টির ভিতরই ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
কলিং করে মাইল খানেক এগোতে হলো। রাজনগরের বাড়ি কয়টা ধ্বংস হয়ে গেছে। কাতলি বাজার, শান্তা, শিকারপুর, রামচন্দ্রপুর মসজিদ সহ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত কামানের গোলায়। ‘
| লাকসামপুরের অবস্থা এক কথায় ভয়াবহ। একটি কুঁড়ে ঘরও অবশিষ্ট নেই। শহীদ বলল, “গতরাতে গোরপাড়ায় গিয়ে শত্রুদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। শত্রুদের পঞ্চাশ ভাগ শক্তি নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু এখনও ওদের লোকসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা বারুদ প্রচুর।’
| রাসেল জিজ্ঞেস কল, অন্যান্য ফ্রন্টের অবস্থা কি?
শহীদ বলল, ‘একই রকম। প্রায় প্রতিটি শত্রু ঘাটিতই গতরাতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। আংশিক সাফল্য এসেছে সব জায়গায়। কিন্তু তারপর থেকেই ব্যাপক অক্রিমণ শুরু করেছে ওরা। তোমাদের ওদিকের খব: কি?
রাসেল সব কথা খুলে বলল।
দুপুরের শেষদিকে খবর এল দক্ষিণে যশোর ধরে শত বাহিনীর বিরাট একদল বেনাপোলের দিকে এগোচ্ছে। ওখানে কমান্ডার সৈয়দ তার দলবল নিয়ে আছে।
শহীদ মন্তব্য করল, মাত্র নয়জন ওরা। টিকতে পারবে বলে মনে হয় না। কুয়াশা ৩৬
১০৩
রাসেল বলল, আমি যাব?
শহীদ বলল, এতটা পথ পেরোতে সময় লাগবে অনেক। তুমি পৌঁছে দেখবে যা হবার হয়ে গেছে। তাছাড়া এই এলাকা মুক্ত রাখার জন্যে কাজ করতে হবে আমাদের?’।
রাসেল পকেট থেকে ম্যাপ বের করে বলল, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হরিণদিয়ার ওখানে বেতনা নদীর ওপার পাকা ব্রিজটার দিকে নজর রাখা। দরকার হলে উড়িয়ে দেব ওটা।
শহীদ বলল, আমিও তাই ভেবেছি।’ এক সঙ্গে দুটো স্যাবর জেট উড়ে এল সীমান্তের দিক থেকে।
হতবাক হয়ে গেল ওরা। পাকিস্তানী স্যার জেট সীমান্তের দিক থেকে আসার মানে? মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল ওরা।
| হঠাৎ জ্বলে উঠল রাসেলের দুটো চোখ। বলে উঠল, এর একটাই ব্যাখ্যা আহে। বেনাপোল পর্যন্ত শক্ত আক্রমণ চালিয়েছে। ওখানে বোমা ফেলে তে-কোণ পথে ফিরে যাচ্ছে। মুক্তাঞ্চলের অবস্থা জরিপ করে নিচ্ছে নিশ্চয়ই।
সন্ধ্যার আগেই শহীদ প্রতিটি ফ্রন্টে খবর পাঠাল বিচ্ছিন্ন মুক্তি বাহিনীকে মাত্র দুটো দলে একত্রিত হতে।
বেনাপোলের কাছাকাছি অবস্থানরত মুক্তি বাহিনী যোগ দেবে বেনাপোলস্থ মুক্তি বাহিনীর সাথে।
এদিক করালকালিপার, বসন্তপুর এবং বাঁশবাড়িয়ার মুক্তি সেনারা যোগ দেবে লাকসামপুরে শহীদদের সাথে ।
সবাইকে নিয়ে শহীদ শিকারপুরে গিয়ে ঘাটি করবে স্থির হলো। যুদ্ধই মুক্তির উপায়। যুদ্ধ করেই ঠেকাতে হবে শত্রুকে। পালাবার রাস্তা হয়ত এখনও খুঁজে নেয়া যায়। কিন্তু পালাবে না ওরা।
হরিণদিয়া গ্রামটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। গ্রামটার উপর দিয়েই চলে গেছে পাকা রাস্তাটা। আধ মাইলটাক উত্তরে গেলেই নদী। ব্রিজটা সেখানেই।
সন্ধ্যার পরপরই ব্রিজ উড়বার সব ব্যবস্থা করে নদীর এপারের ঘন ঘাস বনে ফিরে এল রাসেল।
ঘাসের আড়ালে যন্ত্রপাতি লুকিয়ে রেখে এখন কেবল অপেক্ষার পালা। কামাল ছাড়া বাকী সকলকে শিকারপুরে পাঠিয়ে দিয়েছে রাসেল।
শহীদ রাতটুকু হয়ত লাকসমপরে থাকবে। মুক্তি সেনারা লাকসামপুরে জমায়েত হবে আজ রাতের মধ্যেই। তাদেরকে নিয়ে শিকারপুরে যাবে শহীদ।
জীবন-মরণ যুদ্ধ হবে শিকারপুরেই। এটা জলের মতই পরিষ্কার। রাত সাতটার পর স্থির থাকতে পারল না রাসেল। যেভাবেই হোক বিশাল শত্রু বাহিনীকে ঠেকাতে হবে।
১৪
ভলিউম ১২
কিন্তু সম্ভাব্য ঘটনা ঘটার বদলে অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেল।
রাত আটটায় হরিণাপোতা, মাদারতল এবং রাহিলীপোতা থেকে গ্রামবাসীরা পালিয়ে এল। গ্রামগুলোকে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা বিধ্বস্ত করেছে।
কিন্ত তাদের পালিয়ে আসার কারণ তা নয়। তারা খবর পেয়েছে বেনাপোল দখল করে শত্রুবাহিনী সীমান্ত ঘেঁষে সাদীপুর, রঘুনাথপুর, কাতরাপাড়া পর্যন্ত পৌঁছেছে। তারপর সেখান থেকে আড়াআড়ি ভাবে রওনা হয়েছে শঙ্করীপোতা হয়ে রাহিলীপোতার দিকে।
ঘটনাটা অবিশ্বাস করার মত নয়। শুনেই বুঝতে পারল রাসেল শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্য। মুক্তিবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা মুক্তাঞ্চলকে দুইভাগে ভাগ করে। মাঝখানে ঘাঁটি করবে তারা। এদিকে পালাবার পথও বন্ধ করে দিয়েছে। সীমান্তের দিকে শুরু। বেতনা নদীর তীর বরার শত্রু। যশোর রোডও ওদের হাতে।
| মহুয়া ভাবী এবং লীনাদের কথা মনে পড়ল প্রথমেই। কামাল মাথার চুলে ঘনঘন আঙ্গুল চালাচ্ছে। কপালের দুই পাশের শিরাগুলো উঁচু হয়ে উঠেছে তার। যশোর রোড থেকে মাত্র আড়াই তিন মাইল উত্তরে ন্যাটাডিঙি পাড়া। রাহিলীপোতা থেকে বড় জোর সাড়ে তিন মাইল। মানে মহুয়াদের বিপদ দুই দিক থেকে। | রাত বারোটার দিকে খবর পাঠাল শহীদ–শিকারপুর আক্রমণ করেছে শত্রুপক্ষ। তুমুল যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যবর্তী স্থান নদী পেরিয়ে শহীদ এবং আসলাম গেছে ওপারে।
বুঝতে বাকি রইল না রাসেলের যে শহীদ মুক্তাঞ্চলকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টায় নেমেছে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে।
সবাই যুদ্ধে লিপ্ত। এদিকে অপেক্ষার পালা ওর। অস্থির হয়ে উঠল রাসেল। গরুর গাড়ি নিয়ে আবার ও সোনাদিয়ার শেষ প্রান্তে চলে এল।
ব্রিজের খানিকটা পিছনে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে।
কোন কাজ হবে না ব্যারিকেডে। জানে রাসেল। এবং কাজের আশায় এতটা পরিশ্রমও করেনি ও। শত্রুপক্ষকে ভুল ধারণা দেবার জন্যেই তৈরি করা হলো ব্যারিকেড।
ব্রিজ উড়িয়ে দিলেও ওরা বসে থাকবে না। ঘন্টা কয়েকের মধ্যে অস্থায়ী ব্রিজ তৈরি করে নেবে ওরা। ব্রিজ পেরিয়ে ব্যারিকেড দেখবে। পুড়িয়ে ফেলবে ব্যারিকেড। সামনে আর কোন বাধা না দেখে এগিয়ে আসবে শত্রুপক্ষের সঁজোয়া গাড়িগুলো, ট্রাকগুলো, ভ্যানগুলো, জীপগুলো।
ব্যারিকেডের পিছনে রাস্তার উপর পোঁতা হলো মাইন।
রাত দুটো। শরশর করে শব্দ হচ্ছে পিছনে। স্টেনগান তুলে নিল রাসেল। পিইন দিকে ঘুরে বসল। কুয়াশা ৩৬
ঘাসের বনের ভিতর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে কেউ। পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। শিয়াল নয়ত?
ঘাস থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এল একটি ছায়ামূর্তি। শিয়াল নয়। কুয়াশা। নক্ষত্রের মৃদু আলোতেও চিনতে পারল রাসেল।
মি, কুয়াশা। | ডাকল রাসেল। থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। কুয়াশার কাঁধে বড় এবং ভারি একটি চটের বস্তা।
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?’ শুয়ে পড়ল রাসেল ঘাসের আড়ালে। ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কুয়াশাকে।
পাঁচ হাত দূরেই কামাল। কামালকে দেখতে পাচ্ছে না রাসেল। প্রায় তিন হাত, উঁচু ঘন ঘাসের আড়ালে কামালও লুকিয়ে আছে।
এগিয়ে আসছে কুয়াশা। ঘাসের রাজ্যের সামনে এসে দাঁড়াল সে বলল, “কি করই তোমরা এখানে?”
ব্রিজটাকে পাহারা দিচ্ছি। বলল রাসেল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন এমন সময়? কুয়াশা বলল, ‘ব্রিজটাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাই।’ অন্ধকারে একটু হাসল কুয়াশা। যোগ করল, বাধা দেবে নাকি?”
খা।’ |
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল রাসেল অন্যমনস্কভাবে। বুকের ভিতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর চোখ দুটো, ব্রিজ ওড়াবার দরকার হলে আমরাই আছি।’
হঠাৎ কুয়াশা তার হাতঘড়িটা তুলে ধরল কানের কাছে। মন-যোগের সাথে কি ফেন শুনছে সে।
মিনি অয়ারলেসে ভেসে আসছে স্যানন ডি. কপ্টার কণ্ঠস্বর, ‘এনিমি অ্যাটাক করিয়াছে। ফ্রী-এরিয়া বিপদ গ্রস্ট। আপনি কোঠায়’ব?’
কে কথা বলছে?’
কুয়াশা তাকাল। বলল, “ডি. কস্টা। শত্রুপক্ষ তাদের চরম আঘাত হেনেছে মুক্তাঞ্চলের উপর। পাঁচ রাত আড়াইটায় শহীদের সাথে শিকারপুর রণাঙ্গনে দেখা করল রাসেল।
তুমুল যুদ্ধ চলছে। নদী পেরিয়ে অাসলামকে নিয়ে কৃষ্ণপুর অবধি গিয়েছিল শহীদ। কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে ফিরে এসেছে ওরা।
নদী পেরোবার চেষ্টা অবশ্যি শত্রুপক্ষ করছে না। কিন্তু বিপদ আছে অন্যখানে।
ভলিউম ১২
১০৬
গোলাবারুদ এবং লোকসংখ্যা শত্রুবাহিনীর প্রচুর। মুক্তি সেনারা সংখ্যায় নগণ্য এবং অবিরাম এইভাবে যুদ্ধ করতে হলে চাই অফুরন্ত গোলাবারুদ। কিন্তু গোলাবারুদ যা আছে তা আগামীকাল সকাল অবধি চলতে পারে।
ট্রেঞ্চের ভিতর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ অবস্থা লক্ষ্য করতে করতে রাসেল বলল, ‘এখানের দায়িত্ব আমাকে ছেড়ে দিয়ে আপনি বরং কয়েকজন নিয়ে ন্যাটাডিঙিতে একবার যান।
চমকে উঠতে দেখল রাসেল শহীদকে। “কি ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল রাসেল।
শহীদ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েই। ওদের কথা ভুলেই গেছি আমি।
| একমুহূর্ত পর শহীদ বলল আবার, কিন্তু আমার তো যাওয়া হবে না, ভাই। এরকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় তোমাদেরকে রেখে যাব, তা হতেই পারে না।’
রাসেল বলল, খুব হতে পারে। মহুয়া ভাবীরা নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্যের অ শায় অপেক্ষা করছেন।’’ | কুয়াশার খবর জানো?
রাসেল উত্তরে বলল, ‘‘কোথায় গেলেন বলে যাননি। কিন্তু আপনি আর এক মুহূর্তও দেরি করবেন না, শহীদ ভাই। এখুনি কামাল ভাই এবং আরও দুজনকে নিয়ে যাত্রা করুন। শত্রুরা রাহিলীপোতা অবধি পৌঁছে গেছে। বলা যায় না, হয়ত
ন্যাটাডিঙিতেও পা দিয়েছে ইতিমধ্যে।’ ‘ কিন্তু এ অসভব, রাসেল। আমাকে তুমি অশান্ত করে তুলো না। তাছাড়া ওরা হয়ত ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। গিয়ে দেখ••।’
রার্সেল জোর দিয়ে বলল, “অনুমান করে কিছু না বলাই ভাল। দিন, আপনার স্টেন দিন।’
প্রায় জোর করে শহীদের হাত থেকে স্টেনগানটা নিজের আয়ত্তে আনল রাসেল। বলল, কামাল ভাই একা আছে-হরিণদিয়ায়। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত। ওর জায়গায় আর কাউকে রাখলেই চলবে।’
সিদ্ধান্ত নেবার অবকাশও দিল না রাসেল শহীদকে। দুই হাত দিয়ে কোমর ধরে ট্রেঞ্চের উপর তুলে দিল শহীদকে ও।
ডাক্তার বললেন, মহুয়া ভাবী, আপনি এদিকটা দেখাশোনা করুন। আমি দু’চারজন লোক পাওয়া যায় কিনা দেখি।
‘দেরি কেন না কিন্তু।
লীনা বলল কথাটা।
কুয়াশা ৩৬
‘১০৭
না!’ দ্রুত বেরিয়ে গেল ডাক্তার স্টেনগান নিয়ে। হাসপাতালের গেট অতিক্রম করে।
মহুয়ার পাশে খবির বসে রয়েছে। কয়েক মাস চুলদাড়ি ছাঁটেনি ও। স্টেনগানগুলো দ্রুত পরিষ্কার করছে সে। বারান্দা থেকে লীনা খোলা দরজা দিয়ে একটি কামরায় প্রবেশ করল।
পঙ্গ মুক্তি সেনারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে সবাই। বসে থাকার সময় নেই। সময় নেই শুয়ে থাকার। শরীরে ক্ষমতা থাক বা না থাক, চেষ্টা করতে হবে শত্রুকে বাধা দেবার।
খবিরের একটা পা নেই হাঁটু অবধি। ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই উঠে পড়েছে সে। মহুয়া কোন আপত্তি করতে পারেনি। কোথা থেকে একটা বেয়োনেট লুকিয়ে রেখেছিল বিছানার নিচে। সেটা বের করে খবির বলে উঠেছিল, মহুয়া আপা, আমি কিন্তু আর সকলের মত যুদ্ধ আর জন্যে পালিয়ে যাচ্ছি না। যুদ্ধ আমি এখানেই করব, শত্রু যদি আসে। কিন্তু সে অনুমতিও যদি আপনি না দেন তাহলে নিজের বুকে এই বেয়োনেট…।’
| আপত্তি করতে পারেনি মহুয়া। ডাক্তার অবশ্যি রাজি হতে চাননি। তিনি বলেছিলেন বুঝিয়ে শুনিয়ে বেয়োনেটটা আদায় করে নিয়ে ধমক দিয়ে শান্ত করবেন খবিরকে। ডাক্তারকে বুঝিয়েছে মহুয়া | শেষ অবধি মহুয়ার কথাই মেনে নিয়েছে ডাক্তার।
খবিরের দেখাদেখি আহত মুক্তিসেনারা প্রায় প্রত্যেকেই উঠে পড়েছে বিছানা ছেড়ে।
কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও উরুতে এখনও বুলেট রয়েছে-তারা সবাই কাজ করছে।
| দুপুর হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ফিরহে না কেন বুঝতে পারল না মহুয়া।
বেলা একটার দিকে হাসপাতালের পঁচিশ গজের মধ্যেই পড়ল দুটো কামানের গোলা । সামনের পাচিলের ক্ষতি হলো খানিকটা।
রাহিলীপোতা যে শত্রুদের দখলে চলে গেছে তা অনুমান করতে কষ্ট হলো না। কারও।
কুয়াশা বা শহীদের কাছ থেকে সাহায্যের আশা করা বৃথা। কথাটা ভাল করেই বুঝল মহুয়া।
কিন্তু লীনা ছেলে মানুষ। তাকে আশ্বাস দিয়ে দিয়ে রাখছে মহুয়া।
দুপুরের দিকে মহুয়া বলল, “তোর দাদা হয়ত বিকেলের মধ্যেই এসে পৌঁছবে, কি বলিস?’
মনে হয় না।
১০
ভলিউম ১২.
লীনা বলল, শহীদদা আসবে কিভাবে শুনি? রাস্তা কোথায়? রাহিলীপোতায় খান-সেনারা পৌঁছে গেছে। ওদেরকে কাবু করে এখানে পৌঁছতে কয়েকদিন সময় লাগবে।’
মিসেস রহমান বললেন, তাহলে আমাদের কি হবে?’
মহুয়া এবং লীনা বিপদের মুখোমুখি এর আগেও হয়েছে বহুবার। বিপদে পড়ে অস্থির বা বিমূঢ় হয়ে পড়ে না ওরা সহজে। মিসেস রহমানের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। অনেকটা সামলে নিলেও পুরোপুরি স্থির থাকতে পারেন না তিনি। জিঞ্জিরার ঘটনাচক্র থেকে তিনি মহুয়াদের সাথে জড়ত হয়ে পড়েছেন। স্বামী মারা গেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র মাস দেড়েক আগে। কিন্তু খটা মহুয়া দেয়নি মহিলাকে।
হাসপাতালের আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সকাল অবধি কমে মাত্র পঁচিশে দাঁড়াল। যারা এক-আধটু হাঁটতে পারে তারা লুকিয়ে পালিয়ে গেছে।
দুপুরের পরে ঘটল সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং নৈরাশ্যজনক ঘটনাটা। সকাল থেকেই কামানের গোলা এসে পড়ছিল ন্যাটাডিঙিতে। ট্রেঞ্চ কাটাই ছিল।
অপেক্ষা করছিল ওরা। ডাক্তার ফিরে এলেই ট্রেঞ্চে নামা কথা তুলত মহুয়া। মুক্তিবাহিনীর আহত হেলেরাও যুদ্ধ করে মরতে চায়।
কিন্তু বেলা অনেক হয়ে গেল অথচ ডাক্তারের ফেরার নাম নেই।
গ্রামে লোকজন নেই। থাকলে ওরা টের পেত শত্রুর আগমন অনেক আগেই হয়েছে।
ডাক্তার যে আর ফিরে আসবে না তা ওরা হঠাৎ বুঝতে পারল গ্রামের দুদিকে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে।
মহুয়াই দেখল প্রথমে আগুন। গ্রামের শেষ মাথায় হাসপাতালটা। পিছনে জলাভূমি। সামনে ফাঁকা মাঠ, জল। তারপর গ্রাম।
গ্রাম জ্বলছে। আগুন দেখার খানিক পর শোনা গেল স্টেনগানের শব্দ।
মানুষ মারছে না শত্রুরা। মারবে কাকে? এ অঞ্চলের লোকজন সবাই পালিয়েছে। বেশির ভাগ যুবক এবং কর্মক্ষম পুরুষ গেছে মুক্তিযুদ্ধে। জরাগ্রস্ত, অক্ষম যারা ছিল তার আকস্মিক বিপদের মুখে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে।
আগুন জালিয়ে দিয়ে ঘরগুলোর দিকে বুলেট হৃড়হে খান-সেনারা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাঁচজন আহত মুক্তিসেনা-নামল উঠনে। এর নাম আত্মহত্যা। | *
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল মহুয়া। খরি চিৎকার করে উঠল, মহুয়া আপা, ঘরের ভিতরে চলুন। ‘ * প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান। কুয়াশা ৩৬
১০৯
লীনা এবং মিসেস রহমান সাদেকের সাথে আছে পিছন দিকে।
মহুয়া কামরার ভিতর ঢুকে একটি জানালার পাশে দাঁড়াল। দরজার পাশে বসল খবির।
• হাসপাতালের খোলা গেটটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। শত্ৰু ঢুকবে ওই গেট দিয়েই।
যুদ্ধ কি বলা যায় একে? ভাবল মহুয়া। খান-সেনারা দলে দলে আসবে ভারি অস্ত্র নিয়ে।
পনেরোজনের মত ওরা সব মিলিয়ে। কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে পশু শত্ৰকে? গুলিইবা বেশি কোথায়?
ক্ষীণ একটা আশা এখনও জাগছে মহুয়ার মনে। নিশ্চয়ই অনেক আগে খবর পেয়েছে শহীদ এবং কুয়াশা। ওরা একজনও কি রওনা হয়নি ইতিমধ্যে?
বুকটা কেন যেন ভরে উঠতে চায় আশায় আশায়।
কিন্তু খাকি পোশাক পরা কয়েকজন খান-সেনাকে দেখা মাত্র সব আশা কপুরের । মত উবে যায়।
গর্জে ওঠে ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে মুক্তিসেনাদের স্টেনগান। চোখের পলকে তিনজন খান-সেনা লুটিয়ে পড়ল গেটের সামনে।
শওর লাশ পড়তে দেখে আচমকা সব ভুলে যায় মহুয়া। স্টেনগান তুলে গেটের দিকে গুলি চালায় সে।
ছয় সামনে দুই মাইল নিচু জমি। অন্যান্য বছর এসময় ধান কাটা হয়ে যায়। এ বছর ধান ফেলানো হয়নি। খাঁ খা করছে বিস্তৃত জলাভূমি।
জলাভূমি যেখানে শেষ সেখানেই শুরু রাহিলীপোতা গ্রাম। আন্দরপোতা এবং পায়রাখোপি হয়ে জলাভূমিতে নেমেছে শহীদ এবং কামাল। |
জানা কথা রাহিলীলোতায় শ আছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বোঝবার কোন উপায় নেই। ওদেরও সুবিধে আছে । জলাভূমিটা একেবারে ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও শত্রু ওদেরকে দেখতে পাবে না।
ন্যাটাডিঙিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছুনো দরকার। অন্য পথে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তাহাড়া পথে প্রাকৃতিক বিপদের সম্ভবনা প্রচুর।
এদিকে নিচু ভূমিতে চোরাকাদার কয়া প্রচুর। দুই-চার হাত পর পরই চোরাকাদার ছোট ছোট কুয়া। কোন একটায় যদি পা পড়ে তাহলে প্রাণের আশা ত্যাগ করতে হবে।
এই বিশাল জলাভূমিটা সে বিপদ থেকে মুক্ত।
রাহিলীপোতা গ্রাম হয়ে ন্যাটাডিঙির দিকে এগোবার আরও একটি উদ্দেশ্য হলো ১১০
ভলিউম ১২
শত্রুদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। সম্ভব হলে আঘাত হানার ব্যবস্থাও করা যাবে।
এটা যুদ্ধ। এবং ওরা যোদ্ধা। যুদ্ধের সময় স্বজনের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে সময় অপব্যয় করা যোদ্ধার আদর্শ নয়। তাছাড়া শহীদের মনে একটা স আছে। মহুয়া সাহসী এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। রা সে সহজে পড়বে না।
দ্রুত হাঁটছিল ওরা। কালো এবং সবুজ মিশ্রিত অদ্ভুত এক রঙের ইউনিফর্ম পরনে ওদের। হাতে হালকা মেশিনগান শহীদের।
কামালের হাতে একটি চায়নিজ স্টেন। গতমাসে এক শক্ত ঘাঁটি থেকে প্রচুর গুলি এবং চায়নিজ স্টেন ইস্তগত করেছিল কামাল। ঘটিটা কামাল একার চেষ্টায়
ধ্বংস করেছিল।
আগে আগে হাঁটছে কামাল। দুজনারই পিঠে ম্যাগাজিন ভর্তি, ঝোলা । গ্রেনেড়গুলো অপর এক ঝোলার ভিতর। গলার সাথে ঝুলছে সেগুলো।
প্রায় শ’খানেক গজ সামনে উঁচু জমি। শহীদ পা চালিয়ে চ েএল কামালের পাশে।
দাঁড়া। বসে পড়।’ কথাটা বলেই শুয়ে পড়ল শহীদ। শহীদকে অনুসরণ করুল কামালও।
পকেট থেকে নাইট বায়নোকুলার বের করে সামনে উঁচু জমিটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল শহীদ। কামালও কে কল নাইট বায়নোকুলার।
চাঁদ নেই আকাশে। কিন্তু নক্ষত্র আহে। নাইট বায়নাকুলারে পরিষ্কার দেখা গেল উঁচু জমিটার উপর নড়ছে দুটো মাথা।
ট্রঞ্চের ভিতর থেকে নেমে আহে দুটো মাথা। নিশ্চয়ই আরও শক্র আছে। কামাল ফিসফিস করে বলে উঠল, আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে
হয়?’
“ঠিক বুঝতে পারছি না। শহীদ বলে।
অপেক্ষা সইছে না কামালের। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে লীনা, মহুয়ার মুখ । অস্থির, নিচু গলায় বলে উঠল ও, এগিয়ে যাই চল।
এগিয়ে চলল ওর কলিং করে।
শিশির ভেজা নরম মাটির উপর দিয়ে বুকে ভর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছে ওরা। পঁচিশ গরে মত এগোবার পর আবার ওরা থামল।
বায়নে কুলারে দেখা গেল সেই একই দৃশ্য। সম্ভবত ওদের দুজনকে শত্রু দেখতে পায়নি এখনও।
আবার এগোবার পালা। এবার আরও সতর্কতার সাথে, আরও ধীরে।
গাঢ় অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছু। অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে অদূরেই উঁচু কুয়াশা ৩৬
১১১
জমিটা । আর মাত্র বিশ গজ দূরে। অতি সন্তর্পণে আরও গুজ তিনেক এগোল ওরা। কামালের গায়ে হাত রাখল শহীদ। থামার নির্দেশ।
দুজনেই বায়নোকুলার দিয়ে দেখে নিল শত্রুদ্বয়কে। বায়নোকুলার নামিয়ে ধরল, যে যার অস্ত্র। ফিসফিস করে শহীদ বলল, ‘ওয়ান, টু, খ্রী।’
গর্জে উঠল শহীদের লাইট মেশিনগান এবং কামালের স্টেন। । ব্রাশ ফায়ারের শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বায়নোকুলার তুলে নিল ওরা।
মাথা দুটো দেখা যাচ্ছে না আর। সম্ভবত ট্রেঞ্চের ভিতর পড়ে গেছে মুখ থুবড়ে। দূর থেকে ভেসে এল এল, এম. জি-র শব্দ। গ্রামের মাঝখান থেকে শত্রুপক্ষ ফাঁকা শব্দ করছে।
অদূরে শত্রুদের তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ আসছে না! দুজনই ছিল নাকি? দুজনই মারা গেছে?
শহীদ ভাবছিল।
কিন্তু কামালের ওসব চিন্তা নেই আর। ওর মাথায় একটাই চিন্তা, ন্যাটাডিঙিতে পৌঁছুতে হবে যেমন করেই হোক।’
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কামাল। অন্ধকারে শত্রু আছে কি নেই বোঝা মুশকিল। এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে তীরবেগে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল ও।
লাফ দিয়ে উঠে পড়ল কামাল উঁচু জমিটায়। কয়েক সেকেন্ড পর উঠল শহীদ। কামাল ততক্ষণ নেমে পড়েছে ট্রেঞ্চে।
শুক্রর উত্তপ্ত বুকে পা রেখে কামাল গ্রামের দিকে গুলি শুরু করল।
সামনেই কয়েকটি কলা গাছ। একটি পেয়ারা গাছ। আরও সামনে পাতলা ঝোঁপ। তারপর একটি কুঁড়ের। কুঁড়েঘরের পর ছোট একটি ফাঁকা জায়গা। তারপর বেশ কয়েকটি বাড়ি একটি পুকুর।
ফাঁকা জায়গাটিতেই ঘাটি করেছে শত্রুপক্ষ। শহীদ ধারণা করল।
কয়েকটা স্টেনগানের শব্দ দ্রুত এগিয়ে আসছে। ট্রিগারে আঙুল রেখে তৈরি হয়েই আছে ওরা।
| কুঁড়ে ঘরটার কাছে আলো দেখা গেল। স্টেনগান থেকে বের হচ্ছে আগুনের আভাঁ।. |
সেই আগুনের আভা লক্ষ্য করেই ট্রিগার টিপল শহীদ এবং কামাল।
আর্ত চিৎকার শুনে আনন্দে ভরে উঠল কামালের বুক। শত্রুদের গুলির শব্দ থেমে গেছে।
ট্রেঞ্চ থেকে উঠে পড়ছিল কামাল। এগিয়ে যাবার ইচ্ছা ওর। বাধা দি: শহীদ। কেটে গেল কয়েকটি মিনিট। কোন সাড়া নেই শত্রুপক্ষের। কামাল ট্রিগারে চাপ দিল। বেরিয়ে গেল এক ঝাক বুলেট।
তারপরই ওদেরকে চমকে দিল শত্রুপক্ষ।
১১২
ভলিউম ১২
| একসাথে প্রায় পাঁচটা হেভি মেশিনগান গর্জে উঠল। কিন্তু এবার আগুনের আভা দেখা গেল না।
পাল্টা জবাব দিল কামাল এবং শহীদ।
কয়েক মুহূর্ত পর নেমে এল নিস্তব্ধতা। শত্রুপক্ষ সম্বত কুঁড়ে ঘরটার সামনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছে।
অকস্মাৎ ডান এবং বাঁ দিক থেকে গর্জে উঠল শত্রুপক্ষের স্টেনগান। | বুঝতে বাকী রইল না শত্রুপক্ষ ওদেরকে ঘিরে ফেলার মতলব এঁটেছে।
বায়নাকুলারে বিশেষ কিছু দেখা গেল না। তবে কুঁড়েঘরটার সামনে উঁচু মত কিছু একটা চোখে পড়ল। সম্ভবত পাথরের স্তূপ।
ঝোলা থেকে গ্রেনেড বের করল কামাল। দাঁত দিয়ে পিন খুলে নিয়ে সবেগে ছুঁড়ে দিল ও কুঁড়ে ঘরটার দিকে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে চোখ ধাঁধানো আলোয় চারিদিক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠলো। পর মুহূর্তে
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তৃতীয়বারও তাই ঘটল।
আহত শত্রুর যন্ত্রণাক্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে যেন মধুবর্ষণ করল। শহীদ ডনি এবং বাঁ দিকে একটি করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল।
সামনের শত্রুপক্ষ নীরব।
কামাল এক লাফে উঠে এল ট্রেঞ্চ থেকে। সারা শরীরে ব্যথা। ঘু নেই আজ দুই তিন রাত। ঝিমঝিম করছে মাথার ভিতর। চোখ দুটোয় ভীষণ জ্বালা। কিন্তু এসব অনুভূতিকে গ্রাহ্য করার সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে। পৌঁছুতে হবে ন্যাটাডিঙিতে। লীনারা অপেক্ষা করছে বর্বর পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে ওদের সাহায্যের আশায়।
ক্রলিং করে এগিয়ে যাচ্ছে কামাল। কোনদিকে ক্ষেপ নেই ওর। শহীদ পিছনে আছে কি নেই ভাবছে না ও। শত্রুর দিকেই খেয়াল ওর। শত্রুর সাড়া পেলেই শুধু থামবে ও।
ডান এবং বাঁ দিক থেকে গুলিবর্ষণ থেমে গেছে। কলাগহগুলোকে বয়ে রেখে পেয়ারা গাছটাকে ডানে রেখে হোট হোট পাতলা ঝোঁপের ভেতর দিয়ে কুঁড়ে ঘরটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। কামাল আগে। শহীদ একটু পিছনে।
হঠাৎ থামল কামাল। থামল শহীদও।’
পরমুহূর্তে কামাল হেড়ে দিল নিজের স্টেনগান। বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা ও বুক উঁচু করে ডান হাত দিয়ে প্রচণ্ড ঘুসি চালাল ও অন্ধকারে। চ।
আহত পশুর মত ককিয়ে উঠল একজন শক্ত। কামালের ঘুসি মোখম জায়গায়। গিয়ে আঘাত হেনেহে। শক্রর একটা চোখ ফেটে গেছে।
বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার শহীদ। শত্রুদেরকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা দুজন চার পাঁচজন শত্রুর মুখোমুখি পড়ে গেছে। ক্রলিং কুয়াশা ৩৬
১১৩
করে তারাও এগিয়ে আসছিল।
কামাল উঠে দাঁড়িয়েই প্রচণ্ড এক লাথি চালাল আহত শত্রুর দিকে। সবুট লাথি গিয়ে লাগল শত্রুর মাথায়। কিন্তু শব্দ বের হলো না তার গলা থেকে। ডান পাশে শব্দ। কামাল ঘুসি চালাবার পরপরই ঝাঁপিয়ে পড়লসেদিকে। একজন দণ্ডায়মান শত্রুকে নিয়ে পড়ল ও মাটিত।
শত্রুর বুকের উপরই পড়েছে কামাল। বিমূঢ় শত্ৰু কিছু বুঝে ওঠার আগেই কামাল তার গলা চেপে ধরল ডান হাতে। আত্মরক্ষার ব্যাকুল চেষ্টায় কামালের হাত গলা থেকে সরাবার জন্যে শত্রু তার দুই হাত কামালের হাতের উপর রাখল। কোমর থেকে টেনে আনল কামাল বাঁ হাত দিয়ে ধারাল ভারি হোরাটা।
নরকযাত্রী পর তীক্ষ্ণ ভয়ার্ত চিৎকারে কেঁপে উঠল চারিদিক। কামাল হোরা, ঘষছে তখনও শত্রুর গলায়। মুহূর্ত পরই চিরতরে থেমে গেল শত্রুর চিৎকার। হাত পা দুটো তখনও প্রচণ্ড আক্ষেপে দিকবিদিক ছুটে যেতে চাইছে। ছটফট করছে সর্বশরীর।
সাত
এ যুদ্ধ চলতে পারে না’ এ যুদ্ধে সমাপ্তি চাই। শত্রুকে স্তব্ধ করে দিতে হবে যেমন করেই হোক। তাহলেই থামবে এই যুদ্ধ।
গভীরভাবে ভাবছিল রাসেল। সকাল হতে এখনও তিন ঘন্টা বাকী। গোলাগুলি যা আছে তাতে তিন ঘণ্টার বেশি টিকে থাকা অসম্ভব। সুতরাং সকালের আগেই শেষ করতে হবে এই যুদ্ধ। এবং সামনের শত্রু পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলেই তা সব।
শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
মুষলধারে বৃষ্টির মত বুলেট এসে পড়ছে এপারে। সেই সাথে কামানের গোলা। নদীর ওপার থেকে ট্রেঞ্চে বসে গুলি চালাচ্ছে শত্রুপক্ষ। আর নৈহাটির মুখোমুখি ঘাঁটি থেকে কামানের গোলা ছুঁড়ছে।
| প্রচুর শক্তি শত্রুর। সৈন্য সংখ্যাও প্রচুর। একদল বিশ্রাম নিচ্ছে একদল যুদ্ধ করছে। গোলাগুলির সরবরাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হচ্ছে।
সম্মুখ যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়াটা চরম ভুল হয়ে গেছে। ভাবল রাসেল। এই ভুল সংশোধন করতে হবে। শক্ত ঘাঁটিতে হানতে হবে আঘাত।
কৃষ্ণপুর হয়ে নৈহাটিতে যাওয়ার চেষ্টা করা অনুচিত। শহীদ সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
শিকারপুর থেকে পিছিয়ে গিয়ে মুকুন্দপুর গ্রামের কাছে বেতনা নদী পেরিয়ে, নদীর পাড় ধরে সোজা পথে যেতে হবে পুলমারা গ্রামে। নদী ওখানে মোড় নিয়েছে
১১৪
ভলিউম ১২
ধনুকের মত। পাড় ধরে গেলেই দীপাদিহি। তারপর নৈহাটি।
বারোজনকে রেখে আসলামকে সাথে নিয়ে মুষলধারে গোলাগুলি বৃষ্টির মধ্যেই। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে এল রাসেল! দুটো টিনে দুই গ্যালন পেট্রল নিল ওরা সাথে।
কামানের গোলা সশব্দে উড়ে আসছে মাথার উপর দিয়ে। সামনে পড়ছে কখনও। কখনও পিছনে পড়ছে। কেঁপে উঠছে মাটি। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই ওদের। ওরা ছুটে চলেছে।
আধ ঘন্টার মধ্যে নদী পেরিয়ে পুলমারা গ্রামের শেষ মাথায় পৌঁছে নদীর কিনারা
• ধরে ছুটতে দেখা গেল ওদেরকে।
দীপাদিহি গ্রাম দিয়েই নৈহাটি যাবার নিয়ম। কিন্তু নিয়ম এখানে অচল। নদীর কিনারা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নৈহাটির দিকে ছুটল ওরা।
জঙ্গল শেষ হতে কঁকা মাঠ। সশব্দে শাস-প্ৰশাস ফেলতে ফেলতে দাঁড়াল ওরা। মাঠের পর নৈহাটি হাট।
দূর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। আলোর এতটুকু চিহ্ন নেই কোথাও। দ্রুত পায়ে মাঠের উপর দিয়ে নৈহাটি হাটের দিকে চলল ওরা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই লম্বা লম্বা শুকনো ঘাসের রাজ্যে কল আসলামকে নিয়ে রাসেল,
আসলামকে নির্দেশ দিয়ে একাই এগিয়ে গেল রাসেল।
সময় বয়ে চলল। আসলাম কানখাড়া করে হাতের কাজ নিয়ে পড়ল। ঘাসের বন যেখানে শুরু সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আসলাম।
বড় একটা চটের ছেঁড়া থলেকে পাকিয়ে লম্বা করে বঁধল আসলাম। লম্বা তার দিয়ে বাঁধল পাকানো থলের একটি মাখা। পাকানো থলেটা জবজবে করে ভিজিয়ে নিল ও পেট্রল ঢেলে। ।
হাতে আসলামের দিয়াশলাই। কান দুটো খাড়া হয়ে আছে। স্টেনগানটা মাটিতে রেখে বল ও পাশে।
আরও পাঁচ মিনিট কাটল। তারপর শোনা গেল বাশীর শব্দ। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।
পেট্রল ভেজা পাকানো থলেতে আগুন ধরিয়ে দিল আসলাম। লম্বা তারটার শেষ মাথাটা ধরে ছুটল ও ডান দিকে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো ঘাসের বিশাল রাজ্য। আট গোটা নৈহাটি হাটটাকেই ঘিরে রেখেছে লম্বা লম্বা ঘাস।
মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে নৈহাটির পিছন দিক থেকে দীপাদিহির পাশ ঘেঁষে কুয়াশা ৩৬
১১৫.
কৃষ্ণপুরে চওড়া মেঠো রাস্তার ধারে পৌঁছে গেল আসলাম।
‘ কৃষ্ণপুর থেকে নৈহাটি হাটের পিছন দিকে পৌঁছুল রাসেল মাত্র সাত মিনিটে। শুরু-ঘাটির ঠিক মাঝখান বরা কুয়াশার দেয়া আগুনে বোমা দুটোও ছুঁড়ে মেরেছে সে। নৈহাটি হাটের চতুর্দিকে দাবাগ্নি। শত্রুপক্ষের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়েছে।
হিসেব রাসেল নিখুঁতই করেছিল। শত্রুর দুটো মাত্র পথ পালাবার। কৃষ্ণপুর হয়ে নদীর ধারে যুদ্ধরত সঙ্গীদের সাথে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে আশ্রয় নেয়া। নয়ত নৈহাটির পিছন দিক দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখাকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাওয়া।
. কিন্তু পালিয়ে যাবার কোন সুযোগ ওদেরকে রাসেল দিচ্ছে না? কৃষ্ণপুরের রাস্তায় এবং নৈহাটির পিছনে, আগুনের পাশাপাশি অপেক্ষা করছে যথাক্রমে আসাম এবং রাসেল।
শত্রু দিশেহারা হয়ে পড়বে জানত রাসেল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠবে তা ও অনুমান করেনি।
দুই পাশে আগুন। মাঝখানে মেঠো রাস্তা। রাস্তার উগ্রই শুয়ে আছে রাসেল। | আশায় আশায় ভরে উঠেছে মন। জয় অবশ্যম্ভৰী। দলে দলে পাঞ্জাবী সেনারা। কেসামাল অবস্থায় ছুটে আসছে।
ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা শুধু এখন। নাইট বায়নোকুলারে অবিশ্বাস্য সব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জীবনের এক পরম অভিজ্ঞতা।
বিশ্বের তথাকথিত সেরা যোদ্ধাদের এই করুণ অবস্থা দেখে প্রচণ্ড হাসি পেল রাসেলের।
ছুটে আসছে ভেড়ার পালের মত বীর যোদ্ধারা। বীর যোদ্ধাই বটে। শত্রুর
• কোন চিহ্ন ও দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে না পেলে কি হবে কাদ কাদ মুখ করে দুই হাত মাথার উপর তুলে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে আসছে তারা। কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে ধরাশায়ী হচ্ছে। কেউ তুলছে না তাকে। নিচের দিকে ওদের দৃষ্টি নেই। চারিদিকের আন দেখছে ওরা। আর জীবন ভিক্ষা চাইবার জন্যে সেই আগুনের ভিতর খুঁজছে মুক্তি সেনাদেরকে। আছড়ে পড়া সাথীর পিঠে পা দিয়ে এগিয়ে আসছে দলে দলে।
অথচ এরাই আমার মাকে, আমার বোনকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করেছে। দুই চোখ জলে ভরে উঠল রাসেলের। অথচ এরাই লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙালী সন্তানকে খুন করেছে। ধর্ষণ করেছে মা-বোনদেরকে পৈশাচিক উল্লাসে। পশু নয়, ওরা পরও অধম। মা, তুমি দেখো, কেমন প্রতিশোধ নেয় তোমার ছেলে।
দাঁতে দাঁত চেপে এল. এম. জি-র ট্রিগার চেপে ধরে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করল রাসেল। পরমুহূর্তে হাঃ হাঃ করে হিংস্র প্রতিহিংসায় হেসে উঠল রাসেল। দেখতে
. ১১৬,
ভলিউম ১২
দেখতে বিশ পঁচিশ গজ সামনে লাশের পাহাড় তৈরি হলো।
ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো কৃষ্ণপুরের রাস্তায় আসলামের চোখের সামনে।
ছোট দুই ভাই মুক্তি যুদ্ধে শহীদ হয়েছে ওর। প্রতিশোধ নিল আজ আসলাম প্রাণভরে।
নদীর পাড়ে যুদ্ধরত শত্রুরা আতঙ্কে ভুলে গেল গুলি ছোঁড়ার কথা। পিছনে আগুন। বুঝতে বাকী রইল না ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছে মুক্তিসেনারা।
নৈহাটি হাট তখন পুড়ছে আগুনে। অ্যামুনিশনের গুদামে আগুন ধরে গেছে। অব্রিাম প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় থেকে থেকে কাঁপছে মাটি।
এদিকে পিছন দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে বিস্তৃত অগ্নিশিখা। দিশেহারা শত্রুরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। এবং সলিল সমাধি লাভ করতে বিলম্ব ঘটল না।
নয় শত্রুর শেষ রাখতে চায়নি শহীদ।
কামাল বলল, “দেরি করাটা মোটেই উচিত না। লীনাদের বিপদটা কি ভয়ঙ্কর রকম বুঝতে পারছিস না তুই?
অগত্যা আহত এবং পলাতক শত্রুদেরকে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে রাহিলীপোতা গ্রাম ত্যাগ করে ওরা বিশালজলাভূমির উপর দিয়ে ছুটল ন্যাটাডিঙির দিকে। ভুল করল ওরা। জীবিত শক্ররা পিছু নিল ওদের।
ন্যাটাডিঙিতে পৌঁছুবার আগেই কেঁপে উঠল মাটি। কেঁপে উঠল শুধু নয়, কাঁপতেই লাগল। পিছন দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল ওরা। উত্তরের আকাশ লাল।
আগুন লেগেছে। সেই সাথে বিস্ফোরণের শব্দ এবং কম্পন। বুঝতে কিছু বাকী রইল না ওদের।
রাসেলের কীর্তি। সন্দেহ নেই। ‘অদ্ভুত ছেলে।’ শহীদের গলায় প্রশংসার সুর। ‘কালে বিরাট এক লোক হবে ও। যেমন প্রাণবন্ত, তেমনি বুদ্ধিমান।’ বলল কামাল।
ন্যাটাডিঙিতে পৌঁছে মন ভেঙে গেল ওদের। গ্রামটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাসপাতালের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া গেল না। গ্রামটা চষে ফেলল ওরা। একজন মানুষকেও জীবিত পাওয়া গেল না। লাশ যে কটা পাওয়া গেল তার মধ্যে পরিচিত কেউ নেই। কুয়াশী ৩৬
১১৭
পুকুরটার ধারে এসে দাঁড়াল ওর। হঠাৎ কানে এসে ঢুকল কাতর একটা ধ্বনি। মাগো। বাঁ পাশ থেকে এসেছে শব্দটা। এগিয়ে গেল ওরা। মেয়েলি গলা।
প্রৌঢ়া এক মেয়েছেলে আহত হয়েছে। পরীক্ষা করে শহীদ বুঝল মৃত্যু অবধারিত। বুকে গুলি লেগেছে।
কামাল পুকুর থেকে পানি এনে প্রৌঢ়ার মুখে দিল। শহীদ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাসপাতালের লোকগুলো কোন্ দিকে গেছে বলতে পারেন?
‘ওগো ধইরা…নি…নিছে…। ধুপপাড়া••• | * মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল প্রৌঢ়া। ধুপপাড়ায় যাব।’ কলল কামাল।
শহীদ বলল, গিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে আশা করা বৃথা। মহিলা কি বলতে চাইছিলেন কে জানে। চওড়া মেটো রাস্তা সোজা চলে গেছে ধুপপাড়া অবধি। রাস্তার বাঁ দিকে জলাভূমি। ডানে জঙ্গল। | জঙ্গল কেটে ধুপপাড়া গ্রামের সূচনা হয়েছিল। জঙ্গলের ভিতর গ্রামটা খুব
একটা বেড়ে ওঠেনি। দশ বারোজন কৃষকের বাড়ি। বাড়ি বলতে একটা করে। একচালার ঘর এবং ছোট একটা উঠান। বাকী সব জঙ্গলই এখনও। | নদীর ধারে অবশ্য আরও কয়েকটি বাড়ি আছে। আছে মসজিদ। কিন্তু ওদিকটায় জল নেই। চওড়া রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দশ বারোটা একচালাকে পাশে রেখে মসজিদ এবং নদীর কাহ অবধি গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাস্তা ধরে হেঁটেই ধুপপাড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেল শহীদ ও কামাল।
জঙ্গল দু’ধারেই এদিকে। চওড়া রাস্তাটা ধরে আরও শ’খানেক গজ সামনে গেলেই দেখতে পাবার কথা বাড়িগুলো।
রাস্তা ধরে হাঁটলেও জঙ্গল ঘেঁষে হাঁটছিল ও। নিঃশব্দ পায়ে আরও পঞ্চাশ ষাটগজ এগোবার পর আলো দেখা গেল।
হারিকেনের আলো। একটি ঘরে খোলা দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজা পথে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা নড়াচড়া করছে।
নিশ্চিন্তে আছে শত্রু। বিপদের সম্ভবনা নেই বলে মনে করেছে হয়ত।
দ্রুত ভাবতে লাগল শহীদ কিভাবে আক্রমণ করা যেতে পারে। কামাল নিচু গলায় বলে উঠল, ‘দুজন দুদিক থেকে আক্রমণ করলে ভাল হয়। * শহীদ উত্তর দেবার আগেই মাত্র বিশ গজ সামনের একটি বট গাছের মোটা
১১৮
ভলিউম ১২
কাণ্ডের আড়াল থেকে গর্জে উঠল মেশিনগান।
দমকা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল কামালের বুক থেকে। পড়ে গেল ও তাল সামলাতে না পেরে।
পালটা গুলি না করে কামালকে তুলে নিয়ে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল শহীদ। ‘কোথায় লেগেছে?
উঠে বসল কামাল। নিজের স্টেন গানটা ধরল দুই হাতে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে কুঁচকে উঠছে ওর।
‘পায়ে লেগেছে। মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট। তেমন কিছু না, চিন্তা করিসনে। শত্রা পাহারায় আছে। ডান দিক থেকে আক্রমণ করবি তুই?’ | শহীদ ঝোল থেকে তুলো ইত্যাদি বের করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।
কামালের হাঁটুর উপরে বুলেট লেগে বেরিয়ে গেছে।
শত্রু গুলি করেছিল সন্দেহের উপর। পাল্টা গুলির শব্দ হলো না দেখে সন্দেহটা দূর হলো। কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। দুজন ছিল ওরা বটগাছের আড়ালে। একজন টর্চ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল আড়াল থেকে।
জঙ্গল থেকে মাথা রে করে শহীদ এবং কামাল দেখছিল সব। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছে শত্রু।
তুই সামলা।’ নিচু গলায় কাল শহীদ, ইটের জবাব পাথর দিয়েছে। হেসে ফেলল কামাল। হাসতে হাসতে স্টেনগানটা একটু উঁচু করে ট্রিগার টিপল
ও)
টু-শব্দ করার অবকাশও পেল না শত্রু। ধরাশায়ী হলো। এক ঝাক বুলেট বুকে নিয়ে।
বটগাছের আড়াল থেকে শুরু হলো মেশিনগানের বুলেট বৃষ্টি। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। শহীদ ততক্ষণ একটা গ্রেনেডের পিন, আলগা করে ছুঁড়ে
• মেরেছে বটগাহের দিকে।
অব্যর্থ লক্ষ্য শহীদের। গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হলো বটগাছের এক হাত পেছনে, পাশ ঘেঁষে।
তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল শত্রুর। মেনিশনগান স্তব্ধ হয়ে গেছে কয়েক সেকেণ্ড আগেই।
কিন্তু এবার শুরু হলো আসল বিপদের সূচনা। সামনের দিক থেকে গর্জে উঠল কমপক্ষে আট দশটা মেশিনগান এক সাথে।
| সেই সাথে উড়ে এল একটা গ্রেনেড়।
মাথার উপর দিয়ে চলে গেল গ্রেনেডটা। প্রায় পনেরো হাত পেছনে গিয়ে বিস্ফোরিত হলো সেটা।
শহীদের নির্দেশে জঙ্গলের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে নিল কামাল।
তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা দু’জন সামনের দিকে হামাগুড়ি দিতে দিতে ।
বিশ গজের মত যাবার পরই থামতে বাধ্য হলো ওরা।
জঙ্গল আপাতত এখানেই শেষ। সামনে দু’একটা গাছ। ফাঁকা জায়গা খানিকটা। পঁচিশ গজ সামনে প্রথম বাড়িটা। পাশে আরও দুটো ছোট ছোট কুঁড়ে
ঘর।
ঘরগুলোর সামনে ট্রেঞ্চ। ফাঁকা জায়গাটাতেও ট্রেঞ্চ দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ট্রেঞ্চে দুজন তিনজন করে শত্রু।
শহীদ ফিসফিস করে বলল, গুলি চালাসনে। শত্রু সম্ভবত ঘিরে ফেলেছে আমাদেরকে।
বুঝতে পারল না কামাল শহীদের কথা।
বেশ কিছু বুলেট সহজে খরচ হয়ে গেল। লাশ তিনটে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খান সেনাদের তৎপরতা বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।
ট্রেঞ্চ থেকে দশ মিনিট পরই বেরিয়ে পড়ল দুজন মুক্তিসেনা। কামরা থেকে মহুয়া চিৎকার করে বলল, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সবুর এবং জামাল। হাত দিয়ে গেটটা দেখাল তারা। মহুয়া হাত নেড়ে নিষেধ করল।
কিন্তু শুনল না ওরা। হামাগুড়ি দিতে দিতে গেটের দিকে এগিয়ে চলল তারা দুজন।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে জামালের। বেচারার হাঁটুর পিছনের ঘা এখনও শুকায়নি। নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে সকালে মহুয়া। রক্ত বেরিয়ে লাল হয়ে গেছে, ব্যান্ডেজটা। পায়ের নিচের অংশটা ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছে অপারেশনের পর। তিনটে বুলেট বেরিয়েছিল ওর হাঁটুর পিছন থেকে।
সবুরের ডান পাটা একেবারেই নেই। ব্যান্ডেজ আছে, কিন্তু ঘা ওর প্রায় : শুকিয়ে এসেছে।
। কিন্তু জামালকে হেড়ে আগে এগিয়ে যাচ্ছে না সবুর। জামালের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছে সে। মাঝে মধ্যে জামালকে ধরে সাহায্য করছে।
| গেটের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে ওরা। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ হলো।
কেঁপে উঠল যেন গোটা দুনিয়া। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল মহুয়া। যেমন আচমকা ছিটকে পড়ল তেমনি আচমকা উঠে দাঁড়াল মহুয়া। পড়ে গেলেও
ভলিউম ১২
| ১২০
কোথাও আঘাত পায়নি সে।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মহুয়া দেখল হাসপাতালের দেয়ালটা ভেঙে গেছে মর্টারের গোলায়।
গেটের মাঝখানে পৌঁছে গেছে সবুর এবং জামাল। কামরার ভিতর থেকে গর্জে উঠল খবিরের স্টেনগান।
ভাঙা পাচিলের ওপরে একজন খান-সেনাকে দেখে গুলি করেছে সে। কিন্তু অনেকটা দূরে তারা। কাজ হলো না।
• গর্জে উঠল সবুর এবং জামালের স্টেন।
শত্রুর আর্তচিৎকার কানে এল। পর মুহূর্তে শুরু হলো নারকীয় কাণ্ড।
গর্জে উঠল একযোগে কয়েক ডজন এল. এম. জি এবং দুটো মর্টার। গোটা বাড়িটা থরথর করে কাঁপছে। ইট-বালি খসে পড়ছে।
উপর পানে তাকিয়ে আকাশ দেখতে পেল মহুয়া।
জানালা দিয়ে তাকাবার দরকার ছিল না। সবুর এবং জামালের কি হয়েছে তা জানবার বাকী নেই।
লাশ দুটো দেখে মোচড় দিয়ে উঠল বুকটা। খবিরের উদ্দেশ্যে তাকাতেই মহুয়া আঁতকে উঠল।নেই খরি।
কিন্তু পর মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল মহুয়া। বাধা দিয়ে কি হবে আর। যাক, যা ইচ্ছা করুক। মরার আগে চেষ্টার ত্রুটি যেন না থাকে।
লীনার পদশব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে শুকনোভাবে হাসল মহুয়া। ‘এল না দাদারা কেউ। হাহাকার করে উঠল লীনা। * মহুয়া বলল, পিছনেও রয়েছে একজন, না?”
হা। ওরা লুকিয়ে বসে আছে। গুলি টুলি করছে না। কেন বুঝতে পারছি না।’ মিসেস রহমান কি খুব ভয় পেয়েছেন?’ ‘মোটেই না। তিনি তো রীতিমত সাহস দিচ্ছিলেন আমাকে।
না তুই। মহুয়া বলল, এখানে বিপদ বরং বেশি।’ লীনা বলল, তোমাকে নিতে এসেছি। ছাদ চাপা পড়ে মরে যাবে যে।’ হেসে ফেলল মহুয়া, মরতে তো হবেই। ছাদ চাপা পড়ে মরাটা মন্দ কিসে? লীনা মহুয়ার একটি হাত ধরে বলল, ‘দূর! চলো ভাবী…!” মহুয়ার কথা শেষ হলো না। গর্জে উঠল অদূরেই কয়েকটা স্টেনগান। পরমুহূর্তে শোনা গেল খবিরের অন্তিম চিৎকারঃ মা-গো-ও-ও-ও…! জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।
কুয়াশা ৩৬
সব শেষ হয়ে গেছে। গেট পেরিয়ে দলে দলে ঢুকছে খান-সেনারা স্টেনগান উঁচিয়ে।
‘এখানেই দাঁড়া। বলল মহুয়া লীনাকে। নিজের গায়ের সাথে চেপে ধরে, ‘ফেলে দে স্টেনগান। বাইরে থেকে কর্কশ কণ্ঠে আদেশ হলোঃ আন্দর যে ভি হো বাহার আ যাও! ধীর পায়ে লীনাকে জড়িয়ে ধরে বারান্দায় বেরিয়ে এল মহুয়া। লীনা অসহায় পক্ষীশাবকের মত কাঁপছে মহুয়ার বুকে মুখ লুকিয়ে। হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল একসঙ্গে কয়েকজন পশু-সেনা। নিস্পলক, ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে খান-সেনাদের দিকে তাকিয়ে রইল মহুয়া। কথা বলল না। কোন অনুরোধ করল না। এমনকি কাদলও না মহুয়া।
একজন অফিসার গোহের খান-সেনা উঠে এল বারান্দায়।
মুহুয়া পরিষ্কার ইংরেজিতে বললু, ‘তোরা মারতে চাও মারো। কিন্তু আমাদের গায়ে হাত দিয়ো না।’
বেঁধে ফেলার হুকুম করল পাঞ্জাবী সেনা মহুয়া এবং লীনাকে। দশ
। “কি বলছিস, শহীদ?
কামাল প্রশ্ন করুল। উত্তর দিতে হলো না শহীদকে। পিছন থেকে গর্জে উঠল স্টেনগানু। ‘একি!’ চমকে উঠল কামাল।
শহীদ ফিসফিস করে বলল, আমি আগেই টের পেয়েছি। শত্রু আমাদের পিছু নিয়ে এসেছে রাহিলীপোতা থেকে।
গর্জে উঠল স্টেনগান ডান দিক থেকে। এক মুহূর্ত পর বাঁ দিক থেকেও শোনা গেল ব্রাশ ফায়ারের শব্দ।
মৃত্যু অবধারিত।
কথাটা বলে শহীদ একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে কামাল। শহীদের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে সে।
শহীদ! বলবি কিছু? শহীদ আরও একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল। এবার পিছন দিকে। ‘একি ব্যাপার! ওরা ঘিরে ফেলেছে আমাদেরকে।
অতি কষ্টে হাসল শহীদ। কলল, বুঝতেই তো পারছিস।
ভলিউম ১২
১২২:
বোবা বনে গেল কামাল।
সামনের ফাঁকা জাগাটায় পাশাপাশি তিনটে ট্রেঞ্চ। ট্রেঞ্চের ভিতরকার শত্রুদের সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু স্টেনের নলগুলো বেরিয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। গুলি ছুটে আসছে কুঁড়েঘরগুলোর সামনের ট্রেঞ্চ থেকে।
অনুমানের উপর নির্ভর করে গুলি ছুঁড়ছে শত্রুরা। এখনও দেখতে পায়নি ওরা ওদের দুজনকে।
গ্রেনেড বেশি নেই। মাত্র তিনটে আর। গুলিও নেই যথেষ্ট। স্টেন তুলে নিল কামাল।
এগিয়ে গেল ক্রলিং করে আধহাত। শহীদ একটা হাত রাখল কামালের পিঠে আলতো করে।
চমকে উঠে তাকাল কামাল। চাপা কণ্ঠে বলল ও, কি রে?’
কাছাকাছি থাকিস। ‘কেন রে? কেমন যেন আঁতকে উঠল কামাল।
শহীদ হাসবার চেষ্টা করছে। কামাল ভীষণ ঘারড়ে গেছে। মরিয়া হয়ে উঠছে বাঁচার চেষ্টা করার জন্যে, বুঝতে পারছে শহীদ।
| মনে নেই, শয়তান? মরার সময় একসাথে, হাত ধরাধরি করে মরব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা?’
একটু যেন কেঁপে গেল শহীদের কণ্ঠস্বর। গফুরের মৃতদেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। গফুরের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ও ছিল না তখন। সেটা ছিল পঁচিশে মার্চের রাত । এটা অক্টোবর।
পিছিয়ে এল আবার আধহাত কামাল। বলল, সত্যিই কি আমরা মরতে যাচ্ছি, শহীদ!
হ্যাঁ।
হোট্ট উত্তর শহীদের। দুজনেই চুপচাপ।
শত্রুপক্ষ চারিদিক থেকে অগ্রিম গুলি চালাচ্ছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে মাটি। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হচ্ছে। আলোকিত হয়ে উঠছে মুহূর্তের জন্যে দিকবিদিক।
ওদের কারও মুখে কোন কথা নেই। ‘কেন লাগছে রে?”
অনেকক্ষণ প্র জিজ্ঞেস করুল শহীদ।
কথা বলল না সাথে সাথে কামাল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, মনে পড়ছে…।’
কুয়াশা ৩৬
১২৩
শুরু করেও বলতে পারল না কামাল।
শহীদের একটা হাত কামালের মাথায় গিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। কামালের মাথার চুল মুঠো করে ধরে একটু চাপ দিল শহীদ।
মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা।’
ধীরে ধীরে, দম নিয়ে নিয়ে, উদাস ভাবে বলছে কামাল, একবার দুটো ছেলে ঘুসি মেরে আমার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। আমি পারছিলাম না ওদের সাথে । কোত্থেকে যে তুই ছুটে এলি। মার খেয়ে পালিয়ে গেল ওরী। সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে, গিয়েছিলাম রে…।’
শহীদ কামালের মাথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল, কিন্তু আজ আমি তোকে বাঁচাতে পারব না রে, কামাল।
মনে পড়ছে..মনে পড়ছে।’
অনেক কথা মনে পড়ছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবে ভেবে পাচ্ছে না কামাল। ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে ওরা। একসাথে খেয়েছে, এক বিছানায় শুয়েছে, একসঙ্গে খেলেছে, বকুনি খেয়েছে, স্কুলে গেছে, দুষ্টুমি করেছে। কত মধুর স্মৃতি, কত রোমাঞ্চকর অনুভূতি, কত বিচিত্র ঘটনা–সব একসাথে দেখা, একসাথে উপভোগ করা।
সিগারেট খাবি, কামাল?’ ‘খাবি?’
শহীদ বলল, তুই খা । এইতো শেষ। সিগারেটের যে পাগল তুই।
আর কিসের ভয়? আর কেন সাবধানতা? পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল কামাল।
গ্রেনেড বিস্ফোরিত হবার সাথে সাথে অত্যুজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে। শহীদের মুখ দেখছে সেই আলোয় কামলি। কামালের মুখ দেখছে শহীদ।
‘শেষ কি ইচ্ছা হচ্ছে কল তো তোর, শহীদ?’ জিজ্ঞেস করল কামাল।
কামালও ভাবছিল। গফুরের কথা মনে পড়ছিল। কত বকুনি দিয়েছে সে। চুপ করে শুনত। বড় ভালবাসত গফুর বাইকে। অথচ তার মৃত্যুতে মন খারাপ করার অবসরও ছিল না তখন।
এগারো প্রতিদিন, প্রতিঘন্টা, প্রতি মিনিট মহুয়া আশা করছে শহীদ আসবে। কিন্তু বৃথা আশা। ওদের দেখা নেই। |
ক্যাপ্টেন আকরাম খান ঝড়ের বেগে ঢুকল ঘরের ভিতর। রাগে, উত্তেজনায়। চোখমুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে যেন তার। ১২৪
ভলিউম ১২
পিছু পিছু ঢুকল দুই খান-সেনা।
ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকাল মহুয়া।
দাঁতে দাঁত চাপল আকরম খান। লীনার দিকে তাকাল সে দুই ৭৩ কোমরে দিয়ে।
ভয়ে চোখ ফেরাল লীনা। মহুয়ার দিকে তাকাল সে। ইমান খান! | চিৎকার করে উঠল ক্যাপ্টেন আকরম খান।
ইয়েস, স্যার!’ হুকুম দিল আকরম খান, ‘বেয়োনেট লাও। বেয়োনেট ফিটকরা রাইফেলটা এগিয়ে দিল ইমান খান।
লীনার দিকে এক পা এগিয়ে গেল বেয়োনেট লাগানো সাইকেল নিয়ে আকরম খান।
-আঃ আঃ চিৎকার করে উঠল লীনা। দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেলে উঠল দুই পশু-সেনা। আকরম খান হুকুম করল, ইস যোয়ান লেড়কীকা কাপড়া উতারো, ইমান খান!
এগিয়ে গেল ইমান খান এবং তার সাথী।
মেঝেতে পড়ে আছে মহুয়া। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা ওর। পা দুটোও বাঁধা।
তবু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল মহুয়া। মহুয়া চিৎকার করে উঠল।
দুই চোখে পানি ভরে উঠল মহুয়ার। লীনার দিকে তাকাল না ও ভয়ে ভয়ে। যা ঘটছে তা চোখে দেখার নয়।
আকরম খানের পায়ের সামনে গিয়ে থামল মহুয়া। | ‘ও, কি দোষ করেছে, ক্যাপ্টেন সাহেব? আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছে, আমাকে মেরে ফেলুন•••।’
প্রচণ্ড এক লাথি মারুল আকম খান মহুয়ার পেট বরাবর। লাথি খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে সরে গেল মহুয়া। এতটুকু শব্দ বের হলো না তার গলা থেকে। লীনা অক্সিম আর্তনাদ করছে। ‘তোমোগ বাহার যাও!’
আকরম খান খান-সেনা দুটোকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে কাপড় খুলতে শুরু করল ।
| সব বুঝতে পারছে মহুয়া। পাজরে প্রচণ্ড ব্যথা। ডান দিকের একটি পাজর ভেঙে ‘গেছে লাথির আঘাতে। কিন্তু সে ব্যথা কষ্ট দিচ্ছে না মহুয়াকে। দুই চোখ দিয়ে নেমে
কুয়াশা ৩৬
১২৫
আসছে নোনা জল।
এরচেয়ে মৃত্যু শতগুণ, সহস্রগুণ ভাল ছিল। সে বেঁচে রয়েছে। বেচে থেকে দেখতে হচ্ছে লীনার এত বড় সর্বনাশ! কোথায় তোমরা, শহীদ! কোথায় তোমরা?
অকস্মাৎ আকরম খানের অট্টহাসি শোনা গেল। পরমুহূর্তে একটা ঝাপ্টাঝারি, ধস্তাধস্তির শব্দ।
জ্ঞান হারাল তারপর লীনা। ‘অচেতন দেহের উপর চলল জঘন্য অত্যাচার। আকরম খান উঠে দাঁড়াল লীনাকে ছেড়ে দিয়ে। শব্দ শুনে নড়ে উঠল মহুয়া। খানিক পর ঘাড় ফিরিয়ে ধীরে ধীরে তাকাল সে। আকরম খান উলঙ্গ। কুৎসিত, কদাকার দেখাচ্ছে তাকে।
লীনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আকরম খান। তার হাতে শক্ত করে ধরা বেয়োনেট লাগানো রাইফেলটা। : )
ভয়ে, আতঙ্কে অসহায় ভাবে চিৎকার করে উঠল মহুয়া, না! না! না!
আকরম খান বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিল লীনার তলপেটে। তখুনি সে ব্বে করল না সেটা।
তীক্ষ্ণধার বেয়োনেটটা ঠেলে দিল আকরম খান।
ক্যাচ ক্যাচ করে আওয়াজ হলো। লীনার তলপেট থেকে বুকের কাহ অবধি চিরে দিল এক টানে।
রাইফেলটা ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কুকুরটা। সঁাত রে করে নিঃশব্দে হাসল সে। তারপর এগিয়ে এল মহুয়ার দিকে।
চিৎকার করে উঠল মহুয়া।
বারো
ইচ্ছে করছে লীনাকে, মহুয়াদিকে একবার দেখি..!
কামালের পিঠে হাতটা ছিল শহীদের। মহুয়ার তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে ঢুকল হঠাৎ। তারপরই সৰ চুপচাপ।
হঠাৎ কামাল অনুভব করল শহীদের হাতটা খামচে ধরেহে তার পিঠ। খানিক পর আলগা করুল শহীদ হাতের মুঠো। ‘সব শেষ। কল শহীদ। কামালের সর্বশরীর জ্বলছে। অস্থির হয়ে উঠেছে সে। ‘আমার আগেই চলে গেল মহুয়া। অস্ফুটে বলল শহীদ।
ছাড়ব না, প্রতিশোধ নেব।’
১২৬
ভলিউম ১২
ক্রল করে এগিয়ে চলল কামাল।
কাছাকাছি থাকিস!’ কলল শহীদ। | গুলি এসে লাগল হঠাৎ শহীদের ডানপায়ে। কামাল এগিয়ে যাচ্ছে। শহীদের বুকটা আচমকা কেঁপে উঠল।
কোনদিকে ভ্রুক্ষেপে নেই কামালের। .. দ্রুত এগিয়ে চলেছে কামাল সামনের ট্রেঞ্চের দিকে। আর মাত্র দশ পনেরো হাত দূরেই ট্রঞ্চ।
শহীদ গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল একটা। শত্রুকে ব্যস্ত রাখা দরকার। যেন ওদেরকে দেখতে না পায় শত্রু।
| দ্বিতীয় গ্রেনেডটা ছুঁড়ল শহীদ ফাঁকা জায়গাটায় হামাগুড়ি দিয়ে এসে।
কামাল পৌঁছে গেছে প্রায়।
শহীদ দেখল কুঁড়েঘরের সামনে পাঁচ জন পাঞ্জাবী সেনা। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে ফল করে এগিয়ে আসছে তারা।
বায়নোকুলার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল শহীদ। কামাল ট্রেঞ্চের কাছে পৌঁছে গেছে। থামল শহীদ। খুঁড়ে মারল একটি গ্রেনেড। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।
গর্জে উঠল কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। একটা বুলেট পাগল শহীদের বাঁ হাতের কব্জিতে।
. এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ। কামাল ট্রেঞ্চে নামছে। ট্রেঞ্চ থেকে মাত্র পাঁচ হাত দূরে এখন শহীদ। এমন সময় শহীদ এবং কামালের জীবনের সবচেয়ে মর্মন্তুদ ঘটনাটা ঘটল।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল শহীদের যেন নাকের ডগায়।
পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠল প্রবলভাবে। দুলছে যেন গোটা জাহান। অন্ধকার নেমে আসছে। শহীদ কামালের নাম ধরে ডাকার প্রাণপণ চেষ্টা করুন। এগিয়ে যাচ্ছে ও। একবার মনে হচ্ছে মরে গেছে। একবার মনে হচ্ছেনা বেঁচে আছে।
| নেমে এল গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকার নেমে আবার পূর্ব মুহূর্তে শহীদের মনে হলো-মারা যাচ্ছে ও। একটা হাত বাড়িয়ে দিল ও।
উত্তপ্ত একদলা মাংসের উপর গিয়ে থপ করে পড়ল হাতটা। কামালের দলা পাকানো দেহটার উপর পড়েছে শহীদের হাত।
তেরো একনাগাড়ে মিেশনগানের গুলি এবং গ্রেনেডের শব্দ শোনা গেল প্রায় পনেরো মিনিট। : শত্রুপক্ষ পাল্টা জবাব না পেয়ে অবশেষে থামল। নিস্তব্ধতা নেমে এল
আশা ৩৬
১২৭ ।
ধুপপাড়ায়।
কেটে গেল আরও কয়েকটি মিনিট। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা। উঠে দাঁড়াল এক একজন করে। শহীদের এবং কামালের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করল তারা। টর্চের আলোয় দূর থেকে অনেকক্ষণ, ধরে দেখল।
শহীদ এবং কামাল নড়ছে না এতটুকু। পাঁচজন খান-সেনা এগিয়ে আসতে শুরু করল স্টেনগান উঁচিয়ে।
এগিয়ে আসছে পাঁচজন। পাঁচজনেরই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কামাল এবং শহীদের দিকে।
ট্রেঞ্চের সামনে এসে বঁড়াল পাঁচজন। কামালের অর্ধাংশ পড়ে আছে ট্রেঞ্চের ভিতর। বাকী অর্ধাংশ ট্রেঞ্চের উপর থাকার কথা। কিন্তু তা নেই।
গ্রেনেড পড়েছিল কামালের শরীরের উপরের অংশেই। সেটুকু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
শহীদের দিকে এগিয়ে এল পাঁচজন খান-সেনা এবার। উপুড় হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে শহীদ। একজন খান-সেনা বুট জুতো দিয়ে শহীদের দেহটা উল্টে দেখার চেষ্টা করছে। গর্জে উঠল একটি এল, এম,জি,।
চোখের পলকে ঝক ঝক বুলেট এসে আশ্রয় নিল পাঁচজন খান-সেনার দেহের সর্বত্র। কাটা কলা গাছের মত আছড়ে পড়ল পাঁচজনই।
কল করে বেরিয়ে এল ফাঁকা জায়গাটায় জঙ্গলের ভিতর থেকে এল, এম. জি. হাতে কুয়াশা।
কুঁড়েঘরের সামনের ট্রেঞ্চ থেকে শত্রুপক্ষ মেশিনগান চালাতে শুরু করল।
ফাঁকা জায়গাটায় থেমেছে কুয়াশা। গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল ও একটা। কুঁড়েঘরের গায়ে গিয়ে লাগল সেটা। আগুন ধরে গেল বেড়ার দেয়ালে।
দ্রুত ভাবছিল কুয়াশা। কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। পিছিয়ে এল আবার কুয়াশা। আবার একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল ও।
ট্রেঞ্চের অনেকটা সামনে সেটা বিস্ফোরিত হলো। শত্রুপক্ষের ক্ষতি হলো কিনা দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না কুয়াশী।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দ্রুত ছুটল ও। অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে কুয়াশা জঙ্গল থেকে মাথা বের করে দেখল কুঁড়েঘরগুলোর বাঁ দিকে চলে এসেছে সে।
| সেখানে দাঁড়িয়ে আবার একটি গ্রেনেড ছুঁড়ল কুয়াশা। তারপর এল, এম, জির ট্রিগার টিপে ধরল। আধ মিনিট গুলিবর্ষণ করেই কুয়াশা প্রকাণ্ড কয়েকটি লাফ দিয়ে
আবার খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করল।
ধুপপাড়ার প্রথম পর্যায়ের বাড়িগুলোর পিছনে গিয়েও কুয়াশা গ্রেনেড ছুঁড়ল, একটা এবং আধ মিনিট গুলিবর্ষণ করল।
১২৮
ভলিউম ১২
একই পদ্ধতিতে গোটা শক্ত ঘাঁটি ঘিরে গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং গুলিবর্ষণ করে শত্রুপক্ষের মনোবল একেবারে ভেঙে দিল কুয়াশা। সে যে একা তা শত্রুপক্ষ যেন টের
পায় এই ছিল কুয়াশার ইচ্ছা।
সাড়ে চারটের দিকে কুয়াশার তৃতীয়বার গোটা ঘাটিটা চক্কর মেরে আবার পূর্বস্থলে ফিরে এসে দেখল কুঁড়েঘরগুলোর সামনের ট্রেঞ্চে কেউ নেই।
শত্রুপক্ষ কি নতুন কোন মতলব আঁটছে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই কুয়াশা ক্রল করে এগিয়ে যেতে শুরু করল।
এক মুহূর্ত পরই নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এক লাফে উঠে দাঁড়াল সে। তারপর ছুটল কুঁড়েঘরগুলোর দিকে।
ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে প্রথম সারির ট্রেঞ্চের কাছে যেতে কুয়াশার লাগল দুটো মাত্র লাফ। তৃতীয় লাফ দেবার আগেই গর্জে উঠল শত্রুর মেশিনগান।
হুমড়ি খেয়ে পড়ল ট্রেঞ্চের ভিতর কুয়াশা। গুলি লেগেছে পায়ে। পাশের ট্রেঞ্চে কামালের অর্ধেক দেহ।
ব্যাথায় চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠল কুয়াশার। এল, এম. জি.টা মাটির উপর সোজাভাবে রেখে কুঁড়েঘর দুটোর দিকে ব্রাশ ফায়ার করল ও।
পাল্টা জবাব এল না।
একমুহূর্ত পরই চমকে উঠল কুয়াশা।
চোদ্দ আগুন।
শত্রুপক্ষ ঘাঁটি ত্যাগ করে ধুপপাড়ার পিছন দিক দিয়ে পালিয়েছে। আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে তারা বাড়িগুলোয়।
কুঁড়েঘর দুটোয় আগুন দেয়নি শত্রুরা! আশঙ্কায় কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা। মহুয়ারা কি বেঁচে নেই?
ঝুঁকে পড়ে বা পায়ের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে কুয়াশা বুঝল হাঁটুর উপর এবং নিচে মোট তিনটে বুলেট লেগেছে। হাঁটুর উপরের বুলেটটা রয়ে গেছে ভিতরেই।
ট্রেঞ্চ থেকে উঠতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হলো কুয়াশাকে। প্রচণ্ড ব্যথায় সংজ্ঞা লোপ পাবে না তো?
প্রশ্নটা মনে জাগতেই কুয়াশা পা বাড়াল। ডান পাটা এগোয়। কিন্তু বা পাটা এগোতে চায় না। প্রায় অবলম্বনহীন দশা বা পাটার।
অতিকষ্টে কয়েক পা এগোল কুয়াশা। দুর্বল হয়ে পড়ছে ও। অসহ্য ব্যথা। দাঁতে দাঁত চেপে কোন রকমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে হয়ত। কিন্তু হাঁটবার শক্তি নেই।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। ৯-কুয়াশা ৩৬
১২৯
কিন্তু এগোতে হবে। পিশাচ শত্রুরা হয়ত মহুয়াদেরকে বন্দিনী অবস্থায় রেখে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ঘরে।
কুঁড়েঘরগুলোর খানিকটা পিছনে একচালাগুলো। দাউ দাউ করে জ্বলছে দুটো একচালা। পাশের কয়েকটা এখনও অক্ষত। কিন্তু আগুন দুই ছুঁই করছে। সেগুলোকেও।
পারছে না কুয়াশা। হাঁটা অসম্ভব। কেটে যাচ্ছে সময়। দশ মিনিট, কি আরও বেশিক্ষণ আগে আগুন দিয়েছে শত্রু।
হঠাৎ বসে পড়ল কুয়াশা। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। ডান পায়ের হাঁটু, দুই হাতের কনুই এবং বুকের উপর ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল কুয়াশা।
কুঁড়েঘর দুটোর কাছে পৌহে কুয়াশা বিদ্যুৎবেগে পিছন ফিরে তাকাল হঠাৎ।
কি যেন দেখল কুয়াশা। দ্রুত কুঁড়েঘরের ভিতর টেনে নিয়ে গেল ও নিজের দেহটাকে।
একদল মানুষকে দেখা গেল। এগিয়ে আসহে তারা কুঁড়েঘরগুলোর দিকে। কুয়াশা বিমূঢ় হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে সময় লাগল আরও।
দশ-বারোজন পাঞ্জাবী সেনা এগিয়ে আসছে। তাদের কারও হাত দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকের হাত পিছন দিকে।
পিছমোড়া করে বাধা নাকি?
পাঞ্জাবী শত্রুদের পিহুনে একজনকে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। চেনা যাচ্ছে না তাকে। লোকটার হাতে একটা টর্চ। অপর হাতে স্টেনগনি।
কুয়াশা যে কুঁড়েঘরটার ভিতর লুকিয়েছে সেটার সামনে এসে দাঁড়াল খান সেনারা
হঠাৎ নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারল না কুয়াশা। গলাটা রাসেলের। কুয়াশার নাম ধরেই ডাকছে রাসেল। ‘মি, কুয়াশা, ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। রাসেলের কণ্ঠে তাড়া।
অনেক শক্তি ফিরে এসেছে কুয়াশার শরীরে। হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল সে। রাসেলের দিকে এগোতে এগোতে সবিস্ময়ে সে ভাবল-ছেলেটি কি যাদু জানে নাকি। রাতের অন্ধকারেও পরিষ্কার সব দেখতে পায়?
‘গুলি লেগেছে বুঝি?? ‘ জিজ্ঞেস করল রাসেল। উত্তর দিল না কুয়াশা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ও।
পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে একটি মেশিনগান। নলটা জঙ্গলের দিকে। বুকে পড়ল কুয়াশী। দুই হাতে ধরল মেশিনগানটাকে। ধরে ওঠাবার চেষ্টা করল। ১৩০
ভলিউম ১২
প্রাণপণ শক্তিতে টেনে তোলার চেষ্টা করছে মেশিনগানটাকে কুয়াশা। ওটা নড়ছে, কিন্তু মাটি ছাড়ছে না।
একটা হেভি মেশিনগান একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। বড় বেশি ভারি।
আমাকে দিন।’
ব্যর্থ হয়ে সরে দাঁড়াল কুয়াশা। রাসেল সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওর বাঁ হাতে, ওর নিজের স্টেনগানটা এখনও রয়েছে। সেটা ওর হাতেই রইল।
ডান হাত দিয়ে মেশিনগানটা ধরল রাসেল। দম বন্ধ করল। তারপর আকর্ষণ করল উপর দিকে।
অনায়াসে তুলে ফেলল হেভি মেশিনগানটাকে রাসেল এক হাতে।
বন্দী খান-মোদের দিকে মেশিনগানটা ফিট করে রাসেল কুয়াশাকে বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন। পাহারা দিন।’আমি দেখি মহুয়া ভাবীদের কি অবস্থা।
কুয়াশা চমকে উঠল আগুনের দিকে তাকিয়ে। আসেন। শোনো, রাসেল।’ বসে ততক্ষণ হুটতে শুরু করেছে।
আমি হে র করা একচাতেই। দুটা একচালার চাল ধসে পড়া বলে।
বাকে সেই দুটোর একটির সামনে গিয়ে এক ছুর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে কুয়াশার দিকে একবার তাকাল। তারপর মাথা নিছু করে এক লাফে
বু যম ও প্রজা টপকে চোখের পলকে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মনে মনে স্বীকার করল কুয়াশা এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। অপরকে বাঁচাবার জন্যে কেউ এমন ভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না!
দুই কাঁধে দুটি লাশ নিয়ে আধ মিনিট পরই বেরিয়ে এল রাসেল। লাশ দুটো কার দূর থেকে তা বোঝবার উপায় নেই।
আবার ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল রাসেল। ঠিক দশ সেকের পরই একচালাটার চাল খসে পড়ল।
শিউরে উঠল কুয়াশা। ‘ কিন্তু চালটা ধসে পড়ার প্রায় সাথে সাথে আরও একটি লাশ নিয়ে এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এল রাসেল।
লাশ তিনটে রেখে কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল। হাপাচ্ছে ও ।
শহীদ ভাইয়ের খবর কিছু জানেন?
জানি।’ আঙুল বাড়িয়ে শহীদের দেহটা দেখিয়ে দিল কুয়াশা। মারা গেছেন?
অসম্ভর ভারি এবং উক্তষ্ঠিত কণ্ঠস্বর কুয়াশার। কুম ৩৬
‘জানি না।’
খান-সেনাদের দিকে চেয়ে উত্তর দিল কুয়াশা। ধীর, শান্ত কিন্তু বলিষ্ঠ পদক্ষেপে শহীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল।
আগুনের লালচে আভায় শহীদের মুখের দিকে তাকিয়েই পাথরের মত স্থির হয়ে গেল রাসেল।
ঝাড়া এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল রাসেল। দুই গাল বেয়ে নোনা জল নেমে আসছে ওর দুই চোখ থেকে। শহীদের মুখের অবস্থা মর্মান্তিক। চেনা দায়। চেষ্টা করে চিনতে হয়।
শহীদের পাশে বসল রাসেল। ধীরে ধীরে শহীদের একটি হাত তুলে নিল নিজের হাতে।
উত্তপ্ত হাত। পালস্ দেখল দ্রুত রাসেল। আশার আলো ফুটে উঠল বুকে। শহীদ মরেনি। বেঁচে আছে এখনও। হয়ত বাঁচবে।
কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল আবার রাসেল। কলল, মহুয়া ভাবীরা কেউ বেঁচে নেই।
এদিক ওদিক তাকাল রাসেল। কুয়াশা নিস্পলক তাকিয়ে আছে রাসেলের দিকে।
কি একটা দেখে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা তুলে নিল রাসেল। | একটি রাইফেল। বেয়োনেট লাগানো।
কুয়াশার দিকে তাকাল আবার রাসেল ফিরে এসে বলল ওদের সবাইকে বেয়োনেট চার্জ করে খুন করা হয়েছে।
পাখি ডাকছে। পুবাকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে রাসেল যেন আপন মনেই বলে উঠল, লাল রক্ত দেখতে চাই আমি তাদের, যারা আমার মা-বোন ভাবীকে খুন করেছে।
আচমকা বিদ্যুৎবেগে লাফ মেরে খান-সেনাগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল।
বন্দী সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাসেল পাশাপাশি তিনজনের বুকে বেয়োনেট ঢুকিয়ে বের করে নিয়ে চতুর্থজনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, এমন সময় । কুয়াশার ভারি কণ্ঠস্বর কানে ঢুকতে থমকে দাঁড়াল ও।
‘এদিকে এসো, রাসেল। কুয়াশার গলায় কেমন যেন একটা আপনজনের সুর। এগিয়ে আসে রাসেল।
কুয়াশার পাশে দাঁড়ায় রাসেল।
১৩২
ভলিউম ১২
কুয়াশা বলে, ওদেরকে হত্যা করার জন্যে এত কষ্ট স্বীকার করছ কেন, ভাই? ধরে ধরে ওই আগুনে ফেলে দিই এসো।’
প্রতিহিংসায় থরথর করে কাঁপছে রাসেল। কথা বলতে পারল না ও।
হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে রাসেল কাঁপা গলায় বলে উঠল, মেরে ফেলুন। * ওদেরকে, মি. কুয়াশী। মেরে ফেলুন পশুগুলোকে। ওরা এখনও বেঁচে আছে এ আমি
সহ্য করতে পারছি না।’
গর্জে উঠল কুয়াশার মেশিনগান।
শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। দিনের আলো ফুটছে। মাটি খুঁড়হে রাসেল।
সূর্য উঠল। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন কাল ওরা দুজনেই। কুয়াশা এবং রাসেল।
খানিকক্ষণ পর দেখা গেল রোদের উপর দিয়ে কুয়াশা হেঁটে যাচ্ছে। কুয়াশার পায়ে ব্যান্ডেজ। একটা হাত সে রেখেছে রাসেলের বাঁ কাঁধে।
শহীদের অচেতন, রক্তাক্ত দেহটা ডান কাঁধে নিয়েহে রাসেল। কান পেতেও একটা গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর।
Leave a Reply