৩৫. রক্ত শপথ ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৫
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ এক এদিকে রাত বাড়ছে।
সাভারের তালুকদার কটেজের বৈঠকখানায় অটুট নিস্তব্ধতা।
আহাদ চৌধুরী, মিসেস আহাদ, স্বপন, সবিতা, টেকনিশিয়ান এবং ক্যামেরাম্যান সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
শহীদ এই মাত্র নিজের, কামালের কুয়াশার এবং ডি.কস্টার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেছে। নিজেদের ছদ্মবেশ নেবার কারণটাও ব্যাখ্যা করতে ভোলনি শহীদ। সেই সাথে প্রকৃত মি. তালুকদার হত্যাকারীর পরিচয় এবং সেই হত্যাকারীকে কেন মি, আকবর খুন করেছেন তাও সে ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দিয়েছে।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছে সবাই। এমতাবস্থায় পুলিশ ডাকা উচিত। | একটি কেসের সমাধান হলে স্বভাবতই প্রবর্তী কর্তব্য চাপে পুলিসের কাঁধে। পুলিস এসে জেরা করে, জবানবন্দী নেয়, ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করে, খুনীর ছবি তোলে, হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসে। ‘ কিন্তু সেই রাতে তালুকদার কটেজে কোন পুলিস এল না, এল না, কারণ আসা সবও ছিল না। | ছেঁড়া তার জোড়া লাগিয়ে ডায়াল করে কানেকশন পাওয়া গেল না থানার সাথে। কেননা সেটা ছিল উনিশ শো একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অভিশপ্ত রাত ।
উপরতলায় ফোন করতে গিয়েছিল কামাল এবং ডি.কস্টা।
রাত তখন এগারোটার উপরে। কায়েকবার ডায়াল করে কোন সাড়া না পেয়ে কামাল মুখ তুলে তাকাল।
ডি কস্টা বলল, ‘ডারোগা বাবু বোডহয় স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন!’
কামালকে কিন্তু চিন্তিত মনে হলো। কি যেন বলতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু প্রচণ্ড একটা বাধা পেল তখুনি।
নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কামাল খোলা জানালার দিকে। ‘ তড়াক করে লাফ মারল ডি.কস্টা। সোজা খাটের নিচে গিয়ে আশ্রয় লি সে।
কুয়াশা ৩৫
৪৫
নারী কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল নিচতলা থেকে। পরিষ্কার বোঝা গেল না। কেননা চারিদিক থেকে অকস্মাৎ শোনা যাচ্ছে মর্টার, রাইফেল, এল, এম, জি, স্টেনগনি এবং গ্রেনেডের কান ফাটানো আওয়াজ।
দুই
ওরা বর্বর। ওরা পও। নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালী জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পিশাচরা। বাংলাদেশে তখন গভীর রাত। বাঙালীরা তখন তঘার ঘুমের ভিতর অচেতন। শত্রুরা অকস্মাৎ আঁপিয়ে পড়ল। শক্তি মদমত্ত পশু-সেনারা বিকট উল্লাসে সূচনা করল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম, ঘৃণ্যতম নরমেধযজ্ঞের! ‘
চমকে উঠল শহরবাসীরা! মৃত্যুভয় গ্রাস করতে এল নিরীহ মানুষগুলোকে। কিন্তু মরার আগে রুখে দাঁড়াল তারা।
ব্যারিকেড সৃষ্টি হলো।
ব্যারিকেড ভেঙে শত্রুবাহিনীর ইস্পাতের তৈরি ট্যাঙ্ক তুমুল বেগে এগিয়ে এল শত শত বাঙালী বীরের লাশের উপর দিয়ে। রক্তাক্ত হলো রাজপথ। ভাঙল সোনার সংসার। মা সন্তানকে হারাল। স্ত্রী স্বামীকে খুন হতে দেখল। ভাই দেখল ভাইকে শহীদ হতে।
কিন্তু তবু ভেঙে পড়ল না বাঙালী জাতি। জাতির এই দুর্দিনে প্রতিটি বাঙালী প্রতিজ্ঞা নিল। নিজের মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী, পুত্র, বন্ধুর লাশ দেখে তারা অটল হলো নিজ নিজ প্রতিজ্ঞায়। দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করতে হবে। বাংলাদেশকে করতে হবে স্বাধীন। চাই রক্তের বদলে রক্ত।
| ‘চাই রক্তের বদলে রক্ত!
দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল শহীদ। কামরার ভিতর অন্ধকার।
স্বাধীনতা চাই। বাঁচার মত বাঁচতে চাই। মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে চিৎকার করে উঠল কামাল।
‘ওরা আত্মঘাতী কাজ করে বসেছে।’’
বলল কুয়াশা, ‘ওরা জানে না আমাদের প্রতিশোধ কী ভয়ঙ্কর হবে। যে অপরাধের সূচনা আজ ওরা করল তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওদেরকে যুগ যুগ ধরে। ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে।
শহীদ পায়চারি থামিয়ে দাঁড়াল কুয়াশার মুখোমুখি। চোখ দুটো লাল ওর। পলক পড়ছে না। থমথম করছে মুখের চেহারা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট একটা মোমবাতি জ্বালাল কামাল।
‘আমি বেরিয়ে পড়তে চাই, কুয়াশা।’ | কথাটা বলে শহীদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুয়াশার দুই চোখের দিকে। ৪৬ *
ভলিউম ১২
তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ভাবছ?’
শহীদের প্রশ্নের উত্তর দিল প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে অদূরে কোথাও। বিস্ফোরণের পরই মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার।’
কুয়াশা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, ‘চলো, বেরিয়ে পড়ি আমরা, শহীদ।
‘ঘরের ভিতর বসে থাকা আমাদের সাজে না।’ বলল কামাল, কিন্তু কোথায় যাব আমরা? বাইরে বেরুতে হলে শত্রুর সাথে মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি হয়েই বেরুতে হবে। অস্ত্র কোথায় আমাদের?
• অস্ত্র নেই আমাদের হাতে। কিন্তু শত্রুদের আছে। ওদের হাতের অস্ত্র কেড়ে নেব আমরা। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য কোন উপায় নেই অস্ত্র সংগ্রহের।
শহীদ কথাগুলো বলে মি. আহাদকে কিছু উপদেশ দেবার জন্য পাশের কামরার দিকে পা বাড়াল। মি. আহাদ তার লোকজন নিয়ে পাশের কামরায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে ভীত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। মিসেস আহাদ এবং মিস সবিতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মাঝেমধ্যে।
তিন
.অশদ বাধা দেবার চেষ্টা করল। বলল, এই বিপদে কি কেউ বাইরে বের হয়? স্বীকার করলাম আপনারা অভিজ্ঞ মানুষ। ডাকাত, খুনী, অপরাধীদলদের সাথে লড়েছেন। কিন্তু আপনাদের সে অভিজ্ঞতা কি কোন কাজে লাগবে? একটি গোটা দেশের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর আধুনিক সকল প্রকার অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কি করবেন আপনারা? ওদের সাথে যুদ্ধ করবেন? হাস্যকর হবে না সেটা?
| শহীদ বলল, হাস্যকন্তু আপনার কথাগুলোই। কি করতে বলেন? ওরী মারবে আমাদেরকে আর আমরা তা চুপ করে সহ্য করব বলতে চান? তাহলে তো ক্রীতদাসে পরিণত হবে গোটা জাতটা। আপনি একটি জিনিস ভুল করছেন। আপনি শত্রুবাহিনীর শক্তিকে দেখছেন বড় করে। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে একটি সেনাবাহিনী, তা যতই বর্বর বা বিরাট হোক, একটি জাতির সমান তার কোনই ক্ষমতা নেই। জাতি যদি পাল্টা আঘাত হানে তাহলে নিমেষের মধ্যে চুরমার হয়ে যাবে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের সর্বশক্তি। থাকগে, বিষয়টা তর্ক সাপেক্ষ নয়। এটা ব সত্য। বাঙালী জাতি এই পিশাচদের ক্ষমা করবে না। ভয়কে জয়। করতে আমরা জানি। আমাদের অস্ত্র নেই, অস্ত্র আমরা কেড়ে নেব। জনবলই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ঝল। আমাদের তা আছে। সাড়ে সাতকোটি বাঙালীই আজ থেকে এক একজন যোদ্ধা। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে আমরা বিদায় নিচ্ছি। আরা আগে যাচ্ছি, আমাদের দেখাদেখি আপনারাও আসবেন। আসবে আপামর
কুয়াশা ৩৫
৪৭
জনসাধারণ। শুনতে পাচ্ছেন না?’
শহীদ প্রশ্ন করে চুপ করে রইল কয়েকমুহূর্ত। মেশিনগানের অবিরাম শব্দ হচ্ছে। দূরে। তার মাঝেও শোনা যাচ্ছে রাইফেলের শব্দ। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে কামরা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে।
‘শুনতে পাচ্ছেন ক্রশ ফায়ারের শব্দ? কারা বাধা দিচ্ছে বলুন তো বর্বর সেনাবাহিনীকে? বাঙালী যোদ্ধারা। না, আর দেরি নয়। আমরা চললাম। আপনারা থাকুন। সকাল হোক। সুযোগ এবং সময় মত ঢাকায় ফেরবার চেষ্টা করবেন। অহেতুক ভয় পাবেন না।’
মি. আহাদ বলে উঠলেন, ‘আপনার কথা শুনে রক্ত গরম হয়ে উঠেছে আমার, মি. শহীদ। আমার ইচ্ছা হচ্ছে। | শহীদ হেসে উঠে বলল, আমাদের সাথে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে, এই
বলতে চান তো? না, ভাই। আপনার সাথে মেয়েরা রয়েছেন। ওদেরকে নিরাপদ। জায়গায় পৌঁছে দেয়া দরকার। আপনি পরিচালক, সে দায়িত, আপনারই। দায়িত্ব পালন করুন। তারপর, সময় তো পড়ে রয়েছে, সুযোগ মত দেশের ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু আজ নয়। চললাম।’
শহীদ বেরিয়ে এল কামরা থেকে। শহীদকে দেখেই কুয়াশা প্রশ্ন করল, এবার বেরিয়ে যেতে পারি আমরা? শহীদ বলল, হ্যাঁ।’ কুয়াশা জোর গলায় ডাকল, মি. ডি কস্টা!’ কামাল অবাক কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আরে তাই তো। ডি.কস্টা গেল কোথায়? ডি.কস্টা কামালের সাথে দোতলা থেকে নেমেই আত্মগোপন করেছে ল্যাট্রিনে। কুয়াশার ডাক শুনে ডি.কস্টা ল্যাট্রিন থেকে বেরিয়ে এল হামাগুড়ি দিতে দিতে।
কামার দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই ডি.কস্টা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘গড় সেভ মি।’
হামাগুড়ি দিচ্ছেন কেন, উঠে দাঁড়ান।
কুয়াশার কথা শেষ হতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। দুর্বোধ্য স্বরে চিৎকার করে উঠল ডি. কস্টা। কুয়াশা ধমক মারল এবার, অমন চেঁচাচ্ছেন কেন?
শব্দটা এসেছে দূর থেকে। খামকা ভয় পাবেন না।’
কামাল বলল, এ লোককে নিয়ে বাইরে বেরুনো যায়, কুয়াশা? | ডি কস্টা এক লাফে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বলল, বাজে কঠা লুবেন না, মি. কামাল। আমাকে নিয়ে বাইরে যেটে ভয় পাইটেছেন? রঙ, ফ্রেণ্ড, ৪ 1 আমিই এখন একমাত্র আপনাদিগের সহায়। আপনারা, কালা আদমি কালা আমি মারামারি
কেন, রায়ট করবেন, কিনটু আমি ওসবে নাই। আমাকে কেউ কিছু বলবে না। আমি ইংরেজের জাট, বাঙালী নই বা পাঞ্জাবী নই। আমার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুন,
‘ ভলিউম ১২
৪৮
মিল্টিারি স্যালুট করে পঠ ডেখিয়ে ডেবে।’
কামাল বলে উঠল, তা যা বলেছেন। তবে তাই হোক। আপনিই আমাদেরকে নিয়ে চলুন। চলুন, বাড়ান।’
ডি.কস্টা মুখ বিকৃত করে বলে উঠল, “কিনটু, প্রথমে জানা ডরকার বাহিরে কি ঘটিতেছে। ফায়ারিংয়ের আওয়াজ, কেন হচ্ছে? কারা ফায়ারিঙ করছে? কারা মরছে? ফাইট দুই ডলে হচ্ছে কি না?
শহীদ এবং কুয়াশা নিজের নিজের রিভলভার বের করে পরীক্ষা করে নিচ্ছে। ডি. কস্টার কথায় ওদের মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। দুজনকেই অসত্ব গম্ভীর দেখাচ্ছে।
কামাল উত্তরে বলে উঠল, “কি হচ্ছে জানতে চান?’ ইয়েস। ইংরেজের জাট ডিটেলস না জেনে এক পাও এগোয় না।’
কামাল বলল, ‘বাঙালীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে আজ রাতে। তারা পাঞ্জাবীদের গোলামী আর করবে না। পাঞ্জাবীরা নিরস্ত্র বাঙালীদেরকে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই খুন করছে। কোন বাছবিচার নেই। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় যাকে পাচ্ছে গুলি করছে। ওদের লক্ষ্য প্রতিটি বাঙালীকে খুন করা। বাঙালীরা একচেটিয়াভাবে মার খাচ্ছে। কারণ তাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু তবু তারা প্রতিজ্ঞা নিয়েছে দেশকে শত্রুমুক্ত করার।’
| আই অ্যাম এ লাকী ম্যান, কারণ আমি বাঙালী নই বা পাঞ্জাবী নই। টোমরা টোমরা ফাইট করো, আমি ডুরে উঁড়িয়ে মজা ডেখব। ডরকার হলে হাট টালি ডেবো।’
কামাল বলে উঠল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ডি কস্টা। মজা দেখতে দেব ভেবেছ? বাঙালীরা পাঞ্জাবীদেরকে এ দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন তো করবেই, যারা এই বিপদে অসহযোগিতা করবে তাদেরও বংশ ধ্বংস করে ছাড়বে। এ দেশে যদি থাকতে চাও বাঙালীদের সাথে মিল-মহব্বত রেখে থাকো। তা না হলে স্রেফ খুন হয়ে যাবে। চলো, আগে বাড়ো।’
ডি কস্টা কান পেতে শুনছে গোলাগুলির শব্দ। কামালের কথা সে শুনতে পায়নি। | কামাল বলে উঠল, ‘ওকি, ডি.কস্টা তোমার পা দুটো অমন থরথর করে কাঁপছে,
কেন?
. ডি কস্টা নিজের পা দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলল সে। কাঁদ কাঁদ মুখ।
ডি.কস্টা বলে উঠল, ‘মি. কামাল, ফরগিভ মি। অনেকক্ষণ ধরে ট্রাই করার পরও লেগ দুইটাকে চেক করিটে পারিলাম না।
কামাল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু পা দুটো অমন ঠকঠক করে কাঁপছে কেন বলো
৪-কুয়াশা ৩৫
৪৯
তো?’
ডি কস্টা কোন রকমে বলল, ‘ডিসিশন নিটে পারছি না বলেই, আই গেস। আপনার কঠা শুনে মনে হইটেছে যে বাঙালীদের এগেইনস্টে কিছু করা চলিবে না । রেজাল্ট বড় ব্যাড হবে। কিন্টু পাঞ্জাবীডের এগেইস্টেই বা যাই কি প্রকারে? ওডের রক্ত বড় গরম। ব্যাটাডের মাঠায় এক ফোঁটা বুডটি নাই। ডুম করে গুলি করে ডিলে?
চার অসমসাহসী ক’জন বাঙালী ওরা তালুকদার কটেজ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে মিলিয়ে গেল দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারে। | সতর্ক পায়ে, চোখ-কান খুলে পিছু পিছু বড় রাস্তার দিকে পা বাড়াল শহীদ, কুয়াশা, কামাল এবং পিছু পিছু ডি.কস্টা । * বিদুৎ ব্রাহ বন্ধ । আকাশেও নেই চাঁদ। মৃদু শীতের আমেজ মার্চের রাতে। সুদূর আকাশে গুটিকতক তারা জ্বলছে। তাদেরই মৃদু আভায় পথ খে দুর্জয় প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে চলেছে ওরা। | কুয়াশা এবং শহীদ পাশাপাশি হাঁটছে। রাস্তা লাগোয়া উঁচু পাঁচিল। পাঁচিল ঘেঁষে হাঁটছে ওরা।
ওদের পিছনে কামাল। কামালের পিছনে ডি কস্টা।
কুয়াশা এবং শহীদের হাতে রিভলভার। পিছনে কামাল, ওর হাতেও রিভলভার। নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরোয়নি ওরা। বাইরে নিশ্চয়ই কারফিউ।
| দু’একবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে কামাল। ঠক ঠক করে শব্দ হচ্ছে থেকে থেকে।
. ডি কস্টা কাঁপছে। দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে অমন ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। ঠাণ্ডায় না ভয়ে কে জানে।
গোলাগুলির শব্দে উচ্চকিত চারদিক। বিরামহীন। ‘পৃথিবীর ইতিহাসে এই নৃশ সতার কোন তুলনা নেই। কামাল বলে উঠল। ক্রিটিসাইজ করো না!’ কামালের কথা বুঝতে না পেরে পিছুন থেকে বলল ডি কস্টা।
• শহীদ উত্তর দিল কামালের কথার। ও বলল, ওদের দুর্ভাগ্যেরও কোন তুলনা থাকবে না। ওরা জানে না নিজেদের কী সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ওরা।’
কুয়াশা বলল, পৃথিবীর ইতিহাসে ওরা খুনী হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।’
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না সামনের পথ। দূর থেকে ভেসে আসছে অবিরাম গোলাগুলির শব্দ। মাঝেমধ্যে ভারি ট্রাকের শব্দ আসছে।
ভলিউম ১২
বড় রাস্তা দেখা গেল খানিক পর। চলার গতি কমল ওদের।’
তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে এগিয়ে চলেছে ওরা। চিন্তিত হয়ে পড়েছে শহীদ। বাঙালীর জীবনে নেমে এসেছে কল্পনাতীত বিপদ। এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ নেই যেন। পাঞ্জাবীদের এই চরম আঘাত সহ্য করলে চলবে না। পাল্টা আঘাত হানতে হবে।
তবেই এ জাতির মুক্তি।
শত্রুপক্ষ শক্তিশালী। তাদের হাতে অস্ত্র। আছে কূটবুদ্ধি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদেরকেই নিঃসন্দেহে সমর্থন করবে। কেননা পাঞ্জাবীরা সাম্রাজ্যবাদীদে পা-চাটা কুকুর।
বাঙালীরা নিরস্ত্র। মুষ্টিমেয় ই. পি, আর, এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু বীর ছাড়া যুদ্ধে তারা অভিজ্ঞ নয়। বাঙালীদের মধ্যে ক’জনই বা রাইফেল-বন্দুক চালাতে জানে। কিন্তু তবু নিরাশ হবার মত কিছু নেই। নির্বাচনের পর একথা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে বাঙালীরা মানুষের মত নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। তারা শোষকদের প্রভূত্ব চায় না। তারা নিজেদের অধিকার কায়েম করতে দরকার হলে আন্দোলন করতে প্রস্তুত ছিল, ত্যাগের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত ছিল। আন্দোলন তারা করেহেও, ত্যাগেরও পরীক্ষা তারা দিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবীরা কোন মূল্য দেয়নি। তারা আলোচনার নামে সময় নিয়েছে শুধু। তৈরি করেছে বর্বর সেনাবাহিনীকে। বাঙালী হত্যার নির্মম পরিকল্পনা রচনা করেছে চুপি চুপি। প্রস্তুতি শেষ হতেই তারা মুখোশ খুলে ফেলে ধারাল দাঁত বের করে নগ্নভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাঙালী হত্যায়।
কিন্তু বাঙালীরাও প্রস্তুত। তারা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত না থাকলেও মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত। হয় অধিকার চাই, নয়ত সম্পর্কচ্ছেদ চাই, এই ছিল বাঙালীদের | কথা। মুখ বুজে মার খাবার দিন আর নেই, বাঙালীরা তা খায়নি। কারফিউ দিয়ে চেষ্টা কি করেনি পাঞ্জাবী সেনারা? করেছিল বৈকি। কিন্তু বাঙালীরা সেই কারফিউও মানেনি। কারফিউয়ের মধ্যেও তারা বের করেছে মিছিল । সে মিছিলের শ্লোগান ছিলঃ
ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বালাদেশ স্বাধীন করো ।
যে জাতি কারফিউ মানে না, ঝক ঝক বুলেটকে পরোয়া করে না সে-জাতিকে দশন করে রাখে, দাবিয়ে রাখে, এমন শক্তিশথিবীতে কোথায়?’ শ্য, বাঙালীরা স্বাধিকার অর্জন করবেই। হয়ত দু’দিন দেরি হবে, কিন্তু সে বিলম্ব রক্তদানে দ্বিধার হেতু নয়। রণকৌশলগত কারণেই দেরি হবে।
শহীদ যেন মানসচক্ষে দেখতে পেল বাঙালীরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে গেরিলা যুদ্ধ করছে।
শহীদ, আমাদের প্রথম কাজ একটা মিলিটারি ট্রাক বা জীপ যোগাড় করা। কুয়াশা বলে উঠল।
বড় রাস্তার মুখ দেখা যাচ্ছে অদূরে। নির্জন রাস্তা। মোড়ের প্রায় কাছাকাছি কুয়াশা ৩৫
পৌঁছে গেছে ওরা।
ঢাকায় কি ঘটছে? | বন্ত্র সেনারা নিশ্চয়ই প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে ঢাকায়। কিন্ত ঢাকাবাসীরা কি বসে আহে ঘরে? বিশ্বাস হয় না। বাধা দেবেই তারা। বিশ্বাসঘাতকদেরকে ছেড়ে দেবে
ঢাকাবাসীরা। পীলখানায় আছে শত শত বাঙালী রাইফেলধারী। তারা নিশ্চয়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। রাজারবাগে আছে পুলিস বাহিনী। স্ট্রীট ফাইট শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই। বর্বর খান-সেনারা নিশ্চয়ই বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
| মহুয়ার কথা মনে পড়ল শহীদের। ধানমণ্ডির অবস্থা কেমন কে জানে। গফুর ছাড়া পুরুষ মানুষ নেই কেউ। লীনা এবং মহুয়া দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হচ্ছে শহীদ এবং কামালের জন্যে। হঠাৎ একটা আশঙ্কায় দুলে উঠল শহীদের বুক।
পাঞ্জাবী সেনারা বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে সাথে বাছাবাহা কিছু মানুষকে খুন করার চেষ্টা নিশ্চয়ই চালাবে। রাজনৈতিক নেতা, বিপ্লবী ছাত্র, গণ্যমান্য নাগরিকসা বোধহয় শিকার হবে। শহীদকে কি খুজবে বর্বরেরা?
চিন্তিত হয়ে পড়ল শহীদ। ওর খোঁজে যদি পাঞ্জাবী সেনারা ধানমণ্ডির বাড়িতে যায় তাহলেই সর্বনাশ! শহীদকে না পেয়ে মহুয়া এবং লীনার উপর অত্যাচার।
পাঁচ মোড়ের মাথায় একটি দোতলা বাড়ি। বাড়িটার পাশে দাঁড়াল ওরা চারজন।..
শহীদ কলল, রাস্তার দু’দিক দেখে নেয়া যাক। কামাল বলল, “গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিস, শহীদ?’ কুয়াশা উত্তর দিল হ্যাঁ। গাড়ির শব্দ এগিয়ে আসছে। শহীদ বলল, সত, একটা ট্রাক। পা বাড়াল শহীদ। পাশে কুয়াশা। কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়াল ওরা। উঁকি মেরে চওড়া রাস্তার দুই দিক দেখল।
নির্জন পাকা, রাস্তা । দক্ষিণ দিক থেকে আসছে ভারি একটা ট্রাক। হেডলাইট দুটো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেক দূরে সেটা।
শহীদ বলল, ‘পজিশন নিতে হয়। ট্রাক যদি একটাই হয় তাহলে আক্রমণ করব। আমি রাস্তার ওপারে যাচ্ছি। কামাল, তুই ওই ডাস্টবিরে আড়ালে চলে যা ডি.কস্টাকে নিয়ে।
কুয়াশা বলল, “আমি ডাস্টবিনের পাশের ওই শিমুল গাছটায় চড়ি।
শহীদ বলল, আমি ওপারের গাছটার নিচে থাকব। ড্রাইভারকে গুলি করে খতম করতে হবে। তিনজনই যে যার সময় এবং সুযোগ মত গুলি করব।’
এগিয়ে গেল শহীদ। | কামাল দুই লাফে ডাস্টবিনের পিছনে গিয়ে বসে পড়ল।
৫২
ভলিউম ১২
তরতর করে উঠে গেল কুয়াশা শিমুল গাছের উপরে।
শহীদ রাস্তার ওপারে পৌঁছেছে। রাস্তার ওপারে খানিকটা জায়গা জুড়ে ঘাস, তারপর নিচু হয়ে নেমে গেছে জমি। নিচে ধানখেত। ফাঁকা । | শহীদ রাস্তা ছেড়ে আরও কয়েক হাত এগিয়ে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে শুয়ে রইল।
ডি.কস্টা কোথায়? কামাল এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন ছায়া দেখতে পেল না। লোকটা গেল কোথায়? কুয়াশার সাথে গাছে গিয়ে চড়ল নাকি?
‘ পরমুহূর্তে ব্যাপারটা টের পেল কামাল। ওর সামনেই ডাস্টবিন। ডাস্টবিনের ভিতর কেউ আছে। নড়ছে সেটা। নিশ্চয়ই ডি কস্টা।
শহীদ রিভলবার নিয়ে তাকিয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। দ্রুত এগিয়ে আসছে হেডলাইট দুটো। বিরাট একটা ট্রাকই সত। হেডলাইট দুটো বেশ উঁচুতে।
কুয়াশাও তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে কামালও। কাছে এগিয়ে এসেছে ট্রাকটা। বড় জোর শ খানেক গজ দূরত্ব । ট্রিগারে আঙুল রেখে রুদ্ধশ্বসে অপেক্ষা করে আছে ওরা।
ট্রাকের ভিতর পাঞ্জাবী সেনা কতজন আছে কে জানে। ড্রাইভারের গায়ে গুলি লাগলে ট্রাকটা দিকভ্রান্ত হতে বাধ্য। হয় রাস্তার একপারে কোন বাড়ির পাচিলের সাথে ধাক্কা খাবে, নয়ত সোজা গিয়ে পড়বে নিচু ধান খেতে । বাড়ি মাত্র কয়েকটা, ছাড়াছাড়া ভাবে।
এগিয়ে এসেছে ট্রাক। কিন্তু এখনও গুলি করার সময় হয়নি। ড্রাইভারের গায়ে লাগা চাই বুলেট।
তৈরি হয়ে আছে ওরা। জানালা পথে ড্রাইভারকে দেখামাত্র গুলি করবে ওরা। আর মাত্র কয়েক সেকেন্দ্রে ব্যাপার। কিন্তু তার আগেই দিক-বিদিক সচকিত করে দিয়ে গর্জে উঠল একটি রাইফেল। চমকে উঠল ওরা। রাইফেল কোথা থেকে এল? কিন্তু তখন অন্য কথা ভাবার কোন অবসর নেই।
শহীদ গুলি করল। গুলি করল কুয়াশা।
কামালও হয়ত গুলি করল, কিন্তু শোনা গেল না তার রিভলবারের শব্দ। শহীদ এবং কুয়াশার রিভলবারের শব্দ হবার পরপরই একযোগে গর্জে উঠল কয়েকটা স্টেনগান।
ব্রাশ ফায়ার । শহীদের একহাত সামনে এক ঝাঁক বুলেট পড়ল। নিঃসাড় পড়ে রইল শহীদ।
কুয়াশী ৩৫
তীক্ষ দৃষ্টি ওর চোখে। বুকটা ভরে উঠল সাফল্যের আনন্দে। ভারি ট্রাকটা ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে একটি বাড়ির পাচিলের দিকে।
গাছ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল কুয়াশা। নেমেই ছুটল সে। শহীদও ছুটল। ‘‘ ..
পিছন ফিরে তাকাল একবার কুয়াশা। সেই মুহূর্তেই ট্রাকটা পাঁচিলের সাথে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেল।
ছুটছে কুয়াশা ট্রাকটার দিকে। রাস্তার অপর পারে শহীদ। সে-ও ছুটছে। অনেক পিছনে কামাল। সে-ও এগিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রাকটা। ‘ অকস্মাৎ কুয়াশার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শহীদ, শুয়ে পড়ো।
ডাইভ দিয়ে শুয়ে পড়ল শহীদ। পরক্ষণেই গর্জে উঠল স্টেনগান। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বুলেট উড়ে গেল।
ধীরে মাথা তুলে তাকাল শহীদ। ট্রাকের পিছন থেকে নামছে পাঞ্জাবী সেনারা । গুলি করল শহীদ।
দুটো শব্দ হলো। কুয়াশাও গুলি করেছে। বিকট আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল চারদিকের বাতাস। দুই শত্রু অক্কা লাভ করল।
আবার লক্ষ্যস্থির করল শহীদ। কিন্তু ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই শোনা গেল রাইফেলের শব্দ।
চমকে উঠে পিছনে তাকাল শহীদ।
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তবু আবছাভাবে শহীদ দেখল রাস্তার মাঝখান দিয়ে কালো একটি ছায়ামূর্তি দ্রুত এগিয়ে আসছে বুকে হেঁটে।
কে এই লোক? ছায়ামূর্তি কাছাকাছি আসতে শহীদ বলে উঠল, “আর সামনে যাবেন না। উত্তর দিল না ছায়ামূর্তি। ক্রল করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সে। শহীদ অবাক বিস্ময়ে ভাবল কে এই অসমসাহসী লোক।
কুয়াশাও দেখল ছায়ামূর্তিকে। কাছাকাছি দেখে সে বলল, এখান থেকেই গুলি করুন।
অসমসাহসী সেই যুবক কুয়াশার কথা শুনে তার তি রুদ্ধ করল! হাতের রাইফেলটা তাক করল ট্রাকের দিকে। তারপর ট্রিগারে দিল টান।
প্রচণ্ড শব্দ হলো থ্রী-নট-থ্র রাইফেলের । আবার শোনা গেল পাঞ্জাবী সেনার অন্তিম চিৎকার। সেই চিৎকার থামার আগেই আবার গুলি করল ছায়ামূর্তি। |
আবারও শোনা গেল শত্রুসেনার আর্তনাদ। তারপরই থেমে গেল স্টেনগানের শব্দ।– অন্ধকারে যেন চোখ জ্বলে ছায়ামূর্তির। আবার সে গুলি করল। আবার শোনা,
ভলিউম ১২
গেল শত্রুসেনার মৃত্যু চিৎকার।
তারপর আবার শুরু হলো স্টেনগানের শব্দ।
শহীদও ক্রল করে এগিয়ে এসেছে। | পিছন ফিরে তাকাল ছায়ামূর্তি। তারপর আবার ক্রল করে এগিয়ে যেতে শুরু করল। .. কুয়াশা মনে মনে বিস্ময় মানল। লোকটা মরতে চায় নাকি? দূর থেকে যখন গুলি কর ফল পাওয়া যাচ্ছে তখন আরও সামনে এগিয়ে যাবার মানে কি?
দুত এগিয়ে যাচ্ছে ছায়ামূর্তি। তার অনেকটা পিছনে কুয়াশা এবং শহীদ।
স্টেনগানের শব্দ থেমে গেছে। ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে বটে কিন্তু স্টার্ট বন্ধ হয়নি। পঁচিল ভেঙে ট্রাকের নাকের খানিকটা ঢুকে গেছে বাড়িটার উঠানে।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে! তেরপল দিয়ে ঘেরা ট্রাক।পিছনটা দেখা যাচ্ছে। কোন • পাঞ্জাবী সেনকে দেখা যাচ্ছে না । ছায়ামূর্তি ট্রাকের পিছনে গিয়ে থেমেছে। উঠে দাঁড়াচ্ছে! ‘ | প্রায় ছয় ফুটের মত লম্বা ছায়ামূর্তি । স্বাস্থ্যবান বলা যায় না। তবে বোগও
নয়। বুক টান করে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। এমন সময় আশ্চর্য এক ক লৈ ।
ট্রাকের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল একটি খান-সেনা। তার হাতে একটা জােরা। স্টেনগানের গুলি শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
পাঞ্জাবী বর্বরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে!
হয়।
শঙ্কায় দুলে উঠল শহীদের বুক । গুলি করতে গিয়েও নিজকে সামলে নিল ও গুলি করা বৃথা। ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে শত্রু ছায়ামূর্তির উপর।
. সয়ামূর্তি বিদ্যুৎ বেগে সরে গেল এক পাঁ। কিন্তু পালাবার কোন লক্ষণ তার মধ্যে দেখা গেল না।
ছোরা চালিয়েছিল পাঞ্জাবী সেনা। কিন্তু বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুত সরে গিয়েছিল বলে আঁচড়টিও লাগেনি ছায়ামূর্তির গায়ে। * ছোরা ধরা হাতটা ধরে ফেলল ছায়ামূর্তি। তারপর “ত্রুর বাঁ-পায়ের হাঁটুর উপর প্রচণ্ড শক্তিতে মারল এক লাথি। আর্তনাদ করে উল শত্রু। ছিটকে পড়ল কয়েক হাত দুরে । ছায়ামূর্তি এক লাফে ভূপাতিত দেহটার :ছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রচণ্ড এক লাথি মেরে আহত শত্রুর দেহটাকে উপুড় করে সে তারপর ছায়ামূর্তির লম্বা শরীরটা নুয়ে পড়ল। | শত্রুর পিঠে ডান পা রাখল ছায়ামূর্তি। এক হাত দিয়ে ধরল শত্রুর গলা পেঁচিয়ে। তারপর শত্রুর গলা উঁচু করে ধরল।
মট করে শব্দ হলো একটা। কুয়াশা ৩৫
শিউরে উঠল শহীদ। কী ভয়ঙ্কর শক্তি ছায়ামূর্তির শরীরে। পাঞ্জাবী শত্রুর মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছে সে।
কুয়াশা ছায়ামূর্তির সামনে এসে দাঁড়াল। একটা হাত রাখল সে ছায়ামূর্তির কাঁধে।
কুয়াশা এবং ছায়ামূর্তি, দু’জন প্রায় একই সমান লম্বা। কিন্তু কুয়াশার চেয়ে বয়স অনেক কম ছায়ামূর্তির। সবেমাত্র দাড়ি-গোঁফ কামাতে ধরেছে সে। আঠারো কি উনিশ হবে বয়স। কিন্তু অদ্ভুত স্বাস্থ্য। পেশীবহুল শরীর। বলিষ্ঠ ।
‘সাবাশ! তোমার মত ছেলেই দরকার বাঙলার এই বিপদের দিনে। নাম কি তোমার? পরিচয় কি?
যুবকের কণ্ঠস্বর যেমন ভরাট তেমনি পুরুষোচিত। সে বলল, রাসেল। রাসেল আহমেদ। জগন্নাথ কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি। আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?’ | ‘ ।
ভারি কণ্ঠস্বর কুয়াশার। সে বলল, আমার নাম মনসুর আলী। এ নামে আমাকে অবশ্য কেউ চেনে না। আমাকে সবাই চেনে•••।’
যুবক রাসেলের চোখ দুটো অন্ধকারে যেন জ্বলে উঠল। কুঞ্চিত হলো চোখের পাতা। কিন্তু অন্ধকারে কুয়াশা কিছুই দেখতে পেল না।
রাসেল সংযত কণ্ঠে বলে উঠল কুয়াশাকে বাধা দিয়ে, আমি জানি। আপনার নাম কুয়াশা। আচ্ছা, বিদায়।
পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। যুবক নিজের কাঁধ থেকে কুয়াশার হাত নামিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই পা বাড়াল।
কে ছেলেটি? ভাবল কুয়াশা। তার পরিচয় জানার পরও গুরুত্ব দিল না এতটুকু?
শহীদ এবং কামাল ট্রাকের উপর উঠে পড়েছিল। দুই আহত শত্রুর বুকে বেয়োনেট চার্জ করে নেমে এল ওরা।
* রাসেলকে চলে যেতে দেখে ডাকল শহীদ, এই যে, শুনুন।
তরুণ রাসেল দাঁড়াল। তারপর ফিরল এদিকে। এগিয়ে আসছে সে।
কুয়াশা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। রাসেল সরাসরি কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু অনুমোদন করি না আপনার অ্যাকটিভিটি। দেখা করে এই কথাগুলো আপনাকে বলবার ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু ভাবিনি এই রকম পরিবেশে দেখা হবে। বাঙালীর আজ মহা বিপদ। সময় নেই হাতে আজ। থাকলে যা বলবার সব বলতাম। হয়ত একদিন বলবার সময় পাব । যদি বাঁচি তবে নিশ্চয় দেখা হবে। তখন বলব।
‘ ৫৬
ভলিউম ১২
শহীদের দিকে তাকাল রাসেল। বলল, “আপনি আমায় ডেকেছেন? শহীদ বলল, হ্যাঁ। তোমার পরিচয়।
রাসেল হাসল। মৃদু হাসি, কিন্তু বড় ভাট। সে বলল, আমার নাম রাসেল আহমেদ। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। মোড়ের ওই বাড়িটা আমাদের। দোতলার বারান্দা থেকে গুলি করেছিলাম ট্রাকের ওপর।
শহীদ বলল, ড্রাইভারের মাথায় যে গুলি লেগেছে সেটা তোমার রাইফেলের। সুন্দর হাত তোমার।
রাসেল বলল, ও কিছু না। কলেজে কিছুদিন থেকে প্র্যাকটিস করছি।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, রাইফেলটা তোমারই? রাসেল বলল, হ্যাঁ।’ শহীদ তাকিয়ে আছে রাসেলের দিকে। কিছু যেন প্রশ্ন আছে ওর। বুঝতে পেরেই যেন হাসল রাসেল।
বলল, “ওই মোড়ের বাড়িটা আমাদের। আমার আম্মা এবং বোন থাকে ঢাকায়। সন্ধ্যার পর সাইকেল নিয়ে এখানে এসেছি আমি। নানারকম গজব শুনছিলাম ঢাকায়। তাই বন্ধুবান্ধবদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি তারা কেউ নেই। সবাই চলে গেছে ঢাকায়। সাইকেলের টায়ার ফেটে গেল বলে ফেরা হলো না ঢাকায়। গাড়িঘোড়াও পেলাম না। তাই রাতটা এখানের বাড়িতেই কাটাব ঠিক করলাম। তারপর গোলাগুলির শব্দ শুনে রাইফেল হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। ভাবিনি এখান দিয়ে কোন মিলিটারি ট্রাক পাস করবে। কিন্তু সুযোগটা পেয়ে গেলাম যখন তখন হাড়ব কেন? ট্রাকটাই দরকার আমার, ঢাকায় যেতে হবে। আম্মা-বোন কেমন আছে জানতে চাই। ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ বুঝতে পারছি। কিন্তু কতটা খারাপ জানতে হলে সব নিজের চোখে দেখতে হবে।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার আব্বা…’ রাসেল কঙ্কণভাবে হাসল। বলল, “আব্বা অনেকদিন আগে মারা গেছেন।
রাসেলের চোখেমুখে ক্ষণে ক্ষণে ফুটে উঠছে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। রাগে, দুঃখে দাঁতে দাঁত চাপছে সে। পাঞ্জাবীরা যে কত বড় অমানুষ আজ যেন সে মর্মে : মর্মে টের পাচ্ছে। উচিত শিক্ষা দিতে হবে ওদেরকে। একজন একজন করে প্রতিটি দখলদার সৈন্যকে হত্যা করতে হৰে।
হাত দুটো নিশপিশ করতে থাকে রাসেলের। হাতের কাছে পেলে এখনি গলা টিপে রবে সে কু ইয়াহিয়ার। ‘‘ | আম্মার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ছোট বোন রোশেনার কথা। স্কুল-ফাইনাল
দেবে এবার রোশেনা? সারারাত জেগে পড়ে। এখন কি করছে রোশেনা?
আম্মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল রাসেল । নিঃশব্দে বসে বসে চোখের পানি
কুয়াশা ৩৫
৫৭
মুছছেন শাড়ির আঁচল দিয়ে। রাসেল বাড়ি নেই এই বিপদের দিনে, আম্মার আঁচল ভিজেই থাকবে চোখের পানিতে চব্বিশ ঘণ্টা।
ওদের কথা মনে পড়তে হু হু করে ওঠে রাসেলের চওড়া বুকটা। শহীদ বলে ওঠে, কি করার ইচ্ছা এখন তোমার? ‘ঢাকায় যাব।’
ভারি কণ্ঠে বলে রাসেল। তারপর তাকায় শহীদের দিকে। জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে•••{‘–
শহীদ নিজের পরিচয় দিল। | রাসেল মুক্তোর মত সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল। বলল, “আপনাকে চিনতে না পারা আমার উচিৎ হয়নি। কাগজে আপনার সম্পর্কে লেখাগুলো আমি পড়েছি। ছবিও দেখেছি আপনার।
রাসেল হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শহীদের দিকে।
করমর্দন করল ওরা । অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কুয়াশা! একটু কুঁচকে উঠল তার ভুরু।
শহীদও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। কুয়াশার পরিচয় জানার পরও করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয়নি রাসেল।
শহীদ বলল, “ঢাকায় আমরাও যেতে চাই।’
রাসেল বলল, ট্রাকে উঠুন তাহলে । আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরছি কিছু জিনিস নিয়ে।
।
আট চারিদিকে মৃত্যু। চারিদিকে ক্রন্দন। চারিদিকে হাহাকার। চারিদিকে আগুন।
“ অসহায় বস্তিবাসীরা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে মুখ থুবড়ে মরে পড়ে আছে। পিশাচ খান-সেনারা মৃতদেহের স্তূপ মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। : নরপিশাচদের অট্টহাসিতে চারিদিক বিষাক্ত। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন বস্তিতে । ‘,
প্রাণভয়ে দিশেহারা লোকগুলো বস্তি থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়তে চাইছে কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘিরে রেখেছে পণ্ড সেনারা। আগুনের ভয়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসছে অসহায় মেয়ে-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু-অমনি গর্জে উঠছে স্টেনগান। ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে নিরীহ মানুষগুলো।
. সতীত্ব রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টায় আর্ত চিৎকার করছে মায়েরা, বোনেরা, আয়ারা।
ব্যারিকেড রচনা করেছিল পাড়ার অধিবাসীরা। কামান এবং মর্টাবের গোলার আঘাতে ভেঙে ফেলা হয়েছে সে ব্যারিকেড। ব্যারিকেড়ের আশপাশের বাড়িঘর
ভলিউম ১২
৫৮.
থেকে টেনে বের করা হয়েছে শিশু-বৃদ্ধ, যুবক এবং মেয়েদেরকে। নিমর্মভাবে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। লাশগুলো রাস্তার উপর ফেলে রাখা হয়েছে। সকালে যেন শহরবাসীরা দেখে এই সব লাশ। ..
চারিদিকে হাহাকার। প্রাণ ভয়ে কাঁদছে শিশু। মা কাঁদছে মৃত সন্তানকে বুকে নিয়ে। কিন্তু সেই কান্নাকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে পশু-সেনাদের উকট উল্লাসধ্বনি।
| ঝড়ের বেগে ছুটছে ট্রাকটা। ড্রাইভিং সীটে বসেছে কুয়াশা। পাশে শহীদ। রাসেল, কামাল এবং ডি.কস্টা ট্রাকের পিছনে।
কামাল বসে আছে। ডি.কস্টা শুয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে রাসেল ট্রাকের শেষ প্রান্তে।
‘একটা জীপ আসছে।’
শহীদ আপনমনেই বলে উঠল। বহুদূরে ওর দৃষ্টি। জীপটা দ্রুত এগিয়ে আসছে।
শহীদ, কুয়াশা ও কামাল মৃত খান-সেনাদের পোশাক খুলে পরে নিয়েছে। ডি কস্টাও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওর গায়ে কোনটাই ফিট করেনি।
রাসেল সাদা প্যান্ট এবং নীল শার্ট পরে আছে। পোশাক বদলায়নি সে।
শহীদ পিছন ফিরে তাকাল। রাসেল ট্রাকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দেখল ও! কি যেন ভাবল ও মনে মনে। তারপর বলল, রাসেল, বসে পড়ো। একটা জীপ আসছে। আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালে দেখে ফেলবে তোমাকে। সিভিল ড্রেস দেখে সন্দেহ করা বিচিত্র নয়।
রাসেল শুনল। কিন্তু সবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। শহীদ আবার পিছন দিকে তাকাল। তখনও রাসেল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ সরে এল রাসেল। কামালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ট্রাকে যে বাক্সটা দেখলাম এখন সেটা কোথায় বলতে পারেন?
কামাল আঙুল বাড়িয়ে এককোণে দেখাল বাক্সটা।
রাসেল প্রথমে তুলে নিল একটি স্টেনগান। তারপর সেই বাক্সটার কাছে গিয়ে নুয়ে পড়ল। | একবাক্স গ্রেনেড থেকে দুটো গ্রেনেড তুলে নিল রাসেল। একটা রাখল পকেটে। দ্বিতীয়টা রইল হাতে! স্টেনগানটা ঝুলছে কাঁধে।
আবার রাসেল ট্রাকের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। সামনেটা ভোলা। ফেলে আসা নির্জন পথ দেখা যাচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে আসছে উজ্জ্বল আলো। এগিয়ে । আসছে জীপটা ।
* কান পেতে রইল রাসেল। গ্রনেডটা তুলে ধরেছে সে মুখের সামনে। জিভ দিয়ে স্পর্শ করছে সে গ্রেনেডের পিনট।
শোনা যাচ্ছে জীপের শব্দ। তৈরি হয়ে আছে রাসেল। কুয়াশা ৩৫ ৪
কুয়াশা ট্রাক সরিয়ে নিয়ে গেল রাস্তার একধারে। রাস্তা করে দিল জীপটাকে। জীপটা পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে।
রাসেল পিন খুলে ফেলল গ্রেনেডের। এক সেকেণ্ড পরই জীপটাকে দেখতে পেয়ে ॥ ছুঁড়ে দিল সে গ্রেনেড।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কানে তালা লাগার জোগাড়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে জীপ । রাস্তার উপরই উল্টে পড়ল সেটা।
ট্রাকের গতি কমেনি। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে জ্বলন্ত জীপ এবং চলন্ত ট্রাকের। শহীদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কুয়াশা গম্ভীর হয়ে আছে। একটা কথাও বলেনি সে রাসেলের সাথে পরিচিত হবার পর থেকে।
নয়। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে ব্রিজটা। কুয়াশা তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ তাকাল পিছনে।
“কি ব্যাপার?’ | জিজ্ঞেস করল কামাল।
তৈরি হয়ে নে, কামল,’ বলল শহীদ, সামনে মিলিটারি চেকপোষ্ট বসেছে। সবত দাঁড় করাবে।
ট্রাক চালাতে চালাতেই কুয়াশা পায়ের কাছ থেকে তুলে ঊরুর উপর রাখল একটা স্টেনগান।
শহীদের কোলের উপর আগে থেকেই পড়ে রয়েছে একটা স্টেন। রাসেল নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফেলে আসা পিছনের পথের দিকে। ট্রারে শেষ ধারে দাঁড়িয়ে আছে ও। মানুষ নয়, যেন ও একটি মর্মমূর্তি।
লম্বা শরীরটা টান টান হয়ে আছে চোখের দৃষ্টি সামনে রেখে। কিন্তু বর্তমানের কোন দৃশ্য ও দেখছে না।
• অতীতের কথা ভাবছে রাসেল। অতীতে বাঙালীরা বঞ্চিত ছিল। তাদেরকে শোষণ করা হত। সোনার লোভে, শস্যের লোভে, সম্পদের লোভে শোষকরা। কখনও এই বাংলাদেশে এসেছে ডাকাত হয়ে, কখনও যোদ্ধা হয়ে, কখনও ব্যবসায়ী হয়ে।
| যুগ যুগ ধরে চলছে এই শোষণ। আজও চলছে। কিন্তু আজ বাঙালীরা সচেতন হয়ে উঠেছে। আর তাদেরকে শোষণ করা চলবে না। এই সোনার দেশের অভুক্ত, নির্যাতিত বঞ্চিত সরল মানুষগুলো আজ অধিকার চায়। খেতে চায়, পরতে চায়, মানুষের মত বাঁচতে চায় ।
রাসেলের চোখেমুখে ফুটে ওঠে অভূতপূর্ব এক আলো। দুর্জয় প্রতিজ্ঞায় কঠিন হয় বুক। অত্যাচারীর ধ্বংস চাই। শুধু পাঞ্জাবী সেনাদের আড়ালেই এদেশের দুঃখী ৬০:
ভলিউম ১২
মানুষের মুক্তি আসবে না। বিদেশী আর কোন শক্তিকেই এদেশে প্রভাব খাটাতে দেয়া চলবে না। স্বদেশী পুঁজিপতিদেরকেও ঠেকিয়ে রাখতে হবে। মুক্তি চাই, এদেশের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত দুঃখী সরল মানুষের মুক্তি চাই।
| আকাশে চাঁদ নেই। দু’একটি অনুজ্জ্বল তারা মিটিমিটি জ্বলছে কেবল। দূরে দূরে গুলির শব্দ। আকাশের গুটিকতক নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে রাসেল প্রতিজ্ঞা করল এদেশকে শোষণ করার, এদেশের নিরীহ মানুষকে শোষণ করার বিরুদ্ধে লড়বে সে।
দরকার হলে প্রাণ দেবে। শহীদের গলা শোনা গেল, রাসেল! কী কেয়ারফুল।
চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল রাসেল। শহীদ আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু যা বোঝবার বুঝে নিয়েছে রাসেল।
একলাফে ট্রাকের কোণায় চলে গেল রাসেল। তুলে নিল কয়েকটা গ্রেনেড । দ্রুত চলে এল ট্রাকের শেষ কিনারায়।
কর্কশকণ্ঠে ঠিক সেই সময় শোনা গেল, স্টপ।’ উপর পানে উঠছে ট্রাক। ব্রিজের উপর গিয়ে থামল। নিঃশব্দে নেমে পড়ল রাসেল ট্রাক থেকে নিচে। বুট জুতোর শব্দ হচ্ছে।
কান পাতল রাসেল। চারজোড়া বুট জুতো। দুই জোড়া দাঁড়িয়ে পড়ল।
কুয়াশার গলা শোনা যাচ্ছে। পাঞ্জাবী এম. পি.কে পাঞ্জাবী ভাষাতেই কি যেন বোঝাচ্ছে সে।
বসে পড়ল রাসেল ট্রাকের আড়ালে। দুই জোড়া বুট এগিয়ে আসছে। অন্ধকার।
দু’জন খান-সেনা ঠিক রাসেলের দুই হাত সামনে এসে দাঁড়াল। ট্রাকের। ভিতরটা দেখার চেষ্টা করছে তারা।
কামাল দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকের কিনারায়।
দুই সেকেণ্ডের নিস্তব্ধতা। তারপর কুয়াশার চড়া কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ধমক দিচ্ছে সে পাঞ্জাবী এম. পি.কে।
আর দেরি করা যায় না। বুঝতে পারল রাসেল।
স্টেনগানের নল দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে আঘাত হানল সে পাঞ্জাবী এম, পি, দুজনার হাঁটুতে। পলকের মধ্যে ভূপাতিত হলো তারা।
রাসেল লাফ দিয়ে ট্রাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডান পাশে চলে গেছে।
পরমুহূর্তে ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনা গেল।
ধপ ধপ করে পাঞ্জাবী সেনার দুটো দেহ লুটিয়ে পড়ল। কুয়াশার সাথে ট্রাকের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তর্ক করছিল তারা।
কুয়াশা ৩৫
ব্রিজের উপরই, একধারে, একটা জীপ। জীপের ভিতর দ্রুত শব্দ হচ্ছে।
গ্রেনেডের’ঠাণ্ডী পিনের স্পর্শ নিল রাসেল জিভ দিয়ে। লাফিয়ে নামল দুজন খান-সেনা জীপ থেকে। গ্রেনেড ছুঁড়ে মাল রাসেল।
কয়েক সেকেন্দ্রে ব্যাপার। আশঙ্কায় দুলতে শুরু করল বুকটা। জীপটা নষ্ট হয়ে গেল বুঝি।
কিন্তু গ্রেনেড ফাটল না। পরমুহূর্তে শোনা গেল স্টেরে শব্দ। শহীদ সফল। লুটিয়ে পাদুল দুই শত্রু। পিছনে এবার ব্রাশ ফায়ারের শব্দ।
• বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল রাসেল। ট্রাকের উপর থেকে শুয়ে শুয়ে স্ট্রেন চালাচ্ছে কামাল।
উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল দুই আহত শত্রু। একজন অক্কা লাভ করেছে । অপর জন শুয়ে শুয়ে স্টেনগান হাতড়াচ্ছে।
লাফিয়ে গিয়ে পড়ল রাসেল লোকটার বুকে। ক্যাক করে শব্দ রে হলে লোকটার গলা থেকে।
শত্রুর বুকের উপর দাঁড়িয়ে স্টেনগানের লম্বা ব্যারেল ঠেকাল লোকটার কপালে রাসেল।
কয়েকটা বুলেট প্রবেশ করল মাথার ভিতর। শত্রুর বুক থেকে নেমে ঘুরে দাঁড়াল রাসেল।
কুয়াশা এবং শহীদ ট্রাক থেকে নেমে এগিয়ে আসছে। রাসেল, কথা বলে উঠল, ‘আপনারা এত দেরি করলেন কেন? তর্ক করে কি ওদেরকে বোঝানোর দরকার ছিল?’
* রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে কুয়াশা। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারা।
রাসেল এগিয়ে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে জীপটার দিকে।
শহীদ তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশা নিচু স্বরে বলল, এ ছেলে যে সে নয়, শহীদ।’
শহীদের দুই চোখে প্রশ্ন। | কুয়াশা বলল, বড় দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু ওকে চিনতে পেরে যতটুকু আনন্দ পাচ্ছি তারচেয়ে দুঃন্দ্রে পরিমাণ বোধহয় অনেক কম।
দুঃখ কেন?’ কুয়াশা হাল।
বলল, বুঝতে পারছ না? রাসেল আমাকে ভাল চোখে দেখে না। প্রথম আলাপেই পরিষ্কার বুঝেছি আমি। শহীদ একটু যেন হাসল।
ভলিউম ১২
৬২।
বলল, “আর আনন্দ হচ্ছে কেন?’
কুয়াশা বলল, এমন একটি ছেলের সন্ধানে অনেকদিন থেকেই ছিলাম আমি।– এক দেখেছিলাম তোমাকে। বুদ্ধি, সাহস, প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব ছিল তোমার মধ্যে। তাই দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম. আমি। তারপর আর কাউকে পাইনি। আজ পেলাম রাসেলকে। তুমি দেখো, শহীদ, রাসেল একদিন বিরাট মানুষ হবে। তোমার আমার চেয়েও বড় হবে ও।
| জীপ থেকে রাসেলের গলা শোনা গেল, শহীদ ভাই, আমি জীপ নিয়ে যাচ্ছি।’
শহীদ কলল, ‘একা?’–
ভয় নেই। আপনারা পিছু পিছু আসুন। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় পৌঁছুতে চাই।’
আম্মা এবং বোনের মুখ ভেসে উঠল মানসপটে। স্টার্ট দিল রাসেল জীপে। চোখ ভরা জল ওর। কার উদ্দেশ্যে যেন দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল । ও! চলতে রু করল জীপ।
দশ সত্যি কথা বলতে কি, সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে রাসেল।
ধু একটি ব্যাপারেই নয়, সব ব্যাপারেই। ওই তো বয়স, কিন্তু যে কোন গাড়ি চালনাতেও সে অভিজ্ঞ । আগে তার জীপ, যেটায় সে একা। অন্যটা পিছনে। তাতে কুয়াশা, শহীদ এবং কামাল। তাছাড়া অচেতন ডি কস্টাও রইল। কখন যেন সে জ্ঞান হাড়িয়েছে।
ডি কস্টার জ্ঞান অবশ্য ফিরিয়ে আনল কামাল কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
জ্ঞান ফিরে পেয়েই ডি.কস্টা প্রলাপ বকার মত বলতে লাগল, বী কেয়ারফুল, মিস্টার! আমি নেটেড নেহি আছি। আই অ্যাম অ্যান ইংলিশম্যান। ডোন্ট টাচ মি ইউ! টোমাডের সাটে আমার কোন গুলমাল নেই, মিস্টার।
| কামালের হাসি পেল এমন পরিস্থিতিতেও। খান-সেনাদের হাতে ধরা পড়লে ডি.কস্টা কেমন আচরণ করবে তা সে জানতে পারল পরিষ্কার।
শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে ট্রাক। শহরের ভিতর ঢোকার পরপরই সতর্ক হয়ে গেছে কুয়াশা। বর্বর সেনাদের দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডের কোন সীমা পরিসীমা নেই। বস্তিতে আগুন জ্বলছে এখনও।
ঘাসে শহীদ। রাত আড়াইটা।
সাড়ে এগারোটা থেকে আড়াইটা! এখনও চলছে একইভাবে অবিরাম গোলাগুলি বর্ষণ।
দিকে দিকে জ্বলে উঠেছে আগুন। কুয়াশা ৩৫
L
এ আগুন নিভবে না।
রাস্তায় রাস্তায় স্থাপিকৃত হয়ে রয়েছে রক্তাক্ত মৃতদেহ। ব্যারিকেড ভেঙে ফেলা হয়েছে।
তবে সংঘর্ষ বন্ধ হয়নি। বাঙালী পুলিসরা হাল ছাড়েনি এখনও।
শহরে ঢুকে চমকে উঠল কুয়াশা। বর্বর সেনারা শহরটাকে কি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে চায়? ঢাকাবাসীদেরকে কি হত্যা করবে তারা গুণে গুণে? |
হঠাৎ রাসেলের কথা মনে পড়তেই সামনের দিকে তাকাল কুয়াশা। সামনে কোন জীপ নেই।
নির্জন প্রায় রাস্তা। অন্ধকার বললেই চলে। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে রাস্তার পাশে মৃতদেহ। মাঝেমধ্যে উজ্জল হেডলাইট জ্বেলে সামনের দিক থেকে তীর বেগে ছুটে আসছে বর্বর সেনাদের ভ্যান বা জীপ।
অ্যারোস্লোমের কাছে কয়েকটা ট্যাঙ্ক দেখতে পেল ওরা।
নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীকে দাবিয়ে রাখার জন্যে পশুরা ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে এ যেন দেখেও বিশ্বাস করা সহজ নয়।
রাস্তায় কেউ বাধা দিল না ওদের ট্রাককে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্রাক, বাধা দেবার কথাও নয়।
ষাট মাইল বেগে যন্ত্রদানব ছুটে চলেছে। রাসেলের জীপটা দেখা যাচ্ছে না।’ কুয়াশা বলল একসময়।’ শহীদ বলে উঠল, “অনেক আগেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে সামনের দিকে। | কামাল বলে উঠল, ‘বড় বেপরোয়া। এ ছেলে বাঁচবে বলে মনে হয় না।’
কামালের কথার উত্তর দিল না কেউ। কিন্তু কেউ উত্তর না দিলেও সৃষ্টিকর্তা বুঝি কামালের মন্তব্যে মুচকি একটু হাসলেন।
ধানমণ্ডি এলাকায় পৌঁছে কুয়াশা ট্রাকের স্পীড কমাল।
পাঁচ নম্বর রোডের মাথায় একটা জীপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ওরা তিনজন । দাঁড়ানো জীপটার নম্বর প্লেট দেখেই চিনে নিয়েছে ওরা। এই জীপই চালাচ্ছিল রাসেল। ।
| পাশ কাটিয়ে রোডের ভিতরে ঢোকার সময় ওরা দেখল জীপের ভিতর কেউ নেই।’’
খানিকটা আরও এগোবার পর শহীদের বাড়িটা দেখা গেল।
ধড়াস করে উঠল শহীদরে বুক। বাড়ির সামনে একটা জীপ পঁড়িয়ে আছে। মহুয়া এবং লীনার কথা ভেবে শিউরে উঠল শহীদ।
কুয়াশারও মুখাভাব কঠিন আকার ধারণ করেছে।
জীপটার পিছনে বাড়ির কাছেই ট্রাক থামাল কুয়াশা।
ভলিউম ১২
৬৪
ওদের প্রত্যেকের পরনে পাঞ্জাবী সেনার পোশাক। প্রত্যেকের হাতেই স্টেনগান। ‘
প্রথমে নামল শহীদ। অপর দরজা দিয়ে নামল কুয়াশা। কামাল নামল শহীদের পিছু পিছু।
জীপের ভিতরে কেউ নেই। বাড়ির গেট খোলা । দোতলার বারান্দায় আলো জ্বলছে।
বারান্দায় জীবিত কেউ নেই। কিন্তু গফুরের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত অবস্থায়। গফুরের পাশেই দু’জন শত্রুর লাশ। লড়ে মরেছে গফুর। দাঁতে দাঁত চাপল শহীদ সকলের অজ্ঞাতে।
উঠানটা অল্প আলোয় আলোকিত। সেই আলোয় তিনজন পাঞ্জাবী সেনাকে দেখতে পেল ওরা। নিচতলার বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসছে তিনজন।
শহীর্দের পোশাক দেখে সশব্দে সালট মারল, তিনজন। শহীদ কৃত্রিম কঠোর স্বরে পাঞ্জাবী ভাষায় বলল, তোমরা কার কমাণ্ডে আছ? ক্যাপ্টেন আনসারী, স্যার।’ শহীদ জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন এসেছ? পাঞ্জাবী সেনাদের একজন বলল, ক্যাপ্টেন নিয়ে এসেছেন, স্যার। আর একজন বলল, ডাকব, স্যার?’
। দোতলায় আছে ও?’
• ইয়েস, স্যার।
শহীদ কুয়াশা এবং কামালের দিকে ফিরে পাঞ্জাবীতে বলল, “তোমরা এসো আমার সাথে।
কথাটা বলেই হঠাৎ কি মনে করে পাঞ্জাবী সেনাগুলোর দিকে ফিরে তাকাল ও। বলল, তোমরা নিজেদের গাড়িতে যাও।’ পাঞ্জাবী সেনারা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই ওরা তিনজন শুনতে পেল মহুয়ার চিৎকার, ‘খবরদার, আর এক পা-ও সামনে এগিয়ো না বলছি! আমরা মেয়ে হতে পারি। কিন্তু । দুর্বল নই। আমাদের মান-ইজ্জত রক্ষা…।’ মহুয়ার কথা শেষ হলো না, শোনা গেল লীনার তীব্র চিৎকার, বাঁচাও! বাঁচাও!’
এগারো। ছুটে যাবারও উপায় নেই। বুট জুতোর শব্দে সন্দিহান হয়ে উঠবে শত্রু।
নিঃশব্দ পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরের বারান্দায় উঠে এলো ওরা। | চিৎকারটা আসছে বারান্দার শেষ প্রান্তের কামরা থেকে।
শহীদ এবং কুয়াশা আগে আগে, পিছনে কামাল।
৫-কুয়াশা ৩৫
৬৫
লীনা অবিরাম চিৎকার করছে। মাঝে মাঝে গলা শোনা যাচ্ছে মহুয়ার। কামরাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। তার পাশেই কুয়াশা। খবরদার!’ হুঙ্কার দিল শহীদ।
কামরার ভিতর নেমে এল নিস্তব্ধতা। লীনাকে ছেড়ে দিল পাঞ্জাবী এক পিশাচ। অপর পিশাচ মহুয়ার শাড়ির আঁচল ছাড়ল না, শুধু কঠিন দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল।
উদ্যত স্টেনগান নিয়ে কামরার ভিতর পা দিল শহীদ এবং কুয়াশা। কামালও ঢুকল, কিন্তু চৌকাঠের উপর দাঁড়াবার জায়গা পেল ও।
লীনার পরনে শুধুমাত্র ব্লাউজ আর পেটিকোট। বর্বর পশুরা তার শাড়ি কেড়ে নিয়েছে। আর একটু দেরি হলে লজ্জা এবং মান-ইজ্জত থাকত না।
শহীদ দুই বর্বরের দিকে তাকাল। আগুন ঝরছে ওর দুই চোখে।
শহীদের কাঁধের ব্যাজ দেখেও সন্দেহ দূর হলো না একটা পিশাচের। মহুয়ার শাড়ি ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে ঘুরে দাঁড়াল সে শহীদের দিকে মুখ করে।
শহীদ কঠিন কণ্ঠে বলল; “খবরদার! এক পাও নড়বে না। হাত তোল মাথার উপর।
তুমলোগ হাথ উঠাও শির কা উল্লর । বদমাশ, কাফের কাহিকে। পিছন থেকে বলে উঠল কর্কশ কণ্ঠস্বর।
চমকে উঠল ওরা তিনজন।
শহীদ কুয়াশা এবং কামালের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছে নিচের তিন খান-সেনা।
শহীদদেরকে দেখে ওদের মনে সন্দেহ হয়। সন্দেহবশত নিঃশব্দে উপরে উঠে এসেছে শয়তানগুলো।
‘হাতিয়ার ডালো। পিছন থেকে হুকুম পেল শহীদ, কুয়াশা, কামাল।
• হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে খপ করে ধরে ফেলল কামরার ভিতর এক পশু লীনার একটা হাত।
অপর পশুটি এগিয়ে গেল মহুয়ার দিকে। মহুয়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, “ওরে শয়তান, তোর লজ্জা-শরম ভয় ভীতি কিছুই নেই। সাবধান।
চিৎকার করে উঠল লীনা, কামালদা, দাদা…।’
হেসে উঠল কামরার ভিতর দুই সাক্ষাৎ শয়তান। পরমুহূর্তে শোনা গেল অপ্রত্যাশিত স্টোনের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ।
ওরা, যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। শহীদ কেবল আড়চোখে একবার তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশার দৃষ্টি কামরার ভিতরই নিবদ্ধ। দুই পিশাচ আবার লীনা এবং মহুয়াকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ভলিউম ১২
অকস্মাৎ কামাল, শহীদ এবং কুয়াশাকে ধাক্কা দিয়ে কারার ভিতর প্রবেশ করল রাসেল।
মহিলারা বসে পড়ুন! চিৎকার করে উঠল রাসেল। লীনা এবং মহুয়া যন্ত্রচালিতের মতই বসে পড়ল মেঝেতে। দুই পিশাচ অকস্মাৎ হাত দিল কোমরে অস্ত্র নেবার জন্যে। গর্জে উঠল রাসেলের স্টেনগান আর একবার। ঝাঁঝরা হয়ে গেল দুই বর্বর সেনার বুক। নরকে চলে গেল তারা মুহূর্তের মধ্যে।
রাসেল ঘুরে দাঁড়াল শহীদ এবং কুয়াশার দিকে। বলল, “দেরি করা উচিত হয়নি আপনারদের। কামরায় ঢুকেই গুলি করেননি কেন?’
শহীদ রাসেলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি হঠাৎ এলে কোথা থেকে? বাড়িটাই বা চিনলে…!’
| রাসেল বলল, আপনি গুণী লোক, আপনার বাড়ি চিনব না তো চিনব কার! জীপ নিয়ে আসিনি। দূর থেকেই দেখেছিলাম জীপটা দাঁড়িয়ে আছে এ বাড়ির সামনে। চুপিসাড়ে আপনার পাশের বাড়ির ভিতর ঢুকে ছাদে উঠে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আপনাদের তিনতলার ছাদে চলে আসি। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামি দোতলায়। নেমেই দেখি আপনারা বিপদে পড়েছেন। সময় নষ্ট না করে তিন শয়তানকেই নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
কামাল বলল, তুমি যদি সময় মত।’
রাসেল বাধা দিয়ে বলে উঠল, সে-কথা থাক! এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা নয়। বাড়ি ত্যাগ করে পালাতে হবে।
কামাল বলল, কিন্তু এই অবস্থায় মেয়েদেরকে নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করে যাব কোথায়?’
রাসেল বলল, ‘বাড়ি ত্যাগ তো করতেই হবে, এমনকি এই শহর, এ দেশও ত্যাগ করতে হতে পারে। আপনারা পাঞ্জাবী পশুদের নৃশংসতা টের পাননি নাকি এখনও।
মহুয়া বলে উঠল, শহীদ, আমি আর এক সেকেণ্ডও থাকতে চাই না এখানে। শয়তানগুলো তোমাকে খুন করতে এসেছিল। তোমাকে না পেয়ে আমাকে আর লীনাকে।’
রাসেল বলল, আপনারা বরং পরে আলাপ করবেন। এখুনি বেরিয়ে পড়া উচিত।
| মহুয়া সমর্থন করে বলল, হ্যাঁ। আর একদল কুকুর হয়ত এখুনি এসে পড়বে।
লীনা অপর এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেহে কামরা থেকে। মহুয়াও কামরা ত্যাগ করতে করতে বলল, আমি লীনাকে নিয়ে আসছি এখুনি।
কথাটা আর কারও মনে না থাকলেও কুয়াশার মনে ছিল। রাসেলের দিকে
কুয়াশা ৩৫
৬৭
–
না
।
তাকিয়ে সন্দেহ জাগল মনে। কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছেলেটা আরও। বুকের অন্তস্তল থেকে কেমন যেন উথলে উঠল অসীম স্নেহ।
রালে! মৃদু স্বরে ডাকল কুয়াশা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রাসেল।
তোমার আম্মা, বোন•• |’
রাসেল ঘুরে দাঁড়াল এবার। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। বলল, জিজ্ঞেস করার জন্যে ধন্যবাদ। আমি বাড়ি হয়েই এখানে এসেছি।’
‘খবর ভাল তো?’ জিজ্ঞেস করল শহীদ। রাসেল নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। হাসতে চাইছে ও।
হতবাক হয়ে, সবাই তাকিয়ে রইল রাসেলের দিকে। রাসেল প্রাণপণ চেষ্টা করছে হাসতে। কিন্তু কাঁপছে ওর ঠোঁট জোড়া।
হঠাৎ মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল রাসেল। ঠোঁট জোড়া স্থির হলো। দুই ফোঁটা তপ্ত পানি ঝরে পড়ল চোখ থেকে।
মাথা তুলল রাসেল। মুখের চেহারা অন্যরকম দেখাচ্ছে এখন। মৃদু একটু হাসি ঠোঁটে। ..
বলল, ‘খব্ব ভাল কি খারাপ ঠিক বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে। তবে আম্মাকে, হারিয়েছি, যাকে হারালে আর পাওয়া যায় না। বোনকেও হারিয়েছি। বাড়িতে ঢুকে খুন করে গেছে ওরা! এ হয়ত ভালই হয়েছে। আমার আর কোন বন্ধন রইল না। আমি মুক্ত।
তাকিয়ে রইল সবাই। কারও মুখে কোন কথা নেই। বারো। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুত একটি অ্যাটাচী কেসে ভরে নিল শহীদ এবং কামাল। মহুয়া ও লীনা গহনা এবং টাকা পয়সা নিয়ে নচে নেমে আসতেই কুয়াশা বলল, : শহীদ, এবার আমাদের ছাড়াছাড়ি হোক।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেতে চাও তুমি?’
কুয়াশা হাসল। বড় রহস্যময় সে হাসি। এ হাসির অর্থ জানে শহীদ। তবু সে চুপ করে রইল উত্তরের অপেক্ষায়।
* কুয়াশা বলল, যাবার জায়গা অনেক, শহীদ।’
কুয়াশার কথা শেষ হতেই রাসেল বলে উঠল, মি. কুয়াশা, আপনাকে কলবার একটা কথা আমার আছে। আশা করি বিরূপ হবেন না। দেশের ও দশের মঙ্গলের নাম করে এতদিন আপনি যা করে এসেছেন তা এককথায় ক্রাইম। তাই কলহি দশের উপকারের নাম করে আপনার পক্ষে খান-সেনাদের সাথে হাত মেলানোও বিচিত্র নয়। কিন্তু আপনার কাজকে আমি ঘৃণা করলেও আপনাকে আমি ঘৃণা করি না।
৬৮
ভলিউম ১২
ন
আপনাকে আমি ঘৃণা করি না বলেই একটা অনুরোধ রাখতে চাই বিদায়ের আগে। দেশের এই চরম বিপদে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব পালন। করতে গিয়ে আমরা কে কোথায় ছিটকে পড়ব জানি না। হয়ত এ-জীবনে আমাদের
আর দেখা হবে না। তবু, আমার অনুরোধ আমি রাখছি। আপনি তা মানবেন না .. হয়ত, তবু।
কুয়াশার দুই চোখে কৌতুকের ছটা! রাসেল নামক এই অদ্ভুত যুবকটির ওপর। তার চটে ওঠার যথেষ্ট কারণ আছে কিন্তু মনে মনে সে বরং স্নেহ করতেই রু করেছে তাকে। সে বলল, বলো, রাসেল। তোমার অনুরোধটি কি। * “আর যাই করুন, দেশের সাথে, দেশের মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন
। তার ফল ভাল হবে না।’
অনেক আগেই দাগ কেটেছে কুয়াশার মনে রাসেল। কুয়াশা হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করল, ফল ভাল হবে না কথাটার মানে?’ এবার মুক্তোর মত সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল রাসেল।
কলল, আপনি আজ অবধি যতগুলো কাজ করেছেন তার প্রতিটির মধ্যে ছিল মারাত্মক ক্ষটি। অজি সময় বড় কম হাতে, তা নাহলে ত্রুটিগুলো উল্লেখ করতে পারতাম। আমার এ কথা বলার কারণ এই যে আপনি কোন অপরাধ করার সময় ত্রুটিহীনভাবে করতে পারেন না। ভুল পদ্ধতি, ভুল চিন্তার ফলে আপনি অনেক অকারণ ঝামেলা বাড়িয়েছেন, বিপদে পড়ার আশঙ্কা বাড়িয়েছেন, বিপদে পড়েছেনও। তাই বলছি, দেশের বিরুদ্ধে আবার কোন অপরাধ করতে গেলে ফল ভাল হবে না। কেন না মারাত্মক ভুল আপনি করবেনই।’
কুয়াশা এবার গম্ভীর হলো। যুবকের আত্মবিশ্বাস এবং অহঙ্কার কম নয়। কুয়াশার ভুল ধরছে সে!
কুয়াশা হঠাৎ আবার হাসল। বলল, ‘আমি জানি আবার আমাদের দেখা হবে। তখন তোমার কাছ থেকে আমার ভুল-ত্রুটিগুলো জেনে নেব। আর, কথা দিচ্ছি তোমাদের, দেশের চেয়ে প্রিয় আমার কাছে আর কিছু নেই, হবেও না।’
আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা দিল রাসেলের চোখেমুখে। নিস্পলক তাকিয়ে রইল সে কুয়াশার দিকে। অনেকক্ষণ পর সে কেকল বলল, “আশাকরি আপনার কথা আপনি, | রক্ষা করবেন।’
‘যে অবিশ্বাস করে তাকে বিশ্বাস করানো কঠিন। তুমি আমাকে আগাগোড়া অবিশ্বাস করো।’
‘তা করি। স্পষ্ট ভাষায় বলল রাসেল। কুয়াশা মুচকি হাসল। তারপর মহুয়ার দিকে ফিরে কলল, ‘চলি, বোন।’ চললে, দাদা? কিন্তু অামাদের কি আর দেখা হবে না? মহুয়ার দুই গাল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা।
কুয়াশা ৩৫
হাসল কুয়াশা। মহুয়ার কাঁধে ভারি হাতটা রেখে সে বলল, ‘পাগলী! দেখা হবে
কেন রে! একশোবার দেখা হবে। লীনা, চলি। কামাল, যাই হে। শহীদ, চললাম। আর রাসেল, তোমাকে আশীর্বাদ করি, তুমি দেশের মুখ উজ্জ্বল কোরো। বড় হও আমার চেয়ে অনেক বড় হও। বিদায়, ভাই।’
আপনার কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে। বিদায়।’
রাসেলের গলায় ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম আভাস পেয়েও কুয়াশা বিচলিত হলো না। ঘুরে দাঁড়াল সে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তার দিকে।
দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা।
শহীদ চোখ ফিরিয়ে তাকাল রাসেলের দিকে। রাসেল সাথে সাথে জানতে চাইল, আমাকে আপনারা সঙ্গে নেবেন তো, শহীদ ভাই?’
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শহীদ। কেন, কে জানে। বলল, “নেব বৈকি, ভাই।’
রাসেল মহা উৎসাহে বলল, তাহলে আর দেরি নয়।
কথাটা বলেই প্রকাণ্ড এক লাফ মেরে ট্রাকের পিছনে উঠে দাঁড়াল সে। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন, আমার হাত ধরে উঠে আসুন, মহুয়াদি।’
মহুয়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিল এতক্ষণ রাসেলের দিকে। সরল, নিষ্পাপ দুই চোখবিশিষ্ট কে এই যুবক। মহয়াদি ডাকটি তার কী মধুর। হৃদয় যেন ভরে উঠল এই এক ডাকেই।
অসঙ্কোচে হাতটা ধরল মহুয়া। মহুয়া ট্রাকের উপর উঠল। রাসেল বলল, লীনা, বোন, এবার তুমি এসো।
এগিয়ে গেল লীনা।
কামালের ঠোঁটে একটু হাসি ফুটল। লীনা দ্বিধা করছিল। নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল কামাল। মৃদু হেসে রাসেলের বাড়ানো হাতটা ধরল লীনা।
তেরো সে রাত্রির কথা বুঝি এ জীবনে ওরা কেউ ভুলতে পারবে না। মানুষ যে কত অসহায় তা ওরা এর আগে বুঝি ভাবেনি। গুলি খাচ্ছে, নিশঃব্দে লুটিয়ে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। পাশে দাঁড়ানো লোকটি সব দেখেও পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। নড়বার কোন লক্ষণ নেই তার মধ্যে। নড়বে, নড়ে যাবেই বা কোথায়? এ যে তারই
, লাশগুলো যে তারই মা-বাপ-ভাই-বোন-স্ত্রীর। এদেরকে ফেলে, এই র ত্যাগ করে কোথায় যাবে সে? আত্মরক্ষার উপায় তো নেই। এলাকা ঘিরে ফেলেছে দলে দলে মূর্তিমান শয়তানের দল। ঘরে ঘরে ঢুকছে তারা। ঢুকে খুন করছে।
ওরা শুধু অসহায় মানুষদেরকেই দেখল না। সেই সাথে দেখল আর একদল
৭০
ভলিউম ১২
মানুষ কি ভীষণ নিষ্ঠুর হতে পারে, কি ভীষণ.অমানুষ হতে পারে। মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে শিশুকে আছাড় মারল দেয়ালের সাথে। নিষ্পাপ শিশু খিলখিল করে হাসছিল। অকস্মাৎ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল তার সেই মিষ্টি ঝরঝরে হাসি। বেয়োনেট দিয়ে বিদ্ধ করা হল যুবতী কন্যার বুক, তার বাবার সামনে। স্বামীর সামনে পাশবিক অত্যাচার চালাল নরপিশাচরা স্ত্রীর উপর।
রক্তের বন্যা সদরঘাট টার্মিনালে। রক্তের স্রোত শাখারী বাজারে। প্রতিটি রাস্তায় স্তূপীকৃত লাশ।
| ঢাকা ত্যাগ করে বহুদূর চলে যাবার ইচ্ছা ছিল শহীদের। কিন্তু ঢাকার নবাববাড়ির ভিতর দিয়ে নদীর ঘাটে যাবার পরামর্শ দিল রাসেল। তার ধারণা ঢাকা ত্যাগ করার সময় এখনও আসেনি। কলা যায় না, সকাল হবার পর অন্যরকম খবর পাওয়া যেতে পারে। চারদিকে বরদের বর্বর আচরণের স্বাক্ষর পরিস্ফুট হয়ে দেখা। গেলেও বাঙালী পুলিস এবং বাঙালী সেনারা চুপ করে নেই। তারা লড়ছে, বাধা দিচ্ছে। সকাল হবার আগে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে না। অবস্থা যদি বাঙালীদের অনুকূলে থাকে তাহলে নিরস্ত্র বাঙালীরা সাহসে বুক বেঁধে শত্ৰুসংহারে নামতে দ্বিধা করবে না। সে সময় দরকার বুদ্ধিমান লোকের। রাসেল তাই শহীদকে ঢাকা ত্যাগ করতে দিতে চাইল না।
শহীদ অবশ্য ঢাকা ত্যাগ করতেও চায়নি। সে চেয়েছিল মহুয়া এবং লীনাকে ঢাকার বাইরে রেখে রাতারাতি আবার ফিরে আসতে। ফিরে এসে রীতিমত সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ইচ্ছাই ছিল তার। কিন্তু রাসেল তাতেও রাজি হতে পারল না।
সে বলল, “অবস্থা কেমন তা না জেনে এই মুহূর্তে আপনার কিছুই করা উচিত নয়, শহীদ ভাই। এভাবে কোমর বেঁধে নেমে পড়াটা উচিৎ হবে না। সব খবর আগে পাওয়া দরকার। শত্রুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোথায় তা আগে জানা দরকার। তারপরই সেখানে আঘাত হানা যেতে পারে। দ্রুততা বা ভাবাবেগবশত কিছু একটা করতে গিয়ে যদি প্রাণ হারান তাহলে দেশ মাতৃকার জন্যে প্রাণ দিয়ে আপনি শহীদ হবেন বটে কিন্তু দেশের তাতে খুব একটা উপকার হবে না।’
নদীর ঘাটে নৌকা ছিল। কিন্তু জনমনিষ্যির কোন চিহ্ন ছিল না। অন্ধকার নদী।
নদীর এপার থেকে গুলি করা হচ্ছে নদীর ওপারের গ্রামগুলোকে লক্ষ্য করে। তবে শহীদদের কাছ থেকে প্রায় আধামাইল বায়ে শত্রুপক্ষ।
, নৌকা করে অন্ধকার নদীতে ভাসল ওরী।
. এই যে ভাসল, এই ভাসার বুঝি শেষ নেই, সীমা নেই।
নদীর ওপার থেকে জিঞ্জিরা বাজার। সেখানে ক’দিন পর হানা দিল দখলদারবাহিনী। সেখান থেকে জনস্রোতে মিশে গিয়ে ভেসে চলল মহুয়া এবং লীনা।
শহীদ, কামাল এবং রাসেল তখন ঢাকায়। কিন্তু খুব বেশি দিন ওরা থাকতে কুয়াশা ৩৫
| ৭১
পারল না ঢাকায় কাজ করা দরকার। দুচোখ মেলে অনেক বর্বরতা, অনেক নৃশংসতা দেখল ওরা। কিন্তু দেখে কি লাভ, প্রতিশোধ তো নিতে হবে। আর, প্রতিশোধ নিতে হলে ঢাকায় বসে থাকলে চলবে না।
, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ঢাকা ত্যাগ করল ওরা।
বুড়ীগঙ্গার ওপারে বর্বর সেনাদের তাণ্ডব লীলার পর মহুয়া এবং লীনার কোন সঠিক খবর পায়নি শহীদ।
পথে পরিচিত লোকদের সাথে দেখা হয়েছে। পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলতে পারেনি। ঢাকায় যে-কদিন ছিল শহীদ সে-কদিন এত বেশি ব্যস্ত ছিল যে মহুয়া এবং
লীনার কোন খবর নেবার সুযোগই সে পায়নি।
স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিস অফিসার মি. সিম্পসনের সাথে গোপনে দেখা করেছে শহীদ। ওর সঙ্গে রাসেল এবং কামালও ছিল।
মি. সিম্পসনকে রাসেলই প্রস্তাব দেয় ঢাকা ত্যাগ করে মুক্ত এলাকায় চলে যাবার। কিন্তু মি. সিম্পসন তাতে রাজি হননি। রাজি না হবার কারণও ছিল। সে
কারণ শোনার পর রাসেল তার প্রস্তাবের পক্ষে আর কোন কথা বলেনি।
মি. সিম্পসন বললেন, “আমার অধীনে যারা চাকরি করে তাদের ওপর আমার একটা দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালন করব আমি। তারপর মুক্তাঞ্চলে যাব।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় রাসেল বলল, ‘শহীদ ভাই, এভাবে বসে থাকতে আমার আর ভাল লাগছে না। ইচ্ছে করছে এমন অসঘ একটা কিছু করি যার ফলে রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যাক দেশ। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। চলুন, আগে যুদ্ধ করাটা শিখে ফেলি। ‘
| এপ্রিলের শেষ দিকে মুক্ত অঞ্চলে পৌঁছাল ওরা। মুক্ত অঞ্চলে পৌঁছেও কিন্তু ওরা মহুয়া এবং লীনার কোন সন্ধান পেল না। রাসেল চেষ্টা করেছিল কুয়াশার খবর সংগ্রহ করার। কিন্তু মুক্ত অঞ্চলের মানুষরা কুয়াশার কোন খবর ওকে দিতে পারল না।
এদিকে মহুয়া এবং লীনার জন্যে শহীদ চিন্তিত হলেও ওরা নিজেদের প্রাণের জন্যে মোটেই ভাবিত না।
| অভিজ্ঞতা মানুষকে খাঁটি করে। কঠোর অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে একদিনেই মহুয়া এবং লীনা হয়ে উঠেছে খাঁটি মানবদরদী। | জিঞ্জিরায় যে বিপদে ওরা পড়েছিল এপ্রিলের দু’তারিখে, সে-বিপদ থেকে খোদা নিজে ওদেরকে বাঁচিয়েছেন বলাই ঠিক।
অন্ধকার তখনও দূর হয়নি। ঘুম থেকে তখনও গ্রামবাসীরা জাগেনি। শুধু জেগেছিল বিরাট এক দল নরপিশাচ বুকে রক্ত পিপাসা নিয়ে নদীর ওপারে।
নৌকোর পর নৌকো রেখে, টেমপোরারি ব্রিজ তৈরি করে ট্যাঙ্ক নিয়ে এল শয়তানের দল সদরঘাট টার্মিনাল থেকে।
ওদিকে ধলেশ্বরী পেরিয়ে ডান দিক থেকে এবং নবাব বাড়ির পাঁচ মাইল বাঁ দিকে
‘ভলিউম ১২
৭২
•
সরে গিয়ে আরও দুটি বিরাট শত্রুবাহিনী নদী পেরিয়ে গোটা জিঞ্জিরা ঘিরে ফেলল।
অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার সাথে সাথে গর্জে উঠল ট্যাঙ্ক, মর্টার, রকেট। | ত্রিমুখী আক্রমণ নিরস্ত্র ঘর-সংসারী মানুষগুলো মৃত্যু অবধারিত জেনেও স্ত্রী পুত্র কন্যার হাত ধরে সেই আধো অন্ধকারে ঘর ছেড়ে মাঠে নেমে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল।
। কিন্তু কোন দিকে যাবে তারা?
ছুটছে মানুষ। চারদিকে আর্ত চিৎকার। আকাশ বাতাস চিরে ফেটে পড়ল ট্যাঙ্কের গোলার শব্দ।
পিপঁড়ের মত মরল মানুষ।
মহুয়া এবং লীনা আশ্রয় নিয়েছিল শহীদের এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধু ভদ্রলোকটি বাড়ি ছিল না কদিন থেকেই। বন্ধুর স্ত্রী এবং বৃদ্ধ বাবা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
গোলাগুলির শব্দের পরই গ্রামবাসীরা বেরিয়ে পড়েছে যে যার ঘর থেকে। চারদিকে কলমা আর দোয়া দরূদের কণ্ঠস্বর! কিন্তু সেই সব কণ্ঠস্বরকে চেপে দিয়ে। শোনা যেতে লাগল বুলেটের শব্দ।
অন্ধকারে ছুটছে মানুষ। মহুয়া এবং লীনা বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।
মেঠো পথের পাশেই মাঠ, ধান খেত । বাইরে বেরিয়েই ওরা দেখল দূরে আগুন এবং ধোয়ার রাশি।
আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে ছুটে আসছে দলে দলে যমদূত। •
দলে দলে ছুটছে মানুষ! হাজারও কণ্ঠের আহাজারীতে কান পাতা দায়। মাঠে, খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ, গুলিবিদ্ধ হয়ে। কে পড়ল কে মারল কে তার খবর রাখে। প্রাণে বাঁচতে হবে। থামলে চলবে না ছুটতে হবে।
মহুয়া এবং লীনার পাশ দিয়েই বাচ্চা ছেলে মেয়ের হাত ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে দলে দলে মানুষ।
শিা পিছিয়ে পড়ছে। পিছিয়ে পড়ছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সকলের গলাতেই কান্না।
চোখ ফেটে জল আসে মহুয়ার। একি নারকীয় তাণ্ডব। মানুষের কি কোনই মূল্য নেই? তারা কি কুকুর বেড়ালের চেয়েও অধম। কি করেছিল তারা?
মায়ের কোল থেকে শিশুটি পড়ে গেল অকস্মাৎ মহুয়ার পায়ের সামনেই। ছুটতে ছুটতে শিশুর মা হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার বুকের দুটো শিশুর মধ্যে একটা নেই।
আমার সোনা-মানিক কই পড়ল?’ মহুয়ার কথা চাপা পড়ে গেল অদূরবর্তী কামানের গর্জনে।
মা আর এক পাও এগোতে চাইছে না। কিন্তু তার স্বামী শক্ত হাতে ধরেছে স্ত্রীর একটা হাত। স্বামীর কণ্ঠে আতঙ্ক।
| সে বলছে, ‘সোনার মা, থাউক তোমার সোনা, সোনা তুমি আবার পাইবা, কিন্তু কুয়াশা ৩৫
দুশমন আইয়া পড়ছে-চলো পালাও।
ভিড়ে মিশে গেল শিশুর মা এবং বাবা।
মহুয়া শিশুটিকে তুলে নিয়েছে কোলে। কিন্তু শির দিকে মনোযোগ দেবার সময় তার কোথায়! বৃদ্ধা এক নারী অকস্মাৎ নিজের কপালে হস্তাঘাত করতে করতে লীনার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধা বলছে, মাগো, আমার মাইয়াডারে দেখছনি?”
লীনা বলল, “কি নাম তোমার মেয়ের। কোথায় থাকো তোমরা?’
নদীর কেনারায় খাহি! মাইয়াডা হারাইয়া গেছে। জোয়ান মাইয়া, হায় খোদা এ তুমি কি করলা! মাইয়ার ইজ্জত তুমি কাইড়া নিবার চাও•••!
বৃদ্ধা তার মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভিড়ে মিশে গেল ।
এই করুণ দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজেদের বিপদের কথা মনেই রইল না মহুয়ার। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু হাজার হোক মেয়ে মানুষ তারা দুজন, নিজেদেরই নিরাপত্তা নেই এতটুকু। এই হাজার হাজার নর-নারীর জন্যে কিই বা করার আছে তাদের।
• নেই, আবার আছেও। এমন করে ছুটে কোথায় যাচ্ছে ওরা? ছুটলে কি পরিত্রাণ পাওয়া যাবে?
দল বেঁধে কোথায়, কোনদিকে ছুটছে তা কেউই জানে না।
পথের মাঝখানে দাঁড়াল মহুয়া। ছুটন্ত লোকজনদেরকে বাধা দিল দুই হাত মেলে। বলল, ছুটবেন না আপনারা । যে যার বাড়ির সামনে থাকুন। ফিরে যান আপনারা। পালাবেন কোথায়?’
কিন্তু কে কান দেয় অপরিচিত এক নারীর কথায়? ছুটতে পারলেই যেন সবাই বাঁচবে! তাই কোন কথাতেই তারা কান দিচ্ছে না।
অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাল মহুয়া। পরমুহূর্তে কি যেন দেখল ও। আতঙ্কে ভয়ে, বিস্ময়ে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল মহুয়ার সর্বশরীর। লীনা ছুটে এসে শক্ত করে চেপে ধরল মহুয়ার একটা হাত! কাঁদো কাঁদো কন্ঠে সে শুধু উচ্চারণ, করল, মহুয়াদি!
চোদ্দ
গত প্রায় আধঘণ্টা ধরে এক নাগারে মানুষ কেবল গেছে পুব দিকে।
অকস্মাৎ হাহাকার রবে মথিত হয়ে উঠল চারদিক। ফিরে আসছে মানুষ। দলে দলে সবাই পড়ি মরি করে উধ্বশ্বাসে ফিরে আসছে ।
• মানুষগুলো যেদিকে গিয়েছিল সেদিকে নিরাপত্তা নেই। সেদিক থেকে এগিয়ে আসছে পাঞ্জাবী সেনারা।
অদূরে দেখা যাচ্ছে আগুন।
ভলিউম ১২
এম
বাঁচাও!’ বাঁচাও! চারদিকে সাহায্যের ডাক। কিন্তু কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না।
আরও কয়েকটা মিনিট কেটে গেল। তারপর হঠাৎ শুরু হলো আবার এক বর্ণনাতীত বিশৃঙ্খলা।
পথের পর মাঠ, ধানখেত। তারপর আবার একটা গ্রাম। সে গ্রামের লোকেরা এতক্ষণ এদিকে আসার চেষ্টা করেনি। কিন্তু এ গ্রামের লোক মাঠ, ধান খেত পেরিয়ে ও গ্রামের দিকে রওনা হতেই দেখা গেল ও গ্রামের লোকেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে এ গ্রামেরই দিকে।
বাচার কোন উপায় নেই।
আগুন এগিয়ে আসছে। আধ মাইল দূরে এখনও আগুন। কিন্তু দূরত্ব ক্রমশই কমছে।
মানুষের ভীড়ে খরকুটোর মত ভেসে যেত মহুয়া এবং লীনা। কিন্তু পথ ছেড়ে ওরা দাঁড়িয়ে আছে মাঠে। মহুয়া দেখছিল আগুনের বিস্তৃতি। চারদিকে আগুন। পালাবার কোন পথ নেই। আধঘণ্টা, বড় জোর এক ঘণ্টার মধ্যে এদিকেও আগুন জ্বালানো হবে।
‘‘মহুয়াদি!
ভয় কি, লীনা। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ সাহস হারাব কেন ভাই? আয়, মনে মনে আমরা আল্লাকে ডাকি।’
লীনার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের আরও কাছে টেনে আনল মহুয়া তাকে।
ক্রমশ দিনের আলো ফুটতে শুরু করল পুবদিক রাঙা হয়ে উঠার পর। আলোয় মানুষের মুখ দেখে শিউরে উঠতে হয়মানুষগুলো যেন সামান্য একটি ঘন্টায় ভূতের মত হয়ে গেছে।
মাঠে বসে আছে কত লোক। কেউ ছুটোছুটি করে খুঁজছে তারা-ছেলে-মেয়ে স্ত্রীকে। কেউ কেউ পথের পাশে শুয়ে কাঁদছে চিৎকার করে। আবার অনেককে দেখা গেল স্রেফ পাথরের মত নির্বাক হয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তারা দূরবর্তী অগ্নিশিখার দিকে।
বেলা আটটার দিকে পাশের গ্রামে আগুন দিল পাঞ্জাবী-সেনারা।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল সব। গ্রামটাকে ঘিরে ফেলেছে শয়তানরা। চারপাশ থেকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ-গ্রামের লোকেরা ঠকঠক করে কাঁপছে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দুরু দুরু বুকে বিস্ফারিত নেত্রে আধমাইল দূরবর্তী গ্রামের রুণ অবস্থা দেখছে সবাই।
গ্রামটা পুড়ছে। আগুনের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ছটফট করতে করতে দু’একজন করে বেরিয়ে আসছে ফাঁকা জায়গায়। অমনি গর্জে উঠছে রাইফেল।
মহুয়া এবং লীনা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল অনেকক্ষণ ধরে নরপিশাচদের
কুয়াশা ৩৫
৭৫
কাণ্ডকারখানা। মহুয়া বিশেষ একটি ব্যাপার লক্ষ করছিল অনেকক্ষণ থেকেই। কিন্তু মুখফুটে লীনাকে সে কিছুই বলেনি।
কিন্তু লীনার চোখে ধরা পড়েছে ব্যাপারটা। হাজার হোক সে-ও তো যুবতী মেয়ে।
‘মহুয়াদি । ‘কিছু বলবি রে?’ জিজ্ঞেস কুল মহুয়া। ‘দেখতে পাচ্ছ, মহুয়াদি? ওরা সবাইকে গুলি করে মারছে, কিন্তু।’ | লীনা থেমে গেল। আতঙ্কে বুজে গেল ওর কণ্ঠ। মহুয়া বলল, হ্যাঁ। তুই ঠিকই দেখেছিস। যুবতী মেয়েদেরকে ওরা গুলি করছে । ধরে রাখছে। পাঁচ সাতজন একসাথে হলে হাত বেঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথাও।
কিন্তু…।’
মহুয়া বলে উঠল, ‘ওরা এদেশের মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়, লীনা। ওদের দ্বারা যা সব ওরা তাই করবে। দেশের মেয়েদের কোন মূল্য নেই ওদের কাছে। ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করবে। তারপর মেরে ফেলবে।
আমাদের কি হবে, মহুয়াদি!’ লীনা কেঁদে ফেলল কথাটা বলেই। গাল বেয়ে জল নেমে এল মহুয়ারও। লীনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ও বলল, ‘মন খারাপ করিসনে, লীনা– খোদা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন।’ | ‘মহুয়াদি, কুয়াশাদাদা এখন কোথায়?’ | মহুয়ার ঠোঁটে একটু হাসি ফুটল। বলল, আমিও সে-কথা ভাবছি রে লীনা।
আমরা বিপদে পড়ার আগে নিশ্চয়ই.দাদা এসে পড়বেন।’
কিন্তু যদি না আনে। আর আসলেই তিনি কি…।’
মহুয়া লীনার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠল, ‘আশঙ্কার কথা বলিসনে, লীনা। না আসলে আমাদেরকে মরতে হবে। তোর দাদাও তো আসতে পারবে না, ওরা। ঢাকায়।’
লীনা বলল, আমরা নিজেদের চেষ্টায় কি কিছুই করতে পারি না?
তাই তো! লীনা তো, ঠিকই বলেছে। এ মহা বিপদে কারও সাহায্যের আশা করা বোকামি। তারচেয়ে নিজেরা চেষ্টা করলে কি কোন উপায় হয় না?
মাটির দিকে তাকিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করল মহুয়া। শহীদ হলে এরকম বিপদে কি করত সে প্রশ্নের উত্তর চায় সে।
ভেবে কোন কূলই খুঁজে পেলে না মহুয়া। লীনা হঠাৎ বলে উঠল, ‘মহুয়াদি, ঘরে যাবে না?’
. লজ্জায় যেন মরে গেলমহুয়া ঘরে যাবার কথা মনে পড়তে। শহীদের বন্ধুর স্ত্রী মিসেস বোরহান তার রুগ্ন শওরকে নিয়ে একা আছেন বাড়িতে । ভদ্রমহিলার খোঁজ
৭৬
ভলিউম ১২
নেয়া উচিৎ ছিল আগেই।
শহীদের বন্ধু বোরহান আহমেদ ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে বাস করতেন। কিন্তু বর্তমান বিপদের মাথায় স্ত্রী এবং রুগ্ন পিতাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন জিঞ্জিরার এই বাড়িতে।
বাড়িটা পাকা এবং দ্বিতল। এতদিন খালিই পড়েছিল। বর্তমানে নিচের তলাটা নিরাশ্রয় মানুষরা শহর ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছে। কেউই তারা পরিচিত নন। বোরহানের। বোরহান তাতে কোন আপত্তি করেনি। স্ত্রী এবং রুগ্ন পিতাকে রেখে। গতকালই সে আবার শহরে গেছে। মহুয়া এবং লীনার জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে উপরেরই একটি কামরা। । | বাড়িতে ঢুকে হতবাক হয়ে গেল ওরা। নিচের তলার আশ্রয়প্রাপ্ত লোকেরা কেউ
নেই। ঘর-দোর সব খা খা করছে।
সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় উঠে এল ওরা। মহুয়া শান্তস্বরে ডাকল, মিসেস বোরহান!
| মিসেস বোরহানের সাড়া পাওয়া গেল না। লীনা এগিয়ে গেল মহুয়াকে পাশ কাটিয়ে। মিসেস বোরহানের রূমের দরজা খোলা। ভিতরে কেউ নেই।
| পাশের রূমটা মিসেস বোরহানের শ্বশুরে। মহুয়া দরজার সামনে গিয়ে ডাকল, মিসেস বোরহান।’
| ভিতর থেকে কারও সাড়া পাওয়া গেল না।
দরজাটা ভেজানো। ধীরে ধীরে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল মহুয়া। পরমুহূর্তে ধ্বক করে কেঁপে উঠল তার বুক। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখের চেহারা।
হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী ছিলেন মিসে বোরহানের শওর।
মহুয়া দেখল বৃদ্ধের মাথা থেকে পা অবধি সাদা চাদরে ঢাকা। মিসেস বোরহান মৃতদেহের সামনে পাথরের মূর্তির মত বসে আছেন একা!
পনেরো। অসত্ব শক্তিমতী নারী মিসেস বোরহান। ওদেরকে কামরায় ঢুকতে দেখে চমকে উঠে তাকালেন তিনি। কেউ কথা বলল না। কেটে গেল কয়েক মিনিট। তারপর একসময় মিসেস বোরহান উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “যিনি গেছেন তিনি গেছেন। আমাদের ওপর শুভ দৃষ্টি তিনি রাখবেন। আমরা এভাবে বসে না থেকে চলুন, আত্মরক্ষার চেষ্টা করি।’
মহুয়া কথা বলল না। লীনা সংক্ষেপে পাশের গ্রামের ঘটনাটা বলল। বিশেষ করে শয়তান পাঞ্জাবী সেনারা মেয়েদেরকে নিয়ে কি করছে সে ঘটনা খুলে বলল।
মিসেস বোরহান বললেন, ছাদে সঁড়িয়ে সব আমি দেখেছি। মহুয়া বলল, বাঁচার উপায় কি, মিসেস আহমেদ?
কুয়াশা ৩৫
৭৭
প্রাণ যায় যাবে, মান-ইজ্জত হারাব না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে কোন শয়তান যেন আমাদের গায়ে হাত ঠেকাতে না পারে।’
লীনা আবার কেঁদে ফেলল।
মহুয়া হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। উপায় সে একটা পেয়ে গেছে! বলে উঠল সে, এক কাজ অনায়াসে করা যায়! হয়ত তাতে ফলও হবে!”
‘কি কাজ! মিসেস বোরহান জানতে চাইলেন।
মহুয়া বলল, লীনার দাদা ছদ্মবেশ নেবার সাজসরঞ্জাম সব রেখে গেছে। আমরা ছদ্মবেশ নিতে পারি।
“কিসের ছদ্মবেশ? কিন্তু আমাদের চুল? লীনার কথার উত্তরে মিসেস বোরহান বললেন, চুল না হয় কেটে ফেলব।’
মহুয়া বলল, না, কেটে ফেলারও দরকার নেই। চুলে রঙ লাগাব। সব জিনিসই আছে মেক-আপ-বক্সে। আমরা ছদ্মবেশ নিয়ে সাজব বুড়ি। পাকা চুল। মুখে রেখা। হাত-পায়ের চামড়া শুকনো । চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। কুঁজো হয়ে হাঁটব।’
‘খুব কাজ হবে। মিসেস বোরহানও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
লীনা বলল, হয়ত গুলি খেয়ে মরতেই হবে, কিন্তু তবু এটাই ভাল।
মরতে চাই না।’
বলল মহুয়া, কিন্তু ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে যা করবে তার হাত থেকে বাঁচার জন্যে হাসতে হাসতে মরতে পারব আমরা।’
ক্রমশ বেলা চড়ছে। গ্রামবাসীদের অবস্থা অবর্ণনীয়।
বিকেল চারটের দিকে পুব এবং পশ্চিম দিক দিয়ে গ্রামে ঢুকতে শুরু করল পশু সেনারা।
গ্রামের পুব এবং পশ্চিমে আগুন জ্বলে উঠল। দুই প্রান্তের অধিবাসীরা হাহাকার রব তুলে হুটে পালিয়ে আসতে লাগল গ্রামের মাঝখানে। পশু-সেনারাও তাদের পিছু পিছু বেশ খানিকদূর এগিয়ে এল গুলি করতে করতে। এ যেন জঙ্গল ঘিরে ফেলে বাঘ শিকার।
প্রচণ্ড শোরগোল শুনে মহুয়া, লীনা এবং মিসেস বোরহান বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তিন যুবতাঁকে এখন আর চেনবার উপায় নেই। ওরা তিনজনই পক্ককেশী বিগতযৌবনা অসহায় বৃদ্ধা মাত্র।
পথের উপর কাঁদহে মানুষ। কেউ ছুটছে, কেউ নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে, আছে।
মহুয়া ধান খেতের দিকে আঙুল বাড়িয়ে লীনার উদ্দেশে বলে উঠল, তুই যাঃ দেখি লীনা, ওইখানে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে মরার মত শুয়ে থাক। মরে গেছিস মনে করে••• |
ভলিউম ১২
গুলির শব্দ হলো। চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল লীনা। ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে মুখ। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে পা বাড়াল সে।
মিসেস বোরহান অসহায় চোখে তাকাল, মহুয়ার দিকে।
অকস্মাৎ বাঁচার ইচ্ছায় উন্মাদ প্রায় কিছু লোক হুড়মুড় করে এসে পড়ল। ঝড়ের মত এল তারা। পঁচিশ তিরিশ গজ যাবার পরই কান-ফাটা শব্দ হলো স্টেনগানের। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল এক দল ছেলে-মেয়ে যুবক-যুবতী।
পড়ে গেলেন মিসেস বোরহানও পথের পাশে। গুলি তার গায়ে লাগেনি! ইচ্ছা করেই পড়ে গেছেন তিনি।
মহুয়া চোখের সামনে নারকীয় কাণ্ড দেখে পাথঝের মত স্থির হয়ে গেছে। খুনীর, দল এগিয়ে আসছে। মানুষ দৌড়াচ্ছে। তাদের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে খুনীর দল গুলি করতে করতে।
পথের পাশেই একটি একচালা। মহুয়া দেখল দু’জন বুড়ো লোক সেই একচালার বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদছে। মহুয়া পা বাড়াল।
বুড়োগুলোর পাশে গিয়ে বসল মহুয়া। পরস্পরের দিকে তারা কেউ তাকাচ্ছে । বুটজুতোর শব্দ হচ্ছে। গুলির শব্দ হচ্ছে কানের পাশেই। আশপাশেই বাবারে মারে’ ‘পানি দাও’ ইত্যাদি কণ্ঠস্বর:আহতদের।
‘এই বুড়ালোগ ইধার আও!’ : চমকে উঠল মহুয়া। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে সে তাকাল না। উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। ‘বোলো, জয় বাংলা বোলো!’
এবার তাকাল মহুয়া। তিনজন পশু-সেনা-দশ হাত দূরে। স্টেগান উঁচিয়ে রয়েছে। কথাগুলো বলছে তাদেরই একজন ওদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে।
ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে বুড়ো দু’জন পা বাড়িয়েছে। পশু-সেনারা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল আবার, বোলো শালালো, জয় বাংলা বোলো। শেখ মোজিবকো বুলাও, তোমহারা বাপকো বুলাও, দেখু উঁও গাদ্দার তুমলোগকো বাঁচা সাকতা ইয়া নেহি!
বৃদ্ধদ্বয় এগিয়ে যাচ্ছে। মহুয়া তাকিয়ে আছে পশু-সেনাদের হাতের স্টেনগানের দিকে। এক পশু আর এক পশুকে কলল, ইয়ার, দের মার্ত করো। গোলি চালাও! গুলি চলল।
মহুয়া পড়ে গেল ধপ্ করে সেখানেই। ষোলো গুলি এবং আহতদের কাতর-ধ্বনি ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না অনেকক্ষণ । তারপর একসময় গুলির শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল ক্রমশ দূরে। তখন চোখ মেলল
কুয়াশা ৩৫
মহুয়া। বাঁশ ফাটার বিকট আওয়াজ হচ্ছে চারপাশ থেকে।
আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে ঘর-বাড়িতে। বাঁশ গাছ পুড়ছে বাঁশ বাগানে। কাঁচা বাশ ফাটার শব্দে কান পাতা দায়। আহতদের যন্ত্রণাক্ত ধ্বনিও চাপা পড়ে যাচ্ছে। মহুয়ার সাদা শাড়ির আঁচল রক্তে ভিজে গেছে। তিন হাত সামনেই পড়ে রয়েছে দুই অশীতিপর বৃদ্ধের লাশ। লাশ দুটোর রক্ত গড়িয়ে এসে ভিজিয়ে দিয়েছে মহুয়ার একদিকের গাল।
এখনও মিসেস বোরহানকে দেখা যাচ্ছে পথের পাশে পড়ে থাকতে। মাথা তুলল মহুয়া। মহিলা বেঁচে আছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। মিসেস বোরহানের পাশে একটি যুবক। নড়ছে এখনও। আহত হয়েছে।
এদিক-ওদিক তাকাল মহুয়া। অনেক লাশ। কাঁদছে কে যেন আড়ালে। ছোট একটি কচি মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মহুয়া। এগিয়ে আসছে মেয়েটির কণ্ঠস্বর । বাবা বাবা বলে কাঁদতে কাঁদতে ডাকছে। মেয়েটিকে দেখতে না পেলেও মহুয়া মনোযোগ দিয়ে তার ডাক শুনছিল। হঠাৎ কাছেপিঠে কোথাও থেকে এক পুরুষের গলা শোনা গেলঃ আমি যাইতেছি চান্দের মা।
তার সেই পুরুষ কণ্ঠ থেকেই অস্বাভাবিক জোরে বের হলো, ‘খোদা…!
তারপর সব চুপ । •
মহুয়া শুনতে পেল আবার কচি মেয়েটির কণ্ঠস্বর। দূরে সরে যাচ্ছে কণ্ঠস্বরটি আবার।
উঠে বসল মহুয়া। পা বোধহয় এ গ্রাম থেকে চলে গেছে।
উঠে দাঁড়াতেই আশ-পাশের অনেকদূর অবধি দেখতে পেল মহুয়া সবুজ রঙগুলো কালো হয়ে যাচ্ছে আগুনে পুড়ে এবং ধোয়ায় ধোয়ায়। আর লাল রঙ দেখা যাচ্ছে যেখানে সেখানে। +
আগুন আর রক্ত। যেদিকে চোখ পড়ছে সেদিকেই আগুন, সেদিকেই রক্ত।
মাথাটা বড় ঘুরছে। একপা দুপা করে এগোল মহুয়া। টলছে পা দুটো । মিসেস বোরহানের দিকে চোখ পড়তেই দ্রুত হলো মহুয়ার চলার বেগ। মহিলা উঠে বসছেন।
মিসেস বোরহানের পাশে পড়ে রয়েছে আহত এক যুবক। মহুয়া হাঁটু মুড়ে বসল যুবকের পাশে। করুণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে যুবকটি। মহুয়া হাত দিয়ে রক্তাক্ত লুঙ্গিটা ধরল! ঢেকে দিল যুবকের কোমরটুকু। মিসেস বোরহানের দিকে না তাকিয়েই মহুয়া দ্রুত বলল, বাড়িটায় কি আগুন দিয়েছে? ফাস্ট-এইড বক্সটা যদি পাওয়া যায়। তবে আগে লীনার খবর নেয়া দরকার।’
মহুয়া পা ছড়িয়ে বসল পথের উপর। যুবকের রক্তাক্ত মাথাটা তুলে নিল দুই বাতু দিয়ে নিজের কোলের উপর ।
স বোরহান বিনাবাক্যব্যয়ে টলতে টলতে নেমে গেলেন নিচু ধানখেতের
ভলিউম ১২
দিকে।
চোয়ালে গুলি লেগেছে যুবকের। ক্ষতস্থান থেকে ঘাস, মাটি সরিয়ে দিল মহুয়া। বাঁচবে না ছেলেটা, ভাবল মহুয়া। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করার প্রশ্নই উঠে না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চোখ বুজে মরার মত পড়ে আছে যুবক। মরে গেছে নাকি?
. পালস্ দেখল মহুয়া। মরেনি, তবে শেষ নিঃশ্বাস পড়তে খুব একটা দেরিও |
নেই।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল মহুয়া। প্রৌঢ়া এক সাধারণ গ্রাম্য নারী কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কোলে একটি শিশু। রক্তে রাঙা হয়ে গেছে শিশুর সর্ব রী। মহুয়া ইঙ্গিতে বসতে বলল প্রৌঢ়াকে। প্রৌঢ়া বসল।, কলল, “আমার নাতিটারে বাঁচামু কেমনে কও দেহি, মা।’
মহুয়া চমকে উঠল।
প্রৌঢ়ার কণ্ঠস্বর যেন কেমন। কথাগুলো আরও বিস্ময়কর। তার মৃত নাতিকে সে বাঁচাতে চাইছে।
শিশুর কপালে বড় দাগ। বেয়োনেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে পশুরা।–
মিসেস বোরহান খানিকটা দূরে পথ অতিক্রম করছে আড়াআড়িভাবে। মহুয়া দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকল।
মিসেস বোরহান দূর থেকেই বললেন, লীনা পানি আনতে গেছে। ভাল আছে সে। আমি বাক্সটা নিয়ে আসি বাড়ি থেকে।
• মাথার ওপর চিল আর শকুন ঘুরপাক খাচ্ছে। গা শিরশির করে উঠল মহুয়ার।
লীনা এক কলসী পানি নিয়ে এল। পানি দিল মহুয়া যুবকের ঠোঁট ফঁক করে ধরে পানি খাবার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল সে।
পানি খেয়েই চোখ মেলে চাইল। মহুয়ার দিকে চেয়ে থেকে কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু পারল না। ঢলে পড়ল মাথাটা।
মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকান লীনা। ধীরে ধীরে মাথাটা নামিয়ে রাখল মহুয়া কোল থেকে। মিসেস বোরহান ফাস্ট-এডের বাক্স নিয়ে ফিরে আসছেন।
সেই প্রৌঢ়া এতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মহুয়ার দিকে। হঠাৎ সে উতে দাঁড়াল কোলে মৃত শিশুকে নিয়ে। মহুয়াও উঠে দাঁড়াল। দুই হাত প্রৌঢ়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, তোমার নাতিকে আমার কাছে দাও। আমি ওকে হাসপাতালে দিয়ে আসব।’
প্রৌঢ়া কি মনে করে মহুয়ার কোলে তুলে দিল মৃত শিশুকে। তারপর মহুয়াকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগল যন্ত্রের মত।
তীরবেগে নেমে আসছে শকুনেরা। ৬-কুয়াশা ৩৫
.
৮১
মহুয়া আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘মিসেস বোরহান!
বলুন।
সকলের গলার স্বরই কেমন যেন হয়ে গেছে। সকলের চোখেমুখেই কেমন যেন অস্বাভাবিক একটা পরিবর্তন এসেছে।
মৃতদেহগুলোর কি হবে?’
কাঁদতে কাঁদতে আসছে একটি পরিবারের কয়েকজন। আধাবয়েসী এক পুরুষ, একটি কিশোর, দুটি ছয়-সাত বছরের ছেলেমেয়ে। পুরুষটির কোলে এক বৃদ্ধা সভবত আহত হয়নি বুড়ি। হয়ত পঙ্গু চলৎশক্তিরহিত।
লীনাকে সামনে পেয়ে পুরুষটি কি যেন বলছে, চোখে পানি। খানিকপর লীনা ফিরে এসে মহুয়াকে বলল, “ভাবী, ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ওদের
পরিবারের চারজন মারা গেছে।’
মহুয়া বলল, “আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাও ওদেরকে। কিন্তু কিশোর ছেলেটি এবং লোকটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। ওরা অনেক কাজ করতে পারবে।’
সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। ঝোঁপ-ঝাড় থেকে, ধান খেত থেকে জীবিত মানুষরা একজন দু’জন করে বেরিয়ে আসছে। সবাই অপ্রকৃতিস্থর মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু কেউ কোন শব্দ করছে না। প্রতিটি লাশের সামনে ভিড়। প্রিয়জনকে খুঁজছে সবাই।
লীনা পুরুষ এবং কিশোরটিকে নিয়ে ফিরে এসে দেখল মহুয়া এবং মিসেস বোরহান ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জন লোককে জড় করেছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে কোদাল।
নিচু জমিতে মাটি কাটা শুরু হলো। তারপাশেই একটি একটি করে নিয়ে এসে রাখা হলো লাশগুলো।
মহুয়া অপর একদলকে নিয়ে আহত মানুষদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। লীনা এবং মিসেস বোরহান ফিরে গেল বাড়িতে।
সন্ধ্যার পরপরই মিসেস বোরহানের বাড়িতে লোকেরা আহতদেরকে নিয়ে আসতে শুরু করল।
গ্রামের কয়েকজন বিধবা মেয়েকে মিসেস বোরহান পাঠিয়ে দিলেন রান্নাঘরে। তারা বিরাট এক ডেকচিতে চাল-ডাল ধুয়ে চড়িয়ে দিল চুলোয়।
আহতদের মধ্যে ভোর হবার আগেই মারা গেল পঁচিশ তিরিশজন। পরদিন সকালে দুটি যুবক এল। মহুয়ার সাথে গোপনে কথা বলল তারা। সারা দিন কাটল। সাতজনের মধ্যে মারা গেল আরও পাঁচজন।
সন্ধ্যার পর আবার এল সেই যুবকদ্বয়। আহত দুজনকে নিয়ে মহুয়া, লীনা এবং মিসেস বোরহান তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন।
নৌকোয় উঠে লীনা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছি আমরা, ভাবী?
ভলিউম ১২
মহুয়া কি যেন ভাবছিল মগ্ন হয়ে। লীনার প্রশ্নে চমকে ফিরে অকাল। লীনা আবার প্রশ্নটা করল। মহুয়া বলল, বিক্রমপুরে আহতদের জন্যে মুক্তিবাহিনীর হাসপাতাল করেছে। সেখানে যাচ্ছি আমরা কাজ করতে। পারবিনে, লীনা?
পারব না কেন! পারব বৈকি!’ অন্ধকার নদীতে এগিয়ে চলল নৌকা।
কত কথা মনে পড়ে মহুয়ার। কী সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে গেল! পরিবারের কে কোথায় ভেসে গেল!
হঠাৎ দুই চোখ ভরে উঠল মহুয়ার লোনা পানিতে। গফুরের লাশটা ভেসে উঠল মানসপটে। বছরের পর বছর ধরে গফুর ছিল ওদের সাথে। গফুর বাড়িতে থাকলে কোনদিন কোন ব্যাপারে ভয় পেত না মহুয়া। গফুর একাই একশ ছিল। দিদিমনি বলতে অজ্ঞান ছিল।
সতেরো দেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে, ঘাটে-মাঠে-ঘাটে নেমে এল অশুভ ছায়া। কিন্তু সময় বসে থাকল না। দিন গড়িয়ে রাত হলো। রাত ফুরিয়ে দিন হলো। কেটে গেল সুদীর্ঘ সাত সাতটি মাস। | এই সাতমাসে মহুয়া এবং লীনা অনেক বদলেছে কিন্তু ওদের নারী-ধর্ম ঠিকই আহে। সেবার মহৎ আদর্শে আজও ওরা অটল।
অনেক বিপদ থেকে অলৌকিক ভাবে বেঁচেছে ওরা। আবার অনেক সময় বুদ্ধি খাঁটিয়ে বেঁচেছে। কখনও কোথাও স্থিরভাবে আস্তানা গেড়ে কাজ করার সুযোগ : পায়নি। আজ এখানে, কাল দশমাইল দূরের গ্রামে চলে যেতে হয়েছে।
পাঁচ মিনিটের নোটিসে হাসপাতালের রুগী, ওষুধ, যন্ত্রপাতি সব সাথে নিয়ে পালাতে হয়েছে বার কয়েক।
অনেক আপদে বিপদে পড়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে ওরা। উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, নৈরাশ্য, আতঙ্ক, এসবকে অনেকটা জয় করেছে ওরা। তাছাড়া আতঙ্কিত হবার দুশ্চিন্তা করার সময়ই বা কোথায়। | ন্যাটাডিঙির শেষ মাথায় হাসপাতালটা। আড়াই মাইল দক্ষিণে বেনাপোল কাস্টম চেক পোস্ট। ওখানে যুদ্ধ চলছে। রোজই আহত মুক্তিসেনারা আসছে হাসপাতালে। পশ্চিম দিকে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। ওদিকে কোন হাঙ্গামা নেই। কিন্তু মাইল দশেক উত্তরে বেতনা নদীর ওপারে পাঞ্জাবী সেনাদের ঘাঁটি। নদীর এপারে শহীদ তার দলবল নিয়ে আছে। রোজই সংঘর্ষ হচ্ছে। আহত মুক্তিসেনার ওখান থেকেও আসছে রোজ। আহতদেরকে বাঁচাবার জন্যে একজন মাত্র ডাক্তার। তিনজন মাত্র সেবিকা। মহুয়া, লীনা এবং মিসেস বোরহান। রাত দিন চোখে ঘুম নেই। মৃত্যু পথযাত্রী মুক্তিসেনাদের পাশ থেকে সরে যাবার উপায় নেই এক মিনিটের কুয়াশা ৩৫
জন্যেও। | যমে মানুষে লড়াই এখানে চব্বিশ ঘণ্টা। সময় বয়ে যাচ্ছে। টের পাওয়া যায়
। কাজ কাজ আর কাজ। অন্য কথা ভাববার সময় নেই।
ন্যাটাডিঙি ছোট্ট একটা গ্রাম। সীমান্ত থেকে মাত্র চার মাইল ভিতরে। | লাকসামপুরের হাটও ন্যাটাডিঙি থেকে মাত্র মাইল চারেক দূরে। শহীদরা ক্যাম্প করেছে ওখানেই। কুয়াশাও নাকি ওদিকে আছে। খবরাখবর দু’একদিন
পরপরই পায় মহুয়া। কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ নেই বহুদিন থেকে।– | বেতনা নদীর ওপারে দখলদার বাহিনী। গত মাস দেড়েক ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করছে তারা নদী পেরুতে। কিন্তু শহীদদের সাথে সুবিধে করতে পারছে না।
ইতিমধ্যে শহীদ কমিশনড র্যাঙ্কে উত্তীর্ণ হয়েছে। শহীদ এখন মেজর। রাসেল ফেটেন্যান্ট। কামাল ক্যাপ্টেন। কুয়াশী কোন ট্রেনিং নেয়নি।
ন্যাটাডিঙি গ্রামটা এলাকার শেষপ্রান্তে। উত্তরে আর কোন গ্রাম নেই বললেই চলে। রাহিলীপোতা অনেকটা দূরে পায়ে হাঁটা পথ। তারপরের গ্রাম মানমারি। মানমারির পর আন্দারপোতা পেরিয়ে লাকসামপুর।
লাকসামপুর বেশ বড় গ্রাম। পোস্ট অফিস আছে। রেলপথ থাকলেও এখন অচল। শহীদরা লাইন তুলে ফেলেছে অনেক আগেই।
ন্যাটাডিঙি থেকে যাতায়াতের অন্য কোন উপায় নেই, একমাত্র পায়ে হাঁটা পথ হাড়ী। গরুর গাড়ি অবশ্য যাওয়া আসা করে। বেনাপোল অবধি মেঠো পথ। নদী পথে যাওয়া যায়, কিন্তু ঘুরতে হয় অনেকটা।.।
ন্যাটাডিঙির পুকুরের পরেই দুইচালার একটি অস্থায়ী বাড়িতে হাসপাতাল।
সেদিন শনিবার। মহুয়া আহতদেরকে সন্ধ্যাকালীন খাবার খাইয়ে অফিসরূমে এসে মুখ হাত ধুচ্ছে। অসিরূমেই যাবতীয় কাজ সারতে হয় ওদেরকে। এটাই খাবারঘর, শোবারঘর, বিশ্রামঘর। ওষুধপত্র এখানেই থাকে। মহুয়া, লীনা এবং মিসেস বোরহান এই রূমেই রাত কাটান। ডক্টর ইব্রাহিম রাত কাটান আহতদের সাথেই একটি চৌকিতে।
সন্ধ্যার পরপরই গোলাগুলির দ শোনা যায়। গা সওয়া হয়ে গেছে।
আজ কিন্তু সকলেই একটু বেশি সচেতন। কারণ বিকেল তিনটে থেকে অব্রিাম | গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে।
এমন যে আগে কখনও হয়নি তা নয়।
আগেও হয়েছে। তবে আগে যে কোন একটা দিক থেকে গোলাগুলির অবিরাম শব্দ শোনা গেছে। আজ কিন্তু তার বিপরীত ব্যাপার। আজ বিকেল থেকে পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে শব্দ আসছে। | দুশ্চিন্তার কারণ নেই আবার আহেও। মর্টারের শব্দ সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। ভারি কামানের গর্জনে কান পাতা দায়। সন্ধ্যার খানিক আগে মাদারতলা
৮৪.
ভলিউম ১২
থেকে চিনুর মা এসেছিল। সে একটা দুঃসংবাদ দিয়ে গেছে। কামানের একটা গোলা পড়েছে স্বরূপদেখায়।
| ন্যাটাডিঙি থেকে মাত্র মাইল দেড়েক পূবে স্বরূপদেখা গ্রাম। ছোট গ্রাম। মসজিদের পাশ্বে দুটো বাড়ির লোক জখম হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে মারা গেছে।
চিনুর মা সাত গ্রাম ভিক্ষা করে বেড়ায়। লাকসামপুরেও যায় সে। কিন্তু আজ সে ওদিকে গেলেও লাকসামপুরে যেতে পারেনি। গিয়েছিল আরপোতা অবধি। খ খা করছে গ্রামটা। লোকজন সব পালিয়েছে। ভয়ে পালিয়ে এসেছে চিনুর মা । ওদিকেও যুদ্ধ খুব জোরে সোরে বৈধেছে। পাঞ্জাবী সৈন্যরা বেতনা নদী পেরিয়ে। এপারে আসতে পেরেছে কিনা জানতে পারেনি সে। তবে নদী পেরোবার জন্যেই আদাজল খেয়ে নেমেছে নতুন করে খুনে সেনাগুলো তাতে কোন সন্দেহ নেই চিনুর মার।
সন্ধ্যা নামার আগেই ন্যাটাডিঙি এবং আশপাশের গ্রামগুলোয় নেমে এল উৎকণ্ঠার কালো ছায়া। রাত নামার সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠল মানুষ।
| পায়ে আঘাত প্রাপ্ত দুইজন মুক্তিসেনা সমস্যার সৃষ্টি করল রাত আটটার দিকে।
বিকেল থেকেই আহত মুক্তি সেনারা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল গোলাগুলির শব্দ শুনে। মহুয়াদেরকে হাজারও প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। সন্ধ্যার খাবার পরিবেশন করে মহুয়া নির্দেশ দিয়েছিল সবাইকে ঘুমুতে।
কিন্তু ঘুমোয়নি ওরা কেউই।
আটটার সময় খেতে এসেছিল লীনা এবং মিসেস বোরহান। ডক্টর ইব্রাহিম নামাজ পড়বার জন্যে অজু করতে গিয়েছিল পুকুরে। হঠাৎ আহত একজন মুক্তিসেনা কাতরে উঠল ব্যথায়।
আগে থেকেই ফিসফিস করে কথা বলছিল ওরা নিজেদের মধ্যে। ওদের কথার দিকে কান ছিল না মহুয়ার।
শহীদ কামাল এবং কুয়াশার কথা মনে মনে ভাবছিল মহুয়া। কেমন আছে ওরা কে জানে। এমন সময় বিকট স্বরে কাতরাতে শুরু করল একজন।
ছেলেটা বড় চঞ্চল। জাহেদ ওর নাম। পায়ে গুলি লেগেছে। এসেহে মাত্র গত পরও। পাটা হয়ত কেটে বাদই দিতে হবে। মহুয়া তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘মরে যাচ্ছি আপী।’ “কি হলো হঠাৎ?”
নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে জাহেদ ব্যথা সইতে না পেরে! বলল, ‘পা ভীষণ ব্যথা করছে। আমি বোধহয় বাঁচব না। ডাক্তার ভাইকে ডাকুন•••আপা। আমার আম্মা আছেন কোলকাতায়, ঠিকানাটা••।’
সন্দেহ করার কথা মনেই হলো না মহুয়ার। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল
কুয়াশা ৩৫
৮৫
ইব্রাহিম সাহেব অজু করে চলে যাবেন মসজিদে। মসজিদ আবার স্বরূপদেখাতে। | ফিরতে দেরি হবে। দেরি না করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল মহুয়া।
মিনিট দশেক পরই ফিরে এল মহুয়া ডা. ইব্রাহিমকে সাথে নিয়ে। ফিরে এসে আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখল ওরা। | তিনজন মুক্তিসেনা ধরা পড়ল হাসপাতালের বাইরের গেটের সামনে। তারাও হাঁটতে পারে না। মাটিতে বসে কোমর ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে হাসপাতাল থেকে।
বুঝতে বাকি রইল না কিছু। অনেক বুঝিয়ে অনেক ধমকে ভিতরে আনা হলো তাদেরকে। কেঁদেই সারা সবাই।
সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আহত প্রতিটি মুক্তিসেনা শব্দ করে কাঁদছে। | জাবেদ এবং নুরুল নামে দুটো ছেলেকে পাওয়া গেল না। দু’জনারই একটি করে পা খোঁড়া। ভাল এক পা সম্বল করেই তারা পালিয়েছে। যাবার সময় স্টেনগান নিয়ে যেতে ভোলেনি।
| দেশ এমন এক আকর্ষণ। দেশকে মুক্ত করার যুদ্ধ যখন দোরগোড়ায়, তখন কে চায় ঘরে বসে থাকতে? হোক সে আহত।
জাবেদ এবং নুরুলকে খোঁজার জন্যে গ্রামের চারজন লোককে পাঠানো হলো : দুই দিকে। ডা. ইব্রাহিম এবং মহুয়া গেল অন্য আর একদিকে।
জঙ্গল, জলা, ধানখেত ইত্যাদি পেরিয়ে রাহিলীপোতা অবধি গিয়েও ওদের খবর পাওয়া গেল না। কিন্তু রাহিলীপোতা গিয়ে ওরা যা দেখল তা অবর্ণনীয় । সারাটা গ্রাম তহুনহু হয়ে গেছে কামানের গোলায়। বেশির ভাগ গ্রামবাসীই মার গেছে।
পরবর্তী উত্তরের গ্রাম পায়রাখোপি। কে জানে সেখানের অবস্থা আরও কি | ভয়ানক।
: ডা. ইব্রাহিম নিবেদিত প্রাণ। মহুয়াও তাই। কিন্তু রাহিলীপোতার অবস্থা দেখে নিদারুণ মুষড়ে পড়ল। শহীদ আছে উত্তরে। না জানি তাদের কি অবস্থা।
ডা. ইব্রাহিম আহতদের চিকিৎসা করার কথা ভাবছিলেন। মহুয়াকে রেখে তিনি ফিরতে চান ন্যাটাডিঙিতে। ওষুধপত্র আনা দরকার।
মহুয়া ইতস্তত করছিল কি যেন ভেবে। এমন সময় আন্দরপোতা থেকে একদল । লোক এল।
দুঃসংবাদের চরম। আন্দরপোতা নিশ্চিহ্ন প্রায়। মামারির অবস্থাও তাই। মহুয়ার প্রশ্নের উত্তরে লাকসামপুরের অবস্থা কেউ জানাতে পারল না। অবস্থা নিশ্চয় সেখানে আরও খারাপ।
তবে কি পাঞ্জাবী সেনারা শিকারপুর বা সুরা গ্রামের নিকটবর্তী বেতনা নদী অতিক্রম করেছে? নাকি লাকসামপুরের কাছে নদী পেরিয়ে এপারে চলে এসেছে?
•
«
।
ভলিউম ১২।
রাত দশটায় শিকারপুরের পলায়নরত দু’জন লোক এল।
যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল তাই। শিকারপুরের কাছেই নদী পেরিয়ে এপারে, এসেছে দখলদার বাহিনী।
রাহিলীপোতায় থাকা নিরাপদ নয়। সক্ষম পুরুষদেরকে দিয়ে আহতদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো রাত এগারোটায়।
গরুর গাড়ি অবশ্য পাওয়া গেল খান চারেক। তাতেই ওঠানো হলো অবশেষে আহতদেরকে।
ভোর সাড়ে চারটের সময় ওরা পৌঁছুল ন্যাটাডিঙিতে। এত দেরি হবার কারণ ঘুরপথে এল ওরা। বান্দরপুর, রায়পুর, বাওয়ালিয়ামানকি–এই তিন গ্রাম থেকে আহতকে উঠিয়ে নেয়া হলো গাড়িতে। প্রতিটি গ্রাম কামানের গোলায় ক্ষতবিক্ষত । আহতদেরকে ফেলে অসহায় গ্রামবাসীরা পালিয়েছে। গ্রামবাসী কলতে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু এবং নারী। যুবকেরা কেউ বাড়িতে নেই। সবাই চলে গেছে দূর | দূরাঞ্চলে যুদ্ধ করতে।
ন্যাটাডিঙিতে ফিরে এসে নতুন কোন দুঃসংবাদ ওরা পেল না। | দুঃসংবাদ ব্যাপকহারে আগামীকাল সকালে আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওরা তা কেউ কল্পনা করার অবকাশও’ পেল না।
ভোর হয়ে গেল আহতদেরকে বাঁচাবার সংগ্রামে।
জাবেদ এবং নুরুলের কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। সকাল হবার পর মহুয়া আবিষ্কার করল যে চারজন লোক ওদের খুঁজতে গিয়েছিল তারাও ফিরে আসেনি। আঠারো ভোর হলেও বিপদের গুরুত্ব তেমন করে কেউ টের পায়নি। বেলা যত বাড়তে লাগল ততই পরিষ্কার হতে লাগল সব।
পুবে বাঁশবাড়ীয়ার কাছেও বেতনা নদী অতিক্রম করেছে খান-সেনারা। নিজামপুর মাদারতলা হয়ে রাহিলীপুরে পৌঁছেছে তারা-এখবর পেল ওরা বেলা
এগারোটায়।
মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল মহুয়ার। লাকসামপুর এ ন্যাটাডিঙির মাঝখানে রাহিলীপুর। তারমানে শহীদদের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
বেলা বারোটার সময় খর এল আরও ভীতিকর।
শিকারপুরের কাছে নদী পেরিয়ে এপারে দখলদারবাহিনী পৌঁছলেও নীকমানপুর জয় করতে পারেনি। ব্বং সীমান্তের দিকে হটে যেতে হয়েছে তাদেরকে। মুক্তাদহ, দুর্গাপুর হয়ে বান্দরপুরের দিকে আসছে। | এরপর রইল দক্ষিণ দিক। পালাবার একমাত্র পথ। কিন্তু বেলা দুটোর দিকে
অসহায় গ্রামবাসীরা মৃত্যুভয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে এসে পড়ল দলে দলে, কুয়াশা ৩৫
৮৭
ন্যাটাডিঙিতে।
বেলাবোলে এসে গেছে পরা। রেলপথ ওদের দখলে। | শত্রু ঘিরে ফেলেছে এলাকাটা । আহতদের সেবা কার্যের মাঝখানে অসংখ্য খবর কানে আসছে। মুক্তির কোন উপায় নেই একথা কারও জানতে বাকি নেই। তাই সকলের কাজেই ত্রুটি থাকছে।
প্রাণের ভয় বড় ভয়। লীনা বিকেলের দিকে কানে তুলো খুঁজল। গোলাগুলির শব্দ অসহ্য। মিসেস বোরহান মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন চারটের দিকে। লীনা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডা. ইব্রাহিম অনেকক্ষণ ধরে কি যেন বলি বলি করছিলেন। সাড়ে চারটেয় নিজেকে বাধা দিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। শেষ অবধি মহুয়াকে ডেকে কপাট বুলেই ফেললেন।
মহুয়া আপা, কি করব?’
মহুয়া বুঝতে পারল প্রশ্নটা । কিন্তু উত্তর দিতে পারল না অনেকক্ষণ। ও জানে মুক্তির কোন পথ খোলা নেই। পশুরা সীমান্ত বরাবর তো আছেই। অন্যান্য তিন দিকেও আছে। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাবার উপায় এখন আর নেই। সে সময়
পেরিয়ে গেছে।
মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু তবু মহুয়া এতটুকু বিচলিত হয়নি। শেষ ভরসা কুয়াশা।
মহয়া উত্তরে বলল, ‘আহতদেরকে ফেলে পালাব না আমরা। মরতে হয় ওদের সাথে মরব।’
কুয়াশার কথা মনে পড়ল। এই বিপদে কি সে সাহায্য করবে না? আশায় দুলে উঠল মহুয়ার বুক। কিন্তু কুয়াশা কি সাহায্য করতে পারবে এযাত্রা?
বেঁচে থাকার আশা কি সফল হবে মহুয়ার?
Leave a Reply