৩৪. ভুতুড়ে বাংলো [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৪
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর, ১৯৭২
শহীদের বাড়ির বৈঠকখানা।
পাশাপাশি সোফায় বসে আছে কুয়াশা এবং কামাল। মুখোমুখি আর একটি সোফায় মহুয়া। শহীদকে কোথায়ও দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার কোলে সরোদ ।
পড়ন্ত বিকেল। চারদিক কেমন যেন নিশ্চুপ। সরোদের হালকা সুরলহরী দিকে দিকে অপূর্ব এক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে।
কারও মুখে কোন কথা নেই। কারও চোখে পলক পড়ছে না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছে সময়। সরোদের মিষ্টি সুরের সাথে কোন অতলতলে হারিয়ে যাচ্ছে ওদের হৃদয়। তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছে কুয়াশা। মিয়া কি টোড়ির সুর বিচিত্র এক ঝঙ্কার তুলছে বৈঠকখানার ভিতর।
: এই মুহূর্তে কুয়াশার অন্য কোন পরিচয় নেই। সে সুরের সাধক। সে প্রতিভাবান। সঙ্গীত শিল্পী। নিজেকে বিলিয়ে দেবার এই সূক্ষ্ম শিল্প মাধ্যমকে কুয়াশা গ্রহণ করেছে অন্তর দিয়ে। অনেক ত্যাগ, অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে কুয়াশা আয়ত্ত করেছে এই অপূর্ব সুর সৃষ্টির ক্ষমতা। যন্ত্র নিয়ে যখন সে মেতে ওঠে তখন পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা মনে থাকে না তার। ভুলে যায় তার বিজ্ঞান চর্চার কথা, দেশের কথা, দশের কথা ।
শিল্পীর ধর্মই তাই। কুয়াশা একনিষ্ঠ সাধক। সার্থক শিল্পী।
যন্ত্রের সূক্ষ্ম তারে শেষ আঁচড় টেনে সিলিঙের দিকে তাকাল কুয়াশী। মিষ্টি মধুর সুর হারিয়ে যেতে শুরু করেছে অবলীলায়।
নেমে এল কুয়াশার দৃষ্টি। | কামালের দিকে তাকাল কুয়াশা। নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে কামাল এখনও কুয়াশার সরোদের দিকে।
মহুয়ার দুই চোখে গর্ব। দাদার সুর সৃষ্টির অদ্ভুত ক্ষমতার সাথে তার পরিচয় আছে। কুয়াশার সরোদ বাদন যতবার শোনে মহুয়া ততবারই গর্বে ফুলে ওঠে তার বুক।
থেমে গেছে সুর। কিন্তু নিস্তব্ধ বৈঠকখানায় সেই হারিয়ে যাওয়া সুরের রেশ এখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
মৃদু হেসে তাকাল কুয়াশা মহুয়ার দিকে। বলল, চা খাওয়াবিনে মহুয়া? কুয়াশা ৩৪
মহুয়া যেন সংবিৎ ফিরে পেল কুয়াশার কথায়। ‘এই যে দাদা, আনছি।’ উঠে দাঁড়াল মহুয়া। কুয়াশা তাকাল কামালের দিকে।
নড়েচড়ে উঠল কামাল। বলল, ‘অপূর্ব! অপূর্ব তোমার হাত কুয়াশা। তুমি ধন্য।’
হেসে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইল কুয়াশা, শহীদ কি ফিরবে সন্ধের আগে?’
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মহুয়া। বলল, কখন ফিরবে তার কি ঠিক আছে, দাদা। হয়ত রাত দুপুরে ফিরবে। তুমি কিন্তু আজ খেয়েদেয়ে যাবে, কোন কথা শুনব না আমি।’
হেসে ফেলল কুয়াশা। বলল, নারে, আমাকে ফিরতে হবে। আর একদিন খাব।’
‘ওসব শুনব না আমি।’ | মহুয়া বলল, চা নিয়ে আসি আমি। তোমরা বসো।’ চলে গেল মহুয়া দ্রুত পায়ে।
. কামাল বলল, শহীদ গেছে ওর বন্ধু আসাদ চৌধুরীর কাছে। ভদ্রলোক চাইছেন শহীদের সাথে মিলে একটা সিনেমা প্রযোজনা করতে।’
কুয়াশা বলল, দেশের যা অবস্থা তাতে নতুন কোন ইনভেস্টমেন্টে না যাওয়াই উচিত।’
কামাল প্রশ্ন করল, “দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?’
একটু যেন তিক্ত হাসল কুয়াশা। বলল, মনে হবার মত কথা একটাই। পশ্চিমারা মরণ কামড় দেবে।’
তার মানে?’ কামাল প্রশ্ন করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারছে না বলতে চাও?
আওয়ামী লীগ কেন, বাংলাদেশের কোন পার্টিই কোনদিন ক্ষমতায় যেতে পারবে না এই ব্যবস্থায়।
কুয়াশা বলে চলল, “আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বাঙালীদের সাথে মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা করার পাঁয়তাড়া করছে ইয়াহিয়া খান। জাতীয় পরিষদের বৈঠক পিছিয়ে দেবার একটিই কারণ। ওরা সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করছে।’
অবাক হয়ে জানতে চাইল কামাল, তুমি কি বলতে চাও ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী দিয়ে বাঙালীদেরকে দমাবার চেষ্টা করবে? দেশের লোক এখন অত বোকা নয়, ভীতুও নয়। সেনাবাহিনী যে কিছুই করতে পারবে না তা তো পরিষ্কার। কারফিউ দিচ্ছে না ওরা প্রত্যেক দিন? কাজ হচ্ছে কি? কারফিউও তো মানছে না পাবলিক। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে কি ফল লাভ করতে চায় ইয়াহিয়া?’।
ভলিউম ১৭,
‘সেনাবাহিনীকে ছোট করে দেখো না কামাল।
কুয়াশা বলল, পাঞ্জাবী সেনারা পৃথিবীর সবচেয়ে কোরাপটেড সেনা। ওদের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। রাতারাতি ওরা রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দিয়ে, নেতাদেরকে কয়েদ করে, সারা বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে একটা দক্ষযক্ষ কাণ্ড বাধিয়ে দিতে পারে। সে ক্ষমতা ওদের আছে। এবং সে ক্ষমতাই ব্যবহার করতে যাচ্ছে ওরা। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে ছোট করে দেখতে নেই।’
কামাল বলল, বলো কি তুমি, কুয়াশা! কিন্তু এতে লাভ হবে কি? বাঙালীদেরকে কি আর দাবিয়ে রাখা সম্ব?।
হাসল কুয়াশা। বলল, দাবিয়ে রাখা অব। ওরা যা করতে যাচ্ছে তা ওদের জন্যে স্রেফ আত্মঘাতী। কিন্তু এ ছাড়া ওদের আর কোন পথও নেই।’
‘পথ নেই। তার মানে!”
কুয়াশা বলল, “জলের মত পরিষ্কার। বাঙালীরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। সে দাবি মেটাতে হলে শোষণের কুমতলব ত্যাগ করতে হবে পাঞ্জাবীদেরকে। পাঞ্জাবীরা ইসলাম এবং বৃহত্তম ইসলামিক রাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে জোর করে কলোনী করে রেখেছে শুধু দুটো উদ্দেশ্যে–শোষণ এবং শাসনের। বাঙালীদের দাবি মেনে নিলে উদ্দেশ্য ওদের ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং ওদের পথ একটাই। বাঙালীর তো এমনিতেই ওদের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে কেন্দ্রে সরকার গঠন করার সুযোগ পেলে। সেটা তারা হতে দেবে কেন? পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা তা চাইতে পারে না। ইয়াহিয়া তাদের পরামর্শেই শেষ চাল চালতে। যাচ্ছে। ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে চেষ্টা করবে ওরা বাঙালীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে। সেজন্যেই বলছি দেশের সামনে অকল্পনীয় বিপদ রয়েছে।’
কামাল প্রশ্ন করল, ফলাফল কি হবে বলে তুমি মনে করো, কুয়াশা?’
কুয়াশা কলল, “আমি পাঞ্জাবী সেনাদেরকে বিশ্বাস করতে পারি না। ওরা ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড বাধাবেই। এমন কোন হীন কাজ নেই যা ওদের দ্বারা সদ্য নয়। ব্যাপক গণহত্যা চালাবে ওরা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওরা ওদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। বাঙালী আজ জেগেছে। আমরা আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবই । মুক্তির জন্যে দরকার রক্ত দান। বাঙালীরা প্রস্তুত হয়েই আছে, কামাল। বাধা পেলেই রুখে দাঁড়াবে তারা। সাত তারিখের ভাষণে শৈখ সাহেবও সে কথা বলেছেন। তাই না? এবারের সংগ্রাম যে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম তাতে কোন ভুল নেই। তবে সংগ্রাম এক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রাম হতে বাধ্য। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কোন জাতির মুক্তি ঘটে না।
কামাল বলল, চিন্তার কথা। আমি এতদিন ভাবছিলাম আলোচনার মাধ্যমে, কুয়াশা ৩৪
একটা মীমাংসায় পৌঁছুনো যাবে। কিন্তু তোমার কথা শুনে বড় একটা ভরসা পাচ্ছি
।’
মৃদু হেসে দরজার দিকে তাকাল কুয়াশা। মহুয়া প্রবেশ করছে বৈঠকখানায়। পিছনে ট্রে হাতে দশাসই গফুর।
টেবিলে নাস্তার পেট এবং চায়ের কাপ সাজিয়ে দিয়ে স্বল্পবাক গফুর চলে যাচ্ছিল।
পিছু ডেকে কুয়াশা বলল, গফুর, ডি. কস্টাকে একটু ডেকে দাও তো। । কর্কশ গলায় গফুর জানাল, কস্টা সাহেব বাইরে গেছেন। ফিরলে ডেকে দেব।’
অন্দরমহলে চলে গেল গফুর।
চা পান শেষ হতেই বারান্দায় ত্রস্ত পদশব্দ শোনা গেল। দরজার দিকে মুখ তুলে তাকাল কুয়াশা।
মহুয়াকে কি যেন বলতে গিয়েও থমকে গেল কামাল। মেয়েলি পায়ের হালকা অথচ দ্রুও শব্দ এগিয়ে আসছে বারান্দা ধরে।
লীনার কলেজ-চলছে এখনও।’ হাতঘড়ি দেখে বলে উঠল মহুয়া; কে আসছে তাহলে?
মহুয়ার কথা শেষ হতেই বৈঠকখানার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল বিশ-বাইশ বছরের এক শ্যামলী যুবতী। দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
ওরা তিনজন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যুবতীর দিকে। একে একে পাঁচ-সাত সেকেন্ড কেটে গেল। কারও মুখে কোন কথা নেই। যুবতী উত্তেজিত । বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। ‘মি. শহীদ!
যুবতী কামরায় পা দিয়ে কুয়াশার দিকে এগিয়ে এল সরাসরি, আপনাকেই আমার দরকার। আপনি কি দয়া করে আমার সমস্যার কথাগুলো…।’
যুবতীর কথা শেষ হল না। কুয়াশা অপ্রতিভ বোধ করছে সামান্য। সে বলতে চাইল, “দেখুন, আমি…।’
কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল যুবতী। কুয়াশাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল, “দেখুন, আপনার ফী কত তা আমি জানি না। কিন্তু সে জন্যে চিন্তা করবেন না। আপনার প্রাপ্য আপনি পাবেন। কিন্তু সবচেয়ে আগে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন আপনি।
কামাল কথা বলে উঠল যুবতী দম নেবার জন্যে থামতেই।
শান্ত হোন মিস…’
যুবতী নিজের নাম এবং পরিচয় দিল, আমি মি. ইমাম তালুকদারের মেয়ে। রুমা তালুকদার। সাভারের তালুকদার কটেজের নাম শুনেছেন নিশ্চয়? ওটা
ভলিউম ১২
আমাদের।
কামাল বলে উঠল, ‘আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের সহকারী কামাল। আপনি আগে শান্ত হয়ে বসুন। তারপর ধীরেসুস্থে বলুন..।’
কুয়াশা একটা চুরুট ধরিয়ে তাকাল যুবতীর দিকে। মহুয়ার পাশে বসে পড়লা যুবতী ধপ করে। তারপর সরাসরি কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘প্রথমেই এভাবে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমি, মি. শহীদ।
কুয়াশী আবার চেষ্টা করল যুবতীর ভুল ভেঙে দেবার, দেখুন, আপনি ভুল…।’
আমি জানি আপনারা কিছু মনে করেননি। কেন না তেমন একটা বিপদে না পড়লে কেউ এভাবে কারও বাড়িতে ঢোকে না। যাকগে আমি অদ্ভুত একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি মি, শহীদ। আজ মাত্র তিনঘন্টা আগে চিঠিটা পেয়েছি আমি। সেই থেকে মুহূর্তের জন্যেও স্থির হতে পারছি না।’
কামাল বলল, আপনি বরং গোটা ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়ে প্রথম থেকে কলার চেষ্টা করুন।
যুবতী কিন্তু কামালের দিকে তাকাল না। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একটু ঘুরে আসি রান্না ঘর থেকে।
মহুয়া চলে যেতে যুবতী কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘গোড়া : থেকেই বলি আমি। আমাদের সাভারের বাড়িতে আমার বাবা গত তিন বছর ধরে একাই থাকেন। আমি বছর তিনেক ধরে ভার্সিটির হোস্টেলে থাকি। মাঝেমধ্যে …ছুটিতে যাই বাবার কাছে। পড়াশোনার চাপে পড়ে গত মাস দুয়েক যাওয়া হয়নি। তবে প্রতি মাসেই বাবা টাকা পাঠিয়ে দেন মানি অর্ডার করে। গত মাসেও পাঠিয়েছেন। মানি অর্ডার কর্মের সাথে দু’এক হত্র লেখেনও তিনি।
দম নেবার জন্যে থামল মিস তালুকদার। তারপর বলতে শুরু করল, ‘গাতমাসেও লিখেছিলেন বাবা। কিন্তু তাঁর লেখার কোথাও একথা জানাননি যে তিনি বিদেশে যাচ্ছেন বাবা আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ দেশ ত্যাগ করে ইউরোপে চলে যাবেন তা হতেই পারে না।’
যুবতী ঝুঁকে পড়ল কুয়াশার দিকে। বলতে লাগল, কিন্তু তাই হয়েছে। আজ বাবার চিঠি পেয়েছি। লন্ডন থেকে এসেছে চিঠিটা। লিখেছেন বিশেষ এক কারণে আমাকে না জানিয়েই লন্ডনে যেতে হয়েছে তাঁকে। ফিরে আসছেন আগামী বারো তারিখে। তার মানে আগামী পরশু দিন।’’
| কামাল বলল, আপনার সমস্যাটা কিন্তু ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।’
যুবতী কুয়াশার দিকে তাকিয়েই বলল, ‘বাবা আমাকে কোনদিন টাইপ করা চিঠি পাঠান না। নিজের হাতে লেখা চিঠিই তিনি পাঠান আমাকে। কিন্তু লন্ডন থেকে যে চিঠি আমি পেয়েছি সেটি টাইপ করা । সই অবশ্যি বাবারই। কিন্তু সইটা নকল
কুয়াশা ৩৪
হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে লন্ডন যাবার আগে বাড়ির চাকর এবং বাবুর্চীকে বিদায় করে দিয়েছেন তিনি। আমি যেন বাবুর্চী এবং একজন চাকরের ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিই বাড়িতে। যাতে বাড়ি ফিরে তাঁর খাওয়াদাওয়ার কোন অসুবিধে না হয়। এটাও অবিশ্বাস্য, মানে মেনে নিতে পারছি না আমি ঘটনাটা। যে বাবুটী এবং চাকরটি ছিল আমাদের বাড়িতে তার বহুদিনের পুরানো লোক। প্রায় দশ বছর ধরে তারা আছে আমাদের বাড়িতে। বাবা তাদেরকে বিদায় করে দিতে পারেন না। না, অসম্ভব। বাবা এত নিষ্ঠুর, এমন অবিবেচক আমি বিশ্বাস করতে রাজী নই।’
কুয়াশা প্রশ্ন করল, আপনার ধারণাটা তাহলে ঠিক কিরকম?’
আমার ধারণা কিছুই নয়। আমি আপনার সাহায্য চাই, মি. শহীদ। বড় গোলমেলে ঠেকছে গোটা ব্যাপারটা। কোথায় যেন একটা গভীর রহস্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না কেন? এক, টাইপ করা চিঠি। দুই; আমাকে না জানিয়ে বাবা লন্ডনে গেছেন। তিন, পুরানো চাকরবাকরকে বিদায় করে দিয়ে গেছেন। এতগুলো অসব ঘটনা ঘটতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন। রহস্য আছে।’
কুয়াশা বলল, আপনার কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি তো আগামী তিন দিন অপেক্ষা করে দেখলেই পারেন। আপনার বাবা ফিরলে তার সাথে দেখা করুন। আপনি।’
মিস তালুকদার বলে উঠল, সে কথাই ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু কেন যেন ভীষণ ভয় করছে আমার। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সেগুলো আমার কাছে এত বেশি বিস্ময়কর যে ভয় পাওয়া ছাড়া উপায় কি? এদিকে বাবার চিঠি পাবার পরই বাড়িতে ফোন করি আমি। সেক্রেটারির ফোন রার কথা। কিন্তু কেউ ধরেনি ফোন। সব্বত সেক্রেটারিও নেই বাড়িতে। এর কারণ কি? মি. শহীদ, ব্যাপারটাকে আপনি দয়া করে হালকা ভাবে দেখবেন না। আমি একটুতেই বিচলিত হবার মেয়ে নই। আমার মন বলছে কোন একটা বিপর্যয়, কোথাও না কোথাও ঘটে গেছে। আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, মি. শহীদ। প্লীজ!’
কামাল সাগ্রহে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, আমার একটি প্রশ্ন। আপনি সরাসরি পুলিসের কাছে না গিয়ে এখানে এলেন কেন?’
মিস তালুকদার বলল, ‘পুলিসের কাছে কেন যাইনি? দেখুন, ব্যাপারটা পারিবারিক। হয়ত দেখা যাবে উপযুক্ত কারণেই বাবা লন্ডনে গেছেন চাকর * বাকরদেরকে চিরতরে বিদায় করে দিয়ে। সেক্ষেত্রে পুলিস তাকে বিরক্ত করুক তা
আমি চাই না। বাবা বিরক্ত হবেন আমার ওপর।
কুয়াশা তাকাল কামালের দিকে।
১০
ভলিউম ১২
কামাল মাথা নাড়ল মৃদু। কুয়াশার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বলল, “বেশ, মিস তালুকদার। আমরা তদন্ত করব।
‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।’ যুবতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল সাথে সাথে।
প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তার পর মিস তালুকদার বিদায় নিয়ে চলে গেল।
যুবতী বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর কামাল কলল, “যাচ্ছি আমরা, কেমন, কুয়াশা? চলো, দেখে আসা যাক। শহীদকে তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে। ওর নাম ধারণ করো তুমি আর আমি, আমি তো অরিজিন্যাল।’
“উঁহু।’ | কুয়াশা বলল, তুমিও অরিজিন্যাল নও, আমিও নই। আমি যাচ্ছি হদ্মবেশে। তুমিও। |
“ওয়েট, ওয়েট! হামাকে হাড়িয়া কোঠায় যাওয়া হইটেছে, জানিটে পারি কি? দোরগোড়ায় উদয় হয়েছে ডি. কস্টা।
পরনে তার ঢোলা প্যান্ট। মাথায় হ্যাট। রোগা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল সে।
কুয়াশা বলল, এই যে ডি, কস্টা সাহেব, কোথায় ছিলেন আপনি?’
ইনভেস্টিগেশনে বাহির হইয়াছিলাম।’
ডি কস্টা গভীর ভাবটা ফিরিয়ে আনল চোখেমুখে। বলল, “ঠাক সে কঠা। কোঠায় যাইটেছেন আপনারা?’
কামাল বলল, একটা কেস পাওয়া গেছে। সেটার ব্যাপারেই যাচ্ছি আমরা।’ আপনারা কেন আবার যাইবেন?’
একটু যেন বিরক্ত হয়ে উঠল ডি. কস্টা। বলল, আমি ঠাকটে আপনারা আবার কেন নাক গলাবেন? এসব ব্যাপারে হামিই টো যঠেঠো! টা কেসটা কিরকম, টেল মি।
কুয়াশা বলল, আপনিও যাবেন আমাদের সাথে, ডি, কস্টা সাহেব। শুনুন, আপনার কাছে যে প্যাকেটটা দিয়েছিলাম, সেটা দিন তো।’
‘প্যাকেট!’ ডি, কস্টা হোঁচট খেল যেন।
কুয়াশা কথা না বলে তাকিয়ে রইল ডি, কস্টার দিকে। ডি. কস্টা পিট পিট করে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘প্যাকেটটা ফেলে এসেছি এক রেস্টুরেন্টে। ঠিক হ্যায়, এনে ডিচ্ছি এখুনি।
কথাগুলো বলে ডি, কস্টা বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। মহুয়া এসে ঢুকল কামরায়। ‘
কুয়াশা ৩৪
কামাল তাকিয়ে ছিল অপর দরজাটার দিকে। ও দেখল ডি কস্টা কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেও দরজার কাছ থেকে সরে যায়নি।
কামাল ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সেদিকে। কয়েক সেকেন্ড পরই দেখা গেল ডি, কস্টা উঁকি দিচ্ছে।
কামালের সাথে চোখাচোখি হতেই ডি কস্টা হাত ইশারায় ডাকল কামালকে। কাউকে কিছু না বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কামাল। বাইরে বেরিয়ে এসে কামাল জিজ্ঞেস করল, “কি হে, ডাকছ কেন হাত নেড়ে?
ডি কস্টার চোখ জোড়া ছানাবড়ার মত হয়ে উঠেছে। খুব যেন আশ্চর্য হয়ে। গেছে সে কোন কিছু দেখে। কামালের একটা হাত ধরে রেলিঙের ধারে টেনে আনল সে। উজ্জ্বল আকাশের দিকে আঙুল তু। ফিসফিস করে বলে উঠল, “ওই ডিকে টাকিয়ে ঠাকুন মি. কামাল। ডেখবেন, সসার উড়ছে।’
সসার? কি বলছ ভি, কস্টা তুমি?’ কামাল বেশ একটু অবিশ্বাসের সুরেই বলে। | ডি. কস্টা একটু রাগত স্বরেই বলে ওঠে, এ ডেশের লোককে নিয়া এই এক বিপড়। সায়েন্সকে অবিশ্বাস করে। ভাল করে টাকিয়ে ঠাকুন, ডেখটে পাবেন।’
কামাল উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্মল আকাশের কোথাও কিছু নেই।
এদিকে ডি. কস্টা নিজের কাজ সেরে ফেলেছে। কামালের পকেটে হাত গলিয়ে দিয়ে চুপিসারে বের করে নিয়েছে সে মানি ব্যাগটা ।
কামাল চোখ নামিয়ে দেখল ডি. কস্টা সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে যাচ্ছে। পিছন ফিরে তাকাল সে একবার দ্রুত। কামালের সাথে চোখাচোখি হতেই জোর গলায় বলল, ‘চিন্টার কিছু নেই। আমি ফিরে এসে ডোেব আপনাকে সসার।
আসাদ চৌধুরী শহীদের পুরানো বন্ধু। লন্ডনে ছিল বেশ কয়েক বছর। ঢাকায় ফিরে চিত্র প্রযোজনায় হাত দিয়েছে। কদিন আগে শহীদের বাড়িতে এসে দেখা করে গিয়েছিল সে। আজ ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল শহীদকে বিশেষ দরকার।
শহীদ ফিরল সন্ধ্যার পর। আসাদ চৌধুরীও এল ওর সাথে বাড়িতে। চা পানের পর আলোচনা প্রসঙ্গে শহীদ বলল, বুঝলে আসাদ, ছবি করার ইচ্ছা আমার কোন দিনই ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি আজও নেই তবে ছবি যদি কোন দিন করিই তাহলে কুয়াশার জীবনের বাস্তব ঘটনা নিয়ে ছবি করব।
| তাই করো না কেন।’
• আসাদ বলল, ‘কুয়াশা শুধু এদেশেই নয়, বিদেশেও একটি আশ্চর্য কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর জীবনের কোন ঘটনা নিয়ে ছবি করলে আমি হলপ করে বলতে পারি তা সুপার হিট হবে। কুয়াশার ভক্ত এবং শত্রু সবাই দেখবে সে ছবি।’
ভলিউম ১২
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে ছবি হচ্ছে আজকাল? ‘খুব কম।
আসাদ বলল, আমার ছোট ভাই করছে। শূটিং শুরু হবে সামনের সপ্তা থেকে। গোয়েন্দা কাহিনীই, তবে ভূতটুতও বোধহয় আছে। শূটিং দেখতে যাবে?
‘কোথয় হচ্ছে শূটিং?’
‘এখনও শুরু হয়নি। হলে জানাব। সাভারের তালুকদার বাড়িতে গেছ তুমি কখনও? ওখানেই শূটিং হবে।
সাভারের তালুকদার বাড়ি! ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। ওখানে ইমাম তালুকদার বাস করেন না?’
‘হ্যা! কেন, চেনো নাকি?’
“চিনি ঠিক বলা চলে না। তবে দেখেছি। একবার এক কুখ্যাত স্মাগলারকে তাড়া করেছিলাম মি, সিম্পসনকে সাহায্য করতে গিয়ে। আমার সন্দেহ হয়েছিল ওই জমিদার বাড়িতেই লুকিয়ে পড়েছিল লোকটা। মি. তালুকদারকে ডেকে কথাটা জানাই। কিন্তু তিনি আমাকে তার বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাবার অনুমতি দেননি।
তারপর?’
শহীদ বলে, আমি অবশ্যি বাড়াবাড়ি করিনি আর। কারণ পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না লোকটা সম্পর্কে। হয়ত তালুকদার বাড়িতে ঢোকেনি সে। তল্লাশি চালিয়ে তাকে বের করতে না পারলে অপমান। তাছাড়া মি. তালুকদার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং বৃদ্ধ মানুষ। তার সাথে তর্ক না করেই ফিরে এসেছিলাম। পরে অবশ্যি ওই জমিদার বাড়ি সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।
কি কি শুযে?’
শহীদ বলল, অলৌকিক সব ব্যাপার ঘটে নাকি ওখানে। অবিশ্বাস্য সব গুজব লোকমুখে শোনা যায়। তা মি. তালুকদার রাজী হয়েছেন শূটিং করতে দিতে? শুনেছিলাম বাড়ির ভিতর কাউকেই ঢুকতে দেন না।’
‘পয়সা দিলে দেয় নিশ্চয়।’
আসাদ বলল, আমার ছোট ভাইয়ের প্রযোজক নাকি দশ হাজার টাকা দিয়ে রাজী করিয়েছে।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ছোট ভাই…।’ ‘ও ছবিটা পরিচালনা করছে।
শহীদ বলল, তাহলে সুযোগটা হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। বাড়ির ভিতরটা একবার দেখে আসতে হবে।
আসাদ বলল, আমি তোমাকে খবর দেবো’বন।’ এরপর ওদের আলোচনা শুরু হল দেশের বর্তমান অনিশ্চিত অবস্থা সম্পর্কে।
কুয়াশা ৩৪
একে একে কেটে গেল তিন চার দিন। শহীদ কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিল সাভারের জমিদার বাড়িতে শূটিং দেখতে যাবার কথা। কিন্তু শহীদ ভুললে কি হবে, মনে করিয়ে দেবার লোক আচমকা উপস্থিত হল একদিন।
, সে আসাদ চৌধুরী নয়।’ লোকটিকে শহীদ চিনতে পারল না। সকাল বেলা সবেমাত্র বৈঠকখানায় এসে বসেছে শহীদ। গফুর এসে জানাল এক ভদ্রলোক দেখা করতে চায় তার সাথে । শহীদ নিয়ে আসতে বলল ভদ্রলোককে। | ভদ্রলোককে নিয়ে প্রবেশ করল গফুর কামরায়। চোখ তুলে ভদ্রলোককে দেখল, শহীদ। বলল, বসুন।’
ভদ্রলোক বসলেন। গফুর চলে যেতে শহীদ জিজ্ঞেস করল, “বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি?
ভদ্রলোক মাথা নিচু করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর মুখ তুলল।
বলল, আপনাকে কয়েকটি তথ্য দেব আমি। তথ্যগুলো কোথায় পেলাম তা জিজ্ঞেস করতে পারবেন না।’
শহীদ খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে ভদ্রলোকটিকে। ধূপদুরস্ত পোশাক। দামী সিগারেট টানহে। মাথার মাঝখানে চুল নেই। দামী সেন্ট মেখে এসেছেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক একটু ট্যারাও।
আপনার নামটা জানতে পারি কি? না।’ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, আপনার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারব না আমি। শহীদ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “বেশ, বলুন।’
ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়ে টেবিলের মাঝখানে পেঁয়া ছেড়ে বলল, সাভারের তালুকদার কর্টেজ চেনেন?’
‘চিনি। কেন বলুন তো?’
একটু অবাকই হয় শহীদ।
‘ওখানে হানা দিন । অনেক টাকার চোরাই সোনার গহনা এবং দামী হীরে পাবেন। চোখ কান খোলা রাখবেন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপও বেরিয়ে পড়তে পারে।’
মাত্র এই কটি কথা বলেই উঠে দাঁড়াল ভদ্রলোক। শহীদ কিছু বলবার আগেই দরজার দিকে পা বাড়াল সে।
শহীদ ডাকল, “শুনুন। | কিন্তু ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়াল না, থামলও না।
দরজার কাছে গিয়ে বাধা পেল ভদ্রলোক। শহীদ দেখল সিভিল ড্রেসে ওর পূর্ব পরিচিত ইন্সপেক্টর আজমল হুদা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোকের পথ
১৪।
ভলিউম ১২
আটকে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন হুদা, খবরদার! নড়বেন না, কুদুস সাহেব!
আজমল হুদার হাতের পিস্তলটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শহীদ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। বলল, ব্যাপার কি, দা সাহেব?’ হুদা সাহেব উত্তর দেবার আগেই, ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়াল। মৃদু হাসি তার ঠোঁটে। পরাজয়ের হাসি। বলল, “ব্যাপার
গুরুতর, মি. শহীদ। আমার কপাল খারাপ। ধরা পড়ে গেছি আমি।’
গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখিয়ে কুদ্স সাহেবকে গ্রেফতার করলো ইন্সপেক্টর। পকেট থেকে হাতকড়া বের করে পরিয়ে দিল একজন সেপাই। শহীদের উদ্দেশে বলল হুদা, ইনি হচ্ছেন কুদুস সাহেব। পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে চোরাই মাল কেনা বেচা করে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এর বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ আছে আমাদের হাতে । কিন্তু পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কদিন ধরেই ছায়ার মত ঘুরছি এর পিছনে। আজ একেবারে সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু, মি. শহীদ, আপনার কাছে কেন এসেছিলেন ইনি?’
কুন্দুস সাহেব বলে উঠল, ‘এক সমব্যবসায়ীর সর্বনাশ করতে গিয়ে আজ আমার এই অবস্থা। মি, শহীদ, দয়া করে আপনাকে আমি যা বলেছি ভুলে যান। পুলিসকে কথাটা জানাবেন না। আর আপনিও সেখানে যাবেন না।’
শহীদ হেসে ফেলল কুদ্স সাহেব্বে কথা শুনে। বলল, ‘ধরা পড়ে আপনার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, কুদ্দস সাহেব। ছুঁড়ে দেয়া ঢিল কি হাতে ফিরে আসে? বৃথা চেষ্টা করছে; আপনি।
দুই বন্ধু আসাদ চৌধুরীকে দিয়ে আগে থাকতেই সব ব্যবস্থা সেরে রেখেছিল শহীদ। আসাদ তার ছোট ভাই পরিচালক আহাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে শহীদের। হদ্মবেশে, ছদ্ম পেশায় পরিচিত হয়েছে শহীদ।
শহীদের নাম কায়েস আহমেদ। পেশায় সে সিনেরিপোর্টার।
যাত্রা শুরু হল আরও দুই দিন পর। প্রথম গাড়িতে চেপে বসল আহাদ এবং তার স্ত্রী মিসেস আহাদ। স্বামী-স্ত্রী বসল সামনের সীটে। ড্রাইভ করছে আহাদ। নিজেই। পিছনের সীটে প্রডিউসার মি. আকবর হোসেন এবং কায়েস আহমেদ, মানে
শহীদ।
পরিচালক আহাদ অল্প বয়েসী যুবক। ত্রিশ বহুর বয়সেই সে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। বর্তমান ছবিটা তার পরীক্ষামূলক। একটি ভৌতিক কাহিনীকে ভিত্তি করে লেখা উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে যাচ্ছে সে। মিসেস আহাদ অপূর্ব সুন্দরী । তেইশ চব্বিশ বছর বয়স। প্রডিউসার মি. আকবর হোসেন স্বাস্থ্যবান। পেশীবহুল দেহ । বড় মুখ। ছোট ছোট চুল মাথায়। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস। কুয়াশা ৩৪
পরিচালক এবং প্রযোজক-এ দুইয়ের সম্পর্ক সাধারণত আপসমূলক হয়ে থাকে। কিন্তু এদের দুজনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। ওরা দুজন সবসময় তর্ক করেন। একে অপরকে ব্যঙ্গ করে কথা বলেন। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। শহীদের কাছে একটু আশ্চর্যই ঠেকল। মনে মনে ধারণা করল ও যে নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন কারণ আছে। | গাড়ি ছুটে চলেছে। মি: আকবর হোসেন বলল যে-বাড়িতে যাচ্ছি সেটা নাকি ভূতুড়ে বাড়ি। ভৌতিক ছবি করতে গিয়ে আবার পৈত্রিক প্রাণটা না হারিয়ে ফেলি।
হেসে উঠল পরিচালক আহাদ। গাড়ি চালাতে চালাতে সে শহীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, মি. কায়েস। প্রডিউসাররা অবাস্তব কল্পনা করতে ওস্তাদ।’
| মি. আকবর যেন ঝকাল কণ্ঠে বলল, ‘মোটেই না। ওরকম ঘটনা ইউরোপে দু’একটা ঘটেছে। আমি প্রমাণ করে দিতে পারি।
কায়েস আহমেদ ওরফে শহীদ মৃদু হেসে বলল, আমি আপনাদের ব্যক্তিগত কলহে আগ্রহী নই। আমার অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে কি ভাবে একটি ছবি তোলা হয় তার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা।
পিছনের গাড়িতে ছবির নায়ক-নায়িকা। বাকি সবাই আসবে পরে। নায়ক স্বপন সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান। নায়িকা সুবিতা রূপবতী যুবতী।
গাড়ি চালাচ্ছে নায়ক স্বপন। নায়িকা রাস্তার দুই ধারের গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় বলল, স্বপন, কাজটা তুমি ভাল করছ না।
মানে? কোন্ কাজের কথা বলছ তুমি, সবিতা?” ‘জানো না কোন্ কাজের কথা বলছি?’
একটু বিরক্ত হয়ে উঠল স্বপন। বলল, কি ব্যাপার, আজ তুমি এমন হেঁয়ালিপনা করছ কেন আমার সাথে?
সবিতা সরাসরি তাকাল স্বপনের দিকে। বলল, মিসেস আহাদের সাথে তোমার সম্পর্কটা দিনে দিনে সিরিয়াস…।’
চুপ করো সবিতা।
স্বপন ধমকে ওঠে, বলে, যা জানো না সে সম্পর্কে কোন কথা বলা উচিত নয় * তোমার।
‘তোমাদের সম্পর্কটা খুব বেশিদিন গোপন থাকবে না, স্বপন আহাদ সাহেব জানতে পারলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বেন। যা রগচটা লোক!
‘ওর স্ত্রী আমার ছোট বোনের মত, সবিতা। কথাটা মনে রেখো । তোমার কাছ থেকে এ সম্বন্ধে আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না।’:
‘রাগে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা পথে বাইরের দিকে তাকাল সবিতা। কথা
ভলিউম ১২
বলল না।
তালুকদার কটেজের সামনে দাঁড়াল গাড়ি বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। একে একে নামল সবাই। প্রকাণ্ড গেট। বন্ধ। দোতলা বাড়ি। উঁচু দেয়াল দিয়ে বাড়ির গোটা চৌহদ্দী ঘেরা। পাঁচিলের চেহারা বিবর্ণ, চুনকালি খসে পড়েছে বহু বছর আগে। উঁচু পাচিলের জন্যে এক তলার কামরাগুলোর দরজা জানালা দৃষ্টিগোচর হল না। শহীদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল বাড়িটার হাল। উপরের কামরাগুলোর জানালা সব কটা বন্ধ। বিকেলের পড়ন্ত রোদ লেগে বাড়িটা এতটুকু উজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। বাড়ির ভিতর যে মানুষ বাস করে তা সহজে বিশ্বাস হয় না।
লোহার গেটের গায়ে বড় একটা লোহারই কড়া। কলিং বেল নেই। কড়া ধরে নাড়ল অনেকক্ষণ মি. আকবর হোসেন।
কিন্তু ভিতর থেকে কারও কোন সাড়াশব্দ এল না। | মিনিট দুয়েক পর বিরক্ত হয়ে আহাদ চৌধুরী বলে উঠল, যা হবার তাই হয়েছে এখানেও। জানি, শেষ অবধি একটা না একটা অসুবিধে দেখা দেবেই। আকবর সাহেব, আপনি আরও খোঁজ নেননি? আমার তো মনে হচ্ছে বাড়ির ভিতর কেউ নেই।’
শহীদ কয়েক পা পিছিয়ে এসে নায়ক স্বপন, নায়িকা সবিতা এবং মিসেস আহাদের কাছে দাঁড়াল। সবিতা বলে উঠল, “ওই যে, ওরা আবার তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিয়েছেন!
এমন সময় প্রকাণ্ড গেটটা খুলে যেতে শুরু করায় সবাই তাকাল সেদিকে।
গেটটা খুলে গেল অনেকটা। একজন লম্বা চওড়া লোক হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
| লোকটা যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। ময়লা পোশাক। চাকর বাকরই হবে। কিন্তু গোটা রাজাবাদশাদের মত বিরাট এবং মোম দিয়ে পাকানো। নাকের মাঝখানে
একটি গোল তিল। একটা আঁচিল ডান চোখের ঠিক উপরেই।
মি. আকবর হোসেন ব্যাখ্যা করে বলল তাদের এখানে উপস্থিত হবার কারণ। কিন্তু লোকটি বলল, আমার নাম সুরত আলী। এ বাড়ির চাকর, হুজুর। আপনাদের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’
| ‘অসম্ভব!
চিৎকার করে উঠল মি. আকবর হোসেন, তোমার মালিক মি. তালুকদারকে ডাকো। তিনি নিজে সই করেছেন চুক্তিপত্রে। দেড়মাসের জন্যে শূটিং করার অনুমতি দিয়েছেন তিনি!
সুরত আলী বলে উঠল, ‘বলেন কি, হুজুর! আমাদের মালিক সাধারণত কারও সাথে দেখাই করেন না। ঠিক আছে, মালিকের সাথেই কথা বলুন। ২-কুয়াশা ৩৪
লোকটা চলে গেল। শহীদ লক্ষ করল লোকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। বেশ একটু কুঁজোও সে । মিনিট পাঁচেক পর মি. তালুকদার গেটে এসে হাজির হলেন। শহীদ দেখল ভদ্রলোক আগের চেয়ে বেশি বুড়ো হয়েছেন। ধীরে ধীরে হাঁটেন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে! কথা বলেন আস্তে আস্তে। কালো সুট পরেছেন তিনি। কপালে ভাঁজ পড়েছে। বয়সের স্কুল ভজ মুখেও প্রকট হয়ে উঠেছে।
মি. তালুকদার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন, আমি দুঃখিত। গতকাল মাত্র বিদেশ থেকে এসেছি আমি। এসে দেখি আমার সেক্রেটারি তার অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। কিন্তু একটা চিঠি লিখেও তো সে রেখে যেতে পারত। হয়ত ভুলে গেছে।’
.মি. আকবর হোসেন তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু সে কি দশ হাজার টাকার চেকটিও আপনার জন্যে রেখে যেতে ভুলে গেছে!
দশ হাজার টাকার চেক!’
মি. তালুকদার সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিরাশায় ভেঙে পড়ে বলে উঠলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার। সে তো তাহলে ছুতো দেখিয়ে পালিয়েছে। ঠগ, বদমাশ, জোচ্চর, নেমকহারাম… |
| মি. আকবর বলে উঠলেন, এখন আমরা কি করব তাই বলুন।
মি. তালুকদার বললেন, “আমি কক্ষণো আপনাদেরকে এখানে আসার অনুমতি দিইনি। আমার জোর সেক্রেটারির কাজ এটা। আপনারা আমাকে বাধ্য করতে পারেন না ।’
এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে আবার সেই সুরত আলী এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। বলল, আপনাদের মধ্যে আহাদ চৌধুরী কে? তার ফোন এসেছে ঢাকা থেকে।’
. আহাদ শহীদের উদ্দেশ্যে বলল, কায়েস সাহেব, আসুন আমার সাথে। আর আকবর সাহেব, আপনি যেভাবে হোক একটা ব্যবস্থা করুন। ফিরে এসে যেন দেখতে পাই সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।’ | গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে পিছন ফিরে দেখল স্বপন, সবিতা এবং মিসেস আহাদ হাঙ্গামা থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে।
ফুটবল খেলার মাঠের মত উঠান বাড়িটার। উঠানের পর অস্বাভাবিক উঁচু বারান্দা। | বেশ প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার মেঝে চটে গেছে জায়গায় জায়গায়। কামরাগুলোর সব দরজাই বন্ধ। পাশাপাশি কামরা। দুটো পাশাপাশি কামরার এই অস্বাভাবিক সরু প্যাসেজ। দিনের বেলাতেও প্যাসেজগুলো বেশ অন্ধকার। আলো ১৮
ভলিউম ১২
বাতাস নেই। উপরে টিনের শেড বলেই সম্ভবত।
একটা প্যাসেজ ধরে সুরত আলীর পিছু পিছু এগিয়ে চলল ওরা। প্যাসেজের বা দিকে একটি মোড়। মোড় নিয়ে দশ-বারো হাত এগোবার পরই হলরুম।
বড় অদ্ভুতভাবে সাজানো রূমটা। লোহার মূর্তি বেশ কয়েকটা। যুদ্ধের পোশাক পরী । দেয়ালে দেয়ালে ঢাল-তলোয়ার ঝুলছে! ভোজালি, বর্মণ, বাঘের ছাল, আবক্ষ নারীমূর্তি এমনি সব হাজারো জিনিস। হলরূমের দেয়াল ঘেঁষে সিঁড়ি। প্যাসেজের দেয়ালের মতই সিঁড়ির পাশের দেয়ালটা ভিজে ভিজে। চুন-বালি ওঠা।
দোতলার বারান্দাটাও বেশ চওড়া। আলো বাতাস ঢোকার কোন ব্যবস্থা নেই । কললেই চলে। বারান্দার সর্ব দক্ষিণে মি, তালুকম্বারের বৈঠকখানা।
সুরত আলীর পিছু পিছু কামরাটার ভিতরে ঢুকল ওরা দুজন। ফোনটা এ কামরাতেই। | ফোন করেছে আহাদের সহকারী। শূটিঙের সাজসরঞ্জাম যোগাড় করে ঢাকা থেকে রওনা হতে ঘণ্টা দেড়েক দেরি হবে আরও। এই খটাই দেবার জন্যে ফোন করেছে সে। আহাদ রীতিমত ধমকে উঠল সহকারীকে। বলল, আজ রাতে শুটিং শুরু করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারে সবাইকে নিয়ে চলে এসো।’
| ফোনের কাজ সেরে নিচে নেমে এল ওরা। মি. আকবর হোসেন আহাদের। উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘সব ঠিক করে ফেলেছি। মি. তালুকদার লাইটেরও ব্যবস্থা করবেন কথা দিয়েছেন।’
মি. তালুকদার হাসিমুখে বললেন, ‘মাফ করবেন, আমাকে উপরতলায় যেতে হচ্ছে চাবি রে করার জন্যে। আপনাদের রামগুলো খুলে দিচ্ছি এখুনি আমি। দয়া করে নিচের তলায় বসুন কিছুক্ষণ। সুরত আলী একটি কামরা খুলে দেবে।’
শহীদ চিন্তা করে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছিল। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে গেছে। কিন্তু কি যে ঘটেছে তা বুঝতে পারছে না ও। তিন
একতলার মাঝামাঝি জায়গায় একটি কামরা পেল শহীদ। কামরাটার সামনে বারান্দা নয়, সরু একটা প্যাসেজ। প্রায় অন্ধকার। দরজা ছাড়া মোট চারটে জানালা। জানালাগুলো কামরার ভান এবং বাঁ দিকের দেয়ালে। জানালার পর সরু প্যাসেঞ্জ।
শহীদের কামরার আশপাশের কামরাগুলোয় কেউ থাকছে না। সেগুলো অপরিষ্কার, অব্যবহৃত। ‘কোনটার দরজা ভাঙা। কোনটা তালা মারা।
বাড়ির সামনের দিকে আহাদ এবং তার স্ত্রীর কারা। নায়ক নায়িকা থাকছে .. পাশাপাশি কামরায়, বাড়ির সর্ব পুবে। প্রডিউসার মি. আকবর হোসেন থাকছেন দোতলার একটি কামরায়।
নিচের তলায় আরও কয়েকটি কামরা খুলে দেয়া হয়েছে। কলাকুশলী, কুয়াশা ৩৪
১৯
ক্যামেরাম্যান থাকবে। সকলের ব্যবহারের জন্যে একটি বৈঠকখানাও পাওয়া গেছে। সেটিও আহাদ চৌধুরীর কামরার অদূরেই।
ইতিমধ্যে বাড়ির চাকরানীর মুখদর্শন করেছে শহীদ। বৈঠকখানায় ওরা সবাই যখন বসেছিল তখন সুরত আলীর সাথে সে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকেছিল কামরায়। | লম্বা, রোগা মেয়েলোক। আধহাত ঘোমটা, মুখটা সবটুকু ঢাকা পড়েছে। শাড়ী দিয়ে সবটুকু শরীর ঢাকা হলেও শহীদ মেয়েলোকটার পুরুষালী কাঠামো দেখে একটু
অবাকই হয়েছে।
সুরত আলী কথা প্রসঙ্গে জানাল যে পটলার মা বোবা।
সুরত আলী খানিক পরই সবাইকে যে-যার কামরায় পৌঁছে দিল। মি. তালুকদার সেই যে উপরতলায় গিয়ে উঠেছেন তারপর আর নামেননি। বেশ বোঝা যায়, ভদ্রলোক তেমন মিশুক নন। লোকজনের ভিড় পছন্দ করেন না তিনি।
বাক্স-পেটরা খুলে সংলগ্ন বাথরূমে ঢুকে শহীদ স্নান করে নিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে।
ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে কামরার ভিতর। কিন্তু কামরার ভিতরটা তেমন আলোকিত হয়ে ওঠেনি। দেয়ালগুলো বিবর্ণ। কামরাটা প্রকাণ্ড। চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব যথেষ্ট নয়।
| কাপড়-বদলে নিজের কামরায় তালা দিয়ে শহীদ বেরিয়ে পড়ল মি. আকবর হোসেনের উদ্দেশে। ইন্টারভিউ নেয়া দরকার ভদ্রলোকের। সরু প্যাসেজে আলো নেই। দূরবর্তী কোন বারান্দা বা কামরার ভিতর থেকে মৃদু আলোর আভা এসে পড়েছে প্যাসেজগুলোয়। সামনের দিকে চোখ রেখে বারান্দার দিকে এগোতে থাকে শহীদ।
• মোড় নিয়েই থমকে সঁড়ায় শহীদ। পিছিয়ে আসে ও। দুজনার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখল শহীদ।
| মিসেস আহাদকে জড়িয়ে ধরেছে প্যাসেজের সামনের মোড়ে মি. আকবর হোসেন। জায়গাটা প্রায় অন্ধকার হলেও ছায়ামূর্তি দুটোকে চিনতে পারে শহীদ ওদের কণ্ঠস্ক শুনে।
মিসেস আহাদ নিজেকে মুক্ত করার জন্যে ছটফট করছে। চাপা কণ্ঠে বারবার বলছে সে, ‘হেড়ে দিন কলহি, উহঃ, লাগছে আমাকে ছেড়ে দিন বলছি…!’
মি, আকবরের মৃদু হাসি শোনা যায়। তারপর তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ঠিক আছে, আজ তোমাকে রেহাই দিচ্ছি, সুরী! কিন্তু আর একটিদিন মাত্র ধৈর্য ধরব আমি। ঠাট্টা করছি না, মনে রেখো কথাটা।
মিসেস আহাদকে ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকার প্যাসেজে মি. আকবর।
ভলিউম ১২
শহীদ আড়াল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা ভাবছিল এমন সময় মিসেস আহাদের গলা শোনা যায়, কে?’
‘অামি, স্বপন।
শহীদ দেখে স্বপন অন্য এক প্যাসেজ থেকে মিসেস আহাদের সামনে এসে দাঁড়াল। কলল, কার সাথে কথা বলছিলে, লিলিদি?”
লিলি মিসেস আহাদের নাম।
কুকুরটা আজও আমাকে ধরেছিল, স্বপন।
কুকুরটা হুমকি দিয়েছে তোমার আমার সম্পর্ক ফাঁস করে দেবে বলে। আমি এখন কি করব বলো তো?
‘আহাদ ভাইকে বলা চলবে না। যা রগচটা আর সন্দেহ প্রবণ। তিনি হয়ত কুকুরটার কথাই বিশ্বাস করবেন•••। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।’
স্বপন মিসেস আহাদকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
শহীদ প্যাসেজ ধরে বারান্দায় আসে। বৈঠকখানায় কাউকে দেখতে না পেয়ে হলরুমের দিকে পা বাড়ায় ও।
| হলরুমে ঢুকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অকারণেই থমকে দাঁড়ায় শহীদ। অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগে মনে। কারা যেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এদিক ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখে শহীদ। ‘
| হলরুম নয়, যেন ছোটখাটো একটা মিউজিয়াম। চার কোণে চারটে লোহার মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর তিনটে ঝাড় বাতি। দেয়ালে দেয়ালে ঢাল, তলোয়ার, হোরা, গদা, মুগুর, বর্শা, ভোজালি, বাঘের ছাল, নর কঙ্কাল, আবক্ষ নারীমূর্তি।
| শহীদ যেন ভুলে যায় ওর গন্তব্যস্থল। সিঁড়ির দিকে না এগিয়ে পা বাড়ায় ও একটি লোহার সৈনিকমূর্তির দিকে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকানো সৈনিকমূর্তি। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে শহীদের দুটি চোখ। এক’পা এক’পা করে সৈনিকমূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।
লোহার সৈনিকমূর্তির চোখ জোড়া যেন জ্বলছে। যেন নড়ছে। ব্যাপার কি?
মাত্র তিন হাত সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শহীদ। মূর্তিটা যেন চোখের ইঙ্গিতে কি বলতে চাইছে। পলক পড়ে না শহীদের চোখে। একটু যেন নড়ে উঠল মূর্তিটা। ঝট করে মূর্তির হাত দুটোর দিকে তাকাল শহীদ। একটু যেন নড়ে উঠেছিল হাত দুটো। তাকাতেই থেমে গেল। মৃর্তির চোখ দুটো আকর্ষণ করছে শহীদকে প্রবলভাবে। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে শহীদ। তারপর অকস্মাৎ বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে সরে যায় ও।
মূর্তিটা এগিয়ে আসছে। না, ঠিক এগিয়ে আসছে না। ঢলে পড়ে যাচ্ছে শহীদের উপর।
কুয়াশা ৩৪
চোখের পলকে পাশের দেয়াল থেকে একটা লোহার ভারি মুগুর তুলে নিয়ে সজোরে মূর্তির ঘাড় লক্ষ্য করে আঘাত হানে শহীদ,
প্রচণ্ড শব্দ হয়। মূর্তির ধড় আর মৃৎ আলাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে।– নিষ্প্রাণ লৌহমূর্তি। কিন্তু শহীদ ভুল দেখেনি। বসে পড়ে ও মুণ্ডুটার পাশে। মুণ্ডুটা ধরবার জন্যে হাত বাড়াতে গিয়ে ঝট করে খোলা দরজার দিকে তাকায় ও।’ শ করে কে যেন সরে যায় দরজার কাছ থেকে।একলাফে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটতে শুরু করে শহীদ। ।
হলরুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে কাউকে দেখতে পায় না শহীদ। কে যেন পালাচ্ছে। পদশব্দ অনুসরণ করে আবার ছুটতে শুরু করে.ও।
বাতাসে মিলিয়ে যায় পদশব্দ। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে শহীদ। পালিয়ে গেছে।
লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল ওকে কেউ? কিন্তু কে লোকটা?
অন্যমনস্কভাবে হলরূমে ঢোকে শহীদ। মেঝের দিকে চোখ পড়তেই হ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। লৌহ-মূর্তির ধড় বা মুণ্ডু কেটাই নেই। [ বাকি তিনটে মূর্তি রূমের তিনকোনায় আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু
অন্যটি কোথাও নেই। | ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে শহীদ। হরূমের দেয়ালগুলো দ্রুত পরীক্ষা করতে
শুরু করে ও।
মিনিট দশেক পর ব্যর্থ হয়ে কপালের ঘাম মোছে শহীদ রুমাল বের করে। কে” গোপন পথ পায়নি ও দেয়ালে।
সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে আসে এবার শহীদ। মি. আকবর হোসেনের কামরাটা দোতলার পিছন দিকে। সেদিকে না গিয়ে মি. তালুকদারের কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ও.!
‘কে?’
শহীদ খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই স্বল্পালোকিত কামরা থেকে মি. তালুকদারের গলা শোনা যায়।
‘আমি কায়েস আহমেদ। শহীদ বলে।
‘ভিতরে আসুন। আমি জানতাম আপনারা কেউ না কেউ আসবেন। সেজন্যেই দরজা খুলে অপেক্ষা করছি।
শহীদ, কেমন যেন ইতস্তত করে একটু। কামরার ভিতর বৈদ্যুতিক আলোর বদলে একটি টেবিলের উপর মিট মিট করে জ্বলছে একটি কেরোসিন ল্যাম্প। ল্যাম্পের মাথায় শেড পরানো। টেবিলের ওধারে বসে আছেন মি. তালুকদার।
| গা ছমছম করে ওঠে শহীদের। মৃদু শব্দে খুক করে কাশে একবার। একপা একপা করে টেবিলটার সামনে গিয়ে ও দাঁড়ায়। কাছেই একটা বিড়াল ডেকে ওঠে
ভলিউম ১১
মাও!
বসুন!’
মি, তালুকদার যেন ব্যঙ্গ করে উচ্চারণ করলেন শব্দটা শহীদ হাতলহীন চেয়ারটায় বসল। টেবিলের উপর স্ট্যান্ডে একটি ডানা মেলা বাজ পাখির বিরাট পাথমূর্তি।
একটু আগের ঘটনাটা ধীরে ধীরে বলে যায় শহীদ। মি. তালুকদার সব কথা * বললেন, ‘এরকম যে ঘটবে তা আমি জানতাম। আপনাদের এ বাড়িতে আসা মোটেই উচিত হয়নি।’
‘কে?’ প্রশ্ন করে শহীদ। শান্ত হয়ে উঠেছে ও ইতিমধ্যে। মি. তালুকদার হঠাৎ কার উদ্দেশ্যে যেন বলে ওঠেন, আয়, মিনি, আয়।’’
বৃদ্ধের কথা শেষ হতেই কুচকুচে একটি কালো বিড়াল অন্ধকার মেঝে থেকে লাফ দিয়ে টেবিলের মাঝখানে উঠে পড়ে।..
শহীদের দিকে জ্বলন্ত একজোড়া চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বিড়ালটি ।
শহীদ ঢোঁক গেলে। এমন কালো বিড়াল বড় একটা দেখা যায় না; লেজ নাড়ার ভঙ্গিটিও অদ্ভুত। যেন আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে জানোয়ারটা । | বাড়িটা অতৃপ্ত আত্মাদের দখলে চলে গেছে। বড় ভয়ঙ্কর ওরা। আমাকে এবং আমার দু’একজন চাকর চাকরানীকে ছাড়া আর কাউকে পছন্দ করে না! হায় খোদা, না জানি কি আছে আপনাদের কপালে!
শহীদ বলে, আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে এই সব ব্যাপার বিশ্বাস করেন, মি. তালুকায়?’
বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। যা সত্যি তাকে অস্বীকার করব কি করে? আপনি কি বলেন? যা দেখেছেন তার ব্যাখ্যা করতে পারবেন? | শহীদ কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে রাখল। খানিক পর বলল,
আমি জানি না।’
সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি, মি. কায়েস।’ মি, তালার চাপা কণ্ঠে বললেন, একটু ঝুঁকে পড়লেন তিনি টেবিলের দিকে, এখনও কোন বিপদ ঘটেনি। চলে যান, সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যান ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যরি আগেই। ওরা হয়ত দ্বিতীয়বার সাবধান করে নাও দিতে পারে।’
কাদের কথা বলছেন আপনি?’ শহীদ একটু জোর গতেই প্রশ্ন করে।
‘অতৃপ্ত আত্মাদের কথা বলছি আমি।’ ফিসফিস করে উচ্চারণ করেন মি, তালুকদার।, কালো বিড়ালটার জ্বলন্ত দুই চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থেকে উঠে কুয়াশা ৩৪
দাঁড়ায় শহীদ সিধে হয়ে। বলে, আমি ওসব বিশ্বাস করি না, মি, তালুকদার। আপনারও বিশ্বাস করা উচিত নয়। যাকগে, আমি চললাম।’
বেরিয়ে আসে শহীদ রহস্যময় ভদ্রলোকের কামরা থেকে।
চার, সিঁড়ি বেয়ে হলরুমে নেমে খানিকক্ষণ অকারণেই দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই, শব্দ নেই। আলোছায়ার মধ্যে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পর কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল শহীদের । বাতাস দরকার। হলরুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ ধরে এগোতে এগোতে কার যেন গলা শোনা গেল। পরিচিত গলা। সন্দেহ হলো। কিন্তু কান পেতে পরিষ্কারভাবে শোনার অবসর পেল না শহীদ। মোড় নিতেই ও দেখতে পেল পটলার মা’কে।
পটলার, মা হন হন করে চলে যাচ্ছে। মেয়েলোকটা নাকি বোবা। কিন্তু কথা বলছিল কে তবে?
পটলার মা পিছন ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হল। শহীদ হাত দেখিয়ে থামতে নির্দেশ দিল।
• দাঁড়িয়ে পড়ল পটলার মা। ঘোমটাটা গলা অবধি টেনে দিয়ে প্যাসেজের দেয়াল ঘেঁষে পঁড়াল। শহীদ পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কার সাথে কথা বলছিলে তুমি, পটলার মা?’
পটলার মা নিরুত্তর। শহীদ এবার অন্যভাবে প্রশ্ন করল, কে কথা বলছিল তোমার সাথে?
পটলার মা শহীদের দিকে না তাকিয়েই অবোধ স্বরে গাইগুই করে কি যেন বলল। কিছুই বুঝতে পারল না শহীদ। বিরক্ত হয়ে ও বলল, ‘পথ ছাড়ো।’
পটলার মা পথ থেকে সরে দাঁড়াল। পাশ কাটিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেল শহীদ। বারান্দায় এসে শহীদ কিন্তু দেখতে পেল না কাউকেই।
শহীদ অদৃশ্য হয়ে যেতে প্যাসেজের দেয়। দুই ফাঁক হয়ে গেল ধীরে ধীরে। বেশ খানিকটা ফাঁক হতে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল পটলার মার সামনে, একটি ছায়ামূর্তি। ..
ছায়ামূর্তি বৃদ্ধ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছে যেন সে। পটলর মা’কে সে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে?
জানি না।’ | ছায়ামূর্তি বৃদ্ধ বলল, যা বলছিলাম। তোমার ফ্রেন্ডকে বলো যে বাড়ির আশপাশের কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি আমি। আমার ধারণা লাশটা পাওয়া যাবে বাড়ির পিছনের বাগানে। আজ রাতেই আমরা খোঁজ করব ওখানে। কেমন?
পটলার মা কোমর থেকে একটা দেশি সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে
ভলিউম ১২
মাথা নেড়ে জানাল ঠিক আছে।
বাড়ির উত্তর দিকের একটি কামরায় শুটিঙের প্রস্তুতি চলছে। আহাদ চৌধুরী শহীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ক্যামেরাম্যানের।
ক্যামেরাম্যান এবং তার একজন সহকারী খানিক আগে এসে পৌঁছেছে।
শহীদ লৌহ-মূর্তির ঘটনাটা বলতে চাইল আহাদকে। আহাদ মৃদু হেসে বলে উঠল, “ওসব কথা এখন নাই বা শোনালেন, মি. কায়েস। এমনিতেই জীবিত মানুষদের আত্মা আমাকে যথেষ্ট কষ্ট দিচ্ছে। এরপর মৃতদের আত্মা যদি মাথায় এসে চাপে তাহলে মারা পড়ব নির্ঘাৎ।’
| শহীদ বলল, আপনি আমার কথা বুঝি বিশ্বাস করতে পারছেন না?’
সুইচ টিপে আলোর তেজ পরীক্ষা করতে করতে আহাদ বলল, ‘একশোবার বিশ্বাস করি। কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য কোন বিষয়ে মাথা ঘামানো আমার পক্ষে অসব।’
মিসেস আহাদ কামরায় ঢুকে বলে উঠলেন, ‘ওর মাথা এখন গরম হয়ে আছে, মি, কায়েস। চলুন, আমরা স্বপনের কামরায় যাই।
শহীদকে নিয়ে মিসেস আহাদ বেরিয়ে এল।
স্বপনের কামরায় স্বপনকে পাওয়া গেল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনের বারান্দায় চলে এল ওরা। হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছিল ওরা। হঠাৎ মিসেস আহাদ বলল, আমাদের কামরাটা কেমন যেন।’ ‘
‘কেমন যেন মানে?’ জিজ্ঞেস করল শহীদ।
‘তিনটে দরজা। তারমধ্যে দুটোই বন্ধ। বন্ধ দরজা দুটোর ওদিকে বোধহয় আরও কামব্রা আহে। খুটখাট করে শব্দ হচ্ছিল। ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি। ‘
‘খুলে দেখলেই পারতেন।
দূর, কি না কি আছে। বাড়িটাই যেন কেমন। তাই না? শহীদ অন্যমনস্কভাবে বলল, হ্যাঁ।’
এমন সময় উত্তেজিত গলা শোনা গেল। মিসেস আহাদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, স্বপনের গলা না?’
বাড়ির পুবদিক থেকে আসছে কলহের শব্দ। ওরা সেদিকেই এগোল।
বারান্দা ধরে এগিয়ে মোড় নিতেই একটি কম পাওয়ারের বাবের নিচে শহীদ দেখল স্বপন এবং মি. আকবর হোসেনকে।
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে স্বপন। মি. আকবরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই কোমরে দুই হাত দিয়ে রাগে কাঁপছে সে। বলছে, আপনি নিজেকে যত চালাকই মনে করুন, কোন লাভ হবে না তাতে।
কুয়াশা ৩৪
=
=
মুখ সামলে কথা বলো, স্বপন। তা না হলে পস্তাবে তুমি।’ বলে উঠল মি. আকবর।
স্বপন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আজ আপনাকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু আর কোন দিন যদি শুনি যে লিলিদিকে ব্ল্যাকমেলিং করে কুৎসিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছেন তাহলে…তাহলে…।’
‘স্বপনগর্জে উঠলেন মি. আকবর, আর একটি কথা বলে দেখো, খুন করে ফেলব তোমাকে…।’
স্বপন আচমকা মি. আকবরের শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকানি দিল। কিন্তু সময় মত ওদের দুজনার মধ্যে গিয়ে পড়ল শহীদ।
| জোর করে ছাড়িয়ে দিল শহীদ ওদের দুজনকে। দুজনার আস্ফালন তবু কমল । শেষ অবধি শহীদ অনুরোধ করল মি. আকবরকে স্থান ত্যাগ করার জন্যে। মি. আকর গজরাতে গজরাতে চলে গেল।
এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল মিসেস আহাদ। এবার সে কাছে এসে দাঁড়াল। স্বপনের উদ্দেশে সে বলে উঠল, শয়তানটার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে যাওয়া উচিত হয়নি তোমার, স্বপন। ও হয়ত এবার তোমার দাদাকে গিয়ে সত্যমিথ্যে কত কি লাগাবে।’ | ‘তা যদি কিছু লাগায় তাহলে কুকুরটাকে আমি খুন করব।’ ফুঁসতে ফুঁসতে বলল
স্বপন।
শহীদ ওদের আলোচনায় ইচ্ছে করেই অংশগ্রহণ প্রল না। ওদেরকে পিছনে রেখে বৈঠকখানায় এসে বসল ও।
একটা সিগারেট ধরিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ল শহীদ।
ডিনারের পর নিজের রূমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার গভীরভাবে মগ্ন হয়ে পড়ল শহীদ। মেইন রোডে ঘরঘর ট্রাকের শব্দ। মিলিটারি ভ্যান যাতায়াত করছে। দেশের অবস্থা মোড় নিচ্ছে খারাপের দিকে। • *
ওরা সবাই বৈঠকখানায় বসেই ডিনার সেরেছে। শহীদ লক্ষ করেছে সবাই কেমন যেন থমকে গেছে এ-বাড়িতে ঢোকার চার-পাঁচ ঘণ্টা পরই। কেউ অবশ্যি উল্লেখযোগ্য কিছু বলেনি। তবে বাড়িটার পরিবেশ ভাল লাগহে না একথা বলেছে কথা প্রসঙ্গে প্রায় সব্বাই।
সবচেয়ে কম কথা বলেছে মি, আকবর হোসেন। সেটা হয়ত অপনের সাথে অমন একটি অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটে যাবার ফলে। কিন্তু শহীদ যখন মি. আককে স্থান ত্যাগ করার অনুরোধ জানায় তখন সে এমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল স্বপনের দিকে যে শহীদ তা দেখে রীতিমত চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। মি. আকবরকে ইতিমধ্যেই
ভলিউম ১২
চিনে নিয়েছে শহীদ। লোকটার টাকা থাকলে কি হবে, নিতান্ত কুৎসিত স্বভাবের লোক। স্বপনের সাথে মিসেস আহাদের সম্পর্কটাকে সে অবৈধ বলে মনে করে। ওদের দুজনার মধ্যে কোন অবৈধ সম্পর্ক আছে কিনা শহীদ তা জানে না। থাকতেও পারে। হয়ত মি, আর কিছু দেখে থাকবে। যার ফলে সে-ও অবৈধ ভাবে মিসেস আহাদকে ব্ল্যাকমেইল করে উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার এবং জঘন্য। মিসেস আহাদকে ভোগ করতে চায় সে।
এদিকে স্বপনও রেগে আছে উন্মাদের মত। মুখ ফুটে খুন করার হুমকিও সে দিয়েছে। সেটা অবশ্যি কথার কথা।
নতুন একটি সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিতে গিয়ে চমকে উঠল শহীদ।
শহীদের সারা শরীরে কে যেন ঠাণ্ডা হিম স্পর্শ বুলিয়ে দিল। নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি নারী কন্ঠের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল শহীদ। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল শহীদ। সরু প্যাসেজ ধরে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে শহীদ দেখল বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কালো স্লিপিং গাউন পরে মি, তালুকদার। তার পায়ের সামনে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে একটি নারীমূর্তি। দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়াল শহীদ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও কয়েক সেকেণ্ড মি, তালুকদারের চোখ জোড়ার দিকে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের চোখ জোড়া যেন জ্বলছে। নিঃসাড় মেয়েটির দিকে তাকাল শহীদ। চিনতে অসুবিধে হল না মিসেস আহাদকে।
মিসেস আহাদের মাথার কাছে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন মি. তালুকদার। শহীদ জিজ্ঞেস করুন, আপনি কি ওকে আঘাত করেছেন?’
‘মোটেই না।’
মি. তালুকদার শান্ত, স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, আমি নিচে নেমে আপনাদের সুবিধে অসুবিধে দেখতে বৈঠকখানার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ ইনি দরজা খুলে আমার পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়লেন উচ্চৈস্বরে চিৎকার করতে করতে।
. ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল আহাদ চৌধুরী, মি. আকবর হোসেন, স্বপন এবং অন্যান্যরা।
শহীদ একে একে সকলের দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা সবাই কোথায় ছিলেন? এত দেরি করে এলেন কেন?
‘আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলল মি. আকবর।
‘আমরা গল্প করছিলাম সবিতার কামরায়। কিন্তু সাহস করে বেরোতে, রিছিলাম না বাইরে।’ বলল আহাদ চৌধুরী।
সবিতা বলল, ‘বাড়িটা ভূতুড়ে বাড়ি। এমনিতেই গা-ছমছম করে। কুয়াশা ৩৪
২৭
শহীদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মিসেস আহাদকে একটু ধরুন। বৈঠকখানায় নিয়ে চলুন ওকে।’
মিসেস আহাদকে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে সবাইকে বাইরে বের হয়ে যেতে অনুরোধ করল আহাদ চৌধুরী। কিন্তু শহীদ বলল, আপনি থাকুন।
চোখেমুখে জল ছিটাতেই জ্ঞান ফিরে এল মিসেস চৌধুরীর। আহাদ হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “লিলি? কি হয়েছিল? অমন চিৎকার করে উঠেছিলে কেন?
উঠে বসল মিসেস আহাদ। তার দুই চোখে আতঙ্ক। বলল, আমাদের কামরার ডান দিকের বন্ধ দরজার ওপারে কি আছে দেখার জন্যে দরজা যেই খুলেছি অমনি একটা নরকঙ্কাল দেখে চেঁচিয়ে ঠি আমি। কঙ্কালটা কামরার মাঝখানে ভাসছিল! নিজের চোখে দেখেছি আমি..না না, ভুল দেখিনি। চিৎকার করতে করতে আমাদের দরজাটা খুলে বারান্দায় বেরিয়েই দেখি কালো পোশাক পরা একজন লোক। সাথে সাথে পড়ে যাই আমি। তারপর..তারপর আমার আর কিছু মনে
নেই ।
| শহীদ বলল, আপনার কথা বিশ্বাস করি আমি। আপনি এখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন।’
শহীদ বলল, আপনার কথা বিশ্বাস করি আমি। আপনি এখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। | আহাদ শহীদের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি যা বলছিলেন তখন তা আমি, বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন দেখছি আপনিও ভুল দেখেননি। ব্যাপার কি, মি. কায়েস?”
শহীদ বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না। মি. তালুকদারের বদ্ধমূল ধারণা যে এ বাড়িতে অতৃপ্ত আত্মারা থাকে।
মিসেস আহাদ বলে ওঠে, এ-বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকব না আমি।’
শহীদ বন্ধ দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলে ওঠে, অধৈর্য হবেন না, মিসেস আহাদ। অতৃপ্ত আত্মা, ভূত এসব বিশ্বাস করা উচিত না। এর শেষ না দেখে আমরা যাব না।’
‘ আহাদ চৌধুরী সায় দেয়, বলে, “নিশ্চয়। লোকে যা বলবে আমরা তা এমনি | এমনি বিশ্বাস করব কেন!
বাইরে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। মিসেস আহাদ জ্ঞান ফিরে পেয়ে যা বলেছেন তা শুনে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সবাই। তবে একজন ছাড়া। মি, তালুকদার মোটেই বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, এমনটি যে হবে
তা আমি জানতাম।’
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল মি. তালুকদারের দিকে। শহীদ বলল, “মি. তালুকদার, আপনি আমার সাথে একবার আঁসবেন কি?’ |
ভলিউম ১২
মি, তালুকদারকে নিয়ে শহীদ আহাদ চৌধুরীর কামারায় প্রবেশ করল। মি, তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন, কি করতে চান আপনি?
: কামরার ডান দিকের বন্ধ দরজার দিকে পা বাড়িয়ে শহীদ বলে, এই দরজাটা খোলার পর মিসেস আহাদ একটি নরকঙ্কাল দেখেছেন। আমিও দেখতে চাই।’
লম্বা হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ মি. তালুকদার শহীদের কাঁধে একটি হাত রাখলেন। চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল শহীদ। মি. তালুকদার বললেন, সাবধান, মি, কায়েস। যা করতে যাচ্ছেন তাতে আমার কোন সমর্থন নেই। যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে আপনি একা দায়ী থাকবেন।’
| ‘কেন? কি আছে দরজার ওপাশের কামরায়? | কি আছে জানি না। তবে শুনেছি আমার এক পূর্ব পুরুষ তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে খুন করেছিলেন ওই কামরায়। তারপর থেকে ওটার ধারে-কাছে কেউ আসে
-বন্ধই পড়ে আছে।’
ননসেন্স!’ শহীদ বন্ধ দরজাটার গায়ে ধাক্কা মারে। কিন্তু শহীদের ধাক্কায় দরজা খোলে । হাতল ধরে ঘোরাতে গিয়েই চমকে ওঠে শহীদ।
দরজা বন্ধ বন্ধ করল কে?’ শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকায়।
হাৎ করে ওঠে বুকের ভিতরটা। ভোজবাজীর মত অদৃশ্য হয়ে গেছেন মি. তালুকদার। কামরার কোথাও নেই তিনি।
পাঁচ
ঘন্টাখানেক পর নিজের কামরায় ফিরে এল শহীদ। দরজা খুলে রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিল ও।
কামরায় ঢুকেই থমকে দাঁড়ায় শহীদ। লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে বিছানার তোষক, চাদর। টেবিলের ড্রয়ারগুলো টেনে বের করা। স্যুটকেস দুটো স্থানান্তরিত করা। হয়েছে।..
কেউ ঢুকেছিল কামরায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে দেখতে শহীদের চোখে চকচকে একটা ধাতব পদার্থ রা পড়ল। বিছানার উপর পড়ে রয়েছে জিনিসটা। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিয়ে দেখল জিনিসটা একটি কানের দুল। •
এ বাড়িতে তিনজন মাত্র মেয়ে আছে। মিসেস আহাদ এবং মিস সবিতার কথা– | বাদ দিলে থাকে মাত্র একজন। এ বাড়ির চাকরানী-কাম-রাঁধুনী পটলার মা।
পিতলের দুল। নিশ্চয়ই পটলার মার।
দুলটা হাতে নিয়ে দরজায় তালা মেরে বাইরে বেরিয়ে এল শহীদ। পটলার মা কুয়াশা ৩৪
থাকে বাড়ির পিছন দিককার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে।
প্রায় অন্ধকার প্যাসেজ ধরে বাড়ির পিছন দিকে চলে এল শহীদ। পটলার মার কারার সামনে এসে দাঁড়াল ও।
কিন্তু দরজা বাইরে থেকে খিল দেয়া।
এত রাতে কোথায় গেছে পটলার মা? ভাবতে ভাবতে দূরের শব্দ কানে শুনতে | পায় শহীদ। ডানদিক থেকে মাটি কোপাবার শব্দ হচ্ছে যেন।
দ্রুত পা বাড়িয়ে এগিয়ে চলে শহীদ। কিন্তু শব্দের উৎসস্থল আবিষ্কার করার আগেই থেমে যায় শব্দ। শহীদ পিছন দিককার বারান্দায় এসে অন্ধকারে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুম্ বুম দুটো বোমা ফাটল ঢাকায়।
বারান্দার নিচে থেকে শুরু বিরাট বাগান। অন্ধকারে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। শহীদ কান পেতে থাকে। কিন্তু বাগানে কারোই নড়াচড়ার শব্দ নেই।
বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়ায় শহীদ। ঠিক পিছনেই সুরত আলীর কণ্ঠস্বর শুনে। সুরত আলী? এখানে কি করছ তুমি? শহীদ জিজ্ঞেস করে কঠিন গলায়। কিছু করছি না, হুজুর।
সুরত আলী কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়, আপনাকে এদিকে আসতে দেখে পিছন পিছন এলাম।
বলো কি! কারা মাটি খোড়ে।
শহীদ তাকিয়ে রইল প্রকাণ্ড চেহারার লোকটার দিকে। বাগানে মাটি কোপাবার শব্দ হচ্ছিল। শুনেছ তুমি?
‘নোজই শুনি, হুজুর।’
বলো কি! কারা মাটি খোড়ে। সুরত আলী চাপা গলায় বলে, জানি না, হুজুর। * ‘মি. তালুকদার কথাটা জানেন?
প্রত আলী বলে, জানেন বৈকি। তিনি বলেন এ বাড়িতে অনেক কিছু আছে। আমরা যেন মাথা না ঘামাই।’ | শহীদ গম্ভীর ভাবে শুধু বলে, হু। আচ্ছা, পটলার মা’র কামরা বাইরে থেকে বন্ধ কেন? এত রাতে কোথায় গেছে সে?’
সুরত আলী বলে, পটলার মা তো হুজুর ভাইপো’র বাড়ি বেড়াতে গেছে। ফিরবে কাল সকালে। ‘
শহীদ আর কিছু বলে না। ‘
রাতটা নিরুপদ্রবেই কেটে গেল। সকালে স্নান সেরে বৈঠকখানায় নাস্তা সারে ওরা সবাই। রাতে মিসেস আহাদ ও মিস সবিতা এক কামরায় শুয়েছিল। আহাদ চৌধুরী নিজের কামরায় রাত কাটিয়েছেন একাই।’
৩০
ভলিউম ১২
. সারাটা দিন কেটে গেল উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ব্যতিরেকেই। দেশের অবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। কাজে মন নেই। সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় মিলিত হল শহীদ ক্যামেরাম্যানের সাথে। ক্যামেরাম্যান ইকবালের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে সানন্দে সম্মতি দিল সে।
সাক্ষাৎকার নেয়া শেষ হতেই ট্রে হাতে করে বৈঠকখানায় ঢুকল সুরত আলী। শহীদ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পটলার মা আজ সকালে ফিরেছে, সুরত আলী?’
“জ্বী, হুজুর।’
কই, সারাদিন তো দেখলাম না এদিকে কোথাও?’
‘মেয়েছেলেটা বড় লজ্জাটে, হুজুর। পুরুষদের সামনে বের হতে চায় না। রান্নাঘরেই ছিল সারাদিন।
শহীদ প্রসঙ্গটা ত্যাগ করে। ইকবাল চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোন পত্রিকার রিপোর্টার মি. কায়েস?’
শহীদ বলে, সাপ্তাহিক হালচালের। দারুণ কাটতি পত্রিকাটির। মন্তব্য করে ইকবাল।
এমন সময় বৈঠকখানায় প্রবেশ করল আহাদ। শহীদ জিজ্ঞেস করে, মিসেস আহাদ এখন কেমন, আহাদ সাহেব?’
‘ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না এখনও।’ চিন্তিতভাবে বলে আহাদ। | ইন-ল জিজ্ঞেস করে, এখনও কি তিনি নরকঙ্কালের ব্যাপারটা সত্যি দেখেছেন বল মনে করছেন?
শহীদ বলে ওঠে, মনে করার কিছু নেই। মিসেস আহাদ সত্যিই নরকঙ্কাল দেখেছেন। আমার বিশ্বাস কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল।’
ইকবাল বলল, সত্যি কথা বলতে কি বাড়িটাকে মোটেই ভাল লাগছে না আমার।’
আহাদ বলে উঠল, ‘এসব কথা বাড়ো, ইকবাল। আমরা এখানে এসেছি হবি তুলতে•••।’,
আহাদ চৌধুরীর কথা শেষ হল না। রক্ত হিম করা একটা আর্তনাদ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল।
লাফ মেরে বৈঠকখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল শহীদ।
শহীদের পিহু পিছু ইকবাল এবং আহাদও বেরিয়ে এল। বারান্দার দুটো পাশাপাশি সরার দরজা খুলে গেল পরমুহূর্তে। স্বপন এবং মিস সবিতা বেরিয়ে এল। চোখে প উত্তেজনার চিহ্ন সকলের।
শহীদ বলে উঠল, “চিৎকারটা উপ্রতলা থেকে এসেছে। সিঁড়ির দিকে ছুটল শহীদ। ওকে অনুসরণ করল সবাই।
কুয়াশা ৩৪
উপরতলায় উঠে শহীদ দেখল হাঁ-হাঁ করছে মি. আকবর হোসেনের কামরার দরজা। ভিতরটা অন্ধকার।
খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় ডাকল শহীদ, ‘মি. আকবর। কেউ সাড়া দিল না কামরার ভিতর থেকে।
অন্ধকার কামরার ভিতর প্রবেশ করল শহীদ। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে বাতি জ্বালল। ‘
আলোকিত কামরায় মি, আকবর হোসেনকে দেখা গেল না। পরস্পরের দিকে তাকাতে তাকাতে কামরায় প্রবেশ করল অন্যান্যরা। শহীদ বাথরূমের খোেলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
খোলা দরজার সামনে গিয়ে সঁড়াল শহীদ। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াল ও। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল মিস সবিতা। শহীদ পথ আগলে ধরল, যাবেন না। ওদিকে যাবেন না আপনি।
শহীদের মুখটা অস্বাভাবিক গভীর দেখাচ্ছে। এক মুহূর্তেই ঘেমে উঠেছে ও। ইতিমধ্যে বাথরূমের খোলা দরজার সামনে পুরুষেরা ভিড় করে এগিয়ে এসেছে। পথ ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল শহী।
বাথটাবে ওটা কাব কঙ্কাল! প্রায় চিৎকার করে উঠল আহাদ চৌধুরী।
বাথরুমের ভিতর ঢুকে পড়ল ক্যামেরাম্যান ইকবাল। সে কাঁপা গলায় বলে উঠল, এ কিসের গন্ধ! এযে অ্যাসিড! আকবর সাহেবের বাথটাবে অ্যাসিড! তবে কি কঙ্কালটা…।’ ‘ | . | শহীদের গভীর কণ্ঠস্বর শুনে সবাই চমকে উঠে তাকাল তার দিকে। শহীদ বলে উঠল, হ্যাঁ। ওটা মি. আকবর হোসেনেরই কঙ্কাল। সোনা বাঁধানো দাঁতটা দেখেই চেনা যাচ্ছে। অ্যাসিডে পুড়ে গিয়ে ওই কঙ্কালসার অবস্থা হয়েছে ভদ্রলোকের। | বাথরূমের দরজার কাছ থেকে নিঃশব্দে সরে এল সবাই। কয়েকটি মুহূর্ত চরম অস্বস্তির মধ্যে কাটল। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবাই তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। নীরবতা ভাঙল আহাদ চৌধুরী, ‘একি অবিশ্বাস্য ঘটনা। কে ওকে খুন করল?”
ইকবাল জোর দিয়ে বলল, ‘খুনী নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যেই কেউ হবে।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, এই অ্যাসিড কোথা থেকে আসতে পারে? কেউ ধারণা করতে পারেন?
| জবাব দিল না কেউ।
শহীদ সকলকে নিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিতে
ভলিউম ১২
|
দিতে বলল, তালা কেউ খুলবেন না। আমি পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছি।
সুরত আলী বলল, ফোন করবেন তো, আসুন হুজুর আমার সাথে।
মি. তালুকদারের সবার কামরায় ভদ্রলোককে দেখা গেল না। শহীদ জিজ্ঞেস করতে সুরত আলী লল, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
রিসিভার তুলে ডায়াল করতে গিয়ে শহীদ দেখল ফোন খারাপ। কেউ হয়ত তার কেটে দিয়েছে।
শহীদ রিসিভার নামিয়ে রেখে সুরত আলীর দিকে তাকাল। বলল, “এ বাড়ি সম্পর্কে কি জানো তুমি, সুরত আলী? সত্যিই কি অতৃপ্ত অশরীরী আত্মারা…।’
• বাধা দিয়ে সুরত আলী বলল, কিছুই বুঝতে পারি না, হুজুর। মাত্র পাঁচ হয়। দিন আগে এখানে এসেছি। তালুকদার সাহেবের মেয়ে আমাকে চাকরি দিয়ে পাঠিয়েছেন এখানে। আমি আমার দু’দিন পর তালুকদার সাহেব বিদেশ থেকে পৌঁছেছেন।
শহীদ বলল, কিন্তু তার আগে নিশ্চয়ই চাকরবাকর ছিল। তারা কোথায় গেল?
‘ছিল, হুজুর। কিন্তু তালুকদার সাহেব বিদেশে যাবার আগে সবাইকে বিদায় করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
শহীদ সুরত আলীকে সাথে নিয়ে মি, তালুকদারের শোবার ঘরের সামনে এসে। দাঁড়াল।
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ভদ্রলোকের ঘুম ভাঙল।
দরজা খুলে বিরক্ত কণ্ঠে তিনি সুরত আলীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘এ কিরকম ব্যবহার শুরু করেছ, সুরত আলী? বলেছি না, যত বড় বিপদই ঘটুক, ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না আমাকে।
শহীদ কোন ভূমিকা না করে যা ঘটেছে তা বলে গেল শান্ত ভাবে।
মি, তালুকদারের মধ্যে বিশেষ কোন পরিবর্তন লক্ষ করুল না শহীদ। বড় আজব মানুষ। সব শুনে তিক্ত কণ্ঠে শুধু বললেন, বলিনি আমি? সাবধান করে দিইনি আপনাদেরকে? দেখলেন তো, কী ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়লেন আপনারা!
শহীদ বুঝতে পারল এই আধা-পাগলা বুড়োর সাথে কথা বলা বৃথা। ও শুধু কলল, আপনি কিন্তু ভুলেও ভাববেন না যে আমরা অতৃপ্ত আত্মা বা ভূত প্রেতের কথা বিশ্বাস করব। পুলিস আসুক, তখন দেখা যাবে অতৃপ্ত আত্মার বদলে অন্য কেউ বের
হয় কিনা!
কথাগুলো বলে শহীদ দাঁড়াল না। নিচে নেমে এসে সকলকে ডেকে জড়ো করল ও বৈঠকখানায়।
স্বপন বলল, আমার কামরায় আমি একা ছিলাম। কিন্তু কামরায় যে ছিলাম তা কেউ দেখেনি। তাই বলে সন্দেহের মধ্যে নিশ্চয়ই পড়ি না আমি।’
শহীদ ভারি গলায় বলে উঠল, “আপনারা সবাই সন্দেহের আওতায় পড়েন। ৩-কুয়াশা ৩৪
সত্যি কথা বলতে কি, মি. আকবর হোসেনকে আপনারা কেউই পছন্দ করতেন না। কেউ কেউ প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন তাকে।
তিক্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল আহাদ চৌধুরী, আমি জানতাম মি. কায়েস, আপনি একজন সাংবাদিক। এখন মনে হচ্ছে শার্লক হোমস হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন!
ইকবাল বলে উঠল, ‘আচ্ছা, দেখা যাক ঘটনাটা ঘটার আগে আমরা কে কোথায় ছিলাম।’
শহীদ বলল, “বেশ। সুরত আলী আপনি এবং আমি ছিলাম বৈঠকখানায়। অনেকক্ষণ আগে থেকেই আমরা তিনজন ছিলাম এখানে।
বিরক্ত কণ্ঠে আহাদ বলে উঠল, আমিও ছিলাম আপনাদের সঙ্গে। ভুলে গেলেন এরিমধ্যে?’
শহীদ বলল, না, ভুলিনি। কিন্তু চিৎকারটা শোনার দু’এক মুহূর্ত আগে মাত্র এখানে এসে পৌঁছেছিলেন আপনি। জানতে পারি কি কোথা থেকে এসেছিলেন?
অবশ্যই আকাকে খুন করে!
রেগে উঠল আহাদ। বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল সে। ইকবাল বলে উঠল, ‘এসব আলোচনায় লাভ কি? নিশ্চয়ই আকর সাহেব খুন হয়েছেন আমরা চিৎকার শোনার অনেক আগে। চিৎকারটা করেছে ধুনী, আমাদেরকে বোকা বানানর জন্যে।
শহীদ বলল, ঠিক বলেছেন। সুরত আলী, আমার সাথে এসো তো।’
সুরত আলীকে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল শহীদ। বলল, ‘তুমি গাড়ি চালাতে জানো নিশ্চয়?
মি. তালুকদারের গাড়ি তো আমিই চালাই, হুজুর।’ বাইরে প্রবল বাতাস। ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শহীদ বলল, আমাদের কারও গাড়ি নিয়ে সোজা থানায় চলে যাও তুমি।’
বড় দুর্যোগের রাত, থানা থেকে কি আসবে কেউ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে সংগ্রাম কমিটির লোকেরা কিন্তু ঠিক আছে, হুজুর, আমি যাচ্ছি’
| শহীদ বারান্দা থেকে মিসেস আহাদের কামরায় এল সোজা। অসুস্থ বলে সে কামরা থেকে বের হয়নি। চিৎকারটা সে-ও শুনেছে। কিন্তু এখন অবধি কেউ তাকে কারণটা জানায়নি। শহীদও জানাল না। ‘
প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলল, “মি. আকর ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। অন্য কোন ব্যাপার নয়। আমার কি ধারণা জানেন? আপনাকে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ভয় দেখাতে চেয়েছিল।
“নিশ্চয়ই।’বলল মিসেস আহাদ, কঙ্কালটা কালো রঙে রঙ করা ছিল। শূটিঙের জন্যে ওই ধরনের কঙ্কাল আনা হয়েছে গাড়ি করে।’
শহীদ বলল, “তাই নাকি!’ | মিসেস আহাদ মাথার নিচে আর একটি বালিশ দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু কে
ভলিউম ১২
‘৩৪
আমাকে অমন করে ভয় দেখাতে চাইবে? কেন?’
শহীদ বলল, আপনি বন্ধ দরজা খুলেছিলেন। সে সময় হয়ত ওই কামরায় কেউ ছিল। আমি খোঁজ করে দেখব কে ছিল তখন ওই কারায়। কি করছিল সে ওখানে।
শহীদ বেরিয়ে গেল মিসেস আহাদের কাম্রা থেকে।
সাত উপর তলায় বিশেষ কেউ নেই। সুরত আলী মি, তালুকদারের নির্দেশে এক কাপ কফি দিয়ে গেছে বেশ খানিক আগে তার বসার ঘরে।
মিটমিট করে জ্বলছে টেবিলের উপর কেরোসিন ল্যাম্পটা। আলোর চেয়ে অন্ধকারই যেন সৃষ্টি করছে ল্যাম্পটী।
| খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন মি. তালুকদার। উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে তাকে।
এমন সময় দোরগোড়ায় একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল। কালো একটি চাদরে গা মুড়ে এসেছে ছায়ামূর্তি। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে বসে?’
‘আমি। ভিতরে আসুন।
টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল হায়ামূর্তি। কালো বিড়ালটা টেবিলের মাঝখানে, বাজপাখির ডানার নিচে বসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আহে ছায়ামূর্তির দিকে।
মি, তালুকদার রাগত অথচ নিচু গলায় বলে উঠলেন, ‘বোকামির চরম করেছেন! অতিরিক্ত চমক দেখাতে গিয়ে সর্বনাশ করে ফেলেছেন আপনি! খানিক পরই পুলিস, আসবে বাড়িতে!
ছায়ামূর্তির গলায় ব্যঙ্গ, ভয়ের কিছু নেই।
‘নেই। বোকার মত কথা বলবেন না! আমি আপনার সাহায্য চেয়েছিলাম কোন ব্যাপারে? ভয় দেখিয়ে সব লোককে এ-বাড়ি থেকে ভাগাবার প্যান ছিল আমার। তার বদলে আপনি পুলিস আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যেটা আমি মোটেই চাই
।’
“তাতে কি? ছায়ামূর্তি বলল, আমাকে কেউ সন্দেহ করবে না, বন্ধু।
হায়ামূর্তি ঝট করে কালো চাদরের ভিতর থেকে পিস্তল ধরা’ ডান হাতটা বের করল। পিস্তলের নল মি. তালুকদারের বুক বরাবর ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার লাশ যখন দেখবে তখন সবাই ভাববে শেষ পর্যন্ত তুমি আত্মহত্যা করে। যুক্তিসঙ্গতই ভাবে সেটা সবাই।’
না!
করুণ আর্তি ফুটে উঠল মি, তালুকদারের কণ্ঠে, “আমাকে মারবেন না। যা কুয়াশা ৩৪
৩৫
।
চাইবেন আপনি সব দেব…।
‘এই আমার জবাব! সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলের ট্রিগার টিপে ধরল ছায়ামূর্তি।
বুকে গুলি খেয়ে টু-শব্দটি করার শক্তিও রইল না মি. তালুকদারের। ঢলে পড়লেন তিনি চির অন্ধকারের কোলে।
শহীদ মিসেস আহাদের কামরা থেকে বেরিয়েই দেখতে পায় সুরত আলী মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা প্যাসেজে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। বারান্দায়। সুরত আলী এরিমধ্যে থানায় গেল এবং ফিরে এল?
অসম্ভ! গ্যারেজের দিকে পা বাড়াল শহীদ। গাড়ি নিয়ে সত্যিই সুরত আলী বাইরে গিয়েছিল কিনা দেখা দরকার।
উঠানে নেমে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে চলল শহীদ। গ্যারেজের বড় টিনের দরজাটা খোলাই দেখা গেল। ভিতরে ঢুকে দেশলাইয়ের কাঠি থেকে সুইচবোর্ডটা দেখে নিল শহীদ।
গেটের পাশেই সুইচবোর্ড।
সুইচ অন করে আলো জ্বেলে প্রথম গাড়িটার সামনের বনেটে হাত দিয়ে শহীদ দেখল ইঞ্জিন ঠাণ্ডা বরফ।
| দ্বিতীয় গাড়ির সামনের বনেটে হাত রেখেছে শহীদ। এমন সময় কোথাও কিছু নেই। নিভে গেল বাতি।
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল গ্যারেজ। চমকে উঠে গ্যারেজের গেটের দিকে তাকাল শহীদ। গেটের সামনে আবহুভাবে কে যেন নড়ছে।
| লুকোবার চেষ্টা করে লাভ নেই কায়েস। আমার হাতে ইনফ্রা রেড ল্যাম্প এবং চোখে স্পেশাল চশমা আছে। তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না কিন্তু তোমাকে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
ইচ্ছে করেই কণ্ঠস্বর বিকৃত করে নিয়েছে ছায়ামূর্তি-বুঝতে পারল শহীদ।
আবছা অন্ধকারে হায়ামূর্তিকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল শহীদ। ছায়ামূর্তির কথা শেষ হতেই বিদ্যুৎবেগে লাফিয়ে পড়ল সে তার ঘাড়ে।
সশব্দে পড়ে গেল শহীদ ছায়ামূর্তিকে নিয়ে। কিন্তু দ্রুত উঠে বসতে গিয়ে প্রচণ্ড এক ঘুসি খেল চোয়ালে। ছিটকে পড়ল শহীদ দেয়ালের গায়ে। সেখান থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই সবুট একটা লাথি এসে লাগল ওর পেটে। ‘
পেটে হাত দিয়ে রেখেছিল বলে লাথিটা মারাত্মকভাবে কাবু করতে পারল না শহীদকে। দ্বিতীয় লাথির জন্যে তৈরি হয়ে গেল ও।
. এল দ্বিতীয় লাথি।
সজোরে জড়িয়ে ধরল শহীদ ছায়ামূর্তির পাটা। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে
ভলিউম ১২
গেল ছায়ামূর্তি। শহীদ বুঝতে পারল পড়ে গিয়ে উপুড় হয়ে গেছে লোকটা।
লোকটার পা ছেড়ে দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল শহীদ। কিন্তু পা’টা ছেড়ে । দিতেই পা ছুঁড়ে মারল ছায়ামূর্তি শহীদকে লক্ষ্য করে শুয়ে শুয়েই।
| শহীদ গড়িয়ে সরে গেল খানিকটা। দ্রুত শব্দ কানে ঢুকল। উঠে বসল শহীদ। পেটটা ব্যথা করছে তীব্রভাবে।
টিনের গেটে শব্দ হল। ছায়ামূর্তি পালিয়ে যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়িয়ে পেট চেপে ধরে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করল শহীদ।
ছায়ামূর্তি পালিয়ে গেছে। গ্যারেজের বাতি জ্বলল শহীদ এক মুহূর্ত পরই। মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি টর্চ এবং একটি চশমা। চশমার একটি কাঁচ ভেঙ্গে উড়িয়ে গেছে।
| গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠে এল শহীদ। সুরত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার! কোথায় পাওয়া যাবে তাকে।
প্যাসেজ ধরে যেতে দেখেছিল শহীদ সুরত আলীকে। সম্ভবত হলরূম হয়ে উপর তলায় উঠে গেছে সে।
সিঁড়ির দিকে পা বাড়ল শহীদ।
উপর তলায় উঠেই শহীদ দেখে ফেলল সুরত আলীকে। সুরত আলী মি, তালুকদারের কামরার কী-হোলে চাবি ঢুকিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করছে।
কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল শহীদ, এবনে কেন তুমি, সুরত আলী?’
মি. তালুকদারের কামরার ভিতর কেমন যেন একটা শব্দ হয়েছে হুজুর। তাই নিচে থেকে উঠে এসে তালা খুলতে যাচ্ছিলাম। সুরত আলী কী-হোল থেকে চাবি
রে করে নিয়ে শহীদের দিকে ফিরে কথাগুলো বলল।
‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে! পুলিসে খবর দিয়েছ?
সুরত আলী এতটুকু ইতস্তত না করেই বলে উঠল, জ্বী, হুজুর। পুলিস এসে পৌঁছবে খানিক পরই।’ | শহীদ কঠিন গলায় বলে উঠল, মিথ্যুক কোথাকার! চালাকি করার জায়গা পাওনি? তোমার আসল পরিচয় কি বলো! নিশ্চয়ই তুমি এ-বাড়ির চাকর নও।
সুরত আলীর চোখ জোড়া যেন সতর্ক হয়ে উঠল। পরমুহূর্তে হাসল সে। বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন, মি. কায়েস। আমি চাকর নই। আমি একজন ডিটেকটিভের হয়ে কাজ করছি।’
‘ডিটেকটিভ?’
শহীদ আকাশ থেকে পড়ল। বলল, তোমার…আপনার কথার প্রমাণ কি? | সুরত আলী বলল, “বিখ্যাত ডিটেকটিভ শহীদ খানের নাম শুনেছেন নিশ্চয়? আমি সেই শহীদ খানের বন্ধু। কুয়াশা ৩৪.
• ৩৭
অবাক হয়ে গেল শহীদ। শহীদ খানের বন্ধু।’
সুরত আলী তার বিরাট গোঁফ, লম্বা জুলফি এবং খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ। এগুলো নকল। ছদ্মবেশ নিয়ে আমি আছি এখানে।
কারণ?
প্রচণ্ড রবে হেসে ওঠার প্রবল স্পৃহাটাকে কোন রকমে দমন করে প্রশ্ন করে শহীদ। আশ্চর্য, এতক্ষণ চিনতেই পারেনি শহীদ কুয়াশাকে। হঠাৎ চিনে ফেলল । কুয়াশার ছদ্মবেশ সত্যিই নিখুঁত। তার নিজের ছদ্মবেশেও কোন খুঁত নেই। তার প্রমাণ কুয়াশাও শহীদকে চিনতে পারেনি এখনও।
কুয়াশা বলল, ‘গোড়া থেকে বললে কারণটা বুঝতে পারবেন। শহীদ খানের বাড়িতে মি, তালুকদারের মেয়ে হাজির হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। তার। সন্দেহ হয়েছে মি, তালুকদার মারা গেছেন, মানে নিহত হয়েছেন। মাসখানেক আগে মি, তালুকদার বিদেশে চলে যান। কিন্তু মেয়েকে তিনি বিদেশযাত্রা সম্পর্কে কিছুই বলেন না। মেয়েকে এত ভালবাসেন মি. তালুকদার, অথচ মেয়েকে না জানিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারেন তা অবিশ্বাস্য। তার মেয়ে থাকে হোস্টেলে। বাবা যে বিদেশে গেছেন, তা সে জানতই না। হঠাৎ বিদেশ থেকে তার বাবার চিঠি আসে। চিঠিটা ইংরেজিতে টাইপ করা। চিঠিতে মি, তালুকদার কোন কারণ দেখাননি। কেন তিনি তার মেয়েকে না জানিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। চিঠিতে শুধু লেখা ছিল যে মি. * তালুকদার অমুক তারিখে দেশে ফিরবেন এবং বাড়ির দেখাশোনা এবং রান্নাবান্না করার জন্যে চাকর-চাকরানী দরকার। চাকর-চাকরানীর ব্যবস্থা যেন মেয়ে করে রাখে। চিঠি পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে মি, তালুকদারের মেয়ে। প্রথমত, তার বাবা তাকে কখনও ইংরেজিতে চিঠি লেখেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি টাইপ করতে জানেন
। তৃতীয়ত, খবর না দিয়ে কেন বিদেশে গেছেন এসম্পর্কে কোন কথাই চিঠিতে নেই। যাই হোক, মেয়েটি পরামর্শের জন্যে শহীদ খানের কাছে আসে। শহীদ বাসায় ছিল না বলে কামালের অনুরোধে আমি আসল ব্যাপার কি জানার জন্যে এখানে
এসেছি।’
শহীদ প্রশ্ন করল, ‘ইতিমধ্যে কতটুকু কি জানতে পেরেছেন?
কুয়াশা বলল, মি. তালুকদারকে খুন করা হয়েছে প্রায় মাস দেড়েক আগে। গতরাতে কামাল এবং স্যানন ডি কস্টা তার লাশ আবিষ্কার করেছে এ-বাড়ির পিছনের বাগান থেকে।’ | শহীদ চমকে উঠে বলে, তাহলে আমরা যাকে মি. তালুকদার হিসেবে দেখছি
বর্তমানে ইনি কে?
‘ইনি প্রকৃত মি, তালুকদারের সেক্রেটারি কাসেম বাট।’
কুয়াশা বলল, আমার ধারণা কাসেম বাটই খুন করেছে মি. তালুকদারকে। খুন
৩৮
ভলিউম ১২
করে ফেলে পুরানো চাকরবাকরদেরকে বলে যে মি, তালুকদার বিদেশে চলে : গেছেন। সেই সাথে তাদেরকে বিদায় করে দেয়। তারপর স্বয়ং বিদেশে গিয়ে
পাস্টিক সার্জারির বদৌলতে নিজের চেহারা পাল্টে মি, তালুকদারের রূপ নিয়ে ফিরে এসেছে আবার। ফেরার আগে মি. তালুকদারের মেয়েকে চিঠি পাঠিয়েছিল।’
শহীদ বলল, আপনার সহযোগিতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার কাছে । আমার সত্য পরিচয় দিতে দ্বিধা নেই। আমিও এখানে ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছি। ওই যে
প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খারে নাম বলেছিলেন? আমিই সেই শহীদ খান।
কথাগুলো বলে কুয়াশার, বিস্মিত চোখের সামনে শহীদ ওর নকল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি খুলে ফেলে আবার তা যথাস্থানে লাগিয়ে রাখে।
এমন সময় অপর একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায় বারান্দায়, ‘ওয়ান্ডারফুল! কেহ কারে নাহি চেনে সমানে সমান?
মোটা একটি থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে থুরথুরে এক বৃদ্ধ। কুয়াশা এবং শহীদের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। বলে, আর আমি হচ্ছি বিখ্যাত শখের গোয়েন্দা শহীদ খানের সুযোগ্য সহকারী। আমার নাম শ্রীযুক্ত কামাল আহমেদ।
শহীদ হেসে ফেলে। কুয়াশা জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু তুমি এখানে কেন, শহীদ?
সংক্ষেপে বলল শহীদ ওর এখানে আসার কারণ। সব শুনে কামাল বলল, তার মনে, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কাসেম বাটের শত্রু হচ্ছে কুন্দুস সাহেব, যে তোমাকে এখানে আসতে বলেছিল। কুদুস নিজে চোরাই সোনার গহনা এবং হিরের কারবারী, কাসেম বাটও নিশ্চয়ই তাই। কাসেম বাটকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল সে।
কুয়াশা বলে, কাসেম বাট অনেক দিন থেকেই চোরাই হিরে এবং গহনা কেনাবেচার ব্যবসা করছে এখানে থেকে।’
শহীদ বলে, “হ্যাঁ। এবং মি. তালুকদার হয়ত জেনে ফেলেন ব্যাপারটা। ফলে কাসেম বাট মি. তালুকদারকে খুন করে নিজেই তালুকদার সেজে বসে। কিন্তু কাসেম বাট মি, আকবর হোসেনকে খুন করল কেন? দাঁড়াও, বুঝতে পেরেছি আমি…।’
‘কেন খুন করেছে?’ জিজ্ঞেস করে কামাল।
শহীদ বলে, কাসেম বাট জানত না আমরা ছবি তোলার জন্যে এখানে আসছি। কারণ মি. আকবর হোসেন তার সাথে কোন কথাবার্তা বলেনি। তার কথা হয়েছিল স্বয়ং প্রকৃত মি. তালুকদারের সাথে। সুতরাং আমরা আসছি তা কাসেম বাটের না জানারই কথা। তাই আমাদেরকে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিতে চায়নি সে। কিন্তু আকর হোসেন কথা বলেছিল প্রকৃত মি, তালুকদারের সাথে। তাই সে বুঝতে পারে কোথাও বড় ধ্বনের একটা গোলমাল আছে। গোলমালটা বুঝতে পেরেই সে কাসেম বাটকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে।
কুয়াশা বলে ওঠে, “চমৎকার। তোমার ব্যাখ্যা যুক্তি সঙ্গত। কুয়াশা ৩৪
‘যা ভাবছি ঠিক তাই।’
শহীদ বলে আবার, ‘মি, আকবর হোসেন যে চরিত্রের লোক তাতে বড় অঙ্কের লাভ দেখে অপরাধ করে বসা তার পক্ষে খুবই সব। ওরা দু’জন, মি. আকবর এবং কাসেম বাট, একা ছিল আমরা যখন আহাদ চৌধুরীর সহকারীর ফোন ধরতে বাড়ির ভিতর ঢুকেছিলাম। ফোন সেরে যখন ফিরে এলাম তখন দেখা গেল সব গোলমাল মিটে গেছে। অথচ অত সহজ ছিল না গোলমালটা।
কুয়াশা বলল, মোটিভ পাচ্ছি দুটো খুনেরই। কাসেম বাট মি. তালুকদারকে খুন করেছে তিনি ওর অবৈধ ব্যবসার কথা জেনে ফেলেছিলেন বলে এবং মি. আকবরকে খুন করেছে ব্ল্যাকমেইলিং থেকে রেহাই পাবার জন্যে। কামাল, তুমি বাড়ির বাইরে থাকো। কাসেম বাট ইতিমধ্যেই হয়ত সন্দেহ করেছে কিছু। পালাবার চেষ্টা করতে পারে শয়তানটা। শহীদ, এসো।
কুয়াশা নকল মি. তালুকদার ওরফে কাসেম বাটের কামরার দরজার তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল।
কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় কামরার ভিতরকার সব জিনিস ভাল দেখা যাচ্ছে । কুয়াশা সুইচ অন করে বৈদ্যুতিক আলোয় ভরে দিল গোটা কামরাটা।
চেয়ারের উপর বসে আছে কাসেম বাট। নুয়ে পড়েছে মাথাটা বুকের কাছে। বুকের বাঁ দিকে ছোট একটা ছিদ্র। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে ইতিমধ্যে।
শহীদ কাসেম বাটের গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠল, খুব বেশিক্ষণ আগে মরেনি।’ “আত্মহত্যা, শহীদ?
কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে শহীদ বলল, না। আত্মহত্যা নয়। প্রকৃত খুনীর সাথে খানিক আগে গ্যারেজে আমার ধস্তাধস্তি হয়ে গেছে। চোখে মুখে সদ্যক্ষতের চিহ্ন থাকবেই। কাসেম বাটের মুখে তেমন কোন দাগ নেই। কুয়াশা?’
বলো।’
শহীদ বলল, তুমি দেখো এখানে আর কি পাও। একটু পরই ফিরে আসছি আমি।’ বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল শহীদ কাসেম বাটের কামরা থেকে।
আট বিদ্যুৎ চমকের মত একটা সন্দেহ খেলে গেছে শহীদের মনে। ভয়ঙ্কর সন্দেহ। কল্পনাতীত।
কঙ্কালটা আর একবার দেখতে চায় শহীদ। মি. আকবর হোসেনের কঙ্কাল।
মি, আকবর হোসেনের কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে শহীদ।
আলোকিত কামরা। আলো জ্বালাই ছিল। টেবিলের উপর থেকে একটা টর্চ
ভলিউম ১২
৪০
তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় শহীদ।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শহীদ বাথটাবটা দেখতে পায়। বাথটাব আছে। কিন্তু বাথটাবে কঙ্কালটা নেই।
মুচকি হাসি ফোটে শহীদের ঠোঁটে। মি. আকবর হোসেনের কঙ্কাল নেই। বন্ধ কাদার ভিতর থেকে কোথায় যেতে পারে কঙ্কালটা?
সন্দেহটা আগেই জেগেছিল শহীদের মনে। খুব একটা আশ্চর্য হয়নি ও! কিন্তু কঙ্কালটা চুরি হয়ে গেল কোন পথে?
বাথরূমের মেঝে পরীক্ষা করতে শুরু করল শহীদ। অস্পষ্ট একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেল ও অদ্ভুত এক জায়গায়।
বাথরূমের একদিকের দেয়াল থেকে মাত্র দুই ইঞ্চি এদিকে পায়ের ছাপ। দেয়ালের দিকে মুখ পায়ের আঙ্গুলের। দেয়ালের এত সামনে কেউ কি দাঁড়ায়?
গোপন পথ আছে। মনে মনে অনুমান করল শহীদ। দেয়ালের গায়ে হাত বুলাতে শুরু করল ও। কি যেন ঠেকল হাতে। দেখল শহীদ। একটি অতিক্ষুদ্র বোতাম।
বোতামটায় চাপ দিতেই দেয়ালটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করল।
গুপ্ত পথ। হাত দেড়েক ফাঁক হতেই শহীদ পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালল। ফাঁকটার ওধারে অন্ধকার সিঁড়ি।
কালবিলম্ব না করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল শহীদ। .. সিঁড়ি বেয়ে বেশ বড় একটি কামরায় নেমে এল শহীদ। ভাঙা। অব্যবহৃত আসবাবে ঠাসা কামরাটা। কামরায় মোট দুটো দরজা। একটি বন্ধ। অন্যটি খোলা। খোলা দরজার ওপারে আরও একটি কামরা। সেটাও অন্ধকার।
দ্বিতীয় কামরাটির দিকে না গিয়ে শহীদ আসবাবপত্রগুলোর দিকে টর্চের আলো ফেলে কি যেন খুঁজতে শুরু করল।
একটা টেবিলের উপর টর্চের আলো পড়তেই শহীদ দেখতে পেল বরিক তুলোর একটা বান্ডিল। ছেঁড়া তুলোও রয়েছে খানিকটা। রক্তের দাগ দেখতে পেল সে। ডেটলের শিশিটাও চোখে পড়ল।
চশমার কাঁচ ভেঙে যাওয়ায় লোকটা নিশ্চয়ই জখম হয়েছে। পালিয়ে যেতে পারেনি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে। ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই আছে। কিন্তু কোথায়? বন্ধ দরজাটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। কী-হোলে চোখ রেখে দেখল পাশের কামরায় আহাদ চৌধুরী ঘুমুচ্ছে। তার মানে শহীদ যে কামরায় রয়েছে, এই কামরাতেই মিসেস আহাদ নরকঙ্কাল দেখেছিল। | আহাদ চৌধুরীকে ডেকে এ কামরায় আসতে বলবে কিনা ভাবছিল শহীদ। এমন সময় অপ্রত্যাশিত পদশব্দ শোনা গেল পিছনে।
বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। চমকে উঠে পকেটে হাত ঢোকাতে উদ্যত হল কুয়াশা ৩৪
E
একটি নরকঙ্কাল এক এক করে দু’পা এগিয়ে এল। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। শহীদ দেখল কঙ্কালটার দাঁত নেই। শূটিঙের প্রয়োজনে চাবি দেয়া কঙ্কাল। এ কঙ্কালকে হটাতে পারা যায়।
কামরার ভিতরকার আসবাবপত্রগুলো যেন সশব্দে নড়ে উঠল। ঘাড় ফোতে গিয়েই বাধা পেল শহীদ।
কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ এল, পকেট থেকে খালি হাত বের করো, মি. কায়েস। তা না হলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।’
ধীরে ধীরে পকেট থেকে খালি হাতটা বের করল শহীদ। সেই সাথে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমাকে নিরস্ত্র পেয়ে কোন লাভ হবে না তোমার। তুমি ব্রা পড়ে গেছ।
তাই নাকি!’। | শহীদের পিছন থেকে পিস্তলধারী লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল, তুমি তা হলে জানো আমি কে?
শহীদ কামরার সম্মুখবর্তী দেয়ালে টর্চের আলো ধরে রেখেছে। ও বলে উঠল, হ্যাঁ। আমি যদি তোমার কৌশল দেখে দিশেহারা হয়ে না পড়তাম তাহলে অনেক আগেই চিনতে পারতাম তোমাকে। কৌশলগুলো খুব সুন্দর হয়েছে তোমার চিৎকারটা, বাথটাবে কঙ্কাল, তোমার নকল দাঁতগুলো সুদ্ধ। অদ্ভুত। তোমার চালে
আমরা সবাই মাত হয়েছিলাম!’
শহীদ দম নিয়ে পিছন দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল আবার, কিন্তু তুমি উত্তেজনা এবং অস্থিরতাবশত বিরাট একটা ভুল করেছ। কাসেম বাটকে খুন করা তোমার সবেচেয়ে বড় ভুল। এর ফলে বেশ কয়েক বছর জেলে কাটাতে হবে তোমাকে। ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে।’
না। জেল বা ফাঁসি আমার কপালে নেই, মি. কায়েস। কেন জানো? আমাকে কেউ ধরতে পারছে না। তোমাকে আমি খুন করতে যাচ্ছি, মি. কায়েস। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও, দুঃসাহসী। কিন্তু একটা প্রশ্ন করব গুলি করার আগে। রিপোর্টার তুমি, গোয়েন্দাগিরির শখ কেন জাগল?’ “ বলতে ভুলে গেছি তোমাকে।
| শহীদ বলল, “আমি রিপোর্টার নই। আমি একজন ডিটেকটিভ। এখানকার সব ঘটনা এখন আরও অনেকেই জানে।
লোকটি হাসল ভিখি করে।
বলল, “তাতে কি! আমি ঠিকই পালাব।
কিন্তু লোকটি পিস্তলের ট্রিগার টিপে ব্রার আগেই শহীদ বিদ্যুৎ বেগে পিছন দিকে লাফ দিল। | অনুমানের উপর নির্ভর করে লাফ দিয়েছে শহীদ। সবেগে ও গিয়ে ধাক্কা খেল
ভলিউম ১২
৪২
লোকটার বুকের সাথে। ঠিক সেই মুহূর্তে গুলির শব্দ হল।
বুলেট গিয়ে বিধল কামরার দরজায়। লোকটা পড়ে গেল ধাক্কা খেয়ে। শহীদ পড়ল লোকটার পাশে।
শহীদের আগে উঠে দাঁড়াল লোকটা। শহীদের কপাল লক্ষ্য করে লাথি চালাল সে।
শহীদ উঠে বসেছিল মাত্র। চোখের পলকে সরে গেল ও।
লাখি ফসকে যাওয়ায় তাল হারিয়ে ফেলল লোকটা। শহীদ উঠে পঁড়িয়েই টলটলায়মান লোকটার নাক করার প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল।
ঘুসি খেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল খুনী। শহীদ এবার লাথি চালাল!
লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল লোকটা দূরে। দুইহাত ঘষতে লাগল সে মেঝেতে। তার ডান হাতটা গিয়ে ঠেকল ছিটকে পড়া পিস্তলটার উপর। খপ্ করে ধরল সেটা। প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করার কষ্ট করতে করতে পিস্তল তুলল সে শহীদের বুক লক্ষ্য করে। শহীদ বিপদ টের পেয়ে লাফ মারল।
কিন্তু গুলির শব্দ হল সেই মুহূর্তেই। তারপর দুটি শব্দ। দুটি পিস্তল গর্জে উঠেছে। তীব্র আর্তচিৎকার কানে ঢুকল শহীদের। লাফ দিয়ে সরে গিয়েছিল শহীদ। কাঁপা হাতের গুলি লাগেনি ওর গায়ে।
শহীদ সিঁড়ির দিকে তাকাল। কুয়াশা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। তার এক হাতে একটা কেরোসিন ল্যাম্প। অন্য হাতে পিস্তল।
‘লাগেনি তো, শহীদ?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা । উঠে পঁড়িয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে শহীদ বলল, ‘না।’
শহীদ তাকাল মেঝের দিকে। কুয়াশার গুলি খেয়ে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে লোকটা মেঝেতে মুখ থুবড়ে।
‘কে ও?’ এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। | শহীদ বলল, “মি. আকব্ল হোসেন।
বলো কি, শহীদ!’ কুয়াশা অবাক।
হা। মরেনি ও। কঙ্কালের মুখে নিজের নকল দাঁত লাগিয়ে বাথটাবে ফেলে রেখেছিল। চিৎকার করে ভুল পথে চালাতে চেয়েছিল আমাদেরকে।
পাশের রূমে আহাদ চিৎকার করে মরছে কখন থেকে কে জানে। শহীদ তার নাম ধরে ডাকল। আহাদের সাড়া পেয়ে খুলে দিল দরজা।
“আর সবাই কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল শহীদ।
জানি না। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছি আমি। অথচ কেউ এদিকে আসেনি। ব্যাপার কি, মি. কায়েস?” কুয়াশা ৩৪
৪৩
শহীদ বলল, “সবই জানবেন। চলুন, ওদের সকলের খবর নিই। কুয়াশা, শহীদ এবং আহাদ বৈঠকখানার উদ্দেশে পা বাড়লি। বৈঠকখানায় ঢুকে থমকে গেল ওরা তিনজন।
বৈঠকখানার মাঝখানে একটি চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে পটলার মা অর্থাৎ ডি কস্টাকে। তার পরনের শাড়ী ভূলুণ্ঠিত। ভিতরে হাফপ্যান্ট দেখা যাচ্ছে। | শহীদ এবং কুয়াশাকে দেখে স্বপন চিৎকার করে বলে উঠল, “দেখুন মি. কায়েস, পটলার মা বলে যাকে আমরা জানতাম সে একজন পুরুষ মানুষ। আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল। ধরে বেঁধে রেখেছি আমরা। ও বোবাও নয়।
ডি, কস্টা গভীর ভাবে বলে উঠল, হামাকে চরম ইনসাল্ট করা হইয়াছে। আমি বাংলাদেশ গোয়েত্ত সংস্থার চীফ সেক্রেটারি। মাসে দেড় হাজার টাকা স্যালারী নিই। ফ্রী ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, প্রকাণ্ড ডিনার। ফ্রী বাসষ্ঠান। হামি টোমাডের সবার নামে মানহানির মামলা করিব।
| পুরপুরে এক বুড়ো ওরফে কামাল ঢুকল বৈঠকখানায়। ও বলে উঠল, কিন্তু তার আগে আমিও তোমার মান হানির ব্যবস্থা করছি। আমাকে তুমি আকাশে ফ্লাইং সসার দেখাতে গিয়ে কি করেছিলে মনে আছে, কেস্টা? দাঁড়াও। হাটে হাঁড়ি ভাঙছি আমি এখুনি।’
. প্লীজ! ননা!’-ডি কস্টার কণ্ঠে মিনতি। ‘
ভলিউম১২
4
Leave a Reply