৩৩. গুপ্তচর ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৩
প্রথম প্রকাশ মার্চ, ১৯৭২
এক
জেল হাজতে মি. জামিল হায়দারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর শহীদ এগারো নম্বর চান অ্যাভিনিউয়ে উপস্থিত হল। মিসেস জামিলের সঙ্গে কথা বলবে ও। মি. জামিল হায়দারকে গ্রেফতার করার দিন যে চাকরানীকে দেখেছিল শহীদ সে-ই দরজা খুলে দিল কলিংবেল টিপতে । শহীদ জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের বিবিসাহেৰ কেমন আজ রাতে?’।
| ‘খানিকটা ভাল, হুজুর। ড্রয়িংরুমে আছেন উনি। সেই ঘটনার পর থেকে আজই প্রথম নিচের তলায় নেমেছেন বিবিসাহেব।’
| সেই ঘটনাটা মানে মি. জামিল হায়দারকে গ্রেফতার করার ঘটনাটা। শহীদ জিজ্ঞেস করল, “নার্স কোথায়?” | পুলিস বিভাগ থেকে একজন নার্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে মিসেস জামিলের দিকে নজর রাখার জন্যে। মিসেস জামিলের মেয়ে মিস রোশনার অনুরোধেই এটা করা হয়েছে। মিস রোশনা অদ্ভুতভাবে সন্দেহ পোষণ করে যে তার আম্মা দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করতে পারে। কিন্তু শহীদের বিশ্বাস, মিসেস জামিলকে কেউ খুন করার চেষ্টা করতে পারে এই সন্দেহ পোষণ করে মিস রোশনা মনে মনে।
নার্স বিবি সাহেবের সঙ্গেই আছে।’ ‘খবর দাও আমি দেখা করতে চাই ওঁর সাথে।
চাকরানী চলে গেল শহীদকে হলঘরে রেখে। খানিক পর ফিরে এল সে। শহীদ চলল তার পিছু পিছু। ধনী লোকদের বাড়ির ইউরোপিয়ান ফর্মালিটিগুলো অপরিবর্তনীয়। একটার পর একটা দরজা খোলা হল এবং ঘোষণা করা হল সাক্ষাৎপ্রার্থী প্রবেশ করছেন। অবশেষে ড্রয়িংরুমের সামনে শেষ ঘোষণাটি উচ্চারিত হবার পর শহীদ দেখা পেল মিসেস জামিল হায়দারের।
বিরাট বড় ড্রয়িংরূম । তিন রঙের বিভিন্ন আকৃতি এবং কাঠামোর তৈরি সোফা সেট। জানালায় দামী পর্দা। মেঝের কার্পেটটা কাশ্মীরী । মিসেস জামিল হায়দারের পায়ের কাছে একটা কালো কুচকুচে বিড়াল বসে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। মিসেস জামিল বিড়ালটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বসুন, মি. শহীদ।
ধন্যবাদ।
১০৯
কুয়াশা-৩৩
কার্ড খেলা সম্ভবত হায়দার ফ্যামিলির নিয়মিত রুটিন। মিসেস জামিল নার্সের সঙ্গে পিকেট খেলছিলেন, বত্রিশটা কার্ডের খেলা, দু’জনার। পাশের টেবিলে শেরির বোতল এবং গ্লাস। মিসেস জামিল মদ্যপানে অভ্যস্ত, জানত শহীদ। মিসেস জামিলকে দেখে রীতিমত আশ্চর্য হল আজ শহীদ। আজ ভদ্রমহিলাকে অস্বাভাবিক শাও দেখাচ্ছে। শহীদকে আসন গ্রহণ করতে বলে প্রবোধক চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, আশা করি আমার জন্যে সুখবর নিয়ে এসেছেন?’ | আমি একটা কি দুটো প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে, সেগুলোর উত্তর পেলে। উপকার হবে মি. জামিলের । আপনি কি কখনও ইয়াকুব নামে কোন লোকের খবর জানতেন?’ | উত্তর যেন তৈরি হয়েই ছিল, না। কখনও শুনিনি ও নাম, দেখার প্রশ্নও ওঠে
না।’
‘ধন্যবাদ। আপনি কি কখনও মোহাম্মদ আমান গাজীর নাম শুনেছেন? একজন ইরাকী ভদ্রলোক?’।
মি. জামিলের মতই ভীষণভাবে চমকে উঠলেন মিসেস জামিল আমান গাজীর নাম শোনা মাত্র। শান্ত ভাবটুকু নিমেষে উবে গেল তাঁর মুখাবয়ব থেকে। দারুণ আতঙ্ক স্থান দখল করল মুখের চেহারায়।
আত? না, ঘৃণা?
মিসেস জামিল শক্ত হাতে চেপে ধরেছেন চেয়ারের দুটো হাতল। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছেন। কোন কথা বললেন না। চোখের ভাষা লুকিয়ে রাখার জন্যেই যেন বন্ধ করে রেখেছেন পাতা দুটো। নার্স এক পা এগিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রাখল একটা। তিনি চোখ মেলে চেষ্টাকৃত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠলেন, বহুদিন আগে, মি. শহীদ, আমি একজন মোহাম্মদ আমান গাজীকে চিনতাম সে আমাদের বন্ধু ছিল। কেন জিজ্ঞেস করছেন আপনি তার কথা?
তার কাছ থেকে কোন খবরাখবর পেয়ে আর্সছেন?”
।’
কতদিন আগের ব্যাপার সেটা?’. অনেক বছর আগের কথা। সে চলে যায় ইরাকে বসবাস করার জন্যে। ‘আজ কত বছর বয়স হবে তার?’ মিসেস জামিল খানিক চুপ করে থেকে বলে উঠলেন, ‘পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নর কম:
নয়।’
… শহীদ চমকে উঠল। ঢাকায় যে মোহাম্মদ আমান গাজী এসেছে ইরাক থেকে তার বয়স আটাশ থেকে ত্রিশ, তার বেশি নয়। সে জানিয়েছে মিস রোশনার সাথে তার ইরাকে দেখা হবার পর প্রেমে পড়ে সে। রোশনা বিপদে পড়েছে শুনে ছুটে এসেছে। তাহলে এই বয়স্ক মোহাম্মদ আমান গাজী কে? ইরাকে একই পরিবারের
১১০
ভলিউম-১১
দু’জনের নাম কোন কোন সময় একই রকম রাখা হয়। তবে কি বয়স্ক আমান গাজীর ছেলে ঢাকায় উপস্থিত এই আমান গাজী?
মিসেস জামিল আর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করলেন।
বাড়িতে ফিরে আধঘন্টা চিন্তিতভাকে বসে রইল শহীদ সিগারেট টানতে টানতে। তারপর ফোন করল মিসেস জামিলের নার্সকে। নার্স অপর প্রান্ত থেকে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?’
শহীদ খান।’
নার্স প্রায় উত্তেজিত গলায় জানাল, ‘আমি প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম আপনি ফোন করবেন, মি. শহীদ। আপনি যাবার পরপরই মিসেস জামিল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি আমি। বিছানায় শুয়ে আছেন উনি এখন। খুব বেশি অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমার বিশ্বাস আপনার কথা শোনার প্রতিক্রিয়া এটা।’
শহীদ বলল, কোন মন্তব্য করেছেন আমি চলে আসার পর?” | না। কিন্তু আপনাকে একটা কথা জানানো দরকার, মি, শহীদ। আমি ওর ডেস্কে এবং রাইটিং টেবিলের কাছে গিয়েছিলাম একবার । দুটো চিঠি দেখতে পেয়েছি আমি। দুটোতেই “মোহাম্মদ আমান গাজীর” সই আছে। সাধারণত যে, কাগজে চিঠি লেখা হয় এ দুটো তেমন নয়, ইরাক থেকে এসেছে এ দুটো। তারিখ নেই। মিসেস জামিলের উদ্দেশ্যে লেখা।’
শহীদ জানতে চাইল, চিঠির বক্তব্য কি?’
সাধারণ বক্তব্য। যেন পরিবারের পরিচিত কেউ ভালমন্দ খবর নেবার জন্যে চিঠি দুটো লিখেছে। ইরাকের হোটেল কমোডোরের প্যাডে লেখা চিঠি দুটো।
শহীদ বলল, আমি লোক পাঠাচ্ছি, চিঠি দুটো পাঠিয়ে দিয়ো। আর, হ্যাঁ, কান সব সময় খাড়া করে রাখবে তুমি। আমান গাজী এবং ইয়াকুব-এই দুজনার নাম এবং কথা কেউ বলে কিনা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল রাখবে।’
| আর একটা কথা, মি. শহীদ। আমি একটা রসিদ পেয়েছি। প্রায় তিন বছরের পুরানো রসিদ । প্রফেশনাল ডিটেকটিভ আবিদ চৌধুরীকে টাকা পেমেন্ট করার রসিদ। মিসেস জামিল আবিদ চৌধুরীকে কোন কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, তাই ধারণা হয় না কি?’
‘তা বটে। কিন্তু আবিদ চৌধুরী মারা গেছেন। এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না, যদি মিসেস জামিল নিজে না জানান। এবং জানাবেন না, আমি জানি। আচ্ছা, রাখছি। দরকার মনে করলেই খবর দিয়ে আমাকে।’ | শহীদ রিসিভার নামিয়ে রাখল। তারপর কি ভেবে মি. সিম্পসনকে ফোন করল ও। মি. সিম্পসন অপরপ্রান্তে এলেন। শহীদ বলল, মি. আমান গাজীকে দিয়ে একটা স্টেটমেন্ট সই করিয়ে নিন এখুনি। স্টেটমেন্ট সই করিয়ে নেবার আধঘন্টা পর ছেড়ে দেবেন ওকে হাজত থেকে, তার আগে নয় । যে-সব ঘটনার
কুয়াশা-৩৩
১১১
• সাথে ও জড়িত সেগুলো সম্পর্কে ওর বিবৃতিটায় সই করিয়ে নেবেন। সই করিয়ে
এখুনি সেটা পাঠিয়ে দিন আমাকে। ওর হাতের সইটা দেখতে চাই আমি নিজের চোখে। ওটার সাথে আর একজন আমান গাজীর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখতে চাই।
আমি।’
“আর একজন আমান গাজী? কি বলছ তুমি শহীদ?’
শহীদ মি. এবং মিসেস জামিলের সাথে ওর সাক্ষাত্তারের কথা বলল। নার্সের চিঠি পাবার কথাটা যোগ করল সব শেষে। মি. সিম্পসন ফোন ছেড়ে দিলেন নিশ্চিন্ত ভাবে।
. খানিক পরই ফোন করলেন মি. সিম্পসন শহীদকে, স্টেটমেন্ট সই করেছে আমান গাজী। খানিক পরই ছাড়ব ওকে। ও বলছে ছাড়া পেয়ে শামিম হায়দারের বাড়িতে উঠবে ও।’
শহীদ বলল, “ঠিক আছে। স্টেটমেন্টটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিন আমাকে।’
মি, সিম্পসন বললেন, ‘লোক পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার বাড়ির উদ্দেশে। পৌঁছে যাবে এখুনি। ছাড়ছি।’
ফোন ছেড়ে দিল শহীদও। সাত মিনিট পর একজন কনস্টেবল এল স্টেটমেন্টটা নিয়ে। শহীদ, মোহাম্মদ আমান গাজীর সইটা দেখল। এবার মিলিয়ে দেখা দরকার মিসেস জামিলের কাছে ইরাক থেকে যে মোহাম্মদ আমান গাজীর চিঠি এসেছে তার হাতের লেখার সাথে। কিন্তু গফুরকে পাঠাবে ভেবেছে শহীদ নার্সের কাছ থেকে চিঠিগুলো আনার জন্যে, অথচ গফুর গেছে মহুয়া আর লীনার সাথে কামালের জন্যে মার্কেটিং করতে। কামাল খানিকটা সুস্থ হয়েছে। খবর দিয়েছে কুয়াশা মহুয়াকে ফোন করে। যে-কোন দিন যে-কোন সময় বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে কুয়াশা কামালকে। মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছে কামাল। বাড়ি ফিরলে যত্ন করতে হবে ওকে, তাই ভেবে মার্কেটিং করতে বের হয়েছে
ওরা। | ওরা ফিরল পনেরো মিনিট পরই। শহীদ গফুরকে ডেকে বলল, এগারো নম্বর চান অ্যাভিনিউয়ে এখুনি একবার যা তুই। এখানে যে নার্সটা আছে সে দুটো চিঠি দেবে, সেগুলো খুব সাবধানে নিয়ে আসৰি । দেখিস কেউ যেন তাৈকে না দেখে। আর হাত ছাড়া করবি না চিঠি দুটো।’
গফুর মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে ।
এগারো নম্বর চাঁন অ্যাভিনিউয়ে নিরাপদেই পৌঁছুল গফুর। নার্সের কাছ থেকে একটা খাম নিল, খামের ভিতর চিঠি দুটো আছে। খামটা মুঠোর ভিতর নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এল। খুব সাবধানে নিয়ে যেতে হবে খামটা দাদামণি বার বার করে বলে দিয়েছে। গফুর এদিক ওদিক তাকাল। না, কেউ অনুসরণ করছে বলে মনে হল না। এবার জোরে জোরে পা চালাল ও। যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে
১১২
ভলিউম-১১
পৌঁছুনো যায় ততই ভাল।
হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে পৌঁছে গেল গফুর বিশ মিনিটের মধ্যে। মনে মনে স্বস্তিবোধ করল ও। দশাসই শরীরটা হাঁটার ক্লান্তিতে ঘেমে নেয়ে গেছে। তা যাক, কাজটা দাদামণির আদেশ মত যথাযথ করেছে সে।
বাড়ির গেট অতিক্রম করে বুক পকেটে হাত দিল গফুর খামটা আছে কি না দেখবার জন্যে। আছে। পকেট থেকে হাতের মুঠোয় রাখল ও সেটা। উঠানটা অন্ধকার । যাবার সময় গেট বন্ধ করে গিয়েছিল ও বাইরে থেকে, বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল। অন্ধকার উঠান ধরে বারান্দার দিকে এগোতে লাগল গফুর।
| গফুর বারান্দার সিঁড়ির কাছে এসে পৌঁছুতেই এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটল। বারান্দার থামের আড়াল থেকে একটি ছায়ামূর্তি লাফিয়ে পড়ল তার উপর। ছায়ামূর্তিকে দেখার আগেই বেকায়দায় পড়ল গফুর। ছায়ামূর্তির হাতে একটি চটের থলে ছিল। সেই থলেটা চোখের পলকে গফুরের মাথায় গলিয়ে দিয়েছে ছায়ামূর্তি।
আক্রান্ত হয়েই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল গফুর। বাড়ির ভিতর কেউ তাকে এমন অদ্ভুতভাবে আক্রমণ করবে তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কিন্তু বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠল সে পর মুহূর্তেই। তারপর সে দু’হাত মাথার উপর তুলে থলেটা মাথা থেকে খোলবার চেষ্টা করল। আক্রমণকারীর তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে অবাক হয়ে গেল গফুর। দ্রুত খুলে ফেলল ও মাথা থেকে থলেটা। চোখ মেলে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল ও। চোখ দুটো ভয়ঙ্কর ভাবে করকর করে জ্বালা করে উঠল। একরাশ বালি ছুঁড়ে দিয়েছে বদমাশ আক্রমণকারী ছায়ামূর্তি। হাত দিয়ে ঘষতে লাগল গফুর চোখ দুটো। খামটা পড়ে গেল হাত থেকে। এমন সময় গফুর চিৎকার করে উঠল, আর্তকণ্ঠে, দাদামণি!’
কয়েক সেকেণ্ড পরই শহীদ ও মহুয়া দরজা খুলে ছুটে এল গফুরের কাছে। গফুরের অবস্থা দেখে মহুয়া পানি নিয়ে এল এক বালতি। শহীদ বাড়ির উঠানে দেখতে পেল না কাউকে। ও শুধু লক্ষ করল সদর দরজাটা খোলা। আর গফুরের পাশে পড়ে রয়েছে একটা টর্চ আর একটা থলে। ও দুটো কার চিনতে পারল না। শহীদ। পানি ছিটিয়ে গফুরের চোখ জোড়া বালি-মুক্ত করতে লাগল মহুয়া।
| গফুর খানিক পরই চোখ মেলে তাকাতে পারল। চোখ জোড়া টকটকে রক্তবর্ণ ধারণ করছে ওর। শহীদ প্রশ্ন করল উদগ্রীব কণ্ঠে, ‘কি করে অমন হল গফুর?”
গফুর যা যা ঘটেছে সব বলল। শহীদ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, ‘সেকি! বাড়ির ভিতর আক্রমণ করার জন্যে কে ওত পেতে থাকতে পারে! চিঠি দুটো তুই নিয়ে আসছিস একথা সে জানলই বা কিভাবে!’
. গফুর বলল, আমিও কিছু বুঝতে পারছি না, দাদামণি।’
শহীদ ড্রয়িংরূমে ফিরে এসে ডেস্কের ড্রয়ার টেনে দেখল। আমান গাজীর সই কুয়াশা-৩৩
১১৩
।
করা যে স্টেটমেন্ট মি. সিম্পসন লোক মারফত পাঠিয়েছিলেন সেটা শহীদ ডেস্কের ড্রয়ারে রেখেছিল। শহীদ দেখল সেটা ড্রয়ারে নেই। হঠাৎ জানালাগুলোর দিকে তাকাল শহীদ। ওর সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হল। শহীদ দেখল একটা জানালার শিক বাঁকিয়ে নিঃশব্দে ড্রয়িংরূমে ঢুকেছিল কেউ । সে-ই চুরি করে নিয়ে গেছে স্টেটমেন্টটা। ওই একই চোর গফুরকে আক্রমণ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার মানে চোর অনেকক্ষণ ধরে আড়ি পেতে শুনেছে শহীদের সাথে নার্সের এবং শহীদের সাথে মি. সিম্পসনের ফোনের মাধ্যমে কথাবার্তাগুলো। তা না হলে চিঠিগুলোর কথা জানতে পারল সে কিভাবে?
শহীদ বলল, গফুর, তুই বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিলি?’ গফুর মাথা নাড়ল। শহীদ বলল, “চোর দরজা খুলে পালিয়ে গেছে। যা দরজাটা দিয়ে আয়।’ গফুর দরজা দিতে চলে গেল।
আধঘন্টা পর শহীদ শুনতে পেল গফুরের অস্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠস্বর। গফুর কথা বলছে যেন কার সাথে । মহুয়া আর লীনা যে যার রূমে শুয়ে পড়েছে । শহীদ একা সিগারেট টানছে ড্রয়িংরূমে। গফুর সম্ভবত কিচেনরূমে কফি তৈরি করছে শহীদের জন্যে। কার সাথে অমন গম্ভীরস্বরে কথা বলছে গফুর?
শহীদ ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে ভিতর দিকে পা বাড়াল। ধীরে ধীরে কিচেনরূমের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল ও। দেখল গফুর কেটলিতে পানি চাপিয়ে চুলোয় দিয়েছে। আর নাছোড় বান্দা ডি কস্টা একটা টুলে বসে হাঁটু জোড়া নাচাতে নাচাতে গফুরকে বলছে, কিন্টু হামি কি টোমার কাছে কোন অপরাট করিয়াছি? কেন টুমি আমার সাথে হমন গম্ভীর ভাবে, কঠা বলিটেছ?’
গফুর গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, বকবক কোরো না বলছি, ডি.কস্টা, আমার মন মেজাজ খুব খারাপ এখন।’ | ‘টা টো বুঝিলাম । মাগার, কি কারণে টোমার মুড খারাপ টা টো বুঝিলাম না। হামাকে যডি টুমি সকল প্রোবলেম খুলিয়া বলিটে, টাহা হইলে হয়টো টোমার কোন উপকার করিটে পারিটাম।’
গফুর বিরক্ত ভরে বলে উঠল, “আরে ছো। তুমি আবার আমার কি উপকার করতে পারবে শুনি! তা আসল কথা বলো, এতরাতে আজ আবার এখানে আসা হয়েছে কেন?’
ডি কস্টা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল, টুমি টো জানোই গফুর, হামাকে ডিটেকটিভ হোটেই হোবে। টাই টোমার নিকট হইটে মি.
ভলিউম-১১
১১৪
শহীড খান সম্পর্কে দুই চারিটি মূল্যবান কঠা শুনিটে ইন্টারেস্টেড হামি। কিন্টু, আজকের বিষয় ভিন্ন, আজ হামি স্রেফ টোমার উপকার করার জন্যই আসিয়াছি। বলো ডেখি এবার কি টোমার প্রোবলেম?’
গফুর কথা না বলে চুপ করে রইল। ডি.কস্টা নরম সুরে বলে উঠল, আরে,
গফুঁসের! বললে পাবলে?মার উপক
গফুর একটু ইতস্তত করে বলতে শুরু করল তার আক্রান্ত হবার ঘটনাটা। মিনিট তিনেক লাগল গফুরের সব কথা বলতে। ঘটনাটা শুনে গফুরের প্রতি সহানুভূতিতে বিষপ্ত হয়ে উঠল ডি.কস্টার মুখের চেহারা, চোখের দৃষ্টি। ডি.কস্টা বলে উঠল তারপর, ‘টুমি আলবৎ কিচ্ছুটি ভাবিও না! হামি টোমার সকল প্রোবলেম দুর করিয়া ডিব। টুমি হামার ঢার শোড করিয়া ডাও ডেখি, মনে আছে টো ম্যাঙ্গো খাওয়াইয়াছিলাম গট হল্টায় টেমাকে?’
গফুর চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, গত সপ্তাহে তুমি আম খাইয়েছিলে, আর তার পয়সা চাইছ তুমি আজ! সেকি কথা, পয়সা চাইবে জানলে তোমার আম আমি তো খেতাম না!’
ডি.কস্টা নির্বিকার কণ্ঠে বলে উঠল, কি আর করা যাইটে পারে, ঢার টো শোড করিটেই হইবে! ম্যাঙ্গো টো ফেরট ডিটে পারিবে না, হজম হইয়া গেছে!
| গফুর পকেট থেকে পয়সা বের করতে করতে রাগত কণ্ঠে বলে উঠল, ইংরেজরা বেনিয়ার জাত, আর তুমি তো আধা ইংরেজ-ডবল হারামী! বলো কত দাম তোমার আমের।’ | ডি কস্টা গম্ভীর ভাবে বলে উঠল, ‘জাট টুলে গাল ডেবে না বলে ডিচ্ছি। ৰারো আনা।’
গফুর বারো আনা পয়সা মেঝেতে সশব্দে ফেলে দিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠল, দূর হয়ে যা, শয়তান। আর যদি তোকে কখনও এখানে দেখি তাহলে•••তাহলে•••!’ ‘ | ডি.কস্টা বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘হায় টোমার উপকার করার জন্যে আমি এটো কিছু করিলাম আর টুমি আমাকে গালি পাড়িটেছ। লিসেন, গফুর, টোমার প্রোবলেম দুর করিয়া ডিটেছি। শুটু টো রিই না, টোমার ডাডামণি. মি. শহীড খানের প্রোবলেমও ডুর করিয়া ডিব! এই নাও, এই খামটা রাখো। গুডবাই।’ ডি কস্টা গফুরের সামনে একটা খাম ফেলে রেখে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।
| শহীদ জানালা দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল সব। ডি কস্টার কথা শুনে কিছু একটা ধারণা করেছিল ও, খামটা দেখে ধারণাটা সত্য প্রমাণিত হল। ড্রইংরুম থেকে এই খামটাই খানিক আগে চুরি হয়ে গিয়েছিল।
শহীদ গফুরের উদ্দেশে বলে উঠল, গফুর, ডি কস্টাকে ধরে আনত!’
ডি.কস্টা পিছন ফিরে শহীদকে দেখেই প্রাণপণ শক্তিতে দৌড়তে শুরু করল। কুয়াশা-৩৩
১১৫
গফুর যখন কিচেনরূমের দরজার সামনে এসেছে ততক্ষণে ডি.কস্টা গেট খুলে রাস্তায় নেমে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। শহীদ হাত নেড়ে গফুরকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, পালিয়েছে শয়তানটা! দে দেখি খামটা। কেন ও এমন আশ্চর্য কাণ্ড করল বুঝতে পারছি না।’
| গফুর খামটা তুলে শহীদের হাতে দিল। শহীদ ড্রয়িংরূমে ফিরে এল সেটা। নিয়ে। সোফায় বসে সিগারেট জ্বালিয়ে আপন মনেই ও একটু হাসল। তারপর খুলল ডি কস্টার দিয়ে যাওয়া খামটা।
* খামটা খুলে শহীদ দেখল ভিতরে ড্রয়িংরূম থেকে চুরি হয়ে যাওয়া ঢাকায় অবস্থানরত আটাশ বছরের মোহাম্মদ আমান গাজীর সই করা স্টেটমেন্ট এবং নার্স কর্তক গফুরের হাতে পাঠানো এবং গফুরের হাত থেকে আক্রমণকারী কর্তৃক ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া ইরাক থেকে পাঠানো ষাট বছরের মোহাম্মদ আমান গাজীর লেখা চিঠি দুটো রয়েছে। তা ছাড়াও রয়েছে কুয়াশার লেখা কয়েকটা তথ্য। তথ্যগুলো শহীদের দরকার। দুই আমান গাজীর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখতে চায় শহীদ, দু’জন একই লোক না আলাদা লোক। সে কাজ কুয়াশাই করে দিয়েছে। কুয়াশা লিখেছে ইরাক থেকে ঠিকানাবিহীন চিঠি, দুটো লিখেছে একজন ষাট বছরের লোক, কোন সন্দেহ নেই এতে এবং স্টেটমেন্টটা যে সই করেছে তার বয়স ত্রিশের বেশি হতে পারে না।
শহীদ দেখল ইরাক থেকে পাঠানো বয়স্ক আমান গাজীর চিঠি দুটো অতি সাধারণ ভাষায় এবং সাধারণ বিষয়ে লেখা। যেন বহুদিনের পরিচিত জনের কাছে কুশল জানিয়ে কুশল কামনা করা ছাড়া আর কিছু না।
গফুর কফির পেয়ালা নিয়ে ঢুকল ড্রয়িংরুমে। শহীদ বলল, শয়তান ডি কস্টাই তোকে আক্রমণ করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চিঠি দুটো।”
গফুর গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, “কেন?”
শহীদ বলল, কেন আবার! শখের ডিটেকটিভ হবার সাধ হয়েছে যে তার । যেচে পড়ে আমার কোন কাজ করে দিতে পারলে ওর প্রতি আমি সন্তুষ্ট হব এবং হয়ত ভাবছে ওকে আমার সহকারীও করে নিতে পারি–তাই। লুকিয়ে আমাদের অনেকগুলো কথা শুনে চিঠিগুলো নিয়ে কি করতে হবে বুঝে ফেলেছিল শয়তানটা। চিঠিগুলো বাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কুয়াশার কাছে। তার হাতেপায়ে ধরে আমার কাজটা তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছে। যাক, ওকে আবার তুই মারধর করতে যাসনে। একেই তো রোগা, তার ওপর তোর হাতের মার খেলে ভয়েই মরে যাবে
ও। তবে বেশি ধারেকাছে ঘেঁষতে দিবি না ওকে অপ্রয়োজনে। | গফুর গম্ভীর স্বরে বলল, ওকে আমি অন্যভাবে শাস্তি দেব।’ কথাটা বলে শহীদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বিশাল দেহটা নিয়ে রূম থেকে বের হয়ে গেল গফুর।..
১১৬
ভলিউম-১১
তিন মি. সিম্পসন ফোন পেলেন কনস্টেবল আবিদ আলীর। :
আবিদ আলী কোথাও যে পাহারা দিচ্ছে একথা স্মরণ ছিল মি. সিম্পসনের, কিন্তু ঠিক নির্দিষ্ট কোন জায়গায় তা মুহূর্তের জন্যে ভুলে গিয়েছেন। আবিদ আলী বলল, ‘স্যার, ওরা গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হবার তোড়জোর করছে।’
‘ওরা কারা? | ‘শামিম হায়দার আর মোহাম্মদ আমান গাজী। শামিম হায়দার গাড়ি পরীক্ষা করে তেল ভরার জন্যে তোক ডেকে পাঠিয়েছে গ্যারেজ থেকে, ওদের কথা শুনতে পেয়েছি আমি। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও যাবার ব্যবস্থা করছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, “এখুনি আসছি আমরা। সম্ভব হলে ওদেরকে দেরি করিয়ে দেবার চেষ্টা করো, কিন্তু সাবধানে!’
কথাটা বলেই শহীদকে ফোন করলেন মি. সিম্পসন ।. শহীদকে ওর বাড়ি থেকে তুলে নেবেন মি. সিম্পসন, কথা হল। মি. সিম্পসন ঢাকার প্রতিটি পেট্রল কারকে নির্দেশ দেবার ব্যবস্থা করলেন প্রয়োজনীয় হুকুম জারি করে। পেট্রল কারগুলো শামিম হায়দারের টয়োটা বা আমান গাজীর মরিস গাড়ি দেখতে পেলেই অনুসরণ করবে। অবশ্যই নিজেদেরকে লুকিয়ে। | শহীদকে বাড়ি থেকে তুলে নিলেন মি. সিম্পসন । সীট বদল করে ড্রাইভিং সীটের পাশে বসলেন তিনি। রেডিওর ব্যবস্থাসম্পন্ন স্কোয়াড কারের ড্রাইভিং সীটে বসে বিদ্যুৎবেগে ছেড়ে দিল শহীদ গাড়ি।
| শামিম হায়দারের বাড়ির কাছে পৌঁছুবার আগেই শহীদ দেখল একটা টয়োটা করোনা ছুটে আসছে । রাস্তার পাশে জীপটা দাঁড় করাল শহীদ। মি. সিম্পসন তাড়াতাড়ি একটা ডেলি নিউজ-পেপার তুলে মুখ ঢাকলেন। শহীদ সিগারেট জ্বালাবার ভঙ্গিতে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। টয়োটা ওদেরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। শহীদ দেখল শামিম হায়দার এবং আমান গাজী সামনের সীটে পাশাপাশি বসে। রয়েছে। ওদেরকে লক্ষ করেনি।
জীপের মুখ ঘুরিয়ে টয়োটাকে অনুসরণ করে চলল শহীদ। এয়ারপোর্ট পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে টয়োটা।
দেখতে দেখতে আড়াই ঘন্টা পেরিয়ে গেল। সোজা ময়মনসিংহের দিকে এগিয়ে চলেছে টয়োটা। মধুপুর খুব বেশি দূরে নয় আর।
সামনেই একটা মোড়। মি. সিম্পসন তীক্ষ্ণ চোখে মোড়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাদের অন্য একটা গাড়ি মোড়ে অপেক্ষা করছে। গাড়ি বদলানো যেতে পারে।’
কুয়াশা-৩৩
১১৭
তাকাচ্ছে না একদাঁড়িয়ে পড়লাওয়াগেন। এছ ওরা। নতু
মোড়ের সামনে জীপ থামিয়েই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল ওরা। পুলিসের একটা ফোক্সওয়াগেন অপেক্ষা করছিল। দ্রুত চড়ে বসল ওরা, ড্রাইভারকে জীপ নিয়ে ফিরে যাবার ইঙ্গিত জানালেন মি. সিম্পসন। গাড়ি ছেড়ে দিল শহীদ। শামিম হায়দারের মরিসটাকে দেখা যাচ্ছে না। হয়ত কোনদিকে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাবে কোথায়, পুলিসের অন্যান্য পেট্রল কার নজর রাখছে নিশ্চয়। শহীদ নয়-দশ মিনিট ধরে সত্তর মাইল গতিতে গাড়ি চালাল। তারপর গতি কমিয়ে দিয়ে মোড় নিয়ে একটা গ্রামের পথ ধরল। টয়োটাকে দূর থেকে দেখতে পেয়েছে।
কাঁচা পথ দিয়ে খানিকক্ষণ কোণাকুণি ভাবে এগিয়ে আবার মেন রোডে ফিরে এল শহীদ গাড়ি নিয়ে। টয়োটা সামনে। টয়োটার যাত্রী দুজন পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না একবারও। গাড়ি বদলাবার ফলে ওদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়নি।
হঠাৎ টয়োটা দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার পাশে। শহীদ না থেমে এগিয়ে গেল । ওদের পাশ কাটিয়ে চলে এল ফোক্সওয়াগেন। শহীদ বলে উঠল, “কেউ ফলো করছে কিনা ভাল করে বোঝার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা। নতুন গাড়ির ব্যবস্থা করুন, মি. সিম্পসন।’
মি. সিম্পসন মধুপুর থানায় রেডিওর মাধ্যমে খবর পাঠালেন। কাছাকাছি নির্দিষ্ট একটা জায়গায় একটা গাড়ি পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিলেন তিনি।
টয়োটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে। পূর্বের মন্থর গতি বজায় রেখে সোজা এগিয়ে চলেছে ফোক্সওয়াগেন। মোড় নিল শহীদ। মি. সিম্পসন দিক নির্ণয় করে যেতে লাগলেন শহীদের সুবিধার্থে। মিনিট দেড়েক পরেই দেখা গেল একটা ওপেল রেকর্ড দাঁড়িয়ে আছে একটা ব্রিজের সামনে। নিঃশব্দে নামল ওরা। গাড়ি বদল করে ফিরতি পথে মেন রোডের দিকে চলল ওপেল।
মেন রোডে পৌঁছে ওরা সেই মুহূর্তে গ্রীন রঙের টয়োটাকে দেখতে পল না বটে, কিন্তু তিন মিনিটের মধ্যে আবিষ্কার করা গেল। শহীদ আধ মাইল দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চলল। টয়োটা কয়েকটা মাটির টিলা অতিক্রম করে গেল। শহীদ গাড়ি নিয়ে একটা মাটির টিলার উপর উঠতেই মি. সিম্পসন উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন, ‘ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছে।’
টয়োটা দাঁড়িয়ে পড়েই আবার ব্যাক করল কিছুটা, তারপর বাঁ দিকের মোড়ের কাছে পৌঁছে আধ মিনিটের জন্যে দাঁড়াল। মোড়ের সামনে একটা সাইনবোর্ড, তাতে লেখা-শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্ম ।
রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চলল টয়োটা। গতরাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই কাঁচা রাস্তার কাদার উপর দিয়ে হেলেদুলে, টলতে টলতে এগিয়ে চলল টয়োটা।
ফার্মের প্রধান গেটে টয়োটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আশপাশে কোন মানুষজনের দেখা নেই।
১১৮
ভলিউম-১১
শহীদ মোড়টা অতিক্রম করার আগেই ওপেলের স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে নেমে পুড়ল গাড়ি থেকে। মি. সিম্পসন গাড়ি থেকে নামতে নামতে মোড়ের সাইনবোর্ডটা পড়লেন ভাল করেঃ ‘শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্মফ্রেশ মিল্ক অ্যাণ্ড এগৃস।’ মি. সিম্পসন বললেন, কি করা এখন? রেডিওর আওতার বাইরে আমরা বর্তমানে।’
| হ্যাঁ। কিন্তু রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে যখন, তখন আশপাশের থানা-ইনচার্জরা এবং ট্রেল কারগুলো আমাদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দেরি নয়, পিছন দিক দিয়ে ঘুরে ফার্মের মানুষজন কে কোথায় কতজন আছে পরখ করে আসুন আপনি। যদি দেখে ফেলে এবং জবাবদিহি চায় তাহলে বলবেন আপনার গাড়ির ব্রেক খারাপ হয়ে গেছে, ফোন করতে চান। কোন গ্যারেজে ফোন করবেন, ওদের সন্দেহের উদ্রেক না করার জন্যে। যদি ধরা না পড়েন তাহলে দেখে শুনে ফিরে আসবেন সামনের দিকে। আমাকে দেখতে না। পেলে অপেক্ষা করবেন।’
মি. সিম্পসন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। এবং দ্রুত পায়ে রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়ে এগিয়ে চললেন ফার্মের পিছন দিকে।
মি. সিম্পসন অদৃশ্য হয়ে যেতে শহীদ এগোল প্রধান গেটের দিকে। গেটটা খোলা। ভিতরে ঢুকল শহীদ ধীরে ধীরে। প্রকাণ্ড একটা উঠান সামনে। গোয়াল ঘর দেখা যাচ্ছে, গরু নেই। উঠানের দু’পাশে বেড়াঘেরা বাগান। বাঁ দিকে সারি সারি ঘর। জানালাগুলো কোনটা ভোলা, কোনটা বন্ধ। দরজা সবগুলোই ভিতর থেকে বন্ধ। জানালাগুলো তীক্ষ্ণ চোখে দেখল শহীদ। কেউ ওকে লক্ষ করছে বলে মনে হল না। কোথাও কোন মানুষজনের চিহ্ন নেই।
গোয়াল ঘরের কাছাকাছি সারি সারি ঘরগুলোর প্রধান দরজা। দরজাটার কাছে। গিয়ে পৌঁছুতে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও গলাগুলো আলাদা আলাদা ভাবে চিনতে পারল না ও। তবে ফার্মহাউসের দোকান থেকে শব্দগুলো আসছে বলে ধারণা করল ও।
বুকটা ধক ধক করছে শহীদের। কেউ ওত পেতে বসে নেই তো আশেপাশে তার দিকে লক্ষ রেখে? কামালের কথা মনে পড়ল। কামালের মত মারাত্মক ভাবে আহত হবে না তো সে অকস্মাৎ আততায়ীর গোপন আক্রমণে! | মৃদু পদশব্দ শোনা গেল। অপেক্ষা করে রইল শহীদ। একটু পরই দেখা গেল মি. সিম্পসনকে। কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি, ‘পিছনের দরজাও বন্ধ। বাইরে কেউ নেই।’
শহীদ বলল, আপনি আমাদের গাড়িটা মেইন রোডে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কোন পেট্রল কার দেখতে পেলে তো ভালই, তা না হলে মধুপুর থানায় ফোন করবার ব্যবস্থা করবেন। লোকজন দরকার।’
মি, সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, ফার্মটা ঘেরাও করতে চাও তুমি। কি ব্যাপার,
কুয়াশা-৩৩
১১৯
–
.
*
শহীদ, তোমার কি ধারণা যে মিস রোশনা হায়দার এখানেই আছে?”
‘ওরকমই ধারণা বটে আমার।’ মি. সিম্পসন বললেন, ‘গুড। আমি যাচ্ছি।’ শহীদ অপেক্ষা করে রইল। এক মিনিট দুই মিনিট তিন মিনিট, চার মিনিট।
অবশেষে দশ মিনিট কেটে গেল। বিমূঢ় হয়ে পড়ল শহীদ। মি. সিম্পসন গেলেন কোথায়? প্রতিটি সেকেণ্ড আশা করছিল ও ওপেল রেকর্ডের স্টার্ট নেবার শব্দ শুনতে পাবে। কিন্তু কই!
মি. সিম্পসন কি বিপদে পড়লেন?
শহীদ গেটের দিকে পা বাড়াল। একজন পুরুষের ভারি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘খবরদার, একটুও নড়াচড়া নয়।’’
| চমকে উঠে পকেটে হাত ভরতে ভরতে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। কিন্তু নিরাশ হল । ও। ঘরগুলোর প্রধান দরজার সামনে একজন লোক তার দিকে একটি রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রিগারে চেপে বসছে লোকটার আঙ্গুল । শহীদ পকেট থেকে খালি হাতটা বের করল। এই মুহূর্তে রিভলভার বের করা মানে মৃত্যু বরণ করা।
রাইফেলধারী লোকটা ছোটখাট, ময়লা পোশাক পরনে, কাদা মাখা ভারি জুতো পায়ে। একরোখা ধরনের চেহারা। শহীদ বন্ধে উঠল, “তোমার হাতের ওটা নামাও।’
‘এগিয়ে আসুন, সাহেব, লোকটা ব্যঙ্গভরে.বলে উঠল। শহীদ দ্বিতীয়বার হুকুমের স্বরে বলল, নামাও ওটা.বলছি!’ ঠাট্টা হচ্ছে মনে করছেন? আসুন এখানে, এদিকে!’
লোকটা কথা বলতে বলতে এক পা সামনে বাড়ল। বেপরোয়া ভাবটা চরম আকারে ফুটে উঠেছে লোকটার মধ্যে। শহীদ ভাবছিল কোনদিক থেকে কোন সাহায্যের আশা নেই। মি. সিম্পসনকে সম্ভবত গাড়ির কাছে বাধা দেয়া হয়েছে।
আমি আর একবার সুযোগ দেব। শেষ বার বলছি, এদিকে আসুন। | শহীদ শুরু করল, আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, এবং আমি আদেশ দিচ্ছি…।
* শহীদ ওর পিছনে একটা শব্দ শুনল। নরম মৃদু শব্দ। ঘুরে তাকাবার চেষ্টা করল ও। কাউকে দেখতে পেল না। গর্জে উঠল সামনে দাঁড়ানো, লোকটার হাতের রাইফেল । ওয়ার্নিং ফায়ার । শহীদের মাথা থেকে ইঞ্চি দেড়েক উপর দিয়ে ছুটে গেল বুলেট।
হঠাৎ শহীদের পিছনে দ্রুত শব্দ উঠল একটা। শহীদ ঘুরে দাঁড়াবার সাথে সাথে দেখল একজন লোককে । অচেনা লোক। শহীদের মাথার উপর উঁচিয়ে
১২০
ভলিউম-১১
ধরেছে লোকটা একটা হাতুড়ি। এক পলক সময়ও পেল না শহীদ সাবধান হবার। নেমে এল হাতুড়িটা মাথা বরাবর প্রচণ্ড বেগে। মাথাটা সরিয়ে নেবার ব্যর্থ প্রয়াস পেল ও। তবে আঘাতটা লাগল মাথার একপাশে, পিছলে গেল হাতুড়িটা। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় অন্ধকার ঘনিয়ে এল অকস্মাৎ ওর চোখের সামনে।
ঢলে পড়ে গেল শহীদ। জ্ঞান হারাল সাথে সাথেই।
চোখের সামনে তখনও গাঢ় অন্ধকার বিরাজমান।
জ্ঞান ফিরছে শহীদের, কিন্তু ও এখনও অর্ধ-সচেতন। নিকষ কালো অন্ধকারই সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ওকে। এখন প্রচণ্ড ব্যথায় অবশ হয়ে আসছে সর্বশরীর। কোথাও কোন শব্দ নেই। অন্ধকার, নৈঃশব্দ্য এবং মাথায় দাউ দাউ জ্বলছে ব্যথার আগুন ।
চোখ খুলল শহীদ। তবু গাঢ় অন্ধকার দূর হল না। ব্যথাটা অপেক্ষাকৃত কম মনে হল । চোখ দুটো আবার বন্ধ করল ও। ..
| শহীদ স্মরণ করার চেষ্টা করল সব কথা। ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগল। গোলাম হায়দার হত্যাকাণ্ডের সকল ঘটনা। গোলাম হায়দার জামিল হায়দারের ভাইয়ের ছেলে । বিয়ে হবার আগেই কোন এক যুবতীর গর্ভে জামিল হায়দারের এক অবৈধ সন্তান হয়। পঁচিশ বছর ধরে সে সন্তানের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। অন্তত সকলে তাই জানিয়েছে। জামিল হায়দার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের বড় চাকুরে। তার মান-সম্মান আ৫ে সমাজে। এবং এই মান-সম্মানের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় গোলাম হায়দার। সে জানল জামিল হায়দারের অবৈধ সন্তানের খবর। সে ব্ল্যাকমেল শুরু করে চাচাকে। তারপর একদিন খুন হয় গোলাম হায়দার। খুনী হিসেবে গ্রেফতার করা হয় জামিল হায়দারকে। এখন জামিল হায়দারের বিচার চলছে। কিন্তু জামিল হায়দার গ্রেফতার হবার পরপরই নাটকীয়তার সূচনা হয়। জামিল হায়দারের কন্যা মিস রোশনা ইরাক থেকে ঢাকায় এসে শহীদকে জানায় তার আম্মা, মিসেস জামিলকে পুলিসের তরফ থেকে পাহারা দিতে হবে। শহীদ বুঝতে পারে মিসেস জামিল আততায়ীর হাতে নিহত হবে এই আশঙ্কা করছে মিস রোশনা । কিন্তু মিস রোশনা এর ভিতরকার রহস্য চেপে যায়। সব কথা খুলে বলে না শহীদকে। শহীদ সেদিন রাতেই মিস রোশনার সাথে দেখা করে কথা আদায় করার জন্যে যায় তার ভাই শামিম হায়দারের বাড়ি। সেই বাড়িতে একজন হ্যাট পরিহিত লোককে দেখে ও লোকটা বেপরোয়াভাবে পালিয়ে যায়। শহীদ দেখে বাড়ির ভিতর মিস রোশনা হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় এবং শামিম হায়দার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে অচেতন। কিন্তু ওরা দুজনই অস্বীকার করল পরে। হ্যাট পরিহিত লোকটাকে ওরা চেনে না। অথচ শহীদের ধারণা হয় ওরা লোকটাকে চিনেও মিথ্যে কথা বলেছে।
কুয়াশা-৩৩
| ১২১
শহীদ এরপর কামালকে নির্দেশ দেয় মিস রোশনা যেখানে যায় সে নি পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করার জন্যে। কামাল একটা পোড়োবাড়ির ঠিকানা জানায় ফোনে। শহীদ ছুটে যায় সেখানে। দেখে কামাল মারাত্মক অবস্থায় আহত হয়ে পড়ে আছে, মিস রোশনা কোথাও নেই। কামালকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডাক্তাররা
জানায় কামালকে বাঁচানো তাদের ক্ষমতার বাইরে। কুয়াশা ছুটে আসে খবর পেয়ে। কামালকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায় সে। পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকজন ডাক্তার কুয়াশার কাছে বিশেষ এক গবেষণায় নিযুক্ত, তারা হয়ত কামালকে বাঁচালেও বাঁচাতে পারে। শহীদ রাজি হওয়াতে কুয়াশা কামালকে নিজের আস্তানায় নিয়ে যায়। এদিকে মিস রোশনার কোন সন্ধানই পাওয়া যায়
। তার ভাই শামিম হায়দার দাবি করে রোশনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরপরই সুদূর ইরাক থেকে আগমন ঘটে মোহাম্মদ আমান গাজীর। আমান গাজী বয়সে যুবক, সে শহীদের সাথে দেখা করে জানায় যে মিস রোশেনার সাথে তার প্রেম ছিল, খবর পেয়ে মিস রোশেনাকে উদ্ধার করার জন্যে এসেছে। প্রথম। সাক্ষাৎকারের সময়ই ওদের প্রতি গুলি ছুঁড়ে পালায় একটা লোক। শহীদ বুঝতে পারে না তার প্রতি, না আমান গাজীর প্রতি গুলি ছোঁড়া হল।’ওরা অনুসরণ করল আততায়ীকে। বহুদূর গিয়ে অবশেষে গাড়ি ফেলে পালিয়ে গেল আততায়ী। গাড়ির ভিতর পাওয়া গেল বিশেষ এক ধরনের চুরুট। এই চুরুটই পাওয়া গিয়েছিল সেই পোড়ো বাড়িতে, যেখানে মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল কামাল। বোঝা গেল দুটি ঘটনার নায়ক একজনই। শহীদ এই বিশেষ Ranonez চুরুটের উপর নির্ভর করে লোকটার সন্ধান শুরু করল। পাওয়াও গেল লোকটাকে। কিন্তু পালাতে চাইছিল সে, হঠাৎ কোথা থেকে আমান গাজী ছুটে এসে লোকটাকে ধরে ফেলল এবং মারতে মারতে প্রায় মেরে ফেলার উপক্রম করল। শহীদের আগেই রহস্যময় মনে হয়েছিল আমান গাজীর অদ্ভুত সব ব্যবহার। এবার ওর মনে, প্রশ্ন জাগল ধূত লোকটাকে কি আমান গাজী উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলতে চাইছিল? শহীদ ভেবে-চিন্তে গ্রেফতার করল আমান গাজীকে। ধৃত লোকটার নাম খালেক। তাকে বিভিন্ন ভাবে জেরা করার প্রয়াস পাওয়া গেল। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিল না সে। শহীদ এরপর আমান গাজী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যে তার পাঠাল ইরাকে। ইরাক থেকে যে আমান গাজীর খবর এল সে আমান গাজীর বয়স পঞ্চাশ উত্তীর্ণ । মি. এবং মিসেস হায়দার আমান গাজীর নাম শোনা মাত্র দারুণ ভাবে চমকে উঠলেন এবং এ-সম্পর্কে বিস্তারিত কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। এদিকে মিস রোশনার কোন সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে । হঠাৎ মি. সিম্পসনের সাথে শহীদ চলে আসে আমান গাজী এবং শামিম হায়দারকে অনুসরণ করার জন্যে••• |
একে একে সকল কথা মনে পড়ে গেল শহীদের।
ভলিউম-১১
১২২
কতক্ষণ ধরে অজ্ঞান হয়েছিল তা বুঝতে পারল না।
ব্যথাটা কমে আসছে মাথার। কিন্তু অন্ধকারে নিজের এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন সদ্য ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে না বলে অস্বস্তি বোধ করছে ও। কোথায় আছে সে? হাত দুটো বাধা। চিত হয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে। অন্ধ কুপে ফেলে গেছে শত্রুরা ওকে? নাকি কয়েদখানা এটা? ফার্ম হাউসের এবং যে লোকটা ও মাথায় হাতুড়ির ঘা মেরেছিল তার কথা মনে পড়ল ওর।
ধীরে ধীরে উঠে বসবার চেষ্টা করল। মাথার ব্যথাটা বাড়ল খানিক। উঠে বসল ও। একই প্রচেষ্টায় দাঁড়িয়ে পড়ল। একপা একপা করে অতি সাবধানে প বাড়াল। হাত দুটো এগিয়ে দিয়েছে। যাতে দেয়াল-টেয়াল থাকলে বুঝতে পার যায়। পাওয়া গেছে দেয়াল। দেয়ালের পিঠে হেলান দিয়ে হাঁপাতে শুরু করল ও মাথার ব্যথাটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে আবার।
গাঢ় অন্ধকার দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন দিকেই কোন জানালা নেই। হঠাৎ তলপেটের শূন্যতাবোধ অপেক্ষাকৃত বেশি মনে হল শহীদের। খিদে? মনে মনে এত দুঃখেও হাসি পেল। প্রশ্ন জাগল পরক্ষণেই–এখন রাত না দিন?
| দেয়াল ঘেঁষে পা-পা করে এগোতে লাগল শহীদ। জানালা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। দরজা নিশ্চয় একটা না একটা কোথাও আছে। ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে এক সময় দাঁড়িয়ে পড়ল ও। হাত দুটো বাঁধা তবু শক্ত কাঠের স্পর্শ অনুভব করতে ভুল হল না। পরীক্ষা করে দেখল শহীদ। হ্যাঁ, এটা একটা দরজাই বটে।
এবার চেষ্টা করল হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে। বার বার প্রাণপণে চেষ্টা করল ও হাত দুটোকে মুক্ত করার জন্যে। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল খোলা গেল না শক্ত দড়ির বাঁধন।
দরজার হাতল ধরল শহীদ কোনরকমে । হাত দুটো বাঁধা হলেও হাতলটা মুঠো করে ধরতে পারছে ও, ঘোরাতেও পারছে। দরজাটা তালা মারা কি না ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল ওর ।
দরজা অবশেষে খুলে গেল। তার মানে তালা দেয়া ছিল না। আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল ওর মনে। কিন্তু পরমুহূর্তে সে আনন্দ উবে গেল মন থেকে। দরজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়েছে বটে, কিন্তু তাসত্ত্বেও সামনে গাঢ় অন্ধকার বিরাজমান। তার মানে কি? তবে কি এক ঘর থেকে অন্য ঘরে প্রবেশ করার দরজাটা খুলেছে ও? তবে কি বন্দী দশা থেকে মুক্তি পায়নি ও?
দরজাটা অতিক্রম করে কয়েক পা সামনে বাড়ল অন্ধকারে। বাঁ দিকে দেয়াল রয়েছে, স্পর্শ করে অনুভব করল । ডান দিকেও দেয়াল, পরীক্ষা করে দেখল। তার মানে একটা সরু গলির মধ্যে এসে পড়েছে ও। যাক এটা তাহলে কোন বন্ধ ঘর
কুয়াশা-৩৩
, প্যাসেজ। দেখা যাক কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে প্যাসেজটা। অতি সাবধানে এগিয়ে চলল শহীদ ধীরে ধীরে।
খানিক দূর যেতেই পা ফসকে পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নিজেকে সামলে নিল শহীদ। পাটা, মচকে গেল না ভাগ্যক্রমে। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি সামনে সিঁড়ির ধাপ। ধাপগুলো সাবধানে গুনে গুনে নামতে লাগল ও। মাত্র দুইটা ধাপ। তারপর দু’দিকে দুটো প্যাসেজ চলে গেছে। কোন দিকে যাওয়া যায় এখন? ভেবে এক্ষেত্রে কোন লাভ নেই। দু’দিকেই নিকষ কালো ঘন অন্ধকার। ডান দিক ধরে এগিয়ে চলল শহীদ। খানিক দূর যেতেই মাথাটা ঠুকে গেল দেয়ালের সাথে । বাধা হাত দুটো দিয়ে পথের সন্ধান করে চলল ও। সামনে দেয়াল। বাঁ দিকে একটা প্যাসেজ পাওয়া গেল। পা-পা করে এগিয়ে চলল ও। আবার সিঁড়ি পাওয়া গেল। উপর দিকে উঠে গেছে, মোট ছয়টা ধাপ। ধাপগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে চলল ও দেয়াল ধরে ধরে। ডান দিকে দুবার মোড় নিল। অন্ধকারের যেন শেষ নেই। এগিয়ে চলল শহীদ। বিশ পঁচিশ কদম এগোবার পর আবার মোড়।
মোড় নিতেই শহীদ আলোর দেখা পেল। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা দরজা। দরজার বাইরে একটা বাল্ব জ্বলছে। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে উত্তেজনায়। এগোল ও। দরজাটার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। শক্রর আস্তানা এটা! এখন কি করা উচিত? নিজেকে মুক্ত করা দরকার সব চেয়ে আগে। কিন্তু শত্রুর আস্তানায় কেউ তার বাঁধন খুলে দেবে এ আশা বাতুলতা। অথচ কারও সাহায্য ব্যতীত বাধন। মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এই বাড়ি থেকে বের হবার উপায় ও জানা নেই।
| দুহাত তুলে দরজায় ধাক্কা মারল শহীদ। যা হবার হবৈ । চুপচাপ দাঁড়িয়ে। থেকে কোন লাভ নেই। ভাগ্যের উপর নির্ভর না করে কোন উপায় নেই এই মুহূর্তে। ঘরের ভিতর আলো যখন জ্বলছে তখন ভিতরে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে। তা সে-লোক শত্রু••• |
দরজাটা খুলে গেল অকস্মাৎ। দরজার পাল্লা দুটো শহীদের গায়ে এসে ধাক্কা মারল। ঘরের ভিতর থেকে উজ্জ্বল আলোর বন্যা বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোর বিপরীতে, দরজার চৌকাঠে, এসে দাঁড়িয়েছে এক নারী। শহীদ পরিষ্কার চিনতে পারল মিস রোশনা হায়দারকে।
মিস রোশনা চমকে উঠে পিছিয়ে গিয়ে ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল একটা। শহীদ প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঢলে পড়ছে। খপ করে ধরে ফেলল ও দরজার একটা পাল্লা। হেলান নিয়ে দাঁড়াল ও। মিস রোশনা দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘দাঁড়ান, ধরছি!’
দ্রুত দু’পা এগিয়ে এসে শহীদের কাধ ধরে ফেলল মিস রোশনা। শহীদ পা বল । ঘরে ঢুকে মিস রোশনার সাহায্য ছাড়াই কয়েক পা এগিয়ে একটা কাঠের 5োরে ধপু করে বসে পড়ল ও মাথার ব্যথাটা বেড়ে গেছে হঠাৎ। মিস রোশনা দরজা বন্ধ করে দরজার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকাল শহীদের দিকে।
১২৪
ভলিউম-১১
তারপর অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারণ করল, “মি. শহীদ!”
‘অদ্ভুত জায়গায় দেখা হল। যাক, আগে আমার হাতের বাঁধন খোলবার ব্যবস্থা করা যায়?’ শহীদ হাসবার চেষ্টা করে বলল।
মিস রোশনা ব্ৰস্তপদে একটা টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল । ড্রয়ার থেকে বের করল সে একটা চকচকে ধারাল ছোরা। ছোরাটা নিয়ে এগিয়ে আসছে সে শহীদের দিকে সোজা ।
বুকটা ধ্বক করে উঠল শহীদের। মিস রোশনার সকল রহস্যময় আচরণের কথা মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল। মিস রোশনা তার শত্রু না মিত্র?
| এগিয়ে আসছে মিস রোশনা। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো লেগে চক্চকে ছোরার। ব্রেডটা ঝিলিক মারছে । অসহায়বোধ করল শহীদ। কিন্তু মিস রোশনা সে সব লক্ষ করল না। শহীদের বাড়িয়ে ধরা হাত জোড়া ধরে দড়ির বাঁধনের উপর ছোরা চালাতে শুরু করল সে।
বাঁধন কেটে ফেলল মিস রোশনা। কাটতে গিয়ে দু’জায়গার মাংসে ছোরার ডগা বিধে রক্ত বের হল। তীব্র জ্বালা করতে লাগল কাটা জায়গাগুলো।
| মিস রোশনা পাশের ঘরে গেছে। একটু পরে দুধ নিয়ে এল সে। শহীদ বিনাবাক্য ব্যয়ে গ্লাসটা খালি করল। ক্লান্তি বোধ ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে। শহীদ দেখল মিস রোশনাকে সুসজ্জিতই দেখাচ্ছে। ঘরের দিকে মনোযোগ দিল এবার ও। এটা একটা কিচেনরাম। | মিস রোশনা পাউরুটি কাটছে মিটসেফের কাছে দাঁড়িয়ে। স্টোভে চায়ের পানি ফুটছে। খানিক পরই শহীদের সামনে একটা ট্রে এনে রাখল মিস রোশনা। স্যাণ্ডউইচ, পাউরুটি, মাখন, পনির এবং মধু। সিস রোশনা বলল, খিদে পেয়েছে। বলে মনে হয়, কেমন?’
শহীদ খেতে খেতে বলল, “খুব।’
খাওয়া সারল শহীদ নিঃশব্দে। তারপর হঠাৎ পকেটে হাত ভরল। রিভলভারটা নেই, আশাও করেনি ও। ঘড়িটাও নেই। মিস্ রোশনা জানতে চাইল, “কি খুঁজছেন?”
ক’টা বাজে বলতে পারেন?’ ‘এগারোটা দশ।’ ঘড়ি দেখে বলল মিস রোশনা। শহীদ জিজ্ঞেস করল, “কি বার আজ?
শনিবার।’ শহীদ নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল, ‘সৌভাগ্যক্রমে একটা দিন হারাইনি আমি।’
কতক্ষণ ধরে অমন হালে ছিলেন আপনি? ‘শেষ ব্যাপার যেটা আমার স্মরণ আছে সেটা হল আজ বেলা দুটোর সময়
কুয়াশা-৩৩
১২।
ঘাত খেয়ে জ্ঞান হারাই আমি।
খিদে লাগাটা অস্বাভাবিক নয় সেক্ষেত্রে। আপনি আমাকে আরও আগে মুক্ত করতে পারতেন। আমি জানতাম না আপনি এখানে রয়েছেন।’
শহীদের মনে হল মিস রোশনা সত্য কথা বলছে না। কিন্তু কেনই বা সে মিথ্যে কথা বলতে যাবে? কি প্রয়োজন তার মিথ্যে কথা বলবার? শহীদ কথা বলল । মিস রোশনা বলতে শুরু করল, আমি জানতাম না। সারাদিন এখানে ছিলাম
আমি। ওরা আজ দুপুরে কয়েক ঘন্টার জন্যে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল আজই প্রথম।’
কবে থেকে?’ “সোমবার থেকে।’
আপনাকে বুঝি ইয়াকুৰ এখানে নিয়ে এসেছিল?”
মিস রোশনা চমকে উঠল । এবং রাঙা হয়ে উঠল তার মুখাবয়ব। কোন উত্তর দিল না সে। শহীদ বলল, আমি ইয়াকুবকে চিনি। একজন পুলিসকে আক্রমণ করার জন্যে তার বিচার হবে, আরও সব ব্যাপার আছে। হাজতে সে এখন। এসব আপনি জানেন?’
‘শুনেছি সে কাউকে আক্রমণ করেছিল। না, সে আমাকে এখানে নিয়ে আসেনি। পোডড়া সেই বাড়িটা থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল বটে.সে আমাকে। অন্য একজন গাড়ি করে এখানে নিয়ে এসেছিল, মঙ্গলবার রাতে। এখানে আমাকে একটা অন্ধকার সেলে রাখা হয়েছিল, যেখানে আপনি ছিলেন।
কিন্তু বেশ আরাম আয়েশে আপনাকে রেখেছে, দেখতে পাচ্ছি।’
মিস রোশনার মুখ রাঙা হয়ে উঠল আবার। বলল, মঙ্গলবার দিন আমাকে কিছু জিনিসপত্র এনে দেয় ওরা। সেলে অবশ্য কয়েক ঘন্টা রেখেছিল আমাকে।’
‘কেন?” ‘ওরা আমাকে ভয় দেখাতে চাইছিল। কিছু তথ্য আদায় করার উদ্দেশ্যে।
কি এমন তথ্য?
মিস রোশনা চোখ বন্ধ করল। বলল, আমি জানি না। আমার ভাই শামিম হায়দারের বাড়িতে যে কাগজপত্রের জন্যে ওরা গিয়েছিল সেই কাগজপত্রের সন্ধানে এখনও মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। ওসব সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ কোন ধারণাই নেই আমার। অথচ ওরা মনে করে আমি জানি কাগজপত্রগুলো কোথায়। আছে। আমার অজ্ঞতা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল ওরা পরে। বৃহস্পতিবার দিন এখানে নিয়ে আসে আমাকে। তারপর থেকে এখানেই রাখা হয়েছে আমাকে, আজ দুপুর বেলাটা ছাড়া।
কতজন লোক আছে এখানে?’ ১২৬
ভলিউম-১১
‘তিনজনকে দেখেছি আমি।’
আগে থেকে চিনতেন কাউকে?’
। দু’জন সম্ভবত এখানেরই লোক, তৃতীয় জন এসেছে ঢাকা থেকে। বেঁটে এবং কালো লোকটা। সব সময় সে এখানে থাকে না, কিন্তু আজ সে ফিরে এসেছে। আমার মনে হয় কোন কারণ ঘটেছে, তা না হলে আমাকে বের করত না দুপুর বেলা।’ | শহীদ বলল, ‘কারণটা আমি। আচ্ছা, আপনি নিশ্চয় জানতেন যে ইয়াকুৰ আমাকে এবং আপনার ভাইকে আক্রমণ করেছিল আপনার ভাইয়ের বাড়িতে? তাই
?’
মিস রোশনা উত্তর দিল না। শহীদ প্রসঙ্গ বদল করে বলল, তাহলে আপনার যা যা দরকার সবই দিচ্ছে ওরা?’
‘খাবার দিচ্ছে, কাপড়ও দিচ্ছে–ব্যস।
প্রথম রাত ছাড়া পরে আর আপনাকে প্রশ্ন করা হয়নি?’
। ঢাকা থেকে আসা লোকটা প্রশ্ন করেছিল।’ ‘ওরা শুধু মাত্র সেই কাগজপত্র বা ডকুমেন্টগুলো সম্পর্কে আগ্রহী?’
মিস রোশনা একমুহূর্ত কি যেন ভেবে বলে উঠল, মি. শহীদ, আমি যতটুকু জানি তার সবটুকুই বলেছি। এবং মিথ্যে কথা বলিনি আপনাকে।
কিন্তু অনেক কথাই আপনি আমাকে এখনও বলেননি।’
শহীদ কথাটা বলে দরজার দিকে তাকাল। এখানের দরজা জানালাগুলো সম্পর্কে কোন ধারণা নেই ওর। কেউ শুনছে না তো ওদের কথাবার্তা? মনে একটা প্রশ্ন জাগল ওর–তাকে কেন এমন সেলে রাখা হয়েছিল যেখান থেকে বের হওয়া এত সহজে সম্ভব হল? বের হবার পর প্রায় নির্ধারিতভাবে কি ভাবে সে মিস রোশনার ঘরে পৌঁছুল। আলো জ্বলছিল একমাত্র মিস রোশনার কিচেনরূমে। তার মানে কি এই যে শত্রুরা চায় তার সাথে মিস রোশনার দেখা হোক? তাকে বন্দী করে না রেখে হত্যা করলেই সব ঝামেলা চুকে যেত। তা কেন করেনি শত্রুরা? নাকি সে মরে গেছে মনে করেছে ওরা?
শহীদ উঠে দাঁড়াল। মিস রোশনা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল, কি করতে যাচ্ছেন আপনি?’ * আশপাশটা দেখা দরকার । জানেন না বুঝি যে এখান থেকে ছাড়া পেতে
হবে আমাদেরকে?”
ছাড়া পাওয়া অসম্ভব। বের হবার সব দরজা বাইরে থেকে তালা বন্ধ। জানালাগুলোও বাইরে থেকে বন্ধ। এবং আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ সব সময় পাহারা দিচ্ছে।’
শহীদ কথা না বলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা বাইরে থেকেই কুয়াশা-৩৩
১২৭
তালা মারা। মজবুত তালা। ধাক্কা দিলে আধইঞ্চিটাক ফাঁক হয় পাল্লা দুটো। কোথাও স্পাইহোল দেখা গেল না। দেয়ালগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল শহীদ। কিছু পাওয়া গেল না। ড্রেসারের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল ও এবার।
: হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ও। মনে হল কি যেন নড়েচড়ে উঠল। | ড্রেসারের প্যানেলগুলো সার্চ করতে শুরু করল শহীদ। যা আশঙ্কা করছিল পাওয়া গেল তা। কাঠের গায়ে বড় একটা ছিদ্র। খুব বেশি অবাক ভাব না দেখিয়ে সরে গেল শহীদ ড্রেসারের কাছ থেকে। মিস রোশনা প্রশ্ন করল, দেখলেন কিছু?
কিছু দেখছি বলে মনে হয় না।’ চেয়ারে বসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল শহীদ।
আড়চোখে তাকাল ও ড্রেসারের গায়ের ছিদ্রটার দিকে। ছিদ্রের মধ্যে একটা চোখ রয়েছে, দেখতে ভুল হল না শহীদের । তার মানে সত্যি সত্যি নজর রাখা। | হচ্ছে তাদের প্রতি। শহীদ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মিস রোশনাকে বলল, ‘এবার কথা
শুরু করা যাক। বলুন, কেন আপনি ইয়াকুবের সাথে সেই পোড়োবাড়িতে গিয়েছিলেন?’
আমাকে সে ডেকে পাঠিয়েছিল। যাওয়া উচিত বলেই মনে হয়েছিল।’ উত্তর দিতে অনিচ্ছা মিস রোশনার, বুঝতে পারছিল শহীদ। ‘আপনি জানতেন সে একজনকে আঘাত করেছিল।’
সে আমাকে একটা ঘরে রেখে গিয়েছিল । একজনের চিৎকার কানে ঢুকেছিল, অবশ্য।’
এবং কিছু করার কথা ভুলে পুতুলের মত বসেছিলেন সেখানে, কেমন?’ মিস রোশনা, কোন উত্তর দিল না। শহীদ বলতে শুরু করল, ইয়াকুব আপনাকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে দেখা যাচ্ছে। ঢাকার সেই বাড়িতে, যেখানে আপনি ইরাকে যাবার আগে থাকতেন, সেখানে অধিকার দিয়েছিলেন বাস করবার। অথচ ওই ধরনের লোক তো আপনার সাথে মেলামেশার উপযুক্ত নয়। ব্ল্যাকমেল জঘন্য ব্যাপার। কেন সে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করার সুযোগ পায়? * মিস রোশনা উত্তর দিল না।
চুপ করে থাকলে কোনই লাভ হবে না। এটা একটা জঘন্য কেস। হত্যা, হত্যার চেষ্টা, ধ্বংসাত্মক কাজ, গুলি ছোঁড়াছুড়ি–এসব আপনার এবং আপনাদের
পরিবারকে নিয়ে ঘটে চলেছে। আপনার সাব্বা সম্ভবত ফাঁসিতে ঝুলবেন,, অন্যান্যরা নিহত হতে পারে, যদি এখনও আপনি সব কথা খুলে না বলেন। কেন আপনি ইয়াকুবকে যা ইচ্ছা করবার অধিকার দিয়েছেন? কেন আপনি গিয়েছিলেন ইরাকে? কি কাগজপত্রের সন্ধানে ফিরছিল ইয়াকুব? কেন..? * অকস্মাৎ চুপ করে গেল শহীদ! কোথায় যেন কেমন অদ্ভুত একটা শব্দ হল।
দরজার দিকে তাকাল শহীদ।
দরজার নিচের সামান্য ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। কেঁপে উঠল শহীদের
১২৮
ভলিউম-১১
সর্বশরীর।
সম্মোহতের মত দরজার দিকে তাকিয়ে রইল শহীদ। শহীদের দৃষ্টি অনুসরণ করে মিস রোশনা তাকাল দরজার দিকে। পোড়া কাঠের গন্ধ ঘরের ভিতর। চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল সে, আগুন!
শহীদ অস্বাভাবিক গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, ‘আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এমনটিই তো হবার কথা! এই চরম বিপদের মুখেই তো টেনে এনেছেন আপনারা।’
শহীদ কথাগুলো বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিচেনরূমে দ্বিতীয় দরজাটা খোলবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু নিরাশ হল। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা চেয়ার তুলে আগুন ধরা দরজাটায় আছাড় মারল এবার ও। ভেঙে টুকরো হয়ে গেল চেয়ার। দরজার তেমন কোন ক্ষতিসাধন হল না। মজবুত পুরু কাঠ । মিস রোশনার দিকে ফিরে উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল ও, কোদাল বা কুড়ুল বা হাতুড়ি-টাতুড়ি কিছু আছে?’
হাতুড়ি পাওয়া গেল বটে একটা। কিন্তু দরজা ভাঙার জন্যে সেটা নেহাতই অচল । দরজায় হাত ঠেকাতেই উত্তাপ অনুভব করল শহীদ। মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। মিস রোশনা চিৎকার করে উঠল, বাঁচাও!’ | শহীদ দেখল দ্বিতীয় দরজাটার ফাঁক দিয়েও ধোয়া ঢুকছে। জানালাগুলোর দিকে তাকাল শহীদ দ্রুত। জানালাগুলোতেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বাইরে থেকে।
ধোয়ায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে ঘরটা। বাইরে বের হবার কোন পথ নেই। ঘন ঘন কাশছে–দু’জনেই। চোখ জ্বালা করছে। পানি গড়িয়ে পড়ছে দরদর করে । চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। শহীদ পাগলের মত দরজার গায়ে হাতুড়ির ঘা মেরে চলেছে। ওর মাথার ব্যথাটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। দরদর করে ঘামছে। প্যান্টশার্ট ভিজে গেছে সম্পূর্ণ। ব্যর্থতা ছাড়া কিছু যেন আশা করার নেই। হাতুড়ি পড়ে গেল হাত থেকে ছিটকে। ফোস্কা পড়ে গেছে হাতের চেটোয়। দরজার কোন ক্ষতিই হয়নি। চিৎকার করে মিস রোশনাকে বলল শহীদ, দেশলাই আছে?’
| কাশতে কাশতে দুটো দেশলাই বের করে দিল মিস রোশনা শহীদকে। মৃত্যু ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠেছে তার মুখের চেহারা। শহীদ ওর দিকে না তাকিয়ে দেশলাই জ্বেলে উপরদিকের দেয়াল পরীক্ষা করতে শুরু করল। বিরাট লম্বা, ড্রেসারটা সরিয়ে দেখার কথা মনে হল ওর । মিস রোশনাকে ইঙ্গিতে ডাকল ও।
দু’জন মিলে ফেলে দিল ধাক্কা মেরে ড্রেসারটা। প্রায় দেড় মানুষ উপরে একটা গর্ত দেখা গেল । চোরাপথ । টেবিলটা টেনে নিয়ে এসে মিস রোশনাকে ধরে গর্তের মুখে তুলে দিল ও। মিস রোশনা দ্রুত নেমে গেল গর্ত দিয়ে। শহীদও নামল পরমুহূর্তে। কিন্তু দেশলাই জ্বেলে চারদিকটা দেখার পর জীবনের সকল আশা ত্যাগ ৯-কুয়াশা-৩৩
১২৯
করল শহীদ।
| চোরা পথ দিয়ে একটা প্যাসেজে এসে পড়েছে ওরা। কিন্তু প্যাসেজের দু’দিকের দুটো দরজাই বিপরীত দিক থেকে বন্ধ । ধোয়ায় ভরাট হয়ে রয়েছে প্যাসেজটা। চোখ মেলতে পারছে না শহীদ কোন মতে। শ্বাসের সাথে ফুসফুসে ধোয়াই ঢুকছে কেবল। মিস রোশনা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে অসহ্য কষ্টে কাশছে। শহীদ দুর্বল হয়ে পড়ছে। মৃত্যু এগিয়ে আসছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছে শহীদ। কিন্তু মৃত্যু বরণ করা ছাড়া এখন আর কোন গত্যন্তর নেই। কোন শক্তি নেই
শহীদের আর।
ধীরে ধীরে বসে পড়তে বাধ্য হল ও। তারপর শুয়ে পড়ল কাশতে কাশতে ।
মধুপুর থানার ইন্সপেক্টর কবির আহমেদ বলল, সর্বত্র খোঁজা হচ্ছে, মি. কামাল। হয়ত ওঁরা মধুপুর জঙ্গলের দিকে আছেন, হয়ত গ্রামের দিকে কোথাও। খবর । পাওয়া যাবে, যদি তারা এই এলাকার মধ্যে কোথাও থেকে থাকেন। সব জায়গার রিপোর্ট এখনও এসে পৌঁছায়নি। অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে…’
কামাল বলে উঠল, এই এলাকা থেকেই শেষ নির্দেশ পেয়েছে পেট্রল কারগুলো। নিশ্চয় ওরা এই এলাকার আশেপাশে কোথাও আছে।’
কামালের সঙ্গে একজন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক এসেছেন মধুপুর থানায়। কামাল তার কোন পরিচয় দেয়নি ইন্সপেক্টরকে। সে গম্ভীর ভারি কণ্ঠে বলে উঠল, ওরা
এই এলাকার কোথাও থাকতে বাধ্য।
ইন্সপেক্টর বলল, ‘আমার অধীনে যত লোক আছে সবাইকে সন্ধানে পাঠিয়েছি। নিশ্চিন্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। সন্ধান পাওয়া মাত্রই খবর পৌঁছে যাবে। তাছাড়া তত ভয়ের বোধহয় কিছু নেইও।’
দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক গম্ভীর এবং অস্বাভাবিক মোটা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এই ধরনের কাজে ভয় এবং বিপদ সব সময়ের সঙ্গী। ভয় নেই এ কথা ববেন না।’
এমন সময় বেজে উঠল ফোন। ইন্সপেক্টর রিসিভার তুললেন। ফোনের কথা শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠল তার চেহারা। শক্ত করে রিসিভার ধরে বলে উঠল সে, ‘শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্ম? চিনি! ঠিক আছে–এখুনি আসছি আমরা…!’
| ফোন ছেড়ে দিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ইন্সপেক্টর। বলল, তিনজন লোককে পাওয়া গেছে আহত অবস্থায়–তাদের মধ্যে একজন মি. সিম্পসন। মি. শহীদের কোন সন্ধান নেই।’
চলুন, দেখা যাক।
প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্মের সামনে গাড়ি থেকে নামল ওরা। ফার্মে আগুন জ্বলছে তা ওরা দেখতে পেয়েছে দূর থেকেই। গাড়ি
১৩০
ভলিউম-১১
থেকে নেমে প্রধান গেট দিয়ে ফার্মের উঠানে প্রবেশ করল ওরা তিনজন । কয়েকজন কনস্টেবল এবং একজন সাব ইন্সপেক্টর ছুটে এল ওদের দিকে। ফার্মে এখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ফার্মের বাঁ পাশের বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সাব ইন্সপেক্টর বলল, “মি. সিম্পসন জ্ঞান ফিরে পাননি, স্যার । তিনজনকেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওরা এই ঘাসের উপর পড়েছিল ।
ওদের মধ্যে একজন শুধু রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছেছিল, আমরা দেখতে পাই তাকে ।
কামালের সঙ্গী ভদ্রলোক গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল, ‘দমকল কি করছে?
দমকল বাহিনী বস্তির আগুন যাতে বেশি দূর ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার ব্যবস্থা করছে।’
কামালকে ইঙ্গিত করে দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক এগিয়ে চলল উঠান ধরে। সামনের সারি সারি ঘরগুলোর প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। পিছনে ইন্সপেক্টর
এবং সাব ইন্সপেক্টরও এল। কামাল বলল, দরজাটা ভাঙার উপায় করা যায় না?
যায়।’
দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক আশপাশে তাকালেন। সারি সারি ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। হাত পনেরো বিশ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। এর বেশি সামনে এগোনো যাচ্ছে না গরমের কারণে। দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক বিরাট লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে ফিরে এল গোয়াল ঘরের মাচা থেকে। সারি সারি ঘরগুলোর প্রধান দরজার বেশ কাছাকাছি এগিয়ে গেল সে। সাব ইন্সপেক্টর উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, কি করতে যাচ্ছেন আপনি? যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে ঘরগুলো! মরবেন নাকি?’
দীর্ঘদেহী উত্তর দিল না। আরও সামনে এগিয়ে গেল সে। তারপর লম্বা বাঁশটা দিয়ে আঘাত করল দরজাটার গায়ে। আগুন-ধরা দরজায়, ধাক্কা দিতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল। সকলে দেখল দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে ঘরের ভিতর। দীর্ঘদেহী অপলক চোখে কি যেন দেখতে দেখতে গম্ভীর স্বরে কামালের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ঘরের ভিতরের দরজাটা পুড়তে পুড়তে পড়ে গেছে, দেখতে পাচ্ছ কামাল? দরজাটা দিয়ে পাশের রুমটা দেখা যাচ্ছে। রূমটার একধারে ওই যে একটা টেবিল পুড়ছে।’
| কামাল বলল, যা, দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কি বলতে চাও তুমি?’ | দীর্ঘদেহী বলল, ‘টেবিলের উপরদিকের দেয়ালের দিকে তাকাও। একটা বড় গোল গর্ত দেখা যাচ্ছে। আর মেঝেতে একটা আলমারি বা ড্রেসার মত কি যেন পড়ে রয়েছে। এর মানে কি হতে পারে অনুমান করতে পারো? এরমানে ওই আলমারি বা ড্রেসারটা ফেলে দিয়ে টেবিলটাকে ওখানে রাখা হয়েছিল। কেন? সম্ভবত দেয়ালের ওই গর্ত দিয়ে প্রাণ রক্ষা করার জন্যে কেউ এত সব করেছে বলে মনে হয়। দেখা দরকার।’ কুয়াশা-৩৩
১৩১
।
•
–
–
–
–
–
‘পাগল হয়েছেন আপনি! এই দাউদাউ আগুনের মধ্যে দিয়ে ওখানে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া ওখানে গিয়ে লাভই বা হচ্ছে কি?”
দীর্ঘদেহী কোন কথা বলল না ইন্সপেক্টর কবির আহমেদের কথার উত্তরে, নড়লও না এতটুকু। কামাল বলল, কি করা যায়!’
. দীর্ঘদেহী বলে উঠল, ‘আর তো সময় নষ্ট করা যায় না।’
কথাটা বলে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে লাফ দিয়ে ছুটল সে। কামাল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। বাকি দুজন পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠল, আরে! মাথা খারাপ লোক নাকি আপনি, সাহেব! দাঁড়ান, দাঁড়ান।’
কিন্তু ততক্ষণে দীর্ঘদেহী জ্বলন্ত ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে। ওরা তিনজন অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘদেহী খসে পড়া দরজা টপকে লাফ মারতে মারতে দ্বিতীয় ঘরটার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিদ্যুৎবেগে লাথি মেরে জ্বলন্ত টেবিলটা দূরে সরিয়ে দিল সে। তারপর দেয়ালের দিকে মুখ করে লাফ মেরে গর্তটা ধরে ফেলল । ধীরে উঠে পড়ল তার শরীরটা। ধোঁয়ায় মাঝে-মধ্যে ঢেকে যাচ্ছে তার শরীর, ওরা তিনজন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না।
ধোয়া সরে যেতে দেখা গেল দীর্ঘদেহী গর্তের ভিতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চরম উত্তেজিত কয়েকটি মুহূর্ত।
দেখতে দেখতে কেটে গেল পুরো একটা মিনিট। নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সকলে। কিন্তু দীর্ঘদেহী দুঃসাহসী ভদ্রলোকের দেখা নেই।
দুমিনিট পার হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টর বলে উঠল, “মি. কামাল, ভদ্রলোকের পরিচয় কি? এমন অসম্ভব দুঃসাহস আমি জীবনে কারও মধ্যে দেখিনি। ভদ্রলোক এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই পারতেন। আমার বিশ্বাস এতক্ষণে আগুনে পুড়ে খতম হয়ে গেছেন।
কামালের মুখ-চোখ আশঙ্কায় পাথরের মত হয়ে উঠেছে। এমন সময় দমকলের শব্দ পাওয়া গেল। দুটো গাড়ি এসে থামল। দ্রুত কাজ শুরু করে দিল কর্মীরা। ইন্সপেক্টর দমকলবাহিনীর একজন অফিসারকে বলল, “একজন ভদ্রলোক ভিতরে গেছেন মিনিট তিনেক হল । তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করুন আগে।
অফিসার বললেন, ‘আগুন নেভানর পর ৰূর করা সম্ভব। দেখছি আমরা কিভাবে কি করা যায়।
পাইপ দিয়ে পানি নিক্ষেপ শুরু করা হল । কিন্তু অকস্মাৎ পাইপের পানির ধাক্কায় ধসে পড়ল সামনের দুটো ঘর। কামাল চোখ বন্ধ করল। সব আশা নিভে গেল ওর মন থেকে। থরথর করে কেঁপে উঠল ওর শরীর।
ভদ্রলোকের কপালে মৃত্যু ছিল, কি আর করবেন!’ ইন্সপেক্টর মন্তব্য করল । আবার জিজ্ঞেস করল সে, ভদ্রলোকের নাম কি? কামাল কাঁপা কণ্ঠে বলল, কুয়াশা!
১৩২
ভলিউম-১১
কিন্তু কেউ তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল না। ঘটনার নিদারুণ আঘাতে গলা তার এমন কেঁপে গেছে যে কি বলল বোঝা গেল না। পরমুহূর্তে ওদের পিছনে মোটা, ভারি একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমার সঙ্গে এসো কামাল। শহীদকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।’
বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। দেখল দীর্ঘদেহী সেই দুঃসাহসী ভদ্রলোক রূপান্তরিত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা সামনে। তার পোশাক পুড়ে গেছে সর্বত্র। হাতও অক্ষত নয়।
কামাল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। বাকি সকলের চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। কামাল নিজেকে সামলে নিয়ে ঢোঁক গিলে প্রশ্ন করল, কিন্তু কি ভাবে!
কুয়াশা হাসল। বলল, “গর্ত দিয়ে নেমে দেখি একটা প্যাসেজে পড়ে রয়েছে। দুটো দেহ। শহীদকে চিনতে পারলাম, অপরজন একটি যুবতী। দু’জনেই অজ্ঞান। প্যাসেজের দুটো দরজায় তখন আগুন জ্বলছে। একটা দরজা ভেঙে ফেলতে সময় লাগল। দরজা ভেঙে একজন একজন করে দু’জনকেই বের করে ঘাসের্র উপর শুইয়ে রেখেছি। ওদের অবস্থা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি, ভাগ্য বলতে হবে। তবু কোন নার্সিং হোমে পাঠানো দরকার। এসো, দেরি কোরো না, কামাল।
কামাল শুধু অস্ফুটে বলল, তোমার মত অসমসাহসী মানুষ পৃথিবীতে মাত্র একজনই আছে-সে হচ্ছ তুমি । একথা আজ আবার কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।’
কুয়াশা ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
চার নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে আছে শহীদ। খানিক আগে মি, সিম্পসন উপস্থিত হয়েছেন। তাঁকে, তেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে না। মাত্র একঘন্টা ছিলেন তিনি হাসপাতালে। কামালও উপস্থিত।
মিস রোশনার কথা মনে পড়ে গেল শহীদের। উঠে বসল ও বেডে। অসুস্থতা বোধ প্রায় সম্পূর্ণই দূর হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল ও, মিস রোশনা কোথায়?
‘তোমার পাশের রূমেই আছে সে। একটু বেশি অসুস্থ, তবে ঠিক হয়ে যাবে দু’একদিনের মধ্যেই।’ মি, সিম্পসন বললেন।
কামাল শহীদকে উদ্ধারের জন্য কুয়াশার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার কথা বলল। সব শুনে শহীদ নীরব রইল বহুক্ষণ। তারপর বলে উঠল, ওর প্রতি ঋণ আমাদের দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।’
| মি. সিম্পসন, রিপোর্ট পড়ে এসেছেন, তিনি জানালেন, ‘শামিম হায়দা এবং আমান গাজীও নাকি বন্দী হয়েছিল। কিন্তু কিভাবে যেন আমান গাজী নিজেকে মুক্ত করে। মুক্ত হয়ে আমাকে এবং শামিম হায়দারকে জ্বলন্ত ঘর থেকে উদ্ধার করে কুয়াশা-৩৩
১৩৩
একেই নতুন ফিরল শহর বাড়িতে সে আপনা
নিয়ে আসে উঠানে।’
শহীদ সব শুনল। তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে বলে উঠল, আমি আগামীকালই ফিরে যাচ্ছি ঢাকায়। কিন্তু কামাল, কুয়াশা আর তুই খবর পেলি কি ভাবে?’
কামাল বলল, আমি মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আশ্চর্যজনক দ্রুতভাবে সুস্থ হয়ে উঠছিলাম কুয়াশার ডাক্তার বন্ধুদের আবিষ্কার করা ওষুধ খেয়ে । তুই তো সে খবর জানতিস না। কুয়াশা তোকে চমকে দেবে ভেবেছিল আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে। কুয়াশা তাই আমাকে নিয়ে তোর কাছে গিয়েছিল। মহুয়াদি বলল-তুই চলে গেছিস মি. সিম্পসনের সাথে। তোর খোঁজে ফোন করতেই সব জানা গেল। সাথে সাথে চলে এলাম মধুপুর থানায়।’
শহীদ বলল, যাক, এই কেসে কুয়াশার দান অনস্বীকার্য। সে আমাদের দু’জনকেই নতুন জীবন দান করেছে।’
পরদিন ঢাকায় ফিরল শহীদ।
বিকেলে শামিম হায়দারের বাড়িতে গেল. ও। শামিম হায়দারকে না দেখতে পেয়ে শহীদ আমান গাজীকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার বন্ধু কোথায়?’
. তার আম্মাকে দেখতে গেছে। কিন্তু আপনার আগমনের হেতু? জবানবন্দী? জেরা? এ পর্যন্ত তিনজন পুলিস অফিসারকে সব কথা বলেছি আমি। আর একটা স্টেটমেন্টও সই করেছি।’
শহীদ বলল, আমি সত্য জানতে চাই।’
সত্য আপনি আমার স্টেটমেন্টেই পাবেন, মি. শহীদ। আমরা একটা মেসেজ পেয়েছিলাম ওই ফার্মে যাবার, সেখানে গেলে রোশনাকে পাওয়া যাবে এই খবরও ছিল। হয়ত পুলিসের সাহায্য ছাড়া গিয়ে ভুল করেছি আমরা, কিন্তু সেই রকম নির্দেশই দেয়া হয়েছিল আমাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছিল সে দু’একটা কথা জানত রোশনা সম্পর্কে। এখনও মনে করেন নাকি রোশনা স্বইচ্ছায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল?
আমি জানি না!
মানে! কি বলতে চান আপনি! রোশনা প্রায় মরে গিয়েছিল, একি তার নিজের কাজ?
শহীদ বলে উঠল, দুর্ঘটনা সচরাচর ঘটেই থাকে। এমন কোন প্রমাণ আমি পাইনি যাতে বোঝা যায় ও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওখানে ছিল।’
‘আপনি পাগল হয়েছেন!
‘আমি পাগল হইনি। আমি জানি না মিস রোশনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কিনা। ব্যাপারটা দাঁড়ায় সেই রকমই, কিন্তু সে নিজেও ব্যাপারটা তৈরি করে থাকতে পারে-যদি তাই-ই হয় তাহলে সে মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছে। কি
১৩৪
ভলিউম-১১
ভুল? সে এমন একজন লোককে বিশ্বাস করে এই সব ব্যাপার তৈরি করছে যাকে বিশ্বাস করা তার উচিত হচ্ছে না। লোকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। এবং মিস রোশনার কীর্তিকলাপ এখনও সন্দেহজনক।’
সন্দেহজনক!’ সন্দেহজনক আপনার আচরণও।
‘কেন? কেন? কিসের জন্যে আমাকে সন্দেহ করা? একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এবং একজন পুলিস অফিসারকে রক্ষা করার জন্যে নাকি?’
শহীদ বলল, কিন্তু এখনও জানতে পারিনি আমি যে কিভাবে আপনি নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হলেন, এখনও জানতে পারিনি আমি যে, তারা কেন আপনাকে এমন সহজ ভাবে বেঁধেছিল যার ফলে আপনি মুক্ত হতে পারলেন। তারা অন্য কোন ব্যাপারে অমনযোগী হয়নি, কেন আপনার ব্যাপারেই হল? এবং এখনও আমি জানতে পারিনি যে আমি এবং মিস রোশনা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছি মনে করে আপনি সাহসিকতাপূর্ণ উদ্ধার পূর্ব শুরু করেন কিনা। না, আমি পাগল নই। এবং এই সব প্রশ্নের উত্তর আমি চাই।’
আমান গাজী কেবিনেটের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মদের বোতল বের করে গ্লাসে ঢালল। তারপর ফিরে এল স্বস্থানে। শহীদ বলে চলল, আপনি বিপজ্জনক লোকদের সাথে মেলামেশা করছেন, মি. গাজী। শামিম হায়দারের সাথে এত সখ্যতার কারণ কি আপনার?’
‘শামিম হায়দার চমৎকার ছেলে। ওর বোনকে আমি ভালবাসি–তেমনি ওকেও। আমি বিপদমুক্ত দেখতে চাই রোশনাকে।
যাক, কোথায় গেছে শামিম হায়দার?”
তার আম্মাকে দেখতে।’ •
শহীদ ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে ডায়াল করল । মিসেস জামিলের চাকরানী ফোন ধরল অপর প্রান্তে। সে জানাল শামিম হায়দার আজ ওখানে একবারও যায়নি। আর একটা খবর দিল সেমিসেস জামিল মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পুলিশ বিভাগের নার্স শহীদকে উপস্থিত হতে অনুরোধ জানাচ্ছে এখুনি মিসেস জামিলের বাড়িতে।
| ফোন ছেড়ে দিয়ে শহীদ ডায়াল করল মি. সিম্পসনকে। মিসেস জামিলের বাড়িতে একজন ডাক্তার পাঠাবার জরুরী পরামর্শ দিল ও মি. সিম্পসনকে। তারপর ছেড়ে দিল ফোন। আমান গাজীর সঙ্গে দু’একটা কথা বলে শামিম হায়দারের বাড়ি থেকে বিদায় নিল শহীদ। বাড়ির বাইরে পাহারারত একজন কনস্টেবল ছিল সিভিল ড্রেসে। সে শহীদের প্রশ্নের উত্তরে জানাল, শামিম হায়দার সকাল সাড়ে নটায় গাড়ি ছাড়াই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।
শহীদ ভাবল, তারমানে শামিম হায়দার বাড়ির ভিতর লুকিয়েও নেই, সে তার কুয়াশা-৩৩
১৩৫
আম্মাকেও দেখতে যায়নি। লুকিয়েই বা থাকবে কেন সে? কেনই বা হায়দার পরিবারের কেউ কিছু লুকিয়ে রাখবে? নিজেদের জীবনকে অমন সব বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে কি লাভ ওদের? শহীদ কিছুদিন আগে ভেবেছিল কেসটা বোধহয় মীমাংসা হয়ে যাবার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভুল মনে হয়েছিল।
এখন সে ব্যাপারটার জটিলতা বুঝতে পারছে। মি. জামিল বলছেন তিনি তাঁর ভাইপো গোলাম হায়দারকে হত্যা করেননি, অথচ কে করেছে তা-ও বলছেন না। কেন এই আত্মত্যাগ? তবে কি কাউকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে রক্ষা করতে চাইছেন তিনি? কাকে? | নিজের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগনটা নিয়ে এগারো নম্বর চান অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছুল শহীদ। চাকরানী দরজা খুলে দিল। এই চাকরানীটার বয়স হয়েছে, খ্যাদার মা বলে সবাই ডাকে তাকে। মি. জামিল হায়দারকে গ্রেফতার করার দিন এই-ই দরজা খুলে দিয়েছিল।
শহীদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই খাদার মা বলল, ‘বিবিসাহেব বড্ড অসুস্থ। দু’জন ডাক্তার এসেছেন। আপনি উপরে যান, কিন্তু রূমের ভিতর থেকে আপনাদের নার্স দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’
শহীদ উপরে এল খ্যাদার মার সঙ্গে। একটু পরই খুলে গেল মিসেস জামিলের, রূমের দরজা। পুলিস বিভাগের সার্জন ড. মল্লিক বেরিয়ে এলেন রূমের ভিতর থেকে। শহীদ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল । ড. মল্লিক বললেন, কোন মতে প্রাণ রক্ষা পেয়ে গেল মিসেস জামিলের। সময় মত হাজির হতে পেরেছিলাম অন্তত।
ব্যাপারটা আসলে কি?’
শহীদের প্রশ্নের উত্তরে ড. মল্লিক বললেন, আমার বিশ্বাস আর্সেনিক পয়জন পেটে পৌঁছেছিল, কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফাইনাল রিপোর্ট দিতে পারব আমি, মি. শহীদ। তবে আর্সেনিক না হলেও এই জাতীয় কোন বিষ তাতে সন্দেহ নেই। মিসেস জামিল আমাদের নার্সের তত্ত্বাবধানে না থাকলে বাঁচতেন কিনা সন্দেহ।
* ড, মল্লিক চলে গেলেন। মিসেস জামিলের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান রূমের ভিতরই রয়ে গেছেন। শহীদ খাদার মাকে জিজ্ঞেস করল, আজ সকাল থেকে কে
কে দেখা করতে এসেছিল তোমার বিবিসাহেবের সাথে?’, | ‘কেউ না, হুজুর। শামিম সাহেব ফোন করেছিলেন, ফোন ধরেছিল বাবুর্চি । বাবুর্চি আর আমি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই কাজ-কর্ম করার জন্যে। বাবুর্চি বাজারে গেছে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে।
খ্যাদার মা’র আতঙ্কিত ভাবটা দৃষ্টি এড়াল না শহীদের । সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিচে এসে দাঁড়াল শহীদ। খাদার মা-ও সঙ্গে সঙ্গে এল। শহীদের চোখ পড়ল রান্না ঘরের দিকে। কি যেন দেখে এগিয়ে গেল ও। তারপর প্রশ্ন করল, বাবুর্চি কখন গেছে মার্কেটিং করতে?
১৩৬
ভলিউম-১১
সকালে। ধ্যাদার মা উত্তর দিল। .. শহীদ জানতে চাইল, তুমি কোথায় ছিলে বাবুর্চি বাইরে যাওয়ার পর?
সাড়ে ন’টার সময় বাইরে গেছে বাবুর্চি। আমি উপরে বিছানা তৈরি করছিলাম।: বিবিসাহেব আমাকে ডেকে বললেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে, আর তা পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে। বাবুর্চি চলে যাবার পর নিচে নামিনি আমি, হুজুর।
শহীদ বলল, আমাকে বাড়ির পিছনের গেটটা দেখিয়ে দাও একবার।
বাড়ির পিছনের দর টি শহীদ চিনত আগে থেকেই। কেন যে শহীদ খ্যাদার মাকে কথাটা বলল তা সে নিজেই ভাল বুঝতে পারল না। ও তখন চিন্তা করছিল কিচেনরূমের কথাটা। কিচেনরূমের মেঝেতে পোড়া সিগারেটের একটা টুকরো দেখতে পেয়েছে ও। গোল্ডলিফের টুকরো। এত দামী সিগারেট বাবুর্চি নিশ্চয় খায়নি। তাহলে কে খেতে পারে আর?
| শহীদ পিছনের দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘এই দরজার চাবি কার কাছে থাকে?’
বাবুর্চির কাছে একটা, আমার কাছে একটা•••হুজুর, আসলে এ বাড়ির সকলের কাছে এই দরজার চাবি একটা করে আছে। আর ছিল গোলাম হায়দার সাহেবের কাছেও একটা।
‘কেন? সকলের কাছে বাড়ির পিছন দিককার চাবি থাকার কারণ কি?
বাড়ির গ্যারেজটা পিছন দিকেই, হুজুর। প্রায়ই পিছন দিক দিয়ে সকলে আসা-যাওয়া করে ।
শহীদ বলল, দেখি, তোমার চাবিটা দাও আমাকে।’
চাবিটা দেখল শহীদ। তারপর ফিরে চলল বাড়ির ভিতর দিকে। দোতলায় একবার উঠল। খ্যাদার মাকে বিদায় করে দিয়েছে ও আশপাশ থেকে। একতলা এবং দোতলার মধ্যবর্তী সিঁড়ির ধাপের কাছে ডার্করুমটা–এই ডার্করূমে মিসেস জামিল তার নিজের হাতে শখ করে তোলা ফটোগুলো ধোলাই করতেন, শহীদ কয়েক মিনিট রূমটার ভিতর কাটাল। কিন্তু নতুন কিছুই চোখে ঠেকল না ওর। এরপর মিসেস জামিলের বাড়ি থেকে বের হয়ে এল ও। সিধে আবার উপস্থিত হল শামিম হায়দারের বাড়িতে।
কলিংঙ্গেল টিপতে এবার দরজা খুলে দিল শামিম হায়দার। লিভিংরূমে গিয়ে বসল ওরা। শহীদ বলল, সকালবেলা খুব ব্যস্ত ছিলেন, কেমন? আপনার আম্মাকে দেখে কিরকম মনে হল আজ?’
‘আম্মাকে দেখতে যাইনি আমি। এমনি রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি।’
অস্বীকার করল শামিম হায়দার। শহীদ বলল, আপনি প্রমাণ কতে পারবেন আজ সকালে আপনার আম্মাকে দেখতে যাননি? কিছু-যদি মনে না করেন তাহলে আপনারাবির গোছাটা দেখতে চাই আমি।’
কুয়াশা-৩৩,
১৩৭
শামিম হায়দার তার চাবির গোছা বের করে দিল। অনেকগুলো চাবির মধ্যে শহীদ দেখল খ্যাদার-মা’র কাছে যে চাবি আছে সেই রকম একটা শামিম হায়দারের কাছে রয়েছে। গোছাটা ফেরত দিয়ে শহীদ বলল, আপনি আপনার আম্মার বাড়িতে আজ গিয়েছিলেন। কথাটা অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন না। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে বাধ্য হতে হবে।’
শহীদের কথা শেষ হওয়া মাত্র আচমকা শামিম হায়দার প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল ওর মুখে। তারপরই ছুটল খোলা দরজার দিকে। | অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘুসি খেয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল শহীদের। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ওর নিজেকে সামলে নিতে। সামলে উঠে দৌড়াবার কথা ভাবতেই ও দেখল আমান গাজী ওর পথরোধ করে জড়িয়ে আছে। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নয় অবশ্য, কিন্তু পথরোধ করার সম্পূর্ণ ইচ্ছা তার। শান্তভাবে এগিয়ে গিয়ে আমান গাজীর তলপেটে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মেরে বসল শহীদ। তারপর দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল ও। বাইরে বের হয়ে দেখল পাহারাদানরত কনস্টেবলটি পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বুঝতে বাকি রইল না আর শহীদ যখন দেখল গ্রীন রঙের টয়োটা করোনাটা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রাস্তার মোড়ে। শামিম হায়দার কনস্টেবলটিকে ঘুসি মেরে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
শহীদ ফিরে এল। আমান গাজী যে রূমে রয়েছে ওখান থেকে থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করল ও শামিম হায়দারের গাড়িকে আটক করার জরুরী নির্দেশ দিয়ে।
আমান গাজী ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বলে উঠল, আপনার শরীরে বড় জোর। লেগেছে। খামোকা মারলেন কেন আমাকে?
এ আর এমন কি, এর চেয়ে কড়া মার আপনার কপালে আছে।’ কথাটা বলে বেরিয়ে এল বাইরে। মি. সিম্পসন অফিসেই ছিলেন।
সকল কথা জানাল শহীদ তাঁকে। মি. সিম্পসন বললেন, তাহলে কি শামিম হায়দারই তার মাকে বিষ দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল, শহীদ? তাই যদি হয় তাহলে তো সে-ই তার চাচাত ভাইকে হত্যা করেছে বিষ দিয়ে। এবং মি. জামিল : ছেলেকে রক্ষা করার জন্যে নিজে গ্রেফতার হয়েছেন।
শহীদ বলল, অন্তত মনে হচ্ছে তা-ই। এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই যে শামিম হায়দার তার মায়ের বাড়িতে আজ গিয়েছিল। কিন্তু মিলছে না একটা ব্যাপার। গোলাম হায়দারকে যে খুন করেছে একথা তার মা জেনে ফেলেছে মনে করে যদি সে মাকে খুন করতেই যাবে তাহলে কেন সে আমান গাজীকে বলে গেল। কোথায় যাচ্ছে সে, আর আমান গাজী আমাকে কেনই বা বলে দিল কথাটা? কেউ খুন করতে গেলে বলে-কয়ে যায় কি? যাকগে, এই কেসের অনেক রহস্যই এখনও
জানা নেই আমার। মি. সিম্পসন, আজই আমি মিস রোশনার সাথে দেখা করতে যাব। কিন্তু তার আগে আমি যেতে চাই সেই ফার্ম হাউসে।
“ঠিক আছে, চলে যাওয়া যাক। আহা শহীদ, তোমার মনে আছে তো যে মি. জামিল হায়দারের অবৈধ এক সন্তান আছে এবং সেই সন্তানের কথা তাঁর ভাইপো গোলাম হায়দার জানত বলেই সে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে পেরেছিল। আমরা জানি যে আমান গাজীর কোন আত্মীয়স্বজন ইরাকে নেই। মি. জামিলের সেই অবৈধ সন্তানই আমান গাজী নয় তো? মিস রোশনার সাথে তার প্রেমের কথা সে যা বলছে তা হয়ত মিথ্যে কথা।’
| শহীদ বলল, তা-ও হতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে জানতে হবে, সিদ্ধান্ত নেবার আগে, মিস রোশনা কেন গিয়েছিল ইরাকে। আমার মনে হয় মিস রোশনা শুধু জানত তার বাবাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। কিন্তু সে জানত না তার চাচাত ভাই ব্ল্যাকমেল করছে। তার আম্মাকে ইরাক থেকে বয়স্ক এক আমান গাজী চিঠি লিখত, একথা হয়ত সে জানত। এবং ব্ল্যাকমেলের সাথে এই বয়স্ক আমান গাজীর সম্পর্ক আছে মনে করে সে খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্যে হয়ত গিয়েছিল ইরাকে। কিন্তু বয়স্ক আমান গাজীর সাথে দেখা হয়ত তার হয়নি এবং সেই জন্যেই সম্ভবত ঢাকায় ফিরে অবদি তাকে অস্থির, অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। বদলে পরিচয় হয়েছিল ইরাকে তার সাথে যুবক আমান গাজীর। এবং ওরা পরস্পরের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছি মিস রোশনার ফটো ছাপায় আপত্তি দেখে। কেন সে খবরের কাগজে ছবি ছাপতে কোন মতেই রাজি হয়নি?*
এমন সময় বেজে উঠল ফোন। রিসিভার তুলে কথা বললেন মি. সিম্পসন । ফোন ছেড়ে দিয়ে তিনি শহীদের উদ্দেশ্যে বললেন, শামিম হায়দারের গ্রীন টয়োটা পাওয়া গেছে যাত্রাবাড়ির কাছে রাস্তার উপর। তার দেখা পাওয়া যায়নি। আশা করা যায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে খোঁজ পাওয়া যাবে তার।
শহীদ বলল, “ঠিক আছে, চলুন বেরিয়ে পড়ি আমরা।’
ফার্ম হাউসের দিকে যাবার পথে শহীদ গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। ও ভাবছিল, মিস রোশনা তার সাথে কথা বলার প্রথম দিনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে তার আম্মাকে হত্যা করার চেষ্টা হতে পারে। ঠিক সেই ঘটনাই ঘটছে। তবে কি সব রহস্যই জানা আছে মিস রোশনার? কিন্তু কেন সে তাহলে সব কথা লুকিয়ে রাখছে, তার বাবা হত্যার আসামী জেনেও?
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা একটা পারিবারিক ব্যাপার বলে মনে হয় না। কিন্তু তা
*কুয়াশা-৩২ দেখুন।
কম
আসলে নয় হয়ত। মিস রোশনা মৌত অবলম্বন করে একথাই স্বীকার করেছে পারতপক্ষে যে তাকেও ব্ল্যাকমেল করা হয়েছে। ফার্ম হাউসে তাকে জেরা করে ঢাকা থেকে আগত একজন লোক। কে সে? শামিম বা আমান, গাজী নয়, তো? হতে পারে, হয়ত মিথ্যে কথা বলেছে মিস রোশনা। কিন্তু শামিম হায়দার কেন। ফার্ম হাউসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার বোনকে পুড়িয়ে মারতে চাইবে? আমান গাজীই বা তা চাইবে কেন? আমান গাজীই মি. জামিলের অবৈধ সন্তান তার কোন
প্রমাণ নেই, শুধু দু’একটা ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সম্ভাবনার। | মি. সিম্পসন গাড়ি থামালেন মধুপুর থানায় । অফিস রূমে গিয়ে বসল ওরা। ইন্সপেক্টর কবীর আহমেদ উঠে দাঁড়াল।
মি. সিম্পসন তাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। শহীদ প্রশ্ন করল, শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্ম সম্পর্কে কি কি তথ্য পেলেন, ইন্সপেক্টর।’
স্যার, দুই বন্ধুর ফার্ম ওটা। তবে মোহাম্মদ মারা গেছে অনেক বছর আগে, তার কোন ছেলেমেয়েও নেই। শেখরাই চালায় ফার্মটা। ক্যাপিটাল নেই, ভাল চলে
ফার্ম। শেখ নামে একজন লোক এবং তার ছেলে থাকত-আগুন লাগার ঘটনার পর দু’জনাই পালিয়েছে। শেখের ছেলেটাই রাইফেল তুলে বাধা দিয়েছিল আপনাকে সম্ভবত। যে আক্রমণ করেছিল সে হয়ত শেখ স্বয়ং। কিছু গুজব শোনা গেছে ফার্মটা সম্পর্কে । বেশ কিছুদিন যাবত নাকি রহস্যময় আলো দেখা যায়, আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে গ্রামের লোকেরা নাকি দেখেছে। গুপ্তচর বলে বদনাম ছড়িয়ে পড়ে ওদের। কিন্তু অনুসন্ধান করে কোনদিন কোন প্রমাণ আমরা পাইনি। আগুন লাগার ঘটনা ঘটার আগে একজন কৃষকের কাছ থেকে জানা যায় যে একটা বিশেষ ধরনের গাড়িকে কয়েকবার এই ফার্মে যেতে-আসতে দেখেছে সে। গাড়িতে যারা আসত তারা সবাই পুরুষ। না, লোকগুলোর বর্ণনা দিতে পারেনি সে, দূর থেকে দেখেছিল। তবে একটা তথ্য জানা গেছে। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটি কাটাবার জন্যে খন্দকার নামে একজন লোক ওই ফার্মে আসত। শিকারও করত সে।’
শহীদ জানতে চাইল, খন্দকারের চেহারার বর্ণনা?’ ‘বেঁটে কালো। এর বেশি কিছু জানা যায়নি তার সম্পর্কে।’ মি. সিম্পসন বললেন, আমরা ফার্ম হাউসটা দেখতে চাই।’ ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন, স্যার।’
ফার্ম হাউসের পিছন দিকে এল ওরা গাড়ি থেকে নেমে। মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, “তোমার উদ্দেশ্যটা কি, শহীদ? কি আশা করছ তুমি?’
শহীদ ফার্ম হাউসের গুদাম ঘরের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, সে কথা আমি নিজেই জানি না। হঠাৎ মনে হল ফার্ম হাউসটা আর একবার ঘুরে ফিরে দেখা দরকার–তাই।
১৪০
ভলিউম-১১
গুদাম ঘরের ভিতর খালি চটের বস্তা, পেঁয়াজের খোসা, শুকনো লঙ্কা, কপির শুকনো পাতা ছড়ানো ছিটানো। ঘরের একদিকের দেয়ালে নতুন সিমেন্ট করা হয়েছে গোল করে, বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে। সেদিকে তাকিয়ে ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল ওর। হঠাৎ ও বলে উঠল, মি. সিম্পসন, ওই জায়গাটায় নতুন সিমেন্ট করা হয়েছে, কারণ কি?’ ·
ইন্সপেক্টর এবং মি. সিম্পসন সেদিকে তাকালেন। ইন্সপেক্টর বলল, হয়ত চোরা পথ ছিল, সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, তাই হবে।’ | শহীদ বলল, কিন্তু মনটা বডউ খুঁত খুঁত করছে আমার। কারণটা আমি নিজেই জানি না। অকারণে খুত খুঁত করে না তো আমার মন। ইন্সপেক্টর, লোকজন আনার ব্যবস্থা করুন। ওর ভিতর কি আছে তা না দেখে ফিরছি না আমি।’
শহীদের কথা শুনে অবশেষে লোকজন ডেকে সিমেন্ট করা জায়গাটা ভাঙা হল। ভাঙা হতেই দেখা গেল চওড়া দেয়ালের ভিতর কে যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে ঘাড়-মাথা গুঁজে । মৃতদেহটা দেখে মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, আশ্চর্য ব্যাপার, শহীদ!’
লাশটাকে অনেক কষ্টে দেয়াল থেকে মেঝেতে নামানো হল। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে পরখ করল ওরা। মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, লোকটা এ-দেশীয় নয় বলে মনে হচ্ছে।’
শহীদ বলল, হ্যাঁ, লোকটা ইরাকী। এবং ওর নামও আমি জানি। ওর নাম মোহাম্মদ আমান, গাজী, বা এই নাম সে কিছু সময় ব্যবহার করত। বয়স ষাটের কাছাকাছি।
লাশটার পকেট থেকে একটা নোট-বই পাওয়া গেল। তাতে পাওয়া গেল, তিনটে ফটো। একটা মিস রোশনার। দ্বিতীয়টা মিসেস জামিলের । তৃতীয়টা অজ্ঞাত পরিচয় এক মহিলার । নোট-বইয়ে নাম লেখা–মোহাম্মদ আমান গাজী।
শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর, লাশ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আমরা এখানে আর সময় নষ্ট করতে পারছি না।’
পাঁচ
সেই রাতেই শহীদ নার্সিং-হোমে দেখা করল মিস রোশনার সঙ্গে। শারীরিক কুশলাদির পর শহীদ উদ্দেশ্যমূলক আলাপ শুরু করার জন্য বলল, একটা কথা
স্বীকার না করে আর উপায় নেই আমার–মি, আমান গাজী সত্যিই প্রাণ দিয়ে। ভালবাসে আপনাকে। সে আপনাকে রক্ষা করেছে পুড়ে মরা থেকে আমাকেও ।
: কুয়াশা-৩
১৪:
নিজে মুক্ত হতেই পারত নাকি।
হল। তারপর যিছিলেন বলুন
নিজে মুক্ত হয়ে পুলিসের দৃষ্টিতে না পড়লে মি. সিম্পসন সহ আমরা কেউ বাঁচতাম
। কেউ জানতেই পারত না আমরা কোথায় আছি।’
মিস রোশনা বলল, তাই নাকি। “ শহীদ কথাগুলো ব্যাখ্যা করে আবার বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল ও, ‘আপনি ইরাকে মি. আমান গাজীর সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিলেন বলুন তো? আমার ধারণা আপনি জানতেন একজন মোহাম্মদ আমান গাজী আপনার আব্বাকে ব্ল্যাকমেল করেছে, এবং তার সাথে বোঝাপড়া করতে গিয়েছিলেন আপনি ইরাকে। গোলাম হায়দার ব্ল্যাকমেল করার ব্যাপারে একজন সহকারী হিসাবে কাজ করত। কিন্তু ইরাকেই বাস করত আসল ব্ল্যাকমেলার। তাই নয় কি? এবং আপনি যাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন তাকে পাননি, পেয়েছিলেন অন্য এক আমান গাজীকে, যে আপনার প্রেমে পড়ে। আপনি যে আমান গাজীকে খুঁজছিলেন তার বয়স ষাটের কাছাকাছি।’
বিস্মিত কণ্ঠে মিস রোশনা শুধু বলে উঠল, কি আশ্চর্য! এত কথা জানলেন, কিভাবে আপনি!
কারণ সেই বয়স্ক আমান গাজীর সন্ধান আমি পেয়েছি। এই ঢাকা শহরেই। আর ভয় নেই আপনার, সে আর কোন ক্ষতি আপনাদের করতে পারবে না।’
বিমূঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে মিস রোশনা, মানে! বলেন কি, সে কি তাহলে বলছে•••।’
মিস রোশনা হঠাৎ থেমে গেল। হঠাৎ দুচোখ ভরে উঠল তার পানিতে। ঝরঝর করে গাল বেয়ে ঝরে পড়ল পানির ধারা। শহীদ বুঝতে পারল এ পানি মুক্তির, দুশ্চিন্তা-মুক্তির, আনন্দের। অবশেষে চোখ মুখ মুছে সে বলতে শুরু করল, ‘এবার সব কথা বলতে চাই আমি। আব্বাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিল। আমি এবং শামিম জানতে পারি যে গোলাম ব্ল্যাকমেল করছে, কিন্তু আমান গাজীর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে এ কাজ করছে সে। আমান গাজী আমার আব্বা এবং আমার বন্ধু ছিল বহুদিন আগে। সে কিভাবে অবৈধ সন্তানের গোপন সংবাদ জানতে পেরেছিল তা আমরা জানি না। আমার বাবার বিয়ে হবার দু’বছর আগে ঘটনাটা ঘটে, অবৈধ সন্তান জন্মলাভ করে কোলকাতায়। তারপর আবার বিয়ে করেন তিনি। আমাকে তিনি ভালবাসেন, এবং আজ প্রায় তিরিশ বছর পরও কথাটা তাকে তিনি জানাতে পারেননি লজ্জায়। কথাটা আমরা জানতে পারি। আমান গাজীর সহকারী ছিল। গোলাম হায়দার, আবার গোলাম হায়দারের সহকারী ছিল ইয়াকুব। ইয়াকুব আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। সেই জন্যেই ইরাকে যাবার সময় ওকে আমার বাড়ি ব্যবহার করার অধিকার দিতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। আমি ইরাকে গিয়েছিলাম আমান গাজীকে খুঁজে বের করে ব্ল্যাকমেলিং ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে! কেননা টাকার দাবি ক্রমশ বেড়ে চলেছিল ওদের, এবং আমার আম্মা
১৪২
ভলিউম-১১
অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। | মিস রোশনা ঢোক গিলে শুরু করল, ‘আসল আমান গাজীকে খুঁজে পাইনি আমি। বদলে পরিচয় হল যুবক আমনি গাজীর সাথে। ওর প্রেমে পড়লাম আমি, এবং ও পড়ল আমার প্রেমে। আমাকে অস্থির চিন্তিত দেখে সাহায্য করার প্রস্তাব দিল ও আমাকে। কিন্তু আমি এড়িয়ে গেলাম প্রস্তাবটা। ভিতরে ভিতরে খোঁজ করতে লাগলাম বয়স্ক আমান গাজীর। এমন সময় খবর গেল গোলাম হায়দার নিহত হয়েছে এবং আমার আব্বাকে করা হয়েছে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার। আমার প্রেমিককে কিছু না জানিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে ভাবলাম, সত্যিই কি আব্বা খুন করেছেন? কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না। এমনকি এখনও আমি জানি না গোলাম হায়দারকে আব্বা খুন করেছেন কিনা? যাই হোক, আমাদের পরিবারের এইসব কুৎসিত ঘটনা আমি জানতে দিতে চাইনি আমার প্রেমিক আমান গাজীকে। তাই তাকে কিছু না বলে চলে এসেছিলাম ঢাকায়। কিন্তু আমি জানতাম, সামান্য এতটুক চিহ্ন পেলেই ছুটে এসে পড়বে ও আমাকে সাহায্য করার জন্যে ইরাক থেকে। তাই খবরের কাগজে ছবি ছাপতে অমন অস্বাভাবিক
ভীতি ছিল আমার।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘মিস রোশনা, কেন আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনার আম্মার প্রাণহানীর আশঙ্কা আছে?’
মিস রোশনা উত্তর দিল না। শহীদ জিজ্ঞেস করল, কাকে সন্দেহ করেন। আপনি? কে আপনার আম্মাকে খুন করবে বলে মনে করেন? | কাউকে নয়। কথাটা আমি এমনি বলেছিলাম, যাতে করে আপনারা ধারণা করেন গোলাম হায়দারের হত্যাকারী আমার আব্বা নন, অন্য কেউ। এতে প্রকার হত আব্বার। আমার আম্মার জীবন বিপদের মধ্যে ছিল না।’
শহীদ বলে উঠল, ‘ছিল। এবং তা প্রমাণিতও হয়েছে। আপনার আম্মার প্রাণ ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে, মিস রোশনা।’
বিস্ফারিত হয়ে উঠল মিস রোশনার চোখ জোড়া। চমকে উঠল সে কথাটা শুলে। জিজ্ঞেস করল, “আম্মা। কেমন আছেন আম্মা?”
অসুস্থতা কাটিয়ে উঠবেন তিনি। আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, খাবারের সাথে । যাক, এখনও আমি সত্য কথাটা জানি না। আপনি কি মনে করেন আপনার.আব্বা গোলাম হায়দারকে হত্য: করেছেন, নাকি আপনার ভাই…’
‘অসম্ভব! শামিম ওইরকম একটা নির্মম কাজ না না! গোলাম হায়দারকে যে খুন করেছে সেই হয়ত আম্মাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। সেই একই বিষ । গোলামকে না হয় খুন করার ব্যাপারে কারণ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আমাকে কেন যে-আম্মাকে কেউ কেন খুন করার চেষ্টা করবে?’
হয়ত তিনি প্রকৃত খুনীকে চিনে ফেলেছেন। কুয়াশা-৩৩
১৪৩
কিন্তু আম্মা আপনাদেরকে যা-ই বলুন, আমাকে বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন গোলামকে খুন করেছেন আব্বাই! আব্বার নামেই সব দোষ চাপিয়েছেন আম্মা।
শহীদ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জানতে চাইল, ইয়াকুব যে ডকুমেন্টগুলো আপনার ভাইয়ের বাড়িতে চাইতে গিয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে আপনি কিছু বলেননি এখনও। সে কি আগে চায়নি ডকুমেন্টগুলো? ডকুমেন্টগুলো আসলে কিসের?”
| না, আগে সে আমার কাছ থেকে ওসব চায়নি। ডকুমেন্টের ব্যাপারে আমার সাথে কোন আলাপই করেনি, কথা হয়েছিল তার শামিমের সাথে। শামিমও সেগুলোর কথা কিছু জানে কিনা জানি না। কিন্তু ইয়াকুবের ধারণা শামিম জানে। তাই শামিমকে মেরেছিল ও, আমাকেও বেঁধে রেখে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু ইয়াকুবকে তখন আপনি চিনতে পারেননি বলেছিলেন। কেন?
ইয়াকুব আব্বাকে ব্ল্যাকমেল করছিল সেই অবৈধ সন্তানের ব্যাপারে। ইয়াকুবকে চিনতে পেরেছি বললে প্রতিশোধ বশত হয়ত কথাটা দেশময় প্রচার করে দেবে–এই ভয়ে না চিনতে পারার কথাটা বলেছিলাম আমি আপনাকে।
শহীদ বিশ্বাস করতে পারল না মিস রোশনার কথাগুলো। বড় সহজে ময়েটি মিথ্যে কথা বলতে পারে, এ অভিজ্ঞতা ওর হয়েছে আগে। ও প্রশ্ন করল, ফার্ম হাউসে যে লোকটা ঢাকা থেকে গিয়ে কথা বলেছিল আপনার সাথে সে কি আমান গাজী নয়? ডকুমেন্টের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল যে?’
| না। তাকে আমি আগে কথনও দেখিনি। এ লোকটা বেঁটে, কালো। হ্যাঁ, ডকুমেন্টের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল।’
শহীদ মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাল। আবার প্রশ্ন করার জন্যে মাথা তুলতেই ওর দৃষ্টি নিয়ে পড়ল খোলা জানালার দিকে। আচমকা প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল পরমুহূর্তে।
জানালার বাইরে কেবিনের দিকে মুখ করে একজন ছোটখাট কালো লোক, দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার হাতের রিভলভারটা মিস রোশনার দিকে তাক করা।
মিস রোশনা বসে ছিল বিছানার উপরে । শহীদ আচমকা ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল তাকে। সেই সঙ্গে লাফ দিয়ে খাটের অপর দিকের মেঝেতে গিয়ে পড়ল ও। গর্জে উঠল রিভলভার। মেঝের এক কোণায় চলে গেল শহীদ গড়াতে গড়াতে। দ্বিতীয়বার আততায়ীর হাতের রিভলভার গর্জে উঠল । শহীদ বুঝতে পারল না
প্রথম গুলিটা মিস রোশনাকে আহত করেছে কিনা। দ্বিতীয় গুলিটা মিস রোশনার মাথার উপর দিয়ে গিয়ে লাগল দেয়ালে। শহীদ নিজের রিভলভার বের করল।
* কুয়াশা-৩২ দেখুন।
১৪৪
ভলিউম-১১
দ্রুত। জানালা লক্ষ্য করে কোণ থেকে গুলি করল ও। গুলির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই শোনা গেল দ্রুত পদশব্দ। তড়াক করে লাফ মেরে দরজার দিকে ছুটল শহীদ। দরজার বাইরে তখন চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। নার্সিং হোমের নার্সরা, ছুটাছুটি করছে ভয়ে। একজন নার্সকে ধাক্কা মেরে বাঁ দিকে ছুটল শহীদ। করিডরের শেষ প্রান্তে এসে ও দেখল রিভলভারধারী বেঁটে এবং কালো আততায়ী ছুটে পার হয়ে যাচ্ছে নার্সিং হোমের গেট। ফায়ার করল শহীদ।
এত দূর থেকে গুলি লাগার কথা নয়। শহীদ আশাও করেনি। নার্সিং হোমের গেট অতিক্রম করে অদৃশ্য হয়ে গেল আততায়ী। শহীদ প্রাণপণে ছুটল রাস্তার দিকে।
গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা দিতেই শহীদ তীক্ষ্ণ শব্দ শুনল। কয়েকটা মোটর গাড়ি একই সঙ্গে অকস্মাৎ ব্রেক করেছে। তারই শব্দ হল।
ছুটতে লাগল শহীদ গাড়িগুলোর দিকে। রাস্তার সবগুলো চলন্ত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ। শহীদ একাধিক গাড়ির হেডলাইটের অত্যুজ্জ্বল আলোয় দেখল রিভলভারধারী আততায়ী রাস্তার মাঝখানে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে। মাথাটা ফেটে মগজ বের হয়ে গেছে তার। হাতের রিভলভারটা কয়েক হাত দূরে পড়ে রয়েছে। রাস্তা টপকাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নিজের ইহলীলা সাঙ্গ করেছে আক্রমণকারী । শহীদ কাছে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই বুঝতে পারল মারা গেছে লোকটা।
থানায় ফোন করে লোকটার লাশ পুলিসের জিম্মায় সোপর্দ করে ফিরে এল শহীদ মিস রোশনার কাছে। যে গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে তার ড্রাইভার দাবি করেছে। যে রিভলভারধারী লোক নির্বিকার মুখে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত ভাবে সে মরতে চেয়েছিল। রাস্তায় ডিউটিরত একজন কনস্টেবলও সে কথা সমর্থন করেছে । মিস রোশনা শহীদের প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে এই লোকটাই ঢাকা থেকে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিল ফার্মহাউসে। এর নাম খন্দকার। মধুপুর থানার ইন্সপেক্টর খন্দকারের যে বর্ণনা দিয়েছিল তার সঙ্গে নিহত লোকটার চেহারা হুবহু মিলে গেছে।
মিস রোশনা শহীদের পরবর্তী প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে অস্বীকার করল । বলল, আমার যা বলবার সবই বলেছি।’
শহীদ মি. সিম্পসনের সঙ্গে দেখা করল নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে। মি. সিম্পসনকে সকল কথা বলল ও। মন্তব্য করল, ‘মিস রোশনা আমাকে সব কথা বলে দিচ্ছে মনে করে গুলি ছুঁড়েছিল খন্দকার, এই আমার ধারণা। এবং আমান গাজীকেও হত্যার যে চেষ্টা করা হয়েছিল তা-ও এই সন্দেহে যে মিস রোশনা হয়ত তাকে সব গোপন কথা বলে দিয়েছে। অর্থাৎ একদল লোক চায় না তাদের গোপন। কথা জানাজানি হয়ে যাক। মিস রোশনা সকল কথা জানে কিনা সন্দেহ আছে।
১০-কুয়াশা-৩৩
১৪৫
আমার।’
| মি. সিম্পসন জানালেন, শামিম হায়দারের কোন সন্ধানই পাওয়া যায়নি।
শহীদ বলল, ‘আমি একবার পুলিস কমিশনারের সাথে আলাপ করতে চাই, মি. সিম্পসন । আমার সাথে চলুন একবার।’
নতুন কোন প্ল্যান?’
না। একটা সন্দেহের কথা বলর তাঁকে । আলোচনা দরকার। কেসটার সম্পূর্ণ ভার প্রথম থেকেই যখন আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন তখন সব দিক দিয়ে এর শেষ
দেখে ছাড়ব না আমি। এমন ছ্যাচড়া কেস আমার জীবনে এটাই প্রথম।’
ওরা দেখা করল পুলিস কমিশনারের সঙ্গে।
কমিশনার কেসের সকল বর্তমান খবরই রাখেন। কুশল বিনিময়ের পর শহীদ বলতে শুরু করল, আমি মনে করি এখন আমরা জানি মিস রোশনা এবং তার প্রেমিক আমান গাজীর সম্পর্কটা। এই যুবক সম্পর্কে বেশি মাথা ঘামাবার আর দরকার নেই। কেসটার মীমাংসা এখন এক বা একাধিক রহস্যময় ডকুমেন্টের উপর নির্ভর করছে। ডকুমেন্ট কারা চাইছে তাদের পরিচিতি দরকার আমাদের। ইয়াকুব ছিল, একজন এজেন্ট, তাতে সন্দেহ নেই কোন। আমান গাজী-বয়স্ক এবং নিহত আমান গাজীও–একজন এজেন্ট ছিল ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যাপারে এবং গোলাম হায়দারও ছিল আর একজন এজেন্ট। শামিম হায়দারকে যখন চাপ দেয়া হচ্ছিল ডকুমেন্টগুলো আদায় করার জন্যে তখনই নিহত হয় গোলাম হায়দার। ডকুমেন্টের ব্যাপারটা সৃষ্টি হতেই খুনোখুনি শুরু হতে থাকে।
| ‘এর মানে?’ কমিশনার ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন।
শহীদ বলতে থাকে, ডকুমেন্টকে কেন্দ্র করেই এই রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের সূচনা। সুতরাং এই কেসের মীমাংসাও নির্ভর করছে ডকুমেন্টের উপর। কোথায় সেগুলো আছে, সেগুলো আসলে কি বস্তু এবং কারা সেগুলো চায়? একদিকে দেখতে পাচ্ছি শামিম হায়দার বিরাট ঝুঁকি নিয়ে গ্রেফতার না হবার জন্যে পালিয়ে গেছে। কিন্তু খন্দকার কেন নিহত হয়, প্রায় ইচ্ছাকৃত ভাবে? আমার সন্দেহ খন্দকার তার আসল নাম নয়। সে মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়েছে, যেন কেউ তাকে ধরে তার পেট থেকে কথা আদায় করতে না পারে। রাস্তায় যে রকম ভিড় ছিল। এবং আশপাশে এত বেশি পুলিস ছিল যে সে সময় পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, একথা সে জানত। তাই প্রায় স্বইচ্ছায় নিহত হয়েছে সে। খন্দকারের মৃত্যু এই কেসকে উঠিয়ে দিয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। গোলাম হায়দারের হত্যা স্রেফ একজন ব্ল্যাকমেলারকে হত্যা নয়। এটা আমরা এখন বুঝতে পারছি। মরতে রাজি আছে, ধরা পড়ে জেরার সম্মুখীন না হবার চেয়ে, এমন কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। ভয়ানক বেপরোয়া, তারা যা করতে চায় তা করবেই, এইরকম একটা প্রতিজ্ঞা তাদের মধ্যে। বোঝা যায়, তাদের প্রচুর টাকা আছে। তারা একটা ফার্ম-হাউসের
১৪৬
ভলিউম-১১ :
মালিক এবং তার ছেলেকে বশ করার ক্ষমতা রাখে, তারা ইয়াকুবকে বশ করার ক্ষমতা রাখে, তারা গোলাম হায়দারকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারার ক্ষমতা রাখত। তারা নির্দিষ্ট কিছু ডকুমেন্ট চায়, এবং আমাদেরকে সে ব্যাপারে সব কথা বলে দেবে সন্দেহ কবে একের পর এক হত্যা এবং হত্যার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চারটে প্রশ্নের উত্তর এখন প্রয়োজন। কাগজপত্রগুলো কোথায়? সেগুলো কার কাছে আছে? সেগুলো কি? সেগুলো কে বা কারা চায়? এবং আমরা শেষ প্রশ্নের উত্তর। অনুমান করে বলে দিতে পারি।’ | কিন্তু আমি জানি, শহীদ, তুমি অনুমান করে কোন কথা বলা পছন্দ করো না।’ কমিশনার স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন।
শহীদ বলল, কোন কোন সময়ে অনুমান করাটা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। শেষ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে-ডকুমেন্টগুলো চায় বিদেশী কোন শক্তি। তাদের গুপ্তচর।’
শহীদ একটু হাসল। বলল, সময় হয়েছে যখন আমাদের খানিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিলে নয়। আমি চাই মি. জামিল হায়দারের অতীত কর্মজীবনের ইতিহাস নিখুঁতভাবে ঘেঁটে দেখতে। রিটায়ার করার আগে পর্যন্ত মি. জামিল ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সিভিল সার্ভেন্ট। পররাষ্ট্র বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। এখন আমাদের জানা প্রয়োজন পররাষ্ট্র বিভাগের কি ধরনের ডকুমেন্ট নিয়ে কাজ-কর্ম করতেন মি, জামিল। এবং সে ধরনের কোন ডকুমেন্ট নষ্ট হয়েছে বা হারিয়ে গেছে বা চুরি গেছে কিনা। এ কাজ আমার দ্বারা হবার নয়। কিন্তু তথ্যগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজন আমার।’
কমিশনার একটু চিন্তা করে জানালেন, বেশ। আমি আজই যাচ্ছি পররাষ্ট্র বিভাগে।’ | শহীদ সন্তুষ্ট হল। খানিক পর বিদায় নিল ওরা কমিশনারের অফিস থেকে। মি, সিম্পসন ফিরে গেলেন তার অফিসে। শহীদ গেল থানা হেডকোয়ার্টারের জেল হাজতে। ও দেখা করবে ইয়াকুবের সঙ্গে।
ইয়াকুবকে শহীদ নিহত মামান গাজীর ফটো দেখিয়ে বলল, ‘তুমি এই লোককে হত্যা করেছ, তাই না?’
ছবি দেখে ইয়াকুব চমকে উঠল। চিৎকার করে বলে উঠল সে, মিথ্যে কথা!
শহীদ বলল, ‘শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্মে তুমি হত্যা করেছ এই লোককে। অস্বীকার কোরো না। * সম্মোহিতের মত ফ্যালফ্যাল করে ফটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘অসম্ভব! আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এটা। আমি খুন করিনি।’
শহীদ আর একটা ফটো বের করে ইয়াকুবের সামনে ধরল। বলল, “চিনতে পারো ওকে?’. কুয়াশা-৩৩
১৪৭
ফটোটা দেখেই ইয়াকুব আবার চমকাল, বলল, ‘খন্দকার! খন্দকারই নিশ্চয় আমান গাঁজাকে হত্যা করেছে…নিশ্চয় তাই! ফার্ম হাউসেই ছিল ও। আমান গাজীর সাথে একাকী দেখা করেছিল ও। আমি ঢাকায় ছিলাম। খন্দকারই হত্যা করেছে-আমি না।’
• শহীদ বলল, খন্দকার কে? ওর আসল নাম কি?’ : তা আমি জানি না। আমাকে ও-ই কাজে লাগিয়েছিল।’
শহীদ বলল, তুমি যে রিভলভার দিয়ে আমার দিকে গুলি ছুঁড়েছিলে সেই রিভলভারের গুলিতেই নিহত হয়েছে আমান গাজী। | ‘আমান গাজী খুন হয়েছে তা আমি জানতামই না। খন্দকার পরে দিয়েছিল
আমাকে রিভলভারটা।
| শহীদ ডকুমেন্টের ব্যাপারে প্রশ্ন করল এরপর। কিন্তু কোন উত্তর দিল না ইয়াকুব।
নিরাশ হয়ে ফিরে এল শহীদ বাড়িতে। পুলিস কমিশনার ওর বাড়িতেই অপেক্ষা করছিলেন ওর জন্যে।
পুলিস কমিশনারের চেহারা গম্ভীর দেখাচ্ছে। শহীদকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন গম্ভীর স্বরে, শহীদ, তুমি কি এখনও বিশ্বাস করো ডকুমেন্টগুলো পররাষ্ট্র বিভাগের “কিছু হবে বলে?
নিশ্চয়। ওই রকমই বিশ্বাস আমার।’
কমিশনার বললেন, তুমি ভুল করেছ, শহীদ। পররাষ্ট্র বিভাগের অফিসাররা আমার কথা শুনে হেসেছে। কেউ আমাকে নিয়ে হাসুক তা আমি পছন্দ করি না। পররাষ্ট্র বিভাগের যে সাবজেক্ট নিয়ে মি. জামিল কাজ করতেন সেই সাবজেক্ট সব ঠিক আছে। কিছু চুরি যায়নি, কিছুই হারিয়ে যায়নি। তোমার সন্দেহ ভিত্তিহীন।’
ছয় পরপর পাঁচ দিন কেটে গেছে।
মি. সিম্পসন দেখা করতে এসেছেন শহীদের বাড়িতে।
গোলাম হায়দার হত্যারহস্য যেখানে ছিল সেখানেই থেমে গেছে। পুলিস কমিশনার মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন শহীদের উপর । ভিত্তিহীন সন্দেহ বশত তিনি পররাষ্ট্র বিভাগকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, শহীদের কথার উপর নির্ভর করে।
তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্যে তিনি শহীদকেই দায়ী মনে করেন।
কিন্তু শহীদ কোন কথা না বললেও মনে মনে ও তার সন্দেহই সত্য বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু পররাষ্ট্র বিভাগের উত্তর শুনে মনে মনে নিরাশ না হয়েও পারেনি ও।
১৪৮
ভলিউম-১১
এদিকে নতুন কোন ঘটনাও ঘটেনি। কিছুই ঘটছে না। শহীদের জানা নেই এর কোন পথ ধরে এগোবে সে।
মি. জামিলের দ্বিতীয় শুনানী হয়ে গেছে, শুনানীর দিন পড়েছে আটদিন পর আবার। শামিম হায়দার এখনও নিখোঁজ। একটা স্টেটমেন্টে সই করে ইয়াকুব স্বীকার করেছে যে সে খন্দকারের কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে কাজ করত, কিন্তু খন্দকার কার কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে কাজ করত তা সে জানে না। খন্দকারের অন্য কোন পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। বয়স্ক আমান গাজী সম্পর্কে শহীদ তথ্য সংগ্রহের জন্যে তার পাঠিয়েছে ইরাকে আবার। কোন উত্তর এখনও আসেনি। | মিস রোশনা তার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে। যুবক আমান গাজী এখনও একা অবস্থান করছে তার ভাই শামিম হায়দারের বাড়িতে। মিসেস জামিল বিষের প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি কিংবা তাঁর স্বামী নতুন কোন বিবৃতি দেননি। যেদিন তিনি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন সেদিন শামিম হায়দার তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল একথা স্বীকার করেননি তিনি। তাঁর রূমে আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা গেছে সন্দেহাতীত ভাবে যে তাকে আর্সেনিক বিষ খাওয়ানো হয়েছে। শহীদ ইয়াকুবের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছে জেল-হাজতে। ইয়াকুব জানিয়েছে গোলাম হায়ারের সঙ্গে তার দেখা হত। গোলাম হায়দার বেপরোয়া ভাবে ব্ল্যাকমেল করত তার চাচাকে । এবং তার ধারণা গোলাম হায়দারকে তার চাচাই খুন করেছেন। যদিও নির্ভুল, নিখুঁত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ মিসেস জামিল আক্রান্ত হবার পর এই ধারণাই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে প্রকৃত খুনী স্বাধীন ভাবে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে।
শেখ অ্যাণ্ড মোহাম্মদ ফার্মের শেখ এবং তার ছেলের কোন সন্ধান এ পর্যন্ত করা যায়নি। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে খন্দকারকে তারা থাকতে দিত ফার্ম হাউসে। এবং তাদেরকে খন্দকার যা বলত তারা তাই পালন করত। বদলে তারা টাকা নিত।
মি. সিম্পসন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, ‘শহীদ, মাই বয়, তুমি এমন চুপচাপ হয়ে গেলে চলবে কেন। একটার পর একটা কেস আসছে, আর তুমি। প্রত্যাখ্যান করছ । কতদিন কাটাবে এভাবে? বাদ দাও গোলাম হায়দার হত্যারহস্য । এবার অন্য কাজে মন দাও।
শহীদ বিষণ্ণ ভাবে একটু হাসল । বলল, অন্যান্য কেস হাতে না নেবার কারণ হচ্ছে কেসগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা রহস্যময় কিছু নয়। পুলিসের সাহায্যেই ওগুলোর সমাধান সম্ভব। একটা কথা, মি. সিম্পসন। কমিশনার যাই বলুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখনও, যে, পররাষ্ট্র বিভাগের ডকুমেন্ট নিশ্চয় গোলাম হায়দার হত্যারহস্যে কোন না কোন ভাবে জড়িত। কেসটা যে সাধারণ ব্ল্যাকমেলিং কেস। নয়, এর পিছনে বিদেশী গুপ্তচরদের কারসাজী আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই কুয়াশা-৩৩
১৪৯
আমার।’
মি. সিম্পসন কোন কথা না বলে চুপ করে রইলেন। শহীদ আবার বলল, আমার বক্তব্য কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কারণ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমি পাচ্ছি । কেসটা যদি শুধু ব্ল্যাকমেলিংয়ের হত তাহলে ইয়াকুত চুপ করে থাকত না, খন্দকার ধরা পড়ার ভয়ে আত্মহত্যা করত না, নিহত হত না গোলাম হায়দার এবং বয়স্ক আমান গাজী। সামান্য ব্ল্যাকমেলিংয়ের জন্যে এতগুলো মারাত্মক মারাত্মক ঘটনা ঘটা সম্পূর্ণ অসম্ভব।’
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, ‘আমি নিজে এ সবের কিছুই বুঝে উঠতে পারছি । তোমাকেও এমন বিচলিত আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
শহীদ জানতে চাইল, ‘মিস রোশনার শেষ খবর কি?’
‘মিস রোশনা ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্লাবে, হোটেলে যুবক আমান গাজীর সাথে । দিনের বেশির ভাগ সময়ই ওরা এক সাথে থাকছে।
শহীদ বলল, ওদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি। একটা কথা, বয়স্ক • আমান গাজী সম্পর্কে নিখুঁত খবর এখনও আমরা পাইনি ইরাক থেকে। আমি তারের উত্তর পাঠিয়েছি। সে তার আসবে আশা করি আজকালের মধ্যেই। তৈরি থাকবেন, আমার মন বলছে কেসটার সব রহস্য উন্মোচিত হবার দিশা দেখা দেবে ওই তারের খবরেই।’
শহীদের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে গফুর এল দুটো খাম নিয়ে। শহীদ খাম দুটো হাতে নিয়ে দেখল একটা কামালের চিঠি। কামাল স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে গেছে কক্সবাজারে হাওয়া বদলাতে । দ্বিতীয় খামটা দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শহীদের মুখাবয়ব। খামটা ছিঁড়ে লম্বা একটা কাগজ বের করল ও। মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে তারপর ঘোষণা করল, যা আশা করেছিলাম তা এসে গেছে, মি সম্পসন । ইরাক থেকে আমার তারের উত্তর এসেছে।’
মি. সিম্পসন উত্তেজিত গলায় বললেন, “কি জানাচ্ছে ওরা?’
শহীদ তারটা পড়ল । তারপর বলল, ‘শেখ মোহাম্মদ আমান গাজীর বয়স একষট্টি বছর 1. ইরাকে জন্ম। উনিশ’শ পঞ্চাশ এবং বাহান্নতে বিদেশী গুপ্তচর হিসাবে গ্রেফতার করা হয় তাকে ইরাকে, কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রমাণের অভাবে মুক্তি দিতে হয় বাধ্য হয়ে। ছাড়া পেয়ে তুরস্ক রওনা হয় সে, সেখান থেকে ইসরাইলে পালায়। ইসরাইল থেকে ছদ্মবেশে সে আবার আসে ইরাকে। ইরাকে তার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গত পাঁচ সপ্তাহ আগে, কিন্তু গ্রেফতার হবার আগেই সে দেশ ছেড়ে পালায়। ইরাক সরকার এই ছদ্মবেশী গুপ্তচরের সন্ধান পাওয়া মাত্র তাদেরকে খবর। পাঠাবার অনুরোধ জানাচ্ছেন।
শহীদ মি, সিম্পসনকে বিদায় দিয়ে উপস্থিত হল মিস রোশনার বাড়িতে। মিস
ভলিউম-১১
১৫০
রোশনাকে পাওয়া গেল ড্রয়িংরুমে যুবক আমান গাজীর সঙ্গে। শহীদকে দেখেই মিস রোশনা দ্রুত কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠল, আমার ভাইয়ের কোন সন্ধান পেলেন?
শহীত আসন গ্রহণ করে বলল, সে প্রশ্ন আমিই করতে এসেছি আপনাদের দু’জনকে।’
আমান গাজী জানতে চাইল, আপনার বুঝি ধারণা শামিম গোপনে আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে? এই-ই তো আপনারা শুধু পারেন–খালি ধারণা করা, এই ধারণা করাটা দেখতে পাচ্ছি আপনাদের মজ্জাগত।’ | মিস রোশনা বলল, তা কেন ধারণা করবেন মি. শহীদ। মি. শহীদ, আপনার ভাবা উচিত শামিম অন্তত এই ভয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবে
যে পুলিসের লোক সর্বক্ষণ আমাদের দুজনকে চোখে চোখে রাখতে পারে । কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে শামিমকে কেন গ্রেফতার করতে চান আপনারা? আমার আব্বাকেই তো খুনী বলে সন্দেহ করেন।’
শহীদ বলল, হয়ত দুজনই দায়ী।
মিস রোশনা বলল, ‘অসুবিধা হল এই যে আপনি ওদের দু’জনকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। যদি চিনতেন তাহলে বুঝতে পারতেন খুন-খারাবি করার মত মানুষ ওরা দু’জন নয়। আর বিষ-প্রয়োগে হত্যার মত জঘন্য নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতেই পারেন না আমার আব্ব। শামিমও আম্মাকে হত্যা করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।’
শহীদ বলল, “কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা সত্য যে আপনার বাবাই একদিন আর্সেনিক বিষ বাজার থেকে কিনেছিলেন।’
আমান গাজী প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে উঠল, যাকগে, ওসব কাজের কথা নয়। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে যে রোশনা যদি আমার নামের সেই বুড়ো দুর্ভাগা লোকটাকে খুঁজতে ইরাক না যেত তাহলে এ জীবনে ওর সাথে দেখা হত।
আমার। লোকটার প্রতি এ-কারণে আমি কৃতজ্ঞ।’
শহীদ প্রশ্ন করল, একটা কথা, মিস রোশনা, আপনার আব্বাকে কি সত্যি সত্যি ব্ল্যাকমেল করা হত তার অবৈধ সন্তানের জন্যে?’
‘হ্যাঁ।’
আপনি কখনও কি শুনেছেন এই সন্তানের কপালে কি ঘটেছিল? কত বয়স হয়েছিল তার? বেঁচে আছে, না মরে গেছে?
| বয়স, আজ যদি সে বেঁচে থাকে, চৌত্রিশ হবে। ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারটা আমি। আবিষ্কার করার পর আমার আব্বা আমাকে বলেছিলেন যে সন্তানটিকে প্রতিপালনের জন্যে একজনকে দান করা হয়। কাকে দান করা হয় তা আমাকে বলেননি। সেই লোককে এক কালীন মোটা টাকা দিয়েছিলেন আব্বা। এবং আব্বা সেই লেকের আর কোন খবর পাননি, রাখেননি।’ কুয়াশা-৩৩
১৫১
শহীদ চুপ করে রইল। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। রিসিভার তুলল আমান গাজী। তারপর শহীদের উদ্দেশে বলল, আপনার ফোন। মি. সিম্পসন ফোন করেছেন।’
। শহীদ রিসিভার নিল। মি. সিম্পসন অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলেন, হ্যালো, শহীদ?’
শহীদ বলল, বলছি। কি খবর, মি. সিম্পসন?’
‘শহীদ, মিসেস জামিলের বাড়ির মেথরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা তথ্য পাওয়া গেছে। যেদিন মিসেস জামিল বিষ ক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন সেদিন সে নাকি শামিম হায়দারকে ও-বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে। বুঝতে পারছ, শহীদ? এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে ও-বাড়ির চাকরানী খ্যাদার মা শামিম হায়দারকে ভাল চোখে দেখে, তা সে যে-কোন কারণেই হোক, এবং সেদিনের ব্যাপারে সে মিথ্যে কথা বলেছে তোমার কাছে।’
শহীদ উপস্থিত দু’জনার সামনে কোন মন্তব্য না করে মি. সিম্পসনকে জানালেন, আমি দেখা করছি খানিক পর আপনার সাথে। ছাড়ছি, ধন্যবাদ।’
রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রেখে শহীদ চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। আমান গাজী বলে উঠল, এই রে! আবার চিন্তা করছেন যেন কিছু? নিশ্চয় কিছু ধারণা করছেন আবার-ওই তো আপনাদের কাজ। তাই না?’
শহীদ হেসে ফেলে বলে উঠল, তাই আমার ধারণা!’ কথাটা বলে শহীদ বেরিয়ে এল বাইরে।
সিধে মি. সিম্পসনের অফিসে পৌঁছল ও গাড়ি নিয়ে। মি. সিম্পসনকে অবাক করে দিয়ে ও বলল, “মিসেস জামিলের বাড়িতে হামলা করব আমরা, অন্ধকার নামার পর। ও-বাড়ির পিছনের দরজার চাবিটা আমি যোগাড় করেছি খ্যাদার মার কাছ থেকে কদিন আগে । ওরা যদি আমাদের হামলার ব্যাপারে অজ্ঞ থাকে তাহলে সাবধান হবার সময় পাবে না হাতে। আমি আশা করছি খাদার মা’রই সহযোগিতায় শামিম হায়দার আরামে আত্মগোপন করে আছে ওই বাড়িতে। আমাদের সাথে পুলিস তো যাবেই এক গাড়ি, গফুরকেও সঙ্গে নেব আমি। বাড়িটা সার্চ করার ওয়ারেন্ট দরকার হবে, সে ভার আপনার।’
মি. সিম্পসন বললেন, ভাল কথা, কমিশনারকে ইরাক থেকে বৈপ্লবিক তথ্যটা দেখানো দরকার বলে মনে করো না তুমি, শহীদ?’
শহীদ বলল, দরকার। কমিশনার, আমার ওপর নিরাশ হয়েছেন যখন।’ ওরা কমিশনারের অফিসে উপস্থিত হল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। নতুন কোন খবর?’
শহীদ কোন কথা না বলে ইরাক থেকে পাওয়া তারটা টেবিলের উপর রেখে আসন গ্রহণ করল। সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে একমনে টানতে লাল ও । গভীর
১৫২
ভলিউম-১১
ভাবে কি যেন চিন্তা করছে ও। তারটা পড়া শেষ হয়ে যেতে কমিশনার বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কি আশ্চর্য! এই কেসে তাহলে এমন একজন লোক জড়িত ছিল যে কিনা আন্তর্জাতিক গুপ্তচর! কিন্তু, শহীদ, এতে তো প্রমাণিত হয় না যে
পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে কাগজপত্র সরানো হয়েছে•••।’
শহীদ বিদায় নেবার জন্যে..আসন ত্যাগ করে মৃদু হাসল, অফিস থেকে ফাইলপত্র চিরতরে না সরিয়ে নিয়ে গিয়েও বাইরে পাচার করার নানা উপায় আছে।’
সাত বাড়িটা ঘিরে ফেলা হল রাত এগারোটার সময়। পুলিসবাহিনী আত্মগোপন করে যে-যার জায়গায় সদাসতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শহীদ, মি. সিম্পসন এবং গফুর বাড়ির পিছন দিককার দরজা খুলে প্রবেশ করল ভিতরে। পা টিপে টিপে এগোতে লাগল ওরা প্যাসেজ ধরে একটার পর একটা রূম পাশ কাটিয়ে ।
কিচেনরূমে বাতি জ্বলছে। দূর থেকেই দেখতে পেল শহীদ। ওরা তিনজন নিঃশব্দ পায়ে এগোল । কিচেনরূমের ভিতর থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল। শহীদ খাদার মা এবং বাবুর্চির গলা চিনতে পারল। হাতে উদ্যত রিভলভার নিয়ে কিচেনরূমের ভিতর ঢুকল ও। পিছনে মি. সিম্পসন ও গফুর ।.
এ্যাদার মা শহীদের হাতে রিভলভার দেখে থরথর করে কেঁপে উঠল হঠাৎ। গলা চিরে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বের হয়ে পড়ার উপক্রম হল। বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গিয়ে খাদার মার মুখটা চেপে ধরল শহীদ। তারপর গফুরের দিকে তাকিয়ে একটা ইঙ্গিত করল ও। গফুর এগিয়ে এসে বাবুর্চির একটা হাত ধরে টানতে টানতে বের করে নিয়ে গেল বাইরে। শহীদ গফুরকে আগে থেকেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী গফুর বাবুর্চিকে বাইরে দণ্ডায়মান পুলিসের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে চলে গেল। হাজত ঘরে কয়েক ঘন্টা বন্ধ করে রাখলে এই ধরনের লোকেরা পেটের কথা সব বের করে দেয়।
গফুর চলে যেতে ধীরে ধীরে খ্যাদার মার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল শহীদ। চাপা স্বরে বলল, যা জিজ্ঞেস করব তার উত্তর দেবে নিচু গলায়। জোরে কথা “বলবার চেষ্টা করলে কপালে খারাবি আছে। শামিম হায়দার সেদিন এ বাড়িতে
এসেছিল, অথচ তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলে, কেন?’
খ্যাদার মা আতঙ্কে কাঁপছে থরথর করে । শহীদ আবার একটা প্রশ্ন করল, শামিম হায়দার কি উপরে এখন?
খাদার মা বিস্ফারিত চোখে শহীদের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জানাল শুধু
হ্যাঁ।
কুয়াশা-৩৩
| গফুর ফিরে এল বাবুর্চিকে রেখে। আবার ইঙ্গিত করল শহীদ। এবার গফুর খাদার মাকে ধরে নিয়ে গেল গাড়িতে তুলে দিয়ে আসার জন্যে।
গফুর ফিরে এল কয়েক মিনিট পরই। গফুরকে শহীদ চাপা স্বরে বলল, তুই একতলায় থাকবি। কাউকে ছুটে পালাতে দেখলে বাধা দিবি। রিভলভারটা বের করে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাক, দরকার না হলে গুলি করবি না কিন্তু।
– জ্বী, দাদামণি!’ নিচু, কিন্তু ভয়ানক গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলল গফুর।
গবিলার মত প্রকাণ্ড দেহটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে সিঁড়ির পাশে। শহীদ উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায়। মি. সিম্পসন ওর পিছন পিছন উঠলেন।
চার-পাঁচটা তালা মারা রূমের পর একটা রুমের দরজার সরু ফাঁক থেকে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।
শহীদ নিঃশব্দ পায়ে দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার পাল্লায় হাতের ধাক্কা দিয়ে খোলার জন্যে তৈরি হল শহীদ। এমন সময় রূমের ভিতর থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এলঃ ‘ ‘
| হ্যাঁ, আমিই, আমিই! কিন্তু তোমার কথা শুনতে চাই এখন আমি, দিচ্ছ ওগুলো আমাকে?’
শহীদ মেয়েলী কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল না। খুব ধীরে ধীরে, উত্তেজিত ভাবে, কিন্তু নিচু স্বরে কথা বলছে মেয়েমানুষটা। বোঝা যায় প্রতিশোধবশত কারও সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায় সে, গলা শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারল শহীদ।
সব কথাই জানা ছিল আমার, সব কথা!
আবার শোনা গেল সেই মেয়েলী কণ্ঠস্বর । পরক্ষণেই একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর শহীদের কানে ঢুকল, তুমি নেহাত ডাইনী একটা!’’
‘ওসব কথায় তোমার প্রতি আমার কোন মায়া মমতা জন্মাবে না। এখনও। বলো বলছি কোথায় আছে সেই কাগজপত্রগুলো। তা না হলে তা না হলে তোমার কপালে দুর্ভোগ আছে, শামিম!
এই ক’টি কথা মেয়েলী কণ্ঠস্বরে আবার শুনতে পেল শহীদ। ও বুঝল মেয়েলোকটা কঠোর মন নিয়ে কথা বলছে। মেয়েমানুষটাকে চিনতে না পারলেও, শহীদ বুঝতে পারল পুরুষ কণ্ঠটা শামিম হায়দারের। তবে কি শামিম হায়দার কোন মেয়েকে নিয়ে এ বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে?
শামিম হায়দারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ডকুমেন্টের কথা আমি কিছু জানি না। যাও তুমি। তোমার রিভলভার সরিয়ে নাও বলছি।’
• না। এই মুহূর্তে যদি তুমি কাগজপত্রগুলোর কথা না বলো তাহলে কি করব জানো•••তোমাকে আমি হাসতে হাসতে গুলি করব•••।’
| পিশাচিনীর মতই হে স উঠে কথাগুলো বলল মেয়েলোকটা। আবার বলল সে ‘ছেলেখেলা করছি না আমি, শামিম। তাড়াতাড়ি করো, যদি মরতে না চাও।
১৫.
ভলিউম-১১
গোলাম হায়দারকে মেরেছি, তোমাকেও•••!’
শহীদ নিঃশব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মি. সিম্পসনের দিকে। তারপর আবার দরজার দিকে তাকাল ও। দরজার হাতলটা সন্তর্পণে ঘুরিয়ে দিল ও। তারপর হাতের রিভলভারটা দেখে নিল একবার চোখ বুলিয়ে। পরমুহূর্তেই বিদ্যুৎবেগে দরজার গায়ে ধাক্কা মেরে খুলে ফেলল পাল্লা দুটো। রূমের উজ্জ্বল বিজলী বাতিতে চোখ ঝলসে উঠল ওর। ও দেখল শামিম হায়দারের দিকে রিভলভার ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন বয়স্কা মহিলা। মহিলা বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদের দিকে। পলকের মধ্যে রিভলভারটা ঘুরিয়ে ধরল সে শহীদের বুক লক্ষ্য করে । মি. সিম্পসন শহীদের পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলেন উত্তেজিত গলায়, সাবধান,
শহীদ!
মি. সিম্পসন চিৎকার করার আগেই শহীদ বিদ্যুৎবেগে লাফিয়ে পড়েছে। লাফিয়ে পড়ার পূর্বক্ষণে মহিলাকে চিনতে পারল শহীদ। বিস্ময়ে বিমূঢ় না হয়ে পারল না। মিসেস জামিল যে সব কীর্তিকলাপের জন্যে দায়ী তা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
শহীদ লাফ দেবার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মিসেস জামিলের রিভলভার। গুলিটা গিয়ে লাগল দেয়ালের গায়ে।
শহীদ বজ্রকঠিন হাতে মুচড়ে ধরল মিসেস জামিলের রিভলভার ধরা হাতটা। ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠল মিসেস জামিলের মুখ। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে শহীদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে হিংস্র তাড়নায় নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন মিসেস জামিল। মি. সিম্পসন এগিয়ে এসে মিসেস জামিলের হাতে পরিয়ে দিলেন একজোড়া হাতকড়া। তারপর ঠেলে বসিয়ে দিলেন, তাঁকে একটা চেয়ারে। মিসেস জামিল চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে ব্যর্থ
আক্রোশে হাঁপাতে লাগলেন।
বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল শামিম হায়দার হতচকিত হয়ে। এমন সময় বেজে উঠল কলিংবেল । মি. সিম্পসন বেরিয়ে গেলেন রূম থেকে। শহীদ শামিম হায়দারকে জিজ্ঞেস করল, মি. শামিম, আপনি নিশ্চিত ভাবে কখন জানতে পারলেন যে আপনার আম্মাই আসল অপরাধী?’
বিমূঢ়, বিচলিত কণ্ঠে শামিম হায়দার বলল, এই মাত্র, মাত্র দশ মিনিট আগে, মি. শহীদ! এখানে উনি আসার আগে পর্যন্ত কিছুই জানতাম না আমি…’ | ‘পলাতক হবার কারণ কি আপনার?’
‘ভেবেছিলাম আমি পালালে আপনারা আমার প্রতি সন্দেহ করবেন, তাতে উপকার হবে আমার আব্বার। সেই একই কারণে আমি মিছে করে বলেছিলাম যে সেদিন আমি আম্মার সাথে দেখা করতে আসিনি। খাদার মা যাতে কথাটা প্রকাশ না করে তার জন্যে তাকে টাকা দিয়েছিলাম। আপনাকে বোকা বানাতে
চেয়েছিলাম আমি।’
শহীদ অনুমান করে একটা কথা বলে ফেলল, আপনি জানতেন তাহলে যে আপনার আব্বা কাজের জন্যে, বাড়িতে যে-সব ডকুমেন্ট অফিস থেকে দু’একদিনের জন্যে আনতেন আপনার আম্মা সেগুলোর ছবি তুলে বিক্রি করত বা কাউকে দিয়ে দিত?’
হা..হ্যাঁ। অনেক দিন থেকেই জানতাম•••|’
এমন সময় মি. সিম্পসন ফিরে এলেন নিচ থেকে। পিছন পিছন রুমের ভিতর । ঢুকল মিস রোশনা হায়দার এবং যুবক আমান গাজী।
ওরা দেখল মিসেস জামিলের হাতে হাতকড়া লাগানো। মিস রোশনা হতভম্ব চোখে তাকাল শহীদের দিকে। গলা দিয়ে স্বর বের হল না ওর। পা পা করে ‘ এগিয়ে গেল সে মায়ের দিকে। মায়ের কাছে গিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে
রইল ও।.
মিসেস জামিল আচমকা মুখ তুলে তাকালেন। মেয়েকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অকস্মাৎ খেপে গেলেন যেন তিনি। দুহাত তুলে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করলেন তিনি মেয়ের কোমরে ।
পিছিয়ে এল মিস রোশনা। তার চোখের কোণে পানি। মিসেস জামিল চেয়ারের হাতলে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন এবার। মিস রোশনা অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, কি হয়েছে।’
শহীদ বলল, ‘আমরা এখন জানতে পেরেছি সকল ঘটনা। মিসেস জামিলই হত্যা করেছেন গোলাম হায়দারকে। এবং আপনার আব্বা সকল দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কেননা তিনি সম্পূর্ণ সত্য জানেন
। মিস রোশনা, আপনি আসল সত্যটা অনুমান করেছিলেন, তাই না?’
মিস রোশনা বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে যে আম্মা•••।’
শামিম হায়দার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আম্মা করেছে। আম্মা আমাকে বলেছে যে তিনিই করেছেন। পোকা মারবার ওজুহাত দেখিয়ে আব্বাকে দিয়ে আর্সেনিক বিষ কিনিয়ে আনিয়েছিলেন তিনি। আম্মা জানতেন যে গোলাম হায়দার আব্বাকে ব্ল্যাকমেল করছিল, সেটাই ওঁকে সুযোগ করে দেয়। আম্মা বহুদিন থেকে দেশের গোপন দলিলপত্র বিক্রি করে আসছিলেন। আব্বা কাজের জন্যে যত দলিলপত্র বাড়িতে আনতেন আম্মা গোপনে সেসবের ফটো তুলে নিতেন। কয়েক মিনিট করে সময় লাগত এতে। সেই ছবিগুলো আম্মা দিতেন গোলাম হায়দারের হাতে। অবৈধ সন্তানের কথা জানত বলে গোলাম হায়দার আব্বাকে ব্ল্যাকমেল করতো। আম্মা ও আব্বাকে দিয়ে সে দু’ভাবে কাজ আদায় করত। ভারপর আব্বা রিটায়ার করলেন, আর নতুন ডকুমেন্ট পাবার কোন উপায়
১৫৬
ভলিউম-১১
রইল না। এবার গোলাম হায়দার ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করল আম্মাকে-আম্মা গুপ্তচরবৃত্তির জন্যে। সেই কারণেই আম্মা তাকে হত্যা করেন। গোলাম হায়দা। আব্বার সাথে একটা নির্জন হোটেলে দেখা করেছিল তা ঠিক। কিন্তু আম্মাও সে একই সময়ে দেখা করেছিলেন গোলাম হায়দারের সাথে। গোলাম হায়দারে খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন আম্মা। আব্বা অবশ্যই জানেন যে আম্মা গোলা হায়দারকে খুন করেছেন। কিন্তু আম্মাকে বাঁচাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কার। আম্মার গুপ্তচরবৃত্তির জন্যে আহ্বা নিজেকেই মনে মনে দায়ী করেন।’ | শামিম হায়দার দম নিয়ে বলে চলল, “আম্মা ভেবেছিলেন গোলাম হায়দার হত্যা করলে সব বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু তা হয় না। খন্দকার মাকে চাপ দিন থাকে। শেষ ডকুমেন্টটার জন্যে। ফলে আম্মার মাথা খারাপের মত অবস্থা হে দাঁড়ায় দুশ্চিন্তায়…।’ | মি. সিম্পসন জানতে চাইল, মিসেস জামিল গোলাম হায়দারকে খুন করলে কেন?’ । শামিম হায়দার অধৈর্যভাবে বলে চলল, “সে আম্মাকে ব্ল্যাকমেল করতে শু করছিল বলে । নতুন কোন ডকুমেন্ট পাবার আশা নেই দেখে নতুন উপা রোজগার করার কথা মাথায় আসে গোলাম হায়দারের। সে আম্মাকে ব্ল্যাকমে করতে শুরু করে। দলিল-পত্র বিক্রি করার ব্যবস্থা আম্মা শুরু করে বেশ কয়ে বছর আগে। সেগুলো কিনত শেখ মোহাম্মদ আমান গাজী। এই লোকটা আমা আব্বা-আম্মার পুরাতন পারিবারিক বন্ধু ছিল এককালে। খন্দকার নামে একজ লোকের সাথেও সম্পর্ক ছিল আম্মার। খন্দকার বড় ধরনের একজন বিদেশ এজেন্ট। ঢাকায় থাকত।
শহীদ প্রশ্ন করল, আমরা গ্রেফতার করেছিলাম মি. জামিলকে গোলা হায়দারকে হত্যা করার জন্যে। আমাদের সন্দেহের উদ্রেক হয় অজ্ঞাত ব্যক্তি
একটি চিঠি পেয়ে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল- “গোলাম হায়দারকে খুন কর হয়েছে”। কে পাঠিয়েছিল এই চিঠি?’
খ্যাদার মা।’ মানে?’ অবাক হয়ে বলে উঠল শহীদ।
শামিম হায়দার বলল, হা, খাদার মা-ই পাঠিয়েছিল । আম্মাকে সে ঘূ করে। কেননা একজন লোকের সাথে ওর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। লোকটা এ বাড়ি ড্রাইভার ছিল। আম্মা ব্যাপারটা জেনে ফেলে ড্রাইভারকে বিদায় করে দেয় খাদার মার রাগ সেই থেকে। তাছাড়া খন্দকারের কাছ থেকে টাকা পেয়ে ছোটখাট একজন গুপ্তচরও হয়ে উঠেছিল। পরে যখন সে দেখল পুলিস আম্মার গ্রেফতার করতে পারছে না এবং যখন খন্দকার হুকুম দিল, তখন সে আমাকে বি। খাইয়ে দেয়।
কুয়াশা-৩৩
আপনি এত কথা জানলেন কেমন করে?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
বাবুর্চির সাথে ভাল সম্পর্ক এখন খাদার মার। বাবুর্চিকে যখন সব কথা বলছিল সে, তখন আড়ি পেতে সব শুনেছি আমি। অবশ্য খ্যাদার মা-ই আমাকে এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আমি লুকিয়ে থেকে রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছিলাম–আব্বাকে মুক্ত করবার জন্যে। কিন্তু আব্বাকে মুক্ত করতে গিয়ে আমার নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে তাকে ভেবেছিল! কি ভীষণ লজ্জার কথা যে আমার নিজের জননী, আমাকে খুন করে ফেলতে চাইছিল! আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আপনারা সময় মত উপস্থিত না হলে আমি এতক্ষণ রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে থাকতাম। আমি আর রোশনা যা যা ভয় করেছিলাম তার সবই সত্য ছিল। রোশনা ইরাকে গিয়েছিল সেই নিহত বুড়ো আমান গাজীর সন্ধানে। ও জানতে গিয়েছিল ব্লাকমেলিংয়ের ব্যাপারটা অবৈধ সন্তানের কারণে সৃষ্টি, নাকি এর পিছনে অন্য কোন গূঢ় কারণ আছে। ওকে আমিই পাঠিয়েছিলাম। গোলাম হায়দার নিহত হবার আগে থেকেই চরম দুশ্চিন্তায় কাল কাটাচ্ছিলাম আমরা।’
“কেন?’ প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন।
ইয়াকুব আমাদেরকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল বলে। ইরাকে যাবার আগে রোশনা আম্মার রূম থেকে কিছু দলিল-পত্রের ফটোকপি পেয়েছিল, তার সাথে ছিল ইরাকের বুড়ো আমান গাজীকে লেখা একটা চিঠি। ওগুলো দেখেই ব্যাপারটা টের পায় রোশনা। প্রশ্ন দেখা দেয় আম্মা কেন এসব দলিল জাল করে বিক্রি করছেন? আম্মাকে কি ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে, না•••।’
হঠাৎ থেমে গেল শামিম হায়দার। তারপর বলল, যাই হোক, আমরা ঠিক করি ব্যাপারটা জানতে হবে যেমন করেই হোক। কিন্তু রোশনা বুড়ো আমানের দেখা পায়নি ইরাকে। বুড়ো আমান ঢাকায় পালিয়ে এসেছে, এইটুকুই কেবল জানতে পারি আমরা। আম্মাকে সে টেলিফোন করে জানায় যে সে বিপদে পড়েছে।’ | শহীদ বলল, বুড়ো আমান গাজীর নিয়োগ কর্তারা মৃত্যু দণ্ডাদেশ দিয়েছিল তাকে। মি. শামিম, আপনি বলতে পারেন কি ধরনের ডকুমেন্ট ইয়াকুব চেয়েছিল আপনার কাছ থেকে?
মিস রোশনা বলল, হ্যাঁ। আম্মার রূমে ফটোগ্রাফটা দেখেছিলাম আমি। ওগুলো কিভাবে যেন চুরি হয়ে যায়। এবং ইয়াকুব মনে করে সেগুলো আমরা নিয়েছি। ডকুমেন্টগুলোর ব্যাপারে আমরা মিথ্যে কথা বলেছিলাম, কেননা আমরা চেয়েছিলাম আব্বাকে রক্ষা করতে এবং চেয়েছিলাম ডকুমেন্টের কথা আর আমার অপরাধের কথা কেউ যাতে জানতে না পারে।’
যুবক আমান গাজী বলে উঠল, আমি কিন্তু মনে মনে ইয়াকুবকে ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। আমার মন যেন জানত ইয়াকুব তোমাদেরকে ব্ল্যাকমেল,
১৫৮
ভলিউম-১১)
করছে। সেই জন্যেই ওকে অমনভাবে ধরে মেরে ফেলতে গিয়েছিলাম নিজেরই অজান্তে। মি. শহীদ, আপনার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি মনে করেছিলেন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ইয়াকুবকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম আমি। আপনার কোন দোষ দিই না আমি। সে ব্যাপারে আমি লজ্জিত।’
ফটোকপি আছে?’ শহীদ জিজ্ঞেস করল। না।’ দু’ভাইবোন উত্তর দিল একই সঙ্গে।
কয়েক দিনের মধ্যেই শেখ এবং শেখের ছেলে ধরা পড়ল। দেশের গুপ্তচর বিভাগ উঠে পড়ে কাজ শুরু করে দিল বিদেশী গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে। জানা গেল গোলাম হায়দার ঢাকার বিদেশী দূতাবাস থেকে মোটা টাকা নিত গোপনীয় দলিল-পত্র হস্তান্তরিত করে। সেই একই দূতাবাসের শাখা বুড়ো আমান গাজীকে টাকা দিত। ইরাক থেকে। মিসেস জামিলের সঙ্গে বুড়ো আমান গাজীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল বহু বছর আগে থেকে, এমন কি মিসেস জামিলের বিয়েরও বহু আগে থেকে। এই গোপন সম্পর্কের খরটা বুড়ো আমান গাজী মি. জামিল হায়দারকে জানিয়ে দেবে বলে ভয় দেখায় মিসেস জামিলকে। মিসেস জমিল ভয় পেয়ে বুড়ো আমান গাজীর প্রস্তাব মত গুপ্তচর বৃত্তির কাজ করতে রাজি হন। সেই থেকে গোলাম হায়দারের মাধ্যমে মিসেস জামিল বুড়ো আমান গাজীকে ডকুমেন্টগুলোর ফটোকপি সরবরাহ করে আসছিলেন। এ কাজে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা বুড়ো আমান গাজী যদি বিয়ের আগের তাদের সম্পর্কের কথা মি. জামিলকে জানিয়ে দিত তাহলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত।
অন্য আর একটি বিদেশী গুপ্তচর বিভাগের তরফ থেকে মঞ্চে আগমন ঘটে খন্দকারের। খন্দকার নিয়োগ করে ইয়াকুবকে। মি. জামিলের নতুন বিবৃতি অনুযায়ী জানা গেল ইয়াকুবই তার সেই অবৈধ সন্তান।
বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল মিসেস জামিলের। মি. জামিল বেকসুর মুক্তি পেলেন।
কিছুদিন পর একটা নিমন্ত্রণপত্র পেল শহীদ। মিস রোশনা এবং যুবক আমান–জীর বিয়ের।
Leave a Reply