৩২. গুপ্তচর ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩২
প্রথম প্রকাশঃ মার্চ, ১৯৭১
এক
বিরাট রূমটায় পা রাখল প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। পিছনে পুলিস ইন্সপেক্টর বোরহান উদ্দিন। পিছন ফিরে তাকাল শহীদ। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল ইন্সপেক্টর। দাঁড়িয়ে পড়ল সে খোলা দরজার উপর। ডেকের উপর ঝুঁকে একজন
দ্রলোক তাকালেন শহীদের দিকে। ভদ্রলোকের মুর পারবর্ণ। ডেস্কটা ঘরের-এক। কোণে। মূল্যবান আসবাবে সজ্জিত রূমটা। ঝকঝক তকতক করছে। কিন্তু শান্তি যে উধাও হয়েছে তা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। ভদ্রলোকের সঙ্গে, ডেস্কের পাশে ফ্যাকাসে চেহারার একজন মহিলা। ভদ্রলোকের স্ত্রী ইনি। দামী পোশাক পরনে, কিন্তু নিরানন্দ চেহারা।
শহীদ ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অকস্মাৎ ভদ্রমহিলা চিৎকার করে উচ্চারণ করলেন, না!’
শহীদ প্রশ্ন করল ভদ্রলোকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে, আপনিই মি. জামিল হায়দার?’
হ্যাঁ।
শহীদ একমুহূর্ত ইতস্তত করে মৃদু কণ্ঠে বলল, আপনার বিরুদ্ধে গোলাম হায়দারকে হত্যা করার চার্জ আছে। এ সম্পর্কে যা বলবেন তা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তাই সতর্ক হবার পরামর্শ দিচ্ছি আমি আপনাকে। কিন্তু, আপাতত আমার প্রথম কাজ হল আপনাকে থানায় নিয়ে যাওয়া।
মি. জামিল হায়দার নড়াচড়া করলেন না এতটুকু।
মিসেস জামিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন ব্যাকুল স্বরে, মিথ্যে কথা! এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা•••! পাগল হয়েছেন আপনি! ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে দেব না।’
‘আমি দুঃখিত, মিসেস জামিল।
ফর্মালিটির জন্যে নয়, সত্যিকার অর্থে দুঃখ প্রকাশ করল শহীদ। মিসেস জামিল চেঁচিয়ে উঠলেন, কিন্তু ও তো গোলামকে খুন করেনি…!’
মি. জামিল হায়দার অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা দিয়ে স্ত্রীকে প্রায় ধমক মারলেন, তুমি চুপ করো, সালমা! ওঁর কর্তব্য পালন করতে এসেছেন উনি। তুমি সবার
৬০
ভলিউম-১১
জামিল বন্ধ
ও অভিযেএকটা হাত
কাজে গোলমাল সৃষ্টি করছ শুধু শুধু।
| মিসেস জামিল বলে উঠলেন, কিন্তু তুমি অমন ঠাণ্ডা ভাবে কথা বলছ কিভাবে, জামিল! তুমি কি বুঝতে পারছ না খুনের দায়ে তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন ওঁরা। তোমাকে তোমাকে ওঁরা হয়ত ফাঁসিতে চড়াবেন।
কেঁদে ফেললেন মিসেস জামিল, থরথর করে কেঁপে উঠলেন। জামিল হায়দার স্ত্রীর মাথায় একটা হাত রেখে বলে উঠলেন, আমি গোলামকে খুন করিনি, সুতরাং এ অভিযোগ ওঁরা প্রমাণ করতে পারবেন না। সালমা, তুমি এবার ভিতরে যাও, কেমন? আমরা বেরিয়ে যাবার আগে ওর সাথে এখানেই দুটো কথা বলতে চাই।’
শহীদ নিজের পরিচয় দিল এতক্ষণে। মিসেস ‘জামিলকে নিয়ে যাবার জন্যে দুজন চাকরানী ঢুকল। তারা ক্রন্দনরতা ভদ্রমহিলাকে ঘর থেকে নিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় মি. জামিল হায়দার বলে উঠলেন, “রোশনা আজ রাতেই পৌঁছে যাবে এখানে। ও দেখাশোনা করবে তোমার। দুর্ভাবনা করে কষ্ট দিয়ো না নিজেকে।
মিসেস জামিল রূম ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে মি. জামিল হায়দার শহীদকে বললেন, ‘আমার স্ত্রী এ ঘর থেকে চলে যাক তাই চাইছিলাম শুধু। আপনাকে ধন্যবাদ, ফোনে একা থাকতে বলেছিলেন বলে। কিন্তু আমার স্ত্রী কোনমতে একা ছাড়ছিল না আমাকে। সারা জীবন ধরে ওর বিশ্বাস আমাদের জীবনে কোনদিন কোন বিপদ আসবে না। ওর সারা জীবন কেটেছে স্বস্তি, শান্তি আর নির্ভাবনার মধ্যে••• |
হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি। শহীদ ডেস্কের উপর তিনটে ছবি কে চোখ রেখে বলে উঠল, ‘সবরকম উপায়ে আমরা মিসেস জামিলকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।’
মি. জামিল হায়দার বলে উঠলেন, সে ব্যাপারে চিন্তিত নই আমি।’
ডেস্কে ছবিগুলোর দিকে শহীদ তাকিয়ে রয়েছে দেখে তিনি বললেন, এটা আমার স্ত্রীর আত্মপ্রতিকৃতি, বাকিগুলো••।’ হঠাৎ থেমে গেলেন মি. জামিল। বাকি দুটো ছবির মধ্যে একটা একজন যুবকের, অন্যটা একজন যুবতীর। কিন্তু এ সম্পর্কে মি. জামিল আর কিছু বললেন না। একমুহূর্ত পর শুধু বললেন, ‘এবার তাহলে আমরা যাব, কেমন?
রূম, ছেড়ে বের হয়ে এল ওরা। কামাল এবং আর একজন পুলিস ইন্সপেক্টর অপেক্ষা করছিল বাইরে। কামাল এবং দ্বিতীয় ইন্সপেক্টর মি. জামিল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। শহীদ ইন্সপেক্টর বোরহানকে নিয়ে বাড়িটা সার্চ করার জন্যে রয়ে গেল। মি. জামিলকে নিয়ে ওরা চলে যেতে মার্চ মাসের শীতটা যেন জাপটে ধরল শহীদকে। সারা বাড়িটায় মিসেস জামিলের দূরাগত ক্রন্দন ধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
বাড়িটা বিরাট। প্রতিটি রূম সুরুচি এবং অর্থ সম্পদের সম্যক পরিচয় দেয়।
কুয়াশা-৩২
৬১
মি. জামিল রিটায়ার্ড সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট, এবং ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবসায়ী। একের পর এক কামরাগুলো দেখে যেতে লাগল শহীদ। কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে সার্চ করার সময় নেই। দরকারও নেই। মি. জামিলের বিরুদ্ধে প্রমাণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সংগ্রহ করা গেছে। সিঁড়ির মধ্যবর্তী স্থানে একটা ঘর, সেটা খুলে ভিতরে ঢুকল শহীদ। আলো জ্বেলে দেখল এটা একটা বক্সরূম, কিন্তু ডার্করূমের কাজ সারা হয় এটায়, বুঝতে পারল শহীদ। দুটো ক্যামেরা, স্লাইড, ফিল্ম ইত্যাদি যা যা দরকার একজন ভাল ফটোগ্রাফারের, সবই রয়েছে। ইন্সপেক্টর বোরহান উদ্দিনকে দিয়ে বাড়ির এক চাকরানীকে ডেকে আনাল শহীদ। প্রশ্ন করল তাকে, তোমাদের কত্রী কেমন আছেন এখন?” | বড় কাঁদছেন বিবি সাহেব। কেমন যেন করছেন, তাই ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি একজনকে।
শহীদ বলল, খুব ভাল করেছ। আচ্ছা, এই ডার্করুমটা কে ব্যবহার করে ফটো ভোলার জন্য?
‘বিবি সাহেব, হুজুর। ওনার খুব শখ কিনা ফটো ওঠাবার। বিবি সাহেব নিজেই ফটো ওঠান, নিজেই কেমন করে জানি না এই ঘরে এসে ছবি হাতে করে বের হন।’
‘ নেগেটিভ থেকে ফটোতে রূপান্তর হবার কায়দা বোধগম্য নয় আধবুড়ী চাকরানীর। শহীদ জিজ্ঞেস করল, আর কেউ এই ঘর ব্যবহার করে না?’
না, হুজুর। বিবি সাহেবের মেয়ে এক-আধবার করত অবশ্যি, বড় সাহেবও•••।’ হঠাৎ থেমে গিয়ে সে আবার বলে উঠল, “ওরা কেউ বিশেষ ফটো ওঠায় না। ফটো তোলার পর দেখে শুধু। বড় সাহেব বলে ক্যামেরা নড়ে যায় ওনার হাতে।’
শহীদ বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার বিবি সাহেবের দিকে খেয়াল রেখো। যাও এবার তুমি।’
| দু ঘন্টা পর শহীদকে দেখা গেল মি. সিম্পসনের অফিস রূমে একা বসে থাকতে। মি. সিম্পসন কোন কাজে বাইরে গেছেন। শহীদ অপেক্ষা করছে তার জন্যেই। মি. সিম্পসনের টেবিলের উপর একটা ফাইল। ফাইলটার উপর লেখা ‘গোলাম হায়দার হত্যা রহস্য।’ লেখাটা শহীদের নিজের হাতের। ফাইলটা ও-ই নিজে দিয়ে গেছে আজ বিকেলে মি. সিম্পসনকে। গোলাম হায়দারের খুন সম্পর্কে সকল তথ্য আছে এই ফাইলে। গোলাম হায়দারের লাশ দশদিন আগে কবর থেকে তোলা হয়েছে এবং তার পাকস্থলীতে পাওয়া গেছে আর্সেনিক বিষ। এসবই শহীদের তথ্যানুসন্ধানের ফল । মি. জামিল হায়দার দেশের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বিধায় পুলিস বিভাগ সরাসরি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্যে ইনভেস্টিগেশন চালাতে ইতস্ততবোধ করছিল। তাই শহীদকে অনুরোধ করা হয় মি. জামিল
ভলিউম-১১
৬২
লত
একই ধরয়েছে তা এখন এবং কোন
হায়দার সত্যি সত্যি অপরাধী কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। শহীদ যা তথ্য সংগ্রহ করেছে তাতে মি. জামিল হায়দার নিঃসন্দেহে অপরাধী, গোলাম হায়দারকে তিনিই খুন করেছেন বলে প্রমাণিত হয়। গোলাম হায়দার তার ভাইপো । মি. সিম্পসনের পরিচিত এবং বন্ধু বিধায় গ্রেফতার করার সময় তিনি উপস্থিত থাকাটা
এড়িয়ে গেছেন। |
শহীদ ফাইলটা কাছে টেনে নিয়ে ফিতে খুলে মেলে ধরল চোখের সামনে। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে একটা চিরকুট। গোটা গোটা অক্ষরে চিরকুটটায় লেখাঃ গোলাম হায়দারকে খুন করা হয়েছে।’
লালবাগ থানায় একটা পোস্ট অফিসের খামের ভিতর ভরে পাঠানো হয়েছিল চিরকুটটা, তারিখ আছে বটে, তেরোই ফেব্রুয়ারি, কিন্তু সই নেই প্রেরকের। ঢাকা পোস্ট অফিসের ছাপ ছিল, কোন ঠিকানা ছিল না, এবং কোন হাতের ছাপও পাওয়া যায়নি। চিরকুটটা কে পাঠিয়েছে তা এখনও অজ্ঞাত এবং রহস্যময়। এরপর অন্যান্য নামহীন একই ধরনের কয়েকটা চিঠি এবং যে ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিল তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ। এ ছাড়া পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টও রয়েছে।
শহীদকে এসব তথ্যের প্রায় সবগুলোই সরবরাহ করা হয়েছিল পুলিস বিভাগের তরফ থেকে। প্রকৃতপক্ষে শহীদের উপর ভার ছিল পুলিসের সন্দেহের উপর ভিত্তি করে মি. জামিল হায়দারকে গ্রেফতার করা যায় কিনা..তা দেখার জন্যে। শহীদ পুলিশ বিভাগের প্রদত্ত তথ্যগুলো যাচাই করেছে একবার করে স্বয়ং। তারপর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, পুলিসের সঙ্গে সে একমত। মি. জামিল হায়দারই তার ভাইপো গোলাম হায়দারকে হত্যা করেছেন। তাঁর ভাইপো গোলাম হায়দার বাজে প্রকৃতির লোক ছিল। গোলাম হায়দার যে তার চাচাকে ব্ল্যাকমেল করছিল তাতে কোনই সন্দেহ নেই। ব্ল্যাকমেলের কারণটা বড় নোংরা। মি. জামিল হায়দারের যুবক বয়সের অপরিণামদর্শিতার ফলস্বরূপ একটি অবৈধ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ব্যাপারটা ঘটে ত্রিশ বছর আগে। কিন্তু সেই অবৈধ জারজ সন্তানের কোন সন্ধান নেই। কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি। এমনকি মি. জামিল চৌধুরীও কিছু জানেন
বলেছেন। ওঁর এই অপরাধের কথা জানতে পারে গোলাম হায়দার। কিভাবে, কোথা থেকে জানে সে তা কেউ বলতে পারেনি। তবে সে তার চাচাকে এ ব্যাপারে ব্ল্যাকমেল করে আসছিল গত পাঁচ বছর ধরে। কিছুদিন আগে থেকে মি, জামিল হায়দার টাকা দিতে অস্বীকার করেন ভাইপোকে। কিন্তু ভাইপো ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠায় যে টাকা না দিলে তার ত্রিশ বছর অতীতের কলঙ্ক খবরের কাগজে ছাপাবার ব্যবস্থা করবে সে। চিঠিপত্র সব দেখেছে শহীদ। মি. জামাল হায়দার কয়েক সপ্তাহ আগে আর্সেনিক বিষ কিনেছেন, এটাও প্রমাণিত। এবং দূরবর্তী একটা হোটেলে দেখা করেছেন ভাইপো গোলাম হায়দারের সঙ্গে। সেখানে তিনি গোলাম কুয়াশা-৩২
৬৩
হায়দারের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন একথা প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন শুধুমাত্র জটিলতা বাড়াবার জন্যে। যাই হোক, সেই হোটেলে গোলাম হায়দার ডিনার খাবার পরপরই তার মৃত্যু হয়। উদ্দেশ্য, নিজের দ্বারা তৈরি পরিবেশ এবং আর্সেনিক বিষ সবই মি. জামিলের বিপক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যে শহীদ কোথাও কোন ভুল দেখতে পাচ্ছে না। তবু•• |
| এমন সময় মি. সিম্পসনকে তার অফিস রূমে ঢুকতে দেখা গেল। শহীদকে দেখেই মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, তোমার কাজ শেষ করেছ, মাই বয়?’
হ্যাঁ, মি. সিম্পসন।’
শহীদ মি. জামিল হায়দারের গ্রেফতারের সকল ঘটনা খুলে বলল। মিসেস জামিলের অসুস্থতার কথাও বাদ দিল না ও। সবশেষে যোগ করল, মানুষের দ্বারা, যতরকম ভাবে প্রমাণগুলো চেক করা সম্ভব, আমি তা করেছি বলে মনে করি। আর কিছু করার নেই আমার। একটা কথা, মি. জামিলের সেই জারজ সন্তানের কোন সন্ধানই পাওয়া যায়নি। বিয়ের পর ওঁর তো মাত্র দুটো সন্তান হয়। একজনের নাম : শামিম হায়দার, অন্যজন মেয়ে, মিস্ রোশনা হায়দার। শামিমের বয়স সাতাশ, ৰাপ-মার সাথে ঝগড়া করে আলাদা বাস করে একটা বাড়ি ভাড়া করে। শামিমের সাথে এই খুনের সম্পর্ক নেই। গত দু’বছর ধরে দেখা হয়নি গোলাম হায়দারের সাথে তার। খুনের রাতে সে ছিল তার নিজের বাড়িতে, একথা জানিয়েছে। এবং তার জবানবন্দী মিথ্যে প্রমাণিত করা যায়নি। আর মিস রোশনা হায়দার গত তিন মাস ধরে ইরানে আছে। ইরানে যাবার আগে সে-ও আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত, বাপ-মার সাথে বনিবনা হয় না বলে হয়ত। অবশ্য এখনও বিয়ে করেনি। সে আজ পৌঁছুবে ঢাকায়। ঘনিষ্ঠ কোন আত্মীয়ও কেউ নেই। এদিকে গোলাম হায়দারের টাকাও ছিল না যে টাকার লোভে কেউ তাকে খুন করবে। হত্যার মোটিভ একমাত্র মি. জামিলেরই পাওয়া যায়। একটি মাত্র ব্যাপারে আমি বড়বেশি অস্বস্তিবোধ করছি, মি. সিম্পসন। অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কর্তৃক পাঠানো ওই চিরকুটগুলোর কথা বলছি। সতর্কভাবে হাতের বা আঙুলের ছাপ মুছে ফেলে পাঠানো হয়েছে ওগুলো। যাই হোক, চিরকুটগুলো প্রমাণ করে অন্য কেউ জানত হত্যাকাণ্ডের রাতে মি. জামিল কোথায় ছিলেন। এবং এটা এও প্রমাণ করে যে মি. জামিলের বিরুদ্ধে এমন কেউ আছে, যে তাকে ঘৃণা করে, তার মন্দ চায়। অথচ আমাদের পরিচিত কোন ব্যক্তিই মি. জামিলের মন্দ চায় না।
| মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, মি. জামিলের তরফ থেকে কোর্টে কে যাচ্ছে?
‘মি: কামরুজ্জামান চৌধুরী।
মি. সিম্পসন বললেন, “ঠিক আছে। তোমাকে ধন্যবাদ, শহীদ। যা করেছ। যথার্থ করেছ।’
শহীদ এরপর কফি খেয়ে বিদায় নিল মি. সিম্পসনের অফিস থেকে।
ভলিউম-১১
৬৪।
বাড়িতে ফিরে নিচের তলার ড্রয়িংরূখে বসল শহীদ। মনটা খুঁত খুঁত করছে ভীষণভাবে। মি. জামিল হায়দারের বিরুদ্ধে এতগুলো অখণ্ডনীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ও ঠিক মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটিকে। অথচ প্রমাণের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। তাই গ্রেফতার না করে উপায় ছিল না।
• গফুর গেছে চা তৈরি করতে। মহুয়াকে শহীদ ঘুম থেকে জাগায়নি। রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
একটা শব্দ হল। শহীদ আনমনেই কান পাতল। রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যেতে যেতে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। শব্দটা সে-জন্যেই হয়েছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ। বাইরে গাড়ির দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদু। অমনি বেজে উঠল কলিং বেলটা। এক মুহূর্ত দেরি করে দরজা খুলল শহীদ। বাতির সুইচ অন করেই এসেছে ও। উজ্জ্বল আলোয় শহীদ দেখল সুন্দরী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে।
‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান কি আপনিই?’ সুন্দরী যুবতীটি প্রশ্ন করল। শহীদ বলল, হ্যাঁ।’
যুবতী বলে উঠল, আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিলে বাধিত হব। আমার নাম রোশনা, রোশনা হায়দার।
ড্রয়িংরুমে নিয়ে এসে বসাল শহীদ মি. জামাল হায়দারের মেয়ে মিস রোশনা হায়দারকে। মিস রোশনাকে নার্ভাস এবং আতঙ্কিত দেখে একটুও অবাক হল না শহীদ। কোন আলাপ শুরু করার আগে শহীদ বলে উঠল, ‘আপনি কিছু মনে না করলে আমার স্ত্রীকে একটা কথা বলে আসি?”
“নিশ্চয়।’
শহীদ সোজা উপরতলায় উঠে এল। বেডরূমের দিকে না গিয়ে কিচেনরূমের দিকে এগোল ও। ওর পায়ের শব্দ শুনে গফুর বের হয়ে এল কিচেনরূম থেকে।
শহীদকে জিজ্ঞেস করল গফুর, দুকাপ দেব তো, দাদামণি?’ * শহীদ গফুরের ব্যায়ামপুষ্ট অস্বাভাবিক চওড়া শরীরটা প্রশংসার চোখে দেখল। সত্যি, আগের চেয়েও ভীষণ হয়ে উঠেছে গফুর দেহগত দিক দিয়ে। ব্যায়াম এবং প্রচুর খাওয়াদাওয়া–এই দুটো ব্যাপার ছাড়া বর্তমানে গফুর আর কিছু করছে না। শহীদ আড়চোখে কিচেনরূমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাজারজাত এত রাতে তোর কাছে এসেছে কেনরে? এলই বা কোন পথে?’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নাচের ভঙ্গিতে ছুটে এল একজন রোগা.লোক কিচেনরূমের ভিতর থেকে। লোকটা প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, তার আগে সশব্দে ৫-কুয়াশা-৩২
৬৫
স্যালুট করল শহীদকে, ঢন্যবাড, ঢন্যবাড, মি, শহীদ খান। রাজার জাটের লোক বলেছেন–ঢন্যবাড।’
শহীদ ধমকে উঠল, হয়েছে হয়েছে। এত রাতে এখানে কেন তুমি তাই বলো।’
ডি, কস্টার মুখ শুকিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে, লজ্জিতভাবে। গফুর এবার হাটে হাঁড়ি ভাঙল, “দাদামণি, ডি, কস্টা আমার সাথে । বন্ধুত্ব পাতাতে এসেছে, কদিন ধরেই তো রাত করে আসে ও। কেন জানো, দাদামণি? ও নাকি ডিটেকটিভ হবেই, তাই তোমার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব খবর যোগাড় করতে চায়, তোমাকে ও খুব বড় ডিটেকটিভ বলে মনে করে কিনা…।’
| ডি. কস্টা হঠাৎ ঝট করে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল দরজার দিকে। শহীদ বুঝল লজ্জায় পড়ে ডি কস্টা কেটে পড়ছে। ডাকল ও ডি. কস্টাকে। ডি, কস্টা দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির মুখে। শহীদ বলল, একটা জরুরী কাজ করতে পারবে তোমরা দুজন? গোয়েন্দামূলক কাজ।’
জাদুর মত কাজ দিল শহীদের কথাগুলো। তিন লাফে সিঁড়ির কাছ থেকে শহীদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ডি-কস্টা মাথা-ঘাড় নত করে আনন্দের প্রাবল্যে বলে উঠল রাজ-কর্মচারীদের পুরানো ঢঙে, বান্দা হাজির হ্যায়! ফরমাইয়ে জঁহাপনা!’
গফুর সন্দেহপূর্ণ এবং বিরক্ত দৃষ্টিতে দেখছিল ডি কস্টাকে। শহীদ ওদের দুজনের উদ্দেশ্যেই বলল, বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওটাকে অনুসরণ করতে হবে। বাড়ির পিছনের গ্যারেজ থেকে ভেসপাটা বের করে গাড়িটাকে অনুসরণ করে যাবে তোমরা। গাড়ির ড্রাইভারকে চেনবার চেষ্টা করবে, এবং যেখানেই যায় গাড়িটা পিছনে পিছনে সেখানেই যেতে হবে, কিন্তু ওরা যেন কিছুই বুঝতে না পারে। এবং গাড়িটাকে চোখের আড়াল না করে আমাকে খবর দিতে হবে ফোনে। গাড়িটা নিশ্চয় কোথাও না কোথাও দাঁড়াবে, খবর দিতে হবে তখনই। পারবে তোমরা?’
| ডি. কস্টা বলল, “নিশ্চয় পারে গা, একশবার, হাজার বার পারিটে হইবে আমাকে। এটা টো হইটেছে হামার লাইফের পেরঠম অ্যাসাইনমেন্ট, লাইফ বরবাদ হইলেও যাইবে, মাগার আনসাকসেস•••।’
শহীদ চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, কথা নয় আর। গফুর, দুকাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরূমে আয়। চা দিয়েই পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবি তোরা। | শহীদ ফিরে এল ড্রয়িংরুমে। গফুর চা দিয়ে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। শহীদ মিস রোশনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার জন্যে কিছু করতে পারি আমি বলুন? | মিস রোশনা ব্যাকুলকণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমার আব্বা গোলামকে খুন করেননি,
মি.শহীদ!
. ৬৬,
ভলিউম-১১
কিন্তু প্রমাণ সবই তাঁর বিরুদ্ধে। প্রমাণের উপর নির্ভর করে চলতে হয় আমাদেরকে এবং••• |’।
শহীদের কথা শেষ করতে না দিয়ে মিস রোশনা বলে উঠল, সে প্রমাণ অবশ্যই ভুল হতে বাধ্য! |
শহীদ বলল, মি. কামরুজ্জামান চৌধুরী দেশের একজন অন্যতম সলিসিটর, আমার কোন সন্দেহ নেই যে তিনি পুলিসের প্রমাণ মিথ্যে প্রতিপন্ন করার জন্যে সব রকম প্রয়াস নেবেন। যদি সত্যি সত্যি মি. জামিল নিরপরাধ হন তাহলে ভয়ের কিন্তু নেই। কিন্তু এ পর্যন্ত যা প্রমাণ পাওয়া গেছে তা সরই তার বিরুদ্ধে। সত্যি কথা বলতে কি, পুলিস যাকেই সন্দেহ করুক না কেন, আমরা সব সময় চাই, নিরপরাধ কোন মানুষ যেন সাজা না পায় । আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হলেও, এ কেসে পুলিসের তরফ থেকেই কেসটা যাচাই করে দেখেছি।’
মিস রোশনা খানিকক্ষণ শুকনো মুখে বসে থেকে প্রশ্ন করল, “হিয়ারিং কালকের বদলে অন্য কোন দিনের জন্যে পিছিয়ে দেয়া যায় না?
শহীদ বলল, “কোর্টের ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারি না। কোর্টও আমাদের প্রদত্ত প্রমাণের উপর নির্ভর করে। নতুন কোন প্রমাণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। কাল সকাল এগারোটায় হিয়ারিং।
মিস রোশনা হঠাৎ একটু চড়া গলায় বলে উঠল, কিন্তু ভয়ানক একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে আমাদের বাড়িতে, মি. শহীদ। আমার আম্মা অস্বাভাবিক রকম ঘাবড়ে গেছেন। কাল সকালেই যদি প্রথম শুনানী হয় তাহলে কি যে প্রতিক্রিয়া হবে তার, কে জানে। আম্মা বড় নার্ভাস টাইপের, আমি যেন পরিষ্কার অনুভব করছি যে কোন মুহূর্তে আত্মহত্যা করবেন আম্মা।
শহীদ বলল, ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাখলে বোধহয় সব ঠিক হয়ে যাবে।
মিস রোশনা বলে উঠল, ‘আমার ভরসা হয় না। কিন্তু, আমার প্রশ্ন হল আমার আম্মা আত্মহত্যা করলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? আমার বিশ্বাস আম্মা চেষ্টা করবেন।’
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে মিস রোশনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “সন্দেহ যখন হয়েছে তখন প্রতিক্ষণ চোখে চোখে রাখুন আপনার আম্মাকে। তাহলেই ভয়ের কিছু থাকবে না।’
| আমি সারা রাতের জন্যে একজন নার্সের ব্যবস্থা অবশ্য করেছি। কিন্তু তাকে .সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে আমার ভার তার ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। আমি নিজে অবশ্য থাকতে পারতাম আম্মার সাথে। কিন্তু ইরানে যাবার আগে পারিবারিক ব্যাপারে আমার সাথে আমার একটা ঝগড়া হয়। সে ঝগড়া এখনও মেটেনি। তাই আম্মার এরকম মানসিক অবস্থায় আমি যদি কাছে থাকি তাহলে সেটা হিতে-বিপরীত হয়ে দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হত আপনি যদি একজন পুলিশ বিভাগের কুয়াশা-৩২
নার্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। মি. শহীদ, আমি নিশ্চিত হতে চাই যে আমাদের বাড়িতে আর কোন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটবে না। সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত একজন নার্স আম্মাকে রাত দিন চোখের সামনে রাখবে, এমন একটা ব্যবস্থা করতে পারেন না আপনি?” |
আকুল আবেদন ঝরে পড়ল মিস রোশনার শেষ কথাটায়। শহীদ কোন উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর বলল, আগামীকাল সকালে হলে চলে কি?”
না! আজ রাতেই দরকার–অবশ্যই!’ শহীদ বলল, “আই সি!
থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করল শহীদ। কথাবার্তা বলল কয়েক মিনিট। ক্রেড়লে রিসিভার রেখে দিয়ে মিস রোশনার দিকে তাকাল সে। মিস রোশনার দু চোখের কোণে পানি দৃষ্টি এড়াল না শহীদের। শহীদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেই মিস রোশনা উঠে দাঁড়াল। বলল, আচ্ছা, ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, মি. শহীদ। এবার আমি আসি।’
শহীদ মিস রোশনাকে দরজা অবধি এগিয়ে দেবার জন্যে পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে ও বলল, নার্স পৌঁছে যাবে খানিক পরই। একটা কথা মনে রাখবেন, মিস রোশনা। আমি সর্বদা চাই সত্য, সত্য এবং সত্য।’
মিস রোশনা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। শহীদের কথা যেন ও শুনতে পায়নি। গেটের কাছে এসে একবার ঘুরে তাকাল সে শহীদের দিকে। শহীদ সঙ্গে সঙ্গেই, কিন্তু স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করল তার চোখে চোখ রেখে, সত্যি করে বলুন
তো,আপনার আম্মাকে কে হত্যা করবে বলে সন্দেহ করেন আপনি? | শহীদ দেখল অকস্মাৎ আতঙ্কের রেখায় ভরে উঠল মিস রোশনার মুখ। শহীদের কথার উত্তর না দিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সে কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল সে গাড়িটার দিকে। শহীদ তাকাল দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে। গাড়ি থেকে নামছে একজন যুবক। লাইটপোস্টের আলোয় চিনতে পারল শহীদ যুবকটিকে। শামিম হায়দার, মি, জামিলের চরিত্রহীন কুসন্তান।
ভাই-বোন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলল না। চড়ে বসল গাড়িতে।
রাত একটা। চেস্টারফিল্ড সিগারেটগুলো একটার পর একটা শেষ করছিল শহীদ। টেলিফোনটা বেজে উঠতে একরকম ছোঁ মেরেই রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল ও বলল, শহীদ খান স্পিকিং।’
‘মিস্টার স্যানন ডি কস্টা বলিটেছি আমি। গাড়িটাকে ফলো করিয়া হামরা ইলেভেন নম্বর চান এভিনিউয়ের কাছে ঘাপটি মারিয়া ঠাকি। গাড়িটা এখন ইলেভেন নম্বরের সামনে ডারাইয়া আছে। প্যাসেঞ্জার দুজন ভিটরে অড়শ্য হইয়া গেছে। আমার অ্যাসিসট্যান্ট গরিলা গফুর এখন সেখানে প্রেজেন্ট, হামি একটা
৬৮
ভলিউম-১১
ডাক্তারখানা হইটে ডিউটি পালন করিটেছি!”
শহীদ বলল, “গাড়ি যখন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তখন নিশ্চয়ই আবার-বের হবে ওরা। অন্য কোথাও যাবে হয়ত। তোমরা অপেক্ষা করো। আবার অনুসরণ করতে হবে গাড়িটাকে।
‘জো হুকুম, মাই বস-টুকু, মাই ফ্রেণ্ড!
মৃদু হেসে শহীদ রিসিভার রেখে দিল। তারপর কি মনে করে থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করল ও। খবর পাওয়া গেল যে নার্সের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে মি. জামিল হায়দারের বাড়িতে।
| এগারো নম্বর চান এভিনিউয়ে মি. জামিল হায়দারের বাড়ি। শহীদ মনে মনে ধারণা করল শামিম বা মিস রোশনা হায়দার বাপ-মার বাড়িতে রাত কাটাবে বলে মনে হয় না। দেখা যাক।
ফোন এল কুড়ি মিনিট পরই। অপরপ্রান্ত থেকে ডি কস্টার কণ্ঠস্বর ভেসে এল শহীদ রিসিভার তুলে কানে ঠেকাতেইঃ মি. স্যানন ডি কস্টা বলিটেছি। ইলেভেন সম্বর চান এভিনিউ হইটে হামরা গাড়িটাকে ফলো করিয়া উপষ্ঠিট হইয়াছি সেভেনটি-ওয়ান নম্বর মিয়া রোডে। সেভেনটি-ওয়ান নম্বরে গাড়িটা ঢুকিয়া গ্যারেজের ভিটর রেস্ট লইটেছে। হামরা, আই মীন, হামার অ্যাসিসট্যান্ট গরিলা গফুর ঘাপটি মারিয়া বাড়িটার উপর চোখ রাখিয়া চলিয়াছে, হামি হামার ডিউটি পালন করিটেছি, একটা…।
শহীদ বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি এখুনি মিয়া রোডে আসছি। তোমরা অপেক্ষা করো সাবধানে।’
কথাটা বলে ফোন ছেড়ে দিল শহীদ। পরমুহূর্তে আবার বেজে উঠল ফোনটা। রিসিভার কানে তুলল শহীদ। থানা হেডকোয়ার্টার থেকে জানানো হল মিসেস জামিলকে দেখাশোনার জন্যে পুলিস বিভাগীয় নার্স পাঠানো হয়েছে এগারো নম্বর চাঁন এভিনিউয়ে।
শহীদ মিয়া রোডে ঢুকেই গাড়ি থামাল একটা ঘোড়ার গাড়ির আস্তাবলের কাছে। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগল ও। একটার পর একটা বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে শহীদ। নিঃশব্দে হাঁটা অসম্ভব এই রাস্তায়। কাঁকর বিছানো চওড়া রাস্তা। তার উপর আলোও নেই। সরু একটা রাস্তাকে হঠাৎ বিরাট বড় করে তৈরি করা হচ্ছে।
আবছা অন্ধকারে একজন মোটাসোটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল শহীদ। এগিয়ে গেল ও পা পা করে, জিজ্ঞেস করল, গফুর, কি খবর?’
গফুর সরে এল খানিকটা চিন্তিতভাবে বলল, ‘ওরা বাড়ির ভিতর থেকে আর বের হয়নি, দাদামণি । প্রায় এক ঘন্টা হল এখানে এসেছে ওরা। অথচ তারপর
আগিয়ে গেল ও পা
চিন্তিতভাবে বলনে এসেছে ওর
কুয়াশা-৩২
৬৯
থেকে কোন সাড়াশব্দ পাইনি ওদের।
‘কেউ দেখা করতে আসেনি? জানালায় ওদের কারও ছায়াও দেখিসনি?”
না, দাদামণি। ডি. কস্টা বাড়িটার উঠানে লুকিয়ে আছে, নিচু দেয়াল টপকে ঢুকেছে ও, ও-ও কিছু দেখেনি।
শহীদ বলল, আমি ওদের সাথে কথা বলব এখন। ডি-কস্টাকে ফেরত পাঠিয়ে দিস, কিন্তু তোকে হয়ত দরকার হতে পারে।
কথাটা বলে নিচু পাঁচিল টপকে বাড়িটার উঠানে প্রবেশ করল শহীদ। উঠানটা আলোকিত। ভিতরের রুমগুলোয়ও আলো জ্বলছে। শহীদ উঠান পেরিয়ে দরজার বেল টিপে ধরল।
মিনিট খানেক কাটল। খুলল না দরজা।
আবার বেল টিপল শহীদ। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না এবারও। শহীদ এবার অনেকক্ষণ ধরে একটানা বেল বাজিয়ে চলল। কিন্তু শেষ পর্যন্তও কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
শহীদ উঠানের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে ডাকল, গফুর।
গফুর একলাফে নিচু পাঁচিলটা টপকে বাড়ির ভিতর ঢুকল। শহীদের সামনে এসে দাঁড়াল ও। শহীদ জিজ্ঞেস করল, এ বাড়িতে ঢোকার বা বের হয়ে যাবার আর কোন পথ আছে কিনা জানিস?’
‘নেই, দাদামণি । আমি ঘুরে দেখেছি।’ শহীদ চিন্তিতভাবে গফুরের দিকে তাকিয়ে রইল।
মুহূর্তটি অতীব অপ্রত্যাশিত। শহীদ কোন শব্দই শোনেনি, কিন্তু গফুরের দিক থেকে ঘাড় ফিরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকাতেই ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে বলে মনে হল ওর। পলকের মধ্যে খুলে গেছে দরজাটা। মাথায় হ্যাট পরিহিত, মুখে রুমাল বাঁধা একটা ছায়ামূর্তি বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল শহীদের উপর। ছায়ামূর্তির উঁচানো হাতে একটা মারাত্মক অস্ত্র, শহীদ দেখতে পেল একসেকেণ্ডের জন্যে। অস্ত্রটা একটা হাতুড়ি। সরাসরি শহীদের মাথা লক্ষ্য করে হাতুড়িটা চালিয়ে দিল ছায়ামূর্তি। ভাগ্যগুণে মাথায় লাগেনি, হাতুড়িটা প্রচণ্ড বেগে এসে আঘাত করল কাঁধের মাংসে। অসহ্য যন্ত্রণা পলকেরমধ্যে কাবু করে ফেলল শহীদকে। বসে পড়ল ও নিজের অজ্ঞাতেই। দৌডুবার শব্দ কানে ঢুকল। টপাস করে একটা আওয়াজ হল। আস্তে আস্তে চোখ মেলল শহীদ। কাঁধটা ম্যাসেজ করতে করতে টলতে টলতে দাঁড়াল ও। অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করল, “গফুর!’
গফুর অবোধ্য একটা শব্দ করল উঠান থেকে। শত্রুর হাতুড়ির ঘা খেয়ে ভূপাতিত হয়েছে ওর দশাসই দেহটা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ও। শহীদ বলল, থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করতে হবে, গফুর।’
কাঁধের ব্যথায় মুখ বিকৃত করে কথাটা বলে শহীদ খোলা দরজাটার ভিতর
ভলিউম-১১
৭০
ঢুকে গেল ধীরে ধীরে।
ভিতরের হলরুমটা আলোকিত। ড্রয়িংরূমটাও। তারপরে পরপর তিনটে রূম,. সবকটাই আলোকিত। কিন্তু মিস রোশনা বা জামিল হায়দার নেই কোথাও। উপরতলায় উঠে গেল শহীদ। উপরের প্রায় প্রতিটি রূমই আলোকিত । কোণার একটা রূমে আলো জ্বলছে না। পকেট থেকে রিভলভার বের করে দরজাটা সশব্দে ঠেলে খুলে ফেলল শহীদ। টর্চের বদলে লাইটার জালল ও। দ্বিতীয় কোন শত্রু যদি ওত পেতে বসে থাকে, এই ভয়ে সতর্ক না হয়ে উপায় নেই শহীদের। রূমের সুইচ খুঁজে বাতি জ্বালল ও। কেউ নেই ঘর। পাশের রূমটাও অন্ধকার। পাশের রূমের দিকে এগোল শহীদ।
রূমটায় ঢুকে সুইচ অন করতেই আলোর বন্যায় ভেসে গেল রুমটা।
মিস্ রোশনা হায়দার একটা আরাম কেদারায় বসে রয়েছে। তার মুখে রুমাল গোঁজা। হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা আষ্টেপৃষ্ঠে। শামিম হায়দার হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে মেঝের এককোণে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে তার। শহীদ দেখল শামিম হায়দার একটুও নড়াচড়া করছে না। শামিম হায়দারের মাথার কাছে একটা দরজা খোলা ওয়াল সেফ।
তিন।
শহীদ হাঁটু মুড়ে শামিম হায়দারের পাশে বসল। পালস দেখল ও। বিট হচ্ছে। আঘাতটা কতটা মারাত্মক বোঝা মুশকিল। উঠে দাঁড়িয়ে থানা হেডকোয়ার্টারে একজন ডাক্তারের জন্যে ফোন করল ও। তারপর জুতোয় লুকোনো ছুরিটা বের করে মিস রোশনা হায়দারের দড়ির বাঁধনগুলো খুলে দিল। মুখে গোঁজা রুমালাটাও বের করে দিল শহীদ। হাঁপাতে লাগল মিস্ রোশনা জোরে জোরে। চোখমুখে রক্ত উঠে গেছে। পা দুটো সোজা করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। খিল ধরে গেছে। শহীদ বাথরূমের বেসিন থেকে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে
এসে মিসূ রোশনার চোখ-মুখ মুছে দিল।
যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে রয়েছে মিস্ রোশনার। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে সে। শামিম হায়দারের চোখের পাতা নড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। শহীদের বিশেষ কিছু করার নেই ওর জন্যে। শহীদ ঝুঁকে পড়ল সেফটার দিকে। এটা কমবিনেশন ওয়ালসেফ। প্রায় মেঝের উপর থেকেই তৈরি করা হয়েছে সেটা। সেটা ভোলা দেখে বোঝা যায় ভাঙাচোরার দরকার পড়েনি, কমবিনেশন নম্বর মিলিয়েই খোলা হয়েছে। হাতলটা দেখে শহীদ ধারণা করল আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না হয়। সেফের ভিতরকার ড্রয়ারগুলো টানা হয়েছে। ড্রয়ারের জিনিসপত্র অগোছাল। রূমের একটা টেবিল ওল্টানো।
কুয়াশা-৩২
৭১
দোয়াতের কালি পড়ে কার্পেটে মেখে গেছে।
এমন সময় শব্দ পাওয়া গেল জুতোর। শহীদের নাম ধরে ডাকল কেউ। সাড়া দিল শহীদ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রূমে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘হেডকোয়ার্টারে গফুরকে দেখেছেন, ড. মল্লিক?”
‘দেখেছি। গুরুতর কিছু নয়। ওর শরীরে ওসব কয়েক মিনিটের জন্যে স্থায়ী হয়। বাড়িতে ফিরে যেতে বলে দিয়েছি ওকে।
রূমে প্রবেশ করল এবার ইন্সপেক্টর বোরহান উদ্দিন। শহীদ ঘটনাটুকু প্রয়োজন অনুযায়ী বলে আঙ্গুলের ছাপ আবিষ্কারের জন্যে নির্দেশ দিল। বিশেষ নজর দিতে বলল সেফ টেবিল সম্পর্কে। সেফের কাগজপত্রগুলোও সাজাতে নির্দেশ দিল শহীদ। এক নজর দেখে রিপোর্ট দেবার নির্দেশ দিল। মিনিট তিনেক পরেই
আর একদল লোক ঢুকল রূমে। ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট, ক্যামেরাম্যান। | ড. মল্লিক শামিম হায়দারকে পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন, আঘাত খুব বেশি * মারাত্মক নয়। নার্সের হাতে বাড়িতেই থাকা চলে।’
| শহীদ নিচু স্বরে ডাক্তারকে বলল, “কোন নার্সিং হোমে রাখলে হবে ওকে, পুলিসের লোক সবসময় থাকবে ওর কাছে। ওর অবস্থা সঙ্কটজনক একথা ওকে বোঝালে কাজ আদায় হবে হয়ত।’ | ড. মলিক হাসলেন। বললেন, মৃত্যুশয্যায় আছে মনে করে মুখ খুলতে পারে,
এই ধারণা করছেন, কেমন?’
প্রশংসার দৃষ্টি ডাক্তারের চোখে। শহীদের বুদ্ধির উপর তার আস্থা আছে।
শহীদ মিস রোশনাকে ধরে ধরে হটিয়ে নিয়ে এসে বসাল নির্জন অন্য একটা রূমে। আরাম কেদারায় বসিয়ে দিয়ে ও নিজে বসল একটা চেয়ারে। সিগারেট ধরাল একটা। বলল, এবার বোধহয় আপনি সব বলবেন?
কি…ঠিক কি ঘটেছে তা ভাল করে বলতে পারব না আমি…!’ শহীদ বলল, “খুব দুর্বল স্মরণ শক্তি। কোথায় ঘটেছিল প্রথম আক্রমণ?’ | ‘অপ্রত্যাশিত ব্যাপার যে! আজ রাতটা শামিমের এখানে কাটাব ঠিক করে। এসেছিলাম। শামিমই দরজা খোলে। প্রথমে ভিতরে ঢুকি আমি। ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে একজন লোক আমার মাথা ঢেকে দেয় একটা চটের বলে দিয়ে। আমার কাঁধ অবধি ঢেকে যায় থলেতে। তারপরই শুনতে পাই শামিমের পড়ে যাবার শব্দ। চিৎকার করে উঠেছিলাম আমি, কিন্তু মুখ থলে চাপা ছিল বলে সে চিৎকার বেশি দূর যেতে পারেনি। লিভিংরূমে আক্রান্ত হই আমরা। থলে চাপা পড়ে চিৎকার করে ওঠার সাথে সাথে আমাকে লোকটা তুলে নেয় পাজাকোলা করে। চেয়ারে বসায় শয়তানটা আমাকে, তারপর শক্ত করে বেঁধে ফেলে। থলেটা তখনও আমার কাঁধ অবধি চাপা ছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম শামিমকে শয়তানটা শাসাচ্ছে ওয়াল-সেফের কমবিনেশন নম্বর জানার জন্যে।
ভলিউম-১১
| ‘এবং শামিম নিশ্চয় তাকে নম্বরটা দেয়?
মিস রোশনা বলে উঠল, না দিয়ে উপায় কি? না দিলে প্রাণ যেত। যাই হোক, লোকটা এবার আমার মাথা থেকে থলেটা সরিয়ে নেয়। লোকটার মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। চোখের ভুরু অবধি একটা টুপিও পরা ছিল। শুধু চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম শয়তানটার। শয়তানটা এবার আমাকে জেরা করতে শুরু করে। লোকটা সেঁফের ভিতর থেকে কিছু নিতে এসেছিল জোর করে। সে ব্যাপারেই প্রশ্ন করছিল আমাকে।’
‘জিনিসগুলো কি? কি নিতে এসেছিল সে?’ | মিস্ রোশনা বলল, তা আমি জানি না। শয়তানটা শুধু বলছিল–”সেই কাগজগুলো কোথায় বলো!” লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছিল “সেই কাগজগুলোর কথা যেন আমি ভালভাবে জানি। অথচ সত্যি সত্যি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না
আমি।’
শহীদ ভারি কণ্ঠে বলল, “তারমানে লোকটা রহস্যময় কিছু কাগজপত্র চাইছিল, যা ‘ওয়াল সেফে সে পায়নি, কেমন? এবং কাগজপত্রগুলো সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাই না? থাকবেই বা কেমন করে, আপনি তিনমাস ধরে বাইরে ছিলেন। কিন্তু মিথ্যে কথা বললে, যদি বলেন, ভুল করবেন মিস রোশনা।’
মিস রোশনা ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে অপমান করতে চান?
শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠে বলল, না। স্রেফ সত্য কথা জানতে চাই আমি। কেন আপনারা আক্রান্ত হলেন? এবং কে আপনাদেরকে আক্রমণ করল? মিস রোশনা, আমার সন্দেহ এই কেসের সাথে জড়িত কোন না কোন মানুষ কোন না কোন সত্য চেপে যাচ্ছে। লোকটা দেখতে কেমন ছিল, তাই বলুন।
‘লোকটার গড়ন অনেকটা আপনার মত। কালো ওভারকোট পরে ছিল। গ্লাভস ছিল হাতে, নীল রঙের। কালো জুতো। ডান পায়ের মোজাটা গোড়ালির কাছে ছেঁড়া।
শহীদ বলল, আমি এসে পড়াতে ভালই হয়েছে। কেন এসেছিলাম আমি জানেন? আপনি আজ রাতে আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে কেবল অর্ধ-সত্য বলে এসেছেন কেন তা জানার চেষ্টায়।’
মিস রোশনা উত্তর দিল না। খানিক পর জিজ্ঞেস করল, শামিমকে কোন নার্সিং রূমে পাঠানো হয়েছে?’
শহীদ বলল, ‘খোঁজ নিয়ে পরে জানাব আমি।’
একটু ভেবে নিয়ে, সিগারেট ফেলে দিল শহীদ। মিস রোশনাকে দেখল খানিকক্ষণ। তারপর বলতে শুরু করল, হত্যাকাণ্ড একটা ঘটে গেছে। আপনার আব্বা একাজ করেননি বলে বিশ্বাস আপনার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ কুয়াশা-৩২
রয়েছে আমাদের হাতে, ফাঁসি হতে পারে। আপনার আম্মা আক্রান্ত হতে পারেন বলে সন্দেহ। আপনি হয়ত জানেন না কেন এবং কে আপনাদেরকে আক্রমণ করে পালিয়েছে, কিন্তু আপনার আম্মা আক্রান্ত হতে পারেন একথা যখন জানেন তখন নিশ্চয় তার কারণও জানেন আপনি। এখন সময় হয়েছে সেকথা জানাবার। আপনার ভাই যেভাবে আঘাত পেয়েছে তাতে মারা যেতেও পারে হয়ত। আপনি নিজেও নিরাপদে ঠিক নেই। এছাড়াও অনেক ব্যাপার আছে। মিস রোশনা, আপনাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে আসল সত্য একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে, যা রহস্যময় । বলুন তো কি সেই রহস্য?’
| মিস্ রোশনা উত্তর দিল না। শহীদ আবার বলতে লাগল, আরও হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে, ঘটবে বলেই আমার বিশ্বাস, এবং সেজন্যে দায়ী হবেন আপনিও। এখনও সময় আছে, এখনও বলুন। রহস্যটা যাই হোক, আপনার চাচাত ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নতুনভাবে আলোকপাত করার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এবং তাতে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা দিতে পারে আপনার পিতার জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারে।’
মিস রোশনা উত্তর না দিয়ে খোলা দরজার দিকে মুখ ফেরাল। অকস্মাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠল ওর চোখ জোড়া আতঙ্কে। পরমুহূর্তে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল শহীদ। রিভলভারটা বের করে ফেলেছে ও। সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল এক ঝলক আলো এসে পড়ল ওদের দুজনের উপর। পরক্ষণে দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কণ্ঠ শোনা গেল একজন লোকেরঃ দৈনিক রঙ্গ’-র জন্যে চমৎকার একখানা ছবি হবে! প্রখ্যাত ডিটেকটিভ শহীদ খান জেরা করছে প্রখ্যাত সিভিল সার্ভেন্টের মেয়ে মিস, রোশনাকে–সন্দেহবশত!
শহীদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ফিরে এসে বসল চেয়ারে। মিস রোশনা দিশেহারার মত ফ্যাল ফ্যাল করে শহীদের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্বাভাবিক চিৎকার করে বলে উঠল, ‘অসম্ভব! ছবিটা খবরের কাগজে ছাপা চলবে না।’
শহীদ বলল, আপনি আক্রান্ত হয়েছেন এবং খবরের কাগজের লোক খবর পেয়ে সুযোগ মত ফটো তুলে নিয়ে চলে গেছে। ছাপা না ছাপার উপর আপনার কোন হাত নেই, মিস রোশনা।’
মিস রোশনা কেমন যেন আঁতকে উঠল, “দোহাই আপনার, ছবিটা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন, মি. শহীদ!
শহীদ বলল, “খবরের কাগজের লোক কি ছাপবে আর কি ছাপবে না তা আমার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হবার নয়। একমাত্র অভিযোগ আনা যায় লোকটা বাড়ির ভিতর অনুমতি না নিয়ে ঢুকেছিল। কিন্তু এইরকম ব্যাপারে এ
অভিযোগ টিকবেও না।’
হতাশায় চোখ বন্ধ করল মিস রোশনা। একটু পর ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ৭৪
ভলিউম-১১
আপনি সত্যি কি ওটা না ছাপার ব্যবস্থা করতে পারেন না?’
, দুঃখিত। মিস রোশনা, আপনার আম্মাকে কে আক্রমণ করবে বলে সন্দেহ করেন আপনি?’
মিস রোশনা উত্তর দিল না। শহীদ রূমটার একদিকে তাকাল চিন্তিতভাবে। টেবিলের উপর মিস রোশনার ছবি একটা। ঠিক যেমন একটা ছিল মি. জামিল হায়দারের ডেস্কের উপর। তারমানে ওর ভাইও একটা ছবি কাছে রেখেছে। সম্ভবত ওদের মা তুলেছে ছবিটা। ভদ্রমহিলার দারুণ শখ ছবি তোলার। শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এগোতে এগোতে বলল, আমি আশা করি অত্যধিক দেরি হয়ে যাবার আগেই সব কথা খুলে বলবেন আপনি আমাকে।’
শহীদ ফিরে এল আগের রূমটায়, যেখানে আক্রান্ত হয়েছিল ভাই-বোন একসঙ্গে। রূমের ভিতর কামালকে দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত হল শহীদ। কামাল কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিল পনেরো দিন আগে। কামাল চিন্তিতভাবে এগিয়ে এল শহীদের দিকে। বলল, ‘সন্ধ্যার পরই ফিরেছি ঢাকায়। আজ তোর সাথে দেখা করার ইচ্ছা ছিল না। গফুর বাড়ি থেকে ফোন করেছিল। তাই ছুটে এলাম । খবর কি?’
শহীদ বলল, ‘পরে শুনিস সব। এখানে কতক্ষণ হল এসেছিস?”
কামাল বলল, বেশ খানিকক্ষণ হল । সেফের কাগজপত্রগুলো দেখে ফেলেছি আমি ইতিমধ্যে। হাতের ছাপ দেখা গেছে দু জায়গায়, সম্ভবত শামিম হায়দারেরই। কয়েকদিন আগের আঙ্গুলের ছাপগুলো পরিষ্কার চেনার উপায় নেই। যে লোকটা সেফ থেকে কাগজপত্রগুলো বের করেছে সে নিঃসন্দেহে গ্লাভস পরে ছিল হাতে। মিস রোশনার মুখে যে রুমালটা পাওয়া গেছে তাতে শামিম হায়দারের মনোগ্রাম রয়েছে। কাগজপত্রগুলো ব্যবসায়িক বা ওই জাতীয়, বিশেষ কোন কাজ দেবে না, আমার বিশ্বাস।’
শহীদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, চমৎকার । তুই এখানে ঢুকেই দেখছি আমার চেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিস।’
কামাল ইন্সপেক্টর বোরহানকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘সব তথ্য তো আসলে এর সাপ্লাই করা, আমি পরিবেশন করলাম।
শহীদ বলল, শোন, তুই এখানেই থেকে যা। বাড়িটার সম্পূর্ণ এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখবি কিছু পাওয়া যায় কিনা। সকালে আসব আমি। ইতিমধ্যে নজর রাখবি মিস রোশনার ওপর।’
কামাল হাতে কাজ পেয়ে সানন্দে বলে উঠল, ভাল কথা।
শহীদ বেরিয়ে এল শামিম হায়দারের বাড়ি থেকে। থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করে ও জেনে নিল শামিম হায়দারকে কোন্ নার্সিং হোমে রাখা হয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নার্সিং হোমে উপস্থিত হল ও।
শামিম হায়দারের মাথায় মোটা ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। শহীদকে দেখে হাসল, কিন্তু অভ্যর্থনাহীন হাসি। জিজ্ঞেস করল, আবার কি চান? পুলিস ডিটেকটিভ–এদেরকে আমি দেখতে পারি না । শুধু জেরা জেরা আর জেরা। আমি একটা কথারও উত্তর দিচ্ছি না, মনে রাখবেন। যাক, কি ঘটেছিল বলবেন কি? বাঁচাল কে আমাকে?’
শহীদ মৃদু হেসে বলল, ‘আমি।’ শামিম হায়দার বলে উঠল, বাহ! আমি তাহলে ঋণী হলাম!’
শহীদ বলে উঠল, “ঋণী না থাকলেও চলবে। আমাকে আগে যা বলেছেন তাছাড়া আর কি জানেন বলুন দেখি? চোর কেন এসেছিল?’
জানি না, কিছু জানি না। ওসব কথা বাদ দিন, আমি যা চাই তা হল এই যে পুলিস যেন জনসাধারণকে নিরাপদে রাখার আরও ভাল ব্যবস্থা করে। কাজের মধ্যে শুধু নিরপরাধী লোককে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করতে পারেন, আর চোর-ছ্যাচড়া এলাহিকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যাবার পর যার ক্ষতি হল তাকে বিরক্ত করতে পারেন। শুনুন, আমি শুধু জানি যে আপনি বা আপনারা স্রেফ অকারণে আমার আব্বাকে গ্রেফতার করেছেন। এর বেশি আর কিছু জানি না আমি। আশা করি রোশনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, ‘খবরের কাগজে ফটো ছাপার ব্যাপারে মিস রোশনা অমন আতঙ্কিত কেন বলতে পারেন?’ ‘.
• ‘ও ওই রকমই। কেউ ও ফটো তুলুক তা ও চায় না। ছোটবেলা থেকেই।
আপনার বাড়ির টেবিলে ওর চমৎকার একটা ছবি দেখেছি আমি।’ আম্মা তুলেছিলেন ওটা। নিয়মের ব্যতিক্রম আর কি।
শহীদ কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে চেপে বসল ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনে। শহীদ গভীর ভাবনায় ডুবে গেল গাড়ি চালাতে চালাতে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিল ও মিস রোশনা এবং শামিম.একটা রহস্যময় ব্যাপার চেপে রাখার প্রয়াস পাচ্ছে। সম্ভবত ওদের চাচাত ভাই গোলাম হায়দারের হত্যা সম্পর্কেই কোন রহস্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ওদের পিতার ফাঁসি হবে একথা জেনেও চেপে রাখবে কথাটা?
ভোর সাড়ে-চারটেয় বাড়িতে ফিরে বিছানায় উঠল শহীদ। মাথার ভিতর কিলবিল করছে নানা দুশ্চিন্তা তখনও।
কামাল ইন্টারেস্টিং কিছু কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল থানা হেডকোয়ার্টারে শহীদ চলে যাবার পরই। ইন্সপেক্টর বোরহান বাড়িটা তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করছিল লোকজন লাগিয়ে । কামালও ছিল সঙ্গে। এমন সময় খবর এল মিস রোশনা জীপ নিয়ে বাইরে বের হচ্ছে।
কামাল মিস রোশনাকে অনুসরণ করে ‘দৈনিক রঙ্গ’-এর অফিসের বাইরে ভেসপাটা দাঁড় করাল। মিস বোশনা ততক্ষণ অফিসের ভিতরে প্রবেশ করেছে। ..
লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত অফিস কম্পাউণ্ডের ভিতরে ঢুকে পড়ল কামাল। বারান্দায় উঠে কাছে যে জানালাটা পেল সেটার পাশে গিয়ে উঁকি মারল ভিতরে। কামাল দেখল মিস রোশনা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা টেবিলের সামনে। একজন লোক, হাতে তার ক্যামেরা, তাকে বলছে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, বলুন, মিস রোশনা।’
মিস রোশনা ব্যগ্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনিই নিশ্চয় আমার ছবি তুলেছেন?
তা-ই। খুব চমৎকার উঠেছে কিন্তু। সেজন্যে দায়ী আপনার অপূর্ব সৌন্দর্য। মিস রোশনা গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলল, ওটা আমি ফিরে পেতে চাই।’
অসম্ভব। মাফ করবেন।’ মিস রোশনা পুনরাবৃত্তি করল তার দাবি, ওটা আমি চাই।’
ফটোগ্রাফার বলল, তা হয় না, মিস রোশনা। এটা আমাদের ধর্ম-বিরুদ্ধ কাজ। ফটো তুলি কাগজে ছাপব বলে । তা কোন ক্ষেত্রেই ফিরিয়ে দেয়া যায় না।’
মিস রোশনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল পলকে, “ফিরে পেতেই হবে এটা আমাকে। আপনি বুঝতে পারবেন না কিন্তু, ফিরে পেতেই হবে ওটা••• | টাকা দেব আমি, খুশি হয়ে দেব, যত টাকা চান•••!’
| অকস্মাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মিস রোশনা।
খানিকক্ষণের নিস্তব্ধতা। ফটোগ্রাফার বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। খানিক পর কি মনে করে সে বলল, ‘দেখুন, এই মুহূর্তে আর আমার কিছু করার নেই। ওটার ভার এখন সম্পাদকের হাতে। আমি বড়জোর সম্পাদককে অনুরোধ করতে পারি আপনার সাথে আলাপ করার জন্যে। যদিও তাতে কোন লাভ হবে কিনা বলতে পারছি না আমি।’
মিস রোশনা রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল, তা-ই করুন। আমাকে নিয়ে চলুন সম্পাদকের কাছে।’
ফটোগ্রাফার মিস রোশনাকে নিয়ে চলে গেল সম্পাদকের রুমের দিকে। কামাল অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইল বারান্দাতেই।
প্রায় আধঘন্টা পর মিস রোশনার হিল তোলা জুতোর খটখট শব্দ শুনতে পেল কামাল। বারান্দার এক কোণে সরে গেল ও। অফিস রূম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে এদিকে এগিয়ে যাচ্ছে মিস রোশনা একাই। সম্পাদকের সঙ্গে কোন সমঝোতায় আসতে পেরেছে কিনা বলা মুশকিল-কামাল ভাবল।
মিস রোশনা জীপে চড়ে বসল। ফিরে গেল সে শামিম হায়দারের বাড়িতে।
বেলা দশটায় ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজ মেলে ধরল শহীদ, চোখের সামনে।
কুয়াশা-৩২
৭৭
‘দৈনিক রঙ্গ’-তে মিস রোশনার ছবি নেই দেখে রীতিমত আশ্চর্য হল ও। তবে কি কাগজের কোন হোমরা-চোমরাকে ধরে ছবিটা না-ছাপাবার ব্যবস্থা করেছে মেয়েটা?
তাড়াতাড়ি স্নান করে নাস্তা সারল শহীদ। ফোনে কথা বলল কামালের সঙ্গে মিনিট তিনেক। কোর্টে যেতে বলল ও কামালকে। ফোন ছেড়ে দিতেই ঘরে ঢুকল
মহুয়া । বলল, তোমার পরগাছা এসেছিলেন সকালবেলা।’
মহুয়ার কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল শহীদ পোশাক পরতে পরতে, মানে! আমার পরগাছা আবার কে হলেন? চিরজীবন জেনে এসেছি আমিই তোমার পরগাছা।’
‘এই শুরু হয়ে গেল মুখরোচক কথাবার্তা। মি. সিম্পসন গো, তোমার পরগাছাই তো ভদ্রলোক। রাজ্যের সমস্যা তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে কেমন সরকারী চাকরি করছে নামে মাত্র।
‘ও কথা বোলো না, মহুয়া । মি. সিম্পসনের মত বুদ্ধিমান অফিসার পাকিস্তানে খুব কম আছে। তা কি বললেন মি. সিম্পসন?’
মহুয়া বলল, তোমার মুখ থেকে কাল রাতের ঘটনা শুনতে চাইছিলেন । তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে বলে গেলেন কামালের সাথে আলাপ করবেন। আর কাল রাতে কামাল মিয়া যেসব কাগজপত্র থানা হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছিল সেগুলো দিয়ে গেছেন তোমাকে।
| মহুয়ার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা আর না বলে বেরিয়ে পড়ল ও কোর্টের উদ্দেশে।
কোর্টে গিয়ে শহীদ খবর পেল মি. জামিল চৌধুরীর শুনানির ডেট পড়েছে আগামী সপ্তাহে। কোর্টে উপস্থিত ছিল মিস রোশনা। কামাল তাকে অনুসরণ শুরু করেছে কোট থেকে। সন্দেহজনক কোন লোককে দেখা যায়নি কোটে। ইন্সপেক্টর বোরহান খবরগুলো দিল শহীদকে। শহীদ আর অপেক্ষা না করে ফিরে এল। বাড়িতে।
মি. সিম্পসনের দিয়ে যাওয়া কাগজপত্রগুলো মনোযোগ সহকারে দেখল । শহীদ। ঘন্টা আড়াইয়ের মত সময় লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে। কোন লাভ হল
। সন্দেহজনক বা গোপনীয় কোন কিছুই নেই ওগুলোতে।
মহুয়া ডাকতে এল খাওয়ার জন্যে। আড়াইটা বেজে গেছে। খেতে বসল শহীদ। মহুয়া পরিবেশন করছিল। হঠাৎ অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠল সে, কি পেলে বলো তো তুমি! খাওয়ার সময়টাতেও চিন্তা-ভাবনাগুলোকে দূরে রাখতে পারো
না?’
শহীদ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ঠিক আছে। আগে খেয়ে নেই, তারপর না হয় ভাবব।’
শহীদের কথা শেষ হতেই ঘরের দরজা জুড়ে প্রকাণ্ড একটা দেহ এসে
ভলিউম-১১
দাঁড়াল। মুখ তুলে তাকিয়েই মহুয়া অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘কি রে, গফুর, তোকে
অমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘দাদামণি!’।
চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল শহীদ! গফুরের গলার এই বিশেষ উত্তেজিত ডাক বহুদিন শোনেনি। গফুর সহজে উত্তেজিত হয় না, হলে অমন কাঁপা, গলায় ডেকে ওঠে।
। কি হয়েছে রে?’
গফুর বলে উঠল, দাদামণি, কামালদা ফোন করেছে, শুধু বলল– পাঁচ নম্বর, | জাহাঙ্গীর রোড, শ্যামলীতে আমি আছি।’
যা, গাড়ি বের কর তুই।’ খাওয়া ছেড়েই উঠে পড়ল শহীদ হাত ধুয়ে । কামাল এ ধরনের অসমাপ্ত খবর পাঠাবার লোক নয়। নিশ্চয় অসাধারণ কিছু ঘটেছে। শহীদ মুহূর্তের জন্যেও ভোলেনি, কামাল মিস রোশনাকে অনুসরণ করছিল। | তিন মিনিটের মধ্যে গাড়িতে চেপে বসল শহীদ। দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল গাড়িটা বাড়ি থেকে ট্রাফিক পুলিসকে দু’বার জিজ্ঞেস করে নিল ও গাড়ি থামিয়ে, জাহাঙ্গীর রোডের ঠিক কোন দিকটায় বাড়িটা।
পৌঁছে গেল শহীদ জাহাঙ্গীর রোডে অল্প সময়ের মধ্যেই। আশেপাশে সৌখিন ভদ্রলোকদের বাগান সহ বড় বড় বাড়ি । কিন্তু পাঁচ নম্বরে কোন লোকজন বাস করে কিনা সন্দেহ। বড় বড় আকাটা ঘাস বাড়িটার উঠানময়। নিঃসন্দেহে পোড়ো বাড়ি।
কামালকে আশেপাশে দেখতে পেল নাঃ শহীদ। ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে বাড়িটা অতিক্রম করে খানিক দূরে গিয়ে থামল শহীদ। রাস্তার একদিকে সবগুলো বাড়ি, অন্যদিকে ঘাস এবং আগাছা। শহীদ গাড়ি থেকে নেমে পাঁচ নম্বরের দিকে এগোল। গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। খোলা গেট । এবং বহুদিন থেকেই খোলা এটা, শহীদ অনুমান করল। বোধহয় বন্ধ করা যায় না আর, বহুদিনের পুরানো। কিন্তু গাড়ির চাকার দাগ দেখল শহীদ, গেট অতিক্রম করে চলে গেছে। সম্প্রতি হয়েছে এই দাগ। পায়ের দাগ নেই কোথাও। কামালের অনুপস্থিতিতে ভীতিবোধ করল শহীদ। উপরতলা নিচেরতলা চোখ বুলিয়ে চলল শহীদ। কিন্তু কামালের ছায়াও দেখা গেল, না কোথাও। শহীদ গেট অতিক্রম করল। জানালাগুলোর অস্তিত্ব টের পেল শহীদ, কিন্তু বম্বা লম্বা ঝোঁপ-ঝাড়ে প্রায় জানালাই ঢাকা পড়েছে। নির্জন মনে হচ্ছে এত বড় বাড়িটা। গ্যারেজের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকাল শহীদ। গাড়ি নেই ভিতরে। ও ডাকল উছ স্বাভাবিক কণ্ঠে, কামাল!’
| কোন উত্তর এল না। জানালাগুলোর দিকে তাকাল শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে। কারও কোন ছায়ামাত্র নেই। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ও উঠান পেরিয়ে । কলিংবেল
কুয়াশী-৩২
৭৯
দেখা যাচ্ছে একটা। টিপে ধরল শহীদ। উচ্চরবে বেজে উঠল সেটা। গভীর নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল বেলের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিতীয়বার বেল
বাজিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। তারপর সম্পূর্ণ বাড়িটা চক্কর মারল একবার। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল শহীদ। একটা জানালার পাল্লা খোলা, শহীদ দূর থেকেও পরিষ্কার দেখতে পেল জোর করে কেউ মোচড় দিয়ে লোহার শিকগুলো বাঁকিয়েছে। শহীদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে উঁকি মারল জানালাটা দিয়ে। ভিতরে তাকিয়ে ও বুঝতে পারল ঘরটা এককালে বাথরূম হিসেবে ব্যবহার করা হত। কেউ নেই ভিতরে। জানালা গলে নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকল শহীদ। খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করল একটা ঘরে। আসবাবপত্রহীন ঘর। কেউ নেই। এক ধারে দেখা যাচ্ছে একটা ভোলা দরজা। কান পাতল শহীদ। না, কোথাও কোন শব্দ নেই। দরজাটার দিকে এগোতে এগোতেই শহীদ একজন মানুষের পা দেখতে পেল। চমকে উঠল ও। হঠাৎ মন্থর হয়ে গেল ওর গতি। ধীরে ধীরে দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। যে-কোন মুহূর্তে একজন আততায়ী আক্রমণ করতে পারে বলে সন্দেহ হচ্ছিল ওর। দরজাটা অতিক্রম করল ও অতি সন্তর্পণে। আর কেউ নেই ঘরে। বিরাট ঘরের ভিতর শুধু উপুড় হয়ে পড়ে আছে কামাল। মাথাটা প্রায় খুঁড়ো হয়ে গেছে ওর। মেঝেতে রক্তের ধারা।
চার।
স্থানীয় ভদ্রলোকদের সাহায্যে থানায় এবং হাসপাতালে খবর পাঠাতে বিলম্ব হয়নি। শহীদের। অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছুবার আগেই ড. মল্লিক পৌঁছেছেন। কামালকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে এসে তিনি পাণ্ডুর মুখে বললেন, শরীর থেকে রক্তক্ষরণ বড় কম হয়নি। এক্সরে প্লেট না দেখে কোন আশা দিতে পারছি না আমি, মি. শহীদ। আপনি ঠিক উপযুক্ত সময়ে পৌঁছেছিলেন বলে ওর মৃত্যু ঘটেনি।
ড. মল্লিক, মি. সিম্পসন, ইন্সপেক্টর বোরহান গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন বড় একটা রূমের ভিতর। বাড়িটা পরখ করে দেখা হয়ে গেছে। কয়েকমাস ধরে এখানে বাস করে না কেউ এটা বোঝা গেছে। শহীদ উপর এবং নিচের তালা পরীক্ষা করেছে। পায়ের ছাপ আবিষ্কার করেছে পুলিস বিভাগীয় এক্সপার্টরা। একজোড়া মহিলার এবং দ্বিতীয় জোড়া পুরুষের। শহীদ বুঝতে পারল কামাল মিস রোশনাকেই অনুসরণ করে এ-বাড়িতে ঢুকেছিল নিঃসন্দেহে। মহিলার পায়ের ছাপ নিশ্চয়ই মিস রোশনার। কিন্তু দ্বিতীয় জোড়া পায়ের ছাপ কামালের নয়। মিস রোশনার সঙ্গে তাহলে কে ছিল? পাশের বাড়ির একজন ছোকরা চাকর জানিয়েছে। যে শহীদ পৌঁছুবার কুড়ি মিনিট আগে এ বাড়ি থেকে একটা গাড়িকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে সে। এ ছাড়া আর কোন তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি।
৮০
ভলিউম-১১
ওরা সকলে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। কঠোর মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে শহীদের মুখাবয়ব। কামাল তার জীবনের একমাত্র প্রিয় বন্ধু এবং সহকর্মী। কামালকে ছাড়া কোন কথা ভাবতে পারে না ও। সেই কামাল আজ মৃত্যুর দুয়ারে।
লম্বা হাতলওয়ালা একটা হাতুড়ি পড়ে ছিল কামালের চেতনাহীন দেহের পাশেই। ওটা দিয়েই আঘাত করা হয়েছে ওকে। আততায়ী গ্লাভস পরেছিল বলে ছাপ পাওয়া যায়নি। হাতুড়ির মাথায় রক্ত এবং কালো চুল ছিল–কামালের মাথার। শহীদ মি, সিম্পসনের দিকে ফিরে মৃদু কণ্ঠে বলল, যত বেশি সম্ভব লোক লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন, বাড়িটার সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খোঁজার জন্যে। হয়ত কিছু একটা পেয়েও যেতে পারি আমরা।’ | শহীদের কথা শেষ হতেই একজন কনস্টেবল ছুটে দ্রুত রূমের ভিতর ঢুকল। মি. সিম্পসন গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “কি হল?
কনস্টেবলটি বলল, ঘাসের উপর এটা পড়েছিল, স্যার। মনে করলাম খবরটা জানানো দরকার। একটা চুরুট। এখনও একটু একটু গরম স্যার। যদিও নিভে গেছে অনেকক্ষণ আগে।’
হাত বাড়িয়ে সিগারটা নিল শহীদ। তিনভাগের দু ভাগ পোড়া একটা চুরুট। শহীদ বলে উঠল, এই তো, এরকমই কিছু একটা খুঁজছিলাম আমি!
ড্রয়িংরূমে শহীদের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোফায় বসে আছে মহুয়া। শহীদ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। মহুয়া আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠল, “কেমন আছে কামাল?
‘একই রকম।’ মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিল শহীদ। মহুয়ার চোখের কোণে জল। বলে উঠল, ‘কি
হবে।
শহীদ উত্তর দেবার আগেই দরজার কাছ থেকে শোনা গেল অসম্ভব ভারি এবং আশ্বাসপূর্ণ একটি কণ্ঠস্বর, শহীদ, আমার হাতেই কামালের ভার দাও। আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারি।’ | ‘দাদা!’ মহুয়া সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত স্বরে বলে উঠল। । ‘ শহীদের মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহূর্তে। দরজার দিকে তাকিয়ে বলে
উঠল ও স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে, ভিতরে এসো কুয়াশা।’
অস্বাভাবিক দীর্ঘ এবং বিশাল স্কন্ধধারী কুয়াশা প্রবেশ করল ড্রয়িংরূমে। কালো আলখাল্লার ভিতর থেকে অবিশ্বাস্য শক্তিধর পেশীবহুল শরীরটা ফুটে বেরুচ্ছে। কুয়াশা উজ্জ্বল হাসছে। অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব। রূমে পা দেবার সঙ্গে ৬-কুয়াশা-৩২
,
৮১
সঙ্গে উজ্জ্বল একটা জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ল যেন সর্বত্র। মহুয়া বলে উঠল, বসো, দাদা।’
কুয়াশা আসন গ্রহণ করল ধীরে ধীরে। শহীদ জিজ্ঞেস করল, কামালের খবর পেলে কোথায় তুমি?’
কুয়াশা হাসল । বলল, তোমাদের প্রতিটি মুহূর্তের খবরই আমি রাখার চেষ্টা করি, শহীদ। এখন সোজা হাসপাতাল থেকে আসছি। ডাক্তাররা শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছে–তাদের পক্ষে কামালকে বাঁচানো সম্ভব নয়। আমি ভাবছিলাম–তুমি যদি মনে করো, তাহলে চেষ্টা করে দেখব। জার্মানীর ড, হোগ, ফ্রান্সের উ, সিরাফ্রা, চীনের ড, চ্যা চাং, ব্রিটেনের ড. আব্রাহাম–এরা আমার সাথেই কাজ করছে একটা বিশেষ গবেষণার ব্যাপারে। এক্ষেত্রে ওরা ওদের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করতে পারে কামালকে বাঁচাবার জন্যে।
শহীদ দ্রুত উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে। বলে উঠল, “তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমি অনেক কারণের মধ্যে এটার জন্যেও কুয়াশা। কামালকে বাঁচাবার আর কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। খানিক আগেই ডাক্তার মল্লিক জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের করার আর কিছু বাকি নেই। তোমার সাথে পৃথিবীবিখ্যাত চারজন ডাক্তারী শাস্ত্রের পণ্ডিত যখন রয়েছেন তখন নিশ্চয়ই শেষ চেষ্টা করে দেখা উচিত। আমি সব ব্যবস্থা করছি এখুনি।’
কুয়াশা বলল, আমি সব ব্যবস্থা করেই এসেছি। তুমি শুধু ড. মল্লিককে ফোন করে জানিয়ে দাও ব্যাপারটা। হাসপাতালের বাইরে আমার অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। কামালকে তাতে শুধু তুলে দিলেই চলবে।
শহীদ ফোন করে তখুনি ড, মল্লিককে কৃথাটা জানিয়ে দিল । মহুয়া স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে চা-এর ব্যবস্থা করতে চলে গেল। শহীদ জিজ্ঞেস করল, তুমি অ্যাম্বুলেন্স আনিয়েছ নাকি?’
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, চারটে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া চলছিল না। গরীব লোকগুলো কুঁড়েঘরে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে থাকে, কেউ খবর দেবার নেই হাসপাতালে। তাই ওই রকম মরণোন্মুখ রোগী পেলেই অ্যাম্বুলেন্স করে বাড়িতে নিয়ে যাই। বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।’
শহীদ সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুয়াশার দিকে। মানুষের প্রতি কি অপরিসীম মমতাবোধ কুয়াশার। ও যা বলল তা হাজার ভাগের এক ভাগও নয়, নিজের কথা বেশি করে বলা কুয়াশার চরিত্রে নেই। কুয়াশা দেশের বৃহত্তম এবং সর্বাধুনিক হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে নিশ্চয়ই, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই শহীদের। অথচ কথাটা এমন ভাবে জানাল যে তেমন বড় কিছু নয় ব্যাপারটা।
“তোমার বর্তমান কেসে সাহায্য করার কিছু আছে কি আমার?” শহীদ এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। তারপর বলল, কেসটার সমস্যা বড়
ভলিউম-১১
৮২
বিরক্তিকর। কয়েকজনের অসহযোগিতার ফলে জটিল এবং রহস্যময় হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা আগাগোড়া। তবে সামান্য একটা কাজ করার আছে। তুমি ডি কস্টা আর মান্নানকে একবার পাঠিয়ে দিয়ো।’
কুয়াশা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেব। আচ্ছা, চলি শহীদ। মহুয়াকে বলে দিয়ে ওকে নিরাশ করে চলে যেতে হচ্ছে। কামালকে দেখা দরকার আমার । বুঝিয়ে বোলো, কামালকে যেদিন সুস্থ অবস্থায় দিয়ে যাব সেদিন দুপুরে ওর রান্না খেয়ে যাব।’
‘এসো।’
শহীদ বলল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কুয়াশা ধীরে ধীরে এগোল দরজার দিকে। অকস্মাৎ উদ্যত রিভলভার হাতে নিয়ে দরজার সামনে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং মি. সিম্পসন । থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। মি. সিম্পসন উত্তেজিত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আজ তোমায় নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়েছি, কুয়াশা! আজ তোমার সেই ইঁদুর মুখো ডি. কস্টাও নেই যে আমার রিভলভার থেকে গুলি বের করে নেবে। মাথার ওপর হাত তোলো, কুয়াশা। আত্মসমর্পণ না করলে গুলি করব। আমি।’
কুয়াশা হাসল। বলল, ‘গুলি যে করবেন সে আমি বুঝতে পারছি। পর পর কয়েকটা কেসের কিনারা করতে না পেরে বেপরোয়া হয়ে আছেন আপনি! কিন্তু কি অপরাধে গ্রেফতার করছেন তা জানতে পারি কি?’
মি. সিম্পসন গম্ভীর কণ্ঠে জানালেন, তোমার অপরাধ কি আঙুলে গোনা যায়? হাজার হাজার অপরাধ করেছ তুমি। হ্যাঁ, হয়ত এই মুহূর্তে আমাদের হাতে প্রমাণ নেই। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তোমাকে গ্রেফতার করা চলে না তা ভেবো না। প্রমাণ ছাড়াই তোমাকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা আমার আছে। পরে কি হয় দেখা যাবে। কথা নয় আর, আত্মসমর্পণ করো, কুয়াশা।’
| কুয়াশা উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল হাঃ হাঃ করে। হাসি থামতে বলে উঠল, ‘আপনি বড় তাড়াহুড়ো করেন বলেই ব্যর্থ হন। ধীর মস্তিষ্কে ভেবে দেখুন দেখি, সত্যি সত্যি গ্রেফতার করতে পারবেন কি আমাকে? আপনারা কি জানেন না যে আমি কখনও কোথাও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে যাই না?”
মি, সিম্পসন বলে উঠলেন, “আজ তোমার কোন চালাকিই চলবে না, কুয়াশা। প্রাণ গেলেও তোমাকে আজ পালাতে দিচ্ছি না।’
একবিন্দুও নড়ছে না মি. সিম্পসনের হাতের উদ্যত রিভলভার। কুয়াশা হাসল। বলল, জানেন তো কোন ব্যাপারেই সীমা অতিক্রম করতে নেই। আপনার উচ্চাশা সীমা লঙ্ঘন করে গেছে। এর ফলে শুধু শুধু সাময়িক টাক সৃষ্টি হবে। আপনার মাথায়।
মি. সিম্পসন একটু বিমূঢ় হয়ে কঠোর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “কি বলতে
কুয়াশা-৩২,
চেষ্টা করেন চমকে উঠে কেন তার পিঠে এক কুয়া
পেছন ফিরে দরজা করে।
চাই তুমি পরিষ্কার করে বলো!’
কুয়াশা হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘ভিতরে এসো, গোপী। কর্তব্য পালন করো।কাম ইন গোপী। ডু ইউর ডিউটি।’
| মি. সিম্পসন কুয়াশার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, চালাকি খাটবে না আজ, কুয়াশা। আমার মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না। আমি•••’ ।
মি. সিম্পসন চমকে উঠে থেমে গেলেন। বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল তাঁর চোখের দৃষ্টি । পিছন থেকে কে যেন তার পিঠে একটা শক্ত নল চেপে ধরেছে। নলটা যে রিভলভারের তাতে সন্দেহ হল না তার। কুয়াশা ‘হাসল। বলল, ‘রিভলভারটা ফেলে দিন, মি. সিম্পসন। বলা যায় না, আমি অনুমতি না দিলেও গোপী ওর রিভলভারের ট্রিগার টিপে দিতে পারে।’
। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে মি. সিম্পসন রিভলভারটা ফেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। এবং পরমুহূর্তে অপ্রত্যাশিত একটা দৃশ্য দেখে আতঙ্কে লাফিয়ে দরজার চৌকাঠ থেকে একেবারে রূমের ভিতর চলে এলেন। কুয়াশা হেসে উঠল হাঃ হাঃ করে। হাসি থামতে সে বলে উঠল, ‘গোপীকে গতবার আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসেছি। এতদিন ট্রেনিং নিচ্ছিল ও। আজই প্রথম সঙ্গে করে এনেছি। যে-কোন মানুষের মাথার চুল উড়িয়ে টাক করে দিতে পারে ও গুলি করে, এমন অব্যর্থ লক্ষ্য ওর। আচ্ছা, গুড বাই, মি, সিম্পসন।’
কুয়াশা দরজা অতিক্রম করে গেল। পিছন পিছন চলল আফ্রিকার গহীন জঙ্গলের ভয়ঙ্কর জানোয়ার, ট্রেনিং প্রাপ্ত বিশালদেহী ওরাং ওটাং।
কুয়াশা এবং কুয়াশার বনমানুষ চোখের আড়াল হয়ে যেতেই মি. সিম্পসন তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কুড়িয়ে নিলেন রিভলভারটা। তারপর ছুটলেন দরজার দিকে। শহীদ এতক্ষণে কথা বলে উঠল, অকারণে দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই, মি. সিম্পসন। কুয়াশাকে এত সহজে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। কে না চায়। কুয়াশাকে গ্রেফতার করতে, আমিও কি চাই না? কিন্তু ছেলেমানুষের মত অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে চেষ্টা করলেই তো আর হবে না। আপনি প্রস্তুতি পূর্ণ না করেই কেন চেষ্টা করেন!’
মি. সিম্পসন ধপ করে সোফায় বসে পড়ে বলে উঠলেন, ‘কি করে জানব বলো ও আবার একটা বনমানুষ আনিয়ে দেহরক্ষী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
শহীদ বলল, না জানারই কথা বটে। কিন্তু একথা অবশ্যই ভুলে গেলে চলে যে আমাদের কুয়াশা নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কখনও কোথাও যায় । ওর ব্যবস্থাগুলো ভালমত জানার পর সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে গ্রেফতার করার চেষ্টা করা উচিত ওকে।’
মি. সিম্পসন গুম মেরে বসে রইলেন মাথা নিচু করে। ব্যর্থতার গ্লানিই শুধু
ভলিউম-১১
পেয়ে এলেন তিনি কুয়াশাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে। প্রতিবার কোন না কোন উপায়ে ধোকা দিয়ে পালিয়ে গেছে কুয়াশা। আজও সেই পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল কেবল।
বেশ খানিকক্ষণ গুম মেরে থেকে অবশেষে মি. সিম্পসন কাজের কথা শুরু করলেন। শামিম হায়দারের খবর হল এই যে তাকে আরও দু’তিন দিন নার্সিং ‘ হোমে থাকতে হবে। গতকাল টেমপারেচার দেখা দিয়েছিল তার। আজ কোর্টে শুনানির পর মিস রোশনা তাকে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু সেই শেষ । তারপর যায়ওনি, ফোনও করেনি। তার আম্মাকেও দেখতে যায়নি সে। শামিম হায়দারের বাড়িতেও না। মি. সিম্পসন ফাইল ঘেঁটে দেখে এসেছেন শামিম হায়দারের বাড়িতে যা যা জিনিস-পত্র দেখা গিয়েছিল সেগুলোর লিস্ট। তার মধ্যে সিগারেট আছে কয়েক রকমের, কিন্তু সিগার নেই। এদিকে মিস রোশনার নিরুদ্দেশের খবর– দেশের সকল থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখনও কোন সন্ধান মেলেনি অবশ্য। জাহাঙ্গীর রোডের সেই পোড়ো বাড়ি থেকে বের হবার পর তার আর কোন সন্ধানই নেই। একথা জোর করে বলা অসম্ভব মিস রোশনা ইচ্ছাকৃতভাবে গেছে না
অনিচ্ছাকৃতভাবে। কামাল কথা বলতে পারলে চিন্তা ছিল না। ও নিশ্চয় জানে অনেক কথা। মিস রোশনা সম্ভবত পোেড়া বাড়িটায় গিয়েছিল যে লোকটা কামালকে আঘাত করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। শামিম হায়দারের গাড়িগুলো তার বাড়ির গ্যারেজে ছিল সর্বক্ষণ। কেউ বলতে পারছে না মিস রোশনা গাড়ি ছাড়া কিভাবে কি করছিল!
শহীদ খবরগুলো শুনল । তারপর চিন্তা করতে লাগল ও। এমন সময় গফুর এসে খবর দিল, দাদামণি, কলিম আর ডি. কস্টা এসেছে।
‘ নিয়ে আয় ওদেরকে।’
গফুর খানিক পর ডি. কস্টা আর কলিমকে সঙ্গে করে নিয়ে এল রূমের ভিতর। ডি.কস্টা গর্বিত মুখে বুক ফুলিয়ে রূমের ভিতর ঢুকে ভারিক্কি চালে বলে উঠল, গুড ইভিনিং, জেন্টেলম্যান! টা কি এমন ডরকার পড়িল, মি. শহীড? হামাকে এমন আর্জেন্ট টলব কেন? নিশ্চয় হামার ফার্স্ট অ্যাসাইনমেন্টে স্যাটিসফায়েড হইয়া…!’ | শহীদ বলল, হ্যাঁ, তোমাদেরকে একটা কাজ করতে দেব। সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনো।’
শহীদ পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে সেটা খুলল। প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা কয়েকটা সিগার বের হল প্যাকেট থেকে। শহীদ একটা দেখিয়ে বলল, ‘এগুলোর নাম Ramonez সিগার। একটা ডাচ ফার্ম এগুলো তৈরি করে। টিন এবং প্যাকেটে করে বিক্রি হয়। সম্ভবত টিনের এজেন্ট একজনই আছে ঢাকায় । এই ব্র্যাণ্ডের সিগার বাজারে বহুদিন থেকে চলছে। আমরা অফিশিয়ালভাবে কুয়াশা-৩২
৮৫
এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করব। কিন্তু খুচরো বিক্রেতাদের সাথেও যোগাযোগ করা দরকার, এবং কাজটা খুব কঠিনও। ঢাকায় বহু দোকানদার এই সিগার বিক্রি করে। তাদেরকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া দোকানদারদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে কে কে তাদের দোকান থেকে এই সিগার সচরাচর কেনে।’
শহীদ থামতে কলিম জানতে চাইল, ঠিক কোন এলাকায় খুঁজতে হবে তার কোন সীমানা নেই?’
* শহীদ বলল, না। হয়ত ঢাকায় এগুলো কেনাই হয়নি। সেক্ষেত্রে আমাদের দুর্ভাগ্য বলতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলায় নমুনা পাঠানো হবে। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব সন্ধান চাই। তোমরা সবাই এখন থেকে কাজ শুরু করে দাও। আমার ধারণা যে লোকটা কামালকে আঘাত করে পালিয়েছে সে এই সিগার টানত।
মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে উঠল পরিবেশটা। ছলছল করে উঠল গফুরের চোখ। এমন কি ডি. কস্টারও সারা মুখে বিষণ্ণতার ভাব ফুটে উঠল। শহীদ মি. সিম্পসনকে বলল, আপনিও অফিসে গিয়ে নমুনা দেখিয়ে যত বেশি সংখ্যক লোক
সম্ভব পাঠিয়ে দিন এদিক-ওদিক।’
কলিম বলে উঠল, আচ্ছা, চলি, মি. শহীদ। আশা করি নিরাশ করব না আপনাকে।’
ডি, কস্টা বলে উঠল, ‘টাহলে যেটে হয় হামাদেরকে, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া ডরকার। গুডবাই, ফির মিলেঙ্গে হাম লোগ!’
| ওরা বিদায় নিল । মি. সিম্পসনও কয়েক মিনিট পর চিন্তিত মুখে উঠলেন।
মি. সিম্পসন বিদায় নেবার পর শহীদ দৈনিক রঙ্গ’-র অফিসে গিয়ে উপস্থিত হল। “দৈনিক রঙ্গ’-র সম্পাদক আশরাফ, চৌধুরী একজন হোমরাচোমরা ব্যক্তি। অর্থ এবং প্রতিপত্তি দুই-ই আছে ভদ্রলোকের। শহীদ ভেবে অবাক হচ্ছিল এমন ধরনের লোককে মিস রোশনা রাজি করল কিভাবে ছবিটা না-ছাপাতে!
| কিন্তু কেন রাজী হলেন আশরাফ চৌধুরী! এবং মিস রোশনাই বা কেন অমন ভীতিবোধ করছিল ছবিটা ছাপার ব্যাপারে? এটা কি স্রেফ নির্জলা অনিচ্ছা? নাকি এই অনিচ্ছার পিছনে কোন বিরাট কারণ আছে?
খানিকক্ষণ অপেক্ষা কন্নার পর সম্পাদকের রূমে ডাক পড়ল। রূমের ভিতর ঢুকতেই আশরাফ চৌধুরী সহাস্যে বলে উঠলেন, “কি সৌভাগ্য, আপনার মত গুণীর পদধূলি পড়ল আমার অফিসে! তা কি করতে পারি, মি. শহীদ, আমি আপনার জন্যে?’
শহীদ আসন গ্রহণ করে বলল, “গতরাতে মিস রোশনা আপনার সাথে সাক্ষাৎ করেছিল, মি. চৌধুরী? একটা নির্দিষ্ট ছবির ব্যাপারে?’
চৌধুরী হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ। মেয়েটির জন্যে দুঃখবোধ হচ্ছিল আমার।
৮৬
ভলিউম-১১
ওকে সাহায্য করতে পেরে খুশিই হয়েছি আমি। ছবিটা না-ছাপবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।’
তাই নাকি?
শহীদ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এমন ভাবে উচ্চারণ করল শব্দ দুটো। চৌধুরী বললেন, এ ধরনের অনুরোধ প্রায়ই রক্ষা করতে হয় আমাদেরকে, মি. শহীদ।’
‘আচ্ছা, মিস রোশনা তার এই অদ্ভুত অনুরোধের কারণ সম্পর্কে কিছু বলেছিল কি?’ |
। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল মেয়েটা তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওর সামান্য। একটা অনুরোধ রক্ষা করতে পেরে আমি আনন্দিত।’
শহীদ বলল, ‘আই সি। ও শুধু চাইছিল ছবিটা যেন কোনমতেই ছাপা না হয়?’
| হ্যাঁ। আর একটা ব্যাপার, মিস রোশনা যেন আশা করছিল আমি কিছু তথ্য দেব ওকে। বুঝতে পারলাম না কি তথ্য চায় ও আমার কাছ থেকে। সেজন্যেই অনেক সময় কথা বলে কাটিয়ে গিয়েছিল ও।’ * শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। আবার যদি মিস রোশনা আপনার সাথে দেখা করতে•••।’
আশরাফ চৌধুরী কথা দিলেন, আমি জানাব আপনাকে।
শহীদ বাইরে বের হয়ে একটা পাবলিক বুঁদ থেকে ফোন করল মি. সিম্পসনের অফিসে। না, মিস রোশনার কোন সন্ধানই পাওয়া যায়নি কোথাও।
বাড়ি ফিরে এল শহীদ।
পাঁচ
সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন অবধি ঢাকায় Ramonez সিগার বিক্রেতারা তালিকাভুক্ত হল। পরদিন সন্ধ্যার পর থেকে তালিকাভুক্ত হল দোকানদারদের। রেগুলার সিগার খরিদ্দাররা। প্রায় পঞ্চাশজন খরিদ্দার পাওয়া গেল, যারা নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকান থেকে নিয়মিত Ramonez সিগার কেনে। এইসব খরিদ্দারদের সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হল। মিস রোশনা যেদিন যে সময় অদৃশ্য হয়েছে। সেদিন সে সময় এরা কে কোথায় ছিল তার খোঁজখবর সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়ে গেছে।
মিস রোশনার কোন সন্ধানই নেই কোথাও।
তিনটে খবরের কাগজ মিস রোশনার নিরুদ্দেশের খবর ছেপেছে ছবিসহ । কিন্তু দৈনিক রঙ্গ-’র ফটোগ্রাফার যে বিশেষ ছবিটা তুলেছিল সেটা প্রকাশিত
কুয়াশা-৩২
৮৭
হয়নি।
| কামাল যুদ্ধ করে চলেছে মৃত্যুর সঙ্গে। এখনও অচেতন। কুয়াশা দিনে কয়েকবার ফোন করে আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছে মহুয়া আর শহীদকে। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই কামালের। মিসেস জামিল হায়দারকে যে পুলিস বিভাগীয় নার্স পাহারা দিচ্ছে তার কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। শামিম হায়দারের বাড়ি খালি পড়ে আছে। শামিম হায়দার নার্সিং হোম থেকে সম্ভবত আগামীকাল ছাড়া পাবে।
* শহীদ নিজের বাড়ির ড্রয়িংরূমে বসে সিগারেট টানছিল একটার পর একটা। মহুয়া জানে কখন শহীদকে বিরক্ত করা উচিত নয়। শহীদ যখন গভীর কিছু চিন্তা করে তখন সে কাছে বড় একটা আসে না।.পাশের বাড়িতে বেড়াতে গেছে সে, লীকে নিয়ে। গফুরকে সঙ্গে নিয়ে ডি, কস্টা গেছে কোথায় যেন। ওরা দুজন ক্রমশ বন্ধু হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা বেমানান। একজন যেন ছোটখাট একটা পাহাড়, অন্যজন ঠিক তার সামনে সরু পাটখড়ি একটা। | আর একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। এমন সময় বেজে উঠল কলিং বেলটা। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ। ড্রয়িংরূম থেকে বের হয়ে এল ও। দ্বিতীয়বার বেজে উঠল বেল। অধৈর্য কোন লোক ডাকছে, ভাবছে শহীদ। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আর একবার বাজল বেল। শহীদ খুলে দিল দরজা।
মি. শহীদ?’ শহীদ উত্তর দিল, “ইয়েস।’
দ্রলোক বিদেশী, তবে ইউরোপিয়ান নয়। মধ্য প্রাচ্যের কোন দেশের হবে সম্ভবত। ইংরেজিতে বলে উঠল ভদ্রলোক, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আনন্দিত, হতে পারছি। আমার নাম মোহাম্মদ আমান গাজী। ইরাক থেকে আসছি আমি।
| শহীদের মনে পড়ল মিস রোশনা তিন মাসের জন্যে ইরাক গিয়েছিল। করমর্দন সারতে সারতে দেখল শহীদ, শক্ত-সমর্থ কিন্তু একহারা গড়ন আমান গাজীর। উজ্জ্বল, ঝকঝকে দাঁত। দামী স্যুট পরনে। সাবলীল, সপ্রতিভ ভঙ্গি চোখে মুখে। খানিকটা উত্তেজিত । আমান, গাজী বলে উঠল, বহু লোক আমাকে জানিয়েছেন যে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রোশনাকে খুঁজে বের করে দিতে পারেন।’
একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। শহীদ রাস্তার দিকে তাকাল। আমান গাজীর কালো মরিসটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তার ডান দিক থেকে একটা টয়োটা আসছে মন্থর গতিতে। শহীদ বলল, আসুন, ভিতরে বসে আলাপ করা যাক।’
| একপাশে সরে দাঁড়াল শহীদ আমান গাজীকে পথ করে দেবার জন্যে। ঠিক তখুনি ফায়ারিঙের শব্দটা হল। চোখ তুলে প্রথম ফায়ারিঙের আলোর ঝলকটা
৮৮
ভলিউম-১১
দেখতে পেল ন! শহীদ। দ্বিতীয়টার দেখতে পেল। দ্বিতীয় গুলিটা এসে লাগল। দরজার পাশে, দেয়াল থেকে প্রাসটার খসে পড়ল।
শহীদ দেখল ডান দিক থেকে যে টয়োটা আসছিল সেটার পিছন দিক থেকে ফায়ার করেছে একজন লোক। লোকটাকে ভাল মত দেখতে পেল না ও। দ্রুত বেগে পালাচ্ছে গাড়িটা। ‘
আমান গাজীকে পাশ কাটিয়ে ছুটল শহীদ। আমান গাজীও ছুটল। কয়েক লাফে এগিয়ে গিয়ে আমান গাজীর মরিসটায় চেপে বসল শহীদ। ব্যাক সীটে উঠল আমান গাজী। তীব্র একটা ঝকানি দিয়ে ছুটতে শুরু করল মারস।
গুলশান রোড চওড়া এবং লম্বা । গুলি করে গাড়িটা পালাচ্ছিল উঁচু মাটির ঢিবিটার দিকে। গাড়ি চালাতে চালাতে পলায়নরত টয়োটার পিছনে লাল আলোর টুকরো
দুটো দেখতে পাচ্ছিল শহীদ। টয়োটা মোড় নিল বাঁ দিকে। ওদিকেও ঢিবি আছে।
গতি না কমিয়েই মোড় নিল শহীদ। রাস্তায় চাকার ঘষা লেগে তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল। আমীন গাজী গাড়ির বিপরীত কোণে গিয়ে ধাক্কা খেল। মোড় নিতে আবার দেখা যাচ্ছে টয়োটার লাল আলো। বাঁ দিকে কয়েকটা মোেড় আছে এ এলাকা। থেকে বেরিয়ে যাবার। টয়োটার ড্রাইভার যদি রাস্তাগুলো ভাল করে চেনে তাহলে। ঠিক পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সোজাই এগিয়ে যাচ্ছে টয়োটা এখনও।
অকস্মাৎ বাতাসের তীব্র আঘাত লাগল শহীদের মুখের পাশে। চিৎকার করে উঠল ও, কি হল…!’ | আমান গাজী উইণ্ডস্ক্রীন সরিয়ে মাথা গলিয়ে দেখার চেষ্টা করছে টয়োটাটাকে। সে বলে উঠল, ‘আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন টয়োটার প্যাসেঞ্জারের কাছে রিভলভার আছে।’
| শহীদ ভোলেনি, ওর বাঁ হাতেও রিভলভার রয়েছে। একটা লাইট পোস্ট অতিক্রম করার সময় শহীদ পলকের জন্যে দেখল আমান গাজীর একটা হাত জানালার বাইরে। সেই হাতে একটা রিভলভার। আমান গাজী নাড়াচাড়া করছে। সেটা টয়োটার লাল আলোর দিকে তাকিয়ে। শহীদ মরিসের গতি আরও বাড়িয়ে দিল। দুটো গাড়ির মধ্যে এখন ব্যবধান একশে গজের কাছাকাছি। আমান গাজী চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, আরও স্পীডে চালানো যায় না!’
স্পীডমিটারের কাঁটা কাঁপছে আশির ঘরে। একজন ট্রাফিক পুলিস চিৎকার করে উঠল রাস্তা থেকে। তিনটে প্রাইভেট কার বিদ্যুতবেগে পিছনে চলে গেল, দাঁড়িয়ে পড়ল দুটো বেবীট্যাক্সি রাস্তার ধারে । আমান গাজী বলে উঠল, পুলিসের গাড়ি ছিল আশেপাশে, জীপ আসছে একটা। অকস্মাৎ ডান চোখটায় কি যেন পড়ল শহীদের। বন্ধ হয়ে গেল সেটা। সম্ভবত কাঁকর পড়েছে। পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে চোখ থেকে। এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে ঢুকল। এক
কুয়াশা-৩২
৮৯
মুহূর্ত পর আর একটা শব্দ হল। গুলি করছে টয়োটা থেকে। মরিসের বনেটে লেগে পিছলে গেল বুলেট। দ্বিতীয়টা মিস হল।
আমান গাজীও গুলি করল । শহীদের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে তো ঝরছেই। প্রচণ্ডভাবে করকর করছে চোখটা। আর একটা গুলির শব্দ শুনল ও। টয়োটা থেকে আবার গুলি করা হল । এক চোখ দিয়েই দেখছিল শহীদ। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ডান দিকে মোড় নিল টয়োটা। চোখের আড়াল হয়ে গেল সেটা মুহূর্তে। আমান গাজী চিৎকার করে উঠল, ‘জোরে, আরও জোরে!’
বিদ্যুৎবেগে মোেড় নিল শহীদ। পরক্ষণে চমকে উঠল ও সামনে একটা লরি দেখে। ক্ষিপ্র হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল শহীদ। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ। গাছের পাশ ঘেঁষে ছুটে গেল মরিস। কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে লরির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারল শহীদ। কিন্তু দুর্ঘটনা এড়াতে গিয়ে গাড়ির কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে ও। মরিস সজোরে গিয়ে ধাক্কা খেল বড় একটা গাছের সঙ্গে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকানি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি । মাথা ঠুকে গেল কাঁচের সঙ্গে দুজনেরই। আমান গাজী চিৎকার করে উঠল, ওই যে গাড়িটা!’
শহীদ দেখতে পাচ্ছিল না। আমান গাজী দরজা খুলে নেমে পড়তে শহীদ একচোখে রুমাল চাপা দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। আমান গাজী ততক্ষণ রাস্তা ধরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। শহীদ দেখল টয়োটাটা রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ নেই আশেপাশে। আমান গাজী অদৃশ্য হয়ে গেল দেখতে দেখতে রাস্তার মোড়ে। গুলির শব্দ শুনল শহীদ। পরক্ষণে একটা জীপ গাড়ির শব্দ কানে ঢুকল। পিছন ফিরে তাকাল শহীদ। জীপটা এসে থামল শহীদের পাশে। শহীদ বলে উঠল, “আমি শহীদ খান। রাস্তার ওই দিকে যাও কয়েকজন, সশস্ত্র আততায়ী পালিয়ে গেছে ওদিকে।’
তিনজন কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে ইন্সপেক্টর কায়েস আহমেদ বলে উঠল, জলদি যাও তোমরা। আমার নাম কায়েস আহমেদ, ইন্সপেক্টর, মি. শহীদ। আপনার সাথে
পরিচিত হবার সৌভাগ্য আগে হয়নি আমার।’
শহীদ হাসল। বলল, আমার সাথে পরিচিত হবার এই তো মোক্ষম পরিবেশ। ইন্সপেক্টর, গাড়ি দুটো সরাবার ব্যবস্থা করুন এখুনি। মরিসটা আগে, টয়োটার ব্যাপারে খুব সাবধান, আঙুলের ছাপ চাই ওটা থেকে।’
ইয়েস, স্যার।’ | গাড়ি সরাবার কাজ শুরু করে দিল ইন্সপেক্টর। ভিড় জমে গেছে গাড়ি আর মানুষের। চোখের কাকরটা রুমালের কোণা দিয়ে বের করে ফেলে এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছে শহীদ। আমান গাজী বা কনস্টেবলগুলো ফিরে আসছে না এখনও।
আমান গাজী কে আসলে? শহীদ আততায়ীর গাড়ি টয়োটার হাতলে রুমাল জড়িয়ে খুলল দরজাটা।
| ৯০
..
ভলিউম-১১
ড্যাশবোর্ডের পকেটে, উইণ্ডস্ক্রীন, প্যানেলে টর্চের আলো ফেলে দেখল শহীদ। দ্বিতীয় ড্যাশবোর্ডের পকেটে টর্চের আলো স্থির হয়ে গেল। শহীদ চমকে উঠল । পরিচিত একটা বাক্স দেখা যাচ্ছে। বাক্সের উপর লেখাঃ Ramonez Perfects.
ছয় খানিকপর ফিরে এল আমান গাজী। শহীদকে প্রশ্ন করল, ‘পেলেন কিছু?’
শহীদ বলল, বিশেষ কিছু না। আপনি?’ তিক্ত কণ্ঠে বলল আমান গাজী, ‘পালিয়ে গেছে ব্যাটারা। তবে ছাড়ব না ওদেরকে আমি। কতক্ষণ থাকবেন এখানে?’
‘আমাকে কিছুক্ষণ থাকতে হবে আরও। আপনি চলে যেতে পারেন। কোথায় উঠেছেন আপনি, ঠিকানাটা দিয়ে যান।’
আমান গাজী জানাল, এয়ারপোর্ট থেকে একটা পত্রিকা অফিসে যাই আমি, সেখান থেকে সোজা আপনার বাড়িতে। কোন ঠিকানা নেই।’
শহীদ প্রশ্ন করল, এত তাড়াতাড়ি গাড়ি জোগাড় করলেন কোথা থেকে?’
‘ঢাকায় আমার বন্ধু আছে কয়েকজন, তারা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল এয়ারপোর্টে।
শহীদ ভাবল আমান গাজীর বন্ধুদের অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর নিতে হবে প্রয়োজনে।ও বলল, আপনি আমার বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারবেন?
মাথা নেড়ে সায় দিল আমান গাজী। শহীদ একটা পেট্রল কারে করে বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করল তাকে।
| খানিক পরই মি. সিম্পসন লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হলেন। শহীদ প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা বলল মি. সিম্পসনকে | আমান গাজীর গাড়ি কোন মিস্ত্রিখানায় পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে ঘটনাস্থল থেকে বিদায় নিল ও। আমান গাজীর সঙ্গে কথা বলা দরকার, সিধে বাড়িতেই ফিরে এল শহীদ।
আমান গাজী গফুরের তত্ত্বাবধানে ফিটফাট হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে-। স্যুটটা : ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। সেটা খুলে রেখে শহীদের শার্ট গায়ে দিয়েছে। গফুর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে হাতের কব্জিতে । ড্রয়িংরূমে বসে কফি খাচ্ছিল ও। শহীদ বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। কাপড়-চোপড় বদলে ফিরে এল ও ড্রয়িংরুমে। সোফায় বসতেই আমান গাজী বলল, “মি. শহীদ, আমি সত্যি দুঃখিত যে আমার জন্যে আপনাকে এমন কষ্ট পেতে হল।
শহীদ বলল, কষ্ট সবটুকু হয়েছে আপনারই। ওদেরকে দেখতে পেয়েছিলেন? কি রকম চেহারার লোক তা দূর থেকে দেখে বোঝা যায়নি।’
শহীদ জানতে চাইল, আপনাকে এভাবে আক্রমণ করার কারণ সম্পর্কে কোন কুয়াশা-৩২
ধারণা করতে পারেন?
না। অনুমান করে নিন। শহীদ বলল, ‘ওরা হয়ত চায়ুনি আপনি আমার সাথে কথা বলেন। | আমান গাজী চিন্তিতভাবে বলল, হতে পারে। মি. শহীদ, আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করছি এবং প্রশ্নটার উত্তর পেতেই হবে আমাকে। আপনি কি মনে করেন ওই লোকগুলোই রোশনাকে কিডন্যাপ করেছে?
শহীদ বলল, হয়ত।’
‘যদি ওরা রোশনার কোন রকম ক্ষতি করে তাহলে টুকরো টুকরো করব আমি ওদের সবক’টাকে।’ | শহীদ খানিকপর প্রশ্ন করল, ‘আপনি ইরাক থেকে ঠিক কি কারণে এসেছেন, মি. গাজী?’
‘রোশনাকে খুঁজে বের করার জন্যেই এসেছি আমি। আমার বন্ধু আছে এমব্যাসিতে। তাদেরকে টেলিগ্রাম করেছিলাম ওর খবর চেয়ে। ওরাই নিরুদ্দেশের খবরটা দেয়।’
সম্ভবত মিথ্যে কথা বলছে না ও এমব্যাসিতে বন্ধুর অস্তিত্ব সম্পর্কে, ভাবল শহীদ। ও প্রশ্ন করল, ‘মিস রোশনাকে খুঁজে বের করার এত বেশি আগ্রহের কারণ। কি জানতে পারি? | ‘রোশনার সাথে পরিচয় হয় আমার ইরাকে। ওকে আমার ভাল লেগেছিল। ওর কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। একথা শুনে মনে করবেন না যে আমাদের বিয়ের কথাও পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। এত অল্পদিনে অতদূর এগোনো সম্ভব নয়। মাত্র একমাস আগে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।
কবে শেষ দেখেছেন আপনি মিস রোশনাকে?’ ঢাকায় ফেরার সময় ইরাকে, এয়ারপোর্টে। শহীদ জানতে চাইল, ‘আমার ঠিকানা কোথায় পেলেন আপনি?’
‘এয়ারপোর্ট থেকে একটা সংবাদপত্র অফিসে গিয়েছিলাম আমি। “দৈনিক রঙ্গ”। ওখানের সবাই বলল আপনার সাহায্য ছাড়া রোশনাকে উদ্ধার করা সম্ভব হরে না। আপনার প্রতি জার্নালিস্টদের বিশ্বাস অর্গাধ, দেখলাম নিজের চোখেই। তাই এলাম! এখন, যেভাবেই হোক, আপনি ব্যবস্থা করুন রোশনাকে উদ্ধার করার। আপনি সাহায্য না করলে আমি একাই চেষ্টা করব। কোন বাধাইরুখতে পারবে না আমাকে।’
‘অনেক বাধা রুখে দাঁড়াবে আপনার বিরুদ্ধে, বিশেষ করে যদি লাইসেন্সহীন লোডেড রিভলভার নিজের সঙ্গে রাখেন ঢাকা শহরে।’
ভাল কথা, রিভলভারের লাইসেন্সের ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ঝামেলা মুক্ত হই আমি। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি যখন। আমার দেশের
ভলিউম-১১
লাইসেন্স সঙ্গেই আছে।
শহীদ বলল, তা হয়ত করে দেয়া যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই আপনি ফায়ার করেছেন। টয়োটার পেট্রল ট্যাঙ্কে দুটো গুলি লেগেছে। গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছিল ওরা পেট্রল ট্যাঙ্কে গুলি লাগাতেই। গাড়িটা এখন থানা হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে গেছে। আর আপনারটা কারখানায়। পরে জানাব আমি কোন কারখানায় আছে।’
‘ধন্যবাদ।’
শহীদ প্রশ্ন করল, ‘শুধু মিস রোশনার নিরুদ্দেশ সংবাদ শুনেই চলে এলেন আপনি ঢাকায় সুদূর ইরাক থেকে?
খবর পেয়ে এক ঘন্টাও দেরি করিনি আমি। চাটার্ড প্লেনে ঢাকায় নেমেছি। রোশনাকে খুঁজে পাবার জন্যে আমি গোটা পৃথিবীটা অন্তত তিনবার চক্কর মারতে পারি প্লেন নিয়ে। মি, শহীদ, আমার একটা প্রশ্নের যথাসম্ভব সরাসরি পরিষ্কার উত্তর দেবেন?’
শহীদ চুপ করেই রইল। আপনার কি মনে হয় রোশনা খুন হয়েছে?’
শহীদ সিগারেট ধরাল একটা। শহীদ প্রস্তুত ছিল না মিস রোশনা নিহত হয়েছে কিনা এ কথার উপর মন্তব্য করতে। কেউ যদি তাকে হত্যা করতেই চায়। তাহলে সেই পোড়ো বাড়িতেই তার লাশ পাওয়া উচিত ছিল। যাকে খুন করবে তাকে অন্যত্র বয়ে নিয়ে যাবার কি দরকার? যে যাই বলুক, মিস রোশনাকে জোর করে নিয়ে যাবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে সম্ভবত স্ব-ইচ্ছাতেই গেছে। শহীদ সে কথাই জানাল আমান গাজীকে। আমান গাজী বলল, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন রোশনা একদল অপরাধীদের সাথে স্বেচ্ছায় গেছে? অসম্ভব!”
আমান গাজীর মুখাবয়ব পাণ্ডুরবর্ণ ধারণ করল। প্রচণ্ড একটা মানসিক আঘাত পেয়েছে যেন ও কথাটা শুনে। এমন সময় মহুয়া প্রবেশ করল ড্রয়িংরূমে। আমান গাজীর সঙ্গে মহুয়ার পরিচয় আগেই হয়েছে। শহীদকে ও জিজ্ঞেস করল, আজ রাতে আবার বের হবে নাকি তুমি?’
‘আশা করি বের হব না। ফোন করব মি. সিম্পসনকে।’ গফুর এসে ঢুকল, দাদামণি, রূম তৈরি।
শহীদ”আমান গাজীকে বলল, আপনি এখানেই থেকে যান। ওপাশের রূমে বিশ্রাম নিতে পারেন আপনি।
আমান গাজী উঠে চলে গেল গফুরের সঙ্গে। শহীদ বলে উঠল মহুয়াকে, মিস রোশনার দেশে ফিরে আসার যথার্থ কারণ আছে। কিন্তু আমান গাজী কেন তার দেশ থেকে এত দূরে ছুটে এসেছে? শুধুই কি প্রেম? নাকি অন্য কিছু? সঙ্গে ওর রিভলভার, তারমানে বিপদের আশঙ্কা আছে একথা ওর অজানা ছিল না। আমার কুয়াশা-৩২
সঙ্গে কথা বলার জন্যে আসা মাত্র গুলি করা হয় ওকে লক্ষ্য করে, নাকি…!’ | শহীদ হঠাৎ চুপ করে গেল। মহুয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “গুলি আমান গাজীর দিকে ছোঁড়া হয়েছিল? নাকি তোমার দিকে? আসল কথা চেপে যাচ্ছ কেন
তুমি?’
শহীদ ঠিক জানে না কার প্রতি লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল গুলি। মহুয়ার ধারণা তার প্রতি, কিন্তু সেটা খানিকটা আবেগ প্রবণতার জন্যে। শহীদ ফোন করল মি. সিম্পসনকে। মি. সিম্পসন বললেন, তুমি বরং আমার অফিসে একবার চলে এসো, শহীদ।– রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। পরমুহূর্তে বেজে উঠল ফোনের বেল। রিসিভার কানে তুলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভারি একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কুয়াশা বলছি।’
শহীদ বলছি, কি খবর, কুয়াশা?
ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করল শহীদ। কুয়াশা বলল, ‘বেশি কথা জানতে চেয়ো না, শহীদ। কামালের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। কিন্তু কতটা ভাল এ-কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারব না আমরা। আচ্ছা, ছাড়ছি।’ : : । কুয়াশা ছেড়ে দিতে শহীদও ফোন ছেড়ে ছিল। একটু আশ্বস্ত হল ও মনে মনে। কামাল এ যাত্রা বাঁচবে বলে এখনও বিশ্বাস হয় না ওর। তবু কুয়াশা যখন ভার নিয়েছে এবং অবস্থা যখন অপেক্ষাকৃত ভাল তখন বলা যায় না কিছুই। খবরটা শুনে আনন্দে চোখে জল এসে পড়ল মহুয়ার। গফুরেরও সেই একই অবস্থা। লীনা তো লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেই চলেছে সারাদিন। কামালকে ওরা সবাই ভালবাসে অন্তর দিয়ে।
শহীদ মি. সিম্পসনের অফিসে পৌঁছুল। মি. সিম্পসনের নিজস্ব অফিস রূমে ঢোকার আগে ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের রূমে টু মারল প্রথমে। অনেক তথ্য জমা হয়েছিল ওখানে। জানা হয়ে গেল শহীদের সব। প্রথমত আততায়ীদের গাড়ি * টয়োটায় আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু স্টিয়ারিং হুইলে এবং ড্যাশবোর্ডে কোন ছাপ নেই। তার মানে হাতে গ্লাভস পরে গাড়ি চালানো হয়েছে। গাড়ির ভিতর থেকে পাওয়া গেছে Ramonez সিগার ছাড়া পাইপ, দেশলাই, একটা হ্যাঁণ্ডবুক। এসব সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। তৈরি হলে শহীদের কাছে কপি পাঠানো হবে। অন্য একটা রূমে গেল শহীদ। সকলেই ওকে দেখে কামালের কথা। জিজ্ঞেস করল। এই রূমে বুলেটের পরীক্ষা চলছে। আমান গাজীর মরিস গাড়ি থেকে যে বুলেট উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো আততায়ীদের গাড়ি টয়োটা থেকে ছাৈড়া হয়েছিল। শহীদ প্রশ্ন করে জানতে পারল গুলিগুলো Smith and 4. Wesson 32-র।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট রূমে ঢুকল। সে জানাল-ফাইনাল রিপোর্ট হয়ে গেছে।
৯৪
ভলিউম-১১
শহীদ জানতে পারল টয়োটায় যে আঙুলের ছাপগুলো পাওয়া গেছে তার যেন রেকর্ড নেই পুলিসের জিম্মায়। অর্থাৎ আততায়ী কোন দাগী লোক নয়। গাড়ির ভিতরের কোন কোন আঙুলের ছাপ মিলে গেছে Ramonez সিগারের বাক্সের উপরের আঙুলের ছাপের সঙ্গে। ছাপগুলো সবই নতুন নয় পুরাতনও আছে। শহীদ ছাপগুলো এনলার্জ করিয়ে কপি পাঠিয়ে দিতে বল প্রতিটি জেলার থানা হেডকোয়ার্টারে। শহীদ বলল, “এই হাতের ছাপওয়ালা লোকটাই আক্রমণ করেছিল কামালকে। অর্থাৎ কামালের আক্রমণকারী এবং টয়োটা করোনার আততায়ী একই লোক-Ramonez সিগার টানে লোকটা। একে খুঁজে বের করতে পারলেই অর্ধেক পথ অতিক্রম করতে পারব আমরা। এই মুহূর্তে ওই পর্যন্তই পৌঁছুতে চাই।’
শহীদ একজন কনস্টেবলকে ডেকে পাঠাল। ইতিমধ্যে একটা টেবিল দখল করে ইরাকের পুলিশ কমিশনারের কাছে মোহাম্মদ আমান গাজীর পরিচয় দিয়ে তথ্য দেবার অনুরোধ জানিয়ে একটা টেলিগ্রামের ছক তৈরি করে ফেলল শহীদ। কনস্টেবল আসতে তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল পোস্ট অফিসে। আমান গাজীর কাছে
একটা Colt :32’ আছে এ কথা জানাতেও ভোলেনি শহীদ টেলিগ্রামে।
কাজগুলো সেরে মি, সিম্পসনের অফিসে এসে শহীদ দেখল রূম খালি। মি. সিম্পসন নতুন একটা কেসের কাজে বেরিয়ে গেছেন।
অগত্যা বাড়ি ফিরে এল শহীদ।
পরদিন সকাল । শহীদের ঘুম ভাঙতে মহুয়া এসে জিজ্ঞেস করল, বিদেশী অতিথিকে চা না অন্য কিছু দেব?’
শহীদ বলল, “অরেঞ্জ জুস বা কফি পছন্দ করবে সম্ভবত।’ * শহীদ কথাটা বলে আমান গাজীর রূমের দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। মহুয়াকে বলল, “দেখেছ?
‘কি?’
দ্রলোকের রূমের দরজা ঠিকভাবে বন্ধ নয়।
শহীদ দ্রুত রূম ছেড়ে বের হয়ে এল। আমান গাজীর রূমের ভিতর ঢুকল ও। পিছনে মহুয়া। শহীদ শূন্য রূম দেখে কোন মন্তব্য করল না। কিন্তু মহুয়া বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, ভদ্রলোক চলে গেছেন!
টেবিলের উপর একটা চিরকুট পাওয়া গেল। শহীদের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ লেখা। কোন ব্যাখ্যা নেই।
সাত
মি, সিম্পসনের ফোন পেয়ে এসেছে শহীদ। কুয়াশা-৩২
| মি. সিম্পসনের অফিসরুমে পা দিয়েই শহীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হল ডেস্কের উপর রাখা একটা হ্যাঁটের প্রতি।
‘কোথা থেকে এল ওটা?
শহীদের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে বললেন, “ঢোকার সাথে সাথেই চোখে ঠেকেছে, কেমন? ওটা তোমার জন্যেই রাখা হয়েছে, শহীদ। আততায়ীরা যে টয়োটায় ছিল এই টুপিটা সেই টয়োটা থেকেই ছিটকে পড়েছিল রাস্তায়।
চমকে উঠল শহীদ, বলেন কি!” মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক তাই।’
শহীদ প্রশ্ন করল, ‘ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে চেক করিয়েছেন ওটাকে? চুল পাওয়ার কথা।’
– হ্যাটটা হাতে তুলে নিয়ে পরখ করতে করতে বলল শহীদ। মি. সিম্পসন একটা এনভেলাপ ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পাঁচটা চুল, জেট ব্ল্যাক। চুল দেখে অনুমান করা চলে যুবক লোক পরত এটা। লোকটা কি ধরনের তেল ব্যবহার করত তা হয়ত পরীক্ষা করে জানা যেতে পারে। কিন্তু একই ফর্মুলার তেল বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর আছে। সুতরাং খুব একটা সুবিধে হবে না তাতে।’
শহীদ বলল, তবু পরীক্ষা করতে হবে।’
মি. সিম্পসন জানালেন মিসেস জামিল হায়দারের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। শহীদ ফোন করল একটা বিশেষ নম্বরে। নম্বরটা কুয়াশা জানিয়েছে। কামালের খবর, একই রকম–অপরিবর্তিত। শহীদ আবার ফোন করল শামিম হায়দার নার্সিং হোমে আছে কিনা জানার জন্যে। বেলা ন’টার সময় নার্সিং হোম থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছে শামিম হায়দার, খবর পাওয়া গেল।
মি, সিম্পসনের সঙ্গে কয়েক মিনিট মাত্র আলাপ করে বিদায় নিল শহীদ। গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হল শামিম হায়দারের বাড়িতে। কলিংবেল টিপতে দরজা খুলে দিল শামিম হায়দার। শহীদকে দেখে বিরস হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। বলল, আবার কি দরকার পড়ল আপনার, মি. শহীদ?”
• শহীদ বলল, আপনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন শুনে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এলাম।
কি কথা?
শহীদ শামিম হায়দারকে পাশ কাটিয়ে দরজা অতিক্রম করে ড্রয়িংরূমের দিকে এগিয়ে গেল। পাশের রুমের দরজাটা অর্ধেক খোলা। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ডাইনিংরুমটা। শহীদ আসন গ্রহণ করে বলল, আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপনার আব্বা আপনার চাচাত ভাইকে হত্যা করার অভিযোগে পুলিসের হেফাজতে আছেন।’
‘ শামিম হায়দার তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এই সময়টা আপনি আমার পিছনে
ভলিউম-১১
৯৬
অপব্যয় না করে আমার বোনের সন্ধানে ব্যয় করলে ভাল করতেন।’
শহীদ বলল, “সেই বরং আমাকে খৰৰ দেবার জন্যে পাঁচটা মিনিট ব্যয় করতে পারে।’
তার মানে! আপনাকে খবর দেবে ও কেমন করে! ওকে তো কিডন্যাপ করা হয়েছে।’
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল শামিম হায়দারের দিকে। তারপর হাতের হ্যাটটা চোখের সামনে তুলে ধরে প্রশ্ন করল, চিনতে পারেন এটা?’
শামিম হায়দার মনোযোগ দিয়ে দেখল হ্যাটটা। বলল, ‘সম্ভবত এইরকম একটা হ্যাট পরে আমাকে আর রোশনাকে আক্রমণ করেছিল সেই লোকটা। ঠিক চিনতে পারছি না।’
| শহীদ বলল, এই হ্যাটটাই পরেছিল লোকটা, আমার বিশ্বাস । এবার বলুন আক্রমণকারী কি ধরনের ডকুমেন্টের জন্যে এসেছিল আপনার বাড়িতে।
‘একবার আপনাকে জানিয়েছি যে সে-কথা আমি জানি না।’
শহীদ হেসে ফেলে বলল, সত্য কথা লুকিয়ে কতক্ষণ রাখবেন। নিন, সিগার।.– পকেট থেকে Ramonez সিগারের প্যাকেটটা বের করে শামিম হায়দারের সামনে বাড়িয়ে ধরল শহীদ। শামিম হায়দার বিস্ময়বোধ করল, কিন্তু চমকে ৰা থমকে গেল বলে মনে হল না শহীদের। মনে হল না এই সিগার পূর্ব পরিচিত তার। সে বলে উঠল, সিগার মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার পর খাই। তাও খুব কম। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য কি বলুন দেখি?’
শহীদ সিগার রেখে সিগারেট বের করে দিল। তারপর বলল, সত্য, পূর্ণাঙ্গ সত্য ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করা আমার উদ্দেশ্য নয়।’
একটু থেমে শহীদ অকস্মাৎ জানতে চাইল, আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থীটা কে?’ শামিম হায়দার চমকে উঠল। বলল, কি?’
শহীদ প্রশ্ন করল কঠিন কণ্ঠে, আপনার সঙ্গে কে আছে এখানে? কাকে আপনি আমার কাছ থেকে লুকোতে চেষ্টা করছেন?
শামিম হায়দার নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। বলে উঠল ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে, মাত্র আধঘন্টা আগে এখানে ফিরে এসেছি আমি। এবং কোন মানুষের ছায়াও দেখিনি।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
শহীদ জোর দিয়ে বলল আবার, সম্ভবত কয়েকটা ব্যাপার ভুলে গেছেন আপনি। আপনার চাচাত ভাই খুন হয়েছে, আপনার আব্বা গ্রেফতার হয়েছেন, আপনার বোন রহস্যময় নাটকীয়তা দেখাবার পর ইচ্ছাকৃতভাবে অদৃশ্য…।’
‘রোশনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’
‘ধরা যাক কিডন্যাপই করা হয়েছে, যা সম্ভব বলে মনে হয় না। আপনি ৭-কুয়াশা-৩২
৯৭
আক্রান্ত হয়েছেন কিছু কাগজ পত্রের জন্যে, যেগুলোর অস্তিত্ব নেই বলে ধারণা দেবার চেষ্টা করছেন–সবগুলো যোগ করুন, কি দাঁড়ায়? এ ছাড়া আরও দুটো ব্যাপার আছে।’
শহীদের কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠল। শামিম হায়দার চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু শহীদের চোখজোড়া যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে তার চোখের দৃষ্টিকে। শহীদ কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘দুটোর মধ্যে প্রথমটা তেমন। গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেননা ওই রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে’-গতরাতে আমার প্রতি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। দ্বিতীয়টা ভীষণ সিরিয়াসলি নিয়েছি আমি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং সহকর্মীকে আক্রমণ করা হয়েছে কাপুরুষের মৃত। সে বাঁচবে কিনা বলা। যাচ্ছে না। আমি আর কোনরকম সুযোগ দিতে চাই না কাউকে। কাকে আপনি
লুকিয়ে রেখেছেন এই বাড়িতে?’
| শামিম হায়দার উত্তর দিল না। শহীদ দেরি না করে দরজার দিকে পা বাড়াল। অর্ধভেজানো দরজাটা খুলে গেল শহীদের পৌঁছুবার আগেই। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল মোহাম্মদ আমান গাজী । নিজের বুকে হাত দিয়ে হাসি মুখে বলে
উঠল সে, আমাকে খুঁজছেন বুঝি?
. শহীদ তিক্তকণ্ঠে বলে উঠল, তাহলে আপনি! মি, শামিম, কেন আপনি মি. গাজীকে আমার কাছ থেকে আলাদা রাখতে চান? মিথ্যে কথা বলার কি কারণ দেখাবেন আপনি?’
* শামিম হায়দার বেপরোয়াভাবে বলল, আমার অতিথির ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলালে মিথ্যে উত্তরই পেতে হবে তাকে।’
এখন ওসব খাটবে না। আপনার এবং আপনার অতিথির সকল ব্যাপারে এখন নাক গলাব আমরা। সন্দেহজনক লোকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার দায়িত্ব আমরা পালন করি না।’
| ‘সন্দেহটা কি অভিযোগে?’
হত্যাকাণ্ডের সমাধানে জটিলতা সৃষ্টি। এখানে কেন আপনি, মি. গাজী?
আমান গাজী বলল, ‘রোশনার ভাইয়ের সাথে আলাপ করার জন্যে। এবং আমার ধারণা হয়েছে আপনি যে প্রসেসে রোশনাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন তাতে দ্রুত ফল লাভ করা যাবে না, তাই আমি নিজেই শামিমকে নিয়ে চেষ্টা করব রোশনাকে খুঁজে বের করতে, ঠিক করেছি। আমি ঢাকায় এসেছিও সেই কারণে দ্রুত রেজাল্ট চাই আমি।’
শহীদ বলে উঠল, কিন্তু সাবধান! দ্রুত রেজাল্ট পাবার বদলে দ্রুত হাজতে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনাটাও একবার ভেবে দেখবেন।’
কথাটা বলে দাঁড়াল না শহীদ। বেরিয়ে এল শামিম হায়দারের বাড়ি ছেড়ে । সোজা মি. সিম্পসনের অফিসে পৌঁছুল ও। মি. সিম্পসন অফিসেই রয়েছেন। শহীদ ৯৮
ভলিউম-১১
আসন গ্রহণ করে হ্যাটটা রাখল টেবিলের উপর। বলল ঢাকা শহর এলাকায় কতজন দোকানদার Ramonez সিগার বিক্রি করে?
. মি. সিম্পসন লিস্টটা দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোনও প্র্যান করছ নাকি?’
শহীদ দেখল লিস্টে প্রায় পঞ্চাশটা দোকানের নাম। বলে উঠল ও, দোকানদারের কাছে প্রথমে যাব আমরা। ওদেরকে দিয়েই চেষ্টা করব লোকটার সন্ধান পাবার জন্যে।’
‘কিন্তু কিভাবে?’
শহীদ Ramonez সিগারের একজন ক্রেতা চাই, যে সচরাচর এই হ্যাটটা পরত।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল মি. সিম্পসনের মুখ ।
আট।
হ্যাটটা চিনতে পারল বত্রিশ নম্বর দোকানদার। দোকানদার খরিদ্দারটার নাম ঠিকানা জানে না, কিন্তু এই হ্যাট পরে গত দু’তিন মাস ধরে একজন লোক পনেরো দিন পর পর Ramonez সিগার নিয়ে যায় এক প্যাকেট-পঞ্চাশটা। যখন আসে শনিবারেই আসে লোকটা। আজ শুক্রবার। গত শনিবার লোকটা আসেনি। আগামী কাল আসার সম্ভাবনা সমধিক।
শহীদ ফিরে এল সন্তুষ্ট হয়ে মি. সিম্পসনের অফিসে। মি, সিম্পসন ফোনের রিসিভার কানে উঠিয়েছিলেন মাত্র, শহীদকে দেখেই বললেন, শহীদ, তোমার
ফোন। কুয়াশা।
| ধক করে উঠল বুকটা। কুয়াশা ফোন করেছে তাকে এখানে! কেন! তবে কি কামাল…। রিসিভারটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে শহীদ বলে উঠল, শহীদ বলছি।’
. অপরপ্রান্ত থেকে ভারি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কুয়াশা বলছি, শহীদ। ভাল খবর। কামাল বিপদ-মুক্ত।’ | শহীদের কণ্ঠ হতে বিস্ফোরণ ঘটল, ওয়াণ্ডারফুল! আমি কৃতজ্ঞ, কুয়াশা । কামাল কথা বলতে পারবে?’
‘এখনি না। সময় হলে জানাব।’ ‘ধন্যবাদ, কুয়াশা। তোমাকে আর আটকে রাখব না, ছাড়ছি।’
ফোন ছেড়ে দিল শহীদ। মি. সিম্পসন বললেন, ‘যাক, আমাদের সৌভাগ্য যে কুয়াশা ছিল, তা না হলে কামালকে বাঁচানো সম্ভব হত না হয়।’
শহীদ বলল, “ঠিক তাই।’ | মি. সিম্পসন প্রসঙ্গ বদল করে বললেন, তুমি ইরাকী পুলিস কমিশনারকে যে টেলিগ্রাম করেছিলে তার উত্তর দিয়েছে ওরা। এই যে।’
কুয়াশা-৩২
E
—
–
–
৯১
| ঠিকানা দিয়েছিল শহীদ মি. সিম্পসনের অফিসেরই। টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে মনোনিবেশ করল শহীদ। পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে আমান গাজী সম্পর্কে। বয়স ত্রিশ। অবিবাহিত। পোলট্রি ফার্মের অংশীদার, বিভিন্ন ‘ছোটখাট ব্যবসা আছে আরও। কপর্দকহীন অবস্থায় কর্মজীবনের শুরু। অস্বাভাবিক উন্নতি করেছে। অবশ্য বেআইনী উপায়ে টাকা সংগ্রহ করেছে বলে কোন প্রমাণ নেই। অভিযানপ্রিয় । মাঝেমধ্যেই লণ্ডন, দিল্লী, কায়রোয় ঘুরতে যায়। নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট প্লেনে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে। ইরাকের ঠিক কোথায় প্রথম পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে মিস রোশনার তা জানা যায়নি। তবে দু’জনকে এক সঙ্গে বেড়াতে দেখা গেছে ইরাকের হাই-সোসাইটিতে।
পরদিন সকালে জেল হাজতে মি. জামিল হায়দারের সঙ্গে দেখা করল শহীদ। তিনি জানালেন তাঁর মেয়ে ইরাকে গিয়েছিল ইন্টেরিঅর ডেকোরেশন সম্পর্কে ডিগ্রী নিতে। শহীদ মিসেস জামিল হায়দারের সঙ্গেও দেখা করল বাড়িতে। তিনি এখনও অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মিস রোশনার ইরাকে যাবার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনিও জানালেন ওই একই কথা। শহীদ ভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর পেল কথাটা সত্য।..
ঢাকার পরিত্যক্ত রেল স্টেশনের কাছে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হল শহীদ। সিগারের দোকানটা ওখানেই। গাড়ি দূরে পার্ক করে দোকানের রাস্তার বিপরীত পাশে এসে দাঁড়াল ও। দু’জন কনস্টেবলকে বলে এসেছে ও জোরে গাড়ি চালিয়ে কেউ পালাবার চেষ্টা করলে বাধা দিতে হবে।
দোকানটার দিকে তাকাল শহীদ। সিগারের দোকানের পাশে একটা স্টেশনারী, দোকান। স্টেশনারী দোকানের উপর একজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোস্টার লাগাচ্ছে। লোকটা ডি কস্টা। শহীদ ওকে চারিদিকে চোখ মেলে রাখার কাজ দিয়েছে। গতরাতে শহীদের কাছে কাজের জন্যে গিয়েছিল ডি কস্টা । সিগারের দোকানের কাউন্টারে স্বাস্থ্যবান একজন লোক জিনিসপত্র গুছিয়ে শেলফে রাখছে। লোকটা আসলে ইন্সপেক্টর বোরহান। সেলস ম্যানের ছদ্মবেশ নিয়েছে ও। শহীদ এগিয়ে গিয়ে কুড়িটার প্যাকেট কিনল প্লেয়ার7ে। ইন্সপেক্টর শহীদকে না চেনার ভান করল নিখুঁতভাবে। শহীদ সিগারেট নিয়ে ফিরে গেল অপর পারে। তারপর, হাঁটতে লাগল ধীরে ধীরে।
তৃতীয়বার দোকানের বিপরীত পাশ দিয়ে যাবার সময় শহীদ দেখল একজন লোক নতুন একটা হ্যাট মাথায় দিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তা পেরোবার জন্যে অধৈর্য হয়ে উঠল শহীদ। কিন্তু গাড়ির ভিড়ে সম্ভব হচ্ছে না কোন মতে। এদিক ওদিক তাকাল শহীদ। হঠাৎ একজন লোককে দেখতে পেয়ে ভুরু কুঁচকে উঠল ওর! দোকানের দিকের ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সে-মোহাম্মদ আমান গাজী। সিগারের দোকানের দিকে তীক্ষ্ণ নজর তার। একা।
১০০
ভলিউম-১১
শহীদ দোকানের দিকে তাকাল।
ইন্সপেক্টর বোরহান Ramonez সিগারের প্যাকেট বের করে নতুন হ্যাট পরিহিত খরিদ্দারটাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি কি এই ব্র্যাণ্ড চাইছেন, সাহেব? Ramonez?’
হ্যাঁ।’
লোকটা উত্তর দিল । ইন্সপেক্টর বোরহান উত্তেজনা দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা বা দুটো প্রশ্ন করতে চাই…।’ | নতুন হ্যাট পরিহিত খরিদ্দারটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই ঘুরে দাঁড়াল।
পরমুহূর্তে পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করল সে রাস্তার উপর দিয়ে। | ডি. কস্টা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে পড়ল ছাদের উপর থেকে রাস্তায়। কিন্তু লোকটা তখন দূরে পালাচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার উপর বসে পুড়ে ডি কস্টা চিৎকার করে উঠল, হায় হায়! বড় জোরে রান করিয়া গেল! গ্রেট একটা মিস্টেক। হইয়া গেল!’
নয়।
শহীদ লোকটাকে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল। ছোট ছোট ঘন কালো চুল মাথায়, গায়ের রঙ কালো, পাণ্ডুর বর্ণ মুখ, বড় বড় চোখ, খাড়া নাক, লম্বা গলা। ইন্সপেক্টর বোরহান কথা বলার চেষ্টা করতেই তড়াক করে লাফিয়ে ছুটতে শুরু করল। লোকটা। আমান গাজী অকস্মাৎ শহীদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘মি. শহীদ! ওই লোকটা!’
শহীদ প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল আমান গাজীকে। ছুটতে শুরু করল ও দ্রুত বেগে। লোকটা রাস্তার অপর দিক দিয়ে ছুটে চলেছে। মি. সিম্পসন দৌড়ে যাচ্ছেন পিছন পিছন । কাছাকাছিই ছিলেন তিনি। শহীদ রাস্তা পার হতে গিয়ে অকস্মাৎ ধাক্কা খেল একটা বেবীট্যাক্সির সঙ্গে। সময় মত সাবধান হতে পেরেছিল বলে মারাত্মক আঘাত পেল না ও। কিন্তু রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল হাত থেকে। সেটা কুড়িয়ে নেবার সময় রইল না হাতে, দৌড়ুতে শুরু করল শহীদ। ঠিক এমন সময় পলায়নরত লোকটা গুলি করল। রিভলভার বের করে। মি. সিম্পসনের পায়ে লাগল গুলি। পড়ে গেলেন তিনি রাস্তার উপর। শহীদ থামল না। ইন্সপেক্টর বোরহান শহীদের পিছন পিছন আসছে চিৎকার করতে করতে, চোর! চোর!’
শহীদের পিছনে আর একজন লোকের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। রাস্তার কোন লোক অংশ গ্রহণ করল না পলায়নরত লোকটাকে বাধা দেবার জন্যে। রাস্তা অতিক্রম করল শহীদ দুঃসাহসিকভাবে। কিন্তু পরক্ষণেই একটা ছুটন্ত গাড়ির এক কুয়াশা-৩২
১০১
তার ভেঙে গিয়েলের সশব্দে
ইঞ্চি পাশ ঘেঁষে পলায়নরত লোকটা বিপরীতদিকের ফুটপাতে চলে গেল। হঠাৎ মোড় নিল সে। মোড় নিয়ে তিনটে বাড়ি অতি করে চতুর্থ বাড়িটার খোলা দরজা দিয়ে পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শহীদ শুধু লোকটার শার্ট দেখতে পেল মোড়ে পৌঁছে।
বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। বন্ধ হয়ে গেছে দরজাটা। শহীদ জোরে জোরে ধাক্কা মারল দরজায়। পিছন থেকে আমান গাজী বলে উঠল, ভাঙতে হবে দরজা, খুলবে না।’
শহীদ বলল, রিভলভারটা আমাকে দিন।’ না।
শহীদ বাক্যব্যয় না করে ছোঁ মেরে কেড়ে নিল আমান গাজীর রিভলভারটা। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল ও দরজার, গায়ে। ছিটকিনি ভেঙে গিয়ে খুলে গেল পাল্লা দুটো। বাড়ির উঠানে কাউকে দেখতে পেল
শহীদ। দোতলার উপর সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল একটা। দরজাটা দেখতে পেল শহীদ। ছুটল ও সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায়? আমান গাজী রয়েছে পিছন পিছন ।
দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে এক সেকেণ্ডও চিন্তা করবার সময় নিল না শহীদ। ভিতর থেকে বন্ধ। কী-হোলের উপর রিভলভারের নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপল শহীদ। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড একটা লাথি মেরে খুলে ফেলল ও দরজাটা। সামনের ঘরে কেউ নেই। ভিতরের কোন ঘরে ফোন বাজছে । আততায়ী ফোনে কথা বলছে। সামনের ঘরে ঢুকে অপরদিকের দরজার কাছে গিয়ে আড়াল থেকে উঁকি মারল শহীদ। লোকটাকে দেখতে পেল ও। এক হাতে রিভলভার, অন্য হাতে রিসিভার । শহীদকে দেখতে পেয়েই গুলি করল লোকটা বুলেট বেরিয়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। শহীদ গুলি করল । লোকটার হাতে ধরা রিসিভারে অব্যর্থভাবে গিয়ে লাগল বুলেট। ভেঙেচুরে পড়ে গেল সেটা লোকটার হাত থেকে। দ্বিতীয়বার গুলি করল না শহীদ। ঘরের অপরদিকের আর একটা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে আমান। গাজী। লোকটার পিছনে সে এখন। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটাকে ধরার জন্যে।..
লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমান গাজী লাফিয়ে পড়ল তার উপর। কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিমান পুরুষ লোকটা। আক্রান্ত হয়ে সে রিভলভার হারাল বটে, কিন্তু আমান গাজীকে ধাক্কা মেরে ফেরত পাঠাল ঘরের এক কোণে । কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শহীদ ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছিল ঘরে। প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসিয়ে দিল ও লোকটার মুখে।
লোকটা টলতে টলতে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে।
আমান গাজী উঠে দাঁড়াল। যেন কিছুই হয়নি তার। উঠে দাঁড়িয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে টলায়মান লোকটার ঘাড়ে। হঠাৎ হিংস্রতা পেয়ে বসেছে যেন ওকে ।
ভলিউম-১১
১০২
প্রচণ্ড জোরে কয়েকটা ঘুসি মারল সে লোকটাকে। তারপর দমাদম লাথি চালাল। থামবার কোন লক্ষণ নেই।
শহীদ বলে উঠল, হয়েছে, থাক।’ কিন্তু থামল না আমান, গাজী । পাগল হয়ে গেছে যেন ও। লাথির পর লাথি মেরে চলেছে। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে লোকটা। শহীদ চমকে উঠল হঠাৎ পরক্ষণে রিভলভারের বাঁট দিয়ে আমান গাজীর নাকে ঘা মারল ও। | মি. সিম্পসন খাড়াতে খোঁড়াতে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে সানন্দে বলে উঠলেন, ‘সাবাস! লোকটাকে তাহলে কাত করে ফেলেছ, শহীদ!’
| পকেটের কাগজপত্র দেখে জানা গেল লোকটার নাম ইয়াকুব। বাড়িওয়ালাও সমর্থন করলেন কথাটা। বাড়িওয়ালা থাকেন পাশের বাড়িতেই। তিনি জানালেন মিস রোশনা ইরাকে যাবার আগে এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল। ইরাকে যাবার সময় ইয়াকুবকে দিয়ে গেছে বাড়িটা বসবাস করার জন্যে। নিয়মিত ভাড়া পেয়ে আসছেন তিনি। তার আপত্তি করার কিছু ছিল না।
ইয়াকুব বাইশ-তেইশ বছরের যুবক। কাপড় চোপড় সস্তা দামের এবং পুরানো। নতুন হ্যাটটা বেমানান। অবশ্য, পুরানো হ্যাটটা কাপড় চোপড়ের সঙ্গে মিল খায় । মি. সিম্পসনকে ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। তিনি পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে লোকজন নিয়ে সার্চ করছেন সম্পূর্ণ বাড়িটা। আমান গাজী এই খানিক আগে জ্ঞান ফিরে পেয়ে একটা আরাম কেদারায় উঠে বসেছে। চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছে
যেন ও। নাকের মাঝখানটা আলুর মত হয়ে ফুলে উঠেছে তার।
শহীদ ফিরে এল ৫তিটি রূম একবার করে পরখ করে । মিস রোশনা যে এ | বাড়িতে একসময় থাকত তাতে কোন সন্দেহ নেই। বেডরূমে পাওয়া গেছে তার
আব্বা মি. জামিল হায়দারের বাঁধানো ছবি। ছবির নিচে লেখা-রোশনাকে, উপহার স্বরূপ’। সইটা মি. জামিল হায়দারের। আরও কয়েকটা ফটো দেখেছে শহীদ। সবগুলোই সম্ভবত মিসেস জামিল হায়দারের শখ করে তোলা । কিন্তু অল্প কয়েক দিন আগে মিস রোশনা এখানে ছিল এমন কোন প্রমাণ নেই।
আমান গাজী চোখ মেলল। শহীদ বলল, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট । “কেন, কেন! আমি তো আপনার প্রাণ বাঁচালাম!’
শহীদ বলল, আপনি আর একটু হলে খুন করে ফেলতেন লোকটাকে। আইন রক্ষকের কাজে বাধা প্রদান-এই হল আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ। আপনাকে হাজতে ভরার পর প্রশ্ন করব আমরা। আপনার অতি স্মার্টনেস বিপজ্জনক।
আমান গাজী কথা বলল না। শহীদ ভাবছিল মিস রোশনা যে লোককে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল সেই লোকই আক্রমণ করেছিল তাকে এবং তার ভাইকে–অথচ আক্রমণকারীকে চিনতে পারেনি সে। নাকি চিনতে পেরেও শহীদকে মিথ্যে কথা বলেছিল? কুয়াশা-৩২
| : ১০৩
ইয়াকুৰ এখনও জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে না। তার গাল, ঠোঁট, কপাল ফুলে গেছে। আমান গাজী অমানুষিকভাবে মেরেছে লোকটাকে। কেন? শহীদ ভাৰতে চেষ্টা করল। ষাটটি সেকেণ্ড যদি আরও দিত শহীদ ওকে, তাহলে মেরেই ফেলত সে লোকটাকে। আমান গাজী কি তাহলে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই হত্যা করতে চেয়েছিল ইয়াকুৰকে? একথা ভেবেই তখন চমকে উঠেছিল শহীদ। যদি তাই হয় তাহলে ধরে নিতে হয় আমান গাজী নিশ্চয় চাননি ইয়াকুব পুলিসের কাছে বা শহীদের কাছে মুখ খুলুক! শহীদ ইয়াকুবের পালস দেখল । ৰিট হচ্ছে। আমান গাজী বলে উঠল, আমি খুন করিনি লোকটাকে।’
মি. সিম্পসন রূমে ঢুকলেন, শহীদ ৰলে উঠল, মি. সিম্পসন, এই ভদ্রলোককে হাজতে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন এখুনি। এর সঙ্গে কথা বলব আমি।’
আমান গাজীকে ইন্সপেক্টর বোরহানের সঙ্গে থানা হাজতে পাঠিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন। আমান গাজী কোন কথা বলল না যাবার সময় । চোখ জোড়া শুধু কুঁচকে রইল তার। যেন যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরের কোথাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে কেমন যেন সন্তুষ্ট দেখাল।
ইয়াকুবের পকেট থেকে বুলেট, পেন্সিল, ছুরি, সিগার-দেশলাই, চাবি, মানিব্যাগ, দুটো ঘড়ির বাক্স, কিছু খুচরো পয়সা, চিরুনি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। চাবির গোছাটা ছাড়া আর কিছু প্রয়োজনে লাগবে না। মানিব্যাগের ভিতরে শতখানেক টাকা ছাড়া পাওয়া গেল মিস রোশনার একটা পাসপোর্ট সাইজের ফটো। ফটোটা বহু দিন আগের ভোলা, সম্ভবত কয়েক বছর আগের । ময়লা হয়ে কোণা ছিঁড়ে গেছে। ইয়াকুবের পকেটে বহুদিন থেকে আছে এটা, শহীদের ধারণা। হল । কিন্তু এমন কিছু পাওয়া গেল না যা দেখে মিস রোশনা কোথায় আছে তা জানা যায়।
‘মি. সিম্পসন বললেন, শহীদ! ইয়াকুৰ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে।’ ‘ • শহীদের চিন্তাজাল ছিঁড়ে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল ও ইয়াকুবের দিকে। ড. মল্লিক খানিকটা ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে দিলেন তাকে। চোখ পিট পিট করে তাকাল ইয়াকুৰ। শহীদ সামনে এসে দঁাড়াল, তোমার খেলা খতম হয়ে গেছে, ইয়াকুৰ । মিস রোশনা কোথায় বলো।’
শূন্য দৃষ্টিতে ইয়াকুৰ তাকাল শহীদের দিকে, আমি জানি না!’ জানো, তুমি নিশ্চয়ই জানো। তুমিই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলে।’ ইয়াকুৰ উদাসভাবে বলে উঠল, বাজে কথা । আমি কিছু জানি না।’
এরপর শহীদ এবং মি. সিম্পসনের একটি কথারও উত্তর দিল না ইয়াকুব। থানায় যাবার পথে, থানায়, হাজত ঘরে–কোথাও মুখ খুলল না সে।
১০৪.
ভলিউম-১১ :
দশ
বিকেল বেলা মি. সিম্পসন ইয়াকুৰ সম্পর্কে তথ্য নিয়ে শহীদের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। ইয়াকুৰ একজন প্রাক্তন সৈনিক। অশিক্ষিত বলা চলে না। পারিবারিক ইতিহাস জানা যায়নি। খারাপ আচরণের জন্যে আর্মি থেকে বহিষ্কৃত । অপরাধজগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হলেও, যাওয়া-আসা ছিল। বিভিন্ন চাকরি, ব্রোকারী করেছে-ছেড়ে দিয়েছে সবগুলোই কিছু দিন করে। একবার কুমিল্লা পুলিস সন্দেহ করেছিল ওকে ডাকাত দলকে খবরাখবর সংগ্রহ করে দেবার কাজ করে মনে করে । কখনও গ্রেফতার হয়নি। কিন্তু কয়েকজন ইন্সপেক্টর ওকে চেনে, সম্ভাব্য খারাপ লোক হিসেবে। রিভলভারটা সৈনিক জীবনে সংগ্রহ করেছিল সে। বুলেট কোথা থেকে পেত তা জানা যায়নি। কোন বাঁধন নেই জীবনে। আত্মীয় স্বজন কে কোথায় আছে জানা যায়নি। মিস রোশনা ইরাকে যাবার সময় বাড়িটায় উঠে আসে সে। আগে একটা ছোট বাড়িতে থাকত কয়েকজনের সঙ্গে। মিস। রোশনার বাড়িতে তার ঠাই পাবার কারণ অজ্ঞাত । কিন্তু এ বাড়িতে আসার পর তার আচরণ খুব রহস্যময়। বেশ কিছু টাকা খরচ করতে দেখা গেছে তাকে। ওর। শোবার ঘরের তোশকের নিচে পাওয়া গেছে দেড় হাজার টাকা। ওর সঙ্গে দেখা। করার জন্যে কখনও কেউ আসত না, একথা জানা গেছে। তবে আজ সকালে
একজন দেখা করতে গিয়েছিল। সে হল আমান গাজী। আমান গাজী একজন। লোককে জিজ্ঞেস করে বাড়িতে ঢুকেছিল। ইয়াকুবের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটির শব্দ দু’একজন শুনেছে। কুড়ি মিনিট পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আমান গাজী। কিন্তু চলে যায় না সে। একটু পর ইয়াকুব সিগার কেনার জন্যে বের হয় বাইরে,
আমান গাজী তাকে অনুসরণ করে।
শহীদ চিন্তিতভাৰৈ বলল, ‘মিস রোশনা ইয়াকুবকে চিনত এবং সে জানতে পেরেছিল ইয়াকুবই তাকে এবং তার ভাইকে আক্রমণ করে। আমার মনে হয় ইয়াকুৰ যা করেছে তা করানো হয়েছে টাকা দিয়ে। বেপরোয়া প্রকৃতির ও। ওকে দিয়ে কেউ কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। মিস রোশনার বাড়িতে কেউ পাঠিয়েছিল ওকে, ওদেরকে আক্রমণও করিয়েছিল টাকা দিয়ে, মিস রোশনাকে অন্যত্র নিয়ে যাবার পিছনেও ওই একই কারণ। এবং আমাকে ৰা আমান গাজীকে আক্রমণ করেছিল ও ওই টাকার বদলেই। এসব ব্যাপারে ওর নিজের কোন উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না আমার। সেই পোড়ো বাড়িতে মিস রোশনাকে ইয়াকুৰ ৰাধ্য করেছিল তার সাথে দেখা করতে। এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে শামিম হায়দার জানত ইয়াকুব কোথায় থাকে। সেই-ই সম্ভবত আমান গাজীকে জানায় ঠিকানাটা। শামিম হায়দারকে ইয়াকুব ব্ল্যাকমেল বা এই জাতীয় কোন
কুয়াশা-৩২
১০৫
অসুবিধের মধ্যে রেখেছিল, এই রকম একটা ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি যেন আমি। মি. সিম্পসন, মনে আছে তো যে গোলাম হায়দার একজন ব্ল্যাকমেলার ছিল। গোলাম হায়দার মি, জামিল হায়দারকে ব্ল্যাকমেল করত। ইয়াকুব হয়ত করত শামিম ও মিস রোশনা হায়দারকে। মিস্ রোশনার বাড়ি ব্যবহার করার অধিকারের পিছনে নিশ্চয় একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। যাই হোক, শামিম এবং মিস, রোশনা চায়নি ইয়াকুব ধরা পড়ুক। এমনকি দু’জনে ইয়াকুবের হাতে আক্রান্ত হবার পরও স্বীকার করেনি যে আক্রমণকারীকে ওরা চেনে। এর মানে কি? এর মানে ওরা চায়নি পুলিসের কাছে ইয়াকুব মুখ খুলুক । কেন? ইয়াকুব মুখ খুললেই ওদের গোপনীয় কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে। গোপনীয় কি এমন কথা যার জন্যে ব্ল্যাকমেল করতে পারছে ইয়াকুব ওদেরকে? শামিম হয়ত গোলাম হায়দার হত্যাকাণ্ডের প্রকত রহস্য জানে। বলা যায় না হয়ত সেই-ই তার চাচাত ভাইকে হত্যা করেছে। কেননা গোলাম হায়দার ব্ল্যাকমেল করত তার আব্বাকে। আব্বাকে ব্ল্যাকমেলিং থেকে বাঁচাতে গিয়ে হয়ত খুন করেই ফেলেছে সে গোলাম হায়দারকে। এদিকে পিত ছেলেকে ফাঁসির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে দোষী হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন অপ্রত্যক্ষভাবে। যদিও তিনি স্বীকার করেননি খুনের অভিযোগ। ওদের বিশ্বাস আসল খুনী কে তা আমরা জানতে পারব না, এবং মি. জামিল হায়দার যে আসল খুনী নন তাও স্বীকার করব আমরা শেষ পর্যন্ত এবং মিস রোশনা ভাইকে রক্ষা করার জন্যে ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী সবকিছু চাপা দিয়ে রাখার প্রয়াস পাচ্ছে ।
একটু থেমে শহীদ বলল আবার, কিন্তু আমার এই সব,অনুমান নস্যাৎ করে দেয় অন্য একটি সত্য । সেটা হচ্ছে গোলাম হায়দার খুন হবার আগে থেকেই মিস রোশনার বাড়িতে ঠাই নেয় ইয়াকুব। সেক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেল করার প্রশ্ন ওঠে না। অন্তত গোলাম হায়দারের খুনের ব্যাপারকে মূলধন করে সম্ভব হয় না। কেন না গোলাম হায়দার তখনও নিহত হয়নি। এবং আর একটা ব্যাপার মোহাম্মদ আমান গাজী এসবের মধ্যে কেন এসেছে? ইয়াকুব যখন দৌড়ে পালাতে শুরু করে তখন সে আমার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল প্রায়। ওকে ধাক্কা মেরে ছুটতে শুরু করি আমি। ওকি তাহলে ইয়াকুবকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছিল? তাছাড়া ইয়াকুব যখন ধরা পড়ল তখন এমন অস্বাভাবিক ভাবে তাকে আঘাতের পর আঘাত করার কারণ কি? আমার যেন সন্দেহ আমান গাজী ইয়াকুবকে খুন করতে চেয়েছিল। যাতে সে আমাদের কাছে কোন কথা বলার সুযোগ না পায়।’
.মি. সিম্পসন বললেন, “দেখো শহীদ, আমি স্বীকার করছি এই কেসের সমাধান আমার দ্বারা অসম্ভব। এমন জটিল এবং রহস্যময় ব্যাপার বড় একটা দেখা যায় না। তুমি যেমন অবাঝে তেমন করো । আমার শুধু একটা বক্তব্য। আমান গাজী সম্পর্কে প্রয়োজন মত সাবধান থেকো। বিদেশী লোক। দু’দেশের সাথে,
১০৬
ভলিউম-১১
খারাপ সম্পর্কের সৃষ্টি যেন না হয়।’
শহীদ বলল, ‘ধন্যবাদ, মি. সিম্পস সে কথা আমি জানি বৈকি। মি. সিম্পসন বিদায় নিলেন খানিক পর। শহীদও বের হল বাইরে।
জেল হাজতে আমান গাজীর সঙ্গে দেখা করতে এল শহীদ। আমান গাজী জেল হাজতে আছে বটে, কিন্তু আরামদায়ক বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে তাকে। শহীদ প্রথম প্রশ্ন করল, আপনি যখন শামিম হায়দারের কাছে ইয়াকুবের ঠিকানা পেলেন তখন আমাকে খবর না দিয়ে নিজে বাহাদুরী ফলাতে গিয়েছিলেন কেন, মি. গাজী? কেনই বা আপনি আমার পথরোধ করে ইয়াকুবকে পালাবার সুযোগ করে দিতে চাইছিলেন, এবং অবশেষে ওকে #রে ফেলার চেষ্টা করছিলেন, মি. গাজী?’
| আমান গাজী হতচকিত হয়ে বলে উঠল, ‘আপনার পথরোধ করার চেষ্টা করিনি আমি, ইয়াকুবকে পালাবার সুযোগও করে দেবার প্রশ্ন ওঠে না। আর ওকে মেরে ফেলতেই বা চাইব কেন আমি? ভীষণ রাগ হয়ে গিয়েছিল, তাই এলোপাতাড়ি মারছিলাম আর কি! আপনি ভুল বুঝলে আমার কিছু করার নেই। আমার বক্তব্য, এই মুহূর্তে জানিয়ে দিতে চাই আমি। আগামী তিন ঘন্টা সময় দেব আপনাকে আমি। তারপর এমব্যাসিতে খবর পাঠিয়ে একজন অ্যাটর্নি চাইব। কোন সন্দেহ করবেন না, আমি সাহায্য পাব জানি বলেই এমব্যাসির সাহায্য চাইব। আমাকে কেন্দ্র করে যদি দুই বন্ধু দেশের মধ্যে গোলমাল বাধাবার ইচ্ছা থাকে তাহলে আমাকে আটকে রাখুন।’
শহীদ বলল, আপনাকে আটকে রেখেছি, এটার চেয়ে স্বস্তিকর আর কিছু জানা নেই আমার।’
শহীদ বের হয়ে এল জেল হাজত থেকে। এবার ও উপস্থিত হল মি. জামিল হায়দারের সেলে।
মি. জামিল পেশন্স খেলছিলেন। শহীদকে দেখে খেলা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। কার্ডগুলো গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। শহীদ প্রশ্ন করল, ‘মি. জামিল, দুটো প্রশ্ন এর আগে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি । প্রশ্ন দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রশ্ন–আপনি কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে চেষ্টা, করবেন কোর্টে?’
– “নিশ্চয় করব, একশোবার!
তাহলে কাকে আপনি আড়াল করবার, বাঁচাবার চেষ্টা করছেন? আপনি গোলাম হায়দারকে হত্যা না করে থাকলে আর কে তাকে হত্যা করতে পারে? কে
সে? কাকে আপনি রক্ষা করতে চাইছেন? :
কাউকে নয়, মি. শহীদ,’ জামিল হায়দার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন।
শহীদ বলল, আপনি যদি অপরিচিত কাউকে রক্ষা করার প্রয়াস পান তার কুয়াশা-৩২
১০৭
ফল দাঁড়াবে আপনার মৃত্যু। এবং তা অপমানকরও বটে আপনার জন্যে।
মি. জামিল পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘কাউকে নয়, মি. শহীদ। শহীদ বলল, “বেশ। আচ্ছা, ইয়াকুব নামে কাউকে চেনেন কি আপনি?’
। ওই নামের লোক একজন সিনেমায় আছে হয়ত। কাউকে চিনি না।’ শহীদ জানতে চাইল, মোহাম্মদ আমান গাজী?’ | মি. জামিল হায়দার এমন অস্বাভাবিকভাবে চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালেন। শহীদের দিকে যে, তাঁর শরীরের ধাক্কা লেগে টেবিলের উপর থেকে কার্ডগুলো পড়ে গেল মেঝেতে।
এগারো
শহীদের সঙ্গে যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে মি. জামিলের ততবারের মধ্যে এই প্রথমবার চমকে উঠলেন তিনি ভয়ানকভাবে? শহীদ মৃদুস্বরে বলে উঠল, কি জানেন আপনি আমান গাজী সম্পর্কে, মি. জামিল?’
মি. জামিল হায়দার শহীদের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, কিছুই বলতে পারব না আমি। কোন সাহায্যই করতে পারব না আমি আপনাকে। দুঃখিত।
আমি আপনাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করছি, কথাটা ভুলে যাবেন না, মি. জামিল।
‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার চেষ্টা করছেন।’
শহীদ বলল, ওটা আমার কাজ নয়। আমার কাজ আপনার সুবিচার যাতে হয় তার চেষ্টা করা। আপনি অপরাধ হলে শাস্তি পাবেন, পাওয়াবার চেষ্টা করব আমি। আপনি নিরপরাধ হলে মুক্তি পাবেন, এবং মুক্তি যাতে পান সেই চেষ্টাই করব আমি।’
| ‘আমার লয়ার সে-কাজ আরও ভাল ভাবে করবে।’
সম্ভব হবে না, যদি আপনি তথ্য লুকিয়ে রেখে সব কথা খুলে না বলেন।’
মি. জামিল বললেন, আমি যা বলেছি তার বেশি বলতে রাজি নই, মি. শহীদ। * শহীদ দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। বলল, অন্য কারও খাতিরে মৃত্যুবরণ করাটা খুব বড় ব্যাপার, মি. জামিল। কিন্তু…থাক!’
Leave a Reply