৩০. সীমান্ত সংঘাত [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩০
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ১৯৭১ এক ‘Stand by to jump!
| অ্যারোপ্লেনের ইন্টারকম থেকে ঘোষিত হল সাবধান বাণী। কন্ট্রোল ককপিটের পিছনের মৃদু আলোকিত কেবিনে দুই ব্যক্তির চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। ওদের মধ্যে একজন হচ্ছে প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান এবং অপরজন ওরই প্রিয় বন্ধু এবং সহকারী কামাল আহমেদ।
‘We’re all set!’
শহীদ দ্রুত কণ্ঠে মন্তব্য করল। কামাল সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে শেষবার দেখে নিল প্যারাশুটের বাঁধনগুলো। ইন্টারকমের মাধ্যমে ভেসে এল পাইলটের সন্তষ্ট কণ্ঠস্বরঃ বাইরে গাঢ় অন্ধকার! গুড লাক।
শহীদ বলে উঠল, ‘থ্যাঙ্কস। অল সেট, গো।’
ওয়ার্নিং লাইটের দিকে দৃষ্টি শহীদের। লাল টকটকে আলো। ওদের নামার নির্দিষ্ট স্থানের উপর প্লেন পৌঁছুলেই ওই রেড ওয়ার্নিং লাইট গ্রীন হয়ে যাবে।
নিচের গাঢ় অন্ধকারে শুয়ে আছে সীমান্ত প্রদেশ। কান্দাহার, ঘোরাক, মুশাকাল্লা ছাড়িয়ে যাবে প্লেন। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যবর্তী সরকার বিহীন অশাসিত ভূখণ্ডে নামতে হবে ওদেরকে। জায়গাটা ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু বহু যাযাবর সেখানে বাস করে।
পাকিস্তানের গুপ্তচর বাহিনীর কয়েকজন সদস্য প্যারাশুট নিয়ে কয়েক দিন আগে নেমেছে। কোন খবর পাওয়া যায়নি আর তাদের। মি. সিম্পসন মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের বড় অফিসার তিনি। কিন্তু টপ-সিক্রেট পর্যায়ের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কাজকর্মও তাঁকে দেখতে হয়। এটা তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব। এই অতিরিক্ত দায়িত্বই এবার তাঁর মাথা-ব্যথার সৃষ্টি করেছিল। কয়েকজন গুপ্তচর স্রেফ বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাওয়াতে দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না তার। কথায় কথায় শহীদকে ব্যাপারটা গোপনে জানিয়েছিলেন তিনি। শহীদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ হলেও দেশকে সে ভালবাসে। দেশেরই সুদূর এক প্রান্তে একটা ভয়ঙ্কর বেআইনী অপরাধী দল তাদের ক্ষমতা ক্রমশ বিস্তার করে দেশের পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি কর্তব্য হল শত্রুকে ধ্বংস করা । সুতরাং মি. সিম্পসনের অনুরোধ রক্ষা না করার প্রশ্নই ওঠেনি।
কুয়াশা-৩০
১২১
তথ্য যা পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ এবং মারাত্মক। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের বিশেষ নির্দিষ্ট এক অঞ্চলে যে জায়গাটা নো ম্যানস ল্যাণ্ড’ বলে চিহ্নিত, সেখানে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন গুপ্তচর স্থায়ীভাবে অবস্থান করছিল বহুদিন ধরে। হঠাৎ তার কাছ থেকে কোন খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে না। চীন সরকারের মাধ্যমে জানা গেছে যে ওই নো ম্যানস ল্যাণ্ডের চতুর্দিকে ইলেকট্রিফায়েড তারের ব্যারিয়ার ইত্যাদি লাগানো হচ্ছে। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ এই রহস্যময় ঘটনায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। শহীদ ও কামালকে যোগাযোগ করতে হবে ‘ননা ম্যানস ল্যাণ্ডের’ গড়ে ওঠা নতুন শহরের দক্ষিণের পাহাড়বাসী পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের গুপ্তচরের সঙ্গে। নো ম্যানস ল্যাণ্ড গত চার বছর থেকে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। তারা নিজেদেরকে পাকিস্তানীও বলে না, অন্য কোন দেশের নাগরিক বলেও মনে করে না।
শহীদ কামালের উদ্দেশ্যে বলে উঠল আনমনে, কামাল, “ননা ম্যানস ল্যাণ্ডে” আমাদের লোক হয়ত কিছু জানে সীমান্ত এলাকায় কি ঘটছে না ঘটছে। এই কথা বললেন মি. সিম্পসন।’
কামাল বলে উঠল, “মি. সিম্পসন আমাদেরকে ঠিক পাহাড়ের কাছাকাছি নামবার ব্যবস্থা করেছেন, তাই না? যেখানে আমাদের লোকটা থাকে?’
শহীদ উত্তর দিতে পারল না। ওয়ার্নিং লাইটের দিকে স্থির ছিল ওর দৃষ্টি। দেখা গেল লাল আলো সবুজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
গ্রীন লাইট অন!’
একজন এয়ার –কেবিনের মেঝে থেকে একটা ঢাকনি তুলে গর্তের মুখটা উন্মোচন করল। শহীদের দুকানের পাশে আর্তনাদ করতে লাগল বাতাস। পলকের জন্যে দেখে নিল ও কামাল ওকে অনুসরণ করার জন্যে তৈরি আছে কিনা। তারপর গর্তের দিকে ঝুঁকে পড়ল ও একটু, এবার ঝাঁপ দেয়া যেতে পারে।
আচমকা শহীদের একটা হাত দ্রুতবেগে কামালের উইচীটারে গিয়ে স্পর্শ করল। শহীদের হাতের পিনটা ঢুকে গেল উইণ্ডচীটারে। পরমুহূর্তে এয়ার-কুর উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ও রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন শূন্যে।
কামালও শহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্লেনটা, অনেক দূর সরে চলে গেল ওদের কাছ থেকে। প্লেনের এঞ্জিনের গর্জন ধ্বনি ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্যারাশুট খুলে যেতে উপর দিকে একবার তাকাল শহীদ। নিমিষের জন্যে ও দেখতে পেল কামালের প্যারাশুটটা বড় হয়ে ফুলে উঠতে শুরু করেছে। নিচের দিকে তাকাল শহীদ। মুহূর্তের মধ্যে ভুরু কুঁচকে উঠল ওর। দুশ্চিন্তার রেখা দেখা গেল কপালে।
নিচের মেঘপুঞ্জ হতে ফুটে বের হচ্ছে অদ্ভুত কমলা রঙের আভা। যেন
ভলিউম-১০
১২২
মেঘরাশির নিচে বন ভূমিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলার ফলে ওরকম দেখাচ্ছে। হার্টবিট বেড়ে গেল ওর। ব্যাপার কি? জঙ্গলের কাছে তো নামার কথা নয় ওদের। পাহাড়ী গাছগুলোতে আগুন ধরে গেছে নাকি? সেই আগুনের দিকেই দ্রুত নেমে যাচ্ছে তারা?
মেঘ চারদিক দিয়ে গাঢ় কুয়াশার মত ঘিরে রেখেছে শহীদকে। দৃষ্টিসীমার বাইরে এখন কামাল। প্রায় নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে শহীদ। যতই ও নামছে মেঘের ভিতর দিয়ে ততই কমলা রঙের আভা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। .
অকস্মাৎ মেঘের রাজ্য ত্যাগ করে বেরিয়ে এল শহীদ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নিচের দিকে। মেঘের গায়ে যে কমলা রঙের আলোর আভা পড়েছিল তা আগুনের নয়, মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল শহীদ। কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা দূর হতেই আরেকটা দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসল নাছোড়বান্দার মত। নিচের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল শহীদ। আগুন না, নিচে জ্বলছে শত শত স্ট্রীট ল্যাম্প।
ওরা দুজন তাহলে নামছে মাঝারি ধরনের একটা শহরের উপর। পাইলট নিশ্চয়। ভুল করে ফেলেছে। ভাবল শহীদ। পাকিস্তানী গুপ্তচর সরফরাজ খানের পাহাড়ী কেবিনের কাছাকাছি নামার কথা ছিল ওদের। অথচ তথাকথিত ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ডের অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে বড় শহরে নামাবার ব্যবস্থা করেছে পাইলট ওদেরকে।
শহরের আলোকিত রাস্তাগুলো জনশূন্য দেখাচ্ছে। মধ্যরাত্রি বেশ অনেক আগে পেরিয়ে গেছে। শহরের অধিবাসীরা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শহীদ ভাবল, হয়ত নিরাপদে ল্যাণ্ড করা যেতেও পারে সেক্ষেত্রে। কিন্তু ধরা পড়বার ভয় শতকরা নব্বইভাগ। কে জানে কোথায় গিয়ে পড়বে তারা। | বিরাট বড় একটা বাগান দেখা যাচ্ছে নিচে। পা দুটো নেড়ে সিধে করে নিল শহীদ। সোজা বাগানের দিকে নামছে ও। উপর পানে মুখ তুলল একবার। কামাল। কোথায়! কামালকে দেখা যাচ্ছে না!
নিচের বাগানের মাটি ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে। আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড । পা দুটো মুড়ে ফেলল শহীদ মাটি স্পর্শ করতেই। ডিগবাজি খেয়ে গড়িয়ে গেল খানিক দুর ঘাসের উপর দিয়ে। তাল সামলে মুহূর্ত মাত্র দেরি করল না ও, উঠে দাঁড়াল। দ্রুত হাতে মুক্ত করল ও প্যারাশুটের বাঁধন থেকে নিজেকে। একটা বাণ্ডিল করে
ফেলল প্যারাশুটটাকে। ধীর অথচ সতর্ক পদক্ষেপে সারভর্তি একটা ড্রামের কাছে । গিয়ে দাঁড়াল ও। ঢাকনি খুলে বাণ্ডিলটাকে কবর দিয়ে আবার ঢাকনি চাপা দিল যথাযথ । কামাল কোথায়? এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে প্রশ্ন করল ও নিজেকে। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই মাটিতে নেমেছে ও। রিস্টওয়াচের চারিটা ঘুরিয়ে কান পাতল শহীদ। মৃদু কিরকির কিরকির ধ্বনি বের হতে শুরু করল হাতঘড়িট্টার ভিতর থেকে। দুর্ভাবনা দূর হল শহীদের। কামালের উইশুচীটারে যে পিনটা গেঁথে কুয়াশা-৩০
১২৩
দিয়েছিল শহীদ, সেটা কাছাকাছি কোথাও থাকলেই শুধু এই ধ্বনি ট্রান্সমিট হওয়া সম্ভব। বাগান থেকে বেরিয়ে স্বল্পালোকিত রাস্তায় নেমে এল শহীদ। যান্ত্রিক ধ্বনিটা দ্রুত এবং জোরাল হয়ে বের হচ্ছে এবার ঘড়ির ভিতর থেকে। তারমানে কামালের দিকেই এগিয়ে চলেছে শহীদ। রাস্তার চৌমাথায় গিয়ে পৌঁছুল ও। লোকজনের ছায়াও নেই কোনদিকে | বাঁ দিকে একটা মসজিদ। স্ট্রীট ল্যাম্পগুলো আলোকিত করে রেখেছে চারধার। শহীদের মাইক্রোট্রান্সমিটারটা আরও দ্রুত বেজে চলেছে। তারমানে কামাল আশপাশেই কোথাও আছে।
এদিক ওদিক তাকাল শহীদ। অকস্মাৎ ওর চোখ পড়ল মসজিদের উপর। বিমূঢ় হয়ে পড়ল ও মুহূর্তের জন্যে। মসজিদের চূড়ায় আটকে গেছে কামালের প্যারাশুট। কামাল অসহায় ভাবে ঝুলছে গম্বুজের গায়ে গা ঠেকিয়ে। হঠাৎ চমকে উঠল শহীদ। গাড়ির শব্দ আসছে। এত রাতে গাড়ি কিসের? এখানে আইন নেই, আদালত নেই-সুতরাং পুলিস বিভাগও নেই। আফগানিস্তান, চীন, ইরান থেকে বিতাড়িত হয়ে বা দেশত্যাগ করে শত শত নরনারী অব্যবহৃত ভূখণ্ডে আবাসভূমি গড়ে তুলেছে। চোরাচালানীর স্বর্গ এই অঞ্চল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের হাজার হাজার মূল্যবান জিনিসপত্র এখানে অবাধে কেনাবেচা হয়। কোন আইন নেই, কোন শৃংখলা নেই। এখানে জোর যার মুলুক তার।
বেশি কথা ভাবার সময় নেই শহীদের। দ্রুত লুকিয়ে পড়ল ও দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী নোংরা একটা গলিতে। গলিটা আলোকিত। সম্মুখের ল্যাম্পপোস্টে উঠে বাতির কাঁচ ভেঙে ফেলল শহীদ গ্লাভসপরা হাতের এক ঘুসিতে। ভুল হয়ে গেল। একটা। কাঁচ ভাঙার শব্দ হল বেশ একটু। দ্রুত নেমে পড়ল ও। গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না ঠিক, কিন্তু ও বুঝতে পারল, রাস্তায় ভাঙা কাঁচ পড়ার শব্দ গাড়ির আরোহীরা নিশ্চয় শুনেছে। গলিতে না ঢুকে দৌড়াতে শুরু করল ও। খানিকদূর। যেতেই আলোর বন্যা পিছন থেকে গ্রাস করল ওকে। পিছন ফিরে তাকিয়ে শহীদ দেখল একটা জীপ গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে মোড় নিয়ে ছুটে আসছে তার পিছন পিছন। দ্রুত মোড় ঘুরে চওড়া একটা রাস্তায় পৌঁছুল ও। রাস্তার একধারে বাড়িঘর। অন্যধারে খাল। খালের পাড়ে বড় বড় গাছ। কি গাছ দেখার সময় নেই হাতে। শহীদ দ্রুতবেগে উঠে পড়ল একটা গাছের উপর।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জীপ গাড়িটা গাছের নিচ দিয়ে নাকবরাবর ছুটে চলে গেল। শহীদ কালবিলম্ব না করে নেমে পড়ল রাস্তায়। তারপর ছুটল আবার চৌমাথার মসজিদের পানে। কামাল এখনও ঝুলছে অসহায়ভাবে গম্বুজের গায়ে গা লাগিয়ে।
* শহীদ মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। হাত পনেরো উঁচুতে ঝুলছে কামাল। কোমরের পকেট থেকে শক্ত দড়ি বের করল ও। ফাস তৈরি করল একটা। তারপর সেটা কৌশলে ছুঁড়ে দিল গম্বুজের দিকে। প্রথমবারের চেষ্টাতেই ১২৪
ভলিউম-১০
ফাসটা আটকে গেল গম্বুজের মাথায়। দড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল ও। প্যারাশুটটা আটকে গেছে প্যাঁচ খেয়ে। ছুরি বের করে কাটতে শুরু করল শহীদ। খানিকক্ষণ পরই প্যারাশুটটা গম্বুজ মুক্ত হল। ধীরে ধীরে ঢিলে করতে লাগল শহীদ প্যারাশুটটার দড়ি। ধীরে ধীরে মসজিদের দ্বিতলের বারান্দায় পা পৌঁছুল কামালের। কামাল খুলে ফেলতে লাগল বাঁধনগুলো। ইতিমধ্যে দড়ি বেয়ে নেমে এল শহীদ। একমিনিটের মধ্যেই রাস্তায় নেমে এল ওরা দুজন দ্রুতপায়ে। ওদের পিছনে একটা বাড়ি। বাড়ির বাইরে সামান্য একটু জায়গা নিয়ে ফুলের গাছ। অদূরেই মসজিদটা। কামাল হঠাৎ বলে উঠল, শহীদ! গাড়িটা আবার ফিরে আসছে!’
এদিক ওদিক তাকাল শহীদ। মসজিদটা দেখা যাচ্ছে। গম্বুজের মাথা থেকে এখনও ঝুলছে প্যারাশুটটা। কামাল দৌডুল। দৌডুবার শব্দে ঘুরে তাকিয়ে দেখল পিছন দিককার বাড়িটার সামনের বাগানে আত্মগোপন করছে কামাল। আপাতত আত্মগোপনের এটাই সর্বোত্তম স্থান। শহীদও নিচু বেড়ার দেয়াল টপকে প্রবেশ করল বাগানের ভিতর। পরের মুহূর্তেই রাস্তার চৌমাথায় দেখা গেল জীপ গাড়িটাকে। ফিরে এসেছে ওটা আবার। গাড়িটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা সরু গলির সামনে। এই গলিতেই প্রথমে আত্মগোপন করার কথা ভেবেছিল শহীদ প্রথমবার, যখন গাড়ির শব্দ শুনতে পায় ও। গলিটা থেকে ওরা এখন মাত্র তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাত দূরে রয়েছে। গাড়ির ভিতর থেকে উর্দু ভাষায় কে যেন কথা বলে উঠল। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, আশ্চর্য! স্ট্রীটল্যাম্পের কাঁচ ভেঙে ফেলেছে দেখছি!’ | জীপটা থেকে চারজন লোক নামল। ওদের প্রত্যেকের কোমরে পিস্তল ঝুলছে। বিরাট লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা চারজনের। টর্চ জ্বেলে রাস্তার এদিক ওদিক অনুসন্ধান চালাতে শুরু করল লোকগুলো। একজনের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল মসজিদের উপর দিকে। অমনি সে চিৎকার করে উঠল, ‘প্যারাশুট! আরে,
একি! সাবধান, ছত্রী গুপ্তচর নেমেছে!’, দ্বিতীয় একজন বলে উঠল, “এই, সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করে দাও। হয়ত একজনই নামেনি, ওরা কয়েকজনও হতে পারে। শহরের বাইরে যাতে কোনভাবেই যেতে না পারে তার ব্যবস্থা কর। পেট্রল কারগুলোতে খবর পাঠাও, সব রাস্তা ব্লক করে দিতে বল।
লোকগুলোর কথাবার্তা শুনতে শুনতে শক্ত-কঠিন হয়ে উঠল শহীদ ও কামালের মুখাবয়ব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ওদের। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মেম্বার সরফরাজ খানের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে ওরা এসেছে। শহরে আটকে গেলে ধরা পড়ে যাবে
ওরা।
চারজন লোক দ্রুতপায়ে মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। উপর পানে কুয়াশা-৩০
১২৫
তাকিয়ে গম্বুজের সাথে জড়ানো প্যারাশুটটা পর্যবেক্ষণ করছে ওরা জীপ গাড়ির দিকে পিছন ফিরে।
শহীদ আচমকা নিঃশব্দে লাফ দিয়ে বাগানের বেড়া টপকে অনুচ্চ স্বরে বলে উঠল, আয়, কামাল!’
| জুতো আগেই খুলে ফেলেছিল ওরা দৌডুবার সময়। শুধু মোজা পায়ে রয়েছে বলে ওদের দৌডুবার শব্দ লোক চারজন শুনতে পেল না। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে
জীপ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে লাফ দিয়ে চড়ে বসল শহী!! পরমুহূর্তে ওর পাশে * দেখা গেল কামালকে। গাড়ি ছেড়ে দিল শহীদ। অকস্মাৎ গাড়িটা সশব্দে চলতে
শুরু করে দিয়েছে দেখে চারজন লোকই বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্জন করে। উঠল। পাঁচ সেকেণ্ড পরই গাড়ির পিছন পিছন দৌড়তে শুরু করল ওরা। এবং কোমর থেকে পিস্তল বের করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগল । কিন্তু শহীদ তখন জীপ নিয়ে নিরাপদ দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
দুটো মোড় নিতেই কামাল সামনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রায়, সামনে বন্ধ! সামনে রাস্তা বন্ধ!
শহীদ উত্তর দিল না। কেবল শক্ত হয়ে উঠল ওর মুখমণ্ডল। একটা সুইচ অন করল ও। সামনের বামপার থেকে বেজে উঠল সাইরেন। রাস্তা ব্লক করে যে জীপ গাড়িটা আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়েছিল সেটা মুহূর্তের মধ্যে রাস্তার একপাশে সরে গেল। বিদ্যুৎবেগে গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। শহীদকে চিন্তিত দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে। আধুনিক রেডিও ফিট করা এই জীপগুলো কাদের? কারা টহল দিয়ে ফিরছে এই সরকারবিহীন শহরে? তবে কি ধীরে ধীরে প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং অর্থশালী কোন অপরাধী দল গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলে? | ফাঁকা রাস্তা পাওয়াতে শহর থেকে বেরিয়ে আসতে দেরি হল না ওদের। কিন্তু দুজন গুপ্তচর জীপ গাড়ি করে পালাচ্ছে এ খবর শত্রুপক্ষের পেট্রল কারগুলোয় পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?
| সকাল হয়ে আসছে। কতদূর আর?’ কামাল বলে উঠল।
পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে চলেছে গাড়ি। প্রভাত রশি পুব দিগন্তে ফুটতে শুরু করছে। মোড় নিল শহীদ। পরমুহূর্তে ব্রেক কষল ও আচমকা। অদূরবর্তী পরের মোড়েই রাস্তা ব্লক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পেট্রল কার। বনেটের উপর, ওদের দিকে মুখ করে, একটা রাইফেল তাক করা। শহীদ চিৎকার করে উঠল, ‘নেমে পড়!’
পরমুহূর্তে রাইফেলের গর্জনে পাহাড়ী এলাকার নিস্তব্ধতা চুরমার হয়ে গেল। কামালের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল পর পর দুটো বুলেট। লাফ দিয়ে নেমে পড়ে রাস্তা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী ঝোঁপগুলোর আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজন। শক্ত, ঢালু পাথুরে জমির উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটেছে ওরা উপরপানে। পিছনে পদশব্দ
১২৬
ভলিউম-১০
হচ্ছে। ধাওয়া করছে শত্রুপক্ষ।
ধাতব কোন বস্তুর সংঘর্ষজনিত শব্দ কানে ঢুকল শহীদের। বহু উপর থেকে এল শব্দটা। সেদিকপানেই ছুটল শহীদ। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ও দেখল উপর দিকে একটা রোপওয়ে। স্থানে স্থানে কাঠের পোস্ট আর পাথরের স্তূপ, মজবুত তারের সরলরেখা দেখা যাচ্ছে, ক্রমশ দুরবর্তী পাহাড়ের বাকে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে সব। শহীদ ক্ষুদ্র একটা কম্পাস বের করে দিক নির্ণয় করে নিয়ে বলল, ওই রোপওয়ে সোজা চলে গেছে সরফরাজের কেবিন ছাড়িয়ে।’
| প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে রোপওয়ের নিচে একটা স্টীলের খাম্বার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। রোপওয়েকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে অসংখ্য স্টীলের খাম্বার সাথে যুক্ত মজবুত তার। শহীদ খাম্বা ধরে উঠতে শুরু করল উপর দিকে। কামাল অনুসরণ করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারগুলো ছাড়িয়ে গেল ওরা। শহীদ দেখল একটা বক্স প্রায় কাছে এসে পড়েছে। বক্সটা খালি। কিন্তু বক্সের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। ছাদে চড়লে ভারসাম্য রক্ষা করা মুশকিল। ও বলল, ওটা নাগালের · মধ্যে এলেই ডানদিক ঘেঁষে ধরে ফেলবিকামাল, আমি বাঁ দিকটা ধরে ঝুলব।
•••রেডি!’
একই সঙ্গে নুয়ে পড়ল দুজন। সাফল্যের সঙ্গে বক্সের মাথার দুদিকের রেলিং ধরে ফেলল ওরা। রোপওয়ে নিজস্ব গতিতে গাছপালা, পাহাড়ী খাদ, ঝোঁপ-ঝাড় ইত্যাদির উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে। ক্রমশ গাছপালার সংখ্যা কমে আসতে লাগল। খানিকপরই দৃষ্টিগোচর হল সরু একটা পাহাড়ী পথ। শহীদ হঠাৎ সাবধান করে দিয়ে বলল কামালকে, রাস্তার উপর মটরসাইকেল আর সাইডকার দেখা যাচ্ছে, কামাল! মেশিনগান ওদের হাতে! সাবধান, শত্রুপক্ষ ওরা!’
মটরসাইকেল সাইডকারের দিকে সোজা রোপওয়ে এগিয়ে চলল। শত্রুপক্ষ মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছুতেই সাইডকারের চালক মুখ তুলে তাকাল উপরদিকে। শিউরে উঠল শহীদ এবং কামাল। লোকটা বিনকিউলার, লাগিয়ে ওদেরকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করছে। এক-এক করে পাঁচ সেকেণ্ড কাটল। বিনকিউলার নামিয়ে লোকটা হাত দিল মেশিনগানে। পরমুহূর্তে ঠা ঠা ঠা। শব্দ উঠল মেশিনগানের। কিন্তু স্টার্ট দেয়া মটরসাইকেলের উপর বসে লক্ষ্য স্থির রাখতে পারল না লোকটা। গুলিগুলো ওদের দুজনার পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। সামনেই একটা স্টীলের খাম্বা। শহীদ ইঙ্গিত করল কামালকে। রোপওয়ে এগিয়ে চলেছে। শত্রুপক্ষের মাথার উপর পৌঁছুনো মানে নির্ঘাৎ মৃত্যু। খাম্বাটা নাগালের মধ্যে আসতেই ঝাঁপ দিয়ে ধরে ফেলল ওরা সেটাকে। পিছন ফিরে তাকাল শহীদ। পিছন দিক দিয়ে এবার কোন বক্স আসছে না, আসছে অসংখ্য বার্শ। কামালকে ইঙ্গিত করে খাম্বার আরও খানিক উপরে উঠে গেল শহীদ। ওদের দুজনার সামনেই স্টীলের খাম্বাটা দেয়ালের কাজ দিচ্ছে । গুলি আসছে বৃষ্টির ফোঁটার মত। কিন্তু কুয়াশা-৩০
১২৭
ওদের দুহাত তফাৎ দিয়ে চলে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
অবশেষে বাঁশগুলো নাগালের মধ্যে এসে পড়ল। বাঁশগুলো বাঁধা রয়েছে রোপওয়ের তারে। সঙ্গে লোহার আঙটা দিয়ে। আঙটায় একটা তালা ঝুলছে। খাম্বা থেকে নুয়ে পড়ে লোহার চওড়া আঙটার মাথার উপর উঠে দাঁড়াল ওরা। পায়ের নিচে বাঁশ। শত্রুপক্ষের মাথার উপর দিয়ে যাবার সময় বিপদের আশঙ্কা এখন অল্প। কিন্তু খানিকদূর এগোবার পরই দৃষ্টির বাইরে আর লুকিয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যা করার তা আগেই করতে হবে। ইতিমধ্যে একাধিক শত্ৰু গুলি ছুঁড়ছে। উন্মত্তের মত।
ঘাম ফুটে উঠেছে শহীদের কপালে। লোহার চওড়া আঙটার উপর বসে পড়ল ও। কামাল ওর কাঁধে ভর দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করল। লোহার আঙটার নিচে তালার মুখে হাত দিয়ে তালাটা দেখে নিল শহীদ। কয়েক সেকেণ্ডের, মধ্যেই শত্রুপক্ষের মাথার উপর পৌঁছে গেল রোপওয়ে। যে ক্ষুদ্র শিকলে তালাটা
ঝুলছে তার উপর দেহের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রচণ্ড ঘুসি মারল শহীদ। হাতের। ব্যথায় মাথাটা ঘুরে উঠল শহীদের। কয়েক সেকেণ্ড চোখ বন্ধ করে বসে রইল ও। তারপর শোনা গেল শব্দ। তালা খুলে যেতেই লোহারবেস্টনীর মুখ খুলে গিয়ে শত শত বাশ সশব্দে উপর থেকে পড়তে লাগল রাস্তার উপর। চোখ মেলে তাকাল শহীদ। শত্রুপক্ষের দুজন লোকই বাশের ধাক্কা খেয়ে রাস্তার উপর গড়িয়ে। পড়েছে। কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেল না তাদের। বাঁশগুলো উল্টে দিয়েছে সাইডকারটাকেও। পরবর্তী স্টীলের খাম্বা ধরে রোপওয়ে ছেড়ে নিচে নেমে এল ওরা। রাস্তা ধরে ছুটল। সাইডকারের কাছে পৌঁছে গেল ওরা কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই। দুজনে মিলে সাইডকারটাকে দাঁড় করাল। এঞ্জিন চলছে এখনও। আহত লোক দুজনার মধ্যে একজন মাথা ঘষছে রাস্তার কাকরের উপর। মোটরসাইকেলে চেপে বসল শহীদ। কামাল বসল পাশে। ছুটিয়ে নিয়ে চলল শহীদ সাইড কারটাকে। কামালের উদ্দেশ্যে ও বলল, এই পাহাড়ী পথটাই সরফরাজের কেবিন ছুঁয়ে গেছে।’ সাইডকারের গর্জনকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠে কামাল বলল, বলা যায়
সে কেবিনে আছে কিনা। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে যে খবর তাকে দেয়া হয়েছে তাতে সে জানে গতরাতে পৌঁছুব আমরা তার কাছে।’
| কামাল তীক্ষ্ণ চোখে পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সাইডকারের মেশিনগানে হাত ওর। সদা প্রস্তুত। ওরা বুঝতে পারছে ইতিমধ্যে পাহাড়ী অঞ্চলের প্রতিটি শত্রুপক্ষীয় অনুচর খবর পেয়ে গেছে দুজন পাকিস্তানী গুপ্তচর ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। পায়ে চলা এবড়োখেবড়ো একটা সরু পথের মুখে মোটরসাইকেল দাঁড় করাল শহীদ। এদিক ওদিক দেখে নিল ও। তারপর সেই পথ দিয়ে চলল গাড়ি চালিয়ে। খানিকদূর যেতেই ওরা দেখল পথটা ক্রমশ উপর দিকে উঠে গেছে।
১২৮
ভলিউম-১০
ক্রমশ পাহাড়ের উপর উঠল ওরা। তারপর নামতে শুরু করল আবার। নিচে নেমে একটা ঝোঁপের আড়ালে সাইডকারটাকে রেখে গাছপালার ভিতর দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল ওরা। খানিকদূর এসে থমকে দাঁড়াল শহীদ। গাছের ফাঁক দিয়ে অদূরেই দেখা যাচ্ছে একটা কেবিন ঘর। সন্ধানী চোখে খানিকক্ষণ দেখল ওরা কেবিনটাকে। কেবিনের বাইরে একজন লোক অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। ঘন ঘন তাকাচ্ছে সে রাস্তার দিকে। শহীদ কামালের উদ্দেশ্যে বলল, ঠিক আছে। ও-ই আমাদের লোক-সরফরাজ খান। আমরা আসছি কিনা দেখছে
গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওরা। হাত তুলে তিনটে আঙুল দেখাল শহীদ। সরফরাজ খান উত্তরে পাঁচটা আঙুল দেখাল। এবার শহীদের একটা আঙুল দেখাবার কথা–তাহলেই ওদেরকে নিজেদের লোক বলে চিনে নিতে পারবে সরফরাজ খান। আঙুল দেখাল শহীদ। সরফরাজ খান ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, ব্যাপার কি! বড় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। আপনাদের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়। গত তিনবারে আমাদের তিনজন লোক ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ
করেছে, আশঙ্কা করছিলাম আপনাদের ভাগ্যেও তাই ঘটেছে, স্যার।’
শহীদ প্রশ্ন করল, কিন্তু আপনার কাছ থেকে ব্রাঞ্চ, কোন খবর পায়নি কেন? আমাদের তিনজন লোক যে নিহত হয়েছে এখবর ব্রাঞ্চের কেউ এখনও জানে না, অথচ আপনি জেনেও খবর পাঠাননি-কারণ?
সরফরাজ খান ব্যাখ্যা করে বলল, ব্রাঞ্চ থেকে প্রতিদিন প্রতিটি খবর পেয়ে আসছি আমি, স্যার! সব খবরই আমি রিসিভ করেছি। ব্রাঞ্চ যে তিনজন লোককে ‘ননা ম্যানস ল্যান্ডে পাঠিয়েছে তাদের খবর চাওয়া হচ্ছে আমার কাছ থেকে, তা-ও শুনেছি বইকি। কিন্তু খবর রিসিভ করেও উত্তর দিতে পারিনি। কেননা, আমার চেয়ে শক্তিশালী ট্রান্সমিটার যন্ত্র শত্রুপক্ষের কাছে রয়েছে। আমি খবর পাঠালেই আমার অবস্থান প্রকাশ হয়ে পড়ত, স্যার।’
শহীদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে বলে উঠল, সেক্ষেত্রে ঠিকই করেছেন আপনি খবর না পাঠিয়ে।’
| সরফরাজ খান জানতে চাইল, আপনাদের গতরাতে পৌঁছুবার কথা। রাস্তায় বিপদ-আপদ দেখা দিয়েছিল নাকি?’
শহীদ যা যা ঘটেছে বলে গেল সব। শুনতে শুনতে সরফরাজ খানের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে উঠল। শহীদের কথা শেষ হতেই গম্ভীর গলায় সে বলল, তাহলে ই আলী পিছনে লেগেছিল আপনাদের। এই ই-আলীই আমাদের শত্রু। “ননা ম্যানস ল্যাণ্ডের সর্বত্র এই ভয়ঙ্কর শয়তান তার প্রভাব বিস্তার করেছে। লোকটা আসলে একজন ইহুদি। কিন্তু ছদ্মনাম নিয়ে এলাহি কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে সে। বিদেশী একটা ক্ষমতাবান ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সাহায্য করছে ওকে সবরকমে। তাতেই ই
৯-কুয়াশা-৩০
১২৯
আলী ভয়ানক উদ্ধত এবং নির্মম হয়ে উঠেছে। “ননা ম্যানস ল্যাণ্ডের প্রতিটি অধিবাসী তার শক্তির আওতায়। রীতিমত আধা-সেনাবাহিনী গড়ে তুলছে সে এ অঞ্চলে। | শহীদ অস্ফুটে বলল, ‘পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে? কিন্তু “নো ম্যানস ল্যাণ্ডের চতুর্দিকে ব্যারিকেড তৈরি করছে কেন? বিদেশী টুরিস্টদেরকেই বা ভাগিয়ে দিচ্ছে কেন? উদ্দেশ্য কি তার, খান? সব কথা জেনে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যেই এসেছি আমরা।’ | প্রাক্তন এয়ারফোর্স পাইলট এবং বর্তমানের সিক্রেট এজেন্ট সরফরাজ খান শহীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “অসাধারণ এবং ভীতিপ্রদ উচ্চাশা ই-আলীর। শুধু মাত্র “নো ম্যানস ল্যাণ্ডের অধিকর্তা হবার প্ল্যান নিয়ে আসেনি সে, তার আশা
পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড থেকে যতটা সম্ভব জায়গা দখল করে ছোটখাট একটা রাষ্ট্রের অধিনায়ক হওয়া। বিদেশী প্রভুরা তাকে এই অদ্ভুত ষড়যন্ত্রে উৎসাহিত করে তুলেছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই ই-আলী গুপ্তচর পাঠিয়েছে। এর কারণ…।’
হঠাৎ থেমে গিয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করল সরফরাজ। তারপর বলল, মনে হচ্ছে পাহাড়ের দিক থেকে শব্দ আসছে যেন!’
কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল সরফরাজ। শহীদ ও কামালও তার সঙ্গে বাইরে বের হয়ে এল। খানিকক্ষণ কান পেতে শোনার পর ও বলে উঠল, ই, ব্যাপার কিছু একটা ঘটছে। বিশেষ একটা খবর সংগ্রহ করেছি আমি, স্যার। ই-আলী তার সকল গুপ্তচরকে ডেকে পাঠিয়েছে গোপন বেতারে খবর পাঠিয়ে। নো ম্যানস ল্যাণ্ডের এয়ারপোর্টে আজ যে-কোন সময় সকলে ল্যাণ্ড করবে। আগামীকাল গুপ্তবৈঠকের ব্যবস্থা করেছে ই-আলী তার অনুচরদেরকে নিয়ে। এই গোপন বৈঠকে সে বিশেষ নির্দেশ দেবে তার এজেন্টদেরকে।’
চরম উত্তেজিত কণ্ঠে শহীদ প্রশ্ন করল, “কি রকম নির্দেশ দেবে ই-আলী? আর কোথায় বসবে এই গুপ্ত-বৈঠক?’
আমি জানি কোথায় মিলিত হবে ওরা, স্যার । গুপ্ত বৈঠক বসবে!’
অকস্মাৎ থেমে গেল সরফরাজ খান। নুয়ে পড়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ইতিমধ্যে কেবিনের ভিতর ফিরে এসেছিল ওরা। শহীদও সরফরাজের দেখাদেখি জানালা পথে তাকাল। অকস্মাৎ ক্রমশ উচ্চকিত এবং গতিসম্পন্ন একটা বাতাস-চেরা শব্দ শুনতে পেল ও। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল মালভূমির কোথাও কিছু বিস্ফোরিত হবার ফলে। শহীদ ধাক্কা মারল সবেগে কামালকে। কামাল পড়ে গেল মাটিতে। সরফরাজকে ধাক্কা দেবার আগেই সে শুয়ে পড়ল। ওদের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে সরে গিয়ে। শহীদ নিজেও কেবিনের মেঝেতে শুয়ে পড়ল হাত দিয়ে মাথা ঢেকে । | দ্বিতীয়বারও সেই একই ধরনের শব্দ শোনা গেল। কয়েক সেকেণ্ড পরই প্রচণ্ড
ভলিউম-১০
বেগে নড়ে উঠল কেবিনঘটা। শহীদ গাছের আড়াল দিয়ে যে বস্তুটাকে প্রথমে ছুটে আসতে দেখেছিল সেটা যে একটা মর্টারব তা ওর বুঝতে দেরি হয়নি। দ্বিতীয় মর্টার বম্বটা সোজা উড়ে এসে আঘাত হেনেছে কেবিনের মাথায়। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে গেল শহীদের। দশ সেকেণ্ড পর মাথা তুলে তাকাল। কামালকে মাথা ঝাড়তে দেখল ও ঘনঘন । উঠে দাঁড়াল শহীদ। কেবিনের ছাদের একটা অংশ উড়ে গেছে। বাঁশের ছাদ ধসে পড়েছে সরফরাজ খানের মাথায়। নুয়ে পড়ে নিঃসাড় শরীরটা দেখল শহীদ সরফরাজের। কামাল ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। সরফরাজকে পরীক্ষা করে শহীদ নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, জ্ঞান হারিয়েছে সরফরাজ। কয়েক ঘন্টা লাগতে পারে ওর জ্ঞান ফিরে পেতে, কয়েকদিন লাগলেও আশ্চর্য হব না–আঘাত সামান্য নয়। এদিকে ও যে গুপ্ত-বৈঠকের কথা বলেছিল তা আগামীকাল হতে যাচ্ছে।’
কথাগুলো বলতে বলতে সদ্যভাঙা দরজার কাছে গিয়ে চিন্তিতভাবে এদিক ওদিক তাকাল শহীদ। তারপর প্রসঙ্গ বদলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে! ই-আলীর অনুচররা মালভূমির আরও কাছে সরে আসছে মর্টারকম মেরে কেবিনটাকে ধুলোয় পরিণত করার জন্যে। ওরা হত্যা করতে আসছে, কামাল!
শত্রুরা মালভূমির নিচে। ভেঙে পড়া দরজাটা ওদেরকে আড়াল করে রেখেছে শত্রুপক্ষের দৃষ্টিপথ থেকে। বিধ্বস্ত প্রায় কেবিনের পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ক্রমশ-উচ্চ বনভূমির দিকে তাকাল ও। তারপর হাঁটুর নিচে বাঁধা একটা নাইলনের কেস বের করল দ্রুত হাতে। ধাতব পদার্থ মিশ্রিত একটা টিউব এবং কমপ্রেশড এয়ার সিলিণ্ডার দুটো ফিট করল ও কেসটা থেকে বের করে। সিলিণ্ডারের মাথায় একটা পিন গেঁথে দিল ও এবার। তারপর সতর্কভাবে লক্ষ্যস্থির। করে শহীদ নিরুদ্ধ বায়ু ছেড়ে দিল। বায়ুর প্রচণ্ড চাপে পিনটা অসম্ভব বেগে ছুটে । চলে গেল বনভূমির দিকে।
কামাল শহীদের পাশে এসে দাঁড়াল। | শহীদ একটা ফাউন্টেনপেন বের করে ঠোঁটের কাছে ধরল । কামাল দেখল শহীদ কলমটার মাথার কাছে ঠোঁট ঠেকিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলে চলেছে। ও জানে কলমটা একটা শক্তিশালী মাইক্রো-ট্রান্সমিটার। শহীদ মৃদুস্বরে কলমটার কাছে ঠোঁট নামিয়ে যা বলল হুবহু সেই কথাগুলোই অসম্ভব উচ্চ কণ্ঠে শোনা গেল। বনভূমির দিকে নিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্রাকৃতি পিনটা থেকে ট্রান্সমিট হচ্ছে, প্রাণপণে দৌড়া, কামাল! এই বনভূমি ধরেই পালাতে হবে আমাদেরকে! ওরা ততক্ষণ কেবিনটায় কুয়াশা-৩০
১৩১
খোঁজাখুঁজি করুক আমাদেরকে আমরা ইতিমধ্যে পগার পার হয়ে যাই! ‘ কথাগুলো শহীদ বিশুদ্ধ উর্দুতে উচ্চারণ করল। শত্রুপক্ষ নিঃসন্দেহে শুনেছে কথাগুলো। শহীদের চালাকী ধরা না পড়লে শত্রুপক্ষ কেবিনের নিচ দিয়ে বনভূমির দিকে ছুটবে ওদেরকে ধরার জন্যে।
ঠিক তাই হল। কথাগুলো শুনে শত্রুপক্ষ মনে করল শহীদরা পালাচ্ছে বনভূমির ভিতর দিয়ে। তারা কেবিনের দিকে না এসে নিচে দিয়েই ছুটে চলে গেল জঙ্গলের দিকে। কেবিনের ভিতর শহীদ ও কামাল তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে চরম উত্তেজনায় শ্বাস বন্ধ করে।
শত্রুরা সকলে বনভূমির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে শহীদ দ্রুত সরফরাজ খানের অচেতন দেহটা নিজের কাঁধে তুলে নিল। প্রায় ছুটতে লাগল ওরা কেবিন থেকে বের হয়ে এসে। মিনিট পাঁচেক পরই ওরা পৌঁছে গেল লুকিয়ে রেখে যাওয়া সাইডকারের কাছে।
. সাইডকারে সরফরাজ খানকে তুলে ওরাও চেপে বসল। শহীদ বলল, সরফরাজকে এই মুহূর্তে ডাক্তার দেখানো দরকার। বিপদের আশঙ্কা রয়েছে, তবু শহরে ঢুকতে হবে আমাদেরকে। আসার সময় হাসপাতালের সাইনবোর্ড দেখে এসেছি আমি।’
হাসপাতালের সাইনবোর্ড! এখানে হাসপাতাল এল কোথা থেকে?’
শহীদ বলল, ই-আলী এই অঞ্চলের জনসাধারণের মন জয় করার জন্যে বেশ কিছুদিন আগে একটা হাসপাতাল তৈরি করেছে। তখন সে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেনি। ই-আলী তখন দানশীল জনদরদী হিসেবে পরিচিত ছিল। শুধু হাসপাতালই নয়, ফোন, ইলেকট্রিসিটি, আধুনিক যানবাহন-এসবের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সে।’
সাইডকার প্রচণ্ডবেগে ছুটে চলেছে। কামাল মেশিনগানের উপর হাত রেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। শহরে প্রবেশ করল ওরা। কেউ কোনরকম বাধা সৃষ্টি করল না। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকল সাইডকার। শহীদ বারান্দার সামনে গিয়ে স্টার্ট বন্ধ করল।
স্ট্রেচারে করে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হল সরফরাজ খানকে। একজন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার পরীক্ষা করল তাকে। রূম থেকে বেরিয়ে শহীদের প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার বলল, মারাত্মক কিছু নয়। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লাগবে কয়েকদিন। তাছাড়া ঠিক কখন যে জ্ঞান ফিরবে তা-ও নিশ্চয় করে বলা যাচ্ছে
। দুদিনও লাগতে পারে।’ ., ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে শহীদ কামালকে বলল, সরফরাজের জ্ঞান ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরকে ই-আলী আগামী কাল কোথায় তার গোপন বৈঠক শুরু
ভলিউম-১০
করতে যাচ্ছে।’
কামাল বলল, আমাদের দুর্ভাগ্য, সরফরাজ বলতে যাচ্ছিল কোথায় বসবে এ গোপন-বৈঠক, ঠিক এমন সময় শত্রুরা আক্রমণ চালিয়ে বসল।
শহীদের মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ।ও বলল, একটা কথা! সরফরাজ বলেছিল ই-আলীর এজেন্টরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করবে। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের কাজ শুরু করা যেতে পারে, কামাল। ই-আলী অনুচরদেরকে অনুসরণ করতে পারলে গোপন-বৈঠকের ঠিকানা জানা যাবে সহজেই।
শহীদের কথা শেষ হতে কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিল। শহীদ হঠাৎ চাপা কণ্ঠে সাবধান করে দিল ওকে, চুপ!
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল ওরা দুজন। কামাল ভেবে বিস্মিত হল সাইডকার না নিয়ে শহীদ কেন বাইরে বের হয়ে এল। নিশ্চয় কোন কারণ আছে, কামাল ভাল।
শহীদ রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাতঘড়িটা উঁচু করে ধরল । ঘড়ির সঙ্গে ফিট করা রয়েছে ছোট্ট একটা আয়না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা নামিয়ে নিল শহীদ। কামালকে ও মৃদুস্বরে বলল, কামাল! যা ভেবেছিলাম তাই। হাসাপাতাল থেকেই একজন লোক অনুসরণ করছে আমাদেরকে। কামাল, সামনের মোড়ের কাছে গিয়ে আমাদের ধোকা-বোকা” কৌশলটা শুরু করতে হবে।’ | কামালের ঠোঁটে অস্পষ্ট একটু হাসির রেখা দেখা গেল। মাথা নেড়ে সায় দিল ও।
খানিক পরই মোড় ঘুরল ওরা। মোড় ঘুরেই শহীদ একটা বাড়ির দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। কামাল আগের মতই হেঁটে চলল। একজন লোকের পিছনে হাঁটছে ও। পিছন থেকে মনে হবে কামাল শহীদের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে। মোেড় ঘুরে অনুসরণকারী এতটুকু সন্দেহ করবে না যে শহীদ অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘ তাই-ই হল। অনুসরণকারী লোকটা মোড় ঘুরে কামালকে অনুসরণ করে। চলল। কামাল তখনও তার সামনের পথিকের পিছু পিছু হাঁটছে, যেন কথা বলছে
সে মাথা নেড়ে নেড়ে।
শহীদকে ছাড়িয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল অনুসরণকারী। এদিকে কামাল একটা পাবলিক বুঁদ ছাড়িয়ে গেছে। অনুসরণকারী তাকে বিনা সন্দেহে অনুসরণ করে চলেছে। শহীদ পাবলিক বুদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত প্রবেশ করল বুদে। ক্রাডলের নিচে পয়সা ফেলবার ছিদ্রে ধাতুর তৈরি একটা গোল চাকতি ফেলল শহীদ। ফোন করল না কোথাও। পরমুহূর্তে পাবলিক বুঁদ থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। এদিকে সে বুঁদ থেকে বেরিয়ে কুয়াশা-৩০
১৩৩
আসতেই কামাল, হঠাৎ পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগল । কামালকে দেখে অনুসরণকারী লোকটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেল। বোকার মত তাকিয়ে রইল সে কামাতে দিকে। তাকে যে বোকা বানানো হয়েছে তা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পা চালাল সে। পাবলিক বুদের কাছে এসে পড়ল দ্রুত পায়ে। বুদের ভিতর ঢুকে রিসিভার তুলে নিয়ে। ডায়াল করে সে বলল, ‘পাঁচ নাম্বার চাবি বলছি। খানিকক্ষণ আগে একজন আহত লোককে একটা সাইডকারে করে নিয়ে এসে দুজন লোক হাসপাতালে রেখে গেছে। তোক দুজনকে ফলো করছিলাম আমি। একজন ধোকা দিয়ে সটকে পড়েছে। অন্যজন তাকে খুঁজছে। আমার সন্দেহ, প্যারাশুটে করে যে দুজন স্পাই ল্যাণ্ড করেছে এরা।’
শহীদ বুথের ভিতর যে ধাতব চাকতিটা রেখে এসেছে তা থেকে ট্রান্সমিট হচ্ছে লোকটার প্রতিটি কথা শহীদের হাতঘড়িতে। হাতঘড়িটা কানের কাছে ধরে লোকটার কথাগুলো শুনল শহীদ। সব কথা শোনার ধৈর্য হল না ওর। কামাল ইতিমধ্যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ও বলল, হাসপাতাল থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি আমরা, কামাল। ই-আলীর লোক সরফরাজ খানকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে পালাবে । ওকে বাঁচাতে হলে তার আগেই পৌঁছুতে হবে আমাদেরকে। সরফরাজ ধরা পড়া মানেই ওর মৃত্যু অবধারিত।
. রাস্তায় বেশ ভিড় যানবাহনের। কিন্তু কোন্টা কোনদিকে যাবে কে জানে! লোকজনের পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলল ওরা হাসপাতালের দিকে।
মিনিট সাতেক লাগল ওদের হাসপাতালের ভিতর এসে পৌঁছুতে। গাড়ি বারান্দায় একটা অ্যাম্বুলেন্সকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কামাল চাপা কণ্ঠে বলল,
ই-আলী দেখছি সময় নষ্ট করেনি!
| শহীদ বলল, যদি এই অ্যাম্বুলেন্সটা সরফরাজকেই নিতে এসে থাকে, তাহলে ঠিকই বলেছিস তুই।’
অ্যাম্বুলেন্সের পিছনের দরজাটা খোলা। ভিতরে কেউ নেই। রিশেপশন ডেকে জিজ্ঞেস করে শহীদ জানতে পারল সরফরাজকে রাখা হয়েছে টপ-ফ্লোরের প্রাইভেট ওয়ার্ডে। ক্লার্কটা আরও জানাল যে সরফরাজকে অন্য এক হাসপাতালে বদলি করা হচ্ছে। শহীদ লিফটের দিকে দ্রুত এগোল। কামাল পিছু নিল ওর। দুটো লিফটের একটা উপরে গেছে। দ্বিতীয়টায় ঢুকল ওরা। উপরে উঠে প্রাইভেট ওয়ার্ডের কেবিনগুলোয় উঁকি মেরে দেখতে শুরু করল ওরা। হাতের কাছে নার্স বা ডাক্তার কাউকেই পাওয়া গেল না। কেবিনগুলো পরীক্ষা করে বিচলিত হয়ে উঠল শহীদ। কোন কেবিনেই সরফরাজ নেই। হঠাৎ শহীদের মনে পড়ে গেল একটা কথা। ওরা যখন লিফট নিয়ে উপরে উঠছিল তখন উপর থেকে নামছিল প্রথম লিফটা।
দ্রুত করিডরের রেলিঙের কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকাল শহীদ। চমকে
ভলিউম-১০
১৩৪
উঠল ও। সরফরাজ খানকে স্ট্রেচারে করে ওঠানো হচ্ছে অপেক্ষারত অ্যাম্বুলেন্সে। ছুটতে শুরু করল শহীদ। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে পড়িমরি করে নামতে লাগল ও পাঁচতলা থেকে। লিফট দুটোই নিচে চলে গেছে।
| পাঁচতলা থেকে দোতলায় নামতেই অ্যাম্বুলেন্সের স্টাট দেবার শব্দ কানে ঢুকল। শহীদের । নিচে নেমে গাড়িটাকে আটকানো যাবে না তা ও বুঝতে পারল। অথচ সরফরাজকে এই মুহূর্তে মুক্ত করতে না পারলে চিরজীবনের জন্যে ছেড়ে দিতে হবে ওকে জীবিত ফিরে পাবার আশা। বারান্দার রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়ল শহীদ লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে। অ্যাম্বুলেন্স মৃদু গতিতে চলতে শুরু করেছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শহীদ। পিছন না ফিরেই কামালের উদ্দেশ্যে আয়’ বলে রেলিং টপকে হাত খানেক চওড়া কার্নিসে লাফিয়ে পড়ল ও। কামালও অনুসরণ করল ওকে। পরমুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সটাকে দেখা গেল ওদের নিচে, মাত্র দুহাত নিচে অ্যাম্বুলেন্সের ছাদ। বিপদকে অগ্রাহ্য করে আবার লাফ দিল শহীদ। পরমুহূর্তে কামালও লাফ দিল। দুজনই সময় মত পড়ল অ্যাম্বুলেন্সের মসৃণ ছাদে। গড়িয়ে পড়া থেকে কোনমতে নিজেদের রক্ষা করল শহীদ ও কামাল। গাড়িটা তখন হাসপাতালের গেটের বাইরে বের হয়ে সবেগে ছুটে চলেছে। পিছন থেকে শোনা যাচ্ছে’হৈ-হৈ শব্দ। কিছু লোক অ্যাম্বুলেন্সের ছাদে ওদেরকে দেখতে পেয়ে। তুমুলভাবে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু ড্রাইভার খেয়াল দিল না সেদিকে। শহীদ ও কামাল গাড়ির ছাদের উপর লাফিয়ে পড়াতে যে শব্দটুকু হয়েছিল তা ঢাকা পড়ে গেছে সাইরেনের তীক্ষ্ণশব্দে। সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে তীর বেগে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। কামাল ছিটকে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে শক্ত করে ধরে আছে শহীদের একটা হাত। শহর ত্যাগ করে পাহাড়ী এলাকার নির্জন রাস্তায় গিয়ে পড়ল অ্যাম্বুলেন্স। খানিকদূর যেতেই রাস্তার দুপাশে গভীর খাদ দেখা গেল। গতি কম হয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সের। ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপর উঠছে গাড়ি। হঠাৎ চাপা কণ্ঠ শোনা গেল শহীদের, দেখ!’
সামনেই একটা ড্র-ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। ব্রিজের ওপারে বৃহদাকার এবং সুউচ্চ একটি প্রাচীন দুর্গ। দুর্গের প্রবেশ পথে সশস্ত্র সেন্ট্রিরা পাহারা দিচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে যাচ্ছে ড্র-ব্রিজের দিকে। | লাফ মেরে গাড়ির ছাদ থেকে নেমে পড়ল শহীদ রাস্তার ধারে। একই সঙ্গে কামালও নামল। শহীদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, দুৰ্গটা নিশ্চয়ই ই-আলীর আস্তানা। শয়তানটা যে কী ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ প্রতি পদে পাচ্ছি। সারা পৃথিবী থেকে ই-আলীর যে এজেন্টরা আসছে তারা নিশ্চয় এখানেই মিলিত হবে গুপ্তবৈঠকে।
| কামাল প্রশ্ন করল, কিন্তু এতগুলো সেন্ট্রিকে কাবু করে বা ওদের চোখে ধুলো দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব, শহীদ। কুয়াশা-৩০,
১৩৫
উত্তেজিত দেখাল কামালকে। শহীদ বলল, ঢুকতে আমাদেরকে অবশ্যই হবে দুর্গের ভিতরে। গোপন বৈঠক একটা কারণ, তারচেয়ে বড় কারণ সরফরাজকে রক্ষা করা। এয়ারপোর্টই পথ দেখাবে আমাদেরকে। আজ-ই ই-আলীর এজেন্টরা ল্যাণ্ড করবে। চল, এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি, কি করা যায় । ই-আলীর এজেন্টদের সঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি
।’
মাইল তিনেক রাস্তা দৌড়ে অতিক্রম করল ওরা। তারপর পাওয়া গেল একটা ট্যাক্সি । কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা এয়ারপোর্টে। লাউঞ্জের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কামাল জিজ্ঞেস করল, ‘ই-আলীর সিক্রেট এজেন্টদেরকে কিভাবে চিনব আমরা?’
শহীদও সে কথা ভাবছিল। বাইরের দিকে লাইনবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের যানবাহন। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রতিটি গাড়ি দেখল শহীদ। লম্বা একটা মিনি বাসের উপর দৃষ্টি আটকে গেল ওর। মিনি-বাসের ড্রাইভারের পাশে একজন সশস্ত্র সেন্ট্রি বসে রয়েছে। কামালকে উদ্দেশ্য করে শহীদ বলল, আমার ধারণা ওই মিনি-বাসটা অপেক্ষা করছে সিক্রেট এজেন্টদের জন্যে। বিভিন্ন প্লেনে আসবে ওরা, নজর রাখা যাক কারা চড়ে ওতে, ই-আলীর এজেন্টদের বিশেষ কোন চিহ্ন বা বৈশিষ্ট্য নিশ্চয় আছে।
প্লেন ওঠানামা করছে খানিক পরপরই। যারা আসছে তারা সবাই এই এলাকার স্বাধীন অধিবাসী : বিদেশী আসা বন্ধ করে দিয়েছে তথাকথিত ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ডে’ ই-আলী তার ক্ষমতা বিস্তার করার পর। মিনিবাসে বেশ কয়েকজন– লোক চড়েছে। শহীদ একসময় বলে উঠল, ‘আমরা লাউঞ্জে আসার পর মিনি-বাসে পাঁচজন চড়েছে। পাঁচজনই নিজেদের বাঁ হাতে পরেছে দস্তানা, কিন্তু ডান হাতেরটা
পরে মুঠোর মধ্যে ধরা। এটাই বোধহয় ই-আলীর এজেন্টদের পরিচিতি চিহ্ন।’
কথা বলতে বলতে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে একটা প্যাসেজ ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। টারম্যাক থেকে লাউঞ্জে যেতে হলে এই প্যাসেজ ধরে এগোতে হবে। প্যাসেজের সর্বশেষ প্রান্তের দরজাটা খোলা। দরজার গায়ে লেখা-”মেইনটেন্যানস স্টোর’। শহীদ কামালের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল। তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। রূমটা ছোেট। বালতি, আঁটা, নানারকম পরিষ্কারক সরঞ্জাম ভিতরে। উজ্জ্বল মুখে রূম থেকে বেরিয়ে দরজাটা আবার ভিড়িয়ে দিল শহীদ।
দুজনে টারম্যাকে গিয়ে দাঁড়াল। প্লেন নামল একটা। প্যাসেঞ্জাররা প্যাসেজ ধরে লাউঞ্জের দিকে পা বাড়াল। উজ্জ্বল হয়ে উঠল শহীদের চোখের দৃষ্টি। দুজন প্যাসেঞ্জার এক হাতে একটি দস্তানা পরে অন্য হাতে আর একটি ধরে রয়েছে।
১৩৬
ভলিউম-১০
কোনও সন্দেহ নেই, জনাই ই-আলীর এজেন্ট।
শহীদ কর্তৃত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে লোক দুজনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত ইঙ্গিত করল অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে সরে আসতে। লোক দুজন কি করতে হবে বুঝতে না পেরে সরে দাঁড়াল এক পাশে। অন্যান্য সবাই প্যাসেজ ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই শহীদ লোক দুজনার উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বলল, “আমাকে অনুসরণ কর। দুর্গে পৌঁছে দেবার জন্যে গাড়ি রয়েছে ওদিকে। মহামান্য ই-আলী অপেক্ষা করছেন সেখানে।’
শহীদের বক্তব্য এবং গম্ভীর কণ্ঠ শুনে অবিশ্বাস করতে পারল না ওকে লোক দুজন। বিনাবাক্যে অনুসরণ করল তারা। প্যাসেজের সর্বশেষ প্রান্তের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল কামাল। লোক দুজন সেখানে পৌঁছুতেই সে এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজাটা। শহীদ আচমকা লোক দুজনকে সজোরে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে। দিল রূনের ভিতর। কামাল বন্ধ করে দিল রুমের দরজা। লোক দুজন মুহূর্তের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরমুহূর্তে তাল সামলে পকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠল ওরা। কিন্তু শহীদ ও কামাল ইতিমধ্যেই নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র বের করে ফেলেছে। লোক দুজন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল শহীদের আদেশে। ‘এবার দ্রুত কাজ শুরু করল ওরা। বন্দী এজেন্ট দুজনার রেনকোট, দস্তানা এবং টুপিগুলো খুলে নেয়া হল । দ্রুত পরে নিল ওরা রেনকোট আর হ্যাট। দস্তানা পরল ওরা বা হাতে, ডান হাতে একটা করে দস্তানা ধরল। এজেন্ট দুজনকে ভাল করে বেঁধে বালতিগুলোর আড়ালে ফেলে রাখা হল। কামাল বলল, এখন কি করব আমরা?’
শহীদ বলল, “আমরা দুজন এখনই-আলীর সিক্রেট এজেন্ট। এই লোকগুলোর পরিবর্তে মিনিবাসে গিয়ে বসব আমরা। চল, লাউঞ্জে যাবার পর কি হয় দেখা যাক।’ | হ্যাট নামিয়ে কপাল অবধি ঢেকে মাথা হেঁট করে লাউঞ্জে ঢুকল ওরা। ঢোকার পরপরই একজন বেঁটে এবং মোটা লোক ওদের দিকে এগিয়ে এল। ওদের হাতের দস্তানাগুলো দেখে নিয়ে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল তাকে অনুসরণ করার জন্যে।।
বেঁটে এবং মোটা লোকটাকে অনুসরণ করে ওরা মিনিবাসে গিয়ে উঠল। বাসটা ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে প্রায়। প্রত্যেকেরই পোশাক-আশাক শহীদ ও কামালের মত। কেউ কথা বলছে না কারও সঙ্গে। এতে করে সুবিধেই হল ওদের। বাস ছেড়ে দিল খানিক পর।
অবশেষে শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ী খাদের পাশ ঘেঁষে মিনিবাসটা পৌঁছুল দ্র ব্রিজের কাছে। ধীর হয়ে গেল বাসের গতি। ব্রিজের উপর দাঁড়াল একবার। সেন্ট্রির ড্রাইভারের পাস চেক করল। সবশেষে এসে দাঁড়াল মিনি-বাসটা দুর্গের সুউচ্চ কদাকার দেয়ালগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা উঠনে। কুয়াশা-৩০
১৩৭
তীক্ষ্ণস্বরে নির্দেশ এল, ‘অতিথিরা নেমে পড়ুন। দয়া করে আমাকে অনুসরণ করুন সবাই। মহামান্য ই-আলী আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
সকলে নামতে শুরু করল বাস থেকে।.সবশেষে নামল শহীদ ও কামাল। কামাল তাকিয়ে ছিল সতর্ক চোখে শহীদের দিকে। কিন্তু শহীদ তাকিয়ে ছিল যে লোকটা সবাইকে ই-আলীর কাছে নিয়ে যাবে তার দিকে। লোকটাও পলকহীন চোখে চেয়ে আছে শহীদের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময়। বিস্ফারিত চোখের পাতা। শহীদকে চিনতে পারছে সে। ক্রমশ হা হয়ে যাচ্ছে তার মুখ । এই লোকটাই হাসপাতাল থেকে শহীদ ও কামালকে অনুসরণ করে, বোকা বনেছিল।
বিস্মিত ভাবটা দূর হয়ে যাচ্ছে লোকটার। পাশের কয়েকজন সশস্ত্র সেন্ট্রির দিকে উত্তেজিতভাবে ঘুরে তাকাল সে। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠে শহীদ সম্পর্কে কিছু বলতে গেল।
আর কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই শহীদ ও কামাল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী শয়তান ই আলীর দুর্গে বন্দী হয়ে পড়বে।
তিন
সকলের শেষে বাস থেকে নেমেছিল শহীদ ও কামাল। অন্যান্য যাত্রী ইতিমধ্যে দুর্গের দরজা অতিক্রম করতে শুরু করেছে। ই-আলীর এজেন্টটা চেঁচিয়ে ওঠার আগেই ভয়ানকভাবে গর্জন করে উঠল শহীদ। তড়াক করে লাফ দিয়ে লোকটার মুখের উপর প্রচণ্ড বেগে ঘুসি বসিয়ে দিল ও একটা। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে, শহীদ নাটকীয়ভাবে চিৎকার করে উঠল, ‘একজন গুপ্তচর!
| লোকটা ভূপাতিত হতেই শহীদ আবার কঠিন কণ্ঠে সেন্ট্রিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘গ্রেফতার কর ওকে!’
কথাটা বলে পিছিয়ে এল শহীদ, যেন গ্রেফতার করার জন্যে জায়গা করে দিল সেন্ট্রিদেরকে। কামালকে ইঙ্গিত করে দুর্গের দরজার দিকে এগিয়ে চলল ও এবার দৃঢ় পদক্ষেপে। ই-আলীর এজেন্টরা দুর্গের একজন গার্ডকে অনুসরণ করে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপর দিকে উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সকলের পিছন পিছন এগোতে লাগল শহীদ ও কামাল। শহীদ সর্বশেষ ব্যক্তির রেনকোটের পিছন দিকের বেল্টে আলতোভাবে একটা ক্ষুদ্র পিন গেঁথে দিল। সিঁড়ির ধাপগুলো উতরে চওড়া মত ফাঁকা একটা জায়গায় উঠে আসতে কামালের উদ্দেশ্যে শহীদ নিঃশব্দে আবার ইঙ্গিত করল। একদিকের করিডরে চলে এল ওরা সকলের অজান্তে। এজেন্টরা গার্ডকে অনুসরণ করে চলেছে। তারা কিছুই বুঝতে পারল না।
শহীদ করিডরে দাঁড়িয়ে পড়ে কামালকে বলল, “যে লোকটাকে ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিলাম সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে, কামাল! সেন্ট্রিদেরকে পরিচয়পত্র
১৩৮
– ভলিউম-১০
দেখিয়ে ব্যাপারটা ঘোলাটে করে তুলেছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় জানালা দিয়ে দেখেছি ওরা উত্তেজিতভাবে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে।
এমন সময় পদশব্দ শোনা গেল। করিডরের সর্বশেষ প্রান্তে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ছুটে গিয়ে একসঙ্গে দুটো করে ধাপ টপকাতে শুরু করল শহীদ। কামালও পিছু নিল শহীদের, নিঃশব্দে। আচমকা কামালের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। উপরতলা থেকে নেমে আসছে ছুটন্ত পদশব্দ। নিচের তলার শব্দও দ্রুত হয়ে উঠছে ক্রমশ। শহীদ চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, উপর-নিচ দুদিক থেকেই গার্ডরা ছুটে আসছে আমাদের খোঁজে।’ * সিঁড়ির মাঝখানের দেয়ালে গরাদহীন জানালা একটা। শহীদ উঁকি মেরে দেখল বাইরে। সময় নষ্ট না করে জানালার উপর চড়ে বসল ও। বহু নিচে দেখা যাচ্ছে দুর্গের উঠনটা। দেড়খানা সিঁড়ি ভেঙেছে ওরা, কিন্তু উঁচুতে উঠেছে প্রায় চারতলার সমান। দেয়ালকে ঘিরে সরু একটা কার্নিস দেখা যাচ্ছে পাথরের। অসংখ্য জানালার নিচে দিয়ে বেশ খানিকদূর অবধি দেখা যাচ্ছে কার্নিসটা। কিন্তু অস্বাভাবিক সরু।
কিন্তু ইতস্তত বা চিন্তা করার সময় নেই। জানালা গলে সেই সরু কার্নিসে নেমে পড়ল শহীদ। খানিক এগিয়ে গেল ও কামালকে জায়গা করে দেবার জন্যে। জানালার গরাদ নেই, কিন্তু পান্না আছে। বেশ খানিকটা দূরে সরে এল ওরা। পিছন ফিরে দেখল। জানালার পাল্লা ভোলা থাকায় মুখ বের করে ওদেরকে কেউ দেখতে পাবে না কার্নিসে। কার্নিসের বাইরে শরীরের খানিকটা করে অংশ বেরিয়ে পড়েছে। শুয়ে-শুয়ে এক ইঞ্চি করে-করে এগোচ্ছে ওরা। বহু নিচে ই-আলীর সশস্ত্র সেন্ট্রিরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এতটুকু অন্যমনস্ক হলে ভারসাম্য হারিয়ে একেবারে নিচের উঠনে গিয়ে পড়ে মরতে হবে। এতটুকু শব্দ হলে সেন্ট্রিরা চোখ তুলে তাকিয়েই দেখে ফেলবে ওদেরকে। শহীদ অতি সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, কামাল, গোলাগুলি চালাবার ফোকরওয়ালা ওই দেয়ালের ওপরে উঠতেই হবে আমাদেরকে ধরা পড়বার আগে।’
বুঝলাম, কিন্তু এই কার্নির্স থেকে তা সম্ভব নয়।’
কামালের কথা শেষ হতেই শোনা গেল একটা জানালার পাল্লা খোলার শব্দ। জানালাটা অদূরেই। ওরা বুঝতে পারল কেউ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটার শ্বাসের শব্দও কানে ঢুকল ওদের। পরমূহুর্তে শোনা গেল পদশব্দ। জানালা দিয়ে যতটুকু কার্নিস দেখা যায় তার মধ্যে কাউকে দেখতে না পেয়ে লোকটা ফিরে গেল আবার। উজ্জ্বল হয়ে উঠল শহীদের মুখ। কামাল বলল, কি ভাবছিস?’
| শহীদ বলল, “আমরা পিছু হটে ওই জানালার কাছে যাব এবার। লোকটা নিঃসন্দেহ হয়ে ফিরে গেছে।
কুয়াশা-৩০
১৩৯
আবার অতি সন্তর্পণে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে পিছুতে লাগল ওরা। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা রয়েছে উঠনের সেন্ট্রিদের চোখ তুলে তাকাবার। অবশেষে জানালার ফ্রেমের উপর দাঁড়িয়ে ব্যাটলমেন্টের উপর উঠে যাবার চেষ্টা করব। তুই আমার পা দুটো ধরে থাকবি।’
আতঙ্কে কেঁপে উঠল কামালের বুক। মারাত্মক বেপরোয়া ধরনের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে শহীদ। দুর্গের এত উঁচু থেকে একবার হাত ফস্কে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই । শহীদ কিন্তু অত কথা, ভাবছে না। জানালার ফ্রেমের নিচের কাঠের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে ও। কালো রঙের বিশাল দেয়ালের পিঠ ওর মুখের সামনে। শূন্যের দিকে ওর পিঠ । কজার উপর পা দিয়ে ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠতে চাইছে ও। কামাল দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে মাথা বের করে। শহীদের পা দুটো দুহাত দিয়ে বেষ্টন করে আগলে রেখেছে ও, যাতে করে পা ফস্কে গেলেও নিচে পড়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারা যায়।
শহীদ আরও উপরে উঠে গেল। হাত দুটো পৌঁছে গেছে ওর ব্যাটলমেন্টের ফোকরগুলোয়। ধীরে ধীরে উঠছে ও। পায়ের উপর শরীরের ভার এখন, নেই বললেই চলে। সম্পূর্ণ শরীরটা ঝুলে রয়েছে দেয়ালের গায়ে। কামাল জানালার উপর উঠে দাঁড়িয়ে শহীদের জুতোর নিচে হাত ঠেকিয়ে রেখেছে আলতোভাবে। কিন্তু কামাল এরপর আর নাগাল পেল না শহীদের পায়ের। শহীদের পা দুটো তখন ব্যাটলমেন্টের ফোকরগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে। ফোকরের মধ্যে পা ঢুকিয়ে উপরের দিকে উঠে চলেছে ও। ব্যাটলমেন্টের কিনারা ধরে ফেলল ও এবার। নিচু, কণ্ঠ শোনা গেল ওর, আমি উঠে যাচ্ছি, কামাল। তুইও জানালার উপর দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে একটু একটু করে অতি সাবধানে উঠতে শুরু কর। তোর হাত দুটো ধরতে পারলেই টেনে তুলে নেব আমি তোকে।’
কামাল দেখল শহীদের শরীর অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাচীরের উপর। বড় করে দম নিয়ে জানালার কজায় পা রেখে শহীদের অনুকরণে, উপর দিকে উঠতে শুরু করল কামাল। শহীদকে সাহায্য করার জন্যে কামাল নিচের দিকে ছিল। নিচের দিক। থেকে সাহায্য পাওয়াটাই দরকার। কিন্তু তার কোন উপায় নেই।
কামাল ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু পরই শহীদের গলা পাওয়া গেল, আমি অনেকটা নেমে এসেছি, কামাল। নে, আমার পা’টা ধর ভাল করে।
, কামাল হাঁপ ছাড়ল একটা। শহীদের ঝুলিয়ে দেয়া পা ধরে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই উপরে উঠে পড়ল দুজন। | ত্রিশমিনিট ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে বিশ্রাম নিল ওরা। তারপর ব্যাটলমেন্টের উপর থেকে উঁকি মেরে দেখে নিল শহীদ সেন্ট্রিদের মধ্যে কোনরকম উত্তেজনা দেখা যায় কি না। না, সেন্ট্রিরা ওদেরকে দেখেনি উপরে ওঠার সময়। হঠাৎ শহীদ হাতঘড়িটা কানের ওপর চেপে ধরল। কামালের উদ্দেশ্যে ও বলল, “যে পিনটা
১৪০
ভলিউম-১০
একজন সিক্রেট এজেন্টের বেল্টে গেঁথে দিয়েছিলাম সেটা থেকে সঙ্কেত পাচ্ছি।’
শহীদের হাতঘড়ির মাইক্রো-রিসিভার থেকে কির কির কির করে শব্দ হচ্ছে। সমতল ছাদময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করল শহীদ গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেই সঙ্কেতধ্বনি শুনতে শুনতে। ব্যাটেলমেন্টের ছাদের সুদূর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। কামালের উদ্দেশ্যে বলল, শব্দের কমা-বাড়া অনুভব করে আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সেই এজেন্টটা ঠিক আমাদের নিচে রয়েছে।’
কামাল বলল, তারমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এজেন্টদেরকে নিয়ে ই-আলী গোপন বৈঠকে বসেছে!’
শহীদ সন্তর্পণে গোলা চালাবার একটা ফোকর দিয়ে মাথা গলিয়ে তাকাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা বের করে কামালের উদ্দেশ্যে বলল, ভাগ্যটা ভাল আমাদের। এত উঁচুতে বাইরের আক্রমণের কোনরকম আশঙ্কা নেই মনে করে রূমের একটা জানালার কবাট সামান্য একটু খুলে রেখেছে ওরা।’
শহীদ দ্রুত হাতে সৰু নাইলনের সুতোয় ক্ষুদ্রাকৃতি বোতামের মত একটা মাইক্রো-মাইক্রোফোন বেঁধে ঝুলিয়ে দিল গোলা চালাবার ফোকর দিয়ে। সুতো ঢিল করতে করতে যন্ত্রটাকে জানালার কাছ বরাবর পাঠাল ও। জানালার কাছে গিয়ে সেটা ঝুলতে লাগল নিঃশব্দে। শহীদ হাতঘড়ির মাইক্রো-রিসিভারটা কানের কাছে ধরল। কামাল কান বাড়িয়ে সরে এল কাছে। ওরা দুজনেই মাইক্রো রিসিভারের মাধ্যমে শুনতে পেলঃ•••এবং পাকিস্তান সীমান্তের এই ম্যাপের এই এই পয়েন্টে আক্রমণের সূচনা করব আমরা জিরো পাস টু আওয়ারে। জিরো পাস সিক্স আওয়ারে আমি, মহা শক্তিশালী ই-আলী, স্বয়ং আক্রমণে অংশগ্রহণ করব। জিরো আওয়ার থেকে শুরু করে এক সপ্তাহের মধ্যে এ অঞ্চলের ভূখণ্ডে নতুন একটি দেশ জন্ম লাভ করবে। বদলে যাবে এই উপমহাদেশের মানচিত্র। এবং•• | | বহুলোকের আনন্দ ধ্বনি শোনা গেল। তারপর আবার ই-আলীর কর্কশ এবং উদ্ধত কণ্ঠস্বর শুনল ওরা, •এবং সেই নতুন স্বাধীন দেশের একচ্ছত্র অধিপতি হব আমি। কিন্তু একটি দেশ স্বাধীন হলেই সেই স্বাধীনতা টিকে থাকে না, স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বৃহৎ একটি বন্ধুরাষ্ট্র আমাদেরকে সমর্থন করবে। কিন্তু আপনারা বিভিন্ন দেশের সরকারী মহলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে কসুর করবেন না। স্বীকৃতি লাভ করার জন্যে নানারকম লোভ দেখিয়ে স্বীকৃতি এবং সমর্থন আদায় করতেই হবে আমাদেরকে। সে ব্যাপারে আলাপ করার জন্যেই আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। এবং যদি স্বাধীনতা লাভ করেও একাধিক দেশের সমর্থন আমরা না পাই এবং তার ফলে যদি আমাদেরকে অর্জিত স্বাধীনতা হারাতে হয় তাহলে সেইসব দেশের প্রতি কঠোর আঘাত হানব আমরা। আপনারা যেসব দেশে কাজ করছেন, বর্তমানে সে সব
কুয়াশা-৩০,
১৪১
দেশে দল গঠন সম্পূর্ণ করেছেন।’
আবার শোনা গেল হর্ষধ্বনি। এরপর একজন সিক্রেট এজেন্ট বলে উঠল, মহামান্য ই-আলী, দুজন গুপ্তচর সম্পর্কে কি যেন শুনছি আমরা•••?’
ই-আলীর উত্তর শুনতে পেল শহীদ ও কামাল, ফাঁদ পাতা হয়েছে তাদেরকে এখানে ধরে আনার জন্যে। ওদের একজনকে হাসপাতাল থেকে আমার হেডকোয়ার্টারে আনা হয়েছে। বাকি দুজন তাকে উদ্ধার করার জন্যে এই দুর্গেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। ধরা পড়বে, সন্দেহ নেই। ধরা পড়েলেই সব কটার গর্দান একসাথে নেয়া হবে।’
কথাগুলো বলে হাঃ হাঃ করে খানিকক্ষণ নিষ্ঠুরভাবে হাসল ই-আলী।
অকস্মাৎ শহীদের হাতঘড়ির মাইক্রো-রিসিভার থেকে হ্যাঁশশশ ধরনের অদ্ভুত একটা শব্দ উঠল, অনেকটা বাতাসের মত। তারপর আর কোন কিছু শোনা গেল
। চমকে উঠল শহীদ। কামালের উদ্দেশ্যে ও বলল, ট্রান্সমীটিং মাইক্রোফোনটা দেখে ফেলেছে ওরা। ছিঁড়ে নিয়েছে ওটা কেউ।’
গোলা ছোঁড়ার ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে ওরা দেখল নাইলনের সুতোটা ঝুলছে, আসল জিনসিটা নেই জানালার কাছে। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। চোখে মুখে আশঙ্কা ফুটে উঠেছে ওর। দুর্গের নিচের দিক থেকে পাথরের ধাপ বিশিষ্ট একটা সিঁড়ি ছাদ পর্যন্ত উঠে এসেছে। সিঁড়ির দুধারে নিচু দেয়াল। ছাদের মধ্যবর্তী জায়গায় কয়েকটি প্রাচীন ছোট ছোট ধূম্রনালী, ওগুলোর মাঝখানে একটা বড় চিমনী । শহীদ রেনকোটটা খুলে বড় চিমনীর গায়ে ঝুলিয়ে দিল। সিঁড়ি বেয়ে কেউ উঠলে রেনকোটটার পিছন দিকটা দেখতে পাবে সে। এমন ভাবে রেনকোটটাকে ঝুলিয়ে দিল শহীদ, যাতে মনে হয় একজন মানুষ ওখানে আত্মগোপন করার চেষ্টা করছে। কামালকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির একদিকের নিচু দেয়ালের পাশে বসে পড়ল শহীদ। এমন সময় শোনা গেল দ্রুত পদশব্দ। সিঁড়ি বেয়ে ছুটতে ছুটতে উঠে আসছে কয়েকজন লোক।
সশস্ত্র সেন্ট্রিরা উঠে এল ছাদের উপর। শহীদের বুদ্ধিটা সফল হতে দেখা গেল। চিমনির উপর লটকানো রেনকোটটার দিকে অনর্গল গুলি চালাতে চালাতে
এগিয়ে গেল লোকগুলো।
এদিকে নিচু দেয়াল টপকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে পড়ল শহীদ। কামাল ওকে অনুসরণ করল। ছাদের উপর তখনও চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ হচ্ছে। চওড়া একটা প্যাসেজ ধরে ছুটছে ওরা। ওদের পদশব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছেগুলির শব্দে। হঠাৎ কামালের হাত ধরে থমকে দাঁড়াল শহীদ। প্যাসেজের দিকে মুখ করে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে, পান্না দুটো সামান্য একটু ভোলা। পা টিপে টিপে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভিতর দিকে তাকাল শহীদ। এক পলকের দৃষ্টিতেই শহীদ বুঝতে পারল শয়তান ই-আলীর হেড কোয়ার্টারের হৃদয়-কক্ষের ভিতরটা দেখছে ও।
১৪২
ভলিউম-১০
রূমটার মাঝখানে বিরাট একটা ডেস্ক । ডেস্কের সর্বত্র যন্ত্রপাতি এবং অসংখ্য সুইচ। টেলিভিশন স্ক্রীন, মাইক্রোফোনও দেখা গেল, প্রায় আধ ডজন টেলিফোনও রয়েছে। রূমের এক কোনায় একটা জানালা। দুর্গের ছাদের উপর থেকে এই জানালার সামনেই মাইক্রো-ট্রান্সমিটারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল শহীদ। জানালাটার সামনে একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। ই-আলীর সিক্রেট এজেন্ট ওরা। এজেন্টদের মাঝখানে একজন বলিষ্ঠ, লম্বা, স্বাস্থ্যবান পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার বিশাল হাতের থাবায় কিছু একটা রয়েছে। শহীদ অনুমান করল জিনিসটা তাদেরই মাইক্রো-ট্রান্সমিটার।
হঠাৎ একটা ম্যাপ দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠল শহীদ। রূমের দেয়ালে একটা ওয়ার্ড ম্যাপ। ম্যাপের বিভিন্ন জায়গায় লাল ফ্যাগ আঁকা। কামালের কানের কাছে মুখ নামিয়ে শহীদ নিচু স্বরে বলল, এই ওয়ার্ল্ড ম্যাপের লাল ফ্ল্যাগ দাগানো দেশগুলোয় শয়তান ই-আলীর এজেন্টরা দল করেছে বলে মনে হয়। যতদূর মনে হয় আমার, পাকিস্তানকে আক্রমণ করে যে ভূখণ্ড অধিকার করে একটা দেশের জন্ম দেবে বলে আশা করছে শয়তানটা সেই দেশকে যেসব দেশ স্বীকৃতি দেবে না সে। সব দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করবে এজেন্টদেরকে দিয়ে।
কথাগুলো বলে শহীদ দ্রুত পকেট থেকে বের করল সিগারেট লাইটারের মত দেখতে ছোট্ট একটা ক্যামেরা। চোখের কাছে ক্যামেরাটা তুলেই বোতাম টিপে দিল ও।
অস্পষ্ট একটা শব্দ হল কি হল না, ই-আলী ঘাড় তুলে সোজাসুজি দরজার দিকে তাকাল। লাইটারক্যামেরা দিয়ে ফটো তোলা হয়ে গেছে তখন শহীদের।
শহীদ দেখল ই-আলী.অকস্মাৎ তার অনুচরদের মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে । বেরিয়ে আসছে। পলকের মধ্যে কয়েকজন এজেন্টকে সরিয়ে দিয়ে ঝড়ের মত হুড়মুড় করে ডেস্কের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ই-আলী। ডেস্কের একটা সুইচের উপর প্রকাণ্ড হাতের থাবা দিয়ে চাপ দিল সে।
শহীদ ও কামাল ইতিমধ্যে চওড়া প্যাসেজ ধরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করেছে। দড়াম! দড়াম! দড়াম! দড়াম!
চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল ওরা। প্রতিটি দরজা জানালার পাল্লা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। প্যাসেজের দুই প্রান্তের দরজার পালাও বন্ধ। তার উপর স্টীলের শাটার ফেলে দেয়া হয়েছে। কামাল আতঙ্ক চেপে রাখার চেষ্টা করে বলল,
আমাদের পালাবার পথ চারদিক দিয়েই বন্ধ।’
কামাল মিথ্যে বলেনি। প্যাসেজের একটা মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পাথরের দেয়াল নামিয়ে। দ্বিতীয় এবং শেষ মুখটা বন্ধ করা হয়েছে স্টীলের শাটার ফেলে। দরজাগুলোও ওইভাবে বন্ধ।
শহীদ কেঁপে উঠল। চমকে উঠে একই সময় কামাল আতঙ্কে চিৎকার করে কুয়াশা-৩০,
১৪৩
উঠল। পৃথিবীটা নড়ছে যেন!
শহীদ, দেখ!’ |
মেঝের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল কামাল। শহীদ দেখল ওরা যে পাথরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দেয়ালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে পাথরের মেঝেটা। প্যাসেজের মেঝে পাথরের দেয়ালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাবার ফলে বিপরীত দিকে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে একটা। ক্রমশই বড় হচ্ছে সেই অন্ধকার, তলহীন গহুর । শহীদ বুঝতে পারল এই গভীর গহ্বরের নিচে শয়তান ই-আলীর দুর্গের বন্দীশালা অবস্থিত। বলা যায় না, গহুরটা মৃত্যুগুহাও হতে পারে। হয়ত বাঘ, সিংহ, কেউটে সাপ ইত্যাদি আছে গহ্বরের নিচে।
আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পরই প্যাসেজের সম্পূর্ণ মেঝেটা ক্রমশ মিলিয়ে যাবে পাথরের দেয়ালের আড়ালে। গাঢ় কালো রঙের মৃত্যু-গহ্বর গ্রাস করবে ওদের দুজনকে।
চার
জলদি, কামাল! একদিকের দেয়ালের গায়ে পা দুটো তুলে আটকে নে, কোমর থেকে ওপরের অংশটা অন্য দিকের দেয়ালের গায়ে লাগিয়ে সেঁটে থাক!’।
শহীদ ইতিমধ্যেই অদৃশ্যমান অবশিষ্টাংশ মেঝে থেকে পা দুটো তুলে একদিকের দেয়ালের গায়ে স্থাপন করেছে, শরীরটা সেঁটে রয়েছে ওর বিপরীত দিকের দেয়ালে। পাথরের মেঝেটা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে কামাল শহীদের অনুকরণে দুই দেয়ালের মাঝখানে নিজের শরীরটা স্থাপন করে ব্রিজের মত হয়ে হাপাতে লাগল। ঘাড় ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকাল। অন্ধকার গহুরটা হাঁ করে রয়েছে ওদেরকে গিলে ফেলবার অপেক্ষায়। তল দেখতে পেল না কামাল। শহীদের উদ্দেশে চাপা কণ্ঠে বললও, বেশিক্ষণ এমন কষ্টকর অবস্থায় টিকতে পারব না, শহীদ!’
শহীদ আচমকা মুখ হাঁ করে তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার করে উঠল একটা। মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তিম আতঙ্কভা সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার ক্রমশ নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে গেল। যেন কোন মানুষ শূন্য হতে নিচের দিকে পড়ে যেতে যেতে শেষ আর্তচিৎকার করে উঠল।
আশঙ্কায় জর্জরিত হতে হতে শহীদ অপেক্ষা করে রইল। তার চালাকি কি সফল হবে? শয়তান ই-আলী কি ওই আর্তচিৎকার শুনে বিশ্বাস করবে যে গহ্বরের ভিতর পড়ে গেছে তার শক্ত?
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শহীদ ও কামালের মুখ । পাথরের মেঝে আবার ১৪৪
ভলিউম-১০
সরে আসছে দ্রুত দেয়ালের আড়াল থেকে । গহরটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
মেঝেতে পা রাখল ওরা। মাংসপেশীগুলো কাঁপছে থরথর করে। বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল ওরা। শহীদ পা ঝাড়া দিল। স্টীলের শাটারগুলো উঠে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে ই-আলী দরজা খুলে প্যাসেজে হাজির হতে পারে সদলবলে । কামালকে ইশারা করে প্যাসেজ ধরে দৌড়াতে শুরু করল শহীদ। ওদের পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে ছাদের উপর থেকে সশস্ত্র সেন্ট্রিরা। রেইনকোটে গুলিবিদ্ধ করে বোকা বনে মাথায় রক্ত চেপে গেছে ওদের।
প্যাসেজের দেয়ালে ইলেকট্রসিটির তার দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। প্যাসেজটা বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত। কোমর থেকে দাঁতযুক্ত একটা কাটার বের করে মুহূর্তের মধ্যে বৈদ্যুতিক তারগুলো কেটে দিল শহীদ। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল প্যাসেজটা। আবার দৌড়তে শুরু করল ও। কামাল ওর কাছে কাছেই রয়েছে।
: প্যাসেজটা যেন সীমাহীন। বহুক্ষণ দৌডুবার পর অবশেষে একটা দরজা দেখা গেল বাইরের দিকের দেয়ালের গায়ে। শহীদ হাতল ঘুরিয়ে জোরে ধাক্কা : দিয়ে দরজা খুলে সবেগে প্রবেশ করল রূমের ভিতর। ছোট এবং গোলাকার রূম এটা। রূমটার চতুর্দিকে জানালা। একটা জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শহীদ বলল, এটা একটা কার্টন টাওয়ার। কামাল, নিচে দেখ!” | কার্টন টাওয়ারটা দুর্গের এক প্রান্তের প্রাচীরের গা ঘেঁষে অবস্থিত। কামাল নিচের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। ঘোট, যেরা একটা উঠনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা অ্যাম্বুলেন্স। এই অ্যাম্বুলেন্সে করেই সরফরাজ খানকে দুর্গে নিয়ে আসা হয়েছে, কামাল পরিষ্কার বুঝতে পারল । শহীদ দ্রুত অনুমান করল, ত্রিশ ফুটের মত নিচে উঠনটা ওদের কাছে থেকে।
হঠাৎ জানালা থেকে মাথা বের করে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। সারা শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে ওর। প্যাসেজ ধরে কয়েকজন লোকের দ্রুত পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল না তারা। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল পদশব্দ। শহীদ ফিসফিস করে বলে উঠল, ই-আলীর গার্ডরা পাতালপুরীর বন্দীশালায় নামার জন্যে ছুটে গেল বোধহয়। শয়তানরা ধরে নিয়েছে লাশ পাওয়া যাবে ওখানে আমাদের! ই-আলী নিশ্চয় আমার ক্যামেরাটা হাতে পেতে চায়।’
কামাল কপালের ঘাম আঙুল দিয়ে একপাশে সরাতে সরাতে বলল, কিন্তু আমাদের লাশ না পেয়ে কুকুরের মত হিংস্র হয়ে উঠবে ওরা এবার। এরপর নিশ্চয় গোটা দুৰ্গটাকে চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতেও কসুর করবে না আমাদের খোঁজে।
সুতরাং এই টাওয়ারে লুকিয়ে থাকতে পারি না আমরা, অথচ বেরিয়ে যাবারও উপায় নেই। উপায় শুধু করা যায়…।’ . কথা অসমাপ্ত রেখে শহীদ দরজা খুলে সন্তর্পণে উঁকি মারল প্যাসেজে। কেউ ১০-কুয়াশা-৩০
১৪৫
নেই দেখল ও। বেরিয়ে এল প্যাসেজে। বৈদ্যুতিক তারটা যেখানে ছিঁড়েছিল সেখানে এসে দাঁড়াল ও। তারের ছেঁড়া শেষাংশের একদিকটা ধরে ঝুলে পড়ল। সে। পিনগুলো বাটাম থেকে উঠে আসার ফলে মোটা তারটা অনেকটা খুলে গেল। আন্দাজ মত তার হস্তগত হতে শহীদ অতি সাবধানে কাটল অপর প্রান্তটা। তার নিয়ে ফিরে এল কার্টন টাওয়ারে। জানালা দিয়ে লম্বা এবং মোটা তারটা নিচে নামিয়ে দিল ও। জানালার পানি গলবার ফোকরের সঙ্গে তারটা বাঁধল মজবুত করে। দ্রুত চোখ বুলিয়ে কামাল দেখল তারের শেষাংশ কাঁকর বিছানো উঠনের। কাছাকাছি পৌঁছে গেছে প্রায়। শহীদ নির্দেশ দিল, নামতে শুরু কর কামাল। হাত ঢিল করবি না, পিছলে যাবে তাহলে। এক হাত এক হাত করে নামবি।
কামাল নামতে শুরু করল মোটা তার বেয়ে। শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল ওর নামা। কামাল নিচে পৌঁছে যেতেই শহীদ নামতে শুরু করল। দ্রুত নেমে এল ও প্রাচীর ঘেরা কাঁকরময় ছোট্ট উঠনে। অ্যাম্বুলেন্সের কাছে গিয়ে ওরা দেখল সেটা খালি। তারমানে সরফরাজ খানকে দুর্গের কোন স্থানে বন্দী করে রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে। শহীদ ভাবল সরফরাজ যতক্ষণ বেঁচে আছে। ততক্ষণ আশা করা যেতে পারে তার কাছ থেকে শয়তান ই-আলীর সাংঘাতিক প্ল্যানের বিশদ বিবরণ পাবার। শয়তান ই-আলী জিরো আওয়ারে আক্রমণ চালাবে পাকিস্তানের উপর। কিন্তু তার আক্রমণের ধাচ কি রকম হবে তা জানা যায়নি। হয়ত সরফরাজ সে কথা জানে। সরফরাজকে মুক্ত করে সময় মত তিনজন পালাতে না পারলে মিশনটা ওদের ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। পালানো সম্ভব হলেই কেবল ই-আলীর ষড়যন্ত্রকে বানচাল করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এবং ই-আলীর ষড়যন্ত্রকে বানচাল করতে না পারলে শুধু পাকিস্তানই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিপদের সম্মুখীন হবে।
উঠনের একদিকের দেয়ালে একটা দরজা। দরজা পরীক্ষা করে শহীদ দেখল ভিতর থেকে বন্ধ ওটা। কামালকে ইঙ্গিত করতেই কামাল তৈরি হয়ে দাঁড়াল।
পরমুহূর্তে দুজনে ছুটে গিয়ে ধাক্কা মারল দরজার গায়ে। ভিতরের খিল ভেঙে খুলে, গেল পাল্লা দুটো। হুড়মুড় করে রূমের ভিতর ঢুকে দরজাটা ভিজিয়ে শিকল তুলে দিল শহীদ কামাল বলল, ‘দুর্গের কিচেন রূম এটা।”!
শহীদ হাত বাড়িয়ে অপরদিকের একটা দরজা দেখিয়ে বলল, “দরজাটা খুলে দেখা যাক, পাতালের দিকে নামার রাস্তা পাওয়া যায় কি না। পাতালপুরীর বন্দীশালায় সরফরাজকে বন্দী করে রাখতে পারে ওরা। খোঁজ করে দেখতে হবে।’
পা টিপে টিপে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন। ধীরে ধীরে শহীদ দরজাটা, খুলল । দরজার পাশেই দুটো রাবারের ডাস্টবিন। দুটোই আনাজের খোসায় ভর্তি। হঠাৎ নিচের দিক থেকে চিৎকার ভেসে এল একজন মানুষের, গুপ্তচর দুজন। বন্দীশালায় নেই। পাতালপুরীর কারাগার তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি আমরা-নেই! ১৪৬
ভলিউম-১০
কুকুর দুটো মহামান্য ই-আলীর ফাঁদ এড়িয়ে গেছে! মহামান্য ই-আলীকে সাবধান করে দাও!’
পরমুহূর্তে ইন্টারন্যাল টেলিফোনে চিৎকার করে খবর পাঠানো হচ্ছে ই-আলীর কাছে, শুনতে পেল ওরা। চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। কিচেন রূমের ছাদের দিকে তাকিয়ে ও দেখল একটা লাউডস্পীকার। লাউডস্পীকার থেকে গর্জে উঠল
শক্তিশালী একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ই-আলী সকল ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কথা বলছে।
নার্ভ-কন্ট্রোলের সুইচ অন কর! আমি আবার বলছি, নার্ভ-কন্ট্রোলের সুইচ অন কর! প্রস্তুত হও কাউন্টডাউনের জন্যে। শুরু হচ্ছে। টেন-নাইন-এইট।
অবশেষে শোনা গেল, টু-ওয়ান-জিরো!’
কামাল একটা আর্তচিৎকার বহু কষ্টে দমন করল। ওর চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে শহীদের দিকে চেয়ে রয়েছে। কাঁপছে ও। শহীদের পা থেকে মাথা অবধি ভয়ঙ্কর ভাবে থরথর করে কাঁপছে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে শরীরের কাঁপুনি। কামালের কষ্ট হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ করতে। গলা বুজে আসছে ওর। ওর মাথাটা এত জোরে জোরে কাঁপছে যে চোখ দুটো শহীদের দিকে ধরে রাখতে পারছে না কোনমতে।
শহীদ অসহায়ভাবে চেষ্টা করছে কাঁপুনির হাত থেকে মুক্ত হতে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে ও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে । মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করছে ওর। টলতে টলতে রাবারের দুটো ডাস্টবিনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁপা হাতে উল্টে দিল দুটো ডাস্টবিনই। আনাজের খোসাগুলো পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে। বহুকষ্টে কামালের কাছে নিয়ে গেল শহীদ রাবারের একটা ডাস্টবিন। প্রায় অচেতন কামালের দেহটা ডাস্টবিনটার ভিতর ঢুকিয়ে দিল ও।
শহীদ স্বয়ং অচেতন হয়ে পড়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। চোখের দৃষ্টি রাখতে পারছে না। শূন্য লাংসে বাতাস ভরে নিতেও যেন অক্ষম হয়ে পড়েছে। কিন্তু অবশিষ্ট শক্তিটুকু নিংড়ে কাজে লাগাল ও। হাঁ করে হাঁপাতে হাঁপাতে রাবারের ডাস্টবিনের কাছে সরে এল ও। ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। ডাস্টবিনটা টেনে মাথাটা তুলে ধীরে ধীরে শরীরটাও ঢোকাতে শুরু করল ও।
| রাবারের ডাস্টবিন দুটো ছিল বলে এ যাত্রা প্রাণ রক্ষা হল ওদের। শয়তান ই আলীর নার্ভ-মেশিনের ভয়ঙ্কর প্রভাবের হাত থেকে রক্ষা পাবার আর কোন পথ ছিল না। ই-আলীর অনুচররা অ্যান্টি-নার্ভ ভাইব্রেটরের সুইচ অন করে সাবধান হয়েছে আগেই নিশ্চয়, শহীদ ভাবল।
মিনিট খানেক পর ধীরে ধীরে রাবারের ডাস্টবিনের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল শহীদ। কোন অসুবিধে বোধ করল না ও নতুন করে। কামালকে ডাস্টবিন মুক্ত করে ও বলল, শয়তানটা অফ করে দিয়েছে নার্ভ-মেশিন। ভেবেছে, নিশ্চয় যা ফল ফলবার যথাযথ ফলেছে। ওর আবিষ্কৃত যন্ত্র আমাদেরকে ভাইব্রেট
কুয়াশা-৩০
১৪৭–
করে মেরে ফেলেছে বলে নিশ্চিত ধারণা না হয়ে থাকলে এখনও মেশিন চালু থাকত। সত্যিসত্যি কয়েক মুহূর্তের বেশি কেউ টিকে থাকতে পারে না এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।।
কিচেন রুমের দরজা ত্যাগ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল ওরা। কিছুদূর যেতেই পাওয়া গেল পাথরের ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি। পাতালপুরীর কারাগারের দিকে নেমে গেছে সিঁড়িটা। নিচে নেমে এল ওরা। তারপরই থমকে দাঁড়াল। অদূরবর্তী কোন লাউডস্পীকার থেকে শোনা গেল ই-আলীর কর্কশ কণ্ঠস্বর, দুজন গুপ্তচর এখুন মৃত। ওদের লাশ খুঁজে বের কর। একজনের কাছে মাইক্রো-ক্যামেরা আছে, সিগারেট লাইটারের মত দেখতে সেটা। উদ্ধার করে নিয়ে এস। এটা জরুরি
আদেশ।’
আবার দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল ওরা। শহীদ অনুসন্ধানী চোখে দেখছিল বৈদ্যুতিক তার কোন কোন দেয়ালের উপর দিয়ে কোন কোন দিকে গেছে। সরফরাজ খানকে যদি কোন কারাগার কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়, তাহলে সে কক্ষে আলো থাকবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ওর। কী হোল দিয়ে শত্রুরা যাতে সরফরাজের প্রতিমুহূর্তের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারে সেজন্যে কারাগার কক্ষ আলোকিত না করে উপায় নেই। দুপাশের রুমগুলোয় আলো জ্বলছে না। প্যাসেজটা আরও অসংখ্য প্যাসেজের সন্ধান দিচ্ছে। অন্ধকার প্যাসেজগুলোর দিকে মনোযোগ দিল না শহীদ। যে প্যাসেজগুলোর দেয়ালে বৈদ্যুতিক তার দেখা যাচ্ছে। সেগুলো ধরে এগোতে লাগল ও। আলোকিত প্যাসেজের দুধারে কারা কক্ষ। দরজাগুলো খোলা কোন কোনটার। ভিতর থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কত নিরীহ বন্দী এইসব কারা-কক্ষে প্রাণ দিয়েছে কে জানে! শহীদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা বন্ধ দরজার পাশে থাক থাক কাঠের বাক্স দেখছে ও। বন্ধ রুমটার ভিতর যে মোটা বৈদ্যুতিক তার প্রবেশ করেছে সেগুলো পাওয়ার-কেবল। কামালের উদ্দেশ্যে ও চাপা কণ্ঠে বলল, রূমটার ভিতর বিশেষ কোন ব্যাপার * আছে। পাওয়ার-কেবল কেন তা না হলে?’
কোন শব্দ না করে সন্তর্পণে দরজার হাতলটা ঘোরাল শহীদ। আশ্চর্য হয়ে কামাল দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিঃশব্দে খুলে গেল পালা দুটো।
শক্ত হয়ে উঠল ওদের শরীর।
রূমের মাঝখানে দুটো লোহার বেডের একটিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শুইয়ে রাখা হয়েছে একজন লোককে।
চমকে উঠল শহীদ।
লোকটাকে চিনতে পেরে উত্তেজিত হয়ে পড়ল ও। লোকটা সরফরাজ খান ব্যতীত আর কেউ নয়। সরফরাজ খানের উপর ঝুঁকে পড়ছে মেডিক্যাল মাস্ক পরা দুজন লোক। ওরা সম্ভবত ডাক্তার। একজনের হাতে একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ ।
১৪৮
ভলিউম-১০
সরফরাজকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে সে সবেমাত্র। সে দ্বিতীয়জনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এই যে, জ্ঞান ফিরে পেয়েছে গুপ্তচরটা। পেটের কথা সব খোলসা করে বলবে এবার ও। এখনও খুব দুর্বল বটে, কিন্তু এই সাচ্চা দাওয়াইয়ের বদলৌতে কথা বলতে বাধ্য হবে ব্যাটা। মহামান্য ই-আলীর আশঙ্কা, এ ব্যাটা তার প্ল্যানের কথা, জিরো আওয়ারের কথা সব জানে।
কামাল রাগ সামলাতে না পেরে খোলা দরজা পথে পা বাড়িয়ে দিল। শহীদ ওকে বাধা দেবার আগেই ও লাফ দিল দরজার কাছ থেকে সিরিঞ্জ ধরা মাস্ক পরিহিত ডাক্তারকে লক্ষ্য করে । লাফ দেবার ভঙ্গিতেই অত্যাশ্চর্য ভাবে স্থির হয়ে গেল কামাল। পাথরের মূর্তির মত হয়ে গেল সে এক সেকেণ্ডেরও অল্প সময়ের মধ্যে। এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, দ্বিতীয় পা টা দৌড়বার ভঙ্গিতে উপরে ওঠান, দুটো পা-ই অনড় হয়ে গেছে। চোখের পাতাও নড়ছে না ওর। সম্পূর্ণ নিঃসাড় হয়ে গেছে কামাল। কেউ যেন ওর দেহ থেকে প্রাণ কেড়ে নিয়ে পাথরের নিষ্প্রাণ মূর্তিতে পরিণত করেছে ওকে জাদুবলে।
‘ শহীদ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল যে ডোর পোস্টের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত শক্তিশালী কোন র্যাডিয়েশন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কামাল।
দুজন গুপ্তচরের একজন ফাঁদে পড়েছে! গার্জিয়ান রে কাবু করে ফেলেছে একজন গুপ্তচরকে!’ |
| একজন মাঙ্ক পরিহিত ডাক্তার ঘাড় ফিরিয়ে কামালকে দেখেই চিৎকার করে উঠল। শহীদ সরে এসেছে দরজার আড়ালে। দ্বিতীয় ডাক্তার উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘এই গুপ্তচরই হয়ত ছবি তুলেছে মহামান্য ই-আলীর অপারেশন রূমের। ক্যামেরাটা হয়ত এর কাছেই আছে। কোন না কোনভাবে মহামান্য ই-আলীর নার্ভ-বিধ্বংসী ভাইব্রেটর ব্যর্থ করে দিয়ে বেচে আছে এতক্ষণ লোকটা।’
শহীদ শুনতে পেল একটা সুইচ অফ করবার শব্দ। দরজার পাল্লার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ও দেখল কামালকে ধরে রুমের ভিতর নিয়ে গেল ডাক্তার দুজন।
দরজার কজার নিচের ফাঁক দিয়ে রূমের ভিতর তাকাল শহীদ। দেখল একজন ডাক্তার পিস্তল হাতে নিয়ে গার্ড দিচ্ছে কামালকে। এবং সরফরাজের পাশের লোহার কেডে কামালকে শুইয়ে দিয়ে হাত-পা বাঁধছে দ্বিতীয়জন। এরপর দ্রুত হাতে, কামালকে সার্চ করা হল। একমুহূর্ত পর দ্বিতীয় ডাক্তারটি পিছিয়ে এসে ইন্টারকম রিসিভার তুলে উত্তেজিত গলায় পেঁচিয়ে বলল, ‘মহামন্য ই-আলী! আমরা দুজন গুপ্তচরের একজনকে বন্দী করে ফেলেছি। আপনার ভাইব্রেটর মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে আছে লোকটা। অন্যজনও সম্ভবত মৃত্যুবরণ করেনি। হুকুম করুন,
মহামান্য ই-আলী।’
শয়তান ই-আলীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল কোন লাউডস্পীকার হতে, মাস্ক পরে নাও! আমি আবার বলছি–সবাই মাস্ক পরে নাও! এখুনি! তৈরি হও! এইবার সে
কুয়াশা-৩০
১৪৯
মৃত্যুবরণ করবেই করবে। Vapour controls খুলে দেয়া হচ্ছে সবগুলো
Vapour on-now!
কাছাকাছি কোথাও থেকে মৃদু হিস হিস শব্দ উঠল। শহীদ অস্বস্তিভরে প্যাসেজের উপর-নিচে তাকাল। কোথাও কিছু দেখা গেল না, হিস হিস ধ্বনি ক্রমশ জোরাল এবং উচ্চকিত হয়ে উঠছে। ভয়ঙ্কর কাশি পাচ্ছে ওর। কিন্তু সামলে রাখছে ও প্রাণপণ প্রয়াসে। এতটুকু শব্দ হলে ধরা পড়তে হবে নির্ঘাৎ। চোখ দুটো ওর ভীষণভাবে জ্বালা করতে শুরু করল। গলা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। অসহ্য কষ্টে হাঁপিয়ে উঠেছে ও। বিপদের রূপটা বুঝতে বাকি রইল না শহীদের। শয়তান ই-আলী তাকে হত্যা করার জন্যে অদৃশ্য গ্যাস ছেড়েছে।
শহীদ বুঝতে পারল ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ছে ও। এবং মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া শয়তান ই-আলীর ভেপারের আক্রমণ থেকে প্রাণ রক্ষা করা এক কথায় অসম্ভব।
ভেপার!
শব্দটা বারবার স্মরণ করল ও অচেতন হয়ে পড়তে পড়তে । চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ভেপার-বাতাসের চেয়েও হালকা-ভেপার গ্যাস-চারদিক ভেসে যাচ্ছে–ভেপার-উপরে-বাতাসের চেয়েও-ভেপার!
মেঝের উপর নেতিয়ে পড়ে গেল শহীদ। দেহের সর্বশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও ইচ্ছাশক্তি কাটিয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করছে ও। শরীরটাকে নাড়াতে নাড়াতে মুখটা ঘষছে ও ঠাণ্ডা মেঝেতে। আচমকা এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল
ওর শূন্য লাংসে, দেহের নষ্ট শক্তি ফিরে এল খানিকটা।
: ইচ্ছাশক্তি খাটাবার ফলে প্রাণ রক্ষা পেল শহীদের এ যাত্রা। পাথরের মেঝের নিচে প্রবাহিত হচ্ছে ময়লা পানির ড্রেন। শহীদ মুখ ঘষছিল ড্রেনের ঢাকনির উপর, ফলে ঢাকনিটা সরে যেতে বাতাস ঢুকতে পেরেছে।
খানিকক্ষণ পর শহীদ বুঝতে পারল ভেপার প্রয়োেগ বন্ধ হয়েছে এতক্ষণে ।। মেঝের উপর হামাগুড়ি দিতে দিতে খোলা দরজাটার কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। উঁকি মেরে তাকাল রূমের ভিতর। তারপর ডোর-পোস্টে একটা আঙুল দ্রুততার সঙ্গে স্পর্শ করে দেখল, কিছুই ঘটল না। তারমানে উত্তেজিত অবস্থায় গার্জিয়ান রে-র সুইচ অন করতে ভুলে গেছে ডাক্তার দুজন। শহীদ দেখল একজন ডাক্তারের হাতে নতুন একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ। সরফরাজ খানের উপর ঝুঁকে পড়েছে সে। ইঞ্জেকশন দিতে উদ্যত। শহীদ উরুর কাছ থেকে একটা নাইলনের কেস বের করল। কেসের ভিতর থেকে ছোট একটা গ্লাস বল বের করে রূমের একদিকের দেয়ালের ফিউজ বক্সের দিকে অব্যর্থভাবে ছুঁড়ে মারল সেটা। গ্লাস বল ফিউজ বক্সে গিয়ে লাগতে লাল আগুনের শিখা দেখা দিয়েই ফেটে গেল সেটা।
দুজন ডাক্তারই চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। চিৎকার করে উঠল একজন, ফিউজ
১৫০
ভলিউম-১০
বক্স সর্ট সার্কিট করেছে। সুইচ অফ করে দাও, তা না হলে আগুন ধরে যাবে।’
ফিউজ বক্সের দিকে ছুটে গেল দুজনাই। শহীদ এই ফাঁকে রূমের ভিতর ঢুকে কামালের বেডের নিচে আত্মগোপন করল। কোমরের বেল্ট থেকে ছুরি বের করল ও। হাত দুটো বেডের উপর তুলে দিয়ে কামালের হাত-পায়ের বাঁধন কাটতে মিনিটখানেক সময় লাগল ওর। ফিস ফিস করে বলে উঠল ও, কামাল, তুই মুক্ত।
ডাক্তার দুজন ফিরে এল সরফরাজ খানের বেডের কাছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কামাল বেডের উপর থেকে লাফ মেরে পড়ল একজনের ঘাড়ে। শহীদও কালবিলম্ব
করে ঝাঁপিয়ে পড়ল দ্বিতীয়জনের উপর। কি হতে কি হল, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না ডাক্তার দুজন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শহীদ ও কামালের প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে জ্ঞান হারাল তারা। শহীদ সরফরাজকে মুক্ত করল পরক্ষণেই তার হাত-পায়ের বাধন কেটে। ঠিক এমন সময় বাইরের প্যাসেজে দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল।
শহীদ চঞ্চল চোখে এদিক-ওদিক তাকাল । রূমের ওপাশের দেয়ালের গায়ে কাঠের ফ্রেমের একটা দরজা দেখা যাচ্ছে । ছুটে গেল শহীদ। দরজাটা খুলে ফেলল ও। পাল্লা দুটো সরে যেতেই প্রশস্ত, অব্যবহৃত কাবার্ড, অর্থাৎ একটা দেয়াল আলমারি দেখা গেল। শহীদ কামালকে বলল, সরফরাজকে এর ভিতরে তুলে দে, জলদি!’ . | কামাল সরফরাজকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এসে কাবার্ডের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। কাবার্ডের দরজা বন্ধ করে দিয়ে অচেতন ডাক্তার দুজনের কাছে ফিরে এল ওরা। শহীদ বলল, আমি যা করি তাই কর, কামাল!’
কথাটা বলেই শহীদ একজন ডাক্তারের মেডিক্যাল মাস্কটা খুলে নিজে পরে নিল। সাদা অ্যাপ্রনটাও খুলে নিয়ে পরল শহীদ। কামাল অনুকরণ করল শহীদকে দ্বিতীয়জনের মাস্ক এবং অ্যাপ্রন পরে নিয়ে। এরপর দুটো অক্সিজেন মাস্ক দেয়াল থেকে নামিয়ে ডাক্তার দুজনের মুখে লাগিয়ে দিল দ্রুত হাতে। নিজেদের পোশাকগুলো অচেতন লোক দুজনার গায়ে পরানর সময় নেই। লোহার বেডের উপর তুলে দিল শহীদ দুজনকেই। তারপর দরজার দিকে মুখ করে তাকাল। পরক্ষণেই রূমের ভিতর ঢুকতে দেখা গেল ই-আলীকে।
ই-আলী দুইজন সেন্ট্রিকে সঙ্গে নিয়ে রূমের ভিতর ঢুকল। উভয়ের হাতেই একটা করে সাব-মেশিনগান।।
ই-আলী এসে দাঁড়াল দুই লোহার বেডের মাঝখানে। দুজন অচেতন লোকের মাস্ক পরিহিত মুখের দিকে কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল সে। শহীদ ও কামাল। মেডিক্যাল মাস্কের আড়াল থেকে তাকে দেখতে লাগল সতর্ক এবং উত্তেজিতভাবে । ওদের মনে প্রশ্ন-ই-আলী কি করবে এখন?
ই-আলী অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি তাকাল শহীদের দিকে। মাস্ক পরার ফলে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না ওর আর কামালের। ই-আলী কুয়াশা-৩০
} ১৫১
শহীদের দিকে তাকিয়ে আছে নিমেষহীন দৃষ্টিতে, সে যেন মাঙ্কের আড়ালে শহীদের মুখের ভাব অনুমান করার চেষ্টা করছে।
* “সাচ্চা দাওয়াই” কি কথা বলিয়েছে ওকে?’
প্রথম বেডের অচেতন দেহটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানতে চাইল ই-আলী কঠিন কণ্ঠে। হার্টবিট দ্রুততর হয়ে উঠল শহীদের । সে কি উত্তর দেবে ই-আলীর প্রশ্নের? উর্দু ও বলতে পারে স্থানীয় অধিবাসীদের মতই, কিন্তু তার গলার স্বর কি অচেনা হিসেবে ধরা পড়ে যাবে? ডাক্তারের গলার স্বরের সাথে ই-আলী অতি পরিচিত হলে ধরা পড়বার আশঙ্কা ষোলা আনা। কিন্তু ইতস্তত করার সময় নেই। উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে সেন্ট্রিদের চোখে মুখে ফুটে উঠছে সন্দেহ। শহীদ মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে গলা বিকৃত করে উত্তর দিল, সাচ্চা দাওয়াই কথা বলায়নি, মাহমান্য ই-আলী। কারণ লোকটা আপনার সিক্রেট প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই জানে
।’
| শহীদ দেখল শয়তান ই-আলীর সারা মুখে ফুটে উঠল সন্তুষ্টির ছাপ। কিন্তু পরক্ষণেই হিংস্র কণ্ঠে গর্জন করে বলে উঠল সে, ‘এখনও একজন হারামী গুপ্তচর বন্দী হয়নি। আমার ভেপার গ্যাস নিশ্চয় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে তার! তার লাশ এবং তার সিক্রেট ক্যামেরা অবশ্যই পাওয়া যাবে। সুতরাং এক্ষেত্রে আমার সিক্রেট প্ল্যান সম্পূর্ণ নিরাপদ।
| কথাগুলো বলে বেডের উপর দুটি দেহের দিকে হিংস্র চোখে তাকাল ই আলী। তারপরই কর্কশ কণ্ঠে জানাল, আমি চাই, এই দুজন শত্রুপক্ষীয় গুপ্তচরকে হত্যা করা হোক।’
* ই-আলী কথা শেষ করে রূমের এদিক ওদিক তাকাল। হাই-ভল্টেজ ইনসিনারেটরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল তার। নিষ্ঠুর, শয়তানী ভাব খেলে গেল তার সারা মুখে। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল ভয়ানকভাবে, উঁচু গলায় আদেশ করল সে, “তোমরা দুই ডাক্তার মিলে দুজন গুপ্তচরকে ইনসিনারেটরে ঢুকিয়ে দাও এবং ধ্বংস কর নিঃশেষে। পুড়িয়ে ছাই করে দাও। এখুনি। আমি নিজের চোখে ওদের পোড়া ছাই দেখব।’
কথাগুলো হিংস্র কণ্ঠে বলে পিছিয়ে এল শয়তান ই-আলী; যেন পথ করে দিল শহীদ ও কামালকে ওরা যাতে অচেতন লোক দুজনকে হাই-ভল্টেজ কারেন্টের সুইচ অন করে দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে।
ই-আলীর পিছনে সশস্ত্র সেন্ট্রিরা শয়তানের হাসি হাসছে। শহীদ ও কামাল যদি ই-আলীর আদেশ অমান্য করে বা পালন করতে দেরি করে তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছে তারা।
১৫২
ভলিউম-১০
পাঁচ
দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং বিমূঢ়তার ফলে যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছে শহীদ। ই-আলীর মনে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। আর ইতস্তত করা চলে না। যা হবার হবে মনে করে শহীদ মুখ খুলল, বলল, কন্ট্রোলস চেক করে নিই, মহামান্য ই-আলী।’
| কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল শহীদ ধীরে ধীরে। কাবার্ডের দরজা খুলে দ্রুত ভঙ্গিতে কন্ট্রোল প্যানেল চেক করার নাম করে সরফরাজকে সতর্ক করে দেয়াই শহীদের উদ্দেশ্য।
| দরজা খুলে ভিতরে তাকাল শহীদ। প্রমুহূর্তে একটা বিস্ময় ধ্বনি গলা চিরে বের হয়ে আসতে চাইল ওর। কাবার্ডের ভিতর সরফরাজ খান নেই।
কোনরকমে মনের বিস্ময় বোধটা চেপে রাখল শহীদ। কন্ট্রোল প্যানেলে কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে ফিরে এল ও কামালের পাশে। আচমকা ই-আলী তার বিশাল দেহটা টান টান করে কঠিন কণ্ঠে বলল, “সময় নষ্ট করছ তোমরা । এক মিনিট সময় দিচ্ছি আমি। দুজন গুপ্তচরকে ইনসিনারেটরে ঢুকিয়ে এখুনি হত্যা কর-তা না হলে গুলি করব তোমাদেরকে।
শহীদ মেডিক্যাল মাস্কের আড়াল থেকে বলে উঠল কামালের উদ্দেশ্যে, বেড দুটো ইনসিনারেটরের কাছে নিয়ে এস।।
ইনসিনারেটরের পাশে বেড দুটোকে নিয়ে আসা হল। শহীদ পলকের মধ্যে একবার দেখে নিল ওখান থেকে কাবার্ডের দূরত্বটা। কুঁতকুঁতে চোখে ই-আলী ওর প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। কামাল শহীদের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ই-আলী সন্দেহ করতে শুরু করেছে কিছু একটা।’
কামাল ভুল বলেনি। বেড দুটোয় শায়িত অক্সিজেন মাস্ক পরা অচেতন দেহ দুটোর দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল সে। তারপর আরও কাছ থেকে কিছু পরীক্ষা করার জন্যে পা বাড়াল সেদিকে। পরবর্তী মুহূর্তে সে বেড দুটোর কাছে। পৌঁছে যাবে। এবং অচেতন যে-কোন একজন লোকের অক্সিজেন মাস্ক উঠিয়ে। দেখলেই সব প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
শহীদ আর সময় নষ্ট করল না। আগেই তার কাটার যন্ত্রটা হাতে নিয়ে রেখেছিল ও। আচমকা বিদ্যুৎবেগে পাওয়ার লাইনের মোটা তারের উপর সেটা বসিয়ে চাপ দিল। কেটে গেল তার। আলগা তারটা হাতে নিয়েই ইনসিনারেটরের স্টীলের দেহে ঘষে দিল সেটা। মাত্র দুই সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেল ব্যাপারটা । আগুনের শিখা দেখা দিয়েই নিভে গেল-বাতিল হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ফিউজ। অন্ধকার হয়ে গেল রুমটা। | শহীদ চাকাওয়ালা একটা বেডকে ধাক্কা মেরে পাঠিয়ে দিল ই-আলী যেদিকে
কুয়াশা-৩০
দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে, দ্বিতীয়টিকে গড়িয়ে দিল ও সবেগে সেন্ট্রিদের দিকে। সংঘর্ষ চিৎকার, গোঙানীতে ভরে উঠল রূমের অন্ধকার পরিবেশ।
কামালের একটা হাত শক্ত করে ধরে শহীদ কাবার্ডের কাছে এসে দাঁড়াল। কামালকে কাবার্ডের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও ঢুকল সময় নষ্ট না করে। ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিল ও দেয়াল-আলমারির দরজা। তারপর কামালের উদ্দেশ্যে উত্তেজিত গলায় বলল, “এর ভিতর থেকে বের হবার গোপন পথ নিশ্চয় একটা আছে কোথাও, তা না হলে সরফরাজ অদৃশ্য হয়ে গেল কী ভাবে!
কথা বলতে বলতেই পেন্সিল টর্চ জ্বেলে কাবার্ডের দেয়াল পরীক্ষা করতে লেগে গেছে শহীদ। ও ভাবছিল, সরফরাজ নিজের চেষ্টায় গুপ্তপথের সন্ধান নিশ্চয় পায়নি, কেননা ভয়ানক দুর্বল ছিল ও। নিজের অজান্তেই কোন বোর্তামে গায়ের ধাক্কা লেগে গিয়েছিল সম্ভবত, তার ফলেই চোরা পথ উন্মোচিত হয়, এবং সরফরাজ সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কিভাবে ধাক্কা লাগতে পারে তার গায়ের সাথে••• | শহীদ একমুহূর্ত মনে মনে চিন্তা করল। সরফরাজকে যেভাবে কামাল শুইয়ে দিয়েছিল কাবার্ডের ভিতর তাতে করে পিছন দিকের দেয়ালে লাগতে পারে শুধু তার শরীরের ধাক্কা। এই অনুমানের উপর নির্ভর করে কারার্ডের পিছন দিককার দেয়ালের ইটগুলোর ধাক্কা দিয়ে দেখতে শুরু করল শহীদ।
কামাল কাঁপা গলায় বলে উঠল, রূমের ভিতর আলো জ্বালিয়েছে ওরা।’
পরমুহূর্তে শোনা গেল ই-আলীর গর্জন, ভেঙে ফেল ওই কাবার্ডের দরজা। শয়তান দুটো ওর ভিতরই লুকিয়েছে!’
| সৌভাগ্যই বলতে হবে, সেই মুহূর্তেই দেয়ালের একটা ইটের উপর শহীদ চাপ দিতেই দেখা গেল দেয়ালটা মাঝখান থেকে দুফাঁক হয়ে যাচ্ছে।
দেয়ালটা প্রয়োজন মত ফাঁক হতেই কাবার্ডের ভিতর থেকে পা গলিয়ে বের হয়ে এল ওরা। সরু একটা প্যাসেজে নামল হাঁপাতে হাঁপাতে। দেয়ালটা বন্ধ হয়ে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার। ওরা শুনতে পেল কাবার্ডের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে ই-আলীর হিংস্র সেন্ট্রিরা। পরমুহূর্তে দরজাটা ভেঙে পড়ার শব্দ কানে ঢুকল ওদের। একজন লোকের চিৎকার শোনা গেল, গুপ্তচর দুজন এর ভিতর ছিল, মহামান্য ই আলী! এই যে, এটা দেখুন।
শহীদ কামালের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখে মেডিক্যাল মাস্কটা নেই, কাবার্ডের ভিতর ফেলে এসেছে ও। কামালকে দৌড়ুতে বলে শহীদ প্যাসেজ ধরে ছুটতে শুরু করল। খানিক দূর গিয়েই একটা মোড়। মোড় ঘুরতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। প্যাসেজের মেঝেতে সরফরাজ খান চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছে দেখা গেল। বাক্যব্যয় না করে ঝুঁকে পড়ে সরফরাজকে কাঁধে তুলে নিয়ে আবার দৌড়তে শুরু করল শহীদ। দৌড়তে দৌড়ুতে আবার একবার মোড় নিল ওরা। ১৫৪
ভলিউম-১০
এবার মোড় নিয়ে খানিক দূর এসেই কামাল বলল, “পরের মোড়ে দিনের আলো দেখা যাচ্ছে, শহীদ।’
| শহীদ তা আগেই লক্ষ্য করেছিল। প্যাসেজটা ধরে ছুটতে ছুটতে পিছন ফিরে তাকাল কামাল। তারপর বলল, শত্রুরা এদিকেই আসছে, পায়ের শব্দ পাচ্ছি, শহীদ!
আবার মোড় নিয়ে খানিক দূর গিয়েই নিরাশায় থমকে দাঁড়াল ওরা। সামনে পথ নেই। পনেরো ফুট উঁচু একটা দেয়াল পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে । বিমূঢ় হয়ে পড়ল শহীদ। সামনে পথ বন্ধ । পিছন দিক থেকে সশস্ত্র হিংস্র শত্রুরা ছুটে আসছে।
কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাণরক্ষা হবে না। শহীদ সরফরাজকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে সরু প্যাসেজের দুই দেয়ালের গায়ে দুই পা দিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা শুরু করল। প্রাণ বাঁচানো যেখানে প্রধান সমস্যা, সেখানে মানুষ অনেক অসম্ভব কাজই সমাধান করতে পারে চেষ্টা করলে । উপরে উঠে গেল শহীদ। তারপর, কামালকে হতভম্ব করে দিয়ে বিপরীত দিকে লাফ দিয়ে নেমে গেল সে। কামাল দেখল শহীদ দেয়ালের উপর নেই। •
শহীদের এমন অত্যাশ্চর্য আচরণের কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পেল না কামাল। শহীদ কি নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল? এমন বিপদেও নিজের মনের অবাস্তব প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল কামাল। শহীদ নিজের জীবন নিয়ে পালাবে একথা ভাবাও পাপ। অপেক্ষা করতে লাগল কামাল। কিন্তু মনে মনে অধৈর্য না হয়ে উপায় ছিল না ওর। সশস্ত্র সেন্ট্রিদের পদশব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে।
| হঠাৎ দেখা গেল শহীদ দেয়ালের উপর উঠে এসেছে আবার। টেনে হিঁচড়ে । একটা স্ট্রেচার তুলল ও দেয়ালের উপর। সেটা কামালের দিকে নামিয়ে ধরে ও বলল, সরফরাজকে বেঁধে দে, স্ট্রেচারের বেল্ট দিয়ে।
কামাল ঝটপট বেল্ট দিয়ে বেঁধে স্ট্রেচারটা খাড়া করে ধরা দেয়ালের সঙ্গে। শহীদ যতটা সম্ভব ঝুঁকে পড়ে স্ট্রেচারের নাগাল পেতেই টেনে তুলে ফেলল সেটাকে দেয়ালের উপর। চওড়া দেয়ালের উপর স্ট্রেচারটা রেখে কামালকে উঠতে সাহায্য করল ও।
কামাল দেয়ালের উপর উঠে দেখল নিচেই একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সের ছাদে নামল ওরা প্রথমে স্ট্রেচার নিয়ে। ছাদ থেকে কাঁকর বিছানো উঠনে। উঠন থেকে স্ট্রেচারটা অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর তুলে নিজেরাও ঢুকে পড়ল একে একে। শহীদ বসল ড্রাইভিং সিটে। চলতে শুরু করল অ্যাম্বুলেন্স।
‘অপেক্ষাকৃত স্বস্তির সঙ্গে শ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকাল শহীদ। বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে তৈরি দুর্গের গেটটার দিকে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। বন্ধ গেট। গতি কম : করে ফেলছে শহীদ। এমন সময় শব্দ হল প্রচণ্ড । কুয়াশা-৩০
১৫৫
•• •
•
।
অ্যাম্বুলেন্সের উইস্ক্রীন ফেটে গেল, সম্পূর্ণ কাঁচটা হাজার হাজার ফাটা রেখায় ভরে গেল পলকের মধ্যে। অদৃশ্য কোন সেন্ট্রি গুলি করেছে। শহীদ দেখতে পাচ্ছে
কিছু ফাটা কাঁচের মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু কালক্ষেপ করল না শহীদ। উইণ্ডস্ক্রীনের উপর প্রচণ্ড বেগে ঘুসি বসিয়ে দিল ও একটা। কাঁচ ভেঙে খানিকটা গর্তের সৃষ্টি হল। গেটের এককোনায় একজন
সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়বার গুলি করার জন্যে রাইফেল তুলছে সে।
শহীদ বাড়িয়ে দিল গাড়ির বেগ। নতুন গতি পেয়ে লাফ দিয়ে হু হু করে ছুটে চলল গাড়ি সোজা বন্ধ গেটের দিকে।
সেন্ট্রিটা বিপদ টের পাবার আগেই ধাক্কা খেল, রাইফেলটা গাড়ির সঙ্গে লেগে তার কপালে আঘাত হানল সজোরে। পরমুহূর্তে বন্ধ কাঠের গেটের উপর ধাক্কা মারল অ্যাম্বুলেন্স।
ভারি বনেটটা কাঠের গেট ভেঙে বেরিয়ে এল। দুর্গের পরিখার উপর ব্রিজের দিকে ছুটে চলল এবার গাড়ি। গাড়ির বনেট এবং বাম্পারে কাঠের ও বাঁশের টুকরো দেখে ব্রিজের একজন সেন্ট্রি চিৎকার করে উঠল, ব্রিজ বন্ধ করে দাও!
শহীদ উইশুক্রীনের গর্ত দিয়ে দেখল একজন সেন্ট্রি লাফিয়ে উঠে কাকর বিছানো উঠনের উপর দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুটল। দেয়ালের গায়ে ব্রিজের লোহার গেট বন্ধ করার সুইচ।
শহীদ ব্রিজের দিক থেকে অ্যাম্বুলেন্সের মুখ ঘুরিয়ে ছুটন্ত সেন্ট্রিটার দিকে দিল। সেন্ট্রিটা সুইচের’ কাছে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা টিপে দেয়ার জন্যে, কিন্তু গাড়ির শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে দেখল তাকে লক্ষ্য করেই গাড়িটা সাক্ষাৎ আজরাইলের মত ছুটে আসছে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই দেয়ালের সঙ্গে পিষে চ্যাপ্টা করে দেবে তাকে। মৃত্যু ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সেন্ট্রি। চোখ বন্ধ করেই খিচে দৌড় মারল ।।
শহীদ বন বন করে ঘুরিয়ে দিল হইল। দেয়ালের গায়ে ধাক্কা লাগতে লাগতেও লাগল না, আধা চক্কর মেরে ব্রিজের দিকে মুখ করল অ্যাম্বুলেন্স। পিছন থেকে সেন্ট্রিদের মেশিনগান, গর্জে উঠল। শহীদ গাড়ি সোজা না চালিয়ে আঁকাবাঁকা করে চালাতে লাগল । ড্র-ব্রীজ অতিক্রম করল অ্যাম্বুলেন্স।
পাহাড়ের দিকে মুখ করে ছুটে চলল অ্যাম্বুলেন্স। কামাল ও সরফরাজ স্ট্রেচারের উপর বসে আছে হাতল ধরে। সরফরাজ উঠে বসেছে খানিক আগে। অনেকটা সুস্থবোধ করছে সে। শহীদ বলল, পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বর্ডারের দিকে চালাচ্ছি গাড়ি, কামাল।’
কামাল মাথা নেড়ে সায় দিল। রাস্তাটা ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। উপর দিকে উঠছে গাড়ি সবেগে। শহীদ ভাবছিল, ই-আলী নিশ্চয় চরম এবং শেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, তার এলাকা থেকে যাতে ওরা পালিয়ে না যেতে পারে।
১৫৬
ভলিউম-১০
সরফরাজকে সে কোনক্রমেই বর্ডার টপকে পালাতে দিতে চাইবে না, এই ভয়ে যে সরফরাজ হয়ত তার সিক্রেট প্যান এবং জিরো আওয়ার সম্পর্কে বহু তথ্য জানে।
কামাল গাড়ির পিছন দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, পিছন পিছন কোন গাড়ি আসছে না, শহীদ।’
শহীদ স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তার দিকে। চরম গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। ক্রমশ-উঁচু রাস্তাটা হঠাৎ সমান হয়ে গেছে। সমতল রাস্তার উপর দিয়ে ছুটে চলল অ্যাম্বুলেন্স। তারপরই গাড়ি গিয়ে উঠল বিরাট লম্বা একটা ভায়াডাক্টে-উঁচু এবং বহুদূর বিস্তৃত পুল। বহু নিচ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। শহীদ বলল, পাহাড়ের নিচে রেললাইন, ব্রিজের উপর দিয়ে চলেছি আমরা। কোন গার্ড দেখা যাচ্ছে না। ইরান থেকে এই রেললাইনই আফগানিস্তান অবধি গেছে বলে মনে হয়।’
হঠাৎ চুপ করল শহীদ। অকস্মাৎ পাহাড়ের পিছন থেকে একটা হেলিকপ্টারের অগ্রভাগ দেখা গেল আকাশে। কপ্টারটা সোজা উড়ে আসছে ব্রিজের দিকে, অ্যাম্বুলেন্সের দিকে মুখ করে। শহীদ চাপা উত্তেজনায় বলে উঠল, আক্রমণ করতে আসছে কপ্টারটা, সাবধান!
শহীদ শুধু আশঙ্কা প্রকাশ করল, কিন্তু কামাল দেখতে পেল কপ্টার থেকে গান-ফায়ারের ঝলক। ও বলে উঠল, ‘ভায়াডাক্ট পেরিয়ে যাবার আগেই আমাদেরকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছে ই-আলী রেডিওর মাধ্যমে।
‘আমারও সে বিশ্বাস,’ মন্তব্য করল সরফরাজ কাঁপা গলায়। কপ্টারটা নাক
কাপগয়কার মক নিচু করে তেড়ে এল অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। মেশিনগানের গুলি অনর্গল ছুটে আসছে উপর থেকে। কপ্টারটা মাত্র পঞ্চাশ ফুট উপর দিয়ে উড়ে গেল। চক্কর মেরে এগিয়ে আসছে আবার। অকস্মাৎ ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলল শহীদ ব্রিজের মাঝখানে।
‘নেমে পড়!’
কামাল ও সরফরাজ অ্যাম্বুলেন্সের পিছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়ে দৌডুল শহীদের দিকে। শহীদ ইতিমধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের এক দিকের রেলিং টপকাচ্ছে।
| রেলিং টপকে ব্রিজের নিচে গা-ঢাকা দিল শহীদ। কামাল এবং সরফরাজ পরমুহূর্তে কাঠের ব্রিজের নিচে শহীদের পাশে এসে দাঁড়াল। শহীদ মন্তব্য করল, কপ্টারের পাইলট দেখতে পাবে না এখানে আমাদেরকে।
| ওরা আরও ভিতর দিকে সরে গিয়ে দাঁড়াল। কামাল স্বস্তির হাসি হেসে বলে উঠল, যতক্ষণ গুলি আছে ততক্ষণ মেশিনগান চালাবে ওরা। তারপর ফিরে না গিয়ে উপায় নেই ব্যাটাদের। ওরা থাকতে আমরা বেরুচ্ছি না এখান থেকে।’
কুয়াশা-৩০
১৫৭
শহীদ শুনল কথাগুলো, কিন্তু মন্তব্য করল না, কোন। ওর বিস্মিত দৃষ্টি তখন ব্রিজের অদূরবর্তী শূন্যে একজোড়া বুট জুতো পরা পায়ের দিকে নিবদ্ধ। পা দুটো দড়ির সঙ্গে বাঁধা, ধীরে ধীরে আরও নিচে নামতে দেখা যাচ্ছে, পায়ের পর দৃষ্টি সীমার মধ্যে এল প্যান্ট পরিহিত একজন লোকের ঊরু, কোমর, বুক, মেশিনগান ধরা দুটো হাত এবং সর্বশেষ একটা মাথা। হেলিকপ্টার থেকে দড়ির সিঁড়িতে বেঁধে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ই-আলীর একজন সশস্ত্র অনুচরকে। শহীদ, কামাল এবং সরফরাজকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে।
ব্রিজের কাছাকাছি আরও সরে এল কপ্টারটা। ফলে খুলন্ত মেশিনগানধারীও সরে এল আরও কাছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সেশহীদদেরকে। কপ্টারটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মেশিনগানধারী তার মেশিনগান উঠিয়ে লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করছে। সিঁড়িটা এখনও এদিক-ওদিক দুলছে।
হঠাৎ ঠা ঠা ঠা ঠা করে শব্দ শোনা গেল। মেশিনগান চালাচ্ছে ঝুলন্ত লোকটা। লক্ষ্য ব্যর্থ হল তার। ঝুলন্ত সিঁড়িটা দুলছে বলে লক্ষ্য স্থির রাখা সম্ভব হল না। এতক্ষণ দুলছিল সিঁড়িটা, এবার পাক খেতে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
কামাল চঞ্চল হয়ে উঠল, একবার ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এর পরের বার কি হবে?”
| ঝুলন্ত সিঁড়িটা একবার পাক খেয়ে আবার যথাযথ স্থানে এসে দুলছে। মেশিনগান তুলে ঝুলন্ত লোকটা আবার লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করছে। কপ্টারটা ইতিমধ্যে সরে এসেছে আরও। ফলে ব্রিজের মুখ থেকে ঝুলন্ত লোকটার দূরত্ব মাত্র দুহাত কি আড়াই হাত।
শহীদ পরিষ্কার বুঝতে পারছে এবার আর লক্ষ্য ব্যর্থ হবে না লোকটার । লুকোবার কোথাও কোন জায়গা নেই। পালাবারও উপায় নেই। তাছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা করার মতও সময় নেই হাতে। অর্থাৎ সমুখে সাক্ষাৎ মৃত্যু।
ঝুলন্ত মেশিনগানধারীর ঠোঁট দুটো নিষ্ঠুর বিজয়ী হাসিতে ফাঁক হয়ে গেল । ফাঁদে ফেলেছে সে তিনজন পাকিস্তানী স্পাইকে।
ছয়.
ঝুলন্ত সিঁড়িটা স্থির হয়ে আসছে। ঝুলন্ত মেশিনগানধারী লক্ষ্য স্থির করছে নির্মম হাসিতে ঠোঁট ফাঁক করে। শহীদ সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চেয়ে আছে। বুলেট বিধে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ব্রিজের কিনারার কাঠের দিকে। অকস্মাৎ বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে উঠল শহীদ। এমনই অসম্ভব বেগে লাফ দিল শহীদ যে কামাল ওর অঙ্গভঙ্গি অনুসরণ করতে পারল না চোখ দিয়ে। চোখের পলকে বুলেট বিঁধে ঝাঁঝরা হয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া লম্বা একটা কাঠের টুকরো টেনে তুলে
১৫৮
ভলিউম-১০
নিয়েই ঘুরিয়ে মেরে দিল কয়েকহাত দূরে শূন্যে ঝুলন্ত মেশিনগানধারীর চোয়ালে।
প্রচণ্ড ঘা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল মেশিনগানধারী। হাত হতে খসে পড়ল তার মেশিনগান। শহীদ আবার একবার বিদ্যুৎগতিতে নড়ে উঠল। একহাতে ধরে ফেলল ও মেশিনগানটা, অপর হাতে ধরল দোলায়মান সিঁড়ির দড়ি। মেশিনগানটা পিছন দিকে কামালের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে সিঁড়ির দড়ি ছেড়ে দিল শহীদ।
| হেলিকপ্টারের পাইলট বুঝতে পারল বিপদটা। সরে গেল সে কপ্টার নিয়ে। ঝুলন্ত লোকটাও ক্রমশ দূরে সরে গেল। ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগল কপ্টারের যান্ত্রিক ধ্বনি। শহীদ দ্রুত চিন্তা করছিল। সরফরাজকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম। করতেই হবে। সে ই-আলীর সিক্রেট প্ল্যানের অনেক তথ্য জানে। তাছাড় শহীদের কাছে রয়েছে ক্যামেরা রেকর্ড-ওয়ার্ল্ড ম্যাপ এবং রহস্যময় লাল ফ্ল্যাগের।
| কামাল গর্বিতভাবে হাসল শহীদের দিকে ফিরে। কপ্টারটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওরা ব্রিজের নিচ থেকে বেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে এল। কামাল নিরাশ কণ্ঠে ঘোষণা করল, অ্যাম্বুলেন্সের বারোটা বেজে গেছে বুলেট লেগে-চারটে চাকাই নষ্ট!
কামালের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল শহীদ, আবার ব্রিজের নিচে চলে আয়, কামাল! ট্রাক ভর্তি সেন্ট্রি আসছে!’
শহীদের আগেই কামাল এবং সরফরাজ আবার আত্মগোপন করল রেলি টপকে ব্রিজের নিচে। শহীদ ছুটল অ্যাম্বুলেন্সের কাছ থেকে। ও দেখল পাহাড়ের বাঁক ঘুরে দ্রুতবেগে একটা ভারী ট্রাক সগর্জনে ছুটে আসছে ব্রিজের দিকে। ট্রাকের উপর দাঁড়ানো সেন্ট্রিদের হাতের মেশিনগানগুলো দেখা যাচ্ছে। রেলি টপকাতে শুরু করল শহীদ। এমন সময় গর্জে উঠল একসঙ্গে কয়েকট মেশিনগান। শহীদ রেলিং ধরে ঝুলে পড়ে নেমে পড়ল.ব্রিজের নিচে। মেশিনগানট ওর হাতেই রয়েছে। মাথাটা তুলে ট্রাকের দিকে উঁচিয়ে ধরল মেশিনগানটা। শুর করল ফায়ারিং, দাঁতের উপর দাঁত চেপে।
প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিতে লাগল মেশিনগানের গর্জন। আধ মিনিটে আড়াইশে গুলি বেরিয়ে গেল। খালি হয়ে গেল মেশিনগান। আর কোন কাজে লাগবে ন বুঝতে পেরে সেটাকে নিচের দিকে ফেলে দিল শহীদ। কামাল দেখল মেশিনগানট; সবেগে পড়ে যাচ্ছে নিচের রেল পথের দিকে। পরমুহূর্তে চিৎকার করে উঠল
শহীদ, নিচের রেললাইন দিয়ে একটা রেলগাড়ি আসছে!’
শহীদ ট্রেনটাকে আগেই দেখেছিল। একমহুর্ত কি যেন ভাবল ও। তারপ দ্রুত এবং উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ব্রিজের সাপোর্ট বেয়ে নামব আমরা
জলদি! ট্রেনটা হয়ত সীমান্তের দিকে যাচ্ছে।’
| খাজ কাটা কাঠের পিলার বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিল ও কুয়াশা-৩০
১৫৯
কামাল ও সরফরাজ নামতে শুরু করেছে আগেই।
দেখতে দেখতে বহু নিচে নেমে এল ওরা। ট্রেনটা একটা মালগাড়ি। এখনও এসে পৌঁছয়নি। রেললাইনের পাশেই কাঠের সাপোর্টটা। ওরা তিনজন সেটার উপর অপেক্ষা করছে। লাইনটা হাত তিনেক দূরে। এসে পড়ল ট্রেন। ড্রাইভার লক্ষ্য করেনি ওদেরকে।
শহীদ নিচের দিকে, ট্রেনটার ছাদের উপর তাকাল। ট্রেনের ছাদ ওদের কাছ থেকে দুহাত দূরে, এবং হাত খানেক নিচে। শহীদ বলল, কামাল, তোরা নেমে পড় আগে ট্রেনের ছাদে। যেদিকে ছুটছে ট্রেনটা সেদিকে মুখ করে নামবি, নেমে দৌড়ে যাবি খানিকটা। তারপর বসে পড়বি বগির কিনারার কার্নিস ধরে। তোরা নামলেই ওই একই বগির ছাদে আমি নামব।’
নেমে পড়ল কামাল ও সরফরাজ শহীদের পরামর্শ অনুযায়ী, প্রায় একই সময়ে নামল শহীদও।
ট্রেনের ছাদ থেকে একটা বগির দরজার হাতলে পা দিয়ে শহীদ পা দানিতে নামল। তালা মারা রয়েছে দরজায়। পকেট থেকে টুকরো সেলুলয়েড বের করে তালা খুলতে সময় লাগল ওর মিনিট দুয়েক। বগির ভিতর ঢুকল ও। ভিতরে। তুলোর বস্তা রয়েছে থাক থাক। কামাল ও সরফরাজকে নেমে আসতে বলল। শহীদ। ওরা নেমে এসে ভিড়িয়ে দিল দরজা। ট্রেনটা আফগানিস্তানের সীমান্তের । দিকে যাচ্ছে বলে ধারণা শহীদের। আফগানিস্তানে পৌঁছুতে পারলেও কাজ হবে। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে ওখান থেকে । একবার যোগাযোগ করতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ধ্বংস করে দেবে শয়তান ই-আলীর ভয়ঙ্কর প্ল্যান-প্রোগ্রাম। হঠাৎ বাধা পড়ল শহীদের চিন্তায়। ট্রেনের গতি কমে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে তাকাল শহীদ। নিরাশাব্যঞ্জক একটা ধ্বনি বেরিয়ে এল ওর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।
শহীদ দেখল সামনেই একটা প্ল্যাটফর্ম। বহু লোকের ভিড় রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। স্টেশনে থেমে পড়বে গাড়ি। স্টেশন চিনতে এতটুকু অসুবিধে হল না শহীদের। তথাকথিত ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ডের’ ‘লাব্বা স্টেশন এটা। ট্রেনটা সীমান্তের দিকে না গিয়ে ফিরে এসেছে সেই শহরে, যেখানে প্যারাশুট করে রাতে নেমেছিল শহীদ ও কামাল। অর্থাৎ এই রেলগাড়ি শয়তান ই-আলীরই যাতায়াত ব্যবস্থার একটি। প্ল্যাটফর্মে সশস্ত্র সেন্ট্রিদেরকে দেখে শহীদ বুঝতে পারল তাদের খোঁজেই ওরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। থেমে গেল ট্রেন।
| তুলোর বস্তার সাজানো থাকের আড়ালে আত্মগোপন করল ওরা। পরমুহূর্তে শহীদ ভাবল ই-আলীর সেন্ট্রিরা নিশ্চয় ট্রেনের প্রতিটি কামরায় তন্ন তন্ন করে খুঁজবে তাদেরকে। দ্রুত চিন্তা করছিল শহীদ। এমন সময় কামরার বাইরে চাঞ্চল্য জেগে উঠল । শহীদদের কামরার দরজার তালা খোলা। দুজন লোক উত্তেজিত
ভলিউম-১০
১৬০
গলায় কারণ নিরূপণ করার চেষ্টা করছে। দরজাটা খুলে গেল। কামরার ভিতর উঠে পড়ল দুজন লোক। দুএক মুহূর্তের মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে এবার ওরা।
শহীদ হাতঘড়ির ক্ষুদ্র কন্ট্রোল চাবিটা ঘুরিয়ে ট্রান্সমিটারটা চালু করে দিল। পরক্ষণেই শুরু হল–টিক-টাক, টিক-টাক, টিক-টাক শব্দ। বেশ জোরেশোরেই। হতে লাগল শব্দগুলো। কামরার ভিতর দণ্ডায়মান লোক দুজন হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল একজন, ‘পালাও! টাইম বোমা আছে তুলোর বস্তার আড়ালে!
লাফিয়ে কামরা থেকে নেমে গেল দুজনই! শহীদ সময় নষ্ট না করে দ্রুত বেগে উঠে দাঁড়িয়েই বলে উঠল, আমার সঙ্গে আয়, কামাল?’
কামরার অপর দিকের দরজা খুলে লাফিয়ে পড়ল শহীদ। কামাল ও সরফরাজও নামল। তারপরই শোনা গেল গুলির শব্দ। প্ল্যাটফর্ম থেকে একজন সেন্ট্রি ওদেরকে ট্রেনের বিপরীত দিকে নেমে পড়তে দেখে গুলি চালিয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমেই পরপর কয়েকটা রেললাইন টপকাতে টপকাতে ছুটে চলল ওরা। ওদের সামনেই একটা ট্রেন, সবেমাত্র চলতে শুরু করেছে সেটা। ট্রেনটার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত অবধি দৃষ্টি বুলিয়ে নিল শহীদ। কোন কামরার দরজাই খোলা নেই। কামালের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল, ট্রেনের পিছনে লোহার আঙটার উপর উঠে পড়তে হবে, কামাল!’
ট্রেনের বন্ধ দরজার সামনের পা-দানিতে উঠবার কোন উপায় ছিল না। কেননা ট্রেন ওদেরকে ছাড়িয়ে চলে গেছে তখন। পিছন পিছন রেললাইন ধরে দৌড়ে কামাল উঠে পড়ল পিছনের লোহার আঙটার উপর। সরফরাজও উঠল তারপর। শহীদ উঠল সকলের শেষে। ট্রেনটা তখন বেশ জোরে চলতে শুরু করে দিয়েছে।
খানিকদূর যাবার পরই দেখা গেল রেললাইনের পাঁচ-সাত হাত দূর দিয়ে একই দিকে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে। কামাল রাস্তার পিছন দিকে তাকিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, শহীদ, পিছন দিকে দেখ!’
| পিছন দিকে তাকিয়ে শহীদ দেখল পাকা রাস্তা দিয়ে ভীষণ বেগে ছুটে আসছে একটা মটর গাড়ি। ড্রাইভারের পাশের সিটের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ছাদটা ওঠানো। লোকটার হাতে পিস্তল। ওদের দিকেই কুৎসিত হাসিতে মুখ বিকৃত করে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে কাছে চলে এল গাড়িটা। লোকটা পিস্তলের লক্ষ্য স্থির করল ওদের তিনজনের দিকে।
শহীদ ইতিমধ্যেই পকেট থেকে একটা কাঁচের বল বের করে মুঠো করে ধরেছিল। মটর গাড়ি থেকে গুলি ছোটার আগের মুহূর্তে বলটা হাত ঘুরিয়ে ঘঁড়ে দিল ও গাড়ির বনেটের উপর। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হল সেটা। পাকের মধ্যে আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। কালো ধোয়ায় ভরে গেল চারদিক। মটর গাড়ির ড্রাইভার ১১-কুয়াশা-৩০
১৬১
কিছুই দেখতে পেল না চোখের সামনে। হুইল ঘুরিয়ে ধোয়া মুক্ত হতে চাইল সে। ফলে গাড়িটা রাস্তার বিপরীত দিকের ঢালু কিনারায় গিয়ে পৌঁছুল। তারপর অকস্মাৎ ক্রমশ নিম্নমুখী পাথুরে জমির উপর থেকে নামতে শুরু করল, কিছুদূর। স্বাভাবিকভাবে নেমে গিয়ে হঠাৎ উল্টে গেল সেটা, উল্টতে উল্টাতে নেমে চলল আরও নিচের দিকে।
| গাড়িটা ধ্বংসের পথে অদৃশ্য হয়ে যাওয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শহীদ। কিন্তু স্বস্তিটুকু নিমেষে উবে গেল সরফরাজের হাঁপাননা, যন্ত্রণাক্ত গলা শুনে, আমি আর পারছি না রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে!’
ট্রেনটাকে যেভাবেই হোক দাঁড় করাতে হবে। এক মুহূর্ত চিন্তা করল শহীদ। তারপর দ্রুত রড ধরে ট্রেনের ছাদের উপর উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল ও, কামাল ও সরফরাজের চোখের সামনে থেকে। ছাদের উপর থেকে বগিটার জানালার সামনে ঝুলে পড়ল শহীদ। জানালার কাঁচ ভাঙল ও পরপর দুটো ঘুসি মেরে। দ্রুত ঢুকে পড়ল ও ভাঙা জানালা দিয়ে খালি কামরার ভিতরে। কামরার দেয়ালে ওয়ার্নিং চেন ধরে সজোরে টান মারল ও। সময় নষ্ট না করে আবার জানালা গলে ট্রেনের ছাদের উপর উঠে পড়ল। ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছে, টের পেল শহীদ। রড় ধরে বুলে আবার কামালদের কাছে নেমে এল ও। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ট্রেনটা থেমে গেলেই নেমে পড়ব আমরা। দৌড়ে দূরে সরে যেতে হবে আমাদেরকে। আমার পিছন পিছন দৌড়বি তোরা, কামাল।’
কথাগুলো বলে বাঁ দিকে তাকাল শহীদ। বেশ খানিকটা দূরে বনভূমি দেখা, যাচ্ছে। ট্রেনটা থেমে গেল। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল তিনজন। শহীদকে অনুসরণ করে ছুটল ওরা প্রাণপণে।,
ট্রেনের গার্ড ট্রেন থেকে নেমে চেন কোন কামরা থেকে টানা হয়েছে তা আবিষ্কার করার আগেই বনভূমিতে প্রবেশ করল ওরা তিনজন হাঁপাতে হাঁপাতে।। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল সরফরাজ। বেচারার মাথায় চোট লেগেছিল বলে বেশি ধকল সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে শহীদের উদ্দেশে বলল, আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার! সময় মত ট্রেন যদি না থামাতেন নির্ঘাৎ নিচে পড়ে যেতাম আমি।’
‘এখন ভাল বোধ করছেন তো?’
হ্যাঁ, ধন্যবাদ।’
শহীদ বলল, আলাপ করা যাক,মি. সরফরাজ। আপনার কেবিনে যখন শত্রুপক্ষের মর্টারব এসে আঘাত করে তখন আপনি বলতে যাচ্ছিলেন ই-আলীর সিক্রেট স্কীম-সম্পর্কে। বলুন দেখি, রহস্যটা কি সিক্রেট স্কীমের?’
. লম্বা শ্বাস নিয়ে সরফরাজ খান বলল, শয়তান ই-আলী তার এজেন্টদেরকে ডেকে হাজির করেছে প্রত্যেককে একটা করে প্যাকেট দেবার জন্যে। ইতিমধ্যেই ১৬২
ভলিউম-১০
হয়ত ওই এজেন্টরা পৌঁছে গেছে তারা। প্রত্যেক এজেন্টকে হুকুম দেয়া হয়েছে তারা যে যে দেশে কাজ করছে সেই সেই দেশের শহরের রেডিও স্টেশনে একটা করে প্যাকেট রেখে আসার।
‘প্যাকেটগুলোয় কি আছে?
সরফরাজ শহীদকে রীতিমত চমকে দিয়ে বলল, মাইক্রো ইলোজেন বোমা আছে প্রতিটি প্যাকেটে। বোমাগুলো শুধুমাত্র শয়তান ই-আলীই বিজোরিত করার ক্ষমতা রাখে। জিরো পাস টু আওয়ারে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে’ আক্রমণ চালাবে সে এই মাইক্রো হাইড্রোজেন বোমা দিয়েই। জিরো গাল টু আওয়ারে সুইচ টিপবে সে আর একটা। দুর্গের কন্ট্রোলরূমে সুইচবোর্ড তার। এ থেকে সুইচ টিপে বিভিন্ন দেশের রেডিও স্টেশন উড়িয়ে দেবে সে। সুই শি সে আক্রমণ করবে পাকিস্তানকে। সুইচগুলো ট্রান্সমিট করে একটা সিক্রেট যাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও কন্ট্রোল বীম। শুধুমাত্র সিক্রেট রেডিও বীমের নারাই হাইড্রোজেন বোমাগুলো ফাটানো সম্ভব। জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সীমান্তে এবং বিভিন্ন দেশের রেডিও স্টেশনে বোমাগুলো স্থাপন করবে ই-আলীর এজেন্টরা। জিরো পাস টু আওয়ারে দুটো সুইচই টিপবে ই-আলী। দুঘন্টা সময় পাৰে। এজেন্টরা নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসার জন্য।’
শহীদের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে উঠল, কিন্তু এসব ধ্বংসাত্মক কাও কেন করতে যাচ্ছে ই-আলী? তার এই ভয়ঙ্কর প্যানের পিছনে উদ্দেশ্যটা কি?’
মাইক্রো-হাইড্রোজেন বোমাগুলো ফাটাবে সে দুনিয়ার ধনী দেশগুলোর শহরে। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড করে ই-আলী সাবধান করে দেবে ওই সব দেশগুলোকে, তার হুকুম অমান্য করার সাহস যাতে না হয়। হুকুমটা হমোেটা টাকার প্রচুর সোনা দিতে হবে তাকে। পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করার পর সোনার দরকার হবে
তার।’
| কামাল বলে উঠল, কিন্তু সে-সব দেশ অকারণে ই-আলীর দাবি মেনে না নিয়ে শয়তানটাকে ধবংস করার জন্যে বোমারু বিমান পাঠিয়ে আক্রমণ করতে পারে।’ ।
সরফরাজ মাথা নেড়ে কাম,লকে বাধা দিয়ে বলল, না। এখানেই চমৎকার ফন্দি খাঁটিয়েছে ই-আলীকোন দেশই ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না কারা বোমা ফাটাচ্ছে বা কারা বেনামী চিঠি পাঠিয়ে সোনা দাবি করছে।’ । ‘
শহীদ প্রশ্ন করল; তাহলে সোনা কিভাবে সংগ্রহ করবে ই-আলী? ‘
ই-আলী প্রত্যেক রাষ্ট্রকে হুকুম করবে নিদিষ্ট পরিমাণ সোনা পানির জাহাজ.. করে আরব সাগরের নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষারত একটা সাবমেরিনে পৌঁছে দেবার। যদি তার হুকুম অগ্রাহ্য করা হয় বা সাবমেরিনটাকে অনুসরণ বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয় তাহলে আরও ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়ে ধ্বংস করে কুয়াশা-৩০
১৬৩
দেয়া হবে অগ্রাহ্যকারী দেশগুলোকে।
কামাল জিজ্ঞেস করল, “এত ‘সোনা নিয়ে কি করবে ই-আলী?
‘পাকিস্তানের ভূ-খণ্ড দখল করে সে একটা রাষ্ট্র সৃষ্টি করবে। সেই রাষ্ট্রকে রক্ষা করবার জন্যে এবং তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সে চায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান আর্মি এবং এয়ারফোর্স বাহিনী তৈরি করতে। অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন, ফাইটার, প্লেন ইত্যাদি সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্যে শত শত মণ সোনার দরকার তার।’
শহীদের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল। ধিকি ধিকি জ্বলছে ওর চোখের দৃষ্টি। কঠোর কণ্ঠে প্রতিজ্ঞা করল ও, শয়তান ই-আলী অবশ্যই ধ্বংস হবে। ই-আলী ধ্বংস হলে তার এজেন্টরাও সেই সঙ্গে অসহায় হয়ে পড়বে। নষ্ট করবার মত সময় নেই আমাদের হাতে। ই-আলীকে চরম শাস্তি দিতে হবে এখুনি।
শহীদের কথার সঠিক মর্ম উদ্ধার করতে পারল না কামাল এবং সরফরাজ। প্রশ্ন করে অর্থটা জানার ইচ্ছা হচ্ছিল কামালের। কিন্তু তার আগেই শহীদ গভীরভাবে কি যেন শুনতে শুনতে বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, শুনতে পাচ্ছিস, কামাল? হেলিকপ্টার!
কান পাততেই কামাল এবং সরফরাজ শুনতে পেল হেলিকপ্টারের শব্দটা। সরফরাজ বলল, এটা নিশ্চয়ই সেই প্রথম হেলিকপ্টারটা, যেটা আক্রমণ করেছিল ব্রিজের নিচে, আমাদেরকে।’
শহীদ বলল, আমি একটা প্ল্যানের কথা ভাবছি, কপ্টারটাকে ই-আলী আমার ক্যামেরাটা সংগ্রহ করার জন্যে চরম আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছে। সেই সুযোগটাই গ্রহণ করব ভাবছি।’
এবারও শহীদের কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারল না ওরা। | ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠল কপ্টারের গর্জন। তারপর, হঠাৎ শহীদ বলল, কপ্টারটা ঠিক আমাদের মাথার উপর এসে পড়েছে!’
কিন্তু কপ্টারটাকে দেখতে পাচ্ছিল না ‘ওরা কেউ। মাথার উপর গাছের আড়াল। শহীদ হঠাৎ নড়ে উঠে বলল, শোন, কামাল। আমি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ওই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে দৌড়ে ওই দিকের জঙ্গলের দিকে ছুটতে শুরু করব। ফাঁকা জায়গাটায় আমাকে দেখতে পেলেই গুলি করবে ওরা.। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব বাসের ওপর। কপ্টারটা তখন নিচে নামবে ক্যামেরাটা আমার কাছ থেকে উদ্ধার করার জন্যে। ওরা মনে করবে আমি গুলি খেয়ে নিহত হয়েছি। ঝুঁকিটা নিতেই হচ্ছে, সত্যি সত্যি গুলি খেতেও পারি আমি। হেলিকপ্টার, থেকে একজন আমার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে ক্যামেরাটা নেবার জন্যে। ঠিক তখনই তুই এই আগুনে-পটকাটা ফাটাবি।’
শহীদ কামালকে একটা ছোট সিলিণ্ডার দিল পকেট থেকে বের করে। তারপর ১৬
ভলিউম-১০.
আর কোন কথা না বলে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে ছুটতে লাগল ফাঁকা জায়গাটার উপর দিয়ে। মাত্র পনেরো বিশ হাত দূরে যেতেই গর্জে উঠল মেশিনগান কপ্টার থেকে, শহীদের উদ্দেশে।
হাত-পা মেলে দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল শহীদ ফাঁকা জায়গাটায়। কামাল ও সরফরাজ শক্ত হয়ে উঠল। শহীদ কি সত্যি সত্যি অভিনয় করল পড়ে গিয়ে? নাকি লেগেছে গুলি? শহীদের নিঃসাড় দেহের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরত্ব রেখে কপ্টারটা নেমে পড়ল ফাঁকা জায়গাটার উপর। একজন ইউনিফর্ম পরিহিত লোক নামল কপ্টার থেকে। তার হাতে রিভলভার। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
সে শহীদের নিঃসাড় দেহটার কাছে। | কামাল চিৎকার করে উঠতে চাইছিল। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল ও। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল শহীদের নির্দেশের কথা। উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল ও কথাটা। বিদ্যুৎবেগে আগুনে-পটকাটা জঙ্গলের অন্য এক প্রান্তে ছুঁড়ে দিল ও। বোমা ফাটার মত একটা বিকট শব্দ উঠল। রিভলভারধারী লোকটা তখন শহীদের উপর ঝুঁকে পড়ছে। | বোমার মং শব্দটা হতেই শহীদ তড়াক করে পাশ ফিরেই একটা প্রচণ্ড ঘূসি বসিয়ে দিল রিভলভারধারীর নাকের উপর। সঙ্গে সঙ্গে চিৎ হয়ে পড়ল লোকটা। পড়েই অজ্ঞান। শহীদ ছিটকে পড়া রিভলভারটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই তিন লাফে পৌঁছল কপ্টারের কাছে। কপ্টারের পাইলট ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়েছিল জঙ্গলের দিকে। বোমার শব্দটা কোথা থেকে কি কারণে হল বোঝার চেষ্টা করছিল সে।
শহীদ তার রিভলভার তুলে গর্জে উঠল, আউট! | ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একমুহূর্ত তাকিয়ে রইল পাইলট, তারপর শহীদের কঠিন মূর্তি দেখে বিনাবাক্য ব্যয়ে নেমে পড়ল কপ্টার থেকে। কামাল ও সরফরাজ শহীদের পাশে এসে দাঁড়াল। শহীদ পাইলটকে বেঁধে ফেলেই সরফরাজকে বলল, ‘আপনি অভিজ্ঞ পাইলট; কন্ট্রোলের ভার নিন।
ইয়েস, স্যার,’ বলেই চালকের আসনে উঠে বসল সরফরাজ। শহীদ ও কামালও উঠে বসল কপ্টারে। হাত-পা বাঁধা পাইলটকে ফেলে রেখে কপ্টার আকাশে উঠল। শহীদের নির্দেশে সরফরাজ শহরের বহু উঁচু দিয়ে পার্বত্য এলাকা * অতিক্রম করিয়ে নিয়ে চলল সরফরাজ কপ্টারকে। শহীদ হঠাৎ আঙুল বাড়িয়ে একটা জায়গা দেখাল। সরফরাজ মাথা নেড়ে সায় দিল । অদূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে একটা দুর্গ। প্রচণ্ড শক্তিশালী শয়তান ই-আলীর হেডকোয়ার্টার।
. দুর্গের ব্যাটেলমেন্টের ছাদের উপর শূন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল হেলিকপ্টার। শহীদ দড়ির সিঁড়িটা কপিকল ঘুরিয়ে নামিয়ে দিল ছাদের উপর। কামালের উদ্দেশে দ্রুত কণ্ঠে ও বলল, ই-আলীর সন্দেহ হবার কথা নয়। সে হয়ত ভাববে তার লোকেরাই কুয়াশা-৩০
১৬৫
এখনও খুঁজছে আমাদেরকে। যাক, নেমে যাচ্ছি আমি নিচে। কপ্টার নিয়ে চক্কর মারতে থাকুন, সরফরাজ। কামাল কপিকল নিয়ে তৈরি থাকবি, আমাকে তুলে নেবার জন্যে।
কথাগুলো বলেই সিঁড়ি বেয়ে ব্যাটলমেন্টের ছাদে নেমে এল শহীদ। এই ছাদেই শহীদ ও কামাল ই-আলীর সেন্ট্রিদেরকে বোকা বানিয়েছিল।
শহীদ পাথরের ধাপবিশিষ্ট দেয়াল ঘেরা সিঁড়ি বেয়ে করিডরে গিয়ে পৌঁছুল । তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল ই-আলীর বিরাট বড় আকারের কন্ট্রোলরূমের আধখোলা দরজার দিকে। দরজার পাশে এসে ভিতরে উঁকি দিল শহীদ।
| ই-আলী তার প্রকাণ্ড দেহ নিয়ে প্রকাও ডেকের সামনে বসে রয়েছে। তার ভাটার মত লাল বড় বড় চোখ জোড়া দেয়াল ঘড়ির দিকে নিবদ্ধ। তার একটা হাত সুইচ-বোর্ডের একটি সুইচের উপর আলতোভাবে রাখা। ডেস্কের উপরই ঘোট একটা চারকোনা প্যাকেট। ই-আলীর পিছনে একদল ইউনিফর্ম পরা উচ্চপদস্থ অফিসার । তারা ই-আলীর সামরিক বাহিনীর লোক। শহীদ শুনতে পেল ই-আলীর কর্কশ, বাজখাই কণ্ঠ, ‘জিরো পাস টু আওয়ার হতে আর বাকি মাত্র দশ মিনিট। আর দশ মিনিট পর, হে আমার প্রিয় অফিসারগণ, আমি আপনাদের গর্ব করার মত একটা অতুলনীয় কীর্তির সূচনা করব।’
শহীদ দেখল অফিসাররা ঘনঘন অস্বস্তি ভরা এবং শঙ্কিত চোখে তাকাচ্ছে ডেস্কের উপর রাখা ছোট প্যাকেটটার দিকে। একজন অফিসার দ্বিধাভরে বলে উঠল, ‘স্যার, এই হাইড্রোজেন বোমাটা সেট করা হয়েছে কিনা তা আপনি ভাল করে পরীক্ষা করে নিয়েছেন তো?”
হাঃ হাঃ করে সশব্দে হেসে উঠে ই-আলী বলল, আমাদের এজেন্টরা প্রায়, : দুঘন্টা আগে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য রেডিও স্টেশনে এবং পাকিস্তান সীমান্তে যে
সব মাইক্রো-হাইড্রোজেন বোমা স্থাপন করেছে সেগুলো রেডিও বীমের সাহায্যে বিস্ফোরিত করার জন্যে যে ট্রিগার টেপা হবে তাতে এই প্যাকেটের বোমা বিস্ফোরিত হবে না। আমার পরীক্ষা করাই আছে। এটা বিস্ফোরিত করার জন্যে দরকার শুধুমাত্র একটা শর্ট ওয়েভ বীম। :
কথাগুলো বলে গর্বিত ই-আলী ডেস্কের উপর থেকে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। অফিসাররা ভীত এবং আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল
সেদিকে।
শহীদ হাতঘড়ির দিকে তাকাল।
আট মিনিট বাকি আছে জিরো পাস টু হতে। শহীদ দেখল ই-আলী এবং তার অফিসারদের পিছনের দেয়ালে একটা রেডিও কন্ট্রোল প্যানেল। শহীদ দূরত্বটুকু অনুমান করে নিয়ে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তারপর ওর মাইক্রো ট্রান্সমিটারের সুইচ অন করে ফিস ফিস করে বলে উঠল ক্ষুদ্র যন্ত্রটার কাছে ঠোঁট
ভলিউম-১০
=
=
=
নেড়ে, কামাল, ই-আলীর কন্ট্রোলমের কাছে কপ্টার নিয়ে এসে শূন্যে দাঁড় করিয়ে রাখতে বল সরফরাজকে। আমি চাই ই-আলী কপ্টারের ঝুলন্ত সিঁড়িটা দেখতে পাক।।
সটান হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে রইল শহীদ। তারপরই ও শুনতে পেল কপ্টারের উচ্চকিত গর্জন। খোলা বড় জানালাটার দিকে ই-আলী বিরক্ত হয়ে তাকাল সেই শব্দ গুনে। তার সঙ্গী অফিসাররাও তাকাল সেদিকে।
শহীদ আধখোলা দরজাটা সন্তর্পণে সম্পূর্ণ খুলে নিঃশব্দ পায়ে রূমের ভিতর ঢুকে পড়ল। আস্তে আস্তে, শুধু পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে সে গা-ঢাকা দিল রেডিও কন্ট্রোল প্যানেলের পিছনে।
জানালা পথ দিয়ে অদূরেই কপ্টার হতে ঝুলন্ত সিঁড়িটা দেখে মহাখাপ্পা হয়ে বলে উঠল ই-আলী, বুদ্ধ পাইলটটা কপ্টার নিয়ে এখানে কি করছে?
ই-আলী এবং তার সঙ্গীরা সকলেই তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ঘড়িতে এখন সাত মিনিট বাকি জিরো প্লাস টু আওয়ারের।
শহীদ দ্রুত এবং ঠাণ্ডা মাথায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটায় হাত দিল। কয়েকটা পারস্পরিক সংযুক্তি বিচ্ছিন্ন করে, লীড বদলে দ্রুত সেগুলো অন্য সব। তারের সঙ্গে যুক্ত করে দিল শহীদ কন্ট্রোল প্যানেলের। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল ছয় মিনিট বাকি জিরো আওয়ার হতে।
হঠাৎ ই-আলী জানালার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। একটা সুইচ টিপল সে। সশব্দে এবং বিদ্যুৎবেগে বন্ধ হয়ে গেল রূমের দরজা।
ধক করে উঠল শহীদের বুক। আটকা পড়ে গেল ও রূমের ভিতর দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে। একমাত্র ই-আলীই খুলতে পারে দরজাটা। এবং ই-আলী ও তার সঙ্গীরা সবাই সশস্ত্র । দরজাটা খুলতে চেষ্টা করার প্রশ্নই ওঠে না, গুলি খেয়ে, ঝাঁঝরা হয়ে যাবে শরীর তাহলে।
শহীদের দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল জানালার দিকে। জানালাটা বন্ধ। কিন্তু জানালার বাইরে ঝুলছে কপ্টারের সিঁড়িটা। সরফরাজ কপ্টারটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এখনও উপরে।
শহীদ প্রস্তুত হয়ে নিল। অকস্মাৎ বিদ্যুৎগতিতে ছুটল ও রূমের মেঝের উপর দিয়ে, ই-আলীর সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মাঝখান দিয়ে কয়েকটা বিদ্যুৎগতি পদক্ষেপের পর ও দুহাতে মুখ ঢেকে ডাইভ দিল বন্ধ জানালার দিকে।
ক্র্যাশ!
কাঁচ ভেঙে শহীদের উড়ন্ত শরীরটা বেরিয়ে গেল বাইরে। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে শহীদের। হাত দুটো সামনের দিকে মেলে দিয়েছে ও। বাড়ানো হাত দুটো খপ করে কষে ধরল ঝুলন্ত সিঁড়ির দড়ি।
শহীদকে জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে দেখে শ্বাস আটকে গেল কুয়াশা-৩০
১৬৭
–
–
।
..
কামালের। শহীদ ঝুলন্ত সিঁড়িটা ধরে ফেলেছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে কপিকল ঘোরাতে লেগে গেল ও। শহীদ উপর দিকে উঠে যেতে যেতে চিৎকার করে উঠল, সরফরাজ, কপ্টার ঘোরান। যত তাড়াতাড়ি পারেন দুর্গের
এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে চলুন!’
কথাটা বলেই শহীদ হাতঘড়ি দেখল সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে। জিরো পাস টু আওয়ার হতে তিন মিনিট বাকি।
বিপুল বেগে আরও উপর দিকে উঠে যেতে যেতে দুর্গের এলাকা অতিক্রম করে যেতে লাগল কপ্টার দূরবর্তী সীমান্ত প্রদেশের দিকে মুখ করে।
জিরো প্লাস টু!
অকস্মাৎ দুর্গের দিক থেকে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। দুর্গ এলাকা অতিক্রম করে এসেছে কপ্টার। দুর্গ এখন বহু পিছনে। ওরা তিনজন কেঁপে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। ধোঁয়ায় আর আগুনের শিখায় ঢাকা পড়ে গেছে গোটা দুর্গ। দুর্গের মাথার উপর নাচছে নাগিনীর মত ফণা তুলে আগুনের শিখা। শহীদ একটা স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করল। চিৎকার করে বলে উঠল ও, অহঙ্কারী ই-আলী খতম হয়ে গেল।
কামাল ও সরফরাজ ফিরে তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ ওদের মনের প্রশ্ন বুঝতে পেরে ব্যাখ্যা করে সংক্ষেপে বলল, শয়তান ই-আলীর ডেস্কে একটা মাইক্রো-হাইড্রোজেন বোমা ছিল। আমি শয়তানটার রেডিও প্যানেলের তারের কানেকশন বদলে দিয়ে এসেছিলাম। তাই পাকিস্তান সীমান্তে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওই বোমা ফাটাবার জন্যে সুইচ টিপলে যে রেডিও বীম কাজ করবার কথা সেটা কাজ করেনি। তার বদলে বিস্ফোরিত হয়েছে ওর ডেস্কে রাখা বোমাটা।
কামাল চিৎকার করে উঠল জয়োল্লাসে, তাহলে শয়তান নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে অক্কা পেয়েছে!”
‘ঠিক তাই ঘটেছে, শহীদ বলল। আবার বলল ও, সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে ক্যামেরাটা। ছবি ধুয়ে তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ই-আলীর এজেন্টদেরকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করবে।’
| শেষবার পিছনের ধোয়াচ্ছন্ন দুর্গের দিকে তাকাল ওরা। কপ্টার উড়ে চলেছে সীমান্তের দিকে, সগর্জনে।
ভলিউম ১০ কুয়াশা ২৮, ২৯, ৩০ কাজী আনোয়ার হোসেন
কুয়াশা, শহীদ ও কামাল। দেশে-বিদেশে অন্যায় অবিচারকে দমন করে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করাই এদের জীবনের ব্রত। এদের সঙ্গে পাঠকও অজানার পথে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন। রহস্য, রোমাঞ্চ ও বিপদের স্বাদ। শুধু হোটরাই নয়, হোট-বড় সবাই এবই পড়ে প্রচুর আনন্দ লাভ করবেন। আজই সংগ্রহ করুন।
Leave a Reply