২৯. আত্মহত্যা [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৯
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর, ১৯৭০
এক
রৌদ্রকরোজ্জ্বল শীতের সকাল।
বাগানে চেয়ার পেতে রোববারের কর্মহীন সকালে রোদ পোহাচ্ছিল শহীদ, মহুয়া আর কামাল। সামনে গরম চায়ের কাপ।
আলোচনা হচ্ছিল মিথ্যার সংজ্ঞা আর শ্রেণীভেদ নিয়ে। শহীদ বলল, আমেরিকানরা ঠাট্টা করে বলে,লাই অর্থাৎ মিথ্যা হল তিনরকম।’
যথা?’ প্রশ্ন করল কামাল।
ব্ল্যাক-লাই অর্থাৎ অহেতুক অপবাদ দেওয়া, হোয়াইট-লাই মানে আমরা সচরাচর যে মিথ্যা বলে থাকি, আর স্ট্যাটিসটিকস্।
তার মানে, স্ট্যাটিসটিকসূকে ওরা মিথ্যা বলে গণ্য করে?’
আগে ওরা এমন শ্রেণীবিভাগ করেনি, তবে পাকিস্তানে স্ট্যাটিসৃটিকস-এর দশা দেখেই বোধ হয় আমেরিকানদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে,’ শহীদ সিগারেটে টান দিয়ে বলল।
‘দাদা, তোমার টেলিফোন, বারান্দা থেকে উচ্চকণ্ঠে হাঁক ছাড়ল লীনা।
নাহ্, জ্বালালে দেখছি, রোববারের সকালেও তিষ্ঠাতে দেবে না!’ কামাল বিরক্তি প্রকাশ করল।
উঠে পড়ল শহীদ। ড্রইংরূমে গিয়ে রিসিভার তুলল। ‘হ্যালো?’
শহীদ খান সাহেব বলছেন?’ তরুণী কণ্ঠ ভেসে এল। বলছি। আপনি? ডালিয়া আকরাম।’ “ঠিক চিনতে পারলাম না, শহীদ জানাল।
তা জানি। আমি নারায়ণগঞ্জের মরহুম ফকির আকরামের মেয়ে। ওনার নাম হয়ত শুনেছেন। জুট মার্চেন্ট ছিলেন এককালে। পরে ফিলম্ প্রডাকশনে নামেন। মাস তিনেক আগে মারা যান।
ফকির আকরামের শুধু নামটাই জানা ছিল না, সামান্য আলাপও ছিল তার সঙ্গে শহীদের। ব্যবসায়ের সূত্র ধরেই আলাপ। করিতকর্মা পুরুষ ছিলেন ফকির
৬০ ।
ভলিউম-৯
আকরাম। নিতান্ত সামান্য অবস্থা থেকে বিরাট ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। কোরিয়ার যুদ্ধের সময় পাট চালান দিয়ে কোটিপতি হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীরে প্রাসাদোপম যে অট্টালিকা গড়েছেন তা দেখবার মত । শুধু পয়সাই নয় রুচিও ছিল ভদ্রলোকের। শেষটায় ভদ্রলোক কি কারণে যেন আত্মহত্যা করেন।
শহীদ বলল, “জ্বি, নাম শুনেছি আপনার বাবার।
• হয়ত শুনে থাকবেন উনি আত্মহত্যা করেছেন।’
হ্যাঁ, কাগজে তো তাই পড়েছিলাম।’
সকলেরই তাই ধারণা। পুলিসেরও। ময়নাতদন্তেও তাই বলা হয়েছে। তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সবাই যেটাকে আত্মহত্যা বলে মনে করছে সেটা আসলে আত্মহত্যা নয়। প্লেইন অ্যাণ্ড সিম্পল মার্ডার। আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেটাকে নিপুণ হাতে আত্মহত্যার মত করে সাজানো হয়েছে। অথচ প্রমাণ নেই। আমি চাই, আবার বাবার হত্যারহস্য উন্মোচন হোক। হত্যাকারী ধরা পড়ুক। তার শাস্তি হোক।’ | শেষের দিকে তরুণীর কণ্ঠস্বর খুবই উত্তেজিত শোনা গেল।
* আপনার এমন মনে করবার হেতু?’
‘হেতু অবশ্যই আছে। আর তাই তো আমি জোর দিয়ে বলছি, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে।’
‘পুলিসকে জানিয়েছেন আপনার সন্দেহের কথা?
অস্ফুট একটা শব্দ করে তরুণী বলল, সে অসম্ভব। ওরা চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখছে আমার দিকে। কে জানে, এই টেলিফোনের ব্যাপারটাও ওরা ইতিমধ্যেই
জানতে পেরেছে কিনা। যদি জেনে থাকে তাহলে আমাকে এই মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন, করে দিতে ওরা এতটুকু ইতস্তত করবে না।’
শহীদ একটু ভেবে বলল, আপনি কি এখন নারায়ণগঞ্জ থেকে বলছেন? . না। ঢাকা থেকে বলছি। এখানে ফার্মগেটের কাছে একটা ফ্ল্যাটে থাকি আমি। একাই থাকি। অবশ্য চাকর আর ঝি আছে।’
‘আপনি আমার এখানে আসতে পারেন না?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
‘অতটা সাহস থাকলে কি আর ফোন করতাম? সোজা চলে যেতাম আপনার বাসায়।’
তাহলে আপনার বাসার ঠিকানা দিন। আমি নিজেই যাব।’
একটু ইতস্তত করে তরুণী বলল, ফার্মগেটের কাছে দ্য ডলস নামে একটা চারতলা বুক আছে, চেনেন?’
‘চিনি বই কি?’ . এখানেই আমি থাকি দোতলার পুবদিকের ফ্ল্যাটটায়। কিন্তু শহীদ সাহেব, দয়া করে এখানে আসবেন না। এলে ওরা জানতে পারবেই। তখন ওদের কবল ।
কুয়াশা-২৯
থেকে কিছুতেই নিষ্কৃতি পাব না।’ তরুণীর কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
তাহলে তো আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা অন্তত কিছুটা বুঝতে না পারলে আমি দায়িত্বই বা নেব কি করে, আর এগুবই বা কি করে?
তাহলে কি করা যায়?’ করুণ কণ্ঠে জানতে চায় তরুণী। ব্যাপারটা আমার জানতে হবে তো?’
তা তো নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? বাইরে যদি কোথাও আলাপ করা যায়?’ তরুণী প্রস্তাব করল অবশেষে।
তা যায়।’ শহীদ সমর্থন করল প্রস্তাবটা।
সন্ধ্যায় আমাদের প্রডাকশনের শূটিং আছে নাভানা স্টুডিওতে । সাড়ে দশটার দিকে সেখান থেকে আমি বেরিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু দেখা হবে কোথায়?
‘কোন হোটেলে।’
উঁহু। ওদের লোকের চোখে পড়তে পারি। অন্য কোথাও, বিশেষ করে নির্জন কোন জায়গায় হলে ভাল হয়।’
শহীদ একটু ভেবে বলল, গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের কাছে ঝিলের ধারে একটা মাথাভাঙা বটগাছ আছে। জায়গাটা রাস্তার পাশেই। সন্ধ্যার পর সেখানে বড় একটা কেউ যায় না। সেখানে দেখা হতে পারে। আপনার গাড়ি আছে নিশ্চয়ই?’
আছে ।-ড্রাইভ করতেও জানি। তবে নিজের গাড়িতে যাব না আমি। ডিরেক্টর সাহেবের মাজদা নিয়ে যাব। গাড়িটা সাদা রঙের। চিনতে আপনার সুবিধাই
হবে।’
‘বেশ। আমি ঠিক সাড়ে দশটায় পৌঁছুব।’ ‘আমিও। কিন্তু কিছুক্ষণ যদি দেরি হয় আমার, তাহলে চলে যাবেন না যেন।
আচ্ছা। তাহলে এই কথাই রইল।
যা।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ।।
‘অ্যা-অ্যা-অ্যা-আ-আ-আক•••।’ বেসুরো গলায় সুরচর্চা করতে করতে কামাল এসে ঢুকল। সে প্রশ্ন করল কে রে বটে?’
‘এক ফিলম্ প্রডিউসার। পুরুষ নয়, মেয়ে। ‘কি বললি?” ‘একটা কন্ট্রাক্ট দিতে চায়। কন্ট্রাক্ট! কিসের কন্ট্রাক্ট? বিস্ময় প্রকাশ করল কামাল।
অভিনয়ের, গম্ভীর গলায় বলল শহীদ। একেবারে হিরোর রোলে।’
ভলিউম-৯
।
যাঃ যাঃ। কেন বাওয়া সকাল বেলাই গুল মারছিস?”
কেন, তোর বিশ্বাস হয় না? আমার চেহারাটা কি বাংলা সিনেমার নায়কের মত যথেষ্ট বোকা নয়? হলফ করে বলতে পারিস?’ কৃত্রিম রাগ দেখাল শহীদ।
| ‘তা বটে। তা শহীদ অভিনীত অপরূপ বাণী-চিত্রের নামটা কি হবে?
শহীদ কৃত্রিমভাবে গলা কাঁপিয়ে বলল, “এটা হবে এক নতুন ধরনের টকি। থ্রিল, সাসপেন্স.. বাঘের সঙ্গে খালি হাতে নায়িকার লড়াইয়ের সময় সন্ন্যাসীর মুখে : জাজ সুরে প্রেমের হিট গান। অথচ সপরিবারে অর্থাৎ ছিচকাঁদুনে কোলের শিশুটাকে পর্যন্ত নিয়ে দেখবার মত ছবি। ডালিয়া আকরাম নিবেদিত শহীদ
“হিরোয়িত” অনবদ্য বাংলা চিত্র “কখনও হবে না।’
ফাজলামো ছাড় তো। আসল ব্যাপার কি?’ ঘটনাটা খুলে বলল শহীদ। সর্বনাশ করেছিস,’ সবটা শুনে বিরস মুখে মন্তব্য করল কামাল। কার?’ ‘তোর নিজের।’
কেমন করে!’ ঘাবড়ে গিয়ে বলল শহীদ।
‘গৃহবিপ্লব দেখা দেবে। ট্রয় ধ্বংস করতে না পারলেও গার্হস্থ্য বিবাদ ঘটাবার, মত সুন্দরী মহিলা ওই ডালিয়া আকরাম। নিন্দায় কানপাতা যায় না ওদের সোসাইটিতে। নিন্দুকেরা বলে, ওর জন্যেই নাকি ওর বাবা আত্মহত্যা করেছেন।’
তার মানে?
‘মেয়ের অত প্রশংসা নাকি বাপের বুড়ো হাড়ে সহ্য হয়নি। তাই আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছেন। ওর ধারে-কাছে গেলেও তোর মত দেব-দুর্লভ লোকের নামেও ব্যাক-লাই জুটতে কতক্ষণ। তারপরেই শুরু হবে তোর গার্হস্থ্য বিপ্লব।’
তাহলে তো কেসটা নিতেই হয়,’ হেসে বলল শহীদ। কপালে দুর্ভোগ থাকলে তো নেবেই,’ গম্ভীর হয়ে বলল কামাল।
দই ঠিক সোয়া দশটায় বাসা থেকে বেরোল শহীদ। কামাল সঙ্গ ছাড়ল না। ‘
পৌষ মাসের শীতের রাত। বেশ জেঁকে শীত পড়েছে। পথে লোক চলাচল বিরল। যানবাহনের সংখ্যা নগণ্য। খোলা জানালা দিয়ে শীতের তীক্ষ্ণ হাওয়া হাড়
পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে যদিও দুজনেরই দেহটা মোড়া আছে উত্তম শীতবস্ত্রে। . গুলশান মার্কেট পেরিয়ে মাথাভাঙা বটগাছটা কাছেই। সড়ক থেকে হাত ত্রিশেক দূরে। তার পরই শুরু হয়েছে ঝিল। গন্তব্যস্থানের কাছে যখন এসে পৌঁছল । তখন কাছে-পিঠে একটা লোকও ওদের চোখে পড়ল না। গাড়ি-ঘোড়াও দেখা
কুয়াশা-২৯
গেল না।
ঝিলের তীর পর্যন্ত জায়গাটা ফাঁকা মাঠ। একশ’ গজের মধ্যে বাড়ি-ঘর নেই। ফুটপাথ না থাকায় গাড়িটা মাঠের মধ্য দিয়ে বটগাছ পর্যন্ত নিয়ে গেল শহীদ।
ঝিলের বুক থেকে তীক্ষ্ণ হিমেল হাওয়া ভেসে আসছে।
ভীষণ ঠাণ্ডা রে!’ কামাল বলল, তুই ইন্টারভিউ-এর আর জায়গা পাসনি?”
জবাব না দিয়ে গাড়ি থেকে নামল শহীদ। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘বেশি ঠাণ্ডা লাগলে জানালার কাঁচটা তুলে দে।
‘তুই বাইরেই থাকবি?’
ঠাণ্ডা লাগবে না।’
কথাটা কামালের ব্যক্তিত্বে বোধ হয় আঘাত করল। শহীদ যদি এই ভীষণ শীতেও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে তার অসুবিধে হলেই বা কি করবার আছে। অগত্য সে চুপচাপ বসে রইল।
পায়চারি করতে লাগল শহীদ, আর ঘড়ি দেখতে লাগল বারবার। | কৃষ্ণপক্ষের কুয়াশা জড়ানো চাঁদটা অনেক উপরে উঠেছে। ঝিলের বুকে কাঁপছে তার প্রতিচ্ছবি। আলোয় চিকচিক করছে ঢেউগুলো। অপরূপ, অপরূপ এই রাত। আর, অপরূপ চারদিকের অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
সাড়ে দশটা বেজে গেছে অনেক আগে। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে পৌঁছেছে পৌনে এগারোটার কাছাকাছি। আর একটা সিগারেট ধরাল শহীদ।
আরও কয়েক মিনিট কেটে গেল ।
•••এবং আরও কয়েক মিনিট।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে গেছে। . বিরক্ত হল শহীদ, একটু চিন্তিতও হল। হয়ত ডালিয়া আকরামের ধারণা যথার্থ। হয়ত টেলিফোনের ব্যাপারটা হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের (ডালিয়া বলেছিল, ওরা আমাকে সবসময়ই চোখে চোখে রাখছে। তার মানে, হত্যার পিছনে একাধিক লোক থাকতে পারে) কানে গেছে এবং তার চরম আশঙ্কাটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবু আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক।
কামাল জানালার ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে বলল, ‘কি রে, এল তোর বাগদত্তা?’
সময় হলেই আসিবে আমার কুঞ্জে, সরি, ঝিল-পুলিনে।’ আর এসেছে! চল, এবার কেটে পড়ি। কোথায় স্ফুর্তি করছে কে জানে।
আহ্, তুই বড্ড পরনিন্দা শুরু করেছিস, কামাল! দিনে দিনে অধঃপতন হচ্ছে তোর।’ বিরক্তি প্রকাশ করল শহীদ।
‘বেশ বাওয়া, আর কিছু বলব না।’ উত্তর দিকে দুটো চলমান আলোর রেখা দেখা গেল। আলো ক্রমশ উজ্জ্বলতর
ভলিউম-৯
৬৪।
হচ্ছে। শহীদ অগ্রসরমান আলো দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে আরও দুটো চলমান আলো দেখা দিল। সে দুটোও ক্রমশ উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
একটু পরেই সামনের আলো দুটোর উৎস গাড়িটা দৃষ্টিগোচর হল। কাছে এসে পড়েছে গাড়িটা। রাস্তার উপরকার বৈদ্যুতিক বাতির ঠিক নিচেই থামল। পেছনের আলো দুটো নিভে গেল।
সচকিত হল শহীদ। পেছনের গাড়িটা সামনের গাড়িটাকে অনুসরণ করছে না তো? যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন বিপদ দেখা দিতে পারে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে পকেটে হাত ঢোকাল সে। পকেটে রিভলভার নেই। রিভলভারটা গাড়িতে। বেশ তো, দেখাই যাক।
এই অবস্থায় গাড়িটার দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়। সে চাপারে কামালকে বলল, কামাল, ভদ্রমহিলা এসে গেছেন বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু কেউ পিছু লেগেছে। জলদি রিভলভারটা বের করে আমার হাতে দে। যে-কোন মুহূর্তে দরকার হতে পারে।’
কিন্তু কামাল কিছু বলার বা রিভলভারটা বের করে দেবার আগেই শুরু হয়ে গেল কাটা।
অখণ্ড নির্জনতাকে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দিয়ে অকস্মাৎ গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র, গুড়, গুড়ুম গুড়ুম,গুড়।
কানে তালা লেগে গেল শহীদের। মুহূর্তের জন্যে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কিন্তু পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে দেরি হল না। পিছনের নয়, সামনের গাড়ি থেকেই আসছে টমিগানের মৃত্যু-গর্জন। আর তার লক্ষ্য অন্য কেউ নয়, সে নিজে। কোন অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত তসীসা তার বক্ষ ভেদ করে যায়নি। কিন্তু আর ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। ঘাসের উপর সে শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গাড়ির আড়ালে চলে গেল।
টমিগানের গুলি বর্ষণ সমানে চলছে।
শোনা যাবে শহীদ জানে, তবু চিৎকার করে সে বলল, কামাল, আমার রিভলভার•••।’ *
| কামালের জবাব পাওয়া গেল না। কিন্তু যেরূপ অকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছিল তেমনি অকস্মাৎ থেমে গেল। * শ্বাস রোধ করে শুয়ে রইল শহীদ। কে জানে টমিগানধারী এদিকেই আসছে কিনা। হয়ত ভেবেছে, কুপোকাত হয়েছে তার শক্র। কিন্তু কামাল কি করছে?”
| হঠাৎ তার মনে হল, কামালের গায়ে গুলি লাগেনি তো? শিরদাঁড়ার মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু এখন কামালকে দেখতে গেলে দুজনেরই জীবন সংশয় হয়ে পড়বে। অথচ কিছু একটা করা দরকার এবং এক্ষুণি করা দরকার। দ্রুত চিন্তা করতে লাগল শহীদ।
‘ গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দে সচকিত হল শহীদ। মুখ বাড়িয়ে দেখল গাড়িটার ৫-কুয়াশা-২৯
৬৫
আলো জ্বলে উঠেছে। গতি সঞ্চারিত হয়েছে তাতে। একটু এগোতেই পথের পাশের বৈদ্যুতিক আলো গিয়ে পড়ল চালকের মুখের উপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে এবং শহীদের চোখে পড়ল প্রকাণ্ড জালার মত একটা মুখ। লোকটা তখন শহীদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।
সাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। একটা বেবি অস্টিন।
উঠে দাঁড়াল শহীদ ঘাস-শয্যা থেকে। কামালের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। চি চি করে প্রশ্ন করল, টিকে আছিস তো?’
নিশ্চিত হল শহীদ। কামাল ঠিক আছে তাহলে। কিন্তু পথের ওপর পড়ে আছে ওটা কি? মানুষের মূর্তি বলে মনে হচ্ছে যেন!
তাই তো। ছুটে গেল শহীদ রাস্তার দিকে। কামালও বেরিয়ে এল।
কাছে যেতেই দেখা গেল বস্তুটা মানুষই বটে। স্যুট পরা একটা লোক। চিৎ হয়ে পড়ে আছে রাস্তার উপর। দেহটা একেবারে স্পন্দনহীন। পাশে একটা টমিগান পড়ে আছে।
‘স্টোন-ডেড,’ মন্তব্য করল কামাল। গুলি লেগে মারা গেছে। রক্তে ভিজে / গেছে কাপড়। আশ্চর্য, গুলি করল কে? তুই? কিন্তু?’
বুঝতে পারছি না। আমি তো নিরস্ত্র।’
শহীদ অবাক হয়ে এই কথাটাই ভাবছিল। বলা নেই কওয়া নেই একটা গাড়ি এসে থামল। আচমকা টমিগান চার্জ করতে লাগল। অথচ মারা গেল টমিগানধারী নিজেই এবং গুলির আঘাতেই মারা গেল। কে করল তাকে গুলি? ওই প্রকাশ মুখওয়ালা লোকটা তো হতেই পারে না। তার সঙ্গেই তো এসেছে টমিগানধারী।
তাহলে?
হঠাৎ তার মনে হল, টমিগানধারীর গাড়ির পেছনে আরও একটা গাড়ি আসছিল। সেই গাড়িটা হয়ত। মুখ তুলে তাকাল শহীদ। গাড়িটা চোখে পড়ল
। তার বদলে তার চোখে পড়ল একটা সাচন অলি ।
কামালের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শহীদ সেদিকেই তাকিয়ে রইল। কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিল। হাতে চাপ দিয়ে তাকে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করল শহীদ। কামালও তাকাল সামনের দিকে।
আরও একটু পরে দেখা গেল ওভারকোট গায়ে একটা বিশাল মনুষ্য-মূর্তি ধীরে-সুস্থে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। অগ্নিকুলিঙ্গটা তাবত তারই হাতের সিগারেটের।
আবার কে আসছে কে জানে? মতলবটাই বা কি লোকটার? তবে ধীরে-সুস্থে এগোবার ভঙ্গি দেখে শহীদের মনে হল, লোকটাকে বোধ হয় ভয় পাবার কিছু নেই।
নিউম-১
লোকটা আরও নিকটবর্তী হতেই তার হাঁটবার ভঙ্গিটা পরিচিত বলে মনে হল শহীদের। কামালেরও চিনতে অসুবিধে হল না। ওভারকোট গায়ে যে লোকটা। এগিয়ে আসছে ওদের দিকে সে আর কেউ নয়, স্বয়ং কুয়াশা।
একটু দূরে দাঁড়াল কুয়াশা। কুয়াশা!’ উল্লাসে ফেটে পড়ল কামাল।
আরে, তোমরা যে! কুয়াশার কণ্ঠে বিস্ময়। সে এগিয়ে এসে বলল, আশ্চর্য, আমি তো ধারণাই করতে পারিনি।’
‘তাহলে তুমি উদয় হলে কি করে? | ‘আমি বিলীর আড়ার দিকে নজর রাখছিলাম। দেখলাম, বিলী-আর রওশন গাজী বেরোচ্ছে। পিছু নিলাম। কারণ তখুনি বুঝেছিলাম, একটা খুনোখুনির ব্যাপার
আছে। খুনের প্রোগ্রাম না থাকলে বিলী নিজে বেরোয় না।
কি রকম?’ কামাল প্রশ্ন করল, ‘বিল্লীটা আবার কে?’
‘লোকটার নাম হচ্ছে, মাহদী বিল্লাহ। অপরাধ-জগতে বিলী নামে পরিচিত। বিরাট দল ওর। সোয়ারী ঘাটে আড্ডা। পাইকারী ব্যবসার নামে একটা দোকান আছে সেখানে। তিনতলায় হোটেল আছে। নাম পরিস্কার হোটেল। আসলে এটা হল জুয়ার আড্ডা। এজেন্টদের মাধ্যমে লোক আনে। আর তাদের জুয়ার আড্ডায় এনে সর্বস্বান্ত করে। দরকার হলে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তাদের। তাছাড়া আছে হাজারটা বেআইনী ব্যবসা। চোরাচালান করে। ভেজাল জিনিস বের করে। অর্থাৎ একটা অত্যন্ত সুসংগঠিত দল। বিল্লাহ ওদের নেতা। সে সাধারণত আড্ডাতেই থাকে। বাইরে বেরোয় কম। আগে থেকে খুনোখুনির কোন প্রোগ্রাম থাকলে তবেই
সে বেরোয়।’ | অনেকটা স্পেশ্যাল প্রোগ্রামের মত, কামাল বলল।
| তা বলতে পার, কুয়াশা সায় দিল। ওরা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক কোটি টাকা করেছে এইসব অপরাধ করে। সেগুলো এখন কোথায় রেখেছে তার খোঁজে আমি বিল্পীর আড্ডায় কয়েকদিন ধরে নজর রাখছিলাম। তা ভীষণ ধুরন্ধর বিল্লাহ। কোন হদিস পাইনি ওদের গুপ্ত ধনাগারের।’
‘তোমার গুলিতেই তো এই লোকটা মারা গেছে?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
যদি তোমরা কেউ গুলি না করে থাক, সিগারেট ছুঁড়ে দিয়ে বলল কুয়াশা। শহীদ বলল, সে অবকাশ পাইনি আমরা।’
তা এই লোকটাই বিল্লাহ নাকি?’
, ওর নাম রওশন গাজী। বিল্লাহ নিজে টমিগান চার্জ না করে ওকেই দিয়েছিল দায়িত্বটা। কিন্তু অকং তোমাদের পিছনে লাগল কেন বিল্লাহ?
একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। ধোয়া ছেড়ে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল কুয়াশা-২১
৬৭
Yম।
কুয়াশাকে। শেষটায় বলল, “বোঝাই যাচ্ছে, মিস ডালিয়া আকরামের ধারণা অভ্রান্ত। আর টেলিফোনের ব্যাপারটাও নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে। সম্ভবত বেচারি ইতিমধ্যেই বিল্লীর দলের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। আমাকে এখুনি যেতে হবে ওর খোঁজে, আর দেরি করা উচিত নয়।’, তা ঠিক। তুমি বুরং চলে যাও। তবে খুব সাবধান থেক। আবার হামলা হতে পারে তোমার উপর। আমি চলি এবারে।’
চলে গেল কুয়াশা। টমিগানটা তুলে নিতে ভুলল না।
তিন নির্জন পথে আবার ছুটে চলল শহীদের বিলেট। স্টুডিওতে যখন পৌঁছল তখন সোয়া বারোটা বেজে গেছে।
নাভানা স্টুডিওর বিরাট লোহার দরজাটা বন্ধ। অনেকক্ষণ হর্ন বাজাল শহীদ। কেউ দরজা খুলতে এগিয়ে এল না।
কামাল’বলল, শূটিং বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। চল, ফিরে যাই।’ অগত্যা গাড়ি ফেরাল শহীদ। এখন কোন্দিকে যাবি?’ দ্য ডলস হাউসের দিকে। ‘মিস ডালিয়া ওখানেই থাকে বুঝি?
হ্যাঁ।’ নীরব হয়ে গেল দুজন। অনেকক্ষণ পরে কামাল আবার মুখ খুলল। ‘তোর কি ধারণা, ডালিয়া অলরেডী কালপ্রিটদের হাতের মুঠোয় চলে গেছে?”
তাছাড়া আর কি ধারণা হতে পারে? তবে বাসায় খোঁজ না নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।’
‘তা বটে,’ স্বীকার করল কামাল। ভাল কথা, ওই লোকটাকে দেখেছিস তুই? * বিল্লাহ না কি নাম বলল কুয়াশা। আমি দেখেছি বটে। বিরাট মুখটা, ইয়া বিরাট।
গোলগাল হাঁড়ির আকারের একটা মুখ।
‘দেখেছিস তাহলে তুই? পরে দেখলে চিনতে পারবি?’ নিশ্চয়ই, ওই চেহারা কি সহজে ভোলা যায়?’
‘দ্য ডলস হাউস’ নামের বাড়িটা চিনত শহীদ। গাড়িবারান্দায় গাড়িটা রেখে পুবদিকের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল সে। কামাল তাকে অনুসরণ করল। ১, বৈদ্যুতিক ঘন্টার সুইচ টিপল শহীদ। অন্দরে ঘন্টা বাজার শব্দ কানে এল। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
আবার সুইচ টিপল। একটু পরেই পদশব্দ কানে এল শহীদের। খুট করে
ভলিউম-.
৬৮
একটা শব্দ হল। দরজা খুলে এক বুড়ো দাঁড়াল তার সামনে। ঘুম-জড়িত কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, আপনেরা?”
‘মিস ডালিয়া থাকেন এই বাসায়? ‘জে, আপনেরা কেডা?”
উনি আছেন এখন?’ ‘জ্বে, না। এহনও ফেরেন নাই। কয়ড়া বাজে অহন, সাব?’ ‘পৌনে একটা।
‘পৌনে একটা!’ আর্তস্বরে উচ্চারণ করল বুড়ো। মুহূর্তে তার চেহারায় ফুটে উঠল উদ্বেগের ছাপ। কি যেন বলতে গিয়ে চেপে গেল সে। একটু ভেবে আবার প্রশ্ন করল, তা আপনেরা কেডা?’
আমার নাম শহীদ খান। আর ইনি আমার বন্ধু কামাল আহমেদ। মিস ডালিয়া এলে বোললা, ওঁর সাথে আমরা দেখা করতে এসেছিলাম।
কি নাম বললেন, সাব?’ শহীদ খান আমি, আর…’ শহীদ খান সাব! তা হুজুর, কয়ডা বাজে কইলেন?’ ‘পৌনে একটা। আমরা চলি, বুঝলে?’
‘পোনে একটা। স্যার, একটু ভিতরে আইবেন?’ ইতস্তত করে আবেদন জানাল বুড়ো।
ভিতরে ঢুকল শহীদ।
কিছু বলবে?
‘জে। আপায়, মানে ডালিয়া মেম সাবে কইয়া গেছলেন, উনি রাইত বারোডার মইদ্যে না ফিরলে য্যান শহীদ খান সাবের বাসায় ফোন কইরা খবরড়া
দেই। ফোন নম্বরও লেইখ্যা দিয়া গেছেন এক টুকরা কাগজে। তাই তো স্যার। জিগাইলাম, কয়ডা বাজে। আমি আবার ঘুমাইয়া পড়ছিলাম।’
‘কোন খবর দিতে বলেছিলেন উনি?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
যদি উনি না ফেরেন তাইলে না ফিরনের খবরডাই য্যান দেই, কইয়া গেছেন।’
। আর কিছু?’, ‘জে, না । উনি তো রাইত একটা-দুইটা পর্যন্ত প্রায়ই বাইরে থাকেন, ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল বুড়ো। একাই যান, খুব সাহসী মানুষ আমার আফায় । কিন্তুক পঁচ-ছয় দিনের মইধ্যে আম্মারে দেখবার যাওন ছাড়া বাইরে আর কুন
জাগাতেই পা বাড়ান নাই।’
‘কোথায় গেছেন, বলেছেন কিছু তোমাকে?’
বলছেন। ইস্টুডিওতে যাইবেন। শূটিং আছে। আমার…আমার কেমন য্যান কুয়াশা-২৯
৬৯
ভয় করতাছে, সাব।
কামাল অভয়ের সুরে বলল, “আরে, ভয়ের কি আছে? এখুনি হয়ত এসে যাবেন।’
শহীদ বলল, ‘এখন চলি আমরা। না ফিরলে খবর দিয়ে আমাকে সকালে। ফোন নাম্বার তো জানই।
কামালকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসার দিকে এগোল শহীদ। সমস্ত এলাকাটা নিস্তব্ধ। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে। বাসার সামনে গাড়ি থামাল সে। হর্ন বাজাতে বাজাতে চারদিকে তাকাল একবার। জ্যোৎস্না আর বৈদ্যুতিক আলো উভয়েই হার মেনেছে কুয়াশার কাছে। দৃষ্টি বেশি দূর যায় না। তবে সন্দেহজনক কিছু কাছে-পিঠে চোখে পড়ল না। তবু তার মনে হল, কে যেন তার দিকে লক্ষ্য রাখছে।
গফুর এসে গেট খুলে দিল। প্রাঙ্গণের মধ্যে গাড়ি ঢোকাল শহীদ। গেট বন্ধ, করে গফুর ভিতরে চলে গেল।
গ্যারেজে গাড়ি ঢুকিয়ে বাগান ও বারান্দা পেরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকল শহীদ। একটু সুস্থির হয়ে বসে চিন্তা করতে হবে। গত কয়েক ঘন্টায় অভিজ্ঞতাগুলোকে লজিক্যালি ঢেলে সাজাতে হবে।
| একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। সোফার উপর দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে টানতে লাগল।
কি-চু-চ।
অত্যন্ত চাপা একটা শব্দ শোনা গেল। রাস্তার দিক থেকে শব্দটা আসছে। কান খাড়া করল শহীদ। সমস্ত ইন্দ্রিয় মুহূর্তে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। আর তার মনে হল, যেন এই শব্দটার জন্যেই এতক্ষণ ধরে সে অপেক্ষা করছে। অবাঞ্ছিত অতিথির আবির্ভাব ঘটেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সোফাতে বসে থাকা বিপজ্জনক। উঠে সোফার পিছনে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রিভলভার বের করল পকেট থেকে। জানালার ঠিক সামনে মাথাটা বের করল সে মুহূর্তে, পরক্ষণেই সরে গেল। পর্দার উপর ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল।
এখন কি ঘটবে তা জানে শহীদ। ঘটতে দেরিও হল না।
টমিগানের গর্জনে ভঙ্গ হল চারদিকের অন্তহীন স্তব্ধতা। ইসলাম সাহেবের ফটোটা মেঝেয় পড়ে গেল। দেয়াল থেকে ঝরে পড়ল চুন-সুরকি। জানালার পর্দাটায় অসংখ্য ছিদ্র। একটা পাল্লাও ভেঙে পড়ল।
চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল শহীদ। যেখানটায় সে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গুলি পৌঁছুবার আশঙ্কা নেই। ৭০
ভলিউম
।
*
–
অবশেষে থামল গর্জন। দোতলায় হৈ-চৈ শোনা গেল। কিন্তু সে কয়েক মুহর্তের জন্যে।
আবার গর্জে উঠল টমিগান।
, আর দেরি করা যায় না। উবু হয়ে জানালার নিচে বসল শহীদ। হাতটা তুলে জানালার পর্দার নিচ দিয়ে রিভলভারটা বের করে ট্রিগার টিপল। শত্রু কোথায় তা সে জানে না। দরকারও নেই। দরকার শুধু প্রত্যুত্তর দানের। আন্দাজে গুলি চালাতে লাগল সে। ছয়টা গুলি শেষ হতে ছয় সেকেণ্ড লাগল।।
আর গুলি নেই। দরকারও বোধহয় নেই। বাইরে টমিগানের গর্জন থেমে গেছে। দরজার দিকে এগোল সে। আবার গুলির শব্দ শোনা গেল। কিন্তু টমিগানের শব্দ নয় ওটা। অমানুষিক একটা আর্তনাদ শোনা গেল।
| চিৎকার শোনা গেল বাড়ির ভিতরে। সশব্দে একটা গাড়ি চলে গেল রাস্তা দিয়ে।
. সিঁড়িতে এলোমেলো শব্দ করে আর চিৎকার করতে করতে মহুয়া, লীনা আর গফুর এসে পৌঁছল। কিন্তু শহীদ ততক্ষণে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে।
মহুয়া চিৎকার করে বলল, ‘ওগো, যেয়ো না।’
সে-কথা কানে তুলল না শহীদ। দৌড়ে গেল সে গেটের দিকে। উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল, গেটের ঠিক বাইরেই পড়ে আছে একটা লোক। তখনও ছটফট করছে সে। শেষ ঝা নি দিয়ে লোকটার দেহ নিস্পন্দ হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা নিরস্ত্র।
গেট খুলে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। কতক্ষণ সে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল বলতে পারবে না। গাড়ির শব্দে তার সংবিৎ ফিরে এল। মুখ তুলে দেখল একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কাছে আসতেই চালক তার দিকে হাত নাড়ল। চিনতে পারল সে চালককে। কুয়াশা।।
কিন্তু কুয়াশার গাড়িটা দাঁড়াল না। হুস করে বেরিয়ে গেল।
প্রতিবেশীরা হৈ-হৈ করে এগিয়ে এল। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে রিভলভার। একজন বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছেন। বটিও আছে একজনের হাতে।
সকলেরই চোখে উদ্বেগ আর জিজ্ঞাসা।
মৃতদেহটা দেখে থমকে গেল ওরা। স্যুট পরা একটা লোককে এইভাবে পথের উপর মৃত অবস্থায় দেখবে বলে ওরা হয়ত আশা করেনি।
একজন জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি, শহীদ সাহেব? ডাকাত পড়েছিল নাকি? কি ভয়ঙ্কর কাও, যেন যুদ্ধ বেধেছে!’
অন্য একজন বলল, “ডাকাত ছাড়া আর কি? দেখেছেন তো, আজকাল ডাকাতরাও স্যুট পরে ডাকাতি করতে আসে।’
‘কোন ক্ষতি-টতি–মানে, কেউ জখম হয়নি তো?
কুয়াশা-২৯
না। কয়েকটা জিনিস ভেঙেছে মাত্র।’
তা যাক।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন প্রশ্নকর্তা, উঃ কি মারাত্মক ব্যাপার! আল্লার মেহেরবাণীতে যে কোন ক্ষতি হয়নি এই ঢের। আমি তো সাহেব। | অন্য একজন বলল, ‘কি সাহস, বলুন তো! শেষপর্যন্ত কিনা আপনার বাসায় হামলা!”
ক’জন এসেছিল, শহীদ সাহেব?’ অন্য একজন প্রশ্ন করল। আমি তা দেখতে পাইনি। “আহা, এই লোকটাকে যদি জ্যান্ত ধরা যেত তাহলে সর কটাকেই জালে ফেলা যেত।’
পুলিস এসে পৌঁছুল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল শহীদের দিকে।
উৎসাহী প্রতিবেশীদের আরও অনেক প্রশ্নের জবাব হয়ত দিতে হত শহীদকে। কিন্তু পুলিস দেখেই হোক আর শীতের তাড়নাতেই থোক তারা একে একে কেটে পড়ল।
চার
আটটার সময় ফোন এল ডালিয়া আকরামের বাসা থেকে ফোন করল অভিনেতা, বেলাল সিদ্দিকী। আত্মপরিচয় দিয়ে সে বলল, “মিস ডালিয়া তো এখনও বাসায় ফেরেননি। আপনি নাকি রাতে এসেছিলেন, আর এ ব্যাপারে তোরাব আলীর সাথে আলাপও নাকি হয়েছে আপনার।’
‘তোরাব আলী, মানে সেই বুড়ো লোকটা তো?’ .. হ্যাঁ, বেচারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। আপনি যদি দয়া করে একবার
আসতেন…’ আবেদন জানাল বেলাল সিদ্দিকী।
‘বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছুব আমি।’
কামালকে ফোন করে কতকগুলো জরুরি নির্দেশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শহীদ।
দিব্যকান্তি এক তরুণ আর বুড়ো তোরাব আলী শহীদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ড্রইংরূমের ভোলা দরজার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াতেই তরুণ এগিয়ে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আমি বেলাল সিদ্দিকী। আপনি শহীদ খান তো?’
যা।”
আসুন, বসুন।
ড্রইংরূমের এক কোনায় অস্ত মলিন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বুড়ো তোরাব আলী। শহীদকে দেখে তার বুকে যেন বল ফিরে এল। সে এগিয়ে এসে বলল,
হুজুর, আপায় যে অহনও ফিরল না। কি করুম, হুজুর, অহন আমি?’
ভলিউম-১
৭২
অস্থির হয়ো না, তোরাব আলী। দেখি কি করা যায়। পুলিসে খবর দিয়েছ?
জবাব দিল বেলাল সিদ্দিকী, এখনও দেয়া হয়নি। এই মুহূর্তে পুলিসে খবর দেয়া উচিত কিনা সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তাছাড়া ডালিয়ার পক্ষে এই ধরনের আকস্মিক অন্তর্ধান একেবারে নতুন ঘটনা নয়। অবশ্য ওর বাবার মৃত্যুর পর এটাই প্রথম। তবু তোরাব আলীর কাছে যা শুনলাম তাতে এবারের অন্তর্ধানকে অত সহজভাবে নেয়া সমীচীন বলেও মনে হচ্ছে না। আর পুলিসে খবর দেবার, অধিকার আমার আছে কি না তা-ও বলতে পারছি না।’
কি শুনলেন তোরাব আলীর কাছে?’
যুবক একটু থতমত খেয়ে বলল, এই যে•••ডালিয়া বলে গেছে, সে না ফিরলে যেন আপনাকে খবর দেয়া হয়। তাতে মনে হয়, ডালিয়ার অন্তর্ধানের পেছনে কোন রহস্য থাকা বিচিত্র নয়। তবু আপনার সম্মতি না নিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করিনি। তাছাড়া আর একটা ব্যাপারও ভেবে দেখবার আছে। ডালিয়া সুন্দরী তরুণী। তার অন্তর্ধানের খবরটা মুখরোচক হতে পারে। নানারকম অর্ধ আবিষ্কৃত হতে পারে।’
| ‘তা বটে, শহীদ চিন্তা করে কলল। আজকের দিনটা দেখা যাক উনি ফেরেন কিনা। অন্যথায় পুলিসে জানাতেই হবে খবরটা।’ :
‘আপনি যা বলবেন তাই হবে।’
‘অপরাধ নেবেন না, শহীদ বেলাল সিদ্দিকীকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি ডালিয়ার আত্মীয় হন?”
সিদ্দিকী হেসে বলল, না। রক্তের কোন সম্পর্ক নেই, আমি ওর বাল্যবন্ধু। তাছাড়া ওর প্রোডাকশনে আমি অভিনয় করছি।’ * আপনি কখন এসেছেন এখানে?’
‘আটটার দিকে। এসেই খবরটা শুনলাম।’
শুনেছি, গতকাল নাকি আপনাদের শূটিং ছিল। সেখানে যাবার কথা ছিল মিস ডালিয়ার। তা উনি কি সেখানে গিয়েছিলেন?’
. হ্যাঁ, গিয়েছিলেন। তবে শূটিং হয়নি। ডিরেক্টর সাহেব হঠাৎ কাল বিকেল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডালিয়া ওখান থেকে বেরিয়েছিল সাড়ে আটটার দিকে। আমাকে বলেছিল, সে যাবে ড. কাওসার এলাহীর চেম্বারে। ওর মায়ের খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছে, এখন-তখন অবস্থা।
‘ওর মা কোথায় আছেন? নারায়ণগঞ্জে?” | ‘জ্বি না। ড, এলাহীর স্যানাটোরিয়ামে। ডেমরার কাছে স্যানাটোরিয়ামটা, শীতলক্ষ্যার তীরে। হয়ত শুনে থাকবেন।’
শোনা ছিল না শহীদের। সে বলল, মিস ডালিয়া কি স্যানাটোরিয়ামেই গিয়েছিলেন?
কুয়াশা-২৯
। ভ, এলাহীর চেম্বার মোহম্মদপুরে। ভদ্রলোক সকালে স্যানাটোরিয়ামে যান আর বিকেলে বসেন চেনে। চেম্বারটা তাঁর বাসাতেই।
সেখানে খোঁজ নিয়েছিলেন?’
‘খোঁজ নিতে কোথাও বাকি রাখিনি। সেখান থেকে সোয়া ন’টায় বেরিয়ে গেছে বলে ডাঙ্গার সাহেব জানিয়েছেন। স্যানাটোরিয়ামে খোঁজ নিয়েছি। সেখানেও যায়নি। তাছাড়া পরও সন্ধ্যাতেই নাকি সেখান থেকে ডালিয়া এসেছে। নারায়ণগঞ্জেও যায়নি। দারোয়ানকে ফোন করে জেনেছি।’
অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায়?”
আত্মীয় বলতে ওদের কেউ এখানে নেই। আছে পশ্চিম বাংলায়। সেখানেই ডালিয়াদের আদিবাস। এখানে যেসব আত্মীয় আছে তারা নিতান্তই দূর সম্পর্কের। তাদের সাথে উলিয়াদের যোগাযোগ ছিল না। হয়ত আত্মীয়দের দারিদ্র তার কারণ হতে পারে।’
একটা সিগারেট ধরিয়ে নীরবে কিছুক্ষণ টেনে শহীদ প্রশ্ন করল, মিস ডালিয়া ডক্টর এলাহী চেয়ার থেকে কখন বেরিয়েছে বলতে পারেন?”
‘সেখানে নাকি মাত্র মিনিট দশেক ছিল, ডাক্তার তো তাই বললেন। আমি অবশ্য ডাক্তারের আচরণে একটু বিস্মিতই হলাম।’
বিঘিত হলেন কেন?’ | ভদ্রলোক ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান তো বটেই। ডালিয়ার ভাবী বরও উনি। ভেবেছিলাম ভাবী-স্ত্রীর নিখোঁজ-খবরে উদ্বিগ্ন হবেন উনি, কিন্তু ওকে কেমন যেন নিরুদ্বিগ্ন নির্বিকার মনে হল। একটু উষ্ম প্রকাশ পেল বেলালের কণ্ঠে।
শহীদও অবাক হল।
‘অথচ দেখেন, বেলাল বলল। আমার সাথে ডালিয়ার এমন কি সম্পর্ক আছে? কিন্তু এখন দেখছি আমিই যেন জড়িয়ে পড়েছি বেশি করে।’
‘বিয়েটা কি ওরা, মানে মিস ডালিয়া আর ডাক্তার সাহেব নিজেরাই ঠিক করেছেন, না অভিভাবকরা?’ জিজ্ঞেস করল শহীদ।
‘প্রস্তাবটা ছিল আকরাম সাহেবের। তবে ডালিয়ার আপত্তি ছিল না। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল। ড, এলাহী আকরাম সাহেবের পরম প্রিয়ভাজন ছিলেন। অনেক ব্যাপারে ওর উপর নির্ভর করতেন তিনি। নিজের ম্যানেজার ইত্যাদি থাকা সত্তেও ডাক্তারের কাছ থেকেই বুদ্ধি নিতেন বেশি। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও। পাটের ব্যবসায় গুটিয়ে ফিমের ব্যবসায় নেমেছিলেন আকরাম সাহেব ড. এলাহীর পরামর্শেই। অন্যদিকে ড, এলাহীর স্যানাটোরিয়াম গড়ে তোলার টাকাটাও আকরাম সাহেবই দিয়েছেন। ডালিয়া আর ডাক্তারের বিয়েটা এতদিনে হয়েই যেত। কিন্তু আকরাম সাহেব আত্মহত্যা করলেন। আর মিসেস আকরাম ওই রাতেই মারাত্মক একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ওঁর তো এখন
ভলিউম
তখন অবস্থা। তাই বিয়েটা আপাতত স্থগিত রয়েছে।
মিসেস আকরামের কি হয়েছিল?, তোরাব আলী বলল, আছাড় খাইয়া সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া পইড়া গেছিলেন আমায়।।
বেলাল ব্যাখ্যা করল, আকরাম সাহেব যেদিন আত্মহত্যা করেন সেইদিনই এই ঘটনা ঘটে। যতদূর মনে হয়, গুলির আওয়াজ শুনে উনি আকরাম সাহেবের রূমের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলেন। যে ভাবেই হোক তিনি পড়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে গেছেন। অনেক জায়গায় আঘাত লাগে এবং উনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন।’ ।
শহীদ বলল, আকরাম সাহেব তো আত্মহত্যা করেছেন, তাই না?”
জি যা। কারণ কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’
‘গলায় ক্যান্সার হয়েছিল ওঁর। খুব কষ্ট পেতেন। আমিও দেখেছি ওঁকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে। শেষটায় সম্ভবত যন্ত্রণা সইতে না পেরেই মুখের ভিতর রিভলভার ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনা ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে।
মিস ডালিয়া ওই ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন?’
উনি নারায়ণগঞ্জেই ছিলেন তহন। সাহেবের অসুখের খুব বাড়াবাড়ি হওনে উনি ওইহানেই থাকতেন।’.
বেলাল বলল, ডালিয়া অবশ্য নারায়ণগঞ্জে বড় একটা থাকত না। মায়ের সাথে বনিবনা ছিল না ওর।’
শহীদ সপ্রশ্নদৃষ্টিতে বেলালের দিকে তাকাল। বেলাল বলল, উনি ডালিয়ার আপন মা নন। সৎমা।’ “সেই জন্যেই কি মিস ডালিয়া পৃথক থাকতেন?
‘একেবারে সেই কারণেই আলাদা থাকত তা বলা ভুল হবে। কলেজে পড়বার সময় ডালিয়া এই বাসায় এসে ওঠে। তখন থেকেই সে এখানে থাকে। মাঝেমধ্যে নারায়ণগঞ্জে যায়। ওর বাবাও ঢাকায়– এলে এখানেই থাকতেন। তবে অসুখের বাড়াবাড়ি হবার পর আর এ বাসায় আসেননি।
যদি কিছু মনে না কর তোরাব আলী, তোমার আপার নামটা আমি দেখতে চাই একবার।’
বেশ তো, আহেন না, হুজুর। এই তো পাশের রুমটাই আপার।’ শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে বেলালকে বলল, আপনিও আসুন না। চলুন, উঠে দাঁড়িয়ে বলল বেলাল সিদ্দিকী।
ডালিয়ার রূমটা সুসজ্জিত। চমৎকার করে সাজানো গোছানো। সুরুচির পরিচায়ক। ঘুরে ফিরে সমস্ত রূম পর্যবেক্ষণ করল শহীদ। কুয়াশা-২৯।
৭৫
একপাশে ছোট লিখার টেবিলটার উপর গুটিকয়েক ইংরেজি-বাংলা বই। অধিকাংশই রহস্যোপন্যাস। সেগুলো উল্টে-পাল্টে দেখল শহীদ।
বিছানাটা দামি বেডকভারে ঢাকা। শয়নের চিহ্নমাত্র নেই। সাইড-টেবিলের উপর লেবেলহীন একটা ওষুধের শিশি। তার পাশে ছোট একটা কাগজের বাক্স। বাক্সটা খুলল শহীদ। সেটা খুলতেই দেখা গেল একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ।
বেলাল বলল, ড. এলাহীর সিরিঞ্জ ওটা। মাঝখানে জ্বরের জন্যে ইনজেকশন করা হয়েছিল রহিমের মাকে অর্থাৎ ডালিয়ার ঝিকে। ইনজেকশনটা দেবার জন্যে সিরিঞ্জটা এনেছিলেন ড, এলাহী। আর নেয়া হয়নি।’
সিরিঞ্জটা রেখে ওষুধের শিশিটা হাতে নিল শহীদ। ক্যাপটা খুলল। ভিতরে, আর একটা রাবারের ক্যাপ দেখা গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে লক্ষ্য করে দেখল, ক্যাপটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় সূঁচের সূক্ষ একটা দাগ রয়েছে। শিশির ভিতরে অর্ধেকটা শূন্য।
| সিরিঞ্জটা আবার হাতে নিল শহীদ। সে শিশি আর সিরিঞ্জ পকেটে ফেলে বলল, আমি নিয়ে গেলাম এ দুটো।’
আড়চোখে লক্ষ করল শহীদ বেলালের চেহারাটা কেমন যেন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। বেলাল বলল, তা নিয়ে যান।
দেয়ালের দিকে তাকাল শহীদ। একদিকের দেয়ালে ফকির আকরামের ছবি। বকুল ফুলের একটা মালা ঝুলছে ছবিটার গায়ে। অন্য দেয়ালে এক সুন্দরী তরুণীর ছবি। সন্দেহ নেই ইনিই ডালিয়া আকরাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখল শহীদ। ভদ্রমহিলা যথার্থই সুন্দরী।
‘মিস ডালিয়া পড়াশোনায় কতদূর?’ বেলালকে জিজ্ঞেস করল শহীদ।
আই. এ. পাস করেছিল কষ্টে-সৃষ্টে। ভাল ছিল না পড়াশোনায়, যদিও চেষ্টার ক্রটি ছিল না। তা দুরকারই বা কি বলুন, কোটিপতির একমাত্র মেয়ে।
তা বটে। আচ্ছা, একটা কথার জবাব দেবেন, সিদ্দিকী সাহেব?’ বলুন।
ডালিয়ার ধারণা ছিল ওঁর বাবা আত্মহত্যা করেননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”
বেলালের চেহারা দেখে মনে হল, সে যেন প্রশ্নটা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছে। কিছুক্ষণ সবিস্ময়ে শহীদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি যতদূর শুনেছি আত্মহত্যাই করেছেন আকরাম চাচাজী। আর ডালিয়া আমার কাছে তার সন্দেহের কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। আমার নিজেরও কখনও এ সম্ভাবনার কথা মনে হয়নি।
‘অথচ আমাকে উনি তার বাবার খুনের রহস্যটা তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়েই দেখা করতে বলেছিলেন,’শহীদ বলল। যাই হোক, এখন আসি আমি।
ভলিউম-৯
–
৭৬
দরকার হলে আমাকে জানাবেন। আর যদি মিস ডালিয়া আজ সন্ধ্যার মধ্যে না ফেরেন তাহলে পুলিসে খবর জানাতে ভুলবেন না।’
| বেলাল একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি নিশ্চয়ই এ সম্পর্কে ড. এলাহীর সাথে আলাপ করবেন?”
তাই তো ভাবছি।’
‘তাহলে পুলিশে খবর দেবার ব্যাপারটা তার কাছে জিজ্ঞেস করবেন। আমার ধারণা, ডালিয়ার সাথে ড. এলাহীর যখন বিয়েটা ঠিক হয়ে আছে, আর যেহেতু এখনও তিনিই ডালিয়ার প্রকৃত অভিভাবক সেক্ষেত্রে তার সাথে আলাপ না করে পুলিসকে জানাতে আমি ঠিক ভরসা পাচ্ছিনে। এর জন্যে উনি হয়ত আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন। বলতে গেলে এ সম্পর্কে আমার তো কোন এখতিয়ারই নেই। | ‘ড, এলাহীর পক্ষ থেকে কোন আপত্তি আসবে বলে আশঙ্কা করছেন? | তা করছিনে। তবে ভাবী-বধূর নিখোঁজ খবরটা, লোক জানাজানি তোক তা
উনি পছন্দ না-ও করতে পারেন। তাছাড়া আমি ডালিয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহ দেখালে ডাক্তার সাহেব খুশি হবেন বলেও মনে হয় না। আবার এমনও হতে পারে যে, ডালিয়া কোথায় আছে তা উনি জানেন, কিন্তু যেহেতু খোঁজটা আমি করেছি তাই।’
শহীদ হেসে বলল, তা ঠিক। আমি এ সম্পর্কে ড. এলাহীর সাথেই আলাপ করব।’
বেলাল তার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে শহীদের হাতে দিয়ে বলল, দরকার হলে আমাকে জানাবেন, আমি যতটা পারি আপনার সাথে সহযোগিতা করব।
এয়ারপোর্টের দিকে গাড়ি চালাল শহীদ। সেখানে কামালের অপেক্ষা করার কথা। হয়ত ইতিমধ্যেই সে পৌঁছে গেছে।
গাড়ি পার্ক করে সোজা চলে গেল সে ক্যান্টিনে।
কামাল এককোণে বসে সিগারেট টানছিল চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে। তার দৃষ্টি ছিল দরজার দিকে নিবদ্ধ। শহীদকে ঢুকতে দেখে সে সোজা হয়ে বসল। শহীদ চারদিকে তাকিয়ে কামালের দিকে এগিয়ে গেল। কামালের চেহারায় উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সে শহীদকে দেখেও যেন দেখল না। দরজার দিকেই তাকিয়ে রইল। শহীদ সামনের চেয়ারে বসে বলল, “থাক, তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি দেখেছি। কেউ পিছু লাগেনি আমার। তারচেয়ে বরং চায়ের অর্ডার দে। গলাটা শুকিয়ে গেছে বকবক করতে করতে।’
বেয়ারা ডেকে চা আর স্ন্যাকসের অর্ডার দিল কামাল।।
বেয়ারা চলে যেতেই শহীদ প্রশ্ন করল, খবর আছে কিছু?’ । “নিশ্চয়ই। তোর ধারণা সেন্ট পারসেন্ট কারেক্ট। সেই প্রকাণ্ড মুখওয়ালা
কুয়াশা-২৯।
৭৭
লোকটা, মানে বিলী ডলস হাউসের সামনে একটা লোক নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
ক’জন ছিল ওরা?’ । | ‘সেই বেবি-অস্টিনে করেই এসেছিল। চারজন ছিল গাড়িতে। বিল্পী ছিল পিছনে। গাড়ির নাম্বারটা টুকে নিয়েছি আমি,’ এক টুকরো কাগজ পকেট থেকে বের করে শহীদের হাতে দিয়ে বলল, এই যে নাম্বার।
| নাম্বারটা দেখে কাগজটা ছিঁড়ে অ্যাসট্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে শহীদ বলল, এটা নকল নাম্বার।
নকল নাম্বার! কি করে বুঝলি?”
আমার গাড়ির নাম্বার যে ওটা!’
• বলিস কিরে! আরে হ্যাঁ তাই তো৷ কিন্তু আমি তো ওই নাম্বারটাই টুকেছি।’
‘সেটাই স্বাভাবিক। এসব অপরাধীর দল নিজেদের গাড়িতে আসল নাম্বার ব্যবহার করে না। চোরাই গাড়ি হলে অবশ্য আলাদা কথা।’
বোকার মত চেহারা করে বসে রইল কামাল। বোরা চা দিয়ে গেল।
শহীদ চা বানাতে বানাতে বলল, যাকগে। এখন তোকে আরও একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক।’
কামাল বুক উঁচিয়ে বলল, ভয় দেখাচ্ছিস? বিপদকে খোঁড়াই পরোয়া করে কামাল আহমদ।
“বেশ, নিজেকে একজন গ্রাম্য ব্যবসায়ী হিসেবে কল্পনা কর।
চোখ বুজে কামাল বলল, করলাম।’
মনে কর, দুহাজার টাকা নিয়ে মাল কিনতে এসেছিস মানিকগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে। সোয়ারীঘাটে নেমেছিস।’
নামলাম।’ “কি ধরনের কাপড় তোর পরনে থাকবে?
এবার চোখ খুলল কামাল। ‘এই ধর-পুলি, জামা, একটা টুপি…এই আর কি, কামাল জবাব দিল।
ঙ্গি থাকবে অবশ্য। তবে খুব ফাইন বাবুরহাটের লুঙ্গি হয় যেন। গায়ে হাতে-কাঁচা একটা জামা। তাতে যেন অবশ্যই ঘড়ি-পকেট থাকে। ঢোলা একটা কোট তার উপরে। কোমরে থাকী রঙের কাপড়ের একটা তহবিলে হাজার খানেক টাকা। কিছু থাকবে ঘড়ি-পকেটে আর কিছুটা কোটের পকেটে। কোটটা যেন অবশ্যই কিছুটা পোকায় কাটা থাকে। মাথায় তেল একটু বেশি করে দিবি, জুলপি বেয়ে যেন পড়ে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি হলে ভাল হত। কিন্তু তার জন্যে দুদিন অপেক্ষা করা দরকার, সেটা সব নয়।’
ভলিউম-:
৭৮
‘বেশ, তারপর?
লঞ্চ থেকে তো আর নামতে পারছিল না। তা হোক। লঞ্চ যখন ঘাটে ভেড়ে ঠিক তখন পৌঁছলেই চলবে। ওই ভাল কথা, হাতে একটা পুরানো পোর্টফোলিও ব্যাগ আর বগলে কষলে জড়ানো একটা বালিশ থাকতে হবে।’
থাক।’
‘দেখবি হোটেলে যাবার নিমন্ত্রণ জানাবে অনেকেই। জোর করে নিয়ে যেতে চাইবে। ব্যাগ আর পুটুলি ছিনিয়ে নেয়াও বিচিত্র নয়।’
| তিনতলা বাড়িতে যে হোটেলটা আছে তার প্রতিনিধিকে চিনে নিতে পারবি? অর্থাৎ পরিস্কার হোটলে ঢুকতে পারবি?”
জরুর পারেগা।’ ‘ত চালা যাও উধার। আশা করি একবেলাতেই তোর দু’হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে। তবে বাড়িটার অন্ধিসন্ধি জেনে আসা চাই যতটা সম্ভব।
কবে যেতে হবে?
আজকেই। একঘন্টার মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে বেরুবি। দুটোর মধ্যে সেখানে পৌঁছা চাই। এক্ষুণি বেরিয়ে পড় তুই। আমি একটু পরে বেরোব।’
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়ল কামাল। শহীদ বেরোল আধঘন্টা পরে।
সে নিউমার্কেটে গিয়ে ঢুকল এক কেমিস্টের দোকানে, দোকানদার ভদ্রলোক তার বিশেষ পরিচিত। তিনি একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “আসুন, শহীদ সাহেব। কি মনে করে অভাগার দ্বারে?’ | পকেট থেকে ডালিয়ার রূম থেকে আনা ওষুধের শিশি আর সিরিজটা এগিয়ে দিয়ে শহীদ বলল, এই শিশিটা কোন ওষুধের, বলতে পারেন?
দ্রলোক শিশিটা হাতে নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে বললেন, কেমিক্যাল এক্সামিনেশন ছাড়া বলা যাবে না। ঠিক এই আকারের ফাইল আমাদের কাছে নেই। রেখে যান না হয়, আমাদের কেমিস্ট টেস্ট করে বলে দিতে পারবেন। বিকেলে আসুন।
| ‘বেশ, আর দেখবেন তো এই সিরিঞ্জে যে ওষুধটা সর্বশেষ ব্যবহার করা হয়েছে তা ধরা পড়ে কিনা। * ভদ্রলোক শিশি আর সিরিঞ্জটা নিয়ে গেলেন। শহীদ বলল, ‘বিকেলে যেন জানতে পারি।
অবশ্যই।
কুয়াশা-২১
পাঁচ
টেলিফোনে যোগাযোগ করল শহীদ ড. কায়সার এলাহীর সঙ্গে। রাত আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
পৌনে আটটায় শহীদ ড, এলাহীর চেম্বারে পৌঁছল। শেষ রোগী বিদায় নিতেই ড. এলাহী তাকে ডেকে পাঠাল।
একমুহূর্তে ডাক্তারকে জরিপ করে নিল শহীদ। লম্বা, বলতে গেলে অতিরিক্ত ঢ্যাঙা লোকটা। সেই তুলনায় দেহটা যথেষ্ট চওড়া নয়। রঙটা বেশি রকমের ফর্সা, ফ্লোরোসেন্ট টিউবের আলোয় কেমন ফ্যাকাসে দেখায়। মুখের তুলনায় নাকটা ছোট। সামনের দিকটা চ্যাপ্টা। তার নিচে সরু গোঁফের রেখা। জুলফি কানের নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। চুলগুলো কোঁকড়া। কপালের দু’পাশ থেকে চুল পড়ে যাওয়াতে কপালটা চওড়া দেখায়। দুচারটে ভাজও পড়েছে কপালে। বয়স, শহীদ অনুমান করল, পয়ত্রিশের কম নয়।
শহীদকে বসতে অনুরোধ করে ড. এলাহী তার সামনে সিগারেট-কেস খুলে ধরল।
একটা সিগারেট নিয়ে শহীদ অগ্নিসংযোগ করল। ডাক্তারও একটা সিগারেট ধরাল। একগাল ধোয়া ছেড়ে সে বলল, আপনার নাম শুনেছি, শহীদ সাহেব, কিন্তু আমার কাছে আগমনের কারণটা অনেক চিন্তা করেও আন্দাজ করতে পারছিনে।
শহীদ বলল, আমি এসেছি মিস ডালিয়া আকরামের খোঁজ করতে।’
ডালিয়া আকরামের খোঁজ করতে এবং আমার এখানে!’ বিস্ময় প্রকাশ করল ডাক্তার।
‘জি হ্যাঁ। গতকাল সন্ধ্যায় উনি বেরিয়েছেন বাসা থেকে। তারপর থেকে তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ভাবলাম, আপনার এখানে আসাটা অস্বাভাবিক নয়।
অস্বাভাবিক মোটেও নয়। সে এসেছিল বটে এখানে, রাত নটার দিকে। কিন্তু তক্ষুণি চলে গেছে। দেখুন শহীদ সাহেব, আপনি নিশ্চয় জেনে-শুনেই এসেছেন যে, ডালিয়া আমার ভাবী-স্ত্রী। তবু আমি একটু সাবেকী আমলের লোক। বিয়ের আগেই আমার স্ত্রী আমার বাড়িতে রাত কাটাবে, এতটা প্রগতিবাদী আর সংস্কারমুক্ত আমি নই, যদিও একথা ঠিক যে, আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার অভাব নেই। মাঝে-মধ্যে আমরা একসাথে খাওয়া-দাওয়া করি। বেড়াই, সিনেমা দেখি । আর যাওয়া-আসা তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে। তবে কাল এসেছিল ওর মায়ের অসুখ সম্পর্কে আলোচনা করতে। কিন্তু আসল কথাই আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।
ভলিউম-৫
৮০
বলুন?”
ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘আমার ভাবী-বধু সম্পর্কে আপনার এত উত্সাহের কারণ বুঝতে পারছিনে। হয়ত জানেন যে, বিয়ে না হওয়া সত্ত্বেও আমিই ওর অভিভাবক। আমার নির্দেশ বা অনুরোধ ছাড়া আপনি তার খোঁজ করতে শুরু করলেন কি করে? এ দায়িত্ব তো আপনাকে কেউ দেয়নি? তাছাড়া ডালিয়া নিখোঁজ হয়েছে এই ধারণাই বা কেন হল! * ভিতরে ভিতরে চটে গেলেও শহীদ তা প্রকাশ না করে সহজ গলায় বলল, ‘এতটা আমার জানা ছিল না আগে। এখন জানতে পারলাম। কিন্তু আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তার জবাবটা দিচ্ছি। মিস ডালিয়াই আমাকে একটা তদন্ত পরিচালনার অনুরোধ করেছিলেন। সে সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও হয়েছিল। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট উনি রক্ষা করতে পারেননি। পরে দেখলাম, উনি নিখোঁজ হয়েছেন। সুতরাং আপনার কাছে আসতেই হল। আশা করি, এমন কিছু অন্যায় হয়নি?’ | ডাক্তার একটু চুপসে গিয়ে আমতা-আমতা করে বলল, কিন্তু তদন্তটা কিসের তা তো বুঝতে পারলাম না?’
জানি না, আপনার সাথে মিস ডালিয়া কখনও এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন কিনা। তবে আমাকে বলেছেন যে, ওঁর ধারণা ওর বাবা আত্মহত্যা করেননি। ওনাকে খুন করা হয়েছে। এই ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যেই উনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। বিস্তারিত আলোচনার জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে না পারায় আমিই ওঁকে এখন খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
ডাক্তার কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘অবশ্য ওর পক্ষে ওইরকম ধারণা পোষণ করা অস্বাভাবিক নয়, যদিও আসলে এই ধারণার কোন ভিত্তি নেই।’
হয়ত কোন প্রমাণ ওঁর হাতে এসেছে।’ ডাক্তার সজোরে মাথা নেড়ে বলল, এটা হতেই পারে না। আসলে কি জানেন, আকরাম সাহেবের মর্মান্তিক আত্মহত্যা ডালিয়াকে মনের দিক থেকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করেছে। ওর কাছে ওর বাবা ছিলেন এক আদর্শপুরুষ অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। উনি আত্মহত্যা করতে পারেন, এটা ডালিয়া তখনও বিশ্বাস করেনি এখনও করে না। ফলে, ক্রমে ক্রমে ডালিয়া একটু ভারসাম্য হারিয়ে। ফেলেছে। অন্যদিকে খেপে উঠেছে মাকে নিয়ে। ওর ধারণা, আমার স্যানাটোরিয়ামে ওর মায়ের ঠিকমত চিকিৎসা হচ্ছে না। মাকে সে এখন তার কাছে রেখে চিকিৎসা করাতে চায়। অন্তত নিজ হাতে তাকে শুশ্রূষা করতে পারবে এই আশায়।’
‘শুনেছি, ভদ্রমহিলা ওর বিমাতা।’
হ্যাঁ, মার সঙ্গে বনিবনাও বড় একটা ছিল না ডালিয়ার । কিন্তু এখন সেই মা ৬-কুয়াশা-২৯
ই তার জীবিত নিকটতম আত্মীয়। ওর ধারণা, এতদিন ও মায়ের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেনি। তাই অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে সেবা-যত্ন করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় ও।।
‘আপনি বলতে চাইছেন, মিস ডালিয়ার মনটা এখন সব মিলিয়ে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত আছে?”
| ‘তা…হ্যাঁ, তাই বলতে পারেন। সায় দিল ডাক্তার, বিয়েটা হয়ে গেলে অবশ্য ডালিয়া নিজেও অনেকটা সুস্থ হত। কিন্তু মায়ের এই অবস্থায় ডালিয়া তা কল্পনাও করতে পারে না।’ | ‘আপনি বলতে চাইছেন, আকরাম সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কে ডালিয়ার সন্দেহ ভিত্তিহীন? আপনি তো আকরাম সাহেবকে চিকিৎসা করেছেন। আপনার কি ধারণা, উনি আত্মহত্যাই করেছেন?”
নিঃসন্দেহে।’ ‘কোন কারণ ছিল?
ডাক্তার সিগারেটের শেষাংশ অ্যাসট্রেতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘অন্তত তার কাছে তো ছিলই।
আর আপনার মতে?’
একটু ইতস্তত করে ডাক্তার বলল, আকরাম সাহেবের ধারণা ছিল, ওঁর গলায় মারাত্মক রোগ বাসা বেঁধেছে। এই চিন্তা ওকে দিশেহারা করে তুলেছিল। নিজেকে উনি একেবারে গুটিয়ে ফেলেছিলেন। আমরা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, উনি অবস্থা যতটা খারাপ মনে করেছিলেন ততটা খারাপ ছিল না। কিন্তু উনি বিশ্বাস করেননি।’
শহীদ আর একটা সিগারেট ধরাল। তারপর বলল, কিন্তু ওঁর কণ্ঠনালীর অবস্থাল আসলে কেমন ছিল? নিরাময়যোগ্য ছিল কি?
আমার মতে, ছিল না। কিন্তু ওকে তো উল্টো কথাটাই বলতে হয়েছে। এর : মা মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে। আর আমরা যাই বলি না কেন ওঁর ধারণা হয়েছিল,
ওর ক্যান্সার হয়েছে। অথচ আমরা তা ওর কাছ থেকে গোপন রেখেছিলাম। . আত্মহত্যার রাতে উনি হয়ত হতাশার চরমে পৌঁছেছিলেন।’
“ মিস ডালিয়া নিশ্চয়ই বাপের মানসিক অবস্থা জানতেন। তারপরেও কেন ওঁর দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাল যে, ওঁর বাবা আত্মহত্যা করেননি?” * ডালিয়া জানত নিশ্চয়ই। কিন্তু সে তা নিজের কাছে স্বীকার করতে রাজি নয়। ওর কাছে ওর বাবা ছিলেন এক মহাপুরুষ। ডালিয়া নিজেও অত্যন্ত মজবুত মেয়ে। সে জানে, আত্মহত্যা করা কাপুরুষতা। ওর বাবা কাপুরুষ, তা যেন ও ভাবতেই পারে না।’
আপনার সাথে নিশ্চয়ই মিস ডালিয়া এসব নিয়ে আলাপ করেছেন?
ভলিউম-৯
প্রথম দিকে করত। কিন্তু ইদানীং কিছু বলে না। আমার সঙ্গে ইদানীং সে শুধু । তার মায়ের অসুখ সম্পর্কেই আলোচনা করে।’
‘ওর মায়ের কি হয়েছে? মানে, উনি কি অসুখে ভুগছেন?”
ডাক্তার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সে-ও এক ট্র্যাজেডী, শহীদ সাহেব। ডালিয়ার বাপ যে রাতে আত্মহত্যা করেন সেই রাতেই মিসেস আকরামকে সিঁড়ির গোড়ায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।’
কি হয়েছিল ওঁর?’
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, যা কিনা বাহ্যিক জখমের চাইতেও মারাত্মক। অবশ্য ফ্র্যাকচারও হয়েছে দুজায়গায়। ‘
কিভাবে হয়েছিল?
ঠিক বলতে পারব না। ঘটনাস্থলে তখন কেউ ছিল না। চাকর-বাকরগুলো কোথায় যেন গিয়েছিল। ডালিয়া ছিল বাগানে বসে। কাছে-পিঠে কেউ ছিল না। তবে মনে হয়, স্বামীর নাম থেকে রিভলভারের আওয়াজ শুনে উনি দৌড়ে যাচ্ছিলেন। সম্বত সিঁড়ির মাথাতে যখন পৌঁছোন সেই মুহূর্তে ওঁর স্ট্রোক হয়। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে চলে যান।
‘উনি নিজে কি বলেন?’
মাথা নাড়াল ডাক্তার। আবার একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেইটাই তো চরম ট্র্যাজেডী। কিছু বলবার মত জ্ঞান উনি এখনও ফিরে পাননি, পাবেন সে ভরসাও দেখছিনে।’
পিছন দিকে ফিরে ব্ল্যাক থেকে বেছে একটা বড় ম্যানিলা এনভেলাপ বের করল ডাক্তার। সেটা টেবিলের উপর রেখে সে বলল, “মিসেস আকরামের আঘাতের পরিমাণ জানতে আপনার ঔৎসুক্য থাকতে পারে।’
খামটা থেকে চারটে ধূসর রঙের নেগেটিভ বের করল ডাক্তার।
এগুলো হল মিসেস আকরামের ক্ষতস্থানগুলোর এক্স-রে। জখম হওয়ার পর এইগুলোই প্রথম নেয়া হয়।’
| ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে কোণের বাক্সের আকারের একটা কেবিনেটের আলো জ্বালল। একটা নেগেটিভ বেছে নিয়ে তা আলোর সামনে ধরে শহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। | একটি করোটির রূপরেখা শহীদের চোখের উপর ভেসে উঠল। কানের কাছে বেশ বড় আকারের একটা কালো জায়গা। ডাক্তার ওই কালো জায়গাটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল, পড়ে গিয়ে মিসেস আকরাম কানের কাছে অত্যন্ত মারাত্মক চোট পেয়েছেন। ফলে ভিতটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।’
সেটা রেখে আর একটা নেগেটিভ হাতে নিল ডাক্তার।
শহীদ বলল, “থাক ডাক্তার সাহেব, ওসব দেখবার দরকার নেই। আপনার কুয়াশা-২৯
৮৩
মুখের কথাই যথেষ্ট।
ডাক্তার যেন তা শুনতেই পেল না। সে বলল, এটাতে দেখুন চোয়ালেও ফ্র্যাকচার হয়েছে। হাতেও ফ্র্যাকচার হয়েছে, এই যে, এটাতে দেখুন। ওঁর যা বয়স তাতে বুঝতেই পারছেন ওই ধরনের আঘাত কি মারাত্মক হতে পারে।’
শহীদ চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ নীরবে সিগারেট টানল। ডাক্তার নেগেটিভগুলো গুছিয়ে এনভেলাপে ভরে র্যাকে রাখল।– আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আকরাম সাহেবের চাকর-বাকরগুলো বিশ্বস্ত ছিল তো?’
হ্যাঁ, সবাই প্রায় পুরানো চাকর-বাকর,’ ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, আকরাম সাহেব যদি খুন হয়েও থাকেন তাহলেও অন্তত চাকর-বাকরের হাতে হননি।
‘বেলাল সিদ্দিকী সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
ডাক্তার কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে শহীদের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি ওকে খুব স্নেহ করি। ডালিয়ার বাল্যবন্ধু ছেলেটি। তাই সে আমারও বন্ধু। আশা করি, এরপরে আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।’
‘আপাতত নেই। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি।’
বলুন?
ডালিয়ার অন্তর্ধানে আপনি যে এতটুকু বিচলিত হননি কেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে।
‘এটা ডালিয়ার পক্ষে নতুন কোন ঘটনা নয়। মাঝে-মধ্যে ও এরকম করেই থাকে। আবার কয়েকদিন পরে ফিরে আসে। না, সন্দেহজনক কিছু নেই। যে কোন মুহূর্তে ডালিয়া ফিরে আসতে পারে। তখন ওকে বরং বকে দেবেন। আর ওর কথায় তদন্ত করতে গিয়ে অহেতুক হয়রান হবেন না। আকরাম সাহেব। আত্মহত্যা করেননি। তবু দরকার হলে পুলিসের কাছ থেকে ফাইলপত্র নিয়ে দেখতে পারেন। ময়না তদন্তের রিপোর্ট পড়লেও আপনার সন্দেহ ঘুচবে।
ছয়।
পরদিন সকালে শহীদ গিয়ে হাজির হল মি. সিম্পসনের অফিসে। মি, সিম্পসন। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘আরে, এস এস। খবর কি? তোমার বাড়িতে নাকি। ডাকাত পড়েছিল?
ব্যাপারটা অনেকটা তাই। আর সেই ব্যাপারেই আমি এসেছি। ‘শোনাও তো দেখি?’ গত দুদিনের ঘটনার বিশদ বিবরণ দিল শহীদ। মি. সিম্পসন সবটা শুনে বললেন, ‘কিন্তু ফকির আকরাম যে আত্মহত্যা
ভলিউম-৯
৮৪ •
করেছেন সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। ময়না তদন্তেও তাই বলা হয়েছে। আর বর্তমান সিভিল সার্জন রেজাউদ্দিনকে তো জান। তার ভুল হয় না।’
‘রেজাকে আমি ভাল করেই জানি। ওর ভুল বড় একটা হয় না, তা ঠিক। কিন্তু এক্ষেত্রে যে হয়নি, তা-ও তো আপনি বা রেজা কেউই জোর করে বলতে পারেন না।’
‘তা ঠিক, স্বীকার করলেন মি, সিম্পসন।
তাছাড়া ঘটনাগুলোকেও তো বিচার করতে হবে। তিনমাস আগে আকরাম, সাহেব মারা গেছেন। এর মধ্যে মিস ডালিয়া নিরুদ্দেশ হননি। যেদিন উনি আমাকে সন্দেহের কথা জানিয়ে তদন্তের জন্যে অনুরোধ করলেন সেইদিনই নিখোঁজ হলেন তিনি। আর আমার উপর দুবার বুলেট বৃষ্টি হল। আপনি এ
ঘটনাগুলোকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
| ই, তা তুমি এখন কি করতে চাও? | ‘আমি ময়না তদন্তের রিপোর্ট আর মৃতদেহের ছবিগুলো দেখতে চাই। আপনি সেই ব্যবস্থা করে দিন।’
তাহলে রেজার কাছে চলে যাও।’ কিন্তু আপনার নির্দেশ ছাড়া রেজা আমাকে ওগুলো দেখাবে কেন?’ ‘এখুনি যাবে?’
এখুনি।
মি. সিম্পসন একখণ্ড কাগজে প্রয়োজনীয় নির্দেশ লিখে শহীদের হাতে দিলেন। সেটা পকেটে ফেলে বেরিয়ে এল শহীদ। সোজা চলে গেল সে সিভিল সার্জনের অফিসে।
. সিভিল সার্জন রেজাউদ্দিন ল্যাবরেটরিতেই ছিলেন। সহকারীর কাছে জানতে পেরে হাতের কাজ সেরে অফিসরূমে ঢুকলেন।
“আরে, আমাদের শহীদ ডিটেকটিভ যে! কি মনে করে? রাস্তা ভুলে এসে পড়েছিস নাকি?’
না, পথ ভুলে নয়। নিতান্ত দায়ে ঠেকে।’ । সার্জন বসতে বসতে বললেন, তা কি ব্যাপার, বল? শহীদ মি. সিম্পসনের নোটটা সার্জনের দিকে এগিয়ে দিল। রেজাউদ্দিন সেটা পড়ে বললেন, কিন্তু ওটা যে সত্যি আত্মহত্যা।’ ‘ওর মেয়ের ধারণা, ওটা খুন। শুধু অনুমান নয়, এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। সজোরে মাথা নাড়ল সার্জন, ‘অসম্ভব।’ শহীদ একটু চিন্তা করে বলল, তোরই বা এতটা নিশ্চিত হবার কারণ কি?
আর কিছু যে হতেই পারে না। অন্য কিছু হবার কোন অবকাশই তো নেই। অন্য কোন ধারণাই তো করা যায় না।’ কুয়াশা-২৯
কিন্তু তোর তো ভুলও হতে পারে?’ ইতস্তত করে বলল শহীদ।
সার্জন কিছুক্ষণ শহীদের দিকে নীরবে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল, “তোর ধৃষ্টতা ক্ষমা করলাম, তবু বলি, ভুল আমার হতে পারে বৈকি! মানুষ মাত্রেই ভুল করে। কিন্তু এই বিশেষ কেসটিতে ভুল করার কোন অবকাশই ছিল না। তবু তুই আমাকে চ্যালেঞ্জ করলি তাই বলছি, তুই যদি আমার মুখে জোর করে রিভলভার পুরে দিস তাহলে আমার মুখে ধস্তাধস্তির অথবা বাধা দেবার কোন চিহ্ন থাকবে
? তুই-ই বল?”
তাই তো থাকা উচিত।’ ‘বেশ। তাহলে দ্যাখ। জাস্ট এ মিনিট।
সিভিল সার্জন উঠে গিয়ে একটা আলমারি খুললেন। লাল রিবনে বাধা অনেকগুলো এনভেলাপের মধ্যে থেকে একটা এনভেলাপ এনে টেবিলের উপর রাখলেন তিনি। রিবন খুলে এনভেলাপের মধ্যে থেকে কয়েকটা ফটো বের করলেন। তার মধ্যে, থেকে একটা বেছে নিয়ে শহীদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা দ্যাখ, কোন চিহ্ন মুখে আছে কি?’
ফটোটা অনেকক্ষণ ধরে দেখল শহীদ। তারপর বলল, বুলেটটা মাথার খুলি “ ভেদ করে গেছে, তাই না?
* মুখের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র পুরে আত্মহত্যা করার ওটাই একমাত্র লক্ষণ। তুই করলেও ওভাবেই করবি। কিন্তু অন্য কেউ যদি জোর করে তোর মুখে রিভলভার খুঁজে দিতে চায় তাহলে তো তুই তাকে অনুমতি দিবিনে। বরং কিছু না কিছু বাধা দেবার চেষ্টা করবি। চেহারায় তা প্রকাশ পাবেই।’
। তোর কথাটা ভেবে দেখবার মত।’ ফটোটা ফিরিয়ে দিয়ে শহীদ সিলিং এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, সেক্ষেত্রে অবশ্য বুলেটটা সিলিং-এর দিকে ধাবিত হবে এবং সম্ভবত সেখানেই ঢুকে থাকবে। বলতে পারিস বুলেটটা সিলিং-এ পাওয়া গেছে কি না?
. মাথা নাড়ল সিভিল সার্জন।
‘পাওয়া যায়নি বলেই নি। পুলিস: অনেক খুঁজেছে। কোথাও বুলেটটা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বুলেটটা সিলিং পর্যন্ত পৌঁছুবেই, একথা কেন বলছিস? মাথার খুলি ভেদ করে বেরোতে গিয়ে যদি বুলেটের শক্তি ফুরিয়ে যায় তা হলে সেটা বিছানা বা মেঝেতে পড়বে। তারপর হৈ-চৈ আর বিভ্রান্তির মধ্যে কোথাও হারিয়ে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়।’
‘এ কথাটা ভেবে দেখবার মত,’ শহীদ কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর গাত্রোখান করে বলল। যাক, আমি উঠি, ভাই। তোকে জ্বালাতন করে গেলাম।
“আরে, তাতে কি! দরকার হলেই আসবি। মহুয়া বৌদি ভাল আছেন?
আছে ভালই। তুই আসিস আমার বাসায়। বেশ আড্ডা দেওয়া যাবে।
ভলিউম-৯
রেজাউদ্দিন জানাল, সে যাবে। নিউমার্কেটে কেমিস্টের দোকানে গেল শহীদ।
মালিক সম্বর্ধনা জানিয়ে বলল, এই যে শহীদ সাহেব, এসেছেন, আপনার কাজটা তো গতকালই করে রেখেছি।’
| ড্রয়ারের ভিতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে তিনি বললেন, এর মধ্যে আপনার জিনিস আছে।
‘পরীক্ষার ফল কি?’
মুর্শিয়া। শিশি আর সিরিঞ্জ দুটোতেই।’ অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে শহীদ বেরিয়ে এল। বাসায় ফিরে দেখে কামাল শুকনো মুখে বসে আছে বারান্দায়। শহীদ বলল, কিরে? কে মেরেছে, কে বকেছে, কে দিয়েছে গাল?
কামাল ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সবকটা টাকাই একেবারে গচ্চা দিয়ে আসতে হল। তবে উদারতার সীমা নেই ওদের। মানিকগঞ্জে ফিরে যাবার জন্যে লঞ্চ ভাড়া পাঁচ টাকা দিয়েছে।’
জান নিয়ে যে ফিরতে পেরেছিস এই ঢের। কেউ লাগেনি তো পিছনে?”
। সেদিকে আমি খুব হুঁশিয়ার। তা খবর আনতে পারলি কিছু?”
‘তেমন কিছু না। তিনতলা বাড়িটা পশ্চিমমুখো। নিচতলায় রাস্তার ধার ঘেঁসে পাইকারী দোকান। ওখান থেকে ভেজাল জিনিস সাপ্লাই দেওয়া হয়। দোকানের দু’পাশে সিঁড়ি। উত্তরের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলার হোটেলে যেতে হয়, আর দক্ষিণের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। শুনলাম, দোতলাটা নাকি স্টোর। দক্ষিণের সিঁড়িতে অষ্টপ্রহর শুতামত একটা লোক বসে থাকে। কথায়-বার্তায় বুঝলাম, মালিক দোতলাতেই বসে। তার নাম নাকি মোহাম্মদ মোল্লা। ভদ্রলোক নাকি অসুস্থ, চলাফেরা করতে পারে না। নিচে নামে না, কারও সঙ্গে দেখাও করে না। অনেক বড় বড় ডাক্তার তাকে দেখতে আসে, এবং চমকাবি না, ড. কায়সার এলাহীও তাদের অন্যতম।’
বাহ, তাহলে তোর দু’হাজার টাকায় তো বেশ পুষিয়ে গেছে। অনেক খবর এনেছিস। জুয়োর আচ্ছাটা কোথায়, বল তো?’ খুশি হয়ে বলল শহীদ।
নিচে। রাস্তার পাশে যে রূমটা আছে তার পিছনেরটাই। ফ্ল্যাশ, ব্ল্যাক-জ্যাক, রুলেত সব খেলাই হয়। মেয়েও আছে দলে। ওরা জাদরেল সব খদ্দের জোগাড় করে।
‘একেবারে বৈজ্ঞানিক কায়দায় চালাচ্ছে ব্যবসা।
যা, তৰে খেলায় ভীষণ চুরি করে।’
তা তো করবেই। তবে হ্যাঁ, দিন ওদের ঘনিয়ে এসেছে। ভাল কথা, গাড়িটার কুয়াশা-২৯
৮৭
—
—
*
পাত্তা মিলেছে?”
‘কোনটা? সেই অস্টিন? না। ওটা দেখলাম না কোথাও।’ ‘তা যাকগে। তুই বোস, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।’
‘এখানেই খেয়ে যাবি। এবার তোর কাজ হবে বেলাল ছোকরা, ডালিয়া আর ড. এলাহীর খবরাখবর সংগ্রহ করা। বেলাল তো চিত্রজগতের লোক। সেখানে তো তোর বন্ধুর অভাব নেই। অসুবিধে হবে না নিশ্চয়ই?’।
কামাল ঘাড় নেড়ে জানাল যে, অসুবিধা হবে না।
খেতে বসে কামাল জিজ্ঞেস করল, “তোর ওদিকের খবর কি? হত্যা না আত্মহত্যা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলি?’
শহীদ বলল, আত্মহত্যাই যদি হবে তাহলে মিস ডালিয়াই বা কেন অন্তর্ধান করবে, আর আমার উপরই বা কেন বুলেট-বৃষ্টি হবে, বল?’
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু প্রমাণ পেলি কোন?’
‘প্রমাণটাই তো পাচ্ছিনে। সিভিল সার্জন বলল, ‘ওটা সত্যিই আত্মহত্যা। অথচ শুধু যদি বুলেটটা, মানে যে বুলেট আকরাম সাহেবের মৃত্যুর জন্যে দায়ী . সেটার হদিস পাওয়া যেত তাহলে সম্ভবত আমি প্রমাণ করতে পারতাম যে, ওটা
হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।
কি রকম?’ | শহীদ বলল, ‘বুলেটটা হিসেব অনুযায়ী সিলিং-এ পাওয়া উচিত। কিন্তু সিলিং-এ পাওয়া যায়নি। সেখানে কোন চিহ্নও নেই বুলেটের। সিভিল সার্জনের ধারণা, ফকির আকরামের মাথার খুলি ভেদ করার সময়ই বুলেটের শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে বুলেটটা সিলিং-এর দিকে না গিয়ে নিচে পড়েছিল। তারপর গোলমালের মধ্যে কোন ফাঁকে হারিয়ে গেছে।’
তা সেটা তো অসম্ভব নয়?’ ‘এ ক্ষেত্রে তো অসম্ভবই বটে।
কারণ?’ •
বুলেটটা ছিল 38। তার গতিশক্তি কেমন তা তো জানিসই। আকরাম সাহেবের মাথায় যদি ইস্পাতের লাইনিং থাকত শুধু তাইলেই ‘38-এর পক্ষে
গতিবেগ হারিয়ে ফেলা সম্ভব।’
| কামাল বিভ্রান্ত হয়ে বলল, তাই তো। তাহলে গেল কোথায় বুলেটটা?
শহীদ শুকনো হাসি হেসে বলল, সেটাই তো প্রশ্ন।
খাওয়া শেষ হতেই শহীদ বলল, “তুই পরিষ্কার হোটেলে যাবার রাস্তার একটা নকশা একে দে আমাকে।’
যাবি নাকি তুই সেখানে? ‘যেতেই হবে এবং আজ রাতেই।
৮৮
ভলিউম-৯
সাত শীতটা সে রাতে বেশ জাঁকিয়েই পড়েছিল। বুড়িগঙ্গা থেকে কনকনে হাওয়া ভেসে আসছিল। পথে লোক চলাচল বিরল। সোয়ারী ঘাটের একটা সঙ্কীর্ণ গলি দিয়ে হেঁটে চলেছে শহীদ। সঙ্গে তার অপরূপ বেশভূষা। লুঙ্গির উপর সার্জের পাঞ্জাবী। তার উপর ঢিলে একটা কোট! মাথায় কক্ষরটার জড়ানো। চিবুকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লাগানো নকল দাড়ি। নাকের পাশেই বেশ বড় আকারের একটা তিল। চাহনিতে একটা বোকা বোকা ভাব। সব মিলিয়ে গ্রাম থেকে সদ্য-শহরে আসা লোকের মত লাগছে তাকে।
বেরোবার সময় মহুয়াই শহীদকে দেখে চমকে উঠেছিল।
মোড়ের দোকান থেকে পান মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে এগোচ্ছিল সে। সমস্ত ইন্দ্রিয় তার সজাগ। কামালের আঁকা নকশার কথা স্মরণ করে হাতের বাঁয়ের বাড়িগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল শহীদ।।
উদ্দিষ্ট বাড়িটা চোখে পড়তেই শহীদের গতি আরও মন্থর হল।
কামাল যেমনটি বলেছিল ঠিক তেমনি রাস্তার পাশেই একটা রূম। তার এপাশে-ওপাশে বারান্দা দেখা যাচ্ছিল. একটু দূরের রাস্তার বৈদ্যুতিক আলোয়। পথের উপরেও রূমটার একটা ভোলা পাল্লা দিয়ে আলো আসছে। ভিতর থেকে আলোর রেখা ভেসে আসছে। এটা নিশ্চয়ই হোটেলের সিঁড়ির দরজা।
• রূমটার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল শহীদ। কাউকে দেখা গেল না। রাস্তার অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল ওপাশের সরু বারান্দার উপর একটা লোক আপাদ মস্তক কালো চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা সিগারেট। লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ।
একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। কামালের বর্ণনা অনুযায়ী এটাই দোতলার অর্থাৎ বিল্লাহর রূমে ঢুকবার পথ। অবশ্য মোহাম্মদ মোল্লাই যদি বিল্লাহ হয়। হবে যে তাতে সন্দেহ নেই। এই লোকটা নিশ্চয়ই প্রহরী ।
ভিতরে কি করে ঢুকবে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিল না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে, এটাই ছিল তার প্ল্যান। লোকটাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শহীদ।
কোটের পকেট থেকে একটা স্টার সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, ‘একটু আগুন দিবেন, মিয়াভাই?’
লোকটা নিঃশব্দে তার হাতের সিগারেট বাড়িয়ে দিল। সেটা নিয়ে সিগারেট ধরাল শহীদ। লোকটাকে সিগারেটটা ফেরত দিয়ে আড়চোখে সে দেখল, লোকটা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কুয়াশা-২৯
৮৯
কয়েকটা টান দিয়ে জুৎ করে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে শহীদ বলল, মিয়াভাই, এইডাই তো ঘাটে যাওনের রাস্তা? রাস্তা যে কয়বার ভুল করলাম!’
লোকটা মুখ খুলল। তবে যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে। যাইবেন কই?’
‘সোয়ারী ঘাটে, চান মিয়া সাহেবের হোটেলে। সেহানেই যাইতাম চাই। রাইত-বিরাইত সঙ্গে পয়সা-কড়ি লইয়া চলন-ফিরন ভালা না। তা মিয়াভাই, এই রাস্তায়ই তো যামু?’
লোকটা নীরবে জরিপ করতে লাগল শহীদকে। তার চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল মুহূর্তের জন্যে।
শহীদ মনে মনে বলল, ওষুধ ধরেছে। ‘পথ ঠিকই আছে। ভুল করেন নাই। সিধা যান। একটু হতাশ হল শহীদ। দু’পা এগিয়ে গেল সে। লোকটা জিজ্ঞেস করল, বাড়ি কই? আবার দাঁড়াল শহীদ। রামচন্দ্রপুর।’ ‘বেড়াইতে আইছেন?’ ‘জে না। মাল খরিদ করনের লাইগা। রেডিমেড কাপড়।’
তা সোয়ারী ঘাটে আর এত কষ্ট কইরা যাইবেন কেন? আমাগো এইডাই তো হোটেল। জবর ভালা হোটেল। দেহেন না কত বড় বাড়ি!’
‘এইডাও হোটেল!” বিস্মিত হবার ভান করল শহীদ, এই এত বড় বাড়িই হোটেল।
“কেন, বিশ্বাস হয় না?
‘তা, তা অয়। তবে কিনা…।’ . তাইলে এহানেই উইডা পড়েন। শীতের রাইত। আরামে থাকবেন। তাছাড়া খুব সস্তাও।’ প্রলোভন দেখাল সে শহীদকে।।
* একটু ইতস্তত করল শহীদ, কিন্তুক চান মিয়ার হোটেলে আমার তালতো ভাই আছে। হে আবার চিন্তা করব । হে কইচে, টাকা-পয়সা চাঁন মিয়ার কাছে রাইখা নিশ্চিন্তি। হের পর ফুর্তি-টুর্তি যা করবার চাও কর।”
‘আরে, মিয়াভাই, ফুর্তির ব্যবস্থা তো এহানেই আছে, শহীদের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল লোকটা।
শহীদ সরাসরি লোকটার চোখের দিকে তাকাল।
লোভে ও ধূর্ততায় তার দু’চোখ ধিকধিক করে জ্বলছে। টোপ ফেলা সার্থক হয়েছে শহীদের। সাদর আমন্ত্রণ এসেছে বাঘের খাঁচায় ঢোকবার। এখন শেষরক্ষা করতে পারলে হয়। তবু একটু দ্বিধার ভাব করল, আমার সাথে কিন্তু ল্যাপ
ভলিউম-৯
হয় না?
–
– । • •
:
খ্যাতা নাই।
লোকটা একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলল, “সে তো দেখতেই আছি। তা মিয়া, বড় হোটেলে ল্যাপ-খ্যাতা আনন লাগে না। আহেন, আহেন। জারের মইধ্যে আর খাড়াইয়া কষ্ট কইরেন না।
‘লন চলেন। খাড়ান, মিয়াভাই। আর একটা সিগারেট ধরাইয়া লই।’ প্যাকেট বের করে আরও একটা সিগারেট ধরাল আগেরটার আগুনে। তারপর বলল, চলেন।’
লোকটা একটু সরে দাঁড়িয়ে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে বলল, এই যে ঢুইকা পড়েন। এই তো দরজা।
শহীদ খুশি হল। একটু শঙ্কিতও হল। সে ভেবেছিল, লোকটা তাকে হোটেলের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাবে। এটা যে হোটেলের অর্থাৎ তিনতলার সিঁড়ি . নয় কামাল তাকে তা আগেই বলেছে। এটা হচ্ছে বিল্লাহর রূমের সিঁড়ি। এর দুটো অর্থ হতে পারে। একটা হল, লোকটা নিজেই তাকে বেকায়দায় ফেলে টাকা-পয়সা কেড়ে নেবে। এমন একটা শিকার সে একাই ভোগ করবার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়ত লোকটা হয়ত তাকে চিনে ফেলেছে। তার মৃতলব টের পেয়েছে। সুতরাং উপযুক্ত । শিক্ষা দেবার জন্যে নিজের থেকেই সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যাই হোক এখন আর ফেরবার অবকাশ নেই। তবে লোকটাকে কোন চান্স সে দেবে না। প্রথম সুযোগেই তাকে ঘায়েল করতে হবে।
সামনে অন্ধকার। শহীদ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বড় আন্ধার, মিয়াভাই।’
তাই তো৷ বাত্তি জ্বালান অয় নাই। খাড়ান, আলো জ্বালাইয়া দেই।
লোকটা ভিতরে ঢুকে দেশলাই জ্বালিয়ে বলল, “আহেন আমার পিছনে পিছনে।’
শহীদ ঢুকল তার পিছনে। পাশেই একটা সিঁড়ি দেখা গেল দেশলাইয়ের আলোয়।
| দরজাটা বন্ধ করে দিল লোকটা একহাত দিয়ে। দেশলাইয়ের আলোটা নিভে গেল।।
শহীদের ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢুকে গেল। পরমুহূর্তেই সে তার গলার কাছে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল। আপন মনে হাসল শহীদ। মাথাটা সরিয়ে আন্দাজে লোকটার কানের কাছে প্রচণ্ড শক্তিতে রিভলভারের বাঁট দিয়ে আঘাত করল।
অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে লোকটা শহীদের পায়ের কাছে পড়ে গেল। পকেট থেকে টর্চলাইটটা বের করল শহীদ। সিঁড়ির পিছনটা দেখল একবার। নোংরা জায়গাটা। কয়েকটা ভাঙা প্যাকিং বাক্স পড়ে আছে। কুয়াশা-২৯
টর্চটা মাটিতে রেখে পকেট থেকে সিল্ক-কর্ড বের করে লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে মুখে টেপ আটকে দিল। তারপর টেনে প্যাকিং বাক্সের আড়ালে ফেলে দিল।
সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে আবার দাঁড়াল শহীদ। এখুনি উঠবে কি উঠবে না স্থির করতে পারল না। কে জানে, উপরে ক’জন আছে।
কোন কথাবার্তা শোনা যায় কিনা তার জন্যে কান পেতে রইল শহীদ। কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত কিনা ভাবতে লাগল সে। ‘ হঠাৎ সিঁড়ির মাথায় পদশব্দ শোনা গেল। কে যেন গলা খাকারি দিল। সিঁড়ির পিছন দিকে সরে গেল শহীদ।।
‘জোমারত?’ চাপাকতে সিঁড়ির মাথা থেকে কে যেন বলল।
চুপ করে রইল শহীদ। অচেতন লোকটাই সম্ভবত জোমারত। জবাব না পেলে ওই লোকটা উপর থেকে নেমে আসবে। সুতরাং তার এই মুহূর্তেই বিপন্ন হবার আশঙ্কা আছে। দরজা খুলে সে অনায়াসে বেরিয়ে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে তার অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে, ‘আর সাবধান হয়ে যাবে বদমায়েশগুলো। সুতরাং পালিয়ে যাওয়া চলবে না। শেষপর্যন্ত দেখবে সে।
‘জোমারত।’ আবার শোনা গেল অসহিষ্ণ কণ্ঠ।
জবাব না পেয়ে বোধ হয় সন্দেহ হল লোকটার। সে দ্রুতপদে সিঁড়ি বেয়ে : নেমে এল। সিঁড়ির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিল শহীদ। লোকটা কিন্তু কোন অবকাশ পেল না। একই পন্থায় তাকেও কুপোকাৎ করল শহীদ। কাজটা সহজেই হাসিল হল।
মিনিট দুয়েক পরে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল শহীদ। সিগারেটের বড় তেষ্টা পেয়েছে তার। কিন্তু উপায় নেই।
| সিঁড়ির বাঁ দিকে একটা দরজা, ভারি পর্দা ঝুলছে। অতি সূক্ষ্ম আলো আসছে পর্দার একপ্রান্ত দিয়ে। আধ ইঞ্চির মত পর্দা সরিয়ে ভিতরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল শহীদ। সুসজ্জিত একটা অতি আধুনিক ড্রইংরূম। একটা সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে সেই বিশাল মুখের মালিক–যার নাম, কুয়াশা বলেছে, মাহদী বিল্লাহ। টেলিফোনে কথা বলছে সে। ডান হাতে জ্বলন্ত চুরুট। বিরাট রূমটাতে আর কোন জনপ্রাণী নেই।
নকল দাড়িটা একটানে খুলে ফেলল শহীদ। লুঙ্গিটাও ফেলে দিল খুলে। নিচে ছিল টাইট প্যান্ট। আবার পর্দাটা ফাঁক করে দেখল। রিসিভার নামিয়ে রেখেছে বিল্লাহ।
রিভলভার ডান হাতেই ছিল শহীদের। সেটা দিয়ে পর্দাটা সরিয়ে নিয়ে ভিতরে ঢুকল সে।
ভলিউম-৯
|
–
।
•
r–
—
—
–
৯২
হ্যালো, মিস্টার মাহদী বিল্লাহ।’
মোটা লোকটা ঘাড় তুলল। ঠোঁটে চুরুট লাগাতে যাচ্ছিল। হাত থেকে সেটা কার্পেটের উপর পড়ে গেল । রিভলভার হাতে শহীদকে দেখে বিস্ফারিত হয়ে গেল বিল্লাহর ছোট দুটো চোখ।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আকস্মিকতা-জনিত বিস্ময়ের (এবং শহীদের ধারণায় ভয়ের) ছাপ মিলিয়ে গেল। তার বদলে চোখে-মুখে ফুটে উঠল হিংস্রতার ছায়া। ভয়ঙ্কর ক্রোধে জ্বলে উঠল বিল্লাহর চোখ দুটো।
সে গর্জন করে উঠল, কে তুমি! কি চাও এখানে?’
‘আহা, অমন অপরিচয়ের ভান করছ কেন? এত কষ্ট করে তোমার আতিথেয়তার স্বাদ পেতে এলাম, আর…’ শহীদ ঠাট্টা করল।
দাঁতে দাঁত চেপে বিল্লাহ বলল, “এক্ষুণি স্বাদ পাবে।’
‘অতি আনন্দের কথা। কিন্তু মিয়াজী, সত্যি করে বল তো,তুমি আমার পিছনে এমনভাবে লেগেছ কেন? কেন আমার জন্যে এই মাগগীগণ্ডার বাজারে এতগুলো বুলেট বাজে খরচ করছ? আমার অপরাধ কি দোস্ত?’ রিভলভারটা বিল্লাহর অতিকায় ডুড়ির দিকেই উদ্যত রেখে সে বিল্লাহর সামনের সোফাটার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল।
কঠিন কণ্ঠে বিল্লাহ বলল, কে তুমি, কি চাও?’ মাথা সামান্য নুইয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গি করল শহীদ। নাম আমার শহীদ খান। দেখ তো। চিনতে পার কিনা?’ তরল কণ্ঠে বলল
সে।
বিল্লাহ চিন্তা করার ভান করল, ‘না। চিনি না তোমাকে আমি। নামও শুনিনি তোমার।
“সে কি, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে। এই তো সেদিন, মানে মাত্র পরশু রাতে গুলশানে ঝিলের ধারে বাজ-পড়া বটগাছের পাশে বুলেটবিদ্ধ করার জন্যে তুমি আর তোমার এক স্যাঙাৎ টমিগান নিয়ে গিয়েছিলে। শেষটায় স্যাঙাৎ হারিয়ে চলে। এলে। আবার তার কয়েক ঘন্টা পরেই আমার বাড়িতে গেলে কষ্ট করে। আর এক স্যাঙাৎ হারিয়ে এলে। এমন দু-দুটো স্মরণীয় ঘটনা তোমার মনে নেই? আশা করি স্মৃতিভ্রম রোগে এখনও আক্রান্ত হওনি।’
তুমি কি বলছ এসব বুঝতে পারছি না।’ পকেটের দিকে হাত বাড়াল সে।
“উঁহু, উঁহু। ওটি হবে না, ভায়া। হাত দুটো সামনে একেবারে পেটের উপর রাখ। না হলে হুঁড়িটা ফেঁসে যাবে। দেখছ না সাইলেন্সর লাগানো আছে। রিভলভারে? টেরও পাবে না কেউ। | তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল বিল্লাহ শহীদের দিকে। নিতান্ত কলিকাল বলেই সে দৃষ্টিতে ভষ্ম হয়ে গেল না শহীদ। নির্দেশ পালন করল বিল্লাহ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কুয়াশা-২৯।
నం
একটা কাণ্ড ঘটে গেল। সাঁ করে বিল্লাহর সামনের ছোট টেবিলটা শূন্যে উঠে শহীদের মুখ বরাবর ধেয়ে এল। কিছু বুঝে উঠবার এবং আত্মরক্ষার জন্যে যথার্থ প্রস্তুতি নেবার আগেই সেটা তার ডানহাতের কনুইতে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। রিভলভারটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। ধরে ফেলল শহীদ। পরমুহূর্তেই একটা টিপয় ছিটকে পড়ল তার কপালের উপর। টিপয়ের কোনাটা কপালৈ লেগে ঠকাশ করে শব্দ হল। বাঁ হাত দিয়ে কপালটা চেপে প্রল শহীদ।
| প্রচও একটা মুষ্ট্যাঘাত পড়ল শহীদের চোয়ালে। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সে। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল সে। আতিক ভারসাম্য বজায় রাখবার চেষ্টা করল। কিন্তু আচমকা একটা ঘুসি পড়ল তার চোয়ালে। দু’চোখে অন্ধকার দেখল শহীদ। চিত হয়ে পড়ে গেল সে। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিল্লাহ। হাত থেকে কোন ফাঁকে রিভলভারটা পড়ে গেল টেরও পেল না শহীদ। বিল্লাহ তার বুকের উপর চেপে বসেছে। দুহাত দিয়ে সাড়াশীর মত চেপে ধরেছে শহীদের কণ্ঠ। তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। এখুনি•••এখুনি সব শেষ হয়ে যাবে। চিরতরে, বন্ধ হয়ে যাবে তার হৃৎস্পন্দন। দুনিয়া থেকে মুছে যাবে তার অস্তিত্ব। শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে।
‘আতিথেয়তার স্বাদটা কেমন লাগছে?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল বিল্লাহ। শেষবারের মত চোখ খুলল শহীদ। বিদায় নিতে ইচ্ছে করল সকলের কাছ থেকে। বিদায়। মহুয়া বিদায়! আমি চললাম।।। বিদায়! হে সুন্দর পৃথিবী!! বিদায়!!!
চেতনার উপর দিয়ে অন্ধকার একটা পর্দা নেমে আসছে যেন। কে যেন কানের কাছে কি বলে উঠল।
শহীদের হঠাৎ মনে হল, ধীরে ধীরে বিল্লাহর হাতের মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে। হাতটা কি সরে গেছে? চেতনা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। অন্ধকার পর্দাটা যেন সরে যাচ্ছে।
| চোখ মেলে তাকাল সে। একটু ধাতস্থ হয়ে সে দেখতে পেল তার পাশেই ঊর্ধ্বে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিল্লাহ। তার বিশাল বপুটা একটু একটু নড়ছে (সম্ভবত, শহীদ ভাবল, উত্তেজনায়)। বিল্লাহর মুখটা দরজার দিকে। শহীদ মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দেখতে পেল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা
উদ্যত রিভলভার হাতে।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ। মুহূর্তের মধ্যে তার সমস্ত বেদনা ও অবসাদ দূর হয়ে গিয়ে সে যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।
| কোন কথা বলল না কুয়াশা। | বাঁ হাত দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিঙ্ক-কর্ড বের করে শহীদের দিকে ছুঁড়ে
৯৪।
ভলিউম-৯
দিল।
শহীদ পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল বিল্লাহকে। একটা সোফায় বসিয়ে দেয়া হল তাকে। হিংস্র দৃষ্টিতে কুয়াশা ও শহীদের দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল বিল্লাহ।
কুয়াশা বিল্লাহর কোমর থেকে একটা চাবির গোছা বের করে নিয়ে বলল, ‘আমার কাজ আছে, শহীদ।
কুৎসিত ভাষায় কুয়াশাকে একটা গালি দিল বিল্লাহ। কুয়াশা ফিরেও তাকাল ।
মরতে ইচ্ছে হলে যাও। যম বসে আছে তোমার।’ কুয়াশা একবার মুখ ফিরিয়ে মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
সিগারেটের প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করল, শহীদ। ধীরে-সুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলল, তারপর? দাবার চাল তো আবার পাল্টে গেছে, এবারে,
জবাবটা দিয়ে ফেল তো, বন্ধু, ভালয় ভালয়?’
আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস কর, কিছুই জানি না আমি, অসহায়ের মত বলল বিল্লাহ।
‘বেশি গোলমাল কোরো না। নিস্তার পাবে না।’ | বিল্লাহ বলল, কেন তুমি সেদিন ঝিলের ধারে গিয়েছিলে, আমি জানি না। তবে আমি আর গাজী যে সেখানে গিয়েছিলাম তা ঠিক। তবে ওটা ছিল মোফাখখরের অ্যাসাইনমেন্ট। আমি সঙ্গে ছিলাম মাত্র।
কে সে? ‘তোমার বাড়ির সামনে যে মারা গেল। . বলতে থাক।
‘তোমাকে খুন করার কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল মোফাখখর । গিয়েছিলাম প্রথমে আমি আর গাজী।
তিনি আবার কোন মহাশয়? ঝিলের ধারে তোমার গুলিতে যে মারা গেছে।
শহীদ বুঝতে পারল, কার গুলিতে যে টমিগানধারী গাজী মারা গেছে তা এখনও জানে না বিল্লাহ। সে সম্পকে এখন আলোচনার অবকাশ নেই। সে বলল, ‘কে দিয়েছিল কন্ট্রাক্ট?”
তা আমি বলতে পারব না।’ কারণটা নিশ্চয়ই বলতে পারবে?
সঠিকভাবে পারব না। তবে তুমি অনেকেরই অসুবিধা ঘটাচ্ছ, সম্ভবত তার অবসানের জন্যেই।
তা তো বটেই। এতদিন পরে ফকির আকরামের হত্যারহস্য নিয়ে ঘাটাঘাটি কুয়াশা-২৯
করলে অসুবিধা তো নিশ্চয়ই হবে।’
বিল্লাহর চেহারায় ভয়ের ছাপটা আবার চেপে বসেছে। সে বলল, বিশ্বাস কর, এ সম্পর্কে আমি বিন্দুমাত্র জানি না। যে বলতে পারত অর্থাৎ মোফাখখর, সে তো মারা গেছে।
‘ডালিয়া আকরাম কোথায়?
আমি তার কি জানি? . খুব ন্যাকামো হচ্ছে, না? ভাজা মাছটিও উন্টে খেতে জান না। ড, এলাহীর চেম্বার থেকে পরও রাত নটায় ডালিয়া আকরাম বেরিয়ে যাবার পর তাকে তোমরা চুরি করেছ। তোমাকে বলতে হবে, কোথায় রেখেছ তাকে। আর আমার দিকে কেন টমিগান চালিয়েছিলে তা-ও বলতে হবে। কে তোমাকে এ কাজ করতে বলেছে?”
এই শীতেও ঘাম দেখা দিল বিল্লাহর কপালে। তবু সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমি কখনও কারও চেহারা ভুলি না। তোমার মুখ তো ভুলতেই পারি না। খুব মজা পেয়েছ আমাকে নিয়ে। তবু যদি নিজের কৃতিত্ব থাকত। ওই বদমাইশটা এসে না পড়লে তোমার প্রাণহীন দেহটা এতক্ষণে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতাম। কিন্তু দাবার চাল আবার পাল্টাতে কতক্ষণ?’’
‘সে চিন্তা পরে করা যাবে। এখন নিজের কথা ভাব। চুপ করে রইল বিল্লাহ।
শহীদ কঠোর স্বরে বলল, “আমি জবাব চাই, এবং তা এই মুহূর্তেই চাই। একমিনিট সময় দিলাম। জবাব না দিলে গাজী আর মোফাখখরের দশা হবে। তোমার।
শহীদ ট্রিগারের উপর আঙুল রেখে পুনরাবৃত্তি করল, ‘এক মিনিট সময়।’
শহীদের দিকে তাকিয়ে বিল্লাহ বুঝতে পারল, জবাব না পেলে ঠিকই গুলি করবে সে। একটু দমে গেল সে।
ঘড়ি দেখে শহীদ বলল, আর পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড।’ ‘বেশ তো, বলব আমি।’ ‘এই তো সুবোধ বালকের মত কথা, শহীদ মন্তব্য করল।
হঠাৎ তার খেয়াল হল, বিল্লাহর চোখ দুটো তাকে অতিক্রম করে দরজার দিকে নিবদ্ধ রয়েছে। সেদিক থেকে একটা অত্যন্ত অস্পষ্ট শব্দ কানে এল
শহীদের।
সে মুখ না ফিরিয়েই রূমের একমাত্র জ্বলন্ত বাটার দিকে গুলি করল। সাইলেন্সর লাগানো রিভলভার থেকে দুপ করে একটা শব্দ হল। রূমটা নিবিড় অন্ধকারে তলিয়ে গেল নিমেষে। চিত হয়ে কাপেৰ্টের উপর শুয়ে পড়ে পাক খেয়ে সরে গেল শহীদ।
৯৬
ভলিউম-৯
দরজার দিকে অন্ধকারের মধ্যেই আর একবার গুলি ছুঁড়বে কিনা ভাববার আগেই দুপ করে আর একটা শব্দ হল। কার্পেটের উপর ভারি কিছু একটা পতনের ‘ শব্দ শোনা গেল প্রথমে, তারপর ঘড়ঘড় করে একটা আওয়াজ হল।
শহীদ গুলি চালাল দরজার দিকে আন্দাজ করে। দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল সিঁড়ির দিকে। কে যেন সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
কার্পেট-শয্যা থেকে উঠে পড়ল শহীদ। টর্চ বের করে জ্বালাতেই দেখা গেল রক্তাপুত দেহে মেঝের উপর পড়ে আছে বিল্লাহ। সারা মুখে তার রক্ত। কপাল থেকে তখনও তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকবার প্রচণ্ড খিচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল বিল্লাহর বিশাল দেহটা। | দরজার দিকে টর্চ ঘোরাল শহীদ। কেউ নেই সেখানে। থাকবে না, সে তা জানে। কিন্তু এখানে আর এক সেকেণ্ডও থাকা নিরাপদ নয়। বিল্লাহর দল এক্ষুণি জংলী কুকুরের মত তাড়া করে আসবে।
পথে অনেক কিছুই ভাবছিল শহীদ। কে গুলি করল বিল্লাহকে? কেন করল? বিল্লাহকেই গুলি করতে এসেছিল লোকটা? না, তাকে খুন করতে এসেছিল,
লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিল্লাহ মারা গেছে?
বাসায় ফিরেই মি. সিম্পসনকে ফোন করে বিল্লাহর হোটেলে তক্ষুণি পুলিস পাঠাবার অনুরোধ করল শহীদ।।
শহীদের অভিযানের খবর নেবার আর নিজের সংগৃহীত তথ্য শহীদকে জানাবার জন্যে এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে কামাল শহীদের ড্রইংরুমে বসে ছিল। মহুয়া আর লীনা অনেক আগেই চলে গেছে শুতে। স্ফীতকায় একটা উপন্যাস খুলে, বসেছিল কামাল।
শহীদ মি. সিম্পসনকে ফোন করে রিসিভার নামিয়ে রাখতেই কামাল উপন্যাসটা বন্ধ করে কোলের উপর রেখে বলল, তারপর খবর কি?”
‘বিল্লাহ খুন হয়েছে। সমস্তটা অভিযানই বলতে গেলে ব্যর্থ, সিগারেট ধরিয়ে বলল শহীদ।
‘তা ওকে মারতে গেলি কেন? ম্লান হেসে শহীদ বলল, আমি মারিনি।’
তাহলে?’ ঘটনাটা খুলে বলল শহীদ।
তাহলে কুয়াশা গুলি করেছিল?
উঁহু। সে করলে ওভাবে পালিয়ে যেত না। তাছাড়া লোকটা বিল্লাহর চেনা। কারণ, সে যখন দরজা দিয়ে ঢুকেছিল তখন তাকে আমি দেখতে না পেলেও বিল্লাহ দেখতে পেয়েছিল এবং তাকে দেখে বিল্লাহর চেহারায় ভয়ের কোন ছাপ ফুটে ওঠেনি, বিস্ময়ের ছাপও নয়। এবং ভেসে উঠেছিল পরিচয়ের ও আশীর চিহ্ন। ৭-কুয়াশা-২৯
৯৭
যাকগে, ওদিকে খবর কি? সেই অ্যাক্টর ছোকরার সাথে দেখা হয়েছিল?
না, ওর সাথে দেখা হয়নি। তবে ওর সম্পর্কে রিপোর্ট খুব সুবিধের নয়। ডাক্তার সম্পর্কেও নয়।’
. যথা?’
‘বেলাল,•••শুধু বেলালই নয়, ফিল্ম জগতের অনেকেই এখন মাদকসেরী । ওরা বলে ডোপ। আর সে ডোপ সরবরাহ করে ড, এলাহী। বেলাল তারই একজন খদ্দের।’
ভুল খবর না তো? * ‘মোটেই না। ড: এলাহীর চেম্বারে যারা ভিড় জমায় তাদের অধিকাংশই ডোপ-সেবী। জেনুইন রোগীর সংখ্যা অতি নগণ্য। বুঝতেই পারিস, সাধারণ এম, বি. বি. এস. পাস করা ডাক্তার-স্পেশালিস্ট নয়, অথচ রোগীর ভিড়। কারণটা কি?’
। শহীদ বলল, আমার ধারণা তাহলে মিথ্যে নয়।’ . অথচ প্রমাণ নেই। আবগারী বিভাগের লোকেরা দু’একবার নাকি জিজ্ঞাসাবাদও করেছে ডাক্তারকে। কিন্তু বেশি ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। ডাক্তার অত্যন্ত ঘড়েল আদমী। ওর অতীতও ভাল নয়। একবার বিয়ে করেছিল ডাক্তার মরিয়ম নামে এক নার্সকে। সে নাকি মারা গেছে।’
সাবাস, অনেক খবর জোগাড় করেছিস! কিন্তু ওই ছোকরার ব্যাপারটা কি? ডালিয়ার সাথে ওর সম্পর্ক কি?’
‘স্রেফ বন্ধুত্বের সম্পর্কই। বন্ধুত্বের বদৌলতে ফিমে চান্স পেয়েছে বেলাল। তবে খুব সুবিধে করতে পারছে না।’
ভিতরের বারান্দায় পরিচিত পদশব্দ শোনা গেল।
পর্দা সরিয়ে গফুর উঁকি দিয়ে বলল, দাদামণি, হাত-মুখ ধুয়ে নেন। নাস্তা হয়ে গেল বলে।’
সে কিরে, এতরাতে নাস্তা!’ . রাত আর নাই। চারদিকে আলো ফুটেছে।’ চলে গেল গফুর। কামাল বলল, ‘তাই তো বলি, আমার খিদে পাচ্ছে কেন।
শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি গোসলটা সেরে নিই। তুইও গোসল করে নে। নাস্তা করে চল বেরিয়ে পড়ি।’
সারারাত ঘুমোসনি। এখন আবার যাবি কোথায়? নারায়ণগঞ্জে, ফকির আকরামের বাড়িতে। মি. সিম্পসনও যাবেন।’
: ৯৮
ভলিউম
আট
দারোয়ান গেট খুলে দিল।
মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কে কে আছে এখন এ বাড়িতে?”
দারোয়ান বলল, “দেওয়ান সাহেব, মানে কেয়ারটেকার সাহেব আছেন আর আমি আছি।’ | ‘আমরা বাড়িটার মধ্যে ঢুকব, বিশেষ প্রয়োজন আছে। কেয়ারটেকারকে ডেকে দাও।’
কিন্তু ডাকবার প্রয়োজন হল না। সামনের বারান্দা থেকে কে একজন এগিয়ে আসছিল। তাকে দেখিয়ে দারোয়ান বলল, ‘ওই যে দেওয়ান সাব আসছেন।
মি. সিম্পসনের পুলিসী পোশাক দেখে দেওয়ান সাহেব একটু সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, কাকে চাইছেন, স্যার?”
মি, সিম্পসন বললেন, আমরা একটু দোতলাতে বিশেষ করে মি, ফকির আকরাম যে রূমটাতে মারা গেছেন সেই রূমটা দেখতে চাই। বিশেষ প্রয়োজন আছে।’
দেওয়ান সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু স্যার, আমি দেখাব কি করে? হুকুম নেই। ডালিয়া বেগম সাহেবার বা ডাক্তার সাহেবের হুকুম লাগবে। আমার অপরাধ নেবেন না। পরের চাকরি করি আমি।’
হুকুমের অপেক্ষা এখন করা যাবে না। আমাদের সময় নেই,’ মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে মি. সিম্পসন বললেন।
‘তাহলে সার্চ-ওয়ারেন্ট আনতে হবে। বুঝতেই পারছেন, ওদের অনুমতি ছাড়া কাউকে ঢোকালে আমার চাকরি চলে যাবে।’
যাবে না, মি. দেওয়ান। সে গ্যারান্টি আমি আপনাকে দিচ্ছি।’ দেওয়ান সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, “আসুন তাহলে।’
আমাদেরকে মি. ফকিরের রূমে, মানে যে রূমটাতে উনি মারা গেছেন ‘সেই রূমে নিয়ে চলুন, শহীদ বলল।
মোটা কার্পেট বিছানো সিঁড়ির ঠিক মাথার রূমটাই আকরাম সাহেবের স্টাডি রূম। দেওয়ান সাহেব রূমটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই রূমেই মারা গিয়েছিলেন
উনি।’
রূমের তালা খুলে দিলেন দেওয়ান সাহেব।
রূমের একটা দিকের দেয়াল সম্পূর্ণটাই কাঁচের। সামনেই শীতলক্ষ্যা চোখে পড়ে। দুটো দেয়ালে বুককেসে ভর্তি বই। অন্য দেয়ালের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটা চিক। তাতে একটা ড্রাগনের ছবি। আগুনের হলকা বেরুচ্ছে কুয়াশা-২৯
ড্রাগনের মুখ থেকে। রূমের ঠিক মাঝখানে একটা বড় ডিম্বাকার টেবিল। তার উপরে একটা রেডিও সেট, কয়েকটা চিঠি-পত্রের ট্র। কলম রাখার পাত্রে কয়েকটা দামি কলম। পাইপ-রাকে কয়েকটা পাইপ। একটা সুদৃশ্য ছাইদানি। একটা প্যাড। মেঝেতে ঘন সবুজ রঙের-এর কার্পেট।
দেওয়ান সাহেব জানালেন যে, রূমটা আগে যেমন সাজানো থাকত এখনও তেমনি সাজানো আছে।
‘ ‘আকরাম সাহেব এই রূমেই বোধ হয় সর্বক্ষণ থাকতেন, তাই না দেওয়ান সাহেব?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
‘জি হ্যাঁ। প্রায় সব সময় এখানেই কাটাতেন। বিশেষ করে মারা যাবার আগের কয়েকমাস তো বটেই। বাইরেও বড় একটা বেরোতেন না। পড়াশোনা করেই প্রায় সময় কাটাতেন।’
এরকম একটা স্টাডি-রূম থাকলে সবটা সময়, এখানে ব্যয় করতে ইচ্ছে করবে বৈকি, কামালের মন্তব্য শোনা গেল। ‘
তা তো বটেই, সিলিং পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল শহীদ। : ‘ সিলিং-এ কোন দাগ চোখে পড়ল না শহীদের। কাঁচের দেয়ালের কাছে। এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ফ্রেমগুলো পর্যবেক্ষণ, করল। শেষটায় সে টেবিলটার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, দেওয়ান সাহেব, আকরাম সাহেবকে ঠিক কোন জায়গাটাতে পাওয়া গিয়েছিল?’
| দেওয়ান সাহেব টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন, “এইখানে দাঁড়িয়ে উনি গুলি করেছিলেন।’
শহীদ অবাক হয়ে বলল, দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি! কি করে জানলেন?
তাই তো হওয়া উচিত। চেয়ারটা অনেকটা পিছনে সরানো ছিল। গুলি করার পর উনি মেঝেতে, এইখানে পড়ে গিয়েছিলেন। দেওয়ান সাহেব যে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন সেখানে খড়িমাটির অস্পষ্ট একটা গোল দাগ এখনও দেখা যাচ্ছে।
| ‘গায়ের ধাক্কা লেগে চেয়ারটা সরে যায়নি তো?”
তা কি করে হবে? দেখুন না চেয়ারটা কেমন ভারি? একেবারে আসল মেহগনি-কাঠের চেয়ার।
শহীদ সুইচ টিপে টেবিলটার লাইট জ্বালিয়ে দিল। তারপর রূমের চারদিকে আবার পর্যবেক্ষণ করে বলল, বাতি তো মাত্র এই একটাই?”
‘ঞ্জি হা। তবে বাইরে আলো জ্বালালে কাঁচের ভিতর দিয়ে ভিতরটা আলোকিত হয়ে যায়।’
শহীদ আলোটার দিকে মুখ করে খড়িমাটি চিহ্নিত জায়গাতে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে ঠিক পিছনের চিটার দিকে তাকাল। পরের মুহূর্তে সে এগিয়ে গেল চিকটার ১০০ .
ভলিউম-৯
ন
দিকে।
| কামাল, মি. সিম্পসন ও দেওয়ান সাহেব নীরবে শহীদের কার্যকলাপ দেখছিলেন।
শহীদ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে চিকটা’দেখছিল। অকস্মাৎ সে যেন আবিষ্কারের আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আসুন, মি. সিম্পসন । দেখে যান।’
“কি হল শহীদ?’ এগোতে এগোতে প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন। কামাল ও দেওয়ান সাহেব তাকে অনুসরণ করলেন।
শহীদ প্রায় অদৃশ্য একটা ফুটোর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ‘এটা কি বলতে পারেন, মি. সিম্পসন?
মি. সিম্পসন বললেন, ‘কোন পোকায় ফুটো করেছে বোধহয়।’ উই। কামাল, দেওয়ান সাহেব আপনারা চিকটার দুদিক তুলে ধরুন।
কামাল ও দেওয়ান সাহেব দুপ্রান্তে ধরলেন। মাঝখানটায় ধরল শহীদ নিজে। একহাত দিয়ে চিকটা ধরে অন্য হাত দিয়ে শহীদ মি, সিম্পসনকে দেখাল, ‘এই যে, দেখুন গর্তটা, এটা কি কোন পোকায় কাটা? হতে পারে যদি সে পোকাটার ইস্পাতের দাঁত থাকে।’
মানে, তুমি বলতে চাও…?’
তাঁকে জেরা করতে দিল না শহীদ। সে বলল, হ্যাঁ, যে বুলেটে ফকির আকরাম মারা গেছেন সেই বুলেটেই এই গর্ত হয়েছে। এবং এই বুলেটটাই প্রমাণ করবে যে, ফকির আকরাম সাহের আত্মহত্যা করেননি, তাকে খুন করা হয়েছে।
অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠলেন দেওয়ান সাহেব। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “কি বলছেন স্যার, এই যে সবাই বলছে, বড় সাহেব আত্মহত্যা করেছেন!’
‘ওসব মিথ্যা, সাহেব। ওসব মিথ্যা।’ দেওয়ান সাহেব তবু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
গাড়িতে উঠে মি, সিম্পসন বললেন, তাহলে তোমার ধারণা, ফকির আকরামকে খুনই করা হয়েছে এবং ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার মত করে সাজানো হয়েছে?
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে শহীদ বলল, একজ্যাক্টলি। আমি গোড়াতে যে সন্দেহ করেছিলাম এখন সন্দেহাতীতভাবে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
তাহলে খুনটা কে করতে পারে সে সম্পর্কেও নিশ্চয়ই একটা সন্দেহ পোষণ করছ?”
অবশ্যই। কিন্তু সমস্যা হল, খুনীর বিরুদ্ধে প্রমাণ এখনও জোগাড় করতে পারিনি। এখন আমাকে সেটাই সংগ্রহ করতে হবে। তারপর আমি হত্যাকারীকে পুলিসের হাতে তুলে দিতে পারব বলে আশা করছি।’ কুয়াশা-২৯
১০১
আর কেউ কোন কথা বলল না। কামালের ঘুম আসছিল। সে আলাপে যোগ না দিয়ে পিছনের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোতে লাগল।
কামালকে তার বাসায় আর মি. সিম্পসনকে তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে শহীদ গেল সিভিল সার্জনের অফিসে।
, সিভিল সার্জন ড. রেজাউদ্দিন অফিসেই ছিলেন। শহীদকে দেখে বললেন, “কিরে, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দিগ্বিজয় করে এসেছিস?”
| ‘তা কিছু তো একটা জয় করেছিই,’ বসতে বসতে শহীদ বলল।
সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে সিভিল সার্জন বললেন, তাহলে কি ঠিক করলি–হত্যা না আত্মহত্যা?
একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে শহীদ বলল, ‘হত্যা বলেই সাব্যস্ত করলাম, আত্মহত্যা নয়।’
সজোরে, মাথা নাড়লেন ড. রেজা। এ হতেই পারে না। তাছাড়া ফকির আকরাম যে আত্মহত্যা করেছেন একথা কাল তুইও স্বীকার করেছিস।’
উই। আমি বলেছিলাম, আত্মহত্যা বলে মনে করবার অবকাশ আছে। তবে যথেষ্ট অবকাশ নয়। আমি জানি যে, ফকির আকরামকে হত্যা করা হয়েছে তবে আদালতে উত্থাপনের মত প্রমাণ এখনও সংগ্রহ করতে পারিনি।’ | কিন্তু তোর কথার তো ছাইভস্ম কিছুই বুঝতে পারছিনে। মুখের মধ্যে দিয়ে। গুলি করা হয়েছে, অথচ বাধা দেওয়ার কোন চিহ্ন নেই। বুলেটের খোঁজ পেয়েছিস? গিয়েছিলি নিশ্চয়ই ফকির আকরাম সাহেবের বাড়িতে?” সিগারেট টানতে লাগল শহীদ, জবাব দিল না কোন। ‘ তার মানে, পাসনি, আত্মপ্রসাদের সুরে বলল ড. রেজা। পেয়েছি।’ ডাক্তার ভূ-কুঁচকে বললেন, কোথায়? ‘খুন হলে যেখানে পাওয়া উচিত, ঠিক সেখানে।
তারমানে•••যাঃ, এ হতেই পারে না।’
‘বেশ’তোমি. সিম্পসনও তো সাথে ছিলেন। তিনি নিজে দেখেছেন, কামাল দেখেছে দেয়ালের গর্ত। দেয়াল খুঁড়লেই বুলেটটা বেরিয়ে আসবে।’
| ড. রেজা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শহীদের দিকে। পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করল শহীদ। শেষে যোগ দিল, ‘টেবিলের বাতিটা আমার পথ দেখাল। আকরাম সাহেব টেবিলের দিকে মুখ করে বসেছিলেন বলেই আমি ধরে নিয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে বুলেটটা তার পিছনের দেয়ালে বিধে যাওয়া অসম্ভব নয়, এই অনুমান করে আমি সেই দেয়ালটার দিকে পরীক্ষা করেছিলাম। চিকের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটা ফুটো চোখে পড়ল, তারপর চিক সরাতেই দেয়ালে দেখা গেল বুলেটের গর্তটা। ১০২
ভলিউম-৯
|
|
সিভিল সার্জন কানের পাশটা চুলকে বললেন, “কিন্তু কিন্তু•••তবু এটা আত্মহত্যা হতে পারে না? একজন লোক অন্যের মুখের মধ্যে রিভলভার ঢুকিয়ে দিলে সে বাধা দেবে না, একথা যদি কেউ বলে তাহলে আর যেই বিশ্বাস করে করুক আমি করছিনে।’
. যদি সেই লোকটা ডাক্তার না হয়।’
তার মানে!’ ভীষণভাবে চমকাল সিভিল সার্জন।
‘তোর তো ওই একটাই যুক্তি যে, জোর করে কারও মুখে রিভলভার খুঁজে দিতে গেলেই বাধা আসবে, ধস্তাধস্তি হবে। কিন্তু ধর, রিভলভারধারী যদি ডাক্তার হয় এবং ঐস যদি কণ্ঠনালীর কোন কাল্পনিক রোগের চিকিৎসার নামে যন্ত্র দিয়ে মুখের ভিতরটা পরীক্ষা বা ওষুধ দেবার ছুতো করে ছোট্ট একটা রিভলভারের নল ঢুকিয়ে দেয়?’
সিভিল সার্জন হাঁ করে শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
শহীদ সিগারেটে টান দিয়ে বলল, কণ্ঠনালীর কাল্পনিক ক্ষত দুটো উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে–প্রথমত আত্মহত্যার একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে, দ্বিতীয়ত হত্যার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।’
. আর এই জন্যেই আমি দেয়ালের দিকে বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলাম, একটু থেমে শহীদ বলল।
: কি রকম?’ এতক্ষণে বাকস্ফুর্তি হল সিভিল সার্জনের। \ ফকির আকরাম যদি আত্মহত্যাই করতেন তাহলে গুলিটা সরাসরি সিলিংয়েই গিয়ে ঢুকত। কিন্তু ডাক্তার যদি রোগীর গলার ভিতরটা দেখতে চায় তাহলে রোগী নিশ্চয়ই পিছন দিকে ঘাড় কাত করে রাখবে। সেক্ষেত্রে বুলেট সিলিংয়ের দিকে না গিয়ে দেয়ালের দিকে যাবে।
সিভিল সার্জন মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করলেন। তারপর বললেন, “সেই ডাক্তারটা কে?’
ভদ্রলোক হচ্ছেন ওদের পারিবারিক চিকিৎসক।
তার মানে, ড, এলাহী, কায়সার এলাহী? মানে, আকরাম সাহেবের হবু জামাই!’
হ্যাঁ।’ কিন্তু তার উদ্দেশ্য?’ ‘ স্বভাবতই আকরাম সাহেবের টাকা। ‘কিন্তু টাকা তো তার ঢের আছে। তাছাড়া বিয়ের পর তো বলতে গেলে আকরাম সাহেবের সমস্ত সম্পত্তি তার হাতেই চলে যেত।’
যদি বিয়েটা শেষ পর্যন্ত না হয়? ধর, আকরাম সাহেব যদি তার সিদ্ধান্ত পাল্টে থাকেন এবং সেটা ডালিয়ার অজান্তে যদি ড. এলাহী জেনে গিয়ে থাকে? কুয়াশা-২৯
১০৩,
অথবা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়? হয়ত শুনেছিস, ড, এলাহী আগে একবার বিয়ে করেছিল।
‘হ্যাঁ, এক নার্সকে।’
সে এখন কোথায়? ‘জানি না। বোধহয় তালাক-টালাক হয়ে গেছে।
হয়ত ব্যাপারটা আগে আকরাম সাহেব জানতেন না। পরে শুনে হয়ত তিনি তার মত পাল্টেছিলেন।’
তা হতে পারে।’
হয়ত ভদ্রলোক এটাও জেনেছিলেন যে, ড. এলাহীর বে-আইনী মাদকদ্রব্যের ব্যবসা আছে।
বলিস কিরে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সিভিল সার্জন।
হয়ত তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, ড. এলাহী ডালিয়াকেও মাদকদ্রব্য সেবন শিখিয়েছে।’
• ‘আঁা, এসব কি বলছিস তুই! একটু ধীরে। এতটা চমকে দিবি না। হার্টফেল করতে পারি।’
হেসে ফেলল শহীদ। হাতের সিগারেটটা নিভে গিয়েছিল। সেটা ফেলে দিয়ে আর একটা ধরাল সে।
চা খাওয়া, শহীদ বলল। ‘ নিশ্চয়ই।
বেয়ারা ডেকে চায়ের ফরমায়েশ দিলেন সিভিল সার্জন। একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, কিন্তু রঙ্গমঞ্চে তোর অনুপ্রবেশ ঘটল কি করে?’ ‘
মেয়েটা বোধ হয় সন্দেহ করেছিল। তাই, আমাকে অনুরোধ করেছিল, ব্যাপারটা তদন্ত করতে। ডাক্তার যেভাবেই হোক জানতে পেরে মেয়েটাকেও সরিয়েছে, আর আমারও ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্যে বিল্লাহ ও তার দলকে লাগিয়েছে। ওরা তো দু-দুবার আমাকে আক্রমণ করেছিল।’
| হ্যাঁ, সেসব তো তুই আমাকে আগে বলিসনি। আজ সকালেই শুনলাম। কুয়াশা নাকি গতরাতে হানা দিয়েছিল বিল্লাহর আজ্ঞায়, শুনেছিস নাকি? ভয়ানক লড়াই হয়েছে শুনলাম। বিল্লাহ মারা গিয়েছে। সকালে তো ওর লাশটারই পোল্ট মর্টেম করলাম। আড্ডায় একটা লোকও ছিল না। পুলিস শুধু হোটেলের কয়েকজন নিরীহ লোককে ধরে এনেছিল। ছেড়ে দিয়েছে।’
‘আমিও শুনেছি।
বেয়ারা চা দিয়ে গেল ।
ড. রেজা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, সবই তো বুঝলাম কিন্তু ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আছে?’
ভলিউম-৯
১০৪,
‘সেটাই তো সমস্যা। তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারছিনে। হত্যাকাণ্ডের সময় মিসেস আকরাম কাছে-পিঠেই ছিলেন। তার কাছ থেকে হয়ত কিছু জানা যেত, কিন্তু ড, এলাহী তাকেও হাতের মুঠোয় পুরেছে।
: তার মানে?
ডাক্তার যেভাবে ঘটনাটা, সাজিয়েছিল তাতে মনে হয়, সুযোগের জন্যে তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাড়িতে যেদিন কোন লোক না থাকে সেদিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ঘটনাচক্রে মিসেস আকরাম ঘটনাস্থলের কাছেই, হয়ত পাশের রুমে অথবা কাছাকাছি কোথাও উপস্থিত ছিলেন। গুলির শব্দ শুনে তিনি নিশ্চয়ই দ্রুত সেখানে গিয়ে ডাক্তারকে দেখতে পান। তিনি চিৎকার করতে গেলে ডাক্তার নিশ্চয়ই তার মাথায় কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে। এ সম্পর্কে অবশ্য ডাক্তারের বক্তব্য হল, মিসেস আকরাম সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ার ফলেই মাথায় চোট পেয়েছেন। আমার তা মনে হয় না, কারণ সিঁড়িতে অত্যন্ত পুরু কাপের্ট বিছানো।’
ডাক্তার তাহলে মিসেস আকরামকে হত্যা করল না কেন?’
তাহলে আত্মহত্যার কাহিনী ফেঁসে যেত। একটা হত্যা ও একটা আত্মহত্যা বলে চালাবার চেষ্টা করলে যে তদন্ত হত তাতে ডাক্তার হালে পানি পেত না। সুতরাং সে সহজ পথটাই বেছে নিল, ফকির আকরামের হত্যাকাণ্ডটাকে আত্মহত্যার মত করে সাজিয়ে মিসেস আকরামের মাথায় আঘাত করে ধাক্কা দিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিল। তাতে যদি মারা যেতেন মিসেস আকরাম তাহলে সুবিধাই হত। মারা না যাওয়াতে ডাক্তার তাকে দ্রুত নিজের স্যানাটোরিয়ামে নিয়ে গেছে।’
তা এখন তিনি কোথায়? তার সাথে কথা বল না কেন?’ ‘এখনও তিনি ড, এলাহীর স্যানাটোরিয়ামেই আছেন। তাঁর নাকি কথা বলবার মত অবস্থা এখনও ফিরে আসেনি, আসবে এমন ভরসাও নাকি নেই। তাই
তো বলছি, তাকে মুঠোয় পুরেছে ডাক্তার।’
তাহলে কি করে তার সাক্ষ্য নিবি? সেটা তো সম্ভব বলে মনে হয় না।’
শহীদ চিন্তাজড়িত কণ্ঠে বলল, “সেইটাই তো বড় সমস্যা। একটা তল্লাশি পরোয়ানা বের করতে পারলে হত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ড. এলাহীর আদেশ ছাড়া । অঁকে স্থানান্তর করা যাবে না। অন্য ডাক্তার দিয়েও তাকে পরীক্ষা করানো যাবে
। সবকটা টেক্কাই ডাক্তারের হাতে।’ | মি. সিম্পসনও কি তোর তল্লাশি পরোয়ানা বের করে দিতে পারবেন না? তাঁকে ধর না কেন?’ | কি করে বলি বল। একটা সঙ্গত কারণ তো দেখাতে হবে? আমার কথা, হয়ত মি. সিম্পসন বিশ্বাস করবেন, কিন্তু পুলিসের বড়কর্তারা যদি বিশ্বাস না করেন?’ কুয়াশা-২৯
১০৫
সিভিল সার্জন নীরবে অনেকক্ষণ সি রেট টেনে বললেন, ‘ডালিয়ার খবর কিছু পেলি?’
‘বিন্দুমাত্র না। ডাক্তার তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে– আমার।’
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। হঠাৎ শহীদ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।, ড. রেজা বললেন, কি হলরে?’
পেয়েছি, পথ পেয়েছি আমি। এতক্ষণ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। “কি হল তাই বল? কি পথ খুঁজে পেলি?” শহীদ বলল, ‘অবশ্য পথটা বে-আইনী এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক। মানে?’ ‘বে-আইনী প্রবেশ; সিদকাটা, চুরি ডাকাতি যা খুশি বলতে পারিস।’ ‘খেপেছিস তুই? ‘মোটেও না। অত্যন্ত ঠাণ্ডা আছে মাথাটা এখন।’
“হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে বধির করে দাও। এসব কি শুনছি আমি। কিন্তু কোথায় ডাকাতি করতে যাবি? স্যানাটোরিয়ামে?’
, ডাক্তারের চেম্বারে। সেখানেই আছে আমার তুরুপের তাস। ডাক্তারের সবকটা টেক্কাই আমি ঘায়েল করব।’
‘চেম্বারে কি আছে সে এখন?
না, এবং এইটাই প্রশস্ত সময়। ডাক্তার এখন স্যানাটোরিয়ামে। দুটোর আগে ফিরবে না।’
‘আরে ছ্যা, ছ্যা! পাগল হলি তুই! বোস বোস, মাথা ঠাণ্ডা কর।
না, আমাকে এখুনি বেরোতোব। ‘পরিণাম বিবেচনা করিস। ধরা পড়লে কি হবে?.লজ্জার একশেষ।’
“কাগজে বেরোবে প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি” । কিন্তু এই ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে। তুই কতক্ষণ আছিস?
দুটো পর্যন্ত। তারপর?’ ‘আপন নীড়ে।’ থাকবি কিন্তু বাসায়। খুব দরকার হবে তোকে।’
তা হোক, কিন্তু তুই কেলেঙ্কারি বাধাতে যাবি না।’ ‘যেতেই হবে। টা-টা।’ বেরিয়ে গেল শহীদ : সিভিল সার্জন হতভম্ব হয়ে শহীদের গমন-পথের দিকে চেয়ে রইলেন।
১০৬
ভলিউম-৯
নয়।
ঘন্টা দেড়েক পরে।
সিভিল সার্জনের কাজকর্ম শেষ । হাত-মুখটা ধুয়ে তিনি বেরোবেন বলে ঠিক করেছেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
রিসিভার তুললেন সিভিল সার্জন। হ্যালো?” শহীদ বলছি। সাকসেসফুল?’ ‘হ্যাঁ, আমি তোর বাসায় যাচ্ছি তিনটের দিকে। দরকার আছে।’ ‘পাঁচটায় আয় বরং।’
: বেশ।’
ফোন ছেড়ে দিলেন সিভিল সার্জন।
ঠিক পাঁচটায় শহীদ ও কামাল সিভিল সার্জনের বাসায় গিয়ে পৌঁছুল। গাড়ি থেকে একটা ম্যানিলা খাম হাতে নিয়ে নামল শহীদ। তার পিছনে কামাল।
| গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ড. রেজা বেরিয়ে এসেছিলেন। সম্বর্ধনা জানিয়ে ড্রইংরূমে নিয়ে বসালেন তিনি ওদেরকে।
তারপর খবর কি, কমল বাবু? শহীদের মত তোরও যে টিকিটি দেখা যায়, কারণ কি?” “
সঙ্গত কোন জবাব না থাকায় কামাল হাসল শুধু একটু।
তা তোর খবর কি?’ পাল্টা জিজ্ঞেস করল কামাল। ‘থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর,’ সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বুললেন সিভিল সার্জন। আমি তো আর ডিটেকটিভও নই, তার চেলাও নই। তাই জীবনে কোন উত্তেজনা নেই। লাশকাটা ঘরে ঠাণ্ডা লাশের মতই উত্তাপহীন, উত্তেজনাহীন জীবন।
সিগারেট ধরাল কামাল।
এই তো, ভাল আছিস। উত্তেজনা আর উত্তাপের তো অনিবার্য পরিণতি ওই লাশকাটা ঘর,’ বিজ্ঞের মত মন্তব্য করল কামাল।
‘এসব দার্শনিক কচকচি থামাবি?’ শহীদের কণ্ঠে বিরক্তি।।
“নিশ্চয়ই। এবার তোর কথা শোনা যাক। কি চুরি করে আনলি?’ ড. রের্জা শহীদের দিকে মনোযোগ দিলেন।
ম্যানিলা এনভেলাপটা সিভিল সার্জনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শহীদ বলল, এইটা।’
এনভেলাপটা হাতে নিয়ে সিভিল সার্জন বললেন, কি আছে এতে?’ কুয়াশা-২৯
১০৭।
‘বের করে দ্যাখ না, মুখটা তো খোলাই আছে।’
চারটি এক্স-রে নেগেটিভ বের করলেন সিভিল সার্জন। প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ভাবে আলোর সামনে ধরে পরীক্ষা করে তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন,
তা এগুলোর সাথে এসব হত্যা বা আত্মহত্যার কি সম্পর্ক? ‘ওগুলোতে কি আছে?’ কামাল জানতে চাইল ।।
সিভিল সার্জন আবার একটা নেগেটিভ তুলে নিয়ে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে, একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। ডানদিকের কানের পাশে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন বৃদ্ধা।
সেটা রেখে অন্য একটা নেগেটিভ তুলে সিভিল সার্জন বললেন, ‘লোকটার চোয়ালে চোট লেগেছে। মারাত্মক আঘাতই বলা উচিত।’
তৃতীয় নেগেটিভটা তুললেন। ‘ছোকরার ডান হাতে কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার হয়েছে।’ শহীদের মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
সিভিল সার্জন বললেন, ‘তা এই এক্স-রে প্লেটগুলোর সাথে আকরাম-হত্যা মামলার যোগাযোগটা কি?
বলছি। কিন্তু তোর পরীক্ষায় কোন ভুল নেই তো?”– সিভিল সার্জন আবার প্লেটগুলো দেখে বললেন, ‘মোটেও না। এটা হল একটা বুড়ো লোকের, বুড়ি বলেই মনে হয়। এই চোয়ালটা একটা পুরুষের। তিরিশের মত বয়স হবে। আর এই হাতটা তেরো-চোদ্দ বছর বয়স্ক এক কিশোরের।’
• অথচ এগুলো একই ব্যক্তির অর্থাৎ মিসেস আকরামের বলে আমায় বলা হয়েছিল। ড. এলাহী বলেছিল, মিসেস আকরাম অ্যাক্সিডেন্ট করার পরই এগুলো নেয়া হয়েছিল।’
সিভিল সার্জন বলল, ‘কারণ?’..
বলছি। কিন্তু তার আগে গলাটা ভেজানো দরকার। নিশ্চয়ই। ওরে বিসু, হল?’ হাঁক ছাড়লেন সিভিল সার্জন। হইচে, সাব । আইতাছি,’ অন্দরমহল থেকে জবাব এল। রিসু মিয়া একটু পরেই চা নিয়ে এল।
শহীদ চায়ে চমুক দিয়ে বলল, নকল জখম দেখানর কারণ কি জানিস? চোয়ালে ওরকম জখম দেখিয়ে বোঝানো যেতে পারে যে, ভদ্রমহিলার, মালে মিসেস আকরামের কথা বলার শক্তি নেই। মাথার খুলিতে ফ্র্যাকচার দেখিয়ে ডাক্তার বোঝাতে চাইছে যে, ভদ্রমহিলা সংজ্ঞাহীনা। আর ডানহাতে কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার থাকলে কোন প্রশ্নের লিখিত জবাব দেওয়াও সম্ভব নয়। তার মানে হল, মিসেস আকরাম এমন কিছু জানেন যা ডাক্তার ফাস করতে দিতে রাজি নয়।
সিভিল সার্জনের মুখটা ম্লান হয়ে গেল, আমার তো মনে হয়, আসল অবস্থা ১০৮
ভলিউম-৯
তার চাইতেও গুরুতর।
কি রকম? আমার তো মনে হয়, ভদ্রমহিলাকে ডাক্তার আগেই মেরে ফেলেছে।
কামাল বলল, তা করবে না। ডাক্তার তো জানে যে, সে সকল সন্দেহ থেকে মুক্ত। সুতরাং সে বরং ভদ্রমহিলার স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যেই অপেক্ষা করবে। আর সেটাও খুব সহজ। রোগীর যথাযথ চিকিৎসা না করলেই হল।
ড. রেজা কামালের যুক্তি খণ্ডন করে বললেন, ‘অপেক্ষা করতে যাবে কেন, বল তো? মেরে ফেলে বরং একটা ডেথসার্টিফিকেট লিখে দেবে। ল্যাঠা যত তাড়াতাড়ি চুকে যায় তারই চেষ্টা করবে। ঝামেলা করার মত আছে তো এক ডালিয়া। তাকে যা হোক একটা বোঝাবে। আমার মনে হয়, যেমন করে থোক আজকেই ড. এলাহীর স্যানাটোরিয়ামে যাওয়া উচিত। শহীদ, তুই মি. সিম্পসনকে বল।’
“অবশ্যই বলব। এখন আমার হাতে যে নথিপত্র আছে, মানে এই নেগেটিভগুলো, এর বদৌলতে পুলিস বিভাগের কাছ থেকে সার্চ-ওয়ারেন্ট বের করা কঠিন হবে না।’
সিভিল সার্জন সোৎসাহে বলল, আর একমুহূর্তও দেরি নয়। এক্ষুণি বেরিয়ে পড়া যাক।’
‘তুইও বেরোবি নাকি!’ কামাল বিস্ময় প্রকাশ করল ।
আলবৎ।’
তিষ্ঠ বৎস। মি, সিম্পসনের সাথে আলাপ করি। দেখি উনি কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। ফোনটা দেতো এদিকে এগিয়ে।’
মি. সিম্পসন সবটা শুনে বললেন, ফর্মাল সার্চ-ওয়ারেন্ট বের করতে সময় লাগবে। তবে আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। অবশ্য আমি নিজে যেতে পারব না। একটা কাজে আটকে পড়েছি। স্থানীয় থানায় ফোন করে দিচ্ছি। দারোগা যাতে নিজেই যায় সে ব্যবস্থা করছি।’
চার-পাঁচজন কনস্টেবল সঙ্গে নিতে বলবেন।’
‘নিশ্চয়ই, আমি এক্ষুণি জানিয়ে দিচ্ছি। পুলিস তোমাদের আগেই পৌঁছে যাবে।
‘তাহলে তাদেরকে স্যানাটোরিয়ামের গেট থেকে দূরে থাকতে বলবেন।
আচ্ছা।’ বেরিয়ে পড়ল শহীদ, কামাল আর সিভিল সার্জন ড. রেজা।
স্যানাটোরিয়ামটা নদীর তীর ঘেঁষে। প্রাচীর ঘেরা দোতলা দালানও দূর থেকে ওদের চোখে পড়ল । নদীর তীর দিয়েই পথ। স্যাটোরিয়াম থেকে একটু দূরে অন্ধকারে দুটো জিপ দেখে গাড়ি থামাল শহীদ।.
কুয়াশা-২৯
১০৯
রাস্তার উপর আধা অন্ধকারে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়েছিল। সে গাড়ির জানালার কাছে এসে প্রশ্ন করল, শহীদ সাহেব?’
হ্যাঁ। দারোগা সাহেব সামনের গাড়িতে। আসতে বলব?” দরকার নেই। সোজা স্যানাটোরিয়ামের দিকে চলুন। চলে গেল কনস্টেবলটা।
কামালের দৃষ্টি ছিল নদীর দিকে নিবদ্ধ। তার চোখে পড়ল ছোট একটা লঞ্চ নোঙর করে আছে নদীর তীরে। . স্যানাটোরিয়ামের গেটে গাড়ি থামতেই দারোগা সাহেব নেমে এসে পরিচয় দিলেন নিজের।
লম্বা-চওড়া মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ভারি কণ্ঠস্বর। শহীদের চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছিল না। | ‘মি. সিম্পসন আমাকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। মিসেস আকরামকে আটকে রাখা হয়েছে অসুস্থতার ছুতো করে। তবু আমাকে কি করতে হবে বলুন, দারোগা সাহেব বললেন।
দারোগা সাহেবকে তার কর্তব্য বুঝিয়ে দিল শহীদ। ‘পুলিস কি ভিতরে নিতে হবে?’ বাইরেও রাখতে হবে ভিতরেও নিতে হবে। ক’জন আছে আপনার সাথে? ছয়জন।’ চারজনকে বাইরে রাখুন। দুজন আমাদের সঙ্গে চলুক।’ ‘বেশ, আসুন। রিয়াসত আর গুল মোহাম্মদ, আমার সঙ্গে এস।’
গেট ভোলাই ছিল। দারোগার নেতৃত্বে ওরা ভিতরে ঢুকল। সামনের একটা রূম থেকে বোলা দরজা দিয়ে আলো আসছিল। জুতোয় শব্দ তুলে সেই রূমেই ঢুকলেন দারোগা সাহেব। উর্দি-পরা এক ছোকরা একটা টুলে বসেছিল। তার সামনে টেবিলের উপর টেলিফোন।
সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দারোগার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ভিজিটিং আওয়ার তো শেষ হয়ে গেছে, এখন দেখা হবে না রোগীদের সঙ্গে।’
হুম। রাশভারি গলায় উচ্চারণ করল দারোগা। তারপর প্রশ্ন করল, মিসেস আকরামের কোনটা?
যুবক একটু ভীতস্বরে বলল, আমি তা জানি না, স্যার। তাছাড়া ভিতরে ঢোকবার হুকুম নেই বড় ডাক্তার সাহেবের আদেশ ছাড়া।’
‘আমি পুলিসের লোক, বুঝলে, যা বলছি জবাব দাও। যুবক বলল, ওসব ডাক্তার সাহেব বলতে পারেন। ফোন করে জেনে নিন।
রাখ তোমার ডাক্তার। ল, মিসেস আকরাম কোথায়?’ ধমক দিলেন দারোগা ১১০
ভলিউম-৯
সাহেব।
লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “দোতলার পশ্চিমের রূমে। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের অনুমতি লাগবে ঢুকতে,’ চি চি করে বলল সে।
‘চোপরাও!’ একজন কনস্টেবল হুঙ্কার ছাড়ল।
সিঁড়ির কাছে গিয়ে দারোগা সাহেব নিচুস্বরে একজন কনস্টেবলকে কি যেন নির্দেশ দিল । সে মাথা নেড়ে চলে গেল।
| দোতলার পশ্চিম দিকের রূমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। বারান্দার যেটুকু আলো ভিতরে ঢুকেছিল তাতে বিছানার উপর একটা মানুষকে শায়িত অবস্থায় দেখা গেল।
সিভিল সার্জন সবাইকে পাশ কাটিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলেন। মাথার কাছের সুইচটা টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। দেখা গেল ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা একটা মুখ। শুধু চোখ দুটো অনাবৃত। বুক পর্যন্ত চাদর ঢাকা। বাঁ হাতটা বাইরে পড়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বুকের কাছে চাদরটা সামান্য নড়ছে। তাছাড়া প্রাণের অন্য কোন লক্ষণ নেই।
কামাল বলল, এখনও তাহলে বেঁচেই আছেন ভদ্রমহিলা।’
সিভিল সার্জন ড. রেজা বাঁ হাতটা তুলে নাড়ী দেখলেন। হাতটা রেখে মাথা তুলতেই তাঁর মুখের দিকে তাকাল শহীদ। তার মনে হল ড. রেজার চোখে-মুখে বিস্ময়ের একটা ছাপ ফুটে উঠেছে।
• ড. রেজা বৈরাগিনীর পায়ের কাছে গিয়ে চার্ট দেখে শহীদকে বললেন, ডানহাতে কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার, চোয়াল ও মাথার খুলিতেও ফ্র্যাকচার। শহীদ, ওই ভুয়া নেগেটিভগুলোর মত জখমগুলোও যদি ভূয়া হয় তাহলে ড. এলাহীর হাতে হাতকড়া পরানর জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।’
বেশ তো। খুলে ফেল ব্যাণ্ডেজ। সিভিল সার্জন চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগলেন।
কাজ শুরু করে দিন না,’ দারোগা সাহেব বললেন। ‘ড, রেজা হতাশাভরা কণ্ঠে বললেন, কিন্তু কি করে তা সম্ভব?’ ডান হাতটা দেখিয়ে যোগ করলেন, এটা তো কাস্ট করা আছে। ওঁর ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া এটা খোলার কোন অধিকারই আমার নেই। আইনত পারি না। নৈতিকতাতেও বাধে।
দারোগা সাহেব বললেন, “আরে রেখে দিন নৈতিকতার প্রশ্ন। আর আইনের হাঙ্গামাটা না হয় আমিই সামলাব। আপনি খুলুন, সমস্ত দায়িত্ব আমার।’– তবু সামান্য ইতস্তত করে সিভিল সার্জন পকেট থেকে একটা চামড়ার ছোট কেস বের করলেন। একটু পরে স্কাল্পেল দিয়ে কাস্ট কাটার শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ শোনা গেল না। কাস্টগুলো কেটে কেটে মাটিতে ফেলা হচ্ছে। কুয়াশা-২৯
১১১
•.–
–
শহীদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
কাস্ট কাটা শেষ হতেই সিভিল সার্জন হাতটা নেড়েচেড়ে বললেন, না, কোন রকম জখম নেই হাতে | ফ্র্যাকচার তো নেই-ই। কিন্তু।
কিন্তু কি?’ শহীদ প্রশ্ন করল। সিভিল সার্জন মুখ তুলে শহীদের দিকে তাকালেন। “দ্যাখ, এখানে সারা হাত জুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট বিন্দু। দেখেছিস?’ শহীদ মাথা নুইয়ে দেখল।
দারোগা সাহেব বললেন, “এবার তাহলে মাথার ব্যাণ্ডেজটা খুলুন, সার্জন সাহেব। দেখা যাক সেখানে কি আছে।
কামাল বলল, “চোয়ালে যদি জখম না থাকে তাহলে উনি নিশ্চয়ই কথা বলতে পারবেন, আর বোঝাই যাচ্ছে হাতের মত অন্য জখমগুলোও ভুয়া।
‘এই তো এবার খুলছি মাথার ব্যান্ডেজ, ড. রেজা বললেন।
‘নিশ্চয়ই নয়, মি. সিভিল সার্জন। এ ভীষণ অন্যায়, ভীষণ অন্যায় আপনার! পিছন থেকে বজ্রপাত হল।
চকিতে সকলেই ফিরে তাকাল পিছন দিকে। শহীদ দেখল ডক্টর এলাহী এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা রিভলভার। চেহারায় হিংস্রতা। রাগে ও উত্তেজনায় তার নাকের বাঁশি বারবার ফুলে ফুলে উঠছে।
শহীদ তার রিভলভার বের না করাই উত্তম বিবেচনা করল।
ড. এলাহী কঠিন কণ্ঠে বলল, আমার বিনা অনুমতিতে এখানে প্রবেশ করেছেন। আমি আপনাদের গুলি করলেও আইন আমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। ইন্সপেক্টর, আপনি কোন সার্চ-ওয়ারেন্ট ছাড়াই এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছেন। সার্জন, আপনি আমার বিনানুমতিতে আমার রোগিনীর কাস্ট খুলেছেন। আপনার কোন অধিকারই নেই।’
| ‘অধিকার অধিকারের প্রশ্ন শুনতে আমি রাজি নই। আমরা আপনার রোগিনীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাব। আমাদের বিশ্বাস, আপনি অসুস্থতার নাম করে ভদ্রমহিলাকে এখানে বন্দি করে রেখেছেন। আর আপনাকেও আমরা খুনের দায়ে গ্রেফতার করব,’কঠিন কণ্ঠে বললেন দারোগগা সাহেব। | তাই নাকি, দারোগা সাহেব।’ ব্যঙ্গ করল ড. এলাহী, একটু অপেক্ষা করুন।
মি. সিম্পসনকে আমি ফোন করেছি। উনি আসছেন। তারপর দেখা…!’ । | হঠাৎ একটা রিভলভার গর্জে উঠল । ডক্টর এলাহী তার কথাটা শেষ করতে পারল না। তার শরীরটা একটা পাক খেল। দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগল সে।
সবাই হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের আগে নড়ে উঠলেন সিভিল সার্জন। দ্রুত ডক্টর এলাহীর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে তার ১১২
ভলিউম-৯
দেহ নিশ্চল হয়ে গেছে। ঠিক বুকে বিঁধেছে গুলি।
‘কে? কে করল গুলি?’ গর্জে উঠলেন ড. রেজা।
শহীদ নীরবে বিছানায় শায়িত দেহটার দিকে অঙ্গুলী সঙ্কেত করল।
সবাই দেখল, যে হাতটা থেকে কাস্ট কেটে ফেলা হয়েছে সেই হাতে একটা রিভলভার। হাতটা উপরের দিকে উঁচু। কিন্তু সেটা কাঁপছে।
শহীদ বলল, “রেজা, বি কুইক। আগে ব্যাণ্ডেজগুলো খুলে ফেল।’
সিভিল সার্জন চামড়ার কেসটা থেকে কচি বের করে ব্যান্ডেজ কাটতে লাগল দ্রুত হাতে। ডিমের খোসার মত খুলে এল ব্যাণ্ডেজটা। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে
এল এক অপরূপ সুন্দরী তরুণীর মুখ।
বিস্ময়ে ওরা সবাই বোকা হয়ে গেল। দারোগা বললেন, ‘এ কি, শহীদ সাহেব! আপনি না বলেছিলেন, মিসেস আকরাম বুড়ো মানুষ?’
সিভিল সার্জন সবিস্ময়ে তরুণীর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
শহীদ ও কামাল তরুণীকে চিনতে পারছে। কিন্তু ব্যাণ্ডেজের মধ্যে থেকে এই তরুণী মুখ কেউ আশা করেনি। সুতরাং সকলেই বিস্মিত হয়েছে। ওরা মুখ খোলবার আগেই তরুণী বলল, আমি, আমি ডালিয়া। আমাকে ব্যাণ্ডেজ পরিয়ে
এখানে আটকে রেখেছে ওই যে, ওই শয়তানটা।’ ডক্টর এলাহীকে দেখিয়ে দিল। সে। তরুণীর ঠোঁট কাঁপছিল কিন্তু চেহারায় প্রকাশ পেল তীব্র ঘৃণা।
উঠে বসল ডালিয়া। তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
শহীদ বলল, লুকিয়ে রাখার কি চমৎকার ব্যবস্থা! ইস, আগে যদি এতটুকু সন্দেহ হত!’
‘আপনি, আপনিই তো শহীদ সাহেব? মাথা নাড়ল শহীদ।
‘আপনি এসে পড়েছিলেন বলেই আমি মুক্তি পেলাম,’ অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল ডালিয়া।
কিন্তু আপনার মা? তিনি কোথায়?”
‘ওঁকে। ওঁকে শয়তানটা মেরে ফেলেছে। বাবাকেও মেরেছে। মাকেও মেরেছে, আঁচলে চোখের পানি মুছে বলল ডালিয়া।
আপনি যা বলছেন তা ঠিক তো?’ মাথা নেড়ে ডালিয়া বলল, মা ওকে ধরে ফেলেছিলেন। তাই মাকে চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল কায়সার। ধাক্কা দিয়ে ওঁকে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। তারপর নিয়ে এসেছিল এখানে, যাতে করে কোনদিন ওঁর কথা কেউ
শুনতে না পারে।
আপনাকে এখানে আনল কি করে?’
আপনাকে যেদিন ফোন করেছিলাম সেই রাতেই আমি কায়সারের চেম্বারে ৮ কুয়াশা-২৯
১১৩
গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন গুণ্ডা ছিল। আমাকে ওরা ওখানেই আটকে ফেলে এখানে নিয়ে আসে। তারপর ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেয়। উহ, সে যেন এক দুঃস্বপ্ন! দু’হাতে মুখ ঢাকল ডালিয়া।
আপনি কি আগেই ডাক্তারকে সন্দেহ করেছিলেন?’ মাথা তুলে ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, করেছিলাম। কিন্তু ওকে তা বুঝতে দিইনি। আপনাকে এই জন্যেই অনুরোধ করেছিলাম। কিভাবে কায়সার জেনেছিল তা বলতে পারব না। তবে ও দুজন লোককে আপনাকে খুন করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিল। আমি পরে ভেবেছিলাম, হয়ত সত্যি আপনাকে ওরা খুন করেছে। ভেবেছিলাম, আমি একেবারেই অসহায়। ওর কবল থেকে কোনদিনই মুক্তি পাব না আর।’
একজন কনস্টেবল এসে বারান্দা থেকে দারোগা সাহেবকে ডাক দিল। তিনি বেরিয়ে গেলেন। শহীদ তার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। দারোগা সাহেব বারান্দা থেকেই বললেন, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনারা আসুন।’
ড. রেজা ডাকলেন, শহীদ।
আঁ, যেন স্বপ্ন ভঙ্গ হল শহীদের। ‘এখন কি আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন?
, তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই এখন। পরে করলেও চলবে।’
তাহলে আমরা চলে যাই বরং, ওর এখন বিশ্রামের দরকার। অনেক ঝড় বয়ে গেছে ওঁর উপর দিয়ে। ওঁকে তো এখানে রাখা চলবে না।’
“নিশ্চয়ই। দাঁড়া, রিভলভারটা নিয়ে যাই। বাই দ্য ওয়ে, মিস ডালিয়া, রিভলভারটা কোথায় পেলেন আপনি? ওটা কার?’
ওটা ওরই। কায়সার সেদিন ডেস্কের দেরাজে রেখে গিয়েছিল। বোধ হয় আমাকে আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ করতে। প্রলুব্ধ হইনি এমন নয়। কিন্তু আত্মহত্যা করার মত সাহস হয়নি। তবু বালিশের তলায় রেখেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম ওর চোখেহত্যার নেশা তখন আমি নিজের অজ্ঞাতেই ওটা বের করে ট্রিগার টিপলাম। কি করে যে ট্রিগার টিপলাম নিজেই বুঝতে পারছি না। এখনও আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে ঘটনাটা। উঁহু, কিন্তু আমি আর সইতে পারছি নে।’
আবার দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল ডালিয়া। . শহীদ আলগোছে রিভলভারটা একটা রুমালে আবৃত করে পকেটে রাখল।
সিভিল সার্জন বললেন, “চল, আমরা যাই। আপনি উঠুন, মিস ডালিয়া। আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’
না না, আপনারা যাবেন না। আমি একা এক সেকে েজন্যেও এই রূমে থাকতে পারব না।’
সিভিল সার্জন বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, দারোগা সাহেব আবার এই সময়
১১৪ :
ভলিউম-১০
গেলেন কোথায়? লাশটা তো সরানো দরকার।’
ওরা সবাই বেরিয়ে এল।
শহীদ আমতা আমতা করে বলল, “দারোগা আর ফিরবে না। কনস্টেবলগুলোও না। আমি বুঝতে পারিনি। চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু চিনতে পারিনি। চিনলাম যখন তখন সে বেরিয়ে গেছে।’
“কি বলছিস তুই? সিভিল সার্জন বললেন। ‘ওরে, লোকটা নকল দারোগা। আসল দারোগা নয়।’ ‘বলিস কি!’ সিভিল সার্জন প্রায় আর্তকণ্ঠে বললেন, ‘কারা তাহলে ওরা?’ ম্লান হাসি হেসে শহীদ বললেন, কুয়াশা এসেছিল-সদলবলে।’ কামাল উত্তেজিত হয়ে বলল, তাই তো, আমারও মনে হচ্ছিল খুব চেনা।
আহা, আগে বলিসনি কেন?’ বুঝতে পারলে তো বলব?’
আশ্চর্য, এতগুলো লোককে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল! কিন্তু কুয়াশা এল কি করে? আমরা, যে এখানে আসব তা জানল কি করে?
কি করে বলব বল?
উর্দি-পরা ছোকরা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সে একটা সালাম বুকে বলল, শহীদ সাহেব কে? তার একটা চিঠি আছে, দারোগা সাহেব দিয়েছেন।’
| আমিই শহীদ। দাও চিঠিটা।’
শহীদ চিঠিটা পড়ে বলল, কামাল, ধারে-কাছে কোথাও নদীতে নোঙর করা লঞ্চ দেখেছিস?’
হা। ওই তো, যেখানে পুলিসের সাথে কুয়াশার জিপ দাঁড়িয়েছিল সেখানেই তো নদীতে ছোট একটা লঞ্চ আছে।’
‘জলদি চল। সেখানে আসল দারোগা সদলবলে বন্দি হয়ে আছে।
দশ গাড়িতে উঠে ড. রেজা সিগারেট ধরালেন। ধোয়া ছেড়ে বললেন, কে লিখেছে চিঠিটা? নিশ্চয়ই কুয়াশা, দেখি চিঠিটা?’
শহীদ তার হাতে দিল চিঠিটা।
পড়া শেষ করে ড. রেজা বললেন, তাহলে এখানেই ছিল ড. এলাহীর বে আইনী মাদক দ্রব্যের ভাণ্ডার। কুয়াশা তো সমস্তটাই নষ্ট করে দেবে। যাক, কাজটা ভালই করেছে কুয়াশা। কিন্তু পরের কথাটা বুঝতে পারলাম না।
কামাল বলল, কি লিখেছে?’
লিখেছে, প্রকৃত সত্য যেন উদঘাটিত হয়। এ কথার মানে কি? তুই কিছু কুয়াশা-২৯
১১৫
বুঝলি, শহীদ?” “ কিছুটা বুঝলাম বটে। কাল জানতে পারবি। দশটার দিকে মি. সিম্পসনের কামরায় আয়।’
পরের দিন বেলা দশটায় মি. সিম্পসনের কামরায় হাজির হল শহীদ, কামাল, সিভিল সার্জন ড. রেজা, মিস ডালিয়া ও বেলাল সিদ্দিকী।
সকালেই শহীদ ডালিয়াকে মি, সিম্পসনের অফিসে যেতে অনুরোধ করেছিল। আর কামালকে পাঠিয়েছিল বেলালকে ডেকে আনবার জন্যে।
মিস ডালিয়া সত্যি সুন্দরী। তবে একটু রোগা মনে হচ্ছিল তাকে। সম্ভবত গত কয়েক দিনের মানসিক নির্যাতনই তার কারণ। কমলা রং-এর একটা কাঞ্জিভরম পরেছে ডালিয়া। তার সঙ্গে ম্যাচ করেছে স্লিভলেস ব্লাউজ।
পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর মি. সিম্পসন বললেন, “মিস ডালিয়া, আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন থাকায় আপনাকে বাধ্য হয়েই ডেকেছি।’ ড্রয়ার থেকে একটা 32 বের করে টেবিলের উপর রেখে তিনি বললেন, এটা আপনি চিনতে পারেন?
ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, ওটা আমি স্যানাটোরিয়ামে আমার রূমের ডেস্ক থেকে সরিয়েছিলাম। কায়সার রেখেছিল সেখানে। সম্ভবত আমার মনে আত্মহত্যার প্রেরণা সৃষ্টির জন্যে।
ধন্যবাদ।’ | শহীদ বলল, ‘মিস ডালিয়া, নিপুণভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছিলেন বলেই সব কুল রক্ষা পেল।
ডালিয়া লজ্জিত হয়ে বলল, ব্যাপারটা কেমন যেন ম্যাজিকের মতই ঘটে গেল, শহীদ সাহেব। আসলে লক্ষ্যভেদ তো দূরের কথা এর আগে রিভলভার স্পর্শও করিনি আমি। হয়ত কাজটা আমার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু তখন নিজেকে সংযত করতে পারিনি। কি করে যে ঘটে গেল ঘটনাটা!’
| মি. সিম্পসন গম্ভীর মুখে শহীদকে বললেন, তোমার ওই মন্তব্যের আসল * অর্থটা কি, বল তো?’
শহীদ হেসে বলল,, কায়সার অনেক কুকাণ্ড করেছে, কিন্তু এমন চতুর। লোক ছিল সে যে, আইন তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারত না। তাছাড়া ফকির . আকরামের কেসে তো তাকে ফাঁসানো যেতই না।’
মি. সিম্পসন ভূ-কুঁচকে বললেন, তুমি কি বলছ এসব? ড. কায়সার এলাহী আকরাম সাহেবের গলায় ওষুধ লাগাবার বা পরীক্ষা করার ছুতোয় তার মুখে রিভলভার ঢুকিয়ে গুলি করেছে একথা তো তুমি প্রমাণই করেছ। তারপর একথা বলার মানে কি?’
শহীদ বলল, আমার ধারণা আগে তাই ছিল।” ১১৬
ভলিউম-১০
রূমের সকলের বিস্মিত দৃষ্টি শহীদের দিকে নিবদ্ধ হল।
তার মানে?’
‘অর্থাৎ এখন তোর ধারণা পাল্টেছে? কিন্তু কি করে সম্ভব? কি যে উল্টোপাল্টা বকিস তুই!’ বিরক্তি প্রকাশ করলেন ডাক্তার ।
শহীদ মৃদু হেসে একটা সিগারেট ধরাল।। ড. রেজা অধৈর্য হয়ে বললেন, তাহলে কে করেছে গুলিটা? বেলালের মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল।
একগাল ধোয়া ছেড়ে শহীদ বলল, আকরাম সাহেবের স্ত্রীও হতে পারে মেয়েও হতে পারে, অতি বিশ্বাসী কোন বন্ধু বা চাকরও হতে পারে। অর্থাৎ তার গলায় স্প্রে করার সুযোগ যার যার ছিল তাদের যে কেউ এটা করতে পারে।’
ডালিয়া এতক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শহীদের কথা শুনছিল। সে তড়াক করে উঠে। দাঁড়াল। তার মুখটা ছাইয়ের মত সাদা। সে সক্রোধে বলল, আমার মাকে আমি, জানি। সৎ হলেও আমি বলব, এমন মানুষ তিনি ছিলেন না। আমি একথা কিছুতেই মানব না।’
মাথা নেড়ে শহীদ বলল, আপনার মা নন মিস ডালিয়া, আপনি! আপনিই আপনার বাবাকে হত্যা করেছেন। তাঁর গলায় স্প্রে করার অজুহাতে তার মুখের মধ্যে রিভলভার ঢুকিয়ে ট্রিগার টি পছেন। বেলাল সিদ্দিকী সাহেব বলুন, আমি সত্যি কথা বলছি কিনা?’
বেলাল মাথা নিচু করল।
‘আপনি, আপনি পাগল হয়ে গেছেন, শহীদ সাহেব। উন্মাদের মত কথা বলছেন। আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আদালতে যাব, আপনার এই মন্তব্যের জন্যে আপনার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করব!’ চিৎকার করতে লাগল ডালিয়া।
অবজ্ঞার হাসি হাসল শহীদ।
সে বলল, আপনি যদি আকরাম সাহেবকে হত্যা না করে থাকেন তাহলে হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরের ঘটনা জানলেন কি করে? মনে আছে, গত রাতে আপনি স্যানাটোরিয়ামে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, আপনার মাকে কায়সার সিঁড়িতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল? কিন্তু যেভাবে আপনি ঘটনাটা ব্যক্ত করলেন তাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ড. কায়সার নয় আপনিই আপনার মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আপনার মা অসুস্থ ছিলেন। বাসায় তখন কোন। লোক ছিল না। শুধু আপনি ছিলেন আপনার বাবার স্টাডি-রূমে। হয়ত বুঝতে পারেননি, অসুস্থ মহিলা গুলির আওয়াজ শুনে অত দ্রুত ছুটে আসতে পারেন। সুতরাং তাঁকে আসতে দেখে সিঁড়ির মাথাতেই তাকে আঘাত করেন এবং ধাক্কা মেরে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেন।
কুয়াশা-২৯
১১৭
‘আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। আমাকে এভাবে অপমান করার অধিকার কারও নেই!’ চিৎকার করে উঠল ডালিয়া।
চুপ করুন আপনি। চিৎকার করবেন না।’ মৃদু ধমক দিলেন মি. সিম্পসন, আপনাকে গ্রেফতার করা হল, মিস ডালিয়া।’
‘কোন অপরাধে?’ খেঁকিয়ে উঠল ডালিয়া। ভীষণ বীভৎস দেখাচ্ছে এখন তাকে।
‘আপাতত তিনটে খুনের অভিযোগে, শহীদ বলল । ফকির আকরাম, ড. কায়সার এলাহী ও মাহদী বিল্লাহ এই তিনজনকে খুন করেছেন আপনি।’
রূমসুদ্ধ সবাই চমকে উঠল। এমন কি বেলাল সিদ্দিকীরও চোখে-মুখে বিস্ময়।
মি. সিম্পসন বললেন, মাহদী বিল্লাহ, মানে বিল্লীর কথা বলছ, শহীদ? তাকে উনি খুন করেছেন মানে? সে তো কুয়াশা।’
মৃদু মাথা নেড়ে শহীদ বলল, ডাক্তার, তুমি তো বিল্লীর ময়না তদন্ত করেছ। সে .32-এর গুলিতে মারা গেছে না?’
হ্যাঁ।’
মি. সিম্পসনের টেবিলের উপর রাখা–32-টা দেখিয়ে শহীদ বলল, এটা সেই 32। এটা দিয়েই উনি বিলীকে হত্যা করেছেন।’
‘আমি, আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না। চললাম আমি।’ দরজার দিকে এগোতে লাগল ডালিয়া।
“আরে, গেল যে চলে!’ ড. রেজা ব্যস্ত হয়ে বললেন।
যাবে আর কোথায়? ওকে এক্ষুণি অ্যারেস্ট করা হবে। আমি আগেই ইশারা করে দিয়েছি।’
দরজার বাইরে থেকে চিৎকার ও ধস্তাধস্তির শব্দ এল পরমুহূর্তেই । একটু পরে একজন কনস্টেবল উঁকি দিয়ে বলল, লক-আপে পাঠাব, স্যার?’
‘পাঠাও। চলে গেল কনস্টেবলটা।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। নীরবে সিগারেট টানতে লাগল সবাই। নীরবতা ভঙ্গ করল বেলাল সিদ্দিকী। সে বলল, চাচাজীকে ডালিয়াই খুন করেছে। ‘আপনি জানলেন কি করে?’ ড. রেজা প্রশ্ন করলেন।
‘ডালিয়া ডোপ নিত। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আমার কাছে সবটাই স্বীকার করেছে সে।।
‘আম আপনি সে ডোপ ড. এলাহীর কাছ থেকে এনে ডালিয়াকে দিতেন।
বেলাল ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমার উপায় ছিল না, এমনভাবে আমাকে ধরত। তাছাড়া আমি ওর কাছে অনেকভাবে ঋণী।’
ভলিউম-১০
১১৮
শহীদ বলল, জানি, আপনার অপরাধ নেই। ড. এলাহীই ডালিয়াকে ডোপ নেয়া শিখিয়েছে। পরে কোন অজ্ঞাত কারণে ডালিয়াকে ডোপ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল সে।
ড. রেজা বললেন, “ইয়ে, মানে…সমস্তটা ব্যাপার আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিনে।’
কামাল বলল, আমারও সেই অবস্থা।’
তাহলে ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলতে হয়,’শহীদ বলল। হ্যাঁ বাবা, ঝেড়ে কাশ।’
শহীদ বলতে শুরু করল, ড, এলাহী ছিলেন ডালিয়াদের পারিবারিক ডাক্তার। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক। আকরাম সাহেব তাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার চরিত্রের খারাপ দিকটা তার জানা ছিল না। অন্যদিকে ডালিয়া ছোটবেলা থেকেই বখে, যাওয়া মেয়ে। বেলাল সিদ্দিকীও তা স্বীকার করবেন। বেলাল যথাযথই ভালবাসত ডালিয়াকে তার স্বভাব-চরিত্র জেনে-শুনেও। তাকে শোধরাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টে তাকে ডালিয়ার জন্যে ডোপ জোগাতে হয়েছে। ডালিয়া ভালবাসুত একটা ক্লেদাক্ত উত্তেজনাময় জীবন। মাঝে মাঝে তাই সে নিরুদ্দেশও হত।’ শহীদ
থামল।
সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, কিন্তু মেয়েকে বাবা চিনতেন। অথচ একমাত্র মেয়ে। সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাই কায়সারের মত মজবুত একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন। তিনি অবশ্য জানতেন না যে, ড. এলাহীও তাঁর মেয়ের ক্লেদাক্ত জীবনের অন্যতম সঙ্গী। ড. এলাহী বিয়েতে রাজি হন। তার লক্ষ্য ছিল অবশ্য আকরাম সাহেবের বিপুল অর্থ। ডালিয়াকে হাতের মুঠোয় পেলে তাকে পরে শুধরে নেওয়া যাবে বলে তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু ডালিয়া ডাক্তারকে চিনত ভাল করেই। স্বামী হিসেবে ড. এলাহীকে তার পছন্দ হয়ন্সি। তা সে অবশ্য কখনও প্রকাশ করেনি। সে-ও চেয়েছিল বাপের টাকা। কিন্তু ডাক্তারের হাতের মুঠোয় ঢুকতে সে রাজি ছিল না কিছুতেই। এদিকে আকরাম সাহেব বিয়ের জন্যে খুবই চাপ দিচ্ছিলেন। ফলে একদিন বাড়িতে লোকজনের অনুপস্থিতিতে বাপের গলায় ওষুধ দেবার ছুতো করে তাঁর মুখে রিভলভার ঢুকিয়ে দেয়। গুলির আওয়াজ শুনে মিসেস আকরাম দৌড়ে আসতেই তাঁকে দরজার সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ডালিয়া। পরে তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুজনকে একসঙ্গে সামলানো অসম্ভব বিবেচনা করে শেষপর্যন্ত সে ড. এলাহীকেই ডেকে পাঠায়।
তারপর? ড, এলাহী হত্যাকাণ্ডটাকে আত্মহত্যার মত করে সাজিয়ে ফেলে।
‘তার স্বার্থ কি? সে ডালিয়াকে ধরিয়ে দিল না কেন? কুয়াশা-২৯
১১৯
ব্ল্যাকমেইলিং।’ ড. এলাহী ডালিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করত?
নিয়মিতভাবে। এবং তাতে অতিষ্ঠ হয়েই ডালিয়া চমৎকার একটা চাল চালে। সে তার বাবার হত্যাকাণ্ডটাকে হত্যাকাণ্ড বলেই চালাবার এবং হত্যার দায়টা ড. এলাহীর উপর চাপাবার মতলব আঁটে।
‘খাসা মতলব!’
হা, নিজের দিক থেকে সে নিশ্চিত ছিল। সে তার বাবাকে খুন করতে পারে একথা, কেউই বিশ্বাস করবে না, সে তা জানত। একমাত্র সাক্ষী মিসেস আকরামও মারা গেছেন তখন। সুতরাং সে নিজে থেকে যদি এই ব্যাপারে কাউকে তদন্ত করার অনুরোধ করে তাহলে সন্দেহটা ডাক্তারের উপরেই গড়াবে। আর হয়েছিলও তাই। আমি ড. এলাহীকে সন্দেহ করেছিলাম বরাবর। কিন্তু এতেও নিশ্চিত ছিল
ডালিয়া। সন্দেহটা শতকরা একশ’ ভাগ ডাক্তারের ঘাড়ে চাপাবার জন্যে সে ড. এলাহীর স্যানাটোরিয়ামেই আত্মগোপন করে। স্বভাবতই আমরা ভাবলাম, ড, এলাহী তাকে সরিয়ে ফেলেছে। তবে স্যানাটোরিয়ামে রোগিনী হিসেবে যে ডালিয়াকে দেখব সেটা আমিও আশা করিনি। কিন্তু আমরা সেখানেই তাকে
আবিষ্কার করি, ডালিয়া মনে-প্রাণে এটাই চেয়েছিল। অন্যদিকে সে বিল্লীর দলকে। লেলিয়ে দিল আমার বিরুদ্ধে। তার উদ্দেশ্য ছিল বোধহয় দুটো। প্রথমত আমার জেদ বাড়িয়ে দেওয়া, অবশ্য যদি আমি বেঁচে যাই। দ্বিতীয়ত ড. এলাহীর উপর সন্দেহ যাতে ঘনীভূত হয়। ড. এলাহীর সঙ্গে বিল্লীর যোগাযোগ আছে, আর খোঁজ করলেই আমার পক্ষে যে তা জানা সম্ভব, ডালিয়া তা বুঝতে পেরেছিল। ফলে ডালিয়া অনুমান করেছিল, আমার এই ধারণা হবে যে, ড, এলাহীই বিল্পীকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। সুতরাং সে-ই কালপ্রিট।
‘পরও রাতে আমি বিলীর আড্ডায় হানা দিলাম। তাকে বাগেও আনলাম। (কুয়াশার উপস্থিতি চেপে গেল শহীদ।) সে যখন বাধ্য হয়েই ব্যাপারটা খুলে বলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় আমার পিছন থেকে কে একজন গুলি করল বিলীকে। আমি তাকে দেখতে পাইনি। তখন ভেবেছিলাম, লোকটা ড. এলাহী।’
‘কিন্তু ডালিয়া ওকে গুলি করতে গেল কেন?’ কামাল প্রশ্ন করল ।।
বিল্লী সত্যি কথা বলে ফেললে ডালিয়ার ভালমানুষী ঘুচে যেত বলে । ড. এলাহীকেও সে একই কারণে গুলি করেছে।’
ড. রেজা হাঁ করে শহীদের কথাগুলো গিলছিল। সে এতক্ষণে বলল, কিন্তু ড. এলাহী তাকে স্যানাটোরিয়ামে জায়গা দিল
কেন?’
| ‘তোর মত শিশুর মুখেই এ প্রশ্ন শোভা পায়,’ বলল শহীদ।
০
Leave a Reply