২৮. জাহাজ উধাও [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৮
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট, ১৯৭০
এক
তখনও সূর্যোদয় হয়নি। পুব-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েনি উষার রক্তরাগ। তবু ভারত মহাসাগরের বুকের উপর থেকে কুটিল অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হবে আকাশ-বাতাস-সমুদ্র।
| বছরের এই সময়টায় বড় একটা কুয়াশা জমে না ভারত মহাসাগরে । আজকেও কুয়াশার লেশমাত্র কোথাও ছিল না। সারারাত সামুদ্রিক হওয়ায় মাতামাতির পর সমুদ্র এখন শান্ত। যেন তন্দ্রা নেমেছে সমুদ্রের বিশাল নীল চোখে।
একটি পাকিস্তানী পণ্যবাহী জাহাজ পুব-উত্তরদিকে ছুটে চলেছে শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে। জাহাজটার নাম, এস, এস, তিতাসা । সিডনী থেকে গম নিয়ে আসছে। লক্ষ্য তার চট্টগ্রাম বন্দর। দিন পনেরো আগে সিডনী ও্যাগ করেছে তিতাসা। অন্তত আরও বারোদিন লাগবে চট্টগ্রাম পৌঁছুতে। ।
ঘুমজড়িত চোখে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়েছিল জাহাজের ক্যাপ্টেন হাফ । চারদিকে একবার চোখ বুলাল সে। কাছে-পিঠে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন জাহাজ ‘চোখে পড়ল না। .
ব্রিজ ছেড়ে এসে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়াল সে। দুচোখ বেয়ে ঘুম নামছে তার। সারারাত ডিউটি দিয়েছে । রিলিভার সেকেণ্ড অফিসার রসুলের ডিউটিতে আসতে আরও ঘন্টাখানেক বাকি।
| একটা সিগারেট ধরাল ক্যাপ্টেন। কিন্তু দু’একটা টান দিয়েই সমুক্রের জলে ফেলে দিল। ঢেউ-এর আর্বতে হারিয়ে গেল সিগারেটের টুকরোটা মুহূর্তের মধ্যে।
মুখের ভিতরটা তেতো লাগছিল ক্যাপ্টেনের। লাগবারই কথা, সারারাত ধরে শুধু একটার পর একটা সিগারেটই টেনেছে সে। মদ্যপানের অভ্যাস তার কখনও ছিল না, তবে চা আর সিগারেট খায় প্রচুর।
সমুদ্রের দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন হাফিজ। আদিগন্ত শুধু জল আর জল। মেজাজ ভাল থাকলে সে এতক্ষণ উর্বশী আবৃত্তি করত।
পদশব্দে পিছনে ফিরে তাকাল ক্যাপ্টেন। হাসিভরা মুখে থার্ড অফিসার গোলাম মৃধা এসে দাঁড়িয়েছে। খুব ভোরে ওঠা ওর অভ্যাস। তাছাড়া একটু পরেই ডিউটি আওয়ার শুরু হবে। একেবারে ধড়াচূড়া পরেই এসেছে। ..
কুয়াশা-২৮।
হ্যালো মৃধা,’ বলল ক্যাপ্টেন হাফিজ।
হ্যালো বস্। কি ভাবছ? ভাবির কথা বুঝি? হোম সুইট হোম! সত্যি ক্যাপ্টেন, পথ যেন আর ফুরোতেই চায় না। সেই কবে সিডনী ছেড়েছি আর কবে যে চিটাগাং পৌঁছুব। একটু করুণ হয়ে এল মৃধার কণ্ঠ।
মৃধা সদ্য বিয়ে করেছে। তার ব্যথা অনুভব করতে পারল ক্যাপ্টেন হাফিজ। কিন্তু খেচা না দিয়ে ছাড়ল না। সে ঠাট্টা করে বলল, তাইত কবি বলেছেন
‘রেখেছ স্বামীজী করে নাবিক করনি।’
“তোমাদের মত সদ্য বিবাহিত তরুণদের নিয়েই তো সমস্যা। গিন্নীরাও ছাড়তে চায় না, আর তোমাদের তো কথাই নেই। সামুদ্রিক বাতাসের মতই বুকটা তোমাদের শুধু হু-হুঁ করে সর্বক্ষণ। অথচ আমাদের মত সিজনৃড় সামুদ্রিক প্রাণী•••
লজ্জা পেল মৃধা। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজকে শেষ করতে দিল না কথাটা। সে বলল, ইশ, তুমি ভারি বুড়িয়ে গেছ, না? কছর বড় হবে তুমি আমার চাইতে? বড়জোর দুবছর।’
তা যত দিনেরই বড় হই, আমার আবার চাইল্ডম্যারেজ কিনা। তাই তো বুড়িয়ে গেছি ভাই, অন্তত সাংসারিক চিন্তা-ভাবনা আর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে। এই ‘ দেখ না, তোমার ভাবি তো আমাকে বুড়ো মিয়া বলে ডাকে।
হো-হো করে হেসে উঠল থার্ড অফিসার। হাসছ কেন? অ্যাঁ। এই দুষ্ট ছেলে।
মৃধা হাসি থামিয়ে বলল, “অথচ জান, রিটা মানে সিডনীর সেই মেয়েটা সেইলার্স ক্লাবে তোমাকে দেখে বলেছিল, ডোন্ট সে দ্যাট কিড ইজ দ্য স্কিপার অফ ইওর ক্রুজার।’
| শঙ্কিত হল ক্যাপ্টেন। একবার যখন রিটার নামটা উচ্চারিত হয়েছে তখন শ্ৰীমান মৃধা আলোচনাটাকে যে-কোন্ খাতে বইয়ে নেবে সে সম্পর্কে স্পষ্টই ধারণা আছে তার। সুতরাং আলোচনার ধারা পাল্টাবার জন্যে বলল, তোমার ডিউটি কি শুরু হল?
ঘড়ি দেখে মৃধা বলল, হ্যাঁ, মিনিট পনেরো পরে শুরু হবে। কেন, তুমি যেতে চাইছ? তা যাও না। আমি ম্যানেজ করতে পারব। রসুল তো আসছেই। বোসান দীপেন বড়ুয়া-আছে। যাও তুমি। রিয়েলী, ইউ আর লুকিং ভেরি টায়ারড।’
| ক্যাপ্টেন খুশি হয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি চললাম। নো স্পেশ্যাল ইনস্ট্রাকশন। সো লং।’
পা বাড়াল ক্যাপ্টেন প্যাসেজের দিকে।
মৃধা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল। ক্যাপ্টেন হাফিজ থেমে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হল?
মৃধা আঙুল দিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখাল। তার মুখটা ফ্যাকাসে। ঠোঁট দুটো
ভলিউম-১০
কাঁপছে।
‘ওটা কি?’ উচ্চারণ করল মৃধা। ক্যাপ্টেন হাফিজও তাকাল সমুদ্রের দিকে এবং বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেল।
দূরত্বটা ঠিক অনুমান করা গেল না। দূর সমুদ্র থেকে বিরাট একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ পাক খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। দেখতে অনেকটা কুয়াশার মতই। কিন্তু কুয়াশা অমন করে পাক খেতে খেতে এগোয় না। সামুদ্রিক ঝড় পাক খেতে খেতে এগিয়ে যায় কিন্তু সেটা খালি চোখে ধরা পড়ে না।
সর্বনাশ!’ ক্যাপ্টেন হাফিজের মুখ দিয়ে অনেকক্ষণ পরে মাত্র একটা শব্দই নির্গত হল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই সংবিৎ ফিরে পেল সে। বুকে ঝোলানো দূরবিনটা তুলে ধোয়ার কুণ্ডলীটার দিকে দেখল সে। তারপর বলল, এটা তো কুয়াশাও নয়। ঝড়ও নয়!’
তাহলে কি?”
‘সেটাই তো প্রশ্ন। রাডাররূমে ফোন কর, ওখানে কিছু ধরা পড়েছে কিনা। কুইক।’
ইয়েস, ক্যাপ্টেন রিসিভার তুলল সে ব্রিজে গিয়ে।
হ্যালো, রাডাররূম? দিস ইজ মৃধা। বলুন?
‘পুবদিকে কুয়াশার মত কি একটা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে ক্রমশ আমাদের পথের দিকে। খেতে পাচ্ছেন?’
| ‘দেখেছি, স্যার। অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি। আমিই আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। জাহাজের স্পীড কমাতে হবে, স্যার। একেবারে অর্ধেক পর্যন্ত নামাতে হবে। তাহলে ওটা আমাদের আগেই পথ থেকে সরে যাবে।
ঠিক তো?’ “জ্বি, স্যার। কিন্তু কি ওটা?’
ঠিক বলতে পারছিনে। কুয়াশাও হতে পারে। তবে মনে হচ্ছে, কাছে-পিঠে কোন আইল্যান্ডে আগ্নেয়গিরিতে বিৰ্কোরণ ঘটেছে, তারই ধোয়া আসছে।’
কিন্তু কাছে তো কোন আইল্যাণ্ড নেই! সবচেয়ে কাছের আইল্যাও তো। ম্যাকি। সে তো প্রায় একশ মাইল দূরে। তাছাড়া ধোয়া এভাবে দিগন্তের দিকে আসবে কেন? উপরের দিকে যাবে।
তাই তো, স্যার। তাহলে কাছেই হয়ত সমুদ্রতলে কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে বা আগ্নেয়গিরির অগ্নদগার হচ্ছে।’
তা হতে পারে। স্যার, জাহাজের গতি কমিয়ে দিতে বলুন। জলদি, স্যার।
কুয়াশা-২৮
‘দিচ্ছি। আপনিও লক্ষ্য রাখবেন।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল মৃধা।
ক্যাপ্টেন হাফিজ এতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে মৃধার ফোন শেষ করার অপেক্ষা করছিল।
তাকে রাডার অফিসারের মন্তব্য জানাল মৃধা।
ক্যাপ্টেন হাফিজ সঙ্গে সঙ্গে এঞ্জিনরামকে স্পীড কমাবার নির্দেশ জারি করল । কিন্তু স্পীড কমানোটা ভাল হল কিনা সে সম্পর্কে তার মনে খটকা রয়ে গেল এবং কাজটা যে ভুল হয়েছিল তা পরে সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। রাডার :
অফিসার সোবহানও পরে তার নির্বুদ্ধিতার জন্যে বিবেকের দংশন ভোগ করেছে ।
ক্যাপ্টেন হাফিজের ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেকেণ্ড অফিসার রসুল আমিন ততক্ষণে এসে গেছে। কিন্তু এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন হাফিজ ব্রিজ ছেড়ে যাওয়া সমীচীন বিবেচনা করল না। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে লক্ষ্য রেখে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে রইল সে। সেকেণ্ড অফিসার রইল ব্রিজে।
সিগারেট ধরিয়ে পাঁচয়ারি করতে লাগল মৃধা।
কুয়াশার বা ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল এবং ক্রমেই তা. জাহাজটার দিকে এগিয়ে আসছিল।
আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ সেটা যেন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এল। বাতাসে কেমন যেন একটা দম আটকানো ভাব। কেমন যেন পোড়া পোড়া একটা গন্ধ। কাঁদুনে গ্যাস ফাটলে যে রকম গন্ধ বেরোয় অনেকটা সেই রকম গন্ধ।
আর দু’তিন মিনিট পরেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা জাহাজটাকে ঘিরে ধরবে। অস্থির হয়ে উঠল ক্যাপ্টেন হাফিজ। এই মুহূর্তে ডিসিশন নিতে হবে। তার সিদ্ধান্তের উপর জাহাজুের এতগুলো প্রাণীর জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিটাও তো নতুন। বারো বছরের সামুদ্রিক জীবনে এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি সে কোনদিন।– ব্রিজ থেকে সেকেণ্ড অফিসার রসুল বলল, ক্যাপ্টেন, উই আর ইন গ্রেড ডেঞ্জার।’
“ইয়েস, বাট…। রসুল, এঞ্জিনরুমকে নির্দেশ দাও ইমার্জেন্সি স্পীড দেবার জন্যে। কুইক।’ .
পাশেই বোসান দীপেন বড়ুয়া দাঁড়িয়েছিল। সে ক্যাপ্টেনের নির্দেশ নিয়ে ছুটে চলল এঞ্জিনরূমে।
মৃধা, ফোনে রেডিও-রূমকে বল এস. ও. এস. পাঠাতে। মৃধা, ফোনে রেডিও-রূমকে নির্দেশ দিল ।
এস. এস, তিতাসার ডিউটিরত কর্মচারী ছাড়া সকলেই তখন এসে দাঁড়িয়েছে ব্রিজের কাছে। •
সকলেরই চেহারায় ভয়ের ছায়া পড়েছে। ধোয়ার দানবটা মৃত্যুর মত নির্ভুল
ভলিউম-১০
বাহু মেলে জাহাজটাকে অক্টোপাশের মত গ্রাস করতে আসছে। অনেকে ভয়ে কাঁপছে। শুধু ওদিকের তিনজন খালাসি সব বিপদ-আপদকে তুচ্ছ করে ফজরের নামাজ পড়ছে। তাদের তিনজনকে দেখে ক্যাপ্টেন হাফিজ যেন শক্তি ফিরে পেল।
সে ধীরে ধীরে বলল, লাইফ-বোটগুলো খুলে ফেল।
একজন নাবিক হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, আঁই আর বুঝি বাইচলাম না। গজব আসি পইচ্ছে।’
সত্যি গজব এসে পড়েছে। লাইফবোটগুলো নামানোর সময় পাওয়া গেল । কুয়াশার কুণ্ডলীটা জাহাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। খুকখুক করে কাশছে সবাই। শ্বাস নিতে পারছে না কেউ। বিষাক্ত গ্যাস নাকে ঢুকছে নিঃশ্বাসের সঙ্গে।
নামাজীদের একজন সেজদা থেকে আর উঠতে পারল না। দুজন কষ্টে সূষ্টে উঠল। কিন্তু বুক চেপে ধরে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। | সারেং মালে মোহাম্মদ চোখ-মুখ উল্টে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল। ক্যাপ্টেন হাফিজের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু দম বন্ধ করে সে এগিয়ে গেল ওদের সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু দু’পায়ের বেশি এগোতে পারল না। মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল সে-ও।
মৃধা টলতে টলতে বলল, ‘রসুল ভাই, গ্যাস..উহ্, বুকের ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে।’
কিন্তু রসুল তার কথা শুনতে পেল না। সে তখন বুক চেপে ধরে ছটফট করছে।
কিছুক্ষণ পরেই এস. এস. তিতাসার প্রত্যেকটি আরোহী চেতনা হারাল। রেডিও অপারেটর ইসহাক মোলা অর্ধসমাপ্ত এস, ও. এস., পাঠিয়ে লুটিয়ে পড়ল । রূমের মেঝেতে।।
| চট্টগ্রাম বন্দরের রেডিও-রূমের অপারেটর দাদ আলী চমকে উঠল। হের্ড ফোন খুলে রেখে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার সরিয়ে পাশের রূমে এস, ও. এস. অফিসার আতাউল্লাহর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ।
আতাউল্লাহ মুখ তুলতেই সে বলল, ‘এস. ও. এস,স্যার।’ ‘এস. ও. এস.!’ চমকে উঠল আতাউল্লাহ।
হ্যাঁ, স্যার। এস. এস. তিতাসা থেকে এসেছে। ল্যাটিচ্যুড়-লংগিচ্যুড দিয়ে শুধু বিপদটুকুই কোনরকমে উচ্চারণ করতে পেরেছে।’
‘লিখে নিয়েছেন, ল্যাটিচুড লংগিচ্যুড?”
হ্যাঁ, স্যার।’
আর কোন কথা না বলে আতাউল্লাহ রিসিভার তুলল। ডায়াল করে অপেক্ষা করতে লাগল।
‘এয়ারপোর্ট এক্সচেঞ্জ?’ কুয়াশা-২৮
ইয়েস।’ ‘পুট মি টু এস. ও. এস. রূম প্লীজ। কুইক।
এস. ও. এস. রূমের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হতেই খবরটা জানাল আতাউল্লাহ। শেষটায় যোগ দিল, ‘আপনারা কি কোন সাহায্য করতে পারবেন?
অবশ্যই। আমাদের ইমার্জেন্সি হেলিকপ্টার রেডি আছে! মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রওনা দেবে। আমরাও পেয়েছি এস, ও. এস.।’
ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার রেখে দিল আতাউল্লাহ। তারপর অপারেটরকে বলল, ‘আপনি যান, অন্য কোন মেসেজ আসে কিনা আমাকে জানান।
বেরিয়ে গেল রেডিও অপারেটর।
মিনিট পাঁচেক পরে আবার ফোন করল এয়ারপোর্ট এস, ও, এস, রূমে। সেখান থেকে জানানো হল, হেলিকপ্টার ইতিমধ্যেই রওয়ানা দিয়েছে।
একটু পরেই রেড়িও অপারেটর আতাউল্লাহর রূমে ঢুকে বলল, “আরও একটা মেসেজ এসেছে স্যার, এস.এস. অলরা নামের একটা জাহাজ থেকে। তারা বলছে, তারা এস, এস, তিতাসার এস, ও, এস, পেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। জাহাজটা নাকি তিতাসার দশ মাইলের মধ্যেই ছিল।’
আতাউল্লাহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভাল হল, তার মানে, ওরা হেলিকপ্টারের আগেই পৌঁছুবে।’
দুই
পাশে রাখা একটা মানচিত্রের দিকে বারবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম।
পাশে উপবিষ্ট কু সাহেব আলী বলল, ‘ফোর্স আমাদের ঠিকই আছে, ক্যাপ্টেন। তবে এস. ও. এস, পজিশনে পৌঁছুতে আমাদের কম করেও দুঘন্টা লাগবে।
| তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে কি হয়, কে জানে, ক্যাপ্টেন মন্তব্য, করল।
সাহেব আলী কোন উত্তর দিল না। দেবার কিছু ছিলও না।
হেলিকপ্টার তখন বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে চলছে। নিচের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম। নিচে অথৈ নীল দরিয়া।
ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম বলল, “মেসেজ একটা পাঠিয়ে দাও। দেখ, কোন জবাব আসে কিনা।
ইয়ারফোন অ্যাডজাস্ট করে নব টিপল ক্রু সাহেব আলী। ‘রেসকিউ হেলিকপ্টার পি-৩৪৩। রেসকিউ হেলিকপ্টার পি-২৪৩। হ্যালো
ভলিউম-১০
এস. এস. তিতাসা। হ্যালো এস, এস, তিতাসা।
‘ হ্যালো রেসকিউ হেলিকপ্টার পি-৩৪৩ এ. এস. অলরা ফিলিপিনো লাইনার থেকে বলছি। আমরা এস, ও. এস. পজিশন থেকে বলছি। আবার বলছি। এস. এস, অলরা ফিলিপিনো লাইনার থেকে বলছি। আমরা এস. ও, এস, পজিশন থেকে বলছি। এস. এস. তিতাসা পাকিস্তানী ক্ল্যানশিপের এস, ও. এস, পেয়ে আমরা এসেছিলাম। কিন্তু জাহাজটার কোন চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না।
“কোন চিহ্ন পাচ্ছেন না। বিস্ময় প্রকাশ করল সাহেব আলী।
।’
সন্ধান চালিয়ে যান। চালাচ্ছি।’ ধন্যবাদ।’ সাহেব আলী নব অফ করে ক্যাপ্টেনকে বলল, “ঠিক বুঝতে পারছিনে, এস, এস. তিতাসার নাকি কোন পাত্তাই নেই। ফিলিপিনো লাইনার অলরা এস, ও. এস. মেসেজ পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে। সার্চ করছে ওরা।’
‘ম কি!’ বিস্ময় প্রকাশ করল ক্যাপ্টেন, ঝড় নেই, কোন গোলয়োগ নেই। অথচ জাহাজটার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ তো বড় আজব ব্যাপার! অলরাকে বল সার্চ চালিয়ে যেতে।’
বলেছি।’ আরও একঘন্টা পরে রেসকিউ হেলিকপ্টার এস, ও. এস. পজিশনে পৌঁছল।
উদ্বিগ্ন সাহেব আলী. ও ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম দুজনই দেখল, মহাসাগরের বুকে দুটো নয় মাত্র একটা জাহাজ ভাসছে।
ক্যাপ্টেন দূরবীন দিয়ে দেখল জাহাজটার গায়ে লেখা আছে ‘এস. এস. অলরা। ফিলিপাইনের একটা পতাকা উড়ছে সামুদ্রিক হাওয়ায়।
জাহাজটার খুব কাছে চলে গেল ক্যাপ্টেন তার রেসকিউ হেলিকপ্টার নিয়ে।
তার চোখে পড়ল অলরার ব্রিজ থেকে সঙ্কেত দেওয়া হচ্ছে। সে কুকে বলল, অলরা কি যেন বলতে চাইছে। কনট্যাক্ট কর।’
কনট্যাক্ট করল সাহেব আলী।
অলরা বলল, ‘দেড়ঘন্টা ধরে আমরা তিতাসার খোঁজ করে ব্যর্থ হয়েছি। তিতাসার কোন চিহ্নই নেই। এতটুকু ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত কোথাও আমরা দেখতে
পাইনি। মনে হচ্ছে পুরো জাহাজটাই ডুবে গেছে।’
| ‘কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি! কোন মৃতদেহ বা কাপড়চোপড়, কাঠের টুকরো বা অন্য কিছু?
‘কিন্তু না। তিতাসা নামে এখানে যে একটা জাহাজ ছিল তা-ই মনে হয় না।’
কু ক্যাপ্টেন অলরার কথার পুনরাবৃত্তি করল। কুয়াশা-২৮
অলরা আবার বলল, ‘আমরা কি সার্চ চালিয়ে যাব, না নিজেদের পথে চলে যাব?’
ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম সাহেব আলীকে বলল, ওদেরকে যেতে বল। আমরা কিছুক্ষণ বরং খোঁজ করে দেখি।’
ক্যাপ্টেন তার হেলিকপ্টারটা অনেকটা নিচে নামিয়ে এনে ক্রুকে বলল, “দেখ কোন ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় কিনা।’
একটু পরেই অলরায় গতি সঞ্চারিত হল।
আরও ঘন্টাখানেক ব্যর্থ অনুসন্ধান চালিয়ে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ও সাহেব আলী। ফিরে এল।
চব্বিশ ঘন্টা পরে।
মি. সিম্পসন জরুরি তাগাদা দিয়ে ফোন করল শহীদকে। শহীদ বলল, কি ব্যাপার, মি. সিম্পসন?’
ভয়ঙ্কর ব্যাপার! জলদি চলে এস।’ ‘কি, শুনিই না হয় একটু। “আরে না, এখুনি চলে এস। এলেই জানতে পারবে।’ “আচ্ছা, আসছি।’ রিসিভার রেখে দিল শহীদ।
কামাল সোফায় বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছিল আর দূরালাপনির একপ্রান্তের আলাপ শুনছিল। সে প্রশ্ন করল, কি হল আবার মি. সিম্পসনের?”
কি জানি, বললেন না তো। শুধু তার অফিসে যাবার জন্যে তাড়া দিলেন।
‘এখুনি যাবি?’ *, হ্যাঁ। কাপড়টা পাল্টে আসছি। তুই যাবি?
চল। মি. সিম্পসন যখন ডেকে পাঠিয়েছেন তখন কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই।
মিনিট বিশেক পরে শহীদের গাড়ি মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে থামল। শহীদ গাড়ি থেকে নেমেই থমকে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি সামনের গাড়িগুলোর দিকে।
কামাল বলল, থমকে দাঁড়ালি যে বড়?”
‘দেখেছিস গাড়িগুলো? দুটো আম্পালা। একটা বেন্টলি আর দ্যাখ একটা জোডিয়াক। যেন গাড়ি-নক্ষত্রের মেলা বসেছে মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে। নিশ্চয়ই অনেক রথী-মহারথী ভদ্রলোককে ঘিরে রয়েছেন।’
‘। তা এসব সপ্তরথীদের ভিড় ঠেলে পৌঁছুতে পারবি তো মি. সিম্পসনের কাছে?
. “নিশ্চয়ই। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে, সপ্তরথীদের প্রয়োজনেই ডাকা হয়েছে * আমাকে।
১২
• ভলিউম-১০
|
:: পা এগিয়ে গিয়ে গs, তুই মি. সিম্পসদেখবি । তারপ
‘বেশ তো, বাছা। ওই আনন্দেই এগিয়ে যাও। গাড়ি তো দেখলি, তবু দাঁড়িয়ে আছিস কেন হাঁ করে?’
হ্যাঁ, চল।’
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে শহীদ বলল, কামালু, সামনের আম্পালায় কালো যামার্কা এক ড্রাইভার বসে আছে। তুই মি. সিম্পসনের রূমের ভিতরে না ঢুকে দোতলার বারান্দায় গিয়ে লোকটার চেহারাটা ভাল করে দেখবি । তারপর বেরিয়ে গাড়িটা নিয়ে চলে যাবি। আমি ফেরার পথে সপ্তরথীদেরই কারও ঘাড়ে সওয়ার
হব।
“
। কামাল বিরক্ত হয়ে বলল, “ওরকম ষণ্ডাকিসিম লোক তো ডজন ডজন আছে।
তাহলে দেখছি সবগুলোর পেছনেই লাগতে হবে।’
| দরকার হলে লাগতে হবে বৈকি? শোন, লোকটা আমাদের দুজনকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছে।’
‘আচ্ছা । তাই হবে।’
একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে সালাম ঠুকে বলল, “মি, সিম্পসন আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন, শহীদ সাহেব।
“ওখানে আর কেউ আছেন?
হ্যাঁ, স্যার, পাঁচ-ছয়জন ভদ্রলোক আছেন। তাঁরাও আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
‘চল, যাচ্ছি।’
কনস্টেবলটার পিছনে পিছনে এগিয়ে গেল শহীদ। কামাল চলে গেল সিঁড়ির দিকে।
| দোতলার বারান্দার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাল কামাল। সামনের আম্পালার বাইরে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্ম পরা দু’জন সোফার সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছিল। তাদের একজন শহীদের বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেল। লোকটা লম্বা-* চওড়া, নিকষকালো। কু-কাট চুল। কপালটা চওড়া। নাকটা থ্যাবড়া। উঁচু চোয়াল। সব মিলিয়ে একটা হিংস্র চেহারা। কামালের মনে হল, তার মত তিনটে লোককে একত্রে ঘায়েল করার মত শক্তি আছে লোকটার দেহে। যে সোফারটার সঙ্গে সে গল্প করছিল তাকে ওই দৈত্যটার তুলনায় বামুন বলে মনে হচ্ছিল।
জানালার কাছ থেকে সরে এল কামাল। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়ির। কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আড়চোখে সে দেখল, ষণ্ডাকার সোফারটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার, দিকে চেয়ে আছে।
ওদিকে শহীদ মি. সিম্পসনের রূমে ঢুকতেই মি. সিম্পসন তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘আরে এস এস। এরা সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁর টেবিলের চারদিকে উপবিষ্ট কয়েকজন ভদ্রলোকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ কুয়াশা-২৮
করলেন। হ্যাঁ, আগে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন মি. শহীদ খান। যার কথা আপনাদের বলেছি। আর এঁরা হলেন, মি. খোদাদাদ চৌধুরী, মি. রহিম বখশ, মি. কমরুদ্দিন থানভী, মি. সাজেদুল হক আর মি. বাহরামভাই লাণ্ডিকোটালওয়ালা।’’ * নিকটবর্তী চারজনের সঙ্গে করমর্দন করল শহীদ। তারপর এগিয়ে গেল মি. বাহরামভাই লাঞ্চিকোটালওয়ালার দিকে। তার পাশের খালি চেয়ারটাই শহীদের লক্ষ্য। অস্বাভাবিক মোটা। বিশাল ভুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। শহীদ তার কষ্টকর প্রয়াস দেখে দ্রুত বলল, “থাক, বসুন আপনি। তারপর মনে মনে বলল, ভাগ্যিস কামাল ভিতরে ঢোকেনি। সে ভদ্রলোকের নাম আর বপু দেখে নির্ঘাৎ হেসে ফেলত।
তার পাশের চেয়ারটা অধিকার করল শহীদ। সে দেখল, মি. সিম্পসনের অতিথিরা সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
শহীদ বলল, কি ব্যাপার, মি. সিম্পসন?’
মি, সিম্পসন কিছু বলার আগেই থানভী সাহেব স্টেট এক্সপ্রেসের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন শহীদের দিকে। শহীদ একটা সিগারেট তুলে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। আড়চোখে সমবেত ভদ্রলোকদের একবার দেখে নিল। সবচাইতে ইম্প্রেসিভ চেহারা হল থানভী সাহেবের। টকটকে ফর্সা রং। চমৎকার স্বাস্থ্য। মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সব মিলিয়ে অভিজাত ও ইনটেলেকচুয়্যাল চেহারা ভদ্রলোকের।।
| থানভী সাহেব নিজেও একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘মি, সিম্পসন, প্লীজ স্টার্ট।।
মি. সিম্পসন বললেন, এঁরা হলেন সবাই পাকিস্তান লাইনার্স প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক। গত দশ দিনের মধ্যে এদের দুটো জাহাজ অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছে ভারত মহাসাগরে। এরা এ ব্যাপারে একটা
তদন্ত চালাতে চান। তাই তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছেন।’
থানভী সাহেব ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, “আমাদের বন্ধু খোদাদাদ চৌধুরী, আর রহিম বখশ সাহেব বললেন, আপনি নাকি খুব উমদা ডিটেকটিভ আছেন। ওনারা তো এখানকার আদমী। আপনাকে আচ্ছা করকে মালুম আছেন। আমি তো কারাচীতে থাকে। তা আপনার উপর ওনাদের বহুত বিশ্বাস আছে। আপনি যদি হামাদের সাহায্য করেন, আপনার ফিস যা হোয় উসকা ডবল দেয়েগা।’
ব্যাপারটা সবিস্তারে না জেনে তো কিছুই বলতে পারছিনে, থানভী সাহেব।’
‘থানভী ভাইয়া, আপনিই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন। বাহরামভাই লাণ্ডিকোটালওয়ালার বিশাল বপু থেকে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
শহীদ আবার মনে মনে বলল, ভাগ্যিস কামাল শেষপর্যন্ত এখানে ঢোকেনি। থানভী সাহেব তার সুটকেস থেকে একটা মানচিত্র বের করলেন। শহীদ
ভলিউম-১০
১৪।
দেখল, ওটা ভারত মহাসাগরের মানচিত্র। সেটা সামনে রেখে থানভী সাহেব বললেন, ‘গভর্নমেন্ট বন্যা দুর্গতদের জন্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু গম কিনেছিলেন। দুটো জাহাজে করে তার কিছু ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। জাহাজ। দুটোই ছিল পাকিস্তানী। আমাদের লাইনারের জাহাজ। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দুটো জাহাজই ভারত মহাসাগরে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। কোন চিহ্নমাত্র পাওয়া যায়নি। জাহাজ দুটোরও না, আরোহীদেরও না। ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহও দেখা যায়নি।’
আশ্চর্য ব্যাপার! | আশ্চর্য হবার ঘটনা তো বটেই। অথচ যে দুদিনে জাহাজ দুটো ডুবেছে তার একদিনও কোন ঝড় হয়নি, কুয়াশা পর্যন্ত ছিল না।’
কবে ঘটেছে এই ঘটনা?
একটা ঘটেছে গতকাল,’ মানচিত্রে লালকালি-চিহ্নিত এটা বৃত্ত দেখিয়ে মি. থানভী বললেন। এখান থেকে গায়েব হয়েছে গতকাল এস. এস. তিতাসা।।
‘কোন এস, এ. এস. পঠিয়েছিল?’
হ্যাঁ, একটা অসমাপ্ত এস. ও. এস. পাঠিয়েছিল তিতাসা। এস. এস. সিলেট, মানে আগের জাহাজটাও একটা অসমাপ্ত এস. ও. এস, পাঠিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই রেসকিউ হেলিকপ্টার গিয়েছিল। কিন্তু কোনটারই সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিতাসার এস. ও, এস, অলরা নামে ফিলিপাইনের একটা লাইনার পেয়েছিল। জাহাজটা কাছেই ছিল। কিন্তু তারাও তল্লাশি করে ব্যর্থ হয়েছে। আবার সিলেটের এস. ও. এস, পেয়েছিল ডায়মণ্ড নেকলেস নামে তাইওয়ানের একটা জাহাজ। তারাও অনেক খোঁজ করেছে। এস, এস, সিলেটের কোন চিহ্নই তারা পায়নি।
‘এস, এস, সিলেটের দুর্ঘটনা ঘটেছে কবে?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
দিন দশেক আগে।’ ‘একই জায়গায়?’
না, দুটো ঘটনা ঘটে প্রায় পঁচাত্তর মাইল দূরে। জাহাজ দুটোর গতিপথ আলাদা ছিল,’ থানভী সাহেব মানচিত্রে অন্য একটা লালবৃত্ত দেখিয়ে বললেন।
এস. এস. সিলেট খোয়া গেছে এই জায়গাটাতে।
জায়গাটা চট্টগ্রাম থেকে কতদূর?
‘প্রায় দুশো মাইল হবে। দশ মুটে যদি জাহাজ এগোয় তাহলেও চট্টগ্রাম পৌঁছুতে পনেরো ঘন্টা লাগবার কথা।
কাছে-পিঠে কোন দ্বীপ আছে?”
‘প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে ম্যাকি নামে ছোট একটা দ্বীপ আছে। দুর্গম পাহাড়ী দ্বীপ। এই যে দেখুন। পাঁচ বর্গমাইল হবে বড়জোর দ্বীপটা। মানচিত্রে দ্বীপটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন থানভী সাহেব। কুয়াশা-২৮
‘জাহাজ দুটো কি কারণে গায়েব হল সেটাই আপনারা জানতে চান। প্রাকৃতিক কোন বিপর্যয়ে অথবা মানুষের সৃষ্ট কোন বিপর্যয়ে এটা ঘটেছে কিনা তাই তো আপনারা জানতে চাইছেন?’
রহিম বখশ ঢাকার লোক। সে বলল, হাঁচা, ছহীদ ছায়েব? এর লাইগ্যাই আপনারে কই আপনে একটু দেহেন ব্যাপারটা কি। টাকার কথা ভাইবেন না। আপনার ছরীল সোনা দিয়া বাইন্দা দিমু।’ | শহীদ বলল, না, টাকার কথা ভাবছি না। কিভাবে এগুনো যায় তাই ভাবছি।’
• রহিম বখশ খুশি হয়ে বলল, আরে আগেই কইছি না থানভী ছাব, ছহীদ ছাবই পারব । দেহেন না অহন থাইকাই উনি ভাববার লাগছে।’
‘ থানভী সাহেবের চেহারায় বিরক্তির আভাস দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘এদিকে আমাদের আর একটা জাহাজ আগামী সপ্তাহে সিডনী ছাড়বে। আমরা সেটা অনুমোদন করতে পারছিনে। অথচ কি করব ঠিক বুঝে উঠতেও পারছিনে।
শহীদের মুখটা উজ্জ্বল হল। সে বলল, আমি এই রকম একটা সুযোগ পাওয়া যায় কিনা তাই ভাবছিলাম। খুব ভাল হল মি. থানভী, ওই জাহাজটা ঠিক সময়েই ছাড়তে হবে। ওই জাহাজে আমার থাকবার ব্যবস্থা করুন। তবে জাহাজের কর্মচারী হিসেবে থাকতে হবে আমাকে। আমার এক বন্ধুও আমার সাথে থাকবেন। বাদবাকি আমার উপর ছেড়ে দিন।’
রহিম বখশ বলল, “আরে হালায় আপনেরে কাপ্তান বানাইয়া দিমু।’
‘না না, ক্যাপ্টেন নয়। অন্য কিছু। খালাসী হলেই ভাল হয়। মি. থানভী, ডু ইউ অ্যাপ্রুভ মাই প্ল্যান?”
থানভী সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন, আপনার উপর এই দায়িত্ব চাপাবার জন্যেই যখন আমরা মনস্থির করেছি তখন আপনার যে-কোন সিদ্ধান্ত মেনে
নেব।’
বাহরামভাই লাঞ্চিকোটালওয়ালা বললেন, ‘আরে ভেই, দেখো হামারা সবকুচ বরবাদ না হোয়।’
শহীদ সবিনয়ে বলল, “উওতো আপকা অদৃষ্ট হ্যায়। হাম তো নিমিত্ত মাত্র। তবে হাম কোশেশুকা ত্রুটি নেহি করেগা। মি, থানভী, আপনি তাহলে পরশুর মধ্যে যাতে আমরা সিডনী পৌঁছতে পারি সে ব্যবস্থা করুন। আর জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করুন। তবে তার কাছে পরিচয় দেবেন না আমাদের। আমার বন্ধুটাকে আপ্রেন্টিস আর আমাকে খালাসীর চাকরি দেবার । ব্যবস্থা করুন।’
ঠিক আছে, তাই হবে। আমি আজকেই সমস্ত ব্যবস্থা করছি।’
ভলিউম-১০
১৬
বাহরামভাই লাণ্ডিকোটায়ওয়ালা বললেন, ‘আরে ভাই থানভী, জাহাজমে মেরা ভি এক আদমী কো ভেজ দেনা।।
থানভী সাহেব বিরক্তি চেপে বললেন, আচ্ছা, সে হবে।’
তিন
জাহাজটার নাম এস. এস. মহাযান। এই জাহাজে করেই পাকিস্তানে অস্ট্রেলীয় গমের তৃতীয় চালান পাঠানো হবে। গম বোঝাই যেদিন শেষ হল শহীদ ও কামাল, ‘ সেইদিনই পৌঁছুল সিডনী। এর আগেই থানভী সাহেব শহীদ ও কামালের নিয়োগ
সম্পর্কিত চিঠিপত্র ক্যাপ্টেনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
একসঙ্গে সিডনী পৌঁছুলেও জাহাজে কামাল গেল আগে। পরের দিন অর্থাৎ জাহাজ ছাড়বার দিন গিয়ে হাজির হল শহীদ।
তোবড়ানো গাল, হাসি হাসি মুখ, বেঁটে, ঈষৎ কুঁজো একজন খালাসী অভ্যর্থনা জানাল শহীদকে। তার হাতে সুটকেস আর একটা বেডরোল দেখেই সে বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল যে চাকরিতে যোগ দিতে এসেছে লোকটা। ‘
লোকটা খৈনি টিপতে টিপতে বলল, নতুন লোক বুঝি?’ শহীদ বলল, তা একরকম, ভাই। ক্যাপ্টেন সাহেব কোথায়? চল তোমাকে নিয়ে যাই।’ ক্যাপ্টেন ব্রিজে ছিলেন। সেখানে নিয়ে গেল তাকে লোকটা।
স্যার, নতুন লোক এসেছে একজন।
ক্যাপ্টেন মুখ তুলে শহীদকে দেখে বললেন, ‘কি নাম? রাজা মিয়া, না কালু মিয়া?’
কালু মিয়া, স্যার,’ সালাম ঠুকে বলল শহীদ। ‘দেখি কাগজপত্র?’
শহীদ পকেট থেকে পাসপোর্ট, নিয়োগপত্র, হেলথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি বের করে দিল।
ক্যাপ্টেন সেগুলো পরীক্ষা করে বললেন, ঠিক আছে।’ ব্যাপারী, তুমি কালু মিয়াকে তোমাদের মেস-ডেকে নিয়ে যাও । ওখানে বাঙ্ক খালি আছে না?’
| ‘আছে স্যার, দুটো।’
ভালই হল। আরও একজন নতুন খালাসী আসবে। তাকেও তোমরা ওখানেই থাকতে দিয়ো হে।
‘আচ্ছা, স্যার।’
কামাল কখন এসে দাঁড়িয়েছিল খেয়াল করেনি শহীদ। সে ক্যাপ্টেনকে বলল, স্যার, অফিসার্স রেস্ট-ডেকটা একেবারে নোংরা হয়ে রয়েছে। এই লোকটা তো ২–কুয়াশা-২৮
১৭
•”। জাহাজের কাজ শেখবার আগে ঝাড়া-মমাছাটাই বরং শিখুক। আমাদের গ. ৬টা ওকে বলুন না পরিষ্কার করে দিয়ে যাক।’
কানে বললেন, “আচ্ছা, সে হবে। লোকটা তো সবেমাত্র এল। আগে (সটল করতে দিন।’
শহীদ কামালের দিকে একটা কটাক্ষ হানল। যাও হে, ব্যাপারী।’
খালাসীদের ডেক-মেসে পৌঁছার আগে আরও একটা ধাক্কা সামলাতে হল শহীদকে। তালগাছের মত লম্বা কুচকুচে কালো কদাকার চেহারার একটা লোক বীরদর্পে এগিয়ে আসছিল। তাকে দেখে শহীদের সঙ্গী মাথা নুইয়ে সালাম করে হাসি হাসি মুখে শহীদকে দেখিয়ে বলল, স্যার, আমাদের নতুন খালাসী কালু মিয়া।’
| লোকটা শহীদকে আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, তা কালু মিয়াই হও আর ধলু মিয়াই হও কাজে ফাঁকি দিলে চলবে না। আমি তোমাদের বোসান আমীরগুল। যা বলব সঙ্গে সঙ্গে করবে। না হলে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব।’
শহীদ ঢোক গেলবার ভঙ্গি করে বলল, আচ্ছা।’ | বোসান আর দাঁড়াল না। জুতোর শব্দ তুলে ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল।
ডেক-মেসে ঢুকে মালপত্র রেখে সস্তা দামের সিগারেট ধরাল শহীদ। সঙ্গীর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল । সে সিগারেট না নিয়ে বলল, আমি ভাই
খৈনি খাই।’
‘তোমার নামটা না কি? | মমতাজ ব্যাপারী । ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করেন তো, তাই আমাকে ব্যাপারী বলেন, হাসি হাসি মুখ করে বলল লোকটা।
শহীদ বলল, একটু চা খাওয়া দরকার।’ তাহলে চল ক্যান্টিনে যাই?’ চল।’
চা খেয়ে ওরা ডেকে পৌঁছুতেই থমকে দাঁড়াল শহীদ। ভূত দেখার মত চমকে উঠল সে। ঠিক তারই মত একটা সুটকেস আর বেডরোল নিয়ে ডেকের উপর দাঁড়িয়ে আছে মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে দেখা বাহরামভাই লাণ্ডিকোটালওয়ালার আম্পালার সেই ভয়াল-দর্শন সোফার (আম্পালাটা যে লাণ্ডিকোটালওয়ালার তা পরে জানতে পেরেছিল শহীদ)। তার মনে পড়ল,
• ভদ্রলোক তারও একজন লোককে এই জাহাজে চাকরি দেবার কথা শহীদের সামনেই বলেছিলেন। | ক্যাপ্টেন তার কাগজ-পত্র দেখে মমতাজ ব্যাপারীকে ডেকে বললেন, ‘তুমি
বলেছিলে, তোমাদের মেসে আর একটা বা খালি আছে?” ১৮
ভলিউম-১০
হ্যাঁ, স্যার। ‘এই লোকটাকে নিয়ে যাও।
মমতাজ নবাগত খালাসীকে নিয়ে চলে গেল। লোকটা শহীদের দিকে ফিরেও তাকাল না।
ক্যাপ্টেন ষণ্ডাকার লোকটার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
শহীদ চলে গেল পুরো জাহাজটা চক্কর মেরে দেখে আসতে।
কামাল এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেনের পাশে। সে বলল, ‘ক্যাপ্টেন সাহেব, ইনিই আমাদের রাজা সাহেব নাকি?’
মাথা নেড়ে ক্যাপ্টেন গোলজার আহমদ বললেন, ক্যাণ্ডেলওয়ালার লোক।’
ক্যাণ্ডেলওয়ালা আবার কে? কামাল জানতে চাইল।
কি যেন নাম ঠিক মনে থাকে না। ক্যালেণ্ডারওয়ালাও হতে পারে। মালিকদের একজনের নাম।…
আমার তো মনে হয়, ভদ্রলোকের নাম লাণ্ডিকোটালওয়ালা। | হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই রকমই নাম। অতবড় নাম কি মনে থাকে? দেখেছেন বোধ হয় ভদ্রলোককে, যেমন নামের বহর তেমন দেহের। অথচ কথা শুনলে মনে হয় চি চি করছে।’ হাসলেন ক্যাপ্টেন।
‘আচ্ছা ক্যাপ্টেন সাহেব, আপনাদের মালিকরা লোক কেমন? ‘মানে?’ মানে, ওরা লোক কেমন?
মালিকরা মালিকের মতই। তবে জাহাজের ব্যবসা মোটেও জানে না। জানে শুধু নিজেদের লোক ঢোকাতে, অভিজ্ঞতা থাকুক আর না থাকুক। এই যেমন। থানভী পাঠিয়েছে কালু মিয়াকে, ক্যাণ্ডেলওয়ালা-পাঠিয়েছে ওই গুণ্ডাটাকে।
থানভী তো আমাকেও পাঠিয়েছেন,’ কামাল নির্লজ্জের মত বলল।
ক্যাপ্টেন লজ্জা পেয়ে বললেন, আপনি তো অ্যাপ্রেন্টিস। আপনার কথা; আলাদা। অ্যাপ্রেন্টিসের প্রভিশন সরু জাহাজেই আছে। থাকাও উচিত।’ . একটা সিগারেট ধরিয়ে কামাল বলল, আচ্ছা, আগের যে জাহাজ দুটো সমুদ্রে
খোয়া গেছে সে দুটো কি এই কোম্পানিরই?’
‘একটা আমাদের কোম্পানির। এস. এস. তিতাসা। অন্যটা একটা সিলেটি কোম্পানির।’
‘এবারও কি তেমন কোন আশঙ্কা আছে?
কি করে বলি, বলুন। ভাবতে গেলে তো হাত-পা পেটের মধ্যে সেধিয়ে যায়। সমুদ্রের চাকরি। জানটা হাতে নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু উপায় কি, বলুন?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ক্যাপ্টেন, আজ হোক কাল হোক, রওনা কুয়াশা-২৮
= rE
তো আমাদের দিতেই হবে। বিপদের আশঙ্কা থাকবেই। তাই বলে তো আর সিডনীতে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করতে পারি না।’
তা ঠিক,’ স্বীকার করল কামাল।
পুরো জাহাজটা চক্কর দিয়ে দেখে শহীদ তার মেস-ডেকের কাছে পৌঁছুতেই একটা কুদ্ধ গর্জন কানে এল তার। তাদের মেসের দরজার ঠিক সামনেই কয়েকজন খালাসী জটলা পাকাচ্ছে। সেখান থেকেই আসছে ক্রুদ্ধ গর্জন। দ্রুত
এগিয়ে গেল শহীদ।
জটলার ফাঁক দিয়ে সে দেখল, বিশালদেহী কদাকার বোসান আমীরগুল আর ষণ্ডাকার নবাগত খালাসী পরস্পরের দিকে হিংস্র দৃষ্টি মেলে গর্জন করছে। বুনো শুয়োরের মত ফুঁসছে ওরা, নাকের বাঁশি দু’জনেরই ফুলে ফুলে উঠছে।
অশ্রাব্য ভাষায় তথা নাবিকসুলভ ভাষায় দুজনেরই সমান,দখল দেখে অবাক হল শহীদ।
আশেপাশে যে খালাসীরা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই উপভোগ করছে দৃশ্যটা। তাদের চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা। শহীদ ভিড় ঠেলে দু’জনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল।
শহীদ ষণ্ডাকার লোকটাকে বলল, আরে ভাই সাহেব, করছেন কি? উনি যে আমাদের অফিঙ্গার!’ : শহীদের অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপে নবাগত খালাসী যেন আরও খেপে গেল। সে তার রক্ত-রাঙা চোখ দুটো পাকিয়ে বলল, “আরে এ আবার মামদোবাজি করতে এল কে? ভাগ হিয়াসে।’শহীদকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল লোকটা।
কিন্তু একচুলও নড়ল না শহীদ। ক্যাপ্টেন ইতিমধ্যেই খবর পেয়েছিলেন। তিনি দৌড়ে এলেন। “কি ব্যাপার, কালু মিয়া? নতুন চাকরি নিয়েই ঝগড়া বাধিয়েছ? “জ্বি, আমি না, স্যার।’
একজন খালাসীর কাছে ঘটনাটা জানা গেল। নতুন লোকটা–রাজা মিয়া না। কি নাম, বোসান তাকে তুমি’ বলায় চটে গেছে।
. ক্যাপ্টেন রাজা মিয়ার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন কি যে অকারণ ঝামেলা বাধছে বারবার! থাকগে, যা হবার হয়েছে। মি: বোসান, জাহাজ এখুনি ছাড়বে। আপনি দয়া করে ব্রিজে যান। রাজা মিয়া, আধঘন্টা পরে আপনার অফিসার্স মেস-ডেকে ডিউটি, এখন যান। খাওয়া-দাওয়া করে নিন।’
বোসান আপত্তি করে বলল, কিন্তু? ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এখন জাহাজ ছাড়বার সময়। ওসব পরে হবে।’ রাজা মিয়ার দিকে আর একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল বোসান ।
ভলিউম-১০
রাজা মিয়াও ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করল তাকে।
যাও যে যার কাজে। জাহাজ ছাড়বে এখন, ক্যাপ্টেন হুকুম দিলেন।
ক্যাপ্টেন চলে যেতেই মমতাজ একটু বিরস গলায় বলল, দিলে তো ক্যাপ্টেন মজাটা মাটি করে। আমি আর সোনাউল্লাহ পাঁচ টাকা বাজি ধরেছিলাম। পাঁচটা টাকা পেতাম আমি। মারামারি লাগলে রাজা মিয়া নিশ্চয়ই জিতত।’
সোনাউল্লাহ বলল, “বোসানও তো জোয়ান কম না। সে-ও তো জিততে পারত?’
শহীদ রাজা মিয়াকে বলল, ‘চলুন, এবার খেয়ে নিয়ে ডিউটিতে যাই।’
তাকে আমল না দিয়ে রাজা মিয়া দু’হাতে মমতাজ আর সোনাউল্লার ঘাড় ধরে বলল, ‘খুব তো বাজি ধরেছিলে ব্যাটা ছুঁচোরা। আয় লড়বি তোরা? যে জিতবে তাকে পাঁচ টাকা দেব।’
সোনাউল্লাহ ও মমতাজ দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে গেল ।
রাজা মিয়া দু’জনকেই গলা ধাক্কা দিয়ে একগাল হেসে শহীদকে বলল, তুমি, আর ভাই আমাকে “আপনি, আজ্ঞে কোরো না। তবে হ্যাঁ, অফিসার বলে আমায় অবজ্ঞা করলে সইতে পারব না। তোমরা তো আমাদের লোক। কি বলছ তোমরা?’ উপস্থিত খালাসীদের উদ্দেশ্যে বলল সে।
| কেউ কোন জবাব দিল না, সম্ভবত রাজা মিয়া কোন্ জবাবে তুষ্ট হবে তা বুঝতে না পারাতেই।
রাজা মিয়া তাদের দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সুটকেস আর । বেডরোলটা তুলে নিল। মমতাজকে বলল, “চল, কোথায় যেতে হবে?’
মমতাজ ঘাড় ডলতে ডলতে তাকে মেস-ডেকের ভিতরে নিয়ে একটা বাঙ্ক দেখিয়ে বলল, এই যে, এই বাঙ্কটা তোমার।’
শহীদও ভিতরে ঢুকল। মমতাজ হাসি হাসি মুখে তার উদ্দেশ্যে বলল, রাজা ভাই আমাদের কাছেই থাকবে। ভালই হল।
ব্যঙ্গ করল রাজা মিয়া, ‘ভালটা কি হল? ভালটা টের পাবি যখন তোর ওই হাসি-হাসি মুখটা কাদো কাঁদো করে দেব।’
একটা ঢোক গিলল মমতাজ।। রাজা মিয়া বলল, এই বাঙ্ক দুটোতে কারা থাকে? . শহীদ বলল, এটাতে আমি আর ওটাতে মমতাজ।’
রাজা মিয়া তার জন্যে নির্ধারিত বাঙ্কটা আর এক নজর দেখে বলল, উঁহু। মমতাজ, তুমি এই বাঙ্কটাতে থাক। তোমারটাতে আমি থাকব।’
‘বেশ তো।’
সরাও এখান থেকে তোমার জিনিস-পত্র।’ মমতাজ নীরবে তার বিছানাটা গুটিয়ে সরিয়ে ফেলল। শহীদ ভাবছিল, রাজা
কুয়াশা-২৮
মিয়া বোর হয় এবার তার বিছানাটাও পেতে দেবার জন্য নির্দেশ দেবে। কিন্তু
অতটা বাড়াবাড়ি করল না রাজা মিয়া।
নিজেই নিজের বিছানাটা বাঙ্কে পেতে পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে গলায় পেঁচিয়ে সুটকেসের ভিতর থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করল। চোখের সামনে বোতলটা তুলে ধরে সে বলল, আর বেশি নেই। থাক, এটুকু পরে খাওয়া যাবে।’
| শহীদ একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে বসে রাজা মিয়ার কাণ্ড দেখছিল । প্যাকেটটা ছিল টেবিলের উপর। রাজা মিয়া ছোঁ মেরে প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে বলল, “ধোয়া ছাড়া দুনিয়াটাই ফানা।’ | শহীদ কোন কথা বলল না। মমতাজ তখন তার বিছানাটা পেতে রাজা মিয়ার । দখল করা বাঙ্কের পাশের দেয়াল থেকে দুটো আণ্ডার-ওয়াটার সুইমিং গিয়ার সরিয়ে নিজের বাঙ্কের দেয়ালে লটকাচ্ছিল।
রাজা মিয়া সিলিণ্ডার দুটো দেখে অবাক হয়ে বলল, “আরে, শশার মত ও দুটো আবার কি হে?’
রাজা মিয়ার জ্ঞানের বহর দেখে মমতাজ বোধ হয় একটু বিস্মিত হল। সে হেসে বলল, ওগুলোর মধ্যে অক্সিজেন আছে। আমার আবার সমুদ্রের নিচে নামবার খুব শখ। তাই মাঝে মাঝে ওগুলো নিয়ে সমুদ্রে নামি’। অনেক মজার মজার জিনিস দেখা যায় সমুদ্রের নিচে।’
রাজা মিয়া একটু খোশামোদের সুরে বলল, আমায় একদিন নামাবি, দোস্ত সমুদ্রের নিচে? আমারও খুব ইচ্ছা সমুদ্রের তলে কি আছে দেখবার ।
মমতাজ বলল, এখন তো আর হবে না! একটু পরেই ছেড়ে দেবে জাহাজ। চিটাগাং গিয়েই তোমাকে নিয়ে সমুদ্রের নিচে নামব।’
রাজা মিয়া খুশি হল এবং তার প্রমাণস্বরূপ মমতাজের কাঁধের উপর একটা প্রচণ্ড চাপড় মারল। মমতাজের দেহটা কুঁকড়ে গেলেও প্রভুভক্ত কুকুরের মত হাসি মুখ থেকে মুছে গেল না।
সিডনী ছাড়বার দু’দিন পরে ক্যাপ্টেন গোলজার ও বোসান আমীরগুল রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে আলাপ করছিলেন। একটু দূরে মমতাজ ও সোনাউল্লাহ ক্যাপস্টান-বারের দড়ি গুছিয়ে রাখছিল। উল্টোদিকের রেলিং-এর ধারে বসে ফিশ খেলছিল রাজা মিয়া ও শহীদ।
ক্যাপ্টেন বোসানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বুঝছ হে? এবারও কোন বিপদ দেখা দেবে বলে মনে হয় নাকি?”
ভলিউম-১০
বোন বলল, ঠিক বুঝতে পারছিনে। তবে নতুন ক্রুটাকে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।’
কার কথা বলছ? নতুন ক্রু তো বেশ কয়েকজন আছে। ওই গুণ্ডার মত লোকটা, না কালু মিয়া, না..?”
‘ওই গুণ্ডাটার কথাই বলছি। ওকে একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। তাছাড়া কালুটাও গুণ্ডার সাথে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। সেটাও সন্দেহজমক। ওকেও একবার বাজিয়ে দেখা উচিত। দরকার হলে টিজ করে ফাঁদে ফেলতে হবে। যাতে কোন বিপদ না ঘটাতে পারে।’
কিন্তু দেখ, গুণ্ডাটা আবার ক্যাণ্ডেলওয়ালার পেয়ারের লোক।’
তার প্রমাণ কি? একটা চিঠি বই-তো নয়? এমনও তো হতে পারে, লোকটা ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে এসেছে। ক্যান্ডেলওয়ালার আসল লোককে হয়ত গায়েব করে দিয়েছে। ক্যান্ডেলওয়ালা একটা গুণ্ডা পাঠাবে এটাও তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই না?’
হ্যাঁ, তা-ও অসম্ভব নয়, ক্যাপ্টেন চিন্তা করে বলল । সুতরাং আমি একটু বাজিয়ে দেখতে চাই।’
একজন খালাসী এসে বলল, ক্যাপ্টেন সাহেব, এঞ্জিনিয়ার সাহেব এঞ্জিন রূমে যেতে বলেছেন।’
ক্যাপ্টেন এঞ্জিনরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বোসান আমিরগুল একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরে-সুস্থে রাজা মিয়া ও শহীদের দিকে এগিয়ে গেল। ওরা একবার চোখ তুলে বোসানের দিকে তাকিয়ে খেলায় মন দিল। * আমীরগুল গম্ভীর মুখে রাজা মিয়াকে বলল, ‘রাজা মিয়া, দয়া করে একবার উঠতে হবে। অফিসারদের রেস্ট-ডেকটা পরিষ্কার করতে হবে।’
লাল চোখ দুটো আমীরগুলের মুখের দিকে তুলে রাজা মিয়া বলল, আমার এখন ডিউটি নেই।
আমীরগুল সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, নেই তো কি হয়েছে? আমি যদি বলি তাহলে করতেই হবে। আমার কথাই আইন। উঠে এস।’
ধীরে-সুস্থে তাসগুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল রাজা মিয়া। শহীদ মনে মনে প্রম শুনলেও নির্বিকার ভঙ্গিতে বোসান ও রাজা মিয়ার দিকে তাকাল । দুজনেরই চোখে-মুখে হিংস্রতার ছাপ।
বোসান বলল, ‘চল। কঠিন দৃষ্টিতে রাজা মিয়া বোসানের দিকে চেয়ে বলল, যদি না যাই? বোসান মুখ খিঁচিয়ে বলল, তোর বাবা যাবে, শালা।’
‘চোপরাও!’ গর্জন করে উঠল রাজা মিয়া।। কুয়াশা-২৮
শহীদ তাসগুলো গুছিয়ে নিয়ে সরে গেল। গোলমাল দেখে আরও কয়েকজন খালাসী এসে ভিড় করে দাঁড়াল। মমতাজ সোনাউল্লাকে বলল, “এইরে, লাগল বুঝি দুই সেগুন কাঠে লড়াই। ধরবি বাজি?’
সোনাউল্লা বলল, ‘বোসান শালাই জিতবে। দেখেছিস কেমন পেটা শরীর?
উঁহু, রাজা মিয়া জিতবে। শালার যেন লোহা দিয়ে গড়া শরীর। ‘পাঁচ টাকা বাজি।’ ‘ঠিক হ্যায়, পাঁচ টাকা।
ওদিকে তখন বোসান ও রাজা মিয়া গজরাচ্ছে। বোসান বলল, ‘বেয়াদবি করবি তো সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব।’
রাজা মিয়ার বাঁ হাতটা নড়ে উঠল। বোসানের টুপিটা খুলে অবহেলাভরে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিল রাজা মিয়া। সে বলল, যা যা, আগে টুপি নিয়ে আয়। তারপর কথা বলিস।।
অপমানে রাগে বোসান গর্জন করে উঠল, তবে রে…।’
রাজা মিয়ার চোয়াল বরাবর ঘুসি চালাল বোসান । মাথাটা সরিয়ে ফেলল রাজা মিয়া মুহূর্তের মধ্যে। ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল আমীরগুল।
মমতাজ চিৎকার করে উঠল, লাগা না একটা, রাজা মিয়া। | রাজা মিয়ার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতটা বোসানের চোয়ালের উপর গিয়ে পড়তেই আক’ করে একটা আর্তনাদ শোনা গেল।
আনন্দে মমতাজের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, সে হাততালি দিয়ে উঠল। আর শুকিয়ে গেল সোনাউল্লার মুখ।।
আমীরগুল আঘাতটা সামলে নিয়ে তার বাঁ হাতটা দিয়ে রাজা মিয়ার গলাটা চেপে ধরে ডান হাতটা দিয়ে বার কয়েক ঘুসি চালাল। কিন্তু রাজা মিয়া প্রত্যেকবারই মুখটা এমন দূরত্বে রাখল যে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না বোসান ।
বোসান একটু অসতর্ক হতেই রাজা মিয়া তার মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ধরে মোচড় দিল। অস্কুট আর্তনাদ করে উঠল বোন। এক ঝটকায় রাজা মিয়া বোসানের হাতটা গলা থেকে সরিয়ে তার চিবুকের তলায় হাত দিয়ে ধাক্কা মারল। . এক পা পিছনে সরে গেল আমীরগুল। তারপর মুখ খিঁচিয়ে আবার তেড়ে . এল। রাজা মিয়া প্রস্তুত ছিল। সে ক্ষিপ্র গতিতে বাঁ হাতে আমীরগুলের পেটে
একটা ঘুসি চালাল।
‘আক’ করে আর্তনাদ করে উঠল আমীরগুল । চেহারায় ফুটে উঠল যন্ত্রণার ছাপ। কিন্তু নিজেকে সামলাবার সময় পেল না সে। পরমুহূর্তেই তার চোয়ালে প্রচণ্ড
ভলিউম-১০
১০
একটা মুষ্ট্যাঘাত পড়ল। চারদিক অন্ধকার দেখতে লাগল আমীরগুল।
চিত হয়ে পড়ে গেল সে ডেকের উপর।
ক্যাপ্টেন গোলমালের খবর পেয়েছিলেন। তিনি এসে দেখলেন বেসান ডেকের উপর চিত হয়ে পড়ে আছে।। | বিস্ময়ে, রাগে ও বিরক্তিতে ক্যাপ্টেন ফেটে পড়লেন। রাজা মিয়া তখনও ফুসছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তাকেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, রাজা মিয়া, ব্যাপার কি? আমীরগুল পড়ে আছে কেন? কি হয়েছে ওর?’।
মমতাজ জবাব দিল, ‘পা পিছলে পড়ে গেছে, স্যার।’
হুঁ।’ ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। . . একটু পরেই উঠে বসল আমীরগুল। চোয়ালে হাত বুলোতে বুলোতে সে রাজা মিয়ার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
• ক্যাপ্টেন উপস্থিত সকলের দিকে একবার তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, রাজা মিয়া, কাজে যান। ডিউটি শুরু হয়েছে আপনার।’ * যাই, স্যার ।।
চল, আমীরগুল।’ চলুন, স্যার।’
ক্যাপ্টেনের পিছন পিছন অফিসারস রেস্ট-ডেকে চলে গেল আমীরগুল মাথা নত করে।
রাজা মিয়া বলল, বোসান সাহেব, আপনার টুপিটা তুলে নিয়ে গেলেন না?’ বোসান ফিরে তাকাল একবার তার দিকে। তার দৃষ্টিতে যেন আগুন জ্বলছে। মমতাজ সোনাউল্লাকে বলল, “দে টাকা। জিতেছি আমি।’ ব্যাজার মুখে পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দিল সোনাউল্লা।
মমতাজ হাসিমুখে রাজা মিয়াকে বলল, সাবাস! ওস্তাদ, বেড়ে দেখিয়েছ। লড়তে জান বটে।’
খোশাদীতে তেমন খুশি হল না রাজা মিয়া। সে বলল, “দেখ না, কেমন লোকটার বাড়াবাড়ি! কয় টাকাই বা বেতন দিবি? কিন্তু যেন একটা খাস চাকর পেয়েছে। সারাক্ষণই খালি কাজ-হ্যানো কর, ত্যানো কর। একমুহূর্ত বিশ্রাম নেই। বেশি টাকা দিতিস, তাহলে না হয় বুঝতাম। হুকুমের চাকর হয়ে থাকতাম।’
. ঠিক ওস্তাদ, ঠিক কথা বলেছ।’ ‘ একটু দূরে কামাল ও শহীদ দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে আলাপ করছিল। কামাল, শহীদকে জিজ্ঞেস করল, কিরে, সন্দেহ করবার মত কাউকে দেখলি?”
শহীদ বলল, ‘কাউকেই তো দেখছিনে।’
আমার কিন্তু রাজা মিয়া আর বোন দু’জনকেই সন্দেহ হয়। কুয়াশা-২৮
তাহলে ওরা মারামারি করবে কেন? “ওটা লোক দেখানো হতে পারে।’
তা অবশ্য হতে পারে,’শহীদ স্বীকার করল।
মমতাজ ও রাজা মিয়া, ওদের দিকে এগিয়ে আসায় ওরা প্রসঙ্গ পাল্টাল। কামাল বলল, কি রাজা মিয়া, জাহাজের চাকরি কেমন লাগে?’
রাজা মিয়ার জবাব তৈরি ছিল। সে নীরস কণ্ঠে বলল, “কেন স্যার, ভাল না লাগলে কি আমাকে অন্য চাকরি দেবেন?’
কামাল এমন জবাব আশা করেনি। সে থতমত খেয়ে বলল, না, তা আর কোত্থেকে দেব?”
তাহলে স্যার, এসব রসের আলাপ করতে আসবেন না।’ চলে গেল রাজা মিয়া। মমতাজ তাকে অনুসরণ করল। কামাল বলল, ‘লোকটা তো ভীষণ বেয়াড়া।’ শহীদ সায় দিল।
আস্ত একটা ক্রিমিন্যাল। আমার কিন্তু এই লোকটাকেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়,’ কামাল মন্তব্য করল।
কিন্তু বেয়াড়াপনা ছাড়া আর কোন সন্দেহজনক আচরণ লোকটা এখনও করেনি, শহীদ মৃদুকণ্ঠে বলল।
তবু খেয়াল রাখিস ওর দিকে। “আরে সে তো রাখছিই। কিন্তু তুই ওদিকে লক্ষ্য রাখবি।
আচ্ছা।’
পাঁচ
দশদিন নির্বেঘ্নে কেটে গেল। উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ঘটল না। রাজা মিয়াকে কেন্দ্র করেও কোন হাঙ্গামা হল না আর।
একাদশ দিন ভোরে হঠাৎ দক্ষিণ-পুবদিকে, ঘন একটা বিশাল কুয়াশার কুণ্ডলী দেখা দিল। কামালেরই চোখে পড়ল প্রথম কুণ্ডলীটা। সে দেখল একটা কুয়াশার মেঘ ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পুবদিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। সে দ্রুত ক্যাপ্টেনকে খবর দিল। ক্যাপ্টেন ডেকে ছুটলেন। কামালকে বললেন, রাডার রূমের সাথে কনট্যাক্ট করুন এখুনি।’•••সে দৌড়ে গেল রাডাররূমের দিকে। রাডার
অফিসার হায়দার কবীর রাডারে কুয়াশার কুণ্ডলীর গতি লক্ষ করছিল।
কামালকে হন্তদন্তভাবে গিয়ে দাঁড়াতে দেখেই হায়দার কবীর বলল, আমি দেখেছি কামাল সাহেব, আমি দেখেছি, ভয়ের কিছু নেই। এটা কুয়াশার কুণ্ডলী। লোকালি ফর্ম করেছে। এসব বেশিক্ষণ থাকে না। তবে জাহাজের ওর মধ্যে পড়ে
ভলিউম-১০
যাওয়া বিচিত্র নয়। স্পীড কমিয়ে দিতে হবে। আমি এঞ্জিনরুমকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি।’
‘ঠিক তো?’
হা হা, আপনি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছেন।’
• কিন্তু কামালের সন্দেহ দূর হল না। সে চিন্তিত মনে রাডাররূম থেকে বেরিয়ে দ্রুত চলে গেল শহীদের ডেক-মেসে। শহীদ সেখানে ছিল না। মমতাজ কামালকে দেখে হাসিমুখে বলল, স্যার যে! | শহী..মানে কালু মিয়া কোথায়!’ কামাল রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল।
মমতাজ বলল, “সে আর রাজা মিয়া তো আপনাদের ডেকেই। ব্যাপার কি, স্যার?
জবাব না দিয়েই বেরিয়ে এল কামাল। অফিসার্স মেস-ডেকে যাবার সময় তার খেয়াল হল জাহাজের গতি অনেক কমে গেছে।
দক্ষিণ-পুবদিকে তাকাল কামাল। কুয়াশা তখনও বেশ দূরে। ৫
অফিসার্স রেস্ট-ডেকেওঁ শহীদকে দেখতে পেল না কামাল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে ব্রিজে গিয়ে হাজির হল সে। জাহাজের প্রায় অর্ধেক যাত্রীই সেখানে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কুয়াশার কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আসছে।
বাতাসে একটা পোড়া গন্ধ ভেসে আসছিল। কুয়াশা কুণ্ডলিও ক্রমেই এগিয়ে আসছে জাহাজটার দিকে।
কামাল ভিড়ের মধ্যে শহীদকে দেখতে না পেয়ে এঞ্জিনরূমের দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ির মাথাতেই দেখা গেল শহীদ ও রাজা মিয়া হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসছে ।
. উপরে উঠে এসেই রাজা মিয়া রহস্যভরা কণ্ঠে বলল, “কি ব্যাপার, কামাল, আমি কি এসে গেছি?”
উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত কামাল থতমত খেয়ে রাজা মিয়ার মুখের দিকে তাকাল।
• শহীদ দ্রুত বলল, ওসব পরে হবে, কুয়াশা। এখন চল। অবস্থাটা দেখি।’ নিশ্চয়ই। এস কামাল।
স্বপ্নচালিতের মত শহীদ ও কুয়াশার পিছনে পিছনে এগোল কামাল। তখনও তার বিস্ময় কাটেনি।
ডেকের উপর আরোহীদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। সেখানে কেমন যেন দমবন্ধ করা হাওয়া। কেমন যেন পোড়া গন্ধ। ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল শহীদ, কামাল ও কুয়াশা। কুয়াশার কুণ্ডলীটা ততক্ষণে জাহাজের মধ্যে ঢুকে গেছে । খুকখুক করে কাশছে কয়েকজন।
ক্যাপ্টেন যেন কাকে জিজ্ঞেস করলেন, এস. ও. এস., পাঠাতে বলা হয়েছে? ‘পাঠানো হয়েছে এস, ও, এস., স্যার,’ একজন খালাসী জানাল। ধীরে ধীরে ডেকের ভিতরটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। কাশতে কাশতে
কুয়াশা-২৮
বুক চেপে ধরে বসে পড়ল কয়েকজন ক্রু ও অফিসার। দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেল দুজন। আমীরগুল সঙ্গা হারিয়ে পড়ে গেল ডেকের উপর ।। |. আল্লা আল’ করতে লাগল কয়েকজন ক্রু। কে একজন হাউমাউ করে কাঁদতে গিয়ে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে হাপাতে লাগল। একটু পবে শহীদও কাশতে লাগল। এঞ্জিনিয়ার জসিমুদ্দিন কাশতে কাশতে বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন। ক্যাপ্টেনের অবস্থাও তথৈবচ।
রাজা মিয়া কয়েক সেকেণ্ড তাদের অবস্থা দেখে দ্রুত তার ডেক-মেসের দিকে এগিয়ে গেল। তারও শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কুয়াশায় পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল
। অতিকষ্টে নিঃশ্বাস চেপে এগিয়ে গেল সে। মমতাজ ব্যাপারীর আণ্ডার-ওয়াটার সুইমিং গিয়ার খুলে ফেলল সে দেয়াল থেকে।
গিয়ারটা হাতে নিয়ে সে হ্যাঁণ্ডেলটা ঘুরিয়ে নাকের কাছে চেপে ধরল। অক্সিজেনে বুক ভরে শ্বাস নিল সে।
সিলিণ্ডারটা নাকে চেপে ধরে রেখেই সে বেরিয়ে এল। সমস্ত জাহাজে সে ছাড়া, আর কোন জনপ্রাণী আছে বলে মনে হল না তার। এখানে-সেখানে চিত হয়ে, উপুড় হয়ে পড়ে আছে খালাসী ও অফিসাররা। | প্রথমেই সে গেল শহীদের কাছে। সে সটান চিত হয়ে পড়ে ছিল। উঁচু হয়ে বসে নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল শ্বাস বইছে শহীদের। একটু দুরেই পড়েছিল। কামাল। রাজা মিয়া দেখল তারও শ্বাস-প্রশ্বাস যথারীতি বইছে।
আপন মনে বলল রাজা মিয়া–তাহলে এটা মৃত্যু-ফাঁদ নয়, অজ্ঞান করার একটা কৌশলমাত্র। মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। কিন্তু কুয়াশার আকারে এই ধরনের চেতনা-বিলোপকারী গ্যাস কারা ছাড়ছে? কেন ছাড়ছে? তাদের উদ্দেশ্যটা কি?
কথাটা ভাবতে ভাবতে কুয়াশা নিঃশব্দে ব্রিজের দিকে এগোল। এই বিশাল জাহাজটাতে এখন জীবিত এবং সচেতন বলতে গেলে সে একাই আছে । কিন্তু সত্যিই কি তাই? শত্রুপক্ষের কোন এজেন্ট কি জাহাজে নেই? আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সে কে? এতদিন ধরে প্রত্যেকটা লোকের গতিবিধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করেছে সে। সন্দেহ করার মত কাউকে পায়নি।
* ব্রিজের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। রেডিও-রূমের জানালার দিকে
• তাকাতেই চমকে উঠল সে। কে একজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার মতই বিষাক্ত গ্যাসের কুণ্ডলীকে প্রতারণা করেছে যে লোকটা সে কে? রেডিও-রূমের ভিতরে সে করছেই বা কি?
পা টিপে টিপে কুয়াশা রেডিও-রূমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটু আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে সে দেখল লোকটা আর কেউ নয়, খালাসী মমতাজ। তারও হাতে অক্সিজেন সিলিণ্ডার। আণ্ডার-ওয়াটার সুইমিং গিয়ারের রহস্যটা এতক্ষণে বুঝতে পারল কুয়াশা।
ভলিউম-১০
মমতাজ তখন বলে চলেছে, দিস ইজ এস, এস, ইয়েলো রিভার…দিস ইজ এস, এস, ইয়েলো রিভার। আমরা এস. এস. জলযানের এস. ও. এস. পেয়েছি । জলযান থেকে আমরা মাত্র দশ মাইলের মধ্যে আছি•••এবং জাহাজটার কাছে। এগিয়ে যাচ্ছি পূর্ণ গতিতে, কয়েকবার বলল সে কথাটা।
কুয়াশা আর দাঁড়াল না। সমস্ত চক্রান্ত এক নিমেষে বোঝা হয়ে গেছে তার। সে নিঃশব্দ দ্রুততায় চলে গেল তার ডেক-মেসে। বিষাক্ত গ্যাস তখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কুয়াশা মমতাজের বাঙ্কের কাছে যথাস্থানে অক্সিজেন সিলিণ্ডারটা ঝুলিয়ে রেখে একটা রিভলভার পকেটে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল একটা সাবমেরিন ধীরে ধীরে এস, এস. জলযানের পাশে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।
সেখানেই শুয়ে পড়ল কুয়াশা। তার কয়েক হাত দূরে দুজন খালাসী আর মেডিকেল অফিসার পড়ে আছে।
পরবতী ঘটনা প্রবাহের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল কুয়াশা। যেখানে সে শুয়ে আছে সাবমেরিনটা সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। একটা বিরাট ত্যাচ ধীরে ধীরে সাবমেরিন থেকে উঁচু হয়ে এস, এস, জলযানের ডেকের পাশে লাগল ।
: কে যেন মাইক্রোফোনে বলে উঠল, ‘একশন গ্রুপ ফোর। সবাই চলে এস জাহাজে।’
| হ্যাঁচ বেয়ে উদ্যত রিভলভার হাতে একজন লোক ডেকে নামল। শুধু মুখটা আর হাত ছাড়া তার সমস্তটা দেহই কালো পোশাকে মোড়া। আরও একজন তাকে অনুসরণ করল। তারপর আর একজন। কুয়াশা গুনে দেখল মোট দশজন নেমে এল ডেকে। প্রত্যেকের একই পোশাক। হাতে রিভলভার। কোমরের বেল্টে রিভলভারের খাপ ।
প্রথমে যে লোকটা নেমেছিল সম্ভবত সে-ই দলপতি। সে নির্দেশ দিল, জলদি সার্চ কর । কার কাছে কি অস্ত্র আছে বের করে নাও। কয়েকজন উপরে চলে যাও। মেস-ডেকে যাও দুজন।
বাকি লোকগুলো নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করল।
কুয়াশা অতি সন্তর্পণে পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে দড়ির স্থূপের তলায় ঢুকিয়ে দিল।
তন্নতন্ন করে সার্চ করল ওরা প্রত্যেকটা লোককে । দুজন ফিরে এসে বলল, সার্চ শেষ।।
দলপতি বলল, ‘নামটা বদলে ফেলা হচ্ছে তো? পনেরো মিনিট সময় পাবে।’ “ঠিক আছে। তাতেই হবে।’
রাডাররূম থেকে একজন বেরিয়ে বলল, ‘ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে একটা কুয়াশা-২৮
রেসকিউ হেলিকপ্টার আসছে।’
দলপতি ঘড়ি দেখে বলল, অসুবিধে হবে না। এস. এস. জলযানকে এস. এস, ইয়েলো রিভারে পরিণত করতে আর পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। তুমি যাও, সাবমেরিনটাকে ডুবে যেতে বল।’
লোকটা চলে গেল। একটু পরেই সাবমেরিনের হ্যাঁচটা নেমে গেল। কুয়াশার বুঝতে বাকি রইল যে, সাবমেরিনটা এখন ডুব দেবে এবং রেসকিউ হেলিকপ্টারস এসে এস. এস. জলযানের বদলে এস, এস, ইয়েলো রিভারকে দেখতে য়ে ফিরে যাবে।
একটু পরেই হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা গেল। এবং মিনিট পনেরো জাহাজটার চারদিকে ঘোরাঘুরি করে চলে গেল। | তার কাছেই দুজন লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা নিম্ন স্বরে আলাপ করছিল।
একজন বলল, “এবারও প্ল্যানটা ঠিক ঠিক লেগে গেল। এতটুকু গোলমাল হয়নি কোথাও। হাঃ হাঃ। লীডার সত্যি বুদ্ধিমান লোক।
| জাহাজের টারবাইনের স্পন্দনে আর কোন কথা শোনা গেল না ।
আরও কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল । খুব কাছেই পায়ের শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করল কুয়াশা। তিন চারজন লোক তাকে পাজাকোলা করে টেনে তুলল । অচেতনের ভান করে রইল কুয়াশা।
একজন বলল, ‘লোকটা তো ভারি কম না!’ ।
কুয়াশাকে বয়ে নিয়ে তারা কিছুক্ষণ পরে এক জায়গায় ধপাস করে ফেলে দিল। পাছায় প্রচণ্ড আঘাত লাগা সত্ত্বেও তার চোখ-মুখের কোন পরিবর্তন হল না।
দরজাটা বন্ধ করে দাও।’ একটা কণ্ঠস্বর কানে এল কুয়াশার। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
সাবধানে চোখ খুলল কুয়াশা। খালাসীদের একটা মেস-ডেকে পড়ে আছে সে। সেখানে আছে শহীদ, আমীরগুল ও ক্যাপ্টেন।
উহ্।’ কে যেন অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল। একটা পা এসে পড়ল কুয়াশার কোমরের উপর ।
কুয়াশা দেখল লোকটা হচ্ছে বোন আমীরগুল। সে চোখ মেলে বোকার মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।চুপ করেই রইল কুয়াশা।
আরও কিছুক্ষণ পরে আমীরগুল ধড়মড় করে উঠে বসল। কপালের রগ দুটো ধরে বসে রইল সে। কুয়াশাও উঠে বসল। ।
কুয়াশার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমীরগুল ।
একটু পরে শহীদ ও ক্যাপ্টেন নড়েচড়ে উঠে বসল। শহীদ মেস-ডেকের রুদ্ধদ্বারের দিকে চেয়ে কুয়াশাকে বলল, ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছিনে। আমরা
এখানে কেন?’
৩০
ভলিউম-১০
* আমীরগুল তার দিকে একবার তাকিয়ে কি যেন বলতে গিয়ে চুপ করে রইল।
কুয়াশা বলল, মনে হচ্ছে আমরা সবাই বন্দী।’
বন্দী?’ আমীরগুল এমনভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল যেন কথাটার মানে সে বুঝতে পারেনি।
দরজাটা খুলে গেল।
ওরা সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, মমতাজ ও সর্বাঙ্গে কালো পোশাক পরা দুজন লোক ভিতরে ঢুকছে। তাদের হাতে রিভলভার।
আমীরগুল উঠে দাঁড়াল। মমতাজ, ব্যাপার কি!’ তার কণ্ঠে বিস্ময় ।
জাহাজ এখন আমাদের দল অর্থাৎ মানবধ্বংসী মহাসভার হাতে চলে গেছে। তোমরা সবাই আমাদের বন্দী। তোমরা যদি কোন গোলমাল না করে আমাদের কথা মত চল তাহলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি অবাধ্য হও, আদেশ পালন না কর,’মমতাজ থামল। | তার কথা শেষ হল না। কুয়াশা বসে ছিল। সে হঠাৎ একলাফে মমতাজের পিছনের দাঁড়িয়ে তার ঘাড় চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আমার অনিচ্ছায়
আমি কারও আদেশ মানি না। ওই শয়তান দুটোকে বল রিভলভার নামাতে।’
ঘাড়ে তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও মমতাজের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে লোক দুটোকে রিভলভার নামাবার ইঙ্গিত করে বলল, আরে ছাড় ছাড়, করছ কি? তোমাকে তো আমার খুব পছন্দ। সেদিন তোমার বদৌলতে আমি পাঁচ টাকা আয় করেছি। আর তুমিই না বলেছিলে হাজার হাজার টাকা আয় করতে চাও? আমি তোমাকে সে সুযোগ করে দিতে পারি।’
ঠিক? ‘বিলকুল ঠিক।’
কথার কোন নড়চড় হবে না তো?’ ‘মোটেও না। তুমি দেখে নিয়ে। কিন্তু হ্যাঁ, গোলমাল পাকাবে না।’
‘বেশ, তাই হবে।’ কুয়াশা মমতাজকে ছেড়ে দিল। তবে কালু মিয়াকে যদি তোমাদের দলে নাও তাহলে ভালই হবে। রাজি আছ?’
‘এ তো খুব ভাল কথা।’
আমীরগুল কুয়াশার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল। তাকে আমল দিল না, কুয়াশা। | মমতাজ বলল, ‘তোমরা দুজন তাহলে আমাদের সাথে চলে এস। তোমাদের আর এই শুয়োরগুলোর সাথে থাকা নিরাপদ নয়।’
আমীরগুল ঠোঁট ককিয়ে বলল, তাই নিয়ে যাও। ওই নরক-কীটদের সঙ্গে থাকতে আমারও গা ঘিনঘিন করবে। কুয়াশা-২৮
কালো কাপড়-পরা লোক দুটো আমীরগুলের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
মমতাজের পিছনে পিছনে ওরা কয়েকজন বেরিয়ে যেতেই কালো পোশাকধারীদের একজন দরজাটা বন্ধ করে দিল। | একটা অফিসার্স কেবিনে ওদের দুজনকে ঢুকিয়ে দিয়ে মমতাজ বলল, আপাতত তোমরা এখানেই নিরাপদ থাকবে। আমাদের বন্দরে পৌঁছবার আগে এখান থেকে বের হয়ো না। কারণ তোমরা যে আমাদের পক্ষে তা আমাদের দলের সবাই জানে না। আমাদের আস্তানায় পৌঁছুলে তোমাদের পোশাক বদলে দেয়া হবে।’
কুয়াশা বলল, আমি কিন্তু তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।’ ‘এখন বোঝার দরকার নেই,’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেল মমভজ।
আমাদের খাবার দাবার ঠিক মত দিয়ো হে।’ ‘পাবে।’ দরজাটা বন্ধ করে দিল মমতাজ। কুয়াশা একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল।
শহীদ বলল, “কি বিশ্রী মেকআপ যে নিয়েছ তুমি! আমারও অনেক দিন লেগেছে তোমাকে চিনতে। আর এমন গোলমালইবা কেন করলে আমীরগুলের সাথে?
কুয়াশা বলল, ‘প্রথম প্রশ্নের জবাব হল, এই মানব-ধ্বংসী মহাসভার কয়েকজন কেষ্ট-বিষ্ট আমাকে চেনে। তাই সন্দেহ করার অবকাশটুকু রাখিনি। আর গোলমাল বাধিয়েছিলাম শুধুমাত্র শত্রু এজেন্টদের চোখে পড়বার জন্যে। তাতে তো সফল হয়েছিই।’
| মানব-ধ্বংসী মহাসভার আসল লক্ষ্যটা কি?’
‘ধ্বংস-য চালানো। এবং ধ্বংসের সুযোগ নিয়ে ধনসম্পদ লুট করা। দুনিয়া জোড়া এদের লোক আছে। পৃথিবী থেকে লোক কমানোও ওদের অন্যতম লক্ষ্য। ওরা মানবতার এক ভয়ঙ্কর শত্রু।’
ছয়
ভারত মহাসাগরেরই কোন এক দুর্গম দ্বীপে ওদের ঘাঁটি। ওদের দলে আছে কয়েকজন প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক। দলপতি নিজেও বিজ্ঞানী। সম্ভবত আমরা এখন ওদের ঘাটিতেই যাচ্ছি।’
| জলযানের মালিকদের সাথে এই দলটার কোন যোগাযোগ আছে?’ প্রশ্ন করল। শহীদ।
না। বাহরামভাই লাণ্ডিকোটালওয়ালা আমার পুরানো বন্ধু । তার বিশেষ
ভলিউম-১০
অনুরোধেই আমি দলটার পেছনে লেগেছি। ওরা অবশ্য আসল রহস্য কেউ জানে।
।’
কিন্তু জাহাজ দিয়ে ওরা কি করবে? বিশেষ করে আগের দুটো জাহাজও নিশ্চয়ই ওদের খপ্পরে পড়েছে।’
‘ঠিক বুঝতে পারছিনে। কিছু একটা উদ্দেশ্য তো আছেই। দেখাই যাক না । এখন তো আমাদের কিছু করার নেই। বাইরে বেরুনোও চলবে না। মমতাজ। নিশ্চয়ই দরজার কাছে প্রহরী রেখে গেছে। সুতরাং খাও-দাও ঘুমাও।’
| তৃতীয় দিনে হঠাৎ মানব-ধ্বংসী মহাসভার একজন লোক এসে বলল, চল । গ্রুপ কমাণ্ডার মমতাজউদ্দিন তোমাদেরকে ব্রিজে ডেকে পাঠিয়েছেন।
শহীদের খেয়াল হল জাহাজের গতি কমে গেছে। এঞ্জিনের আর্তনাদ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।
মমতাজ দাঁড়িয়েছিল ব্রিজে। সে বলল, ‘এসে গেছি আমরা। ওই যে দ্বীপটা । দেখতে পাচ্ছ ওটাই আমাদের হেড-কোয়ার্টার।।
অদূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল। উঁচু-নিচু পাহাড়ময় দ্বীপ আর দেখা যাচ্ছিল দুটো জাহাজ দ্বীপটার পাশে।
কুয়াশা কি যেন বলতে যাচ্ছিল। মমতাজের হুঙ্কার শুনে সে থেমে গেল। লোকটা চিৎকার করে সারেঙকে বলল, ‘সাবধান, সামনে খাড়ি আছে। পাশ কাটিয়ে যাও। ভুল করলে কিন্তু তোমার এক মাসের মাইনে কাটা যাবে। তাছাড়া আস্ত রাখবে না ডিরেক্টর।’
দ্বীপটার আরও অনেক কাছে এগিয়ে গেল জাহাজ। সমুদ্রের ভিতর থেকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। তার পাশেই নোঙর করা দুটো জাহাজ ও একটা সাবমেরিন।
মমতাজ সারেঙকে আদেশ দিল, আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ডাইনে রাখ। এন্টনী তুমি হেড-কোয়ার্টারে খবর দাও।’
সারেং-এর পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল সে রেডিও-রূমের দিকে চলে গেল। দ্বীপ থেকে প্রায় একশো গজ দূরে নোঙর ফেলল জাহাজ।
মিনিট পনেরো পরেই সগর্জনে একটা হেলিকপ্টার এগিয়ে আসতে লাগল এস, এস, জলযানের দিকে।
মমতাজ বলল, এই তো আমাদের ট্রান্সপোর্ট এসে গেছে।
হেলিকপ্টার থেকে দেখা গেল একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে। শহীদ বলল, ওটা বোধ হয় আগ্নেয়গিরি।’
হ্যাঁ, কিন্তু শুধু আগ্নেয়গিরিই নয় ওটা আরও কিছু। পরে দেখতে পাবে। আগে সরদারের সাথে আলাপ হোক। তোমাদের পরীক্ষা হোক,’ ককপিট থেকে মমতাজ বলল । ৩-কুয়াশা-২৮
কুয়াশা বিদ্রূপ করে বলল, ‘পরীক্ষায় ফেল করলে নিশ্চয়ই আমাদেরকে আগ্নেয়গিরির মধ্যে ফেলে দিতে কসুর করবে না।
মমতাজ মুখ ফিরিয়ে একগাল হাসি হেসে বলল, তুমি সত্যি রসিক লোক। তোমার রসবোধ আমার মতই মৃত্যুর সামনেও বেপরোয়া।’
| হেলিকপ্টারের ভিতরটা এমনিতেই গরম ছিল। ওরা যত এগোচ্ছিল গরম ততই বাড়ছিল। ঘেমে নেয়ে উঠল ওরা তিনজনই। আগ্নেয়গিরির চারদিক যখন হেলিকপ্টারটা চক্কর দিয়ে এল তখন শহীদের মনে হল যেন আর একটু পরে সেদ্ধ হয়ে যাবে সে।
পাহাড়ের পাদদেশে অসংখ্য বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছিল। হেলিকপ্টারটা নিচের দিকে নামতেই এখানে-সেখানে দুচারজন লোকও দেখা গেল।
মমতাজ বেরে জানালঃ ‘অ্যাকশন গ্রুপ-ফোরের কমাণ্ডার ডিরেক্টর অব অপারেশনের কাছে রিপোর্ট করতে নেমে আসছে, কয়েকবার বলল সে কথাটা।
ফাঁকা একটা জায়গায় ভূমি স্পর্শ করল হেলিকপ্টারটা। প্রথমে মাটিতে নামল মমতাজের রিভলভারধারী স্যাঙাত। তারপর শহীদ ও কুয়াশা। তার পিছনে মমতাজ। বাইরেও প্রচণ্ড গরম।
সামনে বিরাট একটা দালান দেখিয়ে মমতাজ বলল, এইটে হচ্ছে আমাদের হেড-কোয়ার্টার। এখানে গ্রীন-হাউজও আছে।’
শহীদ বলল, ‘এখানে যা গরম! গ্রীন-হাউজের মধ্যে গরম কেমন, কে জানে।
‘চীফ তোমাদের অপছন্দ করলে গরম কাকে বলে তা টের পাবে,’ নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল মমতাজ।
একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সেটা আপনা-আপনি খুলে গেল। শহীদ ও কামালকে মমতাজ নিয়ে হাজির করল একটা উঁচু যন্ত্রের সামনে। যন্ত্রটার উপরের দিকে একটা বিরাটাকার টেলিভিশন সেট। একটা নয় পাশাপাশি দুটো পর্দা। দুটো পর্দারই ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা গোলাকার হ্যাঁণ্ডেল বেরিয়ে আছে। নিচে অসংখ্য নব, বোতাম, মিটার আর ফুটকির মত কাঁচের লাল, নীল ও সবুজ
আলো।
মমতাজ বিজ্ঞের মত বলল, এইটাই হচ্ছে আমাদের চীফ।’ ‘এটাই চীফ, মানে? এগুলো তো দুটো ঢাউস টেলিভিশন সেট।’
আবার হাসি ফুটল মমতাজের মুখে। সে বলল, তোমরা আস্ত গণ্ডমূর্খ। এটা টেলিভিশন সেট নয়। এটা হল ঘৃণা আর নিষ্ঠুরতা নির্ণয়ক যন্ত্র। সাহসও নির্ণয় হয় এই যন্ত্রে। লড়াই-এর ক্ষমতাও। অর্থাৎ এটা হচ্ছে মন পরীক্ষার যন্ত্র।’
যন্ত্রটার সামনের একটা ক্রস চিহ্নিত জায়গা দেখিয়ে মমতাজ শহীদ ও কুয়াশাকে বলল, “ওখানটায় গিয়ে দাঁড়াও দুজন। যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও তাহলে
৩৪
উলিউম-১০,
আমাদের সভায় স্থান পাবে, ফেল করলে বুঝতেই পারছ।’
দুজন গিয়ে ক্রশ চিহ্নিত জায়গায় দাঁড়াল। সঙ্গের গার্ড দাঁড়াল ওদের পিছনে।
কুয়াশা শহীদের কানে কানে বলল, কায়মনোবাক্যে ওই যন্ত্রটাকে ঘৃণা কর । ভাবতে থাক যে, ওটা তুমি ভেঙে ফেলতে চাও। যন্ত্রটার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই যেন তোমার মনে জায়গা না পায়।
মমতাজ পরপর কয়েকটা বোতাম টিপতেই মন পরীক্ষা যন্ত্রের পরদা দুটোতে আলো জ্বলে উঠল। মাঝখানের হ্যাঁণ্ডেল দুটোও একটু একটু করে ঘুরতে লাগল।
শহীদ ও কুয়াশা মনে মনে বলতে লাগল, আমি ঘৃণা করি: ঘৃণা করি এই যন্ত্রটাকে। এটাকে আমি ভেঙে ফেলব। চূর্ণ-বিচূর্ণ করব।
| শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগল যন্ত্রের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পর ওদের দুজনেরই মনে হতে লাগল, ওদের মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি প্রকোষ্ঠে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা দানা বেঁধে উঠছে। সূচোল কোন বস্তু যেন ওদের মস্তিষ্কে অবিরাম খোঁচাচ্ছে।
মাথা ঘুরতে লাগল দুজনেরই। কুয়াশা নিজেকে সামলে নিল কিন্তু শহীদ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বলে উঠল, উঁহু, মাথায় কি যেন হল আমার!’
সুইচ অফ করে মমতাজ বলল, “ওটা কিছু নয়। এখুনি জানা যাবে কি হয়েছে । তোমাদের মাথায়। চীফ এখুনি জানিয়ে দেবে।
অন্য একটা সুইচ টিপল মমতাজ। লম্বা সরু একটা ফোকরের ভিতর থেকে একখণ্ড টাইপ করা কাগজ বেরিয়ে এল।
কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল মমতাজ।
কুয়াশা শহীদের কানে কানে বলল, চীফ যদি গোলমেলে রিপোর্ট দেয় তাহলে বদমাশটার হাড় ভেঙে দেবে। ওই পাহারাদারটাকে কায়দা করতে আমার বেগ পেতে হবে না। থাকুক না ওর হাতে রিভলভার। ‘ | মমতাজ হাসিতে বিগলিত হয়ে বলল, “খুব ভাল, মানে চমৎকার খারাপ রিপোর্ট দিয়েছে চীফ। দুজনেরই মনে চমৎকার নিষ্ঠুরতা আছে। লড়াই-এর শক্তিও চমৎকার, আর দরকার হলে দুজনই, ধংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে সক্ষম। মন খুলে তোমাদের দুজনকেই অভিনন্দন জানাচ্ছি। দুজনই অসম্মানের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। মানব-ধ্বংসী মহাসভায় দুজনকেই স্বাগতম জানাচ্ছি।’
কিন্তু মুখে যতটাই হাসি লেগে থাকুক না মমতাজের সে চীফের রিপোর্ট পুরোটাই ওদের বলেনি। রিপোর্টটাতে লাল কালিতে ক্যাপিটাল লেটারে যে সতর্কবাণী লেখা ছিল তাতে বলা হয়েছে, তাদের অভূতপূর্ব লড়াই-এর ক্ষমতাই শুধু নেই তাদের বুদ্ধিও প্রথম শ্রেণীর। যদি ওদের বুদ্ধি এই সংস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় তাহলে ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দুজনকে কড়া নজরে রাখতে হবে।’ কুয়াশা-২৮
‘তাহলে, তাহলে আমরা দুজনই পাস করেছি, আঁ মমতাজ মিয়া?’ কুয়াশা খুশির ভান করে বলল।
উঁহু, আমি এখন আর মমতাজ মিয়া নই। তোমাদের কমাণ্ডার। আমাকে কমাণ্ডার বলে ডাকতে হবে।’
“ঠিক আছে, কমাণ্ডার।’ রিপোর্টটা মমতাজ আবার মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে বলল, চল এখন।
এবারে কোথায়? ‘এখন আমরা ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে যাব।’
রামটা থেকে বেরিয়ে কয়েকটা দরজা পেরিয়ে আর একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।
দরজার উপর একটা সবুজ আলো জ্বলছিল। মমতাজ সেটা দেখে বলল, হ্যাঁ, আমরা ঢুকতে পারি। সবুজ বাতি জ্বলছে। শোন, ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেবে। ডিরেক্টর আবার গরম মোটেও সইতে পারেন না। ভিতরে অবশ্য গরম। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’
দরজার পাশে দুটো বোম দেখা যাচ্ছিল। তার একটা টিপল মমতাজ।
ভিতর থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এস। আর এসেই দরজাটা বন্ধ করে দাও।’
মমতাজ দরজাটা আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল। ভিতরে ঢুকল প্রথম সে-ই। তার পিছনে ঢুকল শহীদ ও কুয়াশা। মমতাজ দরজাটা বন্ধ করে দিল।
ভিতরটা চমৎকার একটা গ্রীন-হাউজ। ছোট বড় টবে অসংখ্য ছোট ছোট গাছ। মাঝারি আকারের দুচারটে আছে। দুজন লোক রয়েছে শুধু। একজন ওদের দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে বসে ফর্ক দিয়ে একটা টবের মাটি খোঁচাচ্ছে। অন্যজন একটা ট্রের উপর নানা আকার ও আকৃতির কয়েকটা কাঁচি, ফর্ক ও কান্তে নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চেহারা মঙ্গোলীয় ধাচের। বয়স বেশি হলে তিরিশ। মজবুত দেহ। কুটিল দৃষ্টি।
কতকগুলো গাছে ফুল ফুটেছে। মাঝখানে একটা মাঝারি আকারের গাছ। তাতে পাতা নেই একটাও। কিন্তু বটের ঝুড়ির মত অনেকগুলো বুড়ি নিচে নেমে এসেছে।
কুয়াশা, গাছটা দেখে চমকে উঠল। হাওয়া নেই গ্রীন-হাউজের মধ্যে কিন্তু বুড়ির ডগাগুলো লকলক করে নড়ছে।
সে শহীদের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এখানেও তো বেশ গরম আর আর্দ্র। অনেকটা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের মত আবহাওয়া।’
মমতাজ গ্রীনহাউজে ঢুকেই বদলে গেল। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে আনত হয়ে বলল, অ্যাকশন গ্রুপ ফোরের কমাণ্ডার মমতাজ উদ্দিন। আমার অভিযান সফল
ভলিউম-১০
হয়েছে, স্যার।
‘বেশ বেশ। আমি খুব খুশি হয়েছি,’ লোকটা মুখ না ফিরিয়েই বলল।
মমতাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা নীরবে গাছের পরিচর্যা করে যেতে লাগল।
| ‘আরও কিছু বলবে নাকি?’ একটু পরে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “দেখছ না ব্যস্ত আছি আমি?
নতুন দুই রং-রুটকে আপনার সাথে দেখা করাতে এনেছি, স্যার। দুজনেরই চমৎকার খারাপ রিপোর্ট পেয়েছি চীফের কাছ থেকে।
উঠে ঘুরে দাঁড়াল ডিরেক্টর। শহীদ ও কুয়াশাকে একনজর দেখে নিয়ে সে বলল, আমি দেখেছি রিপোর্ট। কি যেন নাম, কালু মিয়া আর রাজা মিয়া।
। চশমা-পরা লোকটা। বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেলেও শক্তসমর্থ দেহ। হাস্যময় দেবতাসদৃশ চেহারা। চোখ দুটো দিয়ে স্নেহ ঝরে পড়ছে।
অথচ শহীদ জানে, কুয়াশা জানে দুনিয়ার যত পাষণ্ড জন্মেছে এ লোকটা তাদেরই একজন।
• ডিরেক্টর এগিয়ে এসে হাতের ফর্কটা নাচাতে নাচাতে বলল, মনে হচ্ছে, রাজা মিয়া বিরল উদ্ভিদে অত্যন্ত উৎসাহী। তোমার কথাই ঠিক। এই উদ্ভিদগুলো সবই এনেছি দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল থেকে। এগুলো আমার অত্যন্ত গর্বের ধন।’
কুয়াশা ডিরেক্টরের কথা শুনছিল। হঠাৎ তার মনে হল তার গলাটা কি যেন পেঁচিয়ে ধরেছে। ঠাণ্ডা কি একটা বড়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল সে এবং দেখতে পেল একটা লতা তার গলায় ততক্ষণে পাক দিয়ে ফেলেছে। এক সেকেণ্ডও দেরি। করল না কুয়াশা। ডিরেক্টরের সহকারীর হাতে ধরা ট্রে-টা থেকে একটা কাস্তে নিয়ে এ্যাচ করে কেটে ফেলল সে লতাটা।
ডিরেক্টর অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। হতাশার ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।
গলা থেকে সাপের মত লতাটা এক টানে খুলে ফেলল শহীদ। গম্ভীর মুখে ডিরেক্টর সেটা হাতে নিয়ে বলল, “আহ্, এমন চমৎকার লতাটা তুমি শেষ করে ফেললে! ট্রেনভিলটাতে ফুল দেবার সময় এসেছিল। নষ্ট করে ফেললে তুমি!
কুয়াশা কাস্তেটা ট্রের উপর রেখে দিয়ে গলাটা ডলতে ডলতে বলল, কিন্তু ওটা তো আমায় খুন করতে যাচ্ছিল। ওটা তো মানুষখেকো লতা।’
ডিরেক্টরের চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলে উঠল। চেহারায় ফুটে উঠল নিষ্ঠুরতার ছাপ। কঠিন দৃষ্টিতে সে কুয়াশার দিকে তাকাল।
• ডিরেক্টরের সহকারী ট্রে নামিয়ে রেখে রিভলভার বের করে কুয়াশার দিকে তাক করে দাঁড়াল।
ভয়ে কাঁপতে লাগল মমতাজ উদ্দিন। কুয়াশা-২৮
.
6
০৭
ডিরেক্টর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, মাত্র একটা জিনিসই তোমাকে বাঁচিয়েছে। তোমার বিপদের উপলব্ধি চিন্তার চাইতেও দ্রুত। এমন লোক এর আগে আমি একজনও দেখিনি। মানব-ধ্বংসী-মহাসভার এই রকমই একজন লোক দরকার। আমি মত বদলাবার আগেই আমার সামনে থেকে দূর হও।
| মমতাজ, ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ স্যার, যাই স্যার। এই, জলদি চলে এস তোমরা।’
বাইরে গিয়ে মমতাজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওফ’ জাতীয় একটা শব্দ করে মমতাজ বলল, ওই বদমাশটা, মানে ডিরেক্টরের সেক্রেটারি জাকের আলী তোমাদেরকে খুন করত, আমাকেও করত।’
শহীদ ও কুয়াশা নীরব রইল । | মমতাজ শহীদ ও কুয়াশাকে কম্পিউটার-রূমের ভিতর দিয়ে অন্য একটা রূমে নিয়ে গেল। রূমটা বিরাট। সমস্ত রূম জুড়ে যন্ত্র আর যন্ত্র। খুব উঁচু রামটা। চারপাশেই ঝুলানো বারান্দা। সেখানেও নানারকম যন্ত্রপাতি। কয়েকজন লোক সেখানেও কাজ করছে। নিচেও কর্মব্যস্ততা, সবাই যেন খুব ব্যস্ত। রূমের প্রত্যেকটা লোকেরই সর্বাঙ্গে কালো পোশাক। কোমরের বেল্টের ধাপে রিভলভার। অনেকগুলো টেলিভিশন সেট রূমের মধ্যে। প্রত্যেকটার সামনে একজন করে বসা।
‘এটা হচ্ছে আমাদের কন্ট্রোলরূম।’
বাহ! অনেক যন্ত্রপাতি তো।’ বোকার ভান করে তারিফ করল কুয়াশা।
তুমি একটা আস্ত বুরবাক। কন্ট্রোলরূমে যন্ত্রপাতি থাকবে না তো কি থাকবে? এই দ্বীপে কোথায় কি হচ্ছে সব জানা যাচ্ছে এখান থেকে। ওই দেখ না টেলিভিশন সেটগুলো। কোথায় কি ঘটছে সবই ওর পর্দায় ধরা পড়ছে বি চল এবার।
‘এখন আবার কোথায়।’
আগ্নেয়গিরিতে। সেখানেই তো আসল জিনিস দেখতে পাবে হে।। | কন্ট্রোলরুম থেকে সরু প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে তারা একটা বিরাট লোহার গেটের সামনে দাঁড়াল।
রিভলভার হাতে একজুন প্রইরী সেখানে দাঁড়িয়ে। তাকে দরজা খোলার ইশারা করে মমতাজ পকেট থেকে দুটো ব্যাজ বের করে কুয়াশা ও শহীদকে দিয়ে বলল, “তোমাদের তো এখনও ইউনিফর্ম দেয়া হয়নি। তাই আমাদের লোকেরা তোমাদেরকে ক্রীতদাস বলে মনে করতে পারে। এই ব্যাজগুলো পরে নাও।
এগুলো হচ্ছে রেডিও অ্যাকটিভ ব্যাজ। তোমরা কোথায় আছ, আর কি অবস্থায়। আছ এই ব্যাজ পরা থাকলে তা আমরা বুঝতে পারব। বাহুতে পরে নাও ব্যাজগুলো। **
ভলিউম-১০
৩৮
শহীদ ও কুয়াশা ব্যাজ দুটো পরল। তাতে লেখা আছে এম. এম.।’ একটার নাম্বার তেরো, একটার চোদ্দ। কুয়াশা তেরো নাম্বারটা পরল।
বিশাল লোহার গেট খুলে ফেলেছিল প্রহরী। শহীদ ও কুয়াশা ভিতরে ঢুকল।
• গরম সেখানে আরও বেশি।
ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল ওরা। সেখানে এক এলাহী কাণ্ড-কারখানা চলছে। পানির ট্যাঙ্কের মত উঁচু বিরাট একটা টাওয়ার। তার মাথাটা সোজা। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বরাবর।
মোটা অত্যন্ত মজবুত লোহা দিয়ে তৈরি টাওয়ারটা। অসংখ্য লোক ভিতরে কাজ করছে। কয়েকজনের পরনে কালো পোশাক, হাতে রিভলভার। অন্য লোকগুলো নোংরা, ছেঁড়া কাপড় পরা। সবাই কর্মব্যস্ত। কুয়াশা একনজর দেখেই বঝতে পারল এই বিশালকায় যন্ত্রদানবটা হচ্ছে রকেট ও পারমাণবিক বোমা ঠেকাবার জন্য লেসার বীম প্রজেক্টর। আগ্নেয়গিরির তাপ-শক্তির সাহায্যে এটাকে কাজে লাগানো হবে।
উপরের দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে প্রজেক্টরটা। সিঁড়ি বেয়ে লোজন ওঠানামা করছে। লোহা পেটাবার শব্দ হচ্ছে। চিৎকার করে একে অন্যকে নানারকম নির্দেশ দিচ্ছে। অসংখ্য শক্তিশালী বিদ্যুৎ-বাতির আলোয় একদম চুড়া পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোন এক অদৃশ্য স্থান থেকে সামান্য ধোয়া বেরোলেও তা জ্বালামুখের ভিতরটাকে অন্ধকার করে রাখতে পারেনি। | শহীদ অনুমান করল, যন্ত্রের চূড়াটা একশো ফুট উঁচু তো হবেই। চতুষ্কোণ কাঠামোর প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে একটা গোল সিলিণ্ডার। তার নিচের তিনটে সরু সিলিণ্ডার একদম নিচের অন্ধকারে নেমে গেছে। উপরের সিলিণ্ডারের চারদিকে কয়েকটা মোটা গোল চাকা। যন্ত্রের ভগাটা অনেকটা গম্বুজের মত। মোট চারটে স্তর। প্রত্যেকটা স্তরের চারদিকে রেলিং-গেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাজ করছে লোকগুলো। রেলিং-এর বাইরেও কাজ করছে কয়েকজন। মোটা তারের কতকগুলো ঝুলন্ত গার্ডারে দাঁড়িয়েও কয়েকজন লোক একমনে কাজ করে চলেছে। কারও হাতে হাতুড়ি, কারও হাতে প্লয়ার্স, কারও হাতে রাদা।
নির্বোধের মত চেহারা করে কুয়াশা অনেকক্ষণ ভিতরটার সবকিছুই দেখে নিল। তারপর মমতাজকে বলল, কমাণ্ডার, এগুলো কি হচ্ছে এখানে? পানির ট্যাঙ্ক নাকি? এর সাথে আমাদের জাহাজ লুটের সম্পর্কটাই বা কি?’ | মমতাজ সমঝদারের মত ভঙ্গি করে বলল, সম্পর্কটা একেবারে জলের মত পরিষ্কার। আমরা এই দ্বীপটা দখল করে তার বাসিন্দাদের ক্রীতদাস বানিয়েছি। ওদের সংখ্যা হবে তিন-চার হাজার। ওদেরও তো খেতে দিতে হবে? তাই তো আমরা খাবার-ভর্তি জাহাজ লুটে নিয়ে আসি। তাছাড়া জাহাজের লোকগুলোকেও কাজে লাগাচ্ছি আমরা।’ কুয়াশা-২৮
৩৯
ই, মাথা নেড়ে কুয়াশা বলল। এবারে বুঝলাম। কিন্তু আগ্নেয়গিরির মাঝখানে পানির ট্যাঙ্ক কেন?’
‘তুমি সত্যি একটা গণ্ডমূর্খ। ওটা ট্যাঙ্ক নয়। অন্য জিনিস। কিন্তু কি ওটা তা বলা নিষেধ আছে। ডিরেক্টর ছাড়া নতুন লোকদের ওকথা বলার অধিকার কারও নেই।’
পিছনে গলার আওয়াজ পেয়ে ওরা তিনজনই ফিরে তাকাল।।
শহীদ চমকে উঠল। দুজন সঙ্গীনধারী প্রহরীর সঙ্গে এস. এস. জলযানের কয়েকজন অফিসার ও খালাসী আসছে। সকলের আগে কামাল, তার পিছনে ক্যাপ্টেন গোলজার আহমদ, বোসান আমীরগুল, এঞ্জিনিয়ার শেখ, খালাসী সোনাউল্লাহ, আরও অনেকে।
একগাল হাসি হেসে মমতাজ বলল, এই যে, আরও কয়েকজন ক্রীতদাস এসেছে। জলযানের লোক।
শহীদ ও কুয়াশাকে দেখে কামাল থমকে দাঁড়িয়েছিল। ওকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছিল। প্রহরী ছিল তার পাশেই, সে কামালের নিতম্বে একটা লাফি মেরে বলল, চল, দাঁড়ালি কেন?’
কামাল বোধ হয় আকস্মিক লাথি খাবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়ে গেল। কুয়াশার চোখ দুটো বাঘের মত জ্বলে উঠল। কিন্তু সে এগগাবার আগেই আর একটা লাথি হাঁকাল তাকে প্রহরী।
কুয়াশা ও শহীদ দুজনেই একসঙ্গে নড়ে উঠল। কিন্তু এগোবার আগেই নড়ে উঠল দীর্ঘদেহী কদাকার আমীরগুল। সে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রহরীর চোয়ালে প্রচণ্ড একটা ঘুসি চালাল এবং নাবিকসুলভ ভাষায় একটা শপথ বাক্য উচ্চারণ করল। প্রহরী এমন আকস্মিক আক্রমণ আশা করেনি। সে আক’ জাতীয় একটা শব্দ করে পড়ে গেল।
দ্বিতীয় প্রহরী চিৎকার করে উঠল, ‘খবরদার! রিভলভার বাগিয়ে এগিয়ে এল সে।
মমতাজের হাতেও রিভলভার ঝিলিক মারল। পড়ে যাওয়া প্রহরীও উঠে দাঁড়াল। সে-ও রিভলভার উদ্যত করল আমীরগুলের দিকে।
কুয়াশা আর শহীদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। কুয়াশা তার ডান পা’টা তুলে গোড়ালি চুলকাতে লাগল। কামাল ওদিকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অপাঙ্গে তার দিকে একবার তাকাল শহীদ। কামালের জন্য শহীদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। সে যে অসুস্থ ছিল তাতে কোনই সন্দেহ নেই। চোখ-মুখ বসে গেছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে।
অতগুলো রিভলভারের সামনেও বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমীরগুল। মমতাজ প্রহরীদের রিভলভার নামাতে ইঙ্গিত করে বলল, “আবে শালা
_ ভলিউম-১০
মাকরানী, বদমায়েশি করার আর জায়গা পাসনি! তোকে এখুনি শেষ করব।’ …
শহীদের মনে হল যেন আমীরপুলের কদাকার মুখে জ্যোতির্ময় হাসি ফুটে উঠল। . কুয়াশা আগেই তার পা নামিয়েছিল। মমতাজ তার হাতে নিজের রিভলভারটা দিয়ে বলল, ‘গুলি কর ওকে, রাজা মিয়া। এটাই হল তোমার উপর মহাসভার. এথম নির্দেশ।’ ।
রিভলভারটা হাতে নিয়ে কুয়াশা আমীরগুলের মুখের দিকে তাকাল। তার মুখটা ততক্ষণে ঘৃণায় আরও কদাকার হয়ে উঠেছে। সে বাঁ হাতের তর্জনী কুয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নরক-কীটের উপযুক্ত কাজই বটে।’
কুয়াশা এক সেকেণ্ড রিভলভারটা হাতের তালুর উপর রেখে ওজনটা অনুভব করে আমীরগুলের দিকে তাক করল।
তারপর ট্রিগার টিপল কুয়াশা। ক্লিক করে একটা শব্দ হল।
মমতাজের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, চমৎকার, চমৎকার! কিন্তু ভুলটা আমারই। গুলি ভরতে ভুলেই গিয়েছিলাম। যাকগে, আমীরগুলকে পরে গুলে খাওয়া যাবে। এখন থাক। গার্ড, ওদের কাজে নিয়ে যাও?’
আমীরগুল ঠোঁট বাঁকাল।। মমতাজ বলল, চল এখন। ‘এখন আবার কোথায়? ‘তোমাদের কোয়ার্টারে। এস আমার সঙ্গে। শহীদ কুয়াশার কানে কানে বলল, ‘গুলি যে ছিল না তা তুমি জানতে?”
‘ওজন নিয়েই বুঝেছিলাম, গুলি নেই। মমতাজ আমাকে পরীক্ষা করছে শুধু। গুলি থাকলে ওটা অবশ্য মমতাজের বুকেই ঢুকত। তারপর দেখা যেত।
কুয়াশা ও শহীদের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে এসে দুজনই ঘাম মুছল। কিন্তু বাইরেও প্রচণ্ড
গরম।
ঘর্মাক্ত কলেবরে দুজন শতচ্ছিন্ন প্যান্টপরা লোক দুটো লোহার বীম বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কুয়াশা তাদের দেখিয়ে মমতাজকে বলল, কমাণ্ডার, এই যে এমন গরমের মধ্যে লোকগুলোকে খাটাচ্ছ ওদের তো চেতনা হারিয়ে ফেলার কথা।
মমতাজ সায় দিয়ে বলল, তা তো বটেই। সেই জন্যেই দুঘন্টার বেশি একনাগাড়ে কাউকে কাজ করানো হয় না, একটা বন্ধ দরজা খুলে মমতাজ বলল। ‘ঢুকে যাও। এটাই গার্ডদের কোয়ার্টার।
শহীদ ও কুয়াশা ভিতরে ঢুকতেই ঠাণ্ডার একটা ঝলক ওদের গায়ে যেন প্রীতির পরশ বুলিয়ে দিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝকঝকে তকতকে রূমের মধ্যে
৪১
কুয়াশা-২৮
২
দুপাশে দুটো ডিভান।
মমতাজ বলল, “বিশ্রাম কর তোমরা। দু’ঘন্টা পরেই তোমাদের গার্ড দিতে যেতে হবে। গার্ডও আমরা দুঘন্টা পরপরই বদলাই। না হলে সব কটাই মারা যাবে। যাকগে, আমি চললাম। তবে হ্যাঁ, দুন্টার মধ্যে বাইরে যেয়ো না কিন্তু। খবরদার! আমরা সবাই এখন খুব ব্যস্ত আছি। কাল দুপুরের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। মধ্যে কোন উটকো ঝামেলা বাধালে ডিরেক্টর ক্ষমা করবে না।
‘ দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মমতাজ।
সাত মমতাজ বেরিয়ে যেতেই শহীদ বলল, কাল দুপুরের মধ্যে বদমাশগুলো কি ঘটাবে কে জানে। ভয়ানক কিছু যে করবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। কি যে করি কিছু বুঝে উঠতে পারছিনে।’
কুয়াশা রূমটার চারদিক দেখছিল। পিছনের দরজাটার দিকে তার নজর পড়তেই সে বলল, সামনের দরজায় নিশ্চয়ই পাহারা আছে। চল, এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সময় নষ্ট করা চলবে না। দরকার হলে ঝুঁকি নিতে হবে।’
দরজার উপর বড় বড় করে লেখা ছিল ‘হুকুম ছাড়া এই দরজা ব্যবহার করা নিষেধ। শহীদ লেখাটা দেখিয়ে বলল, ‘দেখেছ লেখাটা?’।
‘দেখেছি। তবু একবার চেষ্টা করতে হবে।’
দরজা খুলতেই দেখা গেল পাহাড়ী একটা সুড়ঙ্গ। মাথার উপর কিছুদূর পরপর উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে।
শহীদ বলল, মনে হচ্ছে কন্ট্রোলরুমের দিকে গেছে পথটা।’’ ‘চল দেখাই যাক। বিশ গজ দূরে সুড়ঙ্গটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা পথ ডাইনে, একটা বাঁয়ে।
দুজন সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। ‘শহীদ ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, কোনদিকে যেতে চাও?
উবু হয়ে বসে সুড়ঙ্গের ধুলো পরীক্ষা করল কুয়াশা। বলল, বাঁয়ের পথটাতেই চলাচলের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু কন্ট্রোলরূম থেকে দূরে যেতে পারব আমরা ওই পথেই। চল যাওয়া যাক।’
কিন্তু আর এগোতে পারল না ওরা। ওদের ঠিক তিনদিকে তিন সারি মোটা লোহার শিক কুঁড়ে উঠল মাটি থেকে।
শহীদ বলল, সর্বনাশ! আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি।’
ঘটনার আকস্মিকতায় কুয়াশাও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, তাই তো! এ তো মুক্তিলের ব্যাপার হল! আমার কাছে মিনি আল্টাসোনিক্স বাক্স আছে।
ভলিউম-১০
৪২
.
তাতে রড কেটে বেরিয়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু তারজন্যে যে সময় লাগবে তাতে লোকজন এসে পড়বে। তাছাড়া ওরা বুঝে ফেলবে আমাদের অভিসন্ধি।
তাহলে উপায়?’ ‘আমরা লাফ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারি। উঁহু, রডগুলোতে নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। দেখি রাখ।
| কোমরের বেল্ট থেকে সে একটা ছুরি বের করে সেটা খুলে রডের কাছে আস্তে করে ছুঁড়ে দিল। ছুরিটা দুটো রডে সটান লেগে গেল। জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা। অগ্নিস্ফুলিঙ্গও দেখা দিল। একটা পাথর তুলে ছুরিটার উপর ছুঁড়ে মারতেই সেটা মাটিতে পড়ে গেল।
কুয়াশা ছুরিটা বন্ধ করে কোমরের বেল্টে ঢোকাতে ঢোকাতে চিন্তাজড়িত কণ্ঠে বলল, সত্যি, আমরা ধরা পড়ে গেছি। বোধহয় কোনদিকেই যেতে পারব না আর।।
চিন্তা করতে লাগল সে। রডগুলোর উচ্চতা সমান নয়। মাঝখানেরটা সবচেয়ে বড়। সেটার দুপাশেরগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে গেছে।
কুয়াশা বলল, একটা কাজ করা যায়, পারবে? এই একটাই মাত্র পথ আছে মুক্তি লাভের।’
কি?’
কুয়াশা অনেকটা পিছিয়ে এসে বলল, আমি যা করব তাই করবে। খবরদার, শুধু মাঝখানের রডটা ছাড়া আর কোন রডই স্পর্শ করবে না। তাহলে বিদ্যুৎ আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’ “ঠিক বুঝতে পারলাম না।
দেখলেই বুঝবে।
কুয়াশা দৌড়ে গিয়ে মাঝখানটার রডের মাথা চেপে ধরে সমস্ত শরীরটা পাক খাইয়ে বৈদ্যুতিক বেড়াটার ওপারে গিয়ে নেমে পড়ল।
উঠে দাঁড়িয়েই কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, ‘পারবে?’ নিশ্চয়ই। কিন্তু খবরদার, অন্য কোন রডে যেন এতটুক স্পর্শ না লাগে।’
• লাগবে না।’
সেন্ট্রাল কন্ট্রোলরূমে তখন অন্য এক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছিল। মনিটর । টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ পর্দার উপর ভেসে উঠল কুয়াশা ও শহীদের ছবি।
মনিটর চমকে উঠল প্রথমে, তারপর বেআইনী অনুপ্রবেশকারীদের গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। শহীদ ও কুয়াশা সুড়ঙ্গ-পথের মোড়ে পৌঁছুতেই একটা কুয়াশা-২৮
৪৩
বোতাম টিপে দিল। তিনটে মোটা লোহার শিকের বেড়া মাটি খুঁড়ে উঠল।
একটা ধূর্ত-হাসি হেসে মনিটর উঠে দাঁড়াল। একটু দূরে অবস্থিত হটলাইনের ববাতাম টিপতেই লাউড-স্পীকারে ডিরেক্টরের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ইয়েস।’
‘একশো পঁচিশ বলছি কন্ট্রোল থেকে। পাঁচ নাম্বার সেক্টরের ফাঁদে নতুন রং রুট দু’জন আটকে পড়েছে।’
‘ওদের জ্যান্ত ধরে ডেথ-চেম্বারে পাঠিয়ে দিতে বল।’ ‘দিচ্ছি, স্যার।
মনিটর হটলাইনের সুইচ অফ করে মাইক্রোফোনে ডিফেন্স স্কোয়াডকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল। ধীরে-সুস্থে নিজের আসনে ফিরে আসতেই সে ভীষণভাবে চমকে গেল। টেলিভিশনের পর্দায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীদের কোন চিহ্নই নেই। বৈদ্যুতিক বেড়ার ভিতরটা ফাঁকা। তার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। . তিরিশ সেকেণ্ড পর টেলিভেশনের পর্দায় ডিফেন্স স্কোয়াডকে সুড়ঙ্গ-পথে ফাঁদের দিকে এগোতে দেখা গেল। স্কোয়াডে ছিল পাঁচ-ছয়জন লোক। প্রত্যেকের হাতে রিভলভার। লীডারের হাতে একটা পোর্টেবল রেডিও ট্রান্সমিটার।
| লোহার বেড়ার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ডিফেন্স স্কোয়াড। তাদের বিস্মিত ও বিরক্তিপূর্ণ চেহারা ফুটে উঠল টেলিভিশনের পর্দায়।
| পরিণাম বিবেচনা করে শিউরে উঠল মহাসভার একশো পঁচিশ নাম্বার সদস্য। একটু পরে লাউড-স্পীকারে ভেসে এল, কন্ট্রোলরূম?’
হ্যাঁ,’ একশো পঁচিশ নাম্বার বলল। ফাঁদে তো কেউ নেই! গাঁজা খাচ্ছিলে, না ইয়ার্কি মারছিলে?”
জ্বি, মানে হ্যাঁ..মানে না, লীডার। ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু সত্যি দুজন ওখানে ঢুকেছিল।
চুপ, ইডিয়ট! ছিল তো গেল কোথায়? ওখান থেকে বেরোবার বাপের সাধ্য কারও আছে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, না স্বপ্ন দেখছ? এবারে মাফ করে দিলাম। ফের এমনটি করলে ডেথ-চেম্বারে পাঠিয়ে দেব।’
গার্ড-কোয়ার্টারে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল শহীদ ও কুয়াশা।
শহীদ বলল, সুড়ঙ্গে আমাদের উপস্থিতি কি করে টের পেল বুঝতে পারছিনে।’
| ‘আমরা কখন কোথায় আছি তা বোঝবার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করেছে ওরা। কি করে জানছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। তার আগে আমাদের এই কোয়ার্টার থেকে বেরুনো চলবে না। তা বেশিক্ষণ তো আর নেই।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে গেল কুয়াশা। শহীদ তা লক্ষ করে বলল, কি হল? “দেখেছ, ঘড়ির কাঁটা আর অঙ্কগুলো কেমন জ্বলছে? তার মানে ঘড়ির কাছেই
ভলিউম-১০
৪৪
কোথাও রেডিও একটিভিটি রয়েছে। এখন বুঝতে পারলাম, আমাদের হাতের ব্যাজে যে রেডিও একটিভিটি রয়েছে তা দেহের গরমে উত্তপ্ত হয়ে তরঙ্গের মত ছড়িয়ে গিয়ে কোন মেশিনে ধড়া পড়ে। সেখান থেকে টিভির পর্দায় দেখা যায় সবকিছু।’
তাহলে আমাদের উপর নজর রাখবার জন্যেই ব্যাজগুলো দিয়েছে ওরা?’
যা। আসলে আমরাও ওই ক্রীতদাসগুলোর মতই বন্দী। এখন আমাদের এই ব্যাজগুলোকে প্রতারণা করার কৌশল বের করতে হবে,’ কুয়াশা জবাব দিল।
দরজাটা খুলে গেল। দুজন গার্ড ভিতরে ঢুকে বলল, যাও, তোমাদের ডিউটি শুরু হয়েছে।’
‘কোথায় ডিউটি দিতে হবে? ‘আগ্নেয়গিরির মধ্যে। এই নাও রিভলভার। দুজনের হাতে একটা করে রিভলভার দিয়ে বলল, ‘যাও, আর দেরি কোরো ।’
পথে শহীদ কুয়াশাকে বলল, ‘তাহলে, শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করে ওরা আমাদের রিভলভার দিয়েছে।’
| কুয়াশা হেসে বলল, ‘কিন্তু বুলেট তো দিয়েছে মাত্র একটা করে মোর্ট দুটো! ও দুটো ফুরিয়ে গেলেই আঙুল চুষতে হবে।’
অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওরা চতুর্থ স্তরে উঠে গেল। শহীদ বলল, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বলতে পার?’
কুয়াশা বলল, এটা হচ্ছে একটা লেসার বীম প্রজেক্টর। সিলিণ্ডারের ভিতরে আছে রকেট অথবা আণবিক বোমা। নিশ্চয়ই ওটা কোথাও নিক্ষেপ করা হবে। যতদূর মনে হচ্ছে কাল দুপুরেই এই ভয়ঙ্কর কাজটা করবে ওরা। তার আগেই ধ্বংস করতে হবে ওদের।’
| পাশেই চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল কুয়াশা। রেলিং-এর বাইরে একটা অপ্রশস্ত গার্ডারের উপরে নাজুকভাবে দাঁড়িয়ে এবং একটা ঝুলন্ত গার্ডারে বাঁ হাত রেখে দাঁত-মুখ খিচোচ্ছে আমীরগুল একজন রক্ষীর দিকে লক্ষ করে।।
রক্ষীটা আমীরগুলকে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বলল, ‘কাজ কর, বেটা।’
তবে রে…!’ স্থানকাল ভুলে শূন্যে একটা লাফ দিল আমীরগুল। শিউরে উঠে চোখ বুজল শহীদ। এখুনি একশো ফুট নিচে পড়ে গিয়ে আমীরগুলের সর্বাঙ্গ গুঁড়ো গুড়ো হয়ে যাবে।
অস্ফুট একটা শব্দ শুনে চোখ খুলতেই দেখল কুয়াশা তার ডান হাতের চার আঙুলে গার্ডারটা চেপে ধরেছে সে, আর বাঁ হাতে ধরে আছে আমীরগুলের একটা হাত। কুয়াশার আঙুলগুলো গার্ডার থেকে সরে গেলে দুজনেই মরবে।
শহীদ বলল, “চেপে ধর ভাল করে। আমি দুজনকেই টেনে তুলছি।’ কুয়াশা-২৮
৪৫
আমীরগুলের সকা শব্দ শুনেমে, আর বাগেলে দুজনেন তুলছি।
না না।’ চিৎকার করে উঠল কুয়াশা, তাহলে তুমিও মরবে। ওই ঝোলানো গার্ডারটা যতটা সম্ভব নিচে নামাও, তাড়াতাড়ি।
শহীদ দেরি করল না। সে কপিকল ঘুরিয়ে গার্ডারটা নিচে নামাতে লাগল।
রক্ষীটা বাধা দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু শহীদ চোখ গরম করে বলল, ‘গোলমাল করলে তোকে সুদ্ধ নিচে ছুঁড়ে দেব। কমাণ্ডার বলেছে, ওই লোকটার বিশেষ দরকার আছে।’
কি মনে করে রক্ষী আর ঝামেলা বাড়াল না। সে অন্যত্র চলে গেল।
মাত্র চার আঙুলের উপর ভর দিয়ে একটা দশাসই কের ভার বহন করতে কষ্ট হচ্ছিল কুয়াশার। অবশ হয়ে আসছে তার হাত দুটো। এই বুঝি তার আঙুলগুলো ফস্কে গেল।
শহীদ শ্বাস বন্ধ করে কপিকল ঘুরিয়ে গার্ডারটা নামিয়ে আমীরগুলের কাছে পৌঁছে দিল। আমীরগুল বাঁ হাতে গার্ডার চেপে ধরে বলল, ‘ব্যস, ধরেছি আমি।’
তার হাতটা ছেড়ে দিল কুয়াশা। বিস্মিত ও কৃতজ্ঞচিত্ত আমীরগুল সাবধানে গার্ডারের উপরে উঠে পড়ল। তার দেহের ভারে নড়াচড়ার ফলে গার্ডারটা অনেকটা দূরে সরে গিয়ে দুলতে লাগল। শহীদ আবার ধীরে ধীরে সেটা কুয়াশার আয়ত্তের। মধ্যে নিয়ে আসল। বাঁ হাতটা সাবধানে উপরে তুলে দিল কুয়াশা দোদুল্যমান গার্ডারটা ধরবার জন্য। হাতটা ধরে তাকে টেনে তুলল আমীরগুল।
গার্ভার থেকে সাবধানে মূল.কাঠামোর বীমের দিকে এগিয়ে এল কুয়াশা ও আমীরগুল।।
আমীরগুলের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। সে ডান হাত দিয়ে গাল চুলকে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি, তুমি আমার জীবন বাঁচালে। কিন্তু কেন?’’
কুয়াশা নিচু গলায় বলল, ‘শোন বন্ধু, আমি ও কালু মিয়া এই দস্যুদলকে ধ্বংস করতে এসেছি। তুমিও নিশ্চয়ই তাই চাও। আর এ ব্যাপারে তুমি আমাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। এখন সবটা ব্যাখ্যা করার সময় নেই কিন্তু কাজের সময়ে যেন তোমাকে পাই।’
‘ আমীরগুল সকৃতজ্ঞ নয়নে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ। তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু এসব কি কাণ্ড ঘটছে তার তো মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছিনেম’।
কুয়াশা বলল, সময় যদি আসে, অবশ্যই জানতে পারবে। এখন কাজ করে যাও।’ | যে রক্ষীটি শহীদের ধমক খেয়েছিল সে ফিরে এসে বলল, “ডিউটি শেষ হলে কমাণ্ডার মমতাজের সঙ্গে দেখা করতে যেয়ো। এটা তার আদেশ।’
| ডিউটি শেষে কুয়াশা ও শহীদ যখন নিচে নামল তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
ভলিউম-১০
০৬
মমতাজ নিচে অপেক্ষা করছিল। সে ওদের দেখেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘তোমরা নাকি আমীরগুলকে বাঁচিয়েছ?”
কুয়াশা মাথা নাড়ল। ‘কেন?’ কোন জবাব দিল না কুয়াশা। ‘আচ্ছা, চল মজা দেখাচ্ছি।’
কথাবার্তার ফাঁকেই কুয়াশা লক্ষ করল মহাসভার বেশ কয়েকজন রিভলভারধারী সদস্য ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আর পিছনে রিভলভারের নল দিয়ে ঠেলা দিতে দিতে আমীরগুলকে নিয়ে আসছে একজন।
| মমতাজ নির্দেশ দিল, ‘সেক্টর নাম্বার নাইন।
চল,’ ধমকে বলল রিভলভারধারী এক রক্ষী। ..
কোনরকম প্রতিবাদ নিল বিবেচনা করল কুয়াশা। কুয়াশা, শহীদ ও আমীরগুলকে নিয়ে মমতাজ সদলবলে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেল। বাইরেও প্রচণ্ড গরম ছিল কিন্তু সুড়ঙ্গের মধ্যে গরমটা যেন আরও বেশি। আরও একটু এগোতেই দেখা গেল অল্প অল্প ধোয়া পাক দিয়ে উঠছে।
একেবেঁকে অনেকটা যাবার পর মমতাজের নির্দেশে থামল ওরা,। বৈদ্যুতিক আলোকে সুড়ঙ্গের ভিতরটা আলোকিত। সেই আলোয় দেখা গেল একটা চতুষ্কোণ গহ্বরের ওপর মোটা লোহার রডের ঢাকনা। ওই গহ্বরের ভিতর থেকেই অল্প অল্প ধোয়া বেরোচ্ছে।
মমতাজের এক স্যাঙাৎ এগিয়ে গিয়ে ঢাকনাটার তালা চাবি দিয়ে খুলে গহরের মুখটা হাঁ করে দিল।
মমতাজ বলল, “আগে ওই বদমাশ আমীরগুলকে নামিয়ে দাও। দুজন রিভলভারধারী আমীরগুলকে বলল, “চল।
, আমি নামব না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল আমীরগুল। মমতাজের নির্দেশে তিনজন গিয়ে চেপে ধরল আমীরপুলকে। সে ধস্তাধস্তি করতে লাগল।
শহীদ ও কুয়াশা উভয়ের দিকেই কয়েকটা রিভলভার উদ্যত থাকায় তারা অসহায়ের মত দেখতে লাগল। আমীরগুলকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গহ্বরের মধ্যে উড়ে দিল কয়েকজন।
‘দেখবেক্ষণি মজা। মৃত্যুর কি চমৎকার ব্যবস্থা। এখন বললে মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। দেখতে পাবে কাল বেলা এগারোটায়, কুয়াশার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল: মমতাজ। তারপর স্যাঙাদের নির্দেশ দিল, “এরার কালু মিয়া ওরফে শহীদ খান।
শহীদ অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড় হুরের মধ্যে। কুয়াশা-২৮
৪৭
এবারে রাজা মিয়া ওরফে কুয়াশা সাহেবের পালা। নামিয়ে দাও ওকে।’
কুয়াশা চমকাল না মানব-ধ্বংসী মহাসভার ডিরেক্টর নুরবক্সকে সে চেনে বই কি এবং নুরবক্স যে তাকে চিনে ফেলেই ট্রেনভিলের লতা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তার ভবলীলা সাঙ্গ করতে যাচ্ছিল তা-ও জানে। | কুয়াশা তাই বিস্মিত হল না কিন্তু অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। সে উবু হয়ে গহ্বরে নামতে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বসে কাঁদো কাঁদো চেহারা করে মমতাজের কাছে করুণা ভিক্ষা করল। আকুল আবেদন জানিয়ে বলল, কমাণ্ডার, আমাকে বাঁচাও, তোমরা যা বলবে আমি তাই করব। তোমার একান্ত দাস হয়ে থাকব আমি। মেরো না আমাকে। বাঁচাও। কমাণ্ডার, বাঁচাও। তোমাদের সবকথা শুনব। মেরো
আমায়। দোহাই তোর।’ | মমতাজ মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, এটা দেখবার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। মাটিতে পড়ে করুণা ভিক্ষা চাইছে বীরশ্রেষ্ঠ কুয়াশা। এটা দেখবার আশাতেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।’
দয়া কর, দয়া কর আমাকে কমাণ্ডার,’ মিনতি ঝরে পড়ল কুয়াশার কণ্ঠ থেকে।
না, তোমাকে দয়া করা যায় না। তোমাকে কেন, কাউকেই দয়া করি না আমরা। নেমে পড়। না হয় জোর করে নামাবে তোমাকে ওরা। এই, তোমরা হা করে দেখছ কি? জোর করে নামিয়ে দাও ওকে।
* কয়েকজন এগিয়ে এল। কুয়াশা কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করল। তারপর পড়ে গেল নিচে।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল মমতাজ। তারপর স্যাঙাদের বলল, চল, এদিকের কাজ শেষ।’
উঁহু, শেষ হয়নি এখনও,’ রক্ষীদলের নেতা মমতাজের দিকে রিভলভার উঁচিয়ে ধরে বলল। ‘তোমাকেও নামতে হবে ওই গহ্বরে, ডিরেক্টরের নির্দেশ।’
প্রথমে বিস্ময়ে ও পরে ভয়ে ছানাবড়া হয়ে গেল মমতাজের চোখ। সে কম্পিত কণ্ঠে বলল, “গার্ড, তুমি কি পাগল হয়েছ?
‘পাগল হইনি। তুমি ওই গোয়েন্দাগুলোকে মহাসভার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এসেছ। আর জানই তো মহাসভা কখনই ভূলকে প্রশ্রয় দেয় না। ওদের সাথে তোমাকেও ডিরেক্টর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।’
-না,’ প্রাণভয়ে চিৎকার করে উঠল মমতাজ। ‘আমি ডিরেক্টরের কাছে মাফ চাইব। দয়া ভিক্ষা করব।’
গার্ড হাসল, মানব-ধ্বংসী মহাসভা দয়া করে না।’
কাকুতি-মিনতি করতে লাগল মমতাজ, আমায় বাঁচিয়ে দাও ভাই এ যাত্রা। আমার অনেক টাকা লুকানো আছে। সবই তোমাকে দেব।’
• ৪৮
ভলিউম-১০
‘দুনিয়ার সমস্ত টাকা-পয়সা এক সাথে এনে আমার সামনে হাজির করলেও তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
হিড়হিড় করে কয়েকজন গার্ড তাকে টেনে নিয়ে গেল গহ্বরের কাছে।
নিচে, গহ্বরের ভিতরে অন্ধকারে কুয়াশা প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। সে, প্রশ্ন করল, শহীদ, আমীরগুল, কোথায় তোমরা?’. .
‘এই তো, তোমার পিছনে,’ আমীরগুল বলল। অন্ধকারে তোমার চোখ ধাধিয়ে গেছে। একটু পরেই দেখতে পাবে আমাদের।’
একটু পরে অন্ধকারটা চোখে সয়ে যেতেই কুয়াশা দেখতে পেল, গহরের দেয়ালে হেলান দিয়ে শহীদ ও আমীরগুল বসে আছে। গহুরটা নিচে বেশ প্রশস্ত । একদিকে ছোট ছোট কতকগুলো গর্ত থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অসহ্য গরম গহরটার মধ্যে।
কুয়াশা সরে এসে ওদের পাশে বসতেই ধপাস করে শব্দ হল একটা। কি যেন পড়ল।
| ওরা একটু অবাক হয়ে দেখল, যে পদার্থটা উপর থেকে পড়ল সেটা আর কেউ নয় কমাণ্ডার মমতাজ স্বয়ং।
আমীরগুল বিস্ময়ে থ’ বনে গেল। তারপর সে-ই প্রথমে কথা বলল, “দেখেছ, কি পড়ল উপর থেকে? মরার সময়ও কি চোর গন্ধ সইতে হবে নাকি? উহ্!”
ওদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল মমতাজ।
দাঁড়া ছুঁচো, দেখাচ্ছি তোকে এবারে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মমতাজের দিকে পা বাড়াল আমীরগুল।
কুয়াশা দ্রুত মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, “আহ, করছ কি ভাই, আমীরগুল?’
‘তুমি একটু সর, ওকে আমি জনমের মত শেষ করে দেব,’ ফোঁস ফোঁস করতে লাগল আমীরগুল।
শহীদ আমীরগুলকে সরিয়ে নিয়ে তার পাশে প্রায় জোর করেই বসিয়ে বলল, দুচো মেরে কেনই বা হাত গন্ধ করবে, বল? তাছাড়া আমরা সবাই তো একই নৌকার যাত্রী। নৌকা ডুবলে হুঁচোরও তো বাঁচবার সুযোগ পাওয়া উচিত।’
আমীরগুল বসে বসে গজরাতে লাগল। শব্দ শুনেই বোঝা গেল উপরের ঢাকনাটা লাগিয়ে তালা বন্ধ করা হল।
কে যেন বলল, তোমরা এখানে ডিউটিতে থাক | আগুনের স্রোত যখন বইতে শুরু করবে তখন কন্ট্রোলরূমে খবর দেবে।’
একটু পরে রক্ষীদের একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আগুনের ফোয়ারা শুরু হবার আগেই আমি এখান থেকে সরে যাব। এই গরমেই টেকা দায়। তখন তো গরমে বুটের ভিতরই পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে।’
অনজিন বলল, ঘািমিও চলে যাব : বদমাশগুলো তো আর বেরোতে পারছে ৪-কুয়াশা-২৮
। মিছেমিছি এখানে খেকে গরমে য়ে ফোস্কা ফেলবার দরকার কি?
রক্ষীদের আলাপটা শুনতে পেলেও কুয়াশা, আমীরগুল বা শহীদ ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারল না। সে মমতাজকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই লাফ দিয়ে উঠে এসে আমীরগুল মমতাজের জামার কলার চেপে
ধরল, এই ব্যাটা ছুঁচো, এসব আগুনের স্রোত-ট্রোতের ব্যাপার কি? | মমতাজ চিচি করে বলল, ‘প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় একবার ওই গর্তগুলো দিয়ে গলিত ধাতু উঠে এসে এই গহুরটার অর্ধেকটা পর্যন্ত ভরে দেয়। ওগুলো আসে আগ্নেয়গিরি থেকে। এটা অনেকটা সেফটি ভাল্ভের মত। কিছুক্ষণ পরে আবার সেগুলো নেমে যায়। পরের আগুনে স্রোত আসবে কাল বেলা এগারোটায়।’
| এখন সন্ধ্যা সাতটা। তার মানে, আমাদের পরমায়ু আর মাত্র ষোলো ঘন্টা,’ কুয়াশা ঘড়ি দেখে হিসাব করে বলল ।
আমীরগুল মমতাজের জামার কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছিনে। এখানে হচ্ছে কি?’
কুয়াশা অত্যন্ত গাম্ভীর্য সহকারে বলল, আগ্নেয়গিরির মধ্যে যে বিশাল যন্ত্রটা দেখতে পাচ্ছ ওটা হচ্ছে একটা লেসার-বীম মেশিন। ওটা দিয়ে পারমাণবিক বোমা, রকেট ইত্যাদি নিক্ষেপ এবং ধ্বংস করা যায়। কাল দুপুরে বদমায়েশগুলো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করবে। তাই না, মমতাজ?’
মমতাজ মাথা নাড়ল। থ’ বনে গেল শহীদ। আবার মমতাজের জামার কলার চেপে ধরল আমীরগুল । ‘কোথায় ফেলবে?’ কোন জবাব দিল না মমতাজ। বল, না হলে তোর নাক ভেঙে দেব?’ ঘুসি দেখাল আমীরগুল। ‘টোকিও, ব্যাংকক, হংকং, সিডনী।
উঁহু, কি সাংঘাতিক লোক এরা! কোটি কোটি মানুষ যে মারা যাবে এতে। শিউরে উঠে বলল আমীরগুল।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, “তারপর?’ ‘
কুয়াশা বলল, “ওই শহরগুলোতে আছে এই বদমায়েশ দলের লোকেরা। তারা লুঠ করবে ওই শহরগুলোর সমস্ত ধনসম্পদ।
‘অমানুষ, নরক-কীট, কুকুর,’ আমীরগুল আপন মনে বলতে লাগল। এই কুত্তাগুলোর কবল থেকে কি কোন মতেই কোটি কোটি নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা যাবে না? রাজা মিয়া, বল, কোন উপায় আছে? আমার নিজের জীবন দিয়েও যদি
ওদের বাঁচাতে পারতাম।’
দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে ছিল মমতাজ। আর পনেরো ঘন্টা মাত্র বাঁচব
ভলিউম-১০
আমরা, করুণ কণ্ঠে বলল সে। | ‘তোর আরও আগে মরা উচিত। এখুনি মরা উচিত। ছুঁচো কোথাকার। আমীরগুল মমতাজের চোয়ালে একটা ঘুসি মারল।
আট
*
1
/
প্রায় পনেরো ঘন্টা রে।
গর্তগুলো থেকে নির্গত ধোয়ার পরিম। একটু একটু করে বাড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল উত্তাপ। একসময় উত্তাপ অসহ্য হয়ে উঠল। দেয়াল ও নিচের মাটিও গরম হয়ে উঠেছে। বসে থাকা যাচ্ছে না। ঘেমে নেয়ে উঠেছে গহরের চার প্রাণী।। ধোয়ায় ওদের চোখ জ্বালা করছে। খুকখুক করে মাঝে মাঝে ওরা কাশছেও।
বার বার ঘড়ি দেখছে কুয়াশা। এগারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলল মমতাজ।
আর তিন মিনিট বাকি আগুনের স্রোত শুরু হবার,’ কুয়াশা শান্ত কণ্ঠে বলল।
উপরে প্রহরীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, চল, আর নয়। সেদ্ধ হবার আগেই পালাই। আর টেকা যাচ্ছে না।’
যা, চল।। আবার ঘুড়ি দেখল কুয়াশা। আড়াই মিনিট বাকি।
প্রবল বেগে ধোয়া উঠছে গর্তগুলো থেকে। আমীরগুল বলল, মৃত্যুর আর আড়াই মিনিট বাকি আছে।’
শহীদ, কুয়াশা বলল, ‘কুইক, আমার ঘাড়ের উপর উঠে দাঁড়াও।’ শহীদ একটু অবাক হয়ে বলল, “কি বললে তুমি!
আমার ঘাড়ের উপরে উঠে দাঁড়াও। সময় নেই।’ ‘লাভ কি? তালাবন্ধ লোহার দরজা তো ভোলা যাবে না?’ .
কথা বাড়িয়ো না, প্লীজ। যা বলছি, শোন।। শহীদ কথা বাড়াল না। কুয়াশার ঘাড়ের উপর উঠে দাঁড়াল সে।
কুয়াশা আমীরগুলকে বলল, ‘আমাদের পেঁচিয়ে ধরে বেয়ে উঠে যাও। পকেট থেকে নাইলনের মজবুত কর্ড বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখ কাজে । লাগবে।’
‘কিন্তু ওদিকে যে তালা বন্ধ?’
না, বন্ধ নয়। আমি তখন কান্নাকাটির ভান করে তালার গর্তের মধ্যে কাদা ঢুকিয়ে দিয়েছি। ও তালা বন্ধ হয়নি। যাও, আর দেরি কোরো না।
নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাবার ক্ষীণতম সম্ভাবনায় আমীরগুল, কুয়াশা কুয়াশা-২৮
আর শহীদের গা বেয়ে উপরে উঠে গেল। রডের ফাঁক দিয়ে তালাটাতে যখন সে টান দিল তখনও তার মন থেকে নৈরাশ্য আর সন্দেহ দূর হয়নি। কিন্তু যখন তালাটা সত্যি খুলে গেল তখন সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
কুয়াশা নিচ থেকে বলল, “আমীরপুল, কুইক। আর দেড় মিনিট আছে।’
গায়ের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে আমীরগুল লোহার ঢাকনাটা তুলে উপরে উঠে গেল। ঢাকনাটা উল্টোদিকে তুলে গহ্বরের মুখটা খুলে দিল।
উঠেছি,’ বলল আমীরগুল। মমতাজ হাঁ করে ওদের কারখানা দেখছিল। কুয়াশা তাকে বলল, মমতাজ জলদি। উঠে পড়।’
মমতাজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। যেন কুয়াশার কথা সে বুঝতে পারছে না। কুয়াশা তাকে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচাবে এই সম্ভাবনা স্বপ্নেও তার মনে ঠাই পায়নি। সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।।
মমতাজ, দেরি কোরো না। উঠে পড় বাঁচতে হলে।’ আঁ, আমি উঠব! বলছ তোমরা! আঁ!” আহ, তাড়াতাড়ি কর। তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে সবাইকে উঠতে হবে।’ মমতাজ উঠে যাবার পর আমীরগুল শহীদকে টেনে তুলল।
দড়িটা নামিয়ে দাও।’ আমীরগুল দড়ি খুলে ঠিক করে রেখেছিল। দড়ি নামিয়ে দিল সে। ততক্ষণে গর্তের মুখে গলিত ধাতু টগবগ করে ফুটছে।
শহীদ আর আমীরগুল কুয়াশাকে যখন টেনে তুলল তখন গহরের নিচের দিকটা উত্তপ্ত গলিত ধাতুতে ভরে গেছে। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি হলেই কুয়াশার পা দুটো গলিত লাভায় পুড়ে যেত।
আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলে আমীরগুল বলল, আমি যে বেঁচে আছি তা যেন আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না।
কুয়াশা ঘড়ি দেখে বলল, “শোন, আমাদের হাতে সময় খুব কম। বারোটায় ওরা বোমা নিক্ষেপ করবে। তার আগে ওদেরকে স্ম্যাশ করতেই হবে। শোন : আমীরগুল, তোমার একটা কাজ করতে হবে।’
বল।’
বন্দীগুলোকে বিদ্রোহী করে তুলতে হবে। তাতে ওরা সবাই বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সেই অবসরে আমরা লেসার বীম মেশিনটাকে ধ্বংস করব।’
আমীরগুল বলল, আমি একজন গার্ডকে বলতে শুনেছি এগারোটার সময় সমস্ত ক্রীতদাসকে পোতাশ্রয়ে নিয়ে যাবে। তার মানে, এখন ওদের ওখানটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ । কুয়াশা খুশি হয়ে বলল, তাহলে তো আরও ভাল। সেখানে যত তাড়াতাড়ি ৫২
ভলিউম-১০
শহীদ ও গলিত লাভায় পড়ে ফেলে
পার গিয়ে হাঙ্গামা বাধাও। জাহাজগুলো দখল কর। সবাই জাহাজে গিয়ে উঠে পড় এবং যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হও।।
‘বেশ। চল, বেরুনো যাক। কিন্তু মমতাজ গেল কোথায়?’ আমীরগুল বলল।
তাই তো! শহীদ বলল, বদমাশটা পালিয়েছে। দেখি কোথায় গেল।’ ‘দেখবার সময় এখন নেই,’কুয়াশা বলল।
সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ, কুয়াশা ও আমীরগুল। ডাইনে আর একটা সুড়ঙ্গ। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। লেসার বীম মেশিনটা দেখা যাচ্ছে। লোহার কাঠামোটার উপর দিকে যন্ত্রটাকে একটা গম্বুজের মত দেখাচ্ছে। মহাসভার ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন সশস্ত্র সদস্য দাঁড়িয়ে আছে প্রজেক্টরের কাছেই।
কুয়াশা বলল, বাঁ দিকটা দিয়ে এগিয়ে যাও তুমি, আমীরগুল, পাহাড়ের আড়াল দিয়ে। ওদিকে নিশ্চয়ই কেউ নেই। পোতায়টা ওই দিকেই।
কোন কথা না বলে বাঁ দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল আমীরগুল।
ঘড়ি দেখতে লাগল কুয়াশা। দশমিনিট পরে আমরা বেরিয়ে পড়ব। গার্ডগুলোকে বেকায়দায় ফেলতে হবে।’
আমীরগুল পাহাড়ের আড়াল দিয়ে পোতাশ্রয়ে পৌঁছে দেখল সমুদ্রের তীরে বন্দিরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। রিভলভারধারী কয়েকজন রক্ষী তাদের পাহারায় মোতায়েন আছে ।
আমীরগুল যেখানে গিয়ে দাঁড়াল তার মাত্র দশহাত দূরেই একজন গার্ড বন্দিদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা টমিগান। | দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল আমীরগুল। এই গার্ডটাকে সকলের আগে খতম করে ওর টমিগানটা বাগাতে হবে। বাকি কাজটুক তাহলে অনায়াসেই সম্পন্ন করতে পারবে সে। কারও নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই আপাতত, কারণ গার্ডদের কেউই এদিকে তাকিয়ে নেই।
সকলের দৃষ্টি সামনের সমুদ্রের তীরে দাঁড়ানো বন্দীদের দিকে।
ধীরে, অতি ধীরে নিঃশব্দে আমীরগুল গার্ডটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁ হাতটা দিয়ে গার্ডের গলাটা পেঁচিয়ে ধরে ডানহাত দিয়ে তার কানের কাছে প্রচণ্ড
একটা আঘাত করল।
আচমকা হামলায় গার্ডটা আর্তনাদ করে উঠবার চেষ্টা করল কিন্তু আমীরগুল এমনভাবে তার কণ্ঠটা চেপে ধরেছিল যে, সে এতটুকু শব্দও করতে পারল না। অসহায়ের মত সে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। এক ঝটকায় তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে টমিগানটা কেড়ে নিল আমীরগুল। লোকটা চিৎকার করার চেষ্টা করতেই বুট দিয়ে মুখের উপর একটা লাথি হাঁকাল আমীরগুল। লোকটা জ্ঞান হারাল।
পাহাড়ের খাদের মধ্যে দিয়ে আমীরগুল নেমে গেল কয়েক পা। সে চিৎকার কুয়াশা-২৮
করে বলল, বন্ধুগণ, এই দস্যুদের, এই শয়তানদের খতম করে দাও। খুন কর ওদের।’
গার্ড ও বন্দীরা চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে টমিগান হাতে আমীরগুলকে দেখে চমকে উঠল।
আমীরগুল তখনও চিৎকার করে বলছে, বন্ধুরা, এই খুনেগুলোকে খতম করে দাও।’
| ‘গার্ডরা প্রথমে বিস্মিত হলেও মুহূর্তে তৎপর হয়ে উঠল। তারা আমীরগুলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে লাগল। আমীরগুল একটা পাথরের আড়ালে সরে গেল। বন্দীদের গায়ে গুলি লাগতে পারে এই আশঙ্কায় সে গুলি করতে সাহস পেল না।।
কিন্তু বন্দীদের মধ্যে ততক্ষণে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আহ্বানে সাড়া দিতে তারা বিলম্ব করল না। বদমাশগুলোর কবল থেকে মুক্তিলাভের সুযোগ পেয়ে। তিনটে জাহাজের নাবিক আর অফিসাররা ঝাঁপিয়ে পড়ল মুষ্টিমেয় গার্ডদের উপর। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল সব।
ক্যাপ্টেন গোলজার আহমদ আমীরগুলকে জড়িয়ে ধরল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগল।
আমীরগুল বলল, “কোন কথা নয়। এখুনি সবাইকে গিয়ে জাহাজে উঠতে হবে। তিনটে জাহাজই যেন পনেরো মিনিটের মধ্যেই যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয় । এটাই এখন আমার নেতার আদেশ।’
| কিন্তু ব্যাপার কি?’ ক্যাপ্টেন শুধোলেন। । সব পরে শুনবেন, ক্যাপ্টেন, এখন আলাপ করার সময় নেই। এখানকার অধিবাসীদেরও যেন জাহাজে ভোলা হয়। ভাইসব, সবাই গিয়ে নিজ নিজ জাহাজে উঠে পড়ুন। এঞ্জিন চালু করে দিন। যান, আর এক মিনিট দেরি করবেন না।
ক্যাপ্টেন গোলজার বললেন, আপনি কি করবেন? ‘আমিও আপনাদের সাথে থাকব।’
ওদিকে মমতাজ গহ্বরের মধ্যে থেকে গুটি গুটি বেরিয়ে পিছন দিক দিয়ে সোজা ডিরেক্টরের রূমের দিকে এগিয়ে গেল।
| ডিরেক্টর নুরবক্স তখন আতস-কাঁচ দিয়ে একটা ফুলের পাপড়ি পরীক্ষা করছিল। দরজা থোলার শব্দে সে ফিরে তাকিয়ে মমতাজকে দেখে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল।
মমতাজ তার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল।”
নুরবক্সের বিস্ময় কেটে যেতেই সে বলল, ওর একটা ব্যবস্থা কর।’ নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে । | এখুনি করছি, স্যার।’ হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করল জাকের।
ভলিউম-১০
৫৪
হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মমতাজ, স্যার, আমাকে মাফ করে দিন। শুনুন স্যার, কুয়াশা আর শহীদ আগুনে স্রোতের গহ্বর থেকে বেরিয়ে গেছে।’
সে কি! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল নুরবক্স। অসম্ভব! এ অসম্ভব! জাকের, মেরো না ওকে। শোনা যাক ব্যাপারটা।’
সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল মমতাজ। শেষে সে যোগ দিল, ‘বেরিয়েই মনে। করলাম, আমার প্রথম কর্তব্য হল আপনাকে খবরটা দেওয়া।’
প্রচণ্ড ক্রোধে নুরবক্সের চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে জাকেরকে বলল, লেসার-বীম মেশিনের রক্ষীদের বল যে, কুয়াশা ও শহীদ মেশিনটা ধ্বংস করার চেষ্টা করতে পারে। তারপর চারদিকে একটা বিপদ-সঙ্কেত দাও। কুয়াশা ও ‘ শহীদকে দেখামাত্র যেন হত্যা করা হয়।’
রেডিও ট্রান্সমিটারে নুরবক্সের নিদের্শ জানাল জাকের । স্যার, আমি?’ প্রশ্ন করল মমতাজ। ‘তোমাকে এ যাত্রা মাফ করলাম। আপাতত এখানেই থাক তুমি।’
নুরবক্সের নির্দেশ পেয়ে গার্ডরা লেসার-বীম প্রজেক্টরটাকে ঘিরে দাঁড়াল। গার্ডদের লীডার সবাইকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলল, ‘ওরা যদি প্রজেক্টরের ক্ষতি
রতে সক্ষম হয় তাহলে ডিরেক্টর আমাদের কাউকে প্রাণে বাঁচাবেন না। ছড়িয়ে পড় সবাই।’ ‘
সুড়ঙ্গের একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে কুয়াশা ও শহীদ গার্ডদের দিকে লক্ষ্য রাখছিল। হঠাৎ করে ওদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখে কুয়াশা বুঝতে পারল কোথাও একটা গোলমাল ঘটেছে। সে বলল, এখানে আর এক সেকেণ্ডও নিরাপদ নয়। নিশ্চয়ই মমতাজ নুরবক্সকে খবর দিয়েছে। আর তা রেডিও মারফত গার্ডদের কানে এসেছে। চল।’
কিন্তু কোনদিকে?’
‘এস আমার সঙ্গে। মমতাজ নিশ্চয়ই অন্য পথে বেরিয়েছে সেই পথে যেতে হবে আমাদের।’
দৌড়াতে লাগল তারা আবার সুড়ঙ্গের দিকে।
মিনিট দুয়েক পরে ওরা, সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এল। কাছেই কোথাও হৈ-চৈ হচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। শহীদ কান পেতে শুনে বলল, ‘পোতাশ্রয়টা এই দিকেই না? মনে হচ্ছে যেন আমীরগুল গোলমাল পাকিয়ে, তুলতে পেরেছে।’ “ তাই তো মনে হচ্ছে, হাত দশেক উঁচুতে পাহাড়ের গায়ের একটা গর্ত থেকে ধোয়া উদগীরণ দেখতে দেখতে কুয়াশা বলল ।
অদূরেই একটা হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছিল। শহীদ একটু উল্লসিত হয়ে বলল, কুয়াশা, আমরা হেলিকপ্টারটা নিয়েই তো প্রজেক্টরের উপরে উঠে ওটাকে ধ্বংস কুয়াশা-২৮
৫৫
7
,
করেত পারি।’
‘অসম্ভব। আমরা পঞ্চাশ পা এগোতেই নুরবক্সের চোখে পড়ে যাব। তারচেয়ে বরং একটা কাজ করলে ভাল হয়।
‘কি?’ ‘ওই গর্তটা দেখেছ? ধোয়া বেরোচ্ছে?’
হা।’ “দেখ, কিছুক্ষণ ধোয়া বেরোয় আবার কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে।’
শহীদ কিছুক্ষণ গর্তটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই তো! কিন্তু ওটা দেখলে তো হবে না। সময় যে হাতে নেই?’
কুয়াশা ঘড়ি দেখে বলল, তাই তো, আর মাত্র দশ মিনিট। এর মধ্যেই আমাদের লেসার-বীম প্রজেক্টর ধ্বংস করতে হবে।’
কিন্তু কি করে?’ হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল শহীদ। ‘এস। আর দেরি নেই। জ্বালামুখটার মধ্যে ঢুকতে হবে।’
বল কি।’ হ্যাঁ। এখন ওটাই একমাত্র পথ ।’ শহীদ বুঝতে না পারলেও বলল, চল তাহলে।
পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগল দুজন। কুয়াশা বলল, জ্বালামুখটা থেকে দুমিনিট ধোয়া বেরোয় আর তিনমিনিট বন্ধ থাকে। আমি ঘড়িতে মিলিয়ে দেখেছি । ওই তিন মিনিটের মধ্যেই আমাদের কাজ সারতে হবে।’ | জ্বালামুখে যখন পৌঁছুল ওরা ঠিক সেই সময় ধোয়া বেরুনো বন্ধ হয়ে গেল। কুয়াশা ভিতরে ঢুকে বলল, দৌড়ে এস।’
শহীদ ভিতরে ঢুকল। মনে হল যেন আগুনের হলকা এসে লাগল তার চোখে মুখে। জ্বলতে লাগল সর্বাঙ্গ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কুয়াশা দৌড়াচ্ছে তার মাঝখান দিয়েই। শহীদও শ্বাস বন্ধ করে দৌডুতে লাগল।
উহ, শহীদ বলল। সালফারে যেন সর্বাঙ্গ আর ফুসফুস পুড়ে যাচ্ছে।’ উপায় নেই। কষ্ট করতেই হবে। আরও জোরে দৌড়ে এস। গর্তের মুখটা যেখানে খুব ছোট হয়ে গেছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল দুজন।
কুয়াশা বলল, এই গর্তটা নিশ্চয়ই আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত আছে। এটা বন্ধ করে দিলেই অন্য কোন জায়গা দিয়ে বিশেষ করে মূল জ্বালামুখ দিয়ে অর্থাৎ লেসার-বীম প্রজেক্টর যেখানে আছে সেখানে দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত হতে বাধ্য। এস এটাকে বন্ধ করে দিই।’
একটা প্রস্তর-খণ্ড দেখিয়ে কুয়াশা বলল, এটাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তটা বন্ধ করতে হবে। এস জলদি। এক মিনিটের মধ্যে কাজটা শেষ করে বেরোতে হবে আমাদের।’
ভলিউম-১০
অসহ্য উত্তাপে তখন শহীদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস নিতে না পারায় কষ্ট যেন আরও অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। উত্তেজনায় আর ক্লান্তিতে পা দুটো ভেঙে আসছিল। তবু সে দাঁতে দাঁত চেপে কুয়াশার সঙ্গে সঙ্গে পাথর খণ্ডটা ধাক্কা দিয়ে গর্তের মুখের কাছটাতে নিয়ে গেল। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যেই হয়ে গেল কাজটা।
কুয়াশা বলল, ‘এখুনি পালাতে হবে। দৌড়াও।’ বাইরের মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিল ওরা। দ্রুত নেমে এল নিচে। পিছনে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে ওদের কানে তালা লেগে গেল ।
কুয়াশা বলল, “এখুনি সমস্তটা আকাশ ভেঙে পড়বে । মহাপ্রলয় শুরু হয়ে যাবে। তার আগেই যদি আমরা ওই হেলিকপ্টারটায় না উঠতে পারি তাহলে
আমাদেরও মৃত্যু অনিবার্য।
রুদ্ধশ্বাসে ওরা হেলিকপ্টারের দিকে দৌড়াতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ওরা আকাশে উঠল।
ওদিকে আগ্নেয়গিরির ধোয়া উদগীরণের পথে পাথরের খণ্ডটা কামানের গোলার মত ছিটকে পড়ে সমগ্র দ্বীপটাতে মহাপ্রলয়ের সূচনা করল।
নয়
মানব-ধ্বংসী মহাসভার ডিরেক্টর নুরবক্স কন্ট্রোলরূমে গিয়ে পৌঁছুল বারোটা বাজার ঠিক দুমিনিট আগে । তার সঙ্গে গেল মমতাজ আর জাকের।
. কন্ট্রোলার সবিনয়ে নুরবক্সকে অভ্যর্থনা জানাল, আসুন, স্যার । মাস্টার সুইচটা এইখানে। আর দুমিনিট পরে আপনি মাস্টার সুইচ টিপবেন।
একটা টেলিভিশন সেটের সামনে নিয়ে নুরবক্সকে হাজির করল কন্ট্রোলার।
টেলিভিশনের পর্দায় লেসার-বীম প্রজেক্টরের গম্বুজের মত চূড়াটা দেখা যাচ্ছিল। নুরবক্স প্রশ্ন করল, সব প্রস্তুত?’
সব প্রস্তুত, স্যার।’ জানাল কন্ট্রোলার। ঘড়ি দেখে সে বলল, “আর এক মিনিট সময় আছে। তারপর আপনি সুইচ টিপবেন।’
নুরবক্স খুশি হয়ে বলল, চমৎকার! আমাদের এতদিনের চেষ্টা তাহলে এখন সফল হতে চলেছে।’
হ্যাঁ, স্যার।’ ঘড়ি দেখে জাকের বলল, “আর পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড। …আর ত্রিশ সেকেণ্ড।’ ‘…আর বিশ সেকেণ্ড।’
..আর পাঁচ সেকেও।’
• মাস্টার.সুইচের দিক হাত বাড়াল নুরবক্স। কুয়াশা-২৮
হঠাৎ খুব কাছে প্রচণ্ড একটা গর্জন শোনা গেল। আর তার সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে কেপে উঠল মাটি।
তারপর শুরু হয়ে গেল মহাপ্রলয়। নুরবক্স চিৎকার করে উঠল, ব্যাপার কি!’ .জাকের বলল, স্যার, নিশ্চয়ই অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে গেছে।’
‘তাই তো! তাহলে তো সর্বনাশ!’ আর্তনাদ করে উঠল নুরবক্স।
কাঁপছে মাটি। কন্ট্রোলরুমটা দুলছে। যন্ত্রগুলো আর্তনাদ করে ভেঙে পড়ছে । টেলিভিশন সেটটা দড়াম করে এসে কন্ট্রোলারের মাথার উপর পড়ল।
প্রাণভয়ে ইঁদুরের মত দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল নুরবক্স, জাকের আর মমতাজ । চারদিক ধোয়ায় আর ধুলোয় অন্ধকার হয়ে এসেছে। অবিরামভাবে বিস্ফোরণ হচ্ছে।
জাকের,’ চিৎকার করে উঠল নুরবক্স। হোভার ক্র্যাফট?’ ‘রেডি, স্যার। আসুন আমার সঙ্গে।’
জ্বালামুখের পিছনের সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করল ওরা তিনজন। কিন্তু সুড়ঙ্গ-মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে। যখন ওরা ফিরে এল কন্ট্রোলরূমটা তখন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
ককিয়ে উঠল মমতাজ, এখানে থাকলে তো মারাই যেতাম।’’
কন্ট্রোলরূমের ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে ওরা হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল ।
তখনও মহাপ্রলয় চলছে সমগ্র দ্বীপ জুড়ে। বিরাট বিরাট পাথরের খণ্ড ছিটকে, পড়ছে এদিক-ওদিক। ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন। হোভার ক্র্যাফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ল তিনজন।
জাকের বলল, উইন, স্যার। নুরবক্স উঠে পড়ল।
জাকেরও উঠল হোভার ক্র্যাফটে। দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই মমতাজ চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, আমি?’
জাকের বলল, “আর জায়গা নেই।’
চিৎকার করে উঠল মমতাজ, ‘স্যার, আমাকে ফেলে যাবেন না। আমি, স্যার, একেবারে মারা যাব।’
তার কথায় কান দিল না কেউ।
হোভার ক্র্যাফট মাটি ছেড়ে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণ সেটার পিছনে দৌড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মমতাজ। স্তব্ধ হয়ে যোভার ক্র্যাফটটাকে দেখতে লাগল সে। জ্বালামুখের কাছ দিয়ে যাচ্ছে ওটা। প্রবল বেগে ধোয়া উঠছে জ্বালামুখটা থেকে।
হঠাৎ সে দেখতে পেল, বিশাল একটা পাথরের চাই উপর থেকে সোজা গিয়ে ৫৮
ভলিউম-১০
পড়ল হোভার ক্র্যাফটের উপর। পরের মুহূর্তে হোভার ক্র্যাফটটা দুটুকরো হয়ে নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল । পাথরের চাঁইটাও পড়ে গেল মাটিতে।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল হোভার ক্র্যাফটটাতে। . প্রাণভয়ে উল্টোদিকে দৌড়ুতে লাগল মমতাজ। দুমাইল দূরে শহীদ ও কুয়াশা হেলিকপ্টারে বারবার পাক খাচ্ছিল।
শহীদ দূরবীণ দিয়ে নিচের দিকে দেখছিল। সে বলল, কুয়াশা, ওরা আমার মেসেজ পেয়েছে। রওনা দিয়েছে তিনটে জাহাজই।’
কুয়াশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
শহীদ পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখে বলল, এখনও প্রবল বেগে ধোয়া উঠছে আগ্নেয়গিরি থেকে।’
সগর্জনে ছুটে চলেছে হেলিকপ্টার।
একটু পরে শহীদ বলল, ভাল কথা। তুমি যে বারবার নুরবক্স নুরবক্স করছ, আমি তো জানি তুমি নিজে তাকে পাহাড়ী খাদে পানিতে ডুবিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছ।’ | রহস্যজনক হাসি ফুটে উঠল কুয়াশার মুখে। সে বলল, তোমরা যাকে দেখেছ সেটা ছিল অন্য একজনের লাশ।’
বল কি?’ অবিশ্বাসের সুরে বলল শহীদ। তাহলে নুরবক্স ছিল কোথায়? আর খাদ থেকে যার চিৎকার ভেসে এসেছিল সেই বা কে?’
কুয়াশা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি । আমিই তখন আর্ত চিৎকারের ভান করে তোমাদের বোঝাতে চেয়েছিলাম যে নুরবক্সকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
তবুও শহীদের অবিশ্বাস দূর হল না। সে আমতা আমতা করে বলল, কারণ?
কারণ দুটো। প্রথমত আমি তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলাম। বোঝাতে চেয়েছিলাম যে নুরুরক্স মরেছে, আমিও চলে গেছি বিশাল বন থেকে। তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিলে। দ্বিতীয়ত অমরত্বের থিসিস যে পুড়ে গেছে বলে নুরবক্স দাবি করেছিল, আমি তা বিশ্বাস করিনি। আমি ধারণা করেছিলাম ওটা নষ্ট হয়নি। ওটা ওর কাছেই আছে। চাপ দিলেই বের করতে পারব। তোমরা চলে যাবার পর আমি তাই দিন পনেরো ধরে পাহাড়ের প্রত্যেক গুহায় থিসিসের খোঁজ করেছি। শেষ দিন নুরবক্স পালিয়ে যায়।’
শহীদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঠাট্টা করে বলল, ‘এবারে সত্যি সত্যি মারা গেছে তো, না আবার আসবে?’
বলা যায় না!’ মৃদু হেসে বলল কুয়াশা।
Leave a Reply