২৭. অতিমানব ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৭
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট ১৯৭০
এক
তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে কুয়াশার গাড়ি। | অন্ধকার শালবনের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা মসৃণ পথে আর তার দু’পাশের ঘন জঙ্গলের উপর আলোর ঢেউ তুলে ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছে কুয়াশার জোডিয়াক। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে যেন দুটো আলোর সমান্তরাল বৃত্ত নেচে চলেছে। পাশের আসনে বসে আছে কলিম। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনের দিকে। প্রসারিত। হাতে গুলি-ভরা পিস্তল। সবগুলো ইন্দ্রিয় হুঁশিয়ার। যে-কোন মুহূর্তে
যে-কোন দিক থেকে হামলা আসতে পারে। তার জন্যে সে প্রস্তুত।
| মাইল বিশেক যাবার পর গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে এল। চারদিকে সতর্কদৃষ্টিতে লক্ষ্য করে গাড়ি থামাল কুয়াশা। পকেট থেকে সরু পেন্সিল-টর্চটা বের করে দরজা খুলে নেমে পড়ল সে।
কলিম চাপা স্বরে বলল, আমরা ঠিক জায়গাতেইএসেছি, ভাইয়া। আপনি দাঁড়ান, আমি গাড়িটা রেখে আসছি।’
কিট আনতে ভুলিসনে যেন।’ আচ্ছা।
ড্রাইভারের আসনে সরে এসে বসল কলিম। গাড়িটায় স্টার্ট দিল সে। একটু এগিয়ে গিয়ে সাবধানে পথের পাশে নামিয়ে দিল গাড়িটা ।।
কুয়াশা সরু পেন্সিল-টর্চ জ্বেলে কাছেই ঝোঁপ-ঝাড়গুলো দেখছিল। কালো চকচকে একটা বস্তুর উপর আলো পড়তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুয়াশার চোখ দুটো। কালো রং-এর বস্তুটা একটা ফোক্সওয়াগেন। রংটা অবশ্য আসলে কালো নয়। ঘন নীল। রাতে কালোই দেখাচ্ছে।
আবার পথের উপর উঠে এল কুয়াশা। কিট হাতে ততক্ষণে কলিমও এসে গেল।
‘এসেছে তো?”
তাঁ। তুই আমার পিছনে থাকবি । পিস্তল হাতে রাখবি।’ চলুন ।
১১২
ভলিউম-৯
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নীরবে দু’জন এগোতে লাগল সৰু পেন্সিল-টর্চের আলোয়।
| মিনিট পনের পরে দু’জন গিয়ে দাঁড়াল অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায়। আরও একটু সামনে এগোল দু’জন। অন্ধকার এখানে একটু ফিকে। জঙ্গলের মধ্যে শালবনের পাতার ফাঁক দিয়ে কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। জ্যোৎস্নার স্নান রেখা ডালপালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে ওদের চোখে-মুখে।
যেখানে গিয়ে কুয়াশা ও কলিম দাঁড়াল সেখান থেকে তিরিশ গজ দূরে একটা দালান দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় এই গভীর অরণ্যে দালানটাকে একটা ভূতুড়ে বাড়ির মত লাগছিল। অস্পষ্ট আলোতেও বোঝা গেল, পুরানো অতি জীর্ণ দালানটা। কে জানে কে, কবে, কি কারণে এই জঙ্গলের মধ্যে দালানটা তুলেছিল।
পোড়োবাড়িটা ঘিরে চারদিকে দশগজ দূরে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার খুব কাছে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা ও কলিম।
অন্ধকার দালানটায় কোন আলোর রেশ দেখা গেল না। চারদিকে গভীর নৈঃশব্দ। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যায়।
কুয়াশা চারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চাপা স্বরে বলল, কলিম, এসে পড়েছি। কিন্তু এদিকে চাঁদের আলোয় কেউ আমাদের দেখে ফেলতে পারে। আমাদের ঢুকতে হবে পূর্বদিক দিয়ে’। আয়।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দুজন পূর্বদিকে এগিয়ে এল। | পোড়োবাড়িটার ছায়া এসে পড়ায় পুবদিকে অন্ধকারটা একটু গভীর। দু’জন কাঁটাতারের বেড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
কুয়াশা বলল, কাঁটাতারের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ। স্পর্শ মাত্রই সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে যাবে। আর ওর সাথে আছে বৈদ্যুতিক ঘন্টার ব্যবস্থা। স্পর্শের সাথে সাথেই দালানটার ভিতরে কোথাও বৈদ্যুতিক ঘন্টা বেজে উঠবে। সুতরাং প্লয়ার্স দিয়ে কাঁটাতার কাটতে গেলে বিপদ ডেকে আনা হবে। আমাদের উপস্থিতি জানাজানি হয়ে যাবে।’
তাহলে উপায়?’
মাটিতে গর্ত কেটে, সোজা কথায় সিদকেটে ভিতরে ঢুকতে হবে। শাবলটা বের কর। আমি ব্যবস্থা করছি। তুই চারদিকে চোখ রাখিস।’
| নরম ভেজা মাটি। কিন্তু গাছপালার শিকড় থাকায় গর্ত খুঁড়তে অসুবিধে হচ্ছিল। তবু যতটা সম্ভব দ্রুত হাত চালাল কুয়াশা। সবচেয়ে নিচের কাঁটাতারটা মাটি থেকে আঙুল ছয়েক উঁচুতে। সুতরাং গর্তটা গম্ভীর হওয়া দরকার। প্রায় পনের মিনিট ধরে গর্ত খুঁড়ল কুয়াশা। দুজন মিলে মাটি সরিয়ে ফেলল।
শাবলটা কিটের মধ্যে রাখল কলিম।
এক মিনিটের মধ্যেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে দালানটার প্রাঙ্গণের মধ্যে ৮-কুয়াশা-২৭
১১৩
পৌঁছে গেল দু’জন। প্রাঙ্গণটা দ্রুত পায়ে অতিক্রম করে দালানটার অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে কোণে গিয়ে দাঁড়াল দু’জন।
| কান পেতে রইল দুজন। কোন শব্দ আসছে কি? জঙ্গলের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল কুয়াশা। দালানের ছায়াটা জঙ্গলের মধ্যে যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। তার ঠিক উপরেই গাছের পাতার উপর যেন একটা ছায়া নড়ে উঠল। ছায়াটা যেন উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেল।, কুয়াশা কলিমের কানে কানে বলল, ছাদে মানুষ আছে। দালানের সাথে গা মিশিয়ে দে। আর কোন শব্দ যেন না হয়, সাবধান।
কুয়াশা দেখল, ছায়াটা আবার দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে চলে গেল। তারপর আর ছায়াটাকে দেখা গেল না। প্রায় পনের মিনিট দাঁড়িয়ে রইল দু’জন। তারপর কুয়াশা বলল, চল এবার। আমাদের ছাদের উপরেই উঠতে হবে। অন্য পথগুলো এখন নিরাপদ নয়। এই যে পাইপটা। আমি আগে উঠি। তুই পরে আয়। পিস্তলটা কোমরে খুঁজে নে।’
| কুয়াশা দ্রুত পাইপ বেয়ে উঠে গেল। মাথাটা একটু বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল কেউ নেই ছাদে। রেলিং টপকে ছাদে লাফ দিয়ে নামল সে। একটু পরেই কলিমও গিয়ে নামল ছাদের উপর।
চারদিকে পর্যবেক্ষণ করল কুয়াশা। কেউ কোথাও নেই। চিলেকোঠার দিকে, এগিয়ে গেল সে। দরজাটা বন্ধ। পুরানো আমলের জীর্ণ দরজা। কলিম কিট থেকে একটা পাতলা ইস্পাতের পাত বের করে পাল্লার উপর দিকে ঢুকিয়ে আস্তে মোচড় দিতেই কট করে একটা শব্দ হল। খুলে গেল দরজাটা। এক ঝলক চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির উপর।
সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল ওরা কয়েক মিনিট। কলিম ইস্পাতের পাতটা কিটে পুরে পিস্তলটা ডান হাতে তুলে নিল। কলিমকে অনুসরণের জন্যে ইশারা করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল কুয়াশা।।
নিচে দালানের মধ্যে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। সরু টর্চের আলো জ্বেলে পা টিপে টিপে এগোতে লাগল দু’জন। দু’দিকে দেয়াল। মাঝখান দিয়ে সরু প্যাসেজ। দু’বার মোড় নিতে হল, ওদের। তারপর ওরা গিয়ে দাঁড়াল অন্ধকার প্যাসেজের শেষপ্রান্তে। সামনে বিশালকায় এক দরজা। টর্চের আলোয় বোঝা গেল দরজাটা ইস্পাতের। কুয়াশা কলিমের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, আল্টাসোনিক্সের বাক্সটা বের কর।
কিন্তু বের করতে হল না। তার আগেই কে যেন ওদের খুব কাছে থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দীর্ঘ একটানা হাসি। চমকে উঠল কুয়াশা। কেঁপে উঠল কলিম। সে কম্পিতকণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া, বোধহয় ধরা পড়ে গেছি।
| মাথার ঠিক উপরেই জ্বলে উঠল অত্যন্ত জোরালো বৈদ্যুতিক আলো। ১১৪
ভলিউম-৯
কুয়াশার দিকে তাকাল কলিম অসহায়ের মত। কুয়াশার মুখটা ভাবলেশহীন। নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল দু’জন।
তখনও হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধাতব রেশ আছে হাসিতে। লাউড স্পীকারে আসছে শব্দটা। অনেক, অনেকক্ষণ পরে থামল হাসিটা।
লাউড-স্পীকারে শোনা গেল, ‘পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না। পেছনের দরজা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। •••আর সেখানে রয়েছে ভয়ঙ্কর এক প্রহরী।
আবার কলিম তাকাল কুয়াশার দিকে। সে দেখল, কুয়াশার ভাবলেশহীন ভাবটা আর নেই। তার বদলে তার চিবুকের রেখায় ফুটে উঠেছে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের আর কঠিন এক প্রতিজ্ঞার ছাপ। কলিমের ভীতিটুকু দূর হয়ে গেল। সে-ও ফিরে পেল তার আত্মবিশ্বাস।
‘তাহলে এসে গিয়েছ তোমরা এখানে, আলী সাহেব ওরফে কুয়াশা? একা নয় সাগরেদসহ। ভালই করেছ। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানি, তুমি আসবে এবং এটাও জানি আজ রাতেই তুমি আসবে। ভগ্নীপতির জীবনরক্ষার জন্যে তোমায় যে আসতেই হবে। বিধবা বোনের কান্নায় তোমার বুক ভেঙে যাবে যে। আর আমার কথা যদি বল তাহলে আমি বলব, প্রধান অতিথি ছাড়া আমার আজকের উৎসব চলবে কি করে? শুধু টিকটিকি মেরে যদি হাত গন্ধ করতে হয় তাহলে আমার এই অতিমানবীয় জীবনটাই বৃথা।
হাঃ হাঃ অট্টহাসি ভেসে এল।
এদিকে সামনের লোহার দরজাটার দুটো পাল্লা ধীরে ধীরে দু’পাশে দেয়ালের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। সামনেই একটা বিরাট কক্ষ ওদের চোখে পড়ল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।
‘ঢুকে পড়,’ হাসি থামিয়ে নির্দেশ দিল কণ্ঠটা।
কুয়াশা ও কলিম নীরবে ঢুকে পড়ল। কক্ষটা শূন্য। কেউ নেই। শুধু ডানদিকে একটা বন্ধ দেয়াল-আলমারি দেখা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাল কুয়াশা। পিছন ফিরে দেখল, লোহার দরজার পাল্লা দুটো আবার ধীরে ধীরে দেয়ালের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে। ডানদিকের দেয়াল-আলমারিটার দিকে তাকাল সে। তার দুটো পাল্লাও ততক্ষণে খুলে গেছে।
কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ ভেসে এল মাইক্রোফোনে, সাথে যা কিছু আছে সব ওখানেই রেখে দাও। হাতের ঐ কিটটা। পেন্সিল-টর্চটা, পিস্তলটা। অন্য কোন অস্ত্র থাকলে তা-ও রেখে দাও।’
কুয়াশার ইঙ্গিতে কলিম কিট আর পিস্তল মেঝেয় রেখে দিল। কুয়াশা টর্চটা রেখে দিল। কোমর থেকে থ্রোয়িং নাইফটাও বের করে মেঝের উপর রাখল।
সিগারেট লাইটারও রেখে দাও, তবে সিগারেট সাথে রাখতে পার। জীবনের শেষবারের মত তোমাকে ধূমপান করতে দেব না এমন নিষ্ঠুর লোক আমি নই।
কুয়াশা-২৭
| ১১৫
মাথা নিচু করে হাসল কুয়াশা। একটা সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা মেঝের উপর রাখল সে।
| আশা করি, তোমাদের সাথে আর কোন অস্ত্র নেই। মাথা নাড়ালেই আমি বুঝতে পারব।’
মাথা নাড়ল কুয়াশা।
‘বেশ, এবারে ঐ আলমারির মধ্যে ঢুকে পড়। তবে মনে রেখ, অন্য কোন অস্ত্র যদি তোমাদের কাছে খুঁজে পাই তাহলে পরিণাম হবে মারাত্মক। এস এবার। . কয়েক পা এগিয়ে ওরা দুজন আলমারিটার কাছে পৌঁছল। বৈদ্যুতিক আলোয় উজ্জ্বল একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। সিঁড়ির ঠিক নিচেই আর একটা দরজা। পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ে কুয়াশা দেখতে পেল আলমারির দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছুতেই সামনের বন্ধ দরজাটা খুলে গেল।
খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল দু’হাতে দুটো রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক মুখোশধারী। রিভলভার দুটোর লক্ষ্য ওরা দু’জন।
‘এস ভিতরে এস, মরণবিজয়ী আলী সাহেব। বক্তার কণ্ঠে বিদ্রূপ। ভিতরে ঢুকল কয়াশা আর কলিম।
ড.রাজীর বাসায় আমাকে জ্বালাতন করেছ, কিন্তু তারপরে আমায় নতুন করে কষ্ট না দিয়ে নিজে যেচে চলে এসেছ বলে ভারি খুশি হয়েছি,’ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল মুখোশধারী।..
তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কুয়াশা। বিদ্রপে তারও ঠোঁট ঈষৎ বেঁকে গেল। কোন জবাব না দিয়ে সে রূমটার চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। একটু দূরেই দুটো চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে শহীদ ও কামাল। তাদের দুজনের দৃষ্টিই তার দিকে নিবদ্ধ। সে দৃষ্টিতে যেন আশার আলো। কুয়াশার দৃষ্টিটা ঘুরে ফিরে আবার মুখোশধারীর উপর নিবদ্ধ হল।
| মুখোশধারী দাঁড়িয়ে ছিল একটা টেবিলের পাশে। বাঁ হাতের রিভলভারটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলল, “এখুনি শুরু হবে অতিমানবীয় মহাযজ্ঞ। আমার রূমের আজকের এই চার অতিথিকে অভিনব পন্থায় মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই রুমের পিছনে আছে একটা কাঁচের তৈরি রূম। তার ভিতর থেকে সমস্ত অক্সিজেন বের করে নেয়া হয়েছে। তোমাদের একজন করে সেই কাঁচের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কি করে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যায় বাকি কয়েকজন মিলে তাই দেখব। সবশেষে কাঁচের ঘরে ঢুকবে শ্রীমান কুয়াশা। কিন্তু তার আগে কুয়াশা সাহেব, ড. রাজীর বাসা থেকে যে ফর্মুলা চুরি করেছ সেটা বের করে দাও দেখি ভাল মানুষের মত। আশা করি, ওটা তোমার সাথেই আছে। অন্তত থাকতে পারে সাথে।
কুয়াশা জবাব দিল না। সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছিল। সে বলল, যদি অনুমতি দাও আর একটা সিগারেট ধরাই।
ভলিউম-৯
১১৬
বিলক্ষণ। কিন্তু দেরি করলে চলবে না। আমার সময় কম।’
কুয়াশা আর একটা সিগারেট বের করল। নিঃশেষিত-প্রায় সিগারেটের আগুনে সেটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল একগাল।
মুখোশধারী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বের কর, কুয়াশা, সেই কাগজগুলো। বলেছি তো, আমার সময় কম।’
‘ঠিক। তোমার সময় হয়ে এসেছে, মুখোশধারীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কুয়াশা।
বটে,’ সঁতে দাঁত ঘষল মুখোশধারী। বেয়াদবীর অর্থ জান? কার সাথে কথা বলছ আশা করি তা বুঝতে পারনি। মনে রেখ, আমি সুপারম্যান। তোমাদের এই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সবচেয়ে প্রতিভাধর প্রাণী। আমার সাথে কোনরকম চালাকি করে পার পাবে না। আমি সাধারণ নই। অসাধারণ।
জবাবে কুয়াশার ঠোঁটটা ঈষৎ বেঁকে গেল।
‘এখনও বের করে দাও। না হয় বল, কোথায় রেখেছ, ধমক দিল মুখোশধারী।।
হাসল কুয়াশা। শহীদ ও কামালের দিকে একবার তাকাল সে। ‘দিতে পারি এক শর্তে,’ একটু পরে বলল সে ।
‘কোন শর্ত আমি মানি না। ওটা দিতে হবে,’কঠোর কণ্ঠে বলল মুখোশধারী। ‘ওটা আমার চাই-ই।’
তুমি না সুপারম্যান! দুনিয়ার একমাত্র প্রতিভা! তাহলে ওগুলো দিয়ে তুমি কি করবে? তাছাড়া এ ফর্মুলা তোমার কি-ই বা কাজে আসবে! ইউজেনিকসের ফর্মুলা তো তোমার জানাই আছে। বলতে গেলে যারা ওটা উদ্ভাবন করেছে তারা তোমার…।’
মুখোশধারী চিৎকার করে উঠল। কুয়াশার কণ্ঠ ছাপিয়ে সে বলল, সে কৈফিয়ৎ তোমাকে আমি দিতে রাজি নই। তবু বলছি, আমি ছাড়া ও বিদ্যা অন্য কেউ জানুক আমি তা চাই না। ওটা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
কিন্তু, কুয়াশা মৃদু গলায় বলল, অনেকেই তো এখন তা জেনে ফেলেছে। লুকম্যান এইচ কিমের সহকারীরা প্রত্যেকেই জানে ইউজেনিকসের গোপন রহস্য।
আবার হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল মুখোশধারী। তারপর সে বলল, ‘জানে বৈ কি; নিশ্চয়ই জানে। অন্তত জানে বলে মনে করে। ফমূলা অবশ্যই জানে কি? প্রয়োগ করার সামর্থ্য ওদের কারও নেই। ওরা বড়জোর সুপারগিনিপিগ জন্ম দিতে পারে। কিন্তু সুপারম্যান অসম্ভব। তবু আমি সে সম্ভাবনাটুকুরও অবসান ঘটাব। শক্রর শেষ রাখব না আমি। আগামীকালের মধ্যে আমার কোন শত্রু এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে না।’
মুখোশধারী থামল। তারপর বলল, “কিন্তু এসব আলাপনের দরকার নেই। কুয়াশা-২৭
১১৭
আদায় করতে হর করব, চিৎকার করে সবাইকে মরতে হবে ন
বের করে দাও কাগজগুলো।
‘তুমি একটা আস্ত মূর্খ। তুমি কি মনে কর, ওগুলো আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি?’
‘একেবারে নিশ্চিতভাবে তা মনে করি না। কারণ আমি বেওকুফ নই। বেশ তো, কোথায় আছে বল।।
বলেছি তো, এক শর্তে ওগুলো পাবে। ছেড়ে দিতে হবে আমাকে এবং এই তিনজনকে।
‘অসম্ভব। কাউকে আমি ছাড়ব না। সবাইকে মরতে হবে। যেভাবেই হোক আমি ফর্মুলা উদ্ধার করব, চিৎকার করে উঠল মুখোশধারী। কেমন করে ওটা আদায় করতে হয়, আমি জানি। তোমার সামনে যখন তোমার ভগ্নীপতি, ঐ টিকটিকিটা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে বসবে তখন বের করে না দিয়ে পথ পাবে
তুমি।’ দুটো খালি চেয়ার দেখিয়ে মুখোশধারী বলল, যাও, ওখানে গিয়ে বস। তোমাদের এইভাবে বাঁধন-মুক্ত রাখা উচিত নয়। যাও,’ বজ্রকণ্ঠে নির্দেশ দিল। মুখোশধারী।। | কুয়াশার হাতের সিগারেটটা অর্ধেক হয়ে এসেছিল। সে আর একটা টান দিয়ে খালি চেয়ারের দিকে এগোল এবং মুহূর্তের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে দিল মুখোশধারীর দিকে। সিগারেটটা গিয়ে পড়ল মুখোশধারীর ডানহাতের কব্জিতে। প্রচণ্ড শব্দে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল কিছুটা জায়গা। কেঁপে উঠল কামাল ও কলিম। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শহীদ।
ধোয়া যখন কেটে গেল তখন দেখা গেল টেবিলটা উল্টে গেছে। তার পাশেই কুয়াশা ও মুখোশধারী মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ। মুখোশধারীর রিভলভারসুদ্ধ হাতটা উপরের দিকে। সে হাতটা নামাতে চেষ্টা করছে, অন্যদিকে কুয়াশা হাতটা নামাতে দিচ্ছে না। দ্বিতীয় রিভলভারটা গিয়ে পড়েছে কামালের চেয়ারের কাছে।
চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল কলিমের। সে রিভলভারটা ধরবার জন্যে দ্রুত এগিয়ে গেল। রিভলভারটা তুলতেই কে যেন চিৎকার করে উঠল। আর পরমুহূর্তেই পাজরে প্রচণ্ড একটা লাথি পড়ল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে কামালের চেয়ারের উপরে। চেয়ারসুদ্ধ কামালকে নিয়ে সে পড়ল মেঝেতে। মাথাটা ঠুকে গেল দেয়ালে। রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে কখন তা টের পায়নি কলিম। তার তখন মাথা ঘুরছে। তবু প্রাণপণ চেষ্টায় সে চোখ দুটো খুলল । আক্রমণকারী তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়টা ভাটার মত রক্তবর্ণ চোখ দুটো দিয়ে তাকে যেন গিলে খাচ্ছে। তার হাত দুটো সাঁড়াশির মত এগিয়ে আসছে। ভয়ে দু’চোখ বুজল কলিম। কামালও ভয়ে চোখ বন্ধ করল। শহীদ চিৎকার করে উঠল। | ওদিকে মুখোশধারী ও কুয়াশার মধ্যে তখন প্রচণ্ড মল্লযুদ্ধ চলছে। দু’জনের ১১৮
ভলিউম-৯
কেউ কাউকে বাগে আনতে পারছে না। অস্ফুট একটা আর্তনাদ কানে যেতেই শহীদ সেদিকে ফিরে তাকাল। সেখানেও একই দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। মুখোশধারীর হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলভারটা কুয়াশার হাতে চলে গেছে কিন্তু সে হাতটা ঘোরাতে পারছে না কোন মতেই। মুখোশধারী কুয়াশার হাতটা শূন্যে তুলে ধরে আছে। দাবার দান পাল্টে গেছে।
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছে কুয়াশা এবং প্রচণ্ড শক্তিতে সে মুখোশধারীর তলপেটে একটা লাথি মেরেছে। | লাথি খেয়ে পড়ে গিয়ে কেক করে উঠল মুখোশধারী। চিৎকার করে উঠল, ‘পেদ্রো!
পেদ্রো ঘুরে তাকাল এবং মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি অনুধাবন করে কলিমকে ছেড়ে কুয়াশার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই কুয়াশার হাতের রিভলভারটা গর্জে উঠল। পরপর দু’বার ‘গুডুম করে শব্দ হল। বুকে গুলি লেগেছে। দু’হাতে বুক চেপে ধরেছে পেদ্রো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে তার রক্তবর্ণ দেহ থেকে। পাহাড়টা কাঁপছে। মৃত্যু-যন্ত্রণায় তার বীভৎস মুখটা বীভৎসতর হয়ে উঠেছে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পেদ্রোর বিশাল দেহটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। কুয়াশা মুখ ফিরিয়ে দেখল মুখোশধারী অদৃশ্য হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে মিলেয়ে গেছে। দরজাটা খোলা। উদ্যত রিভলভার হাতে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
কলিম ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। ডান পাটা তুলে মোজার ভিতর থেকে বের করল একটা ব্লেড। আবার সে বসল উবু হয়ে । ব্লেডটা দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কামালের হাতের বাঁধন কেটে ফেলল। তারপর শহীদের হাতের বাঁধন কাটল। তারপর আর সে পারল না, পড়ে গেল মেঝের উপর।।
কামাল ততক্ষণে তার পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছে। সে ব্লেড নিয়ে শহীদের পায়ের বাঁধন কেটে দিল।
কুয়াশা ফিরে এল। ধীরে ধীরে সে গিয়ে দাঁড়াল দৈত্যাকার প্রাণীটার মৃতদেহের পাশে। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে মৃতদেহটার দিকে। রক্তে মেঝেটা ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তার মধ্যে পড়ে আছে বিশাল মৃতদেহটা নিস্পন্দ হয়ে। অবিশ্বাস্য ওর দেহের আয়তন। আর কি বীভৎস চেহারা! বিরাট মাথায় এতটুকু চুল নেই। ভুরু নেই। দাড়ি-গোঁফের চিহ্ন নেই। কপালটা সামনের দিকে বেরিয়ে আছে। চোখ দুটো কুতকুতে, গভীর দুটো গর্তের মধ্যে। মুখভর্তি ছোট বড় অসংখ্য আব। নাকটা থ্যাবড়া। রক্তের মত দেহবর্ণ ।
কলিমের চেতনা ফিরে এসেছিল। সে ধীরে ধীরে উঠে কুয়াশার পাশে দাঁড়াল। আশ্চর্য, মানুষ সত্যি এমন দৈত্যের মত হতে পারে!
কামাল বলল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ, কলিম? দৈত্যটা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি কখনও। কুয়াশা-২৭
১১৯
নিশ্চয়ই ও ছিল বোবা।’
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপারটা কি জান, কামাল? এই দানবটার বয়স মাত্র দুবছর।’
দু’বছর মাত্র, বল কি!’ বিস্ময় প্রকাশ করল শহীদ।
হ্যাঁ, মাত্র দু’বছর। এর মধ্যেই ওর দেহে পূর্ণতা এসেছে। ও হচ্ছে আলাদিনের সেই দৈত্যের মত, যাকে সুপারম্যান জন্ম দিয়েছে আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। অথচ দৈত্যটাকে একটা স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেও জন্ম দেওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে হয়ত সে দু’বছরে পূর্ণতা লাভ করত না। আসলে জন্মও ওর কৃত্রিম। জন্ম ওর স্বাভাবিক নয়, আর কোন মানবীর, গর্ভেও নয়। জন্ম ল্যাবরেটরির টেস্ট-টিউবে। সুপারম্যান নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্যে এই অস্বাভাবিক জন্ম দিয়েছে ওদের।
‘ওদের বলছ কেন?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
কারণ এমন দৈত্য আরও একটা আছে। জানি না সেটাকে কোথায় রাখা হয়েছে। যতদূর মনে হয় এখানেই, অন্তত আমার হিসেবে তো তাই বলে।
সর্বনাশ!’ কামাল বলল, আরও একটা আছে! আর এখানেই আছে,’ স্মরণ করিয়ে দিল শহীদ। সাবধান।
কুয়াশা হঠাৎ সচকিত হয়ে বলল, “কিন্তু আমাদের এখুনি এই জায়গাটা ত্যাগ করা দরকার। শয়তানটা পালিয়েছে বটে তবে যে-কোন মুহূর্তে আবার হামলা হতে পারে। আমি ডায়নামোটা নষ্ট করে দিয়ে এসেছি। এখন আর দরজা বন্ধ করতে পারবে না বোতাম টিপে। কিন্তু সাবধানের মার নেই। তাছাড়া আরও একটা ডায়নামো আছে। সেখান থেকে বাইরে কাটাতারের বেড়ায় বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে।’
মৃতদেহটার দিকে শেষবারের মত নজর বুলিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ওরা। কিন্তু আর কোন বিপত্তি ঘটল না। অলি-গলি পেরিয়ে যখন ওরা দালানের বাইরে পা দিল তখন ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া ওদেরকে অভিনন্দন জানাল। জুড়িয়ে গেল ওদের দেহ-মন।
রাতের আঁধার কেটে গেছে। কুয়াশাসিক্ত প্রাঙ্গণ পেরিয়ে ওরা ভোরের অস্পষ্ট আলোয় কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে চলে এল।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলল। কামাল হঠাৎ বলল, কিন্তু লোকটাকে চিনতে পারলাম না।
তুই চিনবি কি করে? এই নাটকের পাত্র-পাত্রীদের মধ্যে তুই তো শুধু ড. রাজী, রোকেয়া আর কুয়াশাকে চিনিস। আর তো কাউকে তুই দেখিসনি। অন্যদের সাথে আলাপ-পরিচয় হলে ঠিকই চিনতে পারবি, অবশ্য তুই যদি তোর মাথার গ্রে সেলগুলোকে কষ্ট দিস একটু।
ভলিউম-৯
১২০
ঠাট্টা করছিস?” “ছিঃ ছিঃ, কি যে বলিস। খালিপেটে এই সাত-সকালে ঠাট্টা? তারপর আবার এই হেনস্তার পর? | হাঁটতে হাঁটতে ওরা বড় সড়কে গিয়ে উঠল। কুয়াশা একটা ঝোঁপের মধ্যে উঁকি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘পালিয়েছে। গাড়িটাও নেই।’
‘এহ্-হে। একেবারে কেটে পড়েছে?’ ক্ষুব্ধ শোনাল কামালের কণ্ঠ, ‘তুমি কেন দ্বিতীয় গুলিটা ঐ বদমাশটার দিকে ছুঁড়লে না?
সময় পেলাম না, ভাই,’ অপরাধীর মত বলল কুয়াশা।
কলিম গাড়ি আনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, ভাইয়া। চারটে চাকাই ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে।’
পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল ওরা কিছুক্ষণ। তাহলে?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
হাঁটতে হবে। আদি ও অকৃত্রিম শ্রীচরণ ভরসা,’ কামাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
হাঁটতে হাঁটতে এগোতে লাগল ওরা। শহীদ একসময় প্রশ্ন করল, এবার তুমি কি করবে?’
‘তোময়া তোমাদের পথ ধরে চল, আমি আমার পথ ধরে এগোেব। আই মাস্ট স্ম্যাশ হিম। আই অ্যাম প্রমিজ-বাউণ্ড টু এ ডেড ম্যান।’
কামাল বলল, কিন্তু সে যদি ভেগে যায়?’
শহীদ এ কথার জবাব দিল। সে বলল, “ঐ ফর্মুলাটা না নিয়ে সে ভাগতে পারে না। দ্বিতীয় কোন সুপারম্যান জন্ম নিক, তা সে চায় না। সুতরাং সে ভাগবে
। আমার সবচেয়ে ভয় হচ্ছে, ইতিমধ্যেই সে ড. রাজী আর তার সহকারীদের কোন ক্ষতি না করে বসে।
| কুয়াশা বলল, ‘সেই আশঙ্কাটা আমার মনেও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে টায়ার ফাঁসিয়ে দেওয়াতে। কে জানে, ইতিমধ্যেই কোন সর্বনাশ হয়ে গেল কিনা, তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
মাইল খানেক যেতেই একটা মোড়ে গিয়ে পৌঁছুল ওরা। কুয়াশা বলল, ‘এখানেই দাঁড়াও তোমরা। বাস পাবে। আমি আর কলিম এখান থেকেই বিদায় নেব? চলি, শহীদ। চলি, কামাল।
প্রাতঃরাশ সেরে শহীদ একটা বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা টেনে নিয়ে বসল ড্রইংরূমে। পত্রিকাটিতে একদা জেনেটিকস সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ চোখে পড়েছিল শহীদের। কিন্তু তখন উৎসাহ বোধ করেনি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সে আরাম করে একটা সোফার উপর বসল। কুয়াশা-২৭
১২১
কামালের ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু সুপারম্যান সম্পর্কে আর রিসার্চ সেন্টারের জটিল ঘটনা সম্পর্কে উৎসাহ ছিল বলে সে-ও গুটিগুটি ড্রইংরূমে গিয়ে বসল। শহীদ বই নিয়ে বসায় সে বলল, “কিরে, তুই যে এখন পড়তে বসলি বড়?’ | মহুয়া ফোঁস করে উঠল, বললাম একটু ঘুমিয়ে নাও। তা আমার কথা শুনলে
তো?’
কিন্তু মহুয়ার কথা যে শহীদের কানে যায়নি তা বুঝতে বিলম্ব হল না।’শহীদ ততক্ষণে প্রবন্ধটার মধ্যে ডুব দিয়েছে। অগত্যা কামাল বিদায় নিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার তুমি তোমার পণ্ডিত-পতির কানের কাছে ঘন্টা বাজাও, আমি চললাম।
‘বোস না। যাবেই বা কোথায়?
আমার ঘুম পাচ্ছে বড়। আমি তো আর তোমার পতি-দেবতার মত আহার নিদ্রা রোগ-শোক, জ্বরা বিজয়ী সুপারম্যান নই, আমি অতি সাধারণ নগণ্য অধম মানুষ কামাল উদ্দিন। আমার খিদে পায়, ঘুম পায়, অসুখ-বিসুখ করে, হাত-পা নেড়ে বলল কামাল।
তার অঙ্গভঙ্গিতে হেসে ফেলল মহুয়া। সে বলল, “বেশ তো, যাবেই না হয়। এত হৈ-চৈ করছ কেন? দুদণ্ড জিরোও। খিদে তো শুধু দেহেরই নয়, মনেরও খিদে আছে। বেশ কঠিন একটা বই নিয়ে আত্মিক পিপাসা মিটাও না হয় বন্ধুর পাশে বসে।’
| ‘উই, ওটি হচ্ছে না,’ মাথা নেড়ে বলল সে। ওসব দিগগজ পণ্ডিতদের ব্যাপার। ওর মধ্যে আমি নেই। আমার হল খাই-দাই-বেড়াই, সিনেমা দেখি, জনৈক ডিটেকটিভের সাগরেদী করি। কিন্তু বই-পত্র দেখলেই আমার ভয় হয়। জ্ঞান-পিপাসাটা তো তুমি জানই আমার তত প্রবল নয়।’
তাহলে.কোন পিপাসাটা প্রবল অন্তত, এই মুহূর্তে? কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই টেলিফোনটা বেজে উঠল।
রিসিভারটা তুলল মহুয়া, হ্যালো?..হ্যাঁ, উনি আছেন। ধরুন আপনি দয়া করে।•••ওগো, তোমার ফোন, শেষের কথাটা বলল স্বামীর উদ্দেশ্যে। রিসিভারটা বাড়িয়েও দিল তার দিকে।
‘হ্যালো?..হ্যাঁ, শহীদ বলছি।..হা…আচ্ছা। আধ ঘন্টার মধ্যে, রিসিভারটা মহুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ। কামালের উদ্দেশ্যে বলল,
আমাদের আশঙ্কাটাই শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হয়েছে রে।’
আবার কি হল?’ কামাল প্রশ্ন করল।
সকাল থেকে ড, রাজীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজে দশটা। তাছাড়া ড. রাজীর বাড়িতে চুরিও হয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই ইউজেনিকসের ফর্মুলা?”
ভলিউম-৯
১২২।
মাথা নাড়ল শহীদ।
তার মানে, তুমি এখনি আবার বেরোচ্ছ?’ মহুয়া প্রশ্ন করা।
হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। তুমি ঝটপট এককাপ চায়ের ব্যবস্থা কর তো, লক্ষ্মীটি। গাটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। ঘুমের ভাবটা দূর হচ্ছে না কিছুতেই।
যথা আজ্ঞা, প্রভু। মহুয়া নিষ্ক্রমণ করল।
তুই বোস হতভাগা চুপ করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার হয়ে যাবে। বেশ ইন্টারেস্টিং আর্টিকল। অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য আছে এটার মধ্যে।
| তা বসছি, বাওয়া। কিন্তু তোমার সাথে আমি এখন বেরোচ্ছি না। ‘কেন? সুপারম্যানের ভয়ে, না পেদ্রোর কাউন্টার-পার্টের ভয়ে?
“যাঃ, ‘এই শর্মাকে ভয় পেতে দেখেছিস কখনও? আসলে আমার সত্যি ঘুমে ধরেছে।
তবে থাক। কিন্তু মনে হচ্ছে যবনিকাপাতের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। হয়ত আজকে, এই এক্ষুণি সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।’
বলিস কিরে!তাহলে তো যেতেই হচ্ছে তোর সাথে। এমন একটা কাণ্ড ঘটবে, আর আমি যাব না, এটা হতেই পারে না,’ সোৎসাহে বলল কামাল।
কিন্তু তোর যে ঘুম পাচ্ছে?
দু’কাপ কড়া চা,না চা নয়। কফি খেয়ে নেব। দেখ না, ঘুম পালায় কোথায় । যাই আমি, এখুনি কফির ফরমাশটা দিয়ে আসি। তুই চালিয়ে যা ততক্ষণ, মানে, বিদ্যেটা হজম করে নে।’
দুই লাফে বেরিয়ে গেল কামাল।
শহীদ হাসল। মনে মনে বলল, আচ্ছা ছেলে-নুষ। কৌতূহলে একেবারে টগবগ।
পত্রিকাটির দিকে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে এবং পরমুহূর্তেই বাহ্যিক দুনিয়ার সম্পর্কে তার আর কোন অনুভূতি রইল না। যেন দুনিয়ায় সে আর ঐ পত্রিকাটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
দুই
লীনা ঢুকল অন্য দরজা দিয়ে। তার হাতে একটা খাম। সেটা সে শহীদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দাদা, তোমার চিঠি। এক হোকরা দিয়ে গেল।
| খামটা ছিঁড়ে ছোট এক টুকরো কাগজ বের করল ও। ছোট সাদা এক টুকরো কাগজে দুলাইন মাত্র লেখা
কপালের জোরে বেঁচে গেছ। কিন্তু ক্ষমা আমি কাউকেই করব না। কুয়াশা-২৭।
১২৩
শত্রুর শেষ রাখব না। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও।
কোন স্বাক্ষর নেই। কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখল শহীদ। সাধারণ সাদা কাগজ থেকে কেটে নেওয়া এক টুকরো কাগজ। খামটাও উল্টে-পাল্টে দেখল সে। নাম ঠিকানাহীন খাম।
লীনা শহীদের দিকে তাকিয়েছিল । তার চেহারায় কোন পরিবর্তন দেখা না দিলেও চিঠি ও খামটা উল্টে-পাল্টে দেখায় সে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার দাদা, কে লিখেছে চিঠি?’
কামাল ফিরে এল। শহীদের হাতে খাম আর কাগজটা দেখে বলল, কি ব্যাপার,কোন গোলমাল?’
, কিছু না। হারে লীনু, সেই ছোকরাটা আছে না ভেগেছে? চলে গেছে! বল না দাদা, কি হয়েছে?
“তেমন কিছু না। ওটা একটা রুটিন মাফিক ব্যাপার। দেখে নেব ব্যাটার জান্তব চোখ রাঙানী। ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে। সেই লোকটা লিখেছে, সারারাত যার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম।’
কিন্তু তুমি সাবধানে থেক, দাদা।
হয়েছে রে হয়েছে। শেষটায় তুইও ভয় পেলি? তুই না সাহসী মেয়ে? মনে নেই বুঝি, গভীর রাতে তুই জলার ভিতর ডুব দিয়েছিলি সায়লা বেগমের শিশু সন্তানকে বাঁচাবার জন্যে?’
ভয় আমি পাইনি, দাদা। কিন্তু বৌদির কাছে যা শুনলাম তাতে স্বস্তিবোধ করারও কোন কারণ দেখছিনে। এ তো আর সাধারণ মানুষের ব্যাপার নয়, কি সব ভয়ঙ্কর অতিকায় মানুষের কাণ্ড। তাছাড়া সাবধানের মার নেই।’
‘ঠিক ঠিক, তুমি ঠিক বলেছ লীনা,’ কামাল সায় দিল। সাবধানের মার নেই।’ লীনা ফোঁস করে উঠল, কিন্তু কথাটা তুমিও স্মরণ রাখলে বাধিত হব।’
মহুয়া একটু আগেই ‘ঢুকেছিল। সে বলল, ‘তাই তো বলি, সেই কিনা বলে, কাকে যেন মেরে কাকে শেখায়?
‘বৌদী!’ চেঁচিয়ে উঠল লীনা। তীব্র একটা কটাক্ষ হেনে সে বেরিয়ে গেল।
কামালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল মহুয়া। শহীদ তখন ঘূর্ণায়মান পাখাটার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কামাল ব্যস্ততার সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট বের করল।।
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ফিরে এল লীনা। সে বলল, ‘দ্যাখ দাদা, কাকে নিয়ে এসেছি।’
শহীদ মুখ তুলতেই দেখল মি. সিম্পসন অত্যন্ত বিষণ্ণ মুখে ড্রইংরূমে ঢুকছেন।
| ‘আরে, মি. সিম্পসন যে! কবে এলেন?’ সোল্লাসে প্রশ্ন করল কামাল। ১২৪
ভলিউম-৯
আসুন, মি. সিম্পসন। বসুন। কেমন আছেন? কাল এসেছি। ভালই আছি, একসঙ্গে দু’জনের প্রশ্নেরই জবাব দিলেন তিনি।
আপনি না বছর খানেকের ছুটি নিয়েছেন? তা এত তাড়াতাড়ি ফিরলেন যে? শরীর ভাল তো?’ এবারের প্রশ্নকর্তা শহীদ।
শরীরটা ভাল বলেই চলে এলাম। জয়েন করিনি অবশ্য। তবে শিগগিরই করতে হবে। সম্ভবতু কালকেই করব,’ বসতে বসতে বললেন মি. সিম্পসন।
ভালই করেছেন। আমরা বেশ একটা ইন্টারেস্টিং কেস পেয়েছি। এবারে দৈত্য-দানো নিয়ে কারবার, কামাল বলল।
| শুনেছি, আর সেই জন্যেই তোমাদের কাছে আসতে হল। হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের ঘটনা তো? আমিও সেই কানেকশনে এসেছি। সেন্টারের ডিরেক্টর ড. রাজী আমার বিশিষ্ট বন্ধু। ওর মেয়ে রোকেয়া আধঘন্টা আগে আমায় ফোন করে জানিয়েছে, ওর বাবাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাই দ্য ওয়ে, রোকেয়া আর আমি গতকাল একসাথেই ফিরেছি। এদিকে চৌধুরী গোলাম হাক্কানী আজ সকালেই রিসার্চ সেন্টারের ঘটনাগুলো বলেছিলেন আমায়। আঙুলের ছাপগুলোও আমাকে দেখিয়েছেন। মহা ফ্যাসাদে পড়েছেন চৌধুরী সাহেব । আমার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছিলেন। তোমাদের কথাও তিনিই বললেন আমাকে। তাই ড. রাজীর বাসায় যাবার আগে তোমাদের এখানটাতেই এলাম।’
| বেশ করেছেন। আমিও এইমাত্র ফোনে খবর পেলাম যে, ড, রাজীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চা খেয়েই বেরোচ্ছিলাম।
মহুয়া মি. সিম্পসনের সামনে খাবারের প্লেট ও চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, চা নিন, মি. সিম্পসন।
ধন্যবাদ। তা আপনি ভাল তো, মিসেস খান? ‘খু-উ-ব ভাল।’
চা খাওয়া শেষ হতেই বেরিয়ে পড়ল ওরা। কামাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নেহায়েত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সঙ্গী হল ওদের। গাড়িতে উঠবার আগেই তাকে নিচুস্বরে কয়েকটা নির্দেশ দিল শহীদ। সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ।।
শহীদ আর নিজের গাড়ি নিল না। কামালকে নিয়ে মি. সিম্পসনের গাড়িতেই উঠল। মি. সিম্পসনকে সংক্ষেপে.ঘটনাগুলো জানাল সে।।
মি. সিম্পসন সবটা শুনে বললেন, তাহলে শুধু তোমরাই নও, কুয়াশাও লেগেছে সেই সো-কল্ড সুপারম্যানের পিছনে?”
য,’ শহীদ বলল। তার ইন্টারেস্টটা কি?
সে নাকি কার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে শপথ নিয়েছে, যেমন করে থোক ইউজেনিকসের সম্ভাবনা সে বিনষ্ট করবে এবং সুপারম্যানকে ধ্বংস করবে। কুয়াশা-২৭
১২৫
অন্যথায় তার নিজের এবং যার কাছে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার ধারণা, সুপারম্যান অথবা ইউজেনিকস স্পেশালিস্ট ইচ্ছে করলেই সমগ্র মানবজগতের চরম ক্ষতি সাধন করতে পারে।’
ই। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
আর এ ধারণা যে যথার্থ তার প্রমাণ তো কুয়াশা নিজেও পেয়েছে। আমরাও পেয়েছি।’
তাহলে ড. রাজী সেই সুপারম্যানেরই পাল্লায় পড়েছে?” নিঃসন্দেহে। অবশ্য যদি সে সত্যি নিখোঁজ হয়ে গিয়ে থাকে। যদি বলছ কেন?
‘এখন তো বাজে মাত্র এগারটা। এমনও তো হতে পারে যে, সে সকালে কাউকে কিছু না বলে কোন কাজে বেরিয়ে গেছে?’
তা মনে হয় না। সম্ভাব্য সব জায়গাতেই তার খোঁজ করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এভাবে সে কখনও বেরোয় না।’
তার সহকারীদের খবর কি? তারাও কি কিছু জানে না?’ কামাল জানতে চাইল।
| মি. সিম্পসন বললেন, ‘সেটা অবশ্য কিছু বলেনি রোকেয়া।।
হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের কাছে পৌঁছুতেই শহীদ গাড়ি থামাতে বলল। মি. সিম্পসন গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রিসার্চ সেন্টারে যাবে নাকি এখন?’
‘আমি না। কামালের কি একটা দরকার আছে।’ গাড়ি থামালেন মি. সিম্পসন। কামাল নামল। মিনিট পাঁচেক পরে গাড়ি ড. রাজীর বাড়ির সামনে পৌঁছুল।
সামনের লনে উদ্বিগ্ন রোকেয়া অপেক্ষা করছিল। গাড়ির শব্দ শুনেই সে ছুটে এল। গাড়িতে শহীদ ও মি. সিম্পসনকে দেখে যেন সে নিরাশ হল। মেয়েটাকে দেখে মায়া হল শহীদের। বোধহয় ইতিমধ্যেই খুব কেঁদেছে রোকেয়া। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। চোখে শঙ্কার ছাপ। বেশভুষা মলিন। চুল অবিন্যস্ত।
মি. সিম্পসন গাড়ি থেকে নামতেই ঝরঝর করে রোকেয়ার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামল।
মি. সিম্পসন কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সস্নেহে বললেন, “ছিঃ মা, কাঁদে না। যেমন করে হোক, তোমার বাবাকে খুঁজে বের করব। এখন তো মা তোমাকে সংযম হারালে চলবে না। স্থির থাকতে হবে। চল ভিতরে চল। এস, শহীদ।’
| আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকল রোকেয়া। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল বুড়ো চাকর জাকের। সে মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বলল, মা আমার সেই সকাল থেকেই কান্নাকাটি করছে। এতটা বেলা হল এখন পর্যন্ত মুখে কিছু দেয়নি। হুজুর, আপনি একটু বলে
১২৬
ভলিউম-৯
ল। মি. সিম্পসাল রিসার্চ সেন্ট কিছু বলেনি রোকেয়া
দেন। অন্তত একটু কিছু মুখে দিক।
আচ্ছা সে হবে’খন। এস তো, মা। আগে সবটা শুনে নিই তোমার কাছ থেকে। না হলে তো মা, আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না।’
রোকেয়া আত্মসংবরণ করে ড্রইংরুমের দিকে এগোল। শহীদ ও মি. সিম্পসন তাকে অনুসরণ করলেন।
রোকেয়ার কাছ থেকে যা জানা গেল তা হল সংক্ষেপে এইঃ সকালে একটা গাড়ির শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে উঠে মশারীর বাইরে বেরিয়েই তার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ইস্পাতের ক্লজিটটার চাবির ফোকরের চারদিকে একটা বৃত্ত। টেবিলের, র্যাকের বই-পত্ৰ লণ্ডভণ্ড । রূমটার এককোণে পুরানো খবরের কাগজের যে গাদা ছিল তার কাগজগুলোও ছড়ানো। ঐ কাগজগুলোর মধ্যেই কয়েকটা পুরানো সাময়িকীর ভাজের মধ্যে ছিল ইউজেনিকসের ফর্মুলা। রোকেয়াই ফর্মুলা লেখা কাগজগুলো আলাদা আলাদা করে সাময়িকীর মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছিল। আর সাময়িকীগুলোও সে রেখেছিল সংবাদ পত্রের স্কুপের ফাঁকে ফাঁকে। প্রথমেই সে কাগজগুলোর মধ্যে ফর্মুলার সন্ধান করতে যায়। কিন্তু সেগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফর্মুলার একটি কাগজও নেই সাময়িকীগুলোর মধ্যে। এদিকে সেদিকে তাকাতে গিয়ে তার দৃষ্টি পড়ে জানালার দিকে। জানালার দুটো শিক নিচের দিকে কাটা এবং উপরের দিকে বাঁকানো। সে ড. রাজীকে খবর দিতে যায়। গিয়ে দেখে ড, রাজী তার রূমে নেই। জাকের ও মইনুলকে জিজ্ঞাসা করেছে। তারা কিছুই বলতে পারেনি, বরং দুজনই অবাক হয়েছে। কারণ ড, রাজী সাধারণত সাড়ে আটটার আগে শয্যাত্যাগ করেন না। রোকেয়ার রূমে চুরির ব্যাপারটা তাদের কানে যাওয়ায় আরও হকচকিয়ে গেছে দু’জন। আশপাশে কোথাও খোঁজ করে ড. রাজীকে পাওয়া যায়নি এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সেলিম আতহার ও পারভেজেরও পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। রুহুল করিমকে পাওয়া গেছে টেলিফোনে। সে ড. রাজীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। তারা এসে চুরির ব্যাপারটা তদন্ত করে গেছে। আবার আসবে, বসেছে। নিখোঁজের ব্যাপারেও একটা: এজাহার লিখে নিয়েছে। তবে পুলিসের ধারণা, জলজ্যান্ত একটা মানুষ তো আর চুরি যেতে পারে না। নিশ্চই ড. রাজী সকালে কোন জরুরী কাজে কোথাও গেছেন। হয়ত কোন কারণে ফিরে আসতে পারেননি, যে-কোন মুহূর্তে তিনি এসে যেতে পারেন। এ নিয়ে যেন মিস রোকেয়া অকারণে উদ্বিগ্ন না হয়। তবে তারা তাঁকে খোঁজ করতেই গেছে।
“ইউজেনিকসের ফমূলা ছাড়া আর কোন কিছু চুরি গেছে কি?’ শহীদ’ প্রশ্ন করল।
আর কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হয় না,’ রোকেয়া জানাল। আপনার ঘুম ভেঙেছে কটায়?”
ছ’টায় হবে। কিছু আগেও হতে পারে। তখন বোদ সবে উঠেছে। আমি ঘড়ি দেখবার অবকাশ পাইনি।’
চলুন, আপনার রূমটা একবার দেখে আসি,’ উঠে দাঁড়িয়ে বলল শহীদ। চলুন, মি. সিম্পসন। আমাদের এখুনি এক জায়গায় যেতে হবে। কিন্তু তার আগে রূমটা একবার দেখে যাওয়া উচিত। নতুন কোন সূত্র যদি পাওয়া যায়।
চল। ওঠ মা,’ মি. সিম্পসন দাঁড়িয়ে বললেন। | দোতলায় সিঁড়ির ঠিক সামনেরই একটা দরজা। রোকেয়া বলল, “আসুন, এটাই আমার রূম।’ | পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল শহীদ। মি, সিম্পসন তাকে অনুসরণ করলেন। শহীদ রুমটা একনজরে জরিপ করল। সে চমকাল না। কিন্তু মি. সিম্পসন চমকে উঠলেন।-অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল তার কণ্ঠ থেকে। শহীদ মি. সিম্পসনের দিকে তাকাল। তাঁর বিস্মিত দৃষ্টি তখন ক্লজিটের পাল্লার উপর একটা বৃত্তাকার কর্তিত স্থানের দিকে নিবদ্ধ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি স্থানটা লক্ষ্য করছিলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন ক্লজিটটার দিকে। নিচে মেঝের উপর পড়ে আছে ইস্পাতের পাল্লার একটা টুকরো আর খানিকটা গলিত ইস্পাত।
শহীদ, এগুলো দেখেছ?”
‘দেখেছি। জানালাটাও দেখুন। শিক দুটো বাঁকানো রয়েছে। নিচের দিকটা কেমন করে নিপুণভাবে কাটা।
হু। বুঝতে পারছি, এ হচ্ছে •••এ হচ্ছে কুয়াশার কীর্তি।’
‘নিঃসন্দেহে, শহীদ বলল। অবশ্য আল্টাসোনিক্স বিদ্যা এখন আর কুয়াশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তবু আমি জানি, এখানে গতরাতে কুয়াশাই এসেছিল।
কুয়াশা? সে কে?’ রোকেয়া জানতে চাইল।
কুয়াশা হচ্ছে এক বিপথগামী প্রতিভা। এ মিসগাইডেড জিনিয়াস। তবে পুলিসের চোখে সে দুর্দান্ত অপরাধী। সে এক দুর্ধর্ষ দস্যু। ডাকাতি করে সে কোটি কোটি টাকা করেছে কিন্তু তা সে ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে অপব্যয় করেনি। ব্যয় করেছে বিজ্ঞানের গবেষণায় আর দান-ধ্যানে।
‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’
‘অদ্ভুত তো বটেই। আর এ-দেশের তো বটেই, বিদেশেরও অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার তার কাছ থেকে বেনামীতে অর্থ পেয়েছে। হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারও সম্ভবত তার কাছে ঋণী।’
রোকেয়া চমকে উঠল। অনেক দিনের পুরানো একটা ঘটনা মনে পড়ল তার। অনেক দিন আগে একদিন সে তার বাবা আর হাকিম কাকামণির মধ্যে এই ধরনের ভাসা ভাসা একটা আলাপ শুনেছিল। কোন এক অজ্ঞাতনামা লোক নাকি এই সেন্টারের জন্যে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা এক ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পাঠিয়েছে।
১২৮
ভলিউম-৯
কাকামণির টাকাটা নেবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাবাই ওঁকে টাকাটা নিতে বলেছিলেন। হয়ত কুয়াশাই সেই অজ্ঞাতপরিচয় দাতা। তাহলে কি গবেষণালব্ধ জ্ঞান অপহরণের জন্যেই সে এভাবে গোপনে টাকা দিয়েছিল? আর লোকটা নিজে যখন বিজ্ঞানী এবং মি. সিম্পসনের ভাষায় প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, তখন হয়ত সে নিজেই ইউজেনিকসের ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে। দৈত্যকায় মানব দুটোও হয়ত তারই সৃষ্টি এবং এই মূল্যবান গবেষণা-জাত ফর্মুলা যাতে অন্য কারও হাতে পড়ে তার সুপিরিয়রিটি নষ্ট না হয় হয়ত সেই কারণেই সে হাকিম রিসার্চ সেন্টারে উদ্ভাবিত ফমূলা চুরি করতে এসেছিল। বিজ্ঞানের সেবায় তার অর্থ সাহায্যের লক্ষ্য তাহলে মহৎ নয়।, সে বলল, আমারও মনে হয় কাকু, যে লোকটা চুরি করতে এসেছিল সে নিজেও অত্যন্ত প্রতিভাধর লোক এবং ইউজেনিকস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান আছে। অন্য কারও পক্ষে ঐ কাগজগুলো খুঁজে বের করা সম্ভব হলেও সে হয়ত ওগুলোর মানেই বুঝতে পারবে না। সুতরাং ওগুলোকে পুরানো ডায়েরীর ঘেঁড়া পাতা মনে করে ফেলে যাবে। এ চুরির পিছনেও কোন জিনিয়াসের হাত আছে।’
নিশ্চয়ই। এবং তার আরও একটা প্রমাণ আছে ঐ ইস্পাতের পাল্লা কাটার মধ্যে। আন্ট্রাসোনিক্স নামে তার একটা যন্ত্র আছে। সেটা ওর নিজ্বস্ব আবিষ্কার। অত্যন্ত মোটা ইস্পাতও অনায়াসে ঐ যন্ত্র দিয়ে অতিদ্রুত নিঃশব্দে কেটে ফেলা
যায় ‘কন্তু …কিন্তু। কাকণ্ঠস্বর, যদি, যদি আপনি দু
|
|
| ‘কিন্তু •••কিন্তু। কাকু, লোকটা মানে কুয়াশা বাবাকে কেন নিয়ে গেল? ব্যাকুল শোনাল রোকেয়ার কণ্ঠস্বর, যদি, যদি •••?’।
শহীদ এ প্রশ্নের জবাব দিল। সে বলল, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, ড. রোকেয়া। আমি নিঃসন্দেহে জানি, আপনার বাবার অন্তর্ধানের সঙ্গে কুয়াশার কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। আর যদি সে আপনার বাবাকে চুরি করেও থাকে তাহলেও বুঝবেন, তার জীবনসংশয় দেখা দিয়েছিল বলেই কুয়াশা তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়েছে। তবে কুয়াশা যদি যথার্থই আপনার বাবাকে সরিয়ে ফেলত তাহলে এতক্ষণে আপনার কাছে খবর এসে যেত।’
‘তাহলে আপনারও কি মনে হয়, বাবা কোন জরুরী কাজে বেরিয়ে গেছেন অথবা অন্য কেউ তাকে চুরি করেছে?
আপনার শেষের আশঙ্কাটাই সত্য বলে মনে হয়।’
কিন্তু অন্য লোকই বা বাবাকে চুরি করতে যাবে কেন?’ যে লোকটা আমার রূমে চুরি করতে এসেছিল, যে লোকটা তারিক খাকে খুন করেছে, আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরি ধ্বংস করেছে এবং অতিকায় মানব জন্ম দিয়েছে বাবাকে সেই-ই চুরি করেছে। আর সে নিশ্চয়ই কুয়াশা।’
মদু হাসল শহীদ। সে বলল, “ঘটনাগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। জেনে ৯-কুয়াশা-২৭
১১৯
রাখুন, কুয়াশা আপনার রূম থেকে ইউজেনিকসের ফমূলা চুরি করেছে বটে, কিন্তু তারিক খার হত্যাকাণ্ড,, আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে অতিকায় মানুষ দ্বারা তাণ্ডবনৃত্য সংঘটন এসব ঘটনার পশ্চাতে আছে অন্য এক কীর্তিমান নায়ক এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, কুয়াশাও সেই কীর্তিমান মহাপুরুষের পিছনে লেগেছে। আর সেই মহামানব লেগেছে কুয়াশার পিছনে।’
রোকেয়া কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। শহীদ ব্যাপারটা আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করল। সে বলল, “যে লোকটা এই কাণ্ডগুলো করেছে সে আপনার পরিচিত, আমারও পরিচিত। সে-ও এক অসামান্য প্রতিভাধর লোক। ইউজেনিকস বিদ্যা বহুদিন আগে থেকেই তার আয়ত্তে এসেছে এবং সে তার সফল প্রয়োগও করেছে। তারই ফল হল ঐ দৈত্যকায় মানব। হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারও ইউজেনিকসের ফর্মুলা উদ্ভাবনের ব্যাপারে তার কাছে বহুলাংশে ঋণী। হয়ত নেহায়েত দয়া পরবশ হয়েই সে ড. লোকমান হাকিমকে সাহায্য করেছিল, যদিও সে চায়নি যে ফর্মুলাটা অন্য কারও হাতে পড়ুক। তবে পড়বে না, সে সম্পর্কে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। দরকার হলে এই গবেষণার সাথে জড়িত সবাইকে খুন করতেও তার বাধবে না। আর, একদিন দরকার হয়ে পড়লও। ড. লোকমান হাকিম সম্ভবত কিছুটা আঁচ করেছিলেন, তাই তাঁকে সরে পড়তে হল।’
তার মানে, হাকিম কাকু•••?
হ্যাঁ। হি ওয়াজ মার্ডার্ড। কিন্তু বর্তমানে নাটক জমে উঠেছে তাঁর মৃত্যুর পরে। নায়ক ভেবেছিল, তার শত্রু নিপাত হয়েছে। রিসার্চ সেন্টারের অন্য কেউ তার পথে আপাতত বিঘ্ন সৃষ্টি করতে আসছে না। কিন্তু তবু সব গোলমাল হয়ে গেল আকস্মিকভাবে রঙ্গমঞ্চে কুয়াশার আবির্ভাবে। সুতরাং তারিক খ মরল, ইউজেনিকসের যন্ত্রপাতি ধ্বংস হল এবং ফমূলা নিয়ে নায়ক ও কুয়াশার মধ্যে সংঘাত বাধল। তারই এক দৃশ্যে ঘটেছে আপনার বাবার অন্তর্ধান,’ থামল শহীদ। ঘড়ি দেখে সে বলল, ‘সর্বনাশ! আর দেরি করা যায় না, মি. সিম্পসন। চলুন, এক্ষুণি আমাদের বেরোতে হবে।
রোকেয়া বোকার মতু শহীদের দিকে চেয়ে রইল।। মি. সিম্পসন বললেন, কি হল? কোথায় যাবে, বল তো?’
ড. রাজীকে কোথায় পাওয়া যাবে আমি তা আন্দাজ করতে পারছি। কে জানে দেরি হয়ে গেছে কিনা। চলুন এক্ষুণি। আর এক মুহূর্তও দেরি নয়,’ মি. সিম্পসনের হাত ধরে টান দিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এল সে রোকেয়ার রূম
থেকে।
মি. সিম্পসন কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিন্তু শহীদ যে অকারণে ব্যস্ততা প্রকাশ করছে না তা তিনি ভাল করেই জানেন। সুতরাং তিনিও ছুটলেন শহীদের ১৩০
ভলিউম-৯
সঙ্গে সঙ্গে।
রোকেয়ার হতভম্ব ভাবটা কেটে গিয়েছিল। সে-ও চিৎকার করে বলল, যাব, আমিও যাব, সিম্পসন কাকু। দাঁড়ান আসছি আমি।’
সে যখন নিচে গিয়ে পৌঁছুল তখন শহীদ, গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে। রোকেয়া হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দাঁড়াল গাড়ির পাশে।
আমিও যেতে চাই, শহীদ সাহেব, যদি অসুবিধা না হয়, করুণ কণ্ঠে বলল রোকেয়া।
বিন্দুমাত্র না। তবে সাবধান থাকবেন। উনি গাড়িতে!’
গাড়িটায় গতি সঞ্চারিত হবার আগেই ঠিক সামনে এসে থামল একটা বেবিট্যাক্সি। আর সেটা থেকে নামল কামাল। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। শহীদকে গাড়ি থামাতে ইশারা করে বেবিট্যাক্সির ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল সে।।
শহীদ কৌতূহলী দৃষ্টিতে কামালের দিকে তাকিয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কামাল।
শহীদ বলল, “ঠিক আছে। তুই আবার চলে যা। কিন্তু তুই চললি কোথায় সদলবলে?
অভিযানে।’ ‘আমি গেলে হয় না?’
উঁহু। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছ তুমি।’ হতাশার ভঙ্গিতে কামাল বলল, তবে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’ গাড়ি ছেড়ে দিল শহীদ।
একটু দূরে গিয়েই সে মি. সিম্পসনকে প্রশ্ন করল, মি. সিম্পসন, আশা করতে পারি কি আপনার সাথে আগ্নেয়াস্ত্র আছে একটা?’
ক্ষুদ্র একটা অস্ত্র অবশ্যই আছে আমার কাছে। | ‘আমরা যাচ্ছি কাজীপুরের জঙ্গলের মধ্যে একটা পোড়াবাড়িতে। সেখানে পৌঁছুলে অস্ত্রটা হাতেই রাখবেন, পকেটে বা হোলস্টারে নয়।
‘বেশ বেশ।
তিন
কামালের তেষ্টা পেয়েছিল। খিদে লেগেছিল, দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্টও হচ্ছিল। ছায়ার সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাল সে। একটা বেবিট্যাক্সি পেলেও হয়।
একটা জীপ এসে থামল তার কাছে। গাড়ি থেকে নামল সমসের শিকদার স্বয়ং। সঙ্গে কয়েকজন কনস্টেবল।
কুয়াশা-২৭
১৩।
‘আরে, শিকদার সাহেব যে!’ কামাল উল্লসিত হয়ে বলল।
তাই তো, কামাল সাহেব, একা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কি করছেন? নিশ্চয়ই কারও দিকে নজর রাখছেন?’
| কামাল বলল, তাছাড়া আর কি। প্রকাশ্য দিবালোকে সদর রাস্তায় আমি লুকিয়ে আছি কিনা।’
‘হেঃ হেঃ কি যে বলেন। আপনি তো বেশ রসিক লোক সাহেব। তা আপনার বন্ধুটি কোথায়?
শহীদের কথা বলছেন?’ হা-হা, তাছাড়া আর কে হবে? ‘সে তো শিকারে বেরিয়েছে।’ ‘শিকারে গেছেন, কোথায়?
কাজীপুরের জঙ্গলে। সেখানে নাকি বাঘ বেরিয়েছে।’
সে কি, সাহেব! ও তো আমার এলাকা। বাঘ বেরোলে, থানাতেই খবর আসবে সকলের আগে। আর আমার মত শিকারী থাকতে•••জানেন, সেবার সুন্দরবনে কি হয়েছিল?’
‘এখনও জানতে পারিনি।’ কিন্তু বাঘ শিকারের গল্পটা শুরু করল না.শিকদার।
উহ, কি অসহ্য গরম! আসুন সাহেব, আমার আবার অনেক কাজ। শুনেছেন ততা, ড. কাসেম আল-রাজীকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না? এই আমি নিজে, মশায়, সারা তল্লাট খুঁজেছি সকাল থেকে। প্রথমটায় ভেবেছিলাম, কোন জরুরী কাজে বেরিয়ে গেছেন ভদ্রলোক অথবা বেখেয়ালে বেরিয়ে গেছেন।’
বেখেয়ালে, মানে?’
‘ববাঝেন তো, এই সব সায়েন্টিস্ট মানুষের আবার খেয়াল-টেয়াল কম থাকে। মানে, দুনিয়াদারীর ধান্দা থাকে না তো। হয়ত আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কোথাও চলে গেলেন, নিজেই জানতে পারলেন না। উঁহু, কি গরম! চলুন, ভিতরে যাই,’ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল শিকদার। তোমরা একজন বাইরে থাক। আর দু’জন এস আমার সাথে,’ কনস্টেবলদের উদ্দেশ্যে বলল সে শেষের কথাগুলো।
গেট খুলে ভিতরে ঢুকল শিকদার। একটু ইতস্তত করে কামালও পিছু নিল। গরমটা সত্যি অসহ্য।
সামনের রূমে কাউকে দেখা গেল না। রুমের দরজাগুলোও বন্ধ।
“কি হল, এরা সব গেল কোথায়?’ বারান্দায় উঠে বৈদ্যুতিক বোতাম টিপে বলল শিকদার।
মিস রোকেয়া তো গেছে শহীদের সাথে। বাঘ মারতে?” আকাশ থেকে পড়ল শিকদার।
১৩২
ভলিউম-৯
“কি আশ্চর্য! বাবা নিখোঁজ, আর মেয়ে গেছে বাঘ মারতে। অথচ তখন কি কান্না। এই মেয়ে জাতটাকে বোঝাই মুশকিল, বুঝলেন, কামাল সাহেব? এই ধরুন
কেন, আমার গিন্নীই…।’
গিন্নীর গল্প শুরু করার সৌভাগ্য হল না শিকদার সাহেবের। ড্রইংরূমের দুয়ার খুলে বুড়ো জাকের এসে দাঁড়াল।
একটা হুঙ্কার ছাড়ল শিকদার সাহেব।
কি হে, থাক কোথায়? আঁ, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি আর পাত্তাই নেই তোমার! বাসার আর সব লোকজন কোথায়?
ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গেল জাকের মিঞা।
মিনমিন করে সে বলল, “হুজুরের কোন খবরই তো পাইনি, দারোগা সাহেব। আপা গেছেন শহীদ সাহেব আর সিম্পসন সাহেবের সাথে। এখন বাসায় শুধু আমি আর মইনুল বাবুর্চি আছি।’
আর লোক নেই বাসায়?’ “জ্বি, না। আমরা তো এই কয়জন লোকই বাসায়।
হু, সর দেখি, একটু বসতে দাও। যে জ্বালায় ফেলেছ, সব রাক্ষস-খোক্কস
নিয়ে সর দৌরা তো এই
জাকের ভয়ে ভয়ে দরজার পাশে দাঁড়াল। শিকদার সাহেব ড্রইংরুমের ভিতরে ঢুকে একটা সোফায় বসে পড়ল। সোফাটা আর্তনাদ করে উঠল আর সে আর্তনাদে কেঁপে উঠল জাকের মিঞা। সে দারোগার ঘর্মাক্ত বিশাল কলেবরের দিকে একনজর তাকিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করে দিল।
কামাল একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। শিকদারের পাল্লায় পড়াটা ঠিক হয়নি। এখন হয় তাকে শিকার না হয় গিন্নীর গল্প শুনতে হবে। অথচ ওদিকে শহীদ তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেছে, আর পেটটাও তার
খিদেয় চো-শুকে একটা গুরুত্বপূর্ণকার না হয় গিন্নীর গল্প
শিকদার বলল, দেখুন তো কি কাণ্ড। তখন তড়িঘড়ি করে চলে গেলাম। একট ভাল করে চুরির তদন্তটা করতে পারলাম না, তাই ফিরে আসতে হল। অথচ এখন বাসায় লোক নেই। চাকর-বাকর আর বাসার মালিক তো আর এক কথা নয়।’
‘কিন্তু ওরাও হয়ত কিছু আলোকপাত করতে পারে।’
তা নিশ্চয়ই পারে। ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কিন্তু মিস রোকেয়া আর ড রাজীর রূম আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা দরকার। বুঝতেই তো পারছেন, আমরা হচ্ছি পলিস অফিসার। আমাদের দায়িত্ব অসীম। হেলাফেলা করা উচিত নয়। আর আমার ব্যাপার তো জানেনই, কর্তব্যকে আমি জীবনের চাইতেও বড়, মনে করি। প্রমোশনটাই তো বড় কথা নয়।’
সমসের শিকদারের পরম কর্তব্যনিষ্ঠার কথা জানা ছিল না কামালের। কিন্তু
কুয়াশা-২৭
১৩৩
সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে বলল, হ্যাঁ, সে তো সকলেরই জানা আছে। কিন্তু শিকদারের এত কর্তব্যপরায়ণতার কারণটা আবিষ্কার করতে তার অসুবিধা হল
। টোপটা প্রমোশনের।
সমসের দারোগা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, জাকের মিঞা, তোমাদের সাহেবের আর তোমার আপার রূম-দুটো যদি আমি সার্চ করি তোমার আপত্তি নেই তো? যদি কোন সূত্র পাই চুরির ব্যাপারে…? মাথা নাড়ল জাকের মিঞা।
, কোন আপত্তি নেই।
তাহলে আপনিও চলুন, কামাল সাহেব । তুমিও চল হে, বারান্দায় তো কনস্টেবল পাহারায় রইলই।
মোগলের হাতে পড়লে খানা খেতেই হবে। অগত্যা আপত্তি করল না কামাল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন।’
| সিঁড়িতে শব্দ তুলে তিনজনের ছোট মিছিলটা দোতলায় উঠল। রোকেয়ার রূমে ঢোকবার আগেই কামাল প্রশ্ন করল, আপনি কি এর আগে, মিস রোকেয়ার রূম তল্লাশি করেননি?’ | করেছি বলেই তো আবার আসতে হল। আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে, সেটা অমূলক কিনা জানবার জন্যেই তো আবার আসতে হল। আপনাকে পেয়ে অবশ্য ভাল হয়েছে।’
রূমে ঢুকল দু’জন। ক্লজিটটার দিকে দৃষ্টি পড়ল কামালের। ডান দিকের পাল্লার গা থেকে বৃত্তাকার একটা অংশ কেটে ফেলা হয়েছে । চমকাল না কামাল।
সে জানে, এটা কার কীর্তি। | সমসের শিকদার সোজা গিয়ে ক্লজিটটার সামনে দাঁড়াল। ভ্রূ কুঁচকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ ক্লজিটটার কাটা জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখে বলল, হুঁ, ঠিকই ধরেছিলাম।’
কামাল জিজ্ঞেস করল, কি ধরেছেন, শিকদার সাহেব??
হুঁ হুঁ, আমার চোখে ফাঁকি দেবে এতটা মামদোবাজ কে আছে? তখুনি আমার সন্দেহ হয়েছিল।
ব্যাপার কি শিকদার সাহেব, আপনি আপন মনে কি বকছেন এসব?’
‘এই যে, দেখতে পাচ্ছেন না?’ ক্লজিটের কাটা জায়গাটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল সমসের শিকদার, দেখেছেন, কি চমৎকারভাবে কেটে ফেলা হয়েছে জায়গাটা। অত্যন্ত ভাল ইস্পাতের তৈরি এই ক্লজিটটা। অথচ অবস্থাটা কি হয়েছে, দেখেছেন? আর নিচে দেখুন, ঐ যে হ্যাঁণ্ডেলটা পড়ে আছে কিছুটা ইস্পাতের পাতসুদ্ধ।দেখুন না? এই যে।’
অতিকষ্টে উবু হয়ে ইস্পাত-খণ্ডটা তুলে নিয়ে সে কামালকে দেখাল। বলল, ‘এটা হচ্ছে তালা। আর দেখুন, এই হ্যাঁণ্ডেলের সাথেও এক্সট্রা লকিং সিস্টেম আছে। ১৩৪
ভলিউম-৯
চোর তালা খুলবার হাঙ্গামা পোয়াতে যায়নি। সোজা পাল্লাটাই কেটে ফেলেছে। এটা কি করে সম্ভব হয়েছে জানেন?
কি করে?’ আন্ট্রাসোনিক্স-এর সাহায্যে।’ “সে আবার কি?’ বোকামির ভান করল কামাল।
হু হু,’ কামালের মূর্খতার প্রতি করুণা প্রদর্শন করে বলল, এটা হচ্ছে একটা রশ্মি। যাকে বলে শব্দ রশ্মি। এ এক অভূতপূর্ব শক্তিধর রশ্মি, সাহেব। এর আবিষ্কর্তাকে অবশ্য আপনার চেনা উচিত।’
| কে তিনি?’ আবার আহাম্মকীর ভান করল কামাল।
সমসের শিকদার কামালের কানের কাছে মুখ এনে বলল, কাউকে এখুনি বলবেন না কিন্তু। এটার আবিষ্কর্তা হচ্ছেন দি গ্রেট কুয়াশা। আর গতরাতে তিনিই এখানে তশরীফ এনেছিলেন। এগুলো তাঁরই কীর্তি। ঐ যে জানালার শিক দেখুন, কি চমৎকারভাবে কেটে উপরের দিকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, খবরদার, এখন কাউকে বলবেন না কিন্তু।
সমসের শিকদার কামালের কানের কাছে মুখ এনে অতি গোপনে যে কথাগুলো বলল তা শুধু অদূরে দাঁড়ানো জাকের মিয়াই শুনতে পেল না, কামালের ধারণা বাড়িসুদ্ধ সবাই তা শুনতে পেয়েছে। রাস্তার লোকের পক্ষেও শুনতে পাওয়াটা বিচিত্র নয়। সুতরাং এত গোপন কথাটা প্রকাশের আর অপেক্ষা রাখে,
শুধু অদূরেনিতে পেয়েকেথাটা প্র
।
| সে মাথা নেড়ে বলল, মাথা খারাপ, এত গোপন কথাটা কাউকে বলা যায়! কিন্তু আপনার ধারণা অভ্রান্ত তো?’
“নিশ্চয়ই। কুয়াশাই এসব কীর্তি করে বেড়াচ্ছে, বুঝলেন? রিসার্চ সেন্টারের ননাখুনিই বলুন আর এই চুরিই বলুন। কিন্তু সাবধান, এখনও এসব কথা প্রাশের সময় আসেনি। প্রমাণ চাই। আর সেই প্রমাণের জন্যেই আমি ফিরে এন্ম। জানেন তো, অপরাধ-বিজ্ঞানের মতে, অপরাধী কিছু একটা প্রমাণ রেখে যাণে।
যার আপনি সেটা লুফে নেবেন। আইডিয়া আপনার রিয়েলী অপূর্ব। কিন্তু আমানে হয় কি জানেন শিকদার সাহেব, এই চুরির ব্যাপারে কুয়াশা জুড়িত হয়ত কিন্তু ঐ খুনোখুনি বোধহয় সে করেনি। কারণ আমি যতদূর শুনেছি, কুয়াশা হত্যা করে না।’
‘ও মিথ, বুঝলেন কামাল সাহেব? নিতান্তই অবিশ্বাস্য কথা। হেন অপরাধ নেয়া সে করেনি। খুন তো তার বলতে গেলে নেশা।
যদি সত্য হয় তাহলেও তো কুয়াশাকে বোধহয় সব ঘটানার জন্যে দায়ী করা ।।
নিশ্চয়ই, একশ’ বার যায় । কুয়াশা-২৭
১৩৫
“রিসার্চ সেন্টারের গেটের ঐ মজবুত শিক কি কুয়াশার পক্ষে বাঁকানো সম্ভব? তাছাড়া ঐ তালাটা কি কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে মুচড়ে ভাঙা সম্ভব? তা-ও গেটের বাইরে থেকে, মানে উল্টোদক থেকে। আর তালাটাতে যে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে ওটাও কি কোন সাধারণ মানুষের হাতের ছাপ?’
সমসের শিকদার কামালের প্রশ্নের তোড়ে হকচকিয়ে গেল। নাকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা একটা লোম টানতে টানতে কিছুক্ষণ ভাবল সে। তারপর বলল, আপনি কুয়াশা সম্পর্কে কতটা জানেন আমি বলতে পারব না। তবে কুয়াশাকে দৈহিক শক্তি এবং বুদ্ধির দিক দিয়ে যদি সাধারণের স্তরে ফেলেন তাহলে ভুল করবেন। আসলে সে একটা অসাধারণ শক্তিধর লোক। ঐ তালা ভাঙা বা গেটের শিক বাকানো আপনার-আমার পক্ষে অসাধ্য হতে পারে কিন্তু কুয়াশার কাছে সেটা একটা ছেলেখেলা মাত্র। আর হাতের ছাপের কথা বলছেন? আমার মনে হয়, ওর মধ্যেও কোন কারচুপি আছে যা আমরা ধরতে পারছিনে।’
কামাল স্পষ্টই বুঝতে পারল যে, সমসের শিকদারের মাথায় কুয়াশা-ভূতটা বেশ ভাল করেই চেপে বসেছে। ওটা আর নামানো যাবে না, সুতরাং সে চেষ্টা করে লাভ নেই। সে রণে ভঙ্গ দিয়ে বলল, এখানে কি আরও কিছু দেখবেন, না ড: রাজীর রূমে যাবেন?’
‘এ রূমে আমার কাজ শেষ হয়েছে। চলুন, ড. রাজীর রূমেই যাই।’
পাশের রুমটাই ড. রাজীর। মাঝখানের দরজাটা খোলা ছিল। রূমটাতে ঢুকে সমসের দারোগা আবার ক্রু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট করে চার দিক তাকাল। কামালও তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কামরটার মধ্যে।
কোথাও অস্বাভাবিকতার কোন চিহ্ন নেই। সবকিছু সাজানো-গোছানো। বিছানায় শয়নের চিহ্ন। মশারীটা তোলা রয়েছে। জানালাগুলো ভোলা। এই রূমটাতেও আছে একটা ক্লজিট। তার দরজা বন্ধ। কামাল হ্যাঁণ্ডেল ঘোরাবার চেষ্ট করে ব্যর্থ হল। মুখে প্রকাশ না করলেও কোথাও কোন প্রমাণ বা অপরাধের কে সূত্র পাওয়া যায় কিনা তার জন্যে কামালও চেষ্টার ত্রুটি করল না। খাটের তন্ম, ক্লজিটের তলায় কোথাও কোন ‘বোর্তাম বা রুমাল বা সিগারেটের টুকরো বিল
।
| সমসের শিকদার শেষটায় ক্লান্ত হয়ে বলল, তাহলে চলুন, যাওয়া যাকব… খিদে পেয়েছে।
নিচে নেমে আসতেই সমসের শিকদার বলল, চলুন না বাড়ির ছিনটা একবার দেখে আসি।’
আবার পিছনটায় যাবেন?’
আহা, চলুন না একবার। আপনারা যাকে বলে ইয়ংমেন অ্যাকটিভ হ্যাবিট। এত তাড়াতাড়ি কি ক্লান্ত হলে চলে? অথচ এই আমার ব্যাংই ধরুন, চুল তো সাহেব কবেই পড়ে গেছে, দাড়ি-গোঁফ পেকেছে অর্ধেকিন্তু হ্যাঁ,
‘ভলিউম-৯
১৩৬
কাজে ফাঁক নেই,’ নিজের বুকটা থাবড়ে বলল সে। _ আপনার ব্যাপারই আলাদা। ভাগ্যিস আপনার মত কিছু লোক পুলিস ডিপার্টমেন্টে আছে। তাই তো দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে যেতে যেতেও টিকে
আছে। তা বেশ চলুন, একবার পিছনটা ঘুরে আসি।’
পিছনের দিকটা বলতে গেলে জঙ্গলে ভরা। ভেজা সঁতসেঁতে, রাজ্যের লতাপাতা আর আগাছায় ছেয়ে আছে। মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দু’একটা লেবু গাছ। একটা ঝাকড়া গোলাপ গাছ।
প্রায় হাটু সমান চোরাকাঁটার মধ্যে দিয়ে দুজন এগোতে লাগল। নিচে প্যাঁচপেচে ভেজা নরম মাটি।
যে জানালাটা শিক কাটা হয়েছে তার নিচে গিয়ে দাঁড়াল দু’জন। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর কামালের তখন গোয়েন্দাগিরিতে ধৈর্য ছিল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সমসের শিকদারের কার্যকলাপ দেখতে লাগল।
সমসের শিকদার তার স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতিতে ভূকুঁচকে চোখ দুটো ছোট করে উপর-নিচে, ডাইনে-বাঁয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে লাগল।
জানালার পাশে একটা পাইপ দেখতে পেয়ে সমসের শিকদার বলল, এই পাইপ বেয়েই কুয়াশা উপরে উঠেছিল। এই যে, পাইপের গায়ে কাদার ছাপ। এখন অবশ্য রোদে শুকিয়ে গেছে।’
কামাল সকৌতুকে বলল, একটু কাদা নিয়ে গেলে হয় না ওখান থেকে? কেমিক্যাল একজামিনেশনে হয়ত আশ্চর্য কোন তথ্য উদঘাটিত হতে পারে।’
প্রস্তাবটা মনঃপূত হল সমসের শিকদারের। সে বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। অপরাধ বিজ্ঞানে বলা হয়েছে, অপরাধী কিছু একটা প্রমাণ রেখে যাবেই। তা এমনও হতে পারে যে, ঐ তুচ্ছ কাদার মধ্যেই অপরাধের অকাট্য প্রমাণ নিহিত আছে।’
পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে সমসের শিকদার পাইপের গা থেকে শুকনো মাটি তুলতে গেলেন, কিন্তু তার আগেই তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল।
“কি হল, শিকদার সাহেব?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল কামাল।
কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব দিল না সমসের শিকদার। দ্রুত স্থানত্যাগ করে প্রায় দৌডুতে দৌডুতে সরে গেল সে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এবং উঃ আঃ করতে করতে দু’হাত দিয়ে পা চুলকাতে লাগল। কামাল এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল। শিকদারের প্যান্টের সর্বত্র লাল বড় বড় বিষপিঁপড়ে মনের আনন্দে বিচরণ করছে। | শিকদার তখন তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছে। তার চোখে-মুখে যন্ত্রণার ছাপ। দু’হাত দিয়ে সে একবার চুলকোচ্ছে আর একবার পিঁপড়ে ছাড়াবার চেষ্টা করছে। মুখ দিয়ে অবিরাম উহ্ আহ্ জাতীয় শব্দ বেরোচ্ছে।
কামাল দ্রুত সমসের শিকদারের সাহায্যে এগিয়ে গেল। কুয়াশা-২৭
১৩৭
চার
শহীদ ও কামাল চলে যেতেই কলিমকে নিয়ে আবার জঙ্গলে ফিরে এল কুয়াশা।
কলিম জিজ্ঞেস করল, আবার ফিরছ যে, ভাইয়া? | ‘লোকটা পালিয়ে গেল কোন পথে সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আর একটা ডিটোনেটর সেট বসাতে হবে। ও কাজটা তুই-ই করতে পারবি। দরকার হলে পুরো বাড়িটা উড়িয়ে দেব।’
‘পারব আমি। গাড়ির বুটেই আছে একটা ডিটোনেটর সেট। কিন্তু তুমি কি মনে কর লোকটা আবার ফিরবে এখানটায়?’
‘ফেরাটাই স্বাভাবিক।’ ‘আমরা জায়গাটা চিনে ফেলেছি তা জানবার পরেও?
যা। সে ফিরবে না বলে আমরা ধরে নেব এবং এখানটায় আমরা আর আসব, এই ধারণা করেই সে ফিরে আসবে। তাছাড়া যতদূর মনে হয়, এটাই হচ্ছে ওর প্রধান ডেরা। লোকটার কাছে আরও একটা দৈত্যাকার মানুষ আছে। আমার বিশ্বাস, সে আছে এখানেই। আর আছে এখানে একটা, ল্যাবরেটরি। ঐ ল্যাবরেটরিতেই সে ঐ দুই গরিলাসদৃশ মানুষের জন্ম দিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। সুতরাং ফিরতে তাকে হবেই। এবং শিগগিরই ফিরবে সে। হয়ত দু-এক ঘন্টার মধ্যেই।’
এত তাড়াতাড়ি?”
তার পরিচয় যে প্রকাশ পেয়েছে একথা এখন আর তার অজানা নেই। সুতরাং তাকে এখন আত্মগোপন করতে হবে। আর তারজন্যে এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম স্থান। তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়। এখানকার কাজ গুছিয়ে নিয়েই পালাবে।’
কথায় কথায় দুজন কুয়াশার অচল জোডিয়াকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একটা কাঠের বাক্স আর অনেকটা তার বের করল কলিম বুট থেকে। কুয়াশা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, চল।’
আবার সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পদ্ম। নিঃশব্দে দু’জন হেঁটে চলল পোড়োবাড়ির দিকে। কাছাকাছি পৌঁছুতেই কুয়াশা কলিমকে ডিটোনেটর সেটটা ফিট করার নির্দেশ দিয়ে পোড়াবাড়ির প্রবেশ-পথ খুঁজতে চলল। | বাড়িটার খুব কাছেই যে কোথাও একটা সুড়ঙ্গ-পথ আছে সে ব্যাপারে কুয়াশা, নিশ্চিত। সেই সুড়ঙ্গ-মুখটা খুঁজে বের করতে চলল সে। একটা মাঝারি আকারের ডাল ভেঙে নিল সে হাতে। মাটির দিকে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলল। প্রায় আধঘন্টার মধ্যে পোড়োবাড়িটার চারদিকে বার তিনেক ঘুরে এল।
১৩৮
ভলিউম-৯
একমাত্র ইঁদুরের গর্ত ছাড়া আর বড় কোন গর্ত তার চোখে পড়ল না।
তৃতীয় বার পরিক্রমা শেষ করে কলিমের কাছে ফিরে এল কুয়াশা। কলিম জানাল যে, সে ডিটোনেটর সেট ফিট করে ফেলেছে। ল্যাণ্ড-লাইন ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে পোড়োবাড়ির মধ্যে। এক্সপ্লেসিভটা বেশ ভাল জায়গাতেই রেখে এসেছে।
কুয়াশা খুশি হয়ে বলল, “বেশ, তাহলে আয় আমার সাথে। আমি তো এখনও আমার কাজ শেষ করতে পারলুম না।’
তাহলে চল না, বেড়ার তলা দিয়েই ঢুকে পড়ি।’
তাতে লাভ নেই। ঐ পথটা খুঁজে বের করা দরকার। না হলে আবার সে হয়ত ঐ পথেই পালাবে।’
তা বটে, চল তাহলে। | হাঁটতে হাঁটতে ওরা পোড়াবাড়িটার পূর্বদিকে এগিয়ে গেল। বড় গাছপালার নিচে ঘোট একটা অতি কঁকড়া ঝোঁপ। বেশ অন্ধকার জায়গাটা, সূর্যের আলোও বড় একটা এসে পৌঁছায় না। সেখানটায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। তার চোখ দুটোতে আশার আলো জ্বলে উঠল। | ঝোঁপটার দিকে এগোল সে। কাছে যেতেই তার চোখে পড়ল একটা সিগারেটুের টুকরো। আপন মনে হাসল সে। পাওয়া গেছে তাহলে এতক্ষণে। লতায়-পাতায় আচ্ছন্ন হলেও মাটিটা পরিচ্ছন্ন। ঘাস নেই জায়গাটাতে।
হাতের ডলটা লতা-পাতার নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে গুচ্ছটা উপরের দিকে তুলে ধরতেই দেখা গেল কুয়োর মত একটা গর্ত।
কলিম পাশে এসে গুচ্ছটা তুলে ধরল দুহাত দিয়ে। গর্তটা আরও স্পষ্ট দেখা গেল।
কুয়াশা বলল, তুই এখান থেকে একটু দূরে গিয়ে একটা গাছে উঠে বসে থাক। আমি ভিতরটা দেখে আসি ।
‘কেউ যদি ঢোকে, মানে সেই লোকটাই যদি ফিরে আসে? ‘সোজা গুলি করবি, যদি পারিস।’
কযোৰ দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথাটা নুইয়ে নিচের দিকে তাকাল কয়াশা। একটা সিঁড়ি চোখে পড়ল তার। বাধানো সিঁড়ি। সিমেন্টহীন হঁটগুলো অবশ্য সাত বের করে আছে।
কলিমকে সরে যাবার নির্দেশ দিয়ে কুয়াশা নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
খাড়া সিডি শেষ হতেই সরু প্যাসেজ, দুর্ভেদ্য- অন্ধকার পথ। কুয়াশার পকেটে টর্চ ছিল বলে অসুবিধা হল না। প্রায় দুমিনিট এগিয়ে যাবার পর অদূরে আলোর সরু রেখা দেখতে পেল। আরও একটু কাছে যেতেই কুয়াশা দেখল সাদা ধবধবে দেয়ালের উপরে নিওন বাতি জ্বলছে। প্যাসেজ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে দু’হাত উঁচু করিডর, উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে। প্যাসেজের ঠিক সামনেই দরজা। কুয়াশা-২৭
১৩৯
টর্চটা পকেটে ফেলে রিভলভার বের করল কুয়াশা। সাইলেন্সার লাগাল তাতে দ্রুত হাতে। আর তিনহাত দূরেই করিডর। প্যাসেজের দেয়ালের সাথে দেহটাকে মিশিয়ে দিয়ে সে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। কোন শব্দ কানে এল না। মাথাটা সামান্য বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। আলোকিত করিডরে কেউ নেই। ডাইনে-বাঁয়ে দু’দিকেই দেখল সে। কাউকে দেখতে পেল না। সামনের দরজাটা ছাড়া আর কোন প্রবেশ পথও চোখে পড়ল না।
ধীরে, অতি ধীরে সে করিডরে পা রাখল। সামনের দরজাটা খুলে গেল আপনা আপনি। এবং কুয়াশা অবাক হয়ে দেখল, দরাজার ঠিক মাঝখানটায় গ্রীবাভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে বিশালকায় একটা কালো কুকুর।
কুকুরটা গর্জন করল না। কিন্তু অপরিচিত আগন্তুককে দেখতে পেয়েই তার চোখে ফুটে উঠল হিংস্রতা। সামনের দাঁতগুলো বের করে সে দু’পা শূন্যে তুলে ঝাঁপ দিল কুয়াশার দিকে। কুয়াশাও প্রস্তুত ছিল। তার হাতের সাইলেন্সর লাগানো রিভলভার থেকে দুপ’ করে দু’বার শব্দ হল। করিডরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কুকুরটার সুবিশাল দেহ। | ‘কয়েকবার উল্টে-পাল্টে স্থির হয়ে গেল কুকুরটার দেহ। রক্তে ভিজে গেল। করিডর। কুয়াশার জামাকাপড়েও রক্তের ছিটে এসে লাগল ।
পাহাড়ের মত বিশাল দেহটার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কুয়াশা। সুপারম্যানের কৃতিত্বকে মনে মনে সে তারিফ করল। সত্যি লোকটা এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা তার বিপদ সম্পর্কেও সর্তক হল। সুপারম্যান যদি এই সুড়ঙ্গ-পথেই ফিরে আসে তাহলে সে সুড়ঙ্গে ঢুকেই তার অস্তিত্বের খবর জানতে পারবে। কিন্তু পোড়োবাড়িটার মাটির নিচের পুরো রহস্যটা
জানা পর্যন্ত তার নিজেরও স্বস্তি নেই। এখানে কি ঘটছে না ঘটছে সে সম্পর্কে অস্পষ্ট একটা ধারণা তার বরাবরই ছিল কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন না করলে তার চলবে না। অবশ্য ঢুকেই সে একটা বড় রকমের বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়েছে। লোকটা শুধু দানবাকার মানুষই জন্ম দিতে জানে না, বিশালকায় কুকুরও সে জন্ম দিতে সক্ষম। হয়ত আরও অনেক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা কুয়াশার জন্যে অপেক্ষা
করছে।
সামনের রূমটায় ঢুকল কুয়াশা। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আপনা-আপনি।
‘এই দরজার রহস্যটা আগে সমাধান করতে হবে আমাকে, আপন মনে বলল কুয়াশা। ভিতর থেকে বেরিয়ে যাবার ব্যবস্থা না করতে পারলে হয়ত অনন্তকাল ধরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে এখানে। তবে দরজাগুলো লোহার বলেই রক্ষা। আল্টাসোনিক্স ইনস্ট্রমেন্ট ব্যবহার করে সে নির্বিবাদে বেরোতে পারবে। কিন্তু যদি সেটা কোন কারণে হাত-ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে বিপদে পড়তে হবে তাকে। সুতরাং বিকল্পটা জেনে রাখা ভাল। ১৪০
ভলিউম-৯
পৃকিন্তু পোড়োবার কি ঘটতে অর্জন
রূমের চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করল সে। দর্শনীয় তেমন কিছু নেই। এটাকে বোধহয় কোন কাজে ব্যবহার করা হয় । রূমের ঠিক মাঝখানে বিরাট একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল আছে শুধু। উল্টো দিকে আর একটা দরজা। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। ভেবেছিল, এই দরজাটাও আপনা-আপনি খুলবে। কিন্তু তা খুলল না। আস্তে ঠেলল কুয়াশা দরজাটা। তবু খুলল না। | ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হল না কুয়াশার। অন্তত এই দুটো দরজা খোলা আর বন্ধ করার চাবিকাঠি এই রূমেই কোথাও আছে এবং যেহেতু দেয়ালে কোথাও কোন সুইচ নেই সুতরাং রহস্যটা আছে টেবিলেরই কোথাও।
| টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এই ধরনের টেবিলের রহস্যও তার মোটামুটি জানা। টেবিলের উপরের কাঠটার বদলে থাকে ইস্পাত। কাঠের সমানই পুরু। ইস্পাতের দুটো পাত দিয়ে তৈরি। মাঝখানে থাকে গোপনীয় কোন বস্তু। | টেবিলের উপর টোকা দিল কুয়াশা। তার ধারণা নির্ভুল। একপ্রান্তে আঙুল দিয়ে উপরের দিকে চাপ দিল। ইস্পাতের ডালাটা উপরে উঠে গেল। সামনে ভেসে উঠল সারিসারি সুইচ। অসংখ্য তার। এক হাতে ডালাটা ধরে অন্য হাতে সে সুইচ টিপতে লাগল একের পর এক। কয়েকটা সুইচ টিপতেই খুলে গেল বাইরের দরজাটা। সেটা অফ করে দিয়ে অন্যগুলো টিপতে লাগল সে। অবশেষে ভিতরের দিকের দরজাটা খুলে গেল। একটা ল্যাবরেটরির অংশ ভেসে উঠল কুয়াশার। চোখের সামনে। ডালাটা নামিয়ে রেখে সে খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে ল্যাবরেটরিটার ভিতরে ঢুকল। | বিরাট ঘরটা জুড়ে একটা অতি আধুনিক ল্যাবরেটরি। কুয়াশার মনে হল যেন সে পাশ্চাত্যের কোন অতি সফিস্টিকেটেড ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ঘুরে ঘুরে সে ল্যাবরেটরিটা দেখতে লাগল। সেটা দেখা শেষ হতেই চলে গেল পাশের রূমটাতে। রূমটা অপেক্ষাকৃত ছোট। এখানে আছে র্যাকভর্তি অসংখ্য কাঁচের জার আর নানা আকারের টেস্ট-টিউব। মাঝখানে একটা চেয়ার ও টেবিল। | পরের রূমটায় ঢুকল কুয়াশা। একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানা বলা যেতে পারে রূমটাকে। ছোট বড় খাঁচার মধ্যে রকমারি প্রাণী–ইঁদুর, গিনিপিগ, ককর বিড়াল । কিন্তু প্রাণীগুলো অদ্ভুত। প্রত্যেকটিই বিশাল আকারের। দেশী ককব
অ্যালসেশিয়ানের দ্বিগুণ, বিড়ালটা প্রায় কুকুরের সমান। রংটা সবজ। চোখের তারা দুটো গভীর নীল! ইঁদুর আর: গিনিপিগগুলোও আকারে বৃহৎ । নীল রং এর বাদরটা ভালুকের চাইতেও বড়•••
আর কুয়াশা অবাক হয়ে দেখল প্রত্যেকটি প্রাণীরই চোখে হিংসতা। বাইরে তার গুলির আঘাতে নিহত কুকুর আর পেদ্রোর মতই এই প্রাণীগুলোও নির্বাক। কিন্তু অজ্ঞাত আগন্তুককে সামনে দেখে প্রত্যেকটা প্রাণীই অস্থিরতা প্রকাশ কর,
সবাই দাঁত আর নখ দিয়ে খাঁচার মজবুত শিক কামড়াচ্ছে আর হিংস চটি কুয়াশা-২৭
১৪১
কুয়াশার দিকে তাকাচ্ছে। যেন নাগাল পেলে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খাবে।
যেন এক শব্দহীন হিংস্রতার জগৎ। | এই রূমটাই শেষ। ফিরে এল কুয়াশা ল্যাবরেটরিতে। একটা ঘোরানো সিঁড়ি চলে গেছে উপরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল কুয়াশা।
এটা সেই রূম যেখানে সুপারম্যানের সাথে তার লড়াই হয়েছিল কয়েকঘন্টা আগে। এখনও সেখানে পড়ে আছে নিহত পেদ্রোর বিরাট দেহটা। রামটা ছেড়ে সে এগিয়ে গেরা দরজার দিকে। সিঁড়ি বেয়ে দেয়াল আলমারির দরজা দিয়ে বড় রূমটায় গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা।
আপন মনে প্রশ্ন করল, আর একটা সুপারম্যান গেল কোথায়?
হয় তাকে অন্য কোথাও সরানো হয়েছে নয় তো ভূ গর্ভের কোন গোপন কামরায় লুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। দানবটা হয়ত যে-কোন মুহূর্তে তার সামনে এসে হাজির হতে পারে।
কিন্তু আপাতত কোন দানব হাজির হল না তার সামনে।
নিঃশব্দ পুরীতে হঠাৎ খুব কাছে থেকেই একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল কুয়াশার। অতি ক্ষীণ শব্দ। পিছনে দেয়াল-আলমারির দরজার দিকে ফিরে তাকাল কুয়াশা। শব্দটা আসছে সিঁড়ি থেকেই। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না সেখানে। আলোকোজ্জ্বল সিঁড়িটাতে কেউ নেই।
আবার কানে এল শব্দটা। তার মনে হল, শব্দটা এল বাইরের দরজার দিক থেকে। নিঃশব্দে দরজার দিকে এগোল কুয়াশা। রিভলভারটা উপরের দিকে তোলবার আগেই খোলা দরজার সামনে একটা মূর্তিকে দেখা গেল। তার হাতে উদ্যত পিস্তল।
| লোকটা আর কেউ নয় শহীদ। সে বজ্রকণ্ঠে বলল, “খবরদার! রিভলভার উপরের দিকে তোলবার চেষ্টা করেছ কি মরেছ। ফেলে দাও। ফ্যাল তোমার হাতের রিভলভার।’
বক্তার দিকে তাকাল কুয়াশা। সে একা নয়, তার পিছনে আছে আরও দুজন লোক। একজন ড. রাজী আর অন্যজন সেলিম আতহার। সবিস্ময়ে তারা তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে, তাদের চোখের পলক পড়ছে না।
ঠোঁটটা ঈষৎ বাঁকিয়ে শহীদের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা রিভলভারটা মেঝের উপর রেখে দিয়ে উপরের দিকে দু’হাত তুলে দাঁড়াল।
শহীদ বলল, লুক ডক্টর’ হি ইজ দ্য ডেভিল। সেলিম বলল, আশ্চর্য, আলী সাহেবই তাহলে নাটের গুরু?’ শহীদ বলল, ‘লোকটা আলী সাহেব নয়। ঐ লোকটাই হচ্ছে কুয়াশা।’ কুয়াশা!’ চমকালেন ড. রাজী।
‘হ্যাঁ, কুয়াশা, কুয়াশার দিকে তাকিয়ে,বলল। ‘ইয়েস মি, কুয়াশা, মুখ ১৪২
ভলিউম-৯
ফিরিয়ে দাঁড়াও। আর ঢুকে পড় ঐ দেয়াল-আলমারির ভিতরে ঢুকে পড়। যাও।’
| নিরীহ শিশুর মত কুয়াশা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।
‘দেখবেন, আসুন।’ অস্পষ্ট কণ্ঠে কি যেন বললেন ড, রাজী। ঠিক বুঝতে পারল না কুয়াশা।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আবার সেই রূমটাতে গিয়ে দাঁড়াল সে যেখানে পড়ে আছে অতিকায় মানবটার মৃতদেহ। পিছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ওরাও এগিয়ে আসছে।
রূমটার দরজার কাছেই পদশব্দগুলো থেমে গেল। কে যেন চরম বিস্ময়সূচক একটা শব্দ করে উঠল। সম্ভবত সেলিম আতহার।
কুয়াশা বুঝতে পারল, দানবটার মৃতদেহ দেখে চমকে উঠেছে সে।
পদশব্দগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে এল । কুয়াশা চোখের কোণ দিয়ে দেখল, ড. রাজী ও সেলিম গিয়ে মৃতদেহটার পাশে দাঁড়াল।
“খবরদার, কুয়াশা! কোনরকম বাঁদরামি আমি সহ্য করব না।’ আর একটা ধমক কানে এল তার।
ড. রাজী ও সেলিম আতহার নিচুস্বরে কি যেন আলাপ করছিলেন কিন্তু তা কানে পৌঁছুল না কুয়াশার। সে তখন দ্রুত চিন্তা করছে। রিভলভারধারী লোকটা যে শহীদ নয় আর তাদেরকে যে জামাই-আদর করতে নিয়ে আসেনি লোকটা, ড. রাজী ও সেলিম, আতহারকে তা বোঝানো দরকার। অনেক সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকেও সে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। তাই নিজের জন্যে ভাবে না সে। কিন্তু শহীদের ছদ্মবেশে ড, রাজী ও সেলিম আতহারকে যে সুপারম্যান শয়তানটা এখানে নিয়ে এসেছে হত্যা করার জন্যে তা এখুনি জানিয়ে দেওয়া উচিত ওদেরকে। তাতে ওরা সতর্ক হতে পারবে। আত্মরক্ষার জন্যে চেষ্টা করতে পারবে, অন্তত কুয়াশা যদি ওদেরকে বাঁচাতে পারে তাহলে ওদের সহযোগিতাটুকু পেতে পারে সে।
| শহীদবেশী লোকটার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে সেলিম আতহারকে বলল, মি. আতহার, প্রীজ হেল্প মি। পুলিস বছরের পর বছর এই লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পায়নি। আজ আমি তাকে হাতে পেয়েছি, সে যাতে আর পালাতে না পারে তারজন্যে আপনাদের সহযোগিতা আমার বিশেষ প্রয়োজন।’
“নিশ্চয়ই বলুন কি করতে হবে? ‘এই হাতকড়াটা পরিয়ে দিন কুয়াশার হাতে।’ কিন্তু আমি তো হাতকড়া পরাতে জানি না, তাছাড়া…।’
তাহলে আপনি রিভলভার ধরে দাঁড়ান। আমিই হাতকড়াটা পরিয়ে দিচ্ছি। সাবধান, লোকটা বাড়াবাড়ি করলেই গুলি করবেন। তবে দেখবেন, শেষটায় যেন আমাকেই প্রাণে মারবেন না।’
হাসির শব্দ শোনা গেল। হাসছে শহীদবেশী সুপারম্যান।
কুয়াশা-২৭
১৪৩
য়াশা আর শইকুয়াশার মুখে পভারটা প্রায় ছিনিলাফে সেলিম
“নিশ্চয়ই না, যদিও আমি ভাল মার্কসম্যান নই।’
হাত দুটো পিছনের দিকে নামাও, কুয়াশা।’
হাত নামাল কুয়াশা। হাতকড়া পরিয়ে চাবি লাগিয়ে দিল শহীদবেশী লোকটা। তারপর তার নিতম্বে লাথি মেরে বলল যাও যাও, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাও। আসুন, ড. রাজী।’ | দাঁতে দাঁত চাপল কুয়াশা। ঘুরে দাঁড়াল সে। শহীদবেশী লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মি. পারভেজ ইমাম, তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে।’ | সচকিত হল লোকটা। কুয়াশার দিকে না তাকিয়ে এক লাফে সেলিম আতহারের কাছে গিয়ে তার হাত থেকে রিভলভারটা প্রায় ছিনিয়ে নিল সে।
| সেলিম ও ড. রাজীও কুয়াশার মুখে পারভেজ নামটা শুনে চমকে উঠেছিলেন। দু’জনই কুয়াশা আর শহীদবেশী লোকটার দিকে তাকাল। পরস্পরের মধ্যেও দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করল। | ততক্ষণে শহীদবেশী লোকটা রিভলভারটা ড. রাজী ও সেলিম আতহারের দিকে তুলে ধরেছে। সে এক রহস্যময় হাসি হেসে কুটি করে ড. রাজীকে বলল, কুয়াশা ভুল বলেনি। ড. রাজী, আমিই পারভেজ ইমাম এবং আই অ্যাম দ্য সুপারম্যান। আপনাদেরকে এখানে নিয়ে আসবার জন্যেই শহীদ খানের ছদ্মবেশ ধরেছিলাম। আমি আপনাদের সবাইকে হত্যা করব,’ নির্বিকার শোনাল পারভেজের কণ্ঠস্বর।
আতঙ্কে ও বিস্ময়ে পারভেজের দিকে তাকিয়ে রইল ড. রাজী। কিন্তু সেলিম চিৎকার করে উঠল, “তুই পারভেজ, তুই আমাদের সাথে এতবড় প্রতারণা করলি!
আর তাই নয় শুধু, আমাদের হত্যাও করতে চাস তুই! কি অপরাধ আমরা করেছি। তোর কাছে?’
বিদ্রুপের হাসি হাসল সুপারম্যান, ‘অপরাধ একটাই। তোমরা ইউজেনিকসের রহস্য জেনেছ, এটাই তোমাদের অপরাধ। অবশ্য একদিক দিয়ে অপরাধ আমারও। কারণ হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের ভূ-গর্ভে ইউজেনিকসের যে গবেষণা চলছিল তা সফল হয়েছে শুধু আমি পথ দেখিয়ে দিয়েছিলাম বলেই। তার অনেক আগেই বলতে গেলে আজ থেকে চার বছর আগে অর্থাৎ রিসার্চ সেন্টারে যোগ দেবারও আগে আমি ঐ বিদ্যা আয়ত্তে এনেছি এবং দুটো দৈত্যাকার বংশব্দ মানুষেরও জন্ম দিয়েছি। তার একটার লাশ পড়ে আছে তোমাদের সামনে। আর একটা এখানেই আছে। জ্যান্ত দৈত্য দেখে তোমরা তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করবে। কিন্তু হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ভেবে দেখলাম, ইউজেনিকসের রহস্য তোমাদের জানানো ঠিক হয়নি। তাই তোমাদের নিয়ে এলাম এখানে। তোমরা বেঁচে থেকে যে আমার ক্ষতি করবে তা আমি চাই না।’ | ‘কিন্তু তোমার ক্ষতি করব কিভাবে?’ চিচি করে উঠল সেলিম। সে তখনও বাঁচবার আশা ত্যাগ করতে পারেনি।
১৪৪
ভলিউম-৯
| ‘একমাত্র আমি ছাড়া অন্যের পক্ষে ঐ বিদ্যা ভ নাটাই আমার পক্ষে ক্ষতিকর। ঐ পবিত্র বিজ্ঞানটি একমাত্র আমারই আয়ত্তে থাকবে, এটাই আমি চাই। বিরাট আমার আকাঙ্ক্ষা, আকাশ-ছোঁয়া আমার পরিকল্পনা। আমি, আমি:সুপারম্যান, তোমাদের মত সাধারণ নই। আমি অনন্যসাধারণ, তোমাতে আমাতে তফাত অনেক। তোমরা শুধু আমার বংশব্দ আজ্ঞাবহ হবার উপযুক্ত। কিন্তু আমার দরকার আরও ভাল আরও দক্ষ ও নীরব ক্রীতদাসের। সুতরাং আমি দুনিয়ায় একের পর এক নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী জীব-জানোয়ার, এমনকি আমার একান্ত অনুগত মানুষ সৃষ্টি করব যাদের সাহায্যে, আই শ্যাল বি দ্য মনার্ক অব দিস প্ল্যানেট।
ড. রাজী এতক্ষণ কোন কথা বলেননি। ভীত দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়েছিলেন পারভেজের দিকে। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই বোধহয় তিনি বুকে বল ফিরে পেলেন। তিনি করুণ হাসি হেসে বললেন, তুমি আস্ত উন্মাদ একটা, পারভেজ। আস্ত উন্মাদ তুমি।’
আমি উন্মাদ? হাঃ হাঃ হাঃ হা।’ আকাশ ফাটিয়ে হাসল পারভেজ। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে হেসে সে বলল, ‘দুঃখের বিষয় আমি উন্মাদ না স্থিতধী, তা দেখবার জন্যে বেঁচে থাকবার সৌভাগ্য আপনার হবে না। কিন্তু থাক, এসব কথার দরকার নেই। চলুন আপনারা। ঐ যে, রূমটার কোণের দিকে এগিয়ে যান। ঘোরানো সিঁড়ি আছে। কুয়াশা, তুমি যাও সকলের আগে।
অতিকায় প্রাণীগুলোকে যে রূমে খাঁচার মধ্যে ভরে রাখা হয়েছে সেই রূমে কুয়াশা, ড. রাজী ও সেলিম আতহারকে হাজির করল পারভেজ। ড. রাজী ও সেলিম, সবিস্ময়ে অতিকায় জীব-জন্তুগুলোকে দেখতে লাগল। প্রাণীগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যে।
পারভেজ বলল, এই রূমটার নাম দিয়েছি আমি সুপার জ্য। এখানে আছে আমার উদ্ভাবিত সুপার এনিম্যাল। এরা প্রত্যেকেই ভয়ঙ্কর হিংস্র। আমার ইচ্ছা, কুয়াশাকে এদেরই হাতে দেওয়া এবং ওকে এরা কিভাবে খতম করে সেটা উপভোগ করা।’
তার এই হিংস্র অভিলাষের ঘোষণায় কেউ কিছু বলল না। ড. রাজী ও সেলিম আতহার আতঙ্কে নীল হয়ে গেলেন।
কুয়াশা দাঁতে দাঁত চাপল।
আমার প্রিয় ককর ফ্র্যাংকেনস্টাইন পাহারা দিচ্ছে সুড়ঙ্গ পথ। অনেক দিন হল তার মানুষের মাংস জোটে না । যাই তাকে নিয়ে আসি। কিন্তু সাবধান, পাগলামি করতে যেয়ো না। তাহলে নিধারিত সময়ের আগেই মারা পড়বে। আর তোমাদের দুজনের জন্যে শান্তিময় মৃত্যুর যে ব্যবস্থা করে রেখেছি সেটাও তাহলে আমি প্রত্যাহার করে এ প্রাণাগুলোর হাতেই তোমাদেরকে তুলে দেন। আলো বলে কুয়াশার দিকে আর একবার তীব্র দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে গেল ১০-কুয়াশা-২৭
১৪৫
পারভেজ। দরজাটা বন্ধ করে দিল। দরজায় চাবি লাগানোর শব্দ কানে এল।
অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইল সেলিম ও ড. রাজী। কুয়াশা দেরি করল না। সে সেলিমকে বলল, ‘প্রাণে বাঁচবার ইচ্ছে আছে আপনাদের, না নেই?’
প্রশ্নটা সেলিম আতহারের কানে ঢুকলেও বোধহয় মস্তিষ্কে পৌঁছাল না। সে শূন্যদৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে চেয়ে রইল।
সেলিম সাহেব?’ উ। কিছু বললেন?’ ‘প্রাণে বাঁচতে চান, না এখানে হিংস্র প্রাণীগুলোর শিকার হতে চান?
সেলিমের দু’চোখে আশার আলো জ্বলে উঠল।
কুয়াশা বলল, আমার কোমরে দেখুন দেশলাইয়ের বাক্সের চাইতেও ছোট একটা বাক্স আছে। শিগগির ওটা বের করুন, দেরি করবেন না। আমাদের হাতে সময় অতি অল্প। পিঠের দিকে ঠিক মাঝখানে দেখুন।
দ্রুত হাতে বাক্সটা বের করল সেলিম।
দেখুন ছোট একটা বোম একদিকে। উল্টোদিকটায় আছে একটা ফুটো। ফুটো দিকটা হাতকড়ার কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে চেপে ধরে সুইচটা টিপুন।
নীরবে কুয়াশার নির্দেশ পালন করল সেলিম। ড. রাজী চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন হাতকড়ার ইস্পাত দ্রুত গলে যাচ্ছে। মাত্র দু’মিনিটের মধ্যেই কড়া দুটো আলাদা হয়ে গেল।
ধন্যবাদ। দিন ওটা।’ সেলিম বাক্সটা কুয়াশার হাতে দিয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করল, দ্রব্যটা কি?’ ড. রাজীও সবিস্ময়ে তাকিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’
কুয়াশা বলল, এটা হচ্ছে একটা মিনি আন্ট্রাসোনিক্স বক্স। এইরকম দুঃসময়ে খুব কাজ দেয়।
দরজার অপরদিকে দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কুয়াশা পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আগের মতই হাত দুটো পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
| দড়াম করে দরজা খুলে গেল। পারভেজ ঢুকল। ভয়ঙ্কর হিংস্র দেখাচ্ছিল তাকে। সে রিভলভারটা কুয়াশার দিকে উদ্যত করে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বটে, তোমার এমন দুঃসাহ! তুমি স্ক্র্যাংককে খুন করেছ! দাঁড়াও। তোমাকে কঠোরতম শাস্তি দেব, কুকুর নয় ঐ হিংস্র বাদরটার হাতে সপে দেব তোমাকে।
ওর লোভ হচ্ছে চোখের দিকে, তোমার চোখ দুটো উপড়ে খাবে।
ড. রাজী ও সেলিম আতহারের দিকে দৃষ্টি ফেরাল পারভেজ, আপনারা পাশের রুমে চলে যান আপাতত। আমি খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে আসছি।’
বীভৎস হাসি হেসে সে আবার বলল, ভয় নেই। ঘটনাটা আপনারাও প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। দরজার পাল্লায় কাঁচ বসানো আছে। সেটা বের করে দিলেই আপনারা পাশের রুম থেকে মহোৎসবটা দেখতে পাবেন। তবে বেরিয়ে যাবার ১৪৬
ভলিউম-৯
চেষ্টা করবেন না, ব্যর্থ হবেন। যান, দেরি করবেন না।’
কুয়াশার দিকে অসহায় দৃষ্টি মেলে ড. রাজী ও সেলিম বেরিয়ে পাশের রূমের দিকে এগোল। দরজাটা বন্ধ করার জন্যে পারভেজ পিছন ফিরতেই কুয়াশা ঝড়ের বেগে এসে প্রচণ্ড একটা লাথি হকাল পারভেজের হাঁটুতে। আক্রমণের প্রচণ্ডতা ও আকস্মিতায় পারভেজ দু’হাঁটু মুড়ে গিয়ে মাথাটায় দরজার গুতো খেল। কিন্তু পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করল সে। পারভেজের ডানহাতটা তখন কুয়াশার পায়ের কাছে। | কুয়াশা ডান পা দিয়ে পিস্তলধরা হাতটাতে লাথি মারল। কিন্তু পারভেজ হুসিয়ার ছিল। সে সাঁ করে হাতটা সরিয়ে গুলি ঘুরল পর পর দু’বার। কিন্তু ততক্ষণে সরে গিয়েছে, কুয়াশা। সুযোগ বুঝে সে পারভেজের চোয়ালে সজোরে ঘুসি চালাল। পারভেজ মুখ ঘোরাবার চেষ্টা করতেই ঘুসি লাগল ভুরুতে। কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। পর পর দু’বার ঘুসি চালাল কুয়াশা। পারভেজ ছিটকে পড়ল একটা খাঁচার উপর এবং সেখান থেকে গড়িয়ে মেঝেতে। আবার দু’রাউণ্ড গুলি ছুঁড়ল সে। কুয়াশা আত্মরক্ষা করল অন্য একটা খাঁচার আড়ালে লুকিয়ে। আবার গুলি করল পারভেজ এবং এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
কুয়াশাও খাঁচার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
পরপর গুলির আওয়াজ শুনে ড. রাজী ও সেলিম আতহার কাঁপছিল। তারা যতটা সম্ভব দূরত্ব রক্ষা করে একটা কোণে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের আতঙ্ক বিহ্বল চোখের সামনে দিয়ে পারভেজ বেরিয়ে গিয়ে অন্য একটা দরজা দিয়ে ঢুকে গেল মুহূর্তের মধ্যে। একবার ফিরেও তাকাল না ওদের দিকে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওরা দু’জন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কুয়াশা ওদের ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করল, কোনদিকে গেল?
তাকে দেখে সেলিমের সংবিৎ ফিরে এসেছিল। সে বন্ধ দরজাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দরজাটা খোলবার চেষ্টা করল না কুয়াশা। সে বলল, চলন আমরা অন্যপথ দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দেরি করলে আবার আমাদের উপর হামলা হতে পারে। এখনও সে লুকিয়ে আছে এই বাড়িটার মধ্যেই। সুযোগ পেলেই হামলা করবে। নেহায়েত ওর রিভলভারে আর মাত্র একটা গুলি আছে বলে গা ঢাকা দিয়েছে ও। যে-কোন মুহূর্তে গুলি ভরে নিয়ে এসে হামলা চালাতে পারে।
চলুন, ড. রাজী কুয়াশার দিকে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ।
উপরের যে রূমটাতে কুয়াশা ধরা পড়ে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। তার রিভলভারটা এখনও সেখানে পড়ে আছে। কুয়াশা রিভলভারটা তুলে পকেটে ঢোকাল।।
খোলা দরজার দিকে এগিয়ে চলল ওরা। কাছেই ভারি পদশব্দ শোনা গেল । কে যেন দৌড়ে আসছে। শব্দটা আসছে খোলা দরজার দিক থেকেই। ড, রাজী ও কুয়াশা-২৭
১৪৭
সেলিম ছিল কুয়াশার সামনে। সে লাফ দিয়ে ওদের দু’জনের সামনে এগিয়ে গেল ।
দাঁড়ান, আর এক পাও এগোবেন না,’ কুয়াশা মৃদু কণ্ঠে নির্দেশ দিল। থমকে দাঁড়ালেন ড. রাজী। সেলিমও দাঁড়িয়ে পড়ল।
ব্যাপার কি?’ প্রশ্ন করল সেলিম।
ব্যাপারটা তখুনি টের পাওয়া গেল। শব্দটা আরও কাছে এগিয়ে এসেছিল। খোলা দরজার দিকে তাকিয়েছিল ওরা। দুপদাপ শব্দ করতে করতে যেন একটা বিরাট দৈত্য এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। নিঃশব্দে নয়, প্রচণ্ড গর্জন করে। পিলে চমকানো গর্জন। কুয়াশার হাতের রিভলভার উপেক্ষা করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দানবটা। এত দ্রুত এবং এত প্রচণ্ড শক্তিতে কুয়াশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যে, কুয়াশা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারল না। সে চিত হয়ে পড়ে গেল। বিশালকায় জটা আর তার দিকে তাকাল না আতঙ্ক-বিহ্বল ড. রাজী ও সেলিমের দিকে এগিয়ে গেল। সেলিমের গালে একটা থাপ্পড় মেরে বুক বরাবর লাথি তুলল অতিকায় দানবটা। কুয়াশা তাকে সে সুযোগ দিল না। সে বিদ্যুৎ গতিতে পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে পর পর তিনবার গুলি করল আক্রমণকারীর পিঠের ঠিক মাঝখানে।
পাঁচ
যথাসম্ভব খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যর্থমনোরথ হয়ে রুহুল করিম ফিরে আসছিল ড. রাজীর বাসার দিকে চিন্তিত মনে। গত দু’দিনের ঘটনাবলীতে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সে। ড, রাজী আর পারভেজ ও সেলিমের অন্তর্ধানে সে তাদের অমঙ্গলের আশঙ্কায় গভীর উদ্বেগ অনুভব করছিল। চরম অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। তাছাড়া, কে জানে ওদের তিনজনের উপর যখন শত্রুর নজর পড়েছে তখন তার উপর কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হওয়াও বিচিত্র নয়, বরং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তো
পরের কথা। তার পরম শ্রদ্ধাভাজন ড. রাজী আর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর ভাগ্য সম্পর্কেও এখন তার উদ্বেগ প্রবল।
সকালে খবর পাওয়ার পর থেকেই তো খোঁজ-খবরের ক্রটি করেনি। বারটা বেজে গেছে, অথচ ওদের তিনজন সম্পর্কে এতটুকু সন্ধানও পাওয়া যায়নি। কে জানে, কোথায় নিয়ে গেছে ওদের সুপারম্যান, তাদের অদৃষ্টেই বা ইতিমধ্যে কি ঘটেছে।
সামনের দিক থেকে একটা গাড়ি আসছিল। সরু পথ। রুহুল করিম নিজের গাড়ির গতি কমাল। সামনের গাড়িটা কাছে আসতেই দুটো পরিচিত মুখ নজরে পড়ল তার। শহীদ সাহেব আর মিস রোকেয়া। তৃতীয় ব্যক্তি তার অপরিচিত। ভাল করে দৃষ্টি মেলে দেখল, গাড়িতে ড. রাজী, পারভেজ বা সেলিম নেই।
শহীদ সম্ভবত রুহুল করিমকে দেখতে পায়নি। কিন্তু রোকেয়া দেখেছিল ১৪৮
ভলিউম-৯
তাকে। সে শহীদকে বলল, “ঐ যে, রুহুল করিম সাহেব আসছেন। উনি হয়ত কোন খোঁজ দিতে পারবেন। সকাল থেকেই উনি আব্বার খোঁজ করছেন।
ততক্ষণে করিমের গাড়িটা অতিক্রম করে বসে শহীদ। সে গাড়ি থামিয়ে পেছন দিকে তাকাল। করিমও গাড়ি থামিয়েছিল। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে শহীদের গাড়ির জানালার পাশে এসে বলল, “পেলেন, পেলেন কোন খবর ড. রাজীর?’
শহীদ মৃদু কণ্ঠে বলল, ঠিক পেয়েছি, বলা যায় না। তবে আশা করছি, পেয়ে যাব। যেখানে ওকে পেতে পারি, মানে যেখানে ড, রাজীকে আটকে রাখার
সম্ভাবনা আছে আমরা যাচ্ছি সেখানেই।’
‘কোথায় সে জায়গা?’
বললে না-ও চিনতে পারেন। ইচ্ছে করলে আপনি আমাদের সঙ্গ নিতে পারেন।’
করিম একমুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “নিশ্চই যাব আমি। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিই।’ গাড়িতে ফিরে গেল সে। আধঘন্টা পরে গাড়ি থামাল শহীদ। মি. সিম্পসন বললেন, ‘বোধহয় কাজীপুরের জঙ্গল, তাই না?’
হ্যাঁ, নামুন। মিস রাজী, আপনিও নামুন।
মি. সিম্পসন ও রোকেয়া গাড়ি থেকে নামল। শহীদ চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল। রুহুল করিমের গাড়ি ততক্ষণে এসে থেমেছে। সে নেমে শহীদের পাশে এসে দাঁড়াল। | ‘মি. সিম্পসন, করিম সাহেব, কুইক। দেখুন তো পথের পাশেই ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে কোন গাড়ি দেখতে পান কিনা। আপনি মি. সিম্পসন, রাস্তার বা দিকে দেখুন। করিম সাহেব, আপনি সামনের দিকে চলে যান। আমি এদিকে দেখছি। কুইক।’
শহীদ সাহেব, আমি কি কোন কাজে লাগতে পারি না?’ রোকেয়া নমকণ্ঠে প্রশ্ন করল।
‘অবশ্যই পারেন। আপনি দেখুন ওইদিকে একটা জোডিয়াক দেখতে পান কিনা। মোট পাঁচ মিনিট সময়।’
ছড়িয়ে পড়ল ওরা কয়েকজন।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পথের পাশের ঝোঁপ-ঝাড় দেখা হয়ে গেল। রোকেয়া ফিরে এল সকলের আগে। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, আছে একটা জোডিয়াক। কালো রং-এর। কিন্তু ওটা মানে ঐ গাড়িতেই কি আব্বা…?
। ওটা অন্য একজনের গাড়ি। পরে জানতে পারবেন।’ মি. সিম্পসন এসে হতাশ হয়ে বললেন, ‘না, কোন গাড়ি দেখতে পেলুম না
ততা।’
কুয়াশা-২৭
১৪৯
কিন্তু চরম উত্তেজনা নিয়ে ফিরল রুহুল । সে উত্তেজনায় রীতিমত হাঁপাচ্ছিল। গুছিয়ে কথা বলতেও তার বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। সে বারবার বলল, একটা ফোক্সওয়াগেন। গাড়িটা মনে হল।’
চোখ টিপল শহীদ রুহুলকে। সে তার কথাটা শেষ করল না। শহীদ বলল, ‘এখনও হয়ত আশা আছে, মি. সিম্পসন। আর দেরি নয়, তাহলে আসুন। এই যে, এই পথ দিয়ে যেতে হবে। আসুন আমার পিছনে। মি. সিম্পসন, আপনার রিভলভারটা বের করে হাতে নিন।
মিনিট পনের পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ওদের ছোট্ট মিছিলটা। কেউ কোন কথা বলল না। জঙ্গলের ভিতরটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। অনেক দূরে দৃষ্টি যায়। অনেক দূর থেকেই জঙ্গলের ভিতরের পোড়োবাড়িটা দেখা যাচ্ছিল।
রুহুল ছিল শহীদের ঠিক পিছনেই। সে প্রশ্ন করল, ওটা কি, শহীদ সাহেব? ফরেস্ট অফিস নাকি?’
না। ওখানেই আমরা যাচ্ছি। ওখানেই আছে আমাদের বন্ধু সুপারম্যান, আর আছে তার সৃষ্ট সেই ডোসাইল জায়েন্ট। সেলিম ও ড. রাজীকে সম্ভবত ওখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছে।’
সত্যি কোন দানব-টানবের আকারের কিছু একটা আছে নাকি? না ওটা কোন মারপ্যাঁচের ব্যাপার?’
শহীদ বলল, স্বচক্ষেই দেখতে পাবেন কপাল ভাল থাকলে । অবশ্য দেখতে পাওয়াটা আবার দুর্ভাগ্যের কারণও হতে পারে।’
পোড়োবাড়িটার খুব কাছে এসে গিয়েছিল ও। হীদ দাঁড়িয়ে পড়ল । পশ্চাত্বর্তীদেরকে থামবার জন্যে ইশারা করল। থেমে গেল ছোট দলটা।
শহীদ চাপা কণ্ঠে বলল, আপনারা এখানটাতেই থাকুন । আমি ঘুরে আসছি।’
বাড়িটার দিকে এগোেল না শহীদ। সে জঙ্গলের ভিতর দিয়েই এগিয়ে গেল। ওরা কয়েকজন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোনক্রমে ভারসাম্য রক্ষা করল শহীদ। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, সবুজ লতায় তার বাঁ পায়ের জুতোর ডগাঁটা আটকে গেছে। কিন্তু না, ভাল করে লক্ষ্য করতেই শহীদ বুঝল, ওটা লতা নয়, ওটা সবুজ রং-এর একটা তার । উবু হয়ে তারটা দেখল সে। লম্বা সবুজ ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে তারটা। একটু অবাক হয়ে সে তারটা দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। ‘বেশি দূরে নয়, কাছেই একটা বড় গাছের নিচে ঘন ঝোঁপের মধ্যে তারটা শেষ হয়ে গেছে। ঝোঁপের ভিতরটা বেশ অন্ধকার। লতা-পাতা সরিয়ে শহীদ যা দেখল তাতে অবাক হল না
সে। ঐ ধরনের কিছু একটা সে আন্দাজ করেছিল। জিনিসটা হচ্ছে একটা ডিটোনেটর সেট অর্থাৎ মাইন ফাটাবার একটা ইলেকট্রিক পাঞ্জার। তার বরাবর
আবার ফিরে এল সে। সেটা সোজা চলে গেছে পোডড়াবাড়িটার দিকে।
শহীদের মনে খটকা লেগেছে। কে বসিয়েছে এই ডিটোনেটর সেটটা? ১৫০
ভলিউম-৯
সুপারম্যান স্বয়ং, না কুয়াশা? কখনই বা বসানো হয়েছে ওটা? কে জানে, রাতে যখন সে আর কামাল এই পোড়ঢ়বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিল তখন ওটা ওখানে ছিল কিনা। তখন যদি কেউ পাঞ্জারটা টিপে দিত তাহলে তো সকলে একসঙ্গে ধ্বংস হত।
একটা কথা মনে হওয়ায় আপন মনে হাসল শহীদ। সুপারম্যান বোকা বানাতে পারেনি তাকে। সুপারম্যান ধারণা করেছিল, তার আড়াটা শহীদের চেনা হয়ে গেছে কাজেই সে আর এই আড্ডায় ফিরে আসবে না বলে শহীদের ধারণা জন্মাবে। ফলে শহীদ আর যেখানেই হোক তার সন্ধানে এই পোড়োবাড়িতে হানা দিতে আসবে না। সুতরাং এটাই হবে তার সবচেয়ে নিরাপদ ঘাটি। কিন্তু সে। সুপারম্যানের সাইকোলজিটা বুঝতে পেরেছিল, সুতরাং ড. রাজী ও তার সহকারীদের অন্তর্ধানের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়েই তার মনে হয়েছিল যে, সুপারম্যানই যদি ওদেরকে চুরি করে থাকে তাহলে তাদেরকে নিঃসন্দেহে ঐ পোভড়াবাড়িতেই নিয়ে গেছে। তার ধারণা যে সত্যি, পথের পাশে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ফোক্সওয়াগনটাই তার প্রমাণ। তবে ড, রাজী বা তার সহকারীরা এখনও বেঁচে আছে কিনা কে জানে। সুপারম্যান তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যে যে শপথ নিয়েছে সে তো তা নিজ কানেই শুনেছে। | কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। পোড়োবাড়িটা থেকে কোন জন-প্রাণীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। | বেড়াটার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে। সমস্ত বেড়ার চারদিক ঘুরে এল। প্রবেশপথ বলতে কিছু দেখতে পেল না। গতরাতে বেড়ার নিচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ও কুয়াশার সাথে। কিন্তু সুপারম্যান তাদেরকে কিভাবে ঢুকিয়েছিল বলতে পারে না। কারণ জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর এগোতেই কয়েকটা প্রচণ্ড ঘুসি মেরে শহীদকে অচৈতন্য করেছিল পেদ্রো নামের সেই দৈত্যটা। সম্ভবত একই দশা হয়েছিল কামালেরও।
মি. সিম্পসন, রোকেয়া ও রুহুল করিমকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেখানে ফিরে গেল শহীদ।
“কি হে, কোথায় ছিলে তুমি? এই আসছি বলে চলে গেলে, আর বিশ মিনিট হল কোন পাত্তাই নেই। শেষটায় ভাবলুম, হয়ত এবার তোমাকেই খুঁজতে বেরোতে হবে।’
মৃদু হাসল শহীদ।
ব্যাপার কি?’ ডিটোনেটর সেটের কথা বলল শহীদ। শেষটায় যোগ দিল, আমি ঐ পেড়োবাড়িটার মধ্যে ঢুকব, মি. সিম্পসন। আপনি ডিটোনেটর সেটটা পাহারা দেবেন। এমনও হতে পারে যে, জঙ্গলের মধ্যেই কেউ লুকিয়ে আছে। আমাদেরকে ঢুকতে দেখলেই প্লঞ্জার অন করে দিয়ে বাড়িটা ধ্বংস করে দেবে। কাজটা অবশ্য কুয়াশা-২৭
‘১৫১
বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেও করা অসম্ভব নয়।
তা বটে।’ মিস রাজী, আপনি মি. সিম্পসনের সাথে থাকুন।
না, আমি আপনার সাথে থাকব। ঢুকব আমিও ঐ বাড়িটাতে। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি আছে যে।’
তা হোক। আব্বাকে তবু যদি বাঁচাতে পারি…নিজে জান দিয়েও যদি আব্বাকে বাঁচাতে পারি, আর্তস্বরে বলল রোকেয়া।
রোকেয়ার অনুভূতি শহীদের অন্তর স্পর্শ করল। সে বলল, ‘আচ্ছা, চলুন। ‘আমিও যাব, শহীদ সাহেব,’ রুহুল করিম জানাল।
আসুন তাহলে।’
মি. সিম্পসনকে ডিটোনেটর সেটের কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে পোড়োবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল শহীদ রোকেয়া আর রুহুল করিমকে সাথে নিয়ে।
শহীদ শেষবারের মত সতর্ক করে দিল মি. সিম্পসনকে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি বড় বেশি সাবধানী হয়ে পড়েছ। ভুলে যাচ্ছ কেন, আমি পুলিস
অফিসার?’
‘জঙ্গলের মধ্যে বলেই তো বিপদ। যে এটাকে এখানে রেখে গেছে সে যে কোন সময়ে ফিরে আসতে পারে। আর আপনি অসতর্ক হলে যে কি পরিণাম হবে বুঝতেই পারছেন। হয়ত দূর থেকে দেখেই গুলি ছুঁড়ে বসবে। আপনি বরং রিভলভারটা হাতেই রেখে দিন।’
নিশ্চয়ই। এবারে তোমরা এগোও।’
সকালে কাঁটাতারের বেড়ার নিচের যেখান দিয়ে শহীদরা বেরিয়ে এসেছিল সেখান দিয়েই ওরা পোড়োবাড়ির প্রাঙ্গণে ঢুকল। প্রথমে শহীদ, তারপর রুহুল করিম ও সকলের শেষে রোকেয়া। সবাই ঢুকে পড়তেই শহীদ নিচুস্বরে বলল, ‘দেরি করবেন না। আমাদের সকলকেই আগে দালানটার দেয়ালের পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রাঙ্গণের মাঝখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলে কারও নজরে পড়ার আশঙ্কা আছে।’
| রুহুল করিম বলল, “ঠিক, আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু ঢুকবেন কোনদিক দিয়ে? এদিকটা বোধহয় পিছন দিক। দরজা তো একটাও নেই, শুধু জানালা দেখা যাচ্ছে।
চলুন দেখি তো!’ | দ্রুত হেঁটে ওরা তিনজন দালানের দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। শহীদ, রুহুল করিম ও রোকেয়াকে ওকে অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করল। নিঃশব্দে ওরা দেয়ালের পাশ দিয়ে এগোতে লাগল।
শুড়ুম! গুড়ুম! দু’বার প্রচণ্ড শব্দ ভেসে এল ওদের কানে।
থেমে গেল মিছিলটা। শব্দটা ওদের মনে হল পোড়োবাড়িটার ভিতর থেকেই ১৫২
ভলিউম-৯
শহীদ পিছন বিস্ফারিত। কারও মুস্তে নিশ্চিত পতন থেে
আসছে। আবার গুলির শব্দ কানে এল।
কান পেতে রইল ওরা। শহীদ দেখল রোকেয়ার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। বোধহয় সামান্য কাঁপছেও সে। তবে নার্ভাস হয়নি একেবারে।
অনেকক্ষণ আর কোন শব্দ শোনা গেল না।
শহীদ আবার পা বাড়াল। রোকেয়া ও রুহুল এগোচ্ছিল। শহীদ ওদেরকে থামবার ইঙ্গিত করল। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে রইল ওরা। তারপর আবার ভেসে এল আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন, পর পর তিনবার। আর সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল এক অমানুষিক আর্তনাদ। কে যেন আকাশ ফাটিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করছে।
শহীদ পিছন ফিরে দেখল, রুহুল করিম ও রোকেয়া দুজনই কাঁপছে থরথর করে। ওদের দৃষ্টি বিস্ফারিত। কারও মুখেই রক্তের লেশমাত্র নেই। রোকেয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত নিশ্চিত পতন থেকে এভাবেই সে নিজেকে রক্ষা করেছে।
শহীদ দু’পা পিছিয়ে এসে চাপা স্বরে বলল, আপনারা এখানেই দাঁড়ান। আমি দেখছি।’
‘আমার ভয় করছে, শহীদ সাহেব।’ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল রোকেয়া। কে জানে, আব্বার কি অবস্থা হয়েছে। উনি কি…?
রোকেয়াকে সান্ত্বনা দেবার সময় ছিল না তখন শহীদের হাতে। সে দ্রুত বলল, আমি দেখছি। আপনি স্থির হোন।
জবাবে করুণ দৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকাল রোকেয়া।
শহীদ মোড় ঘুরতেই তার কানে ভেসে এল দুপদাপ শব্দ। কাছেই, সম্ভবত পাশের রূমটাতেই কারা যেন সশব্দে হাঁটছে। রিভলভার বের করল শহীদ।
কার যেন কণ্ঠস্বর শোনা গেল। পরিচিত কণ্ঠ, কিন্তু কেমন যেন জড়ানো। ঠিক বুঝতে পারল না শহীদ, কথাটাও বোঝা গেল না।
| দড়াম করে একটা শব্দ হল। সম্ভবত দরজা খুলে গেল। দেয়ালের সাথে গা সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। তার দৃষ্টিটা সামনের দিকে।
‘ওদিকে নয়, এদিকে। দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আবার আক্রমণ হতে পারে।’
আশ্বস্ত হল শহীদ। এতক্ষণ ধরে যে উত্তেজনা তার স্নায়ুকে বিপর্যস্ত করছিল তার অবসান ঘটল একমুহূর্তেই। পরমুহূর্তেই কুয়াশাকে দেখা গেল তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে একা নয়, তার পিছনে ড. রাজী আর সেলিম আতহার। তিনজনের চেহারাই চরম বিপর্যস্ত। কাপড়-চোপড় ময়লা, চুল এলোমেলো । সেলিমের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। জামাটার এখানে-সেখানে রক্ত।
| ওরা শহীদকে দেখে থমকে দাঁড়াল। কিন্তু মুহূর্তের জন্যেই। কুয়াশা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলল, “এসে গিয়েছ তাহলে, নির্ভুল হিসাব।
যদিও আসবার দরকার ছিল না। কিন্তু সে দ্রমহোদয় কোথায়? কুয়াশা-২৭
১৫৩
যদিও আসল, এসে গিয়েছড়াল। কিন্তু সেখানে রক্ত এলোমেলে।
‘পালিয়েছে। ধরতে পারলাম না এবারও।’ ‘পালিয়েছে মানে? সে নিশ্চয়ই ভিতরে আছে।’ ‘থাকতেও পারে।’
সেলিম বলল, ‘থাকতেও পারে মানে, নিশ্চয়ই আছে, যাবে কোথায়? বেরোবে কোনদিক দিয়ে? আমার মনে হয় বাড়িটা ঘিরে ফেললেই, এমনকি আমরা নিজেরাও যদি বাড়িটার চারদিকে পাহারা দিই তাহলে বদমাশটাকে অবশ্যই
ধরতে পারব।’
কুয়াশা বলল, কিন্তু এখানে দাঁড়ানো কোন অবস্থাতেই নিরাপদ নয়। সে যদি ইতিমধ্যেই পালিয়ে গিয়ে না থাকে তাহলে ভিতর থেকে গুলি করতে পারে আবার, চল।’
| ‘সেই ভাল। | ড. রাজী এতক্ষণ কোন কথা বলেননি। সম্ভবত তাঁর বিভ্রান্তির ভাবটা কাটেনি। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে শহীদের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। কয়েক পা এগোবার পর ড. রাজী কম্পিত কণ্ঠে বললেন, শহীদ সাহেব, আমার মেয়ে রোকেয়া? সে ভাল আছে তো?’
হ্যাঁ, ভাল আছে এবং এখানেই আছে। আমার সাথেই এসেছে সে। এই তো, মোড়টা ঘুরলেই চোখে পড়বে।’ | ড. রাজীর বিপর্যস্ত চেহারাতেও খুশির ঢেউ খেলে গেল। শিশুর মত উল্লাসে তিনি প্রায় দৌড়ুতে শুরু করলেন।
| আব্বা!’ রোকেয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। সে-ও দৌড়ে এসে ড. রাজীকে জাপটে ধরল। বাবার বুকে মাথা রাখল রোকেয়া।
মা, মাগো, ভাল আছিস তুই?’ পিঠে হাত বুলিয়ে ড. রাজী বললেন। রোকেয়া মাথা তুলল। সজল চোখে বলল, ইশ, তোমার কি হাল করেছে!’
‘বেঁচে যে আমরা আসতে পেরেছি সেটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য, মা। আর তার সমস্তটা কৃতিত্ব হচ্ছে একমাত্র ওঁর।’ কুয়াশার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গদগদ কণ্ঠে বললেন ড. রাজী, বিধাতা যেন চরম লগ্নে ওঁকে পাঠিয়েছিলেন।
রোকেয়া গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকাল। রুহুল করিমও তাকাল কুয়াশার দিকে।
সে বলল, “আরে, এ যে আমাদের আলী সাহেব!’
সেলিম কপালের রক্ত মুছতে মুছতে বলল, আগে তো তাই জানতাম, কিন্তু কে জানত উনিই হচ্ছেন কুয়াশা?’
কুয়াশা!’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল রোকেয়া; উনি…উনিই কুয়াশা?’ বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় রুহুল করিম রোকেয়া চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
রোকেয়া কি যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই কুয়াশা মৃদু কণ্ঠে বলল, কিন্তু ড. রাজী, আমি আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমরা বিপদ এখনও ১৫৪
ভলিউম-৯
কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের এখুনি এই জায়গাটা ত্যাগ করা উচিত।’
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ওরা কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করল। প্রথমে কথা বলল রুহুল করিম। ‘পারভেজ কোথায়? তাকে যে দেখছিনে?’ শঙ্কিত শোনাল তার কণ্ঠ।
এ প্রশ্নের জবাব দিল সেলিম। সে চরম ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, কে জানে। সে শয়তানটা কোথায় পালাল।
‘পালাল মানে?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল রুহুল করিম। শহীদ হেসে বলল, “সেই সাহেবই তো এই রহস্যের নায়ক।
কথাটা যেন মস্তিষ্কে পৌঁছুল না রুহুল করিমের। সে বোকার মত তাকিয়ে রইল শহীদের দিকে।
মৃদুকণ্ঠে ড. রাজী বললেন, রুহুল, পারভেজই গত কয়েক দিনের কাণ্ডগুলো করে বেড়াচ্ছে। হি ইজ দ্য সুপারম্যান।
বল কি, আব্বা!’ কপালে দু’চোখ তুলল রোকেয়া। | হ্যাঁ, মা। ঐ দানরগুলো তারই অবদান। কুয়াশা দুটোকেই শেষ করে দিয়েছেন।’ সশ্রদ্ধ কণ্ঠে বললেন ড. রাজী।
ওদিকে কুয়াশা ও শহীদের মধ্যে মৃদু স্বরে কি যেন আলাপ হচ্ছিল। শহীদ কথা শেষ করে রুহুল করিমকে বলল, করিম সাহেব, আপনি সোজা চলে যান মি, সিম্পসনের কাছে। তাঁকে প্রাঞ্জারটা টিপে দিতে বলুন। আর আপনারা তাঁর কাছেই থাকবেন। এদিকে আসবেন না। পোড়োবাড়িটা বিস্ফোরিত হলে ইটের টুকরো ছিটকে এসে কারও আহত হওয়া বিচিত্র নয়। কুইক। আর শুনুন, বিস্ফোরণ শেষে মি. সিম্পসনকে এখানেই থাকতে বলবেন। বদমাশটা যাতে পালাতে না পারে তাকে তা দেখতে বলবেন। চল, কুয়াশা।
চল।’ কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’ সেলিম প্রশ্ন করল। চূড়ান্ত লড়াইয়ে।’
সুড়ঙ্গ-পথের দিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা ও শহীদ। একটু পরেই ওদের কানে গেল বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ।
ঝাকড়া ঝোঁপটার কাছে কুয়াশা ও শহীদ গিয়ে দাঁড়াতেই গাছ থেকে নেমে এল কলিম।
কুয়াশা হেসে বলল, কি রে, কোন খবর আছে?’
। শুধু পিঁপড়ের কামড় খেয়ে হাত-পা জ্বালা করছে। তোমার সেই দৈত্য দানব বা অন্য কেউ বেরোলও না, ঢুকলও না। কিন্তু এত যে পিস্তলের গল্প শুনলাম, ব্যাপার কি?’
‘একদফা লড়াই হয়ে গেল।
‘সব খতম তো? কুয়াশা-২৭
১৫৫
না, আসল বদমাশটাকে এখনও পাইনি।’
আর পাবে কি করে? বাড়িটা তো ধসেই গেছে। নিশ্চয়ই চাপা পড়ে মারা গেছে।’
“উঁহু, তা হবে না। তোর ডিটোনেটরটা বলতে গেলে ছিল একটা খেলনা মাইন। বাড়িটার ভূ-গর্ভস্থ ঘরগুলোর তেমন কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।’
| তাহলে?’
‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বেঁচে থাকলে এপথেই সে বেরুবে। এখন চুপ কর। একটা কথাও আর নয়। টু-শব্দটি শুনলেও ফিরে যাবে বদমাশটা। আয়,
একটু দূরে সরে দাঁড়াই আমরা।’
হাত দশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।
বেলা পড়ে এসেছে। খিদে পেয়েছে ওদের তিনজনেরই। প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর ঝোঁপটা নড়ে উঠল।
প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে রইল ওরা তিনজন। কিন্তু কেউ বেরোল না ঝোঁপের মধ্য থেকে।
নড়তেই লাগল ঝোঁপটা।
কুয়াশা, কলিম ও শহীদ এগিয়ে গেল ঝোঁপটার কাছে নিঃশব্দে। প্রবলভাবে আন্দোলিত হচ্ছে ঝোঁপটা। মনে হচ্ছে, কে যেন বেরিয়ে আসার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
| একটা ডাল ভেঙে নিয়ে অতি সাবধানে ঝোঁপটার নিচের দিকের লতা-পাতা ফাঁক করল কুয়াশা। ঝোঁপের আন্দোলন থেমে গেল। মুহূর্তের জন্যে নীল লোমশ একটা প্রাণী কুয়াশার চোখে পড়ল।
কি ব্যাপার?’ শহীদ চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
নীল একটা প্রাণী। সম্ভবত নীল বাঁদর হবে ওটা। সুপারম্যানের আর এক অদ্ভুত সৃষ্টি। পারভেজ বোধহয় পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্যেই ওটাকে পাঠিয়েছে।
তাহলে?’ চল, নেমে পড়া যাক। না, তোমরা থাক, আমি একাই নামব।’ তা হয় না, শহীদ বলল। কলিম, তুমি থাক।’ ‘বেশ।
ঝোঁপটা সরিয়ে নেমে গেল কুয়াশা ও শহীদ সুড়ঙ্গ বেয়ে। নীল প্রাণীটাকে দেখা গেল না আর। উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দুজন সাবধানী পদক্ষেপে এগিয়ে চলল। একটু এগিয়েই কুয়াশার বাঁ হাতের সরু পেন্সিল টর্চটার আলোতে যা দেখতে পেল তাতে ভীষণভাবে চমকে উঠল ওরা।
সরু সুড়ঙ্গ যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে এখন আর নিয়ন আলো জ্বলছে । পেন্সিল-টর্চটার ম্লান আলোয় দেখা গেল নিস্পন্দ একটা মানুষের দেহ পড়ে আছে চিত হয়ে। কে যেন খুলে নিয়েছে তার চোখ দুটো। সমস্ত মুখে রক্ত আর ১৫৬
ভলিউম-৯
আঁচড়ের চিহ্ন, জামা-কাপড় ছেঁড়া। কি বীভৎস দেখাচ্ছে মৃতদেহটাকে।
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা।
‘শেষপর্যন্ত নিজের সৃষ্ট ফ্রাংকেনস্টাইনের হাতেই মারা গেল সুপারম্যান!’ ধীরে ধীরে বলল শহীদ।
একটু দূরে পড়ে আছে একটা রিভলভার। অদূরে পড়ে আছে দুটো বিশালকায় কুকুরের আর একটা নীল বাদরের মৃতদেহ।
কুকুর দুটোর একটা আমার হাতে মারা গেছে, কুয়াশা বলল।
শহীদ বলল, ‘বোধহয় ওগুলোকে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিল পারভেজ। শেষপর্যন্ত ওরাই তাকে আক্রমণ করেছে। দুটোকে মেরেছে, নিজেও মারা পড়েছে ওদের হাতে।
ওরা খেয়াল করেনি। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন শহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
| উহ!’ চিৎকার করে উঠল শহীদ। | কুয়াশা দ্রুত মুখ ফিরিয়ে শহীদের দিকে তাকাল। তার দিকে আলো ঘুরিয়েই দেখতে পেল, নীল বাদরটা শহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কুয়াশা বাঁদরটার পেটের উপর রিভলভার চেপে ধরল।
ছয়
পরদিন বিকেলে ড. রাজীর ড্রইংরূমে ওরা সবাই জড় হয়েছিল। শহীদ, কামাল, রুহুল করিম, সেলিম, রোকেয়া আর ড. রাজী সবাই উপস্থিত। আমন্ত্রণ করেছিল রোকেয়া। মি. সিম্পসনকেও দাওয়াত করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যস্ততাহেতু তিনি আসতে পারেননি।
| গোড়ার দিকে হতাশ হয়েছিল রোকেয়া। শহীদ আর কামালকে সে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিল যেন, কুয়াশাকে তারা অবশ্যই সাথে করে নিয়ে আসে। সেটা যে সম্ভব নয় শহীদ তা বলেছিল। কিন্তু তারপরও সনির্বন্ধ অনবোধ জানিয়েছিল রোকেয়া শহীদকে। কুয়াশাকে অবশ্য শহীদও রোকেয়ার পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছিল। কুয়াশা জবাবটা এড়িয়ে গেছে।
এক প্রস্থ চা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সেলিম বলল, জানিস, শহীদ, সমস্ত ব্যাপারটা না এখনও আমার কত কেমন যেন অবিশ্বাস্য রূপকথার মত মনে হচ্ছে।’
ড. রাজী বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমাদের মধ্যেই যে এতদিন ধরে একজন সুপারম্যান আত্মগোপন করে ছিল এবং সে যে এত মানবতাবিরোধী শয়তান, ছিল তা তো ধারণাও করতে পারিনি। তাছাড়া সে যে ইতিমধ্যেই জায়েন্টও তৈরি করছে তা আমাদের কল্পনাতীত ছিল। কুয়াশা-২৭
১৫৭
‘অথচ,’শহীদ সিগারেটে টান দিয়ে বলল। আপনাদেরই এই সম্ভাবনার কথা আগে ভাবা উচিত ছিল।’
| ড. রাজী তা স্বীকার করলেন।
সেলিম বলল, পারভেজ, শেষ পর্যন্ত আমাদের পারভেজ দ্য হ্যাঁণ্ডসাম, মানে আমার ঘনিষ্টতম বন্ধু পারভেজ, নিউ হি ওয়াজ এ ডেভিল? আচ্ছা, বলতে পারিস, ওর অতীত কি?’
‘কিছু কিছু জেনেছি আমি,’ বলল শহীদ।
বলুন না,’ আবদার জানাল রোকেয়া।।
শহীদ সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে বলল, এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল জার্মানিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। হিটলারের নির্দেশে প্রফেসর ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ, যাকে মডার্ন জেনেটিকসের জনক বলা হয়, তিনি সুপারম্যান গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে থাকেন। সফলও হন। কিন্তু তিনি হিটলারের মতলব জানতেন, তাই ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট সুপারম্যান বেবিকে তিনি লুকিয়ে রাখেন। ড. লোকমান হাকিম ছিলেন ড, শেলবুর্গের বিশ্বস্ত ছাত্র। তিনিও তখন পৃথকভাবে ইউজেনিকসের অর্থাৎ সুপারম্যান গড়ে তোলার গবেষণা করছিলেন। ড. শেলবুর্গের গবেষণার এবং তার সাফল্যের খবর তিনি রাখতেন। সুপারম্যান বেবির খবরও পেয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় বরণের পর ড. ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়। সুপারম্যান বেবিকে রেখে যান এক গোয়ালার
যাকে মহাযুদ্ধের গান দিয়ে
কাছে কয়েক বছর পর
রিকায় পাঠিয়ে দেন এবং এখানে ইউজেকে নিয়ে
কয়েক বছর পর ড, লুকম্যান এইচ কিম অর্থাৎ ড. লোকমান হাকিম সেই শিশুকে খুঁজে বের করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন শিক্ষার জন্যে। ইতিমধ্যে তিনি হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করেন এবং এখানে ইউজেনিকসের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে তিনি সুপারম্যান বেবিকে নিয়ে আসেন। অবশ্য তখন আর সে বেবি নয়, পূর্ণ যুবক। পারভেজ ইমাম নামটা তার ড. হাকিমই দিয়েছিলেন। তাকে তার পরিচয়ও দিয়েছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে আপনাদের ল্যাবরেটরিতে ইউজেনিকসের গবেষণা সফল হল। এই সফলতার মূলে ছিল পারভেজ অর্থাৎ সুপারম্যান স্বয়ং। প্রথমে সে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। কিছুদিন পরেই সে বুঝল যে, ইচ্ছানুযায়ী প্রাণী সৃষ্টির রহস্য অন্যের হাতে পড়লে তার একক সুপারম্যানত্ব ঘুচতে পারে, সুতরাং সে সাবধান হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সে কাজীপুরের জঙ্গলে একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তুলে কয়েকটা অতিকায় অথচ বোবা ও মানবাকার প্রাণীর জন্ম দিল। অতিকায় কুকুর, বাদর ইত্যাদিরও জন্ম দিল সে। | ড. লোকমান হাকিম বোধহয় তার কু-মতলবটা আন্দাজ করেছিলেন। হয়ত সেই কারণে অথবা তিনি পারভেজের আসল পরিচয় জানতেন বলে তাকে হত্যা করল সে দূর্ঘটনার অজুহাত দেখিয়ে। ড. রাজী সেলিম বা রুহুল করিমকে সে ১৫৮
ভলিউম-৯
_ সে বলল রোকেয়া।
গ্রাহ্যের মধ্যে আনত না। তবে ভবিষ্যতে একে একে এদেরকেও হত্যা করত পারভেজ।’ কথা শেষ করে থামল শহীদ।
শিউরে উঠল রোকেয়া।
সে বলল, অথচ আব্বা ওকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সেলিম ও করিম সাহেব তো পারেভজ বলতে অজ্ঞান ছিলেন।
শয়তানের কাছে স্নেহের কোন দাম নেই, মিস রাজী,’শহীদ’ বলল। রুহুল প্রশ্ন করল, তারপর?
ইতিমধ্যে বুয়েনস এয়ার্সে ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিকস সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই ড, ম্যানফ্রেণ্ড শেলবুর্গের সাথে কুয়াশার আলাপ হয়। তার কাছে কুয়াশা সুপারম্যানের রহস্য সম্পর্কে জানতে পেরে পশ্চিম জার্মানি যায়। সেখান থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ব্রিটেন হয়ে সে ফিরে আসে দেশে। ড. লুকম্যান এইচ কিমই সুপারম্যান বেবিকে নিয়ে গেছেন তা সে জার্মানিতে জানতে পারে। ড, হাকিমই যে লুকম্যান এইচ কিম এটা জানতে অবশ্য তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। বাই দ্য ওয়ে, কুয়াশা ড, শেলবুর্গকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ইউজেনিকসের সম্ভাব্যতা সে নির্মূল করবে এবং সুপারম্যান বেঁচে থাকলে তারও মোকাবেলা করবে।
‘দেশে ফিরে প্রথমে কুয়াশা, এক আমেরিকান সাইন্টিস্টের ছদ্মবেশে ড. রাণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে।’
ড. রাজী অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাহলে কুয়াশাই আমার কাছে এসেছিলেন!
হ্যাঁ। এবং পরে এসেছিল ইনডেন্টর আলী সাহেবের ছদ্মবেশে।
বলছেন কি এসব, আঁ?’ রুহুল করিম তার স্বভাবসিদ্ধ মেয়েলীকণ্ঠ প্রশ্ন করল।
হাসল শহীদ।
য, এর মাস খানেক আগেই ড. হাকিম মারা যান। আমেরিকান ভদ্রলোককে প্রথমে পারভেজ সন্দেহ করেনি। কিন্তু কুয়াশা একদিন রাতে ড. রাজীর ছদ্মবেশে রিসার্চ সেন্টারে প্রবেশ করে এবং কয়েক জায়গায় রেডিও-ট্রান্সমিটার লাগিয়ে রেখে যায়। ফলে রিসার্চ সেন্টারের কথাবার্তা তারপর থেকে নিজের ঘরে বসেই জানতে পারত সে। শুধু তাই নয়, এই বাড়িও উপরের রূমগুলোতে রেডিও ট্রান্সমিটার লাগানো আছে, চমকাবেন না। খোঁজ নিয়ে দেখুন। এবং সেগুলো কুয়াশাই লাগিয়েছে। আর তার বদৌলতেই সে এখান থেকে ইউজেনিকসের ফর্মলা সরিয়েছিল!
এবারে অবশ্য কেউ অবাক হল না। কারণ ইতিমধ্যেই রোকেয়া তার রুমে রেডিও ট্রান্সমিটারের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল।
কুয়াশা রিসার্চ সেন্টারে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ইউজেনিকসের ফর্মুলার
কুয়াশা-২৭
১৫৯
যান। আমে রাজী
রেখে
সন্ধান পায়নি। যদি কারও কথায় কখনও এ সম্পর্কে কোন হদিস পাওয়া যায় সেই আসাতেই সে ট্রান্সমিটার লাগিয়েছিল। পরের ঘটনাগুলো তো আপনাদের মোটামুটি জানাই আছে। | সেলিম বলল, তাহলে, যে রাতে আমি আর পারভেজ জানতে পারলাম যে ড. রাজী রিসার্চ সেন্টারে ঢুকে কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসেছিলেন সেই রাতেই ড. রাজীর ছদ্মবেশে কুয়াশা ঢুকেছিল সেখানে। অথচ কুয়াশা মানে আলী সাহেবই আমাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণ করেছিলেন সে রাতে।
হা। এবং তখুনি হুঁশিয়ার হয়ে যায় পারভেজ।
““
; ‘সেলিম, ব্যাপারটা কি, বল তো?’ ড. রাজী জানতে চাইলেন। সেলিম ঘটনাটা জানাল তাকে।। ড. রাজী বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, তা ঘটনাটা আমায় বলনি কেন?
সেলিম বিব্রত হয়ে বলল, পারভেজই আমাকে নিষেধ করেছিল। বলেছিল যে, ও গোপনে অনুসন্ধান করবে। আমিও ওকে বিশ্বাস করেছিলাম।
রোকেয়া বলল, সে যাক। তারপর?
তারপর কুয়াশা প্রদর্শিত পন্থাই বেছে নিল পারভেজ। সে নিজেও পরে ৫ ‘ রাজীর ছদ্মবেশে সেন্টারের ভিতরে ঢুকল। তার আগে অবশ্য সি. সি. টিভি রূমে এমন উগ্র মাদকদ্রব্য রেখে এসেছিল যাতে সিকিউরিটি গার্ড চেতনা হারিয়ে ফেলে। তারিক খ তাকে দরজা খুলে দেয়। তাকে সে হত্যা করে ল্যাবরেটরিত্রে ঢোকে। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইউজেনিকসের ফর্মুলাটা হস্তগত করা। তবে সে একা যায়নি রিসার্চ সেন্টারে। তার সাথে ছিল তার অন্যতম সৃষ্টি এক ডোসাইল জায়েন্ট, সে অবশ্য ভিতরে ঢোকে পরে। কুয়াশাও সদলবলে সে রাতে রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিল। সে-ও অবশ্য ভিতরে ঢুকতেই গিয়েছিল সেখানে। যাই হোক, ড. রাজীর ছদ্মবেশে পারভেজ সেন্টারের ভিতরে ঢুকল । তার একটু পরে ড. রাজী নিজেও রিসার্চ সেন্টারের গেটে উপস্থিত হলেন। তাঁর উপর আক্রমণ চালাল পারভেজের ডোসাইল জায়েন্ট। | শহীদ একটু থেমে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ড. রাজীর উদ্দেশে বলল, “ আপনি যখন অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন তখন কুয়াশাই আপনাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছিল।’
“তাই নাকি? ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যজনক ছিল,’ বললেন ড. রাজী। আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারিনি।’ | রুহল করিম প্রশ্ন করল, শহীদ সাহেব, ইউজেনিকসের ফর্মুলা এখন কার। কাছে আছে বলতে পারেন?
যদি কুয়াশা ইতিমধ্যেই তা ধ্বংস করে না ফেলে তাহলে সেটা তার কাছেই আছে। তবে ভয় নেই। সে সুপারম্যানের জন্ম দেবে না। ড, শেলবুর্গের কাছে সে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৬০
Leave a Reply