২৬. অতিমানব ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৬
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট, ১৯৭০
এক
কুয়াশার ডায়েরী থেকেঃ
বুয়েন্স এয়ার্সঃ ৫ জুলাই।
প্লাজা হোটেলের গেটের সামনে গতকাল যে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল আজ তার প্রথম পর্বের অবসান ঘটল। জানি না, এখানে এই প্রথম পর্বেই এই ঘটনার পূর্ণ সমাপ্তি ঘটবে, না ভবিষ্যতে অন্য কোন আশ্চর্য ঘটনার মধ্য দিয়ে তা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছুবে।
প্লাজা হোটেলে এক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক বংশানুক্রম বিজ্ঞান সম্মেলন চলছিল। আজকে তা শেষ হল। গতকাল আমি যখন সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরোচ্ছিলাম লাঞ্চের তখনও কিছুক্ষণ বাকি ছিল। ট্যাক্সির জন্যে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। নোংরা জীর্ণ পোশাক পরা এক স্থবির-প্রায় বৃদ্ধ হোটেলে ঢুকবার জন্যে দারোয়ানের কাছে কাকুতি-মিনতি করছিলেন এবং দারোয়ান তাকে ধমকে তাড়াবার চেষ্টা করছিল। বৃদ্ধ কথা বলছিলেন জার্মান ভাষায় আর দারোয়ান বলছিল স্পেনীয় ও ইংরেজি মেশানো বিচিত্র এক ভাষায়। বৃদ্ধের নিবেদনে স্বভাবতই কর্তব্যপরায়ণ দারোয়ানের মন গলবার কথা নয়। প্রথমটায় আমিও ভেবেছিলাম লোকটা ভিখিরি-টিখিরি হবে। কিন্তু তার চেহারায় বিশেষ করে তাঁর সবুজ চোখের তারায় এক আশ্চর্য দ্যুতি দেখতে পেলাম। থমকে দাঁড়ালাম আমি। বৃদ্ধও আমাকে দেখলেন আপাদমস্তক। তারপর দারোয়ানকে বিস্মৃত হয়ে আমার দিকেই এগিয়ে এলেন। আমি ভাল করে দেখলাম, সত্যি অসাধারণ দীপ্তিময় বৃদ্ধের
চোখ দুটো।
কিন্তু বৃদ্ধ ছিলেন অত্যন্ত অসুস্থ। তাঁর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তিন পা হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েই তিনি হাঁপাতে লাগলেন। আমার বুকে আঁটা প্লাস্টিকের প্লেটের দিকে তাঁর দৃষ্টি। তাতে লেখা ছিল আমার পোশাকী নাম। পরিচয়ঃ আন্তর্জাতিক বংশানুক্রম বিজ্ঞান সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধি। সেটাতে চোখ বুলিয়ে বৃদ্ধ কি যেন আমাকে বলতে চাইলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। কাশতে লাগলেন তিনি। শুকনো কাশি এবং সে কাশি সহজে থামল না। কাশির প্রচণ্ড দমকে তিনি ফুটপাতের উপর বসেই পড়লেন। অভিজাত হোটেলের দারোয়ানের
কুয়াশা-২৬
তা সহ্য হল না। সে চটে-মটে এগিয়ে এল। স্পেনীয় ককনি আমার জানা নেই, তবে তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল, মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো যথেষ্ট অভিজাত না-ও হতে পারে। ইশারায় তাকে বাধা দিয়ে বৃদ্ধকে আমি তুলে নিয়ে একটু দূরে গেলাম। আমার কাণ্ডটা দেখে দারোয়ান অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
বৃদ্ধের কাশি থেমেছিল। তাকে আমি বললাম, আমায় কিছু বলবেন?
মাথা নাড়লেন তিনি। একটু বিশ্রাম নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, জার্মান জান?’ তার উচ্চারণ শ্লেম্মাজড়িত ফাসফেঁসে।
জানি, কিছু কিছু।’
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, তুমি তো জেনেটিকস সম্মেলনে যোগ দিচ্ছ। আচ্ছা বলতে পার, ম্যানফ্রেড শেলবুর্গের অনুপস্থিতিতে
সম্মেলনে কেস সম্মেলন হরে অবাক হয়ে উম্ভর নামটাও শোনেটিকস সম্পন্ন
অরকে গেল, ‘ওহ্, তোম, শুধু আমি না, জেনোরপিতা বলে
ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ!’ আমি অবাক হয়ে উচ্চারণ করলাম। বৃদ্ধের ঠোঁটটা বেঁকে গেল, ‘ওহ, তোমরা তার নামটাও শোননি বোধহয়!’
ম্যানফ্রেড শেলবুর্গের নাম আমি শুনেছি। শুধু আমি না, জেনেটিকস সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারণা আছে তারাও শুনেছে। তাঁকেই তো ঐ বিজ্ঞানের পিতা বলে গণ্য করা হয়। হিটলারের আমলে জার্মানির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন তিনি। জার্মান বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি ছিলেন বেশ কয়েক বছর। আমি তার নাম শুনেছি, তাঁর বই পড়েছি। বই-এর মলাটে, পপ-পত্রিকায় তাঁর ছবি দেখেছি।
এই সম্মেলনেও বারবার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাকে। দেখবার সুযোগ আমার হয়নি। শুনেছি, বার্লিনের পতনের দিন তাকে তার একমাত্র শিশুপুত্রসহ শেষবারের মত দেখা গিয়েছিল। পরে শোনা যায়, তিনি মারা গেছেন। অবশ্য এ সম্পর্কে নিশ্চিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যুদ্ধোত্তর কালে মিত্রপক্ষের গোয়েন্দারা তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেনি। যুদ্ধ-অপরাধীদের তালিকায় তারও নাম ছিল।
| আমি বললাম, তিনি তো মারা গেছেন।
করুণ হাসি হাসলেন বৃদ্ধ, ভুল। হিটলারের মানবতা বিরোধী অপরাধে ইচ্ছার, বিরুদ্ধে তাকে সহযোগিতা করতে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু নিজ দেশে বিরোধী শক্তির হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে সে চায়নি। তাই এক গোয়ালার হাতে সে তার শিশুপুত্রকে তুলে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। তারপর থেকে সে জীবনমৃতের মতই জীবন-যাপন করে আসছে।’
সন্ধানী দৃষ্টিতে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক এতদিন পরে এই অবিশ্বাস্য খবর কোত্থেকে পেলেন? কে ইনি? ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ স্বয়ং? ড. শেলবুর্গের যে ছবি দেখেছিলাম’ এই রোগপাণ্ডুর বৃদ্ধের চেহারার সাথে তার কোন সাদৃশ্য নেই। কিন্তু বৃদ্ধের দ্যুতিময় দুটো চোখের সাথে সুদূর অতীতে দেখা ছবির ৬০
ভলিউম-৯
চোখ দুটোর যেন সাদৃশ্য দেখতে পেলাম অনেকটা।
সন্দেহ ঘুচল না। তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনিই কি তাহলে ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ?’
আমার প্রশ্নটা বোধহয় তার কানে গেল না। চলমান জনস্রোতের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে তিনি বোধহয় তখন অতীত বার্লিনের কোন স্মৃতিচারণ করছিলেন। একটু সরে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, সিগারেট আছে?
সিগারেট কেস বাড়িয়ে ধরলুম। কিন্তু উনি সিগারেট নিলেন না। আনমনে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন। কিন্তু পাঁচ-ছয় পায়ের বেশি হাঁটতে পারলেন না। হাঁপাতে লাগলেন। আমি দ্রুত তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চেহারায় তার যন্ত্রণার ছাপ। কষ্ট হচ্ছিল খুব।
আমি বললাম, ‘হের শেলবুর্গ, আপনাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিই?’
জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিলেন না। একটু বিশ্রাম নিয়ে বললেন, কে বললে আমি শেলবুর্গ?’
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ভুল হয়ে গেছে আমার। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে চলুন কোন লাঞ্চ কাউন্টারে গিয়ে বসি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগছে।’
লোলচর্ম বৃদ্ধের চোখ দুটোতে যেন আগুন জ্বলে উঠল। কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ননা, মি. আলী। থ্যাঙ্কস। কিন্তু আমি ভিখিরী নই। জার্মানরা ভিক্ষা নিতে জানে না।’
না না, আমি তা বলিনি,’ ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ জানালাম।
আবার কাশতে শুরু করলেন বৃদ্ধ। এবারেও কাশির দমকে তিনি বুক চেপে ধরে ফুটপাতের উপর বসে পড়লেন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। একটু অপেক্ষা করে ট্যাক্সি ডাকলাম আমি। বৃদ্ধকে জোর করেই ট্যাক্সিতে তুললাম। অবশ্য আমাকে বাধা দেবার মত শক্তিও বৃদ্ধের দেহে ছিল না। সিটের গদীতে হেলান দিয়ে আচ্ছন্নের মত বসে রইলেন তিনি।
ট্যাক্সি চালককে বললাম, সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে চলে যাও।’ হাসপাতালে যখন গাড়ি থামল তখন তিনি অচৈতন্য প্রায়।
ভর্তি করাবার জন্যে পকেট থেকে কাগজপত্র বের করতে হল। আমার ধারণা যে নির্ভুল, তার পরিচয় পাওয়া গেল। জার্মান পাসপোের্ট ছিল তার পকেটে। নামটা অন্যঃ ফ্রেডম্যান লিণ্ডবার্গ। কিন্তু পাসপোর্টে যে ছবিটা আছে ঠিক সেই ছবিটাই দেখেছি ম্যানফ্রেড শেলবুর্গের বইয়ের মলাটে। দেখেছি পুরানো জার্মান সায়েন্স ম্যাগাজিনে। না, কোন ভুল নেই। ইনিই ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ।
প্রাথমিক পরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, একেবারে শেষ মুহূর্তে নিয়ে এসেছেন। দেহে হাজারোটা রোগ বাসা বেঁধেছে। ফুসফুসটা বিধ্বস্ত প্রায়। চল্লিশ কুয়াশা-২৬
৬১
ঘন্টা বাঁচবে কিনা সন্দেহ আছে।’
খরচ বাবদ অগ্রিম অর্থ দিয়ে চলে এলাম।
সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এলঃ ৩৫৮ নম্বর বেডের রোগী ফ্রেডম্যান শেলবুর্গ এখুনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
সোজা চলে গেলাম হাসপাতালে।
নোংরা জীর্ণ পোশাকগুলো ছাড়িয়ে ফেলাতেই বোধহয় ড. শেলবুর্গকে অপেক্ষাকৃত সুস্থ দেখাচ্ছিল। চেহারাতেও একটা প্রশান্তির ভাব। আমাকে দেখে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘বোস আমার কাছে। আমার সময় হয়ে এসেছে। তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। তাই ডেকেছি।
বলুন।’
স্বীকার করছি, আমিই ম্যানফ্রেড শেলবুর্গ। তোমরা যাকে বল, ফাদার অব জেনেটিকস। এ অভিধার উপযুক্ত আমি কিনা তা জানি না, তবে আমি এমন একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলাম যা এখনও তোমাদের কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ। আমিই প্রথম পৃথিবীতে ইউজেনিকস সম্ভব করে তুলেছি। মানুষের হাজার হাজার বছরের স্বপ্নকে আমি বাস্তবায়ন করেছি। এগুলোকে আমার অসুস্থ মনের বিকার বলে মনে কোরো না।’
অবিশ্বাস আমি করিনি। অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
ড, শেলবুর্গ একটু বিশ্রাম নিয়ে বললেন, আমিই সুপারম্যান গড়ে তুলেছিলাম হিটলারের নির্দেশে। হিটলার চেয়েছিল, ভবিষ্যতের জার্মান তথা সমগ্র পৃথিবীর ভাগ্যবিধাতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে একাধিক সুপারম্যান। আমার উপর দায়িত্ব চাপানো হয়েছিল। আমি প্রথমে অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু নাৎসী বর্বরতার বিরুদ্ধে টিকতে পারিনি। আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল এক গোপন গবেষণাগারে। পরীক্ষামূলকভাবে একটা সুপারম্যান আমি গড়ে তুলেছিলাম । জার্মানির তখন পতন আসন্ন। বার্লিনের পতনের দিনে সুপারম্যান বেবীকে নিয়ে আমি পালিয়েছিলাম বিধ্বস্ত গবেষণাগারের ভাঙা দেয়াল টপকে। যদিও জানতাম, আমি এক ফ্র্যাংকেনস্টাইনের জন্ম দিয়েছি তবু নিজের বৈজ্ঞানিক কীর্তি হিসেবে তাকে প্রাণে মারতে পারিনি। তাছাড়া সে-ও তো একটা প্রাণ। তাকে হত্যার কি অধিকার আছে আমার? আমি যে বিজ্ঞানী, আমি যে স্রষ্টা। পরিচিত এক গোয়ালার হাতে তাকে সঁপে দিয়ে আমি পালিয়ে এলাম। জানি না, সেই গোয়ালা বা সেই সুপারম্যান শিশু বেঁচে আছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তাহলে সে শয়তানের বয়স এখন ছাব্বিশ-সাতাশ বছর হবে।’
আবার থামলেন তিনি। মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ করে রইলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, এসব তোমাকে বলছি এই জন্যে যে, তুমিই আমার জীবনের শেষ বন্ধু। তুমিও জেনেটিকস্ বিজ্ঞানী এটাও তার অন্যতম কারণ। সুপারম্যানকে
ভলিউম-৯
ডেভলপ করার বিদ্যা তোমাকে বলতে পারতাম, কিন্তু বলব না। কারণ পৃথিবীর সুপারম্যান দরকার নেই। এমনিতে পৃথিবীতে এত বৈষম্য। তা আর বাড়ানো উচিত নয়। তাছাড়া তোমরা যে সুপারম্যান গড়তে গিয়ে স্বার্থে অন্ধ হয়ে অমানুষ গড়ে তুলবে না, কে তার নিশ্চয়তা দেবে?, আমার এক ইণ্ডিয়ান ছাত্র এদিকে ঝুঁকেছিল। তাকেও আমি সেই গূঢ় রহস্যের সন্ধান দিইনি। তবে সে ছিল অসাধারণ প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, আর সে নির্ভুল পথ ধরেই এগোচ্ছিল, এমন কি তাকে বিপথগামী করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও। আমার বিশ্বাস, সে তার সাধনায় হয়ত ইতিমধ্যেই সিদ্ধিলাভ করেছে। তোমাকে আমার অনুরোধ, যদি কখনও সম্ভব হয়। তাহলে আমার পক্ষ থেকে তাকে অনুরোধ কর, সে যেন সুপারম্যান সৃষ্টি করে মানবতার অকল্যাণ না ঘটায়। বল, তুমি চেষ্টা করবে? আর যদি সে জন্ম দিয়েই থাকে তাহলে তাকে ধ্বংস করতে হবে। জানি না, সেটা সম্ভব কিনা।’
আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললাম, আপনার সেই ইণ্ডিয়ান ছাত্রের নাম কি, হের ডক্টর?’
লুকম্যান এইচ কিম।’
আমি বললাম, কিন্তু ভারতে তো এই ধরনের নাম হয় না সাধারণত? বৃটিশ বা অন্য কোন জাতি না তো?
মাথা নেড়ে ড. শেলবুর্গ বললেন, ‘আমার স্মরণশক্তি এখনও তীক্ষ্ণ আছে। সে ছিল, বেঙ্গলী মুসলিম। ইণ্ডিয়া তো এখন ভাগ হয়ে গেছে। কে জানে কোথায় আছে
সে, আর বেঁচে আছে কিনা।
নার্স এরমধ্যে দু’বার-উঁকি দিয়ে গেছে। এবারে সে এসে বলল, মাফ করবেন, আপনি দয়া করে উঠুন। ওঁর আর কথা বলা উচিত নয়।’
আমি লজ্জিত হলাম। রোগপাণ্ডুর বৃদ্ধের উজ্জ্বল দুটো চোখের দিকে চেয়ে আমি বিদায় প্রার্থনা করলাম। উনি আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নার্সের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় সাহস পেলেন না।
ক্লান্তকণ্ঠে শেষবারের মত তিনি বললেন, অরভোয়া। আর কোনদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। বৃদ্ধের পরমায়ু নিঃশেষিত। বোধহয় কাউকে না কাউকে নিজের কথাগুলো প্রকাশের জন্যেই মনের জোরে তিনি টিকে ছিলেন এতদিন। তাকে অকারণ সান্ত্বনা দেবার তাই প্রয়োজন মনে করিনি।
বিকেলে হাসপাতাল থেকে ফোন এলঃ ফ্রেডম্যান লিণ্ডবুর্গ পরম করুণাময়ের সুশীতল ছায়াতলে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আমেন। আমেন।
| হামবুর্গঃ ৬ আগস্ট।
ড. শেলবুর্গ মারা গেছেন কিন্তু আমার মনের মধ্যে এক গভীর ঔৎসুক্য সৃষ্টি কুয়াশা-২৬
৬৩
করে দিয়ে গিয়েছেন। সুপারম্যান বেবীর সন্ধানে আমি জার্মানিতে ঘুরে বেরিয়েছি একমাস ধরে। যে গোয়ালার কাছে শেলবুর্গ সুপারম্যান বেবীকে সঁপে দিয়েছিলেন, তার খোঁজ পাওয়া গেল এখানে, হামবুর্গে জানতে পারলাম, সে শিশুটাকে হামবুর্গের একটা এতিমখানায় ভর্তি করে দিয়েছিল।
এতিমখানায় খোঁজ নিলাম। তারা জানাল, শিশুটিকে এক ভদ্রলোক নিয়ে গেছেন দত্তক হিসেবে। পালক পিতার নাম বলল না ওরা। তবে আমি খোঁজ করে জানতে পেরেছি, লুকম্যান এইচ কিম’ নামে এক বৃটিশ নাগরিক শিশুটিকে দত্তক নিয়েছেন। কিমের ঠিকানাটা এখনও পাইনি।
দুই
কয়েক মাস পরে এক গভীর রাতে।
টঙ্গীর হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার সেলিম আতহার ও পারভেজ ইমাম ডিনারের আমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরছিল। রাত তখন বারোটার কাঁটায় পৌঁছেছে। আরও অনেক আগেই ফিরতে পারত কিন্তু বিনি পয়সার মদ পেয়ে পারভেজ আকণ্ঠ টেনেছে। ঘরে ফেরার তাড়া ছিল না । পারভেজু অবিবাহিত ও সেলিম আতহারের স্ত্রী-রত্নটি পিত্রালয়ে নাইয়রে গেছেন।
| রাতগুলো অবশ্য ওদের কাছে দামি কম নয়। দিনের কাজের শেষে প্রায়ই ওরা রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর ড. কাসেম আল-রাজীর সঙ্গে গবেষণা চালায়। আজকেও ওদের রিসার্চ সেন্টারে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ড. রাজী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রোগ্রামটা বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং আমন্ত্রণ সেরে তাড়াতাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না। ওদের রাতের অপর সঙ্গী রুহুল করিম ডিনারের শেষেই ভেগেছে। ড. রাজীও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি অসুস্থতার জন্যে আসতে পারেননি। | আমন্ত্রিতের সংখ্যা নগণ্য। আমন্ত্রণকর্তা আলী সাহেব একজন ইনড়েন্টার । রিসার্চ সেন্টার বিদেশ থেকে কয়েক লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি আনবে। তার ইনডেন্ট পাওয়ার জন্যে ভদ্রলোক কিছুদিন ধরে দৌড়াদৌড়ি করছেন, সম্ভবত ড. রাজীকে পটানোর জন্যেই এক অভিজাত হোটেলে এই নৈশ-ভভাজের আয়োজন করেছিলেন। নৈশভোজের পরে ছিল পানীয়ের অঢেল ব্যবস্থা। আলী সাহেব শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। পারিবারিক প্রয়োজনে তাকে বাসায় ফিরতে হয়েছিল । তবে তাঁর কর্মচারীরা ভদ্রতার ক্রটি করেনি।
মদ্যপানে সেলিমের ততটা অনুরাগ নেই। বেশ কয়েকজন পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল পার্টিতে। গল্প-গুজব করে বেশ কাটল।
সেলিম এখন ভাবছিল অন্য কথা। সে পারভেজকে:বলল, ড. রাজী কি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?’
ভলিউম-৯
৬৪
অতর্কিত প্রশ্নটার অর্থটা বুঝতে পারল না পারভেজ। সে অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, তার মানে? | ‘আমার মনে হয়, পিউরিটান ড, রাজী এভাবে এড়িয়ে গেলেন আলী সাহেবকে। যদি কোন কারণে তাকে ইনডেন্ট না দিতে পারেন, তখন যেন চক্ষু লজ্জায় পড়তে না হয়।’
পারভেজ এতটা তলিয়ে দেখেনি। সে বলল, বলতে পারব না। তবে পিউরিটান যারা তারা তো মিথ্যে কথা বলে না।’
সেলিম তার যুক্তির অসারতা অনুভব করে চুপ হয়েগেল।
গাড়িতে আর কোন কথা হল না। সেলিমের বাসার কাছে এসে পড়েছিল গাড়িটা। পারভেজ চালাচ্ছিল। সে গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিয়ে বলল, “কিরে নামবি?’
‘ততা কি করব? তুইও নাম না, সারারাত গল্প করা যাবে।
তারচেয়ে বরং চল, রাজীর খবর নিয়ে আসি।’ ‘এত রাতে? উনি নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন।
রাত আর কত হয়েছে। সাড়ে বারোটা। দুটোর আগে তো ওঁর ঘুমের কথা কল্পনাই করা যায় না।
তবে চল ঘুরে আসি।’ স্পীড বাড়িয়ে দিল পারভেজ।
মিনিট দশেক পরে গাড়ি ড. রাজীর গেটের সামনে, থামল। গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সেলিম দেখল, ড. রাজীর শয়নকক্ষে ম্লান নীল আলো জ্বলছে। জেগে থাকলে উজ্জ্বল আলো জ্বলত। আর বাসায় না থাকলে জ্বলত স্নান লাল আলো।।
সে বলল, “উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধহয়, শোবার ঘরে নীল আলো জ্বলছে। পারভেজও উঁকি দিয়ে দেখল। তবু কয়েকবার হর্ন বাজাল। কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
চল, ফেরা যাক।
গাড়িতে স্টার্ট দিল পারভেজ। সেলিম একটা সিগারেট ধরাল। সামনের দিক থেকে একটা গাড়ি আসছিল। সরু পথ। স্পীড কমিয়ে দিয়ে বাঁ দিকে সরে আগত গাড়িটার জন্যে আর একটু জায়গা দিল পারভেজ। ওদিকটায় খাল। খেয়াল না করলে দুর্ঘটনা অনিবার্য।
গাড়ির নম্বর পড়া সেলিমের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। চোখ দুটো তার আপনাআপনি নম্বর প্লেটের দিকে নিবদ্ধ হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না এবং নম্বরটা পড়ে ভীষণভাবে চমকে উঠল সে। গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই পেছনের জানালা দিয়ে গাড়িটার নম্বর আবার দেখল। ৫-কুয়াশা-২৬
আপন মনে উচ্চারণ করল সোলম, আশ্চর্য। পারভেজ মুখ ফিরিয়েই বলল, “কি হল রে?’
ড. রাজীর গাড়ি।
ড. রাজীর গাড়ি? বলছিস কি, সেটা তো ড. রাজীর গাড়ি-বারান্দাতেই দেখে এলাম!’
কিন্তু নম্বর তো একেবারে অভিন্ন। আর এটাও লাল রং-এর ফিয়াট।’
তা অবশ্য ঠিক, লাল, রং-এর ফিয়াট। দেখেছি আমিও। কিন্তু নম্বর পড়তে নিশ্চয়ই ভুল করেছিস।
| ‘অসম্ভব,’ দৃঢ় গলায় বলল সেলিম।
তাহলে চল তো, রিসার্চ সেন্টারে খবর নিয়ে আসি। সন্দেহ যখন হয়েছে তখন সেটা ভঞ্জন করাই ভাল।
মোসলেম বিশ্বাস এ সপ্তাহের নাইটগার্ড। লোহার বিরাট গেটটার পিছনে একটা টুলের উপর বসে বুক সিগারেট টানছিল। গাড়ির শব্দ কানে যেতেই সে বাইরের দিকে তাকাল। উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা পিছনে লুকাল।।
সেলিম ও পারভেজ গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওরা জানে, রাতে ড. রাজী নিজে রিসার্চ সেন্টারে না থাকলে ওদেরও প্রবেশের অধিকার নেই। মোসলেম বিশ্বাসঁ তাই গেট খোলবার পাঁয়তারা না করায় ওরা অবাক হল
।
ওরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মোসলেম বিশ্বাস বলল, বড় সাহেব তো এখন নেই, স্যার। একটু আগে, এই মিনিট পনের আগে চলে গেছেন।’
সেলিম ও পারভেজ অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্যেই। সেলিম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কতক্ষণ ছিলেন?’
ঘন্টা দুয়েক ছিলেন। একটা বড় সুটকেস সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ওঁকে অসুস্থ বলে মনে হল।’
কিছু বলেছিলেন আমাদের কথা?
একটু ইতস্তত করে মোসলেম বিশ্বাস বলল, বলেছিলেন যে, আপনারা তিনজন এলে যেন বলি, আজ রাতে উনি একাই কাজ করবেন ল্যাবরেটরিতে।
আবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল সেলিম ও পারভেজ। এটাও তো এক অদ্ভুত ব্যাপার! দু’জনের একজনও এমন কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
নিজের গাড়িতেই এসেছিলেন, না বেবীট্যাক্সিতে?” নিজের গাড়িতেই।’
সেলিমের চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখে মোসলেম বিশ্বাস একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কোন গোলমাল হয়নি তো, স্যার?’
মোসলেম বিশ্বাসের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে সেলিম বলল, না,
৬৬
ভলিউম-৯
গোলমাল কিসের? উনি অসুস্থ অবস্থাতেও এসেছিলেন, সেটাই চিন্তার বিষয়। চলি আমরা।’
চল, পারভেজ। চল।’
দু’জন গিয়ে গাড়িতে উঠল। পারভেজ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, তাহলে দাঁড়ালটা কি?”
তুই তো গাড়িটা ঠিক দেখেছিলি,ড. রাজীর বাসায়?” ‘নিশ্চয়ই। তা জানিস তো, মদ যত বৈশি খাব আমার ইন্দ্রিয়গুলোও তত তীক্ষ্ণ হবে।’
‘কিছু একটা রহস্য আছে এর মধ্যে।
তা তো বটেই, এবং সেটা উদঘাটন করতে হবে। ড. রাজী যে রিসার্চ সেন্টারে আসেননি তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এ নিশ্চয়ই অন্য লোক, ড. রাজীর ছদ্মবেশে এসেছিল। কিন্তু তা-ও যেন বিশ্বাস হতে চায় না।’
‘কিন্তু ছদ্মবেশ কি এতই নিখুঁত হতে পারে? তাছাড়া বেশ ছদ্ম হলেও কণ্ঠ তো আর ছদ্ম নয়? চলাফেরাটাও নয়। মোসলেম বিশ্বাস নিশ্চয় টের পেত। সে তো চালাক লোক।
সেলিম বলল, এখন তো তাই মনে হচ্ছে। এখন কি করতে চাস? | সেই কথাই ভাবছিল পারভেজ। হঠাৎ একটা কথা তার কানে কানে কে যেন বলে গেল। চোখ দুটো তার জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চাপল সে।। | ‘কি রে, জবাব দিচ্ছিস না যে? এখন কি করা উচিত, বল কিছু?
‘আমার যতদূর মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে প্রকাশ্যে হৈ-চৈনা করে গোপনে খোঁজ নেওয়া উচিত আপাতত।।
কিন্তু তাতে যদি এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়? তার মানেটা ভেবে দেখেছিস? কে জানে, ছদ্মবেশীর লক্ষ্যটা কি। আমার তো সন্দেহ হয়…।’ | ‘সে আশঙ্কা আমারও হচ্ছে। কিন্তু কয়েকদিন নিজেরাই গোপনে খোঁজ নিয়ে দেখি। ড, রাজীর কানে এখুনি কথাটা তুলে লাভ নেই। অবশ্য অন্য সূত্রে তিনি জানতে পারলে কিছু করার নেই। আর দেখাই যাক না।
সেলিম বলল, বেশ। তবে তাই হোক।
তিন
এক সপ্তাহ পরে।।
হাকিম রিসার্চ সেন্টারটা যে এলাকায় অবস্থিত একদা তা ছিল গভীর জঙ্গল। এখন তা অনেকটা ফাঁকা হয়েছে। এখানে-সেখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কল কুয়াশা-২৬
৬৩,
কারখানা। আবাসিক ভবনও উঠেছে দু’একটা। কিন্তু দিনের বেলা জনসমাগম থাকলেও রাতে এলাকাটা নির্জনতায় ধুঁকতে থাকে। অতীতের স্মৃতি হিসেবে এখানে-সেখানে এখনও যে ঝোঁপ-ঝাড়গুলো আছে সেখানে বাঘের ডাক না শোনা গেলেও সন্ধ্যার পর থেকেই শিকুলের আলাপনে জায়গাটা মুখর হয়ে ওঠে।
রিসার্চ সেন্টারের গেটটা উত্তরমুখী। মেইন রোড থেকে প্রায় একশ’ গজ প্রাইভেট পথটা রাতে বিদ্যুতের আলোকে ঝলমল করছে। পথটার দু’পাশে অর্থাৎ উত্তরে ও দক্ষিণে ছোটখাটো ঝোঁপঝাড়। পূর্বদিকের জঙ্গলগুলো একটু বেশি ঘন। রাত দশটা বাজতে না বাজতেই দু’জন লোক ইতিউতি করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল। তাদের দৃষ্টি রিসার্চ সেন্টারের বাইরের আলোক-উজ্জ্বল কংক্রিটের পথটার দিকে। তারা অবস্থানস্থলটাও বেছে নিয়েছে কংক্রিটের পথটার কাছেই। ওদের একজন কুয়াশা। অন্যজন তার অন্যতম মোগ্য সহকারী কলিম। আরও কয়েকজন লুকিয়ে আছে রিসার্চ সেন্টারের চারদিকে।
কুয়াশা নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। সে খবর পেয়েছে, ড. রাজীর আজ রাতে রিসার্চ সেন্টারে আসবার সম্ভাবনা নেই। নাইটগার্ড তা জানে না। তাই এই রাতটাই সে বেছে নিয়েছে রিসার্চ সেন্টারে অভিযান চালানোর জন্যে।
ঘন্টা দুয়েক চুপচাপ বসে রইল ওরা। কিন্তু কতক্ষণ আর এমন করে বসে থাকা যায়? উসখুস করতে লাগল কলিম। সে বলল, রাত তো বারোটা বাজতে চলল। মান্নান তো এখনও এসে পৌঁছুল না।’
কুয়াশা বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক।
কুয়াশার দৃষ্টি তখন গেটের দিকে অগ্রসরমান একটা ভক্সলের উপর। গাড়িটা দেখে চমকে উঠল কুয়াশা। চমকে উঠল কলিমও। আরে, এটা যে তাদেরই গাড়ি! এই গাড়ি নিয়েই তো মান্নান সন্ধ্যার পর বেরিয়ে গেছে। তার তো এভাবে গাড়ি নিয়ে রিসার্চ সেন্টারে আসবার কথা ছিল না। ব্যাপারটা কি?
‘ভাইয়া, সর্বনাশ! এ যে দেখছি আমাদেরই গাড়ি। মান্নান তাৈ এই গাড়িটা নিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যায়। ও এখানে কেন?’
| ‘ঠিক আছে, চুপ করে বসে থাক। দেখ, কি হয়,’ গাড়িটার দিকে চোখ রেখে কুয়াশা বলল।
গাড়িটা এসে রিসার্চ সেন্টারের গেটের সামনে থামল। ঠিক ওদের নাকের ডগায় পার্ক করে যে লোকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে মান্নান নয়, সে হচ্ছে রিসার্চ সেন্টারের খোদ বড়কর্তা ড. কাসেম আল-রাজী। কুয়াশা এবার ভীষণভাবে চমকাল, সর্বনাশ হয়ে গেছে! ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে।
| কুয়াশা চঞ্চলভাবে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, কলিম। মান্নান বোধহয় ধরা পড়েছে। এখুনি ওর খোঁজে বেরুতে হবে। তার আগে এক কাজ কর..গাড়ির বুটটা চট করে দেখে আয়, ভিতরে মান্নান আছে কিনা।
৬৮
ভলিউম-৯
কলিম সন্তর্পণে এগিয়ে গেল গাড়িটার দিকে। ড. রাজী তখন গেটের ভিতরে ঢুকে গেছেন। গেট বন্ধ হয়ে গেছে।
| আরও খানিকটা এগিয়ে গেল কলিম। মাত্র ছয়-সাত হাত দূরে গাড়িটা। পেছনে বুটের দিকে একটা গাছের ছায়া পড়েছে। তাতে করে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সুবিধেই হল কলিমের। সে বুটের হ্যাঁণ্ডেল ঘোরাল। তারপর একহাতে ঢাকনাটা তুলে ধরার চেষ্টা করল। উঠল না ঢাকনাটা। চাবি লাগানো আছে নিশ্চয়ই। তাতে করে ভিতরে মান্নানের থাকবার সম্ভাবনাই বেশি। উত্তেজনায় একটা ঝড় বয়ে গেল কলিমের বুকের মধ্যে। সে দ্রুত প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা বাঁকানো শিক বের করল। অন্ধকারেই আন্দাজ করে তার মধ্যে থেকে একটা শিক বেছে নিয়ে চাবির গর্তে ঢুকিয়ে দিল। কয়েকবার এদিক-ওদিক ঘোরাতেই কটকট করে আওয়াজ হল। শিকটা বের করে আবার ঢাকনাটা তুলে ধরার চেষ্টা করল। এবারে সফল হল সে। ঢাকনাটা দুই ইঞ্চি পরিমাণ তুলে পেন্সিল টর্চ বের করল সে পকেট থেকে। বুটের মধ্যে টর্চটা ঢুকিয়ে দিয়ে জ্বালল। না, ভিতরটা একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই। নিরাশ হল কলিম।
সে ফিরে আসতেই কুয়াশা বলল, তুই এখুনি চলে যা। দ্যাখ, মান্নানের কোন খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।’
কলিম জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হল।
কুয়াশার মনের মধ্যে তখন ঝড় উঠেছে। সে বুঝতে পেরেছে, ভেস্তে যেতে চলছে তার প্ল্যান। এত সাবধানতা সত্ত্বেও জানাজানি হয়ে গেছে তার প্ল্যান? শুধু তাই নয়, তার প্ল্যান ব্যবহার করে তাকেই বোকা বানাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বন্ধু, কুয়াশা মনে মনে তাকে চ্যালেঞ্জ করল, দেখা যাক, চূড়ান্ত লড়াইয়ে কে জেতে কে হারে।••• নিজেকে যতই তুমি লুকিয়ে রাখ আমার কাছে ধরা পড়ে গেছ। আমি জানি, তুমি এখন পর্যন্ত আমাকে চিনতে পারনি। পারবে, এমন আশাও তুমি.কোরো না। আজকে এখানেই তোমার সাথে আমার চূড়ান্ত বোঝাপড়া হবে। আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি।
ঘড়ি দেখল কুয়াশা। রাত একটা। এক ঘন্টা হল ড. রাজী ভিতরে গেছেন। এখনও বেরুচ্ছেন না। অথচ কুয়াশা জানে, তার বেশিক্ষণ ভিতরে থাকার কথা নয়। থাক যতক্ষণ খুশি। | বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না কুয়াশাকে। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এ কলিম। সে গভীর উৎকণ্ঠার সাথে বলল, ভাইয়া, মান্নানকে পাওয়া গেছে। পাশে একটা ঝোঁপের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল সে। অবস্থা খুবই খারাপ। কিছুতেই জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। বোধহয় বাঁচবে না। আপনি আসুন।
এখন তো আর ডাক্তার পাওয়া যাবে না কাছে পিঠে।
বলিস কিরে!’ উদ্বিগ্ন হল কুয়াশা, কিন্তু এখানে যে আমার থাকা দরকার? কুয়াশা-২৬
৬৯
‘তাহলে মান্নানকে বাঁচানো যাবে না। অবস্থা খুবই খারাপ।’
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল কুয়াশা। কোনকিছুর বিনিময়েই সে তার সহকারীদের হারাতে পারে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল, মান্নানকে দেখিয়ে দিয়ে তুই আবার ফিরে আসবি এখানে। কিছু ঘটলে আমায় সঙ্গে সঙ্গে খবর দিবি।’
মিনিট পনের পরে কলিম আবার যথাস্থানে ফিরে এল। সে বসতেই একটা। লাল রঙের ফিয়াট গেটের সামনে এসে থামল। কলিম সবিস্ময়ে দেখল, মান্নানের ভক্সল থেকে যিনি নেমেছিলেন আর ফিয়াট থেকে এইমাত্র যিনি নামলেন তাঁরা দু’জন একই ব্যক্তি। অর্থাৎ এই গাড়িটা থেকেও রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর ড. কাসেম আল-রাজীই নামলেন। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল কলিম। যমজ ভাই নয়ত? নিশ্চয়ই না, দু’জনের একজন নিশ্চয়ই নকল। কিন্তু কোনটা। সম্ভবত প্রথমে যে এসেছে সেই-ই। মান্নানকে সে-ই পিটিয়ে আধমরা করেছে। সে-ও দেখে নেবে। দাঁতে দাঁত ঘষল কলিম।
ড. রাজী গাড়ি থেকে নেমে ভক্সলটার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে গাড়িটার কাছে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মুখটা অন্ধকারের দিকে থাকায় কলিম দেখতে পেল না। কিন্তু সে বুঝতে পারল, গাড়িটা দেখে ভদ্রলোক বিস্মিত হয়েছেন।
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে।
কলিম দেখল, ড. রাজী ধীরে ধীরে গেটের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু কেউ গেট খুলল না। দাঁড়িয়েই আছেন ড, রাজী। বৈদ্যুতিক ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে বারবার। কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল।
আর তারপরেই ঘটল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটাঃ ।
সামনের ঝোঁপের অন্ধকার থেকে বিরাট পাহাড়ের মত একটা মূর্তি বেরিয়ে এল। কেঁপে উঠল কলিম। মানুষের মতই দেখতে, কিন্তু মানুষের চেয়েও দেড়গুণ বেশি লম্বা আর বিশাল লোকটার বপু। লাল টকটকে গায়ের রঙ। পরনে শুধু মাত্র একটা জাঙ্গিয়া। সে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অথচ নিঃশব্দে ড. রাজীর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ড, রাজীও বোধহয় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। দৈত্যাকার মূর্তিটা তাঁর চোয়াল দুটো চেপে ধরল।
কলিমের বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পিটতে লাগল। সে কি স্বপ্ন দেখছে? না, এ তো স্বপ্ন নয়। অথচ বিশ্বাস করা যাচ্ছে না নিজের .চোখকে। কি ভয়ঙ্কর আর কি বিশাল ঐ মূর্তিটা! না, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। অন্ধকারে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থেকেও সে ভরসা পেল না। ভাইয়া তো কাছেই আছে, তাকেই খবরটা দিয়ে আসা উচিত।
সন্তর্পণে প্রস্থান করল কলিম। রাস্তায় উঠে সে প্রাণপণে দৌড়ুতে
ভলিউম-৯
৭০।
লাগল।
পরদিন সকালে।
নিজের শয্যাপ্রান্তে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন ড. কাসেম আল-রাজী। জানালার ভিতর দিয়ে তার ভয়ার্ত বিভ্রান্ত দৃষ্টি দূর আকাশের দিকে প্রসারিত। কিন্তু আজ তিনি দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে চেতনাহীন। গতরাতে এক ভয়ঙ্কর, অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা ঘটেছে তার। শঙ্কায় ও বিস্ময়ে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথাই ভাবছিলেন তিনি।
গত পঁচিশ বছর ধরে ড. রাজী হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে জড়িত। সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা এবং মালিক ড, লোকমান হাকিমের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। ভদ্রলোক এই সেন্টার স্থাপনের সময়েই তাকে সহকারী করে নেন।
ড. হাকিম ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভা। দেশীয় উদ্ভিদ থেকে মৌলিক ওষুধ আবিষ্কারই ছিল এই রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের বিঘোষিত লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য তাঁরা সাফল্যের সাথেই অনুসরণ করে এসেছেন এতদিন। গোড়ার দিকে সেন্টারটা ছিল ছোট। এখন তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। একতলা ভবন দ্বিতল হয়েছে। স্টাফ বেড়েছে। ফরমায়েশ বেড়েছে। দেশে-বিদেশে খ্যাতি হয়েছে। ভেষজ শিল্পে হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার একটা বিশিষ্ট নাম। কিন্তু বিঘোষিত লক্ষ্য ছাড়াও রিসার্চ সেন্টারে একটা গোপন গবেষণা তিনি এবং ড. ‘হাকিম গোড়া থেকেই চালিয়ে আসছিলেন এবং সেটা করা হত আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে। শুধু তাঁরা দুজনই নয়, সেলিম আতহার, পারভেজ ইমাম ও রুহুল করিম নামে তিনজন সহকারীও তাদের আছে ঐ গোপন গবেষণাগারের জন্যে। পঁচিশ বছর ধরে একনাগাড়ে গবেষণা চালিয়ে এসেছেন। মাত্র চারমাস আগে সাফল্য এসেছে এবং তার একমাস, পরেই এক মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ড. লোকমান হাকিম। তার মৃত্যুতে কাজের হয়ত অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারত কিন্তু পারভেজ ইমাম ড. হাকিমের চাইতেও প্রতিভাধর বিজ্ঞানী বলে ক্ষতিটা পূরণ হয়েই শুধু যায়নি বরং আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে তাদের গবেষণার পরবর্তী পর্যায়।
তাদের এই গবেষণা চলত প্রধানত রাতে। দিনে তারা সেন্টারের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তারা আগে নিয়মিত রাতে কাজ করতেন কিন্তু মূল গবেষণায় সাফল্য এসেছে বলে কাজের তাড়াটা এখন অপেক্ষাকৃত কম। সুতরাং নিয়মিত রাতে কাজ করার দরকার হয় না।
গতরাতেও তার যাবার কথা ছিল না। পারভেজ ও সেলিম আতহার গত কয়েক দিন ধরে কি এক অজ্ঞাত কারণে চিন্তিত। বাকি থাকে রুহুল করিম। কিন্তু সে তো ইঞ্জিনিয়ার আসলে। সুতরাং তিনি গতরাতে ল্যাবরেটরিতে যাবেন না। বলেই ঠিক করেছিলেন। কুয়াশা-২৬
কয়েকদিন ধরে তিনি নিজেও কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করছিলেন। মাসখানেক আগে আমেরিকান এক ভদ্রলোক তাকে এমন কতকগুলো রহস্যজনক প্রশ্ন করে গেছেন এবং এমন কতকগুলো খবর নিয়ে গেছেন যার পর থেকে তার কেবলই মনে হচ্ছে, হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের উপর যেন শীঘ্রই একটা বিপদ নেমে আসছে। মনটা অস্বস্তিতে ভরে ছিল তার। যুক্তি দিয়ে তিনি সেটাকে
দূর করতে পারছিলেন না।
কাল সন্ধ্যায় বাসায় বসে পড়তে পড়তে সেই আশঙ্কাটাই তার মনটাকে অশান্ত করে তুলেছিল। জোর করে মনটাকে উদ্বেগমুক্ত করে তিনি ঘুমোতে গিয়েছিলেন। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। কাপড়-চোপড় পরে তিনি নিশির ডাকে পাওয়া লোকের মত রিসার্চ সেন্টারে চলে গেলেন।
পাহারায় মোতায়েন ছিল পেশোয়ারী তরুণ তারিক খা। গেটের কাছে গাড়ি থামাতেই অবাক হয়েছিলেন তিনি নীল রং-এর একটা ভক্সল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সেখানে অতরাতে ভুলে করে কে আসতে পারে তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। গাড়িটা ভাল করে দেখে তিনি একটু চিন্তিত মনেই গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারিক খ তখন গেটে ছিল না। বোধহয় ভিতরে রাউণ্ড দিতে বেরিয়েছিল। গেট সংলগ্ন বোতাম টিপলেন তিনি। দোতলায় সিকিউরিটি রূমে বৈদ্যুতিক ঘন্টা বেজে উঠল। রিসার্চ সেন্টারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চমৎকার। নাইটগার্ড ছাড়াও একজন সিকিউরিটি গার্ড থাকে দোতলায় সিকিউরিটি রূমে। তার প্রধান কাজ হল একটা ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন সেটের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা। আর নাইটগার্ডরাউণ্ডে বেরোলে যদি ড. রাজী বা তাঁর তিন প্রধান সহকারী ঢুকতে বা বেরোতে চায় তাহলে গেট খুলে দেওয়া।
| ড, রাজী আশা করছিলেন, সিকিউরিটি গার্ড এসে গেট খুলে দেবে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কিন্তু নাইটগার্ড বা সিকিউরিটি গার্ড দু’জনের একজনেরও পাত্তা নেই। বারবার ঘন্টা টিপতে লাগলেন তিনি। কিন্তু কেউ না আসায় তাঁর বিরক্তি ক্রমশ ক্রোধে রূপান্তরিত হল। আবার একটু উদ্বিগ্নও হলেন: তিনি। রিসার্চ সেন্টারের ভিতরে কোন গোলমাল হয়নি তো? তার আশঙ্কাটাই কি শেষ পর্যন্ত সত্য হল?
গরাদের ফাঁক দিয়ে ভিতরের দিকে তাকালেন তিনি। ভিতরে উজ্জ্বল আলোয় বাগানটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কারও আসবার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি? তিনি কি অপেক্ষা করবেন, না ফিরে যাবেন?
হঠাৎ তার মনে হল, কে যেন তাঁর পিছনে চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। মুখ ফেরালেন তিনি। বিশাল একটা মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে। তিনি ভয়ে আর্তনাদ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটা বলিষ্ঠ থাবা তার চোয়াল দুটো সাড়াশীর মত চেপে ধরল। টু-শব্দটিও করতে পারলেন না তিনি। গেটের মাথার অতি উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় থাবার মালিককে এক নজর দেখে তিনি প্রচণ্ড ভয়ে চোখ
१२
ভলিউম-৯
কড. রাজী আশন তিনি। কিন্তু টিপতে লাগলেন। একটু উদ্বিগ্নও
বুজলেন। তার সমস্ত দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল।
এখনও সেই ভয়ালদর্শন মূর্তিটা তার চোখের সামনে ভাসছে। বিশাল সেই মূর্তি। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে অস্বাভাবিক। দৈত্যাকার চেহারা | অবয়বটা মানুষের মতই। মূর্তিটা একটু নিচু হয়ে তার দিকে ঝুঁকে ছিল বলে আলোটা সরাসরি তার মুখের উপর পড়েনি। তবু অস্পষ্ট আলোয় তিনি দেখেছিলেন তার ভয়ালদর্শন রূপটা। বিরাট মুখটা মানুষের মতই, তবে রোমহীনবলে মনে হয়েছিল। মাথাতেও এতটুকু চুল দেখেননি তিনি। কি ভয়ঙ্কর আর কুৎসিত দেখাচ্ছিল তার টকটকে মুখ আর বুকটা! মনে হচ্ছিল, যেন গা থেকে চামড়া খসিয়ে নিয়েছে অথবা বলা যেতে পারে, আগুনের আঁচে মাংস যেন ঝলসে গেছে। বড় বড় গোলাকার চোখ দুটোতে যেন জিঘাংসার আগুন জ্বলছে। সবচেয়ে হিংস্র দেখাচ্ছিল তার দাঁতগুলো। চকচকে ছুরির মত দু’পাটি দাঁত। তার মধ্যে দিয়ে জিহ্বাটা বেরিয়ে এসেছে। ত্রিকোণাকৃতি থ্যাবড়া-নাকটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে হাপরের মত ফুলে ফুলে উঠছে। নিঃশ্বাসটাকেও যেন আগুনের হলকার মত মনে হচ্ছিল তার। যতক্ষণ চোখ তার খোলা ছিল, মনে হয়েছিল সেই করালদর্শন জীবটা মৃত্যুর মত দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। ড. রাজীর চোয়ালে চাপটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, চোয়াল দুটো এই মুহূর্তেই ভেঙে যাবে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছিলেন। কিন্তু সে বেশিক্ষণের জন্যে নয়। আতঙ্কে ও যন্ত্রণায় তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেলেন সকালে। ধীরে ধীরে চোখ মেললেন এবং অবাক হয়ে দেখলেন, তিনি তার নিজের শয়নকক্ষে নিজের শয্যাতেই শুয়ে আছেন। ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। চারদিকে ভাল করে চেয়ে দেখলেন।
কোন সন্দেহ নেই। বিহ্বল হয়ে বসে রইলেন শয্যাপ্রান্তে। কোথায় কি যেন একটা গোলমাল হয়েছে, কি যেন ঘটেছে, ঠিক স্মরণে আসছে না।
আস্তে আস্তে সব কথা মনে পড়ল তার। রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিলেন তিনি গতরাতে। তারিক খাঁকে গেটে দেখতে পাননি। তারপর…।।
ভয়ে চোখ বুজলেন তিনি। দিনের আলোতেও তার বুকটা কেঁপে উঠল আর একবার। রিসার্চ সেন্টারের সামনে সাক্ষাৎ ঘটেছিল এক ভয়ালদর্শন দানবের সাথে। কি ভয়ঙ্কর তার চেহারাটা! কল্পনাতীত বীভৎস সেই মূর্তি। তিনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন? ওটা কি দুঃস্বপ্ন অথবা উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা? না, তা নয়। এখনও তার চোয়াল ব্যথা করছে। কি প্রচণ্ড শক্তিতে সেই বিকট প্রাণীটা তার চোয়াল চেপে ধরেছিল। কিন্তু কে বা কি ঐ কদাকার দৈত্যাকার মূর্তিটা? অমন বিশাল আকারের মানুষের আকৃতির কোন প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে তিনি জানেন না। ওটা গরিলা নয়, শিম্পাঞ্জীও নয়। তাহলে কি গ্রহান্তরের কোন প্রাণী? নিজেরই হাসি পেল এই অদ্ভুত কল্পানাতে। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই ওটা মানুষ। নিয়াণ্ডারথাল মানুষ নয়, হোমোসেপিয়েন। কিন্তু হোমমাসেপিয়েন আকারে কেমন করে অতটা বিশাল হবে? চেহারা অবশ্য কদাকার হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু ঐ মূর্তিটা কেন কুয়াশা-২৬
ভয়ে ছোশ্রসেন্টারেরহাট! কল্পনা মস্তিষ্কের কন্ধঃ প্রাণীটা তরুন বিশাল
৭৩
এসেছিল রিসার্চ সেন্টারের গেটে? ভিতরে ঢোকবার জন্যে? উদ্দেশ্যটা আসলে কি? নীল রংয়ের ভক্সলটাই বা কার? ওটাই বা কেন অতরাতে রিসার্চ সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিল? তার কোন সহকারীর বা সেন্টারের আর কারও গাড়ি ওটা নয়, তা তিনি জানেন।
•••বাসায় ফিরিয়ে আনল তাঁকে কে? হাজারোটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ভিড় জমাল। কোনটারই সদুত্তর পেলেন না। একটা জটিল আবর্তের মধ্যে হাবুডুবু খেতে লাগলেন তিনি। একটা সন্দেহ তার মনে উঁকি দিতে লাগল বারবার। | 6, রাজীর সংসারটা অতি ক্ষুদ্র। বন্ধন বলতে একটি মাত্র কন্যা-সন্তান। স্ত্রী বহুদিন হল জান্নাতবাসিনী। অন্তঃহীন স্নেহে মেয়ে রাকুকে ড. রাজী লালন-পালন করেছেন এবং সে তাঁর অতি গর্বের ধন। রাকু অর্থাৎ রোকেয়া মিউনিক ইউনিভার্সিটি থেকে জেনেটিকস-এ ডক্টরেট পেয়েছে। দেশে ফেরার আগে কন্টিনেন্ট সফর করছে। যে-কোন দিন ফিরে আসতে পারে। আপাতত বাবুর্চি মইনুল ও মধ্যবয়সী পুরানো চাকর জাকেরকে নিয়েই তার সংসার। রাতে কি করে। তিনি বাসায় ফিরে এলেন সে রহস্য হয়ত তাদের জানা আছে।
জাকেরকে ডাক দেবেন বলে ঠিক করলেন ড. রাজী। কিন্তু দরকার হল না। বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল।
হুজুর?’ জাকের?” ‘জে। আপনার নাস্তা তৈরি।
এদিকে শুনে যা।’
পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল জাকের। ড. রাজীকে বাইরে বেরোবার পোশাকে মায় জুতো পরিহিত অবস্থা দেখেও সে বিচলিত হল না। উনি যে রাতে রিসার্চ সেন্টারে কাজ করেন এবং অনেক সময় একদম সকাল করে বাসায় ফেরেন, তা সে জানে।
‘এক কাপ চা দিয়ে যা।’
একটু অবাক হল জাকের। এটা একটা নতুন ঘটনা। বেড-টির অভ্যাস, ড. রাজীর কোনদিনই ছিল না।
হুজুর।’
ব্যাপারটা নতুন বলে যে জাকের অবাক হচ্ছে তা বুঝতে পারলেন ড. রাজী। তিনি বললেন, শরীরটা ভাল লাগছে না। চা নিয়ে আয়। দেখি, যদি ভাল লাগে।’
আচ্ছা’ বেরিয়ে গেল জাকের।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. রাজী। রাতের ভয়াবহ ঘটনাগুলো আবার চিন্তা করতে লাগলেন। এতক্ষণে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন যে, কিভাবে রাতে, তিনি ফিরেছেন জাকেরও তা জানে না। মইনুলও নয়। তাহলে তিনি কেমন করে
এলেন?
টেলিফোনটা বেজে উঠল । ৭৪
ভলিউম-৯
আচ্ছা কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এটা বুঝতে পেরেছেন তিনি কেমন করে
ড. রাজী জানালা ছেড়ে এসে রিসিভারটা তুললেন, ‘হ্যালো? রাজী বলছি।’
ওদিক থেকে কম্পিত কণ্ঠ কানে এল, ছ্যার, ছিকিউরিটি গার্ড হাতেম আলী বলছি। এদিকে দুর্বনাছ হয়ে গেছে, ছ্যার!
“কি হয়েছে?’
তারিক খ মারা গেছে। মারা গেছে!’ চরম বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন ড. রাজী।
হ্যাঁ, ছ্যার, বাগানের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ছাড়া গায়ে রক্ত,’ কম্পিত কণ্ঠে হাতেম আলী জানাল।
রক্ত! সর্বনাশ! চমকে উঠলেন ড. রাজী। হ্যাঁ, ছ্যার। ঘাছ পর্যন্ত ভিজে গেছে।’
মানে•••খু-উ-ন হয়েছে তারিক খা?’ উত্তেজনায় তোতলাতে লাগলেন ড. রাজী।
তাই তো মনে হচ্ছে, ছার। আরও ছ্যার, অবাক কাণ্ড ঘটেছে।’ ‘কি?’
‘গেটের ছ্যার, ঐকটা ছিক বাঁকানো। আর তালাটা ভেঙে পড়ে আছে গেটের ভিতরে!’
‘পুলিসে খবর দিয়েছ? ‘এখনও দেইনি, ছ্যার। আমি তো এইমাত্র দেখলুম।’ রাতে কিছুই টের পাওনি তুমি? না, ছ্যার। ঘুমিয়েছিলে বোধহয়? কোন জবাব শোনা গেল না। হ্যালো?’ ‘জি, ছ্যার।’ ‘জবাব দিচ্ছ না কেন?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ছ্যার। হরীরটা ভাল ছিল না। একটু জ্বর-জ্বর এছেছিল কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি। এই, একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। নিচে নেমে দেখি এই অবতা।
যাক, পুলিসে খবর দাও। আর, আমি আধঘন্টার মধ্যেই আসছি। পুলিস আসবার আগে দারোয়ান ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দিয়ো না।’
আচ্ছা, ছ্যার।’ রিসিভার রেখে দিলেন ড. রাজী।
আধঘন্টা পরে তিনি রিসার্চ সেন্টারের দিকে রওয়ানা দিলেন। গতরাতের কথাই ভাবছিলেন গাড়ি চালাতে চালাতে, আর যতই ভাবছিলেন ততই তার মনে হচ্ছিল, রিসার্চ সেন্টারে ভেষজের গবেষণার আড়ালে তিনি ও তার সহযোগীরা কুয়াশা-২৬
অতি সঙ্গোপনে যে মৌলিক ও যুগান্তকারী গবেষণা চালিয়ে সম্প্রতি সাফল্য অর্জন করেছেন, যেভাবেই হোক তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা ফাঁস হয়ে গেছে এবং যারা রিসার্চ সেন্টারে এই ভয়াবহ কাণ্ড গতরাতে ঘটিয়েছে ঐ গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সন্ধান লাভই ছিল তাদের লক্ষ্য। সেন্টারের কর্মচারীদের ধারণা যে, তারা চারজন রিসার্চ করেন তার নিজস্ব চেম্বারে। আসলে তার চেম্বারটা হল ভূ-গর্ভস্থ গবেষণাগারের প্রবেশ পথ। ঐ কক্ষটার দেয়ালে যে বিরাট একটা আয়রন সেফ আছে, সেটা হচ্ছে একটা লিফট। সেটা নিচে আণ্ডার-গ্রাউণ্ড গবেষণাগারে চলে গেছে।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন ঐ আণ্ডার গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে। তার ফলাফল জানাজানি হলে বিশ্বব্যাপী তুমুল হৈ-চৈ পড়ে যাবে। কারণ আণবিক বোমা আবিষ্কার বা মানুষের চাঁদে অবতরণের চাইতে তাদের সাফল্য এতটুকু তুচ্ছ নয়। এই আবিষ্কারের ফলে মানবজাতির ইতিহাস পর্যন্ত পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি আছে মারাত্মক। তাদের আবিষ্কার মানুষের যেমন পরম কল্যাণ সাধন করতে পারে তেমনি সামান্য ভুল হলে অথবা কোন অবিবেচক অপরাধীর হাতে পড়লে, মানবজাতি নিশ্চিহ্নও হয়ে যেতে পারে, অথবা নিশ্চিহ্ন না হলেও পৃথিবীটা একটা নরকে পরিণত হতে পারে। আবিষ্কারের সেই অকল্যাণকর দিকটা যতদিন তারা দূর করতে না পারবেন ততদিন তারা তা প্রকাশ করতে চান না। ড. লোকমান হাকিম বারবার তার এবং তাঁর সহকারীদের প্রতি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে গিয়েছেন এবং তারাও তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মানুষের অমঙ্গল হয় এমন কিছু.তারা করবেন না। তাছাড়া ড, রাজী জানেন এবং ড. হাকিমও জানতেন যে, এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ পেলে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের তালিকায় তাদের নাম যুক্ত হবে।।
ড. হাকিম ছিলেন দূরদর্শী লোক। তাদের আবিষ্কারের ফলাফল জানবার জন্য যে চেষ্টা হতে পারে তিনি সে পূর্বাভাসও দিয়ে গেছেন এবং সেই জন্যেই তিনি ড. রাজীর রূমের প্রবেশ পথে সিকিউরিটির ব্যবস্থাও করে গেছেন। ড. হাকিমের সতর্কবাণী আজ তার বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
| ড. রাজী নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ঐ দৈত্যাকার প্রাণীটির রহস্যটা কি? আপাতত কোন মানবীয় যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে তিনি তো এ নৈসর্গিক ঘটনাটার ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। ওটা তো অশরীরী আত্মা নয়, তার উত্তেজিত মস্তিষ্কের কল্পনা নয়, মানসিক বিকার বা বিভ্রম নয়, হ্যালুসিনেশনও নয়। তার অস্তিত্বের মতই ওটাও.সত্য।
তিনি জানেন, পুলিসকে এসব বলে কোন ফায়দা হবে না। পুলিস তাঁকে বিশ্বাস করবে না। বরং তাঁকে হয়ত উন্মাদ বলে মনে করবে। সেটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। তিনি যদি নিজের চোখে মূর্তিটাকে না দেখতেন তাহলে অতি বিশ্বাসভাজন লোকের কথাও তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনিও ব্যাপারটাকে ৭৬
ভলিউম-৯
মানসিক বিকারজনিত কল্পনার ফল বলে মনে করতেন।
| ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান তার বন্ধু মি. সিম্পসন এখন এখানে থাকলে ভাল হত। ড. রাজী তাকে বিশ্বাস করাতে পারতেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্যে ভদ্রলোক জুরিখ গিয়েছেন। কবে ফিরবেন, কে জানে। পুলিসের বড়কর্তাদের আর কারও সঙ্গে তার জানাশোনা নেই।
চার
রিসার্চ সেন্টারে জনসমাগম শুরু হয়েছে। কর্মচারীরাও দু’একজন করে আসছে। সকাল থেকে দারোয়ান মোসলেম বিশ্বাসের ডিউটি। সে এসে গেটের দায়িত্ব নিয়েছে। কিছু মাল ডেলিভারী দেবার কথা ছিল সকালে। তা নেবার জন্যে ট্রাক
এসেছে। ইনডেন্টার আলী সাহেবও এসেছেন।
কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটের বাইরে ছোট ছোট দলে জটলা পাকাচ্ছে তারা। উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, গুজবের ফানুসটাও ক্রমেই
ফীততর হচ্ছে।
পারভেজ ও সেলিম আতহার এসে পৌঁছল। সেলিমের গাড়ি সার্ভিসিং-এ গেছে। পারভেজ সেন্টারে আসবার পথে ওকে নিয়ে এসেছে। গেটের বাইরে জটলা দেখে ওরা অবাক হল। পারভেজ গাড়ি পার্ক করে বন্ধ গেটের দিকে তাকিয়ে কাছেই দাঁড়ানো একজন পরিচিত কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কি সাদউদ্দিন সাহেব, আপনারা সব বাইরে দাঁড়িয়ে, দারোয়ান নেই গেটে?
ঘটনাটা সবিনয়ে প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক।
অবাক হয়ে শুনল পারভেজ ও সেলিম। তারপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল । সেলিম বিড়বিড় করে কি যেন বলল।
অন্য একজন কর্মচারী বলল, “গেটটাও নাকি ভোলা ছিল। গেটের বিরাট মজবুত তালাটা নাকি, স্যার, মুচড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
বলেন কি! বিস্ময় চরমে উঠল সেলিমের, ও তালা ভাঙার মত শক্তি তো মানুষের নেই!
শুধু কি তাই স্যার, গেটের অমন ইস্পাতের মজবুত, শিকও অনেকটা বাকিয়ে ফেলেছে,’ চোখ দুটো বড় বড় করে সাদউদ্দিন সাহেব জানালেন।
কি ভয়ানক ব্যাপার!’ পারভেজ বলল।
‘এ যে ভূতের খেলা শুরু হল রে। চল তো দেখে আসি। আপনাদের বোধহয় ঢুকতে দিচ্ছে না?’ কণ্ঠে তার উদ্বেগের ছাপ।
ডিরেক্টর সাহেব কাউকে ঢুকতে দিতে নিষেধ করেছেন। তবে আপনারা স্যার, ঢুকতে পারেন, পারভেজ ও সেলিমকে দেখে দারোয়ান বলল।
কিন্তু ওরা ঢুকল না। গেটটা দেখতে লাগল দুজন। কুয়াশা-২৬
লাগল
দারোয়ান বল তবে আপনার
৭৭
কর্মচারীটি মিথ্যা বলেনি। গেটের ডাইনের পাল্লাটার দ্বিতীয় শিকটা বেশ কিছুটা বাঁকানো। যেটুকু ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে তা দিয়ে অনায়াসে পাঁচ-ছয় বছরের একটা শিশুকে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে। শিকটার পাশেই তালা ঝোলাবার আংটা। বোধহয় বাইরে থেকে হাত ঢুকিয়ে তালাটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সেলিম সবিস্ময়ে বলল, “দেখেছিস কি ভয়ানক কাণ্ড?’ পারভেজ নীরবে মাথা নাড়ল।
দারোয়ান মোসলেম বিশ্বাস ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমার মনে হয়, কাজটা মানুষ করেনি, স্যার।’
“ঠিক ধরেছ, করেছে ভূতে। তবে তোমার-আমার মত রক্ত-মাংসের ভূত সে, বিরক্তি প্রকাশ করল পারভেজ।
মোসলেম বিশ্বাস সাহেবদের সামনে আর যুক্তিতর্ক করার সাহস পেল না। সে বলল, স্যার, আপনারা কি ভিতরে ঢুকবেন?’
না, থাক। সবাই বাইরে রয়েছেন, আমাদের সে ক্ষেত্রে ভিতরে যাওয়া উচিত নয়। হয়ত এমন কিছু করে ফেলতে পারি যাতে সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হবে,’ সেলিম জবাব দিল ।
পারভেজ বলল, “ঠিক বলেছিস।’ দু’জন একপাশে সরে গেল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিম বলল, “কিরে, ব্যাপারটা তাহলে এই পর্যন্ত গড়াল? তখনই বলেছিলাম, ড. রাজীর্কে বলা দরকার। তুই রাজি হলি নে, বেচারা তারিক খ বিনা দোষে প্রাণে মারা গেল। আমরা তো খোঁজখবর নিতে গিয়ে কিছুই করতে পারলাম না। মাঝখানে এই কাণ্ড ঘটে গেল।
পারভেজ জবাব দিল না। কি যেন ভাবতে লাগল সে।
আলী সাহেব কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি সেলিম ও পারভেজকে দেখে এগিয়ে এলেন।
‘এই যে আলী সাহেব, কি খবর?’ সেলিম প্রশ্ন করল।
আর খবর। সে তো এখানে এসেই শুনতে পেলাম । আর এক খবর শুনেছেন আপনারা? মেহার-পাড়ার এক ভদ্রলোক বলছিলেন, কে নাকি গতরাতে এখানেই
এক ঝোঁপের মধ্যে রাক্ষসের মত বিরাট একটা মানুষ দেখেছে।’
সেলিম প্রশ্ন করল, ‘জেগে, না ঘুমিয়ে?’
প্রশ্নটা শুনে হাসলেন আলী সাহেব। তিনি বললেন, আপনি তো সাহেব উড়িয়েই দিলেন; কিন্তু তালা ভাঙা, শিক বাঁকানো, যা সব শুনছি তাতে বলুন তো সাহেব একেবারে উড়িয়ে দিই কি করে? অবশ্য যেমনটা বলেছে হয়ত সত্যি নয়। খবরটাও ভদ্রলোকের কানে একটু পল্লবিত হয়েই এসেছে। যতদূর মনে হয়, লম্বা চওড়া কোন লোককে দেখেছে কেউ। তারপর এই সব খবর শুনে এটা-ওটা মিলিয়ে বেশ পরিবেশনযোগ্য করে তুলছে ব্যাপারটা।’
ভলিউম
৭৮
পারভেজ আলী সাহেবের লম্বা-চওড়া সৌষ্ঠবময় স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে তরলকণ্ঠে বলল, তাহলে মনে হচ্ছে আপনাকেই দেখেছে কেউ।’
তা মশাই ইচ্ছে করলে রাতের বেলা দু’চারজনের চোখ ছানাবড়া করতে পারি বটে,’ আলী সাহেব হাসতে হাসতে বললেন।
সেলিম পথের দিকে চেয়েছিল। একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। ঠিক তার পিছনে এল ড. রাজীর গাড়ি। পুলিসের গাড়ি থেকে নামলেন সমসের দারোগা । ভদ্রলোককে সেলিম চেনে। প্রশস্ত টাক ও নধর কান্তি এ তল্লাটে তাঁর সুনাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
পরিচয় শেষে ড. রাজী সমসের দারোগাকে নিয়ে রিসার্চ সেন্টারে ঢুকলেন। দারোয়ান ওঁদেরকে অকুস্থলে নিয়ে গেল। তার আগে তিনি বাঁকানো শিকটা দেখলেন এবং একটা রুমালের মধ্যে আলগোছে ভাঙা তালাটা তুলে একজন কনস্টেবলের হাতে সঁপে দিলেন।।
কসমস ফুলের বেডের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে নিস্পন্দ দেহটা। গায়ের বাকী জামাটার রক্ত শুকিয়ে গিয়ে কালচে রং ধারণ করেছে। বুকের কাছে মাটিতেও রক্তের দাগ। বাঁ হাতটা গায়ের তলে। কোনাকুনি করে কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত গুলির বেল্ট। বন্দুকটা পড়ে আছে কয়েক হাত দূরে। ঝাঁকড়া চুলে মুখটা আচ্ছন্ন। তবু চেনা যায় তারিক খাকে।
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল ওরা কিছুক্ষণ। সেলিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সমসের দারোগা বললেন, “দেখবার কিছু নেই। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা লাশটা ময়না তদন্তে পাঠিয়ে দিতে চাই।’
না না, আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। এটা হচ্ছে মার্ডার কেস। অপরাধী যাতে ধরা পড়ে তার জন্যে আমাদের সহযোগিতা করা উচিত।’
সেলিম একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, পিঠে জামাতে একটা ফুটোর মত দেখা যাচ্ছে না? রক্ত ঐ জায়গাতে সবচেয়ে বেশি জমাট বেঁধেছে।’
সমসের দারোগা বলল, “ছোরা মেরেছে বলে মনে হয়, গুলি করাটাও অসম্ভব নয়। কেউ আওয়াজ-টাওয়াজ শুনেছে নাকি?”
‘সেরকম তো কারও কাছে শুনিনি এখন পর্যন্ত,’ ড. রাজী বললেন। “হাতেম আলী তো সারারাত ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।’
হাতেম আলী আবার কে?’ সমসের দারোগা প্রশ্ন করলেন। সিকিউরিটি গার্ড।’ ‘সে-ও কি রাতে ছিল নাকি রিসার্চ সেন্টারের মধ্যে?
হ্যাঁ। রাতে দু’জন লোক থাকে। একজন থাকে গেটে, আর একজন থাকে সিকিউরিটি রূমে,’ সিঁড়ির পূর্বদিকের দোতলার কক্ষটা দেখিয়ে বললেন ড. রাজী।
তার কাজ অবশ্য শুধু সি. সি. টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা।
‘সেটা আবার কেন?”
কুয়াশা-২৬
৭৯
‘আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। চলুন, রিসেপশন রূমে গিয়ে বসা যাক,’ সেলিম প্রস্তাব করল।
সেই ভাল, পারভেজ বলল।
রিসেপশন রূমে গিয়ে বসল সবাই। সমসের দারোগা লাশটা সরাবার জন্য কনস্টেবলদেরকে নির্দেশ দিলেন। কর্মচারীদের ঢুকতে দেবারও অনুমতি দিলেন।
সি. সি. টিভির ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন ড. রাজী। তিনি জানালেন যে, তার নিজের চেম্বারটায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকে বলে তার দরজার দিকে মুখ করে সি. সি. টিভির ক্যামেরা ফিট করা আছে এবং সিকিউরিটি গার্ডের কাজ হল, টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা।
দারোগা তাঁর হুঁড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন, সারা দিন-রাতই সিনেমার ব্যবস্থা আছে তাহলে?’ | না। রাত দশটা থেকে ও ব্যবস্থা। সেকেণ্ড শশা বলতে পারেন, সেলিম
বলল।
কি যেন গার্ডের নামটা?” হাতেম আলী।
হ্যাঁ, হাতেম আলী। তাকে ডাকুন একবার। হাতেম আলী এল। ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়াল। সমসের দারোগা ভ্রূকুটি করলেন তার দিকে।
‘তোমার নাম হাতেম আলী?
জ্বি, দারোগা ছাব।’ ‘তা, খুনটা কে করল? হাতেম আলীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “জানি না, ছ্যার।
বল কি হে? বলতে গেলে তোমার নাকের ডগায় এমন একটা কাণ্ড ঘটল…?
একটা ধমক দিলেন তিনি হাতেম আলীকে। কিন্তু হাতেম আলী কিছু বলতে পারল না। তার কাছ থেকে জানা গেল যে, সে রাত দশটায় এসেছিল ডিউটিতে। তারিক খার সাথে অনেকক্ষণ গল্প-গুজব করেছিল। তারপর সে রাউণ্ডে যাওয়ার পর হাতেম আলী সিকিউরিটি রূমে যায়। টেলিভিশন সেটটা ডিস্টার্ব করছিল খুব।
সেটা সে অ্যাডজাস্ট করে একটা বই নিয়ে ক্যাম্প-খাটের উপর শুয়ে পড়ে।
দরজা খুলে, না বন্ধ রেখে?’ দরজা বন্ধ করেই ছুঁয়ে ছিলাম, ছ্যার। তারপর?” ‘তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারুম না। ছকাল ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল দরজা ধাক্কাধাক্কিতে। দরজা খুলতেই মোছলেম আমাকে ঘটনাটা জানাল। আমি ডিরেক্টার ছাহেবের বাছায় তক্ষুণি খবর দিলাম। থানায় ফোন করলাম। ৮০
বল কমিক দিলেন তিনা গেল যে,
তারপর রোধ করছিল খুব
ভলিউম-৯
হাতেম আদরের মতসলিম চোখ গতিকেস,
‘ম’ জাতীয় একটা শব্দ করে সমসের দারোগা হাতেম আলীকে বিদায় দিয়ে মোসলেম বিশ্বাসকে পাঠিয়ে দেবার হুকুম দিলেন।
হাতেম আলী বেরিয়ে গেল । | দারোগা বললেন, কি কি খোয়া গেছে তার কোন লিস্ট তৈরি করেছেন নাকি, ডক্টর সাহেব? না, আমিই তৈরি করে নেব?’
‘খোয়া গেছে? তাই তো, এ-ব্যাপারটা আমি ভেবেও দেখিনি।’
বলেন কি, স্যার। এটা যে ডাকাতি কেস, বুঝতে পারছেন না?” ‘ডাকাতি কেস!’ সেলিম চোখ দুটো কপালে তুলল।
সমঝদারের মত মাথা নেড়ে দারোগা বললেন, ‘প্রথমটায় আমি ভেবেছিলাম, হাতেম আলীর সাথে তারিক খার বোধহয় ঝগড়া-ঝাটি ছিল । হাতেম আলীই. কাণ্ডটা করেছে। কিন্তু খুন করে কেউ অমন ভাবে ঘুমোতে পারে না, বুঝলেন তো? হেঃ হেঃ অনেক দিনের অভিজ্ঞতা কিনা পুলিস বিভাগে.••।
তা তো বটেই,’ সেলিম সায় দিল।
তাহলে বাইরের লোক। তা অকারণে তারা তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকবে না। নিশ্চয়ই ডাকাতি করতে এসেছিল।
তা তো নিশ্চয়ই,’ সেলিম স্বীকার করতে বাধ্য হল। সাধারণ চোর ছাচোড়ও নয়। “নিঃসন্দেহে।
তাই তো বলছি, কি কি খোয়া গেছে তা জানতে পারলেই ব্যাটাদের ঠিক ধরে দিতে পারতাম। এই যে, তোমার নাম বুঝি•••কি যেন?
মোসলেম বিশ্বাসকে ঢুকতে দেখেই প্রশ্ন করলেন তিনি। “মোসলেম বিশ্বাস।’
এসেছ কখন? কটা থেকে ডিউটি?’ সকাল ছ’টা। তুমিই বুঝি গেট খোলা দেখেছ?’
হ্যাঁ, একেবারে হাট করে খোলা ছিল। ঢুকে তারিক খর খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, বাগানের মধ্যে তারিক খাঁর লাশ পড়ে আছে।
কিছু খোয়া গেছে বলে জান?’
কিছুই খোয়া যায়নি, স্যার। সবকটা রূমেই তালা দেওয়া ছিল। এখন খুলে দিয়ে এলাম।
আচ্ছা, যাও তুমি।’ বেরিয়ে গেল মোসলেম বিশ্বাস। আপনার কিছু বক্তব্য থাকলে বলুন, ডক্টর সাহেব?’
ড. রাজী বললেন, কথা ছিল না, তবু আমি এসেছিলাম রাত একটায়। একটা ভক্সল গাড়ি দেখেছিলাম গেটের সামনে। একটু অবাক হয়েছিলাম অত রাতে ওখানে গাড়িটাকে দেখে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু হাতেম আলী বা ৬-কুয়াশা-২৬
৮১
তারিক খা সাড়া না দেওয়ায় আমি ফিরে যাই। তাতে মনে হয়, হাতেম আলীর ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা মিথ্যে না-ও হতে পারে। কিন্তু তারিক খার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারিনি।’ ড. রাজী তার নিজস্ব অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা চেপে গেলেন একেবারে। সমসের দারোগা হয়ত তাকে টিটকারি দেবে।
সেলিম ও পারভেজ ড. রাজীর কথা শুনে অবাক হল। পরস্পর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। ওরা দুজনে জানত, ড. রাজীর গতরাতে রিসার্চ সেন্টারে আসার কথা ছিল না। তাদেরকেও আসতে নিষেধ করেছিলেন তিনি।
‘গেট তখন বন্ধ ছিল কিনা তা ভাল করে দেখেছিলেন?’
ড. রাজী বললেন, সত্যি কথা বলতে গেলে আমি তা খেয়ালই করিনি। গেট রাতে সব সময়ই বন্ধ থাকার কথা। দারোয়ান গেটে থাকলে তো কথাই নেই। তারিক খাকে না দেখেই আমি ধরে নিয়েছিলাম গেট বন্ধ আছে।’
আপনি অনেকক্ষণ ঘন্টা বাজানোর পরও যখন তারিক খ বা হাতেম আলীর দেখা পেলেন না তখন আপনার মনে খটকা লাগেনি?’
তা অবশ্য লেগেছিল। কিন্তু তখন আমার করবার কি ছিল? ভেবেছিলাম, আজ জিজ্ঞেস করব।’
| সমসের দারোগা সেলিম ও পারভেজকে জিজ্ঞেস করলেন তারা কোন আলোকপাত করতে পারে কিনা। কিন্তু তারা অক্ষমতা প্রকাশ করল ।
সমসের দারোগা উঠে দাঁড়ালেন। সেলিম জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা খুব জটিল বলে মনে হচ্ছে না?’
সমসের দারোগা বললেন, ‘জটিল মানে•••কি যে বলেন! ওষুধ চুরি করতে, মানে ডাকাতি করতে এসেছিল। খুনোখুনি করেই সরে পড়েছে। শীঘ্রই একটা কিনারা করে ফেলব অবশ্য।
আপনিই তো আমাদের আশা-ভরসা।। ‘হেঃ হেঃ, কি যে বলেন। কি যে বলেন, প্রশংসায় গলে গেলেন দারোগা।
ড. রাজী এতক্ষণ চাঞ্চল্য গোপন রেখেছিলেন। এক্ষুণি আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিটা দেখা দরকার। সেখানে কোন গোলমাল হয়েছে কিনা তা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই তাঁর। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সেলিম ও পারভেজকে কয়েকটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে তিনি তার চেম্বারের দিকে এগোলেন।
ইতিমধ্যে গেট খুলে দেয়া হয়েছে। কর্মচারীরা সবাই ঢুকে পড়েছে। কর্মমুখর হয়ে উঠেছে রিসার্চ সেন্টার। ‘তারিক তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে হাজারোটা জল্পনা-কল্পনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ চলছে। ডা. রাজী আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির অবস্থা দেখতে চলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি একাই যেতে চান সেখানে। কারণ গোপনতার মধ্যেও গোপনতা আছে। তাদের আবিষ্কার সম্পর্কিত সমস্ত কাগজপত্র ল্যাবরেটরির মধ্যেই এমন এক স্থানে লুকিয়ে রেখেছেন যা তার প্রিয় সহকারীরা পর্যন্ত জানে না। যদি কোনদিনই যথার্থই ল্যাবরেটরির কোন ক্ষতি হয় তাহলে আবার এইসব
| ভলিউম-৯
কাগজপত্রের ভিত্তিতে তা নতুন করে গড়ে তোলা যাবে। তাছাড়া আবিষ্কারটা এতই জটিল ও সূক্ষ্ম যে, কারও পক্ষে এ দুরূহ প্রসেস স্মরণ রাখা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং তা হারিয়ে গেলে পুনর্গঠন একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। নতুন করে পরিশ্রম করতে হবে বছরের পর বছর। তাছাড়া ড. হাকিম আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির জন্যে যে জটিল প্ল্যান তৈরি করেছিলেন তার ডিজাইনও আছে ল্যাবরেটরির মধ্যে লুকানো। রুহুল করিম ছাড়া দুনিয়ার আর কোন লোক ঐসব যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারবে না।
| ড. রাজীর সহকারীরা শুধু যোগ্যই নয় তারা পরম বিশ্বাসী। বস্তুত তার সহকারীরা তার গর্বের বস্তু। বিশেষ করে পারভেজ তো ড, হাকিমের এক অমূল্য আবিষ্কার। মৌলিক চিন্তা ও পাণ্ডিত্যের দ্বারা সে ইতিমধ্যেই সকলের গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। কতই বা বয়স। পঁচিশ কি ছাব্বিশ। টকটকে, গৌরবর্ণ, আশ্চর্য সুদর্শন ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দ্র ও বিনয়ী। দোষের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মদ খায়। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, পেগের পর পেগ মদ খেয়েও সে কখনও ভারসাম্য হারায় না। গবেষণার কাজেও তার কোন অসুবিধা হয় না। | সেলিমের ব্যাপারটা অন্যরকম। পারভেজ যেমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় সেলিম তেমনি সর্বজনস্নেহধন্য। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেলিমের সঙ্গে সকলেরই ভাই সম্পর্ক। হাসিঠাট্টা, রসিকতা আর হৈ-চৈ করে সবাইকে মাতিয়ে রাখে সে। সে যেন গবেষণাগারের নীরস পরিবেশে প্রাণরসের একমাত্র উৎস! ড. রাজী পারভেজের জন্যে গর্ববোধ করলেও টানটা সেলিমের দিকেই বেশি। সেলিমের চেহারাটা তেমন কিছু নয়। কালো, লম্বা, শুকনো। চোয়াল ভাঙা, বিদ্যাও তেমন নয়। এম. এস. সি-তে কষ্টে-সৃষ্টে তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিল। না আছে তার পাণ্ডিত্য না আছে মৌলিকতা। কিন্তু একটা অদ্ভুত গুণের জন্যে ড, হাকিম তাকে এই গবেষণাগারে স্থান দিয়েছিলেন। সে হল, কোথাও কোন সামান্যতম ভুল হলেও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়বেই। ড. রাজী তাকে অপরিহার্য বলে মনে করেন এই গুণটার জন্যেই এবং সেলিম কাছে না থাকলে কোন কাজেই তিনি এগোতে পারেন না।
রুহুল করিম রিসার্চের কাজে সাহায্য করতে পারে না। সে হল ইঞ্জিনিয়ার। আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির অসংখ্য যন্ত্রপাতি তাকে দেখাশোনা করতে হয়। সে নিজেও ড, হাকিমের উদ্ভাবিত অনেক মেশিনকে উন্নত করেছে। নতুন নতুন মেশিনের ডিজাইন তৈরি করেছে। বোকা বোকা চেহারা। মেয়েলী কণ্ঠস্বর। কথা বলে খুব কম।
সেলিম বলে, রুহুলের নাকি দিনে একশ’ শব্দের বেশি কথা বলা নিষেধ আছে। তার মধ্যে পঁচাত্তরটা মিসেস করিমের জন্যে নির্দিষ্ট। আর বাকিটা অন্যদের
জন্যে।
পারভেজের ধারণা আলাদা। রুহুল ওর মেয়েলী কণ্ঠস্বরের জন্যেই কারও সাথে কথা বলতে চায় না। কিন্তু এসব ঠাট্টাতেও নীরব থাকে রুহুল করিম। কুয়াশা-২৬
বোকার মত হাসে শুধু।
ওরা কয়েকজনই লোকমান হাকিমের আবিষ্কার। ওদের মধ্যে পারভেজই এসেছে সকলের শেষে। বছর দেড়েক আগে। সেলিম ও রুহুল এসেছে প্রায় চার বছর।
ড. হাকিম ভাল করেই চিনতেন ওদের। ড. রাজীও চেনেন। ওরা হচ্ছে খাঁটি সোনা। কিন্তু সোনার মধ্যে খাদ থাকতে পারে। কে জানে?
লিফট বেয়ে আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে নামলেন। দরজা খুললেন লিফটের। মেঝেতে পা দিয়েই তার মাথায় বজ্রপাত হল যেন। সমস্ত পৃথিবীটা কি টলছে? ভূমিকম্প হচ্ছে? না, হয়ে গেছে এর আগেই, অন্তত এই আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির মধ্যে। শ্বাস রোধ করে লিফটের দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আত্মসংবরণ করলেন তিনি। ভূমিকম্প হয়ে গেছে ল্যাবরেটরির মধ্যে। সমস্ত যন্ত্রপাতি কে যেন একেবারে ভেঙেচুরে তছনছ করে রেখে গেছে। সমস্ত রূম ভর্তি, এখানে-সেখানেছড়িয়ে আছে ভাঙা কাঁচ, লোহার টুকরো, বিভিন্ন মেশিনের ভাঙা অংশ। এসিড ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের জার ভেঙে গিয়ে মেঝেটা ভিজে গেছে। তার মধ্যে দুটো নীল গিনিপিগ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
| পাঁচটা অতি শক্তিশালী ইলেকট্রনিক মাইক্রোসকোপের চারটেই হামাগুড়ি দিচ্ছে মেঝেতে। একটার দণ্ড বাঁকানো অবস্থায় টেবিলের উপর পড়ে আছে। টেস্ট টিউব ও কাঁচের জার একটাও অক্ষত আছে বলে মনে হয় না, র্যাকগুলোতে অন্তত একটাও দেখা যাচ্ছে না। ড. হাকিমের তৈরি জেনোমিটার, ইউজেনোমিটার, আল্ট্রাজেনোস্কোপ, ক্রমোসম টেস্টার ইত্যাদি বিরাট বিরাট মেশিনগুলোর অবস্থাও
তথৈবচ। | স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ড. রাজী। তাঁর চেতনা যেন লুপ্ত হয়ে গেছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি তা বলতে পারবেন না। সংবিৎ ফিরে আসতেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ধীরে ধীরে পায়চারি করতে লাগলেন।
| কাঁচের ভাঙা টুকরোর মধ্যে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন ইউজেনোমিটারের দিকে। মিটারের কাঁটাগুলো স্থির হয়ে আছে। লাল, নীল আলোগুলো জ্বলছে না। নিচের একদিকে কাভার খোলা।
উঁকি মেরে দেখলেন, তারগুলো সব ঘেঁড়া। রোলারগুলো বাঁকানো। ইউজেনোমিটার মেশিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার অবস্থাও তাই। ধীরে ধীরে তিনি ল্যাবরেটরির ভিতরটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ইলেকট্রনিক কম্পিউটারটা চিত হয়ে পড়ে আছে ভেজা মেঝেতে। মেমরিসেলের কার্ডগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। বসবার টেবিলের কাছে গেলেন। সবক’টা ড্রয়ার খোলা। সেটার পাল্লাও খোলা।।
সেফের একটা ড্রয়ারের মধ্যে তিনি হাত চালিয়ে দিলেন। ভিতরের একটা বোতাম টিপলেন তিনি। তারপর চলে গেলেন ডার্করামে। ডার্করূমে বাতি
ভলিউম-৯
৮৪
জুলছিল। সেখানেও সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। এককোণে আবর্জনা ভর্তি একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স। সেটা সরালেন। দেখা গেল নিচে ছোট একটা চতুষ্কোণ গর্ত। তার ভিতরে হাত চালিয়ে দিয়ে মরচে ধরা একটা ছোট বাক্স বের করলেন তিনি। ঝাঁকুনি দিলেন বাক্সটা। ভিতরে কিছু একটা নড়ে উঠল। ছোট একটা নোট বই। চাবি দিয়ে বাক্সটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল নোট বইটা। বাক্সটা মাটিতে রেখে নোট বইটা খুললেন। কয়েকটা পাতা উল্টোলেন। চরম দুঃখের মধ্যেও তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। না, আসল জিনিস খোয়া যায়নি। ভাল করে নোট বইটা পরীক্ষা করে সুটের বুক পকেটে তুলে রাখলেন।
সেই বিকট দর্শন মূর্তিটা, কে? ঠিক কি উদ্দেশ্যে সে একা বা অন্য কারও সাথে এই আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে হানা দিয়েছিল, তিনি জানেন না। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই নোট বইটাই ছিল তাদের মূল আকর্ষণ। তারা যত বুদ্ধিমানই হোক, এই ল্যাবরেটরি সম্পর্কে তারা যতটাই জানুক, এটার হদিস তাদের জানা। ছিল না। তাই আসল জিনিসটা এখনও খোয়া যায়নি। কিন্তু এটা আর এখানে রাখা
উচিত নয় ।
বিশ্বস্রষ্টাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন মনে মনে।
ডার্করুম থেকে বেরিয়ে লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। লিফটের দেয়ালে দুটো সুইচবোর্ড। ডানদিকের সুইচবোর্ডে তিন সারিতে ন’টা সুইচ। ঠিক মাঝখানেরটা টিপলেন তিনি। সুইচবোর্ডের উপরের কাঠটা আস্তে আস্তে টান দিলেন। খুলে এল কাঠটা। ভিতরে দেয়ালের ফোকরে চৌকোণা ছোট একটা ক্যামেরা। তিনটে তারে ক্যামেরার তিনটে পয়েন্ট যুক্ত ছিল। সেগুলো সাবধানে ছাড়িয়ে ক্যামেরাটা বের করে আনলেন। ক্যামেরার পেছনের ঢাকনাটা খুললেন । এবং অবাক হয়ে দেখলেন ভিতরে শুলটা নেই।
অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, কাল বিকেলে এই অটোমেটিক ক্যামেরাটাতে তিনি নতুন একটা ফিল্মু ভরে রেখেছিলেন। তাদের অনুপস্থিতিতে কেউ এখানে ঢুকলে এই অটোমেটিক ক্যামেরায় তার ছবি উঠতে বাধ্য।
একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, স্যার। ইন্টারকমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. রাজী।
ইয়েস।’ ‘পারভেজ স্পিকিং। শু্যড উই কাম ইন?’
ইয়েস, মাই বয়। ডু কাম। দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ । আই শ্যাল শো ইউ.।।
কিন্তু স্যার, একটা অসুবিধায় পড়েছি। ‘কি অসুবিধা?’ ‘আমার চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি।’ সলজ্জ কণ্ঠ শোনা গেল।
‘স্ট্রেঞ্জ! এমন ভুল হওয়া তো সাইন্টিস্টের উচিত নয়। যাক, সেলিম আর রুহুল কুয়াশা-২৬
৮৫
করিম কোথায়?
‘ওরা কাজ করছে।’
কাজ থাক, এখুনি ওদেরকে নিয়ে তুমি চলে এস।’
ঘন্টাখানেক পরের কথা। রিসেপশন রূমের দরজা বন্ধ করে ড. রাজী তাঁর তিন সহকারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওদের কারও বাকস্ফুর্তি হচ্ছিল না। আণ্ডার.. গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে যে সর্বনাশ হয়েছে সে আঘাত ওরা কেউই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ড, রাজী ভেবেছিলেন, সবচেয়ে বেশি আঘাত পাবে রুহুল করিম। মেশিনগুলোকে সে সন্তানের অধিক স্নেহ করে। কি কার্যত দেখা গেল, আঘাত সবচেয়ে বেশি পেয়েছে পারভেজ, আর রুহুলই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
মেয়েলি কণ্ঠে রুহুল বলল, আই অ্যাশিওর ইউ, পারভেজ সাহেব, মেশিন সবগুলোই আমি ঠিক করে ফেলতে পারব। সবগুলোকে আর তৈরি করতে হবে। না। রিপেয়ার করলেই চলবে। তবে কম করেও এক বছর সময় লাগবে।’
পারভেজ বলল, “বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে এক বছর যে অনেক সময়, করিম সাহেব?’
| ল্যাবরেটরি অপেক্ষা উপস্থিত সমস্যা সমাধানেই সেলিমের উৎসাহ বেশি। সে বলল, এখন আমাদের প্রথম কাজ হল কালপ্রিটকে খুঁজে বের করা। তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে না পারলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আপনি কি বলেন, স্যার?’।
আমিও সেই কথাটাই ভাবছি। অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক জরুরী কাগজপত্র বিশেষ করে কতকগুলো চার্ট খোয়া গেছে। সম্ভবত সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। স্মৃতিশক্তি আমার অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। কাগজপত্র না দেখে অনেক কিছুই আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ঠিক এই মুহূর্তে আমি নিশ্চিন্তভাবে কিছুই বলতে পারছিনে। তবে পারভেজের বৈজ্ঞানিক প্রতিভায় আর রুহুল করিমের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতায় আমার বিশ্বাস আছে। আসলে ব্যাপারটা ওদের উপরই নির্ভর করছে। কিন্তু সে তো পরের কথা। এখন আমাদের সমস্যা অন্য। যারা আমাদের পিছনে লেগেছে তাদের সনাক্ত করতে না পারলে নতুন করে গবেষণা চালিয়ে কোন লাভ নেই।”
পারভেজ বলল, “ঠিক, আমাদের আগে এই রহস্য সমাধান করতে হবে।’
ড. রাজী ওদের তিনজনের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের কাউকে আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
সেলিম বলল, বলুন?
“তোমরা কি কখনও কারও কাছে আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির অস্তিত্ব এবং আমাদের গোপন গবেষণার কথা প্রকাশ করেছ?
তিনজনই দৃঢ়স্বরে জানাল যে, তারা বাইরের কারও সাথে এ সম্পর্কে কখনও আলোচনা করেনি। ৮৬
ভলিউম-৯
‘অথচ আমাদের শত্রুরা অনেক কিছুই জানে। আশ্চর্য!’ মন্তব্য করলেন ড. রাজী। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি, ড. হাকিমকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা রাখতে পারলাম না।’
সেলিম কি যেন ভাবছিল। সে হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বলল, “ইউরেকা! সবাই সাগ্রহে সেলিমের দিকে তাকাল।
শহীদকে লাগিয়ে দিই, স্যার। সে ঠিক এর রহস্যভেদ করতে পারবে।’ শহীদ? কে তিনি?’
শহীদ খান। আমার হাফপ্যান্টের আমলের দোস্ত। সৌখিন গোয়েন্দা। খুব নাম ডাক। পুলিস মহলেও প্রচুর প্রতিপত্তি।
পারভেজ বলল, যাঃ, এসব কাজ কি সৌখিন লোকদের দিয়ে হয়? তাছাড়া দেখাই যাক না পুলিস কি করে?’
‘ওরা তো রাজ্যের গ্যাং-কেসের আসামীদের পিছু ধাওয়া করবে। শুনলি না সমসের দারোগার কথা?
‘কিন্তু আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির অস্তিত্ব তো পুলিসের জানা নেই। তাহলে হয়ত অন্য ধরনের ধারণা পোষণ করত, পারভেজ বলল।
সেলিম স্বীকার করল সে কথা।
কিন্তু ড. রাজী সম্মত হলেন সেলিমের প্রস্তাবে। তিনি বললেন, ‘পুলিসের যোগ্যতা আমি চ্যালেঞ্জ করছি না, তবে ওরা ব্যাপারটাকে আর দশটা কেসের মতই দেখবে। অথচ আমরা সে ঝুঁকি নিতে পারি না। তাছাড়া আরও একটা ঘটনা ঘটেছে যা তোমাদের কল্পনার সমস্ত সীমারেখাকে ছাড়িয়ে যাবে। অথচ সেইটাই আমাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্য,’ অত্যন্ত দৃঢ় গলায় তিনি কথাগুলো বললেন।
| ওরা তিনজন ড, রাজীর মুখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিনি একটু ইতস্তত করলেন। তারপর তিনি তাঁর বিভীষিকাময় নৈশ অভিজ্ঞতার কথা খুলে বললেন।
ওরা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। ওদের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের রেখা প্রথম দিকে ফুটে উঠলেও ড. রাজীর বিবরণের পুঙ্খানুপুঙ্খতায় তাদের অবিশ্বাস ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু পারভেজ তবু খুঁত খুঁত করতে লাগল।
ড. রাজী শেষটায় যোগ দিলেন, জানি না তোমাদের বিশ্বাস হল কিনা। তবে যেসব অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো ঘটেছে তার সাথে এই ঘটনাকে মিলিয়ে দেখ। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনে, আমাকে আমার বাসায় রেখে এল কে?”।
| ওরা তিনজন নীরব হয়ে রইল। অনেকক্ষণ পরে সেলিম বলল, এখন আর অবিশ্বাস করতে পারি না স্যার, অবশ্য অন্য কেউ হলে অবশ্যই অবিশ্বাস তোম। তবে এই ধরনের গুজব আমি আজ সকালেও একবার শুনেছি। আলী কুয়াশা-২৬
৮৭
সাহেব বললেন, তিনি নাকি এক ভদ্রলোকের কাছে শুনেছেন, গতরাতে রিসার্চ সেন্টারের বাইরে ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে দৈত্যাকার একটা মূর্তি দেখা গিয়েছিল। তখন অবশ্য বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসেনি।’
কিন্তু পারভেজের চেহারা থেকে অবিশ্বাসের ছায়া একেবারে মিলিয়ে গেল না। সে বলল, আমার কিন্তু মনে হয়, ওটা একটা অপটিক্যাল হ্যালুসিনেশন ছাড়া আর কিছু নয়। এইসব গোলমেলে ব্যাপার মিলে বিভ্রান্তিটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।’
ড. রাজী ক্ষুণ্ণ হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। তিনি বললেন, ‘এটা হ্যালুসিনেশন বলে প্রমাণিত হলেই আমি সবচেয়ে খুশি হব।’
রুহুল করিম বলল, আমার সব গুলিয়ে আসছে।’ | ‘আরে, গুলিয়ে তো আসছে আমারও। সমস্ত ব্যাপারটাই তো গোলমেলে, সেলিম গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল।
পারভেজ বলল, ‘পুলিসকে এ ব্যাপারটা বললেন না যে?’ ‘ওরা বিশ্বাস করত না বলেই। যেমন তুমি করছ না।’
লজ্জিত হল পারভেজ। মুখ নিচু করল সে।
তাহলে তো স্যার শহীদকেই অনুরোধ করতে হয়, সুযোগ পেয়ে সেলিম আবেদন জানাল।
তাই কর। দেখ ভদ্রলোক সম্মত হন কিনা।’
সেলিম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আমি এখুনি ফোন করে আসছি। সে দরজার কাছে পৌঁছুবার আগেই কে যেন দরজায় আঘাত করল। সেলিম দরজা খুলতেই দেখল সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী এক অপরিচিতা তরুণী। সে একপাশে সরে দাঁড়াল।
ড. রাজীও দরজার দিকে তাকিয়েছিলেন। তরুণীকে দেখে তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। তরুণী তাঁরই একমাত্র সন্তান রোকেয়া। উত্তেজনায় তিনি সোফা ছেড়ে উঠে এলেন, তুই, তুই কখন এলি মা, আমাকে খবর দিসনি কেন?
| ‘তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, আব্বা,’ ভিতরে ঢুকে বলল। ড. রাজীকে কদমবুসি করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি অনেক বুড়িয়ে গেছ, আব্বা । তোমাকে এবার রিটায়ার করতে হবে।’
ড. রাজী হেসে বললেন, এই যাঃ, এসেই ডাক্তারি শুরু করলি! বোস।’ সেলিম তখনও নিষ্ক্রান্ত হয়নি। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, বসুন, মিস রাজী।’ ‘তোমাদের আলাপ করিয়ে দিই।’ গর্বিত পিতা মেয়েকে আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁর সহকারীদের সাথে।
একটু পরেই সেলিম বেরিয়ে গেল। সে যখন ফিরে এল তখন তার পিছনে ট্রে হাতে বেয়ারা।
পারভেজ খুশি হয়ে বলল, “এতক্ষণে একটা কাজের মত কাজ করেছিস, ৮৮
ভলিউম-৯
গলাটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু বাছা, এতে কি তোমার গলা ভিজবে?’ টিপ্পনী কাটল সেলিম, বেশ ততা, না হয় দু’কাপ বেশিই খেয়ো।
নবাগতার উপস্থিতিতে মন্তব্য করাটা উচিত নয়। নিজে বুঝতে পেরে কথাটা ঘোরাল সে। রোকেয়াকে বলল, ‘মিস রাজী, প্রমাণ করুন তো-যে মেয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী নিতে পারে সে মেয়ে চা-ও তৈরি করতে পারে।’
। হাসল রোকেয়া। পারভেজ দেখল, সুন্দরী মেয়েটার হাসিটাও ভারি মিষ্টি।
ড. রাজী সেলিমকে বললেন, তোমার বন্ধুকে ফোন করেছ?’
‘মিনিট পনেরর মধ্যেই, এসে পড়বে শহীদ,’ জবাব দিল সেলিম। রোকেয়া চা বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের হয়েছে কি, আব্বা? সবাই তোমরা এখানে বসে আছ যে?’
| ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, মা!’ তিনি তারিক খাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা সংক্ষেপে বললেন রোকেয়াকে।
রোকেয়া চোখ দুটো বড়বড় করে বলল, তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে খুন করে গেছে? ভয়ঙ্কর কাণ্ড তো!’
হ্যাঁ, ভয়ানক তো বটেই। তাই তো শুধু পুলিসের উপর ভরসা না করে শহীদ খান নামে একজন দক্ষ গোয়েন্দাকে অনুরোধ করেছি ব্যাপারটা তদন্ত করতে। তিনি এখুনি এসে পৌঁছবেন।’
চা খাওয়া শেষ হতেই রোকেয়া উঠে পড়ল। আব্বা, আমি চলি। আমাকে একটু রেস্ট নিতে হবে।’
হ্যাঁ মা, তুমি যাও।’ তুমি সাঁঝের সময় বাসায় যেয়ো কিন্তু।’ বেরিয়ে গেল রোকেয়া। মিনিট পাঁচেক পরেই শহীদ এসে পৌঁছুল ।
পরিচয়-পর্বের পর শহীদ বলল, আমি আপনার নাম শুনেছি, ড. রাজী। তবে সৌভাগ্য হয়নি আলাপের। ব্যাপারটা কি বলুন তো,’ সেলিম; পারভেজ ও রুহুলকে দেখিয়ে সে বলল। আশা করি, এদের সামনে বলতে আপত্তি নেই।
‘বিন্দুমাত্র না।’
তবে দয়া করে কিছু গোপন করবেন না।’
ড. রাজী বললেন, “আমরা সমূহ বিপদের সম্মুখীন। আমাদের একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপর শনির দৃষ্টি পড়েছে। অথচ এটা খারাপ লোকের হাতে পড়লে এবং তারা তার অপব্যবহার করলে সমগ্র মানবজাতি সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারে। এই অবস্থায় আপনার তদন্তের পক্ষে প্রয়োজনীয় কোন কথাই আমি গোপন রাখব না। রাখতে পারি না।’
শহীদ খুশি হয়ে বলল, “অতি উত্তম কথা।’
ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিলেন ড, রাজী। রাতে রিসার্চ সেন্টারের গেটের কুয়াশা-২৬
হতে পারে। এই অবস্থাও পারি না। কথা।’
ত রিসার্চ সেন্টারের গেট
৮৯
সম্মুখে গাড়ি থেকে নামবার পর থেকে ল্যাবরেটরির বিপর্যয় পর্যন্ত সবকিছু খুলে বললেন তিনি। গেটের সামনে যে ভয়ালদর্শন মূর্তির কবলে পড়েছিলেন তারও বিবরণ দিলেন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
শহীদের অবিশ্বাস তবু দূর হল না। ‘বে-আদবী মাফ করবেন। আপনার দেখায় কোন ভুল হয়নি তো?”
শুকনো হাসি হাসলেন ড. রাজী। ‘কোন ভুল হয়নি, শহীদ সাহেব। কোন ভুল হয়নি।’
শহীদ একটু চিন্তা করে বলল, ‘গেটের বাঁকানো শিকটা আমি দেখে এসেছি। ওটা সত্যি সাধারণ মানুষের কাজ বলে মনে হয় না। ঐ শিক বাঁকাতে অমানুষিক শক্তির প্রয়োজন। ভাল কথা, পুলিস কি ফটো নিয়েছে বাঁকানো শিক থেকে আঙুলের ছাপ পাবার আশায়?’
‘নিয়েছে, জানালেন ডক্টর রাজী।।
আবার চুপ করে রইল শহীদ। একটু পরে ড. রাজীকে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয়?’
না, সন্দেহ করার মত কাউকেই পাচ্ছি না।’
‘হাতেম আলী, না কি যেন নাম বললেন সিকিউরিটি গার্ডের? সে আছে এখনও?’
, চলে গেছে।’ | খবর দিম ওকে। ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপনারা, মানে পারভেজ সাহেব, সেলিম ও রুহুল সাহেব কি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?
রুহুল মাথা নেড়ে বলল, আমি কিছুই জানি না.। ন’টার সময় এখানে এসে দেখলাম এই হুলস্থুল ব্যাপার।
‘পারভেজ সাহেব, আপনি?’ পারভেজ ইতস্তত করে বলল, না, আমি কিছু জানি না।’ সেলিমও অক্ষমতা প্রকাশ করল ।
শহীদ বলল, আমি একবার আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিটা দেখতে চাই, যদি আপনাদের কোন আপত্তি না থাকে।
না, কোন আপত্তি নেই। চলুন।’ উঠে দাঁড়ালেন ড. রাজী।. শহীদ দাঁড়িয়ে বলল, ‘সেলিম, তোরা বরং এখানটাতেই অপেক্ষা কর।
অলরাইট। বেরিয়ে গেল দুজন। বাই দ্য ওয়ে, ড. রাজী, লাশটা কোথায় পড়ে ছিল?’ ‘ঐ তো ওখানে, বাগানের মধ্যে!’
চলুন, আগে জায়গাটা দেখে আসি।’
৯০
ভলিউম-৯
মাটির উপর রক্তের ছাপটা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। জ’ যুগাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল শহীদ। এদিক-ওদিক দেখল। একটু দূরে এ ক্ষয়গায় মাটি খুঁড়ে একটা বেড তৈরি করা হয়েছে। মৌসুমি ফুলের গাছ ৰোনা হবে নিশ্চয়ই। সেখানে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। পায়ের ছাপ না ওগুলো? উবু হয়ে বসল সে। হ্যাঁ, পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল বেডটা। তার উপর কয়েকটা পদচিহ্ন। ছাপগুলো
অস্বাভাবিক রকম বড়, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুদিকেই.. প্রায় এক ইঞ্চি গভীর।
ড. রাজী পাশে এসে দাঁড়ালেন। পায়ের ছাপগুলো তারও চোখে পড়ল।
শহীদ মাথা না তুলেই বলল; ‘পদচিহ্নগুলো দেখেছেন, ড. ‘রাজী? কত বড় আর কত গভীর! আপনি. যে দৈত্যাকার মূর্তির কথা বলেছিলেন সেটা সত্য হলে বলতে হবে, এটা তারই পায়ের ছাপ। মনে হচ্ছে, আপনার দেখাটা হ্যালুসিনেশন। নয়।’
ড. রাজী বললেন, ‘এখন তাহলে আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে?
‘বিশ্বাস না করে উপায় কি?’ পকেট থেকে ফিতা বের করে সাবধানে মেপে শহীদ বলল, সাড়ে পনের ইঞ্চি লম্বা আর সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি প্রস্থ, দেড় ইঞ্চি গভীর। বুড়ো আঙুলটার দৈর্ঘ্য সোয়া দুই ইঞ্চি। এ যে এক দৈত্যাকার মানবের পদচিহ্ন কোন সন্দেহ নেই তাতে, উঠে দাঁড়িয়ে বলল শহীদ।
পরের দৃশ্যে শহীদ ও ড. রাজীকে দেখা গেল আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। বিপর্যস্ত ল্যাবরেটরিটা দেখে শহীদও অবাক হল। কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এমন একটা আধুনিক ল্যাবরেটরির এহেন ক্ষতি সাধন করা সম্ভব কিনা, ভাবতে লাগল সে। অন্ততপক্ষে কয়েক লক্ষ টাকার অত্যন্ত দামি মেশিনারী নষ্ট হয়ে গেছে।
শহীদ বলল, মনের সমস্ত আক্রোশ ঝেড়েছে এর উপর।’ কিন্তু আক্রোশের কি থাকতে পারে? ‘সেটা তো তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার।’
সমস্তটা ল্যাবরেটরি ঘুরে ঘুরে দেখল শহীদ। কোন সূত্র কোথাও আবিষ্কার করা যায় কিনা, এই ছিল তার লক্ষ্য। ড. রাজী তার ল্যাবরেটরির কর্ম-পদ্ধতি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শহীদকে। কিন্তু বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের পারস্পরিক সংমিশ্রণে ল্যাবরেটরির মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস জন্ম নিতে শুরু করেছে। দু’জনেরই শ্বাস-প্রশ্বাসে রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল। গ্যাস-মুখোশ না পরে ঢোকাটা ভুল হয়ে গেছে। সুতরাং সেখানে আর অপেক্ষা না করে দুজন দ্রুত উঠে এল।
| 6, রাজীর চেম্বারে ঢুকে শহীদ বলল, এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, ড. রাজী।
অবশ্যই। আসুন, বসা যাক। দুজন সামনাসামনি দুটো চেয়ারে বসল। | সিগারেট ধরাল শহীদ। নীরধে কয়েকটা টান দিয়ে সে বলল, ‘প্রথমে বলুন, কুয়াশা-২৬
আপনাদের আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে এমন কি গবেষণা চলছিল যার জন্যে এই ধরনের হামলা হতে পারে। কোন মারণাস্ত্র বা কোন মারাত্মক ধরনের বিষ?’
না, বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার হলেও আণ্ডার গ্রাউণ্ডে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের বিষয়ের উপর গবেষণা করা হচ্ছিল। ইউজেনিকস সম্পর্কে কোন আইডিয়া আছে আপনার?
ইউজেনিকস?’ হ্যাঁ।’ শব্দটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। বংশানুক্রম সম্পর্কিত কোন কিছু।’
একজ্যাক্টলি। শব্দটা বায়োলজির, তবে সোশলজিতেও এ সম্পর্কে আলোচনার অবতারণা করা হয়। এর কোন বাংলা প্রতিশব্দ আছে বলে আমি জানি। না। তবে বলা যেতে পারে, দোষত্রুটিহীন প্রজনন বা সর্বোত্তম প্রজনন। যুগে যুগে মানুষ ভাল হতে চেয়েছে। নিষ্কলুষ, চরিত্রবান, স্বাস্থ্যবান এবং প্রতিভাবান হতে চেয়েছে অর্থাৎ সগুণাবলীর অধিকারী হতে চেয়েছে এবং দোষগুলো বর্জন করতে চেয়েছে। মানুষ চেয়েছে পৃথিবীটাকেই স্বর্গে পরিণত করতে কিন্তু তা পারেনি। ইউজেনিকসে এই পরম গুণবান মানুষ গড়ার সম্ভাব্যতা নিয়েই আলোচনা করা হয়। আমরা ইউজেনিকসের সম্ভাব্যতা নিয়েই আমাদের গবেষণাগারে কাজ করছিলাম।’
ড. রাজী একটু থেমে দম নিয়ে বললেন, এই ধরনের গবেষণা শুধু এটাই প্রথম নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমবেশি এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে জার্মানিতে হিটলারের আমলে। তাদের লক্ষ্য ছিল সুপারম্যান বা অতিমানব গড়ে তোলা। সাফল্য লাভ তারাও সম্ভবত করেছিলেন কিন্তু জার্মানির পতনের সময় সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরিটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মারা যান। যতদূর মনে হয়, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে ইউজেনিকসের সম্ভাব্যতারও তখনকার মত অবসান ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ড. লোকমান হাকিম জার্মানিতে অধ্যাপনা করতেন। তিনি কিছু কিছু শুনেছিলেন এ-সম্পর্কে । দেশে ফিরে তিনিই এই রিসার্চ সেন্টার ও আণ্ডার গ্রাউণ্ড, ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন। আমিও এতে যোগ দিই।
‘একনাগাড়ে বিশ বছর গবেষণার পর আমরা সাফল্য লাভ করি মাত্র চারমাস আগে। এটা আসলে এক অসাধ্য সাধন। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার । আণবিক বোমা আবিষ্কারের চাইতেও এর গুরুত্ব অসীম। কারণ আমাদের আবিষ্কার যথার্থ ভাবে ব্যবহার করলে মানবজাতির ইতিহাসই পাল্টে যাবে। পৃথিবীটাই হয়ে উঠবে স্বর্গ। ইচ্ছে করলেই আমরা দেব-সুলভ চরিত্রের মানুষের জন্ম দিতে পারি আমাদের আবিষ্কারের দ্বারা। অথবা জিনিয়াস গড়ে তুলতে পারি।’
এবং,’ শহীদ যোগ দিল । পাষণ্ডও তৈরি করতে পারেন। | হ্যাঁ, এবং সেটাই হল আমাদের সাফল্যের চরম ট্রাজেডী। বিজ্ঞান মানুষের
ভলিউম-৯
ধন।
কারণ আমাধবাচাই হামদের
যেমন কল্যাণ সাধন করতে পারে তেমনি চরম সর্বনাশও করতে পারে। যে প্রসেস আমরা আবিষ্কার করেছি তা কোন অপরাধী প্রকৃতির বিজ্ঞানীর হাতে পড়লে সে এটাকে ব্যবহার করে, সুপার ইনহিউম্যান তৈরি করে পৃথিবীটাকে একটা নরক কুণ্ডে পরিণত করতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই আমরা আমাদের গোপন আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করিনি, যদিও জানি এটা প্রকাশ পেলে আমরা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকব। আমরা অবশ্য সুপারম্যান তৈরি করিনি। গিনিপিগের উপর এক্সপেরিমেন্ট করেছি।’
শহীদ, অভিভূত হয়ে গেল। তার দেশেরই একদল বিজ্ঞানী লোকচক্ষুর আড়ালে বিজ্ঞানের সাধনায় এমন অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে আর তা সে জানতেও পারেনি! পরম শ্রদ্ধায় সে ড. রাজীকে মনে মনে অভিনন্দন জানাল।
, ড, রাজীকে বলার নেশায় পেয়ে বসেছিল। তিনি বলেই চললেন, আমরা এগিয়েছিলাম সহজ থিওরী সামনে রেখে। জানেন তো, অনুবিভাজন সম্ভব হয়েছিল বলেই আণবিক বোমা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদেরও তাই লক্ষ্য “জিন” বিভাজন।’
জিন?’
হ্যাঁ। “জিন” শব্দ থেকেই জেনেটিকস ও ইউজেনিকস শব্দ দুটো এসেছে। জেনেটিকস হচ্ছে বংশানুক্রম বিজ্ঞান। এই জিনই হল মানুষের দেহ, মন, চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের আদি উপাদান। বলতে পারেন, এইগুলোই হচ্ছে বংশধারার ভিত্তি। প্রাণী ও গাছের বংশধারা বয়ে যায় ক্রমোসসামের মাধ্যমে। ক্রমোসোম হল যৌন কোষের নিউক্লিয়াসের অঙ্গ। এটাই পূর্বপুরুষের গুণাবলী উত্তর পুরুষের মধ্যে বয়ে নিয়ে যায় এবং এর দ্বারাই তারা একজন অন্যজনের চেয়ে পৃথক হয়, অথচ পিতা মাতা বা পূর্বপুরুষের সাথে তাদের সাদৃশ্যও থাকে। পুরুষের যৌনকোষের মধ্যে আছে ২৩টি ক্রমোসোম, স্ত্রীলোকের নিষিক্ত যৌন-কোষে থাকে ৪৬টি। এক একটি ক্রমোসোম থাকে একাধিক জিন। অনেকটা পুতির মালার মত এবং প্রত্যেকটা জিন এক একটি গুণের আকর। যেমন ধরুন, একটি নিষিক্ত জিনের জন্যে একটা লোক কালো হতে পারে বা বোকা হতে পারে অথবা ধরুন তার চুল কটা হতে পারে। সে দেবতা হতে পারে পিশাচও হতে পারে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্রমোসোম ভেঙে জিন বিভাজন করা অর্থাৎ একটা জিনকে অন্য জিন থেকে পৃথক করা এবং প্রত্যেকটি জিনের চরিত্র নির্ণয় করা। জার্মান বৈজ্ঞানিকরাও এই পথ ধরে এগিয়েছিলেন। তাঁরা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু আমরা হয়েছি। আমরা জিনগুলোকে আলাদা করেছি, তাদের চরিত্র নির্ণয় করেছি। এখন যদি চেষ্টা করি এবং যদি নির্ণয়ে ভুল না করি, তাহলে আমরা দেবতাও গড়তে পারি শয়তানও গড়তে পারি। সে সাধনায় আমরা সফল হয়েছি। কিন্তু শয়তান গড়ার জন্যে তো আর আমরা এত কষ্ট করিনি? সুতরাং আমরা গবেষণার দ্বিতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলাম।’ কুয়াশা-২৬
৯৩
হতে পারে
তার চুল কটা হতে
করা এবং প্রত্যেকটি বিভাজন করা
একটু থামলেন ড. রাজী।
আমাদের বর্তমান সাধনা ছিল, যেসব জিন দেহ ও মনকে কলুষিত করে সেগুলোকে মডিফাই করা যায় কিনা।’
অর্থাৎ শয়তানকে দেবতা করা যায় কিনা। সে তো বোধয় আরও কঠিন কাজ।
| ‘হ্যাঁ, অত্যন্ত দুরূহ। এবং দুরূহই নয়, বিজ্ঞান যেটুকু এগিয়ে গেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে হয়ত অসম্ভব। কিন্তু আমাদের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে চেষ্টা না চালিয়ে উপায় নেই। শুধু আণবিক বোমা বানালে হবে না। তার বিরুদ্ধে প্রোটেকশন চাই। ব্যালিস্টিক মিসাইল যারা তৈরি করেছে তারা অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম ডেভলপ করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। আমরাও তাই আমাদের আবিষ্কারের ক্ষতিকর দিকটার বিরুদ্ধে নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে বাধ্য।
এব্যাপারে আপনারা কতটা এগিয়ে গেছেন?’
আদৌ এগোইনি। কোন পথ ধরে এগুনো যায় তাই আমরা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিলাম মাত্র।’
আর একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। অনেকক্ষণ ধরে নীরবে সিগারেট টানল সে। তারপর বলল ল্যাবরেটরিতে হামলা করার কারণটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। যেভাবেই হোক আপনাদের গবেষণা আর গোপন নেই। সুতরাং ঐ অসৎ অভিসন্ধি নিয়েই কেউ হানা দিয়েছিল এখানে। কিন্তু ঐ দৈত্যাকার পায়ের ছাপটার রহস্য এখনও বুঝতে পারছি না। সে কথা যাক, আপনার ঘনিষ্ঠ যে তিনজন সহকারী আছে তারা যথেষ্ট বিশ্বাসী তো?’
‘সেন্ট পারসেন্ট। ওদেরকে আমি কখনোই অবিশ্বাস করতে পারিনে।’ ‘সেলিম তো বোধ হয় অনেকদিন ধরে আপনার সঙ্গে আছে।
বছর তিনেক হল আছে সেলিম আর রুহুল করিম। পারভেজ অবশ্য নতুন। মাত্র এক বছর আগে এসেছে। অবশ্য সে অত্যন্ত প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। একদিন না
একদিন সে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করবে।
‘ওরা ছাড়া এই আণ্ডার-গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরির অস্তিত্ব আর কেউ জানে?’
আর জানে আমার মেয়ে রোকেয়া। সে তো এখানে ছিল না। আজকেই ফিরে এসেছে, তবে ওকে আমি আমাদের সাফল্যের খবর জানিয়েছিলাম।’
‘কোথায় ছিলেন আপনার মেয়ে?’ ‘মিউনিকে ডক্টরেট নিতে গিয়েছিল। ওরও সাবজেক্ট ছিল জেনেটিকস।
শহীদ আর একটা সিগারেট ধরাল। নীরবে কিছুক্ষণ টানল। তারপর বলল, ল্যাবরেটরি থেকে কোন কিছু খোয়া গেছে কিনা বলতে পারেন?
ড. রাজী বললেন, তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যেটা সেটা খোয়া যায়নি এবং আমি সেটা সরিয়ে ফেলেছি।
৯৪
ভলিউম-৯
‘আগেই?’
, আজকে। ‘সেটা খোয়া যাবার আশঙ্কা আছে?”
‘সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। ল্যাবরেটরি ধ্বংস হলে আবার তা হয়ত শিগগিরই গড়ে তোলা যাবে ওটার সাহায্যে। কিন্তু আমাদের আবিষ্কার সম্পর্কিত
নথি-পত্র হারালে তা পুনর্গঠন করতে কত বছর লাগবে তার ঠিক নেই।’ ‘ তার মানে, ঐ সব নথি-পত্রের জন্যে আপনার উপর হামলা হওয়া বিচিত্র
নয়।’
তিনি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে।’
আপনি তো বলছেন, কাউকে আপনার সন্দেহ হয় না। তবু আমি ব্যাপারটা আবার আপনাকে ভেবে দেখতে বলি। কারণ দৈত্যাকার প্রাণীর অস্তিত্ব সত্য হলে আমার বিশ্বাস, এর পিছনে কোন প্রতিভাধর অপরাধী আছে এবং সে আপনার খুব কাছে পিঠেই আছে। আপনার ল্যাবরেটরির সবকিছু সে জানে, গোপন ক্যামেরা কোথায় রাখা হয় তা-ও জানে। সেই লোকটাকে খুঁজে বের করাটাই আসল সমস্যা, উঠে দাঁড়িয়ে বলল শহীদ। আপনি আরও গভীরভাবে চিন্তা করুন।
পাঁচ
রিসেপশন রূমে ফিরে গেল শহীদ। সেখানে ঢুকতেই সেলিম বলল, ‘হাতেম আলী
এসেছে, ডাকব ওকে?’
‘ডাক তো। সে কোন নতুন খবর দিতে পারে কিনা দেখি।’
হাতেম আলী সত্যিই একটা নতুন খবর দিল। সে জানাল যে, রাতে যখন সে সিকিউরিটি রূমে ঢোকে তার একটু পরেই মিষ্টি একটা গন্ধ তার নাকে আসছিল। সেটা ফুলের গন্ধ নয়। কিন্তু সে গন্ধটাতে এমন একটা মাদকতা ছিল যে তার দুটো চোখ ঘুমে ভেঙে আসছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমে তার চোখ দুটো জড়িয়ে এসেছিল।
হাতেম আলী বিদায় নিতেই সেলিম বলল, “কিরে, কোন হদিস পেলি।’ হাসল শহীদ।
‘এ তো কেবল তদন্তের শুরু। তবে দেখে শুনে মনে হচ্ছে, যবনিকাপাত হতে বিলম্ব হবে না বেশি। কিন্তু তোরা খুব সাবধানে থাকি।’
‘কেন?
যে-কোন সময় তোদের উপর আঘাত নেমে আসতে পারে। অবশ্য তোদের আমি ভয় পাইয়ে দিতে চাইনে। সতর্ক করে দিতে চাই।’
পারভেজ বলল, ড. রাজী যে বিকটদর্শন দৈত্যাকার মূর্তির কথা বললেন আপনি তা বিশ্বাস করেন, শহীদ সাহেব?’ কুয়াশা-২৬
৯৫
শহীদ ইতস্তত করে বলল, এ প্রশ্নের জবাব আমি এই মুহূর্তে দিতে পারছিনে।’
সেলিম বলল, ‘ড, রাজী ছিলেন বলে তোকে একটা ঘটনার কথা বলতে পারিনি।’
‘এখন বল তাহলে?
ঠিক এক সপ্তাহ আগে এখানে এক কাণ্ড ঘটে গেছে। আলী সাহেব বলে এক ভদ্রলোকের দেওয়া একটা নৈশভোজ থেকে আমি ও পারভেজ ফিরছিলাম। রাত তখন বারোটার মত হবে। ড. রাজীও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু উনি হঠাৎ সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারেননি। নৈশভোজ শেষে তার খোঁজ নিতে গিয়ে রাস্তা থেকেই দেখলাম দোতলায় তাঁর শোবার ঘরে নীল আলো জ্বলছে। তার মানে, উনি ঘুমুচ্ছিলেন। পারভেজ নিচে ড. রাজীর গাড়িও দেখতে পেয়েছিল।
‘ফেরার পথে একটা গাড়ি ও তার নম্বর দেখে মনে হল, ওটা ড. রাজীর গাড়ি। আমার দেখায় কোন ভুল হয়নি। আই অ্যাম অ্যাবসলিউটলি শিওর। পারভেজ অবশ্য ব্যাপারটাকে হ্যালুসিনেশন বলে মনে করেছিল। কিন্তু রিসার্চ সেন্টারে তক্ষুণি এলাম এবং শুনলাম, ড, রাজী সত্যি সত্যি এসেছিলেন। ব্যাপারটাতে খটকা লেগেছিল আমার মনে। ভেবেছিলাম খোঁজ-খবর নেব এ সম্পর্কে। কিন্তু এগোতে পারিনি।’
তা ড. রাজীকে জিজ্ঞেস করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়,’ শহীদ বলল। ঠিক আছে, আমিই জিজ্ঞেস করব। এখনকার মত উঠি । সন্ধ্যার দিকে আর একবার আসব এদিকে।
বিকেলের দিকে মেঘ করে এল। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। সাঁই সাঁই করে বাতাস বইতে শুরু করল। তার মধ্যেই বেরোবে বলে স্থির করল শহীদ।
কামালও এসে হাজির হল সেই সময়। কিরে কোথাও বেরোচ্ছিস বুঝি?
হ্যাঁ, তুইও যাবি, চল । ‘কোথায়?
ঠাকুরমার ঝুলির দেশে। ‘বেশ একটা ইন্টারেস্টিং কেস পেয়েছি হাতে। একেবারে দৈত্য-দানো নিয়ে কারবার।
ক’টা মারলি?’
‘একটাও না। ওদের প্রাণ কোন এক পাতালপুরীর গোপন সোনার কৌটায় আছে তা জানার জন্যে ব্যাঙমা-ব্যাঙমীর খোঁজে শচ্ছি। ওঠ, দেরি করিয়ে দিসনে।।
রাস্তায় কামালকে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো জানাল শহীদ কামাল প্রথমে বিশ্বাস করতেই চাইল না। আর তাকে বিশ্বাস করাবার জন্যে শহীদও আগ্রহ দেখাল না।
থানায় যখন পৌঁছুল তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নাম। সমসের দারোগা
ভলিউম-৯
থানাতেই ছিল। সে শুকনো হাসি হেসে সম্বর্ধনা জানিয়ে বলল, ‘রিসার্চ সেন্টারের রাক্ষস-খোক্কসের কেসে বোধ হয়?’
শহীদ বসতে বসতে বলল, “রিসার্চ সেন্টারের কেসে বটে, কিন্তু রাক্ষস খোক্কসের ব্যাপারটা কি?’
আর বলবেন না, শহীদ সাহেব । তালায় যে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে তা সাধারণ মানুষের নয়।’
অবাক হওয়ার ভান করল শহীদ, ‘কোন অসাধারণ মানুষের বুঝি?’
আপনি তো সাহেব ঠাট্টাই করবেন। কিন্তু এই যে আমি পুলিসের সিযণ্ড চাকুরে, কত চোর-ডাকাত নিত্য ঠেঙ্গাচ্ছি; কিন্তু ব্যাপার দেখে-শুনে ভড়কে গেছি আমিও।
তা সে আঙুলের ছাপটা কোথায়?’ ‘চৌধুরী গোলাম হাক্কানী সাহেবের কাছে পাঠানো হয়েছে।’ মানে, সিম্পসন সাহেবের জায়গায় যিনি আপাতত কাজ করছেন?’
হ্যাঁ, আমাদের মাথায় আর ঢুকছে না। তাই ওখানে পাঠিয়েছি।’ ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছেন?
হ্যাঁ, সেটাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ কি আছে তাতে?’
তারিক ধার বন্দুক দিয়েই তাকে খুন করা হয়েছে, পিঠের একদম সাথে বন্দুক লাগিয়ে। জানেন তো তাতে আওয়াজটা কম হয়। খুনটা হয়েছে রাত এগারটা থেকে তিনটের মধ্যে।
হাতের ছাপ?’ | আশ্চর্য ওতে তারিক খা ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ নেই। মনে হয়, খুনীর হাতে দস্তানা পরা ছিল।’
‘এখন আপনারা কি করতে চান?
কর্তারা যা করেন। আমরা তো নিরুপায়। ওদিকে আর এক কাণ্ড ঘটেছে। রিসার্চ সেন্টারের পিছনে খালের মধ্যে একটা নীল রং-এর ভক্সল পাওয়া গেছে। সেটাকে উদ্ধার করে পেছনের গদী থেকে কয়েকটা আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে এবং সে ছাপগুলো তালার ছাপের সাথে একদম মিলে গেছে। অবশ্য সামনের সিটে পাওয়া গেছে অন্য হাতের ছাপ।’
‘গাড়িটা কার?’
তা জানা যাচ্ছে না। তবে গাড়ির নম্বরটা হাক্কানী সাহেবের গাড়ির নম্বরের সাথে মিলে গেছে। তারও একটা নীল রং-এর ভক্সল আছে। সেটা অবশ্য বোয়া যায়নি।’
তাহলে বেশ জমে উঠেছে দেখছি ব্যাপারটা।’
ভয়ে তো মশাই আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। শেষটায় কি রাক্ষসের ৭-কুয়াশা-২৬
৯৭
হাতে প্রাণ দেব?’
তাই তো, বড় বিপদের কথা, সমবেদনার সুরে বলল শহীদ।
‘বিপদ বলে বিপদ! মশাই, আপনি আবার কেন এর মধ্যে নাক গলিয়েছেন? ভয়-ডর প্রাণে থাকলে এখুনি কেটে পড়ুন।
তা এসব ব্যাপার রিসার্চ সেন্টারের লোকেরা জানে?’ না। হাক্কানী সাহেব বলেছেন গোপন রাখতে। পাবলিক ভয় পেয়ে যাবে।’ তদন্ত কি হাক্কানী সাহেব নিজেই করবেন?
তাই তো করা উচিত। ইতিমধ্যেই এই এলাকায় পুলিস ফোর্স বাড়িয়ে দেওয়ার অর্ডার হয়েছে। রিসার্চ সেন্টারের চারদিকে পুলিস ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। ড, রাজীর সাথে চৌধুরী সাহেবের কি আলাপ হয়েছে, জানি না। তারপরই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
চুপচাপ অনেকক্ষণ কাটল। বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ের মাতামাতি চলছে। একটা সিগারেট ধরাল শহীদ।
সমসের দারোগা চিবুকে হাত বুলাতে লাগল। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
টেলিফোন বেজে উঠল ।
সমসের দারোগা রিসিভার তুলল, হ্যালো-হা, হা…ধরুন। শহীদ সাহেব, আপনার ফোন।
রিসিভারটা হাত বাড়িয়ে নিল শহীদ। একটু অবাক হল সে। থানায় যে সে এসেছে এ খবর তো কারও জানার কথা নয়।
হ্যালো… 1 হ্যাঁ, শহীদ বলছি।’
চুপচাপ শুনল শহীদ কিছুক্ষণ। শেষে একটি মাত্র কথা সে বলল, আই অ্যাকসেপ্ট ইওর চ্যালেঞ্জ।•••ইয়েস আই ডু।•••ইউ, রোগ•••আই ডু অ্যাকসেপ্ট ইওর চ্যালেঞ্জ। •••আচ্ছা দেখা যাবে।’
শহীদের কণ্ঠে উত্তেজনার ছাপ থাকলেও চোখে-মুখে উত্তেজনার এতটুকু আভাস নেই, লক্ষ্য করল কামাল।
রিসিভার রেখে দিল শহীদ।
কি ব্যাপার?’ সাগ্রহে প্রশ্ন করল সমসের দারোগা।
আমাদের অজ্ঞাত পরিচয় এক বন্ধু। রাক্ষস-খোক্কস নিজেই সে অথবা সম্ভবত তার মালিক। আমাকে হুমকি দিচ্ছিল।
‘একটু খোলাসা করুন।
“রিসার্চ সেন্টারের ব্যাপারে আমি নাক গলে আমার পরিণামও নাকি তারিক খার মত হবে। তবে আমার মৃত্যু তারিক খার মত সনাতন কায়দায় হবে না। চব্বিশ ঘন্টা সময় দিয়েছিল চিন্তা করার জন্যে, কিন্তু আমি এখুনি তার চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করলাম, তা তো শুনতেই পেলেন। ৯৮
ভলিউম-৯
তার মানে তোর উপর এখন থেকেই আঘাত হানবার আশঙ্কা আছে,’ কামাল বলল।
কাজটা কি খুব ভাল করলেন, শহীদ সাহেব?’ চিন্তান্বিত কণ্ঠে সমসের দারোগা বলল।
শহীদ হাসল। অন্ধকার জানালার ভিতর দিয়ে বাইরে তাকাল একবার। বুকের ভিতরটা একটু কেঁপে উঠল তার। কে জানে, কাজটা সে ভাল করল কিনা। উঠে দাঁড়াল সে, চল কামাল। ড. রাজীর বাসায় যেতে হবে।’
কামালের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, ‘হাওয়াটা একটু পড়ুক না।’
“তোর ভয় করছে বুঝি?’
ভয়? এই শর্মা ভয় কাকে বলে জানে না,’ হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে কামাল বলল, কাম অন, মাই ল্যাড।
চলি, দারোগা সাহেব।’
কিন্তু গাড়িতে উঠতেই আবার কামালকে অজ্ঞাত ভীতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলল। নির্জন পথ। এদিকটায় জনবসতি তুলনামূলকভাবে কম। বাড়িগুলো একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে দূরে। এখানে-সেখানে ঝোঁপ-ঝাড়। ইটের পাজা। ধানক্ষেতও আছে। একটা অজ্ঞাত আশঙ্কা কামালের কণ্ঠ চেপে ধরল।
শহীদ পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে কামালের হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখ, দরকার হলে ব্যবহার করবি।’
থানা থেকে বেরোবার পরে শহীদ লক্ষ্য করেছিল, একটা গাড়ি আসছে ওদের পিছন পিছন । কিছুদূর যাওয়ার পৰু শহীদ পিছন ফিরে দেখল, গাড়িটা আসছেই । খেলা শুরু হয়ে গেছে তাহলে? সে কামালকে বলল, “দোস্ত সাবধান, লেজ লেগেছে পিছনে।’
কামালও দেখল।
‘আমি রাস্তা বদলাব। বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা আছে সেই দিকে যাব। মোড় ছাড়িয়ে গাড়ি থামাব। ওখানে একটা ঝোঁপ আছে। দৌড়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকবি তারপর দেখব, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। রিভলভার রেডি রাখবি । কিন্তু অকারণে গুলি নষ্ট করবি না।’
| মোড়টার কাছে এসে গিয়েছিল ওরা। স্টেশনে যাবার পথ এটা। তাই বোধহয় বৈদ্যুতিক বাতি আছে পথের ধারে। শহীদ মোড় ঘুরে কয়েক গজ গিয়েই গাড়ি থামাল। কামাল রেডি ছিল। দরজা খুলেই দৌড় দিল সে ঝোঁপের দিকে। শহীদওঁ দৌড়ে এল তার পিছন পিছন।
একটু পরেই দুটো আলো এসে ঠিকরে পড়ল শহীদের গাড়ির উপর । লতাপাতার ফাঁক দিয়ে শহীদ ও কামাল আলোটা দেখতে পেল। একটা গাড়ি এসে থামল শহীদের গাড়ির পিছনে। কুয়াশা-২৬
৯৯
শহীদ ফিসফিস করে বলল, সাবধান, আগে দেখে নে আমাদের বন্ধুকে । অন্ধকারে গুলি ছুড়বি না।’
গাড়ি থেকে নামল এক আরোহী। রেইনকোট গায়ে লম্বা-চওড়া একটা লোক। মাথায় হ্যাট। সে শহীদের গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি দেখে শহীদ ও কামাল দু’জনই বুঝল, লোকটা কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়।
গাড়িটা ফাঁকা দেখে লোকটা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কামাল ফিসফিস করে বলল, ‘আরে, এ-যে কুয়াশা!’
তাই তো! যাঃ, একটা মিস-ফায়ার হয়ে গেল।’ বেরিয়ে এল দুজন।
বাতাসের ঝাঁপটায় কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তবু কামালের যেন মনে হল, কুয়াশা তাকে ডাক দিয়ে বলল, “এস, কামাল সাহেব।
রাস্তার উপর উঠল দুজন।
কি ধবর, তুমি?’ শহীদ বলল।
‘তোমাদের থানায় ঢোকবার খবর পেয়েই আমি সেখানে গিয়েছিলাম । জরুরী দরকার আছে।’
কি, বল?’
এখানে এই ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে কি করে কথা হবে?’ ‘গাড়িতে ওঠ তাহলে,’ শহীদ প্রস্তাব করল ।
শহীদের গাড়িতে উঠল তিনজন।
খুবই ভয়ঙ্কর লোকের পিছনে লেগেছ তোমরা। সে একা নয়, তার সাথে আছে প্রচণ্ড শক্তিশালী দৈত্যাকার চেহারার দুটো মানুষ।’
তুমি তো দেখছি অনেক কিছুই জান।
বলতে গেলে আমি সবটাই জানি শুধু আসল রহস্য ছাড়া। সেটা জনতে পারলেই লোকটাকে আমি দেখে নেব।’
কি সেটা?’ শহীদ শুনতে চাইল । হাসল কুয়াশা ।
‘সে.প্রশ্নের জবাব আমি এই মুহূর্তে দেব না। তোমাকে আমি এগোতে বাধাও দেব না। শুধু বলছি, খুব সাবধান। একেবারে আসল শয়তনের সাথে খেলা । দেবতারূপী এক শয়তান।
“দেবতারূপী শয়তান?’
তাহলে লোকটাকে তুমি চেন?’
‘চিনি বলেই মনে হয়। আমি তার এক গোপন ইচ্ছায় বাদ সাধতে গিয়েছিলাম। বলতে গেলে আমার প্ল্যান বানচাল হয়ে গেছে। সেটা কেমন করে জানি ফাঁস হয়ে গেছে এবং আমাকে বোকা বানিয়ে সেই প্ল্যান ধরেই সে এগিয়ে
ভলিউম-৯
১০০
গেছে।’
তার মানে, তোমাকেও সে চেনে?’
চেনে না। তবে যে নামে আমি এই এলাকায় পরিচিত সেটা সে জানতে পেরেছে। সুতরাং আজ থেকে সে নামের মৃত্যু হল।’
“কি নামে এখানে তোমার পরিচয় ছিল?
‘আলী সাহেব নামে। ইনডেন্টিং ব্যবসায়ের সূত্র ধরে আমি হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য অনেকটা
সফল হয়েছে। কিন্তু আসল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি।’
‘তোমার পরিচয় সে জানল কি করে?’
‘আমার ঘাড়ে শ্যানন ডি কস্টা বলে একটা ভূত চেপেছিল, মনে আছে? সে-ই ডুবিয়েছে আমাকে। মার খেয়ে নাম বলে দিয়েছে। মার খেয়েছে মান্নানও। প্রচণ্ড মার। মড়া মনে করেই বোধহয় ওদের ফেলে রেখে গিয়েছিল। আর ওদেরকে মেরে
আমার গাড়ি নিয়েই লোকটা গতরাতে রিসার্চ সেন্টারে ঢুকেছিল।’
কিন্তু ওদের পেল কোথায়?’ ‘ওরা সেন্টারের পিছনে এক ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়েছিল।’
উদ্দেশ্য?’
সবটা জানতে চেয়ো না। কিন্তু উদ্দেশ্যটা অসৎ ছিল না। বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক মৃত্যুর সময় আমার উপর একটা কর্তব্য চাপিয়ে গেছেন। সেই কর্তব্য পালন করতেই আমাকে হাকিম মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে । সর্বনাশ অবশ্য তার আগেই হয়ে গেছে সকলের অলক্ষ্যে। ফলে আমার কাজটা অনেক বেড়ে গেছে।’
“সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কি ড. লোকমান হাকিম?’ শহীদ প্রশ্ন করল ।
। তাকে আমি দেখিনি। তার মৃত্যুর দু’মাস পরে অর্থাৎ এখন থেকে একমাস আগে আমি রিসার্চ সেন্টারে যাই। বাই দ্য ওয়ে, ড. লোকমান হকিমের মৃত্যুর ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছ?’।
না তো। শুনেছি, মোটর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে উনি মারা গেছেন।’ ব্যাপারটা আংশিক সত্য। কি রকম?’
ঘটনাটা ঘটেছিল রাতে। উনি গাড়ি চালাতে জানতেন না। ড্রাইভারই চালাত। নতুন এক ড্রাইভার তাঁকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। গাড়িটা হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা খালের মধ্যে পড়ে যায়। পরদিন তাঁর মৃতহে আবিষ্কার হয়। কিন্তু ড্রাইভারের খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’
শহীদ অবাক হয়ে বলল, কিন্তু সে ঘটনা তো আমায় কেউ বলেনি!’
‘শুধু এই নয়। পাঁচদিন পর সেই ড্রাইভারের লাশও পাওয়া গেল এক ইটের পাঁজার নিচে। পুলিস অবশ্য লাশ সনাক্ত করতে পারেনি। আমি অন্য সূত্রে কুয়াশা-২৬
কিন্তু ড্রাইভবাক হয়ে বন’পর সেই
১০১
জেনেছি। আসলে রিসার্চ সেন্টারে তখন থেকেই এই খেলা শুরু হয়েছে। তবে নায়ক ধীরে-সুস্থে, সাবধানে এবং কারও সন্দেহের উদ্রেক না করে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ আমার আবির্ভাব ঘটায় এইসব নাটকীয় ঘটনা শুরু হয়ে গেছে। সে হয়ত ভাবতেও পারেনি যে, কেউ তার
এলাকায় নাক গলাবে।’
‘কিন্তু এই আসুরিক চেহারার মানুষের ব্যাপারটা কি?’
দুপুরে তো . রাজীর সাথে তোমার অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছে। এখন একটু গভীর ভাবে চিন্তা কর । পরিষ্কার হয়ে যাবে,’ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল কুয়াশা।।
শহীদ ভাবতে লাগল এবং একটু পরেই তার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিজের উপর তার রাগও হল সঙ্গে সঙ্গে। আগেই তার চিন্তা করা উচিত ছিল । তাহলে অন্ধকারে হাতড়াতে হত না।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি তাঁর সাথে কি আলাপ করেছি তা তো তোমার জানার কথা নয়?’
উচ্চারিত অনেক কথাই জানবার নানা সহজ ব্যবস্থা আছে এ যুগে । ব্যবস্থা নেই শুধু অনুচ্চারিত চিন্তাটা জানবার।’
আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল শহীদের।
কুয়াশা ঘড়ি দেখে বলল, আমার বড্ড দেরি হয়ে গেল। আমাকে এখুনি একটা জরুরী কাজে যেতে হবে। সাবধান থেকে তোমরা । তোমাদের সাফল্য কামনা করি।’ দরজা খুলে রাস্তায় নামল সে।
| ‘এই ভেজা কাপড়-চোপড় পরে আর কোথায় যাবি, এখন বরং বাসায় ফিরে
চল।’
ড. রাজীর সাথে একবার দেখা করতে হবে। ওঁকে কতকগুলো জরুরী প্রশ্ন করতে হবে,’ শহীদ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল ।
ড. রাজী বাড়িতেই ছিলেন। একটু আগেই তিনি ফিরে এসেছেন।
শহীদকে ড্রইংরূমে বসালেন তিনি। চায়ের ব্যবস্থা করার নিদের্শ দিয়ে তিনি কাপড়-চোপড় বদলে এসে বসলেন।
ড. রাজীর মেয়েও এসে বসল। ‘কোন হদিস পাওয়া গেল, শহীদ সাহেব?’ ড. রাজী শুধোলেন।
এখনও কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। তবে এগোচ্ছি দ্রুত। কালপ্রিট আমাকে ইতিমধ্যেই শাসিয়েছে,’ নির্বিকার গলায় বলল শহীদ।
কি রকম?’ টেলিফোনের ঘটনা বিবৃত করল শহীদ। ভয়ঙ্কর লোকের পাল্লাতেই পড়া গেছে, শুকনো গলায় বলল রোকেয়া । ড. রাজী বললেন, ‘ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের চীফ চৌধুরী গোলাম হাক্কানী সাহেব
ভলিউম-৯
১০২
এসেছিলেন। উনি নিজেই তদন্ত করবেন।’
‘অতি উত্তম প্রস্তাব।’
আপনাদের সম্মিলিত প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র মানবতার উপর ভবিষ্যতে কবে কোন বিপর্যয় নেমে আসবে কে তা বলতে পারে।’
আপনাকে একটা প্রশ্ন আমার করার ছিল। আশা করি, আপনাদের গবেষণা সম্পর্কে মিস রাজীর সামনে আলোচনায় আপত্তি নেই।’
‘বিন্দুমাত্র না। মা আমাদের সব কিছুই জানে।’
আপনাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি প্রয়োগে সুপারম্যানের জন্ম দেওয়া সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব।’ | ‘তেমনি ঐ পদ্ধতিতেই কি মানুষের চেহারার বিশালকায় কোন প্রাণীর জন্মদান সম্ভব নয়?’
ড. রাজী চমকে উঠলেন। পলকহীন দৃষ্টিতে শহীদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, এ সম্ভাবনার কথা আমার অনেক আগেই ঠিও কর উচিত ছিল। আশ্চর্য, এটা আপনার মাথায় এল অথচ আমি আকাশ-পাতাল ভেবে মরছি।
আমার একবারও একথাটা মনে হয়নি।’
‘তাহলে সম্ভব বলতে চান?’
‘অবশ্যই সম্ভব। বস্তুত মানুষকে নিয়ে হাজারোটা এক্সপেরিমেন্ট করার অবকাশ আছে আমাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি প্রয়োগে। মানুষকে যেমন দেবতা বানানো চলে, তেমনি শয়তান বানানো চলে। নির্বোধ দাস মনোবৃত্তির মানুষ জন্ম দেওয়া যায় এবং শুধু মানুষ নয় যে-কোন প্রাণী এবং অনেক গাছের ক্ষেত্রেও নানা রূপান্তর সাধন সম্ভব।
তাহলে আপনি কি এমন কোন প্রাণী কল্পনা করতে পারেন, যার আকার হবে মেঘনাদের মত অথচ যে বাধ্য হবে আলাদীনের দৈত্যের মত?’
অবশ্যই।
রোকেয়া এতক্ষণ অবাক হয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। সে বলল, আপনার কি ধারণা, এক্ষেত্রেও তেমনি ঘটেছে?’
আমি নিশ্চিত নই, তবে ঐ রকম একটা সন্দেহ আমার মনে জেগেছে। কিন্তু তার মানেটা কি দাঁড়াল ভেবে দেখেছেন নিশ্চয়ই?
“নিশ্চয়ই। মানেটা দাঁড়াল এই যে, আপনাদের এই আবিষ্কার কোন নতুন ঘটনা নয়। কেউ এর আগেই এই ব্যাপারে সফল হয়েছে এবং দীর্ঘদিনু কালচার করে ঐ দৈত্যাকার প্রাণী উদ্ভাবন করেছে। এবং শুধু তাই নয়, আপনারা যে আশঙ্কা করছিলেন সেই আশঙ্কাটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’
ড. রাজী এতক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘শহীদ সাহেব, আপনার ধারণা যতদূর মনে হয় সত্য। এছাড়া ঐ অত্তিকায় মানবের কোন কুয়াশা-২৬
১০৩
যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে না।’ | ‘যে ঐ প্রাণীকে ডেভলপ করেছে সে এক অসামান্য প্রতিভা। সে নিজে ঐ বিদ্যা আয়ত্তে এনেছে এবং আপনাদের গবেষণা সম্পর্কেও জানতে পেরেছে কিন্তু সে চায় না যে, অন্য কেউ এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করুক। তাই সে আপনাদের পিছনে লেগেছে। বুঝতেই পারছেন আপনাদের শত্রুপক্ষ কি অসীম শক্তির
অধিকারী। তার বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই করতে হবে,’ শহীদ বলল ।
ড. রাজী বললেন, আপনাকে একটা ঘটনা জানাবার প্রয়োজন বোধ করছি।’ বলুন।’ জাকের চা নিয়ে এল এই সময়। টেবিলের ওপর সরঞ্জাম রেখে চলে গেল সে। রোকেয়া চা তৈরি করে এগিয়ে দিল।
ড. রাজী বললেন, মাস খানেক আগে এক আমেরিকান রিসার্চ সেন্টারে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে জানাল যে, সে-ও জেনেটিকস সম্পর্কে গবেষণা করছে। আমরা তাকে আমাদের গবেষণা সম্পর্কে কোন আলোকপাত করে তাকে সাহায্য করতে পারি কিনা জানতে চাইল। আমি পরিষ্কার জানালাম যে, এটা একটা মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। দেশি উদ্ভিদ থেকে ওষুধ তৈরি সম্পর্কে এখানে গবেষণা করা হয়। জেনেটিকস সম্পর্কে কোন রিসার্চ এখানে হয় না।
ভদ্রলোক বিশ্বাস, করল না বোঝা গেল তার চাহনিতে। সে জানতে চাইল, আমি লুকম্যান এইচ কিম নামে কাউকে চিনি কিনা। তিনি নাকি এক প্রতিভাধর বিজ্ঞানী এবং তিনি বিখ্যাত জার্মান জেনেটিকস সায়েন্টিস্ট ম্যানফ্রেড শেলবুর্গের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তাঁর গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মি. কিম দেশে ফিরে সম্ভবত একটা জেনেটিকা গবেষণাগার স্থাপন করেছিলেন। তার যতদূর বিশ্বাস ড. লোকমান হাকিমই হচ্ছে, লুকম্যান এইচ কিম এবং তিনি এখানেই কোথাও একটা জেনেটিকস গবেষণাগার স্থাপন করেছেন এবং সেই লুকম্যান এইচ কিম নাকি সেকেণ্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার শেষ হবার কিছুদিন পরে একটি জার্মান শিশুকে পালকপুত্র করে এনেছিলেন। | আমি এসব ব্যাপার আদৌ জানি কিনা সে জানতে চাইল । আমি স্রেফ অস্বীকার করলুম, তবে একথা ঠিক যে, ড. লোকমান হাকিম কখনও লুকম্যান এইচ কিম, নামে পরিচিত ছিলেন কিনা এবং তিনি কোন পালকপুত্র গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা আমি সত্যি জানতাম না।
যতদূর জানি, তিনি এক জার্মান মহিলার পাণি গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠায় দেশে ফেরার সময় একাকীই ফিরেছিলেন। স্ত্রীকে আনতে পারেননি। যুদ্ধ শেষ হবার পরে তিনি স্ত্রীকে খুঁজতে জার্মানি গিয়েছিলেন বটে কিন্তু ভদ্রমহিলাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। তারপর তিনি আর বিয়ে করেননি। জার্মানি থেকে তিনি কোন শিশুও সঙ্গে নিয়ে আসেননি, অন্তত আমি এ সম্পর্কে কিছু শুনিনি। ১০৪
ভলিউম-৯
‘সেই আমেরিকান ভদ্রলোকের নাম কি?
ডিউ ম্যানসেন। সে আমার সাথে মাত্র একবার দেখা করলেও তাকে আমি রিসার্চ সেন্টারের কাছে-পিঠে বেশ কয়েকবার দেখেছি। আমাদের অনেক স্টাফের
সঙ্গেও কথা বলতে দেখেছি তাকে। অবশ্য এখন আর তাকে দেখি না।’
কদিন আগে এ ঘটনা ঘটেছে?’ মাত্র একমাস আগে। মানে, ড, হাকিম মারা যাবার দু’মাস পরে?’
হ্যাঁ, ঐ রকমই হবে। আমার এখন মনে হচ্ছে, ঐ আমেরিকান ভদ্রলোকই আসল অপরাধী।’
ভদ্রলোক আর কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনাকে?’ ‘পালক পুত্রের কথাটাই বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
চা শেষ করে সিগারেট ধরাল শহীদ। কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টেনে বলল, শুনেছি ড. হাকিমের মৃত্যুটাও নাকি রহস্যজনক?’
চমকে উঠলেন ড. রাজী।
ড. হাকিমের মৃত্যু রহস্যজনক!’ আবৃত্তি করলেন তিনি। না তো, ওটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট কেস, মোটর দুর্ঘটনা। রাস্তার পাশে খালের মধ্যে গাড়ি পড়ে গিয়েছিল। তবে ড্রাইভারটা প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল এবং পালিয়েও গিয়েছিল
সে।
হাসল শহীদ। ‘সে ড্রাইভারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল পরে?’
, পাওয়া যায়নি। তবে পুলিস চেষ্টার ত্রুটি করেনি।’
আপনি হয়ত জানেন না যে, পাঁচদিন পরে সেই ড্রাইভারের লাশ পাওয়া গিয়েছিল এক ইটের পাঁজার তলা থেকে।’
ড. রাজী ভীষণভাবে চমকালেন। দু’চোখে গভীর বিস্ময় নিয়ে তিনি শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর বাকস্কৃর্তি হল না। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
রোকেয়া বিস্ময়ে অস্কুটকণ্ঠে কি যেন বলে উঠল। অনেকক্ষণ পরে ড. রাজী বললেন, কিন্তু পুলিস তো কিছু জানায়নি?’
কারণ, পুলিস লাশটা সনাক্ত করতে পরেনি, আমি জানতে পেরেছি এক গোপন সূত্রে।
ড. রাজী বললেন, তাহলে ওটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়?
“ওটা পূর্ব-পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আপনাদের রিসার্চ সেন্টারে নাটক শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এখন সেটা পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।’
কিন্তু কি ট্র্যাজিক পরিণতি!’ রোকেয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল ।
রাতে সাবধানে থাকতে বলে শহীদ ও কামাল বিদায় নিল। বাইরে তখনও হাওয়ার মাতামাতি চলছে। কিন্তু বৃষ্টি ছিল না। ওরা পথে নামতেই আবার
কুয়াশা-২৬
১০৫
মুষলধারে বর্ষণ শুরু হল।।
বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত পথে গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলল। পথটা একেবারে নির্জন। লোক চলাচল নেই। যানবাহন নেই। যেন নির্জন এক প্রান্তরে ওরা দু’জন মাত্র প্রাণী অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
নীরবে অনেকটা পথ পার হয়ে এল। উঁচু পথের দু’ধারে ফাঁকা মাঠ। দূরে একটা বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। কোন কারখানা হবে ওটা। মাঝে মাঝে ঝোঁপ-ঝাড়।।
| কেউ কথা বলছিল না। শহীদ সামনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে সবেগে। দূরে পথের পাশেই একটা বিরাট বটগাছ দেখা যাচ্ছে।
কামাল সিগারেট বের করল। মাথা নিচু করে সিগারেট ধরাতে যেতেই হঠাৎ প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়িটা থেমে গেল, লাফিয়ে উঠল অনেকটা। আকস্মিক ঝাঁকুনিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারল না কামাল। আসন থেকে তার দেহটা উৎক্ষিপ্ত হয়ে মাথায় আঘাত লাগল। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার জন্যে সামনের দিকে তাকাতেই সে অবাক হয়ে গেল। বটগাছের বিরাট একটা ডাল রাস্তার উপর পড়েছে। একেবারে পড়ে যায়নি। তখনও ডালটার নিম্নমুখী গতি অব্যাহত আছে।
অথচ আশ্চর্য এই একটু আগেও সে রাস্তাটা ফাঁকা দেখেছিল। আসন্ন বিপর্য য়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে কামাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, উহ্, বাবা বেঁচে গেছি। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে গাড়িটা থামিয়েছিলি। না হলে নির্ঘাৎ মরতে হত।’
শহীদ জবাব দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। “কিরে, হাঁ করে দেখছিস কি?’
‘বিপদ যায়নি। কেবল শুরু হল। খুব সাবধান। আমরা ফাঁদে পড়েছি। এই নে রিভলভারটা রাখ । গুলি বেশি নেই।’ কামাল তখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু শহীদের কথায় তার ইন্দ্রিয়গুলো তখনি সজাগ হয়ে গেছে।
তবু সময় পাওয়া গেল না, কানের কাছে জানালার কাঁচের উপর যেন বাজ পড়ল। গুলি ছুঁড়েছে কে যেন পিছনের জানালায়, ঝনঝন করে গাড়ির পিছনের দু’দিকের জানালা ভেঙে গেল।
ওরা থমকে পিছনে তাকাল। সারামুখ মুখোশে ঢাকা একটা লোক, ডান হাতে উদ্যত রিভলভার।
হাত তোল দু’জনেই। এই মুহূর্তে।’ রিভলভারটা স্পর্শ করারও সুযোগ পেল না কামাল।
শহীদ হাত তুলল। চাপা স্বরে কামালকে বলল, হাত তোল, কামাল । না হলে গুলি করবে।’ | কামালও হাত তুলল। ১০৬
ভলিউম-৯
‘বেরিয়ে এস। উঁহু, এই দরজা দিয়ে। খুলে দিয়েছি আমি দরজা। নিরীহ শিশুর মত দু’জন হাত শূন্যে তুলে রাস্তার উপর দাঁড়াল।
বাঁ হাত দিয়ে পকেট থেকে দুটো রুমাল বের করল লোকটা। বৃষ্টি-সিক্ত পথের উপর রুমাল দুটো ফেলে দিয়ে বলল, ‘রুমাল দুটো দিয়ে চোখ বাঁধ দু’জন। ভয়ে হার্টফেল করে মারা যাও, এটা আমি চাই না। তোল রুমাল।
উবু হয়ে রুমাল তুলে নিল শহীদ ও কামাল। বাঁধ চোখ। হ্যাঁ, খুব ভাল করে বাঁধ। কুইক।’
শহীদ নিরীহ শিশুর মত আজ্ঞা পালন করলেও তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মুখোশধারীর উপর। মুখটা দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু তার হাত নাড়া ও হাঁটার ভঙ্গিটা সে লুকোতে পারছে না। হ্যাঁ, শহীদ ঐ ভঙ্গিটা চেনে, ভাল করেই চেনে। যদিও বেশিক্ষণের জন্যে সে দেখেনি তবু লোকটা তার অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ওর মুখোশধারণ বৃথাই হয়েছে। ঠোঁট কামড়াল শহীদ। মনে মনে বলল, বাছাধন, তোমাকে আমি চিনেছি। হয়ত এত শীঘ্রি তুমি ধরা পড়তে না । কিন্তু তোমার দুঃসাহস আর অপরিসীম আত্মবিশ্বাসই তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমি চিনে ফেলেছি তোমাকে। আমার ভুল হয়নি।’
রুমাল দিয়ে চোখ বাঁধল শহীদ। লোকটার কবল থেকে এখন মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। সন্দেহজনক কিছু একটা করে বসলে গুলি ছুঁড়বে লোকটা। কিন্তু সুযোগ কি একবারও আসবে না? দেখা যাক।
রুমাল বাঁধা শেষ হতেই লোকটা বোধহয় তা পরীক্ষা করে দেখল। তার কণ্ঠ শোনা.গেল, চমৎকার।’
পরমুহূর্তেই লোকটা চীৎকার করে উঠল, ‘পেদ্রো!
ওরা কিছু দেখতে পেল না। বৃষ্টির শব্দে অন্য কোন শব্দও শুনতে পেল না। কিন্তু উপলব্ধি করল, কে যেন কাছে এসে দাঁড়াল।
রিভলভারটা এমনিভাবে তাক করে ধর। পরের মুহূর্তে মুখোশধারীর কণ্ঠ শোনা গেল।
হাত দুটো নামাও, পিছনে রাখ।’ শহীদ বুঝল, নির্দেশটা দেওয়া হচ্ছে কামালকে।
পিছমোড়া করে শহীদ ও কামালের হাত বাঁধল মুখোশধারী । ‘গাড়িতে তুলে দে।’
টান লাগল শহীদের চুলে। কয়েকটা চুল বোধ হয় উপড়েও গেল। গাড়ির দরজায় নাকের আঘাত লাগল। ওকে ভিতরে ঢুকিয়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা মারল কে যেন। শক্ত লোহার মত বিরাট থাবা লোকটার। এ নিশ্চয়ই সেই অতিকায় মানুষটা। একটু পরে কামাল হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর।
কুয়াশা-২৬
১০৭
ছয়
রাজার ভর ভিতরে ঢুকল। এপ
বইল সে কিছুক্ষণ। দেখা যাচ্ছে ।
সেই রাতেই।
আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া বইছে। বৃষ্টি আর হাওয়ায় চলছে মাতামাতি। ওয়াপদার বাতিগুলো বোধহয় অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ।
সেই অন্ধকারের মধ্যে কুয়াশা ও কলিম ভিজতে ভিজতে গিয়ে দাঁড়াল ড. রাজীর বাড়ির পিছনে। কলিমকে সেখানেই অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে কুয়াশা বাড়ির ভিতরে ঢুকল। এদিকটা ছোটখাটো একটা বাগানের মত। পঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে দোতলার দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। দোতলার জানালাগুলো সব বন্ধ। শুধু একটা মাত্র জানালা খোলা। ম্লান নীল আলো দেখা যাচ্ছে ভোলা জানালা দিয়ে। খুশিই হল কুয়াশা। ঐ রূমটাতেই আছে ড. রাজীর সদ্য প্রত্যাগত মেয়ে রোকেয়া এবং সে জানে, রোকেয়ার হাতেই ড. রাজী সঁপে দিয়েছেন তার আকাক্ষিত বস্তু।
| জানালাটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। পকেট থেকে রিভলভার বের করে দুই পাটি দাঁতের ফাঁকে বসিয়ে পাইপ বেয়ে দ্রুত উঠে গেল সে। পাইপ থেকে জানালার দূরত্ব দেড় হাতের মত। এক হাতে পাইপে ভর দিয়ে সে ঝুঁকে খোলা জানালার মধ্য দিয়ে ভিতরে তাকাল। অনুজ্জ্বল নীল আলোয় মশারীটা দেখা গেল ।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। কেউ জেগে আছে বলে মনে হল না।
জানালার কার্নিসের উপর উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। কোমর থেকে আসোনিক্স বক্স বের করে জানালার শিকের নিচে স্থাপন করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই শিকটা গলে গেল। আরও একটা শিক কাটুল সে। তারপর শিক দুটো উপরের দিকে বাঁকিয়ে বাক্সটা কোমরের সাথে অ্যাডজাস্ট করে মেঝের উপর গিয়ে দাঁড়াল।
চারদিকে তাকাল কুয়াশা একবার। তারপর, মশারীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে ধীরে ধীরে। স্নান নীল আলোয় নাইলনের মশারীর ভিতর দিয়ে দেখা গেল সায়া ও ব্লাউজ পরে এক যুবতী ঘুমোচ্ছে। স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী তরুণী। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে বুকটা ওঠা-নামা করছে। বড় বড় চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আছে। কয়েক গুচ্ছ কোঁকড়া চুল প্রশান্ত কপাল ছুঁয়ে গালের উপর এসে পড়েছে। সে এগিয়ে গেল কোণের ক্লজিটটার দিকে। ঘড়ি দেখল একবার। আল্টাসোনিক্স বাক্সটা কোমর থেকে খুলে অন করে ক্লজিটটার চাবির গর্তে চারদিকে ঘোরাতে লাগল। ধীরে ধীরে জিটের গায়ে একটা ফোকর সৃষ্টি হল। বাক্সটা কোমরে আটকে ক্লজিটের গায়ে সৃষ্ট ফোকরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পাল্লাটা খুলে ফেলল। ১০৮
ভলিউম-৯
দশ মিনিট ধরে ক্লোজেটের মধ্যে আতিপাতি করে উদ্দিষ্ট বস্তু খুঁজল কুশায়া।, কোথাও নেই সেই নোট-বইটা যেটা ড. রাজী দুপুরে রিসার্চ সেন্টার থেকে ফিরে এসেই তার মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন।
ক্লজিটের মধ্যে নেই।
টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা বইগুলো দ্রুত উল্টিয়ে গেল। সেখানেও নেই। বইয়ের র্যাকের দিকে এগোেল সে। র্যাকে অসংখ্য বই। অত বই এক পৃষ্ঠা করে উল্টে দেখতে সারারাত লাগবে। আর বেশিক্ষণ দেরি করলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। ড, রাজী বা তার মেয়ের হাতে নয়। পুলিসের হাতেও নয়। সেই লোকটার হাতে। সে-ও তো একই বস্তুর খোঁজ করছে।
চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কুয়াশা। খাটের নিচেও দেখল। একেবারে শূন্য। বাথরূমটা ঘুরে এল,। নেই, কোথাও নেই তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। তাহলে তার অভিযান কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? সেই লোকটা কি আগেই নিয়ে গেছে?
রূমের এক কোণে পুরানো খবরের কাগজ জড় করা ছিল। সেদিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা। কাগজগুলো দেখল উল্টেপাল্টে। না, সেখানেও নেই। কয়েকটা পুরানো মলাটহীন ইংরেজি সাময়িকী চোখে পড়ল। একটার পাতা উল্টিয়ে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেখল। আরেকটা সাময়িকী খুলতেই ছোট কয়েক টুকরো টাইপ করা কাগজ মেঝেতে পড়ে গেল। কাগজগুলো চোখের সামনে তুলে ধরতেই কুয়াশার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাদবাকি সাময়িকীগুলোর ভিতরেও কয়েক টুকরো করে টাইপকরা কাগজ পাওয়া গেল।
নম্বর দেখে পাতা মিলিয়ে কাগজের টুকরোগুলো সে পকেটে ফেলল। একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
ঠিক দুই মিনিট পরে সে পাচিলের কাছে পৌঁছুল। বৃষ্টি এখন কমেছে। পথে বাতি জ্বলছে। অন্ধকারটা এখন ফিকে। কিন্তু হাওয়ার গতি কমেনি।
চাপা স্বরে কুয়াশা ডাকল কলিম।’
কোন জবাব এল না। কুয়াশার ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই। আঘাতও নেমে এল সেই মুহূর্তেই। প্রচণ্ড একটা ঘুসি এসে লাগল তার চোয়ালে। আকস্মিকতা ও প্রচণ্ডতার জন্যে কুয়াশা সে ধাক্কা সইতে পারল না। কাত হয়ে পড়ে গেল দেয়ালের উপর। ইটের উপর গিয়ে পড়ল মাথাটা । দ্বিতীয় দফা আঘাত নেমে আসছে। কোনদিক থেকে আসবে তা ঠাহর করার আগেই আঘাতকারী তার চিবুক লক্ষ্য করে লাথি ছুঁড়ল । কিন্তু কুয়াশা যে-কোন দিক থেকে আঘাত আশা করছিল এবং তা মোকাবেলা করার জন্যে তখন সে প্রস্তুত ছিল। পাটা উঠে আসতেই সে হামলাকারীর পা’টা সামনের দিকে সামান্য টান দিয়ে গড়িয়ে সরে গেল। চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল আক্রমণকারী। কুয়াশা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে লোকটার মুখ দেখা গেল না। কেবল একটা ছায়ার মত দেখা গেল লোকটাকে। লোকটার উঠবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল কুয়াশা। কিন্তু সে উঠল না দেখে কুয়াশা-২৬
১০৯
সে আরও সতর্ক হয়ে গেল। লোকটা নিশ্চয়ই কোন আগ্নেয়াস্ত্র বের করছে। সে সুযোগ তাকে দেওয়া চলবে না।
লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। শূন্যে পা তুলে দিয়ে কুয়াশাকে লক্ষ্য করে একটা লাথি হাকাল। কাত হয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা এবং লোকটার জুতো ধরে পা’টা গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে মুচড়ে দিল। আশ্চর্য, লোকটা একটু শব্দও করল না। যেন সমস্তটা ব্যাপারই সে
সহজভাবে নিচ্ছে। যেন সে কুয়াশাকে নিয়ে খেলাচ্ছে।
লোকটা উঠবার চেষ্টা করছে না কেন? অথচ কুয়াশা জানে, ওর উপর এভাবে হামলা করতে গেলে লাভ হবে না। বরং সে উঠে দাঁড়ালেই কাবু করা সহজ হত। কিভাবে লোকটাকে কায়দায় ফেলবে চিন্তা করতে লাগল সে। হঠাৎ সে শব্দ শুনে টের পেল, লোকটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। এই তো সুযোগ। একটু পাশ কাটিয়ে কুয়াশা ডান পাটা লোকটার চোয়ালের দিকে চালান করে দিল। লোকটা বোধহয় এই, আঘাত আশা করেনি। সে একটু কাত হতেই দ্বিতীয় দফা লাথি চালাল কুয়াশা। আবার চিত হয়ে পড়ে গেল লোকটা। কুয়াশা ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার পেটের উপর দু’হাঁটু একত্র করে।
‘কোক করে একটা শব্দ হল। দুহাতে লোকটার টুটি চেপে ধরতে যেতেই লোকটা চাপা কণ্ঠে চীৎকার করে উঠল, ‘পেদ্রো।’
চমকে উঠল কুয়াশা। সর্বনাশ, দৈত্যটাকে ডাকছে নিশ্চয়ই লোকটা।
পাচিলের উপর থেকে কে যেন লাফ দিয়ে নামল। কুয়াশা অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল, যেন একটা পাহাড় নেমে আসছে তার দিকে নিষ্ঠুর নিয়তির মত। এখুনি এসে চেপে ধরবে। তাকে ধ্বংস করে দেবে। মৃত্যু এগিয়ে আসছে দ্রুত•••অতি
দ্রুত।
তবু টুটি চেপে ধরল কুয়াশা লোকটার। মৃত্যুর আগে সে-ও সর্বশক্তি প্রয়োেগ করবে। পড়ে পড়ে মার খেতে সে রাজী নয়।
ঝাঁপিয়ে পড়ল দানবটা কুয়াশার উপর। হিংস্র বাঘ যেন নিরীহ ভেড়ার উপর আক্রমণ চালাল। এক লাথিতেই কুয়াশা চিত হয়ে পড়ে গেল ঘাসের উপর । মুখোশধারী উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে।
টুটি চেপে ধর। শেষ করে দে।’
সাঁড়াশির মত দুটো হাত কুয়াশার কণ্ঠ চেপে ধরল। কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে কুয়াশার । আহ, মৃত্যু, আসছে। কুয়াশা মরতে চলেছে। ধীরে ধীরে কুয়াশার দেহ অবশ হয়ে আসছে। চেতনা লুপ্ত হয়ে আসছে।
কিন্তু ও কি? ফট করে যেন পটকা ছুঁড়ল না? হ্যাঁ…পটকার আওয়াজ আসছে।
•••কে যেন তাকে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। কে? আহ, স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি? চোখ খুলল কুয়াশা, চারদিকে অন্ধকার। কে যেন তাকে ডাকছে। ভাইয়া ১১০
ভলিউম-৯
ভাইয়া:•• |
‘কে? মহুয়া?’
ভাইয়া, উঠুন। এখনি লোকজন এসে পড়বে। তখন পালানো যাবে না, উঠুন।
‘কে?’ কুয়াশা প্রশ্ন করল। ‘আমি কলিম। উনি, ওরা পালিয়ে গেছে।’
ধড়মড় করে উঠে বসল কুয়াশা। তার পূর্ণ চেতনা ফিরে এসেছে। মুহূর্তেই তার সমস্ত ঘটনা মনে পড়ল। আর একদণ্ডও এখানে নয়। উঠে দাঁড়াল সে। সমস্ত শরীরে তীব্র বেদনা, কিন্তু উপায় কি? এখান থেকে পালাতে হবে।
কুয়াশা ডাক দিল, কলিম।
‘ওরা কোথায়?’
‘পালিয়েছে, আমি গুলি করেছিলাম। গুলি বোধহয় অন্ধকারে ওদের গায়ে লাগেনি।’
পকেটে হাত দিল কুয়াশা। আছে, সেই মূল্যবান কাগজগুলো আছে, নিতে পারেনি শয়তানটা। তার অভিযানকে ব্যর্থ করতে পারেনি সে। কিন্তু আন্ট্রাসোনিক্সের বাক্সটা নিয়ে গেছে।
তা যাক।
‘চল, পালাতে হবে এখুনি। কিন্তু খুব হুশিয়ার, ওরা হয়ত ধারে কাছেই আছে। আবার আঘাত হানতে পারে।’
হাঁটতে পারবেন? ‘পারতেই হবে। আমার যে অনেক কাজ।’
Leave a Reply