২৫. কঙ্কাল রহস্য ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৫
প্রথম প্রকাশঃ জুন ১৯৭০
এক
ঠিকানাটা জানা ছিল শহীদের। কলিংবেল টিপতেই একজন মধ্য বয়স্ক কাজের লোক দরজা খুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। মি. সিম্পসনকে দেখে বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে উঠল লোকটা, ইংরেজ দেখলে সচরাচর কোন কোন লোকের যা হয়ে থাকে। শহীদ কথা বলল প্রথম, তোমার সাহেব বাড়ি আছেন?’
| লোকটা শহীদের আপাদমস্তক দেখল। তারপর বেহায়ার মত বলে উঠল, আপনাদের নাম বলে দিন, সাহেবকে গিয়ে বুলি।’
মি. সিম্পসন পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, ‘তোমার সাহেবকে গিয়ে বল যে, পুলিস অফিসার মি, সিম্পসন আর প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খান এসেছেন।
কথাগুলো কানে ঢুকতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটা। দরজা খোেলা রেখেই মুহূর্তের মধ্যে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। মিনিটখানেকও কাটল না, তিনজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে, ওসমান গনি নেই। লোক তিনজন শহীদ ও মি. সিম্পসনকে কৌতূহলী চোখে দেখতে দেখতে চলে গেল বাড়ির বাইরে। তারপরই দরজায় এসে দাঁড়ালেন ওসমান গনি। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব। একটু বিচলিতও মনে হচ্ছে। শহীদকে দেখে তিনি হাসবার চেষ্টা করে বলে উঠলেন, ‘আরে, আপনি! আসুন, ড্রইংরুমে আসুন।’
দরজা টপকে ড্রইংরুমে গিয়ে বসল ওরা সকলে। শহীদ ওসমান গনিকে নিরীক্ষণ করছে মনোযোগ দিয়ে। মি. সিম্পসন চোখ ঘুরিয়ে দেখছেন বসবার ঘরটা। ওসমান গনি ওদের দু’জনের দিকে তাকাচ্ছেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। শহীদ পরিষ্কার বুঝতে পারল, তাদেরকে দেখে ওসমান গনি বিচলিত বোধ করছেন।
ওসমান গনি প্রশ্ন করলেন, তা, ব্যাপার কি বলুন দেখি?
শহীদ মি. সিম্পসনকে দেখিয়ে বলল, ‘পরিচয়টা করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিস অফিসার-মি. সিম্পসন। আপনার পরিচয় ওঁর আগে থেকেই জানা।
করমর্দন করলেন দুজন। মি. সিম্পসন’বললেন, ‘আমি পুলিস হলেও বর্তমান কেসটার কিনারা করার প্রধান দায়িত্ব শহীদের। আমি সহকারী হিসেবে কাজ কুয়াশা-২৫
করছি, বলতে পারেন।’
ওসমান গনি কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন, “কিসের কেস?’ শহীদ উত্তর দিল, ‘মিস সুরাইয়া বেগম হত্যাকাণ্ডের কেস, মি. গনি।
ওসমান গনি ভুরু কুঁচকে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, মিস সুরাইয়া! কোন মিস সুরাইয়া?’।
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে ওসমান গনির দিকে চেয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ক’জন মিস সুরাইয়াকে আপনি চেনেন, মি. গনি?’
ক’জন সুরাইয়াকে চিনি, মানে! আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, মি. শহীদ। বিখ্যাত অভিনেত্রী মিস সুরাইয়াকে অবশ্যই আমি চিনি। কিন্তু আপনারা নিশ্চয় তার কথা বলছেন না?
| শহীদ ধীর কণ্ঠে জানাল, হ্যাঁ, তার কথাই বলছি আমরা। অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগমের লাশ পাওয়া গেছে একটু আগে। তার চাকর-বাকরও সকলে নিহত।’
‘হোয়াট!’
সোফা ছেড়ে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন ওসমান গনি। অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে উঠল তার দুই চোখ। কাঁপছেন তিনি উত্তেজনায়। শহীদ তীব্র চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উঠল, এমন অস্বাভাবিক রকম উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কেন আপনি?’
মি. সিম্পসনও সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন ওসমান গনির দিকে। ওসমান গনি প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, বলছেন কি, মি. শহীদ! উত্তেজিত হব না আমি! জানেন, সুরাইয়া আমাদের চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে দামি তারকা? জানেন, ওর ওপর নির্ভর করত আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের উত্তরণ? জানেন, ও না থাকলে কতজন প্রযোজকের সর্বনাশ ঘটবে? কত ছবি বন্ধ হয়ে যাবে?’
শহীদ প্রশ্ন করল সাথে সাথে, আপনার কোন ছবিতে মিস সুরাইয়া চুক্তিবদ্ধ ছিলেন কি?’
নিশ্চয় । দুটো ছবিতে অভিনয় করছিল ও। আরও একটার জন্যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। তিনটে ছবির জন্যে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা অ্যাডভান্স করেছি। আমি!
থরথর করে কাঁপছেন ওসমান গনি। শহীদ বলল, ‘আচ্ছা, মিস সুরাইয়া নামে আর কাউকে কি চিনতেন আপনি?
না। হঠাৎ এ প্রশ্ন?” না, এমনি। আচ্ছা, মিস সুরাইয়ার কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?
না। খুনি কে, তা জানা যায়নি এখনও?’। | না, জানা যায়নি। আচ্ছা, মিস সুরাইয়ার বাড়ি ছিল হুগলীতে, তাই না?
ভলিউম-৯
| ওসমান গনি আবার বসলেন। হতাশায় মুষড়ে পড়েছেন যেন তিনি। বললেন, হা।’
শহীদ জানতে চাইল, মিস সুরাইয়ার আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় কে কে আছেন? বাবা-মা কোথায় ওর?’
| জানি না। সুরাইয়ার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই বলেই জানতাম। বাবা-মার কথা নাকি মনে পড়ত না সুরাইয়ার। কোলকাতার কোন এক মিশনারীদের আশ্রম থেকে রহমান বলে এক যুবক ওকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এখানে ধর্ম বদলে মুসলমান হয় ও। ওর পরিচয় সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানা নেই আমার।’
হঠাৎ শহীদ জিজ্ঞেস করে উঠল, “আচ্ছা, সোলায়মান চৌধুরী নামে চিত্র প্রযোজক কেউ আছেন নাকি ঢাকায়?’
কই, না তো!’
হুগলী জেলায় বাড়ি ছিল এমন কোন ভদ্রলোক চিত্র-প্রযোজনায় হাত দিয়েছেন কিনা জানা আছে আপনার?
না, জানা নেই।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, এরফান মল্লিক আপনার এবং মি. সারওয়ারের বেশ কিছু টাকা মেরে দিয়েছিলেন। এরফান মল্লিক জমিদার সোলায়মান চৌধুরীর নায়েব ছিলেন, তা আপনাদের জানা ছিল?’
, আমাদের সাথে এরফান মল্লিকের পরিচয় হয় কোলকাতায়। শহীদ হঠাৎ জানতে চাইল, এরফান মল্লিকের সন্ধান পেয়েছেন আপনারা?” | প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন ওসমান গনি। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল শহীদের দৃষ্টি। খানিক ইতস্তত করে উত্তর দিলেন ওসমান গনি, তার “ আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি।’
হঠাৎ আশা ছেড়ে দেবার কারণ কি, মি. গনি?’ কারণ! কারণ আবার কি? ঢাকায় সে নেই বলে মনে হওয়াতে•••।’ ঘাবড়ে গিয়ে অজুহাত দেখালেন ওসমান গনি। শহীদ কথার মোড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, মিস সুরাইয়ার কোন ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর নাম বলতে পারেন?
‘ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কেউ ছিল বলে মনে হয় না। সুরাইয়া মেলামেশা তেমন পছন্দ করত না। একমাত্র রহমান ছাড়া আর কারও সঙ্গে ওকে ঘুরে বেড়াতে দেখিনি।’
শহীদ বলল, রহমানের পুরো নাম কি? দেখতে কেমন? মিস সুরাইয়ার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক কি ধরনের ছিল, জানেন?
‘আবদুর রহমান ওর নাম। সুদর্শন যুবক। কোলকাতা ভার্সিটির এম. এ. ক্লাসের ছাত্র ছিল। সুরাইয়াকে ভালবাসে। ওর সাথেই সুরাইয়া মিশনারীদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসে। সুরাইয়াও ওকে ভালবাসত মনেপ্রাণে! ওদের
কুয়াশা-২৫
বিয়ে হবার কথা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। একই সাথে মানে একই বাড়িতে থাকত ওরা। তবে গত মাস ছয়েক হল সুরাইয়ার কাছ থেকে সরে গিয়ে গোপীবাগ এলাকায় বসবাস করছে। কারণটা কি জানা নেই। ওদের মধ্যে কোন ঝগড়াঝাটি হয়েছিল কিনা বলতে পারব না। রহমান চাকরি-বাকরি করে না, সম্ভবত সুরাইয়ার টাকাতেই দিন চলত ওর। কিন্তু সুরাইয়ার ব্যবহার গত ছ’মাস থেকে কেমন যেন।’
বলে যান।’ | ওসমান গনি খানিক ভেবে নিয়ে বললেন, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়, বুঝলেন মি. শহীদ। গত মাস ছয়েক থেকে সুরাইয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক রকম পরিবর্তন লক্ষ্য করে আসছিলাম আমি। স্টুডিও আর বাড়ি ছাড়া কোথাও ঘোরাফেরা করা একদম ছেড়ে দিয়েছিল ও। শূটিং-এর সময় লক্ষ্য করেছি, কেমন যেন অন্যমনস্কতা দেখা দিয়েছিল ওর মধ্যে। মাঝে মাঝে ও খুব গম্ভীর হয়ে যেত। কি যেন ভাবত একমনে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেত। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা সম্পর্কে আমরা সকলেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সুরাইয়া প্রতি সপ্তাহের সোমবারে বাড়ি থেকে বের হত। বের হত, সোমবারে, কিন্তু ফিরত সোমবার কাটিয়ে মঙ্গলবার কাটিয়ে বুধবার সকালের দিকে। সোমবার আর মঙ্গলবার শূটিং-এ থাকত না ও। ফলে ভয়ানক অসুবিধে হচ্ছিল আমাদের।’
| আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ ও মি. সিম্পসন। শহীদ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কোথায় যেত মিস সুরাইয়া?’
ওসমান গনি মাথা নেড়ে বললেন, তা কখনও বলতে চায়নি সুরাইয়া। জিজ্ঞেস করলে রেগে যেত ও। তবে ঢাকায় ও থাকত না। লঞ্চ বা ট্রেনে কেউ কেউ চড়তে দেখেছে ওকে। মোট কথা সবটা ব্যাপারই রহস্যময়।’
শহীদ চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করল, মিস সুরাইয়া একা যেত, না কেউ থাকত সাথে?’
‘একা যেত বলেই শুনেছি।’
মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, মিস সুরাইয়ার প্রেমিক, মানে আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেননি আপনারা এ ব্যাপারে?’
| ‘সে-ও কিছু জানে না। গত ছ’মাস ধরে তাকে সুরাইয়ার সাথে বেশি দেখা যেত না।’
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল শহীদ। তারপর হঠাৎ ও জানতে চাইল, “আচ্ছা মি. গনি, আমরা, আপনার দরজায় যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন কয়েকজন
ভদ্রলোককে চলে যেতে দেখলাম। ওরা কারা?’
মি. গনি স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দিলেন, কেন, ওরা আমার কর্মচারী । চিত্র নাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক।’
ভলিউম-৯
‘আচ্ছা, আপনি মিস সুরাইয়াকে মোট কত টাকা অ্যাডভান্স করেছিলেন তিনটে ছবির জন্যে?
‘প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।’ ‘সে টাকা আপনি ফেরত পাবার আশা রাখেন?
মি.গনি একটু ভেবেচিন্তে বললেন, ‘মিস সুরাইয়া সম্পর্কে উকিলের সাথে আলোচনা করব আমি। ব্যাঙ্কে ওর নিশ্চয় টাকা আছে। আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকারি বৈকি আমি!
শহীদ জানতে চাইল, ‘কোন্ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে মিস সুরাইয়ার?’ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাঙ্কে।’
মি. গনির কথা শেষ হবার সাথে সাথে মি. সিম্পসন উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে। গেলেন তার দিকে। ঠিক মি. গনির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কখনও লণ্ডনে গিয়েছিলেন, মি. গনি?’
ওসমান গনি মি. সিম্পসনের হাবভাব দেখে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। অস্বস্তি সহকারে উত্তর দিলেন তিনি, গিয়েছিলাম। কেন?’
কবে, কি কারণে লণ্ডনে গিয়েছিলেন জানতে পারি কি? কতদিন ছিলেন লণ্ডনে?’
মি. মিস্পসনের গলার গম্ভীর স্বর শুনে পাংশু হয়ে গেল ওসমান গনির মুখাবয়ব। মি. সিম্পসন ঝুঁকে পড়ে ভদ্রলোকের মুখটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে মশগুল হয়ে পড়েছেন। ওসমান গনি অপ্রতিভ বোধ করলেন। বললেন, পড়াশোনার জন্যে গিয়েছিলাম, প্রায় বছর পনের আগে। তিন বছর ছিলাম সে সময়। তারপর গত বছর গিয়েছিলাম ফিল্ম-ফেস্টিভ্যালে। কিন্তু এসব প্রশ্নের সাথে সুরাইয়া হত্যার সম্পর্ক কি, মি. সিম্পসন?
মি. সিম্পসন সে কথার উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসলেন, কিছু। মনে করবেন না, মি. গনি। আপনার দু’কানের পাশে এবং কপালে মোট তিনটে লম্বা দাগ দেখতে পাচ্ছি–কিভাবে হল দাগগুলো?
বড় বড় হয়ে গেল ওসমান গনির চোখ জোড়া। লাল মত হয়ে উঠল মূর্খ। সেটা রাগে, না লজ্জায় বোঝা গেল না। একমুহূর্ত চুপ থেকে উত্তর দিলেন, ‘ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলাম আমি বছর পাঁচেক আগে। স্টিচ করতে হয়েছিল বলে দাগগুলো রয়ে গেছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘ও। আমি ভেবেছিলাম, পাস্টিক সার্জারী করিয়েছিলেন।’
মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকালেন। শহীদ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, আজ চলি, মি: গনি। একটা কথা, মিস সুরাইয়ার হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার করতে হলে আপনাদের সাহায্য দরকার । আপনি…।’
কুয়াশা-২৫
ওসমান গনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘সেকি কথা! নিশ্চয় সাহায্য করব।’ শহীদ বলল, ‘ধন্যবাদ।’
ধানমণ্ডিতে মি. সারওয়ারের বাড়ি। মাঝারি আকারের নতুন দোতলা বাড়ি। কলিংবেল টিপতে স্বয়ং মি. সারওয়ার দরজায় এসে দাঁড়ালেন। কৌতূহলী, প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তাঁর চোখে। শহীদকে দেখে অপ্রতিভ বোধ করলেন যেন। সম্ভবত ভয় ভয় ভাবও ফুটল সারা মুখে। নীরস স্বরে বলে উঠলেন, মি. শহীদ যে!
শহীদ মি. সিম্পসনের পরিচয় দিল। তারপর মি. সিম্পসনকে বলল, এর পরিচয় আপনি তো আগে থেকেই জানেন। এরফান মল্লিকের সন্ধানকারীদের মধ্যে ইনিও একজন।’
. মি. সারওয়ারের মুখের চেহারা পাংশু হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। অস্থির দৃষ্টিতে শহীদের দিকে ফিরে তিনি বলে উঠলেন, ‘ব্যাপার কি, এরফান মল্লিকের সন্ধান পাওয়া গেছে নাকি?’
শহীদ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে। মি. সারওয়ার তাড়াতাড়ি পথ করে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন যে! আসুন, বসবেন আসুন।’
ড্রইংরূমে গিয়ে আরাম কেদারায় বসল ওরা তিনজন। মি. সারওয়ার বললেন, চা, না কফি?
শহীদ ছোট্ট করে উত্তর দিল, “কিছুই না। আমরা মিস সুরাইয়া বেগম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে এসেছি, মি. সারওয়ার।’
কি বললেন!
মি. সিম্পসন একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে শহীদের পরিবর্তে নিজেই বললেন, ‘অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া খুন হয়েছে। আপনি জানেন না?’
মুহূর্তের জন্যে ফ্যালফ্যাল করে বোকার মত তাকিয়ে রইলেন মি. সারওয়ার ওদের দিকে। তারপর আর্তনাদ করে উঠলেন, “অসম্ভব! এ আপনারা কি বাজে কথা বলছেন!’
বাজে কথা নয়, কাজের কথা।’
শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠল। যোগ করে বলল আবার, আপনি এমন ভয় পেয়ে গেলেন কেন, মি. সারওয়ার?’
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মি. সারওয়ার ওদের দিকে। মুখ ফুটে কথা বের হচ্ছে না তাঁর। শহীদ হঠাৎ বলে উঠল, ‘মিস সুরাইয়ার হত্যাকারিকে গ্রেফতার করতে আমরা বদ্ধপরিকর, মি. সারওয়ার। আমাদের সন্দেহের তালিকায় মিস সুরাইয়ার পরিচিত সব ব্যক্তিকেই ঠাই দিতে হচ্ছে। তাই আপনিও আমাদের সন্দেহের বাইরে নন। আমাদের সবগুলো প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য উত্তর দিলেই কেবল সন্তুষ্ট হব আমরা।’
১০
ভলিউম-৯
মি. সারওয়ারের চোখে-মুখে ফুটে উঠল পরিষ্কার আতঙ্কের ছাপ। কিন্তু নতুন কোন তথ্য আদায় করা গেল না তার কাছ থেকে। মি. ওসমান গনি যা যা বলেছেন, ইনিও হুবহু তাই বলে গেলেন শহীদের জেরার মুখে পড়ে। শহীদের কিন্তু দৃঢ় ধারণা হল, মি. সারওয়ার সত্য কথা লুকোচ্ছেন। কিন্তু স্বীকার করলেন না
মি. সারওয়ার শহীদের অভিযোগ। | মিস সুরাইয়া বেগমের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে ব্যাঙ্কে ফোন করল শহীদ মি. সারওয়ারের ড্রইংরূম থেকেই। অদ্ভুত একটা খবর পাওয়া গেল । মিস সুরাইয়া সব টাকা দু’দিন আগে তুলে নিয়েছে। মোট বার লাখ টাকা। হ্যাঁ, মিস সুরাইয়া নিজে এসেই নিয়ে গেছে টাকা।
চমকে উঠল শহীদ খবরটা শুনে। অত টাকা কেন তুলেছিল মিস সুরাইয়া? প্রশ্নটা ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগল ওকে সারাক্ষণ।
মি. সারওয়ারকে ঢাকা ছেড়ে না যাবার অনুরোধ জানিয়ে চিত্র-প্রযোজক আখতার চৌধুরীর বাড়ির দিকে চলল ওরা। ঘড়িতে তখন বেলা বারটা।
মি. আখতার চৌধুরীর বাড়িতে ওরা আগেও একবার এসেছে। কঙ্কাল-রহস্য উপলক্ষ্যে।
জীপটা দাঁড়াতেই নেমে পড়ল শহীদ। এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে নামলেন মি. সিম্পসন। গেটের দিকে পা বোিয়ছে শহীদ। এমন সময় পরিচিত একটা কণ্ঠ
থেকে চিৎকার হল, শহীদ•••!’।
ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। দাঁড়িয়ে পড়েছেন মি. সিম্পসনও।
কামালকে হনহন করে ছুটে আসতে দেখা যাচ্ছে ওদের দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শহীদ। কামাল কোথা থেকে আসছে? কোথায় ছিল ও?
সামনে এসে দাঁড়াল কামাল। শহীদ বলল, কিরে, তুই কোথা থেকে? এদিকে কি মহাসর্বনাশ ঘটে গেছে তা জানিস?’
কামালকে গম্ভীর দেখাচ্ছে। গম্ভীরভাবেই বলল ও, আমার এক বন্ধুর বাড়ির জানালার ধারে বসে আখতার চৌধুরীর বাড়ির ওপর নজর রাখছি আমি ভোরবেলা থেকে।’
মি. সিম্পসন আগ্রহসহকারে জানতে চাইলেন, ‘কেন?’
কামাল চিন্তিত ভাবে বলল, ‘ভদ্রলোক সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছেন আমার মনে। সেদিন প্রথমে হলফ করে বললেন যে, কঙ্কাল তার বাড়িতে আসেনি, পরে আবার স্বীকার করলেন কথাটা। এর কারণ কি? নিশ্চয় রহস্যময় কোন কারণ আছে। আমার বিশ্বাস, কঙ্কাল-রহস্যের হোতা এই আখতার চৌধুরী। তাই ভদ্রলোককে চোখে-চোখে রাখছি।’
মি, সিম্পসন বললেন, কিন্তু তোমার কোন বন্ধুর বাড়ি থেকে আখতার চৌধুরীর ওপর নজর রেখেছ? কাছাকাছি তো কোন বাড়ি দেখা যাচ্ছে না!’
কুয়াশা-২৫
কামাল দূরবর্তী একটা বাড়ি দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওই তো বাড়িটা। বিনকিউলার সাথে আছে আমার।’
শহীদ বলল, তা বেশ। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখলি?”
কামাল বলল, না, তবে, আখতার চৌধুরীর নিশ্চয় ডিসেন্ট্রি হয়েছে। পাঁচবার ল্যাট্রিনে যেতে দেখেছি সাত ঘন্টায়।’
শহীদ বলল, “বিখ্যাত অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগমের নাম শুনেছিস তো? চাকর-বাকরসহ সে নিহত হয়েছে।’
বলিস কি!’
আঁতকে উঠল কামাল। শহীদ সংক্ষেপে সব কথা বলল ওকে। কামাল মন্তব্য করল, ‘মিস সুরাইয়ার বাবাকে সোলায়মান চৌধুরী বলে সন্দেহ করছিস, তাহলে তুই?’
শহীদ বলল, সন্দেহ নয়, সেটাই আমার বিশ্বাস।’ | মি. সিম্পসন বললেন, ‘শয়তানটাকে ধরতেই হবে। সেই-ই হত্যা করেছে•••।’
কামাল বলল, ‘সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে যদি মূতা মিস সুরাইয়া হয় তাহলে খুনী কে? নিশ্চয় বাবা মেয়েকে খুন করতে পারে না।’ | শহীদ বলল, তা কে বলছে?’ বললাম, সুরাইয়া বেগম একজন নয়, দু’জন। আমার বিশ্বাস, অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম নিহত হয়েছে বলে মনে হলেও আসলে তা হয়নি। নিহত হয়েছে দু’নম্বর সুরাইয়া বেগম।
কে সেই হতভাগিনী দু’মম্বর সুরাইয়া বেগম?’ শহীদ বলল, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।’ | মি. সিম্পসন বললেন, আমি অফিসে ফিরেই সন্ধান নেব, কোন যুবতীর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কিত ডায়েরী কোন থানায় করা হয়েছে কিনা।’
শহীদ বলল, “আয় কামাল, আখতার চৌধুরীর সাথে কথা-বার্তা শেষ করে ফেলি।’
চল।’
গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল ওরা। সামনের রূমের দরজা বন্ধ। ওটাই ড্রইংরূম। কলিংবেল টিপল কামাল। প্রায় সাথে সাথেই একজন মধ্যবয়স্ক কাজের লোক দরজা খুলে দিল।
সাহেব আছেন বাসায়?’ শহীদ জিজ্ঞেস করল । লোকটা মাথা নেড়ে বলল, না।’
কামালের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল শহীদ। কামাল চারটার দিকে অগ্নি চক্ষু মেলে ধমকে উঠল, এই ব্যাটা, মিথ্যে কথা বলছিস, তোর সাহেব বাড়িতে নেই?’
ভলিউম-৯
চাকরটা থতমত খেয়ে মুখ খুলল, আছেন স্যার, মানে পায়খানায় গেছেন।
কামাল শহীদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। চাকরটাকে মি, সিম্পসন বললেন, ঠিক আছে আমরা বসব।’
দরজা থেকে সরে গেল লোকটা। ওরা সকলে গিয়ে বসল ড্রইংরূমে। চাকরটা দ্রুত পালিয়ে গেল অন্দরের দিকে।
চুপচাপ বসে রইল ওরা। কারও মুখে কোন কথা নেই। গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল শহীদ। হঠাৎ পদশব্দ শুনে মগ্নতা দূর হয়ে গেল ওর। আখতার চৌধুরী রূমে পা রেখেই উজ্জ্বল হাসিতে বলে উঠলেন, “কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য আমার!’
শহীদ অস্বাভাবিক গম্ভীরস্বরে বলে উঠল, “সৌভাগ্য কোথায় দেখলেন, মি, চৌধুরী? আমরা দুর্ভাগ্যের প্রতিমূর্তি হয়ে এসেছি আজ আপনার সাথে কথা বলতে।’
| পলকের জন্যে নড়ে উঠল আখতার চৌধুরীর চোখের পাপড়ি জোড়া। পরক্ষণেই নির্ভেজাল কৌতূহল ফুটে উঠল তার দুই চোখে। একটা সোফায় বসে পড়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি নির্বিরোধী মানুষ, দুর্ভাগ্যের শিকার কোন দিন হব বলে বিশ্বাস হয় না আমার।’ | শহীদ উত্তর দিল, ‘নিরীহ এবং নির্বিরোধী মানুষরাই দুনিয়ায় চিরকাল দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয়ে থাকে।
চমৎকার! কথার পিঠে কথা সাজাবার এমন বিচক্ষণতা বড় একটা দেখা যায় না, মি. শহীদ। তা দুর্ভাগ্য হোক বা সৌভাগ্য হোক, ব্যাপারটা কী, বলুন তো?
শহীদ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আখতার চৌধুরীর দিকে। কামাল ও মি. সিম্পসনের চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। চেয়ে আছে ওরা আখতার চৌধুরীর দিকে। আখতার চৌধুরীর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও নেই। হাসিতে উজ্জ্বল তার মুখ। শহীদ বলল, ‘অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম কি আপনার কোন ছবিতে চুক্তিবদ্ধ?
নিশ্চয়। কেন বলুন তো?’
প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইলেন আখতার চৌধুরী। শহীদ প্রশ্ন করল, ক’টা ছবির জন্যে চুক্তি হয়েছে? অ্যাডভান্স করেছেন কত টাকা?
‘আমার আগামী চারটে ছবিরই নায়িকা সুরাইয়া। লাখ তিনেক টাকা অ্যাডভান্স করেছি সম্ভবত । সঠিক হিসেব খাতাপত্র না দেখে দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এসব কথা কেন জানতে চাইছেন, তা তো বুঝলাম না?
শহীদ হঠাৎ জানতে চাইল, সুরাইয়া নামে আর কোন যুবতাঁকে আপনি চেনেন, মি. চৌধুরী?
একটু যেন চমকে উঠলেন আখতার চৌধুরী। কিন্তু উত্তর দিলেন শান্ত, স্বাভাবিক কণ্ঠেই, না, চিনি বলে মনে হয় না।’ কুয়াশা-২৫
দিকে। কয়েক মুহূর্ত
ঝাঁকাল, ভুলই নয়। চাক্ষুষ নে তো?”
সুরাইয়ার”
শহীদ বলে উঠল, ঘন্টা দুয়েক আগে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম এবং তার চাকর-বাকর আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে
, লাশটা মিসূ সুরাইয়ার কিনা। কেননা, খুনী যুবতীর মুখ ক্ষত-বিক্ষত করে রেখে গেছে। চেনবার কোন উপায় নেই।’
আখতার চৌধুরী বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলেন শহীদের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর বলে উঠলেন, আমার সাথে ঠাট্টা করছেন না তো?’
মি. সিম্পসন বললেন, ঠাট্টা নয়। চাক্ষুষ দেখে আসছি আমরা।’
শহীদ মাথা ঝাঁকাল, ‘খুনীকে গ্রেফতার করার জন্যে চিত্র-জগতের, অর্থাৎ মিস সুরাইয়ার পরিচিত সকলের সহযোগিতা কাম্য আমাদের। সকলকেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব।’
আখতার চৌধুরী বলে উঠলেন, যথাসাধ্য সহযোগিতা পাবেন, মি, শহীদ, আমার কাছ থেকে। কিন্তু এখনও যে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি! সুরাইয়া, সুরাইয়া নেই। কিন্তু ওর কোন শত্রু ছিল বলে তো মনে হয় না আমার! কে করল এমন নিষ্ঠুর কাজ!’
শহীদ প্রশ্ন করল, আমরা জানতে চাই, মিস সুরাইয়ার বাবা-মা বা আত্মীয় স্বজন কে কোথায় আছেন। এ সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?’
সুরাইয়ার বাবা-মা? সুরাইয়ার বাবা-মা বেঁচে আছেন বলে মনে হয় না। ও বলত, বাবা-মার কথা মনে পড়ে না কখনও। আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে কিনা বলতে পারছি না। একমাত্র ঘনিষ্ঠতা ছিল ওর আবদুর রহমানের সাথে। রহমানই ওকে ঢাকা আনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সুরাইয়া পশ্চিমবঙ্গের কোন একদল মিশনারীর সাথে ছিল। রহমান ওকে সঙ্গে করে ঢাকায় আনে। এর বেশি আমার কিছু জানা নেই।’
সুরাইয়ার কোন শত্রু নেই বললেন। কিন্তু গত ছ’মাসে ওর আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছেন কি কখনও?’
‘অস্বাভাবিকতা? তা হা, কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হত বটে বেশ কিছুদিন থেকে। প্রতি সোমবার কোথায় যেন যেত ও। কোথায় যেত, ঠিক তা জানি না। বুধবার সকালে ফিরত সচরাচর। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত। উত্তর দিত না। অনেক চেষ্টা করেও কারণটা জানতে পারিনি আমি। তবে রহমানের সাথে কিছুদিন থেকে বনিবনা হচ্ছিল না ওর। ঝগড়া-ঝাটিও হত আজকাল।’
শহীদ স্পষ্ট প্রশ্ন করল, রহমানকে সন্দেহ করা চলে কি?’
গভীরভাবে চিন্তা করলেন আখতার চৌধুরী। তারপর বললেন, সন্দেহ করা চলে কি চলে না, বলতে পারব না। রহমান আগে সুরাইয়ার সাথেই বসবাস করত। বেশ কিছুদিন হল গোপীবাগে চলে গেছে সে। সুরাইয়া ওর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ খুব কমিয়ে দিয়েছিল।’
ভলিউম-৯
১৪
কারণটা কি ছিল, জানেন নিশ্চয়?
সঠিক জানি না। তবে সুরাইয়ার খ্যাতি, অর্থ, মান-সম্মান ইত্যাদিই দায়ী হয়ত। রহমানের সাথে বিয়ের কথা হয়েছিল সুরাইয়ার, সে বহু আগে। তখন কিছুই ছিল না সুরাইয়ার। এখন ওর পাণিগ্রহণের জন্যে অনেক রথী-মহারথী আগ্রহী।’
শহীদ বলল, রহমানের ঠিকানাটা দিতে পারেন? নিশ্চয়।
আখতার চৌধুরী ঠিকানাটা লিখে শহীদের হাতে দিলেন। শহীদ সেটা পকেটে রেখে বলল, কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি, যদিও এই হত্যাকাণ্ডের কিনারা করার জন্যে সবরকম প্রশ্ন করতে বাধ্য আমরা। আশা করি কিছু মনে করবেন না। আপনার জন্মস্থান কোথায়? ঢাকায় আপনি কবে এসেছেন? বিদেশে কখনও গিয়েছিলেন? বিদেশ বলতে ইউরোপ বোঝাচ্ছি আমি।’
জন্ম লণ্ডনে। আমার মা-বাবা লণ্ডনে বসবাস করতেন। ওখানেই মানুষ আমি। ঢাকায় এসেছি গত বছর।
স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিলেন আখতার চৌধুরী। তারপর নিজেই একটা প্রশ্ন করলেন, সুরাইয়া বেগম নামে অন্য কোন যুবতাঁকে চিনি কিনা প্রশ্ন করেছিলেন আপনি। কারণ বলতে আপত্তি আছে কি?’ | শহীদ বলল, যুবতীর মৃতদেহের মুখটা চেনবার কোন উপায় নেই। অবশ্য মিস সুরাইয়ার বাড়িতেই যখন লাশ পাওয়া গেছে তখন স্বভাবতই ধারণা হয়, লাশটা তারই। কিন্তু অন্য কারও তো হতে পারে?
আখতার চৌধুরী বললেন, তা হতে পারে, অবশ্য এটা অতি-কল্পনা বলে মনে হয়। কিন্তু যদি হয়ও, তার নাম সুরাইয়া বেগম হতে যাবে কেন?
শহীদ বলল, অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগমের লাশ:যদি ওটা না হয়ে থাকে তাহলেও যে নিহত হয়েছে তার নাম সুরাইয়া বেগম হতে বাধ্য।’
“কেন?” ‘এই “কেন”-র উত্তর এখন দেয়া যাচ্ছে না বলে দুঃখিত, মি. চৌধুরী।
শহীদ কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল। দেখাদেখি সকলেই সোফা ছাড়লেন। শহীদ বলল, মি. চৌধুরী, আর একটা জরুরী বক্তব্য আছে আমাদের। সুরাইয়া হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। আপনার।’
আখতার চৌধুরী বললেন, তা আমি জানি। ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাব না আমি। কেননা, সুরাইয়ার হত্যাকারীকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই। দেখতে চাই আমি সেই পাষণ্ডকে।
শহীদ দরজার দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। কামালের সাথে কুয়াশা-২৫
চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। ইঙ্গিত করল শহীদ। ইঙ্গিতের ভাষা কামাল কি বুঝল কেবল সে-ই জানে। না দাঁড়িয়ে রূম থেকে বের হয়ে গেল সে। শহীদু আখতার চৌধুরীকে বলল, ‘মিস সুরাইয়া মোট ক’জন ভদ্রলোকের ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল? নাম-ঠিকানাগুলো দিতে পারেন?’
আমি বলছি, লিখে নিন আপনি!’
আখতার চৌধুরী নাম-ঠিকানা বলে যেতে লাগলেন। শহীদ লিখে বিদায় নিল। মিনিট দশেক সময় লাগল সবগুলো লেখা হতে। বিদায় নিয়ে বের হয়ে এল শহীদ ও মি. সিম্পসন।
আখতার চৌধুরী দরজা বন্ধ করে দিতেই মি. সিম্পসন কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় পাঠালে কামালকে, শহীদ?’ | বাড়ির বাইরে এসে পড়েছে ওরা তখন। কামাল বসে রয়েছে জীপের ভিতরে। শহীদ ও মি. সিম্পসন জীপে গিয়ে বসলেন। শহীদ কামালকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, কিছু দেখলি?’
কামাল নিরাশ গলায় জবাব দিল, না রে।’ মি. সিম্পসন কৌতূহল দমন করতে না পেরে বলে উঠলেন, ব্যাপারটা কি?’
শহীদ বলল, কামাল দেখেছিল আখতার চৌধুরীকে বারবার ল্যাট্রিনে যেতে। তাই সন্দেহ হয়েছিল আমার, কেননা আখতার চৌধুরীকে অসুস্থ বলে তো মনে হল
দেখে। তাহলে কেন অন্তত ছ’বার ল্যাট্রিনে গিয়েছিলেন উনি?’
শহীদকে চিন্তিত দেখাল। কামাল জীপ থেকে নেমে পড়ে বলল, “তোরা এখন কোথায় যাবি?’
শহীদ বলল, রহমানের সঙ্গে কথা বলা দরকার সবচেয়ে আগে। ওখানেই যাব।’
কামাল বলল, চল, আমিও যাব। আমার বন্ধুর ভেসপাটা নিয়ে আসি। তোরা একটু অপেক্ষা কর।’
দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল কামাল ওর বন্ধুর বাড়ির দিকে। খানিক পর দেখা গেল, কামাল মাঝ রাস্তা দিয়ে ভেসপা চালিয়ে বাতাস কেটে এগিয়ে আসছে তীর বেগে। জীপটা স্টার্ট দিলেন মি. সিম্পসন।
ধানমণ্ডি ছাড়িয়ে নিউমার্কেটের কাছে চলে এসেছিল জীপ। হঠাৎ একটা ছুটন্ত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা ভদ্রলোকের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল শহীদ। গাড়িটা ধানমণ্ডির দিকে চলে গেল দ্রুত। অবাক হয়ে পিছন ফিরে গাড়িটা দেখল শহীদ। মি. সিম্পসন মিররের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কামালকে দেখা যাচ্ছে
কেন? আমাদের পিছনেই তো ছিল একটু আগে! | শহীদ বলল, কামাল, ওসমান গনিকে অনুসরণ করার জন্যে ভেসপা ঘুরিয়ে নিয়েছে একটু আগে। ভদ্রলোক অদ্ভুত ছদ্মবেশে কোথায় যেন যাচ্ছেন।
ভলিউম-৯
১৬
লক্ষ্য করিনি তো আমি!
শহীদ বলল, “দোষ আপনার নয়। মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস পরার ফলে সহজে চেনার কথা নয়। আমার চোখে ধরা পড়ে গেছেন। কামালও ঠিক চিনেছে।’
ছদ্মবেশে কোথায় যাচ্ছেন ভদ্রলোক?
শহীদ কোন উত্তর দিল না। একটু পর বলল, ‘আমরা এদিকের কাজগুলো সেরে নিই, ওদিকে কি হয় কামাল দেখুক।’
গোপীবাগ। ফিফথ লেনে বাড়ি আবদুর রহমানের। ছোটখাটো একতলা বাড়ি। ঠিকানা মিলিয়ে জীপ থেকে বাড়িটার সামনে নামলেন মি, সিম্পসন। শহীদ আগে নেমেছে।
গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওরা দেখল, গেট বন্ধ ভিতর থেকে। কলিংবেল টিপলেন মি. সিম্পসন, কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কারও।
সময় বয়ে যাচ্ছে। বারবার কলিংবেল টিপলেন মি. সিম্পসন। কোন শব্দ নেই। বাড়ির ভিতরে।
অধৈর্য হয়ে উঠে শহীদ বলল, “গেট টপকে ভিতরে ঢুকতে হবে, মি. সিম্পসন। মনে হচ্ছে, বিপদ ঘটছে কোন।’ | বাড়ির পাঁচিল টপকে ভিতরে নামল ওরা। বারান্দায় উঠে এদিক-ওদিক তাকাল। একটা ঘরের দরজা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। কেউ নেই ভিতরে। মি. সিম্পসন ঠেলা দিলেন আর একটা ঘরের দরজায়। খুলে গেল সেটাও। ড্রইংরূম এটা। কিন্তু কেউ নেই। এগিয়ে চলল ওরা। কয়েকটা কামরা ছাড়িয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। মি. সিম্পসন ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন। শহীদ সামনের ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বলল, এটা ভিতর থেকে বন্ধ। ধাক্কা দিলাম, কিন্তু কোন সাড়া নেই। মনে হচ্ছে, ভাঙতে হবে। ফোন করা দরকার থানায়, শক্ত-সমর্থ লোক দরকার।’
চলে গেলেন মি. সিম্পসন ফোন করতে। বারান্দার উপর পায়চারি করে বেড়াতে শুরু করল শহীদ। চোখ তুলে এদিক-ওদিক দেখছে ও। আবদুর রহমানের ঘরের পর আরও দুটো ঘর দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর দরজা-জানালাও বন্ধ, তবে বাইরে থেকে। বাঁ দিকে বাথরূম। ঘরের ভিতর থেকেই বাথরুমে যাবার দরজা, অনুমান করল শহীদ।
মি. সিম্পসন দ্রুত ফিরে এলেন ফোন করে : শহীদকে জানালেন, পনের মিনিটের মধ্যে এসে পড়বে ওরা।
শহীদ উত্তর না দিয়ে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর শহীদ রহমানের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজাটার দিকে তাকিয়ে দেখল ২ কুয়াশা-২৫
১৭
ও। তারপর অধৈর্য স্বরে মি. সিম্পসনকে বলল, ‘চেষ্টা করে দেখলে হয়, দু’জনের ধাক্কায় ভেঙে যেতে পারে দরজাটা।’
পিছিয়ে এল শহীদ। মি. সিম্পসনও দাঁড়ালেন ওর পাশে। শহীদ মুখ খুলল, ‘এক•••দুই…তিন।’
দু’জন প্রচণ্ডবেগে দৌড়ে গিয়ে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল বন্ধ দরজার গায়ে। ভাঙল না তবু। কেবল শব্দ হল ভাঙার। শহীদ বলল, হবে, আর একটা ধাক্কা লাগবে।’
পিছিয়ে এসে আগের মত আবার দু’জন মিলে মারল ধাক্কা। কজা খুলে ফাঁক হয়ে গেল দরজার পাল্লা দুটো। ধীরে ধীরে ঢুকল শহীদ ঘরের ভিতর।
ঘরের মাঝখানে একটা খাট। খাটের উপর পাশ-ফেরা অবস্থায় পা গুটিয়ে শুয়ে আছে একজন যুবক। নিঃসাড় । নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত যুবকের গলা। দূর থেকে দেখে মনে হয়, কিছুই হয়নি, যুবক ঘুমাচ্ছে।
রক্তে একাকার হয়ে গেছে বিছানার চাদর। গলাটা দ্বিখণ্ডিত হয়েছে অনেক আগে। রক্ত জমে গেছে। যুবকের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে আছে বিছানার একটা বালিশ। বালিশের একপাশে একটা ধারাল ক্ষুর ।।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাশটা দেখল শহীদ। যুবকের বাঁ হাতের আঙুলে একটা আংটি দেখল ও। আংটিতে দুটো ক্যাপিটাল লেটার –A. R.
| লাশের কাছ থেকে সরে এসে ঘরের চারদিকে নজর বুলিয়ে নিল শহীদ। বাথরুমের দরজা খোলা। ঘরের একটিমাত্র জানালাও খোলা। মি: সিম্পসন বিমূঢ়তা কাটিয়ে বলে উঠলেন কাঁপা স্বরে, খুন, না আত্মহত্যা, শহীদ?’
শহীদ টেবিলের উপর থেকে একটা দাড়ি কামাবার কেস তুলে নিয়ে দেখছিল মনোযোগদিয়ে। ধারাল ক্ষুটা এই দাড়ি কামাবার কেস থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে বুঝতে পারল ও। টেবিলের উপরে ফিলিপস কোম্পানির ইলেকট্রিক রেজারটাও চোখে পড়ল ওর। কুঁচকে উঠল ভুরু দুটো। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ও মি. সিম্পসনের দিকে। সিম্পসন আবার অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নিশ্চয় আত্মহত্যা, শহীদ! খুন করে এ ঘর থেকে পালাবে কেমন করে খুনী? জানালা খোলা ছিল বটে একটা, কিন্তু গ্রিল-সিস্টেম নেই। এ আত্মহত্যা না হয়েই যায় না।’
| ‘সে-রকম ধারণাই হয় বটে।’
মি. সিম্পসন উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, ধারণা বলছ কেন? নিশ্চিত করে বলা যায়, এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। মিস সুরাইয়ার সাথে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল নাঃ আবদুর রহমানের, এ কথা জেরার সময় সকলেই স্বীকার করেছেন। হয়ত মিস সুরাইয়া পূর্বওয়াদা মোতাবেক বিয়ে করতে চাননি আবদুর রহমানকে । বিশ্বাসঘাতকতার সাজা দেবার জন্যেই মিস সুরাইয়াকে হত্যা করেছে সে।’
শহীদ নির্ভেজাল কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, “কিন্তু মিস সুরাইয়ার
| ১৮
ভলিউম-৯
চাকর-বাকর কি দোষ করেছিল, বলুন দেখি?
চাকর-বাকররা সাক্ষী দেবে সন্দেহ করেই ঠাণ্ডা মাথায় সবগুলোকে খতম করে দিতে হয়েছে ওকে। তখন ওর মধ্যে অনুশোচনা জন্মায়নি, আত্মহত্যার কথা ভাবেনি তখনও। বাড়িতে ফিরে অনুশোচর জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করেছে সে। লক্ষ্য করেছ শহীদ, মিস সুরাইয়াকে যে অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে অস্ত্র পাওয়া যায়নি তার বাড়িতে। কারণটা কি? রহমান যেটা সাথে করে নিয়ে এসেছিল সেটা দিয়েই আত্মহত্যা করেছে ও। ঐ দেখ, ধারাল ক্ষুরটা।’
শহীদ বলে উঠল, ‘মিস সুরাইয়া বেগমের বাড়ির চাকর-বাকরগুলোকে খুনী হত্যা করেছে এই জন্যে যে, খুনীকে তারা চিনত। কিন্তু খুনী আবদুর রহমান নয়।’
| কেন?’
‘কেননা, যে দাড়ি কামাবার বাক্স থেকে ক্ষুরটন নেয়া হয়েছে সেটা আবদুর রহমানের নয়। আবদুর রহমানের ইলেকট্রিক রেজার রয়েছে। খুনী বা খুনীরা ভয়ানক একটা ষড়যন্ত্র করে ব্যাপারটাকে সাজাতে চেষ্টা করেছে যেভাবে আপনি ভাবছেন সেভাবেই। মিস সুরাইয়াকে যদি আবদুর রহমান খুন করেই থাকে সারাল ক্ষুরটা দিয়ে, সেটাকে সে কষ্ট করে বয়ে বাড়িতে আনল কেন? তখন তো তার আত্মহত্যার ইচ্ছা ছিল না। রিভলভার ফেলে সে সামান্য একটা ক্ষুরের মায়ায় পড়ে গেল, বলতে চান? নাহ, আমার কোন সন্দেহ নেই, যে আবদুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।’
মি. সিম্পসন কঠিন প্রশ্নবাণটি ছাড়লেন এবার, তাহলে খুনী পালাল কোন্ পথে? বাতাসে মিলিয়ে গেছে, তুমি বলতে চাও?’
চিন্তিতভাবে মি. সিম্পসনের দিকে তাকাল শহীদ। পরমুহূর্তে কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, বাতাসে মিলিয়ে যাবে কেন? খুনী পালিয়েছে বাথরূম দিয়ে।’
কিন্তু মি. সিম্পসন অধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, না, বাইরে থেকে আগেই দেখেছি আমি, বাথরূমের আর কোন দরজা জানালা নেই।’
শহীদ পলকের মধ্যে চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠল। চমকে উঠেছে সে মি. সিম্পসনের কথা শুনে। বাথরূমের ভোলা দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলেই ফিসফিস করে চাপা কণ্ঠে বলে উঠল ও, সাবধান মি. সিম্পসন! খুনী তাহলে বাথরূমেই লুকিয়ে আছে!
দু’জনেই বিদ্যুৎবেগে হাত ঢুকিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে । রিভলভারটা বের করে ফেলেছিল শহীদ। কিন্তু পরমুহূর্তে চিৎকার করে উঠল ও, শুয়ে পড়ুন!
বিদ্যুৎবেগে ডাইভ দিল শহীদ। ছিটকে সরে পড়লেন মি. সিম্পসন বিপদ টের পেয়ে।
গোল একটা বস্তু এর্সে পড়ল মেঝেতে খোলা বাথরুমের দরজার আড়াল কুয়াশা-২৫
১৯
থেকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কর্ণ বিদারী শব্দ হল একটা। বোমা ফাটার বিকট শব্দ। কেঁপে উঠল মি. সিম্পসনের সারা পৃথিবী। ধোয়া, বারুদের গন্ধ..তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
কামাল ভেসপা নিয়ে ধূসর-রঙয়ের একটা ফোক্সওয়াগনকে ফলো করছিল। ফোক্সওয়াগেনের চালকের মাথায় হ্যাট দেখে, চোখে রঙিন সানগ্লাস দেখে এবং হাতে গ্লাভস দেখে কামাল প্রথমে চমকে উঠে ভেবেছিল-লোকটা কঙ্কাল!
কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখার সুযোগ পেল ও খানিকক্ষণ পরেই। ফোক্সওয়াগেনটা গিয়ে থামল ধানমণ্ডিস্থ মি. সারওয়ারের বাড়ির সামনে। ছদ্মবেশী চালক নামলেন গাড়ি থেকে। কামাল না থেমে নির্বিকারভাবে গাড়ির পাশ দিয়ে সামনের রাস্তা ধরে ছুটে গেল। পাশ দিয়ে যাবার সময় ছদ্মবেশী ভদ্রলোককে চিনতে পারল ও। কঙ্কাল বলে সন্দেহ হল, না। ওসমান গনি ছদ্মবেশে মি. সারওয়ারের বাড়ি এসেছেন। এ ব্যাপারে কামালের আর কোন সন্দেহ রইল না । কিন্তু ওসমান গনিই বা ছদ্মবেশে কেন? উদ্দেশ্য কি তার। তবে কি কঙ্কাল রহস্যের সাথে এরা জড়িত? নাকি দুজনের মধ্যে একজন সোলায়মান চৌধুরী?
সামান্য কিছুদূর গিয়েই ভেসপা ঘুরিয়ে মি. সারওয়ারের বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অপেক্ষা করতে লাগল ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও মি. সারওয়ারের বাড়ির দিকে।
প্রায় দশ মিনিট পর হোণ্ডা চালিয়ে একজন ইংরেজ মি. সারওয়ারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। চমকে উঠল কামাল। ইংরেজটা’ হেস্টিংস বা বব নয় তো? তা যদি হয়, তাহলে সোলায়মান চৌধুরীর সাথে এসব ব্যাপারের সম্পর্ক না থেকেই যায় না। ইংরেজটার হাতে একটা অ্যাটাচী-কেস দেখা গেল। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। আবার বের হয়ে এল দু’মিনিটের মধ্যেই। কামাল আশ্চর্য হয়ে গেল । অ্যাটাচী-কেসটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না লোকটার হাতে।
| হোণ্ড চালিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই চলে গেল ইংরেজটা। এরপর দশ মিনিট কেটে গেল। দশ মিনিট পর বাড়িটা থেকে বের হলেন মি. সারওয়ার এবং ওসমান গনি। সারওয়ারের হাতে অ্যাটাচী-কেসটা দেখা যাচ্ছে। ওসমান গনির দাঁড় করানো গাড়িতে চড়ে বসলেন দু’জন। ড্রাইভিং সিটে বসলেন মি. সারওয়ার। অ্যাটাচী-কেসটা তাঁর কোলে। গাড়ির মুখ ঘুরে গেল। কামাল নিজের ভেসপায় চড়ে বসেছে ইতিমধ্যে। অনুসরণ করবে ও ফোক্সওয়াগেনটাকে।
| তীব্র বেগে ছুটে চলেছে ফোক্সওয়াগন মিরপুর রোড ধরে। মোড় নিল টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে। সিধে এগিয়ে চলল তীব্র বেগে এক নম্বর মোহাজের কলোনীর দিকে। দূরত্ব বজায় রেখে পিছনে লেগে রইল কামাল। এক নম্বর কলোনী বাঁয়ে রেখে মোড় নিল ফোক্সওয়াগেনটা। খানিকটা গিয়ে বিরাট এক রোড
ভলিউম-৯
ঢুকে গেল স্কেটা এখন আর দেখা যাকেই চলে গেল ইং
আইল্যাণ্ডের কাছে মোড় নিল আবার। এগিয়ে চলল গাড়ি কলোনীর পাশ দিয়ে । মিরপুর চিড়িয়াখানার দিকে এগোচ্ছে ফোক্সওয়াগেনটা।
চিড়িয়াখানা রোডটার অবস্থা খুবই খারাপ। এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে ঝাঁকানি খেতে খেতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে ঘন বন। বনের মাঝ দিয়ে কোথাও কোথাও অপ্রশস্ত পথ। যে-কোন মুহূর্তে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ফোক্সওয়াগেন। কিন্তু সিধে চিড়িয়াখানাতেই গিয়ে থামল সেটা। পশু পক্ষীর খাঁচাগুলোর বাঁ পাশে দাঁড়াল গাড়ি। কামাল দূরের একটা কাঁঠাল গাছের আড়ালে দাঁড় করাল ভেসপা। গাড়ি থেকে নামলেন মি. সারওয়ার এবং ওসমান গনি। চোখে চোখে তাকিয়ে কি যেন কথা হয়ে গেল এঁদের মধ্যে। অ্যাটাচী কেসটা মি. সারওয়ারের হাতে দেখা যাচ্ছে। খাঁচাগুলোর পাশ দিয়ে পুবদিকে হাঁটতে শুরু করলেন দুজন। এদিক-ওদিক তাকালেন। চট করে একটা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করল কামাল। হাঁটতে হাঁটতে ভালুকের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ওঁরা দু’জন। কামাল ভেসপা রেখে এগিয়ে এল খানিকটা। দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আগু-পিছু ডান-বা ভাল করে জরিপ করে নিলেন তীক্ষ্ণ চোখে। তারপর আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে এলেন গাড়ির কাছে। ওঁদের এই আচরণের কোন কারণই খুঁজে পেল না কামাল। গাড়িতে চড়লেন ওঁরা। কামাল বিমূঢ়ভাবে তাকিয়ে রইল দূর থেকে গাড়িটার দিকে। স্টর্ট নিল ফোক্সওয়াগেন। এসেছিল দক্ষিণদিক থেকে কিন্তু সেদিকে না গিয়ে.. পশ্চিমদিকে চলতে শুরু করল গাড়িটা। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কামাল।
| গাড়িটা যখন প্রায় আড়াইশ’-তিনশ’ গজ দূরে চলে গেছে তখন হঠাৎ খ করে একটা প্রশ্ন খোঁচা মারল কামালের মগজে। গাড়ি নিয়ে ওঁরা ওদিকে যাচ্ছেন কেন? চিড়িয়াখানা থেকে গাড়ি বের করার কোন রাস্তা তো ওদিকে নেই!
ছুট দিল কামাল। হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড় করানো ভেসপার কাছে এসে পড়ল ও। স্টার্ট দিয়েই চড়ে বসল সেটায়। দূরে তাকিয়ে দেখল ঘন জঙ্গলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ফোক্সওয়গেন। তীব্র বেগে কামাল ভেসপা ছুটিয়ে দিল। ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে ফোক্সওয়াগেন।
ধুলোর ঝড় উড়িয়ে এগিয়ে চলেছে কামালের ভেসপা । ফোক্সওয়ানে যেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না গাড়িটাকে। যথাস্থানে পৌঁছে নেমে পড়ল কামাল। ভেসপার এঞ্জিন বন্ধ করে : পাতল ও। কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অর্থাৎ হয় গাড়িটার এঞ্জিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে নয়ত গাড়িটা বহুদূরে চলে গেছে। চলে গেছে বলে বিশ্বাস হল না কামালের। ভেসপাটাকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখল। তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল ও। মেঠো প্রশস্ত বহু পথ আছে মিরপুর চিড়িয়াখানায় । মাঝে মাঝেই এমন ঘন সন্নিবেশিতভাবে গাছপালা দেখা যায় যে, য়গাটাকে
কুয়াশা-২৫
জঙ্গল ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না।
মিনিট পাঁচেক ধরে একই জায়গায় চক্কর মারতে লাগল কামাল। গোলক ধাঁধার মত ব্যাপার। কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে বোঝা দায়। অবশেষে মরিয়া হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল কামাল। বেশিদূর নয়, মাত্র শ’খানেক গজ যেতেই আনন্দে চকচক করে উঠল ওর চোখ দুটো । একটা বড়সড় ঝোঁপের আড়ালে দেখা যাচ্ছে ধূসর রংয়ের সেই ফোক্সওয়াগনটা।
চলার গতি মন্থর করল কামাল। গাড়ির ভিতরে কেউ বসে আছে কিনা, বোঝ মুশকিল। পা টিপে টিপে এগোতে লাগল ও। উত্তেজনায় কপালে ঘাম ফুটে উঠছে। আরও একটু এগোতে ও বুঝতে পারল, গাড়িতে কেউ নেই। তাহলে গাড়ি এখানে লুকিয়ে রেখে ওরা গেল কোথায়? প্রশ্ন জাগল বিস্মিত কামালের মনে। গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল ও। কান পাতল হঠাৎ। কোথায় যেন কিরকম একটা শব্দ হচ্ছে। বেশ দূরে বলে অনুমান হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কোন্দিক থেকে আসছে শব্দটা তা বুঝতে পারল না কামাল। অনুমানের উপর নির্ভর করে এগিয়ে গেল ও একদিকে। মিনিট তিনেক ধরে হেঁটে কোন লাভই হল না। যথাস্থানে ফিরে এল ও আবার । আর একদিক ধরে এগোল অনেকটা। কিন্তু এবারও শব্দের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে আধঘন্টা বা পৌনে এক ঘন্টা হয়ে গেছে মি. সারওয়ার এবং ওসমান গনি চোখের আড়াল হয়েছে। কামালের । শব্দটা আবার কান পেতে শুনল ও। তারপর অন্য আর একদিক ধরে দ্রুত এগোতে লাগল। মিনিট পাঁচেক জংলী-পথ ধরে হাঁটার পর চিড়িয়াখানার শেষ সীমানার কাছাকাছি এসে পড়ল কামাল। শব্দটা অতি নিকটে, শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। কৌতূহলে দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হল কামালের। সতর্ক পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ও। সামনেই একটা ঝোঁপ ।
ঝোঁপটার কাছে গিয়ে পৌঁছুতেই চমকে উঠল কামাল। শব্দটা থেমে গেল পরমুহূর্তেই। সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে উঠল ওর চোখ । একি! এ যে হত্যার ষড়যন্ত্র!
মি. সারওয়ারের হাতে একটা কোদাল দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ, ধরে তিনি প্রাণপণে মাটি কাটছিলেন। মাটি কাটছিলেন’ না বলে বলা উচিত, কবর খুঁড়ছিলেন ওসমান গনির।
| শিউরে উঠল কামাল। মি. সারওয়ার কপালের ঘাম মুছছেন কাঁপা হাতে। তাঁর পায়ের সামনে নিঃসাড় পড়ে রয়েছে ছদ্মবেশী ওসমান গনির লাশ। দূর থেকে দেখেই কামাল অনুমান করল, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ওসমান গনি। ঝুঁকে পড়লেন মি. সারওয়ার। ওসমান গনির লাশটা টেনে টেনে কবরের ভিতরে নামিয়ে দিলেন। তারপর অ্যাটাচী-কেসটা ফেলে দিলেন কবরের ভিতরে। দ্রুত হাতে কোদাল দিয়ে মাটি ফেলে ভরে ফেলতে শুরু করলেন বিরাট গর্তটা। চোখের
ভলিউম-৯
১২
সামনে এমন নৃশংস কাণ্ড দেখে শিউরে উঠল কামাল।
দেখতে দেখতে কবরে মাটি চাপা দেয়া শেষ করলেন মি. সারওয়ার। চঞ্চল, ভীত, উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। এক মুহূর্ত দেরি করলেন না তিনি। চারদিক ভাল করে একবার দেখে নিলেন। তারপর কোদালটা তুলে কাছের একটা গাছে কোপ মেরে দু’জায়গায় ছাল তুলে ফেললেন। সম্ভবত একটা চিহ্ন রেখে যাবার জন্যেই করলেন এটা। হনহন করে হেঁটে আসতে লাগলেন এবার মি: সারওয়ার। চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে সিধে কামালের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিল কামাল। এখন কিছু করবে না ও। শহীদকে সব কথা জানানো দরকার সর্বপ্রথম। ওর পরামর্শ না নিয়ে এই জটিল রহস্যের জট ছাড়ানো মুশকিল।
কামালকে দেখতে পেলেন না, হনহন করে হেঁটে যেতে লাগলেন মি. সারওয়ার। সিধে চলেছেন তিনি রেখে আসা ফোক্সওয়াগেনের দিকে। মি. সারওয়ার অদৃশ্য হয়ে যেতেই কামাল ওসমান গনির কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কী যেন ভাবল ও গভীরভাবে। তারপর জায়গাটা চিনে রাখবার জন্যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল চারদিক। দেখা হয়ে যেতে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল ও।
জঙ্গলের বাইরে বের হয়ে এসে কামাল মি. সারওয়ার বা তার ফোক্সওয়াগেনটাকে দেখতে পেল না আর। চলে গেছে লোকটা নিজের কাজ সেরে। ভেসপায় স্টার্ট দিল কামাল। চিড়িয়াখানার অফিচার-ইন-চার্জের অফিস রূমের সামনে এসে নামল ও। পরিচয় বিনিময়ের পর ফোন করার অনুমতি দিলেন। অফিসার। শহীদের বাড়িতেই ফোন করল ও। কিন্তু উত্তর দিল না কেউ-ই। বারবার ডায়াল করেও কোন ফল হল না। রিং হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলছে না কেউ। কারণ কি? ভাবল কামাল–শহীদ না হয় নেই, কিন্তু মহুয়া বৌদি, লীনা, ইসলাম চাচা, গফুর-এরা কোথায় গেছে বাড়ি ছেড়ে! তবে কি কোন অস্বাভাবিক অঘটন ঘটেছে।
মনটা নিদারুণ আশঙ্কায় ভরে উঠল কামালের। অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেসপায় এসে চড়ল ও।।
বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়ে দিল ভেসপাটা শহরের দিকে।
মিরপুর রোডের উপর দিয়ে ছুটছে কামালের ভেসপা । হাত দেখাল ট্রাফিক । কিন্তু গ্রাহ্য করল না কামাল। বুকের ভিতর কে যেন ঘন ঘন হাতুড়ি পিটছে ওর। মহুয়া বৌদি, লীনা, ইসলাম চাচা এবং গফুরের জন্যে, কেন কে জানে, বড় আশঙ্কা হচ্ছে তার। শহীদের বাড়ি না থাকার একটা কারণ আছে, কিন্তু আর সবাই বাড়ি খালি করে গেল কোথায়?
কামালের ভেসপাটাকে পাশ কাটিয়ে একটা ফিয়াট দ্রুতবেগে চলে গেল মিরপুরের দিকে। কামাল এখন নিউ মার্কেটের কাছে পৌঁছে গেছে । ফিয়াটের দিকে তাকিয়েও দেখেনি ও। গভীর দুশ্চিন্তায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কিন্তু ফিয়াটের কুয়াশা-২৫,
৩
দিকে চোখ মেলে তাকালে লাভই হত ওর। গাড়িটার ব্যাক-সিটে দুটো মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে দেখতে পেল ও। দু’জনেরই গা ঢেকে দেয়া হয়েছে সাদা সিল্কের চাদর দিয়ে গাড়ির চালক একজন ইংরেজ । লাল শার্ট তার পরনে। তার পাশেই শহরের কুখ্যাত গুণ্ডা গুল ধা। সিঙ্কের চাদরের নিচের মানুষ দুটোর দেহ আর কারও নয়–একটা মহুয়ার, অপরটা লীনার!
তিন
সেই অন্ধকার থাকতে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছিল শহীদ। দেখতে দেখতে ফিরে আসার সময় পার হয়ে গেল। আরও ঘন্টাখানেক পর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মহুয়া। কোনদিন তো সূর্য ওঠার পরে বাইরে থাকে না শহীদ! আজ এত দেরি হচ্ছে কেন? গফুরকে পাঠাল মহুয়া। গফুর সম্ভাব্য সব জায়গা থেকে ঘুরে এল ব্যর্থ হয়ে। শহীদের কোন খবর পায়নি সে। দুঃসংবাদই বলতে হবে। এমন তো কোনদিন হয় না। শ্বশুরকে দ্বিতীয় কাপ চা দেবার সময় খবরটা জানাল মহুয়া। চিন্তিত হয়ে পড়লন ইসলাম সাহেব। ব্যস্ত-সমস্তভাবে ফোন করলেন থানায় । থানা থেকে কেউ কিছু বলতে পারল না! মহুয়া ফোন করল মি. সিম্পসনের অফিসে। কিন্তু পাওয়া গেল না মি. সিম্পসনকে। দুশ্চিন্তার কালো ছায়া ফুটে উঠল বাড়ির সকলের মুখে। কোন খবর না জানিয়ে গেল কোথায় শহীদ? কামালকে ফোন করা হল। কিন্তু আশ্চর্য, পাওয়া গেল না কামালকেও। তবে কি মি. সিম্পসন, শহীদ আর কামাল হঠাৎ কোন জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেছে? কিন্তু প্রবোধ মানল না কারও মন। বেলা বারটার দিকে বেরিয়ে পড়লেন ইসলাম সাহেব ছেলের খোঁজে। গফুর কাঁদকদ মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বাড়ির গেটের কাছে। মহুয়া আর লীনা ঘর বার করে বেড়াতে লাগল পাংশু মুখে। কেউ কাউকে কিছু না বললেও সকলের মনেই আশঙ্কা জাগছিল-কঙ্কাল কোন ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেয়নি তো। শহীদকে।
| বেলা দেড়টার সময় শুকনো মুখে ফিরে এলেন ইসলাম সাহেব। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। মিনিট দশেক বিশ্রাম নেবার পর থানায় গিয়ে খবর নেবার জন্যে আবার বের হয়ে পড়লেন তিনি। পায়চারি করার ক্ষমতাও এদিকে হারিয়ে ফেলেছে মহুয়া। অমঙ্গল আশঙ্কায় কালো হয়ে গেছে তার মুখ । ড্রইংরুমে লীনাকে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। খানিক পরপরই লীনা ফোন করছে কামালকে। কিন্তু কামালের কোন পাত্তা নেই। | গফুর গম্ভীরমুখে পঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনে। দাদামনির খোঁজে পৃথিবী চষে, ফেলার অদম্য ইচ্ছায় ছুটে বেরিয়ে পড়তে চাইছিল সে। কিন্তু দিদিমণিদেরকে একা, রেখে ঝড়ি ছেড়ে যাওয়াটা উচিত নয় বুঝতে পেরেই বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
ভলিউম-৯
বেলা তখন দুটো। অধীর অপেক্ষায় অনড় দাঁড়িয়ে আছে গফুর। ইসলাম সাহেব ফিরে আসেননি এখনও। লীনা আবার ডায়াল করছে কামালের নাম্বারে। মহুয়া বসে আছে, গালে হাত দিয়ে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল । শব্দটা শুনতে পেল না লীনা বা মহুয়া। কেন না গাড়িটা থেমেছে বাড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে।
গফুর আশায় আশায় তাকিয়ে ছিল গাড়িটার দিকে। দু’জন লোক নামল ধীরে ধীরে। আশ্চর্য, লোক দু’জন তার দিকেই এগিয়ে আসছে হাসিমুখে। দু’জনের মধ্যে একজন ইংরেজ। দ্বিতীয়জনও বাঙালী নয়, পাঞ্জাবী। গফুরের দিকে তাকিয়ে হাসছে ওরা। এগিয়ে আসছে।
বেশ একটু অবাকই হয়ে পড়ল গফুর। লোক দুটো তার সামনে এসে দাঁড়াল। ইংরেজটা হাত বাড়িয়ে দিল গফুরের দিকে হাসিতে মুখ ভরিয়ে। করমর্দন জীবনে কারও সাথে করেনিগফুর। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাতটা অবশ্য বাড়িয়ে দিল সে। ইংরেজের পরে মোটা পাঞ্জাবীটার সাথেও করমর্দন করতে হল। পাঞ্জাবীটা হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে হাতের একটা মাঝারী আকারের বাক্স দেখিয়ে বলল, “মি. শহীদ ইয়ে বাকসা ভেজ দিয়ে হ্যায়। শহীদ সাহাবের মিসেসকে হামি এটা দিতে চাই। সমঝা, দোস্ত?”
গফুর আগ্রহাতিশয্যে জানতে চাইল, কি আছে ওতে, সাহেব?’
রুপিয়া আছে, রুপিয়া। শহীদ সাহাবের খত ভি আছে।’ গফুর বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘খত কি? ‘খত বুঝে না? খত, ইয়ানে লেটার, ইয়ানে চিঠি।’
দাদামণির চিঠি আছে! দাদামণি কোথায়? কই, দিন দেখি আমাকে বাক্সটা?’
পাঞ্জাবী বাক্সটা গফুরকে না দিয়ে ইংরেজকে দিল রাখতে। বলল, ‘তোমাকে হামি এটা দিতে পারি না, দোস্ত । শহীদ সাহাবের বিবিকে দিতে হবে।’
তাহলে চলুন আমার সাথে? ‘চোলো, দোস্ত।’
ঘুরে দাঁড়াল গফুর। বাড়ির ভিতরে ঢুকল সে লম্বা লম্বা পা ফেলে । পাঞ্জাবীটাও গফুরের পিছু পিছু ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে। ইংরেজটাও ঢুকল, তবে সে একটু পিছনে রয়ে গেল। গফুর পিছন ফিরে তাকাল না একবারও। ফলে, আকস্মিক হামলা সম্পর্কে পূর্বাহ্নে কিছুই বুঝতে পারল না ও পাঞ্জাবীটা হঠাৎ পিছন থেকে খপ করে চেপে ধরল গফুরের গলাটা সাঁড়াশির মত। প্রচণ্ড শক্তি লোটার দুই হাতে। টু শব্দটি করার সুযোগও পেল না গফুর। পাঞ্জাবীটা নিঃশব্দে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরে রেখেছে তার গলা। হাত-পা ছোঁড়ার ক্ষমতাটুকুও সাথে সাথে লোপ পেল তার। জ্ঞান হারাল সে এক মিনিটেই। পরমুহূর্তে জ্ঞানহীন দেহটা পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বারান্দার উপর উঠে এল পাঞ্জাবীটা। বাথরুমের দরজা খোেলা
কুয়াশা-২৫
দেখে ঢুকে পড়ল গফুরকে নিয়ে। আধ মিনিট পর বেরিয়ে এল সে অচেতন দেহটা বাথটাবে শুইয়ে রেখে।
ইংরেজটা বাড়িতে ঢুকে দাঁড়িয়ে ছিল একই জায়গায়। পাঞ্জাবীটা তাকে সাথে নিয়ে বাড়ির গেটের কাছে ফিরে গেল আবার। সেখান থেকে কলিংবেল টিপল সে।
বেলের শব্দ শুনে মহুয়া ও লীনা উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওদেরকে দেখে মদ-মধুর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল লোক দুজন। বাক্সটা এখন আবার পাঞ্জাবীটার হাতে। লীনা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “গফুরটা গেল কোথায়?
মহুয়া বলল, আশপাশেই কোথাও আছে হয়ত। কোথাও গেলে বলে যেত । এরা কারা বল তো?’
পাঞ্জাবী আর ইংরেজটা হাসতে হাসতে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। নুয়ে পড়ে সালাম করল পাঞ্জাবীটা মহুয়াকে। মহুয়া জিজ্ঞেস করল, কাকে চান আপনারা?’
পাঞ্জাবীটা বিগলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপ তো শহীদ সাহাবের মিসেস?”
হ্যাঁ, কেন?’
শহীদ সাহাব বহুত বড়া এক ডাকুকে পাকড়াও করেছেন। বাড়ি ফিরতে তার দের হোবে। এই বাক্সটা হামকো দিল আপনার কাছে পৌঁছা দেনেকে লিয়ে। এতে বহুত টাকা ভি আছে, চিঠি ভি আছে একঠো!’
মহুয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল লোক দু’জনকে। তারপর বলল, কই দেখি?
বাক্সটা এগিয়ে দিল পাঞ্জাবীটা। মহুয়া টিপ-তালা টেনে খুলতে যেতেই পাঞ্জাবীটা বলে উঠল, ‘নেহি, বিবিসাব, নেহি! ইধার নেহি, ঘর মে যাকে এটা খুলবার এন্তেজাম করুন। বহুত রুপিয়া আছে কিনা!’
মহুয়া কোন কথা না বলে বাক্সটা নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে চলল। পাঞ্জাবীটা পিছন থেকে বলে উঠল, ‘রুপিয়া গুণে হামাকে একঠো চিঠি লিখে দিবেন।
লোক দু’জনকে দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়েছে মহুয়ার। নিশ্চয় কোন বদ মতলব আছে ওঁদের। ড্রইংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে কিনা ভাবল একবার। লীনার পরামর্শে দরজা বন্ধ না করে অন্য একটা দরজা দিয়ে বেডরূমে গিয়ে বসল ওরা। বাক্সটা বিছানার উপর রেখে খোলার চেষ্টা করল মহুয়া। ঝুঁকে পড়ল লীনাও ভিতরে কি আছে দেখার জন্যে।
বাক্সের ডালাটা খোলামাত্রই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখল মহুয়া। বাক্সের ভিতরে একটা কৌটো। কৌটোটা তুলোর উপর রাখা। বাক্সের ডালা খোলার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল কৌটোর মুখটা। পলকের মধ্যে অশ্চর্য ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করল। কৌটোটা শুধু পলকের জন্যে দেখতে পেল ওরা। পরমুহূর্তে সেই কৌটোর ভিতর থেকে অদ্ভুত এক প্রকার মিষ্টি গন্ধযুক্ত ধোয়া
বেরিয়ে প্রবেশ করল নাকে। মহুয়া হতবাক হয়ে গিয়ে মুখ সরিয়ে তাকাবার চেষ্টা করল লীনার দিকে। কিন্তু মাথাটা তুলতে পারল না ও। ঢলে পড়ল বিছানার উপর জ্ঞান হারিয়ে। মহুয়ার জ্ঞানহীন দেহটার উপর লুটিয়ে পড়ল লীনার জ্ঞানহীন দেহ।
মিনিটখানেক পরই ইংরেজ আর পাঞ্জাবীটা খুঁজতে খুঁজতে বেডরূমে এসে ঢুকল। নিঃশব্দে দু’জন তুলে নিল মহুয়া আর লীনার অচেতন দেহ দুটো।
নির্জন বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেদের ফিয়াটের পিছনের সিটে শুইয়ে দিল ওরা মহুয়া আর লীনাকে। সিল্কের একটা চাদর আগে থেকেই রাখা ছিল গাড়িতে। সেটা দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিল দু’জনের দেহ। বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলল গাড়িটা অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে।
জ্ঞান ফিরে আসছে মহুয়ার। বিকট চিৎকার করছে কে যেন করুণস্বরে। প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানছে কানের পর্দায় আতধ্বনিটা। গলাটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু মাথাটা বড় ঝিমঝিম করছে ওর। হাত দুটো কপালে তোলার চেষ্টা করল মহুয়া। কিন্তু পারল না, কিসে যেন চেপে ধরে রেখেছে ওর হাতজোড়া।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল মহুয়া। এদিক-ওদিক তাকাল। এ কি! চমকে উঠল মহুয়ার অন্তরাত্মা। মাথার উপর খোলা আকাশ কেন? চারদিকে এমন গহন জঙ্গল এল কোথা থেকে!
পলকের মধ্যে সব মনে পড়ে গেল মহুয়ার। উঠে বসতে চেষ্টা করল ও ঝট করে, পারল না। অনুভব করল এতক্ষণে, হাত-পা বাঁধা ওর। ঘাসের উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। আর্ত চিৎকারটা পরিষ্কার চিনতে পারা যাচ্ছে এখন। হাহাকার রব উঠল বুকের ভিতর। লীনার ভয়ার্ত চিৎকার!
ঘাড় বাঁকিয়ে ডান দিকে তাকাল মহুয়া। অদূরেই ঘাসের উপর শুয়ে হাত-পা ছোঁড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে হতভাগিনী লীনা। তারও হাত-পা বাঁধা। লীনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুই শয়তান। লাল-শার্ট পরা ইংরেজটা আর মোটা পাঞ্জাবীটা । কুৎসিত জিঘাংসায় জ্বলজ্বল করছে শয়তান দুটোর চোখগুলো। লীনার দিকে
এগিয়ে যাচ্ছে ইংরেজ বদমাশটা। পাঞ্জাবীটা হি হি করে হাসছে ।।
ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে কান্না পেল মহুয়ার। দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ল তার। কোথায় শহীদ এখন? এই ভয়াবহ মুহূর্তে কেউ কি সাহায্য করবে না অসহায় দুই নারীকে!
| নীরবে হাত-পা ঘষতে লাগল মহুয়া সর্বশক্তি দিয়ে। বাঁধন ঘেঁড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও। জ্ঞান এখনও ফেরেনি, মনে করে বদমাশ দুটো তারদিকে খেয়াল দিচ্ছে না। লীনার সর্বনাশ চোখ বুজে দেখতে পারবে না ও। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে মুক্ত না করা কুয়াশা-২৫
২৭
গেলে লীনাকে রক্ষা করা যাবে না।
হঠাৎ চমকে উঠল মহুয়া। লীনার চিত্তার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে মহুয়া দেখল এক ভয়াবহ দৃশ্য। কোথা থেকে যেন একজন লোক হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে চোখের সামনে। লোকটা কালো সুট পরা। হাতে গ্লাভস। চোখে সানগ্লাস। মাথায় হ্যাট। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট হবে লোকটা। কিন্তু খুব রোগা পাতলা। গায়ে তেমন ক্ষমতা নেই। কখন যে আবির্ভাব ঘটেছে বুঝতে পারেনি মহুয়া। কখন যে-ইংরেজ আর পাঞ্জাবী বদমাশ দুটো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর তাও বুঝতে পারেনি ও। দেখতে দেখতে কাবু করে ফেলল শয়তান দু’জন আগন্তুককে। পাঞ্জাবীটা রহস্যময় আগন্তুকের বাঁ হাতটা ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে মোচড় দিতে শুরু করেছে। ইংরেজটা আগন্তুকের একটা পা ধরে টানছে সর্বশক্তি দিয়ে। ভয়াবহ দৃশ্য। একটা হাত আর একটা পা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যাবে এভাবে টানাটানি করতে থাকলে। কিন্তু আগন্তুকের মুখের চেহারায় কোন কষ্টের.চিহ্ন নেই। শুধু নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ আলগা হয়ে গেল, একটা হাত। পাঞ্জাবীর হাতে এসে পড়ল আগন্তুকের দেহচ্যুত বাঁ হাতটা। কিন্তু আশ্চর্য! রক্তের কোন চিহ্নই দেখা গেল না। আগন্তুকের মুখেও ব্যথা-বেদনার কোনরকম প্রকাশ নেই।
ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল আবার লীনা তীক্ষ্ণস্বরে ।
ইংরেজটা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। আগন্তুকের একটা পা ধরে হেঁচকা টান মেরে ঘোরাতে লাগল সে নিজের চারদিকে। খানিকক্ষণ পরই আগন্তুকের পাটা রয়ে গেল ইংরেজটার হাতে। আগন্তুকের দেহটা ছুটে গিয়ে পড়ল কয়েক গজ দূরে।
চোখবন্ধ করে একনাগাড়ে চিৎকার করে চলেছিল লীনা। মহুয়াও. ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে হাঁপাচ্ছিল। হঠাৎ আবার থেমে গেল লীনার চিৎকার। চৈাখ মেলে তাকাল মহুয়া। ঘাড় ফিরিয়ে যা দেখল তা ভোজবাজির চেয়েও অদ্ভুত!
খানিক পূর্বের পরাজিত রহস্যময় আগন্তুকের মতই হুবহু একই পোশাকে সজ্জিত একদল লোক ঘিরে ফেলেছে বদমাশ ইংরেজ আর পাঞ্জাবীটাকে। সংখ্যায় প্রায় বারজন ওরা’। ধীরে ধীরে আক্রমণের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে শয়তান দুটোর দিকে। অবিশ্বাসে কণ্ঠরোধ হয়ে এল মহুয়ার। একি স্বপ্ন দেখছে সে! বাস্তবে এ কি
সম্ভব!
উত্তেজনায় দম বন্ধ হবার যোগাড় মহুয়ার। লীনারও সেই অবস্থা। রহস্যময় অলৌকিক লোকগুলোকে আলাদাভাবে চেনবার কোন উপায়ই নেই। প্রত্যেকেরই একই পোশাক। সকলেই সমান লম্বা। গায়ের রঙও সকলের এক। ভাব-ভঙ্গিও অভিন্ন। রহস্যময় বারজন মানুষ নয় ওরা, বারটা যন্ত্র যেন।
ইংরেজ আর পাঞ্জাবী বদমাশ দুটোর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। ঘিরে ফেলেছে ওদেরকে চারদিক থেকে। চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে মৃত্যু-ভয়। যুদ্ধ করবার ক্ষমতা হারিয়ে অসহায় জানোয়ারের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে দু’জন
ভলিউম-৯
২৮
ঘামছে দরদর করে।
পলকের মধ্যে আগন্তুক বারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল বদমাশ দুটোর উপর। তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার কানে ঢুকল মহুয়ার। জাপটে ধরে ফেলল রহস্যময় আগন্তুকরা বদমাশ দু’জনকে। ভিড়ের চাপে বদমাশ দুটোর কি হাল হচ্ছে দেখতে পেল না মহুয়া। একটু পরেই ছড়িয়ে পড়ল রহস্যময় লোকগুলো। দুজন শুধু রইল বদমাশ দু’জুনের কাছে। শয়তান দুটোর হাত লোহার তার পেঁচিয়ে বাঁধা হয়েছে। একটা গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বাধা শুরু হল ওদেরকে। একজন রহস্যময় আগন্তুক মহুয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। আর একজন লীনার পাশে বসে পড়ে ধীরস্থিরভাবে খুলে দিচ্ছে তার হাত-পায়ের বাঁধন।
| অকারণেই শিউরে উঠল মহুয়া। আগন্তুক তার পায়ের কাছে এসে বসল আস্তে আস্তে। অকস্মাৎ মনে পড়ে গেল মহুয়ার কঙ্কালের কথা। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে, ফেলল ও। কেঁপে উঠল ওর সর্বশরীর ভয়ে।
চার
হাত-বোমা ফাটার প্রচণ্ড শব্দে টলে উঠেছিল যেন সমস্ত পৃথিবীটা। বোমা ফাটার আগেই মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিল শহীদ। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ভীষণভাবে ঝাঁকুনি খেল ওর সর্বশরীর। কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল ওর সব অনুভূতি এবং বোধ-শক্তি। চোখের পাতা বন্ধ। কানে ঢুকছে না কোন শব্দ। স্পর্শবোধও নষ্ট। সেই সময় কেউ যদি ওকে কেটে টুকরো টুকরো করতে শুরু করত তবু টের পেত না ও।
বারুদের গন্ধে মাথার ভিতরটা ঘুরে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরই স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগল শ্রবণ শক্তি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল শহীদ এক সময়। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালা করে উঠল চোখ দুটো। আবার বন্ধ করে ফেলতে হল চোখের পাতা। ঘরের ভিতরে রাশ রাশ ধোয়া। ঘরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। | মি. সিম্পসনকে নাম ধরে ডাকার কথাটা ভাবল শহীদ, কিন্তু রিস্ক নেয়া উচিত হবে না মনে করে ইচ্ছেটা দমন করল ও। বোমা মেরে শয়তানটা ওত পেতে ঘরের ভিতরই কোথাও বসে আছে কি না কে জানে। সামান্য একটু শব্দ কানে ঢুকলেই হয়ত আবার কিছু একটা করে বসবে শয়তানটা। তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকাটা বিচিত্র নয়।
নিঃশব্দে উঠে বসার চেষ্টা করল শহীদ। চোখ না খুলেই ধীরে ধীরে মেঝের উপর বসল ও। পকেটে হাত দিয়ে শুধু একটা কলম পাওয়া গেল। কলমটাই ছুঁড়ে মারল শহীদ একদিকে । সিধে দেয়ালে গিয়ে ঘা খেয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ল সেটা। পরিষ্কার শব্দ কানে গেল শহীদের। কিন্তু আর কোন শব্দ কানে ঢুকল না।
কুয়াশা-২৫
শত্রু তাহলে ওত পেতে বসে নেই। বোমা মেরেই ভেগে গেছে ।
মি. সিম্পসন•••!’
ডেকেও মি. সিম্পসনের সাড়া পেল না শহীদ। ঘঁাৎ করে উঠল বুকটা। তবে কি আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন মি. সিম্পসন? চোখ মেলল শহীদ। সরে যাচ্ছে ধোয়া। কিন্তু এখনও ঘরের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে না। হাত দিয়ে হাতড়াতে শুরু করল শহীদ। ঘরের একেবারে এক কোণের দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে শহীদের হাত মি. সিম্পসনের দেহের স্পর্শ পেল । পরীক্ষা করে শহীদ বুঝতে পারল জ্ঞান হারিয়েছেন মি. সিম্পসন। আঘাত লেগেছে বাঁ দিককার কাঁধে। আর কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা বুঝতে পারল না ও।
| সময় নষ্ট না করে মি. সিম্পসনের অচেতন দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে মেঝের উপর দাঁড়াল শহীদ। বাড়ির দিকে কয়েকজন লোকের উত্তেজিত স্বর এগিয়ে আসছে, শুনতে পেল শহীদ। ধোঁয়া বের হয়ে যাচ্ছে খোলা দরজা দিয়ে । আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে দরজাটা। ধীরে ধীরে পা ফেলে দরজার দিকে এগোল শহীদ।
ধোয়াচ্ছন্ন ঘরের বাইরে বের হয়ে শহীদ দেখল, কয়েকজন পুলিস ছুটে আসছে বাড়ির উঠানের উপর দিয়ে। সবচেয়ে আগে একজন সাব-ইন্সপেক্টর । সাব-ইন্সপেক্টর শহীদকে দেখে চিনতে পারল মুহূর্তে। উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল
সে, ‘একি, স্যার! আপনি!’
শহীদ দ্রুত কণ্ঠে বলল, মি. সিম্পসন আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি এঁকে। ঘরের ভিতরে লাশ আছে একটা । মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। দুটো রিভলভার আছে ঘরের মেঝেতে। বাড়িটায় পাহারা মোতায়েন করে হাসপাতালে চলে আসুন আপনি রিভলভার দুটো নিয়ে। কমিশনারকেও খবরটা জানাতে ভুলবেন না!’
ইয়েস, স্যার।’
শহীদ আর দাঁড়াল না। লম্বা পা ফেলে বাড়ির বাইরে এসে পড়ল ও। মি. সিম্পসনের জীপটা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অচেতন দেহটা সিটে শুইয়ে দিয়ে লাফ মেরে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল শহীদ। স্টার্ট দিতেই রাস্তার ভিড় সরে গিয়ে পথ করে দিল। উত্তেজিত জনতাকে দু’পাশে রেখে ছুটিয়ে দিল শহীদ জীপটাকে।
মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের হোমরা-চোমরা ডাক্তারদের স্বল্পক্ষণের প্রচেষ্টায় জ্ঞান ফিরে এল মি. সিম্পসনের। হাসি ফুটল শহীদের মুখে। “শহীদের মুখের দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, না হে,
। এত তাড়াতাড়ি অক্কা পাব না আমি। তোমাদের দোয়ায় আরও কয়েক কুড়ি বছর না বেঁচে পার পাচ্ছি না আমি।’
হেসে ফেললেন উপস্থিত ডাক্তাররা। শহীদ দু’একটা বিষয়ে আলাপ সেরে
৩০
ভলিউম-৯
নিল। ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে ওর মন। ভয়ঙ্কর শত্রুদল ওর বাড়িতেও হামলা চালাতে পারে, এই আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছে ও। ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়ে বললেন, মি. সিম্পসনের আঘাত তেমন মারাত্মক নয়। একদিনের জন্যে ধরে রাখব আমরা ওঁকে হাসপাতালে।’
| মি. সিম্পসন শহীদের চঞ্চলতা বুঝতে পেরে বললেন, ‘শহীদ, তুমি একবার বাড়ির খবরটা নিয়ে এস না কেন?
শহীদ চিন্তিতভাবে বলল, আপনাকে এখানে নিয়ে আসার পর বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কোন সাড়া পেলাম না।
বল কি?’
উত্তেজনায় উঠে বসতে চেষ্টা করলেন মি. সিম্পসন । নার্স ধরে ফেলল ওঁকে। আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এখনও তুমি আমার জন্যে এখানে সময় নষ্ট করছ, শহীদ! না, না! এ তুমি ভাল করনি, আমার জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ভুল করেছ তুমি। | শহীদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাড়াহুড়ো করে বিশেষ কোন লাভ নেই। যদি কিছু অঘটন ঘটেই থাকে তাহলে আগে বা পরে পৌঁছুনোর মধ্যে বিশেষ কিছু এসে যায় না। আপনার অবস্থার উন্নতি না দেখে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আচ্ছা, এখন আসি আমি।’
| ‘কোন খবর থাকলে জানাতে ভুল না কিন্তু, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন মি. সিম্পসন। মাথা নেড়ে বের হয়ে গেল শহীদ কেবিন থেকে।
দূর থেকেই বাড়িটাকে কেমন যেন শোকাভিভূত দেখে অমঙ্গল আশঙ্কায় হ্যাঁৎ করে উঠল শহীদের বুক।
| বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল ও চেঁচাতে চেঁচাতে, “গফুর! গফুর!!…
তীরের মত ড্রইংরূম থেকে বের হয়ে এলেন বৃদ্ধ ইসলাম সাহেব । সর্বনাশ হয়ে গেছে, খোকা! বাবা! কি হয়েছে?’
শহীদ ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল ইসলাম সাহেবকে। পাণ্ডুরবর্ণ ধারণ করেছে ইসলাম সাহেবের মুখের চেহারা। হতাশায়, আতঙ্কে মৃতপ্রায় হয়ে গেছেন তিনি। শহীদ ধরে ধরে ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল বাবাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, উত্তেজিত হবেন না, বাবা। বিপদের সময় উত্তেজিত হলে কোনই লাভ’ নেই। কি হয়েছে, ধীরে ধীরে বলার চেষ্টা করুন।’
ইসলাম সাহেব সাথে সাথে অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, কি হয়েছে। তা কি আর আমি জানি, খোকা! তোর ফিরতে দেরি দেখে থানায় খবর নিতে গিয়েছিলাম আমি। ফিরেছি বেলা দুটোয়। দেখি, কেউ নেই বাড়িতে। বাড়ি খাখা
কুয়াশা-২৫
৩১
করছে। বৌমার ঘরে শুধু একটা ছোট্ট বাক্স পড়ে থাকতে দেখলাম।’
| শহীদ ঘড়ি দেখল। বেলা তিনটে। বাবাকে প্রশ্ন করল, “ঠিক ক’টার সময় বের হয়েছিলেন আপনি?’
তা তো মনে নেই! বারটা-সাড়ে বারটা হবে হয়ত।’
শহীদ কি যেন, ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি বাক্সটা দেখে আসি। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। চিন্তা করবেন না, চেষ্টা করলে ওদের খবর পাবই। কামাল এসেছিল?’. ‘
নিরাশভাবে মাথা নেড়ে জানালেন ইসলাম সাহেব, না।
শহীদ বসবার ঘর থেকে শোবার ঘরে এল। মেঝেতেই পড়ে আছে বাক্সটা । এ বাড়ির বাক্স নয় এটা, দেখেই বুঝল শহীদ। হাতে তুলে নিয়ে চমকে উঠল সে। বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধ এসে ঢুকল ওর নাকে। বাক্সের ভিতরে তুলোর উপর রাখা কৌটোটা দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। গ্যাস ভর্তি কৌটোটা গরম থাকারই কথা। বাক্স যাতে উত্তপ্ত না হয়ে ওঠে তার জন্যে তুলোর ব্যবস্থা। কিন্তু কেউ যদি এটা নিয়ে এ বাড়িতে এসেই থাকে, তবু বেডরূমে এটা এল কিভাবে? শহীদ চিন্তা করে নিল খানিক। তারপর অনুমান করল রহস্যটা। কেউ মহুয়া আর লীনাকে দিয়েছিল বাক্সটা ভুল বুঝিয়ে। ওরা শোবার ঘরে এসে খুলেছিল বাক্সটা। সাথে সাথে গ্যাসের দরুন অচেতন হয়ে পড়েছিল ওরা। কিন্তু তারপর? অচেতন দেহ দুটো সরালো কে? শত্রুরা তাহলে অপেক্ষা করেছিল! অচেতন দেহ দুটো নিয়ে ভেগে গেছে। শত্রু তাহলে একজন নয়, দুজন বা আরও বেশি সংখ্যায়
এসেছিল। কিন্তু এই ষড়ন্ত্রের কারণ?
নির্মম রেখা ফুটে উঠতে শুরু করল শহীদের অবয়বে। আগুনের শিখা ঠিকরে পড়ছে যেন দুই চোখের দৃষ্টি থেকে। হাতের মুষ্টি শক্ত হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধীর পায়ে ফিরে এল ও ড্রইংরূমে। এই অপকর্মের জন্যে সোলায়মান চৌধুরী দায়ী, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই শহীদের মনে। শহীদকে শাস্তি দেবার জনন্য কাপুরুষের মত দুর্বল মেয়েদের উপর জুলুম করতেও বাধেনি শয়তানটার। চরম শাস্তি দিতেই হবে শয়তানকে, প্রতিজ্ঞা করল শহীদ। কিন্তু সবচেয়ে আগে মহুয়া, লীনা আর গফুরকে উদ্ধার করতে হবে। | ‘কি করবি ঠিক করলি, খোকা?’ ইসলাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন শহীদের দিকে তাকিয়ে।
শহীদ উত্তর দেবার আগেই শোনা গেল একটা কাতর গোঙানির শব্দ। শব্দটা আসছে পাশের ঘর থেকে । ছুঁটে বের হয়ে গেল শহীদ।
পাশের ঘরে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতবাক হয়ে গেল শহীদ। আবার শব্দ হলে চৌকির নিচেটা দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়ল শহীদ। চমকে উঠল ও। গফুর মাথা ঘষছে মেঝের সাথে চৌকির নিচুে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ।
৩২
ভলিউম-৯
গফুরের শারীরিক কোন কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারল “হীদ! চৌকিটা খাড়া করে তুলে দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে দিল ও। চোখ মেলে তা কাল গফুর। দাদামণিকে ওর সামনে বসে থাকতে দেখে কাকাদ হয়ে গেল ওর মুখ। শহীদ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কিরে, এমন হাল কে করল তোর? তোর দিদিমণিরা কোথায়,
জানিস?
গফুর যা জানে সব বলল। সব শুনে কঠিন আকার ধারণ করল শহীদের মুখাবয়ব। এমন সময় বাড়ির গেটে শোনা গেল গাড়ি থামার শব্দ। ব্রেক কষে ধরার ফলে তীক্ষ্ণ শব্দ হল। ঘর থেকে বের হয়ে এল শহীদ। টলতে টলতে গফুরও এল বারান্দায়। ছুটতে ছুটতে গেট অতিক্রম করে আসতে দেখা গেল কামালকে। দরদর করে ঘামছে ও। চোখ-মুখে উত্তেজনার চিহ্ন। শহীদের কাছাকাছি এসে হঠাৎ যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত’ হল কামাল। বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও শহীদের দিকে। শহীদের এমন কঠিন, এমন ভীতিকর, এমন অদ্ভুত, গম্ভীর চেহারা আর কখনও দেখেনি কামাল। অমঙ্গল আশঙ্কায় দুলে উঠল ওর বুক। অস্ফুট কণ্ঠে ও উচ্চারণ করল, শহীদ!
থমথমে কণ্ঠে শহীদ বলে উঠল, মহুয়া আর লীনাকে সোলায়মান চৌধুরীর গুণ্ডাবাহিনী কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, কামাল। মি. সিম্পসন আর আমাকে আক্রমণ করেছিল ওরা রহমানের ঘরে। মি. সিম্পসন হাসপাতালে। তোর খবর কি?’
| রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল কামাল শয়তান-পক্ষের দুঃসাহসের কথা কল্পনা করে। শহীদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, শহীদ, আমি অদ্ভুত, ভীতিকর এক হত্যাকাণ্ড দেখে এসেছি। আমার কি মনে হয় জানিস, সোলায়মান চৌধুরী আসলে মি. সারওয়ারই। সোলায়মান চৌধুরী ছদ্মবেশে মি. সারওয়ার সেজে আছে।’ | এত দুঃখেও হেসে ফেলল শহীদ। কামাল উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, তুই হাসছিস, শহীদ! আমি নিজের চোখে দেখে এলাম, মিরপুর চিড়িয়াখানার এক ঝোঁপের মাঝে মি. সারওয়ার ওসমান গনিকে হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখলেন!
ভুরু কুঁচকে শহীদ বলে উঠল, বলিস কি!’
কামাল আদ্যোপান্ত খুলে বলল শহীদকে সব কথা। কামালের কথা শেষ হতেই ড্রইংরুমের ফোন বেজে উঠল। দু’জনই ঢুকল ড্রইংরূমে। রিসিভার তুলে নিল শহীদ। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল সে ফোনের অপর প্রান্তের বক্তার বক্তব্য। তারপর হ্যাঁ, আমি আসছি এখুনি,’ বলে রেখে দিল শহীদ রিসিভার। কামালের দিকে ফিরে ওকে চমকে দিয়ে বলে উঠল ও, ওসমান গনিকে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছে মি. সারওয়ার, তুই বললি না? কিন্তু স্বয়ং ওসমান গনি মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ফোন করলেন। গুরুতর একটা ব্যাপারে জবানবন্দি দেবেন বলে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।’ ৩-কুয়াশা-২৫
‘অসম্ভব! চিৎকার করে উঠল কামাল।
শহীদ বলল, “ঠিক আছে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এখুনি। আয় আমার সাথে।’
ইসলাম সাহেব এবং গফুরকে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে বলে বেরিয়ে পড়ল ওরা মিডফোর্ডের উদ্দেশে।
মিডফোর্ড হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট কেবিনে ঢুকে বেশ একটু অবাক হয়ে গেল শহীদ। কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার, বল তো?’
নার্স ওদের পরিচয় নিয়ে কেবিনের দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু কেবিনের অতগুলো ডাক্তারের মধ্যে একজনও মনোযোগ দিচ্ছে না ওদের দিকে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল শহীদ ও কামাল। ডাক্তাররা শলা-পরামর্শ করছে, ছুটোছুটি করছে নার্সরা। কেবিনের মাঝখানে একটা বেড। বেডের পেশেন্ট নিশ্চয় ওসমান গনি। কিন্তু ভিড়ের জন্যে দেখা যাচ্ছে না ভদ্রলোককে।
, পনের মিনিট পর ড, মোমিন শহীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভদ্রলোক শহীদের পূর্ব-পরিচিত। শহীদ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, মি. গনির অবস্থা কি খুব সিরিয়াস?’
| ড. মোমিন বললেন, সিরিয়াস নয়, তবে ভদ্রলোক ভয় পেয়েছেন বড়। আপনাকে ফোন করবার জন্যে ব্যর্থ হয়ে উঠেছিলেন বলে ফোন এখানে আনার ব্যবস্থা করেছিলাম। ফোন করলেন বটে আপনাকে, কিন্তু একটু পরেই জ্ঞান হারালেন। আবার ফিরেছে জ্ঞান, কথা বলার অনুমতি না হয় দিচ্ছি, কিন্তু উনি ভয় পাবেন এমন কোন কথা বলা চলবে না এখন। উত্তেজিতও যেন না হয়ে ওঠেন।
শহীদ মাথা নেড়ে বলল, ধন্যবাদ, ডক্টর।’
কথাটা বলে শহীদ ওসমান গনির বেডের এক পাশে বসল ধীরে ধীরে। কামালও এগিয়ে এল। অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে উঠেছে ওর চোখ জোড়া। এই ওসমান গনিকে মি. সারওয়ার মাটির নিচে পুঁতে রাখছেন, পরিষ্কার দেখে এসেছে কামাল। অথচ জলজ্যান্ত সেই ভদ্রলোকই এখন শুয়ে রয়েছেন হাসপাতালের কেবিনে। কেমন করে এ সব হল?
শহীদ ওসমান গনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কোন চিন্তা নেই মি. গনি, আপনি যা জানেন সব বলুন, আমি তো অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবই।’
. ওসমান গনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ শহীদের মুখের দিকে। কি যেন ভাবতে চেষ্টা করলেন দুর্বলভাবে। তারপর কামালের দিকে তাকালেন। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বলে চললেন, আমি এবং সারওয়ার প্রায় বছরখানেক আগে স্লপনাদের সাহায্য চেয়েছিলাম। কোলকাতায় প্রায় দেড় বছর আগে ওর সাথে এবং এরফান মল্লিকের সাথে পরিচয় হয় আমার। সারওয়ারের পরামর্শেই এরফান মল্লিকের সাথে ব্যবসা করতে রাজি হই আমি। সারওয়ার আর
ভলিউম-৯ ৩৪
আমি দু’জনেই এরফান মল্লিককে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এরফান মল্লিক বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমরা তাকে কোলকাতা শহরে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কোন হদিসই পেলাম না তার। ভাবলাম, শয়তানটা নিশ্চয় ঢাকায় পালিয়ে গেছে। আমরাও আমাদের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। আমি এবং সারওয়ার দু’জনেই ঢাকায় চিত্র-ব্যবসায় নামলাম। এবং এরফান মল্লিকের সন্ধান পাবার আশায় আপনাদের শরণাপন্ন হলাম।
ওসমান গনি প্রচণ্ড উত্তেজনাবোধ করছেন। কিন্তু বড় দুর্বল হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। ফলে উত্তেজনা দমন করে রাখার প্রয়াস পাচ্ছেন প্রাণপণে। শহীদ তন্ময়ভাবে শুনছিল কথাগুলো। ওসমান গনি থামতেই প্রশ্ন করল ও, আপনারা হঠাৎ এরফান মল্লিকের সন্ধান পাবার আশা ত্যাগ করলেন কেন পরে?
| ‘সেই কথাই বলছি। গত মাস ছয়েক আগে হাঁপাতে হাঁপাতে সারওয়ার এল। আমার বাড়িতে। এসেই দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল নিজের হাতে। তারপর বলল, এরফান মল্লিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, দিলে আমাদের পাওনা টাকা নাকি আদায় করা যাবে না। খবরটা ও আমাকে জানাল বটে, কিন্তু এরফান মল্লিক কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, কিভাবে তার সন্ধান পেয়েছে ও–এসব কিছুই প্রকাশ করল না আমার কাছে।
কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠল ওর গতিবিধি। আমাকে বারবার শুধু সাবধান করে দিত ও, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে, আমরা এরফান মল্লিকের সন্ধান
জানি।।
ওসমান গনি জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলেন, বহুভাবে চেষ্টা করেছিলাম আমি আসল কথাগুলো আদায় করার জন্যে। কিন্তু কার সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল ও, তা জানতে পারিনি! তারপরই কঙ্কাল-রহস্য ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আমি, ঘুণাক্ষরেও সারওয়ারকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করিনি। কিন্তু সারওয়ারই কঙ্কালের আবিষ্কারক, মি. শহীদ! আজ আমি তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি।’
মি. সারওয়ার কঙ্কালের আবিষ্কারক।
আঁতকে উঠল কামাল। ওসমান গনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে চললেন, আজ সুরাইয়া-হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিলেন আপনারা। তার একঘন্টা পরই সারওয়ার আসে আমার কাছে। সে আমাকে হঠাৎ সব রহস্য খোলাসা করে বলতে শুরু করল। বলল, অভিনেত্রী সুরাইয়া আসলে এরফান মল্লিকের মেয়ে। তাকে কে হত্যা করেছে তা-ও সে জানে। হত্যাকারী এরফান মল্লিকের মেয়ের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মেরে দেবার ব্যবস্থা করেছে। টাকা ভোলার পরই হত্যা করা হয়েছে তাকে। এখন সেই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে কিন্তু আমাকে সে একটা পয়সাও দেবে না ঠিক করেছে।
. ওসমান গনি দম নিয়ে শুরু করলেন আবার, সারওয়ারের কথা শুনে রেগে উঠি আমি। আমাকে টাকার ভাগ দেবে না কেন, জিজ্ঞেস করলে খেপে যায় সে। কুয়াশা-২৫
খেপে গিয়ে জোরে জোরে লাথি মারে কয়েকবার। সাথে সাথে একজন ঘরের ভিতরে ঢোকে। হ্যাট পরেছিল সে সারওয়ারের মতই। সারওয়ারের মতই হাতে গ্লাভস, চোখে রঙিন চশমা দেখলাম পরেছে লোকটা। না না, লোক নয়–কঙ্কাল! হবহু আমার মত দেখতে। অবিকল আমার চেহারার একজন লোককে দেখে ভয়ে খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় হল আমার প্রাণটা। তারপর আর কিছু মনে নেই, জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। জ্ঞান হারাবার সময় ফোন বাজছিল।’
কামাল রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে, তারপর?
তারপর, জ্ঞান ফেরার পর দেখছি, আমি হাসপাতালে। চাকর-বাকরেরা অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে এখানে।।
কামাল গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, তাহলে মি. সারওয়ারের সাথে মিরপুর চিড়িয়াখানায় আপনি যাননি?’
মিরপুর চিড়িয়াখানায়! মানে?’
শহীদ কামালকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, যাননি মি. গনি। আসলে, এমন কি, মি. সারওয়ারও মি. গনির কাছে আসেননি। এসেছিল কঙ্কাল। এবং তুই আসলে মি. সারওয়ারের সাথে যাকে দেখেছিস তিনি মি. গনি নন-তুই মি. গনি রূপী কঙ্কালকে দেখেছিস। চল, এখুনি একবার যেতে হবে মি. সারওয়ারের বাড়ি। চলি, মি. গনি। পরে দেখা করব আপনার সঙ্গে।’
হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে এল ওরা। গাড়িতে চেপে বসল দু’জন।
মি. সারওয়ারের বাড়ির উদ্দেশে ছুটে চলল গাড়ি। মাঝপথে শহীদ কেবল একটা কথা বলল, এখন পৌঁছে যদি দেখি যে মি. সারওয়ার নিহত হয়েছেন তাহলে আশ্চর্যের কিছুই নেই।’
তার মানে?’ কামালের কথার উত্তর দিল না শহীদ। গভীর চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে ওকে।
মি. সারওয়ারের বাড়ির সামনে এসে দেখা গেল, শহীদের আশঙ্কা সত্য। মি. সারওয়ারের বাড়ির সামনে পুলিস, সাংবাদিক্ আর জনতার পাঁচমিশালী ভিড়। ইন্সপেক্টর মি. খন্দকার অভ্যর্থনা জানালেন শহীদ ও কামালকে। জানা গেল, মি. সারওয়ার কোথা থেকে যেন ঘুরে এসে গাড়ি নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করছিলেন। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল এক ইংরেজ। গুলি করেছে সেই-ই। মাথায় ঢুকেছে’ বুলেট। সাথে সাথে নিহত হয়েছেন মি. সারওয়ার। খুনী পালিয়েছে গুলি
করেই।
সব শুনে গম্ভীর হয়ে উঠল শহীদ। সময় নষ্ট না করে ফিরে চলল ওরা বাড়ি
অভিমুখে।
বাড়িতে ঢুকেই ওরা বুঝতে পারল–মহুয়া, লীনা ফিরে এসেছে। গাড়ির শব্দে চঞ্চল পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল সকলে। মুহুয়া আর লীনাকে দেখে স্বস্তির ৩৬
ভলিউম-৯
নিঃশ্বাস ফেলল শহীদ। কামাল অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মহুয়াদি’! উহ কি দুশ্চিন্তায়ই না পড়েছিলাম তোমার জন্যে! তা ছাড়া পেলে কিভাবে শয়তানগুলোর হাত থেকে? | মহুয়া আনন্দে, উত্তেজনায় কথা বলতে পারল না কয়েক মুহূর্ত। শহীদ বুঝতে পেরে বলল, সবাই ঘরে.চল, বিশ্রাম নিতে নিতে কথা হবে।
সকলে এসে বসল ঘরে। মহুয়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে গেল সব ঘটনা। শেষে যোগ করল, আমাদের বাঁধন খুলে দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে লোকগুলো একটা দিক নির্দেশ করল। সেদিকে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। লোকগুলো এল না আমাদের সাথে, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। একটু দূরে এসে দেখি, একটা কালো । মরিস দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে এসে চড়ে বসলাম দু’জন। ড্রাইভিং সিটে বসলাম
আমি। ঝড়ের বেগে চালিয়ে এই একটু আগে ফিরলাম।’ | শহীদ বলল, পাঞ্জাবী আর ইংরেজ শয়তান দুটো তাহলে জঙ্গলে বাঁধা অবস্থায় এখনও আছে? কিন্তু তোমরা যে গাড়ি নিয়ে এসেছ সেটা কই, দেখলাম না তো!’
| মহুয়া চোখ বড় বড় করে বলল, ‘সে-ও এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমরা বাড়িতে ঢোকার একমিনিট পরই শুনতে পেলাম, গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে।
গফুর বলে উঠল, সাথে সাথে ছুটে বাইরে গিয়ে দেখি, গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। ড্রাইভারটা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
শহীদ বলল, কঙ্কাল। ছিল গাড়ির বুটের ভিতরে লুকিয়ে। কামাল বলল, শহীদ, শয়তান দুটোকে ধরে আনতে হয় এবার।’
শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, চল। মিরপুর চিড়িয়াখানা তো বক্সনগরের কাছেই। কবরস্থ কঙ্কাল আর টাকা-ভর্তি অ্যাটাচী কেসটা উদ্ধার করার চেষ্টা করা যাবে। যদিও আমার বিশ্বাস, অন্তত অ্যাটাচী কেসটা এতক্ষণে গায়েব করে ফেলেছে প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকটা।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। সন্ধার খানিক আগেই পৌঁছুল বক্সনগরে। নির্দিষ্ট জায়গাটা খুঁজতে শুরু করল প্রায় কুড়িজন লোক। শহীদ-একগাড়ি আর্মড-ফোর্স সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল যাবার সময়।
| পাঞ্জাবী গুণ্ডা আর ইংরেজ বদমাশটাকে পাওয়া গেল গাছের সাথে বাঁধ অবস্থাতেই। পাঞ্জাবীটা ঢাকা শহরের কুখ্যাত গুণ্ডা, শহীদ চিনে ফেলু ইংরেজটার পেট থেকে টু শব্দটাও আদায় করা গেল না। কড়া পাহারার ব্যবস্থা করে থানায় পাঠিয়ে দিল শহীদ দুই শয়তানকেই। তারপর কামালের সাথে মিরপুর চিড়িয়াখানার উদ্দেশে রওয়ানা হল।
| কিন্তু, এক্ষেত্রেও শহীদের অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হল। নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত দেখা গেল বটে কিন্তু কঙ্কাল পাওয়া গেল না গর্তে। অ্যাটাচী কেসটারও কোন হদিস মিলল না। কুয়াশা-২৫
৩৭
গম্ভীর মুখে ফিরে চলল ওরা বাড়ির দিকে।
ভয়ানক চিন্তিগুংসের অনুপস্থিনি ইদানীং। পরিরও বের করা যায় নাম বব।
তিন-তিনটি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। বৈচিত্র্যহীন এবং ব্যর্থতার গ্লানিময় তিনটে দিন। পাঞ্জাবী গুণ্ডাটা অবশ্য যা জানে স্বীকার করল সবাই। আসলে সে যা জানে তাতে কোনই লাভ হবার সম্ভাবনা নেই। বেদম মার খেয়ে শুধু বলল, যেদিন ধরা পড়েছে ওরা তার দু’দিন আগে দলে ভিড়েছে সে। এক জুয়া খেলার আড্ডায় দেখা হয় তার ইংরেজটার সাথে। ইংরেজটা তাকে পঁচিশ টাকা রোজ হিসেবে ভাড়া করে। যোগাযোগ করার কোন বিশেষ ঠিকানা ছিল না সেই জুয়ার আড্ডা ছাড়া। মিস সুরাইয়া হত্যাকাণ্ডের কিছুই জানে না সে। রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শহীদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে, ইংরেজটার সাথে আর অন্য কোন ইংরেজকে কখনও দেখেনি সে। এই প্রশ্নের উত্তর না পেয়েই ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়ছে শহীদ। বন্দি ইংরেজটার নাম বব। কিন্তু হেস্টিংস কোথায়? হেস্টিংসের অনুপস্থিতিতে ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে শহীদ। শহরে আর কোন নতুন বিপত্তিও ঘটছে না ইদানীং। পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে।
ববের মুখ থেকে কোন উপায়েই একটি কথাও বের করা যায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা এবং ফটো দেখে শুধু জানা গেছে, বন্দীর নাম বব। সোলায়মান চৌধুরী কোথায় আছে, এই প্রশ্নের উত্তর পেলেও কাজ হত। কিন্তু শহীদ চরম নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিয়েও মুখ খোলাতে পারেনি শয়তানটার। সবরকম নির্যাতন চালিয়ে দেখা হয়েছে কিন্তু কোন ফল লাভ হয়নি। শয়তানটা মরবে, তবু মুখ খুলবে না । আধ-মরা অবস্থায় পুলিস-হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে তাকে। বাঁচে কি মরে ঠিক নেই। ওর কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যাবে না সে ব্যাপারে শহীদ ও মি. সিম্পসন একমত হতে বাধ্য হয়েছেন শেষ পর্যন্ত। এমন অপরাধী পৃথিবীতে দু’টি আছে কিনা সন্দেহ। শহীদের মতে কুখ্যাত মাফিয়া দলের সব সদস্যই এই রকম আদর্শ বজায় রেখে মরে ।, জান যায় যাবে, কিন্তু কথা বলবে
আর কোন হস্টিংসের অভছ শহীদদেখেনি সে করে জানিয়েলের হত্যাকাণ্ড
নাটকীয় ঘটনা ঘটল পঞ্চম দিনে। টঙ্গি থেকে এল রহস্যময় একটা চিঠি। শুরু হল মিস সুরাইয়া হত্যা রহস্যের নতুন অধ্যায়। চিঠিটা পড়ে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠল শহীদ। সত্যি, চিঠিটা যে রহস্যময়, তাতে কোন সন্দেহ নেইঃ
সত্যান্বেষী শহীদ খান,
পত্র পাঠমাত্র নিম্ন ঠিকানায় আপনার শুভাগমন ঘটলে আমার প্রাণ-রক্ষা পাবে বলে মনে করি আমি। বিশেষ কারণবশত আমার সঠিক পরিচয় দিতে পারছি না আপনাকে চিঠির মাধ্যমে। আমি চাই, পুলিস ঘুণাক্ষরেও আমার সম্পর্কে কিছু না জানুক। সাক্ষাতে আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করব। বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আমার প্রার্থনা বিবেচনা
ভলিউম-৯
করবেন, এই আমার অনুরোধ। নিজের বাড়িতে প্রায় বন্দী অবস্থায় আছি আমি। রক্ত-লোভী শয়তানের দল ঘুরঘুর করছে রাতদিন বাড়ির আশপাশে। দেরি হলে আমার সর্বনাশ ঘটবে।
একটা অনুরোধ, আমার মেয়ে ইডেনে পড়ে। তিন নম্বর বিল্ডিং, রূম নম্বর-পাঁচ/তিন। দয়া করে ওকে সাথে করে নিয়ে এলে বাধিত হব। প্রীতি নেবেন। আমার ঠিকানাঃ টঙ্গি, সোনা পাড়া, শান্তি ভিলা।
আপনার সাহায্যপ্রার্থী।
পাঁচ
টঙ্গি। সোনা পাড়া।।
রাত দশটা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত।
একটা মোটর গাড়ি মোড় নিয়ে এগিয়ে আসছে অপ্রশস্ত মেটো পথ দিয়ে। সাইকেল নিয়ে জনৈক পথিক কর্দমাক্ত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটার উজ্জ্বল হেডলাইট দুটো উজ্জ্বলতর হয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। সাইকেল-আরোহী একটা পা মাটিতে রেখে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। পরনে তার পুলিস কনস্টেবলের পোশাক। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল হাত দশেক দূরে।
“কি ব্যাপার?
গাড়ির ড্রাইভার গলা বের করে জিজ্ঞেস করল কনস্টেবলটার দিকে তাকিয়ে। পরমুহূর্তে স্থির হয়ে গেল তার দৃষ্টি কনস্টেবলের পায়ের সামনে লম্বা হয়ে পড়ে থাকা একটা দশাসই মানুষের উপর। লাফ দিয়ে বের হয়ে এল ড্রাইভার গাড়ির ভিতর থেকে। কনস্টেবলটা বিমূঢ় গলায় বলে উঠল, একটু আগে এভাবে দেখেছি আমি লোকটাকে পড়ে থাকতে। তারপরই গাড়ির আলো দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।’
| দম নিয়ে কনেস্টবলটা আবার বলল, “আপনাদের গাড়ির হেডলাইট একটু এদিকে ফেললে ভাল করে দেখা যেত লোকটা মরে গেছে না বেঁচে আছে।
ড্রাইভার দ্রুত গিয়ে গাড়িতে চড়ল। গাড়ির দিক পরিবর্তন করে নেমে পড়ল সে আবার। পিছনের সিট থেকে নামলেন এক ভদ্রলোক। কনস্টেবলটার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনিও। নিঃসাড় পড়ে থাকা বিশাল দেহটার দিকে এক পলক তাকিয়েই বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি, একি! মি. রসুল বক্স এই হালে-গুড গড!
বিস্ময়াভিভূত ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। পেশায় উকিল। আতঙ্কে দিশেহারা দেখাচ্ছে ভদ্রলোককে। তার জীবনে এমন দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য কখনও হয়নি। এ যে রীতিমত হত্যাকাণ্ড! সবচেয়ে আশ্চর্য বাপার যে ভদ্রলোক ঘন্টা কুয়াশা-২৫
৩৯
দুয়েক আগে ফোন করেছেন তাঁকে, পথিমধ্যে সেই ভদ্রলোককেই দেখা যাচ্ছে নিহত। তিনি কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সম্ভবত মি. রসুল বক্সকে চিনতেন। উনি প্রায়ই দু’জন কনস্টেবলের কথা আমাকে বলতেন। তাদেরই একজন আপনি নিশ্চয়?’ | কনস্টেবল বলল, হ্যাঁ, মি. বক্সকে চিনি আমি। একদিন পর পরই তো ওঁর বাড়িতে যাই আমি ডিউটির সময়। আজও ঘন্টাখানেক আগে গিয়েছিলাম, কিন্তু বাড়ি-ঘর সব বন্ধ দেখে ভাবলাম, উনি বাইরে কোথাও গেছেন। মি. বক্সের বিশেষ অনুরোধ ছিল, প্রতিদিন যেন একটু সময় গল্প করে যাই ওঁর সাথে।’
মি. রসুল বক্স একজন সামান্য কনস্টেবলের সাথে গল্প করে সময় নষ্ট করতেন তা জানা ছিল না উকিল ভদ্রলোকের। একটু আশ্চর্য, বোধ করলেন তিনি। কনস্টেবলটা ব্যস্তভাবে বলে উঠল আবার, আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন, আমি । থানায় গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি।’
উকিল সাহেব ভয় পেয়ে বলে উঠলেন, কিন্তু এই অপরিচিত জায়গায় লাশ নিয়ে অপেক্ষা করব কিভাবে আমরা। আমরা বরং ফিরে যাই।
কনস্টেবলটা যুক্তি দেখিয়ে বলল, “ফিরে যাবেন কিভাবে, স্যার? সরু রাস্তা, গাড়ি ঘোরাতে পারবেন না যে?’
উকিল সাহেব তার ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি বল, সাবের?’
সাবের পা পা করে কনস্টেবলটার গা ঘেঁষে উকিল সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যাবার সময় কনস্টেবলটার সাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে গেল তার। ভয় পেয়েছে বেচারা অন্ধকার রাতে লাশ দেখে । নিরুপায় হয়ে বলে উঠল সে, “কি আর করা, আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে তাহলে।
| আর কোন কথা না বলে কনস্টেবলটা প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
অনেকক্ষণ পর ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল কাঁপা কাঁপা গলায়, মি. বক্স কি মরে গেছেন, সাহেব?’।
তাই তো মনে হয়। নড়ছেন না তোতা একটুও।’ দেখলে হয় না একবার? হয়ত আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন।
উকিল সাহেব রাস্তার দু’পাশের গাঢ় অন্ধকারময় জঙ্গলের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। ভয় লাগছে ভদ্রলোকের। গাড়ির বাঁ পাশে কি দেখলেন কে জানে, মনে হল, একটা মানুষের কাধ দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। চমকে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার আর তাকাবার সাহস হল না সেদিকে
তার।।
আরও অনেকটা সময় কেটে যাবার পর ড্রাইভার সাবের অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্যে বলে উঠল কনস্টেবলটা গেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল।’
৪০
ভলিউম-৯
উকিল সাহেব উত্তর না দিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হেড-লাইট দুটোর আলো কমে আসছে। অফ করে দিলেন তিনি লাইট দুটো। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল পরিবেশটা সাথে সাথে। এবং বাতি নেভার সাথে সাথেই সাবের বলে উঠল, মি. বক্স বোধহয় খুন হয়েছে, না সাহেব?’
| ‘খুন! চমকে উঠলেন উকিল সাহেব। নিশ্চয় খুন হয়েছেন মি. বক্স। লাশের গায়ে রক্ত দেখা গেছে আলোতে। হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা তাহলে তো
আশপাশে কোথাও থাকতে পারে! ভয়ে ভয়ে পিছন দিকে তাকালেন তিনি। এবং সাথে সাথে একটা আর্তচিৎকার বের হল তার গলা থেকে–কে•••?’
সাবের দ্রুত হাতে হেড লাইটের সুইচ অন করল। ‘কে, আপনি?’
চিৎকার করে উঠলেন উকিল সাহেব আবার। অন্ধকার থেকে দৃঢ় পদক্ষেপে আবির্ভূত হল শহীদ। শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল ও, আমার গাড়িটা বিকল হয়ে গেছে মাইলখানেক পুবে। বাধ্য হয়ে হেঁটে আসতে হচ্ছে এতটা পথ। আপনাদের বিপদটা কি? গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বুঝি?’
উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, একজন কনস্টেবলকে যেতে দেখেছেন আপনি সাইকেল চালিয়ে?
কনস্টেবল? সাইকেল চালিয়ে? না তো, কাউকে দেখিনি তো আমি?
উকিল সাহেব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কনস্টেবল কোন দিকে গেল তাহলে? ঘটনা যতটুকু জানেন তিনি তা বলা দরকার মনে করলেন আগন্তুককে। নিজের পরিচয় দিলেন, আমার নাম মাহমুদ হোসেন। উকিল।
শহীদ বলল, আমি শহীদ খান।
মাহমুদ হোসেন বলে উঠলেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান? এদিকে দেখুন তো; মি. খান!
নিহত রসুল বক্সের লাশটা এতক্ষণ আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহমুদ হোসেন। সরে গিয়ে দেখালেন শহীদকে লাশটা। শহীদ সামনে এগিয়ে এল। পকেট থেকে একটা ইলেকট্রিক টর্চ বের করে লাশের মুখে আলো ফেলল ও। অনেকক্ষণ ধরে দেখল লাশটা। তারপর বলে উঠল, ‘আমি ভদ্রলোকের চিঠি পেয়ে দেখা করতে আসছিলাম। বাঁচানো গেল না শেষ পর্যন্ত।
“তাই নাকি! আমাকেও উনি ফোনে ডেকে পায়েছিলেন ঘন্টা-দুয়েক আগে। আপনি মি. বক্সকে চিনতেন? বাঁচানো গেল না মানে?’
, চিনতাম না। তবে আজই ভদ্রলোকের ফটো দেখেছি এক জায়গায়। আপনার সাথে এ লোকটা কে, ড্রাইভার?’ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল শহীদ। মাহমুদ হোসেন বললেন, হ্যাঁ।
. শহীদকে সব বললেন মাহমুদ হোসেন। শহীদ রসুল বক্সের লাশ পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছেন। কুয়াশা-২৫
৪১
অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ড্রাইভারটা। ‘একি! রক্ত এল কোত্থেকে!’
দেখা গেল ড্রাইভারের শার্টে রক্তের দাগ। আবার ভীত গলায় ককিয়ে উঠল সে, লাশের ধারেকাছেও যাইনি আমি, রক্ত কোত্থেকে এল আমার শার্টে?’
ভয়ে কাদাদ হয়ে গেছে লোকটার মুখ। শহীদ ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, উত্তেজিত হয়ো না, লাশ না ছুঁলেও অন্য কি কি ছুঁয়েছ?’
‘কিছু ছুঁইনি আমি।’ শহীদ গম্ভীর ভাবে বলে উঠল, ভাল কথা। দেখি আমি।’
দেখতে দেখতে শহীদ মন্তব্য করল, তোমার প্যান্টেও দেখ রক্ত লেগেছে। কোন কিছুর সাথে হোঁচট খেয়েছিলে বা ধাক্কা লেগেছিল কিছুর সাথে?
না!’
শহীদ বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, তাহলে তোমার প্যান্টে সাইকেলের চাকার দাগ কেন? কাদার দাগটা তো সাইকেলের চাকার সাথে প্যান্টের ছোঁয়া লাগার ফলেই দেখা দিয়েছে?’
মাহমুদ হোসেন বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কনস্টেবলের সাইকেলের সাথে ওর একবার ধাক্কা লেগেছিল বটে। ওর মনে নেই।
মাহমুদ হোসেনের দিকে ফিরে শহীদ বলল, আপনি ওকে থানায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে যান। কাল সকালে দেখা করব আমি। রাতটা হাজর্তে কাটাতেই হবে
ওকে।’
অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির যে চিঠিটা আজ সকালে পেয়েছিল শহীদ সেটা যে আসলে এরফান মল্লিকের সে সন্দেহ প্রথমেই করেছিল সে। চিঠিতে লেখা ছিল ভদ্রলোকের মেয়ের নাম মিস সুরাইয়া বেগম। শহীদ পরিষ্কার বুঝতে পারল রহস্যাটা। এরফান মল্লিকের মেয়ের নামও তাহলে সুরাইয়া বেগম। মেয়েকে সাথে নিয়ে যাবার কথা লিখেছিলেন ভদ্রলোক। শহীদ বুঝল, অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগমের বাড়িতে চাকর-বাকরের সাথে যে যুবতী নিহত হয়েছে সে এরফান মল্লিকের মেয়ে মিস সুরাইয়া বেগমই। অপরাধী সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে মিস সুরাইয়া বেগম নয়। তবু ইডেন গার্লস কলেজের হোস্টেলে গেল শহীদ। সন্দেহটা সত্য বলে প্রমাণিত হল। গত পাঁচ দিন হল সুরাইয়া হোস্টেলে ফেরেনি। কোন খবরও দিয়ে যায়নি সে। থানাতে ডায়েরী করানো হয়নি, কারণ সুরাইয়া প্রায়ই এরকম না বলে বাড়ি চলে যেত। যাই হোক, সুরাইয়ার বাক্স-পেটরা ঘেঁটে জনৈক প্রৌঢ় ভদ্রলোকের ফটো পেল শহীদ। এবং একটা চেক বই। ফটোটা অসুস্থ ওসমান গনিকে দেখাতে তিনি এরফান মল্লিককে চিনতে পারলেন। আর কোন সন্দেহ রইল না শহীদের। এরপর ও সুরাইয়ার বাক্স থেকে পাওয়া চেক বইয়ের নম্বর নিয়ে গেল ব্যাঙ্কে। দেখা গেল, একজন ইংরেজ একটা আড়াই লাখ টাকার বেয়ারার-চেক ভাঙিয়ে টাকা নিয়ে গেছে পাঁচ দিন আগে। অর্থাৎ যেদিন নিহত ৪২
ভলিউম-৯
হয়েছে মিস সুরাইয়া সেইদিন।
| শহীদের কাছে আর কোন রহস্য রইল না। অতি সহজ কেস। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রতিদিন এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি তথ্য বের হচ্ছে। পাঠকরা পর্যন্ত পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, সোলায়মান চৌধুরীই এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করছে। এখন সোলায়মান চৌধুরীকে খুঁজে বের করাই একমাত্র সমস্যা। এমন ছোট অথচ অসামান্য সমস্যায় এর আগে কখনও পড়েনি শহীদ। কে যে সোলায়মান চৌধুরী তা নিশ্চয় করে জানা কোনরকমেই সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে এরফান মল্লিক পথিমধ্যে নিহত হয়েছেন দেখে শেষ আশাও শেষ হয়ে গেল। পুলিস কনস্টেবলটা যে আর ফিরে আসবে না, তা শহীদ বুঝতে পারল মনে মনে। মাহমুদ হোসেনকে তাই চলে যেতে বলল ও। মাহমুদ হোসেন গাড়ি ব্যাক করে ড্রাইভার সাবেরকে পাশে বসিয়ে নিয়ে চলে গেলেন স্থানীয় থানার দিকে।
শহীদ সামনের দিকে এগোতে লাগল। সরু রাস্তাটা কিছুদূর গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। ছোটমত একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। মাঠটা রসুল বক্স ওরফে এরফান মল্লিকের বাড়ির সম্মুখভাগে। টর্চ জেলে মাঠের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে রক্তের দাগ খুঁজছিল শহীদ। দু’জায়গায় দেখা গেল রক্তের দাগ। জুতোয় কাদা লাগার ফলে হাঁটতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল ওর। অন্ধকার মাঠের উপর দিয়ে আলো ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়ে একটা বাড়ির সামনে পৌঁছুল শহীদ। গেটের মাথায় আলো ফেলতে দেখা গেল, লেখা রয়েছে শান্তি ভিলা। বাড়ির গেটটা খোলাই দেখা গেল। সামনের দিকে চোখ মেলে ভিতরে ঢুকল ও। হঠাৎ দেখল ও একটুখানি আলোর আভাস। একটা ঘরের জানালা দিয়ে আলোটা দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল আকস্মিকভাবে। শহীদ সেই ঘরের দরজার সামনে গিয়ে টোকা মারল।
সাড়া না পেয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থবার ধাক্কা মারল সে দরজার গায়ে। কিন্তু তবু কেউ দরজা খুলল না। কোন সাড়াশব্দও পাওয়া গেল না ঘরের ভিতর থেকে। শহীদের বারবার মনে হতে লাগল, আশপাশের অন্ধকার ঘরগুলোর জানালা থেকে কেউ ওকে দেখছে। অকারণে সময় নষ্ট না করে শহীদ দরজার কাছ থেকে সরে এসে জানালাটার কাছে চলে এল। প্রবল বাতাস বইছে। শীতের প্রকোপ হঠাৎ যেন প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে। জানালার গ্রিল সরিয়ে ফেলল শহীদ। উঠে পড়ল জানালায়। ঠিক তখনই যেন কানে ঢুকল একটা পদশব্দ। কান পাতল শহীদ। শোনা যাচ্ছে না
আর কোন শব্দ। জানালা থেকে ঘরের মেঝেতে নেমে দাঁড়াল ও। টর্চ জ্বেলে ও দেখল, ঘর শূন্য। ঘরের একটা দরজা বন্ধ। দরজার কাছে গিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল সেটা। একটা মাঝারি আকারের হলঘরে এসে দাঁড়াল শহীদ। দরজা দেখা যাচ্ছে একটা। বন্ধু বলেই মনে হল। পা টিপে টিপে দরজার সামনে গিয়ে পাল্লার সাথে কান ঠেকাল সে। পর মুহূর্তে আচমকা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল ভেজানো কুয়াশা-২৫
.৪৩
জানাল
স। প্রবল বাতাস শহীদ দরজা
পাল্লা দুটো। যা সন্দেহ করেছিল তা-ই। খপ করে কার যেন একটা হাত ধরে ফেলল ও। টর্চটা হঠাৎ পড়ে গেল হাত থেকে। শান্তস্বরে বলে উঠল ও, আমি দুঃখিত। আপনি কোন মহিলা নিশ্চয়?”
. জোরে জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ কানে ঢুকল শহীদের। হাতটা ছেড়ে দিল ও। টর্চটা খুঁজে নিয়ে জ্বালল। শহীদ যার হাত ধরে ফেলেছিল সে ঘরের এককোণে সরে গেছে। টর্চের আলো সেদিকে ফেলে শহীদ শান্তভাবে বলে উঠল, ‘আমাকে ভয় পাবেন না দয়া করে। আমি যা আশা করেছি, তাই। আপনি নিশ্চয়ই অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম?”
আ-আপনি!
শহীদ শান্ত কণ্ঠে বলল, আমার পরিচয়? আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান।’
| আমাকে বাঁচান!’
অকস্মাৎ সুন্দরী মিস সুরাইয়া বেগম কাতর কণ্ঠে আবেদন জানাল । পরমুহূর্তে অদম্য আবেগে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল সে। শহীদ বলল, ভয়ের আর কিছু নেই, মিস সুরাইয়া। আপনি কবে থেকে আছেন, এখানে? আপনি এখানেই বা কেন…?’।
অনেক সাধ্য-সাধনার প্রায় কুড়ি মিনিট পর শহীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করল মিস সুরাইয়া। শহীদ প্রশ্ন করল, আপনি কবে এখানে এসেছেন? কেন?’
| মিস সুরাইয়া মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিতে লাগল, আমি যা বলব তা শুনতে অদ্ভুত ঠেকবে। কিন্তু সত্যি কথাই বলব আমি। আমার বাবা এসব কথা প্রকাশ করতে কঠিনভাবে বারণ করেছেন। কিন্তু যেসব ঘটনা আমি এই কদিনে দেখেছি সেসব ঘটনা যে কেউ দেখলে, পাগল না হয়ে উপায় থাকবে না তার। এই মুহূর্তে আমি প্রকৃতিস্থ নেই। আমার বাবার আদেশ পুরোপুরি পালন করা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলছি–আজ প্রায় ছ’মাস হল মি. রসুল বক্সের কাছে চাকরি নিয়েছি আমি। চাকরিটা নিতে আমার বাবা আমাকে আদেশ করেছিলেন। প্রতি সোমবারে এখানে আসতে হয় আমাকে। বুধবার দিন ফিরে যাই।
‘মি. রসুল বক্সের অদ্ভুত অদ্ভুত কয়েকটা অভ্যাস ছিল। কাদের ভয়ে জানি না, সবসময় তিনি ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতেন। বাড়ি থেকে একেবারেই বের হতেন না। প্রতিটি দরজায় তিনি ইস্পাতের পাত মুড়ে দিয়েছেন। গেটটা সবসময় বন্ধ করে রাখতেন। আমি এবং দু’জন পুলিশ কনস্টেবল ছাড়া এ বাড়িতে কেউ-ই ঢুকতে পারত না। হাট-বাজার করত ঐ পুলিস দু’জনই, মি. বক্স ওদেরকে দুটো সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। প্রতি রাতেই দুজনের একজন বাইরে থেকে মি. বক্সের সাথে কুশল বিনিময় করে যেত। দুজনকেই পয়সা দিতেন মি. বক্স। সানন্দে মি. বক্সের হয়ে কাজ করত ওরা। আমি এখানে চাকরি নেবার আগে মি, বক্সের মেয়ে তাঁর
ভলিউম-৯।
৪৪
ব্যবসা সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি করত। সে এম. এ. পড়ছে বলে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। আমি আমার বাবার অদ্ভুত আদেশে কাজটা গ্রহণ করতে বাধ্য হই।’
একটু দম নিয়ে আবার শুরু করল মিস সুরাইয়া, আমি আমার বাবার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কিছুই জানি না। শুধু এব্যাপারেই নয়, আরও অনেক বিষয়ে তার অদ্ভুত আচরণের কোন কারণ আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি আমি। যাই হোক, মি. বক্স বয়সে আমার গুরুজন। শুধু সে-জন্যেই নয়, কেন জানি না, তার প্রতি আমার এবং আমার প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং স্নেহের অচ্ছেদ্য একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
একটু ভেবে নিয়ে মিস সুরাইয়া আবার বলতে শুরু করল, প্রতি সোমবারের মত এবারও আমি এখানে এসেছিলাম। মি. বক্সকে এবার অতিমাত্রায় বিচলিত এবং ভীত দেখলাম। উনি আমাকে একটা চিঠি লিখতে বললেন। সেই চিঠি পেয়েই আপনি এসেছেন, মি. শহীদ। চিঠির হাতা-মাথা কিছুই বুঝতে পারিনি আমি। চিঠিটা পোস্ট বক্সে ফেলে বাড়িতে ঢুকে দেখি, আশ্চর্য ব্যাপার! দুজন লোক মি. বক্সকে বেঁধে রেখেছে দড়ি দিয়ে। দু’জনের মধ্যে একজন বাঙালী, অন্যজন ইংরেজ। তাদেরকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, তারা কেউ-ই আমার কোন ক্ষতি করল না।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, “লোকগুলো বাড়িতে ঢুকল কিভাবে?
জানালার ইস্পাত খুলেছিল ওরা আমি বাইরে যেতে। মি. বক্স দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমুচ্ছিলেন।
তারপর?
‘লোক দু’জন আমাকে একটা ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল, বলল তারা আমার কোন ক্ষতি করবে না। আমি ঘরের ভিতর থেকে বুঝতে পারলাম, মি. বক্সকে রাজি করাবার চেষ্টা করছে ওরা একটা চেক লিখে দেবার জন্যে। ব্যাঙ্কে যত টাকা আছে সব টাকা দাবি করছিল ওরা। একনাগাড়ে কয়েকদিন অত্যাচার সহ্য করবার পর আজ বিকেলে বাধ্য হয়ে চেক লিখে দেন মি. বক্স। এবং আজ বিকেলেই কি কারণে জানি না, মি. বক্সকে দিয়ে উকিল মাহমুদ হোসেনকে ফোন করায় তোক দু’জন। তারপর দুজনের মধ্যে কি ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয় যেন। রাত সাড়ে নটায় বের হয়ে যায় একজন বাড়ি থেকে। দশ মিনিট পর মি. বক্সকে নিয়ে চলে যায় ইংরেজটা। যাবার সময় আমার ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, তারা যা করছে তা আমার বাবার ইচ্ছানুযায়ীই করছে।’
শহীদ বলল, যাবার সময় বলে গেছে ওরা, আবার ফিরে আসবে কিনা?
খা।
শহীদ বলল, আপনার বাবার নামটা বলবেন কি?
মিস সুরাইয়া বলল, না, আমার পক্ষে ওই একটা মাত্র কথা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার মন বলছে, আমার বাবা কোন গর্হিত অপরাধ করেছেন এবং করছেন। কুয়াশা-২৫
৪৫
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি পারব না তার পরিচয় প্রকাশ করতে। আমি দুঃখিত, মি.
শহীদ। এ ব্যাপারে আমাকে অনুরোধ করবেন না। | শহীদ বলল, “মি. বক্সকে আপনি শ্রদ্ধা করতেন। তার সর্বনাশের কথা ভেবেও
কি আপনার বাবার পরিচয়টা দিতে পারেন না আপনি?
চমকে উঠে মিস সুরাইয়া বলল, মি. বক্সের সর্বনাশ। মানে? ‘মি. বক্স নিহত হয়েছেন।’
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মিস সুরাইয়া শহীদের দিকে! হঠাৎ যেন পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে সে। শহীদ বলল, তবু বলবেন না?
| কোন কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না মিস সুরাইয়া। আচমকা কুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শুধু। বাঁধভাঙা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে শুরু করল তার সর্বশরীর।
একটু প্রকৃতিস্থ হতে শহীদ জিজ্ঞেস করল, আপনি মি. বক্সের মেয়েকে কখনও দেখেছেন? তার নাম জানেন?
, দেখিনি। শুনেছি তার নামও সুরাইয়া! ‘সে-ও নিহত হয়েছে।
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল মিস সুরাইয়া। শহীদের কথা যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। শহীদ বলল, তবুও বলবেন না, আপনার বাবার পরিচয়?
| কোন উত্তর না দিয়ে উন্মাদিনীর মত তাকিয়ে রইল মিস সুরাইয়া শহীদের দিকে একদৃষ্টিতে। শহীদ বুঝল, এ মেয়ের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না ছদ্মবেশী সোলায়মান চৌধুরীর নকল বা আসল পরিচয়। নকল পরিচয়টাই এখন বেশি দরকার। প্রকাশ্যে সোলায়মান চৌধুরী যে নামে ঢাকার বুকে অবস্থান করছে সেই নামটা জানা গেলেই তাকে চেনা যাবে। তাছাড়া আর কোন উপায়েই সম্ভব নয়। শহীদ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আপনি এখন কি করতে চান? আমার হেফাজতে থাকবেন কি? নাকি, লোক দু’জন ফিরে আসলে তাদের সাথে যাবার ইচ্ছা?”
| ‘আমি আপনার সাথেই ফিরতে চাই ঢাকায়।
শহীদ বলল, তাহলে আমার কথা মত কাজ করতে হবে আপনাকে। পুরুষের পোশাক পরিয়ে আপাতত আপনাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করব থানায়। সেখান থেকে পরে আপনাকে নিয়ে ঢাকায় যাব। আমি রাজি?’
থানায় ফোন করল শহীদ। ও.সি.-কে পাওয়া গেল না। কোথায় যেন দুটো লাশ পাওয়া গেছে, সেখানে গেছেন তিনি। শহীদ নির্দেশ দিল, ও. সি. ফিরলে
একটা লুঙ্গি সাথে নিয়ে যেন চলে আসেন তিনি মি. রসুল বক্সের বাড়িতে।
আধঘন্টা পর থানার ও. সি. মনির হোসেন পাংশু মুখে এসে হাজির হলেন। খবর আসলে তিনি পেয়েছেন আগেই। কিন্তু আরও মারাত্মক একটা খবর পেয়ে ছুটতে হয়েছিল তাকে। শহীদ জানতে চাইল, মারাত্মক খবর! মানে কনস্টেবলের ৪৬
ভলিউম-৯
লাশ পাওয়া গেছে, তাই না? | মনির হোসেন হতবাক হয়ে গেলেন। শহীদ বলল, ‘আশ্চর্যজনক কিছুই নয়। ওই দু’জন কনস্টেবলকে হত্যা না করে সোলায়মান চৌধুরীর গুত্তাবাহিনী হত্যা করতে পারতেন না মি. রসুল বক্সকে। মাহমুদ হোসেন এবং তার ড্রাইভার যে লোকটাকে সাইকেল নিয়ে মি. বক্সের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে আসলে খুনীদেরই একজন। কনস্টেবলদেরকে হত্যা করে তাদের পোশাক আর সাইকেল নিয়ে এসেছিল খুনেরা। সাইকেলে করে লাশটা সরাচ্ছিল, একজন খুনে, এমনসময় উকিল মি. মাহমুদের গাড়ির আলো দেখা যায় রাস্তায়। সাইকেলের পিছনের সিট থেকে লাশটা নামিয়ে রেখে ধোকা দিয়েছে সে ওদেরকে। দ্বিতীয় খুনেটা আশপাশেই লুকিয়ে ছিল সম্ভবত।’ * মি. রসুল বক্সের লাশ কি আপনি সরিয়েছেন, স্যার? রাস্তায় তো দেখলাম
?’
| শহীদ অবাক হয়ে গেল। বলল, তাহলে দ্বিতীয় খুনেটাই, অর্থাৎ ইংরেজটা সরিয়ে ফেলেছে লাশ। যাই হোক, মি. মাহমুদের ড্রাইভারকে ছেড়ে দেবেন ফিরে গিয়ে। লোকটা খুনেটার সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল বলেই কাপড়ে রক্তের
দাগ লেগেছিল ওর।’
| মনির হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কি করার পরামর্শ দেবেন, স্যার?’
শহীদ বলল, মিস সুরাইয়াকে আমার পোশাক পরিয়ে সাথে করে নিয়ে চলে যান আপনি। খুনেরা আশপাশেই অপেক্ষা করছে। তারা মিস সুরাইয়াকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চায়। মিস সুরাইয়াকে পুরুষের পেশাক পরিয়ে নিয়ে গেলে ওরা অন্ধকারে চিনতে পারবে না। ভাববে, আমি ফিরে যাচ্ছি আপনার সাথে । পরে মিস সুরাইয়াকে নিয়ে যাবার জন্যে বাড়িতে ঢুকবে ওরা। আপনি থানায় গিয়ে কিন্তু দেরি করবেন না। একদল পুলিস আনবেন, পুলিস যদি সংখ্যায় কম থাকে তাহলে সাহসী একদল গ্রামবাসীকে সাথে করে নিয়ে আসবেন। বাড়ির কাছাকাছি আসবেন
দলবল নিয়ে। ওদেরকে দূরে লুকিয়ে থাকতে বলে আপনি নিজে বাড়ির কাছাকাছি এসে লুকিয়ে থাকবেন। আমার কাছ থেকে বাঁশির শব্দ পেলে আপনি বাঁশি বাজাবেন। সাথে সাথে ঘিরে ফেলতে হবে বাড়িটাকে।’
মনির হোসেন বললেন, কিন্তু থানায় গিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসতে অনেকটা সময় লাগবে। ইতিমধ্যে খুনেরা ঢুকে পড়বে বাড়িতে।
শহীদ বলল, আপনি এখান থেকে ফোন করে দিন এখুনি। যা নির্দেশ দেবার দিয়ে দিন। এক ঘন্টা পর আবার ফোন করে জেনে নেবেন, সব ব্যবস্থা করা শেষ হয়েছে কিনা। একঘন্টার মধ্যে নিশ্চয় হয়ে যাবে। ওদেরকে রওয়ানা হতে বলে আপনিও মিস সুরাইয়াকে নিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যাবেন। পথিমধ্যে দেখা হবে আপনাদের। মিস সুরাইয়াকে কারও সাথে থানায় পাঠিয়ে দিয়ে আপনি কুয়াশা-২৫
8१
দলবল নিয়ে এগিয়ে আসবেন কথামত।
‘বেশ, তাই করি তাহলে। ফোন করবার জন্যে রিসিভার তুললেন মনির হোসেন।
ছয়
ফাঁদ সার্থকভাবেই পাতা হয়েছিল। একটুও এদিক-ওদিক হল না, যেমন অনুমান করা হয়েছিল ঘটল ঠিক তেমনটিই? মনির হোসেন থানায় ফোন করে নির্দেশ দিলেন। ঘন্টাখানেক পরে আবার একবার ফোন করে নিশ্চিন্ত হয়ে নিলেন। তারপর রওয়ানা হয়ে গেলেন পুরুষের ছদ্মবেশে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়াকে সাথে করে। পথিমধ্যেই দেখা হল দলের সাথে। সবাই সশস্ত্র । মিস সুরাইয়াকে দু’জনের সাথে থানায় পাঠিয়ে দিয়ে মনির হোসেন দলবল নিয়ে রসুল বক্স ওরফে এরফান মল্লিকের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ওত পেতে রইলেন।
রাত একটার সময় বাড়িতে ঢুকল একজন লোক। দু’মিনিট পরই বাড়ির ভিতর থেকে বেজে উঠল বাঁশি। শহীদেরই কথা ছিল বাঁশি বাজাবার। সাথে সাথে দলবল নিয়ে কৌশলে ঘিরে ফেললেন মনির হোসেন সম্পূর্ণ বাড়িটা। পাঁচ জনকে সাথে নিয়ে তিনি সাবধানে ঢুকলেন বাড়ির ভিতরে। শহীদ ইতিমধ্যে বন্দি করে ফেলেছিল আগন্তুককে। আগন্তুক আর কেউ নয়-সোলায়মান চৌধুরীর কুখ্যাত সঙ্গী হেস্টিংস। | মিস সুরাইয়ার ঘর অন্ধকার করে দিয়ে ওত পেতে ছিল শহীদ। বিনা সন্দেহে হেস্টিংস পা টিপে টিপে ভেজানো দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল। সুইচ-বোর্ড কোথায় আছে জানাই ছিল তার। সুইচ অন করল সে। শহীদের বগম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল হেস্টিংসের পিছন থেকে, হ্যাঁণ্ডস, আপ! . চমকে উঠল হেস্টিংস। কিন্তু নড়ল না। শহীদের কঠিন স্বর শুনে বুঝতে বাকি রইল না তার, যে শক্ত ফাঁদে আটকা পড়েছে সে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকাল সে। দেখল, শহীদের হাতে চকচক করছে একটা রিভলভার। দেরি না করে বাঁশি বাজাল শহীদ।
এক মিনিটের মধ্যেই ঘরে এসে পৌঁছুলেন সদলবলে মনির হোসেন। বেঁধে ফেলা হল হেস্টিংসকে। তার পকেট সার্চ করে পাওয়া গেল একটা রিভলভার। একটা ক্ষুদ্রাকৃতি ওয়্যারলেস। জিনিসটা দেখতে লম্বা হাফসাইজের পেন্সিলের মত। বেঁধে ফেলার পর কথা আদায় করার চেষ্টা করল শহীদ। কিন্তু হিংস্র দৃষ্টিতে সারাক্ষণ তাকিয়ে রইল হেস্টিংস। শহীদের আধ-ঘন্টা চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। একটা প্রশ্নের উত্তর দিল না সে। শহীদ মনে মনে স্বীকার করল, মাফিয়া দলের প্রতিটি সদস্যের দলগত নীতি মেনে চলার আদর্শঃ মেরে খতম করে ফেললেও মুখ খুলবে না ওরা। ৪৮
ভলিউম-৯
সাত
তনটেয় ঢাকায় ফিরাইয়া বেগমফতার করা
লটাও পাওয়া
ডোর প্রায় সাড়ে তিনটেয় ঢাকায় ফিরল শহীদ পুলিসের গাড়ি করে। একটা জীপে শহীদ, মনির হোসেন এবং মিস সুরাইয়া বেগম। অন্য একটা ভ্যানে পুলিস প্রহরীসহ হেস্টিংস ও শোভান। শোভানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল স্টেশনে। নাইট-ডিউটিরত একজন কনস্টেবল ওকে গ্রেফতার করেছে। সাইকেলটাও পাওয়া গেছে শোভানের কাছে। পোশাকও ছিল সেই পুলিসের। এই শোভানই উকিল মাহমুদ সাহেব এবং তার ড্রাইভার সাবেরকে থানায় খবর দেবার নাম করে ধোকা দিয়ে চলে গিয়েছিল এরফান মল্লিকের লাশ রেখে।
থানায় নয়, শহীদ সকলকে নিয়ে এল ওর নিজের বাড়িতে। কামালকে ফোন করল ও। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এল কামাল ছুটতে ছুটতে। হেস্টিংসকে একটা ঘরের ভিতরে রাখা হল। শোভানকে রাখা হল অন্য একটা ঘরে। হাত পা ওদের আগে থেকেই বাধা। তবু পাহারায় রইল মনির হোসেন দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়ল শহীদ কামালকে সাথে নিয়ে। যাবার পথে কামাল জিজ্ঞেস করল, তুই কথা বলছিস না কেন, শহীদ?”
শহীদ মৃদু হেসে বলল, আগামী দশ ঘন্টার মধ্যেই সব রহস্যের ব্যাখ্যা করতে পারব বলে মনে হচ্ছে। কথা বলর দেখবি তখন। রিজার্ভ করে রাখছি
এখন।’ . মি. সিম্পসনের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামল ওরা। দারোয়ান গেট খুলে দিল। শহীদ মি, সিম্পসনকে কোন কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিল না। কামালের সাথে পাঠিয়ে দিল তাকে পুলিস হাসপাতালে। সোলায়মান চৌধুরীর আর এক কুখ্যাত সঙ্গী আছে সেখানে। তাকে সাথে নিয়ে ওরা ফিরবে শহীদের বাড়ি। শহীদও সোজাসুজি বাড়ি ফিরল না। অন্য কয়েক জায়গায় গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারল ও কয়েকটা। তারপর বাড়ি ফিরল। ইতিমধ্যে ববকে সাথে নিয়ে পৌঁছে গেছেন মি. সিম্পসন এবং কামাল।
. মি. সিম্পসন, কামাল এবং মনির হোসেনকে সাথে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকল শহীদ। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিল ও। ভিতরে গোপন শলা-পরামর্শ চলল আধঘন্টা ধরে। আধঘন্টা পর উত্তেজিতভাবে বের হয়ে এল সকলে। তারপর আশ্চর্য গতিবিধি দেখা গেল সকলের মধ্যে।
সকাল হতে দেরি ছিল না বেশি। দেখা গেল, মি. সিম্পসন বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। দশ মিনিট পরে বিদায় নিলেন মনির হোসেন তাঁর সবক’জন কনস্টেবল সাথে নিয়ে। আর দশ মিনিট পরে বিদায় নিল কামাল। শহীদের বাড়িতে রইল কেবল শহীদ, মিস সুরাইয়া বেগম, মহুয়া, ইসলাম সাহেব, লীনা আর গফুর। তা ৪-কুয়াশা-২৫
৪৯
ও যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকাল হতে সম্ভবত আধঘন্টাও বাকি ছিল না। হেস্টিংস ঘরের ভিতরে বন্দি অবস্থায় ছিল। কিন্তু চারদিক নিঃশব্দ দেখে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগল সে প্রাণপণে। এসব কাজে সে পটু। খুব বেশি বেগ পেতে হল না তাকে। হাত-পায়ের বাধন খুলে জানালার শিক বাঁকিয়ে বের হয়ে এল সে ঘর থেকে। তারপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। দ্রুতপদে দূরে চলে যেতে লাগল সে ক্রমশ।
জানালা দিয়ে শহীদ দেখল হেস্টিংসের পলায়ন। এতটুকু বিচলিত মনে হল না ওকে। ধীরে-সুস্থে মুখ-হাত ধুয়ে পোশাক বদলাতে শুরু করল ও’। মহুয়া গফুরকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে এই একটু আগে। কফি আর হালকা নাস্তা নিয়ে এল দশ মিনিটের মধ্যেই।
কফিটুকু শেষ করার সাথে সাথে ফোনের বেল বেজে উঠল। তড়াক করে লাফ দিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল শহীদ। কান পেতে শুনল কি যেন। তারপর বলল, “ভেরি গুড। এখুনি আসছি আমি।’
মি. সিম্পসন ফোন করেছিলেন। | রিসিভার রেখে দিয়ে মহুয়ার সাথে এক মিনিট আলাপ করল শহীদ। তারপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। সিধে একটা সংবাদ সংস্থার অফিসে গিয়ে হাজির হল ও। সম্পাদকের সাথে আলাপ করল। বলল, ‘ঢাকার সব সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের জানিয়ে দিন, সুরাইয়া হত্যা-রহস্য এবং কঙ্কাল রহস্যের সর্বশেষ সংবাদ জানার আগ্রহ থাকলে তারা যেন সোজা আমার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। এখন বাজে সাতটা। এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছুতে হবে সবাইকে। সেখান থেকে আমার সহকারী কামাল আহমেদ পরবর্তী অনুরোধ জানাবে।’
| সম্পাদক সাহেব উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সব রহস্যের কিনারা করে ফেলেছেন নাকি, মি. শহীদ?’
শহীদ বলল, সেই রকমই বলতে পারেন!
কঙ্কাল-রহস্যটার আসল রহস্য কি বলুন দেখি? আর মিস সুরাইয়াকেই বা কে হত্যা করল?
শহীদ বলল, আপনিও এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যান আমার বাড়িতে। সব জানতে পারবেন। ফোন করতে পারি?
হেসে ফেলে ভদ্রলোক বললেন, বুঝেছি। নিশ্চয়ই, করুন না ফোন।
শহীদ ফোন করল প্রায় দশ-বারটা। কুয়াশাকেও ফোন করল ও। কুয়াশাকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল ডি কস্টাকে। শহীদ জানিয়ে দিল, ‘কঙ্কাল-রহস্য ভেদ করেছি আমি। কুয়াশাকে হাজির হতে বল আমার বাড়িতে এক ঘন্টার মধ্যেই। ৫০
ভলিউম-৯
সবাইকে সহন। এখন বাজে থাকলে তাঁরা যে
ফোন করা শেষ করে বিদায় নিল শহীদ সম্পাদক সাহেবের কাছ থেকে। বাইরে এসে নিজের ফোক্সওয়াগেনে চড়ে পুরানো শহরের দিকে চলল শহীদ। নবাবপুর রোড হয়ে, নয়াবাজার হয়ে আর্মানিটোলার একতলা একটা বাড়ির সামনে এসে শহীদ গাড়ি দাঁড় করালো। গাড়িতে বসেই বাড়িটা দেখল মনোযোগ দিয়ে। তারপর আবার ছেড়ে দিল গাড়ি। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল ও। তারপর হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়িটার দিকেই ফিরে আসতে লাগল আবার।
| বাড়িটার কাছে এসে এদিক-ওদকি তাকিয়ে ঢুকে পড়ল শহীদ ভিতরে। উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল। বাড়িটার কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। বারান্দা ধরে এগোচ্ছে সে। এমন সময় একটা ঘরের দরজা খুলে গেল ধীরে ধীরে। উঁকি মারলেন ঘরের ভিতর থেকে মি. সিম্পসন। শহীদ ঢুকে পড়ল সেই ঘরে। ঘরের ভিতরে মি. সিম্পসন, কামাল, মনির হোসেন এবং কয়েকজন কনস্টেবল রয়েছে। ঘরের এক কোণে মেঝের উপর পড়ে রয়েছে দু’জন লোক। লোক দু’জন হেস্টিংস আর বব ছাড়া কেউ নয়। শহীদ হেস্টিংসকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবেই। শহীদের সন্দেহ ছিল, হেস্টিংস ও ববের নির্দিষ্ট কোন আড্ডা আছে। সেই আড্ডাটা কোথায়, জানা গেলে কাজ হবে অনেক। হেস্টিংস শহীদের বাড়ি থেকে পালিয়ে সিধে এসে উঠেছে এই আড্ডায়। কিন্তু শহীদের পরামর্শে মি. সিম্পসন হেস্টিংসকে অনুসরণ করার জন্যে প্রায় তিন ডজন ইনফর্মারকে কাজে লাগিয়েছিলেন। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে ছিল তারা সাদা পোশাকে। অনুসরণ করে তারা পাকড়াও করেছে হেস্টিংসকে এই আড্ডায়। এত সব আয়োজনের কারণটা অবশ্য শহীদ ছাড়া আর কেউ জানে না। | শহীদ ঘরের ভিতরে ঢুকেই কামালকে বলল, তুই এ বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে আমাদের বাড়িতে যা। সেখানে খানিকক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিক, চিত্র প্রযোজক, কুয়াশা-এঁরা সবাই পৌঁছুবেন। সঙ্গে করে এখানে আনতে হবে সকলকে। পিছনের রাস্তা দিয়েই ঢুকবি সকলকে নিয়ে। | কামাল বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতে শহীদও চলে গেল। বিশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল শহীদ। সাথে করে নিয়ে এসেছে ও অভিনেত্রী সুরাইয়া বেগমকে। কামালের ফিরতে দেরি হল আরও খানিক। বেলা ঠিক আটটার সময় এল ও প্রায় কুড়িজন ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে। তাদের মধ্যে ডি, কস্টা, ওসমান গনি, পাঁচজন চিত্র-প্রযোজক, সাংবাদিক এবং পুলিস কমিশনার স্বয়ং আছেন । শহীদ ডি. কস্টাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বস এল না কেন?’
ডি কস্টা বুক ফুলিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, টুমি নিজেকে অটিরিক্ট বুড়িমান মনে কর, টাই না? কেন আসবে শুনি আমার ফ্রেণ্ড? সে টো জানেই, কঙ্কাল মিসট্রির পিছনে কে আছে।
মৃদু হেসে শহীদ বলল, হ্যাঁ, তা সে জানে বৈকি। তা যাকগে। আচ্ছা, মি. কুয়াশা-২৫
গনি, আখতার চৌধুরীকে দেখছি না যে?’,
ওসমান গনি উত্তর দিলেন, চৌধুরীকে ফোন করেছিলাম। বললেন, অসুস্থ বোধ করছেন বলে আসতে পারবেন না।’
শহীদ সাংবাদিকদেরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারাও সবাই আছেন?
হ্যাঁ, সব পত্রিকা থেকেই এসেছি আমরা।’
উত্তর দিলেন একজন। শহীদ সকলকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে এল। মি. সিম্পসন চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন আগেই। শহীদ কামালকে ইঙ্গিত করল । কামাল বেরিয়ে গেল বাইরে। ঘরের বাতি জ্বেলে দিল শহীদ দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে। সম্মুখের দরজাটা রইল ভেজানো। সকলকে বসতে অনুরোধ করল শহীদ। বসলেন সকলে। ডি. কস্টা বসল সামনের সারিতে। তার বা পাশের একটা চেয়ার খালি পড়ে রইল। ডান পাশে বসেছেন মি. সিম্পসন। শহীদ একটা টেবিলের সামনে সকলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল, উপস্থিত দ্রমহোদয়গণের উদ্দেশ্যে বলছি। আপনারা আজ কঙ্কাল-রহস্য এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমার বক্তব্য শুনতে এসেছেন। বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে হলে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিতে হয়। কিন্তু বেশি সময় আপনারাও ব্যয় করতে পারবেন না, আমিও দিতে পারব না। তাই বক্তৃতা বাদ থাকুক। অবশ্য বক্তৃতার দরকারও তেমন নেই। গতকালকের ঘটনা ছাড়া আপনারা সংবাদপত্রে সকল ঘটনাই জেনেছেন। সুতরাং কোন কিছুই জানতে বাকি নেই আপনাদের, বলা যায়। আপনারা শুধু জানেন না যে, গতরাতে এরফান মল্লিক নিহত হয়েছে। ছদ্মবেশে সে বসবাস করছিল, টঙ্গীতে। সোলায়মান চৌধুরীর সঙ্গী হেস্টিংস একজন স্থানীয় গুণ্ডাকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক দিন থেকেই এরফান মল্লিককে বন্দি করে রেখেছিল তার নিজের বাড়িতে। অবশেষে মোটা টাকার চেক লিখে দিতে বাধ্য হয় এরফান মল্লিক। চেক হাতে পেয়েই হত্যা করে হেস্টিংস তাকে। তার আগে ওরা দু’জন কনস্টেবলকেও খুন করে। এরফান মল্লিকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কনস্টেবলদের। রাতের বেলা| ডিউটির সময় ওরা কুশল জিজ্ঞেস করে যেত রোজ। গতকালও সম্ভবত কুশল জানবার জন্যে এসেছিল ওরা। হেস্টিংস আর শোভান হত্যা করেছে ওদেরকে। তারপর তাদের পোশাক পরে সাইকেল নিয়ে এরফান মল্লিকের লাশ সরাতে চেষ্টা করে। পথে এরফান মল্লিকের উকিলের গাড়ি দেখে ওরা। হেস্টিংস জঙ্গলের ভিতরে আত্মগোপন করে। শোভান কনস্টেবলের ছদ্মবেশে উকিল সাহেবকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য, পরে দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
শহীদ দম নিয়ে শুরু করল, আপনারা জানেন, এরফান মল্লিক সোলায়মান চৌধুরীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এবং সে. মি. সারওয়ার ও মি. গনির মোটা টাকা মেরে দিয়েছিল। ওঁরা তিনজনই এরফান মল্লিকের সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনজনের মধ্যে দু’জন আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন এরফান ৫২
ভলিউম-৯
মল্লিকের সন্ধান পাবার জন্যে। আমরা সন্ধান দিতে পারিনি। প্রায় ছ’মাস পর মি. সারওয়ারের সাথে আলাপ হয় সোলায়মান চৌধুরীর। আমি নিশ্চিত নই, মি. সারওয়ারের আলাপটা হেস্টিংস বা ববের সাথেও হতে পারে। সোলায়মান চৌধুরীর নির্দেশ মোতাবেক মি. সারওয়ারকে দলে ভিড়িয়ে নেয় হেস্টিংস, এটাই আমার বিশ্বাস। ওরা মি. সারওয়ারকে দিয়ে মি. গনিকেও দলে ভিড়িয়ে নেয়। তবে মি. গনি কিছুই জানতেন না সোলায়মান চৌধুরীর নির্মম ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। সম্ভবত মি. সারওয়ারও সবটা জানতেন না। সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে যে বিখ্যাত অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া, তাও জানা ছিল না ওঁদের। ফলে মোটা টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে মিস সুরাইয়াকে পরবর্তী ছায়াছবির জন্যে চুক্তিবদ্ধ করেন ওঁরা। আর সোলায়মান চৌধুরী প্ল্যান করেছিলেন, তার কাজ হাসিল হয়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে চম্পট দেবেন তিনি বিদেশে। অ্যাডভান্স টাকা তাই যতটা সম্ভব আদায় করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি মেয়েকে দিয়ে চিত্র-প্রযোজকদের কাছ থেকে। সোলায়মান চৌধুরী ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এমন কি মি. সারওয়ার, মি. গনি এবং অন্যান্য চিত্র প্রযোজকদের সর্বনাশ করার জন্যেও। এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা জানত না সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়াও। তাই বাবার আদেশে সে পার্ট-টাইমে কেরানির চাকরি নেয় এরফান মল্লিকের বাড়িতে । আপনাদের হয়ত মনে আছে, গত সোমবারে নিহত হয় অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া, নিজের বাড়িতে। কিন্তু আসলে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া নিহত হতে পারে না। কেননা, প্রতি সোমবারেই স্টে যে টঙ্গিতে এরফান মল্লিকের কাজ করত। সোমবার দিন সে সেখানেই গিয়েছিল। আসলে বব এরফান মল্লিকের মেয়েকে ইডেন গার্লস কলেজের গেটের বাইরে থেকে কিডন্যাপ করে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়ার বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে হত্যা করা হয় তাকে। নিহত হবার আগে এরফান মল্লিকের মেয়ে একজন কাজের লোককে কিছু টাকা দিয়ে আমার কাছে একটা চিঠি পৌঁছে দেবার জন্যে পাঠায়। কিন্তু পত্রবাহক পথিমধ্যে বব কর্তৃক নিহত হয়। তবে চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু অনেক দেরিতে। গিয়ে দেখলাম, চাকর-বাকরসহ সুন্দরী’ এক যুবতাঁকে খুন করা হয়েছে। যুবতীর মুখের চেহারা ক্ষতবিক্ষত। সোলায়মান চৌধুরী চেয়েছিলেন, সকলে জানুক নিহত হয়েছে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া। পুলিস একথা বিশ্বাস করলে প্রথমেই তারা খুঁজবে আবদুর রহমানকে। আবদুর রহমান অভিনেত্রী মিস সুরাইয়ার প্রেমিক ছিল এবং ওদের সম্পর্ক বেশ কিছুদিন থেকে ভাল যাচ্ছিল না। এই কথা ভেবেই সোলায়মান চৌধুরী রহমানকেও হত্যা করান। হত্যা করা হল, বটে, কিন্তু দেখে মনে হয় আত্মহত্যা। কৌশলে কাজটা করেছিলেন সোলায়মান চৌধুরী। যুক্তি দিয়ে দেখতে গেলে খুব সহজ বোধ্য কেস। প্রেমিক কোন ব্যক্তিগত ক্রোধবশত প্রেমিকাকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছে। এমন তো প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু আমার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেননি সোলায়মান চৌধুরী। আমি বুঝতে পারলাম, রহমানকেও খুন করা কুয়াশা-২৫
হয়েছে।’
একটু চিন্তা করার জন্যে থামল শহীদ। তারপর বলল, আপনাদেরকে এখানে নিয়ে আসার একটা কারণ আছে। এই বাড়িটা হেস্টিংস আর ববের আস্তানা । সোলায়মান চৌধুরী হেস্টিংস আর ববের সাথে নিজের বাড়িতে দেখা-সাক্ষাৎ করেন
। আসলে, সামনাসামনি দেখা হয়ত মাসে, দুমাসে একবারও করেন কিনা সন্দেহ। ওদের মধ্যে যোগাযোগ হয় ক্ষুদ্রাকৃতির ওয়্যারলেস যন্ত্রের মাধ্যমে। সেই রকম একটা যন্ত্র আমি হেস্টিংসের কাছ থেকে পেয়েছি। আমি জানি সোলায়মান চৌধুরীর পরিচয়। তিনি আপনাদের সকলেরই পরিচিত। নাম বদলে ঢাকার বুকেই বাস করছেন তিনি। আর, নিজের চেহারাও তিনি পালটে ফেলেছেন। প্রাস্টিক সার্জারী করে নতুন একটা মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি।’
শহীদের কথা শুনে সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। শহীদ মৃদু হেসে বলল, ভয় পাবেন না, সোলায়মান চৌধুরী এখানে এখন উপস্থিত নেই। তবে তাকে ডাকতে হবে কৌশলে। আমার বিশ্বাস, আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি পারবেন না। এখানে তাকে ছুটে আসতেই হবে। আপনারা তার দ্রুত পদশব্দ শুনতে পাবেন। এবার বলি, আমি কী কৌশলে ডাকব সোলায়মান চৌধুরীকে । সোলায়মান চৌধুরী খুব ভাল করেই জানেন, এরফান মল্লিকের মেয়ে নিহত হয়েছে তাঁর মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু খুব ভাল করে জানা থাকা সত্ত্বেও এখনও তিনি নিজের মেয়েকে চোখে দেখেননি, এরফান মল্লিকের মেয়ে নিহত হবার পর। কেননা, সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া সেদিন থেকে গতরাত পর্যন্ত আটকা পড়েছিল এরফান মল্লিকের বাড়িতে। সে এখন এই বাড়িরই একটা ঘরে অবস্থান করছে। সোলায়মান চৌধুরীকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ডাকব আমি এখন । হেস্টিংসের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে কথা বলব, আমি। তাকে চমকে দিয়ে হেস্টিংসের অনুকরণে ইংরেজিতে যা বলব তার বাংলা দাঁড়াবে এই রকম–মারাত্মক একটা ভুল হয়ে গেছে, চৌধুরী! আমার সন্দেহ হচ্ছে ভুলবশত বব খুন করে ফেলেছে আপনার মেয়েকে। যে মেয়েটিকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি এরফান মল্লিককে খুন করে সে মনে হয় আপনার মেয়ে নয়। এরফান মল্লিকের মেয়ে। আপনি অনুমতি দিলে খতম করে ফেলি একেও।
শহীদ সকলের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে বলে উঠল, আমার কৌশলে কোন খুঁত না থাকলে সোলায়মান চৌধুরীকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতেই হবে এখানে।
কথাটা বলে পকেট থেকে ছোট্ট একটা ওয়্যারলেস যন্ত্র বের করে মুখ দিয়ে সুইচ অন করল শহীদ। তারপর হেস্টিংসের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে একটু আগে যা বাংলায় বলেছিল সেই কথাগুলোই ইংরেজিতে বলে গেল। তারপর মন দিয়ে কি যেন শুনল ও। উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারা। সুইচ অফ করে দিয়ে বলে উঠল ও, আপনারা কোন শব্দ না করে যে যার জায়গায় বসে থাকুন। দশ
ভলিউম-৯
৫৪
মিনিটের মধ্যেই আসবেন সোলায়মান চৌধুরী।’
কথা শেষ করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। বাইরে গলা বের করে কামালকে ইঙ্গিত করল। কামাল শহীদের ইঙ্গিতে বারান্দায় একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করল। সোলায়মান চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে সন্দেহবশত যেন পালাতে চেষ্টা করে সফল না হন, সেদিকে কড়া নজর রাখবে কামাল। ঘরে ঢুকে সকলের উদ্দেশে শহীদ বলল, “আপনাদের এবার বেশ খানিকটা ধৈর্য এবং সাবধানতার পরিচয় দিতে হবে। দয়া করে কেউ কথা বলবেন না, ভুলেও নিজের আসন ছেড়ে উঠবার চেষ্টা করবেন না, সিগারেট খাবেন না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলবেন না এবং মোটেই ভয় পাবেন না। আমি দরজা ভেজিয়ে দিচ্ছি। তারপর আলো নিভিয়ে দেব। সোলায়মান চৌধুরী সিধে ঘরের ভিতরে ঢুকবেন, সাথে সাথে আলো জ্বালব আমি।’
শহীদ দরজা ভাল করে ঠেলে দিয়ে নিভিয়ে দিল আলো। একমিনিট। দু’মিনিট। তিনমিনিট। চারমিনিট। কোথাও কোন শব্দ নেই। পাঁচ মিনিট।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সকলে। অন্ধকার ঘর। কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কাউকে। ঘরের ভিতরে কেউ আছে কিনা বোঝবার কোন উপায় নেই।
ছয় মিনিট।
কোথায় যেন একটা গাড়ি থামবার কর্কশ শব্দ হল। পরমুহূর্তে গাড়ির দরজা বন্ধ হল সশব্দে। তারপরই ভারি জুতোর শব্দ। ছুটন্ত শব্দ। বিচলিত, দ্রুত জুতোর শব্দ। আসছে। এগিয়ে আসছে। ক্রমশ এগিয়ে আসছে একজোড়া জুতোর শব্দ! অন্ধকার ঘরের ভিতরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভেজানো দরজার দিকে মুখ করে বসে আছে সকলে যে যার আসনে।।
ভারি জুতোর শব্দ এসে গেছে। বারান্দার উপর দিয়ে তুমুল শব্দ করে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক দরজার সামনে এসে থেমে গেল জুতোর শব্দ। একমুহূর্তের নিস্তব্ধতা। পরমুহূর্তে ঝট করে খুলে গেল দরজা। প্রচণ্ড উত্তেজিত একটা কণ্ঠস্বর দরজার চৌকাঠের উপর থেকে আছড়ে পড়ল ঘরের ভিতরে, ‘হেস্টিংস!’
পরক্ষণেই আর্তচিৎকার উঠল একটা। তীব্র যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠেছে আগন্তুক। খোলা দরজা দিয়ে কেবল দেখা গেল, আগন্তুক ছায়ামূর্তিটা ঢলে পড়ল চৌকাঠের উপর। সাথে সাথে শব্দ হল সুইচ অন করার। পরমুহূর্তে চিৎকার শোনা গেল শহীদের, ইলেকট্রিকের কানেকশন কেটে দিয়েছে কেউ! টর্চ জ্বালুন, মি. সিম্পসন!
কথাটা বলেই তড়াক করে লাফ দিয়ে বের হয়ে গেল শহীদ ঘরের বাইরে। মি. সিম্পসন রিভলভারটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিলেন। ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন পকেটে। টর্চ বের করে জ্বালাতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ বিকট বুক-ফাটা কুয়াশা-২৫
একটা আর্তনাদ উঠল পাশের ঘর থেকে। প্রথমে একটা তারপরই আর একটা ।
টর্চটা পড়ে গেছে মি. সিম্পসনের হাত থেকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তিন চারটে চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হল। ঘরের ভিতরে অপেক্ষারত ভদ্রলোকগণ ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। দরজার দিকে ছুটে গেলেন দু’জন। ঠিক এমন সময় ঘরের ভিতরে ঢুকল শহীদ কামালকে নিয়ে । তারপরই জ্বলে উঠল ঘরের বাতি। শহীদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ঘরের প্রতিটি ব্যক্তির দিকে। ডি, কস্টার দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল ওর। ডি. কস্টা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে চৌকাঠের উপর পড়ে থাকা নিঃসাড় দেহটার দিকে। মি. সিম্পসনও তাকালেন সেদিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘একি! এ তো আখতার চৌধুরী।
ঘরের ভিতরে বিস্ময়বোধক গুঞ্জন উঠল। সকলেই ভীতস্বরে ফিসফিস করে উঠতে শুরু করল, আগন্তুক ভদ্রলোক যে চিত্র-প্রযোজক আখতার চৌধুরী। সোলায়মান চৌধুরী তাহলে কে?’।
কামাল সকলকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আখতার চৌধুরীই ছদ্মবেশী সোলায়মান চৌধুরী। প্লাস্টিক সার্জারীর বদৌলতে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন তিনি নিজের চেহারা। কিন্তু ওর বাঁ হাতটা অমন ঝলসে গেল কিভাবে? জ্ঞান হারিয়েছেন ভদ্রলোক। এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে কেউ ওঁর বাঁ হাতটা। কে নিজের হাতে আইন তুলে নেবার সাহস পেল?’
কারও মুখে উত্তর নেই কোন। সকলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে শুরু করল। শহীদকে দেখা যাচ্ছে না ঘরে। পাশের ঘরে গেছে সে। মি. সিম্পসন উপস্থিত পুলিস কমিশনারকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কানে কানে বললেন,
স্যার, আক্রমণকারী এই ঘরেই ছিল। আপনার সন্দেহ হয় কাউকে?’
কমিশনার প্রশ্ন করলেন, তাহলে পাশের ঘরে আর্তচিৎকার করে উঠল কেন? তুমি বলতে চাও, আখতার চৌধুরী ওরফে সোলায়মান চৌধুরীর প্রতি এসিড ছুঁড়ে পাশের ঘরে গিয়ে আরও দু’জনকে আহত করেছে আক্রমণকারী? | শহীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল দরজার কাছ থেকে, ঠিক তাই। ও ঘরে গিয়ে আক্রমণকারী আহত করেছে হেস্টিংস আর ববকেও। আক্রমণকারী এ বাড়িতে একা আসেনি। একজন খানিকক্ষণের জন্যে ইলেকট্রিসিটির মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিল। অন্যজন অন্ধকারের সুযোগে আখতার চৌধুরী ওরফে সোলায়মান চৌধুরীকে আহত করেছে। তারপরই পাশের ঘরে গিয়ে হেস্টিংস আর ববের একটা করে হাত কেটে নিয়ে ফিরে এসেছে আবার এই ঘরে। তারপর জ্বলে উঠেছিল আবার বাতি। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, আক্রমণকারী এই ঘরের ভিতরেই এখনও রয়েছে। আর একটা দুঃখজনক খবর আছে। অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম পাশের ঘরে আত্মহত্যা করেছে। তার বাবার পরিচয় পেয়েই চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সে।’
ভলিউম-৯
কমিশনারের হাতে রিভলভার। মি. সিম্পসনের হাতে রিভলভার। শহীদ এবং কামালের হাতেও রিভলভার। উপস্থিত চিত্র-প্রযোজক, সাংবাদিক, সম্পাদক পরস্পরের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। মি. সিম্পসন ও কামাল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওসমান গনির দিকে। দরদর করে ঘামছেন ওসমান গনি। একবার কামাল আর একবার মি. সিম্পসনের দিকে বিমূঢ় চোখে তাকাচ্ছেন। শহীদের দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন। শহীদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডি, কস্টার দিকে। ডি. কস্টা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জ্ঞানহীন আখতার চৌধুরী ওরফে সোলায়মান চৌধুরীর দিকে। মি. সিম্পসন শহীদের দেখাদেখি ড. কস্টার দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। * অকস্মাৎ শহীদ গর্জন করে উঠল ডি. কস্টার দিকে রিভলভার তাক করে, ধরা, পড়ে গেছ তুমি, কুয়াশা! মাথার ওপর হাত তুলে উত্তর দাও আমার প্রশ্নের।’
চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডি. কস্টা শহীদের দিকে।
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে ডি. কস্টার আপাদ-মস্তক পরখ করতে করতে বলে উঠল, তোমার ছদ্মবেশ আমাকে ধোকা দিতে পারেনি, কুয়াশা। তুমিই আহত করেছ, সোলায়মান চৌধুরী, হেস্টিংস আর ববকে।
ডি. কস্টা হঠাৎ বিষম কণ্ঠে হাঃ হাঃ করে হেসে ফেলে বলে উঠল, ‘টোমার ডেকছি ব্রেনের স্কু ঢিলে হয়ে গেছে, মি. শহীদ! আমাকে টুমি কুয়াশা মনে করে অপমান করছ মহট সাইনটিস্ট কুয়াশাকে। টোমার জানা উচিট, আমার চৌডড পুরুষ টপস্যা করলেও হামি কুয়াশা হটে পারি না।’
মাথার ওপর হাত তোললা, কুয়াশা!’গর্জন করে উঠলেন মি. সিম্পসন রিভলভার উঁচিয়ে।
| মাঠা খারাপ! বলছি না, আমি ডি. কস্টা!’
শহীদ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল, ‘আমি জানি, কুয়াশা, তুমিই কঙ্কালের আবিষ্কারক। বল, সত্যি কিনা, তুমি আখতার চৌধুরীর বাড়ি যাওনি?’ | ডি, কস্টাকে একটু চিন্তিত দেখাল। শহীদের দিকে তাকিয়ে তারপর বলে উঠল, কথাটায়. ভুল আছে একটু। আমি না, কঙ্কাল গিয়েছিল বটে আখতার চৌধুরীর বাড়িতে। তখন জানা ছিল না কুয়াশার, আখতার চৌধুরীই আসলে সোলায়মান চৌধুরী। কঙ্কাল গিয়েছিল টাকা লুট করতে। আখতার চৌধুরীর মেয়ে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম তার অ্যাকাউন্টের সব টাকা বাবার আদেশে তুলে রেখে এসেছিল বাবারই কাছে। খবর পেয়ে কঙ্কাল সেখানে যায়, এবং টাকাটা সহজেই হস্তগত করে। আখতার চৌধুরী অবশ্য স্বীকার করেনি কথাটা। কেননা সেক্ষেত্রে তার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল।’
| শহীদ জিজ্ঞেস করল, আর ওসমান গনির বাড়িতেও তুমি দু’জন কঙ্কালকে পাঠিয়েছিলে, তাই না? মি. ওসমান গনির ছদ্মবেশে ছিল একজন, অপরজন মি. সারওয়ারের ছদ্মবেশে। আমার বিশ্বাস, তুমি চেয়েছিলে, মি. ওসমান গনির দ্বারা কুয়াশা-২৫
আমাদের সমস্যা সমাধান করে দিতে। তাই মি. গনির মনে মি সারওয়ার সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি করার প্ল্যান নাও। তুমি জানতে, ওসমান গনি সবকথা আমাদেরকে
বলে পারবেন না। হয়েছিলও তাই। তাছাড়া, তোমার কঙ্কালরাই রক্ষা করে মহুয়া এবং লীনাকে। তারও আগে তোমার কঙ্কালকে যেদিন আমি অনুসরণ করে আহত হয়েছিলাম, সেদিনও তুমি আমাদের প্রতি নরম ভাব প্রকাশ করেছিলে। ইচ্ছে করলেই তোমার কঙ্কাল আরও আগে গাড়ি থেকে আয়রন-বল ফেলে আমার আর কামালের ইহলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারত। তোমার কঙ্কাল আমাদেরকে সমতলভূমি পর্যন্ত নিয়ে যাবার পরই বিপদে ফেলার ভান করেছিল। এবং তা তুমিই করিয়েছিলে। আমার জানা আছে, কঙ্কাল স্রেফ অত্যাশ্চর্য এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। এর নিজস্ব কোন ক্ষমতাই নেই। একে পরিচালনা করতে হয় যন্ত্রপাতির সাহায্যে। এবং তুমি তাই করও। কিন্তু তুমি আমাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে থাকলেও আমরা তোমার অন্যায়, বে-আইনী কর্মতৎপরতাকে প্রশ্রয় দিতে পারি
। তোমাকে গ্রেফতার করা হল, কুয়াশা। তুমি যতদিন ক্ষতিকর বৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছিলে, ততদিন আমরা তোমাকে নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা ভেঙে আবার অন্যায়, বে-আইনী কাণ্ড শুরু করেছ। এর সাজা পেতে হবে বৈকি তোমাকে। মি. সিম্পসন, কুয়াশার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিন।
মি. সিম্পসন পকেট থেকে একজোড়া হাতকড়া বের করে সামনে পা বাড়ালেন। ডি. কস্টা অনড় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। মি. সিম্পসন কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ দ্রুত পা বাড়াল সে দরজার দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল কামাল ও মি. সিম্পসন। দুজন মিলে দুটো হাত ধরে টান দিল ডি. কস্টার। ওদের দুজনের হাতেই ডি কস্টার দুই হাত কাঁধ থেকে আলগা হয়ে চলে এল। চমকে উঠে হাতহীন ডি, কস্টার দিকে তাকিয়ে রইল মি. সিম্পসন ও কামাল। দরজার দিকে
এগিয়ে যাচ্ছে ডি কস্টা। পুলিস কমিশনার গুলি করলেন পিঠ লক্ষ্য করে।
পরপর তিনটে গুলি বিধল ডি. কস্টার পিঠে। থামল না সে। আহত হয়েছে। বলেও মনে হল না। মি. সিম্পসন রিভলভার উঁচিয়ে তাক করলেন। শহীদ বলে উঠল, “থাক, মি. সিম্পসন। ও কুয়াশাও নয়, ডি. কস্টাও নয়। ও কঙ্কাল। কুয়াশার সর্বশেষ এবং মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময়কর আবিষ্কার!
ঘরের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল ডি কস্টার ছদ্মবেশে কঙ্কাল। ঘরের ভিতরে তার গমগমে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কুয়াশা আবার অত্যাচারীর সাজা দেবে নিজের হাতে। আবার সে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে দুষ্টের দমনে। আবার সে বিভীষিকা হয়ে দেখা দেবে অপরাধীদের সামনে। বিদায়। আবার দেখা হবে, কর্তব্যপরায়ণ বন্ধুগণ।
* মাথা নিচু করে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল সকলে। শহীদ ভাবছে, আবার শুরু হবে দুঃস্বপ্নে ভরা রাত, আবার শুরু হবে উত্তেজনা ভরা দিন। আবার পূর্ণোদ্যমে কাজে নামতে হবে কুয়াশাকে গ্রেফতার করার জন্যে।
Leave a Reply