২৪. কঙ্কাল রহস্য ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৪
প্রথম প্রকাশঃ মে ১৯৭০
এক
শীতকাল।
দিনটি ছিল পয়লা ডিসেম্বর। তারিখটা মনে গেঁথে রাখবার মত। উনিশশো ছেষট্টিসাল। সোমবার।
সময় তখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা।
জিন্নাহ অ্যাভিনিউ। ইস্টার্ন ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের হেড অফিসের সামনে কুচকুচে কালো একটা মরিস গাড়ি এসে থামল।।
ব্যাঙ্কের বন্দুকধারী পাঠান দারোয়ান সরাসরি তাকাল গাড়িটার দিকে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে হালকা নীল রঙের কোট পরে বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক। মাথায় হ্যাট। মাথা নিচু করে ভদ্রলোক কি যেন ভাবছেন বসে বসে। অনড়, অচঞ্চল। টান টান হল পাঠানের চওড়া বুক। তীক্ষ্ণ হল একটু চোখের দৃষ্টি।
এদিকে দারোয়ান একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল না। গাড়িটা ব্যাঙ্কের সামনে এসে থামতেই রাস্তার দু’দিক থেকে দুটো লোক পরস্পরের দিকে নির্বিকার মুখে এগিয়ে এল । দু’জনাই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল দারোয়ানের চোখের আড়ালে। গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই দুজন দুজনার দিকে এগিয়ে আসছে। সরাসরি এগিয়ে এসে ঠিক ব্যাঙ্কের সাত-আট হাত দূরে দুজন দুজনকে ধাক্কা মারল। ব্যস। শুরু হয়ে গেল তুমুল ঝগড়া। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। দু’জনেই প্রচণ্ড রেগেছে। একজন বলছে, আমাকে ধাক্কা দিলে কেন, মিয়া? অন্যজন বলছে,লে বাবা, আমাকে ব্যাটা ধাক্কা মেরে আবার কৈফিয়ত চাইছে।
| দুজনারই পেটা স্বাস্থ্য। লুঙ্গি পরিহিত উভয়েই। তর্ক-বিতর্ক হতে হতে শার্টের কলার ধরাধরিতে পৌঁছল। তামাসা দেখার জন্যে দু’একজন করে পথচারী দাঁড়াচ্ছে। হঠাৎ একজন ঘুসি বসিয়ে দিল অন্যজনকে। অন্যজন আচমকা লাথি কষে দিল আক্রমণকারীর পেটে। মারামারি শুরু হল, সেই সাথে গালাগালি । হুঙ্কার ছাড়ল দুজনেই পরস্পরকে আঘাত করার জন্যে। তড়াক তড়াক করে লাফ মেরে পজিশন নিচ্ছে। হাতের মাসল ফুলি দেখাতে দেখাতে একজন বলছে, আয়, বেলিক, তেকে জন্মের মত ভেলকি দেখিয়ে দিই। অন্যজন বলছে, আবে রাখ, তোর মূত কত ভেলকিবাজকে ভেলকি দেখিয়ে দিলাম আমি! ১৪২
ভলিউম-৮
পরক্ষণে লাফিয়ে পড়ল একে অপরের উপর। ভিড় ইতিমধ্যে জম-জমাট হয়ে উঠেছে ফুটপাতের উপর। কে জিতবে,কে হারবে, তা না দেখে কেউ নড়বে বলে মনে হয় না।
এতে হৈ চৈ, এত শোরগোল চোখের সামনে, কিন্তু কালো চকচকে মরিসে মাথা নিচু করে বসে থাকা ভদ্রলোক একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না সেদিকে। ওদিকে যুদ্ধরত দুই প্রতিদ্বন্দী আড়চোখে দেখে নিল স্টোন ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের গেটের কাছে দাঁড়ানো বন্দুকধারী দারোয়ানটাকে। তাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে দারোয়ান দুই যোদ্ধা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যেন। হাপাচ্ছে। পরস্পরের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার আক্রমণ করার জন্যে দুজন এগোল দু’জনার দিকে। ব্যাঙ্কের দারোয়ান এবার অধৈর্য হয়ে পড়ল। ব্যাঙ্কের একেবারে কাছে এই মারামারি চলতে দেয়া যায় না আর। বন্দুক বাগিয়ে পাঠান এগিয়ে গেল জটলার দিকে। দারোয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখে দুই যোদ্ধা হঠাৎ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে একসাথে বলে উঠল, “ওই যে, খান বাবা আসছে! খান বাবা, তুমি মা বাপ! বিচার কর তুমি! | দারোয়ান পাঠান হলে হবে কি, তাকে মা-বাপ বলে বিচারকের সম্মানে ভূষিত করা হল তা সে বেশ বুঝতে পারল । বাংলা সে ভাল বোঝে না, কিন্তু প্রশংসা বোঝে। বুক আরও উঁচু করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সে।
এদিকে দুই যোদ্ধা সমস্বরে চিৎকার করে উঠতেই কালো গাড়িটায় বসা ভদ্রলোক মাথা তুলে দ্রুত চোখে দেখে নিলেন ব্যাঙ্কের গেট। ঝুঁকে পড়ে বিরাট বিরাট দুই-দুটো সুটকেস দু’হাতে ধরে পাড়ি থেকে নেমে এলেন তিনি। মাথা নিচু করে সিধে পা চালালেন ব্যাঙ্কের গেটের দিকে। হালকা নীল রঙয়ের দামী সুট ভদ্রলোকের পরনে। মাথায় হ্যাট। হাতে গ্লাভস্। চোখে নীল চশমা,পায়ে ক্রেপ সোল জুতো। নিঃশব্দ পায়ে গেট দিয়ে ব্যাঙ্কের ভিতরে ঢুকে পড়লেন ভদ্রলোক।
| মথা নিচু করে ব্যাঙ্কের ভিতরে ঢুকলেন ভদ্রলোক। কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। সিধে ম্যানেজারের চেম্বারে গিয়ে ঢুকে পড়লেন। ম্যানেজার মি. খন্দকার চোখ তুলে তাকালেন। ভদ্রলোক মাথা নিচু করেই এগিয়ে গিয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। তারপর পকেট থেকে বের করলেন বারটা চেক। পঁচাত্তর হাজার টাকার কম নয় কোনটার অঙ্ক। সবচেয়ে বেশি পাঁচ লাখ টাকা। মোট বরটা চেক, বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের। বেয়ারার চেক। বারটা চেকের পিছনেই সই করলেন ভদ্রলোক। ম্যানেজার অতগুলো চেকে সই করতে দেখে একটু অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু তখনও তিনি চেকগুলোয় কত অঙ্কের টাকা লেখা আছে টের পাননি।
মাথা তোলেননি ভদ্রলোক। এক একটা করে চেকগুলো সই করে সবকটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি ম্যানেজারের দিকে। তারপর পকেট থেকে কিংস্টর্কের এক। প্যাকেট সিগারেট বের করে অতি মনোযোগ দিয়ে সেটা খুলতে শুরু করলেন। কুয়াশা-২৪
১৪৩
ম্যানেজার মি. খন্দকার প্রথম চেকের অঙ্ক দেখে চমকে উঠলেন? অঙ্কটা আবার দেখলেন তিনি তীক্ষ্ণ চোখে | না, ভুল হয়নি তার। তিন লাখ টাকার চেক | দ্বিতীয় চেক দেখার আগেই তিনি ভদ্রলোকের দিকে হতবাক হয়ে তাকালেন। ভদ্রলোক সিগারেট জ্বালাচ্ছেন। মি. খন্দকার দ্বিতীয় চেকটা দেখার জন্যে চোখ নামালেন।, দ্বিতীয়বারও চমকালেন তিনি। দ্বিতীয় চেকে দু’লাখ টাকার অঙ্ক। বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ জোড়া। চেয়ে রইলেন তিনি ভদ্রলোকের দিকে।
দ্রলোক মুখ তুলে না তাকিয়েই বলে উঠলেন, টাকাগুলো একটু তাড়াতাড়ি দরকার আমার।
মিঃ খন্দকার বিস্ময় চাপতে না পেরে বলে উঠলেন, এভো টাকা!
ভদ্রলোক শান্ত, নিরুদ্বেগ গলায় বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, টাকা বেশি বলেই তো হেড অফিসের চেক। দয়া করে ক্যাশিয়ারকে ডেকে পাঠিয়ে টাকাগুলো দিতে বলুন। আমার তাড়া আছে। মোট তিরিশ লাখ।
| বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন মি, খন্দকার ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে। কে এই ভদ্রলোক বারটা অ্যাকাউন্ট থেকে বারজন এত এত করে টাকা ওকে দেবার কারণ কি? বড় অ্যাকাউন্ট যাদের আছে তাদের সকলকে চেনেন তিনি। চেকগুলো তাদেরই। কিন্তু বেশি অঙ্কের টাকা তোলার দরকার হলে তারা নিজেরাই চলে। আসেন ব্যাঙ্কে। অথচ তারা নিজেরা না এসে এ কোন ভদ্রলোককে পাঠিয়েছেন? তাছাড়া একটা নয়, দুটো নয়, বারটা অ্যাকাউন্টের বারটা মোটা অঙ্কের চেক। জাল চেক নয় তো?।
রীতিমত ঘাবড়ে গেছেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। তার চাকরি জীবনে এত টাকা একসাথে কাউকে দেননি তিনি। দুটো বা চারটের বেশি চেক কোনদিন কাউকে আনতেও দেখেননি। শোনেননিও এমন ঘটনা কখনও। রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। ছেলেখেলা কথা নয়, তিরিশ লাখ টাকা!
মি.খন্দকার বিমূঢ়তা কাটিয়ে বলে উঠলেন, মাফ করবেন, অফিশিয়াল কর্তব্য অনুযায়ী আপনার চেকগুলো সম্পর্কে একটু খোঁজ করা প্রয়োজন বোধ করছি।
| ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। মুখ তুলে তাকালেন না এবারও। হাতের সিগারেটটা অর্ধেকও শেষ হয়নি, সেটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। ম্যানেজার চুপচাপ বসে বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে আছেন বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, যা করবার তাড়াতাড়ি করুন। আর একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আমার তাড়া আছে। | ‘ চমকে উঠে ক্রেডল থেকে ফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে শুরু করলেন মি.খন্দকার। ভদ্রলোকের কণ্ঠে এমন একটা কাঠিন্য ছিল যা শুনে বুক শুকিয়ে গেছে তার। মি.ইলিয়াস বক্সকে প্রথমে ফোন করলেন মি.খন্দকার। মি. বক্সেরও এই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে। ভদ্রলোকের বারটা চেকের মধ্যে মি. বক্সের ১৪৪
ভলিউম-৮
একটা চেক আছে চার লাখ টাকার। মি. বক্সকে তার অফিসে পাও। গেল,ফোন ধরলেন তিনিই। ম্যানেজার মি.খন্দকার প্রশ্ন করলেন, একিউ ও মি.মি.বন্ধু । একটা তিক্ত কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে আমাকে। আপনার অ্যাকাউন্যের চেক নিয়ে, চারলাখ টাকার একটা চেক নিয়ে এক ভদ্রলোক এসেছেন। আম। টাকা
দেব?’ | মি, খন্দকারের কথা শেষ হবার আগেই ফোনের অপরপ্রান্ত হতে মি. এর বলে উঠলেন, “আরে, এখনও বসিয়ে রেখেছেন মি.সোহরাবকে! দিয়ে দিন টাকা, উনি আমার বন্ধু বিশেষ কারণে নগদ টাকা দিতে পারিনি বলে চেক দিয়েছি । ছিঃ ছিঃ!’ | মি. খন্দকার বলে উঠলেন মি, বক্সকে, আমি লজ্জিত, মি. বক্স। এখুনি দিয়ে দিচ্ছি আমি টাকা । আশা করি, মনে কিছু করবেন না। বোঝেনই তো, আমাদেরকে অনেক দৃষ্টিকটু সন্দেহে ভুগতে হয় কর্তব্যের খাতিরে। আচ্ছা, রাখলাম।’ | বিমূঢ় ভাবটা দূর হয়ে যাচ্ছে মি.খন্দকারের চেহারা থেকে। বিস্মিত হয়ে উঠেছেন তিনি এবার। এত টাকা এতগুলো লোক এই ভদ্রলোককে কেন দিলেন? প্রশ্নটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। মি. বক্সের কথা শুনে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই আর উঠতে পারে না। মি.বক্স নিজেই বললেন, তিনি চারলাখ টাকার চেক লিখে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও খুঁতখুঁত করছে মনটা। রিসিভার নামিয়ে না রেখে আর এক কোটিপতিকে ফোন করলেন তিনি। তাঁর চেকও এনেছেন ভদ্রলোক। এবারও সেই একই উত্তর। ভদ্রলোককে চেকের অঙ্ক অনুযায়ী টাকা দিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন দ্বিতীয় কোটিপতি। তবু মনটা কেমন যেন সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে মি. খন্দকারের । ততীয় এক মিল-মালিককে ফোন করলেন তিনি। মিল মালিক রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন মি. খন্দকারের প্রশ্ন শুনে। এখনও কেন টাকা দিয়ে দেওয়া হয়নি, জবাবদিহি চেয়ে বসলেন। ক্ষমা চেয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন মি. খন্দকার। সন্দেহের আর কোন কারণ নেই। তিন-তিনজন পরিচিত কোটিপতি
জানিয়ে দিয়েছেন–হ্যাঁ, চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন তারা অত অত অঙ্কের । টাকা না । দেবার প্রশ্ন আর ওঠে না। মি. খন্দকার ঢোক গিলতে গিলতে কলিংবেল টিপে ধরতে একজন পিয়ন এসে ঢুকল চেম্বারে।
‘ক্যাশিয়ার আবদুর রহমানকে পাঠিয়ে দাও।
পিয়ন চলে যাবার এক মিনিট পরই এসে পৌঁছুল ক্যাশিয়ার আবদুর রহমান মি.খন্দকার তখনও ঘামছেন, ঢোক গিলছেন, আবার সন্দেহেও ভুগছেন! ঝিমঝিম করছে তার মাথা। ত্রিশ লাখ টাকা! কোন ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?
টাকা দিয়ে দিতে বলুন, দেরি করিয়ে দিচ্ছেন কেন আমার?
হঠাৎ একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন ভদ্রলোক। তেমনি মাথা নত করে বসে ১০-কুয়াশা-২৪
১৪৫
আছেন তিনি। মি. খন্দকার ভদ্রলোকের মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ছায়া পড়েছে ভদ্রলোকের মুখে। চেম্বারের জানালা-দরজা বন্ধ। বিজলী বাতি জ্বলছে ভিতরে। নিওনসাইন সব ক’টা ভদ্রলোকের পিছন দিককার দেয়ালে। মুখে আলো। পড়ছে না তার ফলে। তবে মি. খন্দকার ওসব কথা ভাবছিলেন না মোটেই। তিনি আসলে কোন কথাই সুষ্ঠুভাবে ভাবতে পারছিলেন না। তার শুধু মাথাটা ঝিমঝিম করছে উত্তেজনায় এবং বারবার প্রশ্ন জাগছে, কোন ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?
রহমান, তিরিশ লাখ টাকা, গুণে দিতে হবে এই ভদ্রলোককে। কয়েকজন মিলে গুণে দাও টাকাটা। ‘
মি,খন্দকারের কথা শেষ হতেই ভদ্রলোক অর্ধসমাপ্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘সবকটা পাঁচশো টাকার নোট হয় যেন একটা সুটকেসে ভরে নিয়ে যেতে চাই আমি সব যদি পাঁচশো টাকা না হয়, পঞ্চাশ বা একশো টাকার নোট হলেও চলবে। সুটকেস আমি দুটোই এনেছি অবশ্য। আর হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
ক্যাশিয়ার চমকে গেছে ত্রিশ লাখ টাকার কথা শুনে। নিজের কানকে সে, নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করল আবার, কত টাকা বললেন যেন, স্যার?’
‘ত্রিশ লাখ। হ্যাঁ, ত্রিশ লাখ টাকা। এই যে,বারটা চেক দিয়েছেন উনি। যোগ করে দেখ, ত্রিশ লাখ টাকাই হবে। কোন অসুবিধে নেই । ফোন করে জেনে নিয়েছি আমি।’
বারটা চেক কাঁপা হাতে তুলে নিল ক্যাশিয়ার। একটা একটা করে সব ক’টা চেক দেখল তারপর যোগ করল । অস্ট বিস্ময়ভরা কণ্ঠে সে শুধু উচ্চারণ করল, “ত্রিশ লাখ টাকা!’
ম্যানেজারের ইঙ্গিতে ক্যাশিয়ার বের হয়ে গেল চেম্বার থেকে। ক্যাশিয়ার চলে যাবার পর ম্যানেরি পাথরের মূর্তির মত ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
ভদ্রলোক একমনে সিগারেট টানছেন। কোন চঞ্চলতা নেই তার মধ্যে।
ম্যানেজার কথা বলে উঠলেন, চা, না কফি?’। ভদ্রলোক নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ফান্টা।’
পিয়ন চা আর ফান্টা নিয়ে এল । চায়ে চুমুক দিলেন মি. খন্দকার। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কমিনিট হয়েছে আপনাদের ক্যাশিয়ার টাকা আনতে গেছেন?
‘পনের মিনিট হয়েছে। গোনা শেষ হতে সময় লাগছে হয়ত।
এমন সময় চেম্বারে ঢুকল ক্যাশিয়ার। বলল, “টাকা রেডী, নিয়ে আসব। এখানে?
দ্রলোক বললেন, ‘না, আমি কাউন্টারে যাচ্ছি! কত টাকার নোট? ‘পঞ্চাশ, একশো, পাঁচশো ।
ভলিউম-৮
ভদ্রলোক ফান্টা পান না করেই দুহাতে দু’টো সুটকেস নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ম্যানেজার আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠলেন, কাউন্টার থেকে টাকা নেবেন কি জন্যে। আপনি আরাম করে বসুন, আমরা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
ভদ্রলোক বললেন, অজস্র ধন্যবাদ। আমি কাউন্টার থেকে টাকা নেব।’
কপটা বলে ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। চেম্বার থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্যাশিয়ারও একটু পরে কাউন্টারের অপর দিকে এসে দাঁড়াল। টাকার বাণ্ডিলগুলো একটা টেবিল থেকে তুলে কাউন্টারের উপর রাখতে শুরু করল সে। ভদ্রলোক সেগুলো ভরতে শুরু করলেন সুটকেসে ।।
একমনে সুটকেসে টাকার বাণ্ডিলগুলো সাজিয়ে রাখছেন মি.সোহরাব নামধারী ভদ্রলোক। ক্যাশিয়ার টেবিল থেকে সব টাকা কাউন্টারের উপর এনে দিয়ে একটা সুটকেস ভরে গেছে। দ্বিতীয় সুটকেসটা পায়ের কাছ থেকে ঝুঁকে প: তোলার সময় জানালা দিয়ে সূর্যের যে আলো এসে পড়েছিল সেই আলোই ভদ্রলোকের মুখের উপর পড়ল। ক্যাশিয়ার আবদুর রহমানের বুক ধড়াশ বের উঠল সাথে সাথে!
ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেল পলকের মধ্যে ক্যাশিয়ারের সর্বশরীর। আতঙ্কে ঠকক করে কেঁপে উঠল হাঁট দুটো। অবিশ্বাসে, অলৌকিক ভয়ে ছানাবড়া হয়ে গেল চোখ জোড়া, চোখের মণি দুটো কোর্টর ছেড়ে ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে, ফ্যালফ্যাল করে ভদ্রলোকের মুখের দিবে তাকিয়ে আছে সে। মাথাটা ঘুরছে বন, করে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। টলে পা। যাচ্ছিল বেচারা আতঙ্কিত ক্যাশিয়ার একটা চেয়ারের হাতল ধরে তাল সামল কোনমতে।
রোদ ভদ্রলোকের মুখের উপর পড়তেই ক্যাশিয়ার আবদুর রহমান স্পষ্ট দেখেছে অত্যাশ্চর্য, অসম্ভব, অলৌকিক একটা জিনিস। ভদ্রলোকের মুখে রক্ত বা মাংস কিছুই নেই। কিছুটা স্বচ্ছ, কিছুটা অস্বচ্ছ, কাঁচের মত আবরণ ভদ্রলোকের মুখে। সেই আবরণ ভেদ করে সূর্যের আলো গিয়ে পড়েছিল ভদ্রলোকের মুখের হাড়ে, কপালের হাড়ে। ক্যাশিয়ার পরিষ্কার দেখে ফেলেছে ভদ্রলোকের মুখের কাঠামোটা-মাংসহীন, রক্তহীন কঙ্কাল একটা মানুষ নয়! মোম বা ঐ জাতীয় । কোন পদার্থের প্রলেপ দিয়ে প্লাস্টার করা মুখ। রোদ পড়াতে সেই আবরণ ভেদ করে দৃষ্টি পড়েছে শুধু হাড়ের উপর ।
| কোন ভুল হয়নি ক্যাশিয়ারের। পরিষ্কার সর দেখেছে সে। মানুষ নয়, জলজ্যান্ত একটা কঙ্কালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে । থরথর করে কাঁপছে ক্যাশিয়ারের শরীর। দ্বিতীয় সুটকেসে টাকার বাণ্ডিল ভরছে কঙ্কাল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ক্যাশিয়ার। হঠাৎ মানুষ-বেশী কঙ্কালের কোর্টের আস্তিন সরে যেতে কব্জির উপরটা দেখা গেল । রোদ পড়ল সেখানটায়। তীক্ষ্ণ একটা আর্তধ্বনি কুয়াশা-১৪
১৪৭
বেরুল ক্যাশিয়ারের গলা থেকে। হাত নয়, ধু হাড় দেখতে পেয়েছে সে কঙ্কালের এবারও। চিৎকার করতে করতেই টলে পড়ে গেল সে। পড়েই জ্ঞান হারাল।
কঙ্কাল যন্ত্রচালিতের মত টাকা-ভরা দ্বিতীয় সুটকেসটা বন্ধ করল। ক্যাশিয়ারের চিৎকার যেন তার কানেই ঢোকেনি। একবারও মুখ তুলে না তাকিয়ে সুটকেস দুটো দু’হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। ব্যাঙ্কের অন্যন্য কর্মচারীরা হৈ চৈ শুরু করে ছুটে এসেছে জ্ঞানহীন ক্যাশিয়ারের কাছে। ম্যানেজারও ‘কি হল, কি হল’ বলতে বলতে পড়িমরি করে ছুটে আসছেন।
| কোনদিকে খেয়াল না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে মানুষের মত। বেশধারী কঙ্কাল। কেউ তাকে বাধা দেবার আগেই দরজা দিয়ে বের হয়ে এল সে। ব্যাঙ্কের পাঠান দারোয়ান ভিতরের গোলমাল শুনে দুই পথিকের মারামারির বিচার ত্যাগ করে ছুটে আসছিল। মানুষরূপী কঙ্কালের মুখোমুখি পড়ে গেল সে।
মানুষ-বেশী কঙ্কাল এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সিধে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার। উপর দাঁড়ান মরিস গাড়িটার দিকে। পাঠান দারোয়ানকে পাশ কাটিয়ে গেল সে। দারোয়ানের হাত থেকে খসে পড়ে গেল রাইফেলটা। পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে সে-ও কোট-প্যান্ট, হ্যাট-চশমা পরিহিত লোকটার মুখের হাড়। রক্ত-মাংস নেই এতটুকু। অশরীরী আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই পাথরের তৈরি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সে।
| মানুষরূপী কঙ্কাল যন্ত্রচালিতের মত সুটকেস দুটো রাখল ব্যাক-সিটে। চড়ে বসল কালো গাড়িটাতে। তারপর স্টার্ট দিল গাড়ি। দারোয়ানের আতঙ্কিত, বিস্ফারিত চোখের সামনে চলতে শুরু করল গাড়িটা। ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সেটা। পাঠান দারোয়ান বিকট এক অব্যক্ত শব্দ করে ভয়-তাড়িত হরিণের মত লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ল ব্যাঙ্কের ভিতরে।
এদিকে যে দু’জন লোক মারামারি শুরু করেছিল তারা হঠাৎ পরস্পরকে মাফ করে দিয়ে কোলাকুলি করে ভিড় ঠেলে পরস্পরের কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল। খানিকটা দূরে এসে একটা চলন্ত বেবী-ট্যাক্সি থামিয়ে চড়ে বসল তাতে। তামাসা দেখার জন্যে যারা ভিড় জমিয়েছিল তারা ওদের এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল। জবর তামাসা দেখিয়ে গেল বটে, লোক দু’জন!
এদিকে ব্যাঙ্কের ভিতরে জ্ঞানহীন ক্যাশিয়ারকে নিয়ে মহা গোলমাল শুরু হয়েছে। ডাক্তারকে ফোন করেছেন মি. খন্দকার। এর মাঝে পাঠান দারোয়ান উন্মাদের মত চেঁচাতে চেঁচাতে ঢুকল ব্যাঙ্কের ভিতরে। থামানো যাচ্ছে না তাকে। কেবল ‘ভূত ভূত’ বলে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে আর কাঁপছে ঠকঠক করে। ‘কেউই বুঝতে পারছে না কিছু। সকলেরই চোখে-মুখে একটা আতঙ্কের ছায়া
ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। | ১৪৮
ভলিউম
ডাক্তার আসার আগেই ক্যাশিয়ারের জ্ঞান ফিরে এল। ম্যানেজার মি. খ-কার ঝুঁকে পড়ে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কি, কি হয়েছিল, এমন অমন…!’
ভূত! না না, মানুষ নয়-কঙ্কাল-কঙ্কাল, ত্রিশ লাখ টাকা…!’ তীক্ষ্ণ একটা আর্ত চিৎকার করে আবার জ্ঞান হারাল সে।
ডাক্তার এসে পড়ল একটু পরেই। ক্যাশিয়ারকে ভিতরের একটা মেয়ে যাওয়া হল। দারোয়ানকেও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ভিতরের একটা রুমের মেয়ে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভূত ভূত’ করে সে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত বকে চলেছে।
পরিস্থিতি একটু একটু করে যখন স্বাভাবিকের দিকে এগোচ্ছে, ঠিক তখনই ব্যাঙ্কের সামনে কোটিপতি ইলিয়াস বক্সের প্রাইভেট কার এসে থামল । গাড়ি থেকে নেমে ব্যাঙ্কে প্রবেশ করলেন মি, বক্স। ম্যানেজার চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন চিন্তিতভাবে। মি.বক্সকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। মি.বক্স ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের ভীত, ব্ৰস্ত ভাবটা লক্ষ্য করলেন। ম্যানেজারকে বড় বিচলিত দেখাচ্ছে। তিনি করমর্দন করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার! আপনাদের সকলের মুখ শুকনো কেন?’
অদ্ভুত ব্যাপার, মি.বক্স!’ ম্যানেজার ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনি যে ভদ্রলোককে চেক দিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোককে টাকা দেবার পরই কি যেন দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আমাদের ক্যাশিয়ার আবদুর রহমান। দারোয়ানটাও “ভূত ভূত” করে চেঁচাচ্ছে।’
মি. বক্সের চোখে বিস্ময়ভাব ফুটে উঠল। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমি চেক দিয়েছি। কাকে? কবে?’
চমকে উঠলেন ম্যানেজার। তীব্র, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তার মানে! আপনাকে খানিক আগে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম না আমি? আপনি বললেন, হ্যাঁ, চার লাখ টাকার চেক দিয়েছি! ভদ্রলোক আপনার বন্ধু, বললেন না আপনি?’
মানে চারলাখ টাকার চেক! আপনি আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন! টাকা দিতে বলেছি আমি! এসব কি পাগলের মত বকছেন, মি. খন্দকার! ককখনও ফোন করে আমাকে পাননি আপনি। ফোন আমার আজ সকাল থেকেই খারাপ হয়ে রয়েছে। ‘
আঁ!’। উন্মাদের মত চেঁচিয়ে উঠলেন মি.খন্দকার। মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার। একমুহূর্ত তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন মি.বক্সের দিকে। কঠিন দেখাচ্ছে মি.বক্সকে। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘ব্যাপার কি! আপনার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে?’
‘কিন্তু আমি ফোন করে কানেকশন পেয়েছি, মি.বক্স! আপনি কথাও বলেছেন আমার সাথে! কুয়াশা-২৪
১৪৯
মুখ সামলে কথা বলুন, ম্যানেজার! আমি কি মিথ্যে কথা বলছি আপনার সাথে?
ম্যানেজারের জ্ঞান হারাবার দশা হল। ছুটে নিজের চেম্বারে ঢুকলেন তিনি। নিজের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে দু’হাতে মাথার চুল শক্ত করে ধরে টানতে শুরু করলেন; রাগে, দুঃখে, ভয়ে।
মি.বক্সও ঢুকলেন চেম্বারে। ধীরে ধীরে বসলেন তিনি একটা চেয়ারে! হতবাক হয়ে গেছেন তিনি ম্যানেজারের পাগলামি দেখে। তাঁর এই অদ্ভুত আচরণকে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না তাঁর।
মুখ তুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে বারটা চেক বের করলেন মি.খন্দকার। বেছে বেছে মি বক্সের অ্যাকাউন্টের চার লাখ টাকার বেয়ারার-চেকটা বের করে বাড়িয়ে, দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই দেখুন, আপনার সই রয়েছে চেকে।’
ভুরু কুচকে চেকটা নিয়ে দেখতে লাগলেন মি: বক্স । দেখতে দেখতে বিকৃত হয়ে উঠল তাঁর মুখাবয়ব। খানিক পরে মুখ তুলে বললেন, ‘জাল করা হয়েছে। আমার সই! হায় হায়, চারলাখ টাকা…’
ম্যানেজার ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘লোকটা তাহলে কি বারটা চেকের সই-ই জাল করেছে।’
বারটা।
ম্যানেজার কাঁদোকাঁদো গলায় বলে উঠলেন, ‘বারটা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের চেক নিয়ে এসেছিল লোকটা তাতেই তো সন্দেহ হয় আমার। প্রথমে ফোন করি আপনাকেই। আপনি টাকা দিয়ে দিতে বললেন।’
| ‘আমি বলিনি, আপনার ফোন পাবার প্রশ্নই ওঠে না…!
যাই হোক, ফোনের কানেকশন কেটে কেউ ষড়যন্ত্র করেছে বোঝা যাচ্ছে । আপনার কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে কথার উত্তর দিয়েছে কেউ আমাকে। আমার সন্দেহ হয়নি যে আপনি কথা বলছেন না। তবু মনটা কেমন যেন খুঁত খুঁত করতে লাগল। তাই আবার ফোন করলাম আরও দুই ভদ্রলোককে।’
‘কাকে কাকে ফোন করেছিলেন?’
ম্যানেজার বললেন, আপনার বন্ধুই তাঁরা। মিল-মালিক মি. আগরওয়ালা বেচারাম এবং ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মি.খায়ের মাহমুদকে। ওঁরাও বললেন টাকা ক্রিয়ে দিতে চেকের অঙ্ক অনুযায়ী। | ‘কি আশ্চর্য! এতগুলো অ্যাকাউন্টের চেক জাল করে টাকা তুলে নিয়ে গেল। আর আপনি…!’
ম্যানেজার রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করলেন। কিন্তু এগারটা ফোনের কোনটারই কানেকশন পাওয়া গেল না। কাঁপা হাতে আবার ডায়াল করতে শুরু করলেন মি. খন্দকার । পুলিসে ফোন করা দরকার এখুনি।
১৫০
ভলিউম-৮
দুই
ব্রেকফাস্ট সেরে ড্রইংরুমে এসে একটা সোফায় বসল প্রাইভেট ডি . শাদ খান। টেবিলের উপর আজকের দৈনিক কাগজগুলো রাখা হয়েছে। সে আজ সকালের ডাক। দৈনিকগুলোয় চোখ বুলিয়ে টেবিলেই ফেলে রাখা ). । নতুন একটা চেস্টারফিল্ড ধরিয়ে চিঠি-পত্রগুলো টেনে নিল। কয়েক চিঠি দেয় রেখে. দিল ও, খাম খুলল না। খামের উপরের লেখা দেখেই বুঝতে পারে, কোনগুলো আবেগপ্রবণ যুবকদের প্রশংসা বাক্যে ভরাট। তিনটে চিঠি কে । উপর তুলে নিল শহীদ। চতুর্থটার দিকে মনোযোগী চোখ রেখে ঠিকানা এই খামটা দেখল। বড়সড় একটা খাম । ভিতরে অনেক কাগজ-পত্ৰ । আর্জেন্ট >ি{}। সুদূর ইংল্যাণ্ডের স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে পাঠানো হয়েছে শহীদের নামে। খ’; খুলল শহীদ ধীরে ধীরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে চিঠি-পত্র ওর কাছে আসে না, কিন্তু মাঝে মাঝে আসে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ অফিসাররা কোন রহস্যের কিনারা করতে না পারলে সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখেন, যেমন ও-ও লেখে ।।
খামটা খুলে একগাদা কাগজ-পত্র বের করল শহীদ। পাতার পর পাতা লেখা। পাসপোর্ট সাইজের তিনটা ফটো তিনজন লোকের। দুজন ইউরোপীয়ান, একজন বাঙালী । ফটোগুলো ভাল করে দেখে রেখে দিল শহীদ।. এবার লেখা পত্রগুলো মেলে ধরল পড়ার জন্যে।
প্রায় আধঘন্টা লাগল চিঠিটা পড়া শেষ করতে। গম্ভীর হয়েছে শহীদের। মুখাবয়ব। কি যেন চিন্তা করছে ও। খানিক পর ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করল । অপরপ্রান্ত থেকে কামাল বলল, হ্যালো, কামাল আহমেদ বলছি ।
আমি শহীদ। কামাল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তুই একবার এখানে চলে আয়। খুবই দরকার।’
কামাল কৌতূহলী গলায় জানতে চাইল, “কি ব্যাপার, এমন জরুরী তলব?’
আয় আগে, সব বলব। রাখছি।’ রিসিভার রেখে দিয়ে শহীদ মৃদুস্বরে গফুরের নাম ধরে ডাকল। গফুর ডাকের অপেক্ষাতেই কাছে কোথাও ওত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল, ডাক শুনেই ছুটে এল । শহীদ একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলল, ‘তোর দিদিমণিকে ডেকে দে দেখি?
গফুর চলে গেল। একটু পরেই এল মহুয়া। এইমাত্র স্নান সেরে কাপড় পরেছে। ও। শহীদ অপলক চোখে মহুয়াকে দেখল। লাল হয়ে উঠল মহুয়ার গাল। বলল, ডাকছিলে কেন?”
শহীদ হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে দেখার জন্যে।
মহুয়া কৃত্রিম কোপে বলল, ‘পাঁয়তারা কষা বাদ দাও না, বললেই হয় যে, চা কুয়াশা-২৪
১৫১,
.
*
কার আবার।
শইদহে বলল, ‘চা যে দরকার তা তুমিও জান । কিন্তু আমি বলছি না ও ন? তাতেই তো তোমাকে ডাকলাম।’
মহুয়া বলল, “সে কি, তুমি তো নাস্তা করেছ!”
শহীদ হাসি চেপে বলল, ‘অসম্পূর্ণ হয়েছে সেটা, তোমার সৌন্দর্য পান করা বাকি আছে।’
লজ্জায় ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল মহুয়া। শহীদের দিকে পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে হেসে ফেলল নিঃশব্দে। শহীদ পিছন থেকে বলল, ‘যাও, তোমাকে ক্ষমা করে দিলুম আজকের মত, আজ আমি অভুক্তই না হয় থাকব। কিন্তু চা-নাস্তা সত্যি পাঠাও তাড়াতাড়ি। কামাল আসছে দু’মিনিটের মধ্যেই।
কথাগুলো শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মহুয়া দরজার কাছে। যাবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে বলে গেল, সে আমি আগেই বুঝেছি।’
খানিক পরই মহুয়া গফুরের হাতে নাস্তার ট্রে পাঠিয়ে দিল। গফুর যেতেই মহুয়া এসে বসল ড্রইংরূমে। সকালের ব্রেকফাস্ট এখনও করা হয়নি ওর। কামাল যখন আসছেই দুজন একই সাথে সারবে কাজটা।
শহীদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে পাওয়া চিঠির মধ্যে নতুন করে মনোনিবেশ করেছে আবার। মহুয়ার দিকে কোন খেয়াল নেই ওর। একমনে সিগারেট টানতে টানতে পড়ছে চিঠিখানা। দেখতে দেখতে মিনিট পাঁচ-সাত কেটে গেল। এমন সময় শোনা গেল কামালের কণ্ঠস্বর, দরজার দিক থেকে, তলবের কারণটা কি এই সাতসক্কাল বেলা? নিশ্চয় খাবার-দাবার ব্যাপার?’
শহীদ মুখ তুলে কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, না। তবে তোর পেট না ভরলে আর জিভের জল না শুকালে কোন কথাই টুকবে না কানে, তাই নাস্তাটা সেরে নে তাড়াতাড়ি। জরুরী আলাপ আছে।’
মহুয়া খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকতে বাধ্য হয়েছিল বলে রেগেছে, বোঝা গেল তার কণ্ঠস্বরে । কামালের উদ্দেশ্যে বলে উঠল ও, জরুরী আলাপ না ছাই, নিশ্চয় কেউ জানের ভয় দেখিয়ে চিঠি দিয়েছে, তাই কেমন গুম মেরে গেছে। তোমাকে দেখেই শখ লেগেছে জরুরী আলাপের। এস, ভাই, আমি তোমার অপেক্ষাতেই নাস্তা সামনে নিয়ে বসে আছি।’
কি সৌভাগ্য, কি সৌভাগ্য!
আনন্দে আত্মহারা হয়ে বসে পড়ল কামাল ভাবীর পাশে। দু’জন গল্প করতে করতে নাস্তা শুরু করল। শহীদের খেয়াল নেই ওদের দিকে। কাগজ-পত্রে আবার মনোযোগ দিয়েছে ও।।
মিনিট পনের পর নাস্তা শেষ করে উঠে গেল মহুয়া কামালের একটা ১৫২
ভলিউম-৮
রসিকতায় হাসতে হাসতে। একটু পরেই গফুর এল দুকাপ চা নিয়ে। কামাল নিল একটা কাপ। শহীদ ওর কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে বলল গফুরকে। গফুর কাপ নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ । একটু পর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল শহীদ ওর দিকে। গফুর গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। বিরক্ত হয়েই শহীদ জিজ্ঞেস করল, “কি রে, ভূতের মত করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’ | অভিমান-ভরা গলায় গফুর বলে উঠল, ‘ভূতের মত বুঝি আমি দাঁড়িয়ে আছি, দাদামণি!’
| তাই তো দেখছি।’
গফুর গম্ভীর গলায় বলল, ভূতের মত তাৈ দাঁড়িয়ে আছে ডি, কস্টা,আমি কেন?’
শহীদ বলল, ‘ডি. কস্টা দাঁড়িয়ে আছে! কোথায়?
গফুরের আগ্রহ দেখা দিল, অবাকভাবে সে বলল, “সেকি, দাদামণি! তোমার কিছু মনে থাকে না, কদিন থেকেই বলছি তোমাকে, কস্টাটা রোজ ভোরবেলা
থেকে আমাদের বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে!’ | | শহীদ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ডি কস্টা কদিন থেকে একটা কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে বটে। অন্ধকার থাকতে রোজ আমি একটু বেড়াতে বেরুই। ডি কস্টা বহুদূর থেকে আমাকে অনুসরণ করে। আমি বাড়ি ফিরে এলে কস্টাও বাড়ির কাছে-পিঠে ঘুরঘুর করতে থাকে। তারপর একসময় চলে যায় ও। তা তুই সে ব্যাপারে কি বলতে চাস?’
গফুর গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, কেন ও তোমাকে অনুসরণ করছে রোজ রোজ?’
তা তো বলতে পারব না। কোন খেয়াল বশত নিশ্চয় । হয়ত ডিটেকটিভগিরি শেখার শখ হয়েছে, তাই আমার আচার-আচরণ,ভাব-ভঙ্গি দেখে রপ্ত করবার চেষ্টা করছে।’
গফুর তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, ‘লোকটার ভাবগতিক আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না, তুমি যাই বল, দাদামণি।
শহীদ বলে উঠল, ‘বুঝেছি এবার। তোর হাত নিশপিশ করছে, তাই কাউকে সুযোগমত পেয়ে মনের সাধ পূরণ করার ইচ্ছা। ভাগ, ওসব হবে না।’
| গফুর সন্তুষ্ট হল না। সে এসেছিল ডি. কস্টাকে আচ্ছা মত ধোলাই করবার জন্যে দাদমণির অনুমতি নিতে। উল্টে ধমক খেতে হল তাকে। দুপদাপ পায়ের শব্দ তুলে মনের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বের হয়ে গেল সে রূম থেকে।
গফুর বের হয়ে যেতেই কামাল বলল, গফুরের তেমন দোষ নেই। মারধোর খাবার বা দেবার অভ্যাস ওর । বেশ কিছুদিন ধরে ওসব আদান-প্রদান হচ্ছে না
কুয়াশা-২৪
শহীদ বলল, বাদ দে ওর কথা।’
কথাটা বলে কি যেন চিন্তা করতে লাগল শহীদ } শহীদের দিকে মনোযোগ দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কামাল, জরুরী আলাপটা কিসের রে?’
শহীদ সাথে সাথে কোন কথা বলল না। এক-মুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আচ্ছা, কামাল, দু’জন ভদ্রলোকের কথা তোর মনে আছে? বছরখানেক আগে আমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থী হয়ে এসেছিলেন? মি. সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনি? ওঁরা দু’জনই এরফান মল্লিককে খুঁজে বের করার জন্যে আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। স্মরণ করতে পারিস?”
কামাল বলল, মনে পড়ছে বটে । দুই ভদ্রলোকই ছায়াছবির নাম করা প্রযোজক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন ওঁরা। বছরখানেক আগে পূর্ব বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে এসেছিলেন। আসার মাসখানেক পরই ওঁরা আমাদের কাছে আসেন। মি সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনির অল্প দিনের বন্ধু ছিলেন এরফান মল্লিক। এরফান মল্লিকের বিরুদ্ধে ওঁদের অভিযোগ ছিল নাকি। গুরুত্বপূর্ণ। ওঁদের পাঁচ লাখ টাকা মেরে দিয়েছিলেন নাকি এরফান মল্লিক। মেরে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। ওঁদের দুজনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে
ভেগে পূর্ব-বাংলায় আত্মগোপন করে আছে এরফান মল্লিক | আমাদেরকে অনুরোধ। করেছিলেন ওঁরা, এরফান মল্লিককে খুঁজে বের করে দেবার জন্যে। তুই নিজে কাজটা না নিয়ে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলি।’
শহীদ জানতে চাইল, “কেসটার পরিণতি কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত? ‘ | ‘চার-পাঁচ মাস ভয়ানক জ্বালাতন করে বেড়িয়েছিলেন ওঁরা। দিনের মধ্যে দশ-বারো বার ফোন করতেন, সশরীরে হাজির হতেন দু’বার তিনবার করে । সেই একই প্রশ্ন, কোন সন্ধান পাওয়া গেল এরফান মল্লিকের? চার-পাঁচ মাস ধরে নানা কৌশলে এরফান মল্লিকের সন্ধান বের করার চেষ্টা করলাম আমি । কোন হদিসই করতে পারলাম না। অন্তত আড়াইশো এরফান মল্লিক নামধারী ভদ্রলোককে সন্দেহ করেছিলাম পয়লা। পরে বুঝলাম, অপরাধী এরফান মল্লিক নিশ্চয় নাম বদলে ফেলেছে। যাই হোক, কোন সূত্র ধরেই এরফান মল্লিকের কোন সন্ধান করতে পারছিলাম না আমি। এমন সময় হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম মি.সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনি আমার কাছে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন। হাঁফ ছেড়ে বালা আমি। আমার ধারণা হয়েছিল, এরফান মল্লিক ঢাকায় থাকতে পারে না সুতরাং প্রতিটি জেলা চষে বেড়ানো দরকার তাঁকে খুঁজে বের করতে হলে ন্তু ‘. সারওয়ার এবং মি. ওসমান গনি ইতিমধ্যে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন বোধহয়
একদিন দেখা করে নিজের ব্যর্থতার কথা জানালাম। ওঁদেরকে কিন্তু তেমন হতাশ বলে মনে হল না। এরফান মল্লিক সম্পর্কে কোন আলোচনাই করলেন না ওরা যেচে পড়ে। আমি চলে এলাম । সেই শেষ। আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই ওদের সাথে । ৬৫৪
ভলিউম-৮
কিন্তু সে প্রসঙ্গ হঠাৎ আজ নতুন করে তুলছিস কি কারণে?
শহীদ এবার মূল বক্তব্য প্রকাশ করল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আজ জরুরী চিঠি পেয়েছি একটা। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। বছর দেড়েক ধ ওরা তিন জন লোককে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই যে, তিনজনের ফটো পাঠিয়েছে ওরা।’
ফটোগুলো কামালের দিকে বাড়িয়ে দিল শহীদ। কামাল ফটোগুলো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “আরে, এদের মধ্যে একজন বাঙালীও যে রয়েছে!
শহীদ বলে উঠল, শুধু বাঙালী নয়। শিক্ষিত এবং ধনী। বাঙালী মুসলমান। ভদ্রলোকের প্রকৃত নাম সোলায়মান চৌধুরী। জমিদার ছিলেন। বাকি দু জন তো দেখতেই পাচ্ছিস, ইউরোপীয়ান। কুখ্যাত মাফিয়া দলের দুর্ধর্ষ খুনী ওরা। ওদের আচ্ছা ছিল ইংল্যাণ্ডে। ওদের নাম হেস্টিংস আর বব।’
কামাল জানতে চাইল, অপরাধটা কি ওদের?’
শহীদ বলল, “হেস্টিংস আর ববের ব্যাকগ্রাউণ্ড অন্যান্য মাফিয়ানোদের মতই । কিন্তু জমিদার সোলায়মান চৌধুরীর পূর্ব-ইতিহাস ইন্টারেস্টিং। পশ্চিমবঙ্গে গুলি জেলার জমিদার ছিলেন একসময়। আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউই ছিল না সোলায়মান চৌধুরী পড়াশোনা করতেন লণ্ডনে। জমিদারী দেখাশোনা করত নায়েব। নায়েবের নাম কি হতে পারে বল তো?’
কামাল বলল, সোলায়মান চৌধুরীর নায়েবের নাম আমি কিভাবে জানব?’ ‘সোলায়মান চৌধুরীর নায়েবের নাম ছিল এরফান মল্লিক।’ আশ্চর্য হয়ে কামাল বলল, তাই নাকি!
শহীদ বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ, এই নায়েব এরফান মল্লিকই মি.সারওয়ার এবং মি. ওসমান গনির পাঁচ লাখ টাকা মেরে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে রয়েছেন। তা সে যাই হোক, আসল কথায় ফিরে আসা যাক এবার। সোলায়মান চৌধুরী লণ্ডনে থাকতেন বলে জমিদারী দেখাশোনা করত নায়েব এরফান মল্লিক। হঠাৎ সোলায়মান চৌধুরী লণ্ডনে এক ধনী-কন্যার প্রেমে পড়ে বিয়ে করে ফেলেন। এই বিয়েতে মেয়েটির আত্মীয়-স্বজন কেউ সন্তুষ্ট হয়নি। সোলায়মান চৌধুরী দৈরি না করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন স্বদেশে। ইংল্যাণ্ডে আর কোনদিন ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল না তার। বছরখানেক অতিবাহিত হবার পর ওঁদের মেয়ে হয় একটা । সেই মেয়ের বয়স যখন মাত্র দেড়মাস, তখন লণ্ডন থেকে সোলায়মান চৌধুরীর শ্যালক একটা টেলিগ্রাম করে সোলায়মান চৌধুরীর শ্বশুর মারাত্মক ভাবে অসুস্থ, এখন-তখন অবস্থা। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি একটি বারের জন্যে মেয়েকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে শ্যালক-প্রবর । খবর শুনে সোলায়মান চৌধুরীর স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করে। সোলায়মান চৌধুরী অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন, স্ত্রীকে নিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী শশুরকে শেষ দেখা দেখার জন্যে লণ্ডনে যাবেন। এবং দেখা করেই ফিরে আসবেন। ওঁদের দেড়মাস বয়সের মেয়েটির নাম রাখা কুয়াশা-২৪
১৫৫
হয়েছিল সুরাইয়া। সুরাইয়াকে নায়েব এবং য়েবের স্ত্রীর কাছে রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওদেরও একটি সদ্যজাত কন্যা-সন্তান ছিল। তাছাড়া নাকি মেয়েটির দেখাশোনা করার জন্যে দুজন নার্সেরও ব্যবস্থা করে যান সোলায়মান চৌধুরী।
শহীদ একটু থেমে আবার শুরু করল, আসলে সোলায়মান চৌধুরীর সাথে মেয়ের বিয়ে হওয়াতে প্রচণ্ড রেগে ছিল তাঁর শ্বশুরকুল । মিথ্যা টেলিগ্রাম করেছিল ওরা। সোলায়মান চৌধুরী সস্ত্রীক শশুরালয়ে উঠলেন। সাথে সাথেই টের পেলেন, তাদেরকে মিথ্যে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। দু’চারদিন চুপচাপ রইলেন তিনি। তারপর একদিন স্ত্রীকে বললেন দেশে ফেরার কথা। স্ত্রী সোজাসুজি কোন উত্তর না দিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। চৌধুরী বুঝল, শ্বশুর-শাশুড়ী এবং শালা তাঁর স্ত্রীকে দলে টেনে নিয়েছে। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর একদিন শ্বশুর এবং শাশুড়ীর কাছে প্রশ্নটা উত্থাপন করলেন তিনি। তারা এক কথায় নাকচ করে দিল তাদের মেয়ে ফার ঈস্টের কোন জংলী দেশে ফিরে যেতে চাইছে না। জামাইকে তারা উপদেশ দিল— লণ্ডনেই স্থায়ীভাবে থেকে যাবার জন্যে। সোলায়মান চৌধুরী রাজি হলেন না। তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। কথা কাটাকাটির মধ্যে আবির্ভাব ঘটল চৌধুরীর শালার। সে এসেই শাসিয়ে উঠল। ‘ব্ল্যাক ডগ’ বলে সম্বোধন করল সে চৌধুরীকে। চৌধুরী লজ্জায়, অপমানে দিশেহারা। অবশেষে তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমার স্ত্রীকে ডেকে দাও, তার নিজের মুখে শুনব আমি। সে যদি থাকতে চায় তবে আমিও থেকে যাব লণ্ডনে। শ্বশুর মহাশয় তাঁর মেয়েকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে এল সিটিংরূমে। মেয়ে বাবার শেখানো কথামত বলল, পশ্চিম-বাংলায় ফিরে যেতে চায় না সে।’
শহীদ একটু থেমে শুরু করল আবার, সোলায়মান চৌধুরী অপমানিত হয়ে ফিরে এলেন এক হোটেলে। স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় চরম আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। স্থির করলেন, এই অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। পরদিনই ওত পেতে দাঁড়িয়ে রইলেন শশুরের বাড়ির কাছে। রাত এগারটা। শ্যালক-প্রবর এক পাটি থেকে ফিরছিল। সোলায়মান চৌধুরী অন্ধকার থেকে লাফ মেরে শ্যালকের বুকে ছোরা বসিয়ে দিলেন আমূল। তারপর সিধে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন তিনি। দু’বছর ধরে কেস চলল। অপরাধী প্রমাণিত হলেন সোলায়মান চৌধুরী। কুড়ি বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল তাঁর।
ইন্টারেস্টিং! তারপর?
শহীদ নতুন করে সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগল, তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত । জেলের ভিতরে সোলায়মান চৌধুরী শান্তশিষ্টভাবে কাটিয়ে দিলেন দু’বছর। দু’বছর পর তাঁর পরিচয় হল হেস্টিংস আর ববের সাথে। সদ্যখুন করে জেলে ঢুকেছিল ওরা দু’জন চৌধুরীর লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্য দেখে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল ওরা। যেচে পড়ে ঘনিষ্ঠতা করল ওরা তার সাথে। নাড়ী-নক্ষত্র সব জেনে নিল
ভলিউম-৮
একদিনেই। তখন চৌধুরী দেশের ঠিকানায় নায়েবের কাছে প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখতেন। উত্তরও পেতেন নিয়মিত। কিন্তু ক্রমশ নায়েবের চিঠির সংখ্যা কমতে লাগল। যা-ও দুএকটা আসত, সে-ও দায়সারা গোছের। একসময় হঠাৎ চিঠি পত্র লেখা একদম বন্ধ হয়ে গেল। চৌধুরী নিয়মিত চিঠি লিখে লিখে হয়রান । কিন্তু তার কোন চিঠিরই উত্তর পাওয়া গেল না। হেস্টিংস আর বব চৌধুরীর অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছিল ইতিমধ্যে। তারাও ব্যাপারটা জানল । দু’জনাই সন্দেহ করল নায়েব এরফান মল্লিক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে চৌধুরীর সাথে । চৌধুরীর মেয়েটাকে হয়ত মেরে ফেলেছে, আর সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়ে ভোগ করছে অথবা বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র কোথাও মৌজসে জীবন কাটাচ্ছে । কয়েকদিন পাগলের মতন ছটফট করে কাটালেন মি.চৌধুরী। সান্তনা দেবার চেষ্টা। করল হেস্টিংস আর বব। ওরা প্রস্তাব দিল, চৌধুরী চাইলে জেল থেকে পালাবার। সব বন্দোবস্ত করে দিতে পারে তারা। চৌধুরী রাজি হলেন না। তার ভয়, পালানো। সম্ভব নয়। জেল থেকে বের হওয়া সম্ভব হলেও ধরা পড়ে যাবেন লণ্ডনেই। জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখলেন তিনি– নায়েব এরফান। মল্লিক এবং চৌধুরীর সম্পত্তির হালচাল কি, জানার জন্যে। চিঠির উত্তর এল কয়েকমাস পরে। দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে সবে। উত্তর এল চৌধুরীর সব। সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেছে। এরফান মল্লিকের কোন সন্ধান হিন্দুস্থান সরকারের জানা নেই। তবে তাদের ধারণা, এরফান মল্লিক পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেছেন সম্ভবত । দুঃসংবাদটা পেয়ে চৌধুরী গুম মেরে গেলেন। নায়েক এরফান মল্লিক যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। হেস্টিংস আর বব তাকে পালাবার পরামর্শ দিল আবার। এবার রাজি হয়ে গেলেন চৌধুরী। দিন-ক্ষণ ঠিক হল। জেলের ভিতর থেকেই বন্দোবস্ত করে দিল হেস্টিংস আর বব। নিরাপদে জেল থেকে বের করে দিল তারা চৌধুরীকে। কিন্তু পারলেন না চৌধুরী স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকে ধোকা দিতে। ধরা পড়ে গেলেন দুদিন পর লণ্ডনেই। আবার যথাস্থানে ফিরে আসতে হল। হেস্টিংস আর বব চৌধুরীকে জেল থেকে বের করে দিয়ে মনে কষ্ট পেয়েছিল। চৌধুরীকে পছন্দ করত ওরা দু’জন। চৌধুরী আবার জেলে ফিরে আসাতে খুশি হল ওরা। তারপরের ইতিহাস দুঃখজনক। সোলায়মান চৌধুরী মাফিয়া দলের দুই কুখ্যাত খুনির সাথে চরম ঘনিষ্ঠতা শুরু করলেন। তিনজনের সখ্যতা গড়ে উঠল জেলের ভিতরে। জেলের ভিতরেই নানারকম ছোটখাট অপরাধ করতে শুরু করল তিনজনের দলটা । কোথা থেকে মদ পেত যেন, সেই মদ খেয়ে মাতলামি করত। সোলায়মান চৌধুরীর অধঃপতন ঘটল এভাবেই। যাই হোক, দীর্ঘ কুড়ি বছর পর চৌধুরীর মুক্তিলাভ ঘটল । জেলের বাইরে এসে অসহায়, নিঃসম্বল, একা-একা মনে হল নিজেকে। দেশের কথা মনে পড়ে না তেমন করে। মনে পড়লেও লাভ কি। খুনী বলে চিহ্নিত সে। পকেটে পয়সা নেই। বয়সও বেড়ে
কুয়াশা-২৪
১৫৭
গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেফিরে দিন কাটতে লাগল । ছ’মাস কেটে গেল না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায়। ছ’মাস পর জেল থেকে ছাড়া পেল হেস্টিংস আর বব। দেখা হল আবার তিনজনের। চৌধুরী তখন নিস্তেজ হয়ে গেছেন। কিন্তু ছাড়ল না হেস্টিংস আর বব । ওরা বলল, “চৌধুরী, দেশে ফিরতে হবে তোমাকে। তুমি বড়লোক মানুষ, তোমার মেয়ে আজ বেচে থাকলে বড় হয়েছে। তোমার সাথে এরফান মল্লিক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে দেশে না ফিরলে চলৰে কেন? প্রতিশোধ নেবার জন্যে দেশে তোমাকে ফিরতেই হবে। আমরাও যাব তোমার সাথে । তোমার উপকার না করতে পারলে আমাদের মনে শান্তি নেই।” চৌধুরী রাজি হলেন না প্রথমে । কিন্তু হেস্টিংস আর বব শুনল না কোন কথা। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন চৌধরী, কিন্তু টাকা? হেস্টিংস আর বব বলল, টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লুট করব আমরা।’
শহীদ আবার সিগারেট ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল। কামাল বলল, তারপর?
শহীদ বলতে লাগল, তারপর সত্যি সত্যি তিনটে পিস্তল নিয়ে একটা ব্যাঙ্কে চড়াও হল ওরা। কিন্তু টাকা লুট করল বটে, সহজে সারতে পারল না কাজটা। ক্যাশিয়ার বাধা দিতে এগিয়ে আসতেই হেস্টিংস আর বব, গুলি করল। ব্যাঙ্কের দারোয়ান বন্দুক উঁচিয়ে ধরতেই গুলি করলেন সোলায়মান চৌধুরী। ক্যাশিয়ার আর দারোয়ান নিহত হল। প্রচুর টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল তিনজন। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড ভার নিল কেসের। কিন্তু কোন সন্ধানই করতে পারেনি তারা। সারা ইংল্যাণ্ড চষে বেড়িয়েছে পুলিস। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সকল প্রচেষ্টা। গত বছর স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড জানতে পারে, খুনী তিনজন হিন্দুস্থানে আছে। হিন্দুস্থান পুলিসকে অনুরোধ করা হয় সন্ধান দেবার জন্যে। হিন্দুস্থান পুলিস জানিয়েছে, ওরা তিনজন হিন্দুস্থানে নেই, পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেছে। সেই খবরের উপর ভিত্তি করে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে পূর্ব-পাকিস্তান পুলিসের কাছে অনুরোধ-পত্র এসেছে নিশ্চয় । ওরা আমাকেও ব্যক্তিগতভাবে একটা চিঠে দিয়েছে। সন্ধান পেলে জানাবার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। চিঠির সাথে তথ্যও আছে।
কথা শেষ করে নিঃশ্বাস ফেলল শহীদ। খানিকক্ষণ কামালও কোন কথা জিজ্ঞেস করল না। সিগারেটে টান দিয়ে শহীদ প্রশ্ন করল একটু পর, সব শুনে কি ভাবনা জাগে বল দেখি?
কামাল fি.ন্তিতভাবে বলল, ‘সোলায়মান চৌধুরী যদি সত্যি পূর্ব-পাকিস্তানে এসে থাকেন তাহলে নায়েব এরফান মল্লিককে বিশ্বাসঘাতকতার সাজা দেবার জন্যেই তিনি এসেছেন। তাঁর প্রথম কাজ হবে, এরফান মল্লিককে খুঁজে বে করা।
শহীদ বলল, তাহলে দেখা যাচ্ছে, এরফান মল্লিক একটা জাত শয়তান জমিদার সোলায়মান চৌধুরীর সর্বনাশই সে শুধু করেনি, মি. সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনিরও টাকা মেরে আত্মগোপন করে আছে।
১৫৮
ভলিউ-৮
“শহীদ বলল, তা ঠিক। কিন্তু নায়েব যত বড় অপরাধই করুক, সোলায়মান চৌধুরী, হেস্টিংস ও বরের হাতে সে নিহত হোক তা আমরা কামনা করতে পারি না । ওরা তিনজন এরফান মল্লিকের সন্ধান পেলে নিশ্চই পুলিসে খবর দেবে না। স্রেফ হত্যা করবে। সুতরাং সাবধান হতে হবে আমাদেরকে। এই বছরখানেক আগে চৌধুরী,হেস্টিংস আর বব পূর্ব-পাকিস্তানে এসেছে। আমার মনে হয়,এরফান মল্লিককে ওরা এখনও খুঁজে পায়নি। পেলে খুন করত। যার খুন হলে ব্যাপারটা চাপা পড়ে থাকা সম্ভব নয়।’
| কামাল একটু চিন্তা করে বলল, আচ্ছা, শহীদ, গত বছরখানেক ধরে যদি ওরা বাংলাদেশে থেকেই থাকে, তাহলে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে নাকি? জাত অপরাধীরা তো তেমন হয় না?’
শহীদ বলল, ‘তোর কথাটা খাঁটি। তবে আমার মনে হয়, ওরা এখনও একটিমাত্র উদ্দেশ্য সামনে রেখে দিন কাটাচ্ছে। সেটা হল, এরফান মল্লিককে হত্যা করা । রফান মল্লিককে হত্যা না করে ওরা কোন ঝুঁকি নিয়ে নিজেদেরকে চিহ্নিত করতে চায় না।’
কামাল বলল, ‘তাও বটে।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এরফান মল্লিক চিত্র-প্রযোজক মি সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনির টাকা কিভাবে মেরে দিয়েছিল?
কামাল বলল, ব্যবসা করার জন্যে এরফান মল্লিক এবং ওঁরা দু’জন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রত্যেকে আড়াই লাখ করে টাকা যোগ করে আমব্রেলা ইণ্ডাস্ট্রি গড়ে । তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । ওঁরা দুন ওঁদের ভাগের মোট পাঁচ লাখ টাকা এরফান মল্লিকে বিশ্বাস করে দিয়ে দেন। পরদিন সাড়ে সাত লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাঙ্কে জমা দের কথা। পরদিন সকাল বেলা ওঁরা দুই বন্ধ এরফান মল্লিকের বাড়ি গিয়ে দেখেন, বাড়ি খালি। এরফান মল্লিক ভেগেছে টাকা নিয়ে। এই হল ঘটনা।
তখন এরফান মল্লিক থাকত কোথায়? ক’বছর আগের ঘটনা এটা? এরফান মল্লিকের সংসারে তখন কে কে ছিল? আর একটা প্রশ্ন, এরফান মল্লিকের সাথে কোথায়, কবে ওদের দুজনার পরিচয় হয়?
কামাল উত্তর দিল, “থাকত কোলকাতায়। ওঁদের সাথে পরিচয়ও ওখানেই। পরিচয়ের সঠিক তারিখ ওঁরা আমাকে জানাতে পারেননি, তবে বলেছেন উনিশশো ষাট সালে পরিচয় হয়। বাষট্টি সালে টাকা মেরে দিয়ে অদৃশ্য হয় এরফান মল্লিক। তার সন্ধানেই গতবহর ওঁরা ঢাকায় আসেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই যোগাযোগ করেন আমাদের সাথে ঢাকায় এসে ‘জনাই চিত্র-প্রযোজনাকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেন। যাকগে, তোর বাকি প্রশ্নটার উত্তর হল– এরফান মল্লিকের সাথে ওঁদের পরিচয় হবার পর ওঁরা দেখেছেন, একমাত্র মেয়ে ছাড়া সংসারে আর কেউ
কুয়াশা-২৪
১৫৯
–
–
–
ছিল না তার। স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। মেয়েটি কলেজে পড়াশোনা করত।
শহীদ বলল, সোলায়মান চৌধুরী নিজের দেড় মাস বয়স্কা কন্যা সন্তানকে এরফান মল্লিকের হেফাজতে রেখে সস্ত্রীক যখন লণ্ডনে চলে যান তখন এরফান মলুিকেরও একটি মেয়ে সবেমাত্র জন্ম গ্রহণ করেছিল । ওঁরা যে মেয়েটিকে দেখেছেন সেটা এরফান মল্লিকের নিজের মেয়ে নিঃসন্দেহে। কিন্তু সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ের খবর কি? আচ্ছা এরফান মল্লিকের মেয়ের নাম কি?
কামাল বলল, এরফান মল্লিকের মেয়ের নাম বলতে পারেননি ওঁরা।’
শহীদ বলল, মি.সারওয়ার এবং মি.ওসমান গনি এরফান মল্লিকের খুঁজে বের করার ইচ্ছেটা হঠাৎ কেন যে দূর করে দিলেন সেটা একটা রহস্য বলে সন্দেহ হচ্ছে আমার। ওঁরা কি এরফান মল্লিকের সন্ধান নিজেরাই পেয়ে গেছেন?’
কামাল বলল, তাহলেও তো বলতেন আমাদেরকে। তবে গোপনীয় কোন উদ্দেশ্য থাকলে অবশ্য আমাকে না জানাবারই কথা।’
শহীদ বলল, ‘গোপন উদ্দেশ্য বলতে কি বোঝাতে চাস? ব্ল্যাকমেইল? না,
হত্যা?’
কামাল চিন্তিতভাবে বলল, ‘ব্ল্যাকমেইল হতে পারে, কেবল পাঁচ লাখ টাকা | ওদেরকে ফিরিয়ে দেবার পরও যদি এরফান মলিকের প্রচুর টাকা থাকে। আর হত্যা? নির্দিষ্ট করে বলা যায় না কিছু। মি. সারওয়ার বা মি. ওসমান গনি খুব সহজ-সরল-নিরীহ নন বলেই ধারণা আমার। তবে জোর করে কোন কিছু বলা যায়
।’
শহীদ বলল, যাই হোক, তোর সাথে ওদের ব্যবহারটা খানিকটা রহস্যময় । তুই এখুনি একবার গিয়ে দু’জনার সাথেই দেখা করে আয়। সবরকম চেষ্টা করবি জানার জন্যে, কেন এরফান মল্লিকের সন্ধান লাভের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ওঁরা।
কামাল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি এখুনি যাচ্ছি, পরে তোকে সব জানাব।’
কামাল চলে যেতেই একটা সিগারেট জ্বালিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে পাওয়া চিঠিটা ড্রইং-রূমের আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখে দিল শহীদ। সোফার দিকে
পা বাড়াচ্ছে আবার বসবার জন্যে,এমন সময় ককিয়ে উঠল ফোনটা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে শহীদ বলল, শহীদ স্পিকিং…হ্যালো…?’।
পলকের মধ্যে শহীদের সারা মুখে অবিশ্বাসের, বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠল । ওকে বলতে শোনা গেল, এসব কি বলছেন আপনি, মি. সিম্পসন! ব্যাঙ্ক ডাকাতি•••আচ্ছা। আঁ, কি বললেন?..:ত্রিশলাখ টাকা! একটা•••একটা কি? মানে•••কঙ্কাল•••কঙ্কাল মানে? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন•••সত্যিই তাই
ভলিউম-৮
১৬০
নাকি? আচ্ছা, দারোয়ান আর ক্যাশিয়ার দেখেছে? কঙ্কাল? দিনে দুপুরে। ঠিক আছে, এখুনি আসছি আমি•••|’।
রিসিভার রেখে এক মুহূর্তের জন্যে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শহীদ ফোনের দিকে। তারপর গফুরকে ডাকল ও । গফুর রূমে এসে ঢুকতেই পরজার দিকে পা বাড়িয়ে শহীদ বলল, মি. সিম্পসনের কাছে যাচ্ছি আমি। কামাল ফিরে এলে ইস্টার্ন ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে যেতে বলে দিবি। তোর দিদিমণিকেও আমার যাবার কথা বলে দিস।’
বলব, দাদামণি।।
শহীদকে উত্তেজিত এবং ব্যস্ত দেখে গফুর আন্দাজ করল, নিশ্চয় আবার মারামারি কাটাকাটির কোন খবর পেয়েছে দাদামণি ।
তিন।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। কুয়াশার বাড়ি। ভোর চারটে।।
শীতের রাত। চারদিকে নিস্তব্ধতা। খুট করে একটা শব্দ হল হঠাৎ। ঘুমের মধ্যেও সজাগ থাকে কলিম । শব্দটা শুনে ঘুম ভেঙে গেল ওর। লেপটা নিঃশব্দে, মুখ থেকে সরিয়ে চোখ মেলল ও। ধক করে উঠল বুকের ভিতরটা সাথে সাথে । গাঢ় অন্ধকারে ভরে গেছে সারাটা ঘর। অথচ পরিষ্কার মনে আছে ওর, শোবার সময় জিরো পাওয়ারের বাল জ্বেলে দিয়েছিল। কান পেতে রইল কলিম। একটু পরেই আবার শব্দ হল। মনে হল, ঘরের ভিতরই শব্দটার উৎস। ধীরে ধীরে। বালিশের তলা থেকে একহাতি লোহার ডাণ্ডাটা হাতে নিল কলিম । ঘরের ভিতরে অন্য একটা চৌকিতে শুয়ে আছে, শ্যানন ডি কস্টা। কলিম ভাবল, ডি. কস্টাকে জাগাবার একটা উপায় করতে পারলে হত। কিন্তু চৌকিটা ঘরের আর এক প্রান্তে। আবার শব্দ হল একটা। এবারের শব্দ শুনে মনে হল, কেউ যেন কাপড়-চোপড় নাড়ছে। খসখসে শব্দটা দ্বিতীয়বারও হল । চোর নাকি? নাকি… | সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠল কলিমের। কঙ্কালের কথা মনে পড়ে গেছে ওর। শহরময় কদিন থেকে ভীষণ একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষের মত বেশ-বাস করে, সারা গায়ে এক ধরনের স্বচ্ছ মোম লাগিয়ে একদল কঙ্কাল ভয়ঙ্কর উপদ্রব শুরু করে দিয়েছে। প্রথম যে ঘটনাটা ঘটে সেটা সবচেয়ে বিস্ময়কর। দেশের চারটে ব্যাঙ্কে একই সময়ে, একই কৌশলে চারটে মানুষ-বেশী কঙ্কাল মোটা টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। তারপর এক বোম্বাই-ওয়ালার পঞ্চাশ লক্ষ টাকার গহনা নিয়ে গেছে। তৃতীয় ঘটনাটা ঘটে সমুদ্রে। সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে সরকারী সোনা আসছিল তের মণ। কঙ্কালদল অদ্ভুত উপায়ে সেই তের মণ সোনা নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। আবার একটা শব্দ হতে সারা গা শিউরে উঠল কলিমের। শব্দটা এবার ১১-কুয়াশা-২৪
১৬১
অতি কাছাকাছি কোথাও থেকে হয়েছে। কান পেতে রইল কলিম। আর ঠিক সেই সময় কলিমের মুখের উপর কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলল। সাথে একটা শক্ত হাত ওর গায়ের উপর আলতোভাবে এসে পড়ল। প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে উঠেই অন্ধকারে আন্দাজ করে একটা দেহকে জাপটে ধরল কলিম!
চিৎকার করা উচিত ছিল কলিমেরই। কিন্তু কলিম নয়, যাকে ও ধরেছে সে-ই বিকট স্বরে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে আর্তচিৎকার করে উঠল। ঘাবড়ে গেলকলিম। যাকে সে ধরেছে সে ছাড়াবার চেষ্টা করছে না মোটেই নিজেকে। শুধু তীক্ষ্ণ স্বরে একটানা চেঁচাচ্ছে-ই-ই-ই-ই-করে!
বিলম্বিত চিৎকারটা শেষ হয়ে আসছে। কলিম আরও জোরে জাপটে ধরল লোকটাকে। চিৎকারটা শেষ করেই লোকটা আর্তকণ্ঠে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে উঠল, ‘ছেড়ে ডে, শা! ছেড়ে ডে, টা না হলে টোর বারটা বাজা দেগা! হাড়-টাড় গুঁড়িয়ে ডেবার ফণ্ডি, হামি কমপ্লেন করেগা টোমার নামে বসের কাছে! | আতঙ্ক উবে গিয়ে রাগে সারা শরীর জ্বালা করে উঠল কলিমের । ডি.কস্টাকে ছেড়ে দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ-বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালল সে। ডি কস্টা তখনও গজরাচ্ছে, ‘হাড়-গোড় গুঁড়িয়ে ডেবার ফণ্ডি, হামি কমপ্লেন করেগা টোমার নামে বসের কাছে।
কলিম দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আবার ব্যাটা চেঁচায়, তুই কমপ্লেন করবি কেমন করে, আঁ? এই ভোর রাতে কি কাণ্ড করার মতলব শুনি?’
ডি কস্টা কোমরে হাত দিয়ে রক্ত চক্ষু মেলে শাসিয়ে উঠল, “ডেখো, কলিম মিয়া, ভুলে যেয়ো না যে, টুমি রাজার জাটের সাঠে কঠা বলিটেছ। খবরডার, টুই টোকারি করলে টোমার জিভ টেনে বের করে লেগা!’
| কলিম এক লাফ দিয়ে ধরে ফেলল ডি কস্টার ঘাড়। বলল, আজ ব্যাটা তোর, একদিন কি আমার একদিন। বল, বাতি নিভিয়ে দিয়ে আমার গায়ে হাত দিচ্ছিলি কেন? বল?
| ডি.কস্টা মহা ফাঁপরে পড়ল ।আত্মসম্মান বলে আর কিছু রইল না নেটিভটার কাছে, গায়ে হাত তুলতেও কসুর করল না। এই অপরাধের সমুচিত শাস্তি দিতেই হবে তাকে। কিন্তু মনে মনে ভেবে দেখল, কলিম আজ খেপে গেছে । খ্যাপা মানুষ খুনীর সমান। তেড়িবেরি করলে হয়ত খুনই করে ফেলবে তাকে। আত্মসম্মানের চেয়ে প্রাণ বাঁচানো আগে। শান্ত, নরম, পরাজিত গলায় বলে উঠল সে, ছেড়ে ডে আমাকে, ব্রাদার। টোর দুটো পায়ে ঢারি-থুককু, পায়ে ঢরব না, গিভ মি এ চান্স। রিকয়েস্ট করছি।’
কলিম ছেড়ে দিয়ে বলল, “কিছু চুরি করার মতলব করছিলি বুঝি? | ‘নো। হামি চোর না। হাম ডিটেকটিভ হোবে।
ডি.কস্টার কথা শুনে চোখ জোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল কলিমের। অবাক গলায় ১৬২
ভলিউম-৮
সে বলে উঠল, “কি? ডিটেকটিভ হবি!’
‘টুইটোকারি করবে না, বলে ডিচ্ছি!’ |
হঠাৎ রুখে দাঁড়াল ডি.কস্টা। কলিম বলল, “আচ্ছা, এশা শা তো কস্টা সাহেব, ডিটেকটিভ হবার দুরাশা কেন হয়েছে আপনার?’
ডি.কস্টাকে গম্ভীর হতে দেখা গেল। সে বলতে লাগল, ‘টোমা৬ ৭, আই মীন, আমার ফ্রেণ্ড কুয়াশার ঢারণা, শহীড খান এ-ডেশের বহুট ৭১ লাইভেট ডিটেকটিভ। ড্যাট ম্যান ইজ ভেরি বুড়িমান। মাগার, হামিও টে] • এ৬িমান নয়। হামিও শহীড খানের মটো ডিটেকটিভ হবে। টাই…।’
কলিম ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, “ও,ঘোড়া রোগ হয়েছে । তা এই ঠাণ্ডা যাওয়া হচ্ছিল কোথায় শুনি?’
ডি কস্টা বলল, ও কঠা আউট করা যাবে না, আই অ্যাম সরি।’
কলিম আবার ডি. কস্টার দিকে এগিয়ে এল। বেচারা তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক হায়, টোমাকে বলুটে পারি, মাগার টুমি কাউকে বলটে পারবে না প্রমিজ?’
বলব না কাউকে, বলুন এবার দয়া করে।’
ডি কস্টা গম্ভীর ভাবে বলল, শহীড খানকে ফলো করটে যাই হামি হর রোজ । ডিটেকটিভ হটে হলে শহীড খানের হাঁটা-চলা, কঠা বলা, চিন্টাটারা, হাসা সব। কিছু কপি করা ডরকার টো। টা না হলে ডিটেকটিভ হোবে হামি কেমন করে, টুমিই বল।’
কলিম বলল, তা তো বটেই। আজও বুঝি শহীদ খানকে ফলো করতে যাচ্ছিলেন? কিন্তু আমার গায়ে হাত দেবার কারণটা কি, কস্টা সাহেব?’ | ডি কস্টা বলল, ঠাণ্ডা কিনা, টোমার মাফলারটা খুঁজে ডেকছিলাম ।
‘সেকি কথা, আমি কি আপনার মত শীত-কাতরে! মাফলার কেউ বিছানায় নিয়ে শোয় নাকি? তাছাড়া ডিটেকটিভ হতে হলে শীতকে ভয় পেলে তো চলবে
, কস্টা সাহেব?’ | রেগে গেল ডি.কস্টা। বলল, তুমি আমাকে শীর্টের ভয় ডেখাচ্ছ! জান, ডার্জিলিংয়ে হামি দু’বছর শুটু প্যান্ট পরে কাটিয়েছি?’
| কলিম বলল, আমিও ছিলাম দার্জিলিংয়ে । তখন ভীষণ শীত পড়েছিল। তখন তুমি সেখানে থাকলে স্রেফ বরফ হয়ে গলে পানি হয়ে যেতে। সে সময়টায় এমন বেশি শীত পড়েছিল যে, জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো পর্যন্ত জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেগুলো ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারতাম না।’
| ডি. কস্টা তারচেয়ে বড় গুল ছেড়ে বলে উঠল, “ও আর কি শীট? আমি যখন ডার্জিলিংয়ে ছিলাম টখন এটো শীট পড়েছিল যে, কঠা বললে আমাদের কঠাগুলো বরফের চাই হয়ে আসটো। সেই বরফের চাঁইগুলোকে গলিয়ে ডেখটে হটো যে, আমরা কি কঠা-বার্তা বলাবলি করটেছিলাম।’ কুয়াশা-২৪
কথাগুলো বলতে বলতে চঞ্চলভাবে তাকাচ্ছিল ডি কস্টা এদিক-ওদিক। কথা শেষ করেই লাফ দিল সে দরজার দিকে। কলিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের দরজা খুলে ভো দৌড় দিল ডি.কস্টা। কলিম ওকে যেতে দেবে না সব কথা শোনার পর, এই ভয়ে কায়দা করে ভেগে গেল সে।
শহীদ খানকে অতিরিক্ত চিন্তিত দেখল ডি. কস্টা। রোজকার মত অন্ধকার থাকতেই প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে বটে ও, কিন্তু কদিন থেকেই ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ডি. কস্টাও দূর থেকে শহীদের মত দু’হাত পিছনে রেখে মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখে নিচ্ছে সে শহীদের ভঙ্গিটুকু। শহীদ সিগারেট ধরালে ডি. কস্টাও সিগারেট ধরায়। শহীদ দেশলাইয়ের কাঠিটা নিভিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশের ড্রেনে যেভাবে ছুঁড়ে ফেলে, ডি কস্টাও সেভাবে অনুকরণ করে হুবহু । আজ বেশিক্ষণ হাঁটল না শহীদ। বাড়ি ফিরে এল সে সূর্য ওঠার আগেই। ডি কস্টাও দূর থেকে দেখল সব। আজ সে আর শহীদের বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর না করে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। শহীদ খানের চিন্তিত ভাবটা ভাবিয়ে তুলেছে ডি.কস্টাকে। নিশ্চয় মানুষ-বেশী কঙ্কালের রহস্য মীমাংসা করার কথাই অমন মগ্ন হয়ে ভাবে শহীদ খান কদিন থেকে, অনুমান করল ডি.কস্টা। হঠাৎ চমকে উঠল সে। একটা প্ল্যান.মাথায় এসেছে তার! সে যে ডিটেকটিভ হবার জন্যে সাধনা করছে একথা শুনলে সবাই হাসাহাসি করবে! তারচে’ সকলের তাচ্ছিল্যের দাঁত ভাঙা জবাব দিতে পারলে একটা কাজের মত কাজ হয়। শহীদ খান তো কঙ্কাল রহস্য ভেদ করার কথা ভাবছে এখনও। সে যদি আজ থেকেই কাজ শুরু করে দেয় কঙ্কালকে হাতে-নাতে ধরার জন্যে, তাহলে শহীদ খানের চেয়ে এগিয়ে থাকবে সে। আর একটা কঙ্কালও যদি সে ধরতে পারে–ওহ, দেশময় হৈ-চৈ পড়ে যাবে । সকলেই তখন পাকা ডিটেকটিভ বলে তারিফ করবে তার। শহীদ খান তখন আর ‘তুমি’ বলবে না তাকে, মিস্টার শ্যানন ডি কস্টা বলে হ্যাঁণ্ডশেক করার জন্যে ছুটে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, তার বস গর্ব অনুভব করবে তাকে নিয়ে। বস্ কুয়াশাকে খুশি করতে জানও কবুল করে দিতে পারে শ্যানন ডি কস্টা।
কিন্তু তথ্য কোথায়? কিসের উপর নির্ভর করে কঙ্কাল ধরার জন্যে কাজ শুরু করবে সে? ডি.কস্টা পথ চলতে চলতে চিন্তা করতে লাগল। তথ্যের অভাব কি? মনে মনে ভাবল সে-কঙ্কাল যেখানেই হানা দিয়েছে সেখানেই দেখা গেছে কারও মোটর গাড়ি নিয়ে গেছে। এটাই তো সবচেয়ে বড় তথ্য। ঢাকা শহরের প্রতিটি কালো গাড়িকে সন্দেহ করতে শুরু করবে সে এখন থেকে। কালো গাড়ি দেখলেই. গাড়ির ড্রাইভারকে লক্ষ্য করতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর স্টেশনের কাছে চলে এল ডি কস্টা। তখন সবেমাত্র সূর্য উঠেছে। রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়নি তখনও। ডি.কস্টা দেখল, একটা
১৬৪
ভলিউম-৮
=
;
কালো রঙয়ের গাড়ি এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। ধড়াস করে উঠল একট। তার। যীশুর নাম স্মরণ করে ক্রস আঁকল তাড়াতাড়ি। গাড়িটা এসে পড়ে। ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তড়াক করে লাফ দিল ডি.কস্টা। সর্বশী ৮ উত্তেজনা বিদ্যৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল ডি. 01, দু’হাত উদারভাবে দু’দিকে মেলে দিল। শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে । হতার হোক, কঙ্কাল মানুষ নয়; ভয় তো একটু-আধটু জাগবেই মনে ।।
| ডি.কস্টা রাস্তার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতেই গাড়ির ড্রাইভার এ যে দাঁড় করাল গাড়ি। ডি. কস্টা সন্তুষ্ট হল। প্রাথমিক সাফল্যলাভ ঘটেছে তার, গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছে অন্তত। এখন চালককে পরীক্ষা করতে হবে।
| কি ব্যাপার, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এভাবে বাধা দেয়ার কারণ কি, সাহেব?’ গলা বাড়িয়ে বিরক্তির সঙ্গে জবাবদিহি চাইলেন গাড়ির মালিক ।।
সতর্ক ভঙ্গিতে দু’হাত আক্রমণ করার কায়দায় সামনে বাড়িয়ে দিয়ে পা পা করে এগিয়ে গেল ডি কস্টা। কাছাকছি গিয়ে তীব্র চোখে দেখতে লাগল সে ভদ্রলোককে। একটু অপ্রতিভ বোধ করলেন ভদ্রলোক। ডি কস্টা কঠিন কণ্ঠে হুকুম করল, সূর্যের ডিকে ফেস্ করে ঠাকুন, মিস্টার।’
ভদ্রলোক হতবাক হয়ে গেছেন। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সূর্যের দিকে মুখ ফেরালেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খানিকক্ষণ দেখল ডি.কস্টা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বা। ত্যাগ করে বলল, ভুট্টোরি ছাই, মিসটেক হয়ে গেল। ও-কে। আপ চলা যাইয়ে, মিস্টার।’
মানে! এসবের মানে কি?
ভদ্রলোক এবার রেগে গেলেন। ডি.কস্টা দেখল মহাবিপদ! গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তুলল সে হঠাৎ। বলে উঠল, সাবানের মার নেহি হ্যায়, মিস্টার। হামি কঙ্কাল ঢরার চেষ্টা করটেছি।’
কঙ্কাল শব্দটার উচ্চারণ শুনেই শুকিয়ে গেল ভদ্রলোকের মুখ । গাড়িটা একটু চালিয়ে রাস্তার একপাশে পার্ক করে রাখলেন তিনি। ডি, কন্টাকে বললেন, চা খাবেন?’
ডি.কস্টা এ কথায় রাজি হয়ে গেল। ভদ্রলোক স্টেশনের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘আপনি বুঝি ছদ্মবেশী সি. আই. ডি.?’ |
| ডি. কস্টা গম্ভীরভাবে বলল, ‘সিক্রেট ব্যাপারে নাক গলানো উচিট নয়, মিস্টার ।
প্লাটফর্মে ঢুকে ভদ্রলোক বললেন, আমি উল্কায় আজ চিটাগাং যাব। টিকিট অ্যাডভান্স করতে এসেছি। আমার ট্রেন ক’টায় বলতে পারেন?’ .
হাঃ হাঃ করে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল হঠাৎ ডি, কস্টা। বলল, আপনার ট্রেন! ট্রেন আপনার হটে পারে না, মিস্টার। ট্রেন টো গভর্নমেন্টের!’ কুয়াশ-২৪
১৬৫
না, ঠাট্টা নয় । কখন ট্রেন ধরার জন্যে আসতে হবে আমাকে, জানেন আপনি?”
ডি.কল্টা বলে উঠল, ‘ঢরবেন কি করে, মিস্টার? ট্রেনটা যে খুব জোরে চলে!
দ্রলোক থমকে গেলেন ডি.কস্টার ইয়ার্কি মারার স্পর্ধা দেখে। রক্তচক্ষু মেলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলে উঠলেন তিনি, ‘এ যে বদ্ধ-পাগল দেখছি!’
কথাটা বলে ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। ডি কস্টাকে একা রেখেই দ্রুতপায়ে চলে গেলেন কাউন্টারের দিকে। ডি, কস্টা নিজের অপরাধ বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর গম্ভীর মুখ করে প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে হাঁটতে শুরু করল সে। অনেকক্ষণ ধরে কালো রঙের গাড়ির খোঁজে হন্যে হয়ে শহরের বড় বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটল ডি.কস্টা। কিন্তু কালো রঙের গাড়ি আর একটাও চোখে পড়ল না তার। রীতিমত খেপে গেছে সে। তার ধারণা, কঙ্কাল ব্যাটারা টের পেয়ে গেছে যে, শ্যানন ডি. কস্টা কঙ্কাল ধরার জন্যে প্রতিজ্ঞা করেছে। সেই ভয়েই রাস্তায় বের হচ্ছে না ওরা। হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাক্তারখানা দেখতে পেল ডি, কস্টা। ডাক্তারখানায় বসা ডাক্তারকে দেখেই তার। ডান পায়ের ব্যথাটার কথা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন থেকেই ডান পাটায় ব্যথা বোধ হচ্ছে। এর একটা চিকিৎসা দরকার। কঙ্কালকে ধরতে হলে দৌড়াদৌড়ি কম করতে হবে না। এই সুযোগে পাটার ব্যারাম সারিয়ে নেয়া দরকার। ডাক্তারখানায়। ঢুকে ডাক্তারকে পা দেখাল ডি. কস্টা। ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে দেখলেন। কিন্তু কোন কারণই তিনি বুঝতে পারলেন না ব্যথার। অবশেষে মুখ তুলে মন্তব্য করলেন, আপনার ডান পায়ে আপনি যে ব্যথাটা অনুভব করছেন সেটা হয়েছে বয়সের দরুন, বার্ধক্যের জন্যে।
ডি.কস্টা ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, বয়সের ডরুন! কিয়া আজগুবি বাৎ বোলতা হ্যায় ডাক্তার টোম? তুমি কিছু জান না। আমার ডান পায়ের বয়স বাঁ পায়েরই সমান মাগার, কই, বা পায়ে তো কোন ব্যথা নেহি হ্যায়!’ | মুখ-ভঙ্গির মাধ্যমে অনাস্থা প্রকাশ করে ডাক্তারকে বিমূঢ় করে দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল ডি কস্টা। তার ধারণা হল, দুনিয়ায় সব মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে।
বেলা এগারটা পর্যন্ত একটা দেশী মদের দোকানে কাটাল ডি, কস্টা। চারটে মাত্র টাকা ছিল পকেটে। দু’প্যাট বাংলা গিলেই সব টাকা শেষ। আধ-খিচড়ানো মন নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছে ডি.কস্টা। একটু নেশার আমেজ অবশ্য রয়েছে এখনও। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখল সে গাড়িটা। রাস্তা দিয়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে গাড়িটা। কালো, চকচকে কালো গাড়ি!
কালো গাড়ি দেখেই চমকে উঠল ডি. কস্টা। কি করবে না করবে বোঝার আগেই গাড়িটা এসে পড়ল। তীব্র বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেল গাড়িটা। চালকের আসনে হ্যাট পরিহিত লোকটার মুখ দেখেই শিউরে উঠল তার সর্বশরীর। ১৬৬
ভলিউম-৮
কঙ্কাল! পরিষ্কার দেখেছে সে! লোকটার মুখের উপর রোপ পাল। খর হাড় সে পরিষ্কার দেখেছে। কাল-বিলম্ব না করে প্রাণপণে খুশি সে শাyি কে । আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে তার চোখজোড়া। কঙ্কাল দেখে {। শাড়ির সামনেই! বসকে জানানো দরকার!
চার
শহীদ ও কামাল বসে আছে গম্ভীরভাবে। | ওদের দুজনকেই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
চিন্তিত হবার কারণ অবশ্য ঘটেছে একটা। গতরাতে রহস্যত্র একটা চুরি। সংঘটিত হয়েছে শহীদের ড্রইংরূমে। ড্রইংরূমের দরজা বন্ধই ছিল। জানালা গলে রূমে ঢুকেছিল চোর । টাকা-পয়সা, গহনা-গাটি কিছুই খোয়া যায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে যে চিঠিটা এসেছিল, সেটা ড্রইংরুমের আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল শহীদ। আলমারির তালা ভেঙে চোর চুরি করে নিয়ে গেছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে প্রাপ্ত চিঠির খামটা । চিন্তিত হয়ে পড়েছে শহীদ।।
এদিকে সেদিন কামাল শহীদের নির্দেশ অনুযায়ী দেখা করতে গিয়েছিল চিত্র প্রযোজক মি. সারওয়ার এবং মি. ওসমান গনির সাথে। ওঁরা দুজনেই রহস্যময় ব্যবহার করেছেন কামালের সাথে । প্রথমে দেখাই করতে চাননি কেউ। কামাল নাছোড়বান্দা। অবশেষে ড্রইংরুমে বসবার অনুমতি পেয়েছিল ও। প্রথমে ও দেখা করতে গিয়েছিল মি. সারওয়ারের সাথে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখার পর ড্রইংরূমে এলেন মি. সারওয়ার। তিনি কামালকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু এমন ভাব দেখালেন যে, তিনি কামালকে চিনতেই পারেননি। কামাল স্মরণ করিয়ে দিল, উনি এবং মি. ওসমান গনি এরফান মল্লিককে খুঁজে বের করে দেবার জন্যে
অনুরোধ জানিয়েছিলেন কামালের কথা শুনে কথাটা অস্বীকার করতে পারলেন না। মি. সারওয়ার। যাই হোক, কথা-বার্তার বেশিক্ষণ সময় দেননি মি.সারওয়ার। কামাল প্রশ্ন করেছিল, এরফান মল্লিকের কোন সন্ধান আপনারা পেয়েছেন? | মি সারওয়ার উত্তর দিলেন, না, আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। শয়তানটাকে আর পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস আমাদের।’
কামাল বলেছিল, “খোঁজ করলে পাওয়া যাবে না, তা নয়। আপনারা যদি এরফান মল্লিক সম্পর্কে আরও কিছু বিশদ তথ্য দিতে পারেন তাহলে আমরা নতুন করে চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
মি.সারওয়ার বলেছিল, তথ্য দিয়ে আর কি হবে? তাকে পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস আমাদের। কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ আপনার ব্যাপারটা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কেন, জানতে পারি কি? কুয়াশা-২৪
১৬৭
কামাল তখন শহীদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে পাওয়া চিঠিটার কথা প্রকাশ করেছিল । ও বলেছিল, এরফান মল্লিককে নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করছেন সোলায়মান চৌধুরী প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। যাতে কোন হত্যাকাণ্ড ঘটতে না পারে সেজন্যে সাবধান হতে চাই আমরা।’ | যি সওয়? উ৫ পঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সে তো খুব ভাল কথা। এরফান মল্লিককে খুঁজে বের করতে পারলে তো ভই কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, সে পাকিস্তানে হয়ত নেই-ই। আচ্ছা, আমি একটু ব্যস্ত আজ, আপনাদের অনুসন্ধান কাজ কতটুকু এলে জানালে খুশি হব।’
কামাল বের হয়ে এসেছিল মি. সারওয়ারের বাড়ি থেকে। রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল ও’ তারপর ও মি. ওসমান গনির বাড়িতে যায়। সেখানেও ঐ একই ব্যবহার। শহীদকে এসব কথা জানাতে আশ্চর্য হয়েছিল শহীদও। চিন্তিত হয়ে পড়েছিল দু’জনেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছিল ওরা, যে ভদ্রলোকদ্বয়ের অস্বাভাবিক ব্যবহারের পিছনে রহস্যময় কোন একটা কারণ আছেই। কিন্তু কি সেই রহস্যময় কারণটা?
ধীরে ধীরে মুখ তুলে শহীদ বলল, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে আমি যে একখানা চিঠি পেয়েছি, তা তুই আর আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। আমি কাউকে বলিনি, তবে মি. সিম্পসনও ঐরকম একটা চিঠি পেয়েছেন সরকারীভাবে । কিন্তু তিনিও জানেন না যে, আমার কাছেও চিঠি এসেছে! তুই কেবল মি. সারওয়ার এবং মি. ওসমান গনিকে জানিয়েছিস। আর কাউকে জানিয়েছিলি কিনা মনে করে দেখ দেখি, কামাল?’
কামাল বলে উঠল, ‘ওদেরকে ছাড়া আর কাউকেই চিঠির কথা বলিনি আমি । তুই যাই বলিস শহীদ, আমার সন্দেহ, চিঠিটা চুরি করেছেন ওঁরাই। নিজেরা না করে থাকলেও তোক দিয়ে করিয়েছেন।
শহীদ বলল, “কিন্তু কোন যুক্তিতে একথা বলছিস তুই? চিঠিটা কি কাজে আসবে ওঁদের, বল? একমাত্র সোলায়মান চৌধুরী বা তার সঙ্গী দু’জন ছাড়া ঐ চিঠির ব্যাপারে আর কারও মাথা-ব্যথা থাকার কথা নয়। তুই তো সোলায়মান। চৌধুরীর ফটো দেখেছিস, ওঁদের দু’জনার মধ্যে কেউই সোলায়মান চৌধুরী হতে পারেন না!’ | কামাল শহীদের কথা মেনে নিতে পারল না। বলল, তাই বা জোর করে বলিস কি করে? হয়ত ওঁদের মধ্যেরই কোন একজন সোলায়মান চৌধুরী। আজকাল প্লাস্টিক সার্জারির ফলে মানুষের সম্পূর্ণ চেহারা বদলে দেয়া যাচ্ছে।
শহীদ বলল, তোর কথা মেনে নিতাম যদি সোলায়মান চৌধুরী নিজে অপরাধী না হতেন। এঁদের মধ্যে কেউ যদি সোলায়মান চৌধুরী হতেন তাহলে এরফান মল্লিককে খুঁজে দেবার জন্যে আমাদের কাছে আসতেন না। ১৬৮
ভলিউম-৮
কামাল বলল, তাহলে চুরির ব্যাপারে তোর কি ধারণা?’
শহীদ চিন্তিতভাবে বলল, “চুরির সাথে সোলায়মান চৌধুরীর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যোগ আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু যোগাযোগ কি ধরনের তাই বুঝে উঠছি না। তবে আমার বিশ্বাস, মি. সারওয়ার ও মি. ওসমান গনি এর সাথে জড়িত। কেননা চিঠিটার কথা ওঁরা ছাড়া আর কেউ জানত ।
কামাল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে প্রশ্ন করল, আচ্ছা শহীদ, সোলায়মান চৌধুরীর সাথে কঙ্কাল-রহস্যের কোন যোগাযোগ আছে বলে সন্দেহ হয় নাকি তোর?’
শহীদের আর উত্তর দেয়া হল না। রূমের ফোন বেজে উঠল কর্কশ স্বয়ে। কামাল উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ফোনের দিকে। শহীদ মন্তব্য করল, “দ্যাখ, রোজকার মত কঙ্কাল আবার কারও সর্বনাশ করে ভেগেছে কিনা। মি. সিম্পসনই হয়ত ফোন করেছেন।’
| কামাল রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। অপরপ্রান্তের বক্তার বক্তব্য শুনতে শুনতে ছানাবড়া হয়ে গেল তার চোখজোড়া। একটু পর দ্রুত রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল ও, ঠিকই বলেছিস তুই, শহীদ। আবার কঙ্কাল! তবে এবারে রহস্যটা জটিল আকারে দেখা দিয়েছে। দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী দেখেছে চিত্র-প্রযোজক আখতার চৌধুরীর বাড়িতে কঙ্কালকে প্রবেশ করতে। অথচ আখতার চৌধুরী অস্বীকার করেছেন কথাটা! মি. সিম্পসন যেতে বলে দিলেন আমাদেরকে।
শহীদ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, বলিস কি! যার বাড়িতে কঙ্কাল ঢুকেছিল তিনিই অস্বীকার করেছেন।’
উঠে দাঁড়াল শহীদ। পোশাক পরেই ছিল ওরা। কথা বলতে বলতে দ্রুত বের হয়ে এল রূম থেকে। গ্যারেজের দিকে দ্রুত পায়ে এগোল দু’জন।
চিত্র-প্রযোজক আখতার চৌধুরীর বাড়ি মিরপুর রোডের পাশেই। বাড়িটার আশপাশের চতুর্দিকে ফাঁকা, কোন বাড়ি-ঘর কাছে-পিঠে নেই। বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য বাড়ি।
বাড়িটার সামনে কৌতূহলী, উত্তেজিত জনতার ভিড়! সহজেই চিনতে পারল শহীদ বাড়িটাকে ভিড় দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল ও। কামালও নামল লাফ দিয়ে। ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতর ঢুকল ওরা। ভিড় যত বাইরে। বাড়ির ভিতরে পুলিস ঢুকতে দিচ্ছে না কাউকে। ইন্সপেক্টর শহীদ ও কামালকে দেখে এগিয়ে এল । কাছে এসে বিনীতভাবে জানাল, ‘আসুন, স্যার, মি. সিম্পসন ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছেন আপনাদের জন্যে।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করল ওরা। মি. সিম্পসন ছাড়াও দু’জন হাই র্যাঙ্কের পুলিস অফিসার বসে আছেন দেখা গেল ড্রইং-রূমে। আর একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে কুয়াশা-২৪
১৬৯
দেখল ওরা। শহীদ অনুমান করল, ইনিই আখতার চৌধুরী। লম্বা-চওড়া ফিগার ভদ্রলোকের। প্রশস্ত কপাল। উজ্জ্বল গায়ের রঙ। চোখ দুটো অদ্ভুত আকর্ষণীয়। শান্ত সুবোধ প্রকৃতির চেহারা। ভদ্রলোককে খানিকটা বিস্মিত দেখাচ্ছে।
মি.সিম্পসন শহীদকে দেখে বলে উঠলেন, ‘এস, শহীদ, পরিচয় করিয়ে দিই তোমাদের সাথে মি. আখতার চৌধুরীর।
শহীদ এগোতে এগোতে দেখল, রূমের এক দিকের টেবিলের ওপর বুক ফুলিয়ে বসে আছে ডি, কস্টা। শহীদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে সে।
আখতার চৌধুরীর সাথে করমর্দন করল শহীদ ও কামাল। মি. সি সন। আখতার চৌধুরীকে বললেন, শহীদ খান, প্রাইভেট ডিটেকটিভ এবং ওর সহকারী, কামাল আহমেদ।
আখতার চৌধুরী শহীদের উদ্দেশে বলল, আমার সৌভাগ্য, আপনাদের মত গুণী ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটল । আপনারাই তো দেশের গৌরব, বহু বীরত্বের কথা শুনেছি আপনাদের। দয়া করে বসুন।’ | শহীদ ও কামাল পাশাপাশি দুটো সসাফায় বসল। আখতার চৌধুরী সিগারেট অফার করে বলে উঠলেন, ‘একটু আগে পর্যন্ত ভাবছিলাম, দু’জন পথিকের ভুলে বাজে একটা ঝামেলায় পড়ে সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই ভিত্তিহীন ঝামেলায় জড়িয়ে
পড়লে আপনাদের সাথে হয়ত পরিচয়ই হত না।
শহীদ শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনি বাড়িয়ে বলছেন। আচ্ছা, ঘটনাটা কি আসলে, বলুন দেখি?
আখতার চৌধুরীর সারা মুখে ফুটে উঠল রেখা। যার ফলে গম্ভীর দেখাল ভদ্রলোককে। তিনি শহীদের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, “ঘটনা আসলে কিছুই ঘটেনি, মি, শহীদ। আমি আজ বাড়িতেই ছুটি কাটাচ্ছি, বসে ছিলাম এই ড্রইংরূমেই। হঠাৎ শুনি, কে যেন আর্তনাদ করছে। বের হয়ে দেখি, ঐ লোকটা “কঙ্কাল কঙ্কাল” করে পাড়া মাত করছে শুধু শুধু।
আখতার চৌধুরী হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর বসে-থাকা ডি কস্টাকে দেখালেন। তারপর শুরু করলেন আবার, কাছে গিয়ে থামাবার চেষ্টা করলাম ওকে। কিন্তু কোনমতেই থামানো গেল না। ওর সাথে আরও একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, সে হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল বাড়ির সামনে। হাসপাতালে ফোন করতে চেয়েছিলাম
আমি, কিন্তু একটু পরই জ্ঞান ফিরে এল লোকটার। ওরা দু’জন যা বলল তার। সারমর্ম হচ্ছে, আমার বাড়ি থেকে একটা মানুষ-বেশী কঙ্কাল বের হয়ে একটা কালো গাড়িতে চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। অথচ এ সম্পর্কে, বিন্দু-বিসৰ্গ কিছুই জানা নেই আমার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন, টেবিলের ওপর বসা ওই পাগলটার ধারণা, কঙ্কাল-রহস্যের হোত নাকি আমিই। কঙ্কাল তৈরি করে আমিই ১৭০
ভলিউম-৮
নাকি টাকা লুট করার ফন্দি এঁটেছি। পাগলটার কথায় আবার সায় দিচ্ছে অনেকে। এখন বুঝুন মজা। অনুরোধ করছি, এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত করুন আপনারা আমাকে।’
| আখতার চৌধুরীর কথা শেষ হতেই টেবিল উল্টে পড়ার ভীষণ একটা শব্দ হল। দেখা গেল, মেঝেতে ডিগবাজি খেয়ে ডি, কস্টা ঠিক আখতার চৌধুরীর সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে তার একটা ছুরি। ছুরি বাড়িয়ে সে আখতার চৌধুরীকে আক্রমণ করার জন্যে পজিশন নিতে নিতে বলে উঠল উত্তেজিত কণ্ঠে, টুমি টোকা ডেবার জায়গা নেহি পায়া? তুমি বেটা মার্ডারার! কঙ্কাল টোমার বাড়ি ঠেকে বের হয়ে ভেঙ্গে পড়ল আর টুমি কিনা..হামি নিজের চোখে ডেখলাম…!’
শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে ডি, কস্টাকে ধরে টেনে আনল হিড়হিড় করে নিজের কাছে। জিজ্ঞেস করল, “এই, আস্তে কথা বল? কি দেখেছ তুমি নিজের চোখে?
ডি.কস্টা সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল শহীদের দিকে। তারপর বলল, আমার ফ্রেণ্ড কুয়াশা আমাকে সাভারে যেটে বলেছিল। টাই যাচ্ছিলাম হামি বাই সাইকেলে রাস্টা ডিয়ে। এই বাড়িটার সামনে এসে ডেখি, একটা ব্ল্যাক কার ভঁড়িয়ে আছে । সন্দেহ হল আমার। কঙ্কালকে টরার জন্যে প্রটিজ্ঞা করেছি হামি। ভাবলাম,কঙ্কাল এই ব্ল্যাক কারে করে আসটে পারে। একটা গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে উঁড়িয়ে ঠাকলাম হামি। এর পরেই ডেখি, হ্যাট মাঠায় দিয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে আসছে ব্ল্যাক কারের ডিকে। হামার কঠামটো এই আখটার চৌদুরীকে অ্যারেস্ট না করলে ভুল করবে তুমি। কঙ্কাল এই কালপ্রিটেরই পোষা। এই কঙ্কালকে আজ সকালে হামি আর একবার ডেকেছিলাম। আমার ফ্রেণ্ডকে বললাম, ফ্রেণ্ড কঠাটা হেসে উড়িয়ে ডিলেন। উল্টো হামাকে আডেশ ডিলেন সাভারে যেটে। টাই যাচ্ছিলাম, হাজার হোক ফ্রেণ্ড টো।’
শহীদ বলল, ‘তোমার সাতে আর কে ছিল যেন?’
ডি কস্টা বলল, আমার সাথে আর কেউ ছিল না। টবে একজন পাবলিক ছিল রাস্তার উপর উঁড়িয়ে। সে টো ভয়েই সেন্সলেস হয়ে গেল।
শহীদ মি.সিম্পসনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘সে লোকটা কোথায়?”
মি. সিম্পসন বললেন, “সে বাড়ি চলে গেছে। তার জবানবন্দি লিখে নিয়েছি আমি। তার কথা হুবহু ডি, কস্টার মতই।
শহীদ আখতার চৌধুরীর দিকে ফিরে বলল, এ ব্যাপারে নতুন করে আর কিছুই কি বলবার নেই আপনার? | আর কি বলবার থাকবে? এসব পাগলদের প্রলাপ শুনে বিরক্ত বোধ করছি
আমি; মি. শহীদ!
আখতার চৌধুরীর চেহারা থেকে নিরানন্দ ভাব দূর হয়ে ক্রোধ দেখা দিল । শহীদ জানতে চাইল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না। আপনি কুয়াশা-২৪
১৭১
তো চিত্র-প্রযোজক মি. সারওয়ার এবং ওসমান গনিকে নিশ্চয় চেনেন?
“নিশ্চয় চিনি! কেন বলুন তো?’
শহীদ বলল, না, এমনি। আচ্ছা, আপনার বাড়ির টাকা-পয়সা সব ঠিক আছে কিনা দেখেছেন? চুরি যায়নি তো কিছু?
আখতার চৌধুরী বললেন, বাড়িতে আমার টাকা পয়সা তেমন থাকার কথাই নয়, চুরি হবে কোথা থেকে? হলেও দু’-দশ টাকা হতে পারে। কিন্তু কঙ্কাল সামান্য দু’-দশ টাকার জন্যে নিশ্চয় আসছে না।’ | শহীদ বলল, তা ঠিক। আচ্ছা মি. আখতার, বাড়িতে আপনার আর কে কে আছেন?”
আখতার চৌধুরী বললেন, “আমার, বৃদ্ধ আম্মা আছেন, হসপিটালে। স্ত্রী কোলকাতায় ছেলেটার সাথে রয়ে গেছে। আমি এখানে আম্মার সাথে থাকি। আমার একমাত্র ছেলে, সে হিন্দুস্থান সরকারের প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের বড় অফিসার। চাকরি ছেড়ে ওর পক্ষে টাকায় চলে আসা সম্ভব নয় বলে মাফ নিয়ে রয়ে গেছে ও।’
আপনার চাকর-বাকর ক’জন?’ তিন জন।
মি.সিম্পসন বললেন, ‘ওদের প্রত্যেকের জবানবন্দি নিয়েছি আমি। কেউ কিছু দেখেনি, বলেছে। কালো গাড়িও নয়, কঙ্কাল তো নয়-ই।
শহীদ বলল, ওদেরকে একটু ডেকে দেবেন, দয়া করে আর একবার?”
আখতার চৌধুরী বললেন, আবার জেরা করার কি কোন দরকার আছে? আচ্ছা ডাকছি, আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
শহীদ বলল, কর্তব্য পালন করছি আমরা, মি. আখতার। নিশ্চয়, একশো বার। এই সলিমউদ্দিন। সলিমউদ্দিন..!’
আখতার চৌধুরী জোর গলায় ডাকলেন। প্রায় সাথে সাথেই ড্রইংরূমে ঢুকল একজন আধবয়সী লোক লুঙ্গি পরে। শহীদ বলল, তোমার নাম সলিম?”
“জ্বি, হ্যাঁ।’
লোকটা রীতিমত ঘাবড়ে গেছে মনে হচ্ছে। একটু ভয়ও পেয়েছে যেন। শহীদ হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, বল তো সলিম, তুমি অত ভয় পাচ্ছ কেন?’
সলিমউদ্দিন ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি বলল, না না, না হুজুর, ভয় পাব কেন?
ধমক দিয়ে উঠল শহীদ, মিথ্যা কথা বলছ। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ভয় পেয়েছ তুমি! বল, কি দেখে ভয় পেয়েছ?”
সলিমউদ্দিন দিশেহারার মত হয়ে মনিব আখতার চৌধুরীর দিকে তাকাল। আখতার চৌধুরী অভয় দিয়ে বললেন, বল, যা জিজ্ঞেস করছেন, উত্তর দে।
সলিমউদ্দিন ভীত গলায় বলল, কঙ্কালের কথায় ভয় পেয়েছি আমি, হুজুর।’
শহীদ বলল, তাহলে কঙ্কাল তুমি দেখেছ?’ ১৭২
ভলিউম-৮
প্রবলভাবে আপত্তি প্রকাশ করে বলল, না! দেখিনি হুজুর, খোদার কসম বলছি! লোকে কঙ্কালের কথা বলছে শুনে ভয় পেয়েছি আমি।’
কঙ্কাল তোমাদের বাড়িতে এল, আর তুমি দেখলে না! কোথায় ছিলে তুমি তখন?”
সলিম ঢোক গিলে উত্তর দিল, ‘আমি, আমি তখন রান্নাঘরে ঝাড়ু দিচ্ছিলাম, হুজুর।’
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে সলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তুমি যাও। আরও দুজন লোক আছে, ওদেরকে ডেকে দাও।
| কিন্তু অন্য দু’জনকে কি একটা কারণে ভয়ানক ভীত দেখালেও কেউই সেই ভয়ের কারণটা প্রকাশ করল না। নানারকমভাবে জেরা করল শহীদ। কিন্তু কেউই স্বীকার করল না কঙ্কালের কথা। অগত্যা খুচরো কিছু আলাপ করে বিদায় নিল শহীদ, কামাল ও সহকারীসহ মি. সিম্পসন। ডি. কস্টাকে বাধ্য করা হল বিদায় নিতে। জনতাকে হটিয়ে দিল পুলিস।
শহীদ বাড়ি ফেরার পথে একটা কথাও বলল না। অসম্ভব গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। কামাল শুধু জিজ্ঞেস করল চুপ থাকতে না পেরে, “কি মনে হল তোর সব দেখে?
শহীদ ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আনমনে প্রশ্ন করল, ‘ডি, কস্টা সাইকেলে চড়েই মিরপুর রোড দিয়ে যাচ্ছিল সাভারে, কেন বল তো?’
নিশ্চয়ই কুয়াশার কোন কাজে। আমার প্রশ্নের উত্তর দে, আখতার চৌধুরীকে কেমন মনে হল তোর? কঙ্কালের সাথে কোন সম্পর্ক ওর আছে বলে মনে হয়?
শহীদ, গাড়ি চালাতে চালাতে কামালের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল একবার। তারপর চিন্তিতভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে বলল; অত সহজ নয়, কামাল। কঙ্কাল-রহস্য সত্যি রহস্যময়, তার সাথে যোগ হয়েছে অন্যান্য জটিলতা। তার সামনে আরও পেঁচালো রহস্যের সৃষ্টি হতে পারে। মনে রাখিস, বুদ্ধি খাঁটিয়ে সব রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতে হবে।’
কামাল বলল, “এসব হেঁয়ালি কথার মানে কি তোর?’
শহীদ বলল, হেঁয়ালি! আমার মন বলছে কিছু একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। আমাদেরকে সাবধান হতে হবে কামাল।
পাঁচ
সেই দিনই একটা ঘটনা ঘটল। শহীদ বাড়ি ফিরছিল বাইরে থেকে। বাড়ির ভিতরে গাড়ি ঢোকবার সময় ও দেখল, একজন লোক লুঙ্গি পরে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে লোকটার আপাদ-মস্তক পরখ
কুয়াশা-২৪
১৭৩
করল শহীদ। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল ও। লোকটার মধ্যে কোনরকম ভাবান্তর দেখা গেল না। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল সে শহীদের দিকে তাকিয়ে।
কি চাই?’ জিজ্ঞেস করতে হল শহীদকে।
লোকটা গ্রাম থেকে এসেছে, অনুমান করল ও। হাঁটুর কাছে লুঙ্গি, ময়লা পাঞ্জাবী পরনে, মাথায় কাপড়ের টুপি। লোকটা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, “সাব, গফুর নামে কেউ কাম করে এই বাড়ি?”
হ্যাঁ, করে। কি দরকার তোমার?’
লোকটা জবাব দিল, “হে আমারে কামের কতা কইছিল। আমি কাম-টাম করবার চাই। আমারে আইবার কইছিল গফুর মিয়া, আইজই।।
শহীদ একটু অবাক হল। কাজের মানুষের জন্যে গফুর আসতে বলেছিল নাকি? হবেও বা, ভাবল শহীদ, মহুয়া হয়ত গফুরকে কাজের লোকের কথা বলেছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে শহীদ বলল, “ঠিক আছে, তুমি এখানেই দাঁড়াও, গফুরকে ডেকে দিচ্ছি আমি। | গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়িতে ঢুকল শহীদ। ড্রইংরুমে মহুয়া কামাল বসে ছিল। শহীদকে দেখেই জিজ্ঞেস করল কামাল, কোথায় গিয়েছিলি তুই? কঙ্কাল
ধরতে?’
শহীদ উত্তর না দিয়ে মহুয়াকে বলল, গফুরকে পাঠিয়ে দাও তো মহুয়া, কে যেন ডাকছে ওকে।
মহুয়া চলে গেল। শহীদ কামালকে বলল, ‘বেরিয়েছিলাম আজ এক কাজে। ঢাকা শহরের প্রায় সব গুপ্তা-সর্দারের সাথে আলাপ করে এলাম। হেস্টিংস ও ববকে তারা চেনে না বলল। ঢাকা শহরে ইংরেজ গুণ্ডা মাত্র পাঁচজন। তাদের সকলকেই দেখলাম। কিন্তু হেস্টিংস আর ববের সন্ধান পাওয়া গেল না।
কামাল বলল, ‘তোর আগের কথাই ঠিক। সোলায়মান চৌধুরী অতি সাবধানী লোক। হেস্টিংস ও ববকে সবরকম ভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছেন। তার নিজের উদ্দেশ্য সাধিত না হওয়া পর্যন্ত কোনরকম রিস্ক নিতে রাজি নন তিনি।’
শহীদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু গফুর রূমে ঢুকতেই মুখ তুলে তাকাল ও। গফুরের হাতে একটা খাম। শহীদ খামটা দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘তোর হাতে খাম এল কোত্থেকে? কাকে যেন কাজের জন্যে আসতে বলে দিয়েছিলি,
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম, দেখা করেছিস?’
গফুর রীতিমত অবাক হয়ে তাকাল শহীদের দিকে। বিস্মিত ভাবটা দূর করে বলে উঠল সে, আমি তো কাউকে কাজের জন্যে আসতে বলিনি, দাদামণি! দিদিমণি আমাকে বলল, তোকে একজন লোক ডাকছে। আমি গিয়ে দেখলাম, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের সামনে। আমি, যেতেই এই খামটা দিয়ে ১৭৪
ভলিউম-৮
বলল–তোমার সাহেবকে এই খামটা দিয়ে দাও গিয়ে। আমি রংপুরের এক মসজিদের চাঁদা নিতে এসেছি। এই খামের ভিতরে চিঠি লিখে দিয়েছেন আমাদের ইমাম সাহেব, তোমার সাহেব সেটা পড়ে যা হোক কিছু দান করবেন।’
গফুরের কথা শেষ হওয়ামাত্র তড়াক করে লাফ দিয়ে বের হয়ে গেল কামাল। রূম থেকে। শহীদ গফুরের হাত থেকে খামটা দ্রুত হাতে নিয়ে খুলে ফেলল । খামের ভিতরে একটা চিঠি। চিঠিটা বাংলা টাইপরাইটারে লেখা। শহীদের নামেই লেখা । বিস্মিত হয়ে পড়তে শুরু করল শহীদ চিঠিটাঃ
শখের ডিটেকটিভ শহীদ খান,
তুমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে একটা চিঠি পেয়েছ তা আমরা জেনেছি। চিঠিটায় সোলায়মান চৌধুরী, হেস্টিংস এবং ববের সন্ধান করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে তোমাকে। এই চিঠির আর একটা কপি পৌঁছেছে স্পেশাল ব্যাঞ্চের পুলিস অফিসার মি সিম্পসনের। কাছে। কিন্তু মি. সিম্পসনের ব্যাপারে কোন দুশ্চিন্তা আমরা করছি না। দুশ্চিন্তা আমরা কারও সম্পর্কেই করতে চাই না। তোমার মত শখের ডিটেকটিভ সম্পর্কে তো নয়ই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে তোমাকে অনুরোধ করা হয়েছে তুমি সে অনুরোধ রক্ষা না করলেও পারবে। কিন্তু আমরা তোমাকে কোন অনুরোধ করব না। আমরা তোমাকে আদেশ করব! সেই আদেশ পালন না করলে রক্ষা পাবে না। তুমি সোলায়মান চৌধুরী, হেস্টিংস আর ববকে খোঁজার জন্যে কোনরকম সক্রিয়তা দেখাতে পারবে না, এই আমাদের আদেশ। আমাদেরকে খোঁজার কোনরকম চেষ্টা করলে তোমার এবং তোমার পরিবারের সর্বনাশ করব। আমাদের কথার গুরুত্ব দিয়ো, এটা আমাদের উপদেশ। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করবই। তাতে কারও মাথা ঘুমাবার দরকার নেই। কেউ যদি মাথা ঘামায়, তাহলে তার মাথা গলা থেকে আলাদা করে দেব আমরা।
আশা করি, তুমি আমাদের উপদেশ গ্রহণ করবে। মনে রেখ, আমরা মার্ডারার। দু’-দশটা খুন করা আমাদের কাছে দু’-দশটা পিঁপড়েকে টিপে মারার মতই। সুতরাং শখের গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তোমার এবং তোমার পরিবারের সর্বনাশ ডেকে এন না। তোমাকে একবার সাবধান করে দেয়া উচিত বলে মনে করেই লিখছি এই চিঠিটা।
সোলায়মান চৌধুরী।
কামাল কখন যেন রূমে এসে ঢুকেছে আবার। শহীদ মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে
১৭৫ কুয়াশা-২৪
ও বলে উঠল, বাড়ির আশপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না, শহীদ।
শহীদ বলল, না পাবারই কথা। চিঠিটা পড়ে দেখ, সব বুঝতে পারবি।
চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল কামাল। দেখতে দেখতে থমথমে হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারাঃ চিঠিটা পড়ে ফেরত দিল ও শহীদকে। উত্তেজিত গলায় বলল, হুম! তা কি করতে চাস তুই এব্যাপারে?’
শহীদ কি যেন এক গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল। কামালের প্রশ্ন শুনে বলল, কি যেন বললি?’ | কামাল পুনরাবৃত্তি করল ওর প্রশ্নটা। শহীদ বলল, “শয়তানটা শুধু আমার সর্বনাশ করবে না, আমার পরিবারেরও সর্বনাশ করবে বলেছে। ভাবছি আব্বা, মহুয়া, লীনা আর গফুরের কথা। আমার কারণে ওদের কারও কোন ক্ষতি হলে…।
কামাল বলে উঠল, “ঠিক বলেছিস তুই, শহীদ। এত বড় রিস্ক না নেয়াই ভাল।’
শহীদ একটু হেসে বলে উঠল, ‘নারে, পিছপা হবার কথা ভাবছি না আমি। বাড়ির সকলকে সাবধান করে দিতে হবে। আমি. সত্যানুসন্ধানকে শখ হিসেবে গ্রহণ করেছি বটে, কিন্তু নীতি-পালন বা নীতি-রক্ষাটা আমার কাছে শখের ব্যাপার ছিল না কোনদিনই। আমি বসে থাকব না। আজ থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু করে দিতে হবে, যদিও কোন তথ্যই নেই আমাদের সামনে। সন্দেহ করার মত
কাউকেই দেখছি না।’
কামাল, ‘কিন্তু•••
‘কোন কিন্তু নেই। একটা কথা ভুলে যাসনে কামাল, সোলায়মান চৌধুরী এরফান মল্লিককে হত্যা করবেন বলেই এদেশে এসেছেন। হতে পারে এরফান মল্লিক অপরাধী। কিন্তু তাকে সাজা দেবার ভার সোলায়মান চৌধুরীর ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। আইন আইনই। তার প্রয়োগও হতে হবে আইনানুগভাবে।
কামাল বলল, চিঠিটায় কিন্তু কঙ্কালের কোন উল্লেখ নেই।’
কিন্তু আশ্চর্য হইনি আমি। কেননা কঙ্কাল-রহস্যের সাথে সোলায়মান চৌধুরী জড়িত আছেন, একথা প্রকাশ পেলে আমরাঃতার সাবধান বাণী অগ্রাহ্য করে দেশ তোলপাড় করে দিতে পারি। আবার তিনি যদি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকেন তাহলেও তো কঙ্কালের নাম উল্লেখ না করারই কথা। দু’দিক দিয়েই উল্লেখ না করার কারণ আছে।
কামাল জিজ্ঞেস করল, তোর কি ধারণা?’
‘এখুনি কোন ধারণা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কঙ্কালের মাধ্যমে যে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ধন-সম্পদ লুট করছে, তাকে হয়ত চেষ্টা করলে চিনে নিতে পারব আমরা। আবার বলা যায় না, হয়ত কোন দিনই চিনতে পারব না। মোট কথা, কঙ্কাল-রহস্য ভেদ করা যেমন পানির মত সহজ তেমনি সাধনা করে অমরত্ব
১৭৬
ভলিউম-৮
লাভের মতই কঠিন।
ছয়।
পরদিন মি. সিম্পসনের সাথে আলাপ সেরে বেলা দশটায় তার অফিস থেকে বের হয়ে এল শহীদ ও কামাল। মি. সিম্পসনের সাথে সোলায়মান চৌধুরী, হেস্টিংস এবং বব সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। চিঠি চুরির কথাও জানিয়েছে শহীদ। কঙ্কাল রহস্য নিয়েই পাগল নিরাপত্তা বিভাগ! তার উপর এ আবার কি ভয়ানক দুশ্চিন্তা? অনেক ভেবে-চিন্তে মি. সিম্পসন শহীদকে উপদেশ দিয়েছেন, ও যেন সোলায়মান চৌধুরীর সন্ধান করার চেষ্টা না করে। তা না হলে সমূহ বিপদ ঘটবে । কিন্তু শহীদ রাজি হয়নি। মি. সিম্পসনও জানেন, শহীদ যা একবার করবে ভেবেছে তা না করে ছাড়বে না। রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। শহীদের বাড়িতে পুলিস-প্রহরার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেছিলেন। শহীদ বলেছে, দরকার নেই।
মি, সিম্পসনের অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে চড়ে বসল শহীদ ও কামাল। গাড়ি ছুটল। জিন্নাহ অ্যাভিনিউ ধরে এগোচ্ছে, গাড়ি এবার মোড় নেবে জি. পি. ও.-র দিকে। হঠাৎ চমকে উঠল শহীদ। আউটার স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে একটা কালো মরিস দ্রুতবেগে বের হয়ে সোজা ছুটে চলল । ড্রাইভিং সিটে হ্যাট পরিহিত এবং রঙিন সানগ্লাস চোখে একজন মানুষ। গাড়িতে আর কেউ নেই।
| কামালও লক্ষ্য করেছিল গাড়িটাকে। মোড় নিতে নিতে গাড়িটার বেগ হঠাৎ বাড়িয়ে দিল শহীদ। কামাল উত্তেজিত কণ্ঠে মন্তব্য করল, ‘সন্দেহজনক।’ | সোজা হাই কোর্টের দিকে ছুটে যাচ্ছে কালো মরিস। নিজেদের গাড়ির বেগ, পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ, চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশে বাড়িয়ে দিল শহীদ। অথচ, দুটো গাড়ির মধ্যে শ’খানেক গজের দূরতু রয়েই গেল । কামাল মন্তব্য করল, মরিসের
স্পীডও বাড়ছে, শহীদ! নিশ্চয় কঙ্কাল!’
| দেখতে দেখতে হাইকোর্ট ছাড়িয়ে রেসকোর্সের দিকে মোড় নিল মরিস। পিছু ছাড়ল না শহীদ। গতি বাড়িয়ে পঞ্চাশ করল ও। শহরের ভিতরে এই স্পীডে গাড়ি চালানো বিপজ্জনক। কিন্তু তবু দূরত্ব কমছে না। মরিসের চালক নির্বিকারভাবে বসে রয়েছে ড্রাইভিং সিটে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাচ্ছে না সে পিছন দিকে একবারও। কোন নড়াচড়াও নেই।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিভলভারটা বের করল শহীদ। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সম্মুখবর্তী মরিসটার দিকে। মাঝে মাঝে স্পীড-মিটারের কাঁটার দিকে তাকাচ্ছে ও।
শাহবাগ ছাড়িয়ে ফার্মগেটের দিকে পালাচ্ছে মরিসটা। লাল সিগন্যাল কুয়াশা-২৪
১৭৭
দু’জায়গায় অগ্রাহ্য করেছে ইতিমধ্যে। শহীদও পিছু ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই হর্ন বাজাচ্ছে ও। রাস্তার অন্যান্য যানবাহনকে সাবধান করে দিতে হচ্ছে। যে-কোন মুহূর্তে একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতে পারে।
“ ফার্মগেটে পৌঁছে মিরপুর রোডের দিকে মোড় নিল মরিসটা। দূরতু এখনও সমানই। শহীদের ফোক্সওয়াগেনের স্পীড পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। বিকট শব্দে। মোড় নিয়ে মিরপুর রোডে পৌঁছে গেল কালো মরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর মোড় নেবার পালা ফোক্সওয়াগেনের। হর্নের বোতাম টিপে ধরেছিল শহীদ আগেই। রাস্তার দু’ধারের যানবাহন দাঁড়িয়ে পড়েছিল বিপদ বুঝতে পেরে। কিন্তু একটা বেবী-ট্যাক্সির ড্রাইভার ব্যাপারটা খেয়াল করতে পারেনি যথাসময়ে। ফোক্সওয়াগনের প্রায় সামনে পড়ে গেল ট্যাক্সিটা। মোড় নিচ্ছে শহীদ তখন।। প্রাণপণে দুর্ঘটনা এড়াবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু আংশিক দুর্ঘটনা ঘটলই। বেবীর সামনের চাকার সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল: ফোক্সওয়াগেনের চাকার। বেবীর চাকাটা। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল তীরবেগে। ট্যাক্সিটার বাকি অংশও উল্টে পড়ল । মোড় নিয়ে ব্রেক কষল না শহীদ। গতি বাড়িয়ে দিল আরও। কালো মরিসটা দেড়শো গজ দূরত্ব বজায় রেখে আগে আগে ছুটছে সাভারের দিকে। কামাল পিছন দিকে তাকাল। বলে উঠল, বেবীতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল না। সামান্য।
আহত হয়েছে।’
মিরপুর লোহার পুল ছাড়িয়ে সাভার রোডে পৌঁছুল ওরা। নির্জন রাস্তা পাওয়া গেল এতক্ষণে। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাস বা লরি সামনে থেকে আসছে। হর্ন বাজিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে শহীদ। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ছে সেগুলো। ফোক্সওয়াগেনের স্পীড এখন ষাটেরও উপরে।
দূরত্ব কমছে এবার।
শহীদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাসের শব্দে শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না, অথচ উত্তেজুনায় জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে ওরা। গাড়িটা এখন আর ছুটছে না যেন, রাস্তার উপর থেকে উঠে তীব্র বেগে উড়ে চলেছে যেন রাস্তার দুপাশে নিচু জলাভূমি। মাঝে মাঝেই পুল অতিক্রম করছে ওরা। একটু এদিক-ওদিক হলেই গাড়ি নিয়ে গড়িয়ে পড়বে ওরা। পড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু।
দুটো গাড়ির দূরত্ব এখন আরও কমে গেছে। পনের-বিশ গজের বেশি হবে না দূরতুটা। রিভলভারটা তুলে নিল এবার শহীদ কোলের উপর থেকে। জানালার বাইরে রিভলভার ধরা হাতটা বের করে দিল ও। কামাল বলে উঠল চিৎকার করে, ‘গুলি করলে জীবিত ধরা যাবে না লোকটাকে, শহীদ!
উত্তর দিল না শহীদ। ট্রিগার টিপল ও রিভলভারের। মরিসের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেটটা। ভয় দেখাবার জন্যে ইচ্ছা করেই ফাঁকা আওয়াজ ১৭৮
ভলিউম-৮
করেছে শহীদ।
সামনে একটা পুল দেখা যাচ্ছে। বড় পুল। পুলের ওপারে রাস্তার দু’পাশের জমি সমতল। পুলটা অতিক্রম করার সময় এই প্রথমবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কালো মরির্সের ড্রাইভার। সূর্যের আলো লোকটার গালে পড়াতে চমকে উঠল শহীদ ও কামাল। পরিষ্কার দেখা গেল লোকটার গালে স্বচ্ছ মোমের আড়ালে হাড়। ‘মোমাবৃত কঙ্কাল!
পুলটা অতিক্রম করল কালো মরিস। মোমাবৃত কঙ্কাল আবার পিছন ফিরে তাকাল। ফোক্সওয়াগেন অতিক্রম করল পুল। ঢালু রাস্তা দিয়ে বিদ্যৎবেগে নেমে যাচ্ছে শহীদের গাড়ি। আবার পিছন ফিরে তাকাল কালো মরিসের মোমাবৃত কঙ্কাল। শহীদ ও কামাল দু’জনেই সজাগ হয়ে উঠেছে। বারবার তাকাচ্ছে কেন কঙ্কালটা? কি উদ্দেশ্য ওর মনে? শিউরে উঠল ওরা দুজনই। অজানা আশঙ্কায় দুলতে লাগল বুক।
| ঠিক এমন সময়ই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা ঘটল!
কালো মরিসের মোমাবৃত কঙ্কালের ডান হাতটা নড়ে উঠল একটু। দৃষ্টি এড়াল না শহীদের। পলকের মধ্যে কল্পনাতীত বিপদের সম্মুখীন হল ওরা। আচমকা কালো মরিসের নিচে থেকে হাজার হাজার ক্ষুদ্রাকৃতি আয়রন-বল ছড়িয়ে পড়ল রাস্তার উপর। ছেলেপেলেদের গোল গোল মারবেলের মত আয়রন-বল হাজার হাজার পড়তে লাগল মরিসের নিচ থেকে। ভয়ঙ্করভাবে নেচে উঠল শহীদের ফোক্সওয়াগেন। পলকের মধ্যে রাস্তার একপাশে চলে গেল গাড়ি, পরক্ষণে শহীদের প্রাণপণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মাঝ রাস্তার উপর দিয়ে রাস্তার অপর ধারের দিকে গোঁয়ারের মত লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টায় গাড়ি সামলাবার চেষ্টা করছে শহীদ। কিন্তু গাড়ির নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা ওর সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। রাস্তা থেকে মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়ল গাড়ি তীব্র বেগে । সামনেই একটা পাড়হীন পুকুর। চিৎকার করে উঠল শহীদ ও কামাল।
কামালকে সতর্ক করে দিয়েই দরজা খুলে ঝাঁপ দিল শহীদ ছুটন্ত গাড়ি থেকে।
মোমাবৃত কঙ্কাল ইতিমধ্যে কালো মরিস নিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে কে জানে!
সাত
পরদিনের ঘটনা।
অন্ধকার থাকতেই রোজকার মত শালটা গায়ে জড়িয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে পড়ল শহীদ।
প্রতিদিন বড় রাস্তা ধরে লেক পর্যন্ত যায় শহীদ। লেকের পাড় ধরে আধঘন্টার কুয়াশা-২৪
১৭৯
মত বেড়িয়ে আবার বড় রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে ফিরতি হাঁটা ধরে। তখনও লোক চলাচল শুরু হয় না রাস্তায়। এক-আধটা যানবাহনের দেখাও পওয়া যায় না।
লেকের পাড়ে বসে খানিক হাওয়া খেল শহীদ আজ। গভীর চিন্তায় ডুবে রইল লেকের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে। নির্দিষ্ট আধঘন্টার আগেই ও আজ উঠে পড়ল। বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল ও ধীর পদক্ষেপে। রাস্তায় লোক নেই একজনও। সবেমাত্র দিনের আলোর আভাস দেখা দিচ্ছে। শীতের প্রভাত। হালকা কুয়াশা দূর হয়নি এখনও। সূর্য উঠতে এখনও দেরি অনেক। নিত্য যারা ভোরের হাওয়া খেতে বের হয় তারা এখনও বিছানা ছাড়েনি। শহীদই একমাত্র মুক্ত বায়ুসেবী, সে সকলের আগে বের হয় এবং সকলের আগে ফেরে।
একমনে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল শহীদ। চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে। হঠাৎ কি যেন হল ওর মনের ভেতর। ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল। এলোমেলোভাবে আরও কয়েক পা হেঁটে কি মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল ও ঘাড় ফিরিয়ে বিস্মিতভাবে তাকাল পিছন দিকে। নির্জন শিশির-ভেজা, বহুদূর প্রসারিত কংক্রিটের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। কেউ নেই কোথাও। রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলো কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি বাড়িকেই মনে হচ্ছে ভূতুড়ে-বাড়ি। সাড়া নেই, শব্দ নেই।
থমকে দাঁড়িয়েই রইল শহীদ। কেন যেন বিচলিত হয়ে উঠেছে ও। ওর মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু যেন একটা ঘটছে। কান পেতে রইল ও। বিচলিত ভাবটা বেড়ে গেল ওর। বহুদূর লম্বিত রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল ও। সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে মনে। আশঙ্কায় ভরে উঠছে বুক। বহুদুরে কে যেন আর্তনাদ করছে। ভাল করে শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্রমশই অতি অস্পষ্ট আর্ত-চিৎকারটা জোরালো। হয়ে উঠছে।
এক মুহূর্ত পরই শহীদের সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হল। কুয়াশার ধোয়াটে অস্পষ্টতা ভেদ করে একজন লুঙ্গি আর শার্ট পরিহিত লোককে প্রাণপণে ছুটে আসতে দেখল শহীদ। লোকটা বড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে। বহুদূরে বলেশহীদ শুনতে পেল না লোকটা চিৎকার করে কি বোঝাতে চাইছে।
পরমুহূর্তে চমকে উঠল শহীদ। কুয়াশা ভেদ করে আরও একজন লোক বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসছে। দ্বিতীয় লোকটার পরনে প্যান্ট এবং লাল শার্ট। লোকটার গায়ের চামড়া অস্বাভাবিক ফর্সা। লোকটা সম্ভবত ইংরেজ। সাথে সাথে শহীদের মনে পড়ে গেল হেস্টিংস আর ববের কথা।
কিন্তু দেশী লোকটাকে তাড়া করে আসছে কেন লাল শার্ট পরিহিত বিদেশীটা? এই মুহূর্তে শহীদের করণীয় কিছু নেই। বহুদূরে ওরা। শহীদ ছুটে গেলে কি ঘটে যায় কে জানে। তাছাড়া কি কারণে একজনকে তাড়া করে ছুটছে অন্যজন কে জানে। পাগল-টাগলও হতে পারে।
ভলিউম-৮
১৮০
কিন্তু পাগল নয়। পর মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারল শহীদ। ইংরেজ লোকটা পিছন থেকেই লুঙ্গি পরিহিত লোকটার পিঠ লক্ষ্য করে কি যেন ছুঁড়ে মারল বিদ্যুৎগতিতে। বিকট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল লোকটা রাস্তার উপর। খানিকটা গড়িয়ে গেল লোকটার আহত দেহটা। চোখের পলকে ঘটে গেল আশ্চর্যজনক ঘটনা।
ইংরেজটা ঘুরে দাঁড়িয়েই প্রাণপণে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। শহীদ গায়ের শালটা রাস্তার উপর ফেলে দিয়ে ছুটল আহত লোকটার দিকে।
পরমুহূর্তে শহীদ দেখল, রাস্তার পার্শ্ববর্তী আড়াল থেকে হঠাৎ একজন রোগা লোক ছুটে এসে আহত লোকটার সামনে বসে পড়ল। আহত লোকটাকে দেখল সে ঝুঁকে পড়ে। তারপর ঝট করে মুখ তুলে শহীদকে দেখে নিল । শহীদ তখনও বেশ অনেক দূরে। রোগা লোকটা আহত লোকটার পকেট হাতড়াতে শুরু করল। পকেট থেকে কি যেন একটা বের করল সে। জিনিসটা একবার দেখেই, মুঠোর ভিতরে পুরে তড়াক করে লাফ দিয়ে ছুটতে শুরু করল • সরু বাঁশের মত দুটো পা নিয়ে রোগা লোকটা এঁকেবেঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা গলির ভিতরে। ডি. কস্টাকে চিনতে পারল শহীদ।
শহীদ আহত লোকটার কাছে এসে দাঁড়াল হাঁপাতে হাঁপাতে। নিঃসাড় হয়ে গেছে লোকটার দেহ। পিঠে বিদ্ধ একটা ছোরা। কয়েক ইঞ্চি ঢুকে গেছে মাংসের ভিতরে। ঝুঁকে পড়ল শহীদ। না, লোকটা এখনও মারা যায়নি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা! রুমাল বের করে ক্ষতস্থান চেপে রক্ত বন্ধ করার ব্যর্থ প্রয়াস পেল শহীদ।। বিচলিত অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল ও সাহায্যের জন্যে। জ্ঞান হারিয়েছে লোকটা। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এখুনি।
অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে শহীদ হাসপাতালের করিডরে। আহত লোকটাকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারেরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন লোকটার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে। শহীদকে অপারেশন রূমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে জ্ঞান ফেরা মাত্রই ওকে জানানো হবে, সেই দুরাশা বুকে নিয়েই অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ও।
রাস্তা থেকে জ্ঞানহীন লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে ঝামেলার চূড়ান্ত ভোগ করতে হয়েছে শহীদকে। শীতের দিন, ভোর হতে তখনও অনেকটা দেরি ছিল। আশপাশের কোন বাড়ির দরজাই খোলেনি। সাহায্যের জন্যে কয়েকটা বাড়ির দ্বারস্থ হয়েছিল ও। একটিমাত্র বাড়ির মালিক চোখে ঘুমের রেশ নিয়ে দরজা খুলেছিল। শহীদের অনুরোধ এড়াতে পারেনি ভদ্রলোক। নিজের গাড়িতে করে । হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে। ভদ্রলোককে বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছে
শহীদ।
কুয়াশা-২৪
১৮১
আহত লোকটাকে ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দিয়েই মি. সিম্পসনকে ফোন করেছে ও। মি. সিম্পসন আসবেন বলেছেন। অথচ আধঘন্টা হয়ে গেল এখনও তার দেখা নেই।।
কিন্তু মি. সিম্পসনের কথা ভাবছিল না শহীদ। আহত লোকটার পরিচয় জানার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠেছে ও। একটিবার যদি জ্ঞান ফিরে আসে তাহলে অনেক কথা জানা যাবে। কেন এই শেষরাতে অমন করে তাড়া করে আসছিল লাল শার্ট পরা ইংরেজটা? কেন?
অপারেশন রুমের দিকে এগিয়ে গেল আবার শহীদ। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সেটা খুলে গেল। হতাশ মুখে নার্স এবং পিছনে ডাক্তার বের হয়ে এলেন। শহীদের দিকে চেয়ে ডাক্তার বলে উঠলেন, আমি খুবই দুঃখিত, মি. শহীদ। লোকটা মারা গেছে।
“কি খবর, শহীদ?”
মি. সিম্পসনের গলা শোনা গেল করিডরে। শহীদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ব্যস্তসমস্তভাবে। শহীদ সংক্ষেপে সব ঘটনা বলল মি. সিম্পসনকে। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তিনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটার পরিচয় জানা যায়নি তাহলে? তোমার কি মনে হয়, আততায়ী ইংরেজটা সোলায়মান চৌধুরীর সঙ্গী হেস্টিংস বা ববের মধ্যে কোন একজন?’
শহীদ মি. সিম্পসনের কথার উত্তর না দিয়ে নার্সের দিকে ফিরে বলল, লাশ অপারেশন টেবিলেই আছে না?
নার্স মাথা নেড়ে জানাল, স্যা।’
শহীদ ও মি. সিম্পসন অপারেশন রুমে ঢুকলেন। মি. সিম্পসন নিহত লোকটার উপর ঝুঁকে পড়ে চেহারাটা দেখতে লাগলেন ভাল করে। শহীদ নিহত লোকটার গা থেকে খুলে রাখা শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মি, সিম্পসন বলে উঠলেন, ‘লোকটাকে নিরীহ গোছেরই তো মনে হচ্ছে? | শহীদের খেয়াল তখন অন্যত্র। নিহত লোকটার শার্টের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা চিরকুট বের করে পড়ছে ও। পড়তে পড়তে ওর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। মি. সিম্পসন লক্ষ্য করছেন সব।
“কি ব্যাপার, শহীদ?’
শহীদ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল দরজার দিকে। মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল এগোতে এগোতে, তাড়াতাড়ি আসুন, মি. সিম্পসন! সর্বনাশ বোধহয় হয়েই গেছে!
শহীদের কথা বুঝতে না পারলেও মি, সিম্পসন অনুমান করলেন কোথাও কোন বিপদের গন্ধ পেয়ে ব্যস্ত হয়েছে শহীদ। দ্রুত অনুসরণ করলেন তিনি শহীদকে।
১৮২
ভলিউম-৮
বেলা হয়েছে ইতিমধ্যে। দশটা বেজে দশ। শহীদ মি. সিম্পসনের জীপের ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল লাফ দিয়ে। মি. সিম্পসন বসলেন পাশে। জীপ ছেড়ে দিল, শহীদ দ্রুতবেগে। মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন এতক্ষণে, কি ব্যাপার, বল
ততা শহীদ?”
| শহীদ পকেট থেকে ভাঁজ করা চিরকুটটা বের করে দিয়ে বলল, ‘নিহত লোকটার পকেটে পাওয়া গেল এটা। লোকটা আমার কাছেই আসছিল। অদ্ভুত যোগাযোগ। পড়ে দেখুন।
মি. সিম্পসন চিরকুটটা পড়তে শুরু করলেন–
পরোপকারী মি. শহীদ খান, আমাকে আপনার বোন হিসেবে জানবেন। আমি বিপদগ্রস্তা। কতক্ষণ বেঁচে আছি, জানি না। বি/৪৪৫, নাখাল পাড়া, অভিনেত্রী সুরাইয়ার বাড়িতে বন্দিনী আমি। আমাকে বাঁচান। পুলিস নিয়ে আসবেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন।
সাহায্য প্রত্যাশিনী, মিস সুরাইয়া বেগম।
E
চিঠিটা পড়ে হতবাক হয়ে শহীদের দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন । শহীদ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠল, ‘মিস সুরাইয়া এখনও বেঁচে আছে বলে বিশ্বাস হয় না আমার। তবু দেখা যাক । রিভলভার, মি. সিম্পসন?
‘এনেছি। কিন্তু শহীদ, ব্যাপারটা তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারছ কি?’
শহীদ বলল, আমার ধারণা, আজ থেকে খুন-জখম, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, রহস্য এবং সমস্যার জটিল এক আবর্তের সৃষ্টি হতে চলেছে, মি. সিম্পসন।’
বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলেছে জীপ। মুহূর্ত মাত্র দেরি হয়ে গেলে মিস সুরাইয়াকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া নাও যেতে পারে, বুঝতে পারছিলেন মি. সিম্পসন। তা সত্ত্বেও শহীদের গাড়ি চালানো দেখে শঙ্কিতবোধ করছিলেন তিনি। যে-কোন সামান্য একটু ভুলে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে।। | গন্তব্য এলাকায় এসে পড়েছে জীপ। চারদিক নিঝুম। জীপের যান্ত্রিক শব্দ ব্যতীত কোথাও আর কোন শব্দ নেই। এলাকাটা এমন নির্জন, লোক বসতি-হীন
তা জানত না শহীদ। এদিকে ও কয়েক বছর হল আসেনি। | ঝরা-পাতা বিছিয়ে আছে রাস্তার উপর। সামনেই একটা মোড়। রাস্তায় কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় একটা যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল। একটা গাড়ির শব্দ। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। দ্রুত এগিয়ে আসছে শব্দটা। কিন্তু গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা-২৪
১৮৩
সাবধানে মোড় নিল শহীদ; মোড় নেবার সময় গাড়িটাকে দেখা গেল। বেপরোয়া বেগে একটা সিডান ছুটে আসছে সোজা।
সাবধান, মি. সিম্পসন!’ |
শহীদের কথা শেষ হতেই পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন মি. সিম্পসন । সিডানটা তখন মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে।ছুটে আসছে তীব্র গতিতে । দু’জন লোক সামনের সিটে! একজনের গায়ে লাল শার্ট। পলকের মধ্যে চেহারাটা দেখা গেল। লাল শার্ট-পরা লোকটা ইংরেজ ।।
পঁচিশ গজ দূরত্বে আসতেই সিডানটা পাশের রাস্তা ছেড়ে মাঝ রাস্তায় চলে এল। সোজা যমের মত ছুটে আসছে জীপের দিকে। শহীদ ইতিমধ্যেই জীপের গতি তিরিশে নামিয়েছে। ধাক্কা লাগলে সর্বনাশ ঘটবে। সিডানের গতি অনেক বেশি।
কিন্তু ধাক্কা মারার জন্যে বদ্ধপরিকর সিডানটা। পলকের মধ্যে রিভলভারটা তুলে ফায়ার করলেন মি. সিম্পসন। একই সাথে দুটো রিভলভারের শব্দ শোনা গেল । সিডান থেকেও ফায়ার করা হয়েছে। শহীদ রং-সাইডে চলে এল পলকের মধ্যে ।
মাঝ রাস্তা দিয়ে তীরবেগে চলে গেল সিডানটা। রিভলভারের শব্দ শোনা গেল। মি. সিম্পসন গুলি করার সুযোগ পাননি। সিডান থেকেই পরপর গুলি চালানো হয়েছে। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল শহীদ। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল, মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে সবুজ রংয়ের সিডানটা। শহীদ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, ‘সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে মি. সিম্পসন। মিস সুরাইয়া সম্ভবত নিহত হয়েছে।
জীপের গতি কমিয়ে দিল শহীদ। সামনের রাস্তার দু’দিকে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বড় বড় আধুনিক ধাঁচের বাড়ি। ধীর গতিতে জীপ চালাতে চালাতে বাড়িগুলোর নেমপ্লেট পড়তে পড়তে এগোচ্ছে শহীদ। মি. সিম্পসন রাস্তার অপর দিকের বাড়িগুলোর নাম্বার এবং নেমপ্লেট পড়ছেন। ছাড়াছাড়াভাবে সবকটি, অর্থাৎ গোটাদশেক বাড়ি ছাড়িয়ে এল জীপ। সামনে আবার রাস্তার দু’পাশে জংলী গাছ-পালার প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। গতি বাড়াল শহীদ।।
মিনিট দুয়েক এগিয়ে একটা প্রকাণ্ড মাঠ দেখতে পেল ওরা। মাঠের পর আবার জঙ্গল। দু’পাশে জঙ্গল রেখে আরও খানিকটা এগিয়ে থামাল শহীদ জীপ। লাফিয়ে নেমে পড়ল ও.মি. সিম্পসনও নামলেন তড়াক করে লাফ দিয়ে ।
| রাস্তা থেকে প্রায় একশো গজ দুরে তিনতলা একটা নতুন বাড়ি। ঝকঝক করছে বাড়িটার চেহারা। বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে তিনতলার দেয়ালের গায়ে
সুরাইয়া ভিলা’।
বাইরে থেকে বাড়িটার চাকচিক্য দেখা যাচ্ছে খুবই। কিন্তু বাড়িটার কোথাও ১৮৪
ভলিউম-৮
কোন জন-মানবের সাড়া নেই। নিষ্প্রাণ, নির্জীব। কেমন যেন একটা ছমছমে পরিবেশ। কোথাও যেন কি একটা ঘটে গেছে। অস্বস্তিকর নীরবতা জমাট হয়ে আছে। প্রাণহীন শোক যেন ঘিরে রেখেছে প্রকাণ্ড বাড়িটাকে। গেটটা দেখা যাচ্ছে হাঁ করে খোলা । উপর তলার জানালাগুলো বন্ধ। অটুট নিস্তব্ধতা চারদিকে।
শহীদ থমকে দাঁড়িয়ে রইল গেটের কাছে মুহূর্তের জন্যে। তারপর গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল ও। বিরাট উঠান। উঠানের বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে নানারকম ফল গাছের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে শহীদ দেখল, একদিকে বাগানের বেড়া ভাঙা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। বেড়াটা যেন সদ্য ভেঙেছে কেউ । মি. সিম্পসনও দাঁড়িয়ে পড়লেন শহীদের পাশে ।।
বাগানের ভিতরে নিবিষ্ট মনে কি যেন দেখছে শহীদ। বড় বড় কয়েকটা গোলাপ গাছের আড়ালে সবুজ রঙের কাপড় দেখা যাচ্ছে। ভাঙা বেড়া টপকে বাগানে ঢুকল শহীদ। গোলাপ গাছগুলোর অপর দিকে এসে ও দেখল, একজন লোক চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকের কাছে সাদা হাফ-শার্ট লাল রক্তে একাকার হয়ে গেছে। মুখ হাঁ হয়ে আছে নিহত লোকটার । লোকটার পরনে সবুজ লুঙ্গি। পাশেই একটা রিভলভার।
| শহীদের পিছনে মি. সিম্পসন এসে দাঁড়ালেন। শহীদ তখন লাশটা দেখা শেষ করে রুমালে পেঁচিয়ে পড়ে থাকা রিভলভারটা প্যান্টের পকেটে ভরছে। মি. সিম্পসন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালে শহীদ পা বাড়িয়ে বলে উঠল, “লোকটা সম্ভবত এ
বাড়ির চাকর-বাকর ছিল।’
বাগান থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে এগোল ওরা। বারান্দা ধরে এগোতে এগোতে সিঁড়ির নিচে আর একবার থামতে হল ওদেরকে। শক্ত হয়ে উঠল সিম্পসনের দুদিকের চোয়াল । এতটা যেন তিনি আশঙ্কা করেননি।
| সিঁড়ির ঠিক নিচেই আর একটা মৃতদেহ। বুকে গুলি মেরে হত্যা করা হয়েছে একেও বেশি বয়স নয়, কিশোরই বলা চলে। সিমেন্ট করা বারান্দায় জমে গেছে রক্তের ধারা।
লাশটা দেখল ওরা মিনিট দুয়েক ধরে । সিঁড়ির আরও সামনে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সেই দরজার দিকে পা বাড়াল শহীদ। খোলা দরজার সামনে গিয়ে। দাঁড়াতেই শিউরে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এল ও বীভৎস, কুৎসিত, নিষ্ঠুর এক দৃশ্য। শহীদের পাশ থেকে উঁকি মারলেন মি. সিম্পসন। পিছিয়ে এসে মুখ বাঁকালেন তিনি। শহীদের উদ্দেশ্যে কি যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু শহীদ ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে পা বাড়িয়ে দিয়েছে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরে।
ঘরটা ভাঁড়ার ঘর। চাল-ডালের বস্তা, রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিস সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। মেঝে খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে ঘরটার । সেই সামান্য কুয়াশা-২৪
১৮৫
মেঝের উপরই আটাশ-উনত্রিশ বৎসর বয়স্ক এক যুবতী চিত হয়ে পড়ে আছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থা যুবতীর। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড়ের, আঁচড়ের ক্ষতচিহ্ন। রক্তের দাগ সর্বত্র। যুবতীর বুকের দু’দিকে দুটো ছিদ্র। ওই দুটো ছিদ্র দিয়েই বুলেট হয়ত যুবতীর প্রাণ-বায়ু বের হবার পথ করে দিয়েছে। তার আগে বর্বরের নির্যাতন করা হয়েছে, পরিষ্কার বোঝা যায়। বুলেট-বেঁধা ছিদ্র দেখে শহীদ শুধু বলে উঠল, একই রিভলভার দিয়ে গুলি করা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এবং পাকা হাতের কাজ।
যুবতীর লাশের পাশেই শাড়ি-ব্লাউজ পড়ে রয়েছে। শহীদ আবার বলে উঠল, ‘এ বাড়ির চাকরানী সম্ভবত।’
মি. সিম্পসন অস্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন শহীদ থামতেই, একি ভয়ঙ্কর কাণ্ড, শহীদ!
শহীদ কোন কথা না বলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে বারান্দায় এল। সিঁড়ির কাছে এসে কিশোর চাকরটার লাশ টপকে দোতলায় উঠতে শুরু করল ও। মি. সিম্পসন। শহীদের পিছন পিছন উঠে এলেন। এই শীতের সকালেও তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। থমথম করছে মুখের চেহারা।
দোতলার সব কটা ঘর দেখল শহীদ। কোন জনমানবের চিহ্ন নেই। সে রকম কিছু আশাও করেনি ও। দোতলা থেকে তিন তলায় উঠল শহীদ। দোতলার সব কটা ঘর খালি। এমনকি, আসবাব-পত্রাদিও নেই। শূন্য ঘর পড়ে আছে শুধু। তিনতলায় উঠে পরপর আরও দুটো ঘর সম্পূর্ণ শূন্য দেখল ওরা। তৃতীয় ঘরটার ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখতেই চমকে উঠল শহীদ।
| বিরাট বড় ঘর। কিন্তু ছোট্ট একটা চৌকি দেখা যাচ্ছে ভিতরে, খাট নয়। বিসদৃশ ঠেকল শহীদের চোখে ব্যাপারটা। তাছাড়া ঘরের ভিতরে একটা আলমারি, দুটো হাতলবিহীন সাধারণ চেয়ার ছাড়া আর কিছু না থাকাটাও চোখে পড়বার মত। | চৌকির উপর উপুর হয়ে পড়ে আছে এক যুবতী। যুবতীর পরনে সালোয়ার কামিজ ছিল, বোঝা যায়। সেগুলো বর্বর খুনেরা নির্যাতন চালাবার জন্য খুলে ফেলেছিল। নিঃসাড় শরীরের উপর সেগুলো বিছিয়ে দেয়া রয়েছে। মুখটা বালিশের। উপর থেকে পড়ে গেছে চাদরের উপর। যুবতীর ফর্সা ধবধবে গায়ের রঙ এবং দেহ সৌষ্ঠব দেখে অপূর্ব সুন্দরী বলে মনে না হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু তা হলেও, মুখটা যুবতীর দেখতে কেমন ছিল তা বোঝার কোন উপায়ই নেই। সারামুখ ক্ষত বিক্ষত। ফলে চেনা যাচ্ছে না যুবতাঁকে।
যুবতীর ক্ষত-বিক্ষত মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে কি একটা গভীর চিন্তায় যেন ডুবে গেছে শহীদ। মি.. সিম্পসন বিচলিত কণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, কেন এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড! কার বা কাদের কী লাভ এতে!’
ভলিউম-৮
শহীদ ওর চিন্তার রাজ্য থেকে ফিরে এল। মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি, মি. সিম্পসন । বাড়িতে মিস সুরাইয়ার কাপড়-চোপড় বলতে কিছুই নেই। এর মানে কি বুঝতে পারছেন?’
একটু থেমে শহীদ আবার বলে উঠল, ‘এর মানে, মিস সুরাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্যে সব আসবাব-পত্র এবং কাপড়-চোপড় সরিয়ে নিয়েছিল কোথাও। তা যদি না হয়, তাহলে খুনীদলই সব জিনিস-পত্র সরিয়ে দিয়েছে । কিন্তু কারণটা কি? খুনীরা নিশ্চয়ই আসবাব-পত্র বা কাপড়-চোপড় চুরি করতে আসেনি। চুরি করার জন্যে চারজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়াটা অসম্ভব।’
‘তাহলে? | ‘একটা ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, চারজনকেই হত্যা করা হয়েছে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে। মিস সুরাইয়ার সারা মুখে ধারাল অস্ত্রের দাগ, যার ফলে চেনবার উপায় নেই মুখটা কার, এ-ও গভীর একটা চাল।
মি. সিম্পসন ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারলেন না শহীদের কথাগুলো। শহীদ আবার বলে উঠল, ‘আপনার কাজ শুরু করে দিন, মি. সিম্পসন । আমাদের অনেক ছুটোছুটি করতে হবে সারাটা দিন। | মি. সিম্পসন দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে যেতে বললেন, “অনেক নিষ্ঠুরতা দেখেছি সারাজীবনে, কিন্তু…! শয়তানগুলোকে এমন কল্পনাতীত শিক্ষা দেব যে!
মৃতা মিস সুরাইয়ার হাত পা, পিঠ, গলা, ঘাড় ইত্যাদি মনোযোগ দিয়ে দেখল শহীদ। লাশটার কাছ থেকে সরে এসে ঘরের চারদিকে তাকাল সে। একটা আলমারি ছাড়া দেখার মত কিছুই নেই। আলমারিটা খুলল শহীদ। পুরানো খবরের কাগজ পেল ও, একটা। দৈনিক বাংলা’। দৈনিকটা খুলে ধরতেই একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপনের উপর দৃষ্টি পড়ল শহীরে। নিম্নে দেওয়া হল হুবহু বিজ্ঞাপনটাঃ হুগলী জেলার ললনাগণের উদ্দেশ্যে বিশেষ ঘোষণাঃ
পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার মিসেস মনোয়ারা বেগমের অভিলাশ অনুযায়ী ঢাকায় একটি নারী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গরীব, ধনী, বিবাহিতা, অবিবাহিতা সকল যুবতী এই সংস্থার সদস্য হইতে পারিবেন । গরীবদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে নিরক্ষরাকে অক্ষরজ্ঞান দান করা এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচী।
শর্ত সাপেক্ষে এই সংস্থার সদস্য হওয়া যাইবে। প্রথম শর্ত, মা বাবা হারা অথবা মা-বাবার সন্নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছেন এমন যুবতী হইতে হইবে। দ্বিতীয় শর্ত, হুগলী জেলায় যাঁহারা জন্মগ্রহণ
করিয়াছেন কেবল তাহারাই যোগ্য বিবেচিত হইবেন। অবশ্য মৌখিক কুয়াশা-২৪
১৮৭
বক্তব্যই যথেষ্ট, প্রমাণ দাখিল করার প্রয়োজন নাই। সত্বর যোগাযোগ করুন।
এল, ১০১/১০, নয়া পল্টন, ঢাকা।
বিজ্ঞাপনটা পড়ার পর শহীদের মনে পড়ে গেল, সোলায়মান চৌধুরীর বাড়ি হুগলী জেলাতেই ছিল। দৈনিকটা ছ’মাসের পুরানো। সাথে সাথেই ওর মনে প্রশ্ন জাগল একটা। এই বিজ্ঞাপনটা মিস সুরাইয়া বেগম যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিয়েছিল কেন? সে সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে, না এরফান মল্লিকের? সোলায়মান চৌধুরীর মেয়ে হলে এরফান মল্লিক একে হত্যা করতে সাহস পাবে বলে মনে হয় না। সোলায়মান চৌধুরী অবশ্য এরফান মল্লিকের মেয়েকে হত্যা করতে পারেন প্রতিশোধ নিতে, সেটাই সম্ভব। কিন্তু এরফান মল্লিকের মেয়ে যদি অভিনেত্রী মিস সুরাইয়াই হয়, তাহলে এরফান মল্লিক কোথায়? | দৈনিক কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল শহীদ। আলমারির ভিতরে আজে বাজে কাগজপত্র পাওয়া গেল বহু। নিচের একটা তাকে ইলেকট্রিক বিল, ক্যাশ মেমো, বাড়ি ভাড়ার রসিদ, ব্যাঙ্কের রিমাইণ্ডার, ওষুধের খালি বাক্স, হরলিকসের টিন ইত্যাদি হাজার-রকম জিনিস গাদা করে রাখা। দরকারী কিছু পাবে বলে আশা করেনি শহীদ। কিন্তু তবু জঞ্জালগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল ও। দেখতে দেখতে পেয়ে গেল একটা ডায়েরী। ডায়েরীর উপরের ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করল ও। তারপর একটা একটা করে উল্টাতে লাগল পাতা। ‘মিস সুরাইয়া বেগম। ইংরেজিতে লেখা নাম ঠিকানা।
পরপর কয়েকটা পাতা উল্টাল শহীদ। একটা পাতায় লেখা লম্বা তিনটে লাইন। শহীদ চোখ বুলিয়ে দেখল– আজ মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে আমার, কেন জানি না। বাবার কথা, মায়ের কথা বারবার স্মরণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু, কিছুই মনে করতে পারছি না আমি। মাঝে মাঝে এমন নিঃসঙ্গ মনে হয়, এমন দুর্ভাগিনী মনে হয় যে ••।’
| লেখা শেষ না করেই ডায়েরীর পাতাটায় দড়ি টেনে দিয়েছে। কিন্তু শহীদ এমন কিছু দেখেছে লেখাগুলোর দিকে চেয়ে থেকে, যার ফলে অবিশ্বাসে চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে ওর। নিবিষ্ট মনে লেখাগুলো দেখল ও সুন্দর, ঝরঝরে হাতের লেখা। কিন্তু এই হাতের লেখা যদি মিস সুরাইয়া বেগমের হয় তাহলে শহীদের বুকপকেটে যে চিঠিটা রয়েছে সেটা কার? দুটো হাতের লেখা এক বলে তো মনে হয় না!
পকেট থেকে চিঠিটা বের করে মেলে ধরল শহীদ। বিস্ময়ে চঞ্চল হয়ে উঠল ও। চিরকুটটা শহীদ পেয়েছিল রাস্তায় আহত লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর। লোকটা মারা যাবার পর তার পকেট থেকে চিরকুটটা উদ্ধার করে শহীদ।
Sbrbr
ভলিউম-৮
চিরকুটের নিচে নাম লেখা ছিল ‘মিস সুরাইয়া বেগম। কিন্তু ডায়েরীর মিস সুরাইয়া বেগমের হাতের লেখার সাথে তো চিরকুটের লেখিকা মিস সুরাইয়া বেগমের হাতের লেখা মিলছে না! একি রহস্য!
পরপর কয়েকটা পাতায় আর কিছু লেখা নেই। পঞ্চম পাতায় লেখা– রহমান যদি আমার জীবনে দেখা না দিত তাহলে কি যে ছিল আমার কপালে তা ভাবতেও ভয় পাই আমি। রহমান আমার জীবন, আমার সহায়, আমার একমাত্র সম্বল, একমাত্র আপনার জন। রহমান ছাড়া আমার জীবনের অস্তিত্ব নেই। আমার জীবনধারণ থেকে শুরু করে সব খ্যাতি, প্রতিপত্তি একমাত্র রহমানের শুভ ইচ্ছার পরিণতি। আমার জীবন দিয়েও ওর ঋণ শোধ করতে পারব না!’
শহীদ দেখল, এরপর তিনমাস কিছুই লেখেনি মিস সুরাইয়া বেগম ডায়েরীর পাতায়। পাতার পর পাতা উল্টে শহীদ একটা লেখা-পাতা, দেখল । লেখাটা পড়ে চমকে উঠল শহীদ। মিস সুরাইয়া বেগম লিখেছে- ‘অদ্ভুত একটা বিজ্ঞাপন। বেরিয়েছিল গতকাল “দৈনিক বাংলায়”। কেমন যেন মনটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল আমার। মিশনারীদের কাছে শুনেছিলাম, আমার জন্মভূমি ছিল হুগলী জেলা। বিজ্ঞাপনটা হুগলী জেলার যুবতীদেরকে নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান গঠন করার ব্যাপারে। এমন ধারা বিজ্ঞাপন আমি কখনও দেখিনি। বিজ্ঞাপনটা দেখে কেমন। যেন ঔৎসুক্য জেগেছিল আমার মনে। কেন যেন মনে হচ্ছিল, ঠিকানা অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানে গেলে আমি আমার জন্ম পরিচয় জানতে পারব। তাই গিয়েছিলাম আজ, কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও জানিনি যে, বিজ্ঞাপনটা সুকৌশলে ছাপা হয়েছিল আমার জন্যেই। বিজ্ঞাপনটার জন্যে দায়ী আমার বাবা। আমার বাবা আমাকে খুঁজে পাবার জন্যেই বিজ্ঞাপনটা কাগজে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার পর থেকে কেমন যেন গা ছমছম করছে আমার। অনেক অনেক প্রশ্ন করার পর তিনি নিজের পরিচয় দিলেন আমাকে। বললেন, আমি তার মেয়ে। এরকম অদ্ভুত বিজ্ঞাপন কেন দিয়েছিলেন, একথা জিজ্ঞেস করাতে অস্বাভাবিক গভীর দেখলাম বাবাকে। আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “সব প্রশ্নের উত্তর দেব সময়মত। সময় যতদিন না হচ্ছে। ততদিন তুমি আমার নাম জানতে পারবে না। আমি তোমার বাবা, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি কোথায় ছিলাম এতদিন, তুমি কেন মিশনারীদের হাতে গিয়ে পড়েছিলে, তোমার দুর্দশার জন্যে কে দায়ী–এসব প্রশ্নের উত্তর আজ তোমাকে দিতে পারব না। তবে সব প্রশ্নেরই উত্তর তোমাকে আমি দেব। সময় আসুক। যতদিন না সময় আসছে ততদিন তুমি যেমন আছ তেমনি থাক। মাঝে মাঝে তোমার সাথে দেখা করতে যাব আমি, যেমন চিত্র-প্রযোজকরা তোমার সাথে ব্যবসা উপলক্ষ্যে দেখা করতে যায়। তুমি কিন্তু ভুলেও আমার বাড়িতে এস না । আমাকে তুমি ভুল বুঝ না, সুরাইয়া। আমি তোমার বাবা। আমি জানি, কিসে তোমার ভাল, কিসে তোমার মন্দ তোমার বাবার সাক্ষাৎ তুমি পেয়েছ, একথা কুয়াশা-২৪
১৮৯
ভুলেও কারও কাছে প্রকাশ কোরো না। মনে রেখ, তাতে আমার সর্বনাশই করবে তুমি । আমার একটা ছদ্মবেশী নাম আছে, সেটাও তুমি কখনও কারও কাছে প্রকাশ কোরো না।” বাবার কথা শুনে কেমন যেন ভয় লাগছে আমার। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। উনি যে আমার বাবা, তাতে কোনই সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু•••
কয়েকটা পাতা ভরে লেখা হয়েছে। সবটুকু পড়ল শহীদ। পরিষ্কার হয়ে গেল কতকগুলো ব্যাপার। ডায়েরীর লেখিকা মিস সুরাইয়া বেগম হুগলী জেলার জমিদার সোলায়মান চৌধুরীরই কন্যা। আর, সোলায়মান চৌধুরী ঢাকায় জনৈক চিত্র
প্রযোজকের ছদ্মবেশে বসবাস করছেন ।
গভীর চিন্তা আচ্ছন্ন করল শহীদকে। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন মি. সিম্পসন । শহীদকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, কিছু পেলে, শহীদ?”
শহীদ বলল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে যাকে খোঁজা হচ্ছে সেই সোলায়মান চৌধুরীরই মেয়ে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম, মি. সিম্পসন।’
তাই নাকি! কিভাবে জানলে বল তো?”
শহীদ বলল, অভিনেত্রী মিস সুরাইয়ার একটা ডায়েরী পাওয়া গেছে। খুব বেশি উপকৃত হওয়া যাবে না। তবে সোলায়মান চৌধুরী ঢাকাতেই আছেন, সম্ভবত চিত্র-প্রযোজকের ছদ্মবেশে। এর বেশি কিছু আর জানা যাচ্ছে না। কিন্তু অদ্ভুত একটা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে, মি. সিম্পসন। যে মিস সুরাইয়া বেগমের চিরকুট পেয়ে আমরা ছুটে এসেছি সে অভিনেত্রী মিস সুরাইয়া বেগম নয়। একই নামে দুই যুবতী। অভিনেত্রী সুরাইয়ার ডায়েরীর হাতের লেখার সাথে চিরকুটের লেখিকা সুরাইয়ার হাতের লেখার কোন মিল নেই। দুটো হাতের লেখা দু’জনার। | হতবাক মি. সিম্পসনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল শহীদ চৌকির উপরকার অর্ধ-নগ্ন লাশটার দিকে। বলল, “লাশটা যে কার, বোঝা মুশকিল। ইচ্ছাকৃতভাবেই যুবতীর মুখ ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এই যুবতী কে তাহলে?
মি. সিম্পসনকে বিস্মিত দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘দু’নম্বর সুরাইয়া তাহলে কি নায়েব এরফান মল্লিকের মেয়ে?
| ‘ওই রকম সন্দেহ আমার হচ্ছে, মি. সিম্পসন । মোট কথা, সোলায়মান চৌধুরী এই হত্যাযজ্ঞের রহস্যে নিঃসন্দেহে জড়িত। সোলায়মান চৌধুরীকে খুঁজে বের করাই এখন আমাদের প্রথম কাজ। আমাদের আশপাশেই আছেন তিনি কিন্তু ছদ্মবেশে আছেন। পাস্টিক সার্জারী করে চেহারা পাল্টে ফেলেছেন, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোন। সুতরাং স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে যে ফটো আমরা পেয়েছি তার সাথে এখন আর কোন মিল নেই সোলায়মান চৌধুরীর। নাম বদলেছেন তিনি নিশ্চয় । তাছাড়া, ভীষণ চতুরতার সাথে প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্ল্যানও আছে তার।
ভলিউম-৮ ১৯০
| মি. সিম্পসন বললেন, মর্গের পাড়ি, ফটোগ্রাফার, পুলিস, ওরা সবাই এসে গেছে।
শহীদ বলল, চলুন, এবার যাওয়া যাক। প্রথমে আমরা যাব চিত্র-প্রযোজক ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে।
মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, ওসমান গনি! এই ভদ্রলোক না বেশ কিছুদিন আগে কামালকে নিযুক্ত করেছিলেন এরফান মল্লিককে খুঁজে বের করে দেবার জন্যে?’
হ্যাঁ। কিন্তু গত দু’মাস আগে হঠাৎ ভদ্রলোক এবং ভদ্রলোকের বন্ধু মি. সারওয়ারের আগ্রহ দূর হয়ে যায়। ব্যাপারটা দারুণ অস্বাভাবিক।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, শহীদ, তুমি ছাড়া আমার পক্ষে একা এই জটিল কেসের সমাধান করা সম্ভব নয়। তুমি ভার নাও এই কেসের।
শহীদ বলল, আপনি আমাকে না বললেও এই কেস নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে, মি. সিম্পসন । ধন্যবাদ।
Leave a Reply