২৩. মাস্টার প্ল্যান [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২৩
প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল, ১৯৭০
এক
মেয়েটি কাঁদছিল । কান্নার দমকে দমকে ওর দেহটা বারবার কেঁপে উঠছিল। সোফায় বসেছিল মেয়েটি মাথাটা •ত করে। মেঝের উপর একটা সরোদ। তার পাশেই পড়ে আছে সেদিনের সংবাদপত্র ।।
| সামনের সোফায় বসে আছে কুয়াশা। সে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে তোমার শাহানারা, আমাকে খুলে বল । যদি আমি পারি, মানে আমার সাধ্যে কুলায়, তাহলে যতটা সম্ভব তোমাকে সাহায্য করব আমি । অন্তত তোমার সমস্যা আমাকে জানতে দাও।
আরও অনেকক্ষণ কাঁদল শাহানারা । তারপর আঁচলে চোখ মুছে কুয়াশার দিকে তাকাল। কান্নাভেজা গলায় সে বলল, আজকের কাগজ পড়েছেন, মাস্টার সাহেব? আইন আদালতের পাতা?’
সকালে কাগজটা পড়েই বেরিয়েছিল কুয়াশা। সে বলল, পড়েছি। কোন্ খবরটা বল তো? অবশ্য আইন আদালতের কলামে খবর আছে একটাই। কুলী হোসেন হত্যাকাণ্ডের খবরটা নাকি?”
মাথা নাড়ল শাহানারা।
পরশু, মানে ১০ মার্চের রাতে কোন এক কুলী হোসেনকে নাসিমুল আজিম নামক এক যুবক গুলি করে খুন করে লাশটার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেহটা ছিন্নভিন্ন করে রেখে পালিয়েছিল। ঘটনার সময় জনৈক পুলিস-পেট্রল নিতান্ত আকস্মিকভাবেই সেখানে গিয়ে পড়ে। নাসিমুল আজিম তাকেও গুলি করে। পুলিস অবশ্য মারা যায়নি। সকালেই নাসিমকে গ্রেফতার করা হয়, ছোকরাকে সে চেনে। বিখ্যাত শিল্পপতি সাইফুল আজিম সাহেবের ভাইপো। আজিম সাহেব তার পুরানো পরিচিতদের অন্যতম। গতকাল জামিনের আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
কুয়াশা বলল, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল।
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে শাহানারা। সরোদে হাত খুব ভাল। বছরখানেক আগে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার সরোদ বাজানো শুনে মুগ্ধ হয়েছিল কুয়াশা। অনুষ্ঠান। শেষে গায়ে পড়েই আলাপ করেছিল সে মেয়েটার সাথে । কুয়াশা যে সরোদ
কুয়াশা-২৩
৬৭
বাজানোয় পারদর্শী বুদ্ধিমতী মেয়েটার তা অনুধাবন করতে বিলম্ব হয়নি। সে কুয়াশাকে আমন্ত্রণ করেছিল তার বাসায়। কুয়াশা গিয়েছিল আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তারপর থেকেই শাহানারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। কুয়াশাও প্রাণ ঢেলে মনের। মত ছাত্রীকে সরোদ বাজানো শিক্ষা দিয়ে আসছে। আশ্চর্য প্রতিভা মেয়েটির। কুয়াশার শিক্ষা আত্মস্থ করছে সে অসীম নৈপুণ্যের সাথে ।
সরোদে কুয়াশার অসম্ভব নৈপুণ্য দেখে অবশ্য অবাক মানত শাহানারা । সে মাঝে মাঝে বলত, আপনি কেন রেডিও-টেলিভিশনে বাজান না, মাস্টার সাহেব?’
কুয়াশা হাসত। ওস্তাদের নিষেধ আছে।’ এটা কিন্তু আপনার ওস্তাদের অন্যায়।’ ওকথা বলতে নেই, শাহানারা।’
শাহানারা কিন্তু খুশি হত না। তার ইচ্ছে হত, দুনিয়াসুদ্ধ লোককে সে তার সরোদ শিক্ষকের কাছে হাজির করবে। তার ইচ্ছেটা বুঝত কুয়াশা। মনে মনে হাসত । শাহানারা এখন পর্যন্ত তার পরিচয় জানে না। জানলে যে আঁতকে উঠবে
তাতে সন্দেহ নেই।
কে আপনার ওস্তাদ, মাস্টার সাহেব?’ ‘সেটাও বলতে নিষেধ আছে।’
সপ্তাহে একদিন করে কুয়াশা আসে শাহানারাকে সরোদ শেখাতে। প্রতি মঙ্গলবার। আজকেও এসেছিল। ড্রইংরুমের দরজাটা খোলাই ছিল। জুতোর মচমচ শব্দ করে সে ঢুকল এবং অবাক হয়ে দেখল, সোফাতে মাথা নিচু করে বসে আছে শাহানারা । সবোদটা আর একটা খবরের কাগজ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দেহের কাঁপুনি দেখে সে বুঝতে পেরেছিল, কাঁদছে মেয়েটি।
এক বছর ধরে কুয়াশাকে দেখে আসছে শাহানারা। কুয়াশার ব্যক্তিত্ব সে অনুভব করে আসছে এক বছর ধরে। মাস্টার সাহেবের অন্তরে যে একদিকে কোমলতা আর অন্যদিকে কাঠিন্য আছে তা অনুভব করেছে শাহানারা। আর এটাও জানে যে, তার যেকোন আপদে বিপদে মাস্টার সাহেব ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে জানে, তার উপর নির্ভর করা যাবে সর্ব অবস্থায়।।
| আমি…আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে! এ যে অসম্ভব!
কি অসম্ভব?’
‘নাসিম খুন করেছে–এটা হতেই পারে না। এটা মিথ্যা, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল শাহানারা।
তুমি ওকে, মানে নাসিমকে কতটা চেন? কান্নাভেজা মুখটাতেও একরাশ আবীর ছড়িয়ে পড়ল শাহানারার। সে অস্কুটকণ্ঠে বলল, আমি চিনি•••ওকে আমি চিনি। এ হতে পারে না। নাসিম খুন করতে পারে না! পাগলের মত মাথা নাড়তে লাগল শাহানারা।
ভলিউম
কুয়াশা শাহানারাকে সরোদ বাজানো শেখালেও ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কখনও কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। তাই সে সম্পর্কে তার আদৌ কোন ধারণা ছিল
। এখন সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। নাসিমের প্রতি শাহানারার টানটা হৃদয়ের।
| স্থির হও তুমি, শাহানারা। এখন পাগলামি করলে তো হবে না। আজকের কাগজে মামলার যেটুকু বিবরণ বেরিয়েছে তাতে তো তাকে হত্যাকারী বলে মনে হয়। কিন্তু এ তো সবে শুরু। সত্যিই নিরপরাধ হলে সে নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে।
নাসিম নির্দোষ।’ ‘এটা তো তোমার রায়। আদালতের রায় এখনও বেরোয়নি।’
তাই বলে ওকে জামিন দেবে না কেন?’ ‘অভিযোগটা যেমন গুরুতর তাতে জামিন আশা করা যায় না।’ কিন্তু অভিযোগটা যে মিথ্যে।’
এ সম্পর্কে শাহানারার সাথে আলোচনা করা যে বাতুলতা, তা বুঝতে কুয়াশার অসুবিধা হল না। হৃদয়ের আদালত যুক্তি প্রমাণ বা আইনের ধার ধারে না। তার রায় বড় একপেশে। মনে মনে কষ্ট অনুভব করল সে তার প্রিয় ছাত্রীটির জন্যে। চুপ করে রইল সে। “ এক সময় শাহানারা তার বিশাল দুটো চোখ কুয়াশার দিকে মেলে ধরে বলল, মাস্টার সাহেব, পারেন•••আপনি পারেন নাসিমকে এই মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে উদ্ধার করতে,’করুণকণ্ঠে আর্তি জানাল সে।
| আমি!’
হ্যাঁ, আপনি। আমার মন বলছে, আপনিই পারেন ওকে বাঁচাতে।’
কুয়াশা হাসল । সে বলল, “দেখি, ভয়ের কিছু নেই। যদি সে নির্দোষ হয় তাহলে সে শাস্তি পাবে না। এদেশের আদালতে বিনা অপরাধে কারও শাস্তি হয় বলে শুনিনি। তাছাড়া যতটা জানি নাসিমরা টাকা ঢালবে বির। দরকার হলে কমনওয়েলথের সবচেয়ে ভাল উকিল নিয়ে আসবে। ওর চাচা সাইফুল আজিম সাহেব দেশের অন্যতম সেরা ধনী। তিনি তো ব্যাচেলার মানুষ। ছোট ভাই ড. খুরশীদ আজিমও নিঃসন্তান। নাসিমই ওঁদের বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার জন্যে ওঁরা দরকার হলে আকাশে-বাতাসে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। ওঁদের দরকার হল একজন ভাল উকিলের। আমি উকিল নই।’
| কুয়াশার কথায় শাহানারা অভিভূত হল না। সে বলল, আপনি তো তাহলে ওঁদেরকে চেনেনই। কিন্তু যা ভাবছেন তা হবার নয়। বুড়ো আজিম সাহেব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, এখন-তখন অবস্থা। ড. আজিম চট্টগ্রামের কোন গভীর জঙ্গলে গেছেন গবেষণা করতে। তিনি এ জগতের মানুষ নন। দুনিয়ায় কার কি হল তার চাইতে অতীতের মানুষের কোথায় কি হয়েছিল সে ব্যাপারেই তাঁর আগ্রহ প্রবল।
কুয়াশা-২৩
৬
কুয়াশা তা জানত । ড. আজিম এক খ্যাপাটে এথনোলজিস্ট। মানুষের অতীত গোত্র-পরিচিতি সম্পর্কেই তার আগ্রহ প্রবল, তবে নিজের বংশের একমাত্র নিধির মঙ্গলামঙ্গল সম্পর্কে তিনি যে উদাসীন থাকবেন একথাও ঠিক নয়। শাহানারার। কথায় সে প্রতিবাদ করল না। অবশ্য বুড়ো আজিম সাহেবের সাথে দীর্ঘদিন তার যোগাযোগ নেই, তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও কুয়াশা ওয়াকেফহাল নয়।
‘কিন্তু লোক তো ওদের আরও আছে। ওদের ইণ্ডাস্ট্রির এক্সিকিউটিভরা রয়েছেন না?’
তারা আর কি করবে? এক আছেন মিসেস আজিম। কিন্তু উনি তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আপনি দয়া করে একটা কাজ করুন না, যদি কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে জানা থাকে তাহলে তাকে বলুন না নাসিমের হয়ে সত্য ঘটনা, উদ্ঘাটন করতে। | ‘উদঘাটন করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে, নাসিমই এই খুন করেছে, তাহলে?
তাহলে, অপরাধ যদি সে করেই থাকে তাহলে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া। উচিত। কিন্তু আমার মন বলছে, নাসিম নিরপরাধ । আমি…আমি জানি সে নিরপরাধ। আপনি কি আমার জন্যে, মানে নাসিমের জন্যে কিছুই করতে পারেন? আমার মনে হয়, আপনি নাসিমকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন।’
| চোখ বুজল কুয়াশা। সে বলল, “শাহানারা, তোমার জন্যে সত্যি বলতে কি আমি অনেক কিছুই করতে পারি, এবং করবও। নাসিম যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে তাহলে প্রমাণ করার জন্যে সর্ব প্রকার চেষ্টাও করতে পারি, তাতে সাফল্য নিশ্চয়ই আসবে । তবু তোমাকে আমি বলব, শহীদ খানের সাথে একবার দেখা কর।’
‘শহীদ খান! কে তিনি?
উনি একজন সৌখিন গোয়েন্দা। তিনিই তোমাকে সবেচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারবেন।’
‘কিন্তু টাকা দিতে হবে যে? আপনি জানেন তো আমাদের অবস্থা। হোটেলের রিসেপশনিস্টের চাকরি করি। ক’টা টাকাই বা পাই। অথচ গোটা, সংসার আমাকেই চালাতে হয়,’হতাশা প্রকাশ করল শাহানারা ।।
‘লাগবে না। উনি টাকা-পয়সা নেন না। তাছাড়া একান্তই যদি চায় তাহলে বোল, মাস্টার সাহেব পাঠিয়েছে।’
‘আপনাকে চেনেন উনি?’ উত্তেজিত হল শাহানারা । ‘চেনেন বৈকি।’
তাহলে আপনিও চলুন। এখনি শ্যাব আমি।’ আমার একটু অসুবিধা আছে। আমি এখন চলি।’ কুয়শার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে শাহানারা তখুনি চলে গেল শহীদ খানের
ভলিউম-৮
৭০
সাথে দেখা করতে।
কথা ছিল রাঙামাটি যাবে শহীদ ও কামাল। মহুয়া ও লীনাও সঙ্গী হবে। ঠিকঠাক সব ব্যবস্থাই। বাঁধা-ঘঁদাও শেষ। টিকেটও কাটা হয়েছে প্লেনের। একই ফ্লাইটের চারটে টিকেট পাওয়া যায়নি। এমন কি এক দিনেরও নয়। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে ভিড় যা বাড়ছে! কামাল আজ তাই সকালের ফ্লাইটে চলে গেছে। লীনা ও মহুয়া যাবে কাল সকালের ফ্লাইটে। শহীদ সেকেণ্ড ফ্লাইটে। কিন্তু পরিকল্পনা যখন করা হয়েছিল তখনই ভাগ্য দেবতা বোধহয় পরিহাস করেছিলেন।
অকস্মাৎ সমস্ত প্রোগ্রাম ভেস্তে গেল । চট্টগ্রাম থেকে ড. খুরশীদ আজিমের দুরালাপনী আবেদন এর জন্যে দায়ী।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর ড্রইংরূমে বসে সিগারেট টানছিল, শহীদ। রেকর্ড প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গীত চাপাবে কিনা চিন্তা করছিল লীনা। মহুয়া একটা পুরানো সিনেমা পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগ পড়ছিল মন দিয়ে।
| টেলিফোনটা বেজে উঠল এই সময় বাঁ হাত দিয়ে পত্রিকাটা কোলের উপর চেপে ধরে ডান হাতটা এগিয়ে রিসিভারটা তুলল মহুয়া ।।
হ্যালো?’
এটা কি শহীদ খানের বাসা?
উনি আছেন কি?
‘ধরুন আপনি। ওঁকে দিচ্ছি,’ রিসিভারটা শহীদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওগো, তোমার ফোন।
হ্যালো। শহীদ বলছি।’
‘আমি চট্টগ্রাম থেকে বলছি । আমার নাম খুরশীদ আজিম।’ ব্যগ্র একটা কণ্ঠস্বর কানে এল শহীদের। সে কিছু বলবার আগেই আবার শোনা গেল, চিনতে পারছেন না নিশ্চয়ই। আজকের কাগজ পড়েছেন? খুন ও জখম করার দায়ে নাসিমুল আজিম নামে এক ইয়ংম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে কাল সকালে।। আদালত জামিন দেয়নি। আজকের কাগজে আছে খবরটা। আমি হচ্ছি, নাসিমের চাচা খুরশীদ আজিম। | ‘ও, আপনি তাহলে আজিম কেমিক্যাল ইণ্ডাস্ট্রিজের মালিক সাইফুল আজিমের ছোট ভাই ড. খুরশীদ আজিম, এথনোলজিস্ট?’
“জ্বি, হ্যাঁ, জ্বি-হ্যাঁ।
‘তা বলুন, কি ব্যাপার? কুয়াশা-২৩
‘ঐ মামলার খবরটা পড়েছেন আপনি?’ সাগ্রহে শুধালেন ড. আজিম। খবরটা পড়া ছিল শহীদের। সে জানাল সেকথা।
‘আমার বিশ্বাস, নাসিম নিরপরাধ। পুলিস ভুলক্রমে তাকে গ্রেফতার করেছে। অর্থাৎ পুলিসকে ভুল পথে চালানো হয়েছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিজের শত্রুর শেষ নেই। তাদেরই কেউ চক্রান্ত করে নাসিমকে ফাসাচ্ছে। নাসিমই আমাদের সবকিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারী। দাদা ব্যাচেলার, আমি নিঃসন্তান। পিতৃমাতৃহীন নাসিমকে আমরাই মানুষ করেছি। বলতে গেলে আমারই মরহুমা স্ত্রী ওকে স্নেহ দিয়ে বাপ মায়ের অভাব পূরণ করেছেন। নাসিমকে আমি জানি, ওর দ্বারা এমন পৈশাচিক। হত্যাকাণ্ড আদৌ সম্ভব.নয়। এ মামলা সাজানো। নাসিমকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে, উত্তেজিত শোনাল বক্তার কণ্ঠস্বর।
‘আপনি কি নির্দিষ্ট ভাবে কাউকে সন্দেহ করেন? | ‘সেটা অবশ্য পারছিনে। এ ব্যাপারে কিছু বরং দাদা বলতে পারেন। কিন্তু তিনি মাস ছয়েক ধরে গুরুতর অসুস্থ। খবরটা আদৌ তার কানে গেছে কিনা বলতে পারছিনে। জানলে উনি মারাত্মক শক পাবেন। তাতে আরও ক্ষতি হতে পারে তাঁর পক্ষে । অতটা ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। অথচ আমি এমন একটা সমস্যায় পড়েছি যে, আপাতত কোন অবস্থাতেই ঢাকা যেতে পারছিনে। আপনি যদি দয়া করে আমার নির্দোষ ভাইপোকে বাঁচাতে পারেন তাহলে আমাদের অসামান্য উপকার হয়। টাকার কথা ভাববেন না, যত লাগে আমি দেব।’
| টাকার প্রশ্ন নয় । কথা হচ্ছে ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে বরং আমার বদলে একজন ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ উকিল নিয়োগ করলে ভাল হয়। তাছাড়া আপনাদের ধারণা যাই হোক আমার মনে হয়, আপনার ভাইপোর। বিরুদ্ধে পুলিসের হাতে অত্যন্ত জোরালো ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে।’
তা থাক, সে-সব সাজানো। সেগুলো আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া উকিল একটা কেন, এক ডজন লাগাতে পারি। কিন্তু যুক্তি-তর্কের বন্যা বইয়ে দেবার চাইতে তথ্য-প্রমাণ বড় কথা। ফৌজদারী আইনের ফাঁক খুঁজে নাসিমকে বাঁচাতে চাই না, যদি সে যথার্থই অপরাধী হয়। সে যে অপরাধী নয় সেটাই তথ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আসল সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমরা। তাই আপনাকে আমার দরকার।’
যুক্তিটা উড়িয়ে দিতে পারল না শহীদ। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে রাজি হয়ে গেল । সে বলল, “বেশ আমি চেষ্টা করব। দায়িত্ব নিলাম।’
উঁহু, ভাই, আমাকে বাঁচালেন । কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!’ | ‘সেটা এখন নয়, কাজের শেষে। যদি সাফল্য লাভ করতে পারি তবেই, হাসল শহীদ।
টাকা-পয়সার ব্যাপার?’ १२
ভলিউম-৮
‘ওসব প্রশ্ন এখন তুলবেন না।’
‘আমার পক্ষে এখন ঢাকা ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রয়োজনে আমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে যেতে হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হবার আগেই ফিরতে হবে। আজকেই আমি সেখানে যাচ্ছি। আমার পক্ষ থেকে যা করার দরকার তা করবেন আমার স্ত্রী•••।’
“জ্বি, ইনি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। ‘ওহ, আচ্ছা।’
‘সে হয়ত আজকের ফ্লাইটে অথবা রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছুবে। সকালেই দেখা করবে আপনার সাথে। আপনি এরই মধ্যে দাদার প্রাইভেট সেক্রেটারি মুরাদের সাথে দেখা করতে পারেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় ১০ মার্চের রাতে অর্থাৎ যে রাতে ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছে সেই রাতের মেলেই আমি চট্টগ্রাম এসেছি । যা হোক, এখন আমার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আপনার মাথায় চাপিয়ে দিলাম।’
‘বেশ, এখন রাখি?
আচ্ছা, ‘উইশ ইউ এভরি সাকসেস।’ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল শহীদ।
মহুয়া কান পেতে ফোনের আলাপন শুনছিল । কাথাবার্তার ধরনে মহুয়ার বুঝতে দেরি হল না যে, রাঙামাটি যাওয়াটা মাঠে মারা যেতে আর বাকি নেই। সে একটু শঙ্কিত হয়েই জিজ্ঞেস করল, “কি হল?’
কেয়া আর হোয়েগা। যাওয়া নেহী হোগা, আপাতত।’ বিনি পয়সার চাকরি জুটেছে বুঝি বনের মোষ তাড়াবার?” স্বভাবতই। আজকের কাগজে একটা খুনের মামলার খবর আছে পড়েছ?’
মাথা নাড়ল মহুয়া। নাসিমুল আজিম নামে এক ছোকরা–সেই মামলাটা তো কুলী হোসেন না কে?’ | হ্যাঁ, চাচা ড. খুরশীদ আজিম চট্টগ্রাম থেকে ফোন করেছিলেন। ওঁর ধারণা, ছোকরা নাকি নির্দোষ। মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তাকে বাঁচাতেই হবে। অগত্যা | মহুয়া, আমি এখুনি বেরোব। মি. সিম্পসনের অফিসের দিকে যাব।’
তা আৰু বেরোবে না! এমন পবিত্র একটা কর্তব্য যখন তোমার স্কন্ধেই ন্যস্ত হয়েছে। তা চা খেয়েবেরোবে না কি?’
ঠাকরুন যদি দয়া করেন তাহলে। “থাক থাক, আর দেবী বন্ধনায় কাজ নেই।’
শহীদের উচ্ছ্বাসে বাধা দিয়ে তরলকণ্ঠে বলল মহুয়া, গফুর সাহেবকে চা কুয়াশা-২৩
দিতে বলেছি। আপনি কপড়টা বদলে নিন এই ফাঁকে।’ শহীদ শোবার ঘরের দিকে এগোল।।
মি. সিম্পসন অফিসেই ছিলেন। শহীদকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার শহীদ, হঠাৎ এদিকে? পথ ভুলে নাকি? অনেকদিন তোমার সাক্ষাৎ পাইনি, বস।’
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল শহীদ। সিগারেট ধরিয়ে বলল, একটা কেসের কানেকশনে আপনার কাছে এসেছি।’
“তাতে আর সন্দেহের কি আছে?’ হাল্কা সুরে ললেন মি. সিম্পসূন, নেহায়েত দেশে খুন-খারাবি হয় বলেই তোমার দেখা-সাক্ষাৎ মাঝে মাঝে মেলে। তা কোন কেস, বল তো?’
কুলী হোসেন মার্ডার কেস । আজিম ইণ্ডাস্ট্রির হবু মালিক নাসিমুল আজিম যে মামলার আসামী । কাল জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। আজকের কাগজে দেখলাম।’’
কাগজে দেখেই চলে এসেছ একেবারে’।
না না, তা নয়। আসামীর চাচা ড. আজিম। চেনেন নিশ্চয়ই এথনোলজিস্ট ড. আজিমকে?’
‘চিনি বৈকি?’
উনি চট্টগ্রাম থেকে ট্রাঙ্কল করে খুব করে অনুরোধ জানালেন। ওঁর ধারণা, এটা একটা বানোয়াট মামলা । ওদের শত্রুদের কারসাজি।’
‘আমার ভাইপো যদি আসামী হত তাহলে আমিও তাই বলতাম।’ হাসলেন মি. সিম্পসন । “ক্লিয়ার কেস। কোন জটিলতা নেই। কোন রকম চক্রান্তের ছিটেফোঁটা আছে বলেও মনে হয় না। চার্জ-শষ্ট ও প্রায় তৈরি হয়ে এল বলে। খুন যে আসামীই করেছে তাতে সন্দেহের আদৌ অরকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার তো আর কেড়ে নেওয়া যায় না।’
সিগারেটে টান দিয়ে শহীদ বলল, ঘটনা সম্পর্কে একটু আলোকপাত করুন। আর যদি ফাইলটা দেখাবার ব্যবস্থা করেন।’
নিশ্চয়ই।’
ঘন্টা টিপতেই একজন কনস্টেবল ঢুকল। মি. সিম্পসন তাকে কুলী হোসেন হত্যা মামলার ফাইলটা এনে দেবার নির্দেশ দিলেন। কনস্টেবল চলে গেল ।
শহীদের উদ্দেশে মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক কোন জায়গাতে আসামী কুলী হোসেনকে খুন করেছে তা এখনও জানা যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদ এখনও চলছে। লোকটার মাথায় গুলি করা হয়েছে। তারপর যেভাবেই হোক লোকটাকে রাস্তার উপরে ফেলে গাড়ি চালিয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। মাথার করোটি পর্যন্ত অনেকটা
উম-৮ ৭৪
বিধ্বস্ত হয়েছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে লাশটা। লাশ যাতে সনাক্ত না হয় তার জন্যেই এটা করেছে। অত্যন্ত নৃশংসভাবে খুন হয়েছে কুলী হোসেন।
তারপর?
‘নিতান্ত আকস্মিকভাবেই কনস্টেবটা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। গাড়িটাকে বারবার এগোতে এবং পিছোতে দেখে তার সন্দেহ হয়। গোড়াতে অবশ্য তার। ধারণা ছিল, গাড়ির চালক বোধহয় মাতাল হয়েছিল। সে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চালকের কাণ্ডকারখানা দেখে নম্বরটা টুকে নিয়ে হুইসেল বাজিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটার ভিতর থেকে তাকে গুলি করা হয়। গুলিটা তার ডান হাতের মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। অন্য দু’জন পুলিস-পেট্রল কাছেই ছিল। তারা। এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শেষ রাতের দিকে তার জ্ঞান ফিরে আসে। তার স্টেটমেন্টের উপর ভিত্তি করে গাড়িটাকে খুঁজে বের করা হয়। গাড়ির মালিক নাসিমুল আজিমকেও গ্রেফতার করা হয় ।
শহীদ বলল, লাশটাকে এমনভাবে লেপটে-চেপটে যাবার পরও সনাক্ত করা হল কিভাবে?’
‘লোকটার বাঁ হাতটা তখনও অক্ষত ছিল। তাতে একটা তাবিজ ছিল । তার ভিতরে উর্দুতে একটা কাগজে লেখা কুলী হোসেন’। বুক-পকেটে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে কুলী হোসেনের নামে। পেশায় লোকটা ছিল ট্যাক্সি ড্রাইভার। আসলে কয়েকটা ট্যাক্সির মালিক সে। কিন্তু তার বড় পরিচয় হল, সে হচ্ছে এক দুর্দান্ত গুণ্ডাদলের সরদার । পুরানো ঢাকায় তার একাধিক জুয়ার আড্ডা আছে। লোকটার রেকর্ড খুবই খারাপ। কয়েকটা হত্যা মামলারও আসামী সে। কয়েক বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে পুলিস তার টিকিরও সন্ধান পাচ্ছিল না।’
আশ্চর্য, এমন একটা দুর্দান্ত লোকের সাথে নাসিমের যোগাযোগ ঘটল কি করে!’ বিস্ময় প্রকাশ করল শহীদ।
| ‘তা অবশ্য আসামী নিজেই স্বীকার করেছে। আলাপ হয়েছিল জুয়ার টেবিলেই। আসামী নিয়মিত জুয়া খেলত কুলী হোসেনের আড্ডায় এবং সে তিরিশ হাজার টাকা ধার করেছিল তার কাছ থেকে, পুরো টাকাটাই হেরেছে। এসব আসামী নিজেই স্বীকার করেছে। কুলী হোসেন অনেকদিন ধরেই ফেরত চাচ্ছিল টাকাটা এবং সে আসামীকে আগামী ১০ মার্চের মধ্যে অর্থাৎ আগামীকালের মধ্যে টাকাটা শোধ দেবার জন্যে চূড়ান্ত নোটিস দিয়েছিল মাস দুয়েক আগে। না দিলে ঘটনাটা সাইফুল আজিম সাহেবের কানে যাবে বলেও শাসিয়ে দিয়েছিল সে। ওরা ভয়ঙ্কর লোক।’
“কিন্তু এমন আর কি ক্ষতি হত সাইফুল আজিম সাহেবের কানে গেলে? শহীদ প্রশ্ন করল।
মারাত্মক ক্ষতি হত সেক্ষেত্রেও। কুয়াশা-২৩
৭৫
‘কি রকম?”
‘আজিম ইণ্ডাস্ট্রির মালিক হবার সম্ভাবনা আসামীর যতই থাক তাতে ওর আইনতঃ এতটুকু দাবি নেই।’
“কেন?”
‘আজিম’ ইণ্ডাস্ট্রির মালিক ছিলেন নাসিমের দাদু আজিম আহমদ সাহেব । তাঁর জীবদ্দশাতেই নাসিমের বাবা মারা যান। ফলে সম্পত্তিতে নাসিমের কোন মালিকানা নেই।’
‘কিন্তু…।’
ইশারা করে তাকে থামালেন মি, সিম্পসন। বললেন, ‘অবশ্য সাইফুল আজিম ও ড. আজিম দু’জনই নিঃসন্তান। তাই ওঁরা স্বভাবতই সম্পত্তিটা নাসিমকেই লিখে দেবেন। কিন্তু বুড়ো আজিম সাহেব গোঁড়া পিউরিটান। কোনরকম নোংরামি উনি সইতে পারেন না। জুয়ার কথা শুনলে তাঁর দেহে আগুন ধরে যায়। নাসিম জুয়া খেলছে জানুতে পারলে উনি টাকা তো দেবেনই না, উপরন্তু তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন।’
‘এসব কথা নাসিম স্বীকার করেছে?’ জিজ্ঞাসাবাদের মুখে স্বীকার না করে পারেনি।’ শহীদ বলল, তারপর?’ ‘এটুকুই সে স্বীকার করেছে। এর বেশি নয়।’ কিন্তু আপনার যে সিদ্ধান্তে পৌঁছবার কথা সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন।’ ‘তোমার লজিক কি বলে?’ টিপ্পনী কাটলেন মি. সিম্পসন ।।
আপাতত কিছুই বলে না। আমি যেটুকু জেনেছি সেটুকু অতি নগণ্য। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবার সুযোগ আমার এখনও আসেনি।’
কিন্তু পুলিসের ব্যাপারটা স্বতন্ত্র। কনস্টেবলটাকে জখম করা হয়েছে .২২ অটোমেটিকের গুলিতে। লাশের মাথায় যে, গুলি পাওয়া গেছে সেটাও .২২ অটোমেটিকের। নাসিমের আগ্নেয়াস্ত্রটাও .২২ অটোমেটিক । সেটা থেকেও দুটো গুলি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কেমিক্যাল এনালিসিসে জানা গেছে যে, মোটামুটিভাবে ঐ খুনোখুনির সময় অর্থাৎ ১০ মার্চের রাত দশটা থেকেই ১১ মার্চের রাত দুটো এই সময়ের মধ্যেই অটোমেটিকটা শেষবারের মত ব্যবহার করা হয়েছে। আরও কিছু জানতে চাও?’ একটু উত্তেজিত হলেন মি. সিম্পসন ।
বলুন না, আরও কিছু জানা থাকলে?’ নাসিমের গাড়ির সামনের উইং-এ রক্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এবং?
এবং বলতে ভুলে গেছি, .২২ অটোমেটিকটাতে শুধু মাত্র আসামীরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
ভলিউম-৮
৭৬
এ সম্পর্কে নাসিমের বক্তব্য কি? ‘একটাই, সে কিছু জানে না। এবসলুটলি নাথিং। ‘কোন অ্যালিবাই আছে তার?’
ঘটনা যখন ঘটেছে তখন সে নাকি ঘুমোচ্ছিল। আসামী বলেছে, সন্ধায় হোটেল সোনিয়াতে একটা বিদায় সম্বর্ধনা ছিল ড, আজিমের বিদায় উপলক্ষ্যে। আয়োজন করেছিলেন মিসেস আফরোজা রহমান নামে এক ভদ্রমহিলা। উনি. ড. আজিমের প্রাক্তন ছাত্রী। ভদ্রমহিলা বিধবা। নাসিমও সেই পার্টিতে ছিল। ড. আজিম পাটি থেকে সরাসরি স্টেশনে চলে যান। সঙ্গে যান তার স্ত্রী আর বুড়ো আজিম সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি আবু মুরাদ সাহেব। মুরাদ সাহেবও সেই রাতেই ময়মনসিংহ চলে যান। নাসিম গিয়েছিল তার বড় চাচার কাছে। সেখান থেকে সে চলে যায় জুয়ার আড্ডায়। সেখানে কিছুক্ষণ পরেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু বাসায় না গিয়ে ফিরে যায় হোটেল সোনিয়াতে। সেখানে তার অসুস্থতা না কমে বরং আরও বেড়ে যায়। তখন সে বাসায় চলে যায়।’
তখন কটা বেজেছিল?
নাসিমের বক্তব্য রাত তখন এগারটা। কিন্তু আহত কনস্টেবল বলেছে যে, তাকে যখন গুলি করা হয় তখন প্রায় বারটা হবে। তার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এগারটা সাতানুগমনিটে, সম্ভবত গুলি খেয়ে পড়ে যাবার ফলেই।। | এতক্ষণ ধরে শহীদ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল। কোন কুলকিনারা পাচ্ছিল না। হঠাৎ সে যেন ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটু আলোর রেখা দেখতে পেল। তাই একটু ঔৎসুক্য নিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, হোটেল সোনিয়াটা তো আজিম গ্রুপেরই প্রতিষ্ঠান?’
‘হ্যাঁ, ছোট আজিম সাহেব অর্থাৎ ড. আজিমই ওটার মালিক। স্ত্রীকে লিখে দিয়েছিলেন ওটা।’
ভাল কথা, সেই ভদ্রমহিলা মানে মিসেস আফরোজা রহমানের সাথে পুলিস যোগাযোগ করেছিল নাকি?”
না, তার সন্ধান পাওয়া যাবেনা।
‘সে কি! এটা যে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। পুরুষ মানুষ না হয় পালিয়ে বেড়ায়। তা ভদ্রমহিলার এমন গা-ঢাকা দেবার অর্থ কি?
‘সেটা তো বুঝতে পারছিনে। হয়ত আদালতে সাক্ষ্যটাক্ষ্য দিতে হতে পারে এই কথা ভেবে আপাতত সরে পড়েছেন।’
তার মানে, ভদ্রমহিলা এমন কিছু জানেন যা তিনি প্রকাশ করতে রাজি নন। পাছে পুলিসের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তার মুখ থেকে তা বেরিয়ে যায়, এই তার ভয়।’
| আমাদেরও তাই বিশ্বাস। কুয়াশা-২৩
আর একটা কথা মি. সিম্পসন, কুলী হোসেনের আড্ডার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল?
‘পুলিস নাসিমের কাছে ঠিকানা পেয়ে হানা দিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই সবাই পালিয়ে গেছে। .
“মাসিমের গাড়ির চাবিটা কোথায় পাওয়া গেছে?
শ্রীমানের প্যান্টের পকেটেই চাবিটা ছিল। যে প্যান্ট সে ঘটনার রাতে পরেছিল সেটাতেই।
আর কোন প্রশ্ন করল না শহীদ। একজন কেরানি অনেক আগেই আকাক্ষিত ফাইলটা রেখে গিয়েছিল। সেটায় চোখ বুলিয়ে গেল সে। নতুন তেমন কিছু নেই। তবে একটা ব্যাপার জানা গেল নাসিমের স্টেটমেন্ট থেকে। তা হল, সে তার চাচার সম্মানে দেওয়া পার্টিতে তার টাকার সমস্যার কথাটা মিসেস আফরোজা রহমান ও মিসেস আজিম উভয়কেই বলেছিল এবং তাকে তিরিশ হাজার টাকা পাইয়ে দেবার জন্যে ড. আজিমের কাছে তার হয়ে অনুরোধ করতে বলেছিল।
ফাইলটা রেখে উঠে দাঁড়াল শহীদ। মি, সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, “কি মনে হচ্ছে?’
এখনও বলবার মত কিছু মনে হচ্ছে না। আপনি নাসিমের সাথে আমার একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিন।’
বেশ তো, কবে দেখা করতে চাও?’ সময়টা আপনাকে পরে জানাব। আগে অনুমতিটা নিয়ে নিন।’ তথাস্তু।
তিন বাসায় ফিরল শহীদ সন্ধ্যায়। বারান্দায় মহয়া দাঁড়িয়েছিল। সে নেমে এসে গাড়ির জানালার কাছে মুখ নিয়ে বলল, অবরোধবাসিনী এক রমণী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
| তার মানে?’
‘বোরখাবৃতা এক সুন্দরী তোমার সাক্ষাৎ মানসে অপেক্ষা করছেন। আপাতত ঠাই নিয়েছে। ড্রইংরুমে। কে জানে, দুদিন পরে অন্দরমহলে প্রবেশ করবে কিনা।’ কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহুয়া।
শহীদ হেসে বলল, কি যাচনা সে বিষোষ্ঠির?’ আপাতত আর্যপুত্রের সাথে চারচোখের মিলন। তার চিত্তহরণ করুন, দেব।’ কিন্তু আমি তো প্রস্তুত নই, ভদ্রে। উপযুক্ত সজ্জা কোথায়?’ “আপাতত তোমার শ্রীঅঙ্গই তোমার ভূষণ। শুধু প্রয়োজন বাদ্যবৃন্দসহ ৭৮
ভলিউম-৮
সঙ্গীতসুধার।’
“কি সে সঙ্গীত?’ ‘খোল, অবগুণ্ঠন খোল।’ বাপস, বল কি, তোমার সামনেও অবণ্ঠন ত্যাগ করেনি!
তা যদি না করবে তাহলে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার ভূয়োদর্শন হবে কি করে? চল এবার তিলোত্তমা দর্শনে।
লীনার সাথে গল্প করছিল এক সুন্দরী তরুণী। বোরখাবৃতাই, শুধু নেকাবটা সরিয়ে ফেলেছে। বয়স বেশি নয়। বিশে পা দিয়েছে সবেমাত্র । পাতলা লম্বা মুখটা। চোখ, মুখ, নাক, সব মিলিয়ে সুশ্রী। তবে চেহারায় উদ্বেগ ও বিষাদের ছাপ! দৃষ্টি ঈষৎ ভীত।
শহীদকে দেখে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। শহীদ বলল, বসুন।’
লীনা পরিচয় করিয়ে দিল। শাহানারা ইমাম। হোটেল সোনিয়ার রিসেপশনিস্ট। উনিই আমার দাদা শহীদ খান।
শাহানারা বসল। মহুয়া ও শহীদও বসল।
কি মনে করে?’
লীনাই জবাব দিল শাহানারার হয়ে, সেই একই ঘটনা, দাদা, কুলী হোসেন, মার্ডার কেস। উনি আসামী নাসিমকে চেনেন। ওঁর– ওঁর পরিচিত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বলতে পার।’
মেয়েটি মুখ খুলল এবার, নাসির বড় বিপদ! অথচ আমি জানি, সে নির্দোষ ভাগ্যের পরিহাসে সে আজ খুনের আসামী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। আপনাকে তাই অনুরোধ জানত এসেছিলাম, যদি তার নির্দোষিতা প্রমাণে কোনরকম সাহায্য করতে পারেন। অবশ্য এসে শুনলাম, ড. আজিজ নাকি এর আগেই আপনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আর আপনি তাতে রাজিও হয়েছেন। তবু আমার তরফ থেকে আপনাকৈ আমিও ঐ অনুরোধ জানাতে চাই।’
| ‘বেশ তো, আপনার অনুরো,ও আমি পালন করতে চেষ্টা করব সেই সঙ্গে।’ হেসে বলল শহীদ।।
| ‘আমার মাস্টার সাহেবও বললেন আমার কাছে আসতে। উনি বলেছিলেন, আপনি রাজি হবেন।’
মাস্টার সাহেব কে? ‘ওঁকে চেনেন না আপনি! উনি তো বললেন, আপনি ওঁকে চেনেন!
অবাক হল শাহানারা। নাম বললে চিনব আশা করি।
মনসুর আলী । আমাকে সরোদ বাজানো শেখান। য়াশা-২৩
দাদা! বিস্ময় প্রকাশ করল মহুয়া। দাদা আপনাকে সরোদ শেখান! আপনার ভাই?’ কুয়াশা। কুয়াশা? তার মানে!’ অবাক হল শাহানারা।
হাসল শহীদ। আপনি জানেন না তাহলে। কুয়াশার নাম শুনেছেন। পুলিসের নথি-পত্রে বিরাট করে যার নাম লেখা।
নাম শুনেছি।’ তিনিই আপনাকে সরোদ শেখান?’ “সে কি! আ…!’ বিস্ময়ে বাকহীন হয়ে গেল শাহানারা।
লীনা হাসছিল। সে বলল, আপনি চিনতে পারেননি, এই তো? সেটা অস্বাভাবিক নয়।
শাহানারার মন থেকে তবু সংশয় দূর হল না। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘আশ্চর্য! আমার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। একটা বছর ধরে উনি আমাকে সবোদ শেখাচ্ছেন অথচ উনিই যে কুয়াশা তা কোনদিন আমি কল্পনাও করিনি।’
‘আপনি কি এ ব্যাপারে কুয়াশার, মানে আপনার মাস্টার সাহেবের সাথে কোন আলাপ করেছেন?’
‘আমি ওঁর সাহায্য চেয়েছিলাম। উনি এমন একজন লোক, বিপদে যাকে ভরসা করা যেতে পারে। উনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যতটা সম্ভব তিনি আমার মানে নাসিমের জন্যে করবেন। তবে আপনার সাথে দেখা করতেও বললেন।
অবশ্য, কুয়াশা যদি আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়ে থাকে তাহলে আমার কোন দরকার নেই। তবু আমার পক্ষে যতটা সম্ভব আমি নিশ্চয়ই করব।’
| আপনি এ ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানেন। বলতে গেলে আমি কিছুই জানি
। কিন্তু এমন একটা ঘটনা জানি যা বললে আপনি বুঝতে পারবেন যে, নাসিম এই ঘটনার সাথে কোনক্রমেই জড়িত নয়।’ | শহীদ বলল, “ঐ ঘটনার দিন্ সন্ধ্যায় হোটেল সোনিয়ায় একটা চায়ের পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল, আপনি জানেন?
‘জি। ড. আজিমের বিদায় উপলক্ষ্যে মিসেস আফরোজা রহমান একটা পার্টি দিয়েছিলেন।’
‘আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?
“মিসেস আজিমের নির্দেশে কিছুক্ষণ থাকতে হয়েছিল। হোটেলটা মিসেস আজিমের। ড. আজিম ওঁকে কিনে দিয়েছেন। সুতরাং কত্রীর ইচ্ছায় কর্ম । তখন আমার ডিউটি ছিল। গত সপ্তাহে বিকেল দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি ছিল আমার। | ‘তাহলে ওদের ছিটেফোঁটা কথা-বার্তা শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
৮)
ভলিউম-৮
.
‘কিছু কিছু।’
আমার তদন্তের অনেকটা সুবিধা হতে পারে তাতে। তবে আমার পক্ষ থেকে একটা আবেদন আছে। বলুন?
‘আমি যে এই ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছিলাম তা দয়া করে আজিম সাহেবের পরিবারবর্গের কাউকে বলবেন না। আমার সাথে নাসিমের কোনরকম সৰ্ক প্রকাশ পেলেও মিসেস আজিম ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন। আমি সামান্য রিসেপশনিস্ট। আমাকে ওরা মানুষ বলে গণ্য করেন না।’
বেশ বেশ। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা চেপে যাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। তখন যা হয় করবেন। নাসিমের স্বার্থটাকে বড় করে দেখবেন।’
শহীদ সিগারেট ধরাল। ধোয়া ছেড়ে বলল, এখন আমাকে বলুন মিস শাহানারা, নাসিমের যে অপরাধ নেই, আপনার এই বিশ্বাসের হেতু কি? এটা কি অন্ধ বিশ্বাস? নাকি তার চরিত্র সম্পর্কে এটা আপনার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা, অথবা অন্য কোন কারণ আছে? যা জানেন বা যা আপনার মনে হবে, কিছুই লুকোবেন না। লুকালে আপনার অভীষ্ট সিদ্ধি নাও হতে পারে।’
মেয়েটা একটু ভাবল। তার চেহারায় দ্বিধার ছাপ দেখা গেল । কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যে। লীনা ও মহুয়ার দিকে এক নজুর চেয়ে সে বলতে লাগলঃ
| ‘এই খুনোখুনির ঘটনা ঘটে গত ১০ ও ১১ মার্চের মাঝখানের রাতে। সেই রাতের কথাই বলছি। পার্টির এক ফাঁকে নাসিম আমাকে বলেছিল, ডিউটির পরে আমি যেন মোড়ে অপেক্ষা করি। সে আমাকে দশটার দিকে বাসায় পৌঁছে দেবে। আমার সাথে তার নাকি জরুরী আলোচনা আছে। (শাহানারার চেহারাটায় লজ্জার ছায়া পড়ল)। দশটায় আমার ডিউটি শেষ। বিকেলে ডিউটি থাকলে আমাদের পাড়ার এক বিশ্বাসী রিকশাওয়ালা সাধারণত আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। যথাসময়ে রিকশাওয়ালা এল। আমি তাকে বিদায় দিয়ে মোড়ের উপর অপেক্ষা। করতে লাগলাম।
একটু থামল শাহানারা । তারপর আবার বলতে লাগল, নাসিম এল সাড়ে দশটায়। আমি আধঘন্টা অপেক্ষা করার পর, সে কি অস্বস্তিকর প্রতীক্ষা! যাই হোক, সে যখন পৌঁছুল তখন তাকে অত্যন্ত অসুস্থ দেখাচ্ছিল। সে বলল, তার খুব। খারাপ লাগছে। আরও বলল, সে প্রত্যেকটা জিনিস দুটো করে দেখছে, মাথাটা ঘুরছে, গা বমি বমি করছে, ড্রাইভ করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। হাত কাঁপছে তার। ফলে ওকে সরিয়ে দিয়ে আমিই স্টিয়ারিং ধরলাম। সে সিটের কোণে হেলান দিয়ে বসে রইল। একটু পরেই সে বোধহয় চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। ওর ভারি দেহটা বারবার ঢলে পড়ছিল আমার গায়ের উপর। ড্রাইভ করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। কি করে যে ভারসাম্য রক্ষা করে ড্রাইভ করে ওর বাসায় পৌঁছেছিলাম তা এখন ৬ কুয়াশা-২৩
| ৮১
আমার ভাবতেও ভয় লাগে। বিশ্বাস করুন, সারাটা রাস্তায় কোথাও আমি কাউকে চাপা দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। মানুষ তো দূরের কথা, কুকুর বিড়ালও না। তবু বলা যায় না, হয়ত আমি খেয়াল করিনি। হয়ত কেউ চাপা পড়েছিল। তাহলে খুনের দায়ে নাসিমকে না ধরে আমাকে ধরতে হয়। অবশ্য জানি না, নাসিম পুলিসের কাছে আমার কথা কিছু বুলেছে কি না। | ‘কিছুই বলেনি, শহীদ জানাল। জানালে আপনিও এতক্ষণ ফাটকে থাকতেন হত্যার সহযোগিনী হিসেবে। তাছাড়া আমি পুলিসের ফাইল দেখে এসেছি। আপনার নামের কোন উল্লেখ নেই। যে রাস্তায় পুলিস লাশ পেয়েছে আপনি কি সেই রাস্তা ধরেই গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তাই গিয়েছি বটে। তখনকটা হবে।’ ‘পৌনে এগার, কিংবা আও দু’চার মিনিট বেশি । ওর বাসায় পৌঁছেছি সম্ভবত পৗনে এগারটায় ।।
বাসাটা কোথায়?’
গুলশানে ওর ছোট চাচা মানে ড. আজিমের বাসায় থাকে সে। বড় চাচা সাইফুল আজিম সাহেবের বাসায় সে থাকে না। উনি মেজাজী মানুষ। ওঁকে খুব ভয় পায়। পারতপক্ষে তার ধারেও ঘেঁষে না নাসিম। | সাইফুল আজিম সাহেবের বাসাটা কোথায়?’
‘সেটাও গুলশানে। তবে দুটো বাড়ি দুই প্রান্তে।
নাসিমের বাসায় পৌঁছে কি করলেন?
‘গেট ভেজানো ছিল। সেটা খুলে গাড়ি পোর্টিকোতে নিয়ে রাখলাম। চাকরদের খোঁজ করলাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। মিসেস আজিমকেও না।
“মিসেস আজিম তো চট্টগ্রামে গিয়েছেন ড. আজিমের সাথে।’
‘সেটা অবশ্য তখন আমি জানতাম না, পরে শুনেছি। যাই হোক, নাসিমের পকেট থেকে চাবি নিয়ে ওর রূমের দরজা খুললাম। অনেক কষ্টে ওকে গাড়ি থেকে বের করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। জুতো-জামা খুলে দিলাম। মশারী ফেলে, বাইরে। এসে দরজায় তালা লাগিয়ে জানালা দিয়ে চাবিটা রূমের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম। অনেকটা হেঁটে এসে বাসে চেপে ফিরে এলাম বাসায়। ঐ অবস্থায় কেউ এক ঘন্টার মধ্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে এবং স্থির মস্তিষ্কে খুন করে লাশ গাড়ি চাপা দিতে পারে একথা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে আমি তাকে
একেবারে অচৈতন্য অবস্থায় ফেলে রেখি এসেছি।’
‘ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন? “তেমন কিছু মনে পড়ে না। ‘গাড়িটা রেখেছিলেন পোর্টিকোতে, তাই না?’ শহীদ চিন্তাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন
ভলিউম
করল।
‘গাড়িটা আমি রেখে এসেছিলাম পোটিকোতেই কিন্তু পুলিস সেটাকে পেয়েছে গ্যারেজে।’
‘ভ, কথা, নাসিমের সাথে আপনার পরিচয় কত দিনের?”
বছরখানেকের হরে। তার আগে বিদেশে পত সে।’ আপনি কতদিন আছেন হোটেল সোনিয়ায়?’ বছর দেড়েক হবে।’
‘মিসেস আফরোজা মহমান অর্থাৎ যে ভদ্রমহিলা সেদিন সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন করেছিলেন তাঁকে আপনি চেনেন?
‘দেখেছি কয়েকবার। মাঝে মাঝে হোটেলে আসেন। মিষ্টি হেসে কথাবার্তা বলেন। বড় নরম মানুষ।
“উনি ড. আজিমের কি হন?
‘রক্তের সম্পর্ক নেই বোধহয়। ড. আজিমের ছাত্রী ছিলেন একদা। উনি বিধবা। উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। স্বামী ছিলেন স্থপতি। খুবই স্নেহ করতেন’ ড. আজিম তাঁকে। হয়ত তাকে বিয়েও করতেন তিনি। কিন্তু মাঝখানটায় মিস জোবায়দার সাথে তার আলাপ হয়ে গেল করাচীত। তাকে একেবারে বিয়ে করে নিয়ে এলেন। এটা অবশ্য ড, আজিমের নিতীয় বিয়ে। প্রথম পত্নী বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন। উনিই নাসিমকে মানুষ করেছেন। নিজে ছিলেন মৃতবৎসা ।
একটা সন্তানও বাঁচেনি।।
মিসেস জোবায়দা আজিমের দেশ কোথায়?’
‘ঢাকাতেই বাড়ি ওঁদের। তবে থাকতেন করাচী। কি নাকি একটা বড় চাকরি করতেন সেখানে। কেউ বলেন, উনি নাকি সিনেমায় অভিনয় করতেন ছোটখাট।
করি-বাকরির কথাটা মিথ্যে।’
নাসিম নিয়মিত জুয়ো খেলত আপনি তা জানতেন?’ আগে জানতাম না। সে গ্রেফতার হবার পরে শুনেছি।’ ‘ওর মুখে কুলী হোসেনের নাম কখনও শুনেছেন?”
মা। এ নাম সে কোনদিন আমার সামনে উচ্চারণ করেনি। ইদানীং কি নাসিমের আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন?
শাহানারা একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যেত। কি যেন ভাবত। আমি জিজ্ঞেস করলে অবশ্য হেসে উড়িয়ে দিত। আবার কখনও বলত, ‘পুরুষ মানুষকে কত কি ভাবতে হয়।’
নাসিম টাকার ব্যাপারে আপনার সাথে কখনও আলোচনা করেছে?’
বিষণ্ণ হাসি হাসল শাহানারা। টাকার ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে আর কি আলোচনা করবে? আমি তো বলতে গেলে নিজেই ভিখারিণী। কুয়াশা-২৩
মহুয়া টিপ্পনী কাটল, কিন্তু চেহারাটা তো রাজরানীর মত! লজ্জা পেল শাহানারা।
বাইরে পথের দিক থেকে অস্পষ্ট ক্রিং ক্রিং শব্দ শোনা গেল। শাহানারা বলল, ‘আমি এবার যেতে চাই, শহীদ সাহেব। রিকশা এসে গেছে আমার।’
ব্যস্ত হল শহীদ। তাই তো, আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। আসুন। তাহলে। দরকার হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। ভাল কথা, আপনার ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে যান।
ঠিকানাটা বলল শাহানারা। লীনা ওকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল । শহীদ বসে বসে চিন্তা করতে ও সিগারেট ধ্বংস করতে লাগল।
মহুয়াও অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে কাটিয়ে দিল। পরে সে বলল, ধ্যান করলেই হবে, নাকি খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি করতে হবে?’
সে জবাব দেবার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল। শহীদ হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলল, হ্যালো?… হ্যাঁ, শহীদ বলছি।
অপর প্রান্ত থেকে একটা দুর্বল কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি আজিম ইণ্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাইফুল আজিম বলছি। দয়া করে আমার একটা উপকার করবেন?
বলুন? আপনি মনসুরের আত্মীয়? মনসুর মানে কুয়াশা?’
জ্বি, হ্যাঁ। ইতস্তত করে বলল শহীদ। আক্রমণটা কোনদিক থেকে আসবে বুঝতে পারল না সে।
মনসুরকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। সে যদি ঢাকায় থাকে তাহলে এখুনি তাকে দয়া করে একটা খবর দেবেন?’ করুণ মিনতি ভেসে এল ফোনে।
‘সে ঢাকাতেই আছে। এখুনি খবর দিচ্ছি আমি।
‘আমার ওর সাথে কথা বলা নিতান্তই দরকার, সামনাসামনি হোক বা টেলিফোনে থোক। আমি গুরুতর অসুস্থ। সে যেন অবশ্যই একবার আমার সাথে যোগাযোগ করে। অত্যন্ত বিপদ আমার।’
| ‘আমি খবর দিচ্ছি এখুনি।
কুয়াশাকে ফোন করল শহীদ। সৌভাগ্যবশত কুয়াশা বাড়িতেই ছিল। সে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার? শাহানারা নামে একটা মেয়ে গিয়েছিল তোমার কাছে?
হ্যাঁ, এসেছিল একটু আগে, চলে গেছে। আসলে তার আগেই আমি ঐ ব্যাপারটাতে জড়িয়ে পড়েছি। দুপুরে ড, খুরশীদ আজিম চট্টগ্রাম থেকে ফোন করেছিলেন। তিনি অনুরোধ করলেন। মি. সিম্পসনের কাছে গিয়েছিলাম খোঁজ খবর নিতে। ওদের হাতে যে সব প্রমাণ আছে সেগুলো অত্যন্ত কনভিন্সিং।
| শাহানারা কি বলল?
ভলিউম-৮
৮৪
“সে আমাকে যে ঘটনা বলল তাতে অবশ্য নাসিমকে নিরপরাধী বলেই মনে হয়।.তুমিও শুনেছ নিশ্চয়ই?
তো, আমাকে কিছু বলেনি।’ শাহানারার বর্ণিত ঘটনা বিবৃত করল শহীদ।
কুয়াশা বলল, আমিও কথা দিয়েছি শাহানারাকে, নির্দোষিতা প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রমাণ সংগ্রহ করব। ইতিমধ্যেই যে দু’একটা তথ্য সংগ্রহ করেছি তা অত্যন্ত চমকপ্রদ। ব্যাপারটা আসলে অত্যন্ত জটিল, এই জট ছাড়ানোর সাধ্য কোন উকিলের নেই। মূল রহস্যটা না জানতে পারলে উকিল আসামীকে সমর্থন করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে। তুমি কি এগোতে পেরেছ কিছুটা?’,
বলতে গেলে তেমন কিছু নয়। কিন্তু শোন, আসল কথাই বলা হয়নি। আজিম ইণ্ডাস্ট্রিজের খোদ, মালিক সাইফুল আজিম সাহেব এই মুহূর্তেই তোমার সাথে আলাপ করতে চান। বুড়োকে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত মনে হল।
‘আমিও আশঙ্কা করেছিলাম বুড়ো আমাকে জড়াবেন। ভদ্রলোক অনেক ব্যাপারেই আমার ওপর নির্ভর করেন। এই বিপদে আমার খোঁজ করবেন তিনি
এটা স্বাভাবিক, কুয়াশা বলল।
‘তুমি এখুনি ওঁর সাথে ফোনে কথা বল। আমি রাখছি।’ আধঘন্টা পরে কুয়াশা শহীদকে ফোন করল।
‘বুড়ো আজিম সাহেব ভয়ঙ্কর চটে গেছেন তাঁর ভাইপোর উপর। তিনি যতটুকু খবর পেয়েছেন তাতে তার ধারণা হয়েছে, খুনটা তাঁর ভাইপোই করেছে। একেবারে খেপে গিয়েছেন ভদ্রলোক। গুরুতর অসুস্থ হলেও ভদ্রলোকের নার্ভ অত্যন্ত সবল। আরও চটে গেছেন ছোকরা জুয়াড়ীদের সাথে গিয়ে জুটেছিল বলে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমাকে ডেকেছিলেন কেন?’
সম্পত্তিটা উনি ওয়াকফ করতে চান। আমাকে তার অছি হতে হবে। তাছাড়া নাসিমকে কোন ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি কিনা তাও জানতে চাইলেন।
‘মাসিমকে উনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চান?
‘হ্যাঁ, ওঁর ধারণা হয়েছে, নাসিম অপরাধী হোক আর না থোক ফাঁসীর দড়ি থেকে রেহাই পাবার সম্ভাবনা নেই। আর মামলা কতদিন চলবে কে জানে। ততদিন উনি না-ও বাঁচতে পারেন। সেক্ষেত্রে তার এই কারখানা এসটারিশমেন্ট কে পরিচালনা করবে? পাঁচ ভূতে লুটে খাবে।–ড. আজিমের উপর তার এতটুকু বিশ্বাস নেই, মিসেস আজিমের নামও শুনতে পারেন না তিনি।
কিন্তু যদি নাসিম নিরপরাধী, প্রতিপন্ন হয়, সেক্ষেত্রে?
‘আমি ওঁকে সেই কথাই বলেছি। নাসিম সম্ভবত নিরপরাধ। আমার তাই দৃঢ় বিশ্বাস। মামলাটা ঠিক পথে চালাতে পারলে ওকে বাঁচানো যাবে। ফলে, তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না। অনেক করে বুঝিয়েছি। যুক্তিটা তাঁর কুয়াশা-২৩
৮৫
বড় একটা পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া তাঁর ধারণা, নাসিম যদি খালাসও পায় তবু তাকে সম্পত্তি দেওয়া উচিত নয়, কারণ সে হয়ত পুরো সম্পত্তিটাই জুয়া খেলে উড়িয়ে দেবে।’
‘অত বড় সম্পত্তি জুয়া খেলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
‘বোধহয় যায় না। তেমন কোন উদাহরণ আমার জানা নেই। যাই হোক, বুড়ো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে একমাস অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছেন।’
‘একমাস অনেক সময়। এর মধ্যেই মামলার শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হয়। পুলিস তত চার্জশীট প্রায় তৈরি করেই ফেলেছে।
| হ্যাঁ, আরও একজন ভাল উকিল নিয়োগ করতে বলেছি। ঠিক হয়েছে, আমার বন্ধু ইমদাদ রিজভী নাসিমের পক্ষ সমর্থন করবেন। উনি খুব ভাল উকিল । সত্যি বলতে কি, তার চাইতে ভাল ক্রিমিন্যাল ল-ইয়ার আমার জানা নেই। এখুনি খবর পাঠাচ্ছি তাঁকে।
তাহলে তো ভালই হয় ।, আমারও ধারণা, খুব একজন ভাল উকিল, দরকার আসামীর জন্যে।
প্রসঙ্গ বদলাল কুয়াশা ।
‘ড. আজিম কি তোমাকে ঠিকানা দিয়েছেন? কোথায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে হবে জানো তুমি?’।
ভদ্রলোক এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে । সেখানে কি সব গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকবেন উনি। কামাল চট্টগ্রাম গেছে গতকাল। ওকে বলেছি, প্রাইউড হোটেলে গিয়ে ড. আজিম ও মিসেস আজিমের খোঁজ করতে। ড, আজিম হয়ত কামাল হোটেলে পৌঁছুবার আগেই বেরিয়ে যাবেন। মিসেস আজিমের সাথে তার দেখা হলেও হতে পারে। অবশ্য কাল সকালের মধ্যেই মিসেস আজিম ঢাকা পৌঁছুবেন, শহীদ জানাল।
‘তোমার কথা বলেছি বুড়ো আজিম সাহেবকে। উনি তোমাকে দেখা করতে বলেছেন। সুস্থ থাকলে নিজেই যেতেন। তবে কাল সকালে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি আবু মুরাদ তোমার সাথে দেখা করতে যাবে। যাক, এবার কাজের কথা শোন। পুলিসের দিক থেকে মামলা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। আসলে যারা খুনটা করেছে তারা এতই ধুরন্ধর যে, তাদেরকে সন্দেহ করার মত কোন সূত্রই রাখেনি। বরং যেসব প্রমাণ রেখে গেছে তার সবটাই নাসিমের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এমন কি পুলিসের মনে সামান্যতম বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও কোন সুযোগ রাখেনি। এখন আমি শুধু পুলিস নয় খুনীদের মনেও একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাই। অর্থাৎ পরিস্থিতিটাকে আরও ঘোলাটে করে তুলতে চাই। | কুয়াশার কথায় শহীদ নিজেই বিভ্রান্ত হল। সে বলল, “কিছু বুঝতে পারলাম
না।’
ভলিউম-৮
৮৬
‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাই। কিভাবে?’
‘আমি প্রস্তাব করেছি এবং আজিম সাহেব মেনেও নিয়েছেন যে সমস্ত হত্যাকাণ্ডের দায় আজিম সাহেব আমার ঘাড়ে চাপাবেন।’
শহীদ আরও বিভ্রান্ত হল। সে আমতা আমতা করে বলল, সেটা আবার কেন করতে যাচ্ছ? মিছেমিছি ঝামেলা আর নাই বা বাড়ালে? শেষটায়…।
‘এইটাই হল বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সেরা পন্থা। তাতে করে আসল খুনী অথবা খুনীরা আরও নিশ্চিন্ত বোধ করবে। এবং কিছুটা অসাবধানও হয়ে পড়বে। সে সুযোগটা আমি নেব।’
কিন্তু পুলিস? পুলিস কেন আজিম সাহেবের এই উদ্ভট অভিযোগ কানে তুলবে?’’
‘নিশ্চয়ই মানতে চাইবে না। কিন্তু তারা দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। অন্তত কুয়াশার প্রশ্নটা জড়িত থাকায় কিছুটা ইতস্তত করবে। নতুন করে তদন্তও শুরু করতে পারে। তাতে অবশ্য পুলিস লাভবান হবে না। কিন্তু নাসিম লাভবান হবে। ঘোলা পানিতে আমরা আসল আসামীদের স্পষ্ট দেখতে পাব।
| ‘আমার তা মনে হয় না,’ শহীদ বলল। আজিম সাহেবের অভিযোগের অন্তত কিছু একটা ভিত্তি থাকতে হবে তো? হুট করে আজিম সাহেব বললেই তো আর হবে না? পুলিস এক কথায় নাকচ করে দেবে তার যুক্তি।
একেবারে এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারবে না। আমি আজিম সাহেবকে ভয় দেখিয়ে দুটো চিঠি দিয়েছি আগের তারিখ দিয়ে। এই যেমন ধর, তার কাছে কিছু টাকা-পয়সা চাই। না দিলে পরিণাম খুব খারাপ হবে, এমন শাসানিও রয়েছে সেই চিঠিতে। আজিম সাহেব পুলিসকে চিঠিগুলো দেখাবেন। বোধহয়, ইতিমধ্যেই মি. সিম্পসনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার আগেই পৌঁছুবে আমার চিঠি।’
কুয়াশার পরিকল্পনা শহীদের মনঃপূত হল না। সে বলল, আমার মনে হয়, তুমি ভুল পথে এগোচ্ছ। * জবাবে হাসল কুয়াশা। সে বলল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এটাই উত্তম পন্থা। তাছাড়া আমার আর একটা প্ল্যান আছে যা আমি এখুনি তোমাকে বলতে পারছিনে।
‘বেশ, যা ভাল বোঝ, কর, ক্ষোভ প্রকাশ করল শহীদ।
চার সকালেই মিসেস আজিম ফোনে শহীদকে ঢাকায় তার উপস্থিতির খবর দিলেন এবং কখন তার সাথে দেখা করতে আসবেন জানতে চাইলেন। শহীদ জানাল যে, কুয়াশা-২৩
তাঁর আসবার দরকার নেই। সে নিজেই যাবে মিসেস আজিমের সাথে দেখা করতে। নাসিমের রূমটাও দেখতে চায় সে সেই সঙ্গে।
গফুর এসে খবর দিল, আবু মুরাদ নামে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। তাঁকে সে বসিয়ে রেখেছে ড্রইংরূমে। বাইরে বেরোবার পোশাক পরে ড্রইংরুমে ঢুকল শহীদ। মুরাদ সাহেব সবিনয়ে আত্মপরিচয় দিলেন, আমি আবু মুরাদ। সাইফুল আজিম সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি। উনি আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার সাথে দেখা করতে। যদি আপনার কোন কাজে লাগতে পারি…।।
ভদ্রলোককে জরীপ করল শহীদ। চল্লিশ বছরের মত বয়স হবে আর মুরাদ সাহেবের। রংটা শ্যামলা। বলিষ্ঠ গড়ন। চেহারাটা বুদ্ধিদীপ্ত । পরনে ছাই রং-এর চমৎকার একটা সুট। সব মিলিয়ে স্মার্ট লোকটা।
শহীদ বলল, আপাতত একটিমাত্র কাজ আপনি করতে পারেন। আমি মিসেস আজিমের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। বাসাটা ঠিক চিনি না। আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন।’
‘বেশ, চলুন।
লনে অপেক্ষা করছিলেন মিসেস আজিম। ওদেরকে সাদরে সম্বর্ধনা জানালেন।
মিসেস আজিম সুন্দরী। দুধে-আলতা গায়ের রং। শিল্পীর তুলিতে আঁকা মুখটা যেন ছুরির ফলার মত ধারালো। বয়স তিরিশ পেরিয়েছে। কিন্তু চোখের কোণে এখনও বিদ্যুতের ঝিলিক। সুঠাম দেহবল্লরী। বঙ্কিম গ্রীবা। মাথা ভর্তি বব ছাঁট কোঁকড়া চুল। দু’চারটে অবাধ্য কুন্তল প্রশস্ত কপালের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে । সাদা সিল্কের একটা শাড়ি পরা আর স্লিভলেস ব্লাউজ। দেহের অনাবৃত অংশগুলো স্বাস্থ্য আর যৌবনের জানানি দিচ্ছে। গলায় একটা মুক্তোর মালা। কানে কোন অলঙ্কার নেই। বাহু দুটোও নিরাভরণ।।
রাত জাগার জন্যেই হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক মহিলার চোখ দুটো ঈষৎ লাল।। “ শহীদ গাড়ি থেকে নামতেই মিসেস আজিম এগিয়ে এলেন, শহীদ খান সাহেব!’
“জ্বি, হ্যাঁ, গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল শহীদ। | আসুন, শহীদ সাহেব! এস মুরাদ। তারপর জিভ কেটে বললেন, আই অ্যাম সরি, মি. মুরাদ, কিছু মনে করবেন না।’ | মুরাদ সাহেব সহজ অবহেলায় উড়িয়ে দিলেন। শ্রাগ করে বললেন, নেভার মাইণ্ড, ম্যাম।’ | বাড়ির সামনের দিকটা একবার পর্যবেক্ষণ করল শহীদ। তারপর মিসেস আজিমের দিকে চেয়ে বলল, এই যে লোকটা খুন হয়েছে, মানে কুলী হোসেন না কি যেন নাম, ওকে আগে আপনি চিনতেন নাকি, মিসেস আজিম?”
brbr
ভলিউম-৮
প্রশ্নটার আকস্মিকতায় মিসেস আজিম মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমি, আমি চিনব কি করে! একটু বিরক্ত হয়েছেন শহীদের প্রশ্নে । সেটাও বোঝা গেল।
‘নেভার মাইণ্ড মাই ফুলিশ কোশ্চেন,’ ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল শহীদ।
সত্যি কথা বলতে গেলে, মিসেস আজিম গ্রীবাভঙ্গি করলেন, লোকটার নাম আমি শুনেছিলাম, তবে বেশি দিন আগে নয়। ঐ খুনোখুনির দিনই সন্ধ্যায় এক পার্টিতে । এই যে আসুন, ড্রইংরুমটা এই দিকে। | বিরাট একটা সুসজ্জিত ড্রইংরূমের মধ্যে ঢুকল তিনজন। সোফাতে বসতে বসতে শহীদ বলল, “সে পার্টির কথা আমি শুনেছি। মিসেস আফরোজা রহমান আপনার স্বামীর বিদায় উপলক্ষ্যে পার্টি দিয়েছিলেন, তাই না?
‘জ্বি, হ্যাঁ। সেখানে নাসিমের মুখেই কুলী হোসেন নামটা শুনেছিলাম। নাসিম বলেছিল, সে নাকি লোকটার কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছে । ঐদিনই নাকি টাকাটা ফিরিয়ে দেবার লাস্ট ডেট ছিল। কুলী হোসেন নাকি শাসিয়েছে যে, টাকাটা না দিলে পরিণাম খারাপ হতে পারে।’
‘কি পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে কোন আভাস দিয়েছিল নাসিম?’
‘নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে হয়ত ওকে মারপিট করতে পারত অথবা ওর বড় চাচার কানে তুলতে পারত। তবে যাই হোক, দুটোর একটও নিশ্চয় শুভ নয়। দ্বিতীয়টা তো মারাত্মক। আমার ভাসুর যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে নাসিমের এমন ধরনের বদভ্যাস আছে তাহলে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। তাই নাসিম আমাকে অনুরোধ করেছিল, আমি যেন ওর ছোট চাচার কাছ থেকে ওকে টাকাটা নিয়ে দিই।
আপনি কি বললেন? ‘আমি ওর চাচাকে বলব বলে কথা দিয়েছিলাম।
বলেছিলেন তাকে? ‘ট্রেনে বলেছিলাম, উনি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। নাসিম এতটা বখে যাবে এটা তিনি আশা করেননি।
“উনি টাকা দেবেন কিনা তার কিছু বলেছিলেন?”
তার মানসিক অবস্থা অনুকুল না দেখে ব্যাপারটা তখনকার মত চাপা দিয়েছিলাম অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে।
“আচ্ছা ধরুন, টাকাটা যদি নাসিম জোগাড় করতে না পারে তাহলে নাসিম কি করবে, তার কোন আভাস দিয়েছিল?
মিসেস আজিম জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। আঙুলের আংটিটা ঘোরাতে লাগলেন একমনে। শহীদ সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে দিতে জবাবের অপেক্ষা করতে লাগল । শেষপর্যন্ত জবাব দিলেন তিনি, ‘ছেলেমানুষী জবাব একটা কুয়াশা-২৩
৮৯
দিয়েছিল বৈকি। বিপদে পড়লে মানুষ অনেক উল্টোপাল্টাও তো বকে।
‘সে জবাবটা কি?’ শান্তস্বরে প্রশ্ন করল শহীদ।
তবু একটু ইতস্তত করলেন মিসেস আজিম। তারপর বললেন, নাসিম বলেছিল, সে-ও দেখে নেবে। ঢিল মারলে পাটকেল ছুঁড়তে সে-ও জানে। তার গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে সব সময়ই রিভলভার থাকে। দরকার হলে সেন্টার সদ্ব্যবহার করবে।’
‘পার্টিতে একথা কি শুধুমাত্র আপনাকে বলেছিল, না আর কারও কাছে বলতে শুনেছেন?”
আফরোজাকেও সে ধারের কথাটা বলেছিল। ওর চাচার কাছ থেকে কিা, নিয়ে দেবার জন্যে তাকেও ধরেছিল। তবে রিভলভারের প্রসঙ্গটুকু বলেছিল কিনা
জানি না। তবে হ্যাঁ, মুরাদ সাহেবও ছিলেন।’
আপনিও শুনেছেন তাহলে?’ মুরাদকে প্রশ্ন করল শহীদ।
‘আমি ধারের ব্যাপারটা আগেই জানতাম। টাকাটা কি করে জোগাড় করা যায় তার বুদ্ধি বাতলে দেবার জন্যে আমাকে অনুরোধ করেছিল ।
আপনি কি বলেছিলেন?’ হাসল মুরাদ, আমার কাছে ও প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। আদার কারবারি আমি।’
চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে একটা চাকর ঢুকল। টিপয়ের উপর ট্রে রেখে সে মিসেস আজিমকে বলল, “বেগম সাহেবা, আপনার ফোন । বড় সাহেব ডাকছেন।’
‘ মিসেস আজিম উঠে দাঁড়ালেন। মাফ করবেন, শহীদ সাহেব । আমি এখুনি আসছি। অত্যন্ত অন্যায় হয়ে গেছে। ভাইজানকে এখনও আপনার উপস্থিতির খবরটা জানাইনি।’
| বেরিয়ে গেলেন মিসেস আঁজিম। চাকরটা চা তৈরি করে দিয়ে চলে গেল। শহীদ চুপ করে কি যেন ভাবছিল। আবু মুরাদ বলল, চা নিন, শহীদ সাহেব।
‘এই যে, ভাই, নিচ্ছি।’
চায়ের কাপে চুমুক দিল শহীদ। তারপর বলল, একটা কথা বুঝতে পালোম না, মুরাদ সাহেব, আপনি তো সাইফুল আজিম সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি, আপনার তো অহোরাত্র সাহেবের কাছেপিঠে থাকার কথা উনি আপনাকে স্পেয়ার করেন কি করে?
মুচকি হাসল মুরাদ। সে বলল, “দেখুন, নামে প্রাইভেট সেক্রেটারি হলেও আমার পাওয়ার আর ফাংশন আলাদা। আসলে আমার কাজটা হল, আজিম সাহেবদের সবাইকে তদারক করা। বলতে পারেন, উঁচুদরের চাকর। ওদের সবরকম ঝঞট আমাকেই পোহাতে হয় । মিসেস আজিমের জন্যে চোরা বাজারে এলিজাবেথ আর্ডেমের লিপস্টিক সংগ্রহ থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিক ধর্মঘট বানচাল সবই আমাকে করতে হয়। তাছাড়া নানারকম উমেদারী তো।
ভলিউম-৮
আছেই। ফলে আমার কর্মক্ষেত্রটা ব্যাপক। ক্ষমতাও।
তাহলে আপনার চাকরিটা তো চমৎকার! আপনি তো ওদের হাঁড়ির খবরও রাখেন?
স্বভাবতই।’ কতদিন আছেন এই চাকরিতে?
মাত্র বছরখানেক। এর আগে আমি ইনস্যুরেন্সে ছিলাম। বড় সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম একটা পলিসি, বেচতে। উনি আমাকেই কিনে রাখলেন।
। আপনি থাকেন কোথায়?
ফার্মগেটের কাছে।’ ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
‘তখন আমি ট্রেনে। জরুরী একটা কাজে আমাকে সেইদিনই রাতের ট্রেনে ময়মনসিংহ যেতে হয়েছিল। সন্ধ্যায় পার্টিতে আমি অবশ্য ছিলাম। সেখান থেকে ড. আজিমকে নিয়ে স্টেশনে গেলাম। ওঁকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি স্টেশনেই রয়ে গেলাম বাহাদুরাবাদের গাড়ির অপেক্ষায়। এসেছি গত রাতে। এই দুর্ঘটনার খবর আমি গতকাল কাগজে পড়েছি। আরও দু’একদিন থাকতাম আমি সেখানে। কিন্তু দেরি করা সমীচীন হবে না বিবেচনা করে চলে এলাম।
| চা শেষ করে আর একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। আবু মুরাদকে সিগারেট অফার করল। কিন্তু সে বলল, “সর্বনাশ, বে-আদবী করলে আমার চাকরি চলে যাবে না!
ভাবভঙ্গি দেখে হাসি পেল শহীদের।
মিসেস আজিম ফিরে এলেন। তাকে অত্যন্ত উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। উত্তেজনার কারণ অনুমান করতে শহীদের ওরি হল না। সেই খবরটাই এসে গেছে। গুজবটা চালু করে দেওয়া হয়েছে। মিসে। আজিমই বোধহয় প্রথম বে-সরকারি শ্রোতা । মিসেস আজিম কিছু বলার আগে ই উদ্বেগের ভান করে শহীদ প্রশ্ন করল, “কি হল, মিসে আজিম! আপনাকে অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হচ্ছে যে? কোন দুঃসংবাদ?
দুঃসংবাদ না সুসংবাদ বলতে পারছিনে। ভাইজান ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, তার ধারণা খুনটা নাকি কুয়াশা..মানে কুখ্যাত ক্রিমিন্যাল কুয়াশা করেছে। সে নাকি আগেই শাসিয়েছিল ভাইজানকে। কয়েক লাখ টাকা চেয়েছিল ওঁর কাছে। না দিলে ক্ষতি হবে বলে হুমকি দিয়েছিল। উনি গা করেননি। ওসব উটকো হুমকিতে ভয় পাবার লোক উনি নন। তাছাড়া আক্রমণটা যে এইভাবে আসবে তা তিনি ধারণা করেননি। এখন আমারও মনে হচ্ছে উনি ঠিকই ধরেছেন। আমাদের কোন শক্রই যে চক্রান্ত করেছে, নাসিমের ছোট চাচা গোড়াতেই একথা বলেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, ওঁর ধারণা নিতান্ত অমূলক নয়। আপনার কি মনে হয়, মুরাদ সাহেব?
কুয়াশা-২৩
‘রাতে সাহেব আমার কাছেও কথাটা বলেছিলেন। ওঁর কাছে কুয়াশার পাঠানো দুটো চিঠিও আছে। সেগুলো সি. আই. ডি-র বড় সাহেব মি. সিম্পসনকে দেখিয়েছেন, সোসাহে বলল মুরাদ।
কিন্তু শহীদ উৎসাহিত হল না। সে প্রশ্ন করল, আপনি নিজে দেখেছেন চিঠিগুলো?’
, আমাকে দেখাননি। মি. সিম্পসম বলেছেন, হাতের লেখা কুয়াশারই। আগেও কখনও আজিম সাহেব ঐ ধরনের চিঠির কথা বলেছিলেন নাকি? ‘জ্বি, না, আজিম সাহেব অত্যন্ত চাপা মানুষ। চট করে কোন কিছু ফাঁস করেন ।
আপনার কি ধারণা, কুয়াশাই এটা করেছে?
মুরাদ বলল, ‘নাসিম যতদূর মনে হয় নির্দোষ । যদি সে নির্দোষ হয়েই থাকে তাহলে তো আমি কুয়াশাকে ছাড়া এমন কোন শত্রুর অস্তিত্ব জানি না যে ওঁদের সর্বনাশ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। সুতরাং•••।’
কিন্তু ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে। আবার এমন হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে, কোন তৃতীয় পক্ষের কুলী হোসেনের সাথে শত্রুতা ছিল অথবা নাসিমের সাথে কিংবা আজিম সাহেবের বা তার পরিবারের অন্য কারোর প্রতি অথবা এদের প্রত্যেকের সাথেই তার শত্রুতা ছিল। সে কুলী হোসেনকে খুন করে খুনের দায় নাসিমের ঘাড়ে চাপিয়েছে, এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে, সবাইকে জব্দ করেছে। সে হয়ত কুয়াশার হুমকির কথাও জানে। সুতরাং খুনের দায়টা আর যার উপরেই ‘চাপক তার উপর আসবে না এটা নিশ্চিত জেনেই সে ভেবেচিন্তে কুলী হোসেনকে সরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য কুয়াশার জড়িত থাকার সম্ভাবনাটাও আমি অস্বীকার করছিনে।
শহীদের ব্যাখ্যা শুনে মিসেস আজিম বোকার মত চেয়ে রইলেন। কিন্তু মুরাদ বলল, আমি ব্যাপারটা অত গভীরভাবে ভেবে দেখিনি। আমার ধারণা, কুয়াশাই আসল অপরাধী। তবে আপনি যে ব্যাখা দিলেন মি. সিম্পসনও ঠিক একই ধরনের কথা বলেছেন।
তারমানে, কুয়াশা এই খুনের সাথে জড়িত এ কথা তিনি মানতে চান না?” “জ্বি, হ্যাঁ।
মিসেস আজিম বিজ্ঞের মত বললেন, পুলিসের চাকরি করেন তো মি. সিম্পসন, বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়েছে। আপনি বরং ঐ লাইনেই খোঁজ নিয়ে
দেখুন, শহীদ সাহেব। আমার মনে হয়, নাসিমকে বাঁচাবার সেটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। | শহীদ জবাবে হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একবার নাসিমের রূমটা দেখতে চাই, মিসেস আজিম? রূমটা কি বন্ধ?”
‘এখন ভোলাই আছে। রওশন আলী, মানে আমাদের বুড়ো চাকরটার কাছে
ভলিউম-৮
৯২
r
ডুপ্লিকেট চাবি আছে প্রত্যেক রূমের। দৈনিক সকালে রূমটা ভোলা হয়। পাশের রূমটাই। চলুন। মুরাদ সাহেব, আপনিও আসুন।
চলুন, উঠে দাঁড়াল মুরাদ।
রূমে ঢুকেই মিসেস আজিম বলল, রওশন আলী বলেছিল, পুলিস এসে কামটা তল্লাশি করে পিস্তল নিয়ে গেছে।
| রূমটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল শহীদ। দামী আসবাবপত্রে সাজানো রূমটা। দেয়ালে টেনিস র্যাকেট হাতে এক সুদর্শন যুবকের সহাস্যমূর্তি। সম্ভবত
ওটা নাসিমেরই ফটো।
নাসিম বোধহয় ভাল টেনিস খেলত?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে একবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল নাসিম। খেলা-ধূলোয় ঝোঁক ছিল খুব। শিকারেও।
বাথরুমের দরজা খুলল শহীদ। এক কোণে বড় একটা ক্লজিট। ব্রাকেটে অনেকগুলো সুট। ড্রয়ার টানল শহীদ, একটা ছাড়া সবগুলোই ভোলা। কাপড়চোপড় ঠাশ। ক্লজিটের নিচের তাকে বড় একটা বর্গাকার বাক্স চোখে পড়ল তার। সে জিজ্ঞেস করল, ওটা কি?
মিসেস আজিমও দেখলেন। কি যেন, ঠিক বলতে পারছিনে। মনে হয় কোন মেশিন-টেশিন হবে।’
শহীদ নত হয়ে বের করে আনল প্যাকেটটা। খুলে দেখে বলল, এটা তো টেপ-রেকর্ডার। বাক্সটার ভেতরে ছোট আরও একটা প্যাকেট ছিল, সেটা যে কি
তা বুঝতে পারল না সে। নেড়েচেড়ে আবার বন্ধ করে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এগুলো আমি নিয়ে যাব । নাসিম কি গান-টান পছন্দ করত নাকি?’
না । তেমন নয়। ওর সখ ছিল খেলাধুলা ও শিকারে। এবারও তো ওর ছোট চাচার সাথে শিকারে যাবার কথা ছিল। কিন্তু উনি রাজি হলেন না ভাইজানের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে। খুবই হতাশ হয়েছিল নাসিম। এখন মনে হয়, ওকে নিয়ে গেলেই ভাল হত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মিসেস আজিম।
প্যাকেটটা হাতে তুলে নিল শহীদ। | ‘চলুন। আর দেখবার কিছু নেই। আপনাদের চাকরগুলো কোথায়, ডেকে দিন। ওদেরকে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে। আমি ড্রইংরূমেই বসছি। মুরাদ সাহেব, কয়েক মিনিটের জন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন?
ঠিক আছে। আমি লনে যাচ্ছি, চলে গেল মুরাদ। ড্রইংরুমে গিয়ে বসল শহীদ।।
একটু পরেই রওশন আলী এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল। এই লোকটাই একটু আগে চা দিয়ে গিয়েছিল। লোকটার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। তবে দেহটা এখনও মজবুত।
কুয়াশা-২৩
শহীদ বলল, তোমার নাম রওশন আলী?” জি, হুজুর, ভীতস্বরে বলল রওশন আলী। ‘এ বাড়িতে চাকর কজন আছে?’ ‘দু’জন আমি আর বাবুর্চী জোমারত।
‘তোমার সাহেব, মানে খুরশীদ সাহেব যেরাতে চট্টগ্রাম গেলেন সেরাতে তুমি বাসায় ছিলৈ না?’
| হুজুর, রাতে আমি এখানে থাকি না। জোমাত একা থাকে। আমি হুজুর, বড় সাহেবের বাসায় থাকি। এ বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে তখন এখানে কাজ করি। তবে রাতে ঐ বাড়িতেই ফিরে যাই। সেদিনও গিয়েছিলাম
কটায়?”
‘সাড়ে আটটায়। এখানে কোন কাজ ছিল না, তাই চলে গিয়েছিলাম তাড়াতাড়ি।।
আর জোমার?’ ‘ওর তো থাকবার কথা ছিল। কিন্তু ও বড় ফাঁকিবাজ, হুজুর। দায়িত্বজ্ঞান একটুও নেই। আমি চলে যাওয়ার পরই সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। পরে আমি ওকে ধমকেছি। তা ও বললে, দশটার মধ্যে তো ছোট সাহেব ও বেগম সাহেবা। এসেই পড়বেন। বাসায় সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পাট বন্ধ ছিল,তাই কোন কাজ। ছিল না। বেগম সাহেবা আবার সকালবেলা বকশিশ দিয়েছিলেন দশ টাকা।
সুতরাং ওকে পায় কে? বাসাটা যে খালি রইল, সেকথা একবারও ভাবল না ।। অবশ্য ওর থাকা না থাকা সমান। একবার ঘুমোলে হাতি দিয়ে টানলেও উঠবে
।’
একটু অবাক হয়ে বলল, ‘বেগম সাহেবা দশটার মধ্যে ফিরবেন মানে! উনি তো চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন?
‘জি, হুজুর, উনি চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। কিন্তু তেনার যাওয়ার কথা ছিল না। হুট করেই চলে গিয়েছিলেন তিনি।
‘জোমাত কোথায় এখন?’
বাজারে গেছে, হুজুর।
সে রাতে ফিরেছিল কখন?” ‘সাড়ে বারটার দিকে।
সকালে পুলিসকে দরজা খুলে দিয়েছিল কি জোমারতই?” জি, হুজুর।’ “আচ্ছা, যাও। তোমাদের বেগম সাহেবাকে পাঠিয়ে দিও।’
মিসেস আজিম এলেন একটু পরেই। শহীদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মিসেস আজিম, আপনারা যদি সব কথা স্পষ্ট করে খুলে না বলেন তাহলে আমার পক্ষে
ভলিউম-৮
সত্য নির্ণয় করা সব নয়?
মিসেস আজিম হকচকিয়ে গেলেন। একটু উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল, শহীদ সাহেব? কি করেছি আমরা?
‘আপনার কি আগে থেকেই ড. আজিমের সাথে চট্টগ্রাম যাবার কথা ছিল?
“ওহ এই ব্যাপারে? না, তা ছিল না। তা আপনি জানলেন কি করে? রওশন আলী বলেছে বুঝি?
হ্যাঁ, সেই বলেছে। কিন্তু কথাটা আপনার আগেই আমাকে বলা উচিত ছিল। | আমি, আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করিনি। আমি দুঃখিত, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
শহীদ একটু লজ্জা পেল। সে বলল, আপনার চট্টগ্রাম যাবার ব্যাপারটা ঠিক হল কখন?’
একেবারে স্টেশনে গিয়ে। টিকেটের ব্যবস্থা? রিজার্ভেশন?
‘অ্যাক্সিডেন্টালি পাওয়া গিয়েছিল। সুতরাং ঝামেলা হল না। তবে কাপড় চোপড় নিতে পারিনি, সকালে চট্টগ্রাম থেকে কিনে নিয়েছিলাম দরকার মত।
হঠাৎ এই রকম ডিসিশনের কারণ?
‘ওটা আমার স্বামীর খেয়াল । আসলে অত্যন্ত খামখেয়ালী লোক উনি। অথচ ভয়ানক জেদী। যখন যা খেয়াল হবে তা না করে ছাড়বেন না,’ স্বামীর প্রতি সস্নেহ প্রশ্রয়ের সুরে কথাগুলো বললেন মিসেস আজিম। একটু থেমে পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘একেবারে খেয়ালী মানুষ।’
শহীদ বলল, “এবারে আমি উঠব, মিসেস আজিম,’ উঠে দাঁড়াল সে।
মিসেস আজিম বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে।
দরজার দিকে এগোতে এগোতে সে বলল, বলুন?
আপনার এই মামলা সম্পর্কে কি ধারণা? মানে, নাসিমকে বাঁচাতে পারবেন তো?’ ব্যাকুল শোনাল মিসেস আজিমের কণ্ঠস্বর, ওর চাচাকে আমি কথা দিয়ে এসেছি, চেষ্টার ত্রুটি হবে না। যেমন করে তোক আমরা সবাই মিলে নাসিমকে রক্ষা করব। অবশ্য, যদি সে নির্দোষ হয়। তা আপনি আপনি আপনার কি মনে হয়? আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ।
| মিসেস আজিমের ব্যাকুলতা অনুভব করল শহীদ। সে বলল, এখন পর্যন্ত বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি, মিসেস জিম। যেটুকু জেনেছি তাতে তো মনে হয়, নাসিম নিরপরাধ। কিন্তু সেটুকু জানাটা যথেষ্ট নয়। আসল হত্যাকারি কে, তা জানতে না পারলে এবং তার প্রমাণ দিতে না পারলে নাসিমকে বাঁচানো যাবে না।’
‘আসল অপরাধী তো আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কুয়াশাই। কুয়াশা-২৩
. *
*
‘যেই হোক, প্রমাণ তো চাই?
তাহলে আপনি এখন প্রধানত কুয়াশার বিরুদ্ধেই প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করবেন বলে আশা করি।’
গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল দু’জন। শহীদ দরজা খুলে সিটের উপর প্যাকেটটা নামাল।
‘সে চেষ্টারও ক্রটি করব না,’ শহীদ বলল। আমি একটা ঘটনা জানতে পেরেছি। সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা, মানে আপনি, আপনার স্বামী ও মুরাদ সাহেব স্টেশনে যাবার পর নাসিম আপনার ভাসুরকে দেখতে যায়। সেখান থেকে সে যায় জুয়ার আড্ডায়। সেখানে সে অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনরকমে সে গাড়ি নিয়ে হোটেল সোনিয়াতে পৌঁছে। সেখানে অপেক্ষা করছিল তার এক বন্ধু। সেই বন্ধুটিই অসুস্থ নাসিমকে এখানে নিয়ে আসে, এমন কি বিছানাতে শুইয়েও দেয় তাকে। নাসিম তখন একেবারে অচৈতন্য। তখন রাত এগারটা। আর রাত বারটার সময়, মানে মাত্র একঘন্টা পরে কুলী হোসেনের লাশ রাস্তায় ফেলে গাড়ির তলে চাপা দেওয়া হয়। অসুস্থ নাসিমের পক্ষে একঘন্টা পরেই গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ঐ কাজটা করা সম্ভব কিনা ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া নাসিমের অসুস্থতাটা যথার্থ, না সেটা ভান ছিল জানতে হবে। আবার সেই বন্ধুটি চেতনাহীন নাসিমকে, শুইয়ে দিয়ে গিয়ে তার গাড়িটা নিয়ে ঐ কীর্তি করেছে কিনা কে জানে? অথবা এমনও তো হতে পারে, নাসিম ও তার সেই বন্ধুটি দুজনই এ ব্যাপারে জড়িত আছে। অসুস্থতার ভানটা নাসিম স্রেফ অ্যালিবাই হিসেবে ব্যবহার করছে, এটাও অসম্ভব নয়। আবার কুয়াশার হুমকির কথাও ভেবে দেখতে হবে। সুতরাং এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছিনে।’ | শহীদের দীর্ঘ বিশ্লেষণে মিসেস আজিম মুগ্ধ হলেন। বিস্ময়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। পরে বললেন, রাতে যে বন্ধু ওকে বাসায় নিয়ে এসেছিল সে কে?
অবশ্য আমি নাসিমের বন্ধুদের বড় একটা চিনি না।’ ‘এই মুহূর্তে নামটা আমি বলতে পারছিনে।
তার মানে, নামটা আপনি এখনও জানতে পারেননি!
গাড়িতে চাপল শহীদ। সে বলল, জানতে পেরেছি নিশ্চয়ই। কিন্তু বলা সম্ভব নয়। আচ্ছা, চলি এবার। মুরাদ সাহেব, চলি আমি।’ শহীদের গাড়িতে গতি সঞ্চারিত হল। গাড়িটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
মুরাদ বলল, আমিও চলি, ম্যাডাম।’
আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমার সামান্য কেনাকাটা আছে। যদি অসুবিধা না হয়… স্মিতহাস্যে বললেন মিসেস আজিম।
কিছু মাত্র না, বিগলিত হল আবু মুরাদ।
আসুন তাহলে, বসবেন। আমি কাপড়টা পাল্টে আসি। ৯৬
ভলিউম-৮
;;
পাঁচ
শহীদ সোজা চলে গেল হোটেল সোনিয়ায়। শাহানারাকে একটা কথা বলা দরকার। কুয়াশার ব্যাপারটা তার কানে নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। ওর প্রতিক্রিয়াটা কি, সেটাও জানতে হবে। আর মিসেস আফরোজার খোঁজ কোথায় পাওয়া যাবে সে হদিসটাও দিতে পারে হয়ত।
বাইরে গাড়ি রেখে ভিতরে ঢুকল শহীদ। কাউন্টারে একাই ছিল শাহানারা। ফোনে কথা বলছিল। শহীদ ধীরে ধীরে গিয়ে সামনে দাঁড়াল। শাহানারা ওকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেল এবং তারপর ওর মুখটা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল।
শহীদ বুঝতে পারল, শাহানারাও বিশ্বাস করেছে গুজবটা। বেশ চমৎকার কাজ দিয়েছে!
রিসিভার নামিয়ে রেখে পেশাদারি ভঙ্গিতে শাহানারা শহীদকে জিজ্ঞেস করল, মি., হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’
হাসল শহীদ।
আপনি বোধহয় শুনেছেন…?”
হ্যাঁ, আমারই ভুল হয়েছিল। অবশ্য না জেনেই ভুল করেছি আমি। যে লোকটাকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম সেই আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। সে যে এমন মানুষ তা আমি ভাবতেও পারিনি!’ মৃণায় শাহানারার মুখটা কুঞ্চিত হয়ে গেল। এরপরে আপনাকে বলবার আমার কিছুই নেই। উঃ, এ যে কল্পনাতীত!’
শহীদ মৃদু হেসে বলল, ‘পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যা আমরা কল্পনা করতে পারি না। সে যাক, মিসেস আফরোজাকে কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারেন? | ‘আমি সঠিক জানি না। তাছাড়া এ সম্পর্কে আমার আর কোন উৎসাহ নেই। নাসিমের কপালে যা আছে হবে। আমাকে মাফ করুন।
| শহীদ আর যন্ত্রণার্ত মেয়েটাকে ঘাটাল না। বেরিয়ে গেল। বাসায় ফিরতেই শহীদ দেখল, ড্রইংরূম আলোকিত করে বসে আছে শ্রীমান কামাল আহমেদ। আসতে আজ্ঞা হোক, আসতে আজ্ঞা হোক,’কলরব করে উঠল সে।
“কিরে, কি শিকার করলি?” ঠাট্টা করল শহীদ।
তুই কি শিকার করলি তাই বল, হাতে কি ওটা?
‘এখনও শিকার পাইনি। টারগেট প্র্যাকটিস করছি মাত্র। পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। হাতের প্যাকেটটা নামালো সে।
মানে, শিকার ধরাশায়ী হবার সময় এসেছে? ৭-কুয়াশা-২৩
একেবারে এসে পড়েনি। আসি আসি করছে। ওদিকের খবর কি? আমি তোকে যা করতে বলেছিলাম করেছিস?’
‘পারলাম কোথায়? তোর ফোন পেয়েই তো ছুটলাম প্লাইউড হোটেলে। ড. আজিম তখন অলরেডী রওয়ানা হয়ে গেছেন, রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম। তার সাথে দেখা হল না। মিসেস আজিমকে অবশ্য আমি দেখেছি। ভদ্রমহিলা তখন পি. আই এ-র বুকিং কাউন্টারের সাথে ফোনে ঝগড়া করছিলেন। রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে আর ভদ্রমহিলাকে ঘাটালাম না। তবে হ্যাঁ, ভদ্রমহিলা বটে। একেবারে উঁশা পেয়ারা!’
আই কামাল, এসব কি হচ্ছে?’
‘অশ্লীল হয়ে গেল বুঝি? আই উইথড্র। তা তুই ওটা কি বয়ে আনলি? তা তো, বললিনে?’ |
ভাল কথা, দেখ তো দোস্ত, দ্রব্যটা কি? তুই আবার এসবের কদর বুঝিস। ঢাকনাটা খুলল কামাল।
“এটা হচ্ছে, হাই ফাইড়ালিটি টেপ-রেকর্ডার। স্পীড বাড়ানো কমানো যায়। সেকেণ্ডে প্রায় পৌনে দুই ইঞ্চি টেপও রেকর্ড করা যায়। আবার তিন ইঞ্চিও রেকর্ড করা যায়। প্রথম ক্ষেত্রে তা লং প্লেয়িং টেপের স্কুলের একদিকে তিন ঘন্টা চলবে।
‘তুই তো বিদ্যেটা ভাল করেই রফত করেছিস দেখছি? দেখা তো কিভাবে, চলে?’
তার প্রাপ্তে লাগাতে লাগাতে কামাল বলল, এটা হচ্ছে লেটেস্ট মডেল । এতে লং প্লেয়িং টেপের একটা দিক ইচ্ছে করলে দেড়ঘন্টাও কাজে লাগানো যায়। আবার তিন ঘন্টার বেশিও কাজে লাগানো যায়।
‘গতির এই তারতম্যের কারণ?
“কিছুই না। বিশ্বস্ততার ব্যাপার, মানে নির্ভুলতার জন্যে। যাকে বলে ফাইডালিটি। গানের জন্যে সাড়ে সাত ইঞ্চিই যথেষ্ট। আবার যেখানে মানুষের নির্ভুল কণ্ঠ শুনতে চাও সেক্ষেত্রে সেকেণ্ড পৌনে চার ইঞ্চি টেপ ব্যবহার করলেই চলবে। তবে সেকেণ্ডে পৌনে দুই ইঞ্চি টেপ-রেকর্ড করলেও চমৎকার কাজ দেবে।
চমৎকার জিনিসটা তাহলে? সুইচ টিপল কামাল। টেপের শুলটা ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল। লিসনিং হেড স্পর্শ করে অন্য লটাতে জড়িয়ে যেতে লাগল টেপ । চুপ করে অপেক্ষা করলো দু’জন ।
বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে যাবার পর কামাল বলল, “দুত্তোর ছাই, কিছুই নেই।’
চলুক না, দেখা যাক। সবুরে মেওয়া ফুলতেও পারে।
আরও কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল। ৯৮
ভলিউম-৮
বিরক্ত হল কামাল, বললুম তো, কিছু নেই।
শহীদ কিছু বলল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল।
তবে উল্টোদিকে কিছু থাকতে পারে। দেখব নাকি? এটা হচ্ছে হাফ ট্রাক রেকর্ডিং। অর্থাৎ টেপের একদিকে অর্ধেকটা পুল ঘুরিয়ে দিয়ে টেপের উল্টোদিকে টেপের অপর অর্ধাংশেও রেকর্ড করা যায়। অর্থাৎ রেকর্ডিং ট্র্যাকটা দুই ভাগে বিভক্ত।
উল্টে দিয়ে দেখ না তাহলে? যদি কিছু মেলে?’
মেশিনটা বন্ধ করে দিয়ে পুলটা উল্টে দিল কামাল। মেশিনটা চালিয়ে দিল আবার। অনেকক্ষণ কিছুই শোনা গেল না। অবশেষে এক সময় হঠাৎ মেশিন থেকে নারীকণ্ঠ শোনা গেল,…আর পারি না আমি! অসহনীয় লাগছে আমার…। তুমি কি করে…?” আর শোনা গেল না। নিঃশব্দে ঘুরতে লাগল স্কুল।
কামাল সুইচ অফ করে প্লাগ খুলে ফেলল।
শহীদ তখন টেপের নারী কণ্ঠটার কথা ভাবছিল। কণ্ঠস্বরটা সে চিনতে পারেনি। কিন্তু উচ্চারণ ভঙ্গিটা তার পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল।
কামাল বলল, কিরে, গলাটা কার, বুঝলি?’ “ঠিক বুঝতে পারছিনে। ঐ বাক্সটা কি, দ্যাখ তো?’
বাক্সটা খুলল কামাল। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। আরে, এ যে দেখছি ওয়াল-সুপার!
“সে আবার কি?
অত্যন্ত সেনসিটিভ মাইক। দেয়ালে লাগিয়ে দাও, পাশের রুমে কেউ যদি নিচু গলাতেও কিছু বলে তাও অ্যামপ্লিফায়েড হয়ে টেপে চলে যাবে। টেপ যখন সেকেণ্ড হেডে চলে যাবে তখন ইয়ারফোনে প্রত্যেকটা কথা শুনতে পাবে। টেপে আমরা ঐরকম সুপ করা রেকর্ডই শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। সুপিং করে সেটা শুনে নিয়ে ইরেজিং হেড দিয়ে ঘষে মুছে ফেলা হয়েছে। অসাবধানতাবশত সামান্য দু’একটা কথা মুছে যায়নি। ঐটুকুই আমরা শুনেছি।
শহীদ ভাবতে লাগল। এই রকম সুপিং করার কি দরকার হয়েছিল নাসিমের, সে বুঝতে পারল না। হয়ত কোন মেয়েঘটিত ব্যাপার আছে। শাহানারার গলা ওটা নয়। এমনও হতে পারে, কোন কারণবশত সে কোন মহিলার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিল। খুনের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, কে জানে।
সিগারেটের শেষাংশটা ছাইদানিতে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ। চল, খাবি আমার সাথে? কুয়াশা-২৩
T
ছয়
করাচীর আনজীবী ইমদাদ রিজভী সাহেব আরও তিনদিন পরে এসে পৌঁছুলেন। ইতিমধ্যে মামলার তারিখ পড়েছে । চার্জশীট দাখিল হয়েছে কয়েকদিন আগেই।
অতিরিক্ত দায়রা আদালতে চলে গেছে নথি-পত্র ।।
রিজভী সাহেব অবস্থান করছেন হোটেল সোনিয়াতে। তাকে দেখাশোনার জন্যে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আর মুরাদকে ব্যস্ততার দরুন শহীদ বিমানবন্দরে রিজভী সাহবকে সম্বর্ধনা জানাতে যেতে পারেনি। সন্ধ্যার পর সে যখন তার সাথে দেখা করতে গেল তখন আগের উকিল নীরেন সেন রিজভী সাহেবকে কাগজ-পত্র বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
| আবু মুরাদ শহীদকে নিয়ে গেল রিজভী সাহেবের রূমে। উভয়ের মধ্যে। পরিচয়পর্ব শেষ হল। উকিল সাহেবের বিরাটাকায় চেহারা দেখে ছেলেবেলায় দেখা গোরা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেনের কথা মনে পড়ল তার। সেই রকমই ধবধবে। গৌরবর্ণ, লম্বা-চওড়া। পার্থক্যের মধ্যে, ক্যাপ্টেনকে দেখেই মনে হত, সে রেগে । আছে, আর রিজভী সাহেবের চেহারায় কোন নির্দিষ্ট ভাবের চিহ্ন নেই। কেমন যেন একটা ভাবলেশহীন, চরিত্রহীন চেহারা। বয়স আন্দাজ চল্লিশ। দু-একটা চুলে, পাক ধরেছে। ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়া চুল। সিঁথি মাথার ঠিক মাঝখানে ভেঙে যাওয়ায় আলো গিয়ে মাথার চামড়ায় পড়ে চকচক করছে। চোখের নিচে একটা বড় আকারের তিল। চিবুকে একগুচ্ছ দাড়ি ঝাটার মত দাঁড়িয়ে আছে।
পরিচয়-পর্বের পর রিজভী সাহেব বললেন, তাহলে আপনিই সেই বিখ্যাত শহীদ খান? বসুন।
শহীদ বসল। সেই সন্ধ্যা বেলাতেই রিজভী সাহেব হুইস্কির সরঞ্জামাদি নিয়ে বসেছিলেন। নীরেন সেন সাত্ত্বিক টাইপের লোক। তার বোধহয় অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। কিন্তু উপায় কি?
রিজভী সাহেব শহীদকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেও ভাইসাহাব, এক দফে হোগা?”
মাফ কিজিয়েগা।’
“বেশ বেশ। মুরাদ সাহেব, এই সাহেবের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করুন মেহেরবানি করে।’
জ্বি, হ্যাঁ,’ উঠে গেল আবু মুরাদ।
নীরেন সেনও উঠে যাচ্ছিলেন। কেসটা ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। গোড়াতেই রিজভী সাহেবের চোহারাটা দেখে তার তেমন পছন্দ হয়নি। উকিল তো নয়, যেন কুস্তিগীর। পরে অবশ্য বুঝেছেন যে, ভদ্রলোক তার চেয়েও ভাল উকিল । ল’ অব এভিডেন্স আর ব্যালিস্টিক সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী।
১০০
ভলিউম-৮
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেসব প্রশ্ন তাকে রিজভী সাহেব করেছেন তাতে ইতিমধ্যেই তাঁর প্রতি নীরেন সেনের মনে শ্রদ্ধার ভাব এসে গিয়েছিল। তিনি নিজেও উকিল খারাপ নন, সে পরিচয়ও রিজভী সাহেব পেয়েছেন। তিনি খুশিই হয়েছেন নীরেন সেনের সাথে আলাপ করে। ঠিক হয়েছে, রিজভী সাহেবকে তিনিই মামলায় সহায়তা করবেন।
শহীদ বলল, নীরেন বাবু, চলে যাচ্ছেন নাকি? আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার কালকে কোর্টে আর একটা মামলা উঠবে। ‘এই কেসের তারিখ পড়েছে কবে?’
আগামী সোমবার। কাগজ-পত্র তৈরি?’ যতদূর সম্ভব।’ ‘কোনদিক দিয়ে এগোবেন ঠিক করেছেন?
‘আমি নতুন কিছু ভাবিনি। তাছাড়া মামলা তো উনিই কনডাক্ট করবেন, উনিই ঠিক বলতে পারবেন। আমি এখন আসি । দরকার হলে ফোন করবেন আমাকে। নম্বর দিয়ে গেছি রিজভী সাহেবকে।
চলে গেলেন নীরেন বাবু।
তারপর,’ এক ঢোক হুইস্কি পান করে রিজভী সাহেব খুব নিচু গলায় বললেন, ‘প্লীজ ডু ওয়ান থিং, মি. খান। ইস আদমী, আই মীন দ্য স্পেশাল অ্যাটেনডেন্ট, উকো হটা দো ইধার সে।
কার কথা বলছেন?”
যাকে চা আনতে বললাম। তার সার্ভিসের আমার দরকার নেই। শুনেছি, উনি আজিম সাহেবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। কিন্তু আপাতত আমি ওদের কারও সান্নিধ্য পছন্দ করছি না। কার কি ইন্টারেস্ট আছে, কে জানে! আমার কাছে এখন জরুরী নথি-পত্র আছে। এর যে কোন একটা খোয়া গেলে মর্কেলের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু মিসেস আজিম আবার স্পেশালি ঐ মুরাদ সাহেবকেই রেখে গেলেন আমাকে অ্যাটে করার জন্যে।
‘তা তাকেই বলতেন এসব কথা?
‘নেহী, নেহী। বহুত খুবসুরত লেভী! তোমাদের বাংলা ভাষায় বলে, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। অমন হ্যাঁণ্ডসাম লেডীর ইচ্ছার অমর্যাদা করব, এতটা হৃদয়হীন আমি হতে পারি না। ওসব বিশ্রী কাজ আপনাকেই করতে হবে।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল শহীদ রিজভী সাহেবের কথা বলার ভঙ্গিতে। সে বলল, “ঠিক আছে, ওটা আমিই করব । কেসের অবস্থা কি?
| ‘সেটা নির্ভর করে আপনার ফাইন্ডিং-এর উপর। অন্যথায় শুধু টেকনিক্যাল পয়েন্টের উপর দিয়ে এগোতে হবে, পান-পাত্রে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন তিনি, কুয়াশা-২৩
১০১
যতদূর মনে হচ্ছে, আসামী নির্দোষ। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ চাই।’
শহীদ একটা সিগারেট ধরাল। তারপর সে তার তদন্তের আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। রিজভী সাহেব নীরবে শুনলেন। শেষে বললেন, আপনি যেভাবেই হোক মিসেস আফরোজা রহমানের সন্ধান করুন। ভদ্রমহিলা গা-ঢাকা দিয়েছেন নিশ্চয়ই। তার অবশ্যই একটা কারণ আছে। উনি এমন কিছু জানেন যা কোন কারণে প্রকাশ করতে আপত্তি আছে তার। হয়ত তার কাছেই আছে রহস্যের চাবি কাঠি।’
আমারও তাই ধারণা। আমি অবশ্য আমার এক বন্ধুকে লাগিয়ে দিয়েছি মিসেস আফরোজার খোঁজ করার জনে।।
| চা এসে গেল। আবু মুরাদও ফিরে এল।
রিজভী সাহেব তাকে বললেন, আরে ভাই মুরাদ সাহার, মিসেস রহমানের কোন পাত্তা মিলেছে নাকি? উনি নাকি ভেগে গেছেন?
আবু মুরাদ অবাক হল। সে বলল, ভাগবেন কেন উনি! “নিশ্চয়ই ওঁকে তার বাসায় পাওয়া যাবে।’
‘আরে, না ভাই না। চিড়িয়া উড় গিয়া । আপনি দেখুন তো চেষ্টা করে, তার কোন খোঁজ পান কিনা? দেখুন না একবার বাসায় ফোন করে, যদি ফিরে এসে
কেন?’
আবু মুরাদ বেরিয়ে গেল। নিচু গলায় আলাপ করতে লাগল শহীদ ও রিজভী সাহেব।।
মুরাদ ফিরে এল মিনিট পনের পরে । সে বলল, আপনার কথাই ঠিক। মিসেস রহমান নাকি কয়েকদিন আগে কোথায় চলে গেছেন। তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে
।’
সেগর আর মুরাদ সবল
| ‘তার খোঁজ জানতে চেষ্টা করবেন দয়া করে। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি সেই লোকটা, মানে কুলী হোসেনকে দেখেছেন কখনও?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন রিজভী সাহেব।
| তার দৃষ্টির সামনে একটু সঙ্কুচিত হয়ে গেল আবু মুরাদ। সে বলল, ‘লোকটাকে দেখেছি বটে, এই হোটেলেই আসত মাঝে মাঝে। আমাদের এক রিসেপশনিস্ট আছে শাহানারা বেগম নামে। তার সাথে কথা বলতে দেখেছি।
অনেকদিন।’
শহীদ চমকে উঠল । কিন্তু রিজভী সাহেব উৎসাহিত হলেন, “তাই নাকি! সে তাহলে চেনে কুলী হোসেনকে?
‘আসল পরিচয় জানে কিনা তা অবশ্য জানি না। এমনও হতে পারে, মিথ্যা পরিচয়ে সে শাহানার সাথে আলাপ করেছে।’
‘সেটা অবশ্য সম্ভব। তা আপনাদের সেই রিসেপশনিস্ট মহিলা এখন আছেন ১০২
ভলিউম-৮
নাকি এখানে?”
, “জ্বি, না, সকালে ওর ডিউটি ছিল । তাছাড়া শুনেছি, সে নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে।
| ‘অলরেডী ছেড়ে দেয়নি তো? তাহলেই হবে। কাল সকালে তাকে পাকড়াও করব।’
ঘড়ি দেখল শহীদ। রাত নটা বেজে গেছে। এবার আমি উঠি রিজভী সাহেব?’ সে বলল ।
আরে উঠবেন তো, যাবেন কোথায়? এখন তো আজিম সাহেবের বাসায় যেতে হবে। রাত সাড়ে ন’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আপনিও যাবেন আমার সাথে। তাছাড়া..।
মুরাদ সাহেব, আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন? আমরা আজিম সাহেবের বাসায় যাচ্ছি।’
দরকার নেই। সারাটাদিন ডিউটি দিয়েছেন, এখন ঘরে ফিরে বিশ্রাম করুন গে। পথ চেয়ে বসে আছেন নিশ্চয়ই মিসেস, সহানুভূতির সুরে বললেন রিজভী সাহেব।
‘আমার ওসব বালাই নেই,’ হাসল মুরাদ।
‘আঁ, তাই নাকি! তাহলে তো আছেন মাশ, সাহেব! বিয়ে না করে ভালই করেছেন। বিয়েটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভিশাপ।’
দু’বছর আগে ডাক্তাররা যখন সাইফুল আজিম সাহেবকে অন্তত কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন তখন তিনি তাঁর নিজস্ব অফিস মতিঝিল থেকে স্থানান্তরিত করে নিজের বাসভবনে স্থাপন করেছিলেন। পরে চিকিৎসকরা যখন অকপট ভাষাতেই বললেন, তাঁর দিন ঘনিয়ে এসেছে, বড়জোর ছ’মাস পরমায়ু আছে, তিনি তখন অফিস এনে বসালেন তাঁর শয়নকক্ষে। কিন্তু ডাক্তাররা যাই বলুন, শয্যাশায়ী থেকেই তিনি তার ম্যানেজারের অকৃত্রিম সহায়তায় সাফল্যের সাথেই কোম্পানির কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অদ্ভুত তার মনোবল, অসামান্য তাঁর কর্মক্ষমতা আর কল্পনাতীত তার জিদ। দেহ জীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মনোবলে তাঁর এতটুকু ভাঙন ধরেনি।
খাস-বেয়ারা সলিম শহীদ ও রিজভী সাহেবকে সাইফুল আজিমের কাছে নিয়ে গেলেন। শয্যাশায়ী শিল্পপতিকে বর্ণহীন মোমের মত লাগছিল। উঁচু কণ্ঠা, তোড়ানো গাল, গর্তের মধ্যে বসে যাওয়া জ্বলজ্বলে দুটো চোখ, সব কিছুতেই
গুরুতর অসুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু তাঁর চিবুক আর শুকনো পাতলা ঠোঁটে দৃঢ়তার ছাপ অসুস্থতার চিহ্নকেও ম্লান করে দিয়েছে ।
আজিম সাহেব অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন। কুয়াশা-২৩
১০৩
বিছানার ঠিক পাশেই দুটো চেয়ার। বোধহয় ওদের জন্যেই রাখা হয়েছে।
শহীদ ও রিজভী সাহেব ঢুকলেন। মিসেস জোবায়দা আজিম একটা চেয়ারে বসেছিলেন। তিনিও হাসিমুখে সম্বর্ধনা জানালেন।
ওরা বসতেই আজিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘পারবেন আপনারা ছোকরা টাকে বাঁচাতে?’ তার দুর্বল কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
শহীদ মুখ খুলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আজিম সাহেব বললেন, ‘বেশি কথা আমি বলতে পারব না। অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করার সাধ্য আমার নেই। যা বলি শুনুন, বাধা দেবেন না। জোবায়দা, তুমি যাও তো, বউমা।
| আরও কাছে আসুন, আমার মুখের কাছে।’
শহীদ ও রিজভী সাহেব তাঁদের মুখটা বাড়িয়ে দিলেন আজিম সাহেবের মুখের খুব কাছে।
| ‘আমি জেদী মানুষ, এক কথার মানুষ। আমি একসময় বলেছিলাম, নাসিম যদি কখনও জুয়া বা স্ত্রীলোক-ঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ওকে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করব,’ তিনি থামলেন। তাঁর শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছিল। পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করলেন তিনি। আই ডু নাউ উইথড্র দ্যাট,ওকে বাঁচাতে হবে। ও আমাদের বংশের একমাত্র সন্তান, বংশের প্রদীপ…হি মাস্ট বি সেভড । মি. রিজভী, টাকার জন্যে ভাববেন না । ব্ল্যাংক চেক দেব আমি,’ থামলেন তিনি। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটো বুজে এল। ঠোঁট দুটো আবার একটু নড়ে উঠল।
কুয়াশার সাথে কথা বলবেন।
রিজভী সাহেব শহীদকে ইশারা করলেন, চলুন, লেটস গো।
পরদিন শহীদ ও রিজভী সাহেব গেলেন নাসিমের সাথে দেখা করতে। মাঝারি গড়ন, স্বাস্থ্যবান সুদর্শন যুবক নাসিম। চেহারাটা করুণ, হয়ত দুর্ভাবনায় । ভঙ্গিটাও কেমন যেন অলস। রিজভী সাহেব ও শহীদকে দেখে সে কোন চাঞ্চল্য প্রকাশ করল না। ভবিতব্যকে যেন সে মেনেই নিয়েছে, এমন একটা হতাশা তার চোখেমুখে যে ছাপটা ফেলেছে তা অপসৃত হল না। ধীর, ক্লান্ত পদক্ষেপে সে তার জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারটাতে বসল।
দু’জন মিলে জরীপ করল নাসিমকে।
হতাশার সুরে সে বলল, আপনারা কি মনে করেন যে, এই গোলমাল থেকে আমাকে উদ্ধার করা সম্ভব আদৌ! আমার তো মনে হয় না।’
রিজভী সাহেব জবাব দিলেন, “ইয়ংম্যান, এত বিচলিত, হচ্ছ কেন? এত হতাশ হবার কি আছে? ঘটনার রাতে কি কি ঘটেছিল তা সত্য করে আমাকে কল তাহলে তোমাকে অবশ্যই বাঁচাতে পারব।’
নাসিম তার বাঁ হাতের চেটো দিয়ে কপালটা ধীরে ধীরে মুছল। তারপর বলল, ১০৪
ভলিউম-৮
তা যদি আমি নিজেই জানতাম…!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রিজভী সাহেব তার ঝাটার মত দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বাজে কথা বোলো না। আমাদের সময় কম। ঠাট্টার সময় এটা নয়।’
তার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি হাসল নাসিম।
শহীদ বলল, ‘দ্যাখো, আমরা সবাই তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। যদি যথার্থই বাঁচতে চাও তাহলে তুমি কতটা কি জানো তা আমাদের জানা দরকার। মিথ্যে কথা বললে অথবা কোন কথা চেপে গেলে তোমার কল্যাণ হবে না। উনি
তোমার উকিল, পুলিস নন।’
| ‘কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না।’
আমার কথার জবাব দাও,’ ধমক দিলেন রিজভী সাহেব। কুল হোসেনের সাথে তোমার পরিচয় কত দিনের?
বছর খানেকের। ‘কোথায় আলাপ হয়েছিল প্রথমে?”
আমাদের হোটেলে আসত সে।’ ‘ওর আড্ডায় তুমি জুয়া খেলেছ?’
জি, হ্যাঁ।’ ‘ত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছ ওর কাছ থেকে এবং হেরেছ?’
হ্যাঁ। আড্ডার লোকগুলোর হাতের প্যাঁচে•••|| ‘সেটা আমি জানতে চাইনি। টাকাটা শোধ দিয়েছ? ‘দিতে পারিনি।’ ‘এই ঘটনা কতদিনের?’
মাস তিনেক হবে। তবে একদিনের নয়, একসঙ্গে তো আর অত টাকা ধার নিইনি।
‘ফেরত দিয়েছ কত টাকা?
‘এক পয়সাও না। সে একসঙ্গে সব টাকা চেয়েছিল। ১০ মার্চের মধ্যে টাকাটা শোধ দিতে বলেছিল । অন্যথায় পরিণাম খারাপ হবে বলে শাসিয়েছিল।
কি ধরনের পরিণাম হবে তার কোন আভাস দিয়েছিল?’ | কুলী হোসেন বলেছিল যে, সে আমার চাচাকে জানাবে। তাছাড়া আমাকে খুন করতেও তার বাধবে না। খুন নাকি সে অনেক করেছে।’ | ১০ মার্চ সন্ধ্যায় হোটেল সোনিয়ার পার্টিতে তুমি কি তোমার ছোট চাচী ও মিসেস আফরোজা রহমানের কাছে টাকার ব্যাপারটা তুলেছিলে এবং ড. আজিমের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে দেবার জন্যে ওদের অনুরোধ করেছিলে?
করেছিলাম।
জবাব কি পেয়েছিলে?” কুয়াশা-২৩
১০৫
‘ছোট চাচী বলেছিলেন, তিনি চাচাকে বলবেন, চাচা নিশ্চয়ই রাজি হবেন। বলতে গেলে তিনি আমাকে ভালরকম আশ্বাসই দিয়েছিলেন।
আর মিসেস রহমান?’ উনি উল্টো আমাকে বকেছিলেন? ‘পার্টি শেষ হয়ে গেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
বড় চাচার বাসায়। সেখান থেকে গিয়েছিলাম কুলী হোসেনের আড়োয়। ওর দেখা পাইনি। দিন সাতেক আগে ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল । ভেবেছিলাম, টাকাটার জন্য সেদিন সে নিজেই আড্ডায় থাকবে। কিন্তু এল না। ওর অপেক্ষায় খেলতেও বসেছিলাম। খেলতে বসে দু’পেগ হুইস্কি পান করেছিলাম। দ্বিতীয় পেগটা খাবার পর থেকেই আমার কেমন যেন সুস্থ মনে হতে লাগল। ক্রমেই অসুস্থতা বাড়তে লাগল। সব জিনিসই যেন দুটো করে দেখতে লাগলাম । কেমন যেন বমি বমি ভাব লাগছিল, মাথাটাও স্থির রাখতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম।
‘তোমার কি মনে হয়, মদের সাথে আর কোন দ্রব্য খাইয়েছিল?’ এখন তো আমার তাই মনে হচ্ছে। তবে তখন তা মনে হয়নি।’ তারপর কি করলে?” ‘সোজা বাসায় চলে গেলাম। ‘মিথ্যা কথা বলো না!’ গর্জন করে উঠলেন রিজভী সাহেব। নাসিম মাথা নত করল।
সত্যি কথাটা বল।’ কোন জবাব দিল না নাসিম।
‘তুমি হোটেল সোনিয়াতে গিয়েছিলে। সেখান থেকে এক ইয়ং লেডী তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। ঠিক না?’
মাথা নাড়ল নাসিম।
তুমি যখন জুয়োর আড্ডা থেকে বেরোও তখন কটা বাজে? দশটার বেশি হবে। ‘জুয়োর আড্ডায় তোমার পরিচিতদের মধ্যে কাউকে দেখেছিলে?
‘আমার দু’একজন বন্ধু আগে যেত। আমার অবস্থা দেখে ওরা সরে পড়েছে। তবে মুরাদকে মাঝে মাঝে দেখতাম।
কাকে?” মুরাদকে। আবু মুরাদ। চাচার প্রাইভেট সেক্রেটারি । সে কি!’ শহীদ বিস্ময় প্রকাশ করল। সে নাকি কুলী হোসেনকে চেনেই না!
‘তোমার কি মনে হয়, সেই তোমাকে মাদক দ্রব্য খাইয়েছিল?’ রিজভী সাহেব প্রশ্ন করলেন।
১০৬
ভলিউম-৮
তা হবে কি করে? সে তো তখন স্টেশনে, ওর ময়মনসিংহ যাবার কথা ছিল।’
হু, তাহলে কাকে সন্দেহ কর?” কুলী হোসেনকে সন্দেহ হয়। হয়ত সেই কাউকে বলে দিয়েছিল।
মুরাদ ছাড়া আর কোন পরিচিত লোককে তুমি জুয়ার আড্ডায় দেখনি?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাসিমের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন রিজভী সাহেব। “ ইতস্তত করল নাসিম কিছুক্ষণ। তারপর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল, নৃ-না । আর কাউকে দেখিনি।
শহীদ বুঝল, মিথ্যে বলছে নাসিম । তাহলে কে সে? শাহানারা?
‘একথা কি ঠিক যে, কুলী হোসেন বাড়াবাড়ি করলে তুমিও তাকে দেখে নেবে বলে পার্টিতে তোমার চাচীর কাছে বলেছিলে, আর এই জন্যেই নাকি তুমি তোমার গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে সবসময় রিভলভার রেখে দিতে?’
বলেছিলাম বটে একথা,’ স্বীকার করল মাসিম।
আর একটা কথা–তোমার জানা নেই বোধহয় যে, মিসেস আফরোজা গা ঢাকা দিয়েছেন?
‘সে কি! কেন? বিস্ময় প্রকাশ করল নাসিম। ‘সেটাই আমরা জানতে চাই। তোমার কোন আইডিয়া আছে? কিছুমাত্র না।
‘তোমার বাথরূমের ক্লজিটে যে টেপ-রেকর্ডার আর ওয়াল-সুপার পাওয়া গেছে সেগুলো কি তোমারই?
‘কি পাওয়া গেছে? ‘টেপ-রেকর্ডার ও ওয়াল-স্ব পার।’
‘আমার ক্লজিটে টেপ-রে র্ডার! আকাশ থেকে পড়ল যেন নাসিম। না, আমার টেপ-রেকর্ডার নেই। ৰ খনও ছিল না। তাছাড়া ওয়াল-সুপার শব্দটাই শুধু আমি শুনেছি, এখন পর্যন্ত দেখিনি জিনিসটা।’
অথচ সেগুলো তোমার ক্লজিটেই পাওয়া গেছে। ‘আমি দুঃখিত। এ সম্পর্কে কিছুই আমি বলতে পারছি না। ওগুলো আমার নয়, শুধুমাত্র সেইটুকুই আমি জানি।’’
ইন্টারভিউ-এর সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। রিজভী সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, মিসেস রহমান সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে?
| ‘তেমন কিছু জানি না। ভদ্রমহিলা পশ্চিম বাংলার লোক। বাবা ছিলেন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মচারী। করাচীতে পোস্টিং ছিল। সেখানেই ওর বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানা গেল, তার স্বামী ভদ্রলোক একটা ক্রিমিন্যাল। জেল-পলাতক আসামী । বিয়ের এক সপ্তাহ পরে পালিয়ে যান তিনি। ভদ্রলোক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কুয়াশা-২৩
১০৭
বলে শুনেছি, মিসেস রহমান ঢাকা চলে আসেন। সেই থেকেই বিধবা বলে পরিচয় দিচ্ছেন তিনি। ছোট চাচা ওঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিসেস রহমানের আইনত তালাক নেওয়া হয়নি বলেই তিনি রাজি হননি। পরে চাচা করাচীতে বিয়ে করেন।’
ওয়ার্ডার এসে বলল, ‘সময় শেষ হয়ে গেছে। উঠতে হবে এবার।
সাত
মিসেস রহমানের খোঁজ শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। মীরপুরে তার এক দূর সম্পর্কের মামার বাসায় আছেন উনি। খবর পেয়েই তাঁর সাথে দেখা করতে গেল শহীদ। কামালও তার সঙ্গী হল।
ব; সড়কের উপর গাড়ি থেকে নামল দু’জন, ডাইনে কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল। এদিকটা মোটামুটি ফাঁকা। সরকারের দখল করা জমি। ইটের পাঁজা। প্রায় একশ’গজ দূরে একটা নতুন অসমাপ্ত একতলা বাড়ি। তার সামনে একটা ছোটখাট বাগান।
কামাল বলল, এই বাড়িটাই। মিসেস রহমানের মাতুলালয় এটা। এখামে বনবাসে এসেছেন তিনি।
বারান্দায় এক বৃদ্ধ সংবাদপত্র পড়ছিলেন। শহীদ ডাকল, শুনছেন?”
ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন এবং দু’জন ভদ্রলোককে গেটের কাছে দেখতে পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন।
কাকে চাই? মিসেস রহমান থাকেন এই বাড়িতে? মিসেস আফরোজা রহমান?
আশঙ্কায় ভদ্রলোকের মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ওদের দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, ‘কোত্থেকে আসছেন আপনারা?
‘পুলিস ডিপার্টমেন্ট থেকে। ‘পুলিস আপনারা?’
মিসেস রহমান এখানে আছেন, আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরিছি,’ শহীদ বলল ভদ্রলোকের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে।
দ্রলোক কাঁপাকাপা গলায় বললেন, ‘অ্যারেস্ট করতে এসেছেন। আফরোজাকে? কিন্তু মেয়ে তো আমাদের নির্দোষ!
“সে বিচার আদালত করবে। তাছাড়া আমরা ওঁকে অ্যারেস্ট করতে আসিনি।. কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।’
দ্রলোক শহীদকে বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় ১০৮
ভলিউম-৮
বললেন, ‘আসুন আপনারা।’
শহীদ ও কামালকে ড্রইংরূমে বসিয়ে ভদ্রলোক ভিতরে চলে গেলেন। মিনিট দশেক অপেক্ষা করবার পরে মিসেস আফরোজা রহমান এসে ঢুকলেন। ওরা দুজন উঠে দাঁড়াল। | মূর্তিমতী বিষাদ যেন এসে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে। মহিলা সুন্দরীই। তিরিশের মত বয়স হবে। ক্লান্ত বিষণ্ণ চেহারা। মাথা ভর্তি তৈলহীন অবিন্যস্ত চুল। বড় বড় চোখ দুটো ফোলা ফোলা, সম্ভবত অত্যন্ত কান্নাকাটির ফলেই । এমন একটা মূর্তি দেখতে হবে তা ওরা কল্পনাই করেনি। এই বিষণ্ণতা নকল নয়। একে প্রশ্ন করা যে মড়ার উপর খাড়ার ঘা দেবার সামিল তা-ও ওরা বুঝতে পারল । কিন্তু কেন এই কান্না? কেন তার এই বেদনা? ভদ্রমহিলা কেন অন্তর্ধান হয়েছেন, কেনই বা লোকচক্ষুর আড়ালে চোখের পানি ফেলেছেন?
ছোট্ট একটা আদাব দিলেন মিসেস রহমান। তারপর অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বললেন, বসুন। পুলিসের পক্ষ থেকে এসেছেন, তা কারণটা জানতে পারি কি?’
তিনজনই বসল।
শহীদ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘প্রথমেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার মিথ্যা ভাষণের জন্য। আমি পুলিসের লোক নই। আমার নাম শহীদ খান, আমি একজন সৌখিন গোয়েন্দা। ইনি আমার বন্ধু, কামাল । আপনার সাথে আমাদের দেখা করা অত্যন্ত প্রয়োজন বলেই মিথ্যা পরিচয় দিতে হয়েছিল। তাছাড়া আরও একটা কারণে ক্ষমা চাইব। আমার মনে হচ্ছে, যে বিশ্রী দায়িত্ব পালন করতে আমি এসেছি তা আপনার পক্ষে সুখকর হবে না। হয়ত বেদনাদায়ক হবে। অথচ উপায় নেই।
কলী হোসেন হত্যা-মামলার কানেকশনে এসেছেন আপনারাই বলুন, যা জিজ্ঞেস করার আছে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু বিশ্বাস
করুন, আমি কিছুই জানি না।’
মিসেস রহমানের চোখের দিকে তাকাল শহীদ, তাহলে আপনি এমনভাবে গা-ঢাকা দিয়েছেন কেন? কোন সাক্ষী যদি পালিয়ে যায় তাহলে আমাদের কাজ হল, পলায়নের কারণটা নির্ণয় করা।
মিসেস রহমান কোন জবাব দিলেন না। শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে লাগলেন তিনি।
আমাদের উকিলের ধারণা, কুলি হোসেন হত্যা মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হচ্ছেন আপনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নাসিম নির্দোষ। অথচ তার নির্দোষিতা
প্রমাণ বহুলাংশে আপনার উপর নির্ভর করছে।
“কিন্তু আমি যে কিছুই জানি না! বললেন মিসেস রহমান। তার কণ্ঠে অসহায়তার সুর। কুয়াশ-২৩
১০৯
17,
শহীদ স্থির দৃষ্টিতে মিসেস রহমানের দিকে তাকাল। তারপর অতি নিচু গলায় অথচ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলল, দেখুন মিসেস রহমান, আপনার সন্ধান যখন আমরা পেয়েছি তখন আদালতে আপনাকে আমরা সাক্ষী মানবই এবং তখন উকিলের জেরার কাছে আপনি টিকতে পারবেন না।’
ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখা দিল। মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
আমাকে, আমাকে আদালতে দাঁড়াতে হবে! ‘হ্যাঁ, সাক্ষীর কাঠগড়ায়।’
“না না!’ অস্ফুট কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন ভদ্রমহিলা। “প্লীজ, শহীদ সাহেব, এতটা নিষ্ঠুর হবেন না। আপনারা কি বুঝতে পারছেন না যে কাঠগড়ায় দাঁড়াবার ভয়েই আমি আত্মগোপন করে আছি?’।
| কিন্তু তাতে করে যে নির্দোষ একটা লোকের ফাঁসী হয়ে যেতে পারে। সেটা কি আপনার কাম্য?’
শহীদের প্রশ্নের জবাব দিলেন না মিসেস রহমান। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে করুণকণ্ঠে আবেদন জানালেন, “প্লীজ, আমাকে মাফ করুন। | তা হয় না, মিসেস রহমান। একটা নির্দোষ লোকের জীবন শুধু আপনার। খামখেয়ালীতে ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না।’
আমি যদি বলি যে, নাসিমই খুন করেছে, তাহলে?’ ফোঁস করে উঠলেন মিসেস রহমান।
‘সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে তাই বলবেন। কিন্তু সত্য ঘটনা আপনি জানেন।’
মাফ করবেন, আমি কিছুই বলতে পারব না। দরকার হলে আদালতেই যা বলবার বলব।’
| ‘বেশ, তবে সেই ভাল। তবে আমাদের কাছে আগে সত্যটা প্রকাশ করলে অনেক হেনস্তা, অনেক হয়রানি থেকে রক্ষা পেতেন। আমরা এখন গিয়ে পুলিসকে আপনার ঠিকানা দেব। আয় কামাল, ওঠ।
উঠে দাঁড়াল শহীদ। কামালও উঠে দাঁড়াল। মিসেস রহমান গমনোদ্যত অতিথিদের ডাকল, শুনুন।
বলুন?’ দাঁড়াল শহীদ। বসুন আপনারা।’
দ্যাটস্ লাইক এ গুড গার্ল।’ বলদ শহীদ। বস কামাল। বলুন, মিসেস রহমান?”
আমি একজনকে রক্ষার জন্যে আত্মগোপন করে রয়েছি। আমতা আমতা করে বলল মিসেস রহমান।
১১০
ভলিউম-৮,
কে সে? কুলী হোসেন? মিসেস রহমান প্রশ্নটা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, তিনি তো মারাই গেলেন। তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল ।।
‘তাহলে কে? ড. আজিম?’
মুহূর্তের জন্যে মনে হল, মিসেস রহমান অস্বীকার করবেন। তারপর তিনি মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ,তাকেই।
‘বেশ, তাহলে আসল ঘটনাটা খুলে বলুন?’
“আমি খুব ভাল মিথ্যাবাদী নই, শহীদ সাহেব। অনেকবার মিথ্যা বলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু বলতে পারিনি।’
তা বুঝতে পারছি। ‘কিন্তু মিথ্যে পরিচয় দিয়ে সমাজে তো নির্বিঞ্চে বসবাস করে আসছেন।
মুহূর্তের মধ্যে ক্রোধে লাল হয়ে উঠল মিসেস রহমানের মুখ । তিনি তীব্রকণ্ঠে বললেন, ‘ওকথা বলবার কোন অধিকার আপনার নেই, শহীদ সাহেব।’
শহীদ প্রতিবাদ করল না। কুলী হোসেন আপনার স্বামী ছিলেন?’ পাল্টা আক্রমণ চালাল সে ।
বিস্ময়ে ও ক্রোধে মিসেস রহমান বাকহীন হয়ে গেলেন। কি যেন বলতে গেলেন। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। তার মুখটা ধীরে ধীরে মোমের মত সাদা হয়ে গেল ।
জবাব দিন?’ কঠোর শোনাল শহীদে কণ্ঠস্বর। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন মিসেস রহমান। আঁচলে মুখ লুকালেন তিনি।
শহীদ সিগারেটের প্যাকেট বের করল। কামালকে সিগারেট দিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরাল।।
কাঁদছেন, মিসেস রহমান। কাঁদতে দাও ওঁকে। একটু শান্ত হোক। আবেগের প্রাবল্যের অবসান হোক। দুর্বল মুহূর্তে সমস্ত সত্য তাঁর মুখ দিয়ে আপনাআপনি
বেরিয়ে আসবে।
নীরবে. সিগারেট টানতে লাগল শহীদ।
কয়েক মিনিট পরে মিসেস রহমান আত্মস্থ হলেন। আঁচলে মুখ মুছে বললেন, ‘ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল।
তালাক হয়নি?
আর সেই জন্যেই আপনি ড. আজিমকে বিয়ে করেননি? ‘জি, হ্যাঁ। ‘আপনি তালাক চেয়েছিলেন?
না। মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়, শহীদ সাহেব। কুয়াশা-২৩
কিন্তু সে যে ক্রিমিন্যাল। অবাক হয়ে গেল শহীদ। | কি বিচিত্র রমণী মন! কামালও অবাক হয়ে মিসেস রহমানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেল সে।
‘হোক ক্রিমিন্যাল, কিন্তু সে তো আমার স্বামী। পৃথিবীর সবাই যদি তাকে ঘৃণা করে তাহলেও আমি তাকে ক্ষমা করব।
| ‘ওহ, তাহলে এই জন্যেই আপনি নাসিমের নির্দোষিতা প্রমাণে এগিয়ে যেতে চান না? এই জন্যেই আপনি গা-ঢাকা দিয়েছেন?’ শহীদ কঠিনস্বরে বলল।
মিসেস রহমান মাথা নাড়লেন ।
না, তা নয়। আমি একজনকে বাঁচাতে চাই, তাই আমি লুকিয়ে আছি।’ ‘ড. আজিমকে?’
হ্যাঁ।
• কিন্তু কেন?”
‘সবই বলব। আপনাদের কাছে কোনকিছুই লুকোব না। আপনারা বাধা। দেবেন না আমাকে। আমার মত করে বলতে দিন। কিন্তু সকলের আগে একটা কথা আপনাদের জানানো দরকার।
বলুন?’
নাসিম সেরাতে যাকে খুন করেছে বলে বলা হচ্ছে তিনি, অবাক হবেন না আপনারা, কুলী হোসেন নন।
ভীষণভাবে চমকে উঠল শহীদ ও কামাল।
হোয়াট,’কামাল চিৎকার করে উঠল। কি বলছেন আপনি!’ আকাশ থেকে যেন পড়ল শহীদ। ‘ঠিকই বলছি আমি। ও লাশটা আমার স্বামীর নয়, অন্য কারও।
শহীদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। সে বলল, লাশটা কুলী হোসেনের নয়! অন্য লোকের? এ আপনি কি বলছেন! লাশ যে যথারীতি সনাক্ত করা হয়েছে, অবিশ্বাসের সুর তার কণ্ঠে।
কান্নার চেয়েও করুণ হাসি হাসলেন মিসেস আফরোজা রহমান। বললুম তো, আমাকে বাধা দেবেন না। আপনারা ভাল করে তদন্ত করলেই আমার বক্তব্যের সত্যতা প্রকাশিত হবে।
‘তাহলে কার লাশ ওটা?’
তা আমি বলতে পারছিনে। যতদূর মনে হয়, তাদের গ্যাংয়ের কোন লোক হবে। লোকটা যে কে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার।’
‘কুলী হোসেন তাহলে কবে মারা গেছে?’
ঐ ঘটনার পাঁচ সাতদিন আগে।
কিভাবে? ১১২
ভলিউম-৮
তাকেও খুন করা হয়েছে।’ “কেন, সে সম্পর্কে কোন ধারণা আছে?
‘পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিল সে, অপরাধী জীবনের উপর তার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। জীবনটাকে তার দুর্বিষহ, যন্ত্রণা-পীড়িত বলে মনে হচ্ছিল। আপনারা কুয়াশার নাম শুনেছেন?’
শুনেছি। আমি যা করতে পারিনি উনি সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন। ‘যেমন?
‘ওকে ভাল হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনিই। অথচ লোকে জানে, কুয়াশাও একটা ক্রিমিন্যাল। এটা কতবড় মিথ্যা!
তারপর?
কুয়াশা বলেছিলেন, সরকার যাতে ওকে ক্ষমা করেন তার জন্যে উনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।’
তাহলে সেটাই আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ? কিন্তু কে তাকে হত্যা করেছে, সে সম্পর্কে কোন ধারণা আছে আপনার?
| সঠিক ধারণা নেই। তবে সম্ভবত ওদের দলপতির নির্দেশেই এটা হয়ে থাকবে।’
‘দলপতিকে চেনেন? মানে, কুলী হোসেন সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলেছিল?’
, এ ব্যাপারে সে খুব চাপা ছিল । তাছাড়া ও প্রসঙ্গ তুললেই সে খুব ভয় পেতো। তার নাম তো দূরের কথা, তার প্রসঙ্গও কখনও তুলত না। লোকে জানত, সে-ই দলপতি। কিন্তু আসলে দলপতি ছিল অন্য লোক ।.
আপনার সাথে নিয়মিত দেখাশোনা হত আপনার স্বামীর?”
ছয়মাস আগে আমি ওকে আবিষ্কার করি। ওর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল ছয় বছর আগে। নতুন করে ওকে দেখতে পাবার পর থেকে প্রায়ই দেখা হত। তখন থেকেই সে তার পঙ্কিল জীবন থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে হাঁসফাস করছিল। কিন্তু তার পরিণাম কি হবে তা সে জানত। তাই আমার শত উৎসাহতেও সে সাহস পেত না। শেষটায় কুয়াশা ভরসা দিয়েছিলেন ওকে।
আপনার স্বামীর মৃত্যুর খবর কুয়াশা জানে?’ উনিই আমাকে খবরটা দিয়েছিলেন।’ অনেকক্ষণ তিনজনই চুপ করে রইল।
সমস্ত ব্যাপারটায় অদ্ভুত রকমের গোলযোগ পাকিয়ে গেছে। শহীদ জট অনেকটা ছাড়িয়ে এনেছিল কিন্তু মিসেস রহমানের কাছে যে অচিন্তনীয় কাহিনী সে শুনল তাতে করে সমস্ত ব্যাপারটা আরও প্রহেলিকাময় বলে মনে হতে লাগল তার কুয়াশা-২৩
কাছে ।
নীরবতা ভঙ্গ করে সে বলল, কিন্তু তাতে করে আসল সমস্যার তো সমাধান হচ্ছে না?”
কামাল বলল, কেন নয়? লোকটা যদি কুলী হোসেন না হয়ে অন্য কেউ হয় তাহলে নাসিমের হত্যার কোন মোটিভই থাকতে পারে না। সুতরাং তাকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করা কঠিন হবে না।’
শহীদ হেসে বলল, ব্যাপরটা অত সহজ নয়। সে ক্ষেত্রেও মোটিভ থাকতে পারে নাসিমের। কারণ নিহত লোকটা কুলী হোসেন না হয়ে তার কোন এজেন্ট হলেও মোটিভ একই থাকে। তাছাড়া লাশটা যে কলী হোসেনের তা প্রমাণের। জন্যে সরকার পক্ষের কৌসুলী চেষ্টার ত্রুটি করবে না। সে যাক, এখন ১০ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে আপনি কি জানেন, সেটাই আমাদের বলুন, মিসেস রহমান।
মিসেস রহমান জবাব দিলেন না। তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শহীদ। একটু পরে অধৈর্য হয়ে বলল, “ড. আজিমের বিদায় উপলক্ষে আপনি যে পার্টি দিয়েছিলেন তাতে নাসিম আপনার কাছে ত্রিশ হাজার টাকা চেয়েছিল?
আমার কাছে চায়নি। বলেছিল, আমি যেন ওর চাচাকে টাকাটার কথা বলি। আপনি কি জবাব দিয়েছিলেন?’ ‘আমি ভর্ৎসনা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এতে ওর শিক্ষা হবে। ভবিষ্যতে আর ওসব নোংরামির মধ্যে যাবে না। কিন্তু পরিণাম যে সত্যি এমন হবে, ভাবতে পারিনি।’
‘পরিণাম সম্পর্কে আভাস কিছু দিয়েছিল নাসিম?
‘তা দিয়েছিল। বলেছিল টাকাটা না পেলে কুলী হোসেন ওর চাচার কানে ব্যাপারটা তুলতে পারে, তাছাড়া খুনোখুনি করাটাও বিচিত্র নয়। সাংঘাতিক লোক ওরা। তবে সেও প্রস্তুত আছে । দরকার হলে সে দেখে নেবে।’
| ‘আর তার জন্যেই সে গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে রিভলভার রাখে, একথা সে বলেছিল?’
হ্যাঁ, বলেছিল। তখন আর কে কে ছিল সেখানে?’ ‘আমি ছিলাম আর ছিল জোবায়দা অর্থাৎ মিসেস আজিম।
আর কেউ?’
‘স্মরণ হচ্ছে না। হয়ত আর কেউ ছিল না। আবু মুরাদ থাকলেও থাকতে পারে।’
তারপর?
তারপর, •••দেখুন শহীদ সাহেব, আমি এখন এমন একটা ঘটনা বলব যা আপনাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে না-ও হতে পারে। কিন্তু পরে যদি ঠিকমত খোঁজ
১১৪
ভলিউম-৮
নেন তাহলে হয়ত আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হতেও পারে। এবং অনেকটা ঐ ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ১০ মার্চের রাতের হত্যা-রহস্যের সমাধান। তবে রহস্যের সবটা আমারও জানা নেই। গোটা ব্যাপারটাই গোলমেলে।
বলুন? ‘জোবায়দার সাথে আপনাদের আলাপ হয়েছে?”
হয়েছে।’ ‘ওর সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কি?’
‘এটা বড় কঠিন প্রশ্ন, শহীদ বলল। মাত্র একবার তার সাথে আমার কিছুক্ষণ কথা হয়েছে। একবার আলাপ করে কোন ইমপ্রেশন সৃস্টি হলে তা শেষপর্যন্ত নির্ভুল না হওয়াই স্বাভাবিক।
‘তা বটে,’ স্বীকার করলেন মিসেস রহমান। যাকে আপনারা এখন মিসেস আজিম বলে জানেন, সে ছিল লাহোরের চলচ্চিত্র জগতের একা। অপূর্ব রূপসী হলেও অভিনয় ক্ষমতা না থাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি সে। লাহোরেই ওর সাথে আলাপ হয় খুরশীদের বছর দুয়েক আগে এবং সে তাকে একেবারে বিয়ে করে নিয়ে আসে। মেয়েটার মধ্যে আছে অদ্ভুত একটা আকর্ষণী শক্তি যা দিয়ে সে সহজেই মুগ্ধ করতে পেরেছিল খুরশীদের মত খেয়ালী লোককেও,’ একটু হাসলেন মিসেস রহমান।
‘কিন্তু ইদানীং তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ জেগেছিল খুরশীদের মনে। অথচ জোবায়দা তাকে এমনভাবে বশীভূত করেছিল যে, সে তার কবলমুক্ত হতে পারছিল না। তাছাড়া স্রেফ সন্দেহের বশে কারও কোন ক্ষতি করার মত মনোবৃত্তিও তার ছিল না। এদিকে ভিতরে ভিতরে তার সন্দেহ প্রবল হয়ে উঠেছিল এবং তার ক্ষুব্ধ স্বামী প্রতিশোধের জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হাতে কোন প্রমাণ ছিল না তার। সে তালাক দেবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু কারণ তো একটা চাই? স্ত্রী যদি যথার্থই অবিশ্বাসিনী হয় তাহলে তাকে একলাখ টাকা দেনমোহর আর খোরপোষ দিতে সে রাজি নয়। এই অবস্থায় সে নিজেই স্ত্রীর সতীত্ব পরীক্ষা। করবে বলে স্থির করে। তাছাড়া স্ত্রী কার আসক্ত তাও, সে জানতে চেয়েছিল । প্ল্যানও ঠিক করে ফেলেছিল । সেই অনুযায়ী খুরশীদ ১০ মার্চে চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে কি একটা গবেষণা কাজে যাবে বলে ঘোষণা করল। সন্ধ্যায় আমি পার্টি দিলাম। সেখান থেকে খুরশীদ, মুরাদ ও জোবায়দা চলে গেল স্টেশনে। মুরাদও ঐ রাতেই ময়মনসিংহ চলে গেল।’
একটু থামলেন মিসেস রহমান। তারপর দম নিয়ে বললেন, ‘খুরশীদকে ট্রেনে তুলে দিয়ে জোবায়দা একটা ট্যাক্সিতে চাপল। ওদিকে পিছনের দরজা দিয়ে নামল খুরশীদ। আগেই এক বন্ধুর কাছ থেকে পুরানো একটা গাড়ি ধার করে স্টেশনে, নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম আমি ওর জন্যে। সেই গাড়িতে চড়ে খুরশীদ জোবায়দাকে কুয়াশা-২৩
১১৫
অনুসরণ করল।’
অর্থাৎ ট্রেনে দু’জনের একজনও রইল না, এই তো?” হা। তারপর?
‘আমি আগেই ওর পরিকল্পনা জানতাম । বারবার নিষেধ করেছিলাম, শোনননি।’
‘মিসেস আজিম কি করলেন?’
‘পুরানো শহরের একটা হোটেলে গিয়ে উঠল জোবায়দা। হোটেলটার নাম সম্ভবত জারকা।
“হ্যাঁ, ইমামগঞ্জে ঐ নামে একটা হোটেল আছে শুনেছি, কামাল বলল ।
তারপর?’ তার প্রেমিক ছিল সেখানেই। “ড. আজিম, কোথায় ছিলেন?
‘পাশের রুমটা খালি ছিল । সেখানে সে তার থাকবার ব্যবস্থা করে ফেলল। রূমে ঢুকেই দেয়ালে একটা সুপার লাগিয়ে দিল সে। আর ছিল তার সঙ্গে একটা টেপ-রেকর্ডার। ওদের সমস্ত কথাই রেকর্ড হতে লাগল । ইয়ারফোনে সমস্তটাই সে শুনল।’
আপনি সাথে ছিলেন?’ ‘আমি! আঁতকে উঠলেন মিসেস আফরোজা রহমান।
মাফ করবেন, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? আমাকে সে পরে জানিয়েছে।’ চট্টগ্রাম থেকে?
“না, আগে শুনুন। কিছুক্ষণ পরে জোবায়দা চলে গেল। বলে গেল, সে ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসবে। নাসিমকে জানিয়ে আসবে যে, সে তার মামার বাসায় যাচ্ছে।’
তারপর? | ‘সেখানেই খুরশীদ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বসল। সে ভাবল যে, সে পাশের রূমে গিয়ে লোকটাকে মোকাবেলা করে তাকে বেকায়দায় ফেলে একটা বিবৃতি আদায় করবে এবং তার ভিত্তিতে সে জোবায়দাকে তালাক দেবে। তাছাড়া লোকটা কে, তাও জানতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। কুলী হোসেন নামটা সে হোটেলের রেজিস্টারে দেখেছে। কিন্তু তার সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না খুরশীদের। কুলী হোসেনের রূমটায় তখন স্নান নীল বাতি জুলছিল। খুরশীদ রূমে ঢুকতেই লোকটা তার চোখের উপর অত্যন্ত শক্তিশালী, ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে দিল । তীব্র আলোয় খুরশীদ মুহূর্তের জন্যে একেবারে অন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু লোকটা তাকে চিনতে
ভলিউম-৮ ১১৬
পারল। বুঝতে পারল, ক্রুদ্ধ স্বামী তার উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে । খুরশীদের দৃষ্টি স্বাভাবিক হবার আগেই সে খুরশীদের দিকে একটা চেয়ার ছুঁড়ে মারল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। খুরশীদ পকেট থেকে রিভলভার বের করে লোকটাকে ভয় দেখাতে লাগল। রিভলভারটা নাসিমের। সেটা সে নাসিমের গাড়ি থেকে আগেই সরিয়েছিল । নাসিম জানত না। লোকটা রিভলভারটা ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল এবং ধস্তাধস্তির ফাঁকে একটা গুলি বেরিয়ে গেল সেটা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পড়ে গেল লোকটা। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে দেরি হল না খুরশীদের। গুলির শব্দ শুনে যদি কেউ এগিয়ে আসে তাহলে সে ধরা পড়বেই। সুতরাং সে হোটেল থেকে দ্রুত বেরিয়ে সোজা চলে এল আমার বাসায়। ঘটনাটা আমাকে খুলে বলল এবং সেই রাতেই সে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ভৈরব চলে গেল। সেখান থেকে অন্য একটা ট্রেনে চট্টগ্রাম পৌঁছুল। যাবার সময় বারবার করে আমাকে বলে গেল, পরদিন সকালেই যেন জোবায়দা বোরখা পরে চট্টগ্রাম যায়। তার বিশ্বাস, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হয়ত জোবায়দা রাজি হবে তার প্রস্তাবে। দুজনই দু’জনকে, অ্যালিবাই দেবে,’ একটু হাসলেন মিসেস রহমান । তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, স্বভাবতই জোবায়দা হোটেলে ফিরে গিয়ে তার প্রেমিককে মৃত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ফিরে আসে। ওর মামা বলতে টাকা শহরে আর কেউ নেই। রাতেই সে বাসায় ফিরবে জানতুম। অনেকবার ফোন করলাম তাকে, পেলাম রাত একটায়। তাকে তার স্বামীর অভিপ্রায় জানালাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে পরদিন খুব সকালে একটা ট্যাক্সি করে চট্টগ্রাম চলে গেল বোরখা পরে।।
তারপর! ‘এর বেশি আমি কিছু জানি না। সাতদিন আগে মৃত কুলী হোসেন বেঁচে উঠল কি করে, আর হোটেলে নিহত লোকটার মৃতদেহ রাস্তায় কি করে গড়াগড়ি খেল তা আমার জানা নেই। তবে ওকাজটা যে খুরশীদ করেনি, তা আমি জানি।
ড. আজিম চট্টগ্রাম থেকে কোন খবর পাঠিয়েছেন?’
কয়েকদিন আগে একটা টেলিগ্রাম করেছিলেন। তাতে শুধু একটাই কথা লেখা ছিলঃ জোবায়দা আর আমার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
আর কিছুই নয়? নাসিম সম্পর্কে কোন কিছু?
“ফোন করেছিলেন?’
তাও করেনি।
তাহলে কি ধরে নেব যে, নাসিমের যদি ফাঁসি হয় তাহলেও ড. আজিম নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন?’
‘অবশ্যই নয়। দরকার হলে সে সত্য কথাই বলবে। অন্তত ওদের বংশের কুয়াশা-২৩
১১৭
একমাত্র দুলালকে চাবার জন্যে সে সব কিছুই করতে রাজি আছে। তাছাড়া এটা তো সত্যি কথাই যে, সে আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই খুন করেছিল লোকটাকে, আর ইচ্ছাকৃত ভাবেও সে খুন করেনি। আদালতে সেই কথাই সে বলবে।
তাতে খুব লাভ হবে না। বিশেষ করে মৃতদেহটা ঐভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করাতে তার কেসটা ঢিলে হয়ে গেছে।
‘কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওটুকুতে তার সত্যিই কোন ভূমিকা ছিল না।’
শহীদ ভাবছিল–আসল রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে হাজারটা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে গেছে, অনেক চমকপ্রদ কাহিনী জানতে পারা গেছে, অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা কানে এসেছে কিন্তু মূল রহস্যটা এখনও আগের মতই অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
| বিজ্ঞের মত কামাল বলল, আমার কি মনে হয় জানিস, শহীদ? নিহত প্রণয়ীর লাশটা জোবায়দা নিজেই রাস্তায় এনে গাড়ি-চাপা দিয়েছে।’
মিসেস রহমান বললেন, “জোবায়দা কেন এ কাজ করতে যাবে?”
কারণ,’ কামাল বলল, কেউ না কেউ হয়ত লোকটার সাথে জোবায়দার গোপন সম্পর্কের কথা জানত। ফলে, লাশ যথাযথভাবে সনাক্ত হলে তার উপর সন্দেহ হবার অবকাশ থাকে। সে ঝুঁকি জোবায়দা নিতে পারে না। সুতরাং লাশটাকে বিকৃত করে সত্য পরিচয় মুছে ফেলে মিথ্যা পরিচয় দানের ব্যবস্থা করে তার নিজের জড়িত থাকার প্রমাণ নষ্ট করা তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কুলী হোসেনের সাথে নাসিমের টাকা-পয়সার ব্যাপারটা সে শুনেছিল। কুলী হোসেনের হুমকি আর নাসিমের পাল্টা হুমকিও সে শুনেছে। সুতরাং সে লাশটাকে কুলী হোসেনের লাশ বলেই চালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে আর নাসিমকে জড়াবার জন্যে তার গাড়িটা ব্যবহার করেছে। আর এটাও তো ঠিক যে, যে এই কাজটা করেছে সে নাসিমের অতি ঘনিষ্ঠ। অন্যথায় নাসিমের রূমে ঢুকে তার গাড়ির চাবি সংগ্রহ করা বাইরের কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে জোবায়দা ছাড়া এটা আর কে করতে পারে?
মিসেস রহমান সবটা মন দিয়ে শুনে বললেন, আপনার ব্যাখ্যায় যুক্তি আছে মানি, তবু জোবায়দা এতটা করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হতে চায় না।’
কামাল হাসল, অথচ আপনি যে ঘটনার বিবরণ দিলেন তা আপনার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তবু আপনি জানেন যে, তার সবটা সত্য এবং আমরাও, অন্তত আমি, পুরোটাই বিশ্বাস করেছি। আমি যা বললাম, তা হল আপনার বর্ণিত ঘটনার সম্ভাব্য লজিক্যাল পরিণতি।
মিসেস রহমান কি যেন বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। ‘তোর কি ধারণা, শহীদ?’
এতক্ষণ ধরে সে-ও ভাবছিল কথাটা। কামালের ব্যাখ্যার মধ্যে যুক্তি আছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে পুরো ঘটনাটার ব্যাখ্যা নেই। মৃতদেহের বুক-পকেটে কুলী
১১৮
ভলিউম-৮
হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গিয়েছিল। বাঁ হাতের তাবিজের ভিতরে তার নাম পাওয়া গিয়েছিল। এটা হয়ত নকল হতে পারে, কিন্তু লাইসেন্সটা নকল নয়। তাছাড়া আসল হোক বা নকল হোক ঘটনার পর মুহূর্তেই জোবায়দার পক্ষে সেগুলো জোগাড় করা সম্ভব হল কি করে? নিশ্চয়ই সেটা তখনি হোক আর আগে হোক কেউ তাকে দিয়েছিল। সেই লোকটাই বা কে? আর সর্বোপরি নিহত লোকটার আসল পরিচয় কি? সেই লোকটাই কি কুলী হোসেনের গ্যাং-এর প্রকৃত দলপতি? আরও একটা প্রশ্ন, ঐ বিশেষ রাতেই নাসিমকে মাদক দ্রব্য খাওয়ানো হল কেন? কে খাওয়াল তাকে? সবকটা প্রশ্ন একই সূত্রে আবদ্ধ। এর একটার যথার্থ জবাব পাওয়া গেলে অন্যগুলোরও জবাব সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে।
সে জবাব দিল, “এইমুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না। আরও একটু খোঁজ খবর নিতে হবে আমাকে।
ফেরার পথে নীরবে সে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগল। কামালও চুপ করে বসে রইল। হঠাৎ কেমন যেন একটা অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করল শহীদ।।
কামাল জিজ্ঞেস করল, কি হল রে?”
উহ্, আমি একটা আস্ত অপদার্থ! ছিঃ ছিঃ অকারণে অন্ধকারে হাতড়ে মরছি! শোন, তুই আজ রাতেই চলে যাবি চট্টগ্রামে। যেভাবেই হোক, যেখান থেকেই হোক, ড. খুরশীদ আজিমকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার আমার বন্ধু। তাকেও আমি আজকেই খবর পাঠাব। আনতেই হবে তাকে।
‘জো হুকুম, জাহাঁপনা।
আট
আদালতকক্ষে সেদিন ভিড় হয়েছিল বেশ। আসামী নাসিম কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পেশকার নথি-পত্র এগিয়ে দিল অতিরিক্ত দায়রা জজ কাসেম, এলাহী সাহেবের টেবিলে। উকিলরা জায়গা মত গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। শহীদ এখনও আদালতে পৌঁছেনি। রিজভী সাহেব তাকে জরুরী কাজে পাঠিয়েছেন।
| আদালতের নির্দেশে সরকারী কৌসুলী মামলার অভিযোগের বিবরণ পেশ করলেন এবং সাক্ষীদের ডাক দেবার আবেদন জানালেন। প্রথম সাক্ষী ড. আহমদ মীর। তিনি মৃতদেহের ময়না তদন্ত করেছেন। তিনি জানালেন যে, মাথায় বুলেট ঢুকে কুলী হোসেন মারা গেছে। বুলেট বিদ্ধ ক্ষতস্থানের বর্ণনাও তিনি দিলেন এবং মৃতদেহ থেকে প্রাপ্ত বুলেটটাও প্রমাণ হিসাবে দেখানো হল। অন্যান্য এক্সিবিটও রায়া ও সনাক্ত করা হল ।
রিজভী সাহেব জেরা করলেন না। নীরেন সেন ফিসফিস করে কি যেন তাঁকে কুয়াশা-২৩
| ১১৯
বলল। তিনি মাথা নাড়লেন। | একটি .২২ অটোমেটিক আদালতে দেখানো হল এবং লাইসেন্স ও নম্বর ইত্যাদি দ্বারা প্রমাণ করা হল যে, ওটা নাসিমেরই সম্পত্তি।।
| আদালত রিজভী সাহেবকে জেরা করার সুযোগ দিলেন। কিন্তু এবারও তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন।
দ্বিতীয় সাক্ষী হচ্ছেন ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট মমতাজ শেখ। তিনি জানালেন যে, তিনি অটোমেটিকটার গুলি পরীক্ষা করেছেন এবং সেটাকে মৃতব্যক্তির মাথায় ও আহত কনস্টেবলের হাতে পাওয়া দুটো বুলেটের সাথে মিলিয়ে দেখেছেন এবং বুলেট দুটো যে আদালতে প্রদর্শিত অটোমেটিক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাতে কোন অন্দেহ নেই।
এবারও জেরা করলেন না রিজভী সাহেব।
মহামান্য দায়রা জজ একটু বিস্মিত হলেন। তিনি রিজভী সাহেবকে তাঁর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আসামীর কৌসুলী হিসেবে তার পক্ষ সমর্থন করার জন্যেই আপনি এখানে এসেছেন এবং আদালতে আসামীর পক্ষ যাতে যথাযথভাবে সমর্থিত হয় সেটা দেখাই আপনার কর্তব্য।’
রিজভী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সবিনয়ে বললেন, আমার জিজ্ঞাসা করার কিছু নেই, ধর্মাবতার। প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই জেরা করব । | তৃতীয় সাক্ষী আবু মুরাদ। তাকে যথারীতি ডাকা হল, শপথ নিলেন তিনি। নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা ইত্যাদি প্রশ্ন করা হল।
নাটকীয় ভঙ্গিতে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন সহকারি পাবলিক প্রসিকিউটর এনাম আহমদ। পোকায় কাটা কালো কোটটার বোম দুটো লাগিয়ে চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে ভূকটি করে মুরাদ সাহেবের দিকে তাকালেন তিনি। তারপর হাতটা তুলে আসামীর দিকে ইশারা করে বললেন, আপনি আসামী নাসিমুল আজিমকে চেনেন?
‘চিনি, নিশ্চয়ই চিনি।
কতদিন হল?” বছর খানেক।’ ‘গত ১০ মার্চ আপনি কোথায় কাজ করতেন?’ ‘আজিম ইণ্ডাস্ট্রির মালিক আজিম সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে।’
১০ ও ১১ মার্চের মাঝখানের রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? কি কি কাজ করেছেন?
সন্ধ্যায় একটা পার্টি ছিল হোটেল সোনিয়ায়। সেটায় অ্যাটে করে ড. খুরশীদ আজিমের অর্থাৎ আসামীর চাচার সাথে ঢাকা স্টেশনে গিয়েছিলাম। মিসেস আজিমও সঙ্গে ছিলেন। ড. আজিম গেলেন চট্টগ্রামে আর আমি ময়মনসিংহে।’
১২০
ভলিউম-৮
‘কোন্ ট্রেন আগে ছেড়েছিল?
চট্টগ্রামের ট্রেন।’ ‘ড, আজিমকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন?
উনি কি একাই গিয়েছিলেন?
না। ওঁর স্ত্রী ছিলেন সাথে। সেটা অবশ্য আগে ঠিক ছিল না। আমি তা জানতামও না। পরে শুনলাম, উনিও চলে গেছেন।’ | ‘হোটেল সোনিয়াতে সেদিন কিসের পার্টি ছিল?
ড. আজিমের বিদায় উপলক্ষে তাঁর একবন্ধু মিসেস আফরোজা রহমান পার্টি দিয়েছিলেন।
• আপনি ছিলেন সে পার্টিতে? “জি, হ্যাঁ।
ময়মনসিংহ থেকে ফিরলেন কবে? ‘তিনদিন পরে, অর্থাৎ ১৪ মার্চ।’
আসামীর সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছে আপনার কবে? ১০ মার্চের রাতে পার্টিতে।” ‘কোনও কথা হয়েছিল?
হ্যাঁ সে বলেছিল, কুলী হোসেন নামে একটা লোকের কাছ থেকে সে ত্রিশ হাজার টাকা ধার নিয়ে জুয়া খেলেছিল। সবটাই সে হেরে গিয়েছিল। সেদিনই টাকাটা ফিরিয়ে দেবার লাস্ট ডেট ছিল অথচ সে টাকা জোগাড় করতে পারেনি। কুলী হোসেন হয়ত ক্ষতি করতে পারে, সেইরকমই শাসিয়েছে নাকি লোকটা। হয়ত ওর চাচার কানে কথাটা তুলবে। এমন কি খুনোখুনি করাটাও বিচিত্র নয়।’
‘এটা কি আপনি আগেও শুনেছিলেন?
আগেও আমাকে বলেছিল সে। আমি কিছু করতে পারি কিনা জানতে চেয়েছিল।’
‘ঐ কথাগুলো কি পার্টিতে আর কারও কাছে বলতে শুনেছেন? মিসেস আফরোজা ও মিসেস আজিমের কাছেও বলেছিল। আপনার সামনেই? ‘আমি একটু দূরে ছিলাম। তবে শুনতে অসুবিধা হয়নি।
ওঁরা কি বললেন?’ ‘সহানুভূতি না দেখিয়ে উল্টো ভসনা করেছিলেন।’
আসামী তখন কিছু বলেছিল?
বলেছিল যে, তার কাছেও রিভলভার আছে। সে দেখে নেবে। একটা লোক নাকি তার পিছনে পিছনে ছায়ার মত ঘরে বেড়াচ্ছে। কুয়াশা-২৩।
১২১
‘লোকটা কে? ‘কুলী হোসেনের এক সাগরেদ বলে জানিয়েছিল আমাকে। ‘আর কিছু বলেছিল?’
না। তবে মনে হয়েছিল…’ ‘আপনার কি মনে হয়েছিল তা আদালত জানতে চায় না।’
শহীদ এই সময় আদালতের মধ্যে ঢুকল, তার হাতে একটা কাগজের প্যাকেট। সে ঢুকতেই নীরেন সেন তার দিকে এগিয়ে এলেন। শহীদ নিঃশব্দে তার হাতের প্যাকেটটা তুলে দিয়ে বেরিয়ে গেল। নীরেন সেন রিজভী সাহেবের হাতে প্যাকেটটা তুলে দিল। দ্রুত হাতে প্যাকেটটা খুললেন তিনি। প্রাপ্ত কাগজ পত্রগুলো নাড়াচাড়া করে তার মুখে হাসি ফুটে এল । পিছন দিকে তিনি শহীদের খোঁজ করলেন। কিন্তু শহীদ তার আগেই বেরিয়ে গিয়েছে।
আমার জেরা এখানেই শেষ,’ বললেন এনাম আহমদ। আসামীর পক্ষের কৌসুলী জেরা করবেন নিশ্চয়ই? “নিশ্চয়ই। ‘আচ্ছা মি. মুরাদ, আপনি সাধারণত ট্রেনে কোন শ্রেণীতে ভ্রমণ করেন?
ইন্টারক্লাসে যাতায়াত করি।’ ‘ঠিক বলছেন?’
জ্বি, হ্যাঁ।’ সর্বশেষ ময়মনসিংহ গিয়েছিলেন কোন ক্লাসে? ইন্টার ক্লাসে।। ‘আপনার হয়ত জানা নেই যে পি. ই. রেলওয়ে ইন্টার ক্লাস নামক ক্লাসটা তুলে দিয়েছেন?
‘ও, জ্বি, হ্যাঁ। ওটা এখন সেকেণ্ড ক্লাস হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনের অভ্যাস
আপনার ট্রেন ছেড়েছিল ক’টায়। সাড়ে দশটায়।’ ১০ মার্চ সন্ধ্যায় আপনি কি ইমামগঞ্জের জারকা হোটেলে গিয়েছিলেন?’ নিশ্চয় না।’ ‘আপনি কুলী হোসেনকে চেনেন? ‘নাম শুনেছি, চোখেও দেখেছি। তবে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
ড. আজিমের সঙ্গে আপনার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল কবে? ‘যে রাতে তাঁকে ট্রেনে তুলে দিলাম। ‘তারপর আর দেখা হয়নি?
।’
১২২
ভলিউম-৮
‘টেলিফোনে আলাপ হয়েছে অথবা চিঠিপত্র পেয়েছেন?
‘ফোনে আলাপ হয়েছিল যেদিন আমি ময়মনসিংহ থেকে ফিরে এলাম সেইদিন। উনি তখন কয়েক ঘন্টার জন্যে চট্টগ্রাম ফিরেছিলেন। চিঠি-পত্র অবশ্য পাইনি।’
আবু মুরাদের ভাবভঙ্গির মধ্যে এমন দৃঢ়তা ছিল যাতে তার কথাগুলোকে আদালতকক্ষের অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছিল। জজ সাহেব গভীর মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিলেন।
আমার আর প্রশ্ন নেই।’ কাঠগড়া থেকে নেমে গেল আবু মুরাদ।
রিজভী সাহেব বললেন, ‘ইওর অনার, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার খালেকদাদ সাহেব সাক্ষীকে আমি প্রশ্ন করতে চাই।’
এনাম আহমদ সাহেব বোধহয় আপত্তি প্রকাশ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু জজ সাহেব অনুমতি দিলেন।
খালেকদাদ সাহেব কাঠগড়ায় উঠলেন। শপথ নিলেন। নাম, পরিচয়, বয়স, পেশা জানালেন।
আপনি খালেকদাদ সাহেব?’ রিজী সাহেব প্রশ্ন করলেন। আপনি কি করেন?
আমি রমনা থানার পুলিশ অফিসার। ‘গত ১০ মার্চ রাত ন’টার পর থেকে কোথায় ছিলেন? ডিউটিতে ছিলাম।’ ‘গুলিতে কনস্টেবল আহত হয়েছে, এই খবর পেয়েছিলেন কটায়?’
রাত সাড়ে বারটায়।’ ‘কিভাবে? ‘টেলিফোনে।
তখুনি রওয়ানা হলেন? ‘জি, হ্যাঁ।’ ‘গিয়ে কি দেখলেন?’
‘দেখলাম, রাস্তার উপর একটা মানুষের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। মাথাটারও একটা দিক ভেঙে গেছে।’
কনস্টেবলকে কি অবস্থায় দেখলেন? তাকে আগেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।’ ‘আপনি কি করলেন?”
মুদ্দাফরাশ ডেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশটা গাড়িতে তুলে ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।’ কুয়াশা-২৩
১২৩
লাশ সনাক্ত করেছেন কে?’
কুলী হোসেনের জুয়ার আড্ডার কয়েকজন লোক। শাখাপুর হোটেলের কর্মচারীরা।
কিভাবে সনাক্ত হল?’
‘লোকটার গলায় একটা তাবিজ ছিল। সেটা অবশ্য ভেঙে চেপ্টে গিয়েছিল । ভাঙা তাবিজটার মধ্যে একটা কাগজে উর্দুতে তার নাম লেখা ছিল–কুলী। হোসেন।
উর্দু পড়তে পারেন আপনি? ‘কিছু কিছু।’
অন্য কোন পরিচয় চিহ্ন ছিল?
বুক পকেটে ঠিকানা ছিল, ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল। শাখাপুর হোটেলে থাকত সে। সেখানে যোগাযোগ করলাম। তারা বলল, ঐ নামে একজন লোক তাদের হোটেলের বোর্ডার। তারা তার কাপড়চোপড় সনাক্ত করল । তাবিজটাও।’
আর কি বলল?’ বলল যে, গত কয়েকদিন ভুদ্রলোক হোটেলে ফেরেননি।’ ‘ক’দিন?’ ‘দিন সাতেক।’
টাকা-পয়সা দিত?” মাসিক ভাড়ায় থাকত সেখানে কুলী হোসেন। আসামীকে গ্রেফতার করছে কে? আমিই করেছি। রিভলভারটা কোথায় পেয়েছেন? আসামীর গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে।’ আসামীর গাড়ির সন্ধান পেলেন কি করে?’ ‘আহত কনস্টেবলটা গাড়ির নাম্বার টুকে নিয়েছিল। তার কাছ থেকে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নিয়ে ঐ গাড়িটা কার তা ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট থেকে জেনে নিয়ে আসামীর বাসায় যাই।’
‘গাড়িটা কোথায় ছিল?
আসামীর বাড়ির গ্যারেজে। দরজা খুলে দিয়েছিল কে? ‘গ্যারেজের?”
, বাসার। একটা চাকর।’ ‘গ্যারেজের দরজা?’ ১২৪
ভলিউম-৮
‘আসামী নিজেই।
আসামীকে,গিয়ে কি অবস্থায় দেখেছেন? চাকরটা বলল যে, আসামী তখন গোছল করছিল। ‘গ্যারেজে গাড়ি ক’টা ছিল?”
একটাই।’ কি আস্থায় ছিল? ‘গাড়ির সামনের উইং-এ রক্তের দাগ ছিল পর্যাপ্ত।’
আসামীকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন?’ করেছিলাম। “সে কি জবাব দিয়েছে?” ‘সে বলেছে, এ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।’
আমার আর প্রশ্ন নেই, ইওর অনার,’ রিজভী সাহেব বললেন।
আপনি কোন প্রশ্ন করবেন?’ এনাম আহমদ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন জজ সাহেব।
“জ্বি, ইওর অনার, উঠে দাঁড়ালেন সহকারী সরকারি কৌসুলী ।
করুন তাহলে। ‘খালেকদাদ সাহেব, আপনিই তো আসামীর বাসায় গিয়েছিলেন? “জ্বি, হ্যাঁ।
তখন কটা বাজে?” সাতটা হবে। ‘আসামী তখন গোসল করছিল? “জ্বি, হ্যাঁ।
‘গোসল শেষে আপনার সাথে সে যখন দেখা করতে এল তখন তাকে দেখে আপনার কি মনে হয়েছিল?
‘আপত্তিকর প্রশ্ন, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন, ইওর অনার। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কি মনে হয়েছিল, তাতে কিছু আসে যায় না,’ মীরেন সেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
‘প্রশ্নটা আমি বাতিল করছি।’
আমার আর কোন জিজ্ঞাস্য নেই।
পরের সাক্ষী কনস্টেবল নিজামুদ্দৌলা। সে এসে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াল । শপথ গ্রহণ ও নাম ঠিকানা ইত্যাদি দেবার পর সরকারি কৌসুলী তাকে জেরা করা শুরু করলেন।
‘১০ মার্চ রাতে আপনার ডিউটি ছিল?”
জি, স্যার। পেট্রল ডিউটি ছিল আমার।’
একা?” কুয়াশা-২৩
১২৫
স্যার, আরও দু’জন ছিল। আপনার সঙ্গেই ছিল তারা? ‘ওরা অন্য দুটো গলিতে ঢুকেছিল। “আপনি সেই রাতে রিভলভারের গুলিতে আহত হয়েছিলেন? ‘জি, হ্যাঁ।
ঘটনাটা কি করে ঘটেছিল, খুলে বলুন।’
আমি একটা গলির ভিতর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই রাস্তার আলোতে দেখলাম, একটা গাড়ি একবার সামনে ও
একবার পিছনে যাওয়া আসা করছে। আমি ভাবলাম•••|’।
আপনি কি ভাবলেন তার দরকার নেই। কি করলেন তাই বলুন? আমি গাড়িটার নম্বর টুকে নিলাম। নম্বরটা বলুন?’ নম্বর বলল কনস্টেবল। ‘গাড়িটা কি রং-এর?’
সাদা রং-এর।’ কি গাড়ি?’ তা বলতে পারব না। সব রকম গাড়ি আমি চিনি না। রাস্তায় কি স্পষ্ট আলো ছিল?’
স্পষ্টই। রাস্তার বাতিটা বেশি দূরে ছিল না।’ ‘গাড়িটার বাতি জ্বলছিল নিশ্চয়ই?’ ‘জ্বি, না। ‘গাড়ির ভিতরে যে ছিল তাকে দেখতে পেয়েছিলেন? “জ্বি, না।’
যখন নম্বর লিখছিলেন তখন গাড়িটার কতটা দূরে ছিলেন আপনি?
হাত পনের দূরে। একটা গাছের আড়ালে। সেখানেই দাঁড়িয়ে আমি নম্বরটা লিখেছিলাম।’
তারপর কি করলেন?’ বাঁশি বাজালুম।’ তারপর?’
তারপর অকস্মাৎ আমার হাতে প্রচণ্ড বেদনা অনুভব করলাম। চিৎকার করে উঠেছিলাম আমি যন্ত্রণায়।’
তারপর?’ আর কিছু মনে নেই। ‘পথে আর লোক ছিল না?’
ভলিউম-৮
৭
‘তখন ছিল না। জায়গাটা নিরিবিলি। বাড়ি-ঘর বেশ অনেকটা দূরে দূরে।
আসামীকে আপনি আগে কখনও দেখেছেন? ‘জি, না। ‘গাড়ির ভিতরে যখন ছিল তখন? ‘জি, না।’ ‘আমার জেরা এখানেই শেষ, ইওর অনার। “মি. রিজভী, এনি কোশ্চেন?’ “জ্বি, ইওর অনার।
করুন।
“নিজামুদ্দৌলা সাহেব, আমার একটাই প্রশ্ন আছে । আমার লার্নেড ফ্রেণ্ড প্রশ্নটা কেন করলেন না, ঠিক বুঝতে পারছি না। যখন আপনি গাড়ির নম্বর টুকেছিলেন তখন কটা বাজে?”
‘নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে তখন পৌনে বারটার বেশি হবে। তার কিছুক্ষণ আগেই আমি ঘড়ি দেখেছিলাম। তবে, ঠিক কতক্ষণ আগে, বলতে পারব
।’
তাহলে রাত পৌনে বারটা থেকে বারটার মধ্যেই ঘটনাটা ঘটেছিল, বলতে পারি?”
“জি, হ্যাঁ।।
আপনার ঘড়িটা কোথায়?
‘আমি জখম হয়ে পড়ে যাওয়াতে ঘড়িটার ব্যালান্স স্টাফ ভেঙে গিয়েছিল । ওটা এক্সিবিট হিসেবে এখানে, মানে, আদালতে আছে।’
ঘড়িটা ক’টার সময় ভেঙেছিল?
‘নিজে আমি নির্দিষ্ট করে তা বলতে পারব না। পরে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বলেছিলেন, ঘড়িটা বন্ধ হয়েছিল এগারটা পঞ্চান্ন মিনিটে।
তারমানে, ঘটনাটা তখনি ঘটেছিল, একথা বলা যায়? ‘জ্বি, হ্যাঁ। তা বলা যায়। আর কোন প্রশ্ন নেই।’
পরের সাক্ষী মিসেস আফরোজা রহমান। কিন্তু তখন একটা বেজে গেছে।। এক ঘন্টার জন্যে আদালতের অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করা হল।
| নীরেন, সেনের চেম্বার আদালতের কাছেই একটা গলির মধ্যে। বিরতির সময় শহীদ ও রিজভী সাহেবকে নিয়ে নীরেন সেন সেখানেই চলে গেলেন। মিসেস রহমানও ওদের সঙ্গে গেলেন।
শহীদের জন্যে এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল সেখানে। সে বিস্ময়ের কারণ শাহানারা। শহীদ তাকে দেখে বিস্মিত হল, আর শাহানারা পেল লজ্জা। বেচারি কুয়াশা-২৩
১২৭
মাথাই তুলতে পারল না। শহীদও তার অবস্থাটা বুঝে তাকে এড়িয়ে গেল।
রিজভী সাহেব শাহানারাকে দেখে হাসলেন, কি খবর, ইয়ং লেডী? ‘খবর তো আপনার কাছে, রিজভী সাহেব। বলুন, কি হল?’
হতে এখনও দেরি আছে। সবে তো শুরু।’ নীরেন সেন ব্যস্তভাবে সকলের বসবার ব্যবস্থা করলেন।
মিসেস রহমানকে এতক্ষণ শাহানারা খেয়াল করেনি। রিজভী সাহেবের সাথে কথার ফাঁকে তাকে দেখে তার মুখটা শুকিয়ে গেল।
রিজভী সাহেবের চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। তিনি বললেন, দেখুন মিসেস রহমান, ঢাকায় আসার পর থেকেই একটার পর একটা অবিশ্বাস্য কিছু ঘটছে এবং আমার কানে এসে পৌঁছুচ্ছে। তার মধ্যে একটা হল ১০ মার্চের রাতের ঘটনা সম্পর্কে আপনার বিবৃতি। তেমনি আর একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা এবারে আমি আপনার কাছে পেশ করতে চাই।’
শহীদ ফোনে চট্টগ্রামের লাইন ধরতে চেষ্টা করছিল । রিজভী সাহেবের কথা তারও কানে পৌঁছুল। সে কৌতূহলে রিজভী সাহেবের দিকে তাকাল।
রিজভী সাহেব শাহানারাকে দেখিয়ে বললেন, “এই ইয়ং লেডীকে আপনি চেনেন?
‘চিনব না কেন? ও তো হোটেল সোনিয়ায় কাজ করে। রিসেপশনিস্ট।
কিন্তু আরও একটা পরিচয় তার আছে,’ রহস্যজনক হাসি হাসলেন রিজভী। সাহেব।
“কি সেটা?’ কৌতূহল প্রকাশ করলেন মিসেস রহমান। ‘এই তরুণী নাসিমের বাগদত্তা।’ “ওহ, তাই নাকি! এ তো সুখবর! সত্যি, আই লাইক হার ভেরি মাচ। লজ্জায় অধোবদন হল শাহানারা ।।
কিন্তু এটাই শেষ বিস্ময় নয়। আরও একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। শাহানারার বড় এক ভাই ছিল। সে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি জানা গেছে, তার সেই ভাইটিই আপনার হতভাগা স্বামী কুলী হোসেন।’
সবাই ভীষণভাবে চমকাল। নীরেন সেনও বিস্মিত হলেন, শাহানারাও অবাক হল । মিসেস রহমান অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন শাহানারার দিকে। এই মেয়েটি যে তার নিকট আত্মীয় তা তিনি কোনদিন কল্পনাও করেননি। অবশ্য ওকে তিনি স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখেছেন। অন্যদিকে কুলী হোসেন যে তার নিরুদ্দিষ্ট ভাই শাহানারা সম্প্রতি তা জানতে পারলেও মিসেস রহমান যে তারই ভ্রাতৃবধূ এটা সে কখনও কল্পনাও করেনি। সে-ও অবাক হয়ে চেয়ে রইল মিসেস রহমানের দিকে। তারপর তার চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরতে লাগল । ১২৮
ভলিউম-৮
মিসেস রহমান উঠে গিয়ে শাহানারার পিঠে হাত রেখে দাঁড়ালেন। “ছিঃ কাঁদে না, শাহানারা।’ জবাবে শাহানারার আবেগ আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। মিসেস রহমানের বুকে মুখ লুকিয়ে সে ফোঁপাতে লাগল । উদগত অশ্রু জোর করে দমন করে মিসেস রহমান তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
বিব্রত নীরেন সেন হাত কচলাতে লাগলেন।
শহীদ প্রশ্ন করল, কিন্তু এই গোপন খবর আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করলেন, রিজভী সাহেব?’
উত্তরে রিজভী সাহেব হেসে বললেন, ইউ ক্যান ওয়েল ইম্যাজিন মাই সোর্স।
সবই ভাল,’ নীরেন সেন বলল। তবে জানেন তো, স্যার, কথায় বলে, সব ভাল তার শেষ ভাল যার।’
জানি বৈকি? সে তো নির্ভর করছে আপনার দক্ষতার উপর। আসলে, আপনিই তো ভরসা। কাজ যা কিছু করবার, আপনিই করছেন। বলতে গেলে আমি
তো আপনাকে সামান্য সাহায্য করছি মাত্র।’
‘হেঃ হেঃ হেঃ হে, কি যে বলেন, স্যার!’ বিনয়ে বিগলিত হলেন নীরেন সেন ।
নীরেন সেনের মুহুরী নাস্তার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু শহীদ ও নীরেন সেন ছাড়া আর কেউ তা স্পর্শ করল না। মিসেস রহমান ও শাহানারার আহার করার মত মানসিক অবস্থা ছিল না। রিজভী সাহেব বললেন, “আমার একটু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন। ওসব বাঙালী খাদ্যে এখন পোষাবে না,’ ব্রিফকেস থেকে বিয়ারের বোতল বের করে বললেন, এর চাইতে ভাল নাস্তা এখন আর আমি করতে পারি না। ডোন্ট মাইণ্ড, লেডীজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন।।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শহীদ চট্টগ্রামের লাইন ধরতে চেষ্টা করছিল। অবশেষে পাওয়া গেল লাইন।
হ্যালো, শহীদ বলছি, কামাল…পাওয়া যায়নি এখনও?…বিকেলে?…আচ্ছা, ঠিক আছে, রিসিভার রেখে দিয়ে শহীদ রিজভী সাহেবকে বলল, এখনও পাওয়া যায়নি ড. জিমকে।’
নীরেন সেন ঘড়ি দেখে বলল, স্যার, সময় হয়ে গেল। চলুন, যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, চলুন। মিসেস রহমানও উঠলেন। শাহানারা চোখ-মুখ মুছে বলল, চল ভাবি, আদালত থেকে কিন্তু সোজা আমাদের বাসায় যেতে হবে।’
মাথা নাড়লেন মিসেস রহমান।
হাঁটতে হাঁটতে শহীদ রিজভী সাহেবকে বলল, “আচ্ছা, রিজভী সাহেব; লোকটা খুন হবার পর ড, আজিম মিসেস রহমানের কাছে যে ঘটনা বিবৃত করেছিলেন আদলতে তা প্রকাশ করলে নাসিমের সুবিধা হয় না? এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আকস্মিকভাবেই তার রিভলভার থেকে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল।
৯-কুয়াশা-২৩
১২৯
তাতে কোনই লাভ নেই। সেটা হচ্ছে হিয়ার-সে এভিডে স। আদালতে ওর কোন দাম নেই। ড. আজিম নিজে যদি এই মামলার আসামী হতেন তাহলে ওটাকেই একটা জোরালো যুক্তি হিসাবে দাঁড় করানো যেত। তাছাড়া ওদিকটায় আমি যেতে চাই না। আমার লাইন আলাদা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সরকারি কৌসুলী হিয়ার-সে এভিডেন্সের প্রশ্ন তুলে আমাকে অসুবিধায় ফেলতে পারে।’
কাটায় কাটায় দুটোতে আদালত আবার বসল । জজ সাহেব এসে আসন নিলেন। আসামীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল। উকিলরা আসন নিলেন। মিসেস আফরোজা রহমানকে ডাকা হল। তিনি শপথ নিলেন। নাম, বয়স ইত্যাদি বললেন।
সরকারি কৌসুলী গলা খাকারি দিলেন। মিসেস রহমান, আপনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীকে চেনেন? ‘চিনি।
কতদিনের পরিচয় ওর সাথে? ‘এক বছর হবে। এর আগে আসামী বিদেশে ছিল।’
তার সাথে সর্বশেষ দেখা আপনার কবে? ‘গত ১০ মার্চ সন্ধ্যায়।’ ‘কোথায়? ‘হোটল সোনিয়ায়। ‘নির্দিষ্ট কোন উপলক্ষে? ‘জি, হ্যাঁ। কি সেটা?
‘আসামীর চাচা ড, আজিমের চট্টগ্রাম গমন উপলক্ষে আমি একটা বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিলাম হেঁটেল সোনিয়ায়। তাতে ওকেও দাওয়াত করেছিলাম।’
‘ঐ অনুষ্ঠানে বহুলোক ছিল নিশ্চয়ই?’
না কয়েকজন মাত্র।’
‘বেশ। মিসেস রহমান, অনুষ্ঠানে আসামীর সাথে আপনার কোন কথা হয়েছিল?
হয়েছিল।’ ‘কি সম্পর্কে?
‘সে বলেছিল, কুলী হোসেন নামে একটা লোকের নিকট থেকে সে ত্রিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। সমস্তটাই সে জুয়াতে হেরেছে। এখন কুলী হোসেন তার কাছে টাকাটা ফেরত চাইছে। খুব চাপ দিচ্ছে। ঐদিনই টাকাটা ফিরিয়ে দেবার লাস্ট ডেট ছিল। দিতে না পারলে সে ক্ষতি করতে পারে।
ভলিউম-৮
“কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে তা কিছু বলেছিল?
বলেছিল, টাকাটা না দিতে পারলে কুলী হোসেন হয়ত ব্যাপারটা তার বড় চাচার গোচরে আনবে, অথবা হয়ত মারপিট করবে।
‘আসামীর বড় চাচার কানে গেলে কি কোন ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল?
২ামি সঠিক জানি না। তবে শুনেছি উনি গোঁড়া পিউরিটান টাইপের লোক। যদি জানেন, নাসিম কোন নোংরামিতে জড়িত আছে, তিনি হয়ত তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন।
“কিভাবে? সম্পত্তিতে আসামীর কি কোন অধিকার নেই?
যতদূর জানি, নেই।’ ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ইওর অনার, উঠে দাঁড়ালেন রিভজী সাহেব। প্রশ্নগুলো অপ্রাসঙ্গিক। সুতরাং এ প্রশ্নে আমার আপত্তি আছে।’
‘ইওর অনার, প্রশ্নগুলো অপ্রাঙ্গিক নয়। কুলী হোসেনকে যে আসামীর খুন করার মোটিভ ছিল তা এই প্রশ্নের জবাবের ভিত্তিতেই আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’
‘আপত্তি বাতিল। আপনি জবাব দিন, জজ সাহেব বললেন।
বলুন আপনি মিসেস রহমান, আমার প্রশ্ন ছিল, মি. আজিম অর্থাৎ আসামীর বড় চাচা কিভাবে ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন?’
| ‘আমি যতদূর শুনেছি, আসামীর মানে নাসিমের বাবা নাসিমের দাদুর জীবদ্দশায় মারা যান। ফলে সম্পত্তির উপর আসামীর কোন দাবি নেই। তবে সে-ই শংশের একমাত্র সন্তান বলে স্বভাবতই তার বড় চাচা সম্পত্তিটা তাকেই লিখে দিয়ে যাবেন আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সবাই জানে, নাসিম অসৎ পথে গেলে তাকে তিনি এক পয়সাও দেবেন না।’ | ‘কিন্তু আসামীর ছোট চাচা ড, আজিমও তো নিঃসন্তান, অন্তত তিনি তো তার সম্পত্তি নাসিমকে দিয়ে যেতে পারেন?
তা হয়ত পারেন, তবে…।’ বলুন?’
‘তাঁর স্ত্রী বর্তমান। সম্পত্তিটা তাকেও লিখে দেওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া বড় ভাই-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস তার তেমন নেই।
‘আসামী আর কিছু বলেছিল?
বলেছিল, কুলী হোসেন বাড়াবাড়ি করলে সে-ও দেখে নেবে।’ ‘কিভাবে?”
বলেছিল যে, সে তার গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে সব সময়ই একটা রিভল ভার রেখে দেয়। দরকার হলে সেটা সে ব্যবহার করবে।
‘একথাটা কি কুলী হোসেনের হুমকি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিল আসামী? কুয়াশা-২৩
১৩১
।
T
মিসেস রহমান ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ।’
আসামী কি আপনার কাছে ধার শোধ করার টাকা চেয়েছিল?
‘ওর ঘোট চাচা, মানে ড, আজিমের কাছ থেকে ওর অবস্থা জানিয়ে টাকাটা। নিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল।
আপনাকে যখন এই কথাগুলো বলে তখন আর কে কে কাছে ছিল?
মিসেস আজিম ছিলেন, আর আবু মুরাদ সাহেব কাছেই ছিলেন। উনি শুনেছেন কিনা আমি সঠিক বলতে পারব না।’
কথাগুলো কি একা আপনার উদ্দেশ্যেই বলেছিল? না, দু’জনের উদ্দেশ্যেই বলেছিল। আপনি কি জবাব দিয়েছিলেন।’ আমি ওকে বকেছিলাম।’ “কেন?’ ‘ওসব কাজে আমার প্রশ্রয় নেই বলে। মিসেস আজিম কি বলেছিলেন?’
তিনিও আমার মত বকেছিলেন। তবে টাকাটা তার চাচার কাছ থেকে নিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন, বলেছিলেন।
আপনাদের অনুষ্ঠান শেষ হয় কটায়?” ‘সাড়ে সাতটার দিকে।
তারপর? ড, আজিম, মিসেস আজিম ও আবু মুরাদ স্টেশনে চলে যান। আসামী? ‘সে-ও চলে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায়, তা আমি জানি না।
‘পুলিস কয়েকদিন আপনাকে খোঁজ করে পায়নি। তাদের বিশ্বাস, আপনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন।
‘অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, ইওর অনার, রিজভী সাহেব বললেন। নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক নয়, জোর গলায় জবাব দিলেন এলাহী সাহেব। প্রশ্নটা বাতিল করে দেওয়া হল। আমার কোন জিজ্ঞাস্য নেই।’ ‘জেরা করবেন?’ জজ সাহেব আসামী পক্ষের কৌসুলীকে জিজ্ঞাসা করলেন। রিজভী সাহেব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন।
মিসেস রহমান, বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আসামীর চাচা ড. আজিমের সাথে আপনার কোন কথা হয়েছিল?
‘অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক প্রশ্ন।
আমার এই প্রশ্নের জবাব চাই, ইওর অনার। আমার মনে হয়, পুরো আলাপ
ভলিউম-৮
আলোচনাটাকে একটা ইউনিট হিসেবে দেখতে হবে।’
“নিশ্চয়ই নয়, সরকারি কৌসুলী জবাব দিলেন। আমার লার্নেড ফ্রেণ্ড যদি আসামীর সাথে সাক্ষীর আলোচনা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করতেন তাহলে আমাদের কোন আপত্তি ছিল না।’
আমার মনে হয় সরকারি কৌসুলী ঠিকই বলেছেন রিজভী সাহেব, আমি তার আপত্তি গ্রাহ্য করলাম। সাক্ষীকে আপনি প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে চুলচেরা জেরা করতে পারেন। তাতে আমার আপত্তি থাকবে না।’
আমার আর কোন প্রশ্ন নেই, রিজভী সাহেব জানালেন।
পরবর্তী সাক্ষী মিসেস জোবায়দা আজিম। | তিনি এসে দাঁড়াতেই আদালতে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। তার অসামান্য সৌন্দর্য, দৃপ্তভঙ্গী অথচ তার দুটো বিষাদ মলিন বড় বড় চোখ সবাইকে মুগ্ধ করল। একটা গুঞ্জন উঠল মুহূর্তের জন্যে।
শপথ গ্রহণ করে নাম বয়স, ঠিকানা দিলেন তিনি। স্পষ্ট সুরেলা বাকভঙ্গীতে যে ঋজুতার পরিচয় দিলেন তিনি তাতে তার প্রতি আদালত-করে উপস্থিত সকলের মধ্যে একটা শ্রদ্ধার ভাব এসে গেল। এবং তার প্রকাশ ঘটল সহকারী সরকারি কৌসুলীর প্রশ্নের মধ্যে দিয়েই। বিনয়ে বিগলিত হয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, মিসেস আজিম, গত ১০ মার্চের সন্ধ্যার ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার?
‘জি, হ্যাঁ, মনে আছে,’ মাথাটা একটু কাত করে জবাব দিলেন তিনি। ‘সেদিন আসামী নাসিমের সাথে আপনার কোন কথা হয়েছিল?
কখন? সন্ধ্যায়, হোটেল, সোনিয়ায়?” হয়েছিল। ‘সেখানে একটা পার্টি দেওয়া হয়েছিল আপনার স্বামীর বিদায় উপলক্ষে? ‘জি, হ্যাঁ। সেই রাতেই আপনার স্বামী ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন? ‘জ্বি, হ্যাঁ। ‘আপনিও কি গিয়েছিলেন?
‘জি, হ্যাঁ, তবে আমার যাবার কথা ছিল না, একদম শেষ মুহূর্তে আমার যাবার কথা ঠিক হল। উনি আমাকে সঙ্গে যেতে বললেন,’ মৃদুস্বরে বললেন মিসেস আজিম।
| ‘তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা শুধু আলোচনার স্থান ও কাল নির্ণয় করছি। যাক, হোটেল সোনিয়ায় আগামীর সাথে আপনার আলোচনার সময় কে কে ছিলেন?
| ‘আমি মিসেস আফরোজা রহমান অর্থাৎ হোস্ট আর সম্ভবত আবু মুরাদ। কুয়াশা-২৩
‘আসামী কি বলেছিল আপনাদের কাছে?
বলেছিল, সে জনৈক কুলী হোসেনের কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা ধার করে জুয়া খেলে হেরেছে। আজকের মধ্যে টাকাটা ফেরত না দিলে কুলী হোসেন ওর বড় চাচাকে বলে দেবে অথবা মারবে বলে শাসিয়েছে।’
সে কি আপনার কাছে টাকাটা চেয়েছিল? ‘আমার স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে দেবার জন্যে অনুরোধ করেছিল। বলেছিল, উনি যাবার আগেই যেন একটা ব্যবস্থা করি।’
আপনি কি বলেছিলেন?’ যথাসাধ্য চেষ্টা করব বলে আশ্বাস দিয়েছিলাম।
‘টাকাটা না দিতে পারলে কুলী হোসেন যদি তার ক্ষতি করে তাহলে আসামী কি করবে, তা কি বলেছিল সে?’
| মিসে আজিম চুপ করে রইলেন।
সরকারি কৌসুলী জবাকের জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “মিসেস আজিম আপনি বোধহয় আমার প্রশ্নটা ঠিক মত বুঝতে পারেননি। আমার প্রশ্নটা হলঃ টাকাটা কুলী হোসেন ফিরে না পেলে সে যদি আসামীর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে আসামী পাল্টা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা, সে সম্পর্কে আপনাদের কাছে কিছু বলেছিল?
অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়লেন মিসেস আজিম।
স্পষ্ট করে জবাব দিন। বলেছিল। “কি বলেছিল?
ক্ষীণ কণ্ঠে মিসেস আজিম বললেন, নাসিম বলেছিল, কুলী হোসেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে-ও দেখে নেবে। দরকার হলে তার সাথে মোকাবেলা করবে। তার জন্যে সে প্রস্তুত হয়েই আছে। গাড়িতে রিভলভার রেখে দিয়েছে সে।
‘আপনি এবার প্রশ্ন করতে পারেন,’ বিজয়ীর ভঙ্গিতে রিজভী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন সরকার পক্ষের কৌসুলী।
‘আপনি কি ড. আজিমের কাছে নাসিমের প্রার্থিত টাকাটার কথা বলেছিলেন? রিজভী সাহেব মিসেস আজিমকে প্রশ্ন করলেন।
পরে বলেছিলাম। কতটা পরে?’ ‘ট্রেনে বলেছিলাম।’
“তারমানে, আপনি বলতে চাইছেন যে, আপনি আপনার স্বামীর সাথে ট্রেনে ছিলেন?’
| অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন প্রশ্ন, ইওর অনার। এসব যথার্থ জেরা ১৩৪
ভলিউম-৮
নয়। সাক্ষী তার স্বামীর সাথে কি আলোচনা করেছিলেন তা আমাদের এই মামলার আওতাভুক্ত নয়। আসামীর সাথে সাক্ষীর আলোচনা সম্পর্কে উনি হাজারটা প্রশ্ন করলেও আমাদের কিছুই বলবার নেই। কিন্তু আসামীর সাথে আলোচনা করে সাক্ষী।
তার স্বামীর সাথে কি আলোচনা করলেন সে সম্পর্কিত প্রশ্ন অবান্তর। ওটা শোনা কথা–হিয়ার-সে ছাড়া আর কিছুই নয়, সরকারি কৌসুলী আপত্তি তুললেন।
| ‘আপত্তি মেনে নিলাম, বিচারক বললেন ।
বিচারকের প্রতি সামান্য মাথা নুইয়ে রিজভী সাহেব মিসেস আজিমকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি যথার্থই আপনার স্বামীর সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন?
আবার গর্জন করে উঠলেন সারকারি কৌশলী, অপ্রাসঙ্গিক, অর্থহীন প্রশ্ন, ইওর অনার। যথার্থ জেরা নয়।’
কিন্তু বিচারক তার গর্জন কানে তুললেন না। তিনি বললেন, ‘আমি প্রশ্নটা গ্রাহ্য করছি। আসামী পক্ষকে জেরার পূর্ণ সুযোগ আমি দিতে চাই। সাক্ষী তাঁর স্বামীর সাথে কি আলাপ করেছিলেন সেটা আমাদের দেখবার বিষয় না হলেও আসামীর সাথে সাক্ষীর আলোচনার পর সাক্ষীর আচরণ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের অঙ্গ হতেও পারে। মিসেস আজিম, আপনি প্রশ্নটার উত্তর দিন।’
মিসেস আজিম, বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ‘আমার প্রশ্ন ছিল, আপনি আপনার স্বামীর সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন?’ নিশ্চয়ই গিয়েছিলাম,’ দৃঢ়স্বরে বললেন তিনি।
ঐদিন সন্ধ্যায় আপনি হোটেল জারকাতে গিয়েছিলেন কি? ‘ইওর অনার, সরকারি কৌসুলী কুদ্ধস্বরে বললেন, আসামী পক্ষের উকিলের অসৎ উদ্দেশ্য এখন স্পষ্ট বোঝা গেছে। সমস্তটা মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি পাকাতে চাচ্ছেন তিনি। ওঁর প্রশ্ন সাক্ষীর চরিত্রের উপর জঘন্য আক্রমণ । তাছাড়া প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিকও বটে। আসামীর সার্থে সাক্ষীর যেটুকু আলাপ হয়েছে উনি তো সেটুকু সম্পর্কেই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সাক্ষী তো বলেছেন, তিনি তার স্বামীর সাথে ট্রেনে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। সুতরাং এ সম্পর্কে প্রশ্ন অবান্তর বলে মনে হচ্ছে না। আদালত আসামী, পক্ষকে সর্বপ্রকার সুযোগ দিতে চায়। আপনি প্রশ্নের জবাব দিন, জজ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন।
‘আপনি কি ঐদিন সন্ধ্যায় হোটেল জারকায় গিয়েছিলেন?
“নিশ্চয়ই না,’ মিসেস আজিম সক্রোধে বললেন। তাঁর গৌরবর্ণ মুখটা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করল। ঐ ধরনের কোন প্রশ্ন করার অধিকার আপনার নাই। এটা আমার মর্যাদার পক্ষে হানিকর। আমি যে সেখানে যেতে পারি না, আপনার মত
দ্রলোকের তা জানা উচিত।
নিঃশব্দে হাসলেন রিজভী সাহেব। কুয়াশা-২৩
১৩৫
আপনার স্বামী চট্টগ্রাম থেকে শহীদ খান নামে এক ভদ্রলোকের কাছে ফোন করেছিলেন। সে ঘটনা আপনার মনে আছে?”
মনে আছে। তার পরেই আপনি ঢাকা ফিরে আসেন?’ দুপুরে ফোনে কথা হয়েছিল, রাতে আমি ঢাকার ট্রেনে উঠি।’ তার আগের দিন কি আসামীর জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে গিয়েছিল? ‘জ্বি, হ্যাঁ।’ ফিরে আসার পর শহীদ খানের সাথে আপনার দেখা হয়েছিল? সরকারি কৌসুলী রাগে গরগর করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন।
ইওর অনার, এর প্রত্যেকটা প্রশ্নই অবান্তর। কোথাকার কোন শহীদ খানের সাথে কে কবে ফোনে কথা বলেছিল তা দিয়ে আমার বিজ্ঞ বন্ধু কি প্রমাণ করতে চান, আমি তার কিছুই বুঝতে পারছিনে। আমার নতুন বন্ধু মূল বিষয় বিস্মৃত হয়ে বারবার শুধুমাত্র অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করছেন। আমি আপত্তি জানাচ্ছি।’
| আমি আপত্তি অগ্রাহ্য করছি। আমি নিজেও বুঝতে পারছি, আসামী পক্ষের কৌসুলী মূল বিষয় থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তবে প্রশ্নগুলোকে একেবারে অবান্তর বলে উড়িয়েও দিতে পারছিনে। উনি নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রশ্নগুলোর অবতারণা করছেন। মিসেস আজিম, আপনি ওর প্রশ্নের জবাব দিন।
আপনার স্বামী যখন শহীদ খানকে ফোন করেন তখন আপনি”কোথায় ছিলেন?’
‘চট্টগ্রামেই ছিলাম।’
ঠিক কোন জায়গাটাতে ছিলেন?’ ‘হোটেল প্রাইউডে। সেখান থেকেই ফোন করেছিলেন উনি।’
ড. আজিম যখন ফোন করেন তখন আপনি কি তাঁর কাছেই ছিলেন? তার পাশেই ছিলাম।
তাহলে, মিসেস আজিম, আপনি মহামান্য আদালতের দিকে তাকিয়ে দয়া করে বুঝিয়ে দিন, আপনি কি করে একটা লাশের সাথে চট্টগ্রাম গেলেন, কি করে চট্টগ্রামের প্লাইউড হোটেলে একটা মৃতদেহের সাথে অবস্থান করলেন এবং সেই মৃত ব্যক্তিটা যখন ফোন করল তখন কি করে তা আপনি জানতে পারলেন?”
সমস্ত আদালত মুহূর্তে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।
মিসেস আজিমও চমকে উঠলেন । কিন্তু মহূর্তের মধ্যেই তিনি আত্ম-সচেতন হয়ে বলে উঠলেন, তার মানে! এসব কি বলছেন আপনি?
বিস্মিত সরকারি কৌসুলীও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে অসহায়ের মত রিজভী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
১৩৬
ভলিউম-৮
অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন রিজভী সাহেব। শহীদের আনা কাগজের প্যাকেটটা খুলে তিনি বললেন, আমার প্রশ্ন অত্যন্ত সরল। তা হলঃ কুলী হোসেন বলে যে লোকটা মারা গেছে বলে জানা গেছে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ আর আপনার স্বামীর বুড়ো আঙুলের ছাপ অবিকল এক। আমার কাছে করোনারের রেকর্ড থেকে নেওয়া লাশের ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপের সার্টিফায়েড কপি আর আপনার স্বামীর ড্রাইভিং লাইসেন্সের দরখাস্তের সার্টিফায়েড কপি আছে, হাতের কাগজগুলো দেখিয়ে তিনি বললেন, এই হচ্ছে সেই কপিগুলো। ‘১০ মার্চ রাতে। যে লোকটা .২২ অটোমোটকের গুলিতে মারা গেছে সে লোকটা কুলী হোসেন নয়; সে লোকটা হচ্ছেন আপনার স্বামী ড. খুরশীদ আজিম। এখন দয়া করে আপনি ব্যাখ্যা করুন, কি করে আপনি একটা লাশের সাথে অবস্থান করলেন দু’তিন দিন! * মিসেস আজিম দ্বিতীয়বারও ভড়কালেন না। তিনি দৃঢ়স্বরে বললেন, “আমি আমার স্বামীর কাছেই ছিলাম।’
আদালতে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। বিচারক নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। হাতুড়ি পিটিয়ে আদালত-কক্ষের গুঞ্জন থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘রিজভী সাহেব, আমার কাছে দিন তো আঙুলের ছাপগুলো?’
| রিজভী সাহেব সবিনয়ে তার হাতের কাগজগুলো বিচারকের হাতে তুলে দিলেন।
আদালত-কক্ষে আবার নীরবতা নেমে এল। শহীদ মিসেস আজিমের দিকে তাকাল। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মিসেস আজিমের মুখ।।
অনেকক্ষণ ধরে দুটো প্রিন্ট মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন জজ সাহেব। তারপর সরকারি কৌসুলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সরকার পক্ষের কৌসুলী কি এই প্রমাণগুলো স্বচক্ষে দেখতে চান?
, ইওর অনার। এসব নাটকীয়তায় আমাদের বিশ্বাস নেই। ওতে আমরা সহজে মুগ্ধ হই না।’
কিন্তু এটাতে মুগ্ধ হবেন। কারণ ছাপ দুটো অবিকল এক।
‘তাহলে ছাপ দুটো তৈরির মধ্যে কোন কৌশল থাকতে বাধ্য, জোর গলায় বললেন সরকারি পক্ষের উকিল।
জজ সাহেব বললেন, আমরা মামলার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল পর্যায়ে এসে পড়েছি। সমস্ত পরিস্থিতিটা আমার নিজের কাছেই অত্যন্ত জটিল বলে মনে হচ্ছে। আমি বিশ মিনিটের জন্যে আদালত মুলতবী রাখছি। এই সময়ে আমি উভয় পক্ষের কৌসুলীর সাথে আমার চেম্বারে আলোচনা করব। আসুন আপনারা দু’জন।’
জজ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কুয়াশা-২৩
১৩৭
নয়। জজ সাহেবের চেম্বারে রিজভী সাহেব তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘ইওর অনার, আমার বক্তব্য অতি সরল। কুলী হোসেনের কাছ থেকে নাসিম ত্রিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল সেটা ঠিকই। ১০ মার্চ ফেরত দেবার লাস্ট ডেট ছিল একথাও ঠিক। কিন্তু সেইদিনই যে অন্য একটা দুর্ঘটনা ঘটবে তা কেউ ভাবেনি। কুলী হোসেন গত ৩ মার্চ মারা গেছে। তাকেও খুন করা হয়েছে। কে। করেছে তা এখনও জানা যায়নি। এমন কি । মুত্যুর ঘটনাটা পর্যন্ত এখনও প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া কুলী হোসেন নিজে তার দলের সরদার ছিল না। ছিল অন্য একজন। তার নাম…,’ রিজভী সাহেব থামলেন। আবু মুরাদ। অবাক হবেন, ইওর অনার। সে-ই কুলী হোসেনকে খুন করেছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পুলিস খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে। ঘটনার দিন কুলী হোসেনের নামেই সে জারকা। হোটেলে একটা রুম ভাড়া নেয়। এটা আমি আদালতে প্রমাণ করতে পারতাম, যদি সাক্ষ্যদানের আইনের এখতিয়ার ব্যাপকতর হত । আমি এটাও প্রমাণ করতে। পারতাম যে, মিসেস আজিম ট্রেনে চাপেননি। তিনি স্বামীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে নিজে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল জারকায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ড. আজিমওঁ গোপনে তাঁকে অনুসরণ করে সেই হোটেলে গিয়েছিলেন। কারণ ভদ্রমহিলা আবু মুরাদের সাথে গুপ্ত-প্রেমে মত্ত ছিলেন।
কিন্তু আবু মুরাদ তো ময়মনসিংহ গিয়েছিল?’
যায়নি, ইওর অনার। যাবার কথা ছিল, তা ঠিক। হোটেলে যখন আবু মুরাদ ও মিসেস আজিম প্রমোদে মত্ত ছিলেন তখন ড. আজিম পাশের রুমটা ভাড়া নেন এবং ওখান থেকে ওয়াল-সুপার লাগিয়ে টেপ-রেকর্ডার মারফত ওদের আলাপ বিলাপ শোনেন। কিছুক্ষণ পরে মিসেস আজিম বাসায় চলে যান। পরিকল্পনাটা ছিল, তিনি বাসায় যেয়ে নাসিমকে বলে আসবেন যে, রাতে তিনি তার এক মামার বাসায় থাকবেন,’ মি. রিজভী একটু থামলেন।
তিনি চলে যাওয়ার পর ড. আজিম তাঁর স্ত্রীর লীলা-সঙ্গীটির পরিচয় জানতে পাশের রুমে যান। রুমটাতে ম্লান আলো জ্বলছিল। আবু মুরাদ মিসেস আজিমের প্রত্যাবর্তনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করে সে ড. আজিমকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল। কিন্তু আবু মুরাদ অভিজ্ঞ। সে পাকা অপরাধী। যে-কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা সে করতে জানে। সে জানত যে ড. আজিম তাকে চিনতে পারেননি, চেনবার সুযোগও সে দিতে রাজি নয়। সুতরাং সে অত্যন্ত শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট ড. আজিমের চোখের দিকে জ্বালিয়ে তার চোখ দুটো ধাধিয়ে দিল। পরক্ষণেই একটা চেয়ার ছুঁড়ল এবং তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে ভেবেছিল যে, ড.
ভলিউম-৮
১৩৮
আজিমকে বেকায়দায় ফেলে সে নিজের পরিচয় গোপন রেখেই পালিয়ে যেতে পারবে। ড. আজিম তার পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন। ধস্তাধস্তির সময় এক ফাঁকে রিভলভার থেকে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। আবু মুরাদের উপস্থিত বুদ্ধি অপরিসীম। সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে শুয়ে পড়ল। মারাত্মকভাবে আহত হবার ভান করে পড়ে রইল সে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে ড, আজিম চলে গেলেন মিসেস রহমানের বাসায়। তাকে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বললেন। ঐ মুহূর্তে কি করা উচিত তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না । তবে এর ফলে যে বিশ্রী কেলেংকারীর সৃষ্টি হবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা যেকোন মূল্যে পরিহারের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ভাবলেন, তিনি যে ট্রেন থেকে নেমে এসেছেন একথা এক মিসেস রহমান ছাড়া আর কেউ জানেন না। তিনি স্টেশনে ফোন করে জানতে পারলেন যে, সাড়ে ন’টায় একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ভৈরবে যাবে। তিনি সেই ট্রেনে ভৈরবে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম চলে যাবেন বলে স্থির করলেন।
খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে মি, রিজভী বলে চললেন, ইতিমধ্যে হোটেলের কক্ষে তখন আৰু মুরাদ উঠে দাঁড়িয়েছে। এবং টেলিফোনে মিসেস আজিমকে খবরটা দিয়েছে। মিসেস আজিম সবটা শুনে বুঝলেন, ড. আজিমকে অবশ্যই এখন মিসেস রহমানের বাসায় পাওয়া যাবে। সুতরাং দু’জন পরামর্শ করে দুটো ভিন্ন দিক থেকে মিসেস রহমানের বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন। দু’জনের। সাক্ষাৎ কোথায় হোল বলতে পারব না। কিন্তু ড. আজিম যখন মিসেস রহমানের বাসা থেকে বেরিয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলেন সম্ভবত তখনই পথে অথবা তিনি স্টেশনে পৌঁছুবার পর দুজন মিলে তাকে খুন করে । আবু মুরাদ জানত, নাসিম তখন তারই আড্ডায় জুয়া খেলছে। সুতরাং সি ড. আজিমের লাশটা সাময়িকভাবে কোথাও লুকিয়ে রেখে আড্ডায় চলে যায় । বিং নাসিমের হুইস্কির বোতলে কড়া মাদক দ্রব্য মিশিয়ে দেয়। নাসিম অসুস্থ হয়ে তার এক বন্ধুর সাহায্যে বাসায় চলে যায়। পরে আর মুরাদ নাসিমের গাড়ি নিয়ে তাতে লাশটা তুলে রাস্তার উপর ফেলে তার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। তার আগেই মৃতদেহের বাঁ হাতে কুলী হোসেনের
তাবিজ ও পকেটে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স রেখে দেয়।’
আপনি এগুলোকে সত্য বলে জানেন? এর প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য! একেবারে পানির মত স্বচ্ছ!’ ব্যঙ্গ করলেন সরকারি কৌসুলী।
তাঁর কথায় কান না দিয়ে রিজভী সাহেব বললেন, চট্টগ্রামে রওয়ানা দেবার সময় ড. আজিম মিসেস আজিমকে পরদিন সকালেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বোরখা পরে চট্টগ্রাম যেতে বলবার জন্যে মিসেস রহমানকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, নিজের ইজ্জত রক্ষার জন্যে মিসেস আজিম এতে অমত করবেন না। পরে চট্টগ্রামে দু’জন বোঝাপড়া করে নেবেন এবং দরকার হলে একে অনাকে কুয়াশা-২৩
১৩৯
অ্যালিবি দেবেন। তদনুযায়ী মিসেস রহমান কয়েকবার মিসেস আজিমকে ফোন করেন। মিসেস আজিমকে পাওয়া যায় রাত একটায়। তাঁকে তাঁর স্বামীর অভিলাষ জ্ঞাপন করেন। মিসেস আজিম বুঝতে পারলেন, এটা তার পক্ষে সুবিধাই হবে। চমৎকার অ্যালিবাই হবে তার। পরদিন সকালেই বোরখা পরে চট্টগ্রাম চলে যান তিনি। কিন্তু একা নন, সঙ্গে ছিল আবু মুরাদ। মিসেস রহমান আশা করেছিলেন যে, ড. আজিম নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম থেকে তাকে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি কোন ফোন পাননি। কোন চিঠিও নয়, পেলেন একটা, টেলিগ্রাম। ড. আজিম পাঠিয়েছেন টেলিগ্রামটা। তাতে লেখা ছিল যে, তাদের দুজনের মধ্যে মতৈক্য হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে কেন যে ফোন করা হয়নি অথবা কোন চিঠি লেখা হয়নি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ইওর অনার। অথচ শহীদ খান উ. আজিমের কণ্ঠস্বরের সাথে পরিচিত ছিল না বলে তার কাছে আবু মুরাদ ড. আজিমের পরিচয় দিয়েই ফোন করেছিল।
সবই তো বুঝলাম। অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব আপনি প্রমাণ করবেন কেমন করে?’
| ‘সবটা প্রমাণ করার সাধ্য আমার নেই, তবে অনেকখানিই আমি প্রমাণ করতে পারি। তাছাড়া আমি প্রমাণ করতে যাচ্ছিও না, প্রমাণ করবে পুলিস। আপনার কাছে তাই আমার আবেদন, হোটেল জারকার রেজিস্টারে আবু মুরাদের যে সই আছে–অবশ্য কলী হোসেন নামে, সেটা আবু মুরাদের হস্তাক্ষরের সাথে তুলনা । করলেই অনেক কিছু জানা যাবে। কুলী হোসেনের আড্ডায় নতুন করে খোঁজ নিলেও জানা যাবে যে, সে কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছে। তাছাড়া ড. আজিম
যে মারা গেছেন, খোঁজ নিলে তাও জানা যাবে।’
‘বেশ,.তাহলে আসামীকে খালাসের আর নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছি। আপনারা যান।
রিজভী সাহেব আদালত-কক্ষের ভিতর দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শহীদ, শাহানারা ও মিসেস রহমান তার দিকে এগিয়ে এল। অপরিচিত একটা লোকও এগিয়ে গেল রিজভী সাহেবের দিকে । ওদেরকে এড়িয়ে রিজভী সাহেব অপরিচিত লোকটার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকটা ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই রিজভী সাহেব নীরেন সেনকে বললেন, নীরেন বাবু, আমাকে এখুনি ভাই যেতে হচ্ছে। আপনি সামলাবেন বাকিটা। শহীদ সাহেব, আমি ঘুরে আসছি।’ বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন তিনি। সামনেই একটা হোণ্ডা। তার এঞ্জিন্টা চালুই ছিল। লাফ দিয়ে তিনি হোণ্ডায় চড়ে বসলেন। একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তার হোণ্ডাটা।
নীরেন বাবু অবাক হয়ে বললেন, “আরে, এ কি ব্যাপার! উনি চললেন কোথায়! ১৪০
ভলিউম-৮
শাহানারাও অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ করে চলে গেলেন যে রিজভী সাহেব!” মিসেস রহমানের চোখেও প্রশ্ন।
শহীদ হেসে বলল, বুঝতে পারলেন না? কুয়াশা চলে গেল। ওর কাজ শেষ।’
ভিড়ের মধ্যে সেই অপরিচিত লোকটাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
কুয়াশা-২৩
১৪১
Leave a Reply