২২. নাগিনী [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ২২
প্রথম প্রকাশঃ মার্চ, ১৯৭০
এক
ভোর।।
প্রদোষলগ্নের আলো-আঁধারীতে পৃথিবীটা এখন ধূসর। এখুনি আঁধার কেটে যাবে। সূর্য উঠবে। আলোয় ঝলমল করবে চারদিক। গুলশান আবাসিক এলাকাটা। এখনও নিশ্চপ।
স্পন্দনহীন।
পথ জনবিরল। শুধু দু’একজন টুপি পরা লোককে হেঁটে আসতে দেখা যাচ্ছে। নামাজ আদায় করে ফিরছে তারা। বায়ু-সেবীর দল এখনও বেরোয়নি। এখুনি অবশ্য তাদের বেরোবার সময় হবে।
সবুজ রংয়ের একটা নতুন ট্রায়াম্ফ গাড়ি এসে থামল প্রায় অচেতন গুলশানে শহীদ খানের বাড়ির দোরগোড়ায়। গাড়ির আরোহী একজনই। সুন্দরী এক তরুণী। দুরজা খুলে গাড়ি থেকে নামল সে। সুন্দর মুখটা নিদ্রাহীনতায় পার এবং কোন এক অজ্ঞাত কারণে চোখে-মুখে গভীর উদ্বেগের চিহ্ন আঁটা। কান্নার দরুনই হোক আর ঘুমের অভাবেই হোক চোখ দুটো লাল। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুলগুলো
অবিন্যস্ত। কপালের উপরও ছড়িয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ কুন্তল। দামি শাড়িটার পাট নষ্ট হয়ে গেছে। নিজের প্রসাধনহীন অবিন্যস্ত বেশভূষার দিকে কোন লক্ষ্য নেই তার।।
তরুণী গাড়ি থেকে নেমে শহীদ খানের বাড়ির ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। গেট খোলাই ছিল। শহীদের আব্বা ইসলাম খান সাহেব নামাজ পড়তে গেছেন গেট খোলা রেখে।।
তরুণী গেট পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠল। দরজায় সজোরে ঘা দিল।
একটু পরেই বেরিয়ে এল গফুর। এই সাত-সকালে সে বি-বসনা অপরিচিত রমণী-মূর্তি বোধহয় আশা করেনি। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে সে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে মাত্র কিছুক্ষণের জন্যেই। সংবিৎ ফিরে পেতেই গফুর বলল,
আসুন, কাকে চাইছেন? দাদামণিকে? কিন্তু উনি তো নেই। বিলেত গেছেন।’
উনি নেই? আশাভঙ্গের আভাস পাওয়া গেল তরুণীর কণ্ঠে। লীনা, লীনা আছে?’ কি যেন ভেবে নিয়ে বলল সে। কুয়াশা-২২
| জ্বী। আপা আছেন। ঘুমাচ্ছেন বোধহয় এখনও। আমি ডেকে আনছি। আপনি ড্রইংরূমে বসবেন, আসুন।
তরুণীকে ড্রইংরুমে বসিয়ে গফুর লীনাকে খবর দিতে চলল।
তরুণী বলল, ‘শোন, লীনাকে বল গিয়ে, রোজিনা এসেছে দেখা করতে । বিশেষ দরকার। | ‘কি যে দরকার তা তো বুঝতেই পারছি। নইলে এমন সাত-সকালে কষ্ট করে আসবেন কেন?’ সহানুভূতি ভরা গলায় বলল গফুর। কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হল তরুণী রোজিনা। বিষণ্ণতা ভেদ করেওচহারায় ফুটে উঠল বিরক্তির ছাপ। গফুর
অ লক্ষ্য করল না ।।
বেশভূষাটা গুছিয়ে নিয়ে রোজিনা একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসল। চোখ দুটো বন্ধ করে বসে রইল সে লীনার প্রতীক্ষায়।
পাতলা ছিপছিপে মেয়েটি। মাঝারি উচ্চতা। শ্যামবর্ণ। চেহারাটা খাড়া তলোয়ারের মত ধরাল। চাপা ঠোঁটে দৃঢ়তার আভাস। চোখ দুটোতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং কিছুটা সতর্কতার ছাপ।
মিনিট দশেক পরে লীনা এল। বাইরে স্যান্ডেলের শব্দ শুনে সোজা হয়ে বসল রোজিনা। লীনার দৃষ্টিতে বিস্ময়। ড্রইংরুমে ঢুকে গোজিনাকে দেখেই বলল, “ওমা, তুই! এ য়ে অবিশ্বাস্য! তা হয়েছে কি? এই কাকডাকা ভোরে কি মনে করে?’
হয়েছে একটা কিছু। সুসংবাদ নয়। বোস তুই।’
লীনা, নীরবে জরিপ করল রোজিনাকে। তারপর রোজিনার পাশে বসে বলল, ‘তোকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? দাঁড়া, আগে চা খেয়ে নিই। তারপর শুনব, উঠে দাঁড়াল সে।। | ‘চা পরে হবে। এদিকে বড় বিপদ। আগে শোন। চা খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে।
‘বিপদ?’ আবার বসে পড়ল লীনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রোজিনার দিকে।
শায়লাকে মনে আছে তোর? আমাদের সাথে পড়ত। মীর্জা কবীর হোসেনের মেয়ে। বড় একটা গাড়ি করে স্কুলে আসত।’
| ‘কোন এক শিল্পপতির সাথে বিয়ে হয়েছিল তো?’।
হ্যাঁ, সাদেক আহমদের সাথে। আহমদ টেক্সটাইল মিলসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
‘খুৰ মনে আছে। | হ্যাঁ, সে-ই। চোরি বড় বিপদে পড়েছে। তাই তোর কাছে ছুটে আসা। জানিস না বোধহয় যে, বছর দুয়েক আগে সাদেক সাহেব অর্থাৎ শায়লার স্বামী মোটর অ্যালিডেন্টে মারা গেছেন।
ভলিউম-৮
F
তাই নাকি!’
হ্যাঁ। যাই হোক। শশা। শায়লার একটি মাত্র সন্তান। এক ছেলে। পাঁচ বছর বয়স, থামল রোজিনা।
ই। তারপর? ‘খোকন মানে, শায়লার ছেলেটা গতরাতে চুরি হয়ে গেছে। ‘চুরি হয়ে গেছে! আর্তনাদ করে উঠল লীনা।
চুপ করে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রোজিনা। তারপর ধীরে ধীরে বলল, হা। বুঝতেই পারছিস, কি ভয়ানক বিপদে পড়েছে শায়লা। বেচারি সেই কাল রাত থেকে কাঁদছে। এখন কেন যেন বোধশক্তিহীন স্থবির হয়ে গেছে। যেমন করে হোক হেলেটাকে খুঁজে পেতেই হবে। তাই তো তোর কাছে ছুটে এসেছি।
‘কিন্তু দাদা তো নেই। এমন কি কামাল ভাইয়াও নেই, চিন্তাজড়িত কঠে বলল লীনা।.পুলিসে খবর দেয়া হয়েছে?
। সেটা সম্ভব নয়।’ ‘কেন?’ একটু অবাক হল লীনা।
যারা শায়লার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে তারা একটা ছোট চিরকুটও রেখে গেছে। তাতে লেখা আছে–পুলিসের কাছে গেলে ছেলেটাকে জীবিত পাওয়া যাবে না। মেরে ফেলা হবে।’
‘ওমা! কি ভয়ঙ্কর, আঁতকে উঠল লীনা। তাহলে জেনেধদের উদ্দেশ্যটা কি? চায় কি তারা?’ | ‘তা তো এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। তবে যদূর মনে হয়, টাকার লোভেই ওরা খোকনকে চুরি করেছে।
লীনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তাহলে এখন কি করতে চাস? দাদা থাকলে তো কোন কথাই ছিল না। এক কাজ করি, দাদাকে ফোন করে দিই। কাল-পরশু এসে যাবে।
মাথা নাড়ল রোজিনা। না না। অতক্ষণ অপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে সব নয়। বুঝতেই পারছিস, শায়লা পাগল হয়ে যাবে ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি ফিরে মা পেলে।
|
.
‘কিন্তু নয়। আমার কথা শোন্। শায়লাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই হবে। আর এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এখন একজন লোকই। বুঝতেই পারছিস।’
‘দুই নিশ্চয়ই কুয়াশার কথা বলছিস? রাইট। আমার মনেই আসেনি কথাটা। কিন্তু তাতে আবার ছেলেধরা চটবে না তো? আর চটে গিয়ে
‘সে আশঙ্কার কথা যে আমাদের মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু তবু তেৰে কুয়াশা-২২
দেখলাম, সেটাই একমাত্র পথ। শায়লারও তাই মত। ওদের ম্যানেজার অবশ্য রাজি নয়। কিন্তু এছাড়া আর কি করার আছে? উনি তো তোদের আত্মীয়। তোর বৌদির ভাই। তাই না?
লক্ষ্মী বোনটি, যেমন করে হোক তার সাথে কন্ট্যাক্ট করে এই বিপদের কথাটা বল । শুনেছি, মানুষের বিপদে উনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিশ্চয় শায়লাকে সাহায্য করতেও রাজি হবেন। উনি বোধহয় ঢাকাতেই আছেন।’
‘গতকাল পর্যন্ত ছিলেন জানি। আজকের কথা বলতে পারব না।’ চল। দরকার হলে আমিও তোর সাথে কুয়াশার কাছে যাব।’
যাবার দরকার হবে না। আমি এখুনি ফোন করে ওকে ডেকে আনছি। তুই বরং ওঠ। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড়টা বদলে নে। সারারাত তোর উপর দিয়েও নিশ্চয়ই ধকল কম যায়নি। বোধহয় রাতে তোের খাওয়াটাও হয়নি।’
তা অবশ্য হয়েছে। আর খেতে গিয়েই তো এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা ঘটল,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রোজিনা।
আচ্ছা, সে পরে শোনা যাবে। ওঠ এখন, লীনা টেনে তুলল রোজিনাকে।
নাস্তা শেষ হবার পরপরই কুয়াশা এসে পৌঁছল। তখনও লীনা ও রোজিনা ডাইনিং টেবিলে বসে।
ইতিমধ্যে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টেছে রোজিনা। বিষাদ সত্ত্বেও অনেক সতেজ দেখাচ্ছে তাকে।
খবর দিল গফুরই। জানাল, কুয়াশা দাদামণি এসেছেন।’
‘এসেছেন? যাঁ, ওঁকে এখানেই নিয়ে আয়। আর জলদি চায়ের পানি নিয়ে আসবি।’
‘সে কথা কি আবার আমাকে বলতে হবে? বেরিয়ে গেল গফুর। কুয়াশা এসে ঢুকল একটু পরেই।
| ‘কি, লীনু দিদিমণি, হঠাৎ এমন সকাল বেলায় তলব! ব্যাপার কি? মহুয়াদের কোন খবর এসেছে নাকি?’
কথা বলতে বলতেই কুয়াশার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রোজিনার দিকে। রোজিনাও কুয়াশাকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। | ‘একটা বিপদে পড়ে গেছি, ভাইয়া। আমার এক বান্ধবীর সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার পাঁচ বছরের একমাত্র সন্তান গতরাতে চুরি হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন।
‘ছেলে চুরি হয়েছে, কার?’ দৃষ্টি ঘুরিয়ে রোজিনার দিকে তাকাল কুয়াশা।
ইনি আমার বান্ধবী রোজিনা। রোজিনা হক। আর উনিই হচ্ছেন কুয়াশা।’ অভিবাদনের ভঙ্গিতে দুজনই মাথা নাড়ল। ‘ওরই?’ কুয়াশা বলল।
ভলিউম-৮
। ওর নয়। ছেলেটা ওর খালাতো বোনের। তার পক্ষ থেকে ও এসেছে আপনার সাহায্য চাইতে। আপনাকে সাহায্য করতেই হবে। “না” বললে আমি শুনছি না। আরে, আপনাকে বসতেই বলা হয়নি!
একটা চেয়ার টেনে বসল কুয়াশা। সিগারেট ধরাল একটা। নীরবে কিছুক্ষণ সিগারেট টানল। তারপর রোজিনার উদ্দেশ্যে বলল, “মিস হক, ব্যাপারটা খুলে বলুন ।
গফুর চায়ের সরঞ্জাম রেখে চলে গেল। লীনা টেনে নিল ট্রে-টা।
রোজিনা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলল, সাদেক আহমদ সাহেবের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। আহমদ টেক্সটাইল মিলসের মালিক ছিলেন ভদ্রলোক। বছর দুয়েক আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
মাথা নাড়ল কুয়াশা।।
তার একটাই ছেলে । ভদ্রলোক বিয়ে করেছিলেন আমার খালাতো বোনকে। অবশ্য সম্পর্কটা কাছের নয়। তবে ঘনিষ্ঠতা আছে। তাছাড়া মিসেস আহমদ অর্থাৎ শায়লা আমার ক্লাস-ফ্রেও ছিল ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত। লীনাও। বছর সাতেক আগে শায়লার বিয়ে হয়। ওদের পাঁচ বছরের একটি ছেলে আছে। একমাত্র সন্তান। সাদেক দুলাভাই মারা যাবার পর শায়লা গতকালের আগ পর্যন্ত একটা দিনের জন্যেও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। কোনদিন কোন অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়নি। গতকাল কি মনে করে বলল চল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। প্রিন্সেস আমিনার নাচ দেখে আসি।
একটু থেমে রোজিনা বলল, নাচ দেখে লাউঞ্জে বসে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। অনেক পরিচিত লোকের সাথে দেখা হল। কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল। ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা।
মিসেস আহমদ থাকেন কোথায়? টঙ্গীতে।’ “আপনিও কি সেখানেই থাকেন?
। আমার বাসা পুরানা পল্টনে। প্রতি শনিবার আমি টঙ্গীতে যাই। রোববারটা সেখানে কাটিয়ে সোমবার সকালে ফিরি। কালও গিয়েছিলাম সেখানে।
যদি কিছু মনে না করেন•••?’ কুয়াশা আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল। ‘আমি একটা ব্যাংকে চাকরি করি। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, আনম্যারেড।’
তারপর?
রাত এগারটার দিকে শায়লার বাড়িতে ফিরলাম। শায়লা সোজা চলে গেল ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে দেখে, বিছানা শূন্য। ছেলে নেই। আয়াটা ঘুমোচ্ছ। এঘরে-ওঘরে খোঁজাখুজি করা হল। কিন্তু খোকন নেই। অনেক ধাক্কাধাক্কি করার কুয়াশা-২২
পর আয়ার ঘুম ভাঙল। আশ্চর্য! এতদিন জানতাম আয়াটার ঘুম পাতলা । অথচ গতরাতে অনেক কষ্টে তার ঘুম ভাঙাতে পারলাম । কিন্তু আয়া কিছুই বলতে পারল
। বরং উল্টো বমি করে ঘর ভাসাল । ওকে অত্যন্ত অসুস্থ দেখাচ্ছিল। মনে হল, ওকে কোন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল।’
‘তাই হবে হয়ত।
শায়লা তো কাঁদতে লাগল । অগত্যা হাল ধরতে হল আমাকেই। মিলের ম্যানেজার মহীউদ্দিন সাহেবকে ফোন করলাম । ইতিমধ্যে থোকনের বিছানায়
একটা চিরকুট পাওয়া গেল। ইংরেজিতে টাইপ করা। বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ
“তোমার ছেলেকে নিয়ে গেলাম। আপাতত নিরাপদেই থাকবে। পুলিসে খবর দিলে আর ছেলের মুখ দেখতে পাবে না। পরবর্তী নির্দেশের জন্যে আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা কর।” প্রেরকের নাম-ঠিকানা নেই। ‘চিঠিটা কে পেয়েছিল?’ কুয়াশা প্রশ্ন করল।
আমিই পেয়েছিলাম চিঠি। বালিশের পাশে ছিল । নিয়ে এসেছি চিঠিটা, ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে কুয়াশার হাতে দিল মেজিনা।
কুয়াশা পড়ল চিঠিটা। তারপর প্রশ্ন করল, ম্যানেজার সাহেব এসে কি বললেন?
‘তেমন কোন ডিসিশন দিতে পারলেন না। উনিও হতভম্ব হয়ে গেছেন। তবে ওঁর ইচ্ছে ছিল পুলিসকে জানাবার। কিন্তু আমি রাজি হইনি। শায়লাও না। অতটা ঝুঁকি নেয়া আমি সঙ্গত মনে করি না। কারণ, ছেলেধরাদের আসল উদ্দেশ্যটা এখনও জানা যায়নি। আর অন্তত পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত খোকন নিরাপদে থাকবে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও যায় না। যদি.যদি একটা সর্বনাশ হয়েই যায়,’ ঢোক গিলল রোজিনা। মিনতিভরা দৃষ্টিতে সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই আমি এসেছি আপনার সাহায্য চাইতে। আপনি ছাড়া কেউ এই বিপদ থেকে শায়লাকে উদ্ধার করতে পারবে না।’
লীনা কুয়াশার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরা! কুয়াশা। নীরবে লম্বা টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছাড়ল।
রোজিনা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে সকরুণ আবেদন। কে জানে কুয়াশা রাজি হবে কিনা।
রোজিনা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। বুঝতেই পারছেন, শায়লা কেমন কষ্ট পাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকালে আমারই বুক ফেটে যায়।’
| এতক্ষণে মুখ খুলল কুয়াশা। সে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, কি ধরনের সাহায্য আপনারা আমার কাছে চাইছেন। ছেলেধরা দলটা যদি খোকনের জন্যে
ভলিউম-৮
১০
বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে তাহলে মিসেস আহমদ কি তা দিতে রাজি আছেন? তার পক্ষে কি বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়া সম্ভব?
“নিশ্চয়ই সম্ভব। ওরা বিরাট বড়লোক। কয়েক কোটি টাকার মালিক। টাকা দিতে শায়লার কোন আপত্তি নেই। শুধু সে তার ছেলেটাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেতে চায়। আমাদের ধারণা, আপনি যদি এগিয়ে আসেন তাহলে খোকনকে আমরা খুব তাড়াতাড়িই ফিরে পাব। আর এ কাজটা শুধুমাত্র আপনার দ্বারাই সম্ভব। আমরা ছেলেধরাদের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ প্রত্যাশা করছি আজকে। যদি এখুনি আমার সাথে আসেন তাহলে হয়ত নির্দেশটা আপনিও দেখতে পাবেন, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারবেন। লীনু, তুইও চল না আমাদের সাথে?
‘আমি…’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল লীনা। চল না তুমিও, লীনা?’ কুয়াশাও অনুরোধ করল। ‘বেশ চলুন, আমিও যাব, লীনা রাজি হয়ে গেল।
‘ছেলেটাকে কিভাবে চুরি করেছে তার হদিস পাওয়া গেছে কিছু?’ কুয়াশা জানতে চাইল।
রোজিনা বলল, ‘খোকন দোতলার উত্তর দিকের কামরায় ছিল । মই লাগিয়ে দোতলায় উঠেছিল ওরা। একটা জানালার নিচে মাটির উপর মই রাখার চিহ্নও দেখতে পাওয়া গেছে। আর পিছনের দেয়ালের বাইরে একটা মই পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বাগানের মধ্যে দেয়াল পর্যন্ত পায়ের দাগও দেখা গেছে। মনে হয়, ছেলেধরা দুজন, এসেছিল। অন্ততঃ দু’জন টুকেছিল বাগানের মধ্যে।
কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, ‘মিসেস আহমদ বা আপনি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন নাকি?’
সন্দেহ–না, কাউকে তো সন্দেহ করার মত দেখছি না। চাকর-বাকর? আয়া?’
না, তারা সবাই বিশ্বস্ত। আর তাছাড়া ওরা সবাই খোকনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে । চাকর-বাকরগুলো অধিকাংশই পুরানো। কেউ কেউ তো গৃত বিশ বছর, ধরে আছে ও বাড়িতে।
চাকর-বাকর সবাই এই দুর্ঘটনার কথা শুনেছে তো?”
হ্যাঁ, শুনেছে সবাই। বাইরে এ ব্যাপারে ওদের আলাপ করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে? ‘মহীউদ্দিন সাহেব এ সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করে দিয়েছেন।
সিগারেটের শেষাংশ ছাইদানিতে ফেলে কুয়াশা বলল, আপনি বলছেন, চাকর-বাকররা সবাই বিশ্বস্ত। তাহলে, তাহলে।
তাহলে কি? কুয়াশা-২২
তাহলে মিসেস আহমদ যে কাল রাতে বাসায় থাকবেন না তা ছেলেধরারা জানল কি করে?
রোজিনা বোকার মত কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
লীনা বলল, আপনি বলছেন, মিসেস আহমদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েছে ছেলেধরাগুলো। কিন্তু মিসেস আহমদের উপস্থিতিতেও তো খোকন চুরি হতে পারত? | উঁহু, কুয়াশা বলল। “মিস হক তো নিজেই বলেছেন, গত দু’বছর মিসেস আহমদ বাড়ির বাইরে বেরোননি মোটেও, আর প্রথম যেদিন বেরোলেন সেদিনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। উনি বাসার বাইরে যাচ্ছেন, এটা বাইরের লোকদের জানবার কথা নয়। নিশ্চয়ই বাড়ির ভিতরে ছেলেধরাদের লিয়াজো আছে।’
কিন্তু সে তো অসম্ভব, জোর দিয়ে বলল রোজিনা।। অবিশ্বাসের হাসি হাসল কুয়াশা।
আমি খোনকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টার ত্রুটি করব না। আপনি আর লীনা আগে চলে যান। আমি ঘন্টাখানেক পরে রওয়ানা দিচ্ছি। ভাল কথা, কাউকে আমার আসল পরিচয়টা জানাবেন না। পারিবারিক বন্ধু বলে পরিচয় দেবেন। দরকার হলে। যতদূর মনে হচ্ছে, আমাকে মিসেস আহমদের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে দু’-এক দিনের জন্যে। সে ধরনের ব্যবস্থা করবেন। আর এই চিরকুটটা আপাতত আমার কাছেই রইল।’
| রোজিনার মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হল। সে বলল, আমাদেরও ইচ্ছে, আপনি শায়লার বাড়িতেই গিয়ে কয়েকদিনের জন্যে উঠুন। বেচারি মনে সাহস ফিরে পাবে।
রোজিনা আর লীনা যখন টঙ্গীতে মিসেস আহমদের বাসায় পৌঁছুল তখন দশটা বেজে গিয়েছে। প্রায় দুই একর জায়গা জুড়ে বিরাট দোতলা হাল ফ্যাশানের বাড়ি। নামটা সুন্দর। নীলাভ নিলয়। শায়লা নিজেই নাম দিয়েছে।
| কেয়ারি করা বাগানের পাশ দিয়ে গাড়ি-বারান্দাতে গিয়ে থামল গাড়ি। ওদের দেখে এগিয়ে এলেন বছর তিরিশেক বয়সের এক ভদ্রলোক।
| রোজিনা গাড়ি থেকে নেমে পরিচয় করিয়ে দিল। অভিবাদন বিনিময়ের পর রোজিনা প্রশ্ন করল, শায়লা কোথায়? দেখা হয়েছে ওর সাথে?
সেকথার জবাব দিলেন না মহীউদ্দিন সাহেব। বরং বিরক্তিভরে বললেন, শুনলাম, আপনি নাকি তবু সেই ডাকুটার কাছে গিয়েছিলেন-কুয়াশা না কি নাম?’
ভলিউম-৮
ঈষৎ তপ্ত হল রোজিনা। সে একটু উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এছাড়া এমুহূর্তে আর কি করতে পারতাম। হাত-পা গুটিয়ে ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চয় বসে থাকা যায় না, ম্যানেজার সাহেব?’
না না, আমি তা বলছি না,’ সুর নরম করলেন মহীউদ্দিন সাহেব। অন্তত পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত ছিল। এসব ব্যাপারে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয়। তাছাড়া এই কাজের দায়িত্ব চাপালেন এমন একজন লোকের ওপর যার নামে পুলিসের ফাইলে হাজারটা অভিযোগ লেখা আছে।’
লীনা এতক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মহীউদ্দিন সাহেবকে দেখছিল। বেশ চালাক চালাক চেহারা ভদ্রলোকের। চোখে-মুখে অহঙ্কারের ঝিলিক। এই বয়সেই মাথায় চুল বেশি নেই। কিন্তু জুলপি নেমে এসেছে গালের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
রোজিনা বলল, বিষ ক্ষয় করার জন্যে বিষেরই দরকার। অন্তত আপনাকে তা বুঝিয়ে বলবার দরকার নেই।
গাড়ির হর্ন শুনে পথের দিকে তাকাল তিনজনই। একটা নতুন মার্সিডিস ঢুকল গেটের ভেতর। গাড়িটা ওদের কাছে এসে থামল। আরোহী আর কেউ নয়, কুয়াশা স্বয়ং।
| রোজিনা কুয়াশার সাথে মহীউদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দিল। বেজার মুখে অভিবাদন জানালেন তিনি মালেকানের বিশিষ্ট অতিথিকে ।।
কুয়াশা ও মহীউদ্দিন সাহেবকে ড্রইংরূমে বসিয়ে রেখে রোজিনা লীনাকে নিয়ে দোতলায় শায়লার কামরার দিকে এগোেল। কুয়াশাকে যে মহীউদ্দিন সাহেব পছন্দ করেনি, বুঝতে দেরি হয়নি তার। কুয়াশা মনে মনে হাসল।
বিছানায় উপুড় হয়ে শায়লা তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছিল । দু’জন তাকে অনেক সান্তনা দিয়ে অতিকষ্টে নাস্তা করতে রাজি করাল। পুরানো চাকর রুস্তম আলী শায়লার কামরাতেই নাস্তা নিয়ে এল। এক টুকরো রুটি আর চায়ের বেশি মূখে রুচল না শায়লার। কোনরকমে চায়ের কাপ শেষ করে সে নেমে এল ড্রইংরূমে। রোজিনা ও লীনাও এল তার সাথে।
মহীউদ্দিন সাহেব ইতিমধ্যে কাজের ছুতো দেখিয়ে মিলে চলে গেছেন। কুয়াশা সেই ফাঁকে বাড়ির চারদিকটা এক পাক ঘুরে চাকর-বাকরদের সাথে আলাপ-আলোচনার পালাটা সেরে ফেলেছে।
শায়লা ড্রইংরূমে ঢুকেই আবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
কুয়াশা দরদভরা গলায় বলল, “আপনি কাঁদবেন না, বোন। আপনার আদরের ধনকে আমি যেমন করে পারি ফিরিয়ে এনে দেব। শান্ত হোন আপনি। আপনার কোন ভয় নেই। লীনু, ওঁকে বসিয়ে দাও।
লীনা শায়লাকে একটা সোফায় বসিয়ে দিল । নিজেও পাশে বসল।
তবু কাঁদতে লাগল শায়লা। অনেকক্ষণ কান্নার পর কিছুটা শান্ত হল সে। কুয়াশা-২২
রুস্তম আলী কয়েকটা চিঠি নিয়ে ঢুকল। সামনের টেবিলটার ওপরে রাখল চিঠিগুলো ।
রোজিনা সামনের দিকে মাথা নুইয়ে চিঠিগুলো তুলে নিচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই কুয়াশা সেগুলো হাতে নিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না। আমি দেখছি।’
দ্রুত চোখ বুলাল কুয়াশা খামগুলোর উপর। অধিকাংশই অফিশিয়াল চিঠি। সম্ভবত মিল সম্পর্কিত । একটা লাইফ ইনশিওরেন্স কোম্পানির নোটিস। দু’টো ব্যক্তিগত চিঠি। মেয়েলি. হস্তাক্ষর। শেষের চিঠিটার ঠিকানা টাইপ করা। ঠিকানাটা পরীক্ষা করে কুয়াশার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল।
| সে রোজিনার উদ্দেশে বলল, ভয়ানক ধূর্ত ঐ লোকগুলো। ওরা আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল। তাই কাল খোকনকে চুরি করে নিয়ে যাবার আগেই এই চিঠিটা জি. পি. ও.-র ডাক-বাক্সে ফেলেছে। ওরা একরকম নিশ্চিতই ছিল। নিজেদের সাফল্য সম্পর্কে।
“সে কি! চিঠিটা, মানে, এই চিঠিটা ওরাই পাঠিয়েছে?
হ্যাঁ, এবং গতকালই পোস্ট করেছে। বিকেলে, জি.পি.ও.-তে । মিসেস আহমদ খুলুন চিঠিটা, এগিয়ে দিল সে চিঠিটা শায়লার দিকে।
কম্পমান হাতে চিঠিটা নিল শায়লা। ‘আপনি কি মনে করেন চিঠিটা ওদের লেখা?
মনে করি মানে, ওটা যে ওরাই পাঠিয়েছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
চিঠিটা আঙুলের ফাঁকে ধরে বসে রইল শায়লা। তার চোখ-মুখ মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চিঠিটা খুলতে সে ভয় পাচ্ছে। তারপর মুহূর্তে সে যেন মনোবল ফিরে পেৰ্ণ। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে ছোট একটা কাগজ বের করল। ভাঁজ খুলে চোখ বুলাল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আপনি, আপনিই পড়ুন,’ এগিয়ে দিতে গিয়ে হাত থেকে চিঠিটা মেঝেতে কার্পেটের উপর পড়ে গেল।
চিঠিটা তুলল কুয়াশা।
“আপনার সন্তান সুস্থ আছে। এই চিঠির নির্দেশমত চললে আজ মধ্যরাতে আপনার সন্তানকে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবেন।
একটা সুটকেসে পাঁচ লাখ টাকা (পুরানো নোট) দিয়ে একজন বিশ্বস্ত লোককে রাত দশটার দিকে জয়দেবপুর জঙ্গলের মধ্যে কেশব বাবুর বাংলোতে পাঠিয়ে দিতে হবে। জায়গাটার মাইল দুয়েক এলাকার মধ্যে ছোটখাট ঝোঁপঝাড়। বড় গাছপালা নেই। সুতরাং চালাকি করার কোন অবকাশ নেই। আমার লোকেরা চারদিক থেকে সারাদিন নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে লক্ষ্য রাখবে। কোনরকম চালাকি করে ফল হবে না।
পুলিসকে জানালে পরিণাম হবে ভয়াবহ। কোনদিনই আপনার ছেলেকে ১৪
ভলিউম-৮
ফিরে পাবেন না আর । (শালা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল।)
আপনার লোককে একা এবং তাকে অবশ্যই মোটর গাড়িতে যেতে হবে। ঠিক রাত দশটায় তাকে বাংলোতে পৌঁছুতে হবে। আমার সাথে। আপনার ছেলে থাকবে না। তবে আমাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ তার কাপড়চোপড় দেখিয়ে দেব। নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে চললে মাঝরাতে ছেলে ফিরে পাবেন। আপনার লোককে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেব আমি। বাংলোর চারদিকে পুলিস বা অন্য কোনরকম চর পাঠালে আমি জানতে পারবই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হবে আপনার দূতকে। সে আমার সাক্ষাৎ পাবে না। মনে রাখবেন, আপনার ছেলের জীবন চরম বিপদের সম্মুখীন।”
এখানেই শেষ। চমৎকার!”
অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এল দরজার দিক থেকে। সবাই মুখ তুলল। মহীউদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। তিনি যে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ তা লক্ষ্য করেনি।
| কুয়াশা অত্যন্ত ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে মহীউদ্দিন সাহেবকে জরিপ করল। মহীউদ্দিন সাহেব একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ফলি! আমি বলি, এসব ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। পুলিসে খবর দিলেই টের পাবে বাছাধনরা।
রোজিনা বিরক্তিভরে মহীউদ্দিন সাহেবের দিকে তাকাল । সে বলল, আপনি কি চরম সর্বনাশটা ডেকে আনতে চান?”
“নিশ্চয়ই না। কিন্তু এসব ভাঁওতাবাজি। তাছাড়া টাকা দিলেই যে ওরা খোকনকে ফিরিয়ে দেবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? উপরন্তু নাগরিক হিসেবে
পুলিসে এজাহার দেওয়াটাও আমাদর কর্তব্য।
এসব বাকবিতণ্ডা বোধহয় কয়লার কানে ঢুকছিল না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কুয়াশাকে প্রশ্ন করল, ‘আ’ নি কি বলেন?’
‘আমার মনে হয়, টাকাটা দিয়ে দেয়াই ভাল। এই অবস্থায় কোনরকম ঝুঁকিই নেওয়া সমীচীন নয়।’
মহীউদ্দিন সাহেব, সরবে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শায়লা তাকে বলল, তাহলে মহীউদ্দিন সাহেব, আপনি পাঁচ লাখ টাকার ব্যবস্থা করুন। আজ বিকেলের মধ্যেই চাই।।
কিন্তু এতো অসম্ভব! এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে নগদ এতগুলো টাকা কোথায় পাওয়া যাবে?
‘পেতেই হবে। যেভাবেই হোক, মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বলল শায়লা। আপনি এখুনি চলে যান। ব্যাংকে আমি ফোন করে দিচ্ছি। কুয়াশা-২২
মহীউদ্দিন সাহেব প্রতিবাদ করতে গিয়েও কি মনে করে চেপে গেলেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘বেশ, আপনি যা বলবেন তাই হবে। কিন্তু কেশব বাবুর বাংলোতে টাকাটা কি আমাকেই দিতে যেতে হবে?
কুয়াশা দ্রুত বলল, না, ম্যানেজার সাহেব, ওই কষ্টটুকু আমিই করব। জায়গাটা আমার খুর ভাল করে চেনাও আছে।’
‘ওহো, টাকাটা তাহলে আপনিই নিয়ে যাচ্ছেন বাংলোতে! উত্তম ব্যবস্থা! রহস্যজনক হাসি হেসে মহীউদ্দিন সাহেব বললেন, তবু আমি বলছি, লোকগুলো ভাওতা দিচ্ছে। আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে ওদের নেই, মিসেস আহমদ। মাঝখান থেকে পাঁচ লাখ টাকাও যাবে। তাছাড়া টাকাটা যে যথাস্থানে যাবে, তারই বা ভরসা কি? | চিঠির নির্দেশ আমাকে মানতেই হবে। কথা বাড়াবেন না। আপনি এখুনি ব্যাংকে চলে যান! শায়লা মৃদু ধমক দিল।
চুপসে গেলেন মহীউদ্দিন সাহেব। মুখখানা হাঁড়ির মত কালো করে চলে গেলেন তিনি।
রাতের জন্যে প্রতীক্ষা করা ছাড়া এখন আর কারও কোন কাজ নেই। দোতলার একটা রূমে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কুয়াশার । সে সেখানে চলে গেল। তার সুটকেসটা রূমে পৌঁছে দিল চাকর।
চাকর-বাকরদের জানিয়ে দেওয়া হল যে, ছেলেধরাদের কাছ থেকে চিঠি এসেছে। খোকনকে ফিরে পাবারও আশা আছে পুরোমাত্রায়। তারা পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখার শপথ পুনরায় উচ্চারণ করল। খোকনের আয়া পাঁচপীরের দরগায় শিরনি মানত করল।
সময় যেন আজ স্থির হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা যেন ঘুরছে ধীরে, অতি ধীরে। দুপুরে নিঃশব্দে ওরা খেয়ে নিল। শায়লা তো বলতে গেলে খাবার নেড়েচেড়ে রেখে দিল। লীনা ও রোজিনারও তেমন রুচি হল না। চারটের দিকে ফিরে এলেন মহীউদ্দিন সাহেব। গাড়ির আওয়াজ শুনে শায়লা নিজেই ছুটে বেরিয়ে গেল। মহীউদ্দিন সাহেবকে প্রশ্ন করল, ‘টাকা পেয়েছেন?’ তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘পেয়েছি। তবে অনেক কষ্টে সংগ্রহ করতে হয়েছে, ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলেন মহীউদ্দিন সাহেব। কত রকম কৈফিয়ৎ দিতে হল ব্যাংককে! আমি তো সত্য কথাটা বলতেই পারলাম না, ভারি সুটকেসটা নামালেন তিনি গাড়ি থেকে।
তাতে কি? খোকন ফিরে এলেই আমি ওদের জানিয়ে দেব সব। ওরা বুঝতে পারবে তখন, শায়লা প্রবোধ দিল মহীউদ্দিন সাহেবকে।
মহীউদ্দিন সাহেব নিজেই সুটকেসটা ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন। পরমুহূর্তে কুয়াশাও ঢুকল সেখানে। শায়লাকে বলল, ‘টাকা এসে গেছে। এই সুটকেসে আছে। এখন বাকিটা আপনার উপর নির্ভর করছে। আমি নির্দেশ পালন করেছি।
ভলিউম-৮
তারা যেন তাদের কথা রাখে, সেটাই শুধু দেখতে হবে আপনাকে।’
কুয়াশা কোন জবাব দিল না ।।
একটু পরেই মহীউদ্দিন সাহেব চলে গেলেন। এবং যাবার সময় কুয়াশার প্রতি তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুললেন না।।
শায়লাকে উপরে তার শয়নকক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হল। রোজিনা তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। নিজেও খেল । লীনা কেমন যেন অস্থির এবং অসহায় বোধ করতে লাগল ।
ড্রইংরুমে বসে সিগারেট খাচ্ছিল কুয়াশা। লীনা এসে বলল, ‘একটা কথা বলব, ভাইয়া?
বল। আপনার সাথে আমাকে নিয়ে যাবেন?’ হঠাৎ তোমার এই দুর্মতি কেন?’ অবাক হল কুয়াশা। ‘নেবেন কিনা তাই বলুন আগে। কৈফিয়ৎ চাইবেন না।
হাসল কুয়াশা, তা হয় না, লীনা, ওরা বড় ভয়ঙ্কর লোক। কথার এতটুকু খেলাপ হলে সর্বনাশ রোধ করা যাবে না। যেতে হবে আমাকে একাই।’
হতাশ হল লীনা। কুয়াশা আর কোন কথা বলল না। সে সিগারেট টানতে টানতে বোধহয় কর্মপন্থা চিন্তা করতে লাগল।
রাত ন’টার সময় নেমে এল.শায়লা। একটু ঘুমিয়ে নেবার ফলেই হয়ত তাকে অপেক্ষাকৃত শান্ত দেখাচ্ছে।
কুয়াশা অভিযানের জন্যে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এল। বারান্দায় একটা চেয়ারে। বসে ছিল শায়লা। কুয়াশা তাকে বলল, আমি তাহলে চলি, বোন। দশটার সময় পৌঁছুতে হবে। আর দেরি করা সমীচীন নয়। এগারোটার মধ্যেই ফিরে আসব আশা করি।’ | রোজিনা বলল, খুব সাবধান। শায়লার সবকিছু আপনার সাফল্য-ব্যর্থতার উপর নির্ভর করছে। টাকা ভর্তি সুটকেসটা তুলে দেওয়া হয়েছে আপনার গাড়িতে।
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, লীনা কোথায়? ওকে দেখছিনে যে?’ রোজিনা বলল, সম্ভবত উপরে আছে। ডেকে দেব?’
, দরকার নেই। বিদায় নিয়ে মার্সিডিসে চাপল কুয়াশা ।
কুয়াশা নিজে বা অন্য কেউ যে কথাটা জানতে পারল না, তা হল এই যে, লীনা মাত্র কয়েক মিনিট আগেই মার্সিড়িসের বুটে স্থান করে নিয়েছে ।
২-কুয়াশা-২২
১৭
তিন
মার্সিডিসের লাগেজ-বুটটা এমন প্রশস্ত যে অর্ধশায়িত অবস্থায় লীনা তেমন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল না। কয়েক মিনিট পার হয়ে যেতেই উত্তেজনা দূর হল । তখন সে অনুভব করতে লাগল যে, সে একটা বিশ্রী হঠকারিতা করে ফেলেছে। বুটে তার উপস্থিতি যদি কোনরকমে ধরা পড়ে তাহলে খোকনকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। বিবেকের দংশনে লীনা মরে যেতে লাগল। তবুও সে বারবার নিজেকে এই বলে ক্ষীণ আশ্বাস দিতে লাগল যে, বুটে তার অবস্থান কেউ টের পাবে না। কুয়াশাও না, শত্রুপক্ষও না ।
কিন্তু একটা কাজ করলে হয় না? বুটের গায়ে কোন একটা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করলেই তো শব্দ পেয়ে কুয়াশা কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাকে খুঁজে। পাবে। সে কি ধরা দেবে এইভাবে? নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করবে? কিন্তু সে সাহস তার হল না। কুয়াশা যে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হবে, তা চিন্তা করে সে তার উপস্থিতি ঘোষণা করতে সাহস পেল না। অসহায়ের মত, নিয়তির নিষ্ঠুর খেলার। পুতুলের মত সে নীরবে নিঃশব্দে বসে রইল বুটের মধ্যে! একবার ভাবল, দেখাই যাক না। সে তো আর নির্বোধ নয়? উপস্থিত বুদ্ধিও তার আছে । বিপদে আত্মরক্ষার, শুধু আত্মরক্ষাই নয় অন্যকে রক্ষা করার শক্তিও আছে তার।
কুয়াশা জয়দেবপুরের বড় সড়ক ছাড়িয়ে ডানদিকে সরু একটা কাঁচা রাস্তায় নেমে গেল। কেশব বাবুর বাংলোটা তার চেনা আছে। বড় সড়ক থেকে মাইল দুয়েক দূরে । নির্জন পথটা কাঁচা। এবড়োখেবড়ো। মাঝেমধ্যে গর্ত। সাবধানে। এগোতে হয়।
শুক্লপক্ষের রাত। চারদিকে আলোর বন্যা। মায়াময় পরিবেশ রচনা করেছে। সেই আলোয় দৃষ্টি বহুদূর যায়।
মিনিট পনের পরে লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছুল কুয়াশা। চাঁদনী রাতে নির্জন জীর্ণ বাংলোটা কেমন যেন ভূতুড়ে বলে মনে হচ্ছে। বাংলার চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত একেবারে ফাঁকা। ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় আছে, কিন্তু বড় গাছ নেই। দূরে, অনেক দূর দিয়েও যদি কেউ হেঁটে যায় তাহলেও তাকে দেখা যাবে। আশেপাশে লুকোরার কোন জায়গা আছে বলে মনে হল না এক বাংলোর ভিতরটা ছাড়া।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে ছেলেধরাদের বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। কুয়াশা। ভাল জায়গাই বেছে নিয়েছে বটে। কারও পক্ষেই কাছেপিঠে লুকিয়ে থেকে ছেলেধরাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা সম্ভব নয়। ছেলেধরা যদি তাকে লক্ষ্য করার জন্যে কোন পাহারাদার বসিয়ে থাকে কোথাও, তাহলে সে যে একা এসেছে
তা বুঝতে তাদের বেগ পাবার কথা নয়। ১৮
ভলিউম-৮
নির্জন বাড়িটার চারদিক তাকিয়ে দেখল একবার। না, কাউকে দেখা যাচ্ছে । গাড়ি থেকে সুটকেসটা নামিয়ে মাটিতে রাখল।
চারদিকে অন্তহীন নৈঃশব্দ। কিছুক্ষণ পরে শুধুমাত্র একটি শব্দই তার কানে এল। একটা বিমান চলে গেল তেজগা বিমানবন্দর থেকে । ঘড়িতে দেখল, রাত দশট, । ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ওরা কোথায়? বাড়িটার ভিতরে? না,
তা সম্ভব নয়। প্রায় এক গজ উঁচু কাঠের পাটাতনের উপর বাড়িটা। পাটাতনের। নিচের দিকে তাকাল কুয়াশা। নিচে তরল অন্ধকার । ভাল করে দেখল। না, কেউ নেই। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল কুয়াশা। বিরাট একটা তালা ঝুলছে। সম্ভবত তালাটা দিয়েছে বন বিভাগের লোক। বাংলোটা এখন তাদেরই সম্পত্তি ।
| বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। গাড়ির দিক থেকে ক্ষীণ একটা ধাতব শব্দ ভেসে এল। কিন্তু কুয়াশা কিছু সন্দেহ করল না। নতুন গাড়ি থামিয়ে রাখলে অনেক সময় নানারকম ধাতব শব্দ হয়। কিন্তু শব্দটা হয়েছিল লীনার অসাবধানতায়। সে উৎকণ্ঠায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল।
বাংলোর সামনের প্রাঙ্গণে পায়চারি করতে লাগল কুয়াশা। মিনিট পনের পার হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখল সে। দশটা পনের।
বিরক্ত হল কুয়াশা। এভাবে উল্কণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে তার সবসময়েই বিরক্তি লাগে। কে জানে, সমস্ত ব্যাপারটাই প্রতারণা কিনা। হয়ত অন্য কোন মতলব আছে ছেলেধরাগুলোর সময় আরও পার হয়ে গেল বিলম্বিত লয়ে। | এখন দশটা তিরিশ মিনিট। নিশ্চত হল কুয়াশা, তাহলে ওরা আসছে না। নিঃসন্দেহে ওরা প্রতারণা করেছে। অধৈর্য হয়ে ঘড়ি দেখতে লাগল কুয়াশা বারবার। না, কারও আসবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এবার তাহলে ফিরে যাওয়াই ভাল। আর দেরি করার কোন অর্থ হয় না।
অকস্মাৎ অনেক দূরে অন্ধকারে ক্ষীণ দুটো আলো দেখা দিল। উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে আলো দুটো। এদিকেই আসছে। মোটর গাড়ির ক্ষীণ একটা শব্দও শোনা গেল। ক্রমশ উচ্চতর হচ্ছে শব্দটা। এগিয়ে আসছে গাড়িটা। একটু পরেই একটা কটিনা কুয়াশার খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছুল। কিন্তু সেটা থামল না। তার খুব কাছ দিয়ে ঘন্টায় পনের মাইল গতিতে চলে গেল। গাড়ির মধ্যে চালককে দেখতে পেল কুয়াশা। চালক ছাড়া গাড়িতে দ্বিতীয় কেউ আছে বলে মনে হল না তার।
কাঁচা পথ বেয়ে গাড়িটা চলে গেল অনেক দূরে! তাকিয়ে রইল কুয়াশা সেদিকে । কে জানে অন্য লোকও তো হতে পারে? ছেলেধরা দলটির লোক হলে তো এখানেই থামত। অথবা এটা সাবধানতার লক্ষণও হতে পারে।
কিন্তু ঘুরে এল গাড়িটা ইউ-টার্ন নিয়ে। আপন মনে হাসল কুয়াশা। সাবধানী লোক, সন্দেহ নেই! শায়লা বেগম কথা রেখেছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়াই ছিল কর্টিনা আরোহীর লক্ষ্য। কুয়াশা-২২
গাড়িটা কুয়াশার মার্সিডিসের কাছেই থামল। ইঞ্জিন থামিয়ে আলো নিভিয়ে গাড়ি থেকে একটা দীর্ঘকায় লোক বেরিয়ে এল। মিশমিশে কালো স্বাস্থ্যবান লোকটা। গায়ে মোটা একটা রঙিন গেঞ্জি। পরনে খাকি প্যান্ট।
| কুয়াশ্য এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। কিন্তু কথা বলল প্রথমে লোকটাই। মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে খসখসে গলায় বলল, ‘কোই গলতি হুয়া, ভাইসাহাব?’ উচ্চারণে বোঝা গেল লোকটা বাঙালী ।
‘এখন পর্যন্ত না,’ জবাব দিল কুয়াশা।।
লোকটা বলল, এই নির্জন জায়গায় গাড়ি দেখে ভাবলাম, কোন বিপদে পড়েছেন বোধহয়। হয়ত পেট্রল ফুরিয়ে গেছে। অথবা অন্য কোন ট্রাবল । হয়ত আপনার কোন সাহায্য দরকার হতে পারে।’
‘অবশ্যই। এসব খেজুরে আলাপ বাদ দিয়ে কাজের কথা শুরু করলেই পারেন,রুক্ষ গলায় বলল কুয়াশা। আমি জানি, আপনি কে আর কেন এসেছেন।
লোকটা বোধহয় একটু ধাক্কা খেল। ঠিক এই ধরনের কাটা কাটা কথা সে যেন শায়লা বেগমের দূতের কাছে আশা করেনি। সে হয়ত ভেবেছিল, শায়লা বেগম নিজেই আসবে টাকাটা নিয়ে। কি ভেবে সে বলল, “সেই ভাল। বাজে কথায় লাভ নেই। একাই এসেছেন তো?’
| ‘সন্দেহ থাকলে গাড়িটা দেখতে পারেন তল্লাশ করে।’
লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে একটা টর্চলাইট বের করে গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরটা দেখল? কেউ নেই ভিতরে।
সন্দেহ ঘুচল? গ্লোভ-বক্স আর বুট দেখবেন না?’
বুটের মধ্যে লীনার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। মেরুদণ্ডের ভিতরটা শিরশির করতে লাগল তার। ধরা পড়ে যেতে আর বাকি নেই। তারপর সব শেষ। চরম সর্বনাশের মুহূর্তটা এসে গেছে।
বুটের দিকে লোকটা এগোতে গিয়ে কি মনে করে থমকে দাঁড়াল। কুয়াশার কণ্ঠস্বরে কি যেন একটা আছে যা তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তার হাতে একটা, রিভলভার দেখা দিল মুহূর্তের মধ্যে।
| ‘থামুন আপনি,’ লোকটা বলল। ঐ খানেই দাঁড়িয়ে থাকুন। আর এক পা-ও এগোবেন না। আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনে, কুয়াশার বুকের দিকে রিভলভারটা উদ্যত করল লোকটা। দু’তিন পা পিছিয়ে মার্সিডিসের বুটের হ্যাঁণ্ডেলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
| লোকটা হ্যাঁণ্ডেলটা প্রায় ধরতে যাচ্ছিল। কুয়াশা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, ‘খলেই দ্যাখ, ওর মধ্যে তোমার মৃত্যু-পরোয়ানা আছে। বিশজন পুলিস হাতকড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। শায়লা বেগম পাঠিয়েছেন ওদের, দু’পা
এগিয়ে এল কুয়াশা কথা বলতে বলতে।
ভলিউম-৮
“খবরদার! মিথ্যা ভ্যাচর ভ্যাচর কোরো না,’ লোকটার মনে একটা নিশ্চিত সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। আমি পুটটা যাতে না দেখি তাই তুমি চাও? খবরদার! আর এক পা-ও এগিয়ে না যদি জীবন বাঁচাতে চাও,’ কুয়াশার দিকে তখনও তার রিভলভারটা উদ্যত।
খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে দুজন। লোকটা বলল, ‘পিছিয়ে যাও বলছি । তিন সেকেণ্ড সময় দিলাম। এক, দুই, তি–।’ | সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল ঘটনাটা। কুয়াশা কাত হয়ে ডান পা দিয়ে লোকটার ঠ্যাঙের দিকে একটা গুঁতো দিল। লোকটা তার বাঁ দিকে পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু পুরোপুরি পড়ে যাবার আগেই তার ডান হাতে লাথি লাগল । রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে পড়ল। উঠে দাঁড়াবার আগেই কুয়াশা তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বা হাতটা পিছন দিকে মুচড়ে দিল। আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। | তুমি একটা আস্ত গাধা। ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে এইখানে খতম করতে পারি, কুয়াশা ধীরেসুস্থে বলল । সুতরাং রিভলভার দেখিও না। আপাতত ওটা যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাক। পরে তুলে নিয়ো।’
| একটু কষ্ট করেই উঠতে হল লোকটাকে। রাগত গলায় বলল, ‘বেশ, এর পরিণাম হাড়ে হাড়ে টের পাবে! চীফকে বলে দেব আমি.। এর জন্যে শায়লা বেগমকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’
কুয়াশা বাধা দিয়ে বলল, ‘নির্দেশ ছিল, তোমার হাতে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিতে হবে। সে নির্দেশ শায়লা বেগম পালন করেছেন। এখন যা ঘটল তার জন্যে দায়ী তুমি একা। তোমার কৃতকর্মের জন্যে শায়লা বেগমকে ভাবতে হবে কেন?’ | লোকটা তার হাত ডলতে ডলতে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি লোকটা কে হে?
‘আমি যেই হই, কি এসে যায় তাতে? নিশ্চয়ই আমি গোলমাল করতে আসিনি। পুলিসও নই; ডিটেকটিভও নই। মিসেস আহমদের পরিবারের বন্ধু। তিনি আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন এবং ইচ্ছা না থাকলেও আমি এসেছি। ওখানে সুটকেসটায় টাকা আছে। কিন্তু সেটা নেবার আগে খোকনকে যে তোমরাই চুরি করেছ তার প্রমাণ দিতে হবে। তাছাড়া খোকনকে যে ফিরিয়ে দেয়া হবে সে নিশ্চয়তাও দিতে হবে।’
| সব হবে। কিন্তু তার আগে তোমার মার্সিডিসের বুটটা আমাকে দেখতেই হবে,’ কুয়াশার গাড়ির বুটের হ্যাঁণ্ডেল ধরতে ধরতে বলল তোকট! হ্যাঁণ্ডেলটা ঘুরিয়ে বুটের ঢাকনা খুলে ফেলল সে। পট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালল। একটু বিস্মিত হল লোকটা। আশাভঙ্গের বেদনাও অনুভব করল একটু। না, কোন জনপ্রাণী নেই বুটের ভিতরে। বুটটা শূন্য। কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলল সঙ্গে মতে। কুয়াশা-২২
সন্দেহ ঘুচল? তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল কুয়াশা। সন্দেহ ঘোচাননা আমার দরকার ছিল নিশ্চয়ই,’ জবাব দিল লোকটা।
স্বস্তি বোধ করল লীনাও। নিতান্তই উপস্থিত বুদ্ধির বদৌলতে সে লোকটাকে বোকা বানাতে পেরেছে।
| কুয়াশা যখন লোকটাকে ধরাশায়ী করেছিল সেই মুহূর্তটাকে সে কাজে লাগিয়েছিল। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে ওদের দুজনের অলক্ষ্যে বুট থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে ঢাকনা নামিয়ে গাড়ির তলায় আশ্রয় নিয়েছিল। সমস্তটা কাজে তার লেগেছিল মাত্র দশ সেকেণ্ড ।
নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে সেখানে পড়ে রইল সে।
অন্তত এই মুহূর্তের জন্যে সে নিশ্চিত। তার উপস্থিতি ওরা টের পায়নি। কুয়াশাও না, শত্রুপক্ষের ঐ লোকটাও না। উত্তেজনা ধীরে ধীরে প্রশমিত হতেই সে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগল ।
| লোকটা বলল, সন্দেহ নেই, শায়লা বেগম নির্দেশ নির্ভুলভাবে পালন করেছেন,’ প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাপড় বের করে বলল, ‘এটা তোমাদের বাচ্চার স্লীপিং সুট। দেখে নাও ভাল করে । বুক পকেটে ছেলেটার নামের আদ্যাক্ষর
এমব্রয়ডারী করা আছে।’
উৎসাহ দেখাল না কুয়াশা। এসব ব্যাপারে যে প্রতারণা কেউ করতে চায় না, তা সে জানে। তবু একনজর দেখে সুটটা সে পকেটে ঢোকাল।
কিন্তু পরবর্তী নির্দেশ?’ বলছি। অপেক্ষা কর, টাকাটা কোথায়?’ ‘ওই তো সুটকেসে। তোমার নাকের ডগাতেই রয়েছে।’ ‘দেখতে চাই আমি।’
বেশ তো, দেখে নাও। ভোলাই আছে। তালা দেওয়া হয়নি। দরকার হলে গুনে নাও,’ রাগে কুয়াশার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। তার ইচ্ছা করছিল, লোকটাকে প্রচণ্ড একটা লাথি মেরে খোকনের হদিস জানাতে বাধ্য করে। কিন্তু পরিণাম চিন্তা করে নিজেকে সংযত করল সে।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সুটকেস খুলল লোকটা। টর্চ জ্বেলে দেখে নিল, টাকাটা ঠিক আছে কিনা।
কুয়াশা তখন অন্য কথা ভাবছিল । গোড়াতেই তার ধারণা জন্মেছিল, এই লোকটা নিশ্চয় ছেলেধরা দলের দলপতি নয়। তার আচরণে সে-ধারণা বদ্ধমূল হল কুয়াশার । লোকটার কথা থেকেই তার ধারণার সমর্থন মিলেছে। এই লোকটাকে। বাগে পেতে কুয়াশার কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু তাতে তার কার্যসিদ্ধিও হবে
। এই ধরনের অপরাধ যারা করে তারা অত্যন্ত হুঁশিয়ার। এমনও হতে পারে যে, তাদের আসল গুরুকে লোকটা নিজেই চেনে না।।
ভলিউম-৮
১২
টাকার বাণ্ডিলগুলো পরীক্ষা করে দেখল লোকটা। কোন গোলমাল আছে বলে তার মনে হল না। সুটকেসের ডালাটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মনে হচ্ছে, সব কিছু ঠিকই আছে।’
‘এবার তাহলে তোমাদের প্রতিশ্রুতি পালন কর,’ কুয়াশা আবেদনের ভঙ্গিতে বলল ।।
‘তোমাকে এখানে আরও আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। এখন রাত এগারটা। সাড়ে এগারটা পর্যন্ত এখান থেকে তুমি নড়বে না। যদি তার আগে এখান থেকে রওয়ানা দাও, আমরা জানতে পারবই। সুতরাং ঐ চেষ্টাটা কোরো না। আসলে আমি ইতিমধ্যেই টর্চলাইট দিয়ে সিগন্যাল দিয়েছি।’
‘বেশ । তাই হবে। তারপর?’ অধৈর্য গলায় বলল কুয়াশা।
নীলাভ নিলয়ে ফিরে যাবে সোজা। শায়লা বেগমকে বলবে আমাদের পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে।’
কিন্তু মাঝরাতের মধ্যেই তোমরা ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবে বলে ওয়াদা করেছ,’ হতাশ হয়ে বলল কুয়াশা। তোমাদের কায়দাকানুন আমার আদতেই পছন্দ হচ্ছে না।’
| ‘তা না হলে আমাদের কিছুই এসে যায় না। মিসেস আহমদ তাঁর ছেলে ফিরে পাবেন। কিন্তু তা তার যখন খুশি হবে তখন নয়, আমাদের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী। অবশ্য মাঝরাতের কাছাকাছি সময়েই ফিরে পাবেন বোধহয়, বেশি দেরি হবে না।’
“কিন্তু কিভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছ?’
ধীরে রজনী, ধীরে। অস্থির হচ্ছ কেন? শোন, রাত বারটার দিকে টেলিফোন করে জানানো হবে, কখন কিভাবে ছেলেকে পাবে তোমরা,’ লোকটার কণ্ঠে এতক্ষণে আত্মপ্রত্যয়ের আভাস। প্রথম দিকে কুয়াশার ব্যক্তিত্বের সামনে অস্বস্তি বোধ করলেও টাকা ভর্তি সুটকেসটা হাতে এসে যাওয়ার পর তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। সে ভাল করেই জানে, মিসেস আহমদের দূতের পক্ষে তাদের নির্দেশ অবহেলা করার সাধ্য নেই। | সুটকেসটা নিয়ে ধীরেসুস্থে গাড়িতে উঠল লোকটা। সিটের পিছনে সুটকেসটা নামিয়ে রেখে এঞ্জিন স্টার্ট দিল। মনের আনন্দে শিস দিয়ে উঠল। গাড়িতে সঞ্চারিত হল প্রাণ। কুয়াশার উদ্দেশে হাত নেড়ে টা টা’ বলতেও ভুলল না। কিন্তু লোকটা জানতে পারল না যে, আসার সময় সে একা এলেও ফেরার পথে গাড়িতে
সে অন্য একজনকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
| লীনা পুনরায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। লোকটা যখন টাকা গুনছিল কুয়াশা তখন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। এই অবসরে লীনা মার্সিডিসের তলা থেকে বেরিয়ে লোকটার গাড়ির বুটের ভিতরে স্থান করে নিয়েছে। ভয়ঙ্কর একটা কুয়াশা-২২
ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, তা সে জানে। কিন্তু অদ্ভুত একটা জেদ তখন তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। স্বভাবতই সে ধারণা করল, খোকনকে যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে গাড়িটা এখন সেখানেই যাচ্ছে। তার একবারও মনে হল না যে, সে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই নিজের বুদ্ধির উপর গভীর বিশ্বাস জুনেছে তার। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে, এই বিশ্বাসই তাকে এই বিপজ্জনক পথে দ্বিতীয়বার পা বাড়াতে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাজার হলেও সে শহীদ খানের বোন। দরকার হলে ভাইয়ের স্থান পূরণ করতে পারবে, এমন বিশ্বাস তার আছে। ১
বারটার কয়েক মিনিট আগে কুয়াশা নীলাভ নিলয়ে পৌঁছুল। বারান্দায় বসে ছিল শায়লা বেগম। সে ছুটে এল গাড়ির কাছে। দেখা হয়েছে, দেখা হয়েছে
ওদের সাথে?’ উল্কণ্ঠিত মা প্রশ্ন করল।
শান্ত গলায় কুয়াশা বলল, ওদের একজন এসেছিল, তাকে টাকা দিয়ে দিয়েছি। আপনার ছেলে যে তাদের কাছেই আছে, তার প্রমাণ হিসেবে খোকনের স্লীপিং সুটটা ফেরত দিয়েছে। বারটার সময় তারা টেলিফোনে শেষ নির্দেশ দেবে।’ | আর কিছু বলেনি? আর কিছুই না?’ শায়লা বেগম উদ্বেগ আর নিরাশায় ভেঙে পড়ল। কোথায় আছে আমার বাবু, তা-তা বলেনি কিছু•••?’
‘ঐ ধরনের কিছু ওরা কখনও বলে না,’ বাধা দিয়ে বলল কুয়াশা। ‘টেলিফোনেই বাকিটা কলবে। এখন তো প্রায় বারটা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা ফোন করবে, আশা করছি। আপনি আপনার কথা রেখেছেন, ওরাও নিশ্চয়ই ওদের কথা রাখবে,’ আশ্বাসের সুরে বলল কুয়াশা। কিন্তু মায়ের মন এতে আশ্বস্ত হবার নয়। তার চোখ বেয়ে আবার ঝরঝর করে পানি ঝরতে লাগল। প্রচণ্ড শক্তিতে কান্না রোধ করে শায়লা ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগোল।
পিছনে পিছনে এগোল কুয়াশা। সে বলল, ব্যাপার কি! ওরা সব কোথায়? লীনা, মিস্ হক, মহীউদ্দিন সাহেব? আপনি একা কেন?’ | ‘সে কি! লীনার কথা আপনি জানেন না?’ বিস্মিত হল শায়লা। আপনি যাবার পর থেকেই তো ওকে দেখছিনে! ভাবলাম, সে বোধহয় আমাদেরকে না বলেই চলে গেছে। আপনাকেও কিছু বলেনি?”
| না তো! আমি কিছুই জানি না। এ তো আরেক ভাবনার কারণ হল দেখছি! মিস হককেও তো দেখছিনে। ঘুমোচ্ছেন বোধহয়?’
‘না। লীনার জন্যে ওরও ভাবনা হচ্ছিল। হয়ত লীনা বাসায় ফিরে গেছে। নিশ্চিত হবার জন্যে রোজিনা ঢাকায় লীনার বাসার দিকে গেছে। আর মহীউদ্দিন, সাহেব জরুরী কাজে গেছেন।’
মিস হকের সাথে কে গেছেন?
ভালভম-৮
২৪।
‘একাই গেছে সে। রোজিনা অত্যন্ত সাহসী মেয়ে । কোন কিছুতেই ভয় পায় ও।’
ভিতরে ভিতরে লীনার জন্যে উদ্বিগ্ন হল কুয়াশা। কে জানে, লীনা আবার কোন বিপদে পড়ল কিনা। এমনও হতে পারে, লীনা একা একাই কেশব বাবুর। পরিত্যক্ত বাংলোতে গিয়েছিল। সেটা বড় বিপদের কথা।
ড্রইংরুমে গিয়ে বসল কুয়াশা। একটা সিগারেট ধরাল । চুপচাপ সিগারেট টানতে টানতে সে পরবর্তী কর্মপন্থা চিন্তা করতে লাগল ।
পরিণাম সম্পর্কে এতটুকু চিন্তা না করেই লীনা কার্টিনার বুটে ঢুকে পড়েছিল। এতে যে চরম বিপদ নিহিত আছে মুহূর্তের উত্তেজনায় তা বিস্মৃত হয়েছিল। তাছাড়া তার এই অ্যাডভেঞ্চারিজমের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা তাও ভেবে দেখবার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
কিছুক্ষণ উঁচু-নিচু পথে চলার পর একটা মসৃণ পথের উপর গিয়ে উঠল গাড়িটা। বেশ দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পর গাড়ির গতিবেগ আবার কমে গেল। আবার সেই উঁচু-নিচু পথের অনুভূতি। কিছুক্ষণ চলার পর এক সময় থেমে গেল গাড়িটা। এঞ্জিনটা থেমে গেল। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে খটাশ করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল লীনা।
কে যেন দ্রুত গতিতে হেঁটে আসছে গাড়ির দিকে। কান পেতে রইল লীনা। পদশব্দটা এসে থামল গাড়ির দরজার কাছেই।
সব ঠিক আছে তো আইয়ুব আলী?’ একটা ব্যগ্র কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
জবাব এল, সব ঠিক আছে। শায়লা বেগম কোন ফাঁদ পাতবার সাহস পায়নি। পরিণতি চিন্তা করে নিশ্চয়ই।
টাকা পেয়েছ? “নিশ্চয়ই।’
‘সাবাস! আমি ভেবেছিলাম, সব ভেস্তে যাবে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লোকটা। তাহলে কেল্লাফতে ক দিয়া।।
‘অতো খুশি ভাল নয়, নওসের, চিন্তাজড়িত কণ্ঠস্বর শোনা গেল আইয়ুব আলীর। যে লোকটা টাকা নিয়ে এসেছিল সে খুব সুবিধের লোক বলে মনে হল
। বেশ কঠিন ঠাই। বড় শক্ত লোক। যে-কোনরকম বিপদে ফেলতে পারত। বলতে গেলে, আমি কোনরকমে বেঁচে এসেছি।
তার মানে! পুলিস-টুলিস নয় তো?’ কুয়াশা-২২
–
‘পুলিস নয় তাতে সন্দেহ নেই। ওদের পরিবারের বন্ধু । মিসেস আহমদ এই কাজের জন্যেই ওকে এনেছে। যাকগে, বাদ দাও ওসব কথা । আর’তো কোনদিন তার সাথে দেখা হচ্ছে না। টাকা তো হাতে এসেই গেছে। বাচ্চাটা কেমন আছে?’
চমৎকার।’ ‘কোন ঝামেলা পাকায়নি তো?’
‘মোটেও না। খাবার যা দিয়েছিলাম, সুন্দর করে খেল। আর হাজারবার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল । জাম, আইয়ুব, বাচ্চাটা বড় ভাল। বড় আদর করতে ইচ্ছে করে। কত রকম কথা বলে! আর কি মিষ্টি করে বলে!’
ঘুমোবার আগে সেই– সেই দুধটা দিয়েছিলে তো?” তা।’ খেয়েছে? ‘চেটেপুটে খেয়েছে।’
‘ভাল । তাহলে আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। রাতে আর ওকে নিয়ে ঝামেলা করতে হবে না। আর কাল থেকে তো এই পাটুই চুকে যাবে। রাতে আমরা চলে যাওয়ার পর কান্নাকাটি না করলেই হল।’
প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট শুনতে পেল লীনা। তাহলে ওরা খোকনকে মাকিদ্রব্য খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে? ক্রুদ্ধ হল সে। তবে সুখের বিষয়, ওর কোন ক্ষতি ওরা করেনি। অনেক কথাই জানতে পেরেছে সে। তার দুঃসাহসিক অভিযান একেবারে। ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু ছেলেটাকে ওরা রেখেছে কোথায়? নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও হবে । সম্ভবত এখানেই ওদের আস্তানা। তার মানে, ওদের দলপতিরও এখানে আসবার সম্ভাবনা আছে।
বাইরে কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার, সুটকেসটা নামিয়ে ফেল নওসের । এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই ভাল।’
ঠিক ঠিক।’ লীনা গাড়ির দরজা খোলার ও বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেল। ‘সুটকেসটা বেজায় ভারি,’ বলল নওসের ।।
এত কথা বল কেন? চল এখন,’ আইয়ুব আলীর বিরক্তভরা কণ্ঠ শোনা গেল।
ধীরে ধীরে পদশব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই নীরব হয়ে গেল জায়গাটা । লোক দুটো কিছুটা দূরে চলে গেছে। এখন তার নেমে পড়ার সময় এসেছে। এসেই যখন পড়েছে তখন ওদের কার্যকলাপ দেখতে হবে। চোখের আড়াল হতে দেয়া যাবে না। অতি সাবধানে সে ভিতর থেকে বুটের ঢাকনার হ্যাঁণ্ডেলটা ঘুরিয়ে ঢাকনাটা তুলে ফেলল। নিঃশব্দে মাটিতে নামল। তারপর চারদিকে তাকাতে লাগল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
ভলিউম-৮
আকাশে সাদা মেঘ জমেছে। চাঁদটা ঢেকে গেছে। কেমন যেন ঘোলাটে আধো-অন্ধকার। অনেকক্ষণ পর বুটের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এই অনুজ্জ্বল আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পারছে চারদিকে লীনা। একটা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চারদিকে বেশ উঁচু-নিচু গাছপালা। মাঝখান দিয়ে সাত-আট ফুট চওড়া কাঁচা রাস্তা। অনেকটা টানেলের মত দেখাচ্ছে। অদূরে একটা বাড়ির মত দেখা যাচ্ছে । ঠিক তার সামনে গিয়ে পৌঁছেছে লোক দুটো । লীনা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওদেরকে। সম্ভবত বাড়িটা জনহীন। বেশ উপযুক্ত জায়গাই ওরা খুঁজে বের করেছে। এটাই বোধহয় তাদের সদর দফতর। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? সে কোথায় এসে পড়েছে?
| গাছের ছায়ায় ছায়ায় দ্রুত নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল লীনা! সামনে একটা খাল কিংবা নদী। যেটাকে বাড়ি বলে মনে হয়েছিল সেটা আসলে জীর্ণ একটা পাকা দালান। নদীর তীরেই। লোক দুটো ততক্ষণে একটা নৌকোয় চেপে বসেছে। একজন বৈঠা চালাচ্ছে। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নৌকোটার দকে তাকিয়ে রইল লীনা। প্রায় হাত তিরিশেক দূরেই একটা লঞ্চের মত দাঁড়িয়ে । ঠিক লঞ্চ নয়, ক্রুজার জাতীয়, উঁচু নয় বেঁটে। জীর্ণ মলিন চেহারাটা দূর থেকেও দেখা যায়।
চমৎকার!’ ছেলেধরা দলটির প্রশংসা না করে পারল না লীনা। জঙ্গলের মধ্যে জীর্ণ বাড়ি, নদীর মধ্যে ভাঙা ক্রুজার। দূরে নদীর ওপারে, বহুদূরে দু’একটা আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে। কাছেপিঠে নিশ্চয়ই জনবসতি নেই। থাকলেও ঐ জীর্ণ ক্রুজার সম্পর্কে নিশ্চয়ই কারও উৎসাহ নেই। তাই ছেলে ধরা দলটি ওটাকেই তাদের সদর দফতর হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে নিশ্চিন্তে।
খোকনকে কোথায় লুকিয়ে : খাি হয়েছে তা জানতে পেরে শিহরণ অনুভব করল লীনা। সে দেখল ডিঙিটা ও জারের গায়ে গিয়ে ভিড়ল । সেদিকে চেয়ে রইল লীনা। কিন্তু একটু পরেই আবার লোক দুটো ডিঙিতে চাপল। লীনা ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল । নিজেকে মিশিয়ে দিল অন্ধকারের মধ্যে। একটু পরেই ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল লীনা।
নওসের বলল, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই বুঝতে পারলাম না।’ | ‘কোন ব্যাপারটা?’
‘এইভাবে ক্রুজারের কেবিনে এতগুলো টাকা রেখে দেওয়ার কি মনে আছে?’
কি করে বলব? চীফের যেমন হুকুম। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
লীনার খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছিল ওরা। ওর কানে এল, “কিন্তু এই চীফটা কে বল তো এবারে? তুমি তো আজ পর্যন্ত বললে না?’
বলবও না। শুনতে চেয়ো না। দরকারও নেই। তোমার তো টাকা পাওয় | দিয়ে কথা? সেটা পাবে কালকেই। এখন আমাদের একমাত্র কাজ হল, ঘরে ফিরে কুয়াশা-২২
L
ঘুমিয়ে পড়া। চীফ কি করল না করল, তা দিয়ে আমাদের দরকার কি? তাছাড়া…।’
পরের কথাগুলো শুনতে পেল না লীনা। ওরা তার শ্রবণ শক্তির সীমা পেরিয়ে গেছে। একটু পরেই গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ কানে এল।
তুরিও কটু পরে চলে গেল গাড়িটা
লীর্ষ খুন একা। একটু স্বস্তি বোধ করতে লাগল সে অনেকক্ষণ পরে। একটা অক্সিমের নিঃশ্বাস ফেলল সে। কিন্তু এখন সে কি করবে? কাছেপিঠে টেলিফোন পেলে কিছু একটা করা যেত। কিন্তু এখানে এই জঙ্গলের মধ্যে টেলিফোন আসবে কি করে?
| তারচেয়ে বরং সেই রহস্যজনক চীফের জন্যে অপেক্ষা করা যাক। যদি তাকে চেনা যায়। অন্তত ভবিষ্যতে চিনবার মত কোন হদিস যদি সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু তা কি যাবে?.এসব দলের সর্দাররা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি সাবধানী হয়। তবু দেখা যা । সে তো অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। এমন কি • দলের দুজনের নামও জানতে পেরেছে। দলটাকে ধরবার জন্যে সেটাই কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া সে পথ ঘাট চেনে না। এই গভীর রাতে যাবেই বা কোথায়? আর কুয়াশা নিশ্চয়ই খোকনকে নিতে আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। অবশ্য ওরা যদি কথার বরখেলাপ
করে। আর করলেও লীনা নিজেই বাকিটুকু করতে পারবে ।
সুতরাং অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।
প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো সহজে পার হতে চায় না। বারবার ঘড়ি দেখল লীনা। সময় এগোতেই চায় না। এক একটি মিনিটকে এক একটা ঘন্টা বলে মনে হয়। আর কি সাংঘাতিক মশা। বড় জ্বালাতন করছে। একটা নয়, দুটো নয়, যেন, হাজার হাজার মশা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর দুর্গত এলাকায় রিলিফ সামগ্রী এলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা যেমন লোভীর মত সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মশাগুলোও তেমনি যেন তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা মুহূর্তের জন্যেও তিষ্ঠাতে পারছে না লীনা। সারা শরীরে হুল ফোঁটাচ্ছে। অথচ শব্দ করে জুৎসই একটা থাপ্পড়ও দিতে পারছে না লীনা। হাত-পা নেড়েও খুব সুবিধা করতে পারছে না। জোরে হাত-পা নাড়াচাড়া করলে গাছের পাতায় লেগে খসখস শব্দ হবে। যদি কোন পাহারাদার থাকে তাহলে শব্দটা তার কানে গেলে ফল ভাল হবে না। কিন্তু মশাগুলো শুধু তার রক্ত শোষণ করেই খুশি নয়, কানের কাছে রেডিও পাকিস্তানের কমার্শিয়াল সার্ভিসের হাজার বার শোনা বস্তাপচা গানের মত জ্বালাতন করছে। শেষ পর্যন্ত কি তাকে মশার উপদ্রবেই রণে ভঙ্গ দিতে হবে?
দূর থেকে একটা মোটর গাড়ির শব্দ আসছে না? কান পাতল. লীনা। মনে হচ্ছে, একটা গাড়ি ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে। এই দিকেই আসছে গাড়িটা। আওয়াজটা ক্রমেই বাড়ছে। একটু পরেই আলো দেখা গেল। হেডলাইট নয় ।
ভলিউম-৮
পার্কিং-লাইট জ্বালিয়ে আসছে গাড়িটা। ধীরে ধীরে সরু পথ বেয়ে এগোচ্ছে । লতা-পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল লীনা গাড়িটা। তার সামনে দিয়ে ভাঙা, বাড়িটার কাছে গিয়ে থামল। একজন মাত্র তোক গাড়িতে। শিউরে উঠল লীনা। যদি তাকে দেখে ফেলে!
| গাড়ি থেকে নেমে এল একটা ছায়ামূর্তি। লীনার কাছে থামল সে। ডাইনে বাঁয়ে তাকাল একবার। গায়ে ঢিলে সাদা আলখেল্লা । মাথায় হ্যাট। মুখে মুখোশ । মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো বেরিয়ে পড়ল এই সময় । স্পষ্ট জ্যোৎস্নলোকে লীনা দেখল, ছায়ামূর্তি উঁচু পাড় বেয়ে নেমে গেল।
ইনিই তাহলে চীফ! ছেলেধরা দলের সর্দার! টাকা নিতে আসছে নিশ্চয়ই। হয়ত খোকনকেও নিয়ে যাবে ফিরিয়ে দেবার জন্যে। অথবা শুধু টাকাটাই নিয়ে যাবে। মিলিয়ে যাবে একেবারে। বাতাসে মিশে যাবে। কিন্তু এমন যদি হয়, খোকনকে যদি লোকটা নিয়ে যায়? যদি আবার টাকা দাবি করে? অথবা, অথবা•••ভয়ঙ্কর একটা কিছু করে বসে? লীনার মেরুদণ্ডের মধ্যে শিরশির করে উঠল।
| লোকটার হাঁটবার ভঙ্গিটা তার খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে? খুবই পরিচিত। কে লোকটা? ছায়ামূর্তি ততক্ষণে নৌকোয় গিয়ে উঠেছে। লগি ঠেলে ডিঙিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
লীনা ঝোঁপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়াল। একটা মরিস মাইনর। অন্ধকারে রং বোঝার উপায় নেই। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দ্রুত ছোট একটা টর্চলাইট বের করে পিছনের নাম্বার- প্লট খোঁজ করল।
| আরেজিস্টার্ড গাড়ি, কোন রকম নম্বর নেই। একেবারে নতুন। হার্ডবোর্ডে লেখা অনটেস্ট’। একটু নিরাশ হল লীনা। ধীরে ধীরে সে নদীর তীরে নেমে গেল । কোথা থেকে যেন খুব আস্তে আস্তে খটখট শব্দ আসছিল। কান পেতে শুনল লীনা, কিন্তু শব্দের উৎস আবিষ্কার করতে পারল না সে। মনে হল, শব্দটা বোধহয় ভাঙা ক্রুজার থেকেই আসছে। কে জানে, ওখানে কি হচ্ছে এখন। উদ্বেগে গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগল তার। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যায় না। চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে, আবার বেরিয়ে আসবে এখুনি। হয়ত চীফ’ তাকে দেখে ফেলতে পারে। দ্রুত আবার সে পাড় বেয়ে উঠে ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।
কাজটা যে সে ভাল করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল একটু পরেই। ডিঙিট ফিরে এসে তীরে ভিড়ল। লীনা দেখল, বড় একটা সুটকেস হাতে নেমে এল সেই ছায়ামূর্তি। বেঁটেখাটো, লোকটা। কোমরটা একদিকে সামান্য বাঁকিয়ে হাঁটছে সুটকেসটা নিয়ে হাঁটতে বোধহয়, সামান্য অসুবিধা হচ্ছে ওর। তাই কোমরট বাকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। হাঁটবার ভঙ্গিটা সত্যি পরিচিত-তবু স্মরণ করতে পারল না লীনা । স্মৃতিমন্থন করল দ্রুত। হ্যাঁ, একজনের সাথে ছায়ামূর্তির চলার কুয়াশা-২২
ভঙ্গির মিল আছে হুবহু। কিন্তু না, সে তো অসম্ভব! অসম্ভব! তাহলে এ অন্য লোক। অপরিচিত লোক। তাছাড়া একজনের সাথে অন্যজনের চলার ভঙ্গিতে সাদৃশ্য থাকা বিচিত্র নয়।।
| ছেলেধ দলটির কার্যপদ্ধতি বুঝতে পারছে লীনা। টাকা নিয়ে নিরাপদে সরে যাবার পর খোকনকে ঐ ক্রুজার থেকে নিয়ে যাবার চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া হবে । তার মানে, আরও ঘন্টাখানেকের ব্যাপার। এখন রাত দেড়টা। আড়াইটার আগে নিশ্চয়ই কুয়াশা আসছে না, অবশ্য ছেলেধরা দলটি যদি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। অন্যথায়••• |
ছায়ামূর্তি চলে যাবার পর লীনা আবার এসে নদীর তীরে দাঁড়াল । মেঘটা সরে গেছে। চাঁদের আলোয় সুপ্তিমগ্ন আকাশ-পৃথিবী ভরে গেছে। চিকচিক করছে নদীর বুক। আশ্চর্য সুন্দর লাগছে এই পরিবেশ। মনোহর, পরম মনোহর এই পৃথিবী । প্রকৃতির রূপশোভা আকণ্ঠ পান করতে লাগল লীনা।
পাঁচ
টেলিফোন বেজে উঠল রাত দুটোর সময়, দু’ঘন্টা অপেক্ষা কর পর। শায়লা বেগম হাত বাড়াল টেলিফোনের দিকে। কিন্তু কুয়াশা বলল, “প্লীজ, আমাকে ধরতে দিন।’
হাত গুটিয়ে নিল শায়লা। রিসিভার তুলল কুয়াশা, হ্যালো।
কুয়াশা?’ বাংলোয় দেখা সেই লোকটার কণ্ঠস্বর ।।
‘বেশ, তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেছ । এবার আমরা আমাদের কথা রাখতে চাই।’
‘বেশ, বল?’
মন দিয়ে শোন। কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে, একটু এগিয়ে ডাইনে ভাঙা একটা রাস্তা পাবে। সেটা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বদ্ধ জলাভূমিতে, লক্ষ্যা নদীর মজে যাওয়া একটা অংশ। দেখতে নদীর মতই। সেখানে আছে ভাঙা একটা ক্রুজার। সেখানেই আছে তোমাদের খোকন ।।
কুয়াশা অবাক হল। ছেলেধরা দলটা তাদের কথা রেখেছে বলে নয়। লোকটার মুখে তার নাম শুনে। তার নাম লোকটা এত তাড়াতাড়ি জানল কি করে?
সে তো নিজে তার নাম উচ্চারণ করেনি!
| ‘জায়গাটা চিনতে পারছ?’
হ্যাঁ, জঙ্গল আছে একটা।’
‘ঐ জঙ্গলের মধ্য দিয়েই রাস্তাটা চলে গেছে।’ ৩০
ভলিউম-৮
“চিনতে পারছি।’
‘বেশ, এবার বাকিটা শোন। সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, লোকটার গলায় মিকের আভাস। তুমি সেখানে একা যাবে। একেবারেই একা, আর তুমি ফাউকেই তোমার গন্তব্যস্থান বলতে পারবে না। এমনকি বাচ্চাটার মাকেও নয়।’
| কিন্তু তা কি করে সম্ভব?’
‘সম্ভব করতেই হবে,’ লোকটার গলায় আদেশের সুর। কুয়াশা এই নতুন আদেশের কারণটা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হল। কিন্তু তা প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করল না। সে বলল, কিন্তু ফোনটা যদি অন্য কেউ ধরত? ধর, যদি মিসেস আহমদ নিজেই ধরতেন, তাহলে কি হত?’
আমি জানি তো, তুমি ওখানটাতেই থাকবে,’ হাসল লোকটা। আর টেলিফোনের কাছেই থাকবে । তবু যদি অন্য কেউ ফোন ধরত তাহলে তোমাকেই ডেকে দিতে বলতাম। তোমরা যদি এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন কর তাহলেই শুধু তোমাদের শিশু নিরাপদ থাকবে। আমি আবার বলছি, কোথায় যাচ্ছ কাউকে বলতে পারবে না।’
লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ।
কুয়াশা অবস্থাটা অনুধাবনের চেষ্টা করল । এটা কি নতুন কোন ফন্দি? টাকা। দেওয়া হয়ে গেছে। খোকন ক্রুজারের কেবিনে একা আছে। তাকে আনতে দশজন গেলেই বা ক্ষতি কিসের? কেন এই অতি সাবধানতা? নাকি কোন বিশ্রী ফন্দি করেছে লোকগুলো?
শায়লা ব্যাকুল দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে চেয়ে আছে । তার ঠোঁট কাঁপছে । বুকের ভিতরে চিরচির করছে। কুয়াশাকে চিন্তিত দেখে সে কোন প্রশ্ন করতে সাহস পাচ্ছে না। কে জানে, কোন অমঙ্গল-বার্তা শুনতে হবে কিনা।
কুয়াশ্য তাকে অভয় দিল, ভয়ের কিছু নেই। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আপনার ছেলেকে ফিরে পাবেন, এখুনি আমি যাচ্ছি ওকে আনতে।’
‘আমি, আমিও যাব,’ ব্যাকুল প্রার্থনা জানাল শায়লা বেগম।
না, মিসেস আহমদ, তা হয় না। ওদের নির্দেশ, আমাকে একা যেতে হবে । আর কোথায় এখন খোকন আছে তা-ও কাউকে বলা চলবে না। জানি না কেন ওরা এই নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তা অমান্য করলে খোকনের ক্ষতি হবে বলে শাসিয়েছে।’
‘খোকন, খোকন ভাল আছে তো?
যতদূর জানি, ভাল আছে। কিন্ত আমি আর দেরি করতে পারছিনে। যত দেরিতে যাব খোকনকে আনতে ততই দেরি হবে।’
শায়লা যে খুশি হল না, তা বুঝল কুয়াশা। তার চোখে অনিশ্চয়তাও ভয়ের চিহ্ন। কিন্তু উপায় কি? বেরিয়ে গেল কুয়াশা। একটু পরেই কুয়াশার গাড়ি স্টার্ট
কুয়াশা-২২
দেওয়ার শব্দ কানে এল শায়লার।
উদ্বেগ-ব্যাকুল শায়লা করিডরে এসে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। সমস্তটা বাড়ি নীরব। চাকর-বাকর সব ঘুমিয়ে আছে। বুড়ো রুস্তম আলী জেগে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু শায়লা বেগম তাকে একরকম ধমক দিয়েই শুতে পাঠিয়েছে। কাউকে সহ্য করতে পারছে না সে। প্রায় আধঘন্টা চলে গেছে। নিঝুম রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শায়লা প্রতীক্ষা-ব্যাকুল চিত্তে । কিছুক্ষণ আগে যে বাড়ির পিছনের বাগানের পাঁচিল ডিঙিয়ে একটা ছায়ামূর্তি ঢুকেছে তা সে জানে না। ছায়ামূর্তির হাতে একটা সুটকেস ।। | ছায়ামূর্তি নিঃশব্দ দ্রুততায় বাগানের ভেতর দিয়ে, বাড়িটার পিছন দিকের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। পকেট থেকে চারি বের করে তালা খুলল । এদিকটা এমনিতেই ফাঁকা। প্রধানত চাকর-বাকরগুলো এদিকেই থাকে। তারা সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। দোতলায় যাবার একটা ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি আছে। ছায়ামূর্তিটা সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। না, কেউ নেই। আস্তে আস্তে অত্যন্ত নিঃশব্দে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। কুয়াশার রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আলখেল্লার পকেট থেকে জোরালো একটা টর্চ বের করে কামরাটার কোনায় বসানো পুরানো একটা কাবার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাবার্ডের দরজাটা হাট করে খুলল ছায়ামূর্তিটা। ভিতরে গোটা তিনেক পুরানো সুটকেস পড়ে আছে। ছায়ামূর্তি তার হাতের সুটকেসটা পুরানো সুটকেসের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। দরজাটা অমনি খুলে রেখেই সে আবার বেরিয়ে এল রাম থেকে। তিনটে রূমের পরে শায়লা বেগমের রূম । ভারি পর্দা ঝুলছে দরজায়। নিচ দিয়ে উজ্জ্বল আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে। ছায়ামূর্তি পর্দা তুলে ভিতরে ঢুকল। সোজা চলে গেল খাটের কাছে। গদি তুলে একটা চাবির গোছা বের করে পকেটে পুরল। তারপর ফিরে এল কুয়াশার রূমে। কাবার্ডের ভিতরে কিছুক্ষণ আগে রেখে যাওয়া সুটকেসটার পিছনে চাবির গোছাটা নিঃশব্দে রেখে দিয়ে বেরিয়ে এল ছায়ামূর্তি।
অন্ধকারে পৈশাচিক হাসি হাসল ছায়ামূর্তি। তার পরিকল্পনা সফল হতে চলেছে। চরম সাফল্যের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে সে। কুয়াশা ও শায়লা বেগমকে
এক তীরে বিদ্ধ করতে পেরেছে সে। তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে আর দেরি নেই।
তখন অনেক দূরে জলাভূমির তীরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কুয়াশার জন্যে প্রতীক্ষা করছে লীনা। তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। অস্থিরতা আর অস্বস্তিতে গুমরে মরছে সে। তার বারবার মনে হচ্ছে, কোথায় কি যেন একটা গোলমাল ঘটেছে। কিন্তু এখন তা। বোঝা যাচ্ছে না ।
আসলে এমনটা কখনও হয় না। চুরি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অনেক সময় সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা সে কোথাও শোনেনি। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন
ভলিউম-৮
কারণ আছে। অন্য কোন অভিসন্ধি আছে। সে কুয়াশাকে বলবে, তার এই ধারণার কথা। কিন্তু কুয়াশা এত দেরি করছে কেন? এখনও কি নির্দেশ দেওয়া হয়নি?
ক্রুজারের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল লীনা। অবোধ শিশুটা, একা ঐ ক্রুজারের মধ্যে আছে, ভেবে কষ্ট হচ্ছে লীনার। কিন্তু এগোতে সাহস পাচ্ছে না ও।।
হাওয়া পড়ে গেছে। জলাভূমির জল নিস্তরঙ্গ । অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা চারদিকে। সেই স্তব্ধতা ভেদ করে অত্যন্ত ক্ষীণ একটা শব্দ কানে এল তার। প্রথমে সে শব্দটাকে গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল, কুজারটা যেন একটু নিচু হয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠল লীনা। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল । সর্বনাশ, ক্রুজার যে তলিয়ে যাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তে সে শব্দের গুরুত্ব উপলব্ধি করল। বুদ্বুদের শব্দ ওটা। ক্রুজারটা যে ডুবছে শব্দটা তারই একটা প্রমাণ।
| আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল লীনা। তাহলে সেই ছায়ামূর্তিটাই এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা করে গেছে? সে হয়ত ক্রুজার থেকে নেমে যাবার আগে স্টপ-কক খুলে দিয়ে গেছে। বা অন্য কিছু করে রেখেছে। তা না হলে ক্রুজারটা ডুববে কেন?
কিন্তু এর মানে তো খুন! ঠাণ্ডা মাথায় খুন। নিশ্চয়ই খোকনকে ওরা খুন করতে চায়। অসম্ভব! তা হতেই পারে না । খোকনকে যেমন করে হোক মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচাতেই হবে। ইশ, আগেই যদি সে খোকনকে আনতে যেত! নিজেকে ধিক্কার দিল লীনা।
আর দ্বিধা করল না লীনা। নৌকা চালাতে জানে লীনা। সাঁতার দিতেও জানে ভাল । শাড়িটার আঁচল ভাল করে কোমরে পেঁচিয়ে লাফ দিয়ে ডিঙিটাতে চাপল সে । ওরা যদি পাহারা রেখেও গিয়ে থাকে তাহলে তা এখুনি জানা যাবে । সে চিন্তা করার সময় লীনার এখন নেই। তার লক্ষ্য এখন নিমজ্জমান ক্রুজার। তাকে এখুনি সেখানে পৌঁছুতে হবে। লগিটা তুলল লীনা? সে যত এগোতে লাগল’ বুদবুদের শব্দ ততই স্পষ্ট হতে লাগল।
| ক্রুজারের ককপিটে উঠে একটা রডের সাথে ডিঙিটাকে বাঁধল আগে । ককপিটে ইতিমধ্যেই পানি উঠে গেছে একটু একটু। পায়ের পাতা ভিজে গেল। লীনার। কেবিনের দরজাটা তার সামনেই। হ্যাঁণ্ডেলটা ঘুরিয়ে ধাক্কা দিল । প্রথমটা সে ভাবল যে, দরজাটা বোধহয় তালা দেওয়া আছে । কিন্তু একটু পরেই সে বুঝতে পারল যে কেবিনের ভিতরের পানির চাপের জন্যে তার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু পিছু। হটলে চলবে না। দরজাটা যেমন করে হোক খুলতেই হবে, ভিতরে ঢুকতেই হবে । খোকনকে বের কবে আনতেই হবে। তার দেহে যতক্ষণ আছে শক্তি । শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা করবে। সে দরজায় কাঁধ লাগিয়ে দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ঠেলতে লাগল । আর সামান্য ফাঁক হতেই সে তার পাতলা দীর্ঘ তনুটা সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিল। কেবিনের ভিতরটা অন্ধকার। হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। শাড়ির নিচের দিকটা ভিজে যাওয়ায় হাঁটতেও পারছে না ভাল করে। হাত-ব্যাগটা ৩-কুয়াশা-২২
ভাগ্যিস তখনও তার হাতে। দ্রুত টর্চটা বের করে আলো জ্বালল । আলোটা চক্রাকারে ছড়িয়ে পড়ল কেবিনের ভিতরে। ছোট কেবিনটায় দুটো জানালা । দুটোই ভারি নোংরা পর্দা দিয়ে ঢাকা। দু’পাশে দুটো করে বা নিচের বাঙ্ক দুটো। ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে। উপরের একটা বাঙ্কের দিকে তাকাল। সেটা শূন্য। আলোটা ঘুরিয়ে অন্য বাঙ্কটার উপর ফেলল এবং সেখানে সেই বাঙ্কেই ঘুমন্ত একটা শিশুকে দেখতে পেয়ে আনন্দে ঘুমন্ত শিশুর মুখের উপর আলো ফেলল।
এখন পর্যন্ত নিরাপদেই আছে খোকন। পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সে । মুখে মিষ্টি হাসির ছাপ। অসুস্থতার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। টর্চের আলো মুখে পড়াতেও জাগল না খোকন। এমন কি নড়েচড়েও উঠল না। প্যান্ট আর গেঞ্জি রয়েছে খোকনের পরনে। পরিচ্ছন্ন ছোট একটা বিছানা । যাক, ওরা তাহলে, খোকনের কোন ক্ষতি করেনি। আসলে খোকনকে যে অবস্থায় দেখতে পাবে বলে লীনা আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক ভাল অবস্থাতেই তাকে রাখা হয়েছে।
লীনা কপালের উপর আলগোছে আঙুল ছোঁয়াল। ঠাণ্ডা কপাল। কোঁকড়া চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিল । ঘাড়ে ঝাঁকুনি দিল মৃদু। কিন্তু নড়ল না খোকন। জাগল না ।।
বুঝতে বিলম্ব হল না লীনার! লোক দু’টো যে দুধের কথা বলেছিল তার কৃপাতেই এই অবস্থা হয়েছে খোকনের। ওরা ওকে দুধের মধ্যে কোন মাদকদ্রব্য মিশিয়ে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল লীনার ।। | কেবিনের মধ্যে পানি ক্রমেই বাড়ছে। পানি হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। আর বিন্দুমাত্র দেরি করা উচিত নয় । খোকনকে কোলে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল লীনা। পানির মধ্যে দিয়ে এগোতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল তার। বারবার সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু চরম বিপদের মুহূর্ত দেখা দিল ঠিক
তখনই যখন সে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনেও সে দরজা খুলতে পারল না ।
কেবিনের ভিতরে পানির চাপ এখন এতই যে, প্রচণ্ড শক্তিধর লোকের পক্ষেও দরজা এতটুকু নড়ানো সম্ভব নয়। লীনার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া। আবার তার এক হাতে রয়েছে খোকন। দরজাটা পুরানো। হয়ত তেমন মজবুত নয় । কিন্তু সেটা ভাঙা অন্তত তার পক্ষে সম্ভব নয়। এক হাত দিয়ে তো নয়ই।
অনিবার্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছে সে আর খোকন। ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা।
নিষ্ঠুর চেষ্টায় নিজেকে শান্ত রাখল লীনা। জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। না, একেবারেই ছোট জানালা। কাঁচ ভেঙে ফেললেও ওর ভিতর দিয়ে সে বেরোতে পারবে না। ছেলেটাকে ফেলে দিলে পানিতে পড়ে যাবে।
ক্রুজারটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। নিজেকে বা খোকনকে রক্ষা করার ক্ষীণতম সম্ভাবনাটুকুও নেই। মৃত্যু ধীরে ধীরে এগিয়ে
৩৪
ভলিউম-৮
আসছে শব্দহীন পদক্ষেপে। আতঙ্কে বক্ষসম্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে লীনার। তবু সে শান্ত-সমাহিত ভাবে দাঁড়িয়ে রইল, সাহায্য কি আসবে না?”।
জানালার পর্দাটা তুলে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল অসহায় দৃষ্টিতে।
খোকনকে আনতে চলেছে কুয়াশা। দ্রুতবেণে তার মার্সিডিস ছুটে চলেছে। রাজধানীর নির্জন আলো-আঁধারি পথ দিয়ে যেতে হবে তার বাড়ির পাশ দিয়েই। থামল কুয়াশা তার বাড়ির সামনে। নিঝুম রাত। গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে এগিয়ে গেল। গেট খুলল না। অন্ধকারে হাতড়ে গোপন একটা বোতাম টিপল। দূরে, বাড়ির ভিতরে ক্রিং ক্রি করে ঘন্টা বেজে উঠল। এক মিনিট পরে নিঃশব্দে গেটের কাছে এসে হাজির হল স্যানন ডি কস্টা ।।
ইয়েস, বস্। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? কাম ইন প্লীজ, গেট খুলতে খুলতে সোল্লাসে স্বাগত জানাল ডি, কস্টা কুয়াশাকে।
মান্নান কোথায়? ‘হি ইজ ইল।’
কলিম?’ ‘গন হোম, ইয়েসটারডে। কাল ঘর চলা গয়া।’
শুনুন, আমার হাতে সময় খুব কম। জরুরী একটা কাজে যাচ্ছি। আপনাকে স্কুটারটা নিয়ে আমার পিছনে পিছনে যেতে হবে। তবে অনেকটা দূরে থাকতে হবে। মনে থাকবে?
শওর! এখনি আমি বেরিয়ে পড়ছি।’
কিন্তু তার আগে আর একটা কাজ করতে হবে। আমি আর ভিতরে ঢুকব না। আপনি শহীদদের বাসায় টেলিফোন করে খোঁজ নিন, লীনা ফিরেছে কিনা। বি কুইক। আমি অপেক্ষা করছি।’ | চলে গেল ডি. কস্টা। কুয়াশা একটা সিগারেট ধরাল। ঘড়ি দেখল, রাত সোয়া দুটো। গাড়িতে গিয়ে বসল সে। | মিনিট পাঁচেক পরেই স্কুটারের শব্দ শোনা গেল। ডি কস্টা আসছে। গেট পেরিয়ে বাইরে এসে কুয়াশার মার্সিডিসের পাশে স্কুটারটা দাঁড় করিয়ে বলল, ‘মিস খান বাসায় ফেরেননি রাতে। টঙ্গীতে কোন এক বন্ধুর বাসায় নাকি গিয়েছেন। সকালে। আপনিও নাকি গিয়েছিলেন, গফুর বলল ।।
কুয়াশা কিছু বলল না। লীনার জন্যে শঙ্কিত হল । কি হল মেয়েটার, কে জানে।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, আমরা যাচ্ছি ডেমরার দিকে । ডেমরা নিশ্চয়ই কুয়াশা-২২
৩৫
চেনেন আপনি?
‘চিনি, বস্। খুব ভাল করেই চিনি।
‘ব্রিজ থেকে একটু দূরে, দক্ষিণ দিকে আছে একটা জঙ্গল। তার ভিতর দিয়ে আছে একটা কাঁচা রাস্তা। ঐ রাস্তার শেষপ্রান্তে আছে একটা বড় বিল। সেই বিলের তীরেই যাচ্ছি আমরা। আমি যাব আগে। আপনি অনেকটা পিছনে পিছনে আসবেন।’
| বিশ মিনিট পরে কুয়াশার মার্সিডিস জলাভূমির তীরে গিয়ে পৌঁছল । গাড়ির এঞ্জিন বন্ধ করে নেমে পড়ল সে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নলোকে কেবিন ক্রুজারটা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশা কেবিনে যাবার জন্যে কোন ডিঙি খুঁজে পেল না। কয়েক মুহূর্ত নীরবে চারদিক জরীপ করল। জীর্ণ বাড়িটার দিকে একবার চোখ বুলাল। এখন কুজারটাতে যাওয়া যায় কি করে, ভাবতে লাগল কুয়াশা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, ক্রুজারটার পাশেই একটা ডিঙি রয়েছে।
একটু চিন্তিত হল কুয়াশা। ডিঙিটা তো তীরে থাকবার কথা। ওখানে থাকবার অর্থ হল, ক্রুজারে কেউ ওটাকে নিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ খোকন ছাড়াও ক্রুজারে অন্য লোক আছে। আর সে মিত্রপক্ষের লোক নয় নিশ্চয়ই। তাহলে ঐ ক্রুজারে তার সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্যে তাকে একাই আহ্বান জানানো হয়েছে। বেশ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে সে। সাতরেই যাবে কুয়াশা ক্রুজারে।।
| পানিতে নামবার আগে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে হল, ক্রুজারটাতে কিছু একটা গোলমাল আছে। ওটা কাত হচ্ছে না ক্রমশ? হ্যাঁ, তাই তো, কাত হয়ে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে ওটা। সর্বনাশ, ওতে যে খোকন আছে? হয়ত খোকনের মত শক্রও বন্দী হয়ে আছে সেখানে।
পানিতে নেমে পড়ল কুয়াশা। দ্রুত পানি কেটে এগিয়ে চলল’ সে নিঃশব্দে। ক্রুজারটার দিক থেকে অস্পষ্ট এলোমেলো একটা থপথপ শব্দ আসছে বলে মনে হল কুয়াশার।
ক্রুজারটার কাছে পৌঁছুতেই কুয়াশার কানে এল, ভাইয়া!’
লীনার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল সে। দ্রুত ককপিটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, “কে, লীনা?’
‘আমি আর খোকন দু’জনই আটকে পড়েছি ভিতরে। বেরোতে পারছিনে। কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। দরজা বন্ধ হয়ে গেছে পানির চাপে। খুলতে পারছিনে কিছুতেই।’
| ‘খোকন কেমন আছে?
‘এখন পর্যন্ত ভালই আছে। এখনও ঘুমোচ্ছে। কি ঘটছে তা জানে না খোকন। দরজার নিচের দিকটা ভাঙবার চেষ্টা করছি, পারছিনে। মজবুত কিছু একটা পেলে হয়ত ভেঙে ফেলা যেত।’
ভলিউম-৮
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা । যাক, দুজনেই বেঁচে আছে। দু’জনই এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে। এই মুহূর্তে ঐটুকই যথেষ্ট। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজার উপর চাপ দিল সে। সামান্য একটু নড়েও উঠল দরজা। কিন্তু পানির চাপ এমন প্রবল যে, কুয়াশার বলিষ্ঠ দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগও ব্যর্থ হল।
সে একটু পিছনে সরে গিয়ে দরজার পাল্লার নিচের দিকে সজোরে লাথি লাগাল। দরজাটা পুরানো । তেমন মজবুত নয়। কিন্তু দরজার নিচের দিকে পানি থাকায় লাথিটা তেমন জোরে লাগল না। আবার লাথি মারল। পুরানো কাঠ ভেঙে তার পা ঢুকে গেল ভিতরে । সজোরে পানি বেরিয়ে এল ভিতর থেকে । ভিতরের পানির চাপটা কমে গেলেও পুনরায় ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলতে পারল না কুয়াশা।
| আবার লাথি লাগাল কুয়াশা। লীনা যাতে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে তেমন একটা ফোকর করতে পারলেই হল। ফাঁকটা একটু বড় হতেই লীনা বলল, ওতেই হবে। আগে খোকনকে নিন।’
লীনার কণ্ঠস্বর একটু একটু কাঁপছিল।।
কুয়াশা ভাঙা দেরের মধ্যে দিয়ে লীনার কাছ থেকে তোয়ালেতে জড়ানো খোকনকে হাত পেতে নিল । আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নেমে এল চরম বিপদ। ক্রুজারটা কাত হয়ে তখনই ডুবে গেল। একদম কাত হয়ে পড়ল ক্রুজারটা। লীনা তখনও ভিতরে বন্দী। খোকনকে কোলে নিয়ে কুয়াশা কোনক্রমে ভারসাম্য রক্ষা করল।
সর্বনাশ! লীনা ভিতরে রয়েছে। এ মুহূর্তেই তাকে বাঁচাতে হবে । কয়ে মিনিট দেরি হলেই নিশ্চিত সলিলসমাধি রচিত হবে তার। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মারাত্মক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল কুয়াশা।
কাকে বাঁচাবে সে? লীনাকে? খোকনকে?
দু’জনকে বাঁচানো সম্ভব নয় । ডুব দিয়ে সে লীনাকে উদ্ধার করতে পারবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু খোনকে কোলে নিয়ে তা সম্ভব নয়। খোকনকে যদি ত্যাগ করে তাহলে ডুবে সে মারা যাবে নিশ্চিত। আর যদি সে খোকনকে বাঁচায় তাহলে লীনার মত্যু অনিবার্য।
কাকে বাঁচাবে? চরম দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল সে। অথচ এই মুহূর্তেই তাকে এই ভয়ঙ্কর সমস্যার সমাধান করতে হবে। এতটুকু দেরি কল চলবে না।
এই যে বস্, খুদে শয়টানটাকে আমার হাটে দিন’ ক কনুইয়ের সহ পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
শ্যানন ডি কস্টার হাতে খোকনকে তুলে দিয়েই ডুব দি ইয়াশ । বাক্যালাপের সময় নেই, সুযোগ নেই। তাকে এখুনি তৎপর হতে হবে। নিমজ্জিত, কুয়াশা-২২
ক্রুজারের ককপিটে পৌঁছতে দেরি হল না কুয়াশার । ভিতর থেকে তখন লীনা ভাঙা দরজার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শাড়িতে আটকে যাওয়ায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল। কুয়াশা বুঝল, লীনা তার মাথা ও ঘাড়টা বের করতে পেরেছে। বাহুমূলে চেপে ধরে কুয়াশা প্রচণ্ড জোরে টান দিল । কাপড় ছিঁড়ে গেল লীনার। কিন্তু সে বেরিয়ে আসতে পারল। পানির উপরে ভেসে উঠল দুজনই। | বুক ভরে শ্বাস টানল লীনা। কিন্তু অনেকক্ষণ তার বাস্ফূর্তি ঘটল না। কুয়াশা তাকে একহাত দিয়ে মজবুত করে ধরে রেখে সাঁতার কাটতে লাগল।
একটু পরে লীনা বলল, আমি প্রায় মারা যাচ্ছিলাম! অতক্ষণ কি কষ্ট করে যে শ্বাস বন্ধ করে রেখেছিলাম! উঃ!’
নাকে পানি ঢোকেনি তো?’ না। কিন্তু খোকন? খোকন কোথায়?’ আর্তনাদ করে উঠল লীনা।।
হাসল কুয়াশা, ভয় নেই । ভালই আছে। ডি. কস্টার কাছে আছে সে। আমাদেরকে সাঁতার কেটেই তীরে যেতে হবে। ডিঙিটা ক্রুজারের সাথেই তলিয়ে গেছে। সাঁতার কাটতে কাটতে সে ডি. কস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছিল। সে যে এত দ্রুত বিপদটা আন্দাজ করতে পেরেছিল তার জন্যে মনে মনে তাকে। ধন্যবাদ জানাল কুয়াশা।
গাড়ির মধ্যে বসে ছিল ডি. কস্টা। তার কোলে খোকন। কুয়াশা আর লীনা এগোতেই ডি কস্টা মুখ খুলল । ভালই আছে বস্, খুদে শয়টানটা! তোয়ালেটা একটু ভিজে গিয়েছিল মাত্র। গায়ে পানি লাগেনি। স্টিল স্লীপিং বস, দিস নটি বয়। বাট ভেরি সুইট।
“কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!’ লীনা মুখ খুলল ।
মি থ্যাঙ্কস? হোয়াই, ম্যাম? দিসিস মাই ডিউটি। নো থ্যাঙ্কস।’ | ‘নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাওনা আছে আপনার, মি. কস্টা। আপনি যথাসময়ে না পৌঁছুলে লীনা অথবা খোকন দু’জনের একজনকে মরতেই হত। কিন্তু আপনি ক্রুজারে গেলেন কি মনে করে?’
‘আমার মনে হল, ক্রুজারটা ডুবে যাচ্ছে–সিংকিং। ভাবলাম, ডেখতে হচ্ছে, বস্ মে বি ইন ডেঞ্জার,, অর সাম ওয়ান এস্ । অ্যাণ্ড আই সোয়্যাম । মিস খান, আর ইউ অলরাইট?’
‘আমি ভাল আছি, ভাল থাকবও। ঠাণ্ডাও লাগবে না। কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা,’ শেষের কথাটা বলুল কুয়াশার উদ্দেশ্যে।
কি ভাবছ?
‘ওরা খোকনকে খুন করতে চেয়েছিল। সুপরিকল্পিত ভাবে খুন করতে যাচ্ছিল ওরা খোকনকে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল লীনা । ৩৮
ভলিউম-৮
সে কি! বিস্ময় প্রকাশ করল ডি. কস্টা। এই নিষ্পাপ শিশুটাকে! দিস হার্মলেস কিড!’
| হ্যাঁ, আমি একটা ছায়ামূর্তিকে ক্রুজারে যেতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরে সে সুটকেসটা নিয়ে ফিরে এল। তার অনেকক্ষণ পরে ক্রুজারটা ধীরে ধীরে ডুবতে লাগল । সেই শয়তানটা নিশ্চয়ই স্টপকক খুলে দিয়ে গেছে অথবা অন্য একটা কিছু করেছে।’
‘তোমাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করব আমি। কিন্তু এখন নয়। তুমি কিভাবে এসেছিলে এখানে, জানি না। কিন্তু তোমার উপস্থিতির জন্যেই খোকন বেঁচেছে। তুমিই ওর জীবন বাঁচিয়েছ, গম্ভীর গলায় বলল কুয়াশা।।
‘ তা ঠিক নয়, ভাইয়া। আপনি বাঁচিয়েছেন ওকে। মি. কস্টা বাঁচিয়েছে ওকে। আপনারা আমাকেও বাঁচিয়েছেন। এ নিয়ে আলোচনা করা বৃথা। সেই ছায়ামূর্তিটা। সে এসেছিল নতুন একটা মরিস মাইনরে। অন টেস্ট লেখা। এখনও রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লাগানো হয়নি।’
তাতে ক্ষতি নেই। সেই ছায়ামূর্তিটা কে, তা অন্তত জানি বলে মনে হচ্ছে।’ ‘কে সে?
‘এখনও বলবার সময় আসেনি। আমার ধারণা মির্ভুল কি না তা আগামীকালই জানতে পারব।’
কিন্তু লোকটার উদ্দেশ্য কি বুঝতে পারছিনে। খোকনের মৃত্যুই তার কাম্য, না টাকা? নাকি দুটোই?”
উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি বুঝতে পারছিনে। তবে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, খোকনকে হত্যা করা-ই, আর এই হত্যাকাণ্ডের দায় আমার ঘাড়ে চাপানোই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। টাকাটা ওদের উপরি পাওনা।’ | ডি. কস্টা বলল, আমাদের সকলেরই কাপড়-চোপড় ভেজা। এ অবস্থায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না।’ | ‘ভেজা কাপড়ের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার চিন্তা করার আছে, মি. ডি. কস্টা, হাসল কুয়াশা। খোকনকে নিয়ে এই মুহূর্তে কি করা যায় তাই স্থির করতে
‘কেন? এখুনি তো ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে হবে! চলুন, আর দেরি নয়। বেচারি দুশ্চিন্তায় হয়ত উন্মাদই হয়ে যাবে।’
কুয়াশা একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে লীনাকে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু তুমি এখানটায় কি করে এলে? কি করে জানলে যে, এখানেই খোকনকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে?’
আপনি বাগবেন না, কথা দিচ্ছেন? কুয়াশা-২২
নিশ্চয়ই।’ “আপনার গাড়ির বুটে••{‘। “সে কি?’ ঘটনাটা খুলে বলল লীনা।
সবটা শুনে কুয়াশা বলল, তোমার উপর রাগ করা উচিত। কিন্তু তবু তোমার এই হঠকারিতার জন্যেই খোকনকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তুমি বাঁচিয়েছ আমার। ইজ্জত। সর্বনাশটা হয়ে গেলে মিসেস আহমদের কাছে আমি মুখ দেখাতে
পারতাম?’
লীনা বলল, আমার ঠাণ্ডা লাগছে। এবারে চলুন, ভাইয়া। টঙ্গীতে এখন যাচ্ছিনে, লীনা।’ “সে কি! কেন?’ বিস্ময় প্রকাশ করল লীনা।
‘এই নোংরা কাজটার অন্তরালে আরও ভয়ঙ্কর একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে। আর সেটা আমাকে জানতেই হবে। আমরা শুধু এতটুকুই জেনেছি যে, খোকনকে খুন করার একটা হীন চক্রান্ত হয়েছিল। কেন? কারণটা কি? এই মৃত্যু থেকে কে কে লাভবান হচ্ছে? কিভাবেই বা হচ্ছে? একটা উদ্দেশ্য ছিল খুনের হোক, চুরির হোক, ডাকাতির হোর্ক অথবা এর তিনটারই। দায় আমার উপর চাপানো। কিন্তু কেন? আসল মতলবটা কি?’ কুয়াশা ধীরে ধীরে বলল।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে।’
বুঝতে ঠিক আমিও পারছিনে। আর পারছিনে বলেই আমাকে একটা কৌশল খাটাতে হবে।’
কি রকম?
আমরা যদি সবাইকে বলি যে, খোকন সত্যিই মারা গেছে, তাহলে যারা ওকে খুন করতে চেয়েছিল তাদের চক্রান্তটা ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকবে । ওদের। বুঝতে দিতে হবে যে, আমি যথার্থই ক্রুজারে দেরি করে পৌঁছেছিলাম। তার আগেই খোকন মারা গেছে।’
না না, এমনটা আমরা কিছুতেই করতে পারিনে, প্রতিবাদ জানাল লীনা। শায়লা পাগল হয়ে যাবে।’
‘তুমি কি আমাকে অতটাই নিষ্ঠুর ঠাওরাচ্ছ? শায়লাকে সত্য কথাটা গোপনে জানিয়ে দেব এবং চুপ করে থাকতে বলব। শায়লাকে বুঝিয়ে বলব। সে নিশ্চয়ই আমাকে বিশ্বাস করবে।’
তাহলে অবশ্য ঠিক আছে, যদিও এতে শায়লার কষ্ট হবে। পরিষ্কার বোঝা গেল, কুয়াশার পরিকল্পনা লীনার পছন্দ নয় । | ‘উপায় নেই। তার সন্তানের জীবন রক্ষার জন্যেই এটা প্রয়োজন। খোকনের
ভলিউম-৮
৪০
উপর দ্বিতীয়বার হামলা হোক, এটা নিশ্চয়ই তার কাম্য নয়। তাছাড়া ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি আর মি. কস্টা মার্সিডিসটা নিয়ে চলে যাও সোজা তোমাদের বাসায়। আমি ফোন না করা পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। আমি স্কুটারটা নিয়ে যাব।’
মার্সিডিসের পিছনের আলো দুটো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে স্কুটারে চাপল কুয়াশা।
সাত
ড্রইংরূমের ঘড়িতে তিনটে বাজল। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে শায়লা বেগম। রোজিনা ফিরে এসেছে। লীনা বাসায় ফেরেনি, এসেই রোজিনা খবর দিয়েছে। মহীউদ্দিন সাহেবও এসেছেন। জরুরী কাজে তিনি নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলেন। ধর্মঘটের নোটিস দিয়েছে শ্রমিকরা। মালিক সমিতির জরুরী মীটিং ছিল। না গিয়ে উপায় ছিল না।
তবু শায়লা বিরক্ত হচ্ছিল। মীটিং তো ন’টায় শেষ হয়েছে। এদিকের কাজটাও তো কম জরুরী নয়। একটা হিউম্যান কনসিডারেশনও থাকা উচিত ছিল ভদ্রলোকের । কখন তাঁকে দরকার হয় ঠিক নেই। বৈষয়িক কাজে তাকে ছাড়া যে শায়লা বেগমের চলে না, তা-ও সে জানে। তাহলে লোকটা গেল কোথায়? কোথায় ছিলো রাত দুটো পর্যন্ত?
একগাদা কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন মহীউদ্দিন। মিল সম্পৰ্কীয় জরুরী নথিপত্র সেগুলো। এসব কাগজপত্র শায়লার সেফেই থাকে।
কাগজের প্যাকেটটা নামাতেই রোজিনা প্রশ্ন করল, বড় দেরি করে এলেন যে? এদিকের খবর শুনেছেন?’
| ‘খোকা সাহেব নিশ্চয় ফিরেছেন?’
না, ফেরেননি। কুয়াশা তাঁকে আনতে গেছে। এই এসে পড়বে বলে । এদিকে, লীনাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘সে আবার কি! বাসায় ফিরে যায়নি তো?’
না, আমি এক্ষুণি ফিরে এলাম ওর বাসা থেকে। তাহলে তো বিপদের কথা! বয়স্কা মেয়ে!’ মহীউদ্দিন সাহেব চিন্তিত হলেন।
আমার তো মনে হয়, খোকনকে যারা চুরি করেছিল লীনাও তাদেরই কবলে পড়েছে,’ রোজিনা আশঙ্কা প্রকাশ করল।
মহীউদ্দিন সাহেব চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ পরে তিনি শায়লাকে বললেন, ‘মিসেস আহমদ, এই প্যাকেটটায় অনেক জরুরী কাগজপত্র আছে । সেফে রাখতে হবে।’
কুয়াশা-২২
শায়লার উপরে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। সে রোজিনাকে বলল, তুমি যাও, ভাই একটু, প্যাকেটটা আমার শোবার ঘরের সেফে রেখে এস । গদির নিচে চাবির গোছা আছে । মহীউদ্দিন সাহেব, আপনিও না হয় ওর সঙ্গে যান।
মহীউদ্দিন সাহেব বললেন, ‘চলুন, মিস হক,’ প্যাকেটটা হাতে নিলেন তিনি।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে শায়লার রূমে ঢুকল দুজন। রোজিনা বিছানার দিকে এগিয়ে গেল চাবি বের করার জন্যে। কিন্তু কিছুক্ষণ খুঁজে বলল, না তো, চাবি তো দেখছি না’
| ‘কি হল?’ মহীউদ্দিন সাহেব জানতে চাই: লন। ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?’
“যেখানে চাবি থাকবার কথা সেখানটাতে খুঁজে দেখেছি। পাচ্ছিনে। আপনিও একটু দেখুন না?’ ‘
ব্যাগটা রেখে মহীউদ্দিন সাহেবও চাবি খুঁজতে শুরু করলেন। শুধু বিছানা নয়। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন | না কোথাও নেই। | ‘গেল কোথায় চাবিটা?’ রোজিনা বলল, সাধারণত গদির নিচেই তো থাকে। এই সামান্য ব্যাপার শায়লাকে বলতে এখন ভাল লাগছে না। অন্য কোন ব্যবস্থা করা যায় না কাগজপত্র রাখার?’
কাগজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । অবশ্য নিরাপদ রাখাটাই বড় কথা। ওয়ার্ডরোবটাতে আপাতত রাখলেও চলবে।’
কিন্তু ওয়ার্ডরোবের চাবিও তো পাওয়া যাচ্ছে না, রোজিনা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল। অন্য রূমে একটা পুরানো কাবার্ড আছে। সেটা খোলা। পুরানো জিনিসপত্র রাখা হয়। সেখানে রাখলেও চলবে। কেউ সন্দেহ করবে না যে, সেখানে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার তো ব্যাপার। খোকন ফিরে এলেই এ বাড়ির যন্ত্রণা দূর হবে। তখন সবাই মিলে চাবি খুঁজে বের করা যাবে। কি বলেন? তাছাড়া, ঐ কাবার্ডটা সাধারণত কেউ খোলে না।’
| মহীউদ্দিন সাহেব আশার আলো দেখতে পেয়ে সোসাহে বললেন, “চলু তাহলে।’
যে রূমটা কুয়াশার জন্যে নির্ধারিত হয়েছিল সেই রূমে গিয়ে ঢুকল দু’জন । বোতাম টিপে আলো জ্বালল রোজিনা। মহীউদ্দিন সাহেব কাবার্ডটা খুলে কাগজের প্যাকেটটা রাখলেন ভিতরে!
| রোজিনা বলল, এখন কাবার্ডের মধ্যে ইঁদুর না থাকলেই হয়, তার দৃষ্টি পড়েছিল নিচের তাকের সুটকেসের উপর। একটা কাজ করলে হয় না, মহীউদ্দিন সাহেব?’
আজ্ঞা করুন? ‘একটা সুটকেসের মধ্যে রেখে দিন না কাগজগুলো? নিরাপদে থাকবে।’ পরামর্শটা মনঃপূত হল মহীউদ্দিন সাহেবের। তিনি বললেন, তাহলে একটা
ভলিউম-৮
৪২
সুটকেস এনে দিন না হয়?”
আরে, সুটকেস তো আপনার নাকের ডগাতেই আছে! দেখুন না, কতগুলো। ওগুলো সব খালি। খালি সুটকেসই রাখা হয় এখানে।
কিন্তু সবগুলো পুরানো। ভাঙা।। ভালও আছে, দেখুন না? সরুন, আমি বের করছি।’
সরলেন না তিনি। পরপর দুটো সুটকেস বের করলেন মহীউদ্দিন সাহেব। দুটোই ভাঙা। ততীয়টা বেশ ভারি। তবু সেটা টেনে বের করে আনলেন । আত্মগতভাবে বললেন, কি ব্যাপার, এটা এত ভারি কেন? কি আছে এর মধ্যে?’
‘খোলা নাকি? না বন্ধ?’ রোজিনা জিজ্ঞেস করল ।
‘দেখি। দেখতেই হবে, সুটকেসটা,’ আমতা আমতা করতে লাগলেন মহীউদ্দিন সাহেব।
কি হল? অমন করছেন কেন?’ মনে হচ্ছে..আচ্ছা, আমি দেখছি।’
তালা লাগানো ছিল না। ঢাকনাটা খুলেই সাপ দেখার মত চমকে উঠলেন তিনি। চমকে উঠল রোজিনাও। সমস্তটা সুটকেস ভর্তি দশ টাকার নোট।
বিস্মিত রোজিনা বলল, তাই তো, এ দেখছি অনেক টাকা! সুটকেসটা নিশ্চয়ই কুয়াশার।’
তীব্র কণ্ঠে মহীউদ্দিন বললেন, তার মানে?
হকচকিয়ে গেল রাৈজিনা। সে বলল, হ্যাঁ, মানে এই রূমেই কুয়াশাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে কিনা, তাই বলছি। উনি তো একটা সুটকেস নিয়ে
এসেছেন। হয়ত এইটাই।’
| ‘না, এটা সে সুটকেস নয়, দাঁতে দাঁত চাপলেন মহীউদ্দিন সাহেব। এ টাকা আমি আজকে ব্যাংক থেকে তুলেছি.। এই সুটকেসে করেই এনেছি। এই টাকাই দেবার কথা ছিল ছেলেধরা দলটিকে থোকনের মুক্তিপণ হিসেবে। এ টাকা এখানে এল কি করে?’
| রোজিনা পরম বিস্ময়ে বলল, বলছেন কি আপনি! আর ইউ ইন ইওর সেন্সে? আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে।’
ভুল! মনে রাখবেন, আমি একটা অত্যন্ত দায়িত্বশীল পদে কাজ করি। এতটা ভুল আমার হয় না।’
‘তাহলে এটা এখানে এল কি করে?’ রোজিনা অবিশ্বাসের সুরে বলল। | ‘আমারও সেই প্রশ্ন,’ বিদ্রূপ করলেন মহীউদ্দিন সাহেব । আমারও সেইটাই প্রশ্ন। নিশ্চয়ই আমি এটা এনে এখানটায় রাখিনি, আপনিও রাখেননি, মিসেস আহমদও না। তাহলে কে?’
‘আমার, আমার মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে, রোজিনা বলল। কুয়াশা-২২
G৩
কিন্তু গুলিয়ে গেলে চলবে না। আরও দেখতে হবে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে । ভাল করে দেখতে হবে, কি কি সম্পদ আছে এই রূমে। তখনি বারবার করে নিষেধ করেছিলাম, ঐ ক্রিমিনালটার সাথে যোগাযোগ করতে,’ সোৎসাহে তিনি। ওয়ার্ডরোবের সমস্ত সুটকেস বের করলেন। প্রত্যেকটাই খুললেন, কোনটাতে কিছু পাওয়া গেল না। ( হতবাক হয়ে শুন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল রোজিনী কাবার্ডের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, নিচের তাকের কোণে কি একটা চকচক করছে। কম্পিত পদক্ষেপে সে এগিয়ে গিয়ে চকচকে জিনিসটায় হাত দিল। একটা চাবির গোছা। সেটা বের করে উজ্জ্বল আলোয় দেখল রোজিনা। মহীউদ্দিন সাহেবও দেখলেন । শায়লার চাবির গোছা, যেটা তারা খুঁজছিল। রোজিনার কম্পিত হাত থেকে পড়ে গেল গোছাটা ।।
অর্থহীন, ব্যথিত দৃষ্টিতে মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রোজিনা।।
নিচে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। মহীউদ্দিন সাহেব দ্রুত হাতে সুটকেসগুলো তাক-এ তুলে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চাবির গোছাটা পকেটে ফেলল। রোজিনা চেতনাহীনের মত তখনও দাঁড়িয়ে রইল।
মহীউদ্দিন সাহেব বললেন, “প্লীজ, মিস হক, এই মুহূর্তে অমন আত্মবিস্মৃত হবেন না। এখন নার্ভটাকে শক্ত করুন। পরে আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে। চলুন, কুয়াশা নিশ্চয়ই খোকাকে নিয়ে এসেছে। প্লীজ, প্লীজ একটু শক্ত
হোন।’
রোজিনা ফিসফিস করে বলল, আমি বুঝতে পারছি না! বুঝতে পারছি না!’
“প্লীজ, ডোন্ট বি অ্যান অ্যাস। আসুন নিচে। কুয়াশা এসে পড়েছে নিশ্চয়ই! রোজিনার ঘাড়ে ঝাঁকুনি দিলেন মহীউদ্দিন সাহেব। এগুলো আগে ঠিক মত গুছিয়ে রাখি। আপনিও একটু হেল্প করুন। যেমন ছিল ঠিক তেমনি রাখতে হবে সুটকেসগুলো।’
রোজিনা যেন সংবিৎ ফিরে পেল এতক্ষণে। সে-ও মহীউদ্দিন সাহেবের সাথে সাথে কার্ডে সুটকেসগুলো তুলতে লাগল ।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মহীউদ্দিন সাহেব বললেন, ‘খবরদার! আমাদের এই আবিষ্কারের কথা এই মুহূর্তে প্রকাশ করা চলবে না।
কিন্তু…,’ আপত্তি জানাল রোজিনা। | ‘কোন কিন্তু নয়। আমি জানি, আমার বিদ্যাবুদ্ধির উপর আপনার আস্থা কম। কিন্তু একবার অন্তত নির্ভর করে দেখুন আমার উপর। ঠকবেন না, একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মহীউদ্দিন সাহেব রোজিনার খুব কাছে এসে।
মাথা নেড়ে সায় দিল রোজিনা।
৪৪
ভলিউম-৮
আট
নীলাভ নিলয়ে যখন কুয়াশা পৌঁছল, তখন চারটে প্রায় বাজে-বাজে । ভেজা কাপড় গায়ে শেষ রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় স্কুটার চালিয়ে কুয়াশা যখন এসে পৌঁছুল তখন শীতে সে একটু একটু কাঁপছে স্কুটার রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই শায়লা ছুটে গেল, ‘খোকন? আমার খোকনকে আনেননি?’
| ‘মিস হক ও মহীউদ্দিন সাহেব কোথায়?’ শায়লার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল কুয়াশা।
‘খোকন?’ ‘আমায়ূ প্রশ্নের জবাব দিন, কঠিন শোনল কুয়াশার কণ্ঠ ।
আশঙ্কায়, উত্তেজনায়, যন্ত্রণায় অধোম্মাদ শায়লা বলল, “আগে বলুন, খোকন, কোথায়?’
‘নিচে কি আপনি একাই আছেন?
একটু থতমত খেয়ে, শায়লা বলল, হ্যাঁ, একাই আছি। মহীউদ্দিন সাহেব আর রোজিনা উপরে গেছে। কিন্তু আমার খোকন কোথায়? বলুন, চুপ করে রইলেন যে?’ ভীত কণ্ঠে বলল শায়লা। খোকনকে কি আপনি…?’ থরথর করে কাঁপতে লাগল সে।
চিৎকার করবেন না। যা বলি চুপ করে শুনুন। আপনাকে একাকী পাওয়াই আমার দরকার ছিল। আমাকে বাধা দেবেন না। কোন প্রশ্ন করবেন না। যা বলব, শুনবেন। যা করতে বলব, করবেন। আপনার খোকন বেচে আছে! সুস্থ আছে। লীনার কাছে আছে। ভয় নেই। কোন চিন্তা নেই। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন।’
সত্যি, সত্যি বলছেন?’ শায়লার কণ্ঠে অবিশ্বাস আর আশঙ্কা। সত্যি বলছি। ‘তাহলে তাকে আনলেন না কেন?’,
‘একটু শান্ত হোন। প্লীজ, শান্ত হোন। যা বলি, মন দিয়ে শুনুন। মাথা ঠাণ্ডা করে শুনুন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে হবে।’
শায়লার কাঁপুনি ধীরে ধীরে কমে এল। উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হল । কুয়াশা বলল, “ছেলেধরাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে।’
তার মানে? ওরা তো টাকা পেয়েছেই, কথাও রেখেছে। খোকনকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে।’
‘আমি বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবেন।’
কুয়াশা ধীরে ধীরে অতি সংক্ষেপে খোকনকে উদ্ধার সম্পর্কিত ঘটনা খুলে বলল। লীনা কিভাবে ক্রুজারে পৌঁছেছিল, কিভাবে সে খোনকে বাঁচিয়েছে, সবই কুয়াশা-২২
৪৫
সে শায়লার গোচরে আনল। শেষটায় মন্তব্য করল, কেউ একজন আপনার ছেলেকে খুন করতে চেয়েছিল। আমি জানি সে কে-কিন্তু আমার হাতে কোন প্রমাণ নেই। তাই তার নাম উচ্চারণ করাও সঙ্গত নয়। আমি তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করতে চাই। আর তার জন্যে দরকার হল সেই লোকটাকে বুঝতে দেয়া যে, তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। আসলে এটা সামান্য ছেলেচুরির ব্যাপার নয় । পঁচলাখ টাকার ব্যাপার নয়। উদ্দেশ্য আরও জঘন্য কিছু একটা। এই জন্যেই আমি গোপনে একথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম। আর এই জন্যেই আমি খোনকে নিয়ে আসিনি।’
| কিন্তু কেন, কেন খোকনকে নিয়ে আসেননি আপনি? আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনে, অবুঝ শায়লা বলল।
কারণ সেই শয়তানটাকে ধরবার একমাত্র পথ হল তাকে বুঝতে দেওয়া যে, তার পরিকল্পনা অনুযায়ী খোকন মারা গেছে। আপনাকে আপনার ভূমিকায় পাকা অভিনেত্রীর মত অভিনয় করতে হবে। শোকে, বেদনায় আপনি মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন, বোধশক্তিহীন হয়ে গেছেন এমন একটা ভাব দেখাতে হবে।’
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শায়লা তাকাল কুয়াশার দিকে । ‘আপনি সত্যি বলছেন সব কথা?”
কুয়াশা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমার উপরে বিশ্বাস রাখুন, মিসেস আহমদ। আপনার খোকন বেঁচে আছে । সে সুস্থ আছে। ক্রুজার থেকে নিয়ে আসবার সময়। শুধু ওর গায়ের তোয়ালেটা ভিজে গিয়েছিল। অন্য একটা কাপড় দিয়ে ওর গা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ওর ঘুম ভাঙেনি এখন পর্যন্ত। এখন সে লীনার বাসাতে আছে। তবে সকালেই ওকে অন্য এক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাব। তার ঠিকানাও। দিয়ে যাব । ফোন নম্বর দিয়ে যাব। এমন কি আপনি ইচ্ছে করলে এখুনি লীনাদের বাসায় ফোন করে জানতে পারবেন। কিন্তু সেটা ক্ষতিকর হতে পারে। আপনাকে এখন এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যে, শোকে আপনি পাথর হয়ে গেছেন। কাঁদতে পর্যন্ত পারছেন না, কান্না আসছে না। আর আসল ব্যাপারটা কাউকেই বলা যাবে না। আপনাদের ম্যানেজারকে নয়, রোজিনাকেও নয়। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর, সন্দেহ নেই। কালকেই পুলিস আসবে । অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করবে কিন্তু কিছুই বলা চলবে না। বললে, আসল অপরাধী হাতের বাইরে চলে যাবে।’
কুয়াশার বাচন-ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু ছিল যাতে তার উপর শায়লার বিশ্বাস দৃঢ়ত হল। কুয়াশা যে খোকন সম্পর্কে এতটুকু মিথ্যা বলছে না তা
অনুভব করতে পারল সে ।।
কাজটা কিন্তু খুবই কঠিন হবে । চাকরদেরও বলা যাবে না, আপনি বলছেন। রুস্তম আলীকেও না। সে কিন্তু খুবই বিশ্বাসী। অনেক বছর ধরে সে এই বাড়িতে আছে, বলতে গেলে আমাকে সে সন্তানের মত স্নেহ করে। ওর সাথে কি করে
৪৬
ভলিউম-৮
প্রতারণা করি? মহীউদ্দিন ও রোজিনা না হয় বুঝবে।
না না, কাউকে বলতে পারবেন না। রোজিনা বা মহীউদ্দিনকেও নয়। তা কি করে হবে?’ মৃদু প্রতিবাদ করল শায়লা।
আমি যতদূর ওদের দুজনকে বুঝতে পেরেছি, তাতে কোন কথা চেপে রাখার ধাত ওদের নয়। কোন কথা গোপন রাখার মত মানসিক প্রবণতা ওদের নেই। আর চাকরদের কানে তুললে তো দুনিয়াসুদ্ধ লোক জেনে ফেলবে। এই ঝুঁকি নেবেন না। তাছাড়া ব্যাপারটা মাত্র দু-তিন দিনের মধ্যেই ফয়সালা করতে পারব আমি।’
কিন্তু কি করেই বা মিথ্যে কথা বলব? বিশেষ করে মহীউদ্দিন আর রোজিনার কাছে? ওরাও তো খোকনকে ভালবাসে। খোকন মারা গেছে শুনলে কি সাঘাতিক। আঘাত পাবে ওরা, বলুন তো? না না, আমি ওর পারব না। এ অসম্ভব। নিতান্তই অসঙ্গত। অন্যায়। খোকন যদি বেঁচে থাকে, যদি সত্যি সে সুস্থ থাকে তাহলে ওকে এনে দিন আমার কাছে।
দাঁতে দাঁত চাপল কুয়াশা। শায়লা বেগমকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানো যাচ্ছে না। তার সহযোগিতা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন তাকে তার
তুরুপের তাস ছাড়তে হবে।
| সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তবে তাই হোক, আপনি যদি আমার পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতে না চান, তাহলে আমার আর বলবার নেই কিছু। আমি এক্ষুণি গিয়ে তাকে নিয়ে আসছি।’
তাই করুন। দয়া করে তাই করুন,’ মিনতি জানাল শায়লা।
কিন্তু মনে রাখবেন মিসেস আহমদ,’ তীব্র কণ্ঠে কুয়াশা বলল। মাত্র দু’ঘন্টা আগে আপনার ছেলেকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার চেষ্ট করা হয়েছিল। চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে, বেঁচে আছে আপনার খোকন। এই মুহূর্তে সে নিরাপদ আছে। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবার পর তার কোন দায়িত্ব আমি নেব না। আর তার উপর যে আবারও হামলা হবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই।’
ঠিক জায়গাতেই আঘাত লাগল। কেঁপে উঠল শায়লা।
সে বলল, কিন্তু কে?…কে সে?
‘ছেলে ধরার দল খোকনকে চুরি করেনি। মুক্তিপণের টাকাটা এখানে বড় উদ্দেশ্য ছিল না। খোকনকে খুন করতে চেয়েছিল কেউ একজন । সে আবারও খুনের চেষ্টা করতে পারে। খোকনকে এখানে এখন ফিরিয়ে নিয়ে এলে তার বাসনাই চরিতার্থ হবে। আমি আর এর মধ্যে থাকব না,’ প্রস্থানের ভঙ্গি করল কুয়াশা ।।
‘দাঁড়ান। কিন্তু কে খোকনকে খুন করতে চাইবে? কেনই বা চাইবে?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল শায়লা।
৪৭ কুয়াশা-২২
‘সেটাই তো জানতে চাই। আর তা আবিষ্কারের একমাত্র পন্থা, তাকে বুঝতে দেওয়া যে, তার আজকের রাতের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। খোকন মারা গেছে, জানতে পারলে তার পরিকল্পনার অবশিষ্টটুকু ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আপনি যখন রাজি নন তখন•••।’
আমি রাজি। রাজি আছি আমি, আপনি যেমন বলবেন তাই আমি করব, নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল শায়লা।
| স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা। সে বলল, আপনাকে যেমন অভিনয় করতে বলেছি, তেমনি অভিনয় করতে হবে। এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনি শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ভাল কথা, খোকনের অবর্তমানে আপনাদের এই বিপুল সম্পত্তির মালিক কে হবে? মিল কি আপনার নামে? খোকনের অবর্তমানে আপনিই কি মিলের মালিক হবেন? অন্য সম্পত্তিই বা কে পাবে?”
বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকাল শায়লা। ‘আমি, আমি এভাবে কখনও ভাবিনি।’ ‘এখন ভাবার সময় এসেছে।
‘খোকনের অবর্তমানে আমার স্বামীর চাচাত ভাই, মানে একমাত্র চাচাত ভাই হাসেম হবে মিলের মালিক। মিলে আমার নামে অবশ্য সামান্য শেয়ার আছে । কিন্তু হাসেমই আমার শ্বশুরের তরফের নিকটতম আত্মীয়। খোকনের অবর্তমানে সেই লাভবান হবে সন্দেহ নেই। কতটা হবে তা অবশ্য জানি না। কিন্তু হাসেম এমন ধরনের কাজ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তাকে আমি জানি। আধ্যাত্মিক সন্ন্যাসী টাইপের লোক সে। অবিবাহিত। আমার স্বামী মিলের কাজে ওকে উৎসাহিত করার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। রাজি করাতে পারেননি। কিন্তু এসব প্রশ্ন উঠছে কেন? খোকন তো বেঁচেই আছে । ইনশা-আল্লাহ সেই তার
পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হবে।’
তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা ধরে নিচ্ছি যে, খোকন মারা গেছে। হত্যাকারী ব্যাপারটা যেভাবে দেখত আমাদেরকেও সেই ভাবে দেখতে হবে। তা হাসেম সাহেব এখন কোথায়?’
‘পশ্চিম পাকিস্তানে, এক ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের লেকচারার। কিন্তু ওকে আমি জানি । ওর পক্ষে এ কাজ অসম্ভব।’
‘তা হোক। আজকেই তাকে খবর দিন, একাজটা অবশ্য আপনাদের এটর্নীর। তবু দায়ে পড়ে আপনাকেই তাকে খবর দিয়ে আনতে হবে। এখুনি যেন সে চলে আসে। আর আপনাকে বেদনায় বোধ-শক্তিহীন মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার অভিনয়ের উপরই আমার পরিকল্পনার সাফল্য | নির্ভর করছে।’
কথা বলতে বলতে দু’জন ড্রইংরুমে ঢুকল। ভিতরের বারান্দায় পায়ের শব্দ
ভলিউম-৮
৪৮
শোনা গেল। কুয়াশা ফিসফিস করে বলল, ‘এবার আপনি নিজের রুমে যান। যেমন বলেছি খেয়াল রাখবেন। ওদের আমি ফেস্ করব।’
| শায়লা দাঁড়াল না। সে ধীর পদক্ষেপে শূন্য দৃষ্টি মেলে ভিতরের বারান্দার দিকে এগোল।
দরজা পেরিয়েই রোজিনা আর মহীউদ্দিন সাহেবের মুখোমুখি হল শায়লা। কিন্তু যেন তাদেরকে দেখতে পায়নি এমনভাবে এগিয়ে গেল শায়লা। তার শূন্য, বোবা দৃষ্টি ওরা দুজনই দেখতে পেয়েছিল। দু’জনই থমকে দাঁড়াল। কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে সাহস পেল না! শায়লা যেন নিশির ডাকে পাওয়া মানুষের মত পরিবেশ বিস্মৃত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল শায়লা। শায়লাকে যতক্ষণ দেখা গেল রোজিনা ও মহীউদ্দিন ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ধীরে ধীরে ড্রইংরুমে ঢুকল। মারাত্মক আশঙ্কায় ওরা। দুজনই নির্বাক হয়ে গেছে যেন।
মুখ নিচু করে বসে ছিল কুয়াশা । ওদের দেখে মুখ তুলল রোজিনা প্রশ্ন করল, ‘খোকনকে এনেছেন? কোথায় সে?’
মাথা নাড়ল কুয়াশা ধীরে ধীরে। নম্র, বেদনাঘন কণ্ঠে বলল, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার।’
‘দেরি! কিসের দেরি?’ আতঙ্কভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল রোজিনা। ‘খোকন মারা গেছে, অনেক দূর থেকে যেন কথা বলল কুয়াশা।
মারা গেছে,’ আর্তনাদ করে উঠল রোজিনা । ইয়া আল্লাহ। না না, একথা সত্য নয়। আপনি বলুন, একথা সত্য নয়! মিথ্যা মিথ্যা! খোকন মারা যায়নি,’ উন্মাদের মত রোজিনা ছুটে গেল কুয়াশার দিকে। তার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
বলুন, সত্যি করে বলুন! বলুন, বেঁচে আছে খোকন।’
কুয়াশা আলগোছে রোজিনার হাত দুটো নামিয়ে তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, শান্ত হোন, মিস হক।
| ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল রোজিনা। অনেকক্ষণ পরে আবেগ একটু প্রশমিত হলে সে আঁচলে মুখ মুছে জিজ্ঞেস করল, “কি করে ঘটল এই দুর্ঘটনা? আপনিও খোকনকে বাঁচাতে পারলেন না!’ | কুয়াশা পুনরাবৃত্তি করল, কিন্তু শেষের দিকটা সামান্য পরিবর্তন করে। সে বলল, “আমি ক্রুজারে যখন পৌঁছুলাম তখন সেটা ভুবতে শুরু করেছে। ককপিটে উঠতে পেরেছিলাম ঠিকই। লাথি মেরে দরজার প্যানেলও ভাঙতে পেরেছিলাম । কিন্তু ভাঙা জায়গাটা দিয়ে ভিতর থেকে এমন প্রচণ্ড তোড়ে পানি বেরিয়ে এল যে, আমি তার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলাম। আমি উঠবার আগেই ক্রুজারটা একেবারে তলিয়ে গেল। তোয়ালের মত কিছু একটা ভেসে আসতে দেখে আমি চেপে ধরলাম। বুঝতেও পারলাম যে, ঐ তোয়ালেটার মধ্যেই আছে খোকন।’
৪-কুয়াশা-২২
৪৯
তবু তাকে বাঁচাতে পারলেন না?
না, পারলাম না! সে মারা গিয়েছিল অনেক আগেই। ক্রুজারটা উল্টে যাওয়ায় আমিও একদম তলিয়ে গেলাম। নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে খোকনকে আর তুলে আনতে পারলাম না। এখনও তার লাশ হয়ত ওখানেই পড়ে আছে।’
| অশ্রুসজল চোখে রোজিনা বলল, কয়েক মিনিট আগে গেলেই খোকনকে বাঁচাতে পারতেন। আহা, মাত্র কয়েক মিনিটের পার্থক্যের জন্যে খোকন আমাদেরকে ছেড়ে গেল! আপনার আর কি দোষ,’ ফোঁপাতে লাগল রোজিনা।
মহীউদ্দিন সাহেব এতক্ষণ চুপ করে শুনেছেন। কোন প্রশ্ন করেননি। তিনি দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। রোজিনার শেষ কথাটা শুনে তার সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল ।
তিনি বললেন, আপনার এই আষাঢ়ে গল্প আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বলেন?
‘হোয়াট ডু ইউ মীন?’ কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করে কুয়াশা তাকাল মহীউদ্দিন সাহেবের দিকে।
চুপসে গেলেন মহীউদ্দিন সাহেব মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু থামলেন না। তিনি বললেন, ‘খোকনের যদি মৃত্যু হয়েই থাকে তাহলে তার জন্যে আমরা আপনাকেই দায়ী করব। এবং আরও অনেক কারণেই দায়ী করব আমরা আপনাকে।
যথা•••?’ বিপ করল কুয়াশা।। আপনার রূমে খোকনের মুক্তিপণের টাকা-ভর্তি সুটকেস এল কোত্থেকে?’ তার মানে! চমকে উঠল কুয়াশা। তার মানে কি, দেখতে চান, না শুনতে চান? দেখতেই চাই।’ তাহলে আসুন! না থাক, আমিই নিয়ে আসছি। দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন মহীউদ্দিন সাহেব। রোজিনা অবাক হয়নি। সে নিজেই দেখে এসেছে টাকা-ভর্তি সুটকেসটা।
কুয়াশা দেখল, রোজিনার চোখে ঘৃণা, অবিশ্বাস আর ভয়। মনে মনে হাসল সে। কিন্তু কোন কথা বলল না কুয়াশা। রোজিনাও চুপ করে রইল।
অনেকক্ষণ পরে রোজিনা কথা বলল। কিন্তু আপনি গেছেন মার্সিডিসে, আর ফিরলেন স্কুটারে। ব্যাপার কি?
‘পথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। একটা পরিচিত দোকানে রেখে এসেছি। ভেসপাটা ওদের কাছ থেকেই ধার নিয়ে এসেছি।’
সিগারেট ধরাল কুয়াশা।
বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সুটকেস হাতে মহীউদ্দিন সাহেব ঢুকলেন। কার্পেটের উপর সুটকেসটা ফেলে দিয়ে বললেন, “চিনতে পারেন সুটকেসটা?
ভলিউম-৮
এটাতে করেই আপনার হাতে থোকনের মুক্তিপণের টাকা পাঠানো হয়েছিল, এই আজকে রাতেই। টাকা ভিতরে আছে। সবটা অবশ্য নেই। তবে আমার পকেটে নোটের যে নম্বর ছিল মিলিয়ে দেখলাম, এখুনি। এগুলো সেই টাকাই’ উবু হয়ে সুটকেসটা খুললেন তিনি।
| কুশা দেখল, তারপর একবার মহীউদ্দিন ও একবার রোজিনার দিকে তাকাল। ওদের দু’জনের দৃষ্টিতে চরম অবিশ্বাস আর ঘৃণা। সিগারেটে টান দিয়ে সে বলল, এতে কি প্রমাণিত হয়?’
‘সে বিচারের ভার আদালতের উপর। আপনাকে আমি পুলিসের হাতে তুলে দেব। তারা আপনাকে আদালতে সোপর্দ করবে হুমকি, চুরি ও খুনের দায়ে ।।
মৃদু হাসল কুয়াশা।।
আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না, আদেশ জারি করলেন মহীউদ্দিন সাহেব।
বাইরের দিকে তাকাল কুয়াশা। ভোর হয়ে গেছে। আঁধার কেটে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওসব মেলোড্রামাটিক ভয় আমাকে দেখাবেন না, সারারাত বড় ঝামেলা গেছে। মিস হক, আপনি বোধহয় অফিসে যাবেন আজ? অফিস খুলবে না?’
মাথা নাড়ল রোজিনা।
‘অফিসে দেখা হবে আপনার সাথে চলি এখন, আশ্চর্য শান্তশোনাল কুয়াশার কণ্ঠস্বর।
দৌড়ে সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালেন মহীউদ্দিন সাহেব। নো ইউ কান্ট লীভ ইউ মাস্ট ওয়েট টিল দ্য পুলিস কাম। আদারওয়াইজ•••}
মহীউদ্দিন সাহেবের মুখের কথা শেষ হবার আগেই কুয়াশা বাঁ হাত দিয়ে তাকে একপাশে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এলেন, কিন্তু আঘাত হানার আগেই কুয়াশা তার কব্জি ধরে আস্তে করে মুচড়ে দিল। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। হাতটা ছেড়ে দিয়ে কুয়াশা বলল, এ ধরনের ছেলেমানুষী করার চেষ্টা করবেন না।’ | মহীউদ্দিন সাহেব বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা বুলোতে বুলোতে চরম আক্রোশে কি যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু কুয়াশা দাঁড়াল না। ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল ।
রোজিনা সহানুভূতি সহকারে জিজ্ঞেস করল, ‘খুব লেগেছে বুঝি?’
জ্বলে উঠলেন মহীউদ্দিন সাহেব। কিন্তু কত্রীর বোনকে কঠোর কোন কথা বলতে তিনি সাহস পেলেন না রোজিনাকে তিনি চেনেন। তাকে ঘাটালে ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা, সুতরাং অপমানটা নীরবে হজম করলেন তিনি ।
|
কুয়াশা-২২,
ওদিকে দোতলায় তখন অন্য এক দৃশ্যের যবনিকা উত্তোলিত হয়েছে।
শায়লা তার রুমে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিল। দুরুদুরু বুকে সৈ টেলিফোনটার কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন-ডিরেক্টরীটা ঘেঁটে শহীদ খানের বাসার নম্বর বের করল। (আজকাল ফোন-গাইডগুলোও কি বিশ্রী হয়েছে। দরকারি নম্বরটা খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হয়।)
ডায়াল করতে ভয় করছিল তার । যদি…যদি.•• খোকন•••যদি চরম দুঃসংবাদটাই শুনতে হয়? লীনা অন্তত মিথ্যে বলবে না। তবু বলা যায় না। সে
তো কুয়াশারই লোক।
টেলিফোনটা বেজে চলেছে ওদিকে। কেউ ধরছে না। বুকের কাঁপুনি বাড়ছে শায়লার। ক্রেডলে চাপ দিয়ে আবার ডায়াল করল শায়লা।
হ্যালো…? শহীদ খান সাহেবের বাসা? লীনা আছে?’ আপা ঘুমোচ্ছেন।’
উনি একাই আছেন? না আর কেউ আছে?’ বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। শায়লার।।
‘ওঁর সাথে… | আচ্ছা, আমি আপাকে ডেকে আনছি । আপনি লাইনে থাকুন। ‘শুনুন, আপনি কে বলছেন? ‘আমার নাম গফুর। আমি এই বাসায় কাজ করি।’
“ওহ্, ঠিক আছে, ডেকে আনুন ওঁকে। তাড়াতাড়ি আসতে বলবেন। বড় দরকার।’
শায়লার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। রিসিভারটা টেবিলের উপর রেখে সে কোনরকমে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। আবার রিসিভার তুলে নিল।
ওদিকে কোন সাড়াশব্দ নেই। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। যেন একটা যুগ পেরিয়ে গেল। ঘড়ি দেখল শায়লা। এক মিনিটও যায়নি। ওদিকে তার দেহের কাঁপুনি বাড়ছে। সে কি এখুনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে? না, তাকে চেতনা হারালে চলবে না। যেভাবেই হোক আত্মসংবরণ করতে হবে। ডান হাতে চেয়ারের হাতল ধরে দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজের অস্থিরতা দমাতে চেষ্টা করল। কিন্তু লীনা কেন এত দেরি করছে?
‘হ্যালো?”
লীনা?’ অস্কুটকণ্ঠে বলল শায়লা’। প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও তার বক্ষস্পন্দন আর,
ভাল৬ম-৮
বেড়ে গেল।
হ্যাঁ, লীনা বলছি। আপনি? শা-শায়লা, কাঁপছে শায়লার ঠোঁট, তার কণ্ঠস্বর। ‘খোকন কেমন আছে? কোন উত্তর শোনা গেল না। বল, কেমন আছে আমার যাদু? বেঁচে আছে তো? ভাল আছে তো?’ তুমি যেখান থেকে ফোন করছ সেখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে?’ ‘কেউ নেই, কেউ নেই, ফিসফিস করে বলল শায়লা। লীনা, লক্ষ্মীটি, এখানে। আমি একাই আছি আমার রূমে। দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি।
ঠিক বলছ?”
‘আমাকে আর কত যন্ত্রণা দেবে, তোমরা সবাই মিলে বল, লীনা?’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল শায়লা।।
লীনা কোন কথা বলল না । কিসের দ্বিধা, কে জানে, নাকি সে যে শায়লাই, সে সম্পর্কে লীনার মধ্যে সন্দেহ আছে? অথবা কুয়াশার অন্য কোন নির্দেশ আছে? অথবা সেই রকম দুঃসংবাদটাই?
লীনা বলল, একটু ধর। আমি এখুনি আসছি।’ | রিসিভার কানে লাগিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল শায়লা। লীনা পর্যন্ত তাকে আমল দিতে চাইছে না। ভাগ্যাহত শায়লার উপর এখন সবাই আঘাত হানছে একের পর এক। হয়ত চরম দুঃসংবাদটা দিতে ওদের বাধছে বলে সবাই তাকে মিথ্যা প্রতারণা করছে। তাতে যে তার ব্যথা সহস্রগুণ বাড়ছে তা কি কেউ বোঝে
না?
মামণি? ম্য’মী? আমি খোকন বলছি! কেমন আছ তুমি?’
দু’কান জুড়িয়ে গেল শায়লার । আনন্দে তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। চট করে জবাব দিতে পারল না শায়লা। অসহ্য পুলকে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
বাবু! বাবু! আবু । কেমন আছ তুমি?
‘খুব ভাল আছি। আমাদের বাড়ির মতই মস্ত একটা বাড়িতে আছি আমি আর লীনু আন্টি। জান মামনি, আন্টি বলেছে, একটু পরেই আমরা নাকি আবার অন্য বাসায় বেড়াতে যাব। শ্যানন মামা আমার জন্যে খেলনা কিনতে গেছে। গফুর না, ঘোড়া হয়েছিল… | তুমি এখানে আসছ না কেন? তোমাকে যে কদিন দেখিনে?”
আসব, বাবা, আসব । তোমাকে আনতে যাব আমি।’ ‘আচ্ছা, আমি এখানে কি করে এলাম? লীনু আন্টি কিছুতেই বলতে চায় না। আমি কিন্তু এখানেই থাকব। তুমিও চলে এস না? আন্টি বলেছে, আমাকে একটা আস্ত অ্যারোপ্লেন কিনে দেবে। আমি চালাব।’
দুকান ভরে শুনতে লাগল শায়লা।
একটু পরে লীনা রিসিভার নিয়ে বলল, ‘খুশি হয়েছ তো শায়লা? নাকি কুয়াশা-২২
এখনও সন্দেহ আছে কোন? আর সব কথা কুয়াশা দাদামণির কাছে নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। মনে রেখ, কুয়াশা মানুষের ক্ষতি করেন না। উপকারই করেন, তা ওর সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যাই হোক।
‘আমায় মাফ করো, লীনা। আমার মানসিক অবস্থা কি তোমরা অনুভব করতে পার না? কি তীব্র যন্ত্রণা যে আমি দু’দিন ধরে ভোগ করছি তা এক আমি ছাড়া আর কে বলতে পারে? | ‘পারি বোন, সবই বুঝতে পারি। কিন্তু এবারে ছেড়ে দিই। খোকনকে
এখনও নাস্তা দেওয়া হয়নি।’
‘শোন, ওকে কবে ফিরে পাব আমি?
‘সেকথা আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে যতক্ষণ খোকন বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্তি না পায়, অনুমান করি, ততক্ষণ কুয়াশা দাদামণি ওকে তোমার কাছে নেবেন না।
দশ
পরের ঘটনাগুলো রুটিন মাফিক। পুলিস এল। যথারীতি তদন্ত হল। শায়লা পুলিসের প্রশ্নের জবাব দিল না। বোবার মত শূন্য দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল ইন্সপেক্টরের দিকে। যেন কোন প্রশ্নই সে শুনতে পায়নি। রোজিনা শায়লাকে রেখে এল তার রূমে। ফিরে আসতেই ইন্সপেক্টর ফিরোজ হোসেন বললেন, বড় শোক পেয়েছেন মিসেস আহমদ। আপনাদের এখুনি কোন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। উনি হয়ত পাগলই হয়ে যাবেন।’
মহীউদ্দিন সাহেব আনুপূর্বিক ঘটনা বললেন। কুয়াশার রুম থেকে মুক্তিপণের টাকা বের করে দেখালেন। মিসেস আহমদের চাবির গোছাও যে কুয়াশার রূমে ওয়ার্ডরোবের মধ্যে পাওয়া গেছে তাও জানালেন এবং শেষটায় বললেন, ‘কুয়াশার মত একটা সমাজ-বিরোধী লোককে একাজে নিয়োগ করাটা ভুল হয়েছিল গোড়াতেই। আমি আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু এঁরা শুনলেন না।’
ইন্সপেক্টর কুয়াশার রূম তল্লাশি করলেন, প্রয়োজনীয় নোর্ট নিলেন এবং প্রমাণ হিসেবে মুক্তিপণের টাকাভর্তি সুটকেসটা নিয়ে চলে গেলেন। তিনি তদন্ত শেষে বললেন, যতদূর মনে হচ্ছে, মুক্তিপণের টাকাটা কুয়াশা ছেলেধরাদের দেয়নি বলেই ওরা খোকনকে খুন করেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, কুয়াশা নিজেই খোকনকে চুরি করেছিল টাকার লোভে।
রোজিনা অস্ফুট কণ্ঠে মৃদু প্রতিবাদ জানাল, না না, এ অসম্ভব! এ হতেই পারে!’
জবাবে ইন্সপেক্টর একটা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, কুয়াশার রেকর্ড যারা ৫৪
ভলিউম-৮
জানে তারাই আমার কথার মর্মার্থ বুঝবে সারা পৃথিবী জুড়ে সে হাজারটা অপরাধ করে বেড়িয়েছে। হি ইজ এ বর্ন ক্রিমিন্যাল। অপরাধ সে করবেই। খুন-জখম ওর রক্তের দাবি।
চলে গেলেন ইন্সপেক্টর।
ডেমরা ব্রিজের কাছে বদ্ধ জলাভূমিটা পুলিস জেলে লাগিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজ করল। খোকনের কাল্পনিক লাশ পাওয়া গেল না । ডুবুরিরাও ব্যর্থ হল ।
সকালেই টেলিগ্রাম করা হয়েছিল শায়লার দেবর আবুল হাসেমের কাছে। দুপুরে জবাব এল । সে দুপুরেই রওয়ানা দিচ্ছে । সন্ধ্যায় পৌঁছুবে।
মহীউদ্দিন সাহেবের অনুরোধে রোজিনা সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিল। হাসেমকে রোজিনা-ই এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এল।
শায়লার জন্যে ডাক্তার ডাকবার কথা উঠল। কিন্তু সে আপত্তি করল । সে। এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। হাসেমকে সে শান্তভাবে অভ্যর্থনা জানাল । তার শোকার্ত শূন্য দৃষ্টিতে বিচলিত হল হাসেম। মহীউদ্দিন সাহেবের মনে হল, এই করুণ ঘটনার মধ্যেও হাসেমের উপস্থিতিতে একটু সান্ত্বনা পেয়েছে শায়লা।
| দু’একটা কথাও হল শায়লা ও হাসেমের মধ্যে। নিতান্তই ফর্মাল আলাপ।। হাসেমকে এর আগে মহীউদ্দিন কখনও দেখেননি। ইনিই হবেন তার নতুন মনিব ।। লোকটাকে বড্ড আনইম্প্রেসিভ’ মনে হল তাঁর। দু’একটা কথাতেই তিনি বুঝতে পারলেন, বৈষয়িক ব্যাপারে ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতার যেমন অভাব, উৎসাহের। অভাবও তেমনি প্রবল। শায়লা মিল পরিচালনা সম্পর্কে যতটা বোঝে তার হাজার ভাগের এক ভাগও লেকটা বোঝে কিনা সন্দেহ আছে। ভদ্রলোক বোধহয় অত্যন্ত। লাজুকও। সে শায়লা, বিশেষ করে রোজিনার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চায় না। রোজিনা যে দু’একটা প্রশ্ন করেছে তার জবাব দিলেও তার দিকে একবারও মুখ। তুলে তাকায়নি হাসেম। কে জানে, হয়ত রোজিনার প্রতি কোন দুর্বলতাও থাকতে পারে হাসেমের। মনে মনে হাসলেন মহীউদ্দিন সাহেব। অবশ্য রোজিনার দিকে
অনেক সময় তিনি নিজেও মুখ তুলে কথা বলতে সাহস পান না। যদিও তার কারণ আলাদা। কিন্তু আলাদা হলেও নির্দিষ্টভাবে কারণটা যে কি, মহীউদ্দিন সাহেব নিশ্চিতভাবে তা বলতে পারেন না। তবে তিনি জানেন যে, রোজিনাকে তিনিও একটু সমীহ করেন, এমন কি মিসেস আহমদের চাইতে রোজিনাকেই তিনি
বেশি সমীহ করেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মহীউদ্দিন সাহেব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। শায়লা ডাইনিংরূমে আসেনি। তাই তাকে তার রূমেই খাবার দেওয়া হয়েছে।
| রুস্তম আলী দ্বিতীয়বারের মত কফির সরঞ্জাম দিয়ে গেল । রোজিনা দু’কাপ কফি তৈরি করল। এক কাপ এগিয়ে দিল হাসেমের দিকে। চুপচাপ চুমুক দিল হাসেম। রোজিনার সামনে একা একা অস্বস্তি বোধ করছিল হাসেম। মাথা নিচু করে
কুয়াশা-২২
সে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। কিন্তু কিছু একটা বলা দরকার। এভাবে চুপচাপ থাকা কী বিশ্রী? বিশেষ করে খোকনের মৃত্যুজনিত শোকাবহ পরিবেশে নীরবতা আরও বেদনাদায়ক।
কিছু একটা বলা উচিত, ভাবছিল হাসেম। কিন্তু কথা বলবার সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না সে। অথচ, রোজিনা যে তার সাথে কথা বলতে উনাখ তা সে অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তবু সে আলোচনার বিষয় খুঁজে পেল
।
নীরবতা ভাঙল শেষ পর্যন্ত রোজিনা। সে জিজ্ঞেস করল, ছুটি নিয়ে এসেছেন, একেবারে ইস্তফা দিয়ে এসেছেন?’
রোজিনার চোখের দিকে কুণ্ঠিত দৃষ্টি মেলে ধরল হাসেম। ‘ইস্তফা দেব কেন?’ শিশুর মত প্রশ্ন করল সে।
রোজিনা বলল, ‘অনেক দিন, বলতে গেলে অনেক বছর পরে আপনার সাথে দেখা। তাই না? সেই শায়লার বিয়ের সময়। তাম-এ-ওয়ালিমার দিন এই বাড়িতেই শেষ দেখা। মনে পড়ে আপনার সেদিনের ঘটনা? আপনি গাড়ি থেকে। নামলেন ।•••অনেক বছর হয়ে গেল তবু মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন, স্থির দৃষ্টিতে রোজিনা তাকাল হাসেমের দিকে।
সাত বছর,’ মাথা নামাল হাসেম। আবার কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল দু’জন।। একটু পরে রোজিনা বলল, আপনার উপকারের কথা ভুলব না।’ ‘কোন উপকার?’ মাথা তুলল হাসেম।
মনে নেই আপনার?’
ভাল কথা, এই সাত বছরের মধ্যে আপনি আর আসেননি?’
‘এসেছিলাম একবার। এই দিন পনের আগে। খুলনায় হিস্ট্রি কনফারেন্সে । এক সপ্তাহ ছিলাম সেখানে। ঢাকায়ও ছিলাম দুদিন, কিন্তু বড় ব্যস্ততার মধ্যে। ফিরে গিয়েছি মাত্র দিন সাতেক আগে।’
| রোজিনা বলল, ‘এত বছর পরে দেশে ফিরলেন, অথচ এমনি ব্যস্ত ছিলেন যে, একমাত্র আত্মীয়ের সাথেও দেখা করার সময় হল না! আপনি তো খোকনকে দেখেননি তাহলে?’
না, তবে, ওর অনেক ছবি আছে আমার কাছে । ভাবি মাঝে মাঝে পাঠাতেন, দাম্পাস ফেলল হাসেম।
জিনা বলল, ‘এবারে কি করবেন, ঠিক করেছেন কিছু? কোন ব্যাপারে?’
বলতে গেলে আপনিই তো এখন আহমদ দুলাভাইয়ের সম্পত্তির প্রধান ৫৬
ভলিউম-৮
উত্তরাধিকারী। সুতরাং আপনাকে এসব বুঝে নিতে হবে না।’
ঠিক বুঝতে পারছিনে, কি করা উচিত।’
রোজিনা একটু তরল গলায় বলল, বুঝবার কি আছে, এতবড় মিল তো আর গরিব-দুঃখীদের দান করা যায় না। আপনাকেই মিলের মালিকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর সেই সাথে আপনাকে নিশ্চয়ই ঘর-সংসারও পাততে হবে।’
‘এসব প্রসঙ্গ এখন থাক, মিস, হক। পরে আলাপ করা যাবে,’ বিব্রত হয়ে হাসেম বলল।
‘সেই ভাল, উঠে দাঁড়াল রোজিনা।
সে যখন শায়লার ঘরে ঢুকল তার ঠিক এক মিনিট আগেই শায়লা খোকনের সাথে আর একদফা টেলিফোনে আলাপ করে দরজাটা সবে খুলে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে সে দেয়ালের দিকে ঘুরে শুলো।
| রোজিনা ডাক দিল, শায়লা, জেগে আছ?’।
শায়লার স্তিমিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আছি, বোন, তুমি শুয়ে পড়গে। সারাদিন ঝামেলা তো কম যায়নি!
‘আমার কথা ভাবতে হবে না। শরীর কেমন লাগছে?’
‘আছে ভালই,’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শায়লা। তুমি কালকেই চলে যাচ্ছ ঢাকায়, তাই না?’
যাওয়া তো দরকারই। ইয়ার এণ্ডিং-এর সময়। কিন্তু এখানেও তো থাকা দরকার ।
‘এখানে আর থাকবার কি দরকার আছে? আমার জন্যে ভেব না, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
| তা হয় না, শায়লা। আরও.দু’একদিন যাক। | গভীর শোকার্তের ভূমিকায় অভিনয় করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল শায়লার। সুতরাং রোজিনা আপাতত চলে যাক সেটাই মনে-প্রাণে চাইছিল শায়লা। কিন্তু রোজিনা যে এই অবস্থায় তাকে ফেলে যাবে না তা-ও সে জানে।।
সে বলল, তা বেশ, কিন্তু অফিস কামাই কোরো না। এখান থেকেই না হয় অফিস করো। আমার গাড়িটা করেই যেয়ো।
“সে হবে’খণ, রোজিনা নিষ্ক্রান্ত হল ।
এগার
অফিসে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল রোজিনার। তবু সে ফোনে শায়লার খোঁজ নিল। হাসেমের সাথেও ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলল। সকালে অফিসে আসার পথে লীনার বাসায় গিয়েছিল সে। গফুর জানাল, লীনা গতকাল তার সাথে বেরিয়ে
কুয়াশা-২২
যাবার পর আর ফেরেনি। চিন্তিত হল রোজিনা। লীনা তাহলে গেল কোথায়?
লাঞ্চের পর লীনা হঠাৎ এসে হাজির। সোজা এসে ঢুকল রোজিনার রূমে। ভূত দেখার মত চমকে উঠল রোজিনা। উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল সে। হাজারটা প্রশ্ন করল এক নাগাড়ে, কোথায় গিয়েছিলি, কি হয়েছিল? আমরা তো সবাই ভেবে মরছ! এমন কি শায়লা তার পুত্র-শোকের মধ্যেও তোর জন্যে চিন্তিত হয়ে রয়েছে। কি হয়েছিল, বল তো? কোন বিপদে পড়েছিলি নিশ্চয়ই?”
‘বিপদে পড়েছিলাম ঠিকই। ব্যাপারটা অবশ্য নিতান্তই ব্যক্তিগত।’
‘ও, তাই নাকি!’ স্মিতহাসি হাসল রোজিনা, তাই তো বলি.•• | তবু এমনিভাবে যাওয়াটা তোর ঠিক হয়নি। শিমরা ভেবে মরছি। সকালেও গিয়েছিলাম তোর বাসায় খোঁজ করতে।’
শুনেছি আমি।’ চা খা এক কাপ?’, ‘বেশ তো। আমারও চায়ের জন্যে প্রাণটা আইঢাই করছে।’ বেয়ারাকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিল রোজিনা ।।
লীনা বলল, ‘শোন, আসল কথাটাই বলা হয়নি। কুয়াশা দাদামণি নিচে গাড়িতে বসে আছে তোর অপেক্ষায়। খুব জরুরী কথা আছে তোর সাথে। এখুনি যা তুই।’
“সে কিরে, এতক্ষঃ বলিসনি কেন?’ ব্যস্ত হল রোজিনা।
সময় দিলি কোথায়, বল? যেভাবে এক নাগাড়ে কৈফিয়ত চাইলি, সময় পেলাম কোথায়?’
‘কিন্তু নিচে কেন, এখানে নিয়ে এলেই পারতিস?
না, উনি উপরে এলেন না। আমি বলেছিলাম। তুই জলদি যা। তুইও চল। না, গোপন কথা আছে। আমার সামনে বলবেন না, বলেছেন তিনি। ‘বেশ, আমি যাচ্ছি।’ রোজিনা বেরিয়ে গেল।
নিচে গিয়ে কুয়াশার খোঁজ করল রোজিনা। তাকে দেখতে পেল না, তার মার্সিডিসটাও নয়। চারদিক ভাল করে সন্ধান করে রূমে ফিরে গেল রোজিনা।. ব্যাপার কি, কুয়াশা তাকে ডাকতে লোক পাঠিয়ে সরে পড়ল কেন? এই রহস্যজনক আচরণের কারণ খুঁজে পেল না সে।
ফিরে গিয়ে রোজিনা বলল, কিরে, কোথায় কুয়াশা? পেলাম না তো! নিচে তো দেখলাম না ওকে!’ | ‘সে কিরে, নিচেই তো গাড়িতে বসে আছেন! আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে উনি বসে রইলেন।
मल्लिा
কই, দেখলাম না তো।
লীনাও অবাক হয়ে বলল, এমন তো হবার কথা নয়! ভাল কথা, তুই কি আজকে শায়লাদের বাসায় ফিরে যাবি, না কি তোর নিজের বাসায় যাবি?’
‘শায়লাদের ওখানেই যাব। তুই যাবি?’
‘আমি? আমি আর গিয়ে কি করব? কোন উপকার তো করতে পারলাম না । আচ্ছা, মহীউদ্দিন সাহেব লোকটা কেমন রে?’
‘কেনরে? এ প্রশ্ন করছিস কেন?’ ‘এমনি।
এমনিই এ ধরনের প্রশ্ন করেছিল বলে মনে হয় না।’ উনি নাকি কুয়াশা দাদামণিকে পুলিসের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন?’
রোজিনা বলল, কিছু যদি মনে না করি, তো বলি। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার অত্যন্ত ঘোলাটে লাগছে। বিশেষ করে কুয়াশার রূমে মুক্তিপণের টাকাটা পাওয়ার পর থেকে আমার নিজের মনেই হাজারটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমার মনে হয়, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, কুয়াশার জন্যেই এই দুর্ঘটনা ঘটল। এর জন্যে আমিও দায়ী। মহীউদ্দিন সাহেবের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে আমিই কুয়াশার উপর খোনকে উদ্ধারের দায়িত্ব দেবার জিদ ধরেছিলাম। তাই মহীউদ্দিন সাহেবকেও দোষ দিতে পারি না।’
লীনা কিছু বলল না। চা দিয়ে গেল আৰ্দালী । বিরস মুখে চা খেয়ে বিদায় নিল সে।
বার
নীলাভ নিলয়ে নৈশভোজের পা এই মাত্র শেষ হল। কফি দিয়ে গেল রুস্তম আলী ড্রইংরূমে। শায়লা তার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করছিল। কথাবার্তা বড় একটা সে বলেনি, আর তার স্থবির অভিব্যক্তি সাফল্যের সাথে বজায় রেখেছে। কিন্তু এতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবে সে জানে, তার এই কষ্টকর অভিনয়ের পালা শেষ হতে আর দেরি নেই।
কুয়াশা যে-কোন মুহূর্তে খোকনকে নিয়ে পৌঁছুতে পারে। এই, এল বলে, বিকেলে ফোন করে জানিয়েছে সে। নৈশভোজের পর হাসেম, মহীউদ্দিন সাহেব ও রোজিনা যেন নীলাভ নিলয়ে থাকে, তার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে বলেছে। তেমন কিছু অসুবিধে হয়নি। মহীউদ্দিন সাহেবকে শুধু রাতে খাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে হয়েছে। কারণ, ব্যাচেলার মহীউদ্দিন সাহেব সন্ধ্যার পর হোটেল বা ক্লাবের উষ্ণ পরিবেশই বেশি পছন্দ করেন।
ডাইনিং টেবিলেও বটে, ড্রইংরুমেও কথা দুই-একটা রোজিনা-ই বলেছে । কুয়াশা-২২
হাসেম স্বভাবতই গম্ভীর, নীরব। কিন্তু এখন সে যেন আরও মিইয়ে গেছে। সব মলিয়ে একটা অস্বস্তিকর দম বন্ধ করা পরিবেশ। | মহীউদ্দিন সাহেব কথা একটু রেশিই বলেন। কিন্তু তারও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তবু তিনি চুপচাপ ছিলেন।
রোজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যেন কোন কিছু ঘটেনি, এমনি একটা ভান করে অভিজাত আচরণে কফি খাওয়ার কোন মানে হয় না। আমরা যেন নিজেদের মনকে চোখ ঠাওরাচ্ছি। নিজেদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, যেন এ বাড়িতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। এভাবে আত্মপ্রতারণা করে কি লাভ? সত্যি বলছি, শায়লা, যদি এমন করে বাহীন না হয়ে তুমি একটু কাঁদতে পারতে…!
মহীউদ্দিন সাহেব এই প্রসঙ্গ অবতারণা না করার জন্যে রোজিনাকে ইশারা করলেন। রোজিনা কিছু বলার আগেই হাসেম প্রশ্ন করল, ‘পুলিস কিছু করতে পারল? ধরতে পেরেছে ঐ খুনে কুয়াশাকে?’
আর পুলিসের কথা। বেহদ্দ অপদার্থ । সেই ভয়ঙ্কর অপরাধীটাকে পুলিস এখনও ধরতে পারেনি। শয়তান খুনেটা••• | মহীউদ্দিন সাহেব এতক্ষণে অবাক হলেন।
শয়তান, খুনে কাকে বলছেন মহীউদ্দিন সাহেব?’ দরজার দিক থেকে কে যেন বলল। সবাই তাকিয়ে দেখল, কুয়াশা দাঁড়িয়ে আছে ড্রইংরুমের দ্বারপ্রান্তে।
মৃত্যুর মত স্তব্ধতা নেমে এল রূমটার মধ্যে। মহীউদ্দিন সাহেব আর হাসেম যেন চেয়ারের সাথে সেঁটে গেছে। রোজিনা আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। শুধুমাত্র শায়লাই মনে মনে গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
তবু লাফিয়ে উঠলেন মহীউদ্দিন সাহেব। কেন, কেন এসেছেন আপনি? আপনার কি রক্তের আর অর্থের তৃষ্ণা মেটেনি? খোনকে খুন করেও কি আপনার জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ হয়নি?’ চিৎকার করে বলে উঠলেন তিনি। আবার কাকে
খুন করতে এসেছেন?’
কুয়াশা তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল । শান্তভাবে বলল, উত্তেজিত হবেন । কেন এসেছি জানতেই পারবেন।
কই, লীনা, এস। দেরি করছ কেন?’ বাইরের দিকে চেয়ে রইল কুয়াশা । দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল লীনা । সে ঢুকল । একা নয়, তার কোলে খোকন।
আম্মা!’ খোকন লীনার কোল থেকে নেমে দৌড়ে এল শায়লার কাছে।
অসহ্য আনন্দে তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে শায়লা । খোকনকে সাপ্টে কোলে তুলে চুমোয় চুমোয় আচ্ছন্ন করে দিল সে। সেদিকে মনযোগ দিল না কুয়াশা। শায়লা যে এমনটা করবেই সে তো স্বাভাবিক। সে মনোযোগ দিল, তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল রোজিনা হকের দিকে। মহীউদ্দিন সাহেব ও হাসেম দৃষ্টি নিবদ্ধ করল বাজিনার দিকে। কারণ, রোজিনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এমন তীব্র আর্তনাদ করে
৬০
ভলিউম-৮
উঠেছে যে ওরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আর চেহারাটা এমন বিকৃত হয়ে গেছে যে, তাকে ভয়ঙ্কর কুৎসিত দেখাচ্ছে। ভয়ে তার চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
‘এটা খোকন নয়! এটা খোকন হতেই পারে না!’ রোজিনা উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠল। এটা একটা তামাশা। জঘন্য তামাশা। খোকন মরে গেছে। কুয়াশা তাকে হত্যা করেছে। আমরা সবাই সে কথা জানি।’ | মহীউদ্দিন সাহেব অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বললেন, ফর গডস সেক, কি হয়েছে আপনার? এমন উন্মাদের মত চিৎকার করছেন কেন?’ কুয়াশার দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন তিনি, “আর আপনিই বলুন, এটা কি ধরনের তামাশা হল? এর মানে কি?
খোনকে কোলে নিয়ে শায়লা রোজিনার দিকে আতঙ্ক নীল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বলল, ‘রোজিনা, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? খেপেই বা গেলে কেন? আর এমন গর্জনই বা করছ কেন?’
এর মানে কি! মিসেস আহমদ কেন চিৎকার করে উঠলেন না খোকনকে দেখে? তিনি অবাকই বা হলেন না কেন? মি. কুয়াশা, এসব হেঁয়ালির মানে কি?
কারণ শায়লা গোড়া থেকেই জানত যে, তার ছেলে ডুবে মারা যায়নি,’ তিক্ত কণ্ঠে বলল লীনা। যদিও আপনারা ভেবেছিলেন, কুয়াশা দাদামণিই তাকে খুন করেছে। আসলে উই খোকনকে বাঁচিয়েছেন।’
‘কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। বলতে গেলে খোকনকে বাঁচিয়েছে লীনা-ই। ওকে বাঁচাবার সেন্ট পারসেন্ট কৃতিতুই লীনার। কিন্তু সে যাক, মিস হক কেন ক্ষিপ্ত হলেন জানেন?কুয়াশার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত কঠোর শোনাল, মিস হকই ঐ নিষ্পাপ শিশুকে পুরানো ক্রুজারের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছিল তাকে ডুবিয়ে হত্যা করার
জন্যে ।’
| ‘মিথ্যা, মিথ্যা! আবার চিৎকার করে উঠল রোজিনা। নির্জলা মিথ্যা! তোমরা কেউ বিশ্বাস কোরো না। শায়লা, বিশ্বাস কোরো না।’
‘অস্বীকার করে কোন লাভ হবে না। খোকন:নিজেও বলেছে, সে তোমাকে শাবল হাতে ক্রুজারের তলায় আঘাত করতে দেখেছে। তুমি তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ইঁদুরের মত ফাঁদে ফেলে ডুবিয়ে মারবার জন্যে ক্রুজারে রেখে এসেছিলে ।
তুমি, তুমি মানুষ নও পিশাচ,’ কুয়াশার কণ্ঠে ঘৃণা ফেটে পড়ল। | খোকনকে কোলে নিয়ে শায়লা কাঁপতে লাগল । সে বলল, ‘এসব কি সত্য, রোজিনা? ইয়া আল্লাহ, এ কথা যেন সত্য না হয়।’
রোজিনার অপরাধ সম্পর্কে আর প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না। ক্রোধ ও ভয়ে বিকৃত রোজিনার মুখটাতেই তার অপরাধ যেন আঁকা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। | তুমি যা করেছ তার একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। মুক্তিপণের সামান্য টাকার কুয়াশা-২২
৬১
.
I
জন্যে এ কাজ করনি। কারণ সে টাকা তো সেই রাতেই ক্রুজার থেকে এনে আমার রূমে লুকিয়ে রেখেছ। ভাল কথা, মিসেস আহমদের চাবির গোছাও ঐ রূমে কাবার্ডের মধ্যে রেখে দিয়েছিল কে? যাক, তুমি এসব করেছিলে এই জন্যে যে, খোকন মারা গেলে তার অপরাধের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপানো যাবে। খোকনকে চুরির জন্যে তুমি লোক নিযুক্ত করেছিলে। খোকনকে তারা আদর-যত্নেই রেখেছিল। কিন্তু খুন করতে গিয়েছিলে তুমিই এবং ভেবেছিলে, তুমি সফল হয়েছ। তোমার চক্রান্তের অন্তরালে ভয়ঙ্কর কিছু একটা লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেটা কি…? | ‘রোজিনা, তুমি কিছু বলছ না কেন?’ মিনতি করল শায়লা, ‘খোকন মরলে। তোমার কি লাভ হত? তুমি কি আমাকে মৃণা কর? আমি কি তোমার কোন ক্ষতি করেছি কখনও? উনি যাই বলুন আমার বিশ্বাস হয় না তুমি এর মধ্যে জড়িত আছ।’
‘বিশ্বাস না হবার কারণ নেই। মুক্তি পণের দাবি সম্পর্কে এই চিঠিগুলো দেখুন। আর এই লেখাগুলোও দেখুন। সবগুলো মিলিয়ে দেখুন, একই টাইপরাইটারে টাইপ করা হয়েছে কিনা। আপনিও দেখুন, মহীউদ্দিন সাহেব।’
মহীউদ্দিন সাহেব অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। তিনি বললেন, ‘ও দুটো তো মুক্তিপণের চিঠি, কিন্তু এটা পেলেন কোথায়?’
আজ বিকেলে একটা ফন্দি করে লীনাকে দিয়ে মিস’ হকের রূমের টাইপরাইটারটা দিয়ে টাইপ করিয়েছি,’ ঘটনাটা আনুপূর্বিক খুলেই বলল কুয়াশা। এর মানে কি এই নয় যে, মিস হকই এই চিঠিগুলো পাঠিয়েছে? আরও প্রমাণ চান?’
মিসেস আহমদ দু’বছর বাড়ি থেকে বেরোেননি। আর যেদিন বেরোলেন সেইদিনই দুর্ঘটনাটা ঘটল । তার মানে, এই বাড়ির মধ্যেই ছেলেধরাদের লোক আছে। সে কে? চাকর-বাকরদের সাথে আমি আলাপ করে দেখেছি, তারা প্রত্যেকেই বিশ্বস্ত? খোকনকে প্রাণাধিক ভালবাসে। ছেলেধরাদের সাথে তাদের কারও যোগাযোগ থাকার অবকাশ নেই। তারা বাইরে এসব নিয়ে আলোচনাও করেনি। তাহলে ঐ রাতে যে মিসেস আহমদ বাইরে যাবেন তা ছেলেধরাদেরকে
কে বলেছে?’
| ‘মিস হক একটা নতুন মরিস মাইনরে করে ক্রুজারে গিয়েছিল । গাড়িটা তার অফিসের এক হোমরাচোমরা অফিসারের। সেই দিনই কেনা হয়েছিল। লীনার খোঁজ নেবার নাম করে সে মিসেস আহমদের ট্রায়াম্ফ গাড়িটা নিয়ে সেই ভদ্রলোকের বাসায় রেখে তার নতুন গাড়িটা নিয়ে ক্রুজারে খোকনকে খুনের আয়োজন করতে গিয়েছিল । খোঁজ-র করে এসব জানা গেছে। আইয়ুব ও নওসের নামে যে লোক দুটোকে দিয়ে সে খোকমকে চুরি করিয়েছে তারা এখন পুলিসের কাস্টডিতে আছে। তারা ইতিমধ্যেই তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। এর
২
ভলিউম-৮
পরেও কি, মিস হক, আপনি অভিযোগটা অস্বীকার করবেন?
আরও প্রমাণ সরবরাহ করা হল। এত উত্তেজিত আলোচনার কারণ সম্পর্কে খোকনের এতটুকু ধারণা ছিল না। মায়ের কোল থেকে নেমে সে একদৌড়ে রোজিনার দিকে ছুটে এল। তার হাত দুটো ধরে শিশু-সুলভ কৌতূহলভরে প্রশ্ন করল, খালাম্মা, তুমি কেবিনের মেঝেটা শাবল দিয়ে ভাঙছিলে কেন? আমি জেগে যখন দেখছিলাম তুমি তখন আমার উপর রাগ করলে কেন? জান মা, খালাম্মা আমাকে মিষ্টি দুধ খেতে দিয়েছিল কেবিনে!
শায়লা খোকনকে টেনে কাছে নিয়ে বলল, “ও কিছু না, বাবা, খালাম্মা তোমার সাথে খেলা করছিলেন।
রোজিনা কিছু বলল না। সে মাথা নত করে বসে রইল। শায়লা ও মহীউদ্দিন সাহেব এত গভীরভাবে তাকে লক্ষ্য করছিলেন যে, আবুল হাসেমের আকস্মিক অদ্ভুত আচরণ তাদের চোখে পড়েনি। অথচ চোখে পড়লে তারা দেখতেন.যে সে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। তার দিকে ওদের দৃষ্টি পড়ল তখনি, যখন সে চোখমুখ উত্তেনায় লাল করে সশব্দে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
উঃ, আমার আর সহ্য হচ্ছে না! কঠিন গলায় হাসেম বলল, এই স্ত্রীলোকটা আসলেই একটা শয়তান, একেবারে পিশাচ! সাপের চাইতেও খল। সে জানত যে, খোকন-সোনা মারা গেলে সম্পত্তির বড় শেয়ারটা আমারই হাতে আসবে। পরে সব যখন চুকেবুকে যাবে তখন সে আমাকে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য কররে।’
‘এ আবার কেমন কথা বলছেন, স্যার!’ অবাক হলেন মহীউদ্দিন সাহেব। ‘মিস হক আপনাকে জোর করেই তাকে বিয়ে করাবে! এটা কেমন ধারার কথা হল?’
‘ঠিকই বলেছি। আশ্চর্য শোনালেও কথাটা ঠিক । রোজিনা সবল, আর আমি দুর্বল। আমি জানি, আমি দুর্বল কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে আর দুর্বল নই। এই মুহূর্তে যদি আমি সত্য কথা না বলি, তাহলে কোন দিনই আর সত্য বলার সৎসাহস আমার হবে না।’
ভেঙে পড়ল হাসেম। সমস্ত শরীর তার কাঁপতে লাগল, “সে এই পরিবারের। বিরাট বিত্তের মালিকানা চেয়েছিল। মুক্তিপণের পাঁচ লাখ টাকা সম্পূর্ণ সম্পত্তির তুলনায় অতি সামান্য। সে জানত তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস আমার হবে না কোনদিনই।’
কিন্তু কোন মেয়েই জোর করে কোন পুরুষকে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারে । উল্টোটা অবশ্য হরহামেশাই ঘটে থাকে, অবিশ্বাসের সুরে বললেন মহীউদ্দিন সাহেব। এটী মেয়েটার উপর নির্ভর করে। আপনি ঠিকই বলেছেন, হাসেম সাহেব। এটাই ছিল রোজিনার চক্রান্তের মূল লক্ষ্য। আপনাকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলবার মত ধূর্ততা, তার অবশ্যই আছে। আর সেটা সে করত রয়ে-সয়ে কুয়াশা-২২
৬৩
তাড়াহুড়া করে নয়। আর তাতে কেউ সন্দেহও করত না। বরং এটাকে স্বাভাবিকই মনে হত। সবাই তা সহজভাবে গ্রহণও করত।’
ব্যাপারটা শুধু তাই নয়। আমি আপনাদের কাছে একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই। কয়েক বছর ধরে আমি বিবেকের দংশন সহ্য করেছি, কিন্তু তা স্বীকার করার মত সাহস আমার হয়নি, কারণ কথাটা প্রকাশ করলে আমাকে জেল খাটতে হত। কিন্তু জেলে যেতে আমি এখন প্রস্তুত। প্রাপ্য শাস্তি আমাকে ভোগ করতেই হবে।
আমি এখন প্রায়শ্চিত্তই করতে চাই।’
| জেল খাটতে হবে! কি বলছ, হাসু?’ বিস্মিত হল শায়লা। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে!
| শায়লার কথা কানে তুলল না হাসেম । তাকে থামতে ইঙ্গিত করে সে বলল, ‘দাদার বিয়ের তাম এ-ওয়ালিমা হয়েছিল এই বাড়িতেই। আমি তখন সেগুন বাগিচা থাকতুম । আমার বেবী অস্টিনে করে আসছিলুম আমি। পথ ছিল অন্ধকার। গাড়িটার হেডলাইটও ছিল অনুজ্জ্বল। সেই আধো-অন্ধকারে গাড়িতে কি যেন চাপা পড়ল। ভাবলুম, ছাগল-টাগুল হবে হয়ত। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না। ভয়ে। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে এলুম। নির্বোধ আমি, তাই পিছন ফিরেও তাকালুম না
একবার। গাড়ি থেকে যখন পোটিকোতে নামলুম তখন আমি কাঁপছিলুম। কাছেই ছিল রোজিনা। সে এগিয়ে এল। স্বীকার করতেই হবে, ওকে আমার খুব ভাল লাগত। (এই সময় হাসেমের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে আমাকে দেখে কি বুঝল, জানি না। আমার কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইলে আমি খুলেই বললুম তাকে। গাড়ির সামনের উইংয়ের রক্তের দাগও তার চোখে পড়ল। আমাকে সে উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করে বলল, এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল কাজ হল, মুখ বন্ধ করে রাখা এবং ভুলে যাওয়া।’
কিন্তু হাসু,’ উত্তেজিত হয়ে বলতে গেল শায়লা।
“প্লীজ, ভাবী, আমাকে শেষ করতে দাও,’ মিনতি জানাল হাসেম। একটু পরেই সেই ভয়ঙ্কর খবরটা শুনতে পেলুম– একটা গাড়ির তলে চাপা পড়ে এক বুড়ি মারা গেছে। স্থান-কালও মিলে গেল। বুঝতে পারলাম, ঐ বৃদ্ধার মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী। আমি পুলিসের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চাইলাম। কিন্তু রোজিনা কিছুতেই আমাকে যেতে দিল না। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আমার। নৈতিক দায়িত্ব-বোধকে আছন্ন করে ফেলল সে। সে বলল বোকার মত কেন জেল খাটতে যাবে? সে ছাড়া এব্যাপার তো আর কেউ জানে না। কেউ জানতেও পারবে না। বোকার মত আমি তার কথা মেনে নিলুম। আমি জানি, আমি দুর্বল। আমাকে সে পরাভূত করল। সে থেকেই সে আমাকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে রেখেছে। সে জানে, তাকে অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। করলে আমাকে জেলে পচতে হবে। কিন্তু এখন আমি সেই পাপের প্রায়শ্চিত করতে চাই।’
৬৪
ভলিউম-৮
আর এটাকে সম্বল করেই মিস রোজিনা হক খোনকে হত্যা করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। কারণ সে জানে, খোকনের অবর্তমানে হাসেম সাহেবই হরেন আহমদ সাহেবের প্রায় সমস্ত সম্পত্তির মালিক। আর তাকে বিয়ে করতে সে বাধ্য করবে জেলখানার ভয় দেখিয়ে,’ পাদপূরণ করল কুয়াশা। | ‘নিশ্চয়ই। কাল সন্ধ্যায় আমি তেজগাঁ পৌঁছুবার পর থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার রোজিনা সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাকে। সরাসরি নয়। আকারে ইঙ্গিতে। অস্বীকার করব না। আমি গত কয়েকটা বছর ধরে তার ভয়ে সিটিয়ে আছি। আমি জেল খাটবার কথা, নিজের লাঞ্ছনা আর অবমাননার কথা ভাবতেই পারি না। অথচ তার জন্যে দায়ী ঐ স্ত্রীলোকটাই। কিন্তু এখন আমি আর কিছু পরোয়া করি না,’ একটানা নিজের অপরাধের কথা বলে যেন স্বস্তি পেল সে।
কপালটা ঘেমে উঠছিল। রুমাল দিয়ে কপালটা মুছে রোজিনার দিকে ব্রতী দৃষ্টিতে তাকাল একবার। তারপর অন্য দিক মুখ ফেরাল।।
| শায়লা ইতিমধ্যে বারকয়েক কথা বলবার চেষ্টা করেছে, পারেনি। এখন তার কণ্ঠ শোনা গেল ।
হাসু, তুমি, তুমি একটা আস্তা গাধা। তোমার গাড়ির তলায় চাপা পড়ে যেটা মারা গিয়েছিল সেটা মানুষ নয়, ছাগলই।’
দুঃখের হাসি হাসল হাসেম। সে কথা ঠিক নয় ভাবি, আমাকে বাঁচাবার জন্যে তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছ।•••আসলে এক বুড়িই মারা গিয়েছিল…।’
আগে শুনে নাও,’ বাধা দিল শায়লা। তুমি তো বলা নেই, কওয়া নেই, একদিন পরই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলে। কেন গেলে • এ ভাবে, বুঝতে পারিনি..তুমি হয়ত জানতেই পারনি যে, এক বুড়ি সন্ধ্যায় ছাগল নিয়ে ফেরবার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় । সে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছিল টঙ্গীরই এক ছোকরা । চোরাই একটা গাড়ি করে যাওয়ার সময় ঐ দুর্ঘটনাটা ঘটে। পরের দিন সকালেই পুলিসের কাছে এবং পরে আদালতে সে তার অপরাধ স্বীকার করে। বুড়ি মারা। যাওয়ার পর ছাগলগুলো ছাড়া পেয়ে চরে বেড়াচ্ছিল। তুমি তারই একটাকে চাপা দিয়েছিলে। পুলিস অবশ্য দুটো মৃত্যুর জন্যেই ছোকরাকে দায়ী করেছিল, অথচ তুমি এতগুলো বছর স্লাহক নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে বিবেকের দংশনে ক্ষত বিক্ষত হয়েছ। তুমি নিতান্তই একটা আহাম্মক!’
হাসেম গর্জন করে উঠল, ‘রোজিনা একথা জানত না?’
“নিশ্চয়ই জানত,’ শায়লা বলল। এ তল্লাটের সবাই জানে। এ বাড়িরও সবাই জানে। তুমি রাতে ঢাকায় ফিরে যাবার পর বেশ কয়েকদিন রোজিনা এখানে ছিল । দুর্ঘটনার পরের দিনই তো সে প্রকৃত ঘটনা শুনেছে।’
‘অথচ সেইদিনই সে সন্ধ্যায় ফোন করে আমাকে বিদেশে চলে যেতে বলেছে, অন্ততপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছে। দুর্বলচিত্ত
৫-কুয়াশা-২২
৬৫
আহাম্মকের মত আমি তার কথা শুনেছি। পরদিনই চলে গেছি ।শ্চিম পাকিস্তানে।. আর সেই জন্যেই আমি সত্য ঘটনাটা জানতে পারিনি। তখন থেকেই তার মাথায় শয়তান বাসা বেঁধেছিল। অথচ কতই বা তখন তার বয়স হবে। সতেরও পেরোয়নি বোধহয়। গত বছর সে আমার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়েছে গাড়ি কিনবে বলে । ঐ টাকাটাই আমার একমাত্র সঞ্চয় ছিল। আমি জানতাম, এটা ব্ল্যাকমেইল । কিন্তু আমার কিছুই করার উপায় ছিল না। আর গতকাল আমি এসে। পৌঁছুবার পর থেকেই সে আমাকে সেই দুর্ঘটনার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে । তুমি: তুমি শয়তান..কুত্তী-খুনে…!’ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল হাসেম
রোজিনার দিকে। রাগে হাসেম তখন কাঁপছিল।
মহীউদ্দিন সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মত হাসেমের কথা শুনছিলেন। তার বলার। ভঙ্গিতে এবং নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতায় হাসেমের একটা কথাও তিনি অবিশ্বাস করতে পারলেন না।
ঘণা ভরে তিনি রোজিনার দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, এই ভদ্রমহিলাকে তিনিও, যে ভয় করতেন না এমন নয়। তার উপরও অনেকবার প্রভাব বিস্তার করেছে। রোজিনা। তিনি অসহায়ের মত চুপ করে থেকেছেন। রোজিনার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয় ।
কুয়াশা মহীউদ্দিন সাহেবকে বললেন, ‘এবারে আপনার বাকি দায়িত্বটুকু পালন করুন। আমার কাজটুকু তো আমি করেই দিয়েছি।’
“নিশ্চয়ই। আমি এখুনি থানায় ফোন করে দিচ্ছি।’
এতক্ষণে কেঁপে উঠল রোজিনা। তীব্র চিৎকার করে বলল, না, না! আমাকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়ো না! শায়লা, আমাকে ক্ষমা কর । মাফ কর আমাকে । আমাকে আর একবার বাঁচবার সুযোগ দাও।’
তার কথা কেউ কানে তুলল না।।
মহীউদ্দিন সাহেব কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, ভাই। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। একথা ঠিক যে, গোড়া থেকেই আপনার সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা ছিল। আর সম্ভবত তার সুযোগ নিয়েই মিস হক আমাকে ভুল পথে পরিচালনা করেছেন। আমাকে দিয়েই তিনি আপনার রূম থেকে মুক্তিপণের টাকাভর্তি সুটকেসটা আর মিসেস আহমদের চাবির। গোছা আবিষ্কার করিয়েছেন। ব্যাপারটা যে তিনিই এমন চমৎকারভাবে পরিকল্পনা করেছেন তা আমি এতটুকু বুঝতে পারিনি তখন। উহকি সাংঘাতিক রমণী, আমাদের এই রোজিনা হক! যাক, আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তো?’
জবাবে কুয়াশা একটু হাসল শুধু।
Leave a Reply