১৮. সমুদ্রের অতলে ১ (ভলিউম ৬) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৮
প্রথম প্রকাশঃ জুলাই, ১৯৬৯
এক
কুয়াশার হাতের উপর মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল মেয়েটি। নিস্পন্দ হয়ে গেল তার তন্বী দেহটা। মাথাটা ঢলে পড়ল এক পাশে।
অনেক কষ্টে আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে মাত্র একবার চোখ মেলে তাকাতে পেরেছিল মেয়েটি। যন্ত্রণার্ত বোবা দৃষ্টি মেলে বোধহয় চিনবার চেষ্টা করল ‘কুয়াশাকে। ক্ষীণস্বরে উচ্চারণ করল, এডিথ গ্রে, হোটেল ডি এলিসা, রুম
নম্বর…।’
থেমে গেল মেয়েটা। শ্বাস নেবার চেষ্টা করল। তীব্র আক্ষেপে দেহটা কুঁচকে গেল। কপালে হাত বুলিয়ে দিল কুয়াশা। আবার কি যেন বলবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল মেয়েটি। পর মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল দেহটা।
. গভীর স্নেহে কুয়াশা আলগোছে ক্যানোর পাটাতনের উপর শুইয়ে দিল প্রাণহীন দেহটা। কৃষ্ণাতিথির অস্পষ্ট জ্যোৎস্না মেয়েটার যন্ত্রণায় কুঞ্চিত মুখের উপর এসে পড়েছে। বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে। সুগঠিত সুঠাম দেহের সঙ্গে সঁটা খাকি রঙের সুইম স্যুট। . এতক্ষণ চোখে পড়েনি, এখন কুয়াশা দেখল মেয়েটার কোমরে একটা ওয়াটারপ্রুফ পাউচ। খুলে দেখল একটা রিভলভার তাতে। ম্যাগাজিন পরীক্ষা করল। একটা গুলিও খরচ হয়নি। পাটাতনের তলে পাউচ আর রিভলভারটা রাখল।
সুইম স্যুটের নিচে উরুতে লেগেছে গুলিটা। হয়ত মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। পাটাতনের উপর পানি আর রক্ত কালচে দেখাচ্ছে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায়। বেদিং ক্যাপটা খুলে ফেলল কুয়াশা মেয়েটার মাথা থেকে। একগুচ্ছ সোনালী চুল ছড়িয়ে পড়ল পাটাতনের উপর।
অপলক দৃষ্টিতে কুয়াশা চেয়ে রইল মৃত মেয়েটার যন্ত্রণা-কুঞ্চিত মুখের দিকে। বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।
কাছেই ছপ ছপ একটা শব্দ হতেই মুখ তুলে তাকাল কুয়াশা যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল সেই দিকে। একটা ডিঙি তার ক্যানোর দিকেই আসছে। ডিঙিতে। তিনজন লোক। দুজনের গায়ে নাবিকের পোশাক। তৃতীয় লোকটা মাঝখানে ১০৬
একটা চেয়ারে বসে আছে। লোকটার দামি বেশভূষা। কুয়াশার ক্যানোর পাশে এসে ডিঙিটা ভিড়ল।
| চেয়ারে বসা লোকটাই প্রথমে কথা বলল, কিছু একটা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে?’ লোকটার কণ্ঠ কর্কশ।
কুয়াশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখে বলল, “আপনার মনে হওয়ার কারণ জানি না। তবে ঘটেছে সত্যি। মৃত মেয়েটিকে দেখিয়ে কুয়াশা বলল, এই মেয়েটি মারা গেছে। গুলির আঘাতে।’
| লোকটার হাতে একটা ফ্লাশলাইট। সে লাইটটা জ্বালিয়ে মেয়েটিকে দেখে বলল, “ভেরী স্যাড। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। নিরুত্তাপ কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এল লোকটার।
অত্যন্ত দুঃখিত। আমি কিছুই জানি না। দেখিনি কখনও মেয়েটাকে। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল কুয়াশা। দেখল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে সন্দেহ। কিন্তু তা উপেক্ষা করে কুয়াশা বলল, “বীচ থেকে ইয়টে ফিরছিলাম। হঠাৎ কানে এল কাতরানির শব্দ। চারদিকে লক্ষ্য করতেই দেখলাম কে একজন হাত পা ছুঁড়ছে আর অস্ফুট আর্তনাদ করছে। দ্রুত ক্যানো চালিয়ে গিয়ে টেনে তুললাম। একটু পরেই মারা গেল।’
| লোকটা আবার মেয়েটার মুখের উপর ফ্লাশলাইটের আলো ফেলল। নিভিয়ে দিয়ে বলল, একেবারে ছেলেমানুষ। কিন্তু মেয়েটা এই গভীর রাতে হারবারে
এসেছিলই বা কেন? প্রশ্নটা বোধহয় নিজেকেই করল সে।
‘কোথায় গুলি লেগেছে, মশিয়ে।’ নাবিকদের একজন এতক্ষণে কথা বলল।
‘উরুতে লেগেছে। আঘাতটা তেমন গুরুতর ছিল না। কিন্তু রক্তপাত হয়েছে বিস্তর। ঐ অবস্থাতেই অনেকক্ষণ সাঁতার কেটেছে। ঠিক সময়ে মেডিক্যাল এইড দিতে পারলে বোধহয় বাঁচানো যেত।
লোকটা বলল, মশিয়ে, যদি প্রয়োজন বোধ করেন, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’
ধন্যবাদ। আমি নিজেই পারব, কুয়াশা জবাব দিল।
কিন্তু সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। বাঘের মত পুলিসে ছুঁলেও আঠারো ঘা। হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে। লোকটা সহানুভূতির ভাব আনবার চেষ্টা করল কণ্ঠে। কিন্তু আবেগহীন কণ্ঠে সহানুভূতি মেশাতে গেলে যে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয় তার কণ্ঠ তেমনি শোনাল।.
‘সেটা তো পুলিসের কর্তব্য। ইঞ্জিনটা চালু করতে করতে বলল কুয়াশা। শেষটায় যোগ দিল, ‘সাহায্য করতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
জেটিতে নামতেই হারবার পেট্রোলের সাথে দেখা হয়ে গেল কুয়াশার। ক্যানোতে লাশটা একজন পেট্রোলের পাহারায় রেখে কুয়াশা পুলিস স্টেশনে গিয়ে
১০৭
পৌঁছুল।
পুলিস স্টেশনটা জনশূন্য। করিডরে একজন পুলিস পঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। কুয়াশা তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই সে নিয়ে গেল কর্তব্যরত পুলিশ প্রধান ইন্সপেক্টর দুর্বেয়ার কাছে।
ইন্সপেক্টর দুবোয়া চেয়ারে বসেই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। তাকে ডেকে তোলা হল। চোখ রগড়াতে রগড়াতে তিনি বারবার দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘ব্যাপার কি, মশিয়ে?’
ঘটনাটা খুলে বলল কুয়াশা। লিখিত একটা বিবৃতিতে সই করল। বিবৃতিটা পড়তে পড়তে ইন্সপেক্টর বললেন, আপনার নাম?’
জন আর্থার ল্যাম্প। ‘আমেরিকান না ব্রিটন।’
ব্রিটন।’ ‘কোথায় থাকা হয়? ‘হোটেল ডি লা মেয়ার। রুম নম্বর ১০৭। ছয়তলা।
টেলিফোন বেজে উঠল এই সময়। রিসিভার তুলে ইন্সপেক্টর বললেন, ‘হ্যালো। ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া বলছি…হা..হা..হা..হা আপনি কে বলছেন.•া হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব…।’ শেষের দিকে গম্ভীর হয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর। একটু বিচলিত মনে হল তাঁকে।
কুয়াশা সিগারেট টানতে টানতে ইন্সপেক্টরের চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। রিসিভার নামিয়ে কুয়াশার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। নীরবে কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর উঠে দরজার কাছে গেলেন। দরজা খুলে কি যেন দেখলেন বাইরের দিকে। গার্ডটা দূরে ছিল। খট খট পদশব্দে সে এগিয়ে এল। একটু পরে ফিসফিস শব্দ হল। কুয়াশার মনে হল, ইন্সপেক্টর আর গার্ড কি যেন ফিসফিস করে বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল কুয়াশার কাছে। কিন্তু চঞ্চলতা। প্রকাশ করল না সে।
ইন্সপেক্টর ফিরে এসে বসতেই ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। মাফ করবেন, ইন্সপেক্টর, আমি যেতে চাই।’
ইন্সপেক্টর বিচলিত হয়ে বললেন, “আর কিছুক্ষণ যদি দয়া করে অপেক্ষা করেন-এনকোয়ারীর..’।
‘মাফ করবেন, ইন্সপেক্টর। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনে। কিছুক্ষণ দেরি হলে কি হবে কুয়াশা জানে। কিন্তু সে তো আর আত্মসমর্পণ করার জন্য পুলিস স্টেশনে আসেনি।
এবার গম্ভীর হলেন ইন্সপেক্টর। বললেন, আমি দুঃখিত, মশিয়ে ল্যাম্ব।
১০৮
মশিয়ে ল্যাম্প-কিন্তু ইন্সপেক্টর, আমাকে যেতেই হবে। আপনার সাধ্যও নেই আমাকে এখানে আটকে রাখবার। ক্রু নাচাল কুয়াশা।
আপনাকে গ্রেফতার করা হল। রাগে গরগর করতে করতে বললেন। ইন্সপেক্টর।
‘আমার অপরাধ? ঠাট্টার সুরে বলল কুয়াশা। ‘পুলিসের ধারণা এই মহিলার হত্যার সাথে আপনি জড়িত আছেন।
‘পুলিসের ধারণা মানে তো আপনার ধারণা!’ কৌতুকে চোখ নাচাতে নাচাতে বলল কুয়াশা।
যদি তা বলেন তো তাই। সুতরাং আপনাকে…’ বাক্যটা শেষ করার সুযোগ পেল না ইন্সপেক্টর। কানের পাশে প্রচণ্ড একটা ঘুসি এসে পড়তেই চেয়ারসুদ্ধ সশব্দে পড়ে গেলেন তিনি। মুখ দিয়ে কেক’ করে একটা শব্দ বেরোল।
দু’পা এগিয়ে ইন্সপেক্টরের কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখল কুয়াশা। চেতনা ফিরতে ‘একটু সময় নেবে।
সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। গার্ড ঢুকে পড়েছে রুমের মধ্যে। বোধহয় চেয়ার ধড়ার শব্দ শুনে। হাতে রাইফেল। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়।
রাইফেল উপেক্ষা করল কুয়াশা। বলল, ইন্সপেক্টর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চেয়ার সুদ্ধ পড়ে গেলেন।
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গার্ড তাকাল তার দিকে।
‘হাঁ করে দেখছেন কি। একটা ডাক্তার ডাকুন। কিন্তু তার আগে ঐ হোঁতকা লোকটাকে তো তুলতে হবে। আসুন দুজন ওকে তুলে নিয়ে যাই। বেঞ্চ টেঞ্চ নিশ্চয়ই দু’একটা আছে কাছে-পিঠে।’ অসহিষ্ণু হওয়ার ভান করল কুয়াশা।
একটু ইতস্তত করল গার্ড। রাইফেলটা দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখে এগিয়ে গেল ভূপাতিত ইন্সপেক্টরের দিকে কুয়াশাকে পাশ কাটিয়ে। আর সেই মুহূর্তে তার ঘাড়ের পিছনে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
একটু পরে সমস্ত কক্ষটাই অন্ধকার হয়ে গেল। সুইচ বোর্ডটার সব ক’টা বোম একে একে টিপে দিল কুয়াশা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেটিতে পৌঁছে গেল সে। দিনার্দ হারবার ঘুমে অচেতন। জেটিতে আর ইংলিশ চ্যানেলের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জাহাজ। নানা আকারের, নানা আয়তনের।
কুয়াশার ইয়ট ‘দি ফগ’ জেটি থেকে প্রায় দু’শ গজ দূরে। ভাড়াটে ক্যানোর খোঁজ করল কুয়াশা। পাওয়া গেল না। শহরের দিকে চলল সে হাঁটতে হাঁটতে। হোটেল ডি লা মেয়ারে জন আর্থার ল্যাম্পের নামে তার একটা স্যুইট আছে। কিন্তু সেখানে এখন যাওয়া যাবে না।
১০৯
হোটেল ডি এলিসার লাউঞ্জে ব্রেকফাস্টের পর বসেছিল এডিথ গ্রে আর তার বন্ধু কামাল আহমেদ।
| ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিল কামাল। এডিথ গ্রে তার পেন ফ্রেণ্ড। দুজনেরই পরস্পরকে দেখবার আগ্রহ ছিল। কিন্তু এতদিন সুযোগ আসেনি। লণ্ডনে কামাল এডিথের খোঁজ করেছিল। সেখানে জানা গেল এডিথ গেছে প্যারিসে। প্যারিসের ঠিকানায় খোঁজ করে কামাল গতকালই এসে পৌঁছেছে। হোটেল রিজে উঠেছে কামাল।
এডিথ সুন্দরী। একুশ-বাইশ বছর বয়স হবে। অথবা কিছু কম। একহারা গড়ন। মজবুত বাঁধুনি। লম্বা মিষ্টি মুখ। চাপা কপাল। চুল আধুনিক ঢঙে ছেলেদের মত করে ছাঁটা। চোখের তারা দুটো ঘন নীল। তাতে বুদ্ধির দীপ্তি। | লাউঞ্জটা শুন্যপ্ৰায়। এক কোণে বসে নিচু গলায় কথা বলছিল কামাল আর এডিথ। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল এডিথ। আর লাউঞ্জের দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।
কথা বলছিল প্রধানত কামাল। আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এডিথ।
কামাল বলছিল, “তোমার আর এথেলের মনের বাসনা পূরণ করতে পারে দুনিয়ায় মাত্র একটি লোক। আর কেউ নয়। পুলিস তো নয়ই।
‘তুমি নিশ্চয়ই তোমাদের দেশের সেই কুয়াশার কথা বলতে চাইছ। কিন্তু তাকে আমি পাচ্ছি কোথায়?’
‘সেটাই তো সমস্যা, কামাল চিত্তাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল। তবে যত দূর মনে হয় সে ইংল্যাণ্ডে অথবা কন্টিনেন্টেই আছে। লণ্ডনে ঐ রকম শুনেছিলাম, সে নাকি কিছুদিন আগে জডরেল ব্যাংক অবজারভেটরীতে গিয়েছিল। অথচ তার তখন থাকবার কথা বার্মায়। যাকগে, ওসব ভেবে আর লাভ নেই। এখন আমি তুমি আর এথেল তিনজন মিলে কি করে জো স্টিফেন শয়তানটাকে আর তার অনুচরদের স্ম্যাশ করতে পারি তাই ভেবে দেখতে হবে।’
‘তোমার সেই বন্ধু শহীদ খান আমাদের সাহায্য করতে পারে না?
অবশ্যই পারে। দরকার হলে তাকে খবর দেব।’
কাউন্টার ক্লার্ক কাছে এসে বলল, ‘মাফ করবেন, মিস গ্রে। আপনার টেলিফোন
এডিথ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে যখন ফিরে এল তখন তার মুখে দুর্ভাবনার ছাপ। ‘
কামাল এডিথের মুখেরদিকে চেয়ে বলল, “কি হল, এডিথ। কোনও দুঃসংবাদ? ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। ফগ নামে এক ভদ্রলোক আমার সাথে দেখা করতে
১১০
চান। লাউঞ্জে নয়, আমার রুমে। তিনি নাকি এথেল সম্পর্কে কি একটা সংবাদ দেবেন।’
কি হয়েছে এথেলের?’
‘তা তো বললেন না। বুঝতে পারছি না। কিছু বোধহয় ঘটেছে। সাড়ে আটটায় তো এথেলের এখানে পৌঁছুবার কথা ছিল। এখনও এল না। চিন্তা-জড়িত গলায় বলল এডিথ। তার গলাটা কেঁপে গেল।
ভদ্রলোক কখন আসবেন?’ ‘এখুনি এসে পৌঁছুবেন। চল আমার রুমে।’
‘ভদ্রলোক আমার উপস্থিতি পছন্দ না-ও করতে পারেন, কুণ্ঠিত হয়ে বলল কামাল।
‘সে তখন দেখা যাবে। দুজন ধীরে ধীরে লিফটের দিকে এগোল।
কুয়াশা আরও মিনিট পনের পরে পৌঁছুল। দরজায় আঘাত করতেই ভিতর থেকে এড়িথ বলল, “ভিতরে আসুন।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। কামাল সেদিনের সংবাদপত্র পড়ছিল। সে। মুখ তুলে তাকাল। আর দুজনেই ভীষণ তবে চমকাল।
বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দুজনই অনেকক্ষণ চেয়ে রইল পরস্পরের দিকে। এডিথ কিছু বুঝতে না পেরে একবার আগন্তুক আর একবার কামালের দিকে তাকাতে লাগল।
প্রথমে কথা বলল কুয়াশাই। ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠল হাসি। আমার দৃষ্টিশক্তি যদি আমার সাথে প্রতারণা না করে, তাহলে আমি বলব যে, তোমার নাম কামাল আহমেদ। কামালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল কুয়াশা।
কামালও হাত বাড়িয়ে দিল কুয়াশার দিকে। কিন্তু তার বাকস্কৃর্তি হল না।
কুয়াশা তার হাতটা সজোরে নাড়া দিয়ে বলল, কিহে একেবারে চুপসে গেলে যে?’ তারপর এডিথের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জন আর্থার ফগ।
করমর্দন করে এডিথ বলল, ‘হাউ ডু ইউ ডু।’ ‘হাউ ডু ইউ ডু। সোফা দেখিয়ে দিয়ে এডিথ বলল, বসুন, মি, ফগ।’
কামালের বিস্ময় পুরোপুরি কেটে গেছে। সে এডিথকে বলল, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, বিশ্বাস কর তো এডিথ?
‘কেন বলত?’।
‘আমরা এতক্ষণ যে লোক সম্পর্কে আলাপ করেছিলাম,’ চমকে উঠল এডিথ, ইনিই সেই…’
মানে!’ অবাক হয়ে বলল এডিথ।
হ্যাঁ, ইনিই সেই কুয়াশা। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে এডিথ দেখতে লাগল কুয়াশাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কুয়াশার
১১১
শালপ্রাংসু দেহ, ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে মুগ্ধ হল এডিথ। মনে হল যেন একটা দিগ্বিজয়ী ব্যক্তিত্ব আর প্রবল পৌরুষ তার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে অনুভব করল তার সামনে যেন মাথা আপনা থেকেই নুয়ে আসে। নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়। আরও মনে হল, আজ পর্যন্ত যত লোককে সে দেখেছে, তাদের চাইতে ইনি সবদিক থেকে আলাদা। এর উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা চলে, ভরসা করা চলে। চোখ বুজে তাকে অনুসরণ করা চলে। পলকহীন দৃষ্টিতে এডিথ মন্ত্রমুগ্ধের মত কুয়াশার দিকে চেয়ে রইল। | আর সে দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করল কুয়াশা।
আরও আধঘন্টা পার হয়ে গেছে। এডিথ গ্রের দু’গাল বেয়ে তখন অশ্রু ঝরছে। কুয়াশা আর কামাল নীরবে বসে আছে। রুমালে চোখ মুছল এডিথ। কান্না ভেজা গলায় বলল, ‘এমনি কিছু একটা হবে আমি জানতাম। ঐ শয়তানটার পিছনে যারা লেগেছে আজ পর্যন্ত তাদের কেউই রেহাই পায়নি। হয়ত…আমিও…’ কথাটা শেষ
করেই নীরব হয়ে গেল।
একটু পরে বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, কুয়াশা, খবরটা পৌঁছে দেবার জন্য। লাশ এখন নিশ্চয়ই পুলিস স্টেশনে?’
মাথা নাড়ল কুয়াশা। পুলিস স্টেশন থেকে হয়ত মর্গে পাঠিয়েছে। ‘পুলিস নিশ্চয়ই আপনার খোঁজ করবে এখন।
‘সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিসকে টেলিফোন করল কে-তাই আমি ভাবছি। যারা গুলি করেছে তারাই অর্থাৎ জো স্টিফেন, না যারা তোমার ক্যানোতে মৃত এথেলকে দেখেছিল? কামাল চিন্তা জড়িত গলায় বলল।
: আমি জো স্টিফেনকে চিনি না, কিন্তু এমনও তো হতে পারে সে-ই ডিঙি নিয়ে এথেলের খোঁজ করতে বেরিয়েছিল। আমার নিজের তো তাই ধারণা। সুতরাং সে যাতে কোনরকম সন্দেহে জড়িয়ে না পড়ে তার জন্য পুলিসের কাছে টেলিফোন করে আমার বিরুদ্ধে বলা অস্বাভাবিক নয়। অথবা এমনও হতে পারে, ঐ লোকটা হয়ত আমাকে আগে থেকেই চেনে। সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। কিন্তু কে এই জো স্টিফেন, আর তার সাথে এথেলের কনফ্রন্টেশনের কারণটাই বা কি? অবশ্য ব্যাপারটা যদি গোপনীয় হয় তাহলে বলবার দরকার নেই, কুয়াশা বলল। |, ব্যাপারটা গোপনীয় অবশ্যই, কিন্তু আপনাকে সব কথাই খুলে বলব। তবে কথা দিন আপনি আমাদের সাহায্য করবেন। আকুল আবেদন জানাল এডিথ।
‘আমার সাধ্যে কুলালে অবশ্যই করব, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কুয়াশা।
কুয়াশার কণ্ঠের দৃঢ়তায় আশ্বস্ত হল এডিথ। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, তাহলে আমি গোড়া থেকেই বলি। আমার বাবা সিডনী
১১২
গ্রে আর এথেলের বাবা হেনরী ওয়াকার ছিলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সুদক্ষ অফিসার। আপনি হয়ত জানেন প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এক বা একাধিক অত্যন্ত ভয়ঙ্কর জলদস্যদল গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজের সম্পদ চুরি করে বেড়াচ্ছে। এই ব্যাকেটগুলোকে ধরবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার আর এথেলের বাবার উপর।
| ‘যে দস্যুদলটার পিছনে আমার আর এথলের বাবা লেগেছিলেন, সে দলটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এরা মহাসমুদ্রের তলদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার ধনরত্ন অপহরণ করছে। অথচ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের পুলিস এত বছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের সন্ধান পায়নি। বরং যাদের উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তারা সবাই খুন হয়েছে। একজনও রেহাই পায়নি।
বছর তিনেক আগে আমার আর এথেন্সের বাবার উপর ঐ ব্ল্যাকেটটাকে অনুসন্ধানের এসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পরিভাষায় ঐ অ্যাসাইনমেন্টের নাম ছিল “অ্যাসাইনমেন্ট উইথ ডেথ।” ওদের পিছনে লেগে কেউ আজ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।
‘আমার আর এথেলের বাবাও রক্ষা পাননি। ওঁদের দুজনকে নৃশংসভাবে খুন করে কফিনে করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। আমি আর এথেল তখন অক্সফোর্ডে রিসার্চ করছিলাম। আমরা দুজন ছেলেবেলা থেকেই বন্ধু। দুজনই বরাবর এক সঙ্গে থাকতাম। শৈশবে দুজনই মা হারিয়ে হোস্টেলে থেকে মানুষ হয়েছি।
দুঃসংবাদ পাওয়ার পর আমরা দুজনই প্রতিজ্ঞা করলাম, পিতৃহত্যার প্রতি শোধ যেমন করে তোক নিতেই হবে। তাতে নিজের জীবন যদি দিতে হয় দেব।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল এডিথ। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল এডিথের। মাথা নিচু করে উগত অশ্রু দমন করে বলল, ‘মেসোপটেমিয়া জাহাজের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।’
মাথা নাড়ল কুয়াশা।
এডিথ বলল, ‘১৯০১ সালে মালবাহী জাহাজ মেসোপটেমিয়া ডুবে গিয়েছিল লোহিত সাগরে। তাতে ছিল কয়েক কোটি পাউরে সোনা। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফ্রান্সে আসছিল জাহাজটা। বুঝতেই পারছেন, তোলবার চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। ১৯৫৮ সালে একটা ফরাসী স্যালভেজ কোম্পানি মেশোপটেমিয়ার সিন্দুকে রাখা সম্পদ উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের অনুমতিও পাওয়া যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে স্যালভেজ কোম্পানিটি, একটি জাহাজ পাঠায়। কোম্পানির চেয়ারম্যান নিজে উদ্ধার কাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। স্যালভেজ জাহাজ পাঠাবার আগে কোম্পানিটির কাছে তাদের পরিকল্পনা থেকে বিরত হবার জন্য হুঁশিয়ারী জানিয়ে কয়েকটি উড়ো চিঠি
এসেছিল। বলাবাহুল্য, তাতে ভূক্ষেপ করেনি স্যালভেজ কোম্পানি। কিন্তু করলেই ভাল হত। কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ প্রায় বিশজন মারা যায় স্যালভেজ জাহাজে এক বিস্ফোরণে। বিস্ফোরণের কারণ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
‘পরের বছরই আর একটা ঘটনা ঘটে। আমেরিকান স্যালভেজ জাহাজ রোজেন সিক্স বসফরাসের কাছে গ্র্যাণ্ড ডাচেজ নামে একটি ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধানে যাত্রা করেছিল। গ্র্যাণ্ড ডাচেজ ছিল রাশিয়ার জাহাজ। ডুবেছিল ১৯০৮ সালে। তাতে ছিল তখনকার রাশিয়ার জারের মুকুট ও জার পরিবারের কয়েক লক্ষ পাউণ্ড দামের অলঙ্কার। কিন্তু রোজেন সিক্স গ্র্যাণ্ড ডাচেজের স্ট্রংরুমে এক ক্যারেট সোনাও পায়নি। মাছ তো আর অলঙ্কার পরে না।
ক্যারিবিয়ান সীতে ইস্ট অব মার্সের কাছে ডুবে যাওয়া ফেয়ারব্যাংকে জাহাজটির ধনরত্ব তুলে আনতে গিয়েছিল রোজেন সেভেন। ফেয়ারব্যাংকের স্ট্রংরুমও ছিল শূন্য। অথচ তাতে থাকবার কথা ১ কোটি পাউণ্ড দামের সোনা আর ৭৫ লক্ষ পাউও দামের আকাটা হীরে। সমস্ত জাহাজ খুঁজেও কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়। এরকম আরও অসংখ্য জাহাজের ধন সম্পদ সমুদ্র তল থেকে উধাও হয়েছে। এর কোনটাই নিশ্চয়ই সাগরের প্রাণীদের কীর্তি নয়। এডিথ থামল।
| অবাক হয়ে শুনছিল কুয়াশা। সমুদ্র তলে যে এই ধরনের লুণ্ঠন চলছে, সে সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণা তার ছিল, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কতকগুলো হীন দস্যু বিপুল সম্পদ করায়ত্ত করে আসছে এতটা সে কখনও ভাবেনি। এই বিপুল অর্থ কুয়াশার হাতে এলে সে মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাতে পারে।
তাছাড়া তার নিজের এখনও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড, কোটজে চাঁদের চারদিকে ঘুরছেন তাঁর স্পেস ক্যাপসুলে সামান্য গলদ দেখা দেওয়ায়। তাকে সাহায্য করতে হবে। তারজন্য চাই আর একটা স্পেস ক্রাফট। কয়েক কোটি পাউণ্ড লাগবে একটা স্পেস ক্রাফট তৈরি করতে। চীরণ মন্দিরে যে ধনরত্ন সে পেয়েছে মহাশূন্যযান তৈরির জন্য তা নিতান্তই অপ্রতুল। অথচ তিন মাসের মধ্যে ড. কোটজেকে সাহায্য করতে হবে। অন্যথায় তিনি সেখানেই মারা যাবেন। মানবতা আর বিজ্ঞানের অপরিসীম ক্ষতি হবে তাতে।
কুয়াশা সেই কথাটা ভাবছিল। মুখ তুলে দেখল, এডিথ আবেদন ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। কুয়াশা বলল, এই র্যাকেটটাকে শায়েস্তা করাই তাহলে আপনাদের লক্ষ্য?’
মাথা নাড়ল এডিথ। ‘কিন্তু ওরা যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে সেগুলোর কি হবে? . ‘ওদিকটা আমি বা এথেল কখনও ভাবিনি। আমাদের লক্ষ্য বরাবরই একটা।
মনে হয় অনেকটা এগিয়েছিলেন আপনারা?’ সিগারেট ধরাতে ধরাতে কুয়াশা প্রশ্ন করল।
১১৪
‘সামান্যই। দেড় বছর ধরে অত্যন্ত সাবধানে এগিয়েছি আমরা। র্যাকেটটার পরিচয় সগ্রহ করতেই তো প্রায় এক বছর লেগেছে। এখানে এসেছি মাস চারেক আগে। আমাদের প্ল্যান ছিল আমি দলপতির সাথে খাতির জমাব। এথেল থাকবে দূরে। একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। রঙ্গমঞ্চে সে আবির্ভূত হবে না। এমন কি আমরা দুজনে দেখাশোনাও করতাম গোপনে। কথা ছিল, যদি আমি ফেঁসে যাই তাহৰে
সে শেষ চেষ্টা করবে। কিন্তু ফেঁসে গেল এথেলই।’
দলপতির নামই সবত জো স্টিফেন?’ কুয়াশা প্রশ্ন করল।
হা, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি জোর সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছি। হোটেল দ্য দিনার্দে লোকটা মাঝে মাঝে কাকারেট খেলতে যায়। ওর সাথে সেখানেই আলাপ জমিয়েছি। ব্যাকারেট খেলাও শিখতে হয়েছে আমাকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আনুসঙ্গিক অনেক নোংরামীও সইতে হয় মাঝে মাঝে। হেরেছিও অনেক। আলাপটা জমে উঠেছে ইদানীং। অবশ্য আমার পক্ষ থেকে প্রবল আগ্রহের ফলেই। আশা করেছিলাম জো আমাকে তার জাহাজে দাওয়াত করবে। কিন্তু ভয়ানক হুঁশিয়ার লোক সে। আমি প্রকারান্তরে প্রস্তাব করেও দেখেছি। চমৎকার ভদ্রভাবে এড়িয়ে যায়। এপেল অধৈর্য হয়ে উঠেছিল দেরি দেখে। সবত ঝোঁকের মাথায় এথেল কাল নিজেই হানা দিয়েছিল রোজমেরীতে।
‘রোজমেরীতে?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল কুয়াশা। ‘হা। জোর ইয়টের নাম রোজমেরী। বিরাট ইয়ট। দেখতে চমৎকার।
‘কিন্তু মিস এডিথ, রোজমেরীতে হানা দিয়ে কিভাবে জোকে স্ম্যাশ করতে পারা যাবে তা তো আমি বুঝতে পারলাম না?’ প্রশ্ন করল কুয়াশা।
এডিথ বলল, দেখুন আমরা দুজনই নারী। আমাদের পক্ষে বেশি দূর এগোনো ম্ভব নয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, জো ও তার দলবলের বিরুদ্ধে এমন অকাট্য প্রমাণ পুলিসকে জানানো যে তারা যেন অতিসহজেই তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে যেতে পারে। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে নিজেরাই ওদেরকে শাস্তি দেব।
পুলিস তো অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছে।’
‘আমি কিন্তু পুলিসের সঙ্গ বর্জন করে চলি,’ মৃদু হেসে বলল কুয়াশা। ‘তাতে আমার আপত্তি নেই। ওদের শায়েস্তা করাই আমার উদ্দেশ্য। ‘আর একটা কথা।’
বলুন।
‘জোর কবল থেকে যে ধনরত্ন উদ্ধার করব তাতে আপনার কোনও দাবি থাকবে না।’। ‘
‘বিলক্ষণ। আমি তো জানি ঐ ধনসম্পদ আপনার ব্যক্তিগত ভোগে লাগবে। তা মানুষের কল্যাণেই ব্যয় করা হবে।
আরও আধ ঘন্টা পরে কুয়াশা বিদায় নিল এডিথ ও কামালের কাছ থেকে।
ফুয়াশ- ১৮
১১৫
তিন
ইয়টেই লাঞ্চ সারল কুয়াশা। বাইরে কর্মব্যস্ত দুপুর। আকাশে মেঘ জমেছিল সকালের দিকে। এখন বেশ পরিষ্কার। অদূরে নিচে লোকজনের ভিড়। একটা তপ্ত হাওয়া আসছে ডাঙার দিক থেকে। লাঞ্চের পর বাটলার চার্জি হ্যারিস হুইস্কির বোতল আর গ্লাস এনে দিল।
ইশারায় বোতল আর গ্লাস সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে ডেকের উপর এসে দাঁড়াল কুয়াশা। পাশে যে ইয়টটা ছিল তার নোঙর তুলে ফেলা হচ্ছে। ইয়টের মালিক মোটাসোটা বুড়ো লোক। তিনি চিৎকার করে ক্রুদের নির্দেশ দিচ্ছেন ফরাসী ভাষায়। কুয়াশাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘চললাম। আবার দেখা হবে।’ কুয়াশা হাত নেড়ে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ইয়টটা।
কুয়াশার দৃষ্টিটা ঘুরতে ঘুরতে রোজমেরীর উপর নিক্ষিপ্ত হল। শ’দুয়েক গজ দূরে নোঙর করা আছে রোজমেরী। ডেকের উপর দু’তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিচে ঢেউয়ের দোলায় দুলছে একটা ডিঙি আর একটা মাঝারী আকারের টেণ্ডার।
ইয়ট থেকে দু’জন লোক টেণ্ডারে নামল। একজনকে তার চেনা চেনা মনে হল। গতরাতের সেই অনুসন্ধিৎসু লোকটা। টেণ্ডারটা যাচ্ছে জেটির দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল কুয়াশা। সেলুনে ঢুকে মিনিট খানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে নিল। নিচে নেমে এসে স্পীড বোটে চাপল। চিৎকার করে চার্লিকে ডেকে বলল, “ডিনার বাইরেই সেরে নেব, চার্লি।
টেণ্ডারটা জেটিতে পৌঁছে গেছে। মিনিট দুয়েক পরে কুয়াশাও গিয়ে পৌঁছুল জেটিতে। এতক্ষণ ধরে সে টেণ্ডারটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে ওদের অনুসরণ করল কুয়াশা। দু’জন ফিরেও তাকাল না পিছন দিকে।
| ওরা দু’জন বীচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে একটা ক্যাসিনোতে গিয়ে ঢুকল। কুয়াশাও ঢুকল একটু পরে। ভিতরে অর্ধ উলঙ্গ নারী-পুরুষের ভিড়। আর আছে রোদে পোড়া চেহারার সেইলার্স। বিচিত্র ভাষায় কিচির-মিচির হচ্ছে। হৈ চৈ চলেছে। সেইলার্সদের বগলদাবা হয়ে বসে আছে কয়েকজন অর্ধ-উলঙ্গ তরুণী। কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসছে। সামনের দিকে কোনও টেবিল খালি নেই; ওদরে দুজনকে কুয়াশা আবিষ্কার করল পিছন দিকে এক কোণে।
শূন্য টেবিলের সন্ধান করছে এমন একটা ভাব করে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে এদের টেবিলের কাছে গিয়ে পৌঁছুল। খুব কাছে যেতেই চোখাচোখি হয়ে গেল কাল রাতের সেই লোকটার সাথে।
১১৬
লাশ। এবার পুলি গিয়ে পড়ল পাশের বেশি হবে
কুয়াশা লক্ষ্য করল লোকটার চেহারায় কেমন একটা ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি আছে। নিরাসক্ত দৃষ্টি মেলে কুয়াশার মুখের দিকে তাকাল লোকটা। তাতে পরিচয়ের কোনও আভাস খুঁজে পেল না সে। কিন্তু হাসি মুখে পরিচয়ের চিহ্ন ফুটিয়ে তুলল। লোকটার এত কাছে গিয়ে পড়েছিল যে, তাকে এড়িয়ে যাওয়া বোধহয় সম্ভব হল না। অথবা, কুয়াশা ভাবল, তাকে এড়িয়ে যাবার ইচ্ছে লোকটার আদৌ ছিল না। নিরুত্তাপ হাসি ফুটিয়ে তুলল লোকটা চোখে-মুখে।
কুয়াশাই কথা বলল, ‘হাউ ডু ইউ ডু।
হাউ ডু ইউ ডু। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে লোকটা সম্ভাষণের জবাব দিল। তারপর? আপনার ঝামেলা চুকল?’
সে আর এমন কি ঝামেলা? পুলিসের হাতে তুলে দিয়ে এলাম মেয়েটার লাশ। এবার পুলিস বুঝুকগে।’ অবজ্ঞার একটা ভাব করল কুয়াশা।
কুয়াশার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পাশের ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। বয়স অবশ্য পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। দাড়ির জন্য চেহারাটা বানার্ড শ’এর মত দেখায়। চোখ দুটো স্বপ্নালু। সমস্ত মুখটা জুড়ে শিশুসুলভ সারল্য। চেনা-চেনা লাগছিল চেহারা, অথচ ঠিক চিনতে পারছিল না।
কুয়াশার দৃষ্টি অনুসরণ করে লোকটা বলল, “ইনি প্রফেসর রোজেনবার্গ, আমি জো স্টিফেন। আবাস–রোজমেরী ইয়ট। বসুন না আমাদের সঙ্গে মি…. |
‘ফগ। অবলীলাক্রমে জবাব দিল কুয়াশা। আর্নেস্ট হারল্ড ফগ। আমার বাসস্থানও একটা ইয়ট। নাম-দি ফগ। আমিও আপনার মত জলচর।’
‘হুইস্কি না বিয়ার?’ হুইস্কি।
ওয়েটারকে অর্ডার দিল জো। সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল কুয়াশার দিকে।
সিগারেট ধরাতে ধরাতে সে ভাবছিল প্রফেসর রোজেনবার্গের কথা। এখন তার মনে পড়েছে ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওশানোলজিস্ট। গতবছর জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল ডীপ-সী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। সেখানেই সে দেখেছে প্রফেসরকে। সমুদ্রের মতই অসীম পাণ্ডিত্য ভদ্রলোকের। গতবছরই তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের পাঁচ হাজার ফুট নিচে নেমে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। সাগর তলে অত নিচে মানুষের অবতরণ সেই প্রথম। সর্বশেষ ডীপ
সী কমও তাঁরই আবিষ্কার। কিন্তু জো স্টিফেনের সাথে তার সম্পর্ক কি?
কুয়াশা সেটাই ভাবতে ভাবতে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘অজ্ঞতা ক্ষমা করবেন, প্রফেসর। আপনিই তো পাঁচ হাজার ফুট পানির নিচে নেমেছিলেন? নিশ্চয়ই আপনার অভিযান অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং ছিল?
| ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা ভুল করে বড় অসুবিধায় পড়েছিলাম।
১১৭
জানেন তো সাগরের অত নিচে তাপ মাত্রা অত্যন্ত কম। পাঁচ হাজার ফুট পানির নচে তাপমাত্রা হিমাংকের সামান্য উপরে থাকে। শীতে জান বেরিয়ে যাবার জাগাড়। অথচ আমি পানির চাপ, আলো আর বাতাসের ব্যবস্থা করতে এত ব্যস্ত হলাম যে ঠাণ্ডার কথাটা আমার খেয়ালই হয়নি। শীতে তো আমার জমে যাবার অবস্থা। তবে এবারে আমি আমার বাধিস্টলটাকে আরও উন্নত করেছি। তাতে বদ্যুতিক উত্তাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে। ঠাণ্ডায় আর কষ্ট পেতে হবে না।’ .
তাহলে আপনি আবার সমুদ্রের তলে নামছেন? আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গি করল কুয়াশা।
নিশ্চয়ই। এই তো সবেমাত্র শুরু। প্রথম অভিযান তো বলতে গেলে স্রেফ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল। আমার নতুন বাধিলে করে পাঁচ হাজার ফুট কেন তার দ্বিগুণ এমন কি তিন চার গুণ পর্যন্ত নামা চলবে! আর এতে যে ধাতুগুলো ব্যবহার করেছি তা যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে সমুদ্র তলে পাঁচ মাইল পর্যন্ত নামা যাবে। উচ্ছল হয়ে উঠল প্রফেসরের স্বপ্নালু দুটি চোখ।
কিন্তু প্রফেসর, সমুদ্রের অত নিচে নেমে কি দেখবেন বলে আশা করেন?
. উৎসুক শ্রোতা পেয়ে খুশি হলেন প্রফেসর। সোৎসাহে বললেন, সমুদ্র তলের জীবনটাকে জানাই আমার প্রধান লক্ষ্য। মানুষ জানতে চায় আর জয় করতে চায়। চাঁদকে আমরা প্রায় জয় করে ফেলেছি। অথচ আমাদের নিজেদের গ্রহটা সম্পর্কে কতটা জেনেছি? কিন্তু মানবতার কল্যাণের জন্য আমাদের তো এই গ্ৰহটাকে জানতে হবে। হয়ত এমন হতে পারে যে সমুদ্রতলের সম্পদকে মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োগ করতে পারব আমরা একদিন।
তাহলে তো আপনার অভিযান অত্যন্ত স্তাবনাময়।’
‘কিন্তু বড় ব্যয় সাপেক্ষ। আক্ষেপ করলেন প্রফেসর। আসলে মি. স্টিফেন আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না এলে সমস্ত সম্বাবনা অর্থহীন হয়ে পড়ত। প্রথমবার সমুদ্রে নামবার খরচ বইতে গিয়ে আমি সর্বান্ত হয়েছি। এখন উনিই আমার একমাত্র ভরসা। ওঁর উপর নির্ভর করেই আমি দ্বিতীয় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ জো’র প্রতি কৃতজ্ঞতায় অধ্যাপকের গলাটা বুজে এল।
কুয়াশা হাসল না। সমুদ্রতলের গবেষণা চালাবার বিপুল সম্ভাবনার অন্তরালে জো’র যে দুরভিসন্ধি লুকিয়ে আছে প্রফেসর রোজেনবার্গ তা কোনদিন কল্পনাও করতে পারবেন না।
কুয়াশা জানে, স্টিফেন নামক শয়তানটা তাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। তার প্রত্যেকটি প্রতিক্রিয়া সে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। অথচ বাইরে নির্বিকার নিরাসক্ত ভাব বজায় রাখছে নিপুণ ভাবে।
ক্যামেরা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক হঠাৎ উপস্থিত হল। টেবিলের উপর একটা কার্ড রেখে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মাথাটা চাই প্রফেসর। ১১৮
ক্যামেরা কি ছুরি, মশিয়ে? তা দিয়ে কি মাথা কাটা যায়?’ হেসে উঠলেন প্রফেসর।
কুয়াশা দেখল, কার্ডটাতে লেখা আছে জিম প্যাটারসন। ফটোগ্রাফার, আমেরিকান প্রেস ট্রাস্ট।
| ফটোগ্রাফার হেসে উঠল। ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটা ছবি তুলে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল ফটোগ্রাফার।
জো এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। সে হঠাৎ বলল, ‘মি. ফগ, এইসব সমুদ্র সম্পর্কিত ব্যাপারে আপনার উৎসাহ আছে বলে মনে হচ্ছে?’
‘নেই একথাও জোর দিয়ে বলব না, আবার আগ্রহটা তেমন প্রবল একথাও ঠিক নয়,’ মৃদু হেসে বলল কুয়াশা।
যদি উৎসাহ থাকে তাহলে আসুন না আমাদের সাথে। শিগগিরই আমরা একটা ট্রায়াল দেব রডরিক দ্বীপের কাছে। ওখানে অবশ্য পানি বেশি নেই। মাত্র ৯০ ফ্যাদম। তবুও প্রাথমিক ট্রায়াল দেয়া যাবে। তাই না, মি: প্রফেসর?’ একঘেয়ে ধাতব গলায় বলল জো।
নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। সোৎসাহে প্রফেসর বললেন। আরে আসুন না আপনিও। দেখবেন ভারি ইন্টারেস্টিং।
কুয়াশা খুশির ভান করে বলল, ‘এরকম দাওয়াত হরহামেশা আসে না। তবে আপনাদের কোনও অসুবিধা…।’ কথাটা সে শেষ করল না।
‘মোটেই না, মোটেই না, প্রফেসর উত্তেজিত হয়ে বললেন। ওয়েটারকে বিল চুকিয়ে দিল জো।
ঘড়ি দেখে বলল, “আমরা এবারে উঠব, মি. ফগ। সামান্য কাজ আছে। যথাসময়ে আপনাকে খবর দেব।’ উঠে হাত বাড়িয়ে দিল জো। সাপের শরীরের মত ঠাণ্ডা আর তুলতুলে জো’র হাতটা। ঘামে ভেজা। ঘিন ঘিন করে উঠল কুয়াশার
সর্বাঙ্গ।
প্রফেসরের সাথেও করমর্দন করল কুয়াশা। সে হাতে আছে হৃদয়ের উত্তাপ। যাবার সময় আবার তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘আসছেন কিন্তু আপনি আমাদের
অভিযানে।’
কুয়াশা তাকে আশ্বাস দিল। নিশ্চয়ই যাব, প্রফেসর।
প্রফেসর ও জো চলে যেতেই কুয়াশা দ্বিতীয় দফা ড্রিংকের অর্ডার দিল। পরবর্তী কর্মপন্থা চিন্তা করতে লাগল সিগারেট ধরিয়ে। প্রথম পর্ব ভালয় ভালয় ঢুকে গেছে। জো’র সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে।
| জো’র চরিত্র উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয়নি কুয়াশার। ওর আপাত নির্বিকারত্বের অন্তরালে যে সাংঘাতিক একটা ক্রিমিনাল মন আছে, অনায়াসে তা আবিষ্কার করেছে সে। অন্যপক্ষে সে-ও জানে, জো’ও তাকে আবিষ্কার করেছে।
শুয়াশা-১৮
১১৯
আমরা উঠে হতিগুজা। খি
স্রেফ মস্করা করার জন্য জো থানায় টেলিফোন করেছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাতে নিশ্চয়ই বিচলিত হয়েছে জো, আর সেজন্যেই এবারে অব্যর্থ টোপ ফেলেছে সে। জো জানে গভীর সমুদ্রে প্রফেসর রোজেনবার্গ যে পরীক্ষা চালাবেন তা দেখতে যদি তাকে আমন্ত্রণ করা হয় তাহলে সে তা গ্রহণ করবেই। আর একবার নিজের এলাকায় পেলে জো তার মোকাবেলায় নামবে। মনে মনে হাসল কুয়াশা। জো’র সাহসের আর বুদ্ধিমত্তার তারিফ করতে হয়। কৌশলটা জো ভালোই করেছে।
বিল মিটিয়ে দিয়ে পথে নামল কুয়াশা। ট্যাক্সি খোঁজ করতে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা বিচিত্র অনুভূতি হল কুয়াশার। মনে হল কে যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে আবার মনে মনে। তারিফ করল জো’র। লোকটা সত্যিই করিঙ্কর্মা। এরই মধ্যে পিছনে লেজ লাগিয়ে দিয়েছে। কোনরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।
দু-তিনটে মোড় ঘুরল কুয়াশা। এদিকটা ভিড় একটু বেশি। একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। শশা উইণ্ডোর মধ্যে দিয়ে কোণাকুণি দেখল মদের বোতল বগলে করে এক হিপ্পি বাবাজী আসছে। লোকটার চুল লম্বা। পোশাক কিন্ধুতকিমাকার।
| লোকটাকে কুয়াশা অনায়াসে শায়েস্তা করতে পারে। কিন্তু সেজন্য যে নাটকীয় আচরণের প্রয়োজন হবে এখন তা করা উচিত হবে না। অনুসরণকারীকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া চলবে না যে সে টের পেয়ে গেছে।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটায় ঢুকল কুয়াশা। একটা আই ব্রাউ পেন্সিল কিনে আবার পথে নামল। হিপ্পিবাবাজী তখন আকাশের অদৃশ্য তারার দিকে চেয়ে আছে।
আবার হাঁটতে শুরু করল কুয়াশা। এদিকটায় ভিড় বড়ো বেশি। সুবিধেই হল তাতে কুয়াশার। সামনেই একটা সিনেমা হাউজের ভিতর ঢুকে গেল সে। টিকেট কিনে ঢুকে গেল হলের মধ্যে। পর্দায় তখন বেধড়ক মারপিট হচ্ছে। রেড ইণ্ডিয়ানদের সাথে সাদা আদমীদের কি ভীষণ লড়াই। মিনিট পাঁচেক পরে কুয়াশা বেরিয়ে এল হল থেকে। লাউঞ্জ অতিক্রম করে গেটের দিকে এগোতেই কুয়াশা অপাঙ্গে দেখল হিপ্পির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সিনেমা হাউজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে আছে।
কুয়াশার মুখের দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল লোকটা। কুয়াশা আরও এগিয়ে এসে সোজাসুজি তাকাল লোকটার দিকে। বুঝল হতাশ হয়েছে লোকটা। আইব্রাউ পেন্সিল বেঁচে থাক।
হিল্পিটার নাকের ডগা দিয়েই পেভমেন্টের উপর নামল কুয়াশা।
১২০
চার
নিজের রুমের মধ্যে অস্থির পদচারণা করছিল এডিথ। অবশেষে জো তাকে আমন্ত্রণ করেছে রোজমেরীতে। যে আমন্ত্রণের আশায় দিন গুণছিল সে দীর্ঘকাল ধরে। সেই প্রত্যাশিত আমন্ত্রণ এসেছে এতদিন পরে। অথচ এখন আর এ আমন্ত্রণের কোনও মানেই হয় না।
এডিথ জানে রোজমেরী ইয়টেই আছে জো’র মারণ কাঠি। এতদিন ধরে সে সেই মারণ কাঠি আবিষ্কার করে পুলিসের হাতে তুলে দেবার কথা ভেবেছে। যে মারণ কাঠির সন্ধান করতে গিয়ে এথেলকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। হয়ত তাকেও নিজের প্রাণ দিতে হত-হয়ত দিতে হবে। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে কুয়াশা যখন দিগন্তে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও ক্ষতি নেই।
| অথচ উপায় নেই, যেতেই হবে রোজমেরীতে। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে সে। এড়িয়ে যাবার পথও ছিল না। নিজে যেচে অতীতে যে আমন্ত্রণ ভিক্ষা করেছে, এখন তা সে প্রত্যাখ্যান করবে কি করে? তাছাড়া জো নিশ্চয়ই তাকে সন্দেহ করেছে, আর সেই সন্দেহ ভঞ্জনই হয়ত এই আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে না গেলে জোর সন্দেহটা আরও বদ্ধমূল হবে।
এই অবস্থায় সে কি করবে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছে না।
টেলিফোন বেজে উঠল। টেবিলের কাছে গিয়ে রিসিভার ধরল এডিথ। ‘হ্যালো…উঁ…মি. ফগ?’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এডিধের মুখ। হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিন ওঁকে।’
রিসিভারটা রেখে দিল সে। কুয়াশা এসেছেন। তিনি নিশ্চয়ই এডিথের বর্তমান দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পারবেন।
মিনিট খানেক পরে আস্তে আস্তে টোকা পড়ল দরজায়, হাসিমুখে খুলল এডিথ। আসুন’।
হাসিমুখে ঢুকল কুয়াশা। এডিথের হাসিমাখা মুখের অন্তরালে যে চিন্তার রেখা ছিল তা কুয়াশার নজর এড়ায়নি। সে বসতে বসতে বলল, খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?’
| এডিথ তার সমস্যার কথা খুলে বলল। কুয়াশা বলল, এক্ষেত্রে আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই হবে। আর সম্ভব হলে ওদের বিরুদ্ধে কোনও দলিলপত্র পেলে তা লুকিয়ে সংগ্রহ করতে হবে।
কিন্তু আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে।
ভয় করলে তো চলবে না। এখন, মিস গ্রে। তবে খুব সাবধান। আপনাকে ওরা সন্দেহ করেছে। নিচে লাউঞ্জে জোর লোক বসে আছে। আপনার গতিবিধি
১২১
ওরা লক্ষ্য করছে। সম্ভবত আগে থেকেই লক্ষ্য করে আসছে।
এডিথ চমকাল। তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল।
কুয়াশা বলল, ‘মিস গ্রে, আমাদের বন্ধুটি অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক। প্রখর তার বুদ্ধিমত্তা। সে কোনও ব্যাপারে ঝুঁকি নেয় না। মুহূর্তের জন্যেও অসর্তক হয় না। প্রতিটি পা ফেলে গুণে গুণে।
একটু হাসল কুয়াশা। হয়ত অবাক হবেন। আমার পিছনেও লেগেছিল জো’র লোক। অবশ্য সহজেই তাকে এড়াতে পেরেছি।’
আপনার পিছনেও লোক লাগিয়েছে? এত শিগগির!’ অবাক হল এডিথ।
দুপুরের ঘটনা বর্ণনা করল কুয়াশা। এডিথ নীরবে শুনল। কুয়াশা বলল, ‘শিগগিরই অভিযানে বেরোচ্ছে জো। এবার তার লক্ষ্য হল নরউইচ নামে একটা জাহাজ। আর যাবার আগে জো তার শত্রুদের খতম করে যেতে চায়।’ বলতে বলতে একটা, পত্রিকার কাটিং বের করল কুয়াশা পকেট থেকে।
কাটিংটা হাতে নিয়ে পড়ল এডিথ। ছোট একটা খবর। আগামী বসন্তে বৃটিশ স্যালভেজ জাহাজ প্লিমাউথ জিব্রাল্টারের কাছে নরউইচ জাহাজের সম্পদ উদ্ধার করতে যাবে। নরউইচ ১৯২৯ সালে ডুবেছিল। জাহাজটার স্ট্রংরুমে তিন কোটি পাউণ্ডের আকাটা হীরে আছে। সাম্প্রতিককালে এটা এই ধরনের বৃহত্তম অভিযান।
পড়া শেষ করে এডিথ কুয়াশার দিকে তাকাল। তারপর বলল, বুঝতেই পারছেন, প্লিমাউথ রওনা দেবার আগেই জো সেখানে লুটপাট সমাপ্ত করবে।
‘কিন্তু,’ কুয়াশা দৃঢ় স্বরে বলল। ‘তার আগেই জোর লীলাখেলা শেষ হবে। কিন্তু তার আগে জানতে হবে জো তার ধনসম্পদ কোথায় রেখেছে। সেই
অনুসন্ধানের ভারও আপনার।
পাঁচ
দিনার্দ পোতাশ্রয়ে রাত নেমেছে। আকাশ ভর্তি মেঘ। চোখের সামনে না আনলে নিজের হাতটাও ভাল করে দেখা যায় না। সমুদ্রের বুক নিকষ কালো। শুধু জাহাজগুলোর রাইডিং লাইট তার চার পাশের সামান্য এলাকা আলোকিত করে রাখছে অন্ধকারের সাথে জোর সংগ্রাম করে। ( নিঃশব্দে কুয়াশা দি ফগ থেকে সমুদ্রে নামল। চারদিকে বৃত্তাকারে ক্ষুদ্র ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। ডেকে ম্লান আলোর সীমানা অতিক্রম করল দ্রুত। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে নিঃশব্দে পানি কেটে চলল। ঘন অন্ধকারের মধ্যে তার মাথাটাও মিশে গিয়েছে। সে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে চলেছে রোজমেরীর দিকে।
রোজমেরীর আশপাশে এসে পড়েছে কুয়াশা। রাইডিং লাইটের অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে তার চোখে মুখে। বুক ভরে দম নিয়ে ডুব দিল কুয়াশা। কিছুক্ষণ
১২২
পরে ভেসে উঠঃ রোজমেরীর পাশে।
চুপ করে অ… একগুলো মুহূর্ত কাটিয়ে দিল সেখানে। চাঞ্চল্যের কোনও লক্ষণ রোজমেরীতে আছে :ল তার মনে হল না। এদিকটা জাহাজের সম্মুখ ভাগ। পাশে পরপর তিনটে পোর্টলে। তার ভিতর দিয়ে বৃত্তাকার আলো বিচ্ছুরিত হয়ে বাইরের অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে। টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে পোর্টােল দিয়ে। কিন্তু ডেক থেকে কোনও শব্দ আসছে না। অস্পষ্ট কোনও শব্দও আসছে না সেখান থেকে। ঘড়ি দেখে পুরো তিন মিনিট অপেক্ষা করল কুয়াশা সেখানে। অবশেষে তার মতো বেআইনী আগন্তুকের জন্য রোজমেরী কর্তৃপক্ষ কোনও আয়োজন করেনি বলে ধারণা হল তার।
| প্রথম পোর্টহোলটার দিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা। পোর্টহোলের ঠিক নিচে পৌঁছে হাতড়ে হাতড়ে আঙুল রাখবার স্থান করে নিল। তারপর ধীরে অতি ধীরে সন্তর্পণে তার শরীরটাকে একটু একটু করে তুলল, যতক্ষণ না পোর্টহোলের রিমের মধ্য দিয়ে তার দৃষ্টি ভেতরে পৌঁছুল। | বিরাট একটা কেবিন। সম্ভবত প্রস্থে ইয়টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে। চারটে বাংক কেবিনটাতে। একজন একটা বাংকে ঘুমোচ্ছে। এক কোণে একটা টেবিল। সেখানে টাইপ করছে একজন। একজন ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। তার বুকের উপর একটা পত্রিকা। পাশের চেয়ারে বসে একটা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছে সেই হিপ্পি প্রবর। কেবিনের ঠিক মাঝখানে বড় একটা টেবিল ঘিরে বসে চারজন তাস পিটছে। কেবিনের প্রত্যেকটা লোকের চেহারার মধ্যে একটা ব্যাপারে সাদৃশ্য আছে, তা হল এই যে, প্রত্যেকের মুখে একটা ক্রুরতার ছাপ বিদ্যমান। শুধু হিল্পিটাকে অন্যরকম মনে হল কুয়াশার।
সম্ভবত নতুন রিক্রুট। পেশায় এখনও পাকা হয়নি।
দ্বিতীয় পোর্টহোলটার কাছে গেল কুয়াশা। চোখের উপর ভেসে উঠল হুইল হাউজ। অবাক হল কুয়াশা। শুধু হুইল হাউজই নয়, সুসজ্জিত একটা লিভিংরুম। যে কোনও কোটিপতির লিভিংরুমের মতই স্বাচ্ছন্দ্যকর। রুমটাতে জোস্টিফেনের রুচির পরিচয়ও পাওয়া যায়। একপাশে পরপর দুটো উঁচু বুক কেসে বই ঠাসা। তার উল্টোদিকে ডিভান। এককোণে একটা উঁচু টেবিল। একটা পোক টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন করছে, আর মাঝে মাঝে সামনের দেয়ালের দিকে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল দেয়ালে ভূমধ্যসাগরের একটা মানচিত্র টাঙানো আছে।
তৃতীয় পোর্টহোলটার কাছে এগোতেই গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রফেসর রোজেনবার্গ কথা বলছেন। সম্ভবত সাগর তলের অভিজ্ঞতা বর্ণনার শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছেন তিনি। কুয়াশার কানে গেল মাছটা যখন কাঁচের গায়ে নাক ঘষছিল তখন তার মুখে যে ক্রোধের ছাপ দেখলাম তা দেখলে, মিস এডিথ,
১২৩
আপনি ভয়ে মূৰ্ছা যেতেন।
হাসির তরঙ্গ উঠল। তার মধ্য দিয়ে জোর কর্কশ ধাতব কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এর পরেও সমুদ্রে নামতে তোমার উৎসাহ হচ্ছে না ডসন?’
‘উঁহু, বিন্দুমাত্র না। মাছের রাগ দেখবার সাধ আমার কোনও কালেই ছিল না। উপর থেকে মাছ ধরাই আমার পছন্দ। আপনি কি বলেন, মিস গ্রে।’
‘আমি আর কি বলব? মূৰ্ছা যেতে আমি কিছুতেই রাজি নই। অবশ্য সমুদ্রের তলা দেখতে কার না ইচ্ছে জাগে?’ চোখ নাচিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল এডিথ।
আবার হাসির হররা বয়ে গেল। ডসন নামের লোকটাকে দেখতে পেল না কুয়াশা।
আরও পিছনের দিকে এগোতেই দেখল একটা ক্যানো দ্রুতগতিতে রোজমেরীর দিকে এগোচ্ছে। নিশ্চুপ হয়ে মাথাটাকে খোলের সাথে মিশিয়ে দিল। কিন্তু ক্যানোটা রোজমেরীর গায়ে গিয়ে থামল না। পিছনের দিকে গিয়ে সঁ করে ঘুরে গেল জাহাজটার উল্টো দিকে। ক্যানোর শব্দটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু কুয়াশা আর একটু এগোতেই শোনা গেল ক্যানোর শব্দটা। ক্যানোটা জাহাজটাকে ঘুরে এল। এবার আরও কাছে এগিয়ে গেল ক্যানোটা। জাহাজের আলোতে দেখল, ক্যানোতে একমাত্র আরোহী তার পরিচিত। সে আর কেউ নয় কামাল।
ভীষণ বিরক্ত হল কামালের বোকামিতে। ছেলেটা সব কিছু পও করতে চলেছে। জো ও তার অনুচরদের সতর্ক দৃষ্টি এড়ানো কামালের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এই হঠকারিতার দরকারই বা কি ছিল? কিন্তু এখন আর ওকে সতর্ক করতে যাওয়া সব নয়। তাতে দুজনই ধরা পড়বে।
আর একবার চক্কর দিল ক্যানোটা। কুয়াশা অসহায়ের মত অপেক্ষা করতে লাগল। আর শোনা গেল না ক্যানোর শব্দটা। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কুয়াশা সাঁতার দিতে শুরু করল। সমস্তটা ইয়ট ঘুরে এল আবার সম্মুখভাগে।
| পরিবেশটা শান্ত। বেশ একটা উদ্বেগহীন পরিবেশ সমস্তটা ইয়ট জুড়ে। সম্ভবত গতরাতের আগন্তুকের মৃত্যু ও সম্ভাব্য অপর অতিথি সরকারীভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে আসায় সবাই নিশ্চিন্ত। মাস্কটা একটু তুলে ডেকটা পর্যবেক্ষণ করল কুয়াশা। কোমরের পাউচ থেকে, করল ছোট একখণ্ড পাথর। ডেক হাউজের গায়ে ছুঁড়ে মারল পাথরটা। টং করে পড়ল। মাথাটা নিচু করল কুয়াশা। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কেউ এল না শব্দের উৎসের সন্ধানে।
নিশ্চিন্ত হল কুয়াশা। ডেকের অন্তত এদিকটায় কেউ নেই। বিড়ালের মত স্বচ্ছন্দে লাফ দিয়ে ডেকে উঠল কুয়াশা। কোনও শব্দ হল না। ডেকের এদিকটা আলোকিত আর উন্মুক্ত। সেই আলোকিত স্থানে মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল কামালকে। পরমুহূর্তেই ডেক হাউজের অন্ধকার কোণটাতে মিলিয়ে গেল।
| ডেক হাউজের কোণের অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে কয়েক মিনিট। ১২৪
একটু দূরে কেবিনের ভিতর থেকে কথাবার্তা ভেসে আসছে। নিচের ক্রুদের কক্ষ থেকে ধাতব একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ডাইনে বাঁয়ে আবার তাকাল,কুয়াশা। না কেউ নেই। এবারে এগোনো যেতে পারে, ফিসফিস করে নিজেকেই বলল কুয়াশা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কেবিনের শেষ প্রান্তের দরজাটা খুলে গেল। পদশব্দ কানে গেল তার। তার দিকেই এগিয়ে আসছে কে যেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। পদশব্দটা এবার থেমে গেল। আর পরমুহূর্তে আলোকিত হয়ে উঠল সমগ্ৰ ডেকটা। কুয়াশা নিজেকে আলোর নিচে আবিষ্কার করল। অন্ধকার স্থানের খোঁজে সে চারদিক তাকাতে লাগল। বেশ কয়েক হাত দূরে একটা অন্ধকার কোণ আছে। কিন্তু সেখানটায় পৌঁছুবার আগেই ধরা পড়ে যাবে কুয়াশা।’
কোমরবন্ধের ওয়াটার প্রুফ পাউচটার দিকে হাত চলে গেল কুয়াশার। পরমুহূর্তেই তার হাতে চকচক করে উঠল নীল রঙের একটা রিভলভার। কিন্তু কাউকে আসতে দেখা গেল না। সম্ভবত শুধুমাত্র অন্ধকার দূর করার জন্যই জ্বালা হয়েছে ঐ বাতিটা, তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নয়। সেটাও টের পাওয়া গেল। পরক্ষণেই। কিন্তু পদশব্দটা আবার এগিয়ে আসছে। খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখুনি ধরা পড়বে সে। জোর গলা তার কানে এল। কাকে যেন সে ডেকের বাতির মাহাত্ম বোঝাচ্ছে।
এখুনি ধরা পড়ে যাবে কুয়াশা। উপরের দিকে তাকাল সে। হাত দুটো ঠেকল ডেক হাউসের ছাদে। পরের সেকেণ্ডে সে ছাদে গিয়ে উঠল। নিঃশব্দে ছাদের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে এক প্রান্ত দিয়ে নিচের দিকে চোখ পাতল।
জো’ই আসছে। তার পিছনে এডিথ। তার কাছেই আলোর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করছে জো। ডেক হাউসের পাশ দিয়ে পিছনের দিকে চলে গেল দুজন।
ছয়
সমস্তটা সন্ধ্যা জো বিনয় ও সৌজন্যের অবতার সেজে বসে রইল। নিরুত্তাপ আনুষ্ঠানিক সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সে সম্বর্ধনা জানাল এডিথকে। প্রফেসর রোজেনবার্গ আর ডানকান ডসনের সাথে আলাপ করিয়ে দিল। গোড়ার দিকে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি এডিথের মনটাকে পীড়িত করে রেখেছিল। জোর আনুষ্ঠানিক সৌজন্য সেই অস্বাচ্ছন্দ্য-বোধকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাকা অভিনেত্রীর মত মনের ভাব চেপে রাখতে পারায় নিজের ক্ষমতার উপর আস্থা বেড়ে গেল তার।
| এডিথ মেপে হাসল, মেপে কাশল। অবাক হওয়ার ভান করল, মাঝে মধ্যে আবদার করল। কিন্তু অস্বস্তিটাকে দূর করতে পারল না। প্রফেসর শুধু প্রতিভাধর
১২৫
বিজ্ঞানীই নন চমৎকার হাসির গল্পও করতে পারেন। কথা বলবার এমন একটা ছেলেমানুষি ভঙ্গি আছে যা তার চারপাশে একটা প্রীতিকর পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু তিনি ডিনারের পর অপেক্ষা করলেন না বেশিক্ষণ। আগামীকাল সকাল দশটায় জিওগ্রাফী সোসাইটিতে তাঁর লেকচার হবে, সেই জন্যে প্রস্তুতি নিতে গেলেন তিনি। যাবার সময় বারবার বলে গেলেন, মিস গ্রে, আমার বক্তৃতা
শুনতে গেলে আনন্দিত হব।
আমন্ত্রণ পেয়ে আন্তরিকভাবে আনন্দ প্রকাশ করল এডিথ।
এডিথ জানত, যে মুহূর্তে সে ইয়টে পা দিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকেই জো আর ডসন তাকৈ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে আর তার প্রত্যেকটি আচরণ দুজন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। অথচ তারা দুজনই তার সঙ্গে যে আচরণ করছে তাতে তার প্রতি রানী এলিজাবেথেরও ঈর্ষান্বিত হওয়া বিচিত্র নয়।
আসলে এ যেন সেই ইঁদুর শাবকের সাথে শিকারী বেড়ালের গল্পের মত। দুটো বিড়াল তাকে দুদিক থেকে তাড়া করে ফিরছে। ওকে নিয়ে যেন এক মনস্তাত্ত্বিক খেলায় মেতে উঠেছে জো আর ডসন।
ডসন লোকটাকে দেখে সর্বাঙ্গ ঘিন ঘিন করছিল এডিথের। বিশ্রী রকমের মোটা আর বেঁটে। মাথা কামানো। অল্প অল্প সাদা ভ্র। দাড়িগোঁফ গজায়নি বোধহয়। ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দের মত কণ্ঠস্বর। থ্যাবড়া নাকটার পাশে আধইঞ্চি পরিমাণ গভীর গর্তে মুখটাকে ভয়ঙ্কর দেখায়। পিটপিটে দুটো চোখে নেকড়ের মত হিংস্র দৃষ্টি।
প্রফেসর বিদায় নিতেই জো উঠে দাঁড়াল। বলল, চল এডিথ, ডেকে যাই আমরা।’
* এডিথ উঠল। জো’র পিছন পিছন ডেকের দিকে এগোল এডিথ। ডেকটা অন্ধকার। বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বাতির মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে করতে জো এগিয়ে গেল। জো’র একটা কথাও তার কানে গেল না। দুজন এসে পড়ল পেছনের ডেকে।
হাতের সিগারেট সমুদ্রের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে জো বলল, “কেমন লাগছে, এডিথ?’ জো’র ধাতব একঘেয়ে কণ্ঠে নতুন, একটা সুর বেজে উঠল যেন।
‘চমৎকার জো, চমৎকার তোমার ইয়ট।
‘শুধু ইয়টটাই চমৎকার লাগল?’ এডিথের ঘাড়ে হাত রাখল জো। এই প্রথম স্পর্শ। ঠাণ্ডা ভেজা তুলতুলে হাতটার স্পর্শে শির শির করে উঠল এডিথের সর্বাঙ্গ।
দেহের শিরশিরানি জো টের পেল কিনা এডিথ তাই অনুধাবনের চেষ্টা করল। তার কথার জবাব দিল না।
জো বলল, তুমি যে আমার ইয়টে এসেছ এ তো আমার পরম সৌভাগ্য, এডিথ ডিয়ার। বড় চমৎকার কাটল আজকের সন্ধ্যাটা। আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে
১২৬
এ এক স্মরণীয় দিন। জান, এডিথ, নিঃসঙ্গ জীবন বড় পীড়াদায়ক। একঘেয়ে সুরে জো বলে গেল ধাতব উচ্চারণে। হাসি চাপল এডিথ। আবেগহীন কণ্ঠে আবেগ মেশালে তার প্রকাশ যে হাস্যকর হয়ে ওঠে ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী জো বোধহয় তা কখনও অনুধাবনের চেষ্টা করেনি।
‘তুমি বড় একা, জো। তাই না?’
বড় একা আমি।’
‘কিন্তু একাকীত্ব থেকে মুক্তিলাভ তো তোমার নিজের উপরই নির্ভর করে। তুমি, যাকে সবাই বলে বড়লোক, লাখপতি অথবা কোটিপতি। এতবড় একটা ইয়টের মালিক। হয়ত আরও অনেক সম্পত্তি তোমার আছে। আর দুনিয়াটা তো তোমার মত ধনীর ইচ্ছা অনুসারে চলে। তুমি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সেরা সুন্দরীকে এনে তোমার একাকীত্ব ঘোচাতে পার।
হাসির শব্দ শোনা গেল। জো হাসছে।
অবাক হল এডিথ জো’কে শব্দ করে হাসতে দেখে। কিন্তু হাসির কথা এডিথ কি বলেছে তা সে ভেবে পেল না।
জো বলল, মনে হচ্ছে আমার টাকাকড়িতে তোমার হিংসে হচ্ছে। কিন্তু তোমার কথা ঠিক এডিথ। অফুরন্ত আমার সম্পদ। আমি যে কতটা ধনী তা বললে হয়ত তুমি আমাকে উন্মাদ মনে করবে। ইচ্ছে করলে আমি কয়েকশ’ সুন্দরী স্ত্রী লোক এনে ইয়ট ভরে ফেলতে পারি। জান তো যে কোটিপতি দুহাতে পয়সা ব্যয় করতে পারে তার আকর্ষণ মধুর; কিন্তু কোনদিনই আমি তা করিনি। তোমার আগে কোনও নারী এই জাহাজে ওঠেনি।
জো’র কালো চোখের দৃষ্টি ঘনীভূত হয়ে উঠল। এডিথের হঠাৎ মনে হল,, সবটাই কি অভিনয়? হয়ত মর্মমূল থেকেই জো’র কথাগুলো বেরিয়ে আসছে। অথচ ধাতব একঘেয়ে উত্তাপহীন কণ্ঠে, আবেগ সঞ্চারের প্রয়াস কি হাস্যকর। আর এই প্রেম নিবেদনের ফাঁকে ফাঁকেও সেই নিরুত্তাপ পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। | ‘আমার পরম সৌভাগ্য, জো। কিন্তু কারণটা কি নারী বর্জনের এই সংযম আর কঠোরতার? প্রেমে ব্যর্থতা?
না এডিথ। জীবনে প্রেমই আমি কখনও করিনি। ব্যর্থতার প্রশ্ন তাই ওঠে না। তুমি-তুমিই প্রথম নারী যার কাছে আমি বোকা হয়ে গেছি। তুমি আমার ইয়ট দেখতে চেয়েছিলে। এটা তোমার কাছে সামান্য কৌতূহল, একটু আনন্দ, একটু চিত্তবিনোদন মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। কালকেই হয়ত ভুলে যাবে। কিন্তু আমার কাছে এই তো সবে শুরু। তোমাকে ইয়টে নিয়ে এসে আমি আমার সারাজীবনের আইন ভঙ্গ করলাম। কেন, তা তুমি বুঝতে পার না, এডিথ?”
জো এডিথের কোমরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
একটু সরে গিয়ে দাঁড়াল এডিথ। বলল, এমন তো হতে পারে যে তুমি
‘১১২৭
সরে দাঁড়াল এভিভসটা কেমন ভারতে চাওঃ ব
সকালেই মত পাল্টাবে। নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য আফসোস করবে।
জো এগিয়ে এসে তাকে কাছে টেনে নিল। জো’র ঠোঁট দুটো তার ঠোঁট স্পর্শ করার আগেই ঘৃণায় চোখ বন্ধ করল এডিথ : রবারের মত মুখ জোর! ঠাণ্ডা। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল এডিথের! অনেকক্ষণ পর ছেড়ে দিল তাকে। তখন জো’র চোখ দুটো আগুনের মত জ্বলছে।
একটু পরেই জো আবেদন জানাল, তুমি থাকবে তো, এডিথ ডিয়ার?’
না।’ সরে দাঁড়াল এডিথ। অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছিল এডিথ। সারা গায়ে যেন বিহুটি লেগেছে তার। বাতাসটা কেমন ভারি হয়ে উঠেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন নয়, জো। তুমি বড় তাড়াতাড়ি এগোতে চাও। বল যদি তো কাল আবার আসব।’
কাল আমি চলে যাচ্ছি এডিথ। বড়রিক বেতে। যাবে তুমি? আবেদনের সুরে বলল জো।
‘একটা সিগারেট দাও। প্রসঙ্গ বদলের প্রচলিত ভঙ্গিটাই ব্যবহার করল এডিথ।
জো পকেটে হাত দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত বের করে বলল, ‘ভেতরে রেখে এসেছি প্যাকেট। চল না হয়, ভেতরেই যাই।’
ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার পেছনের দরজাটাই খুলল জো। দুজন ঢুকল কেবিনে। জো সিগারেট আর লাইটার এনে দিল এডিথের হাতে। কেবিনটার চারদিকে দৃষ্টিপাত করল এডিথ! সু-সজ্জিত একটা হুইল হাউস। শুধু হুইল হাউজই নয় একটা চমৎকার লিভিং রুমও।
সেকথাই বলল এড়িথ, এই কেবিনটা তো আমায় দেখাওনি। ভারি চমৎকার তো?’
জো জবাব দিতে যাচ্ছিল। দরজায় টোকা পড়ল।
‘কে? কি চাই?’ জোর গলায় প্রশ্ন করল জো। এই প্রথম জো’কে মেজাজ হারাতে দেখল এডিথ।
জরুরী দরকার আছে, স্যার।
দরজা খুলে দিল জো। যে স্টুয়ার্ড ডিনার পরিবেশন করেছিল সে দাঁড়িয়ে আছে। জো এডিথের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। | দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সিগারেট ধরিয়ে এডিথ একটা চেয়ারে বসে পড়ল। জাহাজে উঠবার পর এই প্রথম সে একা হতে পেরেছে। আর এই সুযোগটাই খুঁজছিল সে। হয়ত এখুনি জো আবার ফিরে আসবে। এডিথ দ্রুত চিন্তা করতে লাগল আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে চাইতে লাগল। কিন্তু সে নির্দিষ্ট ভাবে কি যে চায়, তাই সে জানে না। সামনে পাশাপাশি দুটো বুককেস ভর্তি বই, ওদিকে একটা টেবিল। তারপর চার্টের মত কি একটা দেখা যাচ্ছে।
১২৮
বার ফিরেতে পেরেছে চেয়ারে
সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে দিয়ে বুককেসটার দিকে এগিয়ে গেল এডিথ।
সাত
সারাটা সন্ধ্যা লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াল কামাল। এডিথ গেছে রোজমেরীতে। কুয়াশা কোথায় সে খবর সে নিজে ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। হাতে অখণ্ড। অবসর অন্তত শুতে যাবার আগে পর্যন্ত। অথচ রাত বারোটার আগে শয্যা গ্রহণের কথা কল্পনাই করতে পারে না সে।
বীচে কিছুক্ষণ ঘুরল অন্ধকারের মধ্যেই। ক্যানো ভাড়া করে চ্যানেলের অনেকটা দূরে পাক খেয়ে এল কয়েকবার। পরিতৃপ্তি সহকারে ডিনার সারল হোটেল ডি লা মেয়ারে। সেখান থেকে গেল একটা ক্যাসিনোতে। পায়ে ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে এক সুন্দরী যুবতীর নাচের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। আবার বীচে গেল। জিপসীদের তাঁবুতে ম্যাজিক দেখল কিছুক্ষণ।
ঘড়িতে দেখল, রাত এগারোটা বাজে। এবারে ফেরা যেতে পারে হোটেলে। কি মনে করে হোটেলের বদলে এগিয়ে গেল জেটির দিকে। অন্ধকারে জেটিতে কিছুক্ষণ ঘুরল। রোজমেরীর দিকে দৃষ্টি গেল তার। অন্ধকারের মধ্যে সাগরের বুকে
দাঁড়িয়ে আছে রোজমেরী। রাইভিং লাইটের আলোকে রহস্যময় দেখাচ্ছে ইয়টটাকে। এখান থেকে কুয়াশার ইয়ট দি ফাঁকে দেখা যায় না। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আরও কয়েকটি জাহাজ। তার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে দি ফগ। জেটিতে অসংখ্য ক্যানো। ভাড়ার প্রতীক্ষায় আছে।
| একটা ক্যানো ভাড়া করে কামাল দি ফগ-এর স্পীডবোটের পাশে গিয়ে ভিড়ল। ক্যানো বিদায় দিয়ে ইয়টে উঠল কামাল।
সাদর সম্বর্ধনা জানাল চার্লি হ্যারিস। বিকেলে কামাল এসেছিল ইয়টে তার মাস্টারের কাছে। মাস্টার তাকে খুব খাতির করেছিলেন। মাস্টার যে এই যুবককে স্নেহ করেন তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি চার্লির।
কামাল জিজ্ঞেস করল, ‘মাস্টার কোথায়, মি, হ্যারিস?” চার্লি একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে বলল, ‘আল্লাহ মালুম! ‘ইয়টে নেই? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কামাল।
মাথা নাড়ল হ্যারিস। বলল, ‘বসুন, স্যার, স্যালুনে গিয়ে। মাস্টার যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়তে পারেন।’
কিন্তু কামাল নড়ল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করতে লাগল। স্পীডবোট আছে অথচ কুয়াশা নেই। একটা সম্ভাবনার কথা তার মাথায় উদয় হল। এবং পরের মুহূর্তেই সে একটা সিদ্ধান্ত নিল।
পরম বিনয়ের সাথে কামাল বলল, ‘মি. হ্যারিস, তোমাদের ক্যানোটা পেতে ৯-
১২৯
ডেটিএকটা কর্মবিদায় দিল চর্ণি
পারি কি? আমি একটু ঘুরে আসতাম।
অবশ্য, অবশ্য।
ক্যানোতে চেপে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরল কামাল। অনেকটা দূরত্ব রেখে রোজমেরীর পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করল। স্বভাবতই কিছু বোঝা গেল না। ক্যানোটা নিয়ে কামাল চলে গেল রোজমেরীর আলোর সীমানার কাছাকাছি। দু’বার চক্কর খেল রোজমেরীর চারদিকে। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না, কোনও চাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া গেল না রোজমেরীতে। ডেকে একটা লোকও দেখা গেল
।
একটু ইতস্তত করল কামাল। অথচ তার কি প্রত্যাশা ছিল স্পষ্ট করে তাও সে জানে না। ফিরে যাওয়াই উচিত বিবেচনা করল। কিন্তু একটা অজ্ঞাত আকর্ষণ যেন তাকে ফিরে যেতে দিল না। তৃতীয়বার আর চক্কর দিল না। কাছেই একটা জাহাজের আড়ালে চলে গেল। ক্যানোর ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। এখান থেকে রোজমেরীর সম্মুখ দিকটা অস্পষ্ট দেখা যায়। হঠাৎ আবছা অন্ধকারে, কামালের চোখে পড়ল, একটা মানুষের মূর্তি রোজমূেরীর ডেকে উঠছে। ডেকের আলোয় তাকে মুহূর্তের জন্য দেখা গেল! চমকে উঠল কামাল। মূর্তিটা আর কেউ নয় কুয়াশা।
পরবর্তী দৃশ্যের জন্য কামাল এক দৃষ্টিতে রোজমেরীর দিকে তাকিয়ে রইল। সিগারেটে টান দিতেও ভুলে গেল সে।
হঠাৎ তার মোটর বোটটা দুলে উঠল। চমকে উঠল কামাল। দেখতে পেল একটা লোক পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে তার বোটে। লোকটার মুখে একটা পিস্তল। কামাল পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই লোকটা দ্বিতীয় লাফে তার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখ থেকে পিস্তলটা হাতে নিল। সমস্তটা ঘটনা ঘটে গেল তিন সেকেণ্ডের মধ্যে। অনেকটা জিপসীদের অবিশ্বাস্য ম্যাজিকের মত। ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেল কামাল।
লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বোঝাল, একটু নড়াচড়া করলে, এখানেই তার মানব জীবনের ইতি ঘটবে। সুতরাং সে যেন ভদ্র সন্তানের মত তার নির্দেশ পালন করে। মোটর বোটটা দুলে উঠল আবার। আরও একজন এসে উঠল। পিস্তলধারী ইঙ্গিত করতেই দ্বিতীয় লোকটা এসে কামালের হাত ধরে টেনে তুলল। মুখে বলল,
সরে বস্ এখান থেকে।’
ভয়ে ভয়ে কামাল সরে বসল। দ্বিতীয় লোকটা পিছনে বসে ইঞ্জিন চালিয়ে দিল। পিস্তলধারী কামালের দিকে পিস্তল উঁচিয়েই রইল। মোটরবোট দ্রুত ছুটে চলল রোজমেরীর দিকে।
কামাল এতক্ষণে তার নির্বুদ্ধিতা পরিষ্কার বুঝতে পারল। এই ভয়ঙ্কর দস্যুদলের ঘাটির কাছে এইভাবে ঘোরাফেরা করে সে চরম বোকামির পরিচয় ১৩০
দিয়েছে। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হল তার। মনে পড়ল, কুয়াশা তাকে অত্যন্ত সাবধানে থাকতে বলেছিল। অসহায়ের মত কামাল বসে রইল। এডিথ আর কুয়াশা হয়ত জানতেও পারবে না যে জো স্টিফেনের অনুচররা তাকে বন্দী করেছে।
| রোজমেরীতে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা ছিল ভালই। বেঁটে মোটাসোটা গোলগাল চেহারার একটি লোক তাকে সম্বর্ধনা জানাল। লোকটার চোখ দুটো ছোট ছোট . পিটপিটে। হিংস্র দৃষ্টি। নাকের পাশে এক ক্ষতচিহ্ন। সব মিলিয়ে বীভৎস।
| লোকটা বলল, এই যে আসুন, মি. এটসেটরা। আলফানস, ওকে নয় নম্বর কেবিনে নিয়ে যাও।’
পিস্তলধারীর নামটাই বোধহয় আলফানস। সে ইশারায় কামালকে এগোবার নির্দেশ দিল। কামাল ভাবছিল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিনা। কিন্তু আইডিয়াটা নাকচ করে দিল। এখন একটু সন্দেহজনক আচরণ করলেই জানে শেষ করে দেবে
ওরা নির্দ্বিধায়। তবুও কিছু একটা করতে হবে।
কামাল দেরি করছে দেখে আলফানস আবার ইশারা করল। কিন্তু পা বাড়াবার আগেই কোমরের উপর প্রচণ্ড একটা লাথি এসে পড়ল। কোমরটা যন্ত্রণায় বেঁকে গেল কামালের। মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার। পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াল কামাল। কিন্তু পরমুহূর্তে আরও একটা লাথি পড়ল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কামাল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
আট
প্রথম বুককেসের সামনে এসে দাঁড়াল এডিথ। ঠাসা বই। মোটা, পাতলা, বাঁধানো, পেপার ব্যাক, সবরকমই আছে। মোটা বইয়ের সংখ্যাই বেশি। অধিকাংশের সোনালী হরফে লেখা নাম। দর্শন, ইঞ্জিনিয়ারিং, নেভিগেশন, খেলাধুলা, জেমস বসবই আছে। দ্রুত কয়েকটা বই বের করে পাতা উল্টে পাল্টে দেখল। না
৬ামি নয়। হয়ত দু’একটা ডামি থাকতেও পারে। কিন্তু দুটো বুককেসের বই দেখতে দু’ঘণ্টা লাগবে এভাবে। | উঁচু টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল এডিথ। টেবিলের উপর সরু পেন্সিলে আঁকা একটা চার্ট। খুঁটিয়ে দেখতেই বুঝল ওটা ভূমধ্যসাগর এলাকার একটা ম্যাশ। ডটেড লাইন দিয়ে জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশ করা আছে। লাইট হাউস আর বয়া দেখানো আছে লাল পেন্সিলের চিহ্ন দিয়ে।
হতাশ হল এডিথ। না এতেও কিছু নেই। হঠাৎ তার চোখে পড়ল আর একটা লাল চিহ্ন। সেটা ঠিক অন্য লাল বিন্দুর মত নয়। এটা কলমের কালিতে আঁকা, পেন্সিলে নয়, আর বিন্দুটার চারদিকে কালো কালির সূক্ষ্ম রেখা।
এডিথের বুকের ভিতরটা ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। দাঁত দিয়ে
১৩১
ঠোঁট চেপে ধরে আত্মসম্বরণ করল সে।
উত্তেজনা একটু প্রশমিত হতেই এডিথ পেন্সিল আর কাগজের জন্য ভ্যানিটি ব্যাগ খুলল। এঁকে নিতে হবে ঐ চার্টটা। এডিথ জানে না ঐ চার্ট আর লাল চিহ্নে কোনও মানে আছে কিনা। হয়ত কোনও অর্থ নেই অথবা এমনও হতে পারে ঐ চিহ্নটাতেই আছে জো আর র্যাকেটের মৃত্যুবান, হয়ত ওতেই ইঙ্গিত আছে জো’র
সঞ্চিত ধনরত্নের।
ভ্যানিটি ব্যাগে কাগজ-পেন্সিল কোনটাই পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে ব্যাগ বন্ধ করতে যেতেই মনে হল রুমাল তো আছে, লিপস্টিকও আছে। ওতেই হবে। কিন্তু তার চোখ পড়ল টেবিলের উপরেই একটা পেন্সিলের উপর। তার নিচেই
এক খণ্ড ছোট সাদা কাগজ। এডিথের দরকার মাত্র এক ইঞ্চি কাগজ।
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটতে লাগল এডিথের। কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত কাগজের উপর পেন্সিল চালাল এডিথ। দুমিনিটও লাগল না। কিন্তু এডিথের মনে হল যেন সে যুগযুগান্তর ধরে নকল করে চলেছে চার্টটা।
ব্যাগ খুলে পাউডারের বাক্স বের করল এডিথ। কাগজের টুকরোটা বাক্সে রেখে ব্যাগটা বন্ধ করল। বুকের ভিতর তখনও হাতুড়ি পিটছে। অন্য একটা টেবিলের কাছে চলে এল এডিথ। একটা ম্যাগাজিন খুলে পাতা উল্টাতে লাগল। কিন্তু তার চোখের সামনে সমস্ত লেখা ছবি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। কোনও কিছুই তার স্নায়ুতে পৌঁছুচ্ছে না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।
তবুও সেখানে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর ধীরে ধীরে এডিথর উত্তেজনার অবসান হল। রুমাল বের করে মুখটা মুছল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত, প্রসাধন করে নিল। আয়নায় খুঁটিয়ে দেখল তার চেহারা। কোনও অস্বাভাবিকতার ছাপ নেই। বরং প্রসাধনের ফলে এখন তাকে বেশ তাজা দেখাচ্ছে।
হঠাৎ তার মনে হল সমস্ত ব্যাপারটাই বোধহয় সাজানো, সুপরিকল্পিত। কৌশলে একটা টোপ ফেলা হয়েছে। এডিথ টোপ গেলে কিনা তাই ওরা দেখতে চায়। হয়ত, কেউ সেলুনের ভিতরে বা বাইরে থেকে এডিথের কার্যকলাপ দেখছে, অথবা ক্লোজসার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা আছে কোথাও। জো হয়ত সব কিছুই দেখেছে অন্য কোথাও বসে। নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে এডিথ।
| পুরো ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করল সে। জো ও ডসনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ডেকের উপর জোর প্রেম নিবেদন, একটা অজুহাত দেখিয়ে একলা তাকে হুইল হাউজে রেখে জোর প্রস্থান, টেবিলের উপর চার্ট, পেন্সিল, ছোট এক টুকরো কাগজ সমস্তটাই একটা বিশেষ সিদ্ধান্তের দিক নির্দেশ করে। অথচ এখন আর কিছু করবার নেই। ধরা পড়ে গেছে সে জো’র চালাকির কাছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরাল এডিথ। ম্যাগাজিনটা টেনে নিয়ে একটা সোফায় গা এলিয়ে দিল। অশান্ত মনটার রাশ টেনে ধরবার চেষ্টা করল। তারপর
১৩২
একটা সময় এল যখন এডিথ বুঝল সে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। উত্তেজনার অবসান ঘটেছে। যে-কোনও পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার সাহস তার ফিরে এসেছে। আর জো যখন ফিরে এল তখন সে যে মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করল তা সে আগের মুহূর্তেও কল্পনা করেনি।
এডিথের হাসির জবাবে মাথা নাড়ল জো। সে নিজেও বোধহয় হাসবার চেষ্টা করল বলে এডিথের মনে হল। কিন্তু হাসিটা ফুটল না। এই প্রথম জো’র মুখ থেকে নির্বিকারত্বের মুখোশটা যেন আলগা হল। চিন্তার রেখা পড়েছে জো’র মুখে। তবে
কি?
শিউরে উঠল এডিথ আবার। কিন্তু জো এডিথের দিকে এতক্ষণ পর্যন্ত ভাল করে তাকায়নি। একটা সেফ খুলে কি যেন করছে।
ওখান থেকেই জো বলল, তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ বোধহয় তোমাকে একা থাকতে হবে। জো তার কর্কশ কণ্ঠে একঘেয়ে সুরে বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়াল। তার হাতে একটা অটোমেটিক। ফ্যাকাসে হয়ে গেল এডিথের মুখ। জো এ তক্ষণে আবার তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে ধরেছে এডিথের দিকে। ঢোক গিলল এডিথ। এডিথের মুখের উপর দৃষ্টিটা নিবদ্ধ রেখেই জো বলল, ‘স্টুয়ার্ড আজকে রাতেও একজনকে লুকিয়ে জাহাজে উঠতে দেখেছে। কালরাতেও এসেছিল একজন, তোমাকে তো বলেছি। হয়ত আজকেও সে-ই এসেছে। কিন্তু আজকে আর বাছাধনকে পালাতে হবে না।’
‘সত্যি! অবাক হওয়ার সার্থক ভান করল এডিথ, আর একটু অবাকও হল। কে আজকের এই অভিযাত্রী, কুয়াশা? কামাল? চোর? না কোনও ডিটেকটিভ?
কে? :
| না কি সমস্তটাই জো’র চালাকি? এডিথের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি। সেটাই বোধহয় ঠিক।
“অবশ্য ভয় পাবার কিছু নেই।’ এডিথকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল জো।
“না না, ভয় পাব কেন। ঠোঁট উল্টাল এডিথ। কিন্তু আমি থ্রিলড ফিল করছি। মনে মনে নিজের তারিফ করল এডিথ। অভিনয়টা ভালই হচ্ছে। কিন্তু তোমার প্রতি নিশাচরদের এমন সুনজুরের কারণ কি?’
ত্যাগ করল জো। বলল, ‘ছিঁচকে চোর। বোধহয় ভেবেছে যদি দামী কিছু বাগাতে পারে।
সবচেয়ে দামী জিনিসটার লোভে আসেনি তো?’ এডিথ ঠাট্টা করল। দাঁত বের করে হাসল জো। ‘আমি যাব তোমার সাথে।’ নাকি সুরে আবদার করল এডিথ।
লক্ষ্মীটি, তুমি বরং এখানেই থাক। মিছিমিছি…’
‘আমার কিন্তু এতটুকু ভয় করছে না। তাছাড়া তোমার কাছে তো অটোমেটিক
আছেই। বিশ্বাস কর, তোমার কোনও অসুবিধা ঘটাব না।’ আবদারের মাত্রাটা বাড়াল এডিথ।
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল জো। তারপর দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘এস তাহলে, কিন্তু সবসময় আমার পিছনে থাকবে।’
কেবিন থেকে বেরোতে বেরোতে জো-বলল, “লোকটা এখনও পালাতে পারেনি, ইয়টেরই কোথাও লুকিয়ে আছে।
জোর কথা এডিথের মস্তিকে কোনও তরঙ্গ সৃষ্টি করল না। অজ্ঞাত আগন্তুকের কাহিনী সে এখনও বিশ্বাস করে না। এডিথের ধারণা, এটাও তাকে মানসিক দিক থেকে নিষ্পেষণ করার একটা কৌশল মাত্র। জো পাকা শিকারী। শিকার বাগে পেয়ে তাকে নিয়ে খেলছে।
জো’র পিছনে পিছনে ডেকহাউসের পাশে এসে দাঁড়াল এডিথ। সে তখন কল্পনাও করতে পারেনি যে ঠিক তার মাথার কাছেই রয়েছে কুয়াশা–এত কাছে
যে কুয়াশা ইচ্ছা করলে তার চুল ছুঁয়ে দিতে পারে।
হঠাৎ অন্ধকার আকাশ থেকে বজ্রপাত হল। এডিথ অবাক হয়ে দেখল লাফ দিয়ে নামল একটা লোক। তার একটা পা পড়ল জো’র হাতে ধরা অটোমেটিকের উপর। অন্য পা’টা পড়ল জো’র কপালে। জো চিৎ হয়ে ধপাশ করে রেলিংয়ের উপরে পড়ে গেল। হাত থেকে অটোমেটিকটা ছিটকে পড়ল পানিতে। ঝপ করে
একটা শব্দ হল।
ডেকের উপর নেমে এসেছে লোকটা। পরের মুহূর্তে সে রেলিং টপকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সমস্তটা ঘটনা ঘটে গেল। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে এডিথ দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দেখতে পেল না এডিথ লোকটার। কিন্তু দীর্ঘদেহটা দেখে অনায়াসে চিনতে পারল সে। নির্মেঘ আকাশ থেকে যদি বজ্রপাত হয় নিশ্চয়ই সে বজ্রের নাম কুয়াশা।
বিস্ময়ে আর আনন্দে নির্বাক হয়ে সুমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল এডিথ।
নয়
ধীরে অতি ধীরে চেতনা ফিরে এল কামালের। মাথার ভিতরটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। যেন একটা শূন্যতা বোধ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে মনে হল তার। চোখ মেলে চাইল কামাল। চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কোথাও এতটুকু আলোর রেশ নেই। আর অদ্ভুত নিস্তব্ধ। কোনও শব্দ তার কানে এসে পৌঁছুল না।
আমি এখন কোথায়, নিজেকে প্রশ্ন করল কামাল। তারপর আস্তে আস্তে তার সব কথা মনে পড়ল। তাহলে সে এখন জো স্টিফেনের ইয়টে বন্দী হয়ে আছে।
১৩৪
উঠে বসবার চেষ্টা করল কামাল। সর্বাঙ্গে অসহ্য বেদনা। কোমরটা টনটন করছে ব্যথায়। পকেটে হাত ঢোকাল কামাল। সিগারেট লাইটারটা নেই।
কতক্ষণ এমনি করে ছিল কামাল তা বলতে পারবে না। হাতের ঘড়িটা বন্ধ। হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে অন্ধকার এই কক্ষে বন্দী হয়ে আছে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে, হয়ত অনন্তকালের জন্যই তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু জো স্টিফেন কি এতটা নির্দয় হবে?
উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল কামাল। এমন সময় কাছেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। একটু পরে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কারা যেন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।
দাঁড়াল না কামাল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। তালায় চাবি ঢোকানোর শব্দ হল। তারপর আলো জ্বলে উঠল। সে আলোয় কামাল নিজেকে
আবিষ্কার করল একটা ছোট কক্ষের মধ্যে। বড় জোর দু’হাত বাই চার হাত কক্ষটা।
দরজাটা খুলে যেতেই কামাল মুখ ফিরিয়ে দেখল দুজন লোক এসে দাঁড়াল তার সামনে। সেই ভয়াল দর্শন বেঁটে মোটা লোকটা। দ্বিতীয় লোকটার চুল লম্বা। দাড়ি গোঁফ কামানো। হাতে একটা বিরাট লোহার রড। সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। কামাল ফ্যালফ্যাল করে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।
মোটকা লোকটাই এগিয়ে এল তার কাছে। খ্যান খ্যান করে হেসে বলল, ‘এই যে, বাছাধন, ঘুম ভেঙেছে? এবারে বল তো বাপু খবরটা কি?’
কামাল চুপ করে বসে রইল। ওরা দুজন, তার ওপর হিপ্লিটার হাতে যে লোহার রড আছে তার এক আঘাতেই সে খতম হয়ে যাবে, সুতরাং ওদের সাথে লড়তে যাওয়া পাগলামির নামান্তর।
কথা বলছিস না কেন?’ জুতোর ডগাটা দিয়ে কামালের গালে আঘাত করল লোকটা। কামাল হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে পা-টা সরিয়ে দিল।
লোকটার চেহারা আরও হিংস্র হয়ে উঠল। মাথা নিচু করে চুলের মুঠি চেপে ধরল। আর সেই মুহূর্তেই ঘটনাটা ঘটল। খটাং করে একটা আওয়াজ কানে গেল কামালের। কামালের চুলের মুঠিটা আলগা হয়ে গেল আর সেই মুহূর্তেই আকাশ ফাটানো একটা আর্তনাদ তার কানে এসে পৌঁছুল। মোটকা লোকটা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে হাত পা ছুঁড়ছে। গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে লোকটার মুখ দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থির হয়ে গেল দেহটা। শিউরে উঠল কামাল।
লম্বা চুলওয়ালা লোকটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল সে। দেখল, তার চোখে জিঘাংসা আর ঘৃণা। মেঝের দিকে তাকাল আবার। মেঝেটায় রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তার গায়েও রক্তের ছিটে এসে লেগেছে। কি বীভৎস।
১৩৫
পড়। এমৃত্যু এসর দৃঢ় হাতে
কামালের চেতনা আবার আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। পড়ে যাচ্ছিল।
‘ কিন্তু কে তাকে প্রবল ভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। চোখটা খুলল কামাল। সেই লম্বা চুলওয়ালা লোকটা। সে যেন কি বলছে তাকে। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল কামাল।
…একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরে পেল সে। কে যেন আস্তে আস্তে তার দেহটা নাড়ছে। চোখ খুললো কামাল। দেখল সেই লম্বা চুলওয়ালা লোকটা তার মুখের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।
কামাল চোখ মেলে চাইতেই সে বলল, ‘যদি প্রাণে বাঁচতে চাও এখুনি উঠে পড়। এর পরে আর সময় পাওয়া যাবে না, জো’র হাতে মারা পড়তে হবে।’
প্রাণ…মৃত্যু এসব কথার মানে কি ভাবতে চেষ্টা করল কামাল। কিন্তু লোকটা তাকে সময় দিল না। দৃঢ় হাতে তার একটা হাত ধরে টেনে তুলে বসাল। লোকটার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি।
এতক্ষণে পূর্ণ চেতনা ফিরে পেয়েছে কামাল। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে আর কোনও কষ্ট হচ্ছে না। প্রাণ…মৃত্যু…এসবের মানে জানে সে।
মাটিতে একটা সুইম স্যুট পড়েছিল। লোকটা সেটা তুলে কামালের হাতে দিয়ে বলল, ‘এক মিনিট সময় দিলাম। কাপড়টা বদলে এটা পরে ফেল। কুইক।
দেরি করলে দুজনকেই মারা পড়তে হবে।
কৃতজ্ঞতায় তখন কামালের বুকটা ভরে উঠেছে। সে নীরবে কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে লোকটার দিকে তাকাল। কিন্তু লোকটা বিরক্ত হল। কাপড় বদলে সুইম স্যুট পরল কামাল।
এক মিনিটে হল না, দু’মিনিটেও না। লাগল তিন মিনিট। তাও লোকটা সাহায্য করল বলেই।
কাপড়গুলো গুছিয়ে কামালের হাতে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটা দরজা খুলল সাবধানে। বাইরে উঁকি দিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বোধহয় সুইচ টিপল বলে মনে হল কামালের। কারণ, সঙ্গে সঙ্গে রুমের ভেতর আর বাইরে অন্ধকার হয়ে গেল। . দ্রুত আবার কক্ষটাতে ঢুকল লোকটা। কামালের হাত ধরে টান দিল। বাইরে
অস্পষ্ট আলো। সেই আলোতে একটা সরু প্যাসেজের মধ্যে এসে পড়ল ওরা। লম্বা। চুলওয়ালা লোকটা সামনে আর কামাল তার পিছনে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বা দিকে মোড় নিল। আর একটু এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে। মোড়টা ঘুরতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সমুদ্র।
কামাল তখন মনের জোর ফিরে পেয়েছে। রেলিং পেরিয়ে সে সমুদ্রে নামল। ডেকের উপর পায়চারি করছিল জো। এডিথ নীরবে দাঁড়িয়ে আছে রেলিং-এর
১৩৬
পাশে। তার পাশে প্রফেসর রোজেনবার্গ। তিনি ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলাচ্ছেন। কেউ কোনও কথা বলছে না। মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য জো’র মুখ থেকে নির্বিকার ভাবটা অন্তর্হিত হয়েছিল। এখন আবার সেটা সেঁটে বসেছে।
জো পায়চারি করতে করতেই ডাকল, আলফানস।
আলফানস একটু দূরে একটা বাক্সের উপর দাঁড়িয়েছিল। সে মুখ ফেরাল। জো তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডসন কোথায়?’
আলফানস বলল, নয় নম্বর কেবিনে। ‘এতক্ষণ সে কি করছে ওখানে? যাও তাকে ডেকে নিয়ে এস। আলফানস চলে গেল।
একটা টেণ্ডার এসে ভিড়ল ইয়টের পাশে। জো পায়চারি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাউকে দেখতে পেলে?’
| ফ্লাশলাইট হাতে একটা লোক ইয়টে উঠতে উঠতে বলল, ‘কাউকেই না। দু একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ কিছু বলতে পারল না।
* প্রফেসর রোজেনবার্গ বললেন, কি আশ্চর্য। এর মধ্যেই পালিয়ে গেল! তবে আমার মনে হচ্ছে চোরটা কাছে পিঠেই কোথাও আছে। চলুন, যাই একবার দেখে আসি।’
জো বলল, তাতে কোনও লাভ হবে না মি. প্রফেসর। লুকিয়ে থাকবার জায়গার তো অভাব নেই। তাছাড়া দেরিও হয়ে গেছে অনেক। এখন খোঁজ করতে যাওয়া পশ্রম মাত্র।’
প্রফেসর বললেন, “তাইতো, তাইতো।’
‘আলফানস ফিরে এল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। জো’কে বলল, ‘মি. স্টিফেন, একটু এদিক আসবেন? জরুরী প্রয়োজন।
এডিথ ও প্রফেসরের কাছে ক্ষমা চেয়ে জো আলফানসের সাথে চলে গেল। প্রফেসরও বিদায় নিলেন। এডিথ ডেকহাউজের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি অন্ধকার সমুদ্রের দিকে।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জো প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার, আলফানস?”
আলফানস বলল, ‘বড় ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মি. স্টিফেন। মি. ডসন মারা গেছেন। তার মাথার পিছনে মোটা লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, থেঁতলে গেছে একেবারে।
জো আর এডিথ টেণ্ডার থেকে জেটিতে নামল। ককপিটে বসা লোকটাকে বলল, ‘তুমি অপেক্ষা কর আমি আসছি।’
এডিথ জো’কে বলল, ‘একাই আমি যেতে পারব, জো, একটা ট্যাক্সি নিয়ে।
জো জবাব দিল না। এডিথের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল নীরবে। অনেকটা
১৩৭
পথ অতিক্রম করে জো বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, এডিথ। সন্ধ্যা থেকে নানা হাঙ্গামায় তোমার দিকে মনোযোগ দিতে পারিনি। নিশ্চয়ই তুমি কিছু মনে করনি?’
এডিথ বলল, ‘তুমি মিথ্যেই কুণ্ঠিত হচ্ছ, জো। আমার কিছু মনে করার প্রশ্নই ওঠে না।’
কিন্তু আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনে। তোমাকে অবহেলা করে একটা সামান্য চোরের পিছনে ধাওয়া করা সত্যি আমার উচিত হয়নি। কাল তুমি নিশ্চয়ই আসছ, এডিথ লক্ষ্মীটি?
এডিথ মাথা নাড়ল। কাল নয়, জো। অন্য একদিন যাব তোমার ইয়টে।
না না। তোমাকে কালকেই আসতে হবে। কোনও মানা আমি শুনব না। কালই তো আমরা চলে যাচ্ছি। আর তুমিও যাচ্ছ আমাদের সাথে।
‘তা হয় না, জো। আমাকে অন্তত দু-একটা দিন. ভাবতে দাও।
কিন্তু সময় তোমাকে দিতে পারছি না। কালকে আমাকে যেতেই হবে। আর তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে,’ দৃঢ় স্বরে বলল জো।
‘তাতে তো আমার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এটা জীবনের একটা বড় সমস্যা। চিরদিনের জন্য তুমি আমাকে কিনে নিতে চাই। তোমার কাছে ব্যাপারটা তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু মেয়ে মানুষের জীবন যে একটাই।
তবুও তুমি কাল আসছ। ‘তুমি বড্ড বেশি নিশ্চিত হয়ে আছ। যেন ধরেই নিয়েছ। বেশ তাই হবে, জো। তোমার কথাই থাকবে।’
আর কোনও কথা হল না। নীরবে দুজন অতিক্রম করল বাকি পথটা। হোটেলের দরজায় পৌঁছে জো শুভরাত্রি জানাল এডিথকে। এডিথও জো’র শুভরাত্রি কামনা করল।
জো বলল, যদি দরকার হয় তাহলে তোমার জিনিসপত্র বাছাছদা করার জন্য একজন স্টুয়ার্ড পাঠাতে পারি সকালে।
না, তার দরকার হবে না। নিজেই করে নিতে পারব।
দশ
রাত একটা বেজে গেছে। দিনার্দ পুলিস স্টেশন নিস্তব্ধ। ইন্সপেক্টর দুবোঁয়া সামনে ফাইল খুলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। দরজা খোলার আর জুতোর মচমচ শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। চোখ দুটো ডলতে ডলতে দেখলেন, অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্থানীয় প্রধান শার্লস মরিয়া ও হারবার পেট্রোলের চীফ কনস্টেবল সোয়া রেগ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ১৩৮
চীফ কনস্টেবল রেগা হাসতে হাসতে বললো, কি হে ইন্সপেক্টর, ভয় পেলে নাকি? ভয় নেই, ভয় নেই, আমরা লাশ-টাস নিয়ে আসিনি। আর নক-আউট পাঞ্চ করে তোমাকে ধরাশায়ী করব না।
তার কথায় কান না দিয়ে ইন্সপেক্টর শার্লস ও রের্গাকে বসবার ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এতরাতে কোথা থেকে আসছ?’
‘আর বল কেন, তোমরা জেনারেল পুলিস তো ডায়েরী লিখেই খালাস। দুনিয়ার যত ঝক্কি পোহাতে হয় আমাদেরকে।’ দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল শার্লস মরিয়া।
| শার্লস মরিয়া লোকটা রোগা আর পাতলা। চৌকোণা লম্বাটে মুখ। থুতনিতে সামান্য দাড়ি। চুলের মাঝখানে সিঁথি। চোখে চশমা। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। সুযোগ্য অফিসার। গতকাল যে যুবতী চ্যানেলে নিহত হয়েছে তার তদন্তের ভার পড়েছে তার উপর।
ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘তা পুলিসের চাকুরি যখন নিয়েছ তখন ঝক্কি তো পোহবেই।’
চীফ কনস্টেবল রেগা প্যাকেট থেকে সিগারেট নিতে নিতে বলল, ‘শুধু ঝক্কি নয় হে, ইন্সপেক্টর। রীতিমত ভাবিয়ে তোলবার মত ঘটনা। এটা তোমার সেই বীচের আর দশটা প্রেম-ঘটিত হত্যাকাণ্ড নয়। আরও অনেক জটিল। অবশ্য প্রথমে আমারও প্রেম ঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা হয়েছিল, কিন্তু শার্লস ভায়াতদন্ত করতে গিয়ে যে সব ঘটনা জানতে পেরেছে তাতে ব্যাপার অত্যন্ত সাংঘাতিক বলে মনে হচ্ছে।’
ইন্সপেক্টর দুবোয়া শার্লসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শার্লস সঙ্গে করে নিয়ে আসা একটা ফাইল থেকে একটা চিঠি বের করে ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা পড়ে দেখ।’
| হাত বাড়িয়ে চিঠি নিয়ে পড়লেন দুবোঁয়া। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। চিঠিটা এসেছে প্যারিসের ফ্রেঞ্চ অপরাধ দমন বিভাগের সদর দফতর থেকে। তিন লাইনের চিঠি। তার মর্মার্থ হলঃ যারা সমুদ্রের তলে নিমজ্জিত জাহাজে লুণ্ঠন করে বেড়ায় তাদের একটা র্যাকেট মাস তিনেক হল দিনার্দ হারবারে অবস্থান করছে। তাদের খোঁজ খবর করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
| চিঠি ফেরত দিয়ে ইন্সপেক্টর বলল, কিন্তু গতকালকের হত্যাকাণ্ডের সাথে ঐ পাইরেটদের সম্পর্ক আছে এ ধারণা তোমার হোল কেন? তা না-ও তো হতে পারে?
‘ব্যাপারটা জানতে পারি অনেক”। আকস্মিক ভাবে। এতে আমার তেমন কৃতিত্ব নেই।
| ‘কি রকম?’ ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন।
১৩৯
‘দুপুরে একটা বেনামী টেলিফোন কল পেয়েছিলাম। তাতেই কুটা পাওয়া গেল। টেলিফোনকারী অবশ্য গতরাতে নিহত মেয়েটার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। পরিচয়টা দিয়েই লাইন কেটে দিল।
‘টেলিফোনটা যে করেছিল সে কি পুরুষ না স্ত্রীলোক?’ ‘পুরুষ।
কর্কশ কণ্ঠস্বর, কেমন খন খনে আর একঘেয়ে? তা তো মনে হল না।’ কি বলল সে?’
‘মেয়েটার নাম এথেল ফাউলার। ইংরেজ মেয়েটা হোটেল ডি স্যানিওতে থাকত। মাস তিনেক হল দিনার্দে এসেছে। তখন থেকে ঐ হোটেলেই আছে। অত্যন্ত রাশভারী ধরনের মেয়ে। গম্ভীর। বড় একটা কারও সাথে মিশত না। সব রকম হৈ-চৈ হুলোড় এড়িয়ে চলত। মদ পর্যন্ত খেত না। কখনও-সখনও একটা হিপ্পি এসে দেখা করে যেত। তাও পাঁচ দশ মিনিটের জন্য। থামল শার্লস। | সিগারেটে টান দিয়ে বলল, হোটেলে মেয়েটার রুমে পাসপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। তাতে ঠিকানা ছিল। তখনি রেডি ও ফোটোতে পাসপোর্টের ছবি পাঠিয়েছিলাম স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে। কিছুক্ষণ আগে জবাব এসেছে। সে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেরই এক প্রাক্তন অফিসারের সন্তান। ভদ্রলোক এক ডিপসী পাইরেট দলের হাতে খুন হয়েছিলেন। মেয়েটা তখন অক্সফোর্ডে রিচার্স করত। বাবার হত্যাকাণ্ডের পর সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সম্ভবত তখনি সে কন্টিনেন্টে চলে আসে। আমার ধারণা সে তখন থেকেই প্রতিশোধ নেবার জন্য পিতার হত্যাকারীর পিছনে পিছনে ঘুরছে। আর যে ডিপসী র্যাকেটের হাতে ওর বাবা খুন হয়েছিলেন সম্ভবত সেই দলটাই এখন দিনার্দে এসেছে। মেয়েটাও এসেছে পিছনে পিছনে।
‘এতে নিশ্চিত ভাবে কিছু প্রমাণিত হয় না। ইন্সপেক্টর দুবোঁয়া বললেন।
মৃদু হাসল শার্লস। বলল, অবশ্যই হয় না, কিন্তু সন্দেহ করা চলে এবং সেই সন্দেহকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাওয়া চলে। তাছাড়া, মেয়েটার রুমে.যে সব কাগজ পত্র পাওয়া গেছে তাতে আমার ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। কয়েকটা মানচিত্র পাওয়া গেছে মেয়েটার রুমে বিভিন্ন সাগর মহাসাগরের। অতীতে যেখানে। যেখানে ধনরত্নবাহী জাহাজ ডুবেছে, মানচিত্রগুলোতে সেই সব স্থান আঁকা আছে। ডিপসী পাইরেটরা যে সব ডুবে যাওয়া জাহাজ লুঠ করেছে তাদের একটা তালিকা পাওয়া গেছে। আর একটা তালিকায় আছে যে সব ডুবে যাওয়া জাহাজ এখনও উদ্ধার করা হয়নি তার নাম।
তাহলে তো তোমার ধারণাই নির্ভুল বলে মনে হচ্ছে, ইন্সপেক্টর অবশেষে স্বীকার করেন।
শার্লস বললেন, “আমার ধারণা হারবারের মেয়েটা সেই পাইরেট দলের
১৪০
আস্তানাতেই হানা দিতে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই সুইমস্যুট পরে গভীর রাতে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে চ্যানেল ক্রস করতে নামেনি বা অভিসারে বেরোয়নি। নিশ্চয়ই তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল।
ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া ভীতিমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, তাহলে তো সত্যি বড় বিপদের কথা। তোমাকে খুব সাবধানে এগোতে হবে, হে শার্লস। আমি যতদূর শুনেছি এই ডিপসী পাইরেটা যেমন ধূর্ত তেমনি হিংস্র। আজ পর্যন্ত এদের কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। বরং ওদের কবলে অনেক পুলিস অফিসার প্রাণ হারিয়েছে। খুব সাবধান, শার্লস। খুব সাবধান।
| ‘থাক, তোমার আর আমাকে সাবধানতা শেখাতে হবে না। এখন তোমার এদিকের খবর কি তাই বল। ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেয়েছ?
| ‘মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর। বললেন, ‘ও তো জানা কথাই। ঊরুতে গুলি লেগেছে। একটা শিরা ছিঁড়ে গেছে। প্রচুর রক্তপাতে মারা গেছে।
‘যে লোকটা মেয়েটার লাশ নিয়ে এসেছিল তার কোনও সন্ধান পাওয়া গেল? হোটেল রিজে নিশ্চয়ই তাকে পাওয়া যায়নি? মিথ্যা ঠিকানা দিয়েছিল নিশ্চয়ই কি
নাম লোকটার?’
‘মি. ল্যাম্প। ঠিকানাটা মিথ্যা দেয়নি। হোটেল রিজে তার নামে একটা সুইট আছে বটে। মাসখানেক আগে রিজার্ভ করা হয়েছে। সে দিন তিনেক ওখানে কাটিয়েছে। পরে সেখানে আর যায়নি। কিন্তু সুইটের ভাড়া অগ্রিম দেওয়া আছে দু’মাসের। ম্যানেজার বললেন, “মি. ল্যাম্প বৃটিশ পাসপোর্ট নিয়ে এলেও সে সম্ভবত কোনও কমনওয়েলথ কাস্ট্রির লোক। এখনও সে দিনার্দেই আছে বলে ম্যানেজার জানালেন। গতকাল উনি হারবারে গিয়েছিলেন। একটা ইয়টের ডেকে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। তবে ইয়টের নামটা স্মরণ করতে পারলেন না।
বল কি?’ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চীফ কনস্টেবল রেগা। তুমি নিশ্চয়ই রিজ হোটেলের ম্যানেজারকে নিয়ে হারবারে গিয়েছিলে?’
মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর। তা আর হল কই? ম্যানেজার ভদ্রলোক জরুরী কাজে প্যারিস যাচ্ছিলেন ঐ সময়ই। কিছুতেই তাকে আটকাতে পারলাম না। অবশ্য আমার ধারণা উনি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলেন। এসব ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে আবার হোটেলের বদনাম হয় কিনা।’
‘তাকে গ্রেফতার করলে না কেন?’
তাতে লাভ হত না। বরং ভদ্রলোক কথা দিয়েছেন আগামী পরশু প্যারিস থেকে ফিরে এসেই তিনি আমাকে নিয়ে হারবারে যাবেন। তবে দিনে নয়, রাতে। তাঁর ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। উপায় নেই।
‘কিন্তু তার আগেই হয়ত পাইরেট দলটা বন্দর ছেড়ে যাবে।’ হতাশ হয়ে ধপাশ করে আবার বসে পড়লেন চীফ কনস্টেবল। আমার মনে হয় ল্যাম্প নামের
১৪১
লোকটাই ডিসী পাইরেট দলের লোক। দলপতিও হতে পারে। আর সে নিজেই বোধহয় খুন করেছে।’
| ‘আমি তো এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত যে ঐ লোকটাই মেয়েটাকে খুন করেছে। ইন্সপেক্টর সায় দিলেন।
‘তোমরা দুজনই বেশ হাসির কথা বলছ। এরকম কাকতালীয় সিদ্ধান্ত কি করে তোমাদের মগজে এল?’ ব্যঙ্গ করল শার্লস। যে লোকটা খুন করেছে সে নিজে লাশ বয়ে এনেছে থানায়, এরকম কথা শুধু ডিটেকটিভ কাহিনীতেই শোনা যায়। রিয়াল লাইফে তা ঘটে কদাচিৎ।’
| ‘কেন, তুমি এটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিতে চাও? ফয়েরের ক্রিমিনোলজিতে আছে…’ ইন্সপেক্টর চটে গিয়ে বললেন।
রাখ তোমার ফয়েরের ক্রিমিনোলজি।’ আর লোকটার গায়ে কি অসুরের মত শক্তি। তুমি…’
হো হো করে হেসে উঠল শার্লস। বিব্রত ও ক্রুদ্ধ হলেন ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া। রেগে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘তু-তু-তুমি ব্যাপা-ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দিতে চাও?’
হাসি থামিয়ে শার্লস বলল, শক্তি যদি অপরাধ হয় তাহলে হারকিউলিস, রুস্তম থেকে শুরু করে জৈা লুই পর্যন্ত সবাই অপরাধী।
ইন্সপেক্টর বললেন, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি, আমার বক্তব্য হল…’
টেলিফোনটা বেজে উঠল এই সময়। ইন্সপেক্টর তাঁর বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই রিসিভার ধরলেন, “দিনার্দ পুলিস স্টেশন, ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া বলছি। ও হ্যাঁ, মঁসিয়ে রেগা। আছেন এখানে, ধরুন।
ইন্সপেক্টর ইশারায় চীফ কনস্টেবল রেগাকে রিসিভার ধরতে বললেন। রিসিভারটা তুলে বললেন, ‘হ্যালো…রেগাঁ বলছি। হা-হা…। আচ্ছা আসছি। আমরা। এক্ষুণি আসছি।’
রিসিভার রেখে দিয়ে চীফ কনস্টেবল বললেন, নাও, ওঠ এবারে। চ্যানেলে আর একটা লাশ ভাসছে। তুমিও চল ইন্সপেক্টর। শার্লস, যাবে নাকি তুমি?’
‘সেটা ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে আমি নিজেকে প্রকাশ্যে এসব খুনোখুনির সাথে জড়িয়ে ফেলতে চাই না। আমি আপাতত গোপনেই কাজ করব।’
তিনজন উঠে দাঁড়াল। শার্লস বলল, এক মিনিট রেগা, তোমাকে কতগুলো খবর জোগাড় করতে হবে।
‘বল।’
প্রথমত, হারবারে এখন যে সব জাহাজ আছে তার তালিকা হারবার অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। প্রত্যেকটা জাহাজের ঠিকুজি-কুষ্ঠি যতদূর সম্ভব জানতে চেষ্টা করতে হবে। ঠিক তিনমাস আগে কোন্ কোন্ জাহাজ হারবারে এসেছে এবং
১৪২
এখনও আছে তার একটা পৃথক তালিকা চাই। গতকাল কোন্ কোন্ জাহাজ হারবার ছেড়ে গেছে তা জানতে চেষ্টা করবে, সম্ভব হলে কোন্দিকে জাহাজগুলো গেছে তাও.। আগামীকাল থেকে যে সব জাহাজ বন্দর ছাড়বে সেগুলোর নামের একটা তালিকা তৈরি করবে।’
বেশ। আর কিছু? ** ‘আপাতত এই পর্যন্ত। আর হারবার পেট্রল আরও জোরদার করতে হবে।’
তথাস্তু।’
এগার।
স্ক যেন এক ফিরে কুয়া দিতে
ঘুম ভাঙতেই পোর্ট হোলের ভিতর দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দিল কুয়াশা। সকাল হয়ে গেছে। উজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। ঘড়িতে দেখল আটটা বাজে। দ্রুত শয্যা ত্যাগ করল কুয়াশা। আধঘণ্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ করে কাপড় বদলে তৈরি হয়ে নিল সে। সিগারেট ধরিয়ে ডেকে গিয়ে দাঁড়াল। অদূরে রোদের আলো রোজমেরীর গায়ে ঠিকরে পড়ছে। ডেকে একটা লোকও দেখতে পেল না কুয়াশা। কি যেন একটা সন্দেহ হল তার মনে।
| সেলুনে ফিরে কুয়াশা ফিল্ড গ্লাস বের করল। ফিল্ড গ্লাস লাগিয়ে পোর্ট হোলের ভিতর দিয়ে রোজমেরীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রোজমেরীর ডেক হাউসের ছায়ায় হাঁটুর উপর বিনকিউলার নিয়ে একজন বসে আছে। কুয়াশার মনে হল লোকটার দৃষ্টি তার পোর্ট হোলের দিকেই নিবদ্ধ।
ফিন্ড গ্লাসটা রেখে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা। তাহলে তার সম্পর্কে জো এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে। এখন আর লুকোচুরির বালাই নেই। লড়াই হবে এবার সামনাসামনি।
কিন্তু কিছু একটা করতে হবে এডিথের জন্যে। জো শুধু যে তার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে তাই নয়, সম্ভবত সে এডিথের উদ্দেশ্যও নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পেরেছে। এডিথ একবার যদি জো’র খপ্পরে পড়ে তাহলে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠবে, না। অথচ মেয়েটাকে যেমন করে হোক বাঁচাতেই হবে। ভবিষ্যতে রোজমেরীতে যেতে বাধা দিতে হবে তাকে।
ফোন করে নিষেধ করতে হবে। এডিথের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। দি ফগের দিকে জো যেমন লক্ষ্য রেখেছে তেমনি হোটেল ডি এলিসাতেও নিশ্চয়ই ছড়িয়ে রেখেছে অনেক লোক। ছদ্মবেশ পরে যাওয়া হয়ত চলে, কিন্তু যে কেউ এডিথের সাথে দেখা করলেই ওর উপর সন্দেহ বেড়ে যাবে। ফলে কামালকে পাঠালেও কোনও লাভ হবে না। তাছাড়া তাকে হয়ত চিনেও ফেলতে পারে। ভাগ্যের জোরে আর এক অজ্ঞাত বন্ধুর কৃপায় কামাল রোজমেরী থেকে পালিয়ে
১৪৩
আসতে পেরেছে।
| কুয়াশা দি ফগে ফিরবার আধঘণ্টা পরেই শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় ফিরেছে কামাল। সুস্থ হয়ে ওঠার পর জো স্টিফেনের ইয়টেই তার পরম শত্রু আছে জানতে পেরে কুয়াশা অবাকও হয়েছে খুশিও হয়েছে। কুয়াশার ধারণা যে হিপ্লিটা গতকাল তাকে অনুসরণ করেছিল সম্ভবত সে ই কামালকে রোজমেরী থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। সন্দেহ নেই লোকটা জোর নির্দেশেই তাকে অনুসরণ করেছিল। কিন্তু তার নিজেরও বোধহয় কোনও উদ্দেশ্য ছিল, সেই উদ্দেশ্যটা অসাধু নাও হতে পারে।’
বাইরে খুক খুক কাশির আওয়াজ পাওয়া গেল। কুয়াশা শব্দ শুনে বুঝল চার্লি বাইরে অপেক্ষা করছে। সে ডাকল, চার্লি।’
‘জ্বি,স্যার। ‘মি, আহমেদ কি এখনও ঘুমোচ্ছেন? ‘জ্বি, স্যার। . তাকে ডেকে তুলে প্রস্তুত হয়ে নিতে বল। আর ইয়টটা আজকে ধুয়ে ফেলা দরকার, কি বল?’
নিশ্চয়ই, স্যার। ‘তাহলে মি. আহমেদকে ডেকে দিয়ে তুমি নোঙর তুলে ফেল।’
ন’টার সময় চ্যানেল ছেড়ে সমুদ্রের দিকে এগোল দি ফগ। মাইল খানেক ঘুরে যেখানে গিয়ে দি ফগ নোঙর করল সেখান থেকে রোজমেরীকে দেখা যায় না। এতক্ষণ চারদিকে খেয়াল রেখেছে কুয়াশা। কেউ তার বোট অনুসরণ করছে না। এটা বীচের পূর্ব প্রান্ত। জায়গাটার নাম পেজ দ্য একলুজ। হুইল ছেড়ে ডিঙিতে নামল কুয়াশা।
| কামাল ততক্ষণে চার্লির বীচ রোব পরে ফেলেছে। কুয়াশার পিছনে পিছনে সে-ও ডিঙিতে নামল। কুয়াশা বলল, তুমি বীচেই থাকবে। অন্তত আধঘণ্টা পরে যাবে হোটেলের দিকে। তার আগে নয়।’
মিনিট তিনেক পরে সূর্য আনার্থীদের ভিড়ে মিশে গেল কুয়াশা। কামালকে পিছনে ফেলে সে একটা ক্যাসিনোতে ঢুকল। এডিথকে টেলিফোন করতে হবে।
| ফোনে এডিথকে পাওয়া গেল না। কাউন্টার ক্লার্ক বলল, ‘মিস গ্রে এইমাত্র বেরিয়ে গেছেন। কোনও মেসেজ থাকলে দিতে বলে গেছেন। আর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনার নামটা বলতে পারেন। সেই রকমই বলে গেছেন মিস গ্রে। বাই দা ওয়ে উনি প্রফেসর রোজেনবার্গের বক্তৃতা শুনতে গেছেন জিওগ্রাফি সোসাইটিতে।
‘আমার নাম জন আর্থার ফগ। মিস গ্রেকে জানাবেন।
“ওহ আপনি মি. ফগ? আপনার জন্য মিস গ্রে একটা মেসেজ রেখে গেছেন।
১৪৪
ড্রয়ার গেল কুয়াশার খামটা উত্তর, এবিয়াশা।
যদি দয়া করে এসে নিয়ে যান।
‘ও কে, আমি আধঘণ্টার মধ্যেই আসছি।’
পঁচিশ মিনিট পরে হোটেল ডি এলিসার কাউন্টারে পৌঁছুল কুয়াশা। কাউন্টার ক্লার্ক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। কুয়াশা অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, জন আর্থার ফগ।
প্রাচীন কাউন্টার ক্লার্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুয়াশাকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর ড্রয়ার থেকে সীলমোহর করা একটা এনভেলাপ বের করে দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল কুয়াশা।
ট্যাক্সিতে উঠেই খামটা ছিঁড়ে ফেলল কুয়াশা। একটা ছোট চিরকুট। তাতে লেখাঃ অক্ষাংশ, ৪৯°৪১°৫৬ উত্তর, দ্রাঘিমা ২২৩°৪৫° পশ্চিম। ছিঁড়ে ফেলুন।
টুকরো করে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলল কুয়াশা। ট্যাক্সির অ্যাসট্রের মধ্যে ফেলে দিল টুকরোগুলো।
বীচে ফিরে গেল কুয়াশা। অসংখ্য নরনারীর ভিড়। চিৎকার, হৈ চৈ বেদম চলছে। একটা ক্যাসিনোর দিকে এগোল কুয়াশা। গলাটা শুকিয়ে গেছে, ভিজিয়ে নিতে হবে। ক্যাসিনোতে ঢুকেই সে অবাক হল। জো আর সেই হিপ্পি বসে আছে। জোর দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। চোখে চোখ পড়তেই জো তাকে হাত তুলে ইশারা করল। কুয়াশা মৃদু হেসে এগিয়ে গেল।
| কুয়াশাকে একটা চেয়ারে বসবার ইশারা করে জো তার স্বভাবসুলভ কর্কশ কণ্ঠে বলল, “আমি সকালে গিয়েছিলাম আপনার খোঁজ করতে। আপনার ইয়টটাই দেখতে পেলাম না।
‘ওয়াশ করতে নিয়ে গিয়েছিলাম,’ ঢোক গিলল কুয়াশা। প্রফেসর কোথায়?
‘উনি গেছেন জিওগ্রাফি সোসাইটিতে বক্তৃতা দিতে। আমারও যাবার কথা ছিল, কিন্তু একটা জরুরী কাজে আটকে পড়েছিলাম। অবশ্য পেপারটা আমি আগেই পড়েছি। মিস গ্রেও গেছেন প্রফেসরের বক্তৃতা শুনতে।’
| ‘কে গেছেন?’ কুয়াশা প্রশ্ন করল। কোন মিস গ্রে?’ হুইস্কিতে সোড়া মেশাতে মেশাতে নির্বিকারভাবে বলল, ‘মাফ করবেন, আমি ঠিক চিনতে পারছি না। কে এই ভদ্রমহিলা?’
‘কাল ক্যাসিনোতে যিনি আমাদের সাথেও অত্যন্ত দুঃখিত। আমারই ভুল হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল গতকাল যখন আমাদের দেখা হয়েছিল মিস গ্রে তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। উনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন প্রফেসর রোজেনবার্গের এক্সপেরিমেন্ট দেখতে। অত্যন্ত দুঃখিত, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি আমার দার্শনিক বন্ধু মঁসিয়ে গুস্তভ আতোয়ান। উনিও আমাদের সঙ্গী হবেন। ইনি মি. ফগ।
কুয়াশা আর আতোয়ান অভিবাদন বিনিময় করল। ১০-
১৪৫
য়েছিল, তাই ধারণা জো, মি,,
আতোয়ান এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। নীরবে গ্লাসে চুমুক দিয়েছে আর ওদের কথা শুনেছে। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল কুয়াশার দিকে নিবদ্ধ। কুয়াশা জানে, লোকটা তার শক্তি যাচাই করছে।
আতোয়ান জিজ্ঞেস করল, ‘জো, মি. ফগও কি আমাদের সঙ্গী হচ্ছেন?’
‘আমার তো তাই ধারণা। সেটা জানবার জন্যেই তো সকালে ওঁর খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। মি. ফগ, আপনি নিশ্চয়ই আপনার সিদ্ধান্ত পাল্টাননি?
‘মোটেও না। কিন্তু যাত্রা করছেন কবে?’
কাল রওনা দেব আমরা। আজকে রাতে আমরা প্রফেসর রোজেনবার্গের অভিযানের সাফল্য কামনা করে একটা ডিনার দিচ্ছি। অবশ্যই অতিথির সংখ্যা সীমাবদ্ধ। মি. ফগ, আপনি অবশ্যই আসছেন আমাদের ডিনারে।
সানন্দে। কিন্তু কোথায়?’
‘এই ক্যাসিনোতেই। সেই ব্যবস্থা করতেই এখানে এসেছিলাম। প্রফেসর আর মিস গ্রে এক্ষুণি এখানে আসবেন। ওদের জন্যে অপেক্ষা করছি।’
কিন্তু আমাকে ক্ষমা করতে হবে, মি. স্টিফেন। আমি এবারে উঠব।’ উঠে। দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল কুয়াশা।
‘আসছেন কিন্তু ডিনারে। | ‘অবশ্যই।’ ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা। দু’জোড়া দৃষ্টি তাকে পর্যবেক্ষণ করছে তা সে জানে। কিন্তু তাদের একজনকে ভয় পাবার কিছু নেই।
বার
বিরাট হলঘর ভর্তি শ্রোতা। প্যারিস ইনস্টিটিউট অব জিওগ্রাফির ছাত্রদের জন্য দিনার্দ জিওগ্রাফি সোসাইটি প্রফেসর রোজেনবার্গের এই বক্তৃতার আয়োজন করেছে। বক্ততার বিষয় : মহাসাগরের অতলে।
সামনের সারিতে বসেছিল এডিথ। জো স্টিফেন বক্তৃতা শুনতে না আসায় খুশি হয়েছিল সে। মন দিয়ে প্রফেসরের বক্তৃতা শুনছিল। প্রফেসর বক্তৃতা দেন অপূর্ব। গলাটা চমৎকার, ভাষা সুন্দর আর প্রকাশভঙ্গী মনোজ্ঞ। মুগ্ধ হল এডিথ।
প্রফেসর বললেন, ‘এই মহাশূন্য যুগেও কিন্তু আমাদের নিজেদের গ্রহ সম্পর্কে আমরা সবটা জানি না। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জলাভূমি। এই জলাভূমির অতলে কি আছে আমরা তার কতটুকুই বা জানি? সেখানে যেমন আছে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ তেমনি আছে বিপুল খাদ্য সম্ভার আর আছে হাজার হাজার অজ্ঞাত প্রাণী। আজকের পৃথিবীর জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে তাতে করে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে মহাসাগরের অতলের খাদ্যসম্ভারের দিকে। আমার বিশ্বাস মহাসাগরগুলোর অতলে যে বিপুল খাদ্যসম্ভার
১৪৬
আছে তা যেমন সমগ্র পৃথিবীর মানুষের ক্ষুধা দূর করতে সহায়তা করবে তেমনি সেখানকার খনিজ দ্রব্যও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। মানুষের জ্ঞানের সীমাও সম্প্রসারিত হবে। মহাসাগরের অতল গর্ভে এমন অনেক প্রাণী আছে, মানুষ এখনও যাদের কথা শোনেনি। হয়ত তারা কোনদিনই সূর্যের আলোর দেখা পায়নি। হয়ত সারা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বাইওগ্লবিন নিয়েই জন্মেছে।
সমুদ্রের সেই অতলে হয়ত দেখা মিলবে সী সার্পেন্টের। যুগ যুগ ধরে মানুষ যার সম্পর্কে কল্পনা করে এসেছে।’
প্রফেসরের কণ্ঠ স্বপ্নালু হয়ে উঠল।
মাঝেমাঝে ফ্লাশগান জ্বলে উঠছে। পিছনের দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল ছাত্ররা বক্তৃতা নোট করছে।
প্রফেসর বলে চলেছেন, ‘মহাসাগরের অবতরণ নিয়ে আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আমি নিজেও যৎসামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল হলে, আশা করি, মহাসমুদ্রের গভীরতম স্থানে অবতরণ কিছু দিনের মধ্যেই সম্ভব হয়ে উঠবে।’
বিপুল করতালির মধ্যে প্রফেসরের বক্তৃতা শেষ হল। তিনি ডায়াস থেকে নামতেই একদল সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। এডিথ অতিকষ্টে সাংবাদিকদের ব্যুহ ভেদ করে বের করে আনল প্রফেসরকে। বিব্রত প্রফেসর ধন্যবাদ জানালেন এডিথকে।
এক সাংবাদিক এডিথকে প্রশ্ন করল, মাফ করবেন। প্রফেসরের সাথে আপনার সম্পর্ক জানতে পারি?
‘আমি ওঁর ছাত্রী। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট বলতে পারেন। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বলল এডিথ।
ডিনারেই জো কুয়াশার সাথে এডিথকে আলাপ করিয়ে দিল, ইনি মি, জন আর্থার ফগ। আমার নতুন বন্ধু। ইনি মিস এডিথ গ্রে, আমার বান্ধবী।
‘হাউ ডু ইউ ডু।
হাউ ডু ইউ ডু।’
চমৎকার অভিনয় করল এডিথ। সুন্দর করে সেজে এসেছে সে। প্যারিসের শ্রেষ্ঠ ফ্যাশন হাউজের ম্যানিকুইন বলে মনে হচ্ছিল ওকে ক্যাসিনোর উজ্জ্বল নীলাভ আলোয়। ক্যাসিনোতে গাদা গাদা মেয়ের মধ্যে অনন্যা বলে এডিথকে মনে হল কুয়াশার।
এডিথ কুয়াশা আর প্রফেসরের মাঝখানে বসল। রসনাতৃপ্তিকর চমৎকার খাবার। প্রফেসর একাই ডিনার টেবিল সরগরম করে রাখলেন। জো, আতোয়ান
১৪৭
আর কুয়াশা–এরা বড় একটা কিছু বলল না। নীরবে খেতে খেতে প্রফেসরের কথা শুনল আতোয়ান। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। খাওয়া শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ গল্প গুজব হল। একসময় এডিথ প্রস্তাব করল, আসুন, মি. ফগ। একটু নাচা যাক।
অপ্রস্তুত হল কুয়াশা। এডিথ এমন বেয়াড়া প্রস্তাব করতে পারে এর আগে ভেবে দেখেনি কুয়াশা। ঢোক গিলে কুয়াশা বলল, আমাকে বলছেন, মিস গ্রে? আমি অত্যন্ত দুঃখিত। পায়ে একটা ব্যথা আছে। আমার পক্ষে নাচাটা বোধহয় সম্ভব হবে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।’
‘কিছু ক্ষতি হবে না, আমি বলছি। আসুন।’ আবদার করল এডিথ।
কুয়াশার দুরবস্থা অনুভব করে বোধহয় প্রফেসরের মায়া হল। তিনি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন, মিস গ্রে। আমার সাথে। আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে।’
‘সেই ভাল। আমি বরং আপনাদের নাচ দেখি।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল কুয়াশা।
দ্রুত সুরে বেজে চলেছে ওয়ালজের সুর। গুচ্ছের জোড়া জোড়া মেয়ে পুরুষ নাচছে। প্রফেসর ও এডিথ তাদের সাথে মিশে গেল।
জো, আতোয়ান ও কুয়াশা আবার গ্লাস ভর্তি করল। এক রাউণ্ড শেষ হতেই চলে এলেন প্রফেসর। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বসতে বসতে লজ্জিত কণ্ঠে বললেন, ‘ওই গড, নাচটা একদম ভুলে গেছি। কতদিন অভ্যাস নেই।’
কুয়াশা প্রফেসরের গ্লাস ভর্তি করে দিল। এডিথ তখন অন্য একজনকে পাকড়াও করে নাচছে। | প্রফেসর কিছুক্ষণ পরেই বললেন, ‘মাফ করবেন, মি. ফগ, আমাকে এবার উঠতে হবে।
জো দ্রুত বলল, আমি দুঃখিত, মি. ফগ। প্রফেসরের অনেক কাজ। আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না। আতোয়ান, তুমি প্রফেসরকে নিয়ে চলে যাও।
আমি একাই যেতে পারব, মি. স্টিফেন। প্রফেসরের কণ্ঠে বিরক্তির আভাস।
‘তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আতোয়ানকেও ফিরতে হবে ইয়টে।’ জো তার স্বভাবসুলভ কর্কশ কণ্ঠে বলল।
‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখিত। আসুন, সঁসিয়ে, আমরা এগোই।’
আততায়ান কুয়াশার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। জো কুয়াশাকে বোঝাল, প্রফেসর রোজেনবার্গ অত্যন্ত ভুললামন। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে যাবে তার ঠিক নেই। সঙ্গে কাউকে না কাউকে সবসময় রাখতেই হয়।’
কুয়াশা জবাবে শুধু হাসল। ক্যাসিনোতে নারী বিবর্জিত পুরুষরা হচ্ছে লা-ওয়ারিশ মাল। কুয়াশা ও
–
১৪৮
জো’কে নারীসঙ্গীহীন অবস্থায় বসে থাকতে দেখে জনাকয়েক তরুণী ছুটে এল ওদের দিকে। কুয়াশা অতি কষ্টে নাচের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও জো বিনা আপত্তিতে রাজি হয়ে গেল।
| নাচের তখন আর এক রাউণ্ড শেষ হয়েছে। নতুন রাউণ্ড শুরু হবার আগেই এডিথ এসে কুয়াশার সামনে বসল। কুয়াশা হাসল। সে জানে এডিথ এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
অনেকক্ষণ নেচে এডিথ পরিশ্রান্ত হয়েছিল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল এডিথ। কুয়াশা একটা গ্লাস ভর্তি করে ওর দিকে এগিয়ে দিল। জো তখন এক
এডিথ। কৃস্থলপ্ত হয়ে নেচে চলেংতুলল এডিথ। দুই-এক
| ধন্যবাদ জানিয়ে ঠোঁটে গ্লাস তুলল এডিথ। দুই-এক চুমুক দিয়ে এডিথ বলল, ইউ আর রিয়েলী, গ্র্যাণ্ড, মি. ফগ।
| প্রশংসা কানে তুলল না কুয়াশা। অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কাল কখন ফিরেছিলেন, মিস গ্রে?’
‘রাত একটার দিকে। আসতে কি দিতে চায়। কত খোশামোদ।’ চোখ দুটো বড় বড় করে গ্রীবাভঙ্গী করল এডিথ।
কুয়াশা হেসে বলল, ‘থেকে গেলেই পারতেন। ‘আজ রাতে আবার যাবার কথা ছিল।
যাবেন নিশ্চয়ই?’
মাথা নাড়ল এডিথ, কাল যাব বলেছি। কালকেই ওরা যাবে সেন্ট পিটার পোর্টে। সেখানেই প্রফেসরের বার্থিস্টল পরীক্ষা করা হবে। আপনি নিশ্চয়ই যাচ্ছেন?’
হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। কিন্তু আপনি অবশ্যই যাচ্ছেন না। দৃঢ় গলায় বলল। কুয়াশা।
তার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায় চমকাল এডিথ। কুয়াশার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তা হয় না, মি, ফগ। যেতে আমাকে হবেই। আমার মন বলছে জোর দিন ঘনিয়ে আসছে। আর তার সর্বনাশটায় যদি নিজে অন্তত কিছুটা অংশ নিতে না পারি তাহলে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে না। প্লীজ, মি, ফগ, বাধা দেবেন না আমাকে।’
কুয়াশা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু খুব সাবধানে থাকবেন।’
আপনি থাকতে আমি কোনও কিছুতেই ভয় পাই না।’
কুয়াশা বলল, ওটা বোকামি। সাবধানের মার নেই। আপনার অসাবধানতার ফলে কিছু একটা ক্ষতি হয়ে গেলে তখন আমার করবার কিছুই থাকবে না।’
‘আমার মেসেজ পেয়েছিলেন?
১৪৯
মাথা নাড়ল কুয়াশা। বলল, কাজটা কিন্তু বোকার মত হয়েছে। ওটা জো’র হাতে পড়তে পারত।
এডিথ সে-কথা কানে না তুলে বলল, ওটাতে কি আছে আমি নিজে কিন্তু তা জানি না। চার্টটা দেখে আমি অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমা বের করে টুকে রেখেছিলাম কাল রাতেই। ওখানে কি কোনও জাহাজ ডুবেছে?’
ঠিক বুঝতে পারছি না। খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি, ওখানে কখনও কোনও জাহাজ ডুবেছে এমন কোনও তথ্য কোথাও পাইনি। আমার ধারণা এখানেই আছে জো’র গোপন ধনাগার।’
এডিথের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, মি, ফগ, আমিও তাহলে কিছু কিছু ভালো কাজ করতে পারি।’
“নিশ্চয়ই পারেন, মিস গ্রে,’ স্বীকার করল কুয়াশা।
এরপরও কি আপনি আমাকে রোজমেরীতে প্রফেসর রোজেনবার্গের অভিযানে যোগ দিতে নিষেধ করবেন?
কুয়াশা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘নিষেধাজ্ঞা তো আগেই প্রত্যাহার করেছি, মিস গ্রে।’
‘অন্তর থেকে করেননি।’
হেসে ফেলল কুয়াশা। সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, কামালের খবর শুনেছেন কিছু, মিস গ্রে?’
না তো। কেন, কিছু হয়েছে?’ ভীত কণ্ঠে বলল এডিথ।. গতরাতের ঘটনা খুলে বলল কুয়াশা।
সমস্তটা শুনে খুশিতে উপচে পড়ল এডিথ। তাহলে, তাহলে রোজমেরীতেও—’
জুতোর উপর জোর একটা চাপ অনুভব করতেই থেমে গেল এডিথ।
‘এই যে মিস্টার স্টিফেন ফিরে এসেছেন এতক্ষণে। সময়টা নিশ্চয়ই চমৎকার কাটল আপনার?’ কুয়াশা হাসিমুখে প্রশ্ন করল।
জো বসতে বসতে বলল, মন্দ নয়। তুমি আমার সাথে নাচবে, এডিথ? কর্কশকণ্ঠে অনুনয় করল জো। | এডিথ রাজি হয়ে গেল।
তের
কুয়াশার ডিঙি নিঃশব্দে দি ফগের পিছনে ভিড়ল। চারদিকে গভীর অন্ধকার। ডেক থেকে মলিন নীল আলো দি ফগের চারদিকের অন্ধকারকে ঈষৎ ঘুচিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। নিঃশব্দে ডেকের উপর উঠল কুয়াশা। ডিঙিটাকে বাঁধল দি ফগের সাথে। ১৫০
সংশ-স।
খসখসে একটা শব্দ ভেসে এল ইয়টের সামনের দিক থেকে। কুয়াশার মনে হল তার স্টাডি থেকে শব্দটা আসছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। শব্দটা আর পাওয়া গেল না। ‘
ঝন ঝন ঝনন।
সরোদের ঝংকার। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দটা। সরোদের তারে আঘাত লেগেছে। কেউ নিশ্চয়ই ঢুকেছে তার স্টাডিতে। কে হতে পারে? নিশ্চয়ই বোকা চার্লিটা। রাতদুপুরে ঘর গোছাতে লেগেছে।
নিঃশব্দে স্টাডির দিকে এগোল কুয়াশা। কিচেনের পাশ দিয়ে যেতেই আধো অন্ধকারে দেখতে পেল দরজাটা ভোলা। ডেকের অনুজ্জ্বল আলো পড়েছে কিচেনের মেঝেতে। চমকে উঠল কুয়াশা, কে যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নিচু হয়ে লোকটার মুখ দেখবার চেষ্টা করল। লোকটা আর কেউ নয়, তারই বাটলার চার্লি। চার্লির হাতের কাছে ছোট একটা লোহার রড। | মুহূর্তে আগুন ধরে গেল কুয়াশার মাথার মধ্যে। আরও ভাল করে দেখল কুয়াশা চার্লিকে। চিৎ করে শোয়াল। বাঁ হাতের শার্টের হাতাটা রক্তে ভেজা। হাতাটা সরিয়ে দেখল গুলি লেগেছে হাতে। কিন্তু ক্ষতটা গভীর নয়। চামড়া ছুঁয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। রক্ত পড়েছে বিস্তর। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। আরও দু-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করা চলবে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে চার্লির।
আস্তে আস্তে ঝাঁকুনি দিল চার্লিকে। মাথার চুলগুলো নেড়ে দিল। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরল চার্লি। কুয়াশা উঠে দাঁড়াল।
খটাং করে একটা শব্দ কানে এল কুয়াশার। মেঝেতে পড়ে থাকা লোহার রডটা তুলে নিল। হাত দিয়ে পকেটে পিস্তলের অস্তিত্ব একবার অনুভব করল।
এবারে শব্দটা এল সেলুন থেকে।
অতি সাবধানে কুয়াশা এগিয়ে গেল সেলুনের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছুতেই খুলে গেল সেলুনের দরজা। একরাশ উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল ডেকের উপর, আর সেই আলোতে একটা ছায়া নড়ে উঠল। পরমুহূর্তেই একটা ছায়ামূর্তি পিস্তল হাতে দাঁড়াল তার সামনে। পিস্তলটা দীর্ঘ দেখাচ্ছে সাইলেন্সর লাগানোর ফলে।
ছায়ামূর্তি ধমকের সুরে বলল, কাছে এস না, মারা পড়বে। কুয়াশা সঙ্গে সঙ্গে fাড়াল। সতর্ক পদক্ষেপে লোকটা এগিয়ে এল কুয়াশার দিকে।
কিন্তু তোমার আচরণটা মোটেই অতিথির মত নয়। প্লীজ, আমি ভয় পাচ্ছি। তোমার ঐ অস্ত্রটা নামাও। লোহার রডটা নাড়তে নাড়তে বলল কুয়াশা।
ইয়ার্কি মারা হচ্ছে?’ বেঁকিয়ে উঠল লোকটা। ঘুরে দাঁড়াও।’
তা দাঁড়াচ্ছি। গুলি-টুলি কর না যেন আবার।’ ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কুয়াশা
১৫১
বলল, তোমার হাতে যে অস্ত্র রয়েছে ওটাকে কাজে না লাগালেই আমি খুশি।
| ‘সেকথা মনে থাকে যেন। গোলমাল করার চেষ্টা কর না। এতটুকু ঝামেলা। করেছ কি শেষ হয়ে যাবে।’
কুয়াশা তা ভাল করেই জানে। সুতরাং সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে সময় তার আসবেই। ছায়ামূর্তি তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। দেখাই যাক না ওর দৌড় কতটা।
হাতের জিনিসটা নামিয়ে ফেল।’ কঠোর স্বরে আদেশ করল লোকটা। ‘কি ফেলে দেব? আমার ছোট্ট ছাতাটা?’ ‘ছাতাই হোক আর মাথাই হোক। ফেলে দাও। হুঙ্কার ছাড়ল লোকটা। ‘কিন্তু মাথা ফেলব কি করে বুঝতে পারছি না। ঠাট্টা করার চেষ্টা কোরো না। নামাও ওটা।
কুয়াশা মাথাটা নুইয়ে লোহার রডটা রাখল পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা একটা ছাইদানীর উপর।
এবার দু-পা এগিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান, চালাকি করবার চেষ্টা করবে না। | মেপে দু-পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। মনে মনে হাসল সে। সুযোগ এসে গেছে। কান খাড়া করে রইল ক্ষীণ একটা শব্দের অপেক্ষায়। ছাইদানীর উপর রেখেছে লোহার রডটা। তুলতে গেলে একটু শব্দ হবেই। সে শব্দটা যতই ক্ষীণ। হোক কুয়াশার কানে পৌঁছুবেই। আর সেই শব্দই লোকটার পরাজয় ডেকে আনবে।
পেশীগুলো দৃঢ় করল কুয়াশা আসন্ন মুহূর্তের জন্যে। চোখের কোণ দিয়ে লোকটার কার্যকলাপ দেখবার চেষ্টা করল একবার। কিছু দেখা গেল না।
তারপর এল সেই আকাক্ষিত মুহূর্তটি। লোকটা নিঃশব্দে লোহার রডটা তুলে নেবার চেষ্টার কসুর নিশ্চয়ই করেনি। কিন্তু তবুও অতি ক্ষীণ একটা শব্দ কানে এল কুয়াশার। আর সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার দেহটা নড়ে উঠল।
| লোকটা তা বুঝে উঠবার আগে কুয়াশার ডান পা-টা পিছন দিকে চলে গেল। যেন লুনার মডিউল নিক্ষিপ্ত হল এপোলো-১১ থেকে। লোহার রড তুলতে গেলে তার মাথাটা যে পর্যন্ত নামবে ঠিক সেই খানে চলে এল কুয়াশার ডান পা। আর আগন্তুকের মাথাটা ঠিক সে জায়গাতেই ছিল।
| প্রচণ্ড একটা আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা। হাতে ধরা সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা ছিটকে পড়ে ঠাস করে শব্দ হল।
ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। কাত হয়ে পড়ে গেছে লোকটা। যন্ত্রণায় মুখটা কুৎসিত হয়ে গেছে। ন্যাড়ামাথা থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে। তবুও উঠে বসবার চেষ্টা করছে সে ইতিমধ্যেই।
কুয়াশা পকেট থেকে ধীরেসুস্থে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ১৫২
সিগারেট ধরাল। একটু পরেই লোকটা উঠে বসল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। সে দৃষ্টিতে আছে ভয়, বিস্ময়, অসহায়তা আর কাতর প্রার্থনা।
| নীরবে কিছুক্ষণ সিগারেট টানল কুয়াশা। লোকটাকে আর কোনও দৈহিক শাস্তি সে দেবে না। ওর প্রভু জো স্টিফেনের মত মানসিক শাস্তি দেবে কিছুক্ষণ।
পিছনে একটা শব্দ শুনতে পেল। চার্লির পরিচিত পদক্ষেপ। মুখ ফিরিয়ে কুয়াশা দেখল চার্লি এগিয়ে আসছে। তার হাতে মস্ত বড় একটা লোহার ডাণ্ডা।
শব্দটা লোকটার কানেও গিয়েছিল। চার্লিকে লোহার রড নিয়ে এগোতে দেখে আঁতকে উঠল সে। চার্লির চোখে সে স্পষ্ট খুনের নেশা দেখতে পেল। সারা দেহ একবার কেঁপে উঠল। চোখ দুটো বন্ধ করল।
কয়েকটা মুহূর্ত পার হয়ে গেছে। লোকটা চোখ খুলল ভয়ে ভয়ে। দেখল লোহার রডটা তার মাথার উপর শূন্যে থেমে আছে।
তার কানে এল, করছ কি, চার্লি, লোকটা মরে যাবে যে।’
‘আমি ওকে মেরেই ফেলব। ব্যাটা খুনে। আর একটু হলে আমাকেই খুন করেছিল!’ চিৎকার করে উঠল চার্লি।
কুয়াশা বলল, ‘উত্তেজিত হয়ো না, চার্লি। তোমার মনের অবস্থা দিয়ে ওর মনের অবস্থাটা এখন চিন্তা করে দেখ।
কিন্তু আমি তো চোর-ডাকাত নই, খুনেও নই। ও যে খুনে। প্লীজ, স্যার, আমাকে বাধা দেবেন না।’
তা হয় না, চার্লি। মানুষকে ক্ষমা করতে শেখ। ‘অত্যন্ত বিরক্ত হল চার্লি। সে বলল, “স্যার, অপাত্রে ক্ষমা করা অর্থহীন। সুযোগ পেলে ও আবার আসবে খুন করতে।’
‘তুমি এবার এখান থেকে যাও। সেলুনের ড্রয়ারে ফার্স্ট এইড বক্স আছে। বের কর। তোমার হাতটা বেঁধে দিতে হবে।’
কিন্তু, স্যার।’ ‘প্লীজ, চার্লি।’
মাথা নত করে চলে গেল চার্লি। যাবার সময় ক্রুদ্ধদৃষ্টি হেনে গেল আহত আগন্তুকের দিকে। সে এতক্ষণে ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা বোধহয় তার স্নায়ুতে কোনও তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারছিল না।
চার্লি দৃষ্টির আড়াল হতেই কুয়াশা বলল, তুমি এবারে যেতে পার।’
লোকটা বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছিল না তার কান দুটোকে। সে কুয়াশার দিকে অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল।
‘তুমি এবার যেতে পার, আবার বলল কুয়াশা। কিন্তু পিস্তলটা রেখে যেতে হবে। ওটা আমার পুরস্কার।
| লোকটা কোনও কথা বলল না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কুয়াশার কথা সে
১৫৩
যেন এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। পিস্তলের দিকে সে ফিরেও তাকাল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ইয়টের পিছন দিকে। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার মূর্তি।
চোদ্দ পরদিন সকাল দশটায় দিনার্দ বন্দর ত্যাগ করল রোজমেরী। চার্লির হাতে দি ফগ এর দায়িত্ব চাপিয়ে কুয়াশা সঙ্গ নিল জো স্টিফেনের।
সেইদিন রাতে দি ফগের সেলুনে বসেছিল কামাল, শহীদ ও মহুয়া। কুয়াশাকে না জানিয়েই কামাল কায়রোতে কে পাঠিয়েছিল শহীদের কাছে দ্রুত দিনার্দ হারবারে আগমনের আমন্ত্রণ জানিয়ে। কামালের ধারণা কুয়াশা এবার তার। জীবনের চরম বিপদের মোকাবেলা করতে যাচ্ছে। খবরটা অন্তত মহুয়া বৌদিকে
জানালেই নয়। হাজার হলেও কুয়াশা তো মহুয়ার সহোদর ভ্রাতা। সে কেল পাঠিয়েছিল তাই মহুয়া আর শহীদের কাছে। কুয়াশার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয় কেবলে। তাই লিখেছিলঃ আমি বিপদাপন্ন। চলে এস এক্ষুণি। কামাল জানে এই কেবল পেলে শহীদ একমুহূর্ত দেরি করবে না।
আর ঘটেছেও তাই। টেলিগ্রাম পেয়ে দেরি করেনি শহীদ খান। প্রথম বিমানেই চলে এসেছে প্যারিসে মহুয়া আর গফুরকে নিয়ে। প্যারিস থেকে ট্রেনে বিকেলেই এসে পৌঁছেছে দিনার্দ। [ সকালে কুয়াশা রোজমেরীতে যাবার আগে কামালকে বলেছিল যে সে ইচ্ছে করলে দি ফগ-এ থাকতে পারে। প্রস্তাবটা মনঃপুত হয়েছিল কামালের। তাই পোঁটলা-পুঁটুলি বেঁধে হোটেলের সুইট ছেড়ে দিয়ে সকালে আশ্রয় নিয়েছে কুয়াশার ইয়টে। শহীদদেরকেও নিয়ে এসেছে এখানেই।
| জনসমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় চার্লি খুশি হয়েছিল। কিন্তু শ্রীমান গফুরকে পছন্দ হয়নি তার। গফুরেরও চার্লিকে তেমন পছন্দ হয়নি। ইতিমধ্যেই দুজনের মধ্যে ক্রুদ্ধ ভাব বিনিময় হয়েছে। কিন্তু একজন অন্যের ভাষা না জানায় আর মহুয়ার চেষ্টায় ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ায়নি।
রাতের খাওয়া শেষে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিবরণ দিচ্ছিল কামাল। মহুয়া সবটা শুনে বলল, “এতটা ঝুঁকি নেওয়া দাদার ঠিক হয়নি। তার গলায় আশঙ্কার রেশ।
শহীদ হেসে বলল, একথা তোমার মুখে শোভা পায় না, মহুয়া। তোমার ভাই সম্পর্কে এতটা জানবার পরও একথা কি করে তুমি বল? এরকম একটা শয়তানকে শুধুমাত্র কুয়াশাই শায়েস্তা করতে পারে। অবশ্য আরও একজন লোক আছে। সেও পারে জো স্টিফেনকে শাস্তি দিতে।
কে সে?’ মহুয়া প্রশ্ন করল। ১৫৪
কে ভাব বিনিরেরও চামিয় চানি খুশি
‘তোমার একমাত্র দেবর। গম্ভীর হবার ভান করল শহীদ। ‘কামাল? চটে গেল মহুয়া। কামালও চটল।
মহুয়া রাগে গর গর করতে করতে বলল, এটা কি ঠাট্টার ব্যাপার হল নাকি? প্রচণ্ড ক্রোধের জন্যই বোধহয় আর কোনও কথা সে বলতে পারল না।
কামাল চটে গিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে অনেকগুলো পদশব্দ শোনা গেল। খোলা দরজা দিয়ে একটা আবছা ছায়াও দেখা গেল। তিনজনেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ হল দরজার দিকে।
স্যার, কম্পিত কণ্ঠ শোনা গেল চার্লির। ‘কে চার্লি? ভিতরে এস।’ ‘পু-পুলিস স্যার।’ ‘পুলিস?’ শহীদ অবাক হয়ে বলল। বেশ তো কি চায়? নিয়ে এস এখানে।
পুলিসের পোশাক পরা দুজন এসে ঢুকল সেলুনে। তাদের পিছনে ঢুকল সাদা পোশাক পরিহিত অন্য এক ভদ্রলোক।
শহীদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল আগন্তুকদের দিকে। পুলিসদের মধ্যে ছিলেন দিনার্দ পুলিস স্টেশনের চীফ ইন্সপেক্টর দুবোয়া। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন,
অত্যন্ত দুঃখিত, মশিয়ে…’।
‘শহীদ খান।’ আবৃতি করল শহীদ। উনি কামাল আহমেদ, আমার বন্ধু। ইনি আমার স্ত্রী।
ইন্সপেক্টর মাথাটা সামান্য নুইয়ে বললেন, ‘আপনাদের বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে কিনা পুলিসের চাকরি। আনপ্রেজেন্ট জব।
ততক্ষণে পুরোপুরি ধাতস্থ হয়েছে শহীদ। সে বলল, বসুন, মঁসিয়ে। ইন্সপেক্টর। কিন্তু এই ইয়টে কি মনে করে?’
‘আমি…আমি এসেছি মশিয়ে ল্যাম্বের খোঁজে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।
‘মশিয়ে ল্যাম্প। সাদা পোশাক পরা ভদ্রলোক শুধরে দিলেন।
হা হা, মশিয়ে ল্যাম্প।’ কিন্তু আমরা তো ঐ নামের কাউকে চিনি না! বিস্মিত শহীদ বলল।
ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, না চেনাটাই স্বাভাবিক। আমি জানতাম আপনারা চিনবেন না,’ বক্রোক্তি করলেন তিনি।
তাহলে আর আমাদেরকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?’ পাল্টা বক্রোক্তি করল শহীদ।
ইন্সপেক্টর কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন শহীদের দিকে। তিনি বললেন, এই ইয়টের মালিক কে জানতে পারি?
১৫৫
‘ইয়টের মালিকের নাম মি, ফগ। আর্নেষ্ট হ্যান্ড ফগ।’ জবাব দিল কামাল।
তা হতে পারে। কিন্তু মি. ল্যাম্প এই ইয়টেই বাস করছেন। এমন কি গতকালও তাকে এই ইয়টে দেখা গেছে। এখন বলুন কোথায় তিনি?
শহীদ বলল, আমার মনে হয়, মঁসিয়ে ইন্সপেক্টর, কোথাও কোনও ভুল হয়ে গেছে আপনার।’
মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর দুবোঁয়া। ভুল হতেই পারে না, মশিয়ে খান। আমার কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। ইনি, হোটেল ডিলা মেয়ারের ম্যানেজার, তার স্বাক্ষী। মি. ল্যাম্প এর হোটেলে ছিলেন কয়েকদিন।
শহীদ কি যেন ভেবে বলল, ‘এমনও তো হতে পারে যে মশিয়ে ফগকেই আপনি মশিয়ে ল্যাম্প বলে চেনেন।’
তা কি করে হবে। ও হ্যাঁ, তা-তাতা হা-হা-হ্যাঁ তা হতে পারে বৈকি। তা সেই মশিয়ে ফগ রূপী মশিয়ে ল্যাম্প কোথায়?’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন।
মি. ফগ এখন এখানে নেই। ‘গেছেন কোথায়? তাও জানি না।’ জানেন ঠিকই, বলবেন না।
আপনার যা খুশি ভাবতে পারেন। কিন্তু তার জন্য হঠাৎ সদলবলে ইয়টে হানা দিয়েছেন কেন, ব্যাপারটা জানতে পারি? তার অপরাধটা কি? হালকা সুরে প্রশ্ন করল শহীদ।
মাথা নাড়ল ইন্সপেক্টর। দুঃখিত, মশিয়ে। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তাছাড়া আশা করি আপনারা সবই জানেন। কারণ, আপনারা নিঃসন্দেহে তার দলের লোক।’
আপনার ধারণাগুলো তো চমৎকার রকমের উদ্ভট বলে মনে হচ্ছে।’
‘ইন্সপেক্টর আবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন শহীদের দিকে। তিনি বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বাইরে আবার পায়ের শব্দ শোনা গেল। একজন পুলিস এসে ঢুকল। সে বলল, “মি. ল্যাম্পকে ইয়টের কোথাও পাওয়া গেল না মশিয়ে ইন্সপেক্টর।’
ইন্সপেক্টরের কোনও ভাবান্তর হল না। তিনি শহীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মি. ল্যাম্পকে কোথায় পাওয়া যাবে একথা আপনারা বলতে রাজি নন বলে বোধহয় ধরে নিতে পারি?
‘স্বচ্ছন্দে।
তাহলে আপনাদের সবাইকে আমি গ্রেফতার করলাম।
‘আমাদের অপরাধ?
১৫৬
আমার অর্থাৎ মঁসিয়েই
সাথে ঠাট্টা হন। তৃতীয়ত ও তা প্রকাশ
‘অনেক। প্রথমত আপনারা মি, ল্যাম্পের ডীপসী র্যাকেট দলের লোক বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত আপনারা মি. ল্যাম্পের হদিস জেনেও তা প্রকাশ করেননি, অর্থাৎ পুলিসের সাথে অসহযোগিতা করেছেন। তৃতীয়ত, তৃতীয়ত,
‘আর তৃতীয়ত মঁসিয়ে ইন্সপেক্টরের সাথে ঠাট্টা করেছি।’ আবার তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন ইন্সপেক্টর দুর্বেয়া।
শহীদ বলল, ‘আপনি মারাত্মক ভুল করছেন, ইন্সপেক্টর। আমরা কোনও র্যাকেটের সদস্য নই। আমরা অতিশয় নিরীহ শান্তিপ্রিয় কয়েকজন বাঙালী সন্তান। দিনা বীচে বেড়াতে এসেছি। আমাদের পাসপোর্ট দেখতে পারেন ইচ্ছা করলে।
‘পাসপোর্টে ও সব লেখা থাকে নাকি, মশিয়ে?’
থাকে না। তবে মানুষের চেহারায় আর পাসপোর্টের ছবিতে চরিত্রের কিছুটা প্রতিফলন থাকে। যেমন আপনার চেহারায় একটা নির্বুদ্ধিতার ছাপ–।
| ‘আপনি বড় বাড়াবাড়ি করছেন, মশিয়ে।’ রাগে গর গর করতে করতে বললেন ইন্সপেক্টর। চলুন আপনারা সবাই পুলিস স্টেশনে। একদিন লক আপে থাকলে ইয়ার্কি বেরিয়ে যাবে।’
‘লক আপ থেকে বেরোলে আপনারও ইয়ার্কি বেরিয়ে যাবে।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শহীদ। বাংলাদেশের নিরীহ নির্দোষ নাগরিককে স্রেফ অকারণে গ্রেফতার করছেন। এর পরিণামে ফরাসী সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লজ্জায় পড়তে হতে পারে। আর তার পরিণামে উপরওয়ালাদের কাছে আপনার বেইজ্জতি হার আশঙ্কাটা উড়িয়ে দিতে পারেন না। চাকরি নিয়ে টানাটানি হওয়াও বিচিত্র নয়।
সে সব আপনাকে ভাবতে হবে না। এবার দয়া করে উঠে পড়ুন। মহুয়ার দিকে চেয়ে ইন্সপেক্টর বললেন, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম। আপনাকেও উঠতে হবে।
মহুয়ার মুখটা অপমানে লজ্জায় কালো হয়ে গেল। সে করুণ দৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকাল।
ইন্সপেক্টর বললেন, কোনও চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। কম করেও একশ জন পুলিস ঘিরে রেখেছে এই ইয়ট।
শহীদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বেশ, চলুন।
Leave a Reply