১৭. খুনী কে? ২ (ভলিউম ৬) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৭
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯
এক
কি যেন ভেবে ঘড়ি দেখল শহীদ। রাত একটা। মনে মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিল শহীদের-কামালের কোনও বিপদ ঘটল নাকি? সাড়ে বারোটার সময় খবর নিয়ে আসার কথা ছিল কামালের। কোনও বিপদে পড়ে নিরুপায় না হলে সে
এতক্ষণ দেরি করবে না।
সারওয়ারকে শুয়ে পড়তে বলে নিজের ঘরে ফিরে এল শহীদ। কাপড়চোপড় বদলে নিল তাড়াতাড়ি। গফুরকে ডেকে বলল, “এখুনি মি. সিম্পসন আসবেন। তুই তাঁকে শোবার ঘরে নিয়ে লাশটা দেখাবি। বলবি, আমি জরুরী একটা কাজে বাইরে গেছি। .
গফুর সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। শহীদ আর সময় নষ্ট না করে বের হয়ে এল বাড়ি থেকে। কামাল তার গাড়িটা নিয়ে গেছে। ফলে ট্যাক্সি করেই পৌঁছুতে হবে তাকে শান্তিনীড়ে।
শান্তিনীড়ের কাছাকাছি গিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল শহীদ। ভাড়া মিটিয়ে দিতে ড্রাইভার চলে গেল গাড়ি নিয়ে। তারপর হাঁটা শুরু করল শান্তিনীড়ের গেটের দিকে। কামালের কোনও না কোনও বিপদ ঘটেছে; এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ধারণা হয়েছে শহীদের। তা না হলে ওর দেরি হবার কথা নয়। ঠিক সাড়ে বারোটায় খবর দিয়ে আসত সে শহীদের বাড়িতে। অন্তত কোথাও থেকে একটা টেলিফোনও করত সে। শান্তিনীড়ের ভিতর কামাল ঢুকতে পেরেছিল কিনা জানা নেই শহীদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাড়ির ভিতরটা চুপিচুপি একবার জরিপ করে নেবে সে, ঠিক করল।
গেটের দিকে এগোতে এগোতে কি যেন ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। গেট টপকে ভিতরে ঢোকার চেয়ে পাঁচিল টপকে ঢাকাই ভাল বলে মনে হল তার। শান্তিনীড়ের দেয়াল খুব বেশি উঁচু নয়। দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে নিল শহীদ। চাঁদের আলো ফুটে রয়েছে যতদূর দৃষ্টি যায়। একটু দূরেই নির্জন রাস্তা পড়ে আছে। রাস্তার ওপাশে নিচু ধান খেত। না, আশপাশে কেউ নেই।
এক লাফে পাঁচিলের মাথা আঁকড়ে ধরল শহীদ। তারপর দেয়ালে পায়ের ভর দিয়ে উঠে পড়ল উপরে। বাগানের দিকে উঠেছে সে। চাঁদের আলোয় একটার পর
৫৭
ছে। রাস্তার ওপালের মাথা আঁকড়ে ধঠেছে সে।
দিয়ে এক লাফে পাঁচিলে ধান খেতম, শ্রম, একটু দূরেই দেখে নিল শহীদ।
একটা অসংখ্য গাছ ছাড়া শহীদ আর কিছুই দেখতে পেল না। পাঁচিলের মাথা ধরে ঝুলে পড়ে ঝুপ করে নেমে পড়ল বাগানের ভিতর। তারপর কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। কোথাও কোনও শব্দ হল না। বাঁ দিকে গেলেই সম্ভবত বাড়ির ঘরগুলো দেখতে পাওয়া যাবে। সেদিকেই সতর্ক ভাবে পা পা করে হাঁটতে লাগল শহীদ।
কিন্তু দিক নির্ণয় করতে সামান্য একটু ভুল করেছিল শহীদ। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল সে। ফলে বাড়ির ঘরগুলোকে গাছের আড়ালে ফেলে রেখে গেটের দিকে এগোতে লাগল সে। অবশ্য একটু পরই ভুলটা বুঝতে পারল। সামনেই দুটো গ্যারেজ দেখা যাচ্ছে।
. ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়াল না শহীদ। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে যে, ফ্যামিলি সলিসিটর আহমেদ হোসেন বলেছিলেন, মি. নাসির প্রতিরাতে কোথায় যেন বের হয়ে যান। শহীদ ভাবল, গ্যারেজের সামনে যখন এসেই পড়েছি তখন দেখাই যাক, মি. নাসিরের গাড়ি আছে কি না? তাহলেই বোঝা যাবে মি. নাসির এখন বাড়িতে আছেন, না নেই।
| বাড়িটাকে বাগানবাড়ি বললে ভুল হবে না। সামান্য খানিক দূরে নানা জাতের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো পড়ে কিম্ভুতকিমাকার সব ছায়া পড়েছে মাটিতে; কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে শহীদের। গাছের আড়ালে ওঁৎ পেতে নেই তো কেউ?
একটু সতর্ক হয়ে ওঠে শহীদ। ধীরে ধীরে এগোয় সে গ্যারেজের দিকে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। কোথায় যেন একটা কুকুর কয়েকবার ডেকে উঠেই চুপ করে যায়। তার মনে হল দূরে কোথাও কেউ যেন গম্ভীর গলায় কাউকে ধমক মারছে। গলাটা অতি পরিচিত বলে মনে হয় ওর। কিন্তু ভাল করে শুনতেই পায় না সে শব্দটা। মনে মনে ভাবে, মনের ভুল হবে। তারপর আবার পা বাড়ায় গ্যারেজের দিকে। এবার সে বেশ একটু নিশ্চিন্ত মনে দ্রুত তালে পা ফেলে। কিন্তু…!
কিন্তু গ্যারেজের সামনে আর পৌঁছুতে পারে না শহীদ। একটা আতা গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল সে, অকস্মাৎ খসখস করে শব্দ উঠল গাছটার উপর থেকে। পলকের মধ্যে ডান হাতটা পকেটে ঢুকে গেল তার রিভলভার বের করার জন্যে। কিন্তু হাতটা বের করার আগেই ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল একজন লোক।
| ডান হাতটা পকেটে থাকায় বাঁ হাতেই প্রচণ্ড একটা ঘুসি চালাল সে। দু’জনেই মাটিতে ছিটকে পড়ল। ঘুসিটা শহীদ মারল মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই। কিন্তু ঠিকমত লাগল না। ততক্ষণে আক্রমণকারী লোকটিও সামলে নিয়েছে নিজেকে। মাটিতে কোমরের ভর দিয়ে হাতে ধরা মোটা লোহার শিকটা সজোরে শহীদের মাথা লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল সে। কিন্তু মাটিতে গড়িয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে
৫৮
নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করল শহীদ। তারপরই একটা লাথি ঝাড়ল সে ডান পা দিয়ে। কোঁক করে একটা আর্তধ্বনি বের হল লোকটার গলা থেকে। হাত-পা মেলে দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। লাথিটা লেগেছে লোকটার ঠিক পিঠের ওপর।
এক মুহূর্তে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রিভলভার বের করে লোকটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল শহীদ।
উঠে দাঁড়া, শয়তান!’ গর্জে উঠল শহীদ। | লোকটা ব্যথায় মুখ কুঁচকে শহীদের দিকে তাকাল পাশ ফিরে। চমকে উঠল শহীদ অপ্রত্যাশিত ভাবে। এমনটি সে আশা করেনি। লোকটাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে কি একটা সন্দেহ বিদ্যুতের মত খেলে গেল তার মনে। শান্তিনীড়ের অশান্তির কারণ কি তবে এই ড্রাইভার শামসু মিয়া?
হা। আক্রমণকারীর মুখ দেখেই শহীদ চিনতে পারল লোকটাকে-ড্রাইভার শামসু মিয়া!
‘তাহলে তুমি?’ কঠিন কণ্ঠে বলল শহীদ।
কাঁপতে কাঁপতে ড্রাইভার শামসু মিয়া উঠে বসার চেষ্টা করল। হাতের মোটা লোহার শিকটা মাটিতে ফেলে দিয়েছে সে। কোনরকমে মাটির উপর বসে সে বলে উঠল করুণ মিনতি ভরে, স্যার, আপনাকে চিনতে পারিনি আমি।’
তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ ভেসে এল এমন সময় বাড়ির ভিতর দিক থেকে। বাঁচাও! বাঁচাও! সাহেবকে…!’
চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল শহীদ। মেয়েলী কণ্ঠস্বর! কে অমন করে চিৎকার করছে ওদিকে এত রাতে? কি বিপদ ঘটল আবার?
এখানেই থাকবে তুমি! পালিয়ে গেলে রক্ষা নেই!
কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছুটল শহীদ ভিতরের দিকে। ওদিকে ভয়ানক কোনও বিপদ ঘটতে চলেছে নিশ্চয়। দেরি করলে হয়ত যা ঘটবার ঘটে যাবে। সুতরাং আপাতত ড্রাইভার শামসু মিয়াকে ছেড়ে দিয়ে শহীদ ছুটল সেদিকে। কাছাকাছি পৌঁছুতে মি. নাসিরের কণ্ঠ শুনতে পেল সে। আর ক’সেকেণ্ড পরই সে দেখতে পেল ওদেরকে। মি. নাসির কাকে যেন কড়া গলায় ধমক মেরে চুপ করাতে চাইছেন। মিসেস নাসিরও দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওদের মধ্যে। শহীদ রিভলভারটা পকেটে ভরে ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
‘কে!’ চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন মি. নাসির।
শহীদ খান। কি ব্যাপার, মি. নাসির? কে অমন চিৎকার করছিল? মুহূর্তের জন্যে কালো হয়ে যায় মি. নাসিরের মুখাবয়ব। উত্তর দিতে পারেন তিনি কয়েক সেকেণ্ড। সোনার মা সেখানেই দাঁড়িয়েছিল উত্তেজিত ভাবে। শহীদ তার দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। বাঁচাও বাঁচাও!’ করে সে-ই চিৎকার
করে উঠেছিল।
‘ও কিছু না, মি. শহীদ! সোনার মা আমোকা ভয় পেয়ে…’ ‘না!’ সোনার মা ভীত কণ্ঠে আপত্তি জানায়। মি. নাসির বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে ধমক মারেন তাকে, তুমি চুপ কর
দেখি!
‘ব্যাপারটা শুনতে চাই আমি, মি. নাসির। ওকে বলতে দিন। ‘কিন্তু…’
শহীদের কথা শুনে অপ্রতিভ কণ্ঠে আপত্তি জানাতে যান মি, নাসির। কিন্তু সোনার মা বলতে শুরু করে বড় বড় চোখ করে, আমি আমার ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম সাহেব, হঠাৎ একজন লোকের গরম গরম কথা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে মনে হল বড় সাহেবের ঘরে কে যেন জোরে জোরে কথা বলছে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি-এই লম্বা চওড়া একজন মানুষ, তার মুখ থেকে পা পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে আবার দেখি একটা ছোট বন্দুক, বড় সাহেবকে খুন করবে বলছে! আমি…আমি…তাই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠি!
‘মিথ্যে কথা! বুড়ি ভয় পেয়ে মিথ্যে একটা গল্প বানিয়ে বলছে! ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, মি. শহীদ।’
নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকাল শহীদ মি. নাসিরের দিকে। হঠাৎ অপ্রতিভ হয়ে কি যেন বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন তিনি। শহীদও হঠাৎ চমকে উঠল। বাড়ির পিছন দিকে নদী। ওদিক থেকেই একটা স্পীড বোট স্টার্ট নেবার শব্দ আসছে।
রীতিমত তিরস্কারের দৃষ্টিতে মি, নাসিরের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে রিভলভারটা বের করেই ছুটল শহীদ কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে।
| নদীতে পৌঁছুবার পথটা আগেই দেখে নিয়েছিল শহীদ প্রথমবার এ বাড়িতে এসে। চাঁদের আলোয় পথ চিনে নদীর কিনারায় পৌঁছতে দেরি হল তার। স্পীড বোটটা, তখন বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে। তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়েও কোনও আরোহীর স্পষ্ট চেহারা দেখতে পাওয়া গেল না। শুধু কালো আলখেল্লা পরিহিত একটা দীর্ঘকায় মূর্তিকে স্পীড বোটের উপর নড়াচড়া করতে দেখল সে। কে ও? ভাবল শহীদ। কুয়াশা নয় তো? কিন্তু কুয়াশা কেন আসবে মি. নাসিরের কাছে?
শহীদ তখনও তাকিয়েছিল নদীর দিকে। স্পীড বোটটা তখন নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। শুধু একটুকরো আলো দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। দেখতে দেখতে ক্ষুদ্র আলোর টুকরোটাও নদীর বাঁকে হারিয়ে গেল।
নদীর ধার থেকে ফিরতে ফিরতে শহীদের মনে প্রশ্ন জাগল,. মি. নাসির অস্বীকার করলেন কেন সোনার মার কথা? সোনার মা তো ঠিকই দেখেছিল।
শহীদ ফিরে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার মি. নাসির বললেন, ‘ও কিছু, মি. শহীদ! সোনার মা ভুল দেখেছে, বুঝলেন?’ ৬০
শহীদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি কথাটা স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছেন। এরমধ্যে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে। যাকগে, মাস্টারসাহেবকে দেখছি না যে? এত চেঁচামেচিতেও ঘুম ভাঙেনি ওনার?
মিসেস নাসির বললেন, ‘সত্যিই তো! এত হৈ হট্টগোলে ঘুম না ভাঙবার কথা নয়!’ . .
‘চলুন ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা যাক, শহীদ বলল। মিসেস নাসির পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল শহীদকে। মি. নাসিরও কোনও কথা বলে অনুসরণ করলেন ওদেরকে। শহীদের কথা শুনে একেবারে চুপসে গেছেন তিনি। সোনার মা মি. নাসিরের ধমক খেয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ। করে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। আবার উথলে উঠেছে বোধহয় কাওসার ও মন্টির দুঃখ। | মাস্টারসাহেবের ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল, বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি আটকানো। ঘরে কেউ নেই। রীতিমত আশ্চর্য হলেন মি. এবং মিসেস নাসির। শহীদ মনে মনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। গেল কোথায় মানুষটা? শহীদের বাড়ি থেকে ইতিমধ্যে ফিরে আসার কথা তাঁর। কিন্তু বাড়ি না ফিরে গেলেন কোথায়?
ওদেরকে মাস্টারসাহেব সম্পর্কে কোনও কথা জানতে না দিয়ে বিদায় নিল শহীদ। ফেরার সময় ড্রাইভার শামসু মিয়ার খোঁজে তার কোয়ার্টারে গেল সে। কিন্তু সে যা ধারণা করেছিল তাই ঘটেছে। ড্রাইভার শামসু মিয়া পালিয়েছে বাড়ি
থেকে নিজের কাপড়চোপড় সঙ্গে নিয়ে।
দুই
পরদিন সকালে শহীদ মি. সিম্পসনের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হল। কামালের কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন তিনি। এদিকে মাস্টারসাহেবও নিখোঁজ। গত রাতে মি. নাসিরের অদ্ভুত ব্যবহারের কথা শুনে মি. সিম্পসন বললেন, “কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে। স্পীড বোটে করে যে এসেছিল সে যদি কুয়াশা হয় তবে কুয়াশার নিশ্চয় কোনও স্বার্থ আছে মি. নাসিরের কাছে।
শহীদ বলল, আমারও তাই ধারণা। তবে লোকটা কুয়াশা কিনা বোঝা যাচ্ছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘ইকরামুল্লা খানের সাথে মি. নাসিরের বন্ধুত্ব অনেক দিনের। আর কুয়াশা ইকরামুল্লা খানের সন্ধান করে গেছে আমার কাছে। না, কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমার কাছে। এদিকে মন্টির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাওসারের হত্যাকারীকেও ধরা যাচ্ছে না। আবার মাস্টারসাহেব
৬১
নিখোঁজ।’
শহীদ বলল, ওসব কথা ভেবে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। কাজ করতে হবে। আপনি এখুনি একজন ইনফর্মারকে পাঠিয়ে দিন শান্তিনীড়ের ওপর খেয়াল রাখার জন্যে। কিছুক্ষণ পরপরই খবর পাঠাবে সে। আর আজ রাতে আমরা বের হব। মি. নাসিরকে অনুসরণ করতে হবে। ‘কিন্তু তাতে কি কোনও ফল হবে?’
সে কথা ভেবে বসে থাকলে চলবে না। আমার বিশ্বাস মি. নাসিরকে অনুসরণ . করে অনেক তথ্য জোগাড় করতে পারব আমরা। রোজ রাত এগারোটার পর বের। হন উনি।’
মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক বলেছ তুমি, শহীদ! লোকটা অত রাতে যায় কোথায়? জানা দরকার।’
এরপর আরও খানিকক্ষণ আলোচনা করে মি. সিম্পসনের অফিস-রুম থেকে বের হয়ে এল শহীদ। বাড়ি ফিরেই অনেক সমস্যা নেমে গেল তার মাথা থেকে। যেসব রহস্যের কিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না, সেসব অনেকাংশে পরিষ্কার হয়ে গেল। কুয়াশা একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে শহীদের বাড়িতে। কুয়াশা লিখেছেঃ
প্রিয় শহীদ,
কয়েকটি জরুরী খবর দেবার জন্যে তোমাকে এই চিঠি লিখছি আমি। গতরাতে মাস্টারসাহেব শান্তিনীড় থেকে বের হবার পর তাকে শত্রুরা অনুসরণ করে। আর শত্রুকে অনুসরণ করি আমি। মাস্টারসাহেব নিরাপদেই তোমার বাড়িতে প্রবেশ করেন। কিন্তু অল্পক্ষণ পরই তিনি বের হয়ে আসেন। এবং তখন তাকে আক্রমণ করা হয়। আমি আক্রমণকারীকে নিরস্ত্র করে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু একটু দেরি হয়ে যাওয়াতে মাস্টারসাহেব গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। গতরাত থেকেই তার জ্ঞান ফেরাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু এখনও সফল হইনি। তবে আশা আছে, অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হব। আঘাত খুব গুরুতর, মাথার একটা অংশ মারাত্মক ভাবে লোহার রড দিয়ে জখম করা হয়েছে। মাস্টারসাহেবকে নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত আছি বলে আমি নিজে তোমার সাথে দেখা করতে পারলাম না।
এদিকে কামালকে কারা আহত করে বন্দী করে নিয়ে গেছে তা আমি জেনেছি। আঘাত গুরুতর নয় তার। এখন ভালই আছে। তাকে। উদ্ধার করার চেষ্টা আপাতত করছি না। আসলে তার সঙ্গে দেখা করে একটা কাজের ভার দিয়ে এসেছি। বন্দীদশা থেকেই সে যাতে কাজটা করতে পারে শত্রুদের মনে কোনও সন্দেহ সৃষ্টি না করে, তার ব্যবস্থা
৬২
করে এসেছি। তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না ওর জন্যে।
এবার আমার সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলি, শহীদ। তোমরা সম্ভবত আমার রহস্যময় উপস্থিতিতে অবাক হয়ে পড়েছ। ঢাকায় এত তাড়াতাড়ি ফিরলাম কেন পেরু থেকে, কবে ফিরলাম সে কথা নিশ্চয় বুঝতে পারছ না তোমরা। তাছাড়া কামাল ও গফুরকে হঠাৎ অমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে পেরু থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠালাম কেন তাও অজানা রয়েছে তোমাদের।
আসলে সৈনিকে উঠে যখন আমরা টারাটাকা শহরের কাছে নোঙর করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই একটা অশুভ সংবাদ পেলাম আমি মহাশূন্য থেকে। Dr. Kotze …ভয়ানক বিপদে পড়েছেন। তার মহাশূন্যযানের কলকজা বিগড়ে গেছে বলে বার্তা পেলাম আমি। Dr. Kotze-এর রকেট চাঁদের কক্ষপথে অবিরাম ঘুরছে। যন্ত্রপাতি কোনও কাজই করছে না, ফলে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির পাল্লায় পড়ে একই ভাবে ঘুরছে যানটা। মাত্র মাস ছয়েকের খাদ্য আছে Dr. Kotze-এর রকেটে। মাস ছয়েকের মধ্যে রকেটটা ক্রমশ গতি হারাতে হারাতে একেবারে স্থির হয়ে যাবে শূন্যে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতায় আছে বলে ওটা পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে না, অন্য কোনও দিকেও এগোবে না। ওখানেই অনাদিকাল পর্যন্ত ঝুলে থাকবে। Dr. Kotze দুঃসংবাদটা জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন, আমি যেন তাকে মাস ছয়েকের মধ্যে উদ্ধার করার চেষ্টা করি।
Dr. Kotze-এর অনুরোধ রক্ষা করব আমি। কিন্তু Dr. Kotze-কে উদ্ধার করতে হলে আমাকেও যাবার জন্যে তৈরি হতে হবে মহাশূন্যে। তাছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
বুঝতে পারছ তো শহীদ মহাশূন্যে যাওয়ার মানেটা কি? কোটি কোটি টাকার দরকার মহাশূন্যে যেতে হলে। অথচ টাকা আমার কাছে যা আছে তাতে কুলোবে না। ফলে কামাল ও গফুরকে পেরু থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে আমি সোনার বস্তাগুলো সাজামোর নদী থেকে উদ্ধার করি। তারপর সোজা চলে আসি বার্মায়। চীরণ মন্দিরের গুপ্তধনের কথা জানা ছিল আমার। কিন্তু নকশাটা কোথায় আছে জানতাম না। বার্মায় এসে খবর পেলাম ঢাকা থেকে দুজন লোক এসে নকশাটা নিয়ে ঢাকাতেই ফিরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় চলে এসেছি আমি।
মোট কথা, চীরণ মন্দিরের সব গুপ্তধন আমার চাই। শুধু চীরণ মন্দিরের সম্পদেই হয়ত চাহিদা মিটবে না আমার। মহাশূন্যে যেতে হবে আমাকে, Dr. Kotze-কে উদ্ধার করতে হবে। তার জন্যে কোটি কোটি টাকার দরকার। আমি এখন টাকার সন্ধানে ফিরব পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে
ও-প্রান্ত অবদি।
এখন আর সময় নেই, শহীদ। মাস্টারসাহেবকে অক্সিজেন দিতে যেতে হচ্ছে আমাকে এখুনি। দরকার হলে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আর মাস্টারসাহেবের জ্ঞান ফিরে এলে খবর নিশ্চয়ই পাঠাব তোমার কাছে।
মহুয়াকে আমার প্রীতি দিও! আমার ভালবাসা নিও।
ইতি-কুয়াশা। চিঠিটা পড়ে অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছে শহীদ কামাল এবং মাস্টারসাহেবের ব্যাপারে। এরপর আর বাইরে কোথাও বের হল না। রাত দশটায় এলেন মূর্তিমান বিষাদ মি. সিম্পসন। প্রথম খবরটাই তাঁর দুঃখজনক, শহীদ, শান্তিনীড়ে যে ইনফর্মারটিকে পাহারা দেবার জন্যে পাঠিয়েছিলাম তার কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না সন্ধে থেকে। খবর পেয়ে আমি ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও হদিশই নেই তার।’
চুপচাপ শুনল শহীদ মি. সিম্পসনের কথা। তারপর বলল, আশ্চর্য!’ মি. সিম্পসন বললেন, ‘আরও দুজনকে রেখে এসেছি, কিন্তু আমার সন্দেহ..’
শহীদ বলল, ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে কিছুই করে উঠতে পারছি না আমরা। তবে আজ রাতে একটা হদিস করা যাবে হয়ত। আর একটি কথা, আমি আমার বার্মীজ বন্ধুকে জরুরী তার পাঠিয়েছি। কাল সকাল নাগাদ উত্তর পেয়ে যাব বলে আশা করছি। আমার বিশ্বাস অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য বার্মা থেকে পাব আমরা।’
মি. সিম্পসন বললেন, কি রকম তথ্যের আশা করছ তুমি, শহীদ?’
শহীদ সে কথার উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, মি. সিম্পসন, প্রাক্তন পুলিস অফিসার ইকরামুল্লা খান সম্পর্কে কোনও সন্দেহজনক কার্যকলাপের রেকর্ড আছে কোথাও?’
একটু ভেবে নিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, ‘না, তেমন কিছু না। তবে গত বছর খানেকের মধ্যে যে-ক’টি সোনা চোরাচালানকারীকে ধরা হয়েছে, ধরার সময়কাছে। পিঠে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা গেছে ইকরামুল্লা খানকে। কোইন্সিডেন্স বলেই মনে করা হয়েছে ব্যাপারটাকে। আমরা তেমন গুরুত্ব দেবার মত কিছু খুঁজে পাইনি।’
‘ভুল করেছেন সম্ভবত, চিন্তিত ভাবে বলল শহীদ। মি. সিম্পসন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তার মানে?’
শহীদ বলল, আমার অনুমান বলছে, ইকরামুল খান কোনও আন্তর্জাতিক দুস্কার্যে জড়িত। যাকগে, আজ রাতে মি. নাসির যদি ইকরামুল্লার সঙ্গে দেখা করতে যায় তবে হয়ত তার সঙ্গে ইকরামুল্লার সম্পর্কটা ধারণার মধ্যে আসবে।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘মূল রহস্য কিন্তু এখনও অন্ধকারে রয়ে যাচ্ছে। শহীদ বলল, প্রচলিত একটি কথা আছে–অতি বাড় বেড় না ঝড়ে উড়ে
৬
যাবে, অতি ছোট থেকো না ছাগলে মুড়ে খাবে। আমাদের শত্রুদের হয়েছে কি জানেন? তারা অতি বাড় বেড়ে গেছে।’
মি, সিম্পসন বললেন, সেটা কিরকম?’
শহীদ মৃদু হেসে বলল, শত্রুরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে এমন সব দুষ্কর্ম করে চলেছে। একটার পর একটা যে, আমাদেরকে আর কষ্ট স্বীকার করে ওদেরকে ধরতে হবে
। ওরাই ধরা দেবে।’
শহীদের কথা বুঝতে পারেন না মি. সিম্পসন। কি যেন বলতে চান তিনি। কিন্তু শহীদ ঘড়ি দেখে বলে, আর তো সময় নেই, মি. সিম্পসন। মি. নাসিরের রোজকার নিশি ভ্রমণের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।
রাত এগারোটা।
মি. নাসির খয়েরী রঙের ট্রপিক্যালের স্যুট পরে জুতোর মচ মচ শব্দ করে বের হলেন নিজের ঘর থেকে। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে গ্যারেজের দিকে পা চালালেন তিনি। মনে হয় এত রাতে বাড়ির কেউ জেগে নেই। কিন্তু মিসেস নাসির তাঁর ঘরে জেগে ছিলেন একা। তিনি খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর আবছা এবং অদৃশ্যমান মূর্তির দিকে। বাঁকা একটা ব্যঙ্গের হাসি তাঁর মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। মি. নাসির গাড়ি বের করে যতক্ষণ না স্টার্ট দিলেন ততক্ষণ কান পেতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি খোলা জানালার সামনে।
মি. নাসির গাড়ি বের করে গেট পর্যন্ত চালিয়ে এলেন। গাড়ি থেকে নেমে লোহার গেটটা খুলে আবার গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন।
রাস্তায় পৌঁছে গাড়ির গতি চল্লিশে ওঠালেন তিনি। একমনে গাড়ি চালাতে চালাতে কি একটা গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন মি. নাসির। হঠাৎ বাধা পড়ল তাঁর একাগ্র চিন্তায়, খুট করে একটা শব্দ হল যেন। চমকে উঠেই আবার শান্ত হলেন তিনি। ও কিছু না, গাড়িটা পুরানো হয়ে গেছে বলে খুট-খাট শব্দ প্রায়ই শোনা যায় আজকাল। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তে একটু বিচলিত হলেন মি. নাসির। তাঁর পিছন পিছন একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটা কি তাঁকেই অনুসরণ করছে? স্পীড মিটারের কাঁটার দিকে তাকালেন তিনি। চল্লিশ…গতি বাড়ালেন মি. নাসির। পঞ্চাশ। তুফানের মত ছুটল গাড়িটা নির্জন রাস্তা ধরে।
এদিকে সত্যিসত্যি মি, নাসিরের গাড়িকে অনুসরণ করে আসছিল একটি ক্রিমসন রঙের ফোক্সওয়াগেন। বলা বাহুল্য, শহীদের গাড়ি ওটা। মি, সিম্পসন এবং শহীদ বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছিল মি. নাসিরের গাড়িটাকে।
‘গতি বাড়ালেন উনি। বুঝতে পেরেছেন আমাদের উদ্দেশ্য।’ স্পীড মিটারের
৫-
৬৫
কাটা পঞ্চাশে নিয়ে বলল শহীদ।
| মি. সিম্পসন বসে আছেন শহীদের পাশে। ড্রাইভিং সিটে বসেছে শহীদ।
কিন্তু, যাবেন কোথায়, পিছু ছাড়ব না আমরা।’
মি. সিম্পসনের উদ্দেশে শহীদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় চমকে উঠে চিৎকার করে উঠল সে, ‘একি!’
মি, সিম্পসনও লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। মি. নাসিরের গাড়ি অকস্মাৎ মাতালের মত একবার রাস্তার ডান দিকে আর একবার বাম দিকে কাত হয়ে পড়ে
যেতে চাইছে।
ব্যাপার কি শহীদ!’
শহীদ গাড়ির স্পীড বাড়াতে বাড়াতে বলল। ঐ গাড়ির ব্যাক সিটের দিকে তাকিয়ে দেখুন। একটা লোক মি. নাসিরের গলা টিপে ধরেছে।
ঠিক তাই! গাড়ির পিছনে এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল লোকটা। মি. নাসির টের পাননি ব্যাপারটা।
রাস্তার দু’পাশে নিচু ধান খেত। সামনের গাড়িটা সামান্যের জন্যে বেঁচে যাচ্ছে বারবার ঢালু জায়গাটায় গড়িয়ে পড়া থেকে। শহীদের গাড়ি অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে পড়েছে সামনের গাড়িটার। আততায়ী সামনের সিটের উপর ঝুঁকে পড়ে সজোরে টিপে ধরেছে মি. নাসিরের গলা। দুদিক সামলাতে হচ্ছে মি. নাসিরকে। একহাতে নিজের গলা ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। অপর হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়িটাকে রাস্তার পাশের জলায় পড়া থেকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন।
শহীদ এবং মি. সিম্পসন আততায়ীর পিছন দিকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয়। মুখটা যদিও দেখা যাচ্ছে না। সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা : করছে শহীদ সামনের গাড়িটার পাশে গিয়ে পৌঁছবার জন্যে। কিন্তু প্রতিবারই বাধা আসছে। সাইড পাওয়া যাচ্ছে না কোনও মতে। সামনের গাড়িটার মাতলামো বেড়েই চলেছে ক্রমশ। ডান পা ফাঁকা দেখে এগোতে চেষ্টা করলেই সামনের গাড়িটা বাম পাশ ছেড়ে ডান পাশে এসে পড়ে। পলকের মধ্যে ব্রেকে চাপ দিয়েই পা সরিয়ে নেয় শহীদ। আবার পূর্ণ বেগে ছোটে গাড়ি। আবার চেষ্টা করে সে পাশাপাশি পৌঁছুতে।
| কিন্তু এরকম বেশিক্ষণ চলল না। মি, সিম্পসন পকেট থেকে রিভলভার বের করে শহীদকে বলল, টায়ার ফুটো করে দিলে কোনও ফল হবে?’
| শহীদ উত্তর দিল না। দু’সেকেণ্ড পরেই ব্রেক কষল সে হঠাৎ। তীব্র একটা ঝাঁকানি দিয়ে রাস্তার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। চাকার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই মি. সিম্পসন লাফিয়ে পড়লেন গাড়ি থেকে। মি. নাসিরের গাড়ি নিচু ধান খেতে গড়িয়ে পড়ে গেছে।
৬৬
স্টার্ট বন্ধ করেই দরজা খুলে নেমে পড়ল শহীদ। মি. সিম্পসন ততক্ষণে নামতে শুরু করেছেন নিচু ধান খেতে। ছুটল শহীদ। ‘
তীব্র বেগে নামতে নামতেই শহীদ চাঁদের আলোর মধ্যে দেখতে পেল গাড়িটা। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে কাত হয়ে গেছে পানির মধ্যে। কম পানি, ডোবেনি তাই। স্টার্টও বন্ধ হয়নি।
মি. নাসির ছিটকে পড়ে গেছেন ধান খেতে। শহীদ যখন পৌঁছুল তখন মি. সিম্পসন তাঁকে তুলে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন।
‘তুমি দেখো এনাকে। লোকটা কোনদিকে ছুটেছে দেখেছি আমি! মি. সিম্পসন শহীদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই ধান খেতের ভিতর ঢুকে দৌড়ুতে শুরু
করলেন।
‘কোথায় লেগেছে আপনার? মি. নাসিরকে ধরে ফেলে প্রশ্ন করল শহীদ। ব্যথায় মুখ কুঁচকে রয়েছে মি. নাসিরের। ধান খেতে এখন পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানি জমে আছে। ভিজে গেছেন মি. নাসির। কাপড়চোপড় কাদায় একাকার। মুখের কাদা সাফ করতে করতে রুমালের আড়াল থেকে বললেন, ‘পায়ে ব্যথা হচ্ছে।
শুধু, মচকে গেছে দারুণভাবে।
আর কোথাও?’ শহীদ জিজ্ঞেস করল।
মি. নাসির খোঁড়াতে পেঁড়াতে কয়েক পা পিছিয়ে এসে শুকনো ঘাসের উপর এসে দাঁড়িয়ে বললেন, না।’ ‘
এমন সময় ফিরে এলেন মি. সিম্পসন। বললেন, ‘না, ধরা গেল না লোকটাকে। একটুও ব্যথা পায়নি, দৌড়ে কোন্দিকে পালিয়েছে কে জানে।
‘লোকটা কে, মি. নাসির? নিশ্চয় চিনতে পেরেছেন?’
একমুহূর্ত উত্তর দিলেন না মি. নাসির। তারপর বললেন, আমি এর কিছুই বুঝে উঠতেম পারছি না, মি. শহীদ। জানি না কে এভাবে আমাকে হত্যা করতে চায়।
| শহীদ বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মি. নাসিরের দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আপনি লোকটাকে চিনতে পারেননি বলছেন?’
কি করে চিনব, লোকটার মুখ তো আর আমি দেখতে পাইনি।’
শহীদ বলল, মিথ্যে কথা বলছেন, মি. নাসির। লোকটাকে আপনি ঠিকই চিনতে পেরেছেন। কিন্তু কোনও কারণবশত না চেনার ভান করছেন।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, মি. শহীদ
শহীদ মি. নাসিরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা জানি না, মি. নাসির, আপনি কোন্ স্বার্থে আমাদের সঙ্গে বারবার অসহযোগিতা করে চলেছেন। এর ফল কি হবে জানেন? আপনিই বিপদে পড়বেন এর ফলে। তাছাড়া মন্টিকে খুঁজে বের করতে শুধু শুধু দেরি হয়ে যাবে। কাওসারের নিষ্ঠুর হত্যার মীমাংসা চান না
আপনি?’ কুমাশা-১৭
৬৭
‘চাই।’ অপ্রতিভ কণ্ঠে বললেন মি. নাসির।
শহীদ বলল, ‘কিন্তু আপনি যদি সব কথা খুলে না বলেন তাহলে কাওসারের হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে দঁাড়াবে আমাদের পক্ষে। বলা যায় না,
দেরি হয়ে গেলে হত্যাকারী হাতের নাগালের বাইরেও পালিয়ে যেতে পারে।’
. মি, নাসির চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। শহীদ প্রশ্ন করে হঠাৎ, ড্রাইভার শামসু কেমন লোক বলে মনে করেন, মি. নাসির?’
তাড়াতাড়ি উত্তর দেন মি. নাসির, ‘কেন, বেশ ভাল লোক বলেই তো জানি।
‘ভাল লোক হলে গাড়িতে লুকিয়ে বসে থেকে সুযোগ মত আপনার গলা টিপে ধরে হত্যা করতে চায় কেন সে?
চমকে উঠে বোকার মত তাকিয়ে থাকেন মি. নাসির শহীদের দিকে। শহীদ বলল, “কি, চুপ করে রইলেন কেন?’
মি, নাসির চোখ নামিয়ে নিয়ে শেষ কথা বললেন, ‘আমি জানি না।
‘জানেন! আমি জানি আপনি জানেন কেন লোকটা আপনাকে খুন করতে চায়। কিন্তু কারণটা প্রকাশ করতে চান না আপনি যে কোনও কারণেই হোক! তাই
?’
উত্তর দেন না মি. নাসির। শহীদ বলল, ‘ঠিক আছে, কারণটা চেষ্টা করে আমরাই বের করে নেব, মি. নাসির। মনে রাখবেন অপরাধ কখনও চাপা পড়ে থাকে না।
‘অপরাধ? আমি কি অপরাধ করেছি, মি. শহীদ?’ ‘সেটা আপনি আমার চেয়েও বেশি ভাল করে জানেন।
শহীদের কথার উত্তরে আর কথা বলতে ভরসা পান না মি. নাসির। শহীদও আর কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। মি. সিম্পসন শুধু বললেন, ‘কাল সকালে গাড়িটা এখান থেকে ওঠাবার ব্যবস্থা করবেন, মি. নাসির। চলুন, আপনাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিই।
| গাড়িতে উঠে বসে শহীদ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মি. নাসির ওদের গাড়িতে এসে ওঠেন। সবশেষে ওঠেন মি. সিম্পসন। স্টার্ট দিয়ে শহীদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন, মি. নাসির।
কোনও উত্তর দেন না মি. নাসির। শহীদ বলল, ‘এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আপত্তি আছে আপনার, না?’
এরপর আর কোনও কথাবার্তা হয় না ওদের তিনজনের মধ্যে। শান্তিনীড়ের গেটের কাছে গাড়ি থামাতে বিদায় নিয়ে নেমে পড়েন মি. নাসির। শহীদ তার উদ্দেশ্যে বলল, ভাল মনে করলে মি. সিম্পসনকে কিংবা আমাকে যে কোনও সময় আপনার কথা শোনাবার জন্যে আসতে পারেন আপনি। তাতে রহস্যটার মীমাংসা হতে পারে। যদিও আমি জানি আপনি কোনও কথাই বলবেন না।
৬৮
কথাটা বলে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই গাড়ি ছেড়ে দেয় শহীদ। মি. নাসির পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকেন গাড়িটার অপসৃয়মান লাল দু’টুকরো আলোর দিকে তাকিয়ে। সর্বশরীর তার যেন পাথর হয়ে জমে গেছে। শুধু মাথার ভিতর হাজার হাজার দুশ্চিন্তার সাপ কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। মনে রাখবেন, অপরাধ কখনও চাপা থাকে না।’–শহীদ খানের হুঁশিয়ারি বাণীটা মন থেকে কোনও মতে সরাতে পারেন না তিনি। কি একটা দারুণ আশঙ্কায় সর্বশরীর অবশ হয়ে আসতে চায় যেন তার।
শহীদ এবং মি. সিম্পসন অদৃশ্য হয়ে গেছে চোখের আড়ালে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাবেন মি. নাসির। তারপর বাড়িতে প্রবেশ করে গ্যারেজের দিকে হাঁটতে থাকেন।
মিসেস নাসিরের গাড়িটা বের করে স্টার্ট দেন মি. নাসির। হুশ করে বেরিয়ে যায় গাড়িটা বাড়ি থেকে।
‘ মি, নাসির গাংচিল বারে গিয়ে গাড়ি থামান। রাত তখন সাড়ে বারোটা বাজে। বারের মেন গেটে দারোয়ান মি. নাসিরকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই চটপট সাহেবী কায়দায় স্যালুট মারে।
‘খান আছে তো? ‘জ্বি, হুজুর। আছেন।’
গেট পেরিয়ে ভিতর দিকে এগিয়ে যান মি, নাসির। ঠিক তখনি বাইরে একটি ভেসপা এসে দাঁড়ায়। আরোহী গাড়িটাকে রাস্তার পাশে রেখে বারের মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যায়। দারোয়ানের চোখজোড়া তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। ভেসপার আরোহীকে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি একটা স্যালুট ঠুকে দেয় যন্ত্রচালিতের মত। কিন্তু দীর্ঘাকায় আগন্তুক সেদিকে ভূক্ষেপ না করে এগিয়ে যায় গাংচিল হোটেল অ্যান্ড বারের ভিতর দিকে।
দীর্ঘকায় আগন্তুক হোটেলের ভিতর ঢোকার আধমিনিট পর গেটের দারোয়ান গেট ছেড়ে দ্রুতপায়ে ভিতর দিকে এসে থমকে দাঁড়াল। সুরকি বিছানো চওড়া পথটা পেরিয়ে গার্ডেনের দু’পাশে রাস্তার মধ্যিখানে এসে দাঁড়াল সে। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাল। কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে কি যেন ভাবল। তারপর আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি মনে করে আবার তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। তার দুশ্চিন্তার কারণ হল–সে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেখান থেকে হলঘরে প্রবেশ করার দরজাটা স্পষ্ট দেখা যায় এবং যে অপরিচিত আগন্তুকটি কিছুক্ষণ আগে হোটেলে প্রবেশ করেছে তাকে সে হলঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখতে পেল না। কিন্তু শেষ অবদি সে ভাবল, লোকটা হল ঘরে ঢুকেছে ঠিকই, সে দেখতে ভুল করেছে।
এদিকে দীর্ঘকায় আগন্তুক হোটেলের বাগানে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছিল মি.
৬৯
নাসির কোন্ কেবিনটায় ঢুকলেন। তারপর দক্ষিণ দিকের সরু রাস্তা ধরে বিশেষ একটি কেবিনের ব্যালকনিতে কষ্টেসৃষ্টে উঠে পড়ল। সেখান থেকে খোলা দরজা দিয়ে করিডরটা উঁকি মেরে দেখে নিল। ফাঁকা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে পানির কলের ওপর উঠে দাঁড়াল সে। চোখের নাগালের মধ্যে এসে গেল বাথরুমের ভেন্টিলেটারটা। আগন্তুক ভেন্টিলেটারের ফোকরে চোখ লাগিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল পাশের ঘরটিতে মি. নাসির ও গাংচিল হোটেল এবং বারের প্রোপাইটার এক হাত-ওয়ালা ইকরামুল্লা চিন্তিতভাবে কথা বলে চলেছে। আগন্তুক মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল ওদের কথাবার্তা। বেশ স্পষ্টই শুনতে পেল সে কথাবার্তা। মি, নাসির বললেন ইকরামুল্লা খানকে, কিন্তু লকেটটা আমাদের কাছেই আছে সে কথা জানল কি ভাবে লোকটা?’
. এক মুহূর্ত ভেবে ইকরামুল্লা খান উত্তর দিল, ‘লোকটা মানে কে জান?
কুয়াশা!’
কুয়াশা!’ চমকে উঠলেন মি. নাসির।
আগন্তুক মি. নাসিরের চমকে ওঠা দেখে মৃদু একটু হাসল। মি. নাসির চিন্তিত ইকরামুল্লা খানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তাহলে উপায়? কুয়াশা তো হেলাফেলার লোক নয়, সে করতে পারে না এমন কাজ নেই দুনিয়ায়।
কুটিল একটুকরো হাসি ফুটল ইকরামুল্লা খানের মুখে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কিন্তু বাছাধন ঘুঘু দেখেছে, ঘুঘুর ফাঁদ দেখেনি। হাজার চেষ্টা করলেও সে লকেট আদায় করতে পারবে না আমাদের হাত থেকে।’
কি করে?
ইকরামুল্লা খান বলল, ‘খুব সহজ ভাবেই। লকেটটা কোথায় আছে তা শুধু তুমি আর আমি জানি। আমরা যদি প্রাণ গেলেও সেকথা প্রকাশ না করি তাহলেই হবে। প্রতিজ্ঞা কর নাসির যে, প্রাণ গেলেও তুমি কারও কাছে বলবে না লকেটটা বক্সনগরের কোন গাছের কোটরে লুকিয়ে রাখা আছে।
মি. নাসির গম্ভীর গলায় বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, প্রাণ গেলেও লকেট কোথায় আছে সে কথা কাউকে বলব না।’
‘আমিও প্রতিজ্ঞা করছি!’
ইকরামুল্লা খানের কথা শেষ হতেই মি. নাসির বলে ওঠেন, এদিকে আর এক নতুন বিপদ এসে পড়েছে–ড্রাইভার শামসু জেনে ফেলেছে সেই ব্যাপারটা। সে আজকে মেরেই ফেলত আমাকে। গাড়ির পিছনে কখন কে জানে লুকিয়ে ছিল। কিছুদূর আসার পরই পিছন থেকে গলা টিপে ধরেছিল। ভাগ্য ভাল বলে ধান খেতে
পড়ে গিয়ে এ যাত্রা বেঁচে গেছে প্রাণটা।
‘শালাকে ধরে ফেলেছ তো?’ প্রশ্ন করল ইকরামুল্লা খান।
মি. নাসির বলেন, ‘ধরব কি করে, পা’টা মচকে গেছে যে। আবার মরার উপর
৭০
খাড়ার ঘা-পুলিস আর শখের গোয়েন্দা শহীদ খান ঠিক সময় মত এসে হাজির। আগেই টের পেয়েছিলাম পিছন পিছন আসছে…।’
‘টিকটিকিটাকে সুযোগ পেলেই জাহান্নামের দরজা চিনিয়ে দেব আমি! বড়। বাড় বেড়ে গেছে ব্যাটা! আমার দু’জন লোককে সে গা করে দিয়েছে!’
মি. নাসির বলেন, কিন্তু তার ওপর তুমি এত চটা কেন, ইকরামুল্লা?”
চমকে উঠে তাকায় ইকরামুল্লা মি. নাসিরের দিকে। ধূর্ত একটুকরো হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মি. নাসির তার বন্ধুর দিকে। ইকরামুল্লা বলল, ‘বিজনেসের পার্টনার তো তুমি শুধু নামেই, যত ঝক্কিঝামেলা সবই তো আমাকে পোহাতে হয়। তুমি কি করে জানবে টিকটিকিটার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখতে কেন আমি বাধ্য হয়েছি।’
মি. নাসির বললেন, তার মানে আমাদের ব্যবসার কথা আঁচ করে ফেলেছে নাকি কিছুটা?’–
| ‘সোনার কারবার ছেড়ে দিতে হবে, হে নাসির। শুধু আঁচ করেনি, সব জেনে ফেলেছে।
“তবে? তবে কি হবে?
মি. নাসিরকে অকারণে উদ্বিগ্ন করে তুলে আনন্দ পায় ইকরামুল্লা। হাসে সে। বলে, ‘ভেব না তুমি, ব্যবসা ঠিক খাড়া রাখব আমি। তা না হলে খাব কি? আসলে একটু সতর্ক থাকতে হবে আর কি।
ইকরামুল্লার আশ্বাসবাণী শুনে কিছুটা শান্ত হন মি. নাসির। হঠাৎ ইকরামুল্লা চোখ দুটো কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ভাইপোদের হত্যা আর নিখোঁজ সম্পর্কে পুলিস এবং টিকটিকির ধারণা কি বল তো?’
তারা তো আমাকেই সন্দেহ করছে, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন মি. নাসির।
হষ্ঠাৎ ঘরের ছাদ ফাটিয়ে হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে ইকরামুল্লা খান। বোরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মি. নাসির ইকরামুল্লার দিকে। তাঁর অসহায়তা দেখে লোকটা হাসছে কেমন করে ভেবে পান না তিনি। হাসি থামতে ইকরামুল্লা বলে, ব্যাঙ্কে চিঠি দেখিয়ে টাকাটা কবে তাহলে তুলছ, নাসির?’
‘টাকাটা কি তুলব?’ অসহায় কণ্ঠে পরামর্শ চান মি. নাসির।
ইকরামুল্লা বলল, আরও দু’দিন অপেক্ষা কর বরং। আমার মতে আরও চমক অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।
‘মানে!’ মি. নাসির প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকান ইকরামুল্লার দিকে।
ইকরামুল্লা হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। বলে, ‘দু’দিন ধৈর্য ধরে থাক, নিজেই বুঝতে পারবে মানেটা। যাকগে, অনেক রাত হয়েছে নাসির। তোমার বেগম সাহেব শুয়ে শুয়ে অভিমান করছে বুঝি ফিরতে দেরি দেখে।’
মিসেস নাসিরের প্রসঙ্গ উঠতেই শক্ত হয়ে ওঠে মি. নাসিরের চোয়াল দুটো।
হষ্ঠাৎ ঘরে থাকেন নি ভেবে পা
৭১
কিন্তু কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। তারপর বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
| আগন্তুক এতক্ষণ ধরে ওদের দুজনের সব কথা শুনে নিয়েছে। সে-ও এবার পানির কলের উপর থেকে মেঝেতে নেমে বের হয়ে আসে সন্তর্পণে বাথরুম থেকে। ব্যালকনিতে পৌঁছে লাফিয়ে পড়ে সে মাটিতে। তারপর বাগানের দিকে হাঁটতে থাকে সতর্ক পায়ে।
তিন
রাত একটা।
| সোনার মা বিছানায় পড়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা হয়ে গেছে বাড়ির মেজ ছেলে কাওসারের লাশ খুঁজে পাবার পর। সেই তখন থেকেই কাঁদছে প্রৌঢ়া সোনার মা। কত কথাই তার মনের মধ্যে ভিড় করে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। বড় ভাল ছিল কাওসারের আম্মা। কাওসারের আম্মা যখন এ বাড়ির বড় বউ হয়ে আসে তার সঙ্গেই দেখাশোনার ভার দিয়ে কাওসারের নানী পাঠিয়েছিলেন সোনার মাকে। সোনার মা তখন সবেমাত্র বিধবা হয়েছে। ছেলেটাও মরে গেছে কলেরায়। খুশি মনেই দিদিমণির সাথে দিদিমণির শ্বশুর বাড়ি এসেছিল সে। মনে আশা ছিল নিজের ঘর-সংসার যখন নেই তখন দিদিমণির ঘর-সংসার দেখাশোনা করেই সাধ, মেটাবে সে। তবে সে সাধ তার ব্যর্থ হয়নি। দিদিমণির শ্বশুর বাড়িতে সোনার মা স্থায়ী হয়ে গেল। দিদিমণি মায়ের বাড়ির লোককে ছাড়তে রাজি হল না কোনমতে।
সারওয়ার এবং কাওসার যখন হল তখন সে কি আনন্দ সোনার মার। রাত জেগে আঁতুড় ঘরে ঠায় বসে থাকে সে পুরো পাঁচটি দিন। দু’দুটো ছেলে, দিদিমণি সামলাতে পারত না একা। কিন্তু তাই বলে কোনও সমস্যাঁতেই পড়তে দেয়নি সে দিদিমণিকে। দু’ছেলেকেই খাইয়েছে দাইয়েছে, রাত জেগে বসে থেকেছে, যদি বাচ্চারা ঘুম ভেঙে কান্না শুরু করে দেয়।
একটু বড় হতে কোলে পিঠে করে সারওয়ার এবং কাওসারকে মানুষ করেছে সে। দিদিমণিকে কোনও ঝক্কি ঝামেলাই পোহাতে দেয়নি সে।
ধীরে ধীরে সারওয়ার এবং কাওসার বড় হয়ে গেল। অনেক দিন আর বাচ্চা কাচ্চা হল না দিদিমণির। তারপর বারো বছর পর পেটে এল ছোটটি-মন্টি। কিন্তু মন্টি প্রসব হতেই দুধের বাচ্চাকে রেখে চলে গেল দিদিমণি সকলের হাতের বাইরে। বুক শূন্য হয়ে গিয়েছিল সোনার মার দিদিমণিকে চলে যেতে দেখে। এতদিন বুঝতে পারেনি সে যে তার জীবনের অর্ধেকটাই ছিল দিদিমণি। দিদিমণি তার অর্ধেক জীবন নিয়ে চলে যেতে সে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। তারপর থেকে
কোনদিন হাসতে পারেনি সে ভুলেও। কিন্তু দিদিমণি চলে যাবার সাথে সাথে তার মাথায় একটা দায়িত্ব দিয়ে গেল–দুধের বাচ্চা মন্টিকে মানুষ করে তোলার। . আবার কাজে লাগল সোনার মা। মন্টির ভার নিজের হাতে নিয়ে বড় দাদামণিকে নিশ্চিন্ত করল সে। কিন্তু দিদিমণির শোকে বড় দাদামণিও ইহজগতে বেশিদিন টিকতে পারল না। হঠাৎ কি যে হল, তিন দিনের জ্বরে বিছানায় পড়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বড় দাদামণি অবশ্যি বিছানায় পড়েই বলেছিল আমার সময় হয়ে গেছে, সোনার মা। তুমি আমার মন্টিকে দেখো। . কিন্তু সোনার মা’র কপাল খারাপ। দাদামণি আর দিদিমণির দেয়া গুরু দায়িত্ব
সে পালন করতে পারল কই!
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল সোনার মার। হঠাৎ…!
ও কে সরে গেল জানালার সামনে দিয়ে?
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে সোনার মা। দরজার দিকে পিছন ফিরে শুয়েছিল সে। এদিকের দেয়ালেও জানালা আছে, কিন্তু দরজা নেই। সোনার মা স্পষ্ট দেখল জানালা পথে, কে যেন দ্রুত পায়ে সরে গেল। চেহারাটা চিনতে পারেনি সে। কিন্তু একটা ছায়া সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে। কোনও মানুষেরই ছায়া।
| কে ঐ ছায়া? এই মাঝরাতে কোথা থেকে আসল? ওদিকে যাবার তো কোনও রাস্তা নেই। শুধু সুড়ঙ্গটাই আছে ওদিকে। তবে কি সুড়ঙ্গ থেকেই বেরিয়ে এল কেউ? কিন্তু তা কি করে সম্ভব! নদীর কিনারা থেকে শুরু হয়েছে সুড়ঙ্গটা। নদীর দিক থেকে এত রাতে কোনও চোর ঘঁাচড় ঢুকল নাকি বাড়িতে? কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব? স্পষ্ট মনে আছে সোনার মার যে, সে সন্ধেবেলায় সুড়ঙ্গের দরজা খোলা দেখে নিজের হাতে বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিয়েছিল। তাহলে! তাহলে বাইরে থেকে কেউ ঢোকেনি বাড়িতে। বাড়িরই কেউ সুড়ঙ্গ-পথে নদীর কিনারায় গিয়েছিল। এখন সে ফিরে এল। তাই হবে!
কিন্তু এই মাঝরাতে কেন গিয়েছিল ছায়াটা নদীর ধারে?
সোনার মার বুকের ভিতর কি যেন দাপাদাপি করে ওঠে। কি একটা কথা মন্টি হারিয়ে যাবার পর থেকেই উঁকি-ঝুঁকি মারছে তার মনে অহরহ-মন্টি কোথায় আছে? এ বাড়িতেই নেই তো কোথাও?
বুকের ভিতর থেকে কে যেন কথা বলে ওঠে। মণ্টির করুণ স্বর যেন বেজে ওঠে সোনার মার কানে। কিছুই জানে না সে বাচ্চাটার কি হাল হয়েছে। তবু যেন কোথা থেকে মন্টির আছাড়-পাছাড় করে কান্নার স্বর কানে এসে বাজতে থাকে তার। কান পেতে কি যেন শুনতে চায় সোনার মা। কিন্তু রাতের একটানা নিস্তব্ধতাই বিরাজ করছে চারদিকে। কোনও শব্দ নেই কোথাও। সোনার মার
।
৭৩
সোনার গলার সমানও বা ছায়াগুলো
চঞ্চলতা তবু কমে না। বুকের ভিতর থেকে মন্টির কাকুতি-মিনতি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে যেন সে।
গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় সোনার মা
. মেঝেতে। তারপর পা টিপে টিপে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চাঁদ ডুবে যাচ্ছে আকাশের শেষ প্রান্তে। গাছের ছায়াগুলো বিরাট বিরাট হয়ে পড়ে আছে মাটির ওপর। সোনার মা কোনও প্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পায় না।
জানালার সামনে থেকে সরে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি, যেন ভাবে সোনার মা। মন্টির আব্বা যেন কথা বলে ওঠে তার কানের পাশ থেকে আমার মন্টিকে তুমি দেখ, সোনার মা!
চমকে ওঠে সোনার মা। কি যেন চিন্তা করে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। গতরাতের কথা মনে পড়ে যায় তার। সাহেবের ঘরে একজন লম্বা-চওড়া মানুষ এসেছিল। তার হাতে ছিল ছোট্ট একটা বন্দুক। সে এসেছিল নদীর দিক থেকেই।
সোনার মার মনে হয়-নদীর ধারে হয়ত কিছু ব্যাপার আছে। বাড়ির কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি সে মন্টিকে। কিন্তু নদীর কিনারায় যে বোট-হাউসটা আছে সেটা অনেকদিন থেকে তালা মারা বলে কেউ খোঁজ করেনি সেখানে। সে-ও ভাবেনি কথাটা। বোট-হাউসটা একবার দেখা দরকার।
নিঃশব্দে খুলে ফেলে সোনার মা ঘরের দরজা। উঁকি মেরে দেখে নেয় বারান্দাটা। কেউ নেই। উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে সোনার মা খানিকক্ষণ। গাছের ছায়াগুলোকেই কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে তার। কেউ লুকিয়ে নেই তো
ঐ আলোছায়াতে? ‘
. বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর মনে সাহস আনতে পারে সোনার মা। ঘর থেকে বেরোবার আগে গায়ে-মায়ায় ভাল করে কাপড় জড়িয়ে নেয় সে। দোয়া দুরুদ পড়ে কয়েকবার করে। তারপর বিসমিল্লা বলে বেরিয়ে পড়ে বারান্দায়।
মাঝরাতে আর কোনদিন ঘর ছেড়ে একা বেরোয়নি সোনার মা। অশরীরী একটা ভয় পেয়ে বসতে চায় যেন তাকে। অলৌকিক শক্তি বলেই যেন হাঁটতে থাকে। বারান্দা থেকে নেমে যন্ত্রচালিতের মত উঠান ধরে সে।
উঠানটা ঘুরে তার নিজের ঘরের পিছন দিকে এসেও পা থামে না তার। অদ্ভুত একটা ক্ষমতা এসে গেছে সোনার মার পা দুটোয়। নিজের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। ইচ্ছা করলেই এখন আর সে থামতে পারছে না। সে যেন চলছে না, কে যেন চালাচ্ছে তাকে।
এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে চোরের মত সুড়ঙ্গটার মুখের সামনে পৌঁছে যায় সোনার মা। সুড়ঙ্গের দরজা খোলা দেখে চমকে ওঠে সে। সুড়ঙ্গটার ভিতরে জমাট অন্ধকার যেন খিলখিল করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না এবারও সোনার মা। ঢুকে পড়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর।
৭৪
সামনের কিছুই দৃষ্টিগোচর হবার নয়। নিজের পায়ের শব্দ শুনে চমকে ওঠে সোনার মা। বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। নিজের ঢোক গেলার শব্দ শুনেও সন্দেহ হয়, কে যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিন্তু পা পা করে এগিয়েই চলল সোনার মা সুড়ঙ্গ পথে। এখন তার থেমে দাঁড়ানোর কোনও উপায়ই নেই। পিছন থেকে কারা যেন ছুটে আসছে বলে মনে হতে থাকে তার। হাঁটার গতি নিজের অজান্তে বেড়ে যায়।
হঠাৎ বিদঘুঁটে একটা ছোট্ট আর্তধ্বনি করে দাঁড়িয়ে পড়ে সোনার মা। দুটো হাত দিয়ে সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরে সে। উত্তেজনায় হাঁপাতে শুরু করেছে বলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে দু’বার থরথর করে কেঁপে উঠে তার সর্বশরীর। একটা বাদুরের বাচ্চা উড়ে এসে হঠাৎ তার ঘাড়ে বসে পড়েছিল। সোনার মা চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল ভীষণভাবে চমকে উঠে। যেন পেছন থেকে কেউ তার ঘাড় চেপে ধরেছে।
বুকের ধড়ফড়ানি কিছুটা কমতে আবার অন্ধকারে পা ফেলে হাঁটতে থাকে সোনার মা। ঘর থেকে হ্যারিকেনটা জ্বেলে না নিয়ে এসে ভুল করেছে সে। সুড়ঙ্গটা পরিচিত তার। কিন্তু অন্ধকারে কে কোনখানে ওঁৎ পেতে আছে কে জানে। সাবধান হবার কোনও উপায় নেই। বাঁ পাশের চুন-খসে পড়া এবড়োখেবড়ো দেয়ালের গায়ে একটা হাত রেখে হাঁটতে থাকে সে।
আর বেশি দেরি হয় না সোনার মার। সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে একেবারে নদীর কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। সুড়ঙ্গটা একেবারে নিকষ কালো অন্ধকারে ডোবী। কিন্তু বাইরে এসে আবছা আলো পাওয়া গেছে। নদীর পানি দেখাচ্ছে কালো পিচের মত। চকচক করছে। নদীর ওপারে গ্রাম।
| চাঁদের অন্তিম আলো পড়ে কেমন ছবি মত দেখাচ্ছে গ্রামটা। কোনও জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। মৃদুমন্দ শব্দে নদীর পানি বইছে। হঠাৎ ছানাবড়া হয়ে ওঠে সোনার মার চোখ দুটো। ওটা কি ভেসে যাচ্ছে নদীতে?
নদীর মধ্যিখান দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটা আধকাটা কলা গাছ। সোমার মার চোখ থোকা দেয় তাতে। মনে হয়, কোনও মানুষের পচে ওঠা লাশ ভেসে যাচ্ছে। তারপর নিজেরই অজান্তে অলক্ষুণে একটা সন্দেহ জাগে তার মনে–মণ্টির লাশ নয়ত।
তওবা তওবা করে সোনার মা। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করে, তারপর নদীর দিকে তাকায় ভাল করে। এদিকেই ভেসে আসছে কলা গাছটা। একটু পরই চিনতে পারে সোনার মা কলাগাছটাকে। বুকটা কে যেন মুক্ত করে দেয় ভারি ওজনদার একটা পাথর সরিয়ে দিয়ে। সোনার মা এবার নদীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে উঁচু পাড়ের দিকে তাকায়। বোট-হাউসটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কিন্তু নদীর কিনারা ধরে হাঁটতে চায় না সোনার মা। কাদায় পা পিছলে যাবার ভয়। আছে।
৭৫
নদীর কিনারা থেকে উঁচু পাড়ের দিকে উঠতে শুরু করে সোনার মা। বেশ উঁচু পাড়টা। কষ্ট হয় উঠতে। এমনিতেই দারুণ একটা গা ছমছমে ভয় তাকে কাহিল করে ফেলেছে। তার ওপর এত পরিশ্রম। রীতিমত হাঁপাতে থাকে সোনার মা।
পাড়ের উপর উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির পিছন দিক এটা। দরকার না পড়লে ভুলেও কেউ কখনও এদিকে আসে না। তাই কচু গাছ, জংলী লতা-পাতায় জঙ্গল মত হয়ে আছে এদিকটা। সোনার মা সেই ঝোঁপ-ঝাড় পেরিয়ে হাঁটতে থাকে বোট-হাউসের দিকে।
আবার সেই করুণ কান্নাটা শুনতে পায় সোনার মা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোথায় যেন কাঁদছে মন্টি। থমকে দাঁড়ায় সোনার মা। কিছুই যেন বুঝতে পারে না সে। কে যেন কানে কানে কি বলতে চাইছে তাকে। কান পাতে সে শ্বাস বন্ধ করে। কিন্তু কিছুই তেমন স্পষ্ট করে শুনতে পায় না। শুধু মন্টির অসহায় কান্নাটা বেজে ওঠে তার কানে। মনের কোনও কোণ থেকে যেন আসছে কান্নাটা। কিন্তু পরক্ষণেই সন্দেহ হয় তার। পিছন ফিরে তাকায় সে। কচু বন থেকে আসছে নাকি কান্নার সুরটা? আশপাশেও তাকায়। কিন্তু বুঝতে পারে না সে রহস্যটা। একবার মনে হয়, ও তার কানের ভুল। আবার পরক্ষণেই কান খাড়া করে কি যেন শুনতে চেষ্টা করে সে। ভাবেনা তো, কাছে পিঠে থেকেই কেউ কাঁদছে থেকে থেকে। ঠিক যেন মন্টির গলার আওয়াজ! | বোট-হাউসের দিকে তাকায় সোনার মা। আবার কান পাতে। তারপর হঠাৎ অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ঐ তো আবার শোনা যাচ্ছে আমার খোকামণির কান্না!
| ভয়ঙ্কর ভয় পায় সোনার মা। শিউরে ওঠে অকারণেই! হঠাৎ অদ্ভুত একটা ইচ্ছা জাগে-ছুটে পালাতে ইচ্ছা করে ঘরের দিকে। তারপরই মনে হয়-গলা চিরে চেঁচিয়ে উঠতে চাইছে সে যেন। কিন্তু পালাতেও পারে না সোনার মা, চেঁচিয়েও ওঠে না। পাথরের মূর্তির মত আরও খানিকক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিলম্বিত একটা ডাক শুনে অন্তরাত্মা পর্যন্ত কুঁকড়ে যায় তার। কোথায় যেন একটা কুকুর ককিয়ে উঠল। | যা থাকে কপালে, এসেছি যখন তখন এর হদিশ করেই যাব-ভাবে সোনার মা। তারপর পা বাড়ায় সামনের দিকে। কিন্তু মনের ভিতর থেকে কে যেন বারবার সাবধান করতে থাকেযাসনি তুই, আর এক পাও এগোবি না, যদি নিজের ভাল চাস।
সোনার মা মনের সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করেই এগোতে থাকে। এখন তার গতি ঢিমে হয়ে গেছে আপনা থেকেই। প্রতি পদেই ভয়ের চাপ আরও বেশি করে তার বুকে চেপে বসছে। প্রতি নিঃশ্বাসের সঙ্গে কে যেন তাকে বারণ করছে-আর
, ফিরে যা এবার!
৭৬
আরও কয়েক পা এগোল সোনার মা। আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার চোখজোড়া। অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। মধ্যরাতের শীতল বাতাসেও দরদর করে ঘেমে নেয়ে উঠেছে সে। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট দুটো থেকে থেকে। সেই ঠোঁটের ফাঁক গলে একটি নাম অস্ফুটস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে যেন তার অজান্তেই ‘মন্টি! মন্টি! মন্টি! মন্টি!
সোনার মা এখন স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছে মণ্টির ফোঁপানি! কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই আর। ভয়ের চেয়ে অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় কাঁপছে সে। অপ্রত্যাশিত আনন্দে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সোনার মা। একদিকে উত্তেজনা, একদিকে আতঙ্ক, একদিকে আনন্দ-সব মিলেমিশে অবর্ণনীয় আকার পেয়েছে সোনার মার মুখমণ্ডল। কোনও দিকে খেয়াল দেবার কথা ভুলে গিয়ে বোট হাউসের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটছে সে। আর মাত্র পাঁচ হাত দূরে বোট হাউসের জানালাটা!
উন্মাদিনীর মত এক ছুটে গিয়ে জানালাটার শিক ধরে ঝুঁকে পড়ল সোনার মা। কিন্তু বোট-হাউসের ভিতর একাগ্র দৃষ্টিতে অন্ধকার ভেদ করে মন্টিকে খুঁজে ফিরতে লাগল তার চোখজোড়া। কিন্তু ব্যর্থ হল চেষ্টা। অন্ধকার ভেদ করে মন্টিকে দেখতে পেল না সে।
মন্টি! খোকাবাবু! ফিসফিস করে আকুল গলায় ডেকে উঠল সোনার মা। বোট-হাউসের ভিতর মন্টির কান্না মুহূর্তের জন্যে থমকে থেমে গেল।
‘খোকাবাবু! কে তোমাকে এখানে আনছে বাছা!’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল সোনার মা।
: কিন্তু কোনও উত্তর এল না তার কথার। মন্টি এবার জোরে কেঁদে উঠল। সোনার মার বুক ফেটে যেতে লাগলো মন্টির কান্না শুনে। কি করবে সে ভেবে পেল
। একবার মনে হল ছুটে গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে আসে। একবার মনে হল, এখান থেকেই গলা ফাটিয়ে সাহেবকে ডাকতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবল-কে রেখে গেছে এখানে মন্টিকে? সাহেবের কাজ নয়তো? কিংবা ছোট বউয়ের হাত নেই তো এই কাজে? | সন্দেহ দুটো মন থেকে কোনমতে সরাতে পারল না সোনার মা। এখন কি করবে সে? মন্টিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে কে তাকে এই বোট-হাউসে রেখে গেছে? কিন্তু মন্টি যে আরও আছাড়-পাছাড় করে কাঁদতে শুরু করেছে।
মন্টি! খোকাবাবু! আমার কথা শোন, বাবা! আমি সোনার মা! আমাকে তোমার ভয় কি! আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। সেজন্যেই তো এসেছি আমি, খোকাবাবু! আর কেঁদ না, লক্ষ্মী আমার, আর কেঁদ না…।’
কিন্তু সোনার মার আদরের কন্ঠ শুনেই প্রচণ্ড অভিমানে কান্না জোর করে তুলেছে মন্টি। থামছে না সে কোনও মতে। হাজার কথাতেও সে এখন থামবে না।
৭৭
জানালার সামনে থেকে সরে গিয়ে বোট-হাউসের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সোনার মা। বড় একটা তালা ঝুলছে দরজায়। তালাটা ভাঙা তার কর্ম নয়। ফিরে এসে দাঁড়াল আবার জানালাটার সামনে। বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ সেখানেই। মন্টির কান্না থামবে কিসে সেই চিন্তাতেই পাগল সে এখন। মারা যাবে যে ছেলেটা! এভাবে গলা ফাটিয়ে কি কেউ বেশিক্ষণ কাঁদতে পারে?
চোখের জল বাঁধ মানে না সোনার মার। দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ে তার দু’গাল বেয়ে। কে এমন নিষ্ঠুর কাজ করল? দয়ামায়া বলতে কি কিছু নেই তার বুকে!
‘খোকাবাবু?’ মন্টি আরও জোরে কেঁদে ওঠে। ‘খোকাবাবু, আমি তোমার সোনার মা!
মন্টি মাথা ঠুকতে থাকে বোট-হাউসের দেয়ালে। শব্দটা যেন ছুরির ফলা হয়ে ঢোকে সোনার মার বুকে!
‘খোকাবাবু তোমাকে খাবার এনে দেব? টফি?’
টফি মণ্টির খুব প্রিয়। তাই টফির কথা বলে কান্না থামাতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু বুকটা তার ভয়ে হিম হয়ে গেল পরক্ষণেই। মন্টি এক নাগাড়ে মাথা ঠুকতে
শুরু করল তার কথা শুনে।
স্থান-কাল ভুলে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল সোনার মা। আর সহ্য হচ্ছে না। ছেলেটার দুর্দশার কথা ভেবে। মা হয়ে ছেলের এই হাল কে আর সইতে পারে। মন্টি তার পেটের ছেলে না হতে পারে, কিন্তু তার চাইতে কম কিসে? পরের ছেলের জন্যে হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ মমতা ঢেলে দিয়েছে সে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষ করেছে পাঁচ-পাঁচটি বছর। মায়ের বাড়া সে। | মা এবং ছেলের আকুল কান্না শুনে চারপাশের গাছপালা পর্যন্ত থমকে গেছে। যেন। চাঁদ এই করুণ দৃশ্য সইতে না পেরেই বুঝি অস্ত গেল। আর দূরে কোথাও করুণ স্বরে ডেকে উঠল একটা মোরগ।
চার
পরদিন সকালে সোনার মাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল ঘরের ভিতর।
| ভোর বেলা এক কাপ চা হাতে নিয়ে মি. নাসিরের ঘরে পৌঁছে দেবার দায়িত্বটা অনেকদিন থেকেই নিয়মিত পালন করে আসছিল সোনার মা। সেদিন সকাল সাতটা বেজে গেল অথচ চায়ের দেখা নেই। মি. নাসির কিছুটা আশ্চর্য হয়ে মিসেস নাসিরের দরজায় এসে করাঘাত করলেন। মিসেস নাসিরের বেলা আটটার আগে ঘুম ভাঙে না কোনদিন। স্বামীর ঘন ঘন ডাকে ঘুম জড়িত চোখে দরজা খুলে ৭৮
দিয়েই বিরক্ত কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন, “ডাকাত পড়েছে নাকি বাড়িতে! এত চেঁচামেচি কিসের শুনি?
মি. নাসির শান্তভাবেই বলেন, ‘সোনার মা কোথায় দেখ তো। আমার চা দেয়নি কেন এখনও?”
‘ও, এই জন্যে এত হট্টগোল! তা তুমি নিজে গিয়ে দেখতে পার না? জান না এত সকালে আমার ঘুম ভাঙে না!’
স্ত্রীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকান মি. নাসির। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু রান্নাঘর অবদি যেতে হয় না তাকে। সোনার মার ঘরটাই আগে পড়ে। মি. নাসির দেখেন তার ঘর এত বেলাতেও ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হয় ঘুম ভাঙেনি এখনও।
অগত্যা সোনার মার দরজার কড়া নাড়েন মি. নাসির। কিন্তু বারবার শব্দ করে কড়া নাড়াতেও সাড়া পাওয়া যায় না তার। আশ্চর্য হন মি. নাসির। নাম ধরেও ডাকেন তিনি তাকে। কিন্তু ভিতর থেকে কোনও টু-শব্দও পাওয়া যায় না। আবার তিনি স্ত্রীর দরজায় ফিরে এসে দাঁড়ান। মিসেস নাসির ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় লুটিয়ে পড়েছেন। এবারও প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেন তিনি।
‘সোনার মার ঘরের দরজা বন্ধ কেন? এত ডাকাডাকি করছি তবু কোনও সাড়া নেই
. মিসেস নাসির ভ্রু কুঁচকে তাকান স্বামীর দিকে। বিরক্তি এখনও পুরোপুরি যায়নি যেন তাঁর, তবে কিছুটা অবাক ভাব ফুটে ওঠে তাঁর মুখে।
কই চল তো দেখি!’
স্বামীর সঙ্গে সোনার মার দরজার সামনে এসে দাঁড়ান মিসেস নাসির। তারপর কড়া নাড়েন জোরে জোরে।
কিন্তু এবারও সোনার মার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না ভিতর থেকে। এরপরও নানা চেষ্টা চলে তার ঘুম ভাঙাতে। কিন্তু সোনার মা চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। বরং বলা ভাল সোনার মাকে চিরদিনের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন আর ডাকাডাকি করে লাভ কি?
কুড়ি মিনিট পরই মিসেস নাসিরের পরামর্শে মি. নাসির ফোন করেন থানায়।
মি. সিম্পসন খবর পেয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে শহীদকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনীড়ে উপস্থিত হন। তারাও অনেক চেষ্টা করেন সোনার মার ঘুম ভাঙাতে। জানালা-দরজা সব বন্ধ। সুতরাং ভিতরে কি ঘটেছে তা বোঝার কোনও উপায় নেই। অগত্যা গায়ের জোরে ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলা হয় দরজা।
দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে গিয়েই চমকে ওঠে শহীদ। সোনার মাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায় সে। কড়ি-কাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস পরে যেন
৭৯
আত্মহত্যা করেছে সোনার মা।
মাগো!
মিসেস নাসির সকলের পিছনে ঘরে ঢুকেই দৃশ্যটা দেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেন। মি. নাসির বোকার মত তাকিয়ে থাকেন কড়ি-কাঠের দিকে, যেখানে দড়িটা বাঁধা হয়েছে। মি. সিম্পসন তাকান শহীদের দিকে। শহীদ ধীরে ধীরে ঘরের অপর দিকের জানালার সামনে গিয়ে দঁাড়ায়। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে ঘুরে দাঁড়ায় সে। একে একে মি. নাসির এবং মিসেস নাসিরের দিকে তাকায় সে। তারপর অতি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে, গত রাতে এ বাড়িতে সোনার মাকে নিয়ে আপনারা তিনজন ছিলেন মোট, তাই না?’
‘জ্বি, হ্যাঁ। উত্তর দেন মিসেস নাসির, ড্রাইভার শামসু মিয়া গত কালকের রাত থেকে কোথায় যেন চলে গেছে।’
‘আপনি জানেন কেন এ বাড়ি থেকে ও চলে গেছে। মিসেস নাসির চমকে উঠে তাকান শহীদের দিকে। শহীদ তাকে প্রশ্ন করছে, নিজের সিদ্ধান্ত জানাল, তা তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না।
‘আমি জানি না!’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিসেস নাসিরের দিকে তাকিয়ে থেকে শহীদ বলল, জানেন
না?’
মি. নাসির হঠাৎ বলে ওঠেন, একটা কথা, মি. শহীদ।
শহীদ বলল, আমি জানি, আপনি কি বলতে চান, মি. নাসির। আপনি বলতে চান, আপনার স্ত্রী যখন একবার বলছেন যে, ড্রাইভার শামসু মিয়া এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে কেন তা উনি জানেন না, তখন ওনাকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করা ঠিক নয়-তাই না?
অপ্রতিভ হয়ে যান মি. নাসির। শহীদ ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘বেশ!’
মি. সিম্পসন বলেন, ‘লাশটা নামাবার ব্যবস্থা করব কি, শহীদ?’
হা।’ ছোট্ট করে উত্তর দেয় শহীদ। সে তখন ঘরের একটি মাত্র দরজার সামনে গিয়ে কি যেন পরীক্ষা করছে গভীর মনোযোগের সাথে।
মি. সিম্পসন ঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, ‘জমাদার। একজন পুলিস কনস্টেবল এসে ঢোকে ঘরের ভিতর। ‘আপনারা একটু ঘরের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন দয়া করে।
মি. এবং মিসেস নাসিরের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল শহীদ। ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান ওঁরা। জমাদার আসলে পুলিশ কনস্টেবলটির ডাক নাম। সে সম্মুখে দাঁড় করানো একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সোনার মার গলার দড়ি ব্লেড দিয়ে কেটে লাশটা নামাতে লেগে যায়। মি, সিম্পসন সাহায্য করেন তাকে। এদিকে শহীদ
৮০
ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কি যেন পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় বাইরে বের হয়ে এসে দরজার মাথার উপরের ছোট একটু ফাঁক দিয়ে কড়ে আঙুলটা ভিতরে ঢোকাতে চেষ্টা করে সে। একটু চেষ্টা করার পরই আঙুলটা ঢুকিয়ে ঘরের ভিতরকার ছিটকিনিটা স্পর্শ করতে পারে। সাফল্যের একটুকরো হাসি ফোটে তার মুখে। মি. এবং মিসেস নাসির ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শহীদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন এতক্ষণ।
শহীদ তাঁদের দিকে ফিরেই বলল, বুঝতে পারলেন কি দেখছিলাম আমি? “কি! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রশ্ন করে ওঠেন একসঙ্গে। ‘খুনীর বুদ্ধিমত্তা!’
খুনী! এবার রীতিমত চমকে উঠে বলে ওঠেন মি. এবং মিসেস নাসির। ‘ইয়েস! দিস ইজ এ প্লেন কেস অত মার্ডার! দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে এসে মি. সিম্পসন বলে ওঠেন। সোনার মাকে গলা টিপে খুন করে খুনী কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে লটকে দিয়েছে। আমাদের চোখে ধোকা দেবার জন্যেই অবশ্য। কিন্তু লাশের গলা টিপে ধরার ফলে দাগ রয়েছে, এখনও মিটে যায়নি। যদিও এখনও আমি জানি না খুনী কিভাবে ঘর থেকে…।
এ কি বলছেন আপনারা!’ আর্তনাদ করে ওঠেন মি. নাসির। মিসেস নাসির ককিয়ে উঠে বললেন, ‘হায়, আল্লা! এ কি শুরু হল বাড়িতে।
শহীদ কোনও কথা না বলে ঘরে ঢুকে সোনার মার লাশের উপর ঝুঁকে পড়ে। | মি, সিম্পসন ঢোকেন পিছন পিছন। “ঠিক তাই! আপনি নির্ভুল! মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে শহীদ।
মি. সিম্পসন শহীদের কানের কাছে মুখ সরিয়ে এনে বলেন, আর দেরি করে কোনও লাভ আছে কি, শহীদ? মি. নাসিরকে এখুনি গ্রেফতার করাটাই কি উচিত হবে না?
না! আরও একদিন…।
মি. এবং মিসেস নাসিরকে ঘরে ঢুকতে দেখে চুপ করে যায় শহীদ। তারপর আবার বলে, ‘লাশ পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠাতে পারেন মি. সিম্পসন।’
‘এ বাড়ির ফোনটা একটু দেখিয়ে দেবেন? | মি. সিম্পসনের কথা শুনে মিসেস নাসির বললেন, আমার সঙ্গে আসুন।’
মি. সিম্পসন এবং মিসেস নাসির ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতেই মি. নাসির দ্রুত পায়ে শহীদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর হঠাৎ শহীদের একটা হাত ধরে ফেলে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন, আপনি এ ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ করবেন না, মি. শহীদ-প্লীজ! আমি যা জানি সব আপনাকে বলব, কিন্তু আপনি শুধু মন্টিকে খুঁজে বের করে দিন।
শহীদ বলল, ‘সোনার মার হত্যার ব্যাপারে কিন্তু আপনি সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন, ৬-
মি. নাসির। যাই হোক, এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। আপনি যদি সব কথা খুলে বলতেন, তবে না হয় বুঝতাম। কিন্তু…’।
‘আমি বলব, মি. শহীদ! আমার যা অপরাধ তা আমি স্বীকার করব। বিশ্বাস করুন আমার কথা। কিন্তু তার আগে আমার মন্টিকে খুঁজে দিন আপনি…’
শহীদ স্থির দৃষ্টিতে তাকায় মি. নাসিরের চোখের দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, ‘যদি বলি আপনি নিজেই মন্টিকে এ বাড়ি থেকে সরিয়েছেন!
‘আমি! ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু আমার কি স্বার্থ তাতে, মি. শহীদ! মন্টিকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি।
‘শহীদ বলে, স্বার্থ? সেই চিঠিটা দেখিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে বলবেন আপনার বড়দার ছেলে বিপদগ্রস্ত, টাকা দরকার। উইলে তো সেরকম ব্যবস্থা করে রেখেই গেছেন আপনার বড়দা। টাকাই যদি হয় আপনার স্বার্থ? আর মন্টিকে আপনি বেশি ভালবাসেন বলেই আপনি হয়ত মনে করছেন, পুলিস আপনাকে সন্দেহের অতীত ব্যক্তি বলে মনে করবে। কিন্তু আপনার ব্যবহারই এমন উদ্ভট, যাতে আপনাকে নানা দিক দিয়ে সন্দেহ না করে উপায় নেই।
নিরাশ দৃষ্টিতে মি. নাসির তাকান শহীদের দিকে। তারপর বলেন, ‘আমার শেষ কথা আমি বলে দিয়েছি, মি. শহীদ। মন্টিকে খুঁজে এনে দিন যেভাবেই হোক, তখন আমি নিজের কথা বলব। তার ফলে আমার কপালে যা আছে তাই হবে। কিন্তু মন্টিকে জীবিত এবং বিপদমুক্ত না দেখে মুখ খুলব না আমি। এখন যা করার ইচ্ছা করুন আপনারা।’
শহীদ কথা না বলে দরজার দিকে তাকায়। মি. সিম্পসন এবং মিসেস নাসির ফিরে এসেছেন।
| মর্গের গাড়ি এসে পড়বে বিশ মিনিটের মধ্যে। লাশ পাহারা দেবার জন্যে জমাদার রইল। এখন আসুন আমরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসি। আপনাদের জবানবন্দী লিখে নিতে হবে।
ড্রয়িংরুমে এসে বসল ওরা সকলে। জেরা করা হল মি. এবং মিসেস নাসিরকে, কিন্তু প্রয়োজনীয় কোনও তথ্যই তারা দিতে পারলেন না। মি. সিম্পসন পরোক্ষভাবে এ প্রশ্নও করলেন যে, আপনারা কেউ কি হত্যা করেছেন সোনার মাকে? ওনারাও পরোক্ষভাবে জানালেন-না। কারও উপর সন্দেহ হয় কিনা। জিজ্ঞেস করাতে দুজনেই ড্রাইভার শামসু মিয়ার নাম উল্লেখ করলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতে উত্তর এল দুজনের একই লোকটার না বলে পালিয়ে যাওয়াটা
সন্দেহের ব্যাপার।
আর কিছু উল্লেখযোগ্য কথা আদায় করা গেল না জেরা করে। ঢাকার বাইরে
৮২।
ওঁরা না জানিয়ে যেন না যান এই নির্দেশ দিয়ে শান্তিনীড় ছেড়ে বের হয়ে এল। শহীদ এবং মি. সিম্পসন। গাড়ি এসে ততক্ষণে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেছে।
শহীদের ফোক্সওয়াগেনে উঠে বসে মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মি. নাসিরকে গ্রেফতার করতে মানা করলে কেন, শহীদ?’
শহীদ বলল, ‘ভোর রাতে বার্মা থেকে আসা সেই টেলিগ্রামটি পেয়ে গেছি আমি মি. সিম্পসন। আমার বন্ধু মিয়ান জাপকে টেলিগ্রাম করেছিলাম কয়েকটি তথ্য পাঠাবার জন্যে। বার্মার বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিয়ান। সে জানিয়েছে যে, ইকরামুল্লা খান এবং নাসিরউল্ল্যা নামের দুজন সোনা চোরাচালানকারী পাণ্ডা বার্মায় ধরা পড়তে পড়তে পালিয়ে গেছে। তারা পালাবার সময় চীরণ নামের বিখ্যাত মন্দিরের গুপ্তধনের নকশাটিও চুরি করে নিয়ে গেছে একজনকে খুন করে। যাকে খুন করা হয়েছে সে-ও বার্মার এক সোনা চোরাচালানকারী দলের পাণ্ডা। এ সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারকে শিগগির জানানো হবে। বুঝলেন?’
| ‘অত। তা কি করতে চাও তুমি এখন, শহীদ?’
মি. সিম্পসনের কথার উত্তরে শহীদ বলল, মি. নাসিরকে এখনই গ্রেফতার করলে সাবধান হয়ে যাবে পুরো দলটা। আমার ইচ্ছা তা নয়। আরও একদিন অপেক্ষা করে দেখা যাক মন্টির কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা। তারপর কাওসারের হত্যাকারীকেও খুঁজে বের করতে হবে। সবগুলো রহস্যের জাল একই সঙ্গে ছিঁড়তে চাই আমি। ভাল কথা, ড্রাইভার শামসুর কোনও হদিস করতে পারলেন?’
মি. সিম্পসন বললেন, শান্তিনীড়ের আশপাশে তো দূরের কথা, ঢাকা শহরের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। আর একটি কথা, শহীদ, তুমি তো আমাকে জিজ্ঞেস করনি ড্রাইভার শামসু মিয়ার ঘরে রক্তমাখা যে হাতুড়ীটা পাওয়া গেছে তাতে কারও হাতের ছাপ আবিষ্কৃত হয়েছে কিনা?’
‘আমি জানি, হাতুড়ীটায় কারও হাতের ছাপ পাওয়া যাবে না।’ শহীদের কথা শুনে মি. সিম্পসন বললেন, ‘মানে! কিভাবে জানলে তুমি?’
‘অনুমান। যাকগে, আপনি এখন চব্বিশ ঘন্টার জন্যে নজর রাখার ব্যবস্থা করুন শান্তিনীড়ের ওপর। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম দেখলেও আমাকে জানাতে ভুলবেন না যেন।
“ঠিক আছে।
মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে এসে পড়েছে গাড়ি। বিদায় নিয়ে নেমে পড়েন তিনি। শহীদ বলে, মৃতদেহের গলায় হাতের ছাপ আছে, ওর রেজাল্ট কি হয় জানাবেন।
দ্বিতীয়বার ঠিক আছে বলে বিদায় নেন মি. সিম্পসন। শহীদ বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে নেয় গাড়ি। ,
৮৩
তাতে কারও হাহাতুড়ীটায় কারও বললেন, ‘আনে জন্যে নজর রাখা জানাতে
দু’ঘণ্টা পরই সিম্পসন ফোন করলেন শহীদকে। শান্তিনীড়ে একজন লোক ঢুকে মি. নাসিরের সঙ্গে দেখা করে তখুনি বের হয়ে গেছে। লোকটা গাংচিল বারে ফিরে গিয়ে আর বের হয়নি। এদিকে মি. নাসির উত্তেজিতভাবে পায়চারি শুরু করেছেন শান্তিনীড়ের বারান্দাময়। মনে হয় অপরিচিত আগন্তুক কোনও দুঃসংবাদ দিয়ে গেছে তাকে। তাই তিনি হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।’
মি. সিম্পসনের কথা শুনে শহীদ বলল, আমি এখুনি গাংচিল বার-এ যাচ্ছি। আপনি মি. নাসিরের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকুন।
| দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল শহীদ গাংচিল বারের উদ্দেশে। কমার্শিয়াল এরিয়ার কাছাকাছি গাংচিল বার। রাস্তা থেকে একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছুল সে গাংচিল বার অ্যান্ড হোটেলে।
গাংচিল বার অ্যান্ড হোটেলের বিল্ডিংটা তিনতলা। নিচের তলায় বার ও রেস্তোরাঁ। দোতলা এবং তিনতলায় বোর্ডারদের থাকবার জন্যে সুইটের ব্যবস্থা।
শহীদ যখন বারের হলঘরে পৌঁছল তখন লোকজন নেই বললেই চলে। গাংচিল হোটেল অ্যাও বারে লোক জমায়েত হয় সন্ধ্যার পর থেকে। শহীদ দেখল .. মোট গোটা সাতেক লোক এ-টেবিল ও-টেবিলে ছাড়াছাড়া ভাবে বসে আছে। বদ্ধ মাতাল এরা। এক মুহূর্ত থাকতে পারে না এরা মদ ছেড়ে। তা না হলে এমন সময় বারে লোকজন থাকার কথা নয়।
ভিড় বেশি থাকলে কৌণের একটা টেবিল বেছে নিত শহীদ। কিন্তু এখন সে হলঘরের মাঝবরাবর একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে
উর্দিপরা একজন বেয়ারা এসে দাঁড়াল। লোকটা বুড়ো। চিবুকে সাদা দাড়ি।
| লোকটার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা পানীয়ের অর্ডার দিয়ে চোখ ফিরিয়ে কাউন্টারের দিকে দৃষ্টি ফেলতে যাচ্ছিল শহীদ। হঠাৎ আবার সে চোখ তুলে তাকাল বুড়ো বেয়ারাটার দিকে। বেশ কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকার পর বোঝা যায় না এমন মৃদু একটু হাসি ফুটল তার ঠোঁট জোড়ায়। বুড়ো বেয়ারা আর দাঁড়াল না। চলে গেল পানীয় আনার জন্যে।
এক মিনিট পর ফিরে এসে শহীদের অর্ডার মোতাবেক টেবিল সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল বেয়ারা। শহীদ গলা ভেজাবার সাথে সাথে হলঘরটা ভাল করে জরিপ করে নিল। হলঘর থেকে বোর্ডারদের কেবিনে যাবার দরজা মোট চারটে। দোতলায় উঠবার সিঁড়িটা দেখা গেল না খোলা জানালা দিয়ে।
একটু পরই বুড়ো বেয়ারাটা বিল নিয়ে ফিরে এল। বিলটা হাতে নিয়ে কত টাকা হয়েছে দেখে, বিল মিটিয়ে দিল শহীদ। তারপর মেমোটা উল্টে দেখল, | তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছেঃ
শহীদ, ৮৪
চলে নিল। হলঘর থেকে দেখা গেল না খোলাক্ষির এল। বিলটা উল্টে দেখল
রাত এগারটার দিকে মি. নাসিরকে অনুসরণ করে এখানে এস। পিছনের পাইপ বেয়ে ওপরে উঠবার চেষ্টা করবে। ছদ্মবেশে দলবল নিয়ে
হাজির থাকতে বলবে কাছাকাছি মি, সিম্পসনকে।
কুয়াশা চিরকুটটা পড়ে আবার একবার অস্পষ্টভাবে হাসল শহীদ। বুড়ো বেয়ারা ওরফে ছদ্মবেশী কুয়াশাকে আগেই চিনতে পেরেছিল সে।
গাংচিল হোটেল অ্যাও বার থেকে বের হয়ে সিধে মি. সিম্পসনের অফিসে পৌঁছুল শহীদ। মি. সিম্পসন জরুরী একটা কাজে বাইরে গেছেন, তবে এক্ষুণি ফিরবেন। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর মি. সিম্পসন ফিরলেন।
| ‘অদ্ভুত, অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে শহীদ। মন্টিকে কে চুরি করেছে তা জেনে ফেলেছি!’ অফিসরুমে ঢুকে শহীদকে দেখতে পেয়েই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ বলল, “তাই নাকি? কে? ‘মি. নাসিরের বন্ধু, ইকরামুল্লা চুরি করেছে মন্টিকে!’
‘অসম্ভব!’ দৃঢ়কণ্ঠে দ্বিমত প্রকাশ করল শহীদ, ইকরামুলার পক্ষে মন্টিকে চুরি করা সম্ভব নয়। ইকরামুল্লা অনেকদিন শান্তিনীড়ে পা দেয়নি এখবর আমি জানি।
কিন্তু এই দেখ চিঠি! এই চিঠিটা একটা লোক মি. নাসিরকে দিয়ে গাংচিল বারে গিয়ে ঢুকেছে-যার কথা তোমাকে ফোনে জানিয়েছিলাম। মি. নাসির এই চিঠি নিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেছে একটু আগে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার চিঠিটা পরীক্ষা করার জন্যে রেখে দিয়েছিল। আমি খবর পেয়ে নিয়ে এসেছি চিঠিটা। তুমি নিজেই দেখ।’’
মি. সিম্পসনের বাড়ানো হাত থেকে চিঠিটা নিল শহীদ। চিঠিটায় লেখাঃ বন্ধুবর নাসির,
আমার এই চিঠি পেয়েই তোমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠবে। তুমি হয়ত এক্ষুণি ছুটে আসতে চাইবে আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্যে। কিন্তু তোমাকে আমি উপদেশ দিচ্ছি-রাত এগারোটার আগে এস না আমার কাছে। দেখা পাবে না এলে।
যাকগে, যা বলতে চাই তা এবার বলেই ফেলি। মন্টিকে যে চুরি করেছিল সে তোমার কাছে মাত্র দশ হাজার টাকার দাবি করেছিল। কিন্তু এখন তুমি তার নির্দেশ মত দশ হাজার টাকা রেখে আসলেও মন্টিকে ফিরে পাবে না। পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা যদি তুমি আমার টেবিলে নিয়ে এসে সাজিয়ে দাও তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে তোমার মন্টিকে ফিরে পাবে। নচেৎ এ জীবনে তার হদিস করা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।
ইতি,
তোমার অসময়ের বন্ধু।
৮৫
চিঠিটা পড়া শেষ করে মৃদু হাসল শহীদ। তারপর বলল, “চিঠিটা ইকরামুল্লা খান লিখেছে বলেই একথা সত্যি নয়, মি. সিম্পসন, যে মণ্টিকে সে-ই চুরি করেছে। তাছাড়া একথাও তো লিখেছে যে দশ হাজার টাকার দাবি যে করেছিল তার কাছে এখন মন্টি নেই। কথাটা একটু ঘুরিয়ে লিখেছে সে।
| মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘শহীদ, তুমি কি জানতে পেরে মন্টিকে কে চুরি করেছে?– না। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে মণ্টিকে ঐ বাড়ির কোনও মানুষই সরিয়েছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘ড্রাইভার শামসু মিয়াকে সন্দেহ হয় তোমার?
শহীদ বলল, মি. নাসিরের প্রতি লোকটার বিরূপতা আছে বটে। কিন্তু তার পক্ষে কাওসারকে খুন করা অসম্ভব। আক্রমণ করার হাত তার কাঁচা। আমি তার প্রমাণ পেয়েছি।’
তবে?’ . মি. সিম্পসনের মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল দেখে শহীদ হাসে। তারপর বলে, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, মি. সিম্পসন, যে অপরাধীরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে–যার ফলে আমরা কোনও রহস্যেরই হদিস করে উঠতে পারছি না। কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়ে অপরাধী এমন সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে চলেছে যে, তারা নিজেরাই ধরা পড়ে যাবে। কষ্ট করে আর ধরতে হবে না আমাদেরকে।
মি. সিম্পসন আর কোনও প্রশ্নই করলেন না। শহীদ আবার বলতে শুরু করল, আজ রাত এগারটার সময় আপনি সিভিল ড্রেসে কিছু সংখ্যক সশস্ত্র পুলিস নিয়ে উপস্থিত থাকবেন গাংচিল হোটেলের কাছাকাছি। আমি পিছন দিয়ে উপরে উঠব। হুইসেল বাজলেই ভিতরে ঢুকে পড়বেন আপনি।
মি. সিম্পসন আশ্চর্য হয়ে তাকালেন শহীদের দিকে। শহীদ মৃদু হেসে আরও কয়েকটি কথা বলে বিদায় নিল মি. সিম্পসনের অফিসরুম থেকে।
পাঁচ
কাঁটায় কাঁটায় রাত এগারোটা। গাংচিল হোটেল অ্যাণ্ড বার।
| মি. নাসিরের গাড়ি এসে থামল বারের ফটকে। সারবন্দী আরও অনেকগুলো গাড়ির পাশে নিজের গাড়িটা রেখে নেমে পড়লেন মি. নাসির। ঠিক সেই সময় শহীদের ক্রিমসন কালার ফোক্স-ওয়াগেনটি হোটেলের পিছন দিককার মাঠের অন্ধকারে এসে থামল। গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল শহীদ ধীর-শান্তভাবে। গাড়ি লক করে একই জায়গায় অনড় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সে কয়েক সেকেণ্ড। ৮৬,
তার হাতে একটা দড়ির মই দেখা গেল।
পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারটা একবার স্পর্শ করল শহীদ। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কঁকা মাঠটা জরিপ করে নিল। দ্বিতীয়বার গাংচিল হোটেল অ্যাণ্ড বারের বিল্ডিঙের পিছন দিককার কাঠামোটায় চোখ বুলাল। না, কেউ দেখছে না তাকে।
| রাত এখন এগারোটা। কেবিনে কেউ নেই বললেই চলে। সকলে পান ভোজনে মত্ত বারের হলঘরে। নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত এগোল শহীদ। দশ কদম হেঁটেই পাঁচিলের আড়ালে চলে এল। মাথা নিচু করে দড়ির মইটা খোলার কাজে লেগে গেল সে তখুনি। মইটা ভোলা হয়ে যেতেই এক কাণ্ড ঘটল। এক গামলা ময়লা পানি ঠিক শহীদের মাথার ওপর পড়ল। কে যেন উপর থেকে ফেলেছে পানিটা।
ঝট করে রিভলভারটা বের করতে করতে উপর দিকে তাকাল শহীদ। দেখল একজন বেয়ারা চলে যাচ্ছে বারান্দা ধরে। তার হাতে একটা গামলা। হেসে ফেলল শহীদ। লোকটা অজ্ঞাতসারেই শহীদের মাথার উপর ফেলেছে ময়লা পানি। রুমাল দিয়ে মাথা আর কাঁধের কাছটা মুছে নিয়ে তৈরি হল শহীদ। প্রথমবারের চেষ্টাতেই দড়ির মইটা আটকাতে সমর্থ হল সে দোতলার বারান্দার রেলিঙের উপর। দেরি করা মানেই শত্রুপক্ষকে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়া। তরতর করে উঠে পড়ল সে মই বেয়ে দোতলায়। ফাঁকা বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে থেকে মইটা টেনে তুলে ফেলল তিন সেকেরে মধ্যে। তারপর বারান্দা ধরে নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে একটা আধ-খোলা দরজার সামনে গিয়ে ভিতরটা উঁকি মেরে দেখল।
ঘরটায় আনাজ-পাতি রাখা হয়। ঢুকে পড়ল শহীদ। দড়ির মইটা ঘরের এক কোণে ফেলে রেখে বন্ধ একটা দরজার দিকে এগোল। হঠাৎ শব্দ শোনা গেল কোনও লোকের। ঝটিতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল শহীদ। একটা লোক আলুর বস্তার আড়াল থেকে বেরিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে খোলা দরজাটা দিয়ে। পাথরের মত অনড় দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। লোকটা কোনও কাজে আগেই ঢুকেছিল ঘরে। শহীদ টের পায়নি। লোকটাও বুঝতে পারেনি শহীদের অনুপ্রবেশ। বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল লোকটা। খোলা দরজা বন্ধ করে দিল সে বাইরে থেকে। অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে পেন্সিল-টর্চটা বের করে অপর বন্ধ দরজাটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। দেখল ও দরজাটা ভিতর থেকেই বন্ধ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এটাও যদি বাইরে থেকে বন্ধ থাকত। তাহলেই হয়েছিল! বন্ধ ঘরের ভিতরই আটকা পড়ে যেত সে।
দরজার ছিটকিনিটা খুলল শহীদ। উঁকি মেরে দেখল ফাঁকা একটা করিডর, আর করিডরের সর্বদক্ষিণে উপরে ওঠার সিঁড়ি। দ্বিধায় পড়ে সময় নষ্ট করা উচিত নয়, আর একবার সতর্কভাবে ফাঁকা করিডরটা দেখে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোল শহীদ সিঁড়িটার দিকে।
৮৭
সিঁড়িতে উঠতে উঠতেই পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে হাতে নিল সে। কিন্তু তিন তলায় উঠে কাউকে দেখতে পেল না। করিডরের দু’পাশের কেবিনের দরজা জানালা বন্ধ। সতর্কভাবে এগোল শহীদ। সামনেই একটা জানালা দেখা যাচ্ছে। কাঁচের শার্সি ভেদ করে ঘরের আলো এসে পড়েছে করিডরের মেঝেতে। উঁকি মেরে দেখল শহীদ জানালাটার পাশ থেকে। মিনাসির!
দেখা গেল ঘরের ভিতর মি. নাসির একা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে উত্তেজিত ভাবে। জানালাটাকে পাশ কাটিয়ে আরও তিন কদম এগোল শহীদ। জানালাটার একটু দূরেই একটা আধ-ভেজানো দরজা। তিরিশ সেকেণ্ড ধরে অল্প অল্প করে ফঁক করল শহীদ দরজাটা। একটা বাথরুম। ঢুকে পড়ল ভিতরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে পানির চৌবাচ্চার উপর উঠে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটারের ফোকর দিয়ে পাশের ঘরের ভিতর তাকাল সে। মি. নাসির এখনও একা একা ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। চোখ দুটো খুনীর মত অচঞ্চল, আর একটা হিংস্র প্রতিজ্ঞার চিহ্ন তার দৃষ্টিতে। হাত দুটো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ, দ্রুত পায়ে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন তিনি।
অপেক্ষা করাই স্থির করল শহীদ। ইকরামুল্লা খানের জন্যেই মি. নাসির অপেক্ষা করছেন। সে ঘরে প্রবেশ করলেই কথোপকথন শুরু হবে ওদের। শোনা দরকার ওদের কথাবার্তা।
কিন্তু শহীদের অজ্ঞাতসারে ঠিক তখুনি বাথরুমের দ্বিতীয় দরজাটি বিন্দুমাত্র শব্দ না তুলে খুলে গেল আস্তে আস্তে। বিশালাকার একজন লোক ঢুকল তীক্ষ্ণফলা একটা ছোরা হাতে। লোকটার মুখে ধূর্ত হাসি ফুটে রয়েছে। চোখ দুটোয় হিংস্র দৃষ্টির ঝলকানি। পা পা করে এগোছে সে শহীদের দিকে নিঃশব্দে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে। হাতের চকচকে ছোরা বাগিয়ে ধরে।
দাঁড়িয়ে আছে শহীদ চৌবাচ্চার উপর। ভেন্টিলেটারের ফোকর থেকে চোখ সরাচ্ছে না সে। মি, নাসির আগের মতই ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন একা। শত্রুর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সচেতন নয় শহীদ। জানা আছে বাথরুমের দুটো দরজাই বন্ধ। কেউ যে ইতিমধ্যেই সেখানে ঢুকে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে গুটি গুটি
এগিয়ে আসছে তা সে বুঝবে কি করে?
লোকটা ঠিক শহীদের পিছনে এসে পড়েছে। ছোরাটা আরও শক্ত ভাবে ধরল সে আঙুলগুলো দিয়ে। তারপর হাতটা উপরে তুলে পিছন দিকে নিয়ে গেল। এবার সে বিদ্যুৎ গতিতে শহীদের পিঠে বসিয়ে দেবে ছোরাটা আমূল।
লোকটা বিদ্যুৎ গতিতেই চালাল ছোরাটা। ‘আঁ-আঁ-আঁ!’–
অস্ফুট একটা আর্তনাদ উঠল বাথরুমের ভিতর। পলকের মধ্যে চৌবাচ্চার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল শহীদ বাথরুমের মেঝেতে। একটা লোককে বিস্ফারিত bro
পড়েছে।
ততে শহরের হাত
চোখে হাঁ করে মেঝেতে পড়ে যেতে দেখল। লোকটার হাতে তখনও একটা চকচকে ছোরা ধরা। লোকটা মেঝেতে পড়ে যাবার সাথে সাথে শহীদ দেখল তার। পিঠে একটা ছোরা বিঁধে রয়েছে। ঠিক তক্ষুণি খোলা দরজার দিকে চোখ পড়তে শহীদ দেখল কুয়াশা এগিয়ে আসছে।
“কি ব্যাপার, কুয়াশা?’ শহীদ প্রশ্ন করল।
কুয়াশা লোকটার উপর ঝুঁকে পড়ে একটা রুমাল দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে আক্রমণ করতে এসেছিল শয়তানটা, শহীদ।
কুয়াশা লোকটার মুখ বাঁধার পর হাত-পা বাঁধল পকেট থেকে সরু কর্ড বের করে। তারপর শহীদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘চল, কামালকে নিয়ে আসি।
কামাল কোথায়?
শহীদের প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা বলল, কামাল একটা ঘরে বন্দী হয়ে আছে। তাকে আমি নিজের বাঁধন খুলতে এবং লাগাতে শিখিয়ে দিয়েছি। শত্রুদের অজ্ঞাতে নিজেকে নিজেই মুক্ত করে ইকরামুল্লার কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনে
সে।’
নির্জন করিডর ধরে নিঃশব্দ পায়ে আধমিনিট হেঁটে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। পরপর বিশেষ ভঙ্গিতে টোকা দিল কুয়াশা দরজার গায়ে। এর মিনিট খানেক পরই খুলে গেল দরজা। দরজার মুখে দেখা গেল কামালের সদা হাস্যময় মুখমণ্ডল।
কি খবর শহীদ?” কামালের প্রশ্ন শুনে শহীদ বলল, তোর খবর কি তাই বল?
কুয়াশা বলল, কথাবার্তা পরে হবে, শহীদ। এখন চল মি. নাসির আর ইকরামুল্লার নাটক শুনি।
কুয়াশা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ওদেরকে। কয়েকটি খালি ও নোংরা ঘরের ভিতর দিয়ে ওরা একটা ছোেট্ট বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে একটা বন্ধ দরজা দেখাল কুয়াশা শহীদকে। বলল, ঐ ঘরের ভিতর মি. নাসির আছেন।
ওরা তিনজন দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মি. নাসিরের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ফেটে পড়ল ঘরের ভিতর। মি. নাসির সম্ভবত ইকরামুল খানকে এতক্ষণে ঘরে ঢুকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। তুমি? তাহলে তুমিই আমার মন্টিকে চুরি করেছ! উহ! কি ভয়ঙ্কর, এত বড় নিষ্ঠুরতা তুমি করতে পারলে, ইকরামুল্লা? আমি
যে বিশ্বাস করতে পারছি না এখনও!’”। | ইকরামুল্লার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল ঘরের ভিতর থেকে। কথা আস্তে বল, নাসির। এত চেঁচাচ্ছো কেন?
| ‘কিন্তু আমার কথার উত্তর দাও, ইকরামুল্লা?’ উত্তেজনায় আবার চিৎকার করে
৮৯
ওঠেন মি. নাসির।
ইকরামুল্লা বলে,”সবই তো জেনেছ তুমি আমার চিঠিতে। আবার কি জানতে চাও?’
মন্টিকে তাহলে তুমিই চুরি করেছ?’
‘চুরি করিনি। তবে মন্টি এখন আমার হাতেই আছে। মানে, আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা যদি তুমি না দাও, তবে ওকে ফিরে পাবে না।’
মি. নাসির এক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘আর কাওসারকে খুন করেছ তাহলে তুমিই?’
‘আমি না। কাওসারকে খুন করেছে অন্য একজন। ‘কে?’ ‘তা তুমি কোনদিন জানতে পারবে না।’
মি. নাসির হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘শয়তানের বাচ্চা শয়তান! তোর স্পর্ধা দেখে…’
সাবধানে কথা বল নাসির। নয়ত…’ ইকরামুল্লাও সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে কথাটা।
মি. নাসির প্রচণ্ড ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘নয়ত কি? আমাকে গুম করে ফেলবে বুঝি।
‘অসম্ভব নয়।’ নির্বিকার কণ্ঠে বলে ইকরামুল্লা।
মি. নাসির হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললেন, “ইকরামুল্লা! তুমি না আমার বন্ধু? বন্ধু হয়ে আমার এমন সর্বনাশ তুমি করতে পারলে!’
‘কেউ কারও বন্ধু নয়, নাসির, এই দুনিয়ায়।’
ইকরামুল্লা মৃদু মৃদু হেসে বলে, তোমার আমার বন্ধুত্ব? সে তো প্রয়োজনের খাতিরে গড়ে উঠেছিল।
হা-হুঁতাশ করে মি. নাসির বলে ওঠেন, ‘এখন আর আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই বুঝি?
‘আছে! তবে এখন তোমার সঙ্গে আগের মত বন্ধুত্ব না রাখলেও তুমি আমার কাজ করে দেবে।’
ইকরামুল্লা বলতে থাকে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে, একটা কথা ভুলে গেছ তুমি, নাসির। আমি কেন তোমাকে এতদিন বন্ধুত্বের সমান মর্যাদা দিয়েছি, তা তুমি ইচ্ছে করেই ভুলে থাক দেখছি।
মি. নাসির ককিয়ে ওঠেন, তাহলে তোমার বন্ধুত্ব মেকি ছিল?
“নিশ্চয়ই! আসলে তোমার একটা দুর্বলতা খুঁজে পাবার পরই আমার মাথায় বুদ্ধিটা আসে। তোমার বাড়িতে যে গুরুতর দুর্ঘটনাটা তুমি ঘটিয়ে ফেলেছিলে তার সাক্ষী কেবল তুমি আর আমি ছিলাম। তারপর থেকেই আমি তোমাকে আমার ৯০
চেয়ে হাজার গুণ নিম্নপদস্থ লোক বলে জানতাম। সোনা, চোরাচালানীর ব্যবসা যদিও আমরা দুজন একসঙ্গেই শুরু করেছিলাম, কিন্তু এই ঘটনার পর তুমি আর আমার সমকক্ষ হতে পার না। ঠিক সেই কারণেই তোমাকে আমি অর্ধেক শেয়ার
দিয়ে দশ পারসেন্ট দিয়ে আসছি। এই দশ পারসেন্টও তোমার পাওনা হয় না। তুমি যে কাজ কর, তার জন্যে বেতন হওয়া উচিত বড় জোর দু’শো টাকা। কিন্তু এখন তুমি বছরে প্রায় পঁচাত্তর হাজার টাকা রোজগার করছ। এত বেশি তোমাকে দিচ্ছি কেন জান?’
‘কেন?’ হতভম্ব মি. নাসির প্রশ্ন করেন যেন স্বপ্নের ঘোরে।
‘তোমার সোশ্যাল প্রেসটিজের জন্যে। সমাজে তুমি গণ্যমান্য ব্যক্তি, তোমার নাম লোকে সমীহের সঙ্গে উচ্চারণ করে-তাই! যাতে আমার অবৈধ সোনা চোরাচালান কারবারের প্রতি পুলিসের নজর সহজে না পড়ে। তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে একথা যখনই লোকে শুনবে তখনই অন্য একটা ধারণা জন্মাবে তাদের মনে। বুঝলে? লোকে মনে করবে মি. নাসির যেখানে আছেন সেখানে কোনও অসৎ কাজ ঘটতে পারে না। এই সুযোগ ব্যবহার করি আমি নানা ভাবে।’
মি. নাসির বাবা হয়ে যান। অনেকক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে তিনি বললেন, তাহলে অনেক আগে থেকেই তুমি আমাকে এইভাবে বিচার করে আসছ!’ | | ‘নিশ্চয়! আমি তোমার সামাজিক মূল্যের কদর করে এসেছি এতদিন। একথা তো তোমারও না জানার কথা নয় হে! তুমি বাধ্য হয়েই আমার কাজ করছ। যদি তোমার অপরাধের কথাটা আমি না জানতাম তাহলে কি আর তুমি মাত্র দশ পারসেন্টে আমার হয়ে কাজ করতে?’
এই অবধি কথাবার্তা শুনেই কুয়াশা শহীদ ও কামালকে দরজার সামনে থেকে সরে যেতে বলল। ওরা দরজার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কুয়াশাও বন্ধ দরজার একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঝুঁকে পড়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে বন্ধ দরজার নিচের দিকে ঠক ঠক করে টোকা মারল। পরমুহূর্তেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল একটা।
বন্ধ দরজার ঠিক মাঝবরাবর দিয়ে ফুটো করে বেরিয়ে গেল কয়েকটি রিভলভারের গুলি। করিৎকর্মা ইকরামুল্লা খানের তারিফ না করে পারা যায় না। বন্ধ দরজার গায়ে অপরিচিত টোকা পড়তেই বুঝতে পেরেছে সে শত্রুর আগমন। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়েছে সে।
কুয়াশাও দেরি করল না। বিদ্যুৎগতিতে সামনে এসে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল দরজার গায়ে। এক ধাক্কাতেই ভেঙে পড়ল মজবুত দরজাটা। দরজার ভাঙা হুড়কোটা সিধে গিয়ে লাগল ইকরামুল্লা খানের মাথায়। দরজার দিকে মুখ করে বসেছিল। উফফ করে চিৎকার করে উঠল সে। পড়ে গেল হাত থেকে রিভলভারটা, আর ঠিক তখুনি কুয়াশা এক লাফে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
এদিকে সুইটে আরও দুজন ষণ্ডামার্কা লোক ছিল। এদের অস্তিত্বের কথা জানত না ওরা। যাই হোক, শহীদ এবং কামাল ঐ দুজনকে নিয়ে পড়ল। ইকরামুল্লা খান কুয়াশার মাত্র দুটো আধমণী ওজনের ঘুসি খেয়েই ঢলে পড়ল চেয়ার থেকে মাটিতে। কুয়াশা তাকে ছেড়ে দিয়েই দেখল খোলা দরজা দিয়ে একজন লোক ঢুকছে রিভলভার হাতে। লোকটা আত্মসমর্পণ করার জন্যে আদেশ দেবার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল শহীদের দিকে তাকিয়ে। শহীদ তখন তার শত্রুকে ধরাশায়ী করে বেদম ঘুসি মারছে। কুয়াশা দেখল কামালের শত্রু ঠিক তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। রিভলভার হাতে যে লোকটি সবেমাত্র ঘরের চৌকাটে এসে দাঁড়িয়েছে সে কুয়াশাকে দেখতে পায়নি। কামালের শত্রুও জানে না তার ঠিক পিছনে রয়েছে কুয়াশা। সুযোগটা নষ্ট করলে বিপদ ঘটবে বুঝতে পেরে দেরি করল না কুয়াশা। কামালের শত্রু ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করেছিল কামালের উপর। কুয়াশা পিছন দিক থেকে লোকটাকে ধরে ফেলে পলকের মধ্যে তুলে ফেলল মাথার উপর। তারপর প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ে মারল দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার উপর। | দরজার বাইরে গিয়ে আছড়ে পড়ল দুজনেই। কুয়াশাও চলে এল বারান্দায়। রিভলভারটা লোকটার হাত থেকে পড়ে গেছে। সেটা তুলে নিল সে। তারপর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, মাথার উপর হাত তুলে সাধু বাবাদের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক!’। কিন্তু এদিকে ইকরামুল খান সকলের অলক্ষ্যে টেবিলের উপর একটা হাত তুলে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল শহীদ। তখন তার হাতেও রিভলভার ধরা রয়েছে। কিন্তু বারান্দার দিকে মুখ করে গুলি ছুঁড়তে হবে তাকে ইকরামুল্লা বাধা দিতে গেলে। লক্ষ্যস্থির করতে না পারলে কুয়াশার গায়ে গিয়ে লাগতে পারে গুলি।
দপ করে নিভে গেল ঘরের বাতি।
আন্দাজেই ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শহীদ ইকরামুল্লার উপর। কিন্তু কোথায় ইকরামুল্লা! পালিয়েছে সে।
| খট খট করে কয়েকটা সুইচ টিপল কামাল সুইচবোর্ডটা খুঁজে পেয়ে। কিন্তু তখুনি জ্বলল না বাতি। জ্বলল আরও কয়েক সেকেণ্ড পর। আলোকিত সুইটে ওরা তিনজন পরস্পরের মুখ দেখল শুধু নিরুপায় বোধে। বাইরের বারান্দায় দুজন আহত হয়ে পড়ে আছে, সুইটের ভিতরও পড়ে আছে একজন। কিন্তু মি. নাসির এবং ইকরামুল্লার কোনও হদিস নেই।
দরজা দিয়ে পালায়নি ওরা! নিশ্চয় কোনও গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ আছে এই ঘরে।
কুয়াশার কথা শেষ হতেই শহীদ পকেট থেকে হুইসেল বের করে বাজাল দু’বার। কুয়াশা ব্যস্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়। গুপ্ত পথের সন্ধান করছে সে।
৯২
আধমিনিটের মধ্যে সফল হল কুয়াশা। দেয়ালের গায়ে একটা অতি ক্ষুদ্র বোম দেখে চাপ দেয় সে আঙুলের মাথা দিয়ে। একদিকের দেয়াল সরে যেতে থাকে বেশ দ্রুতভাবেই। দেয়ালটা একজন মানুষ গলার মত ফাঁক হতেই দেখা গেল একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। কোনও দ্বিরুক্তি না করে এগিয়ে যায় কুয়াশা সিঁড়ির দিকে। ঠিক তখুনি মি. সিম্পসন তার দল বল নিয়ে উপর তলায় হাজির হন।
কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে গেছে গুপ্ত পথে। মি. সিম্পসন শহীদকে কোনও প্রশ্ন করার আগেই শহীদ বলল, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হবে, মি. সিম্পসন। শত্রুরা পালাবার তালে আছে!
কামাল বলল, “এতক্ষণে পালিয়েছে বলেই তো মনে হয়…
‘না।’ শহীদ বলে, ‘সোনার গুদাম-ঘর আছে এই হোটেলেই। তার একটা ব্যবস্থা না করে পালাষে না শয়তান ইকরামুল্লা।
মি. নাসিরও ভেগেছেন নাকি!
মি. সিম্পসনের প্রশ্নের উত্তরে শহীদ বলল, “আসুন দেখা যাক। এই পথেই পালিয়েছে সবাই।
কুয়াশা যে পথে কিছুক্ষণ আগে নেমে গেছে, শহীদ দ্রুত পায়ে সেই গুপ্ত পথের দিকে এগোয়। মি. সিম্পসন আর কামাল তার পিছু নেয়। পুলিশ কনস্টেবল কজনও সবার পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে একটা আলোকিত সুইটের ভিতর। সুইটের সবগুলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। বাঁ দিকের একটা দরজা শুধু ভোলা দেখা গেল। ভেজানো রয়েছে। দ্রুত হাতে দরজাটা খুলতেই একতলার হলঘরটা দেখা গেল।
হলঘরে তখন মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। মদ্যপায়ী নারী-পুরুষ টেবিল চেয়ার উল্টে দিয়ে ভীত কণ্ঠে চিৎক্কার জুড়ে দিয়েছে। হুড়মুড় করে কেটে পড়তে চাইছে অনেকে দরজা দিয়ে তোওঁতি করে।
কাউকে বের হতে দেবেন না, মি. সিম্পসন, হোটেল থেকে। ইকরামুল্লা ওদের সাথে সাথে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে নেবে তাহলে।
রিভলভার হাতে সকলের উদ্দেশ্যে হুকুম জারি করেন মি, সিম্পসন, দরজার কাছ থেকে সরে এসে হলঘরের মাঝখানে জড়ো হন সকলে। কোনও ভয় নেই আপনাদের। কিন্তু কেটে পড়ার চেষ্টা করবেন না কেউ দয়া করে।
মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল হলঘরে। পুলিশ কনস্টেবল ক’জন ছুটল দরজার দিকে। শহীদ বলল, আপনি দরজাটা দেখুন, কেউ যেন পালাতে না পারে। আমরা ভিতরটা দেখি। হুইসেল বাজালে ভিতরে আসবেন আপনি।
মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে কথাকটি বলেই ছুটল শহীদ কামালকে সঙ্গে নিয়ে। হলঘর থেকে বের হয়ে ফাঁকা করিডর ধরে এগোল ওরা। চারদিকে উজ্জ্বল বাতি .
জ্বলছে। কিন্তু কোনও জন-মানুষের সাড়াশব্দ নেই কোথাও। এমন সময় ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করার কথা বয়-বেয়ারাদের। কিন্তু কারও দেখা নেই। খবর পেয়ে কে কোথায় সটকেছে কে জানে।
একটার পর একটা কেবিনের দরজা খুলে ভিতরটা পরীক্ষা করে সামনের দিকে এগোল ওরা। দু’বার মোড় পরিবর্তন করে হোটেলের বাঁ দিকের শেষ প্রান্তের
করিডরে চলে এল ওরা। শেষ সুইটের দরজার সামনে এসে ধাক্কা দিয়ে দরজা। খুলতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল শহীদ। সুইটের ভিতর কারা যেন কথা বলছে।
কান পেতে রইল ওরা। হঠাৎ কামাল তাকাল শহীদের দিকে। মিসেস নাসিরের স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা গেল সুইটের ভিতর থেকে, বোট-হাউজের ভিতরে আছে। আমি যাব?’
হ্যাঁ, এখুনি যেতে হবে তোমাকে। নাসির পৌঁছুবার আগেই যেতে হবে।’ ইকরামুল্লা খানের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ‘কিন্তু যাব কিভাবে? পুলিস যে সারা হোটেল ঘিরে ফেলেছে। ‘আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। এস।’
ইকরামুল্লার কথা শেষ হতেই করাঘাত করল শহীদ দরজায়। কিন্তু ভিতর থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
| ভাঙতে হবে দরজা। আয় ধাক্কা মারা যাক!’
দু’জন একসঙ্গে ছুটে গিয়ে গায়ের ধাক্কা লাগাল জার কপাটে। ভেঙে গেল দরজা। রিভলভার হাতে হুড়মুড় করে সুইটের ভিতর ঢুকে পড়ল ওরা দুজন। কিন্তু ঘর ফাঁকা! অপর দিকের দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে ভেগেছে ইকরামুল্লা এবং মিসেস নাসির।
| সুইট থেকে আবার বের হয়ে ছুটল ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুইটটার অপরদিকের করিডরে এসে হাজির হল। কিন্তু এখানেও কারও চিহ্ন দেখা গেল না। কোন্ দিক দিয়ে সরে পড়েছে ইকরামুল্লা ও মিসেস নাসির বোঝা গেল না। * ডান দিকে হোটেলের মেইন গেটটা আন্দাজ করে সেদিকেই ছুটল ওরা। ঠিক সেই সময় দু’রাউও গুলির শব্দ শোনা গেল ডান দিক থেকে। ছুটল ওরা পড়িমরি করে। কিন্তু যা ঘটবার ঘটে গেছে ততক্ষণ। ওরা পৌঁছুবার আগেই একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ শোনা গেল। সম্ভবত মিসেস নাসির সরে পড়লেন।
মি. সিম্পসন ছুটে এলেন শহীদকে দেখতে পেয়ে। ‘কে গেল গাড়ি নিয়ে?
মি, সিম্পসন বললেন, মি. নাসির পালালেন। হলঘরের লোকজনদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন তিনি। সুযোগ বুঝে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।
‘মিসেস নাসিরকে যেতে দেখেছেন? কামাল প্রশ্ন করে। মি. সিম্পসন বললেন, ‘মিসেস নাসির! মিসেস নাসির আবার কোথা থেকে এলেন?” ৯৪
হঠাৎ হোটেলের ভিতর থেকে রিভলভারের শব্দ শোনা গেল কয়েকবার। কোনও উত্তর না দিয়ে ছুটল ওরা সেইদিকে।
হোটেলের দক্ষিণ প্রান্তের করিডরে পৌঁছুতেই ওরা দেখল কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক মেঝেতে পড়ে আছে গুলি খেয়ে। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে দেখল শহীদ লোকগুলো জীবিত না মৃত।
বেঁচে আছে একজন। শহীদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা ব্যথায় ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্ধকার নিচু উঠানটা দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “শালা ইকরামুল আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে ঐ দিকে।’
ছুটল শহীদ তখুনি। কিন্তু করিডর থেকে নামার আগেই অন্ধকার উঠান থেকে কুয়াশার স্বর শোনা গেল, শহীদ, মন্টিকে জীবিত পেতে হলে এখুনি ছুটে যাও শান্তিনীড়ে!’
থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে শহীদ। তারপর হোটেলের মেইন গেটের দিকে ছুটতে শুরু করল। কামালও সঙ্গ নিল বিনাবাক্যব্যয়ে।
ছয়
মি. নাসির নিজেদের বাড়ির বাগানে মাটি খুঁড়ে চলেছেন কোদাল দিয়ে!
| রাত বারোটা বেজে বাইশ মিনিট। সবেমাত্র ঝড়ের বেগে মোটর চালিয়ে গাংচিল হোটেল অ্যাণ্ড বার থেকে ভেগে এসেছেন তিনি পুলিসকে ফাঁকি দিয়ে। ভাবছেন নাসির সাহেব, কাজটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ফেলতে হবে। তার অপরাধের চিহ্নমাত্র আর রাখবেন না তিনি এ বাড়ির কোথাও। শয়তান ইকরামুল্লা এর পর তাকে আর শায়েস্তা করার কথা ভাবতে সাহস পাবে না। উফ! এতদিন শয়তানটা তাঁকে ব্লাকমেইল করে আসছিল শুধু তাঁর পুরানো এই অপরাধের জন্যে। অনেক আগেই কাজটা করা উচিত ছিল তার। কিন্তু ভয়ে ভয়ে দেরি করে নিজের সর্বনাশই ডেকে এনেছেন তিনি। আর নয়। আজ তিনি এর একটা ব্যবস্থা করবেনই। তারপর দেখবেন ইকরামুল্লা কিভাবে তাঁকে দিয়ে কাজ করাতে পারে।
“ দশ মিনিটের মধ্যে কোদাল চালানো বন্ধ করলেন মি. নাসির। ঝুঁকে পড়ে গর্ত থেকে একটা বড় আকারের কাঠের বাক্স টেনে বের করলেন তিনি। এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন মি. নাসির। ভূত দেখার মত থমকে গিয়ে তাকালেন সামনের দিকে। হাতে রিভলভার নিয়ে তার পাঁচ হাতের মধ্যে
এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁরই সহধর্মিনী-মিসেস নাসির!
‘প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাও বুঝি!’ ব্যঙ্গ ভরে কথা বলে ওঠেন মিসেস নাসির, কিন্তু অত সহজ নয়, নাসির সাহেব! আমি যে তোমার ঐ অপরাধ-চিহ্নের
পাহারাদার!’
তুমি! তুমি এত রাতে বাগানে এসেছ কেন? বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন মি. নাসির।
মিসেস নাসির বলেন, আমিও তো তোমাকে ঐ প্রশ্ন করতে পারি। এত রাতে বাগানে কি করছ তুমি? মাটি খুঁড়ে ঐ যে বাক্সটা বের করেছ ওতে কি আছে?
এক পা এগিয়ে এসে মি. নাসির বললেন, সে কথায় তোমার দরকার কি? যাও, ঘরে যাও তুমি।’
এগোবার চেষ্টা করবে না আর এক পাও। গুলি করব তাহলে।
‘কি!’ গর্জে ওঠেন মি. নাসির। বললেন, তুমি আমাকে গুলি করবে বললে? কেন? কি অপরাধ দেখলে আমার?’
মিসেস নাসির খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, অপরাধ। তোমার অপরাধ হচ্ছে তুমি তোমার পাপের চিহ্ন চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছ। | ‘কিন্তু তাতে তোমার ক্ষতি কি? ইকরামুল্লার স্বার্থ আছে জানি, কিন্তু তুমি কেন আমাকে বাধা দিতে এসেছ?’
মিসেস নাসির হেলেদুলে বললেন, “আহা, কচি খোকা যেন তুমি! ইকরামুল্লা যে আমাকে পাহারাদার নিযুক্ত করে রেখেছে তা জান না বুঝি?’’
নিষ্ফল আক্রোশে বিকট চিৎকার করে উঠলেন মি. নাসির। জানি, হারামজাদী, আমি সব জানি। অনেকদিন থেকেই সন্দেহ জেগেছে আমার। তোর সঙ্গে ইকরামুল্লার অবৈধ সম্পর্ক আছে। তা আমার আগেই সন্দেহ হয়েছে। আজ আমি
জানলাম আমার সন্দেহটা.অমূলক নয়।’
‘চেঁচামেচি কোরো না বেশি। এখন লক্ষ্মী ছেলের মত নিজের ঘরে যাবে কিনা। বল।’
মি. নাসির চিৎকার করেই বললেন, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দে, পিশাচিনী। মন্টিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল।
খিলখিল করে পিশাচিনীর মতই হেসে উঠলেন মিসেস নাসির। কৌতুক করে বললেন, ‘জা-নি-না।’
| ‘জানিস না! আর আমার কাওসারকে, কাওসারকে কে হত্যা করেছে বল?
‘আমি।’
নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিয়ে এক পা এগোন মিসেস নাসির। তারপর বলেন, “ তুমি ঘরে ফিরে যাবে কি না বল এবার।
মিসেস নাসিরের কঠিন কণ্ঠস্বর শুনেও নড়েন না মি. নাসির। চিবিয়ে চিবিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেন, আমি জানতে চাই মন্টিকে কোথায় রেখেছিস তোরা সরিয়ে?’
মিসেস নাসির ব্যঙ্গ ভরে বললেন, ‘পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে মন্টি কোথায়
আছে শুধু তাই বলব না, তোমার আদরের মন্টিকে এনে কোলে তুলে দেব জ্যান্ত।
‘কোথায় রেখেছিস বলবি না তাহলে?’ নিজের পকেটে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে তীব্র কণ্ঠে শাসিয়ে উঠলেন মি. নাসির।
সাবধানী কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন মিসেস নাসির, পকেট থেকে খালি হাত বের করে আন ভালয় ভালয়। নয়ত বুক ফুটো করে বেরিয়ে যাবে গুলি। একটুও কাঁপবে না আমার হাত।
| মি. নাসির শ্লেষাত্মক একটুকরো হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘আমি জানি তোর মত পাপীয়সীর হাত এতটুকুও কাঁপবে না স্বামীর বুক ফুটো করে দেবার জন্যে গুলি ছুঁড়তে। জানি বলেই আগে থেকে সাবধান হয়ে আছি। এই আমি আমার রিভলভার বের করছি। গুলি করে দেখ, হারামজাদী-তোর রিভলভারে একটিও গুলি নেই। আজ দুপুরের পর সবগুলি আমি বের করে নিয়েছি।
চমকে ওঠেন মিসেস নাসির মি. নাসিরের কথা শুনে। নিজের হাতে ধরা রিভলভারের দিকে একবার তাকিয়েই তাকান তিনি স্বামীর দিকে। মি. নাসির ততক্ষণ নিজের পকেট থেকে রিভলভার বের করে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বৈরিণী স্ত্রীর দিকে। বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে নিজের রিভলভারের ট্রিগার টিপে ধরেন মিসেস নাসির মি. নাসিরের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মৃত্যু ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে যায় তাঁর মুখ। সত্যিই গুলি বের হয় না রিভলভার থেকে। আতঙ্কে নীল হয়ে ওঠে তার চেহারা। বিকৃত ঠোঁট জোড়া থরথর করে কেঁপে ওঠে। কি যেন বলতে চান মিসেস নাসির অস্ফুট স্বরে। কিন্তু ঠিক তখুনি গর্জে ওঠে মি. নাসিরের হাতের রিভলভার।
পরপর দুবার গুলি বর্ষণ করেন মি. নাসির। প্রথম গুলিতেই আহত হয়ে পড়ে যান মিসেস নাসির বিকট আর্তনাদ করে। দ্বিতীয় গুলিটা লাগল কি না বোঝা গেল
। তৃতীয় বারও ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিলেন মি. নাসির। কিন্তু কাদের যেন দ্রুত পায়ের শব্দ কানে এসে ঢুকতেই চমকে উঠে থমকে গেলেন তিনি। শখের গোয়েন্দা শহীদ খান আর তার সঙ্গী কামাল আহমেদ ছুটে এসে পড়েছে এদিকে দেখতে পেলেন তিনি চাঁদের আলোয়। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করা মানে ধরা পড়ে যাওয়া। কিন্তু ধরা পড়লে চলবে না এখন। মন্টির খোঁজ পেতে হবে। আর সেই লকেটটা! ইকরামুল্লার হাত থেকে বাঁচাতে হবে সেই মহামূল্যবান লকেটটা।
শহীদ এবং কামাল কাছে এসে পড়ার আগেই ছুটতে শুরু করলেন মি. নাসির। নদীর দিকে চললেন তিনি। মোটর বোটটা নদীর ধারেই রাখা আছে।
শহীদ ও কামাল দৌডুতে দৌডুতে থমকে দাঁড়াল হঠাৎ। মিসেসনাসিরের ভূপাতিত দেহটা পলকের জন্যে দেখল ওরা। তরপর মাটি খুঁড়ে যে বড় আকারের বাক্সটা ৭-
৯৭
বের করা হয়েছে সেটার দিকেও চোখ পড়ল ওদের। কিন্তু দেরি করল না ওরা এখানে দাঁড়িয়ে। মি. নাসির নদীর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। ধরতে হবে তাঁকে।
কিন্তু ওরা নদীর কিনারায় পৌঁছবার আগেই মোটর বোটের গর্জন শোনা গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে নদীর কিনারায় পৌঁছল ওরা। মি. নাসির ততক্ষণ মোটর বোট নিয়ে মাঝ দরিয়া বরাবর চলে গেছেন।
‘পালিয়ে গেল, শহীদ!’ কামাল নিরাশ কণ্ঠে বলে উঠল।
শহীদ কোনও উত্তর না দিয়ে দূরবর্তী বোট-হাউসের দিকে হাঁটতে লাগল দ্রুত পায়ে।
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?’
শহীদ বলল, হোটেলের কেবিনে মিসেস নাসির ইকরামুল্লাকে, কি বলছিল মনে নেই তোর?’।
কামাল বলল, হ্যাঁ, বলেছিল বোট-হাউসের ভিতরে আছে। কিন্তু বোট হাউসের ভিতর কি আছে, শহীদ?’
শহীদ হাঁটতে হাঁটতে বলে, কান পেতে শোন তো, কেউ যেন কাঁদছে মনে হচ্ছে?’
কামাল কান পেতে শুনে বলল, হ্যাঁ! বাচ্চা ছেলের কান্না বলেই তো মনে হচ্ছে!’ :
আরও খানিকটা সামনে এগোতে বোট-হাউসের ভিতর থেকে স্পষ্ট কান্ন শুনতে পেল ওরা। পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে বোট-হাউসের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাল শহীদ।
অন্ধকার বোট-হাউস পলকের মধ্যে আলোকিত হল। বিদ্যুৎবেগে একটি ছোট ছেলে জানালার দিকে তাকাল মুখ ফিরিয়ে। শিউরে উঠল শহীদ। সারাক্ষণ কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল টকটকে হয়ে গেছে। চোখের কোণে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। সারা গাল সিক্ত। শুকনো পাপুর, পীড়িত একটি কচি মুখ। মনে মনে দুঃখ অনুভব করল শহীদ ছেলেটার অসীম দুর্দশা দেখে এই-ই তাহলে মন্টি!
‘দরজা ভাঙতে হবে শহীদ!’ কামাল বোট-হাউসের দরজাটা পরীক্ষা করে বলল।
শহীদ বলল, তাড়াতাড়ি যা করার করতে হবে কামাল। আরও কাজ আছে আমাদের।’
দুজনের মিলিত চেষ্টায় ভেঙে ফেলা হল বোট-হাউসের দরজা। শহীদ ও কামালকে এগিয়ে আসতে দেখে আর্তনাদ করে উঠল মন্টি দারুণ ভয়ে। যে কোনও লোককে দেখলেই এমন চিৎকার করে উঠবে সে এখন। কারও উপর তার কোনও বিশ্বাস নেই আর।
‘কেঁদো না, মন্টি, আমরা তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাব বল তো? তোমার বড়দার কাছে নিয়ে যাব, বুঝলে?’
. শহীদের মিষ্টি এবং নরম কথা শুনে কান্না থামিয়ে অবিশ্বাস ভরে তাকিয়ে রইল মন্টি। শহীদ ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কে এখানে নিয়ে এসেছিল বল তো, মন্টি?
মন্টি শহীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মুখ বিকৃত করে ফুঁপিয়ে উঠল। কোলে তুলে নিল শহীদ তাকে। কাঁদতে কাঁদতে মন্টি বলল, চাচীমা আমাকে এখানে রেখে চলে গেল। আমি বললাম, এখানে থাকব না, চাচীমা…’
শহীদ এবার আরও নরমভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাওসারদা কোথায় জান, মন্টি?
‘চাচীমা মেজদাকে মেরেছে।
এই পর্যন্ত বলেই মন্টি চিৎকার করে বলতে শুরু করল চাচাজীর কাছে যাব! চাচাজীর কাছে নিয়ে চল!
: কামাল বলল, “আর দেরি করা উচিত নয়, শহীদ। মি. নাসির বক্সনগরের দিকে রওনা হয়ে গেছেন। ইকরামুলাও বক্সনগরে পৌঁছুতে চাইবে।
শহীদ মন্টিকে কোলে রেখেই হাঁটতে শুরু করে বলল, সুতরাং সময় থাকতে বক্সনগরে আমাদেরও পৌঁছুনো উচিত। চল্ মন্টিকে মহুয়ার কাছে রেখে ছুটে যাই আমরা।’
শান্তিনীড় থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসল ওরা। মিসেস নাসিরের কথা মনে ছিল ঠিকই শহীদের। কিন্তু ফিরে এসে একটা বিহিত করা যাবে মনে করে ক্ষান্ত হল সে। মিসেস নাসির মারা গেছেন মনে করেই কথাটা ভেবেছিল শহীদ। কিন্তু
ভুল করেছিল সে!
সাত
মীরপুরের হাবলা নদীর ধারে বক্সনগরের গভীর কাঁঠাল বাগান। কাঁঠাল বাগান ছিল একসময় বক্সনগরে। কিন্তু আজ বাগান বলা চলে না, জঙ্গল বললেই ঠিক বলা হয়। * বক্সনগরের জঙ্গল।
রাত একটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নদীর ধারে এসে ভিড়ল একটা মোটর বোট। চারদিকের নির্জন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল মোটর-বোটের ক্ষীণ গর্জন। কেঁপে উঠল বক্সনগরের জন্তুজানোয়ারেরা। মি. নাসির এক লাফে পারে এসে উঠলেন মোটর-বোট থেকে। মোটর-বোটের দড়িটা একটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দ্রুত পদক্ষেপে উঁচু পাড়টা অতিক্রম করে জঙ্গলে প্রবেশ করলেন তিনি।
জঙ্গলে প্রবেশ করে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালেন মি. নাসির। চারদিকে তাকিয়ে সঠিক পথ বেছে নিতে একটু সময় লাগল তার। চাঁদের আলো আছে এখনও। চন্দ্রালোকিত বনভূমিতে সরু পায়ে চলা পথ ধরে একা একা হাঁটতে লাগলেন মি. নাসির।
মিনিট দশেক কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পা চালালেন মি, নাসির। তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ তাঁর সর্বক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আশপাশে নজর দেবার কথা মনেও নেই। সড়সড় করে সরে যাচ্ছে একটা দুটো সাপ শিয়ালেরা দলভেঙে পড়িমরি করে ছুটছে পিছন দিকে, বনভূমির সকল অধিবাসী চঞ্চল হয়ে উঠেছে গভীর রাতে কোনও শত্রুর অনধিকার প্রবেশে।
| হঠাৎ চোখ দুটো চকচক করে ওঠে মি. নাসিরের। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তিনি। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করেন। কিন্তু এবার তিনি এক পা এক পা করে হাঁটছেন। বুকটা নেচে ওঠে তার। চোখ দুটো চকচক করে ওঠে সাফল্যে ইকরামুল্লার আগেই তিনি পৌঁছে গেছেন নির্দিষ্ট স্থানে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে শিমু গাছটা! ঐ গাছের কাণ্ডের উপরদিকে আছে একটা কোটর। সেই কোটরে আছে বার্মা থেকে উদ্ধার করা চীরণ মন্দিরের লকেট। লকেটের ভিতর আছে চীরণ মন্দিরের কোটি কোটি টাকার গুপ্ত ধনের চাবিকাঠি। চীরণ মন্দিরের গোপন কুঠরীর নকশা!
এক পা এক পা করে এগিয়ে শিমুল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ান মি. নাসির। উত্তেজনায় কাঁপছেন তিনি। হাত, পা, বুক কাঁপছে তাঁর।
ধীরে ধীরে একটা হাত তোলেন মি. নাসির। গাছের কোটরের মুখে গিয়ে ঠেকে তার হাতটা। ঠিক সেই সময় কেঁপে ওঠে মি. নাসিরের পৃথিবীটাও।
| রিভলভারের একটি মাত্র শব্দ শোনা যায়। শিমুল গাছের কোটরের মুখে রাখা মি. নাসিরের ডান হাতের উল্টো দিকে এসে লাগে গুলিটা। হাড় ভেদ করে গাছের ভিতর গিয়ে ঢেকে বুলেটটা। আটকে গেল যেন হাতটা গাছের সঙ্গে। কেউ যেন পেরেক মেরে আটকে দিয়েছে।
চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকান মি. নাসির।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হা!’
ইকরামুল্লার বাজখাই গলার অট্টহাসি শোনা গেল অদূরেই। মাত্র পনের হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
“কি ব্যাপার, ওস্তাদ! ফাঁকি মারার তালে আগেই পৌঁছে গেছ দেখছি! ভেবেছ ইকরামুল্লা পুলিসের ভয়ে ভুলে গেছে লকেটের কথাটা-কেমন?
মি. নাসির কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারেন না যেন। ফ্যাল ফ্যাল করে ইকরামুল্লার হাতে ধরা রিভলভারটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কথা সরে না মুখে।
১০০
এদিকে শহীদ আর কামাল নিঃশব্দ পায়ে এসে দাঁড়ায় একটা গাছের আড়ালে। দ্রুত গাড়ি চুটিয়ে শহীদ মন্টিকে মহুয়া ও সারওয়ারের হেফাজতে রেখে এসেছে। স্পষ্ট দেখতে পায় ওরা ইকরামুল্লা এবং মি. নাসিরকে। মি. নাসিরের সর্বনাশ আসন্ন বুঝতে পারে শহীদ। ইকরামুল্লা মি. নাসিরকে আহত করেই ক্ষান্ত হবে না। আজ তার মাথায় খুনের নেশা চেপেছে। তার কিছুক্ষণ আগের অট্টহাসি শুনে যে-কোনও সাহসী লোকেরও বুক কেঁপে উঠত। অথচ মি. নাসিরকে বাঁচাবার কোনও উপায়ই নেই! মি. নাসিরের দিকে এগোতে গেলেই দেখে ফেলবে ইকরামুলা শহীদকে। ইকরামুল্লার দিকেও এগোনো সম্ভব নয়। দেখলেই গুলি চালাবে সে। এখান থেকে গুলি করাও চলে না। ইকরামুল্লা দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের আড়ালে। অর্ধেকটা মাত্র শরীর দেখা যাচ্ছে তার। লক্ষ্য ব্যর্থ হলে সমূহ বিপদ।
পিছন দিক থেকে গিয়ে শয়তানটাকে ধরে ফেললে মি. নাসিরকে হয়ত রক্ষা করা যায়, শহীদ ফিসফিস করে বলল কামাল।
শহীদ ইকরামুল্লার পিছন দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কামালের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, তার আর দরকার নেই, কামাল। ইকরামুল্লার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখ, কে এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে!
‘কুয়াশা!’ উৎফুল্ল কণ্ঠ কেঁপে উঠল কামালের। চুপ! মি. নাসির কি যেন বলছেন ইকরামুল্লাকে।’
মি. নাসিরও হঠাৎ দেখে ফেলেছেন কালো আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় একজন মানুষকে। মানুষটা নিঃশব্দ পায়ে এগোচ্ছে। মি. নাসির চোখ সরিয়ে ইকরামুল্লার দিকে তাকালেন। ইকরামুল্লা টের পায়নি অপরিচিত মানুষটার
আগমন। | ‘লকেটটা তোমার কপালে নেই, নাসির! শুধু শুধু এত কষ্ট করে ছুটে এসেছ তুমি। আমি আজই ঐ লকেট নিয়ে রওনা হব বার্মা। এখানকার ব্যবসা আপাতত বন্ধই করে দিলাম। সেই সাথে কয়েকজনের মুখও বন্ধ করে দিয়ে যাব!
‘কার মুখ বন্ধ করে দিয়ে যাবে, ইকরামুল্ল?’. আঁতকে উঠে প্রশ্ন করেন মি. নাসির।
‘তোমার মুখ বন্ধ করব সবার আগে। কেননা তুমি পুলিসকে জানিয়ে দেবে আমি বার্মায় চলে গেছি। সেটা বিপদের কথা।
মি. নাসির বললেন, কিন্তু আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি, ইকরামুল্লা? তুমি আমার এতবড় শত্রু কেন হলে?’
হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে ইকরামুল্লা।
শহীদ চমকে উঠে বলে, একি। গাড়ির শব্দ আসছে কোথা থেকে। জঙ্গলে ভিতর মোটর আসবে কেমন করে?’
১১
কামাল কান পেতে কি যেন শুনতে শুনতে বলে, আরে, তাই তো। মৃদু একটা গর্জন এদিকেই এগিয়ে আসছে যেন! কে আসছে গাড়ি নিয়ে! | এদিকে অনর্গল কথা বলে চলেছেন মি. নাসির। পা পা করে এগিয়ে আসছে ইকরামুল্লার পিছন দিক থেকে আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি। ঐ মানুষটার উপরই নির্ভর করছে তার জীবন। এতটুকু চঞ্চলতা তার চেহারায় ফুটে উঠলেই ইকরামুল্লা সন্দেহ করে বসবে। পিছন ফিরে তাকাবে সে তখুনি। মি. নাসির তাই বিন্দুমাত্র চঞ্চলতা প্রকাশ করছেন না। অনর্গল কথা বলে ইকরামুল্লার মনোযোগ নিজের দিকে টেনে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি।
‘আমার বিবাহিতা স্ত্রীকে তুমি অসৎপথে টেনে নিয়ে গেছ, ইকরামুল্লা! আমার কাওসারকে খুন করিয়েছ তাকে দিয়ে তোমার কাছেই শিখেছে সে নিষ্ঠুরতা। আমার প্রতি, আমার সংসারের প্রতি তার মনে ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে নিজের দলে টেনে নিয়ে গেছ তুমি। কেন এমন সর্বনাশ করলে তুমি আমার?
. কথা বলতে বলতে খোদার দরবারে মিনতি জানাচ্ছেন মি. নাসির–ইকরামুল্লা যেন কিছু টের না পায়! খোদা!
হঠাৎ চমকে ওঠে ইকরামুল্লা। তার কানেও ঢোকে অদূরবর্তী গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন। তীব্রবেগে ছুটে আসছে একটা গাড়ি এদিকেই।
এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে ইকরামুল্লা। তারপর হেসে ওঠে সে কুৎসিত ভঙ্গিতে। মি. নাসিরের দিক থেকে পলকের জন্যেও চোখ না সরিয়ে বলে ওঠে, ‘ঘাবড়াচ্ছ কেন, ওস্তাদ! এসে পড়েছে তোমার বিবাহিতা বউ। শুনতে পাচ্ছ না গাড়ির শব্দ? ঐ আসছে সে, তার মুখেই শুনবে সে কেন তোমাকে ঘৃণা করত!
মি. নাসির সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, কিন্তু তুমি তো আমার অনেক দিনের পুরানো বন্ধু, ইকরামুল্লা। আমার স্ত্রী আমাকে ঘৃণা করত বলে তুমিও কেন তার সঙ্গে হাত মেলালে? কি করেছিলাম আমি তোমার?
বারবার নিজের সাফাই গেয়ো না, নাসির! সময় হয়ে এসেছে তোমার, পরওয়ারদেগারকে ডাকো!’
মি. নাসির বললেন, আমাকে মেরে কি লাভ তোমার, ভাই?’
গাড়ির শব্দ উচ্চকিত হয়ে উঠেছে এবার। নির্জন বনভূমির উঁচু-নিচু মাটির উপর দিয়ে মাতালের মত টালমাটাল ভঙ্গিতে ছুটে আসছে একটা গাড়ি। কিন্তু হেড লাইট দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আলোয় পথ চিনে চিনে কোনও বদ্ধ মাতাল ঝড়ের বেগে বিপথে গাড়ি চুটিয়ে আসছে। এদিকে অনর্গলভাবে কথা বলে ইকরামুল্লার মনোযোগ টেনে রেখেছেন মি. নাসির। আলখাল্লা পরিহিত কুয়াশা নিঃশব্দ পায়ে এগোচ্ছে এখনও। আর মাত্র সাত কি আট হাত সামনে পিছন ফিরে
দাঁড়িয়ে আছে ইকরামুল্লা.।
আরও এক পা এগোল কুয়াশা।
১০২
=
=
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ ও কামাল। যে কোনও মুহূর্তে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
| ‘কার হাতে মরতে চাওঁ, ওস্তাদ? ব্যঙ্গ ভরে জিজ্ঞেস করে ইকরামুল্লা, বউয়ের হাতে না বন্ধুর হাতে?
মি, নাসির বললেন ব্যাকুল কণ্ঠে, ‘ আমাকে প্রাণে মের না তোমরা, ইকরামুল্লা!’’
কুয়াশা সামনে বাড়ে আরও এক পা।
উশখুশ করে ওঠে কামাল। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। গাড়ির শব্দ ক্রমেই বনভূমি কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। উঁচু-নিচু মাটিতে গাড়ির চাকা পড়ে যান্ত্রিক শব্দ উঠছে-শোনা যাচ্ছে এখন।
মি. নাসির কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, কাউকে কোনও কথা বলব না আমি, ইকরামুল্লা! তোমরা শুধু প্রাণে বাঁচতে দাও আমাকে…’
আরও এক পা এগোল কুয়াশা। ইকরামুল্লা বলে, ‘কেন, মন্টিকে ফিরে চাও না তুমি? মি, নাসির বলে উঠলেন কোনও রকমে, না! আমি আঁচতে চাই শুধু…’ কিন্তু তা হবে না…’
কথা শেষ হয় না ইকরামুল্লার। পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুয়াশা তার উপর। শহীদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, সরে যাও, কুয়াশা!’
ইকরামুল্লাকে নিয়ে মাটির উপর গড়াতে গড়াতে এক পাশে সরে যায় কুয়াশা! ঠিক সেই সময় ঘটনাস্থল উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। এসে পড়েছে গাড়িটা ঝড়ের বেগে। হেড লাইট জ্বলে উঠেছে এতক্ষণে।
এঁকেবেঁকে ছুটে আসছে গাড়িটা বদ্ধ মাতালের মত। মাত্র বিশ হাত দূরে দেখতে পান মি. নাসির গাড়িটার চোখ ঝলসানো দুটো হেড লাইটের উজ্জ্বল আলো। গাড়িটা তার দিকে ছুটে এসে পড়েছে।
পালাতে চান মি. নাসির ছুটন্ত যমের হাত থেকে। চোখ মুখ বিকৃত হয়ে বীভৎস আকার নেয়। মৃত্যু ভয় জাগে মি. নাসিরের বুকে। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাঁপেন তিনি দৌডুবার শক্তি পান।
শরীরে। বিড় বিড় করে কি যেন বলতে থাকেন। ঠোঁট জোড়া নড়ে ওঠে করুণ। ভাবে। কিন্তু..
কিন্তু ছুটন্ত মৃত্যুদূত কোনও প্রার্থনাই শোনে না তাঁর। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে মি. নাসিরের এবং গাছের গয়ে সিধে ধাক্কা মারে! বিকট একটা আর্তনাদ নির্জন বনভূমিতে জেগে উঠেই চাপা পড়ে যায় চিরতরে। সেই সাথে উল্টে যায় গাড়িটাও! পেঁতলে যায় গাছের খানিকটা অংশ।
ছুটে যায় শহীদ ওল্টানো গাড়িটার দিকে। উল্টে গিয়েও ইঞ্জিনটা চালু
১০৩
রয়েছে চার সামনে হয়ে গেছেন
প্রায়। ইতিময়ে সামনে গিয়ে জ্বলছে তেমনি
রয়েছে। হেড লাইট দুটোও জ্বলছে তেমনি।
গাড়িটার সামনে গিয়ে শহীদ দেখে মি. নাসিরের দেহ দু’ভাগ হয়ে গেছে প্রায়। ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছেন তিনি। মাথাটা থেঁতলে ছাতু হয়ে গেছে। প্রাণের কোনও চিহ্নই নেই।
ঝুঁকে পড়ে ওন্টানো গাড়ির ভিতর তাকাল শহীদ। কামালও এসে দাঁড়াল তার পাশে।
‘একি! এ যে ড্রাইভার শামসু মিয়া! চমকে উঠে বলে কামাল। শহীদ বলল, “মিসেস নাসিরও আছেন পিছনের সিটে!’ কিন্তু…’
কামাল কি যেন বলতে চায়। শহীদ বলল, ‘মিসেস নাসির মি. নাসিরের গুলিতে মারা যাননি, আহত হয়েছিলেন কেবল। তিনিই রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন ড্রাইভার শামসু মিয়াকে।’
কামাল বলল, “কিন্তু ড্রাইভার শামসু মিয়া কেন মি. নাসিরকে খুন করল?
কুয়াশা ইতিমধ্যে বেঁধে নিয়ে এসেছে ইকরামুল্লাকে গাড়িটার কাছে। ইকরামুলার ডান চোখ দিয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। একটি মাত্র হাত তার, তাও পিঠের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে কোমরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে কুয়াশা। কাঁধের উপর মুখ ঘষে রক্ত মুছতে মুছতে সে বলল, ‘ড্রাইভার শামসু মিয়ার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলেছিল নাসির দু’বছর আগে। লাশটা সে লুকিয়ে রেখেছে শান্তিনীড়ের বাগানে মাটির তলায়। শামসু মিয়া তারই প্রতিশোধ নেবার জন্যে
‘গাড়ির ভিতর কি ওরা দুজনেই মারা গেছে শহীদ?’ কুয়াশা কথা বলে উঠল এতোক্ষণে।
শহীদ গাড়ির ভিতর থেকে মাথা আর হাত বের করে নিরাশ কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, দুজনেই মারা গেছে!
কুয়াশা কামালের দিকে ইকরামুল্লার কোমরে বাঁধা দড়ির অবশিষ্টাংশটা বাড়িয়ে ধরে বলল, এর ভার নাও কামাল। আমি চলি এবার।
কামাল দড়িটা ধরে। কুয়াশা বলল, চলি শহীদ, আর কোনও দরকার নেই তো এখানে আমার?”
শহীদ অবাক হয়ে বলল, ‘চলে যাচ্ছ তুমি, কুয়াশা? কিন্তু লকেটের জন্যে এসে লকেট না নিয়ে চলে যাচ্ছ যে?’
কুয়াশা হাসল। বলল, লকেট আমি আজ দুপুরেই নিয়ে গেছি এখান থেকে। ‘সেকি!’
কামাল বলল, তাহলে তুমি রাত এগারোটার পর থেকে আমাদের সঙ্গে এত ছুটোছুটি করলে কেন?’
কুয়াশা ঘুরে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে বলে, তোমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে
১০৪
শুধু, আর কোনও কারণে নয়।
‘ধন্যবাদ, কুয়াশা! শহীদ আন্তরিক গলায় বলল। কুয়াশা ততক্ষণ বনভূমির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে শুধু শোনা গেল তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর, ‘Don’t mention, my friend!’
Leave a Reply