১৬. খুনী কে? ১ (ভলিউম ৬) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৬
প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ১৯৬৯
এক
সারওয়ার বললো, ‘অসম্ভব!’
কাওসার বললো, ‘সম্ভব। সারওয়ার বললো, না, সম্ভব নয়। দেবেন না।’ কাওসার নিজের অনুমানে অটল, ‘কেন সম্ভব নয়, বাধাটা কোথায়?
সারওয়ার তাকালো কাওসারের দিকে। যমজ ভাই ওরা। সারওয়ার একঘন্টার বড় কাওসারের চেয়ে। ওদের দুজনেরই বয়স যোবলা। সবেমাত্র ম্যাট্রিক পরীক্ষা। দিয়েছে। রেজাল্ট বের হতে এখনও মাসখানেক দেরি আছে। বাড়িতে বসে বসে সময় কাটছে না বলে সময় কাটানো যায় কিভাবে তাই নিয়ে আলাপ করছিল।
প্রসঙ্গটা সারওয়ারই প্রথমে তুললো। কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় সে কথা। ঠিক করতে পারছিল না ওরা। কাওসার কক্সবাজার, সিলেট ইত্যাদি জায়গার নাম করছিল। কিন্তু কোনটাই পছন্দ হচ্ছিলো না সারওয়ারের। হঠাৎ তার মারীর কথা মনে পড়ে : কাওসারকে কথাটা বলতে খুশির চোটে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে
সে। কিন্তু সারওয়ার হঠাৎ শুকনো মুখে বলে, কিন্তু অতো টাকা কোথায় পাবো। চাচা অতো টাকা কিছুতেই দেবেন না। মারী যেতে হলে চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে হবে না!
সারওয়ারেরা তিন ভাই। বাবা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে।মা গত হয়েছেন পাঁচ বছর হল। পাঁচ বছরের একটা ছোটো ভাই আছে ওদের। মন্টি।
কাওসার বলে, তাহলে মারী যাওয়া হবে না?’ বড় ভাইয়ের উপরই যেন অভিমান করে সে।
সারওয়ার কথা বলে না। মনটা দমে গেছে তারও। পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়াতে যাবে ভাবতেই সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার। কাওসারের চেয়ে কম আগ্রহী নয় সে। কিন্তু মারীতে বেড়াতে যাওয়া সহজ কথা নয়। মাসখানেক না থাকলে বেড়ানো হবে না ভালো করে। যেতে হবে প্লেনে। ফিরতেও হবে প্লেনে। পানির জাহাজে অনেক বেশি সময় লেগে যাবে। যদিও প্লেনের চেয়ে জাহাজের ভাড়া অনেক কম।
‘তুমি এতো ভীতু তা আমি জানতাম না, কাওসার বলে।
তবু কথা বলে না সারওয়ার। আরও কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে। তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়ায় কাওসার চেয়ার ছেড়ে। বলে, “ঠিক আছে, তুমি না যেতে চাইলে যেয়ো না, আমিই গিয়ে চাচাকে বলি। তোমার মতো নই আমি, বুঝলে? | ‘এই দাঁড়া,’ হেসে ফেলে ডাকে সারওয়ার। বলে, চল, আমিও যাচ্ছি। কিন্তু
তুই বলবি কথাটা। আমি কিছু বলতে পারবো না।
‘আমিই বলবো। এসো।’
দু’ভাই ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। দুজনেই সমান লম্বা। স্বাস্থ্যও একই রকম। সারওয়ার গায়ের রঙের দিক থেকে একটু ফর্সা কাওসারের চেয়ে।
সারওয়ার যদিও বড় কাওসারের চেয়ে তবু বড়কে বড় বলে মানতে আপত্তি কাওসারের। তুই না বলে তুমি বলে সে সারওয়ারকে, কিন্তু কাজে এবং কথাবার্তায় গার্জেনগিরি ফলাতে কুণ্ঠা নেই তার। আসলে দু’ভাইয়ের সম্পর্কটা ওদের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ছোটবড় ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছে ওরা ছোট বেলা থেকে। এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়ে এতো বড়টি হয়েছে ওরা। ঝগড়াঝাটি হয় না যে তা নয়। কিন্তু বন্ধুতে বন্ধুতে যেমন ক্ষণস্থায়ী অভিমানের পালা চলে, তার চেয়ে বেশি কিছু না। মা-বাবা হারা এই ছেলে দুটি ছোটবেলা থেকে একজন আরেকজনের সঙ্গী, সহায়, বন্ধু।
দুরুদুরু বুকে মি. নাসিরুদ্দিনের ঘরে পা রাখলো ওরা। ‘কি ব্যাপার?’
মি. নাসির সোফায় বসে ভুরু কুঁচকে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিলেন। ভাইপোদেরকে অমন জড়সড় হয়ে ঘরের ভিতর এসে দাঁড়াতে দেখে একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করেন তিনি।
বল! সারওয়ার কাওসারের কানে কানে বলে। তুমি বলো না!’
বাহাদুরি দেখানো শেষ হয়েছে কাওসারের। চাচার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ থেকে কথা সরতে চাইছে না তার।
ব্যাপার কি বল তো! অমন বোকার মতো ঠেলাঠেলি করছিস কেন? কি চাই?
‘আমরা মারীতে বেড়াতে যাব…তাই…। ‘মারীতে বেড়াতে যাবি!’ সারওয়ারের কথা শুনে আঁতকে ওঠেন মি. নাসির।
কাওসার এবার কথা বলার সাহস পায়। সে বলে, হ্যাঁ, রেজাল্ট বের হতে এখনও দেরি আছে তো, তাই আমরা ঠিক করেছি মারী যাবো। আপনি শুধু অনুমতি দিলেই…
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন মি. নাসির কাওসার এবং সারওয়ারের দিকে। মুখ থেকে কথা সরে না তাঁর।
চাচাকে কথা বলতে না দেখে সারওয়ার শঙ্কিত হয় মনে মনে। কিন্তু কাওসার উৎফুল্ল স্বরে বলে বসে, আপনি অনুমতি দিচ্ছেন তো!
!’ গম্ভীর স্বর গমগম করে ওঠে মি. নাসিরের। চমকে উঠে তাকায় ওরা দুজন। মুখ দুটো শুকিয়ে যায় পলকের মধ্যে। সারওয়ার সামলে নেয় কোনমতে নিজেকে। কিন্তু কাওসার কিছুটা সেন্টিমেন্টাল ধরনের। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে তার প্রচণ্ড অভিমানে। এতো সাধের আশায় এমন করুণ ভাবে ছাই পড়বে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
| ‘মারীতে বেড়াতে যাবে! বলি বেড়াতে গেলে টাকাপয়সার দরকার সে খেয়াল আছে?’
বেঁকিয়ে ওঠেন এবার মি. নাসির। ওদেরকে চুপ করে থাকতে দেখে আরও রাগ হয় তাঁর। বলেন, ‘আবদারের একটা সময় আছে, সীমা-পরিসীমাও আছে।
জানিস, কতো টাকা লাগবে মারীতে বেড়াতে গেলে দুজনের?’
কথা বলতে পারে না ওরা।
‘পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। তার কমে তোমাদের হবে না, রাজা বাদশা তোমরা!
এ কথারও উত্তর দেয় না ওরা। মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে।
যাও! আমাকে এভাবে আর বিরক্ত কোরো না কখনও। আমার মাথা ঠিক নেই এখন হাজারো দুশ্চিন্তায়, ওনারা আবদার নিয়ে এলেন–মারীতে ছুটি কাটাতে যাবো। আশ্চর্য!
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় ওরা দুজন। একজন অন্যজনের দিকে তাকাতে পারে না।
| মন্টি কোথায়? ছোটো ভাইটার দিকে একটু খেয়াল দিয়ে। কখন, কোথায়। কোথায় যে সে ঘুরে বেড়ায় কে জানে। নিজেদেরকে নিয়ে সবসময় ব্যস্ত না থেকে তার কথাও ভেবো একটু। পাঠিয়ে দাও ওকে আমার কাছে। মি. নাসির তিরস্কার করে বলেন কথাগুলো।
. মাথা নেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে ওরা। বারান্দা ধরে হাঁটে ওরা পাশাপাশি। কেউ কারও দিকে তাকায় না। কথাও বলে না। মিসেস নাসিরের ঘর পেরিয়ে হাঁটতে থাকে ওরা মাস্টার সাহেবের ঘরের দিকে।
মি. নাসির বছরখানেক হলো দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা, গেছেন বছর কয়েক আগে। কোন পক্ষেরই ছেলেপুলে হয়নি।
চাচীর ঘরের দিকে আড়চোখে তাকায় ওরা। শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন তিনি
একমনে। মাস্টার সাহেবও তাঁর নিজের ঘরে বই হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। ওদের পদশব্দেও চোখ তুলে তাকান না তিনি।
বারান্দা থেকে নেমে উঠান পেরিয়ে বাগানে প্রবেশ করে ওরা।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সারওয়ার। বলে, আমি আগেই বলেছিলাম–অসম্ভব। টাকা দিতে পারবেন না চাচা।’,
‘দেবেন না বলো! দিতে পারবেন না কেন, ইচ্ছে করলেই দিতে পারতেন। কিন্তু দেবেন না।’
রাগে ফেটে পড়ে কাওসার। সারওয়ার কি যেন ভাবে। তারপর কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নারে, দিতে পারলে ঠিক দিতেন। কিন্তু দেবেন কিভাবে বল? আব্বার উইলে কি লেখা আছে জানিস না?”
চুপ করে যায় এবার কাওসার। মাথা নিচু করে বসে পড়ে সে বাগানের ঘাসে। সারওয়ার বলে, “আব্বা উইল করে গেছেন এমনভাবে যে ব্যাঙ্ক থেকে এক হাজার টাকার বেশি কোনো মাসে তোলা যাবে না। এখন ভেবে দেখ, চাচা অতো টাকা পাবেন কোথায়? চাইলেই তো আর হলো না।
‘দাদা। হঠাৎ উত্তেজিত গলায় ডেকে ওঠে কাওসার। কিরে?’ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সারওয়ার।
‘দাদা, উইলে আব্বা আরও একটা কথা লিখে গেছেন, মনে নেই তোমার? চাপা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে কাওসার।
সারওয়ার রীতিমতো আশ্চর্য হয় এবার। কাওসারের কথা ঠিক ধরতে পারে
সে। বলে, “কি কথা লিখে গেছেন আব্বা উইলে? আর তুই এমন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠছিস কেন?’
অধৈর্য স্বরে কাওসার বলে, কিছু মনে থাকে না তোমার! উইলে লেখা আছে, ছেলেরা অসুখবিসুখে পড়লে বা তারা তেমন গুরতর কোনো বিপদের মধ্যে পড়লে, উপযুক্ত কারণ দর্শাবার পর, ব্যাঙ্ক থেকে যে কোনো পরিমাণ টাকা তুলতে পারবেন চাচা।
, হ্যাঁ, কিন্তু তাতে হয়েছে কি?’
বলছি!’ নিচু স্বরে কথাটা বলে চারপাশে তাকায় কাওসার।
ওদের ঠিক পিছনেই রান্নাঘর। বাঁ পাশে কয়েকটা গাছ। দূরে দেখা যাচ্ছে ড্রাইভারের ঘর এবং গ্যারেজ দুটোর ছাদ। বাড়ির গেটটা এখান থেকে দেখতে পাবার কথা নয়। ডান পাশে বাগানের বিস্তারিত এলাকা। সামনেও একই রকম।
‘বসো, গোপনীয় একটা পরামর্শ আছে…’
কাওসারের ব্যবহারে হতবাক হবার জোগাড় সারওয়ারের। কথা না বলে ঘাসের উপর বসে পড়ে সে। কাওসার দাদার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে। কানে কানে কথা বলার মতো এগিয়ে এসে সে বলে, মন্টিকে চুরি করবো আমরা। তারপর পাঁচ
হাজার টাকার দাবি জানিয়ে চিঠি লিখবো চাচাকে!’
নিচু স্বরে ষড়যন্ত্রটার কথা বলতে চাইছিল কাওসার। কিন্তু উত্তেজনায় তার গলা বেশ চড়ে আছে।
কি বলছিস তুই কাওসার! মাথাটা…’
‘আহা! ঘাবড়াচ্ছ কেন তুমি, সত্যিসত্যি তো আর মন্টিকে চুরি করছি না আমরা। একদিন কি দুদিন লুকিয়ে রাখবো শুধু। মাঝখান থেকে মারীতে বেড়াতে যাবার টাকা পেয়ে যাবো আমরা।’
‘কিভাবে?’ ধীরে ধীরে সারওয়ারও আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আমাদের চিঠিতে পাঁচ হাজার টাকার দাবি থাকবে। পাঁচ হাজার টাকা দিলে মন্টিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। চিঠি দেখিয়ে চাচা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা, তুলে।
কিন্তু আমাদের হাতের লেখা দেখে বুঝে ফেলবেন না চাচা?’
‘আমরা লিখবো কেন, প্রথমে একটা খসড়া করে নিয়ে সেটাকে বাংলা টাইপ রাইটার দিয়ে টাইপ করিয়ে নিয়ে আসবো।
| ‘কোথা থেকে? যে টাইপ করবে সে জেনে ফেললে..’
জানবে না। আমাদের স্কুলে টাইপ রাইটার আছে। বেয়ারাকে পয়সা দিয়ে আমরা নিজেরাই টাইপ করে আনবো।
তার পর?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করে ওঠে সারওয়ার।
চিঠিতে লেখা থাকবে– টাকা না দিলে তোমাদের মন্টিকে আর কখনও দেখতে পাবে না।’
‘কিন্তু…’
কাওসার দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, চিঠির নিচে লেখা থাকবে–ব্ল্যাক অ্যারো।
ব্ল্যাক অ্যারো!’ ‘না, হাতে লিখলে বা টাইপ করলে চলবে না। ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যাবে তাতে! রবারস্ট্যাম্প তৈরি করতে হবে একটা। | ‘কিন্তু মন্টিকে কোথায় লুকিয়ে রাখবো?’
কাওসার বলে, তাও ঠিক করে ফেলেছি। বাগানের শেষ মাথায় যে কয়েকটা ঘর আছে, তার একটিতে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবো ওকে।
কিন্তু ঘরগুলোতে যে তালা মারা। আর অনেক মালপত্তর ঠাসা?’
‘চাবি জোগাড় করা কি আর অতোই কঠিন। আমি জানি ঐ ঘরগুলোর চাবি কোথায় ফেলে রেখেছেন চাচা। আর মালপত্তর সরিয়ে একজনের মতো জায়গা বের করে নিতে কতক্ষণ?’
সারওয়ার বলে, কিন্তু মন্টি যদি ওখানে যেতে না চায়?
‘সে আমি দেখবো। ঠিক ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাৰাে।
‘কিন্তু বাড়ির ভিতরেই রাখবো ওকে? চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলে?
‘কেউ শুনতে পাবে না হাজারো চিৎকার করলেও। ওখানে বোমা ফাটলেও কেউ শুনতে পাবে না এখান থেকে।
কিন্তু কদিন রাখতে হবে ওকে?’
ক’দিন আর, বড় জোর তিন দিন।’ সারওয়ার বললো, ‘এই কদিন খাবে কি ও?’ ‘আমরা খাবার দিয়ে আসবো।’ কিন্তু যদি ধরা পড়ে যাই।’
কাওসার বলে, ‘ধরা তো পড়বোই। কিন্তু, তখন আমরা মারীর পথে প্লেনে চড়ে বসেছি।’
এরপর ওরা দুজন নিচু স্বরে আরও খানিকক্ষণ গোপন পরামর্শ করলো। তারপর মন্টির খোঁজে দুজনে উঠে এলো বারান্দার উপর। কিচেনরুমে ঢুকে দেখলো সোনার মায়ের কোলে চড়ে কোকো খাচ্ছে মন্টি। মন্টির খুব প্রিয় কোকো।
সারওয়ার বললো, “সোনার মা, ওকে খাইয়ে চাচার ঘরে পৌঁছে দিও। চাচা ওর খোঁজ করছিলেন।’
‘দাদা কোকো খাবে?’ পাঁচ বছরের মন্টি দাদাদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।
, তুমি খাও, মন্টি। উত্তর দেয় কাওসার। তারপর ওরা বেরিয়ে আসে কিচেনরুম থেকে। ড্রইংরুমের একটা আলমারি থেকে কাওসার পুরানো একগোছা চাবি বের করে পকেটে ভরে নেয়। এরপর সিধে গিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে হাজির হয় ওরা।
জমিদারী আমলের বাড়ি এটা। বিরাট এলাকা নিয়ে বাড়িটা তৈরি করা হয়েছিল। ওদের দাদা তৈরি করেছিলেন এটা। নাম রেখেছিলেন শান্তিনীড়। বাড়ির পিছন দিকে নদী। নদীর ধার থেকে একটা সুড়ঙ্গ এসে পৌঁছেছে বাড়ির ঠিক নিচে। নদীর কিনারায় একটা বোট-হাউসও আছে। আজকাল আর সেটা ব্যবহার হয় না। একটা মোটরবোট আছে ওদের। মাঝে মধ্যে ওরা দুভাই মোটরববাটে করে বেড়িয়েটেড়িয়ে আসে।
নদীর কিনারা থেকে বাড়িটা প্রায় আড়াইশ গজ দূরে। মধ্যবর্তী জায়গাটায় নানারকম গাছ-গাছড়া জন্মেছে।
| বাড়ির সদর গেটটাকে বাঁ দিকে রেখে ওরা এগোলো। গেটটাও অনেক দূরে। বাড়ির ডান দিকে বাগান। বিরাট এলাকা নিয়ে আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি শত শত গাছ। বাগানের শেষ প্রান্তে কয়েকটি ছোটো ছোটো ঘর। আজেবাজে মালপত্তরে ঠাসা। ..
| পৌঁছে গেল ওরা। বারান্দায় উঠে চাবি দিয়ে একটা ঘরের দরজা খুললো কাওসার। দিনের বেলাতেও ঘরটা অন্ধকার। জানালাগুলো খুলে দিতে আলো এলো
ঘরটায়। রাশ রাশ ঘেঁড়া বালিশ, তোশক, কাঠের ভাঙা তক্তা ইত্যাদিতে ঘরটা ভরাট। দেরি না করে কাজে লেগে পড়লো ওরা। আধঘন্টার মধ্যে অর্ধেকটা ঘর পরিষ্কার হয়ে গেল।
. ভাঙা একটা হ্যারিকেন দেখে খুশি হলো ওরা। মন্টিকে রেখে যাবার সময় জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে। অবশ্য তেলের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্ধকার রাতে হ্যারিকেন না থাকলে ভয় পাবে মন্টি ঘুম থেকে উঠে। বিছানাপত্রের দরকার হবে
। ছেঁড়াখোঁড়া তোশক আর বালিশ সাজিয়ে একটা চমৎকার বিছানাও করে ফেললো ওরা।
ওখানকার কাজ সেরে ফিরে এসে স্নানাহার করে যে যার ঘরে ঠাঁই নিলো। একটু পরই কাওসার এলো সারওয়ারের ঘরে। বেলা তখন দুটো।
এই সুযোগ! ফিসফিস করে বললো সে।
চাচী কোথায় যেন গেলেন গাড়িতে করে। মন্টি ঘুমোচ্ছে। চাচার দরজা বন্ধ। সোনার মা খেতে বসেছে। আর মাস্টার সাহেব খেয়েদেয়ে ঘুমাচ্ছেন।
| আর ড্রাইভার?’
বললাম তো, চাচী কোথায় যেন গেলেন। ড্রাইভারকে নিয়ে গেছেন।
সারওয়ার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কিন্তু মন্টি ঘুমোলে হবে কি করে?’
হবে। আমি কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি ওকে। ঘুম ভাঙবে না। তুমি কেরোসিন আর মন্টির খেলনাগুলো নিয়ে এসো।’
সারওয়ার বলে, “ঠিক আছে। কিন্তু তুই পারবি মন্টিকে নিয়ে যেতে? উঠে পড়লে?’
‘উঠবে না! দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি চললাম!’
দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল কাওসার। সারওয়ার চৌকির তলা থেকে একটা মাঝারি আকারের বোতল বের করলো কেরোসিনের। আগেই সে জোগাড় করে রেখেছে সুযোগ বুঝে। খেলনাগুলোর জন্যে ড্রয়িংরুমে যেতে হবে।
ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হলো সারওয়ার। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। তার। হঠাৎ বুঝি কেউ দেখে ফেলে জিজ্ঞেস করে বসবে-কোথায় যাচ্ছো তুমি?
ড্রয়িংরুমে একটা ট্রামগাড়ি এবং দুটো পুতুল দেখতে পেলো সারওয়ার। একহাতে কেরোসিনের বোতল, অপর হাতে খেলনাগুলো নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে এলো সে। কিন্তু সোনার মাও খাবার ঘর থেকে বের হয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে দেখতে পেলো সে। তাড়াতাড়ি আবার ড্রয়িংরুমে ঢুকে হাতের জিনিসগুলো ঘরের এক কোণে লুকিয়ে ফেললো। তারপর ঝটপট একটা বই তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। সোনার মা ড্রয়িংরুমেই এসে ঢুকলো। টেবিলের উপর
দুটো পিরিচ ছিলো, সে দুটো নিয়ে তখুনি বের হয়ে গেল সে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সারওয়ার। ইতিমধ্যেই কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে তার।
| দরজার পাশ থেকে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে নিলো এবার সারওয়ার। সোনার মা বাথরুমে ঢুকেছে। তাড়াতাড়ি ঘরের কোণ থেকে জিনিসগুলো তুলে নিয়ে আবার ড্রয়িংরুমের বাইরে এলো সারওয়ার। এবার সে কোনো দিকে ফিরে
তাকিয়ে বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো বাগানের দিকে। . কাওসারকে দূর থেকেই দেখতে পেলো সারওয়ার। বারান্দার উপর উঠে চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওঠেনি?’ . না। ঘুমোচ্ছে! দাও, খেলনাগুলো ওর বিছানার পাশে রেখে দিই।’ | সারওয়ারের হাত থেকে খেলনাগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকলো কাওসার। পিছন পিছন নিঃশব্দ পায়ে সারওয়ারও ঢুকলো। মন্টি বিছানার উপর শুয়ে রয়েছে দেখতে পেলো সে। হ্যারিকেনটায় তেল ভরে দেয়াশলাই বের করে জ্বাললো সে। সলতেটা কম করে দিলো। কাওসার ইতিমধ্যে ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে।
‘চলো!’ . কাওসার তাড়া লাগালো জানালাগুলো বন্ধ করেই। মন্টির ঘুমন্ত মুখের দিকে চোখ পড়তে বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে সারওয়ারের। কাজটা কি ভালো হচ্ছে? মনটা কেমন যেন করে ওঠে। কাওসারের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চায় সে। কাওসার বুঝতে পারে দাদার মনের কথা। তারও কেমন যেন অস্বাভাবিক একটা আতঙ্ক জাগে মনে। এতো আদরের ভাইটিকে এখানে ফেলে রেখে যেতে তারও ভালো লাগে না। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে যেতেও কেমন যেন লাগে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে, আমি নাহয় রাতেরবেলা ওর কাছে এসে শুয়ে থাকবো। ভোর হবার আগে ঘরে ফিরে গেলেই হবে। কি বলো?’
কি যেন বলতে চায় সারওয়ার। কিন্তু মুখ থেকে কথা বের হয় না তার। নিজেদের অপরাধের সীমা অনুধাবন করে বোবা হয়ে গেছে সে।
‘চলো দাদা! এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয় আমাদের।’
একরকম ঠেলে ঠেলেই সারওয়ারকে বের করে আনে কাওসার ঘর থেকে। চাবি বের করে ঘরটায় তালা লাগাবার সময় হাত দুটো কাঁপতে থাকে তার। চোখ দুটোও ছলছল করে ওঠে মায়ায়।
| তালা লাগিয়ে কাওসার বলে, বাড়িতে নয়, চলো বাইরে বের হয়ে পড়ি আমরা।’
সারওয়ার বলে, “কেন?”
‘একটু পরই মন্টির খোঁজ করবে সবাই। আমাদের শুকনো মুখ দেখে ধরে ফেলতে পারে যে আমরা মন্টির কথা জানি। তারচেয়ে চললা সিনেমা দেখে আসি। বাড়ি ফিরে হঠাৎ শুনবো খবরটা, তখন আমাদের শুকনো মুখ দেখে ওরা কিছু ১২
বুঝতে পারবে না। কিন্তু সাবধান দাদা, ধমক খেয়ে ফাঁস করে দিয়ো না যেন কোনো কথা! তাহলে আর লাঞ্জনা গঞ্জনার সীমা থাকবে না।
তাই চল। যন্ত্রচালিতের মতো বলে সারওয়ার।
কাওসার বলে, সিনেমায় যাবার আগে স্কুলে যেতে হবে, আর রবারস্ট্যাম্প বানাবার দোকানেও যাবো। আসার সময় নিয়ে আসবো ওটা।
স্কুলে কেন?’ সারওয়ার প্রশ্ন করে। কাওসার বলে, “চিঠি টাইপ করতে হবে যে, ভুলে গেছো নাকি কথাটা?’ সারওয়ার বলে, “ওঃ, হ্যাঁ!’
সন্ধ্যার পর বাড়ির দিকে ফিরলো ওরা।
বাড়ির গেটের কাছেই নাটকের সূচনা হলো। ড্রাইভার শামসু রাস্তার উপর ছটফট করছিল ওদের অপেক্ষায়।
সারওয়ার সাহেব! মন্টি কোথায়!
কি হয়েছে শামসু?’ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কাওসার। এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে মিসেস নাসির বের হয়ে এলেন।
‘একি! তোমরা মন্টিকে নিয়ে যাওনি? কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’
সারওয়ার মনে মনে অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে। চাচীর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো সে। ড্রাইভার ভীত গলায় বললো, মন্টিকে দুপুরবেলা থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যে! আপনারা নিয়ে যাননি তাকে সঙ্গে করে?
‘কি বলছো, শামসু? মন্টিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!’ কাওসার আশ্চর্য হয়ে চিৎকার করে ওঠে।
সারওয়ার চাচীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, এসব কি বলছেন, চাচী!’ মন্টি…’।
মিসেস নাসির ধীরে ধীরে বলেন, তার মানে মন্টি তোমাদের সাথে যায়নি!
সারওয়ার বলে, ‘সেকি কথা! আমরা তো সিনেমায় গিয়েছিলাম। যাবার সময় মন্টি আপনার ঘরে ঘুমাচ্ছিল দেখে গেলাম!’
চিৎকার করে প্রশ্ন করে কাওসার, সব কথা খুলে বলুন, চাচী! মন্টি…’।
মিসেস নাসির বলেন, মন্টিকে আমার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমি মার্কেটিং করতে গিয়েছিলাম ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে। ঘন্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে এসে দেখি ঘরে মন্টি নেই। সারা বাড়ি খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। পুলিসে খবর দেয়া হয়েছে। তোমার চাচা থানাতেই আছেন, কোনো খবর পাবার আশায়।
সন্ধ্যা সাতটার সময় মি, নাসির থানা থেকে বাড়িতে ফোন করে জানতে চাইলেন কাওসার এবং সারওয়ার ফিরেছে কিনা। ফোন ধরলেন মিসেস নাসির। এর
আধঘন্টা পরই ফিরে এলেন মি. নাসির। ফিরেই দু’ভাইকে জেরায় জেরায় ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। প্রকৃতপক্ষে পাগলপারা হয়ে গেছেন তিনি মন্টির নিরুদ্দেশে। বাড়ির সব লোককে ধমক মারছেন। ইতিমধ্যেই তাঁর চোখে জল এসে পড়ছে থেকে থেকে। মুখে কালো রঙের ছাপ পড়েছে। চোখ দুটো লাল। মাথার চুল বিশৃঙ্খল।
| জেরার উত্তরে বেশিরভাগ সময় মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো ওরা দু’ভাই। মি, নাসিরও ব্যস্তভাবে চলে গেলেন একসময়। খবরের কাগজের অফিসে মন্টির নিখোঁজ সংবাদটা পৌঁছে দিতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন তিনি। আসার সময় থানা থেকে আরও একবার ঘুরে এলেন। এর একটু পরই প্রৌঢ় মাস্টার সাহেব ফিরলেন। মন্টির নিখোঁজে তিনিও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি কয়েক ঘন্টা মন্টির খোঁজে।
কাওসার ও সারওয়ার বাড়ির গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো ঘন্টা দুয়েক। ওদের চাচী মিসেস নাসিরও ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলেন ঠায়। রাস্তার এদিক ওদিক আশায় আশায় সারাক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তিনি। যদি কেউ মন্টিকে খুঁজে পেয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিতে আসে এই আশায়।
ড্রাইভার শামস মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আবার বের হয়ে পড়লেন মাস্টার সাহেব। যাবার সময় ওদের দু’ভাইকে বাড়ি থেকে বের হতে মানা করে গেলেন। মিসেস নাসির মেয়েমানুষ, বাড়িতে আর একজন মেয়েমানুষ সোনার মা ছাড়া আর কেউ থাকবে না ওরাও বের হয়ে গেলে, তাই।
সোনার মা বারান্দায় বসে কাঁদছে সারাক্ষণ। ঘন্টা দুয়েক পর ওরা তিনজন ফিরে এলো গেট ছেড়ে বাড়িতে। ড্রয়িংরুমে বসলো ওরা। কারও মুখে কথা নেই। গম্ভীর একটা পরিবেশ। দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাবার কথা!
| আরও দু’ঘন্টা কাটলো অপেক্ষায় অপেক্ষায়।
| মি. নাসির ফিরে এলেন নিরাশ হয়ে। মাস্টার সাহেব এবং ড্রাইভারও ফিরলো। সোনার মাকে কোনমতে থামানো গেল না। একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে সে। হাজার হোক, জন্মাবার পর থেকে মন্টির দেখাশোনার ভার তার উপরই ছিলো। মা হারা ছেলেটির সে ছিলো মায়েরও বাড়া।
খাওয়া দাওয়া করার কথা কেউ তুললো না। কাওসার ও সারওয়ারকে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলা হলো। একটু পরই মি. নাসির বারান্দা থেকে ওদের দু’ভাইয়ের উদ্দেশে বললেন, ‘জানালা দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকো তোমরা। বাইরে বের হবার দরকার নেই। আমি বেরুচ্ছি।’
একটু পর মাস্টার সাহেবও ঐ এক কথাই বলে গেলেন ওদেরকে উদ্দেশ্য করে। সব শেষে ওদের চাচী মিসেস নাসির এসে সাবধান করে দিয়ে বললেন,
বাইরে বইয়ের উদ্দেশে বললে হলো। একটু
বিপদ যখন একটা ঘটেছে তখন বলা যায় না এরপর কি হয় না হয়, তোমরা সব জানালা দরজা বন্ধ করে দাও।’
রাত একটা পর্যন্ত নিঃশব্দে পড়ে রইলো সারওয়ার তার বিছানায়। মন্টি জন্যে অসহ্য একটা অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছে সে। বালিশ ভিজে গেছে এতক্ষণ ধরে কেঁদে কেঁদে। খাওয়া হয়নি সেই দুপুরের পর থেকে মন্টির। কথাটা ভাবতেই বুকে একটা তীব্র যন্ত্রণা জাগছে তার।
ধীরে ধীরে বিছানার উপর উঠে বসলো সারওয়ার। বিছানা থেকে মেঝেতে নেমে দরজার দিকে এগোলো সে নিঃশব্দ পায়ে। দরজা খুলতে গিয়েই থমকাল। সে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে হঠাৎ! আকাশে কখন মেঘ জমে উঠেছে খেয়ালই করেনি
বৃষ্টি থামলো আধঘন্টা পর। . কোনো শব্দ না করে দরজা খুলে পা পা করে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে চললো সারওয়ার। গামবুটটা পরে নিয়েছে সে। বৃষ্টিতে মাটি ভিজে কাদা হয়ে গেছে। গামবুট না পরলে পায়ে কাদা লাগবে, পিছলে পড়ারও ভয় আছে।
কাওসারের সাথে কোনো কথা বলার সুযোগ হয়নি সারওয়ারের। মন্টিকে কে খাবার পৌঁছে দিতে যাবে তাও ঠিক হয়নি। সারওয়ার ঠিক করে ফেলেছে সে-ই চুপিচুপি মন্টিকে খাবার দিয়ে আসবে। আর মন্টি যদি খুব বেশি কান্নাকাটি করে তবে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ঘরে। তারপর যা থাকে কপালে। এমন নির্মমতা করা উচিত হয়নি তাদের কোনমতেই। বাড়ির সব মানুষকে এভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলা রীতিমত একটা পাপ।
কাওসারকে ডাকবে না ভাবলো সে। চাচী এবং সোনার মা কান খাড়া করে জেগেই আছে যে যার ঘরে। ডাকতে গেলে দরজা খুলে বের হয়ে পড়বে বাইরে। ধরা পড়ে যেতে হবে তখন।
রান্নাঘর থেকে বিশেষ করে টফি এবং কোকো নিলো সারওয়ার। তাছাড়া রুটি, জেলী, কলা এবং সন্দেশও একটা প্লেটে সাজিয়ে নিলো।
টর্চ নিয়েছিল ঘর থেকে। কিন্তু তখুনি সে জ্বাললো না সেটা বারান্দা থেকে নেমে বাগানের সীমানায় যতক্ষণ না পৌঁছুলো ততক্ষণ অন্ধকারে আন্দাজ করে করে পা বাড়ালো সে। বাগানে পৌঁছে টর্চ জ্বাললো। . গামবুট পরা সত্ত্বেও অতি সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিলো সারওয়ারকে। ঝমঝম করে একনাগাড়ে আধঘন্টা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাগানের নরম মাটি বৃষ্টির পানিতে প্যাঁচপেচে কাদা হয়ে গেছে। যে-কোন মুহূর্তে পিছলে পড়ার ভয়।
আর এক ভয়! হঠাৎ সারওয়ার যেন জমে গেল পাথর হয়ে। কাঁপা কাঁপা বুকে মাথার উপর তাকালো সে। গাছের পাতা থেকে মাথার উপর দু’এক ফোঁটা পানি পড়েছে। ভূতের ভয় চেপে ধরলো। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে সে কথা মনে
পড়লো না তার তখুনি। চমকে উঠে ভাবলো সে, ভূত বুঝি তার গায়ে-মাথায় থুথু ফেলছে।
দৈত্য! রাতের নির্জন বাগানের সবগুলো গাছই যেন মস্ত মস্ত দানবের মূর্তি হয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৈত্যদের একটা চোখ থাকে। সারওয়ার ভাবলো, একচোখা দৈত্যগুলো কটমট করে চেয়ে আছে তার দিকে।
| মিনিট খানেক কাটলো। চাঁদের আলো ফুটছে বৃষ্টির পর। চোখে সয়ে এলো আস্তে আস্তে গাছ-পালার কালো ছায়া। মনে পড়লো ভূতের থুথু নয়, বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে তার গায়ে গাছের পাতা থেকে। মনে মনে একটু হাসলো সে নিজেকে সাহস দেবার জন্যে। তারপর পা বাড়ালো।
‘ হাঁটতে হাঁটতে বুকটা কেমন যেন একটা আনন্দে ভরে উঠলো সারওয়ারের। আদরের ছোটো ভাইটির প্রতি সত্যি সত্যি জঘন্য ব্যবহার করেছে তারা। যাই হোক, খাবার দেখে খুশি হবে মন্টি। সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে সারওয়ার ওকে আদর করে।
বাগানের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে সারওয়ার দেখলো সামনের দিকে নিচু মতো জায়গাটায় বৃষ্টির পানি জমেছে। এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। ঘুরে যেতে হবে। | ঘুর পথে হেঁটে মন্টির ঘরের বাঁ পাশের জানালার ধারে গিয়ে পৌঁছুলো সে। কি মনে করে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে টর্চ দিয়ে ঠেলা দিলো সারওয়ার কপাটে। বেশ জোরেই চাপ দিয়েছিল সে জানালার কপাটে। পুরানো হয়ে গেছে ছিটকিনি। স্কু খুলে পড়ে গেল ছিটকিনিটা। জানালার কপাট দুটো দু’পাট হয়ে খুলে গেল। ঘরের ভিতর তাকালো সারওয়ার কৌতূহলী চোখে। অমনি হ্যাঁৎ করে উঠলো তার বুকটা।
ঘরের একটি মাত্র দরজার পাল্লা দুটো হাঁ হাঁ করছে!
পলকের মধ্যে চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল সারওয়ারের। জানালার গা ঘেঁষে সরে এলো সে আরও একটু। ঘরের চারদিকে তীক্ষ্ণ চোখে বারবার তাকালো। হ্যারিকেনটা এখন জ্বলছে ঘরে। ঘরটা বেশ আলোকিত। কিন্তু মন্টির বিছানায় মন্টি নেই! ঘরের কোনদিকেই কারো ছায়ামাত্র দেখা গেল না!
জানালার সামনে থেকে ছিটকে সরে এলো সারওয়ার। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু বুদ্ধি গুলিয়ে গেছে ওর। কিছু ভাবতে পারছে না সে। আবার একবার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু না, চোখের ভুল হয়নি তার। সত্যি সত্যি ঘরে কেউ নেই।
থরথর করে কেঁপে উঠলো সারওয়ারের ঠোঁট দুটো। নিজেকেই কি যেন সে বলতে চাইলো। একটা অশুভ আশঙ্কায় দম বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে যেন তার। জানালার সামনে থেকে সরে দুরু দুরু বুকে কাঁপা কাঁপা পায়ে ঘরটার বারান্দার দিকে এগোল সে। বারান্দার দিকে পৌঁছে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো। হঠাৎ
নিজের অজান্তেই ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল তার। কাঁপা কাঁপা, ভীত এবং ব্য,
গলায় ডেকে উঠলো, মন্টি!’
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না মন্টির।
ভয়ঙ্কর একটা ভয় জাগলো সারওয়ারের বুকে। চোখ দুটো শক্ত হয়ে উঠলো। জলে ভরে গেল পলকের মধ্যে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত চেপে বারান্দার সিঁড়িতে পা রাখলো সে। দ্বিতীয় সিঁড়িটিতে পা রাখতে রাখতে টর্চের আলোর পিছু পিছু তার চোখ জোড়া গিয়ে পড়লো হঠাৎ বারান্দার উত্তর প্রান্তে।
‘আঁক!’ ডুকরে কেঁদে ওঠার মতো অদ্ভুত একটা আর্তধ্বনি বের হলো সারওয়ারের গলা চিরে।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের পেটটা বারান্দার সিঁড়িতে পড়ে ঝনঝন শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে বারান্দার, উত্তর প্রান্তে পড়ে থাকা কাওসারের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে রইলো সারওয়ার। তার হাতের টর্চটা তখনও কাওসারের মুখের উপর তীব্র আলো ছড়াচ্ছে!
রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে বারান্দার উপর। কাত হয়ে পড়ে আছে লাশটা। দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রয়েছে মাথাটা। পাশেই পড়ে রয়েছে একটি প্লেটের টুকরো
অংশ। কয়েকটা টফিও ছড়িয়ে রয়েছে আশপাশে। কিছুক্ষণ আগেই নিহত হয়েছে সে। কাওসার এখানে এলো কিভাবে? কে তাকে এভাবে মারলো? মন্টি কোথায়?
পাথরের মূর্তির মতো কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইলো সারওয়ার কাওসারের লাশের দিকে। হাতের টর্চটাকে অসুরের শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছিল সে। হঠাৎ হাত থেকে পড়ে নিভে গেল সেটা। চিন্তাশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেললো সে। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যেতে চারপাশ থেকে ভয়ানক একটা ভীতি চেপে ধরলো তাকে। কারা যেন গলা টিপে ধরার জন্যে অন্ধকারে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কথাটা ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। পলকের মধ্যে বারান্দা থেকে নেমেই প্রাণপণে ছুটলো সে বাড়ির দিকে।
দুই ভোর পাঁচটা।
শখের গোয়েন্দা শহীদ খান সবেমাত্র ব্যায়াম শেষ করে বাগান থেকে ঘরের দিকে ফিরে আসছিল। এমন সময় গফুর এসে খবর দিলো, চা-নাস্তা তৈরি, দাদামণি। কামালদা এখনও এলো না যে?’
উত্তর দিলো না শহীদ। কামালদা কখন আসবে, দাদামণি?’
২-
‘এই আসলো বলে। হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো শহীদ।
গফুর আর কিছু জিজ্ঞেস না করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। তার দাদামণি, আর কামালদা আজ শিকার করতে যাবে কোথায় যেন। নাস্তা তৈরি করা হয়েছে। কামালদা আসলেই হয় এখন।
একতলা বাড়িটা ভেঙেচুরে তিনতলা করা হয়েছে মাসখানেক হলো। সিঁড়ি বেয়ে সিধে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো শহীদ। দশমিনিট সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে মান করলো। স্নান করতে করতেই শুনতে পেলো টেলিফোন বাজছে। তারপরই কামালের কণ্ঠস্বর শুনলো। ফোন ধরেছে সে-ই। শহীদ ভাবলো, এতো ভোরে আবার কার কি দরকার পড়লো? নিশ্চয়ই বুড়োটা কোনো সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব চাপাবার জন্যে ফোন করেছে। মৃদু হাসলো শহীদ তোয়ালে দিয়ে গা-হাত মুছতে মুছতে। বুড়োটা মানে-পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ঘুঘু অফিসার মি সিম্পসন।
গ্যাবার্ডিনের অ্যাশ কালার স্যুট পরে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে এলো শহীদ। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখলো কামাল মুখ গোমরা করে বসে আছে সোফায়।
‘কেমন?’ খবর জিজ্ঞেস করলো শহীদ। ‘খারাপ।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো কামাল। ‘. | ‘কেন, কি হলো?’ সোফায় বসতে বসতে প্রশ্ন করলো শহীদ, ‘মি. সিম্পসন ফোন করেছিলেন বুঝি?
হা। তুই বুঝলি কিভাবে?
‘এতো সকালে আর কে খোঁজ করতে পারে শহীদ খানের। মৃদু হেসে উত্তর দিলো শহীদ।
‘শিকারে যাওয়া হবে না।’ দুঃখিত কণ্ঠে ঘোষণা করলো কামাল, ‘মি, সিম্পসন দশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন। খুন হয়েছে।
‘কে খুন হয়েছে, বাল্যবন্ধু? আমাদের শিকার করতে যাবার প্রোগামটা নিশ্চয়ই?’ | ঠাট্টা রাখ, শহীদ। রীতিমত রাগ হচ্ছে আমার খুনীটার ওপর। ব্যাটা আর সময় পেলো না খুন করার। আজকে আমরা শিকারে যাবো, আর ঠিক আজকেই হারামজাদা কাণ্ডটা করে বসেছে।
হেসে ফেলে শহীদ বললো, ‘বাহ্ বাহ্! এই না হলে তুই শহীদ খানের সহকারী! ইতিমধ্যেই খুনীকে চিনে ফেলেছিস দেখছি—সাবাশ!’ |
তারমানে!’
শহীদ কামালের আশ্চর্যবোধক প্রশ্নের উত্তরে বললো, এই তো তুই খুনীকে ‘ব্যাটা’ এবং ‘হারামজাদা’ বললি। তারমানে খুনী যে পুরুষ মানুষ তা তুই ধরে ফেলেছিস ইতিমধ্যেই। ঠিক বলিনি?’
১৮
শহীদের কথা শুনে লজ্জা পেলো কামাল। বললো, “না, মানে, ওসব কথা ভেবে বলিনি আমি…’
কিন্তু তোর মতো লোকের না ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত নয়, বাল্যবন্ধু।’ ‘তা ঠিক,’ মেনে নিলো কামাল শহীদের যুক্তি।
হা, বল এবার মি. সিম্পসন কি বললেন। কেন আসছেন তিনি?
এমন সময় গফুর ট্রে ভর্তি ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কামালের পাণ্ডুর মুখে জ্যোতি ফিরে এলো সেই সাথে। হাফ-বয়েল একখানা ডিম প্রথমেই মুখে পুরলো সে। তারপর গাল নাড়তে নাড়তে শহীদের প্রশ্নের উত্তর দিলো, শান্তিনীড়ের মি. নাসিরউল্লাহর ছোট ভাইপো নিখোঁজ হয়েছে, মেজটি খুন। মি.সিম্পসন আর কিছু জানাননি।
| ভুরু কুঁচকে শহীদ প্রশ্ন করলো, শান্তিনীড়ের ‘মি. নাসিরউল্লাহ! তারমানে নামজাদা অভিজাত বংশের…?’ ·
কামাল আরও একখানা ডিম মুখে পুরে ছোট্ট করে উত্তর দিলো, হু।
ওদের ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই মি. সিম্পসনের গাড়ির হর্ন শোনা গেল। প্রস্তুত হয়েই ছিলো ওরা। বাক্যব্যয় না করে ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে পড়লো দু’জন।
তৈরি?’ মি. সিম্পসন একটুকরো হাসি উপহার দিয়ে প্রশ্ন করেন শহীদকে দেখে।
‘গুডমর্নিং মি. সিম্পসন। তৈরি। কিন্তু…
‘গুডমর্নিং, মাই বয়েজ। গাড়িতে ওঠো আগে, তারপর কথা বলা যাবে যেতে যেতে।
গাড়িতে উঠে বসলো ওরা। ড্রাইভার স্টার্ট দিলো। মি. সিম্পসনই মুখ খুললেন এবার, মি. নাসির-এর বাড়িতে একটা খুন হয়েছে, আর একটা ছেলে নিখোঁজ হয়েছে–এছাড়া এখনো আমি কিছু জানি না শহীদ। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কারণ হলো এই যে, যতটুকু শুনেছি ততটুকুতেই আমার ধারণা হয়েছে ব্যাপারটা কুৎসিত রকমের জটিল। চলো, ওখানে গিয়ে নিজেই সব দেখতে পাবে। কিন্তু তোমাকে একটা খবর শোনাই…।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় শহীদ। মি. সিম্পসন বলেন, গতকাল কুয়াশা এসেছিল আমার অফিসে।
| চমকে উঠে শহীদ তাকায় মি. সিম্পসনের দিকে। ভু দুটো কুঁচকে উঠলো তার। কামাল ও গফুরকে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে আকস্মিকভাবে প্লেনে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল কুয়াশা। পঁচিশ দিন হলো ঢাকায় পৌঁছেছে ওরা। হঠাৎ কুয়াশা পেরুতে একা রয়ে গেল কেন তা কামালও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেনি। সাজামো থেকে পেরুর উদ্দেশে ফিরছিল কুয়াশা কামাল ও গফুরকে
নিয়ে। বৈজ্ঞানিক কোটেযের যারা শত্রু ছিলো তাদের হোত মাতবরটি লুকিয়ে পড়েছিল টারাটাকা শহরে। তার সন্ধানেই যাচ্ছিলো ওরা। লোকটাকে খুঁজে বের করে ধরার ইচ্ছা ছিলো কুয়াশার। কিন্তু হঠাৎ অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটলো। মহাশূন্য থেকে কোনো গুরুতর খবর এসে পৌঁছলো একদিন। চঞ্চল হয়ে উঠলো কুয়াশা। তাড়াহুড়ো করে কামাল ও গফুরকে ঢাকার উদ্দেশে প্লেনে চড়িয়ে দিলো সে। কামালকে বলেছিল আমি ফার্ণান্দোর কাছ থেকে স্বর্ণের যে বস্তাগুলো উদ্ধার করে নদীতে ডুবিয়ে রেখেছি সেগুলো তুলতে যাচ্ছি। পরে সব রহস্য পরিষ্কার করে বলবো যখন আবার দেখা হবে। চলি। তারপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি কুয়াশার।
* কুয়াশা এসেছিল আপনার অফিসে?’ কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করে কামাল। ‘কেন? সে আবার ঢাকায় ফিরলো কবে?
কবে ফিরলো জানি না, তবে এসেছিল একজন প্রাক্তন পুলিস অফিসার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। ব্যস্ত ছিলো সে, আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
‘প্রাক্তন পুলিস অফিসার?’ প্রশ্ন করে শহীদ।
মি. সিম্পসন বলেন, ‘লোকটার নাম ইকরামুলা খান। কোনো একটা গুণ্ডদলকে গ্রেফতার করতে গিয়ে একটা হাত খসে যাওয়ার ফলে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। বার্মা থেকে লোকটা সম্প্রতি ঘুরে এসেছে। তার সম্পর্কেই জানতে চায় কুয়াশা।
“কি জানতে চায়? ইকরামুল্লা খান সম্পর্কে তার তথ্য সংগ্রহের কারণ?’
মি.সিম্পসন বলেন, তা কুয়াশা আমাকে বলেনি। তবে রহস্য একটা নিশ্চয়ই আছে।’
কামাল বলে, সে কথা ঠিক। তা না হলে কুয়াশা নিজে তথ্য সংগ্রহের জন্যে আপনার কাছে আসতো না।’
মিনিট কয়েকের মধ্যেই শান্তিনীড়ে পৌঁছুলো ওরা। মি. নাসির দ্রুত পায়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওরা তিনজনই তাকালো মি. নাসিরের দিকে। এক পলকের দৃষ্টিতেই সবাই বুঝতে পারলো যে, ভদ্রলোক পাগল হয়ে যেতে যা বাকি, আছেন। খুনীর মতো লাল টকটকে হয়ে উঠেছে চোখ দুটো। দাঁড়াবার ভঙ্গিটিও স্বাভাবিক নয়। টলটলায়মান অবস্থায় কোনরকমে যেন দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। চোখের কোণে এবং গালে এখনও জলের রেখা। দৃষ্টি ঘোলাটে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন মি. নাসির। কথা বলতে পারছেন না যেন। মি. সিম্পসনই এগিয়ে গেলেন।
‘আমরা এসে গেছি, মি. নাসির। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান, আর ইনি ওঁর সহকারী কামাল আহমেদ। আমার বিশেষ
অনুরোধে এঁরা এসেছেন তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে।
স্বাভাবিক সুনীর মতো বুঝতে পারলে
মাথা নেড়ে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ালেন মি. নাসির। কথা বলতে পারলেন না।
‘চলুন, ঘটনাস্থলের দিকে যাওয়া যাক। লাশ কেউ ছোঁয়নি তো?”
না। চলুন। ভাঙা গলায় এই প্রথম কথা বললেন মি.নাসির। তারপর পথ দেখিয়ে আগে আগে হেঁটে চললেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে বাগানে প্রবেশ করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর শহীদের দু’কাঁধে হাত তুলে অরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মি. শহীদ, আপনি..যেই হোক আমার ভাইপোর খুনী, আপনি নামটি বলবেন আমাকে শুধু…তারপর আমি দেখবো তাকে…’।
দাঁতে দাঁত চেপে উত্তেজনা দমন করার চেষ্টা করলেন মি. নাসির। শহীদ ধীর। এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে আশ্বাস দিলো,’বিচলিত হবেন না, মি. নাসির। আপনারা বিচলিত হলে খুনীকে ধরা অসম্ভব। আপনাদের তথ্য দানের ওপরই নির্ভর করছে আসল খুনীকে খুঁজে বের করার সম্ভাবনা।
আবার ওরা হাঁটতে শুরু করলো। বাগানের বিরাট এলাকা পেরিয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হলো ওরা। দু’জন পুলিস কনস্টেবল আগেই পৌঁছে গেছে। কাওসারের লাশ পাহারা দিচ্ছে তারা। অদূরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে একজন মহিলা। অপর একজন মহিলা একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে। উঁপিয়ে চলেছেন। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে যে সে হলো এ বাড়ির পুরাতন চাকরাণী–প্রৌঢ়া সোনার মা। গাছের নিচে যিনি তিনি মিসেস নাসির। মাস্টার সাহেব বারান্দার উপর একটা খামের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন অনবরত। আর ড্রাইভার শামসু বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সারাক্ষণ তাকিয়ে আছে কাওসারের মৃতদেহের দিকে। সে যেন পাথর হয়ে গেছে। সারওয়ারকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
শহীদ এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লো লাশটার ওপর। কাওসারের মাথায় আঘাত করেছে খুনী। মোটা রড বা ঐ জাতীয় লোহার কোনো অস্ত্র দিয়ে করা হয়েছে আঘাতটা।
‘রড যদি হয় তবে সেই রডের মাথাটা ছিলো মোটা। কামালের উদ্দেশে নিচু গলায় বললো শহীদ।
মি. সিম্পসনও দেখলেন লাশের মাথার ঠিক মাঝখানে গভীর একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। মৃতদেহের আশেপাশে কয়েকটা টফি, একটা ভাঙা পিরিচ, মাখন মাখানো কয়েক পিস পাউরুটি ইত্যাদি ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। মি. নাসিরের দিকে তাকিয়ে শহীদ প্রশ্ন করলো, এসব খাবার এলো কোথা থেকে?’
| ‘কিছুই বুঝতে পারছি না, মি, শহীদ। আমার কাওসার কেমন করে এখানে এলো, কে তাকে এভাবে হত্যা করলো কিছুই অনুমান করতে পারছি না আমি। একটি কথাই কেবল বলতে পারি আপনাকে। তা হলো, টফিগুলো আমার ছোটো
নর উদ্দেশ্যের সব কথা শোনে ওঁদের ড্রয়িংরডি
ভাইপোর খুব প্রিয়! তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কাল থেকে। তাকেও বুঝি শেষ করে)
কথা শেষ করতে পারলেন না মি. নাসির। ছেলে মানুষের মতো ডুকরে কেঁদে ফেললেন। শহীদ মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বললো, আপনি এবার লাশের ব্যবস্থা করতে পারেন। চলুন বৈঠকখানায় গিয়ে বসে সব কথা শোনা যাক।
লাশ পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে ওঁদের ড্রয়িংরুমের দিকে নিয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ জানালেন মি. সিম্পসন। শহীদ বারান্দার সিঁড়ি
ধরে নামার সময় থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়ির ধাপে একজোড়া গামবুটের ছাপ চোখে পড়েছে তার।
‘এদিকে বৃষ্টি হয়েছে ঠিক কখন?
শহীদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন মিসেস নাসির। তিনি গাছের তলা থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছেন, রাত সোয়া একটায় শেষবার বৃষ্টি হয়েছে।’
শহীদ আপন মনেই বললো, তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল কি? মাটি দেখছি এখন শুকিয়ে গেছে প্রায়। কাদাটাদা, নেই।’
‘হা।’ সায় দিলেন মিসেস নাসির।
শহীদ মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি সকলকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসুন। আমি আসছি এখুনি।
চোখেচোখে কি যেন কথা হয়ে গেল ওদের দুজনের। মি. সিম্পসন বাক্যব্যয় করে সকলকে নিয়ে চলে গেলেন বাগানের পথ ধরে ড্রয়িংরুমের দিকে। শহীদ ও কামাল রয়ে গেল ঘটনাস্থলে। বাকি দুজন পুলিস কনস্টেবল লাশ পাহারা দেবার জন্যে রইলো শুধু।
“কি ব্যাপার?’ প্রশ্ন করলো কামাল।
শহীদ বললো, “সিঁড়ির দিকে চোখ ফেলে দেখ। গামবুটের চিহ্ন, তাই না? তারমানে রাতে যখন বৃষ্টি হয়েছিল তার পরপরই কেউ গামবুট পরে এসেছিল এদিকে। কিন্তু সে বারান্দার ওপর ওঠেনি বোঝা যাচ্ছে। এক কাজ কর, তুই আশপাশটা ভালো করে দেখ, খুনী কোনো কিছু ফেলে গেছে কিনা। আর আমি এই গামবুটের ছাপ ধরে এগোই। ড্রয়িংরুমে দেখা করবো।
কামালকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শহীদ গামবুটের ছাপ লক্ষ্য করে এগোতে যাবার জন্যে পা বাড়াতে গিয়েই ক্ষান্ত হলো। দেখলো সিঁড়ির বাঁ পাশে ছোটো ছোটো গাছের ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতর দু’টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে একটা পিরিচ, কয়েকটা টফি, রুটি ইত্যাদি। জিনিসগুলো তুলে কামালের হেফাজতে দিয়ে শহীদ চিন্তিত মুখে গামবুটের চিহ্ন অনুসরণ করতে শুরু করলো।
মাটি এখনও ভিজে ভিজে, কিন্তু কাদা নেই কোথাও। মাটির উপর গামবুটের ছাপ পড়ে যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও পরিষ্কার।
দাগ লক্ষ্য করে সারওয়ারের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শহীদ। ঘরট। ভিতর থেকে বন্ধ। ফিরে এলো সে ওখান থেকে। বৈঠকখানায় সকলে জমায়েত হয়েছে এতক্ষণে। শহীদ বারান্দা ধরে এগোতে এগোতে বৈঠকখানাটা দেখতে পেলো। ঢুকলো সে ধীর পদক্ষেপে।
বাড়ির সকলে উপস্থিত হয়েছে বৈঠকখানায়। কেবল সারওয়ার তার নিজের ঘর থেকে বের হয়নি।
আপনাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে লাশ দেখেন?’ শহীদ একটা সোফায় আসন গ্রহণ করতে মি. সিম্পসন সকলের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন।
‘আ-আমি! প্রৌঢ় মাস্টার সাহেব কিছুটা অপ্রতিভ কণ্ঠে উত্তর দেন।
মি. সিম্পসন বলেন, “আচ্ছা, শুধু আপনি থাকুন। আর সবাইকে একে একে জেরা করবো আমরা।’
মি. সিম্পসনের কথা শেষ হতে মাস্টার সাহেব ব্যতীত আর সকলে ড্রয়িংরুম ছেড়ে বের হয়ে যান। মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কেসটা জটিল বুঝতেই পারছো। আমি চাই তুমি নিজের হাতে নাও এটা। তুমিই জেরা করে যা জানবার জেনে নাও।’
ফর্মালিটির ধার না ধেরে মেনে নেয় শহীদ মি. সিম্পসনের অনুরোধ। সত্যি বলতে কি, কেসটা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে শহীদের। মাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, আপনি মি. নাসিরের…’।
‘আমি এ বাড়ির বহুদিনের গৃহশিক্ষক। এখানেই থাকি।’
‘আচ্ছা। তা মাস্টার সাহেব, আপনাকে আমি প্রথমে কোনো প্রশ্ন করবো না। কালকের এবং আজকের ঘটনা যা ঘটেছে শুধু তাই হুবহু বলে যান আপনি। যা জানেন।
কিন্তু গতকালকের ঘটনাই বলতে গিয়ে বারবার গুলিয়ে ফেলতে লাগলেন মাস্টার সাহেব। খুব বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেখে শহীদ বললো, ঠিক আছে, আপনাকে আমি একটা একটা করে প্রশ্ন করি, আপনি ধীরেসুস্থে উত্তর দিতে থাকুন। আচ্ছা বলুন তো, কাওসারকে শেষবার আপনি কখন দেখেছেন কাল রাতে।’
‘শেষবার ওকে দেখেছি সম্ভবত রাত নটায়। ও যখন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তখন রাত এগারোটা কি সাড়ে এগারোটা হবে। ওর এবং সারওয়ারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি মন্টিকে আবার খুঁজতে বের হবার আগে বলে যাই ওরা যেন জানালা দরজা ভালো করে বন্ধ করে শোয়।
| ‘আপনি ঐ গুদাম ঘরের দিকে আজ অতো সকাল বেলা কি দরকারে গিয়েছিলেন?
মাস্টার সাহেব ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, নাসির সাহেব কয়েকজন লোক ঠিক
করে নিয়ে আসেন বাড়ির পিছনের নদীতে মন্টিকে খুঁজে দেখার জন্যে। লোকগুলো জেলে, কিন্তু তাদের নৌকো ছিলো না। এ বাড়িতে কোষা নৌকো আছে একটা। সেটা আবার ঐ গুদাম ঘরের একটিতে ছিলো। গুদাম ঘরের চাবি খুঁজতে গিয়ে পাননি নাসির সাহেব। তাই আমাকে বলেন গুদাম ঘরে তালা দেয়া আছে কি না দেখে আসতে। আমি গিয়ে দেখি কাওসার মরে পড়ে আছে…
শহীদ প্রশ্ন করে, “আচ্ছা, মাস্টার সাহেব, কাওসারকে কে খুন করতে পারে বলে মনে হয় আপনার? কাউকে সন্দেহ হয় কি আপনার? আর মন্টিকে চুরি করেছে যে সে-ই কি খুনি বলে মনে হয় আপনার?’
শহীদের প্রশ্ন শুনে মাস্টার সাহেব অবাক হয়ে তাকান। তারপর বলেন, “আমি তো জানি না।’
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে শহীদ বলে, সত্যি জানেন না?’
।’
স্পষ্ট অজ্ঞতা প্রকাশ করেন মাস্টার সাহেব। তারপর হঠাৎ বলে ওঠেন, তবে একটা কথা বলতে চাই, এ বাড়িটাকে, গত দু’বছর ধরে কেমন যেন ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয়। আগে এরকম ছিলো না। জানেন, গত প্রায় দু’বছর ধরে প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে এ বাড়ির ভিতর একটা ছায়াকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
‘ছায়া! ছায়াকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়!শহীদ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে।
মাস্টার, সাহেব বলেন, বিশ্বাস করুন মি. শহীদ, আমি নিজের চোখেও দেখেছি।’
‘আর কে কে দেখেছেন আপনার মতো?’ ‘সোনার মা, এ বাড়ির চাকরাণী। মিসেস নাসিরও দেখেছেন। ‘আপনার কি মনে হয় রহস্যটা সম্পর্কে?’ ‘কি আর মনে হবে, ভুতুড়ে বাড়ি এটা তাই মনে হয়।
মাস্টার আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয় শহীদ। তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর মি. নাসির প্রবেশ করেন ঘরে। তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসে একটি সোফায় ধপ করে বসে পড়েন।
শহীদের অনুরোধে মি, নাসির মন্টির নিখোঁজ হবার ঘটনা থেকে আজ, সকালের সব ঘটনা ধীরে ধীরে ব্যক্ত করেন। শেষে শহীদ জেরা করতে শুরু করে, ‘আচ্ছা মি. নাসির, আপনার বড় ভাইপো সারওয়ারকে দেখলাম না তো? সে বুঝি কিচেন রুমের পাশের ঘরটিতে থাকে?
| হ্যাঁ। মন্টির নিখোঁজ সংবাদ শুনে ভয়ানক মুষড়ে পড়েছে ও। কাল রাতে দরজা বন্ধ করার পর ভোরবেলা কাওসারের নিহত হবার খবর শুনে দরজা খুলেছিল একবার। তারপর আবার ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিয়েছে দরজা। কোনমতে খুলতে চাইছে না।
শহীদ বললো, “ওকে সবার শেষে প্রশ্ন করবো। আচ্ছা মি. নাসির, কাল রাতে যখন বৃষ্টি আসে তখন আপনারা কে কোথায় ছিলেন বলতে পারেন?’
‘আমি ছিলাম থানায়। মন্টির কোনো খবর পাবার আশায়। আমার স্ত্রী ছিলো তার নিজের ঘরে। কাওসার ও সারওয়ার ছিলো তাদের নিজ নিজ ঘরে। সোনার মাও নিজের ঘরে ছিলো। আর মাস্টার সাহেব আর ড্রাইভার গিয়েছিল সম্ভাব্য
জায়গায় মন্টির খোঁজ করতে।’
কখন ফেরেন আপনারা?’
‘আমি ফিরেছি চারটের দিকে। ওরা ফিরেছে সাড়ে চারটের দিকে। আমি জেলে পাড়ার কয়েকজন জেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। নদীতে পড়ে মন্টি ডুবে গেছে কিনা জানার জন্যে ওদেরকে ডেকে এনেছিলাম। ওদের আবার নৌকো ছিলো না। আমাদের বাড়ির নৌকোটা…’। . শহীদ বললো, ওকথা শুনেছি আমরা। আচ্ছা, এবাড়িতে বছর দুয়েক ধরে প্রতি পূর্ণিমার রাতে নাকি একটা ছায়াকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। কথাটা কতটা সত্যি?’, শহীদের প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠেন মি. নাসির। শহীদের নজর এড়ায় না মি.
নাসিরের ভাবান্তর।
‘আমি কখনও ওরকম কিছু দেখিনি। তবে ওরা বলে দেখেছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে শহীদকে তাকাতে দেখে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন মি. নাসির।
শহীদ বলে, “আচ্ছা, মন্টি নিখোঁজ এবং কাওসার খুন এ দুটো ঘটনার সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ আছে বলে মনে করেন আপনি?
‘ঠিক বুঝতেই পারছি না, মি. শহীদ, কি ঘটেছে, কেন ঘটেছে, কে ঘটিয়েছে…’
শহীদ বলে, আপনার কোনো শত্রু আছে, মি. নাসির? শহীদের এ প্রশ্ন শুনেও চমকে ওঠেন, মি. নাসির।
চুপ করে থাকবেন না, মি. নাসির। মনে রাখবেন, আপনাদের সত্য কথনের উপর নির্ভর করছে অপরাধী বা অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া।
না। আমার কোনো শত্রু নেই।’ শহীদের প্রশ্নের উত্তর দেন মি. নাসির।
শহীদ একই প্রশ্ন করে একটু ঘুরিয়ে, আপনাকে বিপদে ফেলে লাভবান হবে এমন কেউ আছে কি?
একমুহূর্ত চুপ করে থেকে উত্তর দেন মি. নাসির, বুঝতে পারছি না আমাকে বিপদে ফেলে কার কি লাভ হতে পারে।
কারো উপর সন্দেহ হয় আপনার?
।’ শহীদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “এ বাড়ির মালিকানা কার নামে?
২৫
‘আমার জীবিত অবস্থায় এ বাড়ি ভাগ-বাঁটওয়ারা করা যাবে না। আমার মৃত্যুর পর এ বাড়ি পাবে আমার ভাইপোরা। আমার সন্তান হলে সমান ভাগে ভাগ করা যাবে। বড়দা মারা যাবার আগে উইলে সেরকম ব্যবস্থাই করে গেছেন।
শহীদ বলে, “আপনার বড়দা উইল করেছিলেন? আচ্ছা, আপনাদের সম্পত্তি এবং ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকার একটা হিসেব দিতে যদি আপত্তি না থাকে…’।
‘আপত্তি আর কি। এ বাড়িটা ছাড়া আমাদের আর কোনো বাড়ি নেই। বড়দা ব্যাঙ্কে টাকা রেখে গেছেন মোট দশ লাখ। প্রতিমাসে এক হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না, যতদিন সারওয়ার বিয়ে না করে। আমার অবর্তমানে আমার ভাইপোরা তুলতে পারবে টাকা।’
শহীদ বলে, কিছু মনে করবেন না, মি. নাসির, আমি একটা প্রশ্ন করছি আপনাকে। আপনার বড়দা ব্যাঙ্কে টাকা রেখে যানদশ লাখ, কিন্তু প্রতিমাসে এক হাজারের বেশি না তুলতে পারার ব্যবস্থা করে গেলেন কেন উইলে?’
একমুহূর্ত কি যেন ভাবলেন মি, নাসির। তারপর বললেন, ‘বড়দা ঠিকই করেছিলেন। তা না হলে টাকাগুলো এতদিনে শেষই করে ফেলতাম। আসলে আমার খরচাপাতির হাত অত্যন্ত লম্বা, এবং দাদা সেটা জানতেন। অবশ্যি আমার ভাইপোদের কোনো…’
হঠাৎ কি যেন ভেবে থেমে যান মি. নাসির। শহীদ বলে, থামলেন কেন, . বলুন?
না, কিছু না। আমার আর কিছু বলার নেই।’
শহীদ অপর একটি প্রশ্ন করে এবার, আচ্ছা, মি. নাসির, কাওসার এবং সারওয়ারের মধ্যে সপ্তাহখানেকের ভিতর কোনো ঝগড়াঝাটি হয়েছিল কিনা বলতে পারেন?’
কাওসারের সঙ্গে সারওয়ারের ঝগড়া! অসম্ভব, মি. শহীদ। যদিও মাত্র তিনদিন হলো বাড়িতে ফিরেছি আমি, এক সপ্তার কথা ঠিক জানি না। তবু বলছি, কাওসারের সঙ্গে সারওয়ারের তেমন ঝগড়াঝাটি হওয়া একেবারেই অসম্ভব। ওরা পরস্পরের প্রাণের বন্ধু।
তিন দিন মাত্র বাড়ি ফিরেছেন বললেন? কোথায় গিয়েছিলেন?’
শহীদের প্রশ্ন শুনে স্পষ্ট অপ্রতিভ হয়ে পড়েন মি. নাসির। বেশ একটু বিচলিত মনে হয় তাকে। তারপর শুকনো কণ্ঠে উত্তর দেন, বার্মায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।’
‘তাই নাকি? তা কতদিন ছিলেন? সঙ্গে কেউ ছিলো, না একাই গিয়েছিলেন?
‘ছিলাম পনেরো দিন। না, একা যাইনি। আমার একজন বন্ধুও গিয়েছিল সঙ্গে। | ‘কিছু মনে না করলে আপনার বন্ধুর নামটি…’
২৬
অনিচ্ছাসহকারেই নামটা বলেন মি. নাসির, ইকরামুল্লা খান। প্রাক্তন পুলিস অফিসার।
নামটা শুনে চমকে ওঠে শহীদ। মি. সিম্পসনের দিকে তাকায় সে। মি. সিম্পসনও চমকে উঠেছেন। কুয়াশা মি. সিম্পসনের অফিসে এসেছিল ইকরামুল্লা খানের সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে। তার সঙ্গে কি সম্পর্ক মি. নাসিরের?
কতদিনের বন্ধুত্ব ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার?’ শহীদের প্রশ্নের উত্তর দেন মি. নাসির ছোটো করে, ‘বছর সাতেকের।
আর কোনো প্রশ্ন আছে কিনা ভাবছিল শহীদ, এমন সময় কামাল ঢুকলো ঘরে। কামালের দিকে তাকিয়েই শহীদ বুঝতে পারলো কামাল ভিতরে ভিতরে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। মি. নাসিরের দিকে ফিরে সে বলে, “ঠিক আছে এবার আপনি যেতে পারেন। মিনিটপাঁচেক পর আপনি ড্রাইভার শামসুকে পাঠিয়ে দেবেন দয়া করে। আর একটি কথা, যতদিন না সব রহস্যের মীমাংসা হয় ততদিন
এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না কেউ। সকলের বেলাতেই এই নির্দেশ প্রযোজ্য। . মি. নাসির মৌনসম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে কামাল পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আনে। রুমালটা শহীদের হাতে দিয়ে বলে, ‘খুলে দেখ! এটা দিয়েই খুন করেছে কাওসারকে খুনি।’
একটা হাতুড়ি পেয়েছে কামাল। শহীদ রুমালটা সরিয়ে দেখলো হাতুড়ির মাথায় রক্ত এবং কয়েক গোছা চুল সেঁটে আছে। দেখেই বুঝলো কাওসারকে এটার সাহায্যেই খুন করা হয়েছে। প্রশংসার দৃষ্টিতে কামালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে, কোথায় পেলি এটা?’ | ‘ড্রাইভারের কোয়ার্টারে।
মুহূর্তের জন্যে কঠিন হয়ে গেল শহীদের মুখ। তারপর মি. সিম্পসনের হাতে রুমাল সুদ্ধ হাতুড়িটা সমর্পণ করে সে বললো, এর বাটে হাতের ছাপ পাওয়া যাবে সম্ভবত।
শহীদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে ঘরে এসে ঢুকলো ড্রাইভার শামসু। ঘরের মাঝখানে এসে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়ালো সে। মনোযোগ সহকারে ড্রাইভারের আপাদমস্তক দেখলো শহীদ। বেশ লম্বা লোকটা। বয়েস আন্দাজ ছাব্বিশ। গায়ের রঙ শ্যামলা। তীক্ষ্ণ নাক। চোখ দুটো কেমন যেন নিষ্প্রভ আর চঞ্চল এবং অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তবে কাঠামোটা শক্তসমর্থ। পরনে প্যান্ট শার্ট।
‘তোমার নাম শামসু? এ বাড়ির ড্রাইভার? “জ্বি।
কতদিন ধরে কাজ করছো তুমি এ বাড়িতে? বিয়ে করেছো, না?’
‘পাঁচ বছর। বিয়ে করেছিলাম কিন্তু…’
হঠাৎ শহীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে চুপ করে যায় ড্রাইভার। শহীদ ড্রাইভারের আকস্মিক পরিবর্তনটা লক্ষ্য করে। বলে, “ওঃ, মারা গেছে বুঝি?
| বেশ জোরে চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ ড্রাইভার, ‘মারা যায়নি সে! বিশ্বাস করুন আপনারা, সে মারা যায়নি হারিয়ে গেছে, না…’
হারিয়ে গেছে! কবে?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে শহীদ।
ড্রাইভার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আজ দু’বছর হলো এবাড়ি থেকেই নিখোঁজ হয়েছে আমার স্ত্রী। সাহেব সেদিন আমাকে একটা কাজে বাইরে পাঠিয়েছিলেন, ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে তাকে আর দেখিনি আমি। কেউ বলতে পারেনি কোথায় গেছে সে। থানায় খবর দিয়েছিলাম, কোনো সংবাদ দিতে পারেনি তারা।
শহীদ বলে, অবাক কাণ্ড তো! বাড়ি থেকে জলজ্যান্ত একজন মেয়েছেলে গায়েব হলো অথচ কেউ জানলো না কোথায় সে গেছে? বাড়িতে তখন কে, কে ছিলো?’
‘সাহেব ছিলেন। আর কেউ ছিলেন না। তিনি নিজের ঘরে ছিলেন, তাই জানতে পারেননি।
গম্ভীর হয়ে ওঠে ড্রাইভারের কণ্ঠস্বর। শহীদ বলে, তোমার সঙ্গে তোমার বউয়ের ঝগড়াঝাটি হয়েছিল নাকি?’
। ঝগড়া করার মতো মানুষ ছিলো না সে।’ ‘তার নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?’
মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে ড্রাইভার শামসু। তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে, জানি না।’
এ ব্যাপারে কারো হাত আছে বলে সন্দেহ করো তুমি? ‘ঠিক বুঝতে পারি না কাকে সন্দেহ করবো।
একটু ভেবে শহীদ প্রশ্ন করে, যেদিন তোমার স্ত্রী নিখোঁজ হয়েছে সেদিন কত তারিখ ছিলো বলতে পারো?’
তারিখটা বললো ড্রাইভার। লিখে নিলো কামাল। শহীদ আবার জেরা করা শুরু করলো, কতদিন থেকে এ বাড়িতে আছো তুমি?’
| ‘তিন বছর।’
‘আচ্ছা, প্রতি পূর্ণিমার রাতে এবাড়িতে নাকি একটা ছায়াকে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যায়?
‘আমি জানি না। দেখিনি কোনদিন।’
শহীদ এবার উঠে দাঁড়ায় সোফা ছেড়ে। ড্রাইভারের মুখের সামনে গিয়ে
s by
দাঁড়ায় সে। বলে, কাওসারকে খুন করার উদ্দেশ্যটা কি? কেন কাজটা করলে
তুমি?
‘আঁ!’।
অকস্মাৎ আঁতকে ওঠে ড্রাইভার শহীদের কথা শুনে। ফ্যালফ্যাল করে কয়েক সেকেণ্ড তকিয়ে থাকে সে। তারপর পাংশু হয়ে যায় তার সারা মুখ। কাকুতি মিনতি করে বলে ওঠে, ‘আমি! আমি না! আমি কেন খুন করবো মেজ সাহেবকে! বিশ্বাস করুন! আমি..’
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে লোকটা কথা বলতে বলতে। কিন্তু শহীদ কঠিন স্বরে বলে ওঠে, ন্যাকামি রাখো!
শহীদ মি. সিম্পসনের কাছ থেকে রুমালে জড়ানো হাতুড়িটা চেয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে দেখায়। বলে, ‘এটা এলো কিভাবে তোমার ঘরে?
| আমার ঘরে! বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে লোকটা শহীদের হাতের হাতুড়িটার দিকে। কথা বলে ওঠে শহীদ, ‘কি, বোবা হয়ে গেলে যে একেবারে!
কথা শেষ হতেই ড্রাইভার আছাড় খেয়ে পড়ে শহীদের পায়ের ওপর। বলে, না না! আমি জানি না ওটার কথা। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি রাখিনি ওটা আমার ঘরে। আমি খুন করিনি মেজ সাহেবকে কিছুই জানি না আমি…
দু’পা পিছিয়ে গিয়ে শহীদ ধমক দেয়, উঠে দাঁড়াও!’
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় ড্রাইভার। শহীদ জিজ্ঞেস করে, কাল রাতে বাইরে ছিলে কতক্ষণ?’..
‘প্রায় সারা রাতই ছোট সাহেবকে খুঁজেছি স্যার! বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞেস করে দেখবেন মাস্টার সাহেবকে। উনিও আমার সঙ্গে ছিলেন।’
তুমি এখন যেতে পারো। কিন্তু মনে রেখো এ বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করলে ভালো হবে না। মিসেস নাসিরকে ডেকে দিয়ো গিয়ে।
কিন্তু মিসেস নাসিরের বদলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেন একজন অপরিচিত ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ওরা তিনজন।
‘মাফ করবেন, আমি এ বাড়ির ফ্যামিলি সলিসিটর। এখুনি এসে পৌঁছেছি আমি। কয়েকটা কথা বলবার আছে আমার।’
ভদ্রলোককে বসতে অনুরোধ করে নামটি জেনে নেয় শহীদ। ভদ্রলোকের নাম আহমদ হোসেন। সুপুরুষ। কালো রঙয়ের স্যুট পরনে। শহীদের দিকে একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে আহমদ হোসেন বলেন, এই হুমকিপত্রটি এই মাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে মি. নাসিরের ঘরের টেবিলের ওপর থেকে। দেখুন।
আহমদ হোসেনের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে শহীদ চিঠিটা নিলো। বাংলায় লেখা চিঠিটা। পরিচ্ছন্ন পুরুষালী হাতের লেখা।
মি, নাসিরউল্লাহ,
হোসেন বলেকে। দেখুন ‘হীদ চিঠিটা
আশা করি এক, তোমার বল তুমি অ
অতি অল্প কথায় আদেশ করছি। আশা আছে, কোনরকম চালাকি না করে আদেশ পালন করবে। যদি না করো, তাহলে কাওসার যেভাবে শেষ হয়েছে মন্টিও সেভাবে শেষ হবে।
মন্টিকে পেতে হলে নগদ দশ হাজার টাকা জিন্না অ্যাভিনিউয়ের সামনে কামানের মুখের ভিতর রেখে ফিরে আসবে। টাকাটা রাখতে হবে রুমালে জড়িয়ে। আগামী পরশু ঠিক রাত আটটার সময়। এরপর সোজা চলে যাবে ডি.আই.টি. বিল্ডিংয়ের দিকে। আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, পুলিসে খবর দিয়ে বা অন্য কোনভাবে কোনো ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলে ভালো হবে
। তোমার মন্টির দশা কাওসারের মতো হবেই যদি তেমন কিছু করো– আশা করি একথাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।
আমি জানি, তোমার বড়দা উইলে কি ব্যবস্থা করে গেছে সুতরাং আমি এ-ও জানি যে এই চিঠির বলে তুমি অনায়াসে ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার টাকা তুলতে পারবে।
ইতি
তোমার যম। চিঠিটা পড়া শেষ করে শহীদ সেটা মি. সিম্পসনের দিকে বাড়িয়ে ধরে আহমদ হোসেনকে প্রশ্ন করলো, উইলের ব্যাপারটা কি বুঝলাম না তো। পত্রলেখক কি বলতে চায়?’
আহমদ হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মি. নাসিরের বড়দা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। সে জানতো মি. নাসিরের খরচ করার হাত খুব বেশি লম্বা। তাই প্রতি মাসে এক হাজার টাকার বেশি না তুলতে পারার ব্যবস্থা করে যায় উইলে। তবে তার তিন সন্তানের কোনো বিপদ বা অসুখবিসুখ দেখা দিলে প্রয়োজনমত টাকা তুলতে পারার ব্যবস্থা উইলে করা আছে। | তাই নাকি! কই, মি. নাসির তো সে কথা বলেননি?’ শহীদ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করতে আহমদ হোসেন অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কিন্তু মুখে তিনি কিছুই প্রকাশ করলেন না। শহীদ চিন্তিত হয়ে উঠলো মনে মনে। মন্টিকে তাহলে চুরি করা হয়েছে। এবং মন্টিকে যে বা যারা চুরি করেছে সে বা তারাই হত্যা করেছে বেচারা কাওসারকে। এই মার্ডার এবং কিডন্যাপের মোটিভ স্পষ্টই অর্থলোেভ। শহীদ প্রশ্ন করলো, “চিঠিটা এইমাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে না? যদি নতুন কোনো লোক বাড়িতে ঢুকে না থাকে কিছুক্ষণ আগে, তাহলে এ কাজ করেছে আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন…কি বলেন?’
| আহমদ হোসেন বিচলিত দৃষ্টিতে তাকান শহীদের দিকে। তারপর বলেন, ‘নতুন লোক বলতে আমাকেই বোঝায়। আমি মি. নাসিরের ঘরে ঢোকার একটু পরই চিঠিটা টেবিলের ওপর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই আমাকে
৩০
সন্দেহ করছেন না?’
শহীদ বলে, ‘ও কথা এখন থাক।
শহীদকে বাধা দিয়ে আহমদ হোসেন বলেন, একটা কথা বলতে হচ্ছে, আমার সঙ্গেই মি. নাসির তাঁর ঘরে ঢোকেন। এবং এর আগে তিনি ঘরে ঢোকেননি। কাল রাতেও ঘরে প্রবেশ করেননি তিনি। সুতরাং এটা খুবই সম্ভব যে, চিঠিটা অনেক আগে থেকেই টেবিলের ওপর ছিলো।
শহীদ ফ্যামিলি সলিসিটর আহমদ হোসেনের কথায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, মি. নাসির কি এই চিঠির হাতের লেখা চিনতে পারেননি?’
না!’ শহীদ বলে, আপনার নিজস্ব কোনো ধারণা আছে এসব ঘটনা সম্পর্কে?
আহমদ হোসেন কি যেন বলতে গিয়েও চুপ করে যান। শহীদ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মি. নাসির সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
একটু ভেবে নিয়ে আহমদ হোসেন হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘খরচা-পাতির দিক থেকে বারবার সাবধান করে আসছি আমি। কিন্তু আমার কথা কে মানে। টাকা পয়সার টানাটানি চলছে এখন, এটুকু আমি জানি।’
শহীদ বলে, ‘মি. নাসিরের খুব বেশি খরচার প্রয়োজন হয় কেন?
‘ঠিক জানি না। তবে বংশ পরম্পরায় বিলাস-ব্যাধি তো আছেই, তার ওপর উনি একটু বেসামাল ভাবেই চলেন।
‘যেমন?
আহমদ হোসেন একটু নিচু স্বরে বলেন, প্রতি রাত এগারটার সময় গাঙচিল বারে একবার করে হাজির হওয়া চাই-ই ওনার। বুঝতেই পারছেন, মদ এবং মেয়েমানুষে প্রবল ঝোঁক।’
কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে শহীদ। তারপর বলে, “আচ্ছা, আপনি ঢাকার বাইরে যাবেন কিছুদিনের মধ্যে?
না, কেন?’
‘আপনি এখন যেতে পারেন। তবে আবার আপনার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন পড়তে পারে। আপনার বাড়ির ঠিকানা?’
আহমদ হোসেন একটা ঝকঝকে কার্ড বের করে দেন। তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান দৃঢ় পদক্ষেপে। শহীদ ভদ্রলোকের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে।
শহীদের হাত থেকে কাগজ কলম নিয়ে কামাল এতক্ষণ ধরে সকলের জবানবন্দি লিখে নিচ্ছিলো। খাতা থেকে মুখ তুলে কিছু বলবার জন্যে ঠোঁট খুলতে গিয়ে খুললো না সে। মিসেস নাসির দরজায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। শহীদ ভদ্রমহিলাকে ঘরে আহ্বান করে বসতে বলে। আসন গ্রহণ করার পর শহীদ বলে,
৩১
চিঠিটা নিশ্চয় দেখেছেন আপনি?’
| ‘জ্বি। ছোট্ট করে উত্তর দেন মিসেস নাসির।
অপূর্ব সুন্দরী বলতে আপত্তি নেই ভদ্রমহিলাকে। একহারা গড়ন। গায়ের রঙ দুধে-আলতা। চোখ দুটি টানা টানা। এবং চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা বেপরোয়া ভঙ্গি ফুটে আছে।
“কি মনে হয় চিঠিটা সম্পর্কে? আমার তো মনে হয় বাড়িতে এই মুহূর্তে যারা অবস্থান করছে তাদের একজনেরই কাজ এটা।
শহীদের কথা শুনে নিজের অজান্তে একটু যেন চমকে ওঠেন মিসেস নাসির। ভীত চোখে তাকান তিনি শহীদের দিকে। তারপর সাথে সাথে সামলে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলেন, “সে কি! তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কাওসারের খুনি আমাদের মধ্যেই কেউ?–মাগো!’
শহীদ প্রশ্ন করে, মন্টি যখন নিখোঁজ হয় তখন বাড়িতে কে কে ছিলো বলতে পারেন?’
‘আমি ছিলাম না!’
আত্মসমর্থনের কণ্ঠে বলেন মিসেস নাসির, আমি মন্টিকে ‘আমার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিলাম। মার্কেটিং করে ফিরতে দেরি হবে বলে নিউ মার্কেট থেকে ড্রাইভারকে ফেরত পাঠাই।’
“আচ্ছা!’ অবাক কণ্ঠে বলে শহীদ, তারপর বলুন।’
বিচলিত দৃষ্টিতে তাকান মিসেস নাসির শহীদের দিকে। তারপর বলেন, ‘যাবার সময় আমার স্বামীর ঘরে ঢুকেছিলাম আমি। উনি নিজের ঘরেই ছিলেন। সোনার মা-ও ছিলো। সারওয়ার এবং কাওসার কোথায় ছিলো দেখিনি আমি। মাস্টার সাহেবও সম্ভবত ওনার ঘরেই ছিলেন। ফিরে এসে আমিই প্রথম লক্ষ্য করি যে মন্টি ঘরে নেই। তারপর থেকেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। সারওয়ার ও কাওসার তখন বাড়িতে ছিলো না। সিনেমায় গিয়েছিল, কিন্তু কাউকে বলেনি। .
| ‘আপনার স্বামী কি আলাদা ঘরে থাকেন?’
কি যেন ভাবেন মিসেস নাসির শহীদের প্রশ্ন শুনে। তারপর মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ।’
এরপর আরও কয়েকটি প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয় শহীদ মিসেস নাসিরকে। ভদ্রমহিলা শহীদের প্রশ্নের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বেঁচে যান যেন। দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান তিনি। এতক্ষণ তাকে যেন বাধ্য করা হচ্ছিলো প্রশ্নের উত্তর দিতে। এরপর সোনার মা এলো ড্রয়িংরুমে। কিন্তু প্রৌঢ়া চাকরাণীর মুখ থেকে একটি কথাও আদায় করতে পারলো না শহীদ,। ধমক-ধামকেও কাজ হলো না। ভয় দেখাতেও কসুর করলো না শহীদ। কিন্তু সোনার মা এক মুহূর্তের জন্যেও কান্না
৩২
নলন।’
থামালো না। একনাগাড়ে ফুঁপিয়েই চললো ফুলে ফুলে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে শহীদ বিদায় করলো তাকে।
মি, নাসির শহীদকে সঙ্গে নিয়ে সারওয়ারের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নাম ধরে কয়েকবার ডাকলেন তিনি সারওয়ারকে। কিন্তু দরজা খুললো না। অবশেষে শহীদ নিজের পরিচয় দিয়ে আশ্বাস দিলো এই বলে যে, কেউ তাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করবে না। তার নিজের কোনো কথা বলবার থাকলে তাই শোনা হবে। তার বেশি কিছু না। শহীদের কথায় সারওয়ার দরজা খুললো। শহীদ ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলো সে।. দরজা বন্ধ করেই শহীদকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো সে। শহীদ তাকে দু’হাতে ধরে খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে বসালো। নিজেও বসলো তার পাশে। হঠাৎ কি মনে করে খাটের নিচের দিকটা ঝুঁকে দেখলো শহীদ। যা ভেবেছিল সে ঠিক তাই- খাটের নিচে কাদামাখা একজোড়া গামবুট রাখা। সারওয়ারের দিকে তাকালো শহীদ। কেঁদে কেঁদে আধমরা হয়ে গেছে ছেলেটা। কেমন যেন হুহু করে উঠলো শহীদের বুকটা তার দিকে তাকিয়ে। ছেলেটার জন্যে দুঃখ হলো তার। কিন্তু সেই সাথে হাজারটা আশঙ্কার কথাও তার মনে হতে লাগলো। সে ভাবছিল, কাওসারের মৃত্যু এবং মন্টির নিখোঁজ সম্পর্কে কি কি জানে সারওয়ার? ও নিজেও কি জড়িত এসবের সঙ্গে? কতটুকু?
ভীত-ত্রস্ত চোখে দেখছিল সারওয়ার শহীদকে। শহীদ কোমল কণ্ঠে বললো, ভয় কি, ভাই। আমি পুলিসের লোক নই। ডিটেকটিভ বইয়ে পড়ো না, শখের গোয়েন্দা?—আমি সেই। আমি তোমাকে কোনো কথা বলবার জন্যে জোর করবো
। কিন্তু তোমার যদি কিছু বলার থাকে তবে নিশ্চয়ই তা শুনবো। আর এটা তো নিশ্চয়ই জানো যে, তোমার ভায়ের খুনিকে খুঁজে বের করার জন্যে আমি এসেছি। সুতরাং আমি জানি–তুমি যদি কিছু জানো নিশ্চয়ই আমাকে তা বলবে। তাই না?”
শহীদের কথা শেষ হতে কেমন যেন বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সারওয়ার তার দিকে। তারপর আবার কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। কাঁদতে কাঁদতেই খাট থেকে নেমে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শহীদ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সারওয়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ এবং একটি রবারস্ট্যাম্প বের করে শহীদের কাছে ফিরে এলো। সেগুলো শহীদের সামনে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লো অস্ফুট একটা শব্দ করে বিছানার উপর। কান্নার কোনো শব্দ পাওয়া গেল না তার। শুধু দেহটা প্রচণ্ড আক্ষেপে ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। শহীদ সারওয়ারের দিকে একবার দেখে নিয়ে বাংলায় টাইপ করা চিঠিটা পড়তে শুরু করলো। চিঠিটা নিম্নরূপঃ
‘মিস্টার নাসির,
৩-
মন্টিকে পাইতে হইলে পাঁচ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক হইতে তুলিয়া আপনার বাড়ির গেটের সামনে রাখিবেন। তাহা না হইলে ছেলেটাকে পাইবার আশা ত্যাগ করিবেন। পুলিসে খবর দিয়া কোনো লাভ হইবে না।
ব্ল্যাক অ্যারো। চিঠিটার নিচে কালো রঙের একটা তীরের রবারস্ট্যাম্প মারা রয়েছে। শহীদ চিঠিটা পড়ে সারওয়ারের দিকে ফিরলো। তারপর ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, তুমি
বুঝি চিঠিটা টাইপ করিয়ে নিয়ে এসেছিলে, সারওয়ার?
| শহীদের কথা শেষ হতে খাটের উপর উঠে বসলো সারওয়ার। তারপর শুধু একটি কথাই বললো, এখন আমি আপনাকে কিছু বলতে পারবো না। কিছুই ভাবতে পারছি না আমি…আপনি আমাকে এ বাড়ি থেকে কয়েকদিনের জন্যে অন্য কোথাও নিয়ে চলুন দয়া করে এখানে থাকলে কথা বলতে পারবো না আমি…’।
‘বেশ তো, তাই হবে, সারওয়ার। আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়েই রাখবো। যখন বলতে পারবে, তখনই সব বলবে।’
শহীদের কথা শেষ হতে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো সারওয়ার। কথা বললো না আর।
তিন
সেদিন রাতের ঘটনা। | গাঙচিল হোটেল অ্যাণ্ড বার। রাত আটটা। ব্যস্ত সমস্ত ভাবে বয়-বেয়ারা হুকুম তামিল করছে। প্রচুর লোক জমেছে ইতিমধ্যেই। মদ্যপানের স্বর্গ এটি, রাত যতো বাড়বে ততই জমজমাট হয়ে উঠবে আসর। অধিক রাতে হৈ-হল্লা শুরু হবে, গ্লাস ভাঙবে, ভদ্রসন্তানেরা খিস্তির মহড়া শুরু করবেন।
গাঙচিল বারের প্রোপাইটার ইকরামুল্লা খান বসে আছে হলঘরেই। একটা টেবিল দখল করে মোট তিনজন বসে আছে। অন্যান্য খরিদ্দারদের দিকে খেয়াল নেই তাদের। নিজেদের কোনো গোপন পরামর্শ চলছে এখন। এদের মধ্যে আমাদের পূর্ব পরিচিত মি. নাসিরকেও উপস্থিত দেখা যাচ্ছে। তিনি অবশ্য কথাবার্তা বিশেষ বলছেন না। মাঝে মধ্যে মাথা নাড়ছেন শুধু। মি. নাসিরকে দেখেই বোঝা যায় যে, মানসিক দিকটা তার এখনও স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। অপর দুজন সঙ্গীর মতো মদ্যপানও আজ তিনি করছেন না।
মিনিট পাঁচেক পর একজন উর্দি পরা বেয়ারা ইকরামুল্লা খানের পাশে এসে দাঁড়ালো। কানে কানে কি যেন বললো সে। ইকরামুল্লা খান বেয়ারার কথা শুনে আড়চোখে তাকালো অদূরবর্তী একটা টেবিলের দিকে। সেখানে একটু আগে এক
৩৯
সুন্দরী তরুণী এসে আসন গ্রহণ করেছে। তরুণীটিকে দেখে চোখ দুটো হঠাৎ আনন্দে নেচে উঠলো ইকরামুল্লা খানের। আজকের শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে তরুণীটিকে তার বেশ পছন্দ হলো।
“ঠিক আছে, তুমি ওকে সুইটে নিয়ে যাও। আমি আসছি।’
নিচু স্বরে বেয়ারাকে কথাটা বলে ডান হাতটা মি, নাসিরের দিকে বাড়িয়ে দিলো ইকরামুল্লা খান। ঐ একটি হাতই সম্বল তার। বাকি একটি হাত সে যখন পুলিস বিভাগে চাকরি করতো তখন একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে খোয়া গেছে। সেই সঙ্গে চাকুরিও যায় তার। কিন্তু ভালোই হয়েছে আখেরে, ইকরামুল্লা খান ধার করে মদের লাইসেন্স বের করে গাঙচিল হোটেল অ্যাণ্ড বার চালু করেছে। বেশ মৌজসে আছে সে এখন। এমন ব্যবসা আর নেই। এছাড়াও আরও লাভজনক ব্যবসা করে সে। কিন্তু সেকথা অনেকেই জানে না। গোপন ব্যবসা কিনা। যাই হোক, মি. নাসির এবং অপর সঙ্গীটির সঙ্গে করমর্দন সেরে বিদায় নিলো ইকরামুল্লা। খান। তিনজনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এক সঙ্গে। প্রকাণ্ড শরীর ইকরামুল্লা খানের, তার পাশের দুজনকে নেহাত ছেলে মানুষ বলে মনে হয় তার সামনে। চল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি লোকটার। হাতির উরুর মতোই উরু। লোমশ শরীর। চোখ দুটো সব সময় ঢুলু ঢুলু। কিন্তু সেই চোখ থেকেই যেন আগুনের গরম আভা ফুটে বেরুচ্ছে।
মি. নাসির এবং অপর লোকটি আগু পিছু করে হলঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর ইকরামুল্লা খান গম্ভীর মুখে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ম্যানেজার খোদ মালিককে দেখে স্প্রিং দেয়া পুতুলের মতো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। লোকটার ভীত ভঙ্গি দেখে মনে হয় এখুনি বুঝি সে ইকরামুল্লা খানের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে অজ্ঞাত অপরাধের জন্য মাফ চাইতে শুরু করবে। | ‘ডান দিকের কোণের টেবিলটায় রঙিন চশমা পরে যে বসে আছে ও কে?’ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে ইকরামুল্লা খান।
ম্যানেজার ডান দিকের কোণের টেবিল দখল করে লম্বা-চওড়া শরীরের যে লোকটি এদিকেই তাকিয়ে বসে আছে, তার দিকে একবার দেখে নিয়ে বলে, ঠিক চিনি না, হুজুর। কদিন থেকেই দেখছি এই সময়টা চুপচাপ এসে বসে থাকে। নতুন কোনো খরিদ্দার হবে মনে হয়।’ ‘
‘খেয়াল রেখো। ভিতরে যেন ঢুকতে না পারে। আমার সন্দেহ হচ্ছে।’ “আচ্ছা, হুজুর। খেয়াল রাখবো, ভিতরে ঢুকতে যাতে না পারে…’
কিন্তু ম্যানেজারের কথা শোনার জন্যে ইকরামুল্লা ততক্ষণ দাঁড়িয়ে নেই। হলঘর থেকে বেরিয়ে নির্জন করিডর ধরে এগোচ্ছে সে রাজকীয় ভঙ্গিতে, এক হাত দুলিয়ে দুলিয়ে।
ম্যানেজার হঠাৎ দেখলো ডান দিকের কোণের টেবিলের সামনে রঙিন চশমা
৩৫
পরা লোকটা বেয়ারাকে ডেকে বিল মিটিয়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো সে। লোকটা চলে যাচ্ছে। নজর রাখতে হবে না এখন তাকে।
| এদিকে ইকরামুল্লা খান কয়েকটা বাঁক ঘুরে লম্বা একটা করিডর ধরে এগিয়ে একটা সুইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত তুলেছিল সে কেবিনের দরজায় টোকা দেবার জন্যে। কিন্তু পিছন থেকে গমগম করে উঠলো সতর্কবাণীঃ মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, ইকরামুল্লা!
চমকে উঠলো ইকরামুল্লা খান। কিন্তু বিপদ বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে হাতটা মাথার উপর তুললো সে।
‘পিছিয়ে এসো তিন কদম গুণে গুণে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠ আদেশ জারি করলো সঙ্গে সঙ্গে।
যন্ত্রচালিতের মতো তিন পা পিছিয়ে এলো ইকরামুল্লা খান। সেই সঙ্গে সামান্য একটু ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নিলো শত্রুকে। মনে মনে অবাক হলো সে। লোকটাকে আগে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না।
‘ডান দিকে ঘুরে হাঁটতে থাকো। সময় না দিয়ে দ্রুত উচ্চারণ করলো পিছনের লোকটি।
এবারও অতি বাধ্য ছেলের মতো আদেশ পালন করলো ইকরামুল্লা খান। কেননা লোকটার হাতে ধরা সাইলেন্সর লাগানো জার্মান পিস্তলটা চোখে পড়েছে তার। ডানদিকে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে হোটেলের বয়-বেয়ারাদের মা-বাপ তুলে গালাগালি করতে লাগলো ইকরামুল্লা খান। শালার বেটারা একজনও নেই এদিকে। এবং ম্যানেজারটাকে জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে ছাড়া পেয়েই–মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে। এইসব ভয়ঙ্কর লেক হোটেলে স্থান পায় কিভাবে তা সে দেখে নেবে।
দাঁড়াও! এবার বাম পাশের সুইটের সামনে গিয়ে দরজায় ঠেলা দাও। পিছন থেকে আবার আদেশ জারি হলো।
এবার হঠাৎ করেই চমকে উঠলো ইকরামুল্লা খান। লোকটা ইংরেজিতে আদেশ করছিল। এতক্ষণে কথার সুরে বার্মীজ টানটা ধরতে পারে সে। গ্রেফতারকারী তাহলে বার্মীজ! কিন্তু হুবহু বাঙালীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছে দেখা যাচ্ছে–মনে মনে ভাবে ইকরামুল্লা খান। বাম পাশের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ঠেলা দেয় সে দরজায়। খুলে যায় কেবিনের দরজা।
ভিতরে ঢোকো।’.’।
ক্ষীণ একটুকরো নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায় ইকরামুল্লা খানের মুখে। সুইটের ভিতর ঢুকতেই তার ঘাড়ের ওপর শীতল একটা স্পর্শ লাগে। বার্মীজটা ঠিক তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা চেপে ধরেছে ঘাড়ের পিছনে। ঝট করে ঘুরে
৩৬
দাঁড়িয়ে আক্রমণ করে বসবে কিনা ভাবলো ইকরামুল্লা খান। কিন্তু হঠাৎ জ্বলে উঠলো সুইটের বাতি। বার্মীজটা হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে দিয়েছে। ঘাড়ের কাছ থেকে একবিন্দুও নড়লো না পিস্তলের নল, একটা হাত দিয়েই ইকরামুল্লার সারা শরীরে তল্লাশি চালিয়ে রিভলভারটা বের করে নিল লোকটা।
‘ঐ চেয়ারটায় গিয়ে বসো, আদেশ জারি হলো।
বাধ্য ছেলের মতো চেয়ারটায় বসে পড়লো ইকরামুল্লা খান। তারপরই রাগে ফেটে পড়লো সে, ‘এসব কি হচ্ছে শুনি! ইয়ার্কি মারার জায়গা পাওনি! কে তুমি?’
গম্ভীর মুখে খাটের উপর বালিশে হেলান দিয়ে বসলো বার্মীজটা। তারপর কঠিন কণ্ঠে বললো, তুমি কে সেটা জানলেই তোমার পক্ষে যথেষ্ট, আমার পরিচয়ে দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বলো এখন, লকেটটা কোথায় রেখেছো?’
‘কি বললে! লকেট? কিসের লকেট? কার লকেট? অবাক হবার ভান করে চিৎকার করে ওঠে ইকরামুল খান। বার্মীজটার হাতের পিস্তল এখনও তার বুক
লক্ষ্য করে রয়েছে।
‘চেঁচিয়ো না, সিধে বুকে গিয়ে বিধবে গুলি।
বার্মীজটার কথা শেষ হতে বিরক্তিসূচক শব্দ করে ইকরামুল্লা খান বলে, ‘গুলি করবে তুমি! কেন?’
‘গুলি করবো দুটো কারণে। এক, চিৎকার করে তোক ডাকতে চেষ্টা করলে। দুই, লকেটটা কোথায় রেখেছে তার খোঁজ না দিলে।
ইকরামুল্লা বলে, লকেটের কথা আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমাকে গুলি করলে মনে কোরো না যে তুমিও ছাড়া পাবে। এ হোটেল থেকে বেরোতেই পারবে
।’
| ইকরামুল্লার কথা শুনে আকৰ্ণ বিস্তৃত নিঃশব্দ হাসি ফোটে বার্মীজটার মুখে। বলে, সাইলেন্সর লাগানো রয়েছে পিস্তলে, দেখতেই পাচ্ছো। গুলি করলে কেউ শুনতে পাবে না। সাধারণ বোর্ডারের মতো বুক ফুলিয়ে বের হয়ে যাবো আমি তোমার হোটেল থেকে। যাকগে, আমার কাজ আমিই ভালো বুঝি–বলো এখন কোথায় আছে লকেটটা? পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। পাঁচ মিনিট পর পায়ের ওপর লুটিয়ে গড়াগড়ি করলেও ছাড়বো না–গুলি করবো।’
বিচলিত হয়ে ওঠার ভান করে ইকরামুল্লা খান। যেখানে বসে আছে সে, সেখান থেকে খাটটা বেশ খানিক দূরে। ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করলেই গুলি খেতে হবে। দু’জনের মাঝখানে আবার একটা টেবিলও রয়েছে। না, লাফিয়ে পড়ে
সুবিধে করা যাবে না।
কই বলো!’ তাড়া দেয় লোকটা ইকরামুল্লা খানকে। ইকরামুল্লা বলে, ভুল করছো তুমি। আমি তোমার কথাই বুঝতে পারছি না!
৩৭
সম্ভবত আমাকে অন্যলোক ভেবে…’
‘বার্মায় যাওনি তুমি?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে বার্মীজটা, ‘চীরণ মন্দিরের পুরোহিতকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করোনি? তার আগে লাম্বাকে খুন করে লকেট সুদ্ধ গুপ্তধনের নকশাটা হাতিয়ে নাওনি তুমি?’
‘আমি! আমি বার্মায় গিয়েছিলাম তা মানছি। কিন্তু শুধু বার্মায় যাওয়ার অপরাধে কাউকে মেরে ফেলে না কেউ।
বামীজটা ঘড়ি দেখে নিয়ে বললো, লাম্বাকে হত্যা করার কথা অস্বীকার করছো তাহলে তুমি?’ .
ইকরামুল্লা খান রীতিমত চঞ্চল হয়ে ওঠে মনে মনে। স্পষ্ট বুঝতে পারে সে, যে লোকটা তার সম্পর্কে সব খবরই জানে। সম্ভবত বার্মা থেকেই তার পিছু নিয়েছে। ইকরামুল্লাকে চুপ করে থাকতে দেখে বার্মীজটা, বলে, আর তিন মিনিট তোমার আয়ু আছে। এখনও বলো।’
ইকরামুল্লা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গেলে বাধা দিয়ে বার্মীজটা বলে ওঠে, ‘খবরদার! কোনো চালাকি নয়!’
লোকটা নিজেই এবার খাট থেকে নেমে মেঝের উপর দাঁড়ায়। পিস্তলের নলটা মুহূর্তের জন্যেও ইকরামুল্লার বুকের দিক থেকে নড়েনি।
আর দু’মিনিট তুমি বেঁচে আছে, স্থির কণ্ঠে বলে লোকটা।
ইকরামুল্লা খানকে এতক্ষণে চিন্তিত বলে মনে হয়। কি যেন ভাবে সে। তারপর বলে, ‘ঠিক আছে, বলবো আমি তোমাকে। কিন্তু লকেটটা সত্যিই আমার কাছে এখন নেই। কথাগুলো গুছিয়ে বলা দরকার। তার জন্যে সময় প্রয়োজন।
‘গুড বয়! লাগুক সময়, বলতে শুরু করো তুমি। আমি শুধু জানতে চাই লকেটটা আছে কোথায়। আদায় করে নেবার ভার আমার ওপরই ছেড়ে দাও।’
‘সিগারেট খেতে পারি?’ জিজ্ঞেস করে ইকরামুল্লা খান।
মাথা নেড়ে অনুমতি দেয় লোকটা। ইকরামুল্লা খান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ঠোঁটে নেয় একটি। তারপর প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় বার্মীজটার দিকে। একহাতে লুফে নিয়ে আবার ছুঁড়ে ফেরত দেয় সে প্যাকেটটা। বলে, ‘চলে না।’
| প্যাকেটটা ধরে পকেটে ভরে ইকরামুল্লা খান। তারপর সেই পকেট থেকেই বের করে আনে একটা লাইটার। বার্মীজটার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে লাইটারে আঙুল বসিয়ে চাপ দেয় সে। প্রথমবার জ্বলে না লাইটার। দ্বিতীয়বার চাপ দিতেও জ্বলে না। বিরক্ত হয়ে লাইটারটা উল্টেপাল্টে দেখে ইকরামুলা খান। তারপর আবার চাপ দেয়। কিন্তু পরপর আরও তিনবার চাপ দিতেও জ্বললো না সেটা। জ্বললো পঞ্চম বারের চেষ্টায়।
৩৮
সিগারেটটা জ্বালিয়েই লাইটারটা আস্তে করে ছুঁড়ে দিলো ইকরামুল্লা খান বার্মীজটার দিকে। তৈরি ছিলো না বার্মীজটা। ফুলে ধরতে গিয়েও ফসকে গেল সেটা হাত থেকে। দু’পায়ের মাঝখানে গিয়ে পড়লো সেটা। বিরক্ত কণ্ঠে লোকটা বলে উঠলো, একবার বললাম না তোমাকে যে, সিগারেট খাই না?”
দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে।’
মনে মনে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ-দশ পর্যন্ত গুণতে গুণতে বার্মীজটার উদ্দেশ্যে বললো ইকরামুল্লা। ঠিক দশ সেকেণ্ড হতেই অকস্মাৎ কয়েক পা পিছিয়ে এলো ইকরামুল্লা খান। সঙ্গে সঙ্গে বার্মীজটার পায়ের তলায় পড়ে থাকা লাইটারটা বাস্ট করলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো তিনফুট জায়গা জুড়ে। বিশেষ কোনো শব্দ হল না। আগুনের শিখার হিসহিস শব্দ কেবল শোনা গেল একটানা। অবশ্য বাস্ট করার মুহূর্তে টিপ করে একবার শব্দ হয়েছে কি ঘটলো কিছুই বোঝবার সাধ্য নেই এখন আর বার্মীজটার। শরীরের ডান দিকটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। হয়ে গেছে তার মাথার মাঝ বরাবর জায়গা থেকে। ছটফট করে সরে যেতে চেয়েছিল সে আগুনের আওতা থেকে, কিন্তু কোনো উপায় ছিলো না তার। বিশেষ ধরনের এই আগুনে-বোমার আসল শক্তিই এর তীব্র ঊর্ধ্বমুখী শিখায়। এর মাঝখানে যে পড়বে তার শরীরের অর্ধেকের বেশি ছাই করে দিয়ে ফুঁ মেরে দূরে সরিয়ে দেবে। বার্মীজটা এখন খাটের তলায় পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ও যে একজন মানুষ ছিলো তা বিশ্বাস করা কঠিন। একগাদা ছাই ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…’ গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে ইকরামুল্লা খান। হাসি থামিয়ে বার্মীজটার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপে ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, “কি বলেছিলে হে, মাত্র দু’মিনিট আমার আয়ু! কুয়াশার কাছ থেকে চুরি করা জিনিস, বাওয়া! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…’
হাসতে হাসতে কেবিনের কোণের দিকে এগোতে থাকে ইকরামুল্লা খান। বার্মীজটার হাত থেকে মিলভারটা পড়ে ছিটকে গেছে এককোণে। হঠাৎ চমকে
ওঠে ইকরামুল্লা খান। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ার শব্দ ওঠে কেবিনের একটা জানালার কাঁচ। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখলো রঙিন চশমা পরা যে লোকটাকে হলঘরে বসে থাকতে দেখে ম্যানেজারকে সাবধান করে এসেছিল, যাতে ভিতরে ঢুকতে না পারে, সেই লোকটা রিভলভার হাতে কেবিনের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছে। বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে ওঠে আগন্তুক, যা মনে করেছি তাই, শেষ করে ফেলেছে লোকটাকে, কেমন?’
কে তুমি? একটু ভয়ে ভয়েই শক্ত সমর্থ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ইকরামুল্লা খান। জানালা ভেঙে এখানে ঢোকার কারণটা কি তোমার?
আগন্তুক তীব্ৰদৃষ্টিতে ইকরামুল্লা খানের আপাদমস্তক দেখে একবার। তারপর
৩৯
বলে, আমাকে ঐ বার্মীজটার মতো আনাড়ী মনে কোরো না। যা জিজ্ঞেস করবো তার উত্তর দেবে সোজা ভাষায়। বার্মা থেকে যে লকেটসুদ্ধ নকশাটা নিয়ে এসেছে, সেটা কার কাছে? তোমার কাছে না নাসিরুল্লার কাছে?’
‘লকেট! আমি তো…’
ইকরামুল্লাকে ধমক মেরে আগন্তুক মোটা গলায় বলে ওঠে, বাজে অজুহাত শুনতে আসিনি আমি। যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর চাই।’
‘আমি জানি না।’ গোঁয়ারের মতো জেদের সুরে বলে ইকরামুল্লা খান।
আগন্তুক, বলে, পৃথিবীতে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে ঐ লকেটের ভিতর রাখা নকশা নিয়ে চীরণ মন্দিরের কোটি কোটি টাকার হীরে-জহরত উদ্ধার করতে পারবো। এবং আমিই তোমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবো লকেটটা। বলো, কার কাছে আছে সেটা?’
‘আমি জানি না।’ যন্ত্রচালিতের মতো বলে ইকরামুল্লা খান। ভিতরে ভিতরে দারুণ উৎকণ্ঠায় ঘেমে উঠতে থাকে সে। এ শত্রু ভয়ঙ্কর শক্তিধর তা সে
অনুমানেই টের পেয়ে গেছে।
‘আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা কোরো না। তুমি যদি সৎ উপায়ে লকেটটা সংগ্রহ করতে তবে আমি এভাবে তোমার কাছ থেকে সেটা ছিনিয়ে নিতে আসতাম না কখনও। অভিশপ্ত লকেট ওটা। শত শত উচ্চাভিলাষী প্রাণ হারিয়েছে ওর প্রতি লোভ করে। তুমিও লাম্বাকে খুন করে ওটা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছে বার্মা থেকে। সুতরাং ওটার জন্যে আমি তোমাকে কোনো দাম দেবো না।’
‘কিন্তু…’ কি যেন বলতে চায় ইকরামুল্লা খান।
আগৰ্ভুক বাধা দিয়ে বলে, আমি তোমাকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই–আমাকে তুমি আজ দেখলে, পরে আর একবার দেখবে তৃতীয়বার আমাকে দেখতে পাবে না। তার আগেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে তোমাকে। আজ আমি চলি। আর একবার লকেটটার জন্যে আসবো আমি, সেই শেষ। ‘
রিভলভারটা ইকরামুল্লা খানের দিকে ধরে রেখে পিছু হটতে থাকে আগন্তুক। জানালার সামনে গিয়ে পিছন ফিরেই জানালার উপর উঠে বসে চলে যেতে থাকে অপর দিকে।
কিন্তু কে তুমি? নাম কি তোমার?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ইকরামুল্লা খান।
আগন্তুক তখন জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাতাসে ভর করে ভেসে আসে গুরু গুরু মেঘের ডাকের মতো একটি মোটা স্বর, কুয়াশা’।
কুয়াশা!
৪০
নামটা শুনে ইকরামুল্লার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে আতঙ্কে। আপন মনেই অস্ফুট স্বরে বারবার উচ্চারণ করতে থাকে সে, কুয়াশা! কুয়াশা!! কুয়াশা!!!
চার
আজ পূর্ণিমা। শান্তিনীড়ের আনাচে কানাচে আজ রহস্যময় একটি ছায়াকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতে পারে। প্রতি পূর্ণিমার রাতেই ছায়াটাকে দেখা যায়।
শহীদ নিজের বাড়িতে সারওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে অপেক্ষা করছে। শহীদ আর মহুয়া মিলে চেষ্টা করে চলেছে সারওয়ারকে সাহস যোগাবার জন্যে। বোবা হয়ে গেছে যেন ছেলেটা। ভয়, অবিশ্বাস, অপরাধবোধ, চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরেছে বেচারাকে। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করেনি ওকে মহুয়া। শান্তিনীড় হত্যারহস্যের অনেক রহস্য, উন্মুক্ত হবে সারওয়ারের কথা শোনার পর–শহীদের বিশ্বাস। যে কোনো মুহূর্তে সে কথা বলে উঠতে পারে। সুতরাং নিজে না গিয়ে কামালকে পাঠালো শহীদ শান্তিনীড়ে। কামাল রাতের অন্ধকারে ঢুকবে শান্তিনীড়ে। তাকে ভেদ করে আসতে হবে পূর্ণিমা-রাতের ছায়া-রহস্য। রাত সাড়ে বারোটার মধ্যে খবর দেবে কামাল শহীদকে।
কামাল.শহীদের ফোক্সওয়াগেনটা নিয়ে শান্তিনীড়ের মেন গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে থামলো। রাত এখন এগারোটা।
আমিন বাজারে রাত এগারোটা। চাঁদের অদ্ভুত আলোর আভা চারদিকে। আলো এবং ছায়ায় জায়গাটা রহস্যময়। কংক্রিটের সুদূর প্রসারিত রাস্তাটা চলে গেছে সাভারের দিকে। দু’পাশে নিচু ধান খেত। মাঝখানে বিরাট উঁচু পাঁচিল ঘেরা শান্তিনীড়। জনমনিষ্যিহীন-রাত এগারোটার প্রাসাদতুল্য বাড়িটাকে মৃনে হচ্ছে পোড়ো ভুতুড়ে বাড়ি।
কামাল গাড়ি লক করে নিঃশ্বাস বন্ধ করলো। না, কোথাও কোনো টু-শব্দ নেই। আর কয়েক সেকেণ্ড নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। না, কোনো দিকে কোনো মানুষের ছায়ামাত্র নেই।
গাড়িটা রাস্তার পাশে রেখে শান্তিনীড়ের পাঁচিল ঘেঁষে সতর্ক পায়ে হাঁটতে লাগলো কামাল। শান্তিনীড়ে যে অশান্তির কালো ছায়া ছেয়ে গেছে হঠাৎ করে, তার কারণ এবং রহস্য খুঁজে বের করতে হবে। প্রতি পূর্ণিমার রাতে যে ছায়াটাকে শান্তিনীড়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে, তার সঙ্গে কি এই মর্মান্তিক অশান্তির কোনোযোগাযোগ আছে?
মিনিটখানেক পাঁচিল ঘেঁষে হাঁটার পর দু’টি বকুল গাছ পেরিয়ে শান্তিনীড়ের লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো কামাল। বাড়ির ভিতরটা এখান থেকে দেখা যায় না ভালো করে। অনেকগুলো গাছ বাধার সৃষ্টি করে। চারপাশটা একবার দেখে
৪১
নিয়ে বন্ধ লোহার গেটের শিক ধরে উপরে উঠতে থাকে কামাল। হঠাৎ কেমন যেন ছমছম করে ওঠে তার সর্বশরীর। ঘাড় বাঁকিয়ে অদূরে দাঁড়ানো বকুল গাছ দুটোর দিকে তাকায় সে। চাঁদের আলো আজকে কেমন যেন লালচে, পূর্ণিমা বলেই সম্ভবত। কামাল বকুল গাছের দিকে তাকিয়ে কিছুই ঠাহর করতে পারে না। মনে মনে হাসে সে। মনের ভুল ভেবে নিয়ে আবার সে নিঃশব্দে এবং অতি সতর্কভাবে উঠতে থাকে লোহার শিকগুলোর উপর পা ফেলে ফেলে।
লোকটা শিকারী বিড়ালের মতো বিন্দুমাত্র শব্দ না করে ঝুপ করে নামলো একটি
লের মতেপুমান করে ওপু করে নামল একা বকুল গাছের উপর থেকে। বাকী রঙের টি-শার্ট আর মোটা জিনের নীল রঙের প্যান্ট পরনে। গলায় একটা নকশা করা রঙিন রুমাল বাঁধা। নুয়ে নুয়ে, নিঃশব্দ . পায়ে, তীক্ষ্ণ চোখ দুটো কামালের দিকে স্থির রেখে লোকটা দ্রুত এগোলো। হাতে
একটা মোটা রড।
বিন্দুমাত্র টের পেলো না কামাল। শেষ মুহূর্তে লোকটা বুঝি ইচ্ছে করেই জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। থমকে দাঁড়ালো কামাল লোহার গেটের উপর। অর্ধেকটা মাত্র উঠেছে সে। প্রায় সাথে সাথে লাফ দিলো লোকটা। কামাল লোকটাকে দেখলো লাফ দেয়া অবস্থায়। কিন্তু কিছুই করা সম্ভব হলো না তখন তার পক্ষে। লোহার মোটা রডটা কামালের মাথার ঠিক বাম পাশে বসিয়ে দিলো লোকটা সজোরে। দু’হাত খসে গেল শিক থেকে। অজ্ঞান হয়ে গেছে সে প্রচণ্ড আঘাতে।
লোকটা হাতের রড ফেলে দিয়ে ধরে ফেললো কামালের অচেতন দেহটা। সামান্য একটু শব্দ হলো মাত্র। লোকটা ঝটপট কাঁধে তুলে নিলো কামালকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বকুল গাছ দুটোর নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।
‘চললাম বে! আর এক হালা আইবার পারে, সামাল দিস-কিমুন?’
লোকটার কথার উত্তর এলো একটা বকুল গাছের উপর থেকে, “ঠিক হ্যায়, শাগরেদ!’
কামালকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে লোকটি বললো, “অই ঠেপির পো, ওস্তাদ ক!
খিল খিল করে হেসে একদলা থুথু ফেললো গাছের উপর থেকে অপর লোকটা। আর কোনো কথা হলো না ওদের মধ্যে। কামালকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা একটা ঝোঁপের ভেতর ঢুকলো। সেখানে একটা ওল্ড মডেলের পুরানো ফোরডোর বেবী অস্টিন রাখা আছে দেখা গেল। কামালকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো লোকটি। স্টার্ট নিলো গাড়ি। রাস্তায় উঠে এসে পুরানো গাড়িটা যেন পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় রূপান্তরিত হলো। তীব্র বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটা দেখতে দেখতে।
৪২
এদিকে আর এক রহস্যের সূচনা শুরু হলো শান্তিনীড়ের ভিতর।
আজ পূর্ণিমা। ‘
প্রৌঢ় মাস্টার সাহেব জানালার সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে উদাস নয়নে তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। গতকালের ঘটনা থেকে আজ সকালের ঘটনাগুলো বারবার গুছিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই জট পাকিয়ে, যাচ্ছিলো তাঁর চিন্তা-জাল। আশ্চর্য, অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর ব্যাপার! বাড়ির ছোট ছেলেটা নিখোঁজ, তারপরই মেজটা খুন! কিভাবে ঘটলো এসব? কেন ঘটলো? কে
ঘটালো? এবং আরও কি কি ঘটবে?
হঠাৎ একটা সন্দেহ জাগলো মাস্টার সাহেবের মনে। আচ্ছা, প্রতি পূর্ণিমার রাতে এ বাড়িতে যে রহস্যময় ছায়াটাকে দেখা যায় তার সঙ্গে এসব ঘটনার কোনো যোগাযোগ আছে না কি? কথাটা মনে মনে নাড়াচাড়া করছিলেন তিনি, ঠিক এমন সময়ই দেখলেন ছায়াটা।
মাস্টার সাহেবের জানালা থেকে হাত পনেরো-বিশ দূরে একটা শিমুল গাছ। সেই গাছের পাশ ঘেঁষে ধীরে ধীরে একটা মানুষের কালো ছায়া সরে গেল পুব দিকে।
আজই তো পূর্ণিমা। কথাটা মনে পড়তেই সারা শরীর শিরশির করে উঠলো মাস্টার সাহেবের। অশরীরী একটা ভয় এসে ছুঁয়ে দিলো আলতো ভাবে মাস্টার সাহেবের বুকের ভিতরটা। চেয়ার থেকে উঠে নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলেন তিনি জানালাটা। কিন্তু পরক্ষণেই পুরানো সন্দেহটা জাগলো তাঁর মনে–এই রহস্যময় ছায়ার সঙ্গে কাওসারের মৃত্যু আর মন্টির নিখোঁজ হবার যোগ নেই তো? সন্দেহটা কেন যেন সত্যি বলে ঠেকলো মাস্টার সাহেবের। কি যেন ভাবলেন তিনি ঘরের মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ছোটবেলা থেকে পড়িয়ে আসছেন তিনি এ বাড়ির তিনটে ছেলেকে। সেই কত যুগ আগে এসেছিলেন তিনি এ বাড়িতে গৃহশিক্ষক হয়ে। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, চাল-চুলো কিছুই নেই। সারওয়ারের আব্বা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁকে রাস্তা থেকে তুলে এনে। সেই থেকে রয়ে গেলেন তিনি এ বাড়ির একজন হয়েই। সারওয়ার কাওসারকে লেখাপড়া শিখিয়ে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। বিয়েসাদী করার কথা তার কোনদিন মনেই পড়েনি। মন্টিকেও মানুষ করে গড়ে তোলার ভার তাঁর উপরই বর্তেছে। তাকেও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলতে হবে–অথচ এমন কাণ্ড ঘটে গেল! সারওয়ার, কাওসার, মন্টি তাঁরই হাতে বলতে গেলে মানুষ। তিনিই তো এদের গুরু। তারও তো একটা দায়িত্ব আছে এদের ভালো মন্দের ব্যাপারে। ভয় পেয়ে সে দায়িত্ব পালন না করা। তো রীতিমত অন্যায়। কাওসারের খুনীকে ধরার ব্যাপারে তিনিও তো কোনো না কোনো তথ্য পেয়ে যেতে পারেন, চেষ্টা করলে।
কেন রে দাঁড়িয়ে কত যু
আর কোনো ভয় বা দ্বিধা রইলো না মাস্টার সাহেবের। টেবিলের উপর থেকে ভারি পাওয়ারের চশমা চোখে লাগিয়ে জুতোটা পরে নিলেন তিনি। কি মনে করে চৌকির তলা থেকে একটা মোটা লাঠি বের করে হাতে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে চারপাশটা ভালো করে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। যে রহস্যময় ছায়াটাকে দেখেছেন, তাকে তিনি খুঁজে বের করবেন আজ। এই রহস্যের একটা সুরাহা হওয়া উচিত। বলা যায় না, কাওসারের হত্যা রহস্যই হয়তো মীমাংসা হয়ে যাবে ছায়াটাকে ধরতে পারলে।
চাঁদের আলো চারদিকের গাছের পাতার ফাঁক গলে উঠানে নকশা কেটেছে। চশমাটা ঠিক করে উঠানে নেমে এলেন মাস্টার সাহেব। চশমা পরে দিনের বেলাতে তবু যা হোক দেখতে পান তিনি, কিন্তু রাতে খুব অসুবিধে হয়। মাস্টার সাহেব সন্দেহে সন্দেহে চারটে দিক বারবার দেখে নিলেন। উঠানের এক ধার ঘেঁষে কয়েক কদম এগোবার পরই চমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। কাছে-পিঠে কে যেন ভারি নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে মনে মনে হেসে ফেললেন মাস্টার সাহেব। ও কিছু না, গাছের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। এবার হঠাৎ খসখস করে শব্দ উঠলো সামনের ছোট একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে। পিটপিট করে তাকিয়ে রইলেন তিনি ঝোঁপটার দিকে। একটা ছুঁচো ছিটকে বেরিয়ে গেল। আবার একবার হাসলেন তিনি। তারপর পা পা করে পুব দিকে হাঁটতে লাগলেন। ছায়াটাকে তিনি পুবদিক বরাবরই যেতে দেখেছেন।
কিছুদূর যাবার পরই কোথায় যেন একটা পঁাচা ডেকে উঠলো। মাস্টার সাহেব চমকে উঠলেন। হাঁটতে হাঁটতে বারবার থেমে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক কি যেন খুঁজছিলেন তিনি। একটা লম্বা ছায়া দেখে হঠাৎ তিনি কেঁপে ওঠেন। ধ্বক করে ওঠে বুকের ভিতরটা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকেন তিনি সেই দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ভুল ভাঙে তার ওটা একটা গাছের ছায়া। আবার
এগোলেন পা পা করে।
রান্নাঘরটা ঘুরে সামনের দিকে এগোতে থাকেন মাস্টার সাহেব। আর একটু সামনে এগোলেই তিনি মি, নাসিরের ঘরের কাছে এসে পড়বেন। চলার গতি আর একটু মন্থর করেন তিনি। শব্দ হলে ঘুম ভেঙে যাবে কারো। রাতে এভাবে চোরের মতো চুপিচুপি বাড়ির উঠানে ঘুরে বেড়াতে দেখলে কে কি ভাববে কে জানে। সুতরাং সাবধানে চলা উচিত।
মি, নাসিরের ঘরটা দূর থেকে দেখতে পান মাস্টার সাহেব। দরজা জানালা বন্ধ বলেই মনে হয় তার। কিন্তু জানালার চিকন ফাঁক গলে সরু আলোর ছটা বাইরে এসেছে যেন। নাসির সাহেব জেগে আছেন, ভাবেন মাস্টার সাহেব। আর ঠিক তখুনি তিনি দেখতে পান নাসির সাহেবের দরজার একপাশে একটা কালো মতো ছায়া।
৪৪
গাছের ছায়া বোধহয়, ভাবেন মাস্টার সাহেব। এমন অনেকবার গাছের ছায়াকে মানুষের ছায়া বলে সন্দেহ করে চমকে উঠেছেন তিনি। আরে! গাছের ছায়া কি নড়েচড়ে ওঠে! এ যে দেখছি…।
হার্টবিট একলাফে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় মাস্টার সাহেবের। নাসির সাহেবের দরজার পাশ থেকে সরে যাচ্ছে একজন মানুষ। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি। পা ফেলে ফেলে হাঁটছে ছায়ামূর্তি। না; আর কোনো সন্দেহ নেই। ছায়ামূর্তি নাসির সাহেবের দরজা ছাড়িয়ে মিসেস নাসিরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাড়াতাড়ি উঠনের একটা গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন মাস্টার সাহেব। কণ্ঠতালু শুকিয়ে যাচ্ছে তাঁর। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ছায়ামূর্তিকে চিনে উঠতে পারেন না প্রৌঢ় মাস্টার সাহেব। কে এ রহস্যময় লোক? এভাবে প্রত্যেকের দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি করছে ও? কিছু শোনার চেষ্টা করছে নাকি?
মিনিটখানেক মিসেস নাসিরের দরজার সামনে অপেক্ষা করে নিঃশব্দ পায়ে বারান্দা ধরে এগিয়ে চলে ছায়ামূর্তি। শক্ত করে চেপে ধরেন মাস্টার সাহেব তাঁর হাতের লাঠি। ছায়ামূর্তি সোনার মার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবার। সেখানেও বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না সে। বারান্দা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে ছায়ামূর্তি দক্ষিণে বাগানের দিকে।
খুক খুক! হঠাৎ কেশে ফেলেন মাস্টার সাহেব।
মুখে হাত চাপা দিয়েও শব্দ চাপা দিতে পারেন না তিনি। চমকে উঠে উঠনের মাঝখানে থমকে দাঁড়ায় ছায়ামূর্তি। পরক্ষণেই বারান্দার উপর থেকে ডেকে ওঠে একটি বিড়াল মিউ মিউ করে। ছায়ামূর্তি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় বিড়ালটার দিকে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে। ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে দেখে পা টিপে টিপে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দুরুদুরু বুকে হাঁটতে থাকেন মাস্টার সাহেব। ছায়ামূর্তিটাকে চিনতে হবে। কে ও?
ছায়ামূর্তি কোনো দিকে না তাকিয়ে বাগানের ভিতর প্রবেশ করে। পুরো বাগানটা ঘোরে সে ক্লান্ত পদক্ষেপে। পাগল নাকি লোকটা? রাত দুপুরে কেন সে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
মাস্টার সাহেবের মনে হাজারটা কল্পনা যেতে আসতে থাকে। কিন্তু কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। বাগান থেকে বেরিয়ে লোকটা বাড়ির গেটের দিকে এগোয়। দূর থেকে ছায়ামূর্তির নড়াচড়া লক্ষ্য করতে করতে পিছন পিছন হাঁটেন মাস্টার সাহেবের। ছায়ামূর্তি গেটের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে। তারপর আবার পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করে। ঝট করে লুকিয়ে পড়েন মাস্টার সাহেব একটা ঝোঁপের আড়ালে। ছায়ামূর্তি তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। মনের ভিতর ঝড় বইতে শুরু করে মাস্টার সাহেবের। লাঠিটা শক্ত করে
৪৫
ধরে থাকেন তিনি। এগিয়ে আসছে ছায়ামূর্তি। কি করবেন তিনি। হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে চিৎকার করে বাড়ির সকলকে জাগিয়ে তুলবেন? নাকি তার আগে সর্বশক্তি দিয়ে ছায়ামূর্তির মাথায় বসিয়ে দেবেন মোটা লাঠির এক ঘা? কিন্তু, হঠাৎ তার মনে হয়–লোকটা আসলে কে হতে পারে? এ বাড়িরই কেউ নয় তো? | ছায়ামূর্তি সামনের দিকে আসছে এখনও পা পা করে। নাসির সাহেব নয়তো? চশমাটা খুলে কাঁপা হাতে ভালো করে মোছার চেষ্টা করে আবার পরেন মাস্টার সাহেব কিন্তু ছায়ামূর্তিকে এবারও চিনতে পারেন না তিনি। এসে পড়েছে লোকটা। মানুষ? না কি অশরীরী কোনো কিছু… }
| ছায়ামূর্তি নিশ্চিন্ত মনে মাস্টার সাহেবের চারহাত দূর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মাস্টার সাহেব দেখতে পান ছায়ামূর্তির গায়ে একটা কালো চাদর জড়ানো। মাথার উপরও ঘোমটার মতো জড়ানো রয়েছে চাদরের একটা অংশ। মেয়েছেলে নয় তো? ভাবেন মাস্টার সাহেব।
কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করার সুযোগ পান না তিনি। এগিয়ে যাচ্ছে ছায়ামূর্তি। অদৃশ্য হয়ে যাবে চোখের আড়ালে। এমনিতেই তিনি চোখে দেখতে পান না, হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আবার সতর্ক পদক্ষেপে অনুসরণ করতে থাকেন মাস্টার সাহেব রহস্যময় ছায়ামূর্তিকে।
আধঘন্টা পর রীতিমত বিরক্ত হয়ে ওঠেন মাস্টার সাহেব। ছায়ামূর্তির উদ্দেশ্য কি বুঝতে পারেন না তিনি। কেন এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু শুধু? ইতিমধ্যে গোটা বাড়িটা কয়েকবার চক্কর মেরেছে সে। এবার নিয়ে চারবার হবে। বাড়ির কোথাও যেতে বাকি রাখেননি মাস্টার সাহেব ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে। অথচ কিছুই পরিষ্কার হয়নি তাঁর কাছে। তিনি যদি চিনতে পারতেন, তবে যা তোক একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতেন। মাথায় বাড়ি মেরে ব্যাটাকে কাবু করে ফেলা খুব একটা শক্ত কাজ নয়। কিন্তু * হঠাৎ চমকে ওঠেন মাস্টার সাহেব হাঁটতে হাঁটতে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি একটি গাছের নিচে। অদূরে থমকে দাঁড়িয়েছে ছায়ামূর্তিও। বাগানের ভিতর রয়েছে ওরা এখন। মাস্টার সাহেব বিস্ফারিত চোখে দেখেন, ডান পাশের সরু রাস্তা। ধরে লম্বা-চওড়া আর একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে হন হন করে। তার হাতে লম্বা মতো কি যেন রয়েছে একটা। ইনি আবার কে হলেন? কোথা থেকে আবির্ভূত হলেন হঠাৎ? বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না মাস্টার সাহেবের। দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি তার এবং প্রথম ছায়ামূর্তির মধ্যবর্তী সরু রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যায় দ্রুত তালে পা ফেলে। চলার ভঙ্গি দেখেই চিনে ফেলেন মাস্টার সাহেব দ্বিতীয় ছায়ামূর্তিকে। নাসির সাহেব! নাসির সাহেব এতো রাতে বাগানে কেন?
* কিছু চিন্তা ভাবনা করার সময় পান না তিনি। প্রথম ছায়ামূর্তি গাছের আড়াল ৪৬
থেকে বেরিয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করে যেদিকে নাসির সাহেব গেছেন সেদিকে। মাস্টার সাহেবও চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে প্রথম ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে চলেন।
| বেশিদূর যেতে হলো না। বাগানের দক্ষিণ দিকের একটা লিচু গাছের নিচে। দাঁড়িয়ে পড়লেন মাস্টার সাহেব। কুড়ি হাত দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন নাসির সাহেব। ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছেন তিনি মাটির উপর। প্রথম ছায়ামূর্তিটিও মাস্টার সাহেবের ডান দিকে একটি ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে নাসির সাহেবের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। নাসির সাহেবের হাতে ধরা জিনিসটা হঠাৎ চিনে ফেলেন মাস্টার সাহেব। হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি। কোদাল! নাসির
সাহেবের হাতে কোদাল কেন?
অকস্মাৎ নাসির সাহেব মাথার উপর উঁচিয়ে ধরেন কোদালখানা। তারপরই মাটির উপর একটা কোপ মারেন সজোরে। এক চাঙ মাটি সরিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার কোপ মারার জন্য মাথার উপর তুলে ধরেন তিনি কোদালটা। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে আস্তে আস্তে নামিয়ে নেন সেটা। কি যেন ভাবেন মাটির দিকে মাথা নিচু করে। তারপর নিজেকেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, “থাক, আজ থাক।
কথাটা আপন মনেই বলে চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকান নাসির সাহেব। তারপর কোনদিকে ভূক্ষেপ না করে আবার ফিরতি পথে চলতে শুরু করেন হন হন করে। মাস্টার সাহেব অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নাসির সাহেবের অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছেন তিনি কুৎসিত একটা সন্দেহ মনে চেপে বসায়। সন্দেহটা ক্রমে ক্রমে চেপে বসতে থাকে মাস্টার সাহেবের মনে। তাহলে মন্টিকে খুন করে নাসির সাহেব মাটিতে পুঁতে রেখেছেন।
সর্বশরীর রী রী করে ওঠে মাস্টার সাহেবের। নাসির সাহেব তেমন চরিত্রবান। লোক নন তা তিনি অনুমানে জানতেন। মদ তিনি বাড়িতে বসেও খান। তাছাড়া প্রত্যেক দিন গভীর রাতে কোথায় যেন বের হয়ে যান তিনি। নিশ্চিত অতো রাতে কোনো ভালো জায়গায় যান না তিনি। কিন্তু নাসির সাহেব যে ভয়ানক একটা শয়তান তা তিনি কোনদিন ভাবেননি। কিছুক্ষণ আগের কার্যকলাপ দেখে তাঁর আর কোনো সন্দেহই নেই যে, কাওসারকে নাসির সাহেবই খুন করেছেন। আর মন্টিকে নিশ্চয়ই খুন করে পুঁতে রেখেছেন মাটির তলায়। পুলিসের ভয়েই মাটি থেকে লাশটা তুলে বাড়ির বাইরে কোথাও ফেলে আসতে চান এখন!
কিন্তু এ আবার কি?
মাস্টার সাহেব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকান যেখানে নাসির সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন কোদাল হাতে করে সেইদিকে। প্রথম ছায়ামূর্তিটি ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতো। আর ঠিক তার হাত দশেক পিছনে, এক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে। চশমাটা খুলে তাড়াতাড়ি মুছে আবার পরে নেন মাস্টার
| ৪৭
সাহেব। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে মহিলা প্রথম ছায়ামূর্তির দিকে।
হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকায় প্রথম ছায়ামূর্তি। মহিলা ছায়ামূর্তি কথা বলে ওঠে নিচু স্বরে, ভয় নেই! তোমার কাছেই এসেছি আমি!
স্বপ্ন নাকি! এ যে মিসেস নাসিরের কণ্ঠস্বর! নিজেকে পাগল মনে করবেন কিনা ভাবেন মাস্টার সাহেব। এসব কি ঘটছে রাত দুপুরে!
‘প্রতিশোধ নিতে চাও?’ হিসহিস করে ওঠে মিসেস নাসিরের কণ্ঠস্বর। দু’পা এগিয়ে গিয়ে প্রথম ছায়ামূর্তির পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। বলেন, ‘কি, কথা বলছো
যে!’ | ‘চাই! এখুনি চাই! ড্রাইভার শামসু মিয়ার কণ্ঠস্বর! আবার একবার চমকে ওঠেন মাস্টার সাহেব। ড্রাইভার শামসু হিংস্রভাবে কথা বলে ওঠে।
না, আজ নয়! আমি সুযোগ করে দেবো তোমাকে, আমিও তৈরি হয়ে নিই আগে…’ মিসেস নাসির ড্রাইভার শামসুর উদ্দেশ্যে বলেন।
কান পেতে ওদের বাকি কথা শোনার চেষ্টা করেন মাস্টার সাহেব। কিন্তু ওরা দুজন অতি কাছাকাছি সরে গিয়ে অত্যন্ত নিচু স্বরে শলা-পরামর্শ করছে। আর কোনো কথাই কানে ঢোকে না মাস্টার সাহেবের। কি করবেন তিনি এখন ভাবছেন। এরমধ্যে হঠাৎ তিনি দেখলেন মিসেস নাসির এবং ড্রাইভার শামসু হাঁটতে শুরু করেছে। তিনিও নিঃশব্দ পায়ে অনুসরণ করলেন ওদের দুজনকে।’
কিন্তু আজকের পূর্ণিমা রাতের নাটকের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। ড্রাইভার শামসু ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার কোয়ার্টারে। মিসেস নাসিরও তাঁর ঘরে ঢোকেন পা টিপে টিপে। একা মাস্টার সাহেব উঠানে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকেন এখন তার কর্তব্য কি। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো একে একে কল্পনা করেন তিনি। অনেক কথাই জানতে পেরেছেন তিনি। সবগুলোর রহস্য যদিও বুঝতে পারেননি। কিন্তু এসব কাজ কারবার নিয়ে রাতদিন যারা মাথা ঘামায় তারা হয়তো এর মধ্যে থেকেই নতুন কোনো তথ্য পেয়ে যাবে। সুতরাং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মাস্টার সাহেব, ডিটেকটিভ শহীদ খানকে সব ব্যাপার জানাবেন। তিনি হয়তো একটা সুরাহা করে ফেলবেন এ থেকেই। পুলিসের উপর তেমন আস্থা নেই তার। তাছাড়া শহীদ খানের বাড়িতে গেলে সারওয়ারকেও দেখে আসতে পারবেন।
. নিজের ঘরে ফিরে না গিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন মাস্টার সাহেব। টেলিফোন গাইড ঘেঁটে শহীদ খানের বাড়ির ঠিকানা লিখে নিলেন একটি কাগজে। তারপর হাতের লাঠিটা রেখে ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে এসে বাড়ির গেটের দিকে হাঁটা
শুরু করলেন। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শহীদ খানকে জানানো দরকার সব কথা।
.
৪৮
পাঁচ
রাত বারোটা।
উত্তেজিত পদক্ষেপে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে শহীদ।
দোতলার পশ্চিম দিকের ঘরের সবকটা জানালা খোলা। ঘরের ভিতর দুজন মাত্র প্রাণী। সারওয়ার এবং শহীদ।
এইমাত্র সবকথা বলা শেষ করেছে সারওয়ার। শুনতে শুনতেই সোফা ছেড়ে পায়চারি শুরু করেছিল শহীদ। এখন সে আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। সারওয়ার যা বলেছে তা মিথ্যে নয়, একথা বুঝতে পারলো শহীদ। কিন্তু প্রশ্ন তাহলে–মন্টিকে গুদাম ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে গেল কে? কাওসার মন্টিকেই খাবার দেবার জন্যে ওখানে উপস্থিত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সারওয়ারের অনেক আগেই গিয়েছিল সে। তখন বৃষ্টিও শুরু হয়নি। কাওসার নিহত হলো তাহলে কার হাতে? নিশ্চয়ই মন্টিকে যে চুরি করেছে গুদাম ঘর থেকে সে-ই খুনী।
সারওয়ার এবং কাওসার যখন মন্টিকে চুরি করার প্ল্যান করছিল তখন ওদের। কথা কেউ না কেউ আড়ি পেতে শুনেছে। তারই কাজ এগুলো। তার মানে অপরাধী বাইরের লোক নয়, বাড়িরই কেউ! কিন্তু কে হতে পারে সেই লোক? মি. নাসির? উনি টাকার লোভে এমন নিষ্ঠর কাজ করবেন? মিসেস নাসির? কিন্তু উনি কোন্ স্বার্থে এমন কাজ করতে যাবেন? ড্রাইভার? এমন নির্মম কাজ করার দুঃসাহস কি তার হতে পারে? সোনার মা? কিন্তু সোনার মা ওদের তিন ভাইকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, তার দ্বারা এমন কাজ অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। মাস্টার সাহেব? সোনার মার মতো তিনিও তো বহুদিনের পুরানো লোক শান্তিনীড়ের। যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায়, তিনি কি টাকার লোভে এই কাজ করতে পারেন? আর একটা কথা, বাড়ির লোকের সঙ্গে বাইরের লোকেরও যোগাযোগ আছে এই কাজে। চিঠিটা তার প্রমাণ। বাড়ির কোনো লোকের হাতের লেখার সঙ্গে মিল নেই চিঠিটার লেখার। এখন প্রশ্ন হলো–চোরের উপর বাটপারি করলো কে? কে মন্টিকে চুরি করলো। চুরি করে রাখলই বা কোথায়?
এইসব ভাবছিল শহীদ উত্তেজিত পায়ে পায়চারি করতে করতে। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ালো জানালার সামনে। ঝট করে সরে গেল একটা ছায়া রাস্তার এক পাশে। শহীদকে জানালায় দাঁড়াতে দেখেই অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো লোটা। শহীদের বাড়ির ঠিক সামনেই এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে।
কি যেন ভাবলো শহীদ। এমন সময় সারওয়ার বলে উঠলো, ভাইয়া, ধরতে পারবেন আমার ভাইদের…’।
‘নিশ্চয়ই, সারওয়ার অপরাধী কোনদিন না ধরা পড়ে যায় না। তুমি একটুও
–
৪৯
ভেবো না।’
সারওয়ার আস্থার দৃষ্টিতে তাকালো শহীদের দিকে। শহীদ জানালার সামনে থেকে সরে এসে আবার বললো, এখন তুমি তোমার ঘরে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়গে, সারওয়ার! তোমার ঘুম দরকার এখন।
ধীরে ধীরে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল সারওয়ার। শহীদ দরজা বন্ধ করতে গিয়েও করলো না। পাশের ঘরে মহুয়া আছে। ওকে সাবধান করে দিয়ে আসতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে মহুয়ার ঘরে ঢুকলো। শহীদ। মহুয়া শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। শহীদ বিছানার উপর গিয়ে বসে নিচু স্বরে বললো, ফেরেশতা এসেছেন বাইরে। তাকে অভ্যর্থনা করার ব্যবস্থা করছি আমার ঘরে। কিন্তু তুমিও সাবধানে থেকো, বলা যায় না, ফেরেশতা তো, তোমার ওপরও…।’
শহীদের সঙ্কেতধর্মী বক্তব্য শুনে আঁতকে উঠলো মহুয়া। বিছানা থেকে এক ঝটকায় নেমে জানালাগুলো সব বন্ধ করে দিলো। তারপর শহীদের কাছে সরে এসে বললো, বাইরে থেকে ভাগিয়ে দাও। খামোকা…’
না! কাজ আছে।’
শহীদের এই কথাতেই মহুয়া বুঝলো হাজার মাথা কুটলেও শহীদ যা ভেবেছে তা থেকে পিছিয়ে আসবে না। অগত্যা সে বলে উঠলো, এ ঘর থেকে বেরোও জলদি, আমি দরজা বন্ধ করে দিই।’
মৃদু হেসে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলো শহীদ। মহুয়াও বের হয়ে এসে দাঁড়ালো শহীদের সামনে। শহীদের একটা হাত ধরে ফেলে সে মৃদুকণ্ঠে বললো, “সাবধানে, কেমন!
মাথা নেড়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো শহীদ। মহুয়া দরজা বন্ধ করে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইলো মেঝের উপর। শহীদ ঘরে ঢুকে. জামা-কাপড় ছাড়লো জানালার দিকে পিছন ফিরে। দরজা বন্ধ করে বিছানার উপর বালিশ সাজিয়ে একজন শায়িত মানুষের আকার দিলো। তারপর রিভলভারটা পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে বাতি নেভাবার জন্যে হাত বাড়ালো সুইচ বোর্ডের দিকে। ঠিক এমনি সময়ই
দরজায় শব্দ হলো, ঠক! ঠক! ঠক!’
ভুরু কুঁচকে তাকালো শহীদ দরজার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো সে আস্তে করে, কে?’
‘আমি! আমি মাস্টার সাহেব, শান্তিনীড় থেকে…’ ‘খুলছি, খুলছি!
ব্যস্তভাবে এগিয়ে যায় শহীদ দরজার দিকে। দরজা খুলে মাস্টার সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কি খবর? এতো রাতে আপনি..?’
‘আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, মি. শহীদ। কিন্তু এতো রাতে চলে
এলাম, সত্যি, কথাটা একবারও মনে পড়েনি আমার। এখন না এসে কাল সকালে এলেও চলতো। তা এক কাজ..’।
| শহীদ বলে, আপনি বিচলিত হবেন না, মাস্টার সাহেব। আমি এখনই আপনার কথা শুনতে আগ্রহী। কিন্তু আধঘন্টাটাক আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আসুন, সারওয়ারের ঘরে এখনও বাতি জ্বলছে, ঘুমায়নি ও। আপনাকে ওর ঘরে রেখে আসি। আমার সামান্য একটু কাজ আছে।’
মাস্টার সাহেবকে সারওয়ারের ঘরে রেখে ফিরে আসে শহীদ। দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে জিরো পাওয়ারের বাবটা জ্বেলে দেয় সে। তারপর ঘরের বুক শেলফের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। | পাঁচ মিনিট! দশ মিনিট! পনেরো মিনিট। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ি দেখে শহীদ। আরও পাঁচ মিনিট কাটে অপেক্ষায়। তারপরই দেখা যায় একজন লোককে জানালার কাঁচ দিয়ে। নিঃশব্দে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে শহীদ। এদিকে জানালার গ্রিলটা ওঠাবার চেষ্টা করছে লোকটা। শহীদ লোকটার শরীরের কাঠামো আন্দাজ করে বুঝতে পারে লোকটা দারুণ শক্তির অধিকারী। দেখতে দেখতে জানালার গ্রিলটা সরিয়ে ফেলে লোকটা। বিন্দুমাত্র শব্দ হয় না তার কাজে। পাকা লোক। পা ঝুলিয়ে দিয়ে নেমে পড়ে ঘরের মেঝেতে। জিরো পাওয়ারের বালুবের আলোয় চকচক করে ওঠে লোকটার হাতে ধরা ছোরাটা। এক পা এক পা করে খাটের দিকে এগোয় লোকটা। খাটে মশারী খাটানো রয়েছে। মশারীর ভিতর সাজানো বালিশের উপর চাদর ঢাকা দেয়া। লোকটা দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। এগোচ্ছে সে অদ্ভুত ভাবে শরীরটাকে বাঁকিয়ে নিয়ে। হাসি পেয়ে যায় শহীদের লোকটার শিকার ঘায়েল করার একাগ্রতা দেখে। মজাটা উপভোগ করতে চায় সে আর একটু।
মশারীর কাছে গিয়ে আলতোভাবে সেটা তুলে ধরে লোকটা। তারপরই হাতের ছোরাটা উঁচিয়ে ধরে বসিয়ে দেয় বালিশের উপর। কিন্তু চালু লোক ব্যাটা, ছোরাটা বসিয়েই বুঝতে পারে ধরা পড়ে গেছে সে। ঠিক সেই সময়ই শহীদ মাথার উপর সুইচ বোর্ডের সুইচ টিপে ঘর আলোকিত করে দিয়ে বলে ওঠে, ‘সাবধান! নড়াচড়া নয় একচুলও!’
কিন্তু ঘুঘু লোক অনাহূত ব্যক্তি। তাছাড়া আগেই সে টের পেয়ে গিয়েছিল শহীদের চাতুরী। শহীদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে পিছন ফিরেই শব্দ লক্ষ্য করে লাফ দেয় সে। এতোটা কল্পনা করেনি শহীদ। পলকের মধ্যে লোকটা শহীদের শরীরের উপরে এসে সজোরে ধাক্কা মারলো। প্রথম ধাক্কাতেই হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলভারটা। দুজনেই পড়লো মেঝের উপর সশব্দে। শহীদ রিভলভারটা দেখতে পেলো হাতখানেক দূরে। শুয়ে শুয়েই হাত বাড়ালো সে। কিন্তু পলকের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে ঠিক শহীদের তলপেট বরাবর প্রচণ্ড একটা
লাথি চালিয়ে দিলো লোকটা। রিভলভারটা আর তোলা হলো না। সর্বশরীর কুঁচকে দু’হাত দিয়ে ঠেকালো শহীদ লাথিটা। ঠেকালো তো বটেই, ধরেও ফেললো লোকটার ডান পা-টা। ধরে মোচড় দিতেই ককিয়ে উঠে পড়ে গেল লোকটা মেঝেতে। চট করে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। কিন্তু রিভলভারটা এখন দুজনেরই আওতার বাইরে। লোকটাও উঠে দাঁড়ালো একই সঙ্গে। দুই শক্তিশালী যোদ্ধা হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো পরস্পরের দিকে। লোকটার চোখ দুটো যেন আগুনের দুটো টুকরো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না শহীদ সেদিকে। একপা
এগোলো। সতর্ক হয়ে গেছে সে। শত্রু বিদ্যুতের মতোই দ্রুতগতি। একটু সুযোগ দিলেই বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
একপা পিছিয়ে গেল লোকটা। আরও একপা এগোলো শহীদ। এবারও এক পা পিছিয়ে যাবার জন্যে বাম পা-টা পিছন দিকে নিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু শহীদকে ধোকা দিয়ে ডান পায়ের উপর ভর দিয়েই ঝাঁপ দিলো লোকটা। অত্যন্ত অল্প সময় পেলো শহীদ। কিন্তু তবু তৈরি হয়েই ছিলো সে। লোকটার ঘুসি শহীদের নাকে এসে লাগার আগেই মাথা সরিয়ে নিলো শহীদ। সেই সাথে কানের ঠিক নিচেই কষলো সে একটা কারাতের কোপ। এর ফলে লোকটি মেঝের উপর আছাড় খেয়ে পড়লো, শুধু তাই নয় ছিটকে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেলো দেয়ালের সাথে। রিভলভারটার জন্যে মেঝের দিকে তাকালো শহীদ। কিন্তু দেখতে পেলো
সেটা। শহীদের অজ্ঞাতে রিভলভারটা ধাক্কা খেয়ে খাটের নিচে গিয়ে ঢুকেছে। মেঝেতে রিভলভার না পেয়ে লোকটার দিকে এগোলো শহীদ। কিন্তু লোকটাও বুঝতে পেরেছে শহীদের ক্ষমতা। খোলা জানালার সামনে গিয়েই পড়েছিল সে। হাঁটু ভাজ করে জানালা গলে পালাবার জন্যে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু
একটা হাতি এসে দাঁড়িয়ে আছে ইতিমধ্যে জানালার অপর দিকে–গফুর!
গফুরকে দেখেও কিন্তু লোকটা শহীদের দিকে ফিরলো না। এদিকে শহীদ, লোকটায় পিছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে গিয়েই মার খেলো। লোকটা শহীদকে ধোকা দেবার জন্যেই পিছন ফিরে অপেক্ষা করছিল। সময় আন্দাজ করে সজোরে পিছন দিকে কনুই দিয়ে তো মারলো সে। পেটে লাগলো শহীদের
তোটা। ব্যথায় নীল হয়ে গেল মুখের রঙ। শরীরের সব রক্ত যেন উপর দিকে উঠে এসেছে হঠাৎ। চোখমুখ কুঁচকে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। কিন্তু পরমুহূর্তেই লোকটা শহীদকে নিয়ে গড়িয়ে পড়লো মেঝের উপর। তারপর সাঁড়াশির মতো দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরলো শহীদের গলা।
সর্বশক্তি দিয়ে চেপে বসছে লোকটার হাত দুটো শহীদের গলার উপর। নড়াচড়া করার উপায় নেই তার। শরীরের উপরে ছিনে জোঁকের মতো লেপটে আছে লোকটা। অতি কষ্টে হাত দুটো মুক্ত করলো শহীদ। হাত দুটো ব্যবহারের উপরই নির্ভর করছে জয়-পরাজয়। না, ঘুসি চালালো না শহীদ। হাত দুটো নিলো
৫২
সে নিজের গলার কাছেই। লোকটার হাতের উপর হাত রেখে টের পেতে চাইলো সে দু’হাতের কড়ে আঙুল দুটোর অবস্থান। কিন্তু এদিকে শ্বাস বন্ধ হতে চলেছে। তার। দুর্বল হয়ে পড়েছে ভয়ানক ভাবে।
. অতি কষ্টে লোকটার কড়ে আঙুল দুটোর তলায় নিজের বুড়ো আঙুল ঢোকালো শহীদ। তারপরই চোখ বন্ধ করে, শক্তি সঞ্চয় করলো। শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে লোকটার কড়ে আঙুল দুটোয় ইলেকট্রিক শক মারলো সে। আসলে আঙুল দুটো ভেঙে ফেলার জন্যে আচমকা ধাক্কা মারলো। ফলটা কি হবে জানতো শহীদ। হলোও তাই। বাবারে’ বলে চিৎকার করে উঠে শহীদকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে পড়লো লোকটা। দুটো হাতের কড়ে আঙুল একই সঙ্গে মট করে ভেঙে গেছে বেচারার।
এক লাফে উঠে দাঁড়ালো শহীদ ছাড়া পেয়েই। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শ্বাস ফেলার সময়টুকুও তর সইলো না তার। প্রচণ্ড একটা ঘুসি চালালো সে লোকটার নাক বরাবর। অবশ্য এর জন্যে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার উপর ডাইভ দিয়ে পড়তে হলো তাকে।
* লোকটাকে এই ঘুসি না মারলেও চলতো শহীদের। এমনিতেই ভাঙা আঙুল দুটোর ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু ঘুসিটা মারলো সে এতো যোগাড় যন্ত্র করে শুধুই রাগের বশবর্তী হয়ে। উপরি পাওনা!
হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। জানালার দিকে হাত উঁচিয়ে ধরে গফুরের উদ্দেশ্যে বললো সে, ‘দড়ি!’
মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরালো না শহীদ ধরাশায়ী লোকটির দিক থেকে। পাশ ফিরে পড়ে আছে প্রকাণ্ড শরীরটা। কাতরাচ্ছে। তা হলেও এ শত্রুকে বিশ্বাস নেই। গফুর মোটা একগাছি দড়ি ছুঁড়ে দিলো জানালা দিয়ে। দড়িটা তুলে নিয়ে লোকটাকে বেঁধে ফেললো শহীদ। বাঁধা শেষ হতে শহীদ দেখলো গালে একরাশ হাসি মেখে গফুর ঘরের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছে জানালা দিয়ে। তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো শহীদ, ‘চেয়ারের ওপর উঠিয়ে বসা ব্যাটাকে। | দশাসই এবং ব্যায়ামবীর গফুরও অনেক চেষ্টা করার পর লোকটাকে চেয়ারে বসাতে পারলো পাজাকোলা করে ধরে। পিটপিট করে তাকালো লোকটা এবার শহীদের দিকে। লোকটার সহ্যক্ষমতা দেখে অবাকই হলো শহীদ। আঙুলের ব্যথার কথা ভুলে দিব্যি তাকিয়ে রয়েছে।
| কে তুমি? কেন মারতে চেয়েছিলে আমাকে? কার হুকুমে?’ কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করে শহীদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ফেলে লোকটা। কথা বলে না।
‘উত্তর দিচ্ছে না যে!’ ধমক মেরে ওঠে শহীদ।
লোকটা চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে। ব্যঙ্গ করে শহীদ বলে ওঠে,
. ৫৩
‘দোয়ারুদ পড়ছো বুঝি? কিন্তু সেজন্যে সময় দেয়া হবে তোমাকে। এখন আমার
প্রশ্নের উত্তর দাও।
| জানি না। উত্তর জানা নেই!’
“তাই নাকি। উত্তর জানা নেই?’ রেগে ওঠে শহীদ লোকটার সাহস দেখে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আলমারির একটা কৌটা থেকে সুঁই বের করে নিয়ে আসে সে। তারপর লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তোমাকে ইচ্ছে করেই ঘরে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছিলাম সে কথা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, কেমন? কেন বলো তো? তোমাকে কথা বলার জন্যে। আমি জানতে চাই কে তোমাকে পাঠিয়েছে এখানে। সুতরাং যেভাবেই হোক, কথা তোমাকে আমি বলাবই।
‘কথা তোমাকে বলাবই!’ মুখ ভেংচে ওঠে লোকটা কুৎসিত মুখভঙ্গি করে। . গরম হয়ে ওঠে শহীদের মেজাজ। লোকটার বাঁধা একটা হাত ধরে মধ্যমা আঙুলটা বেছে নেয় সে। তারপর বলে, কথা তাহলে বলবে না, কেমন?’
উত্তর দেয় না লোকটা। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে শহীদের দিকে। ছাড়া থাকলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করতো সে শহীদকে। ধীরে ধীরে সুইটা মধ্যমা আঙুলের নখের মধ্যে দিয়ে ঢোকাতে থাকে শহীদ। ঢোকাতে ঢোকাতেই বলে, ‘খুব বেশি লাগলে বলবে, মিয়া, একটু আস্তে আস্তে করবো কাজটা। আর কথা বলার ইচ্ছে হলেও বলবে-বুঝলে?’
কিন্তু শহীদ ভূল বুঝেছিল লোকটাকে! সে ভুল তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙলো। একটি একটি করে তিনটে আঙুলে সুঁই ফোঁটাবার পরও টু-শব্দটি করলো না লোকটা। শুধু অসহনীয় যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো দেহটা। শহীদ বুঝলো এতে কাজ হবে না। কিন্তু এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতেও রাজি নয় সে। তার দৃঢ় বিশ্বাস শান্তিনীড়ের হত্যা এবং নিখোঁজ রহস্যের সঙ্গে এ লোকটার কোনো না কোনো যোগ আছে। এখন যোগটা কি তা তাকে জানতেই হবে যেমন করে হাক। মারের চোটে ভূতও কাবু হয়। আর এ তো মানুষ। তবে এর বেলায় একটু কড়া ডোজ দরকার।
নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসলো শহীদ। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কয়েক টান দিলো চিন্তিতভাবে। লোকটা মুখ বাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে, মাথা নুইয়ে বসে আছে মরার মতো। তার দিকে তাকিয়ে আবার চেয়ার থেকে উঠে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শহীদ। বললো, এবার আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে তোমার একটি চোখে এই জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরবো। এখন বলো কোনটা পছন্দ তোমার?’.
বলো কি জানতে চাও।’ অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো লোকটা মাথা তুলে। শহীদ আশ্বস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো, কে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে? ‘শয়তান!’ লোকটা গোঁয়ারের মতো উত্তর দিলো।
তা সত্ত্বেও আবার জিজ্ঞেস করলো শহীদ, তুমি কে? ‘শয়তানের চেলা!’
লোকটার দুঃসাহস দেখে রীতিমত দমে গেল শহীদ। কিন্তু সেই সঙ্গে রাগও হলো তার প্রচণ্ড। জ্বলন্ত সিগারেটটা দু’আঙুলে ধরে লোকটার ডান চোখের দিকে হাত বাড়ালো সে।
পানি! হাতটা ফিরিয়ে নিলো শহীদ। গফুর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এককোণে। শহীদ তাকে পানি আনতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। আধুমিনিটের মধ্যে একগ্লাস পানি এনে গফুর লোকটার মুখে ঢেলে দিতে তৈরি হলো। লোকটা পানি খাবার আগের মুহূর্তে শহীদের দিকে তাকিয়ে একটু করুণ হাসি হাসলো। লক্ষ্য করলো শহীদ, লোকটার এই অদ্ভুত ব্যবহার। পরক্ষণেই একটা শব্দ হলো কট করে। শব্দটা লোকটার মুখের ভিতর থেকেই উঠলো। একলাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গফুরের হাত থেকে পানির গ্লাসটা কেড়ে নিলো শহীদ। কিন্তু ততক্ষণ যা ঘটার ঘটে গেছে। গফুর ইতিমধ্যেই খানিকটা পানি ঢেলে দিয়েছে লোকটার মুখের ভিতর। লোকটাকে দু’বার ঢোক গিলতে দেখেই তাড়াতাড়ি তার মুখটা এক হাতে কষে ধরে অপর হাতের দুটি আঙুল মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো শহীদ। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। আগেই গিলে ফেলেছে দুঃসাহসী লোকটা বিষভর্তি কৃত্রিম দাঁতটা মাড়ি থেকে জিভের সাহায্যে খসিয়ে!
কথা তোমাকে আমি বলাবই! বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আবার ব্যঙ্গ করলো লোকটি শহীদকে। তারপর বললো, “দুমিনিটের মধ্যে আমি চলে যাচ্ছি, আমার মুখ থেকে কথা শুনতে হলে তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।’
এবার আর রাগ হলো না শহীদের। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সাথে রাগ করা যায়। ইতিমধ্যেই নুয়ে পড়তে শুরু করেছে লোকটা। বিষক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। শহীদ বুঝতে পারলো ডাক্তার ডেকে লাভ নেই কোনো। বাঁচানো যাবে না একে। এবং দু’মিনিট নয়, মাত্র আধমিনিটের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো লোকটা। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারলো সে। লোকটাকে যে বা যারা পাঠিয়েছিল তারা ভয়ানক জবরদস্ত গ্যাং। তথ্য না প্রকাশ করার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়া বড় সহজ কথা নয়। কিন্তু আসলে কে এই লোকটা? কে বা কারা একে পাঠিয়েছিল?
সাময়িকভাবে ভাবনা-চিন্তা স্থগিত রেখে টেলিফোন তুলে মি. সিম্পসনকে এখুনি চলে আসতে অনুরোধ করলো শহীদ। তারপর ঘরে গফুরকে রেখে বের হয়ে এলো সে বাইরে। বারান্দায় অপেক্ষা করছিল মহুয়া। শহীদকে দেখে এগিয়ে এলো সে উৎকণ্ঠিতভাবে। বললো, ‘খবর কি?’
‘ভালো নয়, লোকটা আত্মহত্যা করেছে। তুমি ঘরে যাও। সারওয়ারের ঘরে তার মাস্টার সাহেব বসে আছেন। কয়েকটা কথা সেরে নিই আমি।
মহুয়ার উদ্দেশ্যে কথাকটি বলে সারওয়ারের ঘরের দিকে এগোলো শহীদ। সারওয়ারের ঘরের দরজা খুলে একটু অবাক হলো সে। যাই হোক, ঘরে ঢুকেই শহীদ দেখলো চিন্তিত মুখে খাটের উপর বসে আছে সারওয়ার। মাস্টার সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না ঘরের কোথাও।
‘তোমার মাস্টার সাহেব কোথায় গেলেন সারওয়ার?”
সারওয়ার বললো, ‘কি জানি, ভাইয়া! আপনার ঘরে মারামারির শব্দ শুনে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। একটু পর পিছন ফিরে দেখি দরজা খোলা, ঘরে মাস্টার সাহেব নেই।’
Leave a Reply