১৫. অপারেশন পেরু ৩ (ভলিউম ৫) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৫
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৯৬৮
,
এক
গাছের ছায়া এবং চাঁদের আলোর উপর দিয়ে দ্রুত হেঁটে জঙ্গলটা অতিক্রম করলো। কুয়াশা। আধঘণ্টা হয়ে গেছে শহীদদেরকে ছেড়ে এসেছে সে। অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে গেছে ওরা সম্ভবত। সৈনিকে গিয়ে পৌঁছুতে আরও আধঘন্টা লাগবে ওদের। নিরাপদে ‘সৈনিকে’ পৌঁছুবে তো ওরা?
বিদায় বেলার দৃশ্যটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না কুয়াশা। এই পৃথিবীতে, তার একমাত্র আপনজন মহুয়া। মহুয়াকে কথা দিয়েছে সে। কথা। দিয়েছে একই সঙ্গে দেশে ফিরবে তারা। সম্ভব হবে কি তা?
| দ্রুত করলো কুয়াশা চলার গতি। কামালকে উদ্ধার করতে হবে। জংলীরা তার বিশ্বাসঘাতকতা টের পেয়ে গেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় কে জানে বন্দী করে। রেখেছে তাকে। প্রত্যেকের জীবন নির্ভর করছে। এখন আমার উপর, ভাবলো কুয়াশা। গুরুদায়িত্ব উঠিয়ে নিয়েছে সে নিজের কাঁধে। কামালকে সময়মতো উদ্ধার করতে না পারলে জংলীদের হাতে প্রাণ যাবে তার। এদিকে কামালকে খুঁজে বের করতে দেরি করে ফেললে শহীদরাও ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে। তাদের পালাবার। খবর এতক্ষণে জানতে বাকি নেই জংলীদের। খবর ছড়িয়ে পড়েছে দ্বীপের সর্বত্র। হিংস্র অসভ্যরা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে ওদের। সৈনিকের খবর জানতে পারলে দলে
দলে ছুটবে ওরা। কিছুই করার থাকবে না শহীদের। মৃত্যু অবধারিত।
বৈজ্ঞানিক Kotzeকে সাহায্য করতে যাচ্ছিলো ওরা দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে। পথিমধ্যে জাহাজডুবি হলো। প্রত্যেকেই জংলীদের দ্বীপে এসে ভিড়লো বিচ্ছিন্নভাবে। দেখা হলো সকলের সঙ্গে জংলীরাজ হিরিরিরি-র রাজসভায়। সকলকেই উদ্ধার করা হলো। কিন্তু কামাল বন্দী হয়েছে। উদ্ধার করতে হবে। ওকে। মরিয়া হয়ে কামালের খোঁজে দলছাড়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছে কুয়াশা।
. আরে! এ যে পাহাড়ের সারি! আশ্চর্য হয়ে থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। কামালকে, কি তবে জংলীরা এদিকে ধরে আনেনি? কিন্তু ধস্তাধস্তির শব্দ তো এদিক থেকেই শুনতে পেয়েছিল সে। তবে কি রাস্তা ভুল করলো!
পাহাড়ের গায়ে একটা সুড়ঙ্গ দেখা যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো কুয়াশার দৃষ্টি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে চেষ্টা করলো সে কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে কি না।
১২৭
সুড়ঙ্গের গোল মুখটা যেন গিলতে আসছে। দরজা তো নেই-ই, পাথরের ঢাকনিও দেখা যাচ্ছে না। জংলীদের তৈরি এটা, ভাবলো কুয়াশা। চাঁদের আলোয় . চকচক করছে পাথরের গা।’ বিরাট আকার নিয়ে শূন্য পড়ে আছে সুড়ঙ্গটা। পনেরো বিশজন লোক একসঙ্গে ঢুকতে পারবে অনায়াসে। কোথায় গিয়ে শেষ। হয়েছে এ সুড়ঙ্গ?
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো কুয়াশা। সতর্ক হয়ে পায়ে পায়ে এগোলে সে : এবার। দশ হাত দূরে হবে সুড়ঙ্গটার মুখ। আরও দু’পা এগোলো কুয়াশা। একি! ‘ হঠাৎ অদ্ভুত একটা আকর্ষণ অনুভব করলো কুয়াশা। টানছে তাকে! কি
ব্যাপার, কে তাকে সামনের দিকে এমন ভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? দাঁড়িয়ে পড়তে চেষ্টা করলো কুয়াশা। পারলো না। তার শরীরটাকে কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি জোর করে সামনে টেনে নিচ্ছে। দাঁড়াতে পারছে না কুয়াশা। বিহ্বল হয়ে পড়লো। সে। এর মানে কি! এগোতে চাইছে না সে আর একপাও। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না এক জায়গায়।
তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ক্রমেই আকর্ষণটা। যতোই সামনে পা ফেলতে বাধ্য হচ্ছে কুয়াশা ততোই বাড়ছে টানটা।
‘ এগোতে এগোতে সুড়ঙ্গটার ভিতরে প্রবেশ করলো কুয়াশা। সামনের দিকে আকর্ষণটা এখন আর অনুভব করছে না সে। কিন্তু শরীরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা। অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। নিচের দিকে টেনে বসিয়ে দিতে চাইছে এখন। অজ্ঞাত শক্তিটা। অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে থাকছে কুয়াশা। কি যেন চিন্তা করছে সে। এমন সময় লেসারগান ধরা ডান হাতটা ব্যথা করে উঠলো তার। এতক্ষণে একটা জিনিস পরিষ্কার হলো। লেসারগানটাই, আসলে নিচের দিকে নেমে যেতে চাইছে হাত থেকে। ব্যাপারটা, লক্ষ্য করে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কুয়াশার মুখ। পাথরের
সুড়ঙ্গ নয় এটা, ম্যাগনেট হোলের পাল্লায় পড়েছে সে।
. ম্যাগনেট, অর্থ চুম্বক। আশ্চর্য হলো কুয়াশা। জংলীরাজ হিরিরিরি-র মাথা তো কম নয়। সে এই কৌশল জানলো কিভাবে? পাহাড়ী দ্বীপে না হয় চুম্বক পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে এ রকম ফঁদ তৈরি করা তো যার তার কর্ম নয়।
লেসারগানটা ফেলে দিলেই অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারে কুয়াশা এই ম্যাগনেট হোল থেকে। কিন্তু লেসারগানটাই এখন সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন। কি: করা যায়?
| খুব একটা কঠিন মনে হলো না সমস্যাটা কুয়াশার কাছে। লেসারগান দিয়ে। সামনের দিকটা প্রথমে অদৃশ্য করে দিলো সে। লোহা গলে পানি হয়ে গেল এক নিমেষে। মিনিটখানেক লাগলো, তার ম্যাগনেট হোল থেকে মুক্তি পেতে। সামনে। এগোলো। গরম এবং পোড়া মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে কোনো অসুবিধেই হলো না।
তার। . ১২৮
: ,
**
‘
‘
‘
‘
–
—–
–
–
—
–
–
–
–
দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো আবার কুয়াশা। কিছুক্ষণ পরেই দুপাশে বাঁশের দেয়াল দেয়া একটা রাস্তা দেখতে পেলো সে।
রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর রাস্তাটার তিনটে মোড়ের সামনে এসে দৃড়ালো কুয়াশা। কোনদিকে যাওয়া যায় ভেবে পেলো না। এমন সময় শব্দটা কানে ঢুকলো তার। কয়েকজন জংলী উত্তেজিত স্বরে কথা কাটাকাটি করতে করতে এগিয়ে আসছে এদিকে।
দমে গেল কুয়াশা। তিন দিকের রাস্তাই সোজা চলে গেছে সরলরেখার মতো। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলে জংলীরা শব্দ শুনে টের পেয়ে যাবে। কিংবা নিঃশব্দে কোনো একটা রাস্তা ধরে পিছিয়ে গেলেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয় না। দৃষ্টি একবার সেদিকে পড়লেই দেখে ফেলবে ওরা। যে রাস্তাটা দিয়ে লোকগুলো আসছে সেটাই শুধু আঁকাবাঁকা। একটা মোড় দেখা যাচ্ছে দশ হাত দূরে রাস্তাটির। লোকগুলো এখনও মোড়ের কাছে এসে পড়েনি বলেই রক্ষে, মোড়টা ঘুরলেই দেখতে পাবে জংলী গুলো কুয়াশাকে।
| বাঁশের দেয়ালের উপরে তাকালো কুয়াশা। তিন মানুষ সমান উঁচু হবে দু’পাশের দেয়াল দুটো। লেসারগানটা শক্ত করে ধরে একদিকের দেয়ালের সামনা সামনি হলো কুয়াশা। এসে পড়েছে প্রায় জংলীরা। আর দেরি করা উচিত হবে না। তাড়াতাড়ি উঠতে চেষ্টা করলো সে বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে, আঙুল ঢুকিয়ে। তরতর করে উঠে পড়লো কুয়াশা, অর্ধেকটা। এমন সময় মোড়টা ঘুরে বেরিয়ে এলো কয়েকজন জংলী। অনড় রইলো কুয়াশা ঝুলন্ত অবস্থায়। এখন নড়াচড়া করলেই জংলীদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাবে।
লোকগুলোকে দেখলো কুয়াশা। ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে পেরিয়ে গেল ওরা। উপর। দিকে তাকালো। কোনো সন্দেহ জাগেনি তাদের মনে। লোকগুলো হাত পঁচিশ এগোবার পরই নেমে পড়লো কুয়াশা। অনুসরণ করতে হবে লোকগুলোকে। কুয়াশা স্পষ্ট দেখছে চাঁদের আলোয় খোদ রাজা হিরিরিরি এবং রাজকন্যা মিলতি রিব ও সাতজন মন্ত্রীকে। সংখ্যায় ওরা মোট ন’জন। কুয়াশার কোনো সন্দেহ রইলো না যে ওরা কামাল সংক্রান্ত খবর পেয়েই অমন উত্তেজিত ভাবে ছুটে যাচ্ছে।
পিছন পিছন নিঃশব্দ পায়ে সামান্য কিছুক্ষণ হাঁটতে হলো কুয়াশাকে। সব। পরিশ্রমের ফল পেয়ে গেল সে। রাজা দলবল নিয়েই হঠাৎ একটা লোহার রেলিং * দেয়া ঘরের পিছন দিকে থমকে উঁড়ালো। ব্যাপারটা দূর থেকে বুঝতে পারলো না
কুয়াশা। অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইলো সে দেয়ালের ছায়ায়। কিছুক্ষণ ধরে একটা ঝড় বইলো রাজা হিরিরিরি-র কণ্ঠ থেকে। আর কারও কথা শুনতে পেলো না কুয়াশা। অকস্মাৎ চমকে উঠলো’ সে। রাজা হিরিরিরি একটা গদা চেয়ে নিলেন একজন মন্ত্রীর হাত থেকে। তারপর কি যেন বললেন একবার চিৎকার করে। কোনো প্রত্যত্তর শোনা গেল না। তারপর ঝট করে ঘুরে ঘরটার সামনে থেকে সরে ৯-
=
গিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি দুপদাপ পায়ের শব্দ করে। দলবলও পিছু নিলো তার।
| দ্রুত পদক্ষেপে লোহার রেলিং দেয়া ঘরটার কাছে এসে পঁাড়ালো কুয়াশা। কামালকে বসে থাকতে দেখতে পেলো সে। কুয়াশাকে দেখে রেলিংয়ের সামনা সামনি এসে দাঁড়ালো কামাল।
‘এসেছো!’
সরে যাও কামাল এককোণে। মারণরশ্মি ব্যবহার না করলে হাত দিয়ে এতো মোটা রড বাঁকানো যাবে না।’
সরে গেল কামাল একদিকে।
রাজা হিরিরিরি এবং তার দলবল হিংস্র হয়ে উঠেছে। কামালের বিশ্বাসঘাতকতার সাজা দেবেন রাজা হিরিরিরি: এখুনি। ঘরের সামনের দিকে
পৌঁছুবার জন্যে রওনা হয়ে গেছেন তিনি। ঘরের একমাত্র দরজাটা ঐ দিকেই।
বন্দী দশা থেকে বের করে কামালকে বাইরে নিয়ে এলো কুয়াশা। তারপর এক তিল সময়ও নষ্ট না করে ছুটতে লাগলো।
পরিচিত রাস্তা। ছুটছে ওরা দু’জন। কিন্তু খবর ছড়িয়ে পড়েছে জংলীদের মধ্যে। বিশ্বাসঘাতক জামাতা ভেগেছে কয়েদখানা থেকে। হৈ হৈ করতে করতে ছুটে আসছে তারা। রামশিঙা ফোকার শব্দ আসছে কানে। চারদিক থেকে ছুটে আসছে জংলীরা ঢাল, গদা, তীর-ধনুক এবং বর্শা নিয়ে।
| কুয়াশা ভেবেছিল, জংলীরা কামালকে না পেয়ে প্রথমে এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করবে। তারপর হয়তো ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। চতুর্দিক থেকে ছুটে আসছে জংলীরা দ্রুত। ক্রমেই উচ্চকিত হয়ে উঠছে। হিংস্র চিৎকার। কিভাবে কে জানে বুঝতে পেরেছে ওরা কোন্দিকে ছুটলে দেখা পাওয়া যাবে শত্রুর।
| বাঁশের রাস্তা ছাড়িয়ে এলো ওরা। আরো কিছুক্ষণ দৌডুবার পর জঙ্গলে প্রবেশ করলো। এদিকে অন্যদিক থেকেও জংলীরা ছুটে আসছে পিছন পিছন। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। বাধ্য হয়ে কামালকেও দাঁড়াতে হলো।
জংলীরা এসে পড়েছে, কুয়াশা!’
উত্তর দিলো না কুয়াশা। পাশের কয়েকটি গাছ মারণরশির সাহায্যে রাস্তার উপর শুইয়ে দিলো। তারপর কামালের হাত ধরে সরে দাঁড়ালো একপাশে। তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে এসে পড়লো জংলীদের প্রথম দলটা। থমকে দাঁড়ালো তারা রাস্তার উপর প্রকাণ্ড কয়েকটা গাছকে শোয়ানো দেখে। কি কথা হলো ওদের মধ্যে কে জানে। অন্য একটা রাস্তা ধরে পুব দিকে চলে গেল ওরা দলে দলে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করতে করতে। চিৎকার শুনে মনে হলো, কোথায় যেন জ্বলে-পুড়ে খাক ১৩০
হয়ে যাচ্ছে ওদের।
দ্বিতীয় দলটিও মিনিটখানেক পর এসে পড়লো। তারাও কি মনে করে চলে গেল পুব দিকে।
| ‘চলো এবার।’ কামালকে কথাটা বলেই ছুটতে শুরু করলো কুয়াশা। বিশ মিনিট ধরে এক নাগাড়ে ছোটবার পর সেই বটল ট্রিগুলোর কাছে এসে পড়লো ওরা দুজন। থামলো না সেখানে। শহীদরা যেদিকে গেছে সেদিকেই ছুটে চললো প্রাণপণে। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলো ওরা হাজার হাজার জংলীর উন্মত্ত চিৎকার। পিছন থেকে নয়। এবার শোরগোলটা আসছে সামনের দিক থেকে। শহীদদের খোঁজ পেয়ে গেছে জংলীরা। ছুটে যাচ্ছে দলে দলে। শহীদরা কি পৌঁছুতে পেরেছে ‘সৈনিকে?
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো কুয়াশা। “কি ব্যাপার,’ ব্যস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো কামাল।
‘ঐ বড় গাছটায় ওঠো, কামাল, জলদি! শহীদরা “সৈনিকে গিয়ে পৌঁছেছে . কিনা জানতে হবে।’
কথা বললো না কামাল। তরতর করে উঠে পড়লো সে কুয়াশার নির্দেশিত গাছটার মগডালে।
‘হা! হা! ওরা সবাই উঠে পড়েছে “সৈনিকে”। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কিন্তু কিন্তু কুয়াশা, জংলীরা যে, ঘিরে ফেলেছে “সৈনিককে”! ছোট ছোট নৌকোয় ছেয়ে গেছে সৈনিকের চারপাশ!’
চিৎকার করে কথা কটি বললো কামাল দূরের দিকে তাকিয়ে। ‘জলদি নামো, কামাল। দেরি করো না। জলদি! জলদি
নামতে শুরু করলো কামাল। শহীদদের কথা ভেবে পেটের ভিতর হাত-পা গুটিয়ে যেতে চাইছে তার। পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে। সকাল বেলার শীতল বাতাসেও ঘামছে সে। শেষ পর্যন্ত ওরা কি জংলীদের হাতেই নিজেদেরকে সঁপে দেবে?
অধৈর্য হয়ে উঠেছে কুয়াশা। বার বার তাড়া দিচ্ছে সে কামালকে তাড়াহুড়ো করে গাছ থেকে নামার জন্যে। কিন্তু যতো তাড়াতাড়ি গাছে চড়েছিল কামাল ততো তাড়াতাড়ি নামতে পারছে না। শহীদদের ভাগ্যে কি ঘটবে বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে।
| গাছের অর্ধেকটা নেমেছে মাত্র কামাল। চিৎকার করে কুয়াশা বললো, লাফ দাও, কামাল! ধরে নেবো ঠিক আমি।’
চমকে তাকালো কামাল মুহূর্তের জন্যে কুয়াশার দিকে। তারপরই পনেরো বিশহাত উপর থেকে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে কুয়াশাকে লক্ষ্য করে।
কোলের উপর লফে নিলো কুয়াশা কামালকে। মাটিতে নামিয়ে দিলো সে
১৩১
তাকে সঙ্গে সঙ্গে। তারপর দিক পরিবর্তন করে ছুটলো সে দক্ষিণ পূর্ব দিকে। মুখে শুধু বললো, দৌড়োও আমার সাথে!
| অবাক হলো কামাল। কুয়াশা কি ভয় পেয়ে পালাতে চাইছে? দৌডুতে দৌড়তেই বললো সে, কিন্তু এ আমরা কোনদিকে ছুটছি কুয়াশা? শহীদরা তো উত্তর দিকে রয়েছে। আমরা যাচ্ছি উল্টোদিকে!’
কুয়াশা না থেমেই বললো, হ্যাঁ। দক্ষিণ দিকেই পালাতে হবে আমাদেরকে। কিন্তু, কেন! শহীদদেরকে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে চাইছো নাকি তুমি?’
ছুটতে ছুটতে মুখ টিপে হাসলো কুয়াশা। মুখে বললো, “আপনি বাঁচো তো বাপের নাম। নিজেদেরকে রক্ষা করা পবিত্র দায়িত্ব। সেটাই করি এসো।, কুয়াশার পরিষ্কার কথা শুনেও অর্থ উদ্ধার করতে পারলো না কামাল। কিন্তু তা
সত্ত্বেও ছুটতে লাগলো সে কুয়াশার পাশাপাশি। বিশ্বাস করে সে কুয়াশাকে। চেনে। ১ মিনিট দশেক লাগলো ওদের দক্ষিণ দিকের সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছুতে। কামালকে হতভম্ব করে দিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়াশা। ডুব সাঁতার দিয়ে দশ হাত দূরের একটা পাথরের সামনে গিয়ে মাথা তুললো সে। পাথরটার গায়ে রাখা ছিলো কুয়াশার অ্যাটাচি কেসটা। এই দ্বীপে এসে ওঠার আগেই সে ঐ পাথরটায় যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল তার অ্যাটাচি কেসটা।
এক হাতে যন্ত্রপাতি সমেত ভারি অ্যাটাচি কেসটা উঁচিয়ে ধরে রেখে তীরে ফিরে এলো কুয়াশা। দ্রুত হাতে খুলে ফেললো সে অ্যাটাচি-কেস। টেলিভিশনের সুইচ টিপে দেবার আগে খট খট করে কয়েকটা সুইচ টিপলো সে। তারপর টেলিভিশনের পর্দায় ছবি ফুটে ওঠারঅপেক্ষায় একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
দুই
পিছনে তাড়া করে ছুটে আসছে জংলীরা।
. শহীদ, মি. সিম্পসন, মহুয়া ও গফুর প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছুলো। খুব বেশুি পিছনে নেই জংলীর দল। কিন্তু শহীদরাও সৈনিকের কাছে পৌঁছে গেছে। এতটুকু দ্বিধা না করে সর্বপ্রথম পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মি. সিম্পসন। গফুর তার দেখাদেখি ঝাঁপ দিলো। শহীদ মহুয়ার হাত ধরে নামলো
পানিতে।
শহীদ ও মহুয়া খানিকদূর যেতে যেতেই মি. সিম্পসন পৌঁছে গেলেন সৈনিকের কাছে। দড়ির সিঁড়ি ধরে ভেসে রইলেন তিনি। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুরে তাকিয়ে গফুরের উদ্দেশ্যে একটা হাত বাড়িয়ে ধরলেন তখুনি। গফুর মি. সিম্পসনের হাত ধরে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে হাঁপাতে লাগলো সশব্দে।
১৩২
‘উঠে পড়ুন আপনারা! দেরি করছেন কেন?’ মহুয়াকে নিয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বললো শহীদ মি, সিম্পসনের উদ্দেশ্যে। সৈনিকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা।
মি, সিম্পসন ও গফুর দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ডেকের উপরে। শহীদ ও মহুয়াও উঠতে শুরু করলো। এদিকে জংলীরা এসে পড়েছে কাছে। তীর ছুড়ছে। তারা। | নিরাপদেই সবাই উঠলো সৈনিকে। উঠেই শুয়ে পড়লো ডেকের উপর। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সকলেই হাঁপাচ্ছে হাপরের মতো। কথা বলবার শক্তিও কারও নেই যেন। | ঠকাঠক শব্দ হচ্ছে সৈনিকের গায়ে বর্শা লাগার। মাঝে মাঝে এক আধটা বর্শা এসে বিঁধছে ডেকের উপর। ওরা বুঝলো ভয়ঙ্কর একটা সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। ডেকের এপাশে মরার মতো এভাবে পড়ে থাকলে।
‘গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে সরে যেতে হবে সবাইকে। রেলিঙের ঐ কোণে গেলে। নিরাপদ হওয়া যায় কিছুটা।’ জংলীদের চিৎকারে কান পাতা দায়। কথাটা চিৎকার করে কয়েকবার বললো শহীদ সকলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কারও কানে ঢুকলো না তার কথা। বুঝতে পেরে শহীদ নিজেই গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে সরে যেতে লাগলো। তার দেখাদেখি অন্যেরাও চলে এলো এক কোণে।
কোণের দিকে এসেই সন্দেহটা জাগলো শহীদের মনে। চারপাশ থেকে হৈ হল্লার শব্দ আসছে কেন? ‘ জংলীরা তো তীরে ট্ৰাড়িয়ে আছে। ৰা কেউ কেউ পানিতে নেমে পড়েছে। কিন্তু চতুর্দিক থেকে চিৎকারের শব্দ হবে কেন তাহলে?
‘ ব্যাপারটা মি. সিম্পসনও টের পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতে চাইলেন ডেকের উপর। রহস্যটা কি দেখতে হবে।
মি. সিম্পসনকে বাধা দিলো শহীদ, ‘উঠবেন না, আমাকে দেখতে দিন ব্যাপারটা কি!’
| হামাগুড়ি দিয়ে বসলো শহীদ। তারপর পা দুটো ভাঁজ করে আধা দাঁড়ানো অবস্থায় তীরের দিকে তাকালো। সমুদ্রে জংলীরা নেমেছে কিনা দেখতে পেলো না সে। তীরের উপর দেখা গেল শত শত জংলী দাঁড়িয়ে আছে। বসে নেই তারা। তীর হুঁড়ছে, বর্শা মারছে সৈনিককে লক্ষ্য করে। পিছন ফিরে তাকালো এবার শহীদ। চমকে উঠলো। হায় হায় করে উঠলো তার অন্তরাত্মা। শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না। প্রাণ যাবেই এযাত্রা। কোনো উপায় নেই হিংস্র এই জংলীদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচবার।
শহীদ দেখলো, সমুদ্রের এমন একটা দিকে সৈনিক নোঙর করা যে তার চারপাশে ছোটখাট অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে। সম্ভবত রাজা হিরিরিরি কোনো সঙ্কেত
১৩৩
ব্যবহার করে ঐ দ্বীপগুলোর জংলীদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছেন বিদেশী শত্রুদেরকে ঘায়েল করার জন্যে। ঐসব জংলীদের সাজ-পোশাক এবং অস্ত্রাদি অন্য রকম দেখেই এ ধারণা হলো শহীদের। | বড় জোর আর তিন মিনিট বেঁচে আছি আমরা। ভাবলো শহীদ। ছোট ছোট দ্বীপগুলো থেকে শত শত নৌকোয় চড়ে জংলীরা ঘিরে ফেলেছে সৈনিককে। খানিকটা দূরে আছে এখনও ওরা। কিন্তু বড় জোর তিন মিনিট লাগবে ওদের সৈনিকের কাছে এসে পৌঁছুতে।
| শুয়ে পড়লো আবার শহীদ। একে একে তাকালো সে মহুয়া, মি. সিম্পসন ও গফুরের দিকে। মোচড় দিয়ে উঠলো তার বুকটা। কি করা যায়, কি করা যায়, কি করা যায়! দ্রুত চিন্তা করতে চেষ্টা করলো শহীদ। প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে নিজেকে স্থির রাখবার। আবার তাকালো সে সকলের মুখের দিকে। হাঁপাচ্ছে ওরা
এখনও ক্লান্তিতে জানে না, আর মাত্র দু’মিনিট পরই ওদের মৃত্যু ঘটবে।
গোলাগুলি ছুঁড়ে কোনো লাভই হবে না। এক্ষেত্রে। তাছাড়া জংলীদের কাছেই রয়ে গেছে সব অস্ত্রাদি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যেতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো শহীদ। কথাটা এতক্ষণ মনে আসেনি বলে আশ্চর্য হলো সে। ভাবলো, এতোটা দিশেহারা হয়ে পড়া উচিত হয়নি তার– ছিঃ ছিঃ!
তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটলো শহীদ ডেক ধরে তিনতলার সিঁড়িটার দিকে। উঠে পঁাঁড়াতে শোঁ শোঁ করে কয়েকটা তীর চলে গেল শহীদের মাথার ইঞ্চিখানেক উপর দিয়ে। সাবধান হবার কথা মনে হলো না শহীদের। মরিয়া হয়ে ছুটলো সে তিনতলার দিকে।
নিরাপদেই সৈনিকের তিনতলায় উঠলো শহীদ। একটি মাত্র কেবিন উপরে। কেবিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শহীদ দেখলো একটা লৌহমানব বিরাট বড় একটা যন্ত্রের হাতল ঘোরাচ্ছে বন বন করে। এই হাতলটার কথা মনে পড়ে যেতেই ছুটে এসেছিল শহীদ।
এদিকে শহীদ তিনতলার সিঁড়ির দিকে চলে যেতেই মি. সিম্পসন সচেতন হয়ে পড়লেন। কাউকে কিছু না বলে অমন করে ছুটলো কেন শহীদ? উঁকি মেরে সৈনিকের আশপাশে ভয়ঙ্কর কিছু দেখেছে নাকি সে? কথাটা মনে জাগতেই ডেকের উপর উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে রেলিঙের সামনে চলে এলেন।
শর্ষে ফুল ফুটলো মি. সিম্পসনের চোখের সামনে। সৈনিকের চারপাশের গা বেয়ে জংলীরা উপরে উঠে আসছে।
স্বচ্ছ একটা আবরণ পড়লো মি. সিম্পসনের চোখের সামনে। আর ঠিক তখুনি তার কপাল বরাবর ছুটে এলো একটি তীর। ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠতে গেলেন মি. সিম্পসন। পিছিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে কয়েক পা। ১৩৪
আর কুনো চিন্টা নেই!’ | লৌহমানবের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল এমন সময়। পিছন ফিরে তাকালেন মি. সিম্পসন। দেখলেন হাতে একটা ট্রে নিয়ে মহুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লৌহমানব। নানারকম টিনের খাবার সাজানো রয়েছে ট্রের ওপর। মাংস, ডিম, হরলিকস। সৈনিক ডুবে গেলেও এয়ার-টাইট টিনের খাবারগুলো যেমন ছিলো ঠিক তেমনই আছে।
মি. সিম্পসনের কপালে জংলীদের ছোঁড়া তীরটা লাগেনি। যন্ত্রের হাতল ঘুরিয়ে প্রাস্টিকের স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে সৈনিকে। তীরটা এসে তাতেই ঠক করে লেগে ছিটকে পানিতে গিয়ে পড়েছে।
মহুয়া ও গফুরও জানে প্লাস্টিকের আবরণটা আনব্রেকে বল্। ডেকের উপর উঠে বসলো ওরা। মহুয়া লৌহমানবের হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিলো। শহীদ ফিরে এলো এতক্ষণে। সকলে যে যার কেবিনে চলে গেল কয়েক মিনিটের জন্যে। মুখ হাত ধুয়ে ফিরে এলো ওরা আবার।
এবার ডেকের উপর পাতা চেয়ারগুলোয় আরাম করে বসলো সবাই। মহুয়া একে একে প্রত্যেকের প্লেটে সাজিয়ে দিলো মাংস ও ডিম। এক কাপ করে হরলিকসও নিলো সবাই। কিন্তু গফুর রেলিঙের ধারে ছুটে গেল হঠাৎ। পাস্টিকের
অপর দিকে একজন জংলীর হাত দেখা যাচ্ছে। জংলীটা প্লাস্টিকের উপর উঠে। আসার চেষ্টা করছে প্রাণপণে।
| রেলিঙের ধারে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো গফুর। খানিকবাদেই উঠে পড়লো জংলীটা। মুখটা দেখা যাচ্ছে তার। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সৈনিকের ভিতরে। গফুরকে দেখতে পেয়ে মুখ ভেংচাবার কথা ভুলে গেল সে। উল্টো গফুর হরলিকসের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসিখুশি ভঙ্গিতে অনুরোধ করতে লাগলো জংলীটাকে তার সামান্য উপহার গ্রহণ করতে। জংলীটা বোবার মতো তাকিয়ে রইলো।
দেখতে দেখতে আরো কয়েকজন জংলী উঠে এলো পাস্টিকের উপর। যে-ই উঠছে হতভম্ব হয়ে পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে। দু’একজন অবশ্যি অতটা ঘাবড়াল না। বর্শার খোঁচা দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো তারা প্লাস্টিকটা ভেদ করে ভিতরে ঢোকার।
গফুর একবার এ জংলীকে হরলিকস খাবার জন্যে সাধে, সে রাজি না হলে অন্য একজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপার দেখে মি. সিম্পসনও উঠে এলেন রেলিংয়ের ধারে। তিনিও মজা করবেন মনে হচ্ছে।
আর ঠিক তখুনি দুলে উঠলো সৈনিক। টাল সামলে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা দুজন। ব্যাপারটা বুঝতে পারলো শহীদ। কিন্তু মহুয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভীত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘এ কি!’ ‘
১৩৫
‘কিছু নয়। কুয়াশার কৌশল এটা। সৈনিককে পরিচালিত করছে সে কোথাও থেকে।’
. নিশ্চিন্তে আবার বসলো মহুয়া’। শহীদ আবার বললো, কামালকে সম্ভবত উদ্ধার করতে পেরেছে কুয়াশা।’
ডুবে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কুয়াশার ক্ষুদ্রাকৃতি সাবমেরিন। জংলীগুলো প্লাস্টিকের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লো পানিতে। ঠিক এই সময় যদি কেউ পানির উপরে থাকতো, তাহলে সে দেখতে পেতো হাজার হাজার অসভ্য জংলী হতবাক হয়ে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে ওরা বিমূঢ় দৃষ্টিতে। শত্রুরা যে এভাবেও ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারে তা চাক্ষুষ করেও ভাবছিল তারা এটা অবিশ্বাস্য!
সাত মিনিট পর।
প্রত্যেকে এক কাপ হরলিকস হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে। ডেকেই বসে আছে ওরা।
| কারো মুখে কথা নেই। সকলেই আত্মস্থ হয়ে আছে। গত কয়েকদিনে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ওরা সকলেই। জীবনের আশা কি করেছিল কেউ?
জীবনের আশা করেনি একথা বললে ভুল হবে। অসাধারণ ক্ষমতা আছে এদের মধ্যে। ভয় পায়, দুর্বলতা জাগে, দুশ্চিন্তা করে। কিন্তু বিপদ মাথায় নিয়ে ওরা সংগ্রামও করতে পারে! আঁপিয়ে পড়তে পারে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে। লড়তে পারে হাঙ্গর এবং অক্টোপাসের সঙ্গে। নিজেদের দল রক্ষা করতে কঠিন পরিশ্রমেও কিছু হয় না। নিজের জীবন তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে পারে সঙ্গী সাথীকে বিপদ থেকে যেমন করে তোক বাঁচাতে।
অসমসাহসী এই বীরের দল ঘটনার নিষ্ঠুরতা দেখে ভীত হয়েছিল বৈকি। কিন্তু দমেনি ওরা। সংগ্রাম করেছে। বুদ্ধি খাঁটিয়েছে। উপযুক্ত ফলও পেয়েছে তার ফলে। ওদের মুক্তি ওদেরকে চেষ্টা করেই অর্জন করতে হয়েছে। সে কৃতিত্ব ওদেরই।
ভেসে উঠলো সৈনিক।। ‘ঐ তো কামাল! শহীদ হাসলো। মহুয়া বললো, ‘দাদা!
কুয়াশা এবং কামাল পানিতে নেমে এগিয়ে আসছে সৈনিকের দিকে। দশ হাত দূরে ভেসে উঠেছে সৈনিক। * ক্লান্তিত্নে শরীর কাহিল। ঘুম হয়নি গত আটচল্লিশ ঘণ্টা কারও। তবু স্বর্ণের উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে ওদের সকলের মুখে। আবার একত্রিত হয়েছে ওরা। মনে পড়ছে এখন সকলের সেই কথাটা। রাতে : অন্ধকারে মত্ত-মাতাল সমুদ্রে লাফিয়ে
পড়েছিল ওরা। তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল একজন অন্যজনের কাছ থেকে। আবার সকলে একত্রিত হতে পারবে ওরা কেউ ভাবেনি। দিবাস্বপ্ন বলেই তো মনে হয়েছিল কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত।
আবার ফিরে পেয়েছে ওরা নিজেদেরকে। যার যার প্রতি মতো কাজ করছে। ওরা। ইতিমধ্যেই গফুর দু’বার গম্ভীর কণ্ঠে বলেছে, ‘যাও দাদামণি, ঘুমিয়ে নাও এবার একটু। না হলে মারা পড়বে। শরীরের উপর দিয়ে গত দুদিন ধরে ধকল তো কম যায়নি!
উট মারছেন মি. সিম্পসন সুযোগ পেলেই, ‘জংলীগুলোকে নাকানিচোবানি খাইয়েছি খুব। মনে রাখবে ব্যাটারা বহুদিন।
| হাসছে মহুয়া সকলের দিকে তাকিয়ে। চোখে আবার ফিরে এসেছে উজ্জ্বল দীপ্তি। শহীদ ও কুয়াশা দীপ্ত চোখে তাকাচ্ছে পরস্পরের দিকে। কথা নেই ওদের মুখে। নিঃশব্দে উপভোগ করছে ওরা মহান একটা জয়গানের সুর মন ভরে। মুক্তির আবেগে স্থির-অচঞ্চল ওদের দৃষ্টি পরস্পরের দিকে। কামাল সকলের দিকে তাকাচ্ছে। আর মাঝে মাঝেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘রাজা হিরিরিরি একমাত্র আমাকেই পছন্দ করেছিলেন রাজ-জামাতা হিসেবে একথা তোমরা কিন্তু কেউ ভুলে যেয়ো না। আমার মধ্যে কিছু একটা গুণ আছে বৈকি, তা না হলে বুঝতেই পারছো! আর খাওয়া দাওয়ার কি ঘটা…!’
| গফুর হাসছে। মহুয়া হাসছে। কুয়াশা এবং শহীদও হাসছে এক একবার তার কথা শুনে। মি. সিম্পসনও বাদ যাননি।
“ এমন সময় হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। রিস্টওয়াচের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতে তাকাতে চেয়ার ছাড়লো সে।
মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কি হলো কুয়াশা?’, সিগন্যাল পাঠাচ্ছে কেউ। আচ্ছা, দেখে আসি আমি ব্যাপারটা।’
ডেক থেকে চলে গেল কুয়াশা কন্ট্রোলরুমের দিকে। ফিরে এলো সে মিনিট দুয়েক পরই। মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না শহীদ। প্রশ্ন করার আগেই কুয়াশা বললো, একটা সুখবর আছে। শত্রুপক্ষের সাবমেরিনের কথা নিশ্চয় কেউ ভুলে যায়নি–যেটা থেকে টর্পেডো মেরে সৈনিকের তলা ফুটো করে দেয়া .. হয়েছিল।’
কি হয়েছে তার?’ জানতে চাইলো কামাল।
কুয়া হাসতে হাসতে বললো, হয়নি এখনও, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হবে। স্থায়ী নরকবাস হবে ওদের।’
ব্যাপারটা এরপর ব্যাখ্যা করলো কুয়াশা। শত্রুপক্ষের ঐ সাবমেরিন থেকে কাছেপিঠের জলযানগুলোতে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে এই বলে যে, আমাদের সাবমেরিনের দুটো এঞ্জিনই ফেল মেরেছে। পানির উপর ভেসে উঠতে বাধ্য হয়েছি।
১৩৭
আমরা। কেউ আমাদেরকে উদ্ধার না করলে না খেতে পেয়ে মারা যাবো–প্লীজ হেলপ আস।
. একটু থেমে কুয়াশা বললো, না খেতে পেয়ে তিলে তিলে মরার আশঙ্কা মিছে ওদের। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই নরকে পৌঁছে যাবে ওরা।
‘কোনদিকে ভেসে উঠেছে সাবমেরিনটা?’ শহীদ প্রশ্ন করলো।
‘তোমরা যেখানে সৈনিককে নোঙর করা দেখেছিলে তার কাছেই। তবে আরো গভীর সমুদ্রে।
মি. সিম্পসন লাফিয়ে উঠলেন এতক্ষণে। বললেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের মৃত্যু ঘটবে! তার মানে আমরা ওদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিশোধ নেবো আক্রমণ করে–তাই না, কুয়াশা?’
হো হো করে হেসে উঠলো কুয়াশা। বললো, ‘না। তা আমরা করতে পারি না। আর করার দরকার হবে না।’
‘কেন!’ কামাল প্রশ্ন করলো।
‘আমরা কেন শুধু শুধু আক্রমণ করবো? আমরা আক্রমণ না করলেও তো ওরা শাস্তি পাবে।’
কিন্তু, কিভাবে?’
মি. সিম্পসনের এই প্রশ্নের উত্তর দিলো শহীদ। মাথা নিচু করে গভীর ভাবে কি যেন দেখছিল সে নেভিগেশন সংক্রান্ত একগাদা কাগজ-পত্র নিয়ে। মুখ তুলে মি. সিম্পসনের উদ্দেশে সে বললো, ব্যস্ত হবেন না, মি. সিম্পসন। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন সব।
শহীদ কুয়াশার দিকে তাকালো এবার। বললো, আর দেরি কেন, সৈনিক যাত্রা আরম্ভ করতে পারে এখন। একটা কথা, সৈনিক যেদিক থেকে এসেছে সেদিক দিয়েই মাঝসমুদ্রে পৌঁছায় যেন।
* তারমানে! কামাল প্রশ্ন করলো।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘ওদিকেই তো সাবমেরিনটা আছে। তারমানে তুমি বলতে চাও ওদেরকে আমরা সাহায্য করবো?’
মাথা নেড়ে হেসে ফেললো শহীদ। বললো, না, তা নয়।’
তবে কি ওদেরকে আক্রমণ করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি?’ কুয়াশা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো।
শহীদ বললো, ‘না না। আসলে পেরুতে যাবার জন্যে ঐ দিক দিয়েই যেতে হবে আমাদেরকে।
বুঝেছি, শহীদ। চলে গেল কুয়াশা কন্ট্রোলরুমের দিকে।
চলতে শুরু করলো সৈনিক একটু পরই। ১৩৮
দু’মিনিটেই আশি মাইল স্পীড উঠলো সৈনিকের। তুফানের মতো এগিয়ে চললো। সে বিজয় কেতন উড়িয়ে জল কেটে কেটে। | সাবমেরিনটাকে সামান্য সময়ের জন্যে দেখতে পেলো ওরা। শহীদ এবং কুয়াশা আগে থেকে অনুমান করেছিল একটা ব্যাপার। মি. সিম্পসন ও কামাল ধরতে পারেনি ব্যাপারটা।
. ভাসছে সাবমেরিনটা মাঝ দরিয়ায়। পিঠটা দেখা যাচ্ছে তার। অসংখ্য মাছির মতো জংলী উঠে পড়েছে তার উপর। বর্শা দিয়ে খোঁচাচ্ছে তারা সাবমেরিটাকে। ইতিমধ্যেই অনেকটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে কাজে। আর বড় জোর পাঁচ মিনিট। ঢুকে পড়বে ওরা সাবমেরিনের ভিতর দলে দলে। | নিরুপায় দাঁড়িয়ে আছে সাবমেরিনটা। সেটার গায়ে নৌকো ঠেকিয়ে ঘিরে ফেলেছে জংলীরা চতুর্দিক থেকে। বর্শার ঘা বসাচ্ছে হরদম।
রসগোল্লার টুকরো একটা অংশের উপর লাখ খানেক পিঁপড়ে চড়লে যেমন মনে হয় সাবমেরিনটা এবং হিংস্র জংলীগুলোকে দেখে তাই মনে হলো শহীদের।
‘ওদের জন্যেই আমরা প্রাণ হারাতে বসেছিলাম,’ মি. সিম্পসন বললেন। কামাল বললো, এখন কেমন মজা, টের পাচ্ছে ব্যাটারা।’
শহীদ কিছু বললো না। পাশ কাটিয়ে দ্রুত পেরিয়ে গেল সৈনিক সাবমেরিনটাকে। কুয়াশা বললো, ওরা আমাদের বিপদে ফেলে দেরি করিয়ে দিয়েছে। পেরুতে পৌঁছে যদি দেখি বৈজ্ঞানিক Kotze-এর, যে সর্বনাশ ঘটবার
আশঙ্কা আছে তা ঘটে গেছে তাহলে দুঃখের সীমা থাকবে না আমাদের।’
একটু থেমে পিছন ফিরে দূরবর্তী সাবমেরিনটার দিকে তাকিয়ে আবার কুয়াশা বললো, “ওদেরকে আমরা অনায়াসে জংলীদের কবল থেকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু…’’
শহীদ বললো, কিন্তু ওরা নিজেরাই সে পথ বন্ধ করে রেখেছে।’
তিন
জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর বজ্রপাত ঘটালো কানের পাশে, হ্যাঁণ্ডস আপ-অল অভ ইউ— হ্যাঁণ্ডস আপ!’
| দড়ির সিঁড়ি বেয়ে সৈনিক থেকে নামছিল কুয়াশা। স্থির হয়ে গেল সে। শহীদ ধীরে ধীরে হাত থেকে অ্যাটাচি কেসটা ডেকের উপর রেখে হাত তুললো মাথার উপর।
কানের পর্দায় আঘাত করলো তীক্ষ্ণ অপর একটি কণ্ঠ। ডানপাশ থেকে এলো শব্দটা, সাবধান। কোনো চালাকি চাই না!’
পকেটের পাশে ডান হাতটা স্থির হয়ে রয়েছে মি. সিম্পসনের। মানা করলো। কুয়াশা চোখের ইঙ্গিতে। মি. সিম্পসন নিরুপায় হয়ে হাত দুটো তুললেন মাথার উপর। কামাল অলস ভঙ্গিতে চুলহীন মাথাটা দু’হাত দিয়ে ঢাকলো। মহুয়া এবং গফুর মাথার উপর হাত তুলেছে সবার আগে।
ধীরে ধীরে চারপাশটা দেখে নিলো কুয়াশা। মোট কুড়িজন। পিছনে পাঁচজন। একটু ডান দিক ঘেঁষে একটা উঁচু পাথরের উপর সাতজন। বাম দিকে চারজন। লোকগুলো জার্মান। প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান। পিস্তল রয়েছে কেবল একজনের হাতে। দলপতি বোধহয় ঐ লোকটিই। সে-ই হুকুম জারি করেছে প্রথম।
| এবারও সেই লোকটি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাদের মধ্যে “কুয়াশা কে?’
অস্বাভাবিক বেঁটে লোকটার দিকে তাকালো কুয়াশা। পাথরে খোদাই করা মুখ। যেন। শত শত বর্ষের রোদ বৃষ্টি সয়ে সয়ে তামাটে হয়ে গেছে গায়ের রঙ। কুতকুঁতে ছোট্ট দুটো চোখ। ফিকফিক হাসছে। বেটপ পটলের মতো নাকটা বারবার কুঁচকে উঠছে লোকটার। তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে আর সবাই। কুয়াশাদের দিকে।
| তুমি? তুমিই তাহলে দুর্ভাগা কুয়াশা?’
কথা বললো না কুয়াশা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে লোকটির চোখের মণিতে। চোখ ঘুরিয়ে নিলো লোকটি। বুঝতে পেরেছে সে ব্যাপারটা। কুয়াশা হিপনোটিজমের সাহায্য নিয়ে দাবার চাল পাল্টে দিতে চাইছে।
নেমে এসো হে! জলদি জলদি নেমে এসো তুমি। অস্বস্তিকর গলায় বললো লোকটি অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে।
শহীদ অ্যাটাচি কেসটার দিকে তাকালো চোখ নামিয়ে। লৌহমানব দুটো কন্ট্রোল রুমে আছে। কিন্তু অ্যাটাচি কেসটা হাতে তুলতে না পারলে তাদেরকে কোনো কাজেই লাগানো যাবে না। লেসারগানটা আছে কুয়াশার কেবিনে। শেষ উপায়, সৈনিককে যদি পানির নিচে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সে-ও অসম্ভ।.পানি এখানে খুব বেশি নেই। সৈনিক সম্পূর্ণ ডুববে না এই পানিতে। না, ধরা পড়ে গেছে ওরা! তীরে ভিড়েই তরী ডুবলো বুঝি।
‘ওয়ান, টু। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো কুয়াশা। ‘গুড বয়!”
দশ পর্যন্ত গুনে গুলি চালাৰে স্থির করেছিল লোকটি। কুয়াশাকে নেমে আসতে দেখে হাসলো সে।
কুয়াশা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে চাপা স্বরে শহীদকে বললো, ‘এরা সম্ভবত আমাকেই ধরে নিয়ে যাবে। যদি তাই হয় তবে ভালোই। তোমরা কিন্তু আমার।
১৪০
জন্যে অপেক্ষা করো না। চলে যেও বৈজ্ঞানিকের ঠিকানায়। নো ম্যানস ল্যাণ্ড!
কথা বলতে পারলো না শহীদ। হতভম্ব হয়ে পড়েছে সবাই এই বিপদের মুখে পড়ে। পেরুর সমুদ্রতীরে পৌঁছে গেছে তারা। সৈনিককে ডুবিয়ে দিয়ে সদলবলে টাকনা শহরে যাবার কথা তাদের। সেখান থেকে বিমানে নিউ সাজামোতে পৌঁছুবে। তীরে সকলকে নামিয়ে দেবার জন্যেই সৈনিক এখানে এসে থেমেছিল। চারপাশে অসংখ্য পাথরের খণ্ড। পানির গভীরতাও খুব কম। অতি ধীরে ধীরে সৈনিক তীরের কাছ বরাবর এসে থেমেছিল। সকলে নেমে যাবার পর লৌহমানব দুটোকে দিয়ে মালপত্র নামাবার ব্যবস্থা করা হবে। প্রথমে নামছিল কুয়াশা। জায়গাটা ভালো করে দেখে নিতে চেয়েছিল সে। টাকনাতে যাবার রাস্তাটা কোথায় আছে সেটা জানার প্রয়োজন ছিলো। শহীদরা সকলে প্রস্তুত হচ্ছিলো নামার জন্যে। রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পার্বত্য এলাকাটা জরিপ করছিল তারা। ঠিক এমন সময় সামনে-পিছনে এবং দু’পাশের পাথরের আড়াল থেকে স্টেনগান নিয়ে বের হয়ে এলো লোকগুলো। অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেছে
ওরা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হারিয়ে গেছে লাল সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে। নেমে এলো কুয়াশা সৈনিক থেকে গম্ভীর থমথমে মুখে। তিনজন লোক এগিয়ে এসে তিন দিক। থেকে ঘিরে ফেললো কুয়াশাকে। সার্চ করলো তন্ন তন্ন করে। পেলো না কিছু।
‘তোমার দলবলকে রেহাই দিলাম। ওদেরকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না আমরা। মাথাটাকেই ধরে নিয়ে যাবার আদেশ পালন করবো আমরা।’
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো বেঁটে জার্মানটা। ঝটপট বেঁধে ফেলা হলো কুয়াশাকে। লোকগুলো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে উঠলো। তীরের দিকে আসছে ওরা। পানিতে নেমেও স্টেনগানের মুখ স্থির রেখেছে সৈনিকের দিকে।
একজোট হলো লোকগুলো। যন্ত্র চালিতের মতো ঘুরে দাঁড়ালো। দুজন শুধু শহীদের দিকে তাকিয়ে পিছু হটে দলের সঙ্গে এগোতে লাগলো।
| মিনিট খানেকের ব্যাপার। অদৃশ্য হয়ে গেল দলটা। কুয়াশাকে নিয়ে লোকগুলো চোখের আড়ালে চলে যেতে কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদরা। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে ওরা পাহাড়ের বাঁধটার দিকে। ওদিকেই নিয়ে গেছে কুয়াশাকে।
সংবিৎ ফিরে পেতেই অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিলো শহীদ। খুলে ফেললো সেটার ডালা। সুইচ টিপলো দ্রুত। কিন্তু লৌহমানব ডেকে এসে পৌঁছুবার আগেই শব্দ পাওয়া গেল পাহাড়ের আড়াল থেকে–ঘোড়র পায়ের শব্দ। কুয়াশাকে নিয়ে চলে গেল শত্রুরা নাগালের বাইরে।
১৪)
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন মি. সিম্পসন। শহীদের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি, ‘কোনো লাভ নেই শহীদ! আর কিছু করার নেই আমাদের।’
‘আমরা বৈজ্ঞানিক Kotze-কে সাহায্য করতে এগিয়ে যাবোই!
কঠিন প্রতিজ্ঞা শহীদের বজ্রকঠিন কণ্ঠে, কুয়াশার কথা রাখতে হবে আমাদেরকে।
রুক্ষ ভূমি। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। সন্ধ্যার ছায়া নামছে গাঢ় হয়ে। পাহাড়ের গহুর, খাজ, বাঁক দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে কোনো কোনো জায়গায়। পিছনে পাহাড়ের এবড়োখেবড়ো আকুতি। দু’পাশেও তাই। সামনে উঁচু নিচু রুক্ষভূমি। চড়াই। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে বিরাট বিরাট পাহাড়ের প্রাচীর। ছুটছে লোকগুলো কুয়াশাকে নিয়ে।
তারা ফুটছে একটি একটি করে। অন্ধকারের গাঢ় কালিমা দূর হয়ে গিয়ে মায়াময় স্বপ্নের মহিমা নিয়ে ফুটে উঠলো কুয়াশার চোখের সামনে টাকার পার্বত্য এলাকা। কি সুন্দর!
মৃদুমন্দ সমীরণ বয়ে যাচ্ছে। মিটমিট করে কি যেন গোপন ভাবের ইঙ্গিত জানাচ্ছে শত-সহস্র নক্ষত্র। চাঁদ উঠবে আর একটু পর। ঘোড়ার খুরের শব্দও সৃষ্টি করেছে অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ। অত সুরে একটি গান গাইছে যেন এই পাহাড়ের প্রতিটি বাঁক, খাজ ও প্রাচীর। তাল দিচ্ছে ঘোড়ার পদশব্দ। সহস্র-কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রগুলোও যোগ দিয়েছে এই স্বপ্নিল উৎসবে। উদাস করে তুলছে মন। কার কথা যেন মনের অবচেতন কোণ থেকে উঁকি মারতে চাইছে। অবশ হয়ে যেতে চায় কুয়াশার মন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই বিচিত্র রূপ দেখে। তা সত্ত্বেও কোথায় যেন একটি করুণ অভাব বোধ জাগে। কি যেন নেই তার। কি যেন সে পায়নি। তার জীবনে কিসের যেন অভাব রয়েছে একটা। | চাঁদ উঠলো আর একটু পরই। একুশটা ঘোড়া একুশজন মানুষকে নিয়ে টগবগিয়ে ছুটে চলেছে। ঘণ্টাখানেক ছুটেই দাঁড়িয়ে পড়লো ঘোড়াগুলো ঐ পাহাড়ের একটা গুহার সামনে। মশাল জ্বলছে গুহার ভিতর। ঘোড়াগুলো থমকে দাঁড়াতেই গুহার ভিতর থেকে বের হয়ে এলো একটি অস্বাভাবিক লোক। যেমনি লম্বা লোকটি, তেমনি শক্ত সমর্থ চেহারা। জ্বলন্ত মশাল নিয়ে বের হয়ে এসেছে লোকটা। সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো কুয়াশা লোকটির দিকে। মশালের লালচে আভায় অদ্ভুত দেখাচ্ছে লোকটিকে। বলিষ্ঠ একটা ব্যক্তিত্ব আছে লোকটির অবয়বে। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, রুমাল দিয়ে মাথার লম্বা চুল বাঁধার
. য়দ এবং রোদে পোড়া তামাটে রং দেখে লোকটিকে সাধারণ একজন বলা ম ম্ভব। | বেঁটে মতো-জার্মানটি কি যেন বললো স্থানীয় ভাষায়। ধীরে ধীরে উত্তর দিলো
৪২
সে। বেঁটে লোকটি আবার কিছু বলতেই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো কুয়াশার দিকে। | ঘোড়া থেকে নেমে চলে গেল লোকগুলো গুহার ভিতর। কুয়াশা এবং লোকটি রইলো শুধু। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে লোকটি কুয়াশার দিকে। হঠাৎ কুয়াশার উদ্দেশ্যে চোখ টিপলো লোকটি। আশ্চর্য হলো কুয়াশা। কি বলতে চায় লোকটি তাকে? কি ইঙ্গিত করলো?
কথা বলা সম্ভব হলো না দুর্ভাগ্যক্রমে। গুহা থেকে বের হয়ে এলো সেই বেঁটে জার্মানটা। ঝটপট, কুয়াশার পিছনে চলে এলো লোকটি।
দু’হাত পিছনে রেখে বাঁধা হয়েছে কুয়াশাকে। পিছন দিক থেকে দু’হাতে ধরে নামিয়ে আনলো লোকটি কুয়াশাকে। লোকটির শক্তি দেখে বিস্মিত হলো কুয়াশা। ভাবলো কে এই লোকটি? এ তো জার্মান নয়। তবে এদের দলে জুটলো কিভাবে? তাছাড়া গোপন ইঙ্গিতই বা করলো কেন সে তাকে? লোকটি কি তবে বৈজ্ঞানিক Kotze-এর লোক?
ব্যাপারটা জানা গেল না। রহস্যই রয়ে গেল সবটা ব্যাপার। গুহার মধ্যে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়া হলো কুয়াশাকে। এবার তাকে আরও শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। পা জোড়া মুক্ত ছিলো, এবার তাও বাঁধা হলো।
জার্মানরা পেটুক হয় তা জানতো কুয়াশা। কিন্তু এতোটা আশা করেনি সে। দল বেঁধে বসে হাসি মস্করা করতে করতে ঘণ্টাখানেক ধরে খাওয়া-দাওয়া সারলো ওরা। এতোই অতিরিক্ত হয়ে গেল ওদের প্রত্যেকের খাওয়া যে নড়তে চড়তে পারছে না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গুহার মধ্যে শুয়ে পড়লো ওরা যে যার বিছানায়। কুয়াশার কথা যেন ভুলেই গেছে।
স্থানীয় সেই লোকটি তখনও শুতে যায়নি। সে এলো কুয়াশার বাঁধনটা পরীক্ষা করতে। বাঁধন পরীক্ষা করার সময় আরও একটা গোপন কাজ করলো লোকটা। মিনিটখানেকের মধ্যে যতটুকু কাবাব খেতে পারলো কুয়াশা, ততটুকু খাওয়াল লোকটি ওকে সকলের অজান্তে।
ইচ্ছে করেই কোনো কথা বলার চেষ্টা করলো না কুয়াশা। লোকটিও উঠে চলে গেল। গুহার বাইরে বের হয়ে একটা উঁচু মতো পাথরের উপর বসলো সে নিজের রাইফেলটি পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে। গুহায় পাহারা দেবার ভার তার উপর।
| লোকগুলো শুয়েছে বটে। কিন্তু ঘুমোয়নি। এপাশ ওপাশ করছে কেউ কেউ। তিনজন সিগারেট ধরিয়েছে। কথা বলছে ফিসফিস করে দু’জন।
একটি মাত্র মশাল জ্বলছে গুহায়। লোকগুলোর মতো নরম বিছানা না পেলেও ঘুম এসে পড়লো কুয়াশার। রাত আন্দাজ বারোটার সময় চোখ জুড়ে ঘুম এলো তার। ঘুম ভাঙলো ঘণ্টা দুয়েক পরই। প্রলয়ঙ্কর আর্তনাদ, স্টেনগানের গর্জন, ধোয়া–চোখ মেলে হতভম্ব হয়ে পড়লো কুয়াশা এই দৃশ্য দেখে।
১৪৩
চার
আধ মিনিট ধরে প্রচণ্ড গুলির শব্দ হলো। শব্দ শুনেই চোখ মেলে তাকালো কুয়াশা। ধোঁয়া! ধায়ায় ভরে গেছে ওহাটা।
উ…উঁ…’।
মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের অন্তিম গোঙানি শোনা গেল। মশালটা জ্বলছে আগের মতোই। কিন্তু ধোঁয়ায় এমন ভাবে ভরে গেছে গুহাটা যে, কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। হঠাৎ কুয়াশা দেখালো, ধোয়ার মধ্যে দিয়ে একজন লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে। মুখ দেখা যাচ্ছে না লোকটার। লম্বা একটা শরীর তার কাছে এসে পঁড়ালো। শুনতে পেলো সে, লোকটি অদ্ভুত শান্ত গলায় বললো, ‘আশ্চর্য হয়ো না, বন্ধু। আমার নাম, ফার্ণানন্দা। আমি শ্রদ্ধেয় Dr. Kotze-এর লোক।’ | মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল লোকটার। বসে পড়লো সে কুয়াশার পাশে। হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দিলো কোমর থেকে ছোটো একটা ছুরি বের করে।
চলো, কেটে পড়া যাক এখান থেকে।
লোকটি কুয়াশাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে করতে বললো, জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছি সর্বকটিকে। গুলির শব্দ তুলিকা পর্বত শৃঙ্গে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়ই। এসে পড়বে ওরা। তার আগেই কেটে, পড়া উচিত, কি বলো?
ধোয়া পাতলা হয়ে গেছে অনেকটা। আস্তে আস্তে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে গুহার ভিতরটা। অস্বাভাবিক লম্বা ফার্ণান্দোর কথা শুনতে পেলো কুয়াশা, কিন্তু বুকের ভিতর টনটন করছে তার ব্যথায়। মানুষের প্রাণের মূল্য কি সে তা জানে। মানুষ যে কোনো মূল্যে বাঁচতে চায়, এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্যে যুদ্ধ করতে হয় মানুষকে। ফার্ণান্দো বলছে সে বৈজ্ঞানিক kotze-এর লোক। ভালোই। কিন্তু এতগুলো লোককে নিদ্রিত অবস্থায় মেরে ফেলার কি দরকার ছিলো? চুপি চুপি পালিয়ে গেলেই তো ওদেরকে ব্যর্থ করা হতো। কাপুরুষোচিত, এই হত্যাকাণ্ড ঘটাবার কারণ কি?
কুয়াশাকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অধৈর্য স্বরে ফার্নান্দো বললো, রওনা হয়ে গেছে ওরা, চলো না হে!’
গম্ভীর গলায় কুয়াশা প্রশ্ন করলো, এদেরকে মারলে কেন তুমি?’
‘মারলাম কেন?’ আশ্চর্য হয়ে গেল লোকটা কুয়াশার কথা শুনে। বললো, মারবো না? ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কি করতো জানো! স্রেফ জাহান্নামে পাঠাতো। তোমাকে বাঁচানো দরকার, তাই তোমার বদলে ওদেরকেই জাহান্নামে যেতে হলো।
১৪৪
কুয়াশা বললো, একজনের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে তুমি বিশজন মানুষকে হত্যা করতে পারো না, মি. ফার্ণালন্দা। তাছাড়া আমাকে মুক্ত করার আরও হাজারটা উপায় তৈরি করে নেয়া যেতো।’
কুয়াশার কথা যেন ঠিক বুঝতে পারছে না ফার্ণান্দো। প্রথমে সে আশ্চর্য হয়ে। তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। তারপর হাসলো হোঃ হোঃ করে। এতগুলো লোককে হত্যা করে এক বিন্দু অনুতাপ জাগেনি লোকটার বুকে। সহজ, স্বাভাবিক, উচিত কাজ করার মতোই করেছে সে কাজটা। মানুষ মারার জন্যে কোনো লোকের কাছে জবাবদিহি করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না সে।
| হাসতে হাসতে একটা স্টেনগান এনে দিলো ফার্ণান্দো কুয়াশার হাতে। দমে গেছে কুয়াশা। এ লোকটা স্বীকার করবে না নিজের বোকামি। মানুষ মারা এর সহজাত প্রবৃত্তি। বোঝানো সম্ভব নয় একে যে, অকারণে মানুষ মারা উচিত নয়।
হাত বাড়িয়ে স্টেনগানটা নিলো কুয়াশা। তারপর কুলি পাকানো লাশগুলোর দিকে ধীরে ধীরে এগোলো সে। দু’পা মাত্র এগোতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো
একজন লোক পড়ে থাকা লাশগুলোর মাঝখান থেকে। সিধে ছুটলো সে প্রাণপণে। গুহামুখের দিকে। পা জখম হয়েছে লোকটার। ঠিকমত দৌড়ুতে পারছে না, খোঁড়াচ্ছে। গুহার বাইরে যেতে পারবে না লোকটা। তার আগেই গুলি খাবে মাথার পিছনে। ফার্ণান্দো তুলেছিলও স্টেনগানটা, কিন্তু ঝট করে হাত বাড়িয়ে ঘুরিয়ে দিলো কুয়াশা স্টেনগানের মুখ।
“কি ব্যাপার!’ আবার আশ্চর্য হলো লোকটি কুয়াশার ব্যবহারে।
কুয়াশা শান্তভাবেই বললো, পালাচ্ছে, পালাতে দাও ওকে।
বিমূঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো ফার্ণান্দো, তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কুয়াশা। লোকটাকে পালাতে সাহায্য করলে কেন?’ রাগ নয়, ফার্ণান্দোর গলায়
একরাশ বিস্ময়। | কুয়াশা বললো, এখন আমাদের প্রথম কাজ কি বলো তো?’ .
* এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া,’ ব্যস্ত ভাবে উত্তর দিলো ফার্ণান্দো।
কুয়াশা বললো, ঐ আহত লোকটিকে গুলি করলে আমাদের পালিয়ে যাবার কাজটা কি সুগম হতো?”
. ফার্ণান্দো কি বলবে ভেবে না পেয়েই বুঝি চুপ করে রইলো কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কুয়াশা লাশগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখে বললো, উনিশজনকেই শেষ। করেছো, আশ্চর্য! | ম মেরে গেছে ফার্নান্দো। গুহাটা ঘুরে দেখলো কুয়াশা একবার। স্টেনগানটা তার হাতেই ধরা আছে। আরো দু’একটা জিনিসপত্র নিলো সে। ফার্ণান্দোও দুতিনটে পুঁটলি নিলো। প্রচুর পরিমাণে ডিনামাইট আছে পুঁটলিগুলোয়। চলো এবার।’ ১০-
১৪৫
কুয়াশার কথা শুনে গুহামুখের দিকে পা বাড়ালো ফার্ণালো। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে। পুঁটলিগুলো হাত থেকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে গুহার মাঝখানে ফিরে গেল সে আবার। তারপর ঝুঁকে পড়ে বিছানাপত্র ঘাটাঘাটি করতে লাগলো ব্যস্তসমস্ত হয়ে।
কি খুঁজছো?’ ‘একটা ছোটো ব্যাগ, অ্যাটাচি কেসের মতো দেখতে। কিন্তু…কিন্তু…’।
ফার্ণান্দো কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ব্যাগটা যেন না পেলেই নয় তার। পাগলের মতো উঠে দাঁড়ালো সে। ভুরু দুটো কুঁচকে গেছে তার। ঘামে ভিজে গেছে মুখ। টেনিসবলের মতো ড্রপ খেতে খেতে একদিক থেকে অন্যদিকে ঘুরছে . সে।
ব্যাগটা গুহার ভিতর নেই তা অল্পক্ষণেই বোঝা গেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো ফার্ণান্দো। সব মাটি হয়ে গেছে! হায় হায়!
কুয়াশা বললো, কি ছিলো ব্যাগটায়? এতো মাথা ঘামাচ্ছো দেখে আমার মনে হচ্ছে মানুষ খুন করার চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনো ব্যাপার জড়িত আছে. ব্যাগটার সঙ্গে।
| আহত গলায় ফার্ণালো বললো, তুমি তা অস্বীকার করতে পারো না, কুয়াশ। শ্রদ্ধেয় Dr. Kotze-এর থিসিসের একটা অংশ আছে সেই ব্যাগটায়। উহ। হাতছাড়া হয়ে গেল এবারও।’ মানসিক যন্ত্রণা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ফার্ণানন্দার।
| কুয়াশা বললো, ‘Dr. Kotze-এর থিসিস? এখানে কিভাবে এলো সেটা?’
‘চুরি করে এনেছিল ওরা। ওটাই আমি উদ্ধার করার জন্যে ছদ্মবেশে এদের দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। এদের কারো কাছেই ছিলো ব্যাগটা–সেই ব্যাগেই আছে থিসিসটা–কিন্তু দেখছি না তো কোথায়… ঐ লোকটা পালাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেছে নিশ্চয়ই…ঠিক তাই!
কুয়াশা বললো, তাহলে থিসিসটা উদ্ধার করার জন্যেই এদের দলে যোগ দিয়েছিলে তুমি? কিন্তু ব্যাগটা কার কাছে আছে, কোথায় আছে তা না জেনেই লোকগুলোকে মেরে ফেললে, কেমন?
|’, কথা খুঁজে পেলো না ফার্ণান্দো। হঠাৎ সচেতন হলো সে। বললো, যা হবার হয়েছে, চলো এবার চলে যাই। এখুনি এসে পড়বে ওরা।
কুয়াশা বললো, বারবার বলছো তুমি, ওরা এসে পড়বে–এসে পড়বে। ব্যাপারটা কি আসলে?
ব্যাপারটা হলো…’ গুহামুখের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফার্ণান্দো বললো, শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক Kotze-এর শত্ৰু এই লোকগুলো। তাকে যেমন করে হোক ধ্বংস করে ১৪৬
দেবার জন্যে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ক্রিমিন্যালের দল লোক নিয়োগ করেছে। লোকগুলো এই অঞ্চলের বিশেষ বিশেষ জায়গায় পাহারা দিচ্ছে। তোমার আসার খবর তাদেরও জানতে বাকি নেই। কোনরকম সাহায্য যাতে না পায় কারো কাছ থেকে শ্রদ্ধেয় Kotze তার জন্যে এই সতর্কতা ওদের। তুলিকা পর্বত শৃঙ্গে এদের আরও লোক আছে। গুলির শব্দ শুনে সন্দেহ হওয়া খুবই সম্ভব। ব্যাপারটা জানার জন্যে অনেকক্ষণ আগেই রওনা হয়ে গেছে ওরা।
| সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো কুয়াশা। কিন্তু কিছু বললো না সে ফার্ণান্দোকে।
ঘোড়াগুলো বাঁধা ছিলো গুহার বাইরে। দুটো ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে উঠে বসলো ওরা। দু’জনেরই হাতে একটি করে স্টেনগান। ফার্ণালো ডিনামাইটের পুঁটলিগুলো বেঁধে নিলো ঘোড়ার পিঠে। তারপর উঠে বসে ছুটিয়ে দিলো ঘোড়াটাকে দু’পাশের পাহাড় কেটে যে পথটা ডান দিক ধরে সোজা চলে গেছে সেইদিকে। কুয়াশাও বিনাবাক্যব্যয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো ফার্ণান্দোর, পাশাপাশি।
সন্দেহটা জেগেছিল কুয়াশার মনে। কিন্তু চাঁদ পাহাড়ের আড়ালে বলে দিকটা নির্ণয় করে উঠতে পারছিল না। তাছাড়া সহজ পথ কোনটা সে অভিজ্ঞতাও তার নেই। ম্যাপ তো নেই-ই সঙ্গে। সুতরাং ফার্ণান্দো যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই সঠিক পথ ভাবলো সে। দূর করে দিলো মন থেকে সন্দেহটা।
একবার শুধু জিজ্ঞেস করলো কুয়াশা, কোনদিকে যাচ্ছি আমরা?’ ..
ফার্ণালন্দা কি যেন চিন্তা করছিল একমনে। চমকে উঠলো সে কুয়াশার কথা শুনে। বললো, কি বললে?’
কোনদিকে যাচ্ছি আমরা?” একমুহূর্ত পর উত্তর দিলো ফার্ণান্দো, কেন, শ্রদ্ধেয় Kotze-এর আস্তানায়।
কুয়াশা বললো, তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমরা উত্তর দিকে যাচ্ছি, না উত্তর পশ্চিম দিকে?
‘উত্তর দিকে,’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো ফার্ণান্দো। কুয়াশা আর কিছু জানতে চাইলো না। ফার্ণান্দোও কথা বললো না আর।
দু’ঘণ্টা একভাবে ঘোড়া ছুটলো ওদের! এক হাজার ফুট উপরে উঠে যাবার কথা ওদের। পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাহাড়ও পাথর কেটে রাস্তা তৈরি করা। একদিকে পাহাড়ের দেয়াল অন্যদিকে শূন্যতা। তারার আলোয় অস্পষ্ট দেখাচ্ছে নিচের দিকটা। ঐ অন্ধকারের বাধা থাকা সত্ত্বেও কল্পনা করে নেয়া যায় দৃশ্যটা। আড়াইশো ফুট নিচেই দেখা যাবে সরু একটা রাস্তা। তারপর কাঁকা। আরও নিচে পাহাড়ের কালো শরীর। তারপর আবার রাস্তা। রাস্তার পাশে দেখা যাবে আবার
১৪৭
একটা সরু পথ। তারও নিচে রুক্ষভূমি নজরে পড়বে। টানা শহরটা খুব বেশি
. দূরে নেই আর। ছাড়িয়ে আসেনি তো ওরা। পাহাড়ের বাধা না থাকলে দেখা
যেতো একগুচ্ছ ফুলের মতো শহরের ঘড়বাড়িগুলোকে পিছন দিকে। দেখা অবশ্য যাবে, তবে আড়াই হাজার ফুট উপরে উঠলে। সকাল হবার আগে তা আর সম্ভব নয়। আড়াই হাজার ফুট উপরে উঠে যাবে ওরা সকালের দিকে, কুয়াশা ভাবলো। * সোয়া চারটে বাজে। হঠাৎ ফার্ণান্দো ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিলো বেশ খানিকটা। এগিয়ে গেল সে কুয়াশাকে পিছনে ফেলে। একটু অবাক হলো কুয়াশা। দু’মুহূর্ত পরই ভুরু কুঁচকে উঠলো তার। ফার্ণান্দোকে দেখা যাচ্ছে না সামনে।
| চাবুক কষে ঘোড়ার গতি বাড়ালো কুয়াশা। কিন্তু খানিক এগিয়ে দমে যেতে হলো তাকে। মূল রাস্তাটা থেকে সরু একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের পুব দিকে। ফার্ণানন্দার ঘোড়ার পদশব্দ পাওয়া যাচ্ছে ঐ পুব দিক থেকেই।
কেন? ফার্ণান্দো না বলে না কয়ে ওদিকে গেল কেন? পূর্ব সন্দেহটা আবার ফিরে এলো কুয়াশার মনে। লোকটাকে ঠিক যেন চিনতে পারছে না সে। কোনো বদ মতলব, আছে নাকি ওর? কিন্তু কুয়াশাকে অন্যপথে কোথায় নিয়ে যেতে চায় লোকটা? কি লাভ ওর তাতে?
| দেরি করলো না কুয়াশা। ফার্ণান্দোকে ধরতে হবে। খোলাখুলি জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে এতো লুকোচুরির কারণ কি। উত্তর দিকের পথ ছেড়ে হঠাৎ পুব দিকে মোড় নিলো কেন সে?
| খানিকটা রাস্তা ঘোড়া ছুটিয়ে রীতিমত শঙ্কিত হলো কুয়াশা। ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে পুব দিকের রাস্তাটা। তার মানে গিরিপথ ছেড়ে যাচ্ছে তারা। সমতলভূমির দিকে নামছে ঘোড়া। এদিকে ফার্ণান্দোর ঘোড়র পায়ের শব্দ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে
* চাঁদ দেখা যাচ্ছে নিচু আকাশে। তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে দেখতে চেষ্টা করলো কুয়াশা : সামনেটা। না, ফার্ণান্দোকে দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের বাধা নেই যদিও সামনে, তবু কোনো কোনো জায়গায় জমাট অন্ধকার মনে হচ্ছে। সম্ভবত বড় বড় পাথরের খও পড়ে আছে জায়গাগুলোতে।
তাই-ই। পাহাড় ছেড়ে রুক্ষ সমতলভূমিতে নেমে এলো কুয়াশার কালো ঘোড়াটা। চাঁদের আলো ম্লান এখন। কিন্তু সমতলভূমিতে নেমে আসার পরই কুয়াশা দেখতে পেলো ফার্ণান্দোকে। বেশ খানিকটা দূরে। অটল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে তার ঘোড়াটা। নেমে পড়েছে ফার্ণান্দো ঘোড়া থেকে। চঞ্চল মনে হচ্ছে তাকে। তার সামনের পথ রোধ করে জমাট বেঁধে রয়েছে রাশি রাশি অন্ধকার। উঁচু
উঁচু পাহাড়ের সারি।
ঘোড়া ছুটিয়ে ফার্ণান্দোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। নেমে পড়লো। নিচু হয়ে একটা দড়িতে পরপর সাজিয়ে কি যেন বাঁধছে ফার্ণালো। কুয়াশাকে দেখে ১৪৮
* মৃদু হাসলো সে ঘর্মাক্ত মুখ তুলে। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার নিজের কাজে
মনোনিবেশ করলো সে।
‘কি ব্যাপার জানতে পারি কি?’ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কুয়াশা রুমাল দিয়ে গলার ঘাম মুছে নিয়ে।
* ভুরু কপালে তুলে তাকালো ফার্নান্দো কুয়াশার দিকে। আশ্চর্য হয়েছে যেন সে কুয়াশাকে কথা বলতে দেখে। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ছোটো ছেলেকে ভূতের ভয় দেখাবার মতো করে কথা বলতে নিষেধ করলো সে কুয়াশাকে। ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে অন্ধকার পাহাড়ের দিকে ইশারা করলো ফার্ণান্দো কথা বললো মা।
| স্যামনে তাকালো কুয়াশা। ঠিক এমন সময় সজাগ হলো তার কান দুটো। ঘোড়ার খুরের শব্দ আসছে পাহাড়ের দিক থেকে। ক্ষীণ চিৎকার উঠছে থেকে থেকে মনুষ্য কণ্ঠের।
কয়েকজন লোক এগিয়ে আসছে অন্ধকার পাহাড়ের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। বেশ দূরে আছে এখনও। অন্তত বিশ পঁচিশজন ঘোড়সওয়ার হবে, কুয়াশার মনে হলো। ব্যস্ত ফার্ণান্দোর দিকে তাকালো সে এবার। কি যেন একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ফার্নান্দো। ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করলো কুয়াশা। ডিনামাইট! ফার্ণান্দো ডিনামাইটের পুঁটলিটা খুলে ডিনামাইট এবং প্লনজার যন্ত্রটা .
বের করছে।
কি করছো তুমি?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো কুয়াশা।
‘দেখতে পাচ্ছো না, কি করছি?’ মিটিমিটি হেসে উত্তর দিলো ফার্ণান্দো উঠে দাঁড়ালো সে এবার সিধে হয়ে কুয়াশার মুখোমুখি। কুয়াশার দুকাঁধে হাত রেখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো সে তার দিকে নিস্পলক। তারপর ঘাম মুছলো কাঁধের উপর শার্টে মুখ ঘষে।
‘ডাকাত ওয়া। টাকা থেকে সরকারী ট্রেন লুট করে ফিরে যাচ্ছে আস্তানায়। ফিসফিস করে বললো ফার্নান্দো।
‘কি করতে চাও তুমি?’
বন্দী অবস্থায় যখন গুহায় ছিলো সে তখনকার কথা মনে পড়ে গেল কুয়াশার। অনেকগুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই রক্তপিপাসু লোকটি। আবার কি করতে চাইছে ও?
‘সোনার প্রতি লোভ আছে তোমার?’ গুরুত্ব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ফার্নান্দো। কুয়াশার উত্তর শোনার আগেই সে বললো আমার মতো তোমারও নিশ্চয় লোভ আছে সোনার প্রতি। ওরা সরকারী ট্রেন থেকে বস্তাভর্তি সোনা নিয়ে আসছে। ওগুলো আমরা নিয়ে নিচ্ছি ওদের হাত থেকে।
ফার্ণান্দোর কথা শুনে কুয়াশার মনে হলো, চাইলেই যেন দিয়ে দেবে সোনার :*
|
২৪৯
বস্তা ডাকাতগুলো।
মামার বাড়ির লোক নাকি? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, খাতির যত্ন করে, তোমাকে দিয়ে যাবার জন্যেই সোনা নিয়ে আসছে ওরা।
হাসলো না এবার ফার্ণান্দো। গভীর কণ্ঠে বললো, না, মামার বাড়ির লোক। নয়। নয় বলেই ব্যবস্থা করবো। দিয়ে যেতে চাইবে না সত্যিই, কিন্তু দিয়ে যেতে বাধ্য হবে। কুয়াশার সামনে থেকে সরে গেল ফার্ণান্দো কথাটা বলে। ডিনামাইট নিয়ে একটা বিরাট পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
| চট করে এগিয়ে গেল কুয়াশা তার দিকে। ‘সাবধান ফার্ণান্দো!’ গমগম করে উঠলো কুয়াশার কঠোর কণ্ঠস্বর। চমকে উঠে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো ফার্ণান্দো। হাতের স্টেনগানটায় শক্ত করে চেপে বসলো কুয়াশার আঙুলগুলো। মাটির দিকে মুখ করা সেটা।
| ‘একজন মানুষকেও আঘাত করতে পারবে না তুমি।’
উত্তর দিলো না ফার্ণান্দো। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কুয়াশা কিছুটা ধীর গলায় আবার উচ্চারণ করলো, মানুষ মারা, বিশেষত অকারণে মানুষ মারা পছন্দ করি না আমি। তোমারও পছন্দ করা উচিত নয়।’
| ‘উচিত নয়! ধক করে জ্বলে উঠলো যেন ফার্ণান্দোর চোখ দুটো চাঁদের নিত আলোয়। কুঁচকে উঠলো তার মুখটা কি একটা কথা মনে পড়ে যেতে। তারপর হঠাৎ সচেতন হলো সে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো তার মুখ। ছেলেমানুষের মতো খল খল করে হেসে উঠলো ফার্নান্দো। ১ উচিত নয়, মানুষ মারা উচিত নয়। তোমার কথা মেনে নিলাম আমি। মারবো না ওদেরকে। ভয় দেখাবো। তাতেই কাজ হবে।’
আবার লেগে পড়লো ফার্ণান্দো তার কাজে। পাথরটার দু’দিকে দুটো ডিনামাইট বসিয়ে এগিয়ে গেল আর একটি পাথরের দিকে। কিন্তু কুয়াশার মনে, হলো, ফার্ণান্দো শেষ পর্যন্ত কথা রাখবে না বা রাখতে পারবে না। এসে পড়েছে ডাকাতগুলো। স্পষ্ট পদশব্দ শোনা যাচ্ছে ঘোড়ার। চিৎকার করছে থেকে থেকেই লোকগুলো ঘোড়াগুলোকে ঠিক পথে চালাবার জন্যে। সাবধান করছে ওরা পরস্পরকে। লোভে পড়েছে ফার্ণান্দো। যা তা কাণ্ড করে বসবে
সে।
‘ওরা যে ডাকাত এবং সরকারী ট্রেন লুট করে সোনা নিয়ে ফিরছে তা তুমি জানলে কিভাবে?’
‘আমার চেয়ে ভালভাবে এখবর আর কেউ জানে না।’
ফার্ণান্দোর উত্তর শুনে কুয়াশা ভাবলো এ লোকটির সঙ্গে কথা বলা বৃথা। তবু। | শেষ চেষ্টা করে দেখলো সে। বললো, তুমি পাগল, না মাথা খারাপ তোমার, ১৫০।
শুনি? শুনতে পাচ্ছে না, এসে পড়েছে ওরা? তোমার ডিনামাইট বসানোর আগেই। | না এসে পড়েনি। ঘড়ি দেখলো ফার্নান্দো। তারপর বললো, মনে হচ্ছে কাছে এসে পড়েছে ওরা। যদিও ওরা ঠিক আমাদের সামনেই আছে–দুশো গজ। মাত্র দূরে। কিন্তু ওদের সামনে এখন পাহাড়ের দেয়াল। ডান দিকে ঘুরে আসতে হবে ওদেরকে। এইখান দিয়েই যাবে, আর পনেরো মিনিট পর দেখতে পাবো আমরা ওদেরকে।’
| নীরব হয়ে গেল কুয়াশা। না, দমানো যাবে না লোকটাকে। | ‘কি করবো জানো?’ ছ’টা বিরাট বিরাট পাথরের নিচে ডিনামাইট বসিয়ে পিছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো ফার্ণান্দো, মাঝখানের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে চতুর্দিকে ডিনামাইট বসাবো। মাঝ বরাবর এলেই প্লনজারে চাপ দিয়ে ফাটিয়ে দেবো সামনের কয়েকটা। ওরা তখন পিছু হটবে। তখন ফাটাবো পিছনেরগুলো। দু’দলে ভাগ হয়ে যাবে এবার ওরা। দু’পাশেরগুলোও ফাটিয়ে দেবো সঙ্গে সঙ্গে। তাছাড়া আমরা দুজনেই পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্টেনগান চালাবো। না না, ওদেরকে মারবো না। আমার প্রতিটি গুলি ওদের শরীরে বাতাস লাগিয়ে আধ ইঞ্চি দূর দিয়ে ছুটে যাবে।’
উত্তর দিলো না কুয়াশা। আবার শুরু করলো ফার্ণান্দো তার প্ল্যান ব্যাখ্যা করতে। বড় জোর পনেরো জন ওরা। আর ঘোড়া? কম করেও চল্লিশটা। পিঠে সোনার বস্তা চাপিয়ে দিয়ে খুশিতে ডগমগিয়ে আসছে ওরা। দু’চারটে ঘোড়া যখন লুটিয়ে পড়ে ছটফট করবে চোখের সামনে, পালাতে দিশে পাবে
এবারও কথা বললো না কুয়াশা। কাজ করতে করতে একবার মুখ তুলে তাকালো ফার্ণান্দো তার দিকে। আবার কাজ শুরু করে প্রশ্ন করলো সে, তুমি কি রাগ করেছে আমার উপর, কুয়াশা?’।
কুয়াশা বললো, একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যর্থ হয়েও তুমি আবার এমন একটি কাজে সময় অপব্যয় করছে, যার দ্বারা কোনো উপকার হবে না সম্ভবত Dr. Kotze-এর।
. থেমে গেল ফার্ণালন্দা। কুয়াশার দিকে না ফিরে মাথা নিচু করে বসে কি যেন ভাবলো সে। তারপর বললো, তুমি খুব সত্যি কথা বলেছে, বন্ধু। আমি ব্যর্থ হয়েছি। দুঃখিত আমি। আমি…আমি লজ্জিত। মুখ দেখাতে পারা উচিত নয় আমার শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের কাছে। কিন্তু আমি অন্য একটা উপায় ঠিক করেছি, কুয়াশা। আমার জানা আছে থিসিসটার অংশটুকু কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে। আদায় করবো সেটা আমি ওদের কাছ থেকে। আর সময় অপব্যয় হচ্ছে বললে না? পুষিয়ে নেবো এটুকু সময়।
১৫১
. একটু চুপ করে আবার কাজে লেগে গেল ফার্ণান্দো অন্যদিকে উঠে গিয়ে। কুয়াশা দুটো ঘোড়াকে একটা পাথরের আড়ালে বেঁধে রেখে ফিরে এলো ফার্ণান্দোর কাছে। ‘
শেষ হয়ে গেল ডিনামাইটগুলো ফিট করার কাজ। একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো ফার্নান্দো। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললো, আসলে ডাকাতগুলোর হাত থেকে সোমাগুলো কেড়ে নেয়াটা সৎকাজ, বুঝলে? রাশ রাশ সোনা লুট করে টারাটাকা চলে যায় ওরা ওদের শহরে। নিরীহ গ্রামবাসীদের যম হয়ে দেখা দেয় এক একজন। মদ, মেয়ে ও জুয়ায় সময় কাটায় যতদিন লুটের মাল থাকে। খুন-খারাপি জুলুম ধর্ষণ করে ওরা ইচ্ছে হলেই। পয়সা শেষ হয়ে গেলেই আবার দল বেঁধে বের হয়ে পড়ে ডাকাতি করতে। টাকার– এমন অপচয়। আর কোথাও হয় কিনা জানা নেই আমার। কোটিগুণ ভালো কাজে ব্যয় করা যায় ঐ সোনা বেচা টাকাগুলো। পেরুর মুক্তিকামী জনসাধারণকে সাহায্য করা যায়, গরীবদের সাহায্য করা যায়।
‘ঐ সোনা নিয়ে সেই রকম কোনো কাজ করতে চাও বুঝি তুমি?’
কুয়াশার প্রশ্নে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ফার্ণান্দো। তারপর কি যেন বলবার জন্যে কুয়াশার দিকে তাকালে সে, ঠিক তখনই ওদের কানে এলো শব্দ–এসে পড়েছে ওরা। ডিনামাইট বসানো পাথরগুলো অতিক্রম করছে ওরা।
“ ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় যদি কোনদিন আসে-দেবো আমি।’ ‘ ফিসফিস করে কথাটা বলে শক্ত করে ধরলো ফার্ণামে! ডিনামাইট ফাটাবার চাপ-যন্ত্রটা।
তেরোজন ওরা। পঁচিশটা ঘোড়া। ছোটো ছোটো সাদা কাপড়ের বস্তা ঝুলছে ঘোড়াগুলোর পিঠের দুদিকে। অপেক্ষা করে রইলো ওরা। ঘোড়াগুলোর একেবারে সামনে তিনজন ঘোড়সওয়ার পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। দু’পাশে চারজন করে আটজন চাবুক হাতে নিয়ে সামলাচ্ছে ঘোড়াগুলোকে, যাতে দলছাড়া হয়ে না যায়। পিছনে দেখা যাচ্ছে মাত্র দুজন ঘোড়সওয়ারের মাথা। প্রত্যেকের মাথায় টুপি দেখা যাচ্ছে।
মাঝখান বরাবর জায়গাটায় গোটা দুলটা এসে পড়লো দেখতে দেখতে। পরপর দুটো কাজ করলো ফার্ণান্দো। চাপ-যন্ত্রটায় চাপ দিলো সে পরপর তিনবার। সেটা ছেড়েই স্টেনগানটা তুলে নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে আধা দাঁড়ানো ভঙ্গিতে উঠে গুলি করলো কিছুক্ষণ। | ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠলো প্রচণ্ড শব্দ শুনে। তারপরই দুটো ঘোড়া গুলি
খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। লোকগুলো চমকে উঠে থমকে গেল। মুহূর্তের জন্যে
১
২
যেন জ্ঞান হারালো তারা। তারপরই সামনের লোক তিনজন লাগাম টেনে ধরে পিছন ফিরলো। দেখাদেখি চিৎকার করে পিছু হটবার জন্যে নির্দেশ দিতে শুরু করলো ভীতস্ত লোকগুলোকে। পিছনের লোক তিনজন ঘোড়ার মুখ ঘোরাবার : আগে রাইফেল চালালো আন্দাজ করে। স্টেনগানের শব্দ শুনে গুলি করলো লোক তিনজন। কুয়াশাদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল গুলি। ঘোড়াগুলোকে বাগে আনার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওরা। কিন্তু চঞ্চল হয়ে পড়েছে তারা বিপদের গন্ধ পেয়ে। পিঠের উপর সওয়ার নেই বলে কিভাবে তাদেরকে পরিচালনা করতে চায় মালিকরা বুঝতে পারছে না অবলা জানোয়ারগুলো। কোনো কোনোটা সামনে বিপদ ধরে নিয়ে পিছন ফিরছে। কোনো কোনোটা আবার বিচলিত হয়ে সামনের দিকেই ছুটে আসতে চাইছে।
| একটু থেমে আবার গুলি করলো ফার্ণালন্দা। চমকে উঠলো পিছন ফেরা লোক তিনজন। ঠিক তাদের শরীরের আধ ইঞ্চি দূর দিয়ে চলে গেল স্টেনগানের কয়েকটা গুলি। লাফাতে শুরু করলো তাদের ঘোড়াগুলো। তাদেরকে বশ মানাবার চেষ্টা কয়েক মুহূর্তের জন্যে বাদ দিলো লোক তিনজন। সুযোগ বুঝে কয়েকবার গুলি করলো তারা। অব্যর্থ লক্ষ্য। গুলিগুলো কুয়াশাদের সামনের পাথরে লাগলো। পাথরটা না থাকলে ফার্ণান্দের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যেতো কয়েকটা গুলি।
ফার্ণান্দো জানে এদের হাতযশ, তাই প্রতিবার গুলি করার পর বসে পড়ছে সে মাথা নিচু করে।
মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। ঘোড়ার চিহি চিঁহি ভীত আর্তনাদ, তাদের সামলাতে তেরো জন বলিষ্ঠ লোকের চিৎকার, স্টেনগান এবং রাইফেলের শব্দে জায়গাটা রীতিমতো ছোটখাট একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো।
মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেল। কিন্তু মাঝখানের জায়গাটা ছেড়ে পনেরো হাতের বেশি পিছু হঠতে পারলো না ওরা। দু’চারটে ঘোড়া ইতিমধ্যে দলছাড়া হয়ে সরে যাবার ফলে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেছে তাদের। সামনের দিকেই এসে পড়েছিল ঘোড়াগুলো ছুটতে ছুটতে। ফার্ণান্দো গুলি করে শুইয়ে দিয়েছে সেগুলোকে। পনেরো হাত দূড়ে রয়েছে মৃত ঘোড়াগুলো। | বেশ খানিকক্ষণ গুলি করলো না আর ফার্নান্দো। কাজ হলো : তাতে। ঘোড়াগুলো আশ্বস্ত হলো কিছুটা। তার ওপর কড়া চাবুক খেয়ে বুঝতে পারলো ওরা, কোনদিকে ঘুরতে হবে। দলটা মাঝখানের জায়গাটা থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। দেখে কুঁজো হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
| কুয়াশা স্টেনগানটা হাতে নিয়ে দেখছিল চুপচাপ। ফার্ণান্দো চাপ-যন্ত্রটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, আমার গুলির শব্দ পেলেই চাপ দেবে এতে। সাজানো আছে, প্ল্যান মতো ফাটবে। যখনই সঙ্কেত দেবো, একবারের বেশি যেন না পড়ে যায় চাপটা।
কুয়াশাকে কিছু বলতে না দিয়ে বাম দিকে চলে গেল ফার্ণান্দো পাথরের আড়ালে আড়ালে থেকে। স্টেনগানে নতুন ম্যাগাজিন ভরে নিয়েছে সে এক ফাঁকে।
মিনিট খানেক পরই গর্জন শোনা গেল ফার্ণান্দোর স্টেনগানের। চাপ দিলো কুয়াশা যন্ত্রটায়। এদিকে ফার্ণান্দোর স্টেনগানও থামেনি। বাম দিকের ডিনামাইট বসানো পাথরগুলোর একটির আড়ালে বসে গুলি করছে সে।
| লোকগুলো দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো! বেশ খানিকটা বাকি ছিলো পাথরের টুকরোগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছুতে। কত যন্ত্রটায় চাপ দিতেই প্রচণ্ড শব্দে ফাটলো পাথরগুলো! ঠিক বলেছিল ফ : তত হয়ে গেল পুরো দলটা। কয়েকটা রাইফেল গর্জে উঠলো বটে ১৬ :: :: সেকেণ্ড পরেই দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল লেকগুলো। ঘোড়াগুলো, . ::টায় মত্ত অবস্থায় দাপাদাপি করতে শুরু করলো দিশেহারা হয়ে। পালাবার পথ পাচ্ছে না তারা। একটা যেতে চায় দক্ষিণ দিকে, আর একটা লাফাতে লাফাতে পূব দিকে ছুটতে চাইছে। মাটিতে পড়ে গিয়ে পা ছুঁড়ছে কয়েকটা।
ফার্ণান্দোর সাড়া পাওয়া গেল না মিনিট দুই। ঠিক দু’মিনিট পরই ডান দিক থেকে স্টেনগানের শব্দ হলো। চাপ দিলো কুয়াশা যন্ত্রটায়! এবার প্রচণ্ড শব্দ করে ফাটলো বাম দিকের ডিনামাইটগুলো। ইতিমধ্যে বাম দিকে যে দলটা এগোচ্ছিল তারা পাথরগুলোকে ছাড়িয়ে চলে গেছে খানিকটা। তাদের পিছনে শব্দ হতে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরে গেল তারা। গুলি চালাতে চালাতে কুঁজো হয়ে ডান দিক থেকে বাম দিকে দৌড়ুচ্ছে ফার্ণান্দো। আবার বাম পাশে চলে এলো সে। সেখান থেকে পলায়নপর লোকগুলোর উদ্দেশে গুলি করছে। বাম দিকে ছিলো ন’জন লোক। পালিয়ে গেল বলেই মনে হলো তারা। বাকি চারজন সরে গেছে বেশ খানিকটা। ডান দিকের পাথরগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে তারা।
কিছুক্ষণ থেমে আবার ডান দিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করলো ফার্নান্দো। চুপচাপ বসে রইলো কুয়াশা। এখন যদি যন্ত্রটায় চাপ দেয় সে তবে ঐ চারজন লোকের একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
| মুহূর্তের জন্যে আশ্চর্য হয়ে পড়ার ফলে ফার্ণান্দোর স্টেনগানের শ থেকে থাকলো। আবার শব্দ শুনতে পেলো কুয়াশা। এবার ঐ চারজন লোকও গুলি করছে অনর্গল। কাৰ্ণানন্দা একী। বুঝতে পেরেছে লোকগুলো। চারজন তারা, পিছু হট, কেন। এগিয়ে আসতে লাগলো এবার ওরা। একটু বিচলিত হলো কুয়াশা পাথরের আড়াল থেকে গুলি করছে ফার্ণান্দো। তার ভয় নেই ততো। কি : লোকগুলো না থামলে বাধ্য হয়ে ফার্ণান্দো গুলি করে জখম করবে ওদের।
রাইফেল উঁচিয়ে একপা একপা করে এগোচ্ছে লোকগুলো। স্পষ্ট দেখা যা. চারটে রাইফেলের চেহারা। চাপ-যন্ত্রটা রেখে দিলো কুয়াশা একপাশে। স্টেনগান। তুলে নিলো হাতে। ১৫৪
ভলিউম
একনাগাড়ে কয়েক পশলা গুলি করলো কুয়াশা। মৃত্যু ভয় এবারও জাগলো লোকগুলোর মনে। পিছু হটে পালানো ছাড়া উপায় নেই বুঝতে পারলো ওরা। চারজনই প্রাণভয়ে ছুটলো ওরা ডান দিকে। ডানদিক থেকে কোথায় যে গেল তা আর বোঝা গেল না।
ফার্নান্দো এবার সুযোগ বুঝে স্টেনগানে এক্সট্রা ম্যাগাজিন ভরে নিয়ে ছুটে চলে এলো কুয়াশার কাছে। কি যেন বলতে যাচ্ছিলো কুয়াশা। তার আগেই ঠিক তার পিছন থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে পড়লো পাথরের গায়ে। চমকে উঠে ওরা
দু’জনেই পাথরের অপর দিকে আশ্রয় নিলো। এগিয়ে আসছে বাকি, ন’জন। কুয়াশাদের দেখতে পায়নি স্পষ্ট। সতর্ক পায়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে ওরা।
‘ঘোড়াগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখো তুমি, আমি দেখছি ওদের।’
হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল ফার্ণান্দো পাথরটার আশ্রয় ছেড়ে। মিনিট খানেক লাগলো তার বাম পাশের একটা পাথরের কাছে গিয়ে পৌঁছুতে। প্রথমে গুলি করলো ফার্ণান্দো। তারপরই গুলিবর্ষণ শুরু করলো কুয়াশার স্টেনগান।
ভড়কে গেল লোকগুলো। দু’দিক থেকে অনর্গল গুলিবর্ষণ হচ্ছে। মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। কোনো পাথরের আড়ালে গা বাঁচানোর উপায় নেই! প্রাণ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করা যেতে পারে বড় জোর।
দেরি করলো না লোকগুলো। কোনো আশা নেই একথা বুঝতে পেরেছে ওরা। এখন কোনমতে প্রাণটা রক্ষা পেলে হয়। খিচে দৌড় মারলো ওরা ঘুরে দাঁড়িয়ে।
ফিরে এলো ফার্ণান্দো কুয়াশার কাছে। সাফল্যের হাসিতে উদ্ভাসিত তার অবয়ব। কুয়াশা ভাবলো-কাজের লোক বটে!
পাঁচ
সকাল হয়ে গেছে।
ঘোড়াগুলো একটার সঙ্গে একটা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ফার্নান্দো। ব্যাগ খুলে শুকনো মাংস খেয়ে প্রাতঃরাশ সেরেছে ওরা দুজন। ঘোড়র বাঁধনগুলো আবার একবার পরীক্ষা করলো ফার্ণান্দো।
সব ঠিক আছে।’ কথাটা বুলে চারপাশের দূরবর্তী পাহাড়ের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো সে। বারোজন দুর্ভাগা লোক এক সঙ্গে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওদেরকে। নড়ছে না কেউ। পাথরের মূর্তির মতো নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে কুয়াশাদের দিকে। বাকি একজন গেল কোথায়?
১৫৫
‘তিন বছরে তিনবার হলো-ভাগ্য মন্দ ওদের। আমি কি করবো।’ “কি বলছো?’ কথাটা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো কুয়াশা। * ‘গত তিন বছরে তিনবার আমি এইভাবে কেড়ে নিয়েছি ওদের হাত করা। জিনিস। প্রথমবার সংখ্যায় ছিলো ওরা পাঁচজন। দ্বিতীয়বার নয়, এবার তো দেখতেই পাচ্ছো-তেরো জন। একজন ভয় পেয়ে পালিয়েছে।’ ..
ঘোড়ার পিঠে সাজানো সোনার বস্তার দিকে একবার তাকিয়ে কুয়াশা প্রশ্ন, করলো, ‘গত দু’বারও সোনা ছিলো নাকি ওদের কাছে?
ফার্ণান্দো অবাক হয়ে বললো, ‘সোনা না হলে আমি হামলা করবো কেন?’
“খুব লোভ সোনার প্রতি, না? কি করবে এতো সোনা দিয়ে? কবরে নিয়ে যাবে নাকি?’ . চুপ করে রইলো ফার্ণালো। একটু পর বললো, একবিন্দু সোনাও নিজের
জুন্যে ব্যয় করবো না…’ ‘
হঠাৎ থেমে গেল ফার্ণান্দো। সন্দিহান দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো সে, তার অর্ধ সমাপ্ত কথায় কি ভাবছে কুয়াশা।
| ‘থামলে কেন, চালিয়ে যাও, ক্রিপ করে বললো কুয়াশা।
। এখনও সময় হয়নি। বলা যায় না, সব কথা আমার বলার বা হোমর শোনার সময় হয়তো কখনও আসবে না।’
‘দয়া করে দেরি করো না, তাহলেই হবে। চলো রওনা হওয়া যাক এবার।
চঞ্চল হয়ে উঠলো এবার ফার্ণান্দো। দূরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে বললো, হ্যাঁ, অনেক রাস্তা পেরোতে হবে আমাদেরকে। | বারোটা মাত্র ঘোড়া জীবন্ত পেয়েছে ওরা। চারটে দল ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কোন দিকে কে জানে। বাকিগুলো মরে পড়ে আছে মাটিতে।
দুটো ঘোড়ায় চড়ে বসলো ফার্ণান্দে। ও কুয়াশা। বাকি দশটায় চাপানো হয়েছে সোনার নাস্তাগুলো। দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধেছে ফার্ণান্দো। দড়ির মাথা তার হাতে ধরা। সে ছুটলে ঘোড়াগুলোও ছুটবে পিছন পিছন } দল ছাড়া হবার ভয় নেই।
ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো ফার্ণান্দো একটা জোরালো শিস দিয়ে। দশটা ঘোড়াও ছুটলো তার পিছনে। কুয়াশা থমকে গেল। চিৎকার করে উঠলো সে, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো ফার্ণান্দো?’
| শর্টকাট রাস্তা। কথা না বলে এসো আমার সঙ্গে সঙ্গে,’ হাসতে হাসতে ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিলো ফার্ণান্দো চিৎকার করে।
গতি কমালো না ফার্ণান্দো কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলতে চাইছিল কুয়াশা। কিন্তু কিছু বললো না সে। ঘোড়ার খুরের শব্দে ফার্ণান্দোর কানে যাবে না তার কথা। বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে সে।
কিন্তু স্বস্তিবোধ করলো না কুয়াশা। যে রাস্তা ধরে সমতল ভূমিতে নেমে এসেছিল ওরা সে রাস্তা ধরেই কি ফিরে যাচ্ছে? উত্তর দিক বরাবর যাবার কথা। এখন ওদের। কিন্তু এটা কি উত্তর দিক? না তো। উত্তর-দক্ষিণ কোণ লক্ষ্য করে ছুটছে ওরা।
গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লো কুয়াশা খানিকক্ষণের জন্যে। সত্যিই কি শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফার্ণান্দো তাকে, নাকি অন্য কোথাও যেতে চায়। সে?
| যুক্তিতর্ক খাড়া করে কুয়াশার মনে হলো–অন্য কোথাও নিয়ে যাবারও যথেষ্ট কারণ এখন থাকতে পারে ফার্নান্দোর। গতরাতের কথা মনে পড়লো তার। ফার্ণান্দো জানতো কোন্ রাস্তা দিয়ে কতটুকু গেলে ডাকাত দলের সম্মুখীন হবে তারা। ইচ্ছাকৃতভাবেই মোড় নিয়েছিল সে। এ কথা মানতেই হরে যে এ এলাকার পথঘাট সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোক ফার্ণান্দো। সেটা আরও ভয়ের কারণ। তাছাড়া কুয়াশা ফার্ণান্দো সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হতে পারছে না কোনমতে। লোকটিকে। অবিশ্বাস করতে কোথায় যেন বাধছে তার। ফার্ণান্দো যদি তার শুভানুধ্যায়ী না হতো, তবে অতগুলো মানুষকে হত্যা করে তাকে উদ্ধার করতো না। বৈজ্ঞানিক Kotze-এর লোক সে তাতেও সন্দেহ প্রকাশ করা চলে না। কুয়াশার নাম পর্যন্ত আগে থেকে জানতো সে। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না কুয়াশা। লোকটিকে। অসম্ভব শক্তিশালী লোক এ। রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করতে পারে।’ হাসি লেগে আছে সব সময় ঠোঁট জোড়ায়। গোফহীন লম্বা মুখে ছেলেমানুষি সরলতা ফুটে আছে। এমন একটি সুদর্শন এবং কঠোর পরিশ্রমী লোক আবার সোনার লোভে নিজের কর্তব্য পর্যন্ত তুচ্ছ মনে করছে। কথাটা ভাবতেই যেন। কেমন লাগে কুয়াশার। তার ওপর লোকটার হিংস্রতার কথা মনে পড়ে কুয়াশার। আরও কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করলো কুয়াশা। হঠাৎ তার মনে হলো, ফার্ণান্দোকে চিনতে কোথাও সে ভুল করেছে।
বেলা বারোটা।
ঠিক তেমনি ভাবে ছুটছে ওরা। ফার্ণান্দো তুফানের মতো ঘোড়ার গতি, বাড়িয়ে দিয়েছে। পিছনে ধুলো উড়িয়ে চলেছে দশটা ঘোড়া, তার পিছনে কুয়াশা।
ঘণ্টাখানেক ধরে চেষ্টা করছে কুয়াশা সামনের ঘোড়াগুলোকে পেরিয়ে ফার্নান্দোর কাছে পৌঁছবার জন্যে। কিন্তু রাস্তা জুড়ে চলছে ঘোড়াগুলো। উদ্দেশ্যটা কোনো মতেই সফল হচ্ছে না আর।
কয়েকবার চিৎকার করে ডাকলো কুয়াশা ফার্ণান্দোকে। গতির নেশায় পেয়েছে ফার্নান্দোকে। কোনদিকে ঐক্ষেপ না করে ঝড় তুলে ছুটছে তার ঘোড়াটা। রুক্ষ বিজন ভূমিতে ঘোড়ার পদশব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে
১৫৭
। মাথার উপর উঠে এসেছে সূর্য। ঘামছে ওরা। ঘোড়াগুলোর শরীরও সিক্ত হয়ে উঠেছে।
রাস্তাটা হঠাৎ বেশ খানিকটা চওড়া হয়ে গেছে। সুযোগটা গ্রহণ করলো কুয়াশা। ঘোড়াগুলোকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছোটালো সে। স্পষ্ট দেখতে পেলো কুয়াশা এবার ফার্নান্দোকে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে দুর্ধর্ষ লোকটিকে। পাহাড়ের একপাশে গভীর খাদ, অন্য পাশে প্রাচীর। মাঝখান দিয়ে ছুটেছে। ফার্ণান্দোর ঘোড়াটা। বাতাসে রুমাল এবং লম্বা চুল উড়ছে ফার্ণান্দোর। লম্বা শরীরটা সোজা হয়ে বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। থেকে থেকেই শিস দিচ্ছে সে। মাঝেমাঝে চারুক কষছে জিভ দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ উচ্চারণ করে।
কাজটা করার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালো কুয়াশা। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর নয়–এই মনে করে সিদ্ধান্তটা কাজে পরিণত করার পক্ষে সায় দিলো তার
মন।
স্টেনগানটা ভালো করে দেখে নিলো কুয়াশা একবার। দেখতে দেখতে হঠাৎ অদূরবর্তী কার্ণান্দোর দিকে চমকে উঠে তাকালো সে। তাকিয়ে আশ্বস্ত হলো। ফার্ণান্দো জানতে পারেনি এখনও তার এই নিকট উপস্থিতি। হঠাং স্প্যানিশ ভাষায় গান গেয়ে উঠেছিল বলে অমন চমকে উঠেছিল কুয়াশা।
স্টেনগানটা দেখে নিয়ে একহাতে লাগাম কষে ধরে রেখে অন্যহাতে স্টেনগানটার মুখ সামনের দিকে করলো সে। ঘোড়র গতি একটু বাড়ালো। দশ হাতের মধ্যে চলে যাবার পর ফার্ণান্দো টের পেলো তার উপস্থিতি। গান থামিয়ে হাসিমুখে পিছন ফিরে তাকালো সে কুয়াশার উদ্দেশে।
‘স্টেনগান ফেলে দাও!
চোখ কপালে উঠলো ফার্ণান্দোর কুয়াশার অগ্নিমূর্তি দেখে। কি যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। কুয়াশা লক্ষ্য স্থির করছে দেখে লাগাম টেনে ঘোড় থামালো সে। তার আগেই হাত থেকে ফেলে দিলো স্টেনগানটা।
ফার্ণান্দোর ঘোড়া আচমকা থমতে সতর্ক হলো কুয়াশা। সে-ও লাগাম টেনে ধরে ঠিক সময়মতো ঘোড়া থামিয়ে ফেললো। আর একটু দেরি করলে বিপদ ঘটতে পারতো। ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে এলেই ফার্ণালো সুযোগ নিতে পারতো কুয়াশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূরত্ব বজায় রেখে কুয়াশাকে ঘোড়া থামিয়ে ফেলতে দেখে স্পষ্ট নিরাশার চিহ্ন ফুটে উঠলো ফার্ণান্দোর মুখে। মনে মনে হাসলো কুয়াশা অকস্মাৎ বিপদে পড়েও কুটবুদ্ধি হারায়নি লোকটা।
চোখের দৃষ্টিতে বন্দী রেখে সতর্কভাবে নেমে পড়লো কুয়াশা ঘোড়ার পিঠ থেকে।
‘এসবের মানে কি কি করছো তুমি!
কথা নয়। তোমাকে আমি বন্দী করলাম। . ১৫৮
‘কিন্তু কেন?
কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই না আমি, কুয়াশা গম্ভীর কণ্ঠে বললো। তুমি যেমন তোমার মর্জি মতো যাচ্ছিলে যেদিকে খুশি, কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করোনি। তেমনি আমিও আমার কাজের ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত নই।’
অবাক গলায় প্রশ্ন করলো ফার্ণান্দো, তোমার ধারণা, আমি আমার মর্জি মতো যাচ্ছিলাম যেদিকে খুশি?’ |
কুয়াশা বললো, আমি জানি তুমি কথাটা অস্বীকার করবে। তাই ও সম্পর্কে কথা বলতে চাই না।’
| কুয়াশাকে স্থির প্রতিজ্ঞ দেখে একটু যেন অবাক হলো ফার্ণান্দো। বললো, তুমি কি আমার চেয়েও ভালো জানো এখানকার পথঘাট? বোকার মতো শুধু শুধু জেদটা বজায় রাখলে কোনদিনই তুমি পৌঁছুতে পারবে না শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের কাছে।
কুয়াশা স্টেনগানের মুখ একমুহূর্তের জন্যেও ফার্ণান্দোর দিক থেকে না সরিয়ে বললো, না, তোমার চেয়ে ভালভাবে এখানকার পথঘাট চিনি না আমি। আসলে ভালভাবে তো দূরের কথা, পথঘাট চিনি-ই না আমি এখানকার। এবং এ-ও জানি যে তুমি এখানকার রাস্তা সম্পর্কে ওস্তাদ মানুষ। সেজন্যেই তো তোমার উপর আর নির্ভর করতে চাই না।
‘তার মানে! তুমি শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের কাছে হাজির হতে চাও না নাকি?
সেটাই চাই আমি, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখন সেদিকেই যাবো আমরা।’ হাসলো ফার্ণান্দো এতোক্ষণে। বললো, আমি যেদিকে যাচ্ছিলাম সেদিকে তো যাবে না তুমি। কোন্ দিক দিয়ে গেলে সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে পারবে বলে মনে হয় তোমার?’ .
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো কুয়াশা। তার অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছে ফার্ণান্দো। অবশেষে কুয়াশা বললো, “রাস্তা আমি চিনি না বলেই তোমাকে বন্দী করেছি। এখন আমার কথা মতো শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে তুমি আমাকে Dr. Kotze-এর কাছে। বুঝলে?’
হাসি থামিয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো ফার্ণান্দো, ‘আমি সঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো বলছো?’ | ‘নিয়ে যেতে বা তুমি–তুমি এখন আমার হাতে বন্দী একথা ভুলে যেয়ে
।’ ‘
ফার্ণান্দো হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলো এবার। বললো, যে পথে যাচ্ছিলাম, সেটা ছাড়া আর কোনো শর্টকাট পথ আমার জানা নেই। এখন কি করবে তুমি?’
ফার্ণান্দোর ডান হাতটা নিশপিশ করছে লক্ষ্য করলো কুয়াশা। কি মনে করে পিছনের ঘোড়াগুলোর দিকে তাকালো সে ঘাড় বাঁকিয়ে। পরমুহূর্তেই এক লাফে
একদিকে সরে গিয়ে গুলি করলো সে।
১৫৯
| ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলো ফার্ণালো। পকেট থেকে রিভলভারটা অর্ধেক। বের করে এনেছিল সে। গুলি লেগে পড়ে গেল সেটা ছিটকে খাদের নিচে।
‘শেষবার বারণ করেছি তোমাকে ফার্ণান্দো–আমার সঙ্গে কোনো রকম চালাকি খাটাতে চেষ্টা করো না।
* চুপ করে তাকিয়ে রইলো ফার্ণান্দো কুয়াশার দিকে। খানিকটা দড়ি জোগাড় করে নিলো কুয়াশা। তারপর পিছনে গিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো ফার্ণান্দোর হাত দুটো।
‘আমাকে তুমি চেনো না কুয়াশা। কোনমতে তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবো না আমি। দেখি কি করতে পারো তুমি।’
. কুয়াশা নিজের ঘোড়ায় চড়ে বসলো। পিছনের দশটা ঘোড়ার দড়ি এখন তার হাতে। ফার্ণানন্দার কথা শুনে সে বললো, তাহলে স্বীকার করছো তুমি যে ভুল পথে। নিয়ে যাচ্ছিলে এতক্ষণ আমাকে?’
একটু চুপ করে থেকে ফার্ণান্দো অদ্ভুত নিরস কন্ঠে বললো, এরপর থেকে একটি কথাও তুমি বলতে পারবে না আমাকে দিয়ে।
ভালো কথা। আমিই চেষ্টা করে দেখি সেই মূল রাস্তাটায় পৌঁছুতে পারি কিনা। কিন্তু মনে রেখো, তোমাকে এর জন্যে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
নির্বিকার বসে রইলো ফার্ণান্দো অন্যদিকে তাকিয়ে। কুয়াশার কথা যেন শুনতেই পায়নি সে।
‘এই গফুর,কি দেখছিস অমন করে?’ :
খামোকা ধমক মারলো-কামাল গফুরকে। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো দোষ করেনি সে। তিন হাত দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে কামালের মাথার দিকে
অবাক হয়ে তাকিয়ে।
এই নিয়ে দু’বার ধমক খেলো সে। প্রথমবার সরলভাবে একটা প্রশ্ন করেছিল সে তার কামালদার উদ্দেশে? তা শোনাও না কামালদা, কেন জংলীরা অমন করে তোমার মাথা কামিয়ে দিলো।
ভালো কথা মনে করেই জিজ্ঞেস করেছিল সে কথাটা। আসলে জংলীদের কথা ভুলতে পারছিল না সে। পারবেও না জীবনে। যে শান্তি পোহাতে হয়েছে তা কি জীবনে ভোলা যায়? সে ভেবেছিল তার মতো তো কামালদাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। তা সত্ত্বেও মাথা কামিয়ে দিলো কেন জংলীরা? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে
১৬০
‘
–
এর মধ্যে। সেই কথা মনে করেই প্রশ্ন করেছিল সে। তা, কামালদা যে অমন করে ধমকৈ উঠবে তা কে জানতো। | প্রশ্নটা শুনেই মারতে এলো কামাল। বললো, আবার যদি ওকথা মুখে আনবি তো ধাক্কা মেরে খাদের নিচে ফেলে দেবো, দেখিস।’
সেই থেকে ঐ ব্যাপারে কথা বলেনি আর গফুর। কামালদা ভুলে গেছে ব্যাপারটা, ভালো গফুর। তা নয়তো গান গাইছিল কেন একটু আগে। এখনও কিছু বলেনি গফুর। কামালদাকেই একমাত্র জয় করে সে। সবার কাছে মাতব্বরি চলে, কিন্তু কামালদার কাছে চলে না ওসব। রেগে গেলে বেইজ্জত করে বসবে হয়তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কামালদার মাথার দিকে তাকিয়ে ভাবছি সে, কি আশ্চর্য! কেন এমন করলো জংলীরা? কি রহস্য আছে এর ভিতর?
কি রে, কথা বলছিস না যে?’ থতমত খেয়ে গফুর বললো, ‘কই, কিছু দেখছি না তো, কামালদা।
‘দেখছিস না তো যা, সরে যা আমার সামনে থেকে, রুমাল দিয়ে নেড়া মাথাটা ঢেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো কামাল। কি মনে করে তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে। রইলো গফুর।
মহুয়া ব্যাগ থেকে প্লেট বের করে খাবার সাজাচ্ছিল। শুনতে পেয়েছে সে ওদের কথা। চোখ তুলে তাকালো সে গফুরের দিকে একবার। তারপর, আবার কাজে হাত দিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, এদিকে আয়, গফুর, স্টোভটা জ্বালিয়ে পানি। গরম কর। কফি বানাতে হবে। কামালের হাঁড়িপানা মুখের দিকে একবার তাকিয়ে। সরে গেল গফুর। কামাল রুমালটা দিয়ে ভালো করে বাঁধতে চেষ্টা করলো এবার মাথাটা।
ভোর চারটের দিকে সৈনিককে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে হাঁটা পথে রওনা হয়েছিল ওরা। প্লেনে যাবার কথা ছিলো ওদের। কুয়াশা হঠাৎ শুক্রর হাতে বন্দী হবার পর অনেক ভেবে চিন্তে পূর্ব পরিকল্পনা বাদ দিলো শহীদ। বৈজ্ঞানিক কোড ব্যবহার করেছিল তার ঠিকানা জানাতে। প্লেনে করে গেলে গোলমাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। কুয়াশার কেবিনে একটা ম্যাপ পাওয়া গেল। যেটা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল শহীদ। সাজানো বলে কোনো জায়গার চিহ্ন পর্যন্ত নেই ম্যাপটায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার কথাটা। বন্দী হয়ে সৈনিক থেকে নামবার সময় কুয়াশা . বলেছিল, ‘No man’s land!’
ম্যাপটায় নজর ফেলতেই ভেসে উঠলো পাহাড় চিহ্নিত এলাকাটা। ছোট্ট করে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে দেখতে পেলো শহীদ-No man’s land!
ম্যাপটা দেখতে দেখতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শহীদ হাঁটা পথে যাত্রা শুরু করবে। তারা। প্রথমত গোলমাল হবার ভয় কম এতে। কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে। ১১-
‘১৬১
হবে না। তার উপর কুয়াশাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে পথে সেই পথেই যাওয়া, ভালো বলে বিবেচনা করলো সে। পথে হয়তো দেখা হয়ে যেতেও পারে কুয়াশার সঙ্গে। | বেলা ন’টার সময় এক জায়গায় বসে নাস্তা এবং বিশ্রাম দুটোই সেরে নিয়েছে তারা। দশটার সময় আবার যাত্রা শুরু করেছিল। দু’ঘণ্টা হেঁটে আবার থেমেছে ওরা মধ্যাহ্ন ভোজন এবং বিশ্রামের জন্যে। | মহুয়া খাবার সাজাচ্ছে। কাছাকাছি একটা ঝর্না থেকে পানি নিয়ে এসে ডান পাশের পাহাড়ের আড়ালে কিসের জন্যে কে জানে গেছে শহীদ অ্যাটাচি কেসটা হাতে নিয়ে। মি. সিম্পসন স্নান করতে গেছেন। লৌহমানব দুটোকে বোঝা টানার ভার দেয়া হয়েছে। পিছনে আছে তারা। আপন মনে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে তারা। ইচ্ছা করেই তাদেরকে পিছনে রেখেছে শহীদ। কুয়াশা যদি পিছনে পড়ে থাকে ঘটনাচক্রে তাহলে হয়তো লৌহমানবের চোখ দিয়ে পিছনের অঞ্চলটা দেখার সময় শহীদ কুয়াশাকেও দেখতে পাবে। তাই একবারের জন্যেও কাছ ছাড়া করেনি শহীদ অ্যাটাচি কেসটা। | ‘এসো কামালদা, খেয়ে নেই আমরা।’
চোখ বুজে কি যেন ভাবছিল কামাল। মহুয়ার ডাকে চোখ মেলে তাকে সে। হঠাৎ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল কামালের। কুয়াশার জন্যে মন ভালো নেই মহুয়ার। কথা বলছে না সে ভালো করে। হাসি তো, একেবারেই উবে গেছে তার মুখ থেকে।
ধীরে ধীরে উঠে পড়লো কামাল। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে এসে বসলো কামাল। বললো, এখন খাবো না।’
‘কেন? ওর জন্যে অপেক্ষা করবে নাকি?’ শহীদের কথা ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করলো মহুয়া।
। চোখ বুজে ধ্যান করার মতো দু’হাঁটুতে হাত রেখে কামাল বললো, আমি এখন সাধনায় বসছি। কুয়াশার কথা সব বলে দেবো আমি পাঁচ মিনিট পর।’
‘দাদার কথা?’ শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলো মহুয়া; “কি বলবে তুমি দাদার কথা?’
‘তাকে শত্রুরা বন্দী করার পর থেকে এখন পর্যন্ত কি ঘটেছে সব জানতে পারবো আমি। অপেক্ষা করো, পাঁচ মিনিট।
শহীদ পাহাড়ের বেশ খানিকটা উপরে উঠে পড়েছিল একা। দূর দূরান্তে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল সে। কুয়াশাকে দেখতে পাবে মনে করে পাহাড়ের এতোটা উপরে উঠে এসেছে সে। কিন্তু না, যতদূর পাহাড়ের বাধা নেই ততদূর ১৬২
অবধি বেশ খানিকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে নিরাশ হলো শহীদ। পাহাড় থেকে নেমে আসছিল, কি মনে করে অ্যাটাচি কেসটা খুলে সুইচ টিপলো সে। টেলিভিশনের পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার সাথে সাথে আশ্চর্য হলো শহীদ। লৌহমানবদ্বয় খুব বেশি দূরে নেই। কোয়ার্টার মাইল হবে বড়জোর। কিন্তু সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। শহীদ লৌহমানবের কাছাকাছি দেখতে পেলো চারটে ঘোড়াকে।
| চারটে ঘোড়ার পিঠেই জিন লাগানো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটিতেও আরোহী নেই। ক্লান্ত শ্রান্ত পদক্ষেপে একটা জায়গায় চরে বেড়াচ্ছে ঘোড়া চারটে।
সুইচ টিপে লৌহমানবদ্বয়কে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড় করালো শহীদ। ঘোড়াগুলোর মালিকদেরকে দেখা যাচ্ছে না টেলিভিশনে। তা হোক, মালিক থাকলেও কিছু এসে যায় না। ঘোড়াগুলো শহীদদের দরকার। হাঁটার পরিশ্রম সহ্য করা যাবে না। বেশিক্ষণ। এইভাবে শুথ গতিতে হাঁটলে অনেক দিন লেগে যাবে বৈজ্ঞানিক Kotze-এর আস্তানায় গিয়ে পৌঁছুতে। ঘোড়াগুলোকে বরং ধরে আনাই বুদ্ধিমানের। কাজ। .
| লৌহমানবদ্বয়কে পাঠিয়ে দিলো শহীদ ঘোড়াগুলোর কাছে। ধীরে শান্ত পদক্ষেপে ওরা ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছুলো। বিনা কষ্টে ধরে ফেললো ওরা দুজন। দুটো মোড়ার লাগাম। কিন্তু অপর দুটো ঘোড়া ভারী চালাক। কাছে ঘেঁষতে দেয়।
মোটেও। অনেক চেষ্টা করলো শহীদ। কিন্তু যতো ধীরে কাছে পৌঁছুতে চাক লৌহমানব, ঠিক দেখে ফেললো ঘোড়াগুলো। লাফ দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।
কিন্তু ধরা পড়তেই হলো অবশেষে। মোট তিনটে হতেই সন্তুষ্ট হলো শহীদ। বাকি একটির জন্যে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করলো না তার। সেটা বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে ভয় পেয়ে।
| ঘোড়ার লাগাম ধরে চললো লৌহমানবদ্বয় যান্ত্রিক পা ফেলে ফেলে।
অ্যাটাচি কেসটা বন্ধ করে দিয়ে মৃদু হাসলো শহীদ। পাহাড় থেকে নামতে নামতে ভাবলো সে, বেশ তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে সকলকে। কামাল তো চিত্তার
জুড়ে দেবে আনন্দে। ও একটু আরামপ্রিয় কিনা।
কিন্তু কামাল এমনিতেই আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। পাহাড় থেকে নেমে এগিয়ে আসছিল শহীদ, এখনো দেখতে পাচ্ছে না সে ওদেরকে! কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে কামালের চিৎকার। গলা ফাটিয়ে গান গাইছে কামাল।
মোড়টা ঘুরতেই চমকে উঠলো শহীদের অন্তরাত্মা। চট করে শরীরটা লুকিয়ে ফেললো সে পাহাড়ের একপাশে। হতভম্ব হয়ে সে দেখলো বারজন কাঠ-খোট্টা গোছের স্থানীয় লোক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে মহুয়ার পিছনে। মহুয়া পিছন ফিরে। বসে কি যেন কাজ করছে মাথা নিচু করে। গফুর পাশ ফিরে বসে স্টোভটা পরিষ্কার
১৬৩
*
–
করছে। আর কামাল চোখ বন্ধ করে গলা ফাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি আওড়াচ্ছে-বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
ওরা কেউই টের পায়নি, ডাকাতের মতো চেহারার বারোজন অপরিচিত লোক নিষ্ঠুরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছে ওদের দিকে। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করলো শহীদ। অ্যাটাচি কেসটা খুলে ফেললো তাড়াতাড়ি। লৌহমানবদ্বয়ের গতি চূড়ান্ত করে দিয়ে আবার বন্ধ করে দিলো সেটা। | কবিতাটা সম্পূর্ণ না করেই চোখ মেললো কামাল। চোখ মেলেই সঙ্গে সঙ্গে
আবার চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো সে। একি দেখলো সে? স্বপ্ন, না সত্যি?
ধীরে ধীরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো কামাল চোখ বন্ধ রেখেই। কিন্তু হাতটা আর বের করতে হলো না তাকে। ঝাঁপিয়ে পড়লো দু’জন লোক তাব উপর। এবার আর কোনো সন্দেহই রইলো না কামালের। ঠিকই দেখেছিল সে। পলকের জন্যে চোখ মেলে–ডাকাতে ধরেছে ওদেরকে। .
শহীদ আগেই লক্ষ্য করেছে লোকগুলোর হাতে ছোরা ছাড়া আর কোনো অস্ত্র শস্ত্র নেই। কিন্তু তবু সে আড়াল থেকে বের হয়ে এলো না। লৌহমানবের খটখট। যান্ত্রিক পদশব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে–এসে পড়বে ওরা এখুনি।
একটু আগে কামাল কবিতা পড়ছিল–বিপদে না যেন করি আমি ভয়।
শহীদ দেখলো নিরুপায় ভয়ে চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে যে তাঁর। কাবু করে ফেলেছে লোক দুজন সহজেই কামালকে। ছটফট করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে শহীদের জন্যে। গফুরকে ধরে রেখে দিলো তিনজন মিলে। বাকি সাতজন লোক মহুয়ার সাজানো প্লেটগুলো হাতে নিয়ে খেতে। শুরু করেছে গোগ্রাসে। তারই মাঝে সময় করে চকচকে দৃষ্টিতে মহুয়ার আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহুয়া। মুখটা দেখা যাচ্ছে না তার। | প্লেটগুলো শেষ করতে দু’মিনিট লাগলো ওদের। ঠিক এমনি সময়ে লৌহমানবন্দ্বয়ের আবির্ভাব ঘটলো মঞ্চে। চকিতে ঘাড় বাঁকিয়ে, তাকালো লোকগুলো ভারি পদশব্দ শুনে। ঝন্ঝন করে ভাঙলো হাত থেকে প্লেটগুলো পাথরের উপর পড়ে। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওরা আগাগোড়া দুটো লোহার মানুষকে তিনটে ঘোড়া টেনে নিয়ে আসতে দেখে।
| ‘পিছনে না তাকিয়ে দূর হয়ে যাও যতদূর পারো। তা না হলে প্রাণ হারাতে হবে।
| পাথরের আড়াল থেকে উদ্যত রিভলভার হাতে নিয়ে লোকলোর পিছন দিকে এসে দাঁড়ালো শহীদ। যন্ত্রচালিতের মতো পিছন ফিরলো সবকটা লোক; শহীদের হাতে রিভলভার দেখে প্রত্যেকে হাত তুললো মাথার উপর।
যাও!’ গর্জন করে উঠলো শহীদ। ১৬৪।
—
.
..
3—
—
.
ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ালো ওরা কামাল এবং গফুরকে ছেড়ে দিয়ে। ভয়ে ভয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। টকটকে দুজোড়া লাল চোখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ওরা। মাথা নিচু করে আড়চোখে লৌহমানবদ্বয়ের তৎপরতা লক্ষ্য করতে করতে হাঁটা শুরু করলো ওরা। লৌহমানবদ্বয়কে ছাড়িয়ে গিয়েই খিচে দৌড় লাগালো লোকগুলো। মাইলখানেক দূরে না গিয়ে থামবে বলে মনে হয় না, শহীদ হাসতে হাসতে ভাবলো।
লোকগুলো দূর হয়ে যেতে সংবিৎ ফিরে এলো ওদের। ঘোড়াগুলোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে লৌহমানবদ্বয়। কামাল জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো, কোথায় পাওয়া গেল ঘোড়াগুলো, তার আগেই সব কথা বললো শহীদ। শেষে বললো, বিপদে যেন ভয় না পাস তার জন্যে শুনলাম তুই প্রার্থনা করছিস। কিন্তু…’। | ‘জি না। জোর গলায় বললো কামাল, ‘ভয় আমি পাইনি। তাছাড়া আমি প্রার্থনাও করছিলাম না। কুয়াশার ভাগ্যে যা ঘটেছে তাই বলতে যাচ্ছিলাম তামি।
| বুঝতে পারলো না শহীদ ঠিক কামালের কথা। কামালও হৃক্ষেপ করলো না তার দিকে। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে সে বললো, ধ্যান করে দেখলাম কুয়াশাকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে একদল লোক, আর কুয়াশা মনে মনে গাইছে। বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
| ‘তারপর? বেশ আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলো গফুর। কাছে এগিয়ে এলো। সে একটু কামালের। এবার আর রাগ করলো না কামাল। বলতে লাগলো সে, ‘একটা গুহায় নিয়ে গিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল কুয়াশাকে। গভীর রাতে প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ভার। চোখ মেলে সে দেখলো গুহাটা ধোয়ায় ভরে গেছে। আর. সে কি গোলাগুলির শব্দ! কান পাতা দায় হয়ে পড়লো কুয়াশার। যাই হোক একটু পর ধোয়া সরে যেতে দেখা গেল সবগুলো শত্রু মরে পড়ে আছে। কেবল তিনজন লোককে জীবন্ত দেখা গেল। এগিয়ে এলো তারা কুয়াশার দিকে। তার বাঁধন খুলে দিলো। তারপর তার নিজেদের পরিচয় দিলো। বৈজ্ঞানিক Kotze-এর লোক আসলে এরা। কুয়াশাকে মুক্ত করতে
এসেছিল।’
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মহুয়ার মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে দেখতে পেলো কামাল। হাসছে মহুয়া কামালের কথা শুনে। দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু করলো আবার সে কুয়াশার ভাগ্যের কথা বলতে।
অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বানিয়ে বানিয়ে বললো কামাল। মহুয়া হাসতে হাসতেই কাজ সারছে। নতুন প্লেট বের করে আবার খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করছে সে। কামালের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো সে, এখনকার খবর কি বলো তো দাদার?’
‘প্লেনে চড়বার জন্যে অ্যারোদ্রোমে অপেক্ষা করছে সে।’ গুরুমশায়ের মতো কথাটা বলে খেতে শুরু করলো সে। শহীদ বুঝলো ব্যাপারটা। মহুয়াকে আনন্দিত করার জন্যেই হাসিখুশির মধ্যে সময় কাটাতে চাইছে কামাল। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘কামালের কথায় কোনো সন্দেহ নেই আমার। আমার কল্পনার সঙ্গে ওর দিব্যদৃষ্টি হুবহু মিলে যাচ্ছে।
এসো খেতে বসে। এবার। সহজ, সুস্থ কণ্ঠে কথাটা বললো মহুয়া। মনমরা ভাবটা এখন আর নেই তার মধ্যে। কামাল ও শহীদ না জেনেই এইসব কথা বলছে। তা জানে। কিন্তু তাহলেও খুব ভালো লাগলো তার কথাগুলো শুনতে।
.
সাত
তুফানের মতো আলোড়ন তুলে ছুটছে কুয়াশা। পাশেই রয়েছে বন্দী অবস্থায় ফার্ণালো। পিছনে দশটা ঘোড়া।
| ঝাড়া একঘণ্টা ছুটে থামলো কুয়াশা। ফার্ণান্দো তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তার বিপরীত দিকটা বেছে নিয়েছিল সে। ভেবেছিল যেখানে ডাকাত দলের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল সেখানে পৌঁছুতে পারবে। কিন্তু ভুল হয়ে গিয়েছিল পথ। আধঘণ্টাটাক ছুটেই থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। দুটো রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের দু’দিকে।
| কোনদিক দিয়ে ফার্নান্দো নিয়ে এসেছিল তাকে স্মরণ করতে পারলো না কুয়াশা। ফার্ণান্দোর দিকে তাকালো সে। নির্বিকার বসে আছে সে ঘোড়ার পিঠে। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলো না। প্রশ্ন করে লাভ নেই, ফার্ণান্দোকে দিয়ে কথা বলানো যাবে না জানে কুয়াশা। আন্দাজে নির্ভর করে একটা রাস্তা বেছে নিলো সে। ভুল পথটাই দুর্ভাগ্যক্রমে বেছে নিলো সে নিজের অজান্তে। মনে মনে হাসলো শুধু ফার্ণান্দো।
আরো: আধঘন্টা ঘোড়া ছুটিয়ে একটা ঝর্না দেখে ঘোড়া থামালো কুয়াশা। বিশ্রাম দরকার।
দু’হাত দিয়ে ধরে ফার্ণান্দোকে নামালো কুয়াশা ঘোড়ার পিঠ থেকে। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে নিচু ঝর্না থেকে পানি খাবার জন্যে ঝুঁকে পড়লো। ফার্ণান্দোও এসে বসলো কুয়াশার মুখোমুখি। পানি খাওয়া হলো না কুয়াশার। উঠে গিয়ে খুলে দিলো সে ফার্ণান্দোর হাতের বাঁধন। ফার্নান্দো ঝুঁকে দু’হাতের আঁজলা ভরে পানি
খেলো।
রিভলভারটা হাতে নিলো কুয়াশা। আবার বসলো সে পানি খাবার জন্যে। ১৬৬
এক হাতের চেটো ভরে পানি খেলো সে। দ্বিতীয়বার ঝুঁকতে গিয়েই থমকাল সে। ফার্নান্দো তার মুখোমুখি বসে নিশপিশ করছে। নির্নিমেষে একজোড়া সন্ধানী দৃষ্টি কুয়াশার দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টায় মগ্ন। | কঠিন চোখে তাকিয়ে নিঃশব্দে তিরস্কার করলো কুয়াশা ফার্ণান্দোকে। তারপর আবার সে ঝুঁকে পড়লো পানি তোলার জন্যে। কিন্তু এবারও পানি খাওয়া হলো না তার। কুয়াশা মাথা নিচু করতে গেলেই ফার্ণালোও অল্প একটু ঝুঁকে পড়ে। সুযোগ বুঝলেই ধাক্কা মারবে সে। চিৎ করে দেবে কুয়াশাকে।
বারবার তিনবার একই ব্যাপার ঘটলো। দুজনেই বোবা যেন। শেষবার মৃদু কণ্ঠে কুয়াশা বললো, “আচ্ছা পাগল তো! পানি খেতে দেবে না নাকি?”
‘আমাকে না বেঁধে অসম্ভব।
হেসে ফেললো কুয়াশা। ফার্ণালো কিন্তু নির্বিকার ভাবেই বললো কথাটা। | হাত দুটো না বেঁধে উঠে গিয়ে ফার্ণান্দোর পুঁটলিটা খুললো কুয়াশা। মাংস ছিলো ওতে, গমের রুটিও ছিলো কয়েকখানা। দুটো রুটি এবং মাংস দিলো কুয়াশা ফার্ণান্দোকে।খেতে শুরু করলো ফার্ণান্দো। এই ফাঁকে মুখ হাত ধুয়ে নিলো কুয়াশা।
কুয়াশার খাওয়া শেষ হতে বললো, “বদর।’ কি বললে?’ কুয়াশা জিজ্ঞেস করলো।
ফার্নান্দো বললো, বাঁদর দেখতে পাচ্ছে না? ঐ দিকের পাহাড়ের দিকে চোখ মেলে দেখো।
ফার্ণানন্দের কথা শুনেও তখুনি পাহাড়ের দিকে তাকালো না সে। ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলো ফার্ণান্দোর হঠাৎ এই কথা বলার উদ্দেশ্য। বেশ খানিকটা দূরে বসে আছে সে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সফল হবে
সে।
ঘাড় বাঁকিয়ে দূরের পাহাড় সারির দিকে তাকালো কুয়াশা। ঠিকই, পাহাড়ের সর্বত্র বাঁদর দেখা যাচ্ছে। কুয়াশা আবার তাকালো. ফার্ণালোর দিকে।
. হঠাৎ বাঁদরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কেন তুমি?’
কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে মিটিমিটি হাসলো কাৰ্ণানন্দা। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো সে। একটু পর বললো শুধু, এদিকে আরো নানা জাতের বাঁদর দেখতে পাওয়া যায় কিনা–তাই।’
কুয়াশা ফার্ণান্দোর বক্তব্য ঠিক বুঝতে পারলো না। কিন্তু কেন যেন মনে হলো তার ফার্ণান্দোর কথার একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আছে। রহস্য করে সে বক্তব্য জানালো ফার্ণান্দো। ইচ্ছে করেই আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কুয়াশা ওকে? উত্তর দেবে না ফার্ণান্দো, সে জানে।
পরিমিত বিশ্রাম নিয়ে ঘোড়ায় চড়লো আবার কুয়াশা। ঘোড়াগুলোর ক্লান্তিও
১৬৭
দূর হয়েছে। ফার্ণান্দোর হাত পা বেঁধে রেখে ঘোড়াগুলোকে ঘাস খাইয়ে নিয়ে এসেছে সে।
ঘণ্টাখানেক সামনের দিকে এগোবার পর ধু-ধু প্রান্তরের চিহ্ন দেখা গেল। ঘোড়া থামিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিলো কুয়াশা। দু’পাশের পাহাড়গুলো কমপক্ষে মাইল চার পাঁচ দূরে হবে। সামনের পাহাড়ের সারির দূরত্ব আরো কম। মাইল তিনেক হবে বড় জোর। উঁচুও অনেক বেশি মনে হলো কুয়াশার। সামনের দিকের পাহাড়েই হয়তো গিরিপথ পেয়ে যাবে ওরা, কুয়াশা আশা করলো। পথ সে
হারিয়ে ফেলেছে অনেকক্ষণ আগেই। ডাকাতদের সঙ্গে যেখানে সংঘর্ষ হয়েছিল সেখানে পৌঁছুতে পারেনি সে। আন্দাজে ভর করে দিকটা ঠিক রেখে এগোচ্ছে সে। ভাগ্য ভালো হলে, পেয়ে যেতেও পারে মূল পাহাড়ী রাস্তাটা এইটুকুই যা ভরসা।
গোলক ধাঁধার মতো পথঘাট এখানকার? মূল রাস্তা থেকে হাজারটা শাখা উপশাখা বেরিয়ে গেছে। মূল রাস্তাটা একবার হারিয়ে ফেললে খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অজ্ঞ লোকের পক্ষে খুঁজে বের করা তো আরো কঠিন। ফার্নান্দোর দিকে একবার তাকিয়ে মুখের ঘাম মুছলো কুয়াশা। হাসছে ফার্ণান্দে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। মুখ ফিরিয়ে নিলো কুয়াশা। তারপর কষে একটা চাবুক মারলো সে ঘোড়ার পিঠে। টগবগিয়ে ছুটতে শুরু করলো বলিস্ট জানোয়ারটা কুয়াশাকে নিয়ে।
ফার্ণান্দোর ঘোড়াও ছুটলো কুয়াশার পাশাপাশি। তীক্ষ্ণ একটা শিস দিলো, ফার্ণান্দো অকারণ আনন্দে। তারপর মৃদু কণ্ঠে একটা গান পালো লে; ক্রমশ উঁচু পর্দায় চললো ফার্ণান্দের গান। ঘোড়া লাফাচ্ছে বলে কবর থমকে থমকে যাচ্ছে। কষ্ট করে গাইতে হচ্ছে তাকে। তবু থামছে না সে।
ধু-ধু প্রান্তরের মাঝখানে এসে পড়লো ওরা। সামনের পাহাড় সারির দিকে তাকাচ্ছিল কুয়াশা মাঝে মাঝে। মনে মনে ভাবছে সে অনেক কথা। শহীদরা এখন কতদূর এগোতে পেরেছে কে জানে। Dr. Kotze-এর অবস্থা ভালো না মন্দ। ঠিকসময় পৌঁছতে পারবে না, নাকি সে? গিয়ে যদি দেখে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাহলে আফসোসের সীমা থাকবে না তার। সেক্ষেত্রে এই গোঁয়ার লোকটিকে . ছেড়ে দেবে না সে। কঠিন শাস্তি পেতে হবে কুয়াশার হাতে। দেরি করে পৌঁছবার
কারণই হলো লোকটার অসহযোগিতা।
..
..
আর এক পা-ও সামনে এগিয়ে না কুয়াশা।
স্পষ্ট সাবধান রাণী শুনতে পেলো কুয়াশা মনের ভিতর থেকে। লাগাম টেনে ধরে ঘোড়া থামালো সে সঙ্গে সঙ্গে। ফার্ণাদোর দিকে তাকাতে দেখলো এখনও মিটিমিটি হাসছে সে।
| ‘দেখতে পেয়েছে তাহলে?’ দৃপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ফার্ণাদো। ১৬৮
‘কি দেখতে পাবার কথা বলছো?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফার্নান্দোর দিকে তাকালো কুয়াশা।
‘এখনও নজরে পড়েনি তাহলে! ঠিক আছে, অপেক্ষা করো, একটু পরেই দেখতে পাবে। কিন্তু হঠাৎ তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে কেন হে? বন্দী তো আগেই করেছো, এবার নতুন কিছু করার ইচ্ছা হয়েছে বুঝি?’।
| কথা বললো না আর কুয়াশা। সামনের পাহাড়ের দিকে আবার তাকালো সে অন্যমনস্কভাবে। আরে কি ব্যাপার? চোখ দুটো ঝলসে উঠলো কুয়াশার আলো পড়ে। পাহাড়ের উপর থেকে কে যেন আলোর সঙ্কেত দেখাচ্ছে।
ক্রু কুঁচকে তাকালো কুয়াশা ফার্ণান্দোর দিকে। হাসছে সে বেপরোয়া ভঙ্গিতে।
‘আয়নার সাহায্যে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে ওরা, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো ফার্ণান্দো।
কারা এরা! কাদেরকে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে?’ | * পেরুর সরকারী সৈন্য ওরা। আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি তার চতুর্দিকেই ওরা আছে। পেরুর মুক্তিবাহিনীকে গ্রেফতার করার জন্যে জায়গায় জায়গায় ক্যাম্প। ফেলে রেখেছে ওরা বহুদিন ধরে। | ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো কুয়াশা চারদিকে। ঠিকই বলেছে ফার্ণান্দো। চারপাশেই সরকারী বাহিনী আছে। লোকজনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে আয়নার মারফত সঙ্কেত পাঠানো হচ্ছে চতুর্দিক থেকেই।
কি সঙ্কেত পাঠাচ্ছে ওরা?’ কুয়াশা প্রশ্ন করলো।
মুক্তিবাহিনীর দুটো লোক ওদের হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে। ধরবে না ওরা আমাদেরকে। গুলি করে মারবে দূর থেকে।
কিন্তু আমরা কি মুক্তিবাহিনীর লোক?’
‘ওরা তাই মনে করছে। এদিকে সাধারণ লোকের যাতায়াত করার কথা নয়, নিষেধ আছে।’
ব্যাগ থেকে বিনকিউলার বের করে একে একে দেখলো কুয়াশা চারটে দিক। | ‘ওভাবে দেখে কোনো লাভ নেই।’ ফার্ণান্দো বললো, মৃত্যু, অবধারিত ধরে নাও! মোট ছ’টা রাস্তা আছে এই তেপান্তর থেকে বের হবার। সবগুলোই ওরা দখল করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কোনো উপায় নেই।’ ‘ ‘চাচামেচি করো না বলছি, থামো। ভাবতে দাও একটু আমায়,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললো এবার কুয়াশা।
‘কোনো লাভ নেই হে। ওদের হাত থেকে ফসকে যেতে পারবে না, ঠাট্টা করে বললো ফার্ণান্দো।
একটু পর কুয়াশা বললো, ‘ওরা আমাদেরকে না চিনেই গুলি করবে বলে বিশ্বাস করি না আমি। এ কাজ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের দ্বারা সম্ভব
১৬৯
নয়।’
‘খুবই সম্ভব। কেননা ওরা আমাদেরকে মুক্তিবাহিনীর লোক বলে মনে করছে।’
| ‘শুধু শুধু মুক্তিবাহিনীর লোক মনে করবে কেন?’ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো
কুয়াশা।
* শুধু শুধু নয়।’ ধীর, গম্ভীর, বিরস কণ্ঠে বললো ফার্নান্দো, ‘ওরা নিশ্চিত হয়েই গুলি করবে। ওরা জানে আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক।
. “তারমানে!’ খ্ৰী কুঁচকে চিৎকার করে উঠলো কুয়াশা।
আশ্চর্য হয়ো না, বন্ধু। আমাকে ওরা দূরবীনের মাধ্যমে দেখে ঠিকই চিনেছে। আমি যে ধরা পড়বো তা ওরা স্বপ্নেও আশা করেনি কখনও।
‘কি বলতে চাও তুমি, ফার্ণান্দো? তুমি কি মুক্তিবাহিনীর লোক নাকি?’ | শান্ত কণ্ঠে ফার্ণান্দো বললো, ‘মুক্তিবাহিনীর লোক বললে গুরুত্ব কম হয়– আমি পেরুর মুক্তিবাহিনীর অন্যতম মাথা। আমার গানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ আমেরিকান ডলার। এখন বুঝতে পেরেছো তো ব্যাপারটা? আমাকে ওরা ঠিকই চিনতে পেরেছে। আমার সঙ্গে তোমাকে দেখে একটুও সন্দেহ করছে না ওরা–মুক্তিবাহিনীর আর এক পাণ্ডা মনে করছে। গুলি খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ধরে নাও।
‘কিন্তু…. রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়লো কুয়াশা। ফার্ণান্দোর দিকে
. তাকালো সে। বললো, তুমি জানতে না আমরা ওদের হাতের মুঠোয় এসে পড়ছি?’
না। ঠিক এখানে আছে ওরা তা আমি জানতাম না। আমার ধারণা অনুযায়ী এখানে থাকার কথা নয় ওদের। আগে থেকে কোনভাবে খবর পেয়ে গেছে হয়তো ওরা।’ ‘
নির্বিকার কণ্ঠ ফার্ণান্দোর। কোনো দুশ্চিন্তা নেই যেন তার। মৃত্যু অবধারিত। তা যেন বিনা সন্দেহে মেনে নিয়েছে। হঠাৎ সে রেগে উঠে বললো, আমার সঙ্গে অমন বিশ্রী ব্যবহার না করলে এমনটি হতো না। তুমি জানো না, আমি যদি এইসব সোনা আমার মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারতাম তার ফল কি হতো, অস্ত্র নেই তাদের, খাবার নেই, শীতের আগমনী সঙ্কেত পাচ্ছি আমি–তাদের পরার মতো কাপড়চোপড়ও নেই। তারা আমার দিকেই আশায় আশায় তাকিয়ে আছে। এই যে ডাকাতদের হাত থেকে সোনা ছিনিয়ে নেবার পরিকল্পনা, এ আমার মুহূর্তের সিদ্ধান্ত নয়। বহুদিনের পরিকল্পনা ছিলো এটা আমার। তুমি, তুমি আমাকে ব্যর্থ করেছো। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। তুমি আমার সর্বনাশ করেছে। মৃত্যুকে ভয় করি না আমি, আমার আনন্দ হচ্ছে এই কথা ভেবে, আমার কথা না মেনে নিজের জেদ বজায় রাখার শাস্তি হিসেবে তোমাকেও আমার সঙ্গে গুলি খেয়ে ১৭০
মরতে হবে।
| এখনও ওরা এগিয়ে আসছে না। কুয়াশা ওদের গতিবিধি দেখছিল দূরবীনে চোখ লাগিয়ে। পাহাড়ের পাদদেশে ঘোরাফেরা করছে ওরা। সবচেয়ে কাছের পাহাড়গুলো সামনের দিকে। ওদিকে যাওয়া চলবে না। পিছনেও নয়। ডান পাশেও রয়েছে ওরা। সুতরাং ডান পাশটাও বাদ। বাম দিকে তাকালো কুয়াশা। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি। বহুদূরে পাহাড়গুলো। ওদিকে যাওয়াও সম্ভব নয়। পাহাড় শুরু হবার আগেই বিরাট বিরাট পাথরের খণ্ড ছড়ানো ছিটানো রয়েছে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে।
| ‘ওদিকে সরকারী বাহিনী নেই বটে, কিন্তু ওদিক দিয়ে বের হবার পথও নেই। দূরে বলে মনে হচ্ছে পাহাড়গুলো ততো উঁচু নয়।’
চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ফার্ণালো। গায়ের ঝাল মিটছে না তার কোনমতেই। কথার চাবুক মেরে কুয়াশাকে জব্দ করতে চাইছে সে।
কুয়াশা চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়েই চলেছে। ফার্ণান্দোর কথায় কান দিলো না সে।
‘একেবারে নার্ভাস হয়ে পড়লে যে হে! ব্যঙ্গ করলো ফার্ণান্দো, ‘খুব তত বাহাদুরি দেখিয়ে বন্দী করে ফেললে আমাকে। এবার যে তুমিই চিৎপটাং!
ধীরে ধীরে ফার্ণান্দোর দিকে তাকালো এবার কুয়াশা। অমনি চিৎকার করে ফার্ণান্দো বললো, তোমার সেই বাহাদুরি গেল কোথায়, উত্তর দাও।
| ফার্ণালোর দিকে তাকিয়ে হাসলো কুয়াশা। তারপর বললো ধীর-স্থির কণ্ঠে, ‘তুমি মনে করছে তোমার সঙ্গে আমি আছি বলে ওরা আমাকেও গুলি করে মারবে। কিন্তু তা ঘটবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।’
দিবাস্বপ্ন দেখছো তুমি,’ পি করলো ফার্ণালো। | ‘আমাকে আক্রমণ না করার একমাত্র কারণ হলো… কুয়া T মৃদু হেসে কথাটা শেষ করলো, তোমাকে আমি বন্দী করেছি ওরা দূরবীন দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সেটা।
ধীরে ধীরে নিভে গেল ফার্ণান্দোর মুখের ব্যঙ্গ ভরা হাসিটুকু। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে রু করলো সে।
‘ কুয়াশা বললো, ‘ওরা এগিয়ে আসার আগেই তোমাকে নিয়ে আমি ওদের কাছে পৌঁছে যেতে পারি। তোমাকে ওদের হাতে তুলে দিলে ওরা আমাকে পুরস্কৃত করবে, কি বলো?’
| একটি কথাও সরল না আর ফার্ণান্দোর মুখ থেকে। নিরাশায় ভেঙে পড়েছে সে ভিতরে ভিতরে। মাটির দিকে চোখ স্থির হয়ে আছে তার। দুশ্চিন্তায় মাথা যেন নুয়ে পড়ছে তার।
নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ফার্নান্দোর দিকে তাকিয়ে রইলো কুয়াশা। হঠাৎ মৃদু হাসি
১৭১
ফুটলো তার, ঠোঁটে। ফার্ণান্দোর স্টেনগানটা তার গোড়ার পিছনে বেঁধে রাখা হয়েছে। পিছন থেকে ‘স্টেনগানটা খুলে হাতে নিলো কুয়াশা। দ্বিধা না করে ফার্ণান্দোর হাতের বাঁধনও খুলে দিলো সে। তারপর তার ঘোড়াকে দু’কদম এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ফার্ণান্দোর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। উদাস এক জোড়া চোখ তুলে তাকালো ফার্ণান্দো কুয়াশার দিকে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ফার্ণানন্দার মুখের প্রতিটি রেখার ভাঁজ দেখলো কুয়াশা। একটু আশ্চর্য হলো ফার্ণান্দো কুয়াশার ব্যবহারে। | ‘কি দেখছো তুমি অমন করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ফার্ণান্দো। উত্তর দিলো না কুয়াশা। কি যেন, পরীক্ষা করছে সে ফার্ণানন্দার মুখের পানে তাকিয়ে।
‘মরতে ভয় পাচ্ছি কিনা দেখছে বুঝি?’ তেতো গলায় আবার প্রশ্ন করলো ফার্ণালো।
না।’
“তবে?” চিৎকার করে উঠলো ফার্ণান্দো নিরুপায় ক্রোধে।
‘এটা নাও। মনে রেখো, আত্মরক্ষা করতে হবে আমাদের, স্টেনগানটা ফার্ণান্দোর দিকে বাড়িয়ে দিলো কুয়াশা বিনা দ্বিধায়।
অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে গেল ফার্ণান্দোর চোখ জোড়া। স্টেনগানটির দিকে তাকালো সে। তারপর তাকালো কুয়াশার হাতের দিকে। ঠাট্টা করছে নাকি লোকটা? ভাবলো সে। স্টেনগানটা নেবার জন্যে আমি হাত বাড়ালেই হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে সরিয়ে নেবে। তারপর কুয়াশার মুখের দিকে তাকালো চঞ্চল দৃষ্টিতে। নিলো না স্টেনগানটা।
হাসছে কুয়াশা। “হাসতে হাসতেই বললো সে, ‘দেরি করো না। রওনা হয়ে পড়বে ওরা এক্ষুণি।
‘কি করতে চাও তুমি?” আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো ফার্ণান্দো।
আত্মরক্ষা করতে হবে আমাদেরকে। ‘কিন্তু আমাকে যে তুমি বন্দী দশা থেকে মুক্তি দিলে, আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমারও রেহাই নেই তা জানো?’
কি করা উচিত তবে আমার?’
ফার্ণান্দো একমুহূর্ত কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমাকে তুমি বন্দী অবস্থায় ধরিয়ে দিলে তো মরবই, এমনিতেও আমার মৃত্যু কেউ আজ আর আটকাতে পারবে না। আমাকে আত্মরক্ষার সুযোগ করে দিলেও তাতে ফল হবে না কিছু। বরং তোমার পক্ষে সেটা মারাত্মক হবে নিঃসন্দেহে। মরতে যখন আমাকে হবেই তখন আমার কথা হচ্ছে, আমাকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করো তুমি।
‘অনেক বাঁচালতা হয়েছে, থামো এবার।’ ১৭২
ধমক মারলো কুয়াশা। ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে বললো, এসো, ওদিকটায় পাথরের টুকরো রয়েছে অনেক। আড়াল পাওয়া যাবে। দেখি কি করা যায়।’
কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো করকর করে উঠলো ফার্ণান্দের। এরকম মানুষের দেখা পায়নি সে সারাজীবনে। নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভাবে যে লোক, যে লোক অপরাধীকেও প্রাণে-বাঁচাতে চায় সে লোক মহান মানব সমাজের গৌরব।
আর কোনো অবিশ্বাস নেই ফার্ণান্দোর। কুয়াশাকে চিনতে পেরেছে সে। আগে ভুল করেছিল সে মানুষটাকে চিনতে। ঘোড়া ছুটিয়ে কুয়াশার পাশে চলে এলো ফার্ণান্দো। কুয়াশা আশ্বাসের হাসি হাসলো তার দিকে তাকিয়ে। স্টেনগানটা বাড়িয়ে দিলো ফার্ণান্দোর দিকে। সেটা হাতে নিয়ে ফার্ণান্দো নিস্পলক দৃষ্টিতে কুয়াশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাকে ক্ষমা করো, কুয়াশা।’
‘কেন, তুমি আবার কখন কি অপরাধ করলে?’ কুয়াশা হাসতে হাসতে বলে কথাটা।
. ফার্ণান্দো বললো শুধু, আমি অনুতপ্ত, কুয়াশা।
কুয়াশা বললো, একজন ভালো লোকও ভুল করতে পারে, ফার্নান্দো, তাকে ভুল শোধরাবার সুযোগ দেয়া উচিত। এর বেশি তোমার জন্যে আর কিছু করিনি আমি। আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোটো করো না।
ফার্ণান্দো কুয়াশার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, আজ থেকে আমরা বন্ধু।
“নিশ্চয়!’ হাসলো কুয়াশা ফার্ণান্দোর উচ্ছ্বাস দেখে। মনে মনে ভাবলো সে, লোকটা অসাধারণ।
আট।
পাথরের খণ্ডগুলোই আসলে এক একটা ছোটখাট পাহাড় যেন। জায়গাটা পছন্দ হলো ওদের। ঘোড়াগুলোকে বেঁধে কাজে লেগে গেল ওরা। কুয়াশা মানা করেছিল, কিন্তু ফার্ণান্দো যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে রাজি করালো তাকে ডিনামাইট সেট করার
ব্যাপারে। ফার্ণান্দো একাই করলো সব।
সোনার বস্তাগুলো ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে থাক থাক করে সাজালো ফার্ণান্দো। ডিনামাইট ফিট করেছে সে অনেকগুলো বিরাট বিরাট পাথরের গায়ে। দরকার হলে ফাটাবে সেগুলো। শেষ পর্যন্ত ফার্ণান্দোর প্ল্যানটা ভালোই লাগলো, কুয়াশার। সবকটা পাথর ফাটিয়ে দিলে সরকারী বাহিনী পাথরের স্তূপ, পেরিয়ে কোনো দিন আসতে পারবে না সামনে। পাথরের টুকরো তো নয়, ছোটখাট পাহাড় এক একটা। চারপাঁচটা ফাটাতে পারলেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
১৭৩
পাথরগুলোয় ডিনামাইট ফিট করে পিছিয়ে এলো ওরা নিরাপদ দূরত্বে। সোনার বস্তাগুলো থাক থাক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এবার স্টেনগান দুটোয়। গুলি ভরলো সে। তারপর দুজনেই বসে পড়লো মুখোমুখি। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
ধীরে ধীরে কথা বলছিল ওরা। এখানকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে অনেক তথ্য বললো ফার্ণান্দো কুয়াশাকে। Dr. Kotze-এর কাছে প্লেনে করে যাবার কথা। বলতে ফার্ণান্দো বললো, সেটাই ভালো হবে। আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি যেখান থেকে ম্যাকুয়েও শহরটা মাত্র পাঁচ মাইল দূরে। পশ্চিমদিকের পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফার্নান্দো বললো, “সরকারী বাহিনীর কাছে খুব বেশি ঘোড়া নেই। থাকলে বড়জোর দু’চারটি। পায়ে হেঁটে আমাদের ধরতে চেষ্টা করবে ওরা। ঐ দিকের পাহাড়ের দিকেই যেতে পারলে ভালো হয়। শহরে যাবার সহজতম রাস্তাটা হলো ঐ দিকেই। কিন্তু রাস্তার মুখ দখল করে বসে আছে ওরা।
কুয়াশা বললো, শহরে গিয়ে অ্যারোড্রামটা কোনদিকে পড়বে?
শহরে ঢুকতে হবে না আমাদেরকে। পাহাড় ছাড়িয়েই পিচ ঢালা রাস্তা পেয়ে যাবো। সেটা ধরে সোজা তিন মাইল গেলেই অ্যারোড্রোম।’
‘কোথায় নামবো আমরা প্লেন থেকে? টিটিকাকা শহরে। ‘সেখান থেকে কোন্দিকে যেতে হবে?’
ফার্ণান্দো বলে গেল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বৈজ্ঞানিক Kotze-এর ঠিকানায় পৌঁছতে হলে কোন কোন রাস্তায় যেতে হবে। ইলামাপো বলে একজন লোকের নাম উল্লেখ করলো সে। তার কাছে একা গাড়ির ব্যবস্থা আছে। ফার্ণালোকে লোকটা ভালো করে চেনে। তার নাম শুনলেই কেঁপে অস্থির হবে। লোকটা।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা শুরু করলো ফার্ণালো। এক মুহূর্তের জন্যেও চুপ থাকতে পারছে না সে। নিজের কথা, দেশের কথা, দেশের আপামর জনসাধারণের কথা অনর্গল বলে গেল সে। দেশকে সে মুক্ত করবে জুলুমবাজদের হাত থেকে।
সবশেষে বল ফার্নান্দো বৈজ্ঞানিক Kotze-এর সম্পর্কে। তাকে আমি ভয় করি। সম্মান করি। তিনি আমার গুরু। আমার ধর্ম পিতা।’ শ্রদ্ধায় গম্ভীর হয়ে উঠলো ফার্ণান্দোর কণ্ঠ। তিনি জানেন না এখনও আমার আসল পরিচয়। সব কথা, বলার সুযোগ পাইনি আমি এখনও।’
| কুয়াশা প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো কিভাবে?
১৭৪
| সে এক সাধারণ ঘটনা। আমার পিছনে সরকারী বাহিনী লেগেছিল। একশো মাইল পর্যন্ত তাড়া করে এসেছিল আমার পিছনে পিছনে শিয়ালগুলো। কোথায় লুকাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি। হঠাৎ দেখলাম পাহাড়ের নিচে সবুজ একটা বাগান। আশ্চর্য লাগলো আমার। অঞ্চলটা আমার কম বেশি পরিচিত, কিন্তু সবুজের নাম নিশানা দেখিনি কখনও। কৌতূহল হলো বাগানটা দেখে। পাহাড় থেকে নেমে অনেক কষ্টে পৌঁছুলাম সেখানে। হঠাৎ চুপ করে গেল ফার্ণান্দো। সিঞ্চে হয়ে বসে উত্তেজিত গলায় বললো সে, আরে। একজন লোক পাঠাচ্ছে দেখছি ওরা!’
বস্তার ফাঁক দিয়ে তাকালো কুয়াশা। মোটা একজন লোক হেঁটে আসছে এদিকে। দূরবীনটা নিয়ে দেখলো কুয়াশা লোকটাকে। একটা হাত পিছনে লোকটার। অপর হাতটি খালি দেখা যাচ্ছে। বেশ খানিকটা দূরে আছে এখনও লোকটা। | ফার্ণান্দো দূরবীনটা কুয়াশার হাত থেকে নিয়ে চোখে লাগালো। লোকটাকে দেখেই সে বললো, “আশ্চর্য!”
কুয়াশা প্রশ্ন করলো, কি আশ্চর্য!
‘লোকটা কে জানো? আসমুত ফান্দো ওর নাম। আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আজ দুবছর হলো পালিয়েছিল ও।
কুয়াশা বললো, ‘ও লোকটা আমাদের খোঁজ পেলো কিভাবে?’
খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে ফার্ণান্দো বললো, বুঝতে পেরেছি এবার। আসলে ডাকাতদের দলে এই ফান্দোও ছিলো। মনে আছে তোমার কুয়াশা, সকাল হলে বারোজন ডাকাত দেখেছিলাম আমরা? ভেবেছিলাম বাকি একজন পালিয়েছে। তা নয়, আসলে এই ফান্দেই সেই লোকটা, সরকারী বাহিনীকে খবর দিয়ে সেই আনিয়েছে এদিকে। তা নয়তো ওদের এদিকটায় পাহারা বসাবার কথা নয়।
লোকটা এগিয়ে আসছে দ্রুত। তৈরি হয়ে বসে রইলো. ওরা। ‘কেন আসছে ও একা?’ কুয়াশা বললো। ‘ওকে পাঠানো হয়েছে আমাদেরকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব জানাতে। . “ কিন্তু ওর একটা হাত পিছন দিকে কেন বলো তো?’ ‘লক্ষ্য করেছি ব্যাপারটা আমিও। কিন্তু বুঝতে পারছি না ঠিক ব্যাপারটা।
এসে পড়লো লোকটা ওদের পঞ্চাশ হাতের মধ্যে। ঐ পর্যন্ত এসেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। কেন না ফার্ণান্দের গলা দিয়ে শুরু গম্ভীর শব্দ বের হলো, আর এক পাও এগিয়ো না, ফান্দো। কেন এসেছো বলো ওখান থেকে।
বিচলিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালো ফান্দো। দারুণ ভীতি পেয়ে বসেছে তাকে। ফার্ণান্দোর সামনে সে আসতে চায়নি। কিন্তু সরকারী বাহিনীর ক্যাপ্টেন রিভলভার উঁচিয়ে আদেশ করেছে বলে না এসেও উপায় ছিলো না তার। মৃত্যু
১৭৫
অবধারিত, তা জেনেই আসতে হয়েছে তাকে।
ক্যাপ্টেন মান্দা তোমাদেরকে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দিয়েছে।’ ফার্নান্দোর কানে কথাটা যাওয়া মাত্র স্টেনগানের ট্রিগার টিপলো সে।
বিপদটা বুঝতে পেরেছিল ফান্দো আগেই। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়তে গেল সে। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলো না বেচারা। গুলি লাগলো গিয়ে তার
. পাঁজরে। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে। কিন্তু মাটিতে পড়তে পড়তেই হাতটা উপরে তুলে ছুঁড়ে মারতে গিয়েছিল হাত বোমাটা। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটা গিয়ে লাগলো ঠিক তার বোমা ধরা হাতটাতে। হাত থেকে ছুটে গেল বোমাটা। সামনের দিকে না এসে পিছনের দিকে গিয়ে ড্রপ খেলো। প্রচণ্ড শব্দে ফাটলো সেটা সঙ্গে সঙ্গে।
ধোয়ার মেঘ সরে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে। চমকে উঠে কুয়াশা ধরে ফেললো। ফার্ণান্দোর একটি হাত। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে ফার্ণান্দো গুলি করে মারবে লোকটাকে। কিন্তু তার আগে আরেক কাণ্ড করে বসেছে সে।
ধোয়ার মেঘ সব সরে যাবার আগেই প্রচণ্ড শব্দ হলো একটা ডিনামাইট ফাটার। তারপর পরপর ফাটলো কয়েকটা মিনিটখানেক সময় নিয়ে।
সামনের দিকটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল দেখতে দেখতে। ছোটখাট পাহাড়ের মতো পাথরগুলো টুকরো টুকরো হয়ে উঠে পড়লো শূন্যে। সশব্দে আবার পড়লো সেগুলো একটু দূরে। এইরকম তাণ্ডবলীলা ঘটতে লাগলো ওদের চোখের সামনে। ফান্দোকে গুলি করেই প্লানজারে চাপ দিয়ে বসেছে ফার্ণানন্দা। সবকটা ডিনামাইট ফেটে গিয়ে অসংখ্য পাথরের চাঙ টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ে
স্তূপ হয়ে গেল সামনের দিকটায়।
ধোঁয়া সরে যেতে কুয়াশা বললো, ‘লোকটাকে তুমি গুলি করবে জানতাম না আমি, ফার্ণান্দো। আর ডিনামাইটগুলোই বা ফাটালে কেন?
ফার্ণান্দো বললো, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি, কুয়াশা, ফান্দোকে নিজের হাতে শাস্তি দেবো।
কুয়াশা তখনই আর কিছু বললো না। একটু পর ফান্দোর লাশটার দিকে একবার তাকিয়ে সে বললো, সেটা অবশ্যি তোমার নিজের ব্যাপার। কিন্তু তোমার একটা দুর্বলতার কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। বিরোধী মনোভাবের লোক দেখলেই তোমার মাথায় খুন চেপে যায়। হত্যা করতে ইচ্ছা জাগে তোমার। এটা উচিত নয়। যদি সম্ভব হয় তবে এই রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করো। আমার আর কিছু বলার নেই।’
কুয়াশা থামতে ফার্ণান্দো বললো, তুমি নমস্য ব্যক্তি, কুয়াশা। সত্যিসত্যি আমিও অনুভব করেছি ব্যাপারটা। নিজেকে সামলাতে পারি না আমি। যাক, আজ থেকে তোমার উপদেশ শিবাধার্য করলাম আমি। ১৭৬
কুয়াশা এবং ফার্ণান্দো দুজনেই এ ব্যাপারে আর কথা বললো না।
সরকারী বাহি এখনও এগিয়ে আসছে না। সিগারেট ধরিয়ে গল্প করছিল ওরা। ফার্ণান্দোই কথা বলছিল বেশি। নিজের বৈচিত্র্যময় জীবনের কাহিনী শুনিয়ে কুয়াশাকে সত্যিসত্যিই মুগ্ধ করে দিলো সে। | সরকারী বাহিনীর লোকগুলো এগিয়ে না আসার কারণ আছে। মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটতে দেখে তারা ঠিক বুঝতে পারছে না শত্রুরা বেঁচে আছে কি না।
হাসছিল ফাৰ্ণানন্দা। তার প্রেমিকার কথা বলতে বলতে হঠাৎ কি মনে পড়ে যেতে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো সে। কুয়াশাও মৃদু মৃদু হাসছিল ফার্ণান্দোর দিকে তাকিয়ে।
| ফার্ণান্দোর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো কুয়াশা। হঠাৎ থেমে গেল ফার্ণান্দোর হাসি। কপালে একটা লাল বড় টিপ পরিয়ে দিলো কেউ যেন। মুখটা হাসছিল ভজ তুলে। নিভাঁজ হয়ে গেল তখুনি। শুধু বড় বড় দুটো চোখ চেয়ে আছে কুয়াশার চোখের মধ্যমণির দিকে।
ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো কুয়াশা পিছন দিকে। ফান্দো নামের লোকটিকে দেখতে পেলো সে। হাতে তার একটি রিভলভার। প্রথম গুলিটা ঠিকই মারতে পেরেছে সে স্থিরভাবে। দ্বিতীয়বার মারার চেষ্টা করছে কুয়াশাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু জখম শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে ঠিকমত।
পাঁচ সেকেণ্ড ধরে, গুলি করলো কুয়াশা লোকটির বুক লক্ষ্য করে। ঝাঁঝরা হয়ে গেল বুক।
‘ফার্ণান্দো!
কোলে তুলে নিলো কুয়াশা ফার্ণান্দোর মাথাটা। কথা বলবে না আর ফার্ণান্দো, বুঝতে পারলো কুয়াশা। মারা গেছে লোকটা। ঠিক কপালের মধ্যে দিয়ে গুলি ঢুকেছে।
তিনমিনিট অবিশ্বাস ভরে তাকিয়ে রইলো কুয়াশা ফার্ণান্দোর মুখের দিকে। লোকটা যে মারা গেছে এটা জেনেও যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।
নয়।
গুলির শব্দ শুনে সরকারী বাহিনী সচেতন হয়ে পড়লো। চারদিক থেকে এগিয়ে আসতে দেখলো কুয়াশা ওদেরকে।
পালানো দরকার। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোনদিক দিয়ে? আর ফার্ণান্দোর কি
হবে?
মিনিটখানেক সময় নিলো না কুয়াশা কাজে লেগে পড়তে। ফার্ণান্দোকে ১২-
১৭৭
পাঁজাকোলো করে তুলে নিয়ে গেল সে টুকরো টুকরো পাথরগুলোর কাছে। মাটিতে শুইয়ে দিলো সে লাশটা। তারপর একটার পর একটা পাথর তুলে লাশটার আপাদমস্তক ঢেকে দিলো সে।
| ফিরে এলো কুয়াশা এবার ঘোড়াগুলোর কাছে। পিছন ফিরে দেখলো সরকারী বাহিনী ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে এদিকে। ফার্ণান্দো বলেছিল ওদের কাছে ঘোড়া থাকলেও দু’চারটে আছে। কিন্তু একটি ঘোড়াও দেখতে পেলো না কুয়াশা। সাদা পোশাক সরকারী বাহিনীর, মাথায় ক্যাপ। হাতে রাইফেল। অনেকটা দূরে আছে এখনও ওরা।
| সোনার বস্তাগুলো ফেলে রেখে যাবে ভেবেছিল কুয়াশা। কিন্তু ফার্ণান্দোর কথা। ভেবে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো সে। এই সোনা কোনো সৎ কাজে ব্যয় করা উচিত। ফার্ণান্দোর আত্মা সন্তুষ্ট হবে তাতে।
| ঘোড়ার পিঠে বস্তাগুলো চাপালা কুয়াশা। ভালো করে বাঁধলো। বারবার পরীক্ষা করলো বাঁধনগুলো। তারপর একটা গান্য উঁচু পাশ্বরের উপর চড়ে পশ্চিমদিকের পাহাড়ের দিকে তাকালো সে।
ফার্নান্দো রাস্তাঘাট সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য দিয়ে গেছে কুয়াশাকে। পশ্চিমদিকের রাস্তা ধরে যেতে হবে কুয়াশাকে। কিন্তু পশ্চিম দিকেও সরকারী বাহিনী ওঁৎ পেতে
আছে। একদল এগিয়ে আসছে। আর একদল রাস্তা পাহারা দিচ্ছে।
আন্দাজ করতে চেষ্টা করলো কুয়াশা কতটা দূরে সরিয়ে দিতে পারলে একছুটে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে রাস্তাটা। দূরবীন চোখে লাগিয়ে গিরিপথটা দেখে নিলো সে। অঙ্ক কষতে শুরু করলো সে মনে মনে। মাঠের সিকি ভাগ যাবার আগেই ওরা দেখে ফেলবে, শত্রু পালাচ্ছে। ধরা যাক, সিকি মাইল দূরে থাকছে তখন ওরা পশ্চিম দিকের ঐ গিরিপথের মুখ থেকে। সিকি ভাগ মাঠ অতিক্রম কর পর সামনে থাকবে কম করেও চার মাইল লম্বা মাঠ। ওদের সিকি মাইল আর আমার . চার মাইল। ওদের পায়ে হাঁটা, আর আমার ঘোড়ায় ছোেটা। ইউরেকা।
পাথরটার উপর থেকে নামলো না কুয়াশা। দেখতে দেখতে চোখ দুটো তার। ভাটার মতো টকটকে লাল এবং বড় বড় হয়ে উঠলো। অনড় দাঁড়িয়ে আছে তার শরীরটা বুক টানটান করে। কিন্তু খানিকক্ষণ পর ঠোঁট জোড়া কাঁপতে লাগলো তার। তারপর নড়তে লাগলো, যেন কার উপর হুকুম জারি করছে সে। কিন্তু ঠোঁট জোড়া নড়ছে শুধু, কোনোই শব্দ নেই!
সফল হলো কুয়াশা। পশ্চিম দিক থেকে যে দলটি আসছিল এইদিকে তারা তালে তালে পা ফেলে মোড় নিলো। দক্ষিণ দিকের দলটির দিকে এগোলো তারা। পশ্চিম দিকে গিরিপথ ছেড়ে দক্ষিণ দিকের গিরিপথের দিকে রওনা দিলো বাকি অংশটি, যারা পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিলো।
১৭৮
ঝাড়া দশ মিনিট ধরে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলো কুয়াশা। সাফল্যের হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। সার্থক হতে চলেছে তার প্ল্যান। ভেন্ট্রিলোকুয়িজম এর ধাঁধায় ফেলে গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে কুয়াশা সরকারী বাহিনীকে।
| দশ মিনিটই যথেষ্ট। অনেকটা সরে গেছে ওরা। এই সুযোগ। ধাঁধাটা আবিষ্কার করে ফেললে আর কোনো উপায় থাকবে না। এখন যতো তাড়াতাড়ি’ পারা যায় ঝড়ের বেগে পলায়ন-পর্ব শুরু করা।
: ছুটে চলে এলো কুয়াশা ঘোড়াগুলোর কাছে। বাঁধা আছে দড়ি দিয়ে প্রত্যেকটি প্রত্যেকটির সঙ্গে। কুয়াশ। নিজের ঘোড়াটায় না চড়ে ফার্ণান্দোরটায় চড়ে বসলো। তুফানেরও আগে আগে ছুটতে পারে ঘোড়াটা।
ঘোড়ায় চড়ে বসেই হাতের দড়িটা ধরে হেঁচকা টান দিলো কুয়াশা। সচকিত, হলো বস্তা বোঝাই ঘোড়াগুলো। তারপর কষে একটা চাপড় মারলো কুয়াশা ঘোড়ার পিঠে।
তীরের মতোই ছুটলো ঘোড়াটা পশ্চিমদিকের গিরিপথ লক্ষ্য করে। দড়ির টান, পড়তেই বাধ্য হয়ে সমান গতি বজায় রেখে ছুটতে হলো পিছনের ঘোড়াগুলোকে। এক মুহূর্তে দমকা ঝড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে যেন মাটির উপর দিয়ে। এই আছে এই ‘নেই। পিছনে ধুলোর ঝড় তুলে তীব্রবেগে ছুটলো কামানের কয়েকটা বড় বড় গোলা যেন।
নির্ভুল হিসেব করেছিল কুয়াশা। সিকিভাগ মাঠ পেরোবার পরই শত্রু পালাচ্ছে বুঝতে পারলো ওরা। অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে পথ বন্ধ করার জন্যে ছুটলো ওরা। দক্ষিণ দিকের শেষ কোণেও শত্রু পালাবার খবর পৌঁছে গেছে বুঝতে পারলো। কুয়াশা। কয়েকজন ঘোড়সওয়ার এতক্ষণে দেখা গেল। আড়াআড়ি ভাবে পশ্চিম দিকের গিরিপথ আটকাবার জন্যে এগোচ্ছে ওরা।
চরম গতিতেই ছুটছে কুয়াশার ঘোড়া। এর চেয়ে বেশি জোরে ছোটানো সম্ভব নয়। হিসাব করে একটু নিরাশ হয়ে পড়লো কুয়াশা। গিরিপথ থেকে কুয়াশার বর্তমান দূরত্ব যা তার চেয়ে কম দূরত্ব অতিক্রম করলেই সরকারী বাহিনীর ঘোড়সওয়ারেরা ঐ জায়গায় পৌঁছে যাবে। ওদের গতি কুয়াশার সমান নয় এই যা একটু ভরসার কথা। কিন্তু খুব একটা দুর্বলও নয় ওদের ঘোড়াগুলো।
| দূরত্ব যততা কমে আসতে লাগলো ততই শঙ্কিত হয়ে উঠলো কুয়াশা। আগে পৌঁছে গিরিপথু দিয়ে বের হয়ে যাওয়া অসম্ভব। একই সঙ্গে গিরিপথের কাছে গিয়ে পৌঁছুতে পারা যাবে বড় জোর। তার মানে যুদ্ধ। ভয়ঙ্কর একটা ফয়সালার প্রশ্ন দেখা দেবে সেক্ষেত্রে। ওরা চারজন মিলে আক্রমণ করবে। কুয়াশা একা। তাছাড়া ওরা যদি একটু আগে পৌঁছতে পারে গিরিপথমুখে তাহলে পাথরের আড়াল থেকে গুলি করার সুযোগ পাবে। তাই যদি হয় তবে আর প্রাণের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
১৭৯
কুয়াশা বুঝতে পারলো সামান্য একটু দূরত্ব অতিক্রমের উপরে নির্ভর করছে তার জীবন। দেরিতে পৌঁছুলে মৃত্যু তার কেউ-ই রুখতে পারবে না। আগেই পৌঁছুতে হবে তাকে। কিংবা তা যদি একেবারেই সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত ওদের একই সঙ্গে পৌঁছুতে হবে। তারপরও সংঘর্ষ ঘটবে একটা ভয়ঙ্কর। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে জয়ী হবে সে। নয়তো…
এসে পড়েছে কুয়াশা গিরিপথের সামনে। বিরোধীদলও এসে পড়েছে। একই। সঙ্গে পৌঁছেছে ওরা গিরিপথের কাছে।
, রাইফেল গর্জে উঠলো প্রথমে ওদের তরফ থেকেই। ঘোড়ার পিঠের উপর। শুয়ে পড়লো কুয়াশা পা দুটো যথাযথ ঝুলিয়ে রেখে। স্টেনগানটা হাতেই ধরা আছে তার। কিন্তু ওদের গুলির বদলে তখুনি গুলি করলো না সে। করলো আরও দশ সেকেণ্ড কেটে যাবার পর। মাত্র একশো হাত দূরে তখন চারজন ঘোড়সওয়ার।
| লক্ষ্যস্থির করে ট্রিগার টেপার জন্যে সময় লাগলো তিন সেকেণ্ড। এই তিন সেকেণ্ড এবং গুলি লেগে জখম হবার পরও ঘোড়াগুলো পড়লো মাটিতে আরো তিন। সেকেণ্ড পর–মোট ছ’সেকেণ্ডে দু’ তরফের গতির, পরিমাপ হলো পঞ্চাশ হাত। মাটিতে পড়েও ছিটকে আরো খানিকটা সামনে গড়িয়ে এলো ঘোড়া এবং ঘোড়সওয়ারেরা। কুয়াশার দশ হাত দূরে এসে পড়লো একজন লোক। ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল কুয়াশা ওদেরকে পিছনে ফেলে।
রাইফেলের শব্দ হলো তারপরও পিছন থেকে। কিন্তু অনুমানের উপর নির্ভর করে গুলি ছুঁড়ছে ওরা। ধুলোয় ওদের সামনেটা অদৃশ্য এখন।
গিরিপথ ধরে ছুটে চললো বিজয়ী বীর কুয়াশা। পিছন থেকে তাড়া করার ভয় নেই এখন আর। চারটে ঘোড়ারই পা খোঁড়া করে দিয়েছে সে।
ফার্ণান্দোর কথামতো একটা হ্রদ দেখতে পেলো কুয়াশা। কি করবে ভেবে ফেলেছিল সে। ঘোড়র উপর থেকে সোনার বস্তাগুলো নামিয়ে হ্রদের পানিতে ডুবিয়ে দিলো সে। জায়গাটা ভালো করে চিনে রাখলো।
ঘোড়াগুলোকে ছাড়লো সে অ্যারোড্রোমের কাছাকাছি একটা জঙ্গল মতো জায়গায় এসে।
অ্যারোড্রোমে ঢোকার আগে একটা সেলুন খুঁজে বের করলো কুয়াশা। দাড়ি কামালো প্রথমে। সেখান থেকেই খোঁজ পেলো একটা হোটেলের। হোটেলে গিয়ে। খাওয়াদাওয়ার আগে বখশিশের লোভ দেখিয়ে স্নান সারলো সে। হোটেলটা আবাসিক নয়। বয়কে রেডিমেড কাপড়ের দোকানে টাকা এবং যথাযথ নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে খেতে বসলো সে। পেট ভরে খেয়ে উঠতেই বয় ফিরে এলো কাপড় চোপড় নিয়ে। একঘণ্টা পর হোটেল ম্যানেজারের খাস রুম থেকে বের হলো কুয়াশা ফিটফাট সাজে সজ্জিত হয়ে। সোনার বড় সাইজের একটা টুকরো পেয়ে
১৮০
হোটেল ম্যানেজার বিনয়ে বিগলিত হয়ে জানতে চেয়েছিল কোথায় পৌঁছে দিতে হবে তাকে। কুয়াশা ঠাট্টা করে বললো ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারবে?
বোকার মতো তাকিয়ে রইলো লোকটা কুয়াশার মুখের দিকে। ঢাকার নাম শোনেনি সে জীবনে। হঠাৎ কি মনে করে দাঁত বের করে হাসলো সে। তারপর ইঙ্গিতে কুয়াশাকে অপেক্ষা করতে বলে ছুটে ঘরে চলে গেল সে। ফিরে এলো একটু পরই। কয়েকটা স্থানীয় মেয়ের ফটো কুয়াশার চোখের সামনে ধরে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো কোটা পছন্দ বলুন, হুজুর! |
কুয়াশা হেসে ফেলে চোখ সরিয়ে নিলো ফটোগুলোর দিক থেকে। বললো, না মিয়া, ভুল বুঝেছো তুমি।
| কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না কুয়াশা। হাঁটা দিলো সে অ্যারোড্রোমের দিকে। খানিকটা দূরেই দেখা যাচ্ছে অ্যারোড্রোম।
| সন্ধ্যা হয়েছে এইমাত্র। ইতিমধ্যেই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে শহরটা। | অ্যারোড্রোমে গিয়ে খোঁজ নিয়ে কুয়াশা জানলো মীরাফ্লোরেস হয়ে টিটি কাকার প্লেন আছে একটা ঘণ্টাখানেক পর। ভাগ্য ভালো কুয়াশার। সপ্তাহে দুটো মাত্র ফ্লাইট। আজ বুধবারে একটা। আর একটা শনিবারে।
ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করতে হবে ঘণ্টাখানেক। শহরটা একেবারেই ছোটো। দেখার কিছুই নেই। শরীরটার উপর দিয়ে যথেষ্ট ধকল গেছে। এইটুকু সময় অপেক্ষা করেই কাটিয়ে দেবে ভাবলো কুয়াশা। কিন্তু ওয়েটিংরুমে ঢোকার মুখেই থমকে দাঁড়ালো সে। রুমের ভিতরে একটা সোফায় বসে বসে ঢুলছে, একজন। লোক। লোকটাকে দেখেই চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে কুয়াশা।
মুহূর্তের মধ্যেই লোকটাকে চিনতে পারলো কুয়াশা। সৈনিক থেকে যে লোকগুলো তাকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল এ লোকটা তাদের, দলেই ছিলো। গুহার ভিতর সবগুলো লোককে মেরে ফেলেছিল ফার্ণালো। কিন্তু এ লোকটা আহত হয়ে পালিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল কুয়াশার কথাটা। Dr. Kotze-. এর থিসিসের একটা চুরি করা অংশ আছে এই লোকটির সঙ্গে। ফার্ণান্দো বলেছিল কথাটা।
| নিঃশব্দে সরে এলো কুয়াশা ওয়েটিংরুমের দরজা থেকে। লোকটা নিঃসন্দেহে টিটিকাকা শহরেই যাবে,। Dr. Kotze-এর আশপাশেই আছে তাঁর শত্রু। এ লোকটাও যাবে নিশ্চয় কাছাকাছি জায়গায়। খিসিসটা এমনভাবে হাতের কাছে রয়েছে যখন, তখন ওটা মুঠোর মধ্যে আনতেই হবে। অ্যারোড্রোম থেকে বের হয়ে এলো কুয়াশা। টুপি কিনবে সে একটা বড় দেখে। কয়েকটা দোকান ঘুরে ছোটখাট আরও কয়েকটা জিনিস পেলো সে। নকল গোফ, চশমা, ইত্যাদি।
প্লেনে চড়ে লোকটির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখলো কুয়াশা। চিনতে পারেনি ব্যাটা কুয়াশাকে। যথাসম্ভব বদলে নেবার চেষ্টা করেছে কুয়াশা নিজের চেহারাটা
.১৮১
টুকিটাকি জিনিস দিয়ে। কিন্তু এই ছদ্মবেশে ধোকা দেয়া সম্ভব নয়। সন্দেহে ঝুলিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব। তবে কুয়াশাকে স্ববেশে দেখলেও লোকটা চিনতে পারতো কিনা সন্দেহ। সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে ঢুলছে। | প্লেন থেকে নেমে লোকটা চলে গেল অন্যদিকে। লোকটার গমন পথের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলো কুয়াশা। ফার্ণান্দো বলেছিল Dr. Kotze যে জায়গায় থাকে সেখানে কাউকে যেতে হলে ইলামাপো নামের একজন লোকের কাছে যেতেই হবে। তার কাছেই একমাত্র এক্কা গাড়ি আছে। আর এক্কা গাড়ি ছাড়া No man’s land-এ পৌঁছানো অসম্ভব। ইলামাপোর চাকরি হলো কেউ যেন ঐ দিকের নিষিদ্ধ এলাকায় যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। টাকা পেলে, আবার
কখনো ভয়ে কোনো কোনো লোককে বিনা বাধায় ঐ দিকে যেতে দেয় সে।
কুয়াশা যখন ইলামাপোর কোঠায় পৌঁছুলে তখন রাত আটটা। কুয়াশা কোনো ভূমিকা না করেই ফার্ণান্দোর নাম করলো। ইলামাগো জুতো মেরামত করছিল বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। নামটা শুনেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো সে। জোড়হাতে কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে জানালো, হুকুম করুন, হুজুর!’
কুয়াশার কথামত চটপট সব করলো ইলামাপে। ঠিক কুড়ি মিনিট পর এলো সেই লোকটা। | লোকটা ইলামাপোর সঙ্গে ফিসফিস করে কথাবার্তা বললো খানিকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত কথা কাটাকাটি শুরু হলো ওদের মধ্যে। ইলামাপো বললো, এতো রাতে তোমাকে আমি গাড়ি দিতে পারবো না। কেননা এখন আমি ঘুমোবো। তুমি তো গাড়ি নিয়ে যাবে। ফিরিয়ে দিয়ে যাবে কে?’
লোকটি বললো, “টাকার বদলে এক রাত না হয় নাই ঘুমালে তুমি। ঘুম তোমার অন্য সময়ও হবে, কিন্তু টাকা কি হবে?
ইলামাপো বললো, এককথা বারবার বলতে পারবো না। আমাকে ছাড়া যদি চলে তবে ব্যবস্থা করতে পারি আমি। লোকটা আমারই বন্ধু মানুষ। চিনি ওকে
আমি। ওকে নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারো। আমি যেতে পারবো না।’
অবশেষে রাজি হয়ে গেল লোকটা।
ইলামাপো বিদঘুঁটে একটা নাম ধরে কয়েকবার চিৎকার করতে গাড়োয়ানের পোশাক পরে বের হয়ে এলো একটি লোক চোখ কচলাতে কচলাতে। ইলামাপো তাকে বোঝালো ব্যাপারটা। মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। ‘
লোকটি এক্কা গাড়িতে চড়ে বসে একটা সিগারেট ধরালো। গাড়োয়ান পিছন ফিরে দেখলো লোকটির কোলে একটা অ্যাটাচি কেস পড়ে রয়েছে।
‘যেতে পারো, কিন্তু সাবধানে চালাবে।
‘জো হুকুম! বিগলিত কণ্ঠে কথাটা বলে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষালো চালক। ১৮২
মিনিট কুড়ি ধরে ঝড়ের মতো ছুটেই হঠাৎ থেমে গেল এক্কা। “কি হলো, গাড়ি থামালে কেন?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো লোকটা।
চালক গাড়ি থেকে নেমে বললো, ধাক্কা মারতে হবে, হুজুর, পিছন থেকে। কাদায় আটকে গেছে চাকা। ঘোড়ার সাধ্য নেই টেনে তোলে।
খানিকক্ষণ গজর গজর করলো লোকটা।
কানা নাকি! দেখতে পাও না কোথায় কাদা কোথায় কি? “কি করবো, হুজুর,অন্ধকার যে। ‘অন্ধকার যে!’ | মুখ ভেংচে নেমে এলো লোকটি গাড়ি থেকে। চালক তার আসনে বসে ঘোড়া দুটোকে বকাঝকা করতে শুরু করলো। একফাঁকে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনের আসনের দিকে তাকালো সে। অ্যাটাচি কেসটা আসনের উপর পড়ে রয়েছে দেখে হাসলো
সে। তারপর চাবুকটা তুলে নিয়ে শপ শপ করে বাড়ি মারলো ঘোড়া দুটোর পিঠে।
লোকটাকে কিছু বুঝতে না দিয়েই একা গাড়ি ছুটতে শুরু করলো হঠাৎ। দেখতে দেখতে নাগালের বাইরে চলে গেল গাড়িটা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ইলামাপোর মা-বাপ তুলে গালাগালি শুরু করলো সে। ‘
, আর চালকের ছদ্মবেশে এক্কা গাড়িতে বসে কুয়াশা ভাবছিল, একটার পর একটা বিপদ অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত এসেছি এতদূর। এবার বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ধন্য হবো আমি। কিন্তু এইটুকু পথের মাঝেও আবার কোথাও কোনো বিপদ ওত পেতে নেই তো?’
সারারাত গাড়ি চালিয়ে একটা নদীর তীরে পৌঁছুলো কুয়াশা। জঙ্গলমত একটা জায়গায় গাড়িটা রেখে তখুনি নদীর ধারে চলে এলো সে। কিন্তু তীর ধরে খানিকক্ষণ দৃষ্টি ফেলতেই অবাক হয়ে গেল সে। ‘ ‘একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে নদীর এপারে। কুয়াশাকে দেখতে পায়নি সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ডিঙির রশি খুলছে।
আড়ালে সরে এলো কুয়াশা। নদীটার ওপারে পাহাড়ের সারি। গুহা মতো দেখা যাচ্ছে একটা। গুহা না হয়ে ওটা একটা সুড়ঙ্গ হতে পারে, ভাবলো কুয়াশা। ফার্ণান্দো বলেছিল, নদীটা পেরোতে হবে। কিন্তু নদীর ওপারে কোনো সুড়ঙ্গ দেখা যাবে কিনা তা তো বলেনি সে। * কি করা যায় ভাবছিল কুয়াশা। ঠিক কোন জায়গাটা থেকে নদীর ওপারে যাবে ঠিক করতে পারছিল না সে। ইতিমধ্যে নৌকাটায় চড়ে বসে মাঝ নদীতে * চলে গেছে লোকটা, দেখতে পেলো কুয়াশা। তীরে আর নৌকা নেই। পার হতে
চাইলেই হবে কি করে।
পাহাড়ী নদী। বেশ খানিকটা চওড়া। তীব্রই বলা যায় স্রোত। পানিও ভরাট।
১৮৩
তাকিয়েছিল কুয়াশা নৌকাটার দিকে। হঠাৎ দৃষ্টি পড়লো তার ওপারের সুড়ঙ্গটার দিকে।
পাঁচজন লোক বেরিয়ে আসছে সুড়ঙ্গটা থেকে। গোপনে গোপনে এগিয়ে আসছে যেন ওরা। সবার হাতে একটি করে রাইফেল। মাথায় টুপি। সাদা ধবধবে পোশাক। লোকগুলো নিঃশব্দ পায়ে খানিকটা হেঁটে এসে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
ব্যাপার কি! মনে মনে ভাবলো কুয়াশা। কারা এরা? অমন উত্তেজিতভাবে কার জন্যে ওঁৎ পাতছে ওরা? সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল আর দু’মিনিট পরই। পূর্বোক্ত লোকটা নৌকা থেকে নেমে তীরে উঠতেই পাঁচজন বেরিয়ে এলো রাইফেল বাগিয়ে পাথরের আড়াল থেকে। থমকে দাঁড়ালো লোকটা। কি যেন বলতে গেল সে তোতলাতে তোতলাতে। কিন্তু তার পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিয়ে বেঁধে ফেলা হলো তাকে। নিয়ে চলে গেল লোকগুলো বেচারাকে টেনে হিঁচড়ে সুড়ঙ্গের ভিতর।
| প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি পেলো বটে কুয়াশা। কিন্তু এ উত্তরে কেন যেন সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তা সত্ত্বেও নীটা পেরোতে হবে ঠিক করলো সে। | ভাবতে হলো না কুয়াশাকে। দেখা গেল সেই সুড়ঙ্গ থেকে আবার একজন সাদা পোশাক পরা লোক বেরিয়ে এসেছে। হাতে কোনো অস্ত্র নেই লোকটার। সিধে নদীর তীরে এসে নৌকায় চড়লো সে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এপারে এসে ভিড়লো নৌকাটা। নেমে পড়লো লোকটা। নৌকোটা একটা বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রেখে চলে গেল সে দ্রুত পদক্ষেপে চোখের আড়ালে।
সুযোগ বুঝে আড়াল থেকে বের হয়ে নৌকাটার কাছে চলে এলো কুয়াশা। রশি খুলে নৌকায় চড়লো সে। বৈঠা বেয়ে চারমিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ওপারে।
| নৌকা থেকে নামার পরই থমকে গেল কুয়াশা। পাঁচজন লোক তীরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দিকে তাকিয়ে। হাসছে লোকগুলো। হাসছে কেন ওরা?
‘আসুন, আসুন! আমরা আপনার জন্যেই এসেছি। বৈজ্ঞানিক Kotze আপনার জন্যে তার কামরায় অপেক্ষা করছেন।’ | একে একে পাঁচজনের মুখের দিকে তাকালো কুয়াশা। খালি হাত ওদের সকলের। গালে হাসির ছড়াছড়ি। মুখে Dr. Kotze-এর নাম–ব্যাপার কি? কারা
এরা?
| কি করবে বা কি বলবে ঠিক করতে পারলো না কুয়াশা কয়েক মুহূর্ত। কোথায় যেন একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে বলে বারবার তিরস্কার করছে তার মন তাকে। কিন্তু কি ভুল হয়েছে বুঝতে পারছে না কুয়াশা।
কুয়াশাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে এলো ওদের মধ্যে থেকে
১৮৪
একজন। হ্যাঁণ্ডশেকের জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা বললো, আপনার মতো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পেরে আমরা ধন্য মনে করছি নিজেদেরকে। আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন আপনি।
হ্যাণ্ডশেক করলো কুয়াশা হাত বাড়িয়ে দিয়ে। মৃদু হাসলো সে লোকটির কথার উত্তরে। বলা বাহুল্য, হাসিটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
লোকটি এবং কুয়াশা আগে আগে এগিয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গটায় প্রবেশ করলো। পিছন পিছন ঢুকলো অপর চারজন।
‘ফাঁদে পা দিয়েছো, কুয়াশা!’ কুয়াশার কানে কানে কে যেন বলে গেল কথাটা। সতর্ক হলো কুয়াশা। মন কখনো তাকে ধোঁকা দেয় না। নিশ্চয়ই কোনো ফাঁদে পা দিয়েছে সে।
‘ সুড়ঙ্গটা ধরে মিনিট দুই হেঁটে একটা পাথরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। দরজা খুলে যেতেই চমকে উঠলো কুয়াশা। দরজার সামনে মাঝারি আকারের দুটো মেশিনগান কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে স্থির হয়ে আছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবারও সময় পেলো না সে। বজ্রকঠিন কয়েকটা হাত জড়িয়ে ধরলো তার শরীর। ঝটপট ঘরে ঢুকিয়ে ফেললো তারা কুয়াশাকে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। মেশিনগানধারী লোক দুজন দাঁড়িয়ে রইলো তার দু’পাশে। অপর একজন লোক তার পকেট থেকে রিভলভার এবং বাকি যা পেলো বের করে নিলো। সবচেয়ে আগে ছিনিয়ে নিলো লোকটা Dr. Kotze-এর থিসিসটা যে অ্যাটাচি কেসটীয় ছিলো সেটা।
সবকিছু কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিলো ওরা কুয়াশাকে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। পিছনে দুজন মেশিনগানধারী। তাদের পাশে বাকি পাঁচজন লোক। কুয়াশার সামনে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে অলস বাদুড়ের মতো একজন লোক। মিটিমিটি হাসছে সে কুয়াশার আপাদমস্তক জরিপ করতে করতে। চেয়ারের সামনে টেবিল নেই। কিন্তু লোকটার উরুর উপর রাখা আছে একটি মেশিনগান। বাঁটের উপর হাত রেখে যেন আদর করছে সে মারণাস্ত্রটাকে। | দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠলো কুয়াশা লোকটার দিকে তাকিয়ে, বুঝেছি! তোমরাই তাহলে সেই শয়তান? Dr. Kotze-এর শত্রু তাহলে তোমরাই, কেমন?’
‘জ্বি, হ্যাঁ! কেন, অপরাধ নাকি সেটা?’, | লোকটার স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল কুয়াশার। লাফিয়ে পড়ে কেড়ে নেবে নাকি সে মেশিনগানটা? ভাবলো সে। কিন্তু কি মনে করে ক্ষান্ত হলো সে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি চাও তোমরা আমার কাছ থেকে? আমাকে এভাবে ফাঁদ পেতে ভুলিয়ে নিয়ে আসার মানে কি?
| লোকটি বললো, মানেটা আবার বলে দিতে হবে বুঝি বাছাধনকে? তোমাকে
১৮৫
ধরে নিয়ে আসার মানে তোমার মৃত্যু। বুঝেছো এবার?’
কুয়াশা তেমনি কঠোর স্বরে বলে উঠলো, না! জানিস না কোন কালকেউটেকে ঘরে ডেকে এনেছিস তোরা। মৃত্যু আমার নয়, তোদেরই কপালে ঝুলছে মৃত্যু। মনে রাখিস আমার নাম কুয়াশা। কুয়াশা সুদূর পাকিস্তান থেকে এসেছে Dr. Kotze-এর শত্রুকে নির্মূল করতে। শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট থাকতে তাকে কেউ দমাতে পারবে না।’
‘চমৎকার! চমৎকার! বেড়ে ফুটানি মারতে পারো দেখছি তুমি তা কয়েকটা কথা বলতে হয় এবার তোমাকে।’
লোকটা সিধে হয়ে বসলো চেয়ারে। তারপর কুৎসিত এক টুকরো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো, তুমি এখন যতো কথাই বলো, বর্তমান অবস্থা হচ্ছে তুমি আমাদের হাতে বন্দী–যাকে বলে ঢলি নেই, তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার। আর বুড়ো Kotze-এর দফারফা করতেও খুব বেশি সময় লাগবে না আমাদের তাও তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। বিশ্বাস না হয় ঐ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখো।
লোকটার কথা শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো কুয়াশা। দেখলো পাহাড়ের প্রাচীরের সামনে একটা সুড়ঙ্গ মতো তৈরি করছে কয়েকজন লোক কোদাল এবং শাবল হাতে নিয়ে।
‘আজকেই শেষ হয়ে যাবে কাজটা। আজ রাতেই বুড়োকে ঘুম পাড়িয়ে দেবো আমরা।’
কুয়াশা তখন লোকটির দিকে তাকিয়ে শুরু করে দিয়েছে তার কাজ।
লোকটি কুয়াশার দিকে তাকিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে চলেছে তাদের প্ল্যানের কথা। একটি কথাও কানে যাচ্ছে না কুয়াশার।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশা লোকটির চোখের মধ্যমণিতে। স্থির অনড় তার শরীর। চোখের পাতা কাঁপছে না ক্ষণিকের জন্যেও। তার দৃষ্টি যেন কুরে। খাচ্ছে লোকটির চোখ জোড়ার মণি দুটো। জাদু! জাদু করছে কুয়াশা লোকটাকে।
জড়িয়ে এলো লোকটার উচ্চারণ। নিষ্পলক হয়ে গেছে তার দৃষ্টি। চোখ সরাতে পারছে না সে কুয়াশার চোখের উপর থেকে। হাসিটা উবে গেল তার মুখ। থেকে। দেখতে দেখতে কথা বলতে ভুলে গেল সে।
কুয়াশা যখন বুঝতে পারলো যে সময় হয়েছে, ঠিক তখনই নিজের চোখ জোড়া পলকের জন্যে মেশিনগানটার উপর ফেলে শক্ত করে নিলো নিজের শরীরের মাংসপেশী; কুয়াশার দৃষ্টি অনুসরণ করে যান্ত্রিকগতিতে তুলে নিলো লোকটা নিজের উরু থেকে মেশিনগানটা। তুলেই উঁচিয়ে ধরলো সে কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে। এরপর একই সঙ্গে দুটো কাণ্ড ঘটলো।
কুয়াশা বিদ্যুৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার পায়ের কাছে। একই সময়ে পরপর অনেকগুলো গুলি বের হলো মেশিনগানটা থেকে। ঝাঁপিয়ে পড়েই
লোকটাকে জড়িয়ে ধরলো কুয়াশা। ধপ ধপ করে কয়েকটা শব্দ হলো পিছনে। লোকটার হাত থেকে মেশিনগানটা কেড়ে নিয়ে পিছন দিকে তাকালো। সাতজনই
শেষ।
জানালার দিকে দৃষ্টি পড়তেই সচেতন হলো কুয়াশা। শাবল আর কোদাল ফেলে ছুটে আসছে পাঁচ-সাতজন। গুলির শব্দ শুনেছে ওরা। লোকটার দিকে তাকালো কুয়াশা। বোকার মতো তাকিয়ে আছে লোকটা নিজের লোকের লাশগুলোর দিকে। শার্টের কলার ধরে দাঁড় করালো কুয়াশা লোকটাকে। বাঁধবার সময় নেই। দাঁড় করিয়ে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারলো সে নাকের উপর। এক ঘুসিতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল লোকটা মাটিতে চিৎ হয়ে। মেশিনগানটা নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। দরজাটা পাথরের। বন্ধ।
| একটু পরই আপনাআপনি খুলে গেল দরজাটা। থমকে দাঁড়ালো সাতজন লোক কুয়াশাকে মেশিনগান, উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ওরা কুয়াশার হাতে ধরা মেশিনগানটার নলের দিকে ভীত দৃষ্টিতে।
* পিছু হটো!’
কথাটার অর্থ বুঝতে একটুও দেরি হলো না লোকগুলোর। হুড়মুড় করে পিছিয়ে গেল ওরা খানিকটা। দরজা অতিক্রম করে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। ইঙ্গিতে লোকগুলোকে কাজের জায়গায় ফিরে যেতে বললো। ঘুরে াড়িয়ে ধীরে ধীরে এগোলো ওরা যেখানে শাবল-কোদাল নিয়ে কাজ করছিল সেদিকে। পিছন পিছন চললো কুয়াশা।
| সাতজনকেই কাজ শুরু করতে বাধ্য করলো কুয়াশা। ইঙ্গিতে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছে সে কতক্ষণ লাগবে বাকি কাজটা শেষ হতে। এক ঘন্টা লাগরে জানালো,
ওরা। তারপরই Dr. Kotze-এর উদ্যান দেখা যাবে।
আধঘণ্টা সময় নির্দিষ্ট করে দিলো কুয়াশা। এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়া চাই। তা না হলে কপালে খারাবি আছে বলে সাবধান করে দিলো সে। আর যদি ঠিক সময় মতো কাজুটা হয় তবেই প্রাণে বাঁচবে।
প্রাণের ভয়, বড় ভয়। উঠে পড়ে লাগলো লোকগুলো পাহাড় কাটতে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কুয়াশার আহত লোকটার কথা। ঘু।ি মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে বটে, কিন্তু যে কোনো সময় তার জ্ঞান ফিরে আসতে পারে। কথাটা ভেবে চঞ্চল হয়ে উঠলো কুয়াশা। কি করবে বুঝতে পারলো না। এদেরকে ছেড়ে গেলে চলবে
। আবার ঘরের লোকটাকে না বাঁধলেও নয়।
দেরি হয়ে গিয়েছিল আগেই। সূর্যের আলোতে ছায়া পড়তেই ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো কুয়াশা। এসে পড়েছিল লোকটা। গুলি করলো কুয়াশাকে লক্ষ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লো কুয়াশা। লোকটা একটা ড্রামের আড়ালে আছে। শুয়ে পড়াতে দেখতে পেলো না কুয়াশাকে। এই সুযোগে সরে গেল কুয়াশা ডান পাশে।
১৮৭
নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফাঁকা জায়গাটায় উঠে দাঁড়ালো সে।
| টুপ করে শব্দ উঠলো একটা। তারপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। কয়েকজন লোকের আর্তনাদ শোনা গেল। ঝলসে উঠলো কুয়াশার চোখ দুটো। লোকটাকে দেখতে পেলো. সে এবার। খুঁজছে কুয়াশাকে। গুলি করলো কুয়াশা দেরি না করে। আর্তচিৎকার উঠলো আরো একটা। ধপ করে শব্দ তুলে পড়লো লোকটা মাটিতে।
| বোমা মেরেছিল লোকটা কুয়াশাকে লক্ষ্য করে। বোমাটা গিয়ে পড়েছিল সড়ঙ্গ মতো জায়গাটায়। লোকগুলো কাজ ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল আগেই। বোমাটা পড়বার সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে।
কাছাকাছি পৌঁছে কুয়াশা দেখলো মারা গেছে লোকগুলো। কড়াইটের উৎকট গন্ধ নাকে ঢুকলো তার।
বোমার আঘাতে পাহাড় কাটার বাকি কাজটা শেষ হয়ে গেছে। খানিকটা পাথর উড়ে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে একটা। স্টেনগানটা হাতে নিয়ে গর্তমুখের সামনে, গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা তখুনি। মাথা গলিয়ে বাইরেটা দেখে নিলো সে প্রথমে।
তারপর শরীরটা ধীরে ধীরে গলিয়ে দিলো গর্তের ভিতর।
গর্ত থেকে শরীরটা এপারে নিয়ে এসে মাটির উপর দাঁড়ালো কুয়াশা। জঙ্গল মতো দেখলো সে জায়গাটা। তবে ছাড়া ছাড়া ভাবে গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশে এবং সামনেও দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথা। তবে সে সব অনেক দূরে।
অদ্ভুত সব গাছ দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটায়। এরকম গাছ জীবনে দেখেনি কুয়াশা। একটা গাছ দেখে রীতিমত দাঁড়িয়ে পড়লো সে আশ্চর্য হয়ে। গাছটা হাত পাঁচেকের বেশি লম্বা হবে না। ডালপালাও খুব বেশি নয়। নিমগাছের পাতার মতো। গাছটার পাতা। কিন্তু আশ্চর্য এই যে একটা সরু মতো সূতো দিয়ে প্রতিটি পাতা প্রতিটির সঙ্গে যোগসূত্র রেখেছে। আর একটি গাছ দেখে কুয়াশার মনে হলো, আরে! এযে দেখছি রঙিলা গাছ! সত্যি রঙচঙেই বটে গাছটা। খানিকটা অংশ একেবারে লাল, মাঝখানটা সবুজ, উপরের দিকটা গাঢ় হলুদ! এই রকম আরো অদ্ভুত অদ্ভুত গাছপালা দেখতে দেখতে একটা ছোটো হ্রদের সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা।
| এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো।কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। ঘরবাড়িও দেখা যাচ্ছে না। হ্রদটা বাঁয়ে রেখে হাঁটতে লাগলো কুয়াশা দ্রুত পায়ে।
| হ্রদটা চোখের আড়ালে চলে গেল একসময়। হঠাৎ কুয়াশা থমকে দাঁড়ালো। গরিলা!
মাত্র পঞ্চাশ হাত দূরে গরিলাটাকে দেখতে পেলো কুয়াশা। এখান থেকে একটা চওড়া মতো রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। রাস্তার মুখে পায়চারি করে
১৮৮
বেড়াচ্ছে বিরাটাকৃতি জানোয়ারটা।
আশ্চর্য হলো কুয়াশা, আফ্রিকা ছাড়া গরিলা আর কোথাও পাওয়া যায় না। সেই গরিলা পেরুর No man’s land-এ এলো কিভাবে? কেমন যেন সন্দেহ হলো কুয়াশার গরিলাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। হঠাৎ তার মনে হলো গরিলাটা নিজের ইচ্ছায় ওভাবে একদিক থেকে অন্যদিকে অবধি পায়চারি করে বেড়াচ্ছে না। রীতিমত যান্ত্রিক মনে হচ্ছে গরিলাটির পদচারণা। নির্দিষ্ট একটা জায়গা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে জানোয়ারটা। অন্য কোথাও তার পা পড়ছে না। নিশ্চয় কোনো বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিচালিত করা হচ্ছে একে।
পায়ে পায়ে এগোলো কুয়াশা পরিলাটার দিকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ‘গোগীর কথা। আহত গোগীকে সঙ্গে নেয়ার কোন উপায় ছিল না, তাই গুলি করে, মেরেছিল সে প্রভুভক্ত জানোয়ারটাকে। বিশ্বাস করতে পারেনি অবোধ জানোয়ারটা কুয়াশার নিষ্ঠুরতা। বোবার মতো একজোড়া নিরীহ চোখ মেলে তাকিয়েছিলো সে প্রভুর দিকে গুলি খেয়ে।
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো কুয়াশার সব কথা মনে পড়ে যেতে। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। গরিলাটা দেখে ফেলেছে তাকে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলো কুয়াশা জানোয়ারটার হাতে একটা বন্দুকের মতো অস্ত্র। গরিলাটা লক্ষ্য স্থির করছে। সেটা দিয়ে কুয়াশার দিকে। মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়লো কুয়াশা। পরক্ষণেই তৈরি হলো আত্মরক্ষার জন্যে। স্টেনগানের ট্রিগার টিপতে আর এক সেকেণ্ড বাকি ছিলো তার। এই এক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়ালো। বন্দুকের মতো অস্ত্রটা নামিয়ে নিয়ে রীতিমতো সাহেবী কায়দায় স্যালুট করলো গরিলাটা কুয়াশাকে।
| স্টেনগানটা নামিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। গরিলাটা তাকে পথ ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যাবার জন্যে ইঙ্গিত করছে। দেরি না করে এগোলো কুয়াশা চওড়া মতো রাস্তাটা ধরে। গরিলাটাকে ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে সে দেখলো আবার আগের মতো পদচারণা শুরু করেছে জানোয়ারটা।
যেতে যেতে আরো দুটো গরিলাকে একই কায়দায় পায়চারি করে বেড়াতে দেখলো কুয়াশা। এবার তাকে দেখেই স্যালুট করলো ওরা। দেখিয়ে দিলো হাত বাড়িয়ে কোনদিকে যেতে হবে।
| খানিক দূরে এগিয়েই শুনতে পেলো একটা গম্ভীর, গভীর, প্রাচীন এবং আবেগপ্রবণ ভারি কণ্ঠস্বরঃ স্বাগতম!
| অদ্ভুত কণ্ঠস্বরটি শুনে চমকে উঠলো কুয়াশা। এদিক-ওদিক তাকালো সে চঞ্চল দৃষ্টিতে। কোনো মানুষ দেখতে পেলো না। এপাঁশে ওপাশে আজব ধরনের গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা। শরীরে আগাগোড়া সাদা রঙয়ের আঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি গাছ, আর একটি গাছের পাতা নেই, অপর একটি গাছের
১৮৯
কাও গোল নয়। দেশলাইয়ের মতো।
কাউকে দেখতে না পেয়ে রোমাঞ্চিত হলো কুয়াশার সর্বশরীর। অতি কাছ থেকে শুনেছে সে অদূত আবেগপ্রবণ কণ্ঠস্বরটি, অথচ কাছাকাছি কেউ নেই তার।
– ‘স্বাগতম! স্বাগতম, বন্ধু!
কুয়াশা আবার শুনলো কণ্ঠস্বরটা। পিছন দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হলো সে। শরীরে আগাগোড়া সাদা আঁশ নিয়ে যে গাছটি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটার ভিতর থেকে লম্বা একটা হাত বেরিয়ে এলো কুয়াশার দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে কুয়াশা বুঝলো যেটাকে সে গাছ মনে করে ভালো করে। তাকিয়ে দেখেনি সেটা আসলে কোনো গাছই নয়।
‘আমি বৈজ্ঞানিক Kotze, বন্ধু। তোমার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ অনুভব করছি। আমার জন্যে শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এখন পর্যন্ত ছুটে আসার জন্যে আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। | Dr. Kotze! ইনিই সেই মানুষ যাকে চোখে দেখার জন্যে কুয়াশার লোভের সীমা ছিলো না। বিয়ে অবশ হয়ে আসতে চাইলো কুয়াশার সর্বশরীর। কি ভীষণ লম্বা মানুষটা! সাত ফুট হবেন নিশ্চয়।
শরীরে কাঁচাপাকা লম্বা লম্বা লোম। মুখের দাড়ি, গোফ সাদা-কালো। ভুরুর লোমগুলো নেমে এসেছে চোখের পাতার উপর পর্যন্ত। টুলটুল দৃষ্টি Dr. Kotze-. এর। অলোকিত এক টুকরো হাসি ফুটে রয়েছে ঠোঁট জোড়ায়। সাদা পোশাকে দেবদূত বলে মনে হচ্ছে তাকে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কুয়াশা। স্টেনগানটা মাটিতে রেখে বৈজ্ঞানিকের। বাড়ানো হাতটা ধরলো সে দু’হাত দিয়ে। Dr. Kotze তাকে দু’হাত দিয়ে
জড়িয়ে টেনে নিলেন বুকের কাছে।
মহান এবং উদার একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো কুয়াশার মন। কুশাি মুগ্ধ হলো Dr. Kotze-এর ব্যক্তিত্বের অবর্ণনীয় রূপ দেখে।
আজ পাঁচ বছর পর আমার ঘর থেকে এতো দূরে এলাম আমি। শুধু তোমাকে স্বাগত জানাবার জন্যে, কুয়াশা।’
কুয়াশা বললো, ধন্যবাদ, ডক্টর, কিন্তু কি কারণে এতদিন এদিকে আসেননি আপনি?
| Dr. Kotze বললেন, কোনো রিস্ক নিতে চাই না বলে ঘর থেকে বের হই না আমি। শত্রুরা কখন কোথা দিয়ে আমার এলাকায় ঢুকে পড়ে ওঁৎ পেতে থাকে কে জানে। যথেষ্ট ব্যবস্থা করেছি আমি পাহারার। কোনো মানুষই পারতপক্ষে আমীর অজান্তে এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। তবু বলা যায় না, তাই সাবধান থাকি আমি সবসময়।
কুয়াশা প্রশ্ন করলো, কারা এই শত্রু আপনার? কি তাদের উদ্দেশ্য? কি চায় ১৯০
=
4
=
তারা আপনার কাছে?
| Dr. Kotze বললেন, চলো ঘরের দিকে হাঁটা যাক। সবকথা বলবো তোমাকে। সে অনেক কথা। সময় না নিয়ে বললে বুঝতে পারবে না তুমি।’
কুয়াশা বললো, “ঠিক কথা। কিন্তু কয়েকটা খুঁটিনাটি ব্যাপারে আমার কৌতূহল হচ্ছে।’
‘প্রশ্ন করো, বন্ধু।
কুয়াশা বললো, আমার যন্ত্রে আপনার পাঠানো আবেদন বাণী ধরা পড়েছিল। ঐ থেকে আমার ধারণা হয়েছে আপনি মঙ্গলগ্রহে কোনো যন্ত্র পাঠিয়েছেন। এখান থেকে যোগাযোগ করেন আপনি দরকার মতো।
– ঠিক ধরেছো। মঙ্গলগ্রহে যে যন্ত্রটা পাঠিয়েছি সেটা একটা গরিলার শরীরে ফিট করা আছে।’
কুয়াশার মুগ্ধ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আপনি মঙ্গলগ্রহে গরিলা পাঠিয়েছেন? তার মানে, দূরপাল্লার মহাশূন্যযান আছে আপনার? | Dr. Kotze মৃদু শব্দ করে হেসে নিয়ে বললেন, মঙ্গলগ্রহ ছাড়িয়ে, আমাদের সৌরজগৎ ছাড়িয়েও অনেক দূর গ্রহ নক্ষত্রে গরিলা পাঠাতে সক্ষম হয়েছি আমি।’
খানিকক্ষণ কোনো কথা, সরলো না কুয়াশার মুখে। তারপর আবার প্রশ্ন করলো সে, এখানে ঢুকেই যে গরিলাগুলোকে দেখলাম সেগুলোকে বিশেষ ট্রেনিং দিয়েছেন আপনি। এবং যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসেই ওদেরকে পরিচালিত করেন, তাই না?”
| ‘তুমিই একমাত্র আমার উপযুক্ত সাহায্যকারী হতে পারবে, কুয়াশা। তোমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আগেই পেয়েছি আমি। এখন আরো পাচ্ছি। তুমি সাহায্য না করলে আমি এখনো বেকার!’,
কুয়াশা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতে Dr. Kotze বললেন, ‘তুমি যে মঙ্গলগ্রহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার কাজে সফল হয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটা যন্ত্র তৈরি করে, তা আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে আগত সঙ্কেত থেকে জানতে পেরেছিলাম। তখন থেকেই তোমাকে সম্মান করি আমি। প্রতিভাকে ভালবাসা উচিত আমাদের।
দুজনই নীরব রইলো কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে হাঁটছে ওরা সানের ওপর দিয়ে। কিছুক্ষণ থেকে কি একটা কথা বলার চেষ্টা করছে কুয়াশা। কিন্তু কোনমতে ঠোঁট খুলতে পারছে না সে।
হঠাৎ Dr. Kotze মৃদু হেসে বলে উঠলেন, তুমি যা বলতে চাও অথচ বলতে পারছে না, তা আমি জানি, বন্ধু। মারা গেছে আমার ছেলে–এই কথা তো? আমি আগেই জেনেছি খবরটা। ওর হৃদযন্ত্রে ক্ষুদ্রাকৃতি ওয়্যারলেস ছিলো– সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়েছিলাম আমি।’
হতবাক হয়ে তাকালো কুয়াশা Dr. kotze-এর দিকে। মানুষটা অন্তর্যামী
১৯১
নাকি। কি করে বুঝলেন উনি কুয়াশার মনের কথা? তাছাড়া আরো আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হলো কুয়াশার এই কথা ভেবে যে Dr. Kotze নিজের ছেলের হৃদযন্ত্রে ওয়্যারলেস ফিট করেছিলেন কিভাবে? আজ পর্যন্ত এরকম সংযোজনের কথা শোনা যায়নি কোথাও।
“ কুয়াশা ধীরে ধীরে বললো, ফার্নান্দো, মারা গেছে সে কথাও জানেন আপনি?” ‘ফার্ণান্দো:..ফার্ণান্দো…মারা গেল ছেলেটা? আশ্চর্য তো! মারা গেল কেন?’
ভ্রূ কুঁচকে উঠলো ‘Dr. Kotze-এর। কুয়াশা বলতে যাচ্ছিলো ঘটনাটা, বৃদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলেন অন্যমনস্ক ভাবে, মানুষ মরে..কেন মরে দেখে নেবো আমি। তার চেয়ে কিছু বোলো না, কুয়াশা–সব মৃত্যুই তো,একই ভাবে ঘটে। ঘটনায় কৌতূহল নেই আমার।’
সী–লেবেলের অনেক নিচে Dr. Kotze-এর বাসস্থান। উদ্যানের একটা জায়গায় সিঁড়ি আছে নিচে নামার। একটি মাত্র বিরাট হলঘর। সেখানেই হাজার রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রাখা আছে। পাথর দিয়ে তৈরি করা ঘরটা। হলঘরের পাশেই পর পর সাতটা ছোটো ছোটো গুদাম ঘর। যন্ত্রপাতিতে সাজানো ঘরগুলো। এছাড়া আর কোনো ঘর নেই। হলঘরের গুপ্ত দরজা দিয়ে একটা জায়গায় যাওয়া আসা করেন Dr. Kotze, সেখানে রকেট নিক্ষেপক মঞ্চ তৈরি করা আছে।
হলঘরেই রাতদিন কাটে বৃদ্ধের। খাওয়া, কাজ করা, ঘুমানো সব এখানেই সারেন তিনি। কয়েকটা গরিলা ছাড়া অন্য কোনো পরিশ্রমী প্রাণী নেই। রান্নাবান্না করে ঐ ট্রেনিংপ্রাপ্ত গরিলাই। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন Dr. Kotze-এর। উদ্যানে ফলমূল, শাক-সজি আছে। চলে যায় ওতেই। নিরামিষ পছন্দ করেন বৈজ্ঞানিক।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া না হওয়া পর্যন্ত কাজ নিয়ে থাকলেন Dr. Kotze. কুয়াশার সঙ্গে একটি কথাও বললেন না তিনি। এমন কি তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলেন না। কুয়াশা যে তাঁর সামনেই বসে আছে তা যেন তিনি ভুলেই গেছেন। [ মুগ্ধ হলো কুয়াশা ষাট বছর বয়েসের বৃদ্ধের নিষ্ঠা দেখে। কাজের সময় পৃথিবীতে থাকেন না বৈজ্ঞানিক। সব ভুলে যান এক নিমেষে। কাজটা সৃষ্টিকর্তার মনে করেন অনেক মনীষী। Dr. Kotze যেই মনীষীদেরই একজন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে মুখ খুললেন বৈজ্ঞানিক। ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর। বললেন, তোমাকে দরকার আমার। কঠিন একটা সমস্যায় পড়েছি আমি। জীববিদ্যা সম্পর্কে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব হচ্ছে না সমস্যাটার জন্যে। সূত্রটা জানা নেই আমার। তুমিই আমাকে উদ্ধার করতে পারো এ ব্যাপারে। সূত্রটা তৈরি করে দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি তোমাকে আমি।’
কুয়াশা বললো; ‘আমি আপনাকে সাহায্য করতেই এতদূর এসেছি। যথাসাধ্য ১৯২
চেষ্টা করবো আমি সূত্রটা তৈরি করতে।’
‘আমি জানি তুমি সফল হবে।’
বৃদ্ধ বললেন আবার, আমার জীবনের কথা শুনতে কৌতূহল হচ্ছে তোমার বুঝতে পারছি। বলছি শোনো। আচ্ছা, কুয়াশা, জার্মানীর বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ড. হারাফেলোর সঙ্গে পরিচয় আছে তোমার?
কুয়াশা বললো, আমি যখন ড, কার্ল ব্র্যাণ্ডেনবার্গের ছাত্র ছিলাম তখন দেখেছিলাম একবার ড. হারাফেলোকে। পরিচয় করার সুযোগ পাইনি।
বৃদ্ধ বললেন, ‘কার্ল ব্র্যাণ্ডেনবার্গ তোমার শিক্ষক ছিলেন বুঝি? কুয়াশা বললো, হ্যাঁ।
‘ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড় আমি। কার্ল ব্র্যাণ্ডেনবার্গ যদিও আমার ছাত্র ছিলো না, তবে আমার বন্ধুর ছাত্র ছিলো ও। নিহত হয়েছিল সে, মনে আছে,
আমার। ব্যাপারটা কি ঘটেছিল জানো তুমি?’
কুয়াশা বললো, আমি সব জানি। তার ঐ দশার জন্যে আমাকে দায়ী করা যায়।’
‘ওঃ!’
বৃদ্ধকে চমকে উঠতে দেখে কুয়াশা বললো, ‘ড, কার্ল ব্র্যাণ্ডেনবার্গকে হত্যা না করে উপায় ছিলো না আমার, Dr. Kotze! লোকটার অতবড় একটা প্রতিভা ছিলো, কিন্তু ভিতরটা তার পশুর চেয়েও শতগুণ কুৎসিত।’
‘ জানি আমি, তুমি কি বোঝাতে চাইছে। আমিও তোমাকে ঐ একই ঘটনা শোনাবো। তোমার মতো আমিও ভুক্তভোগী। কিন্তু ড. হারাফেলোকে শেষ না করে ভুল করেছিলাম আমি। যার জন্যে এতো অশান্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাকে।’
.. সারাটা দুপুর এবং বিকেল লেগে গেল Dr. Kotze-এর কথা শেষ হতে। জঘন্য চরিত্রের একটা প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকের কথা শুনতে শুনতে ঘৃণায় জ্বলে উঠলো কুয়াশার সর্বশরীর। না থাকতে পেরে আশ্চর্য হয়ে আপন মনে বললো সে, ‘কি শয়তান আপনার ঐ বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হারাফেলো। এতবড় একজন সাধক যে এমন নীচ হতে পারে তা বিশ্বাস করতে বাধা বাধো ঠেকে।’।
‘কেন। ড, কার্ল ব্র্যান্ডেনবার্গও তো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান সাধক। সে কি তোমাকে কম অসুবিধেয় ফেলেছিল? সেও তো হারাফেলোর মতো জঘন্য নীচতার পরিচয় দিয়েছে। তা না হলে তুমি তাকে হত্যা করলে কেন।
‘হ্যাঁ। আমিও ভুক্তভোগী। জানি আমি এইসব প্রতিভাবানদের। মানব সমাজের সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছে এরা, কিন্তু এদের মতো কুরুচি কোনো পাগল ছাগলেরও নেই।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল Dr.Kotze-এর জীবনকাহিনী। ড. হারাফেলোর
–
১৯৩
সহকারী ছিলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স চব্বিশ। তিরিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর ছেলের বয়স ছিলো চার। তখনই বিরোধ শুরু হয় Dr. Kotze-এর ড. হারাফেলোর সঙ্গে।
পদার্থবিজ্ঞানের উপরই পড়াশোনা করেছিলেন Dr. Kotze. যুগান্তকারী কয়েকটি আবিষ্কার সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন তিনি অনেকদিন থেকেই। শেষ পর্যন্ত অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটা থিসিস লিখে শেষ করলেন তিনি আবিষ্কার সম্পর্কে। থিসিসটা তিনি তাঁর গুরু ড, হারাফেলোকে দেখতে দিয়েছিলেন। ধিসিসটা আসলে যুগান্তকারী একটা আবিষ্কারের সম্ভাবনা উদ্মাটন করে দেবার মতো সূত্র সম্বলিত ছিলো। নীচমনা হারাফেলো সেটা পড়তে নিয়ে আর ফিরিয়ে দিতে রাজি হলো নাথিসিসটা যার নামে প্রকাশ করা যাবে সে হবে প্রাতঃরণীয়, একথা বেশ ভালো ভাবে বুঝেছিল সে। Dr. Kotze-কে সে ভয়। দেখিয়ে বললো, এ সম্পর্কে একটি শব্দও যদি তার মুখ থেকে বের হয় তবে প্রাণে মেরে ফেলা হবে তাকে।
| Dr. Kotze ছিলেন হারাফেলোয় সহকারী। তেমন খ্যাতিও তাঁর ছিলো। তিনি যদি লোককে বলেন যে ড. হারাফেলো আমার থিসিস মেরে দিয়ে নি, নামে প্রকাশ করতে চাইছে তবে সেকথা উড়িয়ে দেবে তারা। বিশ্ববিখ্যাও পণ্ডিতের বিরুদ্ধে একথা বলার ফলে তাকে হয়তো জেল খাটতে হবে শেষ পর্যন্ত। সাত-পাঁচ ভেবে চুপ করেই রইলেন Dr.Kotze..
এদিকে থিসিসটা পড়ে ভালমতো কিছুই বুঝতে পারেনি হারাফেলো। অত্যন্ত জটিল এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিলো Dr. Kotae-এর সূত্র এবং তত্ত্বগুলো। সেগুলোর ব্যাখ্যা করা একমাত্র তাঁর নিজের দ্বারাই সম্ভব ছিলো। হারাফেলো বুঝলো অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের সামনে থিসিসটা ব্যাখ্যা করতে না পারলে তার নাম-যশ হয় না। প্রাতঃস্মরণীয় হবার সাধও মেটে না। তাই আরও একটা নিষ্ঠুর কাজ করার প্ল্যান করলো সে। | যেখানে যততা বক্তৃতা দেবার ডাক আসে হারাফেলোর সেখানে বক্তৃতা দেবার জন্যে সে নিজেই উপস্থিত থাকে। কিন্তু Dr. Kotze-কে দিয়ে লিখিয়ে নেয় সে বক্তৃতা, নিজে সভায় গিয়ে নিজের লেখা বলে পড়ে শোনায়। এভাবেই চলছিল বহুদিন। এরপর চুরি করা থিসিসটা মূল সূত্র সম্পর্কে বক্তৃতা লিখে দেবার জন্যে চাপ দিলো সে Dr. Kotze-কে। রাজি হলেন না Dr. Kotze, তাঁকে শায়েস্তা করার জন্যে Dr. Kotze-এর স্ত্রীকে কিডন্যাপ করা হলো একদিন। এছাড়া Dr. Kotze যাতে পালাতে না পারেন তার ব্যবস্থাও করলো শয়তান হারাফেলো। চারজন ষণ্ডামার্কা গুণ্ডা দিনরাত তার আশপাশে ঘোরাফেরা করতে লাগলো। তাতেও নিজের সিদ্ধান্তে অটুট রইলেন Dr. Kotze. কিন্তু একদিন তাঁর সামনে তার যুবতী স্ত্রীর শরীরের যত্রতত্র অ্যাসিড ছিটিয়ে দিতে দেখে সহ্যের বাঁধ ভেঙে ১৯৪
গেল তাঁর। রাজি হয়ে গেলেন তিনি থিসিসের সূত্র সম্পর্কে বক্তৃতা লিখে দিতে। বাধ্য হয়ে রাজি হলেন বটে Dr. Kotue. কিন্তু মনে মনে ভেবে রাখলেন সুযোগ পেলেই থিসিস উদ্ধার করে পালাবেন তিনি।
. সুযোগ এলো বহুদিন পর। থিসিসটাও হাতে পেলেন তিনি। কিন্তু স্ত্রীকে হারালেন চিরতরে। হারাফেলো বন্দী করে রেখেছিল তাঁকে। আত্মহত্যা করেন। তিনি কিছুদিন পর। * Dr. Kotze-এর বাবা ছিলেন জমিদার। টাকা পয়সা তার যথেষ্টই ছিলো। হঠাৎ দেশে ফিরে গেলেন তিনি একদিন। বাবা শয্যাগত এই খবর আগেই পেয়েছিলেন তিনি। গিয়ে জীবিত দেখতে পেলেন না পিতাকে। দুদিন মনমরা হয়ে দেশের বাড়িতে কাটিয়ে তৃতীয় দিন জমিদারী বিক্রি করে দিয়ে ফিরে এলেন তিনি লাখ লাখ টাকা নিয়ে শহরে।
এক অন্ধকার রাতে থিসিস এবং প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে নিয়ে। পৃথিবীর এই নির্জন প্রান্তে এসে সাধনায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। একমাত্র সন্তানকে এক বন্ধুর কাছে রেখে এসেছিলেন। ছেলে বড় হলে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় পিতা-পুত্রের। বড় হতে একবার মাত্র দেখা হয় দুজনের। তারপর থেকে Dr. Kotze ছেলেকে দূরে দূরে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। হারাফেলো কিভাবে যেন খোঁজ পেয়ে আবার পিছু লেগেছে তাঁর–হঠাৎ একদিন টের পেলেন তিনি। ছেলেকে নিরাপদ রাখার জন্যেই দূরে পাঠিয়ে দিলেন। দূরে থেকেই পিতাকে সাহায্য করতো সে। বছর চারেক শয়তান হারাফেলো লেগে থাকলো Dr. Kotze-এর কাজে বাগড়া দেবার জন্যে। আসলে থিসিসটার লোভ ছাড়তে পারেনি সে। কিন্তু তার পাঠানো চারজন লোক ফিরে গেল একদিন। Dr’. Kotze-এর কোনো ক্ষতি করা সাধ্যে কুলোল না।
তাই বলে চুপ করে বসে থাকলো না হারাফেলো। ভয়ঙ্কর একটা চাল চাললো সে। অসম্ভব শক্তিশালী একটা আন্তর্জাতিক অপরাধী দলকে লেলিয়ে দিলো সে। Dr. Kotze-এর পিছনে।
| হারাফেলো তাদেরকে ভালো করে বোঝালো Dr. Kotze-এর থিসিস এবং আবিষ্কারগুলো হাত করতে পারলে কি বৈপ্লবিক কাজ ঘটবে পৃথিবীতে। Dr. Kotze-এর থিসিস এবং আবিষ্কার সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা ছিলো না হারাফেলোর। আবিষ্কারগুলো যে হাতে পাবে তার বিরুদ্ধে কোনো শক্তিই টিকবে।
। একথা সে জানতো ভালো করেই। ইন্টারন্যাশনাল গ্যাংয়ের দলপতির সঙ্গে দেখা করে সব কথা খোলসা করে বুঝিয়ে দিলো সে। দলপতিও বুঝলো। সে ভাবলো, সত্যি আবিষ্কারগুলো যদি আমাদের হাতে আসে তাহলে আমেরিকা বা রাশিয়ার কাছে সেগুলো বিক্রি করে কোটি কোটি স্বর্ণ মুদ্রার ব্যবস্থা হতে পারে। কিংবা, এমনকি, কারো কাছেই বিক্রি না করে আমরা নিজেরাই সেগুলো কাজে
১৯৫
লাগাতে পারি। Dr. Kotze-কে জীবিত ধরতে পারলেই আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করতে পারবো আমরা। তখন সর্বশক্তিমান একটা দল হবে। পৃথিবীকে শাসন, করবো আমরাই। রাশিয়া বা আমেরিকা তখন থাকবে আমাদেরই শক্তির অধীনে।’
এই রকম আশাতীত সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে রাজি হয়ে গেল গ্যাংটা। সর্বশক্তি দিয়ে Dr. Kotze-এর পিছনে লাগলো তারা। এমন কি, Dr. Kitze কে কুয়াশা সাহায্য করার জন্যে আসতে পারে এই খবর পেয়ে বাধা দেবার জন্যে সুদূর পূর্ব-পাকিস্তানেও সাবমেরিন পাঠাতে দ্বিধা করলো না তারা। গত পনেরো ‘ বিশ বছর ধরে কাজ করছে তারা। বহুদিন কোনো হদিশই করে উঠতে পারেনি।
ওরা Dr. Kotze-এর আস্তানা সম্পর্কে। কিন্তু এখন তারা সব জেনে ফেলেছে।
পঁচাশি বছরের শয়তান হারাফেলো বেঁচে আছে এখনও। দূরে বসে বসে মজা পাচ্ছে সে Dr. Kotae-এর দুর্দশার কথা ভেবে।
| এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো কুয়াশা। পরদিন সকালে হলঘরে ঢুকে কাজে লেগে পড়লো দুই বৈজ্ঞানিক। বসলো সকাল আটটায় উঠলো মধ্যরাতে!
দশ।
—
–
–
–
–
–
–
–
–
ফিসফিস করে ষড়যন্ত্র চলছিল শহীদের বিরুদ্ধে মহুয়া এবং কামালের মধ্যে। শহীদ রিভলভার পরিষ্কার করছিল আপন মনে। অবশ্যি মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছিল। সে তার বিরোধী দলের দিকে। কিন্তু গুরুত্ব দিচ্ছিলো না সে ওই চুনোপুঁটিদের। নিজের কাজে মশগুল যেন সে, এই ভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল।
ঘোড়াগুলো বাঁধা রয়েছে একদিকে। লৌহমানবদ্বয় পিছনে আছে, এখনো এসে পৌঁছয়নি ওরা। ঘোড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ুতে পারে না ওরা। তাই পিছিয়ে পড়েছে। গফুরকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মি. সিম্পসন মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছেন বসে বসে।
ফ্লাস্কগুলোয় পানি ভরা আছে। তাই কাছে পিঠে কোনও ঝর্না আছে কিনা দেখতে যেতে রাজি হয়নি শহীদ। মহুয়া হাজারবার সেধেও সফলকাম হতে পারেনি। অবশেষে কামালের সঙ্গে জোট পাকাচ্ছে সে। ব্যাপারটা এখন আর স্বাভাবিক নেই, জেদের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। খাবার পানি যথেষ্ট আছে তা ঠিক। আসলে খাবার পানির জন্যে মাথাব্যথাও নেই মহুয়ার। মেয়েমানুষ সে,
একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে। স্নান করেনি গত তিন দিন সে। সাধ হয়েছে আজ স্নান করবে। শহীদকে এতো করে বলেও যখন কাজ হলো না তখন ১৯৬
কামালের শরণাপন্ন হলো। এখন যে সে স্নান করবে বলেই জোট পাকাচ্ছে তা নয়। তার জেদ শহীদকেও স্নান করিয়ে ছাড়বে। এদিকে কামাল অনেক রকম পরামর্শ দিচ্ছে বটে শহীদকে কিভাবে কাবু করা যায় সে ব্যাপারে, কিন্তু যথার্থ পরামর্শ
একটিও দিতে পারছে না।
কামাল, শহীদ কাজ করতে করতে হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলো। নড়েচড়ে বসে কামাল বললো, বল।
তুই কেমন লোক বলতো?’ রীতিমত তিরস্কার শহীদের কণ্ঠে। আমি কেমন লোক? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো কামাল।
শহীদ বললো, “আচ্ছা, ও প্রশ্ন থাক। বলতো, তুই আমার সঙ্গে এমন শত্রুতা শুরু করেছিস কেন?
মনে! শহীদ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, তুই না আমার বাল্যবন্ধু, কামাল?.
কামাল শহীদের দিকে সাবধানে তাকিয়ে বললো, ‘হা! কিন্তু তাতে কি হয়েছে?’
মহুয়ার দিকে ইঙ্গিত করে শহীদ বললো, ‘ও তো ক’দিন মাত্র হলো আমাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্য, এরইমধ্যে তুই আমার বন্ধুত্বের অমর্যাদা শুরু করে দিলি? মহুয়া তো ততো নয়, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ পুরানো। আমাকে ছেড়ে তোর যতো শলাপরামর্শ সব এখন ওর সঙ্গে হয় দেখে মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয় তোর বন্ধুত্ব মেকি কিনা।’’ | শহীদ হেসে ঠাট্টা করছে বুঝতে পেরে কামাল বললো, ‘কে বললো আমরা তোর বিরুদ্ধে জোট পাকাচ্ছি?”
শহীদ হেসে বললো, তুই কি ভাবিস আমাকে? মনে করেছিস বুঝতে পারি, কি আলোচনা করছিস তোরা আমার বিরুদ্ধে?
শহীদকে কথা বলার সুযোগ না দেবার জন্যে শুধু শুধু চিৎকার করে উঠলো। মহুয়া, গফুর! গফুর!!
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না গফুরের।
কোথায় গেল হারামজাদাটা!”
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো মহুয়া। তারপর কিছুক্ষণ আগে গফুরকে যেদিকে যেতে দেখেছিল সেইদিকে এগিয়ে গেল একা। ‘
খানিকটা দূরে গিয়ে একটা মোড় ঘুরতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মহুয়া। বড়সড় একটা ঝর্না দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অদূরে। পাহাড়ী ঝর্না। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পানি জমে আছে। ক্ষুদ্র একটা পুকুরই বলা যায়। কর্নাটার ধারে শুধু ল্যাংগোট পরে ঘনঘন উন বৈঠক কষছে যে লোকটা সে আর কেউ নয়–স্কুলবুদ্ধি গফুর!
‘এই গফুর, এ আবার কি হচ্ছে তোর। খাবি না?
ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় পড়লো গফুর। তা সত্ত্বেও গম্ভীর হয়ে বললো সে, না দিদিমণি, তুমি আমাকে আর খাওয়ার কথা বলো না। তাড়া মেরে বেশি বেশি করে খাইয়ে আমাকে আলসে করে দিয়েছো তুমি। আমি কি এরকম ছিলাম আগে? এই ভুঁড়ি ছিলো আমার? যাই বলো তুমি, আমি আর তোমার কথায় ঘনঘন খাবো না। এখন আমি নিয়মিত ব্যায়াম করবো, যতদিন না আগের মতো জোর হয়। ওহ! এই ভুড়ির জন্যে জংলীদের হাতে কম নাকানিচোবানি খেতে হয়নি আমাকে।’
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে আবার শুরু করলো গফুর ডন-বৈঠক। গফুরের কথা শুনতে শুনতে একটা বুদ্ধি খেললো মহুয়ার মাথায়। তখুনি এগিয়ে. গিয়ে ঝর্নার পাশে চলে এলো সে। তারপর গফুরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ঝাঁপিয়ে
পড়লো ঝর্নার পানিতে। শব্দ শুনে ঘাড় ঘোরাতেই গফুর দেখলো, মহুয়া পানিতে। ডুবে যাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলো সে সঙ্গে সঙ্গে। মহুয়াকে উদ্ধার করার জন্যে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো সে আর একটু হলে। মাথা তুলে মহুয়া বললো, “তুই না, তুই না! তোর দাদামণিকে গিয়ে খবর দে। বল, দিদিমণি ডুবে যাচ্ছে-জলদি এসো।
কথাটা শুনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো গফুর শহীদের কাছে। মহুয়া ডুবে যাচ্ছে শুনেই ছুটলো শহীদ ও কামাল গফুরকে সঙ্গে নিয়ে ঝর্নার দিকে।
ঝর্নার কাছে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শহীদ পানিতে। মহুয়ার মাথা দেখা যাচ্ছিলো। সেদিকেই দ্রুত সাঁতরাতে লাগলো শহীদ। কাছাকাছি পৌঁছুতেই মাথা তুলে খিলখিল করে হেসে ফেললো মহুয়া। হাসতে হাসতে শহীদকে ধরে ফেলে। বললো সে, কেমন! স্নান করিয়ে ছাড়লাম তো!’
সন্তুষ্টির হাসিতে ভরে উঠলো কামালের মুখ মহুয়ার জয় এবং শহীদের নিদারুণ পরাজয় দেখে। আর গফুর ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে কামালকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থমকে গেল। শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন না করারই সিদ্ধান্ত নিলো সে। কেননা কামালদাকে তার ন্যাড়া মাথা সম্পর্কে প্রশ্ন করে ধমক খেয়েছিল সে। বলা যায় না, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও হয়তো ধমক খেতে হবে।
=
.
. . .
.
তিনদিনে চার ভাগের এক ভাগ দূরত্ব অতিক্রম করেছে শহীদরা। রাতে বিশ্রাম নিয়ে দিনের বেলা যতটা সম্ভব এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ওরা। নির্বিঘ্নেই
এগোচ্ছে। তেমন কোনো বিপদ দেখা দেয়নি এখন পর্যন্ত।
রাতেরবেলা একটা গুহায় আশ্রয় নিলো সবাই।
গভীর রাত। গুহার ভিতর সাড়াশব্দ নেই কারও। শহীদ শোবার আগে ১১৮
।
অন্ধকার করে দিয়েছে গুহার ভিতরটা। সারাদিন ঘোড়ার পিঠে বসে থাকার পর। রাত জেগে পাহারা দেবার সামর্থ্য থাকে না কারও। গুহার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লৌহমানবদ্বয়। কেউ বা কোনো দস্যুদল এদিকে এসে পড়লেও দুটো যান্ত্রিক মানুষকে দেখে পালাতে দিশে পাবে না।
ঘুমিয়ে পড়েছিল কামাল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। কে যেন ধাক্কা মারছে নিঃশব্দে।
ভয়ে ভয়ে একবার চোখ মেললো কামাল। অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারলো না সে। কে ধাক্কা মারছে তাকে? ডাকাত পড়লো নাকি? ডাকাত হলে এভাবে ধাক্কা মারবে কেন? তবে তবে কি কোনো অশরীরী…
কামাল, এই কামাল!’ | ফিসফিস করে কে যেন ডেকে উঠলো তার নাম, ধরে। ভয়ে আরো সিটিয়ে গেল সে। মরার মতো পড়ে রইলো। সাড়া দিলো না ভুলেও।
এবার কে যেন তার ডান কানটা ধরে মলে দিতে দিতে বললো ফিসফিস করে, ভূতটুত নইরে আমি। আমি শহীদ। ওঠ না, বাইরে কিরকম চাঁদ উঠেছে দেখবি চল-এই কামাল।
| এবার সাড়া দিলো কামাল। যেন এইমাত্র ঘুম ভাঙলো তার। বললো, কি হয়েছে রে, এতরাতে ডাকাডাকি করছিস কেন? ভূতের ভয় লাগছে নাকি?”
অতিকষ্টে হাসি চেপে শহীদ বললো, চুপ! মহুয়া কিংবা মি. সিম্পসন উঠে পড়লে সব ভণ্ডুল করে দেবে। চল, পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ি।’
দু’বন্ধু গুহা থেকে নিঃশব্দ পায়ে বের হয়ে এলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসাধারণ এক দৃশ্যাবলীর সম্মুখে। বাইরে এসেই মুগ্ধ আবেশে ভরে গেল ওদের বুক এবং চোখের দৃষ্টি। কি অপূর্ব, মহাম সৌন্দর্য! উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তের অন্তে ক্ষীণ একটা নদীর জল। চাঁদের আলোয় হাসছে পাহাড়ের চূড়া। হাসছে দূরের ঐ চিকন জলরাশির স্রোত। নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে ভেসে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড উজ্জ্বল মেঘের দল। নিচে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী পথ। ঐ পথ দিয়ে কয়েক ঘন্টা আগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে ওরা।
. কি সুন্দর, তাই না-রে, শহীদ?
বুক ভরা আকুলতা উথলে উঠতে চায় কামালের এই অপূর্ব সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
‘ছোটবেলার কথা মনে পড়ে তোর, কামাল?
একটা পাথরের উপর বসে পড়ে শহীদ বলে, মনে পড়ে তোর, বাঁশ বাগানের মাথার উপর এইকম চাঁদ উঠতো। নতুন রাস্তার পাশের কাজল দীঘি থেকে কই মাছ ধরে মাঝরাতে শহরে ফিরে আসতে আসতে বাগান পাড়ার কাছে প্রত্যেকদিন সাইকেল থেকে নেমে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। তুই বলতিস, আচ্ছা শহীদ, ,
১৯৯
চাঁদটা অমন করে কোথায় যায় বলতে রোজ রোজ? আমি বলতাম, চাঁদ যায় ভিন্ন দেশে, ঘুরে বেড়াতে ওর খুব ভালো লাগে কিনা। কামাল, বড় হলে আমরাও ঐ চাঁদের মতো অনেক দেশে ঘুরে বেড়াবো।
কামাল বললো নিচু স্বরে, মনে আছে, শহীদ, সব মনে আছে আমার।
দু’বন্ধু এরপর অনেকক্ষণ বসে রইলো চুপচাঁপ। একসময় দুটো সিগারেট ধরিয়ে উঠবো উঠবো করছিল, হঠাৎ মহুয়ার মিষ্টির শোনা গেল অদূরে।
‘সাধে কি আর কামালদাকে আমি আমার সতীন বলি! চাঁদ দেখতে রাত দুপুরে আমাকে না ডেকে, ডেকে নিয়ে এলো বাল্যবন্ধুকে।’
শহীদ হাসতে হাসতে একটু সরে গিয়ে মহুয়াকে বসবার জায়গা করে দিলো। কিন্তু শহীদের পাশে না বসে মহুয়া কামালের উরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
| শহীদ বললো, তোমার দাবিটা একটু বেশি, মহুয়া। কামাল আমার বাল্যবন্ধু, আর তুমি তো মাত্র সেদিন পরিচিত হলে আমার সঙ্গে। এখন তুমি বলো কার, অধিকার বেশি?”
বাল্যবন্ধুকেই বিয়ে করলে পারতে তাহলে আমাকে নিয়ে আসা কেন, বাপু?”
কামাল ওদের কৃত্রিম ঝগড়ায় বাধা দিয়ে বললো, আচ্ছা মহুয়াদি, এখন একটা গান গাইবে তুমি? তুমি গান না গাইলে কি একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে যেন এই বিপুল সৌন্দর্যটার কোথাও।
‘ঠিক কথা। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সার্থক করে তুলতে, আরো সুন্দর, আরো মহান আরো অর্থবহ এবং পরিপূর্ণ করে তুলতে হলে তার কণ্ঠের সুরেলা গান একান্ত দরকার। নিরাশ করো না, মহুয়া, গাও তুমি।
কোনো আপত্তি না করে গান শুরু করলো মহুয়া।
এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হলো ওদের তিনজনের তখনকার জীবনে। সৌন্দর্যের আকণ্ঠ পিপাসায় বারি সিঞ্চন করলো প্রকৃতি এবং প্রকৃতিরই কন্যা মহুয়া যোগ করলো সুর-ধ্বনি। অপূর্ব একটা আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো ওরা। তিনজনই স্বর্গবাস করে এলো যেন ক্ষণিক সময়ের জন্যে।
এগারো
আজ এগারোদিন চেয়ারে বসে বসে কাটিয়ে দিচ্ছে ওরা একরকম। সকালে মুখ হাত ধুয়ে চা-নাস্তা সেরে বসে কাজ নিয়ে। দুপুরেও চলে কাজ। খাওয়া-দাওয়ার বালাই নেই। রাত যখন গম্ভীর হয়ে আসে তখন খেয়াল হয় ঘুমোবার কথা। যন্ত্রপাতি ফেলে মুখে-চোখে পানি ছিটিয়ে দু’মুঠো খেয়ে নেয় কোনরকমে। তারপর ২০০
বিছানায় শুয়েই তলিয়ে যায় অকাতর ঘুমে। দিনের পর দিন চলছে এই বাঁধাধরা রুটিন। এগারোদিন হলো আজ।
দু’জন বিজ্ঞান-সাধক বসেছে মুখোমুখি। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘন্টা তাদের মুখে একটি কথা নেই। কখনো একজন লিখছে অন্যজন সেই লেখাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে মগ্ন হয়ে পড়ছে চিত্তাসাগরে। লেখাটা শেষ হয়ে গেলে পড়ার জন্যে টেনে নিচ্ছে অপরজন। বিরাট বিরাট বা ছোটখাট বিচিত্র সব কলকজার সামনে উঠে গিয়ে কি যেন পরীক্ষা করছে। কথাবার্তা যে হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু ওদের কথা বলার প্রকৃতিও অদ্ভুত হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। হঠাৎ হয়তো একজন কথা বলতে শুরু করলো। ঝড় বয়ে যেতে থাকে যেন কণ্ঠ থেকে ঝাড়া আধঘণ্টা হয়তো চলে তার কথা বলার পালা। কথা শেষ হবার পর আবার ঘন্টাখানেক হয়তো আর কোনো টুশব্দটি নেই। খুটখাট শব্দ ওঠে কেবল যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়ার।
এদিকে ভয়ঙ্কর বিপদ চতুদিক থেকে প্রচণ্ড থাবা মারার জন্যে কতদূর অগ্রসর হয়ে এসেছে তা ওদের জানার কথা নয়, বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের জীবনের সফলতা নির্ভর করছে কয়েকটা সূত্র আবিষ্কারের উপর। উপযুক্ত ব্যক্তিকেই কাছে পেয়েছেন তিনি। কুয়াশাও এতদিনে একটা মনের মতো কাজ পেয়ে মজে গেছে এর ভিতরে। একজন বৈজ্ঞানিক আর একজন বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করবে না তো করবে কে। তাছাড়া কুয়াশা বেশ কিছুদিন এতো জটিল কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যার মধ্যে, পড়েনি। যতো জটিল এর সূত্র, ততোই আগ্রহ বাড়তে থাকে। একজন বৈজ্ঞানিকের এই আগ্রহটাই সবচেয়ে বড় কথা। কুয়াশাও. সূত্রগুলো আবিষ্কার করতে চরম আগ্রহী। এবং ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো তৈরি করে সফলকাম হয়েছে সে। এখন শুধু সেগুলোর খুঁত খুঁজে বের করার পালা। সেটাও মোটেই সহজ কাজ নয়। যন্ত্রপাতি টেনে নিয়ে তার পরীক্ষাপর্ব চলছে।
কাজে বসে ভুলে গেছে কুয়াশা নিজের কথা। নিজের দেশের কথা। বোন মহুয়া, বন্ধু শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন-সকলের কথাই ভুলে গেছে সে এই এগারো দিনে। এমনকি Dr. Kotze-এর শক্ত যে কোনো মুহূর্তে চরম আঘাত হেনে তছনছ করে দিতে পারে, তা পর্যন্ত চিন্তা করে দেখতে ভুলে গেছে সে।
| প্রথম দিনই উদ্ধারকৃত থিসিসটা নিয়ে এসে Dr. kotze-এর হাতে তুলে দিয়েছিল কুয়াশা। পাহাড়ের ঐ গুহা থেকে শেষবার বের হয়ে এসে গর্তটা বন্ধ করে দিয়েছিল সে পাথর সাজিয়ে। তার উপর Dr. Kotze একটা গরিলাকে, ঐখানে পাহারায় নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তারপর একবারও ভেবে দেখেননি চারদিকের অবস্থা কি রকম। শত্রুরা কি করছে না করছে তাতে কিছুই যেন এসে যায় না ওদের।
সকাল বেলা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠেছিল একটা অ্যালার্ম। বৈজ্ঞানিক বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘পাখি এলো কোথা থেকে যা!
২০১
আসলে পাহারাদার কোনো গরিলা জরুরী খবর পাঠাতে চেয়েছিল। Dr. Kotze কাজ করতে করতে ভাবলেন–পাখি ডাকছে।
কুয়াশা যেখান দিয়ে Dr. Kotze-এর উদ্যানে প্রবেশ করেছিল ঠিক সেখান দিয়ে একজন একজন করে রাইফেলধারী লোক উদ্যানে প্রবেশ করলো। মোট বারোজন ওরা। প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে রাইফেল। কয়েকজনের পকেটে রয়েছে হাতবোমা। নিঃশব্দ পায়ে খানিকটা এগোতেই একটা গরিলার দেখা পেলো লোকগুলো। এক মিনিট, দেরি না করে গুলি করলো বারোজন লোক জানোয়ারটাকে। একটা গরিলা মারতে একজন গুলি করলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু চোখের সামনে যাকে দেখবে, যা কিছু দেখবে ওরা তাই-ই ধ্বংস করে দেবে–সেই প্ল্যান নিয়েই ঢুকেছে ওরা। আরো একটা গরিলাকে মেরে হ্রদের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। দূরে দেখা গেল আর একটি দল দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে হ্রদের দিকে। ওদের দলে মোট ন’জন। প্রত্যেকের হাতে রাইফেল। মুখে নিষ্ঠুর ক্রোধ ||
ভয়ঙ্কর একটা সর্বনাশ ঘটতে চলেছে।
বৈজ্ঞানিকের উদ্যানের চতুর্দিকে পাহাড়। সেই পাহাড় খুঁড়ে গর্ত করে ফেলেছে শত্রুরা অনেকদিনের চেষ্টায়। আজ তারা লুঠ করবে Dr. Kotze-এব সবকিছু! এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হতে চলেছে ওদের। চারদিক থেকেই চারদল লোক এসে জুটলো হ্রদটার সামনে। Dr. Kotze যে মাটির নিচে আছেন তা ওরা জানে। ওরা ঠিক করলো প্রথমেই চারদল চারদিক দিয়ে এগোতে এগোতে মাটির নিচে নামার পথটা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবে। তারপর সকলে একসঙ্গে নেমে
একযোগে ধ্বংস লীলা শুরু করবে। বন্দী করে ফেলবে Dr. Kotze-কে অনায়াসে।
বেলা এগারোটার সময় সফল হলো ওরা। পেয়ে গেল মাটির নিচে নামার রাস্তাটা। বিরাট একটা পাথর দিয়ে সিঁড়ির মুখটা ঢাকা। ভিতর থেকেই পাথরটা। ওঠানো-নামানোর ব্যবস্থা আছে। ওরা ওসব কিছু ভাবলো না। একটার পর একটা হাতবোমা মেরে ধসিয়ে দিলো পাথরটা কিছুক্ষণের মধ্যে।
| বোমা মেরে পাথরটা উড়িয়ে দেবার শব্দ ঠিকই পৌঁছুলো Dr. Kotae-এর হলঘরে। কিন্তু ওরা তখনও এই পৃথিবী থেকে এক কোটি মাইল দূরে বাস করছিল যেন। কানে ঢুকলো না শব্দটার রেশ। মাথা নুইয়ে একটা যন্ত্রের স্কু টাইট করছিল কুয়াশা। আর Di: Kotze কুয়াশার লেখা পড়ছিলেন খাতার পাতাগুলোকে চোখের সামনে তুলে ধরে।
মিনিটখানেক পর হৈ চৈ উঠলো হলঘর থেকে খানিকটা দূরে। অযথা গুলি ছুঁড়ছে শয়তানগুলো যত্রতত্র। গুলির শব্দও হচ্ছে। নিজেদের সর্বনাশ দেখার,
২০।
জন্যেই যেন অপেক্ষা করছে ওরা। কোনো শব্দই কানে ঢুকছে না ওদের।
প্রচণ্ড শব্দ হলো বোমা ফাটার। শয়তানগুলো কোনো বাধা না পেয়ে গুদামগুলোর ক্ষতি করতে থাকলো বোমা মেরে।
| চমকে উঠলেন Dr. Kotze. কিন্তু আর তেমন কোনো জোরালো শব্দ তিনি শুনতে পেলেন না। মনে মনে ভাবলেন কানের ভুল হয়েছে, তেমন কোনো শব্দ শোনেননি তিনি। আবার কাজে মগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি। কুয়াশা আপন মনে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। হলঘরের এদিক-ওদিক গিয়ে কয়েকটা যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে কি কি সব পরীক্ষা করলো। তারপর আবার ফিরে এসে বসলো চেয়ারে।
কিন্তু আবার বোমা ফাটার শব্দ ঢুকলো Dr. Kotze-এর কানে। কি যেন স্মরণ করার চেষ্টা করলেন Dr. Kotze. স্মরণ করতে কষ্ট হচ্ছে তার কি যেন একটা কথা। কারা যেন আসবে বলে মনে হলো তাঁর। কাদের যেন আসার কথা ছিলো তাঁর আস্তানায়। তারা এসে তাকে মেরে ফেলবে বা ধরে নিয়ে যাবে কিন্তু
কা’রা … কারা কারা?
কুয়াশার দিকে তাকালেন Dr. Kotze. কুয়াশার খেয়াল নেই কোনদিকে। আবার উঠে গিয়ে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করছে সে গভীর মনোযোগ সারে।
আবার একটা বোমা ফাটলো। তৃতীয় গুদামঘরটাকেও নষ্ট করছে শয়তান গুলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেল Dr. Kotze-এর সব কথা। চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি। বুঝতে বাকি রইলো না তার আর কিছু। এসে পড়েছে শত্রু। এতদিন যাদের জন্যে এতো সতর্ক হয়েছিলেন তারা ঢুকে পড়েছে তার গোপন আনায়।
অথচ কিছুই জানতে পারেননি তিনি।
কুয়াশা। এসে পড়েছে ওরা!’
Dr. Kotze-এর ভীত কণ্ঠস্বর কুয়াশার কানে ঢুকলো কি ঢুকলো না বোঝা গেল না। চেয়ারে ফিরে এসে বসলো সে আবার।
হয়ে এসেছে কাজ–আর একমিনিট! মাথা না তুলে কুয়াশা অনেক দূর থেকে বলে উঠলো যেন কথাটা।
| ‘কিন্তু ধরা পড়ে যাবো আমরা। কুয়াশা, পালাতে হবে আমাদেরকে!’
উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন Dr. kotze. কোনো উত্তর পাওয়া গেল না এবাৰ কুয়াশার তরফ থেকে।
তিরিশ সেকেও পর হাতের কলমটা বন্ধ করে কুয়াশা মাথা তুললো। মাথার চুলে হাতের আঙুল চালিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো সে, ‘শেষ হয়েছে আমার কাজ, Dr. Kotze, আমি সফল হয়েছি।’
তীক্ষ্ণ একটা কম্বর ব্যঙ্গভরে বলে উঠলো পিছন থেকে, হ্যাঁ, শেষ হয়েছে। তোমার দিন। বিফল হয়েছে তুমি!
. কিছুই বুঝতে পারলো না । ঘাড় ঝাঁকিয়ে পিছন দিকে তাকাতেই
২০৩
হতবাক হয়ে গেল সে। এক দল লোক ঠিক তার পিছনে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। Dr. Kotze-এর পিছনেও রয়েছে সমসংখ্যক রাইফেলধারী লোক।
পলকের মধ্যে সব টের পেলো কুয়াশা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিমূঢ়তা কাটলো না তার। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো সে লোকগুলোর মুখের দিকে। কি যেন চিৎকার করে বলে উঠলো ওদের মধ্যে একজন Dr. Kotze-এর উদ্দেশ্যে। সবটা শুনতে পেলো না কুয়াশা। হলঘরের বাইরে ঘনঘন বোমা ফাটার শব্দ উঠলো হঠাৎ। গর্জে উঠলো পরপর কয়েকটা রাইফেল।
| ‘বেঁধে ফেলো বুড়োটাকে তোমরা,’ আদেশ দিলো একজন দলের লোকদের
| ‘ঐ ব্যাটাকেও বাধা, কুয়াশার দিকে ইঙ্গিত করে আবার হুকুমজারি করলো লোকটা। দু’জন করে চারজন লোক এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
| ‘গুলি খেয়ে মরতে চাও নিশ্চয় তুমি?’
লোকটা খিকখিক করে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো কুয়াশাকে। কুয়াশা তাকালো Dr. Kotze-এর দিকে। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে তাঁকে। করুণ। দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি কুয়াশার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিলো কুয়াশা। দুর্বল হয়ে পড়েছে সে হঠাৎ এই অকল্পিত বিপদ দেখে। বেঁধে ফেলা হয়েছে তাকেও। কিছুই করার নেই তার। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই কোনো। এতো পরিশ্রম করেও Dr. Kotze-কে রক্ষা করতে পারলো না সে। রাতদিন ধরে অক্লান্ত কাজ করে যে সূত্র ক’টি আবিষ্কার করেছে সে, সেগুলো এখন অর্থহীন মনে হলো তার। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো সবার আগে। করা হয়নি বলে এখন সব শেষ হয়ে গেল ps | লোকটা আবার বললো, গুলি খেয়ে মরতে চাও তুমি, আমি জানি-ওটা খুব সহজ মৃত্যু। কিন্তু সহজ মৃত্যু তেমার কপালে নেই। যন্ত্রণা দেয়া হবে তোমাকে।’
পকেট থেকে সুচের একটা বাক্স বের করে কুয়াশার দিকে এগিয়ে এলো শয়তানটা। আর একজন এগিয়ে গেল Dr. kotze-এর দিকে। | হ্যাঁ, বুড়োটাও মজা বুঝুক একটু। তারপর যা কিছু দরকারী জিনিসপত্র সব
আদায় করতে সুবিধে হবে।’
কুয়াশার ডান পায়ের শেষ আঙুলের নখের ভিতর সুচ ঢুকিয়ে লোকটি দাঁত। বের করে জিজ্ঞেস করলো নরম গলায়, খুব বেশি লাগছে নাকি হে?’ জোর করে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো কুয়াশা। অসহ্য যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে উঠেছে তার মুখ। Dr. Kotze-এর চোখ দুটো এখনো খোলা রয়েছে। শান্ত সমাহিত দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। এই ভয়ঙ্কর শাস্তিতে তাঁর শরীরে যেন কোনো যন্ত্রণাবোধই হচ্ছে না। শুধু চোখের কোণ বেয়ে দুটো জলের ধারা গড়িয়ে– ১৪
।
পড়ছে গাল বেয়ে দাড়ির ভিতর। শান্তভাবেই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছেন তিনি।
‘টোমরা উঠে আসো ওদের কাছ ঠেকে!’
হঠাৎ একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ফেটে পড়লো গমগম করে হলঘরের ভিতর। রাইফেলধারী প্রত্যেকটি শয়তান হতবাক হয়ে তাকালো শব্দ শুনে। কুয়াশাও চোখ মেললো অতি কষ্টে। লৌহমানব!
লৌহমানব এসে দাঁড়িয়েছে হলঘরের মাঝখানে! হাতে তার লেসারগান। কুয়াশা ভাবলো শহীদরা তাহলে সময়মতই এসে পড়েছে।
বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠতে যা দেরি। তারপরই গর্জে উঠলো পনেরোটা রাইফেল একসঙ্গে লৌহমানবের বুক লক্ষ্য করে।
উচ্চগ্রামের গমগমে হাসিতে ফেটে পড়লো লৌহমানবের কণ্ঠস্বর। তারপর আচমকা একটা কথা বললো সে। কথাটা শুনে বিস্ফারিত হয়ে উঠলো কুয়াশার চোখ জোড়া। থমকে গেল রাইফেলধারী লোকগুলো। পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো ওখ হতভম্ব হয়ে।
শেহমানব বললো, “আজেবাজে কাজ বাড ডাও! টোমাদের মঢ্যে যে কোনো একজন রাইফেল টাক করে বন্ধীদের যে কোনো একজনকে গুলি করো। বুক লক্ষ্য করে গুলি করবে। যাটে এক গুলিটেই শেষ হয়ে যায়।
নিরাশায় মলিন হয়ে গেল কুয়াশার মুখ। তার তৈরি করা যান্ত্রিক মানুষের হাতেই তার মৃত্যু লেখা ছিলো শেষ পর্যন্ত! এটা কিভাবে সম্ভব হলো? তবে কি। শহীদ ব্যর্থ হয়েছে? পরাজিত হয়েছে সে শত্রুদের হাতে এখানে পৌঁছে? তার মানে শৌহমানবকে পরিচালিত করছে শহীদ নয়, শত্রুদের কোনো লোক? ঠিক, তাই, না হলে লৌহমানবের কণ্ঠ থেকে ঐ মৃত্যুদণ্ডাদেশ উচ্চারিত হতো না।
যে লোকটা কুয়াশার পায়ের আঙুলে সুচ ঢোকাচ্ছিল সেই তুলে নিলো তার নিজের রাইফেলটা। একটু পিছিয়ে গিয়ে কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে রাইফেল তুললো
সে। অমনি একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো। লৌহমানবের হাতের লেসারগানটার মুখ উঠলো লোকটার পেট লক্ষ্য করে। এক ঝলক তীব্র আন্ধোয় চোখ ঝলসে গেল সকলের। চোখ ভালো করে মেলে সকলে দেখলো লোকটির বুক থেকে কোমর পর্য নেই। মারা গেছে সঙ্গে সঙ্গে লোকটা। খানিকটা নিম্নাংশ এবং খানিকটা উর্ধাংশ পড়ে আছে শুধু মাটিতে।
‘এখার টুমি Dr. Kotze-কে লক্ষ্য করে রাইফেল টোলো!
র কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার লৌহমানবের। Dr. Kotze-এর আঙুলে যে লোকটা সুচ ঢোকাচ্ছিল তার উদ্দেশ্যে কথাটা বললো সে। ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো লোকটা। দেখতে দেখতে চোখ দু’টো, বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে গেল সে। কিন্তু জ্ঞানহীন শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই লেসারগানের নল দিয়ে মারণরশ্মি বের হলো এক ঝলক। মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল
২০৫
অচেতন লোকটার। ধড়টা পড়লো হলঘরের মেঝেতে ধপ করে।
রাইফেল ফেলে দাও সকলে।
শহীদের কঠিন কণ্ঠস্বর শোনা গেল হলঘরের দরজায়। রিভলভার হাতে ঘর্মাক্ত কলেবরে এসে দাঁড়িয়েছে সে হলঘরের ভিতরে। কুয়াশা এতক্ষণে খেয়াল করলো হলয়রের বাইরে আর কোনো গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
‘প্রাণে মারবো না তোমাদেরকে।
সরকটা শয়তানকে তাদের রাইফেল মাটিতে ফেলে দিয়ে মাথার উপর হতি তুলতে বললো শহীদ, ‘বন্দী করা হলো তোমাদেরকে। ঐ দু’জন লোককে মরতে হলো ওদের নিষ্ঠুরতার জন্যে। তোমরাও ওদের চেয়ে কম পাপী নও। কিন্তু আমি নিজের চোখে তোমাদেরকে কোনো নিষ্ঠুরতা করতে দেখিনি বলে মৃত্যুদণ্ড দিলাম
।’
‘আর সবাই কোথায়, শহীদ!’ শহীদকে একা দেখে প্রশ্ন করলো কুয়াশা।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে Dr. Kotze-এর বাঁধন খুলে দিলো শহীদ। তারপর কুয়াশার বাঁধন খুলে দিতে দিতে ধরা গলায় সে বললো, ‘মহুয়া মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে, কুয়াশা।’ . ‘কি বললে! আহত হয়েছে মহুয়া! কোথায়, কোথায় রেখে এলে তাকে? কোথায় আঘাত লেগেছে? বাঁচবে তো?’
দাঁতে দাঁত চেপে কোনো রকমে বললো শহীদ, ‘গুলি লেগেছে তার ডান পাশের পেটে। অপারেশন করা সম্ভব না হলে কি হয় বলা যায় না।’
‘কোথায় আছে সে?’
কামাল আর গফুরের কাছে রেখে এসেছি তাকে উঠানের একপাশে।
বাঁধনমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। এমন সময় দ্বিতীয় লৌহমানবটি প্রবেশ করলো হলঘরে। চলো দেখি কি অবস্থা।
চিন্তিত কণ্ঠে কথাটা বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো কুয়াশা। Dr. Kotze ওদের দুজনের কথা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনিও কুয়াশার পাশাপাশি বের হয়ে গেলেন হলঘর থেকে।
শহীদও দুটো লৌহমানবকে বন্দী লোকগুলোর ভার দিয়ে বের হয়ে এলো হলঘর থেকে।
জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে না ‘মহুয়া। রক্তক্ষরণ হচ্ছে এখনও। কাঁদো কাঁদো মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে গফুর। কামাল মহুয়ার মাথা কোলে নিয়ে চোখের জল মুছছে। এমন সময় কুয়াশা, Dr. Kotze এবং শহীদ এলো।
| Dr. Kotze মহুয়ার পাশে বসে পড়ে একটা হাত তুলে নিয়ে পাস দেখলেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। একমিনিট পরই চিন্তিত মুখে তাকালেন তিনি কুয়াশার
২০৬
দিকে। কেস খুব একটা সিরিয়াস নয়। তবে অপারেশন করতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। তা না হলে।’
কিন্তু এই অপারেশন তো আমাদের কারো দ্বারা সম্ভব হবে না,’ শহীদের নিরাশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। | কি করবো তাহলে, কি করা যায়…’ কুয়াশা উত্তেজিত হয়ে উঠলো কোনো উপায় বের করতে না পেরে।
হঠাৎ Dr. Kotze বললেন, চমৎকার একটা উপায় করতে পারি আমি।
. আমার সমস্যা বলতে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সূত্রগুলো তৈরি করে দিয়েছো তুমি, বন্ধু। এ উপকার সারাজীবন স্মরণ থাকবে আমার। এখন আমি তোমাদের জন্যে সামান্য একটা, উপকার করার সুযোগ পেলে ধন্য হবো। আমার মহাশূন্যে রওনা হবার সব যৌগাড়-যন্ত্র অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে আছে। চলো ততামাদেরকে যাবার পথে পাকিস্তানের যে কোনো জায়গায় নামিয়ে দিই। মাত্র এক মিনিট সময় লাগবে পৌঁছুতে | একমাত্র এই উপায়েই তোমাদের রোগীকে কোনো নার্সিং হোমে পৌঁছানো সম্ভব।’
‘ধন্যবাদ, Dr. Kotze! ধন্যবাদ! আপনার মহানুভবতার কথা কোনো দিন ভুলতে পারবো না আমরা, কঠে আবেগ ঢেলে কথাটা বললো শহীদ।
‘তাহলে দেরি করার দরকার নেই। চলুন আপনারা। Dr. Kotze কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে বললেন কুয়াশাকে, “অনেক আলাপ করার ছিলো তোমার সঙ্গে। কিন্তু এবার আর হলো না। আমি মহাশূন্যে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করবো ঠিক করেছি অনেকদিন আগেই। এই পৃথিবীর মানুষের নীচতাকে ঘৃণা
করি আমি। আমি মানুষকে ভালবাসতে পারবো না সামগ্রিক ভাবে। মানুষের চেয়ে উন্নত প্রাণীর সন্ধান করে কাটিয়ে দেবো আমি আমার জীবন। যদি তাদের সন্ধান পাই তবে তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠাতে চেষ্টা করবো। আমার মনে হয় মানুষের কাছ থেকে মানুষের কিছুই শিখবার নেই। উন্নত কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে এলে যদি এরা সত্যিকার মানুষে পরিণত হয়–তা না হলে আর কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
কুয়াশা বললো, আমরা আপনার সাফল্য কামনা করি। আপনার মতো জ্ঞানী পুরুষের পক্ষেই এতবড় পরিকল্পনা করা সম্ভব। আপনাকে আমি বুঝতে পারছি।
মহুয়ার অচেতন দেহ নিয়ে শহীদ এবং গফুরের সঙ্গে সবাই হলঘরে প্রবেশ করলো। বন্দীরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও তেমনি। Dr. Kotze গুপ্ত দরজাটা খুলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন সকলকে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই রকেট নিক্ষেপক মঞ্চের উপর এসে পৌঁছুলো ওরা। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে Dr. Kotze বললেন, “ওঠো আগে তোমরা, আমি সবশেষে উঠবো।
২০৭
.
কুয়াশা বললো, একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, Dr. Kotae. আমি এদের সঙ্গে দেশে ফিরছি না এখন। কয়েকটা কাজ আছে আমার অন্যত্র। আমি পরে ফিরবো দেশে। আপনি এদেরকে পৌঁছে দিলে যথেষ্ট হবে।
দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বেশি কিছু কথা বললেন না Dr. Kotze.
মি. সিম্পসন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ছুটি শেষ হয়ে গেছে, আমিও বরং চলে যাই শহীদের সঙ্গে।
‘নিশ্চয়,’ কুয়াশা বললো।
‘গফুর এবং কামাল?’ মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন গফুর আর কামালের দিকে তাকিয়ে।
‘ওরা আমার সঙ্গেই থাক,’ কুয়াশা বললো। | শহীদ মহুয়াকে নিয়ে লিফটে করে উঠে গেছে বিরাটাকৃতি বুকেটের ভিতর। মি, সিম্পসনও উঠে গেলেন। Dr, Kotze কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলি, বন্ধু! আবার দেখা হতে পারে আমাদের। বারো বছর পর আমি একবার
পৃথিবীতে ফিরে আসবো।’
| হেসে ফেললো কুয়াশা। হাসতে হাসতে বললো, আপনি বারো বছর মহাশূন্যে কাটিয়ে যখন আমাদের এই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, তখন আমি থাকবো না, আপনার চিরশত্রু ড হারাফেলো থাকবে না, এই পৃথিবীতে এখন যারা বেঁচে আছে তাদের একটি প্রাণীও সেদিন বেঁচে থাকবে না {
| ‘কেন? শিউরে উঠে প্রশ্ন করলেন Dr. Kotze.
মহাশূন্যে বারো বছর মানে পৃথিবীতে প্রায় একশো পঁয়তাল্লিশ বছর। আপনি মহাশূন্যে বারো বছর কাটিয়ে ফিরে আসবেন যখন আমাদের এই পৃথিবীতে তখন কেটে গেছে প্রায় একশো পঁয়তাল্লিশ বছর।
‘বুঝেছি!’ Dr. Kotze অন্যমনস্ক ভাবে কথাটা বলে সিঁড়ি বেয়ে রকেটের উপর দিকে উঠতে লাগলেন। সিঁড়ির মাথায় উঠে কুয়াশার দিকে আবার তাকিয়ে বললেন তিনি, চলি, বন্ধু! আমাদের তাহলে আর কোনো দিন দেখা হবে না।’
কুয়াশা বললো, “দেখা হবে না সে কথাও জোর করে বলা যায় না। এমনও তো হতে পারে যে আমিই একদিন আপনার কাছে গিয়ে উপস্থিত হবো।’
নিশ্চয় নিশ্চয়! আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো সেখানে।
কথাটা বলে রকেটের ভিতর অদৃশ্য হলেন Dr.Kotze.
.
কুয়াশা, শহীদ ও কামাল। দেশে-বিদেশে অন্যায় অবিচারকে দমন করে। সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করাই এদের জীবনের ব্রত। এদের সঙ্গে পাঠকও অজানার পথে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন। রহস্য, রোমাঞ্চ ও বিপদের স্বাদ। শুধু ছোটরাই নয়, ছোট-বড় সবাই একই পড়ে প্রচুর আনন্দ লাভ করবেন। আজই সংগ্রহ করুন।
Leave a Reply