১৪. অপারেশন পেরু ২ (ভলিউম ৫) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৪
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর, ৬৮
এক
হালকা কুয়াশায় ঘেরা আবছামতো একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে উত্তর দিকে।
সমুদ্রের উথালপাথাল সেই ভীষণ মূর্তি এখন আর নেই। সকাল হবো হবো। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। সূর্য উঠবে এখুনি। পুব আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। মাথার উপরে এখনো মিশকালো মেঘের মিছিল শেষ হয়নি। কি যেন একটা জরুরী কাজে দক্ষিণ দিকে অনবরত ছুটে চলেছে মেঘগুলো। বিরামহীন, বিশ্রামহীন।
| নির্জন, নিস্তব্ধ একটা দ্বীপ। ধ্যানমগ্ন, প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তির মতো সমাহিত দেখাচ্ছে দূর থেকে দ্বীপটাকে। লালচে পাড় দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। বালুকাবেলা থেকে ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে পাড়টা। গতরাতের ঝড়বৃষ্টিতে লাল মাটি ভিজে গিয়ে আরো লালচে দেখাচ্ছে।
মগ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশা দ্বীপটার দিকে। কুয়াশার কপালে একটা ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দেখা যাচ্ছে। গতরাতের সাইক্লোনে একটা ভারি রড এসে পড়েছিল। তার কপালে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাণ্ডেজটা বেঁধে “সৈনিক” থেকে নেমে পড়েছিল। সে সমুদ্রে মি. সিম্পসনকে নিয়ে। ব্যাণ্ডেজের কাপড় ভেদ করে লাল রক্তের ছাপ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
আধমাইল দূরে নেই দ্বীপটা। কুয়াশাচ্ছন্ন বলে আবছা আবছা দেখাচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর লাগছে দেখতে। মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে কুয়াশা সেই দিকে।
, কোনো জনমানবের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। বালুকাবেলা পড়ে আছে নির্জন। তারপর উঁচু পাড়। পাড়ের উপর গাঢ় সবুজের সমারোহ। গভীর জঙ্গল। মনে হচ্ছে দ্বীপটা জঙ্গলাকীর্ণ। না, কোনো ঘরের ছাদ বা বাঁশের ছাউনি দেখা যাচ্ছে না।
ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে লাইফবয় দুটো। মি. সিম্পসন ঘুমিয়ে রয়েছেন। অ্যাটাচি কেসটা কোলের উপর টেনে নিয়ে সিধে হয়ে বসলো কুয়াশা। গতরাতের ভয়াবহ সাইক্লোনে ডুবে গেছে কুয়াশার আবিষ্কৃত ক্ষুদ্র সাবমেরিন প্রশান্ত মহাসাগরের অতল তলে। শত্রুপক্ষীয় সাবমেরিন থেকে টর্পেডো এসে আঘাত করেছিল “সৈনিকের” তলায়। ফুটো হয়ে গিয়েছিল “সৈনিক”। | একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মুখবর্তী দ্বীপটার দিকে আবার তাকালো কুয়াশা ভূ ৫৬
কুঁচকে। তারপর মি. সিম্পসনকে জাগাবার জন্যে রশি ধরে টান দিলো একটু। লাইফবয় দুটো যাতে পরস্পরের কাছ থেকে সরে যেতে না পারে সেজন্যে রশি দিয়ে বেঁধে নিয়েছিল কুয়াশা।.”সৈনিক” ডুবে যাবার আগেই নেমে পড়েছিল তারা সমুদ্রে। | ধক করে উঠেছিল কুয়াশার বুকটা পানিতে নেমেই। সমুদ্র যে রূপকথার রাক্ষসীর মতো ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে তা সে আগে বুঝতে পারেনি। শহীদ, মহুয়া, কামাল ও গফুরের কথা ভেবে শিউরে উঠেছিল সে অশুভ আশঙ্কায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পেরেছিল, তার আশঙ্কা অমূলক নয়। শহীদরা কে কখন কোথায় কোনদিকে ভেসে গেছে কে জানে! হায় হায় করে উঠেছিল কুয়াশার অন্তরাত্মা ওদের কথা ভেবে। কোথায় গেল ওরা! কোনদিকে ভেসে গেল? একসঙ্গেই আছে তো ওরা, নাকি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পরস্পরের কাছ থেকে? ডুবে যায়নি তো ওরা অতল সাগরে? ‘
. দারুণ দুশ্চিন্তায় এখনো বিমূঢ় হয়ে আছে কুয়াশা। গতরাতের প্রাকৃতিক ঝড় শেষ হয়ে গেছে একসময়। কিন্তু ঝড় বইছে এখনও কুয়াশার সমস্ত বুক জুড়ে। শহীদরা কি হারিয়ে গেল চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে? | কুয়াশা, দেখো দেখো সামনে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে!’ ঘুম থেকে জেগে উঠে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন মি. সিম্পসন। চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এলো কুয়াশা। মি. সিম্পসনের দিকে ফিরে বললো, দেখেছি আমি দ্বীপটা। আপনি দেখুন তো মি. সিম্পসন, দ্বীপটায় কোনো মানুষজনের চিহ্ন দেখা যায় কি না?’
সিধে হয়ে বসলেন মি. সিম্পসন। চোখ কচলে নিয়ে তাকালেন দ্বীপটার দিকে। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন তিনি দ্বীপটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কই, মানুষজন তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।’
আমিও দেখতে পাইনি কিছু। পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করতে করতে কথাটা বললো কুয়াশা।
কি নাম এই দ্বীপের!’ কিছুক্ষণ পর ম্যাপটা থেকে চোখ তুলে কুয়াশা বললো, ‘ম্যাপে তো দেখছি দ্বীপটার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বীপটা সম্ভবত এখনো অনাবিষ্কৃত।
‘অনাবিষ্কৃত!’ মি. সিম্পসন যেন চমকে উঠলেন, ‘জংলীদের আড্ডা নয় তো?” চিন্তান্বিত কণ্ঠে কুয়াশা বললো, “গড নোজ, মি. সিম্পসন।
জোয়ারের সময় এখন। | বিরাটাকায় একটা পাথরের পাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে লাইফবয়টা এগিয়ে চললো মি. সিম্পসনের। দুমিনিটের মধ্যেই বালুকাবেলায় গিয়ে ঠেকলো লাইফ
বয়টা।
৫৭
কুয়াশা দশ হাত পিছনের একটা পাথরের কাছে রয়েছে। অ্যাটাচি কেসটা পাথরের গর্তে যত্ন করে রেখে লাইফবয় নিয়ে সে-ও বালুকাবেলায় এসে নামলো, খানিক পর।
. মি. সিম্পসন ইতিমধ্যেইউঁচু পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন মাথার বিশৃঙ্খল চুলগুলোকে পিছন দিকে দু’হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে। কুয়াশা নিজের লাইফবয়টাকে একটা পাথরের আড়ালে রেখে ঘুরে দাঁড়ালো। ঘুরে পঁড়িয়েই থমকাল সে। ..
| ‘মি. সিম্পসন, এদিকে আসুন একটু!’ ব্যস্ত কণ্ঠে কথাটা বলে অদূরবর্তী একটা পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। দেখা গেল পাথরটার পাশে একটা লাইফবয় পড়ে আছে। মি. সিম্পসন তাড়াতাড়ি ফিরে এসে কুয়াশার পাশে দাঁড়ালেন। ঝুঁকে পড়লো কুয়াশা ওল্টানো লাইফবয়টার উপর। দু’হাত দিয়ে সিধে করে দিলো সে জিনিসটাকে। সঙ্গে সঙ্গে আশার আলো ফুটে উঠলো কুয়াশার সারামুখে। সে দেখলো : লাইফবয়টার গায়ে স্পষ্ট বাংলা হরফে লেখা রয়েছে “সৈনিক”!
মি. সিম্পসনও দেখলেন লেখাটা। চিন্তান্বিত মুখে তাকালেন তিনি কুয়াশার দিকে। কি যেন চিন্তা করতে করতে সিধে হয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর ব্যগ্রদৃষ্টিতে তাকালো চারদিকে। ধীরে ধীরে নিভে গেল তার মুখ থেকে আশার আলো। নেই, আর কোনো লাইফবয়ের চিহ্নও নেই চারপাশে!’
কার লাইফবয় হতে পারে এটা? এর গায়ে “সৈনিকের নাম লেখা রয়েছে যখন তখন শহীদ, মহুয়া, কামাল বা গফুরের লাইফবয় এটা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু লাইফবয় দেখা যাচ্ছে মাত্র একটা। তার মানে, একজন ছিলো এতে। আর সবাই গেল কোথায়? তাছাড়া লাইফবয়টা শূন্যই এখানে এসে ঠেকেনি তো! : এটাতে যে ছিলো সে হয়তো ঝড়ের মুখে ছিটকে পড়ে গেছে সমুদ্রে। তা সে শহীদ, মহুয়া, কামাল বা গফুর-যে কেউ হতে পারে। মাথার ভিতরটায় ঝিম ঝিম করতে শুরু করলো কুয়াশার। শহীদদেরকে সে-ই যেচে পড়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। যাচ্ছিলো তারা বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক Kotze-কে সাহায্য করতে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে। দুর্ধর্ষ শত্রু কর্তৃক বিপদগ্রস্ত বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক অভিনব এক উপায়ে কুয়াশার কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল। সে নিজে একজন। বৈজ্ঞানিক। অপর একজন প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকের বিপদে সাড়া না দিয়ে পারেনি সে। বেশ যাচ্ছিলো তারা। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষীয় সাবমেরিন থেকে টর্পেডো মেরে ফুটো করে দিলো “সৈনিকের” তলা। ফলে আত্মরক্ষার জন্যে পানিতে নেমে পড়তে বলেছিল কুয়াশা সকলকে। কিন্তু কে জানতো ভীষণ ঝড়ের মুখে পড়ে ওরা অসীম সমুদ্রে ভেসে যাবে? ওদেরকে রক্ষা করবার দায়িত্ত্ব ছিলো আমারই, ‘মনে। মনে ভাবলো কুয়াশা, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি।
* ‘চলো, কুয়াশা, জঙ্গলে ঢুকলে হয়তো হদিস পাওয়া যাবে কিছু। শহীদ বা অন্য যে-কেউই এই লাইফবয় নিয়ে এখানে এসে থাকুক, সে নিশ্চয় জঙ্গলে। গিয়ে ঢুকেছে।
* উত্তর দিলো না কুয়াশা। কোমর থেকে লেসারগানটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো সে। মি. সিম্পসন তার পিছন পিছন চললেন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে।
উঁচু পাড়টা বেয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলো ওরা। সূর্য তখন আকাশের পুব দিকে উঠে এসেছে। কিন্তু রোদ্র ভালভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না। মেঘের আড়াল সরে না যাওয়াতেই এমনটি হচ্ছে। তাছাড়া জঙ্গলটাও দুর্ভেদ্য। মেঘ যখন সরে যাচ্ছে তখনও শুধুমাত্র টুকরো টুকরো সূর্যের আলো অনুপ্রবেশ করছে বনভূমির ঘন-সন্নিবেশিত গাছের পাতার ফাঁক গলে।
অতি কষ্টে এগোতে হচ্ছিলো ওদেরকে।
কাঁটা গাছ, বিছুটি পাতার চারা, আরো সব বিষাক্ত রঙিন পাতার গাছ গাছড়ায় ভরে আছে জঙ্গলটা। প্যান্টের কাপড়ে কাঁটা আটকে বাধার সৃষ্টি করছে।
পায়ে চলার নির্দিষ্ট কোনো পথের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল কুয়াশা। এবং বিষাক্ত গাছের অদ্ভুত আকৃতির ঝোঁপ-ঝাড় দেখতে দেখতে সে ভাবছিল, জঙ্গলটা সত্যিই কি অনাবিষ্কৃত? সভ্য মানুষের পদধূলি কি এই দ্বীপে এখনো। পড়েনি?
কুয়াশা! হঠাৎ সতর্ক কণ্ঠে ডেকে উঠলেন মি, সিম্পসন। শুনতে পাচ্ছো, ডান দিক থেকে একটা শব্দ আসছে যেন?’ | কান পেতে শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলো কুয়াশা। হ্যাঁ, শব্দ একটা হচ্ছে। ডান দিক থেকেই আসছে শব্দটা। খটখট, খটখট, খটাখট-যেন দুটো শক্ত জিনিসে বাড়ি লেগে সৃষ্টি হচ্ছে শব্দটা।
‘ডান দিকেই চলুন, দেখা যাক ব্যাপারটা কি।
ডান দিকে ফিরলো ওরা। শব্দ লক্ষ্য করে দ্রুত এগোতে চেষ্টা করলো নিঃশব্দ পদক্ষেপে।
নিস্তব্ধ, নির্জন দ্বীপ। খটাখট সেই শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। কোনো জন্তু-জানোয়ারের সাড়াশব্দ মাত্র নেই। একটা খরগোসের বাচ্চাও দেখা যাচ্ছে না কোনদিকে। বড় বড় মাছি,ফড়িং এবং প্রজাপতিই শুধু উড়ছে অসংখ্য। কোনো চিহ্ন নেই ঘরবাড়ি বা বাঁশের কোনো ছাউনি বা মাচার, যা দেখে বোঝা যায় দ্বীপটায় মানুষ আছে। : ডান দিক ধরে বেশি দূর যেতে হলো না ওদেরকে। পায়ে চলা সরু পথ, পাওয়া গেল একটা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো কুয়াশা সরু পথটা। না। বোঝা। যাচ্ছে না পথটা মানুষ চলাচলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে, না নিশাচর জন্তু-জানোয়াররা এর কারণ। :
৫৯
থেকে থেকে দমকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে গাছের উপর দিয়ে। রাস্তাটা ছাড়লো ওরা। এখন আর শোনা যাচ্ছে না সেই খটখট শব্দটা। অনুমানের উপর ভর করে এগোতে লাগলো ওরা।.
বেশ খানিকটা হাঁটার পর হঠাৎ শেষ হয়ে গেল রাস্তাটা। সামনে বিশ-পঁচিশ ফুট লম্বা চওড়া ফাঁকা একটা জায়গা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটা এবার অন্যদিকে মোড় নিয়েছে সম্ভবত। খুঁজল ওরা রাস্তাটা ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টি ফেলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেল নতুন রাস্তাটা। আগের মতোই সরু রাস্তাটা এবার দক্ষিণমুখো এগিয়ে গেছে। পা বাড়ালো ওরা সেই দিকে। ঠিক এমনি সময়ে শব্দটা আবার শুনতে পেলো ওরা। ওদের খুব কাছাকাছিই হলো শব্দটা। ঠিক মাথার উপর থেকে।
থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা এবং মি, সিম্পসন। একই সঙ্গে মাথা তুলে তাকালো ওরা উপর দিকে।
প্রাচীন একটা বটগাছ। গাছটার মাথাতেই শব্দটার উৎস। মাথা তুলে তাকাতেই শরীর শিউরে উঠলো মি. সিম্পসনের। ভূ দুটো কুঁচকে উঠলো তার ধীরে ধীরে। কুয়াশার দিকে তাকালেন তিনি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে। কুয়াশাও তাকালো। চিন্তাৰিত মুখে। তারপর মাথা তুলে তাকালো গাছটার উপরে।
, বুড়ো বটগাছটার মাথায় রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে দুটো নরকঙ্কাল! হালকা বাতাসে ঘুরছে কঙ্কাল দু’টো। দুলছে। হঠাৎ দমকা বাতাস পড়লেই ধাক্কা লাগছে একটার সঙ্গে অন্যটার। তার ফলেই শব্দ হচ্ছে খটখট, খটখট, খটাখট।
গাছের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো ওরা।
‘অশুভ সঙ্কেত! গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন মি. সিম্পসন। কুয়াশা ভাবছিল দ্বীপটা তাহলে অসভ্য জংলীদেরই আড্রা? তা না হলে গাছের মগডালে নরকঙ্কাল টাঙিয়ে রাখার মানে কি? ‘
‘অশুভ সঙ্কেতই বটে, মি. সিম্পসন। চিন্তান্বিত কণ্ঠে মি. সিম্পসনের কথার উত্তর দিলো কুয়াশা। তারপর নতুন রাস্তাটা ধরেই এগিয়ে চললো সামনের দিকে।
কাটা গাছের বাধা টপকে টপকে চললো ওরা আবার। . এবার ওদের দৃষ্টি মাঝেমাঝেই এদিক-ওদিকের গাছের মাথার উপর ঘুরে ফিরছিল। মিনিট দুয়েক পরই দেখতে পেলো ওরা আর একটা গাছে একটি নরকঙ্কাল। এগিয়ে চললো ওরা গম্ভীর মুখে সামনের দিকে সতর্ক পদক্ষেপে।
আগে আগে হাঁটছিলেন মি. সিম্পসন। কুয়াশা এগোচ্ছে ঠিক তার পিছন পিছন। হাঁটতে হাঁটতে আবার একটা বুড়ো বটগাছ ধরা পড়লো কুয়াশার দৃষ্টিতে। সন্দিহান হয়ে তাকালো সে গাছটার মাথায়। পরক্ষণেই পিছন থেকে আচমকা একটা প্রবল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সে মি, সিম্পসনকে। সাত হাত দূরে ছিটকে
|
৬০
পড়লেন মি. সিম্পসন ধাক্কা খেয়ে। পরমুহূর্তে একটা লম্বা বর্শা এসে বিঁধলো ঠিক যেখানে মি. সিম্পসন দাঁড়িয়েছিলেন সেই জায়গায়।
. ‘আঁ-আঁ-আঁ…।’
তীক্ষ কিন্তু অস্কুট একটা মৃত্যু-আর্তনাদ উঠতে না উঠতে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
‘ধপ!’ সশব্দে একটা মুণ্ডুহীন লাশ পড়লো বুড়ো বট গাছটার উপর থেকে।
ব্যথা ভুলে তড়িৎবেগে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। উঠে দাঁড়িয়েই মুণ্ডুহীন একটা জংলীকে আকাশ থেকে পড়তে দেখে অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে উঠলো তাঁর চোখ দুটো। বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল কুয়াশাও।
‘একি! বিস্ময়ের ঘোর কোনমতে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না মি. সিম্পসন।
কুয়াশা বললো, আপনাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়েছিল জংলীটা গাছের উপর থেকে। ধাক্কা দিয়ে আপনাকে সরিয়ে না দিলে সিধে আপনার বুকে এসে বিঁধতো বর্শাটা। আমি…
কুয়াশার কথায় বাধা দিয়ে মি. সিম্পসন বলতে চাইলেন, কিন্তু জংলীটার দশা…’
কুয়াশা বললো, আপনাকে সরিয়ে দেবার সময়, তাড়াহুড়োতে আমার হাতের লেসারগানের ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়ে যাবার ফলে এ দুর্ঘটনাটা ঘটলো মি. সিম্পসন।
মারণরশ্মির বীভৎস ক্ষমতা দেখে চোখ বন্ধ করলেন মি. সিম্পসন। মুণ্ডহীন জংলীটার ঘাড় থেকে কলকল করে রক্তের স্রোত বের হচ্ছে।
| ‘ঐ জংলীটার নয়, আসলে ঐ দশা হবার কথা ছিলো আমারই।’ কথাটা ধীরে ধীরে বললো কুয়াশা মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে।
… কেন?’
বিমূঢ় মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন আশ্চর্য হয়ে। কুয়াশা বললো, “লেসারগানের ট্রিগারে চাপ পড়তে, মারণরশি আমার মুখের ইঞ্চিখানেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর একটু হলেই…’
‘থাক, কুয়াশা!
বাধা দিলেন মি. সিম্পসন কুয়াশাকে। ব্যাপারটা কল্পনা করাও অসহ্য রকমের অস্বস্তিকর মনে হলো তাঁর। আর একটিবারও মুণ্ডুহীন জংলীটার দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কুয়াশাও পা বাড়ালো সামনে।
৬১
. উড়ে আসছিল একটি পাখি। একটি রহস্যময় পাখি উড়ে আসছিল ওদের দিকে। ছোট্ট একটা পাখি, কিন্তু ভয়ঙ্কর।
ইতিমধ্যে বনভূমির গভীরতম দেশে প্রবেশ করেছে ওরা। আগে আগে হাঁটছে এখন কুয়াশা। পিছনে মি. সিম্পসন।
এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল কুয়াশা নতুন কোনো পায়ে চলা পথের খোঁজে। কি যেন ভাবছিলেন মি. সিম্পসন। আর তীব্র বেগে উড়ে আসছিল একটি পাখি ওদের, দিকে। ওদের দুজনেরই অগোচরে। * উড়ে আসছিল পাখিটা। তীব্র, একরোখা, দুর্ধর্ষ গতিতে এগিয়ে আসছিল। তীক্ষ্ণ, ছুরির ধারালো ফলার মতো এক জোড়া চঞ্চ তার। চোখ জোড়া দুফোঁটা রক্তের মতো টকটকে লাল। প্রতিহিংসার নীল আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে সেই চোখের শাণিত দৃষ্টিতে। বহুদূর থেকে উড়ে উড়ে আসছিল পাখিটা। দূর থেকেই কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল সে।
উঁচু উঁচু গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো গাছের মাথার উপর দিয়ে। থেকে থেকে অদ্ভুত একটা করুণ রবে শিস দিতে দিতে উড়ে আসছিল পাখিটা। কোনদিকে খেয়াল নেই তার, সিধে এগিয়ে আসছিল কুয়াশাকে লক্ষ্য করে।
দেখতে দেখতে এসে পড়লো রহস্যময় পাখিটা। ঠিক হাত দুয়েক দূরে থাকতে টের পেলো কুয়াশা। দু’সেকেণ্ডের জন্যে দেখতে পেলো সে, ছোট্ট একরত্তি একটা কালো রঙের পাখি তার কপাল লক্ষ্য করে তীরের মতো এসে পড়েছে। আশ্চর্য হবারও সময় পেলো না কুয়াশা। ঠোকর মারলো পাখিটা।
সিধে এসে ছুঁচালো তীরের মতো বিঁধলো পাখিটার ঠোঁট জোড়া কুয়াশার কপালের ব্যাণ্ডেজ-মুক্ত অংশটায়। পরমুহূর্তে হাত-ঝাঁপটা মারলো কুয়াশা। ছিটকে পড়লো, পাখিটা কুয়াশার চওড়া হাতের প্রকাণ্ড এক থাবড়া খেয়ে। প্ৰাণবায়ু বের হয়ে গেল তার সঙ্গে সঙ্গে।
দু’পা এগোলো কুয়াশা পাখিটাকে ভালো করে দেখার জন্যে। দু’পা-ই এগোল। মাত্র। হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো তার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কি যেন ভাবলো কুয়াশা। তারপর নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অদূরে পতিত মৃত রহস্যময় পাখিটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেঁপে উঠলো কুয়াশার সর্বশরীর। টলতে লাগলো পা দু’খানা।
কি হলো, কুয়াশা?” কুয়াশাকে থরথর করে কেঁপে উঠতে দেখে ভয়ে ভাবনায় প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন পিছন থেকে। ৬২
:
কোনো উত্তর পাওয়া গেল না কুয়াশার তরফ থেকে।
বিস্মিত হয়ে এগিয়ে এলেন মি. সিম্পসন। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই সশব্দে কুয়াশার বিশাল শরীর পড়ে গেল মাটিতে।
এক বিরাট মহীরুহের পতন ঘটলো যেন। | দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। মাটিতে বসে পড়ে তুলে নিলেন তিনি তাড়াতাড়ি কুয়াশার মাথাটা নিজের কোলে। চোখ দুটো বুজে গেছে কুয়াশার। কপাল থেকে রক্ত বেরুচ্ছে চিকণ ধারায়। কঁপা হাতে তুলে নিলেন মি.
. সিম্পসন কুয়াশার একটি হাত। পালস্ দেখলেন।
জ্ঞান হারিয়েছে কুয়াশা। পালস্ চলছে। কিন্তু মি, সিম্পসনের মনে একটা ভয়াবহ, প্রশ্ন ককিয়ে মরছে, শেষ পর্যন্ত পালস্ ঠিক থাকবে তো কুয়াশার! নাকি কুয়াশার মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্যেই অনাবিষ্কৃত দ্বীপের সর্বনাশী বিষাক্ত পাখিটা উড়ে এসেছিল? কে বলতে পারে সেই চরম শাস্তিটাই সে দিয়ে গেল কিনা?
ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থাপত্র এখন হাতের কাছে নেই। কাছেপিঠে তেমন কিছু পাবার আশাও হাস্যকর। তা সত্ত্বেও লেগে পড়লেন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার মি. সিম্পসন। যতো রকম জ্ঞান ছিলো তার একজন অচেতন মানুষের চেতনা আনার ব্যাপারে, একে একে সব খাটালেন তিনি। কিন্তু হা হতোহস্মি! কোনো উপায়েই কোনো পরিবর্তন হলো না। জ্ঞান ফিরলো না কুয়াশার। বার্থ মনোরথ মি. সিম্পসন ছটফট করতে লাগলেন কি করবেন ভেবে না পেয়ে।
| বিশুদ্ধ পানির দরকার। কিন্তু বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যাবে কোথায়? ভেবে ভেবে কোনো কূল দেখতে পেলেন না মি. সিম্পসন। গরম হয়ে উঠলো তার মাথা। দেরি হয়ে যাচ্ছে বড্ড। এখনো পালস্ চলছে ধীরে ধীরে। এখনো প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়নি কুয়াশার। যা হোক কিছু একটা করা দরকার এখুনি। সময় কাটছে হুহু করে। আধ ঘন্টা কেটে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু কই, জ্ঞান ফিরে আসার তো কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার!
| অস্থির হয়ে পড়লেন মি. সিম্পসন। কুয়াশার মাথাটা অতি যত্নের সঙ্গে নামিয়ে রাখলেন তিনি মাটির উপর। তারপর উঠে দাঁড়ালেন সিধে হয়ে। দারুণ একটা
ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে তার সারামুখে। চোখ দুটো আশঙ্কায় চঞ্চল।
| কিছু একটা করা দরকার। এবং সময় নষ্ট না করে যা করার এখুনি করা দরকার। কিন্তু কি করার উপায় আছে? পানির জন্যে সমুদ্রের দিকে ফিরে গেলে কেমন হয়? মনে মনে ভাবলেন মি. সিম্পসন কথাটা। না; সমুদ্র থেকে পানি আনতে দেরি হয়ে যাবে। পানি আনবেনই বা কিভাবে? সামনে এগিয়ে পানির সন্ধান করাই বরং উচিত হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। বহু কষ্টে নরম ঘাসের উপর তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে ‘ দিলেন তিনি কুয়াশার জ্ঞানহীন দেহটাকে। তারপর দেরি না করে যথাসম্ভব দ্রুত
৬৩
এগিয়ে চললেন সামনের দিকে কাটা গাছের খোঁচা খেতে খেতে। গহীন জঙ্গলে অচেতন এবং একা পড়ে রইলো কুয়াশার বিশাল শরীর।
মিনিট পাঁচেক একনাগাড়ে হাঁটার পর হঠাৎ ডান দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। আচমকা আটটা তীক্ষ্ণফলা বর্শা কে জানে কোথা থেকে এসে বিধলো তার চারপাশের মাটিতে। ঝট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন রিভলভার বের করার জন্যে।
কারাই বা, কা কারাইবা, কারাই বা কা-!
জংলীদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল দুর্বোধ্য ভাষায় আশপাশের গাছের উপর থেকে। চকিতে উপর দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন।
হিংস্র জংলীর দল গাছের উপর চড়ে বসে আছে। সংখ্যায় দশ-বারোজন হবে। হাতে তাদের তীর-ধনুক বাগিয়ে ধরা। হিংস্র, বীভৎস উল্লাস ফুটে বেরুচ্ছে ওদের মুখ থেকে।
‘গুড়ুম! গুড়ুম!!’ গুলি করলেন মি. সিম্পসন। ‘আঁ-আঁ।’ | দুটো মাত্র গুলি বের হলো রিভলভারের নল দিয়ে। পরক্ষণেই একটা বিষ মাখানো তীর এসে বিধলো মি. সিম্পসনের ডান বাহুতে। বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেল পলকের মধ্যে। অবশ হয়ে এলো মি. সিম্পসনের সর্বশরীর। দেখতে দেখতে হাত থেকে খসে পড়লো তাঁর রিভলভারটা। থরথর করে কেঁপে উঠলেন মি. সিম্পসন। টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছেন তিনি মাটিতে। ভয়ানক পিপাসা পাচ্ছে তার। অস্পষ্টভাবে কানে ঢুকছে জংলীদের হৈ-হল্লা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ঠিক মাথার উপরের গাৰ্ছটা থেকে লাফ দিয়ে পড়লো একজন জংলী মি. সিম্পসনের ঘাড়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়লো মি. সিম্পসনের অচেতন দেহটা মাটিতে।
মি. সিম্পসনের গুলিতে দুজন জংলীর প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে দেহ ছেড়ে চিরতরে। মি. সিম্পসনকে ঘায়েল করতে পেরে বীভৎস উল্লাসে হৈ-হৈ করে উঠলো অর্ধনগ্ন তামাটে রঙের অসভ্যগুলো। দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে আটজন জংলী নেমে এলো মি. সিম্পসনের জ্ঞানহীন দেহের পাশে। তারপরই সকলে মিলে কাঁধে তুলে নিলো তাঁকে। তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বয়ে নিয়ে চললো তারা মি. সিম্পসনকে তাদের রাজার কাছে। রাজা এর বিচার করবেন। যার অর্থ মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না। বলি দেয়া হবে নির্ঘাৎ এই সভ্য মানুষটাকে তাদের পবিত্র জন্মভূমিতে এসে পড়ার জন্যে।
একটা স্বপ্ন দেখছিল কুয়াশা।
অসভ্য জংলীরা বর্শা হাতে ঘিরে ফেলেছে তাকে। বিরাট একটা এলাকা নিয়ে ৬৪
গোল মতো করে ঘিরে ফেলেছে কুয়াশাকে জংলীরা। গম্ভীর পদক্ষেপে বর্শা উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে ওরা। ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে গোল মতো জায়গাটা। চিৎকার করছে জংলীগুলো দুর্বোধ্য ভাষায়। কান পাতা: দায় সেই চিৎকারে। | ঘুম ভেঙে গেল কুয়াশার এমন সময় চোখ মেলে তাকালো সে চারপাশে। ধড়মড় করে উঠে বসলো পরক্ষণেই। কানে বাজছে এখনো জংলীদের হৈ হৈ | চিৎকারটা।
উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে সে। কপালের রক্ত শুকিয়ে যাবার ফলে চিড় চিড় করে উঠলো কপালের চামড়াটুকু। তারপরই ভূপাতিত সেই সর্বনাশী বিষাক্ত পাখিটার দিকে দৃষ্টি পড়লে তার হঠাৎ। মনে পড়ে গেল সব কথা।
আশ্চর্য হয়ে তাকালো কুয়াশা চারপাশে। মি. সিম্পসন কোথায় গেলেন? হঠাৎ কানে এসে বাজলো আবার জংলীদের হৈ-হৈ চিৎকারটা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো সে কি যেন। একটু পরই কুয়াশা বুঝতে পারলো যে ব্যাপারটা স্বপের ঘোর, নয়। সত্যিই একটা হৈ-হৈচিৎকার এগিয়ে আসছে এদিকেই।
দক্ষিণ দিক থেকে আসছে শব্দটা? উত্তর দিকে ফিরে তাকালো কুয়াশা। সেদিকে পায়ে চলা রাস্তা দেখা যাচ্ছে একটা। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে কুয়াশা। গন্ধ পেয়ে গেছে অসভ্য জংলীর দল অনাহূত শত্রুদের। পালাতে হবে। ধরা পড়লে চলবে না ওদের হাতে। কিন্তু মি. সিম্পসন গেলেন কোথায়? আমাকে এখানে অচেতন রেখে কোথায় যেতে পারেন তিনি, ভাবলো কুয়াশা। ধরা পড়ে যাননি তো জংলীদের হাতে?
দক্ষিণ দিক থেকেই আসছে ‘জংলীরা। দলে দলে আসছে। যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েই আসছে।
| দ্রুত পায়ে উত্তর দিকের পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করলো কুয়াশা। মি. সিম্পসনের খোঁজ পরে করলেও চলবে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে হিংস্র চিৎকারটা।
পালাতে হবে আগে। ঝোঁপ-ঝাড় ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে মটমট করে।
মিনিট তিনেক হাঁটার ই একটা উন্মুক্ত মাঠ দেখতে পেলো কুয়াশা। এবার কোনদিকে এগোনো যায় ভাবছিল সে। এমন সময় সামনের দিকে দৃষ্টি পড়তেই চমকাল সে। সারবন্দী হয়ে গম্ভীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে শ’দুয়েক জংলী বর্শা উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম দিকে তাকালো কুয়াশা। দমে গেল সে এবার। পশ্চিম দিক থেকেও একদল জংলী এগিয়ে আসছে সারবন্দী হয়ে।
| কুয়াশার পিছন দিকটা দক্ষিণ দিক, অর্থাৎ পিছন দিকে জঙ্গল। জঙ্গলের দিক। থেকে জংলীদের চিৎকারটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ। উত্তর দিকে অর্থাৎ তার সামনে এবং পশ্চিম দিকেও জংলীরা রয়েছে। এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে তার দিকে সতর্ক ৫-
দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ব্যগ্র হয়ে তাকালো কুয়াশা এবার পুব দিকে। | নেই! পুব দিকে কোনো জংলীর চিহ্নমাত্র নেই। উন্মুক্ত, শূন্য মাঠ পড়ে আছে
শুধু। কিছুটা উঁচু মতো হয়ে পড়ে আছে মাঠটা। ছুটলো কুয়াশা সেই দিকে। | গাঢ় বাদামী গায়ের রঙ জংলীগুলোর। সারা মুখে লাল ও হলুদ রঙয়ের পোঁচ দেয়া। কাঁধে ঝুলছে তীর-ধনুক। হাতে তীক্ষ্ণফলা বর্শা।
‘মাঠের মাঝামাঝি পৌঁছে দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে নজর ফেললো কুয়াশা। রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেল সে। শত শত জংলী রে হয়ে এসেছে জঙ্গল থেকে। এখন আর তারা চিৎকার করছে না। অন্য দুটো দলের মতো এরাও এগিয়ে আসছে তার দিকে ধীরে, গম্ভীর পদক্ষেপে, বর্শা উঁচিয়ে।
এতো দেরি করছে কেন ওরা! | কুয়াশা দৌডুচ্ছে পালিয়ে যাবার জন্যে। কুয়াশার পিছন পিছন ওরাও ছুটতে পারে। কিন্তু কোনো তাড়াহুড়োর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওদের মধ্যে। এর কারণ কি!
কারণটা বুঝতে পারলো না কুয়াশা। লেসারগানটা হাত বদল করে দৌড়তে লাগলো সে।
আবার পিছন ফিরে তাকালো একবার কুয়াশা। আশ্চর্য হয়ে দেখলো সে যে, সব জংলীগুলোই তাদের বর্শার মুখ আকাশের দিকে করে নিয়েছে, একসময়।
এগিয়ে আসছে সমান তালে পা ফেলে। কোনো, তাড়াহুড়ো নেই।
মাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছে নিরাশ হয়ে পড়লো কুয়াশা। চওড়া একটা নদী দেখা যাচ্ছে সামনে। অসংখ্য কুমীর রোদ পোহাচ্ছে তীরে উঠে এসে। কুয়াশার সাড়া পেয়েই নড়েচড়ে উঠলো তারা। অনেকদিন মানুষের মাংসের স্বাদ পায়নি ওরা। সুযোগ এলো বোধহয় এতদিনে। সাড়া পড়ে গেল হিংস্র জলচর জন্তুগুলোর মধ্যে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে কুয়াশা। এতক্ষণে বুঝতে পারছে সে জংলীরা কেন এমন ধীর এবং শান্ত পায়ে তার পিছন পিছন ধাওয়া করে আসছে। ওরা তো জানেই সামনে ছাড়া অন্য কোনোদিকে এগোতে পারবে না কুয়াশা। এগোবার। চেষ্টা করলেই প্রাণ দিতে হবে বর্শার মুখে। আর সামনে এগিয়ে গেলে আরও বীভৎস মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করছে-হিংস্র কুমীরগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো টুকরো করে খাবে।
এমন একটা বিপদে পড়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো কুয়াশা। জংলীগুলোকে বোঝানো সম্ভব নয় যে, সে ওদের শত্রু নয়। এক্ষেত্রে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় লেসারগন। তা না হলে তাকে প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এতগুলো বুদ্ধিহীন মানুষকে পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে চিরতরে বঞ্চিত করা কি ঠিক হবে?
৬৬
অসভ্য ওরা। কোটা ভালো কোটা মন্দ জানে না। বোঝে না কে শত্রু কে মিত্র। ওদের চোখে ওরা ছাড়া সকলেই খারাপ। সকলেই বদ, শত্রু। কিন্তু তাই বলে ওদেরকে কি মেরে ফেলা উচিত কাজ হবে?
না। তা পারবে না কুয়াশা। কোনো একটা উপায় বের করতেই হবে। যাতে একবিন্দুও রক্তপাত না হতে পারে।
| নদীর দিকে তাকালো কুয়াশা। আরে! এই তো কি চমৎকার একটা উপায় তৈরি করা রয়েছে। কুয়াশা দেখলো নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে ছোটো একটা নৌকো। কেউ যেন তার জন্যেই আগে থেকে নৌকোটা রেখে গেছে এখানে।
| দেরি করলো না কুয়াশা। ছুটে চলে এলো নৌকোটার কাছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লো সে সেটায়। ঠিক তখুনি দেখা গেল জংলীরা দলে দলে এসে পড়েছে একবারে কুয়াশার একশো হাতের মধ্যে।
দাঁড়টা তুলে নিয়ে পানিতে ফেললো কুয়াশা। কিন্তু হা হতোহস্মি! নৌকোটা যে তিন তিন জায়গায় ফুটো!
ফুটোগুলো দিয়ে পানি উঠছে দ্রুত। এভাবে পানি উঠতে থাকলে মিনিটখানেকও লাগবে না নৌকোটা ডুবে যেতে। পা দিয়ে চেপে ধরলো কুয়াশা দুটো ফুটো। এদিকে পনেরো কুড়িটা কুমীর মাথা তুলে এগিয়ে আসছে নৌকোর দিকে।
লেসারগানের মুখ তুলে ধরলো কুয়াশা কুমীরগুলোর দিকে লক্ষ্য করে। গোটা তীর থেকে হাত চার-পাঁচ সরে এসেছে। দুটো কুমীর এগিয়ে এসে পাশ থেকে গায়ের ধাক্কা মেরে উল্টে দেবার তালে আছে নৌকোটাকে। ট্রিগার টিপলো কুয়াশা। অদৃশ্য হয়ে গেল দুটো কুমীরের মাথা। ভীষণ একটা তোলপাড় উঠলো। পানিতে। খানিকটা জায়গার পানি ধোয়ার সৃষ্টি করে উড়ে গেল উপরের দিকে। রক্তে লাল হয়ে গেল নদীর পানি। থমকে দাঁড়ালো জংলীরা। চোখগুলো তাদের বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে।
অসংখ্য কুমীর এগিয়ে আসছে এবার দলে দলে। আবার লেসারগানের ট্রিগার টিপলো কুয়াশা কুমীরগুলোকে লক্ষ্য করে। আড়াল হয়ে গেল সামনের দিকটা ধোয়ায়। পানির চারপাশে দারুণ একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল মুহীন কুমীরগুলোর তড়পানিতে। লালে লাল হয়ে উঠলো নদীর পানি। জংলীগুলো বিচলিত হয়ে তাকালো পরস্পরের দিকে। ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে তাদের চোখেমুখে।
লাইন বন্দী জংলীগুলোর দিকে তাকালো এবার কুয়াশা। বর্শাগুলো আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ওরা এখনো। বর্শাগুলোর মাথা লক্ষ্য করে লেসারগানটা তুলে ধরলো এবার কুয়াশা। ট্রিগার টিপে লেসারগানের নলটা ধীরে ধীরে একদিক থেকে অন্যদিকে ঘোরালো সে। মুহূর্তের মধ্যেই নেই হয়ে গেল শত
৬৭
শত বর্শার অর্ধেকটা করে।
| মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেল জংলীদের মধ্যে। ভেঙে গেল লম্বা সারবন্দী লাইনগুলো। ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ওরা দেখতে দেখতে। তারপরই দেখা গেল সবাই পিছন ফিরে পালাতে শুরু করেছে এলোমেলোভাবে ভয়ার্ত আর্তনাদ করতে করতে।
| আধ মিনিটের মধ্যে গায়েব হয়ে গেল মূর্তিমান ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার কারণ। পালাতে দিশে পেলো না অসভ্য জংলীগুলো মারণরশ্মির অলৌকিক কেরামতি, দেখে।
এদিকে আরো কুমীর এগিয়ে আসছে নৌকোর দিকে। চারপাশে পানির রঙ রক্তে লাল হয়ে গেছে। লেসারগানটা একহাতে শক্ত করে চেপে ধরে তীরের দিকে। লাফ দিলো কুয়াশা। ডুবে গেল এতক্ষণে জলভর্তি নৌকোটা। এতক্ষণ দুটো পায়ের চেটো দিয়ে নৌকার দুটো ফুটো চেপে রেখেছিল কুয়াশা। একটিমাত্র ফুটো দিয়ে পানি উঠছিল তার ফলে। তা না হলে অনেক আগেই ডুবে যেতে নৌকোটা।
মাঠের মাঝখানে আবার ফিরে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। জঙ্গলে ঢুকতে হবে তাকে আবার। মি. সিম্পসনকে খুঁজে বের করতে হবে। কে জানে ইতিমধ্যে কি দশা। হয়েছে তাঁর। তিনি যদি কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে ধরা পড়ে গিয়ে থাকেন অসভ্য জংলীদের হাতে তাহলে আর তার রক্ষা নেই। উদ্ধার করতে হবে তাঁকে। তাছাড়া সমুদ্রতীরে একটা লাইফবয় দেখেছিল তারা। সেই লাইফবয়ে কে এসে উঠেছে এই দ্বীপে, সেটা জানতে হবে যেমন করে হোক। বাঁচাতে হবে ওদেরকে জংলীদের কবল থেকে। | আবার এগিয়ে চললো কুয়াশা মাঠের উপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে ভয়ঙ্কর বিপদ মাথায় করে।
তিন।
এ কোথায় এসে পড়লাম।
সেদিনই সকালবেলা মহুয়ার লাইফবয়টা জোয়ারের টানে অসভ্য জংলীদের দ্বীপের তীরে এসে ঠেকতেই জ্ঞান ফিরে এলো তার। | সমুদ্রের ভীষণ মূর্তি দেখে, ক্লান্তিতে ও ভয়ে গতরাতে বারবার অচেতন হয়ে
পড়েছিল মহুয়া লাইফবয়ের উপর।
এ কোন অচেনা দেশে এসে পড়লাম! কোনো জন-মনিষ্যির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলাকীর্ণ মনে হচ্ছে। এটা কি একটা দ্বীপ? কাদের অধিকারে আছে এই দ্বীপ? কিভাবে গ্রহণ করবে, এখানকার মানুষ আমাকে? একা দুর্বল মেয়েমানুষ
৬৮
আমি! সাহায্য করবে তো এখানকার মানুষ আমাকে? নাকি একা মেয়েমানুষ দেখে জুলুম সইতে হবে
নানা রকম দুশ্চিন্তার কথা ভাবতে ভাবতে লাইফবয় থেকে তীরে নেমে পড়লো মহুয়া। সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কি যেন খুঁজলো সে, কি যেন দেখার চেষ্টা করলো সীমাহীন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। তারপর নিরাশ হয়ে দৃষ্টি : ফিরিয়ে দ্বীপটার চারপাশটা দেখতে লাগলো অসহায় ভঙ্গিতে।
খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। ভিজে শরীর সামুদ্রিক হাওয়া লেগে শুকিয়েছে বটে, কিন্তু সঁতিসেঁতে ভাবটা কাটেনি মোটেই। নোনা পানি শুকিয়ে যাবার পরও শরীর চটচট করছে কেমন যেন। আর অসম্ভব ক্লান্তিতে শরীর হালকা হয়ে গেছে। যেন এক’পা হাঁটার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই।
ধীরে ধীরে বালুকাবেলা ছাড়িয়ে এলো মহুয়া। দুরুদুরু করছে বুকের ভিতর। এ কোথায় এসে পড়লো সে।
| বালুকাবেলা ছাড়িয়ে একটা বড় পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো মহুয়া। হু হু করে উঠলো তার বুকটা নিজের অসহায় অবস্থার কথা কল্পনা করে। নিঃশব্দ ধারায় দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা।
শহীদের কথাই তার মনে পড়ছে অহরহ। বেঁচে আছে তো সে? নাকি সমুদ্রের অতলতলে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে…ভাবতে ভাবতে থরথর করে কেঁপে উঠলো তার সর্বশরীর। শিউরে উঠলো বুকটা অমঙ্গল আশঙ্কায়। তওবা তওবা করে অমঙ্গল চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলো সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে আবার সমুদ্রের দিকে তাকালো সে। ‘
মাগো! একি, এরা কোথা থেকে এলো! কারা এরা? তামাটে রঙের মোটা মোটা দুজন লোক দেখছি যে! এরা তো সভ্য মানুষ নয়…তবে কি দ্বীপটা অসভ্য জংলীদেরই..
প্রায় উলঙ্গ দুজন অসভ্য জংলী বিস্ফারিত নেত্রে পঁড়িয়ে আছে মহুয়ার পরিত্যক্ত লাইফবয়টার সামনে।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে জংলী দুজন। কি যেন বললো একজন অন্যজনকে। শুনতে পেলো না মহুয়া ওদের কথা। পিট পিট করে চারদিকে তাকালো ওরা দুজন। কাকে যেন খুঁজছে ওরা। উত্তেজনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে ওদের চোখেমুখে। ‘হিংস্র একটা উল্লায় যেন খেলে বেড়াচ্ছে ওদের অঙ্গভঙ্গিতে।
ভয়ে কজে শুকিয়ে গেল মহুয়ার। চট করে পাথরের আড়ালে শরীরটা লুকিয়ে ফেললো সে। শুধু মুখটা সামান্য একটু বের করে দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে রইলো অদ্ভুতদর্শন লোক দুজনের দিকে।
কালো পিচের মতো রঙ দিয়ে জংলী দুজনের হাত দুটোতে বিদঘুঁটে ছবি আঁকা। এক হাতে বর্শা ধরা। কাঁধে তীর-ধনুক। মুখে নানা রঙের পোঁচ।
এক’পা এক’পা করে লাইফবয়টার কাছাকাছি এগিয়ে গেল ওরা দুজন। তারপর কিচিরমিচির করে কি যেন বলা-কওয়া করলো খানিকক্ষণ। হঠাৎ মাটিতে ঝুঁকে পড়লো দুজনই একসাথে লাইফবয়টার দিকে। ছোঁ মেরে তুলে নিলো একজন লাইফবয়টা পলকের মধ্যে কাঁধের উপর। কেউ যেন জিনিসটা কেড়ে নেবার তালে আছে তাদের হাত থেকে। কাঁধে তুলে নিয়েই তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ছুট দিলো জঙ্গলের দিকে।
| কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল জংলী দুজন।
খিদেটা এতক্ষণ ভুলে ছিলো মহুয়া। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো জংলী দুজন চোখের সামনে থেকে সরে যেতেই আবার চেগিয়ে উঠলো’ প্রচণ্ড খাই খাই অনুভূতিটা। জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করেছে জংলী:দুজন। অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ালো মহুয়া। পুব দিকের জঙ্গলে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তেমন কিছু পাবার আশা না থাকলেও বনভূমিতে ফল-পাকড়ের গাছ আছে নিশ্চয়। এখন তাই পেলেই রক্ষে। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে কি দুর্ভোগ আছে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।
কাঁটা গাছে বেধে যাচ্ছে শাড়ি।
| দু’পা হেঁটেই থামতে হচ্ছে মহুয়াকে। ঝোঁপ-ঝাড় টপকে টপকে হাঁটতে হচ্ছে। তাকে। এখনো পায়ে চলা একটা রাস্তাও কোনদিকে দেখতে পায়নি সে।
জানে না সে কোন অচিন মুলুকে ভেসে এসেছে। অভুক্ত শরীরে হাঁটার পরিশ্রম সইতে বড় কষ্ট হচ্ছে তার। এই দুর্গম জঙ্গলে দ্বীপ থেকে কোনদিন আবার মুক্ত বিশ্বে ফিরে যেতে পারবে কিনা তাও সে জানে না। সে জানে না, তার স্বামীর কি
দশা হয়েছে। কোথায় কেমন হলে সে এখন আছে তা একমাত্র খোদাই জানে। যেভাবেই থাকুক; বেঁচে থাকে যেন সে-প্রার্থনা জানালো মহুয়া খোদার দরবারে। কামাল ও গফুরের দশাই বা কি হলো? আর তার দাদা কুয়াশা?.মি: সিম্পসন?
হু হু করে উঠলো মহুয়ার বুকের ভিতরটা। চোখ থেকে জলের ধারা ঝরতে শুরু করলো আবার। | যাচ্ছিলো তারা সবাই মিলে দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে। শহীদ জানতো, তাকে না নিয়ে যেতে চাইলে সে নিজেও যেতে পারবে না। কান্নাকাটি শুরু করে দেবে তাহলে মহুয়া। তাই সঙ্গে না নেবার প্রশ্নই তোলেনি শহীদ। কিন্তু একি মহা সর্বনাশ ঘটে গেল মাঝপথে! এখনো যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না ঘটনাটা। এমনটি যে হবে তা তো কেউ দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। পৃথিবীর সব সুখ-স্বস্তি, বেঁচে থাকার সামান্যতম আশা, অবলম্বন সব এমন করে হারিয়ে যাবে জীবন থেকে তা কি কেউ জানতো? এতো দুঃখেও হাসি পেলো মহুয়ার। জীবনের কথা ভাবছে কেন সে? বেঁচে থাকার কথা এখন চিন্তা না করাই ভালো। জংলীদের বর্শার মুখে
৭০
যে প্রাণ যাবে না তা কি কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে?
এক ঢোক পানিও পাওয়া যাবে না কোথাও!
এখনো এমন কোনো গাছ দেখতে পায়নি মহুয়া যাতে কোনো না কোনো রকম ফল ধরে আছে। কিন্তু পেট ভরাবার জন্যে না হয় কিছু না-ই পাওয়া গেল, গলা ভেজা-বার জন্যে এক ঢোক পানিও পাবার আশা নেই!
গাছের উপর তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল মহুয়া। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো সামনের দিকে গাছের সংখ্যা কমে আসছে। আরো একটু এগোলো সে। অকারণ, খুশিতে বুকটা নেচে উঠলো তার। সামনে একটা ছোট্ট মাঠ মতো দেখা যাচ্ছে।
| প্রখর রোদের মধ্যে দিয়ে ছোটো মাঠটা পেরিয়ে আবার ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করলো মহয়া। এবার একটা পায়ে চলা পথ পেয়ে গেল। ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরের বোঝা বইতে বইতে কোনমতে হাঁটছিলো সে। ছিঁড়ে গেছে শাড়িটা কাটার খোঁচা লেগে অসংখ্য জায়গায়। রক্ত ঝরছে পায়ের তলা থেকে। সর্বশরীর বেয়ে নামছে নোনা ঘাম। চুলের খোঁপা খুলে গিয়ে মুক্তকেশী হয়ে পড়ছে সে। পাগলিনী পারা হয়ে হাঁটছে এক মুঠো খাবার এবং এক ঢোঁক পানির আশায়। হাঁটছে সে মন্থর গতিতে। তার দু’চোখ বেয়ে ঝরছে অনবরত জলের ধারা। তার স্বামী, গর্বের বস্তু দাদা, কামালের মতো দেবর, গফুরের মতো প্রভুভক্ত সেবক এবং শুভানুধ্যায়ী মি. সিম্পসনের জন্যে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল ধারায়।
ওটা কি! ওটা কি পড়ে রয়েছে! একটুকরো কাপড় না? ওটা, ওটা তো
চমকে উঠলো মহুয়া। থমকে দাঁড়ালো সে পায়ে-চলা সরু পথটার উপর। আশায় আনন্দে, সবরকম বিপদের আশঙ্কা ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো তার। একটুকরো ছেঁড়া কাপড় পড়ে রয়েছে পথের উপর। ঠিক তার হাত, পাঁচেক দূরে হবে। ক’পা এগিয়ে গিয়ে খপ করে তুলে নিলো মহুয়া কাপড়ের টুকরোটা। চিনতে বিলম্ব হলো না, জিনিসটা কার। গফুর ওই কাপড়ের শার্ট পরে ছিলো। এটা, তারই শার্টের ভেঁড়া টুকরো।
কিন্তু গফুরকে দেখা যাচ্ছে না তো! কোথায় সে? তার শার্ট ছিঁড়লই বা। কিভাবে?
| দপ্ করে নিভে গেল মহুয়ার চোখমুখ থেকে শত প্রদীপের উজ্জ্বল আলো। ব্যস্ত-ব্যাকুল চোখে তাকালো সে এদিক ওদিক। দু’পাশে শুধু গহীন জঙ্গল। সম্মুখদিকে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে সরু পথটা। পিছনেও ফেলে এসেছে সে পথের খানিকটা অংশ। কই, কোথাও দেখা যাচ্ছে না তো গফুরকে!
‘গ-ও-ও-ফু-উ-উ-র…গ-ও-ও-ফু-উ-উ-র!’
বারবার ডাকলো মহুয়া গফুরের নাম ধরে আশায় নিরাশায় দুলতে দুলতে। সে থামতেই তার মনে হলো বহুদূর থেকে কার যেন একটা ক্ষীণ অথচ গম্ভীর মোটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো বেশ খানিকক্ষণ ধরেঃ আ-আ-আ-স-ছি-ই-ই-ই!
কানের ভূল নয় তো? ভাবলো মহুয়া। আবার যতো জোরে সম্ভব গফুরের নাম ধরে ডাকলো সে। কিন্তু এবার আর তার ডাকের প্রত্যুত্তর শোনবার সুযোগ হলো
মহুয়ার। পায়ের পাতার উপর সড়সড় করে উঠলো কি যেন। শিরশিরিয়ে উঠলো মহুয়ার সর্বশরীর। সাপ না কি?
চকিতে পায়ের দিকে তাকালো মহুয়া। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার সঙ্গে সঙ্গে। পলকের মধ্যে দু’পা পিছিয়ে এলো সে নিজেরই অজান্তে আত্মরক্ষার স্বাভাবিক তাগিদে। কিন্তু তারপরই ভয়ঙ্কর এবং অবাঞ্ছিত বিপদ দেখে অবশ হয়ে গেল সে পাথরের মতোই। নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে ফ্যালফ্যাল করে মাটির দিকে তাকিয়ে।
। কয়েকটা, সবুজ দড়ি এগিয়ে আসছে। সাপেরই মতো দেখতে কয়েকটা দড়ি এগিয়ে আসছে সড়সড় করে। চার-পাঁচ গজ লম্বা সবুজ রঙের দড়ির মতো দেখতে জিনিসগুলো। পায়ে চলা পথ থেকে বেশ খানিকটা দূরে অস্বাভাবিক বড় আকৃতির একটা ফুল ফুটে রয়েছে। রাক্ষসী পদ্ম ফুল ওটা। এতবড় ফুল দেখা তো দূরের কথা, মহুয়া শোনেওনি এর কথা। ফুলটার গোড়া থেকে সাত-আটটা সবুজ দড়ির মতো ডাল বেরিয়ে আছে। ছড়িয়ে আছে নানাদিকে। বিছিয়ে আছে মাটির উপর। জলজ্যান্ত একটা মানুষের গন্ধ পেয়ে লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে রাক্ষসী ফুলটার পক্ষে। ডালগুলো সাপের মতো এগিয়ে আসছে বুকে হেঁটে মহুয়ার দিকে।
মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছে মহুয়া! মৃত্যুভয় জাগছে তার মনে। বিমূঢ় বিস্ফারিত হয়ে উঠলো মহুয়ার চোখের দৃষ্টি। অচেতন হয়ে পড়েছে সর্বশরীর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে মহুয়া নিজের। নিঃসাড় দাঁড়িয়ে আছে সে দু’পা মাত্র পিছিয়ে এসে সেই একই জায়গায়। ক্রমশ এগিয়ে আসছে সড়সড় করে বুকে হেঁট দুটো সবুজ ডাল।
বিপদের ভয়াবহতা বুঝতে পারছে মহুয়া। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তার, যে তাকে পেঁচিয়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে বিরাটাকার ঐ রাক্ষসী ফুলটার মধ্যিখানে। সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা ফুলটা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার ফুটবে ওটা খানিকক্ষণ পর। তখন আর মহুয়ার সামান্যতম চিহ্নও থাকবে না ওর মধ্যে। হজম করে ফেলবে সহজেই মানুষখেকো ঐ রাক্ষসী ফুলটা এতো বড় একজন মানুষের দেহ।
আবার পায়ের পাতায় স্পর্শ পেলো মহুয়া একটা ডালের। শেষ মুহূর্তে শরীরের অসাড়তা কেটে গেল তার পলকের জন্য মাত্র। ভয়ার্ত একটা অস্ফুট শব্দ করে আবার দু’পা পিছিয়ে এলো সে। তারপর আর নড়ার শক্তি রইলো না। দাঁড়িয়ে রইলো সে কাঁপতে কাঁপতে, ঘামতে ঘামতে। এগিয়ে আসছে আরও ডাল দুটো নাছোড়বান্দার মতো সড়সড় করে।
অদ্ভুত ব্যাপার! এবারের স্পর্শটুকু আশঙ্কা করেনি মহুয়া। পিছন দিক থেকে কি যেন স্পর্শ
করলো এবার তার ডান পায়ে। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় শিউরে উঠলো সে। সামনের ডাল দুটো এখনো ইঞ্চি কয়েক দূরে রয়েছে। এ তবে কিসের ছোঁয়া লাগে তার পায়ে!.
| দারুণ ভয়ে পিছন ফিরলো মহুয়া। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে উঠলো তার চোখের দৃষ্টি। ঠাণ্ডা হিম হয়ে উঠলো সর্বশরীর। কাঁপছে সে থরথরিয়ে। দু’হাতে চোখ ঢেকে কুঁকড়ে গিয়ে মাটিতে বসে পড়তে ইচ্ছে করলো মহুয়ার। কিন্তু পারলো না সে। নড়াচড়ার একবিন্দু শক্তিও তার দেহে অবশিষ্ট নেই।
এবার পিছন দিক থেকে এসেছে অন্য একটা রাক্ষসী ফুল গাছের দুটো ডাল। দেখতে দেখতে মহুয়ার ডান পা-টা পেঁচিয়ে ধরলো দড়ির বাঁধনের মতো একটি ডাল। অপর ডালটিও এসে পড়লো। ‘খানি পা-ই পেঁচিয়ে ধরার জন্যে মুখ বঁকিয়ে এগিয়ে এলো সেই ডালটা। পেঁচিয়ে ধরে ফেললো ধীরে সুস্থে দু’খানি পা ই নির্বাধায়।
সবচেয়ে বড় ভয়, সবচেয়ে ভীষণ ভয়-মৃত্যুভয়!
মৃত্যুভয়ে চোখ দুটো কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে মহুয়ার। এমন সময় ডাল দুটোর শক্ত কঠিন টানে মাটিতে পড়ে গেল মহুয়া ধপাস করে। আরো তিনটে ডাল এগিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। পেঁচিয়ে ধরেছে সেগুলোও মহুয়ার গলার কাছে, কোমরে এবং হাঁটুর কাছটায়। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে মৃত্যু গহ্বরে!
| এতক্ষণে প্রাণে বাঁচবার আকুল ইচ্ছেটা শক্তি এনে দিয়েছে তার শরীরে। ছটফট করছে, মহুয়া। ছটফট করছে তিন-চারটে ডালের শক্ত কঠিন বাঁধন থেকে ছাড়া পাবার জন্যে। এমন সময় প্রথম ফুলগাছটার ডালগুলো পেঁচিয়ে ধরলো তাকে উল্টোদিক থেকে। সড়সড় করে ঐ ডালগুলোও এসে পড়েছে কখন যেন।
| একেই সম্ভবতঃ বলে টাগ-অব-ওয়ার!
টানা হেঁচড়া শুরু হয়ে গেল. দুটো রাক্ষসী ফুল গাছের ডালগুলোর মধ্যে মহুয়াকে নিয়ে। কোমরের উপর একটা ডালের শক্ত বেষ্টনী ক্রমেই চেপে বসেছে। কষ্ট হচ্ছে মহুয়ার। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখ। ব্যথার চোটে জল এসে গেছে চোখের কোণে। এদিকে ভেঙে যাবার দশা হয়েছে উরু দুটো। এখন আর কোনদিকেই এগোচ্ছে না মহুয়ার দেহ। দুদিক থেকে দুপক্ষের ডালের প্রবল টানে মাঝখানে স্থির হয়ে পড়ে আছে সে। শরীরের সবকটা হাড়গোড় ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছে টানা-হেঁচড়ার ফলে।
. গলার উপর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। নীল হয়ে উঠলো দেখতে দেখতে সারা মুখ। হাত দুটো এখনো ধরতে দেয়নি মহুয়া। গলাটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে প্রাণপণ শক্তিতে। কিন্তু সামান্যতম সুবিধেও করা যাচ্ছে না। ক্রমেই শক্ত হয়ে
৭৩
চেপে বসছে ডালটা গলার চারপাশে।
অক্ষুট একটা আর্তনাদ করে উঠলো মহুয়া-বা-চা-ও-আ-আ-ও! আর সইতে পারছে না সে কষ্ট। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্টে বুক ফেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে দম। নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেহ। শক্তি নেই আর সংগ্রাম করার।
আবার একবার চিৎকার করার চেষ্টা করলো মহুয়া। পারলো না। গলা দিয়ে একটুও শব্দ বের হলো না এবার।
হিস! হিস্! হিস!!!’ / ঢিলে হয়ে গেল একদিকের ডালগুলোর টানা-হেঁচড়া। গলাটা ছাড়া পেয়ে চোখ বন্ধ রেখেই নিঃশ্বাস ফেললো মহুয়া। বুক ভরে শ্বাস নিলো। তারপর হাঁপাতে লাগলো শব্দ করে। চোখ দুটো বন্ধ করেই রাখলো। কি ঘটেছে তা ভেবে দেখার শক্তিও তার নেই। কিন্তু কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই! কি ঘটলো।
ধীরে ধীরে চোখ মেললো মহুয়া। ‘ভয় নেই আর, মহুয়া! এসে পড়েছি আমি।’
কুয়াশার কণ্ঠস্বর। লেসারগানের ট্রিগার টিপতে টিপতে মহুয়ার উদ্দেশ্যে আশ্বাসের হাসি হেসে তাকালো সে |
স্বপ্ন নয় তো? মহুয়া তার দাদাকে দেখে বিশ্বাস করতে পারলো না সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু অবিশ্বাস করারও তো উপায় নেই। লেসারগান হাতে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে কুয়াশাকে রাক্ষসী ফুলগাছের ডালগুলোকে শেষ করে দেবার কাজে।
উঠে পড় এবার।’
মহুয়া এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি ব্যাপারটা। আসলে রাক্ষসী ফুল গাছ একটি বা দুটি নয়, অসংখ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে ঐ ভয়ঙ্কর পদ্মফুল এদিক ওদিক। এগিয়ে আসছে এখনো সেই সব ফুলের ডালগুলো দু’জন মানুষের সাড়া পেয়ে। কুয়াশা ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবগুলো ফুল এবং ফুলের ডালগুলোকে শেষ করে দিতে।
‘ডানদিকে সরে গিয়ে দাঁড়া, মহুয়া।’
মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে সরছিল মহুয়া। কুয়াশার কথায় দিক পরিবর্তন করে ডান ধারে পিছু হটতে, শুরু, পরলো। . সরে যাচ্ছে মহুয়া পেছন দিকে! ভুল করছে সে। আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে রয়েছে। এখনো। ভয় কাটছে না তার “কবিন্দুও। কুয়াশাকে দেখেও তার সাহস সঞ্চয় হচ্ছে না। পিছিয়ে যাচ্ছে সে অপ্রকৃতিস্থর মতো। চোখ দুটো এখনও বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে তার। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে সে। সারামুখে ভয়ের রেখা ফুটে রয়েছে। তার বিপদ-মুক্তির পরও।
থামবার কথা ভাবছে না মহুয়া। ভাবতে পারছে না সে কিছুই। কুয়াশা অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রাক্ষসী ফুলগাছগুলোর সংখ্যাহীন ডালগুলোকে মারণরশ্মি দিয়ে
৭৪
পোড়াতে। পিছু হটছে সেই থেকে মহুয়া। দূরে, বহুদূরে সরে যেতে চাইছে সে। পালাতে হবে। পালাতে হবে রাক্ষসী ফুল গাছের আওতা থেকে। স্থির, অচঞ্চল দৃষ্টি পড়ে আছে মহুয়ার সামনের দিকে। অসহায় একটা আকুতি ফুটে আছে তার চোখ-মুখে।
পিছন ফিরে হাঁটছিল সে। একবারও পিছন দিকে তাকিয়ে দেখেনি বলেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পিছন দিকে পা মচকে পড়ে গেল মহুয়া। জায়গাটা হঠাৎ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে হাত পাঁচ-সাত। পা ফসকে নিচে নেমে এলো মহুয়া মাটির উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে।
. উঁচু মতো একটা কিছুতে মাথাটা এসে ঠেকলো। গাছের গুঁড়ি বলে তো মনে হচ্ছে না? ব্যথা পেলো না সে কেন?
নিঃসাড় পড়ে রইলো মহুয়া কিছুক্ষণ। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়লে কয়েকটা। কিন্তু একি! এমন হচ্ছে কেন? মাথাটা ঘুরে উঠলো নাকি? না তো! এ যে দেখা যাচ্ছে আশ্চর্য! মাথাটা দুলছে কেন তার? নড়ছে কেন মাথাটা? আরে, ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে যে মাথাটা!
ক্লান্তি ভুলে ধড়মড় করে উঠে বসলো মহুয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে কালো সে . পিছনে। তাকাবার সাথে সাথে মাগো! বলে ককিয়ে উঠলো সে।
বিরাট একটা পাইথন সাপের দেহ। কুণ্ডলী পাকানো লেজটা দেখা যাচ্ছে শুধু। লেজটার উপরই এতক্ষণ মাথা রেখে পড়ে ছিলো মহুয়া। কুণ্ডলী পাকানো লেজটা বাইরে রেখে শরীরের প্রায় সবটাই একটা গর্তে ঢুকিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করছিল পাইথনটা। গর্ত থেকে বিশাল শরীরটা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে এখন।
| উপর্যুপরি মৃত্যুমুখে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মহুয়া। বাবার মৃত্যুভয় জাগাতে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সে। এতও ছিলো তার ভাঙা কপালে!
চেতনহারা মহুয়া বসে রইলো সেই একই জায়গায় নিঃসাড়। নিঃশ্বাস আটকে গেছে যেন তার। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে
অবিশ্বাসে সাপটার দিকে। মনে মনে ভাবছে সে- এতো ভয়ানক মৃত্যু ছিলো শেষ পর্যন্ত তার কপালে!
মহুয়া টের পেলো না নতুন আর একটা বিপদ! চার-পাঁচ জন অসভ্য জংলী ঝোঁপের পাতা ফাঁক করে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে ওর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে।
|
L
গর্ত থেকে বিরাট শরীরটা বের করে মহুয়ার দিকে ঘুরছে এখন পাইথটি। নিঃশ্বাস পড়বার শব্দ হচ্ছে হিসহিস করে ভয়াল সাপটা! ঝোঁপ-ঝাড়ের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন প্রতিটি নিঃশ্বাস পড়বার সাথে সাথে। ঘুরছে স:পটা
এখনো মহুয়ার দিকে।
মৃত্যুর দিকে নিথর তাকিয়ে আছে মহুয়া ও শক্তি পাচ্ছে না সে প!!! বার। গলায় জোর নেই কুয়াশাকে ডাকবার। মৃত্যু এবার অবধারিত বুঝতে পারছে সে।
,
৭৫
কেউ নেই যে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে তাকে।
বুকে হেঁটে এগিয়ে আসছে সাপটা। লকলকে সরু লোভাতুর জিভ বেরিয়ে পড়ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। মোটা শরীরটা সড়সড়িয়ে এগোচ্ছে এবার মহুয়ার দিকে। * শিরশির করে উঠলো মহুয়ার সর্বশরীর। বোকার মতো করুণ মিনতিভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সে সাপটার দিকে। হঠাৎ যেন একটা স্বপ্নের দৃশ্য ভেসে উঠলো মহুয়ার চোখের সামনে। পূর্ব পরিচিত হিসস’ করে একটা শব্দ কানে ঢুকলো তার। এক ঝলক চোখ ঝলসানো তীব্র আলো এসে পড়লো পাইথনটার মাথায়। ভয়ঙ্কর একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল সাথে সাথে।
অদৃশ্য হলো পাইথনটার মাথা। মুণ্ডুহীন পাইথনটা মহা-আক্ষেপে তড়পাতে লাগলো। কেঁপে উঠলো.চারপাশের বনভূমি।
নেমে এলো কুয়াশা উঁচু জায়গাটা থেকে লাফ দিয়ে। উপর থেকেই মরণরশির সাহায্যে সাপটার বারোটা বাজিয়েছে সে।
একেবারে শেষ করে ফেলা দরকার সাপটাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করে বেড়াচ্ছে সে। চারপাশের গাছ-গাছড়া উপড়ে ফেলছে শরীরের বাড়ি মেরে মেরে। মৃত্যুপথযাত্রী পাইথনটার লেজের বাড়ি যদি লাগে তবে দেখতে না দেখতে মৃত্যুর দুয়ারে হাজির হতে হবে।
মহুয়াকে উঠিয়ে নিয়ে দূরে দাঁড় করিয়ে দিলো কুয়াশা। সতর্ক হয়ে ফিরে ‘গেন সে সাপটার যতোটা সম্ভব কাছে। অপেক্ষা করতে লাগলো সে লক্ষ্য স্থির করার জন্যে। মুহূর্তের জন্যেও স্থির হতে পারছে না পাইথনটা যন্ত্রণার প্রকোপে।
মিনিট খানেক লাগালে কুয়াশার পাইথনটাকে পুড়িয়ে শেষ করতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে, এতক্ষণে। মহুয়ার দিকে ঘুরলো সে মুখে আশ্বাসের হাসি ফুটিয়ে। কিন্তু কোথায় মহুয়া!
চমকে উঠলো কুয়াশা। নেই তো মহুয়া! যেখানটায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সে সেখানে দেখা যাচ্ছে না মহুয়াকে। দ্রুত এদিক ওদিক ঘুরে তাকালো কুয়াশা। কই! কোথায় গেল আবার সে।
‘মহুয়া!’
কোনো উত্তর এলো না কোনো দিক থেকে। আবার কয়েকবার মহুয়ার নাম ধরে ডাকলো কুয়াশা। ড্রিক চিক করে ডেকে উঠলো একটা পাখি, গাছের ডাল : থেকে উড়ে যেতে যেতে। মহুয়ার সাড়া পাওয়া গেল না।
কি মনে করে একটা উঁচু মতো গাছে চড়তে শুরু করলো কুয়াশা তরতর করে; গাছটার মগডালে উঠে নিরাশ হতে হলো তাকে। উপর থেকে বনভূমি দৃষ্টিগোচর হলো না। গাছের সবুজ মাথা দেখতে পেলো সে বহুদূর অবৃদি। আরো, অনেক দূরে দৃষ্টি দিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলো সে। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে বাঁশের তৈরি গোল গোল গম্বুজ মতো। জংলী অধিবাসীদের গ্রাম ওটা।
নেমে এলো কুয়াশা ব্যস্ত হয়ে। কি করা যায় ভেবে ঠিক করতে পারছে না
৭৬
সে। উপর্যুপরি বিপর্যয় এবং ভাগ্যের বিদ্রুপে দিশেহারা হয়ে পড়ার মতো মনের অবস্থা হয়েছে তার। | কি করা যায় এখন, কি করলে মহুয়ার খোঁজ পাবে সে?
চার,
কে যেন গফুরের শার্ট ধরে আস্তে আস্তে টানছে। | সেইদিনেরই, সকাল বেলার ঘটনা। সূর্য আকাশের উপরে উঠে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু ঘুম ভাঙেনি এখনও গফুরের পুরোপুরি। তন্দ্রার আমেজ
কাটবো কাটবো করেও কাটছে না।
গতরাতে শেষবার অচেতন হয়ে পড়ে গফুর মস্ত উঁচু একটা ঢেউয়ের উপরে। চড়ে। ঢেউটা যখন লাইফবয়টাকে তীব্রবেগে উপর দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখনই জ্ঞান হারায় সে। তারপরের সব ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞ সে। ইতিমধ্যে জ্ঞান ফিরে। এলেও ঘুম ভাঙেনি তার।
‘ঢেউয়ের নাগরদোলায় দুলতে দুলতে অসভদের এই দ্বীপে উঠে এসেছিল গফুরের লাইফবয়। বালুকাবেলা পেরিয়ে লাইফবয়টা বনভূমিতে ঢুকে পড়েছিল প্রবল পানির তোড়ে। গফুরকে মাটিতে ফেলে রেখে আবার ভেসে গেছে লাইফবয়টা। সেই থেকে একভাবে এলিয়ে পড়ে আছে সে মাটির উপর।
পাতলা হয়ে এসেছে গফুরের ঘুম। অস্পষ্টভাবে টের পাচ্ছে সে কে যেন তার শার্টের কোনা ধরে টানছে ধীরে ধীরে।
চোখ না মেলেই হাত ঝাঁপটা মারলো গফুর। আটকে গেল হাতটা। কে যেন, খ করে তার হাতটা কিসের মধ্যে ভরে নিলো। কুসুম কুসু: গরম মনে হলো। হঠাৎ হাতের আঙুলগুলো। কে যেন তার আঙুলগুলো চুষছে মনে হলো। ভিজে, যাচ্ছে আঙুলগুলো পিচ্ছিল রস লেগে।
| ‘কি জ্বালাতনে পড়া গেল!’ বিড়বিড় করতে করতে অগত্যা চোখ মেলে তাকালো গফুর।
ধক করে উঠলো বুকটা চোখ মেলতেই। এ কোথায় রয়েছে সে! চারপাশে এমন জঙ্গল কেন! আর ওটা, ওটা কি জানোয়ার? কি নাম ঐ জানোয়ারটার?
ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লো গফুর মাটি থেকে। প্রথমেই দৃষ্টি পড়লো তার গায়ের শার্টের দিকে। শার্টের অর্ধেকটাই তার নেই। অদ্ভুত জানোয়ারটার দিকে চোখ ফেললো গফুর। দশ হাত দূরে লেজের উপর সম্পূর্ণ শরীরের ভর দিয়ে চারপেয়ে জন্তুটা দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের নিখোঁজ অংশটা ঝুলছে তার মুখে। এতক্ষণ তাহলে ঐ জানোয়ারটাই দাঁত দিয়ে টানছিল তার শার্টটা! কিন্তু এ আবার কেমন আজব জানোয়ার রে বাবা! চার-চারটে পা থাকতে অমন লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। থাকে কেন? দেখতে ঠিক যেন একটা ছাগল। হালকা খয়েরী রঙের পশম সারা
৭৭
গায়ে। ছাগলের মতোই আকার-আকৃতি। কিন্তু লেজটা অস্বাভাবিক মোটা এবং লম্বা। ঠিক সাপের মতো গোল আর শেষের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে।
গফুরকে কটমট করে তাকাতে দেখে মাথা নেড়ে কি যেন বোঝাতে চাইলো জানোয়ারটা। কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা-টমা চাইলো সম্ভবত। কিন্তু গফুর তার সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক বন্ধুত্ব স্থাপন করতে রাজি নয় বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে পা চারটে মাটিতে ফেললো সে। লেজটাকে শূন্যে তুলে নিয়ে চলে গেল নিরাশ হয়ে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো সব কথা মনে পড়ে গেল গফুরের। শুকিয়ে গেল তার মুখ সকলের কথা ভেবে। দিদিমণি কেমন আছে? আছেই বা কোন্ জায়গায়?
অন্ধকার মাতাল সমুদ্রে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ওরা। কারও খোঁজই সে জানে না। কে মরলো আর কে বাঁচলো তা শুধু খোদাই জানে। নাকি সে একাই বেঁচে আছে? কেন বাঁচলো সে! সেও তো ডুবে যেতে পারতো অন্ধকার সমুদ্রে। এখন সে কার জন্যে জীবন যাপন করবে? দাদামণি আর দিদিমণি ছাড়া ইহজগতে আর কেউই তো তার নেই। দাদামণি! দাদামণির কথা মনে হতেই আশার একটা আলো দেখতে পেলো গফুর। সহজে হার মানার মানুষ নয় তার দাদামণি। জীবনে হাজার হাজার বিপদে পড়েছে দাদামণি। কখনও হার হয়নি তার। ঠিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে বুদ্ধি খাঁটিয়ে। বুদ্ধি এবং সাহস আছে তার দাদামণির যে কোনো মানুষের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।
‘দাদামণি তুমি ঠিক বেঁচে আছে-আমি জানি। শব্দ করেই কথাটা শোনালো গফুর নিজেকে। তারপর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো সে। ভাবলো, দাদামণি বেঁচে থাকলে দিদিমণিও বেঁচে আছে নিশ্চয়ই। তাহলে কামালদাই বা মরবে কেন? দণি ঠিক বাঁচিয়েছে সকলকে।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো গফুর। শার্টের অর্ধেকটা অদৃশ্য হওয়াতে উঁচু ভুড়িটা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে শার্টটার জন্যে দুঃখ হলো গফুরের। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে একটা। তারপর পায়ে চলা একটা রাস্তা ধরে দিক নির্ণয় না করেই হাঁটতে লাগলো।
অভুক্ত ক্লান্ত শরীর। আধঘন্টাটাক বহু কষ্টে হাঁটলো গফুর। গত রাতের ঝড়ে যথেষ্ট নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে তাকে। পেট ভরে আছে নোনা পানিতে। নোতা নোতা ঠেকছে এখনও মুখের ভিতরটা। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পেট ভর্তি নোনা পানি থাকলে হবে কি, প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে তার। খাবার পাওয়ার আশা যে বিন্দুমাত্র নেই তা সে বেশ বুঝতে পারছে। সেই দুঃখে মনটা মরে গেছে যেন তার। তার উপর হাঁটার এই পরিশ্রম। না হাঁটলেও, চলবে
, হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। শেষ কোথায় এই গহিন জঙ্গলের? কতদূর আছে আর। লোকালয়? | যুক্তিতর্ক খাড়া করে নিজেকে শাসন করলো গফুর। মনমরা হয়ে পড়া উচিত নয়। বিপদে পড়েছে তারা। সকলকেই চেষ্টা করতে হবে বিপদ থেকে মুক্তি
,
পাবার। অন্যান্যরা যে যেখানেই থাকুক নিশ্চয় চেষ্টা করছে সবাই একটা উপায় খুঁজে বের করার জন্যে।
. আবার হাঁটতে লাগলো গফুর মন শক্ত করে। পা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। কখন থেকে। কাঁটা গাছের বাধায় নির্বিঘ্নে একপা-ও এগোনো যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা অচেনা গাছের মাথার উপর নজর পড়তে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। লাল টুকটুকে জংলী ফল ঝুলছে গাছটার ডালে ডালে। দেখতে ঠিক আঙুরের মতো। কিন্তু টকটকে লাল এগুলোর রঙ।
| দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবনা করার সময় নয় এটা গফুরের পক্ষে। মনস্থির করতে দু’সেকেণ্ডের বেশি সময় নিলো না সে। ঝোঁপ টপকে টপকে এগিয়ে গেল সে গাছটার দিকে। তারপর চড়তে শুরু করলো মোটা গাছটাকে দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরে।
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত শরীর। তায় ঘামে নেয়ে উঠেছে সে। খুবই কষ্ট হচ্ছিলো গফুরের উঁচু গাছটায় চড়তুে। এতবড় দশাসই শরীরকে গাছের উপর টেনে ভোলা যারতার কর্ম নয়। পাঁচ-সাতজন কুলি হলেই বরং কাজটা ভালভাবে সারা যেতো। যাই হোক, রসে টুসটুসে এবং রঙে টকটকে ফুলগুলোর আকর্ষণও কম নয় কিছু। খিদে মিটবে :ফলগুলো পেড়ে আনতে পারলে। গলা ভিজবে। লোকালয়ে গিয়ে পৌঁছুবার জন্যে হাঁটার শক্তি পাবে সে। তাছাড়া নতুন ধরনের একটা ফল টেস্ট করার অভিজ্ঞতাও কম লোভনীয় নয় নিশ্চয়। প্রাণপণ চেষ্টায় উঠতে লাগলো গফুর উপর দিকে।
আর সামান্য উঠতে হবে। সামনেই ঝুলছে থোক থোক ফলগুলো। হাত বাড়ালো গফুর। জিভে জল, এসে গেছে তার। শূন্য পেটটা ফোলা বেলুনের মতো আরো খালি খালি ঠেকছে। গলা ভিজে ভিজে মতো হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।
টপাটপ মুখে ফেললো গফুর তিন-চারটে জংলী ফল একসঙ্গে। কিন্তু দাঁত দিয়ে কামড় দিতেই বেঁকে গেল হাঁড়িপানা মুখটা। বিকৃত আকার ধারণ করলো গফুরের মুখমণ্ডল। খুক খুক করে ফেলে দিলো সে পরক্ষণেই কামড়ানো ফলগুলো মুখের ভিতর থেকে। ফলগুলো থুথুর সাহায্যে ধুয়েমুছে ফেলে দেবার পরও বাঁকা . চোরা হয়ে রইলো তার মুখ। বিরাম নেই এক দুণ্ডের জন্যেও তবু থুথু ফেলার। ফলগুলো আসলে জহরের জ্ঞাতিভাই-তেতো বিষ!
| তেতো ফল মুখে দিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে গাছ থেকে নেমে এলো বেচারি গফুর। ভয়ানক বিগড়ে গেছে তার মেজাজ। খেপে উঠেছে সে নিজের ভাগ্যের উপর। কিন্তু খেপে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও তো চলবে না। চেষ্টা : করতে হবে এই জঙ্গল থেকে বের হবার জন্যে। খুঁজে বের করতে হবে লোকালয়। তা না হলে সকলের অজ্ঞাতে এই জনমনিষ্যিহীন জঙ্গলে পচে মরতে হবে তাকে।
কাঁটা গাছের শয়তানি বাধা অগ্রাহ্য করে আবার হাঁটা শুরু করলো গফুর। রেগেমেগে জোরে জোরে হাঁটছিল সে। ফলে কিছুদূর যেতেই হাঁপ ধরে গেল তার।
৭৯
মন্থর হয়ে এলো চলার গতি। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেল আরো। ফল খেয়ে যে শাস্তি সে পেয়েছে তার কথা মনে পড়তে লাগলো বারবার। মনে পড়ার সাথে সাথে থুথু ফেলছে’ সে মাটিতে সশব্দে। তবু দূর হচ্ছে না মুখের ভিতরের তিতকুটে ভাবটা। ফলে মেজাজও হয়ে উঠছে ভীষণ খাটা। সঙ্গে কেউ নেই বলে রক্ষে, তা
হলে তার উপরই অকারণে খানিকটা ঝাল ঝাড়তো সে।
আর মাত্র বিশ কদম হাঁটার পর ফাঁকা মতো একটা জায়গায় এসে পড়লো গফুর। চারপাশে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকাল সে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলো সে সেদিক থেকে। কিন্তু আশা বড় পাজি জিনিস। এদিক ওদিক খানিকক্ষণ দেখে শুনে আবার জিনিসটার দিকে চোখ রাখলো সে। এবার আর চোখ ফিরিয়ে নেবার কথা মনে রইলো না তার। মুখের ভিতর থেকে তিতকুটে ভাবটা এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে কিনা।
ঝোঁপ-ঝাড়ের সঙ্গে অদ্ভুত একধরনের ছোট ছোট সবুজ গাছ দেখতে পেয়েছে।
. গফুর। গাছগুলোর পাতা বলতে একটাও নেই। বুড়ো আঙুলের মতো একধরনের মোটা এবং লম্বা বেগুন ঝুলছে ডালগুলোতে। গাছগুলোর মধ্যিখানে সরু সরু এবং বেগুনী রঙের কয়েকটা করে শিষের মতো ফুল খাড়া খাড়া ভাবে ফুটে আছে।
| পায়ে পায়ে একটা গাছের দিকে এগিয়ে গেল গফুর দ্বিধাগ্রস্ত মনে। এদেশের। বেগুন এই রকম! মনে মনে আশ্চর্য হলো গফুর। কিন্তু বেগুন-এর রঙ কালো হবে কেন? এদেশের বেগুন বোধহয় কালই হয়। গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। তারপর মনের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ঝুঁকে ছিঁড়ে নিলো একটি কালো বেগুন।
“ হুবহু বুড়ো আঙুলের মতো দেখতে জিনিসটা। উল্টেপাল্টে বেশ খানিকক্ষণ পরীক্ষা করলো গফুর। তারপর দু’হাতের আঙুল লাগিয়ে চাপ দিলো সে ফলটার দু’দিক ধরে। ফট শব্দ করে দু’ভাগ হয়ে গেল সেটা। অবাক কাণ্ড! জিনিসটার ভিতরে শাঁস বলতে কিছুই নেই। ভিতরটা শুধু ঠাণ্ডা পানিতে টইটম্বুর। দু’ভাগ হবার সাথে সাথে দু’হাতের আঙুলের ফাঁক গলে সবটুকু পানি পড়ে গেল মাটিতে। ভিজে গেছে হাতটা। হঠাৎ কি মনে করে একটা ভিজে আঙুল জিভে ঠেকালো গফুর। বাহা রে! উজ্জ্বল হয়ে উঠলো গফুরের মুখ। তেতো নয়, কোনরকম বিশ্রী ঝজও নেই। বেশ মিষ্টি পানি। একেবারে চিনির শরবতের মতো মিষ্টি। কিছুটা ভিটাকোলার মতো স্বাদও পাওয়া যাচ্ছে। আর খুবই ঠাণ্ডা। রায়শার বাজারের হাবলাদের দোকানের বরফ দেয়া শরবতের মতো’।
| এক ঢোক পানির জন্যে ছাতি ফেটে যাবার দশা হয়েছে গফুরের। এবার আর ঠকবার কোনো প্রশ্ন নেই। সুতরাং শুভ কর্মে বিলম্ব কেন। ফট ফট করে ছিঁড়ে নিলো সে কালো রঙের সেই জংলী ফল গোটা চার-পাঁচ। বলাই বাহুল্য, তারপর গফুর একটি একটি করে ফাটিয়ে সেগুলোর ভিতরের সবটুকু পানি খেতে লাগলো মহা তৃপ্তির সঙ্গে।
| সেই সুস্বাদু পানি খেয়ে পেট ভরে গেল গফুরের। ছেঁড়া শার্টটা ভেদ করে
৮০
উড়িটা উঁচিয়ে উঠলো আরো বেশি করে। প্রশান্ত মনে আবার হাঁটতে লাগলো সঁকা মতো জায়গাটা পেরিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে। এর ঠিক মিনিট দেড়েক পর হু দুটো কুঁচকে উঠলো তার–জ্বর আসছে নাকি ওর বাবা। * পঁড়িয়ে পড়লো গফুর। কি যেন অনুমান করা চেষ্টা করলো সে। কি যেন হচ্ছে তাৰু, কি সুক যেন একটা পরিবর্তন আসছে তার শরীরে। ও কিছু না। হয়তো, মনে মনে ভাবলো পফুর। তারপর হাঁটতে লাগলো আবার। কিন্তু তিন-চার কদম এগোতে না এগোতে সে বুঝতে পারলো সত্যিসত্যি তার শরীর ক্রমশ তেতে উঠছে। আর কেমন যেন দুলে দুলে উঠছে, পৃথিবীটা চোখের সামনে। মাটি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেসামাল হয়ে পড়লো গফুর। কালো বেগুনের রস খেয়ে মাতাল হয়েছে সে। আদতে ঐ পানিটুকু এক ধরনের জংলী মাদক-রসই।
শরীর টলতে লাগলো পরের। পা কাঁপতে লাগলো। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু হয়ে এলো দেখতে না দেখতে। দৃষ্টি হলো ঝাপসা ঝাপসা। আর শরীরটা ক্রমশই গরম { হয়ে উঠতে লাগলো।
| ‘একি রে বাবা, এমন হচ্ছে কেন!’ জড়িয়ে জুড়িয়ে কথাটা উচ্চারণ করলো গফুর আপনমনে। তারপর মাতালের মতো এঁকেবেঁকে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।
“মিনিট দশেক ধরে হেঁটেও সেই জায়গা থেকে দূরে কোথাও যেতে পারলো না পফুর। হাঁটছে সে, হাঁটার বিরাম নেই এতটুক, কিন্তু দু’পা সামনে গিয়ে আবার ডান দিকে সরে আসছে দু’পা। তারপর পিছন হটছে আরো দু’পা। অর্থাৎ একই জায়গায় ঘুরছে সে কেবল মাতাল অবস্থায়। মাতালের দৃষ্টি যেমন হয় তেমনই হয়েছে গফুরের। সাদাটে ধোয়ার একটা পর্দা পড়েছে তার চোখের সামনে। একটা গাছকে সে দশটা গাছ দেখতে পাচ্ছে। দৃষ্টিভ্রম আর বলে কাকে।
বেশ খানিকক্ষণ এভাবে কাটাবার পর গফুর দেখলো কালো রঙয়ের ইয়া বড় বড় কি যেন এগিয়ে আসছে দশ-বারোটা। প্রথমে সে ভাবলো ব্যাপারটা চোখের ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। চোখ দুটো ভালো করে কচলে নিয়ে আবার তাকালো সে, না, চোখের ভুল নয়তো! ওই তো গুটিগুটি এগিয়ে আসছে দূর থেকে হেলতে দুলতে কালো কালো কি যেন। মোষ নাকি? কিন্তু এতগুলো মোষই বা হঠাৎ আসবে কোথা থেকে?
টলতে টলতে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে রইলো গফুর মাটির উপর। রীতিমত ভয় পেয়েছে সে। মনে মনে চিন্তা করার চেষ্টা করছে সে, এখন তার কি করা
উচিত।
আরো কাছে এগিয়ে আসছে কালো কালো জানোয়ারগুলো। ঝুঁকে পড়লো গফুর মাটির দিকে। কাঁপা হাতে অন্ধের মতো ইট বা একটা পাথর খোঁজার চেষ্টা
. করছে সে। একটা বড় গাছের গুঁড়ি ধরে ফেললো সে। গুঁড়িটাকেই সে বড় একটা ৬- ০
পাথরের টুকরো মনে করে টানাটানি শুরু করে দিলো। যখন কোনমতেই পারলো
গাছের গুঁড়িটাকে ওঠাতে তখন হাল ছেড়ে দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়ালো আবার সে। দাঁড়িয়েই সে দেখতে পেলো কালো মোষের মতো জানোয়ারগুলো অনেকটা এগিয়ে এসেছে কাছে। লাল টকটকে তাদের হিংস্র চোখগুলো। চুঁচালো মুখ। ছোরার ফলার মতো চকচকে ধারালো দাঁত দু’পাটি—-গ করে গর্জন করছে জানোয়ারগুলো গফুরের দিকে তাকিয়ে।
আবার মাটিতে ঝুঁকে পড়লো গফুর। এবার সে একটা পাথরের টুকরো পেয়ে গেল ভাগ্যগুণে। পাথরটা সিধে ছুঁড়ে মারলো সে সামনের জানোয়ারটাকে লক্ষ্য। করে। বাহ! অব্যর্থ লক্ষ্য। একটি মাত্র ছোটো পাথর ছুটে গিয়ে সবকটা জানোয়ারের দাঁতে গিয়ে আঘাত করলো। ভেঙে গেল সবকটা দাঁত একটি একটি করে প্রত্যেকেরই। মুখের কশ বেয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলো দরদুরিয়ে।
| ছেঁড়া শার্টে অর্ধেকটা উঁড়ি ঢেকে মাতাল গফুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ক্যাবলার মতো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এমন সময় সেই জানোয়ারগুলো তেড়ে আসতে শুরু করলো আবার। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে গফুর। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পেটে এসে গুতো মারলো জানোয়ারগুলো একসঙ্গে। বুঝতে, পরে পিছিয়ে গিয়েছিল বলে এ যাত্রা অল্পের মধ্যে দিয়ে ফাড়াটা কেটে গেল। তা না। হলে নাড়িভূঁড়ি বের হয়ে পড়তো এক ঔতোতেই। পেটের চামড়া ছড়ে গিয়ে জ্বালা করে উঠলো। আবার গর্জন করে এগিয়ে আসতে লাগলো জানোয়ারগুলো। এতো বিপত্তিতে তো আর মাদক-রসের প্রতিক্রিয়া নষ্ট না হয়ে পারে না। নেশা কেটে গেল গফুরের। সংবিৎ ফিরে পেলো সে। চোখের ঝাপসা দৃষ্টি এবার স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সরে গেল চোখের সামনে থেকে সাদাটে ধোয়া। তারপরই পিছন ফিরে ছুট লাগালো সে প্রাণপণ শক্তিতে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার নিজের * বোকামির কথা ভেবে। সব কথা দাদামণি জানতে পারলে ঠিক তার কান দুটো আচ্ছামত ডলে দেবে। ওহ! জানোয়ার বলতে মোষও নয়, অনেকগুলোও নয়। কালো রঙের জানোয়ার ওটা-একটাই। বুনো ভালুক একটা। নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে গফুর এতোক্ষণ একটি ভালুককেই অসংখ্য এবং আজব জানোয়ার হিসাবে। দেখছিল।
সবকটা দাঁত বের করে পিছন পিছন লাফাতে লাফাতে আসছে ভালুকটা। ছুটছে গফুর। পালাতে হবে। তা না হলে ছিঁড়েখুঁড়ে তার বারোটা বাজিয়ে দেবে জানোয়ারটা।
কিন্তু কতক্ষণ একটানা দৌড়ুননা সম্ভব। পথটা তো সরু বটেই, তাছাড়া দু’দিক থেকে কাঁটা গাছের ডালগুলো বেরিয়ে বাধার সৃষ্টি করছে চলার পথে। কাপড়ে বেধে যাচ্ছে কাটা। রক্ত ঝরছে পা কেটে গিয়ে। হাঁপাচ্ছে সে। ঘামছে। দরদর করে আর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গালাগালি করছে নিজের বোকামিকে।
‘দাদামণি থাকলে মজা টের পেতি, ব্যাটা!’ ভালুকটার উদ্দেশ্যেই শাসানি ৮২
বাক্যটা ব্যবহার করলো গফুর। কিন্তু শুনবে কেন বুনোন্টা। লাফাতে লাফাতে আসছে সে এখলে। গফুর পিছন দিকে তাকাতেই মুখ ভেংচে নিচ্ছে একবার করে। বিশ্রী ভঙ্গিতে। গতি কমে এসেছে এবার গফুরের। দৌড়ুতে পারছে না সে এখন আগের মতো। বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে সে। দেখছে আর কতটা দূরে সাক্ষাৎ যমদূত।
বারবার পিছন ফিরে তাকাবার ফলে সরু পায়ে-চলা রাস্তাটা থেকে অন্যদিকে সরে গেল গফুর। ঝোঁপঝাড় টপকে টপকে খানিকটা যাবার পর সামনে এগোবার উপায় দেখতে পেলো না সে আর। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা উঁচু গাছ। একেবারে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।
২ ভালুকটার কেবল মাথা দেখা যাচ্ছে এখন। ঝোঁপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তার বিশাল লোমশ শরীরটা। চাপা একটা গর্জন শোনা যাচ্ছে। নাছোড়বান্দার মতো ছুটে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদৃত। .
| নিরুপায় হয়ে দু’সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলো গফুর। প্রথমে তার ইচ্ছে হলো এখানেই বসে পড়ে হাউ-মাউ করে ককিয়ে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু না। তা না করে এক বুদ্ধি করলো গফুর। সামনের গাছটার দিকে তাকালো সে। তারপর আর সময় নষ্ট না করে চড়তে শুরু করলো গাছটার কাণ্ড বেয়ে।
| প্রাণের মায়া বড় মায়া। গাছে চড়ার অভ্যেস কোনদিনই ভালো করে রপ্ত করেনি গফুর। প্রকাণ্ড শরীরটাই এ ব্যাপারে তাকে বিফল করে এসেছে সবসময়। কিন্তু আজ বিপদে পড়ে; মাত্র একবারের চেষ্টাতেই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গেছুঁড়ে হিসাবে প্রমাণিত হলো সে। তরতর করে উঠে পড়লো গফুর গাছের উপরে। ঠিক
তখুনি বুনো ভালুকটা গাছের নিচে এসে হাজির হলো।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মুখ ভেংচালো ভালুকটা গফুরকে। কিন্তু এবার কম গেল না গফুরও। গাছের উপর চড়ে বসে আছে সে, এখন আর তয় কি? কাছেপিঠে থেকে কেউ যখন গফুরকে লক্ষ্য করছে না, তখন শুধু শুধু সঙ্কোচ করার মানে হয় না। দাঁত-জিভ বের করে, মুখ বাঁকিয়ে, ঠোঁট উল্টে খুব করে মুখ ভেংচে দিলো সে-ও। গফুরের তিকিমাকার মুখ বিকৃতি দেখে ভালুকটাও রীতিমত লজ্জা পেলো। রেগে গেল
সে তারপর।
রাগে গরগর করতে করতে কয়েকবার চক্কর মারলো ভালুকটা গাছটাকে কেন্দ্র করে। তারপর গফুরের পিলে চমকে দিয়ে একটা হুঙ্কার ছেড়ে গাছের উপর চড়ার জন্যে দু’পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ালো। গফুর অবশ্যি তখন গাছের মগডালে উঠে গেছে।
“আরে! শয়তানটা দেখছি. গাছে চড়তে চায়! | বুক থেকে সবটুকু আশা উবে গেল গফুরের। দেখতে না দেখতে বেশ খানিকটা উপরে উঠে পড়লো গেছো ভালুকটা। অসহায় গফুর ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। একটু পর বোকার মতো তাকালো সে এদিক-সেদিক
সাহায্যের আশায়। মাথা ঝিমঝিম করছে তার। ধুকপুক করছে বুকের ভিতর। * বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তার দাদামণির কথা।
‘আছাড় মেরে জাহান্নামে পাঠাতো তোকে দাদামণি…’
কথাটা শেষ করতে পারলো না গফুর। অভিমানে গলা বুজে এলো, তার। ছলছলিয়ে উঠলো চোখ দুটো। মনে মনে সে বললো, “দাদামণি, আমি যে মরণের
মুখে পড়েছি…হারামজাদাটা আমার কথা শুনতে চাইছে না মোটে…’
একটা ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে উপর দিকের অন্য একটি ডালের দিকে লাফ দিচ্ছে ভালুকটা। এমনি করেই এগিয়ে আসছে সে গফুরের দিকে। বেশি নিচে নেই
সে আর। মাত্র দুটো ডাল উপরে বসে প্রাণভয়ে কাঁদছে গফুর।
আবার একবার ঝুলতে ঝুলতে লাফ দিলো ভালকটা। আরো একটি ডাল উপরে উঠলো সে। আর একটিবার লাফ দিলেই ধরে ফেলবে ভালুকটা গফুরকে। দেখতে হবে না আর, খামচে ধরবে ভয়াল জানোয়ারটা তাকে। ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে ফেলবে।
| কি যেন ভাবলো গফুর। মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করলো, দাদামণি হলে এক্ষেত্রে কি করতে। নিরাশ হলো গফুর। দাদামণি এক্ষেত্রে কি করতো তা সে বুঝতে পারলো এক কণা সময় চিন্তা করেই। রিভলভার দিয়ে খতম করতো, না হয়, লড়াই করতে শুরু করে দিতে আস্তিন গুটিয়ে। কিন্তু সে ওসব পারবে কেন? সে তো আর দাদামণি নয়। দাদামণির সেবক সে। তার উচিত…
বুদ্ধি খুলে গেল গফুরের হঠাৎ। চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। কি করা উচিত তার গা সে জেনে ফেলেছে। একটার পর একটা গাছ ‘দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। এক গাছের ডাল অন্য গাছের ডালের সঙ্গে লেগে আছে গায়ে গায়ে। গফুর বুঝতে পারলো এক গাছ থেকে অন্য গাছে সরে না গিয়ে আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই তার। পালানোই এখন ধর্ম আত্মরক্ষার জন্যে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে সে এখন। তারপর দেখা যাবে।
এতসব কথা ভাবতে ক’সেকেণ্ড মাত্র সময় লাগলো। পাশের একটা গাছের শক্ত ডাল ধরে ঝুলে পড়লো সে। দুলতে দুলতে আর একটি ডালে পা রাখলো সে। তারপর ডাল ধরে ধরে বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেল সে টলটলায়মান পা ফেলে ফেলে। কিন্তু খুব একটা ফল হলো না তাতে। বুনো ভালুকটাও কম যায় না তার চেয়ে। এবার আর তাকে ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে হলো। না। কাছাকাছি ডাল পাচ্ছে সে অসংখ্য। সেই ডালগুলোর উপর পা ফেলে এদিকের গাছটায় চলে এলো সে। মুখ ভেংচে নিলো আবার একবার গফুরের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু গফুর, এবার মুখ ভেংচালো না দেখে খুশি হলো সে। ফলে আর একবার দাঁত-মুখ দেখালো সে গফুরকে। কিন্তু গফুরকে নিস্তেজ ভেবে ভুল করেছিল সে। কথা আছে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। ঠিক তাই ঘটলো।
, এবার আর মুখ ভেংচালো না গফুর। মুখ ভেংচাবার কথা দাদামণি জানতে ৮৪
:
পারলে-সেটা লজ্জার ব্যাপার হবে। কেউ না বললেও, সে যখন সব কথা তার দাদামণিকে বলবে তখনই প্রকাশ হয়ে পড়বে এই মুখ ভেংচাবার কথাটা। মিথ্যে কথা বলতে পারে না সে তার দাদামণিকে-হুঁবহু, সব বলে ফেলে। যা হবার হয়েছে, আর নয়। এবার সে ভালুকটার মুখ ভেংচাঁনির জবাবে প্রথমে বুড়ো আঙুল দেখালো-অর্থাৎ কলা খাও! তারপর পৃথিবীর একমাত্র বুদ্ধিমান জীব সে, সে একজন মানুষ এই কথা ভালুকটাকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে ব্যঙ্গ করে বললো তুই তো একটা জানোয়ার বই আর কিছু না! জানোয়ার, জানোয়ার!
কথাটা বলে গফুর বুঝতে পারলো খানিকটা সময় ফালতু খরচ হয়ে গেল। উঠে আসছে আবার জানোয়ারটা। পালাতে হবে আবার অন্য একটা গাছে।
জমে উঠেছে খেলাটা! | সেই থেকে এক গাছ থেকে অন্য গাছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে গফুর। আর হাত জোড় করে মাঝে মাঝে বলছে সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে, রেহাই দুে সোনা ভাই আমার, ছেড়ে দে! হার মানছি তোর কাছে বাপ! আমার দাদামণি নেই কাছেপিঠে, তা না হলে তোর… | বাপ-ভাই কিছুই বলতে বাকি রাখছে না বেচারা গফুর জানোয়ারটাকে। কিছুক্ষণ আগে ভালুকটাকে জানোয়ার বলেছিল, তা সে বেমালুম ভুলে বসেছে।
এদিকে গফুরের কথার কোনোই মূল্য দিচ্ছে না ভালুকটা। কান পেতে শুনছে বটে সে গফুরের নাটকীয় ডায়ালগ। কিন্তু সে থামতেই গর্জন করে উঠছে গোঁ গোঁ করে। তারপর অভ্যাসবশতঃ মুখ ভেংচায়, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে। আবার এগিয়ে আসতে থাকে গফুরের দিকে, গফুরকে পাকড়াবার জন্যে। ইচ্ছাটা তার অতি পরিষ্কার।
ভবিতব্যই বলতে পারে এই ভয়ঙ্কর খেলা কতক্ষণ চলবে।
পাঁচ
ঐ একই দিনের ঘটনা। | নিরাশ হলো শহীদ। পাথরটার পাশ দিয়েই চলে যাবে তার লাইফবয়টা। ঠেকবে না গায়ে। উপায় নেই, সাঁতার কাটতে হবে কিছুটা। তা না হলে আবার মাঝ সমুদ্রে ভেসে যাবে লাইফবয়। .
সকাল হয়েছে সবে মাত্র। আকাশে ছাই রঙের মেঘের মিছিল। চারপাশে, হালকা কুয়াশা। সমুদ্র এখন সুবোধ বালক। কোনোই চঞ্চলতা নেই। ডান দিকে বড় বড় পাথরের খণ্ড পানির উপর মাথা তুলে রয়েছে। তারপরেই খাড়া একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সোজা উঠে গেছে পাহাড়টা সমুদ্র থেকে সোয়াশো-দেড়শো ফিট। কালো পাথরের গা, পিচ্ছিল। সকালবেলার রোদ লেগে চকচক করছে ভিজে
পাহাড়টা। কি আছে পাহাড়টার ওপাশে?
৮৫
. একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শহীদ পাহাড়টার দিকে। না, পাহাড়টার ওপাশে কি আছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
অজ্ঞাত এক দ্বীপের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে শহীদের লাইফবয়টা। মনস্থির করে ফেলেছে শহীদ করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে। লাইফবয়টা টেনে নিয়ে চললো সে। সঁতরে গিয়ে উঠলো সামনের একটা বড় পাথরের উপর। বুক’ ভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মহুয়ার কথা মন থেকে মুহূর্তের জন্যেও সরাতে পারছে না সে। কোথায় গেল মহুয়া? কোন্দিকে ভেসে গেল সে? বেঁচে আছে
তো? নাকি, সমুদ্রের অতলতলৈ হারিয়ে গেছে চিরতরে, তাকে ফাঁকি দিয়ে?
কুয়াশা যাচ্ছিলো বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক Kotze-কে সাহায্য করতে। কুয়াশারই অনুরোধে তার সঙ্গী হয়েছিল শহীদরা। কিন্তু এ কি চরম সর্বনাশ ঘটে গেল পথিমধ্যে! বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের প্রবল-পরাক্রান্ত শত্রু বঙ্গোপসাগর থেকেই “সৈনিকের পিছু নিয়েছিল। কুয়ালালামপুর এবং বোর্নিও পার হয়ে আসার একদিন পর টর্পেডো মেরে ফুটো করে দিলো সৈনিকের তলা। তার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ভয়ঙ্কর তুফান। আত্মরক্ষার তাগিদে পানিতে নেমে পড়েছিল ওরা লাইফবয় নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সমুদ্রের মত্ত স্রোতে পড়ে ভেসে গেল একের পর এক সকলে বিশাল সমুদ্রের কোথায় কে জানে। তাদের জলযানু সৈনিককেও ডুবে যেতে দেখেছিল শহীদ বিদ্যুৎচমকের আলোয়। সৈনিকে কুয়াশা এবং মি, সিম্পসন ছিলো তখনও। তাদের অবস্থাই বা কি হলো? বেঁচে আছে না ডুবে গেছে
সৈনিকের সঙ্গে?
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো শহীদের সব কথা মনে পড়ে যেতে। পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে বসে রইলো সে পাথরটার উপরে অনড়।, এক মিনিট কাটলো। দু’মিনিট, তিন মিনিট কাটলো। তারপর নড়েচড়ে উঠলো শহীদ। ভাবনা চিন্তা করে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং সামনের ওই পাহাড়টায় আশ্রয় নেয়া ভালো। বলা যায় না, পাহাড়টার ওপাশে হয়তো একটা বড়সড় দ্বীপ আছে। হয়তো সেই দ্বীপে আছে মানুষের বাস। মনুষজন থাকলে খাদ্য আছে। জলযানও হয়তো থাকতে পারে। চেষ্টা করলে তবু সে একদিন না একদিন দেশে ফিরে যেতে পারবে। তাছাড়া আর সকলের খোঁজ নেবার উপায়ও তখন একটা বের করা যাবে। কে কে বাচলো আর কে মারা গেল সেটা ভালো করে খুঁজে না দেখলেই নয়। বলা যায় না, তার মতো কেউ কেউ বেঁচে যেতেও তো পারে। তার লাইফবয় যেমন ভাসতে ভাসতে একটা দ্বীপের কাছাকাছি এসেছে; তেমনি ওদেরও কারো কারো লাইফবয় জোয়ারের টানে ভাসতে ভাসতে কোনো এক দ্বীপ গিয়ে ঠেকতে পারে। খুবই সম্ভব সেটা। সুতরাং চেষ্টার ত্রুটি করলে চলবে না। | খুঁজে বের করতেই হবে ওদেরকে।
| জোয়ারের সময় এখন। সাঁতরে যেতে হবে পাথরগুলোর পাশ কাটিয়ে পাহাড়টার কাছে। খুব একটা অসুবিধে হবে না জোয়ারের সময় সঁতরাতে। ৮৬
.
অনেকগুলো পাথরের মাথা দেখা যাচ্ছে ছাড়া ছাড়া ভাবে পানির উপরে। সব শেষের পাথরটা পার হবার পর পাহাড়ের গায়ে গিয়ে পৌঁছুনো যাবে। তারপর চেষ্টা করতে হবে পাহাড়টার খাড়া শরীর বেয়ে উপরে ওঠার। কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। | দেরি করার মানে হয় না। হোলস্টারটা কোমরের সঙ্গে আঁট করে বাঁধা আছে কিনা দেখলো শহীদ। তারপর পাথরটার উপর উঠে দাঁড়ালো সে। স্বচ্ছ ফটিকের মতো সমুদ্রের পানি। ‘তল দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। না, কোনো জলচর জানোয়ার কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না। নেমে পড়লো শহীদ পানিতে।
ডুব সাঁতার দিলো শহীদ। একদমে বিশহাত দূরে গিয়ে মাথা তুললো সে। সামনের পাথরটা আকারে বেশ বড়। এক ডুবেই অর্ধেকটা দূরত্ব পার হয়ে এসেছে সে। আবার মাথা নোয়ালো পানির নিচে। তারপর আবার যখন মাথা তুললো তখন পাথরটা মাত্র হাত তিনেক দূরে।
| পাথরটা পেরিয়ে গেল শহীদ। থামলো না। যতক্ষণ ক্লান্ত হয়ে না পড়ে ততক্ষণ বিশ্রাম নেবে না ঠিক করলো শহীদ। ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটা পাথর ধরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেই চলবে।
গোটা পাঁচেক পাথর অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শহীদ। কিন্তু তখন সে পঞ্চম পাথরটাকে ছাড়িয়ে বেশ খানিকদূর চলে এসেছে। সামনেও দেখা যাচ্ছে একটা পাথর। চল্লিশ হাত দূরে সেটা এখনও। শহীদ ভবিলে, রিস্কটা না নেয়াই উচিত ছিলো। হাঁপিয়ে গেছে সে রীতিমত। এমনিতেই দুর্বল শরীর। তায় ক্ষুধার্ত। সারারাত সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে লাইফবয়ের উপর টিকে থাকার জন্যে। মাতাল সমুদ্র মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নিতে দেয়নি। এই শরীর নিয়ে এতদূর সাঁতরে আসা কম কথা নয়।
আরো হাত পাঁচেক এগিয়েছে শহীদ। চিৎ সাঁতার দিচ্ছে সে। আকাশের দিকে মুখ করে শরীরটাকে যথাসম্ভব হালকা করে দিয়ে এগোচ্ছে সে। নার্ভাস হয়ে পড়লে চলবে না। পৌঁছুতেই হবে সামনের পাথরটার কাছে। কিন্তু, এ কি! কি ব্যাপার! কে
জড়িয়ে ধরতে চাইছে তার পা দুটো? আক্টোপাস নাকি? সামুদ্রিক লতা নয়তো? নাকি তার মনের ভুল? :
| শিরশির করে উঠলো শহীদের আপাদমস্তক। কে যেন একটা মহাবিপদের সঙ্কেত. ধ্বনি বাজিয়ে গেল তার কানে কানে। সচেতন হলো শহীদ। পা দুটো গুটিয়ে নিয়ে উপুড় হলো সে। পিছন ফিরে তাকাবার আগেই আবার একবার স্পর্শ পেলো সে কিসের যেন। পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে তার পা দুটো।
. পিছনে তাকিয়ে সময় নষ্ট করলো না শহীদ,। বিপদের গন্ধ নাকে ঢুকেছে তার। ক্লান্তির কথা ভুলে যেতে হলো তাকে। প্রাণ বাঁচাতে হবে প্রাণপণ শক্তিতে সঁতরে চললো সে। কিন্তু এই মুহূর্তে পলায়ন শহীদের ভাগ্যে ছিলো না। ধরা পড়ে গেল, সে শক্ত বাঁধুনিতে।
।
।
–
|
জানোয়ারটাকে না দেখেও অনুমানে বুঝতে বাকি রইলো না শহীদের কিছু। আটপেয়ে মাঝারি গোছের একটা অক্টোপাস। সাপের মতো গোল এবং মোটা আর, লম্বা আটটি পায়ের একটি শহীদের হাঁটু জোড়া পেঁচিয়ে ধরেছে শক্ত করে। গতিরুদ্ধ হলো শহীদের। অক্টোপাসটা তার মুখের কাছে টেনে নিয়ে যাঙ্গে শহীদকে। পানির নিচে ডুবে গেল শহীদের মাথা। পাঁচ পা মাটিতে নামালো অক্টোপাসটা। এক পায়ে ধরে আছে শহীদের হাঁটু জোড়া। বাকি দুটো এপিয়ে আসছে আক্রমণের জন্যে। একটা শহীদের গলায় চেপে বসে শ্বাসরোধ করা মতলব আঁটছে। অন্যটা কোমর পেঁচিয়ে ধরবে।
ধস্তাধস্তি করে কোনো লাভই হবে না বুঝতে পারলো শহীদ। পানির জগতে বাস অক্টোপাসের। সে ডাঙার মানুষ। আপনা গলিমে কুত্তা ভি রাজা। অনেক বেশি জোর পানিতে ওর। বুদ্ধি এবং কৌশলে ছাড়া পেতে হবে। অস্ত্রও দকার। এদিকে গলা পেঁচিয়ে ধরার আগেই যা করবার করতে হবে তাকে।
| হাত দুটো মুক্ত আছে এখনো। হোলস্টারে রাখা রিভলভারের কথা ভোলেনি শহীদ। ডান হাতটা হোলস্টারের দিকে বাড়ালো সে। রিভলভার ছোঁয়ার আগেই মাটির স্পর্শ পেলো সে। ধস্তাধস্তি করে বাঁচা যাবে না তা ঠিক, কিন্তু হাত-পা ছুঁড়তে কসুর করছে না শহীদ। অবশ্য তার ফলে অক্টোপাসটা তাকে ছাড়ছে না, ছাড়বে না শত হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করলেও কিন্তু পুরোপুরি কাবু করার সুযোগও পাচ্ছে না সে শহীদকে। হোলস্টারে হাত দিতেই ছোরাটার কথা মনে পড়ে গেল শহীদের। বেল্টের সঙ্গে একটা খাপ তৈরি করা আছে। ছোরাটা রাখা আছে সেই খাপে। রিভলভার বের না করে ছোরাটাই টেনে নিলো শহীদ। কিন্তু ইতিমধ্যেই অক্টোপাসটা কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে তার। অবশ্যি গলাটা পেঁচিয়ে ধরার কায়দা। ঠিক মতো করে উঠতে পারেনি এখনও। এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুঁড়ছে শহীদ। এদিকে দম রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। মনে হচ্ছে গলার কাছে একটা টাইমবোমা আটকে গেছে। ফেটে গিয়ে বুক আর গলা উড়িয়ে দেবে এখুনি।
কোমরে চেপে বসেছে বাঁধনটা। অক্টোপাসের সেই পায়েতেই আমূল বসিয়ে দিলো শহীদ ছোরাটা। তারপর ছোরাটা তুলে না নিয়ে জোরে চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেল যতদূর সম্ভব। চিরে গেল হাতখানেক জায়গা গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। রক্তে লাল হয়ে উঠলো স্বচ্ছ পানি।
| এভাবে বিশেষ সুবিধা করা যাবে না বুঝতে পারলো শহীদ। বিশেষ কোনো লাভই হলো না ছোরার আঘাত করে। ছোরাটা এবার তুলে নিয়ে শক্ত করে চেপে, ধরে রাখলো সে। সুযোগ চাই একটা। অক্টোপাসটার চোখে বসাতে হবে ছোঁয়ার ফলা। তবেই কাজ হাসিল হতে পারে। ধস্তাধস্তি শুরু করলো শহীদ আবার। কোমরের পা-টা জখম হওয়ায় তেমন শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরা সম্ভব হচ্ছে না আর অক্টোপাসটার পক্ষে। মাটি থেকে উপরের দিকে ওঠবার চেষ্টা করলো শহীদ। এলোমেলো ভাবে ছোরা বসাচ্ছে সে সুযোগ পেলেই যত্রতত্র।
৮৮
*
|
–
–
. মরিয়া হয়ে উঠেছে জন্তুটা। তৰে মাটি ছেড়ে উপর দিকে উঠতে বাধ্য হয়েছে সে। শহীদের হাত-পা ছোঁড়ার চোটে স্থির ব্যয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সবকটা পা দিয়ে আক্রমণ করছে এবার সে। অতি কষ্টে মাথাটা পানির উপর তুললো শহীদ। বুক ভরে বাতাস নিয়ে আবার পানির নিচে ডুব দিলো সে। পানির নিচে এসেই শরীরটা ঢিলে করে দিলো শহীদ। অক্টোপাসটা ভাবলো শত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটাই চাইছিল শহীদ। ছোরাটা উঁচিয়ে তৈরি হয়ে রইলো সে।
| সাহস বেড়ে গেছে আক্টোপাসটার। ছোরাবিদ্ধ শরীরের ব্যথা ভুলে আটটা পা। দিয়ে জড়িয়ে ধরে ধীরেসুস্থে শহীদকে নিজের শর্ক্সীরের ভিতর টেনে নিতে শুরু করলো সে।
| আটটা পা দিয়েই ঘিরে ফেলেছে অক্টোপাসটা শহীদকে। অপেক্ষার ইতি হয়েছে এতক্ষণে। মুখের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে খাবলা মারার তোড়জোড় এখন শুধু।
ঢিল করে দিয়েছে শহীদ নিজেকে। মুখ থেকে হাতখানেক দূরে থাকতে সে বুঝলো সময় হয়ে গেছে। তৈরি হয়েই ছিলো সে আগে থেকে। বাগিয়ে ধরা ছিলো ছোরাটা। হঠাৎ উঁচিয়ে ধরা ছোরাটা তীব্রবেগে বসিয়ে দিলো অক্টোপাসটার ডানদিকের চোখে। অব্যর্থ লক্ষ্য।, ফিনকি দিয়ে খানিকটা আঠালো রস এসে লাগলো শহীদের মুখে। ঝাপসা হয়ে গেল সামনের দিকটা। ছোরাটা তুলে নিয়ে আবার আক্রমণের জন্যে তৈরি হচ্ছিলো সে। কিন্তু অক্টোপাসটার অপর চোখটি দেখতে পাচ্ছে না শহীদ। আন্দাজ করে মারবে নাকি? ভাবলো শহীদ। কিন্তু এমন সময় সে টের পেলো অক্টোপাসটা একটা চোখ হারিয়ে ছটফট করছে অসহ্য-যন্ত্রপায়। বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিচ্ছে সে শহীদকে।
দু’সেকেণ্ডের মধ্যে উল্টোদিকে ফিরলো শহীদ। এই সুযোগ। পালাতে হবে যমের হাত থেকে। যন্ত্রণাটা সয়ে এলেই চতুণ শক্তিতে আক্রমণ করবে আবার শয়তানটা। তার আগেই সরে যেতে হবে নিরাপদ দূরত্বে। মানে সামনের পাথরটার উপরে গিয়ে উঠতে হবে শহীদকে। তবেই এ যাত্রা রক্ষা পাবার আশা করা যায়।
সঁতরাতে লাগলো শহীদ প্রাণপণে। হাত দশেক দূরে এখনো পাথরটা। ঘাড় বাঁকিয়ে পিছন দিকে তাকালো সে এরইমধ্যে একবার। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো পানিতে স্পষ্ট দেখলো শহীদ আবার পিছু পিছু ছুটে আসছে অক্টোপাসটা আট পায়ে সাঁতার কেটে। ধক করে উঠলো শহীদের বুকটা। যুদ্ধ করার মতো শক্তি আর এক বিন্দুও অবশিষ্ট নেই তার শরীরে। অক্টোপাসটা এবার যদি তাকে ধরে ফেলে তবে নির্ঘাৎ অকালমৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু মরলে চলবে কেন। যেমন করেই হোক, ধরা পড়ে যাবার আগেই গিয়ে উঠতে হবে তাকে পাথরটার উপরে।
পিছন দিকে তাকালো না শহীদ আর। ডুব দিয়ে সঁতরে চললো সে দম বন্ধ
৮৯
করে। আর পাঁচ হাত। কিন্তু অক্টোপাসটা এসে পড়েছে কাছাকাছি। আর মাত্র তিনহাত। অক্টোপাসটা ছুঁয়ে ফেললো প্রায় শহীদের ডান পা-টা। দাঁত দিয়ে চেপে রেখেছে শহীদ. ছোরাটা। কিন্তু ছোরাটা হাতে না নিয়ে হঠাৎ সে ডিগবাজি খেয়ে সরে গেল ডান দিকে খানিকটা। অক্টোপাসটাও গতি পরিবর্তন করলো নাছোড়বান্দার মতো। আবার পাথরটার দিকে এগোলো শহীদ। ধরে ফেলেছে শহীদ পাথরটা।
শক্ত করে চেপে ধরলো শহীদ পাথরটার গা। ছোরাটা ফেলে দিলো মুখ থেকে পাথরের উপরে। ডান পা-টা তুলে ফেললো সে হাঁটুমুড়ে পাথরটার উপর। কিন্তু বাঁ পা-টা ওঠাবার আগেই স্পর্শ পেলো সে অক্টোপাসটার। কিন্তু এবার আর ধক করে উঠলো না শহীদের বুক। পানির জানোয়ার ডাঙার মানুষকে পানিতে পেয়ে বাহাদুরি ফলাতে, পারে বৈকি। সেখানে তার শক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু মানুষ যদি একবার ডাঙায় উঠে আসতে পারে, তবে জলচর দানবকে হার মানতেই হবে।
* হেঁচকা টান মারলো শহীদ। একটানেই মুক্ত হলো পা-টা। ফিরে তাকাবার ইচ্ছে হলো না শহীদের। পাথরটার মাঝ বরাবর চলে এলো সে হামাগুড়ি দিয়ে। তারপর অসম্ভব ক্লান্তিতে ধপাস করে শুয়ে পড়লো পাথরের উপর। মরার মতো পড়ে রইলো সে হাত পা ছড়িয়ে। ক্লান্তিতে মরে যাচ্ছে যেন সে। হাঁপাচ্ছে সশব্দে।
| আশা কি এতো সহজে ছাড়া যায়? শিকার নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে পড়ার পরও পাথরটর চারপাশে ঘুরঘুর করছিলো অক্টোপাসটা। পানিতে নামতেই হবে একসময় না একসময় বাছাধনকে। দেখে নেবে কে তখন।
মিনিট সাতেক পর পানিতে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ পেলো শহীদ। ইতিমধ্যে খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। প্রায় দূর হয়ে গেছে ক্লান্তি। মাথা তুলে তাকালো
সে পানির দিকে। প্রবল একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে হাত তিনেক দূরের পানিতে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলো না শহীদ দূর থেকে। কৌতূহল জাগলো। ব্যাপারটা কি জানার জন্যে। উঠে বসলো ধীরে ধীরে। তারপর পাথরটার কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো।
পানির নিচে তাকিয়ে হেসে ফেললো শহীদ আপনমনে। উচিত সাজা হচ্ছে শয়তান অক্টোপাসটার। আক্রমণ করে বসেছে ওকে বিরাট একটা হাঙ্গর। রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে সে।
প্রাণপণ চেষ্টা করছে অক্টোপাসটা পালাবার জন্যে। কিন্তু অতো বড় হাঙ্গরের হাত থেকে যাবে কোথায়,সে। মিনিটখানেক ও লাগলো না হাঙ্গরটার
অক্টোপাসটাকে ফেড়ে টুকরো টুকরো করতে। খেতে শুরু করলো, সে টুকরোগুলো। মজা করে। চোখ ফিরিয়ে নিলো শহীদ।
ভর-পেট ব্রেকফাস্ট করে বিশ্রাম নিচ্ছে হাঙ্গরটা। নিঃসাড় পড়ে আছে সে পানির ৯০
নিচে মাটির উপর শরীরটা বিছিয়ে দিয়ে। আজকের ভোজন-পর্ব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তার।
নেমে পড়া যায় পানিতে? ভাবলো শহীদ। হাঙ্গরটা তো এখন নড়তে চড়তে পারবে বলে মনে হয় না। নাকি ভরপেটেও লোভ সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়বে ওর পক্ষে? কিন্তু তার নিজের যে পেটে পড়েনি কিছু এখনও। ইঁদুর ছুটোছুটি করছে পেটের ভিতর কখন থেকে। ব্যবস্থা কিছু একটা করার উপায়ও নেই এখন। হারামজাদা হাঙ্গরটা যদি খেয়েদেয়ে সরে যেতো এতক্ষণ, তাহলে ও পাহাড়টা টপকাবার চেষ্টা শুরু করে দিতে পারতো। পাহাড়ের ওপাশে সম্ভবত আবার সমুদ্র শুরু হয়নি। দ্বীপ যদি হয় এটা তবে গাছপালা দুটো একটা নিশ্চয়ই আছে। কিংবা ভাগ্য যদি প্রসন্ন হয় তবে দ্বীপটায় মানুষের বসবাসও আছে। সেটাই সম্ভব সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে একটা আশ্রয় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিছু না হোক, খিদেটা মিটবে। কিন্তু * এইতো ভালমানুষের পো নড়ছে! বেশ বেশ, এখন নিজের আড্ডায় ফিরে যাও
তো ধন। খুব তা ভুরিভোজন হয়েছে, আর কেন শুধু শুধু পড়ে থাকা।
| হাঙ্গরটা নড়েচড়ে উঠলো। শহীদ আশায় আশায় তাকিয়ে রইলো। ভাবলো এবার চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু না। নড়েচড়ে ভালো করে মাথাটা নরম মাটিতে পেতে দিলো হাঙ্গরটা। এখনও বিশ্রাম পুরোপুরি হয়নি তার।
বিরক্তি চেপে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো শহীদ। কিন্তু কতোক্ষণ আর বসে থাকা যায়। ভেবেচিন্তে হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করলো সে। হাঙ্গরটাকে মেরে ফেলা ইচ্ছে নয় শহীদের। একটা গুলি করে ভয় পাইয়ে দিতে চায় সে জানোয়ারটাকে। ভয় পেয়ে যদি পালিয়ে যায় তবেই বাঁচোয়া। পানির বাধা অতিক্রম করে গুলিটা চরম আঘাত হানতে পারবে না। হাঙ্গরটা সামান্য জখম হবে বড়জোর। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির নিচে হাঙ্গরটাকে। লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টিপে দিলো শহীদ। ‘
| আশঙ্কাটা শহীদ আগেই করেছিল। আংশিকভাবে সত্য প্রমাণিত হলো তার সন্দেহ। হাঙ্গরের পিঠ লক্ষ্য করে গুলি করেছিল সে। লাগলো গিয়ে লেজে।.তবে কাজ হলো। ঘুম ভেঙে গেল হাঙ্গরটার। যেন বিদ্যুৎগতিতেই সে দূরে সরে গেল খানিকটা রক্তের একটা রেখা রেখে। পিছন ফিরে তাকালো একবার। কি দেখলো কে জানে, তবে চলে গেল সে নতুন আর কোনো খেল না দেখিয়ে। | হোলস্টারে রিভলভারটা রাখলো শহীদ। ছুরিটা দু’পাটি দাঁতের সাহায্যে মুখে ধরে রাখলো। তারপর পাথরটার উপর উঠে দাঁড়ালো সিধে হয়ে।
ভালো মতো দেখে নিলো শহীদ পানির নিচেটা। ছোটো ছোটো সামুদ্রিক মাছ এসেছে এখন এদিকটায়। হাঙ্গরটা নেই তাহলে কাছে পিঠে। থাকলে মাছগুলোকে এদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতো না। অন্য কোনো বড় জানোয়ারও নেই আশা করা যায়। এক-আধটা বড় মাছ থাকতে পারে বড়জোর। যদিও তাও নজরে
৯১
পড়লো না শহীদের। তাছাড়া হিংস্র জানোয়ার না থাকলেই হলো। শহীদ পানিতে নামলে মাছগুলো ভয় পেয়ে পালিয়েই যাবে প্রাণ নিয়ে শশ হাত দূরে। | ধীরে ধীরে নামলো শহীদ পানিতে। তিনটে বড় আকারের পাথর সাঁতরে পেরিয়ে যাবার পর পাহাড়টার গায়ে পৌঁছুতে পারা যাবে। অজানা বিপদের আশঙ্কা করে বুকটা একবার কেঁপে উঠলো শহীদের। কিন্তু উপায় নেই। পাহাড়টার উপর চড়তে না পারলে চলবে না।
| হাঙ্গরটাকে গুলি না করে উপায় ছিলো না। কিন্তু গুলি করাও উচিত হয়নি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা উচিত ছিলো। ব্যাপারটা শহীদ বুঝলো ঠিকই, কিন্তু অনেক পরে। নির্বিঘ্নে দুটো পাথর সঁতরে পার হয়ে সাত-আট হাত এগিয়ে যাবার পর বিপদটা টের পেলো সে। জখমি শরীর নিয়ে ফিরে আসছে হাঙ্গরটা। তা না হলে মাছের দলগুলো অমন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে পালাচ্ছে কেন? এতোক্ষণে মাছগুলো শহীদকে দেখে পালাচ্ছিল দু’পাশে। কিন্তু এখন পিছন থেকে দলে দলে দু’পাশ দিয়ে শহীদকে ছাড়িয়ে ছুটে পালাচ্ছে তারা।’ হাঙ্গরটাই হবে, ভাবলো শহীদ। ছুরিটা মুখে ধরা আছে বটে। কিন্তু এবার আর কাজ হবে না ওটা দিয়ে। হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করে হাতে নিলো শহীদ। থামলো না সে। পিছন ফিরে তাকিয়ে সময় নষ্টও করলো না। মনে মনে আত্মরক্ষামূলক পন্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। হাঙ্গরটা এসে পড়ার আগেই যেন সামনের পাথরটায় উঠে পড়তে পারে, সেটাই সে চায়। যুদ্ধ নয় আর। দুর্বল সে পানির মধ্যে। দুর্বলের পক্ষে যুদ্ধ করতে চাওয়া.বোকামি।
আট-নয় হাত দূরে আর পাথরটা। দ্রুত সাঁতার কেটে এগোচ্ছে শহীদ। সে ভেবেছিল পিছনে তাকিয়ে সময় নষ্ট করবে না। কিন্তু তাকাতেই হলো তাকে। কে যেন ফিসফিস করে সতর্ক করে দিলো তাকে–আর বোকামি করো না, শহীদ খান, প্রস্তুত হও প্রাণ বাঁচাতে।
যুদ্ধই করতে হবে।
পিছন ফিরে তাকাতেই বুঝতে পারলো শহীদ, যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এবং এক্ষেত্রে যে আগে আক্রমণ করবে সুযোগ বুঝে সে-ই জয়ী হবে। ‘
হাঙ্গরটাই! এতক্ষণ দূরে সরে গিয়ে লুকিয়ে ছিলো সে। যথেষ্ট কারণ ছিলো তার মনে সন্দেহ এবং প্রতিহিংসাবোধ জাগার। আহারের পর আয়েশ করে। ঘুমোচ্ছিল। আর তো কিছু করেনি সে, কেন তাকে নিষ্ঠুরভাবে জখম করা হলো।
. দূরে সরে গিয়েও লক্ষ্য রেখেছিল সে এদিকটায়। টের পেয়ে ছুটে আসছে। দেখে নেবে কতো বড় শক্তিশালী শত্রু তার।
| বিচলিত হবার মতো তেমন কিছু নয় ব্যাপারটা। গুলিটা লেজে লাগলেও বেশ কাহিল করেছে হাঙ্গরটাকে। এগিয়ে আসছে বটে তবে জেদই বেশি তার, শক্তি তেমন নেই। হাত তিনেক দূর থেকে গুলি করলো শহীদ। মাথায় লক্ষ্যস্থির করেছিল সে। মাথাতেই লাগলে গিয়ে পুলিটা। দ্বিতীয় গুলি করতে দেরি করে
৯২
ফেললো শহীদ। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টিপে দেয়া উচিত ছিলো তার। তবে দ্বিতীয় গুলিটাও ফসকালো না। চোখে মেরেছিল। হাঙ্গটা তখন তড়পাতে শুরু করে দিয়েছে মাথায় গুলি খেয়ে। চোখে লাগলো না তাই গুলিটা। শহীদ বুঝতে পাড়লো গুলিটা হাঙ্গরের গায়ে লেগেছে। কিন্তু ঠিক কোথায় বিঁধেছে দেখতে পেলো না সে। হাঙ্গরটা তখন ভীষণ চাঞ্চল্য প্রকাশ করছে তীব্র যন্ত্রণায়।
| দ্রুত ফিরলো শহীদ। সরে যেতে হবে দূরে। ঘুরে সঁতরাতে শুরু করলো সে পাথরটার দিকে। কিন্তু কপালের লিখন খাবে কে?
দু’সেকেণ্ডও কাটলো নানা পানিতে প্রকাণ্ড একটা তোলপাড় তুলে লাফ দিলো হাঙ্গরটা। :
মৃত্যু-যন্ত্রণায় ভুগছে সে। লাফটা দিলো আক্রমণ করার জন্যে নয়। ব্যথা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। পানি থেকে হাত দুয়েক উপরে উঠে পড়লো হাঙ্গরটা কাতরাতে কাতরাতে। বুঝতে পেরেছে শহীদ ব্যাপারটা। ডুব দিলো সে সঙ্গে সঙ্গে পানির নিচে। ঠিক তারপরই হাঙ্গরটা পড়লো আবার পানিতে। পড়লো ঠিক শহীদের পিঠের ওপরে।
ব্যথায় কুঁচকে গেল শহীদের মুখটা। ধাক্কা খেয়ে মাটির সঙ্গে গিয়ে ঠেকলো। তার অসাড়প্রায় শরীরটা। ছিটকে পড়ে গেল ধাক্কা খাবার সঙ্গে সঙ্গে মুখের ছুরি। মানসিক শক্তি বজায় রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করলো শহীদ। শক্ত হয়ে উঠলো তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো। শক্ত হাতের মুঠি থেকে পড়তে দিলো না সে রিভলভার টাকে। ট্রিগারের উপর চেপে বসেছে একটা আঙুল। পরপর দুটো গুলি বেরিয়ে যেতে একটু ঢিল করলো শহীদ হাতের আঙুলগুলো।
| পিঠটা অসাড় মতো হয়ে গেছে। হাটা দ্বিতীয় আর একটা লাফ দিয়ে সরে গেছে দূরে। হাঙ্গরটার কথা ভাবছে না শহীদ। মাটি থেকে উপর দিকে উঠছে সে এখন একটু একটু করে দম ছেড়ে। মনের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে সে। পরাজয় নয়, জয়ী হওয়া চাই। মানুষ সে, এতো সহজে হার মানলে চলবে কেন তার। বেঁচে থাকতে হবে তাকে। বেঁচে থাকার জন্যে সংগ্রাম করতে করতেও হেরে যাওয়া চলবে না তার। জয়ী হতেই হবে তাকে। হবেও সে জয়ী।
মনে মনে এইসব কথা ভেবে ভেবে শক্তি সঞ্চয় করলো শহীদ। ফল হলো বৈকি। ভেসে উঠলো শহীদ ধীরে ধীরে পানির উপরে। শ্বাস নিলো সে বুক ভরে। আশ্চর্য হলো সে। শ্বাস নেবার সময় ব্যথাটা বাড়লো না তো পিঠের! আঘাত তাহলে মারাত্মক কিছু একটা নয়। ব্যাকযোন ভাঙেনি তা শহীদ জানে। যদি ভাঙতো তাহলে আর পানির উপরে ভেসে উঠতে হতো না তাকে জীবন্ত অবস্থায়। সলিল সমাধি লাভ করতো সে নিঃসন্দেহে।
আসলেই চোটটা মারাত্মক নয়। ব্যথাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল তা ঠিক। লেজের ভারটুকু লেগেছিল প্রকৃতপক্ষে তার পিঠের উপর। শুধু ভারটুকু নয়, আসলে চাবুকের মতো তীব্রবেগে লেজটা তার পিঠে পড়েই সরে গিয়েছিল। ফলে
* চাবুকের কাজ হয়েছিল পিঠের মাংসে। অবশ্য লেজটা চাবুকের চেয়ে চওড়া ছিলো
অনেক বেশি। | আস্তে আস্তে সঁতরে গিয়ে পাথরটার কাছে থামলো শহীদ। অলক্ষুণে। হাঙ্গরটার হদিস পায়নি সে আর। মরে গেছে সেটা এতোক্ষণে। পিঠের উপর আলতো ভাবে এক হাত বুলিয়ে দেখলো শহীদ। উঁচু হয়ে উঠেছে খানিকটা জায়গা। না দেখেই শহীদ বুঝতে পারলো উঁচু মতো জায়গাটায় রক্ত জমে আছে। অবশ মতো হয়ে রয়েছে এখনও।
পাথরটার উপর উঠলো না শহীদ। আশঙ্কা করেছিল সে অনেক বেশি চোট পেয়েছে। কিন্তু তা নয়। ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে ব্যথাটা। সুতরাং এবার, সাঁতরাতে লাগলো সে পাহাড়টার সামনে গিয়ে পৌঁছুবার জন্যে।
সামনে আর কোনো পাথর নেই। পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে মাথার উপরে। সূর্য উঠে এসেছে অনেকটা। কালো এবং উঁচু পাহাড়টার কালো ছায়া পড়েছে সমুদ্রের স্বচ্ছ পানিতে। বুকে সাহস সঞ্চয় করতে চেষ্টা করলো শহীদ। টপকাতে হবে খাড়া পাহাড়টা, বড় সহজ কাজ নয় সেটা।
ঠিকই ভেবেছিল শহীদ। বড় কঠিন কর্ম পাহাড়টায় চড়া। সিধে উঠে গেছে। পাহাড় কম পক্ষে সোয়াশো ফিট।
| গর্ত আছে বটে। পাথরের চোখা চোখা এবং মোটা হাতল মতো বেরিয়ে আছে অনেক। কিন্তু অনেকটা জায়গাতেই ওগুলো নেই। সেখানে হয়তো দুটো একটা গর্ত-টর্ত পাওয়া যাচ্ছে।
রিভলভারটা হোলস্টারে না ভরে পকেটে রেখেছে শহীদ। ধরবার মতো পাথর পেলে তাঁই ধরছে এবং পায়ের ভর সেইরকম একটা দুটো পাথরের উপর দিয়ে অতিকষ্টে একটু একটু করে উপর দিকে উঠছে সে। আর যেখানে ধরবার মতো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে নিরুপায় হয়ে সে গর্ত-টর্ত খুঁজে ঝুলতে ঝুলতে এবং পা দুটো দুমড়ে নিয়ে কোনো একটা গর্তের ভিতর ঢুকিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও গর্তে হাত ঢোকাতে রীতিমত ভয় জাগছে তার। সাপটাপ থাকা খুবই সম্ভব গর্তগুলোতে। কিন্তু এই রিস্কটুকু না নিয়েও উপায় নেই।
| পঁচিশ তিরিশ ফিট ওঠার পর প্রথমবারের মতো নিচের দিকে তাকালো শহীদ। এখান থেকে পড়লে কি ফল হতে পারে? প্রশ্নটা মনে জাগতে হাসলো শহীদ! গর্ত ধরে ঝুলছে সে। ঠিক ঝলছে বলা চলে না। পায়ের নিচে একটা মজবুত পাথর আছে তার। ডান হাতটা সরিয়ে নিলো গর্তটা থেকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছলো সে। তারপর পকেটে রেখে দিলো রুমালটা। হাতটা আবার ঢুকিয়ে দিলো সে গর্তের ভিতর ঢুকিয়েই।, গর্তের ভিতর হাতটা ঢোকাতেই শিউরে উঠলো শহীদ। আঙুলগুলো নরম মতো কোনো জিনিসের উপর চেপে বসেছে স্পষ্ট অনুভব করলো সে। সাপ! সাপের মাথার উপর হাত পড়েছে তার। ৯৪
ঝট করে টেনে নিলো শহীদ হাতটা। সাপই! কেউটে একটা। হাতটা টেনে, নিতেই সাপটা হাতের সঙ্গে বেরিয়ে এলো গর্ত থেকে। গর্তে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো শহীদ। কিন্তু সাপটা পড়লো তার মাথায়। সাথে সাথে দ্বিতীয় হাতটাও গর্ত থেকে বের হয়ে এলো শহীদের। শরীর শিরশিরিয়ে ওঠার ফল এটা। পঁচিশ-তিরিশ ফিট উপর থেকে শূন্যে কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে পানিতে পড়লো শহীদ। সাপটা পড়লো ক’সেকেণ্ড পরই।
ভাগ্যটা কি তাকে শুধুই নিরাশ করে দিতে চাইছে? নাকি এসবই কোনো একটা ভয়াবহ বিপদের সঙ্কেত? বাধ্য হয়ে মনে মনে প্রশ্ন করলো শহীদ নিজেকে। | আঘাত লাগেনি তার কোথাও। পানিতে পড়ার ফলে তেমন ব্যথা লাগার, কথাও নয়। কিন্তু এতো বড় বাধা-বিঘ্ন কেন? কি আছে ঐ পাহাড়ের ওপাশে? এসবই কি কোনো ভয়ানক বিপদের সঙ্কেত?
আর মাত্র গজ তিনেক! উঠে এসেছে শহীদ পাহাড়টার প্রায় উপরে। অতি সাবধানে উঠছে, এখন। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে সে ক্লান্তি দূর করার জন্যে। সাবধান হয়ে একটু একটু করে ধীরে ধীরে উঠছে সে। তাড়াহুড়ো করলেই সর্বনাশ ঘটার আশঙ্কা। আবার যদি সে ফসকে গিয়ে পড়ে যায় তবে আর সাহস হবে না পাহাড়ে চড়ার।
. আধঘন্টা সময় নিয়ে বাকি তিনগজ উচ্চতা অতিক্রম করলো শহীদ। প্রচণ্ড ধকল গেছে শরীরটার উপর দিয়ে। খিল ধরে গেছে হাতপায়ের গাটে গাঁটে। চারদিকে একবার দেখে নিয়ে শুয়ে পড়লো শহীদ পাথরের উপর। পাহাড়ের এদিকের অংশটা সমতল। খানিকটা জায়গা বাদ দিয়ে তিনদিকে পাথরের প্রকাণ্ড খণ্ড পড়ে আছে। দৃষ্টি চলে না। | দশমিনিট বিশ্রাম নিলো শহীদ। ভিজে কাপড়-চোপড় প্রায় শুকিয়ে এসেছে। রোদ লেগে। কিন্তু সে কথা ভাবছে না সে। খিদে, প্রচণ্ড খিদেয় প্রাণশক্তি নিঃশেষ। হয়ে গেছে যেন তার।
মহুয়াকে ডাক দিয়ে বলবে নাকি খেতে দিতে? হেসে ফেললো শহীদ নিজের ঠাট্টায় নিজেই। পরক্ষণেই দপ করে নিভে গেল তার ঠোঁট থেকে উজ্জ্বল হাসির। রেশটুকু নিঃশেষে.। কোথায়, কিভাবে কেমন আছে সে? একা মেয়েমানুষ সে। বেঁচে যদি থাকেও বেঁচে আছে তো? চমকে উঠে বলো শহীদ। ঝাপসা হয়ে আসছে তার দৃষ্টি। জ্বলজ্বলে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে, চলচ্চিত্রের পর্দার মতো। করুণ, অসহায় একটা মুখ। ভয়ার্ত, আতঙ্কিত একটা মুখ। মহুয়ার মুখ দেখতে পেলো শহীদ। ভেসে চলেছে সে সীমাহীন বিশাল প্রশান্ত। মহাসাগরে একা। একা! কেউ নেই তার দৃষ্টির আওতায়। কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোনদিকে। শুধু জল আর জল। জল আর সমুদ্রের একটানা গর্জন। অথৈই জল আর গম্ভীর, গভীর একটানা গর্জন আর দানবীয় ঢেউ একটার পর একটা। ভাসছে
‘মহুয়া তার লাইফবয়ের উপর। মুখ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে তার।
আবেগে বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠলো শহীদের। দু’হাতে মুখ ঢেকে অশ্রু সংবরণ করলো সে। শক্তি দরকার, ধৈয় দরকার। নিরাশ হলে চলবে না তার। মাথার উপর কর্তব্যের বোঝা চেপেছে আজ তার। উদ্ধার করতেই হবে মহুয়াকে। বুদ্ধি হারালে চলবে না আজ। মহাপরীক্ষা শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে উত্তীর্ণ তাকে হতেই হবে এই পরীক্ষায়। সশরীরে বাঁচিয়ে সকলকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেশে। যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবে সে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো শহীদ-আমি দমবো না শত বিপদ, শত বিপঞ্জিতেও।
এপাশে এসে ভরসা পেলো শহীদ। পাহাড়ের উপর থেকেই জঙ্গলটা দেখতে পেলো সে। উঁচু পাহাড়ের সারি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আরো দূরে। মাঝখানটায় বনভূমি।
, কোনো মানুষঙন দেখা যাচ্ছে না, চারদিকে।কই, বাঁশের ছাউনি বা মাচা জাতীয় কিছুও নজরে পড়ছে না।
গভীর নয় জঙ্গলটা। বেশি বড়ও নয় আয়তনে। একদিক থেকে অপরদিকে পৌঁছুতে মিনিট সাতেক লাগলো তার। আতা গাছ পেলো সে কয়েকটা। পাকা আতা। গাছে ওঠার কষ্টটুকু সইতে হলো বটে, কিন্তু পরিবর্তে ক্ষুধা মিটলো। খিদে মিটতেই চাঙ্গা হয়ে উঠলো শহীদ। বনভূমি শেষ হয়ে এসেছে দেখেও দমলো না।
সে। এগোলো পাহাড়গুলোর সারির দিকে।
সিধে হাঁটছিল শহীদ। দ্রুত পায়েই হাঁটছিল সে। মাঠটা তেপান্তরের মতোই। শেষ হতে চায় না কোনমতে। হঠাৎ দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো শ। সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল সে। দক্ষিণ দিকে চোখ পড়তেই সমুদ্র দেখতে পেলো। তার মানে পাহাড়ের সারির পর সমুদ্র শুরু হয়েছে আবার। তাহলে? নিরাশার ছায়া পড়লো শহীদের মনে। তাহলে আর এদিকে গিয়ে লাভ কি? ভুল করেছে সে। পশ্চিম দিকে না এসে উত্তর দিকে এগোনো উচিত ছিলো
তার।
কিন্তু উত্তর দিকে সে কোনো পথ দেখতে পায়নি। কথাটা মনে পড়লো শহীদের। এবার সে সত্যিসত্যি চিন্তিত হয়ে পড়লো। দ্বীপটা কি এতোই ছোটো? : সমুদ্রের উপর বিন্দুর মতো পঁড়িয়ে আছে এই দ্বীপটা? লোকজন নেই নাকি?
| দেখা দরকার সুবটা। বলা যায় না, উত্তর দিকে এগোবার একটা পথ পেয়েও যেতে পারে সে। আসলে হয়তো দ্বীপটা তুতো ছোটো নয়, যত ছোটো মনে, করছে সে। সে তো ভালো করে উত্তর দিকের পাহাড়টার দিকে খোঁজও করেনি।
জঙ্গল দেয়ে এদিকেই মনোযোগ ছিলো তার।
আবার পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো শহীদ ছেড়ে আসা পাহাড়টার দিকেই। ৯৬
যাবে, নাকি যাবো না? ঢুকবো, নাকি, ঢুকবো না? | দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছে না শহীদ। উত্তর দিকের পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। খুঁজতে খুঁজতে আচমকা সে পেয়ে গেছে এই সুড়ঙ্গটা। দু’মানুষ সমান উঁচু হবে সুড়ঙ্গের মুখটা। পনেরো হাত সমতল ভূমি দেখা যাচ্ছে। তারপর ধুলোবালি মাটির চিহ্ন নেই। রয়েছে পাথরের অসমান জমি। অবশ্যি পাথরের জমিটা দেখা যাচ্ছে মাত্র সাত-আট হাত। তারপর বাম দিকে মোড় নিয়েছে সুড়ঙ্গটা। যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকুও তেমন আলোকিত ময়। ছায়া ছায়া মতো। সুড়ঙ্গটা যেখানটায় মোড় নিয়ে হারিয়ে গেছে দৃষ্টির বাইরে সেখানটায় রীতিমত অন্ধকার। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে শহীদের। সে ভাবছে–যাবো, নাকি যাবো না? ভিতরে ঢুকবো, নাকি ঢুকবো না?
| ওয়াটারপ্রুফ পেন্সিলটর্চটা পকেটে আছে কিনা দেখলো শহীদ। হাতে নিয়ে জিনিসটা নাড়াচাড়া করতে করতে মৃদু হেসে শহীদ নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যালো, তুমি কি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান?’
উত্তর হলো, কোনো সন্দেহ নেই তাতে।’
তবে তুমি মরে গেছে বলে আমার বিশ্বাস, নিজেকে বিদ্রূপ করে কথাটা বললো শহীদ। তবে মনের ভিতর থেকে সত্যিকার, প্রশ্ন করলো শহীদ খান ভূকুঁচকে, মানে! এসব কথার মানে কি? দিব্যি বেঁচে রয়েছি আমি…’
| ‘বেঁচে থাকলে সুড়ঙ্গটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশপাতাল ভাবতে না তুমি।’
শহীদ খান এবার বললো, ঠিক আছে, এই দেখো শহীদ খান বেঁচে আছে কি। সে আসলে ভয় বলে কোনো জিনিসকে চেনে না। উচিত অনুচিত ভেবে দেখে মাত্র।’
দৃঢ় পদক্ষেপে সুড়ঙ্গটার দিকে এগিয়ে গেল শহীদ। কুড়ি-বাইশ হাত হাঁটার পরই পেন্সিলটর্চটা, জ্বালতে হলো তাকে। সামনে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
ফ ফর!’। | মাথা হেঁট করে রাখলো শহীদ। চামচিকে আর বাদুড়েরা ভয় পেয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। কতত যুগ হয়তো কেউ প্রবেশ করেনি তাদের রাজত্বে।
সারাক্ষণ জ্বেলে রেখে পেন্সিলটর্চটা অপব্যয় করতে চায় না শহীদ। মাঝে মাঝে জ্বালছে সে সেটা। সামনেটা দেখে নিচ্ছে সতর্ক দৃষ্টিতে। তারপর পা ফেলছে আন্দাজ মতো। মিনিট সাতেক হাঁটলে শহীদ এভাবে। তারপর সে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো মনে মনে। পেন্সিল টর্চটা নিভিয়ে দিলো সে। সামনে দেখা যাচ্ছে দিনের আলোর ছটা। সুড়ঙ্গটা শেষ হয়ে এসেছে।
আশায় আশায় এগোলো শহীদ। ব্যর্থ হয়ে উঠেছে তার মন। কৌতূহল জাগছে। কি আছে সুড়ঙ্গের শেষে?
একটা করুণ কাহিনী আছে সুড়ঙ্গের শেষে। ভয়ঙ্কর একটা ইতিহাস আছে। ৭-
। ৯৭
চরম বিপদের সূচনা আছে। মুখব্যাদান করে অপেক্ষা করছে এই দ্বীপের কুটিলতা-হিংস্রতা। “ থমকে দাঁড়ালো শহীদ। নিস্পলক তাকালো সে সামনে। এ-ও কি সম্ভব?
ছয়
বসে আছে একটি মানুষ। না, ভুল বলা হলো। কোনো একদিন এখানে এসে বসেছিল মানুষটা। ঠিক তেমনি বসে আছে সে আজও। ঠিক একই ভঙ্গিতে, একই উদ্দেশ্যে। ব্যতিক্রম শুধু এই যে, শরীরে তার এক কণা মাংসের চিহ্ন মাত্র নেই। সব ঝরে গেছে সময়ের সাথে সাথে। কঙ্কালসার নয়, সম্পূর্ণ কঙ্কাল সে এখন। মরে ভূত হয়ে গেছে কত যুগ আগে কে জানে! | কে ও? কোথা থেকে এসেছিল এখানে। পাথরটার সামনে এভাবে এসে বসেছিলই বা কেন সে? বসার ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না লোকটা হাঁটতে চলতে পারতো না। তবে?
কঙ্কালটার সামনে উঁচু মতো পাথর একটা? ভ্রু কুঁচকে কি যেন লক্ষ্য কতে চেষ্টা করলো শহীদ। কিসের আঁচড় ঐ পাথরটার গায়ে! লেখা মনে হচ্ছে যেন।
পরিষ্কার আলোর অভাব বোধ করলো শহীদ। পেন্সিল টর্চটা আবার শটে থেকে বের করে পায়ে পায়ে এগোলো সে পাথর এবং কঙ্কালটার দিকে।
কঙ্কালটার মাথা ঠেকে আছে পাথরটার গায়ে। হঠাৎ একটা ছোরার ফলা চকচক করে উঠলো মেঝেতে। স্টেনসেল স্টীল তুলে নিলো শহীদ রেডটা। মনোযোগ দিয়ে দেখলো সে জিনিসটা। আশ্চর্য! বাটটার সবটুকু নেই কেন ছোরাটার? শহীদের মনে হলো কে যেন দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলেছে কাঠের বঁটটা। পেন্সিলটর্চটা এদিক ওদিক ঘোরালো শহীদ। আরো একটা জিনিস পাওয়া গেল। শার্টের বোতাম একটা। অর্ধেকটা নেই। কে যেন দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ফেলে দিয়েছে। পাথরটার গায়ে আলো ফেললো এবার শহীদ।
অবিশ্বাস করার উপায় নেই। জ্বল জ্বল করে উঠলো শহীদের চোখের সামনে কয়েকটি লাইন। ইংরেজি ভাষায় লেখা রয়েছে কয়েকটা কথা পাথরটার গায়ে। অতি যতে, অনেক পরিশ্রম স্বীকার করে এই মৃত মানুষটি লিখে গেছে অদ্ভুত কয়েকটা কথা। করুণ সে কাহিনী। ভয়ঙ্করও বটে। ভরে উঠলো শহীদের বুকটা.. এই অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটির প্রতি করুণায়। দুঃখ হলো তার মানুষটার দুর্ভাগ্য দেখে। শিউরে উঠলো সে মানুষটির কষ্টের কথা কল্পনা করে। না খেতে পেয়ে সে মরেছে তিলে তিলে। তবু তার সাহস হয়নি।
মৃত মানুষটি ইংরেজীতে লিখে গেছে পাথরটার গায়ে ছোরার ফুলা দিয়ে বাংলা করলে দাঁড়ায়, আমার নাম আলবার্ট হোয়াইটম্যান। সুইডেন আমার জন্মভূমি। অরনিথলজির ছাত্র ছিলাম আমি। জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে
৯৮
পড়াশোনা করেছিলাম।
‘উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে আমি এবং আমার দুজন বন্ধু অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের জন্যে সুইডেন থেকে যাত্রা আরম্ভ করি। সে-সময় ছুটি উপলক্ষে দেশেই ছিলাম আমরা। ছুটি শেষ হয়ে আসার দেরি ছিলো। সময়ও কাটছিল না ভালভাবে। তাই আমরা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ভ্রমণে বের হবো।
‘আগস্ট মাসের এক তারিখে জাহাজে চড়ি আমরা। ঠিক তার বিশদিন পর ভীষণ একটা সাইক্লোনে ডুবে যায় আমাদের জাহাজ। জাহাজের যাত্রীরা কে কোথায় ভেসে গেল তা আমার জানা নেই। তবে আমরা তিন বন্ধু সবসময় একই সঙ্গে ছিলাম। একটি লাইফবোটে উঠে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের দুর্ভাগ্য, অন্য কোনো যাত্রীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে।
| রাতের বেলা ডুবে গিয়েছিল আমাদের জাহাজ। সকাল যখন হলো, তখন দেখলাম আমরা একটা দ্বীপের সামনে পৌঁছেছি। আনন্দই হয়েছিল দ্বীপটা দেখে। কিন্তু আমরা কেউই জানতাম না এই দ্বীপটা আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে মৃত্যুহরে। মা-বাবা-ভাই-বোন এবং বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছিল এই ভয়ঙ্কর দ্বীপটা আমাদেরকে। এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
| ‘বেশি কথা লিখতে পারবো না আমি। গত তিনদিন কিছু খাবার জোটেনি আমার। সংক্ষেপে দু’চার কথা জানাচ্ছি শুধু। যাতে যদি কোনো মানুষ এখানে আসে সে যেন। আমার লেখা পড়ে সাবধান হয়। এটা একটা হিংস্র অসভ্য জংলীদের দ্বীপ। আমার এক বন্ধুকে এরা বলি দিয়েছে আমার সামনে। অপর বন্ধুটিকে এরা জংলীদের রাজার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। তারও আয়ু মাত্র এক বছর। ছেষট্টি সালের আগস্ট মাসের কুড়ি তারিখে একেও বলি দেয়া হবে। এটাই ওদের নিয়ম। কোনো সভ্য মানুষ যদি জাহাজডুবির পর এই দ্বীপের একটি নির্দিষ্ট পাথরে ওঠে এবং তাকে দেখে যদি পছন্দ হয়ে যায় এদের, তবে এক বৎসরের জন্যে তাকে রাজ জামাতা করে আরাম-আয়েশে রাখা হয়। তারপর বছর ঘুরলেই হত্যা করা হয়। তাকে। যে পাথরে অবস্থান করলে জামাতা হিসেবে এক বৎসরের জন্যে মেনে নেয়। ওরা সেটি দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে মাইলখানেক এগোলেই পাওয়া যাবে। সমুদ্রের কাছেই আছে সেই পাথরটা। পাথরটাকে ওরা ‘খাংখাবি কাংখাবি’ বলে ডাকে। যার অর্থ দেবতার চাদি। আমার সেই বন্ধু জানে না যে তাকে একবৎসর পর হত্যা করা। হবে। লুকিয়ে পালিয়ে আসার সময় আমি তাকে আমার সঙ্গে আসতে বলেছিলাম। সে রাজি হয়নি। এমনকি সে একথা জানার পরও আমার প্রতি কোনো সহানুভূতিও জানায়নি, আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে শত্রুর মতোই নির্বিকার ছিলো। সে আমার। সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে…আমার শেষ অনুরোধ, দক্ষিণ দিকে যেন কেউ। ভুলেও না যায় …,
আর পড়া গেল না। দুর্বল হয়ে পড়েছিল লোকটা। হাত কাঁপছিল নিশ্চয়ই তার। আঁকাবাঁকা ভাবে কি কি যেন লিখতে চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু অস্পষ্ট সে আঁচড়গুলো। সম্ভবতঃ ওই পর্যন্ত লিখেই মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছিল দুর্ভাগী!
চোখ মুছলো শহীদ। বললো, ধন্যবাদ, ভাই আলবার্ট হোয়াইটম্যান। আমি তোমার জন্যে মর্মাহত এবং তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, সাবধানবাণী লিখে রেখে যাবার জন্যে। সৃষ্টিকর্তা তোমার আত্মাকে সুখ-স্বস্তি দান করুন।
কি মনে করে আলবার্ট হোয়াইটম্যানের ঠিকানা লিখে নিলো শহীদ একটা ওয়াটারপ্রুফ নোটবই বের করে। তারপর সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলো সে তুরিত বেগে। দক্ষিণ দিকে যেতে হবে শহীদকে। তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে সে। দক্ষিণ দিকেই আছে সেই পাথরটা। যেটার নাম ‘খাংখাবি কাংখাবি।
তারিখটা শহীদের দৃষ্টি এড়ায়নি। আলবার্টের বন্ধুকে জংলীরা রাজ-জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল উনিশ শশা পঁয়ষট্টি সালের আগস্ট মাসের কুড়ি তারিখে। আজও আগস্ট মাসের কুড়ি তারিখ। উনিশশো ছেষট্টি সাল এটা। পুরো এক বছর হয়েছে আলবার্টের বন্ধু রাজ-জামাতা হয়েছে। আজ, আজই তার এই পৃথিবীতে শেষ দিন। জংলীদের নির্মম নিয়ম অনুযায়ী আজই তাকে বলি দেয়া হবে সেই ‘খাংখাবি কাংখাবি পাথরের উপর।
প্রায় ছুটতে ছুটতে দক্ষিণ দিকে হাঁটছে শহীদ। বাঁচাতে হবে লোকটাকে। আলবার্টের প্রতি সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বটে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে লোকটাকে রক্ষা করা শহীদের কর্তব্য। লোকটাকে বাঁচাবে সে জংলীদের কবল থেকে।
একটা নদীর সামনে পথটা শেষ হয়েছে। পাহাড়ী নদী। স্বভাবতই খরস্রোতা। জঙ্গল দেখা যাচ্ছে নদীর ওপারে। গাছগুলো কেমন লতাপাতা বিশিষ্ট। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ওগুলো কি। একটা আশঙ্কা দেখা দিলো শহীদের মনে। কিন্তু আমল দিলো না সে আশঙ্কাটাকে। ভাবনা-চিন্তা করার সময় কম। যতো তাড়াতাড়ি ‘খাংখাবি কাংখাবির কাছে পৌঁছুতে পারে ততোই ভালো। নয়তো যা সর্বনাশ ঘটবার ঘটে যাবে।
ঝাঁপ দিলো শহীদ পানিতে। ছোট্ট, নদীটা। তেমন চওড়া নয়। তা সত্ত্বেও স্রোতের সঙ্গে সংগ্রাম করে ওপারে পৌঁছুতে বেশ সময় লাগলো। কিন্তু একি! সাপ।
| সতর্ক হয়ে উঠলো শহীদ। কিন্তু এখন আর সতর্ক হয়ে কি হবে। এসে যখন পড়েছে তখন এগোতেই হবে সামনে। গাছে গাছে ঝুলতে দেখতে পেলো শহীদ অদ্ভুত জাতের একধরনের অসংখ্য সাপ। সবুজ। মধ্যমা আঙুলের মতোই সরু। এবং হাত দুয়েকের বেশি লম্বা নয় কোনোটা। গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে, সাপগুলো। নট নড়ন চড়ন। যেন সাপ নয় ওগুলো। লতাপাতা বলে ভ্রম হয়।
ধীর পায়ে, এতোটুকু শব্দ না করে হাঁটছে শহীদ। জঙ্গলটা ততো গভীর নয়। মাটির দিকে তাকিয়েই হাঁটছিল শহীদ। গাছের সাপগুলো সাড়াশব্দ না পেলে
. ১০০
কিছু বলবে না। আরামে ব্যাঘাত না ঘটলেই হলো ওদের। কিন্তু মাটিতে যেগুলো চলে ফিরে বেড়াচ্ছে সেগুলোর গায়ে শুধু একটু আঁচড় লাগলে হয়। অমনি করে দেবে। দেখতে হবে না আর, সাপগুলোর গায়ের রঙয়ের মতোই সবুজ হয়ে যাবে শরীরের রঙ বিষক্রিয়ায়। ঢলে পড়তে হবে মৃত্যুমুখে টু-শব্দটিও না করে।
এবং সেই ব্যবস্থাই শহীদের জন্যে করা হয়েছে! এগিয়ে আসছে সড়সড়িয়ে। একটা সাপ। রঙিন একটা প্রজাপতিকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছিল আসলে সাপটা। নিশ্চিন্ত মনে বসেছিল প্রজাপতিটা ঘাসের ডগায়। হঠাৎ শহীদের পায়ের শব্দে উড়ে গেল সেটা। বিগড়ে গেল সাপটার মেজাজ। শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে তাকালো সে শহীদের দিকে। তারপর ‘আয় তোকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছি’ মনে মনে বলে এগিয়ে আসতে লাগলো।
. এদিকের জায়গাটা সংকীর্ণ। দু’দিকে গাছ। মাঝখানে সরু ঘাসের জমি। নিঃশব্দ পদক্ষেপে হাঁটার চেষ্টা করছিল শহীদ। গাছগুলো বেশ বড় বড়ই। কিন্তু ডালপালাগুলো খুবই নিচু। সাপগুলো ঝুলছে মাথার উপরেই। তা হোক, শহীদ ভয়ের কিছু দেখতে পেলো না। আসলে মাটির নিচের সাপটিকে সে তখনও লক্ষ্য করেনি।
* হাত দেড়েক দূরে থাকতে বিপদটা টের পেলো শহীদ। ফলে কি করছে না করছে ভেবে দেখার আগেই উপর দিকে লাফ দিলো সে। ধরে ফেললো একটা নিচু গাছের ডাল। ঝুলতে লাগলো পা দুটো শূন্যে রেখে।
শত্রুকে চোখের সামনে থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে অবাক হলো *সাপটা। দাঁড়ালো না সে। একটা হৃষ্টপুষ্ট পোকা দেখে পেটুক সাপটা ছুটলো সেদিকে। ঠিক এমনি সময়ে শিউরে উঠলো শহীদ। ডালের উপরে তার হাত দুটো স্পর্শ করে হেঁটে চলে যাচ্ছে একটি সাপ। ভরপেট খাওয়া-দাওয়া করে চলার গতি তার ধীর। ডালটা খামোকা কেঁপে না উঠলে নড়তো না সে। শ্বাস বন্ধ করে
অপেক্ষা করে রইলো শহীদ। সময় যেন শেষ হতে চায় না। সাপটা যাচ্ছে তো | যাচ্ছেই।
অবশেষে কোনো বিপদ না ঘটিয়েই চলে গেল সাপটা। ঝুপ করে নামলো শহীদ স্মাটিতে। তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে দৌড় দিলো দক্ষিণ দিকে। দেরি হয়ে গেছে অনেক। যা থাকে কপালে, দৌড়েই পার হয়ে যাবে সে ভয়ঙ্কর জঙ্গলটা।
বেশিক্ষণ দৌড়তে হলো না শহীদকে। মিনিটখানেক দৌড়াবার পরই দেখা পেলো সে আর একটা পাহাড়ী নদীর। নদীটা পেরিয়ে আবার ছুটলো সে। খানিকক্ষণ পরই সামনে সমুদ্রের দেখা পাওয়া গেল। কি চকচক করছে ওটা?
ওটাই কি ‘খাংখাবি কাংখাবি পাথর?
| কোনো সন্দেহ করার উপায় নেই। কাছাকাছি পৌঁছেই শহীদ নিরাশ হলো। যা হবার তা আগেই হয়ে গেছে। সূর্যের আলো পড়ে ঝকমকিয়ে উঠেছে পাথরটা।
১০১
শহীদ দেখলো তাজা লাল রক্তে কে বা কারা যেন লেপে গেছে পাথরটা। শুকিয়ে যায়নি এখনও।
দেরি করে ফেলেছে শহীদ। আলবার্টের বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর কপালে যা ঘটবার ছিলো তাই ঘটে গেছে; জংলীরা তাকে বলি দিয়ে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু লাশটা কই? :
চারপাশে তাকাতে তাকাতে জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখলো শহীদ। লাশটা কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে খাংখাবি কাংখাবি পাথরের উপরে যে রক্ত দেখা যাচ্ছে সে রক্ত কোনো মানুষের নয়। খুবই সম্ভব সেটা, ভাবলো শহীদ। এ রক্ত হয়তো কোননা জানোয়ারের। জংলীরা হয়তো কোনো জানোয়ারকে বলি দিয়ে নিয়ে চলে গেছে পুড়িয়ে খাবার জন্যে।
আপনমনে হাঁটতে শুরু করলো আবার শহীদ। জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করবে সে। নিশ্চয় করে জানতে হবে আলবার্টের বন্ধুর কি দশা হয়েছে।
এদিকে কেন এলো শহীদ। আলবার্ট বলেছিল দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে জংলীদের গ্রাম। কিন্তু এ যে দেখা যাচ্ছে কাদার সমুদ্র! গ্রামটা তো এদিকে নয় তাহলে। ভুল। দিকে চলে এলো নাকি সে?
ঠিক তাই। গভীর জঙ্গলে সূর্য ঠিক কোনদিকে ছিলো বুঝতে পারেনি শহীদ। দক্ষিণ দিক ছেড়ে পূর্বদিকে চলে এসেছে সে। সামনে এগোবার কোনোই উপায় নেই। কিন্তু আধঘন্টা ধরে হেঁটে আবার ফিরে যাওয়াও তো বিরক্তিকর।
অথচ সামনে এগোতে গেলে বিপদও ঘটতে পারে। জঙ্গলটা হঠাৎ এইখানে এসে শেষ হয়ে গেছে। সামনে দেখা যাচ্ছে কালো রঙয়ের থকথকে কাদা। লম্বা একটা নদীর পানি সরে গিয়ে যেন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেদিকে দৃষ্টি পড়ে সেদিকেই কাদা আর কাদা। কাদার নদীটা চওড়াও কম নয়। শ’খানেক গজ হবে সম্ভবত। তা হোক, পা ফেলে ফেলে পেরিয়ে যাওয়া যায় হয়তো। . কি করবে ভাবছিল শহীদ। হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে কাদার নদীটার কাছ থেকে। পিছনেই তার বনভূমি। পা বাড়াবার জন্যে মনস্থির করতে পারছিল না সে। এরকম কাদা আগে কখনও দেখেনি সে। পেরিয়ে যাবার কথা ভাবছে বটে, কিন্তু সাধারণ কাদা যদি না হয়ে থাকে? চোরা কাদা হয় যদি?
তাহলে আর দেখতে হবে না। পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যেতে হবে। বিপদের। আশঙ্কা জেনেও রিস্কটা নেয়া কি উচিত হবে?
সাবধান শহীদ খান!
খশখশ করে শব্দ হলো কেমন যেন পিছন দিক থেকে। আর কে যেন শহীদের কানে কানে বলে গেল-সাবধান বাছা!
প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার শুনতে পেলো শহীদ। অসম্ভব দ্রুত হাতে হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করে ফেলেছিল সে আগেই। গর্জনটা কানে ঢুকতেই বোঁ করে ১০২
পিছন দিকে ফিরলো সে। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের নলটা একটু উপর দিকে তুলে
গুলি করলো শহীদ।
শূন্যেই একটা ডিগবাজি খেলো চিতাটা। অতিরিক্ত জোরে লাফ দিয়েছিল সে। শহীদের পাঁচ হাত দূরে ফুটবলের মতো ড্রপ খেলো হলুদ চক্র আঁকা চিতাবাঘটা। ড্রপ খেয়ে সরাসরি কাদায় গিয়ে পড়লো।
| গুলিটা লেগেছিল বাঘটার বুকে। ছটফট করতে লাগলো চিতাটা। শহীদ ভাবলো গুলি লাগার ফলেই ওরকম ছটফটাচ্ছে চিতাটা। কিন্তু না! ডুবে যাচ্ছে চিতাটা কাদার ভিতর। চোরা কাদাই। তিরিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্দ্রে ব্যাপার। ডুবে গেল বাঘটা কাদার ভিতর। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। না, ফিরে যেতে হবে শহীদকে। এই কাদা পেরিয়ে কেউ কোনো দিন যেতে পারবে না ওপারে।
শহীদের জন্যে অপেক্ষা করছিল আরও একটা চমক। ঘুণাক্ষরেও যা সে জানতো না তাই জানলো সে। একদিকে আনন্দ এবং অপরদিকে অস্বস্তিকর দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসলো তাকে। সত্যিকথা বলতে কি, চোখে শর্ষে ফুল দেখছিল যেন সে। কি করবে কি ভাববে তা পর্যন্ত নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো তার পক্ষে। প্রস্তর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে খাংখাবি কাংখাবি’ পাথরটার সামনে।
ফিরতি পথে পাথরটার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলো শহীদ। পাথরটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলো সে অ ক দিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করার জন্যে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। অশ্বাসে চোখ দুটো কুঁচকে উঠলো তার প্রথমে। উত্তেজনা বোধ করলো সে রীতিমত। পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে হলো তাকে পাথরটার দিকে। সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়লো সে। কোনো সন্দেহই রইলো
আর। স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, পড়তে অসুবিধে হবার কারণ নেই। সম্ভবত কোনো ছুঁচালো পাথর দিয়ে লেখা হয়েছে শব্দটা-কামাল’। .
কামাল! তবে এই দ্বীপে এসে উঠেছে? আকাশে উড়ে গিয়ে ডিগবাজি খেতে। ইচ্ছে করলো শহীদের। মুখটা ভরে উঠলো আনন্দের হাসিতে। ফুটে উঠলো প্রিয়। বন্ধুর ছবিটা চোখের সামনে। কামালের হাত মুখ নেড়ে কথা বলার ভঙ্গিটিও দেখতে পেলো শহীদ। এক চোখ টিপে কামালের রসিকতা করার ধরনটা মনে পড়ে যেতে মেহসূচক সম্বোধন করলো শহীদ কামালকে, পেটুকবাজ! খাওয়া দাওয়ার খবর কি হে তোমার? পেটে কিছু পড়েছে তো?’
কিন্তু মুহূর্ত পরই দপ করে নিভে গেল শহীদের উজ্জ্বল মুখটা। পাথরটার উপর কামাল নিজের নাম লিখেছে। আর রক্তও লেগে রয়েছে পাথরটার উপর। না!
! এসব কি ভাবছো শহীদ। তা কেন হবে। এ নিশ্চয় আলবার্টের সেই বন্ধুর রক্ত। বা কোনো জানোয়ারের। কামাল কি করেছে জংলীদের যে তাকে বলি দেয়া হবে?
কিন্তু শান্ত হলো না শহীদের মন। বারবার লেখাটা এবং রক্তের দাগের উপর
১০৩
দৃষ্টি আছড়ে আছড়ে পড়লো তার। যতোই আশঙ্কাটা দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে সে, ততোই যেন আঁকিয়ে বসছে মাথার ভিতর সেটা-কামালকে বলি দিলো নাকি জংলীরা! | | এ এক অবর্ণনীয় মানসিক কষ্ট। বিচলিত হয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। শহীদ। কোনো কথাই স্থির মস্তিষ্কে ভেবে দেখার অবস্থা নয় তার। জংলীদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছুতে হবে তাকে। এটুকু মাত্র সে বুঝতে পারছে। তারপর কি হবে না
হবে, কি করতে পারবে সে বা কি করতে পারবে না তা সে জানে না। প্রয়োজনও বোধ করছে না জানার।
জঙ্গলটা অসম্ভব ঘন। হাঁটছিল শহীদ তা সত্ত্বেও যথাসম্ভব দ্রুত। তিন তিনবার গাছের মাথায় চড়ে জংলীদের গ্রামটা কোনদিকে দেখার চেষ্টা করেছে সে। প্রথম দু’বার ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়বার হদিস পেয়ে গেছে গ্রামটার। সেইদিকেই হাঁটছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে। কোনো ক্লান্তি নেই যেন তার। কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার নিজের শারীরিক কষ্টের প্রতি। হেঁটে চলেছে সে তার প্রিয় বন্ধুকে কাছে পাবার। জন্যে। অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দেবার সময় নয় এখন। জংলীদের হাতে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না তাহলে।
টপ টপ করে দু’ফোঁটা তাজা রক্ত পড়লো শহীদের কাঁধে। আশ্চর্য হয়ে তাকালো নিজের কাঁধের দিকে। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেল। কোথা থেকে রক্তের ফোঁটা পড়লো? মাথা তুলে তাকালো শহীদ উপর দিকে . ধক করে উঠলো অন্তরাত্মা। কামাল নাকি!
না। শ্বেতাঙ্গ একজন। কামাল নয়, একজন শ্বেতাঙ্গের ধড়টা ঝুলছে গাছের উপর। মাথাটা ঝুলছে পাশের একটি ডালে। বুঝতে বাকি রইলো না শহীদের এ কার লাশ। আলবার্ট হোয়াইটম্যানের বন্ধু ছিলো লোকটা।
কিন্তু সময় নষ্ট করলে চলবে না আর। কামালকে বলি দেয়া হয়নি, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। কিন্তু জংলীদের গ্রামে কামালকে যে পাওয়া যাবে তার কি নিশ্চয়তা? সে হয়তো অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বনভূমির আর কোনো দিকে।
মহা ভাবনায় পড়ে গেল শহীদ। গাছটার তলা থেকে সরে এসে মাথা হেঁট করে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো সে। জংলীদের গ্রামে গিয়ে কি কোনো লাভ হবে? কামাল হয়তো ধরা পড়েনি ওদের হাতে। সে যদি জংলীদের গ্রামে গিয়ে ধরা পড়ে যায় তবে…। | খোঁচাটা লাগলো প্রথমে শহীদের বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে। তারপর পিঠের সাত-আট জায়গায় এবং পাঁজরের দুদিকেও অনেকগুলো মৃদু খোঁচা অনুভব করলো শহীদ।
পকেটে হাত চলে গেল শহীদের তৃরিত বেগে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। বর্শার খোঁচাগুলো চেপে বসলো কাপড় ভেদ করে মাংসের উপর। সেই সাথে বিরাশি ১০৪
সিক্কার একটা রদ্দা পড়লো তার কাঁধে। অবশ হয়ে গেল একদিকের কাঁধ। তা
সত্ত্বেও পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে এনেছে শহীদ। কিন্তু কাজ হলো না। একজন জংলী মজা করার জন্যে, যেন মামার বাড়ির আবদার-শহীদের দু’দিকের কাঁধের উপর দিয়ে দুটো হাত বাড়িয়ে চাপ দিলো প্রথমে। তারপর দু’মণ ওজনের জংলীটা শহীদের কাঁধ ধরে ঝুলে পড়লো। হেসে উঠলো, একজন জংলী শহীদকে ভার সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল রিভলভারটাও। তুলে নিলো সেটা জংলীরা। তারপর বর্শার খোঁচা মারতে মারতে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো শহীদকে তাদের গ্রামের দিকে।
পনেরো-কুড়িজন জংলী দেখে শান্ত ছেলের মতোই হাঁটতে লাগলো শহীদ। সত্যিকথা বলতে কি, এদের হাত থেকে পালাবার মতলব আঁটছিল না সে। পালানো অসম্ভব তা তার বুঝতে বাকি ছিলো না।
সাত
এক রাজা। তার সাত মন্ত্রী। রাজার এগারো দু’গুণে বাইশজন স্ত্রী। সাত মন্ত্রীর সাত দু’গুণে চোদ্দ। পোষা কাকাতুয়া আছে রাজার এক ডজন। আর আছে তিনটে বাঁদর। মন্ত্রীদের প্রত্যেকের আছে একটি করে পোষা ইঁদুর। তাদের পকেটেই থাকে সেগুলো। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজার মাথার প্রশস্ত টুপিটি। টুপি নয়, যেন উদ্যান একটা। বাঁশেরই তৈরি জিনিসটা। তবে দু’হাত চওড়া সেটার জমি। লম্বায় আড়াই হাতের চেয়ে কম নয়। খাবার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে টুপিটার সমতল জমিতে। পায়রারা বসে সেখানে দানা খুঁটছে।
বাঁশের কেল্লায় রাজার বাস। কেল্লার মাঝখানে বিরাট বড় একটা ঘর। ঘর না : বলে মাঠ বলাই ভালো। ঐ ঘরটাই হলো দরবার বা কাঁচারি ঘর।
বৈকালিক দরবার বসেছে কাঁচারি ঘরে।
জংলীরাজ ‘হিরিরিরি’ আসন গ্রহণ করেছেন সবেমাত্র। কাকাতুয়া পাখিগুলো ঘরের বারোটা কোণে একটি একটি করে শিকল দিয়ে বাঁধা। এখানে বলে রাখা ভালো যে কাঁচারি ঘরটা সাত আট মানুষ হবে উঁচু এবং মোট বারোটা কোণ ঘরটার। রাজা হিরিরিরি-র তিনটে বাঁদরও এই রাজসভায় উপস্থিত। বলা বাহুল্য, বাঁদরগুলো তাদের বাঁদরামি এক দণ্ডের জন্যেও বন্ধ রাখেনি। ছাদের উপরদিকে। তিনটে বাঁশের সংস্থান করা আছে। সেখান থেকে একটা বাঁদর মুখ ভেংচাচ্ছে রাজাকে আদর করে। দ্বিতীয়টি একটি পা সারাক্ষণ রাজার দিকে তুলে ধরে রেখেছে। তৃতীয়টি অভিনয় শিল্পে ওস্তাদ বলে মনে হয়। রাজা যা করছে সে-ও তা। অনুকরণ করে চলেছে হুবহু। রাজা হাসলে সে-ও হাসে। রাজা রাগলে সে-ও রাগে।
আগেই বলা হয়েছে কাঁচারি-ঘরের বারোটা কোণ। বারোটা কোণের মাঝে
১০৫
মাঝে দুটো করে দরজা আছে উন্মুক্ত। মোট চব্বিশটা দরজা। প্রতি দরজায় গম্ভীর মুখ শান্ত্রী দাঁড়ানো। হাঁড়িপনা মুখ করে, হাতে চিত্রাঙ্কিত ঢাল নিয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা অনড়। ঢাল আছে, কিন্তু তলোয়ার নেই তাদের। তলোয়ারের বদলে প্রত্যেকের হাতে একটি করে দশসেরী গদা।
| রাজ-সভার প্রতি অধিবেশনে প্রজারা একবার করে হাজিরা দিয়ে যায়। কড়া নিয়ম এটা। প্রত্যেককেই দিনে দু’বার করে এই হাজিরা দিতে হবে। সকালে
একবার, তারপর আর একবার বিকেলে। | বিকেলের অধিবেশন চলছে এখন। দ্বীপের প্রজারা বেশিরভাগই উপস্থিত রাজসভায়।
নির্দিষ্ট রুটিন করা আছে রাজার কর্মের কোন সময় তিনি ঠাট্টা করে সময় কাটাবেন, কোন্ সময় তিনি বিচার পর্ব সারবেন, কোন্ সময় নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দেবেন তিনি, আবার কোন সময় শুধু শুধু হাসবেন–কোন কারণ ব্যতীতই। হাসবেন তিনি একনাগাড়ে নির্দিষ্ট একটা সময় ধরে। এবং তিনি যে একাই শুধু হাস্য পর্বের একমাত্র অভিনেতা হবেন তা নয়। রাজসভায় তখন যারা উপস্থিত থাকবে তাদের প্রত্যেককেই রাজার সাথে তাল রেখে হাসতে হবে।সাত মন্ত্রীরা
এবং রাজার স্ত্রীরাও হাসতে বাধ্য। ছোটো ছেলেপিলে থাকলে তারাও বাদ যাবে
। না হাসলে রাজার যখন নিষ্ঠুরতা প্রমাণ দেবার সময় আসবে তখন এই অপরাধের সাজা দেয়া হবে।
বিচারপূর্ব সবেমাত্র শুরু হয়েছে।
রাজা হিরিরিরি বসে আছেন উঁচু একটা মঞ্চের উপর বিরাট বাঁশের সিংহাসনে। সাত মন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তার পিছনে সারবন্দী হয়ে। বাবার ইন্তেজাম তাদের কপালে নেই। রাজার স্ত্রীরা বসে আছেন রাজার পদতলে। বাইশজন দুম্বা মার্কা মহিলা মুখে রঙয়ের কারুকার্য নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন কটমটিয়ে। মন্ত্রীদের স্ত্রীরা সকলেই এখন অনুপস্থিত। সাতজন মন্ত্রীর চোদ্দজন স্ত্রী কিছুক্ষণ আগে সতীনে সতীনে চুল ছেঁড়াঘেঁড়ি শুরু করেছিল। রোজকার ব্যাপার এটা। রাজা স্বয়ং তাদের মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বের করে দিয়েছেন রাজসভা থেকে। মন্ত্রীরা সকলেই আজ বেজায় খুশি রাজার এই বিচারে। ‘ রাজার পাশেই বসে আছে রাজকন্যা মিতি রিব। সদ্যপ্রাপ্ত নতুন স্বামীর দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। বসার নিয়ম রক্ষা করে আসন গ্রহণ করেনি সে। নতুন স্বামীর দিকে পাশ ফিরে বসেছে সে। ডান পা-টি তুলে দিয়েছে সে নতুন স্বামীটির কোলের উপর। নতুন স্বামী বেচারি এই দেশে নতুন তাই কি করলে আর কি না করলে, বলি দেয়া হবে তাকে তা সে জানে না। সেজন্যেই সম্ভবত সে। রাজকন্যার পা-টি অ’িযত্নের সঙ্গে টিপছে। বিদেশী রাজ-জামাতা বসেছে রাজ কন্যার পাশের আসনটিতেই। এই বিদেশী নতুন রাজ-জামাতাটি আসলে বাঙালী-বাংলাদেশেই তার বাস। নাম কামাল আহমেদ। ঢাকার প্রাইভেট
১০৬
ডিটেকটিভ শহীদ খানের সহকারী। শহীদ খানের সেই স্বনামখ্যাত বন্ধুই এ
কামাল।
জংলীদের নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিদেশীকে সমুদ্র তীরবর্তী ‘খাংখাবি কাংখাবি পাথরের উপর দেখা গেলে তাকে এক বৎসরের জন্যে রাজ-জামাতা করা হবে। দুর্ভাগ্যবশত কামালের লাইফবয়টা জোয়ারের সময় সেই সম্মানীয় ‘খাংখাবি। কাংখাবি পাথরের উপর উঠে থেমে গিয়েছিল। অজ্ঞান অবস্থায় পাথরটার উপর পড়েছিল কামাল। এমন সময় পাহারাদার একজন জংলী তাকে দেখতে পেয়ে সরবার তার পা চেটে নিয়ে ছুটে আসে রাজাকে সুখবরটা জানাতে। রাজা তখন। তার তিন বাঁদরকে মাথায় তুলে খেমটা নাচ নাচছিলেন। সুখবর শুনেই রাজকন্যাকে ডাকলেন তিনি। নিজের মাথা থেকে বাদর তিনটিকে চালান দিলেন তিনি যুবতী কন্যার মাথায়। তারপর নাপিত ডেকে কেটে ফেললেন নিজের মাথার সব চুল। নিয়ম অনুযায়ী করলেন এটা। চুলগুলো পাঠিয়ে দিলেন তিনি নতুন রাজ জামাতার কাছে। সে এগুলো কয়েকটা গোছা করে বেঁধে মালার মতো রবে নিজের গলায়। দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটা। আসলে রাজা যে নতুন এই বিদেশী মানুষটিকে জামাতা হিসেবে স্বীকার করে নিলেন এই দুর্গন্ধযুক্ত চুলের মালাই তার
প্রমাণ।
রাজার চুল নিয়ে ছুটলো মন্ত্রীরা। তাদের সঙ্গে চললো বাইশজন রানী পরস্পরের সঙ্গে চুল ভেঁড়াৰ্ছিড়ি করতে করতে। আর পাঠানো হলো রাজ-কন্যাকে। রাজকন্যার যাবার নিয়মও বাঁধা। হেঁটে হেঁটে যাবে সে সকলের আগে আগে। তার পিছনেই থাকবে একজন নাপিত। নাপিতেরও দরকার আছে। রাজ-জামাতার মস্তক-মুন করবে সে। নাপিতের পিছনে একটি চারবেহারার পাক্কি। রাজ জামাতাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হবে এতে করে। পিছনে পিছনে আরও অনেক কিছু চললো। | নাপিত অচেতন কামালের মাথা মুড়িয়ে দিলো। ঘুম ভাঙেনি এখনও তার। রাজকন্যা মিতি রিব নিজের হাতে গোছা বানিয়ে পরিয়ে দিলো গলায় চুলের মালা। এরপরই জ্ঞান ফিরলো কামালের।
জ্ঞান ফিরলো বটে কামালের। কিন্তু সচেতন হতে দেয়া হলো না তাকে। রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী আরো নানা ক্রিয়াকাণ্ড বাকি ছিলো। একটি একটি করে
সমাধা হতে লাগলো সেগুলো।
প্রথমেই রাজকন্যা মিতি রিব হাঁটু মুড়ে প্রণাম জানালো কামালের জ্ঞান ফিরতে। হতভম্ব কামাল চোখ কচলাতে লাগলো বেদম। কিন্তু কিছুই পরিষ্কার বলে মনে হলো না, তার চোখে। স্বপই এসব কাণ্ড ঘটতে পারে, তার ধারণা হলো।
মিতি রিব প্রণাম সেরে কামালের চোখ দুটো বন্ধ করে দিলো আঙুলের চাপ দিয়ে। চোখ বন্ধ করে রইলো কামাল। চোখ বন্ধ করেই কেমন যেন সন্দেহ হলে। তার একটা। বাঁ হাতটা মিলতি রিব কোলের উপর টেনে নিয়ে রঙ মাখাচ্ছে। ডান
১০৭
হাতটা মাথার উপর ওঠালো সে। তার সন্দেহ হয়েছে মাথাটা অতিরিক্ত হালকা হালকা ঠেকছে।
নিজের কামানো মাথায় হাত, পড়লো কামালের। বজ্রাঘাত পড়লো যেন মাথায়। একেবারে চাঁছাছোলা মাথাটা! চুল বলতে এক গাছিও নেই।
কিন্তু হতভম্ব হবার আরো উপকরণ তার জন্যে প্রস্তুত ছিলো। একটু পরই মিলতি রিব তার চোখ দুটোর পাতা খুলে দিলো আঙুল দিয়ে। একি! চমকে উঠলো কামাল তার সামনে দুটো কালকেউটেকে ফণা তুলে দুলতে দেখে। কামালকে আঁতকে উঠতে দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠলো মিতি ৱিব। তারপর দু’হাতে করে দু’বাটি দুধ নিয়ে এসে কামালের হাতে দিলো সে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সম্ভবত কামাল। কিন্তু ভিতর ভিতর নাভিশ্বাস উঠছে তার তখন। হার্টবিটগুলো পরস্পরের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। কাঁপা হাতে বাটি দুটো নামিয়ে রাখলো সে পাথরের উপর। ব্যস! অমনি কেউটে দুটো মাথা হেঁট করে। খেতে শুরু করলো বাটির দুধ। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো এবার কামালের। বোঝা গেল কেউটে দুটো পোষা।
| বিভিন্ন প্রকার আচার-অনুষ্ঠান চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে কামাল বুঝলো, স্বপ্ন নয় এসব। নিষ্ঠুর বাস্তব। ‘
পাল্কি চড়ে রাজ-সভায় যেতে যেতে কামাল মিলতি রিব-কে প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কি, কন্যা?’
জালকি ফালকি ফঃ!’ মিলতি রিব কামালের প্রশ্ন বুঝতে পারলো না। সে তার নিজের ভাষায় বললো, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে গো!’
কামাল হাসি সামলে জিজ্ঞেস করলো,”জালকি ফালকি” তোমার নাম বুঝি। | মিতি রিব এবার তার ভাষায় আদর করে যা বললো তার অর্থ তুমি আমার সুন্দর গাধা!
কামালকে কথায় পেয়ে বসেছে। চুপ করে বসে থাকতে পারছে না সে অপূর্ব সুন্দরী জংলী রাজকন্যার সামনে। কবিত্ব করে এবার সে বললো, কোথায় নিয়ে চলেছে আমাকে, সুন্দরী?” | রাজার তিন বাঁদরও সঙ্গে ছিলো মিতি রিব-এর। অভ্যাস মতো বাঁদরামি করছিল তারা। কামালের কথা শুনে কি অর্থ গ্রহণ করলো মিতি রিব খোদা মালুম। তিনটে বাঁদরকেই কাছে ডেকে’কামালের কাঁধে চড়িয়ে দিলো সে। থ মেরে গেল এবার কামাল। এরপর একটা পাকা কলার খোসা ছাড়িয়ে কামালের মুখের সামনে ধরলো রাজ-কন্যা। কিন্তু কপালে নেই ঘি, ঠকঠকালে হবে কি! বাঁদরগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়লো কলাটার উপর। দেখতে না দেখতে, অদৃশ্য হলো সেটা। এরপর রাজকন্যা সরিয়ে দিলে বদরগুলোকে অন্যত্র। আবার সে একটা কলা কামালের মুখের সামনে ধরলো।
১০৮
.
খিদে যা পেয়েছিল কামালের তা বলার নয়। একটি মাত্র কলা দেখে নিরাশ হলো সে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সে বললো, “শুধু কলা হলে চলবে না, আরো কিছু খেতে দাও আমায়। ব খিদে পেয়েছে।
| উল্টা বুঝিলি রীম! মিতি রিব মনে করলো তারুনতুন স্বামী বলছে-খিদে নেই আমার। তুমি আমাকে খাবার জন্যে অনুরোধ করো না, সুন্দরী।
কলাটা ফিরিয়ে নিলো রাজকন্যা মিলতি রিব। পরিতৃপ্তির সাথে নিজে খেতে লাগলো সেটা। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে রইলো কামাল। তারপর মনে মনে সে বললো, মেয়েটা দেখছি আমার চেয়েও পেটুক!’
অবশ্যি রাজপ্রাসাদে গিয়ে অপরিমিত ভোজন সেরে নিয়েছে কামাল। সত্যি কথা বলতে কি, রাজপ্রাসাদে ঢুকে অবৃদি এখন পর্যন্ত খাবার উপর দিয়েই আছে। সে। কলা সংক্রান্ত দুর্ঘটনাটার কথা ভুলে গেছে বেমালুম। পাকা কলার অগুণতি ছড়া এখন তার সামনে রাখা রয়েছে।
কলা বলে কথা নয়। আপেল, আতা, বেল, মুলো, মটরশুটি, ছোলা ইত্যাদি স্তূপ করা তার সামনে। মাংসের মধ্যে-ভেড়া, হরিণ, শুকর, বক, বনমুরগী ইত্যাদি আগুনে ঝলসানো হচ্ছে একদিকে। যখন যেটা হচ্ছে সেটাই নিয়ে আসা হচ্ছে জামাতার সামনে। পানীয় আছে নানা জাতের। মাদকদ্রব্যও বাদ যায়নি।
আট
রাজার এখন হাস্য উদগীরণ করার সময়। হাসাহাসি চলছে কর্ণবিদারী কণ্ঠে। মন্ত্রী পরিষদ, প্রজা, মহিলা, পুরুষ, ছেলে এবং মেয়ে-সকলেই হাসছে রাজার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু রাজার গলার হাসি! তুলনা হয় না। সকলকেই লজ্জা পেতে হয় তাঁর গলার জোর দেখে। ‘
| প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারলো না কামাল। সকলকে বেদম বেগে হাসতে দেখে সে ভাবলো, আরে! ব্যাপারখানা কি? পাগল হয়ে গেল নাকি এরা সবাই?
| এক মিনিট কাটলো, দুমিনিট কাটলো। এমনিভাবে পাঁচ মিনিট কাটলো দেখতে দেখতে। কিন্তু হাসি আর থামে না কারো। এদিকে রাজ-কন্যা মিলতি রিব কামালের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আসন থেকে ঢলে পড়ছে সে হাসির দমকে। মিতি রিব-এর পাগলিনী পারা হাসি দেখে বোকার মতো কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো, . কামাল। যার দিকেই তাকায় সে, তাকেই দেখে মহা রগড় দেখে সে যেন কোনমতেই হাসি চাপতে পারছে না। কিংবা কেউ যেন সকলের পেটে বা বগলে। সুড়সুড়ি দিচ্ছে মজা পাবার জন্যে।
ছোঁয়াচে ব্যারাম এই হাসি। প্রথম মৃদু একটু হাসলো কামাল জংলীগুলোকে পাগল-ছাগল মনে করে। তারপর দেখতে না দেখতে সে নিজেই পাগল-ছাগলে রূপান্তরিত হলো। রাজকুমারী মিতি রিবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু করলো সে
১০৯
তার হাসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে রাজা হিরিরির-কেও ছাড়িয়ে গেল হাসির উচ্চগ্রামের দিক দিয়ে।
মহা সর্বনাশ! একবার শুরু হলে এ যে আর থামতে চায় না রে বাবা! হাজার চেষ্টা করেও মুখ বন্ধ করতে পারছে না কামাল। হাঁপিয়ে গেছে সে। দরদরিয়ে ঘামছে। ক্রমে চোখ দুটো হয়েছে ফালাফালা। কিন্তু তা সত্ত্বেও থামাতে পারছে না।
সে নিজের হাসি।.এমন সমস্যায় কামাল ছাড়া আর কেউ পড়েছে কিনা সন্দেহ।
হঠাৎ, হঠাৎ-ই হাস্যরোলটা যেন দম আটকে থমকে গেল।
রাজা থামলেন। মন্ত্রীরাও হাসি থামালো। রানীদেরও মুখ থেকে উবে গেল হাসি। রাজাকে হাস্য সংবরণ করতে দেখে প্রজাদেরও অট্টহাস্য দম আটকে থমকে * গেল। সবশেষে থামলো কামালের হাসি।
| কি ব্যাপার।
উঠে দাঁড়ালেন রাজা হিরিরিরি ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে। কড়া দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে তার দক্ষিণ দিকের একটা দরজার সামনে। দক্ষিণ দিকের ঐ দরজা দিয়ে। নিয়ে আসা হচ্ছে একজন বিদেশী লোককে। তাকে ঘিরে এগিয়ে আসছে রাজার অনুচরেরা ঢাল এবং গদা হাতে নিয়ে। বিদেশী একজন শত্রুকে বন্দী করে ধরে নিয়ে আসছে তারা। শত্রুর কাঁধে একটা বোঝ দেখা যাচ্ছে। মৃত ভালুক সেটা একটা। এবং বলাই বাহুল্য, জংলীদের এই বিদেশী শত্রু আসলে আমাদের পূর্ব পরিচিত গোবর্ধন গফুর।
গফুরকে দেখার আগে কামাল দেখতে পেলো মি. সিম্পসনকে। মি. সিম্পসনের কাঁধেও বোঝা দেখা যাচ্ছে। তাঁর বোঝাটা রীতিমত ভীতিপ্রদ। দু’দুটো জংলীর লাশ তার কাঁধের উপর। পুব দিকের একটি দরজা দিয়ে রাজার অনুচরেরা তাকে নিয়ে এসেছে বন্দী করে। | ফুলঝুরির মতো ঝিলিক মারলো কামালের চোখের তারা দুটো। কিন্তু ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে মি. সিম্পসনের দিক থেকে। যেন কোনো কালেই মি. সিম্পসনের সঙ্গে তার পরিচয় ছিলো না। মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ দিকে তাকালো। কামাল নির্বিকার ভঙ্গিতে। দ্বিতীয়বার ঝিলিক মারলো তার চোখের তারা। গফুরকে দেখতে পেয়েছে সে। গফুরও কামালকে দেখতে পেয়েই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে। উঠলো হাউমাউ করে, কামালদা, মেরে ফেললো এরা আমাকে বাঁচাও আমায়!’।
| নিষ্ঠুরের মতো মুখ করলো কামাল। চিনতে পারেনি যেন সে গফুরকে। মুখ ফিরিয়ে নিলো উত্তর দিকে। উত্তর দিকে তাকাতেই কামালের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো পলকের জন্যে। শহীদ! উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বন্দী অবস্থায় শহীদ খান।
‘কামাল!’ মি. সিম্পসন ডেকে উঠলেন আকুল কণ্ঠে। শহীদকেও যেন চিনতে পারেনি কামাল। মি. সিম্পসনের ডাকে তার দিকে ফিরলো কামাল আস্তে আস্তে . ঘাড় বঁকিয়ে। তারপর রাজার দিকে তাকালো সে মৃদু হেসে।
হায় হায় করে উঠলো মি. সিম্পসন এবং গফুর। কামাল তাদেরকে চিনতে
১১০
,
পারলো না!
বউয়া’! | চিৎকার করে কি যেন বললেন রাজা হিরিরিরি। অমনি ছুটলো দুজন অনুচর। রাজ-সভা থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল তারা। ফিরলো আধ মিনিটের মধ্যেই। কামাল দেখলো জংলী:দুজন একটা মোটাসোটা শূকর ধরে নিয়ে এসেছে।
মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন রাজা হিরিরিরি।, জংলী দুজন শূকরটাকে একটা বড় পাথরের উপর চিৎ করে ধরে রেখেছে। এগিয়ে গেলেন রাজা সেই দিকে। সমস্ত রাজ-সভা অধীর উত্তেজনায় দম বন্ধ করে তাকিয়ে আছে উন্মত্ত রাজার দিকে। পাঁচশো জংলীর এক হাজার চোখ হিংস্র দৃষ্টিতে মাঝেমাঝেই একবার করে দেখে নিচ্ছে তিন তিনজন বিদেশী শত্রুকে। টু-শব্দটি নেই কারো মুখে।
একটি গদা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন রাজা চিৎ করে ধরা শুকরটার কাছে। মি. সিম্পসনের দিকে আঙুল দেখিয়ে রাজা চিৎকার করে উঠলেন, কারাই বা কা। কিরি চস-হিরিরিরি।’ অর্থাৎ রাজা হিরিরিরি ঐ বিদেশীটার শাস্তির ব্যবস্থা
করেছে। কথাটা বলেই হাতের দশসেরী গদাটা দিয়ে পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শূকরটার ঘাড়ে-মাথায় আঘাত করতে শুরু করলেন। অর্থাৎ এই ভাবে মি, সিম্পসনকে শাস্তি দেয়া হবে।
| এক মিনিট ধরে চললো এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড! রাজার গলা থেকে গুম গুম একটা অদ্ভুত শব্দ বের হতে লাগলো প্রতিটি আঘাত করার সময়। আর অসহায় শূকরটার আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস চঞ্চল হয়ে উঠলো যেন ভায়ে। | শূকরটাকে হত্যা করেই খেমটা নাচ শুরু করলেন রাজা হিরিরিরি। এমনিতেই তিনি অর্ধনগ্ন নাচের ঠমকে এবার তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু কোনোই খেয়াল নেই তাঁর ঐ তুচ্ছ ব্যাপারে। নাচে পেয়েছে এখন তাকে। | বেশ কিছুক্ষণ নাচার পর থামলেন রাজা। গাছের বাকলটা আবার কোমরে জড়িয়ে নিয়ে আঙুল বাড়িয়ে গফুরের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারপর আবার তার চিৎকার শোনা গেল, কারাই বা কা, রাপুন রা। অর্থাৎ ‘ঐ লোকটাকে খেমটা নাচ নাচাও এক্ষুণি।
দুজন জংলী গফুরকে ধরে রাজসভার মাঝখানে নিয়ে এলো। তারপর ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো কি করতে হবে। ইঙ্গিতটা ঠিকই বুঝতে পারলো গফুর। কিন্তু নাচবে কেন সে? ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে কামালের দিকে তাকিয়ে। ঠোঁট দুটো আধ ইঞ্চি ফাঁক হয়ে গেছে তার-কামালদার ব্যবহারে এতোই অবাক হয়েছে সে।
খেচাটা লাগলো পিছন দিক থেকে। ঠিক বাঁ পায়ের হাঁটুর পিছন দিকে। হাঁটু মুড়ে পড়েই যাচ্ছিলো গফুর। ধরে ফেললো একজন জংলী। পড়ে যাওয়া চলবে না। দাঁড়িয়ে থাকো। দাঁড়িয়ে থাকাও চলবে না আসলে-নাচো!’
| রাজার হুকুম-নাচো! ইঙ্গিতে আবার সে কথা বুঝিয়ে দেয়া হলো গফুরকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে কামালের দিকে। কামাল অন্য একটা কাজে ব্যস্ত। রাজকন্যা “মিতি রিবে’র মুখে মটরশুটি তুলে দিচ্ছে সে।
১১১
দুজম জংলী এগিয়ে এলো গফুরের দিকে এবার। তাদের দুজনেরই হাতে একটি করে গরম আগুনে শিক।
{ উপায় নেই কোনো। নাচতেই হবে। তা না হলে গরম শিক দুটোর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো গফুর। তারপর আর কাল বিলম্ব না করে নাচ শুরু করলো
. সে।
ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর। দেহটার ওজন কম নয়। তার উপর কাঁধে দু’মণি ভালুকটা চাপানো রয়েছে।
চোখ ফেটে জল এসে পড়লো গফুরের। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সে তার . দাদামণি শহীদ খানের দিকে। শহীদ তখন ইঙ্গিত করে কি যেন বলছে মি. সিম্পসনকে। নাচতে নাচতে ডুকরে উঠলো গফুর-কামালদা, ভুলে গেলে
আমাদেরকে!’
‘ এমন সময় রাজা হিরিরিরির দিকে তাকিয়ে তার পোষা বাদর তিনটি কিচ কিচ করে উঠলো। উপর দিকে তাকালেন রাজা। উপর দিকে তাকাতেই তিনটে বাঁদর বাঁদরামি করে একটি করে পা রাজসভার মাঝদিকে তুলে ধরলো। খিটখিটিয়ে হেসে ফেললেন রাজা হিরিরিরি। তারপর একজন অনুচরকে ডেকে কি
যেন বললেন তিনি। জংলী অনুচরটি শহীদের কাছে এগিয়ে এলো ভারি পদক্ষেপে। তারপর ইঙ্গিত করে বোঝালো-একটি পা মাটিতে না রেখে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখতে। বিনাবাক্যব্যয়ে.শহীদ মেনে নিলো সেটা।
শহীদের শাস্তির ব্যবস্থা সারা হতেই একজন মন্ত্রী কিচিরমিচির করে কি যেন বললো রাজা হিরিরিরি-র কানে কানে। বিদঘুঁটে হাসি ফুটলো রাজার মুখে। অনুচরেরা ছুটলো রাজার ইঙ্গিত পেয়ে। কাকাতুয়া পাখিগুলো নিয়ে এসে দাঁড়ালো তারা মি, সিম্পসনের কাছে। পাখির ডানার মতো হাত দুটো দুদিকে মেলে দিতে ইঙ্গিত করা হলো মি. সিম্পসনকে। নিরুপায় হয়ে শহীদের দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন। মাথা ঝাঁকালো শহীদ। অর্থাৎ যা করতে বলে ওরা আপাতত তাই করে। যান।
হাত দুটো ডানার মতো মেলে দিতেই প্রতি হাতে ছ’টি করে কাকাতুয়াকে বসিয়ে দেয়া হলো। অমনি বিদঘুঁটে ডাক জুড়ে দিলো তারা। অবশ্যি মি. সিম্পসনের গাম্ভীর্য তাতে নষ্ট হলো না একবিন্দুও।
এদিকে গফুরের নাচ চলছে একনাগাড়ে।
চালাকি করে একবার ধপাস করে বসে পড়েছিল গফুর। ভালুকটাকে ফেলে দিয়েছিল কাঁধ থেকে। কিন্তু তার এই ফাঁকিবাজির দরুন বর্শার খোঁচা খেতে হয়েছে তাকে আবার একটা। এখন তার দিকে একজন জংলী নজর রেখেছে বর্শা উঁচিয়ে। বসে পড়লে বা নাচে ঢিলেমি দেখলেই খোঁচা মারবে সে যেখানে সেখানে। সুতরাং ফাঁকি দেবার কথা এখন ভাবতে চাইছে না গফুর। এই দুর্ভোগ তার কপালের লিখন। সইতেই হবে যতক্ষণ প্রাণ আছে। এতকথা ভেবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে বটে গফুর। কিন্তু দরদর করে চোখ দুটো থেকে জলের ধারা গড়াচ্ছে
১১২.
তার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মাঝে মাঝে বলছে সে,’ কামালদা, তুমি একটা জংলী মেয়েকে পেয়ে ভুলে যেতে পারলে আমাদেরকে! |
তিনচার মিনিট পরই মি:সিম্পসনের হাত দুটো ব্যথায় টনটনিয়ে উঠলো। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সিনিয়র অফিসার মি. সিম্পসনের গাম্ভীর্য ভেঙে খান :: খান হয়ে গেল এবার। করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি কামালের দিকে। তারপর
অতি দুঃখে জানতে চাইলেন চিৎকার করে, কি অপরাধ করেছিলাম আমরা তোমার, কাছে, কামাল! আশ্চর্য, তোমাকে চিনতে পারিনি এতো দিনেও!’
কামাল শুনতেই পায়নি যেন মি, সিম্পসনের কণ্ঠস্বর। একটা হরিণের ঝলসানো রান তুলে নিলো সে নিজে। আর একটা দিলো রাজকুমারী মিতি রিবকে। দুজনে চোখে চোখে তাকিয়ে থেকে একই সঙ্গে কামড় বসালো মাংসে।
ট্রেনিং দেয়া কাকাতুয়া। মি. সিম্পসনের হাত দুটো ব্যথায় নড়েচড়ে উঠলেই কাকাতুয়াগুলো মি. সিম্পসনকৈ চক্কর মেরে ওড়ে একবার। তারপর ঠোকর মরে মি. সিম্পসনের মাথায়। আবার এসে বসে হাতে।
গফুরকেও মঞ্চের মাঝখানে নিয়ে আসা হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে নাচছে সে : অসমান তালে। রাজসভার সকলে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে গফুরের ভুড়ির নাচন : দেখে। সকলের দৃষ্টি এখন গফুর এবং মি. সিম্পসনের দিকেই নিবদ্ধ।
কতক্ষণ এই ভেলকিবাজী চলতো বলা যায় না। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো রাজসভায়। সাত-আটজন জংলী একজন আর একজনের মাথার উপর চড়ে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো সেখানে। কে কার মাথার উপড় চড়ে আছে বোঝা মুশকিল। দুজনের দুজোড়া পা শূন্যে ঝুলছে দেখা গেল। মাঝখানের। মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না। তার উপর সাত-আটজন জংলী ঝুলে আছে চিনেৰ্জোকের মতো। বিকট কণ্ঠে চিৎকার করছে তারা রাজার দিকে তাকিয়ে। অথচ অতগুলো মানুষের সচল পুঁটলিটা ছুটে চলে এলো মঞ্চের মাঝখানে। তারপরই অকস্মাৎ সবগুলো ঝুলন্ত জংলীই যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে ছিটকে পড়লো চারপাশে। কেউ চিৎ হয়ে কেউ উপুড় হয়ে মাটিতে পড়লো তারা। কাতরাতে লাগলো ব্যথা পেয়ে। এতোক্ষণে দেখা গেল মাঝখানের মানুষটিকে-কুয়াশা!
| অনড় দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা জঞ্জালগুলোকে ফেলে দিয়ে। হাতে তার লেসারগানটা ধরা রয়েছে এখনও। অবয়বে ক্লান্তি এবং দুশ্চিন্তার পাণ্ডুর মেঘ।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো কুয়াশা। রাজসভার সকলে বিশালদেহী এই মানুষটিকে দেখে থমকে গেছে। রাজা হিরিরিরি পর্যন্ত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
শহীদকে দেখতে পেয়ে মৃদু হাসি ফুটলো কুয়াশার ঠোঁটে। মি. সিম্পসনকেও দেখতে পেলো সে। হাসলো। গফুর এই সুযোগে নাচে ক্ষান্ত দিয়েছে। ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে সে ভালুকটাকে। কুয়াশা তার দিকে তাকিয়েও হাসলো। কিন্তু মহুয়া নেই তো! চঞ্চল দৃষ্টিতে উঁচু মঞ্চের দিকে তাকালো কুয়াশা। মহুয়া নয়, ৮ ,,,
১১৩
কামালকে দেখতে পেলো সে রাজকীয় পরিবেশে। চোখ ফিরিয়ে নিলো কামাল কুয়াশা তার দিকে তাকাতেই।
ইঙ্গিতে কুয়াশা জানতে চাইলো শহীদের দিকে মুখ করে, মহুয়ার খবর
জানোক।
মাথা নেড়ে শহীদ ম্লান মুখে জানালো-না। ঠিক এমনি সময়ে ওদের সকলের দুশ্চিন্তার কারণ দূর হয়ে গেল! রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলো প্রধানমন্ত্রীর দুই স্ত্রী মহুয়াকে নিয়ে।
অপূর্ব একটি সুন্দরী রমণী দেখে জংলীরা বোবা হয়ে গেল যেন। কারো মুখে টু-শব্দ নেই। বাচ্চারা পর্যন্ত উঁা-ফোঁ করতে ভুলে গেল। কিন্তু হিরিরিরি হলেন . গিয়ে হাজার হাজার প্রজার রাজা! তিনি কখনো শত্রুপক্ষের রূপ-গুণ দেখে মোহিত
হতে পারেন না। তার পক্ষে কর্তব্যই প্রধান ব্যাপার।
কির কির হাপুস!’
চিৎকার করে উঠলেন তিনি। অমনি রুখে দাঁড়ালো প্রধানমন্ত্রীর দুজন স্ত্রী পরস্পরের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তিন হাত দূরে ছিলো ওরা পরস্পরের। ‘ পাগলিনীর মতো দু’হাত বাড়িয়ে লাফিয়ে পড়লো একজন অন্যজনের ঘাড়ে। শুরু
হয়ে গেল চুল ছেঁড়াছিড়ি। : আধমিনিট পূরই রাজার আদেশে বন্ধ হলো দুই সতীনের যুদ্ধ। রাজা হিরিরিরি মহুয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে কুৎসিত হাসিতে ভেঙে পড়লেন। অর্থাৎ মহুয়াকে এই ভাবে চুল ছেঁড়াঘেঁড়ির লড়াই করতে হবে। সম্ভবত রাজার ধুমসী স্ত্রীর সঙ্গে যুদ্ধটা করতে হবে মহুয়াকে দেখা গেল ভাটার মতো দুটো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মহুয়ার দিকে তাকাতে তাকাতে উঠে দাঁড়ালো সে।
কিন্তু রাজা তাকে বসার আদেশ দিয়ে সদ্যপ্রাপ্ত জামাতার দিকে তাকালেন। * কুয়াশাকে দেখিয়ে কামালকে তিনি ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ ঐ লোকটার শাস্তির
ব্যবস্থা তুমি করো তো, বাপু! . | সুযোগটা পেয়ে কৃতার্থের হাসি হাসলো কামাল রাজার দিকে ফিরে। মিলতি রিবের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো সে। একে একে তাকিয়ে দেখলো সে একপেয়ে শহীদকে, ডানা মেলা মি. সিম্পসনকে, অর্ধ আবৃত ভূড়ি সমেত গফুরকে, অচঞ্চল কুয়াশাকে এবং ভীত-সন্ত্রস্ত মহুয়াকে। তারপর ফিক ফিক করে হাসলো সে রাজকন্যা মিতি রিবের দিকে তাকিয়ে।
মিলতি রিবের মুখেও মিটিমিটি হাসি। কামাল এবার তার সামনে রাখা খাদ্য সম্ভারের দিকে তাকালো।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন এই সময়, কামাল, কিছু একটা করো, ভাই! পারছি না যে আর! | ঝট করে মুখ তুলে তাকালো কামাল মি. সিম্পসনের দিকে। আগুন ঝরছে যেন তার দৃষ্টিতে। জামাতার ক্রোধ তাদেরই মতো জোরালো দেখে তৃপ্ত হলেন রাজা হিরিরিরি। মন্ত্রীদের দিকে তাকালেন তিনি তাঁর ধারণার সমর্থন পাবার ১১৪
জন্যে। মাথা নেড়ে একই সঙ্গে সায় দিলো সাতজন মন্ত্রী।
মি, সিম্পসনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঝুঁকে পড়লো কামাল পায়ের সামনে স্কুপীকৃত খাদ্য-সম্ভারের দিকে। একটা আপেল তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো সে সেটা মি, সিম্পসনের দিকে। দু’হাত দিয়ে ধরে নিলেন সেটা মি. সিম্পসন। উড়ে গেল কাকাতুয়াগুলো ভয় পেয়ে। প্রচণ্ড খিদেয় মারা যাচ্ছিলেন যেন মি. সিম্পসন। আপেলটা ধরেই কামড় লাগালেন তিনি। ইতিমধ্যে আর একটি আপেল তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরেছে কামাল। অসতর্ক থাকায় সেটি এসে লাগলো মি. সিম্পসনের কপালে।
কোনদিকেই এখন খেয়াল নেই কামালের। সে যেন পাগল হয়ে গেছে অন্ধ ক্রোধে। একটি করে আপেল তুলছে সে, ঝুঁকে পড়ে আর মুখে বলছে-খাও খাও! ধরো আরও খাও?
| শহীদ, কুয়াশা এবং গফুরকেও ছুঁড়ে মারলো কামাল অনেকগুলো আপেল। কিন্তু মহুয়ার বেলায় আর আপেল হলো না। শেষ হয়ে গেছে সব আপেল। কিন্তু থামলো না কামাল। হরিণের ঝলসানো একটা রান তুলে নিলো সে। ছুঁড়ে মারলো। সেটা মহুয়ার দিকে।
| কামালের চিৎকার শুনে জংলীরা ভাবছে গালাগাল দিচ্ছে সে ধৃত শত্রু গুলোকে। এবং খাবার ছুঁড়ে মারার অর্থ করলো তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। ঘামাতার এসব যোগ্যতা দেখে রাজা হিরিরিরি তো খুশিতে আটখানা হয়ে পড়লেন। এমন সময় দু’হাত তুলে সকলকে চুপ করতে বললো কামাল। ফিসফাস করে রাজ-জামাতার প্রশংসা করছিল প্রজারা। আদেশ পেয়ে চুপ করলো তারা।
‘উলু কা পাঠঠা, শালার বেটা শালা, পেঁচামুখো বান্দর, শুয়োরখেকো হারামখোর’,
এতগুলো গাল দিয়ে দম নিয়ে নিলো মাল। তারপর আবার শুরু করলো, শালার বেটা শালা হিরিরিরি-র বাচ্চা, তুমি হারামজাদা আমার নিজের লোক গুলোকে এভাবে শাস্তি দেবার কে হলে শুনি?’ | জামাতার মুখে নিজের নাম শুনে খুশিতে ডগমগ রাজা হিরিরিরি। সব কথা। বুঝতে পারেনি সে। কিন্তু নিজের নাম শুনেই ধারণা করে নিয়েছে সে আসল ব্যাপার। জামাতা শত্রুদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে নিশ্চয় রাজা হিরিরিরি-র প্রভাব প্রতিপত্তি কতো ভীষণ। জামাতার গুণাবলী’যতাই দেখেন ততোই মোহিত হতে থাকেন রাজা।
‘জংলী কেউটে হিরিরিরি, জানিস কাকে কাকে ধরে এনেছে তোর পিচ্চিগুলো? শহীদ খান, হুঁ হুঁ বাবা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ও। মি. সিম্পসনকে চিনিস তুই নেংটা ভূত? আর কুয়াশা! জানিস পদ্মা-মগুঁজে হিরিরিরি-র পো, কুয়াশা তোর কি করতে পারে? তুই শালা আমার মাথা চেঁছে বেল করেছিস কোন্ আক্কেলে?”
* বক্তৃতায় পেয়েছে কামালকে। একনাগাড়ে বক্তৃতা দিলো সে রাজা হিরিরিরি এবং তার প্রজাদের উদ্দেশে। স্রেফ বিশুদ্ধ গালাগালি বের হলো তার মুখ থেকে।
১১৫.
এর মধ্যে কতো মাথা খাঁটিয়ে কতো যে নতুন নতুন গালাগালির জন্ম দিলো সে, তা। গুণে শেষ করী যায় না। এমনকি গফুরও লজ্জা পেলো তার কামালদার এমন। অসাধারণ প্রতিভা দেখে। ৯।
ইতিমধ্যে কুয়াশার হাত থেকে লেসারগানটা কেড়ে নিয়েছে কামাল। বক্তৃতার। সবশেষে সে বললো, “আচ্ছা কুয়াশা, তোমাদেরকে আজকের মতো বাঁচিয়ে দিচ্ছি। আজ তোমাদেরকে জেলখানায় বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। তোমাদেরকে এদের হাত থেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় এই লেসারগান। এখন এটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা বলে দাও।’
| কুয়াশাকে এই সব কথা বলার সময়ও কামালের চোখ-মুখ যেন ক্রোধে লাল। হয়ে উঠেছে। হিরিরিরি জামাতার বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা দেখে একটা কাণ্ড করে বসলো।. তার মাথার বেঢপ টুপিটা খুলে পরিয়ে দিলো সে নিজ হাতে কামালের মাথায়। টুপিটার উপরটা বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে সমতল। দানা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেখানে। কয়েকটা পায়রা দানা খুঁটতে উড়ে এলো কামালের মাথার টুপির উপরে। ‘
| হাসলো কামাল। রাজকন্যা মিলতি রিব এগিয়ে এলো এবার। হাতে তার রঙের পাত্র। পাখির পালক দিয়ে রঙ মাখিয়ে দিলো সে কামালের সারা মুখে। রঙ মাখানো হয়ে যেতে কামাল রঙের পাত্রটা নিয়ে রাজা হিরিরিরি এবং রাজকন্যা মিলতি রিব-এর মুখে রঙ মাখালো খুব করে। প্রজাদের মুখে হাসি আর ধরে না, রাজ-জামাতার কাণ্ড দেখে। কামাল হাসিমুখে তাকালো তাদের দিকে। তাকিয়ে বললো, উল্ল কা পাঠঠা!’
জংলীরা একবাক্যে বলে উঠলো, মিখা মিখা!’ অর্থাৎ ধন্য! ধন্য!!’ | আবার সে কুয়াশাকে বললো, কুয়াশা, লেসারগানটা ব্যবহার করার নিয়মটি কি?
মুখ খুলেছিল কুয়াশা। কিন্তু পাঁচশো লোক এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো। শত্রুদের কথা শুনতে আপত্তি তাদের। কামাল, সকলের দিকে তাকালো। আবার একটা গাল দেবার জন্যেই মুখ খুলতে চাইছিল সে। কিন্তু তার আগেই…
‘ও মাগো।’ মহুয়ার ভীত কণ্ঠস্বর।
ধুমসী রানী এগিয়ে যাচ্ছে লড়াই করার জন্যে মহুয়ার দিকে। হেলতে দুলতে মত্ত-হস্তিণী এগোচ্ছে যেন।
রাজা হিরিরিরি-র এখন নিষ্ঠুরতা প্রমাণ দেবার সময়। ধুমসী রানীকে ইঙ্গিত করছেন তিনি মহুয়ার দিকে এগোতে।
বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পারলো সঙ্গে সঙ্গে কামাল এতো তাড়াতাড়ি এমন, একটা কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে তাকে তা সে ধারণা করেনি। দিশেহারা হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে তার। ধুমসী রানীকে কোনমতে সুযোগটা দেয়া যায়
। মহুয়াকে ফেড়ে ফেলবে সে।
‘হিরিরিরি!’ ১১৬
| গলা ফাটিয়ে ডেকে উঠলো কামাল। রাজা তাকালেন জামাতার দিকে। হাসলো কামাল। তারপর পা পা করে এগিয়ে গেল সে রাজার কাছে। কি করবে কি ভাববে বুঝতে পারছিল না কামাল। কিন্তু হাঁটতে গিয়েই তাল সামলানো দায় হয়ে পড়লো তার পক্ষে। মাথায় সাত সের ওজনের টুপিটার জন্যে টুমল করে উঠলো, তার শরীরটা। অমনি একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। টুপিটা হিরিরিরি তার মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন কেন? মনে পড়লো কামালের ঘটনাটা। রাজার প্রতীক এই বিরাটাকার টুখিটা। কুয়াশাকে শাস্তি দেবার জন্যে টুপিটা পরিয়ে দিয়েছিলেন রাজা তাকে।
| চিৎকার করে ডেকে উঠেছিল কামাল রাজার নাম ধরে। সকলে তাকিয়ে আছে এখন তার দিকে। ধুমসী রানীও দাঁড়িয়ে পড়েছে। কামাল রাজার সামনে গিয়ে পঁড়িয়ে ইঙ্গিতে টুপিটা দেখালো। ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হলো না হিরিরিরি-র। কিন্তু কামালকে বোকা বানিয়ে টুপিটা খুলে নিয়ে পরে নিলেন হিরিরিরি নিজের। মাথায়।
অকস্মাৎ প্রধানমন্ত্রী তার পকেট থেকে পোষা ইঁদুর দুটো বের করে খেলাতে লাগলো। তারপরই ঝড়ের বেগে প্রবেশ করলো তার প্রথম স্ত্রী রাজসভায়। ইঁদুর দুটো নজরে পড়ছে তার। চুল ছেঁড়াছিড়ির লড়াই দেখতে খুবই ভালবাসে। প্রধানমন্ত্রী। ইঁদুর দুটো পকেট থেকে বের করেছে সে তার স্ত্রীর দৃষ্টিতে পড়ার।
নেই। এই ইঁদুর বের করার অর্থ হলো-যুদ্ধক্ষেত্রে নামো।
| প্রধানমন্ত্রী আসলে চান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ধুমসী রানীর সামনে বিদেশী ঐ মেয়েটা ‘ তো কেঁচো। তাই নিজের স্ত্রীকে ডাকলো সে। রাজা এতে অসন্তুষ্ট হবেন না। তিনিও প্রতিদ্বন্দিতা পছন্দ করেন। কামাল সামলে নিয়েছে ইতিমধ্যে নিজেকে। রাজাকে ইঙ্গিত করে কি যেন বোঝাচ্ছে সে। নানারকম চেষ্টা করে মনের কথাটা বোঝাতে চাইছে: কামাল। মাথা নাড়ছেন হিরিরিরি। কিন্তু কি বুঝছেন তিনি কে জানে।
সব সন্দেহ একটু পরই দূর হলো কামালের। তার কথা ঠিক বুঝতে পেরেছেন। রাজা। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ জারী হলো। কুয়াশা, শহীদ, গফুর এবং মহুয়াকে বাঁধা, হলো দড়ি দিয়ে ভালো করে। তারপর তাদের সকলকে পুব দিকের একটি দরজা দিয়ে রাজ-সভা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কামাল। রাজাকে সে বুঝিয়েছে বিদেশী শব্ৰুগুলোকে সাজা দেবে সে নিজের হাতে। আগামীকাল সকালে কার্যকরী করবে সে ওদের শাস্তির ব্যবস্থা।
রাজা তাকালেন একজন অনুচরের দিকে। কি যেন ইঙ্গিত করলো সে। রাজাকে। রাজা অন্যদিকে তাকালেন। রাজার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে তার সবগুলো স্ত্রী উঠে দাঁড়ালো কর্কশ চিৎকার করতে করতে। যুদ্ধ হবে রানীতে। রানীতে।
ইতিমধ্যে ধুমসী রানী প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে চিৎ করে ফেলেছে। আকাশ ফাটিয়ে “ শ-১৪
১১৭
চিৎকার করছে সে।
নয়।
গভীর থমথমে রাত। পৃথিবীর সব শব্দ যেন দম আটকে মরে গেছে। ঘরের ভিতর মশাল জ্বলছে একটা। অতি সন্তর্পণে পাশ ফিরলো কামাল বিছানায়।
* মিলতি রিব ঘুমাচ্ছে। মিষ্টি একটা হাসি ফুটে রয়েছে তার মুখে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে রাজকন্যা।
“ ধীরে ধীরে উঠে বসলো কামাল বিছানার উপর। খড়ের বালিশের তলা থেকে লেসারগানটা বের করলো সে।
| খিলখিল করে হেসে উঠলো মিলতি রিব। চমকে উঠে তাকালো কামাল। ধরা পড়ে গেল নাকি! :.
কামাল বুঝলো স্বপ্নের মধ্যে, হাসছে মিলতি রিব। লেসারগানটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লো সে মাচা থেকে ঘরের মেঝেতে। তারপর নিঃশব্দ হাতে খুললো দরজাটা। ঠিক এমনি সময় বিকট একটা শব্দ হলো কাছাকাছি কোথাও থেকে। থমকে গেল কামাল। চিৎকারটা বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আরো দূরে একই ধরনের চিৎকার উঠলো একটা। বুঝলো কামাল ব্যাপারটা। পাহারাদারদের গলা ওগুলো। সাড়া নিচ্ছে পাহারাদাররা পরস্পরের।
| কাঁচ কাঁচ করে উঠলো দরজা। কিন্তু কোনো উপায় নেই। ঘড়িতে বাজে দুটো দশ। ভোর হবার আগেই সকলকে উদ্ধার করতে হবে। কোথায় রেখেছে। জংলীরা ওদেরকে তা জানে না কামাল। খুঁজে বের করতে হবে বন্দীশালাটা। সুতরাং ভয়ে ভয়ে দেরি করে ফেললে চলবে না। দরজাটা খুলে ফেললো কামাল সাহস করে। সে মনে করেছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হবে বাইরেটা তা নয়। চাঁদ উঠেছে আকাশে। পরিপূর্ণ উজ্জ্বল চাঁদ। চারদিক আলোকিত হয়ে আছে।..
* মাথাটা বের করে বাইরেটা দেখে নিলো কামাল। বাঁশের উঁচু দেয়াল চারপাশে। এদিক ওদিক দেখা যাচ্ছে পাথরের তৈরি ঘর। আঁকাবাঁকা পথ অনেকগুলো। কেল্লার ঠিক মাঝখানটায় আছে সে এখন। আশপাশের ঘরগুলোতে রানীরা থাকে। | কোন্দিকে যাওয়া যায়! কয়েক সেকেণ্ড গভীরভাবে চিন্তা করলো কামাল। তারপর পরিচিত রাস্তাটা ধরেই এগোল সে নিঃশব্দ পায়ে। এই রাস্তা দিয়েই রাজকন্যা মিলতি রিব তাকে শোবার ঘরে এনেছিল। এই রাস্তা ধরে হাঁটলেই
পৌঁছুনো যাবে রাজ-সভায়। . একটা বাঁক পেরোতেই একজন জংলী কামালকে দেখতে পেলো। অনড় পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। পাথর যেন সে একটা। তাকে দেখে মানুষ বলে মনে করা সম্ভব হলো না কামালের। চাঁদের আলোর মাঝে ঘরের এবং দেয়ালের ছায়া পড়েছে খাপছাড়া ভাবে। মানুষ বলে চিনতে পারলো না কামাল
১১৮
:
জংলীটাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকুও যেন হচ্ছিলো না জংলীটার তিনহাত দণ দিয়ে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতে লাগলো সে।
| গম্ভীর থমথমে মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জংলীটা কামালের গতিপথের দিকে। কি যেন চিন্তা করলো সে। তারপর সচল মর্মর মূর্তির মতো অনুসরণ করলো সে কামালকে।
মিনিট পাঁচেক লাগলো কামালের রাজসভায় গিয়ে পৌঁছুতে। ফাঁকা রাজসভার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে করতে চেষ্টা করলো কামাল শহীদদেরকে কোন্ দরজা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খুব বেশি অসুবিধে হলো না তার দরজাটা খুঁজে বের করতে। খুলে ফেললো কামাল অর্গল লাগানো দরজাটা। বেরিয়ে এলো
সে একটা ফাঁকা উঠানে রাজসভা থেকে।
এবার কোনদিকে যাওয়া উচিত? ভাবলো কামাল। সামনের দিকে একটা এবং দু’পাশে দুটো রাস্তা আছে টের পাওয়া যাচ্ছে। উঠানটা পেরিয়ে সামনের দিকে এগোল সে। এদিকে কামাল যখন উঠানটার মাঝ বরাবর এসেছে ঠিক তখন পাঁচজন পাহারাদার জংলী রাজসভার একটি দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। একজন ছিলো, এখন পাঁচজন হয়েছে ওরা। ধৈর্যের প্রতিমূর্তি যেন পাহারাদার জংলীগুলো। দশসেরী একটা গদা, পিঠে তীর-ধনুক, হাতে ঢাল নিয়েও নিঃশব্দ পায়ে অনুসরণ ‘ করে চলছে ওরা কামালকে। সন্দেহে থমথম করছে ফোলা মুখগুলো। চোখে শ্যেনের দৃষ্টি। কিন্তু মুখে টু-শব্দটিও নেই। এমনকি নিঃশ্বাস পড়ার শব্দও হচ্ছে না।
| উঠানটা পেরিয়ে একপাশের রাস্তাটার ভিতর পানে তাকালো সে। এই রাস্তা ধরেই এগোবে কিনা বুঝতে পারলো না কামাল। এদিকে ঘড়িতে বাজছে এখন দুটো পঁচিশ। ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। অথচ কোনদিকে এগোলে শহীদদেরকে পাওয়া যাবে জানে না সে।
দেরি করে লাভ নেই, ভাবলো কামাল। সেই সামনের রাস্তাটা ধরেই দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে। কিন্তু পিছন দিকে তাকালো না ও,
সিধে চলে গেছে রাস্তাটা। বাঁশের দেয়াল শেষ হয়ে এলো একসময়। দমে গেল মনে মনে কামাল। কোথায় যাচ্ছে সে? কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে আসলে “এই রাস্তাটা?
বাঁশের দেয়াল শেষ হয়ে শুরু হলো পাথরের দেয়াল। মিনিটখানেক পাথরের দেয়ালের মাঝখান দিয়ে হেঁটে কয়েকটা ঘর পেলো কামাল। ঘরগুলো পাথরেরই। তবে দরজাগুলো মোটা বাঁশের, প্রত্যেকটি ঘরের ভিতর উঁকি মেরে দেখলো কামাল। শহীদরা কেউ নেই কোনো ঘরে। এগুলো আসলে রাজ-পরিবারের মেয়েদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘর। রাজা এবং পাহারাদার ব্যতীত অপর কোনো পুরুঘ্নের প্রবেশ নিষেধ এদিকে।
মোট পনেরটা ঘর। সাবধানে বাঁশের ফাঁকে চোখ রেখে ঘরগুলো জরিপ
১১১
করলো কামাল। কিন্তু বৃথাই।
ঘরগুলোকে পিছনে রেখে আবার হাঁটতে শুরু করলো কামাল। হঠাৎ তার মনে হলো রাস্তাটা সোজা নয় এখন আর। কখন থেকে কে জানে বেঁকে গেছে রাস্তা দক্ষিণ দিকে।
একি! বিশ্বাস হতে চাইলো না কামালের নিজের ব্যর্থতাকে। আবার ফিরে এসেছে সে রাজসভার কাছে। উঠানটায় রাস্তা মোট তিনটে। একটি রাস্তা ধরে গিয়ে দ্বিতীয় একটি রাস্তা দিয়ে ফিরে এসেছে একই জায়গায়। তাহলে? কামাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এতক্ষণে। তৃতীয় রাস্তাটা দিয়ে এগোলে নির্ঘাৎ শহীদদের হদিস পাওয়া যাবে। এগিয়ে গেল কামাল তৃতীয় পথটির দিকে। চঞ্চল ‘ হয়ে পড়েছে সে। কোনদিকে না তাকিয়ে রাস্তাটা ধরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো কামাল।
বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ চমকে উঠলো কামাল। বাঁশের গায়ে
. বঁশ পুঁতে দেয়াল করা হয়েছে দুদিকে। বিমূঢ় কামাল’ চাঁদের আলোয় দেখলো চার-পাঁচটি বাঁশ বাদ দিয়ে দিয়ে একটি একটি করে বাঁশের মাথায় বসানো রয়েছে নরমুণ্ডু। আশ্চর্য না হয়ে পারলো না কামাল। এতগুলো নরকঙ্কাল পেলো কিভাবে জংলীরা! কতদিনের সংগ্রহ এগুলো? | রাস্তাটা প্রায় আধমাইল। দ্রুত হেঁটে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরের সামনে এসে পঁড়ালো কামাল। মনটা ভেঙে গেল তার। তবে কি শহীদরা এদিকেও নেই? কোথায় তাহলে রাখতে পারে ওরা শহীদদেরকে?
বিশাল প্রান্তরের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে. কামাল। চাঁদের আলো পড়েছে। চতুর্দিকে। দু’একটা গাছের ছায়া পড়েছে প্রান্তরের এদিক-সেদিক। মায়াময় স্বপিল পরিবেশ, কামাল যেন স্বপ্নের ঘোরে চলে এসেছে কল্পনার জগতে। চিন্তা করতে করতে চোখ দুটো এদিক-সেদিক ঘোরাচ্ছিল সে। এমন সময় অদ্ভুত একটা জিনিস চোখে পড়লো তার। জংলীদের পাহারাদারের ঘরগুলো ঐ রকম দেখতে? আশ্চর্য হয়ে ভাবলো কামাল। দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা বোতলের মতো জিনিস। ঘর নাকি ওগুলো? কিন্তু তা তো মনে হচ্ছে না।
কোনো কোনো দ্বীপে বটল-ট্রি বলে একধরনের গাছের কথা শুনেছে কামাল। তাতে পানি রাখা হয়। হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো কামাল। একটা কথা মনে পড়ে গেছে তার। অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে এক ধরনের গাছ আছে জানে সে। পানি জমিয়ে রাখা হয় সেগুলোতে। আবার জেলখানা হিসেবেও সেগুলো ব্যবহার করার নজির আছে। গাছগুলোর ভিতরে ফাঁকা হয় নাকি রে বাবা! ভাবলো কামাল।
এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না সে। ছুট লাগালো জিনিস গুলো কি দেখার জন্যে।
বটল-টি-ই জিনিসগুলো। কিন্তু এগুলো আরো অনেক বেশি উঁচু ও মোটা। . : ডালপালা আছে বটে দু’চারটে। কিন্তু পাতা নেই।
| লালচে মাটিতে চাঁদে ম্লান আলো পড়েছে। ছাড়াছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে
১২০
বটল-টিগুলো দুটো বটল-ট্রি পাঁচ হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনোটা একটি অন্যটির কাছ থেকে পনেরো-বিশ গজ দূরে দূরেও দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলো কামালের কান। কে কাঁদে
মিহি একটা নারীকণ্ঠ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে একটু উঁচু হচ্ছে গলার স্বরটা। কোথায়? কোথায়, কে কাঁদছে এই চন্দ্রালোকিত নির্জন প্রান্তরে? পায়ে পায়ে এদিক ওদিক হাঁটলো কামাল। কেউ নেই কোথাও। তবে কে কাঁদে এমন করে?
ঘুরছে কামাল বটল-ট্রিগুলোর চারপাশে। একটু দূরে গেলেই মনে হয় পিছনের দিক থেকে আসছে কান্নাটা। ফিরে আসতে আসতে থেমে যায় ফোঁপানিটা। ঘেমে নেয়ে উঠলো কামাল রহস্যটা বুঝতে না পেরে। থেমে গেছে আবার, মিহি গলার কান্নাটা। পায়ে পায়ে একটা বটল-ট্রির দিকে এগোল সে।
কাছে এলো কামাল। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলো সে সন্দিগ্ধ মনে। চকচক করছে তার চোখ দুটো উত্তেজনায়। এমন সময় ঠিক পিছন থৈকেই কান্নাটা শুরু হলো। চমকে উঠে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালো কামাল। অতি কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে। এবার সে কান্নাটা। ‘বটল-ট্রর মাথার উপর তাকালো কামাল। তিন মানুষ উঁচু হবে গাছটা। ডালপালা রয়েছে দু’চারটে। কেউ নেই গাছের উপর।
কাঁদছে মেয়েটা এখনও। হঠাৎ কি যেন ভাবলো কামাল। আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ। কান পেতে আবার শুনলো সে কান্নাটা। এবার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না তার। মহুয়া কাঁদছে। বন্দী করে রাখা হয়েছে তাকে বটল-ট্রির অভ্যন্তরে।
কামালের প্রশ্ন শুনে থেমে গেল কান্নাটা।
আমি কামাল বলছি, মহুয়াদি, কোথায় তুমি?’ ‘ডান দিকে তাকাও কামাল। ডান দিকে একটা বটল-ট্রি দেখতে পাচ্ছো কি?”
কুয়াশার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো কামাল। চট করে ঘুরে তাকালো ডান দিকে। হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে একটি বটল-ট্রি সাত হাত দূরে।
হা কুয়াশা, দেখতে পাচ্ছি গাছটা আমি।’
কুঁয়াশা গাছের ভিতর থেকে বললো, লেসারগানটা নিয়ে এসেছে তো কামাল?’
|, ‘নিশ্চয়। | কুয়াশা বললো, লেসারগান ছাড়া আমাদেরকে তুমি উদ্ধার করতে পারবে না এই কয়েদখানা থেকে। আমাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা গাছে ঢুকিয়ে দেয়া। হয়েছে। দরজা বলে কিছু নেই, তবে ঠিক মাথার উপরে ফাঁক আছে একটা। তিন মন ওজনের পাথর চাপা আছে গর্ত-মুখটায়। একজনের কর্ম নয় পাথরটা সরানো। লেসারগান দিয়ে গাছের উপরের খানিকটা অংশ অদৃশ্য করে দিতে হবে। বুঝেছো?’
’,
১২১
‘বুঝেছি। কিন্তু লেসারগান চালাতে জানি না যে আমি।’
‘বলে দিচ্ছি, কি করতে হবে। বন্দুকটার নলের মুখে একটা লাল বোম আছে, সেটা খুলে হাতে নাও। নল থেকে সাত ইঞ্চি দূরে একটা পেরেক মতো বেরিয়ে আছে, তার পাশেই আছে একটি ছোট্ট গর্ত। গর্তটায় ভালো করে বসিয়ে দাও, লাল বোতামটা। তারপর নল এবং হাতলটা দুহাতে ধরে চাপ দাও, ভাঁজ হয়ে যাবে ওটা। একটা স্প্রিং দেখতে পাবে। টানো ওটাকে…
কুয়াশা বলে গেল একের পর এক, কামাল যথাযথ অনুসরণ করলো তার নির্দেশ।
‘এবার অতি সাবধানে গাছের মাথার উপর তাক করো লেসারগানের মুখটা। দেখো, নিচের দিকে যেন নেমে না’আসে বন্দুকের নল। কোনো ভয় নেই। আমার মাথার উপর কিছু পড়বে না, তোমারও কোনো ভয় নেই। ট্রিগার টিপে দাও
এবার।
ট্রিগার টিপলো কামাল অতি সাবধানে। কেঁপে গিয়েছিল হাত। ফলে গাছটার অর্ধেকটাই পুড়ে গেল। পলকের ব্যাপার। অদৃশ্য হয়ে গেল পাছটার উপরের অংশটুকু।
* এবার আমি বেরিয়ে আসছি। অপেক্ষা করো।’
বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল কুয়াশার গাছটার ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে। উপর থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো সে। কি যেন শক্তমতো। জিনিসে বাঁ পা-টা পড়লো তার। ঝুঁকে পড়ে দেখলো কুয়াশা জিনিসটা। লেসারগান! লেসারগানটা এভাবে পড়ে রয়েছে কেন? কামাল গেল কোথায়? ভয়াবহ একটা সন্দেহ জাগলো কুয়াশার মনে। লেসারগানটা কি ঠিক মতো সামলাতে পারেনি কামাল? যার ফলে সে নিজেই নিজেকে পুড়িয়ে… * দ্রুত লেসারগানটা ভাঁজ করে মিটারের কাঁটা দেখলো কুয়াশা। না, আশঙ্কাটা সত্যি নাও হতে পারে। মাত্র এক সেকেণ্ড চালু ছিলো যন্ত্রটা। এক সেকেণ্ডের মধ্যে তেমন কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনা না ঘটাই উচিত। … | চারদিকে তাকালো কুয়াশা ভ্রূ কুঁচকে। জঙ্গল দেখা যাচ্ছে একদিকে। এক দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজলো কুয়াশা সেদিকে তাকিয়ে। হঠাৎ অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ শুনতে পেলো জঙ্গলের দিক থেকে। ছুটলো কুয়াশা দূরের জঙ্গলের দিকে। কামাল হয়তো বন্দী হয়েছে জংলীদের হাতে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌডুতে শুরু করলো কুয়াশা। জঙ্গলটা বেশ দূরে। চাঁদের আলোয় জঙ্গলের কালো রেখা দেখে বোঝা যায়নি দূরত্বটা। যাই হোক, বটল-টি টা পেরিয়ে গেল কুয়াশা। এরপরই জঙ্গলটা শুরু হয়েছে। দশ হাত ভিতরে প্রবেশ করতেই শেষ বটল-ট্রি-র আড়াল থেকে একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। দৌডুতে পারা যাচ্ছে না। সরু রাস্তা। তাড়াহুড়ো করলে। হারিয়ে যাবে পৃথটা। চাঁদের আলোও এখানে তেমন নির্বাধায় প্রবেশ করতে পারেনি। গাছের ডালপালা ফাঁক গলে টুকরো টুকরো আলো পড়েছে। সুবিধের ১২২
চেয়ে অসুবিধে বেশি তাতে। দৃষ্টিভ্রম ঘটবার সমুহ আশঙ্কা।
হাঁটছে তো হাঁটছেই কুয়াশা। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলো তার মন। সন্তর্পণে পা ফেললো সে এবার। কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে সে। কিন্তু থামলে চলবে না। ঘড়িতে বাজে চারটে।সকাল হয়ে এলো প্রায়। আবার দ্রুত করলো কুয়াশা চলার গতি। পরক্ষণেই ধাক্কাটা খেলো সে। প্রচণ্ড শক্তিধর মানুষের ধাক্কা। | পিছন থেকে আচমকা লাগলো ধাক্কাটা। তাল সামলাতে পারলো না কুয়াশা পড়ে
গেল ছ’হাত দূরে গিয়ে মাটির উপর। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি খেয়ে মাটির উপর দাঁড়ালো সে। একটি শন শন শব্দ কানে গিয়েছিল কুয়াশার। মাটির দিকে তাকালো সে। তারপরই তাকালো একটি ছায়ামূর্তির দিকে-শহীদ।
| ‘কি ব্যাপার, শহীদ?’
‘তোমাকে অনুসরণ করছিলাম আমি, কুয়াশা।’ শহীদ বললো, “চিনতে পারিনি তোমাকে। শেষে চিনতে পেরেছিলাম বলেই রক্ষা, তা না হলে বিপদ ঘটতো একটা। ঐ দেখো কি অদ্ভুত ফাঁদ পেতে রেখেছে জংলীরা।’
আগেই দেখেছে কুয়াশা, মাটির উপর সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে তিনটে তীর এসে বিঁধেছে। জংলীরা এদিকে কাউকে যেতে দিতে চায়। তাই এই ফঁদের ব্যবস্থা। এর কথা না জানলে প্রাণ যাবে নির্ঘাৎ।
বড় বাঁচা বেঁচে গেছি শহীদ। কিন্তু তুমি কোথা থেকে এলে বলো দেখি?’
শহীদ প্রশ্ন করলো, লেসারগান তুমি ব্যবহার করোনি নাকি? আমি যে গাছের ভিতরে বন্দী ছিলাম তার কাণ্ডটা তো মারণরশির সাহায্যে তুমিই উড়িয়ে দিয়েছো.’
: আমি না, কামাল। আসলে ও আমাকে উদ্ধার করার জন্যে লেসারগান ব্যবহার করেছিল। নল, এঁকেবেঁকে গিয়েছিল বলে তার অজান্তেই ব্যাপারটা ঘটেছে।’
শহীদ বললো, কিন্তু তুমি অমন ব্যস্ত হয়ে চলেছো কোথায়? কামালকেই বা রেখে এলে কোন্দিকে।
তাড়াতাড়ি কি যেন ভাবলো কুয়াশা। তারপর বললো, সময় খুব বেশি হাতে নেই, শহীদ। কামালকে ধরে নিয়ে এসেছে জংলীরা এদিকে। আচ্ছা তুমি জানো। মি. সিম্পসন আর গফুরকে কোন্ কোন্ গাছে বন্দী করে রাখা হয়েছে?’
| ‘জানি।’
| তবে চলো, ওদেরকে আগে উদ্ধার করি। মহুয়া কোন গাছে বন্দী তা আমি জানি।
শহীদ আশ্চর্য হয়ে বললো, কিন্তু কামালের কি হবে?’
সে ব্যবস্থা আমি করবো। এখন বেশিরভাগ মানুষকে নিরাপদ জায়গায়। পাঠিয়ে দেয়া দরকার। এসো ছুট লাগাও আমার সঙ্গে।
ফিরে এলো আবার ওরা আগের জায়গায়। মহুয়াকে উদ্ধার করা হলো প্রথমে।
১২৩,
শহীদ গাছের উপরে উঠে মহুয়াকে নামিয়ে নিয়ে এলো। গফুর এবং মি. সিম্পসনকেও উদ্ধার করা হলো। দু’মিনিট পরপরই হাত ঘড়ি দেখছে কুয়াশা। চারটে বেজে পনেরো।
সকলে একত্রিত হলে কুয়াশা বললো, ‘উত্তর দিকে চলে যাও তোমরা, শহীদ। সকলেই যাও শহীদের সঙ্গে। উত্তর দিকে গেলেই সমুদ্রতীরে পৌঁছুতে পারবে তোমরা।’
কামালদা’কই?’ গফুর বললো। মহুয়া বললো, “সত্যি তো!’ | কুয়াশা বললো, কামালের জন্যেই তোমাদের সঙ্গে যেতে পারছি না আমি। জংলীরা ধরে নিয়ে গেছে ওকে। কিন্তু তাই বলে তোমাদেরকে নিরাপদে দূরে সরিয়ে না দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছি না আমি। উত্তর দিক ধরে সাবধানে চলে যাও তোমরা। দিকটা ভালো করে খেয়াল রেখো, শহীদ।’
.. কিন্তু উত্তর দিকে গেলেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা হচ্ছে কি করে?’ জানতে চাইলো শহীদ।
| মি. সিম্পসন বললেন, ‘তারচেয়ে সকলে একসঙ্গে কামালকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা যাক। আমাদের সঙ্গে তো লেসারগান আছে, ভয় কি।
| না, তা হয় না।’
কুয়াশা বললো, “শোেনো শহীদ, উত্তর দিক ঠিক রেখে যদি এগোতে পারো তোমরা তবে সমুদ্রতীরে ঠিক জায়গা মতো পৌঁছুবেই পৌঁছুবে। অনেক হিসেব নিকেশ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি।’
– শহীদ বললো, ‘সমুদ্রতীরে না হয় পৌঁছুলাম, কিন্তু তাতে লাভ কি? আচ্ছা, কতক্ষণ লাগবে আমাদের সমুদ্রতীরে পৌঁছুতে?’
‘ঘন্টাখানেকের কম নয়।
শহীদ বললো, ততক্ষণ নিঃসন্দেহে সকাল হয়ে যাবে। জংলীরা যখন দেখবে যে কয়েদখানা থেকে পালিয়েছি আমরা তখন তো তারা সবচেয়ে আগে সমুদ্রের দিকেই ছুটবে দল বেঁধে!’
| তা ঠিক;’। . মেনে নিলো কুয়াশা শহীদের কথা। তারপর বললো, কিন্তু সমুদ্রতীরে তোমরা একবার পৌঁছুতে পারলেই হলো। জংলীরা তারপর গিয়ে তোমাদের চুলও স্পর্শ করতে পারবে না।’ ..
বাধা দিয়ে, শহীদ বললো, কিভাবে?
মি. সিম্পসন কঠিন সমস্যায় পড়েও কুয়াশাকে মৃদু ঠাট্টা করতে ছাড়লৈন না। তিনি ধললেন, ‘তার আগেই বুঝি আমরা সমুদ্রের জলে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবো? এই কথাই তুমি বলতে চাইছো তো, কুয়াশা?’
কুয়াশা বললো, ‘আত্মহত্যা নয়, আত্মরক্ষা করবেন আপনারা প্রত্যেকে। সমুদ্রতীরে অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্যে একটা মিরাকল। সৈনিক নোঙর করা
১২৪
আছে উত্তর দিকের সমুদ্রতীরে।’
মিটিমিটি হাসতে লাগলো কুয়াশা কথাটা বলে। সকলে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকালো কুয়াশার দিকে। কিন্তু শহীদ কি যেন ভাবছিল কুয়াশার কথা শুনে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে মৃদু হেসে সে বললো, “ও বুঝেছি! অলরাইট, চললাম আমরা, কুয়াশা।’ ‘
‘কি ছাই বুঝেছো হে তুমি? খুলে বলো না একটু রহস্যটা। মি. সিম্পসন শহীদকে প্রশ্ন করলেন।
শহীদ বললো, লৌহমানব দুটোর কথা ভুলে গেছেন নাকি আপনি, মি. ‘সিম্পসন?’
না, ভুলবো কেন?’ | ‘লৌহমানবের শ্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগ ও গ্রহণের প্রয়োজন নেই তা আপনি জানেন তো?’
‘জানি।’
শহীদ বললো, ‘এরপরও বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা? :আসলে লৌহমানব …. দুটোকে কুয়াশা ডুবন্ত সৈনিকে রেখে এসেছিল। এবং তারা সৈনিককে মেরামত– করে, পাম্পের সাহায্যে পানি বের করে আবার চালু করে ফেলেছে। বুঝলেন?
| ‘শুধু তাই নয়, এখন সৈনিকের গতিও বেড়ে গিয়ে হয়েছে ঘন্টায় আশি মাইল।’
. কথা সরলো না মি. সিম্পসনের মুখে। জংলীদের এই দ্বীপ থেকে মুক্তি পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন ঢিনি। মুক্তি অবশ্য এখনো পায়নি তারা। কিন্তু সত্যিই একটা আশা পেলেন তিনি। কুয়াশার প্রতি আবার সেই অনুভূতিটা সৃষ্টি হলো নতুন করে তার মনে-কি ভয়ঙ্কর বুদ্ধি এই সৃষ্টিধর্মী মানুষটার। মনে মনে বললেন। তিনি-যে অসম্ভবকে সম্ভব করে তার নাম কুয়াশা! ..
শহীদ বললো, তুমি একাই যাবে, কুয়াশা, কামালের জন্যে? আমিও সঙ্গে গেলে ভালো হতো না?’
‘তোমাকে আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে দিচ্ছি আমি, শহীদ। কামালকে উদ্ধার আমি করবোই। যেমন করে হোক। কিন্তু তোমাকে রক্ষা করতে হবে এদের সকলকৈ।’ | চুপ করে রইলো শহীদ। কুয়াশা বললো, যাও শহীদ, সময় ফুরিয়ে আসছে। আশা করি ভালভাবে পৌঁছুবে তোমরা। চলি, দেখা হবে শিগগিরই।’।
মহুয়া করুণ কণ্ঠে ডাকলো দাদা!’. মৃদু হেসে তাকালো কুয়াশা, “কি রে?’
ভাই-বোনের মধ্যে স্নেহু-ভালবাসার অমর দৃশ্য অভিনীত হতে চলেছে। চন্দ্রালোকিত নিস্তব্ধ প্রান্তরে।
মহুয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো কুয়াশার সামনে।
F
‘দাদা!’ ‘কিছু বলবি?’
মহুয়া কুয়াশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের সঙ্গেই দেশে, ফিরবে তো তুমি?’
শব্দ করে স্নেহের হাসি হাসলো কুয়াশা। বললো, “দেশে ফেরার কথা তুই এখন কেন ভাবছিস, মহুয়া। তুই কি ভুলে গেলি বোন বৈজ্ঞানিক kotze-এর কথা? ভদ্রলোককে বিপদ থেকে মুক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি না আমরা?’
. মাথা নেড়ে মহুয়া সমর্থন জানালো। তারপর বললো, “যাই হোক, তবু তুমি কথা দাও যে আমাদের সঙ্গেই দেশে ফিরবে। তা সে যেদিনই ফিরি আমরা।’
কুয়াশা মহুয়ার মাথায় হাত রাখলো একটা। বললো, “কেন মহুয়া, তোর কি মনে মনে কোনো ভয় জাগছে?
না, দাদা!’ “তবে?’ চুপ করে রইলো মহুয়া। ‘তোর কি মনে হয়, মহুয়া? আমি তোদের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারবো না?”
গলা শুকিয়ে গেল মহুয়ার। কি বলবে ভেবে পেলো না সে। দাদার কথা ভাবতে গেলেই ভয় জাগে তার। মনে হয় তার দাদা বুঝি কোনো একটা বিপদে পড়বে, আর মুক্তি পাবে না কোনদিন সে বিপদ থেকে।
বল, মহুয়া। দেরি করিয়ে দিসনে আমাকে, বোন।’ ‘আমার কি মনে হয়…’ দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছে না মহুয়া। ‘‘হ্যাঁ।’
‘আমার কিছু মনে হয় না। আমার মনে হয় মনে হয়, তুমি আমাদের সঙ্গেই, দেশে ফিরবে।
| কুয়াশা বললো, তবে আর কি! দেখিস, তোর কথাই সত্যি হবে। আমি তোদের সকলের সঙ্গে সুস্থ অবস্থাতেই দেশে ফিরবো।’
মহুয়ার মাথা থেকে ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিলো কুয়াশা। একটু সরে দাঁড়ালো মহুয়া। হঠাৎ ঘুরে উঁড়ালো সে। শান্ত গলায় বললো, তোমরা যাও, ‘ আমিও চলি।’
তারপর আর দেরি না করে চন্দ্রালোকিত প্রান্তর ধরে কুয়াশার বিশাল মূর্তিটা দ্রুত এগোতে লাগলো,। শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে ঘুরে দাঁড়ালো মহুয়া।
সকলের সঙ্গে হাঁটতে লাগলো সে উত্তর দিকে। শহীদ একটা হাত ধরে রেখেছে। তার। চতুর্থবার পিছন ফিরে তাকালো মহুয়া। দেখলো কুয়াশার বিশাল মূর্তি ছুটতে ছুটতে হারিয়ে গেল একটা গাছের আড়ালে।
| জঙ্গলে প্রবেশ করছে আবার কুয়াশা। ১২৬
Leave a Reply