১৩. অপারেশন পেরু ১ (ভলিউম ৫) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১৩
প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮
এক
চো-বোশেখের মাস। বেলা আন্দাজ দুটো। পুলিশ কনস্টেবল হিকমত খান বাড়ি ফিরছিল ছাতা মাথায় ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে।
প্রচণ্ড গরম পড়েছে এবার ঢাকায়। অসহ্য গরম সইতে না পেরে দু’একজন লোক প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে, খবরের কাগজে দেখা যায়।
হিকমত খান ছাতা মাথায় হাঁটছিল। ছাতা থাকলে হবে কি, রোদের প্রখর ঝাঁঝ শরীরকে যেন ঝলসে দিতে চাইছে। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। কাজকর্ম থাকলেও সহজে মানুষ ঘর ছেড়ে বের হবে না এমন দিনে। একটা কুকুর বিড়ালেরও দেখা পাওয়া ভার। শুধু মাঝে মাঝে এক আধটা রিক্সা বা মোটর গাড়ি
দুপুরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো পাশ কাটিয়ে।..
হিকমত খানের সর্বশরীর ঘামে ভিজে গেছে। তেষ্টা পাচ্ছে ভীষণ। এদিক ওদিক তাকালো সে, রাস্তার আশপাশে কোনো হোটেলের সন্ধানে। কিন্তু এদিকটায় হোটেল নেই তেমন, যেখানে এক গ্লাস পানি খাওয়া যেতে পারে। বড় একটা। আঁভিজাত হোটেল আছে বটে। হোটেল আফলাতুন। কিন্তু হোটেলটা তিনতলা এবং শুধু পানি পান করার জন্যে উপস্থিত হওয়া নিঃসন্দেহে অসঙ্গত।..
কাছাকাছিই এসে পড়েছিল হিকমত খান। হোটেলটার সামনেই কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। প্রাইভেট গাড়ি। গাড়িগুলোর বিশ-পঁচিশ গজ দূরে একটা ডাস্টবিন দেখতে পেলো, হিকমত খান। হোটেলের বয়-বেয়ারারা উচ্ছিষ্ট খাদ্য ফেলে গেছে একরাশ। যেমন ফেলে গেছে ঠিক তেমনি আছে। একটা কুকুর বা। একটা কাকুও কাছ ঘেষেনি। হিকমত খান, দেখতে পেলো বেশ খানিকটা দূর থেকে একটা কুকুর ছায়ায় বসে ডাস্টবিনটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু ছায়া ছেড়ে রোদের অসহ্য উত্তাপকে মেনে নিতে পারবে না বলে কুকুরটা অভুক্ত থাকবে স্থির করেছে। সত্যি, দাবানল জ্বলছে যেন চারদিকে!
এক গ্লাস পানি পাওয়া দুষ্কর ভেবে হিকমত খান বাড়ি ফিরে তৃষ্ণা নিবারণ করবে ঠিক করলো। মনস্থির করে আরো দ্রুতগতিতে হাঁটতে যাচ্ছিলো সে, এমন সময় হোটেলের সামনে পার্ক করা গাড়িগুলোর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠে থমকে দাঁড়াতে হলো।
পাশাপাশি অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটায়। নানারকম বিদেশী কোম্পানির গাড়ি। হিকমত খান পলকের জন্যে দেখতে পেলো, একটা ওপেল রেকর্ড এবং একটা টয়োটা করোনার মধ্যবর্তী ফাঁকটা থেকে একজন ইউরোপিয়ান মানুষ পলকের জন্যে উঁকি মেরে চারপাশটা দেখে নিলো। বিদেশী লোকটা মাথা তুলেই হিকমত খানকে দেখতে পেয়েছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গে আবার লুকিয়ে পড়ার জন্যে টুপ করে যথাস্থানে বসে পড়েছে।
‘ তিন সেকে. অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হিকমত খান। তারপর সন্দেহের বশবর্তী হয়ে দ্রুত পা ফেলে এগোতে লাগলো গাড়িগুলোর দিকে।
পাঁচ কদম এগোবার পরই আবার থমকে দাঁড়াতে হলো হিকমত খানকে। ইউরোপিয়ান লোকটা হঠাৎ তড়াক করে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে কায়েদ-এ-আযম কলেজের দিকে দৌড়ুতে শুরু করলো প্রাণপণে।
| মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল হিকমত খান। তারপরই সে ছুটতে শুরু করলো ইউরোপিয়ানটার পিছু পিছু। দৌডুতে দৌড়ুতেই হিকমত খান তাকালো ওপেল রেকর্ড এবং টয়োটার মধ্যবর্তী জায়গাটায়। তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে শিউরে উঠলো সে। গাড়ি দুটোর মাঝখানে দেখা গেল একটা লোক চিৎ হয়ে পড়ে
আছে। বুকে তার আমূল বিদ্ধ একটি ছোরা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে লোকটার আশপাশ। নিহত লোকটাও যে ইউরোপিয়ান তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঘটনার আকস্মিকতায় নার্ভাস হয়ে পড়লো না হিকমত খান। পঁচিশ বছর। চাকরি করছে সে পুলিস বিভাগে। ঘটনাটার গুরুত্ব সে ঠিকই অনুধাবন করতে পারলো। ফলে হাতের ছাতাটা ফেলে দিয়ে প্রাণপণে আততায়ীর পিছু ধাওয়া করলো সে। কিন্তু নিরাশার কথা হলো ইউরোপিয়ানটা তখন বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে। প্রায় নির্জন রাস্তা। কেউ বাধা দেবারও নেই। প্রায় যুবকই বলতে হবে। ইউরোপিয়ানটাকে। তাছাড়া তার দৌড় দেবার ভঙ্গি এবং গতি দেখে মনে না হয়ে ‘ যায় না যে লোকটা একজন ওস্তাদ রানার। তা সত্ত্বেও কনস্টেবল হিকমত খান বুটজুতোর উচ্চকিত শব্দ তুলে প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছে বিদেশীটাকে পাকড়াও করার জন্যে।
হিকমত খান স্থির-প্রতিজ্ঞ যে, আততায়ীকে সে ধরবেই। কায়েদ-এ-আযম কলেজকে বাঁয়ে রেখে মোড় ঘুরছে যখন সে, তখন বিদেশীটা মাত্র বিশ গজ এগিয়ে আছে। ঠিক এমনি সময় পিছন থেকে একটা গাড়ির যান্ত্রিক শব্দ পাওয়া গেল।
তীব্র বেগে একটা নতুন চকচকে কালো ফোক্সওয়াগন ফিফটিন হানড্রেড রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটে আসছে। শব্দ পেয়ে মাঝ রাস্তা ছেড়ে একপাশে সুরে এসে দৌডুতে লাগলো হিকমত খান। পরক্ষণেই গাড়িটা সাঁ করে ছুটে গেল হিকমত খানের প্রায় গা ঘেঁষেই। মাঝ রাস্তা থেকে সরে আসতে যদি মুহূর্ত মাত্র
বিলম্ব ঘটতো তবে নির্ঘাৎ চাপা পড়তো সে। ড্রাইভারের বেপরোয়া মতিগতি দেখে। মুখ খারাপ করে একটা পুলিসি গাল দিয়ে কটমট করে চাইলে হিকমত খান, এমন সময় সে দেখলো গাড়িটা পলায়নরত ইউরোপিয়ানটার কাছে গিয়েই আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় খুলে গেল গাড়িটার দরজা। পলায়নরত ইউরোপিয়ানটা মুহূর্তমাত্ৰ ইতস্ততঃ না করে উঠে পড়লো। গাড়িতে। হিকমত খান তখন গাড়িটার দশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু ব্যর্থতাই বরণ করে নিতে হলো তাকে। আরও দু’পা এগোতে না এগোতে গাড়ির দরজা জোরালো শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ছুটতে শুরু করলো প্রায় লাফ দিয়ে, বেপরোয়া গতিতে।
পুলিস কনস্টেবল হিকমত খান ঘর্মাক্ত কলেবরে দাঁড়িয়ে পড়লো স্থাণুবৎ। হাঁপাতে লাগলো সে জোরে জোরে। দেখতে না দেখতে চোখের আড়াল হয়ে গেল ফোক্স-ওয়াগেন। ততক্ষণ এ-দোকান ও-দোকান থেকে কিছু কিছু লোক নেমে পঁড়িয়েছে রাস্তার উপর।
* অযথা সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে হিকমত খান সামনের একটা ডাক্তারখানা থেকে পুলিস হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানালো সম্পূর্ণ ঘটনাটা। তারপর বড়কর্তার আদেশ অনুযায়ী হোটেল আফলাতুনের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো আবার।
| ফেলে যাওয়া ছাতাটা রাস্তার মাঝখানে ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। তুলে। নিলো সেটা হিকমত খান। দ্রুত পায়ে এগোলো হোটেলের পাশে পার্ক করা গাড়িগুলোর দিকে।
কিন্তু কই! কোথায়! কোথায় গেল লাশটা? গাড়ি দুটোর মাঝখানে ছোরা বিদ্ধ লাশটার চিহ্নমাত্র নেই! ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে সেটা। কালো পিচের। উপর শুধু খানিকটা জমাট বাঁধা রক্ত সাক্ষ্য দিচ্ছে ঘটনাটার। হিকমত খান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
ঢং ঢং!
গভীর, নিস্তব্ধ রাত। আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। লিয়াকত অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছি একটা গির্জা থেকে এইমাত্র রাত দুটো বাজার
সময় সঙ্কেত শোনা গেল।
চারদিকে নিস্তব্ধতা অটুট হয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বুড়িগঙ্গার বুকে একটা লঞ্চের ভটভট শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো। এখন আর তাও শোনা যাচ্ছে না। শুধুই নিস্তব্ধতা চারদিকে প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। নিস্তব্ধতা আর নির্জনতা। ।
‘ঘেউ ঘেউ! ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ…’.
আচমকা চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ঘিঁড়েখুঁড়ে শান্তিময় পরিবেশটাকে বীভৎস করে তুললো একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ… | ভয়ার্ত, বিস্মিত, পরাজিত কণ্ঠে ডেকে উঠলে কুকুরটা। ডেকে উঠলো এবং প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পিছন হুটতে লাগলো এক পা দু’পা করে। উত্তেজিত, সাবধানী কণ্ঠে চারদিক সচকিত করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলো কর্তব্যপরায়ণ জানোয়ারটা। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিলো না।
পিছন হটছে কুকুরটা। উত্তেজনায় কাঁপছে। রাস্তার এপার থেকে ওপারে চলে গেল কাঁপতে কাঁপতে। সমানে ককিয়ে চলেছে সে এখনও সামনের একটা লাইটপোস্টের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অদ্ভুত একটা ভয়াল জানোয়ারকে হেঁটে যেতে দেখতে পাচ্ছে সে!
মূর্তিমান বিভীষিকা একটা! হেঁটে যাচ্ছে গম্ভীর চালে। কোনদিকে যেন তাকাবার ফুরসত নেই তার। হুবহু একজন মানুষের আকৃতি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সেটা রাস্তার উপর দিয়ে। গড়নে ঠিক একজন মানুষের সমান হবে। টেবিলের মতো বড় বড় টকটকে লাল দুটো চোখ ঠিক কপালের দু’পাশে বসানো। জ্বলছে। মাথাটা হুবহু একজন মানুষেরই মতো। কখনো দের, কখনো লাইটপোস্টের আলো পড়ে চকচক করছে মাথাটা। ইস্পাতের চেয়েও শক্ত এবং ট্রি বেডের মতো রঙ নেড়া মাথাটার। সমস্ত শরীরটার রঙই ঐ রকম। শরীরের যে অংশে আলো পড়ছে সেই অংশটাই চকচক করে উঠছে, আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে। হাত দুটো গড়ন অনুযায়ী একজন মানুষের চেয়ে দু’গুণ মোটা। দুটো হাতই ঝুলে রয়েছে দু’পাশে। একটা হাত খালি, অপর হাতে একটা বিদঘুঁটে যুঞ্জ। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে লৌহমানব। স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটছে না, সে। হাঁটু দুটো তার ভাঁজ হচ্ছে না পা ফেলার সময়।
নিঃশব্দ পায়ে নবাবপুর রোডের দিকে হেঁটে যাচ্ছে লৌহমানব। নির্জন ফাঁকা রাস্তা। ভীত কুকুরটা এখনও ডাকছে দূরে সরে গিয়ে। ভয় পেয়েছে জানোয়ারটা। জীবনে এরকম বিদঘুঁটে জীব সে আর দেখেনি। তার চোদ্দপুরুষও শোনেনি এরকম অদ্ভুত জানোয়ারের কথা! | ছায়ায় হারিয়ে গেল লৌহমানব। এরকম প্রায়ই হারিয়ে যাচ্ছে। আবার আলোয় এসে পড়াতে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। নিঃশব্দ, দ্রুত, লম্বা পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে, সে ক্রমশ। নবাবপুর রোডে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে সে। এমন সময় দু’জন টহলধারী পুলিস, টহল দিতে দিতে একটা সরু গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। * পুলিস দুজন বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই লৌহমানবকে চোখের সামনে দেখে দুরুদুরু বুকে পিছিয়ে গেল দু’পা। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল দু’জন।
পুরোপুরি ইস্পাতের তৈরি একটা অদ্ভুত যন্ত্র-মানব হেঁটে যাচ্ছে নিঃশব্দ পায়ে। হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকালো লৌহমানব পুলিস দু’জনের দিকে। কিছু বললো না। আবার ঘাড় সোজা করে হেঁটে যেতে লাগলো নিজ পথে গম্ভীর চালে। এ যেন একটা দুঃস্বপ্ন। একটা অদ্ভুত গল্প। একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা।
বেশ ক’পা এগিয়ে গেল লৌহমানব। এমন সময় একজন কনস্টেবল সংবিৎ ফিরে পেয়ে পিছন ফিরে পালিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু অপরজন বাধা দিলে
তাকে। কাঁপা একটা হাতে লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে অসম্ভব কাঁপা কাঁপা পায়ে ছুটলো, সে লৌহমানবের দিফে। অন্য হাতে সে পলায়ন-ইচ্ছু, সঙ্গীটার পিঠের জামার একটা অংশ খামচে ধরে রাখলো সাহস সঞ্চয়ের জন্যে। | ঠকঠক করে কাঁপছে লোকটার পা দুটো। দু’হাঁটুতে ঠকাঠক বাড়ি লাগছে সশব্দে। অপর সঙ্গীটি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পালাবার প্রয়াস দেখলে বোঝা যায় মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সে। ভীষণভাবে। কিন্তু ছাড়া পাচ্ছে না সে কিছুতেই।
উঁচিয়ে ধরা লাঠিটা নিয়ে লৌহমানবের ঠিক. পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো লোকটি। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠিটা সজোরে বসিয়ে দিলো সে, লৌহমানবের ঠিক ঘাড়ের উপর। সঙ্গে সঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেল পুলিসি ডাণ্ডাটা। লৌহমানব আরও একবার পিছন ফিরে তাকালো শুধু! প্রাণ নিয়ে পলায়নরত পুলিস দুজনকে দেখে নিয়ে আবার সে হেঁটে চললো। গন্তস্থান আর বেশি দূরে নয় তার। এই নবাবপুর। রোডেরই একটি হোটেলে ঢুকবে সে।
গভীর রাত। দুটো বেজে পনেরো মিনিট।
বুড়িগঙ্গার বুকে নোঙর করা একটা বড়সড় লঞ্চ দাঁড়িয়ে রয়েছে। লঞ্চটার দ্বিতলস্থ একটা কেবিনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিশেষ একটা কাজে ব্যস্ত দেখা
গেল একনিষ্ঠ বিজ্ঞান সাধক কুয়াশাকে।
| কুয়াশার আবিষ্কৃত লঞ্চটা দেখতে সাধারণ একটা লঞ্চের চেয়ে কোনো অংশে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। কিন্তু দেখতে যাই হোক, ভিতরে এর এলাহি কাণ্ডের সমাবেশ . নিউক্লিয়ার জেনারেটর-এ চলে এটা। সুপার সাবমেরিন স্টকে আছে এর লিকুইড হাইড্রোজেন ব্যাটারি এবং প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন। অনির্দিষ্টকাল গভীরতম জলদেশে অবস্থানে সক্ষম এটি। কুয়াশা কর্তৃক আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে সার্জানো গোছানো লঞ্চটি। আলট্রা মডার্ণ এর অভ্যন্তরভাগ। যদিও বাইরে থেকে দেখে মনে হয় জরাজীর্ণ রোগগ্রস্ত থুথুরে বুড়ো একটা। তিনতলা।
একটা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছে
কুয়াশা। সামনেই টেলিভিশন। টেলিভিশন স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে একটা ছবি। ছবিটা, আমাদের পূর্ব-পরিচিত লৌহমানবের। নবাবপুর রোডের উপর একটা হোটেলের বন্ধ গেটের সামনে এখন পঁড়িয়ে আছে লৌহমানব।
| লৌহমানবের হাতের যন্ত্রটা আসলে একটা ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র–একট। ব্যাটারিচালিত লেসার গান। এবং লৌহমানব আসলে কুয়াশার নব আবিষ্কৃত একটা. বৈজ্ঞানিক সাফল্য-রোবট।
একটা কাঠের বোর্ডের উপর স্থাপিত টেলিভিশনটি। বোর্ডটায় অসংখ্য সুইচ। ঝুঁকে পড়ে খটাখট শব্দ তুলে তিনটে সুইচ টিপে দিলো কুয়াশা। অমনি ট্রান্সমিটার কাজ শুরু করে দিলো। ভিশনের পর্দায় দেখা গেল কুয়াশার নির্দেশে লৌহমানব তার হাতের ভয়ঙ্কর যন্ত্রটি তুলে ধরেছে হোটেলের বন্ধ দরজার দিকে মুখ করে। | অস্ত্রটা যেইমাত্র তুলে ধরেছে অমনি এক ঝলক চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল মারণরশি বের হয়ে গেল নল দিয়ে। এক কণা সময়ের মধ্যে অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন। দরজাটা আর নেই!
| অত্যাশ্চর্য মারণরশ্মির এ এক অবিশ্বাস্য কেরামতি। মদ হাসি ফুটে উঠলো কুয়াশার ঠোঁটে। তার আবিষ্কার মূল্যহীন নয়। এতো দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে কাজ করে এই লেসার-গান যে, কেউ তা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। মারণরশাির জাদু-শক্তিতে হোটেলের লোহার গেটটা দেখতে না দেখতে পুড়ে ছাই। হয়ে গেল। খানিকটা ছাই এবং খানিকটা তরল লোহা দেখা যাচ্ছে ফাঁকা জায়গাটায়। কুয়াশা আবার একটা সুইচ টিপলো।
লৌহমানব ঢুকে পড়লো হোটেলের ভিতর। তারপর নিঃশব্দ : পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলো করিডর ধরে সিঁড়ির দিকে নির্বাধায়।
| নিঃশব্দে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো লৌহমানব। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো হোটেলের সব ক’টা প্রাণী। কিন্তু আচমকা একটা কাণ্ড ঘটলো। লৌহমানবের পায়ের ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠলো একজন বেয়ারা গাঢ় ঘুম থেকে। করিড়ারের এক পাশে ঘুমিয়েছিল বেচারা। জেগেই লৌহমানবকে দেখতে পেলো সে। অমনি গলা চেরা তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ করে চারদিক সচকিত করে তুললো লোকটা। তার ভয়ার্ত চিৎকার শুনে আরো দু’জন বেয়ারার ঘুম ভেঙে গেছে। প্রথমে কিছু বুঝতে
পেরেই পাল্লা দিয়ে চেঁচাতে লাগলো তারা। তারপর সত্যিসত্যি যখন। লৌহমানবকে দেখতে পেলো তখন চোখ কপালে উঠলো তাদের। ‘বাবাগো মা গো’ ‘ভূত ভূত’ ইত্যাদি রকম শব্দ বের হতে লাগলো তাদের গলা চিরে কর্ণবিদারী শব্দে।
নির্বাধায় একতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করলো লৌহমানব। বেয়ারাগুলোর শোরগোল শুনে একবার সে ধু থমকে দাঁড়ালো কি।
১০।
ভেবে যেন, তারপর গ্রাহ্য না করে উঠে যেতে লাগলো উপরের দিকে।
দেখতে না দেখতে একতলার সবকটা রুমের দরজা খুলে গেল। দোতলায়ও সকলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো বিস্মিত হয়ে। কিসের শব্দ হচ্ছে? এই রাত দুপুরে কারা হঠাৎ এমন ভাবে চিৎকার জুড়ে দিলো? ডাকাত পড়লো নাকি হোটেলে? লৌহমানব তখন সিঁড়ি টপকে টপকে তিনতলার দিকে উঠছে। ঠিক এমনি সময় দোতলারও সবকটা দরজা খুলে গেল একে একে। লাঠিসোটা, দা, বন্দুক ইত্যাদি হাতে নিয়ে সন্দিহানদৃষ্টিতে দুরুদুরু বুকে দরজার বাইরে এসে। দাঁড়ালো সকলে।
একতলার মানুষগুলোকে সঙ্গে করে নিয়ে উঠে এলো হোটেল ম্যানেজার দোতলায়। সকলে মিলে এবার গিয়ে দাঁড়ালো, সিঁড়িমুখে। লৌহমানব, তখনও তিনতলায় উঠছে গম্ভীর চালে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার।
| ছুটে গেল ম্যানেজার নিজের কেবিনে। বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা নিয়ে চলে এলো আবার সিঁড়ির কাছে। লৌহমানব ততক্ষণে তিনতলায় উঠে গেছে
প্রায় সবকটা সিঁড়ি অতিক্রম করে।
‘গুড়ুম! গুড়ুম!! গুড়ুম!!!
পরপর তিনবার গুলি করলো ম্যানেজার লৌহমানবকে লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ্য। দুটো গুলি গিয়ে লাগলো লৌহমানবের পিঠে, অপরটি ঠিক ঘাড়ের মধ্যবর্তী জায়গায় আঘাত করলো। কিন্তু প্রতিটি গুলিই ঠনঠন করে ছিটকে পড়লো সিঁড়ির ধাপে। লৌহমানবের শরীরে বিদ্ধ হলো না।
তিনতলায় উঠে করিডর ধরে হাঁটতে লাগলো লৌহমানব। অনেকগুলো রুম। ছাড়িয়ে আঠারো নম্বর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
| লৌহমানবকে দাঁড় করিয়ে রেখে কি যেন ভাবলো একটু কুয়াশা। তারপর একটা সুইচ টিপলো সে। লৌহমানব আঠারো নম্বর দরজার গায়ে টোকা মারলো ঠকঠক করে।
খুললো না দরজা। তিনতলার কোনো রুমেরই দরজা খোলেনি কেউ। এদিকে একতলা এবং দোতলার সব লোক একসঙ্গে জমায়েত হয়ে মহাশোরগোল শুরু করে দিয়েছে। কেউ কৈউ হোটেল থেকে বের হয়ে পড়েছে লৌহমানবের আওতা থেকে পালাবার জন্যে। কেউ আবার রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। হোটেল ম্যানেজার তার সহকারীদের নিয়ে দোতলার সিঁড়িমুখে দাঁড়িয়ে তিনতলার বোর্ডারদের উদ্দেশে কি যেন বলছে চিৎকার করে।
| রেডি ওটা জোর করে দিলো কুয়াশা। শোনা যাচ্ছে এখন ম্যানেজারের কণ্ঠস্বর। চিৎকার করে বলছে সে তিনতলার উদ্দেশে, আপনারা কেউ দরজা খুলবেন না! মঙ্গলগ্রহ থেকে একটা ভয়ঙ্কর জীব এসে ঢুকে পড়েছে হোটেলে।
তিনতলায় উঠে গেছে সে। দরজা-জানালা বন্ধ করে ফেলুন, খুললে প্রাণ যাবে খবরদার!
| লৌহমানব কুয়াশার নির্দেশে আবার লেসার গানটা তুলে ধরলো আঠারো নম্বর রুমের বন্ধ, দরজার দিকে। এবারও পলকের মধ্যে মারণরশি পুড়িয়ে ফেললো কাঠের দরজা। লৌহমানব রুমের ভিতর প্রবেশ করলো দৃঢ় পদক্ষেপে। . ঘরের ভেতর উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। অপরদিকের দরজাটা দেখা যাচ্ছে খোলা। সেই. খালা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। দুজনেই ইউরোপিয়ান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভয়ে, উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপছে তারা। কুয়াশা পরপর আরো দুটো সুইচ টিপলো। তারপর নিচু স্বরে কি যেন বললো মুখের সামনে একটা মাউথপিস তুলে ধরে। লৌহমানবের কণ্ঠ হতে অস্বাভাবিক স্বর ঘরময় গমগম করে উঠলো, ‘কুয়াশা জানে টোমরা কে। টোমাডের শক্তি সম্পর্কেও কুয়াশার কোনো সহে নেই। কিন্টু কুয়াশা অন্যায়-অপরাঢ়ের ঘোর শত্রু। টাই টার জামান যে বটুটিকে টোমরা খুন করেছে, টার বড়লা কুয়াশা নেবে। আমি টোমাডেরকে ধরে নিয়ে যেটে এসেছি।’
যান্ত্রিক কণ্ঠে কথা কটি বলেই এগোতে লাগলো লৌহমানব। | জার্মান দু’জন তখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লৌহমানবের দিকে। লৌহমানবকে এগোতে দেখেই সরে গেল তারা দরজার কাছ থেকে। লৌহমানব দরজা অতিক্রম করলো। দরজার এপাশে লম্বা মতো একটা ব্যালকনি শুধু। এখান ‘ থেকে অন্য কোথাও পালানো অসম্ভব।
| ‘ঠা ঠা ঠা ঠা ঠা…’.. | দরজা অতিক্রম করতেই দু’দুটো সাব-মেশিনগান গর্জে উঠলো লৌহমানবের দিকে মুখ করে। জার্মান দুজন বেপরোয়াভাবে গুলি করছে রেলিঙের ধারে
দাঁড়িয়ে।
‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…’
যান্ত্রিক হাসিতে ভেঙে পড়লো লৌহমানব। একটি গুলিও বিদ্ধ হচ্ছে না তার শরীরে। লৌহমানব এগোতেই থাকলো শিকার ধরার মতো দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে। আচমকা থেমে গেল গুলিবর্ষণ। ব্যালকনির রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে লোক দুজন। স্থির প্রতিজ্ঞা জ্বলছে তাদের দুজনেরই চোখে, প্রাণ দেবো কিন্তু ধরা। দেবো না’। | লৌহমানব ধরে ফেললো বলে লোক দুজনকে, ঠিক এমন সময় জার্মান দুজন নির্বিকার ভঙ্গিতে একই সঙ্গে লাফিয়ে পড়লো তিনতলার উপর থেকে। শুন্যে পাক খেতে খেতে সশব্দে শক্ত রাস্তার উপর গিয়ে পড়লো দু’জনই। সঙ্গে সঙ্গে ছাতৃছানা হয়ে গেল। ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়-এই শিক্ষাই পেয়েছে ওরা দলপতির কাছ থেকে। কে ওদের দলপতি? কি তার উদ্দেশ্য? ১২
}
ব্যাপারটা টেলিভিশনে স্বচক্ষে দেখতে দেখতে চমকে উঠলো কুয়াশা। এটাতো সে চায়নি। সে চেয়েছিল লোক দু’জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে জরুরী কিছু তথ্য জেনে নেবে শুধু। কিন্তু এ কি হয়ে গেল! ধরা দিলো না ওরা। কে জানতো ধরা দেবার চেয়ে মৃত্যুবরণ করে ফাঁকি দেবে এই ছিলো ওদের প্রতিজ্ঞা!
কয়েক মুহূর্তের জন্যে আনমনা হয়ে পড়লো কুয়াশা। মানুষ খুন করবে না। বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে শহীদের কাছে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও সেই মানুষ খুনই হয়ে গেল ঘটনাচক্রে। শহীদ যখন ব্যাপারটা জানতে পারবে তখন সে কি ভাববে কে জানে।
| একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কুয়াশা। তারপর টেলিভিশনের দিকে দৃষ্টি ফেলেই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উঠলো সে। হোটেলের একতলা এবং দোতলার সব লোক উঠে এসেছে তিনতলার সিঁড়িমুখে। লোহার ডাণ্ডা, বন্দুক, রিভলভার, দা, ভোজালি ইত্যাদি ভয়ানক সব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত সকলেই।
সুইচ টিপলো কুয়াশা। লৌহমানব ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর আঠারো নম্বর রুম পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো নিঃশব্দ পায়ে।
| লৌহমানবকে রুম থেকে বের হতে দেখেই ফায়ারিং শুরু হয়ে গেছে। রিভলভার বন্দুক দুটোই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু লৌহমানব সিঁড়ির দিকে দু’পা
এগোতেই হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল একটা। হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে জলপ্রপাত বয়ে গেল যেন। মুহূর্তের মধ্যে সব জঞ্জাল সাফ হয়ে গেল। লৌহমানবের ভূক্ষেপ নেই কোনদিকে। দৃঢ় পায়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় নামলো সে। দোতলা থেকে নামলো একতলায়। তারপর রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে একমূহ কি যেন ভাবলো, পরমুহূর্তেই ঠিক যেদিক দিয়ে এসেছিল সে সেদিকেই হাঁটতে লাগলো। দ্রুত পদক্ষেপে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ইভিমধ্যে থানা হেডকোয়ার্টারে জরুরী সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ফোন করে দেয়া হয়েছে।
লৌহমানব তার নির্দিষ্ট পথে হাঁটতে থাকে, পিছন পিছন রাইফেল এবং রিভলভারধারী কিছুসংখ্যক অসমসাহসী লোক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ধাওয়া করে তাকে। ঠিক এমনি সময় মি. সিম্পসন এক গাড়ি আমর্ড ফোর্স নিয়ে হাজির হন হোটেলের সামনে।
“ হোটেল ম্যানেজারের মুখে সংক্ষেপে ঘটনাটা শুনে নেন মি. সিম্পসন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারপর ছুটতে থাকেন সদলবলে লৌহমানবের উদ্দেশে।
| সামান্য কিছু দূর গিয়েই লৌহমানবের দেখা পান মি. সিম্পসন। চিৎকার করে আদেশ করেন তিনি গোলাগুলি ছোঁড়া বন্ধ করতে। লৌহমানব হেঁটে যাচ্ছিলো মাঝ রাস্তা ধরে। মি. সিম্পসনের গলা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় একবার। পাঁচ সেকেণ্ডের জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে সে। তারপর আবার শুরু করে
হাঁটা।
বুড়িগঙ্গার তীরে পৌঁছে গেছে লৌহমানব। মি, সিম্পসন এখনো পিছু ছাড়েননি, তার। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রিভলভার বাগিয়ে দলবল নিয়ে অনুসরণ করে চলেছেন তিনি নাছোড়বান্দার মতো। লৌহমানব লঞ্চঘাটে এসে দাঁড়ালো। তারপর ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলো পানির দিকে।
লঞ্চঘাটের সিঁড়িগুলো অতিক্রম করে পানিতে নেমে পড়লো লৌহমানব। মি, সিম্পসন এতক্ষণে লঞ্চঘাটের উপরে এসে দাঁড়ালেন। লৌহমানবকে পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তবে কি পানির অতলতলেই এর বাসা? ভেবে কোনোই কূল পেলেন না মি. সিম্পসন। সিঁড়ির ধাপ কটা অতিক্রম করে এবার তিনি ও তার দলবলও এগিয়ে চললেন পানির দিকে।
| লৌহমানব ঘুরে দাঁড়ালো এমন সময়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো মি: সিম্পসনকে। চোখ দুটো দাউ দাউ করে জ্বলছে যেন তার। হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে লৌহমানব তার হাতটা উরুর কাছে নিয়ে গেল। কি যেন করলো সে। খুট করে শব্দ হয়ে ফাঁক হয়ে গেল খানিকটা জায়গা।
থমকে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। লৌহমানব উরুর ফাঁকটা থেকে বের করে আমলো লম্বা মতো একটা রিভলভার। মি. সিম্পসন এবং তার দলবলের দিকে তাক করলো সে রিভলভারটা। ঝটিতে শুয়ে পড়লেন মি. সিম্পসন লৌহমানবের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে। চিৎকার করে শুয়ে পড়তে আদেশ দিলেন আর সকলকেও। কিন্তু কোনো লাভই হলো না তাতে। লৌহমানবের হাতে ধরা রিভলভার থেকে এক পশলা লিকুইড ক্লোরোফর্ম স্প্রে হয়ে গেল হিস হিস শব্দ করে। তারপর লৌহমানব ঘুরে দাঁড়ালো।
লৌহমানব এবার নির্বিঘ্নে হেঁটে চললো ক্রমশ গভীর পানির দিকে। পেছনে আর কেউ ধাওয়া করছে না তার। মি. সিম্পসন, এবং তার দলবল আধঘন্টার জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছেন লঞ্চঘাটের শেষ সিঁড়িটার উপর।
মৃদু হাসি ফুটে উঠলো কুয়াশার ঠোঁটে। তার সবকটা আবিষ্কারই কাজে লাগছে প্রয়োজনের সময়।
তিন
সেদিনই বেলা আন্দাজ দশটা থেকে দশ-বারোটা নৌকাকে বুড়িগঙ্গার কূলে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। নৌকাগুলো লঞ্চঘাটের আশপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো সারাটা বেলা। বিকেল ঠিক পাঁচটার সময় একটা ছাড়া অপর
১৪
,
নৌকাগুলোকে আর দেখা গেল না সেই জায়গায়। নৌকাগুলো অদৃশ্য হবার আধঘন্টা পর তিনজন কুলি এসে দাঁড়ালো লঞ্চঘাটে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত তিনজন কুলি আসলে আমাদের পূর্ব পরিচিত মি. সিম্পসন, শখের ডিটেকটিভ শহীদ খান এবং তার সহকারী কামাল ব্যতীত আর কেউ নয়। বিশেষ কারণবশতঃ কুলির ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে ওদেরকে। শহীদের এখানে আসার কারণ হলো এই যে, গতরাত তিনটের সময়। মি. সিম্পসন তাকে ফোন করেছিলেন। লৌহমানবের প্রায় অলৌকিক কাহিনী সবিস্তারে বলে শহীদের সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। সে কারণেই ওদের আগমন ঘটেছে এই অদ্ভুত ছদ্মবেশে বুড়িগঙ্গার কূলে।
মি. সিম্পসন আগেই ইনফর্মার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লঞ্চঘাটে। তেমন সন্দেহজনক কোনো কিছু নজরে পড়লেই খবর পাঠাবার নির্দেশ ছিলো তাদের উপর। সারাদিন ঘুর ঘুর করেও সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়েনি তাদের। বিকেল পাঁচটার সময় ফিরে গিয়ে ‘মি. সিম্পসনকে রিপোর্ট দিয়েছে তারা। সঙ্গে সঙ্গে মি. সিম্পসন ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। শহীদ এবং কামালকে ফোন করে ডেকে
এনে কুলির ছদ্মবেশ ধারণ করে অফিস থেকে বের হয়ে সোজা লঞ্চঘাটে এসে . উপস্থিত হন। তাঁর ধারণা ইনফর্মাররা যেখানে সন্দেহজনক কিছু পায়নি সেখানে। তিনি নিজে উপস্থিত হলে অনেক কিছু পেতে পারেন। সঙ্গে শহীদ খান থাকলে
তো কথাই নেই।
যাই হোক, সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত শুধুই এদিক ওদিক ঘুরেফিরে কাটলো। সন্দেহজনক তেমন কিছু নজরে না পড়লেও বিশেষ একটা লঞ্চের দিকে বারবার ওদের তিনজনের দৃষ্টি পড়ছিল। তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য ছিলো না লঞ্চটার। আকারেও খুব একটা দশাসই নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, অন্যান্য অসংখ্য লঞ্চে যেমন লোকজন উঠছে নামছে বা ঘুরে বেড়াচ্ছে এটিতে তেমন কিছুর চিহ্নমাত্রও নেই।
অসংখ্য লঞ্চের সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরে নোঙর করা হয়েছে লঞ্চটা। ঝক্কড়মাৰ্কাই বলা যায়। এক হাজার একশত বৎসর একদিন বয়েস হবে লঞ্চটার জং ধরা, নড়বড়ে। লঞ্চটায় কেউ উঠছেও না, নামছেও না। কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না ভিতর থেকে। জনপ্রাণীর সাড়ামাত্র নেই।
| সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শহীদ, মি. সিম্পসন ও কামাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তকিয়ে ছিল লঞ্চটার দিকেই। এমন সময় অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য দেখা গেল লঞ্চটার উপরের ঢুেকে। দৃশ্যটা দেখে প্রথম মুহূর্তেই হতবাক হয়ে গেলেন মি, সিম্পসন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে শহীদের দিকে তাকালেন তিনি। উত্তেজনায়, অবিশ্বাসে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে তাঁর কুয়াশাকে লঞ্চটার উপরের ডেকে পায়চারি করে বেড়াতে দেখে।
১৫
–
‘অবিশ্বাস্য শহীদ! কুয়াশা! তবে কি কুয়াশাই হোটেলে লৌহমানব পাঠিয়ে ইউরোপিয়ান দুজনকে খুন করিয়েছে? লৌহমানব কি তবে কুয়াশারই তৈরি?’
. মি. সিম্পসনের কথা শুনে মৃদু হাসূলো শহীদ। বললো, ‘কুয়াশা খুন করিয়েছে বলে বিশ্বাস করি না আমি, মি. সিম্পসন। তবে লৌহমানব যে কুয়াশার দ্বারাই আবিষ্কার করা সম্ভব এ আমি জানি। আপনার মুখ থেকে সব শুনে আমার ধারণাই হয়ে গিয়েছিল কুয়াশা ছাড়া আর কেউ লৌহমানব পাঠাতে পারে না।
কিভাবে বুঝলি তুই?’ প্রশ্ন করলো কামাল।
অনুমান।
কথাটা বলে মি. সিম্পসনের উদ্দেশে পাশ ফিরে তাকালো শহীদ। কিন্তু মি. সিম্পসন তখন ঘাটের শেষ ধাপে নেমে গিয়ে একটা নৌকার মাঝির সঙ্গে কি যেন
আলাপ করছেন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে।
| মি. সিম্পসনের ব্যগ্রতা দেখে আশ্চর্য হলো না শহীদ। কুয়াশাকে হাতের নাগালে পেয়ে হাতের মুঠোর ভিতর কে না আনতে চায়। বিশেষত, মি. সিম্পসনের মতো কুয়াশার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হলে তো কথাই নেই।
| কামালকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামলো শহীদ। মি. সিম্পসনের পাশে গিয়ে পঁড়াবার আগেই তাড়া লাগালেন তিনি, ‘নৌকায় ওঠো, শহীদ, জলদি!
প্রস্তুত হয়েই এসেছেন মি. সিম্পসন। তিনি যদিও জানতেন না যে এবারও কুয়াশা এই অবিশ্বাস্য ঘটনার নায়ক, তবে প্রতিপক্ষকে তিনি মহা-শক্তিশালী ধরেই নিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি গতরাতের অদ্ভুত ঘটনা পরম্পরায় বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। অজ্ঞাত প্রতিপক্ষকে মনে মনে বাহবা না দিয়ে পারেননি। ভয় মিশ্রিত একটা শ্রদ্ধাবোধ তখনই জনে গিয়েছিল তার শত্রুর প্রতি। সুতরাং তিনি জানতেন, এই শত্রুকে কাবু করতে হলে পাড়া মাত করে হৈহৈ শব্দে হাজির হলে চলবে না। শক্তি নয়, বুদ্ধিবলই প্রয়োজন এই শত্রুকে ঘায়েল করতে।
লঞ্চের পিছন দিক দিয়ে ওপরে উঠবো আমরা।’
নৌকায় চড়ে বসে ফিসফিস করে বললেন মি. সিম্পসন শহীদ ও কামালকে লক্ষ্য করে। লঞ্চের দিক থেকে একমুহূর্তের জন্যেও দৃষ্টি সরাননি তিনি। কুয়াশা এখনও আপন মনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে তার লঞ্চের ডেকে।
ছেড়ে দিলো মাঝি নৌকা।
‘টেরও পাবে না বাছাধন, আমরা উঠে পড়বো লঞ্চে। উঠেই আক্রমণ করতে হবে। সময় দিলে হাজার রকমের কারসাজি শুরু করে দেবে কুয়াশা দেখতে না দেখতে। সেই লৌহমানবটাকে যাতে কাজে লাগাতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তা না হলে সব মাটি।’..
অন্ধকার গঢ়ি হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। কথাগুলো বলতে বলতে শহীদের দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন একবার। পরক্ষণেই লঞ্চের দিকে তাঁকিয়ে দেখলেন ডেক
থেকে কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
| ‘কি ব্যাপার, শহীদ! কুয়াশা কি দেখতে পেয়েছে আমাদের?’
কামাল বললো, “অসম্ভব, মি. সিম্পসন। অতদূর থেকে দেখলেও চিনতে পারবে না কুয়াশা আমাদেরকে। তাছাড়া কি রকম অন্ধকার দেখছেন না, কুয়াশার চোখ তো আর অন্ধকারেও জ্বলে না।’
. সকলের অজান্তে শহীদ লক্ষ্য করে দেখছিল একটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্ততঃ তার কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হলো। কুয়াশার লঞ্চের আশপাশে অন্য একটা লঞ্চের আলো পড়েছে উজ্জ্বল হয়ে। সেই আলোতে শহীদ দেখলো কুয়াশার লঞ্চের চারপাশের পানিতে অদ্ভুত একটা আলোড়ন শুরু হয়েছে। অস্বাভাবিক উথলে উথলে উঠছে পানি। পানির নিচে দারুণ একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। শহীদের মতো কামালও লক্ষ্য করলো ব্যাপারটা। অবাক বিস্ময়ে তাকালো কামাল শহীদের দিকে।
| ‘চিড়িয়া ভাগলবা হে,’ ঠাট্টা করে বললো শহীদ।
তার মানে!’ ক্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন। শহীদ আবার বললো, কুয়াশা বোধহয় পালালো মি. সিম্পসন।’
‘অসম্ভব! সে আমাদেরকে দেখতেই পায়নি। দেখতে পেলেও এই অন্ধকারে চিনতে পারবে কিভাবে শুনি?’ .
ঠোঁট টিপে হাসলো শহীদ অন্ধকারে। মুখে বললো, তাই তো! চলুন তবে চেষ্টা করে দেখা যাক।
মাঝিকে নির্দেশ দেয়া হলো নিঃশব্দে পঁাড় বেয়ে ঠিক লঞ্চটার পিছন দিককার গায়ে ভিড়তে। যথাযথ আদেশ পালন করলো মাঝি। অতি সন্তর্পণে ভিড়লো নৌকোটা লঞ্চের গায়ে। কোনো শব্দ নেই লঞ্চে। ফিসফিস করে মি. সিম্পসন বললেন, বুঝতে পারেন কুয়াশা। তা না হলে বাধা দিতো। অন্তত মইটা এভাবে আমাদের জন্যে ঝুলিয়ে রাখতো না।’
ঠিকই। একটা কাঠের মই রাখা ছিলো জায়গাটায়। দেরি না করে কোমরে লুকিয়ে রাখা রিভলভারটা বের করলেন মি. সিম্পসন। দেখাদেখি কামালও হাত। দিলো তার নিজের কোমরে রিভলভার বের করার জন্যে। মি, সিম্পসন ততক্ষণে মই বেয়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছেন।
‘ ‘প্রথমেই তিনতলার ডেকের উপর গিয়ে পৌঁছলো ওরা। তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে পড়লো অন্ধকারে। ডেকের উপর তো কোনো আলো ছিলোই না, একটি মাত্র কেবিন থেকেও কোনো আলোর আভাস মাত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না। শহীদ ও কামালের আগেই দোতলায় নেমে গেলেন মি. সিম্পসন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নামলো কামাল ও শহীদ। নেই। কেউ নেই। তিনতলার মতো দোতলাতেও কোনো জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। চিহ্নও নেই। নিরাশার ছায়া ফুটে উঠলো মি. ২-
সিম্পসনের কপালে। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি দোতলার শেষ কেবিনটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে না পেয়ে। এমন সময় কামালকে সেই কেবিনে ঢুকতে দেখলেন মি. সিম্পসন।.
কুয়াশা পালিয়েছে মি, সিম্পসন, নিরাশ কণ্ঠে বললো কামাল। শহীদের কথাই সত্যি হলো।’
কামালের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ডেক থেকে শহীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তাড়াতাড়ি বাইরে বের হয়ে আসুন, মি. সিম্পসন।’
| ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো কামাল ও মি. সিম্পসন। শহীদের গলায় এমন একটা জরুরী ভঙ্গি ছিলো যে দুজনই যুগপৎ চমকে উঠলো প্রায়।
কুয়াশাকে দেখতে চান? ওরা বাইরে বের হয়ে আসতেই মিটিমিটি হেসে প্রশ্ন করলো শহীদ। ‘, | বোকার মতো তাকালো কামাল শহীদের দিকে। মুখ দিয়ে কথা বের হলো না তার। | ‘ঐ দেখুন, ডান দিকের দুটো লঞ্চ ছাড়িয়ে তিন নম্বর লঞ্চটার ডেকের উপরে কুয়াশা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
ব্যস্ত-ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো ওরা ডান দিকে।
নির্দিষ্ট লঞ্চটা মৃদু মৃদু দুলছে ঢেউ লেগে। খুব একটা বড়সড় লঞ্চ এটাও নয়। তবে নতুন তা দেখলেই বোঝা যায়। নীল এবং হাল্কা সবুজ রঙে ঝকমক করছে। লঞ্চটা আলোর প্রতিফলনে। ঐ দিকটা আলোর প্রাচুর্যে স্পষ্টই দৃষ্টিগোচর হয়। সম্পূর্ণ লঞ্চটাতেই অন্য লঞ্চ থেকে আলো এসে পড়েছে। তাছাড়া, ডেকে তো উজ্জ্বল আলোর ছড়াছড়ি। ডেকের সেই আলোয় দেখা গেল বিলাসী পদক্ষেপে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ধুরন্ধর কুয়াশা আপন মনে। মুখে তার অস্পষ্ট হাসির রেখা।
কি আশ্চর্য! এও কি বাস্তবে সম্ভব?
‘এ কি করে সম্ভব হলো, শহীদ?’ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন।
‘স্বপ্ন দেখছি না তো?’ শুকনো গলায় জানতে চাইলে কামাল।
‘স্বপ্ন নয়, বাস্তবেও এটা সম্ভব। অনেকের বেলায় সম্ভব না হলেও কুয়াশার বেলায় অসম্ভবও নির্ঘাৎ সম্ভব। তা না হলে কুয়াশা আমাদেরই মতো একজন বুদ্ধিপ্রধান মানুষ হতো, কালজয়ী প্রতিভাবান বলতাম না। বলতাম কি?’
‘ তা বলতাম না,’ মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিলেন মি. সিম্পসন শহীদের কথা। সত্যি, কুয়াশার তুলনা এককথায় মেলা অসম্ভব। কিন্তু শুধু যদি সে অসামাজিক কাজগুলো থেকে নিজেকে…:
কুয়াশা ততক্ষণে আর ডেকের উপরে নেই। মি. সিম্পসনকে বাধা দিয়ে
১৮
কামাল বললো, ‘গল্প পরে করলেও চলবে মি. সিম্পসন, ভুলে যাবেন না যে আমরা কুয়াশাকে গ্রেপ্তার করতে চাই।’
“নিশ্চয়ই! চলো চলো!’ চিংড়ি মাছের মতো লাফিয়ে উঠলেন মি. সিম্পসন। বললেন, ‘কুয়াশাকে তার প্রাপ্য সাজা পেতেই হবে।’ ‘
| মই বেয়ে নৌকায় নেমে এলো ওরা। সেই নির্দিষ্ট লঞ্চের দিকে দাঁড় বাইতে বললো মাঝিকে। অল্পক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল নৌকা লঞ্চটার পাশে। এখানেও যই পাওয়া গেল একটা। দারুণ উত্তেজনায় মি. সিম্পসন এবং কামাল একটা গিনিস লক্ষ্য করতে বেমালুম ভুলে গেল। কিন্তু শহীদের দৃষ্টি এড়ালো না ব্যাপারটা। এই লঞ্চটারও আশপাশে প্রথমবারের মতো পানির ভিতর দারুণ তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।
মই বেয়ে উপরে উঠলো ওরা বিনাবাক্যব্যয়ে। উদ্যত রিভলভার হাতে ডেক ধরে একটা কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগলো গুটিগুটি। এমন সময় শহীদের হাস্যময় কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো ওরা, কুয়াশাকে এভাবে ধরা যাবে না, মি. সিম্পসন। ঐ দেখুন, কলা দেখিয়ে প্রথম লঞ্চটাতেই ফিরে গিয়ে আবার পায়চারি
করে বেড়াচ্ছে সে।’
ধীরে ধীরে ঘাড় বাঁকিয়ে দূরের লঞ্চটার দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন। সোজাসুজি না তাকিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো কামাল।
হাসতে হাসতে শহীদ বললো, বলন, এখন কি করবেন?
কঠিন হয়ে উঠেছে মি. সিম্পসনের মুখ। মাজেহাল হবারও একটা সীমা পরিসীমা আছে। এমন বিদঘুঁটে নাকানি-চোবানি খেলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে।
| ‘শেষ পর্যন্ত দেখবো আজ আমি। আবার যাবো আমরা ঐ লঞ্চে,’ মইয়ের দিকে ফিরতে ফিরতে কথা কটি বলেন মি. সিম্পসন। অগত্যা শহীদ ও কামালও তার পিছু নেয়।
নৌকার উপর বস্তা চাপা দেয়া একটা সাব-মেশিনগান বের করে নিলেন মি. সিম্পসন। আর মাত্র দশ-বারো গজ দূরে লঞ্চটা দাঁড়িয়ে আছে। এবার আর পালাবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার। আপন মনে ডেকের উপর পায়চারি করে বেড়াচ্ছে সে এখনও। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বিস্মিত হলো শহীদ। কুয়াশা এমন নির্বিকার কেন।
| মাত্র পাঁচ গজ থাকতে হাঁক ছাড়লেন মি. সিম্পসন কুয়াশার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ‘পালাবার চেষ্টা কোরো না, কুয়াশা। তাহলে আজ আর তোমার রক্ষা নেই।
ধীরে ধীরে ফিরলো কুয়াশা ওদের দিকে। হাসছে উদারভাবে। ঠিক এমনি সময় রেলিঙের উপর একটা লৌহমানবের ছায়া দেখা গেল। চমকে উঠলেন মি.
সিম্পসন। লৌহমানব রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ালো। হাতে তার উঁচিয়ে ধরা
একটা লেসার গান।
সাবটান, মিস্টার ছিমছন। হৈ চৈ করলে বিপড ঘটবে বলে ডিচ্ছি। ভিজে বেড়ালের মটো. ওপরে উঠে পড়ুন টাড়াটাড়ি। ডশ পর্যন্ট গুণবো আমি-এক, দুই, টিন, চার..
ভিজে বেড়ালের মতো নয়, হিংস্র বাঘের মতো ক্রোধে গর্জন করে উঠলেন মি. সিম্পসন। টিপে দিলেন হাতের সাব-মেশিনগান।
ঠা, ঠা, ঠা ঠা ঠা…’
‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ,’ যান্ত্রিক শব্দে বিকটু হাসি বের হলো লৌহমানবের গলা দিয়ে। তারপর আবার শুনতে শুরু করলো সে, ‘সাট, আট…”
উঠে পড়ুন মি. সিম্পসন,’ বিচলিত কণ্ঠে বললো কামাল। তাই তো! আর তো কোনো উপায় দেখছি না।’
দারুণ ক্রোধে গজর গজর করতে করতে মই বেয়ে লঞ্চের উপর উঠতে শুরু করলেন মি. সিম্পসন। তার পিছন পিছন শহীদ ও কামালও উঠতে লাগলো লৌহমানবের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি রেখে। অদ্ভুত মাথা কুয়াশার। কি ভয়ঙ্কর যান্ত্রিক মানুষ তৈরি করেছে সে!
মি. সিম্পসন আগে আগে, তার পিছনে লৌহমানব এগোতে লাগলো ডেক ধরে। দশ কদম এগোবার পর কি মনে করে পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালেন। কেউ নেই তার পিছনে। শহীদ ও কামালও নেই। মিনিটখানেক থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন মি. সিম্পসন। একবার ভাবলেন-এই সুযোগ, পালিয়ে যাই এই ফাঁকে। তারপর ভাবলেন, না। দেখা যাক না কি হয়। সুযোগ পেয়েও তো যেতে পারি কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে।
যেদিক যাচ্ছিলেন সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলেন মি. সিম্পসন। ডেকের উপর আলোটা এখন নিভে গেছে। অদূরেই দেখা যাচ্ছে একটা কেবিন। দরজা খোলা কেবিনটার। উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে বাইরে। মি. সিম্পসন পা টিপে টিপে সেদিকেই এগোলেন কোমর থেকে রিভলভারটা বের করে নিয়ে।,
নিঃশব্দ পায়ে আলোকিত কেবিনটার দিকে এগোতে লাগলেন মি. সিম্পসন। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ভোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন চুপিচুপি। ভিতরে দৃষ্টি পড়তেই আশায় আনন্দে শিরশির করে উঠলো তার সর্বশরীর-কুয়াশা!
বিশাল পিঠ দেখা যাচ্ছে কুয়াশার। পিছন ফিরে বসে রয়েছে। সামনে সম্ভবত একটা টেবিল। টেবিলটার উপর ঝুঁকে মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছে সে। কোনদিকে যেন খেয়াল নেই এতটুকু।
মুহূর্তের জন্যে দিশেহারা হয়ে পড়লেন মি, সিম্পসন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কুয়াশাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। শহীদ ও
২০
কামালের কথা মনে পড়লো তার। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও দেখতে পেলেন
তাদের তিনি। কিন্তু শহীদদের কথা তখন তার ভাবনা নয়। কুয়াশাকে এরকম আনমুনায় পেয়ে কিভাবে এবার হাতের মুঠোর ভিতর আনা যায় সেই দুশ্চিন্তাতেই উতলা হয়ে উঠেছে তার মন। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। ফিরে যাবেন তিনি। লঞ্চের নিচেই নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে ইনফর্মার। তাকে দিয়ে খবর পাঠাবেন অদূরেই জলপুলিসকে। কুয়াশা এখনও জানতে পারেনি যে সে ধরা পড়ে গেছে। লৌহমানবের হাতে সব কাজের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করছে সে। দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই জলপলিসকে সঙ্গে নিয়ে ঘেরাও করে ফেলবেন তিনি কুয়াশার লঞ্চ। পালাবার আর কোনো পথ থাকবে না কুয়াশার।
যেই ভাবা সেই কাজ। মি. সিম্পসন নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু হিতে সবসময় বিপরীত ঘটে এটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। মি. সিম্পসন যেইমাত্র ঘুরে দাঁড়ালেন অমনি দরজার পাশ থেকে বের হয়ে এসে তার পথরোধ করে দাঁড়ালো একটা লৌহমানব। ‘প্রস্তরমূর্তির মতো থমকে গেলেন মি. সিম্পসন। তারপরই, লৌহমানবের আগুনের মতো জ্বলন্ত দুটো চোখ লক্ষ্য করে সাইলেন্সর লাগানো রিভলভারের ট্রিগার টিপে দিলেন পরপর দুবার। কিন্তু হা হতোহস্মি! একটা গুলিও বের হলো
রিভলভারের নল থেকে। বেরোবেই বা কিভাবে। মি. সিম্পসনের অজান্তে লৌহমানব তার রিভলভার বের করে নিয়ে গুলিগুলো ফেলে দিয়ে আবার যন্ত্রের সঙ্গে যথাস্থানে রেখে দিয়েছিল।
চার
সোজা কুয়াশার ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়বেন ঠিক করলেন মি. সিম্পসন। তৈরি হয়ে লাফ দেবেন এমন সময় অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল কুয়াশার।
| ‘ধীরে, মিস্টার ধীরে! লাফদিলেই প্রচণ্ড আঘাত খাবেন শুধু শুধু। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখুন একবার, লৌহমানব কৈমন নিঃশব্দে আপনার পিছনে এসে ল্যাং মারার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছে।’
চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। আশ্চর্য, কুয়াশা তেমনি পিছন ফিরে বসে রয়েছে তার চেয়ারে। অথচ মি. সিম্পসন যে লাফ দিয়ে তার ঘাড়ের উপর পড়তে যাচ্ছিলেন তা ঠিক বুঝতে পেরেছে। চকিতে পিছন ফিরে তাকালেন মি. সিম্পসন। দেখলেন লৌহমানব তার পায়ের ভিতর আলগোছে একটা পা ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকারভাবে। শুধু বলের মতো দুটো আগুনের পিণ্ড ‘তার দিকে তাকিয়ে
‘ ২১
আছে জ্বলজ্বল করে।
‘ভিতরে ঢুকুন, মি. সিম্পসন।
আহ্বান জানালো কুয়াশা। প্রচণ্ড ক্রোধে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন মি. সিম্পসন। এমন সময় অপরদিকের দরজা দিয়ে শহীদ ও কামালকে নিয়ে একটা
লৌহমানব কেবিনের ভিতর প্রবেশ করলো দেখতে পেলেন তিনি।
‘এসো শহীদ, কথা আছে তোমাদের সঙ্গে আমার, শহীদের উদ্দেশ্যে বললো কথাটা কুয়াশা। ‘
মি. সিম্পসন ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে জানতে চাইলেন, জানতে পারি কি, আমাদেরকে এভাবে ধরে আনার কারণ কি?’
হেসে ফেললো কুয়াশা। বললো, কারণ আছে, মি. সিম্পসন। দাঁড়িয়ে কেন শহীদ, বসো তোমরা। আপনিও ভিতরে এসে বসুন, মি, সিম্পন।
| অগত্যা নিরুপায় মি. সিম্পসন কেবিনের ভিতর ঢুকে সামনের একটা চেয়ারে বসলেন ধীরে ধীরে। শহীদ ও কামালও বসেছে ইতিমধ্যে। লৌহমানব চলে গেছে। একসময় কেবিন ছেড়ে। কুয়াশা শুরু করলো তার কথা।
| ‘আমি জানি, গতরাতের লৌহমানব রহস্য ভেদ করার জন্যে আবার আমার পিছনে লেগেছেন মি. সিম্পসন। যদিও লৌহমানব যে আমারই সৃষ্টি তা তিনি আগে জানতে পারেননি। হ্যাঁ, লৌহমানব আমারই সৃষ্টি। প্রচণ্ড ক্ষমতা এই লৌহমানবের। হেন কাজ নেই যা এর দ্বারা সম্ভব নয়। একে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো কাজে লাগিয়েছি আমি। লেসার রশ্মি, যাকে মারণরশি বলা হয়, তা এর হাতের অস্ত্র থেকে বিচ্ছুরিত হয়। যে কোনো পদার্থেই এই রশ্মি ফেললে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু ধোঁয়া উঠবে নামমাত্র। আগুন ধরবারং ভয় নেই। এর শরীরে অটোমেটিক টিভি-ক্যামেরা ফিট করা আছে। ওয়্যারলেস, টেপ-রেকর্ডার, ক্লোরোফর্ম প্রেযুক্ত একধরনের রিভলভার ইত্যাদি আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজিয়েছি একে আমি।’
| একমুহূর্ত থেমে শহীদের দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করলো, কুয়াশা, ‘গতরাতের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে একটা গল্প শোনাতে হয় তোমাদেরকে। গল্পটা গল্প নয়, বাস্তব সত্য। সত্য, এবং অবিশ্বাস্য এক কাহিনী সেটা। শোনো | ‘গত মাসের পনেরো তারিখে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে অজ্ঞাতনামা একজন বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের চিঠি আসে আমার কাছে। অদ্ভুত একটা চিঠি! পুরো ঠিকানা নেই, বক্তব্যও সরল নয়, জার্মান ভাষায় মাত্র কয়েকটা লাইন লেখা। যার সারমর্ম হলো, “মানবের কল্যাণ কামনায় উৎসর্গিত-প্রাণ সংগ্রামী এক বৈজ্ঞানিক আমি। মহাশূন্যে রাজত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। এক্ষণে শক্ত কর্তৃক বিপদগ্রস্ত। আপনার সাহায্য একান্ত এবং জরুরী ভাবে কাম্য। যেভাবেই হোক
২২
আমি জেনেছি আপনিও একজন উৎসর্গিত-প্রাণ সংগ্রামী বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান জগতে আপনি যে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি তার প্রমাণ আমার হাতে আছে। দোহাই আপনার, আমাকে সাহায্য করুন।”
একমুহূর্ত থেমে কি যেন ভাবলো কুয়াশা। তারপর আবার শুরু করলো, এবং শুধু এই চিঠিটাই নয়, এরপর গত পঁচিশ ও একত্রিশ তারিখে একটা একটা করে দুটো চিঠি আসে আমার কাছে সেই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে লেখা হয়েছে চিঠিগুলো। পরবর্তী চিঠি দুটিরও বক্তব্য প্রায় এক।’
| গভীর মনোযোগে শুনছিল ওরা কুয়াশার কথা। কুয়াশা থামতে শহীদ প্রশ্ন করলো, দক্ষিণ আমেরিকার পেরু তো একটা দেশ। চিঠিতে প্রদেশ, জেলা, গ্রাম বা শহরের উল্লেখ নেই কেন? পুরো ঠিকানা না দেবার কি কারণ থাকতে পারে?’
কুয়াশা বললো, ‘প্রথমে সেটা আমার কাছে একটা রহস্যই ছিলো বটে। তবে আগেই আমি ধারণা করেছিলাম যে, বৃদ্ধ হয়তো নিজের পুরো ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক। তিনি হয়তো দেশান্তর হয়ে ছদ্মবেশে বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত আছেন।’
শহীদ বললো, “তা হওয়া অসম্ভব নয়। বৃদ্ধ তো জার্মান ভাষায় চিঠি লিখেছেন। তার মানে তিনি জার্মান, কিন্তু তাহলে পেরুতে থাকবেন কেন?
| কুয়াশা বললো, হ্যাঁ, পরে আমি সব জানতে পেরেছি। প্রথমে তো আমি বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম এই ভেবে যে, কিভাবে সাহায্য করবো তাঁকে। ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। এমন সময় হঠাৎ, এই মাসের সাত তারিখে, অর্থাৎ গত পরশুদিন, একজন জার্মান যুবক আমার সঙ্গে এসে দেখা করলো। যুবকটি আসলে সেই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকেরই ছেলে।
| কথার মাঝে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো কামাল। শহীদ তার আগেই জানতে চাইলো, তারপর?
কুয়াশা বলে চললো, যুবকটি আমার সঙ্গে দেখা করে বললো যে, সে পেরু থেকে এসেছে। তার বাবা তাকে পাঠিয়েছে আমার সর্বশক্তি নিয়ে আমি যেন তার সঙ্গে পেরুতে গিয়ে উপস্থিত হই। তার বাবা নাকি যে কোনো মুহূর্তে শত্রু কর্তৃক। নিহত হবার আশঙ্কা করছেন। এবং তিনি নিহত হলে মানব সমাজের যে অপরিসীম ক্ষতি হবে তা হাজার মাথা কুটলেও পূরণ হবে না। যুবকটির সঙ্গে এই পর্যন্তই আলাপ হয়েছিল আমার। সে হোটেল আফলাতুনে থাকছিল ঢাকায় এসে অবধি।
কুয়াশা মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে থামলো একটু। তারপর বললো, ‘আপনি তো জানেন, মি. সিম্পসন, যে গতকাল দুপুর দুটোর দিকে হোটেল আফলাতুনের সামনে একজন জার্মানকে হত্যা করে দু’জন জার্মান পালিয়ে গিয়েছিল?
যন্ত্রচালিতের মতো মাথা নাড়লেন মি. সিম্পসন।
নিহত ঐ জার্মানটিই সেই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের ছেলে। গতকাল দুপুর ঠিক দুটোর সময় আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে, আসার কথা ছিলো তার। সোয়া দুটো বেজে যাবার পরও তাকে আসতে না দেখে বিচলিত হয়ে পড়ি আমি। কেননা সুদূর পেরু থেকেই তাকে শত্রুরা অনুসরণ করে আসছে একথা সে আমাকে জানিয়েছিল। তাকে আমি আমার আতিথ্য গ্রহণ করার জন্যে অনুরোধও করেছিলাম। তার নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করা হতো তাতে। কিন্তু রাজি হয়নি সে। কেন জানি নিজের সম্পর্কে ওভার-শিওর ছিলো যুবকটি। রাজি হয়নি সে আমার কথায়। যাই হোক, তার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমিই রওনা হয়ে যাই হোটেল আফলাতুনের উদ্দেশে। হোটেলে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করার সময় তার মৃতদেহ দেখতে পাই আমি।’
| কুয়াশাকে বাধা দিয়ে মি. সিম্পসন বলে ওঠেন, আর যার যা স্বভাব, অমনি বাহাদুরি ফলাবার জন্যে মৃতদেহটা গাপ করে দিলে! এদিকে তার ফলে কি বিচ্ছিরি
ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে…। | মৃদু হেসে কুয়াশা বলতে শুরু করলো আবার,. মৃতদেহটার সদগতি করার সময় প্রতিজ্ঞা করি আমি যে, বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিককে আমার প্রাণ দিয়ে হলেও আমি। সাহায্য করবো। এবং তাঁর শত্রুপক্ষকে আমার শক্তির পরিচয় না দেখিয়ে ক্ষান্ত হবো না।’
‘কুয়াশা, তুমি একটা পিশাচ! তোমার শক্তির পরিচয় দেবার দরকার পড়বার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন মানুষকে নির্বিকারভাবে তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেয়ে ফেললে, কেমন?”
| কুয়াশার গল্পীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘না! ওদেরকে ছাদ থেকে ফেলে দেবার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না। আসলে নরহত্যাকে এখন আমি ঘৃণা করি। একথা আর কেউ না জানলেও শহীদ ভালভাবেই জানে। খুনী জার্মান দু’জনকে আমি শুধু বলপূর্বক আমার চোখের সামনে ধরে আনতে চেয়েছিলাম। কয়েকটা জরুরী তথ্য আদায় করবার জন্যেই এই প্ল্যান করেছিলাম আমি। আর বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিককে আমি সাহায্য করতে বদ্ধপরিকর একথা শত্রুদেরকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ভাবিনি এ শত্রু সাধারণ শত্রু নয়। ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যুকে এরা শ্ৰেয় জ্ঞান করে তা আমার জানা ছিলো না।’ | কথা শেষ করে চিন্তিত মুখে বসে রইলো কুয়াশা। কেউ কোনো কথা বললো। হঠাৎ একসময় মি. সিম্পসন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন সকলের অজান্তে।
কিছুক্ষণ পর শহীদ বললো, কুয়াশা, তুমি তাহলে দক্ষিণ আমেরিকায় যাচ্ছো? | যেন বহুদূর থেকে কুয়াশার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যাঁ, যেতে হবে আমাকে। ২৪।
যেতেই হবে।
পিক পিক, পিক পিক পিক, পিক পিক:..
কুয়াশার কথা শেষ হতেই ঘরের একদিকের কোণ থেকে অদ্ভুত শব্দে একটা
. ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠলো। তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা সোফা ছেড়ে। লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল কেবিনের যেদিকটায় কালো ভারী একটা পর্দা টাঙানো রয়েছে সেদিকটায়।
কিছু বুঝতে না পেরে শহীদ ও কামালও চমকে উঠেছিল। কুয়াশাকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে উঠে দাঁড়ালো ওরাও ওদের দুজনের মনেই প্রশ্ন কোনো বিপদ ঘটলো নাকি?
পাঁচ
‘এদিকে এসো, শহীদ।
কালো পর্দার ভিতর ঢুকেই ডাকলো কুয়াশা শহীদকে। এগিয়ে গেল ওরা। পর্দার ওপারে গিয়েই বিস্মিত হয়ে পড়লে শহীদ বিরাটাকার একটা কমপিউটার কাম ট্রান্সমিটার যন্ত্র দেখে। মানুষ সমান উঁচু হবে যন্ত্রটা। অদ্ভুত সব কলকজা তার। বিভিন্ন রঙের কাঁচ, কাঁটা; অদ্ভুত সব সঙ্কেতলিপি, নাম্বার, সুইচ।
| কুয়াশা বললো, মহাশূন্যের শব্দ তরঙ্গ ট্রান্সমিট করে এই যন্ত্র। আমার আরও একটি আবিষ্কার এটি। সৌরজগৎ ছাড়িয়ে তো দূরের কথা, চাঁদ মঙ্গলগ্রহ প্রভৃতি গ্রহ-উপগ্রহের সঙ্গেও আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এখনো আমরা জানি না সঠিকভাবে যে, আমাদের মতো আর কোনো জীব সৌরজগতে বা বিশাল মহাশূন্যের অন্য কোনো জগতে আছে কিনা। আমি তা জানতে আগ্রহী। একটু আগে যে ওয়ার্নিং বেল শুনতে পেলে সেটার অর্থ মহাশূন্যের শব্দতরঙ্গ রেকর্ড হয়ে গেছে এই যন্ত্রের ভিতর রাখা টেপরেকর্ডারে।’ | আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো শহীদ, এটার কার্য ক্ষেত্রের আওতা কতদূর কুয়াশা?’
অনেক, শহীদ। আমাদের সৌরজগৎ ছাড়িয়েও এর কার্যসীমা প্রসারিত। রেকর্ড করা শব্দ তরঙ্গ শুনবার পর বলা সম্ভব শব্দটা কতদূর থেকে এসেছে। শুনবে তুমি?
. অবাক বিস্ময়ে কামাল মাথা নেড়ে বললো, ‘শুনব বৈকি!
মুগ্ধ নেত্রে দেখছিল শহীদ কুয়াশাকে। প্রতিভাধর এই মানুষটির প্রতি তার শ্রদ্ধা আকাশপ্রমাণ হয়ে উঠলো। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সে কুয়াশার দিকে। সুইচ অন করে দিয়ে চালু করে দিলো কুয়াশা যন্ত্রটা।
যন্ত্রটা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে শো-ও-ও-ও শোঁ-ও-ও-ও করে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাবার মতো শব্দ হতে লাগলো প্রায় একমিনিট ধরে। তারপর অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপারের সূচনা হলো। হঠাৎ যন্ত্রটা থেকে একটা মনুষ্য কণ্ঠের ঘড়ঘড়ে বাজখাই শব্দ পাওয়া গেল।
বিদ্যুৎবেগে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো কুয়াশা শহীদের দিকে। ‘আশ্চর্য!’ কুয়াশাকে বিমূঢ় হতে দেখে শহীদ প্রশ্ন করলো, কি ব্যাপার, কুয়াশা?’
‘বিশ্বাস করতে পারছি না আমি, শহীদ! শুনতে পাচ্ছে না মানুষের কণ্ঠ? মহাশূন্য থেকে মানুষের কণ্ঠ ভেসে আসছে, এও কি সম্ভব।’
তার মানে!’
কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না যেন শহীদ, মহাশূন্য থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর! কি বলছো তুমি, কুয়াশা?’
‘শুনতে পাচ্ছো না, শহীদ, বিদেশী ভাষায়, খুব সম্ভব ফ্রেঞ্চ ভাষায় কে যেন কি বলছে?
শহীদ বললো, শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা মহাশূন্য থেকে ভেসে আসতে পারে কিভাবে?
শহীদের কথা শেষ হতে ট্রান্সমিটার যন্ত্রটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো কুয়াশা। এক মিনিট, দু’মিনিট, তিন মিনিট। সিধে হয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা আবার।
বললো, কোনো রকম গোলযোগ নেই, শহীদ, যন্ত্রে। কণ্ঠস্বরটা মঙ্গলগ্রহ থেকেই ভেসে আসছে। এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
বলো কি!’ | ইতিমধ্যে তিনবার একই ভাষায় উচ্চারিত একই শব্দ-তরঙ্গ ভেসে আসার পর অন্য একটা ভাষায় এখন শব্দ-তরঙ্গ ভেসে আসছে।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। সকলের মুখেই অবিশ্বাস দানা বেঁধে রয়েছে। এমন সময় হঠাৎ জার্মান ভাষায় শব্দ-তরঙ্গ ভেসে আসতে শুরু করলো ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে। একবার চকিতে শহীদের দিকে তাকিয়েই গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতে লাগলো কুয়াশা মঙ্গলগ্রহ থেকে আগত জার্মান ভাষায় মনুষ্যকণ্ঠের বক্তব্য।
পরপর তিনবার সেই একই শব্দমালা ভেসে এলো যন্ত্রের মাধ্যমে। তারপর বন্ধ হয়ে গেল টেপ-রেকর্ডার।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে কুয়াশা। ঘেমে উঠেছে সে কেবিনে দু’দুটো এয়ারকুলার থাকা সত্ত্বেও। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে শহীদের দিকে তাকালো একসময়। তারপর বললো, জার্মান ভাষায় যা শুনলাম তার অনুবাদ দাঁড়ায়, “আমি বৈজ্ঞানিক কিছষ্ণ বলছি। মঙ্গলগ্রহ থেকে এই সংবাদ কুয়াশা নামক
২৬
বৈজ্ঞানিকের সমীপে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে আমি ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন। সাজামো আমার ঠিকানা।”
. কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে কুয়াশা?’ কুয়াশার অনুবাদ শেষ হতেই শহীদ অবাক-বিস্ময়ে জানতে চাইলো।
কুয়াশা বললো, ঠিক বলতে পারছি না। সম্ভবত কোনো স্পেস ক্রাফট তৈরি করে তাতে টেপ-রেকর্ডার ফিট করে মঙ্গলগ্রহে পাঠানো হয়েছে সেটা। সেখান থেকে টেপ-রেকর্ডার খবরটা ছড়িয়েছে, আর আমার যন্ত্র সেটা ধরেছে। | তিনজনই একটা সোফায় গিয়ে বসলো এবার। শহীদ বললো, তুমি তাহলে খুব শিগগিরই রওনা হচ্ছে?
হ্যাঁ, শহীদ। বড় কৌতূহল হচ্ছে আমার বুদ্ধিমান এবং ক্ষমতাশালী এই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে পরিচিত হতে। আমাকে যেতেই হবে এবার।
হঠাৎ কি মনে করে শহীদের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো কুয়াশা। তারপর আবেগ-জড়িত আন্তরিক কণ্ঠে শহীদকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, যাবে, শহীদ, তোমরাও যাবে আমার সঙ্গে? চলো না, দেখে আসি আশ্চর্য একটা মানুষকে। কৌতূহল হচ্ছে না তোমাদের? একজন বুড়ো মানুষ কি জানি কি ভয়ানক বিপদে পড়ে সাহায্যের জন্যে হা-পিত্যেস করে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। তাকে কি সাহায্য করা মহত্ত্বের কাজ নয়, শহীদ?’
কুয়াশা থামতে কি বলবে ভেবে পেলো না শহীদ।
‘এসো না, শহীদ, আমরা সবরকমের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে, ছোট-বড় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক হয়ে যাই? এসো না, আমরা সবাই মিলেমিশে পৃথিবীটাকে সুন্দর এবং পবিত্র করে গড়ে তোলার জন্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করি? অনেক কিছু করার সাধ হয় আমার, শহীদ। অনেক কৌতূহল আমার। সাগরের নিচে কি অফুরন্ত সম্পদ, কি অসীম রহস্য! মহাশূন্যে কি অবিশ্বাস্য বিস্ময়! অথচ কোনো কিছুরই তো খবর রাখি না আমরা। কিন্তু সব জানতে চাই আমি! সব রহস্যের মীমাংসা, সব কৌতূহলের নিবৃত্তি না করতে পারলে জন্ম সার্থক হবে। কেন। সব জানবো আমি, সব জানবো।.এসো না, শহীদ তোমরা, সব ন্যায় অন্যায় ভুলে গিয়ে এসো না আমরা একজোট হয়ে বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর পথে? বিজ্ঞান সাধনার জন্যে আমি আর নরহত্যা করবো না। তোমরাও আর আমার পিছু পিছু ছুটবে না। আমিও আর কোনো সীমা লঙ্ঘন করবো না। চমৎকার হবে না কি সেটা? শহীদ, কামাল, তোমরা কি বুঝতে পারছো না আমার কথা? তোমাদের সাহায্য আমার দরকার।
‘পারছি, বন্ধু!
কুয়াশার আবেগ-মিশ্রিত আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারলো না শহীদ। উঠে দাঁড়ালো সে। কামালও অভিভূত হয়ে পড়েছে আশাতীত। এক মুহূর্তে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কেটে গেছে তার। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে-ও। কুয়াশার প্রসারিত হাতখানা সজোরে ধরলো চেপে দুজনে। শহীদ বললো, উত্তম প্রস্তাব, বন্ধু! তোমার সান্নিধ্য পেয়ে আমরা ধন্য হলাম।
উজ্জ্বল হেসে কুয়াশা বললো, ধন্যবাদ, শহীদ। ধন্যবাদ, কামাল। আগামী পরশুদিন যাত্রা শুরু করবো তাহলে আমরা, কি বলো?’
মাথা নেড়ে সায় দিলো ওরা।
মহুয়া হয়তো যেতে চাইবে। অনেকদিন সে বাইরে কোথাও যায়নি সম্ভবত। যেতে চাইলে আপত্তি কোরো না তুমি। গফুর তো তার দাদামণিকে ছেড়ে স্বর্গেও থাকতে রাজি হবে না। আর লীনা?’
কুয়াশার প্রশ্নের উত্তর দিলো কামাল, ‘লীনার সামনে পরীক্ষা। ওকে বোর্ডিংয়েই থাকতে হবে।
, মি. সিম্পসনকে দেখছি না যে! হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে শহীদ। . কুয়াশা বলে, মি., সিম্পসন অনেকক্ষণ হলো কেবিন থেকে বের হয়ে গেছেন। কেবিন থেকে বের হয়েছেন বটে, কিন্তু লঞ্চ ছেড়ে কোথাও যাবার পথ পাননি তিনি। উনি ভেবেছিলেন লঞ্চ থেকে পালিয়ে গিয়ে পুলিশ ফোর্স নিয়ে এসে আমাকে গ্রেফতার করবেন। কিন্তু আমার লঞ্চ এখন সাবমেরিনে রূপান্তরিত হয়ে পানির নিচ দিয়ে ছুটছে।’
বুঝলাম না তো!’ শহীদ প্রশ্ন করলো।
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলো, “তোমরা যে আমাকে একবার এই লঞ্চে আর একবার অন্য একটা লঞ্চে পায়চারি করে বেড়াতে দেখেছিলে সে ব্যাপারটার রহস্য কি জানো? রহস্যটা হলো এই যে, যে দুটো লঞ্চে আমাকে তোমরা দেখেছিলে সে দুটো মোটেই লঞ্চ নয়। খোলস মাত্র। শুধু খোলসটা রেখে সাবমেরিন নিয়ে অন্য একটা খোলসে আশ্রয় নিয়েছিলাম আসলে আমি। এখন বুঝতে পেরেছে তো?’
হাসতে হাসতে কামাল বললো, ওরে বাপরে! |
কামালের কথা শেষ হতেই মি. সিসনকে দেখা গেল দরজার সামনে। নিরুপায় হয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। কুয়াশা বললো, আমরা এখন শীতলক্ষা নদীতে আছি, মি. সিম্পসন। পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেবো আপনাদেরকে সদরঘাটে। দেরি করিয়ে দেবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
হাঁড়িপানা মুখ করে একটা চেয়ার দখল করে বসলেন মি. সিম্পসন একটি কথাও উচ্চারণ না করে। শহীদ ও কামাল ‘পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো নিঃশব্দে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা সোফা ছেড়ে। পকেট থেকে একটা সাধারণ লাইটার বের করে মি. সিম্পসনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। লাইটারটা মি. সিম্পসনের হাতে দিয়ে বললো, আপনাকে সামান্য একটা উপহার দিতে চাই, মি.
২৮
সিম্পসন। গ্রহণ করলে বাধিত হবো।
হাতে নিয়ে একবার লাইটারটার দিকে আর একবার কুয়াশার মুখের দিকে বার কয়েক পালা করে তাকালেন মি. সিম্পসন। তারপর সেটা ফিরিয়ে দেবার জন্যে কুয়াশার দিকে বাড়িয়ে ধরে গম্ভীর চালে বলে উঠলেন, ‘ধন্যবাদ। এরকম লাইটার বাজারে অনেক কিনতে পাওয়া যায়।
না, যায় না। বাজারে এরকম লাইটার কিনতে পাওয়া যায় না, মি. সিম্পসন, একথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। কেননা জিনিসটা দেখতে খুব সাধারণ হলেও এটি আমার নিজের আবিষ্কার।’
একটু হেসে নিয়ে কুয়াশা আবার বলতে শুরু করলো, “জিনিসটা আসলে লাইটারই নয়। দেখতে যাই হোক, এটা আসলে একটা হ্যাঁণ্ডবম। মাত্র দু’বার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে পারেন আপনি। কিন্তু তৃতীয়বার জ্বালাবার ঠিক পনেরো সেকেন্ড পর এটা একটা হাতবোমায় পরিণত হবে। কোনো শত্রুকে যদি আত্মরক্ষার্থে শেষ করে দিতে চান তবে এর আর জুড়ি নেই। তৃতীয়বার জ্বালিয়ে।
এটা আপনি যেখানেই ফেলবেন সেখানে পনেরো সেকেণ্ডের মধ্যে চার ফুট জায়গা নিয়ে দাউদাউ করে আগুন ধরে যাবে। এবং সেটা হবে বিশেষ এক ধরনের আগুন, যার উচ্ছ্বাস থাকবে সব সময় উপরের দিকে খাড়া। আশপাশে অন্য কেউ বা অন্য কিছু থাকলে কোনো ক্ষতিই হবে না।’
হাতটা টেনে নিলেন মি. সিম্পসন। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ জিনিসটা। তারপর তীক্ষ্ণ এক টুকরো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে থমথমে গলায় বললেন কুয়াশার দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে, এখন, এখন যদি এই হাতবোমাটা তোমার উপরই ছুঁড়ে মারি, কুয়াশা! কি করতে পারে। সেক্ষেত্রে তুমি?
হাঃ হাঃ করে প্রাণখুলে হাসলো কিছুক্ষণ কুয়াশা মি. সিম্পসনের কথা শুনে। হাসি থামতে বললো, কিছুই করতে পারি না সেক্ষেত্রে আমি, মি. সিম্পসন। কিন্তু
আমি জানি আপনি তা পারবেন না। ক্ষমতা থাকলেও সে ইচ্ছা আপনার নেই।’
মুখ কাঁচুমাচু করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন মি. সিম্পসন। ধরা পড়ে গেছেন তিনি। কুয়াশার প্রতি তাঁর যে দুর্বলতা আছে, কুয়াশার প্রতি তার মনের নিভৃত কোনায় যে
একরাশ সহানুভূতিবোধ জন্মে গেছে তা নিজেরই বোকামির ফলে প্রকাশ হয়ে, পড়বে ভাবেননি তিনি।
| মি. সিম্পসরে ঠিক এই দুর্বল মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করছিল কুয়াশা। হঠাৎ সে শহীদ ও কামালকে যে প্রস্তাব দিয়েছিল সেই প্রস্তাব দিয়ে বসলো। পরিশেষে বললো, ‘যাবেন, মি. সিম্পসন, চলুন না, পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করি আমরা সবাই মিলেমিশে। যাবে? * কি যে বলো তুমি, কুয়াশা!’
স্ব-মহিমায় ফিরে আসতে পেরে আনন্দিত হলেন মি. সিম্পসন। বললেন
‘ওসব করতে গেলে কি আর আমাদের চলে। আমাদের উপর নির্ভর করে ওসবের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব যে আমাদের উপর নির্ভর করছে, তা বুঝি বুঝতে পারছে না? তা না হলে তোমার মতো রথী-মহারথীরা যে স্বর্গ মনে করে বসবে এই পৃথিবীটাকে। তা কি হতে দেয়া
যায়?’
| কুয়াশাকে ব্যঙ্গ করতে পেরেছেন ভেবে তৃপ্তির হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুললেন মি. সিম্পসন।
কুয়াশার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লঞ্চঘাটে নেমে পড়লো ওরা তিনজন। ঘাটে উঠে খানিকদূর গিয়েই মি. সিম্পসন বললেন, “তোমরা যাও, শহীদ, আমার একটা কাজ আছে শ্যামবাজারের দিকে। ফিরতে দেরি হবে।’
| শহীদ ও কামালের মধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে কি একটা ইঙ্গিত বিনিময় হলো। তারপর মি. সিম্পসনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভালমানুষের মতো চলে গেল ওরা।
ওরা বেশ খানিকটা দূরে চলে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। দ্রুত পদক্ষেপে ফিরে চললেন তিনি লঞ্চঘাটের দিকেই।
ঘাটের কাছাকাছি এসে গতি মন্থর করলেন মি. সিম্পসন। ধীরে ধীরে হেঁটে, যেন সারাদিন মিন্তিগিরি করে ভীষণ ক্লান্ত, ঘাটের একটা সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়লেন। এবং আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন অদূরে দণ্ডায়মান একজন। মানুষকে।
| দণ্ডায়মান মানুষটি যে একজন জার্মান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কুয়াশার লঞ্চের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। মি. সিম্পসন শহীদ ও কামালের সাথে কুয়াশার লঞ্চ থেকে নেমেই লোকটাকে ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিলেন। তখনই কেমন সন্দেহ হয়েছিল তাঁর। শহীদ ও কামালকে মিথ্যে কথা বলে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা ভালভাবে জানার জন্যেই ফিরে এসেছেন তিনি।
দশমিনিট, বিশমিনিট, আধঘন্টা, একঘন্টা…দু’ঘন্টা, আড়াই ঘন্টা,::পুরো আড়াই ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলো জার্মান লোকটা কুয়াশার লঞ্চের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে– চেয়ে। অগত্যা মি. সিম্পসনকেও বসে থাকতে হলো। আড়াই ঘন্টা পর ফিরে চললো লোকটা লিয়াকত অ্যাভিনিউয়ের দিকে। মি. সিম্পসনও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করে চললেন লোকটাকে।
| পুরানো শহরের একটা বাড়িতে ঢুকলো লোকটা অনেক গলিঘুজি অতিক্রম করে। পিছন পিছন গিয়ে চিনে রাখলেন মি. সিম্পসন বাড়িটা। নাম্বারটাও টুকে, * নিলেন। তারপর থানায় ফিরেই একজন ইনফর্মারকে পাঠিয়ে দিলেন সাদা
৩০
পোশাকে চব্বিশ ঘন্টা বাড়িটার উপর নজর রাখার জরুরী নির্দেশ দিয়ে।
থানা থেকে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে এসেও স্বস্তি পেলেন না মি, সিম্পসন। সারাক্ষণ কি একটা দুশ্চিন্তা যেন তাকে ছটফটিয়ে মারছে। সে রাতে ভালো করে ঘুম হলো না তার।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শেলফের উপর রাখা টেলিফোনটা তুলে নিন মি. সিম্পসন। ধীরে ধীরে শহীদের নাম্বারে ডায়াল করলেন। কিন্তু কানে না
ঠেকিয়ে ফোনটা যথাস্থানে রেখে দিলেন আবার। কি একটা সঙ্কোচবোধে ইতস্তত করছেন তিনি। স্বস্তিও পাচ্ছেন না চুপচাপ বসে থাকতে।
দাড়ি কামাতে গিয়ে আজ গাল কেটে ফেললেন মি. সিম্পসন অন্যমনস্কতার জন্যে। কাক-স্নানটা কোনরকমে সেরে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসলেন, এবং অর্ধভুক্ত অবস্থাতেই মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটার দিকে এগিয়ে গেলেন আবার।
শহীদকে বাড়িতেই পেলেন মি. সিম্পসন। ‘কি খবর শহীদ, তোমরা তাহলে যাচ্ছো কবে বলো তো?’
ওপার থেকে শহীদ বললো, আগামীকাল রওনা হবো আমরা, মি. সিম্পসন। কিন্তু হঠাৎ আপনি একথা জানতে চাইছেন যে? মত পরিবর্তন করলেন নাকি? যাবেন আমাদের সঙ্গে?’
গম্ভীর স্বরে বললেন মি. সিম্পসন, ‘পাগল আর কি! আমি কি ছেলেমানুষ যে এতো সহজে মত পরিবর্তন করবো? একবার যখন বলেছি যাবো না, তারপর আর মত পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। তোমাদের যাবার কথা জিজ্ঞেস করছিলাম, সত্যিসত্যি তোমরা যাচ্ছে কিনা সে কথা জানতে।’
‘ আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো, শহীদের সঙ্গে। তবে সে সব মামুলি কথা। মি. সিম্পসন ফোন ছেড়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ফিরতে যাবেন ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলে চমকে দিয়ে। . গতরাতে যে ইনফর্মারটাকে নিযুক্ত করেছিলেন তারই ফোন। ফোনে সে জানালো, যে বাড়িটার উপর নজর রেখেছিল সে সেই বাড়িটা থেকে একজন ইউরোপিয়ান লোক সকালে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জে যায়। সেখানে একটা সী-প্লেন অপেক্ষা করছিল সম্ভবতঃ তারই জন্যে। লোকটা সী-প্লেনে চড়ে চলে যায় তারপর।’ | ব্রেকফাস্ট করা আর হলো না মি. সিম্পসনের। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন তিনি। কপালে তাঁর ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার রেখা। কি এক দুশ্চিন্তায় ছটফটিয়ে মরছেন যেন তিনি।
পায়চারি থামিয়ে টেবিলের সামনে বসে কাগজ-কলম নিয়ে একটা চিঠি লিখলেন মি. সিম্পসন। কলিংবেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে পুলিস কমিশনারের
কাছে পাঠিয়ে দিলেন তখুনি চিঠিটা। তারপর ফোনটা তুলে নিয়ে বিশেষ এক নাম্বারে ডায়াল করলেন। অপর প্রান্তে কেউ ফোন ধরতেই বললেন তিনি, শীতলক্ষার উপর দিয়ে একটা সী-প্লেন যাচ্ছে। খুব বেশি দূর সেটা যেতে পারেনি এখনও। কোনরকম সন্দেহের উদ্রেক না করে ওটার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ মনোযোগ রাখা হোক। আর আমার ভ্রন্যে জলপুলিসের একটা লঞ্চের ব্যবস্থা করা হোক আধঘন্টার মধ্যে। আমি এই সময়ের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জে উপস্থিত হচ্ছি।
উপরোক্ত নির্দেশ দেবার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো মি. সিম্পসনের। ঝটপট কাপড়-ঢোপড় পরে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
ছয়
বঙ্গোপসাগরের কূলে নির্জন বালুকাবেলা। ক্ষুদ্র একটা লঞ্চ ‘সৈনিক’ সাগরে ভাসছে একাকী। ক্ষুদ্র, নড়বড়ে লাঞ্চটা প্রতীক্ষা করছে সুদূরের পানে যাত্রার। ক্ষুদ্র, ঝক্কডমার্কা একটা লঞ্চ বলাই স্বাভাবিক এটাকে। আসলে কিন্তু এটা একটা ক্ষুদ্র জলচর-দানব বিশেষ। সুপার সাবমেরিন। জলের গভীরতম তলদেশেও এর গতিবিধি সহজ এবং স্বাভাবিক রাখা যায়।
এমন সময় ভালভ ওঠাবার শব্দ পাওয়া গেল ‘সৈনিকের ভিতর থেকে। তাপ সরবরাহ শুরু করলো নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর। সর্বশক্তি যোগ করলো টারবাইনগুলো নিজ নিজ কাজে। প্রপেলার ঘুরতে লাগলো পানিতে দারুণ তোলপাড় তুলে। যাত্রা
হলো শুরু।
| শুরু হলো দুঃসাহসী একদল মানুষের দুর্গমের পথে যাত্রা। মানবকল্যাণের স্বার্থে বিদেশী একজন প্রতিভাবান বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানবপ্রেমিক একদল দুর্ধর্ষ মানব যাত্রা শুরু করলো সুদূরে। বহুদূরে, সুদীর্ঘ ষোলো। হাজার মাইল দূরে-দক্ষিণ আমেরিকার পেরু নামক দেশের কোনো এক দুর্গম
পাহাড়তলীতে।
টিপটপ ছিলো সব ব্যবস্থা। শহীদ, কামাল, মহুয়া ও গফুর তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল বাড়িতে। কুয়াশা নিজে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল শহীদের বাড়িতে। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সকলকে এই নির্জন বালুকাবেলায়। বঙ্গোপসাগরের কূলে।
| এখানেই নোঙর রা ছিলো কুয়াশার ক্ষুদ্রাকৃতি জলচর দার ‘সৈনিক। সুন্দরবন ঘুরে, সতর্কতা অবলম্বন করে ওদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিল কুয়াশা। সতর্কতা অবলম্বনের বিশেষ কারণও ছিলো। বিদেশী শত্রু যে এখনও তার পিছু পিছু ভয়ঙ্কর একটা সর্বনাশ করার সুযোগের অপেক্ষায় আছে তা কুয়াশা
৩২
ভালভাবেই জানতো। তাছাড়া তাকে গ্রেফতার করার জন্যে মি. সিম্পসনের মতো জেদি এবং ধুরন্ধর পুলিস অফিসার তো আছেনই। সুতরাং সতর্কতার প্রয়োজন ছিলোই। সতর্কতা অবলম্বনে ত্রুটিও কুয়াশা রাখেনি। কিন্তু কেউই জানতো না কি
ভয়ঙ্কর, রহস্যপূর্ণ ব্যাপারই না ঘটে গেছে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে।
| বিপদটা ওরা জানতো না। জানলোও না পুরো পাঁচ ঘন্টা। যখন জানতে পারলো তখন আর কিছু করার নেই সাবধান হবার জন্যে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে আত্মরক্ষা করা ছাড়া তখন আর উপায় নেই কোনো।
| ঘন্টায় চল্লিশ মাইল গতিতে এগোচ্ছিল সৈনিক।
জ্যোৎস্নাভরা মায়াময় রাত। সম্মুখে বিস্তারিত অতল সাগর। বিপুল জলরাশির উপর চন্দ্রকিরণ বিছিয়ে পড়েছে। সুউচ্চ ঢেউ উঠছে একটার পর একটা। ঢেউয়ের উপরে ঢেউ পড়ে ভেঙে যাচ্ছে। চূর্ণবিচূর্ণ জলরাশির উপর মায়াময় চাঁদের আলো : পড়ে চিকচিকিয়ে উঠছে। চারদিকে মৃদু একটা গতিময় গর্জন।
নাতিপ্রবল সমীরণের শীতল স্পর্শ ডেকে বসে উপভোগ করছিল ওরা। কুয়াশা ছিলো না ওদের সঙ্গে। খাওয়া-দাওয়ার পাট বেশ খানিকক্ষণ আগে চুকে গেছে। কামালের বারবার অনুরোধে একটা আধুনিক বাংলা গান শেষ করে সবেমাত্র মাথা নিচু করেছে মহুয়া মেয়েলী লজ্জায়। এমন সময় কুয়াশা এসে বসলো ওদের পাশে
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।
‘দাদা, অনেকদিন তোমার সরোদ শুনিনি। বাজাবে তুমি, শুনবো আমরা? কুয়াশাকে বসতে দেখে মহুয়া বললো আবদারের সুরে।
| চুপচাপ বসেছিল শহীদ। কুয়াশা মহুয়ার কথার উত্তর দিলো না দেখে মুখ। তুলে তাকালো সে। দেখলো হঠাৎ নিজের হাতের রিস্টওয়াচটার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েছে কুয়াশা। এবং কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সকলের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত স্বরে বললো, তোমরা একটু বসো, আমি আসছি একটু পর।’
কথাটা বলেই চলে গেল কুয়াশা তার কেবিনের দিকে। কেউ তেমন করে, লক্ষ্য না করলেও শহীদের দৃষ্টি এড়ালো না কুয়াশার বিচলিত মুখ-ভঙ্গি।
| ‘দাদামণি!’
খাওয়া-দাওয়া সবেমাত্র শেষ করে শহীদের পিছনে এসে দাঁড়ালো গফুর। এসেই দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে ডাকলো শহীদকে। শহীদ কি যেন ভাবছিল কুয়াশার কেবিনের দিকে তাকিয়ে। শুনতে পেলো না সে গফুরের কন্ঠস্বর। গফুর আবার ডাকলো, দাদামণি!’।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো এবার শহীদ উত্তর না দিয়ে।
‘দাদামণি, একটা কথা বলবো?’ মাথার পিছনের চুলগুলো খামোকা নাড়তে নাড়তে গফুর দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বললো। ৩-
‘তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। নড়েচড়ে বসলো শহীদ, যা বলবার বলে ফেল দেখি ঘাড় না চুলকে।
না দাদামণি, ব্যাপারটা হাসির নয় কিনা,যদি হেসে ফেলো, তাই বলছিলাম…
এবার সত্যিসত্যি হেসে ফেললো শহীদ।
কামাল ঠাট্টা করে বললো, কি যে বলো তুমি গোবর্ধন, তোমার কথায় আমরা কি হাসতে পারি?
কামালের কথা শুনে মহুয়াও হাসি চাপতে পারলো না। সকলকে এভাবে হাসতে দেখে ঘাবড়ালো না গফুর। কিন্তু অভিমান হলো তার। ফলে গাল দুটো ফুলে উঠলো ফোলা বেলুনের মতো। ফোলা গাল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালে চলে যাবার জন্যে আর একটি কথা না বলে।
শহীদ তাড়া দিয়ে বললো, “এই, হাঁদারাম, দাঁড়া! একটা কথা বলতে এতো ভড়ং কেন বলতো তোর? এবার বলে ফেল দেখি কি এমন কথা তোর।’
ফোলা গাল নিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়ালো গফুর। অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে শুধু বললো, রান্নাঘর থেকে পরোটা চুরি গেছে চারটে।’ | ‘তিনজনই ভ্রূ কুঁচকে তাকালো গফুরের দিকে। প্রথম কয়েক সেকেণ্ড কারো মুখেই কথা সরলো না কোনো। এক পা এগিয়ে এলো গফুর। মনোযোগ দিয়ে তাকালো সকলের মুখের দিকে। তারপর গম্ভীরমত গলা করে বললো, বিশ্বাস তো করবে না, তাই বলতে চাইনি। কিন্তু সত্যি বলছি, দাদামণি, চার-চারটে পরোটা চুরি গেছে মিটসেফ থেকে। আর মিটসেফের ওপরে এক গ্লাস পানি রাখা ছিলো, সেটাও পাচ্ছি না। . তুই বুঝি খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি গফুর?’ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো কামাল।
“তাই-ই হবে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছে,’ বললো মহুয়া।
‘বিশ্বাস না হয় তো দেখবে চলো দাদামণি, আমি সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি।
শেষ চেষ্টা করে দেখলো গফুর। শহীদ এখনও কিছু বলেনি। হাসেওনি ওদের মতো। সুতরাং গফুর শহীদের দিকে এগিয়ে এলো আরো এক পা।
শহীদ শান্ত কণ্ঠে বললো, কি দেখবো বলতো তোর সঙ্গে গিয়ে?’
‘মোর্ট বাইশটা পরোটা বানিয়েছিলাম, দাদামণি। তোমাদের খাবার পর ছিলো ন’টা। তার থেকে আমার জন্যে ছিলো পাঁচটা। ন’টা থেকে পাঁচটা বাদ গেলে তো চারটেই থাকে। কিন্তু দেখবে চলো তুমি, আর একটাও নেই পরোটা। মিটসেফের ওপর পানি ভর্তি গ্লাসটাও নেই।’
শহীদ বললো, তোর ভাগের পাঁচটা পরোটা তুই খেয়েছিস?’
একটু থেমে গফুর বললো, হ্যাঁ।’ “বাকি অংশ থেকে ক’টা খেয়েছিস ঠিক বলতো?’
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো এবার গফুর শহীদের দিকে। কিন্তু মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না সে। তারপর নিরস কন্ঠে বললো, ‘একটিও না।’
ঠিক বলছিস?’ ছোট্ট, গম্ভীর উত্তর গফুরের, হা।’
শহীদ বললো, তাহলে তোর সমস্যাটা হচ্ছে এই যে পরোটাগুলো গেল কোথায়, তাই না রে?’
গফুর কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইলো। ‘পরোটাগুলো ইঁদুরের পেটে গেছে। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কেমন?
না, দাদামণি, চারটে পরোটা ইঁদুরে নিয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া পানির গ্লাসটা নিয়ে যাবে কিভাবে? আর আমি কেমন একটা কালো ছায়া মতো দেখলাম।
যে…’
‘পরোটাগুলো ইঁদুরেই নিয়ে গেছে। আর গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে গ্লাসটা এমন জায়গায় রেখেছিস যে এখন আর খুঁজে পাচ্ছিস না সেটা। যা ভাগ এখান থেকে, আর বকাসনে।’
| কথাটা বলে শহীদ পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে গেল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো গফুর। ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে যেতে নিজের কথা বলতে ছাড়লো না, আমার কথা তোমরা উড়িয়ে দিলে, দাদামণি,কিন্তু কাজটা ভালো করলে না। দেখা, বিপদ একটা হবেই।’
সিগারেটটা ধরাবার জন্যে লাইটারটা জ্বালিয়ে মুখের সামনে এনেছিল শহীদ। কিন্তু ধরানো আর হলো না। সামান্য একটু চমকে উঠে গফুরের দিকে তাকালো সে। চলে যাচ্ছে গফুর দুপদাপ শব্দ তুলে। পিছু ডাকলো না শহীদ | কিন্তু গফুরের গলা শুনে কেমন যেন খটকা লেগেছে তার। এই প্রথমবারের মতো শহীদ ভাবলো সত্যিই কি ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ? গফুরের কথাটা কি না দেখে না জেনে উড়িয়ে দেয়া উচিত হলো?
সাত
গফুর চলে যেতে গম্ভীর পদক্ষেপে ফিরে এলো কুয়াশা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শহীদ কুয়াশার দিকে। কুয়াশা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে তার পরিত্যক্ত চেয়ারটার পিছনে দাঁড়ালো। তারপর শহীদের দিকে তাকিয়ে থমথমে উচ্চারণে। বললো, একটা বড় ধরনের বিপদ আমাদের পিছন পিছন ঘনিয়ে আসছে শহীদ।
শত্রু আমাদেরকে অনুসরণ করছে। একটা বিরাট আকৃতির সাবমেরিন। পঞ্চাশ মাইল গতিতে ছুটে আসছে।
চেয়ার ছেড়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো সবাই। মহুয়ার চোখেমুখে দারুণ ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো। কামাল শহীদের দিকে তাকালো বিচলিত হয়ে।
‘কারা এরা?’ কুয়াশার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো শহীদ।
সাবমেরিনটা জার্মান মেড তা আমি জানি। তার মানে এরাই সেই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের শত্রু। অর্থাৎ আমাদেরও শত্রু। কেননা বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করতে চলেছি আমরা।’
বুঝলাম। ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল আসছে, না? পঞ্চাশই কি ম্যাক্সিমাম স্পীড?’
তার বেশি হবে বলে মনে হয় না। পানির উপরে ওদের চেয়ে আমাদের স্পীড পাঁচ মাইল বেশি। কিন্তু পানির নিচে ওদের চেয়ে আমাদের স্পীড’পাঁচ মাইল কমে যাবে।
শহীদ বললো, তার মানে ফুল স্পীডে আসছে ওরা।কতটা পিছনে আছে ওরা এখন, টর্পেডোর পাল্লার মধ্যে নেই তো?’
কুয়াশা বললো, খুব বেশি পিছনে নেই ওরা। কুড়ি-পঁচিশ মাইল খুব বেশি হলে। আমাদের মতো টর্পেডো যদি ওদের থেকে থাকে, তাহলে ওদের পাল্লার মধ্যেই আছি আমরা ধরে নিতে হবে।’
‘আমরা এখন কতো স্পীডে যাচ্ছি?’ প্রশ্ন করলো কামাল। ‘পঞ্চান্ন।’
এতক্ষণে মহুয়ার ভীত স্বর শোনা গেল, কি হবে, দাদা!
কুয়াশা অভয় দিয়ে বললো, ভয় কি রে, মহুয়া, তোর দাদা থাকতে দুশ্চিন্তার বোঝাটা কি আর কাউকে বইতে হবে? নির্ভয়ে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি যখন তখন তোদেরকে সবরকম বিপদ থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থাও করে রেখেছি। ভয় পাসনে।
মুহূর্তের মধ্যে ভয় এবং দুশ্চিন্তার রেখাগুলো উবে গেল মহুয়ার মুখ থেকে। পরম শ্রদ্ধায় দাদার দিকে লজ্জিত হাসি হেসে তাকালো সে। তারপর নিচু স্বরে
. বললো, আমার ভুল হয়ে গেছে,দাদা। এমনটি অরি হবে না।’
মিটিমিটি হেসে এগিয়ে এলো কুয়াশা। মহুয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখলো তার মাথায়। বললো, যা, নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করগে।’
গভীর আনন্দে মাথা তুলে তাকালো মহুয়া একবার তার দাদার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে ধীর পদক্ষেপে চলে গেল একা। কোনো ভয় নেই এখন আর তার মনে। কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
| ‘কি প্রোটেকশন নেয়া উচিত আমাদের?’ মহুয়া চলে যেতে প্রশ্ন করলো শহীদ।
‘ কুয়াশা বললো, বিশেষ তেমন কিছু এই মুহূর্তে দরকার নেই। ম্যাক্সিমাম স্পীড বজায় থাক। আর ইতিমধ্যেই অ্যান্টি-টর্পোেের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যস।’
শহীদ বললো, কিন্তু এভাবে তাড়া খেয়ে কতদূর অব্দি যাবো আমরা? পিছন পিছন ওরা যদি আসতেই থাকে তবে তো’বিপদ’
কিছুক্ষণ চিন্তা করে কুয়াশা বললো, “আজ রাতটা দেখবো আমি। কাল সকাল অব্দি যদি পিছু না ছাড়ে তবে কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। সকাল না। হলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কি পরিমাণ শক্তিশালী ওরা।
সকাল অব্দি পিছু না ছাড়লে কি করবে বলে ভেবেছো?’ নিশ্চিন্ত হবার জন্যে জানতে চাইলো শহীদ।
কুয়াশা শহীদের দিকে তাকিয়ে থাকলো একমুহূর্ত। তারপর বললো, ধোকা দিয়ে ভুল পথে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করবো। অন্যকিছু করার শক্তি আমাদের হাতে থাকলেও তেমন কিছু করা চলবে না। করলে যতগুলো প্রাণী আছে ওই সাবমেরিনে সবগুলো সলিলসমাধী লাভ করবে। ঘৃণ্য নরহত্যাই হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত তাহলে।’
মাথা হেঁট করে চিন্তা করতে করতে শহীদ শুধু বললো, “ই!
এবার তোমরা যাও, শুয়ে পড়োগে। আশা করি কাল সকালে তোমাদেরকে সুখবরই দিতে পারবো, কথাটা বলে চলে যেতে উদ্যত হলো কুয়াশা।
একটা কথা…’, শহীদের ডাকে ফিরলো কুয়াশা।
‘প্রয়োজন পড়লে, আমাদের ডাকতে দ্বিধা করো না। সারারাত জেগে যদি সতর্ক থাকতে হয় তবে সবাই ভাগাভাগি করেই জেগে কাটিয়ে দেবো রাতটা।
তার কোনো প্রয়োজন নেই, শহীদ। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়াগে তোমরা।’
আর কোনো কথা না বলে শহীদ ও কামাল যার যার কেবিনের দিকে চলে গেল ধীরে ধীরে। ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতেই দ্রুত পায়ে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা। ঠিক এমনি সময়ে শহীদ যদি কুয়াশার মুখ দেখতে পেতো তাহলে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারতো না সে। অস্বাভাবিক গম্ভীর, কয়েকটা দুশ্চিন্তার রেখা কুয়াশার সারামুখে ফুটে উঠেছে। কি যেন অনুমান করার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছে না কোনমতেই।
কেবিনের দরজা অতিক্রম করে ঢুকে পড়লো কুয়াশা। ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলো না ডেকের অন্ধকার কোণে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে দু’জন লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের একজনের চোখে সতর্ক দৃষ্টি। অপরজনের চোখ প্রতিহিংসার অনলে দাউ দাউ করে জ্বলছে যেন!
৩৭
আট
মধ্যরাত।
কন্ট্রোলরুমে ঢুকে দরজার পাশে রাখা একটা নারীমূর্তির কপালের লাল রঙের টিপে চাপ দিতেই ঘড়ঘড় শব্দ হলো একটা। দেখতে না দেখতে কন্ট্রোলরুমের বাম পাশের দেয়ালটা মাঝখান থেকে ফাঁক হয়ে গেল খানিকটা। দেয়ালের ওদিক থেকে উজ্জ্বল আলো এসে পড়লো এদিকে। ফাঁকটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নানা আকারের টেবিল এদিক ওদিক দাঁড় করানো। টেবিলের উপর অদ্ভুত সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি থরে থরে সাজানো। ঢুকে পড়লো কুয়াশা ফাঁকটা দিয়ে। দেয়ালটা আবার ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল।
এদিকের রুমটায় ঢুকেই এগিয়ে গেল কুয়াশা রাডার স্ক্রীনের দিকে। রাডার স্ক্রীনের দিকে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলো কুয়াশা। ভূ দুটো কুঁচকে উঠলো তার অবিশ্বাসে। দ্রুত পায়ে অদ্ভুত একটা যন্ত্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঝুঁকে দেখলো পিছনের সাবমেরিন আগের গতিতেই ছুটছে। ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল। কিন্তু শত্রুপক্ষের সাবমেরিন তাহলে এতো কাছে এগিয়ে আসে কিভাবে? রাডার স্ক্রীন তো মিথ্যে কথা বলবে না। ছুটে চলে এলো কুয়াশা এদিকের রুমটায়। স্পীডোমিটারের কাঁটা দেখলো ঝুঁকে। পঁয়তাল্লিশ! পঁয়তাল্লিশে নেমে এলো কিভাবে শীড? কে নামালো?
মিথ্যা দুশ্চিন্তা করে নষ্ট করবার সময় নয় এটা। চট করে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে একটা স্টীলের সুটকেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। পকেট থেকে ডাবল এম চাবি বের করে খুলে ফেললো তালা। ফড়িং-এর মতো দেখতে, আধগজ লম্বা কয়েকটা ইনোসেন্ট মিউজিশিয়ান’ বের করে হাতে নিলো কুয়াশা। তারপর স্যটকেসের তালা বন্ধ করে কেবিন থেকে বের হতে গিয়ে আর একটা অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা তাকে স্তম্ভিত করে দিলো। কুয়াশা দেখালো অ্যান্টি-টর্পেডো নিক্ষেপ করার জন্যে যে সুইচ বোর্ডটা ব্যবহার করার নিয়ম সেটা ভেঙেচুরে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে একদিকে। | দারুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো কুয়াশা। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন সে।
কিন্তু সময় খুব মূল্যবান এখন। ধাওয়া করে আসছে শত্রুপক্ষের সাবমেরিন। মাইল পাঁচেকও পিছিয়ে নেই আর। টর্পেডো হেনে যে কোনো মুহূর্তে সর্বনাশ করতে পারে। প্রায় ছুটে বের হয়ে এলো কুয়াশা কন্ট্রোলরুম থেকে। ডেকের একপাশে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি। টপাটপ সিঁড়ি টপকে সৈনিকের সবচেয়ে উঁচু
৩৮
এবং শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা।
ফড়িংয়ের মতো দেখতে আধগজ লম্বা জিনিসগুলো একটা একটা করে ছুঁড়ে ফেললো কুয়াশা সমুদ্রে। ফেলার আগে প্রত্যেকটার গা থেকে খুঁজে খুঁজে একটা সরু অথচ শক্ত তামার তার টেনে বের করলো খানিকটা করে। তারপর ছুঁড়ে ফেললো পানিতে একে একে সবকটা।
ফড়িংয়ের মতো দেখতে অদ্ভুত এই আধগজী জিনিসগুলো সত্যিই অবিশ্বাস্য কার্যকরী। এটার তার টেনে নিয়ে পানিতে নিক্ষেপ করলে পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে এর গতি দাঁড়াবে ঘন্টায় পঁচিশ মাইল। নিচের দিকে মুখ করে পড়বে এটা পানিতে। তামার তারটা টেনে বের করার প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে কোনদিকে এর গতি হবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ছুটতে ছুটতে অসম্ভব জোরালো শব্দ এবং কম্পন সৃষ্টি করবে এটা সমুদ্রে। ঠিক মনে হবে কোনো জলযান ছুটে যাচ্ছে। ফলে কোনো শত্রুপক্ষীয় জলযান যদি পিছু ধাওয়া করে এবং তাকে যদি ভুল পথে পরিচালিত করার ইচ্ছা থাকে তবে এর চেয়ে ভালো কোনো পন্থা হতে পারে না। অনুসরণকারী জলযানটিকে ঠিক ধোকা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবে অন্তত চল্লিশ মাইল দূরে। দেড়ঘন্টারও বেশি এর কর্মক্ষমতা। কুয়াশা এর নাম দিয়েছে
ইনোসেন্ট মিউজিশিয়ান’।
শীত লেগে ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। পায়ের কাছে একটা চাদর আছে মনে করে চোখ বুজেই পা দিয়ে সেটা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরও পায়ের আওতার মধ্যে চাদরটা না পেয়ে অগত্যা তাকে চোখ মেলতে হলো।
ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কেবিনের ভিতর। অন্ধকার কেন?
ধড়মড় করে উঠে বসলো শহীদ। জিরো পাওয়ারের বা জ্বলছিল, ঘুমাবার আগে স্পষ্ট মনে আছে তার। বাটা এখন জ্বলছে না কেন তবে? মহুয়া উঠেছিল নাকি এর মধ্যে? চোখে আলো সহ্য না হতে অফ করে দিয়েছে বুঝি?
রেডিয়াম ডায়াল রিস্টওয়াচটা বালিশের তলা থেকে বের করলো শহীদ। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বলা যায়। পৌনে চারটে বাজে।
‘বাতি অফ করলে কেন?’ নিদ্রাজড়িত মহুয়ার গলা। এইমাত্র ঘুম ভেঙেছে তার শহীদের নড়াচড়ার শব্দে।
। তার মানে! তুমি অফ করোনি সুইচ? আমি ভাবছিলাম তুমিই বুঝি …।
না তো।’
আর কথা না বলে পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে জ্বাললো শহীদ। প্রথমেই দৃষ্টি পড়লো তার পায়ের দিকে। কই, চাদরটা দেখা যাচ্ছে না তো! ঠিক এমনি সময় মনে পড়লো শহীদের শীত লাগবার তো কোনো কারণ নেই। এয়ার-কণ্ডিশন করা কেবিন। নিউক্লিয়ার জেনারেটর থেকে ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ না হলে তো-কিংবা
কুয়াশা কি কোনো কারণে ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে?
চাদরটা কোথায় বলো তো? দেখছি না যে।
উঠে বসলো মহুয়া। গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে সে বললো, চাদর তো ছিলো না। আমিই তো আগে ঘরে ঢুকেছিলাম, কই, চাদর দেখিনি।
বলো কি, মহুয়া! স্পষ্ট মনে আছে আমার বিছানায় চাদর দেখেছি আমি।’ কখন?’
সন্ধ্যার পরই সম্ভবতঃ। সন্ধ্যার পর দেখেছো বলছো? কিন্তু আমি তো ঘরে ঢুকে দেখিনি চাদর?’
নিস্তব্ধ কয়েকটি মহুর্ত কেটে গেল। দুজনেরই মনে পড়লো আচমকা-গফুর বলেছিল রান্নাঘর থেকে চারটে পরোটা এবং এক গ্লাস পানি কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর মহুয়া বললো, ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ হলো কেন?’
সে কথাই ভাবছি।’ ‘আমার মনে হয়…’ চুপ!’
চাপা গলায় সতর্ক করে দিলো শহীদ মহুয়াকে। তারপর ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলো, কান পেতে শোনো তে কারা যেন কথা বলছে কেবিনের বাইরে।
শব্দহীন কয়েকটা মুহূর্ত কে ‘ট গেল।
এক সময় ফিসফিস করে মহুয়া বললো শহীদের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে, ঠিক বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে দরজার পাশে কারা যেন কথা বলছে, আবার মনে হচ্ছে কানের ভুল।’
| নেমে পড়লো শহীদ বিছানা থেকে নিঃশব্দ পায়ে। বালিশের তলা থেকে আগেই সে রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়েছে। দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে একটা বন্ধ জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। তারপর পাল্লা দুটো ধীরে ধীরে খুলে ফেললো এতটুকু শব্দ না করে।
চাঁদ এখনও সমুদ্রের পশ্চিম কোণ থেকে রহস্যময় মৃদু হাসি ছড়াচ্ছে। তারই এক চিলতে রহস্যঘন আলো এসে পড়লো কেবিনের ভিতর। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শহীদ বাইরের দিকে। কোনো শব্দ হচ্ছে না এখন। কাউকে দেখা যাচ্ছে
কোথাও। | কি করবে ভাবছিল শহীদ। আচমকা কি দেখে দৃষ্টিটা তার তীক্ষ্ণতর হয়ে, উঠলো। ছায়া! একটা মানুষের ছায়া এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বামদিকের খালি কেবিনগুলোর দিকে চলে গেল অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে যেতেও বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো শহীদ আরো কিছুক্ষণ।
৪০
কার ছায়া ওটা? কে ও?
মহুয়া এসে দাঁড়ালো শহীদের পিছনে। কিছু দেখতে পেলে? | মহুয়া আতঙ্কগ্রস্ত হবে বলে মিথ্যে কথা বললো শহীদ, না, বাইরে বের হয়ে দেখতে হবে একবার। কথাটা বলে জানালার পাশ থেকে সরে এলো শহীদ।
‘একা এই অন্ধকারে থাকতে পারবো না বাপু আমি, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।’
জামাটা গায়ে চড়াতে চড়াতে শহীদ বললে, ‘চলো।’
বের হয়ে এসে বাইরে থেকে লকআপ করলো শহীদ কেবিনটা। এক হাতে টর্চ এবং অপর হাতে রিভলভার নিয়ে আগে আগে এগোল সে। পিছনে মহুয়া। বামদিকের কেবিনগুলোর দিকে হাঁটছিল ওরা। কিন্তু বেশিদূর আর যেতে হলো
। মাত্র গোটা পাঁচ সাত কদম হেঁটেছে এমন সময় গফুরের গগনবিদারী আর্তনাদ সাগরমাঝের রাতের নির্জন নিস্তব্ধতাকে চিরে-কেটে বীভৎস করে তুললো, ‘দাদামণি বাঁচাও! শয়তানটাকে ধরে ফেলেছি!! বাঁচাও!!! দাদামণি…
নয়
‘মাগো!হঠাৎ অপ্রত্যাশিত প্রচণ্ড চিৎকার শুনে ভয়ার্ত একটা শব্দ বের হলো মহুয়ার কণ্ঠ চিরে।
| ‘ডান দিকে, আমার পিছু পিছু দৌড়াও!’ ‘ মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলো শহীদ। তখনো একই ভাবে চিৎকার করে চলেছে গফুর। শহীদ কিচেন রুমের কাছাকাছি গিয়ে শুনতে পেলো। খানিকটা দূরে প্রচণ্ড ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে দু’জন লোকের। তাদের মধ্যে একজন গফুর তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না শহীদের। আর অপরজনটি নিশ্চয়ই কোনো শত্রু।.ধরা পড়ে গেছে গফুরের হাতে। কিন্তু আরো খানিকটা এগিয়ে যাবার, পর টর্চের তীব্র আলো ফেলে শহীদ যা দেখলো তাতে রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাকে।
শহীদ দেখলো খালি গায়ে, দশাসই গফুর কামালকে ঠেসে ধরেছে একটা কেবিনের দেয়ালের সঙ্গে প্রাণপণ শক্তিতে। আর প্রাণপণ শক্তিতে গফুরকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে কামাল। কিন্তু কোনক্রমেই গফুরের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে। উঠছে না সে। গফুর তার মুখে একটা হাতের চেটোর সম্পূর্ণ চাপ দিয়ে ঠেসে ধরেছে দেয়ালের সঙ্গে। কোনমতে ছাড়ছে না। ফলে মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না কামালের।
ছাড়াবার জন্যে দু’পা এগিয়েছে শহীদ, এমন সময় দীর্ঘ একটা ছায়াকে
৪১
এদিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল-কুয়াশা আসছে।
প্রচণ্ড ধমকের শব্দে চমকে উঠলো গফুর। ধমকের তোড়ে কামালকে ছেড়ে দিয়ে শহীদের দিকে তাকালো সে।
‘কি, হচ্ছে কি?’’
কঠিন গলায় প্রশ্ন করলো শহীদ। বিচলিত হয়ে তালো গফুর, যে লোকটাকে সে এতক্ষণ ধরে রেখেছিল তার দিকে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো, চমকে উঠলো বেচারা, কামালদা, আপনি!
তিক্ত, কর্কশ কণ্ঠে কামাল বেঁকিয়ে উঠলো, কামালদা, আপনি! কোথাও কিছু নেই ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লি কেন শুনি?’
গফুর হতভম্ব। নিরুত্তর। ‘কি ব্যাপার, শহীদ?’ কুয়াশা এসে দাঁড়ালো সকলের মাঝে।
শহীদ বললো, বুঝতে পারছি না এখনও। সম্ভবতঃ অন্য কেউ মনে করে গফুর কামালকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠেছিল অন্ধকারে।
শহীদের কথা শেষ হতেই কামাল তিক্ত কণ্ঠে শুরু করলো, ঠাণ্ডা লেগে ঘুম ভেঙে যেতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কার একটা ছায়া হেঁটে চলে গেল কিচেনরুমের দিকে। ভীষণ সন্দেহ হলো আমার। “সৈনিকে” আমরা ছাড়াও যে অজ্ঞাত পরিচয় কোনো লোক থাকতে পারে তা বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কিন্তু স্বচক্ষে যা দেখছি তা তো অবিশ্বাসও করা যায় না। তাই কেবিন থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে এদিকে আসছিলাম ব্যাপারটা জানতে। কিন্তু এই পর্যন্ত এসে দাঁড়াতেই ওই হাঁদারাম উলুক পিছন থেকে লাফ দিয়ে পড়লো আমার ঘাড়ে। ওহ, ঘাড়টা আমার ভেঙেই দিয়েছে হারামজাদা!’
‘তুই কেন বাইরে বের হয়েছিলি, গফুর?’, কোনরকমে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলো মহুয়া।
গফুর পূর্ববৎ মাথা নিচু করে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। ‘বল না হাঁদারাম, কি হয়েছিল?’ ‘ধমক মারলো এবার শহীদ।
মাথা হেঁট করেই জড়িত কণ্ঠে কোনো রকমে গফুর বললো, আমিও যে আমার ঘরের জানালা দিয়ে একটা ছায়াকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলাম। কামালদাকে চিনতে না পেরে
মাঝপথেই চুপ করে গেল গফুর। শহীদ মনে মনে ভাবলো, তা কি করে সম্ভব? কামাল যাকে দেখেছিল সে যদি গফুর হয়, তাহলে গফুর যাকে দেখেছিল সে কামাল হতে পারে না। কিংবা গফুর যাকে দেখেছিল সে যদি কামাল হয়, তাহলে কামাল যাকে দেখেছিল সে গফুর হতে পারে না। তাছাড়া সে নিজেই বা কাকে দেখেছিল জানালা দিয়ে? কামাল, গফুর, না অন্য কারও ছায়া সেটা?
৪২.
চাদরটা, চাদরটাই বা গেল কোথায়?
মহুয়া এবার গফুরকে বললো, দাঁড়িয়ে থাকিসনে আর সঙয়ের মতো। যা, চা বানা গিয়ে কয়েক কাপ। ঘুমোবার আর সময় নেই।’
নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে খুশি হয়ে উঠলো, গফুর। মনে মনে কামালদার কাছে হাজারবার মাফ চাইতে চাইতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। ইচ্ছে হচ্ছিলো তার কামালদার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নেয়। কিন্তু দাদামণির ধমকের ভয়ে সাময়িকভাবে সেটা স্থগিত রাখলো সে।
কি যেন ভাবছিল শহীদ। মুখ তুলে তাকালো একসময় দেখলো, একটু দূরে সরে গিয়ে মহুয়া মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চাপবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আর উঠেপড়ে লেগে কি যেন বোঝাতে চাইছে কামাল। হঠাৎ লক্ষ্য করলো শহীদ, কুয়াশা কখন চলে গেছে এক ফাঁকে
পুব আকাশে নতুন প্রভাতের পবিত্র আলো ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করেছে। সীমাহীন সমুদ্র ক্রমেই দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠছে। শীতল, মুক্ত, প্রভাতী বাতাস বইছে একটানা। মহুয়া ও কামাল উন্মুক্ত ডেকে গিয়ে বসলো দুটো চেয়ার নিয়ে। এখনও কৌতুকের হাসি লেগে রয়েছে মহুয়ার ঠোঁটে। কামাল কিছু বলছে না এখন। মুখ গো করে বসে আছে সে সাগরের দিকে তাকিয়ে।
চুপিচুপি সরে গেল শহীদ। রহস্য একটা নিশ্চয় কোথাও আছে। কেউ না কেউ কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে উঠে পড়েছে “সৈনিকে”। কিন্তু কে হতে পারে লোকটা? শত্রু নিশ্চয়ই। শক্ত না হলে লুকিয়ে থাকবে কেন? কার শত্রু! তাদের সকলের শত্রু, না কেবল কুয়াশার? জানতে হবে ব্যাপারটা। যেমন করেই থোক, খুঁজে বের করতে হবে অজ্ঞাত পরিচয় লোকটাকে। কোথায় আছে সে এখন? কিন্তু সময় নেই হাতে। কুয়াশা নেভিগেশনের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়েছে শহীদের উপর। সুতরাং কতদূর এসেছে তারা, এবং এখন কোথায় আছে সেটা জানা দুরকার। সরে গেল ‘শহীদ। ব্রিজে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে এক গাদা কাগজপত্র, | নক্সা, ম্যাপ নিয়ে ঝুঁকে পড়লো টেবিলের উপর।
কিছুক্ষণ পর কুয়াশা এসে দাঁড়ালো তার পাশে। মুখ তুলে তাকালো শহীদ। প্রশ্ন করলো, “কি ব্যাপার, কুয়াশা, আলো নেই কেন?’
| ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ করে দিতে হয়েছে শহীদ। আমার সঙ্গে এসো, বলছি তোমাকে সব। ১
দশ।
ব্যস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো শহীদ। শত্রুরা কি এখনও আমাদেরকে অনুসরণ করে
৪৩
. আসছে?
কুয়াশা হঠাৎ দৌড়তে শুরু করে বললো, ‘জলদী এসো, শহীদ! মারাত্মক বিপদের সিগন্যাল পাচ্ছি আমি ওয়্যারলেসে। শত্রুরা চরম আঘাত হানতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কুয়াশার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে দু’টো কুঁচকে উঠলো শহীদের অমঙ্গল আশঙ্কায়। তারপরই দৌড়ুতে শুরু করলো সে কুয়াশার পিছন পিছন।
ব্রিজ অতিক্রম করে শহীদ দেখলো, কামাল ও মহুয়া তাদের জন্যে চা নিয়ে বসে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কুয়াশা এবং শহীদকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে অবাক হয়ে গেল তারা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওরাও দ্রুত পায়ে চললো পিছন পিছন।
ছুটে গিয়ে প্রথমে নিজের কেবিনে ঢুকলো কুয়াশা। পরক্ষণেই বের হয়ে এলো হাতে একটা অ্যাটাচি-কেসের মতো চামড়ার ব্যাগ নিয়ে। যন্ত্রটা কায়দা করে ভাঁজ করা আছে ব্যাগটায়।
‘ কেবিন থেকে বের হয়ে সোজা তিনতলায় ছুটলো কুয়াশা! পিছন পিছন আর সকলেও তাকে অনুসরণ করতে লাণলো। তিনতলায় একটি মাত্র কেবিন। কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলে কুয়াশা। একদিকের মোটা কালো ভারি পর্দা সরিয়ে একটা গোলাকৃতি মেশিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। মেশিনটার বাঁ পাশ থেকে একটা লম্বা হাতল বেরিয়ে আছে। সেটা ধরে চক্রাকারে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরালো, তারপর কেবিন থেকে বের হয়ে এসে সকলের উদ্দেশ্যে বললো, সৈনিকের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে দেখবে চলো, শত্রুরা কি ভীষণ গতিতে
এগিয়ে আসছে।’
কুয়াশা আগে আগে চললো সকলের পিছনে আর সবাই। থমথম করছে গম্ভীর কয়েকখানা মুখ। অমঙ্গল আশঙ্কায় মহুয়ার মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। কামাল ভাবছে, ব্যাপারটা কি? শহীদ গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে-আসন্ন বিপদের রূপটা কি পরিমাণ ভীষণ হয়ে দেখা দেবে?
সৈনিকের পিছন দিকের রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ালো সকলে। আতঙ্কিত না হয়ে উপায় রইলো না এবার। তিমি মাছের মতো পিঠ উঁচু বিরাট আকৃতির মিশমিশে কালো একটা সাবমেরিন পিছন পিছন ছুটে আসছে বেপরোয়া গতিতে।
পাঁচমাইল দূরেও নেই আর সাবমেরিনটা। * রাত দশটার সময় ছিলো সাবমেরিন এবং সৈনিকের দূরত্ব বিশ-পঁচিশ মাইল। অজ্ঞাত শত্রুর কারসাজিতে দূরত্ব এখন আর পাঁচ মাইলও নয়!
‘ও কি! গলা চিরে বিস্ময়বোধক একটা শব্দ বের হলো কামালের।
সী-প্লেন! সী-প্লন পাঠাচ্ছে ওরা!’ বিনকিউলারটা চোখ থেকে নামিয়ে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো
৪৪
শহীদ। সত্যিই তাই। সাবমেরিনটা থেকে দু’দুটো সী-প্লেন উঠে পড়েছে আকাশে। গোল হয়ে একবার চক্কর মারলো সী-প্লেন দুটো সাবমেরিনটাকে। দ্বিতীয়বার চক্কর মারবার আগেই আরো দুটো প্লেনকে আকাশে উড়তে দেখা গেল। আগের দুটোর মতো এ দুটোও চক্রাকারে ঘুরলো সাবমেরিনটাকে কেন্দ্র করে। তারপর, দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো সৈনিককে টার্গেট করে।
‘মাপাম বোমা ফেলবার তালে আছে শয়তানরা,’ মিটিমিটি হেসে কথাটা বললো কুয়াশা। তারপর হাতের অ্যাটাচি কেসটার তালা খুলতে খুলতে ডেকের একপাশে রাখা কয়েকখানা চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল। পিছন পিছন ওরা সকলেও চেয়ারগুলোর কাছে চলে এলো। কুয়াশা একটা চেয়ারে বসে আটাচি কৈসটা টেবিলের উপর রাখলো।
বসো সবাই, সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাটা বলে নিজের কাজে মন দিলো কুয়াশা। ট্রান্সমিটার যন্ত্রটার বোর্ডে কম করেও দেড়শ’ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুইচ এবং আলোর সঙ্কেত রেখা। ঝুঁকে পড়ে খটাখট শব্দ তুলে সুইচ টিপতে শুরু করলো কুয়াশা। এবং একই সঙ্গে আলোর সঙ্কেত রেখাগুলোর রূপান্তর গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
ওরা তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বসে পড়লো একসময়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এগিয়ে আসছে আকাশ পথে চার-চারটে সাক্ষাৎ যমদূত।গর্জন। শোনা যাচ্ছে বিপদের। এগিয়ে আসছে শত্রুরা, পুড়িয়ে ছারখার করে দেবার জন্যে এগিয়ে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকা। এই নড়বড়ে ঝক্কড়মার্কা ক্ষুদ্র জল্যানটিকে একটি মাত্র নাপাম বোমাই ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। হার্টবিট বেড়ে গেল ওদের তিনজনের। ঠিক এমনি সময়ে অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটা ঘটলো।
চমকে উঠলো ওরা ভয়ে। শিউরে উঠলো মহুয়া। সৈনিক ডুবে যাচ্ছে। সাগর-গভীরে প্রবেশ করছে সৈনিক। ডুবে যাচ্ছে সীমাহীন জলরাশির অতলতলে!
এগার
প্রথমে একটা তীব্র ঝাঁকুনি খেলো ওরা। সামনের দিকে হঠাৎ ঝুঁকে পড়লো একটু। তারপরই সামান্য উঁচু হয়ে গেল সৈনিকের পিছন দিকটা। গোত্তা খেলো একটা। নিচু হয়ে পানির তলায় ডুবে যেতে লাগলো দ্রুত। লসুদ্ধ পানির নিচে চলে গেল
ওরা।
কিন্তু পানি কই? ভিজছে না কেন ওরা?।
দশ সেকেণ্ডের মধ্যে রহস্যটা ধরতে পারলো শহীদ। কামাল আর মহুয়ারও বুঝতে বাকি রইলো না রহস্যটা। ওদের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা হাসলো মৃদু মৃদু।
৪৫
বললো, স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের আবরণ ঢেকে রেখেছে আগাগোড়া সৈনিককে। রকেই।
ফ, টর্পেডো প্রুফ এবং ওয়াটার প্রুফ তো বটেই জিনিসটা, এমন পরিষ্কারভাবে স্বচ্ছ যে বোঝাই যায় না এর অস্তিত্ব।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে এখন ওরা। রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো সবাই। কিছুক্ষণ পরই সমুদ্রের গভীরে চলে গেল সৈনিক। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো পাথরের টিলা, প্রবালের শুম্ভ, রঙবেরঙের শ্যাওলা, সামুদ্রিক ফুল বিস্তারিত জায়গা জুড়ে। আর মাছ। আজব রকমের সব সামুদ্রিক মাছ দেখা যাচ্ছে। সৈনিকের অনধিকার প্রবেশে ভীত হয়ে পড়েছে ছোটো ছোটো নাম না জানা সামুদ্রিক মাছগুলো। পালাচ্ছে ভয়ে নিরাপদ দূরত্বে। একটা অক্টোপাসের বাচ্চা সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়িয়ে আছে দেখা গেল দশ হাত দূরে। প্রতিপক্ষ মনে করে তিমি মাছের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ সৈনিকের দিকে রুখে আসছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর এগোলো না।যদিও সে মোটেই ভয় পায়নি এই ভাব দেখাতে লাগলো। আসলে সৈনিককে গুরুত্ব দিতে রাজি নয় সে। একটা বুড়ো তলোয়ার মাছের ঠোঁট কামড়ে ধরে বেচারাকে কষ্ট দিতে দিতে আড়চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। লিকলিকে চেহারার একধরনের মাছ সভা করছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। সৈনিকের অযৌক্তিক আগমনে বিরক্ত হয়ে কিলবিল করতে করতে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। আরো সব অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণী মুহূর্তে মুহূর্তে ধরা পড়তে লাগলো ওদের চোখে। বিপদের আশঙ্কা ভুলে গিয়ে মগ্নচিত্তে দেখছিল ওরা সমুদ্রের তলদেশ। কুয়াশার কথায় সংবিৎ ফিরে পেলো শহীদ। | টেবিলের উপর থেকে মুখ তুলে কুয়াশা বললো, ‘বুঝলে শহীদ, পানির নিচে আমাদের স্পীড কমে পঁয়তাল্লিশে নেমে এসেছে। সী-প্লেন দুটোকে আকাশে রেখে পানির নিচ দিয়ে ওরাও আসছে আমাদের পিছন পিছন। ঘন্টায় পাঁচমাইল হিসেবে পিছিয়ে পড়ছি আমরা।’
ফিরে এসে চেয়ারে বসলো শহীদ। বললো, “বেশিক্ষণ পানির নিচে ওরা থাকতে পারবে না নিশ্চয়। তেল ফুরিয়ে যাবে প্লেনের।
| কুয়াশা বললো, সেই সুযোগই নেবো আমরা। অবশ্য পানির নিচে আমরা নিরাপদ নই মোটেও।’
হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে সকলের অজান্তে কুয়াশা নিচু স্বরে বললো, আমাদের সঙ্গেই, এই জাহাজে, কোনো শত্রু যাচ্ছে, শহীদ। অ্যান্টি টর্পোেের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়েছে গত রাতে। আর এঞ্জিনরুমে ঢুকে কে যেন স্পীড কমিয়ে দিয়েছে আমাদের।’
| ‘আমি তা জানি, কুয়াশা। কিন্তু সময় নেই এখন হাতে খোঁজ করবার। কিন্তু এ ব্যাপারে কি উপায় করা যায়?’ কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললো শহীদ।
‘উপায় একটা করা যাবে হয়তো। মেরামত করে নিতে হবে ভাঙা
৪
৬
কলকজাগুলো। কিন্তু দুশ্চিন্তার কথা হলো লোকটা কে? আমাদের জাহাজ ছোটো হলেও এমনভাবে তৈরি করা যে, ইচ্ছা করলে যে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারবে এতে দীর্ঘদিন। সহজে ধরা যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমার হাতে সময়ও নেই।’
‘লোকটা সম্পর্কে তোমার কি মনে হয়, কে হতে পারে? কুয়াশা বললো, “আন্দাজ করে কিছু বলা যায় না, শহীদ।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো শহীদ। তারপর বললো, ‘আন্দামান দ্বীপ ছাড়িযে এসেছি আমরা। এখন পাঁচটা বাজে। পুব দিকে চলেছি আমরা। ঠিক পুবদিকে নয়, দক্ষিণ-পূবদিকে বলা যায়। আমরা সুমাত্রা আর কুয়ালালামপুরকে দু’ধারে রেখে এগিয়ে যাবো নিউগিনির দিকে। পথে বোর্নিও পড়বে।’
কুয়াশা জানতে চাইলো, প্রথমবারের মতো কোথায় নোঙর করবো আমরা?
‘নিউগিনিতে। তবে ইতিমধ্যে কি বিপদ ঘটে বলা যায় না। বিপদ ঘটলে দেরি হয়ে যেতে পারে, প্ল্যানও বদলে ফেলতে হতে পারে। যদি তেমন কিছু না। ঘটে তাহলে আগামী পরশু দিন বেলা তিনটের দিকে আমরা নিউগিনিতে নোঙর করবো আশা করা যায়।
শহীদ জানতে চাইলো, ধাওয়ার সাবমেরিনটাকে খসানো যায় কি ভাবে, কোনো উপায় কি নেই?
কুয়াশা বললো, “উপায় খুব ভালোই ছিলো আমার কাছে। কিন্তু আমাদের লঞ্চেই শত্রুপক্ষের কোনো লোক সব ব্যর্থ করে দিচ্ছে। গতরাতে ধাওয়ারত সাবমেরিনটার রাডারে ভুল তথ্য পাঠিয়ে দিয়ে অন্যপথে বেশ খানিকটা সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সৈনিক থেকেই ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে সৈনিকের সঠিক
অবস্থান জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তার ফল তো দেখতেই পাচ্ছো।’
দুশ্চিন্তায় মাথাটা ভারি হয়ে উঠলো শহীদের। নির্বাক তাকিয়ে রইলো সে কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা আবার বললো, যতো বিপদের আশঙ্কাই থাক শহীদ, ওদেরকে ডুবিয়ে মারবো না আমি। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি হয়। অ্যান্টি-টর্পেডোর ব্যবস্থাটা ঠিক করে ফেলি ইতিমধ্যে। টর্পেডো থেকে বিপদ না ঘটলে ওরা এমনিতেও পারবে না আমাদের সাথে।
‘ও কথা কি জোর করে বলা যায়?’ প্রশ্ন করলো শহীদ। | ‘পানির নিচ দিয়ে যদি সব সময় চলি, তবে স্বভাবতই পিছিয়ে পড়বে। আমরা। আর পানির উপরে ভেসে উঠলেই সী-প্লেন পাঠাবে ওরা। তখন আবার পানির নিচে ডুবে যেতে হবে আমাদেরকে। অবশ্য, প্লেনও বেশিক্ষণ আকাশে থাকতে পারবে না, ওদের। তেল ফুরিয়ে গেলে নামতেই হবে। এতে করে সময় নষ্ট হবে ওদের। ফলে পিছিয়ে পড়তে থাকবে। তাতেই যতটুকু লাভ হয় আমাদের।
.
৪৭
কিন্তু আসল ভয় অন্যখানে। ঘরের শত্রুকে যতক্ষণ না ব্যর্থ করা যাচ্ছে, ততক্ষণ . যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা থাকছে। তাই প্রধান কাজ এখন আমাদের, সেই অজ্ঞাত পরিচয় শত্রুকে খুঁজে বের করা। কামাল ও গফুরকে লাগিয়ে দাও তুমি এই কাজে, শহীদ।
গভীর মনোযোগের সঙ্গে কুয়াশার কথাগুলো শুনলো শহীদ। তারপর চিন্তা করতে লাগলো পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে।
বারো
সুমাত্রাকে দক্ষিণে রেখে এবং কুয়ালালামপুরকে উত্তরে রেখে পরদিন দুপুরের আগেই ওরা অতিক্রম করলো বোর্নিও। কখনও শত্রুপক্ষীয় সী-প্লেনের ভয়ে পানির নিচ দিয়ে, কখনও টর্পেডোের ভয়ে পানির উপর ভেসে ঘন্টায় তিরিশ মাইল বেগে। একটানা ছুটে চললো সৈনিক।
প্রতি মুহূর্তে ভয় ছিলো সর্বনাশের। অ্যান্টি-টর্পেডোর ব্যবস্থা অনেকটা আয়ত্তের মধ্যে আনা গেলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে যথেষ্ট ভালভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি। যে কোনো মুহূর্তে একটা টর্পেডো লেগে সর্বনাশ ঘটে। যাবার আশঙ্কা ছিলো পুরোমাত্রায়। যদিও পূর্ববর্তী বত্রিশ ঘন্টায় তেমন কিছু। ঘটেনি। কিন্তু এই বত্রিশ ঘন্টা কেটেছে ওদের প্রচণ্ড উত্তেজনা এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে। কে জানে কখন কি বিপদ কোনদিক থেকে মাথার উপর এসে পড়ে। শত্রু তো সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আত্মগোপনকারী শয়তানটাকে!
কম চেষ্টা করেনি কামাল ও গফুর খুঁজতে। কিন্তু ভীষণ ধুন্ধর প্রতিপক্ষের লোকটা। কোনমতে ধরা দিচ্ছে না এদের হাতে। ঠিকই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
পরবর্তী তিনদিনের দৈনন্দিন ঘটনাও কোনো বিশেষ পরিবর্তন বয়ে আনলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করা আশঙ্কাজনিত উত্তেজনা এবং শিরঃপীড়নকারী দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল পরপর তিনটে দিন। আত্মগোপনকারী শত্রুও রইলো চোখের আড়ালে।
ঠিক বেলা তিনটের সময় পৌঁছলো ওরা নিউগিনির সমুদ্র সীমায়। ইতিমধ্যে এক মুহূর্তের জন্যেও পিছু ছাড়েনি শত্রুপক্ষের বিরাটাকার জলচর দানব সাবমেরিনটা। দশ মাইল পিছনে সেটা তখন। ছুটে আসছে একটানা।
নিউগিনিতে নোঙর করা হলো না সৈনিক।
সমান গতি বজায় রেখে এগোতেই হলো সামনে। অবশ্য নোঙর করবার
০৮
বিশেষ প্রয়োজন ছিলো না। প্রচুর খাদ্য ছিলো স্টোররুমে। সৈনিকের ব্যক্তিগত প্রয়োজনও কিছু ছিলো না। তিনমাসের জন্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সে। আর এখন শুধু শুধুই নোঙর করা মানে বিপদ জেনেও তাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করা।
সকাল থেকেই সমুদ্র রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল সেদিন। সুবিধেই হয়েছিল তাতে। পানির তোড় ছিলো সামনের দিকে। বেড়ে গিয়েছিল সৈনিকের গতি। কিন্তু নিকষ কালো মেঘ উঠে আসছিল আকাশের পশ্চিম কোণ থেকে অশুভ ইঙ্গিত
বহন করে।
চারটে নাগাদ ক্রমশ ঘন হয়ে উঠলো ঘনকৃষ্ণ মেঘের স্তরগুলো। ভয়ঙ্কর একটা গম্ভীর, থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হলো আকাশে। তার জমকালো ছায়া পড়লো সমুদ্রেও। অশান্ত হয়ে উঠলো আরও দিক-চিহ্নহীন বিশাল সমুদ্র।
বৈকালিক চা-নাস্তা সেরে উপরের ডেকে উঠে এসেছিল শহীদ, কামাল, মহুয়া ও গফুর।
মহুয়া, কামাল এবং গফুর রেলিঙের ধারে বসে বসে দেখছিল সামুদ্রিক মাছ। শহীদ একা বসেছিল ডেকের মাঝখানে চুপচাপ। তার মনে একই কথা ঘোরাফেরা করছিল সর্বক্ষণ-ঝড় উঠবে নাকি!
কুয়াশা তার কেবিনে বসে কি করছিল কে জানে।
গফুর, মহুয়া ও কামালের পায়ের কাছে বসে একটা গল্প বলছিল আর হাসছিল মহুয়া। গফুর এবং মহুয়ার কোনো দুশ্চিন্তা নেই যেন। মহুয়া তার দাদার উপর এমনই আস্থাশীল যে কোনো বিপদের আশঙ্কাকেই পাত্তা দিতে চায় না সে। দাদা তাদের সকলকে যে কোনো রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করবে এ যেন তার জানা। আর গফুরের বিশ্বাস তার দাদমণির উপর। তার দাদামণি সাথে থাকতে কোনো দুশ্চিন্তা করাকে মগজের বাজে পরিশ্রম বলে মনে করে সে।
| গফুর গল্প শোনাচ্ছিল, জানো দিদিমণি, আমাদের দেশে লোকে একটা গল্প বলে-অসুখে অসুখে একটি ছেলে মরে যায় দেখে একদিন তার বাবা মসজিদে গিয়ে। খোদার দরবারে জানালো, আমার ছেলেকে ভালো করে দাও, খোদা! তোমার নামে তাহলে এক জোড়া উট কোরবানি দেবো আমি। আশ্চর্যের ব্যাপার, ছেলেটির অসুখ ভালো হয়ে গেল। কিন্তু লোকটা তার কথামত জোড়া উট কোরবানি দিলো
। একদিন হলো কি, লোকটা একটা স্বপ্ন দেখলো। স্বপ্নে তাকে মনে করিয়ে দেয়া হলো জোড়া উট কোরবানি দেবার কথা। লোকটা তখন মনে মনে বললো, উট তো এদেশে পাওয়া যায় না; উট না, আমি জোড়া গরু কোরবানি দেবো আগামী মাসে। একদিন আগামী মাস গত মাস হয়ে গেল। তবু সে গরু কোরবানি দিলো না। আবার লোকটা একটা স্বপ্ন দেখলো। এবার তাকে গরু কোরবানি দেবার ওয়াদার কথা মনে করিয়ে দেয়া হলো। এবারও মনে মনে বললো লোকটি, গরু কোরবানি দেবার তো সামর্থ্য নেই আমার খোদা, আমি বরং এক জোড়া ছাগল ৪-
৪৯
কোরবানি দেবো। কিন্তু এবারও লোকটা তার কথা রাখতে পারলো না। এমনিভাবে সে একটি করে স্বপ্ন দেখে এবং একবার একটা ছাগল, তারপর ভেড়া, তারপরের বার মোরগ, তারপরের বার মুরগীর ছোটো বাচ্চা এবং শেষ বার একটা শালিক পাখি কোরবানি দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলো। যদিও রাখতে পারলো না। আগের বারের মতোই। ফলে আবার একটা স্বপ্ন দেখলো গরীব লোকটা। এবার কিন্তু সে ভীষণ রেগে গেল। রেগেমেগে বিছানা থেকে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়ালো সে। তারপর চিৎকার করে আাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো-হায় খোদা! তোমার মতি বোঝা ভার। এই দুনিয়ার পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার সবই তো তোমার সৃষ্টি। একটা শালিক পাখি কোরবানি দেবো বলেছি তার জন্যে হরদম স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছো আমাকে-কেন, শালিক পাখি তো যেখানে সেখানে চরে বেড়াচ্ছে, তুমি একটু কষ্ট করে একটা ধরে নিতে পারো না?’
গফুরের গল্প শুনে হাসতে লাগলো মহুয়া। এমন সময় দেখা গেল কুয়াশা উঠে আসছে ডেকের উপরে।
উজ্জ্বল আলোকিত ডেকটা। কুয়াশার পদশব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালো। শহীদ। হঠাৎ কুয়াশার পিছন দিকে দৃষ্টি পড়তেই দারুণ আতঙ্কে শিউরে উঠলা
শহীদ। একজন ইউরোপিয়ান লোক ডেকের এক কোণে আলোছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে রিভলভার তাক করছে পিছন থেকে কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে। চেয়ার থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে উঠতে রিভলভারের জন্যে হাতটা ঢুকিয়ে দিলো শহীদ পকেটে। একই সঙ্গে চিৎকার করে কুয়াশার উদ্দেশ্যে বললো, “শুয়ে পড়ে, কুয়াশা, জলদি!’’
‘গুড়ুম! ‘গুড়ুম! গুড়ুম!!’ | কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। শহীদের কথা শেষ হবার পরপরই তিনটে গুলির শব্দ উঠলো। ক্যাঙ্গারুর মতো লাফ দিয়ে একপাশে সরে গিয়েছিল কুয়াশা। সামান্যের জন্যে রক্ষা পেয়ে গেল সে। সরে গিয়েই দ্রুত পাক খেয়ে পিছন ফিরলো সে। তার ঘাড়ের ইঞ্চিখানেক দূর দিয়ে একটা গুলি ছুটে গিয়ে রেলিঙের কাঠে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আর দুটো গুলি কোথায় বিঁধলো? ছুঁড়লোই বা কে?
আশ্চর্য হয়ে দেখলো সবাই, আক্রমণকারী ইউরোপিয়ানটা মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ঠিক তার ঘাড়ের উপর পাশাপাশি দুটো গর্ত
সৃষ্টি হয়েছে বুলেটের। তাজা লাল টকটকে ‘রক্ত কলকল করে বেরুচ্ছে গর্ত দুটো। থেকে। কুয়াশাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল এই জার্মান লোকটা। লোকটা : নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষীয়, কিন্তু একে কে মারলো? সৈনিকে তাহলে একজনমাত্র অজ্ঞাত পরিচয় লোক ছিলো না। কিন্তু কুয়াশাকে রক্ষা করলো কেন সে? কি তার উদ্দেশ্য? যাচ্ছেই বা কেন সে এদের সঙ্গে? শত্রুই যদি না হয়, তবে লুকিয়ে থাকবার ইচ্ছা
কেন? কে হতে পারে এই শুভাকাক্ষী? কে?
তেরো।
অপরিচিত ইউরোপিয়ান লোকটাকে এক পলক দেখে নিয়েই ছুটলো শহীদ ডেক। ধার। জানতেই হবে রহস্যটা। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে কে বাঁচালো ক. য়াশাকে? পিছন থেকে, যদি অদৃশ্য মানুষটা গুলি না ছুঁড়তো, তাহলে ইউরোপিয়ানটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না নিশ্চয়। কে এই শুভনুিধ্যায়ী? কেন এই উপকার বলা সে।
দোতলায় নামবার সিঁড়ির দিকে ছুটলো শহীদ। সিঁড়িমুখের সামনে গিয়ে পঁড়াতেই কে যেন বললো, ওদিকে নয় শহীদ, আমি এই দিকে রয়েছি!’
| অবাক কাণ্ড! চট করে ঘুরে দাঁড়ালো শহীদ। কে, মি. সিম্পসন নাকি?’
হ্যাঁ, সিম্পসন! বিধ্বস্তপ্রায় মি. সিম্পসনই শহীদের উদ্দেশ্যে কথাটা, বললেন।
একটা ড্রামের পাশের জমাট অন্ধকার থেকে টলমল করতে করতে মি. সিম্পসন বের হয়ে এলেন। অসহায় একটুকরো হাসি তার ঠোঁটে কোনরকমে লটকে আছে। পরনের প্যান্টটা কুঁচকে একাকার হয়ে গেছে। ছিঁড়ে গেছে টাইটা। শার্টটায় দাগ ধরে গেছে ছোপ ছোপ। এবং সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হলো একমুখ দাড়ি গজিয়ে ওঠার ফলে মি. সিম্পসনকে ঠিক যেন চেনাই যাচ্ছে না।
‘আরে! আপনি, আপনি কোথা থেকে এসে পড়লেন, মি. সিম্পসন?’ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো কামাল। .
‘মাফ করবেন মিস্টার, আপনি কি সত্যিই মি. সিম্পসন?’ মিটিমিটি’ হেসে প্রশ্ন করলো কুয়াশা।
বাজে কথা বাদ দাও!’
মি. সিম্পসন কারো দিকেই সরাসরি তাকালেন না। মাপা পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সারেণ্ডারের ভঙ্গিতে কিছুটা, কিছুটা ছেলেমানুষী কথাবার্তা বন্ধ করার তাগাদা দিয়ে দু’হাত উপর দিকে উঠিয়ে বলে উঠলেন, বাজে কথা বাদ দাও! খিদে, খিদে এবং খিদে-প্রচণ্ড ক্ষুধায় মরমর অবস্থা হয়েছে আমার। খেতে, দাও আগে, তারপর… উহ্, গফুর ব্যাটা এমন আগলে আগলে রাখে রান্নাঘরটা
যে …
গফুর এসে দাঁড়িয়েছিল ইতিমধ্যে। চলে গেল সে মুখ লুকিয়ে মি. সিম্পসনের জন্যে খাবার আনতে। মি. সিম্পসনের খেদোক্তি শুনে কোনরকমে হাসি সামলালো। সবাই। একটা রোবট এসে সরিয়ে নিয়ে গেল লাশটা। .
তখন কি যেন বলছিলে তুমি?
একপেট খেয়ে একটা ঢেকুর তুলে প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। সত্যিসত্যি আমি সিম্পসন কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছিলো তোমার,
?’
| ‘আপনার দাড়ির জন্যে আপনাকে চেনা যাচ্ছিলো না বলেই বলেছিলাম কথাটা. মি. সিম্পসন। তাছাড়া, না খেতে পেয়ে আপনি বেশ রোগা হয়ে গেছেন, তাই চিনতে পারছিলাম না। আর…’
কুয়াশার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বাধা দিয়ে বললেন মি. সিম্পসন, আমাকে সিম্পসন হিসেবে চেনা যাক বা নাই যাক, এই বান্দা আজ এখানে না থাকলে গিয়েছিলে তো শেষ হয়ে।
| ‘তা অস্বীকার করবো না। সে জন্যে আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, মি. সিম্পসন!’
কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন মি. সিম্পসন। হঠাৎ কেঁপে উঠলো সৈনিক কিসের যেন ধাক্কা খেয়ে। ছিটকে পড়লো মহুয়া চেয়ার থেকে। টাল সামলাতে সামলাতে উঠে দাঁড়ালো ওরা সকলে। এদিক ওদিক দুলছে সৈনিক অস্থিরভাবে। কি হলো বোঝা গেল না ব্যাপারটা। টলতে টলতে মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল শহীদ। কুয়াশা ছুটলো তার কেবিনের দিকে উত্তষ্ঠিত হয়ে। মি. সিম্পসন রেলিং ধরে ধরে দৌড়লেন দোতলার সিঁড়ির দিকে। ব্যাপারটা কি জানতে চান তিনি। কামাল এবং গফুর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে হতবাক হয়ে “সৈনিক কাত হয়ে যাচ্ছে
একদিকে।
| বেশ খানিকটা কাত হয়ে গেল সৈনিক দেখতে না দেখতে। মহুয়াকে উঠিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো শহীদ। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো কুয়াশা তার কেবিন থেকে।
‘মি, সিম্পসন কোথায় গেলেন?’ ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলো কুয়াশা। কামাল বললো, নিচে নেমে গেছেন তিনি।
কামালের কথা শেষ হতেই কুয়াশা দ্রুত কয়েকটা কথা বললো শহীদের উদ্দেশ্যে, পেছনের সাবমেরিন থেকে টর্পেডো এসে আঘাত করেছে সৈনিককে, শহীদ। ফুটো হয়ে গেছে সৈনিকের তলা। আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হও তোমরা। এখুনি পানির উপরে ভেসে উঠছি আমরা। লাইফবয় এনে দিচ্ছে লৌহমানব। কোনো ভয় নেই। নির্ভাবনায় নেমে পড়বে সবাই।’ কথা কটি বলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো কুয়াশা।
সকলের আগে মহুয়া প্রশ্ন করলো উৎকণ্ঠিত স্বরে, কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছো, . দাদা?’
মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। বললো, “মি. সিম্পসনকে সরিয়ে
—
–
আনতে হবে, মহুয়া। সৈনিক অল্পক্ষণেই ডুবে যাবে!’ কাষ্ঠ হাসি হেসে কথাটা বললো কুয়াশা। তারপর আর কাউকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেল দোতলায়।
কুয়াশা অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো লৌহমানব উঠে এলো নিচের তলা থেকে। প্রত্যেকের পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলো তারা একটা করে লাইফবয়। তারপর চলে গেল নিভাঁজ পদক্ষেপে। ঠিক এমনি সময়ে পানির তলা থেকে সমুদ্রের উপরে ভেসে উঠলো সৈনিক।
| লৌহমানব দুজনের একজন চলে গেছে নিচের তলায়। অন্যজন কুয়াশার কেবিনের ভিতর ঢুকে গোলাকৃতি যন্ত্রটার হাতল ঘোরাচ্ছে। ফলে প্ল্যাস্টিকের যে আবরণটা সৈনিককে ঘিরে রেখেছিল সেটা উন্মুক্ত হতে লাগলো ধীরে ধীরে। এবং…
এবং বাতাসের প্রচণ্ড গর্জনে চমকে উঠলো ওরা সকলে প্লাস্টিকের আবরণটা সরে যেতেই। সেই সঙ্গে আচমকা বাতাসের ঝাঁপটা খেয়ে মাতালের মতো দুলতে লাগলো সৈনিক। টলতে লাগলো ওরা সবাই।
ভয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বলক্ষণ দেখা দিয়েছে। সাইক্লোনের পূর্বাভাস! মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে রেলিঙের ধারে সরে গেল শহীদ। বাতাসের ঝাঁপটায় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বলে এক হাতে নাকটা আড়াল করে বসে পড়লো গফুর, ডেকের উপর। কোনরকমে তাল সামলে দাঁড়িয়ে রইলো কামাল রেলিং ধরে। সৈনিক আরো কাত হয়ে গেছে।
মহুয়াকে রেলিং ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে শহীদ তুলে নিলো দুটো লাইফবয়। চিৎকার করে বললো কামাল ও গফুরের উদ্দেশ্যে, লাইফবয় হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোও সবাই!
ডুবে যাচ্ছে ক্রমশঃ সৈনিক।
লাইফবয় হাতে নিয়ে এগোল ওরা। কি যেন বললো কামাল, শুনতে পেলো না কেউ। গফুর বুঝি ‘দাদামণি গো’ বলে ককিয়ে উঠলো। শোনা গেল না তাও বাতাসের হাঁউ-উ-উ গর্জনে।
এগোচ্ছে ওরা রেলিং ধরে। . মাত্র পাঁচ গজ দূরে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে পানিতে নেমে যাবার সিঁড়িটা। কিন্তু বাতাসের আক্রমণে এক পা এগোতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ওরা।
পিছিয়ে পড়েছে শহীদ ও মহুয়া। মহুয়াকে সামনে রেখে এগোচ্ছে শহীদ। শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটছে বলে থেকে থেকে এলিয়ে পড়ছে মহুয়া শহীদের কাঁধে। রাশ রাশ চুল ঝাঁপটা মারছে শহীদের চোখে-মুখে। কিন্তু উপায় নেই আর। কোনো, সময়ও নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাইফবয় নিয়ে নেমে যেতে হবে সমুদ্রে।
প্রথমে নামলো কামাল। কামালের পর গফুর এবং মহুয়া। কামাল পানিতে নেমেই গলা ফাটিয়ে কি যেন বললো চিৎকার করে। শুনতে পেলো না শহীদ। শহীদ নামলো সকলের শেষে।
নেমেই বিপদের ভয়ঙ্করত্ব দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লো শহীদের মতো অসম সাহসী মানুষও। কি বীভৎস সর্বনাশ ঘটবে এবার তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার।
পরস্পরের হাত ধরে এই মাতাল সমুদ্রে টিকে থাকা এককথায় অসম্ভব। ঢেউ উঠছে অনবরত। প্রচণ্ডভাবে ছুটে এসে ধাক্কা মারছে একটার পর একটা। সেই সঙ্গে দমকা বাতাসের তীব্র আঘাত। কি যেন বলতে গেল শহীদ কামালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আগেই বিদ্যুৎচমকের আলোয় হতবাক হয়ে দেখলো, গফুরের হাত থেকে ছুটে গেছে কামালের হাত।
. স্রোতের সঙ্গে তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে লাইফবয়টা। বিদ্যুৎ চমকালো আবার। কোনো রকমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কামাল লাইফবয়ে। ঢেউয়ের তালে তালে উঠছে নামছে লাইফবয়টা। একবার তিনহাত উপরে দেখা যাচ্ছে, সেটাকে, আবার দেখা যাচ্ছে ঝপাৎ করে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনহাত পানির নিচে, ডুবে যাচ্ছে। আবার ভেসে উঠছে অনেকটা দূরে গিয়ে।
* কামালের হাত খসে যাবার পর থেকেই হায় হায় করে বিলাপ করছে গফুর। শক্ত হাতে ধরে আছে শহীদ ঝোলানো একটা রশি। ব্যথা হয়ে গেছে হাতটা। রক্ত জমে টনটন করছে আঙুলের মাথাগুলো। মাথা তুলে তাকালো শহীদ উপর দিকে। সৈনিক ক্রমশঃই কাত হয়ে যাচ্ছে।
| একসাথে বেঁধে ফেলা যায় না লাইফবয় তিনটেকে? কথাটা ভাবলো বটে শহীদ, কিন্তু বাঁধবে কি দিয়ে? বাঁধবেই বা কে? তার দুটো হাতই তো ভেড়া!
মাথা তুলে আবার একবার তাকালো শহীদ সৈনিকের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো।.মি. সিম্পসন খালি হাতে সমুদ্রে লাক দিয়ে পড়ার জন্যে রেলিং টপকাচ্ছেন!
এভাবে লাইফবয় না নিয়ে লাফ দিলে নির্ঘাৎ মারা যাবেন মি. সিম্পসন, ভাবলো শহীদ। চিৎকার করে সাবধান করে দিতে চাইলে সে মি. সিম্পসনকে। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। শহীদ দেখলো মি. সিম্পসনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং কুয়াশা। পিছন থেকে ধরে ফেললো কুয়াশা মি. সিম্পসনকে। তারপর আবার যখন বিদ্যুৎ চমকালো ওদেরকে আর দেখা গেল না। * বিদ্যুচ্চমকের সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল-গগনবিদারী মেঘের গর্জন। পরক্ষণেই শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি।
স্রোতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। বাড়ছে আরো ভয়ঙ্করভাবে। শহীদের রশি ধরে ৫৪
।
–
থাকা হাতের আঙুলগুলোয় নোনা পানি লাগছে, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ছে যেন। কি করবে ভাবছিল শহীদ। এমন সময় সে বুঝতে পারলো, মহুয়া জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো তার লাইফবয়ে। এর ঠিক পঁচিশ সেকেণ্ড পর প্রকাণ্ড একটা ঢেউয়ের আঘাতে ছুটে গেল শহীদের হাত থেকে রশিটা। প্রথমে তীরের মতো ছুটে গেল তিনজন একসাথে স্রোতের তীব্র টানে। কিন্তু দ্বিতীয় আর একটি প্রকাণ্ড ঢেউ এসে পড়তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো ওরা তিনজন পরস্পরের কাছ থেকে |—
কি নিদারুণ সর্বনাশ ঘটে গেল দেখতে না দেখতে! অচেতন মহুয়ার কথা : ভেবে কান্না পেলো শহীদের। নিরুপায় সে! কোনো উপায়েই কোনো চেষ্টা করার কিছু অবশিষ্ট নেই। কাউকে উদ্ধার করার চিন্তা করাও যেন এখন হাস্যকর। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার! স্রোতের তীব্র টান। ঢেউয়ের গগনবিদারী গর্জন। মেঘের গুরু গুরু গম্ভীর অশুভ ডাক, এবং প্রবল বর্ষণ। হু হু করে উঠলো শহীদের বুকটা। লাইফবয়টাকে কোনরকমে জড়িয়ে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইলো সে। গফুরের কথা মনে পড়লো তার। কামাল তো আগেই দলছাড়া হয়ে গেছে। মহুয়া কি জ্ঞান ফিরে পাবে না? বাঁচবে তো এরা? সে নিজেই কি বাঁচবে? মহুয়া যদি জ্ঞান না ফিরে পেয়ে থাকে, তবে …তবে কি মহুয়া চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে গভীর সমুদ্রের অতলতলে? এ ব্যথায় নীল হয়ে যেতে থাকলো শহীদ। কুয়াশার কথা মনে পড়লো তার। কুয়াশা কি এখনও জানতে পারেনি, কি সর্বনাশ ঘটে গেছে?
আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো।
বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো আলোয় শহীদ যেন দেখলো, বেশ খানিকটা দূরে একটা লাইফবয়। লাইফবয়টায় কে যেন পড়ে আছে হুমড়ি খেয়ে। চেনা গেল না। ধক করে উঠলো শহীদের বুকটা। কে হতে পারে? তার দয়িতা মহুয়া, না, তার প্রাণপ্রতিম বন্ধু কামাল, না, প্রভুভক্ত গফুর? কে?
. আবার বিদ্যুৎ চমকালো।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শহীদ। না, এবার আর লাইফবয়টা দেখা গেল না। ঘাড় বাঁকিয়ে সৈনিকের দিকে তাকালো। বিদ্যুৎ চমকালো একটু পরই। আবার একবার কেঁপে উঠলো শহীদে বুকটা। নেই! পানির উপরে আর সৈনিকের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না।
একা সে। কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কোনদিকে। কেউ নেই তার সঙ্গে। কুয়াশা নেই, মহুয়া নেই, কামাল নেই। গফুর নেই, মি. সিম্পসনও নেই। সে শুধু একাই বুঝি বেঁচে আছে। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না কোনো দিকে। সম্মুখে শুধু উত্তাল ভয়ঙ্কর সমুদ্রের বীভৎস উল্লাস। আর গগনবিদারী গর্জন চারদিকে।
৫৫.
Mohiuddin
অসাধারণ একটি গল্প।