১২. ধূসর প্রান্তর (ভলিউম ৪) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১২
প্রথম প্রকাশ ও মে, ১৯৬৮ এক
তীরবেগে ছুটছে ঘোড়াটা। কুয়াশার বিশাল মূর্তি বিরোচিত ভঙ্গিতে অশ্বপৃষ্টে আসীন। জনমানবহন ধূধূ প্রান্তর। রুক্ত পরিবেশ। ছোটবড় পাহাড় সুবিশাল প্রান্তরের এ-প্রান্ত। “প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কালো পাথরের নুড়ি, এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমি, মাঝেমধ্যে লালচে বালির ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ঘোড়াটা। সুদক্ষ ঘোড়সওয়ার পেয়ে আরবী ঘোড়াটার শক্তি ও সাহস যেন বেড়ে গেছে শতগুণ।
কুয়াশার পরনে প্রাচীন দুর সম্প্রদায়ের সর্দারের পোশাক। মিশমিশে কালো রঙের কাপড়ে তৈরি পোশাকে অদ্ভুতদর্শন একজন হুর সর্দার বলে কুয়াশাকে চিনতে কোনো অসুবিধা হবে না। স্থানীয় অধিবাসীদের। | সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সন্ধ্যা সমাতি প্রায়। হঠাৎ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো কুয়াশা। তারপর কাঁধে Zeiss Ikon বিনকিউলারটা চোখের সামনে তুলে ধরে তাকালো সামনে। কিছুক্ষণ এইভাবে তাকিয়ে থাকার পর লাগাম টেনে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো কুয়াশা। তারপর ওটা চোখ থেকে নমিয় ব্যাগের মধ্যে ভর ঘোড়া ছোটালো নেদিক পনিই।
কিছুক্ষণ ঘোড়া ছোটাবার পর একটি সরাইখানার সামনে এসে ঘোড়া থামলো কুয়াশা। তিনজন লোক ঘোড়ার পার শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো তাঁবুর ভিতর থেকে। এরা স্থানীয় অধিবাসী। তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধিৎসু চোখ কুয়াশা তাকালো লোকগুলোর দিকে। কাকে যেন খুজলো লোকগুলোর মধ্যে। কিন্তু নিরাশ হলো সে। দেখতে পেলো না কুয়াশা তার বন্দী পথ-প্রদর্শক শতান আবদানকে।
| পাপিয়া-সুকির হত্যাকারী, ব্ল্যাকমেলার, কিডন্যাপার এবং বিশ্বাসঘাতক আবেদানকে কুয়াশা ছিনিয়ে এনেছিল মি. সিম্পসন ও শহীদের কবল থেকে। ছিনিয়ে এনেছিল তাকে পথ প্রদর্শক হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। কেননা, বেগার কলোনীর গোপন আস্তানার খবর জানা ছিলো শুধু আবদারই।
| কিন্তু সুযোগসন্ধানী আবদীন পালিয়েছে কুয়াশার কবল থেকে। নির্জন, দুর্গম, “ জনমানবহীন প্রান্তরে কেউ পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে না। মাছেপিঠে
থাও পানি নেই, খাদ্য নেই, বাহন নেই। পালিয়ে যাবে কোথায়? এক্ষেত্রে পালিয়ে || মানে আত্মহত্যা করা। কুয়াশা তাই আবদানকে মুক্ত করেই রেখেছিল। কিন্তু, কদিন সকালবেলা কুয়াশা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলো যে আবেদীন তাঁবুতে নেই।
১১৩
অথচ, দুবৃত্তদের ঘাঁটিতে পৌঁছাতে হলে আবেদীন তার দরকার। কিন্তু কোথায় সে?
লোক তিনজন অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে কুয়াশাকে দেখছিল। একমুহূর্ত থমকাল কুয়াশা। তারপর নির্ভুল সিন্ধী উচ্চারণে বললো, ‘দোস্ত! আমি ক্ষুধার্ত পথিক। মাথা সোজবার মতো একটা ঠাইও আমার দরকার। আপনাদের সরাইয় জাগা হবে আজ রাতের মতো?’
কুয়াশার কথা শুনে লোকগুলোর মুখে হাসি ফুটে উঠলো! হুর সম্প্রদায়ের লোকেরা সহজে কখনও কারও আশ্রয়প্রার্থী হয় না। হুররা খুব দুধ আর স্বাজাত্যাভিমানী। হুরদেরকে তাই অন্যেরা খুব ভয় কর। লোক তিনজন তাই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো কুয়াশার পান। আর খুশি হয়ে উঠেছিল হুর সম্প্রদায়ের একজন সর্দার তাদের সরাইয়ে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে বলে।
লোক তিনজনের একজন এবার এগিয়ে এলো কুয়াশার পানে। তারপর শ্রদ্ধামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘আমি এই সরাইখানার মালিক। আপনি এই সরাইখানায় রাত গোজান করলে ধন্য মনে করবো নিজেকে।
কুয়াশা গম্ভীর কণ্ঠে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁবুর সামনে ঘোড়াটা বেধে ঢুকে পড়লো ভিতরে।
গভীর রাতে দু’দুবার ঘুম ভেঙে গেল কুয়াশার। তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালানো হয়েছে। এই আগুন জ্বালানো হয় পাহাড়া নেকড়ের উৎপাত থেকে সরাইখানাটাকে নিরাপদ রাখবার জন্য। সরাইখানার তাঁবুটার সামন ছোটো একটা পাহাড়।
পাহাড়টার নিচে সমতল ভূমি। সমতল ভূমি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু জায়গাতেই সরাইখানাটা। কিন্তু নেকড়গুলো ভয়ানক হিংস্র আর দুধ। রাতের অন্ধকার প্রায়ই তারা পাহাড়টার ঢালু পথ বের তালুতে হামলা চালাবার চষ্টা কর। তাই ওই আগুনের ব্যবস্থা। আগুনকেও যে নেকড়েগুলো খুব ভয় করে তা নয়। আগুন টপকেও নেকড়েওলা তাঁবুতে হানা দেবার চেষ্টা করে। একটা লোক তাই সারারাত নেকড়ে আসবার রাস্তায় একটি পাথরের উপর বসে পাহারা দেয় রাইফেল হাতে। নেকড়েগুলোকে ঢালু রাস্তাটা বেয়ে আসতে দেখলেই পাহারাদার গুলি ছোঁড়ে। এই গুলির শব্দেই জেগে উঠছিল কুয়াশা।
দ্বিতীয়বার রাইফেলের শব্দে ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম এলো না কুয়াশার। নেকড়েগুলো নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মহা সোরগোল শুরু করে দিয়েছে। | ঘুমানো সম্ভবপর না ভেবে কুয়াশা তাঁবুতে লম্বা চৌকোণা বাতির সলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে একটা ম্যাপ বের করল। পকেট থেকে। নিবিষ্টমনে সেটা কিছুক্ষণ দেখবার পর ধারে ধার মুখ তুললো সে। আচমকা তার ভ্র জোড়া কুচকে উঠলো। চিন্তার জগত থেকে বাস্তব জগতে, এই তাঁবুর পর্দার একটা বিশেষ আঁকিবুকির উপর তার দৃষ্টি মনোযোগী হয়ে উঠলো। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কুয়াশা সেদিকে।
১১৪
তার মন কোনমতেই মানতে চাইছিল না যে, অনুজ্জ্বল আলোয় তাঁবুর পর্দায় খাপছাড়া আঁকিবুকিগুলো, যা সে কিছুটা দূর থেকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে, সেগুলো বাংলা ভাষার অক্ষর। এই সুদূর, রুক্ষ, জনমানবহীন, বিপজ্জনক স্থানে বাঙালী আসবে কোথা থেকে? কিন্তু কৌতূহলী না হয়েও পারলো না কুয়াশা। বিছানা ছেড়ে নিঃশব্দে বাতিটা তুলে তাঁবুর পর্দার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো।
বাতিটা পর্দার সামনে নিয়ে গিয়ে আঁকিবুকিগুলো পড়ে চমকে উঠলো কুয়াশা। পরক্ষণেই তার মুখের চেহারা কঠোর হয়ে উঠলো। যে-কোনো মানুষ ওই মুখের চেহারা দেখে চমকে উঠব, শিউরে উঠবে প্রাণভয়ে।
কুয়াশা দেখলো ছেলেমানুষি কাঁচা হাতে বড় বড় হরফে ছাড়া ছাড়া ভাবে তাঁবুর পর্দায় লেখা রয়েছে বাংলা ভাষায়ঃ আমাকে বাঁচান! আমাকে বাঁচান! ছেলেধরার কবলে। পড়েছি আমি! উত্তর-পূর্ব দিক বরাবার আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানতে পেরেছি। আজ বোধ হয় মার্চ মাসের দশ তারিখ। বাবুল।
নিবিষ্টচিত্তে আরও একবার লেখাটা পড়লো কুয়াশা। তারপর অস্ফুট স্বগতোক্তি করলো, ‘পেয়েছি এবার! নিশ্চয়ই শয়তানদের আস্তানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বুদ্ধিমান ছোটো ছেলেটাকে। যেমন করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে ওদেরকে। ধন্যবাদ তোমায়, তাই বাবুল। তোমার আবেদন কুয়াশা বার্থ হতে দেবে না।’
আজ বারো তরিখ। মাত্র দু’দিন আগে বাবুল ছিলো এই সরাইখানায়। ইতিমধ্যে ওরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কুয়াশা মনে মনে উচ্চারণ করলো, ‘যতো দূরেই যাক শয়তনিটা, রেহাই পাবে না আমার কবল থেকে।
দুত, নিঃশলে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। ঝটপট পোশাক পরে নিলো। সকলের অজান্তে বের হয়ে যেতে হবে এই সরাইখানা থেকে। সরাইখানার লোকদের নিজের উদ্দেশ্য বুঝতে দিতে চায় না কুয়াশা, তাছাড়া রাত শেষ হওয়ার আগে ওরা যাত্রা করতে দেব না নিশ্চয়ই। অতিথিকে ওরা বিপদ থেকে মুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। সুতরাং, সকলের অজান্তেই যাত্রা করা শ্রেয়। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলো কুয়াশা সন্তর্পণে। চাঁদ রয়েছে এখনও আকাশে। অদুরে সবকিছুই দৃষ্টিগ্রাহ্য। একজন লোক তাঁবু থেকে প্রায় গজ পঞ্চাশেক দূরে উঁচু পাথরে বসে রয়েছে পিছন ফিরে। নেকড়েগুলো চিৎকার করছে সমানে। নিঃশব্দে সতর্ক পদক্ষেপে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর ডান দিক ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো চুপি চুপি। ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েকবার দেখলো পাহারাদারটিকে। নেকড়েগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে লোকটা। অন্যদিকে খেয়াল দেবার দরকার বোধ না করাই স্বাভাবিক। তিনটে ঘোড়ার সঙ্গে কুয়াশার ঘোড়াটাও দাঁড়িয়ে আছে তাঁবুর সামনে। প্রভুকে দেখে চিহি করে ডেকে উঠলো গোড়াটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাথরের আড়ালে বসে পড়লো কুয়াশা। পাহারাদার লোকটা একবার তাকালো পেছন দিকে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে আবার নেকড়গুলোর দিকে চোখ রাখলো। উঠে দাঁড়িয়ে আবার এগোল কুয়াশা | ঘোড়াটার সামনে গিয়ে খুলে
শি–১২
১১৫
ফেললো দড়ি। কুয়াশা ঘোড়র জিন এবং একটা বিরাটাকার ব্যাগ তাঁবু থেকে সঙ্গে করে বেরিয়েছিল। জিনটা তখুনি ঘোড়ার পিঠে চাপলো না। লাগাম ধরে আস্তে আস্তে তাঁবুর পিছন দিকে হাঁটতে লাগলো সে। কিছুদূর হাঁটবার পর পাহারাদার লোকটাকে আর দেখা গেল না। সন্তর্পণে ঘোড়াটাকে আরও কিছুটা হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে তার পিঠে জিন চাপালা কুয়াশা। তারপর চেপে বসলো ঘোড়ার পিঠে। মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে একটা প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে ঝড়ের মতো তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করলো ঘোড়াটা।
সরাইখানার কেউ জানতেও পারলা না, তাদের অতিথি অদৃশ্য হয়ে গেল কোন ফাঁকে।
দুর্দমনীয় গতিতে ছুটছে কুয়াশী। সকাল হয়ে গেছে ইতিমধে। ধু-ধু করছে উন্মুক্ত প্রান্তর। ঘোড়া থামিয়ে বিকিউলার তুলে কুয়াশা দেখালো কিছুটা দূরে কালো একটা রেখার মতো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সারি। অনুমানে বুঝলা, পাহাড়গুলো দশ পনেরো মাইলের কম দূরে নয়। চারদিকে আর কোনো কিছুর চিহ্ন নেই।
ঘন্টা দুয়েক ঘোড়া চালিয়ে কুয়াশা পাহাড়গুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো। পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে ঘোড়া ছোটালো কুয়াশা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। অনুমান করে ধরে নিয়েছে সে এই বহুদূর বিস্তৃত পর্বতশ্রেণীর মধ্য দিয়ে কোনো উপত্যকা নিশ্চয়ই আছে। ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর সফল হল। কুয়াশা। সত্যিই উপত্যকার মতো একটা পথ চলে গেছে, পাহাড়-শ্রেণী ভেদ করে। বিশ্রাম করার কথা মনে না এনে বেদম গতিতে ছুটিয়ে দিলো কুয়াশা তার বিশ্বস্ত বাহনকে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পার হতে হবে এই উপত্যকা। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই উপত্যকাটির শেষ সীমায় এসে পৌঁছলো কুয়াশা। সম্মুখে আর পাথুরে জমির চিহ্নমাত্র নেই। যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধু বালুঢ়াকা চরাচর ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। বালি আর বালি। চারদিকে শুধু বালির রাজ্য।
ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় বিনকিউলারটা তুলে দেখে নিলো একবার কুয়াশী। কিছুই নজরে পড়লো না মরুভূমির নির্জনতায়। শান্ত পদক্ষেপে পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করলো কুয়াশা। বিশ্রাম কার তার। তার নিজের চেয়েও বেশি দরকার একমাত্র সঙ্গী ঘোড়াটার। সম্মুখে শুষ্ক মরুভূমিতে সে-ই একমাত্র সঙ্গী, একমাত্র ভরসা, একমাত্র বাহন। তাছাড়া বেচরাকে আজ বহু মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।
সন্ধে পর্যন্ত বিশ্রামের পর আবার যাত্রা শুরু করবে ভেবেছিল কুয়াশা। কিন্তু চাঁদ উঠলো না। চাঁদ উঠলো আরও দু’ঘন্টা পর। চন্দ্রালোকিত মরুভূমিতে বালি চিকচিক করতে লাগলো। ঘোড়াকে সজ্জিত করে আবার চড়ে বসলো কুয়াশা তার পিঠে। তারপর ১১৬
আবার বেদম গতিতে ছুটে চললো ঘোড়া।
পরদিন ভোরবেলা একটা মরুদ্যান দেখতে পেলো কুয়াশা বিনকিউলারের লারের মধ্যে দিয়ে। আরও মাইলখানেক এগোবার পর মরুদ্যানের ভিতর দুটো তাঁবুও সে দেখতে পেলো। কাছাকাছি পৌঁছাতে একটা লোক তাঁবুর পর্দা ফাঁক কর বাইরে এসে দাঁড়ালো। অদ্ভুতৰ্দশন পোশাক পরনে একজন অনাহুতাকে দেখে আতঙ্ক শুকিয়ে গেল লোকটার মুখ।
হঠাৎ কি মনে করে লোকটা সরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পা বাড়ালা তাঁবুর দিকে। কিন্তু বাধা দিয়ে কুয়াশা বলে উঠলো, ‘দাঁড়াও! তাঁবুর ভিতরে ঢোঁকবার চেষ্টা করলে
গুলি ছুড়বো।’
থমকে দাঁড়ালো লোকটা। চোখমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠলো বেচারার। ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও একটা একটা করে।’ ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে লোকটা বললো, ‘বলুন, সর্দার! কুয়াশা বললো, ‘এটা কি একটা সরাইখানা?’ কাঁপতে কাঁপতে লোকটা বললো, ‘জি, সর্দার। ‘ক’জন লোক আছে এই তাঁবুতে?’
লোকটা পূর্ববৎ কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘মোট তিনজন আমরা এই ব্যবসা চালাই সর্দার। দু’জন গোছে পানির সন্ধান। এখানকাব কুয়োর পানি শুকিয়ে গেছে।’
কুয়াশা জানতে চাইলো, ‘কোনো মুসাফির আছে কি এখন সরাইখানা?’
জ্বী, না সর্দার। কেউ নেই। ‘গত দু’তিন দিনের মধ্যে কেউ ছিলো কি? ‘জ্বী, সর্দার। গতকাল দু’জন ছিলো।
উত্তেজিত হয়ে গোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলো কুয়াশা। তারপর দু’পা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘সেই দুজনের মধ্যে একজন ছোটো ছেলে ছিলো, না?’
‘জ্বী, সর্দার, ছিলো। * দ্রুত জিজ্ঞেস করলো কুয়াশা, কখন এখান থেকে যাত্রা করেছে তারা কোন দিক গেছে? রাতে তারা কোন তবুটাতে ছিলো?
| লোকটা কাঁপা আঙুল একটা তাঁবু দেখিয়ে বললো, ‘ওই তাঁবুটাতে গত সন্ধ্যায় তারা ছিলো, সর্দার। আজ ভোরে তারা চলে গেছে আন্দাজ চারটার সময়। তাঁবুর ভিতর ছিলাম আমি।
কুয়াশা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললো, ‘ঠিক আছে। যে তাঁবুতে লোকটা এবং ছেলেটা ছিলো সেটা আমি একবার দেখবো। তুমিও আমার সঙ্গে এসো। কিন্তু তুমি অমন করে কাঁপছো কেন বলো দেখি!
প্রশ্ন না করে লোকটা বারবার হুর সম্প্রদায়ের সর্দারের কালো অদ্ভুতদর্শন
..শি[-১২
১১৭
পোশকিটা দেখতে লাগলো অসহায় ভীত দৃষ্টি মেলে। কিন্তু কিছু বলতে সাহস পেলো না। বরং আরও বেশি করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘আসুন সর্দার, আপনাকে তাঁবুটা দেখিয়ে দিই।’
| তাঁবুর ভিতর প্রবেশ করে কুয়াশা তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশে তাকালো। একমিনিটও ব্যয় হলো না। পেয়ে গেলি কুয়াশা তার প্রার্থিত জিনিসটি। দেখলো, বুদ্ধিমান বাবুল এই তাঁবুর পর্দাতেও লিখে রেখে গেছে, ‘ছেলে ধরার কবলে পড়েছি আমি। উত্তর-পূর্ব দিকে যাবো আমরা। আমাকে উদ্ধার করার জন্য কি কেউ নেই পৃখিবাত? হতভাগ্য বাবুল।’
‘আমি আছি ভাই তোমাকে উদ্ধার করতে।’ | লেখাটা পড়ে ধীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলো কুয়াশী। লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালো। এবং একটি কথা না বলে একলাফ চড় বসলো ঘোড়ার পিঠে। তারপর লোকটাকে কিছু বোঝবার অবসর না দিয়েই বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল বহুদূর।
লোকটা হতভম্ব হলো বটে। কিন্তু হুরদের খোদ সর্দারের কবল থেকে পরিত্রাণ পেয়ে তার ধড়ে সত্যিকার প্রাণ ফিরে এলো।
দুই
শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন ও দু’জন পুলিস কনস্টবল করাচী থেকে হায়দারাবাদ পৌঁছলো একখানি যাত্রীবাহী বিমানে। এই অভিযানে অংশগ্রহণের ইচ্ছা মহুয়ারও ছিলো। মহুয়া জেদ করলে শহীদও ‘না’ বলতে পারতো না। কিন্তু মহুয়ার কোনো উপায় ছিলো না শহীদের কাছে আবদার করার। কারণ, কুয়াশাই এ ব্যাপারে উপদেশ দিয়েছিল।
কুয়াশার ভালো-মন্দ জ্ঞানকে অমান্য করার কথা মহুয়া মনেও স্থান দিতে পারে।
ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকমঃ
মিস সুকিয়া এবং মিস পাপিয়ার হত্যা রহস্য মীমাংসার পরদিন কুয়াশা লোক নারত একটা খাম ও একটা বেশ বড় ব্যাগ পাঠিয়েছিল শহীদের বাড়িতে! ব্যাগটায় ছিলো শহীদ ও মহুয়ার জন্য কুয়াশার নিজের আবিষ্কৃত কয়েকটা অদ্ভুত সুন্দর এবং কার্যকরী বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
কুয়াশা শহীদকে যে সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি উপহার দিয়েছিল তার মধ্যে একটা ছিলো পেন্সিল টর্চের মতো দেখতে যন্ত্র। সেটার সুইচ টিপলে অতি উতপ্ত নীল আগুনের যে শিখা বের হয়ে আসে তা দিয়ে কঠিন ইস্পাতও গলিয়ে ফেলা সম্ভব। আরও ছিলো একটা সিগারেট পাইপ ও লাইটার। পাইপটা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ওয়্যারলেসের কাজ চালানো সম্ভব। লাইটারটা ছিলো আকারে একটু বড়, কিন্তু অদ্ভুত এর ক্ষমতা। কোনো
১১৮
ভলিউম-s
মানুষকে লক্ষ্য করে এটা দিয়ে কেউ যদি সিগারেট ধরায় তবে সেই মানুষটার ছবি উঠে যব এর ভিতর কৌশল রাখা ছোট্ট ক্যামেরাটিতে। অর্থাৎ, লাইটারের মুখোশ পরানো থাকলেও এটা ক্যামেরা ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য, জিনিসটার স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভবপর নয় কারুর পক্ষেই।
কুয়াশা এসব কিছুর সঙ্গে মারাত্মক আরও একটা জিনিস পাঠিয়েছিল। এই জিনিসটা দেখতে অনেকটা হ্যাঁণ্ড গ্রেনেডের মতো। ছোট্ট, মসৃণ, গোল সাদা বলের মতো দেখতে এই গোলাকার বস্তুটি আসলে একটা ফায়ার বম। এর উপর সবুজ রঙের সুইচ আছে। মুঠোর মধ্যে বলটা ধরে বুড়ো আঙুল চাপে সুইচটা টিপে লক্ষ্যস্থলে ছুঁড়ে মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়া যায় নিমিনের মধ্যে এটা দিয়ে।
এছাড়া কাগজের খামটায় ছিলো একটা ম্যাপ ও একটা চিঠি। ম্যাপটা ছিলো হায়দারাবাদের পূর্ব দিক একটি জনমানবহীন রুক্ষ পাহাড়ী এলাকার। মরুভূমি এলাকাও চিহ্নিত করা ছিলো ম্যাপটায়।
চিঠিতে কুয়াশা লিখেছিলঃ প্রিয় শহীদ,
| অপরাধী আবেদীনকে তোমাদের কবল থেকে আমার ছিনিয়ে নিয়ে আসার একমাত্র কারণ হলো একটি জঘন্য, নিষ্ঠুর, অমান্যবাচিত অপরাধমূলক ব্যবসায়ের চরম সমাপ্তি ঘটানো। অপরাধ্যর আড্ডাটা সিন্ধু প্রদেশের একটা বিজন অঞ্চলে। সুরক্ষিত একট। দুর্গার অভ্যন্তরে রয়েছে এদের মূল ঘাঁটি। এ সবই আমি। আবেদীনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। তবে, এর সত্যাসত্য সম্বন্ধে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি।
বিভিন্ন সূত্র থেকে এদের সম্বন্ধে আমি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছি।
. নাবালক ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে এরা যে শুধু বেগার খাটায় তাই নয়। এইসর ছেলেদের মধ্যে যাদের চোখের কোনো অসুখ নেই তাদের চোখ উপড়ে নিয়ে বিরাট মূল্যের পরিবর্তে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে এই ন:. ধমরা। চোখ উপড়ে নেয়ার পর অন্ধ ছেলেগুলোকে এরা মেরে ফেলে না। চালান দেয় শহর, লঞ্চে, হাট, বাজারে, মেলায়, উরসে। ভিক্ষা করায় এদেরকে দিয়ে। ভিক্ষার পাস ছেলেগুলো পায় না একটাও। খাবার এদেরকে কি দেয়া হয়
না হয় সে সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো।
আর যে ছেলেগুলোর চোখ খারাপ থাকে বা যারা একটু বয়স্ক হয় তাদেরকে এরা বেগার কলোনীতে চালান দেয়। বেশ কয়েকটা বেগার কলোনীর পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এদের। দেড় থেকে দু’হাজার টাকার বিনিময়ে ছেলেগুলোকে এরা বিক্রি করে।
বুঝতেই পারছো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ব্যাপারে আমার হস্তক্ষেপ করা
প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমি চললাম। তুমিও আগ্রহ বোধ করছে কি? যদি করে। তবে আনন্দিত হবো। মহান কর্তব্যে সাড়া দিতে আমাদের মধ্যে কেউই তো পিছিয়ে নেই। পথনির্দেশের জন্য একটা ম্যাপ পাঠালাম! স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আন্দাজের উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে ম্যাপটা। স্কেলেরও ভুল থাক অস্বাভাবিক নয়। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, এ কথায় আমি যেমন বিশ্বাস করি তেমন আর কিছুই নয়।
যদি তুমি এই অভিযানে আগ্রহী হও তবে মহুয়াকে আমার কথা জানিয়ে বলা যে, আমি তাকে এই দুর্গম স্থানে আসতে নিষেধ করছি।
সামানা কয়েকটা উপহার পাঠালাম তোমার এবং মহুয়ার জন্য। ওগুলোর কার্যকারিতা সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য তথ্য আলাদা একটা কাগজে লেখা আছে।
ইতি-কুয়াশা
কুয়াশার চিঠি পড়ে আগ্রহী না হয়ে পারনি শহীদ। প্রথমে ভেবেছিল সে একাই অভিযান রওনা হবে। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কথা বিবেচনা করে মি. সিম্পসনকেও গোটা ব্যাপারটা না জানিয়ে পারেনি। সব কথা শুনে মি, সিম্পসনও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কুয়াশাকে গ্রেফতার করার সর্বপ্রচেষ্টা এ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও কুয়াশাকে ফলো করার দুর্দমনীয় নেশা মি, সিম্পসনের অদ্যাবধি এতটুকুও হ্রাস পায়নি। কুয়াশাকে অনুসরণ করার সুযোগ পাওয়া গেলে তিনি আর কিছুই চান না। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে শহীদ, মি. সিম্পসন ও কামাল আলোচনা করলা ব্যাপারটা নিয়ে। অবশ্যকরণীয় কয়েকটা কাজ সমাধা করবার পর আগামী পরশুদিন ঢাকা থেকে করাচী, সেখান থেকে হায়দারাবাদ রওনা হন তারা। তার পরের রাস্তা ম্যাপ দেখে খুঁজে বের করে নিতে হবে। গফুর ঢাকাতেই থাকবে বলে স্থির হলো। করাচী পৌঁছে দু’জন পুলিস কর্মচারীকে সঙ্গে নেয়া হবে বলেও মি. সিম্পসন মত প্রকাশ করলেন। দুর্গম অঞ্চলে অতিরিক্ত কিছু লোকজন থাকলে ভালো হয়। পথের সম্পূর্ণ গতি-প্রকৃতিও
তো জানা নেই।
হায়দারাবাদ বিমানবন্দরে মি. সিম্পসন এবং গোটা দলটাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন সেখানকার পুলিশ সুপারিন্টেন্ট মি. ফারুক জাহাঙ্গীর লোধী স্বয়ং। মি. সিম্পসন আগেই খবর পাঠিয়েছিলেন।
| সকাল সাতটায় মোটরে করে যাত্রা করলা শহীদরা। যাত্রা শুরু করার আগে মি. সিম্পসন পুলিস সুপারিন্টেন্টে লোধার সঙ্গে জরুরী কয়েকটা বিষয়ে কথাবার্তা সেরে নিলেন। মি. সিম্পসন কথা প্রসঙ্গে মি. লোধীকে জানালেন যে কুয়াশাকে গ্রেফতার করার জন্যেই তিনি প্রধানত এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু দুবৃত্ত দলের
ভলিউম-১
অস্তিত্ব যদি সত্যিসত্যিই থাকে তাহলে তারও একটা বিহিত তিনি করতে চান। মি, লোধীর কাছ থেকে তিনি একটা ওয়্যারলেস যন্ত্র চেয়ে নিলেন। এটার সাহায্যে তিনি হায়দারাবাদ পুলিসের সদর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। প্রয়োজনীয় খবর আদান-প্রদান ছাড়াও দরকার পড়ল এই ন্ত্রটার সাহায্যে তিনি পুলিসের সাহায্য কামনা করতে পারেন। দুর্গম অঞ্চলের অভিযানে অংশগ্রহণ করার জন্যে এমন একটা যন্ত্র যে অতিপ্রয়োজনীয় সে কথা মি. লোধা ও স্বীকার করলেন। স্থির হলো, পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য মি, সিম্পসন ‘DD-333 এই কোড় ব্যবহার করবেন।
মোটর একনাগাড়ে বিশ মাইল ছুটে গিয়ে এক জাগো থামলো অবশ। মোটঘাট নিয়ে একে একে নামলো সবাই। এক পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হয়েছে
ওরা। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি চলার পথ এ পর্যন্ত এসেই শেষ হয়েছে।
পাহাড় অতিক্রম করে মাইল পাঁচেক পথ সামনে এগোল উপজাতীয়দের একটা গ্রাম পাওয়া যাবে কুয়াশার ম্যাপে চিত্রিত নির্দেশ অনুযায়ী। তারপর হাটার পরিশ্রম আর পোহাতে হবে না। উপজাতীয় সর্দাররা ঘোড়া বেচাকেনা করে। ঘোড়া ছাড়া অন্য কোনো বাহনে এগোন সম্ভবপর নয়। উপজাতীয়দের সামানা ছাড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ ভূমি। তারপর শুরু হবে মরুভূমি। সুতরাং ঘোড়াই দরকার।
| পাহাড়টা বেশ উঁচু। পার হতে হতে সূর্য মাথার উপর উঠে এলো। সমতল ভূমিতে পৌঁছবার পর শহীদ চারদিকে তাকাতে তাকাতে বললো, ‘ খাওয়া দাওয়া সেরে আবার যাত্রা শুরু করা যাবে।’
কামাল বললো, ‘কথাটা আমিই বলতে যাচ্ছিলাম।’
হাসতে হাসতে মি, সিম্পসন বললেন, ‘এখন যদি আমি হাতের নাগালে কুয়াশাকেও পাই তাহলেও এক ঘন্টা বিশ্রামের বিনিময়ে তাকে আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।
‘শহীদ! হঠাৎ ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে কামাল শহীদকে ডেকে উঠল। কামালের দিকে তাকিয়ে অবাক ক, শহীদ বললো, ‘কি রে!
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কামাল বিস্ফারিত চোখে পশ্চাতের পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে শহীদ সেদিক পানে তাকিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলো।
একদল ভীষণদর্শন লোককে পাহাড়ের উপর থেকে দত্ত ঘোড়া ছুটিয়ে আসত দেখা গেল। তাদের প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল। ততক্ষণে মি. সিম্পসনেরও ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। মি. সিম্পসন কোমরে হাত রেখেছিলেন বেন্ট থেকে রিভলভার বের। করার জন্য। সেদিকে নজর পড়তে শহীদ মি. সিম্পসনকে ইঙ্গিত নিষেধ করলো। তারপর দ্রুত কণ্ঠে বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে লোকগুলো উপজাতীয়। ওদের সঙ্গে একটু বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করতে হবে। দেখতে পাচ্ছেন তে সংখ্যায় ওরা ত্রিশজনের কম নয়। যুদ্ধ করে পারবো আমরা? অসম্ভব! তার চেয়ে দেখা যাক, কে ওরা
আর কি-ই বা চায়।’
দু’জন পুলিশ কর্মচারীর একজনের দেশ সিন্ধু প্রদেশে। তার নাম সাক খান। সে বললো, ‘উপজাতীয়দের ভায়া কিছু কিছু আমি জানি। প্রশ্ন করলে আমি কোন উত্তর দেবো?’
শহীদ বললো, ‘ড, প্রথম প্রশ্নগুলো আমাদেরকে শোনাবে। তারপর আমরা বল ‘ দেব কি উত্তর দিতে হবে, বুঝছো?’
‘জ্বি–সারি।’
ততক্ষণ একেবারে সামনে এসে পড়েছে লোকগুলো। হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে আরও সামনে। হঠাৎ ককটা লোক বিচিত্র ভাবে ছড়িয়ে গিয়ে শহীদদের গোটা দলটাকে চক্রাকার ঘিরে ফেললো। চক্রটাকে আরও খানিকটা ছোটো কর দাঁড়িয়ে পড়লা সকলে এক সঙ্গে। নিঃশব্দে স্ত্রর মুখে দাঁড়িয়ে রইলা লোকগুলো বেশ খানিকক্ষণ। তারপর একজন স্থূলকার লোক চিৎকার করে কি যেন বললো।
সাকী খান সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে শহীদকে জানালো, ‘‘ জিজ্ঞেস করছে, কে তোমরা, কোথায় যাচ্ছা, উদ্দেশ্য কি?’
শহীদ বলতে বললো, ‘আমরা ভালো লোক, কারা কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। দুরর মিরান নদী ছাড়ি আরও বহুদূর, আমরা যাবো। সেখানে নাকি বিদেশী শক্রর একটা প্লেন পড়ে গেছে। সেটার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেবার জন্য সরকার আমাদেরকে পাঠিয়েছে। কোনো রকম বদ মতলব আমাদের নেই। আমাদের পরিচয় আমরা দিলাম, এখন তোমাদের পরিচয় কি বলো।’
প্রত্যুত্তরে ঘোড়সওয়ার লোকটা বললো, আমরা কে সে কথা আমাদের সর্দারকে জিজ্ঞেস করা। আর আমাদের কথা তোমরা যা বলল তাও আমাদের সর্দার শুনে ইচ্ছা
হয় বিশ্বাস করবেন না হলে করবেন না। সেটা আমাদের বিবেচনার ব্যাপার নয়। এখন। তোমাদেরকে যেতে হবে আমাদের সর্দারের কাছে। জোরাজুরি করল, বুঝতেই পারছো, সবকটাকে লাশ বানিয়ে ছেড়ে দেবো।’
শহীদরা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলো ওদের সঙ্গে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবুও শহীদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কতদূর যেতে হবে তোমাদের
সঙ্গে? কোথায় থাকেন তোমাদের সর্দার?’
ঘোড়সওয়ার উত্তর দিলা, ‘আমাদের কাছে তোমাদের সব অস্ত্র সমর্পণ করো। তারপর আমাদের ঘোড়ার পিছনে এসে বাসা। দশ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সর্দার কোথায় থাকেন জানতে পারব।’
নিন্দুপ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা এক মুহূর্ত। তারপর শহদের ইঙ্গিতে সকলে যার যার পিস্তল, ছুরি ইত্যাদি বের কর মাটিতে রাখলো। ঘোড়া থেকে উপজাতীয় তিনজন। লোক নেমে এসে সেগুলো তুলে নিলো। তারপর সকলের পকেট ইত্যাদি খোঁজ করে কিছু পাওয়া গেল না দেখে ঘোড়ার পিছনে তুলে নিলো ওদেরকে, জোর কদমে ছুটে
চললো সামনের দিকে।
তিন
মিনিট কুড়ির মধ্যেই উপজাতীয় একটা গ্রামে এসে পৌঁছলো ওরা। গ্রামটাতে শ’খানেক লোক বাস করে। মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা আঙিনার মধ্যে ছোটো ছোটো ঘর। সবকটি ঘরই মাটির তৈরি, শুধু সর্দারেরটা ছাড়া। তার বাড়িটা পাথরের। গ্রামের মধ্যে ঢুকে সকলেই যেন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আর যাই হোক, দর্টস নয় এরা। উপজাতীয়ই। এরা গম্ভীর, মিতবাক, ওদের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর জানতে চাইলে রেগে যায়। অনাহুত, সন্দেহজনক লোকজনকে দেখলে যাচাই করে নেঃ লোকটা বিশ্বস্ত কি
। আর বিরূপ আচরণ ওরা একেবারেই সহ্য কর না। | গ্রামের ভিতর খানিকটা এগিয়ে ঘোড়সওয়ারের দাঁড়ালো একটা পাথরের নিচ এবং ছোটমত বাড়ির সামনে। মোড়র পায়ের শব্দ শুনে একজন বিশালকায় চেহারার বৃদ্ধ কিন্তু সতেজ ব্যক্তি বাড়ির ভিতর থেকে বের হয় এলো।
শহীদ দেখলো, লোকটা চোখ ছোটছাট করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাঁজ পড়েছে কপালে। যেন বিরক্ত অথবা ক্রোধান্বিত। ক’মুহূর্ত পরই হুঙ্কার দিয়ে উঠলো লোকটা পশতু ভাষায় ‘ কে তোমরা? কোথায় যাবে? কি উদ্দেশ্য?’
এবার উত্তর দিলো শহীদ। বিনীত ভাবেই সে বললো, ‘আমরা আপনাদের কাছেই আসছিলাম, সর্দার। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রওনা দেবো ভেবেছিলাম। এমন সময় আপনাদের লোকজন আমাদেরকে ধরে এনেছে। কয়েকটা ঘোড়ার দরকার আমাদের। আমাদেরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। বিদেশী শত্রুর একটা উড়োজাহাজ সম্পর্কে আমরা খবর সংগ্রহ করতে এসেছি। আমাদের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।’
আশাতীত ব্যাপার ঘটলো এবার। বিদেশ শত্রু রাষ্ট্রের উল্লেখ রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠালা উপজাতি সর্দার। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই আমি বলে দিতে পারি সে শত্রু না মিত্র। আমার লোকজন আপনাদেরকে বিশ্রাম এবং আহারের সুযোগ না দিয়ে এখানে জোর-জবরদস্তি করে আসতে বাধ্য করেছে, সেজন্যে আমি মাফ চাইছি আপনাদের কাছে। শত্রুর বিমান ধবংস হয়েছে বললেন, সেটা খুবই সুখবর। কিন্তু শত্রুর কি কোনো বদ মতলব আছে বলে মনে কারন আপনারা? আমাদের তাহলে যুদ্ধের জনো তৈরি হতে হয়।’
শহীদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এবার। সে বললো, ‘না সর্দার, শত্রু আর আমাদেরকে আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। তেমন কিছু ঘটলে সরকার আপনাদেরকে সে খবর জানাতে এতটুকুও দেরি করবেন না। আমি যা বলেছি তার চোর বেশি কিছুই ঘটেনি।
১২
. সর্দার শান্ত গলায় বললো, ‘যাক, স্বস্তি পেলাম। আসুন, এবার আপনাদের আহরর বন্দোবস্ত করি গরীবখানায়। তারপর আমার ঘোড়াশালে গিয়ে ঘোড় বেছে নেবেন।’
সমরাহ সহকারে আহার পর্ব শেষ হলো। ঘন্টাখানেক পর শহীদ উপজাতি। সর্দারকে বললো, ‘এবার রওনা হতে চাই আমরা।’
রওনা হবার মুখে হঠাৎ উপজাতি সর্দার শহীদের সামনে এগিয়ে এসে তার দুটি হাত চেপে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, তোমাদেরকে বলবো না বলবো না কারও একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। আমি তোমাদের কর্তব্য-কর্মে বাধা দিতে চাই না। বিশেষ শত্রুর প্রশ্ন জড়িত যেখানে সেখানে বাধা দেয়াটা পাপ বলে মনে করি। কিন্তু, মিরান নদীর ওপারে তোমরা যাবে শুনে আমি তোমাদেরকে কথাটা না বলেও থাকতে পারছি না। মিরান নদীর ওপার একটা পাহাড় আছে। পাহাড়টার নাম কিলা। ওই পাহাড়টার ওপার গিয়ে আমাদের দলের কোনো লোক আজ পর্যন্ত ফিরে আসতে পারেনি। ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না, বাবা। আমি তোমাদের
ত্রায় বাধা দিতে চাই না। শুধু একটা কথা মনে রেখো আমার–সর্বদা অতি সাবধানে কো। জানো তো, কথায় আছে, সাবধানের মার নেই।’
| শহীদ সারের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয় ধন্যবাদ জানালো। তারপর বললো, সর্দারের কথামত তারা অতিমাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করেই চলবে। সর্দারের উপদেশ অমান্য করব না। | বিকেল নাগাদ সর্দারের দেয়া ঘোড়া ছুটির ওরা মাইলকুড়ি পথ অতিক্রম করলো। সামনেই একটা লবণ হ্রদ দেখতে পাওয়া গেল। রাতের মতো তাঁবু খাটাবার বন্দোবস্ত করা হলো এখানেই। তাঁবু খাটানো শেষ করে ঘোড়ার জন্যে ঘাস সংগ্রহ করতে গেলি পুলিস কর্মচারী দু’জন। আধঘন্টা পর উত্তেজিত হয়ে ফিরে এলো ওরা।
সাকী খান বললো, ‘স্যার, দু’বস্তা ঘাস কেটে নিয়ে আসছিলাম আমরা, এমন সময় দুজন লোক রাইফেল দেখিয়ে এক বস্তা কেড়ে নিয়ে তোল জোর করে।’
হাদ অবাক কণ্ঠে বললো, ‘আজব ব্যাপার তো! লোকগুলো গেল কোথায়?
সাকী খান বললো, তা জানতে দেয়নি ওরা। রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের দুজনকে বললো, একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যাও তোমাদের আস্তানার। পিছন ফিরে তাকালেই গুলি করবো।’
কি রকম চেহারা লোকগুলোর?’ সাকী খানের সঙ্গী জবাব দিলো এবার। সে বললো, ‘লোকগুলোকে স্থানীয় অধিবাসী বলে মনে হয় না। দাগী আসামীদের মতোই চেহারা লোকগুলোর।’
কামাল বললো, ‘কিছু একটা করা দরকার মনে হচ্ছে।’
মি, সিম্পসন বললেন, ‘অন্যায় কাজ মেনে না নেয়াই উচিত। কিন্তু, কি-ই বা করা যেতে পারে এখন?’
২৪
ভলিউম-১
কামাল বললো, ‘চলুন, খোঁজ করে দেখি ব্যাটাদের। ধরতে পারলে উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে।’
| হাঁদ ধার কণ্ঠে বললো, লোকগুলো আমাদের মিত্র নয় সে কথা এতক্ষণ তোদের বুঝে ওঠা উচিত ছিলো। হয়তো আমাদের বিশেষ কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ওদের। নেই। তবু ভালো লোক হলে ওরা এরকম ব্যবহার করতো না নিশ্চয়ই। সুতরাং, ওদেরকে খুজতে গিয়ে ওদের ফাঁদে পা দেবার কোনো দরকার নেই এখন। আমি বলি কি, তার চেয়ে বরং আজ রাতটা যাতে নিরুপদ্রব কাটাতে পারি সে জন্য সারারাত তাঁবু পাহারা দেবার বন্দোবস্ত করা যাক। হয়তো কিছুই ঘটবে না আজ রাত, তবু সাবধান থাকা ভালো।’
রাতে সত্যিই তেমন কিছু ঘটলো না। পরদিন সকালবেলা হদর পাশ ঘেষে আবার যাত্রা শুরু হলো ওদের। দুপুর নাগাদ একটা জঙ্গলের পাশে তাঁবু খাটালো ওরা আবার। হ্রদটা এখানেই শেষ হয়েছে। জঙ্গল পেরিয়া একটা পাহাড় নদী পাওয়া যাবে। ওরা স্থির করলো আজ সন্ধ্যার আগেই নদী পেরাবে। দুপুরে খাওয়া সেরে খানিক বিশ্রামের পর সন্ধ্যার মুখে ওরা নদীতীরে এসে পৌঁছলো।
সন্ধ্যার কালিমা বেশ ঘন হয়ে আসছে দেখেও শহীদ বললো, ‘নদীটা আমরা এখুনি পেরোবো।’
মি. সিম্পসন ও কামাল আপত্তি করায় আর কিছু বলল না।
নদীর তীরেই তাঁবু খাটানো হলো। তাঁবুর আশপাশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো হিংস্র জন্তু-জানোয়ার যাতে না যেতে পারে সেজন্য।
সন্ধ্যার পরপরই আকাশে চাঁদ উঠলো নেকা রুটির মতো। গল্পগুজব করতে করতে হঠাৎ শহীদ বললো, ‘চাঁদের আলোয় তাঁবুর বাইরে গিয়ে প্রকৃতিকে একবার দেখবার লোভ হচ্ছে আমার। চলুন মি. সিম্পসন–ঘুরে আসি।’
মি. সিম্পসন শহীদের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বললেন, ‘আমি কিছুটা ক্লান্তি বোধ করছি, শহীদ। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস তো নেই।’
কিন্তু তুমি এখানে কি চাও?’ শহীদ হঠাৎ বললো।
শহীদের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালো কামাল। কিন্তু শহীদ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই তাঁবুর পর্দার একটা বিশেষ স্থান লক্ষ্য করে সজোরে হাতের উন্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করে বসেছে ততক্ষণে।
উপ!’
তাঁবুর বাইরে থেকে যন্ত্রণাকাতর একটা আর্তধ্বনি জেগে উঠলো। পরক্ষণেই একটা লোকের ছুটে পালিয়ে যাবার শব্দ শোনা গেল। ইতিমধ্যে শহীদও বের হয়ে গেছে তাঁবু থেকে। মি. সিম্পসন ও কামাল উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু শহীদ ফিরে এলো তখুনি গম্ভীর মুখে।
‘কে লোকটা?’ শো–১২
কামালই প্রথম প্রশ্ন করলো।
শহীদ বললো, ‘কথা বলতে বলতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পর্দার ফুটোয় চোখ রেখে একজন তাকিয়ে আছে ভিতরে। বাইরে বের হয়ে ব্যাটাকে ধরা যেতো না। পালিয়ে যে, তার আগেই। তার চেয়ে নগদ বখশিস দিয়ে বিদায় দেয়াই ভালো মনে হলো।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘কিন্তু, কি দেখছিল লোকটা?’
শহাদ বললো, ‘আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্যের সঙ্গ এ সব ব্যাপারের যোগাযোগ আছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্ভবত ওর। নিঃসন্দেহ নয়। হয়তো তাই খোঁজ-খবর সংগ্রহ করতে এসেছিল।’
‘বিপদের কথা! শত্রুপক্ষ আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আছে তাহলে। .
মৃদু হেসে শহীদ বললো, ‘বিপদের কথা হলও এতে আমাদের প্রচুর লাভ হবে। কেননা, আমাদের গন্তব্যস্থান সম্পর্কে মোটামুটি আমরা যা জানি তাতে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। শত্রুপক্ষ যতক্ষণ আমাদের অসুবিধার সৃষ্টি করবে। ততক্ষণ আমরা ভাববো যে, আমরা সঠিক পথই অগ্রসর হচ্ছি।’
‘মি, সিম্পসন শহীদের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তোমার বুদ্ধির মান চিরকালই উন্নত, শহীদ। আমি তোমার সঙ্গে একমত।’
চার
পরদিন সকালে নদী পার হওয়ার সময় সমস্যা দেখা দিলা একটা। পাহাড় নদী ভীষণ খরস্রোতা। এক-মানুষের চেয়ে বেশি গভীর। পানির নিচে উঁচু নিচু পাথর ছড়ানো আছে। ঘোড়াগুলো কোনমতে পার হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু, ঘোড়ার পিঠের মালপত্র কিংবা মানুষ পার হওয়ার সময় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেলিআনা।
| শহীদ কামালকে বলল, ‘তুই ঘোড়া নিয়ে নদীটা পার হয়ে যা। যদি দেখা যায় বে: তুই ভিজে গেছিস তাহলে মালপত্র পার করার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’
শহীদের আশঙ্কা কিন্তু মিথ্যা প্রমাণিত হলো। | ঘোড় নিয়ে নদীতে প্রথম নামলা কামাল। এবং নির্বিঘ্নেই পার হয়ে গেল সে। এরপর একে একে মি. সিম্পসন, সাকা খান ও অপর পুলিশ কর্মচারী রহমত খানও পার হয়ে গেল।
সবশেষে পার হওয়ার পালা শহীদের। নিরাপদেই পার হচ্ছিলো সে। এমন সময় রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো তার ঘোড়াটা। শহীদ হতবুদ্ধির মতো তাকালো কামালের পানে।
‘নেমে পড়, শহীদ!’ তা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো কামাল।
শহীদ এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে লাফিয়ে পড়লো নদীতে। তারপর দক্ষ সাঁতারুর মতো পানি কেটে এগোতে লাগলো তীরর পানে। ১২৬
ভলিউম-১
খরস্রোতা পার্বত্য নদী। বেশিদূর এগোনো যায় না ডুব সাঁতার দিয়ে। এক সময় মাথা তুলে পানির উপর উঠে এলো শহীদ। সঙ্গে সঙ্গে ওর বাম কানের পাশ দিয়ে ‘চুইই’ শব্দে একটা গুলি ছুটে গেল।
| ওদিকে মি. সিম্পসন, কামাল, সাকী খান আর অপর পুলিস কর্মচারিটিও বসে। নেই। তারা অপর তীরের একটা পাথরের চাঙর আড়াল লক্ষ্য করে অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলেছে। হঠাৎ ওপার থেকে আহত একজন মানুষের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ ভেসে এলো। তারপর হালাগুলির আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।
এদিক ডুব সাঁতার দিয়ে দিশেহাদ প্রায় তীরের কাছে পৌঁছে গেল। পানির তলা থেকে ভেসে উঠতেই কামাল ও মি, সিম্পসন তাকে সাহায্য করলো তার উঠত।
কামাল বললো, ‘তুই বলেই সতর উঠতে পাল। আমি হল ভেসে যেতাম। ‘ভেসে গেলে চলবে কেন?’ শহীদ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘মিরান নদীর এপারে এসে কোনো মানুষ কখনও নাকি ফিরতে পারেনি। এখন থেকে মাথার পিছনে একজোড়া করে চোখ রাখতে হবে
আমাদের।’
সেদিন সন্ধ্যায় ওরা আর একটা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলো। রহমত আর সাকী খান তাঁবু খাঁটিয়ে কিছুটা দূয়ে গিয়েছিল পানি আর কাঠ আনত। কিছুক্ষণ পর রহমত খান ফিরে এলো একা। তার চোখ-মুখ উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ Fট উঠেছে।
শহীদ তাঁবুর ভিতর বসে ল্যাম্পের আলোয় কুয়াশার দো ম্যাপটা দেখছিল। মি. সিম্পসন আর কামাল অদুরে বসে পুরানো কি একটা বিষয়ে তর্কে মেতে উঠেছিল।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে তাঁবুর ভিতর ঢুকলা রহমত খান।
‘কি ব্যাপার রহমত?’ শহীদই প্রথম জিজ্ঞেস করলো, তুমি অমন হাঁপাচ্ছো কেন?’
‘সর্বনাশ হয়েছে সাহেব! ‘মানে?’
‘সাকী খানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাঠ কাটার জন্যে ও জঙ্গলের ভিতর ঢুকেছিল। আমি পানি ভরা শেষ হতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ওকে আসতে না দেখে জঙ্গলের ভেতরে যাই ওর সন্ধানে।
তারপর?’ প্রশ্নটা করলেন মি. সিম্পসন। ‘তারপর জঙ্গলের ভিতর গিয়ে দেখি গাছ কাটার বড়ো ছুরিটা পড়ে আছে এক জায়গায়। কিন্তু, চারপাশের কোথাও সাকী খান নেই!
ভগ্নকণ্ঠ রহমত খান তার কথা শেষ করলো।
রহমত খানের কথা শুনে কঠিন হয়ে উঠলো শহীদের মুখ। তারপর ইঙ্গিতে কমলক তৈরি হতে বললো সে। মি. সিম্পসন স্যঙ্গ যেতে চাইলে ইঙ্গিতে মান।
করলো শহীদ। তারপর বললো, ‘তাঁবুতে আপনার থাকা দরকার। শয়তানরা কখন কি সুয়াগের অপেক্ষায় থাকে কে জানে! | ঘটাদেড়েক পর নিরাশ হয়ে ফিরে এলো শহীদ ও কামাল। ওরা আশা করেছিল হয়তো কোনো তাঁবু টাবু ওদের চোখে পড়বে। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু দেখতে পেলো না ওরা।
শহীদ বললো, ‘সার্কী খানের কোনো খোঁজ না পাওয়া গেলে যাত্রী আগামীকালের জন্যে বন্ধ রাখতে হবে। দিনের আলো তন্ন তন্ন করে না খুঁজে আমরা এক পা’ ও এগোবো না।
সাকী খানের জন্য সকলের মনেই একটা দুশ্চিন্তা জেগে রইলো সারারাত।
পরদিন সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহীদ ও কামাল বেরিয়ে পড়লো সাকী খানের খোঁজে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো ওদের। দুপুরের পর ঘর্মাক্ত কলবরে ফিরে এলো ওরা তাঁবুতে।
তাঁবুতে ফিরে ওরা পরস্পরের সঙ্গে কোনো বাক্য বিনিয়ম করলো না। গোটা তাঁবুটায় নেমে এলো একটা থমথমে ভাব।
সেদিন বিকেলের দিকে যাত্রা করে সন্ধ্যার পর আহারের জন্যে ওরা এক জায়গায় থামলো।
শহীদ বললো, ‘আমরা যে গতিতে এগোচ্ছি তাতে এ অভিযানের কোনো সার্থকতাই আশা করতে পারি না। এখন থেকে রাত্রিবেলাতেও এগোতে হবে। চাঁদের। আলো আছে, সুতরাং কোনো অসুবিধা হবে না।’
মি. সিম্পসন শহীদের কথায় সায় দিলেন।
খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রামের পর রাত ন’টার সময় আবার ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা শুরু করলো ওর।
কিছুদূর যেতেই চালাকিত উন্মুক্ত প্রান্তরের এক জায়গায় দুটো তাঁবু দেখতে পেলো ওরা দূর থেকে। সতর্ক হলো শহীদ তাঁবু দুটো দেখে। ঘোড়া থামিয়ে মোঠঘাটের। ভিতর থেকে একটা হালকা সাব-মেশিনগান বের করে নিজের কাছে রাখলো। যার যার রাইফেল এবং রিভলভার ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলো সকলে। শহীদ সাবধান করে দিলো অকারণে কেউ যেন গুলি না ছোঁড়ে। সকলের উদ্দেশ্যে বললো সে, ‘কিছু না বললে আমরাও কিছু বলবো না ওদেরকে। ওদের তাঁবুর কাছ দিয়েই যাবো আমরা।’ | একসার হয়ে ছুটলো ওরা। ওদের শব্দ পেয়েও কেউ বের হলো না তবু থেকে। কামাল বললো, ‘বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ছ ব’, মনে হচ্ছে লোকগুলো। এরকম বিপদজনক জায়গাতেও এতা নিশ্চিন্ত থাকলে কি করে এরা?’
কামালের কথার প্রত্যুত্তর দিলে না কেউ। কেউই জানতে পারলো না পাথরের আড়াল থেকে কয়েকজন লোক ওদের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
| তাঁবু দুটা ছাড়িয়ে খুব বেশিদূর যায়নি ওরা। শ’খানেক গাজ হবে হয়তো ১২৮
এগিয়েছে। এমন সময় চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো গোটা দলটা। একদল পাহাড়ী নেকড়ের হিংস্র ডাক শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলা ঘোড়াগুলো। চাঁদের আলোয় সকল দেখলো দশ-এগারোটা নেকড় দুর্দান্ত বেগে ছুটে আসছে ‘ওদের দিকে।
‘পিছু ছাড়বে না ওরা! সুযোগ মতো প্রথম গুলি করবো আমি, তারপর আর সকাল।
কথাটা সকলের উদ্দেশে বলে পিছনে চলে এলো শহীদ। তারপরই তার হাতের মেশিনগানটি গর্জে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আর সকলের রাইফেলও চারদিকের নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙচুর খান খান করে দিলো। প্রথম চোটই সাতটা নেকড়ের দফারফা হয়ে গেল। বাকি তিনটার একটা মি, সিম্পসনকে লক্ষ্য করে লাক দিতে কামাল সেটাকে শূন্যেই গুলি করে ভূপাতিত করলো। অন্য দুটো শহীদের মেশিনগানের গুলিতে আহত হয় প্রাণ নিয়ে ছুটে পালালো। ঘোড়াগুলো প্রাণভয়ে ছুটছিল এতক্ষণ ধরে। নেকড়েগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে শান্ত হয়ে পড়লো জানোয়ারগুলো। শহীদের নির্দেশ মোড় দাঁড় করালো সকলে। শহীদ কি মনে করে বললো, ‘নেকড়েগুলো ছিলো পোষা এবং আমাদেরকে ভোজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য লেলিয়ে দেয়।’
‘বলিস কি শহীদ! কিভাবে বুঝলি তুই বলতো।
কামালের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শহীদ বললো, ‘দাঁড়া এখানে, এখুনি আসছি আমি।’
| কেউ বাধা দেবার আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল শহীদ।
মিনিট তিনেক পর ফিরে এলো সে।
‘এই দেখ, সত্যি কিনা।’ কুকুরের গলার বকলেসের মতো একটা বকলেস বাড়িয়ে ধরে কামালের উদ্দেশ শহীদ বলে উঠলো।
| বকলেসটা হাতে নিয়ে দেখে কামাল বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য তো!’
মি. সিম্পসন কামালের হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে দেখতে দেখতে শহীদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করতে হয়, শহীদ। আমরা তো দেখতেই পাইনি চাঁদের আলোয় জিনিসটা। কিন্তু, কি করা যায় এখন, শহীদ? নেকড়েগুলোকে নিশ্চয়ই ঐ তাঁবু দুটো থেকে ছাড়া হয়েছিল। আমরা কি এখন ওদের কাছে গিয়ে এর
জন্য জবাবদিহি চাইব?’
ঘোড়া ছুটিয়ে দেবার আগে শহীদ চিন্তিত কণ্ঠে বললো, ‘সে সময় এখনও আসেনি বলে আমি মনে করি, মি. সিম্পসন। তবে এখন থেকে যে কোনো মুহূর্তে সে সময় আসতে পারে।
পাঁচ
ঝাড়া তিন ঘন্টা বিদ্যুণ্ডতিতে ছুটছে কুয়াশা। মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য। কোনদিক তবু
৯-কুয়াশী-১২
১২৯
ক্ষপ নেই তার। শুধু মাঝে মাঝে ঘোড়া থামি বিনকিউলারটা চোখের সামনে তুলে ধরে বহুদূর অবধি জরিপ করে নিচ্ছে সে। একবার চোখ থেকে বিনকিউলারটা সরিয়ে নি, ঘোড়ার পিঠে উত্তেজনাবশতঃ কয় এক চাপড় মারলো কুয়াশা। ঘোড়াটা আরও জোর, যেন ঝড়ের মতো উড়ে চলল। দূরবীন চখে লাগিয়ে আবার সামনে তাকালো কুয়াশা।
চোখমুখ তার সাফল্যর আনন্দে উজ্জ্বল হয় উঠছে। দেখতে গেছে সে একজন ঘোড়সওয়ারকে। আর ঘোড়সওয়ারের পিছনে একটি ছোটো ছেলেও তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
মিনিট তিনেক পর সম্মুখবর্তী ঘোড়সওয়ারটি পিছন ফিরে তাকালো শব্দ শুনে। একজন অপরিচিত মোড়সওয়ারক তার দিকে বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসতে দেখে চমক উঠলা লোকটা। শিউর উঠলো অজানা আশঙ্কায়। তারপর সর্বশক্তি দিবোড়াটা পিঠ উপর্যুপরি গোটাককে চাবুক ক গতি বাড়ি দিলো।
কুয়াশাও লক্ষ্য করলো ব্যাপারটা। মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁট। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলা অক্ষুট, পালাবি ভেবেছিস!”
ক্রমশই কম আসতে লাগলো কুয়াশা এবং ঘোড়সওরের মধ্যবর্তী ব্যবধান! ইতিমধ্যে কুয়াশা তার রাইকলটা বাগিয় করছ। আরও কাছাকাছি গিয়ে হৎ কুশ পশতু ভাষায় চিৎকার করে উঠলো, ‘ধাম।’’
পামলা ন| ঘোড়সওয়ার। উন্টে- বারংবার ঘোড়ার পি চাবুক হেন গোড়ার গতি বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠলো। কুয়াশা আবার চিৎকার করে উঠলো, ‘ভালো তো গানো-নইলে গুলি করবো।’
বৃথাই গেল কুয়াশার আদেশ। ঘোড়সওয়ারটি ঘোড়া থামাবার কোনে। চেষ্টাই করলো না।
ঘোড়সওয়ারের পিছনে বাবুল রয়েছে। এলোপাতাড়ি লি চালালে যে কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কতক্ষণ। একটা মাত্র হলি চালালে কুয়াশা ঘোড়সওয়ারের পাগড়ি লক্ষ্য করে। গুলি লেগে উড়ে গেল পাগড়িটা মাথা থেকে। মুহর্তের জন্যে চমক উঠলা ঘোড়সওয়ার, তারপর আবার ছুটত লাগলো যেমন ছুটছিল।
এবার ঘোড়ার পা লক্ষ্য করে গুলি চালালে কুয়াশা। অব্যর্থ লক্ষ্য। ঘোড়ার হাটুতে প্রবেশ করলা গুলি। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলি ঘোড়াটা। কুয়াশা দেখলা, ঘোড়সওয়ার ও বাবুলও ছিটকে পড়ে গেছে বালু।
অকুস্থলে কুয়াশা পৌঁছবার আগেই উঠ বসল৷ লোকটা। কিন্তু রাইলি বাগি ফায়ার করার আগেই কুয়াশা হাজির। গুলি করার সুযোগ না দিয়েই লোকটার উপর। ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়াশা। তারপর প্রচণ্ড ককটা ঘুসির অাঘাত ওকে অজ্ঞান কর? দাঁড়াল।
‘তোমার নাম বাবুল?’ কুয়াশা জিজ্ঞেস করলা। ১৩০
ভলিউম-১
অদ্ভুতদর্শন কালো পোশাক পরিহিত, বীরোচিত দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী একজন অসমসাহসী পুরুষকে এই জনমানবহীন মরুভূমিতে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে দেখে বাবুল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। অবাক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলে সে কুশাকে। তারপর সংবিত ফিরে পেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপনি?’
‘আমার পরিচয় পর জানতে পারবে, ভাই। আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি।’
‘কি ভাবে খবর পেলেন আপনি? সরাইখানার তাঁবুতে আমার লেখা দেখে বুঝি?’
‘হ্যাঁ, ভাই—তাই। বিপদে পড়েও তোমার বুদ্ধি খাটানোর মেধা দেখে আমি চমৎকৃত হরছি। এখন বলো দেখি, কি ভাবে তুমি এই শয়তানদের কবলে পড়লে?’
বাবুল কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘ছেলে ধরারা আমাকে ধরবার জন্যে ফাঁদ পেতেছিল তা ঠিক-কিন্তু ওরা আমাকে ধরতে পারেনি, আমিই ওদের হাত ধরা দিছি।’
কেন বলত! কুয়াশা বিস্মিত কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো।
সেই মুহূর্তে বাবুল কোনো উত্তর দিলো না। কি যেন একটা ব্যাপারে চিন্তিত সে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার! খুব বেশি হলে বারা। মুখ রোদে পুড়ে কালসিটে নের গাছ। চোখ দুটো তে ঢুকে গেছে দুশ্চিন্তায় অনাহার, পরিশ্রম।
হঠাৎ কাবুল বলতে শুরু করলো, আমি আর আমার একটা ছোট ভাই ঢাকার একটা হাই স্কুলে পড়তাম। আমার আব্বা নেই, আম্মা আছেন। আমার ভাইয়ের নাম শাকিল। শাকিল আমার চর দু’বছরের ছোট। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে শাকিল একটা লোক খেলনা পিস্তল কিনে দেয়, আর একদিন লোকটা শাকিল, দুটো পাখি কিনে দে রাস্তার একটা দোকান থেকে। আম্মা আর আমি শাকিলকে বকা-ঝকা করি অপরিচিত লোকের কিনে দেয়া খেলনা, পিস্তল আর পাখি নেয়ার জন্য। শাকিল বলে যে, লোকটা খুব ভালো। তাকে খুব ভালবাসে। আমি শাকিলকে তখন বলি লোকটার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। শাকিল লোকটার সঙ্গে আমার পরিচয়ও করিয়ে দেয়। লোকটা সেদিন আমাদের খেলার মাঠে নিয়ে যায়। চিনেবাদাম, ফুচকা খাওয়ায়। তারপর আমরা বাড়ি ফির আনি। এই ঘটনার ক’দিন পর স্কুল থেকে ফেরার পথ হারিয়ে যায় শাকিল। তন তন্ন করে খুঁজেও তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। সেই লোকটাকেও সেই থেকে আমি আর দেখতে পাইনি। না, ভুল হলো আমার, দেখতে পেয়েছিলাম লোকটাকে আমি আবার। মাস ছয়েক পর। লোকটার সঙ্গে দেখা হত আমাক শাকিলের কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি তাকে শাকিল যে হারিয়ে গেছে সে
কথা বললাম। লোকটা তখন খুব আফসোস করতে লাগলো। বললো, সে দেশে গিয়েছিল– তাই এতদিন শাকিলের খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। শাকিলের কথা বলতে বলতে লোকটা আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে এমন মনে হচ্ছিল। আমার কিন্তু, নিশাি-১২
১৩১
লোকটাকে তখন থেকেই কেমন সন্দেহ হতে আরম্ভ করে। আমি কথা বলতে বলতে লোকটার সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করি। কিছুটা রাস্তা হাটবার পর লোকটা হঠাৎ আমাকে বললো, ‘শাকিলকে খুঁজে বের করার জন্যে কি কি করেছে?’ আমি বললাম, ‘করতে আমরা কিছুই বাকি রাখিনি। থানায় ডায়েরী লেখান থেকে আরম্ভ করে রেডিওতে খবর দেয়া পর্যন্ত সবকিছুই করা হয়েছে। আমি নিজে ভাইয়ের খোঁজে কতো সকাল-দুপুর বিকেল যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। লোকটা তখন বললো, ‘আমার এক বন্ধু আছে, সে হারানো লোকের খোঁজ বলে দিতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শাকিলকে খুঁজে দিতে পারবে?’ লোকটা বললো, ‘নিশ্চয়ই পারব। আমার বন্ধু পারে না এমন কাজ খুব কম আছে।’ শাকিলের আবার ফিরে পাওয়া যাবে সেই আনন্দে তখন আমি লোকটা বদমায়েশ হতে পারে এ-কথা একদম তুলে বসে আছি। লোকটা বললো, ‘আমাদেরকে একটা বাড়িতে যেতে হবে সন্ধ্যের পর। আমি লোকটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। তখন লোকটা আমাকে অন্ধকার গলির ভিতর একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে চা খেতে দিলো লোকটার বন্ধু। চা খাওয়া শ্যে হওয়ার আগেই আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরলো যখন তখন আর লোকটাকে দেখতে পেলাম না। জায়গাটাও কেমন অচেনা ঠেকলো..|
কুয়াশা এতক্ষণ পর বলে উঠলো, ‘থাক ভাই, সব কথা শুনতে গিয়ে তোমাকে আর কষ্ট দেবো না। এরপর কি ভাবে তুমি এখানে পৌঁছেছে তা আমি অনুমান করেই বুঝতে পারছি। তুমি হয়তো জানো না যে, তুমি এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি দুর্গম এলাকায় রয়েছে। আরও বহুদূরে তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। শুধু তোমাকেই নয়, তোমার মতো শতশত ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে শয়তানরা বন্দী করে রাখে একটি দুর্গ। সে-সব ছেলেদের মধ্যে কাউকে অন্ধ করে, কারও শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়, তারপর তাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। বাবুল, তুমি জিজ্ঞেস করছিলে কে আমি? আমি ওই শয়তানদের যম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি প্রতিদিন দিগ্বিদিক ছুটছি।’
হঠাৎ চুপ করলো কুয়াশা। বাবুল কুয়াশার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রদ্ধাপূর্ণ কণ্ঠে বললো, ‘আপনি এখন আমাকে নিয়ে কি করবেন, ভাইয়া?
কুয়াশা বললো, ‘আমি এখন তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো।’
কোথায়? ‘দুর্গের পথ অনুসন্ধান করতে।
বাবুল বললো, ‘তাহলে তো আমাদের বেশ দেরি হয়ে যাবে, ভাইয়া। তার চেয়ে এই লোকটার সঙ্গে যদি যাই তাহলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবো। লোকটা। নিশ্চয়ই পথ চেনে দুর্গের।
‘সত্যি, খব খাঁটি কথা বলেছে।’ ১৩২
.
‘কিন্তু আমি তো, ভাই, এ ভাবে যেতে পারি না, কুয়াশা এক মুহূর্ত থেমে আবার বললো, আমাকে যে অনেক তোড়জোড় করে যেতে হবে। আমার তো কর্তব্য একটা নয়, হাজারটা। কখন কোন কর্তব্যের উকে ছুটতে হয় তার কোনো ঠিক আছে? বরং যদি সাহস না হারাও তবে তুমি যাও এই লোকটার সঙ্গে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি যখন তোমাকে যেতে বলছি তখন তোমার ভালমন্দের সব দায়িত্ব আমারই। যদি তুমি যেতে রাজি থাকে তাহলে কয়েকটা কথা তোমাকে এখুনি বুঝিয়ে দিচ্ছি।’
বাবুল বললো, ‘আপনার কথায় ভরসা করতে আর ভয় কি। আমি যাবো।’
বাবুলের কথা শুনে কুয়াশা পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা দেশলাইয়ের মতো দেখতে যন্ত্র বের করে বাবুলের হাতে দিলো।
‘এটা একটা খবর পাঠাবার যন্ত্র, কুয়াশা বললো, ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন এটার চাবি টিপে মুখের কাছে ধরে তুমি যখন যা বলবে আমি শুনতে পাবো। আর এই যে বোতামটা খুলছে এর মাথায়, এটি কানের কাছে ধরলে আমি যা বলবো তোমাকে তুমি তা ঠিক শুনতে পাবে, বুঝছো?’
বাবুল মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর কুয়াশা বাবুলের হাতে প্রয়োজনীয় আরও কয়েকটা জিনিসপত্র দিয়ে বুঝিয়ে দিলো কিভাবে এগুলো ব্যবহার করতে হয় এবং কখন ব্যবহার করবে–ইত্যাদি।
বাবুল বললো, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু লোকটার যে এখনো জ্ঞান ফিরলো না। আহত ঘোড়াটাও তো আর ছুটতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।’
| কুয়াশা বললো, ‘তার জন্য চিন্তা কি, বলে দিচ্ছি কি করতে হবে। দেখো, আমি কিছুটা দূরে একটা বালিয়াড়ির আড়ালে আমার ঘোড়াটা রেখে আসি। আর খোঁড়া ঘোড়াটিকেও রেখে আমি অন্য আর একটা বালিয়াড়ির আড়ালে। আমি নিজে খানিকটা দূর বালিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকো মড়ার মতো। তারপর লোকটার জ্ঞান কিরলে তাকে তুমি বলবে যে, আমি যখন তোমাদের জিনিসপত্র লুঠ করতে ব্যস্ত ছিলাম তখন অনেকগুলো ঘোড়সওয়ার আমাকে মারধর করে আমার সব জিনিস নিয়ে চলে যায়। কিন্তু ঘোড়ার ব্যাপারে অন্য কথা বলবে। যেদিকে আমার ঘোড়াটা আমি রেখে আসবে সেদিকটা দেখিয়ে বলবে ভালো ঘোড়াটা পালিয়ে গেছে দস্যুদের অজান্তে। আর খোঁড়া ঘোড়াটা নিয়ে পালিয়েছে দস্যরা।
একমুহূর্তের জন্য থেমে কুয়াশা আবার বললো, ‘এই নাও- এই জিনিসটা লোকটার নাকের কাছে ধরলই ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
| বাবুল কুয়াশার হাত থেকে শিশিটা নিতে কুয়াশা তার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমার উপর ভরসা রেখো, ভাই, আমার উপদেশ মতো সব কাজ করা।
‘আপনার প্রতিটি কথা আমার মনে থাকবে, তাইয়া। শ্রদ্ধা বিজড়িত কণ্ঠে বললো বাবুল।
কাশী-২
১৩
ছয়
সেদিন রাত আটটা নাগাদ সোড়া ছুটিয়ে প্রায় পনেরো মাইল পথ অতিক্রম করলে। শহীদরা। পথে কোনরকম উল্লেখ্যযোগ্য কিছু ঘটলো না। পরদিন সকাল দশটার যাত্রা শুরু করে দুপুর নাগাদ আর মাত্র মাইল বিশেক পথ অতিক্রম করতে পারলো ওরা। ভীষণ দুর্গম পথ, উঁচু-নিচু পাথরের বাবা অগ্রাহ্য করে ঘোড়া খুবই মন্থর গতিতে এগোচ্ছিল। মাঝ রাস্তায় একবার থামতেও হলো। মি, নিষ্পসন ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছিলেন। অবশ্য খানিকটা ব্যাপ্তি পান করে দ্রুত চাঙ্গা হয়ে উঠছিলেন তিনি। কিন্তু দুপুরের পর যাত্রা স্থগিত রাখতে হলো। মি. সিম্পসন নতুন একটা বিপদে কাহিল হ্যর পড়েছিলেন। একটা চোখ তাঁর বেশ ফুল উঠছে। বিষাক্ত পোকা পড়েছিল চোখে। আই অয়েন্টমেন্ট লাগানো সত্ত্বেও ফোলাটা কমলা না। শহীদ বললো, ‘রাতের মধ্য মি, সিম্পসন সুস্থ হয়ে উঠল আবার যাত্রা শুরু করা যাবে। আর মাত্র মাইল পাঁচক পরই
আমরা মরুভূমিতে গিয়ে পড়বে। মাঝখানে আর একটা মাত্র পাহাড় আছে।’
সেদিন রাত তিনটের পর থেকে পাহারা দেবার ভার নিয়েছিল শহীদ। তার আগে পাহারা দেবার কথা ছিলো কনস্টেবল রহমত খানের। ঠিক তিনটের সই ঘুম ভাঙলো শহদের। ঘড়ি দেখে কুচকে উঠলো তার। রহমত খান তাকে জাগিয়ে দেয়নি কেন?
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লা শহীদ। বাইরে কাউকে দেখতে না পেরে কঠিন হয়ে উঠলো শহদের মুখ। শহীদ দু’বার ডাকলো রহমত খানের নাম ধরে। কিন্তু কোনদিকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। | আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ, এমন সময় কামাল বের হয়ে এলো তার ভিতর থেকে। শহীদের মুখে ব্যাপারটা শুনে কামাল বললো, ‘রাত ঠিক একটার সময় আমি ওকে এখানে বসিয়া তাঁবুর মধ্য ফিরে যাই। এর মধ্যে গেল কোথায় লোকটা?’
শহীদ বললো, ‘তোর হাতের টর্চটা জ্বাল তো দেখি। হয়তো কোনো বস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যাবে।’
টর্চের আলোয় ধস্তাধস্তির চিহ্ন কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে পড়লো ওদের। অস্বাভাবিক গম্ভার হয়ে উঠলো শহীদের মুখ। কামালের উদ্দেশে সে বললো, ‘আর চুপ করে থাকা যায় না রে। তুই এখানেই দাঁড়া, আমি মি. সিম্পসনকে জাগিয়ে দিয়ে আসি।’
তাঁবুতে ঢুকে মি, সিম্পসনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাকে সব কথা বলে নিজের ব্যাগ খুলে দু’একটা জিনিস নিয়ে বের হয়ে এলো শহীদ। তারপর কামালকে সঙ্গে নিয়ে টর্চের আলো ফেলে কোল রওনা হলা শত্রুর সন্ধানে। প্রায় আধঘন্টাটাক খোঁজাখুঁজির পর একটা তাঁবু দেখে সন্তর্পণে এগোলো ওরা। পাথরের আড়ালে আড়ালে থেকে তাঁবুটার। ১৩৪
ভলিউম-১
একেবারে কাছাকাছি গিয়ে চমকে উঠলো শহীদ। কামালের উদ্দেশ্যে গম্ভার কণ্ঠ নে। বললো, ‘ওনলি?’
| ফিসফিস কণ্ঠে কামাল বললো, রহমত খানকে ওরা মেরে ফেলছে বোধহয়। মৃত্যুযন্ত্রণাতে ছটফট করলেই এমন চিৎকার শুধু মানুষের কষ্ট থেকে বের হতে পার। এখুনি কিছু একটা করা দরকার, শহীদ।
চাপা গলায় প্রশ্ন করলা শহীদ, ‘কোনো পাহারাদার দেখা যাচ্ছে না, না?’
কামাল বললো, ‘না।’
পাথরের আড়াল থেকে বের হয় নিঃশব্দ এগোতে লাগলো শহীদ। তাঁবুর একেবারে সামনে পৌঁছে রহমত খানের চিৎকার আর শোনা গেল না। অজানা আশঙ্কায় শক্ত হয়ে উঠলো “ই: মুখ। তাঁবুর দুটো ফুটা খুঁজে নিয়ে ভিতরে তাকাতে ভয়াবহ নিষ্ঠুর একটা দৃশ্য দেখে আপদিমস্তক শিউরে উঠলা শহীদ ও কামালের। পরক্ষণেই চোখ সরি নি ওরা দুজন দুজনের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো। রহাত খানের দুটো চোখ দুটো উত্তপ্ত লাল শিক প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়ছ, দুটা গালের চামড়া ছোরা দি ফালা ফালা করা হয়েছে, ভীষণ কুৎসিত হয়ে উঠছে সদ্যমৃত রহমত খানের মুখটা।
‘জ্বালিয়ে দেবো!’ দত দাঁত চেপে বললো শহীদ। তার মুখটা ঘৃণায়, যন্ত্রণায়, বিরতি কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছিল।
কথাটা বলে কামালের হাত ধরে তাঁবুটা থেকে কিছুটা দূরে সরে এলো শহীদ। তারপর তাঁবু থেকে নিয়ে আসা গোল বলের মতো একটা জিনিস বের করলো পকেট থেকে। বলটা হাতের তালুতে রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন খুজলা ওটার মধ্যে। ক’ মুহূর্তের মধ্যেই সুইচটা নজর পড়লো ওর।
| আর দেরি না। মুঠোর মধ্যে বলটা ধরে বুড়ো আঙুলর চাপে সুইচটা টিপে ছুঁড়ে মারলা সেটা শক্র তালুর উপর।
তাঁবুর উপর গিয়ই পড়ল গোলাকার বস্তুটা। সঙ্গে সঙ্গে, যেন চোখের পলকে, জ্বলে উঠলো তাঁবুটা। ধীরে ধীরে আগুনের বিরাট কুণ্ডলী ঘিরে ধরলো তবুিটাকে।
তাঁবুর ভিতর হুলস্থল শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা লোক ছিটকে বেরিয়ে এলো তাঁবুর ভিতর থেকে।
একটু পর আরও দুজন বেরিয়ে এলো তার ভিতর থেকে টলতে টলতে। একজনের মাথার খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে, দুহাত মাথাটা চেপে ধরে আছে সে। আর একজন অন্ধের মতো দুহাত সামনে মেলে ধরে গোঙাচ্ছে উন্মাদের মতা। মনে হয় লোকটার চোখমুখ পুড়ে গেছে।
ইতিমধ্যে ধসে পড়েছে তাঁটা। কামাল চাপা কণ্ঠে বললো, ‘গুলি করে মারবো নাকি শয়তানগুলোকে!’
শহীদ একটা হাত তুলে বলল, ‘খবরদার! পাগলামি করি না।’ কুণা-১২
১৫
লোকগুলো ইতিমধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়েছে।
ভস্মীভূত তাঁবুটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শহীদ ধীরে ধীরে বললো, ‘বেচারা রহমত!’
‘কিন্তু রহমতকে ওরা খুন করলো কেন?’ কামাল যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এমন কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো শহীদের দিকে তাকিয়ে।
‘খুব সম্ভব ওরা রহমতর কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছিল। রহমত হয় তা মুখ খোলেনি, তাই এতো অত্যাচার-এমন বীভৎস মৃত্যু!’
রহমতের তুলনা হয় না,’ বললো কামাল।
পরদিন সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগেই একটা পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলো ওরা। পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে শহাদ বিমর্ষ কণ্ঠে বললো, ‘সর্বনাশ হয়েছে, মি. সিম্পসন। আমরা পথ ভুল করেছি।’
মি. সিম্পসন বা কামাল, কারা মুখেই কোনা কথা জোগালো না। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকি রইলো ওরা দুজন শহীদের দিকে।
শহীদ পকেট থেকে কুয়াশার দেয়া ম্যাপটা বের করে গভীর মনোযোগ সহকারে সেটার উপর মিনিট দুয়েক দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আবার সেটা পকেটে রেখে দিলো। তারপর বললো, ম্যাপে উল্লেখ না থাকলেও পাহাড় থাকা অসম্ভব না হয়তো। কিন্তু এই পাহাড়ের ওপর কিছুদূরর মধ্যে মরুভূমি না থাকলে ধরে নিতে হবে ভুল পথে চলেছি আমরা। একটা কুট নোট কুয়াশা সে কথাই উল্লেখ করছে।’
এতক্ষণ মি. সিম্পসন বললেন, ‘তবে, পাহাড় টপকে ব্যাপারটা দেখে আসতে
হব?’
| শহীদ বললো, তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কেননা, উত্তর দিক বরাবর যাচ্ছি আমরা। আনুমানিক গন্তব্যে পৌঁছবার জন্যে অনেকগুলো দিক আছে। তবু বলা যায় না, আমরা ঠিক পথেই চলেছি কি না।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘সন্ধ্যের আগেই আমরা পাহাড়ের ওপারে পৌঁছে যাবে। তারপর ওখানেই তাঁবু খাঁটিয়ে তথা সংগ্রহ করা যাবে।’
শহীদ বললো, ‘হ্য। আজ রাতের মধ্যেই আমি আর কামাল জেনে নেবে। ব্যাপারটা। আপনি তালুতই থাকবেন।’
সাত
সন্ধ্যা রাতে দুটো ঘোড়ার পিঠে চড়ে বের হয়ে পড়ল৷ শহীদ ও কামাল। ঘন্টাখানেক ঘোড়া ছোটাবার পর উক্ত মরুভূমির দেখা পাওয়া গেল।
পথের চিহ্নগুলো ভালো করে মনের পর্দায় গেথে নেয়ার জন্য বেশ খানিকক্ষণ ঘুরে
১৩৬
ভলিউম-১
ফিরে দেখে নিলো ওরা চারপাশটা।
ফেরার পথে শহীদ বললো, ‘পথ ভুল হয়নি আমাদের। সামনে যে মরুভূমিটা রয়েছে ওটাই শেষ। এর কোনো না কোনো জায়গায় শয়তানদের দুর্গাটা আছে।’
| মোড়। তখনও ছুটতে শুরু করনি ওদের। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে কাছাকাছি একটা পাথরের চাঙর আড়াল থেকে কাদের যেন রাইফেল গর্জে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঘোড়া দুটো মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। আচমকা বিপদে পড়ে তাল সামলাতে পারলো না ওরা, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। দুজনের রাইফেল ছিটকে পড়লো দুরে।
মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো শহীদ প্রথম, তারপর কামাল। উঠে দাঁড়িয়েই পিস্তলের জন্যে পকেটে হাত ঢোকালো ওরা।
‘যাণ্ড স আপ!’ | হতবাক হয়ে গেল ওরা। সামনে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারলো না দৃশ্যটাকে। দুজনেই ধীর ধীর পকেট থেকে হাত বের করে মাথার ওপর তুললো।
প্রায় পঁচিশজন ঘোড়সওয়ার যেন মাটি ফুড়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যকের হাতেই রাইফেল, চাঁদের আলোতে নলগুলো চকচক করছে।
পাঁচজন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ঘোড়া থেকে নেমেই দুজনের পকেট থেকে পিস্তল দুটো বের করে নিলো। কামাল আপত্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু শহীদ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে ইশারায় নিরস্ত করলা।
| লোকগুলো এবার মাটিতে পড়ে থাকা ওদের রাইফেল দুটো তুলে নিয়ে দুজনকেই পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। এরপর সামনে, পিছনে, ডাইন, বাম পঁচিশজন ঘোড়সওয়ার ওদেরকে ঘিরে চলতে শুরু করলো।
ঘন্টাখানেক চলার পর লোকগুলো ওদেরকে নিয়ে একটা গুহায় প্রবেশ করলো। গুহাটার দেয়ালে নানান ধরনের অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক কোণে মশাল জ্বলছে। গুহার মেঝেটা সমতল। যার যার বিছানা পাতা।
গুহায় ঢুকে কামাল শহীদের উদ্দেশ্যে মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা লোক কামালের পিঠে কষে এক থাপ্পড় মারলো।
‘খবরদার: শহীদ গর্জে উঠলো।
শহীদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে কেউ বিশেষ খেয়াল করলা না তার দিকে। সকলের মাঝখান থেকে কদর্য চেহারার একটা লোক শহাদের সামনে এসে দু’পা কি। করে কোমর হাত রেখে দাঁড়ালো। তারপর পশতু ভাষায় চিবিয়ে চিবির বললো, আমরা কে সে কথা জানার ইচ্ছা আর একবার প্রকাশ করলে মাথার মগজ বের করে নেবা! তোমরা কে সেটা আমাদের জানা হয়ে গেছে, সুতরাং আর কোনো প্রশ্ন নয়। সৌভাগ্য তোমাদের, তোমাদেরকে সাজা দেবার ভার আমার হাতে নেই। নইল, কয়েকটা নমুনা দেখাতে পারতাম।’
১৭
কতো রাত কে জানে। ঘুমিয়ে পড়েছিল শহীদ ও কামাল। হঠাৎ একটা ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল শহীদর। পরক্ষণেই টের পেলো সে, তার বাঁধন কে যেন মুক্ত করে দিয়েছে। হঠাৎ গুহার মুখের দিকে চাখ Fেলত শহীদ অবাক হয়ে দেখলো একজন লোক নিঃশব্দে বের হয় চাল তার দিকে মাত্র পলকের জন্য তাকিয়ে। গুহার চারদিকে মাথা উঁচু করে পরখ করে নিলো শহাদ। তারপর কামালের হাত-পরে বাধন খুলে দিতে তৎপর হয় উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কল বন্ধন মুক্ত হলো। ঘুম ভেঙছিল তার আচাই। দু’জনেই উঠে দাড়ি গুহার মুখের দিকে অতি সন্তর্পণে এIাতে লাগলো ঘুমন্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটি। | নির্বিঘ্নেই গুহার বাইরে এসে পৌঁছালো ওর। বের হয়েই অবাক হলো তারা। কিছুক্ষণ আর লোকটা বের হয়েছিল গুহা থেকে তার কোনো চিহ্ন নেই কোনদিকে। কিন্তু দুজন লোক ঢলে পড়ে রয়েছে গুহার সামনে।
আকাশে চাঁদ নেই। তারার আলোয় পথ চেনা দায় হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় দিশেহারার মতো দাঁড়ি রইলা রো, কিন্তু, সে মাত্র কক মুহূর্তের জন্য। তারপরই অন্ধকারে দ্রুত ছুটতে শুরু করলো।
মাত্র কয়েকশ’ গজ এগিয়েছে এমন সময় ভয়ানক একটা শোরগোলের আওয়াজ উদ কানে এল। জানতে পেরেছে দুর্বলের তাদের শিকার পালিয়েছে।
অন্ধকারে পথ স্পষ্ট নয়। একেবারে ঘুটঘুঁটে নিকষ কালো অন্ধকার না হলেও যে কোন মুহূর্ত পাথর হোঁচট খে, ছিটকে পড়া অসম্ভব নয়। তবু প্রাণপণে ছুটছে, দুজন। পিছন ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বহু লোকের হৈ-হল্লার শব্দও আসছে কনি। কিন্তু তবু অন্ধকারের ভিতর ওৎ পেতে থাকা বিপদকে অগ্রাহ্য করে মরিয়া হয় ছুটছে ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে।, এক সময় ঘোড়ার পায়ের শব্দ যেন একটু পিছিয়ে গেল বলে মনে হলো ওদের। মনে মনে স্বস্তি অনুভব করলো ওরা। মিনিট কুড়ি এই ভাবে ছুটে চললো ওরা। তারপরই ভয়ানকভাবে চমকে উঠ থমকে দাঁড়ালো শহীদ। শহীদের দেখাদেখি কামালও দাঁড়িয়ে পড়লো।
সর্বনাশ হয়েছে, কামাল! পথ ভুল করছি আমরা!”
খরস্রোতা পার্বত্য নদীর খল খল শব্দ শুনে শহীদ নিরাশ কণ্ঠে আবার বললো, ‘নদী এলো কোথা থেকে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘া করবার এখুনি কর, শহীদ।’ কামাল বললো অস্থির কণ্ঠ। ‘পিছনে ঘোড়ার পার শব্দ পাচ্ছি আবার। মনে হচ্ছে এ দিকেই আসছে।’
‘নদী পেরোনো ছাড়া কোন উপায় নেই।’
সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেই ছুটলে। শহীদ। কিছুদূর গিয়ই নদীটার দেখা পেলো ওরা। ভাষণ খরস্রোতা নদী। সাঁতার কিংবা হেট পার হওয়া একেবারেই অসম্ভব। ১৩৮
ভলিউম-১
‘পাথরের উপর পা দিয়ে দিয়ে পেরুত হব।’
শহীদের কথা শেষ না হতেই একটা ছোটো লাফ দিয়ে পানির উপর একটা পাথরের উপর গিয়ে দাঁড়ালো কামাল।
এগিয়ে আসছে লোকগুলো। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাটি কাঁপছে। উত্তেজিত কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে তাদের।
নদাটা বেশ চওড়া। ওপার পৌঁছবার আগেই হয় তা ধরা পড়ে যাবে ওরা! |
বেশ খানিকটা এগিছিল কামাল। শহীদও কামালের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগোচ্ছিল। এমন সময় তিন চারটি টর্চের তীব্র আলো ওদের উপর এসে পড়লো। সন্ধানী লাকগুলোর মধ্যে উল্লাসের সাড়া জেগে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কর একট। দুর্ঘটনা ঘটে গোল।
দ্রুত একটা পাথর থেকে অন্য একটা পাথর লাফ দিতে গি; পা ফসকে ঝপ করে নদীর তীর স্রোতে পড়ে গেল কামাল। পড়েই ভেসে চললো একটা খড়কুটোর মতো। প্রতি মুহূর্ত আশঙ্কা হচ্ছিল। তার এই বুঝি কোনো পাথরর সঙ্গে ধাক্কা লেগে। হাড় চোড় ভেঙে যায়।
বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল শহীদ। কামালকে তার নদীর স্রোত ভোসতে দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। কি করবে না করব ভেবে স্থির করতে পারছিল না সহসা। সংবিত কির এলো যখন তার, তখন ছুঁড়ে দেয়া ল্যাসার একটা কাল তার গলায় এট বলছ।
আবার বন্দা হলো শহীদ। সকল হত তখন আর ঘটাখানেক বাকি আছে।
সকাল দশটার মধ্যেই “ইদকে আবার সেই গুহা এন হাত-পা বেধে Fেল রাখলো দুবৃত্তগুলো। দশটার দিকে একজন আগন্তুক গুহার ভিতরে প্রবেশ করলো। লোকটাকে দেখে রীতিমত চমকে উঠলা শহীদ। বিস্ময়ের সামা-পরিণীমা রইলা না তার। আবদান! আবেদান এখানে কেন! কি ভাবে সে এলো এখানে?
আট
ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলো শহীদের। সটাং ঘটাং প্রচও একটা শব্দ কান তালা লাগার দশা হলো তার। অবিরাম শব্দর সঙ্গে মেঝের বেলে রাখা শরীরটাও কাঁপছে অবিরত। বাতাসের অপ্রাচুর্য শ্বাস নিতে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। নড়াচড়া করার জায়গাও নেই কোনদিকে। স্মরণ করার চেষ্টা করলো শহীদ জ্ঞান হারাবার পূর্বের ঘটনাগুলো। আবেদীন তাকে দেখে ব্যঙ্গর হাসিতে ভরি তুলেছিল মুখ। তারপর বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে তোমাকে যমের বাড়ি নিয়ে যাবো আজ, মি. শহীদ। সেখানে তোমার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তার আগে নরকযন্ত্রণা অবশ্য প্রাপ্য তোমার।’
শহীদ ক্রোধে চিৎকার করে উঠেছিল বাঘের মতো, অতি বাড় বেড়েছে৷ তুমি, কুণা-১২
আবেদীন! ভেলছে অন্যায়ের সাজা থেকে তুমি পার পাবে? আমার জন্যে নয়, তোমার জন্যেই মৃত্যুদণ্ড ঝুলছে আইনের হাতে।’
শয়তান আবেদীন শহীদের কথা শেষ হতে গলা ফাটিয়ে হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বললো, ‘বন্দার সঙ্গে কোন রকম কথা বলাই আমাদের মানা আছে, মি, শহীদ। সুতরাং কথা না বলে কাজ করি।’
কথা ক’ টি বল হাতে ধরা একটা সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল আবেদীন। শিউরে উঠেছিল শহীদ মনে মনে কি একটা অজানা আশঙ্কায়। জোড়া পা দিয়ে কম একটা লাথি ছুঁড়েছিল সে আবেদীনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু লাগেনি। তারপর তিন চারজন লোক তাকে ধরে বাহুতে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করেছিল। এর কিছুক্ষণ পর
ইদের আর কোনো কিছু স্মরণ নেই।
ঘটাং ঘটাং শব্দটা কিসের তা বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে পড়লো শহীদ। ট্রেন! ট্রেন এলো কোথা থেকে কতক্ষণ তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল? মরিয়া হয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করল। শহদ। হাত-পা বাঁধন নেই বুঝতে পারলো সে। কিন্তু উঠ বসতে পারলো না তবু। চেষ্টা করতেই ঠক কর মাথায় আঘাত লাগলো। হাত তুলে
. চারপাশটা অনুভব করলো শহীদ। তারপরই বুঝতে পারলো একটা ট্রাঙ্ক বন্ধ করে রাখা হয়ছে তাকে। সমস্ত শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে দর দর করে। বাতাসের অভাবে দম বন্ধ হবার জোগাড়। ট্রাঙ্কের মধ্যে কয়েক জায়গায় মাত্র ফুটো করা আছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। কোনরক একটা হাত কোমরের কাছে নিয়ে গেল সে। তারপর প্যাটের ভিতর হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে কুয়াশার দেয়া প্রচণ্ড শক্তিশালা লোহা চালানোর টর্চটা বের করে আনলো। অতি কষ্ট পাশ ফিরে যন্ত্রর সুইচটা অন্ কর দিয়ে ট্রাঙ্কের উপর দিকের একটা কোণ ধরলো। চোখ ধাঁধানো তীর নীল আলোয় চোখ বন্ধ করল৷ শহীদ। তারপর যন্ত্রটা একদিক থেকে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো প্রাণপণ চেষ্টায়।
| দশ মিনিটের মধ্যেই কাজটা শেষ হলো শহীদের। প্রচণ্ড গরমে ঝলসে গেছে যেন সে। কয়েক মিনিট মড়ার মতো পড়ে থেকে বিশ্রাম নিলো। তারপর ট্রাঙ্ক থেকে মাথা বের করে তাকালো চারদিক।
রাত। ট্রেনের কামরায় বাতি জ্বলছে। আবেদীন ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দেখতে পেলো না
শহীদ কামরায়। উপরের একটি বার্থ নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আবেদীন। নিঃশব্দে সম্পূর্ণ শরীরটা বের করে আনলো শহীদ ট্রাঙ্ক থেকে। তারপর আবেদীনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগলো কি যেন। | টেটা ছুটে চলছে উদ্দাম গতিতে। কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করলো শহীদ। চাঁদের আলো বুঝতে পারলো সে, একটা পাহাড়ী এলাকা দিয়ে ছুটছে টেনটা। ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেললো শহীদ। দরজার পাশেই
১৪ ০
ভলিউম-১
রাখা ভাঙা ট্রাঙ্কটা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। রাতের বুকে তুফানের মতো ছুটন্ত ট্রেনের শব্দ অন্য সব শব্দকে দমিয়ে দিচ্ছে। কেউ জানতে পারলো না ব্যাপারটা। মিনিট দশেক পর ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে আসছে বুঝতে পারলো শহীদ। তৈরি হয়েই থাকলো সে। টুন একটা স্টেশনে থামতেই দ্রুত নেমে পড়লো। স্টেশনটির নাম পড়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলা প্ল্যাটফর্ম। অনুমান করে বুঝতে পারলো সে, হায়দারাবাদ আর ঘন্টাখানেকের পথ। দু’মিনিট পরই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করলো। সংবিত ফিরে পেয়েই দৌড়ে একটা কামরার হাতল ধরে উঠে পড়লো। শহীদ। তারপর দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা এটা। চার পাঁচজন লোক ঘুমিয়ে আছে। শহীদ একটা বার্থে উঠে শুয়ে পড়ে ভাবনার অতলতল তলিয়ে গেল।
ভোর পাঁচটায় ট্রেন হায়দারাবাদ পৌঁছুলো। তবুও ট্রেন থেকে নামলো না শহীদ। জানালা দিয়ে আবেদীনের কামরাটার উপর নজর রাখলো। টেন সম্পূর্ণ থামার আগেই হন্তদন্ত হয় আবেদীনকে নামতে দেখলো শহীদ। প্ল্যাটফর্মের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত আবেদীন খুব খানিকক্ষণ খোঁজাখুজি করলো শহীদকে। তারপর নিরাশ হয়ে শুকনো মুখে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লা। ট্রেনের সব মানুষ ইতিমধ্যে নেমে। গেছে। উল্টো দিক দিয়ে নেমে যুর প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলো শহাদ। দূর থেকে আবেদীনের উপর দৃষ্টি রেখে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। কয়েক মিনিট পর আবেদন বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে কি যেন জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার ফিরে এসে বসলো বেঞ্চিটায়। কি মনে করে শহীদও টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন লোক কাউন্টারে ঝিমোচ্ছে ঘুমের নেশায়। গলা খাঁকারি দিয়ে শহীদ বললো, ‘ও মিস্টার, পূর্বদিকের ট্রেন ক’টার সময় বলতে পারেন?
বললাম তো একবার, বেলা দশটার দিকে ট্রেন নেই। ঘুম কাতুরে লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো।
| হেসে ফেলে শহীদ বললো, ‘ভুল করছেন আপনি, এর আগে আমি আপনাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করিনি।’
এতক্ষণে ঘুমের নেশা কাটিয়ে শহীদের দিকে তাকালো লোকটা। তারপর বললো, মাফ করবেন, আমি মনে করেছিলাম আপনারা দুজন একই লোক। আর একজনও আপনার মতো এ প্রশ্ন করে তোলেন কিনা একটু আগে। তা আপনি কোথায় যেতে চান?
প্রশ্ন কর লোকটা শহীদের উদ্দেশ্যে তাকালো। কিন্তু শহীদ তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সির সন্ধান চারদিকে তাকাচ্ছে।
| বেলা দশটার আগেই ফিরে এলো শহীদ নতুন মানুষ হয়ে। আবেদীন তো দূরের কথা, খোদ মি. সিম্পসনও এখন তাকে দেখে চিনতে পারতেন না। একজন পাঠান যুবকে রূপান্তরিত হয়েছে শহীদ। প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি সে সংগ্রহ কুয়াশী-১২
১১ ১
করছে প্রায় অনায়াসে। হায়দারাবাদ শহরে শহীদের ছাত্র জীবনের বন্ধু ক্যাপ্টেন আলমগীর বাস করে সপরিবারে। ছাত্র বিনিময় কর্মসূচী অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করতে আসে আলমগীর। তখনই শহীদের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠ তার। আলমগীরকে বাড়িতে পাব আশা করনি শহীদ। কিন্তু ছুটি উপলক্ষে সে বাড়িতেই আছে কিছুদিন। অনেকদিন পর পুরনো দিনের বন্ধুকে আপ্যায়নের সুয়াগ
পে: বর্ত যা আলমার।
কি দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে টিকিট কেটে টেন চেপে বসলো আবেদান। এতক্ষণ সে টেনের অপেক্ষাতেই প্ল্যাটফর্ম বসেছিল গম্ভীর মুখে। ব্যাপারটা আগেই অনুমান করে নিয়েছিল হাদ। বন্দাসুদ্ধ ট্রাঙ্কটা বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাওয়াতে অনা কোথাও যেতে পারে না আবেদীন। অন্তত যতক্ষণ না ট্রাঙ্কটার কোনো খোঁজ পায়। শহীদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের অভিযান থেকে তারা সকলেই যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তখন অন্য কোনো পথ নেই আবদানকে অনুসরণ করা ছাড়া। ঘটনাচক্রে কিছু লাভও হতে পারে। সে-ও ফিরতি পথের টিকিট কেটে আবেদীনের কামরাতেই চড় বসলো।
| এক নাগাড়ে ঘন্টাখানেক ছুটলো টেনটা। তারপর মিনিট দুয়েক ধনে আবার ছুটতে শুরু করলো। আবেদীন টেন ছাড়ার সময় থেকে বরাবর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শহীদ তার দিকে তাকিয়ে আছে নির্বিকার মুখে। মিনিট পঁচিশ পর শহীদ লক্ষ্য করলো আবদান হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে কিনে দেখতে পেলো। ভাঙা হাঁ-মুখ ট্রাঙ্কটা একটা পাথরের গায়ে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। শহীদ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অবদানের দিকে তাকালো। সে যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল টাটা। তারপর দরজা ছেড়ে অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে একটা বেঞ্চিতে এসে বসলো মাথা নিচু করে। শরীদের দিকে ফিরেও তাকালো না।
পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন কে নেমে পড়লো আবেদীন। তারপর একটা টাঙ্গায় চড়ে হায়দারাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলো। শহীদ টাঙ্গা নিয়ে পিছু ধরলো তার। বেলা। তিনটার সময় হায়দারাবাদ শহরের বিখ্যাত হোটেল লা কারবুজের সামনে এসে। দাঁড়াল আবেদীনের টাঙ্গা। টাকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হোটেলের ভিতর প্রবেশ করলো সে। শহীদও তাই করলো। সৌভাগ্যক্রম আবেদীনের পাশের সাইটটাই খালি ছিলো দোতলার সবকটি স্যুইটের মধ্যে। শহীদ হোটলের কেরানীক বলে ওই কাইটটাতেই থাকার ব্যবস্থা করলো।
| আবেদীন নিজের স্যুইটের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত হোটেলেই রইলো। শহীদও কোথাও বের হলো না। সন্ধে সাতটার সময় হোটেল ছেড়ে বের হলো। আবেদীন। একটা ট্যাক্সি নিয়ে শহরের অভিজাত এলাকার একটি প্রাসাদতুল্য বাড়ির। সম্মুখে এসে নামলে৷। শহীদ পিছু নিছ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। বাড়িটার দারোয়ান আবেদীনকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। শহীদ পাচিল টপকে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। একটা ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে দোতলায় ওঠার। ১৯২
ভলিউম-১
সিঁড়িটার দিকে তাকি. দাঁড়িয়ে রইলো সে। একটু পরই দারোয়ানট। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। তারপর নিচের বারান্দা ধরে চলে গেল অন্যদিক। দরিয়ানটা অদৃশ্য হ যতই গাছের আড়াল থেকে বের হয় সিঁড়ি টপক দোতলায় উঠে এলো শহীদ। দোতলার কোনো ঘর আলো দেখতে না পেরে তিনতলায় উঠে গেল সে নিঃশব্দ | সিঁড়ির পাশেই একটা ঘর আলো জ্বলছে দেখতে পেলো শহীদ। দরজায় কান পেতে দাঁড়াতে ভিত থেকে অস্পষ্টভাবে কথাবার্তার শব্দ পাওয়া গেল। কাহাল দিয়ে ভিতর কাউকে দেখতে না পেয়ে, শহীদ একটা খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। উঁকি ম্যর দেখলো একজন যুলকার লোকের সঙ্গে কথা বলছে আবদান। আরও একজন লকায় লোক মাথায় হাত দিকে বসে আছে। টেবিলের উপর মদের বোতল এবং আনুষঙ্গিক আসবাবপত্র সাজানো র-ছ। শহীদ শুনতে পেলো ঝুঁকে পড়া লোকটা নিবে হয়ে বসে মোটা কর্কশ কণ্ঠ বললো, তুমি একটা গর্দভর বাচ্চা, বুঝল: লোকটাকে হাত পেয়েও খেলে? তোমার ওপর আর তে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস রাখা যায় না।
করুণ, মিনতির সুরে আবদান কি যেন বলো শুনতে পেলো না শহীদ। তুলকায় লোকটা বলো, মহা সর্বনাশ করেছে। তুমি, ইডিট। তোমাক জ্যান্ত পুঁতে ফেললেও আমার রাগা মিটবে না। তোমাকে এতো দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে কি এই জন্য?
আবার কি যেন বলল আবেদীন মিনতিভরা কণ্ঠ। স্থূলকায় লোক দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কি ৫ন ইঙ্গিত করল। তারপর আবদানের দিকে ফিরে একজন বললো, এরপর কি করতে হবে না হত তা আজ রাতেই জানতে পারবে তুমি। মোসাফির খান, হুরমত বো, নজরুল এবং শাহাদত খান আজ রাত বারোটায়। তোমার সঙ্গে দেখা করবে। এখন, তুমি যেতে পারে।’ | যন্ত্রচালিতর মত উঠে দাঁড়ির দরজার দিকে এগোল আবেদীন। তার আগেই দ্রুত নেমে এলো শহীদ সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নেমে দারোয়ানকে দেখতে পেলো না সে। ভিতর থেকে ছোট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ালা। একটু পর আবেদনও রাস্তায় এসে পৌঁছুলো। তারপর আবদীনকে অনুসরণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদ হোটেল লা কারবুজতে এসে পৌঁছল। ( কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটা। শহীদ উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে নিজের স্যুইটে। এমন সময় করিডরে কয়েকজনের মিলিত পারে শব্দ শুনতে পেলো সে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো শহীদ সোকা ছেড়ে। বাথরুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পার্শ্ববর্তী সাইটের বাথরুমে প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে গেল সে। “হদ আগেই কুয়াশার দেয়া টর্চটা দিয়ে আবেদীনের বাথরুমের ছিটকিনি গলিয়ে ফেলেছিল। সুতরাং অনায়াসেই সে ভিতরে প্রবেশ করে কী হলের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর তাকাতে পারলো। চারজন লোক আবদানের সঙ্গে কথা বলছে দেখতে পেলো ‘শহাদ। আবদানের গুলি শোনা
হলি, আমাকে সঙ্গে না নেবার আদেশ যদি তোমরা পেয়ে থাকে। তবে আমার বলার
১৪৩
কি-ই বা থাকতে পারে। কিন্তু এখন আমাকে কি করতে হবে তা তো তোমাদের কাছ থেকেই জানতে পারবে বলে জানি।
একজন বললো, ‘তুমি এখন কি করব তা আমরা জানি না। আমরা চারজন এখন কি করবো তা জানি। আমরা আগামীকাল সকালে কারখানার উদ্দেশে যাত্রা করবো। সেখানকার হাল-হকিকত সম্পর্ক রিপোর্ট করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।’
আর একজন বললো, ‘ডাক্তাররা ঠিক মত কাজ করছে কিনা বা কর্নিয়ার জন্য কোনো নতুন অর্ডার এসেছে কিনা সে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ত বা আলোচনা করতে আমরা যাচ্ছি না কারখানা। আমরা যাচ্ছি শহদ খান এবং সিম্পসনকে ছিঁড়েখুড়ে কাক-শকুনক দিন খাওয়াতে।’
| অন্য আর একজন বললো, ‘অবশ্যি বিশ্বাসঘাতক যাত সেই মহাত্মাদেরকে আগে থেকে সাবধান না করে দিতে পারে তার বাবস্থা না করে আমরা রওনা হবো না।’
| প্রথম লোকটা বললো, ‘তা তো নিশ্চয়ই।’
লোকটা কথা শেষ করেই টেবিলের তলা থেকে একটা তীক্ষ্ণফলা ছোরাসহ হাতটা তুলেই আবদানের বুকে আচমকা বলি দিলো আমূল। সঙ্গে সঙ্গে একজন এগিয়ে এসে আবদানের মুখ চেপে ধরলা যাতে কোনো শব্দ না করতে পারে। গোঁ গোঁ একটা শব্দ তবে আবেদীনের কণ্ঠ চির বের হয়ে এলো। ‘চাখ দুটো যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠলো।
| শিউরে উঠলো শহীদ বীভৎস দৃশ্যটা দেখে। লোকগুলো আবেদীনের শরীরের যত্রতত্র ছোরা বসিয়ে আঘাত করছে। অসহায় জানোয়ারের মতো মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে আবদীন। কিছুক্ষণ পর ছোরাবিদ্ধ শরীরটা স্তব্ধ হয়ে গেল তার। .
এই অমানুষিক দৃশ্য সহা করতে না পেরে নিজের স্যুইট ফির এলো শহীদ। তারপর তৈরি হয় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কান পেত। একটু পরেই লোকজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল করিডর। পায়ের শব্দ সামনে এগিয়ে যেতে দরজা খুলে বাইরে থেকে সেটা বন্ধ করে দিয়ে লোকগুলোক গোপনে অনুসরণ করতে লাগলো
| লোকগুলো ল৷ কারবুজ থেকে বেরিয়ে একটা বারে ঢুকলো। শহীদও ভিতরে ঢুকে কাছাকাছি একটা টেবিল দখল করে বসলো। লোকগুলো শহীদের দিকে তাকিয়ে দেখলো বটে, তবে মনোযোগী হলো না। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলো।
চারজনই প্রচুর মদ খেলো ঘন্টাখানেক ধরে। ইতিমধ্যে মদের নেশায় লোকগুলোর কথাবার্তা জোরে জোরে হচ্ছিলো। শহীদ সব কথা অবশ্যি শুনতে পেলো না। শুধু জানতে পারলো আগামীকাল সকাল দশটার ট্রেন ওরা যাত্রা করবে। একে একে স্টেশনে। উপস্থিত হবে ওরা দশটার আগেই। ওদের মধ্যে বাঙালী লোকটা, যার নাম শহীদ অনুমান করে বুঝলা নজরুল ইসলাম, বেশ স্বাস্থ্যবান, লম্বা, ফরসা। টিকালো নাক। জোড়া ভু। সরু ঠোঁট। মনে মনে হাসলো শহীদ। কেননা ওই লোকটার ছদ্মবেশ ধরে
১৪৪
কি তিনজনের সঙ্গে সে-ও দুর্বত্তদের ঘাঁটি অভিমুখে যাত্রা করবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল ইতিমধে। দুদ্মবেশ বেশ নিখুঁতই হবে। চেহারার ভঙ্গিত অনেক মিল এমনিতেও আছে লোকটার সঙ্গে শহীদের।
কিছুক্ষণ পরই বার ছেড়ে বের হয়ে পড়লো লোকগুলো। রাস্তায় নেমে চারজন চারদিকে চলে গেল ট্যাক্সি কর। “হা ও ভাড়া করা একটা ট্যাক্সিতে বাঙালী লোকটাকে অনুসরণ করে শহরতলার পুরনো একটা বাড়ির সামনে এসে নামলা। ট্যাক্সিওয়ালাকে বেশি ভাড়া দিয়ে শহীদ বললো যে রাস্তার মোড়ে ফিরে গিয়ে তার জন্যে কিছুক্ষণ
পক্ষ করলে মোটা বকশিশ মিলবে। রাজি হলো ডাইতার, তারপর চলে গেল রাস্তার মোড়ের দিকে। নজরুল ইসলাম বাড়ির ভিতর ঢুকে দরজা বন্দ করে দিয়েছিল। ট্যাক্সি চলে যেতে শহীদ একবার তা দুষ্ঠিত চারপাশটা দেখে নিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়িটার। ভিতর ঢুকে পড়লো। বাড়িট। পুরানো এবং বেশ বড়। অন্ধকারে বেশি কিছু ঠাহর করতে পারলো না শহীদ। বারান্দা ধরে কিছুটা হাঁটতেই একটা ঘর দেখতে পেলো সে। ভিতর আলোর আভাস পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে ঘরের জানালার সামনে গিয়ে উঁকি মরে দেখলো শহীদ। নজরুল ইসলামকে কাপড়-চোপড় ছাড়তে ব্যয় দেখা গেল। মরের ভিতর আর দুজন লোক নিয়ে আছে। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে তাবছিল শহীদ। এমন সময় নজরুল ইসলাম ঘরের দরজা ঠেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো লুঙ্গি আর চোঞ্জি পরে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে বাথরুমের দিকে হাঁটতে লাগলো। একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল শহীদ নজরুল ইসলামকে। লোকটা বাথরুমে ঢুকতে খুশি হয়, উঠল সে। তারপর দ্রুত পা বাথরুমের পাশে গিয়ে ওত পেতে দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। একটু পরই বাথরুম থেকে বের হয়, আসতে দেখা গেল লোকটাকে। বিলম্ব
করে সর্বশক্তি দি পচণ্ড একটা ঘুসি মারলো শহীদ লোকটার নাক লক্ষ্য করে। অতর্কিত অসহনীয় একটা বুনি খেয়ে তাল হারিয়ে টলে পড়ে যাচ্ছিলো সে। তাকে পড়তে না দিয়ে ধরে ফেলে আবার একটা প্রচণ্ড গুলি চালালো তলপেটের উপর। সহ্য করতে পারলো না লোকটা। জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তখুনি। মাটিতে পড়বার আগে এবারও শহীদ অজ্ঞান শরীরটা ধরে ফেলে। তারপর অচেতন লোকটাকে দ্রুত কাঁধে তুলে নিলো সে। বাড়ির দরজা খুলে নিঃশব্দে পপ নামলো। তারপর ক্রন্ত পদে মোড়ে দিকে হাঁটতে লাগলো।
মোড় এসে ট্যাক্সিটাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হলো শহীদ। ড্রাইভারের। ভয়ার্ত মুখ একবার প্রত্যক্ষ করে গম্ভীর কণ্ঠে সে বললো, ‘থানা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে চলো জলদি। আমি পুলিসের লোক।
‘জ্বি, হুজুর!”
ড্রাইভার ব্যস্ত কণ্ঠে কথাটা বলে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো।
:-
১৪৫
নয়।
জ্ঞান ফিরে পেতে ধীরে ধীর চোখ খুলে তাকালো কামাল। একজন পাঠান ভদ্রলোককে তার পাশে বসে থাকতে দেখলো সে। ভদ্রলোক একটা খোলা বইর পাতায়, চাখ রেখে বসে আছেন। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়! হতভম্ব দৃষ্টিতে তাঁবুটা দেখতে লাগলো কামাল। বিদ্যুৎচমকের মতো স্মরণ হলো তার এ নদী পার হবার সময় পা ফসকে পড়ে যায়, স্রোতের মধ্যে। কিছুক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টা করে সে তারের দিকে এবার। কিন্তু অল্পক্ষণ পরই জ্ঞান হারায়। তারপর থেকে আর কিছুই মনে নেই তার। ককটা প্রশ্ন জো উঠলো কামালের মন। কে তাকে উদ্ধার করলো মৃত্যুর কবল থেকে এখানেই বা সে এলো কিভাবে? শহীদ কোথায়? সে কি বন্দী হছে শত্রুর হাতে?
‘ড গড! এই তো আপনার জ্ঞান ফিরে এসেছে। আমি আনন্দ অনুভব করছি মি. পার্শ্ববর্তী পাঠান ভদ্রলোক ইংরেজিতে বলে উঠলেন কামালের উদ্দেশ্যে।
ফিরে তাকালো কামাল। তারপর বলল, ‘আমার নাম কামাল আহমদ, কিন্তু…’
কথাটা শেষ না করেই উঠে বসতে গেলি কামাল। ভদ্রলোক আপত্তি করে বললেন, ‘উঠবেন না, মি. কামাল। আপনি ভয়নিক অসুস্থ এখনও। আপনার বেশি কথা বলাও মান। আমরা আপনার সম্পর্কে যা জানি সব বলছি, তবে আমার অনুরোধ আপনি এই মুহূর্ত বেশি কথা বলবেন না। প্রথমে আপনার কিছু খাও. দরকার। তারপর সুস্থবোধ করল আলাপ করা যাবে।’
| একটু থেমে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম খুরশীদ আলম, সিভিল সার্জন। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে পড়াশোনা আছে সামান্য। বর্তমানে আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এদিকে এসেছিলাম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিছু পাও হয় কিনা অনুসন্ধান করতে। ফেরার পথে এই সরাইখানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম রাত কাটাবার জন্য।
| ‘গতকাল ভোের রাতে যাত্রা করার সময় আপনাকে এই তাঁবুতে আবিষ্কার করে বিমূঢ় সরাইখানার মালিক খবরটা আমাদেরকে জানায়। কে যেন আপনার অচেতন এবং সিক্ত শরীরটা সকলের অজান্তে এই তাঁবুতে রেখে গিয়েছিল।
‘আপনার অবস্থা দেখে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়লাম আমি। অগত্যা আমার বন্ধুদেরকে বিদায় জানি আপনার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাকে। এই হলো সম্পূর্ণ ঘটনা। আপনার সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা নেই মি, কামাল। বাংলাদেশের একজন ভদ্রলোক এই দুর্গম এলাকায় যাই হোক, পরে আমরা সব শুনলে আপনার মুখে। এখন আপনার খাবার ব্যবস্থা করতে বলি।’
কামালকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে খুরশীদ আলম তাঁবু থেকে বের হয়, গেলেন হাসিমুখে। কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কামাল ভদ্রলোকের গমন পথের দিকে। তারপর চিন্তার জটাজালে জড়িয়ে পড়লো গভরভাবে। ১১৬
ভলিউম-১
সেদিন বিকালে কামালকে উঠে বসার অনুমতি দিলেন খুরশীদ আলম। উঠে এলেও বেশ দুর্বলতা অনুভব করছিল কামাল। মনে হলো মাথা ঘুরে বুঝি পড়ে যাবে। নালিশ ঠস দিয়ে বসে কামাল খুরশীদ আলমের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কবে নাগাদ আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হবে বলে মনে হয়, মি, খুরশীদ?’
অন্তত সাতদিন আপনার সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার, তারপর আপনার দুর্বলতা আর থাকবে না।’
| আঁৎকে উঠলো কামাল, অসম্ভব! বড়জোর আগামীকাল পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নিতে পারি, তার বেশি কোনমতেই সম্ভব নয়। এমনিতেও কি সর্বনাশ যে হয়ে গেছে কে জান।’
| কৌতূহলী স্বর মি. খুরশীদ বললেন, ‘বলুন দেখি, মি. কামাল, এবার আপনার সম্পর্কে। আমার তো আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু আপনার কথা শুনে আগ্রহটা অতিমাত্রায় খোঁচাচ্ছে আমায়। অবশ্য সব কথা যদি বলতে আপত্তি থাকে আপনার, তবে আমার অনুরোধ আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।’
মি. খুরশীদকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখলো না কামাল। দু’একটা কথা বাদ দিয়ে তাদের সব কথাই বললো সে। অভিযানের মূল কেন্দ্রে প্রবেশ করার পূর্বেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বলে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলো। তারপর বললো, ‘এক্ষেত্রে বিশ্রাম গ্রহণের কথা আমি কোনমতে মেনে নিতে পারছি না। যেমন করে হোক যেতে আমাকে হবেই। অবশ্যি এখন আমি কপর্দকশূন্য। ঘোড়া, খাদ্য, অস্ত্র-প্ৰয়োজনীয় কিছুই নেই আমার। তবু
মি. খুরশীদ বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনি কপর্দকশূন্য কি না জানি না। তবে, একটা ঘোড়া আপনার সঙ্গে এই সরাইখানায় পাওয়া গেছে।’
চমকে উঠে কামাল বললো, ‘তাই নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার কিন্তু। আমার। ‘এণরক্ষাকারী যে কে তা পর্যন্ত আমি জানতে পারলাম না।’
কামাল আবার বললো, তবে আর ভাবনার কিছু রইলো না। আমি যে-কোনো সময় যাত্রা করতে পারি। আগামীকালই রওনা হবো আমি।’
মি. খুরশীদ বললেন, ‘সেটাই ভালো হবে। শরীরটা আর একটু সুস্থ হলে যাত্রা শুরু করাই ঠিক হবে আপনার পক্ষে।’
মাঝখানের একটা দিন বাদ দিয়ে যাত্রা শুরু করলো কামাল বিকেলের দিকে। অজ্ঞাত প্রাণরক্ষাকারীর ঘোড়ায় চড়ে কেমন অস্বস্তিবোধ করছিল সে।
ঘোড়ায় চড়া অভ্যাস নেই কামালের। উপরন্তু ঘোড়াটাও শুরু থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছিল। একসময় ঘোড়াটা সত্যিই খেপে উঠলো। চলতে চলতে কামাল একবার একটু জোরে লাগামটা টেনে ধরেছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য, ঘোড়াটা সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ালো। শুধু তাই নয়, পিঠ দুলিয়া, পিছনের পা শূন্য তুলে তাকে পিঠ থেকে কেলে দেবার চেষ্টায় উন্মাদ হয়ে উঠলো। শুশ-১২
১১৭
অনভ্যস্ত হাতে মোড়াটাকে প্রাণপণে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলো কামাল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। লাগাম টেনে টেনে হাতে ফোস্কা পড়ে গেল তার। একবার ঘোড়াটা প্রাণপণ ছুটতে আরম্ভ করলো হঠাৎ। কামাল কোনমতে প্রাণভয়ে অধার হয়ে জাপটে ধরে রইলো ঘোড়ার গলা। বেশ কিছুক্ষণ একটানা এই ভাবে ছোটবার পর গোড়াটা আবার পূর্ববৎ আচরণ করতে লাগলো। কিছুতেই স্থির হয়ে বসে থাকতে দেবে না কামালকে পিঠের
উপর।
কোনরকমে কুণ্ডলী পাকিয়ে জাপটে ধরে আছে কামাল ঘোড়াটার ঘর্মাক্ত পিঠ। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার মরুভূমিতে কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কোথা থেকে কোথায় যে যাচ্ছে তা অনুমান করার সাধ্য নেই তার। ঘোড়াটা একটু স্থির হলেই সে লাফ দিয়ে নেমে পড়বে ভাবছিল কামাল। কিন্তু শিক্ষিত ঘোড়া চট ঢাছে। উপায় নেই আর। ছুটছে সে দুর্দম বেগে! . হঠাৎ একসময় ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলি কামাল। পড়বার সময় চোখ। বন্ধ করে ভবিতব্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল সে। বালিত ছিটকে পড়েই চোখ খুল তাকালো।
| কিন্তু একি! হায়, শেষ পর্যন্ত সে কি চোরাবালিতে পড়লো?
ঠিক তাই। উঠে বসতে গিয়েই বুঝলো কামাল ধার ধারে বালির নিচে ঢুকে যাচ্ছে সে।
| ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কামাল কিন্তু হতদিশা হয়ে পড়লো না। শরীরের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করও যতক্ষণ পারে নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যে তৈরি হলো সে মনে মনে।
এ রকম বিপদে পড়লে কি করতে হয় কামালের তা জানা আছে ভালো করে। হাত . আর পা এলিয়ে সে নিঃসাড় পড়ে রইলো। শরীরটাকে রাখল যেভাবে হাত-পা না
নেড়েও সাতারুরা পানির উপর চিত্ হয়ে আসে সেই ভাবে। * সর্বনাশী ঘোড়াটার পিঠটা দেখা যাচ্ছে খানিক দূরে। বেদম পা ছুঁড়ছে বোকা জানোয়ারটা। ক্রমশই ডুবে যাচ্ছে তার শরীরটা নরম ভিজে বালির ভিতরে।
শিউরে উঠলো কামাল। কিছুক্ষণ পর তারও ওই দশা হবে।
অনড় পড়ে থাকলে একটু বেশি সময় লাগবে বালির ভিতর জীবন্ত ঢুকে যেতে। কিন্তু কেউ উদ্ধার না করলে, পরিত্রাণ নেই তার। তবু একবার শেষ চেষ্টা করতে দোষ কি! কামাল হঠাৎ অনেকটা উন্মাদের মতোই হাত-পা ঝেড়ে চিৎকার করে উঠলো আকাশকাটা কণ্ঠে-কে আছে, বাঁচাও! বাঁ- চা-ও!
পরক্ষণেই টের পেলো কামাল, প্রায় আধ হাত বালির নিচে ঢুকে গেছে সে নড়াচড়ার দরুন!
| আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে অসহায়ভাবে নিঃসাড় পড়ে রইলো সে চোখ বন্ধ করে।
ক’মিনিট পর চোখের উপর তীব্র আলোর ছটা পড়তে চমকে তাকালো কামাল।
১৮
সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার থেকে মি, সিম্পসনর গলা ভেসে এলো, ‘কামাল?”
‘মি. সিম্পসন! আবেগ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গোল কামালের।
‘এই দড়িটা ধরো।’ মি, সিম্পসন ল্যাসে ছোঁড়ার কায়দায় কামালের দিকে একটা দড়ি ছুঁড়ে দিলেন।
কোনো পরোয়া না করে শরীরের সমস্ত শক্তি সংহত করে দৃড়ির ফাঁসটা দুহাতে জাপটে ধরলো কামাল। এবারকার মতো বেঁচে গেছে সে!
দশ
মি. সিম্পসনের দড়ি বর চারাবালি থেকে মুক্ত হয় কামাল শহীদকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘শহীদ কোথায়, মি, সিম্পসন?’
অধৈর্যশ্বর মি. সিম্পসন বললেন, ‘তুমি কি পাগল হল, কামাল! শহীদ কোথায় সে কথা তো আমিই তোমায় জিজ্ঞেস করবো। বলো, কোথায় শহীদ?’
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলা কামাল। বুঝতে পারলো সে সব। শহীদ শত্রুর হাতে বন্দী হয়েছিল তাহলে। কিন্তু কোথায় সে এখন?
‘কই বলো! অান চুপ করে রইলে কেন?’ | যা ঘটেছিল সবই বললো কামাল মি, সিম্পসনকে। অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে উঠলো। মি. সিম্পসনের মুখ। কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে একসময় তিনি বললেন, ‘শহীদের ব্যাপার নিয়ে আমরা যতটা দুশ্চিন্তা করছি ততোটা বোধহয় ঠিক নয় কামাল। শহীদকে আমরা খুব ভালো ভাবেই জানি। সুতরাং তার উপর ভরসা রেখে এসো আমরা কাজ শুরু করি। কুখ্যতি দুর্গাটা এখান থেকে দূরে নয়। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখো, দেখতে পাৰে দুটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবো সম্ভবত ওখান। আশা করি। শহীদকে আমরা ওখানেই পাবো। আমার বিশ্বাস গন্তব্যস্থানে সে যেমন করেই হোক পৌঁছবেই। তাছাড়া এখানে আমরা আজ রাতের মধ্যেই পৌঁছাতে না পারলে হয়তো কুয়াশার যা করার সব কার সর্বনাশ ঘটিয়ে কেটে পড়বে আগেভাগে।’
| কামাল বললো, ‘বেশ, তাই হোক। কিন্তু ঘোড়া নেই আমাদের, তাছাড়া দুর্গে তো অনেক লোকজন আছে শত্রুপক্ষের বাধা দেবার। আমরা ভিতরে ঢুকতে পারবো। তো?’
| মি. সিম্পসন বললেন, ‘চষ্টা করতে দোষ কি। প্রায় কোয়ার্টার মাইল জায়গা জুড়ে দুর্গটা। এতো বড় জায়গাটার কোনো না কোনো খানে দুর্বল অংশ না থেকেই পারে না। চেষ্টা করলে আমরা নিশ্চয়ই ঢুকতে পারবো।’
কামাল বললো, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কুয়াশার কাজ কুয়াশা সেরে ফেলেছে। ইতিমধ্যে। আমরা গিয়ে হয়তো দুর্গা শূন্য দেখবো।’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘‘অসম্ভব নয়। কেননা, মরুভূমিতে শত্রুদের একটা
১৪৯
পাহারার ঘাটিতেও লোক নেই দেখে এসেছি আমি। সবগুলো তাঁবুই শূন্য। লোকগুলোকে হয়তো কুয়াশা বন্দী করে নিয়ে গেছে।’
কামাল বললো, ‘অসম্ভব নয়।’ . মি. সিম্পসন হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে উঠলেন, ‘আরে! আমার ওয়্যারলেস সেটটা কোথায় গেলি! ওটা তো চোরাবালির কাছে যখন যাই তখন ছিলো আমার কাঁধে ঝোলানো!’
‘বলেন কী?’ কামাল হতবাক কণ্ঠে বললো।
‘আমার কি মনে হয় জানো,’ মি, সিম্পসন চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার দিকে যখন আমি চোরাবালির কিনারে দাঁড়িয়ে ল্যাসো ছুঁড়েছিলাম তখনই সেটা পড়ে যায় আমার কাঁধে ঝোলানো বাগি থেকে। এখন কি করি বলো তো? ওটা ছাড়া বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো উপায়ই রইলো না যে আমাদের।’
‘তবু একবার খোঁজ করে দেখতে দোষ কি।’ কামাল বললো, ‘চলুন দেখি সেটটা কোথাও পড়েছে কি না।’ | ‘কোনা লাভ নেই কামাল। মি, সিম্পসন হতাশ কণ্ঠে বললেন, আমি জানি এটা আর পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে সময় নষ্ট না করে চলো আমরা দুর দিকেই যাই।’
‘চলুন,’ কামাল অগত্যা সায় দিলো।
গভীর রাতে দুর্গার পিছন দিক এসে পৌঁছুলো ওরা। কোনরকম বাধাই দিলো না কেউ। বিরাটাকার দুর্গটি৷ আগাগোড়া পাথরের তৈরি। দু’মানুষ সমান উঁচু চারদিকের দেয়াল। দেয়ালের গায়ে কোনরকম গর্ত পাওয়া হল না। পাঁচিলের উপর হাতখানিক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। দড়ির মই বের করলেন মি. সিম্পসন। প্রথমে কামাল উঠলো পাঁচিলের মাথায়, তারপর মি. সিম্পসন।
দুর্গের ভিতর দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলো না ওরা। হঠাৎ বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো কামালের। শহীদকে ছাড়া কোনো অভিযানেই সে একা কখনও সফল হতে পারেনি। প্রতিবারই বিপদ থেকে শহীদ তাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখন যদি কোনো ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে সে? কে বাঁচাবে তাকে?
দুজনই নেমে পড়লো একে একে দুর্গের ভিতর। দুর্গের মেঝেটাও পাথরের তৈরি। সামনের কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। পাঁচিল ঘেঁষে গুটি গুটি পায়ে এগোলো ওরা নিঃশব্দে। টর্চ জ্বালতে মানা করেছেন মি. সিম্পসন। যদিও সম্পূর্ণ অপরিচিত ওদের কাছে দুর্গের আকার-আকৃতি, তব টর্চ জ্বেলে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করার কোনো মানে হয় না। হাঁটতেই থাকলো ওরা। মিনিট কয়েক হেঁটে অবশেষে দুর্গের একাংশে
একটা আলোর রেখা দেখতে পেলো।
| একটা ঘরের জানালা পথ আলো এসে পড়েছে বাইরে। জানালাটা বেশ উঁচুতে। লোহার শিক দেয়। কিন্তু জানালার নিচে কোনো বারান্দা নেই। ঘরটার গা ঘেঁষে ওরা হাঁটতে লাগলো আবার। অস্বাভাবিক লম্বা ঘরটা। বিরাট একটা হল ঘর যেন। হঠাৎ ১৫০
একটা কম বয়সী ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো ওরা। তারপর একটা লোহার পাতের দরজা দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল চুপিচুপি। দরজার গায়ের ছোট্ট একটা ফুটা চাখ রেখে কিছুই দেখতে পেলো না কামাল। কান পেতে তবু কণ্ঠস্বরট। শুনতে চেষ্টা করলো। | আশ্চর্য হয়ে শুনলে কামাল ছেলেটি উজিত স্বর বলছে, ‘হ্যাঁ ভাইয়া, সক্কলকে ঘুম পাড়ি দিয়েছি। বাইরে বোধহয় একজন লোক পাহারায় আছে। আমাদের সবাই পাশের ঘর তৈরি হয়েই আছে। আপনার হুকুম পেলেই লোকগুলোকে আমরা বাইরে নিয়া যেতে পারবো। না, না, কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি আপনার এই ছোটা ভাইটার উপর নির্ভর করতে পারেন, ভাইয়া। আর একটা সুখবর আছে, ভাইয়া, আমার ভাই-শাকিলকে পেয়েছি। ওর চেহারা বদলে গেছে বলে চিনতে পারিনি প্রথমে। আগামীকাল ওর চোখ তুলে নেবার দিন ছিলো!’
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার শোনা গেল, ‘আপনি দুর্গার ভিতরই আছেন, ভাইয়া? তবে আপনি নিজে আসছেন না কেন এখানে?’
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর শেষবারের মতো শোনা গেল, ‘বুঝেছি। হ্যাঁ, আমরা ওদেরকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। যন্ত্রটা বন্ধ করে দিই এবার?’
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ওর। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। কামাল বললো, ‘ঘরটার ভিতর ঢুকত হবে মি. সিম্পসন। অনেক তথ্য জানা যার ভিতর। কে যেন ওয়্যারলেস কথা বলছিল কার সঙ্গে।
‘সুতরাং ভিতর ঢোকার জন্য চেষ্টা করা যাক। | লোহার দরজাটা ভালভাবে পরীক্ষা করা হলো, কিন্তু অসম্ভব বলে মনে হলো দরজাটা অতিক্রম করা। হলঘরটায় ঢোকার জন্য ঘোরাফেরা করতে লাগলো ওরা। এদিক থেকে ওদিক ঘুরতে লাগলো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই দিশে হারিয়ে ফেললো ওরা। হলঘরটার সঙ্গে লাগোয়া আরো ঘর ছিলো চারপাশে। ওরা ভাবলো ঘর একটাই। মিনিটের পর মিনিট কেটে গেল। হঠাৎ মেশিনগানের শব্দে চমকে উঠলো ওরা। বিমূঢ় হয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলো। মেশিনগানের শব্দ কিছুক্ষণ হয়েই থেমে গেছে। ছুটতে ছুটতে কামাল বললো, ‘গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি আমরা মি. সিম্পসন। এদিক দিয়ে তো আমরা একবার গেছি, আবার সেই একই জায়গায় এলাম কি করে!
মি. সিম্পসন কিছু বলার আগেই কামাল মরিয়া হয়ে টর্চ জ্বাললো। টর্চের আলোয় ওরা দেখলে চারদিক চারটে সংকীর্ণ গলি চলে গেছে, গালিগুলোর দু’পাশে উঁচু সারি সারি ঘর শুধু। টর্চটা না নিবিয়েই একটা গলি ধরে ছুটলা দুজন। দুপাশের ঘরের সারি। আর শেষ হতে চায় না। মিনিট দুয়েক ছোটার পর মুক্তি পেলো ওর গোলক ধাঁধা থেকে। তারপরই থমকে দাঁড়ালা।
সম্মুখেই তিনজন সেন্টির মৃতদেহ দেখতে পেলো ওরা। আবার ছুটলো কুয়াশা- ১২
১৫১
মৃতদেহগুলো পিছন ফেলে। একটা দোলের আড়াল থেকে উঠান মতো একটা জায়গায় পৌঁছেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল কমালের। উঠানটা বিজলী বাতিতে আলোকিত। সেই আলোকিত উঠানে একজন লোক একটা হালকা মেশিনগান উচি দাঁড়িয়েছিল। লোকটার পিছনেই প্রায় দু’ আড়াইশো ছোট। ছোটো ছেলে শক্ত-কঠিন মুখ নিঃশব্দে দীড়িয়ে আছে।
‘স্টপ!’। | চিৎকার করে উঠলো লোকটা কামাল ও মি. সিম্পসনকে দেখেই। একমুহূর্ত পরই লোকটা মেশিনগানের মুখটা ওদের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো, নাক করবেন! এতক্ষণ চিনলাম।’
কামাল লোকটাকে চিনতে পেরে অবাক না হয়ে পারলো না। লোকটা কুয়াশার অনুচর মান্নান ছাড়া আর কেউ নয়। কামাল জিজ্ঞেস করলে গম্ভার চাল, তোমরা যাচ্ছে কোথায়?’
মান্নান হাসিমুখে উত্তর দিলো, ‘উত্তর দেবার অনুমতি আছে কি নেই জানি না বলে উত্তর দিতে পারছি না আমি। আচ্ছা চলি।’
ঘুরে দাঁড়ালো মানুনি কথাকটি বল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দলও ঘুরে দাঁড়ি সামনে এগিয়ে চললো। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল এক সময়।
মি. সিম্পসন কামালের উদ্দেশ্য বললেন, ‘ওদেরকে কি যেতে দেয়া উচিত হলো?’
হেসে ফেলে কামাল বলল, ‘ওদেরকে আটকে রেখে কি লাভ হতো?
তাহলে হয়তো কুয়াশার সাক্ষাত পেতাম।’।
কামাল কোনো উত্তর না দিয়ে একটা ঘরের খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের ভিতর ঢুকে ওরা দেখলা ঘরটা শূনা। ভিতর দিয়ে অন্য ঘরে যাবার দরজা রয়েছে একটা। দরজাটা খোলাই ছিলো। দ্বিতীয় ঘরটা প্রবেশ করে আবার অন্যান্য মরে যাবার দরজা দেখতে পেলো ওরা। এভাবে একটার পর একটা পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একসময় থমকে দাঁড়ালো ওরা। দূর লোহার গেট খোলা বা বন্ধ করার ক্যাচ ক্যাচ একটা শব্দ শুনতে পেয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। তারপর দুত পায় শব্দ লক্ষ্য করে সামনে এগোতে লাগলো। কয়েকটা ঘর পার হতে ওরা একটা বিরাট হলঘরের ভিতর এসে দাঁড়ালো। ঘরটার অন্যদিকের দরজাটার দিকে আগে আগে এগিয়ে গেলেন মি, সিম্পসন। মি. সিম্পসন দরজাটা টপকেই দেখতে পেলেন কাল। আলখেল্লা পরিহিত একটা বিশাল মূর্তি তার কাঁধে চার-পাঁচজন অচেতন মানুষকে নিয়ে একটা ঘরের ভিতর ঢুকলা। তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলন মি. সিম্পসন। কুয়াশাকে চিনতে বিলম্ব হয়নি তাঁর। একটু পরই ঘরটা থেকে বের হয় ছোটো উঠানটায় এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার তাক করে গম্ভীর কণ্ঠে মি. সিম্পসন কুয়াশার উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও কুয়াশা: সাবধান! চালাকি
:৫২
করার চেষ্টা করে খামোকা বিপদের ঝুঁকি নিও না।
মি. সিম্পসনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। ছট কর কোথা থেকে একটা ঢিল এসে লাগলো সিম্পসনের হাতের কতি। বাবুল একট। থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মেরেছে ঢিলটা।
| মি, সিম্পনর হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়লা দূর।
‘সাবাশ!’ হেসে উঠ কুয়াশা বলো বাবুলের দিকে তাকিয়ে।
এদিকে যে মুহূর্তে মি. সিম্পসন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সেই মুহূর্ত কামাল পিছন দিকে একটা ঘড় ঘড় শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালো। তারপর শব্দটা লক্ষ্য কর পাশের ঘরে। এসে দাঁড়ালো সে নিঃশব্দে। চমকে উঠলা কামাল ঘরটার ভিতর পা ফেলেই। ঘরের একদিককার দেয়াল সরে যাচ্ছে ভোজবাজির মতো ক্রমশ। আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কামাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেয়ালের একটা অংশ অদৃশ্য হয়ে গেল একপাশে। দোলটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই একটা কুয়ার মতো দেখতে পেলালে। একটা সিঁড়িও উঠে এসেছে নিচের দিক থেক। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে একটা পদশব্দ ক্রমশ উঠে আসছে উপর দিক শুনতে পেলো কামাল। সঙ্গে সঙ্গ সে দেয়ালের পাশে সরে দাঁড়ালো। একটু পরই একটা লোককে ঘরের ভিতর ঊ আসতে দেখলো স্টেনগান হাতে কর। কালবিলম্ব না করে স্টেনগানটা কেড়ে নিয়ে দূরে কেল দিলো কামাল। তারপর লোকটার গলা টিপে ধরলো শত আঙুলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারালো লোকটা। অচেতন লোকটাকে এবার বেধে ফেললো কামাল। তারপর মি. সিম্পসনের খোঁজ না করেই সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলো একহাত উদ্যত রিভলভার আর অন্য হাতে টর্চ জ্বল।
এগারো
নজরুল ইসলামকে থানায় জমা রেখে পরদিন সকাল দশটায় তারই ছদ্মবেশে প্ল্যাটফর্মে পৗছে নিরাপদেই যাত্রা করেছিল শহীদ। তিনজনের মধ্যে কেউই তার ছদ্মবেশ ধরতে পারেনি। সন্দেহ করনি বিন্দুমাত্রও। ট্রেনে কার মাইল পঞ্চাশ অতিক্রম করেছিল ওরা। তারপর এক জায়গায় নেমে মোটর আরোহণ করেছিল। মোটর চড় আর পঞ্চাশ মাইল গিয়ে একটা জঙ্গলে প্রবেশ করেছিল ওরা সেদিনই। ‘কপ্টার রাখা ছিলো আগে থেকেই। কোথা থেকে, কিভাবে ‘কপ্টারটা জঙ্গলে এলো তা শহাদ বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করতেও ভরসা করেনি সে। তাহল নির্মাৎ সন্দেহ হত। লোকগুলোর।
হেলিকপ্টারে চড় ঘন্টা দুয়েক ওড়ার পর মরুভূমির দেখা পাওয়া যায়। মরুভূমিতে কয়েক জায়গায় নেমেছিল তারা। অসম্ভব চমকে উঠেছিল লোক তিনজন। শহীদও কম হতবাক হয়নি। মরুভূমির বহু স্থানেই তাঁবু দেখতে পেলো ওরা। কিন্তু একটা তাঁবুতেও লোক নেই। লোকগুলার কথা শুনে শহীদ বুঝলো সবগুলো তাঁবুই ছিলো অনাহুত
•াশা-১২
ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যাতে দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করতে না পারে তার জন্য পাহারার মাটি। কিন্তু খুব সম্ভব, শত্রুপক্ষের আক্রমণের মুখে লোকগুলো টিকতে পারেনি। তাদেরকে হতা বন্দী করে নি, হাওয়া হয়েছে।
| চমকে উঠেছিল লোকগুলো। শহীদ ও গম্ভীর গম্ভার ভাব এনে অভিনয় করতে লাগলা। অবশে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো গুপ্ত পথ ওরা দুর্গা প্রবেশ করব। ব্যাপার খুব গুরুতর বোঝা যাচ্ছে। দুর্গ নিশ্চয়ই অজানা কোনো শত্রু শক্তির দ্বারা বিপদগ্রস্ত হয়েছে। লোকগুলোর মেজাজ দেখে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে উঠলো শহীদ। কিন্তু ভাবসাব সে হিংস্র হয়ে উঠলো অজ্ঞাত শত্রুর বিরুদ্ধে।
একটা পাহাড়ের উপর নামানো হলো ‘কপারটা সন্ধ্যার সময়। পাহাড় থেকে কিছুটা নেমে একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ ধর মিনিট পনেরা হাঁটার পর প্রশস্ত একটা জায়গায় হাজির হলো ওরা। আশ্চর্যের সামা রইলো না শহদের, যখন জানতে পারলো সে এই পরির সুড়ঙ্গ পথ ধার দুর্গার একেবারে সর্বশেষ স্তরে পৌঁছানো যায়। কিন্তু আশ্চর্য হবার মতো আরো বিষয় ছিলো শহীদের জন্য। আরো কিছুদূর এগিয়ে একটা অন্ধকার মতো জায়গায় সে দেখতে পেলো একটা ফোক্সওয়াগন থারটিন হাওড।
সকলেই একে একে চড়ে বসলো গাড়িটায়। তারপর হেডলাইট জ্বেল দু’ পাশের পাথরের দেয়াল যে ভয়ানক বেগ চালাতে লাগলো একজন গাড়িটা। প্রতি মুহূর্তে শহীদের আশঙ্কা হতে লাগলো এই বুঝি একটু বেকে গিয়ে পাথরের গায়ে ধাক্কা লো গাড়িটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা ছুটল। মিনিট দশেক। তারপরই পৌঁছে গেল ওরা। লোহার মোটা পাত দিয়ে মোড়া একটা বিরাট টের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো গাড়িটা। একে একে দ্রুত নেমে পড়লো সবাই গাড়ি থেকে। সাঙ্কেতিক বেল বাজাতে খুলে গোল গেট। দুজন স্টেনগানধারী সেন্টি দাঁড়িয়ে আছে দেখলো শহীদ। এদেরকে দেখেই স্টেনগান নামিয়ে রেখে স্যালুট করলো চটপট।
‘খবর কি, হিকমত খনি?’ একজন সেটি বললো, ‘সব ঠিক আছে, হুজুর।’ ‘সব ঠিক আছে? ‘জ্বি, হুজুর।’ ‘ এক তলা আর দু’হলার খবর জানো?’ ‘না, হুজুর। উপরের তলায় ওঠার হুকুম নেই তা তো জানেন। ‘তা ঠিক। আচ্ছা যাও, গাড়িটা ঠিক জায়গায় রাখে।’
সেন্ট্রি দু’জন গেট পেরিয়ে চলে গেল ওদিকে। নজরুল, তুমি চাবিটা নিয়ে এসো সেটির। আমরা ততক্ষণ এগিয়ে গিয়ে দেখি।’
কথাটা বলে চলে গেল তিনজনই। শহীদ লক্ষ্য করলো পূর্বদিকের একটা বারান্দায় উঠে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ তালা মের চাবির গোছাটা হাতে
১৫৪
নিয়ে। সেন্ট্রি দুজন গাড়ির তদারক ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। হঠাৎ মনস্থির করে ফেললো শহীদ। অন্যমনস্কভাবে এগিয়ে গিয়ে আচমকা িেটটা বন্ধ করে দিলো সে। একটুও দেরি না করে তালা লাগিয়ে দিলো দ্রুত। লেন্টি দুজনের স্টেনগান দুটো পড়ে ছিল সামনেই। তুলে নিলো শহীদ একটা। অন্যটা একপাশে সরিয়ে রাখলো যাতে কেউ না দেখতে পায়। তারপর লোক তিনজন কিছুক্ষণ আগে হেদিকে গেছে সেইদিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা ঘর দেখতে পেলো শহীদ। নির্ভর ভিতর ঢুকে পড়লো সে। কিন্তু দেখতে পেলো না কাউকে। ঘরটার ভিতর দিয়ে পরপর কয়েকটা ঘর . পেরিয়ে ফেলি শহাদ। এবার সে যে ঘরটায় এসে দাঁড়ালো সেটা একটা অদ্ভুত রকমের ঘর। কিছুটা ল্যাবরেটরির মতো দেখতে। অদ্ভুত আকারের শত শত শিশি আলমারিতে সাজানো রয়েছে। ঘরটা শাতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আলমারিটার কাছে এগিয়ে গিয়ে শিশিগুলোর গায়ে আটা লেবল পড়ে শিউরে উঠলো শহীদ। শত শত ছেলেকে চিরতরে অন্ধ করে দিয়ে তার চোখের কর্নিয়া বের করে ভর রাখা হয়েছে বিশেষভাবে তৈরি– এই ছোট শিশিগুলোতে। দাঁতে দাঁত চেপে ঘরটা ছেড়ে অন্য একটা ঘরের উদ্দেশে পা বাড়ালো শহাদ। মাঝখানের দরজাটা অতিক্রম করেই থমকে দাঁড়ালো সে। একজন ডাক্তার একটা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন পড়ছেন। শহীদের পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। স্টেনগানের মুখ তার দিকে উচির শহীদকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার, মি. নজরুল! স্টেনগান হাতে কোথায় চলছেন?’
গম্ভীর কণ্ঠে শহীদ বললো, আমার নাম নজরুল ইসলাম নয়, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের নাম আপনি নিশ্চয়ই শোনেননি, আমি সেই শহীদ খান। নজরুল ইসলামের ছদ্মবেশে আছি। আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিন ভালো চান তো।’ | অবাক দৃষ্টিতে ডাক্তার তাকিয়ে রইলো শহীদের দিকে। তারপর মুখ খুলতে গিয়েই বাধা পেলো শহীদের কণ্ঠস্বরের, ‘দরকার নেই আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় ব্যয় করার। তালমানুষের মতো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। তা না হলে গুলি করবো।’
যন্ত্রচালিতর মতোই উঠে দাঁড়ালেন ডার। তারপর শহীদের পরবর্তী আদেশ অনুযায়ী টেবিলের কাছ থেকে কয়েক পা সরে এসে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন নিঃশব্দে। ডাক্তারের পকেট সার্চ করে কিছুই পেলো না শহীদ। সে তার নিজের পকেট থেকে সিল্কের কর্ড বের করে বেঁধে ফেলে রাখল। ডাক্তারকে মেঝেতে। ডাক্তারকে বাঁধা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ লাউড স্পীকারে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো শহীদ ‘নজরুল দোতলায় উঠে এলো তাড়াতাড়ি! সর্বনাশ হতে বাকি নেই কিছু! একতলায় উঠছি আমরা। ডাক্তার আর সেন্ট্রি দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। বেশি লোকর দরকার হতে পারে। লিফট নামিয়ে দিচ্ছি।’
চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। দোতলায় যেতে চাইলেই সে যাবে কিভাবে। লিফট কোন দিকে তা কে জানে। হঠাৎ ঘড় ঘড় করে একটা শব্দ হলা ঘরের বাইরে।
১৫
ছুট ঘরর বাইরে এসে দাঁড়ালো শহীদ। বারান্দার এক কোণে দেখা যাচ্ছে একটা লিফট। এখনি নিচে নেমে এসেছে ওটা দোতলা থেকে।
দোতলায় উঠে দুজন সেন্টির মতদেহ ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পেলো না শহীদ। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা সিঁড়ি পেয়ে গেল সে। কালবিলম্ব না করে সিঁড়ি টপকে উঠতে শুরু করলো তৎক্ষণাৎ। সিঁড়িটা একটা প্রশস্ত ঘরে এসে শেষ হয়েছে। শূন্য ঘর। ঘরটার চারদিকে অনেক গুলো খোলা দরজা। কোন দিকে যাবে ভেব ঠিক করতে পারলো না শহীদ। এমন সময় গুলির শব্দ শুনে চমকে উঠলা। পরমুহূর্তে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলো ঘর ছেড়ে। রিভলভারের শব্দ ঘন ঘন কানে আসছে তার। কখনো ঘরের ভিতর দিয়ে কখনো অন্ধকারে উঠান পেরিয়ে সামনে ছুটতে লাগলো শহীদ। অবশেষে একটা আলোকিত গন্ত উঠানের পিছন দিকে এসে দাঁড়ালো সে। তারপরই দেখলো লোক তিনজন এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে দুর্গার প্রধান গেটের দিকে লক্ষ্য কর। দূর্গর ভিতর, গেটের পাশেই কেউ লুকিয়ে আছে বুঝতে পারলো শহীদ। সেখান থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। পিছন শহীদের উপস্থিতি টের পায়নি লোকগুলো। সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। মিনিট দ’য়েকের মধ্যেই লোকগুলোর গুলি শেষ হয় গেল। সঙ্গে সঙ্গে আড়াল থেকে বের হয়ে বর্ষার কণ্ঠ শহীদ বলে উঠলো, ‘মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই।’
| ভয়ানকভাবে চমকে উঠলো লোকগুলো। কিন্তু মাথার উপর হাত তুলে রাখতে কেউই বিলম্ব করলো না।
‘পিছন ফিরে তাকাবার দরকার নেই। আমি তোমাদের কাছে নজরুল ইসলাম বটে, কিন্তু আসল নই, নকল!
শহীদের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গার বিরাটাকার গেটের আড়াল থেকে কালো আলখাল্লা পরিহিত স্বং কুয়াশা বের হয়ে এলো।
‘ধন্যবাদ, বন্ধু। কিন্তু শহাদ আর একমুহূর্ত এখান থাকা উচিত নয় আমাদের। ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি আমি সম্পূর্ণ দুটা। সলতত আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। মিনিটখানেকের মধ্যেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দুটা ধসে পড়বে।’
কুয়াশার কথা শেষ হতে আঁতকে উঠলা শহীদ। বললো, ‘সর্বনাশ! ভিতরে যে মানুষ আছে দেখে এসেছি।’
কুয়াশা বললো, ‘না, কোনো মানুষ আর নেই। যাদেরকে বন্দী করে রেখেছিলাম আমি তাদের সবাইকেই আমার লোকেরা দূর্গের বাইরে নিয়ে গেছে। ওদেরকে আমি পুলিসের হাতে সোপর্দ করতে চাই। আর সময় নেই শহীদ, চলা বেরিয়ে পড়া যাক।’
‘ এক সঙ্গে টের দিকে দৌড় দাও তোমরা তিনজন।’ চিৎকার করে উঠলো শহীদ লোক তিনজনের উদ্দেশ্যে।
দুর্গের বাইরে চন্দ্রলোকিত মরুভনি। নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছতেই প্রথম বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলো ওরা। তারপর ঘন ঘন ডিনামাইট ফাটার গগনবিদারী ১৫৬
শব্দ সকলের কানে তালা লাগার দশা হলো। ক্রমশই দুটা ধসে পড়তে লাগল। চতুর্দিক থেকে। ডিনামাইট কাটার শব্দ ক্রমেই কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো।
বিশাল দুর্গর একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত পর্যন্ত ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ড ঘটতে লাগলো নির্জন মরুভূমিতে।
| ডিনামাইট কাটার শেষ শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই শহীদ ও কুয়াশা লোক তিনজনকে বেঁধে ফেলেছে দড়ি দিয়ে। কোনদিকে যখন কোনো শব্দ নেই আর তখন একটা হেলিকপ্টার আসার শব্দ শুনে শহীদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো, ‘কপ্টারটা আমারই।
| আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো শহীদ।
ইতিমধ্যে ‘কপ্টারটা নেমে পড়েছে অদূরে। দুজন লোক নেমে এলো সেটা থেকে। কুয়াশা এগিয়ে গেল ‘কপ্টারটার দিকে। তারপর লোকগুলোর সঙ্গে কি আলোচনা কর শহীদের কাছে ফিরে এসে বললো, ‘তোমার বন্দীগুলোকে আমার জিম্মায় এখন গচ্ছিত রাখতে পারো শহীদ। করাচীতে ফিরিয়ে নিতে পারবে।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শহীদ। বন্দী লোক তিনজনকে নিয়ে চলে গেল কুয়াশার লোকেরা।
‘কপ্টারটা আকাশপথে অদৃশ্য হয় যেত একটু পরে শহীদ বললো, ‘কামালকে হারিয়েছি আমি, কুয়াশা। তাকে।
মৃদু হেসে কুয়াশা বললো, ‘বৃথা আশঙ্কা করছে শহীদ। কামালক আ7ি নদী থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে এসেছি। তারও আগে গুহার ভিতর ঢুকে তোমার পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিলাম আমি।’
শহীদ বললো, ‘ধন্যবাদ, কুয়াশা। কিন্তু মি. সিম্পসনের খবর কি বলতে পারে?
হাসতে হাসতে কুয়াশা বললো, ‘মি, সিম্পসন আহত অবস্থায় আমারই তত্ত্বাবধান আছেন।’
হঠাৎ মনে পড়ে যেতে শহীদ বললো, আসল কথাই যে জিজ্ঞেস করা হয়নি। দুর্গের ভিতরের সব ছেলেকে উদ্ধার করেছে তো?’
কুয়াশা বললো, ‘মিথ্যে তোনার দুশ্চিন্তা, শহীদ। মোট আড়াইশো ছেলেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
অস্বাভাবিক কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো শহীদ, আড়াইশো কেন? তোমার কি বুদ্ধি ভ্রংশ হলো কুয়াশী? আড়াইশো ছেলেকে উদ্ধার করেছে যে! দুর্গ ছেলে ছিলো মোট চারশো।
‘চারশো! থতমত খেয়ে কুয়াশা শহীদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ‘নিশ্চই চারশী। এই দেখো চারশো ছেলের লিস্ট।
পকেট থেকে একটা লম্বা মতা কাগজ বের করে শহীদ কুয়াশার হাতে দিলো।
কুয়াশী-১২
১৫৭
কাঁপা হাতে কাগজটা নিয়ে দেখলো কুয়াশা। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। কাগজটা থেকে মুখ তুলে কুয়াশা শহীদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইলা। তারপর বললো, ‘কোথায় পেল তুমি লিস্টটা?’
অধস্বর শহীদ বললো, ‘যে লোকগুলোকে এখন পাঠালাম তোমার ‘কপ্টার কর ওদের সঙ্গে হায়দারাবাদ থেকে আসছি আমি। ওদের মুখে তো তথ্যটা জেনেই ছিলাম, কাগজটাও সংগ্রহ করেছিলাম ওদের কাছ থেকে।
| নিথর দাড়ি রইলো কুয়াশা। দেড়শো ছেলের হত্যাকারী বলে নিজেকে কোনমতে মেনে নিতে পারছিল না সে। ‘তুমি জানত না কুয়াশা দুর্গের কোন স্তরে, কোন দিকে কত ছেলে আছে?’ কঠিন চালায় প্রশ্ন করলা শহীদ।
স্তর। তার মানে?’
তুমি জানতে না কুয়াশা দুটার নিচের দিকে আরো দুটো স্তর আছে? সেখানে কেনা না কোনো জায়গায় আরো ছেলে থাকতে পারে সে কথা তোমার মনে হয়নি
একবারের জন্যও?’
নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। কোনো কথাই তার মুখে জোগাচ্ছে না। দুর্গের নিচের তলায় যে আরও এক বা একাধিক জগৎ ছিলো তা কুয়াশা ঘুণাক্ষরেও জানতো
না।
অস্বাভাবিক মূর্তিতে রূপান্তরিত হলো শহীদ। কঠিনতর হয়ে উঠলো তার কণ্ঠস্বর। তীক্ষ্ণ ভর্ৎসনার স্বরে জিজ্ঞেস করলো সে, ‘উত্তর দাও, কুয়াশা। কি বলবার আছে তোমার দেড়শো নিষ্পাপ ছোটো ছোটো ছেলের জীবন সম্পর্কে?’
বিমূঢ় কণ্ঠে এতক্ষণ কুয়াশা আর কথা বললো, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না, শহীদ। আমি খবর পেয়েছিলাম দুর্গ আড়াইশো ছেলে আছে, কিন্তু আর
‘কে বলেছিল তোমাকে আড়াইশো ছেলে দুর্গ আছে, জানতে চাই।’
‘একটা ছোটো ছেলেকে ভিতরে পাঠিয়েছিলাম আমি, ওয়্যারলেস মারতে সে-ই খবরটা জানায় আমাকে। আমি,
চিৎকার করে উঠে কুয়াশাকে বাধা দিলো শাঁদ, ‘একটা বাচ্চা ছেলের ওপর আস্থা রেখে দুৰ্গটা উড়িয়ে দিতে পারলে তুমি, কুয়াশী! অদ্ভুত, অদ্ভুত তোমার কাও–কারখানা। আসলে পৃথিবীতে তুমি একটা অভিশাপ, কুয়াশা। নিজেকে তুমি ভালো মানুষের দুর্ভাগ্য মোচনকারী বৈজ্ঞানিক হিসেব, দুস্থ মানুফ জন্যে আশীর্বাদ হিসেবে–কিন্তু ভুল, তা তুমি নও, কুয়াশা! আমরাও- তোমাকে ঠিকমত চিনতে পারিনি, কুয়াশা। তা নয়তো এতে দ্বিধা জনায় কেন, এতে ভয় কেন, এতো মায়া কেন, কেন এতো সহানুভূতি তোমার প্রতি আমাদের সকলের? ভুল ধারণা আমাদের, সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসল। ব্যাপার বুঝতে পারছি আমি। তুমি সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ, মানুষ খুন করা তোমার নেশা। জ্ঞান-অজ্ঞানে, চেতন-অবচেতনে তুমি রক্তপিপাসু। তুমি চেষ্টা করলেও পারবে না মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে। তুমি
৫৮
* ভলিউম-১
শহীদ।
যন্ত্রণায় যেন ককিয়ে উঠলো কুয়াশা। শহীদের প্রতিটি শব্দ চাবুকের মতো হৃদয় আঘাত করছে তারা।
‘বলত দাও আমাকে তোমাকে আমি ভূল চিনছিলাম, কুয়াশা। তোমার কোন দোষ নেই এতে। সৃষ্টিকর্তার এই-ই ইচ্ছা, তোমাকে দিয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করছেন। কি গঢ়ি উদ্দেশ্য এর মধ্যে আছে তা তিনিই জানেন একাত্র।’
থরথর করে কাঁপছে শহীদ। অস্বাভাবিক তা হয় উঠছে তার দৃষ্টি। লাল টকটকে হয়ছে চোখ দুটো। সর্বশরীর দিয়ে যেন আগুন ছুটছে।
শহীদের কথা শেষ হয়ত স্থির, গম্ভীর গলায় কুয়াশা বললো, ‘তুমি যা বলল তা কি তোমার মনের কথা, শহীদ? তুমি কি মনে মনে কথাগুলো সত্যি বলে বিশ্বাস করা?’
ভালমন্দ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে শহীদ। ভেবেচিন্তে কোনো কিছু করার বা বলার মতো অবস্থা নয় তার তখন। কুয়াশার প্রশ্ন শুনে সে কঠিন গলায় বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ প্রতিটি কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কুয়াশা!’ আবার শোনো, তুমি মানুষের উপকার না করে চিরটা কাল অপকার কর যতই বাধ্য। মানুষের জন্য আশার্বাদ নও তুমি, অভিশাপ!
‘তবে এখন যা করা উচিত তাই করা, শহীদ। ভয় পেয়ো না, পিছিয়ে যেয়ো না দুর্বলতায়, দ্বিধা করা না কোনরকম।’
‘স্থির অবিচলিত কণ্ঠে কথা কটি বল শহীদের দিকে নিজের রিভলভারটি ছুঁড়ে দির আবার বললো, ‘গুলি করা আমার বুক লক্ষ্য কর। মনুর জন্য অভিশাপকে
চিরদিনের জন্যে মানুফর পৃথিবী কে সরি দাও।’
| শহীদ বুঝি পাগল হয়ে গেছে। স্থির হতে পারলো না সে কোনমতে। উত্তেজনায়, কাঁপছে নে। খপ কর কুয়াশার রিভলভারটি ধর.নিলো সে।
অস্বাভাবিক উত্তেজনায় হাত যে কাঁপছে শহীদের। কিন্তু সেদিকেও খেয়াল নেই তার। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কাঁপা হাতে পরপর দু’বার টিপে দিলো সে রিভলভারের
টগার।
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভর লি কুয়াশা আর শহীদের মধ্যবর্তী জায়গাটুকু। গুলি শেষ হয়ে যেতেই রিভলভারটি পড়ে গেল বালিতে শহীদের কাঁপা হাত থেকে খসে। দরদর করে ঘামছে লে ফাঁকা মরুভূমির শীতল আবহাওয়াতে।
ধোঁয়া সরে যেতে নির্বাক তাকালো দুজন দুজনের দিকে। অরুত শরীরে নিথর দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশী একই জায়গায়। যেন একটা প্রাণহন স্ট্যাচু। নিষ্পলক দৃষ্টি তার শহীদের মুখের উপর শান্ত ভাবে রাখা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মিলেমিশে ফোঁটায়
পরিণত হচ্ছে। আর শহীদ কাঁপছে তখনও দুর্দমনার উজেনায়।
‘একটা গুলিও লাগাতে পারল না, শহীদ! তোমার পকেট হয় তা রিভলভার আছে, কিংবা তোমার পাশেই রয়েছে স্টেনগান–স্টেনগানটাই তুলে নাও, শহীদ। এতে
শি-১২
এবার কাজ হল, দেখা।’
তেমনি ভঙ্গিত দাড়ি থেকে কুয়াশা কা কটি বললো।
কথা জোগাতলা না শহীদের মুখে। নির্বাক, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। কুয়াশার দিকে তাকাতে না পেরে। হঠাৎ দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আবদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো সে, ‘আমাকে ক্ষমা করো, কুয়াশা, ক্ষমা করা আমাকে।’
মুখ ঢেকেই দাঁড়িয়ে রইল। শহাদ। একটু পরই তার কাঁধে কুয়াশার হাতের মোলান স্পর্শ অনুভব করলো সে।
কুয়াশা হাসিমুখে বললো, ‘আজ আমার নবজন্ম হলো, শহীদ! সত্যি তুমি আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করছি তোমার সামনে, আমি আজ থেকে নরহত্যাকে মৃণা করবো। আমি আর কখনো আমার সাধনার জন্য, স্বার্থের জন্য নরহত্যা করব না। অৰ্তত যে সব নরহত্যা আমার দ্বারা ঘটেছে তার জন্য আমি অনুতপ্ত।’’
মুখ থেকে হাত নামিয়ে কুয়াশার মুখের দিকে তাকালো শহীদ। গম্ভীর মুখাবয়ব বদলে লি কুয়াশার। মৃদু হাসলো সে। এমন সময়, অদূরই ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে সচকিত হয়ে তাকালে দু’জন। চাঁদের আলোয় দেখা গেল একজন ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে এদিকে। | ঘোড়সওয়ারটিকে ভালো করে দেখেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শহীদের মুখ দেখেই চিনতে পেরেছে সে কামালকে।
ওদের সামনে এসে দ্রুত নামলো কামাল ঘোড়া থেকে। শহীদকে দেখতে পেয়েই আনন্দ চিৎকার করে উঠলো সে, ‘তুই তাহলে এখানেই আছিল, শহীদ! আর আমি। ভাবছি…
তোর কি খবর, কামাল?’
হাসিমুখে কামাল বললো, ‘খবর ভালো। গুলির শব্দ শুনে ছুটে আসছি দেড়শো ছেলেকে নিরাপদ একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে। ছেলেগুলোকে আমি দুর্গের দ্বিতীয় স্তর থেকে উদ্ধার করছি।’
| চমকে উঠলো শহীদ কামালের কথা শুনে। কি প্রচণ্ড ভুল করে বসেছিল সে। কুয়াশার দিকে তাকাতে পারলো না সে অপরাধবোধ জর্জরিত হয়ে।
কুয়াশা শহীদকে লক্ষ্য করে বললো, ‘লজ্জার কিছু নেই, শহীদ। অনুশোচনার দরকার নেই তোমার। তুমি আমাকে যা বলেছো, যা করেছে তা তো আমার জন্যে প্রয়োজন ছিলো। তা না হলে কি আমি আমার ভুল ধরতে পারতাম?’
ধীর কণ্ঠ শহীদ বললো, ‘তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে, বন্ধু?
হেসে ফেলে কুয়াশা বললো, ‘ক্ষমা চেয়ো না, শহীদ। কোনো অপরাধই তুমি করনি। সর্বশক্তিমান বিধাতার | কাম্য ছিলো তাই করিয়েছেন তিনি তোমাকে দিয়ে। তোমার অপরাধ তো আমি দেখছি না কোথাও।’
| কামাল কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগলো কুয়াশা ও শহীদকে।
৬০ .
| কুয়াশা এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো, ‘তোমরা যাও, শহীদ। ‘কপ্টার। পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। আমার লোকেরা তোমাদেরকে ‘কপ্টারে করে নিয়ে যাবে নদীর ওপারে। সেখানে কয়েকটা ডিঙ্গি নৌকা আছে। নৌকার মাঝিরা আধঘন্টার মধ্যে জাঁহাবাজ স্টিমারে পৌঁছে দেবে তোমাদের সকলকে। তোমরা পৌঁছবার আগে জাহাজ ছাড়বে না। ছেলেগুলোকে ‘কপ্টারে করে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা আমি করছি–কেমন?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো শহীদ।
ঘুড়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চললো। হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা পকেট থেকে ছোট্টো ওয়্যারলেস যন্ত্রটা বের করে মুখের কাছে তুলে ধরে কি যেন বললো। তারপর যন্ত্রটা পকেটে ভরে আবার হাঁটতে লাগলো।
শহীদ দেখলো কালো আলখেল্লা পরিহিত কুয়াশার বিশাল মূর্তিটা লম্বা লম্বা পা ফেলে মরুভূমির দিগন্ত বিস্তৃত ধু-ধু বালির রাজ্যে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ একসময় একটা বালিয়াড়ির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল মূর্তিটা।
| তারপরও আচ্ছন্নের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলো শহীদ বিবিক্ত হৃদয়ে।
Leave a Reply