১১. লালসা (ভলিউম ৪) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১১
এক
শীতের সকাল।
একটু আগে শহীদ, কামাল, মহুয়া ও লীনা একসঙ্গে নাস্তা সেরেছে। নাস্তা খাওয়া শেয় হতেই মহুয়া আর লীনা গেছে পাশের বাড়ির জিনা আপার কাছে উলের নতুন ডিজাইন শিখতে–আসলে পরচর্চা করতে। শহীদ পা পর্যন্ত গরম চাদরে আবৃত করে রোদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা ফাইল। বিশালবন থেকে ফিরে শহীদ আবার তার ব্যবসায় মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। কামাল তার একমাত্র অংশীদার–ব্যবসাতেও। শহীদের বাড়িতে কামালের যাতায়াত তাই আগের মতোই অব্যাহত আছে।
নতুন একটা প্রোডাক্ট চালু করার আগে নমুনা হিসেবে বাজারে কিছু ছাড়া হচ্ছে। ফাইলটাতে সে সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গভীর মনোযোগ সহকারে ফাইলট। তাই পড়ছিল শহীদ।
কামাল তার সামনে বসেছিল। সে তেপায়ের ওপর লানার সদা কেন। পাঠ্যপুস্তকগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল।
শহীদের হাতে একট। বলপয়েন্ট কলম। সে মাঝে মাঝে ঝুঁকে পড়ে ফাইলটাকে কায়দা করে ধরে জরুরী জায়গাগুলোতে দাগ দিচ্ছিলো।
এমন সময় গফুর একটা খাম হাতে করে ঘরে ঢুকলো। দাদামণির দিকে তাকালো সে একবার। তারপর হাতের খামটার দিকে। মুখ নিচু করে ভাবলো কি যেন। কাজের সময় দাদামণিকে বিরক্ত করতে চায় না সে। এমন সময় শহীদের ডাক শুনে চমকে উঠলো গফুর।
গফুর! ‘বলো, দাদামণি।’ ‘তোর হাতে ওটা কি?’ ‘চিঠি, দাদামণি।
‘দে! ফাইল থেকে মুখ না তুলেই ডান হাতটা গফুরের দিকে বাড়িয়ে দিলো শহীদ।
| গফুর ওর হাতে ফিকে হলুদ রঙের খামটা তুলে দিতেই রোদের আলোতে খামের ৫–
*।
ভিতর চিঠিটার অবস্থান দেখে নিয়ে সাবধানে মুখটা ছিঁড়ে ফেললো শহীদ। তারপর খামের ভেতর থেকে দু’আঙুলের সাহায্যে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলো। | চিঠি পড়তে পড়তে শহীদের কপালের চামড়া কুঁচকে উঠলো। একটু পর চোয়ালের দু’দিকের মাংসপেশীও কঠিন হয়ে উঠলো যেন।
কামাল শহীদের এই ভাবান্তর লক্ষ্য করছিল। সহজে বিক্ষুব্ধ বা বিচলিত হওয়ার পাত্র শহীদ নয়। কামাল এ কথা ভালো করেই জানে। সে তাই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলো
।
‘কি ব্যাপার শহীদ?’ কামাল উদ্বিগ্ন কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো। শহীদ কোনো কথা না বল চিঠিটা কামালের দিকে বাড়িয়ে দিল৷ শুধু। চিঠিটা নিম্নরূপ : প্রিয় শহীদ,
‘ বিশেষ একটি জরুরী ব্যাপারে তোমার সাহায্য কামনা করে এই চিঠি লিখছি।
‘ আমার একমাত্র পুত্র টুটুলকে কে বা কারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। আমার বাড়ির আশপাশ থেকেই ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। পুলিস এ পর্যন্ত ব্যাপারটার কোনো সুরাহা করতে পারেনি।
| লোক মুখে এবং সংবাদপত্র তোমার কীর্তি কাহিনীর কথা আমি অনেক শুনেছি। আমার ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানগরিমা এবং কর্মনিপুণতায় তোমার মতো আর একটিও চোখে পড়েনি।
টুটুলকে উদ্ধার করার ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্য কামনা করি। আশা করি, পুত্রশোকাতুর্যকে তুমি হতাশ করবে না।
ড. আবু সুকিয়ান
জালালাবাদ তা তুই কি করবি এখন?’ চিঠি পড়া শেষ হতেই শহীদের দিকে তাকিয়ে কামাল জিজ্ঞেস করলো।
‘স্যারের অনুরোধ আমি উপেক্ষা করতে পারবো না।’ শহীদ হাতের ফাইল আর কলমটা সামনে তেপয়র ওপর রেখে চেয়ার থেকে পা দুটো নামিয়ে বললো, ‘তুই তো
জানিস, উনি আমাকে কি স্নেহই না করতেন। প্রফেসর সুফিয়ানের কাছে আমি কত দিক দিয়ে কতা ভাবে যে ঋণী, তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। ভেবেছিলাম। স্যারের ঋণ বুঝি এ জীবনে আর শোধ করতে পারবো না। এখন একটা সুযোগ পেয়েছি স্যারের সেবা করার। এমন সুযোগ কি আমি হেলায় হারাতে পারি? তুই-ই বল?’
| ‘তাহলে কখন রওনা হচ্ছি, আমরা জালালাবাদে?’ কামাল আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলো।
ভলিউম-১
আমরা নয় বন্ধু। শহীদ হাসিমুখে মাথা নেড়ে বললো, ‘এবার আমি একাই যাবো। তোর ওপর এবার ব্যবসা খবরদারী করার ভারটা দিয়ে যাবো ভাবছি।
‘এই কি তোর শেষ কথা?’ অভিমান ফুটে ওঠে কামালের মুখে।
‘তুই হঠাৎ এমন সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়লি কেন বলতো?’ শহীদ কামালের আহত মুখভাবের দিকে তাকিয়ে বল, ব্যবসাটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।’
‘থাক, তোকে আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না।’ কামাল মাঝপথেই শহীদকে থামিয়ে দেয়, ‘আমি বুঝছি।’
কথাটা বল পর্দা ঠেলে ঘরের বাইরে চলে যায় কামাল। শহীদ ওর যাওয়ার দিকে লক্ষ্য করে হাসতে থাকে। ভাব, সত্যি কামালটা মাঝে মাঝে এমন অবুঝ হয়ে ওঠে। কিন্তু শহীদ তার সিদ্ধান্তে অটলই থাকে। কামালকে সে এবার সঙ্গে নেবে না
কোনমতেই। একজনের অবর্তমানে বিজনেস যাতে লাটে উঠে না যায় সেজন্যে আর একজনকে অবশ্যই থাকতে হবে ঢাকায়।
মনে মনে ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে শহীদ। তারপর গলা ছেড়ে হকি দেয়, ‘গফুর।’
খানিক পর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় গফুর, ‘বলো, দাদামণি।’
‘শোন, কাছে আয়।’ শহীদ বলে, ‘আজ রাতে আমি একটু বাইরে যাবো। তুই বিছানাপত্তর সব বেধে রাখ দিকি। আর শোন, সাড়ে সাতটার সময় একটা ট্যাক্সি ডেকে আনবি। বলবি, স্টেশন যায়গা, কেমন?’
মাথা ঝাঁকিয়ে বের হয়ে যায় গফুর।
টেলিফোনে ব্রেলর সীট রিজার্ভ করে রেখেছিল শহীদ। স্টেশনে ট্যাক্সি থেকে নেমে মুটের মাথায় স্যুটকেস আর হোল্ডঅল চাপিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোতে থাকে সে। জালালাবাদ এক্সপ্রেস মাত্র কিছুক্ষণ আগে ‘ইন’ করেছে, ছাড়বে আর মিনিট সাতেক পর।
| প্ল্যাটফর্মে বেজায় ভিড়। ভিড়ের মাঝখানে রাস্তা করে সামনে এগোনো মুশকিল। শহীদ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সঙ্গের মুটেটার পরও তার বিরক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। ব্যাটা যেন নবাব পুঙুর, আর একটু জোরে পা চালায় না কেন, ভাবছিল শহাদ।
| এমন সময় প্ল্যাটফর্মের দূরপ্রান্তের একটা লাইটপোস্টের নিচে চোখ পড়তেই মুখভাৰ কঠিন হয়ে ওঠে শহীদের। লাইটপোস্টের নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মাথায় ফেল্ট ক্যাপ, মুখে চুরুট। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে চুরুটটা কায়দা করে ধরে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ছে লোকটা। ট্যাক্সি থেকে নেমে ডাইভারকে ভাড়া দেবার সময়ও লোকটাকে দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল শহীদ। তখন অবশ্য ব্যাপারটার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু,
এই মুহূর্তে লোকটা তার দিকে উদ্দেশাহীন ভাবে অমন একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে সত্যিই অবাক হলো শহীদ।
আর কয়েক মিনিট পরই ট্রেন ছেড়ে দেবে। সুতরাং শহীদ, আপাততঃ কামরাটা খোঁজায় মনোযোগ দিলো। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে, ভাবলো সে। আরও মিনিট খানেক সময় ব্যয় করার পর নির্দিষ্ট কামরাটি খুঁজে পেলো শহীদ। রেলওয়ের ট্যাগ লেখা নাম আর নম্বর দেখে মুটকে মোট তুলতে বলে সে উঠে পড়লো। ট্যাগ আরও একজন যাত্রীর নাম লেখা ছিলো। কিন্তু শহীদ তাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। নিজের নাম জে পেয়েছে এই তার পক্ষে যথেষ্ট।
| স্যুটকেট। সীটের নিচ ঠেলে দিয়ে হোল্ডঅলটা বাঙ্কের উপর পেতে নিলো শহীদ। ব্যাঙ্কে শেলে ট্রেনের দোলাটা লাগে কম। শোবার সুবিধা। তাই এই ব্যবস্থা।
ট্রেন ছাড়বার শেষ হুইসল পড়ত আর দেরি নেই। ইদ একটা সিগারেট ধরিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে তাকালো। তার কামরায় আরও একজন যাত্রীর সার কথা। সে এলো না কেন সে কথাই ভাবছিল শহীদ। হয়তো জরুরী কোন কাজ আটকে গেছেন। ভদ্রলোক, শহীদ ভাবলা, কিংবা, বলা যায় না স্টেশনে পৌঁছবার পথে হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডেই হয়তো কাতরাচ্ছেন এখন ভদ্রলোক। আজকাল শহরে অ্যাকসিডেন্টের যা হিড়িক পড়েছে, কিছুই বলা যায় না নিশ্চিত ভাবে।
এমন সময় পূর্বোক্ত সেই লোকটাকে তার কামরার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগোতে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না শহীদ। সঙ্গে গার্ড রয়েছে টর। খুব সম্ভব নিজের কামরাটা খুঁজে পাচ্ছে না বলেই লোকটা গার্ডের শরণাপন্ন হয়েছে। কিংবা এটা হয়তো নিছক একটা ভান। আসলে লোকটার উদ্দেশ্যই খারাপ। | যা ভেবেছিল তাই। তার কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। গার্ড ট্যাগটার ওপর চোখ বুলিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই কামরাতেই আপনার, সীট, মি. জাফর।’
‘থ্যাঙ্ক ফর দি ট্রাবল ইয়ু টুক। ফেস্ট ক্যাপ মাথায় ভদ্রলোক গার্ডের দিকে হেসে কথাটা বলে হ্যাঁণ্ডেল ধরে কামরায় উঠে পড়লো।
শহীদ একপাশে সরে দাঁড়ালো। সে লক্ষ্য করলো লোকটার সঙ্গে পরনের কাপড় চোপড় ছাড়া আর কিছুই নেই।
দীর্ঘ একটা হুইসল বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রদানবটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর ক্রমশঃ যেন ভয়তাড়িত কোনো জন্তুর মতো দুত বেগে ছুটতে শুরু করলো সেটা।
ঢাকা স্টেশন পেরিয়ে বেশ কিছুদূর এগোবার পর শহীদ সরে এল। দরজা থেকে। তাকালো একবার শেষ মুহূর্তের যাত্রীটার দিকে। তারপরই অভাবিত একটা কাণ্ড করে বসলো সে। দরজা থেকে ছুটে এসে আগন্তুক যাত্রীটার ফেস্ট হাটটা খামচে ধরে চুলসুদ্ধ টুপিটা খুলে নিলো তার মাথা থেকে। আগন্তুক ভদ্রলোক নিজের সীটে বসে পায়ের ওপর পা তুলে নিজস্ব ভঙ্গিতে চুরুট টানছিলেন। এমন একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সে কথা | তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। শহীদ তার টুপিসুদ্ধ পরচুলাটা খুলে নিতেই ভদ্রলোক
৬৮
| ভলিউম-১
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই শহীদ, আস্তে!
| ‘তুই বুঝি সামান্য একটা পরচুলা আর হাভানা একটা চুরুটের দৌলতেই আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি ভেবেছিল, না কামাল?’ শহীদ মাথা দুলিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো। | ‘কিন্তু তোকে যে শুরু,তই একটা ব্লাক দিতে পেরেছি সেটা আশা করি অস্বীকার করতে পারবি না?’ কামাল হাসিমুখে বললো।
‘না, তা অস্বীকার করবো না। কিন্তু তুই ধরা পড়েছিস তোর কণ্ঠস্বরর জনা। গার্ডকে ধন্যবাদ না জানলে হয়তো তুই কিছুক্ষণ তোর ছদ্মবেশ বজায় রাখতে পারতিস। আমার সজাগ কানকে ফাঁকি দেয়া তোর কাজ নয়।’ কথাটা বলে সবজান্তার হাসি হাসে শহীদ।
তাহলে, আমাকে সঙ্গ নিতে তোর আপত্তি নেই, কি বলিস?
‘এখন সে-প্ৰশ্ন অবান্তর। হাজার হোক, প্রাণাধিক বন্ধুকে তো আর চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারি না।’
‘আচ্ছা, টুন তো জালালাবাদে পৌঁছবে ভোর রাতে, তখন কি ড. সুফিয়ানকে বিরক্ত করা উচিত হবে আমাদের?’ কামাল জিজ্ঞেস করে।
‘আমরা তো স্যারের বাসায় উঠবে। না। আমরা উঠবে হোটেল ডি করোনেশনে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অকুস্থল থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখেই অনুসন্ধান কাজ চালানো বুদ্ধিমানের কাজ। তাতেই সুবিধা বেশি।’
তার মানে?’ কামাল বঝত না পেরে জিজ্ঞাস করে। | ‘মানে খুবই সোজা।’ শহাদ কোটের পকেট থেকে আজকের খবরের কাগজট। বের করে একেবারে কামালের নাকের কাছে ধরে, দেখ, এখন তোর পড়তে অসুবিধা হচ্ছে তো? কিন্তু নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রাখলেই পড়তেও সুবিধা হবে, আর চোখের ওপর স্ট্রেইনও কম পড়ব, ঠিক বলিনি কথাটা আমি?
‘ঠিক।’ কামাল মৃদু কণ্ঠে উত্তর দেয়। ‘তোর তুলনা হয় না!
রাত শেষ হয়ে আসছে।
বরাবরের অভ্যাসমত নামাজ পড়ার জন্য ঘুম ভেঙে যেতে পাশের খাটের দিকে চোখ পড়তেই চোখমুখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো আয়শা বেগমের। তার মানে, আজও সারা রাত ড. সুফিয়ান লাবরেটরিতেই কাটিয়ে দিলেন। চাপা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো আয়শা বেগমের বুক থেকে।
নামাজ পড়া শেষ হত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলেন আশেয়া বেগম। চাকর
বাকররা এখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। বারান্দা পেরিয়ে ল্যাবরেটরির দিকে নজর পড়তে দূর থেকেই উজ্জল বাতিটা চোখে পড়লো তার। ঘরের দজার পান্না দুটা হাট করে খোলা। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আশা বেগন দেখতে পেলন, টেবিলের ওপর মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন ড, সুফিয়ান।
| বেদনায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আয়শা বেমের। নিজের অজান্তেই পা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ মেঝেতে কি দেখে ভয়ানক দাঁড় গেলেন তিনি। পরক্ষণেই একটা আর্তচিৎকার বের হয়ে এলো তাঁর গলা থেকে। এর ভাষণ তাড়া খেয়ে চকিতে পিছিয়ে এলেন কয়েক পা। চোখ দুটো ভর বিস্ময় আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠলো তাঁর।
হোটল ডি-করানেশনের ছাব্বিশ নম্বর সুইটের টেলিফানটা কনঝন শব্দ আর্তনাদ করে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। টেলিফোনের শব্দ শুনে লেপের তলা থেকে মুখ বের করে তাকালো কামাল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকাতেই শহীদ বললো, ‘টেলিফোনের আর্তনাদ শুনে তোর কিছু মনে হচ্ছে না, কামাল?’
কামাল মাথা নাড়লা।
লেপের তলা থেকে ডান হাতটা বের করে রিসিভারটা তুলে নিতে নিতে শহীদ বললো, ‘টেলিমেনের শব্দ কানে গেলেই আমি বুঝতে পারি খবর শুভ না অশুভ। হ্যালো আচমকা লেপটা এক ঝটকায় সরি দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসলে শহীদ। কানের ওপর নিসিভারটা চেপে ধর নাগ দি অপর প্রান্তের কথা শেনিবার ফাঁকে ফাঁকে;- শোনা গেল তাকে, ‘স্যার বলছেন? আঁ? ..আপনার ল্যাবরেটরির মেঝেতে …চেনেন না আপনি? পুলিশে খবর দেননি এখনও…একটু অপেক্ষা করুন তাহলে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো, কি বলছেন, আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না? . নিশ্চয়ই। ইতিমধ্যে ল্যাবরেটরিতে কাউকে ঢুকতে নিষেধ করুন।’
কি ব্যাপার?’ শহীদ রিসিভারটা ছাড়তেই কমাল উদ্বি কত জিজ্ঞেস করলো। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে।’ শহদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘ড, সুফিয়ানের ল্যাবরেটরিতে একটি যুবতী মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে আজ রে বই।’
‘বলিস কি!’ কামাল, আশ্চর্য কণ্ঠে বলে, ‘ভদ্রলোকের অবস্থা তো সঙ্গীন হয়ে উঠেছে তাহলে। আমি বুঝতেই পারি না, দুনিয়ায় এতো লোক পাকতে নিরীহ এই বৈজ্ঞানিকের ওপর এতো বিপদ নেমে আসছে কেন।’
‘এটা তো খুব পুরানো কথা, ভালো মানুষেরাই তো সবচেয়ে বেশি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, শহীদ বলে, ‘কিন্তু তত্ত্ব কথার সময় এখন ন, তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হয় নে দেখি, আমাদেরকে এখুনি সারের বাড়িতে যেতে হবে।’ | পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয় শহীদ ও কামাল
হোড–করনেশনের
ভলিউম-১
বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাইরে অপেক্ষমাণ একটা বেবিট্যাক্সি কট কট আওয়াজ তুল ওদের সামনে এসে দাঁড়ালা। কোনরকম ইতস্ততঃ না করে উঠে পড়লো ওরা বেবিতে। তারপর ড্রাইভারের উদ্দেশে বললো, ‘মনিপুর রোড চালা।’
মিটার ডাউন করে ড্রাইভার স্টার্ট দিলো গাড়িতে। শহীদ নাসিমুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে রইলো চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ বেবিট্যাক্সির লুকিং গ্লাসের দিকে নজর পড়ত তার বেন মনে হলো চকিত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ডাইভারটি। মনে মনে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলো “হাদ। আবার বাইরের দিকে খানিকক্ষণ। তাকিয়ে থেকে আচমকা চোখ রাখলো লুকিং-গ্লাসটায়। ধরা পড়ে গেছে এবার লোকটা। স্পষ্ট দেখলো শব্দ, লোকটার দুটো চোখ তার দিকে স্থির নিবদ্ধ। চোখাচোখি হতেই চকিতে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিলো লোকটা।
মনিপুর রোড ধরে ছুটছিল গাড়িটা। মাইল তিনেক লম্বা মনিপুর রেড়ি। রোডের শেষ প্রান্তে ডঃ সুফিয়ানের বাড়ি। মাঝপথেই কিন্তু গাড়ি থামিয়ে ফেললো ডাইভার।
নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছিল শহীদ। গাড়ি থেমে যেতে নামতে গোল নে। এমন সম; কামাল বলে উঠলো, ‘এখানে তো নয়। এই ডাইভার গাড়ি থামালে কেন হে? তেল নেই নাকি? | তোতলাতে লাগলো ড্রাইভারটা। ‘তে-তেল আছে সাহেব কিন্তু, মানে, যাবেন কোথায় আপনারা? মনিপুর রোড বললেন না? এটাই তো মনিপুর রোড। * গম্ভীর ‘লায় শহীদ বললো, সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে নাকি, আঁ? এটা মনিপুর রোড়ই, কিন্তু মনিপুর রোড তো এখানেই শেষ নয়, তোমার কি মনে হয়?’
‘জ্বী, হুজুর! আমি মনে করছিলাম।’
কথা শেষ না করেই ড্রাইভার আবার স্টার্ট দিলো গাড়িতে। শহীদ আর কোনো কথা না বলে বাইরে দৃষ্টি কেলে জায়গাটা দেখে নেয় এক কাক।
থামে। এখানে।
শহীদের আদেশে ড্রাইভার ড. আবু সুফিয়ানের আর্কিমিডিস লজ-এর সামনে গাড়িটা দাঁড় করায়। মিটার দেখে পয়সা দিতে গিয়ে শহীদ লক্ষ্য করলো লোকটা ড, সুফিয়ানের বাড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ধমকে উঠলো শহীদ, ‘এই মিয়া! হয়েছে কি তোমার? পয়সা নেব না নাকি?
‘এই যে, হুজুর।’
ঘাবড়ে গিয়ে লোকটা শহীদের হাত থেকে পাঁচ টাকার নোটটা নেবার জন্য হাত বাড়ালো। কি মনে করে শহীদ টাকাসুদ্ধ হাতটা সরিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে পারবে তুমি? আমরা আবার ফিরে যাবো হোটেলে।
লোকটা ইতস্ততঃ না করে উত্তর দিলো, ‘পারবো, হুজুর।
আর কোনও কথা না বলে শহীদ ও কামাল আর্কিমিডিস লজ-এর গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
খোলাই ছিলো চোটটা। গেট ছাড়িয়ে ভিতরে ঢুকতেই ওরা দেখতে পেলো ড, সুফিয়ান দাঁড়িয়ে রয়েছেন উঁচু বারান্দায়। আয়েশা বেগমও রয়েছেন একটু দূরে। চাকর-বাকরেরা বারান্দার নিচে তা দৃষ্টিতে শহীদ ও কামালের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।
শহীদক দেখে বারান্দা থেকে নেমে এলন ড. সুফিয়ান। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মুখ খোলার আগেই শহীদ বললো, আপনার টেলিফোনটা
বোধ হয় উপর তলায়?’
ড. সুফিয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ।
শহীদ বললো, ‘পুলিস ফোন করে নিচে নেমে আসুন আপনি। তারপর লাশটা দেখবো আমি।’
উপর তলায় চলে গেলেন ড. সুফিয়ান। মিনিট দু’তিন পরই নেমে এলেন নিচে।
শহীদের দিকে তাকাতেই শহীদ বললো, ‘আপনার সব কথা পরে শুনবো, স্যার। তার আগে ল্যাবরেটরিতে চলুন, যেখানে মৃতদেহটা রয়েছে।
চিন্তিত কণ্ঠে ড. সুফিয়ান বললেন, ‘চলো।’
ল্যাবরেটরি রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শহীদ বললো, ‘আপনার কথা এখুনি শুনতে চাইনি বলে কিছু মনে করবেন না, স্যার। পুলিশকে সব জানাতে হবে। তখনই সব শুনতে পাবো আমি। একই বক্তব্য শুধু শুধু দুবার করে যাতে না বলতে হয়
| বাধা দিয়ে ড. সুফিয়ান বললেন, ‘আই আণ্ডারস্ট্যাও। আমি কিছু মনে করিনি, শহীদ।
| ড, সুফিয়ানের ল্যাবরেটরি রুমটা বেশ বড়। একটা বড় টেবিল ঘরটার এককোণে। টেবিলের বামপাশে একটা টেবিল ল্যাম্প। সারা টেবিলটায় ছড়ানো রয়েছে বই, প্যাড, পেন্সিল। কয়েকটা বইয়ের পাতা খোলা। চেয়ারের ওপর একটা গরম চাদর অগোছাল ভাবে ঝোলানো, ফোনটা নেঝেতে লুটাচ্ছে। সমস্ত ঘর জুড়ে মাইক্রোস্কোপ, কাঁচের জার, টেস্টটিউব, হিটার ছড়ানো ছিটানো রয়েছে।
তীক্ষ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখে নিয়ে ঘরের ভিতর পা রাখলো শহীদ সন্তর্পণে। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলো গুলটেক্সের একটা নতুন চাদর জড়ানো একটি যুবতীর নিঃসাড় শরীর। বুক অবধি চাদরটা জড়ানো। মুখ, চুল, গলা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটার। দেখে মনে হয় বিশ-বাইশ বছর বয়স হবে। মুখটা দেখে সহজেই আন্দাজ করা যায় যুবতী সত্যিই খুব সুন্দরী। চাদর জড়ানো শরীরটার আভাস দেখেও বোঝা যাচ্ছে যুবতী স্বাস্থ্যবতী ছিলো। একটু যেন বেশিই। তবে দৃষ্টিকটু বলা যায় না। স্বাস্থ্য বর্তী বলতে যা বোঝায় তার বেশি নয়। মুখমণ্ডল গোলাকার মেয়েটির, ববছাট চুল।
| বুকে পড়ে দেখল শহীদ, কিন্তু হাত দিয়ে কিছু ছুঁলো না সে। খানিকক্ষণ নিচু হয়ে দেখার পর টেবিল থেকে ল্যাম্পটা এনে চালাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপর ফিসফিস করে কামালকে বললো, গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে মেয়েটিকে।
ভলিউম-১
१२
কামালও ফিসফিস্ করে কি যেন বললো শহীদকে। শহীদ কিন্তু তার কথায় মনোযোগ দিতে পারলো না। লাশটির ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখতে ব্যস্ত হয়। পড়েছে সে তখন। দেখতে দেখতে মাটি থেকে তুলে নিলা সে চাদরটার একাংশ। জায়গাটা সাদা মতো এবং ভিজে। নাক ঠেকিয়ে কি যেন কে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। তার মুখ দেখে মনে হলো অদ্ভুত কিছু একটা দেখে সে বিস্ময়র ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। শহীদ উঠে দাঁড়াতেই বাইরে পুলিসের জীপ এসে দাঁড়াবার শব্দ শোনা গেল।
‘আমার দেখা শেষ।’ ল্যাবরেটরি ছেড়ে বের হয়ে আসতে আসতে শহীদ বললো। ইতিমধ্যে পুলিস ইন্সপেক্টর মি: হোজা বারান্দায় এসে পৌঁছেছেন। দূর থেকে শহীদকে দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে এলেন তিনি।
‘আরে, সাহেব, এ যে দেখছি আমাদের বিশ্ববিখ্যাত শার্লক’
বাধা দিয়ে শহীদ বললো, ‘থাক, থাক, নিজেকে আর ঠকাতে চেষ্টা করবেন না দয়া করে।’
| বেশ কিছুদিন আগে শহীদ খানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য মিষ্টার হোজর প্রমোশন বন্ধ ছিল তিন বছর। মি, হোজার খোঁচার অতর্নিহিত অর্থ বুঝতে অসুবিধা হলো না তাই শহীদের।
মি. হোজা শহীদের কথা বুঝতে না পারার ভান করে তার মেদবহুল কোমরে দুহাত ঠেকিয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা আবার কি রকম হেয়ালী ভরা কথা হলো, মনে বুঝলাম না।’
কামাল সামনে এগিয়ে এসে উত্তর করলো, ‘‘কথাটার মানে হলো, আপনারা কি আর খুশি মনে শহীদ খানকে অসাধারণ মেধাবী শার্লক হোমসের সাথে তুলনা করেন? মনে মনে নিশ্চই ঈর্ষা হয়, তাই মাত্রাতিরিক্ত বাহবা দিলই শহীদ খান ধরতে পারে ব্যাপারটা আর কিছু নয়, ইফিরিওরিটি কমপ্লেকস, ঈর্ষা ঢাকার অপকৌশল মাত্র।’
পরিবেশ ভুলে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন মি. হোজা। সে হাসি থামতেই চায় না অরি। কোনরকমে যখন সামলে নিলেন, তখন শহীদ অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বারান্দা থেকে তার দৃষ্টি কখন বাড়ির গেটের দিকে আটকে গেছে কেউ জানে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে সে।
মি, হোজা বললেন, ‘কি ব্যাপার মি. শহীদ, এনিথিং রং? | ‘ওহ্, না।’
শহীদ মৃদু হেসে উত্তর দিলো মি. হোজার প্রশ্নের। তারপর বললো, আপনার কাজ। সেরে নিন আপনি। আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি আগেই। আমি ড, সুফিয়ানের কাছ
থেকে এখনও কিছু শুনিনি, একই সঙ্গে শুনবো ভাবছি।’
‘ভালো কথা। ডাক্তার রহমান এবং ফটোগ্রাফার এখুনি পৌঁছে যাবে। যা দেখার দেখে নিয়ে একটা কনস্টেবলকে পাহারায় বসিয়ে রেখে এখুনি আসছি আমি।’ কাশ-১১
৭৩
মি. হোজা একজন কনস্টেবলকে সঙ্গ নিয়ে ল্যাবরেটরির উদ্দেশে পা বাড়ালেন। ড. সুফিয়ান, শহীদ ও কামালকে ড্রইংরুমে বসতে বলে মি. হোজার অনুগামী হলেন। কির এলন দশ মিনিটের মধ্যেই।
চা-পান ইত্যাদির পর মি. হোজা প্রশ্ন করলেন, ‘এখন বলুন ড, সুফিয়ান, মৃতদেহ আপনিই কি প্রথম দেখতে পান?’
‘না, আমার স্ত্রী প্রথম দেখেন। তার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি আমি। তারপর আমার স্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই।’ | সঙ্গে সঙ্গে মি, হোজা প্রশ্ন করেন, ‘ঘুম ভেঙে যেতেই মৃত্যদহ দেখতে পেলেন আপনি?’
| ড. সুফিয়ান ইস্পক্টরের সন্দিগ্ধ প্রশ্নে একটু অবাক হন। তারপর ছোট্ট করে উত্তর দেন ‘হ্যাঁ।
কিভাবে সেটা সম্ভব?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন মি. হেজা। ‘কেন, আমি কি ভুল বলছি?’ রীতিমত অবাক হন ড. সুফিয়ান।
‘লাশ পাওয়া গেল আপনার ল্যাবরেটরিতে, আর ঘুম ভাঙতেই আপনি দেখতে পেলেন মেঝের উপর লাশ, এ-ও কি কখনও সম্ভব ড. সুফিয়ান?’
| ভুল বোঝাবুঝিটা ধরতে পেরে শহীদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই ড, সুফিয়ান বলে উঠলেন, ‘গতরাতে কাজ করতে করতে ল্যাবরেটরিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
‘তাই বলুন।’
মি. হোজা যেন একটা রহস্য উন্মোচন করতে পেরে শহীদের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসেন। তারপর প্রশ্ন করেন, ‘মেয়েটি কে? মানে, মেয়েটি সম্পর্কে আপনি কি জানেন বলুন।’
ড. সুফিয়ান ধীর কণ্ঠে বলেন, ‘কিছুই জানি না আমি। মেয়েটি সম্পর্কে কিছু জানা তো দূরের কথা মেয়েটিকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি পর্যন্ত। | মি, হোজা তার মুদ্রাদোষে আওড়ালেন, ‘এও কি সম্ভব?’
‘মানে?’ ড. সুফিয়ান বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন।
মি. হোজা তাড়াতাড়ি বলেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কিছু বলিনি। আচ্ছা ড. সুফিয়ান, আপনার আত্বীয়-স্বজন বা চেনা-শোনা কোনো বাড়ির মেয়ে বলে একে স্মরণ করতে পারেন কি না দেখুন তো?’
| ড, সুফিয়ান একটু ভেবে বললেন, ‘কাউকে একবার দেখলে কি সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া সম্ভব? তাছাড়া মেয়েটি অপূর্ব রূপসী। ও মুখ একবার দেখলে অনেকদিন মনে থাকারই কথা। তাছাড়া, এখানে আত্মীয়-স্বজন বলতে আমার কেউ নেই-ও। | ‘আপনার স্ত্রী?
‘আমার স্ত্রী?’ তাহলে আমিও চিনতাম।
গতকাল রাতে কখন আপনি ল্যাবরেটরিতে ঢোকেন?’ ‘ঘড়ি দেখিনি আমি, তবে রাত আন্দাজ আটটা হবে।’
তারপর আর বের হননি একবারও না।’ ‘রাতে খাবার সময়ও নয়?’
না। কাসেমকে খাবার পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। ‘কাসেম কে?’ ‘আমার চাকর।’ ‘কখন সে খাবার পৌঁছে দেয় আপনাকে?’ ‘সাড়ে ন’টার সময়।’
মি. হোজা একটু দম নিয়ে আবার শুরু করেন, ‘খাওয়া শেষ হ, বাসন-কোসন নিতে এসেছিল কে?’।
‘কাসেমই।’ ‘সেটা কখন বলতে পারেন? ড. সুফিয়ান একটু ভেবে উত্তর দিলেন, ‘রাত একটার কম নয়।’
মি. হোজা ভূ-কুঁচকে প্রশ্ন করেন, ‘কাসেম অতো রাত পর্যন্ত আপনার এটো বাসন নিয়ে যাবার জন্য জেগেছিল? কিংবা ইতিমধ্যে সে কি করছিল? এটা বাসন তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কি রাত একটা? এও কি সম্ভব?’
ড. সুফিয়ান ব্যাপারটা খোলাসা করে বলেন, ‘আসলে সাড়ে ন’টার সময় আমাকে খাবার দিলেও আমি তখুনি খাইনি। খিদে পেতে কাজ বন্ধ কর যখন খেতে শুরু করি তখন রাত বারোটা। আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে– খেতে বসেও বই নিয়ে থাকি। গতরাতে খেতে খেতে বই পড়ছিলাম বলে বেশ সময় লাগে। খাওয়া শেষ হওয়ার। কিছুক্ষণ পরই কাসেম এটো বাসন নিয়ে যায়। তখন রাত আন্দাজ একটাই ইব। ওকে আমি ছোটবেলা থেকেই জানি। খুব ভালবাসে ও আমাকে। রাতে আমার কখন কি দরকার হয় ভেবে প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত ও জেগে থাকে। গতকালও ছিলো। গতকাল এটা বাসন নিয়ে যাবার সময় ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল চা বা কফি কর দেব কি
। বলেছিলাম, আমার কিছু লাগবে না। তারপর ওকে ডেকে একটা ধাকও দিয়েছিলাম এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকার জন্যে। তখুনি গিয়ে শুয়ে পড়তে বলেছিলাম। মাথা নেড়ে ও চাল যেত আমি আবার কাজে মগ্ন হয়ে পড়ি। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।’
ড. সুফিয়ান থামতে মি, হোজা প্রশ্ন করেন, ‘কাসেমের সঙ্গে রাত আন্দাজ একটায় কথা বলার সময় ল্যাবরেটরির মেঝেতে আপনি কিছু দেখেননি?’
না।’
কাশ-১১
৭৫
‘আচ্ছা রাত ক’টা নাগাদ আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলতে পারেন ড, সুফিয়ান?
‘ঠিক জানি না, তবে দুটো আড়াইটা হবে বোধ হয়। কদিন থেকে ভালো করে ঘুম হচ্ছে না আমার, খুবই ক্লান্ত ছিলাম আমি।’
মি. হোজা প্রশ্ন করেন, ‘কোনরকম শব্দ গতরাতে সন্দিগ্ধ করেনি আপনাকে?” ‘স্মরণ করতে পারছি না, তবে শুনিনি বোধ হয়। শুনলে ভুলে যাবো কি করে?
আপনার কোনো শত্রু আছে, ড, সুফিয়ান?’ নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন ড. সুফিয়ান, ‘না!’
মি. হোজা এবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনাকে বিপদে ফেলে কারো লাভ হয়ে, যাবে বা কেউ খুশি হবে আপনার সর্বনাশ হতে দেখলে, এমন কোনো লোক আছে?’
উ, সুফিয়ান এবার গভীর চিন্তায় ডুবে যান। তারপর ভাঙা গলায় বলেন, ‘আমার ধারণায় কেউ নেই, অর্থাৎ তেমন কাউকে আমি চিনি না। কিন্তু, জানেনই তো আপনারা, আমার টুটুলকে কে বা কারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। তার কোনো হদিস তো আপনারা করতে পারলেন না। সে কথা স্মরণ করে বলতে বাধ্য আমি–আমাকে বিপদে ফেলে নিশ্চয়ই কারো লাভ আছে। আমার ছেলের জন্য দু’লক্ষ টাকা চেয়েছে
এটা তো প্রত্যক্ষ লাভ। কিন্তু এ ব্যাপারে কার কি উদ্দেশ্য তার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এতক্ষণ শহীদ আর কামাল একটি কথাও বলেনি। ড. সুফিয়ান থামতে শহীদ বললো, ‘আমি দুটি মাত্র প্রশ্ন করতে চাই, স্যার। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, জালালাবাদে আপনি কাকে কাকে চেনেন?
পরিচিত বলতে জালালাবাদে আমার তেমন কেউ নেই। নির্জনে নিজের রিসার্চ করবো বলে আমি এখানে এসে উঠেছি আজ বছর দুয়েক হলো। অবশ্য, ইদানীং আমার পূর্ব পরিচিত এক ভদ্রলোক জালালাবাদে এসেছে, বোধহয় ছবির শুটিং করতে। সাবির চৌধুরী নাম, আমার এককালের বন্ধু বলতে পারেন, অনেকদিন হলো ওর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই আমার।
ব্যাপারটা খুলে বলতে পারেন, স্যার?’ | কোনো প্রকার ইতস্ততঃ না করে ড, সুফিয়ান বললেন, ‘উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নয়। কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি, এই পর্যন্ত। পরবর্তী জীবনে আমি যখন প্রফেসর ছিলাম ও তখন ছায়াছবির পরিচালক। মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হতো, কিন্তু তার বেশি আর কিছু নয়। একদিন হঠাৎ রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কুশলাদি বিনিময়ের পর যে যার পথে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ওর একটা নতুন ছবি রিলিজ হয়েছে তখন। আমাকে ধরে রাখলো ছবিটা দেখার জন্যে। ছবি আমি দেখতাম না তা নয়। তবে ইংরেজি ছবি ছাড়া বাংলা বা উর্দুতে রুচি ছিলো না তেমন। রাজি হাত চাইনি সাবিরের অনুরোধে। ও কিন্তু ছাড়েনি আমাকে। জোর করে ধরে নিয়ে গেল সিনেমা হলে। কিছুতেই নিস্তার মিললো না ওর হাত থেকে।
৭৬
কিন্তু অর্ধেকটা দেখার আগেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার। স্থল যৌন আবেদন, নিছক ভাড়ামি, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংলাপ, ত্রুটিপূর্ণ বেশ-বাস পরিবেশ নির্দেশনা ইত্যাদি ধৈর্য ধরে দেখা আমার কাছে শান্তি কঠিন বলে মনে হতে লাগলো। সম্পূর্ণ ছবিটা না দেখেই হল থেকে বের হয়ে আসতে চাইলাম আমি। সাবির কিন্তু আমাকে বেরুত দিলো না। আটকে রাখলো। ছবির পরের অংশটুকু কদর্য-কুৎসিত, এককথায় জঘনা। তবু শেষ পর্যন্ত দেখতে হলো। হল থেকে বেরিয়ে মুখে যা এলো তাই বলে গালাগাল দিলাম এইসব ছবির নির্মাতাদের। সাবিরও ছেড়ে কথা বলেনি। ওর কথা হলো, টাকা রোজগরিই আসল কথা। তাছাড়া, জনসাধারণ নাকি এই জাতীয় ছক বাঁধা ছবিই ভালবাসে। তুমুল কথা কাটাকাটির পর রেগে মেগে আগুন হয় যে যার পথে রওনা হয়েছিলাম। এই ঘটনার কিছুদিন পর আমি শহর রাজধানী ত্যাগ করে জালালাবাদে চলে আসি। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।’
ড. সুফিয়ান থামতে একটু পর শহীদ বললো, ‘মি, সাবির এখানে এসেছেন কতদিন হয় বলতে পারেন?
‘সঠিক জানি না, মাস দেড়েক হবে হয়তো।
‘আপনি জানালেন কিভাবে সাবির সাহেব জালালাবাদে এসেছেন?’ প্রশ্ন করলেন মি, হোজ।
‘আমার স্ত্রীর কাছ থেকে।’
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, শহীদ কিছুটা ইতস্ততঃ করে বললো, ‘আপনি কি গতকাল ড্রিঙ্ক করেছিলেন–দিনে বা…
শহীদের কথা শেষ হতেই ড, সুফিয়ান ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এ কি বলছে, শহীদ। আমি জীবনে কখনও মদ ছুঁইনি।
ড. সুফিয়ানের কথা শেষ হতে মি, হোজা বললেন, ‘আমার আর জিজ্ঞেস করবার কিছু নেই, ড. সুফিয়ান। এবার মিসেস সুফিয়ানকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
তারপর একে একে চাকরগুলোর জবানবন্দী নেবো।’
ড, সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালেন কিছু না বলে। তারপর ক্লান্ত পদে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মিসেস সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু পাওয়া গেল না। চাকর-বাকরদের কাছ থেকেও এমন কিছু পাওয়া গেল না। কেউ কোনো শব্দ শোনেনি। বাড়ির গেট যথাযথ বন্ধ ছিলো। দেড়টার পর কেউ জেগে ছিলো না। কাসেমকে নানাভাবে জেরা : করা হলো, কিন্তু রাত দেড়টার পর সে ঘুমিয়ে পড়ে। এর আগে বাড়ির কোথাও কোনো সন্দেহজনক কিছু তার নজরে ঠেকেনি। কাসেম ছাড়া আরও দুজন চাকর আছে এ বাড়িতে। সকলেই অনেক দিনের পুরানো। সন্দেহজনক বলে কাউকে মনে হলো না। সবাই খুব ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো। তবে কানে বললো, গত পরশু সে সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়েছিল বর্ধমান হাউসে। সেখানে একজন মহিলাকে দেখছিল সে দূর
৭৭
থেকে। মেয়েটির ববছাট চুল তা সে লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত লাশটা সেই মহিলারই কিনা তা সে বলতে পারলো না। মোট কথা নিহত মেয়েটি সম্পর্কে কোন তথাই জানা গেল না।
শহাদ শুধু কাসেমকে একটা প্রশ্নই করলো, ‘সাবির চৌধুরী কোথায় এসে উঠেছেন বলতে পারা?’
কাসেম মাথা নেড়ে বললো, ‘বর্ধমান হাউসে।’ ‘সেটা কোথায়?’
মনিপুর রোডেই, সবাই চেন বাড়িটা।
আর কোন কথা না বলে পর্যায়ক্রমে ‘ড. সুফিয়ান ও হোজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহীদ ও কামাল ‘আর্কিমিডিস লজ’ থেকে বেরিয়ে বেবিট্যাক্সিতে চড়ে বসলো।
তিন
বেবিট্যাক্সিতে বলে প্রভাতী কাজের একজন ফিরিওয়ালাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে একটা কাগজ কিনে নিলা হাদ। কাজটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে ডাইভারের উদ্দেশ্যে বললো, বর্ধমান হাউস চেনো তো?’
জা, পাব।’ ‘আমাদেরকে সেখানেই নিয়ে চলো আপাততঃ।’ মাথা নেড়ে ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলা।
মিনিট পনের পর বর্ধমান হাউসের সামনে গাড়ি থামাতে বলে নেমে পড়লো শহীদ ও কামাল।
কামাল চারদিকে তাকাতে তাকাতে শহীদকে বললো, ‘ঘন্টা দেড়েক আগে বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভারটা এখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল না?’
| শহীদ সে কথার উত্তর না দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখো তো, আমার লাইটারটা তোমার গাড়ির সাটে পড়ে আছে কিনা?’
কথাটা বলে শহীদ আবার গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
‘এই যে, সাব।’ ড্রাইভার রূপালী লাইটারটা সীট থেকে তুলে শহীদের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
শহীদ পকেট থেকে মুখ মোছবার অছিলায় রুমালটা বের করে লাইটারটা ড্রাইভারের হাত থেকে নিয়ে কায়দা করে পেচিয় পকেটে ভরলে সঙ্গে সঙ্গে। তারপর পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললো, ‘এখন তুমি যেতে পারে, আমাদের ফিরতে দেরি হবে। ৭৮
iT–
ড্রাইভার আশাতিরিক্ত ভাড়া পেয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে গেছে এমন মুখ করে লম্বা একটা সালাম দিয়ে চলে গেল।
কামাল হতবাক হ্য, শহীদকে লক্ষ্য করছিল। কিরে আসতে জিজ্ঞেস করলো, তুই ডাইভারটার হাতের ছাপ সংগ্রহ করলি কেন?
| দরকার আছে, তাই।’ শহীদ সংক্ষেপে উত্তর দিলো। তারপর কাগজটা কামালের দিক বাড়িয়ে ধরে একটা ছোট্ট খবরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘পড়ে দেখ।
কামাল একবার শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন বুঝবার চেষ্টা করলো। তারপর কাগজটা নিচু করে ধরে পড়তে পড়তে এগোতে লাগলো সামনে। খবরটা নিম্নরূপঃ
| ১৫ই ডিসেম্বর। গত শুক্রবার অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা হইতে মিস পাপিয়া নামী একজন মহিলা নাট্যশিল্পী নিখোঁজ হইয়াছেন। ঢাকার অদূরে একটি বাগান বাড়িতে দলবদ্ধভাবে পিকনিক করিতে গিয়ে তিনি আর ফিরিয়া আসেন নাই। সঙ্গী সাথীদের একজনের কাছে শুধুমাত্র উল্লেখ করিয়াছিলেন যে, তিনি পিকনিক হইতে ফিরিবার পথে কোনো এক আত্মীয়ার বাড়িতে বেড়াতে যাইবন। তারপর তাহার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নাই। মহিলার বয়স চব্বিশ। তিনি স্বাস্থ্যবতী। মুখমণ্ডল গোলাকার। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি { কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি নিম্ন ঠিকানায় মিস পাপিয়ার সন্ধান দিতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি।”
খবরটা পড়া শেষ করে কিছু বুঝতে না পেরে কামাল মুখ তুলে তাকালো শহীদের দিকে। শহীদ তখন বর্ধমান হাউসের চোট ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে ভিতরে। কামাল দুত
পা চালালো কাগজটা বগলদাবা করে। | ছোট্ট সবুজ মাঠটা পার হয়ে শহদ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাদুলো। একমুহূর্ত কি ভাবলো দাঁড়িয়ে। তারপর দরজার সামনে থেকে পিছিয়ে এসে আবার ঘাসের উপর নেমে দাঁড়ালো। তারপর সম্মুখবর্তী ঘরটার পানি নিষ্কাশনের ছোট্ট কোঁকরটা থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে গিয়ে কি যেন শুকলো সে জোরে জোরে শ্বাস টোনে। কামাল ততক্ষণে শহীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ শহীদ ড্রেনের পাশে বসে পড়ে কি যেন দেখলো। তারপর কামালের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘নিশ্চয়ই মদের গন্ধ নাকে গেছে তোর?’
কামাল কিছু বলবার আগেই সম্মুখবর্তী ঘরটার দরজা হঠাৎ খুলে গেল। দরজার সামনে ভিড় বাড়ু হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক।
‘কাকে চাকপি
শহীদ বুঝরিলো ঘর ধুচ্ছিল। লোকটা, চাকর-বাকর হবে হয়তো। কামাল উত্তর দিলো, ‘সাবির সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
‘আসুন।
লোকটা ঘরের ভিতরে শহীদ ও কামালকে ঢুকতে বলে সরে গেল একদিকে। ঘরে কুয়াশা-১,
a
ঢুকে শহীদ দেখলো ঘরটা বেয়া শেষ হয়েছে এখুনি। কিন্তু ঘরের ভিতর একটা উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে তখনও।
‘ চৌধুরী সাহেব কোথায়?’ ‘আছন, পাশের ঘর, ‘ লোকটা বললো। ‘বলো, আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। চলে গেল লোকটা ঝাঁটা হাতে।
লোকটা চলে যেতে শহীদ আচমকা নিচু কণ্ঠে কামালকে বললো, খাটের ওপর তোষক রয়েছে কিন্তু চাদরটা নেই কেন বলতো?’
শহীদের বক্তব্য কানে যেতেই কামাল চমকে উঠলো রীতিমত। দেখলো, সত্যি সত্যিই খাটটার ওপর তোষক আছে, বালিশও আছে দুটো বিশৃংখলভাবে রাখা, কিন্তু চাদর বা এই জাতীয় কিছু নেই।
‘কে আপনারা?’
বিরক্তিপূর্ণ একটা কণ্ঠস্বর শুনে কি তাকালো শহীদ ও কামাল। একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভিতর মাঝখানের পর্দা ঝোলানো খোলা দরজাপথ। অত্যন্ত সুপুরু চেহারার লোক। স্বাস্থ্যবান। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী, পরনে লম্বা ঢোলা পায়জামা, পায়ে জমিদারী নগরা। মুখে একটা সদ্য ধরানো সিগারেট। মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো এবং যত্ন করে ব্রাশ করা। কিন্তু ভদ্রলোকের চোখ দুটো লাল।
একদৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থেকে শহীদ বললো, ‘আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারল আনন্দিত হবো।’
ভ্রু কুচকে বিরক্তি না চেপেই ভদ্রলোক বলে ওঠেন, ‘জানতে পারি, আপনারা
কে?’
আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান আর আমার সঙ্গের ইনি… ‘বলতে হবে না আর।’ হাত নেড়ে শহীদকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন সাবির চৌধুরী, ‘কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলতে চান? কি চান আপনারা?’
শহীদ ধীর কণ্ঠে বলে, ‘ব্যস্ত হবেন না, মি. চৌধুরী। সময়ে সব জানতে পারবেন। এখন যদি আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেন,..
| একমুহূর্ত কি যেন ভাবলেন মি. সাবির চৌধুরী, তারপর অপেক্ষাকৃত অনুত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘বলুন, কি জানতে চান?
‘জালালাবাদে আপনি কতদিন হলো এসেছেন? উদ্দেশ্য কি?
‘মাস দেড়েক হবে। আমার নতুন ছবি এপার-ওপারের শূটিং উপলক্ষে জালালাবাদে এসেছি আমি।’
‘বৈজ্ঞানিক ড. আবু সুফিয়ানকে চেনেন আপনি?’
শহীদ লক্ষ্য করলো মুহূর্তের জন্য মি. চৌধুরীর মুখ ভয়ে সিটকে গেল। অবশ্য,
,
৮০
সহজ গলায় স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলেন তিনি, ‘চিনি।
সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করলো শহীদ, আপনি আপনার শত্রু বলে মনে করেন ড. সুফিয়ানকে?’
‘মানে?’ রীতিমত চমকে উঠে বলেন মিস্টার চৌধুরী।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে শহীদ প্রশ্ন করে, ‘আপনি কাল রাতে ড্রিঙ্ক করেছিলেন, তাই না?’
পাথরের মতো শক্ত মনে হয় মি. চৌধুরীর মুখ। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিনি শহীদের দিকে। সময় না দিয়ে আবার প্রশ্ন করে শহীদ, ‘আপনার সঙ্গে শূটিং উপলক্ষে ক’জন মহিলা আর্টিস্ট এসেছেন মি. চৌধুরী?
‘পাঁচজন। ‘তাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যাঁর বব-ছাঁট চুল?’ ‘আছে। বেশ সহজ কণ্ঠেই উত্তর দেন মি. চৌধুরী। ‘আপনার পক্ষে নিশ্চয়ই জানা অসম্ভব নয় এখন তিনি কোথায় আছেন?
এমন সময় দ্রুতপায়ে একজন যুবতী বাইরের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে মি. চৌধুরীর উদ্দেশে বলে ওঠে, ‘আবার তুমি টাকা দিয়েছো শয়তানটাকে। বারবার বলেছি আব্বাকে সব কথা আমরা জানিয়ে দিই চলে। তারপর যা হবার হবে কিন্তু তুমি.
হঠাৎ চমকে উঠে থেমে যান যুবতী শহীদ আর কামালকে দেখতে পেয়ে। শহীদ দেখলো, প্রচণ্ড উত্তেজনায় যুবতীটি রীতিমত হাঁফাচ্ছে, অত্যন্ত লোভনীয় দেহবল্লরীর অধিকারিণী যুবতীটি। বব-ছাঁট চুল। শহীদ ভাবলো, যুবতীটি কোনো বড়লোকের দুলালী।
বিচলিত না হয়ে মি. চৌধুরী দু’পা এগিয়ে গেলেন যুবতীটির দিকে। তারপর বললেন, ‘টাকা তো আমি দিইনি।
হঠাৎ যুবতীর নাক সিটকে ওঠে। কিসের যেন গন্ধ নাকে যেতে কঠিন হয়ে ওঠে তার মুখ।
| ‘তুমি কাল শূটিং থেকে মাতাল হয়ে ফিরেছে, না? মদ আর খাবে না, বলেছিলে
?’ কঠিন গলায় বলে যুবতী।
‘এবারের মতো ক্ষমা করে দাও,’ থিয়েটারি ঢঙে বলে ওঠেন মি. চৌধুরী, বিশ্বাস করো আমার কথায়, আর কখনও ও জিনিস ছোঁবো না। এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি। মি. চৌধুরী সত্যি মাথা ছুঁয়ে কথা ক’টি বলেন। কিন্তু, কি করি বলো, শূটিং-এ যাবার সময় এমন গায়ে পড়ে ঝগড়া করলে তুমি যে মেজাজটা দারুণ খিঁচড়ে গেল।
উসখুস করছিল-কামাল। এবার হঠাৎ খুক খুক করে কেশে ওঠে। কাশির শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে মি. চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘এই যে আমার বব-ছাঁট মহিলা। ৬-
| ৮১
চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছেন। আর কিছু প্রশ্ন আছে আপনাদের?’
আপাততঃ শহীদ বলে, ‘মনে রাখুন শব্দটা-আপাততঃ, আর তেমন কিছু জিজ্ঞাস্য নেই আমাদের। শুধু জানতে চাই গতকাল রাতে কোথায় ছিলেন আপনি?
কখন বাড়ি ফিরেছেন?’
হাসিমুখেই উত্তর দেন মি. চৌধুরী, ‘গতকাল প্রায় সারারাত আউটডোর শুটিং উপলক্ষে ব্যস্ত ছিলাম আমি। বাড়ি ফিরছি আপনারা এখানে আসার ঘন্টাদুয়েক আগে।’
শহীদ আচমকা বলে ওঠে, ‘তারপর আপনার ঘুমাতে যাওয়া উচিত ছিলো না?
একটুও অপ্রতিভ না হয়ে মি. চৌধুরী বলেন, ‘ঘুমাতেই যাচ্ছিলাম কয়েকটা কাজ সেরে, এমন সময় আপনারা যে আবার বিরক্ত করতে হাজির হবেন কে জানত! |
শহীদ মৃদু হেসে বললো, ‘যাবার আগে আপনাকে অন্ততঃ একটা খবর দিয়ে যাই। ড. সুফিয়ানের ল্যারেটরিতে একটা যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে যুবতীটিকে। যুবতীটির চুল বৰ-ছাঁট। মৃতদেহটির সঙ্গে অবশ্য অপরাধী নিজ পরিচয় প্রকাশ করার জন্য কয়েকটি মূল্যবান বস্তুও পাঠিয়ে দিয়েছে। নিরাশ হবার মতো আমাদের কিছুই নেই।’
শহীদের কথা বলার মাঝে মি, চৌধুরীকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখায়। শহীদের কথা শেষ হতে তিনি বলেন, ‘তাই নাকি! আশ্চর্য ব্যাপার তো! তা যুবতীটি কে?
গম্ভীর গলায় শহীদ বলে, এখনও অপরিচিতা।’
হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠে মি. চৌধুরী বলেন, ‘মগ্নচৈতন্য রুচিশীল বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরিতে যুবতী মেয়ের লাশ! বাহ্ বাহ্! কিন্তু মি. খান, বৰ-ছাট চুল হলেও আপনি যে সন্দেহ করে এখানে এসেছিলেন তা নিরসন হয়ে গেল নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টিতে। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই–ইনি মিস শাহবাজী। ওসেনা শাহবাজী। আমার ছবির প্রযোজক মি, ফারুক শাহবাজীর কন্যা। শূটিং উপলক্ষ্যেই এসেছেন। এনারও বৰ-ছাঁট চুল। কিন্তু চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছেন, সশরীরে জীবিত ইনি, এবং সতেজও বটে।
মি. চৌধুরীর কথা বলার ভঙ্গিতে একটা বিদ্রুপাত্মক টান রয়েছে।
শহীদ বললো, ‘আপনাকে উপদেশ দেবো ভদ্রভাবে কথা বলা শিখতে, নয়তো অথা বিপদে পড়তে পারেন।
কথা ক’টি বলে ওসেনা শাহবাজীর সঙ্গে পরিচয়পর্ব অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে এলো শহীদ। কামালও পিছু নিলো ওর।
গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শহীদ দেখতে পেলো, যে লোকটা তাদেরকে ঘরে ডেকে বসিয়েছিল সে কমপাউণ্ডের এদিক-ওদিক কি যেন খুজছে। সামনে গিয়ে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খুজছো হে অমন করে?
| ‘একটা বোতল।
৮২।
কথাটা বলে ফেলেই চকিতে তাকালো লোকটা শহীদের দিকে। তারপর হঠাৎ যেন নিজেকে সামলে নেবার ভঙ্গিতে বললো, ‘কই, না তো!
লোকটার অপ্রতিভ ভাব দেখে হেসে ফেললো কামাল। কিন্তু আর কিছু না বলে ওরা বের হয়ে এলো গেটের বাইরে।
চার
শহীদ ও কামালকে মি. হোজা তাঁর অফিসরুমে প্রবেশ করতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘কি করি বলুন তো সাহেব! জালালাবাদ যে হঠাৎ খুনীদের আড্ডা হয়ে উঠলো। ‘
কি হলো আবার?’ প্রশ্ন করলো শহীদ।
মি. হোজা সমান তেজে বলে ওঠেন, ‘আবার একটা খুন হয়েছে, সাহেব, এই তো এলাম সেখান থেকে।
মি, হোজার কথা শুনে শহীদ মনে মনে বললো, আমি এ রকম কিছু একটা ঘটবে ভেবেছিলাম।
ব্যাপারটা গোড়া থেকে বলুন শুনি,’ শহীদ বললো। মি. হোজা বেশ গুছিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসে শুরু করলেনঃ
থানায় পৌঁছেই একটা জরুরী ফোন পেলাম লিটন রোড থেকে। অমনি ছুটতে হলো। গিয়ে দেখলাম একটা মোটর গাড়ি। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গাড়িটা, ভিতরে একটা লাশ। লাশটা সম্পূর্ণ অগ্নিদগ্ধ, চেনার উপায় নেই মেয়ে না পুরুষ। তবে, প্রায় অক্ষত একপাটি জুতো পাওয়া গেছে গাড়ির বাইরে। জুতোটা মেয়েলোকেরই বটে। গাড়ির নম্বর-টম্বর কিছু বোঝা যায়নি।
শহীদ জিজ্ঞেস করলো, লিটন রোডটা এখান থেকে কতদূরে? ‘তা প্রায় মাইল দশেক হবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শহীদ বললো, ‘আচ্ছা, মি. হোজা, গত কয়েকদিনের মধ্যে কোনো মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন এই মর্মে থানায় কেউ কোনো ডায়েরী করেছে কিনা বলতে পারেন?’।
ধূর্ত হাসি হেসে মি, হোজা বললেন, ঠিক ধরেছেন। তবে গত কয়েকদিন আগে নয়, ডায়েরীটা করা হয়েছে আজই–মাত্র কিছুক্ষণ আগে।’ ড. সুফিয়ানের বাড়িতে যে লাশটা পাওয়া গেছে তার সঙ্গে হুবহু বর্ণনা মিলে যাচ্ছে এই নিখোঁজ মহিলার। আরও আশ্চর্য কি জানেন, খবরটা পেলাম আপনারই বর্তমান আস্তানা, হোটেল ডি করোনেশন থেকে। মেয়েটির নাম মিস সুফিয়।
‘কে খবরটা দিলো? না কি তার?
৮৩ কুশা-১১
মি. হোজা, ডায়েরী-বুকটা দেখে বললেন, ‘হোটেলের ম্যানেজার মি. মল্লিক খবরটা দিয়েছেন। মিস সুফিয়া হোটেলের ব্রিজ পার্টনার কাম ড্যান্সার ছিলো।
আজকের মতো আসি, মি. হোজা।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। তারপর পকেটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে রুমাল জড়ানো লাইটারটা মি. হোজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা রাখুন। লাইটারটার। ওপর একজনের আঙুলের ছাপ আছে। আমার বিশ্বাস ছাপটা কোনো দাগী আসামীর। আপনি পরীক্ষা করে ফলাফলটা যদি আমাকে জানান তাহলে ভালো হয়।
মি. হোজা রুমালে জড়ানো লাইটারটা ড্রয়ারের ভিতর রেখে দিলেন। তারপর তেজী গলায় বলে উঠলেন, ‘ফিংগারপ্রিন্টের রেজাল্ট আপনি পেয়ে যাবেন কালই, কিন্তু, আরও যে আছে। মিস সুফিয়া যে চাদরে মোড়া ছিলো তার ভিতর থেকে একটা বড় সাইজের…’
শহীদ মৃদু হেসে হোজর কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠলো, ‘একটা মদের বোতল, তাই না?’
| হতবাক হয়ে মি. হোজা শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি বুঝি আগেই দেখেছিলেন চাদরের ভিতর বোতলটা?’
মি. হেজার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে শহীদ জানতে চাইলো, ‘ভালো কথা, পোস্ট মর্টেমের খবর পেয়েছেন?
পেয়েছি। ডাক্তারের রিপোর্টে জানা গেছে মিস সুফিয়াকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার সময় রাত দশটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
‘দশটা থেকে মধ্যরাত। আপন মনেই কথাটা আওড়াল শহীদ।
মি. হোজা বললেন, ‘ হোটেলেই তো ফিরবেন এখন? এক কাজ করুন মি. শহীদ, মিস সুফিয়া সম্পর্কে যাকে যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার, সেটা আপনিই করুন গিয়ে। আমিও আসবো একটু পরে, রিপোর্টগুলো লেখা শেষ করে।’
হেসে ফেলে শহীদ বললো, ‘এমন একটা দায়িত্ব আমার ওপর চাপাচ্ছেন কেন?’
মি. হোজা মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, ‘অনুপযুক্ত লোক আমি বাছিনি, আমার কর্তা ব্যক্তিরা এর চেয়েও ভীষণ ভীষণ কাজের ভার আপনার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হন যখন…
মি. হোজার বক্তব্য সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই শহীদ আর কামাল বের হয়ে আসে থানা থেকে।
হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে মিস সুফিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবানবন্দী নিতে শুরু করে শহীদ। শহীদ ও কামালের সঙ্গে একসময় মি. হোজাও | এসে যোগ দেন। তিনি সকলের জবানবন্দী লিখে নেন।
বিশেষ নারী-পুরুষের পরিচয় সমেত ওদের বক্তব্য এবং গতরাতে তারা কে কোথায় ছিলো তার একটা চিত্র দেয়া হলোঃ
৮১
হোটেল ম্যানেজার মি. মল্লিকঃ বয়স-আন্দাজ পঞ্চাশ। টাকমাথা, গোলগাল চেহারা। পরনে গ্যাবার্ডিনের স্যুট।
মি. মল্লিক জানালেন, ‘মিস সুফিয়া তাঁর হোটেলে ব্রিজ পার্টনার কাম ড্যান্সার ছিলেন। তবে, মিস সুফিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তিনি জানেন না। মিস জোবায়দার সহকারী ছিলেন উনি, মিল জোবায়দাই তাকে নিয়ে আসেন ঢাকা থেকে মাস দুই আগে।
‘মিস জোবায়দা কে?
‘মিস জোবায়দা আমাদের হোটেলের প্রদর্শনী নর্তকী। মিস সুফিয়ার দূর সম্পর্কের বোন তিনি।
মিস্টার মল্লিককে শহীদ শুধু একটি প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা মি. মল্লিক, মিস সুফিয়ার চুল বব-দুটি ছিলো না, তাই না?’
আশ্চর্য কণ্ঠে মি. মল্লিক বলেন, ‘বব-ছাঁট ছিলো না মানে? স্বচক্ষে দুমাস ধরে দেখছি তার মাথার চুল ঘাড়ের নিচে কখনও নামেনি।’
চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো শহীদের মুখে। বললো, ‘ঠিক আছে।
মিস জোবায়দাঃ ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স। অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেহবল্লরী। মিস সুফিয়া এর অধীনেই হোটেলে চাকরি করতেন। তিনি জানালেন, ‘মিস সুফিয়া তার দূর সম্পর্কের বোন। ঢাকায় একটি হোটেলে ড্যান্সার ছিলো সে। মাস দুয়েক আগে তার পা মচকে যাওয়ায় প্রদর্শনী নাচের জন্য, হোটেল ডি-করোনেশনে এনেছিলেন তাকে। সেই থেকে সুফিয়া তাঁর সঙ্গে এই হোটলেই রয়ে যায়। শহীদ জানতে চায়, গতরাতে মিস জোবায়দা শেষবার কখন দেখেছেন মিস সুফিয়াকে।
প্রথম প্রদর্শনী নাচের অনুষ্ঠানে। মিস জোবায়দা উত্তর দেন, রাত সাড়ে দশটায় ফ্লোরে আসে সে। তখন আমি মিসেস রসূল বক্স ও মিসেস খোদাবক্সের সঙ্গে গল্প করছিলাম একটা টেবিলে। কিন্তু শেষবার সুফিয়াকে দেখেছি মি, শ্রীধরের সঙ্গে। প্রদর্শনী নাচ শুরু হবার খানিক পর মি. আবেদীন আমাদের টেবিলে এসে বসেন। এরপরই আমরা ব্রিজ খেলতে শুরু করি। ব্রিজ খেলার ফাঁকেই দেখেছিলাম মি. শ্রীধর সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, আর সুফিয়া সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছিলো। তখন খুব সম্ভব এগারোটা-সোয়া এগারোটা বাজে। দ্বিতীয় প্রদর্শনী নাচের অনুষ্ঠান হবার কথা রাত বারোটায়। বারোটা বাজার কিছুক্ষণ আগে মি. সারোয়ার আমাকে এসে বলেন, সুফিয়াকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তাকে উপদেশ দিই, সুফিয়ার রুমে ফোন করতে। কিছুক্ষণ পর কোনে সুফিয়াকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন মি. সারোয়ার।’
‘মি. সারোয়ার কে? ‘হোটেলেরই লোক, মি. মল্লিকের সহকারী বলতে পারেন।’
তারপর বলুন।
তখন আমি সুকিয়ার রুম যাই। কিন্তু ঘরে তাকে দেখতে পাই না। আমি ভেবেছিলাম, কোনো লোকের সঙ্গে সে দেখা করতে গেছে হোটেলের বাইরে। খুব রাগ হয় আমার এই রকম দায়িত্বহীন কাজের জন্য। নাচের অনুষ্ঠান বাতিল করা হলে হোটেলের দুর্নাম হবে বলে মচকানো পা নিয়েই আমি নাচত রাজি হয়ে যাই অগত্যা। রাত একটার সময় শেষ হয়ে যায় নাচ। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আমি। তারপর নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়ি, এবং ঘুমও নেমে আসে সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখে আমার। আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি গতরাত সুফিয়া হোটেলে ফিরে আসেনি।’
শহীদ বলে, ‘ড. সুফিয়ানকে চেনেন আপনি? ‘না তো! কেন?’
‘ আজ সকালবেলা মিস সুফিয়ার মৃতদেহ পাওয়া গেছে উ. সুফিয়ানের ল্যাবরেটরিতে।
শহীদ লক্ষ্য করে, মিস জোবায়দার চোখে মুখে ফুটে ওঠে অবিশ্বাসের চিহ্ন। ‘সাবির চৌধুরীকে চেনেন নিশ্চয়?”
মিস জোবায়দা একটু যেন চমকে ওঠেন শহীদের প্রত্যে। বলেন, ‘না, চিনি না। ও নাম কোনদিন শুনেছি বলেও মনে হয় না।’
‘কাউকে সন্দেহ করেন আপনি মিস সুফিয়ার হত্যাকারী বলে? ‘না, সত্যিই কি সুফিয়া খুন হয়েছে, মি. শহীদ?’ ‘গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে তাকে। ‘বলেন কি! সুফিয়া–খুন?’ মিস জোবায়দা চিৎকার করে ওঠেন প্রায়।
শহীদের মনে হয় তিনি যেন ইচ্ছা করেই মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনার ভাব দেখাচ্ছেন।
শহীদ বলে, ‘লাশটা একবার আপনাকে দেখতে হবে, মিস জোবায়দা। আপনিই যখন তার একমাত্র আত্মীয়।
‘বেশ বেশ, তা দেখবো বৈকি, দেখতে হবে যখন।’
মি, হোজা মিস জোবায়দাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান পানায়। লাশ দেখেই মিস জোবায়দা বলে ওঠেন, ‘এই তো সুফিয়া!
কথাটি বলে ভারাক্রান্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
মিসেস রসুল বক্স। বয়স আটান্ন বছর। বিধবা। স্বামী কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন। একমাত্র মেয়ে এবং বড় ছেলে লণ্ডনে এক প্লেন অ্যাক্সিডেন্ট, নিহত হয়েছেন বছর দশেক আগে। লণ্ডনে তাঁর ছোটো ছেলেটি স্কুলে পড়তো। সে-ও মারা গেছে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে। তার জামাই তারবার্তা করে এই খবর দেন। দুঃখজনক প্লেন
ভলিউম-8
৮৬
অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে তিনি পাগলিনীপারা হয়ে গিয়েছিলেন। তারপরই কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুতে বিছানা নেন তিনি। কিন্তু তাঁর মেয়ে এবং বড় ছেলে মারা গেলেও বিপত্নীক জামাই এবং স্বামীহীনা পুত্রবধূ এখনও বিয়ে করেনি। তারা এখনও তাঁর সঙ্গেই থাকে। শাশুড়ীকে প্রবোধ দেবার জন্য তাঁর জামাই একটা অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে। দেখাশোনার ভার তাঁর জামাইয়ের ওপরই। ইদানীং মিসেস রসুল বক্সের স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না বলে স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় সমুদ্র-শহর জালালাবাদ এসেছেন। তিনি। এখানে আসার পর একটা চমকপ্রদ কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছিল তাঁকে কেন্দ্র করে। মিস সুফিয়া নাকি তাঁর একমাত্র মেয়ে –যিনি দশ বছর আগে প্লেন অ্যাক্সিডেন্ট নিহত হয়েছেন, হুবহু তাঁর মতো দেখতে ছিলো। ইদানীং তাঁর পুত্রবধু ঢাকার এক ইণ্ডাষ্ট্রিয়ালিস্টকে বিয়ে করার জন্য মনস্থির করে ফেলছে এবং তাঁর জামাইও তাঁর প্রতি তততা মনোযোগী নয়। ঢাকাতে প্রায়ই থাকে না সে। মদ আর জুয়া নিয়েই সে মেতে থাকে বলে খবর পেয়েছেন তিনি। এদের কারও ওপরই তাঁর কোনো আশা নেই। তাই মিস সুফিয়াকেই তিনি পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন।
শহীদ জানতে চায়, ‘মিস সুফিয়াকে পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করতে চাওয়ায় আপনার জামাই বা পুত্রবধূ আপত্তি করেননি?’
মিসেস রসুল বন্ধু বললেন, ‘ওদের আপত্তি করার কিছু নেই তো। আমার স্বামী ছেলে ও মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর পাঁচ লক্ষ করে টাকা ওদের নামে জমা করে দেন। ব্যাঙ্কে। আমার ছেলে এবং মেয়ের মৃত্যুর পর সে সব টাকা তো ওরাই পেয়েছে। আমার নামে ব্যাঙ্কে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে, তাতে ওদের কারো কোনো অধিকার নেই। সে টাকা আমি যেমন ইচ্ছা ব্যয় করতে পারি, তাতে ওদের কিছু বলার থাকে কি? সুফিয়াকে আমি সব টাকা লিখে দিলেও তাতে ওদের মাথা-ব্যথার কোনো কারণ ছিলো না।’
শহীদ জানতে চায়, ‘সত্যি সত্যি তেমন কোনো ইচ্ছা ছিলো নাকি আপনার?
‘হ্যাঁ, ছিলো। সুফিয়াকে বলেছিলাম, আমাকে যদি ও ধর্ম মা হিসেবে চায় তাহলে পনেরো লক্ষ টাকা আমি ওর নামে লিখে দেবো–অবশ্য সে টাকা ও খরচ করতে পারবে। আমি মারা যাবার পর।
‘মিস সুফিয়ার নামে পনেরো লক্ষ টাকা লিখে দিতে চেয়েছিলেন আপনি মাত্র ক’দিনের পরিচয়। আপনার মনোভাবের কথা আর কেউ জানতো নাকি?’
একটা কথা আমি বারবার বলতে চাই না, মি. শহীদ খান। বলেছি তো আপনাকে, সুফিয়া দেখতে ছিলো ঠিক আমার জাহানারার মতো। আর সুফিয়াকে পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল এটা সকলকে জানাতে আপত্তি থাকবে কেন? টাকার কথা সবাই জানতো।’
মি. আবেদীনঃ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স হবে। মিসেস রসুল বক্সের মৃত কন্যা জাহানারার স্বামী। হালকা পাতলা গড়ন। দেখে মনে হয় শান্তশিষ্ট। চোখ দু’টি চঞ্চল।
৮৭
ইনি কল্যাণী অনাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। জানালেন, মিস সুফিয়া সম্পর্কে বিশেষ কিছুই অবগত নন তিনি। তবে তাঁর শাশুড়ী মৃতা মিস সুফিয়াকে পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর বলার কিছু ছিলো না। তবে ব্যাপারটা তাঁর ভালো লাগেনি, এ পর্যন্ত।
শহীদ বলে, ‘আপনার আপত্তিটা কোথায় ছিলো, মি. আবেদীন?
‘একজন হোটেল ড্যান্সারকে পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারটা আমাদের সমাজে দৃষ্টিকটু ঠেকে।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে শহীদ জিজ্ঞেস করে, ‘গতকাল ডিনারের পর মধ্য রাত পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন বলতে পারেন, মি. আবেদীন?’
শান্ত কণ্ঠেই জবাব দেন মি. আবেদীন, ‘ডিনারের পর গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার অনেকদিনের অভ্যাস। গতকাল সমুদ্রের দিকে গিয়েছিলাম।’
| ‘তারপর কখন ফিরেছেন হোটেলে?
এগারোটার সময়, আন্দাজ। তারপর আমি আমার শাশুড়ীর কাছে যাই। গল্প। ছিলেন তিনি মিস জোবায়দা এবং মিসেস খোদাবক্সের সঙ্গে। আমাকে দেখে ওনারা। বিতে খলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
‘মিল সুফিয়াকে দেখেছিলেন তখন?
হ্যাঁ, মিনিট কুড়ি পর তাকে আর দেখতে পাইনি।’
মি. আবেদীন ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর শহীদ কামালকে বলল, ‘মিস সুফিয়াকে হত্যা করার পিছনে একটি উদ্দেশ্যর কথা কিন্তু জানা গেছে, কি বলিস?
কামাল বলে, ‘সেটা কী?’ শহীদ বলে, পনেরো লক্ষ টাকা।
মিসেস খোদাবক্সঃ মিসেস রসুল বক্সের নিহত বড় ছেলের স্ত্রী। খোলামেলা স্বভাব। বয়স আন্দাজ ত্রিশ। সুদর্শনা।
জানালেন, মিস সুফিয়ার সঙ্গে তার একটা সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মিসেস রসুল বক্স মিস সুফিয়াকে পালিতা কন্যা হিসাবে গ্রহণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এ খবর তাঁরও জানা ছিলো। তবে এ ব্যাপারে তিনি গুরুত্ব দিয়ে কিছুই চিন্তা করেননি।
| মি. শ্রীধরঃ স্থায়ী আবাস ঢাকায়। জালালাবাদে বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে একটা প্রাইভেট গাড়িও এনেছেন। শহীদের সঙ্গে কথা বলার শুরুতেই তিনি জানালেন তাঁর মোটর গাড়িটা পাওয়া যাচ্ছে না আজ সকাল থেকে।
শহীদ জানতে চাইলো, পুলিসে ফোন করেছেন এ ব্যাপারে? ‘না,’ মি. শ্রীধর বললেন, মাত্র কিছুক্ষণ হলো ঘুম থেকে উঠেছি আমি। ‘মিস সুফিয়ার সঙ্গে গত রাতে দেখা হয়েছিল? ‘হয়েছিল।’
৮৮
‘কখন?’
প্রথম নাচের পর। শহীদ বলে, ‘ভালো কথা, আপনার গাড়িটা শেষবার কখন দেখেছিলেন আপনি? ‘তাতে বলতে পারছি না। একটু আগে গাড়ির খোঁজে নিচে গিয়ে দেখি গাড়ি
নেই।’
‘আমার মনে হয় খবরটা আপনার এখুনি পুলিসকে জানানো দরকার।’
পাঁচ
পরদিন বেলা দশটার সময় একটা ফোন এলো। শহীদ রিসিভার কানে তুলে নিলো।
. ‘হ্যালো, শহীদ বলছি। ‘বাবা, আমি আয়েশা বেগম।
জ্বী, বলুন।’ বিনীত কণ্ঠে বলে ওঠে শহীদ।
প্রফেসর সাহেব আজ সকাল থেকে কেমন যেন হয়ে গেছেন। আনন্দে চিৎকার করতে করতে নিচে থেকে এসে উনি বলতে লাগলেন, জানো আয়েশা, টুটুলকে খুব। শিগগিরই ফিরে পাবো আমরা। দুনিয়ার কোনো শক্তিই আর আমার টুটুলকে ধরে। রাখতে পারবে না। কিছু বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে যাই আমি। কিন্তু সব কথা আমাকে খুলে বলার অনুরোধ করতে তিনি গুম মেরে যান। গম্ভীর হয়ে যায় তাঁর মুখ। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, এ খবর যেন কেউ না জানে। আমি বললাম, শহীদকেও বলবো না? তিনি বললেন, দরকার নেই শহীদের। টুটুলকে এমনিই ফিরে পাবো আমরা। তারপর আর কিছু না বলে হঠাৎ ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন তিনি। আমি কিন্তু, বাবা, খুব ভয় পেয়ে গেছি। তাই তোমাকে ব্যাপারটা না জানিয়ে পারলাম না। আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, কোনো একটা রহস্য উনি জানেন, কিন্তু কাউকে বলতে চান না।
শহীদ মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলো আয়েশা বেগমের। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। কিন্তু কণ্ঠস্বরে কিছুমাত্র উদ্বেগ না ফুটিয়েই সে বললো, ‘আপনি কিছু ভাববেন না, চাচী আম্মা। শুধু একটা ব্যাপার লক্ষ্য রাখবেন, স্যার যেন কোনো
অবস্থাতেই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও না যান। আর সন্দেহজনক তেমন কিছু চোখে পড়লে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। …এখন তাহলে রাখি?”
‘রাখো, বাবা।
শহীদ ফোন ছেড়ে দিলো।
রাত নটা বেজে দশ মিনিট।
জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে শহীদ কামালকে বললো, ‘দেখ, একটা খোঁড়া ফকির
৮৯
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হোটেলটার দিকে কেমন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এতো রাতে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।’
শহীদের পাশে সরে এসে কামাল উঁকি মেরে দেখলো, সত্যিই একটা খোঁড়া ফকির রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হোটলের দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
ড্যান্স ফ্লোরের আশপাশের আসনগুলো এখনও সব ভরে ওঠেনি। শহীদ ও কামাল বিরাট হলঘরটার ভিতর প্রবেশ করে খালি টেবিল দখল করে বসলো। কিছুক্ষণের মধাই হলঘরটা ভরে উঠলো। জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতা টেবিল জুড়ে বসে হৈ-চৈ শুরু করে দিলো। টেবিল টেবিলে নানা রকমের রঙিন পানীয়। আশেপাশে সুন্দরী ললনাদের মিষ্টি-মুধুর হাসি। মন মাতানো মিষ্টি একটা ইংরেজি গানের সুর বাজছে রেকর্ডে। সিগারেটের ধোঁয়া এবং সুন্দরী নারীদের উচ্ছ্বসিত হাসি আনন্দলোভী পুরুগুলোকে মাতিয়ে রেখেছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হল- ঘরটা একবার জরিপ করে নিলো শহীদ।
নাচ শুরু হতে এখনও বেশ দেরি আছে। শহীদ দেখতে পেলো মি. আবেদীন এবং মিসেস খোদাবক্স একটা টেবিলে বসে কি যেন আলাপ করছেন।
হঠাৎ হল- ঘরের একেবারে ডান দিকের কোণে, বারান্দার প্রায় কাছ ঘেঁষে বসা একটা লোকক দেখে শিউরে উঠলো শহীদ। লোকটার মুখ কে যেন তীক্ষ্ণলা ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। দাগগুলো অনেকদিনের পুরানো বলেই মনে হলো শহীদের। লোকটা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।
প্রায় মিনিট পনেরো পর মিস জোবায়দাকে নাচের পোশাক পরে হল-ঘরে প্রবেশ করতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে হল ঘর একটা মুদগুঞ্জন জেগে উঠে ক্রমে থিতিয়ে এলো।
মিস জোবায়দা কারও প্রতি ভুক্ষেপ না করে ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপে মি, আবেদীনের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর মিসেস খোদাবক্সের পাশে তাঁকে বসে পড়তে দেখা গেল।
হঠাৎ কি মনে করে কামালকে বসতে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। তারপর দু’পাশের চেয়ারগুলোকে পাশ কাটিয়ে সে মি. আবেদীনের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মি. আবেদীন তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে শহীদ মিস জোবায়দাকে লক্ষ্য করে বলে, ‘আপনার পাশের আসনটি কি খালি আছে?
বসতে পারেন।’ মিস জোবায়দা শহীদের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বললেন।
‘থ্যাঙ্কিউ। চেয়ারটা দখল করে শহীদ মি, আবেদীনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মিসেস রসুলবক্স আজকের নাচের আসরে আসবেন না?’
শহীদের প্রশ্নের উত্তর দেন মিসেস খোদাবক্স। আজ উনি আসতে পারবেন না। দুর্ঘটনাটা মারাত্মক আঘাত দিয়েছে ওনাকে, মি. শহীদ। মাত্রাতিরিক্ত মুষড়ে পড়েছেন
৯০
আমার শাশুড়ী।
‘সেটা খুবই স্বাভাবিক।
মিস জোবায়দার দিকে তাকিয়ে শহীদ বলে, ‘একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করবো আপনাকে, যদি কিছু মনে না করেন? মিস সুফিয়া কোন্ সেলুন তার চুলের পরিচর্যা করতেন ইদানীং, বলতে পারেন? হোটলেই নাপিত বা নাপিতানী কেউ বাস করে নাকি?’
কটমট করে শহীদের দিকে চেয়ে মিল জোবায়দা বলেন, ‘কিভাবে আপনার ধারণা হলো যে এ সব ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখার দায়িত্ব আমার?’
তীক্ষ্ণ অথচ নিচু গলায় শহীদ বলে উঠে, তা নয়। কিন্তু, মিস সুফিয়ার মৃতদেহ সনাক্ত করার সময় আপনার বলা উচিত ছিলো যে মিস সুফিয়ার চুল বৰ-ছাঁট ছিলো
।’
‘মানেমিস জোবায়দা আঁৎকে ওঠেন শহীদের কথা শুনে।
মিসেস খোদাবক্স অবাক কণ্ঠে বলেন, ‘সুকিয়ার চুল তো বব-ছাঁটই ছিলো। সেক্ষেত্রে মিস জোবায়দা কেন বলতে যাবেন মিস সুফিয়ার চুল বৰ-ছাঁট ছিলো না!
শহীদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তাই যদি হয়, কেন আপনারা বলছেন না যে ড. সুফিয়ানের ল্যাবরেটরিতে যে মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেটি মিস সুফিয়ার নয়?’
হতভম্ব হয়ে বসে থাকে তিনজন নারী-পুরুষ। শহীদ তিনজনের দিকে পর্যায়ক্রমে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে দু’ পাশের চেয়ার টেবিল পাশ কাটিয়ে।
নাচ শুরু হলো রাত সাড়ে দশটায়।
শোভন পোশাক পরেই স্টেজে নেমেছিলেন মিস জোবায়দা। কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যেই একটি একটি করে পোশাকের ভার তার যৌবনপুষ্ট শরীর থেকে খসে খসে পড়তে লাগলো।
নাচ চলছে পুরোদমে। মিস জোবায়দা অপূর্ব নাচেন। জুড়ি নেই তাঁর এই নাচের। আজকে যেন একটু বেশি অশ্লীল হয়ে উঠেছেন তিনি। নাচতে নাচতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন মিস জোবায়দা। ফলে ছন্দপতন ঘটছে। পরক্ষণেই সেটা সামলে নেবার জন্যে নিতম্ব-বুক- কোমর কল্পনাতীত অশ্লীল ভঙ্গিতে দর্শকদের চোখের সামনে দুলিয়ে ক্রটি ঢাকছেন। দর্শকদের আনন্দোচ্ছ্বাসে থেকে থেকে হল-ঘরটা ভরে উঠছে।
নিঃশব্দে বসে আছে শহীদ ও কামাল। কামাল একমনে উপভোগ করছে মিস জোবায়দার নাচ। শহীদও দেখছে, কিন্তু এক একবার সে তাকাচ্ছে এপাশে-ওপাশে।
এমন সময় হঠাৎ তার চোখে পড়লো ডানদিকের টেবিলে বসে থাকা ক্ষতবিক্ষত চেহারার লোকটা টেবিলের নিচে থেকে ঝুঁকে পড়ে কি যেন একটা তুলে নিলো। কি মনে করে শহীদ মি. আবেদীনের দিকে তাকালো। দেখলো, মি. আবেদীনও তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছেন ব্যাপারটা।
এরপর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। কামাল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তাকে ইশারায় চুপ করিয়ে দিলো শহীদ।
হল-ঘর থেকে বের হয়ে সোজা হোটেল ডি-করোনেশনের ম্যানেজারের অফিসের দিকে দ্রুত পায়ে এগোতে লাগলো সে। মি, মল্লিক অফিস রুমেই ছিলেন। শহীদকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আসুন, মি. শহীদ।
| ব্যস্ত হবেন না।’ মি, মল্লিককে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও একটা চেয়ার দখল করে শহীদ বললো, ‘একটা লোক সম্পর্কে কিছু জানতে চাই আমি।’
‘বলুন? | ‘নাম জানি না আমি ভদ্রলোকের, ক্ষতবিক্ষত চেহারা ওনার, বসে বসে নাচ দেখছেন হল-ঘরে। হোটেলেই থাকেন বোধ হয়। চিনতে পেরেছেন?
| ক্ষতবিক্ষত মুখ? মি. মল্লিক যেন চিনতে পেরেছেন লোকটাকে। বললেন, ‘ওনার নাম সেলিম খান। হ্যাঁ, হোটেলেই থাকেন। প্রায়ই আসেন উনি জালালাবাদে এবং এই হোটেলেই থাকেন। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?’
শহীদ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘এবার কবে উঠেছেন তিনি হোটেলে?
গত দশ তারিখে। কি করেন ভদ্রলোক জানেন?
‘একমিনিট দাঁড়ান,’ মি, মল্লিক শহীদের দিকে তাকিয়ে কলিং বেল টেপেন। একজন কেরানী এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আচমকা বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে চেয়ারটা পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে শহীদ মেঝেতে সটান শুয়ে পড়ে চকিতে। সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণধার একটা ছোরা জানালার বাইরে থেকে তীর বেগে এসে ছিটকে পড়ে মেঝেতে।
‘এ কি!’ চিৎকার করে ওঠেন মি. মল্লিক।
ততক্ষণে শহীদ দ্রুত মেঝে থেকে উঠে ছুটে বের হয়ে গেছে ঘর ছেড়ে। মি. মল্লিকও তাঁর থলথলে শরীর নিয়ে থপথপ করে শহীদের পিছু নেন।
অফিস রুম থেকে বের হয়ে শহীদ কোনো মানুষের ছায়াও দেখতে পেলো না। ‘কি ব্যাপার, মি, শহীদ?’ উত্তেজিত কণ্ঠে মি. মল্লিক জানতে চান। মৃদু হেসে শহীদ বলে, ‘ব্যাপার গুরুতর। কিন্তু লোকটাকে ধরা গেল না।
অফিস রুমে ফিরে এসে চেয়ারটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে আবার বসলো শহীদ। মি. মল্লিক হোটেলের রেজিস্টার বই আনিয়ে দেখে বললেন, ‘মি সেলিম খান, ব্যবসায়ী, স্থায়ী ঠিকানাঃ বন্দর রোড, করাচী, ব্যবসাঃ জাহাজ ভাড়া খাটান, রুম নম্বর। বাইশ।
শহীদ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, মি. মল্লিক, গত কয়েকদিনের মধ্যে মি, আবেদীন বা মিসেস খোদাবক্স হোটেল ছেড়ে জালালাবাদের বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন কি না বলতে পারেন?
‘মি. আবেদীন গিয়েছিলেন–গত বুধবার। ‘কেন, তা জানেন?
না, তা জানি না। নাচের আসরে প্রত্যহ মি. আবেদীনের উপস্থিতি বাঁধাধরা। গত বুধবার, নাচের আসরে তাঁর দেখা পাইনি বলে জিজ্ঞেস করেছিলাম মিসেস খোদাবক্সকে। তিনিই আমাকে জানিয়েছিলেন যে মি. আবেদীন ঢাকায় গেছেন।
ধন্যবাদ। আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই আমার।
শহীদ কথা ক’টি বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মি. মল্লিকও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘একটা প্রশ্ন আছে, মি. শহীদ। মিস সুফিয়ার হত্যাকে কেন্দ্র করে আমার হোটেলের কোনো বদনাম হবার আশঙ্কা নেই তো?
মৃদু হেসে শহীদ বলে, ‘আধা কাউকে বিব্রত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই, মি. মল্লিক।
‘ধন্যবাদ, মি. শহীদ।
কামালের কাছে ফিরে এসে শহীদ চাপা স্বরে বলে, ‘এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে আমাদের, কামাল। প্রতিপক্ষ আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। এই মাত্র মি. মল্লিকের ঘরে আমাকে লক্ষ্য করে ছোরা ছোঁড়া হয়েছিল।’
আশ্চর্য হয়ে কামাল বললো, ‘কে লোকটা? দেখতে পেয়েছিলি?’
শহীদ বলে, ‘না। দেখতে পেলে অক্ষত ফিরতে হতো না। যার আঙুলের ছাপ নিয়ে মি. হোজার হাতে দিয়েছিলাম, সেই বেবিট্যাক্সি ড্রাইভারটাই ছুঁড়েছিল ছোরাটা, আমার যতদূর বিশ্বাস।
ছয়
পরদিন ঢাকায় মি. সিম্পসনের কাছে জরুরী একটা টেলিগ্রাম পাঠালো শহীদ। তারপর পোস্টাফিস থেকে বেরিয়ে হোটেলে না ফিরে জালালাবাদ থানায় গেল মি. হোজার সঙ্গে দেখা করতে। মি. হোজা ছিলেন না থানায়। কোথায় গেছেন তাও জানতে পারলো না শহীদ।
| সে হোটেলে ফিরতেই কামাল বললো, ‘মি হোজা এসেছিলেন তুই চলে যাবার পর।’
| ‘নাকি? তা নতুন কিছু খবর পাওয়া গেল?’
কামাল বললো, ‘তার আন্দাজ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে–সেই ড্রাইভারটি একজন। দুর্দান্ত লোক। আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে জানা গেল লোকটি খুন, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি নানারকম দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত আছে। বছর তিনেক লোকটির কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। নাম, হোবি। লোকটিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল পেশোয়ারে। দ্বিতীয় খবর, মি. হোজা ড. সুফিয়ানের বাড়িতে যে বোতলটি পেয়েছিলেন তাতে পুরুষ কুয়াশা- ১১
৯৩
মানুষের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে স্পষ্ট। সেই হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখার জন্যে হোটেলের দু’জনের হাতের ছাপ সংগ্রহ করে নিয়ে চোছেন তিনি।
‘কার কার?’ ‘মি. শ্রীধর আর মি, আবেদীনের।
‘এরা দু’জনেই মদাপায়ী বলে হোটেলে পরিচিত।
শহীদ বললো, ‘বৃথা চেষ্টা। ছাপ মিলবে না।’ কামাল বললো, ‘সে আমিও জানি।’
কথা বলা এবং শোনার ফাঁকে শহীদের দৃষ্টি জানালা পথে বাইরের দিকে পড়তে সে দেখতে পায়, হোেটলের রাস্তার ওপর ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেই ফকিরটা। তাকিয়ে দেখতে থাকে সে ফকিরটাকে। এমন সময় রাস্তা পেরিয়ে সুবেশী একটি লোকক ফকিরটার দিকে হেঁটে আসতে দেখা যায়। লোকটা এগিয়ে এসে ফকিরটির হাতে খুব সম্ভব পয়সা দেয়। কিন্তু দুর থেকে হলেও শহীদের দৃষ্টি এড়ায় না, লোকটার বাম হাতটি কোটের পকেট থেকে কি যেন একটা বের করে ফকিরটার ঝোলার ভিতর ফেলে দেয় গোপনে। তারপর দু পায়ে রাস্তার চলমান জনতার সারিতে মিশে যায় লোকটা।
একটু পর আরও একটা ভদ্রলোককে রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা যায় খোঁড়া ফকিরের দিকে। শহীদ মুখ ফিরিয়ে পার্শ্ববর্তী কামালের দিকে তাকায় একবার। তারপর বলে, ‘পূণ্যবিলাসীরা খোঁড়া ফকিরকে ভিক্ষা দিতে হরদম রাস্তা পার হচ্ছেন, ব্যাপারটা কি বল তো?
শহীদের কথা শেষ হতে দেখা গেল ভদ্রলোক ফকিরটিকে কি যেন বলতে সে তাড়াতাড়ি তার কাঁধের বোলাটা পাশের চৌকো সিমেন্ট বাঁধানো ডাস্টবিনের ভিতর ফেলে দেয়। তারপর ক্রাচে ভর দিয়ে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফাতে লাফাতে রাস্তা পেরিয়ে কোনদিকে গেল দেখতে পেলো না শহীদ। পূর্বোক্ত ভদ্রলোকও ইতিমধ্যে উধাও হয়েছেন।
| শহীদ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত ফকিরের কোলাটার দিকে। হঠাৎ একটা বোমা ফাটার শব্দে চমকে উঠলো শহীদ ও কামাল। শহীদ দেখলো, সিমেন্ট-বাঁধানো চৌকো ডাস্টবিনটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, দেখা যাচ্ছে না কিছুই।
| দিন দুপুরে রাস্তার ওপর একটা অঘটন ঘটতে দেখে ভিড় জমে গেল চারদিকে। ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে দেখা গেল ডাস্টবিনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে, ফকিরের বোলার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।
কামাল বললো, ‘অদ্ভুত! কিছুই বোঝা গেল না ব্যাপারটার রহস্য। শহাদও সায় দিলো, ‘সত্যি অদ্ভুত।’ | সেদিন হোটেলের সামনে ফকিরটাকে আর একবারের জন্যেও দেখা গেল না।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। সকাল বেলা আয়েশা বেগমের জরুরী ফোন পেয়ে আর্কিমিডিস লজে গিয়েছিল শহীদ একা। আর্কিমিডিস ঢুকে সোজা দোতলায় উঠে গেল শহীদ। আয়েশা বেগম তার ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। শহীদকে দেখে তিনি বললেন, ‘এসেছো, বাবা, তুমি। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ।
| কথা ক’টি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে আয়েশা বেগম হাতের মুঠো থেকে একটা চিঠি বের করে শহীদের দিকে বাড়িয়ে দেন। বলেন, ‘এটা আজ ওনার পকেট থেকে পেয়েছি। আমার মনে হয় এই চিঠিটা পেয়েই উনি এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।’
‘স্যার কোথায়?
আয়েশা বেগম ভেঙে পড়া গলায় বললেন, ‘তোমাকে টেলিফোন করে নিচে নেমে ওনাকে আর দেখতে পাইনি। কোথায় গেছেন, কাউকে বলে যাননি।
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে শহীদ বল, ‘আপনি ভয় পাবেন না, চাচী আম্মা, আমি তো রয়েছি আপনাদের সঙ্গে।
হাতের চিঠিটা খুলে লেখার ওপর চোখ ফেলতেই ভীষণ চমকে ওঠে শহীদ। তারপর মৃদু একটা হাসির রেখা তার ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে। চিঠিটা পড়া শেষ করার পর তার মুখের হাসিটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে।
‘কি বুঝলে, বাবা? ভালো ব্যাপার?’ আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করেন।
‘হ্যাঁ,’ হাসতে হাসতে বল শহীদ, ‘আপনার টুটুলকে আপনি ফিরে পাবেনই, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
সত্যি, বাবা! আশেয়া বেগমের চোখে অশ্রু টলমল করে ওঠে, ‘কিন্তু তার আর কতো দেরি! আমি যে আর পারছি না।
আর্কিমিডিস লজ থেকে বেরিয়ে শহীদ একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে মি. হোজার সঙ্গে দেখা করার জন্য থানায় পৌঁছলো। মি, হোজাকে আজও, থানায় পাওয়া গেল না। শহীদ জানতে পারলো, মি. হোজা গেছেন জালালাবাদ নিউ মার্কেটে। মিস সুফিয়ার মৃতদেহ যে নতুন গুলটেক্সের চাদরে জড়ানো ছিলো সেটা কোন্ দোকান থেকে কেনা হয়েছে। এবং কে কিনেছে তার খোঁজ নিতে। খবরটা শুনে মনে মনে হাসে শহীদ। তারপর থানা। থেকে বেরিয়ে অপেক্ষারত বেবিট্যাক্সিতে চড়ে ডাইভারকে বলে, ‘হোটেল ডি করোনেশনে চলো।’
| হোটেলের সামনে স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া ঢুকিয়ে দেবার পর হঠাৎ কি মনে করে শহীদ রাস্তার অপর পারে তাকায়। তাকিয়েই চমকে ওঠে। সেই খোঁড়া ফকিরটা দীড়িয়ে আছে রাস্তার ওপারে। শহীদের দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে মৃদু মৃদু। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ। কিন্তু আচমকা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চোখ দু’টো। লোকটার হাসির প্রত্যুত্তরে সে-ও হাসে মৃদু মৃদু। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হোটেলর গেটের দিকে পা বাড়ায়।
শিা-১১
রুমের দরজা খুলে দিয়ে কামাল বলে, ‘মি. সিম্পসনের টেলিগ্রাম এসেছে শহীদ।
‘কই দেখি!’ আগ্রহী হয়ে ওঠে শহীদ কামালের কথা শুনে।
কামালের হাত থেকে টেলিগ্রামের খামটা নিয়ে সোফার উপর বসে মনোযোগ সহকারে সেটা পাঠ করে শহীদ। তার চোখ দুটো কুঞ্চিত হয়ে আসে ধীরে ধীরে। কি ভেবে কামালের মুখের দিকে তাকায় একাবার, তেপয়ের ওপর টেলিগ্রামটা রেখে বুকে পড়ে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সেটার উপর। তারপর তেপয়ের উপর হাল্কা একটা মুষ্ট্যাঘাত করে বলে ওঠে, ‘দ্যাটস ইট!
বিস্মিত কামাল হতবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। বললো, ‘কি ব্যাপার?’
| ‘ব্যাপার গুরুতর। মি. আবেদীনের কল্যাণী অনাথ আশ্রম এবং ঢাকা থেকে নিখোঁজ মিস পাপিয়া সম্পর্কে বহু চমকপ্রদ তথ্য জানা গেছে।
বল তো শুনি, কামাল আগ্রহান্বিত কণ্ঠে বলে। এহ বাহ্য। শহীদ বলে, ‘এর চেয়েও গুরুতর খবর তোকে দিতে পারি।
কামাল অধৈর্য কণ্ঠে বলে, ‘তোর এই রকম দগ্ধে মারা আমার সহ্য হয় না মোটেই।’
শোন না,’ শহীদ হাসতে হাসতে বলে, ‘আজ আয়েশা বেগম আমাকে একটা চিঠি দেখিয়েছেন। সেটি কার জানিস? কুয়াশার! কুয়াশা জানিয়েছে টুটুলকে সে ড. সুফিয়ানের হাতে তুলে দেবে আগামী ২৯শে ডিসেম্বর তারিখে রাত দশটার মধ্যে।
কামাল বলে, ‘জবর খবর বটে। কিন্তু কুয়াশা এ ব্যাপারে আগ্রহী কেন?’
শহীদ বলে, ‘খুবই সহজ কারণটা। ড, সুফিয়ানের সাহায্য কামনা করে কুয়াশা তার বিজ্ঞান সাধনার জন্যে।
কামাল বলে, তার মানে ড. সুফিয়ানকে কুয়াশা তার কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে নিজের কাজ করিয়ে নিতে চায়?
‘ঠিক তাই। চিন্তিত মুখে কামাল বলে, ‘ভাবনার কথা।
‘ভাবনার কথাই বটে, শহীদ বলে, ‘আয় ভাবনার বস্তুটাকে দেখে নে তবে।” কামালের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে জানালার কাছে টেনে আনে শহীদ।
কামাল বলে, ‘হেঁয়ালি শুরু করলি যে!
জানালার বাইরে তাকিয়ে শহীদ চোখের ইশারায় বলে, ‘রাস্তার ওই খোঁড়া ফকিরটাকে দেখতে পাচ্ছিস তো?”
‘পাচ্ছি।’ ‘লোকটা, শহীদ কামালের দিকে ফিরে বলে, ‘কুয়াশা।
‘কুয়াশা!
সাত
সেদিনই বেলা একটার সময় শহীদ ও কামাল বর্ধমান হাউসে গিয়ে উপস্থিত হলো।
‘কাকে চান?’ দরজা খুলে প্রশ্ন করলো ওসেনা শাহবাজী। ‘সাবির চৌধুরী আছেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করলো শহীদ।
‘আসুন আয়নারা। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললো ওসেনা শাহবাজী, ‘আমি ডেকে দিচ্ছি ওনাকে।
ওদেরকে বসতে বলে মিস শাহবাজী পর্দা ঠেলে পাশের ঘরে যেতে কামাল বললো, ‘ইনি এখানে কেন বলতো, শহীদ?’
হেসে ফেলে শহীদ বললো, আমি কি করে জানবো বল?’ |
এমন সময় স্বয়ং সাবির চৌধুরী ঘরে প্রবেশ করে ওদের মুখোমুখি একটা সোফায় বসলেন। ওসেনা শাহবাজীও একটু পরে তার পাশে এসে বসে।
‘আপনারা
আপনার সঙ্গে জরুরী কয়েকটা কথা আছে, মি. চৌধুরী, শহীদ বলে। আপনি কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলে বাধিত হবো। আর, তার ফলে আপনি অনাবশ্যক অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত হবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
কথা ক’টি বলে শহীদ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মি. সাবির চৌধুরীর দিকে। মুখের রেডিমেড হাসিটা তাঁর মিলিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সেদিনকার মতো আজ আর হৈ-চৈ চিৎকার করছেন না, কেমন যেন অপ্রতিভ দেখাচ্ছে তাঁকে। মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি।
ধীর অথচ শান্ত কণ্ঠে শহীদ শুরু করে, গত ১২ই ডিসেম্বর রাতে হোটেল ডি করোনেশনের ড্যান্সার-কাম-ব্রিজ পার্টনার মিস সুফিয়াকে গলা টিপে হত্যা করার অভিযোগে যে কোনো মুহূর্তে আপনি গ্রেফতার হতে পারেন, মি. চৌধুরী।
শহীদের কথা শেষ হতে ভয়-কাতর দৃষ্টিতে মি. চৌধুরী তাকায় শহীদের পানে। নৰ্ণিমেষ দৃষ্টিতে মি. চৌধুরীকে দেখতে থাকে শহীদ।,
‘এ সব কি বলছেন উনি। তুমি অমন চুপ করে রইলে কেন, সাবির? মিস শাহবাজী চিৎকার করে ওঠে যেন।
‘বিশ্বাস করুন, মি. শহীদ, আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। খুন আমি। করিনি। করুণ মিনতির সুরই ফুটে ওঠে মি. চৌধুরীর কণ্ঠে। ‘ .
‘কিছুই জানেন না আপনি?’ অধৈর্য কণ্ঠে শহীদ বলে ওঠে, ‘জানেন না ভালো কথা, কিন্তু গ্রেফতার আপনি হবেনই। একটা মদের বোতল পাওয়া গেছে মিস সুফিয়ার লাশের সঙ্গে, বোতলের গায়ে আঙুলের ছাপ প্রমাণ করবে আপনি দোষী।’
শহীদের কথা শেষ হতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিস শাহবাজী বলে ওঠে আমি যে ৭-
| ৯৭
কিছুই বুঝতে পারছি না, সাবির! এমন নার্ভাস ফীল করছো কেন?
| হঠাৎ উঠে দাঁড়ান মি. চৌধুরী। শহীদের সামনে গিয়ে করুণ কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘বিশ্বাস করুন, মি. শহীদ, মিস সুফিয়াকে আমি খুন করিনি, তাকে আমি চিনতামই
, কিন্তু আপনি আমাকে রক্ষা করুন, মি. শহীদ! আমি যা জানি সব বলছি আপনাকে।
শহীদ শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘এই তো কাজের কথা। আপনি যা জানেন, সেটার শুরু আমিই করি। ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। গত ১২ই ডিসেম্বর রাতে শূটিং থেকে মত্তাবস্থায় ফিরে আপনি এই ঘরে
| মি. চৌধুরী শহীদকে বাধা দেন। বলেন, ‘আমিই বলছি মি. শহীদ। সব কথা না বললে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না। গত ১২ই ডিসেম্বর বিকেল বেলা শাহবাজীর সঙ্গে আমার একটু ঝগড়া-ঝাটি হয়। তাতে রাগ করে ও চলে যায় ওর এক আত্মীয়ার বাড়ি। রাতে শূটিং-এ গিয়ে আমি ওকে খবর পাঠাই আমার কাছে ফিরে আসতে। আমার কিছু টাকার দরকার ছিলো। সব টাকা শাহবাজীর কাছেই থাকে। শাহবাজী আমার পাঠানো লোকটার হাতে টাকা দেয় বটে; কিন্তু রাগ করে বলে পাঠায়, সে আসবে না। শাহবাজীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার দরুন মেজাজ এমনিতেই আমার ভালো ছিলো না। তারপর ওর অদর্শনে মনটা খিঁচড়ে ওঠে আরও। শুটিং করতে করতেই তাই আমি অবাধ্য হয়ে উঠি। শাহবাজী আমাকে মদ খেতে দেখলে রাগ করতো বলে ঠিক করি, আজ আমি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরবো। রাত যখন দুটো বাজে, তখনও শূটিং-এর কাজ বাকি ছিলো। কিন্তু তখন আমি পুরোপুরি মাতাল হয়ে পড়েছি। কোনরকমে সহকারী পরিচালকের হাতে সব ভার দিয়ে আমি একা গাড়ি করে বাড়ি ফিরে আসি। ঘরের চাবি আমাদের দুজনের কাছেই থাকে। ঘরের তালা খুলে আলো জ্বালতেই আমি অবাক হয়ে যাই। শাহবাজী আজ ফিরবে না বলেছিল, ফিরলেও এঘরে তার শোবার কথা নয়, কিন্তু ঘরে ঢুকে আলো জ্বালার পরই আমি দেখতে পাই একটি যুবতী শুয়ে আছে খাটের ওপর। যুবতীটির মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। ভাবলাম শাহাবাজী ফিরে এসেছে তাহলে। মদ খেয়ে অপ্রকৃতিস্থ ছিলাম বলেই বোধ হয় তখন মনে পড়েনি যে দরজায় তালা লাগানো থাকা সত্ত্বেও শাহবাজী ঘরে ঢুকলে কি করে? যাই হোক, খাটের ধারে এগিয়ে গিয়েই আমি বুঝতে পারি, বিছানায় যে শুয়ে আছে সে শাহবাজী নয়। বোকার মতো দাঁড়িয়েছিলাম আমি। তারপরই আমি বুঝতে পারি যুবতীটি জীবিত নয়– | ‘মদের নেশা তখন আমার ছুটে যায়। কিছুই বুঝে উঠতে পারি না আমি। যুবতীটি। কে তা আমি জানতাম না। কে এমন কাজ করলো তাও ভেবে পেলাম না। রাত শেষ হয়ে যাবার আগেই শুটিং শেষ হয়ে যাবে, ফিরে আসবে সহকারী পরিচালক, তারপর আমাকে এবং যুবতী একটি মেয়ের মৃতদেহ দেখলে কি সর্বনাশ ঘটবে তা আমি বুঝতে পারলাম। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম আমার কি করা উচিত।
ভাবলাম পুলিসকে ফোন করি। কিন্তু পুলিসকে ফোন করার ব্যাপারটা কেন যেন মনে হলো নিজের সর্বনাশ করারই নামান্তর হবে। পুলিস এই অদ্ভুত সত্য ঘটনা কোনমতেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল সুফিয়ানের কথা। সুফিয়ানকে আমি চিনতাম, লেকিটা এককালে আমার বন্ধুর মতো ছিলো; কিন্তু বউড ‘অহংকারী ও। বহুদিন হলো কোনো সম্পর্ক রাখি না তাই ওর সঙ্গে। ঠিক করলাম পুলিস-ফুলিসের হাঙ্গামা না করে লাশটা সরিয়ে ফেলা যাক। আর সরাতেই যদি হয় তবে সুফিয়ানের বাড়িতেই সরানো যেতে পারে। এখন মনে হচ্ছে নেশা আমার সে এতে আদৌ কাটেনি। সব মাতালের মতো ভেবেছিলাম, আমি নেশাগ্রস্ত নই। ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলার পর বেশ আনন্দই লাগছিল আমার। যুবতী একটি মেয়ের পাশ এবং আদর্শবাদী বৈজ্ঞানিক সুফিয়ান–দৃশ্যটা কল্পনা করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি। তাড়াতাড়িতে কিন্তু মারাত্মক দুটো ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। আমার সঙ্গে মদের বোতল ছিলো একটা, কখন জানি না সেটা বিছানার ওপর রেখেছিলাম, তাড়াতাড়িতে যুবতীর মৃতদেহটা বিছানার চাদরটাতে পেচিয়ে কাঁধে তুলে
•াড়ির ভিতর নিয়ে যাই। মদের বোতলটা যে চাদরের ভিতর রয়ে গেল তা আর অনলাম না। দু’একদিন আগে কেনা নতুন চাদরটাও প্রমাণ হিসেবে গেল, সে খেয়ালও
ইলো না।’
নীরবতা ভঙ্গ করে শহীদ বলে, আমার ধারণার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সব। ‘বে একটা প্রশ্নের উত্তর আমার এখনও জানা বাকি রয়ে গেছে। বলুন দেখি, মি. চৗধুরী, প্রথা যেদিন আপনার সঙ্গে আমরা দেখা করতে আসি, সেদিন মিস শাহবাজী আপনাকে হঠাৎ এসে বললেন, ‘‘ আবার তুমি টাকা দিয়েছে শয়তানটাকে? বারবার বলেছি আব্বাকে আমরা সব জানিয়ে দিই চলো। ব্যাপারটা আসলে কি সংক্রান্ত জানতে পারি কি? | মি. চৌধুরী শহীদের প্রশ্ন শুনে মিস শাহবাজীর দিকে তাকান একবার। তারপর বলেন, ‘আপনার কাছে ব্যাপারটা গোপন করার কোনো মানে হয় না। ব্যাপারটা হচ্ছে, আজ থেকে বছর খানেক আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে, গোপনে। এই বিয়েতে শাহবাজীর আব্বার ঘোরতর আপত্তি ছিলো। তাই আমরা বিয়েটা করে ফেলেছি লুকিয়ে। এখনও সেটা প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশ পেলে ওর আ ওকে ত্যাগ করবেন নিশ্চিত, আমার পরিচালক জীবনের অবসান ঘটবে। তাই ব্যাপারটা চাপা দিয়ে রাখতে চাই ‘অন্ততঃ বর্তমান ছবিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু বিয়ের কথাটা কেমন করে জানি না সেলিম খান নামে একটা লোক জানতে পেরেছে কয়েক মাস আগে। তারপর থেকে প্রতি মাসে এক হাজার করে টাকা তুলে দিতে হয় সেলিম খান নামে ওই শয়তানটার হাতে। লোকটা এখন জালালাবাদেই আছে, হোটেল ডি-করোনেশন। শাহবাজীর কাছে টাকা
চায়ে পাঠিয়েছিলাম সেলিম খানকে দিতে হবে বলেই।
শহীদ বলে, ‘আপনাদের বিয়ে যদি গোপনেই হয়ে থাকে তাহলে সেলিম খান
‘য়াশা-১১
জানলো কিভাবে?
মিসেস শাহবাজী উত্তর দেন, ‘কি জানি, মি, শহীদ, সে কথা আমরাও জানি না।’ শহীদ বলে, ‘রেজিষ্ট্রি অফিসে বিয়ে হয়েছিল তা আপনাদের?
হা। ‘সাক্ষী ছিলো কে কে?
মি, চৌধুরী বলেন, ‘আগে থেকে সাক্ষী যোগাড় করে আমরা ব্রেজিস্ট্রি অফিসে যাইনি। ভেবেছিলাম, ঘুষ-টুষ দিয়ে সাক্ষী যোগাড় করে নেবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে ঘুষ দেবার দরকার হয়নি। আরও দু’জন নারী-পুরুষ সেদিন আমাদেরই মতো গোপনে বিয়ে করতে রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়েছিলেন। তাঁরাই সাক্ষী হন আমাদের, আমরাও তাদের সাক্ষী হই।’
আগ্রহী কণ্ঠে শহীদ জিজ্ঞেস করে, ‘কে তারা? চেনেন নিশ্চয়?
মিসেস শাহবাজী এবং মি. চৌধুরী একই সঙ্গে বলে ওঠেন না, চিনি না তাদের। যোগাযোগও নেই কোনো।
এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে শহীদ বলে, ‘আচ্ছা, আপনাদের বিয়ের কাবিননামাটা আপনাদের কাছে আছে?’
তা আছে। এটা সব সময় আমার কাছেই থাকে,’ মিসেস শাহবাজী উত্তর দেয়। ‘দেখাতে পারেন সেটা একবার?” . ‘বেশ বসুন, আমি আনছি এখুনি। | কিছুক্ষণ পর মিসেস শাহবাজী একটা কাবিননামা নিয়ে ফিরে আসেন। হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে সাক্ষীদের ঘরে দু’টো পরিচিত নাম দেখে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠে শহীদ। কিন্তু সে কিছু বলে উঠবার আগেই মি. হোজা দু’জন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন।
| শহীদের দিকে তাকিয়ে ধূর্ত হাসি হাসেন তিনি। কিন্তু কিছুই বলেন না শহীদকে। মি. সাবির চৌধুরীর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘মিস সুফিয়াকে হত্যা করার অভিযোগে আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে, মি. চৌধুরী। আমরা আপনার বিরুদ্ধে বহু প্রমাণও সংগ্রহ করেছি ইতিমধ্যে। সে সব যথাসময়ে কোর্টে হাজির করা হবে। এখন আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে আপনাকে।
কথাটা বলে পুলিশ ইন্সপেক্টর মি. হোজা সাবির চৌধুরীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন। তারপর শহীদ কিছু বলবার আগেই মি. হোজা তার দিকে তাকিয়ে, ‘চলি মি. শার্লক হোমস,’ বলে সাবির চৌধুরীকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান।
। ঘটনার আকস্মিকতায় মিসেস শাহবাজীর বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মি. চৌধুরীকে হাতকড়া পরিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠে সোফার ওপর লুটিয়ে পড়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বারবার শুধু একটা কথাই মিসেস শাহবাজী বলতে থাকে, ‘না, না, আমি বিশ্বাস করি না। সাবির খুনী নয়। ১০০
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শহীদ। বলে, ‘সে আমি জানি, মিসেস শাহবাজী।
আপনি জানেন!
জানি বৈকি! সুফিয়ার হত্যাকারী কে, তা-ও আমি জানি। কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে অমোঘ প্রমাণ যোগাড় করা সহজ নয়। আপনি নিশ্চিন্ত মনে ধৈর্য ধরে থাকুন কয়েকটা দিন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওরা বর্ধমান হাউসের বাইরে বের হয়ে আসতে কামাল এতক্ষণে নীরবতা ভঙ্গ করে বলে, ‘তুই সব জেনে-শুনেও সাবির চৌধুরীকে গ্রেফতার হতে দিলি কেন?
শহীদ তাকালো একবার কামালের দিকে। তার কপালে ভাঁজ পড়েছে। বলে, ‘তুই-ই বল না, কেন?
‘আমি জানলে তোকে আর জিজ্ঞেস করবো কেন?
ওরে, বুদ্ধ, সাবির চৌধুরী গ্রেফতার না হলে আসল অপরাধীরা যে সাবধান হয়ে যাবে–এই সহজ-সরল ব্যাপারটাও তোর মাথায় ঢুকলো না?
কামাল কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
আট
হোটেল ডি-করোনেশন থেকে মাইলখানেক দূরে সমুদ্রের তীরবর্তী একটা পাথরের আড়ালে চুপচাপ শুয়ে আছে শহীদ ও কামাল।
পাথরের আড়াল থেকে মুখ বের করে চাঁদের আলোয় বিস্তৃত বালুকাবেলায় সন্ধানী দৃষ্টি মেলে অপেক্ষা করছে দু’জনে। আধঘন্টাখানেক হলো ওরা এসেছে এখানে। ওরা পৌঁছেই দেখতে পেয়েছে কূল থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙ্গর করা রয়েছে একটা জাহাজ। পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করার আগে ওরা একটা ছায়ামূর্তিকে সামনের একটা পাথরের ওপাশে লুকাতে দেখেছিল। দূর থেকে চেনা যায়নি ছায়ামূর্তিটাকে। এখনও আড়াল থেকে বের হয়নি লোকটা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে শহীদ চারপাশে। বারবার ঘড়ি দেখছে। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় নটা বেজে পনেরো। আরও খানিক সময় কেটে যাবার পর বেশ কিছুটা দূরে প্রায় পানির কাছ ঘেষে একটা লোক এগিয়ে আসছে দেখতে পেলো ওরা। কি মনে করে শহীদ পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে তৈরি হয়ে নিলো। এগিয়ে আসছে লোকটা ধীরে ধীরে। চেনা যাচ্ছে না লোক টাকে। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে ধূসর একটা ছায়া এগিয়ে আসছে যেন। আরও কিছুটা। এগিয়ে এলো লোকটা পাতলা কুয়াশার মধ্য দিয়ে। এবার ফিসফিস করে কামালের উদ্দেশে শহীদ বললো, ‘স্যার না?”
কামালও চাপা গলায় ফিসফিস করে উত্তর দিলো, আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’
কামালের কথা শেষ না হতেই সামনের তেকোণা পাথরের আড়ালে আত্মগোপন
sos
করে থাকা ছায়ামূর্তিটা আত্মপ্রকাশ করলো।
ড’, সুফিয়ান ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ান। ছায়ামূর্তিটা কিন্তু দাঁড়ায় না, দ্রুত হাঁটতে থাকে ড. সুফিয়ানের দিকে। ড. সুফিয়ানের কাছে গিয়ে কি যেন বলে ছায়ামূর্তি। ড. সুফিয়ানও হাত নেড়ে কি যেন বলেন। ভাসা ভাসা শব্দ শুনতে পায় শহীদ ও কামাল; কিন্তু কথাগুলো বুঝতে পারে না।
ছায়ামূর্তিটা এরপর পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বেলে জাহাজের দিকে দোলাতে থাকে। ওরা দেখলো জাহাজ থেকেও একটা আলো তিনবার সামান্য বিরতির ব্যবধানে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। কয়েক মিনিট সময় এরপর কাটে পিন-পতন নীরবতার মধ্যে। তারপর আচমকা একটা হেলিকপ্টারের স্টার্ট নেবার শব্দ শুনে চমকে ওঠে শহীদ কামাল। . মুহূর্তেক পরই কপ্টারকে জাহাজের সামনে খোলা ভেক থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে তীরের দিকে উড়ে আসতে দেখা যায়। তীরে দাঁড়িয়ে ছায়ামূর্তি আর তার পাশে ড, সুফিয়ান দু’জনে ‘কপ্টারটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ছায়ামূর্তি আর ড, সুকিরি নাথার ওপর এসে পড়লো হেলিকপ্টারটা। তারপর নামতে শুরু করলো ধীরে ধীরে।
ছায়ামূর্তি ড. সুফিয়ানকে নিয়ে এগিয়ে গেল হেলিকপরের দিকে। কাছাকাছি। পৌঁছে কি যেন বললো কাকে। উত্তর দিল৷ কে যেন কিছুই শুনতে পেলো না শহীদরা। হেলিকপ্টারের দরজা আগেই খুলে গিয়েছিল। ছায়ামূর্তি ড. সুফিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে কপ্টারটার কাছে এসে দাঁড়াতেই শহীদ ও কামাল চিনতে পারলো ছায়ামূর্তিকে। ছায়ামূর্তি কুয়াশা।
এমন সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটলো। হেলিকপ্টারের পিছন দিকের একটা দরজা। খুলে গেল আস্তে আস্তে। সন্তর্পণে সেই খোলা দরজা পথ নেমে এলো দু’জন লোক। লোক দু’জনের হাতে চাঁদের আলোয় দেখা গেল চকচক করছে দু’টো রিভলবার। গুটি গুটি এগিয়ে কুয়াশা আর ড. সুফিয়ানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো লোক দু’জন। তারপর ভয়াল কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘হাত ওপরে তোল, শয়তান!
ড. সুফিয়ানের কণ্ঠ থেকে একটা বিস্ময়কর আওয়াজ বের হয়ে এলো। কুয়াশাও মনে হলো কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে মাত্র মুহূর্তেকের জন্যে। পরক্ষণেই ড. সুফিয়ানকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিয়ে চোখের পলকে কুয়াশা লোক দুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের গুলির আওয়াজ শোনা যায়–কড়াক! কড়াক!
ইতিমধ্যে জাহাজের দিক থেকে তীব্র বেগে একটা স্পীডবোট তীরের দিকে ছুটছে দেখতে পাওয়া যায়।
গুলির আওয়াজ শুনে শহীদ আর কামাল উঠে দাঁড়িয়েছিলো। প্রবল উত্তেজনায় কাঁপছিল ওরা দু’জন। কুয়াশা কি তাহলে ঘৃণ্য আততায়ীর গুলির শিকার হলো? ১০২
| কিন্তু মুহর্তেক পরে স্পীডবোটের আলো বালুকাবেলায় পড়তে ওদের সে ভুল ভেঙে যায়। ওরা পরিষ্কার দেখতে পায় কুয়াশা অদৃশ্য হয়েছে আর আক্রমণকারী লোক দুটি মূৰ্ছিতপ্রায় ড. সুফিয়ানের থেকে একটু দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
‘আশ্চর্য! কামাল বলে।
আয় আমার সঙ্গে। কামালের উদ্দেশে কথাটা বলে শহীদ ছুট দেয় তীর লক্ষ্য করে।
স্পীডবোটটা ইতিমধ্যে তীরে এসে ভিড়েছিল। স্পীডবোট থেকে একে একে নামলো দশ-এগারো বছরের একটি ছোটো ছেলে আর শক্ত সমর্থ চেহারার দু’জন লোক।
শহীদ আর কামাল ছুটে এসে প্রথমেই তুলে ধরে ড. সুফিয়ানকে। প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক অস্থির আতঙ্কে ভুল বকে চলেছেন। ড. সুফিয়ানকে কামালের হেফাজতে রেখে শহীদ ছুটে যায় সামনে। এমন সময় হেলিকপ্টারের ককপিট থেকে খোলা ভোজালি হাতে বেরিয়ে আসে একটা লোক। লোকটাকে ককপিট থেকে বেরুতে দেখে ঘুরে দাঁড়ায় শহীদ। কিন্তু তার আগেই লোকটা হাতের ছোরাটা ছুঁড়ে মারে শহীদকে লক্ষ্য করে। চকিতে একপাশে সরে দাঁড়ায় শহীদ। বাতাসে শিস কেটে ছোরাটা দূরে গিয়ে পড়ে।
| আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতেই শহীদ লাফিয়ে পড়ে আততায়ীর ওপর। ঝুঁকে পড়ে মাথা দিয়ে লোকটার তলপেটে প্রচণ্ড আঘাত করে শহীদ। উক’ শব্দ করে লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে যেতে চায় মাটিতে। কিন্তু তার আগেই শহীদ তার ঘাড়ের পাশে ডান হাতের কনুই দিয়ে আবার প্রচণ্ড একটা আঘাত করে। ‘
তীব্র আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে লোকটা। জাপানী কারাতের অব্যর্থ কৌশল ব্যর্থ হবার নয়।
হেলিকপ্টারকে পাশ কাটিয়ে শহীদ তার লক্ষ্য করে ছুটতে থাকে। সেখানে তখন রীতিমত একটা খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না শহীদ। কুয়াশাকেও দেখতে পায় না চারপাশে চোখ মেলে। শুধু একটু দূরে দশ-এগারো বছরের ছোটো একটি ছেলে ডুকরে কাঁদছে দেখতে পায় সে।
মুহূর্তের মধ্যে ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে শহীদ। এক ফাঁকে ছুটে গিয়ে সে ছোটো ছেলেটাকে তুলে নিয়ে উল্টোদিকে দৌড় দেয়।
| কামালের সেবায় ইতিমধ্যেই ড. সুফিয়ান চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে তাদের কাছে হাজির হয় শহীদ। বলে, “স্যার, শিগগির চলুন। আমাদের এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা উচিত নয়।
ছছাটো ছেলেটাকে দেখেই ড. সুফিয়ান আবেগভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন, টুটুল, বাবা আমার! .
আব্দু!” ছেলেটাও ডুকরে কেঁদে ওঠে।
১০৩
ড. সুফিয়ান কাঁপা হাতে ছেলেকে বুকের ওপর তুলে নেন।
ড. সুফিয়ান আর টুটুলকে আর্কিমিডিস লজে পৌঁছে দিয়ে শহীদ ও কামাল যখন হোটেল ডি-করোনেশনে এসে পৌঁছলো তখন রাত বাজে একটা। গেট পেরিয়ে লবিতে পা রাখতেই কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পাইপ সেবনরত একটা লোককে দেখে হেসে ওঠে শহীদ। যাণ্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে সে লোকটার কাছে গিয়ে বলে ওঠে, ‘হ্যাল্লো, মি. সিম্পসন, হাউ ডু ইউ ডু?’
‘ভালোই আছি, মি. সিম্পসন মুখ থেকে পাইপটা খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি হেসে বলেন, ‘তোমাদের খবর কি?
| ভালোই বলতে পারেন, কামাল উত্তর দেয়, ‘আমরা এইমাত্র বিরাট একটা অ্যাডভেঞ্চার থেকে ফিরলাম।
‘কি রকম?
আসুন আমাদের স্যুটে গিয়ে বলছি। কিন্তু আমিও তো একটা স্যুট ভাড়া নিয়েছি। তোমরা আমার ঘরেই চলো না। ‘আপনি কখন এসেছেন?’’ ‘এই তো, মাত্র কিছুক্ষণ আগে। ‘কিন্তু ট্রেন তো, এ সময়
‘আই হ্যাভ কাম বাই স্পেশাল প্লেন। মৃদু হেসে কামালের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন মি. সিম্পসন। শহীদ ও কামাল তাঁর পিছু নেয়।
নয়
পরদিন বিকেলে ড. সুফিয়ানের ড্রইংরুমে শহীদ ও ড. সুফিয়ানের আমন্ত্রণক্রমে মিসেস রসূলবক্স, মিসেস খোদাবক্স, মি. আবেদীন, মিস জোবায়দা, হোটেল ডি করোনেশনের ম্যানেজার মি. মল্লিক, মি. শ্রীধর, মিসেস শাহবাজী এবং জালালাবাদ থানার ইন্সপেক্টর মি. হোজা একটি আনন্দ উৎসবে হাজির হলেন। বলাই বাহুল্য, মি. সিম্পসন শহীদ ও কামালের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
দৃশ্যতঃ হারানো ছেলে টুটুলকে ফিরে পাওয়া উপলক্ষে ড. সুফিয়ান এই আনন্দোৎসবের আয়োজন করলেও শহীদেরও অন্য আর একটা উদ্দেশ্য ছিলো। সে উদ্দেশ্যের কথা ড. সুফিয়ানকে সে আগেই জানিয়েছিল। মিসেস শাহবাজী এবং মিসেস রসুল বক্সকেও একটা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল।
মিসেস রসুল বক্সের ইচ্ছাতেই মিসেস খোদাবক্স এবং মি. আবেদীন এই সমাবেশে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছেন। মিস জোবায়দাও হোটেল ম্যানেজার মি. মল্লিকের কথার অবাধ্য হতে না পেরে যোগ দিয়েছেন অগত্যা।
শহীদ ও কামাল পাশাপাশি দটো চেয়ারে বসে আছে। শহীদের পাশে আসীন মি.
১০৪
সিম্পসন, কামালের পাশে বসে আছেন মিসেস রসুল বক্স তারপর যথাক্রমে মিসেস
শাহবাজী, মিসেস খোদাবক্স, মি, আবেদীন এবং মিস জোবায়দা পর পর বসেছেন।
চা-নাস্তার পর্ব সবে মাত্র শেষ হয়েছে। হোটেল থেকেই খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরিবেশন করেছে বেয়ারারা। কিছুক্ষণ আগে টেবিল পরিষ্কার করে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছে তারা। খোশ গল্পে মগ্ন এখন অতিথিরা। ব্যতিক্রম শুধু মিসেস, ওসেনা শাহবাজী।
এমন সময় হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শহীদ। সকলের উদ্দেশে বলে, আমরা উপস্থিত অতিথিবৃন্দ, সকলেই জানি, ড. সুফিয়ানের একমাত্র সন্তান টুটুলকে ফিরে পাওয়া উপলক্ষে আজকের এ আনন্দোৎসবের আয়োজন। কিন্তু “ব চেয়েও বড় এবং চমকপ্রদ আরও একটা কারণ আছে। সেটা আপনাদের সমীপে প্রকাশ করার অনুমতি পেলে বাধিত হবে। অবশ্যি মনে মনে আমার আশঙ্কা আছে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সে অনুমতি দিতে কণামাত্র আগ্রহী নন। কিন্তু, আপারা কেউ অনুমতি দিন। বা না দিন, আজকের এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় কারণটা যেটা চমকপ্রদ, এই মুহূর্তে আমি সেটির উল্লেখ না করে পারছি না। কারণটা হলো মিস সুফিয়ার আসল হত্যাকারীকে সনাক্তকরণ।
| উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একটা অস্বস্তির ঢেউ বয়ে যায়। শহীদের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মিসেস রসুলবক্স ক্রু কুঁচকে বলে ওঠেন, ‘আপনি আমাকে সে কথা বলে তো নিমন্ত্রণ করেননি, মি. শহীদ।
শহীদ শান্ত কণ্ঠে বলে, স্পষ্ট করে বলিনি বটে, তবে জানিয়েছিলাম বিশেষ একটা ব্যাপার আছে এই আয়োজনের মধ্যে।
তা বলেছিলেন। কিন্তু
হঠাৎ ব্যঙ্গভরে বলে ওঠেন মি. আবেদীন, ‘মিস সুফিয়ার হত্যাকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিস, সে খবর দেখছি জানা নেই মি. শহীদের।
‘মিস সুফিয়াকে সাবির চৌধুরী, খুন করেনি। দৃঢ় কণ্ঠস্বর শোনা যায় মিসেস শাহবাজীর, ‘ভুল বুঝে পুলিস গ্রেফতার করেছে তাকে।
তাই নাকি? তবে সুফিয়াকে বুঝি আপনি হত্যা করেছেন? মিস জোবায়দা মিসেস শাহবাজীর দিকে তাকিয়ে তীরে প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারেন।
| আচমকা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেন না মিসেস শাহবাজী। তারপর মৃদুস্বরে বলেন, ‘আর যেই করুক, সাবির চৌধুরী মিস সুফিয়াকে হত্যা করেনি করতে পারে না!
‘আমাকে বলতে দিন, শহীদ সকলকে থামিয়ে দিয়ে বলে। ‘দৃশ্যতঃ ব্যাপারটা কিন্তু সে রকমই সন্দেহ হয়। মি. সাবির চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তাদের। দৃষ্টিতে, উপযুক্ত কারণেই। তবে সৌভাগ্যক্রমে তথাকথিত উপযুক্ত কারণগুলো আমার দৃষ্টিতে অনুপযুক্ত প্রমাণিত হয়েছে। মিস সুফিয়ার হত্যাকারী মি. সাবির চৌধুরী নয়, এ
১০৫
কথা প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার। তবে প্রথম দায়িত্ব হলো মিস সুফিয়ার হত্যাকারীর সনাক্তকরণ। বলা যেতে পারে সে ব্যাপারে আমি সফল হতে পেরেছি।’
| কথা ক’টি বলে এক মুহূর্তের জন্য দম নেয় শহীদ। তারপর নিজের নীরবতা ভঙ্গ করে সকলকে আশঙ্কাতীতভাবে চমকে দিয়ে বলে ওঠে, ‘মিস সুকিয়ার হত্যাকারী মিস জোবায়দা, ওরফে মিসেস জোবায়দা, বা মিসেস আবেদীন।
ঘরের ভিতর জীবন্ত বাঘের বজ্রনির্ঘোষ শুনলেও এমন চমকে উঠতে না কেউ। মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে যায় মিসেস জোবায়দার মুখ। পলকের জন্য একবার তাকান তিনি মি. আবেদীনের দিকে। নির্বিকার মুখ করে বসে আছেন মি. আবেদীন শহীদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে। মিসেস রসূল বক্স উত্তেজিত কণ্ঠে শহীদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেন, ‘কী সব বলছেন আপনি! মিস জোবায়দাকে মিসেস আবেদীন বলার অর্থ কী?’ ‘
| ‘আজ থেকে বছর খানেক আগে মি. আবেদীন আপনাদেরকে লুকিয়ে মিসেস জোবায়দাকে বিয়ে করেছেন। খবরটা আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমি জানি আর এখানে উপস্থিত একজন মহিলা জানেন। তিনি আপনার পাশেই বসে আছেন। উনি সাবির চৌধুরীর বিবাহিতা স্ত্রী, মিসেস শাহবাজী। মি, আবেদীন ও মিসেস জোবায়দার বিয়েতে উনি এবং ওনার স্বামী সাক্ষী ছিলেন। তাই না মি, আবেদীন?’
| হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে শহীদের প্রতি খেঁকিয়ে ওঠেন মি. আবেদীন, তাতে কি হলো! বিয়ে করেছে বলেই খুনী হয়ে গেল জোবায়দা!” | মৃদু হেসে শহীদ বলে, তাতো হলো বৈ কি, মি. আবেদীন। আপনার সঙ্গে বিয়ে
হলে আর মিসেস জোবায়দাকে দিয়ে আপনি মিস সুফিয়াকে হত্যা করাতে পারতেন?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন মি. আবেদীন শহীদের কথা শুনে। তারপর হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
‘আরে না সাহেব, শহীদ খানের মাথা অতো সহজে খারাপ হতে পারে না। কথাটা বলে তীব্র দৃষ্টিতে মি. আবেদীনকে আপাদমস্তক দেখে নেয় শহীদ। তারপর বলে, ‘আমাকে সবিস্তারে ঘটনাটা বলতে দিন। ড. সুফিয়ানের ল্যাবরেটরিতে যে যুবতীর মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হয় সেটি মিস সুফিয়ার মৃতদেহ ছিলো না।’
| শহীদের কথা শেষ হবার পর পরই সারা ঘরময় আবার একটা উত্তেজনার হলকা বয়ে যায়।
‘মানে?’ মিসেস রসুল বক্স চিৎকার করে ওঠেন। ‘কিছুই বোঝা যাচ্ছে না?” বলে উঠেন মিসেস খোদাবক্স।
‘বাধা দেবেন না দয়া করে। সকলের উদ্দেশেই কথাটা বলে আবার শুরু করে শহীদ, ‘মৃতদেহটি যে মিস সুফিয়ার নয় তা আমি দেখার সঙ্গে সঙ্গে ধরতে না পারলেও একটা ব্যাপারে আমার দৃষ্টি পড়েছিল। মৃত যুবতীর মাথার চুল দেখে বুঝতে
১০৬
পেরেছিলাম আমি যে, চুলগুলো ছিলো তার সুদীর্ঘ, বব-দুটি নয়। কিন্তু যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক, হঠাৎ আনাড়ী হাতে দীর্ঘ চুল ছেটে বব-ছাঁটের মতো করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা জন্মায় আমার। এরপরই যখন জানতে পারলাম যে মিস সুফিয়া, চুল অনেক দিন থেকেই বব-ছটি করা ছিলো, তখনই স্থির বিশ্বাসে পৌঁছলাম। ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত মৃতদেহটি মিস সুফিয়ার নয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা অনুমানভিত্তিক আশঙ্কা জাগে। আরও একটা যুবতীর অকাল মৃত্যু ঘটবে বলে আশঙ্কা হয় আমার। যাই হোক, ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত মৃতদেহটি মিস সুফিয়ার নয় এ কথা জানার পর মিসেস জোবায়দার উপর আমার সন্দিহান দৃষ্টি পড়ে। মিস সুফিয়ার না হওয়া সত্ত্বেও ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত মৃতদেহটিকে মিস সুফিয়া বলে সনাক্তকরণের অর্থ কি? মিসেস জোবায়দাই একমাত্র লাশ সনাক্ত করেছিলে। তিনি জানতেন, মিস সুফি.র মৃতদেহ সেটি নয়। কিন্তু তবু তিনি পুলিসকে বললেন, সেটি মিস সুফিয়ারই মৃতদেহ। ড. সুফিয়ানের ল্যাবরেটরিতে লাশ পাওয়া গেছে শুনে চমকে উঠেছিলেন মিসেস জোবায়দা। কেন? কেননা তিনি ভালো করেই জানতেন লাশটা কোথায় আবিষ্কৃত হওয়া উচিত ছিলো। মি. সাবির চৌধুরীর বাড়িতে লাশটা আবিষ্কৃত হওয়ার কথা ছিলো তাদের পরিকল্পনানুযায়ী। প্ল্যান অনুযায়ী কাজেও তাদের ভুল হয়নি। গোলমাল বেধেছিল অন্যত্র। যাই হোক, সেদিন সকালেই খবর পাওয়া গেল, লিটন। রোডে একটা গাড়ির ভেতর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে আরও একটা মেয়ের লাশ। এই মেয়েটাই আসলে মিস সুফিয়া। কিন্তু প্রশ্ন দীড়ায়, তাহলে ল্যাবরেটরিতে যে লাশটা পাওয়া গেছে সেটা কার? সেটা মিস পাপিয়া নাম্নী একজন নাট্যাভিনেত্রীর। মিস পাপিয়া নিখোঁজ হবার সংবাদ সেদিনকার প্রভাতী কাগজে বের হয়েছিল। অনেকে তা দেখে থাকবেন হয়তো। মিস পাপিয়ার নিরুদ্দেশ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমি জানতে পারি নিখোঁজ হওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর এক বান্ধবীকে বলেছিলেন যে, কোনো একটা ছায়াছবির নাম ভূমিকায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানার জন্য তিনি জালালাবাদ যাবেন। সেখানে তাঁর স্ক্রীন টেস্ট হবে। এ খবরটা স্বভাবতই মি. সাবির চৌধুরীর উপর সন্দেহ আনে। কেননা জালালাবাদে ইদানীং একটি মাত্র ছায়াছবির শুটিং হচ্ছে এবং তার পরিচালক সাবির চৌধুরী! কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম, ছক কাটা। অপরাধীরা সুপরিকল্পিতভাবে মিস সুফিয়াকে হত্যা করে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়েছিল।
ঘরের দমবন্ধ করা আবহাওয়ায় অনড় বসে আছে সকলে যে যার চেয়ারে। এক মুহূর্তের জন্য থেমে শহীদ আবার শুরু করেঃ
| ‘প্রথম থেকেই মিস সুফিয়ার হত্যাকে আমি পনেরো লক্ষ টাকার প্রেক্ষিতে ভেবেছি। মিসেস রসুল বক্স মিস সুফিয়াকে পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে পনেরো লক্ষ টাকা তার নামে লিখে দেবেন জানার পর আমার সন্দেহ গিয়ে পড়ে মিসেস খোদা বক্স এবং মিস্টার আবেদীনের উপর। কেননা, মিসেস রসুল বক্স মারা গেলে সব টাকা
১০৭
স্বভাবতই এঁদের দখলে এসে পড়বে। অথচ তিনি মারা যাবার আগে পনেরো লক্ষ টাকা যদি কোথাকার কে সুফিয়ার হাতে গিয়ে পড়ে তবে তা সহ্য করা যায় কেমন করে? এরপরই হঠাৎ একদিন আমার রুমের পিছনদিকে জানালার কপাটে ক’ গাছি চুল দেখে সন্দেহ হয় আমার। সঙ্গে সঙ্গে নিচের এদো গলিতে গিয়ে খোঁজ করতেই পেয়ে যাই মেয়েদের এক গোছা চুল। চুলগুলো আসলে মিস পাপিয়ার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি। আমার উপরের ঘরটা মিসেস জোবায়দার।
মিস জোবায়দার ব্যাপারে আমি বোকা বনে যাই সম্পর্কের সামঞ্জস্য খুঁজে না পেয়ে। মিস সুফিয়াকে হত্যা করে মিসেস জোবায়দার লাভ কি? কি তার উদ্দেশ্য? সুস্থ মস্তিষ্কে পরিকল্পিত হত্যা অসম্ভব নিশ্চয়। যদি না কোনো মোটিভ থাকে। কিন্তু মিসেস জোবায়দার কি লাভ মিস সুফিয়াকে হত্যা করে? ধাঁধায় পড়লাম আমি। কিন্তু সব পরিষ্কার হয়ে গেল চোখের সামনে, যখন জানতে পারলাম মিসেস জোবায়দা আসলে মিসেস আবেদীন। মি. আবেদীন এক বছর আগে তাকে বিয়ে করেছেন।
| ডাক্তার রিপোর্ট অনুয়ায়ী মিস সুফিয়াকে হত্যা করা হয়েছে রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে। অথচ, রাত এগারোটা কুড়ি মিনিট পর্যন্ত মিস সুফিয়াকে হোটেলের প্রদর্শনী নাচের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। এবং সে সময়ে সকলেই প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তারপর মিস সুফিয়াকে আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও অন্য সকলে রাত একটা পর্যন্ত প্রদর্শনী নাচের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মিসেস জোবায়দাও উপস্থিত ছিলেন সেই সময়ে। তা সত্ত্বেও কিভাবে তাকে অভিযুক্ত করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে শুরু করতে হবে অন্যভাবে। ব্যাপারটা হলো এই যে, মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে মি. আবেদীন ঢাকায় গিয়ে মিস পাপিয়াকে একটি ছায়াছবিতে অংশগ্রহণের লোভ দেখান। জালালাবাদের হোটেল ডি-করোনেশনে তাকে তিনি দেখা করতে বলেন। সেখানে তার স্ক্রীন টেস্ট নেয়া হবে বলে তাকে জানান। মিস পাপিয়া জালালাবাদে কবে পৌঁছান সে কথা জানা যায়নি। তবে নির্দিষ্ট দিনটিতে, অর্থাৎ যেদিন মিস সুফিয়াকে হত্যা করা হয়, সেদিন খুব সম্ভব রাত আটটা সাড়ে আটটার সময় হোটেল ডি-করোনেশনে মি. আবেদীনের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। মি. আবেদীনই তাকে সঙ্গে করে মিস জোবায়দার ঘরে নিয়ে যান। তারপর তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার ফাঁকে চা বা কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মিস পাপিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর সম্ভবতঃ রাত দশটার সময় গলা টিপে হত্যা করা হয় তাকে। মি. আবেদীন আমাকে জানিয়েছিলেন ডিনার শেষে সেদিন তিনি তাঁর পুরানো অভ্যাস অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের দিকে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। আসলে সে সময়ে তিনি মিস পাপিয়ার মৃতদেহ হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে গোপনে বের করে গাড়িতে তোলেন এবং মি, সাবির চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তাঁর বাড়ির সামনের একটি ঘরের তালা খুলে মৃতদেহটি খাটের ওপর শুইয়ে রেখে আবার তালা বন্ধ করে হোটেলে ফিরে আসেন। মিস পাপিয়ার সুদীর্ঘ কেশরাজি মিসেস জোবায়দার দৃষ্টি এড়ায়নি, তিনি তাই
১০৮
চুলগুলো কেটে যেন-তেন প্রকারে বব-ছাঁট করে দেন। কিন্তু আনাড়ী হাতের লক্ষণ দূর হয়নি।
‘আমার ধারণা মিস সুফিয়াকে মিসেস জোবায়দা আগে থেকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে তার ঘরে সে যেন অপেক্ষা করে প্রথম প্রদর্শনী নাচের পর। মিস সুফিয়া তাঁর কর্তৃত্বেই চাকরি করতেন হোটেলে। সুতরাং নির্দেশ অমান্য করার প্রশ্ন ওঠে না। মিস পাপিয়ার মতো সুফিয়াকেও বারবিটোন জাতীয় কিছু খাওয়ান হয়েছিল খুব সম্ভব ডিনারের পর কফির সঙ্গে।
‘দ্বিতীয় প্রদর্শনী নাচের সময় হয়ে আসায় খোঁজ পড়ে মিস সুফিয়ার। কিন্তু তার ঘরে ফোন করে যখন উত্তর পাওয়া যায় না, তখন মিসেস জোবায়দা নিজে খোঁজ করতে আসেন এবং মিস সুফিয়ার ঘরে না ঢুকে পাশের ঘরে ঢোকেন। পাশের ঘরটি মিসেস জোবায়দার নিজের। মিস সুফিয়া সম্ভবতঃ তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘরে প্রবেশ করে তাঁর মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে বা গলা টিপে তাকে হত্যা করেন। তারপর ঘরের ভিতরেই লাশটা লুকিয়ে রেখে প্রদর্শনী-নাচের আসরে গিয়ে বলেন মিস সুফিয়াকে তিনি তার ঘরে দেখতে পাননি। এরপর তিনি নিজেই প্রদর্শনী নাচে অংশগ্রহণ করেন। নাচ শেষ হয়ে যাবার পর ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েন তিনি। ঘন্টা তিন চারেক পর, যখন ভোর হতে আর সামান্য দেরি আছে, তখন মি. শ্রীধরের গাড়ি চুরি। করে মিস সুফিয়ার মৃতদেহ নিয়ে লিটন রোড অভিমুখে যাত্রা করেন। লিটন রোডেরই নির্জন একটি জায়গায় গিয়ে পেট্রোল ঢেলে গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। গাড়ির ভিতরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায় মিস সুফিয়ার মৃত শরীরটিও। তাকে সনাক্ত করার কোনো
উপায়ই আর থাকে না।
‘তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মিস পাপিয়াকে হত্যা করা হলো কেন? মিস পাপিয়াকে হত্যা করার পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে-একটি হলো সময় সংক্রান্ত। মি. আবেদীন সুফিয়াকে হত্যা করার সময় অকুস্থলে ছিলেন না তিনি ওই সময় হোটেলের হল ঘরে, সর্বজনসমক্ষে অবস্থান করছিলেন। মিসেস জোবায়দা যে সুফিয়াকে হত্যা করতে পারেন, এটা কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভবপর ছিলো না। অবশ্য যি আবেদীনের সঙ্গে মিসেস জোবায়দার সম্পর্কের কথা জানবার পর ব্যাপারটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। মি. আবেদীন সুফিয়ার হত্যাকারী হিসাবে সাবির চৌধুরীকে সনাক্ত করাতে, চেয়েছিলেন। রাত আটটার দিকে সাবির চৌধুরী যে বর্ধমান হাউসে থাকবেন না, এ তথ্যটুকু জানা ছিলো মি. আবেদীনের। মিস পাপিয়ার মৃতদেহটা সে কারণেই তিনি আগেভাগে সাবির চৌধুরীর ঘরে ফেলে রেখে এসেছিলেন। সাবির চৌধুরীকে পুলিসের চোখে দোষী সাব্যস্ত করার পরিকল্পনাটি সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যেই নিরীহ একটা যুবতাঁকে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হননি মি. আবেদীন। পুলিস কিংবা অন্য কেউ যাতে ঘুণাক্ষরেও তাঁকে মিস পাপিয়ার হত্যাকারী হিসাবে সন্দেহ করতে না পারে সে জন্যেই। জোড়া খুনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন মি. আবেদীন। কিন্তু আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন,
কুয়াশা-.১১
১০৯
তিনি শেষ পর্যন্ত সফলকাম হতে পারেননি–তাঁর সব চালাকিই আমরা ফাঁস করে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ | শহীদের কথা শেষ হতেই মিসেস জোবায়দা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠেন। মি.. আবেদীন কিন্তু নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন শহীদের দিকে। মিসেস জোবায়দার কান্নাজড়িত কণ্ঠ হতে স্বীকারোক্তি বের হয় হঠাৎ।
‘আমি চাইনি…চাইনি…ওই নরাধমটাই বাধ্য করেছে আমাকে দু’দুটো খুন করতে।’
. ‘খবরদার! বিশ্বাসঘাতিনী!’ চিৎকার করে ওঠেন মি. আবেদীন মিসেস জোবায়দাকে লক্ষ্য করে। রিপর পকেট থেকে কি একটা বের করতে চান দ্রুত। তার আগেই শহীদ পকেট থেকে রিভলভার বের করে বলে ওঠে, ‘পকেট থেকে হাত বের করে ফেলুন, মি. আবেদীন।
| বাধ্য ছেলের মতো পকেট থেকে শূন্য হাতটি বের করে মি, আবেদীন মিসেস জোবায়দার দিকে আগুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
মি, হোজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর মিসেস জোবায়দার কাছে গিয়ে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন। এরপর মি. আবেদীনের দিকে মি, হোজা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটলো ঘরের ভিতর। সকলকে অবাক করে দিয়ে রিভলভার হাতে চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ান মি. সিম্পসন। রিভলভারের নলটা মি, আবেদীনের বুক লক্ষ্য করে শক্ত হাতে ধরে রেখে তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘এবার আর উপায় নেই তোমার, কুয়াশা! অন্যবারের মতো ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা এবার তুমি ভুলে যাও। তোমার লোক এখানে নেই আজ। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তোমাকে, চিনতে দেরি হয়েছে বটে; কিন্তু ব্যর্থ হইনি। দু’হাত ওপরে তুলে দাঁড়াও কুয়াশা। আজ আমি মরিয়া!
ঘরের সকলে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। এদিক-ওদিক চায় সবাই, কি ঘটবে না ঘটবে ভেবে। মি, আবেদীন রূপী কুয়াশার মুখে ফুটে ওঠে কৌতুকের হাসি। তে, মি. সিম্পসনের উদ্দেশে বলে, ‘আমাকে চিনতে পারার জন্যে আপনার প্রশংসা না করে
পারছি না। কিন্তু, কি জানেন, কুয়াশা কখনও হাত ওপরে তুলে দাঁড়ায় না।’
এটুকু বলেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা।
নড়ে না আর একচুলও, গুলি করবোকঠিন গলায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন মি. সিম্পসন।
তা সত্ত্বেও কুয়াশা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পকেটে হাত ঢোকায়। রিভলভারের ট্রিগার টিপে দেন মি. সিম্পসন কুয়াশার বাহু লক্ষ্য করে। কিন্তু রিভলভার থেকে কোনো গুলি
বের না হওয়াতে পরক্ষণেই হতভম্ব হয়ে যান তিনি।
হাঃ হাঃ শব্দে প্রাণ খুলে হেসে ওঠে কুয়াশা। তার হাতের ভিতর ইতিমধ্যে একটা রিভলভার চকচক করছে। হাসি থামিয়ে কুয়াশা বলে, ‘আপনাদের কারও রিভলভারেই
১১০
গুলি নেই, মি. সিম্পসন। দুর্মটি অনেক আগেই সারা হয়েছে।
কথা শেষ করে শহীদের দিকে তাকায় কুয়াশী। তারপর আবার বলে, ‘গতরাতের উপকারের জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, শহীদ। তুমি না থাকলে টুটুলকে কাল ড. সুফিয়ানের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারতাম কি না সন্দেহ। ড. সুফিয়ানকে আমি কথা দিয়েছিলাম, টুটুলকে উদ্ধার করে তার কাছে ফিরিয়ে দেবো বলে। সে উদ্দেশ্যেই
জালালাবাদে এসেছিলাম। এখানে আসার আগেই আমি জেনে গিয়েছিলাম কল্যাণী অনাথ আশ্রম আসলে ছেলে ধরাদের একটা আস্তানা। সারা দেশে এই ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান আছে। এ সবগুলোরই পরিচালক আবেদীন। সেলিম খান তারই সহচর। ঢাকা থেকে একটি জাহাজে করে টুটুল এবং কল্যাণী অনাথ আশ্রমের আরও কয়েকজন ছেলেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে বলে আমি আমার লোক মারফত খবর পাই। আমি আমার লোকজনকে জাহাজটা যে কোনো উপায়ে দখল করতে বলি। তারা আমার নির্দেশ পালন করে। কিন্তু জাহাজটার ভিতরে আবেদীনের কিছু লোক আত্মগোপন করে থাকে। গতকাল তারাই আমাকে আক্রমণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমরাই জয়ী হই। গতকাল খও যুদ্ধে আমার লোকজনের হাতে নিহত হয়েছে সেলিম খান। গতকাল রাতেই আবেদীনকে হোটেল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছি আমি। আমাকে যেতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের দুর্গম অঞ্চলে। ওখানকার রাস্তাঘাট আবেদীনই ভালো চেনে। ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি বেগার কলোনীগুলোর ঘাঁটি চেনাবার পথপ্রদর্শক হিসেবে।
কথা শেষ করে ধীর পদক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে যায় কুয়াশা। অবাক হয়ে সকলে দেখে ড্রইংরুম থেকে বাইরের গেটের দিকে না গিয়ে কুয়াশা বাড়ির অন্দরের দিকে হাঁটছে। কুয়াশার পিছন পিছন ড. সুফিয়ানও অগ্রসর হন।
মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় কুয়াশা এবং ড. সুফিয়ান। কামাল ও মি. সিম্পসন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। কি করবে ভেবে পায় না কেউ। মি. সিম্পসন অতিকষ্টে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন। কিছুই এখন করার নেই তাঁর। সকলের মনেই কিন্তু একটি প্রশ্ন কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে, বাড়ির অন্দরের দিকে কুয়াশা গেল কি
জন্য?
এমন সময়ে অপ্রত্যাশিত একটি শব্দ শুনে চমকে ওঠে সকলে। বুঝতে আর কারও কিছু বাকি থাকে না। সকলের অজান্তে কখন কে জানে কুয়াশা তার হেলিকপ্টারটি এনে আর্কিমিডিস লজের ছাদে রেখেছিল। হেলিকপ্টারের স্টার্ট নেবার শব্দ শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পারে সবাই।
সঙ্গে সঙ্গে ওরা সবাই ছুটলো বাড়ির ছাদের দিকে। ছাদে যখন পৌঁছলো সকলে, কুয়াশার হেলিকপ্টার তখন বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গছে।
কুয়াশার সঙ্গে ড. সুফিয়ান কোথায় যাচ্ছেন? হেলিকপ্টারটির দিক থেকে দৃষ্টি
১১১
ফিরিয়ে মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ওনার সঙ্গে টুটুল এবং আয়েশা
বগমও রয়েছেন দেখছি।
শহীদ এককথায় উত্তর দেয়, ওকে বিজ্ঞান গবেষণায় সাহায্য করতে।”
১১২
Leave a Reply