কিরগিজস্তানে কোরবানির ঈদের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন মঈনুস সুলতান
বানি ইসমাম মনে হয় ঘোড়ায় চড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তার পরনে চামড়ার স্কিনটাইট স্ন্যাকসে অনেকগুলো জিপার। শরীরে নাদুসনুদুসের ধাত আছে বলে তার চলাচলে চামড়ার ওয়াড় পরানো দীর্ঘাকৃতির জোড়া কোলবালিশের আকার ফোটে। সুনামবুবুও পৃথুলা, সে হাল্কা সোনালি রঙের ড্রেস পরে এসেছে বলে মনে হয় সার্কাসের ঘাগরাপরা টেডিবেয়ার চপাচপ বরফের কাদা মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে আমোদ ফুটিয়ে বলে, ‘টয় টয়।’ ঠিক বুঝতে পারি না আজ ঈদের দিনে কিরগিজস্তানে কি জানি কী হয়। বানি বুজদারের মতো জানায়, ‘টয়’ হচ্ছে কিরগিজদের একধরনের ফেস্টিভ্যাল। এ পর্বের ইন্তেজাম হয় ঈদের দিনে কোনো না কোনো পাহাড়ের পাদদেশে। বানির ভিন দেশে এসে তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দেখে রীতিমতো আমোদ লাগে। যাক, তাহলে তার খানিক অগ্রগতি হচ্ছে। আমেরিকার মফস্বল শহরের ইটছিবিটছি এক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান বানি কিরগিজস্তানে ডেলিগেটের সদস্য হয়ে সফরে যাচ্ছে শোনামাত্র ‘ও ইয়া কিরগিজস্তান, রাইট নেক্সট টু পাকিস্তান, আই অ্যাম সো একসাইটেড, আমি কিন্তু গোল্ডেন টেম্পোলে গোর্খারা যে উপাসনা করে তার ভিডিও করব,’ বলে পুলক প্রকাশ করলে তার ভূগোল জ্ঞানের কথা ভেবে বলতেই হয়, গোর্খারা যদি ভিডিওকরণেওয়ালীকে কোকরি দিয়ে তাড়া করে তাহলে তো মুছিবতই হবে। এ বক্তব্যে কিন্তু কাজ হয়, বানি তার পরদিন থেকে কিরগিজস্তানের ওপর যাবতীয় বইপুস্তক লিফলেট প্যাম্ফলেট বাদাছাদা যেখানে যা পায় তা পড়তে শুরু করে।
সুনামবুবু ও রামাজান রফিকভ দুজনেই জাতিতে কিরগিজ ও পেশায় লাইব্রেরিয়ান। একটি লাইব্রেরিয়ান এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের ডেলিগেট হয়ে তাঁরা বছর দেড়েক আগে সফর করেন যুক্তরাষ্ট্র। বানির ইটছিবিটছি লাইব্রেরিতে তারা ইনটার্ন হিসেবে কাজ করেন হপ্তা দুয়েক। আমরা এবার প্রজেক্ট ফলোআপে কিরগিজস্তানে আসলে ঈদের দিনের আচারানুষ্ঠানের সঙ্গে যাতে আমাদের সাক্ষাত্-পরিচয় হয় এ জন্য তাঁরা টয় ফেস্টিভ্যালে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা একটি বরফ মাখা পাহাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটি। এ পাহাড়ের মাথায় পোঁতা টেলিভিশনের টাওয়ারকে মেরু অঞ্চলের আইসবার্গের তীব্র তুষারে আটকানো জাহাজের মাস্তুলের মতো দেখায়। ঠিক তার নিচে আমরা টয় ফেস্টিভ্যালে আসা কিরগিজ ঘোড়সওয়ারদের দেখতে পাই। তাদের গায়েগতরে হাল্কা সোনালি সবুজ বা লোহিতে ব্রোকেডের কাজ করা আঙরাখা। তাদের জমকালো শিরোভূষণের দিকে তাকিয়ে জিপার সাঁটা জ্যাকেটের সঙ্গে বেইসবলক্যাপে নিজেকে আধনাঙ্গা পর্যটকের মতো দেখায়। ভাবি, পরের বার কিরগিজস্তানে আসার সময় যাত্রাদলের কাছ থেকে ভাড়া করে নবাব আলীবর্দী খান ও বানি ইসমামের জন্য ঘষেটি বেগমের লেবাস নিয়ে আসতে হবে দেখছি। এক বৃহত্ প্রান্তরের সামনে ঘোড়সওয়াররা যেন যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই আব্দুল্লাবালি আকায়েবকে দেখতে পাই। এর আগে কিরগিজ জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির এ ধারক, অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা আব্দুল্লাবালির একাধিক ছবি দেখেছি। সুতরাং সত্তর-পঁচাত্তর বছর বয়সের এ কালচার্যাল আইকনকে চিনতে আমার অসুবিধা কিছু হয় না। সোভিয়েত আমলে কিরগিজস্তানের ঘোড়দৌড়, বাজপাখি দিয়ে শিকার, কনে অপহরণ থেকে ঈদে চান্দে কোরবানি ও শিন্নি-সালাত এসব সামাজিক রেওয়াজকে সামন্তবাদী আখ্যা দিয়ে বাতিল ঘোষণা করা হলে তিনি অ্যানথ্রোপলজিস্টদের দক্ষতায় ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ছন্দবদ্ধ পদবিন্যাসে রচনা করেন অনেকগুলো গ্রন্থ। তাঁর বইগুলো বাজেয়াপ্ত করা হলে তিনি গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করে চীন দেশে নির্বাসিত থাকেন এগারো বছর।
সাদা দাড়িগোঁফে গলায় বাইনোকুলার ঝোলানো আব্দুল্লাবালিকে বয়সের তুলনায় অনেক সুঠাম শক্তপোক্ত দেখায়। তিনি একটি চাবুক হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, যেন আমরা তাঁর কুটুমখেশ, ফিরে এসেছি গাঁয়ে অনেক বছর পর। ঘোড়সওয়ারদের পাশে শিকলে বাঁধা কটি শিকারি কুকুর। রামাজান রফিকভ আমাদের জন্য নিয়ে আসেন জিনগদি লাগানো দুটি ঘোড়া। আব্দুল্লাবালি জানতে চান কিরগিজ সম্প্রদায়ের অশ্বারোহণবিষয়ক পদ্যটি রফিকভ বা সুনামবুবু আমাদের ব্যাখ্যা করে বলেছে কি না। বানি ইসমাম নোটবুক বের করে তাতে মানবজীবনের হায়াতের যদি অর্ধেক দিন বাকি থাকে তাহলে শেষবারের মতো ঘোড়ায় চড়ার জরুরতবিষয়ক পদ্যটি যে টুকে নিয়েছে তা আব্দুল্লাবালিকে দেখায়। আব্দুল্লাবালি দরাজ হেসে বলেন, তাহলে তোমরা অপেক্ষা করছ কেন, অ্যাঁ? জলদি চাপো ঘোড়ায়। বানিকে এবার একটু নার্ভাস দেখায়। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ও লর্ড, ডু আই রিয়েলি হ্যাভ টু রাইড হর্স নাও? বানি, এখানে তো কিরগিজরা তোমার জন্য পাল্কির বন্দোবস্ত করবে না। আমার মন্তব্যে সে হাল্কাভাবে মুখ ভেংচিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে চেপে বসে একটি ঘোড়ায়। আব্দুল্লাবালি আমার দিকে তাকিয়ে চাবুক হিসহিসিয়ে অশ্বারোহণের কবিতাটি আওড়ান। ছন্দময় চরণ অ্যায়সা জোশ দিয়ে উচ্চারণ করেন যে মনে হয় তিনি বলছেন, ‘যদি বাকি থাকে জিন্দেগির কেবল একটি দিন/জলদি চড়ো ঘোড়ায় হে বেকুব অর্বাচীন।’ অগত্যা কী আর করা, আমি কায়ক্লেশে শরীর ছেঁচড়িয়ে অন্য ঘোড়াটিতে চেপে বানির দিকে অ্যায়সা শানজরে তাকাই যেন আমি ঈশা খানের অধস্তন বংশধর মীর কুশা খান। এগারোসিন্ধুর লাড়াইয়ে মোগলদের কি আমরা ডিফিট করি নাই? আরে ঘোড়াফোড়া চড়া তো আমাদের কাছে কোনো বিষয়ই না। আব্দুল্লাবালি তাঁর নিজের ঘোড়ায় সওয়ার হলে অশ্বারোহীদের সম্পূর্ণ দল মুভ করতে শুরু করে। আমি লাগাম সামলাতে সামলাতে বরফ ছাওয়া পাহাড়ের ঢালুতে দেখি নির্বাক যুগের ছায়াছবির মতো ফুটে উঠছে তাদের চলমান প্রতিফলন।
মিনিট তিরিশেক আমরা কদমচালে পথ চলি। আশ্চর্য হয়ে দেখি এদিকে বরফের কোনো লিমলেশ নেই। তামাম ময়দান ভরে আছে মরা ঘাসে। অশ্বারোহণের দুলুনি জমে আসতেই যেই ভাবতে শুরু করেছি বিষয়টি নিয়ে বীরত্ব করে লিখতে হবে, ঠিক তখনই পাশের অশ্ব থেকে ‘আই…ইউ ইউ’ করে আওয়াজ আসে। ঘোড়ার তো চিহি হিহি করে ডাকার কথা। কিরগিজ ঘোড়ারা কি তবে অন্য ভাষায় কথা বলে? না, আওয়াজটা আসছে আমার ভ্রমণসঙ্গিনী বানির জবান থেকে। তা মিস্ ইসমাম—এ রকম খচ্ছরের মতো আওয়াজ দিচ্ছ কেন? দ্য স্টুপিড হর্স ইজ হিটিং মি উইথ হিজ টেইল। ইউ ইউ আই…লেংগুড় দিয়ে বাড়ি মেরে আমার পাছায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে তো। তা চাবুকের ডাঁটি দিয়ে খচর খচর করে চুলকে নাও কেন—বলতে গিয়ে শিঙার দরাজ আওয়াজ শুনে আমরা সকলে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাই। আব্দুল্লাবালি শিঙা ফুঁকে সকলকে থামার ইশারা করেন। এ স্থানটির উচ্চতার জন্য ছোটখাটো মালভূমির মতো মনে হয়। আমাদের সামনে প্রান্তর যেন ড্রপ খেয়ে নেমে গেছে কয়েক ধাপ নিচে। ওখানে বরফের চাকলা ভাসা শীর্ণকায় নদী সাদা ফেনা তুলে ছুটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। তার পাড়ের ময়দান ঝোপেঝাড়ে হয়ে আছে সবুজাভ। এ উঁচু ভূমি থেকে নিচে নামার মতো কেবল একটি ট্রেইল—তা ভরে আছে বড়সড় সব বোল্ডারে। ঘোড়া ছুটিয়ে নিচের ধাপে নেমে নদী অতিক্রম করার কথা ভেবে আমার হালত খারাপ হয়ে যায়।
ট্রেইলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায় চার চারটি শিকারি কুকুরসহ দুই ঘোড়সওয়ার। তাদের পেছনে পজিশন নিয়েছে শিরস্ত্রাণ ও চামড়ার কোমরবন্ধ পরা তিন কিরগিজ নওজোয়ান। আব্দুল্লাবালির ইশারা পেতেই ঘোড়ার স্যাডেলের সঙ্গে আংটা দিয়ে ঝোলানো পর্দা ঢাকা পিঞ্জিরা থেকে তারা বের করে আনে ‘বারকুত’ বলে তিন তিনটি তাজাতনা সোনালি ঈগল। পাখিগুলোর চোখের হুড খুলে নিতেই তারা মেঘের দিকে তাকিয়ে ডেকে ওঠে, থাক…কুরর…কুরর..। সমস্ত বিষয়-আশয় দেখে খানিক ভড়কে গিয়ে আমি ও বানি নেমে পড়ি ঘোড়া থেকে। রামাজান রফিকভ এসে আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আব্দুল্লাবালি হচ্ছেন এ জামানার সবচেয়ে বড় ‘বারকুতচি’ বা শিকারি ঈগল বারকুতকে প্রশিক্ষণ দেনেওয়ালা। সোভিয়েত আমলে সোনালি ঈগলের শিকার প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। তখন তিনি এ সামাজিক প্রথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে তা লোকস্মৃতিতে জিইয়ে রাখেন। তারপর গ্লাসনস্ত পরোস্ত্রৈকার দিনে সোভিয়েত শাসনের কব্জা শিথিল হলে তিনি চীনের নির্বাসন থেকে কিরগিজস্তানে ফিরে এসে আবার চালু করতে চান ঈগল দিয়ে শিকারের সনাতন প্রথা। তত দিনে পুরোনো দিনের বারকুতচিরা সব বিগত হয়েছেন। তরুণ সমাজ ভুলে বসে আছে বারকুত বা সোনালি ঈগলের ব্রিডিং করার হেকমত। আব্দুল্লাবালি স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে ডিম থেকে তা দিয়ে বাচ্চা সব ঈগলকে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর হাতে শিকারের সবক গ্রহণ করে নয়া জামানার তরতাজা তরুণরা। এ কয় বছর হলো ঈদের দিনে আবার তিনি চালু করেছেন ‘সলবুরুনে’র সনাতন রেওয়াজ। বানি তার বক্তব্যে ফোড়ন দিয়ে আমাকে জ্ঞান দেয়—কিরগিজ ভাষায় সোনালি ঈগল দিয়ে খরগোশ, খেঁকশিয়াল ও নেকড়ে শিকারকে সলবুরুন বলা হয়ে থাকে। তার পর্যটকভোগ্য চটি বই থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দেখে আমি আবার ইমপ্রেসড হই। হাতের কব্জিতে ‘বালডাক’ বলে একধরনের কাঠের কাঠামোতে ঈগলদের বসিয়ে তিন তরুণ টানটান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের পেছনে কাতার দিয়ে দাঁড়ানো তামেশগির গোছের জনা ছয় নারী-পুরুষ অশ্বারোহী। আমাদের ঘটনা কি তার তদারকে স্বয়ং আব্দুল্লাবালি এদিকে আসেন। তাঁর বাতচিতে মনে হয়, বানির অশ্বারোহণে তিনি বেজায় খুশ। তবে আমার দিকে এমন নারাজ হয়ে তাকান যেন আমি নকল করতে গিয়ে হেডমাস্টারের কাছে ধরা পড়েছি। বানি এবার খুব জাঁক করে তাকে বলে, কিরগিজস্তানে আসার জন্য সিলেক্ট হয়েই সে স্থানীয় হর্স-ফার্মে গিয়ে ঘোড়া চড়ার ওপর এক সপ্তাহের ক্র্যাস কোর্স করে তবে এ দেশে এসেছে। আব্দুল্লাবালি এবার আমার দিকে স্পষ্টত অসন্তুষ্টি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কী হয়েছে তোমার, কোমরে সমস্যাটা কী, অ্যাঁ? আমি কাঁচমাচু হয়ে বলতে চাই, ওস্তাদ, ঘোড়ায় চড়ে পশ্চাদ্দেশে অ্যায়সা ব্যথা লাগছে যে এখন তো একটু আয়োডেক্স মালিশ না করলেই নয়। কিন্তু আমার কিছুই বলার ফুরসত হয় না। তিনি আবার তেঁতে উঠে বলেন, বয়স তো চল্লিশ-পাঁচচল্লিশের কম হবে না, কী ধরনের মর্দ তুমি, জিন্দেগিতে ঘোড়া-গাধা কি কিছুই চড়োনি? বলে চাবুক দিয়ে সপাং করে বাতাসে বাড়ি দিলে আমি জান রক্ষার জন্য ডাহা মিথ্যা বলি, ঘোড়া পাব কোথায়, ওস্তাদ? তবে ভঁইষ চড়েছি, ভঁইষের পিটে চড়ে একসময় আড় বাঁশি বাজাতাম। আমার মিথ্যা ভাষণে তিনি কনভিন্স হন না একেবারেই। বিরক্ত হয়ে বলেন, তুমি সবার পেছন পেছন যাবে, ঈগল দিয়ে নেকড়ে শিকার করতে গিয়ে মাস দেড়েক আগে আমার গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। তাই আমি আজ সলবরুনের দলে যোগ দিচ্ছি না। আমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে সব নজর রাখব। তুমি ট্রেইল ধরে নামার সময় খুব সাবধানে আস্তেধীরে বোল্ডারগুলো পাড়ি দেবে। আমি এবার মওকা পেয়ে বলি, ওস্তাদ যেখানে যাচ্ছেন না সেখানে আমার ঘোড়ায় চড়ে সামনে যাওয়াটা বেয়াদবির মতো হয়ে যায় না? আমি বরং ওস্তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই না হয় সোনালি ঈগলের শিকার দেখি।
বাইনোকুলার গলায় ঝুলিয়ে আব্দুল্লাবালি তাঁর প্রৌঢ় দুই সাগরেদকে নিয়ে দাঁড়ান। আমি তাদের পাশে আসতেই দেখি, বানিও চোটপাট ঘোড়া ছেড়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে। সেও ঈগল শিকারিদের সঙ্গে যাচ্ছে না দেখে আমি মনে মনে খুশিই হই। ওস্তাদ শিঙা ফুঁকতেই ঘোড়সওয়ারদের যাত্রা শুরু হয়। কুকুর নিয়ে দুই সওয়ার খুব সাবধানে ট্রেইল ধরে নেমে যায়। তাদের পেছন পেছন কব্জির বালডাকে বসানো সোনালি ঈগল নিয়ে তিন নওজোয়ান লাফিয়ে বোল্ডারগুলো পাড়ি দেয়। দেখতে দেখতে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে চারদিকে পানি ছিতরিয়ে নদী অতিক্রম করতে দেখা যায়। আব্দুল্লাবালি চোখে বাইনোকুলার দিয়ে সমস্ত কিছু অবজার্ভ করছেন। প্রান্তরে নেমেই সবুজাভ ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘোড়াগুলোর আকৃতি ছোট হয়ে আসতে থাকে। বার দুই আমি সোনালি ঈগলদের চক্রাকারে উড়তে দেখি। একটি পাখি মনে হয় বিজুলির মতো সূর্যালোকে সোনালি ডানার ঝলক ছড়িয়ে ডাইভ দিয়ে চলে যায় ঝোপের অন্তরালে। তারপর আর তেমন কিছু দেখা যায় না।
আস্তে আস্তে টেম্পারেচার নেমে যাওয়ার মতো দর্শনধারীদের উত্তেজনা কমে আসে। বানি এবার আব্দুল্লাবালির সঙ্গে টুকটাক খেজুরে আলাপে মেতেছে। সে তাকে পার্স থেকে বের করে এক তোড়া আমেরিকান রেসের ঘোড়ার ছবি দেখায়। আমি তো ছবিফবি কিছু নিয়ে আসিনি। মনে মনে ভাবি, আবার যদি কিরগিজস্তানে আসি তাহলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি নিয়ে আসতে হবে দেখছি। নিচের প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আমি ঘোড়ার লেঙ্গুড় ছাড়া বিশেষ কিছু দেখতেও পাই না। সোনালি ঈগলের শিকার নিয়ে খুব বীরত্ব করে একটি লেখা তাইয়ার করব ভেবেছিলাম, কিন্তু দূর ছাই, কারও কোনো কেশই তো দেখছি না, কী ঘোড়ার ডিম লিখব?
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সলবরুনের শিকারি ঘোড়সওয়াররা ফিরে আসে। ঘোড়াগুলোর কষা বেয়ে ফেনা গড়াচ্ছে। বারকুত বলে সোনালি সব ঈগলকে চোখে হুড পরিয়ে পিঞ্জিরায় পোরা হয়। শিকারিরা নিয়ে এসেছে তিনটি খরগোশ ও একটি মৃত শিয়াল। এসেই সকলে ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়ে খুব জম্পেশ করে চুমুক দিতে শুরু করে ঘোটকির ফারমেন্টেড দুগ্ধ, কমিসের মোশকে।
হঠাত্ করে দেখি আব্দুল্লাবালির দুই প্রৌঢ় সাগরেদ দুটি ডুগডুগিজাতীয় ঢোলক বের করে বাজাতে শুরু করেন, টুবা ডুগডুগ টুবাডুগ…। ঘটনা কী? আমরা এবার নিচের প্রান্তরকে পিছনে রেখে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এদিকের বৃক্ষ-লতা-পল্লবহীন ময়দানে পাঁচটি ঘোড়া। তাতে বসা দুটি নারী ও তিনটি পুরুষ। এ দলে রামাজান ও সুনামবুবুকেও ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতে দেখা যায়। বানি আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট দেয়ার গোয়িং টু ডু? তারা এবার ‘কিজ কুমাই’ বা ‘ব্রাইড চেইজিং’ খেলবে। মেয়েদের ঘোড়া ছুটিয়ে অনুসরণ করবে পুরুষেরা। ধরতে পারলে তারা তাদের চুমোও খাবে। হাউ এক্সাইটিং! আমি বিরক্ত হয়ে বানিকে বলি, ইউ ডোন্ট নিড টু টেল মি এভরিথিং, আমি তো কানা-আন্ধা না। যা ঘটবে তা ঠিক দেখতে পাব।
আব্দুল্লাবালি ডুগডুগির রিদমের সঙ্গে তাঁর শিঙার সুর মেলালে মেয়েদের ঘোড়াগুলো পয়লা ছুটতে শুরু করে। তারা বেশখানিক দূরে চলে যাওয়ার পর শিঙার ইশারায় এবার পুরুষরা ঘোড়া ছোটায়। এক অজানা ঘোড়সওয়ার সুনামবুবুর পেছন পেছন ঘোড়া ছোটাচ্ছে। সুনামবুবু অর্ধচক্রাকারে ঘুরে তাঁকে বিভ্রান্ত করে ছুটে যায় অন্যদিকে। ঘোড়সওয়ার দিক পরিবর্তন করে। সুনামবুবু আবার তীব্র গতিতে পাক খেয়ে লাফিয়ে বোল্ডার পাড়ি দিলে তার পেছনের পুরুষ ঘোড়সওয়ার ব্যালেন্স হারায়। ডুগডুগি বাজিয়ে তার হেরে যাওয়ার ঘোষণা হয়। ঠিক তখনই চাবুক হাঁকিয়ে সুনামবুবু হেরে যাওয়া পুরুষের ঘোড়ার দিকে ছুটে যায়, চারদিকে হাততালি পড়ে। মনে হয় সে তাকে আচ্চাসে দু ঘা দেবে। ঠিক তখনই কোথা থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তার খুব কাছাকাছি চলে আসেন রামাজান রফিকভ। তাঁর চাবুকের ঘায়ে উড়ে যায় সুনামবুবুর হাতের উদ্যত চাবুক। রামাজান খপ করে সুনামবুবুর ঘোড়ার লাগাম জাপটে ধরলে আবার ডুগডুগি বাজিয়ে তার বিজয় ঘোষণা করা হয়। রামাজান দেরি না করে সুনামবুবুর গণ্ডদেশে চটজলদি চুম্বন করেন। সারা ময়দানে হাততালি পড়ে। ঠিক তখনই আকাশ থেকে ঝরতে শুরু করে বরফ। শর্করার শুভ্র দানার মতো বিন্দু বিন্দু বরফে দ্রুত ঢেকে যেতে থাকে প্রান্তর। দেখতে দেখতে সুনামবুবুর কালো চানকপালি ঘেটকীর সারা শরীর হয়ে ওঠে ভিজা তুষার কণায় শুভ্র সফেদ।
মঈনুস সুলতান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০০৯
Leave a Reply