ষাটের দশকে ফলপ্রসূ সাহিত্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের সূচনা সম্ভবত কবিতা দিয়েই। তাঁর ‘প্রতিশোধে হ্যামলেট’ কবিতার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে পড়বে। এমনকি তিনি বসন্তের জাগুয়ার নামে একটি কবিতার বই প্রকাশের ঘোষণাও দিয়েছিলেন সেই ষাটের দশকে। কবিতার প্রতি তাঁর ঝুঁকে পড়ার আরেকটি উদাহরণ আমরা দেখতে পাব এসকাইলাসের গ্রিক ট্র্যাজেডির অনুবাদ শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস-এ। এসবই হচ্ছে কবিতার প্রতি তাঁর ঝোঁকের প্রত্যক্ষ উদাহরণ।
আমরা লক্ষ করলেই দেখতে পাব যে কবিতার সঙ্গে তিনি আর প্রত্যক্ষ সংযোগ খুব বেশি দিন বজায় রাখেননি। ধীরে ধীরে তিনি ঝুঁকে পড়েন গদ্যের দিকে। আন্দোলনের নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং টেলিভিশনের রুচিসম্পন্ন অনুষ্ঠানই হয়তো তাঁকে গদ্যের গহিন অরণ্যে বিচরণে বাধ্য করেছে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যিক গদ্য বা স্মৃতিধর্মী গদ্যেও কেউ প্রবেশ করলে যেকোনো মনোযোগী পাঠকই লক্ষ করবেন তাঁর সুপ্ত কবিসত্তার পরোক্ষ যাতায়াত। তাঁর প্রবন্ধের অনন্য মাধুর্য হয়তো স্মরণ করিয়ে দেয় বুদ্ধদেব বসুর কথা, পাণ্ডিত্যের মার্জিত প্রকাশের কারণে যতটা নয় তার চেয়ে বেশি বরং অনুভূতির সূক্ষ্মতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার বিবরণকে উপস্থাপনের মাধ্যমে। কবিসত্তার সঙ্গে অব্যাহত বিনিময়ের মাধ্যমে এই গদ্য অনুভূতির গভীরতা ও চারিত্রকে সুনির্দিষ্ট করে নেয়।
অস্কার ওয়াইল্ড তাঁর দ্য ক্রিটিক অ্যাজ আর্টিস্ট গ্রন্থে ব্রাউনিংয়ের কবিতার ভাষাশৈলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘হি ইউজ্ড্ পোয়েট্রি অ্যাজ এ মিডিয়াম ফর রাইটিং প্রোজ।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গদ্যের সঙ্গে পরিচিত হলে তিনি হয়তো বাক্যটিকে উল্টে দিয়ে একই মন্তব্য করতেন। কারণ, কবিতার স্বভাব দিয়ে এই গদ্য সতত চালিত। এমন নয় যে তাঁর আগে গদ্যের এমন নজির ছিল না। কথাসাহিত্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চয় অগ্রপথিক। কিন্তু প্রবন্ধে এমন উদাহরণ বিরল। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে আমরা যে কাব্যগুণ দেখতে পাই তা আসলে অবন ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধ থেকে একেবারেই আলাদা। এই অর্থে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের প্রধান নির্ভর উপমা। উপমাকে নির্ভর করে তিনি তাঁর প্রবন্ধের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধের প্রধান নির্ভর উপমা নয়, বরং অনুভূতির চিত্রল বর্ণনা। বাস্তবের বর্ণনাকে তাঁরা অনুভূতির কাল্পনিক বিশ্লেষণে হূদয়গ্রাহী করে তোলেন। বুদ্ধদেব বসুর গদ্য সম্পর্কে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যেমন বলেছেন, ‘বস্তুত তাঁর গদ্য প্রধানত কবিতার ভিতর থেকেই নিষ্ক্রান্ত হয়েছে।’ তিরিশের প্রধান এবং শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথার গদ্য সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গদ্যও এ ধারারই অব্যর্থ উদাহরণ। এঁদের বাইরে এই গদ্যশৈলীর চারিত্র আর কারও মধ্যেই দেখা যায় না।
বাংলা গদ্যের চর্চা বা গদ্যশৈলীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইংরেজি বা স্প্যানিশ ভাষার মতো তত দীর্ঘ নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাংলা গদ্য মাত্র ২০০ বছরের স্বল্পকালেই বিপুল বৈচিত্র্যের জন্ম দিতে পেরেছে। আর এই বৈচিত্র্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রাণস্পর্শী ধারাটির অন্তর্গত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
বহুদিন পর তাঁর ভালোবাসার সাম্পান পড়তে গিয়ে আবারও নতুন করে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি তাঁর গদ্যের অনন্য মাধুর্যে। ঘটনা বা পরিস্থিতির আলংকারিক বর্ণনা দিয়েই এই গদ্য তার দায়িত্ব থেকে খালাসবোধ করে না; এর স্পন্দনে প্রবাহিত করে সুষম তাল ও লয়ের এক প্রচ্ছন্ন ছন্দ, যাকে আমরা গদ্যের মুখোশ পরা অবস্থায় দেখলেও আসলে তা সংগীতের গোপন দয়িতা। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে আমরা অভিহিত করতে পারি ‘গদ্যসংগীত’ হিসেবে। কীভাবে তিনি এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন? ঘটনা বা পরিস্থিতি বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি যখন শব্দ নির্বাচন করেন তখন তিনি দুটো ইন্দ্রিয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন: দৃষ্টি এবং শ্রবণ। ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দ নির্বাচন এতটাই যথাযথ যে তা বর্ণনার সাবলীলতা এবং মসৃণতাকেই শুধু নিশ্চিত করে না, তার মধ্যে তিনি উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন প্রচ্ছন্ন সংগীত আর চিত্রল অনুভূতির সুষমা। দু-একটি বাক্যাংশ এখানে হাজির করলে আমার মন্তব্যের যথার্থতা পাঠক হয়তো মেনে নেবেন।
এক. ‘উচ্চতর সংঘ-চেতনাকে তারা স্পর্শ করেছিলো’। দুই. ‘গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের কল্যাণের অঙ্গীকার/তাঁর স্নায়ু-ধমনীকে অধিকার করে।’ তিন. ‘আমরা ভোরের আলোর মতো উপচানো আর অপরিমেয়।’
কৌতূহলী পাঠকমাত্রই সামান্য উত্কর্ণ হলেই লক্ষ না করে পারবেন না যে প্রথম দুই বাক্যাংশের দেহ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের দ্বারা স্পন্দিত। আর তৃতীয় বাক্যাংশের দেহ স্পন্দিত হয়ে উঠেছে স্বরবৃত্তের অভিঘাতে। প্রশ্ন উঠতে পারে এ কাজ কি তিনি সচেতনভাবে করেছেন। আমার ধারণা, সচেতনভাবে করা সম্ভব হলেও তিনি সেটা করেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর ধমনীতে কবিতার নীল স্রোত প্রবাহিত বলেই তা সচেতন চেষ্টা ছাড়াই উত্সারিত হয়। ছন্দের এমন অভিঘাত—কখনো সুবিন্যস্ত, কখনো বা শিথিলরূপে—তাঁর গদ্যে প্রচুর। যদিও আমরা জানি কেবল ছন্দই কবিতার একমাত্র নির্ভর নয়, কাব্যময় অনুভূতিকে সুবিন্যস্ত প্রকাশের মাধ্যমেই কবিতার আত্মা প্রতিষ্ঠা পায়। আর এই আত্মার স্পন্দনই হলো ছন্দ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গদ্য যেমন কাব্যময়, তেমনি ছন্দময়। কেতাবি পরিভাষার ছন্দ বলতে যা বোঝায় সে রকম নিশ্চয় নয়। গদ্যের সাবলীল গতিময়তার মধ্যে এই ছন্দ নিহিত। আর এই নিহিত ছন্দের গায়ে তিনি চড়িয়ে দেন অলংকার-চঞ্চল এক পরিচ্ছদ। ফলে তাঁর ভাষা হয়ে ওঠে প্রাণ ও সৌন্দর্যের সবটুকু প্রকাশের এক সুদৃশ্য বাহন।
বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো লেখকদের প্রতিভার স্পর্শে ভাষা নিজের নান্দনিক ক্ষমতাকে চূড়ান্ত রূপে তুলে ধরার সুযোগ পায়। শিল্পের অন্য যেকোনো মাধ্যমের তুলনায় প্রবন্ধে এই নান্দনিকতাকে শীলিত ও হূদয়গ্রাহী রূপে উপস্থাপন কিছুটা জটিল ও কঠিন। প্রবন্ধের পেছনে থাকে লেখকের যত্নশীলতা ও সতর্ক-চেতনার প্রক্ষেপ: বুদ্ধি ও যুক্তির ধারাবাহিক উন্মোচন এবং পাঠকের হূদয়ে তার স্থায়ী অধিকার। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গদ্যে এসব লক্ষণচিহ্ন খুবই প্রকট। এ ছাড়া তাঁর গদ্যে শব্দ তার চূড়ান্ত মূল্যবোধসহ হাজির হওয়ায় বর্ণনা হয়ে ওঠে তীক্ষ ও যথাযথ। শুধু শব্দই নয়, ঘটনা ও ব্যক্তিত্বের বর্ণনার ক্ষেত্রেও তাঁর অনুভূতি সূক্ষ্মতম স্তর থেকে সাড়া দেওয়ার ফলে অন্তর্গত বিভার বিচ্ছুরণ এই গদ্যের আত্মা ও শরীরকে আলোকিত করে তোলে। তার ভালোবাসার সাম্পান থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টিকে পাঠকের কাছে আরেকটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করব: ‘সবাই যেন ছেঁড়া পাতার মতো মিয়োনো। ওদিকে অন্যপক্ষের ওরা তলোয়ারধারী রাজপুত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে, যেন উদ্যত বর্শার ফলা একেকজন।’ ‘সে-সীমা ততদিনে শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী বৃক্ষবহুল জগতের দিকে ক্ষুধার্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’ ‘এই লেখকদের ব্যাপারে যা প্রশংসনীয় তা হলো, সব যুগের স্পর্শকাতর শিল্পীদের মতোই এই অবক্ষয়ের নতুনত্ব, ক্লেদ ও উত্তেজনাকে তারা ধারণ করেছিলো তাদের শিউরে-ওঠা অস্তিত্বে, এর ভেতর আগাগোড়া জড়িয়ে গিয়ে এর আবিলতাকে পুরোপুরি ধারণ করেছিলো। বিনষ্টি আর ক্লেদের এই নবাস্বাদিত উত্তেজনাকে তারা উদযাপন করেছিলো রক্তের প্রদীপ্ত কণিকায়, জীবনযাপনের নৈরাজ্যে।’ ‘অন্তঃসত্ত্বা রক্তের ভেতরে যাদের নতুন সৃষ্টির আগ্রহ উদগ্রীব।’
এ রকম অজস্র উচ্চারণ ভালোবাসার সাম্পান-এ ছড়িয়ে আছে। এই বইয়ের এক জায়গায় কথক, আড্ডাবাজ ও হাস্যরসের অমেয়-অমিয় উত্স কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘উদ্দাম অননুকরণীয় ভঙ্গিতে প্রতিটা শব্দকে জীবন্ত করে ও এমনভাবে ছুড়ে দিত যে, কথাটার সমস্ত শক্তি আর মত্ততা আমাদের রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়ত।’ বাক্যটি কথক শহীদ কাদরী সম্পর্কে বলা হলেও এটি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধের বা স্মৃতিধর্মী গদ্যেরও বৈশিষ্ট্য।
রাজু আলাউদ্দিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০০৯
Leave a Reply