সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা শিরোনামে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ১২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থগুলো হলো ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা, টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্শা, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্পতরু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি।
গ্রন্থমালায় যে গ্রন্থগুলো রয়েছে তার অধিকাংশই বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু হয়ে প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় ১২টি গ্রন্থকে সম্পাদক এখানে একটি মালায় গেঁথেছেন। মালা থেকে যেকোনো একটি গ্রন্থ আলাদা করে নিলেও পাঠক বাকিগুলোর সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না—তিনি পূর্ববর্তী বা পরবর্তী গ্রন্থের সন্ধান করতে পারবেন। উপরন্তু গ্রন্থমালায় কয়েকটি গ্রন্থকে সম্পাদক নতুন করে পাঠকের সামনে এনেছেন বলা যায়। বিশেষ করে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্পতরু (১৮৭৪) ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী (১৮৯২) উপন্যাস দুটি। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যঙ্গরসকে মূল উপজীব্য করে লিখেছিলেন কল্পতরু, আর ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় রূপকথার বিষয়বস্তু নিয়ে লিখেছিলন কঙ্কাবতী।
কল্পতরু বাংলা সাহিত্যের প্রথম ব্যঙ্গ উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কল্পতরুকে ‘বাংলাভাষার একটি উত্কৃষ্ট উপন্যাস’ আখ্যা দিয়েছিলেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এখানে হাস্যরসের তর্জনীসংকেতে উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্রায়ণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে।’ নকশা ও প্রহসনের বিষয়কে উপন্যাসের ক্ষেত্রে তুলে নিয়ে আসা ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ভাবন।
অন্যদিকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কঙ্কাবতীতে মূলত অতিপ্রাকৃত জগতের অধিবাসীদের আচরণে মানবসমাজভুক্ত প্রাণীদের ছায়াপাত ঘটিয়ে বাঙালি সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অন্ধ সংস্কারকে আঘাত করেছেন, বিদ্রূপ করেছেন। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি বৈঠকি। ভাষা সহজ, সরল, অনাড়ম্বর। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যে রঙ্গব্যঙ্গের একজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতা।
এ ছাড়া টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল বা কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্শা, কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্ও প্রায় দুর্লভ গ্রন্থ। গ্রন্থস্বত্ব না থাকায় অন্য গ্রন্থগুলোও সুমুদ্রিতভাবে খুব একটা পাওয়া যায় না। সে-বিচারে ‘সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা’র আওতায় এ ১২টি গ্রন্থের একত্র প্রকাশ পাঠকদের জন্য আনন্দের খবর। এর মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের প্রায় শত বছরের বিকাশ ও অর্জন সম্পর্কে পাঠক ধারণালাভ করতে পারবেন। আর একসঙ্গে হাতে থাকলে, যিনি একবার পড়েছেন কৃষ্ণকান্তের উইল বা বিষাদ-সিন্ধু বা পথের পাঁচালী ; তিনি চাইলে আবারও পড়তে পারবেন। বইগুলো তো পড়ার মতো, বারবার পড়ার মতো।
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা—আনিসুজ্জামান সম্পাদিত \ প্রচ্ছদ: সাইম রানা \ সেট মূল্য: ২৭০০ টাকা \ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০০৯
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০০৯
Leave a Reply