কলকাতার অদূরে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের খ্রিষ্টান মিশনারিরা ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সমাচার দর্পণ পত্রিকাটি মুদ্রিত করলে বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বাঙালি মুসলমানেরা গ্রন্থ রচনা, সাময়িকপত্রে লেখালেখি বা পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়েছেন আরও কয়েক দশক পর। এ ব্যাপারে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) পথিকৃত্। তাঁর বিষাদ-সিন্ধু ছাড়াও জমীদার দর্পণ নাটক এবং উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়াঁর বস্তানী, আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থের কথা স্মরণ করা যায়। সমাচার দর্পণ-এর অর্ধশতাব্দী পর হুগলি থেকেই মীর মশাররফ হোসেন বের করেন বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা আজীজান্নাহার। আজীজান্নাহার ছাড়া হিতকরী নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে হিতকরী পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যার খোঁজখবর পাওয়া গেলেও আজীজান্নাহার-এর কোনো সংখ্যা আজ পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে এ পত্রিকাটি সম্পর্কে খুব একটা আলোকপাত চোখে পড়ে না।
বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে আজীজান্নাহার-এর ভূমিকা দুটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বাঙালি মুসলমান পরিচালিত ও সম্পাদিত এটি প্রথম পত্রিকা। দ্বিতীয়ত, মীর মশাররফ, কাঙাল হরিনাথসহ আরও অনেকের অপ্রকাশিত রচনা এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে অখণ্ড নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার কুমারখালী থানার লাহিনীপাড়া গ্রামে মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম। তাঁর জন্মের সময় মুসলমান পরিবারে লেখাপড়ার সূচনা হতো প্রধানত আরবি-ফারসি শিক্ষার মধ্য দিয়ে। সেই রীতিতে তাঁর ‘হাতেখড়ি’ হয় মুন্সি জমিরুদ্দিন নামের এক মৌলভির কাছে। তবে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু লাহিনীপাড়ার পার্শ্ববর্তী জয়নাবাদ গ্রামের জগমোহন নন্দীর পাঠশালায়। পরে মশাররফের পিতা মোয়াজ্জেম হোসেন পাঠশালাটি লাহিনীপাড়ায় তুলে আনলে সেখানে অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি পড়াশোনা করেছেন কুষ্টিয়া ইংরেজি স্কুল, পদমদীর নবাব স্কুল এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে।
মীর মশাররফের প্রথম স্ত্রী আজিজননেহারের নামানুসারে পত্রিকাটি বের হয়। এই স্ত্রীর সঙ্গে মীরের দাম্পত্যসম্পর্কিত বিষয়ে পাঠকের কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনার সময় একবার মশাররফ হোসেন কলকাতায় যান। সেখানে দেখা পান বাল্যবন্ধু মুনসী কারাম মাওলা ওরফে চাঁদ মিয়ার। চাঁদ মিয়ার পিতা পাবনা ফৌজদারি আদালতের নাজির মুনসী নাদের হোসেন ছিলেন মশাররফের পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নাদের হোসেন বাস করতেন যশোরের মুক্তারপুরে। কলকাতা থেকে চাঁদ মিয়ার সঙ্গে মুক্তারপুরে যান মশাররফ। ওখানে তাঁর বৈমাত্রেয় বোন (নাদের হোসেনের বড় মেয়ে) লতিফুননেসার সঙ্গে ঘটে মশাররফের চেনা-পরিচয়। ধীরে ধীরে এই চেনাজানার মধ্যে গড়ে ওঠে দুজনের প্রেমের সম্পর্ক। উভয়ের মধ্যে শুরু হয় চিঠিপত্র লেখালেখি। অভিভাবকেরা তাঁদের সম্পর্ক আঁচ করতে পেরে উভয়ের বিয়ের আয়োজন করেন। তারিখটি ছিল ১৮৬৫ সালের ১৯ মে। একই দিনে নাদের হোসেনের অন্য মেয়ে আজীজানেনসার বিবাহ ঠিক হয় হোসেন আলী নামে প্রভাবশালী এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে। সেই সময় মশাররফের পিতা মোয়াজ্জেম হোসেন না আসায় তিনি ছিলেন অন্যমনস্ক। প্রথমে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় হোসেন আলীর সঙ্গে লতিফুননেসার। পরে মশাররফের বিয়ের সময় পাত্রীর নাম আজীজানেনসা শুনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার জন্য লতিফুননেসা প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। পরে মশাররফ দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন আজীজানেনসাকে নিয়ে।
আজীজানেনসাকে মীর মশাররফ আজীজান্নাহারও বলেছেন। মশাররফ-গবেষকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, মশাররফের প্রথম স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আজীজানেনসার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে মশাররফের দুই পুত্র মফাজ্জল হোসেন ওরফে শরত্ এবং মহামদ হোসেন ওরফে শিশিরসহ এক কন্যা। শরত্ ও শিশিরের মৃত্যু হয় যথাক্রমে ৯ ও ১৪ বছর বয়সে। এরা দুজনই পড়াশোনা করত হুগলি কলেজ স্কুলে। কন্যাটিরও মৃত্যু হয়েছিল অকালে।
১২৮১ (১৮৭৪) বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে মশাররফ তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম অনুসরণে বের করেন আজীজান্নাহার পত্রিকা। ওই মাসেই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন লাহিনীপাড়ার পার্শ্ববর্তী সাঁওতা গ্রামের বিবি কুলসুমকে। শিশিরের জন্মও ১২৮১ সালের পৌষ মাসে। আজীজান্নাহার বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা এ কথা স্বয়ং মশাররফই তাঁর অগ্রন্থিত আমার জীবনীর খসড়া অংশে লিখে রেখেছেন। এই পত্রিকার শিরোদেশে মুদ্রিত থাকত এই পঙিক্ত দুটি: ‘প্রিয়দিন উপহার দিলাম যতনে/দিনপ্রিয় হের সদ্য সদয় নয়নে।’
উল্লিখিত পঙিক্ত সূত্রে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, মশাররফের হূদয়ে কোনো একসময়ে তাঁর স্ত্রী আজীজানেনসা সত্য সত্যই ছিলেন প্রিয়তমার স্থানে; নইলে পত্রিকাটির নামকরণ তিনি আজীজান্নাহার করলেন কেন?
আজীজান্নাহার পাক্ষিক কী মাসিক ছিল, এ নিয়ে সমসময় থেকে তর্কাতর্কির জের একাল পর্যন্ত পৌঁছেছে। সমকালে গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা (জুন ১৮৭৪) লিখেছিলেন, আজীজান্নাহার ছিল পাক্ষিক; এডুকেশন গেজেটে (১ মে, ১৮৭৪) বলা হয় পত্রিকাটি ছিল মাসিক। মশাররফ নিজেও অগ্রন্থিত আমার জীবনীর এক স্থানে বলেছেন, ১২৮১ সালের ১ বৈশাখে আজীজান্নাহার পত্রিকা পাক্ষিক হিসেবে ছাপা হয়, আবার এর অন্য অংশে বর্ণিত আছে: ‘মাতামহীর স্বর্গারোহণের পর ১২৮১ সালের ১ বৈশাখ আজীজান্নাহার নামে বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করিলাম। মুসলমান সমাজে এই বাংলা পত্রিকা বঙ্গদেশে প্রথম প্রকাশিত হইল।’
ধারণা হয়, পত্রিকাটির প্রথম কয়েকটি সংখ্যা পাক্ষিক এবং পরে প্রকাশিত হয়েছিল মাসিকরূপে। মশাররফ পরিচালিত বাংলা ভাষার আর একটি স্মরণযোগ্য পত্রিকার নাম হিতকরী। এই হিতকরী পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের সূচনা সংখ্যার (২২ এপ্রিল, ১৮৯১) উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে এবং অগ্রন্থিত আমার জীবনী সূত্রে জানা গেছে, ‘আজীজান্নাহার দুই বত্সরকাল চলিয়াছিল।’ অগ্রন্থিত আমার জীবনী থেকে আরও জানা যায়, পত্রিকাটি কোনো একসময়ে ছাপা হতো হুগলি বোধোদয় যন্ত্রে। তবে প্রকাশনার ঠিকানা যে লাহিনীপাড়া ছিল, এমন ধারণা করা যায় হিতকরীর ওই নিবন্ধসূত্রেই। এখানে উল্লেখ আছে: ‘কুষ্টিয়া সাবডিভিশন সৃষ্ট হইতে এ পর্য্যন্ত তিনখানি পত্রিকা প্রকাশ হইল। প্রথম গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা, তাহার পর আজীজান্নাহার।’
আজীজান্নাহার পত্রিকাটি প্রকাশের প্রথম চিন্তা কবে এবং কেন মীরের মাথায় এসেছিল, সে সম্পর্কে তিনি অপ্রকাশিত আমার জীবনীতে জানিয়েছেন: ‘আমার ভ্রাতাগণ হুগলী কলেজে পড়িতেছে। চঁচুড়ায় আমাদের এটি বাসা বাড়ী আছে। সময় সময় চঁচুড়ায় যাওয়া-আসা করি। একদিন চঁচুড়ায় বান্ধাঘাটে বসিয়া গঙ্গার জলস্রোত বিষয় ভাবিতেছি। জলস্রোতের আবার ভাবনা কি? অপর পারে ([পাড়ে] গঙ্গার) বাংলার সুপ্রসিদ্ধ লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ী। একদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বঙ্কিম বাবুকে সামান্য একখানি নৌকার উপর বান্ধাঘাট হতে পূর্ব পার (পাড়) যাইতে দেখিলাম। সঙ্গে একজন আর্দালী। হুগলীর ফৌজদারী কাছারি হইতে বাটী যাইতেছেন। প্রত্যহ এইরূপ যাওয়া-আসা করেন। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন মুসলমান ছাত্র ছিলেন। আমাদের সমাজে বাঙলাভাষা চর্চা একেবারে নাই বলিয়া অনেকে দুঃখ করিলেন, আর বলিলেন আমাদের সমাজে একখানি বাঙলা খবরের কাগজ নাই বড়ই আক্ষেপের বিষয়।’ (উদ্ধৃতির সূত্র: শাসসুজ্জামান খান—মীর মশাররফ হোসেন: নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে)
পত্রিকাটি চলাকালে জমিদারনন্দন মশাররফ দারুণভাবে অভাব-অনটনের সম্মুখীন হন। এ সময় তিনি স্থাবর সম্পত্তি ইজারা দিয়ে একদিকে সাংসারিক খরচ, অপরদিকে পত্রিকা মুদ্রণ বাবদ প্রেসের ব্যয় মেটাতেন। অগ্রন্থিত আমার জীবনীতে তিনি বলেছেন: ‘দিন২ ঋণ বৃদ্ধি ব্যতীত পরিশোধ হইতেছে না। আজীজান্নাহার পত্রিকার প্রথম দুই বছর বেশ টাকা আদায় হইল। তাহার পর আমারও মন খারাপ। লিখাও আর পূর্ব্বের মত উত্সাহের সহিত হইল না। মূল্যও পাওয়া যায় না। প্রেসের দেনা-কাগজের দেনা—অনেক দায়ী হইতে হইল। পৃষ্ঠপোষক কাহাকেও পাইলাম না। লিখিবার লোকও আর নাই। মধ্যেই আমার ভক্তিভাজন শ্রদ্ধেয় বাবু হরিনাথ মজুমদার বিশেষ সাহায্য করিতেন।’ (নিজস্ব সংগ্রহ, ১৯৮৭)
আলোচ্য উদ্ধৃতির শেষ অংশটি বেশ তাত্পর্যময়। গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকার পরিচালক হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-৯৬) মশাররফকে যে বিশেষ সাহায্য করতেন, তার অর্থ এমনও হতে পারে, দুই বছরের প্রকাশিত (১৮৭৪-৭৬) সব সংখ্যা কেবল ‘হুগলী বোধোদয় যন্ত্রে’ মুদ্রিত হয়নি, কোনো কোনো সময় ঠিকানা হুগলির থাকলেও ছাপা হতো কুমারখালীর হরিনাথের ‘মথুরানাথ যন্ত্রে’।
কুলসুমকে বিয়ে করার আগ পর্যন্ত আজীজানেনসা ছিলেন মীরের প্রিয় দিনের প্রিয়জন; কিন্তু প্রিয় দিনের প্রথম পর্যায়ের ঘটনাসমূহ প্রাপ্ত অগ্রন্থিত আত্মজীবনীতে এখনো পাওয়া যায়নি। আমার জীবনীর (প্রথম-দ্বাদশ খণ্ড) মাধ্যমে আমরা তাঁর রচিত জীবনীর ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হই। কিন্তু ‘বিশ বত্সরের ঘটনা অতি আশ্চর্য্যরূপে চিত্রিত’ হয়ে যা আমার জীবনীর পরবর্তী খণ্ডগুলোতে প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল, তারই বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ মশাররফের উত্তরপ্রজন্মের সৌজন্যে সংগৃহীত হয়েছে এবং তা থেকে এ পর্যন্ত বর্তমান লেখকসহ শামসুজ্জামান খান, আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আজীজানেনসার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে বিবি কুলসুমকে বিয়ের আগ পর্যন্ত বিশেষত আজীজান্নাহার পত্রিকা প্রকাশের কিছুকাল আগে পর্যন্ত আজীজানেনসার সঙ্গে মীরের দাম্পত্য জীবন কেমন কেটেছে, তার বিস্তারিত খবরাখবর এখনো উদ্ধারের অপেক্ষায়।
কুলসুমকে বিয়ে করার পরই আজীজানেনসা ও মীরের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি এবং আত্মীয়পরিজনসহ অনেকের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল ভুল বোঝাবুঝি। দুই স্ত্রীর পরিবেশ আলাদা করে সাময়িক পরিবেশ মীর কিছুটা সামলে নিলেও আজীজানেনসা ও কুলসুমের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সৌহার্দ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। সম্ভবত কুলসুমের প্রতি মশাররফ বেশি ঝুঁকে পড়ায় স্বামী, সংসারের কর্তৃত্ব থেকে আজীজানেনসা ধীরে ধীরে হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। এ সময় মীর একদিকে কুলসুমের ব্যক্তিত্বে-আচরণে আকর্ষিত হয়েছেন, অন্যদিকে আজীজানেনসার আচার-আচরণে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। মীরের ঘরে কুলসুম আসার কয়েক বছর অর্থাত্ আজীজানের সন্তানেরা যত দিন পর্যন্ত জীবিত ছিল তত দিন অনুভূত হচ্ছে, মীর কিছুটা হলেও তাঁর প্রথম স্ত্রীর প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল, যদিও তখন সংসারগণ্ডিতে দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রতিনিয়ত লেগে থাকত ঝগড়াঝাঁটি।
বিবি কুলসুম গ্রন্থে মীর মশাররফ হোসেন জানাচ্ছেন, আজীজানেনসা ষড়যন্ত্র করেছিলেন কুলসুমকে মেরে ফেলার জন্য। প্রথম স্ত্রী প্রসঙ্গে আর বেশি কিছু তথ্য জানা যায় না। অগ্রন্থিত আমার জীবনীর অনুসরণে কেবল জানা যাচ্ছে, আজীজানেনসাকে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে তিনি তালাক দেন। ৩২ বছর পর তালাক দেওয়ার মতো এমন কী ঘটনা ঘটেছিল, তা জানা যাচ্ছে না। এ ঘটনার পরও কিন্তু আজীজানেনসা লাহিনীপাড়া ছেড়ে নিজ পৈতৃক ভিটাতে চলে যাননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। হয়তো গর্ভের সন্তানদের জন্মভূমি আর কবরের স্মৃতির টানেই লাহিনীপাড়ার মাটি তাঁর কাছে পবিত্র হয়ে উঠেছিল। এই এলাকার এক বৃদ্ধের কাছে শুনেছি (১৯৮৭) শেষ জীবনে তিনি বছরের অধিকাংশ সময় রোজা পালন করতেন। তালাকপ্রাপ্তির পর সম্ভবত আর বেশি দিন আজীজানেনসা জীবিত ছিলেন না। যে কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন, সে সময় নাকি আশ্রয় পেয়েছিলেন লাহিনীপাড়ায় তাঁর সপত্নীকন্যা রাওসন আরার বাড়িতে। আজীজানেনসার কবর লাহিনীপাড়ায় অরক্ষিত অবস্থায় এখনো আছে।
রাজবাড়ী জেলার অন্তর্গত বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদীতে ছিল মীর মশাররফের পূর্বপুরুষদের বসবাস। এখানকার জমিদার এস্টেটে দ্বিতীয়বার চাকরিসূত্রে আসার কিছুকাল পর তিনি স্ত্রী বিবি কুলসুমকে পদমদী নিয়ে আসেন। পদমদীতেই কুলসুমের মৃত্যু ঘটে ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। এর প্রায় দুই বছর পর মীর মশাররফ হোসেনের মৃত্যু হয়। পদমদীতে মীর মশাররফ, বিবি কুলসুম, মশাররফের এক ভাই মোকাররম হোসেন ও মোকাররম হোসেনের স্ত্রী বিবি খোদেজার নামাঙ্কিত কবর ঘিরে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র’।
ম. মনিরউজ্জামান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৩, ২০০৯
Leave a Reply