ধনাগোদা নদীর তীরে অর্ধেকটা চাঁদ তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। মাছ কাটার বড় ধামার চেয়ে খানিকটা চওড়া হবে চেহারায়। পশ্চিম আকাশে হেমন্তের ফুলে ওঠা শাদা মেঘের গায়ে আছড়ে পড়ছে তার হলদেটে ঘিয়ে রঙের আলো। তার নিচে দিগন্তবিস্তারী মাইল-মাইল জলে ডোবা ফসলের ক্ষেত। জলাজমির ওপর সেই অর্ধেকটা চাঁদের আলো দুধের সরের মতো জমে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাতাস থেমে আছে, ফলে পাতার সড়সড় শব্দটাও বন্ধ। নিস্তব্ধতার একটা ঝাঁপি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে যেন কেউ চরাচর। সেই গুমোট নৈঃশব্দ্য ভেঙে সজল এগোতে থাকে ইটখোলার জঙ্গলের দিকে। ধনাগোদা নদীর ওপর দিয়ে যে বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়েছে, তার লাগোয়া দুধমুখা গ্রামে তাদের বাড়ি। ইটখোলার জঙ্গলে যেতে হলে শ্মশানতলা আর ছেঙ্গার চর ফেলে যেতে হয়। দিনের বেলা পা চালিয়ে হাঁটলে শ্মশানতলায় পৌঁছাতে লাগে দেড় ঘণ্টা, সেখান থেকে ছেঙ্গার চর আরও ঘণ্টাখানেক। ছেঙ্গার চর ফেলে আরও আধঘণ্টা এগোলে তবে ইটখোলার জঙ্গল। মাইলের হিসাবে কত তা জানে না সজল। গ্রামের আর সবাই আঙুল দিয়েই দূরত্বটা দেখায়—ইটখোলা ওই তো কাছেই! এমনটাই সে শুনে আসছে সবার কাছে। এক বছরে সে বুঝতে পেরেছে ‘খুব বেশি দূরে না—ওই তো কাছেই’ কথাটার প্রকৃত অর্থ হলো ঘণ্টা দুয়েকেরও বেশি রাস্তা!
সজলের কাঁধের জালের গোছার ঝনঝন শব্দ তার হাঁটার ছন্দ জানান দিচ্ছে। চাঁদের উপস্থিতি প্রচণ্ড হলেও বিলের এই রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। বড়-বড় শিশু, বাবলা আর হিজলগাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়া চাঁদের আলো সে অন্ধকারের গায়ে এক-একটা জলজ্যান্ত মানুষের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পথের বাঁকে বাঁকে এমন আলো-অন্ধকারের খেলা। চলতে চলতে হঠাত্ সে দ্যাখে দূরের বাঁকটার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে শাদা কাপড় পরা একজন মস্ত লম্বা মানুষ। যত বিপদই আসুক, আজ ইটখোলার বিলে পৌঁছাতেই হবে—এমন সংকল্পই তাঁকে সামনে এগিয়ে নেয়। ঘোরের ভেতরেই সে জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছাল। আর তখনই পরিষ্কার হলো লম্বা মানুষের রহস্য। পথের ধারে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো তালগাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলো এমন বিভ্রম তৈরি করেছে। সে সামনে এসে দাঁড়াতেই লম্বা মানুষটা কেমন বেঁকেচুরে তার গায়ের ওপর পড়ল মুন্সি দাদুর স্নেহের হাত নিয়ে। এই তীর্যক চাঁদের আলোটুকু অতিক্রম করার পর তার ভয় অনেকটাই কেটে গেল। পথে পথে সে এমন দৃশ্য আরও বহুবার দেখল। কোথাও মনে হলো, একদল শাদা লোক উবু হয়ে তামাক খাচ্ছে। গাছগাছালির দলা পাকানো ডালপালার ছায়া আর হেমন্তের হালকা কুয়াশাকে চিনতে ভুল হয়নি তার। সে জোরে পা চালায়। ভোর চারটার মধ্যে আজিজ মুন্সির বাড়ি পৌঁছাতে হবে। ইটখোলার বিলে জাল ফেলবে আজিজ মুন্সির সঙ্গে।
২
ইটখোলার ভাটগাছের জঙ্গল পার হয়ে বিলের সামনে আসতেই আজিজ মুন্সির ধৈঞ্চার ক্ষেতটা নজরে পড়ে। তার পেছনে তাল, সুপারি, নারকেল, কুল, নিম আর হিজলগাছ ঘেরা মুন্সির বাড়ি। গাছগুলো বাড়ির আব্রু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখে একটা দ্বীপের মতোই মনে হয়। আখক্ষেতের পাশ দিয়ে ধারালো পাতার আঁচড় খেতে খেতে একটু এগোতেই হারিকেনের আলোটা নজরে পড়ে তার। ধৈঞ্চার ক্ষেতের ভেতর নড়ছে আলোটা। ভালো মতো দেখার জন্য দাঁড়ায় সজল। দায়ের কোপের শব্দে বুঝতে পারে ধৈঞ্চার খড়ি কাটছে বুড়ো।
মুন্সি দাদা না গো! আলোটার দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক দেয় সে।
হয় হয়, আইয়া পড় নাতি। ধৈঞ্চার ক্ষেত থেকে উত্তর আসে।
কিছুক্ষণ পর ক্ষেতের আল ধরে বুড়ো নিজেই বেরিয়ে আসে। কাঁধে ধৈঞ্চার খড়ি। এই বয়সেও বোঝার ভারে ফুলে উঠেছে আঢাকা পায়ের গোছা। মালকোচা মারা, খোলা উদোম শরীর, সফেদ দাড়ি নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। আজিজ মুন্সির শরীর অন্ধকারে আধো হারিকেনের আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়।
বও নাতি, আমি জ্বালানিগুলান রাইখা আসি। বুড়ো দুলতে দুলতে অদৃশ্য হয় গাছে ঘেরা বাড়ির দিকে।
৩
সজলকে আজ পারতেই হবে। দাদা, দাদি, মেহের চাচা আর চাচাতো ভাই তানিজের সামনে মাছের ডালাটা নিয়ে ফেলবে সে। তাতে তিন সের ওজনের রুই, সিলভার, বোয়াল আর কাতলামাছ তখনো লেজের ডগায় জানটা জমা রেখে কাঁপতে থাকবে। তার বাবা জয়নাল শেখ আর সে তিন বছর আগে যখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে গ্রামে চলে এসেছিল, তখন থেকেই সে বুঝতে পারছিল গ্রামের মানুষ হয়ে ওঠা অত সহজ নয়। প্রথম প্রথম তার বাবা প্যান্ট আর জুতো পরে বাজারে যেত বলে সবাই হাসাহাসি করত। ক্ষেত-খামারের কিছুই জানত না লোকটা। তা এই তিন বছরে রোজ ফজরের আজান থেকে মাগরিবের ওয়াক্ত পর্যন্ত ক্ষেতির কাজ নিয়ে পড়ে থাকার পরও দুর্নাম ঘোচাতে পারেনি সে। তার দাদার ধারণা, জয়নালকে দিয়ে ক্ষেতির কাজ হবে না। ছোট ছেলে মেহেরকে নিয়েই সব কাজ করেন তিনি। গেল বছর বীজতলা থেকে চারা উঠিয়ে দক্ষিণের ক্ষেতটাতে কালিজিরার ধান বুনল তারা জয়নালকে না জানিয়েই। তবু জয়নাল নিজের গরজেই সার ছিটায়, আগাছা নিড়ায়, রাত জেগে সেচপাম্প চালু করে। শহরে দোকান করতে গিয়ে ফেল মেরেছে সে, তাই এখানেও তার পাস হবে না—এমনই বিশ্বাস গ্রামের মানুষের। না ঘাটকা না ঘরকা সে। এই তো সেদিন দাদা ইটখোলার বিলে মাছ মারতে পাঠিয়েছিলেন তাকে। দুপুর গড়িয়ে গেলে পুকুরঘাট থেকে কোনো বাড়ির বউ যেন চিত্কার দিয়ে জানান দেয়, পাইছে গো পাইছে! সজলের বাপে ডুলাভর্তি মাছ পাইছে! ঘাটলা পেরিয়ে উঠোনে আসতেই সবাই ঘিরে ধরে জয়নালকে, দেখি কী মাছ আনলা, কয়টা রুই পাইলা দেখাও মিয়া! উত্তরে ডুলা উপুড় করে ধরে জয়নাল। সঙ্গে সঙ্গেই হাসির একটা বিস্ফোরণ ঘটে। ডুলা থেকে মাছের বদলে বের হয় পোকায় খাওয়া কিছু ধুঁদুল।
খালি ডুলা লয়া ফিরতে মন চায় নাই তাই এগুলান আনলাম। মাছ পাই না গো, ব্যাকটি খ্যাতে উইঠা বয়া রইছে। জয়নালের কৈফিয়ত শুনে হাসির দমক যেন আরও বেড়ে যায়। ভিড়ের মধ্য থেকে নূরজাহান ফুফু বলে ওঠেন, মাছে তরে দেইখা ব্যাজার হইছে গো! এমুন বোদাইয়ের জালে ধরা পড়লে মাছের জাত যাইব!
যা ভাগ, তিন দিন আবি না ঘরে, মসজিদে থাকবি! বাজখাঁই গলায় চিত্কার দিতে দিতে জয়নালের ঘাড়ে হাত দিয়ে পুকুরঘাট পর্যন্ত নিয়ে যায় দাদা। জোরে ধাক্কা মারাতে লুঙ্গির কাছা খুলে যায় তার। সেটা সামলে নিতে নিতে যতটা মাথা নিচু করা যায় তার চেয়ে আরও অনেক নিচু করে হাঁটতে থাকে সে। তিন দিন পার হয়ে তিন সপ্তাহ গেলেও তার বাবা ফেরেনি এখনো। তার মা হানুফা চুলার কাছে বসে সারা দিনই চোখ মোছে। কেউ প্রশ্ন করলে বলে, কই, কানমু ক্যান, চুলার ধোঁয়া গো, সইতে পারি না!
৪
ধৈঞ্চার আঁটির বোঝা ফেলে এসে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় আজিজ মুন্সি। কাঁধে গামছার দুই প্রান্তে দুটো পুটলি বাঁধা। আলের ওপর বসে হারিকেনের আলোয় পুটলিগুলো খোলে সে। একটা সরষের খৈল অন্যটাতে চিঁড়ার নাড়ু।
নাড়ুগুলান তর আর খৈল মাছের লাইগ্যা। তুমি বও এইখানে। আমি আধার দিয়া লই আগে।
গ্রামের মাঝখান দিয়ে রাস্তা করার সময় ইট তৈরির জন্য এখানে ইটখোলা বানিয়েছিল সরকারের লোকেরা। বড়সড় একটা গর্ত করে মাটি খুবলে নিয়ে গেছে তারা। মাঝারি একটা পুকুরের সমান হবে। এখন সেই গর্তে বৃষ্টির জল জমে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। আশপাশের বিল উজিয়ে বড়-বড় রুই, পাঙ্গাশ, বোয়াল ঘাঁটি গেড়েছে খাঁড়িটাতে। মাঝেমধ্যে তারা খাঁড়ি ছেড়ে চলে যায়। তবে কখনো কখনো দলবেঁধে ফিরেও আসে। আজিজ মুন্সির কাছে শুনেছে সে এসব। আজকে মাছেরা খাঁড়িতে আসবে—এ কথাও মুন্সি জানিয়েছে তাকে। মাছের জ্বর আইসে গো! এখন তারা উদাস হয়া ইটখোলার বিলে ঘুরতাসে। জাল দেখলে ধরা পড়ার লাইগ্যা তড়পায়। মরণ কাছে ডাকছে তাগো। বুড়ো হেঁটে হেঁটে জলাশয়ের চারপাশে খৈল ছিটায়। কিনারের কলমি আর কচুরিপানার ঝোপগুলো লাঠি দিয়ে গুঁতো দেয়, যাতে মাছগুলো বেরিয়ে আসে।
এক পায়ের ওপর জালের গোছা রেখে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে কী করে জাল ছড়াতে হয় তার পর গোল করে কী করে ছুড়ে দিতে হয় তা এত দিনে শিখে নিয়েছে সজল। ধনাগোদা নদীতে বাঁধ দেওয়ার আগে এখানে মাছের আকাল ছিল না কখনো। মেঘনা থেকে বড় বড় মাছ উজিয়ে আসত এসব বিলে। বুড়ো মুন্সি পাঁচ সেরি, দশ সেরি মাছও ধরেছে কত। আর আধ হাত লম্বা বড় চিংড়ি মাছ তো হাত দিয়ে ধরা যেত। সেই সব দিন কবেই গত হয়েছে। মুন্সির দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে বিগত দিনের গল্পগুলো সজলের বুকের ওপর চেপে বসে। মেঘনার ওপারে কুসুমপুর গ্রামে একসময় সোজা নৌকা নিয়েই গিয়েছিল মুন্সি। তার নতুন বউ তুলে এনে এই ইটখোলার পাশে সংসার শুরু করেছিল কত কাল আগে। প্রমত্তা ধনাগোদা এখন মৃতপ্রায়। বেড়িবাঁধ তার টুঁটি চেপে ধরেছে। বড় বড় মাছও তাই এদিকে আসতে পারে না আর। তবু এই ইটখোলার ছোট জলাশয়ে মাঝেমধ্যে তাদের দেখা মেলে। সজল মনে মনে প্রার্থনা করে আজ যেন সব মাছের জ্বর ওঠে!
৫
ঝুপ করে শব্দ হতেই জালের কাঠিগুলো বুড়বুড়ি তুলে ডুবতে থাকে। জালের রশিটা সজলের হাতে দিয়ে আজিজ মুন্সি ডুব দেয় জালের প্রান্তে আটকে থাকা জলজ গুল্মের ডালপালার মাথাগুলো ভেঙে দিতে। জালটা যেন লুকিয়ে থাকা মাছের ওপর নির্বিঘ্নে পড়তে পারে সে জন্যই এই সতর্কতা। ভুস করে ভেসে ওঠে বুড়ো যেখানে দাঁড়ায়, সেখানে গলা সমান পানি। সফেদ দাড়ির গোছাটা ডুবে আছে জলের মধ্যে। আধখানা চাঁদ পশ্চিম আকাশে তখনো এমনভাবে ঝুলে আছে মনে হয়, তালগাছের মাথায় উঠলে তার নাগাল পাওয়া যাবে। পুরোপুরি আলো ফুটতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। চাঁদের আলো ভোরের ফিকে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে একটা নরম রেশমি প্রভা ছড়িয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে। সেই আলোয় বুড়োকে ৩০ বছরের যুবকের মতো মনে হচ্ছে।
কত বয়স হবে বুড়োর? এই ইটখোলায় মেছোবাঘ আর সাপখোপের সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের বয়সের কথাই ভুলে গেছে সে। ব্রিটিশের রাজত্ব চলে যাওয়ার আগেই সে না কি জমিতে লাঙল চালিয়েছে। সে সময় বিরান চর ছিল এই জায়গা। বন্য মহিষ, বড়-বড় বাঘ আর সাপখোপের রাজত্ব ছিল। নদীর ভাঙন ঠেলতে ঠেলতে মুন্সির দাদাকে নিয়ে এসেছিল এই ইটখোলার জঙ্গলে। মুন্সি তার বাপ-দাদার সঙ্গে এই ইটখোলার জঙ্গল সাফ করে বাড়ির ভিটা করেছে। তখনো রাস্তা হয়নি, ইটখোলা তো দূরের কথা। বিলের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে যত দূরে তাকানো যায় তার চেয়ে আরও বড় এলাকার খাসজমি জুড়ে ক্ষেতি করেছিল মুন্সি। সে সময় বছরে একবার মাত্র ফসল ফলত। বাকি ছয়-সাত মাস জলে ডুবে নদীর সঙ্গে একাকার হয়ে যেত। তবে অভাবে থাকতে হয়নি। হাত দিলেই মাছ পেয়েছে। ছয় ফুট লম্বা বোয়ালমাছ কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়েছিল একবার। মাছটা ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ আকারের। এসব গল্প সে বহুবার বুড়োর মুখে শুনেছে।
ইটখোলার এই বিরান জায়গাটায় ভূতপ্রেত আর সাপখোপের ভয়ে তেমন কেউ আসে না। বিলের পানিতে কেউ কেউ জাল ফেলতে এলেও বেশিক্ষণ থাকে না। সজলেরও এখানে আসাটা আকস্মিক ঘটনা। ছেঙ্গার চর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের রাস্তাটা ধরে প্রায়ই দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়াত সে। ঘোরার নেশায় নয়, বরং স্কুলে তার মন টিকত না বলেই বেরিয়ে পড়ত এদিক-সেদিক। লেখাপড়া করার চাইতে গ্রামের অন্যদের মতো চাষবাস শিখে পুরোদস্তুর চাষি হতে চাইছিল সে। বাবার লেখাপড়ার বদনামটা যেন তাকে না ছোঁয়। সে যেন সবার সামনে সহজভাবে হেঁটে যেতে পারে। ক্ষেত-খামার চাষবাসের বিষয়-আশয় নিয়ে সবাই যেন তাকেও আলোচনার ভাগী করে। সজল ভাবেনি সে এই ইটখোলায় একজন অকৃত্রিম শিক্ষক পেয়ে যাবে।
বছর খানেক আগের কথা সেটা। স্কুলে না গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইটখোলার এদিকটায় আখক্ষেতের জঙ্গলে ঢুকেছিল সে। বুড়োর সঙ্গে পরিচয় এই আখক্ষেতেই। আখের গুচ্ছ গুচ্ছ রসে ভরা লাঠি ভেঙে না পড়ার জন্য বেঁধে দিচ্ছিল বুড়ো। একমনে কাজ করলেও পেছনে এসে দাঁড়ানো সজলের উপস্থিতি টিকই টের পেয়েছিল সে।
আমার আউখক্ষেতে কে গো? হিয়ল নি ঢুকছে! এই বলেই পেছন ফিরেই বুড়ো খপ করে ধরেছিল সজলের হাত।
৬
ধনাগোদা নদীর পারের মানুষেরা জয়নালের নাম দিয়েছে ভাদাইম্মা পাবলিক। গ্রাম্য ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে লোকটা প্রায় অবশ হয়ে থাকে সব সময়। কথার পিঠে কথা বলা দূরে থাকুক, কারও দিকে চোখ তুলে তাকানোটাও তার ধাতে নেই। যখন কাজ থাকে নিজের গরজেই সে কাজ করে। যখন থাকে না তখন তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কই থাকে লোকটা এটাও একটা রহস্য আর সব মানুষের কাছে। ধানি জমির আলগুলো জেগে থাকে যতক্ষণ, ততক্ষণই গ্রামের মানুষজনের কাজকামের ব্যস্ততা। তারপর রাতের অন্ধকার নদীর বানের জলের মতো যখন আলগুলো ঢেকে দেয়, তখন কর্মক্লান্ত মানুষজন ঘরবন্দী হয়। সজলের বাপের বন্দী হওয়ার মতো তেমন ঘর তো নেই। বাপের আর ভাইয়ের যৌথ পরিবারের বড় সংসারে এক রকম আশ্রিতই সে। প্রতি সন্ধ্যায় সজলের দাদার মুখে তাই মুখস্থ বুলি: কই রে, ভাদাইম্মা পাবলিকে কই! শহর কুতুবটায় কোনহানে হান্দাইসে?
আজ কয়েক সপ্তাহ হলো সজলের ভাদাইম্মা বাবার কোনো খোঁজ নেই। বদইল্যা নইস্যা নাকি মেঘনার কোন চরে তার দেখাও পেয়েছে। নসু বা নইস্যার কথার বিশ্বাস কী! দাদা বলেন, হেই ভাদাইম্মা আর যাইব কই, হেয় মতলব বাজারেই আছে! দাদার এমন নিশ্চিত ধারণা প্রকাশের পর জয়নালের খোঁজ আর কেউ করে না। সবাই আশা করে আছে মতলব বাজার থেকে যেকোনো দিন হঠাত্ই এসে হাজির হবে জয়নাল। কেবল চুলার ধারে বসে হানুফা ফোঁপায়। কেউ প্রশ্ন করলে বলে, কই, কান্দি না তো। ধোঁয়ায় চক্ষু জ্বালা করে গো!
৭
প্রথম জালেই এত বড় একটা মাছ পড়বে আশা করেনি সজল। প্রায় ১০ সের ওজনের পাকা রুই। জাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বুড়ো তার হাতে তুলে দিতেই সর্বশক্তিতে সে জাপটে ধরে মাছটাকে। মতলব বাজারের ছোট্ট দোকানঘরটাতে রাতে সে আর তার বাবা ক্যাশ বাকশো রাখার ছোট পালঙ্কের মধ্যে কোনোমতে জায়গা করে নিত। বাবার হাতটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ঘুমাত সে। মাঝেমাঝে ঘুমের ঘোরে মৃগীরোগীর মতো কেঁপে উঠত তার বাবার হাত। গোঁ-গোঁ শব্দ করে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী সব দুর্বোধ্য কথা বলত তার বাবা। সজল তখন বাবার হাতে বড় একটা ঝাঁকুনি দিত। আর তাতেই আবার ঠান্ডা হয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ত সে। এখন এই মাছটাও যেন বাবার হাতের মতোই তড়পাচ্ছে তার বুক জুড়ে। ল্যাজের বাড়ি পড়ছে হাঁটুর নিচের দিকে। পিচ্ছিল লালায় ঢাকা মুখ দিয়ে মাছটা গুঁতো দিচ্ছিল সজলের বুকে। অভ্যাসবশে পাল্টা ঝাঁকুনি দিয়ে মাছটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু তাতে তার তড়পানি আরও বাড়ে।
দুধমুখা, ইছাখালী, ছেঙ্গার চর আর শ্মশানতলা ভোরের আলোয় তখন একটু একটু করে জেগে উঠেছে। বাতাসে রাতের পুরোনো গন্ধ তখনো একটু একটু রয়ে গেছে। আর তার রেশটুকু কাটিয়ে দিতেই কয়েকটি টিট্টিভ পাখি ভোরের বাতাসকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে চিত্কার করে ওঠে। গাছের ডাল আর ক্ষেতের আলের ওপর জেগে থাকা খুঁটিগুলোর মাথায় ফিঙে পাখিরা এসে বসতে শুরু করেছে। সবুজ ধানের ক্ষেত তার কালো আবরণ সরিয়ে খানিকটা নীলচে রং ধারণ করতে থাকে এই ফাঁকে। পুব আকাশকে তখনো রক্তিম আভা স্পর্শ করেনি। তবে তার প্রস্তুতি যে শুরু হয়েছে সে-দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। বুড়োর জাল মারার ঝপঝপ শব্দ শুনছে সজল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শিশুগাছটার নিচে বড় মাছটাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে সে। কত মাছ উঠবে আজ ভাবে সে। জলার দক্ষিণ পাড়ে ছোটখাটো একটা মাছের স্তূপ। তার লোভেই কয়েকটা চিল চক্কর দিতে থাকে নতুন আলো ফোটা আকাশে।
মাছের জ্বর আইসে গো! বুড়ো চিত্কার করে ওঠে আনন্দে।
বড় মাছটা তখনো তার বুকের ভেতরে তড়পায়। শীতল রক্তের এই প্রাণীর শরীরও কেমন উষ্ণ মনে হতে থাকে তার কাছে। জ্বরের ঘোরেই মাছটা যেন কাঁপতে থাকে তার বুকের ভেতর। রাতের অবসাদ অথবা একটা আবছা তন্দ্রার ঘোরই যেন তাকে একটা ধাক্কা মারে। ঢুলতে ঢুলতে সে শুনতে পায় মাছটা দুর্বোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে কী যেন বলছে তাকে।
আহমেদ মুনির
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৩, ২০০৯
Leave a Reply