আজিজ মার্কেটের দোতলায় ‘পাঠক সমাবেশে’র অফিসে বসে কাজ করছিলেন জীবনানন্দ-গবেষক মুসাররাত হোসেন। সেলফোন বেজে উঠল।
—হ্যালো।
—এই, কোথায় তুমি?- অপর পক্ষের কণ্ঠ উত্তেজিত।
—আজিজ মার্কেটে। ঘানি টেনে যাচ্ছি। জীবনানন্দের একটি বই সম্পাদনা করছি।
—শোনো শোনো। একটু আগে ভূমিকম্প হয়ে গেল। টের পেয়েছ?
—তাই নাকি? ওরে বাবা! তুমি কোথায়?
—আমি বাড়িতেই। কেউ নেই। খাট-পালং টেবিল-চেয়ার সব নড়ে উঠল।
—আর ভূমিকম্প! আমি নিজে ভূমিকম্পমান। তোমরা তো এসব পার্থিব ভূমিকম্পই টের পাও। হূদয়ের ভূমিকম্পটা তো তোমাদের স্পর্শ করে না। হূদয়ের জায়গায় পাথর বসানো। বুঝলে, পাপড়ি মহোদয়া। আর যে-সে পাথর নয়—কারারা পাথর। অতি মূল্যবান।
—দ্যাখো, পাপড়ি হাসছিল, আমরা মাটির মানুষ। তোমাদের মতো অত দামি না আমাদের হূদয়। নিতান্ত হালকা-পাতলা।
—তার মানে, আছে?
—আছে একটা। তোমাদের মতো না। মাটির মানুষদের থাকে যেমন। তোমরা তো আবার গবেষক-হূদয়। তাও জীবনানন্দ। কঠিন এক কবির। তারপর যেসব মোটাসোটা বই লিখেছ তুমি—
নিজের অজ্ঞাতসারে ‘পাঠক-সমাবেশ’ অফিসের বাইরে চলে এসেছিলেন মুসাররাত হোসেন। পশ্চিমের আকাশ ওখান থেকে অনেকখানি দেখা যায়। সন্ধ্যা উতরে গেছে। ঘন নীল আকাশ। একটু শাদার আভাস দেখা যাচ্ছে কি যাচ্ছে না। দূরে একটা বহুতল বিল্ডিংয়ে আলো জ্বলছে ঘরে ঘরে। কাছে কয়েকটা সোডিয়াম লাইটের হলদে-সোনালি। সবুজ বিশাল একটা ঝাকড়া গাছ। আরও সবুজ গাছ। মাটিতে বিরাট একটা মোটর ওয়ার্কশপের মতো। সারি বাঁধা অনেক গাড়ি দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোনো কোনোটি বিকল। আর বহুঊর্ধ্বমুখ একটা টাওয়ার।
এত সব কি চোখে পড়েছিল মুসাররাত হোসেনের? মনে হয় না, কিন্তু দ্রুত চোখ চলে যাচ্ছিল তাঁর। পাপড়ির প্রভাবেই কি? পাপড়িই তো তাঁকে নিসর্গ চিনিয়েছে। পাখি, গাছের পাতার রং বদল। তা না হলে তিনি তো অক্ষরসমূদ্রেই ডুবে থাকতেন দিনরাত।
পাপড়ি এই নিয়ে খোটাও দ্যায় তাঁকে। বলে, আচ্ছা তুমি তো জীবনানন্দ-বিশারদ। অথচ তুমি একটা গাছ চেনো না, ফুল চেনো না, পাখি চেনো না।
হাসেন মুসাররাত হোসেন—একটা কথা আছে, জানো? পানিমে মীনপিয়াসী। অক্ষর সমুদ্রে ডুবে থেকে আমি নিরক্ষর হয়ে ছিলাম আসলে। সেখান থেকে তুমি মুক্ত করেছ আমাকে। আমাদের ছেলেবেলার সেই পলাশ গাছ দেখি না আর। আচ্ছা, তুমি কি পলাশ গাছ চেনো?
পাপড়িও হাসে—চিনি, বাবা চিনি। ঢাকায় খুব বেশি নেই বোধহয় এখন। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার বাহার এখনো আছে ঢাকা শহরে। আর সবুজ কত রকমের। একদিন কার্জন হলের ওখানে গিয়ে দেখো।
মুসাররাত হোসেনও হাসেন—আমি একটি মেয়েকে চিনি। তার নাম পাপড়ি। এখন তার নাম বদলে ফেলা উচিত। কেননা এখন সে পুরো ফোটা ফুল। আমি তার মধ্যেই দেখি সমস্ত ফুলের মুঞ্জরণ। আর ঋতুতে ঋতুতে রং বদল।
—হয়েছে হয়েছে! হাসতে হাসতে মুখ ঝামটা দ্যায় পাপড়ি। আচ্ছা, গবেষক তো কবি হয়ে উঠেছে মনে হয়।
মুসাররাত হোসেন বলেন—অবশ্য কবিতা লিখতে হয় না আমার। তুমিই আমার জীবন্ত কবিতা।
কথা বলতে বলতে বর্তমানে কোন সময় ফিরে এসেছেন মুসাররাত হোসেন নিজেও জানেন না। কথার মোড় ফিরিয়ে মিনতি ভরা স্বরে মুসাররাত হোসেন বলেন—এই, তোমার কি একটু সময় হবে, কাল বিকেলে বা সন্ধেবেলা? বসতাম একটু।
—হ্যাঁ, বসা যায়। ফ্রি আছি। কোথায় বসতে চাও?
—বাহ বা! মুসাররাত হোসেন খুশিতে বাগে-বাগ। সবচেয়ে ভালো হয় সেই তোমার প্রিয় কুরচিফুল-এ। ওখানে ভিড়টিড় তেমন হয় না। আর আমাকে—আমাদের ওরা খাতিরও করে খুব। যতক্ষণ ইচ্ছে থাকা যায়। কটার সময় তোমার সুবিধে হবে?
পাপড়ি ফোনের ওপার থেকে বলে—সন্ধে ছটায়।
—দিন ছোট হয়ে এসেছে না এখন? কার্তিক মাস। হিম পড়তে শুরু করেছে। পাঁচটায় চলে এসো। একটু বেশি সময় পাওয়া যাবে।
পাপড়ি একটু চিন্তা করে বলে—আচ্ছা, পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে।
—সাবধানে এসো। খোদা হাফেজ। বলেন মুসররাত হোসেন।
—ঠিক আছে। রাখি তাহলে। ফোন রাখে পাপড়ি।
দুই.
কারওয়ান বাজার।
একটা কাঠের দোকানে বসে আছেন মুসাররাত হোসেন। সঙ্গে গোমেশ মাঝি আর তার সহকারী।
তিনি আলমিরার জন্য কাঠ কিনবেন। তাঁর ৬৫০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটবাড়ির মেঝেতে ছত্রখান হয়ে আছে বইপত্র। এমনকি জীবনানন্দের নিজস্ব বই, তাঁর সম্পর্কিত বই, তাঁর সম্পর্কিত পত্রপত্রিকা। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত জীবনানন্দের কয়েকটি বই, নাভানার প্রকাশিত বই, ফুটপাত থেকে আশ্চর্যভাবেই একবার পেয়ে গিয়েছিলেন কবিতাভবন প্রকাশিত বনলতা সেন-এর চটি সংস্করণ, একজন তার সংগ্রহ থেকে তাঁকে জীবনানন্দবিদ হিসেবে উপহার দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার জীবনানন্দ সংখ্যাটি। আর কবির জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত বেশ কিছু পত্রপত্রিকা। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। যেটি সংস্করণের পর সংস্করণ হয়ে চলেছে এবং প্রতিটি সংস্করণে তিনি নতুন নতুন কবিতা সংযোজন করে যাচ্ছেন। এ বইটি তাঁর খ্যাততম গ্রন্থ। এ ছাড়া ছোট কিন্তু মূল্যবান ধানসিড়ি নদীটির তীরে নামে তাঁর একটি বই আছে।
জীবনানন্দের বাইরে অল্প কিছু প্রবন্ধ আছে, কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় জীবনানন্দ গবেষক হিসেবেই।
হোসেন পরিবারের বড় ছেলে মুসাররাত হোসেন। বাবা অল্প বয়সে মারা গেছেন। তারপর এই মুসাররাত হোসেনই ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যান তাঁর পিতাই। অন্য দুই বোনের লেখাপড়া-বিয়ের ব্যবস্থা মুসররাত হোসেনই করেছেন। নিজে লেখাপড়া শিখেছেন ঠিকই, চাকরিও করেছেন। সরকারি চাকরিতে পঁচিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন, পেনশন এককালীন বিক্রি করে দিয়েছেন। তা থেকে তাঁর সংসার চলে—অবশ্য যদি একে সংসার বলা যায়। কেননা তাঁর আর বিয়ে করা হয়নি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায়? না। অর্থাভাবে? তাও না। ভাই-বোনদের মানুষ করতে, বিয়ে দিতে দিতেই বয়স পেরিয়ে গেছে।
আজিমপুরে বাপের দুই কামরার টিনের বাড়ি এখন ছোট একটা বহুতল বাড়ি। উদ্যোক্তা, মুসাররাতেরই ছোট ভাই মুশাররাফ হোসেন।
এবং মুশররাফই একদিন বলে—বড় ভাই, তুমি তো বিয়েথা করলে না। ৬৫০ স্কয়ার ফুটের দু-তিনটি ফ্ল্যাট বানাচ্ছে ওরা। বলছিলাম কি, তুমি যদি আপত্তি না করো…
মুসাররাফ হোসেন তখন অফিসের এক কাজে বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছিলেন। সহাস্যে বললেন—ব্যস। আমাকে ওটাই দিস। তোরা ঠিকমতো পাবি তো?
—হ্যাঁ। মুশররাফ একটু সংকুচিতভাবেই বলেছিল।
এসবের আগেই তিনি দলিলে স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন।—আমি একা মানুষ। আমার আর কিছু লাগবে না। তোরা ঠিকমতো ভাগ করে নিস।
এই ছোট ভাইয়েরই বউ খাবারদাবার পাঠিতে দিত তাঁকে। তিনি ভালো টাকাই দিয়ে দিতেন। কিন্তু কিছুদিন পরে সেই ভাইয়ের বউ খাবার পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ওরা তিন ভাই-ই এই বাড়িতে থাকেন। অন্য দুই ভাইয়ের ছেলেমেয়েও আছে, খরচাও অনেক।
মেজোটার অবস্থা ভালো, গাড়িও আছে, গাড়ি অবশ্য রাখার জায়গা নেই এখানে, কাজেই একটা গ্যারেজে থাকে। সে ভাইয়ের ঠাটবাট খুব, ব্যস্তও থাকে, কথা বলার সময় নেই। কিছুদিন বাইরের হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেছিলেন মুসাররাত।
তারপর একদিন মুসাররাতের পরবর্তী ভাই মুকাররাম আর তার বউ মিনু হঠাত্ তাঁর ফ্ল্যাটে চলে আসে এক রাতে। মুকাররাম বলে, তুমি যে বাইরে খাও তা তো জানতাম না। আমি তো ভাবতাম, মুশাররাফ পাঠায়।
মুসাররাত কোনো জবাব দেন না এ কথার। ওর বউ মিনু বলে—বড় ভাই, আমি আপনাকে দুবেলা, দুপুরবেলা আর রাত্রিবেলা—খাবার পাঠাব। সকালের আর বিকেলের নাশতাও। হোটেলে খেলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
—পাঠাবে তুমি? তোমরা? তাহলে ভালো হয় খুব। রোজ বাইরের খাবার একঘেয়ে লাগে।
—আপনার শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে বড় ভাই।
—ঠিক আছে, পাঠাও। বিকেলের নাশতা পাঠাতে হবে না। আমি তো বিকেলে হাঁটতে বেরোই, তখন বাইরে একটু চা-টা খেতে ভালোই লাগে আমার। আর মুশাররাফকে কিছু টাকা দিতাম। তোমাদেরও সেটা দেব।
মুকাররাম আর মিনু বলে সমস্বরে—টাকা দিতে হবে না।
মুসাররাত হোসেন হেসে কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন—কত টাকাই বা দিতে পারব আমি আর? কিন্তু টাকা তোমরা যদি কিছু না নাও, আমার খারাপ লাগবে।
একটু চুপ থেকে মিনু বলল—ঠিক আছে, আপনার খারাপ লাগলে দেবেন।
মুসাররাত হোসেন বললেন—তোমরা কদ্দিন পরে এলে আমার কাছে। তোমাদের কী খেতে দিই?
—ওমা! মিনু হেসে বলল—আমরা কি খেতে এসেছি নাকি? আমরা সেদিন মাত্র জানলাম যে আপনি বাইরে খাচ্ছেন।
—দাঁড়াও, দেখি। বলে একটা জ্যামের বোয়েম বের করে দিলেন—এই তো, এটা খোলা হয়নি, কিনে রেখেছিলাম কবে যেন, নিয়ে যাও, বাচ্চাদের দিয়ো। মিনুর হাতে বোয়েমটা দিলেন।
মিনুর চোখ ছলছলিয়ে উঠল। বলল—বড় ভাই, আপনি চিরকাল সবার জন্য করে গেলেন।
এই সংসারে এসে মিনু জেনেছে অনেক কিছু। অবশ্য সময় লেগেছে বুঝতে।
তারপর মিনুই দুবেলা খাবার পাঠায়। সকালের নাশতাও। কচিত্ দুপুরে বা রাতে বাইরে দাওয়াত বা খাবার প্রোগ্রাম থাকলে সকালেই জানিয়ে দেন মুসাররাত হোসেন।
সেলফোন বেজে উঠল।—হ্যালো।
—সালাম আলায়কুম, মুসা ভাই। ২২শে অক্টোবর এসে গেল কিন্তু। কবে বলে রেখেছি আপনাকে। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী। আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলিনি কিন্তু।
—কবে দিতে হবে?
—সোমবার। বড়জোর মঙ্গলবার।
—ঠিক আছে। আমি বিষয় ভেবেই রেখেছি। জীবনানন্দ কলকাতা রেডিওতে সর্বশেষ যে কবিতাটি পড়েছিলেন, সেই কবিতার একটি আলোচনা। ‘মহাজিজ্ঞাসা’। মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসার অসামান্য কাব্যরূপ। দেব আপনাকে। যদি সোমবারে না হয়, মঙ্গলবারেই দেব। কাউকে পাঠিয়ে দেবেন।
—কাকে পাঠাব আর? আমি নিজেই ফোন করে চলে আসব।
—ঠিক আছে।
ফোন রাখতেই বেজে উঠল ফের।—কী, কার সঙ্গে এত গল্প করছিলে? কখন থেকে খোঁচাচ্ছি। নাকি এবার একটা পাপড়ি জুটে গেল? নাকি আস্ত ফুল?
—এবার আর হলো না। পাপড়ি নিয়েই থাকলাম এ জন্ম। পরজন্মে আস্ত ফুল খুঁজে নেব। ঈশ্বর সহায় হবেন নিশ্চয়।
—হু। পরজন্মে আমি তোমাকে ছাড়ছি? এত সোজা? কত কষ্টে খুঁজে বের করেছি। আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই কক্খনো।
হা হা করে হাসলেন মুসাররাত হোসেন। কাঠের দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঠেস দিয়ে বসলেন সারি সারি ঠেলাগাড়ির একটিতে। পাপড়ির সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর আর হুঁশ থাকে না। এদিকে এলাকাটিতে রিকশা চলছে, ঠেলাগাড়ি চলছে, ভ্যানগাড়ি চলছে। এদিকটায় সারি সারি কাঠের দোকান। ওদিকে আরও সব দোকান। মার্কেট সব বিশাল বিশাল।
কথা আর কথা আর কথা। পাপড়ি আর মুসাররাতের কথা চলেছে তো চলেছেই।
গোমেশ মাঝি বিল এনে দিল।
—কত হয়েছে?
—বারো হাজার ছ শ তেইশ টাকা।
—সেগুন কাঠ ঠিকমতো দেখে নিয়েছেন তো?—হ্যালো, পাপড়ি। একটু ধরো। —আর বোর্ড?
—দেখেছি, স্যার। কাঠবোর্ড সব ঠিক আছে।
—ছ শ তেইশ আবার। পুরো বারো হাজার টাকা নিতে বলেন।
—বলেছি, স্যার। সাড়ে বারো হাজার টাকার নিচে দেবে না।
পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে যখন সেলফোনটা কানে নিলেন আবার, কোনো সাড়াশব্দ নেই আর। নিশ্চয় চার্জ নেই। মেয়েটা যা, কিছু খেয়াল থাকে না!
দোকানে ভালো করে দেখাই হয়নি। বাড়িতে এসে গোসল করতে যাবার আগে ডায়েরিতে কাঠের হিসাবটি টুকে রাখলেন মুসাররাত হোসেন—সেগুন কাঠ পাকা…
হিসাব টোকার সময় মুসাররাত হোসেন সেগুন কাঠের হিসাবটা বুঝতে পারলেন না লেখার হিজিবিজির জন্য। গোমেশ মাঝি ও তার সহকারী ততক্ষণে পাড়ার হোটেলে খেতে গেছে। পনেরো মিনিট চোখ বুজে শুয়ে থেকে উঠে জীবনানন্দের ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি নিয়ে লেখা ধরলেন।
তিন.
১৯৫৪ সালে, বঙ্গাব্দ ১৩৬১-তে, শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় এমন তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, যাকে বলা যেতে পারে মণিরত্ন। কিংবা আধুনিক বাংলা কবিতার তিনটি মিনার। প্রথমে ছিল আশ্চর্য-আধুনিক যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা। পরবর্তী দুই পৃষ্ঠায় ছিল সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত ও সঞ্জয় ভট্টচার্যের অর্থাত্ তিরিশের দশকের পাঁচজনের কবিতা। তারপর অন্য কবিদের। তার মধ্যে কোনো কোনোটি হয়তো উপরত্নও বলা যেতে পারে। বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতাত্রয়—একটু আশ্চর্যভাবেই—তিনটিই প্রেমের কবিতা। যতীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতার বিষয় ভিন্ন এবং পরামশ্চার্যভাবে তাও সাযুজ্যবহ। বলা বাহুল্য প্রত্যেকের স্বরগ্রাম আত্মচারিত্রিক। জীবনানন্দ ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পড়েছিলেন আকাশবাণীতে ১৯৫৪র ১৩ই অক্টোবর, আরও কয়েকজন কবির মধ্যে। পরদিনই তাঁর ট্রাম দুর্ঘটনা ঘটে, যা তাঁর অকালমৃত্যু ডেকে আনে সপ্তাখানেক পরে, ২২শে অক্টোবর ১৯৫৪-য়।
‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি হতে পারে জীবনানন্দের সম্ভবত সর্বশেষ রচিত কবিতা। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন, পূর্বাশা পত্রিকায় কবির ‘অবিনশ্বর’ কবিতাটি—কিন্তু তিনিও ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটির উল্লেখ করেন। যেমন করেছেন কবির সহোদর অশোকানন্দ দাশ। তা হোক বা না হোক, ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি কবির উপাত্ত কবিতাগুচ্ছের মধ্যে অসম্ভব মহার্ঘ্য। জীবনানন্দের প্রাথমিক ও মধ্যন্দিন কবিতা থেকে এই কবিতা (কবির সায়ন্তন কবিতাগুচ্ছের প্রায় সবই) অন্য আরেক আয়তনে উত্তীর্ণ।
যতীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ—তিনজন কবির তিনটি কবিতার আশ্চর্যতার কথা বলছিলাম। যতীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ—এই দুই কবিই ১৯৫৪ সালে প্রয়াত হন। সুধীন্দ্রনাথ আরও কয়েক বছর বেঁচেছিলেন, ১৯৬০ অবধি, তাঁর সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ দশমীর ১০টি কবিতার এটি অন্যতম। যতীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ—দুজন সম্পর্কেই এক-এক টুকরো শোকলিখন প্রকাশিত হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায়। ময়ূখ পত্রিকা জীবনানন্দ সম্পর্কে পরপর দুটি সংখ্যায় (দ্বিতীয় সংখ্যাটি ছিল ‘জীবনানন্দ সংখ্যা’) সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল।
আমার ধারণা, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ওই কবিতাটিই তাঁর সর্বশেষ কবিতা। শেষ যদি নাও হয়, লুপ্তির সংকেত আছে এখানে। যতীন্দ্রনাথ তাঁর আবহমান ব্যঙ্গবঙ্কিম স্বরে পুনর্জন্মে কী হতে আকাঙ্ক্ষা করেন, তার একটি চিহ্ন রেখে গেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতায় যতীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ রকমে অভিন্ন কণ্ঠ, শুধুমাত্র এই কবিতাটির সাক্ষ্যেই তা সপ্রমাণ করা যেতে পারে। ‘কচি ডাবে’র কবি এখানে পরিহাসনিষ্ণাত। অশথ গাছ এবং তার নিচেকার মাঠে চারণরত একটি দুধোলো গাভী—এই দুটির বর্ণনা দিয়েছেন কবি। কবিতা শেষে সহাস্য কিন্তু সুগভীর উপসংহার: ‘আমার মতন মণিষ্যিদের/খোলা আছে দুটি ভবিষ্যত্,/হয় গোজন্ম নয় অশথ।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘প্রতীক্ষা’ কবিতাটিও বহু জন্মজিজ্ঞাসার দোলাচলে স্যন্দমান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন, ‘অতএব কারও পথ চেয়ে লাভ নেই:/অমোঘ নিধন শ্রেয় তো স্বধর্মেই; বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।/অনুমানে শুরু, সমাধা অনিশ্চয়ে,/জীবন পীড়িত প্রত্যয়ে প্রত্যয়ে;/তথাচ পাব না আমি আপনার দেখা কি?’
জীবননান্দের কবিতাটিও একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসায় উপনীত। তিনটি কবিতাই তা-ই।
তিনটি কবিতাই জন্ম-মৃত্যু-ভাবনা-বেদনায় আন্দোলিত। জীবনানন্দের কবিতাটি আবহমান সময়ের পটভূমিকায় স্থাপিত। সময়চেতনাও তো জীবনানন্দে আবহমান। মধ্যিখানে সমাজচেতনা-রাজনীতিচেতনা উথলে উঠেছিল। এখন সরে গেছে তারা। দেশ-কালের যে নদী প্রবাহিত অনন্তকাল ব্যেপে, সেই তরঙ্গিনীতে অসংখ্য শৈবাল-জঞ্জাল ‘তমসার থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে সময়ের অন্ধ মর্মস্থলে/অন্ধকারে ভাসে।’ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা উন্মীলিত, কিন্তু তমসা আর অন্ধকার স্তরে স্তরে পরিব্যাপ্ত। তবু নীলিমা ও সূর্যের ‘অমৃতত্ব’ মানুষ বুঝেছে। সবকিছু ভেদ করে প্রজাপতি আর মাছরাঙা ‘জ্ঞানের অগম্য এক উত্সবের সুর’ জাগ্রত রাখে। কবিতাটি সমাপ্ত হচ্ছে যতীন্দ্রনাথের মতো পরিহাসাঞ্চিত সুরে নয়, সুধীন্দ্রনাথের মতো জিজ্ঞাসায় আর্ত নয়, মানুষের জয়গানেই, প্রেমের নীলিমাআলোকে: ‘শূন্য তবু অন্তহীন শূন্যময়তার রূপ বুঝি;/ইতিহাস অবিরল শূন্যের গ্রাস;—/যদি না মানব এসে তিন ফুট জাগতিক কাহিনীতে হূদয়ের নীলাভ আকাশ/বিছিয়ে অসীম করে রেখে দিয়ে যায়:/অপ্রেমের থেকে প্রেমে গ্লানি থেকে আলোকের মহাজিজ্ঞাসায়।’—রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো জীবনানন্দ জীবনের পাপ-পতন-অন্ধকারকে সমগ্রত উন্মূলিত করে দেননি, কোনো নিরত্যয় শ্রেয়বোধে তাঁর প্রতীতি প্রতিষ্ঠিত নয়, আলো-অন্ধকারে বিরামহীন দুল্যমান থেকে অন্ধকার ঘরে লতার মতো কি তরুর মতো সূর্যালোকের পিপাসা জীয়ন্ত রেখেছেন। মানুষের তিন ফুট জাগতিক কাহিনী শূন্যতাকে অর্থবান করে তোলে—এই সত্য উচ্চারণ করে গেলেন এ কালের মহাকবি।
চার .
সেদিন সন্ধেবেলা।
‘কুরচিফুলে’ ওরা দুজন মুখোমুখি বসে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটাতেই এসে গিয়েছিলেন মুসাররাত হোসেন। পাপড়ি কি আর কখনো সময়মতো আসে? তবে আজকে সময়মতোই উপস্থিত হলো বলতে হবে। তখন সোয়া ছটা বাজে। কার্তিকের সন্ধ্যা দ্রুত নেমে আসছে তখন। পাপড়ির আসতে দেরি হচ্ছে দেখে এক কাপ চা নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছিলেন মুসাররাত হোসেন।
মুসাররাতের পছন্দসই বাদামি-হলুদ একটা শাড়িতে ঝলমল করছিল পাপড়ি। সহাস্যে ভেতরে ঢুকল। ওদের বসবার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। একটেরে। ভারি সুন্দর! নির্জন রেস্তোরাঁর নির্জনতর জায়গা।
—বোসো।
বসে পাপড়ি তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা চিনেমাটির মগ বের করল। গায়ে ছোট-বড় বাদামি রঙের চক্কর আঁকা শাদা রঙের মগ। পাপড়ি জানে, মুসাররাত হোসেন চা খেতে খুব ভালোবাসেন। আর এই একটি বিষয়ই তিনি পারেন, নিজের হাতে চা বানাতে।
—বাহ! দুর্ধর্ষ! বলে উঠলেন মুসাররাত হোসেন।
—সত্যি ভালো লেগেছে তোমার?
—অবশ্যই। কিন্তু শুধু এই চায়ের মগটির কথাই বলিনি আমি, এর বাহিকাকেও দুর্ধর্ষ লাগছে।
পাপড়ি হাসল।—অনেকক্ষণ আগে এসেছ?
—না, বেশিক্ষণ আগে না। মাত্র সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে। তারপরই বললেন, তুমি কালকে সন্ধেবেলা ভয় পেয়েছিলে খুব, তাই না?
—প্রথমেই কী মনে হয়েছিল জানো? যদি ঘরবাড়ি ধসে পড়ে, যদি মরে যাই, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আর। বিশ্বাস করো, আব্বা-আম্মা ভাই-বোনের কথা মনে হয়নি। মুহূর্তে তোমার মুখ ভেসে উঠেছিল। তারপরই ফোন করেছিলাম তোমাকে। আব্বা-আম্মা এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন। ভাই-বোনরা কে কোথায়—কেউ কোচিংয়ে, কেউ আড্ডায়। পরে অবশ্য আব্বাকে ফোন করেছি।
এই রেস্তোরাঁটি ভারি সুন্দর! কোন কালে পয়লা বৈশাখ চলে গেছে। এখনো দেয়ালে তার সাজসজ্জা। টেবিলে টেবিলে তাজা ফুল। আর নির্জন। এই নির্জনতাই সবচেয়ে পছন্দ মুসাররাত হোসেনের। অনেকখানি জায়গাজুড়ে রেস্তোরাঁটি। দুপুরবেলা খাবার বুফে ব্যবস্থা আছে। ওরা খেয়েছেও ওখানে। আস্ত দিন কাটিয়ে দিয়েছে সেই দুপুর বরোটা থেকে। বেরিয়েছে হয়তো দশটা-এগারোটার দিকে। শহর ঘুরে এখানে এসে বসেছে। মুসাররাত হোসেন বলেন এটাকে ‘মরূদ্যান’। ঢাকা শহরটা মরুভূমি।
পাপড়ি বলে—তুমি কী আশ্চর্য মানুষ। লোকজন পছন্দ করো না।
—আমার ভালো লাগে না।
—আমার অবাক লাগে, তোমার কোনো বন্ধু নেই।
—ভালো লাগে না কারও সঙ্গে মিশতে।
—কই, আমার সঙ্গে তো মেশো। মেশো মানে তো সারাক্ষণ। আসল কথা কি জানো, তুমি এমন কোনো মানুষ পাওনি যে তোমাকে বুঝতে পারে ঠিক।
—কী জানি।
—আর জীবনানন্দ-চর্চা করো তো। জীবনানন্দও শুনেছি খুব একা মানুষ।
—জীবনানন্দ আর আমার জীবন আলাদা। আমার পারিবারিক ইতিবৃত্তের কথা বলিনি তোমাকে? ভাইবোন সবাইকে মানুষ করেছি আমি, আর—
—থাক, সেসব দুঃখের কথা। একজনকে তো পেয়েছ।
—সেই আমার সাত রাজার ধন, এক মানিক।
মুসাররাত হোসেন বলেন—কী খাবে, বলো? মেনু টেনে পাপড়ির কাছে দেন। নিজেও কিছু যোগ করেন আরো আইটেম। এই রেস্তোরাঁর সব বেয়ারাই নীল টাই সাদা শার্ট পরা। সুদর্শন হাসিমুখ ওদের চেনা বেয়ারাটি এসে অর্ডার নিয়ে যায়।
ঠিক তার পরপরই কাছাকাছি কোথায় যেন বিরাট বোমার মতো শব্দ হয়। সেই সঙ্গে সমস্ত টেবিল-চেয়ার নড়ে ওঠে। কোথায় ছিটকে পড়ে ওরা, পাপড়ি আর মুসাররাত হোসেন। মুহূর্তে সব অন্ধকারে ছেয়ে যায়। বিরাট কোলাহল। হুড়মুড় করে সমস্ত শহর যেন ভেঙে পড়ছে। অনেক লোকের কোলাহল। আর্তনাদ। ক্রন্দন। কাছাকাছি চেঁচিয়ে উঠছে কেউ কেউ—বাঁচাও! বাঁচাও!
মুসাররাত হোসেনের একটা পা কোথায় যেন আটকানো। বিহ্বল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরই তিনি অন্ধকারেই সেলফোনটি টিপতে লাগলেন। আলো জ্বলে উঠছে। পাপড়ি নামটি টিপলেন। সাড়াশব্দ নেই। আবার। আবার। তারপরই সেই মিহি গলা—হ্যালো, তুমি কোথায়? আর্ত, কান্নাজড়ানো গলা পাপড়ির।
—আমি তো এখানেই। সেলফোনটা একটু রাখো। আমি জোরে কথা বললেই তুমি শুনতে পাবে। শুনতে পাচ্ছ?
—হ্যাঁ। তুমি তো খুব কাছেই।
—তোমার লাগেনি তো?
—হাতে পায়ে অসম্ভব চোট লেগেছে। মনে হচ্ছে আমি একটা গর্তে পড়ে আছি। দেখি, কোথাও ধরে উঠতে পারি কিনা।
—আমার ওঠবার উপায় নেই। আমার পা আটকে গেছে।
—দাঁড়াও। গাছে চড়া মেয়ে আমি। একটু হাসল যেন পাপড়ি। একটু অপেক্ষা করো।
বহু দুঃখে যেন হাসলেন মুসাররাত হোসেন। তখন চতুর্দিকে বোমার মতো শহর, পতনের মতো শব্দ। উতরোল কান্নার শব্দ। মনে হচ্ছে একেকটি বিশাল বিশাল বাড়ি ধসে পড়ছে। আর্তনাদের শব্দ। কোলাহল। চিত্কার।
আর একটু পরেই পাপড়ির জোরালো কণ্ঠস্বর—এই, আমি উঠে এসেছি। কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না। স্যান্ডেল কোথায় পড়ে গেছে।
—আমি? আমি তো এখানে। কিন্তু নড়তে পারছি না। আমার বাঁ পা আটকে গেছে। কলে-পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা আমার। অসহ্য লাগছে।
—দাঁড়াও ধৈর্য ধরো। আশা হারিয়ো না। আমি তোমাকে টেনে তোলার ব্যবস্থা করছি।
কাছেই বিরাট জোরে যেন একটা দেয়াল ধসে পড়ল। আর তারপরই—যেন সোজা খোলা সিংহদরজার মতো দেখা গেল। আর বেরিয়ে এল ওরা দুজন—একটু পরেই হাত ধরাধরি করে—সারা আকাশ ধোঁয়াটে—একটাও তারা নেই—তারই মধ্যে কোত্থেকে যেন আলোর ফোয়ারা আসছে। রাস্তাঘাট উল্টে আছে। বাড়িঘর, ল্যাম্পপোস্ট, গাছ পড়ে আছে। তারই মধ্যে কীভাবে ওরা পথ খুঁজে পাচ্ছে।
পাঁচ.
ভোর।
কীত্তনখোলা নদীর ঘাটে লঞ্চ থেমে আছে। কেবিনের সামনে বসে আছে পাপড়ি আর মুসাররাত হোসেন। কাকেরা এসে বসছে পাশের লঞ্চের শিখরে। শালিকেরা ওড়াউড়ি করছে। ঘুমভাঙা চোখে-মুখে কী যে সুন্দর লাগছে পাপড়িকে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন মুসাররাত হোসেন। ওর ঘুমভাঙা কণ্ঠস্বর একটু মোটা। চুল আঁচড়ে নিয়েছে। তবু অনেকটা চূর্ণ চূর্ণ চুল চোখে-মুখে এসে পড়ছে। ঘুমে ফোলা মুখ-চোখ মুসাররাতকে মুগ্ধ করল আরেকবার।
পাপড়ি চেঁচিয়ে উঠল—এই দ্যাখো, দ্যাখো! ওর চেয়ারের উল্টো দিকে আবদ্ধ চেয়ারে বসে ছিলেন মুসাররাত।—দ্যাখো, দ্যাখো, সূর্য উঠছে!
পূর্বাকাশে সূর্যোদয়। চেয়ারটা তো নড়ানো যাবে না। পাপড়ির চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ালেন মুসাররাত।
সত্যি অবিস্মরণ দৃশ্য। পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠছে। নদীতেও লাল আভা। সূর্য দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। কিন্তু ঠিক নদীর পাশে বনজঙ্গল না কি? অনেকটা জায়গা কালো। নদীর পানিও কালচে। এদিকে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ আর নদীর পানির রং পাল্টে যাচ্ছে। লাল। লালচে। হলুদ। হলুদাভ। লাল আর হলুদের আশ্চর্য মিশেল। অপরূপ। রঙে রঙে রঙিন আকাশ আর নদী। তারপর ক্রমশ আকাশ আর নদী দুই-ই শাদা হয়ে উঠতে লাগল।
পাপড়ির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন মুসাররাত হোসেন—তুমি এক সূর্যোদয় দেখছ, আমি আরেক সূর্যোদয় দেখলাম। বলতে বলতে ওর সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ফের। তাঁর চোখে মুগ্ধতা। তৃপ্তি।
হাসল শুধু পাপড়ি। বলল—দুটো আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। কাল রাতে আর আজ ভোরে।
কাল অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছিল ওরা। বেশ রাতে ওরা ডেকে গিয়ে দুটো চেয়ারে বসেছিল। মাঝরাতের হু হু বাতাস যেন ওদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে কোন অনন্তে। লঞ্চ বোধহয় তখন অকূল মেঘনা নদীতে। ওদের লঞ্চ থেকে মাঝে মাঝে সার্চলাইট জ্বলে উঠছিল। যত দূর দেখা যায়, বিস্তীর্ণ জলরাশি। উল্টো দিক থেকেও জলযান আসছে যখন সার্চলাইটের আলো ফেলছিল। এদিক-ওদিক দু-চারটে ছেলে বসে গল্প করছিল। ভিড় ছিল না। ওদের দু-জোড়া চোখে বিস্ময়।
বেলা সাতটার দিকে সেলফোন থেকে ফোন করলেন মুসাররাত। এত সকালে ফোন ধরবে কি না ভাবনা ছিল তাঁর। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল।
—হেনরী, আমি মুসাররাত। মুসাররাত হোসেন।
—একি, মুসাররাত ভাই, আপনি এত সকালে?
—হ্যাঁ, বরিশালে এসেছি। আপনি একটু আসবেন লঞ্চঘাটে? আমি—আমরা এসেছি।
—ঠিক আছে, আমি আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল হেনরী স্বপন।
পাপড়ির দিকে তাকাল কি তাকাল না।
ওদের একটা গেস্টহাউসে পৌঁছে দিয়ে গেল হেনরী। যাবার সময় বলল—আমি সাড়ে নটায় আসব। এসে কাছেই আপনাদের নাশতা খেতে নিয়ে যাব।
কী যে খুশি পাপড়ি এ রকম একটি ঘর দেখে!
স্নান করে প্রস্তুত হয়ে ওরা গল্প করছিল। হেনরী স্বপন এসে গেল। তারপর ওদের নিয়ে গেল নাশতার জন্যে। কাছেই একটা চমত্কার হোটেল।
নাশতা সম্পন্ন করে সর-পড়া একটু দুধ-পোড়া চমত্কার সুস্বাদ চা খেতে খেতে মুসাররাত হোসেন বলছিলেন—হেনরী, আমরা এখানেই থেকে যেতে চাই। দুটো ঘরের একটা বাড়ি যদি খুঁজে দেন, খুব ভালো হয়। যথাসম্ভব কম টাকায়। একতলা বা দোতলা যা-ই হোক। শহরের মধ্যে যদি না হয়, শহরতলিতে হলেও চলবে। একটু নির্জন হলে খারাপ লাগবে না আমার।
হেনরী বলল—মুসাররাত ভাই, কোনো অসুবিধে নেই। একটু সময় দিন আমাকে। কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ি খুঁজে দিচ্ছি আপনাদের। সে কদিন না হয়, আপনারা ওখানেই থাকুন।
উত্সুক চোখে হেনরীর দিকে তাকিয়ে ছিল পাপড়ি। তার কথা শুনে পাপড়ির মুখ গভীর পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠল।
আবদুল মান্নান সৈয়দ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৬, ২০০৯
Leave a Reply