নিউইয়র্ক-প্রবাসী মননশীল লেখক হাসান ফেরদৌসের নির্বাচিত প্রবন্ধ বইটি নিয়ে স্বল্প পরিসরে আলোচনায় উদ্যোগী হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেন হবে না সেটা ব্যাখ্যা করে লিখতেও যে জায়গা দরকার তা এই পাতায় আমার জন্য বরাদ্দ নেই। তাই, বইটি সম্পর্কে বরং একটি খবর রচনা করা যাক, সে-খবর কোনো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, এবং তার ফলে বইটি সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল জাগলে, তিনি বইটি সংগ্রহ করে নিজেই পড়ে দেখতে পারেন। আপাতত এর চেয়ে দরকারি কথা আর খুঁজে পাচ্ছি না।
নির্বাচিত প্রবন্ধ নামের এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, একুশের বইমেলায়। এতে আছে মোট ১৯টি প্রবন্ধ, যেগুলো লেখা হয়েছে প্রায় এক দশক ধরে। বইটি শুরু হয়েছে শেখ সাদীর বিশ্বখ্যাত ক্লাসিক গ্রন্থ গুলিস্তাঁ দিয়ে। হাসানের ভাষ্য থেকে শেখ সাদী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা থেকে খুবই ভিন্ন খবর পাওয়া যায়। দরবেশ ও দার্শনিক শেখ সাদীর মধ্যে দেখা মেলে এক ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষের, যে কিনা পুরুষের প্রেমে পড়ে। হাসান জানিয়েছেন, তিনি বইটি পড়েছেন ইংরেজি অনুবাদে, মূল ফারসিতে নয়। অবশ্য সাদীর দৈহিক প্রেমের ধারণাটিকে কোনো কোনো ফারসি সাহিত্যবিশারদ ভাগবত্ প্রেম বলে ব্যাখ্যা করেছেন—এমন তথ্য জানাতেও হাসান কার্পণ্য করেননি। সম্রাট বাবরের আত্মজীবনী বাবুরনামার আলোচনায় দেখা গেল এই মোগল সম্রাট জীবনে কখনো নারীর প্রেমে পড়েননি, কাতর হয়েছিলেন এক বালকের প্রেমে। আর তিনি ছিলেন এক গভীর সুরাপায়ী, সুরাপান ভালো নয়—এ সত্য বিলক্ষণ জেনেও তিনি সুরা পান করতেন প্রচুর পরিমাণে। অবশ্য এই ব্যাপারে আত্মনিয়ন্ত্রণের নিরন্তর প্রয়াসের একপর্যায়ে তিনি সুরাপান ছাড়তে পেরেছিলেন। সুগভীর পর্যবেক্ষণতার অধিকারী, প্রখর স্মৃতিধর সম্রাট বাবর সম্রাট বা রাজনীতিক হিসেবে কেমন ছিলেন তার চেয়ে বেশি জায়গা ও গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর লেখার ক্ষমতা কেমন ছিল এবং সেই লেখার মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের যে-মানুষটির ছবি ফুটে ওঠে তার স্বরূপ কী ছিল। ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর দি স্পাইরাল স্টেয়ারকেস বইটি নিয়ে আলোচনায় (ধর্ম ও ইতিহাস) এসে হাসান ফেরদৌস সমসাময়িক কালের সবচেয়ে উত্তপ্ত বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। ইসলাম ধর্ম ও সে-ধর্মকে ভিত্তি করে যে-রাজনীতি বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছে, এই প্রবন্ধের বিষয় তাই। এখানে ক্যারেনের অভিমত পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর আনুষ্ঠানিক মতের কাছাকাছি বলে মনে হয়; এবং হাসান ফেরদৌস সে-মত পড়ে বিস্মিত হয়েছেন এবং নিজের দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। পরের প্রবন্ধ ‘ধর্ম, মৌলবাদ ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা’য় আলোচনার সূত্র আলী রিয়াজের বই গড উইলিং। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহ্যাটনে অরুন্ধতী রায়ের বক্তৃতা শোনার সুবাদে হাসান ফেরদৌস রাষ্ট্রশক্তির হাতে নাগরিকের মুক্তি ও স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘এ স্টেট অব ইমারজেন্সি’ শিরোনামের প্রবন্ধটিতে। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নিরাপত্তার নামে যে দমনমূলক পরিবেশের সৃষ্টি করে সে-দেশের সরকার, তারই সূত্র ধরে হাসান ফেরদৌস সোভিয়েত ইউনিয়নের পুলিশ-রাষ্ট্রের স্বভাব নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। এই প্রবন্ধে দেশকাল নির্বিশেষে আরবিট্রারি স্টেট পাওয়ার সম্পর্কে হাসানের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে, যা মুক্ত নাগরিক সমাজের সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির সহগামী। টোটালিটারিয়ান বা সর্বময় রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হাসান এখানে জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোর এবং তার পূর্বসূরি, বিশ্বসাহিত্যের প্রথম অ্যান্টি ইউটোপিয়ান নভেল ইভগেনি জামিয়াতিনের উই উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনেছেন খুবই জুতসইভাবে। অরুন্ধতী রায়ের মতো মুক্তচিন্তার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্রাজ্য নামক ক্লিশে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এই আপাতদৃশ্যের গভীরে আছে সব ধরনের টোটালিটারিয়ান পাওয়ারকে চ্যালেঞ্জ করার প্রত্যয়। নাইন ইলেভেনের পরে জর্জ বুশের আমেরিকায় প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টসহ নানা ধরনের কালাকানুন ও গোয়েন্দা-পুলিশি জবরদস্তি-নিবর্তনমূলক তত্পরতার প্রেক্ষাপটে সেই সংগ্রাম অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে ওঠে। অতি শক্তিমান ও সুন্দর কথাশিল্পী, নোবেল-বিজয়ী ঔপন্যাসিক সূর্যপ্রসাদ নাইপলের (ভিএস নাইপল) ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষত ইসলাম ধর্ম বিষয়ে তাঁর মতামত নিয়ে হাসান আলোচনা করেছেন ‘নাইপলের পাকিস্তান’ শীর্ষক প্রবন্ধে। এ আলোচনার সূত্র নাইপলের ননফিকশান বই বিয়ন্ড বিলিফ; এখানে ইসলাম আলোচিত হয়ে ভারতবর্ষের, বিশেষত পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে: সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানকে এক ট্র্যাজেডি বলে বর্ণনা করেছেন হাসান ফেরদৌস, ভিএস নাইপলের কথার সূত্র ধরে।
জায়গার অভাবে বাকি প্রবন্ধগুলো নিয়ে কিছু লেখার উপায় আর নেই। পাঠক যাতে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন, সে-জন্য অন্যগুলোর শিরোনাম উল্লেখ করা যাক: ভিন্নচোখে মেঘনাদবধ কাব্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত, গণতন্ত্র ও সংখ্যালঘুর অধিকার, সোভিয়েত ইউনিয়ন: দুটি ভাষ্য (লেখককে ধন্যবাদ না বলে উপায় নেই: এই প্রবন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন মিখাইল গর্বাচভের অটোবায়োগ্রাফি ও আমার লেখা উপন্যাস তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত-এর সূত্র ধরে); সালমান রুশদির শালিমার দি ক্লাউন, অমিতাভ ঘোষের ভাটি দেশ (হাংরি টাইড), জিন্দাবাহার লেন, দিনযাপনের ভূগোলে রবীন্দ্রনাথ, বিল ক্লিনটনের জীবন, ইবসেন (আলী আনোয়ার রচিত ইবসেন-জীবনী) ও মিরজাফরের নাতি (হুমায়ুন মির্জার লেখা ফ্রম পলাশি টু পাকিস্তান গ্রন্থের সূত্রে)।
নির্বাচিত প্রবন্ধ এমন একটি বই যার বিষয়বস্তু কেবলই বই। আবার, এটি কোনো বুক রিভিউয়ের সংকলন নয়। প্রথমত লেখাগুলোর দৈর্ঘ্য, দ্বিতীয়ত আলোচনার বিশ্লেষণী ভঙ্গি ও আনুষঙ্গিক তথ্যের ব্যাপক সমাবেশ, আলোচ্য বিষয়বস্তুর বিস্তার। ২৩৮ পৃষ্ঠাজুড়ে মোট ১৯টি লেখা। আবার প্রবন্ধ বলতে সাধারণভাবে যে নৈর্ব্যক্তিক গুরুগম্ভীর, প্রায়-রসকষহীন, তথ্য-পরিসংখ্যানবহুল, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভরপুর লেখাকে বোঝানো হয়, এই বইটির লেখাগুলোর ভাষা-ভঙ্গি ও মেজাজ সে রকম নয়। প্রতিটি লেখায় লেখক ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর নিয়ে হাজির; সে-কণ্ঠস্বর যেন শোনা যায়, যেন লিখছেন না, কথা বলছেন পাঠকের সঙ্গে। ফলে পাঠক সাড়া না-দিয়ে পারেন না, বরং তাঁরও ইচ্ছে করে লেখকের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে, প্রশ্ন করতে, কখনো-বা তর্ক করতে।
আলোচ্য বইটি পড়ার প্রতিক্রিয়াই বটে; কিন্তু সে-প্রতিক্রিয়ার ফলে লেখক কেবল সে-বইটির বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। বইটির লেখক, তাঁর সম্বন্ধে অন্যদের লেখালেখি, এবং তাঁর আলোচিত বিষয় বা প্রসঙ্গগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত আরও অনেক বইপত্রও ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন হাসান ফেরদৌস; এবং সেসব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন, নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। কখনো-বা লেখকের সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছেন, কখনো সেই লেখকের অন্য বইগুলোর কথাও বলেছেন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অন্যান্য বইয়ের কথাও টেনে এনেছেন। যেমন, সালমান রুশদির শালিমার দি ক্লাউন ও অমিতাভ ঘোষের হাংরি টাইড নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ দুই লেখককে দেখার ও তাঁদের কথা শোনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, টেনে এনেছেন তাঁদের লেখা আগের কোনো বইয়ের প্রসঙ্গও। শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম, রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় ও প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন তাঁর পড়া ও আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া বইগুলোর সুবাদে। সে-কারণেই দেখি, কখনো কখনো একটি লেখা যে একটি মাত্র বই নিয়েই, তা নয়। নির্বাচিত্র প্রবন্ধ বইটিকে যদিও প্রথমেই ‘বই নিয়ে বই’ বলে বর্ণনা করতে চেয়েছি, প্রকৃতপক্ষে মনে হয়, হাসানের লক্ষ্য এসব বইয়ের পরিচিতি দেওয়া বা মূল্যায়ন করা নয়, বরং এসব বইয়ের বিষয়বস্তুগুলোর সূত্র ধরে সমসাময়িক কালের চিন্তাজগতে ক্রিয়াশীল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রসঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করা। তাঁর লেখার কথ্য ভঙ্গি থেকে অন্তত সেটাই মনে হয়।
নির্বাচিত প্রবন্ধ: ‘গুলিস্তাঁ’ থেকে ‘মিরজাফরের নাতি’—হাসান ফেরদৌস; সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৮
মশিউল আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৬, ২০০৯
Leave a Reply