হাওর জনপদের গীতরঙ্গ অন্তরঙ্গ আলোয় \ কামালউদ্দিন কবির \ জুন-২০০৭ \ আইইডি \ প্রচ্ছদ: শাহীনুর রহমান \ ২০৮ পৃষ্ঠা \ ২০০ টাকা।
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির পাদপীঠে শুধু লেখ্যরূপে নয়, মৌখিক রূপেও সাহিত্য তার আলো ফেলে গেছে। বস্তুত মৌখিক রীতির ভেতর জনসংস্কৃতির যে উত্তাপ, তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের স্পন্দন ও আকাঙ্ক্ষা। আর এই স্পন্দন-আকাঙ্ক্ষাকে কথা, সুর ও হাবভাবে যাঁরা ফুটিয়ে তোলেন, তাঁদের সম্পর্কে গ্রন্থ বা লেখাপত্র এ দেশে প্রকাশিত হয়নি তেমনভাবে। জনতার নন্দন-রুচি এবং অনুভবগুলো যাঁরা নির্বিকারভাবে প্রস্ফুটিত করে চলেছেন, সামাজিক বাস্তবতায় তাঁদের শিল্পজীবনের ইতিহাস সম্পর্কে কতটা জানি আমরা? প্রশ্নটি বৃহত্ হয়ে উঠল কামালউদ্দিন কবির প্রণীত হাওর জনপদের গীতিরঙ্গ অন্তরঙ্গ আলোয় বইটি পড়তে পড়তে। পাশাপাশি মনে উঁকি দিল ‘মালীর যোগান’ প্রবন্ধে চন্দ্রকুমার দের শেষ কথাটি: ‘এই মালী তাহার কর্তব্য কার্য শেষ করিয়া যোগদান দিয়া বিদায় মাগিতেছে। সৌন্দর্য বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞের কাছে; মালীর ইহার অধিক বলিবার কিছুই নাই।’ জননন্দন রুচি যাঁরা আসরে আসরে মূর্ত করে তোলেন, সেই কিসসা-কথন বা গীতিকা পালার কবি-গায়েন-দোহারদের চন্দ্রকুমার সেকালে বলেছিলেন মালী। আর একালে কামালউদ্দিন কবির সেসব মালীর সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে রচনা করলেন তাঁদের শিল্পীজীবনের খেরোখাতা—আস্ত একটি গ্রন্থ।
প্রথমেই বলে রাখি, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাপেক্ষে এটি একটি জরুরি গ্রন্থ। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ, বৃহত্তর সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জলে ভাসা হাওর জনপদের প্রায় ৪০টি থানায় মাঠপর্যায়ের সমীক্ষার মাধ্যমে গ্রন্থটি বর্তমান আকার পেয়েছে। লেখক এখানে ‘গীতরঙ্গ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন আমাদের পরিবেশনামূলক নাট্যিক ক্রিয়ার সমার্থক শব্দরূপে। তাঁর ভাষ্যে ‘এই শব্দটি দিয়ে যেন একসঙ্গে ধরা গেল হাওর জনপদের যত সব গীত-বাদ্য-নৃত্য-অভিনয়, কবিগান-জারিগান, ধামাইল গান, কলতাঝাড়ার পদ্মার গান, ডরাই পূজার সুরমা গান ইত্যাদি স্থানীয় সংস্কৃতির নানা উপাদানকে’। এই গ্রন্থে লেখকের পক্ষপাতও স্থানীয় সংস্কৃতির অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা পরিবেশযোগ্য উপাদানগুলোর প্রতি। এর সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করা চলে যে এই স্থানিক উপাদান তথা গীতিরঙ্গগুলোর বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ গায়েন-দোহারদের হালফিল অবস্থা—সব মিলিয়ে হাওর অঞ্চলের বিস্তৃত সংস্কৃতির প্রামাণ্য ধারাভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা রয়েছে।
এই কাজে কবির গ্রহণ করেছেন সাক্ষাত্কারপদ্ধতি। ‘অন্তরঙ্গ বয়ান’ শিরোনামে বিভিন্ন শিল্প আঙ্গিক পরিবেশনকারী শিল্পীদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেছেন তিনি। কবিয়াল মদন সরকার, বিভা চক্রবর্তী, আব্দুল হেলিম বয়াতি, বিনোদ চন্দ্র সরকার, আলালউদ্দিন ফকির থেকে শুরু করে তরুণতম জোছনা বাউল, আবুল বাশার তালুকদার, আবদুস সালাম সরকারসহ বিভিন্নজনের সাক্ষাত্কার পর্বগুলো আবার প্রচলিত পদ্ধতিতে গৃহীত হয়নি, গৃহীত হয়েছে প্রতিবেদনের মতো করে। এখানে প্রথমত শিল্পী সম্পর্কে বিবরণ আছে, আছে অবিকৃত কথ্যরীতিতে ওই শিল্পীর নিজস্ব কথাভাষ্য, শিল্প-আঙ্গিকের বিবরণ, পরিবেশনপদ্ধতি, পূর্বাপরসহ ওই শিল্পমাধ্যমটির বর্তমান আকার-গড়ন। কথোপকথনের কৌশলটি এমন যে পুরো বিষয়ের মধ্যে এক ধরনের ফিচারের স্পর্শ ও বর্ণনাত্মক আবহ খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া উপরি পাওনা হিসেবে প্রতিবেদনের স্থানে স্থানে কবিগান, জারিগান, রামমঙ্গল প্রভৃতির অংশবিশেষ জুড়ে দেওয়ার ফলে এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। পাঠক যেন পড়ামাত্রই কোনো একটি শিল্প-আঙ্গিক সম্বন্ধে নির্দিষ্ট মাত্রায় ধারণা পায়, সে ব্যবস্থা একেবারে পাকা। তবে এখানে শুধু ধারণাই মিলবে। এটিকে যদি হাওর জনপদের গীতরঙ্গ অন্তরঙ্গ আলোয় গ্রন্থের দুর্বলতা ধরি; তাহলে সফলতা হলো, বইটি স্থানীয় সংস্কৃতির বিচিত্রমুখী উপাদান-আঙ্গিক ও বিষয় সম্পর্কে পাঠকমনে বিশদভাবে জানার আগ্রহ তৈরি করতে পারে।
একটি দেশের পুঁজিনির্ভর সমাজব্যবস্থার বাতারণের মধ্যে একজন শিল্পীর পরিচয় ও অবস্থান, পুঁজিবাজার ও পণ্য বিকোবার দ্বৈরথে তাঁর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা বা খোয়ানোর মানসিকতা—নানাভাবেই হাওরাঞ্চলের গীতল সমাজকাঠামোর রূপ-রূপান্তরের পরিচয় মিলেছে বইটির মাধ্যমে। আর প্রথমেই যে বলা হলো, এটি একটি জরুরি গ্রন্থ, সেটা এ কারণে যে জনসংস্কৃতির নানা ধারার পরিচয় এখানে মোটামুটিভাবে লভ্য। এটি গবেষণাগ্রন্থ নয়, সমীক্ষা গ্রন্থ। কিন্তু ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে এটি হয়তো আকর হিসেবে প্রয়োজন মেটাতেও সক্ষম।
যদিও কামালউদ্দিন কবির গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে ‘অনুধ্যান’ অধ্যায় যোজনা করে স্থানীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াসে কিছু প্রস্তাব সংযুক্ত করেছেন। শুরু থেকেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ‘বিদেশি বিদ্যার বহর’ দিয়ে বোঝাপড়ার বিরুদ্ধে তাঁর মত। ফলে জনসংস্কৃতির পাদপীঠে দাঁড়িয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনিবার্যভাবেই প্রাচ্যীয় হয়ে ওঠে, প্রাচ্যের অভেদতত্ত্বের দিকেই যেতে চেয়েছে বারবার।
নির্লিপ্ত নয়ন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৬, ২০০৯
Leave a Reply