আমাদের কালের কথা—সৈয়দ মুর্তাজা আলী \ উত্স প্রকাশন ঢাকা সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ \ প্রচ্ছদ: আবুল হাসান আবু \ ২৯৬ পৃষ্ঠা \ ৩০০ টাকা
বাংলার একটা সনাতনী বিগ্রহ আছে। হাজার ভাবুকের তৈয়ার বলে তার আদ্যোপান্ত গড়ন পাওয়া মুশকিল, কিন্তু সে কল্পনা এমন বিরাট যে ভাঙা-আলোর ইশারা নিয়েও কাজ চলতে পারে। হঠাত্ মনে হবে বাংলা হয়ত হাজার বছরের একটা পোস্টকার্ড। সন্ধ্যাবেলা গাঁয়ের দশজনা জড়ো হচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপে, পাঁচ রকম কথা উঠছে। নদীতে নৌকা দুলছে পাল খাটিয়ে, গলুইয়ের মধ্যে রেড়ীর প্রদীপ নিবু নিবু। উঠোন ঝাঁট দিয়ে সকলে গাজীর গীত শুনতে বসল, রাতের মধ্যে আর ওঠাউঠি নেই। ছেলেবুড়ো খেলা করছে—গুড়গুড়া খেলা। আর নেমন্তন্ন তো আছেই, সেখানে শনি-মঙ্গলের বাছ-বিচার দরকার হয় না।
এখানে যদি রাশ টানা যায় তবে পুরাণকার আমোদ পাবেন। কিন্তু সৈয়দ সিকন্দর আলী এই পৌরাণিক ছবিটার ওপরে ব্রাশ টেনে ইতিহাস করে দিলেন। বেশ তো হচ্ছিল বাউলা গান ঘাটু গান, কিন্তু কয়েক পোছ রং লাগতেই চা এল। লোকে খুব করে চা খাচ্ছে, তবু তিয়াস মিটছে না। আর দরকারের নতুন নতুন ফর্দ—বেলা বুঝতে জলঘড়ি লাগছে, তামুক জ্বালতে হবে তো দেশলাই আনো, আর পায়ের তলায় একজোড়া জুতো থাকবে না?
একটা ফটোগ্রাফ যেন নড়ে উঠল, তার মধ্যে ফিরিঙ্গি-প্রত্যুষার ঢেউ উঠল। সিকন্দর আলী উনিশ শতকের লোক, বাংলার সনাতনী বিগ্রহে ফিরিঙ্গি কামিজ যখন উঠছে সিকন্দর তখন বালকমাত্র। ওই বালকের চোখ দিয়েই আমাদের সেই আদি ও আসল রঙ্গিলা বাংলাকে বুঝতে হবে। ইতিহাসের রসদ ওই বালকের সুতো বেয়ে উঠে এসেছে।
আমাদের কালের কথা স্মৃতিকথার লেখক সৈয়দ মুর্তাজা আলী এই বালকের পুত্র। তাঁর শোকর আদায় করি, কারণ তিনি বুদ্ধি করে নিজের স্মৃতিকথার মধ্যে বাবার ডায়েরি ভেজাল দিয়েছেন। তাতে করে বাংলার আরও কাঁচা বয়সের ছবি পাওয়া গেল। এখন বদলটা মিলিয়ে আনতে সুবিধা হবে।
মুর্তাজা আলী আলাপ যখন শুরু করেছেন তখন তিনি নতুন ইন্দ্রিয়ের দমে শুঁকে দেখছেন শ্রীহট্টের গ্রাম, আর বুড়ো বয়সে রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি পর্যন্ত পৌঁছালেন। সামান্য আমলার মামলা হলে এত কথার দরকার হতো না। কিন্তু ওই পথের বয়ান লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন একটা ইতিহাস, আর সে ইতিহাসের রূপগরিমা এমন যে উপমা ছাড়া ভেঙে বলা যাচ্ছে না। পাঠের অভিজ্ঞতাটা এ রকম—যেন সিলেটের এক অজপাড়াগাঁ থেকে ট্রেন ছাড়ল, তারপর জাদুর মতোন, সে গ্রাম পেরোল, মাঠ-প্রান্তর পার হলো, ঢুকতে লাগল শহরে, ক্ষুদ্র শহরতলী থেকে জমজমাট নগর; আর প্রজাপতির মতো রং ধাঁধাচ্ছে, সময় যেন চরকির মতো ঘুরছে, তারপর বেলা পড়লে ট্রেন গিয়ে থামল একটা জটিল ব্যাধিগ্রস্ত শহরে। এককালে বাঙালি-বাবুরা ট্রেনকে জাতি-গরবিনী হয়ে বলতেন ‘বাষ্পীয় রথ’, মুর্তাজা যেন সে রকম কোনো অলৌকিক রথে তুলে দিলেন আমাদের।
এসব সুখ্যাতি শুনলে অনুমান হয় লেখকের হয়তো খুব সাহিত্য প্রতিভা আছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর সেটা নেই। কথক ঠাকুর যেমন গল্পের জাল টেনে টেনে একটা নিখুঁত ফাঁদ বানিয়ে তোলেন তেমন ষড়যন্ত্রের আভাস বইতে পাওয়া যাচ্ছে না বরং যে বেখেয়ালি সুর আমরা বয়সের দোষ বলে ক্ষমা করি তাকেই বইয়ের রাস্তায় হরদম দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রসঙ্গগুলো যেন সুতো-ছেঁড়া পুঁতির মতো ঝুরঝুর করে নামছে, মহাযুদ্ধ দাঙ্গা ইশকুল সাহিত্য চাকরি রবীন্দ্রনাথ বা রাধারমণ—এ রকম বেশুমার কাসুন্দি বা হয়তো একঘেয়ে আলাপ। এসব দোষ আছে, তবু এই বই অমূল্য হতে বাধা নেই। কারণ মুর্তাজা আলীর শিরার মধ্যে সময়ের হাওয়া ঢুকে পড়েছে। এই আশ্চর্য বলে ইতিহাসের পটে তিনি যা খুশি আঁকেন সেটাই ছবি হয়ে যায়।
বাঙালি মুসলমানের দুঃখের বাগান প্রায় চা বাগানের সমান বড়। ঐতিহ্যে আমাদের লোভ আছে, কিন্তু আমাদের বংশলতিকা মেলে না, যদিও মেলে তার বারো আনাই হয়তো নকল। আম-মুসলমানের তাই ইতিহাসও হয় না। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস বাদ দিলে মুসলমানের ঘরের কথা জানার দ্বিতীয় দুয়ার খোলা নেই। একালের ঐতিহাসিকদের তাই স্মৃতির ওপর বড্ড নির্ভর। এই চোঙ্গা দিয়ে দেখলে আমাদের কালের কথা বইটার একটা উপরি-দাম মিলবে।
কর্মজীবনে মুর্তাজা আলী কিছুদিন হাকিম ছিলেন। তখনকার স্মৃতি লিখতে গিয়ে তিনি আদালতের অনেক ঘরের সন্দেশ বার করেছেন, তাতে পাঠকের রসনা তৃপ্ত হবে। বাংলা আর সিলেটের আত্মীয়তা নিয়ে কথা উঠেছে কয়েকবার। প্রমিত বাংলার সঙ্গে সিলেটি ভাষার প্রায় বিদেশি ভাষার সমান দূরত্ব ছিল, এককালে বাঙালি বাবুরা সেখানে গিয়ে না পড়লে সে দূরত্ব ঘোঁচানো সম্ভব হতো না। বাংলা ভাষার স্বভাব ও বৈচিত্র্য ঠিকভাবে বুঝে নিতে হলে এসব কথা বোধহয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
বইয়ের শুরুর দিকে সৈয়দ মুর্তাজা আলী বিনয়ের সঙ্গে লিখেছেন আত্মজীবনী লেখার বিপদের কথা। অহংকারের ফেরে পড়ে অনেকে ভুল করে আত্মরতিমূলক গপ্পো ফেঁদে বসেন, এই দোষে নাকি নবীনচন্দ্র সেনের আত্মজীবনী পণ্ড হয়ে গেছে, তিনি সেই ভুল থেকে পানাহ চেয়েছেন। এই চেষ্টায় লেখক ষোলআনা জিতে রইলেন, কারণ তাঁর চোখে শুধুই ইতিহাসের ক্ষুধা লেগে আছে, আত্মরতির ঘোর তাঁকে মুহূর্তের অবকাশেও জব্দ করতে পারেনি।
তৈমুর রেজা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৬, ২০০৯
Leave a Reply