কুয়াশা ৭৪ (ভলিউম ২৫) / প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৭৭
০১.
সকাল আটটার সময় পঁচিশ নম্বর চক্রবর্তী লেনের গেটের কড়া নড়ে উঠল। মিনিট খানেক পর গেট খুলল একটি যুবতী। বলল, কাকে চান?
শহীদ বলল, আপনি কি মিস তসলিমা?
যুবতী বলল, আমি আতিয়া। তসলিমা আমার ছোট বোন। সে এইমাত্র অফিসে চলে গেল। কি দরকার আপনার তার সাথে?
প্রশ্ন করে আপাদমস্তক কম্বল জড়ানো ডি. কস্টার দিকে তাকাল আতিয়া।
দাঁত বের করে হাসল ডি. কস্টা। আতিয়ার চোখের দৃষ্টি কঠোর হলো একটু।
শহীদ বলল, আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। শামিম কবির নামে এক যুবক সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। শামিম সাহেব সম্ভবত আপনার বোনের সাথে এ বাড়িতে এসেছিলেন গতকাল রাতে।
আতিয়ার মুখ শুকিয়ে গেল নিমেষে, লক্ষ করল শহীদ।
শামিম আমাদের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। তসলিমার সাথে ওর দেখা হয়েছিল কোন ক্লাবে। শামিমকে তসলিমা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল ঠিক, কিন্তু সে তো খানিকপর বিদায় নিয়ে ফিরে গেছে নারায়ণগঞ্জে।
কটার সময় বিদায় নিয়েছিলেন?
নটা সাড়ে নটা হবে। কিন্তু তার সম্পর্কে এতকথা কেন জানতে চাইছেন আপনি?
শহীদ বলল, আমাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর সব কথা বলা যায় না।
ইতস্তত করতে লাগল আতিয়া। অবশেষে সে বলল, আসুন। মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন কিনা, ঘর-দোর অগোছাল হয়ে, আছে।
গেট অতিক্রম করে বাগানের মধ্যে দিয়ে হলঘরে ঢুকল শহীদ, ওর পিছু পিছু ডি. কস্টা।
হলঘরে পা দিয়েই একটা সোফা দৃষ্টি আকর্ষণ করল শহীদের। সোফার উপর একটা কম্বল অযত্নের সাথে ফেলে রাখা হয়েছে, একটা বালিশও রয়েছে তার সাথে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল শহীদ বালিশটার দিকে। সোফায় যে কেউ রাতে শুয়েছিল, বুঝতে পারল ও। মাথা রাখার ফলে গর্ত হয়ে গেছে বালিশের মাঝখানে।
অন্য একটি সোফায় বসল শহীদ। ডি. কস্টা আগেই বসে পড়েছে একটি চেয়ারে।
বলুন, কি জানতে চান? আতিয়া একটা দেয়াল-আলমারির কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
শহীদ আতিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল, শামিম কবির গত রাতে খুন হয়েছেন। আমি এসেছি ব্যক্তিগত ভাবে তদন্ত করতে।
কি! কি বললেন? আঁতকে ওঠার ভান করল আতিয়া।
খুন যে হয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ছোরা মেরে খুন করা হয়েছে তাঁকে। এই গলির শেষে যে মাঠ, সেই মাঠের ধারে ফেলে রাখা হয়েছে লাশটা।
এ আপনি কি বলছেন? আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না। কে খুন করল শামিমকে?
খুন যেই করুক, ধরা সে ঠিকই পড়বে সময় মত। গতকাল রাতে আপনার বোনের সাথে শামিম সাহেবকে দেখা গেছে, তাই ভাবলাম আনাদের সাথে দেখা করলে অনেক তথ্য পাব। বিদায় নিয়ে যখন তিনি চলে যান, সাথে কি কেউ গিয়েছিল তার?
না তো! শামিম একাই যায়।
শহীদ পাইপ এবং এরিনমোরের কৌটা বের করল। নিস্তব্ধতা নামল হলঘরে। পাইপে টোবাকো ভরতে ভরতে প্রশ্ন করল ও, তার কোন শত্রু ছিল কিনা বলতে পারেন আপনি?
শামিমের শত্রু? অসম্ভব বলে মনে হয়। খুবই ভাল ছেলে ছিল সে.:.তবে, কতটুকুই বা জানতাম আমরা তার সম্পর্কে। শত্রু থাকলেও, আমরা ঠিক বলতে পারব না।
তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে, অনুমান করে কোন ধারণা দিতে পারবেন না, তাই না?
কি করে বলব বলুন? তবে, ওর কাছে বেশ কিছু টাকা ছিল। তসলিমার সাথে এই হলঘরে ঢুকে কি একটা কথার উত্তরে ও বলেছিল, হাউজী খেলতে গিয়ে আট হাজার টাকা জিতেছে। এমন হয়তো হতে পারে, গুণ্ডা বদমাশরা অনুসরণ করেছিল, এ-বাড়িতে ওকে ঢুকতে দেখে বাইরে অপেক্ষা করছিল তারা। বিদায় নিয়ে ও যখন আবার বের হয়, তারাও পিছু নেয় আবার। তারপর মাঠের কাছে যেতে আক্রমণ করে…।
শহীদ বলল, সেরকম কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না। গুণ্ডা-বদমাশ যদি পিছু নিত, এ বাড়িতে শামিম সাহেব ঢোকার আগেই তারা খুন করত তাঁকে। এটা যে শামিম সাহেবের বাড়ি নয়, তিনি আবার বাড়ি থেকে বেরুবেন–একথা তারা জানবে কেমন করে?
তাদের মধ্যে এমন কেউ হয়তো ছিল যে শামিমকে চিনত।
শহীদ বলল, আচ্ছা, শামিম সাহেব কি হেঁটে এসেছিলেন? নাকি সাথে গাড়ি ছিল?
গাড়ি নেই শামিমের।
শহীদ বলল, আপনি শামিম সাহেব সম্পর্কে যা যা জানেন বলুন দেখি ধীরে ধীরে। দেখবেন, কোন কথা যেন বাদ না পড়ে।
আতিয়া বলল, ওর সম্পর্কে আমরা কেউই বিশেষ কিছু জানি না। বাবার বহু দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলে, নারায়ণগঞ্জে চাকরি করে, ওখানেই থাকে। বাবা-মা-ভাই-বোন কেউ নেই। একটু চাপা স্বভাবের। মাথার ওপর গার্জেন কেউ নেই বলে আচার-ব্যবহারে বেশ একটু বেপরোয়া। আমাদের এ বাড়িতে খুবই কম যাতায়াত। গত তিনমাসে গতকালই প্রথম এসেছিল।
আতিয়া কথা বলছিল, শহীদ তাকিয়ে ছিল পাশের সোফার উপর ফেলে রাখা বালিশটার দিকে। এক সময় হাত বাড়িয়ে দুআঙুলের নখ দিয়ে লম্বা একটা চুল তুলে নিয়ে চোখের সামনে আনল ও।
চুলটা যারই হোক, তার মাথার চুল যে কোঁকড়ানো তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং এই চুলটা যার, মাঠের ধারে ফেলে রেখে আসা অস্টিনের ভিতর যে চুলটি পাওয়া গেছে সেটিও তার। অর্থাৎ দুটো চুলই একই মাথার।
শহীদ মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করল, এই হলঘরের সোফায় এ বাড়ির ছোট মেয়ে তসলিমা রাত কাটিয়েছে। একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগল ওর মনে, নিশ্চয়ই তসলিমার আলাদা কামরা আছে–সেখানে না শুয়ে হলঘরের সোফায় কেন সে শুয়েছিল?
তাহলে দেখতে হয় ছোট মেয়ের শোবার কামরাটা। শহীদ উৎসুক হয়ে উঠল মনে মনে। ঠিক সেই সময় জানালার দিকে নজর পড়তে ও দেখল বাগানের মধ্যে দিয়ে একজন লোক দ্রুত এগিয়ে আসছে হলঘরে ঢোকার দরজার দিকে।
লোকটার চেহারাটা যেন কেমন কেমন ঠেকল শহীদের। মুখ দেখে মনে হয় সজীব তারুণ্য বিদ্যমান তার মধ্যে, কিন্তু ভুরু এবং মাথার চুল মনে হয় পরিণত প্রৌঢ় মানুষের।
কড়া নড়ে উঠল দরজার। আতিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা বসুন, আমি দেখি কে আবার এল।
দরজা খুলে আতিয়া পাশের বাড়ির জাহাঙ্গীর হোসেনকে দেখল।
ও, আপনি, জাহাঙ্গীর ভাই।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলল, তসলিমা কোথায়, আতিয়া?
সে তো অফিসে চলে গেছে।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলল, তসলিমা এই সেন্টটা চেয়েছিল আমার কাছ থেকে। পাওয়া যায়নি এতদিন। দিতে পারিনি বলে খেপে আছে আমার ওপর। এক বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম, এই একটু আগে সে দিয়ে গেল। এটা রাখো, ও এলে দিয়ে ওকে।
আতিয়া বলল, তসলিমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। এ তো দেখছি খুবই দামী জিনিস, এত দামী জিনিসের জন্যে বায়না ধরলেই হলো!
আহা, তাতে কি! শখ হয়েছে, চাইবে নাইবা কেন! ওকে কিছু দিতে পারা সে তো আমার জন্যে আনন্দের ব্যাপার! আচ্ছা, যাই তাহলে, কেমন? ভাল কথা, গত রাতে সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল তো? ইস! গত রাতের মত কুয়াশা আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি।
সত্যি …।
আমি তো নাইট শোয়ে সিনেমা দেখে বাইরে বেরিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি-ঘোড়া কিছু পেলাম না। অগত্যা রাতটা কাটিয়ে দিতে হলো সিনেমা হলের চত্বরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে কথা বলছে আতিয়া, এই ফাঁকে শহীদ সোফা ত্যাগ করে তরতর করে উঠে গেল উপরতলায়।
সিঁড়ির মাথার কাছে যে কামরাটা, সেটা ভিতর থেকে বন্ধ দেখে শহীদ অনুমান করল, গৃহকত্রীর কামরা হবে এটা। তার পরেরটার দরজা খোলা। করিডর থেকেই কামরার ভিতরের টেবিল, টেবিলের উপর আতিয়ার বাঁধানো ছবি দেখা যাচ্ছে। এটার সামনে থেকে সরে তৃতীয় কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ।
দরজা ভেজানো। ঠেলা দিতেই খুলে গেল সেটা। নিঃশব্দে কামরার ভিতর ঢুকল শহীদ। এ কামরায় যে কোন মেয়ে থাকে তা আলনার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল ও। বিছানার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেল ও। কামরার অন্যান্য জিনিস অগোছাল অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু বিছানাটা একেবারে নিষ্ঠজ। কেউ যেন এ বিছানায় শোয়নি। পোড়া গন্ধটা নাকে ঢুকেছে, ঢোকার সাথে সাথে। কার্পেট পোড়া দেখে ভুরু কুঁচকে গেল ওর। এমন সময় নিচে থেকে হলঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দ ভেসে এল। শহীদ কামরা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল।
নিচে থেকে বিস্মিত আতিয়া বলে উঠল, ও কি! আপনি ওপরে কেন গেছেন?
আপনার বোনের কামরাটা দেখার জন্যে।
আতিয়া বিরক্তির সাথে জানতে চাইল, কেন?
শহীদ নিচে নামতে নামতে বলল, একটা ধাঁধার উত্তর পাচ্ছিলাম না। তাই কামরাটা দেখার দরকার ছিল। উত্তরটা পেয়ে গেছি কামরা দেখে।
আতিয়া বলল, কি বলতে চাইছেন আপনি?
আচ্ছা, কার্পেটটা পুড়ে অমন গর্ত হয়ে গেল কি করে, বলুন তো? পাল্টা প্রশ্ন করল শহীদ।
আতিয়া নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে বলল, গত হপ্তায় তসলিমা ওর সোয়েটার পরিষ্কার করছিল, অসতর্ক থাকায় এক শিশি পেট্রল ফেলে দেয়, তাতেই আগুন ধরে যায় হঠাৎ করে। আগুন নেভাবার আগেই অমন দামী কার্পেটটা পুড়ে গেল।
শহীদ হাসতে হাসতে বলে বসল, মিস আতিয়া, আপনি আসলে মিথ্যে কথা বলতে জানেন না। সুতরাং সে চেষ্টা না করাই ভাল।
মুহূর্তে ফণা তোলা নাগিনীর মত ফুঁসে উঠল আতিয়া, তার মানে?
মানে খুব সহজ। এক হপ্তা আগে কার্পেট যদি পুড়ত, পোড়ার গন্ধটা এখনও কামরার ভেতর থাকত না। তাছাড়া এক শিশি পেট্রল পড়ে গিয়ে আগুন ধরে যাওয়ায় যদি কার্পেটটা অতখানি পুড়তে পারে তাহলে পাশের শো কেসের পায়াগুলো অন্তত আগুনের শিখায় খানিকটা করে পুড়ত। কিন্তু পোড়া তো দূরের কথা, পালিশ পর্যন্ত যাকে তাই আছে, একেবারে নতুনের মত চকচকে। তাই বলছি, মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। আমার বিশ্বাস, আগুন দুর্ঘটনাবশত ধরেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরিয়ে কার্পেটটা পোড়ানো হয়েছে।
আপনি প্রলাপ বকছেন। দয়া করে বিদায় হোন, আপনার সাথে কথা বলতে রুচি হচ্ছে না আমার।
শহীদ সোফায় বসল, তারপর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বলল, যাব বৈকি, তবে প্রকৃত সত্য না জেনে যাই কি করে! মিস আতিয়া, আপনি হয়তো ভাবছেন আপনাদেরকে বিপদে ফেলার জন্যে আমি এখানে এসেছি। তা যদি ভেবে থাকেন, ভুল করছেন, আমি প্রকৃত সত্য জানার জন্যে এসেছি। আপনারা যদি কোনও ব্যাপারে কোন দোষ বা অপরাধ করে না থাকেন, চিন্তার কিছু নেই তাহলে। আমিই আপনাদেরকে আমার সাধ্যমত সাহায্য করব।
ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য আমাদের দরকার নেই।
শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করল, কিন্তু আমার ধারণা ঠিক উল্টো। সে যাক, আমার বিশ্বাসের কথা বলি এবার। মিস আতিয়া, আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে শামিম কবির আপনাদের এই বাড়িতে খুন হন। তাঁকে এ বাড়িতে খুন করে, তার লাশটা ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে এ পাড়ার দক্ষিণের মাঠে।
মিথ্যে কথা। প্রায় চিৎকার করে প্রতিবাদ করল আতিয়া।
শহীদ বলল, আপনার উত্তেজনাই প্রমাণ করছে আমি যা বলছি তা সত্যি। কি জানেন, অকাট্য প্রমাণ না পেয়ে আমি নিজের বিশ্বাসের কথা বলি না।
আতিয়া একটা চেয়ারে বসে পড়ল। বলল, আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন। শামিম আমাদের ভাই, তাকে কেন আমরা খুন করতে যাব?
টাকার জন্যে, সম্ভবত। গতকাল আপনার বাবা দশ হাজার টাকা হারিয়ে ফেলেছেন।
আতিয়া ঢোক গিলে বলল, তাও আপনি জানেন?
জানতাম না, খানিক আগে জানলাম। কে যেন এসেছিলেন দরজায়, তাকে আপনি কি একটা প্রশ্নের উত্তরে বলছিলেন।
আতিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই তসলিমাকে ভিতরে ঢুকতে দেখল।
তসলিমা, তুই এই অসময়ে ফিরে এলি…
আতিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তসলিমা বলল, চাকরিটা চলে গেল, আপা! গতকাল আমাদের বসের স্ত্রী আমাকে বলড্যান্স করতে দেখেছিল, সে স্বামীকে বাধ্য করেছে…।
হঠাৎ শহীদ এবং ডি. কস্টাকে দেখে চুপ করে গেল তসলিমা, তাকাল আতিয়ার দিকে, এরা কারা?
আতিয়া বলল, শামিম নাকি খুন হয়েছে, উনি বলছেন। আর শামিমকে নাকি টাকার লোভে আমরাই খুন করেছি।
এতটুকু অবাক হতে দেখল না শহীদ তসলিমাকে। মেয়েটি বরং ওকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, আপনি বুঝি গোয়েন্দা?
শহীদ বলল, আমার নাম শহীদ খান।
ধন্য হয়ে গেলাম। আপনার মত বিখ্যাত মানুষ আমাদের বাড়িতে আসবেন, এ ভাবা যায় না। আচ্ছা, কি চান আপনি বলুন?
সত্য জানতে চাই।
তসলিমা ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে কথা বলছিল। শহীদের কথা শুনে তার চেহারা বদলে গেল আমূল। হাসি হাসি ভাবটার জায়গায় গাম্ভীর্য ফুটে উঠল চেহারায়। এগিয়ে এসে বসল সে একটা চেয়ারে। বলল, সত্য জানতে চান, না? বেশ, মন দিয়ে শুনুন। শামিম গতরাতে জোর করে আমার কামরায় ঢুকেছিল, তাই রাগে উন্মাদ হয়ে তাকে আমি ছোরা দিয়ে আঘাত করি। মেরে ফেলার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু পরে আবিষ্কার করি, মরেই গেছে। তাই লোক দিয়ে লাশটা মাঠে ফেলে দেবার ব্যবস্থা করি। এখন বুঝতে পারছি, ভুলই হয়ে গেছে অন্য লোককে লাশ ফেলার দায়িত্ব দিয়ে। যাক, চলুন, থানায় যাই।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল শহীদ তসলিমা থামতেই। হাসি থামতে বলল, নাহ! বোনই দেখছি একরকম। মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলতে জানেন না।
তসলিমা রক্তচক্ষু মেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, তার মানে? আমার কথা বিশ্বাস করছেন না আপনি?
শহীদ বলল, করছি। এবং তার কারণও আছে। আপনি তো গতরাতে আপনার কামরায় শোনইনি। শামিম সাহেব যখন খুন হয় তখন সম্ভবত আপনি চক্রবর্তী লেনেই ছিলেন না। বাড়ি ফিরেছেন শামিম সাহেব নিহত হবার অ-নে-ক পরে। কুয়াশায় পথ ভাল দেখতে পাচ্ছিলেন না বলে গাড়িটা রেখে এসেছেন মাঠের ধারে। বাড়ি ফিরে হাতে দুএক ঘণ্টা যা সময় পান, ওই সোফায় শুয়ে কাটিয়ে দেন। বলুন, এসব কথা ঠিক কিনা?
তসলিমা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল শহীদের দিকে। খানিকপর অস্ফুট কণ্ঠে সে বলল, এ কি! আপনি দেখছি সবই জানেন! আতিয়ার দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকাল সে।
আতিয়া বলল, তুই চুপ করে থাক, তসলিমা।
তসলিমা বলল, আর চুপ করে থেকে কচু হবে। যা সত্যি বলে ফেললেই তো হয়। দেখা যাচ্ছে এ ভদ্রলোক নিজের পেশায় মাস্টার, আমরা না বললেও অনায়াসে সব জেনে নেবার ক্ষমতা রাখেন।
আতিয়া ধমকে উঠল, তসলিমা! চুপ করলি?
চুপ করে থাকলে কি লাভ হবে, আপা?
শহীদ বলল, হবে না। বরং আমি যদি সব কথা জানতে পারি, আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারব। অবশ্য, আপনারা যদি শামিম সাহেবকে খুন না করে থাকেন, তবেই।
আমরা খুন করিনি। আমরা জানিও না, কে খুন করেছে।
শহীদ নড়েচড়ে বসল, তাহলে বলুন সব খুলে।
তসলিমা বলল, আপনাকে যে বলব, প্রমাণ কি আপনি মি. শহীদ খান, প্রাইভেট ডিটেকটিভ?
শহীদ কোটের পকেট থেকে পরিচয় পত্র বের করে বাড়িয়ে ধরল। তসলিমা উঠে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করল সেটা, পড়ল। তারপর প্রশ্ন করল, আপনাকে সব কথা বলা মানে পুলিসকে বলা, তাই নয় কি?
তা নয়। পুলিসকে মাঝে মধ্যে আমি সাহায্য করি বটে, কিন্তু পুলিসের পদ্ধতির সাথে আমার পদ্ধতি কখনও মেলে না। পুলিস অপরাধীকে ধরে শাস্তি দেয়, আমি অপরাধীকে কেন অপরাধ করেছে, কোন্ বিশেষ সামাজিক অবস্থায় সে অপরাধ করেছে, সে যা করেছে তা অপরাধের সংজ্ঞা অনুযায়ী অপরাধের মধ্যে পড়ে কিনা বিশেষভাবে বিচার করে দেখি। সত্যানুসন্ধানী আমি। নিরপরাধকে সবরকম সাহায্য করি। এইখানেই প্রভেদ।
আতিয়া প্রশ্ন করল, এই ব্যাপার নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথার কারণ কি? আমরা গরীব মানুষ, আপনাকে তো ফী দিতে পারব না।
শহীদ বলল, আমি টাকা নিই না। গোয়েন্দা হয়েছি শখে।
তাহলে কেন…?
সত্য প্রকাশ পাক, এই চাই। শামিমকে খুন করল কে জানতে চাই।
আতিয়া বলল, কে খুন করেছে আমরা তা জানি না।
শহীদ বলল, সেক্ষেত্রে, একটা কথা বলি। আমার সঙ্গে এই যে মি. স্যানন ডি. কস্টা, ইনিও একজন ডিটেকটিভ। আমাকে সাহায্য করছেন এই কেসে। যে-কোন কারণেই হোক, ইনি আপনাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছিলেন গতরাতে। ইনি দুজন লোককে গভীর রাতে এ বাড়ি থেকে বেরুতে দেখেছেন। লোক দুজন একটা মৃতদেহ ধরাধরি করে নিয়ে গেছে মাঠের দিকে।
শেষ কথাটা অনুমান করে বলল শহীদ।
আতিয়া চুপ করে রইল, যেন বোবা হয়ে গেছে হঠাৎ করে। আর তসলিমা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। নিস্তব্ধতা ভাঙল সে-ই। আপনি যখন এত কথা জেনে ফেলেছেন, তখন আর বাকি কথা লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। শুনুন, সত্য প্রকাশ করছি। শামিমকে কে খুন করেছে, কেন খুন করেছে কিংবা ও আমার কামরায় কেন ঢুকেছিল–এসব আমরা কিছুই জানি না। খুনী কিভাবে ঢুকেছিল আর কিভাবেই বা বেরিয়ে গেছে, তাও একটা রহস্য হয়ে রয়েছে আমাদের কাছে।
কামরাগুলোর দরজা জানালা কি সব বন্ধ ছিল?
হ্যাঁ। শুধু এই হলঘরের, ওই আপনার সামনের জানালাটার শার্সি খোলা ছিল। ওটা আম্মা খোলা রেখেছিলেন, বন্ধ করতে ভুলে যাই আমরা। খুনী যদি বাইরে থেকে এসে থাকে, নিঃসন্দেহে তাই এসেছে তাহলে একমাত্র ওই খোলা জানালা দিয়েই সে এসেছে বলে মনে করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জানালার শার্সি ভেজানো ছিল, খুনী জানল কিভাবে ওটা খোলা আছে? তাছাড়া, গভীর রাতে জোরে দরজা বা জানালা খোলা বা বন্ধ করার একটা শব্দ হয়, সেই শব্দেই ঘুম ভেঙে যায় সকলের। তারপর আমার কামরায় আবিষ্কৃত হয় শামিমের লাশ। কিন্তু শব্দটার উৎস বা কারণ আমরা এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি।
শহীদ বলল, বাইরে থেকে খুনী এসেছিল এমন কোন প্রমাণ নেই। বাড়ির লোকদের মধ্যে কেউ…।
সবাই তাই ভাববে। আর সেইজন্যেই লাশটা আমরা বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই।
শহীদ বলল, কাজটা অন্যায় করেছেন। পুলিসকে বোকা বানাবার চেষ্টা করাটাও একটা অপরাধ।
আতিয়া বলল, তখন অত কথা ভাববার সময় ছিল না। তাছাড়া, তখন ফারুক সাহেবের প্রস্তাবটা একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব বলে মনে হয়েছিল আমাদের সকলের।
শহীদ প্রশ্ন করল, ফারুক সাহেব?
তিনি আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন বলতে পারেন। আমাকে পড়ান, চাকরিও করেন।
তিনিই তাহলে লাশ সরাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন?
হা। তিনি এ প্রস্তাব আমাদের সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে দিয়েছিলেন।
শহীদ প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইল, শামিম সাহেব শুয়েছিলেন। কোথায়?
এই হলঘরে, ওই সোফায়।
শহীদ বলল, ফারুক সাহেবের একটা ফটো চাই আমি দিতে পারেন?
আতিয়া বলল, নেবেন।
শহীদ খানিকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল। তারপর বলল, বাড়ির ভিতর বাহির ভাল করে দেখতে চাই আমি একবার, আপত্তি নেই তো?
দেখুন। তবে, আম্মাকে বিরক্ত করতে পারবেন না।
বেশ। ছাদে ওঠার কি ব্যবস্থা?
সিঁড়ি আছে।
দরজা আছে সিঁড়িতে?
না।
শহীদ উঠল। ডি. কস্টার দিকে তাকাতে হাসি পেল ওর। ডি কস্টা এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। তার কারণ এবার বুঝতে পারল শহীদ। সারারাত জেগে বেচারা কখন নিজের অজান্তেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রথমে দোতলায়, সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির ছাদে উঠে এল শহীদ। দুবোনও ওকে অনুসরণ করে ছাদে উঠল। নিজেদের মধ্যে তারা ফিস ফিস করে কথা বলছে। শহীদ অবশ্য তাদের কথা শোনার কোন চেষ্টাই করল না।
বাড়িটার ডান পাশে চব্বিশ নম্বর বাড়ি। দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। পঁচিলের প্লাস্টার খসে পড়েছে। যে কেউ পঁচিল টপকে ও-বাড়ি থেকে এ-বাড়িতে আসতে পারে। চব্বিশ নম্বর বাড়ির ছাদ এ-বাড়ির ছাদের কাছ থেকে মাত্র হাত তিনেক দূরে, এক লাফে এ-বাড়ির ছাদে যে-কেউ আসতে পারে।
চব্বিশ নম্বর বাড়িতে কারা থাকেন?
তসলিমা বলল, একটা লঞ্চ কোম্পানীর সুপারভাইজার, ভদ্রলোক প্রৌঢ়, চির কুমার, রাতদিন মদ খান, নাম আকরাম হোসেন চাকলাদার। কখন যে তিনি বাড়িতে থাকেন আর কখন থাকেন না, বলা মুশকিল।
এটা কি তার নিজের বাড়ি?
না। তিনি আজ বছর খানেক হলো ভাড়া নিয়েছেন।
শহীদ ছাদের অপর প্রান্তে এসে দাঁড়াল। এ-পাশের বাড়িটা আরও যেন নিস্তব্ধ, জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। বাড়ির মধ্যবর্তী পাঁচিল খুবই উঁচু, প্রায় দুমানুষ সমান হবে। নতুন পঁচিল তোলা হয়েছে বা নতুন করে প্লস্টার করা হয়েছে। দুবাড়ির ছাদের দূরত্বও অনেক, তিন লাফেও এ বাড়ির ছাদে পৌঁছানো যাবে না।
এ বাড়িটা?।
এটা জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাড়ি। তিনি নানারকম পাঁচ মিশালী ব্যবসা করেন। খুব ভাল মানুষ। এ পাড়ার সকলের সাথে মধুর সম্পর্ক আছে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন…।
থাক, থাক। অত প্রশংসা শুনলে হিংসা হয়। তিনি কি গত রাতে বাড়ি ছিলেন?
না। তিনি নাকি গত রাতে সিনেমা দেখতে গিয়ে কুয়াশার জন্যে বাড়ি ফিরতে পারেননি!
শহীদ বলল, হুঁ।
এরপর শহীদ আতিয়াকে তার বাবার টাকা চুরির ঘটনা সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করে নিচে নেমে এল। ডি কস্টাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে, ফারুক চৌধুরীর একখানা পাসপোর্ট সাইজের ফটো আতিয়ার কাছ থেকে নিয়ে বিদায় নিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে।
.
০২.
গলির মুখে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে পঁচিশ নম্বর চক্রবর্তী লেনে ঢুকেছিল শহীদ এবং ডি. কস্টা। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে গলি-মুখের দিকে পা বাড়াল ওরা।
বাড়ি ফিরছিল এই সময় ফারুক চৌধুরী। শহীদ এবং ডি. কস্টাকে দেখে থমকে গেল সে, স্যাত্ করে সরে গেল পরমুহূর্তে পাশের বাড়ির গেটের আড়ালে। শহীদের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা, মার্জিত এবং শোভন পোশাক দেখে তার সন্দেহ হলো, ভদ্রলোক কেউকেটা গোছের কেউ হবেন।
ওরা গলি-মুখে অদৃশ্য হয়ে যেতে দুরু দুরু বুকে বাড়ির ভিতর ঢুকল। সে। হলঘরে, আতিয়া এবং তসলিমা ছিল, ঢুকেই সে প্রশ্ন করল, ওঁরা কারা এসেছিলেন?
ওঁরা ডিটেকটিভ-পুলিস নয়, প্রাইভেট।
ফারুক মুখ বিকৃত করে বলল, এহ্! যা ভেবেছি-টিকটিকিরা কেন এল?
কেন আবার, শামিমের খোঁজে!
জানল কিভাবে শামিম সাহেব…?
আতিয়া বলল, শুধু তাই নয়, ওঁরা জেনেই এসেছেন–শামিম এ বাড়িতে খুন হয়েছে, আমরা তার লাশ মাঠে ফেলে রেখে এসেছি–সব!
অ্যাঁ। তুমি সব অস্বীকার করেছ নিশ্চয়ই?
আতিয়া বলল, কি অস্বীকার করব? অস্বীকার করলে ছাড়ত? ওঁরা সবই জানেন, স্বীকার না করে উপায় ছিল নাকি?
ফারুক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, তার মানে সব বলে ফেলেছ? সর্বনাশ হয়েছে। এখন কি হবে?
কি হবে না হবে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আপনিই তো যত নষ্টের গোড়া!
ফারুক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল আতিয়ার দিকে। পরমুহূর্তে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল সে, একেই বলে অকৃতজ্ঞ। তোমাদেরকে রক্ষা করার জন্যে…।
থামুন! কাকে রক্ষা করেছেন আপনি? বাবাকে? লজ্জা করে না বলতে? নিজে শামিমকে খুন করে বাবার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছেন?
কী! এত বড় কথা! আতিয়া, সাবধানে কথা বলো বলছি! উঠে দাঁড়াল ফারুক, রাগে কাঁপছে সে।
চোখ রাঙিয়ে কথা বলবেন না! পাল্টা জবাব দিল আতিয়া।
তসলিমা মুখ খুলল এবার, থামো তো, আপা। মাথা গরম কোরো না। ফারুক ভাই, বিপদটা আমাদের এবং আপনার, দুতরফেরই। এ সময় ঝগড়া-ঝাটি করা কি উচিত?
ফারুক নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলল, কিন্তু সব কথা তোমরা স্বীকার করলে কোন বুদ্ধিতে! পুলিস বা টিকটিকি যাই সন্দেহ করুক, প্রমাণ করতে পারত কিছু? স্বীকার করায় সব প্রমাণ হয়ে গেল। টিকটিকিরা তোমাদেরকে বোকা বানিয়ে পেটের কথা বের করে নিয়ে গেছে।
তসলিমা বলল, স্বীকার করেছি তো কি হয়েছে? ওঁরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ, ওঁদের তদন্তের পদ্ধতি আলাদা। শহীদ সাহেব কথা দিয়ে গেছেন, একান্ত প্রয়োজন না হলে তিনি পুলিসকে এখুনি সব কথা জানাবেন না।
কিন্তু তারা খবর পেল কোত্থেকে?।
তা বলেননি। জানতে চাইলেও বলতেন কিনা সন্দেহ।
ফারুক উত্তেজিত ভাবে বলল, নিশ্চয়ই ওদেরকে কেউ নিযুক্ত করেছে। কে সে? তার পরিচয় জানতেই হবে। বোঝা যাচ্ছে, সে আমাদের শত্রু। শত্রু কোনরকম অনিষ্ট করার আগেই তাকে খতম করা দরকার।
মানে?
পুলিসকে সে সব কথা বললেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার আগেই মুখ বন্ধ করতে হবে তার।
কিভাবে তা সম্ভব?
ফারুক পায়চারি শুরু করল অস্থিরভাবে, যে ভাবেই হোক সম্ভব করতে হবে। বন্দুকের গুলি কিংবা ছোরার…।
কি ভেবে পায়চারি থামাল ফারুক, শান্ত করার চেষ্টা করল নিজেকে। তারপর বলল, কি ভাবে কি করতে হবে তা তোমাদেরকে ভাবতে হবে না। ব্যবস্থা আমিই করব। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখতে হবে তোমাদের।
শহীদ সাহেব তো সবই জেনে গেছেন। তসলিমার কামরাও দেখেছেন তিনি…।
ওপরেও নিয়ে গিয়েছিলে?
আতিয়া বলল, আমি যখন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেই ফাঁকে শহীদ সাহেব একাই উপরে উঠে গিয়েছিলেন।
ইস্! জাহাঙ্গীরকেও তাহলে দেখেছে তারা?
সম্ভবত দেখেছেন। তাতে ক্ষতি কি?
ফারুককে অপ্রতিভ, দেখাল। খানিকপর বলল, ক্ষতি বৈকি! জাহাঙ্গীর দেখল তো, আমাদের বাড়িতে টিকটিকি আসা যাওয়া করছে! পাড়ার লোক যদি জানে–ঢি ঢি পড়ে যাবে না? নাহ্! মাথা ঘুরছে, যাই, শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি, কি করা যায় নতুন করে।
ফারুক ধীরে ধীরে উঠে গেল দোতলায়।
দুপুরের খানিকপর আজহার মল্লিক বাড়ি ফিরলেন। মেয়েদেরকে দেখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে গায়ের কোট খুলে সোফার উপর রাখলেন। জানতে চাইলেন, আতিয়া, তোমার মা কেমন?
শুয়ে আছেন। শরীর ভাল নেই।
সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। পিছন থেকে তসলিমা বলল, তোমার কোট…।
কথা শেষ না করে তসলিমা সোফা থেকে কোটটা তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল, বাবার হাতে সেটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
চেয়ারে বসে ছিল আতিয়া, সে দেখল কোটের পকেট থেকে একটা নীল কাগজ পড়ে গেল মেঝেতে। কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে কি মনে করে মেলে ধরে পড়ল সে।
কাগজের লেখাটা পড়েই মাথা ঘুরে গেল আতিয়ার। অসুস্থ বোধ করল সে। চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে হাঁপাতে লাগল ঘন ঘন।
কাগজটা আজহার সাহেবের অফিসের একটা লেটারহেড প্যাডের শীট, তাতে লেখা:
মি, আজহার মল্লিকের কাছ থেকে গতকালের কালেকশন বাবদ দশ হাজার টাকা সম্পূর্ণ বুঝে পেলাম। ইবনে গোলাম রসুল।
আতিয়া জানে, গোলাম রসুল সাহেব বাবার বস্।
তার বাবা টাকা পেলেন কোথায় ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেছে আতিয়ার। সে ভাবছে, তবে কি…?
.
সেদিনই বিকেলে মি. সিম্পসন হাজির হলেন শহীদের বাড়িতে। ফুট কেক এবং দুকাপ চা খেয়ে তিনি কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলেন, অমন সকাল বেলা তুমি চক্রবর্তী লেনের দিকে কেন গিয়েছিলে, বলো তো?
শহীদ বলল, ব্যক্তিগত একটা কাজ ছিল। ভাল কথা, কেসটা কি রকম বলুন তো, মি. সিম্পসন? কিছু জানতে পারলেন?
ইন্সপেক্টর হায়দার আলী তদন্ত করছে। জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। লাশের কাছে যে অস্টিনটাকে পাওয়া গেছে সেটার মালিক এমদাদুল হক নামে এক বখাটে যুবক। বছর খানেক আগে পর্যন্ত ছোকরা হাইজ্যাকার ছিল। পুলিসী ব্যবস্থা কড়াকড়ি হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে ওসব। প্রকাশ্যে সে এখন তেমন কিছু করে না, তবে গোপনে নাকি অবৈধভাবে টাকা পয়সা কামায়। পিছনে লোক লাগানো আছে, তেমন কোন প্রমাণ নেই বলে এতদিন গ্রেফতার করার চেষ্টা হয়নি। এবার হয়তো বাছাধন রেহাই পাবে না।
তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ?
সেই খুনী, তার বিরুদ্ধে ইন্সপেক্টর হায়দার খুনের অভিযোগ আনার কথা ভাবছে। তবে, প্রথমে তার সাথে কথা বলতে চায় হায়দার। জানো, গাড়িটা ওখানে ফেলে রেখে যাবার কারণটা কি? ইচ্ছায় নয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেলে রেখে যেতে হয়েছে তাকে গাড়ি।
মানে?
মি. সিম্পসন বললেন, পেট্রল শেষ হয়ে গিয়েছিল, পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে ফেলে রেখে গেছে। আরও একটা ব্যাপারে ওকে জেরা করা হবে।
আরও একটা ব্যাপারে?
মি. সিম্পসন বললেন, চক্রবর্তী লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়ির আজহার মল্লিকের দশ হাজার টাকা ভর্তি একটা ব্যাগ গতকাল কেউ অদলবদল। করে ভদ্রলোককে সর্বস্বান্ত করেছে। এমদাদুল হক সিরাজীর অস্টিনে যে কালো চামড়ার ব্যাগটা পাওয়া গেছে সেটা ওই আজহার মল্লিকের ব্যাগ। আজহার মল্লিকের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল ব্যাগটা, বাড়ির লোকেরা সেটা সনাক্ত করেছে। কি দাঁড়াল ফলাফল? এমদাদই যে আজহার মল্লিককে ঠকিয়ে দশ হাজার টাকা চুরি করেছে, সন্দেহ আছে তাতে আর কোন?
শহীদ চুপ করে রইল।
মি. সিম্পসন বলে চলেছেন, এমদাদ একটা নিশাচর। খামোকা। সারারাত শহরময় ঘুরে বেড়ায় সে। আমার সন্দেহ, শামিমকে একা পেয়ে গাড়ি থামায় সে, শামিমের টাকা পয়সা কেড়ে নেয়, তারপর তাকে খুন করে।
শহীদ এতক্ষণে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, মি. সিম্পসন, ধরুন, আপনি গাড়ি থামিয়ে একজন মানুষকে খুন করলেন, কেমন? আপনি জানেন আপনার গাড়ি পুলিস যদি সকালে লাশের কাছে দেখে, নির্ঘাত তারা আপনাকে খুনী বলে ধরে নেবে, তাই নয় কি? এরকম অবস্থায় কি করতেন আপনি?
তেল না থাকলে, স্বভাবতই তেল যোগাড় করার চেষ্টা করতাম।
শহীদ বলল, অত রাতে তেল পেতেন না। আমি হলে কি করতাম বলব?
বলো। কি করতে?
শহীদ বলল, নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, খানিকটা সামনে রাস্তা ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে পুব দিকে। গাড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে এখানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতাম। গড়াতে গড়াতে অনেকটা দূরে চলে যেত গাড়ি। তারপর সুযোগ সুবিধে মত আবার খানিকটা মাত্র ঠেলে কোন বাড়ির পাশে রা গলির মুখে রেখে দিতাম।
মি. সিম্পসনকে চিন্তিত দেখাল, তাই তো! সেটাই তো হত বুদ্ধিমানের কাজ।
শহীদ বলল, আমার কি ধারণা জানেন? হয় এমদাদ জানত না ওখানে একটা লাশ পড়ে আছে, নয়তো গাড়িটা তার হলেও, সে নিয়ে যায়নি ওখানে গাড়ি।
মি. সিম্পসন বললেন, হায়দারকে তাহলে এসব কথা বলতে হয়। সে তো এমদাদকেই খুনী মনে করে বসে আছে। তার আরও একটা ধারণা, শামিম এবং এমদাদ দুজন মিলে আজহার মল্লিকের টাকা চুরি করেছে। শামিম সংবাদ সংগ্রহ করেছে, কাজ হাসিল করেছে এমদাদ। তরিপুর, টাকার হিস্যা নিয়ে গোলমাল বাধে দুজনের। মারামারি শুরু হতে এমদাদ খুন করে শামিমকে। এও একটা সম্ভাবনা। অন্তত হায়দারের তাই মনে হচ্ছে।
শহীদ মুচকি হাসল শুধু, কোন মন্তব্য করল না। শহীদের বক্তব্য শোনার পর থেকে মি. সিম্পসন অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তাই বেশিক্ষণ বসলেন না, বিদায় নিয়ে চলে গেলেন খানিকপর।
কামাল এল আধঘণ্টা পর। বলল, নারে শামিম কবির কেন, গতকাল কোন ক্লাবেই কেউ আট হাজার টাকা জেতেনি হাউজীতে। সবচেয়ে বেশি পেমেন্ট দেয়া হয়েছে ইউনিক ক্লাবের হাউজীতে, ইব্রাহিম নামে এক বুড়োকে, তাও মাত্র সাতশো টাকা।
শহীদ বলল, তাহলে শামিম টাকা পেয়েছিল অন্য কোন সূত্র থেকে। কিন্তু হাউজী খেলায় পেয়েছে বলেছিল কেন সে? নিশ্চয়ই টাকাটা অবৈধ উপায়ে রোজগার করেছিল, তাই। কি বলিস?
কামাল বলল, তাছাড়া আর কি হতে পারে!
এমন সময়, ক্রিং ক্রিং শব্দ হলো। শহীদ হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফোনের রিসিভার, শহীদ খান স্পিকিং।
ভারি একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে, শহীদ, যে ফটোটা পাঠিয়েছ তুমি সেটা দেখলাম। ডি. কস্টা কোথাও ভুল, করেছেন। আমি যে লোকটাকে অনুসরণ করতে বলেছিলাম ওঁকে, ফটোর যুবক সে লোক নয়।
শহীদ বলল, কিন্তু ডি. কস্টা হলপ করে বলছে; সে লোকটাকে তোমার নির্দেশ মত সারাক্ষণ অনুসরণ করেছিল, লোকটাকে সে চক্রবর্তী লেনে পঁচিশ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে।
অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, পঁচিশ নম্বর বাড়িতে পুরুষ মানুষ আর কে আছেন?
আজহার মল্লিক, প্রৌঢ়, বাড়ির কর্তা। ব্যস।
সেক্ষেত্রে, ডি. কস্টাই ভুল করেছেন।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। আমি খোঁজ-খবর নিচ্ছি।
সাহায্যের দরকার হলে জানিয়ো। মহুয়া কেমন? তোমার পুত্র রত্নটি?
শহীদ বলল, ভাল আছে সবাই।
রিসিভার রেখে দিতে কামাল জানতে চাইল, কে, কুয়াশা?
শহীদ বলল, হ্যাঁ।
শহীদকে চিন্তিত দেখে কামাল আর কোন প্রশ্ন করে বিরক্ত করল না ওকে। অন্দর মহলের দিকে পা বাড়াল সে। মহুয়াদির কথা মনে পড়ে যেতেই পেটটা কেন যেন খালি খালি লাগছে তার।
শহীদ পাইপ টানছে অন্যমনস্কভাবে আর ভাবছে, হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কি?
ক্রিং ক্রিং!
আবার ফোনের বেল বেজে উঠল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিল শহীদ, হ্যালো!
অপরিচিত একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনি কি মি. শহীদ, প্রাইভেট ডিটেকটিভ কথা বলছেন?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। কে আপনি?
আমি এমদাদুল হক। মি. শহীদ, আমি চক্রবর্তী লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়ি সম্পর্কে বেশ কিছু আশ্চর্য তথ্য জানি। তথ্যগুলো আপনার কাজে লাগবে।
শহীদ বলল, তাই নাকি? বেশ তো, বলে ফেলুন।
এমদাদুল হক বলল, না, ফোনে সে সব কথা বলা সম্ভব নয়। খুব গোপনীয় কিনা, কেউ যদি শুনে ফেলে সর্বনাশ ঘটে যাবে।
তাহলে আপনি চলে আসুন আমার বাড়িতে।
না, আমার পক্ষে এখন তা সম্ভব নয়। আপনি যদি দয়া করে আমার এখানে একবার কষ্ট স্বীকার করে আসেন…।
কোত্থেকে বলছেন আপনি?
এমদাদ বলল, ৩২ নং পুকুরঘাটা রোড, এখানেই পাবেন আমাকে।
শহীদ বলল, কিন্তু হাতে এখন কাজ রয়েছে, যাওয়া তো সম্ভব নয়।
এমদাদ বলল, প্লীজ, মি. শহীদ, দয়া করে একটিবার আসুন। আমিই যেতাম, কিন্তু পুলিস আমার পিছনে লেগেছে অকারণে। আমি বাইরে বেরুলেই ধরবে আমাকে। আপনি ভাববেন না, এখানে এলে আপনার কোন ক্ষতি হবে না…!
আপনি বুঝি ভাবছেন ভয়ে আমি যেতে চাইছি না?
ছিঃ ছিঃ! তা কেন ভাবব? তবু বলছি, কোনরকম সন্দেহ থাকলে, সহকারীদের সহ যত ইচ্ছে পিস্তল রিভলভার সাথে নিয়ে আসতে পারেন।
শহীদ বলল, ঠিক আছে, যাব আমি। তবে এখন নয়, রাত দশটার দিকে যদি সময় করতে পারি।
এমদাদ বলল, ঠিক আছে। ধন্যবাদ, মি. শহীদ।
রিসিভার রেখে দিয়ে পাইপে নতুন করে আগুন ধরাল শহীদ। ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে, ভাবল ও।
.
০৩.
রাত দশটা। নির্জন, নিস্তব্ধ গোটা পুকুরঘাটা রোড। এমনিতেই শহরের একধারে বলে লোকজনের বসবাস এদিকে কম, তার উপর শীতের রাত, লোকজন তো দূরের কথা, একটা কুকুর বিড়ালও নেই রাস্তায়।
কুয়াশা আজও গাঢ় হয়ে নেমেছে। তবে গত রাতের মত নয়।
৩২ নং বাড়ির সামনের দিকটায় সারি সারি কখানা দোকান। সবগুলোই বন্ধ। পিছনের অংশটা গুদামঘর বলে মনে হয়। সদর দরজাটা খোলা।
কড়া নাড়তে কেউ সাড়া দিল না দেখে শহীদ বলল, চল, ভেতরে ঢুকে দেখি কি অবস্থা।
কামাল অনুসরণ করল শহীদকে। পাকা একটা উঠান দেখা গেল। অন্ধকার। টর্চ জ্বালল কামাল। কয়েকটা ছোট ছোট দরজা দেখে সেদিকে পা বাড়াল সে।
শহীদ বাধা দিল তাকে, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? ওগুলো তো দোকানে ঢোকার ভেতর দিকের দরজা।
কথাগুলো বলে শহীদ একটা ভেজানো দ্রজার দিকে পা বাড়াল।
বাড়িটা খুবই পুরানো, ভেঙে পড়ার মত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেজানো দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। দরজাটা বেশ বড় এবং ভারী। ফুটো দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা বেরিয়ে আসছিল। শহীদ হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল কবাট দুটো।
প্রকাণ্ড একটা হলঘর, এক ধারে একটা টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। টেবিলের উপর জ্বলছে লম্বা একটা মোমবাতি।
ভিতরে ঢুকল শহীদ। কামাল ওকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কোথায় তোর এমদাদুল হক?
শহীদ টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বলল, একটুকরো কাগজ পড়ে রয়েছে দেখছি টেবিলে। দেখা যাক কিছু লেখা আছে কিনা এতে।
টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। শহীদের অনুমানই ঠিক। কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে।
হঠাৎ জরুরী একটা খবর পেয়ে আধঘণ্টার জন্যে বাইরে যাচ্ছি, দুঃখিত। ইতি, এমদাদুল হক।
চিরকুটটা পড়া শেষ হতেই, চমকে উঠে ওরা দুজন একযোগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল দরজার দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। বাইরে থেকে কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে দরজা। হুড়কো লাগিয়ে কড়ার তালায় চাবি ঢোকাচ্ছে কেউ, শব্দ শুনে বোঝা গেল।
তিন লাফে দরজার সামনে এসে গায়ের জোরে লাথি মারল শহীদ দরজার কবটে, কিন্তু সেগুন কাঠের কবাট তাতে এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলো না।
এদিক ওদিক তাকাতে টেবিলের কাছাকাছি জানালাটার উপর নজর পড়ল ওর।
আয় দেখি, দুজনে মিলে জানালাটা ভাঙা যায় কিনা! বলে এগোল শহীদ।
দুজনে মিলে জানালা ভাঙার চেষ্টা করছে, এমন সময় কাগজ ছেঁড়ার মত শব্দ ঢুকল কানে।
কান খাড়া করে রইল শহীদ। হাত দুটো স্থির হয়ে গেছে ওর। পেশীগুলো টান টান হয়ে আছে। বিদ্যুৎবেগে পিছন দিকে তাকাল ও।
দেখল, পিছন দিকের দেয়ালের এক জায়গায় একটা ফুটো। ফুটোটা কাগজ দিয়ে ঢাকা ছিল। একটা মেশিনগানের নল সেই ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে। চোখের পলকে কামালকে ধরে হেঁচকা টান মারল শহীদ, নিজেও পিছন দিকে লাফ দিয়ে দেয়ালের ধারে এসে শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে।
প্রায় একই সময় গর্জে উঠল সাব-মেশিনগান।
মাথার উপর মেশিনগানের ব্যারেল। বিপরীত দিকের দেয়ালের প্রায় সবটা অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে শত শত বুলেটের আঘাতে।
মিনিট খানেক বুলেটের বৃষ্টি হলো। সাব-মেশিনগানের নলটা ফুটো দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে শহীদ হামাগুড়ি দিয়ে এগোল টেবিলের দিকে। ফিস ফিস করে বলল, আলোটা নেভাতে হবে।
টেবিলের কাছে গিয়ে মাথা উঁচু করে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল শহীদ। গঢ়ি অন্ধকার গ্রাস করল প্রকাণ্ড হলঘরটাকে।
কামালের পাশে আবার ফিরে এল শহীদ হামাগুড়ি দিয়ে, এবার শত্রু দরজার দিক থেকে গুলি করতে পারে। চল্, দরজার দুপাশে ওঁৎ পেতে থাকব দুজন।
অনুমানের উপর নির্ভর করে দরজার দিকে এগোল ওরা। শহীদ বলল, যখন গুলি হচ্ছিল, গুলির শব্দ ছাড়াও আর একটা শব্দ হচ্ছিল, শুনেছিস?
কামাল চাপা কণ্ঠে বলল, শুনেছি। আশেপাশে বোধহয় লোহার কারখানা আছে। শব্দটা লোহা-পেটাবার বলে মনে হলো।
বারুদের তীব্র কটু গন্ধে ভরে গেছে ঘরটা। দরজার কাছে পৌঁছে নিঃশব্দে শুয়ে রইল ওরা। কিন্তু শত্রুর আর কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
মিনিট দশেক পর শহীদ বলল, ব্যর্থ আততায়ী চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কামাল, এ শত্রু আর যেই হোক, এমদাদুল হক নয়। আমাদেরকে খুন করে এমদাদের এমন কোন লাভ হবে না। তা ছাড়া, পুলিস যাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে এমন লম্বা পরিকল্পনা করে কাউকে খুন করার কথা ভাবতে পারে না।
কামাল বলল, আমারও তাই বিশ্বাস। কিন্তু শহীদ, এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কি?
শহীদ বলল, সহজ উপায় আছে। গুলি করে দরজার তালা উড়িয়ে দিলেই হবে।
আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর যখন পরিষ্কার বুঝতে পারল শহীদ শত্রু সত্যি সত্যি অনুপস্থিত, রিভলভারের গুলি করে বাইরের তালা ভেঙে দরজা উন্মুক্ত করে ফেলল ও।
বাইরে বেরিয়ে কামালকে বলল, সবশেষের দোকান ঘরের ভিতর ঢুকতে চাই, আয়।
ছোট দরজা দিয়ে দোকান ঘরটায় ঢুকে টর্চের আলোয় ওরা দেখল, মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটা হাতুড়ি এবং একটা ছেনি, দেয়াল ছিদ্র করার যন্ত্র হিসেবে। ঘরের ভিতর আর একটা উঁচু টুল ছাড়া কিছুই নেই।
কি ব্যাপার! কি করছেন আপনারা ওখানে? বাড়ির গেট থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
রিভলভার হাতে দোকানঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওরা দেখল একজন পুলিস কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে।
শহীদকে এবং কামালকে চিনতে পেরে সবিস্ময়ে কনস্টেবলটি বলল, স্যার, আপনারা এখানে? গুলির শব্দ পেয়ে ছুটে এলাম এইমাত্র…।
কামাল বলল, আমাদেরকে খুন করার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল।
সে কি! কে…?
শহীদ জানতে চাইল, এ বাড়িটা কার বলতে পারো?
পরিত্যক্ত বাড়ি, স্যার। দাঁতব্য চিকিৎসালয় ছিল কিছুদিন আগে পর্যন্ত। নিউ রি-কনস্ট্রাকশন স্কীমে এ বাড়ি ভেঙে ফেলার কথা। ভেঙে ফেলা হবে বলে এখানকার ভাড়াটেদের উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ বাড়ির পিছন দিকে একটা লোহার কারখানা আছে সম্ভবত, না?,
জ্বী, স্যার। জেনুইন আয়রন, স্টীল অ্যান্ড মেশিনারীজ কোম্পানীর কারখানা।
রাতে কি কাজ হয় কারখানায়?
আগে হত।
শহীদ জানতে চাইল, আজকাল হয় না বুঝি?
না।
কিন্তু আজ কাজ হয়েছে। যখন গুলি করা হয়েছে আমাদেরকে তার ঠিক আগে থেকে লোহা-পেটাবার কান ফাটানো শব্দ শুরু হয়। আমার সন্দেহ হচ্ছে, গুলির শব্দ যাতে চাপা থাকে সেজন্যেই লোহা-পেটাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে আজ এই অসময়ে। চলো তো, কারখানাটা আমি একবার দেখব।
আসুন, স্যার। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
পুকুরঘাটা রোডের পিছন দিকে পৌঁছল ওরা।
কারখানাটি ছোটখাট। চারজন মিস্ত্রি কাজ করছিল।
শহীদ প্রশ্ন করল মিস্ত্রিদের হেডকে, রাতে কাজ করছ কেন?
হেড উত্তরে বলল, অফিস থেকে জরুরী হুকুম হয়েছে, সাহেব। সকালেই সাপ্লাই দিতে হবে কিনা।
কে হুকুম দিয়ে গেছে?
ফারুক সাহেব।
হেড অফিসের কে তিনি?
হেড মিস্ত্রি বলল, সুপারভাইজার, হুজুর।
শহীদ হঠাৎ বলল, কাজও দিয়ে গেছে, সেই সাথে বেশ ভাল বকশিশের লোভও দেখিয়ে গেছে, না?
জ্বী, মানে, হ্যাঁ, বলেছেন সকালের মধ্যে কাজটা করে দিতে পরলে নাস্তার টাকা দেবেন।
ঠিক আছে, কাজ করো তোমরা।
কারখানা ত্যাগ করে বেরিয়ে এল ওরা। খানিক দূর এসে শহীদ বলল, আজহার মল্লিকের বাড়ির ভাড়াটের নামও ফারুক।
দুজন মনে হচ্ছে একই লোক।
শহীদ চিন্তিতভাবে বলল, তাই সন্দেহ হচ্ছে।
.
০৪.
শহরের একধারে ডিভাইন ক্লাব। এমদাদুল হক পুলিসের ভয়ে এই ডিভাইন ক্লাবের দোতলার একটি কামরায় আত্মগোপন করে আছে। সঙ্গে আছে তার বন্ধু রকিব হোসেন।
এমদাদ জানে, তসলিমাকে একবার খবর দিলে হয়, অমনি ছুটে আসবে সে। মেয়েটা কেন যেন তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। তসলিমাকে খবর সে পাঠিয়েছে। রাত এখন দশটা। সাড়ে দশটার মধ্যে তাকে আশা করছে সে। শুধু খবরই পাঠায়নি সে, লোক মারফত একটা লেডিস কোটও পাঠিয়ে দিয়েছে উপহার স্বরূপ।
উপহার পাওয়া কোটটা গায়ে দিয়ে ঠিক সাড়ে দশটার সময়ই এল তসলিমা। কামরার দরজা বন্ধ করে পরামর্শ শুরু হলো ওদের। তসলিমার মান এবং সন্দেহ ভাঙাতে বেশ বেগ পেতে হলো এমদাদকে। তসলিমা জানতে চাইল, তার বাবার টাকার ব্যাগ এমদাদের গাড়ির ভিতর গেল কিভাবে?
এমদাদ ব্যাপারটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করল। বলল, বিশ্বাস করো, গাড়িতে কোন ব্যাগ ছিল কিনা তাই আমি জানি না। তাছাড়া, তুমি ভাবতে পারলে কিভাবে তোমার বাবার টাকা আমি চুরি করব? আমি কি এতই নিচে নেমে গেছি?
ব্যাগটা তাহলে তোমার গাড়িতে গেল কিভাবে?
এমদাদ বলল, নিশ্চয়ই আমাদের কোন শত্রুর ষড়যন্ত্র। তুমি আমাকে ভালবাস, আমি তোমাকে ভালবাসি-এটাকে ধ্বংস করার জন্যে কেউ এই শত্রুতা করেছে।
কাকে সন্দেহ করো তুমি?
এমদাদ বলল; তোমার প্রতি লোভ আছে এমন লোক তো আর কম নেই শহরে।
তসলিমা থমথমে মুখ করে বসে রইল। এমন সময় দরজায় ঘনঘন করাঘাত করল কেউ বাইরে থেকে। পুলিশ হানা দিয়েছে সন্দেহ করে এমদাদ লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল, ছুটল জানালার দিকে।
দেখতে দেখতে জানালার শার্সি খুলে উঠে পড়ল সে উপরে, লাফ দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে চলে গেল। সেখান থেকে ছুটল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল একটা চিলেকোঠার আড়ালে।
কামরার দরজা খুলে দিল রকিব। ইউনিফর্ম পরা ইন্সপেক্টর হায়দার আলী দৃঢ় পায়ে ঢুকল কামরার ভিতর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে তসলিমার দিকে তাকাল সে, তুমি! তসলিমা, তুমি এখানে কেন?
তসলিমা বলল, কেন, তাতে তোমার কি?
হায়দার বলল, ছিঃ তসলিমা, এতটা নিচে নামা কি তোমার মত মেয়ের উচিত? তোমাকে আমি চিনি। জানি, কিরকম পরিবারের মেয়ে তুমি…।
কেন এসেছ? উপদেশ খয়রাত করতে বুঝি?
হায়দার আলী বলল, না। তোমাকে উপদেশ দিয়ে লাভ কি! আমি এসেছি এমদাদের সন্ধানে। কোথায় সে?
আমার কোটের পকেটে। খুঁজে দেখো, পাবে।
হায়দার আলী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল রকিবের দিকে, আপনি বলুন, কোথায় এমদাদ? আমি জানি, এখানে ছিল সে। খবর পেয়েই আমরা এসেছি।
ও কিছু জানে না। আমাকে জিজ্ঞেস করো। এমদাদ এখানে আসবে, কথা আছে। এখনও আসেনি। আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করছি। দরকার মনে করলে তুমিও অপেক্ষা করতে পারো।
হায়দার আলী বলল, তসলিমা, সত্যি তুমি অনেক নিচে নেমে গেছ। আমি জানি, এমদাদ একটু আগে এই কামরায় ছিল…।
তসলিমা জোর গলায় বলল, আমি বলছি ছিল না। আর-শোনো হায়দার, বারবার নিচে নেমে গেছ, নিচে নেমে গেছ বলবে না তুমি আমাকে, সাবধান করে দিচ্ছি আমি! পুলিস অফিসার হয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ নাকি?
হায়দার আলী হাসল। সে-হাসি ম্লান, তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বলল, তসলিমা, তুমি আমাকে দেখলেই অকারণে রেগে যাও। এটা কি উচিত? আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমি চাই না তোমার অধঃপতন ঘটুক…।
সব্বোনাশ! আবার তুমি আদর্শের-বুলি ছাড়তে শুরু করলে? তসলিমা অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকাল।
অপমান বোধ করল সম্ভবত এবার হায়দার আলী কাঁধ ঝুঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, বলল, বেশ। চললাম আমি তোমাকে আর আর কিছু বলার নেই।
ক্লাবের নিচতলায় নেমে গেল ইন্সপেক্টর হায়দার আলী। তার সাথে সাব-ইন্সপেক্টর আবদুর রউফ এবং কয়েকজন রাইফেলধারী কনস্টেবল এসেছিল, তাদেরকে রেখেই সে চলে গেল থানায়।
চক্রবর্তী লেনের চব্বিশ নম্বর বাড়িতে এখন ভাড়া থাকেন লঞ্চ কোম্পানীর সুপারভাইজার আকরাম হোসেন চাকলাদার, কিন্তু বছর দেড়েক আগে ওই চব্বিশ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকত হায়দার আলী। হায়দার আলী সং, ভদ্র যুবক। তখন সে সাব-ইন্সপেক্টর ছিল। পাশের বাড়ির তসলিমাকে সে মনে মনে ভালবাসত সেই তখন থেকেই। কিন্তু তসলিমা ঠোঁট-কাটা চঞ্চলা প্রকৃতির মেয়ে বলে পরিষ্কার ভাষায় হায়দার আলী কোনদিনই বলতে পারেনি তার ভালবাসার কথা। প্রায়ই সে তসলিমাদের বাড়িতে যেত, গল্প করতে। তসলিমার ছটফটে স্বভাবটাই আসলে আকৃষ্ট করত তাকে। কিন্তু হায়দারকে তসলিমা বিশেষ পাত্তা কোনদিনই দেয়নি। বাঁকা চোখে দেখত তাকে, বাঁকা বাঁকা কথা বলত। হায়দার আলী মনে মনে আশা পোষণ করত, একদিন না একদিন তার অন্তরের গভীর প্রেমের কথা হৃদয়ঙ্গম করবে তসলিমা, তার ভালবাসার যথোপযুক্ত মূল্য দেবে।
কিন্তু তা ঘটেনি। দিনে দিনে আরও দূরে সরে গেছে তসলিমা। যার তার সাথে মেলামেশা রাত গভীর করে বাড়ি ফেরা, দায়িত্বজ্ঞানহীনার মত আচরণ-তসলিমা ক্রমশ যে দূরে সরে যাচ্ছিল তাই নয়, নষ্ট হয়েও যাচ্ছিল সে।
হায়দার আলী বহু চেষ্টা করেছে তসলিমাকে বোঝাতে। যেচে পড়ে ডেকে পাঠিয়ে উপদেশ দিয়েছে। কিন্তু তসলিমা তার কথায় গুরুত্ব দেয়নি এতটুকু! তসলিমাকে ফেরানো সম্ভব না আর, ধরেই নিয়েছিল। হল আলী। কিন্তু তসলিমার প্রতি তার যে দুর্বলতা, তা আজও সে অনুভব করে! আজও সে গভীরভাবে ভালবাসে তসলিমাকে।
হায়দার আলী নিচে নেমে যেতে রকিব বলল, ইন্সপেক্টরের সাথে অমন ব্যবহার করলেন, কাজটা কি ভাল হলো?
তসলিমা বলল, থামুন আপনি! ওকে আমি চিনি, আমার একটা মিষ্টি কথার জন্যে নিজের প্রাণ পর্যন্ত বাজি রাখতে পারে ও। ইন্সপেক্টর হলে হবে কি, মেয়েদের মত নরম স্বভাব ওর।
রকিব বলল, এখন আর এখানে বসে থেকে লাভ কি! চলুন, আমার বাড়িতে যাই। রাতটা আমার ওখানেই কাটাবেন।
কী?
রকিব ঢোঁক গিলে বলল, না…মানে, এত রাতে বাড়ি ফেরার চাইতে…।
আপনি দেখছি আস্ত একটা ছোট লোক! এরকম একটা কথা মুখ দিয়ে বের করলেন কিভাবে? দাঁড়ান, দেখা হোক এমদাদের সাথে, বলবখন। বলে উঠে দাঁড়াল তসলিমা।
রকিব হাসল। বলল, এমদাদ কি করবে আমার? ওর এমন সব দুর্বলতার কথা আমি জানি যে…।
কি দুর্বলতার কথা জানেন আপনি তার?
রকিব সিগারেট ধরিয়ে বলল, আজ নয়, আর এক দিন বলব। তা, চললেন নাকি?
তসলিমা তাচ্ছিল্যভরে অন্য দিকে তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, জুতোর খট খট শব্দ তুলে বেরিয়ে পড়ল কামরা থেকে।
নিচের হলঘরে সাব-ইন্সপেক্টর ক্লাবের সেক্রেটারি এবং দস্যদের জেরা করছিল। তসলিমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখল সে।
হলঘরে নেমে তসলিমা কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা দরজা, দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সাব-ইন্সপেক্টর পিছন থেকে ডাকল, এই যে মিস, শুনুন!
তসলিমা দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আমাকে ডাকছেন?
সাব-ইন্সপেক্টর তসলিমার মুখের দিকে নয়, তসলিমার পরনের দামি কোটটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, বলল, হ্যাঁ, এদিকে আসুন তো, আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
তসলিমা ফিরে এল।
বসুন। একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল আবদুর রউফ। সেক্রেটারি এবং অন্যান্যরা তসলিমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আপনি কি এই ক্লাবের মেম্বার?
তসলিমা বলল, না।
কারও সাথে এসেছেন তাহলে?
তসলিমা বলল, না। একজনের আসার কথা ছিল এখানে, তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। সে আসেনি।
তার পরিচয়টা বলবেন?
না বলতে চাই না।
আবদুর রউফ কিছু যেন চিন্তা করল, তারপর বলল, আপনাকে আসলে ডাকলাম অন্য একটা কারণে। কিছু যদি মনে করেন, আপনার গায়ের কোর্টটা একবার খুলবেন?
তসলিমা সাব-ইন্সপেক্টর আবদুর রউফের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার মানে?
কোটটা আমি দেখতে চাই।
তসলিমা, কেন? দেখার কি আছে আমার কোটে?
আবদুর রউফ বলল, বলুন তো, কোটটা কোত্থেকে পেয়েছেন? নাকি কিনেছেন কোন দোকান থেকে?
সত্যি বলল, না, কিনিনি। আমার এক বন্ধু আমাকে উপহার দিয়েছেন এটা। কেন?
বন্ধুর পরিচয়?
দিতে চাই না।
আবদুর রউফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, আপনার পরিচয়?
তসলিমা মল্লিক, গ্ল্যাডস্টোনে চাকরি করি।
আবদুর রউফ বলল, মিস তসলিমা, আপনাকে আমার সাথে এখুনি একবার থানায় যেতে হবে।
থানায় যেতে হবে! কেন?
তসলিমা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারেনি।
আবদুর রউফ বলল, গত হপ্তায় মতিঝিলের সুদর্শন রেডিমেড গার্মেন্টস-এর দোকানে চুরি হয়েছে, চোরেরা দোকানের তালা ভেঙে প্রায় দুলক্ষ টাকার কাপড়-চোপড় নিয়ে গেছে। দোকানে কিছু দামি কোটও ছিল। আমার ধারণা, আপনার এই কোটটা ওই দোকানের চুরি যাওয়া কোটগুলোর একটা।
এরকম অযৌক্তিক ধারণার কারণ কি আপনার? তসলিমা জানতে চাইল।
অযৌক্তিক নয়। আপনার গায়ে যে কোট দেখছি এরকম কোট একমাত্র সুদর্শন রেডিমেড গার্মেন্টস-ই বিক্রি করে। এবং, এ বছর এ ধরনের কোট তারা বিক্রি করেনি একটাও। সুতরাং এটা নিশ্চয়ই চুরির মাল। চলুন, থানায় গিয়ে জবানবন্দী দিতে হবে আপনাকে।
তসলিমা বিপদের গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ হলেও, করার কিছু ছিল না তার। সাব-ইন্সপেক্টরকে সে বোঝাতে চেষ্টা করল অনেকভাবে, কিন্তু কাজ হলো না। থানায় গেলে মান-সম্মান তো যাবেই, কোটটা যদি সত্যি চোরাই মাল হয়ে থাকে, তাহলে হাজতে আটকে রাখবে তাকে, পরে কোর্টে বিচার হবে তার, জেল-জরিমানা হবে ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলল তসলিমা।
তার কান্না দেখে আবদুর রউফের মন গলল। কিন্তু একটুমাত্র। সে বলল, এই ক্লাবের কেউ যদি আপনার জামিন হন, তাহলে শুধু কোটটা আপনার কাছ থেকে নিয়ে ছেড়ে দিতে পারি আপনাকে। তবে কাল সকালেই থানায় হাজির হতে হবে।
কিন্তু ক্লাবের কেউ তসলিমাকে চেনেই না। তারা নিজেরাই ঝামেলায় আছে, তার উপর অপরিচিতা একটা মেয়ের জামিন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং, উপায় রইল না। তসলিমাকে পুলিসের জীপে চড়ে যেতে হলো থানায়।
তসলিমার মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল, থানায় হায়দার আলীকে পাবে সে, তার সহায়তায় এই বিপদ থেকে এ যাত্রা মুক্ত হতে পারবে। কিন্তু থানায় পৌঁছে দেখল, ইন্সপেক্টর হায়দার অনুপস্থিত।
কোটটা খুলে দিতে হলো তসলিমাকে। তার সামনেই পরীক্ষা করা হলো সেটাকে। প্রমাণ হলো, এটা চোরাই মাল। অপ্রত্যাশিত বিপদ আরও একটা ঘাড়ে এসে পড়ল। কোটের ভেতরের পকেটগুলো সার্চ করার সময় একটা জড়োয়া সেট বেরিয়ে পড়ল। অত্যন্ত মূল্যবান, প্রায় হাজার দশেক টাকা তো হবেই। হৈ হৈ পড়ে গেল থানায়।
সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, রমনা ভবনের সুবর্ণ জুয়েলারী থেকে এই জড়োয়া সেট চুরি হয়েছে কিছুদিন আগে।
ভরাডুবির আর বাকি রইল না। তসলিমাকে কড়া পাহারায় পাঠিয়ে দেয়া হলো ভিতরের সেলে। আবদুর রউফ তার বিরুদ্ধে ডায়েরীতে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে বসল।
আধঘণ্টা পর অফিসে ডাক পড়ল আবার তসলিমার।
অফিসে এসে বসল তসলিমা। আবদুর রউফ তাকে জেরা করার জন্যে ডেকেছে।
নাম, ঠিকানা, পরিচয় ইত্যাদি জেনে নিয়ে আবদুর রউফ প্রশ্ন করল, কোটটা কে আপনাকে দিয়েছে, এবার বলুন।
নাম বলতে পারব না।
নিজের এতবড় বিপদ জেনেও?
তসলিমা চুপ করে রইল। এমন সময় হায়দার আলী ঢুকল অফিসে। তসলিমাকে দেখে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল সে।
সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবদুর রউফ গড়গড় করে বলে ফেলল সব। তার কথা শেষ হতেই ধমক মারল হায়দার আলী কঠিন কণ্ঠে, তুমি একটা বোকা, রউফ। একজন ভদ্রমহিলাকে এভাবে অপমানিত করা কি উচিত হলো?
কি…কি বলছেন আপনি?
হায়দার চেয়ার দখল করে বসল। বলল, ঠিকই বলছি! ক্লাবের উপরের একটা কামরায় এই কোটটা পাই আমি। এটা ফেলে রেখে এমদাদ জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমি কোটটা এই ভদ্রমহিলার হাতে দেই রাখার জন্যে। তখন আমি এমদাদকে ধাওয়া করে ধরা সম্ভব কিনা বিবেচনা করছিলাম জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। তারপর ভুলে গিয়ে কোটটা না নিয়েই নেমে আসি নিচে…।
আবদুর রউফ কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ছি-ছিঃ। কিন্তু মিস তসলিমা যদি এসব কথা আমাকে বলতেন…।
কেন বলবেন উনি? দোষ ওর নয়, আমার। আমার উচিত ছিল কথাটা তোমাকে জানিয়ে আসা।
আবদুর রউফ তসলিমার দিকে তাকাল লজ্জিতভাবে, মিস তসলিমা, আমি দুঃখিত। বিশ্বাস করুন, আমি সারাক্ষণ ভাবছিলাম, এ ধরনের জঘন্য চৌর্যবৃত্তির সাথে আপনার মত একজন ভদ্রমহিলা জড়িত থাকতে পারেন না …।
তসলিমা, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল, এখন কি আমি যেতে পারি?
হায়দার বলল, রাত তো অনেক হয়ে গেছে। ঠিক আছে, পৌঁছে দেব আমি গাড়ি করে।
দুজন এক সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ওরা। জীপে চড়ে বসল তসলিমা। হায়দার ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল। স্টার্ট দিয়ে জীপ ছেড়ে দিল সে।
কারও মুখে কোন কথা নেই। তসলিমার মনটা কেমন যেন হয়ে গেছে। হায়দারকে যেন সে আজ নতুন করে চিনেছে। লোকটার মধ্যে অদ্ভুত একটা গুণ আছে, যা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে থাকে না, হঠাৎ আজ আবিষ্কার করল তসলিমা ব্যাপারটা।
এমদাদের কথাও বারবার মনে পড়ছিল তসলিমার। এমদাদ এবং হায়দার দুজনই মানুষ, কিন্তু দুজনের মধ্যে কি রকম আকাশ পাতাল প্রভেদ!
একটা সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলো তসলিমার মনে। এর-তার মুখে সে শুনেছে, এমদাদ ভাড়াটে ডাকাতদেরকে নিযুক্ত করে দোকানপাটের মালামাল লুট করার জন্যে। সেই চোরাই মালামাল বিক্রি করে দেয় সে নাম মাত্র মূল্যে। তাতে তার ভাল রোজগার হয়। রোজগারের সব টাকা সে মদ খেয়ে, জুয়া খেলে ওড়ায়।
কথাগুলো এতদিন শুনেই এসেছে তসলিমা, বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ আর অবিশ্বাসের কিছু রইল না।
নিজেকে প্রশ্ন করল তসলিমা, তবে কি বাবার টাকাও এমদাদ…?
.
০৫.
চব্বিশ নম্বর বাড়ির ভাড়াটে লঞ্চ কোম্পানীর সুপারভাইজার আকরাম হোসেন চাকলাদার মদ খেয়ে টং মাতাল অবস্থায় বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল। রাত তখন গভীর।
ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দুখানা পাঁচ টাকার নোট মনে করে দুখানা দশ টাকার নোট দিয়ে টলতে টলতে গেট অতিক্রম করে বাড়ির ভিতর ঢুকল সে। গেটটা বন্ধ থাকারই কথা। কিন্তু খোলা দেখেও সে ব্যাপারে মাথাব্যথা দেখা গেল না তার।
ঝোঁপ-ঝাড় এবং আগাছায় ভর্তি উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল সে। পকেট হাতড়ে চাবি বের করল। তালার ছিদ্রে চাবি ঢোকাতেই পিছন থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ, কাকা! গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম ওই ঝোপে, মশায় খেয়ে ফেলেছে একেবারে!
গলার স্বর শুনে আকরাম হোসেন চিনতে পারল লোকটাকে।
এমদাদ! তুই এত রাতে কোত্থেকেরে, আঁ?
দরজা খোলো তাড়াতাড়ি! কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ। পুলিসের দল আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আকরাম হোসেন তালা না খুলে ঘুরে দাঁড়াল। তাই নাকি? তাতে আমার কি? তোকে পুলিস ধরবে, তুই জেল খাটবি–আমার তাতে কি ক্ষতি, আঁ?
এমদাদ বলল, মাতালদের নিয়ে এই আর এক বিপদ। বলছি না। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে? দরজাটা খোলো…।
আঁই! হুকুমের সুরে কথা বলবি না, বলে দিচ্ছি এমদাদ। ভাল হবে না তাহলে কিন্তু!
মাতাল প্রৌঢ় আকরাম হোসেন চাকলাদার টলতে টলতে শাসিয়ে দিল এমদাদকে।
আচ্ছা, আচ্ছা! দাও, চাবিটা না হয় আমাকেই দাও…।
চাবি নিয়ে এমদাদ হলঘরের দরজা খুলল। আকরাম হোসেনকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। তারপর ভিতর থেকে নিঃশব্দে বন্ধ করে দিন দরজা।
আকরাম হোসেন সোফায় বসে পড়ল সশব্দে। বলল, যা ভাগ এখন! আমাকে একটু আরাম করতে দে।
সে কি! বললাম না, পুলিস আমাকে খুঁজছে! আমি তো গা ঢাকা দিয়ে এখানে থাকব বলেই এসেছি, কাকা।
তাতে আমার কি লাভ?
এমদাদ বলল, ওহ, লাভ লোকসানের কথা ভাবছ? দেখো কাকা তোমার মাধ্যমে আমি মাল বিক্রি করে যে ঠকা ঠকছি–আর কেউ হলে…।
কি! আমি তোকে ঠকাচ্ছি?
এমদাদ বলল, ঠকাচ্ছ না? দশ টাকার মাল এক টাকায় বেচছি, একে ঠকা বলে না তো কাকে বলে?
চোরাই মাল এর চেয়ে বেশি দাম কে দেবে রে?
পার্টিরাই দেবে। তুমি যদি এতই সাধু, দাও না পার্টির সাথে সরাসরি আমার পরিচয় করিয়ে?
আকরাম হোসেন মাতাল হলেও, স্বার্থবুদ্ধি হারায়নি। এমদাদের কথা শুনে হাসল সে। বলল, উঁহু! সেটি হবে না। মাল বিক্রি করতে হলে আমার মাধ্যমেই করতে হবে। ধরে নে, আমিই তোর পার্টি।
এমদাদ বলল, সে যাক। দালালি করে অনেক টাকা, খেয়েছ। আমার। এখন এই বিপদে কদিন গা ঢাকার জন্যে আশ্রয় দাও আমাকে।
আকরাম বলল, আচ্ছা, তা না হয় হলো। কিন্তু মাল আবার কবে দিচ্ছিস তাই বল?
কিছুদিন মাল দিতে পারব না। পুলিস খেপে আছে বড়। খুব সাবধানে, রয়ে সয়ে কাজে হাত দিতে হবে।
এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল।
পুলিস!
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এমদাদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে বড় একটা আলমারি দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে তার আড়ালে গা ঢাকা দিল।
কে?
সোফা ত্যাগ করে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল আকরাম।
বাইরে থেকে জবাব এল, দরজা খোলো, চাকলাদার। আমি জাহাঙ্গীর হোসেন
ওহ্। জাহাঙ্গীর সাহেব!
দরজা খুলে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল, আকরাম। হলঘরে ঢুকল চক্রবর্তী লেনের ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির জাহাঙ্গীর হোসেন।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে আকরাম বলল, বসুন। এত রাতে কি মনে করে, জাহাঙ্গীর সাহেব? জরুরী কোন খবর আছে নাকি?
জাহাঙ্গীর বলল, তুমি আবার মাতাল হয়েছ?
না না! মাতাল হয়েছি কে বলল, সামান্য একটু গলায় ঢেলেছি আর কি!
জাহাঙ্গীর সোফায় বসে দামী সিগারেটের প্যাকেট বের করল পকেট থেকে আগুন ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল সিলিংয়ের দিকে। বলল, লঞ্চে মাল তোলা হয়েছে সব?
হয়েছে, জাহাঙ্গীর সাহেব। সে-ব্যাপারে আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
জাহাঙ্গীর বলল, আর কতটা জায়গা খালি আছে?
আছে, খুব বেশি নয়। টন তিনেক তোলা যায় আরও।
লঞ্চটায় কেবিন যেন কটা?
তিনটে। কেন বলুন তো?
জাহাঙ্গীর বলল, আচ্ছা, আকরাম, তোমার এই লঞ্চ কি সাগরের তীর ঘেঁষে দূর কোন বন্দরে যেতে পারবে?
বলেন কি! এটা তো নামে লঞ্চ, আসলে স্টীমারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কোলকাতায় তো এই লঞ্চ অমন একশোবার যাতায়াত করেছে। কিন্তু এসব প্রশ্ন…।
জাহাঙ্গীর বলল, এবার আমরা টেকনাফে মাল বিক্রি করব না, আকরাম। আরও দূরে কোথাও যাবার কথা ভাবছি আমি। তাতে মালের দাম অনেক বেশি পাব।
খুব ভাল কথা।
জাহাঙ্গীর বলল, তাছাড়া, আমাদের প্রতিবেশী আজহার সাহেব এবং আরও দুএকজনের হাওয়া পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমার মাল বিক্রি এবং ওদের হাওয়া পরিবর্তন, একসাথে দুটো কাজই করতে চাই।
হুকুম দিলেই নোঙর তুলব, জাহাঙ্গীর সাহেব।
জাহাঙ্গীর সিগারেট টানতে টানতে উঠে দাঁড়াল, ভাল কথা, তেমন বিশ্বস্ত লোক আছে তোমার হাতে?
কেন বলুন তো?
জাহাঙ্গীর বলল, বিশ্বস্ত এবং সাহসী হওয়া চাই লোকটার। অচেনা বন্দরে নামব, একজন দেহরক্ষী ধরনের লোক দরকার।
নিশ্চয়ই দরকার। সেরকম লোক আমার হাতেই আছে, আপনি ভাববেন না।
ঠিক আছে। চললাম। তৈরি হয়ে থেকো, বললেই যেন রওনা হতে পারো।
জাহাঙ্গীর হোসেন চলে যেতেই এমদাদ বেরিয়ে এল আলমারির আড়াল থেকে।
কাকা!
আহ, আবার কেন বিরক্ত করিস?
এমদাদ বলল, আমি যাব।
যাবি কোথায় যাবি?
ওই যে, ভদ্রলোক বললেন, তার দেহরক্ষী দরকার…।
ওহ্। যাবি নাকি? তা…বেশ, যাবি। কিন্তু এমদাদ, বুঝতেই তো পারছিস, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার ওপর নির্ভর করছে। এখন, আঃ কে যদি তুই সন্তুষ্ট করতে পারিস।
কি দিতে হবে বলো?
আকরাম হোসেন হাসতে লাগল। বলল, বিশেষ কিছু না। এক ডজন জনিওয়াকারের বোতল।
পুলিসের হাত থেকে বাঁচতে হলে দেশ ছেড়ে কিছু দিন বাইরে থাকা দরকার আমার–ঠিক আছে, পাবে তুমি এক ডজন জনিওয়াকার। রাজি হয়ে গেল এমদাদ। তারপর, হঠাৎ সে বলল, কাকা, কিছু মনে কোরো না, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
ন্যাকামি না করে…।
ওই ভদ্রলোকই আমার মাল কেনেন, না?
আকরাম হোসেন খেপে গেল, না! অসম্ভব! কে বলল তোকে?
এমদাদ বলল, নিজের কানেই তো শুনলাম…।
না হয় কেনেই, তাতে তোর কি? তুই আমার কাছে বিক্রি করিস, আমি জাহাঙ্গীর সাহেবের লোক-বুঝলি কিছু?
তার মানে ব্যবসায় তোমরা অংশীদার?
আকরাম হোসেন বলল, সন্দেহ হয় নাকি? শুনলি না, লঞ্চটা আমার? ওই লঞ্চ যদি ম্যানেজ না করতে পারতাম, ব্যবসা হত?
এমদাদ বলল, আমি তো স্রেফ চুরি করি, আর তোমরা চোরাকারবার করো। আমি ধরা পড়লে কমাসের জেল হবে, তোমরা ধরা পড়লে হয় যাবজ্জীবন, নয় মৃত্যুদণ্ড!
বাজে কথা বলবি না, এমদাদ। ধরা পড়ব কেন, আঁ? ধরা পড়লে তুই-ই পড়বি। চুনোপুঁটিরাই সবসময় ধরা পড়ে, রুই কাতলারা চিরকাল গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে এমদাদ বলল, ঠিকই বলেছ, কাকা।
.
০৬.
পুকুরঘাটা রোডে অদৃশ্য আততায়ীকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাড়ি ফিরে শহীদ এবং কামাল ডাইনিংরুমে খেতে বসল।
খেতে খেতে কামাল বলল, আজহার মল্লিক ভদ্রলোককে আমি দেখিনি। তিনি কেমন মানুষ জানি না। মানুষ যেমনই হোন, টাকার লোভে যদি তিনি দূর সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে শামিমকে খুন করে থাকেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু আমি ভাবছি, ফারুক চৌধুরী নামে তার ওই অবিবাহিত ভাড়াটেকে সব কিছুতে সবার আগে দেখা যাচ্ছে কেন? বাড়িতে খুন হলো শামিম, লাশ বাইরে ফেলে দিয়ে আসার প্রস্তাব এল তার কাছ থেকে। এদিকে, তোকে খুন করার ফাঁদ পাতা হলো আজ, খোঁজ নিতেই জানা গেল, সে-ও রয়েছে এর মধ্যে।
শহীদ বলল, কথাটা আমিও ভাবছি। লোকটার আচরণ খুবই সন্দেহজনক। নিজের অনিষ্ট করে অপরের ভাল করার ব্যাপারে সে যেন একপায়ে খাড়া হয়ে আছে। আরও একটা ব্যাপার!
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কামাল শহীদের দিকে।
সেই লোকটা, যে ডি. কস্টাকে শূন্যে তুলে ডোবার পানিতে ফেলে দিয়েছিল–কে সে? তার ভূমিকা কি এই নাটকে? আজহার মল্লিকের বাড়িতে পুরুষ মাত্র দুজন। তিনি এবং ফারুক চৌধুরী। দুজনেই সে-সময় শামিমের লাশ নিয়ে ব্যস্ত। বাইরের রাস্তার সে লোকটা তাহলে কে? তার কি স্বার্থ? লাশটা নিয়ে বাড়ি থেকে আজহার মল্লিক এবং ফারুক চৌধুরী বের হবে, ডি. কস্টা দেখে ফেলবে–লোকটা চায়নি তা। কেন? আমার কি মনে হচ্ছে জানিস, কামাল?
কি?
পঁচিশ নম্বর বাড়িতে এই রহস্যের সমাধান নেই। আর রহস্যময় সেই লোকটাসেই হয়তো এই নাটকের মূল চরিত্র, আসল নায়ক।
কামাল বলল, ঠিক কি বলতে চাইছিস তুই?
ভেবে দেখ, শামিমের খুনের ব্যাপারটা বাইরের কোন লোকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অথচ, ঘটনাক্ষেত্রে কি দেখা গেল? দেখা গেল, বাইরে থেকেও একজন লোক খুনের কথাটা জানে। শুধু জানে তাই নয়, সে পঁচিশ নম্বর বাড়ির লোকদের মান সম্মান এবং নিরাপত্তা যাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্যে যা করা প্রয়োজন সব করতে তৈরি হয়ে আছে। এই লোককেই দরকার আমাদের। একে পেলেই এই কেসের সমাধান পাওয়া যাবে।
কামাল বলল, কিন্তু অন্য দিক থেকে চিন্তা করে দেখ, ধাঁধা আরও আছে।
শহীদ বলল, জানি। যেমন, আজহার মল্লিকের অফিসে ফোন করে আমি জেনেছি, দশ হাজার টাকাই তিনি জমা দিয়েছেন আজ সকালে অফিসে।
কোত্থেকে পেলেন তিনি অত টাকা? শামিমকে খুন করে আট হাজার টাকা সংগ্রহ করেছেন, বাকি দুই হাজার টাকা ধার করেছেন সম্ভবত কারও কাছ থেকে।
শহীদ বলল, কিন্তু শামিমের কাছে যে টাকা ছিল–প্রমাণ কি? মিস আতিয়া মিথ্যে কথা বলে থাকতে পারে। শামিম যে হাউজী খেলে টাকা জেতেনি, এ তো আমরা জেনেছিই।
তাহলে?
শহীদ বলল, শামিমের কাছে টাকা ছিল কিনা সেটাই একটা প্রশ্ন। টাকা থাকলে, ধরে নিতে হবে, অবৈধ কোন উপায়ে সে তা পেয়েছিল কারও কাছ থেকে।
কামাল মুখ বিকৃত করে বলল, গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি!
শহীদ বলল, পঁচিশ নম্বর বাড়ির চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দে। গোলকধাঁধা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাবে।
.
ডিনার শেষ করে ড্রয়িংরূমে এসে বসল ওরা। কামাল সিগারেট ধরাল। শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করল।
মহুয়া লাল কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে ভিতরে ঢুকল। বলল, এই শীতে আবার বাইরে কোথাও যাবে নাকি তোমরা?
না। কামাল বলল।
শহীদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওকে বাধা দিয়ে ফোনের বেল ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল।
কে হতে পারে? কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল কামাল।
শহীদ ইতোমধ্যে রিসিভার তুলে নিয়েছে। শহীদ খান স্পিকিং!
সেই পরিচিত, ভারি কণ্ঠস্বর, শহীদ, লোকটার সন্ধান পেয়েছি। ডি. কস্টা ভুল করেছিলেন। অবশ্য দোষ পুরোপুরি তাঁর নয়। আমি যাকে অনুসরণ করতে বলেছিলাম, তিনি তাকেই অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু লোকটা সোজা নিজের বাড়িতে না ঢুকে ঢুকেছিল তার পাশের বাড়িতে, প্রতিবেশীর ভাল মন্দ খবর সংগ্রহের জন্যে।
তার মানে লোকটা পঁচিশ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা নয়, ছাব্বিশ নম্বরের বাসিন্দা, এই তো?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ।
শহীদ হেসে ফেলল, বুঝেছি। লোকটার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন। আচ্ছা, ওকে তোমার সন্দেহ করার কারণ কি, বলো তো? ও-পাড়ায় খুব সুনাম ওর। পরোপকারী, নিঃস্বার্থ, মিশুক–ইত্যাদি প্রশংসা শুনেছি ওর নামে।
সন্দেহ ঠিক করি না। সেদিন রাস্তায় হঠাৎ প্রথম দেখি, তার আগে কখনও দেখিওনি। কি জানো, লোকটাকে দেখেই কেমন যেন ছাত করে উঠেছিল বুকের ভিতর। এমন তো সাধারণত হয় না। ওর সম্পর্কে কিছু না জানলেও, কেন যেন দেখা মাত্র মনে হয়েছিল, এই লোককে বিশ্বাস করা যায় না, এ লোক পারে না এমন কাজ নেই।
শহীদ বলল, লোকটাকে দেখে আমারও অবশ্য অনেক কথা মনে হয়েছিল। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি নজর রাখছি ওর ওপর।
কুয়াশা বলল, শোনো, লোকটা এখন একটা ক্লাবে ঢুকে বীয়ার খাচ্ছে। গাড়িটা বাইরে, বিকল করে দিয়েছি আমি। তুমি এই সুযোগে ওর বাড়িটা একবার সার্চ করে দেখতে পারো। হয়তো তেমন কিছু পাবে না, তবু…।
শহীদ উৎসাহভরে বলল, এক্ষুণি যাচ্ছি আমরা।
কতক্ষণ সময় পাবে জানি না। তাড়াতাড়ি কাজ সারার চেষ্টা কোরো। হাতে আমার সময় নেই, তা না হলে ওকে দেরি করিয়ে দেবার জন্যে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
শহীদ বলল, কোন দরকার নেই। আমরা এখুনি রওনা হয়ে যাচ্ছি, পনেরো মিনিট সময় পেলেই কাজ সারতে পারব।
রিসিভার রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ।
মহুয়া শুকনো মুখে বলল, দাদাও দেখি তোমাদেরকে বাড়ির বাইরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আজকাল!
কামাল অবাক হয়ে বলল, আজ নতুন নাকি! আগে বাইরে বেরোতাম ওর পিছু ধাওয়া করার জন্যে–এই যা!
শহীদ বলল, ভবিষ্যতেও ওই একই কারণে আমাদেরকে বাড়ির বাইরে বেরুতে হবে আবার, এই আমি বলে রাখলাম। ওর নাম কুয়াশা, কখন কি আবিষ্কার করার জন্যে কি না কি ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড ঘটাতে শুরু করবে–আগে থেকে বলা মুশকিল।
.
চক্রবর্তী লেনের মুখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল শহীদ এবং কামাল। পায়ে হেঁটে গলির ভিতর ঢুকল।
রাত সাড়ে এগারোটার মত বাজে। পলিপথ নির্জন, কুয়াশায় ঢাকা। দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে পঁচিশ নম্বর বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা। ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির গেট খোলা, হা হা করছে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় গেট খোলা রেখে গেছে জাহাঙ্গীর হোসেন।
বাড়ির ভিতর ঢুকল ওরা। উঠানের এখানে সেখানে বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছে।
শহীদ নিচু গলায় বলল, কামাল, পাহারায় থাক তুই। কেউ এলে সিগন্যাল দিবি।
তথাস্তু!
উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল শহীদ। আলো জ্বলছে। দেয়ালের গায়ে সুইচ বোর্ড, তাতে লাল একটা বোতাম। কলিংবেলের বোতাম ওটা। শহীদ চেপে ধরল আঙুল দিয়ে।
অন্দর মহলে বেল বাজছে। অনেকক্ষণ কেটে গেল, কেউ সাড়া দিল না দেখে শহীদ বুঝতে পারল, বাড়ি শূন্য, কেউ নেই।
নিশ্চিত হয়ে সামনের জানালা দরজাগুলো পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শহীদ। কিন্তু সুবিধে করতে পারল না বলে উঠানে নেমে বা দিক, দিয়ে চলে এল বাড়ির পিছন দিকে।
পিছন দিকে একটা জানালা খোলা ছিল। কিন্তু গরাদ লাগানো। লোহার শিক ধরে গায়ের জোরে টানাটানি করতে বাঁকা হয়ে গেল দুটো শিক দুদিকে। শহীদ ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকল।
ভাড়ার ঘরে ঢুকে সেখান থেকে কিচেনে গেল শহীদ। তারপর ড্রয়িংরূমে দেখল, বাংলাদেশের প্রকাণ্ড একটা মানচিত্র টাঙানো রয়েছে। টেকনাফ, চালনা ইত্যাদি জায়গায় বারবার হাত পড়ায় কালো দাগ পড়ে গেছে, লক্ষ করল শহীদ।
কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়ল না। আসবাবপত্র দেখে শহীদ শুধু বুঝতে পারল, জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রচুর টাকার মানুষ। কম দামী কোন জিনিসই সে ব্যবহার করে না। আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করল শহীদ, জাহাঙ্গীর হোসেনের সব ব্যবহার্য জিনিসপত্রই একেবারে আনকোরা নতুন। পুরানো জিনিস বলতে তার কিছুই নেই। ব্যাপারটা লক্ষ করে রীতিমত আশ্চর্যই হলো শহীদ।
বেডরূমটা দোতলায়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল শহীদ। খাট, ড্রেসিং টেবিল, ডেস্ক, সোফা-বেডরূমের ভিতর এসবও রয়েছে। ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। ড্রয়ার খুলে দেখল, কাগজপত্র ঠাসা। সেটা বন্ধ করে দিয়ে নিচের ড্রয়ারটা টেনে বের কবুল ও।
একটা ভাঁজ করা কাগজ ছাড়া আর কিছু নেই দ্বিতীয় ড্রয়ারে। কৌতূহলবশত কাগজটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলল শহীদ।
একটা হ্যান্ডনোটের অরিজিনাল কপি কাগজটা। হ্যান্ডনোটের লেখা পড়ে জানা গেল, আজহার মল্লিক কোত্থেকে টাকা সংগ্রহ করে অফিসে জমা দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন আজহার মল্লিককে বিনা সুদে নগদ দশ হাজার টাকা ধার দিয়েছে। এই হলো হ্যান্ডনোটের সারমর্ম।
শহীদ আশ্চর্য হয়ে ভাবল, আজহার মল্লিকের প্রতি এত সদয় হলো কেন জাহাঙ্গীর হোসেন? দশ হাজার টাকা ধার কেন দিল সে?
এদিক ওদিক ভাল করে দেখছিল শহীদ, হঠাৎ চোখ পড়ল একটা পিতলের থালার উপর। কার্পেটের একধারে পড়ে আছে থালাটা। থালার উপর এক গাদা পোড়া কাগজ।
চিন্তিতভাবে পোড়া কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিল শহীদ, এমন সময় কোকিলের ডাক কানে ঢুকল তার।
চমকে উঠে দ্রুত আলো নিভিয়ে দিল ও। কামাল সঙ্কেত দিচ্ছে। তার মানে বাড়িতে ঢুকেছে কেউ।
আলো নিভিয়ে বেডরূম থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে সিঁড়ির মাথায় চলে এল শহীদ। অন্ধকার সিঁড়ির চার পাঁচটা ধাপ নামতেই নিচে থেকে একজন পুরুষের কর্কশ স্বর ভেসে এল, ব্যাটা নিশ্চয়ই ওপরে কোথাও আছে! তুমি পঁড়াও, দেখছি আমি।
অপর একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ফারুক, সাবধান! ব্যাটার কাছে। অস্ত্র থাকতে পারে!
দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল শহীদ সিঁড়ির ধাপের উপর। ফারুক উঠে আসছে, আবছা মত দেখতে পাচ্ছে ও।
ফারুক কাছাকাছি আসতেই সবুট লাথি মারল শহীদ। লাথিটা লাগল ফারুকের পায়ে, ছিটকে পড়ল সে রেলিং-এর গায়ে। তারপর কি হলো তার অবস্থা তা দেখার জন্যে অপেক্ষা না করে লাফ দিয়ে ধাপ কটা টপকে দোতলার করিডরে পৌঁছে গেল। এক ছুটে বেডরূমের ভিতর ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা।
বাগানের দিকে জানালার শার্সি খুলছে শহীদ, সিঁড়ি থেকে ফারুকের চিৎকার ভেসে এল, শয়তানটা বাগানে লাফিয়ে নামতে পারে। জাহাঙ্গীর, বাগানে ছুটে যাও তুমি।
শহীদ ইতোমধ্যে শার্সি খুলে ফেলে লাফ দিয়েছে অন্ধকারে। ফারুক এবং জাহাঙ্গীর বাগানে পৌঁছবার আগেই বাগানের পাচিল টপকে পাশের বাড়িতে চলে গেছে ও।
আজহার মল্লিকের বাড়িতে নেমে শহীদ দেখল, বাগানের মধ্যে দিয়ে একটি যুবতী হলঘরের দরজার দিকে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। দুবোনের একজন হবে, ভাবল শহীদ, এই মাত্র গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে।
দ্রুত এগিয়ে গেল শহীদ। কাছাকাছি গিয়ে চাপা কণ্ঠে ডাকল, শুনছেন!
কে? আঁতকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল তসলিমা, কে আপনি?
আমি শহীদ খান। চেঁচাবেন না, ভয়ের কিছু নেই।
তসলিমা অবাক হয়ে বলল, এত রাতে…বাড়িতে ঢুকলেন কিভাবে?
শহীদ বলল, পরে শুনবেন। আগে হলঘরের দরজা খুলুন, আমাকে ভিতরে নিয়ে চলুন। চাবি আছে আপনার কাছে?
তা আছে।
তালা খুলে ভিতরে ঢুকল তসলিমা। শহীদও ঢুকল তার পিছু পিছু।
কি ব্যাপার বলুন তো?
এমন সময় দোতলা থেকে আজহার মল্লিক জিজ্ঞেস করলেন, কে? তসলিমা নাকি?
হ্যাঁ, বাবা।
গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, এত রাত করে বাড়ি ফিরলি! ভাল! তোর জন্যেই আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে দেখতে পাচ্ছি।
মিসেস আজহার বললেন, হারে, জাহাঙ্গীরের বাড়িতে চোর ঢুকেছে বলে মনে হলো। কিছু শুনলি গেট দিয়ে আসার সময়?
তসলিমা বলল, কই, না তো!
উপর থেকে আর কেউ কোন প্রশ্ন করলেন না। তসলিমা ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে পা বাড়াল লাইব্রেরী রূমের দিকে।
শহীদ তসলিমার পিছু পিছু লাইব্রেরী রূমে ঢুকল।
কি হয়েছে বলুন এবার।
শহীদ বলল, চোর নয়, আমি ঢুকেছিলাম জাহাঙ্গীর সাহেবের বাড়িতে। পালাবার জন্যে পঁচিল টপকে আপনাদের বাড়িতে নেমে পড়ি। আপনাকে দেখে কয়েকটা প্রশ্ন করার ইচ্ছে হয়, তাই ডাকি। ভাল কথা, আমি যে কেন এ পাড়ায় এসেছিলাম কেউ জিজ্ঞেস করলেও বলবেন না যেন।
তসলিমা একটা চেয়ারের হাতলে বসে জানতে চাইল, কি জানতে চান আপনি?
আচ্ছা, হায়দার আলী কি আপনাকে…? প্রশ্নের বাকি অংশটা ইচ্ছা করেই উচ্চারণ করল না শহীদ।
তসলিমার চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ। কিন্তু সে কথা আপনি জানলেন কি করে?
হায়দার আমাকে ফোন করেছিল। সে অনুমান করেছে, শামিমের হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি অনুসন্ধান করছি।
কি বলল ফোনে হায়দার?
শহীদ মুচকি হাসল। বলল, পরিষ্কার করে সে কিছুই বলেনি। তবে যা বলেছে তা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেছে, সে আপনাকে ভালবাসে এখনও।
লজ্জা রাঙামুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে তসলিমা বলল, এসব কথা থাক। ওর প্রতি অবিচার করেছি, সত্যি। কিন্তু সুবিচার যে করব, সে সময়ও আর নেই। আমি অনেক দূর চলে এসেছি।
শহীদ বলল, দরকার হলে দূর থেকে আপনাকে কাছে টেনে আনবে হায়দার–সে যাক। এখন বলুন দেখি, শামিম আপনার কামরায় ঢুকেছিল কেন সে-রাতে?
তসলিমা বলল, এ প্রশ্নের উত্তর আমি তো দিয়েছি। কেন সে ঢুকেছিল, আমি জানি না।
আচ্ছা, কামরা থেকে কিছুই কি হারায়নি আপনার?
না–শুধু চিঠিটা ছাড়া আর কিছুই হারায়নি।
শহীদ বলল, চিঠিটা কার লেখা? কাকে লেখা?
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের লেখা। আমাকে। একটা বিদেশী সেন্ট চেয়েছিলাম শখ করে। বলেছিলেন, দেব। কিন্তু আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি করে অনেকদিন কেটে গেল, দিতে পারলেন না। তাই আমি অভিমান করেছিলাম জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ওপর। দেখা হলেও কথা বলতাম, না। তাই আমার অভিমান ভাঙানর জন্যে ক্ষমা চেয়ে তিনি একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই চিঠিটাই হারিয়েছে।
চিঠিটার কথা শামিম জানত?
তসলিমা বলল, জানত। চিঠিটা আমি হলঘরে দাঁড়িয়ে পড়ি, পড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিই। সেই সময় শামিম সেটা কুড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রাগ করে ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ওকে বলি, পরের চিঠি পড়তে নেই। এরপর চিঠিটা আমি রেখে দিই ব্যাগের ভেতর।
শামিম তা দেখে?
নিশ্চয়ই দেখেছিল।
শহীদ বলল, রাত দুপুরে বিরক্ত করলাম, দুঃখিত। এবার আমি যাব।
নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল শহীদ পঁচিশ নম্বর বাড়ি থেকে। অন্ধকারে অপেক্ষা করছিল কামাল। শহীদকে দেখে বলল, প্রেম করার শখ তো তোর মধ্যে দেখিনি কোনদিন…!
প্রেম করতে যাইনি, গিয়েছিলাম আর একজনের হয়ে প্রেমের বীজ পুঁততে।
তার মানে?
শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর হায়দার ফোন করেছিল বলিনি বুঝি তোকে? তবে শোন, হায়দার আমাকে বলেছে, সে তসলিমাকে ভালবাসে। সে চায় তসলিমাও যেন তাকে ভালবাসে। এ ব্যাপারে আমাকে সে ধরেছে, আমি যেন ওদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করে দিই।
কামাল বলল, কী আশ্চর্য! হত্যাকাণ্ড এবং প্রেম–দুটো যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস!
শহীদ বলল, কিন্তু হত্যাকাণ্ড যেমন সত্য প্রেমও তেমনি সত্য, অস্বীকার করতে পারবি না।
.
পরদিন সকাল দশটায় গ্যাবার্ডিনের সাদা স্যুট পরে শহীদকে দেখা গেল ইন্সপেক্টর হায়দার আলীর অফিসে ঢুকতে।
সাদর আমন্ত্রণ জানাল হায়দার আলী, শহীদ ভাই, আপনি স্বয়ং! কি দরকার ছিল নিজে আসার, আমাকে ডেকে পাঠালেই আমি ছুটে যেতাম। বসুন, বসুন!
শহীদ আসন গ্রহণ করে বলল, কিছু যেন ভাবছিলে?
হ্যাঁ। শহীদ ভাই, আমি ভাবছি…।
শহীদ বাধা দিয়ে সহাস্যে বলল, জানি।
কি জানেন?
তুমি কি ভাবছিলে, বলব? তসলিমার পিছনে লোক লাগাবে কি না ভাবছিলে, যাতে এমদাদকে ধরা যায়, তাই না?
আপনি সর্বজ্ঞ। সেজন্যেই তো আপনাকে এমন শ্রদ্ধা করি। কাজটা কি ভুল হবে, শহীদ ভাই? তসলিমা খবর পেলে দেখা করবেই এমদাদের সাথে, আমি জানি।
কিন্তু, তার দরকার হবে না, হায়দার। শোনো, শামিম যে অফিসে কাজ করত, ঠিকানা জানো?
জানি।
তাহলে গাইড দেখে ফোন নাম্বারটা বের করে দাও আমাকে।
দিচ্ছি।
ফোন গাইড টেনে নিয়ে নাম্বার খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইন্সপেক্টর হায়দার আলী। নাম্বারটা খুঁজে বের করে জানাল সে খানিকপর শহীদকে।
শহীদ ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করল, বলল, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান বলছি। বিশেষ একটা ইনফরমেশন দরকার আমার। শামিম সাহেব আপনাদের কোম্পানীতে চাকরি করতেন, তাই না?
উত্তর এল, হ্যাঁ।
ব্যাঙ্কের কাগজপত্র কি তিনিই দেখা শোনা করতেন? কিংবা, ব্যাঙ্কে যাতায়াত করার দায়িত্ব কি তাঁর ওপরই ছিল?
তিনিই যেতেন ব্যাঙ্কে। কাগজপত্রও তার মাধ্যমে যেত অ্যাকাউন্ট সেকশনে।
শহীদ প্রশ্ন করল, আপনারা কি স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের নারায়ণগঞ্জ শাখার সাথে লেনদেনের কাজ করতেন?
ঠিক তাই।
ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ।
রিসিভার রেখে দিয়ে পাইপে অগ্নিসংযোগ করে অনর্গল ধোয়া ছাড়তে লাগল শহীদ। চোখ দুটো বন্ধ, কি যেন ভাবছে।
খানিকপর চোখ মেলে মৃদু হাসল শহীদ। বলল, হায়দার, পাগলা বিজ্ঞানী প্রফেসার রেহমানের আত্মহত্যার কেসটাও বোধ হয় তোমার হাতে ছিল, তাই না?
ছিল। কিন্তু, শহীদ ভাই…।
শহীদ বলল, জানি কি বলতে চাইছ। প্রফেসার রেহমান আত্মহত্যা করেননি, এই তোমার সন্দেহ, তাই না? আমারও তাই সন্দেহ। না, সন্দেহ নয়, বিশ্বাস। প্রফেসর রেহমান খুন হয়েছেন। খুনীকে ধরতে চাও?
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ইন্সপেক্টর হায়দার আলী, শহীদ ভাই, কী বললেন? কোথায়…কোথায় সে খুনী?
উত্তেজিত হয়ো না, উত্তেজিত হবার দরকার নেই।
খুনীকে ধরতে পারলে আমার প্রমোশন হবে, শহীদ ভাই!
প্রমোশন তোমার নানাক্ষেত্রে হবে। যেমন ধরো, প্রেমে। ভেব না। কেবল রহস্য ভেদ করাই নয়–ঘটকালীও আমার একটা নেশা। আমি হাতে নিয়েছি তোমাদের কেসটা।
.
০৭.
ছাব্বিশ নম্বর চক্রবর্তী লেন। বাড়ির ভিতর দ্বার রুদ্ধ করে বসে আছে জাহাঙ্গীর হোসেন এবং ফারুক চৌধুরী।
হুইস্কির বোতল থেকে গ্লাস দুটোয় আবার তরল পদার্থ ঢালতে ঢালতে জাহাঙ্গীর হোসেন বলল, তোমার কাছ থেকে সত্যি অনেক রকম উপকার পাচ্ছি আমি, ফারুক। সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।
ফারুক তার গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিল। বলল, কিন্তু শুধু কৃতজ্ঞ হলেই তো আর চলবে না। ভেবে দেখো, তোমার অনুরোধে আমি কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। হেড অফিস থেকে জরুরী কোন নির্দেশ ছিল না, তবু মিথ্যে কথা বলে মিস্ত্রীদেরকে সারারাত কাজ করতে বাধ্য করলাম।
উদ্দেশ্যটা কিন্তু পূর্ণ হলো না। টিকটিকি ব্যাটারা বেঁচে গেল ঠিকই। ঠিক আছে, এবার দেখব, কিভাবে তারা শামিমের খুনীকে ধরে।
ফারুক বলল, গতকাল রাতেও তোমার জন্যে প্রাণটা হারাতে বসেছিলাম। লোকটা এমনভাবে লাথি মেরে ফেলে দিল আমাকে সিঁড়ি দিয়ে যদি গড়িয়ে পড়তাম-বাঁচতে হত না।
আচ্ছা, কে হতে পারে লোকটা?
ফারুক বলল, কে আবার, ওই টিকটিকি!
জাহাঙ্গীর হোসেন জানতে চাইল, কিন্তু আমার বাড়িতে সে আসবে কেন?
তা আমি কি করে বলব? হয়তো সন্দেহ করেছে। এসব কথা এখন থাক। দেখো জাহাঙ্গীর, তোমার বিপদের সময় আমি নিজের প্রাণ দিয়েও তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করব, সে প্রমাণ তুমি একাধিকবার পেয়েছ ইতিমধ্যেই। কিন্তু প্রতিদানে আমি কিছু চাই। মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যতই করো, ওতে আমি সন্তুষ্ট নই। একটা কথা মনে রেখো তুমি, আমি ফারুক চৌধুরী, শামিম কবিরনই। শামিমটা ছিল বোকা, আত্মরক্ষায় অসমর্থ। আমি কিন্তু তা নই। যেমন সাহস আছে তেমনি বুদ্ধির ধারও আছে আমার।
তুমি যা বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো।
বলতে চাইছি, আমাকে তুমি আর যাই ভাব শামিমের মত বোকা এবং দুর্বল ভেব না। সোনার ডিম পাড়া হাঁস পেয়েছিল সে ঠিকই, কিন্তু প্রথম ডিমটা পকেটে যেতে না যেতে বেচারী প্রাণে মারা পড়ল। শামিম আসলে ভুল করেছিল, কিন্তু সে-ভুল আমি করব না। হাঁসটাকে কিভাবে প্রতিদিন ডিম পাড়াতে হয় সে কৌশল আমার জানা আছে।
বাঁকা চোখে জাহাঙ্গীর তাকিয়ে ছিল ফারুকের দিকে। ফারুক থামতেই সে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার বক্তব্য।
ফারুক বলল, যে চিঠি তুমি তসলিমাকে লিখেছিলে, শামিম সেটা দেখে। দেখেই তড়িঘড়ি তোমার কাছে এসে টাকা দাবি করে সে। চিঠিটা যে আগে হস্তগত করা দরকার, তা সে ভাবেনি। ওইখানেই ভুল করেছিল সে। যাক, আট হাজার টাকা তুমি তাকে দিলে। আমি সৌভাগ্যবশত জানালা দিয়ে সব দেখলাম এবং সব শুনলাম। শুনে, মাথায় বুদ্ধিটা খেলে। চিঠিটাই আসল জিনিস, সুতরাং সেটা হস্তগত করতে হবে। তাই করলাম। এদিকে গভীর রাতে শামিম চিঠি আনতে গেল তসলিমার কামরায়, খুন হয়ে গেল সে সেখানে। তা সে খুন হয়েছে, ভালই হয়েছে। চিঠিটা এখন আমার কাছে।
পকেট থেকে বের করল ফারুক একটা কাগজ, এই দেখো-এটা চিঠির ফটোস্ট্যাট কপি। আসলটা নিরাপদে রাখা আছে।
আমার কাছ থেকে কি চাও তুমি?
বখরা চাই। তোমার ব্যবসার আধাআধি অংশীদার করে নাও আমাকে, বন্ধু!
জাহাঙ্গীর হোসেন চুপ করে রইল।
ফারুক সোফা ছেড়ে উঠল, দর কষাকষি দুএকদিন পরে হলেও ক্ষতি নেই। চলি, কেমন?
ফারুক দরজা খুলে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
জাহাঙ্গীর হোসেন রাগে, ঘৃণায় সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে মতলব আঁটতে লাগল সে, কিভাবে শায়েস্তা করা যায় ফারুককে।
.
পরদিনের ঘটনা। রাত তখন নটা। চক্রবর্তী লেনের ভিতর ক্রিমসন কালারের একটা ফোক্স ওয়াগেন ঢুকল।
ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির কাছাকাছি থামল গাড়িটা। দরজা খুলে গেল দুদিকের। একদিক থেকে নামল সুদর্শন, সুবেশ প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। অপর দরজা দিয়ে নামল তরুণ পুলিস ইন্সপেক্টর হায়দার আলী।
এদিক ওদিক দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে কামালকে কোথাও দেখতে না পেয়ে শহীদ অবাক হয়ে গেল। সন্ধ্যার খানিক আগে ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে কামালকে পাঠিয়েছে সে ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটার উপর নজর রাখার জন্যে।
পঁচিশ নম্বর বাড়ির ভিতর আলো জ্বলছে। কিন্তু চব্বিশ নম্বর বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা। ছাব্বিশ নম্বরের অবস্থাও তাই।
শহীদ দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল সাতাশ নম্বর বাড়ির দরজার দিকে। কড়া ধরে নাড়ল ও খানিকক্ষণ।
এক প্রৌঢ়া মহিলা দরজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলেন, কাকে চাই?
শহীদ বলল, আপনার পাশের বাড়ির জাহাঙ্গীর সাহেব বাড়িতে আছেন কিনা বলতে পারেন? বাড়ির ভেতর দেখছি আলো-কালো নেই।
প্রৌঢ়া বললেন, সন্ধ্যার সময় জাহাঙ্গীর তার মোটর গাড়িতে জিনিসপত্র, সুটকেস-বাক্স তুলে নিয়ে চলে গেছে। তার সাথে এ পাড়ার আকরাম হোসেন চাকলাদারও ছিল।
শহীদ বলল, কোথায় গেছেন ওরা বলতে পারেন?
না।
আচ্ছা, জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে যাবার আগে তার বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেখেছিলেন?
কই, না…হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একটা ফেরিওয়ালা এসেছিল আমার, বাড়িতে, এখান থেকে সে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে ঢোকে।
তাকে বেরুতে দেখেননি?
না। দরজায় ছিলাম না বেশিক্ষণ।
ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে এল শহীদ। বলল, হায়দার, বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি জাহাঙ্গীরের বাড়িতে কামালকে খুঁজতে যাচ্ছি।
ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির ভিতর ঢুকে শহীদ দেখল দামী-দামী প্রায় সব জিনিসপত্রই অদৃশ্য হয়ে গেছে। ড্রয়িংরূমে একটা রুমাল পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিল সেটা ও।
রুমালে ক্লোরোফর্মের মিষ্টি গন্ধ পেল ও। কিচেনে ঢুকল এরপর শহীদ। কামালকে হাত-পা বাঁধা, মুখে তুলো গোঁজা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হলো ও।
জ্ঞান ফিরে পেয়েছে কামাল খানিক আগেই। তার হাত-পায়ের বঁধন খুলে দিল এবং মুখ থেকে তুলো বের করে নিল ও।
কামাল বলল, ওরা গেছে নারায়ণগঞ্জে। এখলাসপুরে ওদের লঞ্চ অপেক্ষা করছে, হংকং-এর উদ্দেশে রওনা হবে আজ রাতেই।
কামালকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে শহীদ জানতে চাইল, তোর এ অবস্থা হলো কেমন করে?
শিশি-বোতলের ঝুড়ি মাথায় করে ভেতরে ঢুকতেই পেছন থেকে কে যেন আমার নাকে একটা রুমাল চেপে ধরে…
রুমালে ক্লোরোফর্ম ছিল।
তারপরে আমার আর কিছু মনে নেই।
শহীদ বলল, ক্লোরোফর্মে রুমাল ভিজিয়ে ওরা তৈরি হয়ে ছিল। কার জন্যে? নিশ্চয়ই তোর জন্যে নয়?
না, আমার জন্যে কেন–ওরা জানবে কিভাবে আমি আসব?
শহীদ বলল, এ প্রশ্নের উত্তর আছে, যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, পঁচিশ নম্বর বাড়িতে। আয়, দেখা যাক।
রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা।
কামাল, তুই হায়দারের সাথে এখানেই থাক। এখুনি আসছি আমি।
শহীদ হন হন করে এগিয়ে গিয়ে পঁচিশ নম্বর বাড়ির গেট খুলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জানালা দিয়ে আতিয়া দেখতে পেয়েছিল শহীদকে। হলঘরের দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, আসুন, মি. শহীদ।
শহীদ ভিতরে ঢুকল। বলল, বসব না। বাড়িতে কে কে আছেন, বলুন তো?
কেউ নেই, আমি ছাড়া। কেন বলুন তো?
কোথায় গেছেন সবাই?
আতিয়া বলল, মা এবং আব্বা গেছেন, আমাদের এক আত্মীয়র বাড়ি। সন্ধ্যার সময় তসলিমা একটা চিঠি পেয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে বেরিয়ে গেছে।
চিঠি? কে চিঠি পাঠিয়েছিল?
কে পাঠিয়েছিল তা তসলিমা বলেনি আমাকে। তবে হাতের লেখাটা আমার চেনা। চিঠিটা পড়ে সে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়। ওই তো, দেখুন।
বাজে-কাগজের ঝুড়ি থেকে ছেঁড়া চিঠিটা তুলে নিয়ে এসে দিল আতিয়া শহীদকে। বলল, এটা এমদাদ নামে এক লোকের লেখা।
শহীদ বলল, কিন্তু চিঠির কাগজ আমার চেনা, এ তো জাহাঙ্গীর হোসেনের। আচ্ছা, ফারুক সাহেব কোথায়?
তসলিমা চলে যাবার পর এসেছিল, এসেই চলে গেল হাতে একটা সুটকেস নিয়ে।
কোথায়?
তা আমি কি করে বলব?
শহীদ বলল, দেখুন তো, মিস তসলিমার কামরায় তার সুটকেস আছে কিনা? ফারুকের কামরাটাও দেখবেন।
উপরে উঠে গেল আতিয়া। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নেমে এল আবার নিচে। বলল, আশ্চর্য ব্যাপার! ফারুক ভাইয়ের দুটো সুটকেসই রয়েছে। অথচ তসলিমার সুটকেসটা নেই।
শহীদ হঠাৎ চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল দরজার দিকে। বলল, হঠাৎ একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেছে…।
গাড়িতে ফিরে এল শহীদ- দ্রুত স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে। বলল, এমদাদকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে জাহাঙ্গীর হোসেন তসলিমাকে বাড়ি থেকে বের করে সাথে করে নিয়ে গেছে। রুমালে ক্লোরোফর্ম তোর জন্যে নয় কামাল, তসলিমার জন্যে ঢালা হয়েছিল। আর ফারুকও ভিড়েছে জাহাঙ্গীরের দলে। আমার সন্দেহ, তসলিমার ঘাড়ে শামিমের হত্যার দায় চাপাবার ষড়যন্ত্র করছে ওরা সবাই।
লঞ্চ যদি ছেড়ে দিয়ে থাকে…।
শহীদ বলল, মনে হয় মধ্যরাতের আগে ছাড়বে না। জলপুলিসের সাহায্য নিতে হবে, যদি গিয়ে দেখি লঞ্চ নেই।
তীরবেগে ছুটছে ফোক্সওয়াগেন নারায়ণগঞ্জের দিকে। স্পীডমিটারের কাঁটা সত্তরের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।
তীব্র বাতাসে চুল উড়ছে ওদের তিনজনের।
.
রাত নটা বেজে তখন দশ মিনিট হয়েছে। যাত্রাবাড়ির তেমাথায় হাতে সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফারুক চৌধুরী। ঘন ঘন রিস্টওয়াচ দেখছে সে। অস্থির, চঞ্চল দেখাচ্ছে তাকে।
এমন সময় দেখা গেল শহরের দিক থেকে ছুটে আসছে একটা গাড়ি। ফারুক পঁড়িয়ে রইল, তার গায়ে হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোর বন্যা এসে পড়ল।
গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়াল ফারুকের সামনে। গাড়ির ভিতর অন্ধকার। এক পা এগিয়ে ফারুক প্রশ্ন করল, বন্ধু, আছ?
আছি বৈকি।
দরজা খুলে নিচে নামল জাহাঙ্গীর হোসেন। তার হাতে একটা উদ্যত রিভলভার।
ভেতরে ওঠো, নয়তো গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
ভয়ে দিশেহারা ফারুক সুড়সুড় করে গাড়িতে উঠে বসল। জাহাঙ্গীরও উঠল তার পিছু পিছু। দরজা বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলল, চাকলাদার, গাড়ি ছাড়ো।
পাশে বসা ফারুকের দিকে তাকাল জাহাঙ্গীর। ধূর্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটে, কী? আধাআধি বখরা নেবে না? বন্ধু, ভুল একা শামিমই করেনি, তুমিও করলে।
.
০৮.
আধঘণ্টা পর নির্জন ধলেশ্বরী নদীর কাছে থামল গাড়িটা। নদীর জলে বিরাটাকার একটা লঞ্চ নোঙর ফেলে ভাসছে। কোন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না, ভিতরটাও অন্ধকার।
একদিকে নদী, অপরদিকে তেপান্তরের মাঠ, জলাভূমি।
নদীর পাড় থেকে খানিক দূরে কয়েকটা শিমুল গাছ। সেই গাছের পাশে একটা একচালা কুঁড়েঘর। চাকলাদার গাড়ি থামিয়েছে ওই কুঁড়েঘরের সামনেই।
প্রথমে নামল চাকলাদার। জাহাঙ্গীর তাকে ঘর খোলার চাবি দিয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়েছে। ঘরের তালা খুলে হারিকেন জ্বালল সে, ফিরে এল গাড়ির কাছে।
রিভলভার হাতে নিয়ে এরপর নামল জাহাঙ্গীর হোসেন। বলল, কই রে, শালা ফারুক, নামলি না এখনও?
বিনাবাক্যব্যয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ফারুক। জাহাঙ্গীর বলল, ওই ঘরের ভেতর ঢোক।
ফারুক পা বাড়াল। পিছন থেকে পিঠে রিভলভারের নল দিয়ে খোঁচা মারল জাহাঙ্গীর, শালা বলে কিনা আধাআধি বখরা নেব। নে, কত নিবি নে?
বলেই জুতোসহ পা দিয়ে ফারুকের পিছনে সজোরে লাথি মারল জাহাঙ্গীর।
লাথি খেয়েও পড়ল না ফারুক, কোনমতে সামলে নিল সে আছাড় খাওয়া থেকে। ঘরের ভিতর নিঃশব্দে ঢুকে দাঁড়াল এক পাশে।
চাকলাদার, জ্ঞান ফেরেনি তসলিমার?
না।
দুজন ধরাধরি করে নিয়ে এসো ওকে।
নির্দেশ পেয়ে গাড়ির ভিতর থেকে তসলিমার জ্ঞানহীন দেহটা বের করল চাকলাদার এবং এমদাদ। পাজাকোলা করে ঘরের ভিতর নিয়ে এল তসলিমাকে এমদাদ।
শুইয়ে দাও একধারে। কথাটা বলে জাহাঙ্গীর তাকাল ফারুকের দিকে।
ফারুক এই প্রথম কথা বলল, কি করতে চাও তুমি আমাকে নিয়ে?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল জাহাঙ্গীর। বলল, এটা একটা প্রশ্ন হলো? এই শালা, কি করব তোর মত কুকুরকে নিয়ে তা আবার জিজ্ঞেস করার বিষয়? খুন করব, এক্ষুণি গুলি করে মেরে ফেলব তোকে।
ফারুক দরদর করে ঘামছে। ঘন ঘন তাকাচ্ছে সে জাহাঙ্গীরের হাতে ধরা রিভলভারটার নলের দিকে। লোলুপ দৃষ্টিতে নলটা যেন তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে।
কিন্তু আমাকে খুন করে কি লাভ হবে তোমার? আমি যদি আর না ফিরি, কিংবা পুলিস যদি কোনদিন আমার লাশ আবিষ্কার করে, নিঃসন্দেহে তারা আমার কামরার জিনিসপত্র পরীক্ষা করে দেখবে। দেখার সময় তাদের চোখে তোমার লেখা চিঠিটাও পড়বে। তোমার হাতের লেখা দেখে তারা ঠিকই বুঝে নেবে…।
বুঝল, তাতে ক্ষতি কি আমার? আমি চলে যাচ্ছি হংকঙে, জীবনে আর ফিরব না এদেশে।
ফারুক বলল, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। আচ্ছা, তসলিমাকে নিয়ে এসেছ কেন? তাকেও তুমি খুন করবে?
জাহাঙ্গীর গম্ভীর হয়ে বলল, না। ওকে আমি অনেকদিন থেকে ভালবাসি। ওকে আমি বিয়ে করব। তাই এনেছি।
এই সময় তসলিমা একটু নড়ে উঠল। জাহাঙ্গীর সেদিকে তাকাতেই, ফারুক সুযোগটা নেবার চেষ্টা করল। বিদ্যুৎবেগে পা তুলে লাথি চালাল সে।
কিন্তু জাহাঙ্গীর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তড়াক করে লাফ দিয়ে পিছন দিকে সরে গেল খানিকটা, সরে গিয়েই গুলি করল।
ফারুকের বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল তপ্ত বুলেট, পিঠে মস্ত একটা গর্ত সৃষ্টি করে। ধরাশায়ী হলো ফারুক সশব্দে।
নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রইল স্থির হয়ে মাটির মেঝেতে।
বারুদের গন্ধ ঘরে।
কি হলো? কিসের শব্দ ওটা? ধড়মড় করে উঠে বসল তসলিমা।
কেউ নড়েছ কি মরেছ!
কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিল অকস্মাৎ কেউ। পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল শহীদ, কামাল, পুলিস ইন্সপেক্টর হায়দার আলী। ওদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত রিভলভার।
কামাল তার রিভলভারের নল চেপে ধরল জাহাঙ্গীরের পিঠে। স্থির, নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে জাহাঙ্গীর দরজার দিকে পিছন ফিরে। এমদাদ এবং চাকলাদার নির্দেশ না পেলেও, মাথার উপর দুহাত তুলে ঠক ঠক করে কাঁপছে।
শহীদ দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল জাহাঙ্গীর হোসেনের সামনে। ফেলে দাও হাতের রিভলভার।
জাহাঙ্গীর ফেলে দিল রিভলভার।
শহীদ বলল, হায়দার, স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের পলাতক ম্যানেজার, প্রফেসার রেহমানের হত্যাকারী, শামিম কবিরের হত্যাকারী এবং ফারুক চৌধুরীর হত্যাকারী, আবদুর রহিমকে গ্রেফতার করো। জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে আবদুর রহিম, সত্যি, অনেক খেলা দেখিয়েছ তুমি আমাদেরকে। কিন্তু যা হয় শেষ পর্যন্ত তাই হলো, শেষরক্ষা তুমি করতে পারলে না!
ইন্সপেক্টর হায়দার অবাক বিস্ময়ে বলল, শহীদ ভাই, এই লোককে আপনি আবদুর রহিম বলছেন? কিন্তু স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আবদুর রহিমের চেহারার সাথে এর যে কোন মিলই নেই! আমি তার ছবি অন্তত এক লক্ষবার দেখেছি…।
শহীদ বলল, চেহারার মিল তুমি পাবে না, হায়দার। তার কারণটা বলছি। আবদুর রহিম ব্যাঙ্কের বিশ লক্ষ টাকা চুরি করে, তারপর সে যায় প্রখ্যাত নিউরো সার্জেন প্রফেসার রেহমানের কাছে। ভয় দেখিয়ে সে প্রফেসার রেহমানকে বাধ্য করায় প্লাস্টিক সার্জারীর সাহায্যে তার চেহারা বদলে দিতে। প্রফেসার রেহমান চেহারা বদলে দেন আবদুর রহিমের। নতুন চেহারা, নতুন নাম গ্রহণ করে আবদুর রহিম। আবদুর রহিম হয় জাহাঙ্গীর হোসেন। প্রফেসার রেহমান তার প্রকৃত পরিচয় জানেন, সুতরাং তাঁকে খুন করে সে, যাতে ধরা পড়ার শেষ ভয়টাও আর না থাকে।
বুঝেছি।
হায়দার আলী এগিয়ে এসে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে আবদুর রহিমের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
শহীদ বলল, ফারুককে হয়তো বাঁচানো যেত আরও খানিক আগে পৌঁছুলে। কিন্তু গুলির শব্দ না হলে তো এই কুঁড়েঘর খুঁজেই পেতাম না। ফারুক-সে-ও নিজের দোষে খুন হলো। শামিম যে পথে পা বাড়িয়ে খুন হয়েছিল, ফারুকও সেই পথে পা বাড়াতে…।
কামাল প্রশ্ন করল, কিন্তু শামিম কেন খুন হলো? শামিমের হত্যা এখনও আমার কাছে একটা রহস্য হয়ে রয়েছে।
শহীদ বলল, সব রহস্যের সমাধান বের করে ফেলেছি আমি। শামিম খুন হয়েছে লোভে পড়ে। শোনো তবে, স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আবদুর রহিমের হাতের লেখা পরিচিত ছিল শামিমের। কেননা, শামিম যে অফিসে চাকরি করত সেই অফিসের সাথে স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের লেনদেন ছিল। ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাশোনা করত শামিমই। সুতরাং আবদুর রহিমের হস্তাক্ষরের সাথে পরিচিত ছিল সে।
তা না হয় হলো। কিন্তু…।
শহীদ বলল, সব কথা বলতে দে আমাকে আগে। জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে আবদুর রহিম নতুন নামে, নতুন চেহারায় বসবাস শুরু করেছিল চক্রবর্তী লেনের ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটা কিনে নিয়ে। ঘটনাচক্রে, পাশের বাড়ির মিস তসলিমাকে যেদিন সে চিঠি লেখে সেদিনই শামিম উপস্থিত হয় তসলিমাদের বাড়িতে। চিঠিটা সে দেখে। দেখেই আবদুর রহিমের হাতের লেখা চিনতে পারে সে। যেভাবেই হোক, খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারে পাশের বাড়িতেই থাকে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে আবদুর রহিম। মিস তসলিমাদের বাড়ি থেকে সোজা সে জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়িতে যায়। জাহাঙ্গীরকে সে বলে, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, চেহারা বদলালে কি হবে, হাতের লেখা তো আর বদলাওনি। স্বভাবতই জাহাঙ্গীর ভয় পেয়ে যায়। পুলিস জানলে ধরে নিয়ে যাবে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ফাঁসি হবে তার। টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে সে শামিমের।
কামাল বলল, এতক্ষণে বুঝলাম।
হাতকড়া পরানো হলো সবার হাতে।
শহীদ চাকলাদার এবং এমদাদের দিকে আঙুল তুলে বলল, হায়দার, এদের দুজনকে থানায় নিয়ে গিয়ে খাতির-যত্ন করো। যতক্ষণ না গড়গড় করে সব কথা বলে ততক্ষণ চালিয়ে যাবে। এরা শত শত কুকর্মের ভাগীদার। এদের কাছ থেকে তুমি অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করতে পারবে…আরে! মিস তসলিমা! আপনি কাঁদছেন কেন? ওহে, হায়দার, ওকে একটু সান্ত্বনা দাও!
শহীদ হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল কুঁড়েঘর থেকে বন্দী তিনজন ও হতচকিত কামালকে ঠেলে নিয়ে।
Leave a Reply