কুয়াশা ৭২ (ভলিউম ২৪)
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
০১.
বোম্বে।
রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ খাবার পর কুয়াশার কাছ থেকে নোটবুকটা চেয়ে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলেন মি. বচ্চন। দেখা শেষ হতে বললেন, পাঁচটা এন্ট্রির সাথে…
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। বিমানের আরোহীদের সাথে ওই এন্ট্রিগুলোর বিষয়বস্তু মিলতে পারে বলে মনে হয়। পড়ুন তো এক এক করে।
মি. বচ্চন পড়তে শুরু করলেন:
CL 52. বাংলাদেশী শিল্পী। স্বামীও নাম করা।
RT 362. ডাক্তার। ধানমণ্ডি, ঢাকা।
MR 24. নকল মূর্তি, প্রাচীন অ্যান্টিকস।
XVB 724, বাংলাদেশী। কোম্পানীকে চিট করছে।
GF 45. অ্যাটেম্পটেড মার্ডার। বাংলাদেশী।
কুয়াশা বলল, বাংলাদেশী শিল্পী, স্বামীও নাম করা–মিসেস পারভিন সম্ভবত, তাই না?
তাই তো মনে হচ্ছে।
কুয়াশা চুরুটে আগুন ধরাল, ধোয়া ছেড়ে বলল, মহিলা যে হারে জুয়া খেলে এবং এতই বিলাসবহুল জীবন-যাপন করে, টাকা ধার না করে উপায় কি তার। ম্যাডাম নোয়া কত টাকা ধার দিয়েছিলেন তাকে, এই মুহূর্তে জানবার উপায় নেই। আমাদের। স্বামী নাম করা–এই কথাটা কেন লিখেছিলেন ম্যাডাম নোয়া। স্বামীর কাছ থেকে সুদের টাকা আদায় করার ইচ্ছা ছিল সম্ভবত। যেহেতু স্বামী নাম করা, তাই স্ত্রীর কোন দুর্বলতা বা অপরাধের কথা প্রকাশ করে দেবার ভয় দেখালে পাওনা টাকা এবং সুদ পাওয়া যাবে অনায়াসে, এই হয়তো ভেবেছিলেন ম্যাডাম নোয়া।
মি. বচ্চন বললেন, রত্নাগিরি থেকে বোম্বে ফেরার দিন ম্যাডাম নোয়ার কাছে সাক্ষাৎপ্রাথী…
মিসেস পারভিন সে, আমার কোন সন্দেহ নেই। ম্যাডামকে রত্নাগিরি থেকে অনুসরণ করে বোম্বেতে আসে সে। বোধহয়, আরও টাকা ধার করার জন্যে।
মি. বচ্চন বললেন, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যে?
কুয়াশা চুপ করে রইল।
কি ভাবছেন, মি. শহীদ?
কুয়াশা বলল, ভাবছি…না, থাক। যা ভাবছি তা সত্যি না-ও হতে পারে। আসুন, আমাদের বাছাই করা পরবর্তী এন্ট্রিটাকে ধরা যাক। RT 362 ডাক্তার। ধানমণ্ডি, ঢাকা।
ডাক্তার সমীরের বাড়ি এবং চেম্বার ধানমণ্ডিতেই।
কুয়াশা বলল, এর সম্পর্কে তদন্ত করবেন মি. সিম্পসন।
আপনি? ডাক্তারকে কি আপনি সন্দেহ করেন না?
কুয়াশা বলল, সন্দেহ ঠিক জানি না। তবে, সন্দেহ করা উচিত নয়। কিন্তু আমার ধারণা যদি ভুল হয়, তাহলে শুধু সন্দেহ করা উচিত নয়, এখুনি ডাক্তার সমীরকে গ্রেফতার করা উচিত।
অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন কুয়াশার দিকে মি. বচ্চন, এসব কি বলছেন? কিছুই যে বোধগম্য হচ্ছে না!
কুয়াশা বলল, বাদ দিন। এরপর–MR 24, নকল মূর্তি, প্রাচীন অ্যান্টিকস। প্যাটেলদ্বয়কে ইঙ্গিত করছে বলে মনে হয়। কিন্তু, বিশ্বাস হয় না আমার। ওরা বিখ্যাত গবেষক, ওরা কেন টাকা ধার করতে যাবে ম্যাডাম নোয়র কাছ থেকে? এবার ধরুন–xVB. 724, কোম্পানীকে চিট করার চেষ্টা করছে, কে? আবদুল হাফিজ, একটা কোম্পানীর প্রতিনিধি। মিস লিলি, একটা কোম্পানীতে চাকরি করে। এদের মধ্যে যে-কেউ একজন হতে পারে। ডাক্তার, লেখক, হিপ্পী-এদের মধ্যে কেউ না। এরপর আসছে Gl: 45, অ্যাটেম্পটেড মার্ডার। কার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে? নির্দিষ্ট কার দিকে, বোঝা মুশকিল। লেখক, ডাক্তার, প্রাইভেট ডিটেকটিভ, হিপ্পী, চাকুরে, গৃহিণী, বেকার–যে কেউ হতে পারে Gl 45. একমাত্র প্যাটেলদ্বয় ছাড়া।
মি. বচ্চন কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, নতুন কোন ইনফরমেশন এসেছে কিনা জানার জন্যে চলুন যাই আমার অফিসে।
কুয়াশা বলল, অবশ্যই। যাব আপনার সাথে। কিন্তু তারপর আমি নিজে ইনভেস্টিগেশনে বেরুব এদিক ওদিক, আপনার সঙ্গ তখন হয়তো দরকার হবে। আমার।
কমিশনারের অফিসে পৌঁছুল ওরা ট্যাক্সি নিয়ে।
চেম্বারে ঢুকে মি. বচ্চন একজন ইন্সপেক্টরকে ডেকে পাঠাল পিয়নের মাধ্যমে। ইন্সপেক্টর তক্ষুণি ঢুকল চেম্বারে। স্যালুট করল মি. বচ্চনকে।
ম্যাডাম নোয়া মার্ডার কেস সম্পর্কে নতুন কি জানতে পেরেছেন বলুন।
ইন্সপেক্টরকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। উত্তেজনা, দমন করার চেষ্টা করছে সে, মুখ দেখে বুঝতে পারল কুয়াশা।
একজন গ্রীক অ্যান্টিক ডিলার রিপোর্ট করেছে, স্যার। লোকটার নাম জিরোপোলাস, শার্প এভিনিউয়ে তার দোকান। রিপোর্টে সে জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার তিনদিন আগে সে একটা ব্লো-পাইপ বিক্রি করেছে।
মি. বচ্চন জানতে চাইলেন, ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে তার?
মাত্র আধঘণ্টা আগে খবরটা এসেছে, স্যার।
কুয়াশা বলল, আমি ইন্টারভিউ নিতে চাই। ইন্টারেস্টিং, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।
.
দোকানটা বেশ বড় আকারের। জমজমাট ব্যবসা জিরোপোলাসের। অনর্গল কথা বলে লোকটা। বপু আছে একটা প্রকাণ্ড। লম্বায় প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। মিনিট তিনেকের মধ্যে অনেক কথা বলে ফেলল সে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আর্কিয়োলজিস্ট জগৎ সিং প্যাটেল তার দোকানের নিয়মিত খদ্দের। বাংলাদেশ থেকে যারা এখানে বেড়াতে আসে, তারা প্রায় সবাই তার দোকানে একবার। পায়ের ধুলো দিয়ে যায়। এই তো, কদিন আগে মিসেস পারভিন, বাংলাদেশের নৃত্য শিল্পী এসেছিলেন তার দোকানে।
ব্লো-পাইপ এবং বর্শা সম্পর্কে সে জানাল, বহু বছর ধরে দোকানের সস্তা দামের জিনিসের সাথে ওগুলো পড়ে ছিল। কেউ ছুঁয়েও দেখত না। বিক্রি হবে না, ধরেই নিয়েছিল সে, কিন্তু হঠাৎ করে আমেরিকান লোকটা সেদিন দোকানে ঢুকেই ওটা দেখে দাম জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, লোকটা আমেরিকান। চুয়িংগাম চিবাচ্ছিল, মাথায় ছিল হ্যাট, হিন্দী বাংলা কোন ভাষাই জানে না। ব্লো-পাইপটার ইতিহাস ব্যাখ্যা করে তাকে শোনায় সে, উপজাতীয়রা জিনিসটাকে কিভাবে শত্রু খতম করতে ব্যবহার করে, তাও বিশদ জানায় তাকে। দাম চায় সে ভারতীয় মুদ্রায় পঞ্চাশ টাকা। অস্বাভাবিক বেশি দাম চেয়েছিল সে। ভেবেছিল আমেরিকানটা দামাদামি করবে, কিন্তু না! দর কষাকষি না করে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে লোকটা ব্লো-পাইপ এবং বর্শাগুলো নিয়ে চলে গেল। এইখানেই শেষ ব্যাপারটার। কিন্তু খবরের কাগজে হত্যাকাণ্ডটির সংবাদ পড়ে তার টনক নড়ল। ব্লো-পাইপ ব্যবহার করে খুন করা হয়েছে। যে ব্লো-পাইপটা সে বিক্রি করেছে সেটা দিয়ে নয়তো? সন্দেহটা মনে জাগতে টেলিফোনে খবর দেয় সে থানায়।
মি. বচ্চন বললেন, খুব উপকার করেছেন আপনি, মি. জিরোপোলাস! রো পাইপটা এখন ঢাকায় আছে, আবার ব্যবস্থা করছি আমরা। দেখে বলতে পারবেন তো সেটাই আপনার দোকান থেকে বিক্রি হয়েছে কিনা?
তা পারব।
কুয়াশা বলল, ব্লো-পাইপ এবং বর্শাটা দেখতে কেমন, বর্ণনা করুন তো?
জিরোপোলাস বলল, বর্শা একটি নয়, স্যার, চারটি। ব্লো-পাইপটা আট ইঞ্চি লম্বা, আমার এই পেনের মত মোটা। হালকা ধূসর রঙের জিনিসটা। বর্শাগুলোর মাথা সূচের মত ছুঁচালো, এগুলো আসলে কোন এক গাছের কাটা। লাল সিল্কের সূতোর ঝালর আছে পিছন দিকে।
লাল?
জিরোপোলাস বলল, হ্যাঁ, স্যার, লাল।
মি. বচ্চন বললেন, বলেন কি! কালো এবং হলুদ নয় তাহলে?
তা কেন হতে যাবে…।
মি. বচ্চন কুয়াশার দিকে মুখ ফেরালেন।
কুয়াশার মুখে হাসি ফুটে উঠছে। অচেনা, রহস্যময় ঠেকল মি. বচ্চনের চোখে কুয়াশার হাসিটা। কেন এই হাসি, সেটা তার কাছে আর এক রহস্য। জিরোপোলাস মিথ্যে কথা বলছে মনে করে, নাকি অন্য কোন কারণে হাসছে ভদ্রলোক?
মি. বচ্চন প্রশ্ন করলেন, হাসছেন যে, মি. শহীদ?
কুয়াশা মি. বচ্চনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিরোপোলাসকে প্রশ্ন করল, আপনার আমেরিকান খরিদ্দারের চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
জিরোপোলাস বলল, অনেক আমেরিকান আমার দোকানে আসে, স্যার। সব আমেরিকানদের মতই এই লোকটা। নাক দিয়ে কথা বলে, চুয়িংগাম খায়, গোল্ডরিমের চশমা ছিল নাকে, হ্যাট ছিল। বেশ লম্বা, বয়স চল্লিশের এদিকেই হবে।
মাথার চুল?
হ্যাটে ঢাকা পড়ে ছিল, তাই…
আবার তাকে দেখলে চিনতে পারবেন?
সন্দিহান মনে হলো জিরোপোলাসকে। বলল, দেখুন স্যার, প্রত্যেকদিন কত যে লোক দোকানে ঢোকে, তার হিসেব রাখাই মুশকিল-চেহারা মনে রাখা তো অসম্ভব! তা ছাড়া, সব আমেরিকানকেই আমার এক রকম মনে হয়।
দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে মি.বচ্চন বললেন, সিল্কের ঝালর কালো এবং হলুদ রঙের নয়। তার মানে জিরোপোলাস যে ব্লো-পাইপ এবং বর্শা বিক্রি করেছে সেটার সাথে আপনাদের পাওয়া জিনিসটার কোন সম্পর্ক নেই।
কুয়াশা হেসে উঠল। বলল, বলেন কি!
সম্পর্ক আছে, আপনি বলতে চান, মি. শহীদ?.কিন্তু লাল রঙের ঝালরের কথা বলল যে ও?
কুয়াশা বলল, ঝালর বদলানো কি অসম্ভব, মি.বচ্চন?
ঝালর-কি? বদলাবে কেন? এ আপনি কি বলছেন?
কুয়াশা বলল, বদলাবে, কারণ তা না হলে সাইকোলজিকাল মোমেন্ট সৃষ্টি করবে কিভাবে খুনী?
আপনার কথা…
বুঝতে পারছেন না, এই তো? পারবেন, যথাসময়ে পারবেন। এখন, চলুন, বাংলাদেশ বিমানের অফিসে যাওয়া যাক একবার।
মি. বচ্চন অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কেন, সেখানে আবার কি? কার কাছে যাবেন?
কুয়াশা গম্ভীর হলো। বলল, কার কাছে যাব জিজ্ঞেস করছেন। যাব–একজন মিথ্যেবাদীর কাছে। মি. বচ্চন অসহায় ভঙ্গিতে মাথা দোলাতে শুরু করলেন, হে ভগবান! এই ভদ্রলোককে কি তুমি হেঁয়ালি না করে কথা বলতে শেখাওনি!
বাংলাদেশ বিমানের ব্রাঞ্চ অফিস। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে কুয়াশা নিজের পরিচয় দিল প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান হিসেবে। টিকেট কাউন্টারের কেরানী লোকটা খাতির করে বসাল ওদেরকে একটা রূমে।
কুয়াশা বলল, আমরা এসেছি ম্যাডাম নোয়া হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু খুচরো ইনফরমেশন সংগ্রহ করতে।
কেরানী বলল, আপনাদের সেবায় লাগলে নিজেকে ধন্য মনে করব, স্যার। আমার নাম গিয়াস উদ্দীন খান, কাউন্টারের দায়িত্ব আমার ওপরই। ..
কুয়াশা বুলল, গত মোলো তারিখের দুপুরের ফ্লাইটে ম্যাডাম নোয়া ঢাকায় যান। টিকেট রিজার্ভ করা হয়েছিল কবে বলুন তো?
তার আগের দিন, স্যার। ম্যাডামের সেক্রেটারি ফোন করে রিজার্ভ করেছিল।
কুয়াশা বলল, মাডামের সেক্রেটারি আমাকে জানিয়েছে, সকালের ফ্লাইটের টিকেট চেয়েছিল সে, কথাটা কি ঠিক?
গিয়াস উদ্দীনকে হতভম্ব দেখাল। বলল, স্যার, …হা, চেয়েছিল। কিন্তু, সকালের ফ্লাইটের সব টিকেট বুকড় হয়ে গিয়েছিল, তাই তাকে আমরা দুপুরের ফ্লাইটের টিকেট দিই।
কুয়াশার চেহারা কেমন যেন গভীর, লক্ষ করলেন মি. বচ্চন।
আচ্ছা, গিয়াস খান, পনেরো তারিখে কখন ফোন করেছিল তার সেক্রেটারি?
এই সন্ধ্যা সাতটার দিকে, স্যার।
কুয়াশা বলল, সাড়ে সাতটার দিকে আর এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন আপনাকে। তাকে আপনি পরদিন অর্থাৎ মোলো তারিখের সকালের ফ্লাইটের টিকেট অফার করেছিলেন। কথাটা আপনার মনে আছে কি? আমি জানতে চাই, সকালের ফ্লাইটের সব টিকেট বুক হয়ে গিয়ে থাকলে এই ভদ্রলোককে টিকেট দিতে চেয়েছিলেন কিভাবে?
গিয়াস খান ঘামছে। ঢোক গিলছে ঘন ঘন। খাঁচায় বন্দী ভীতু একটা ছুঁচোর মত দেখাচ্ছে তাকে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে জানালা এবং দরজার দিকে তাকাচ্ছে সে।
মিথ্যে কথা বলেছিলেন আপনি ম্যাডাম নোয়ার সেক্রেটারিকে। সকালের ফ্লাইটের টিকেট ছিল, অথচ তাকে আপনি তা দেননি। কারণ? কত টাকা খেয়েছেন, গিয়াস খান? এবং কার কাছ থেকে?..
ছিচকাঁদুনে বাচ্চার মত কেঁদে ফেলল গিয়াস খান। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, স্যার, আমার চাকরিটা যাবে! দয়া করেন, আপনারা আমাকে এবারের মত মাফ করে দিলে…
কত টাকা?
পাঁচশো, স্যার!
কুয়াশা জানতে চাইল, কার কাছ থেকে?
গিয়াস খান রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলতে শুরু করল, এর মধ্যে কোন অপরাধ আছে, তখন বুঝিনি, স্যার। লোকটা আমেরিকান সে আমার সাথে এই খানেই দেখা করে, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন। আমাকে বলে, ঢাকায় যাবে সে আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে। হাতে কাজ আছে, তাই সকালের ফ্লাইটে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। আমাকে আরও বলে, ম্যাডাম রাউল চিখারীও আগামীকাল ঢাকায় যাবেন, এবং ম্যাডামের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করার ইচ্ছা আছে তার। তার ইচ্ছা, বিমানের ভিতর দেখা করবে সে ম্যাডামের সাথে, ম্যাডামের। বাড়িতে বা অন্য কোথাও নয়। বিমানে দেখা করে টাকা চাইলে ম্যাডাম প্রত্যাখ্যান করবেন না, তার নাকি এই রকম বিশ্বাস। আমাকে সে অনুরোধ করে, ম্যাডামের সেক্রেটারি সকালের ফ্লাইটের টিকেট চাইলে আমি যেন তাকে জানাই সব টিকেট বুক করা হয়ে গেছে, দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকায় যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এই কাজের জন্যে সে আমাকে নগদ পাঁচশো রুপি দিতে চায়। কাজটার মধ্যে ক্ষতিকর কিছু নেই মনে করে
লোকটা আমেরিকান? চেহারার বর্ণনা দিন।
লম্বা। হ্যাট ছিল মাথায়। দাড়ি ছিল থুতনির কাছে, ছাগলের মত। চুয়িংগাম ছিল মুখে। গোল্ডরিমের চশমা পরেছিল।
কুয়াশার দিকে তাকালেন মি. বচ্চন।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, লোকটা তাহলে দুপুরের ফ্লাইটের একটা টিকেট কেনে? কিন্তু কোন আমেরিকান তো ছিল না বিমানে।
গিয়াস খান বলল, ম্যাডামের সীট নম্বর ছিল দুই, লোকটাকে আমি এক নম্বর সীটের টিকেট দিই। কিন্তু লোকটা ওই ফ্লাইটে ঢাকায় যায়নি, তা ঠিক। খবরের কাগজে বিমানের আরোহীদের যে নামের তালিকা ছাপা হয়েছে তাতে ওই লোকের নাম দেখিনি আমি।
নামটা কি বলেছিল?
সাইলাস হারপার।
চেয়ার ত্যাগ করল কুয়াশা। দেখাদেখি মি. বচ্চনও।
গিয়াস খানের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন মি. বচ্চন, আপনি ঘুষ খেয়েছেন–উপযুক্ত শাস্তি আপনার যাতে হয় তার ব্যবস্থা আমি করব।
বাইরে বেরিয়ে এসে মি. বচ্চন বললেন, আই স্যালুট ইউ, মি. শহীদ। কিন্তু ব্যাপারটা ধরলেন কিভাবে?
কুয়াশা বলল, খুব সহজেই। পনেরো তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় এই লোকের কাছে ফোন করেছিলাম আমিই। আমাকে জানিয়েছিল সকালের টিকেট আছে। অথচ, আজ কারানান খাট্টা বলল, সে-ও ফোন করেছিল, কিন্তু তাকে বলা হয়েছিল সকালের ফ্লাইটের টিকেট বুক হয়ে গেছে। মিলছিল না ব্যাপারটা। হয় ভুল, নয়তো কেউ ইচ্ছা করে মিথ্যে কথা বলেছে–এই ভেবে সন্ধান নিতে এসেছিলাম আর কি। প্রমাণ হয়ে গেল ঘুষ খেয়ে মিথ্যে কথাই বলেছিল গিয়াস খান।.
মি. বচ্চন বললেন, প্রতি মিনিটে কেসটা জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছে। খানিক আগে মনে হচ্ছিল খুনী বুঝি কোন নারী–এখন দেখা। যাচ্ছে সে একজন পুরুষ। এই আমেরিকান লোকটা… :
কুয়াশার কণ্ঠে শ্লেষ, আমেরিকান, না? বোম্বে শহরে আমেরিকান কম নেই..তাছাড়া, আমেরিকান সাজাও তেমন কঠিন কোন ব্যাপার নয়। আলগা দাড়ি, একটা হ্যাট, গোন্ড রিমের চশমা; মুখে চুইংগাম, একটু নাকি সুরে কথা বলার নৈপূণ্য–ব্যস! হয়ে গেলেন আপনি আমেরিকান।
পকেট থেকে সিনেমা সাপ্তাহিকটা বের করে মেলে ধরল কুয়াশা চোখের সামনে।
কি দেখছেন? মিসেস পারভিনকে? ওকে আবার কেন?
কুয়াশা কথা না বলে তাকিয়েই রইল ছবিটার দিকে।
আপনি কি ভাবছেন মিসেস পারভিন আমেরিকান যুবকের ছদ্মবেশ নিয়ে নাহ্, এ অসম্ভব। হতে পারে মিসেস পারভিন অভিনেত্রী…
কুয়াশা বলল, আমি কি তাই বলেছি?
কিন্তু ছবিটার দিক থেকে চোখ তুলল না কুয়াশা। গভীর আগ্রহের সাথে কি যে দেখছে একমাত্র সেই জানে।
.
০২.
খুলনা।
আসিফ চৌধুরীর বাসভবন।
ড্রয়িংরুমে একা পায়চারি করছে আসিফ চৌধুরী। কপালে চিন্তার রেখা। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স তার। লম্বায় একটু খাটো সে, গায়ের রঙ শ্যামলা। স্বাস্থ্যটা ভাল। পরনে ধোপদুরস্ত পায়জামা-পাঞ্জাবী, হাতে সোনার চেনওয়ালা দামী ঘড়ি, আঙুলে হীরে বসানো একটা আঙটি, পায়ে বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি একজোড়া স্যান্ডেল।
পায়চারি থামিয়ে মাঝে মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে আসিফ চৌধুরী, তারপর আবার পায়চারি শুরু করছে। কোন ব্যাপারে সে যেন নির্দিষ্ট একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চাইছে–কিন্তু পারছে না।
একসময় ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে গেল আসিফ চৌধুরী। করিডর ধরে সিঁড়ির দিকে হন হন করে হাঁটতে লাগল সে।
সিঁড়ি টপকে দোতলায় উঠে স্ত্রীর বন্ধ কামরার দরজায় মৃদু নক করল আসিফ চৌধুরী।
ভিতরে এলো। কর্কশ কণ্ঠস্বর পারভিনের, ভিতর থেকে ভেসে এসে আসিফ চৌধুরীর কানে ধাক্কা মারল। দরজার কবাট উন্মুক্ত করে ভিতরে ঢুকল সে, দেখল নরম ফোমের বিছানায় কয়েকটা বালিশের উপর পিঠ রেখে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে পারভিন। তার কোলের উপর, এবং আশপাশে সিনে-ম্যাগাজিন পড়ে রয়েছে কয়েকটা।
হঠাৎ এই সময়ে? দাঁড়িয়ে কেন, বসো? স্বামীর দিক থেকে চোখ-সরিয়ে নিয়ে ম্যাগাজিনে দৃষ্টি রাখল পারভিন।
আসিফ চৌধুরী কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়েই রইল, বসল না। বলল, কেন এসেছ তুমি খুলনায়, পারভিন? কি উদ্দেশ্য তোমার?।
স্বামীর দিকে তাকাল পারভিন, এ প্রশ্নের অর্থ? এখানে আমার আসা নিষেধ নাকি?
আসিফ বলল, কোন কারণ ছাড়া এখানে তো তুমি আসতে চাও না। একমাত্র অতিরিক্ত টাকা আদায় করার জন্যেই এখানে আসো। তাছাড়া…তোমার সাথে মোটামুটি একটা বোঝাঁপড়া হয়েছিল আমার, ভুলে গেছ নাকি! তুমি কথা দিয়েছিলে ঢাকাতেই থাকবে, এখানে আসবে না। এখানের মানুষ আমাকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে। তারা যদি দেখে তুমি….আমার সম্পর্কে কি ভাববে জানো না?
কি ভাববে? পারভিন যেন আকাশ থেকে পড়ল।
নিজেকে দমন করার চেষ্টা করছে আসিফ চৌধুরী। বলল, তোমার চালচলন আমার মনঃপূত নয়, জানো তুমি। সী-বীচে প্রায় উলঙ্গ হয়ে তুমি সাঁতার কাটতে যাও, সিনেমায় নামমাত্র কাপড় পরে তুমি নাচানাচি করো, নায়কদের সাথে প্রেম করো–এসব আমি ঘৃণা করি।
সেক্ষেত্রে আমাকে ত্যাগ করলেই পারো।
আসিফ চৌধুরী বলল, পারি। তুমি চাও-ও তাই। কারণ, জানো তুমি, তোমাকে আমি ডিভোর্স করলে বিয়ের শর্ত অনুযায়ী পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে তোমাকে। বারা এই ভুলটা করে গেছেন। কিন্তু পারভিন, পাঁচ লাখ টাকা তোমাকে আমি দেব না। তারচেয়ে তোমার সব অত্যাচার আমি সহ্য করব।
পারভিন বলল, শুধু পাঁচ লাখ টাকা নয়, আমাকে ডিভোর্স করলে মাসহারা দিতে হবে প্রতিমাসে দুহাজার টাকা, মনে আছে তো!
আসিফ বলল, এখনও তাই দিচ্ছি– সুতরাং তোমাকে ত্যাগ করেও আর্থিক দিক থেকে লাভ হচ্ছে না আমার।
পারভিন ঠোঁট বাঁকা করে হাসছে। বলল, তা হচ্ছে না। কিন্তু আমাকে ত্যাগ করলে সাঈদাকে বিয়ে করার সুযোগ পাচ্ছ।
পারভিন।
পারভিন বলল, ঢাকায় থাকি বটে, কিন্তু সব খবরই আমি ওখানে বসে পাই, আসিফ। অস্বীকার করতে পারবে, সাঈদার সাথে প্রত্যেকদিন তুমি দেখা করো না?
অস্বীকার করব কেন? ওদের বাড়িতে আমি যাই। ওদের বাড়ির লোকদের সাথে বেড়াতেও বের হই, সাথে সাঈদাও থাকে। ভুলে যেয়ো না, সাঈদা আমার খালাতো বোন।
খালাতো বোন হোক আর যাই হোক, তুমি ওর প্রেমে পড়েছ।
আসিফ ধীরে ধীরে খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নই। তুমি কেন এসেছ তাই বলো।
কিছুদিন থাকব বলে এসেছি। বেড়াতে এসেছি। ঢাকায় একঘেয়ে লাগছিল, তাই চলে এসেছি। আমার হঠাৎ এসে পড়ায় তোমাদের প্রেমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে, ভাবছ বুঝি?
আসিফ বলল, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না। তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে–কি সেটা?…আচ্ছা! ম্যাডাম…কি যেন? ম্যাডাম নোয়া, তার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলে নাকি?
তার মানে?
আসিফ বলল, আকাশ থেকে পড়ো না। এর আগে তোমার তিনজন পাওনাদারের দেনা পরিশোধ করেছি আমি।
ম্যাডাম নোয়ার কাছ থোক আমি টাকা ধার করিনি।
আসিফ বলল, করলেও, সে-দেনা পরিশোধ করতে হবে না, তাই না? খুন হয়েছে যখন বেঁচে গেছ! আমি ভাবছি…
খুনটা আমিই করেছি কিনা–এই ভাবছ তো?
আসিফ জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল। তাকাল স্ত্রীর দিকে। বলল, পারভিন, সত্যি কি ঘটেছে বলে আমাকে।
পারভিন বলল, সত্যি কি ঘটেছে মানে?
এই খুনের সাথে তুমি যদি জড়িত থাকো…
আমি! তুমি আমাকে ভেবেই কি?
আসিফ বলল, এখনও সময় আছে পারভিন, যদি কিছু বলার থাকে, বলে ফেলো।
পারভিন হঠাৎ হেসে উঠল। বলল, আমি যদি খুন করেই থাকি, তাতে তো তোমার খুশি হবারই কথা! পুলিস আমাকে গ্রেফতার করবে, আমার মৃত্যুদণ্ড হবে বেঁচে যাবে তুমি!
আসিফ বলল, তা হয়তো বাঁচব। কিন্তু এর দরুন আমার এবং আমার পরিবারের যে সম্মানহানি ঘটবে তা পূরণ করা কোনদিন সম্ভব হবে না। তুমি জানো সম্মানের মূল্য দিই আমি।
কিন্তু স্ত্রীর মূল্য দাও না!
আসিফ বলল, স্ত্রী যদি কথা শুনে চলত…
তুমি তো একটা গেঁয়ো ভূত, তোমার কথা মত চললে বন্দিনী অবস্থায় জীবন কাটাতে হবে–সে আমি পারব না।
আসিফ চৌধুরী রাগে কেঁপে উঠল। আমি গেয়ো, না? নিজেকে দমন করবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তার। স্ত্রীর দিকে একবারও না তাকিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে কামরা থেকে।
পারভিন খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল, ইডিয়ট!
.
বাগানে ফুল তুলছিল সাঈদা। গেট দিয়ে আসিফকে ঢুকতে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। কিন্তু আসিফের চেহারা দেখে শঙ্কিত হলো সে। বলল, কি হয়েছে তোমার?
যাই…
আসিফের একটা হাত ধরল. সাঈদা, চলো, পুকুর পাড়ে বসি গে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা পুকুরের কাছে চলে এল। ঘাসের উপর পাশাপাশি বসল দুজন।
পারভিন এসেছে, জানো?
সাঈদা বিস্মিত হলো, না তো! কখন?
কাল বিকেলে। সাঈদা, বিমানে ঠিক কি ঘটেছিল বলো তো আবার আমাকে।
সাঈদা বলল, তুমি বুঝি সন্দেহ করছ…
হ্যাঁ।
সাঈদা হাসল। বলল, অকারণ সন্দেহ, আসিফ। পারভিন খুন করেনি। আমিও না। কেন বলছি জানো? এই জন্যে আমি করলে পারভিনের চোখে ধরা পড়তই, পারভিন করলে আমার চোখে ধরা পড়তই। আমরা পরস্পরের দিকে সবসময় লক্ষ রাখছিলাম।
কথাগুলো বলে হেসে উঠল সাঈদা। আসিফও হাসল একটু। বলল, ওর এই হঠাৎ উড়ে আসাটা আমার কাছে কেন যেন ভাল ঠেকছে না। সাঈদা, তুমি একটা পরামর্শ দাও আমাকে কি করব. আমি ওকে নিয়ে?
সাঈদা বলল, এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই, আসিফ।
কিন্তু আমি কি সুখী হতে চাইব না জীবনে, সাঈদা? তোমাকে আমি…
সাঈদা বলল, বেশ তো আছি, আসিফ! কাটুক না এভাবে দিন.. তারপর যখন বাড়ি থেকে চাপ পড়বে বিয়ের..সে তখন দেখা যাবে।
এরপর চুপ হয়ে রইল দুজনেই। খানিকপর সাঈদা বলল, আমাকে একটু মার্কেটে যেতে হবে, বিকেলের দিকে এসো, কেমন? এগুলো নিয়ে যাও। বলে হাতের ফুলগুলো আসিফকে দিল সাঈদা।
আসিফ বলল, মার্কেটে আমারও দরকার আছে যাবার। চলো, একসাথে যাই। তুমি তৈরি হয়ে গেটে দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি, তোমাকে তুলে নেব।
মিনিট পাঁচেক পর গাড়িতে তুলে নিল আসিফ সাঈদাকে।
মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা শেষ করল ওরা একঘণ্টার মধ্যেই। চা খাবার জন্যে।
একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল ওরা দুজন। কেবিনে বসল।
চা শেষ করে কেবিন থেকে বেরোল ওরা। আগে আসিফ, পিছনে সাঈদা। হঠাৎ হাত ফসকে হ্যাণ্ডব্যাগটা পড়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সাঈদা, ইতিমধ্যে দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হ্যান্ডব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে বাড়িয়ে ধরল ওর দিকে।
হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে ধন্যবাদ জানাল সাঈদী, আসিফ রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পা চালিয়ে তাকে অনুসরণ করুল সে। যে ভদ্রলোক তার হ্যাণ্ডব্যাগটা কুড়িয়ে দিলেন, তার কথা তখনও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি সে। ভদ্রলোককে অত্যন্ত পরিচিত, চেনা চেনা মনে হয়েছে তার।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চড়ল ওরা। গাড়ি ছেড়ে দিল আসিফ। এমন সময় মনে পড়ল সাঈদার, আরে! এই ভদ্রলোকই তো প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান! বিমানে দেখেছে সে ভদ্রলোককে।
কিন্তু ডিটেকটিভ শহীদ খান খুলনায় কেন? উদ্দেশ্য কি তার?
.
০৩.
ঢাকা।
সমস্যাটা এমন উগ্ররূপ ধারণ করবে কল্পনাও করেনি লিলি। সহকর্মীরা তাকে ঈর্ষা করে, তার ভাল দেখতে পারে না–কোনদিন একথা তার মনে হয়নি। কিন্তু ওরা সবাই মিলে ওর সাথে যে ব্যবহার করছে ম্যাডাম নোয়া খুন হবার পর থেকে, তাতে প্রমাণ হয় ওকে কেউ সুনজরে কোনদিন দেখেনি। এতদিন সুযোগ পায়নি, তাই প্রকাশ করেনি মনের ভাব। আজ সুযোগ পেয়ে জানিয়ে দিচ্ছে, তোমাকে আমরা ভাল চোখে দেখি না।
অফিসে যাচ্ছিল সে নিয়মিতই। কিন্তু কেউ তার সাথে ভালভাবে কথা বলেনি, একটা প্রশ্ন তিন-চারবার জিজ্ঞেস করলে গভীর কণ্ঠে উত্তর দিয়েছে, তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে চাপা কণ্ঠে আলোচনা করেছে তাকে নিয়ে–এসব কি! বস্ ঢাকায় নেই, টুরে গেছেন গণচীনে। তিনি থাকলে বিচার দাবি করত লিলি। ম্যানেজার লোকটা সুবিধের নয়, শুধু পণ্ডিতী বুলি জানে লোকটা। সে-ও ওদের সকলের সাথে যোগ দিয়েছে।
কি ভাবছে ওরা সবাই, বুঝতে পারে লিলি। ওরা সন্দেহ করছে, ম্যাডাম নোয়াকে আমি খুন করেছি। কী অদ্ভুত কাণ্ড? এই রকম একটা ভয়ঙ্কর কাজ আমি করতে পারি-মাথায় ঢুকল কিভাবে ওদের?
যে যা ইচ্ছা ভাবুক, বস্ না ফেরা পর্যন্ত অফিসে যাবে না সে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ছুটি চেয়ে নিয়েছে সে পনেরো দিনের।
বাড়িতেই আছে গতকাল থেকে ও। বই পড়ে, খবরের কাগজ পড়ে আর মায়ের সাথে গল্প করে। সুখেই কাটছে দিন।
কড়া নড়ে উঠল বাড়ির সদর দরজার।
প্রৌঢ়া মা কিচেন থেকে বলল, নিলি, দেখ তো কে এল?
এই বিকেলে কে আবার এল! বই বন্ধ করে কামরা থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এল লিনি। উঠনে নামল ও। সদর দরজা খুলে দিতে দেখল অপরিচিত এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে সামনে, কাকে চান?
চেনা চেনা লাগছে যুবককে, কিন্তু ঠিক স্মরণ করতে পারছে না কোথায় সে দেখেছে ভদ্রলোককে।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় যুবকটি বলল, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?
মনে পড়ে গেল হঠাৎ, বিমানের আরোহী ছিল যুবক, আর্কিয়োলজিস্ট, জগৎ সিং প্যাটেলের বন্ধুবৎ পুত্র, রাঘব সিং প্যাটেল।
আমি রাঘব সিং, আপনি যে প্লেনে করে বোম্বে থেকে ঢাকায় এসেছেন আমিও…।
লিলির মুখ থেকে অপ্রতিভ ভাবটা ধীরে ধীরে মুছে গেল। মিষ্টি হেসে বলল ও, আসুন, মি. রাঘব, ভিতরে আসুন। তা কি মনে করে…
তরুণ আর্কিয়োলজিস্ট ইতস্তত করতে লাগল। হঠাৎ হেসে ফেলল সে। বলল, কি জানেন, বুঝতে পারছি, কাজটা ভদ্রতাসম্মত, উচিত কাজ হয়নি। একটু খাপছাড়া ধরনের মানুষ আমি। মি. সিম্পসনের বাড়িতে আপনাকে দেখি শেষবার–তারপর থেকে আবার একবার আপনাকে দেখার জন্যে মনটা এমন ছটফট করছিল..মাফ করবেন, আমি বোধহয় বোকার মত কথা বলছি। আচ্ছা, চলি, দয়া করে কিছু মনে করবেন না।
বলে, আধ-পাগলা আর্কিয়োলজিস্ট সত্যি সত্যি ঘুরে দাঁড়াল, পা বাড়াল চলে যাবার জন্যে। লিলি বেশ একটু বিস্মিত হয়েছে। লোকটা যেন কেমন! কিন্তু যা বলল তার মধ্যে কৃত্রিমতা আছে বলে মনে হলো না, ওর।
এই যে, দাঁড়ান, ডাকল লিলি। লোকটাকে এভাবে চলে যেতে দিতে ভদ্রতায় বাধছে ওর।
ফিরে এল রাঘব সিং। বলল, আমি একটা ইডিয়ট। একজন ভদ্রমহিলার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানি না। বাবা এর জন্যে দায়ী। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন সেই ছেলেবেলা থেকে, কথা বলবার সময় ছলাকলার আশ্রয় যেন না নিই। ফলে মনের কথা অকপটে বেরিয়ে আসে বাইরে।
লিলি হাসি চেপে বলল, কিন্তু এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ভাল দেখায় না। আসুন, ভিতরে বসবেন।
রাঘব সিং কি যেন চিন্তা করুন। তারপর বলল, আপনাকে কোন সমস্যায় ফেলে দেব না তো?
না না! আসুন।
বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসাল লিলি রাঘবকে। মাকে ডেকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল। প্রৌঢ়া রাঘবকে বসতে বলে ফিরে গেলেন কিচেনে, চা করবার জন্যে।
কোথায় উঠেছেন আপনারা বাপ-বেটায়? জানতে চাইল লিলি।
হোটেল প্রাচীতে। আজ রাতে ডিনারের নিমন্ত্রণ নেবেন? খুব খুশি হবেন বাবা।
তিনি জানেন, আপনি এখানে এসেছেন?
রাঘব বলল, বাবাই তো পাঠালেন!
লিলি বোকার মত চেয়ে রইল, তার মানে?
হাসতে লাগল রাঘব সিং, মন খারাপ দেখে বাবা কারণ জিজ্ঞেস করল। বললাম।
কি বললেন?
বললাম সেই মেয়েটাকে..মানে আপনাকে, মন থেকে তাড়াতে পারছি না। বাবা বুদ্ধি দিলেন, যাও, দেরি না করে তার সাথে দেখা করে এসো। চলে এলাম সোজা।ঠিকানাটা তো দেখে রেখেছিলাম আগেই মি. সিম্পসনের নোটবুক থেকে।
লিলি লজ্জা পেল। বলল, আশ্চর্য মানুষ আপনি, সন্দেহ নেই। তা, কবে দেশে ফিরছেন?
ঠিক নেই। বোধহয় আরও পনেরো বিশ দিন থাকতে হবে। ঢাকায় পণ্ডিত সব আর্কিয়োলজিস্ট আছেন, সকলের সাথে মতামত বিনিময় না করে তো আর ফিরতে পারি না। ভাল কথা, মি. সিম্পসন গ্রেফতার করেছেন কাউকে?
লিলি বলল, না। তদন্ত খুব একটা এগোয়নি মনে হচ্ছে।
রাঘব সবজান্তার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ওদের কথা কিছুই বলবার যো নেই। তলে তলে কাজ করে ওরা-হঠাৎ করে খুনীকে গ্রেফতার করে অবাক করে দেবে–দেখবেন।
লিলি বলল, খুনটা কে…
রাঘব ব্যস্তভাবে দ্রুত বলল, আর যেই হোক, আমি করিনি। আপনি?
লিলি ভুরু কুঁচকে তাকাল, আমি কি?
খুন করেননি তো?
সিরিয়াস দেখাল রাঘবকে। যেন এই প্রশ্নের উপর তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।
হেসে ফেলল লিলি, না, আমি করিনি।
বাচালেন? তাহলে, আমরা কেউ নই, কেমন? কে তাহলে? আমাকে জিজ্ঞেস করুন, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব আমি খুনীকে।
মানে? আপনি জানেন কে খুন করেছে?
জানে না কেউই, একমাত্র খুনী ছাড়া। কিন্তু আমি অনুমান করে জানি, কে খুনী। মিসেস পারভিন।
মিসেস পারভিন খুনী?
হ্যাঁ। এই ধরনের মেয়েরা পারে না এমন কাজ নেই। এরা পুরুষদেরকে নাচায়, টাকা-পয়সাকে নাচায়, সমাজকে নাচায়, স্বামীকে নাচায়, লক্ষ লক্ষ নোংরা মনের অধিকারী দর্শকদের নাচায়–এদের পক্ষে সবই সম্ভব–খুন করাও।
চা এল। চা খেতে খেতেও প্রচুর কথা বলল রাঘব। মাঝেমধ্যেই কথা বন্ধ করে জানতে চাইল, আপনাকে বিরক্ত করলে বলবেন। কোন কারণে আমার ওপর রাগ হলে সোজা বেরিয়ে যেতে বলবেন বাড়ি থেকে।
বিদায় নিল রাঘব আরও আধ ঘন্টা পর। বারবার করে যেতে বলে গেল সে লিলিকে হোটেল প্রাচীতে। লিলি ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে শুধু জানাল, আজ নয়, দুঃখিত। আজ অন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার।
লিলির শেষ কথাটা শুনে ম্লান হয়ে গেল রাঘবের মুখের চেহারা। বলল, তাই বুঝি! গুড! শুভকামনা রইল। আচ্ছা, বিদায়! অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
.
রাত আটটা। হোটেল ড্রীম।
একটা কেবিনের ভিতর ডিনার খাচ্ছে লিলি এবং আরিফ। খাওয়া শেষ হতে লিলি বলল, কিছু একটা হয়েছে তোমার, আরিফ। গত কদিন থেকেই লক্ষ করছি। এখনও কিছুই খেতে পারলে না তুমি। ব্যাপার কি?
আরিফ বলল, পসার জমছে না, বুঝলে। বাবা যে টাকা রেখে মারা গেছেন, এতদিন খরচ করেছি। দাঁতের ডাক্তারদের কদর নেই এখানে। তার ওপর, ম্যাডাম নোয়ার সাথে একই বিমানে থাকার কথাটা প্রচার হয়ে গেছে, রোগীরা ভুলেও চেম্বারে ঢুকছে না।
হু। দুজনেই আমরা খারাপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে পড়েছি। কি করা যায় বলো তো? মি. সিম্পসনের সাথে কিংবা প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খানের সাথে দেখা করবে?
কি লাভ? তারা কি আর খুনীকে গ্রেফতার করার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করছেন!
লিলি বলল, তা ঠিক। মুশকিল হলো, খুনী ধরা না পড়া পর্যন্ত সবাই আমাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখবেই।
আরিফ বলল, গতরাতে আর এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িতে।
কি!
চুরি হয়ে গেছে বেশ কিছু কাপড় চোপড়। জানালা ভেঙে ঢুকেছিল চোর। ঘুম ভেঙে যেতে বিছানা থেকে নামার আগেই পালিয়ে গেছে।
দামী কিছু নিয়ে যেতে পারেনি তো?
ঠিক বুঝতে পারছি না এখনও-বোধহয় নিয়ে যায়নি। সবই তো ঠিক আছে, কাপড়গুলো ছাড়া।
বেয়ারা এল বিল নিয়ে। টাকা দিতে চলে গেল সে। যাবার সময় কেবিনের পর্দাটা সরাল, লিলি বাইরে তাকিয়েই দেখতে পেল এক ভদ্রলোককে।
এই! লেখক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। একা।
আরিফ বলল, কোন লেখক?
আমাদের সাথে বিমানে ছিলেন যিনি। যার কাছে ব্লো-পাইপ আছে একটা। আমার তো সন্দেহ এই ভদ্রলোকই…
আরিফ পর্দা একটু সরিয়ে তাকাল বাইরে।
একা বসে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছে কিন্তু।
লিলি বলল, ধরা পড়বার ভয়ে অমন করছে। এই, ফলো করবে ওকে? দেখবে কোথায় যায়, কি করে?
আরিফ হেসে ফেলল, দৃর! এসব কাজ পুলিসের।
পুলিস অনেক সময় দেখতে পায় না। আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে পারি। প্লীজ, আরিফ, চলো, লেখক সাহেবকে ফলো করি আমরা। দেখাই যাক না…
আরিফ অগত্যা রাজি হলো, ঠিক আছে। লক্ষ রাখছি আমি, কখন বেরোয় রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে।
সাড়ে আটটার সময় রেস্তোরাঁ থেকে বের হলো লিলি এবং আরিফ। ওদের সামনে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে রহস্য উপন্যাস লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীর। হাঁটার ভঙ্গিটা কেমন যেন। ভদ্রলোক যেন মনস্থির করতে পারছে না ঠিক কোন্ দিক যাবে সে। কখনও জোরে পা চালায়, কখনও প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ছে স্থির হয়ে। কখনও চঞ্চল ভঙ্গিতে ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে।
বিড়বিড় করে কথা বলছে সৈয়দ জাহাঙ্গীর আপনমনে।
সন্দেহ বেড়ে গেল ওদের। সেই সাথে সাহস। লিলির প্রস্তাবে রাজি হলো আরিফ আরও কাছে থেকে লেখককে অনুসরণ করতে। ভদ্রলোকের একেবারে পিছনে চলে এল. ওরা। বেশ ভিড় রাস্তায়। লেখক যে ওদেরকে সহজে দেখে ফেলবে সে ভয় কম।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সৈয়দ জাহাঙ্গীর। ঠিক পিছনেই রয়েছে লিলি এবং আরিফ, ওদেরকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বিড়বিড় করে কথা বলছে, পরিষ্কার শুনতে পেল ওরা কথাগুলো।
কেন, কেন, মেয়েটাকে পুলিস সন্দেহ করবে না? প্রকৃত খুনী–কোথাও তো কোন ভুল করেনি সে। তবে মেয়েটা টের পেয়ে থাকতে পারে-হা! সেক্ষেত্রে মেয়েটাকে খুন না করে উপায় নেই।
আবার হাঁটতে লাগল সৈয়দ জাহাঙ্গীর।
গলা শুকিয়ে গেছে লিলির। বুক ধড়ফড় করছে। আরিফের একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। মেইন রোড থেকে একটা সরু গলিতে ঢুকল সৈয়দ জাহাঙ্গীর। কাছাকাছি থেকে নয়, এখন বেশ একটু দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছে তাকে ওরা।
.
একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল সৈয়দ জাহাঙ্গীর। মিনিট তিনেক দাঁড়িয়েই রইল। তারপর নক করল বাটে, খুলে গেল দরজা। বুড়ো এক লোক খুলে দিল দরজাটা। ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল সৈয়দ জাহাঙ্গীর, বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
ওই খুনী! ফিসফিস করে বলল লিলি। আরিফ হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল।
অনুসরণ সাকসেসফুল, কেমন?
অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল লিলি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখল দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোককে। গলির আবছা আলোয় সাথে সাথে চিনতে না পারলেও ভদ্রলোক কাছে আসতে চিনতে অসুবিধে হলো না তাকে।
মি. শহীদ খান! আপনি! এখনও বুঝি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন।
শহীদরূপী কুয়াশা বলল, ঠিক ধরেছেন। আপনারা তাহলে লেখক সাহেবকে সন্দেহ করছেন?
আরিফ বলল, আপনিও সন্দেহ করছেন তাকে, তাই না? তা না হলে এই। গলিতে আপনাকে দেখতাম না।
কুয়াশা বলল, আমার কাজ কাউকে সন্দেহ করা নয়। যারা সন্দেহের মধ্যে পড়ে তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর সংগ্রহ করে তাদেরকে সন্দেহের উর্ধ্বে তুলে দেবার কাজটাই আমার আসল কাজ। অবশ্য, সে যদি সত্যি নিরপরাধ হয়।
লিলি বলল, দয়া করে আমাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর আগে সংগ্রহ করুন, মি. শহীদ। আমরা দুজনেই ভীষণ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছি ওই বিমানে আরোহী হিসেবে থাকার অপরাধে।
কুয়াশা বলল, একে একে সকলের সম্পর্কেই খবর নেব আমি। এই মুহূর্তে আমি সৈয়দ জাহাঙ্গীর সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। আপনারাও, তাই না? তা এক কাজ করতে হয়। আপনাদের মধ্যে যে কেউ একজন আমার সঙ্গী হতে পারেন। মিস লিলি, আপনি হলে ভাল হয়। আপনি আমার সেক্রেটারি, এই পরিচয় দেয়া যেতে পারে। একটা নোট বুক আর একটা পেন্সিল না হয় আমিই সাপ্লাই দিচ্ছি।
লিলিকে আগ্রহী হতে দেখা গেল, কিন্তু আমি যে শর্টহ্যাণ্ড জানি না।
কিছু আসে যায় না। নোটবুকের পৃষ্ঠায় হিজিবিজি আঁকবেন,-লেখক না দেখলেই হলো। মি. আরিফ, আপনি কি বলেন? আপনার সঙ্গিনীকে আধঘণ্টার জন্যে ছেড়ে দিন আমার জিম্মায়। আপনি হোটেল ড্রীমে গিয়ে কফি খান, আমরা মিলিত হব ওখানে।
উত্তেজনায় হাসছে লিলি, বলল, আরিফ, মি. শহীদ খানের সহকারী আমরা এখন থেকে। শোনো, আর কাউকে দেখতে পেলে একাই তাকে অনুসরণ কোরো তুমি, বুঝলে?
আরিফ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। বলল, কিন্তু আমাদেরকে কেউ অনুসরণ করছে কিনা তা কিভাবে বুঝব?
চলে গেল আরিফ। পকেট থেকে লিলিকে নোটবুক, পেন্সিল আর একটা চশমা বের করে দিল কুয়াশা। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের বাড়ির দরজার সামনে। তার পাশে চশমাপরা লিলি।
নক করল কুয়াশা। ফিসফিস করে লিলি বলল, লেখক সাহেব আমাকে চিনে ফেললে?
চিনতে পারবে না, সম্ভবত। চিনে ফেললেও কিছু যায় আসে না। বলবেন, নতুন চাকরি নিয়েছি।
বুড়ো এক লোক খুলে দিল দরজা, কাকে চাই, হুজুর?
সৈয়দ জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। গিয়ে বলুন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান এসেছেন।
বুড়ো বলল, ভিতরে এসে বসুন, হুজুর। আমি খবর দিচ্ছি।
ড্রয়িংরূমে গিয়ে বলল ওরা। বুড়ো চাকর লোকটা ভিতরে চলে গেল। মিনিট তিনেক পর সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রবেশ করল ড্রয়িংরুমে।
কী সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য! মি, শহীদ আপনি কি মনে করে গরীবের বাড়িতে পায়ের ধুলো…খু-উ-ব খুশি হয়েছি আমি…
কুয়াশা লিলিকে দেখিয়ে বলল, আমার সেক্রেটারি।
হাত কপালে তুলে লিলি এবং সৈয়দ জাহাঙ্গীর পরস্পরকে সালাম করল। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বসল ওদের মুখোমুখি একটা সোফায়। বলল, অনুমান করতে পারি কেন আপনারা এসেছেন। ম্যাডাম নোয় হত্যাকাণ্ড, ঠিক তো?
কুয়াশা বলল, বিমানে যাঁরা আরোহী ছিলেন তাঁদের সকলের সাথেই দেখা করছি আমি।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, আমি কারও সাথে দেখা টেখা করছি না। তবে, প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি আমি মনে মনে। প্রত্যেককে নির্দিষ্ট একটা চরিত্র হিসেবে দেখছি আমি। এরা সবাই আমার পরবর্তী উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী।
আপনার উপন্যাসে খুনী দেখাবেন কাকে?
লেখক বলল, সেটা এখনও ঠিক করিনি। আমি অপেক্ষা করছি আপনাদের ফাইনাল বক্তব্যের জন্যে। আপনারা যাকে খুনী বলে সাব্যস্ত করবেন আমার উপন্যাসে তাকেই আমি খুনী হিসেবে দেখাব।
শেষ পর্যন্ত যদি তেমন কাউকে পাওয়া না যায়? খুনী যদি ধরা না পড়ে?
সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে চিন্তিত দেখাল। বলল, সেক্ষেত্রে, আরোহীদের কাউকেই খুনী হিসেবে দেখানো চলবে না। যাকে খুনী দেখাব সেই মামলা দায়ের করবে। এক কাজ করা যেতে পারে, আমিও তো একজন আরোহী ছিলাম, নিজেকেই খুনী হিসেবে দেখাতে পারি আমি। অবশ্য উপন্যাসটা সেক্ষেত্রে উত্তমরুষে লেখা উচিত হবে না।
কুয়াশা বলল, আপনি জ্ঞানী লোক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর। ক্রিমিনোলজি সম্পর্কে পড়াশোনা আছে আপনার। বাস্তব ঘটনাটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করুন না। প্রকৃত খুনী কে হতে পারে–বলুন তো? আপনার মতামতের দাম আছে মনে করি বলেই প্রশ্নটা করছি আপনাকে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর এতটুকু ইতস্তত বা চিন্তাভাবনা না করেই বলল, দুই ভারতীয়দের মধ্যে একজন খুনী, আমার বিশ্বাস।
আপনার বিশ্বাসের কারণ?
ম্যাডাম নোয়াও ভারতীয়, খুনী একজন ভারতীয় হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া ম্যাডাম নোয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি বসেছিল ওরাই।
কিন্তু মোটিভ?
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, মোটিভ নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে দেখুন–পাবেন।
কুয়াশা বলল, মোটিভ হতে পারে–ধরুন, ম্যাডাম নোয়া কারও সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য জানত–হয়তো জানত সেই লোক অন্য কোন ব্যক্তিকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, অ্যাটেম্পটেড মার্ডার…
অ্যাটেম্পটেড মার্ডার। তার মানে কি বলছেন আপনি?
কুয়াশা বলল, কেউ হয়তো কাউকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, সে-কথা জানত ম্যাডাম। ম্যাডাম কথাটা প্রকাশ করে দিতে পারে ভেবে সেই লোক ভয়ে খুন করেছে ম্যাডামকে-এমন হতে পারে না?
জানি না। মি, শহীদ, আমার মাথায় ব্যাপারটা ঠিক ঢুকছে না। শরীরটা কদিন থেকে ভাল নেই কিনা, একটা প্লট তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
কুয়াশা বলল, আচ্ছা, আপনার সেই ব্লো-পাইপটা…
ওটার কথা বাদ দিন। আমার কাছে ওটা আছে এই কথা বলাই কাল হয়েছে। দেখছি!
কুয়াশা বলল, কি জানেন, গোয়েন্দাদের সব কথা না জানলে চলে না। আচ্ছা, কোথা থেকে কিনেছিলেন?
দোকানের নামটা ভুলে গেছি। পাশাপাশি কয়েকটা অ্যান্টিক-এর দোকান গ্রীনরোডে, ওগুলোর কোন একটি থেকে কিনেছিলাম, যতদূর মনে পড়ে।
কুয়াশা বলল, আচ্ছা, আমি ছাড়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিমানের লেজের দিকে অর্থাৎ ম্যাডাম নোয়ার দিকে গিয়েছিলেন-ম্যাডাম নোয়ার সাথে কি কথা বলেছিলেন তখন আপনি?
মোটেই না! তাকে আমি চিনতাম নাকি যে…।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল।
কুয়াশাও উঠল। বলল, বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত, জাহাঙ্গীর সাহেব। কিছু মনে করবেন না।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের খেয়াল নেই কুয়াশার দিকে। সে বড় বড় চোখ করে দেখছে লিলির হাতে ধরা খোলা নোটবুকটা। বলল, আপনার সেক্রেটারি ভদ্রমহিলা। পিটম্যান বা গ্রেগ শর্টহ্যাণ্ড ব্যবহার করছেন না-কি ব্যাপার? কাগজে হিজিবিজি ওসব কি আঁকছেন তিনি?
কুয়াশা মুচকি হাসল। বলল, মিস লিলি অত্যন্ত আপ-টু-ডেট। চেকোশ্লোভাকিয়ানরা লেটেস্ট যে সিস্টেমটা আবিষ্কার করেছে ও সেটা শিখে নিয়েছে নিজের চেষ্টায়।
আচ্ছা! তাই নাকি। কিন্তু কই, শুনিনি তো..
কুয়াশা বলল, খুব কম লোকই এনেছে। আচ্ছা, বিদায়, জাহাঙ্গীর সাহেব।
.
০৪.
হোটেল ড্রীমের একটা কেবিনে ওরা আরিফের সাথে মিলিত হলো।
সংক্ষেপে জানানো হলো আরিফকে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎকারের ফলাফল। লিলি জিজ্ঞেস করল, মি. শহীদ, গ্রীনরোডের অ্যান্টিকস-এর দোকানগুলোয় যাওয়া দরকার একবার, তাই না?
কুয়াশা বলল, তা যাওয়া দরকার। ব্লো-পাইপটা সেখানে কোন দোকান থেকে কিনেছে কিনা জানা দরকার। কিন্তু একটা তথ্য আপনাদের জানা নেই। বিমানে যে ব্লো-পাইপটা পাওয়া গেছে সেটা কেনা হয়েছে বোম্বে থেকে।
আরিফকে উত্তেজিত দেখাল, তাই নাকি! তাহলে তো খুনী ধরা পড়তে বাধ্য। দোকানদার জানায়নি পুলিসকে, তার রো-পাইপের খরিদ্দার কে?
কুয়াশা বলল, জানিয়েছে। একজন পুরুষ মানুষ। আমেরিকান।
আরিফ এবং লিলি একযোগে বিস্ময় প্রকাশ করল, আমেরিকান!
হ্যাঁ।
আরিফ বলল, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব! আমাদের সাথে বিমানে তো কোন আমেরিকান ছিল না।
কুয়াশা বলল, থাক বা না থাক, সেটা বড় কথা নয়। আসলে, আমরা তার পরিচয় আবিষ্কার করতে পারব, যদি জানতে পারি এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কি।
আরিফ বলল, ম্যাডাম নেয়ার অফিসে গিয়েছিল পুলিস? সেখানে নিশ্চয়ই কাগজপত্র আছে, সেই সব কাগজে আরোহীদের কারও নাম ঠিকানা থাকতেও পারে।
কুয়াশা বলল, সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
ব্যাখ্যা করে ঘটনাটা শোনাল ওদেরকে কুয়াশা।
লিলিকে নিরাশ দেখাল। বলল, তবে আর এই কেসের সমাধান হয়েছে।
আরিফ বলল, কি বিপদ!
কুয়াশা কৌতূহল প্রকাশ করল, বিপদটা কোথায়?
লিলি বলল, আরিফের চেম্বারে একটা রোগীও ঢুকছে না। আমার সহকর্মীরাও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, বাধ্য হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছি।
আরিফ বলল, এই ভাবে কতদিন চলবে! গতরাতে আবার চুরি হয়েছে বাড়িতে।
কুয়াশা বলল, কয়েক মাসও লাগতে পারে খুনীকে ধরতে। কি বললেন, চুরি হয়েছে?
হা। বিশেষ কিছু নিয়ে যেতে পারেনি।
লিলি বলল, চাকরিটা যাবে আমারও।
কুয়াশা কফির কাপে চুমুক দিয়ে তাকাল আরিফের দিকে।
আমি ভাবছি, চলে যাব…
চুরি হয়েছে বলে? সে কি!
আরিফকে চিন্তিত, বিরক্ত মনে হলো, ঠাট্টা নয়, মি. শহীদ। এমনিতেও রোগীর সংখ্যা বেশি নয় আমার। শুনেছি ইরানে ডেন্টিস্টদের অনেক বেতন দেয়া হয়– ওখানেই চলে যাব আমি।
লিলি বলল, মাথা গরম কোরো না, আরিফ। দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কি হয়।
কুয়াশা চুরুট ধরাতে ব্যস্ত, খেয়াল নেইযেন ওদের কথা। চুরুট ধরিয়ে এক মুখ ধোয়া ছাড়ল,সে। হাসতে হাসতে বলল, ম্যাডাম নোয়ার খুনীকে গ্রেফতার আমি করবই, কোথাও আপনাকে সেক্ষেত্রে যেতে হবে না, আরিফ সাহেব। কিন্তু তাড়াতাড়ি খুনীকে ধরতে হলে আমার সাহায্যের দরকার।
লিলি জানতে চাইল, কি ধরনের সাহায্য?
কুয়াশা বলল, আপনি তো সাহায্য করতে শুরু করেছেনই। আরিফ সাহেব, আপনিও যোগ দিন আমাদের দলে।
আরিফকে ইতস্তত করতে দেখে কুয়াশা বলল আবার, আপনাদেরকে খাঁটি মানুষ বলে মনে হয়েছে বলেই আমি আপনাদের সাহায্য চাইছি।
কিন্তু আমি কি সাহায্যে লাগব আপনার?
কুয়াশা হাসছে। বলল, আমি একজন ব্ল্যাকমেইলার চাই।
কি! ব্ল্যাকমেইলার চান? মানে?
কুয়াশা বলল, একজন লোক চাই যাকে দিয়ে আমি একজনকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারি। আরিফ সাহেব।
কাকে? কেন?
কুয়াশা বলল, কেন–এটা আমার ব্যাপার। কাকে–এই ধরুন, মিসেস পারভিনকে।
মিসেস পারভিনকে…
কুয়াশা শেষ করল আরিফের কথাটা, ব্ল্যাকমেইল করতে চাই। অস্থির হবেন না, মন দিয়ে শুনুন আমার কথা। কি করতে হবে আপনাকে, ব্যাখ্যা করে বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন, আমার সহকর্মী হিসেবে কাজ করবেন তো আপনারা?
করব, করব! উৎসাহের সাথে জানাল লিলি।
আরিফ বলল, ঠিক আছে।
কুয়াশা শুরু করল ব্যাখ্যা করতে।
আমি একটা চিঠি লিখব মিসেস পারভিনকে, সেটা আপনি কপি করবেন। এনভেলাপের ওপর লেখা থাকবে ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়। চিঠিতে আপনি মিসেস পারভিনের সাথে দেখা করার অনুমতি চাইবেন। ম্যাডাম নোয়া যে বিমানে ঢাকায় আসছিলেন সেই বিমানে মিসেস পারভিনও ছিলেন–এটা আপনি জানেন, উল্লেখ করবেন চিঠিতে। তাকে আরও জানাবেন, ম্যাডাম নেয়ার কিছু কাগজপত্র আপনার হাতে পড়েছে, সেই কাগজপত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপনি তার সাথে দেখা করে আলোচনা করতে চান। চিঠিতে আপনার নাম থাকবে–এই ধরুন কারিয়াপ্পা মোলুজ, ভারতীয়। ছদ্মবেশ নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যাবেন আপনি পরে। তখন মিসেস পারভিনকে কি বলতে হবে, সব শিখিয়ে দেব আপনাকে আমি।
আপনি পাগল হয়েছেন?
কুয়াশা বলল, মোটেই না।
আরিফ বলল, মিসেস পারভিন সোজা খবর দেবে পুলিসে।
না। দেবে না। আর যদি দেয়ও আপনার ভয়ের কিছু নেই। আমি গোয়েন্দা শহীদ খান, আপনাকে ছাড়িয়ে আনতে পারব কমিনিটের মধ্যেই।
লিলি বলল, হ্যাঁ। সে বিশ্বাস আপনার ওপর আমার আছে। আরিফ, সত্যি ভয়ের কিছুই নেই।
আরিফ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল, ঠিক আছে।
কুয়াশা বলল, মিস লিলি, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
বলুন!
আপনি কি এতিম?
লিলি অবাক হয়ে বলল, কি আশ্চর্য! এ আপনি জানলেন কিভাবে!
কুয়াশা হাসল, সত্যি কিনা?
হা। আমি এখন যাকে মা বলে জানি তিনি আমাকে ছোটকাল থেকে মানুষ। করছেন…আমি তার পালিত কন্যা। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
কুয়াশা বলল, এমনি। ভুলে যান। আরিফ সাহেব, আপনারা গল্প করুন। আমাকে এবার যেতে হয়। কাল দেখা হবে-আমিই দেখা করব।
বিদায় নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
আরিফ বলল, আমার কিন্তু ভয় লাগছে, লিলি!
লিলি আশ্বাস দিয়ে বলল, কিসের ভয়! অমন একজন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারব–এ তো আমাদের সৌভাগ্য, আরিফ।
আরিফ বিরসবদনে বলল, তা ঠিক।
.
টিকাটুলির একটি একতলা বাড়ি। বাংলাদেশ বিমানের স্টুয়ার্ড তারেক হোসেন তার নিজস্ব ড্রয়িংরুমে বসে আছে, সদ্য আগত অতিথি কুয়াশার সাথে আলাপ করছে সে। চুরুটের নীলচে ধোয়া ছাড়ছে কুয়াশা। বলল, মি. সিম্পসন ইন্সপেক্টরকে পাঠিয়েছিলেন, তা আমি জানি। কিন্তু, তারেক সাহেব, আমি আপনাকে যে প্রশ্ন করতে এসেছি সে প্রশ্ন ইন্সপেক্টর আপনাকে করেনি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
তারেক হোসেন হাসছে। বলল, শখের গোয়েন্দা হিসেবে আপনি নাম করেছেন কি এমনিতে! তা বলুন–কি জানতে চান, স্যার?
কুয়াশা বলল, ম্যাডাম নোয়ার টেবিল সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন। মানে, আমি জানতে চাই, টেবিলটায় কি এমন কিছু ছিল যা দেখতে বিসদৃশ্য লাগার কথা?
কখনকার কথা জানতে চাইছেন আপনি? যখন তিনি যে মৃত বুঝতে পারি?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ-ধরুন সেই সময়ের কথাই। টেবিলে ছিল ট্রে। ট্রে-এর উপর ছিল চামচ, কেটলি, কাপ, পিরিচ, সুগার এবং মিল্কপট–সব ঠিকঠাক ছিল কি? যেমন থাকার কথা?
তারেক হোসেন বলল, ওসব তো ছিল না। ছিল শুধু একটা কাপ। কফি খাওয়া শেষ করে কাপটা ম্যাডাম ট্রে-তে নামিয়ে রেখেছিলেন পিরিচের ওপর।
ট্রে-তে আর কিছুই কি ছিল না? ভেবে দেখুন।
তারেক হোসেন ভাবতে শুরু করল। একসময় বলল, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। চামচ ছিল। দুটো চামচ ছিল। পিরিচের ওপর।
দুটো চামচ, কেমন? কেন? দুটো চামচ কেন একটা পিরিচে?
তারেক হোসেনকে বিচলিত দেখাল। বলল, তা তো বলতে পারব না, স্যার। সত্যিই তো! আপনি বলার আগে ব্যাপারটা মাথায় খেলেনি–সত্যি, দুটো চামচ কোত্থেকে পেলেন ম্যাডাম নোয়া?
কারও ট্রে থেকে কি কোন চামচ হারিয়ে গিয়েছিল? স্মরণ করে দেখুন তো, কার ট্রেতে চামচ ছিল না?
অনেকক্ষণ চেষ্টা করল তারেক স্মরণ করার। ব্যর্থ হলো সে। অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, মনে পড়ছে না। ব্যাপারটা লক্ষ করিনি আসলে।
কুয়াশা এরপর সেকেণ্ড স্টুয়ার্ড আবদুর রউফের সাথে সাক্ষাৎ করল। আবদুর রউফ তাকে বিশেষ কোন তথ্য দিতে পারল না। ম্যাডাম নোয়ার ট্রে-তে দুটো চামচ কোত্থেকে এল, জানে না সে, ও।
কুয়াশাকে এরপর মেহমান হিসেবে গ্রহণ করল আবদুল হাফিজ।
আবদুল হাফিজ এক সিমেন্ট ডিলিং কোম্পানীর চাকুরে।
ঝাড়া একঘণ্টা গল্প করল কুয়াশা তার সঙ্গে। বিদায় নেবার সময় গভীর দেখাল। তাকে। বলল, ম্যাডাম নেয়ার কাছে আপনি টাকা ধার করার জন্যে গিয়েছিলেন–এই তথ্যটা যে আমাকে দিয়েছে সে আমার খুবই বিশ্বস্ত লোক।
বিশ্বস্ত নয়। কারণ, সে মিথ্যে তথ্য দিয়েছে আপনাকে, আবদুল হাফিজ রেগেমেগে বলল।
কুয়াশা বলল, সেক্ষেত্রে হাফিজ সাহেব, আমি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। প্লীজ, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাবেন না। আমি এসেছিলাম–ভুলে যেতে চেষ্টা করুন কথাটা।
.
হোটেল ড্রীম। কুয়াশা এবং লিলি নির্দিষ্ট এক কেবিনে বসে আছে। অপেক্ষা করছে ওরা আরিফের জন্যে। বেয়ারা কফি দিয়ে গেছে খানিক আগে। পান করছে ওরা।
এমন সময় কেবিনের পর্দা সরিয়ে অপরিচিত, এক লোক ঢুকল ভিতরে। লোকটা যে বাংলাদেশী নয়, তাকালেই বোঝা যায়। দশাসই চেহারা। মাথায় গান্ধী টুপি। দুদিকের গালে দুটো জরুল।
কুয়াশার উদ্দেশ্যে লোকটা বলল, চিনতে পারেন?
কুয়াশা গম্ভীর হলো। বলল, পারি। চলবে না এই ছদ্মবেশ, আরিফ সাহেব। মিসেস পারভিন এই বেশে আপনাকে দেখলে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, হেসে, খুন হবে।
লিলি খিলখিল করে হেসে উঠল, নাহ। ছদ্মবেশ নেয়া তোমার কর্ম নয়, আরিফ।
আরিফ বসল লিলির পাশে। বলল, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাকে যদি দোষ দেয়া হয়…
কুয়াশা বলল, না, দোষ দিচ্ছি না। দোষ নয়, এটা গুণ। সে যাক, মিস লিলি, আপনি বসুন একা এখানে খানিকক্ষণ। আমি আরিফ সাহেবকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নিজের হাতে সাজাব ওকে আমি। ওখান থেকে পাঠিয়ে দেব গুলশানে।
আরিফ জিজ্ঞেস করল, মিসেস পারভিন ফিরেছেন ঢাকায়? আপনি বলেছিলেন…
ফিরেছে। খবর না জেনে কি আর আপনাকে পাঠাচ্ছি?
লিলি বলল, দেরি করবেন না যেন!
কুয়াশা আরিফকে নিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
.
প্রৌঢ় এক চাকর বাড়ির গেট থেকে ভিতরে নিয়ে গেল ছদ্মবেশী আরিফকে। ড্রয়িংরূমে ঢুকল আরিফ।
বসুন, স্যার। বিবি সাহেবা আসছেন।
চাকর নোকটা বেরিয়ে গেল করিডরে। পরমূহুর্তে অন্দরমহল থেকে অপর এক দরজা দিয়ে সুদর্শনা পারভিন প্রবেশ করল ভিতরে। লাল শাড়ি-রাউজে আগুনের মত জ্বলছে তার রূপ। মুখের চেহারাটা মলিন, কিন্তু আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই তার মধ্যে।
আপনি কি কারিয়াপপা মোলুজ?
সোফা ছেড়ে উঠল না আরিফ। বলল, হ্যাঁ। বসুন মিসেস পারভিন। নিশ্চয়ই আমার চিঠি পেয়েছেন?
মিসেস পারভিন বলল, তা না পেলে আপনি এখানে এলেন কিভাবে?
আরিফ বলল, চোটপাট দেখাবেন না, প্লীজ! এখন বলুন, কি করতে চান আপনি?
পারভিন বলল, তার মানে? আপনি কতটুকু কি জানেন কিছুই তো আমাকে বলেননি এখনও।
আরিফ হাসল। বলল, বিশদ আলোচনা করে সময় অপব্যয় করার কি মানে হয়? ম্যাডাম নোয়ার খাতায় আপনি আছেন। এ আমিও জানি, আপনিও জানেন। খাতাটা আপনি দেখতে চাইবেন, এই তো? দেখাব বৈকি, নিশ্চয়ই দেখাব যথাসময়ে। কিন্তু তার আগে…
পারভিন বলল, ম্যাডাম নোয়ার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম আমি, কিন্তু সেটা কোন অপরাধ নয়। আপনি এটা প্রকাশ করতে পারেন যার কাছে ইচ্ছা।
আরিফ হাসল। বলল, আমার নাম কারিয়াপ্পা মোলুজ, মিসেস পারভিন। হাতে অস্ত্র না নিয়ে আমি যুদ্ধে নামি না। ম্যাডাম নোয়া আপনার রূপ দেখে আপনাকে টাকা ধার দেয়নি। আপনার ক্ষতি করা সম্ভব এমন সব ঘটনার কথা, প্রমাণসহ সে সংগ্রহ করেছিল। সেই প্রমাণগুলো এসেছে আমার হাতে। কিভাবে এসেছে, দয়া করে জানতে চাইবেন না।
কি প্রমাণ?
আরিফ বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসতে লাগল, আপনি শিওর হতে চাইছেন, না? পরীক্ষা করতে চাইছেন, সত্যি প্রমাণগুলো আমার কাছে আছে কিনা? বেশ, বলছি। এই ধরুন, কিছু প্রেমপত্রের ফটোস্ট্যাট কপি আছে আমার কাছে। আপনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত নায়ক, পরিচালক এবং প্রযোজকের কাছে যে সব রসাল প্রেমপত্র লিখেছেন এবং তারা আপনার কাছে যে-সব অশ্লীল প্রেমপত্র লিখেছে– প্রচুর সংখ্যক আছে আমার কাছে, ফটোস্ট্যাট কপি। শুধু তাই নয়, আরও আছে।
আর কি আছে? পারভিন ঘামছে। কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে উঠেছে তার।
ছবি। ছবি আছে। আপনি বোধহয় জানতেন না, ম্যাডাম নেয়ার একটা সিক্রেট সার্ভিস ছিল। এদেশেও সেই সিক্রেট সার্ভিস সক্রিয় ছিল। সেই সার্ভিসের সিক্রেট এজেন্টরা গোপনে আপনার এবং আপনার প্রেমিকদের ছবি তুলেছে। কোন ছবিতে দেখা যায় আপনারা বিছানায় শুয়ে আছেন, কোন ছবিতে দেখা যায় আপনারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে রেখেছেন, কোন ছবিতে।
পারভিন ঢোক গিলে বলল, কত টাকা চান আপনি?
আরিফ আনন্দে হেসে উঠল, এই ছবিগুলো এবং প্রেম পত্রের ফটোস্ট্যাট কপিগুলো আপনার স্বামীর হাতে পড়লে ভাত-ভিৎ সবই যাবে আপনার। আসিফ চৌধুরী এক কথায় আপনাকে ডিভোর্স করবেন। এবং যেহেতু কোর্টে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে আপনি চরিত্রহীনা নারী সেইহেতু বিবাহের চুক্তি অনুযায়ী এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা এবং দুহাজার টাকা মাসহারা থেকে বঞ্চিত হবেন।
পারভিন ভয়ে মূর্ছা যাবে বলে মনে হলো। অসুস্থ বোধ করছে সে। কাঁপা গলায় বলল, কত টাকা পেলে আপনি প্রমাণগুলো হস্তান্তর করবেন?
দুলাখ টাকা, মিসেস পারভিন, তার চেয়ে এক পয়সাও কম নয়।
পারভিন সোফার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিল। বলল, অত টাকা আমাকে খুন করলেও পাবেন না আপনি!
আরিফ বলল, সেক্ষেত্রে, এককালীন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিন, মাসে মাসে দেবেন এক হাজার করে।
অসম্ভব! পঞ্চাশ হাজারই বা আমি পাব কোথায়?
আরিফ হাসছে নিজের আনন্দে, গহনাগাটি বিক্রি করুন। ধার-দেনা করুন।
কে দেবে আমাকে অত টাকা ধার? আর আমার গহনা…সবই তো আমি বিক্রি করে ফেলেছি।
আরিফ সোফা ত্যাগ করল, সাতদিন সময় দিচ্ছি আপনাকে। ভেবে দেখুন। টাকা না পেলে আমি আপনার স্বামীর সাথে দেখা করব। আচ্ছা, আজকের মত চলি। আবার দেখা হবে।
পাথরের মূর্তির মত বসে রইল পারভিন। চেয়ে রইল সে আরিফের গমন পথের দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে।
.
কয়েকঘন্টা পরের কথা।
ড্রয়িংরূমে তখনও বিমূঢ় ভঙ্গিতে বসে আছে পারভিন। প্রৌঢ় চাকর তার সামনের টেবিলে একটা ভিজিটিং কার্ড রেখে সসঙ্কোচে বলল, বেগম সাহেবা, ভদ্রলোক এখুনি আপনার সাথে দেখা করতে চান।
পারভিন ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল, কে! যে-ই হোক, গিয়ে বল দেখা হবে না। বেগম সাহেবা অসুস্থ।
জী, আচ্ছা!
প্রৌঢ় দরজার দিকে পা বাড়াল। চোখ নামিয়ে পারভিন তাকাল ভিজিটিং কার্ডটার দিকে। চোখের অগ্নিদৃষ্টি পরিবর্তিত হলো সেই মুহূর্তে, বিস্ময় ফুটল সেই দৃষ্টিতে। সিধে হয়ে বসল সে। চিন্তার রেখা ফুটল কপালে।
শোনো! ভদ্রলোককে নিয়ে এসো সাথে করে।
মিনিটখানেক পর শহীদের ছদ্মবেশে কুয়াশা ঢুকল ড্রয়িংরুমে।
পারভিন কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, মি. শহীদ, আপনি হঠাৎ আমার বাড়িতে কি মনে করে। মি. সিম্পসন তো ঘন্টায় ঘন্টায় এসে জেরা করে যাচ্ছেন, আপনিও কি…
কুয়াশা মুচকি হেসে বলল, আপনার বিপদে স্থির থাকতে পারলাম না। আপনাকে আমি সাহায্য করতে চাই। এ ব্যাপারে আমি আপনার সহযোগিতা পাব আশা করি।
পারভিন তীব্র দৃষ্টিতে লক্ষ করছে কুয়াশাকে। বলল, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না!
কুয়াশা বলল, আপনার সামনে মস্ত বিপদ, কথাটা কি মিথ্যে?
খানিকক্ষণ ইতস্তত করল পারভিন। তারপর বলল, সত্যি। জানলেন কিভাবে আপনি?
কুয়াশা চুরুট ধরাল ধীরে সুস্থে। ধোয়া ছাড়ল আয়েশ করে। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে সোফায় বসল হেলান দিয়ে, কোথায় কার কপালে কি ঘটছে তা আগাম জেনে নেয়াটাই গোয়েন্দার কাজ–জানেন না বুঝি?
পারভিন চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
কারিয়াপ্পা মোলুজ এসেছিল আপনার কাছে। সে এসেছিল আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে, তাই নয় কি? সম্ভবত, ত্রিশ হাজার টাকা দাবি করেছে সে, তাই না?
পঞ্চাশ হাজার।
ওই হলো! তা পারবেন পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে যোগাড় করে দিতে?
পারভিন ভেঙে পড়ল, কোথায় পাব বলুন। এমনিতেই দেনায় ডুবে গেছি আমি, মি. শহীদ, আপনি আমাকে এই লোকটার হাত থেকে বাঁচান।
শান্ত হোন, মিসেস পারভিন। ভেঙে পড়লে কাজের কাজ কিছুই হবে না। ভুলে যাবেন না, আমি আপনার বিপদে সাহায্য করতেই এসেছি।
কিন্তু আপনি কিভাবে আমাকে উদ্ধার করবেন এই বিপদ থেকে?
একেবারে অনায়াসে উদ্ধার করতে পারব, কারণ আমি শহীদ খান, শখের গোয়েন্দা। আপনার কোন ভয় নেই। নিজেকে আপনি ছেড়ে দিন আমার হাতে। আমি এই কারিয়াপ্পা মোলুজকে সামলাব।
অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল পারভিন। খানিক পর বলল, কত দিতে হবে আপনাকে?
কুয়াশা হো হো করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না।
পারভিন ভয়ে ভয়ে চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
হাসি থামতে কুয়াশা বলল, টাকা নয়, মিসেস পারভিন, আমি চাই অন্য একটা জিনিস।
কি? আমাকে?
ওহ্ নো! ওসব কিছু নয়। আমি চাই আপনার কাছ থেকে সত্যি কথা জানতে।
পারভিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অস্ফুটে উচ্চারণ করল, বলুন, কি জানতে চান?
কুয়াশা বলল, গুড। বলুন, কত টাকা ধার করেছিলেন আপনি ম্যাডাম নোয়ার কাছ থেকে? প্রথমবার কবে?
আঠারো মাস আগে, প্রথমবার। মোট দেনার পরিমাণ আটাশ হাজার টাকা।
ধার করার কারণ? আপনি তো এমনিতেই ভাল টাকা রোজগার করেন, তার ওপর স্বামীর কাছ থেকে মাসে মাসে দুহাজার করে পান।
একটা বদভ্যাস আমাকে ডুবিয়েছে, মি. শহীদ।
জুয়া?
পারভিন নিচু গলায়, মাথা নত করে বলল, হ্যাঁ।
কুয়াশার পরবর্তী প্রশ্ন, কে আপনাকে তার কাছে পাঠিয়েছিল?
সুলতান। বিখ্যাত প্রযোজক, ইদানীং নায়ক হিসেবেও নাম করেছে। ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে ম্যাডাম নোয়ার নাম শুনেছিল, আমার টাকার দরকার হওয়ায় ও কথাটা আমাকে জানায়।
সিনে-ম্যাগাজিনগুলোর রিপোর্ট দেখে মনে হয় আপনার সাথে সুলতানের প্রেম চলছে। সে আপনাকে টাকা দিল না?
চল্লিশ হাজার নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে আগেই। তাছাড়া, তখন ওর হাতে। টাকা ছিল না।
আপনার স্বামী জানেন?
না। জানলে আমাকে ডিভোর্স করার একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে সে এটাকে।
ম্যাডাম নোয়াকে ঠিকমত সুদ দিচ্ছিলেন?
অস্বাভাবিক চড়া সুদ-মানে প্রতি হাজারে একশো টাকা। তার মানে, প্রতি মাসে আটাশশো টাকা সুদ। কমাস থেকে দিতে পারছিলাম না। ম্যাডাম নোয়ার…
আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিল, সুদ না দিলে আপনার বিরুদ্ধে নানা প্রমাণ আপনার স্বামীর কাছে প্রকাশ করে দেবে বলে, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো কিভাবে সে সংগ্রহ করল–আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি আমি।
কুয়াশা বলল, ম্যাডাম নোয়া পাক্কা ব্যবসায়ী ছিল, নিজস্ব সিক্রেট সার্ভিস ছিল তার। যাক, এই অবস্থায় সে খুন হওয়াতে আপনি খুশি?
হ্যাঁ, মানে, খুশি হব না কেন বলুন? পেত্নী-বুড়ীটা ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছিল আমার জীবন।
কুয়াশা বলল, রত্নাগিরি থেকে ম্যাডামকে আপনি অনুসরণ করে বোম্বে গিয়েছিলেন, তাই না?
না। রত্নাগিরি থেকে সে বোম্বেতে আসে ভোরের কপ্টারে। আমি আসি বেলা সাড়ে নটার কপ্টারে। তার সাথে তার অফিসে দেখা করি আমি।
ধন্যবাদ। কি কথা হয় আপনাদের?
পারভিন বলল, আমার কোন কথা শুনতেই চায়নি সে। তার একটাই কথা, সুদের টাকা দাও নয়তো তোমার ঘর ভাঙব। এক রকম জোর করে তাড়িয়ে দেয় সে আমাকে তার অফিস থেকে।
কুয়াশা বলল, অথচ আপনি জেরার সময় বলেছিলেন ম্যাডাম নোয়াকে জীবনে কখনও দেখেননি।
এ ছাড়া আর কি বলবার ছিল আমার বলুন?
কুয়াশা হঠাৎ বলল, মিসেস পারভিন, কেন খুন করলেন আপনি ম্যাডাম নোয়াকে?
কি? আমি খুন…আপনি কি পাগল হয়েছেন? আমি কেন খুন করতে যাব? আপনিও মি. সিম্পসনের মত…
কুয়াশাকে হাসতে দেখে থেমে গেল পারভিন।
আপনি…আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন, মি. শহীদ!
কুয়াশা বলল, আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি, মিসেস পারভিন। বিশ্বাস করি দুটো কারণে। এক, আপনার রূপ-সৌন্দর্যের জন্যে। দুই, একটি বোলতার জন্যে।
কুয়াশার কথা বুঝতে না পেরে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল পারভিন। বলল, একটা বোলতার জন্যে?
হ্যাঁ। আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন না। থাক, বুঝে দরকার নেই। মিসেস পারভিন, আপনি কারিয়াপ্পা মোলুজকে জীবনে আর কখনও দেখবেন না। আমি তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করছি!
আপনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, মি. শহীদ।
কুয়াশা বলল, আরও কয়েকটা প্রশ্ন করব আমি, মিসেস পারভিন। আপনার মনের মানুষ প্রযোজক-নায়ক সুলতান সম্পর্কে। হত্যাকাণ্ডের দিন সে কি আপনার সাথে বোম্বেতে ছিল
হ্যাঁ। সুলতান আমাকে পেত্নী-বুড়ীটার কাছে একা পাঠায়। ও একটা রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছিল।
আর একটা প্রশ্ন। আপনার প্রকৃত নাম কি?
কেন, পারভিন।
আর কোন নাম নেই?
না তো!
কুয়াশা বলল, আচ্ছা, আপনার জন্মস্থান কোথায়?
পারভিনকে বিস্মিত দেখাচ্ছে, যশোরে। কিন্তু এসব প্রশ্ন…
কুয়াশা সোফা ত্যাগ করল। এমনি, কৌতূহলবশত জেনে নিলাম। ভাল কথা, আপনাকে আমি একটা উপদেশ দিতে চাই।
একশো বার…।
আসিফ চৌধুরীকে ডিভোর্স করুন। আপনার জীবন আর তার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। এবাধন টিকবে না।
কিন্তু আমি ডিভোর্স করলে যে টাকা পাব না।
কুয়াশা বলল, টাকার দরকার কি? সুলতান কি আপনাকে…
পারভিন বলল, হয়তো বিয়ে করবে। কিন্তু ও-ও তো বিবাহিত, শৈষ পর্যন্ত…
কুয়াশা বলল, কিন্তু এভাবে দুনৌকায় পা দিয়ে চললে সলিল সমাধি লাভ করবেন যে আপনি, মিসেস পারভিন। কোন উপায় যদি সত্যিই না থাকে, সময় থাকতে আত্মহত্যা করুন না কেন?
বোকার মত চেয়ে রইল পারভিন, দেখল ড্রয়িংরূম থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ, ঋজু চেহারার রহস্যময় লোকটা।
.
০৫.
ঢাকা।
ডাক্তার সমীরুল হকের চেম্বার। মুখোমুখি বসে আছেন মি. সিম্পসন এবং ডাক্তার সমীর।
মি. সিম্পসন, মার্ডার কোর্সের ফলাফল কি?
মি. সিম্পসন পাইপ কামড়ে ধরে লক্ষ করছেন ডাক্তারকে। চোখের পলক না ফেলে বললেন, কাজ করছি এখনও। খুব বেশি দূর এগোতে পারিনি। আপনার : কাছে এসেছি আমি আসলে, যে পদ্ধতিতে খুন করা হয়েছে সে-সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করতে। সাপের বিষ–এ সম্পর্কে কারও কাছ থেকে বিশেষ কিছু জানতে পারছি না আমি।
দেখুন, আমি টোক্সিকোলজিস্ট নই। ডাক্তার ইয়াকুব এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ।
মি. সিম্পসন বললেন, কি জানেন, ডা. ইয়াকুব একজন এক্সপার্ট তা আমি জানি। কিন্তু বোঝেন তো এক্সপার্টরা কি ধরনের মানুষ হয়। তারা এমন জটিল ভঙ্গিতে কথা বলে, বোঝা কার সাধ্য! আমি সহজ সরল ভাষায় এ সম্পর্কে কারও কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করতে চাই। আচ্ছা, শুনেছি এপিলেন্সী রোগ হলে রোগীকে নাকি সাপের বিষ ইজেক্ট করা হয়?
এই রোগ সম্পর্কেও বিশেষজ্ঞ নই আমি। তবে যতটুকু জানি, হয়। কেউটের বিষ নাকি এই রোগে খুবই ফলদায়ক।
মি. সিম্পসন বললেন, আপনি কি কখনও সাপের বিষ নাড়াচাড়া করেছেন, ডাক্তার সমীর? ওষুধ হিসেবে?
না। ডাক্তার সমীর গম্ভীর হলেন।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, আমাদের দেশে সাপের বিষ নিয়ে রিসার্চ করে এমন কেউ আছে কি?
আমার এক বন্ধু আছে। তার ল্যাবরেটরিতে অনেক রকম সাপের বিষ আছে। কিন্তু বুমশ্লাং সাপের বিষ আছে কিনা জানা নেই আমার।
পকেট থেকে নোটবুক বের করে খুললেন সেটা মি. সিম্পসন, আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবেন, ডা. ইয়াকুব আমাকে এই তিনজনের নাম জানিয়েছেন, বলেছেন, এদের কাছ থেকে আমি তথ্য পেতে পারি। আপনি কি এদের কাউকে চেনেন? ডা. রজব আলী, প্রফেসর করিম, প্রফেসর আবদুল হাকিম।
ডাক্তার রজবকে খুব ভাল করে চিনি, আমার বন্ধুই বলতে পারেন। আর প্রফেসর করিম-তিনি আমার শিক্ষক। প্রফেসর আবদুল হাকিমের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা নেই, তবে আমার নাম বললে চিনবেন তিনি।
ধন্যবাদ, ডাক্তার। আজ তাহলে আসি।
মি. সিম্পসন বিদায় গ্রহণের জন্যে উঠে দাঁড়ালেন!
.
মি. সিম্পসনের অফিল। রিভলভিং চেয়ারে বসে পাইপ টানছেন তিনি। তাঁর মুখোমুখি বসে আছে শহীদরূপী কুয়াশা।
বোম্বে থেকে জিরোপোলাস ব্লো-পাইপটা দেখে জানিয়েছে, এটাই কেনা হয়েছিল তার দোকান থেকে। মি. বচ্চন দিনে চারবার করে ফোন করে জানতে চাইছেন, তুমি কতদূর এগিয়েছ। তোমার সেই সাইকোলজিক্যাল মোমেন্ট সম্পর্কে তার সে কি কৌতূহল।
কুয়াশা বলল, অথচ, সবাই বলছে, বিমানে উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনাই ঘটেনি। আমিও ছিলাম বিমানে, আমিও ঘটনাটা লক্ষ করিনি। কিন্তু আমি সেন্ট পার্সেন্ট শিওর, ঘটনাটা ঘটেছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, আমি আরোহীদের প্রত্যেককে কয়েকবার করে জেরা করেছি, প্রত্যেকের সম্পর্কে সম্ভাব্য বহু তথ্য সংগ্রহ করেছি।
কাকে সন্দেহ করেছেন আপনি?
মি. সিম্পসন বললেন, এমন কেস আমি আগে কখনও দেখিনি, শহীদ। কাউকে। ভাল মানুষ বলে মনে হচ্ছে না আমার। সবাইকে সন্দেহ হচ্ছে।
স্টুয়ার্ডদেরকে? ম্যাডাম নোয়ার সাথে ওদের কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু, তুমিই সম্ভবত একসময় বলেছিলে, অন্য কারও নির্দেশে অপরাধ ঘটিয়ে থাকতে পারে ওদের কেউ।
কুয়াশা বলল, বলেছিলাম। কিন্তু খুনের মত অপরাধ কখন করে একজন? যখন সে কোন বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়, কিংবা লোভে পড়ে কিছু পাবার আশায়। স্টুয়ার্ডদ্বয় সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করে দেখেছি আমি, ওরা কেউ কোন বিপদে পড়েনি। এবং হঠাৎ করে ওরা মোটা টাকা কোথাও থেকে পায়নি। পেয়ে চেপে রাখার চেষ্টা করলেও লক্ষণ প্রকাশ পেত-তা পায়নি। ডা. সমীর সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
মি. সিম্পসন বললেন, আরোহীদের মধ্যে ভদ্রলোকের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব সাপের বিষ সংগ্রহ করা। এদেশে সর্প-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ যে-কজন আছেন তাদের। সবাইকে চেনেন ইনি, খাতির আছে প্রত্যেকের সাথে। কিন্তু মোটিভ কি?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, সেটাই হলো প্রশ্ন, মোটিভ কি, ম্যাডাম নোয়া খুন হওয়ায় তিনি উপকৃত হচ্ছেন কিনা।
হচ্ছেন কিনা জানা যাচ্ছে না।
কুয়াশা বলল, কয়েকজন উপকৃত হয়েছে, আমি জানি। যেমন, মিসেস পারভিন। ডাক্তার সমীর যদি RT362 হয়ে থাকে, সে-ও উপকৃত হয়েছে। আবদুল হাফিজ যদি XVB7:24 হয়ে থাকে, তারও উপকৃত হবার কথা। এরপর আছে মিস লিলি, ইউরোপীয়ান হিপ্পি, আরিফ–এদের কারও পক্ষে খুন করা সম্ভব বলে মনে হয় না। কারণ, ওরা সীট ছেড়ে ওঠেনি, কেউ কেউ উঠলেও ম্যাডাম নোয়ার দিকে যায়নি। এরপর আসছে সৈয়দ জাহাঙ্গীর।,
লোকটাকে আমার সুবিধেজনক মনে হয় না। ম্যাডাম নোয়ার দিকে তুমি ছাড়া একমাত্র এই লোক গিয়েছিল। হত্যাকাণ্ড ঘটার পর থেকে খুব নার্ভাসনেসে ভুগছে, লক্ষ করেছি। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বিড়বিড় করে।
কুয়াশা বলল, প্লট তৈরি করার কাজে মত্ত সে, তাই হয়তো…
মি. সিম্পসন বললেন, সবাই তাহলে নিরপরাধ-হত্যকারী কে?
বিমানের আরোহীদের মধ্যেই একজন–তাকে আমরা সঠিক চিনতে পারছি না, হাসতে হাসতে বলল কুয়াশা।
মি. সিম্পসন বললেন, ক্লু নেই, কোন ক্লু নেই।
কুয়াশা হাসতে হাসতে মাথা দোলাল, না, মি. সিম্পসন, আপনার সাথে আমি একমত নই। কু আছে।
ব্লো-পাইপটার কথা বলছ তুমি?
কুয়াশা আবার মাথা দোলাল, না, মি. সিম্পসন।
বিস্মিত হলেন মি. সিম্পসন, তবে? আর কি ক্লু?
কুয়াশা সিধে হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, তিনটে বড় বড় ক্লু আছে আরও, মি. সিম্পসন। একটা হলো–বোলতা। দ্বিতীয়টা হলো–আরোহীদের ব্যাগ-ব্যাগেজ। তৃতীয়টা হলো–পিরিচে অতিরিক্ত চামচ।
তোমার তদন্তের ধারা সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ রয়ে গেলাম চিরকালই। পিরিচে অতিরিক্ত চামচ-এ আবার তুমি কোথায় পেলে?
কুয়াশা বলল, ম্যাডাম নোয়ার ট্রে-তে যে পিরিচটা ছিল তাতে চামচ ছিল দুটো, মি. সিম্পসন।
পিরিচে দুটো চামচের অর্থ–বিবাহ।
কুয়াশা বলল, কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এটার অর্থ–মৃত্যু!
.
ঢাকা।
আলাপ হচ্ছে হোটেল ড্রীমে।
কুয়াশা বলছে, কারিয়াপ্পা মোলুজ মারা গেছে। সে আর কোনদিন জীবিত হবে না।
আরিফ সাগ্রহে জানতে চাইল, মিসেস পারভিনের সাথে কি কথা হলো আপনার? ম্যাডাম নোয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল?
কুয়াশা বলল, যা আমি জানতে চেয়েছিলাম তা জানতে পেরেছি। ভাল কথা, মিস লিলি, কিছু যদি মনে করেন, আপনার জন্মস্থান কোথায় জানাবেন কি?
আমার জন্মস্থান! তা জেনে আপনার কি লাভ, মি. শহীদ?
কুয়াশা বলল, লাভ–আমার নয়, আপনার।
কি লাভ?
হেসে ফেলল কুয়াশা, পরে বলব, যদি বলা উচিত বলে মনে করি।
ঢাকায় জন্মেছি আমি। বাবা আমার জন্মাবার আগেই মারা গিয়েছিলেন, আম্মা মারা যান আমার যখন তিন মাস বয়স।
কুয়াশাকে একটু যেন নিরাশ দেখাল। বলল, হু। আচ্ছা, আপনার জীবনের লক্ষ্য কি?
হেসে উঠল লিলি, বাপরে বাপ! মি. শহীদ, আপনি যে দেখছি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আমার লক্ষ্য… দুনিয়া দেখে বেড়ানো। এমন একজন সঙ্গী দরকার আমার যে আমাকে দুনিয়ার সর্ব জায়গায় নিয়ে যাবে। জানেন, নতুন নতুন জিনিস দেখতে, নতুন নতুন জায়গায় যেতে কি যে ভাল লাগে আমার।
কুয়াশা মিটি মিটি হেসে আরিফের দিকে তাকাল, শুনছেন তো কথাগুলো। এখন থেকে তৈরি হোন!
লিলি ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, যাহ্! কিযে রলেন আপনি, মি. শহীদ।
কুয়াশা বলল, মি. আরিফ, আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
আরিফ হাসল। বলল, এবার আমাকে ধরেছেন, না? বলছি–আমি পসার চাই, প্রচুর টাকা কামাতে চাই। টাকা আমার দরকার, কারণ আমার সঙ্গিনীকে নিয়ে আমি দুনিয়ার সব জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই।
ভাল হবে না বলে দিচ্ছি, আরিফ! চোখ রাঙাল লিলি।
আরিফ বলল, ঠিক আছে, আর ঠাট্টা নয়। মি. শহীদ, আমি আসলে ডেন্টিস্ট হয়েছি বাইচান্স। আমার কাকা একজন ডেন্টিস্ট ছিলেন, তার কাছেই মানুষ আমি। তিনি মারা যান হঠাৎ করে। আমিও বেরিয়ে পড়ি ঘর ছেড়ে। বহু দেশ দেখেছি, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি…
বিদেশে কোথায় কোথায় গেছেন আপনি?
আফ্রিকায় গেছি। ভারতের সব বিখ্যাত জায়গায় গেছি, নেপালে গেছি। আফগানিস্তানে গেছি। আমি আবার চলে যাব। এবার যাব ইরানে।
কুয়াশা ফিরল লিলির দিকে, আপনি?
আমি? কি বলছেন?
কোথাও যাবেন না? ইরানে কিংবা অন্য কোথাও? এখানে চাকরি করা তো খুব ঝামেলার ব্যাপার হয়ে পঁড়িয়েছে–অন্য কোথাও গেলে সুযোগ পাবেন ভাল।.
কেন, ঢাকাতে কি আর কোন চাকরি আমি পাব না, যেটা করছি সেটা ছেড়ে দিলে?
কুয়াশা মৃদু মৃদু হাসছে। বলল, পাবেন না কেন, পাবেন। ভাল কথা, আমার হাতে একটা চাকরি আছে। আপনি রাজি হলে আপনার জন্যে চাকরিটার ব্যবস্থা করতে পারি। আগামী হপ্তায় আমি বোম্বে যাচ্ছি, ইচ্ছে করলে আপনিও আমার সাথে যেতে পারেন।
টেমপোরারি চাকরি! ঠিক আছে–যাব।
কৃত্রিম তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল লিলি। কুয়াশার সাথে ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ এবং খোলামেলা আলোচনা হবার ফলে লিলি কুয়াশাকে আপন বড় ভাইয়ের মত করে ভালবাসতে শুরু করে দিয়েছে নিজেরই অজ্ঞাতে। কুয়াশার মধ্যে একটা স্নেহশীল, মন, কঠিন ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং নির্ভেজাল ভদ্রতাবোধ আছে, আবিষ্কার করে ফেলেছে লিলি। পুরুষ মানুষ সাধারণত যেমন হয় এ লোক তেমন নয়, এটা সে বুঝতে পেরেছে পরিষ্কার। মেয়েদের সাথে ওঠাবসার সময় পুরুষরা কত রকম দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায়, কিন্তু এ লোকের মধ্যে সে-সব নোংরামির ছিটেফোঁটাও নেই। এইসব কারণেই লিলি কুয়াশার সাথে যেখানে সেখানে যেতে অস্বস্তিবোধ করে না।
টেমপোরারি-হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে আমি পারমানেন্ট একটা চাকরি পাইয়ে দিতে পারি চেষ্টা করলে।
লিলি বলল, এখন থেকেই চেষ্টা করুন।
.
তিন দিন পরের ঘটনা। কুয়াশার আস্তানায় ফোন এল লিলির। সম্পর্কটা এখন আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কুয়াশাকে লিলি শহীদ ভাই বলে, কুয়াশা ওকে বলে শুধু লিলি।
চাকরিটার কি হলো?
কুয়াশা বলল, কোন্ চাকরি? বোম্বে যাবার?
হ্যাঁ-টেমপোরারি চাকরিটার কথা জানতে চাইছি।
কুয়াশা বলল, সে চাকরি তো তোমাকে দেয়াই হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার যাচ্ছ তুমি বোম্বে।
.
বোম্বে। বোম্বেতে পৌঁছুল ওরা মঙ্গলবার সকাল এগারোটায়। উঠল হোটেল ফরচুনে। সিটিংরুমে বসে কফি খেতে খেতে কুয়াশা বলল, লিলি, বোম্বেতে আমার অনেক কাজ। অনেক লোকের সাথে দেখা করতে হবে আমাকে। আইন-উপদেষ্টা লবঙ্গম মেহতা, পুলিশ কমিশনার মি. গুরুদয়াল বচ্চন, তারপর রয়েছে জগৎ সিং প্যাটেল ও রাঘব সিং প্যাটেল। লিলি, আমি যখন বাপের সাথে কথা বলব, তোমার কাজ হবে ছেলের সাথে গল্প জমানো। নিশ্চয়ই সে তোমাকে চিনতে পারবে, মি. সিম্পসনের বাড়িতে দেখেছে সে তোমাকে…।
লিলি বলল, না, তারপরও রাঘব সিং প্যাটেলের সাথে আমার দেখা হয়েছে।
কুয়াশা অবাক হলো না এতটুকু, জানি। কথাটা স্বীকার করো, না অস্বীকার করো পরীক্ষা করলাম…সে যাক, কি উদ্দেশ্য ছিল তার তোমার সাথে দেখা করার?
লিলি বিশদ ব্যাখ্যা করে বলল সেদিনের ঘটনাটা। মন্তব্য করল, ভদ্রলোক আমার প্রেমে পড়েছেন বলে মনে হয়েছিল।
কুয়াশা হাসতে শুরু করল, দোষ দেয়া যায় না। পছন্দ হবার মত মেয়ে তুমি, সন্দেহ নেই। সে যাক….
শহীদ ভাই! আপনি আমাকে নিয়ে বড় রসিকতা করছেন।
কুয়াশা যেন শুনতে পায়নি লিলির কথা, ছেলেটা ভাল। সহজ-সরল, শিশুর মত। আবার পাণ্ডিত্যও অগাধ। সে যাক, মন দিয়ে শোনো এবার। ম্যাডাম নোয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন আলোচনার সূত্রপাত করবে না তুমি। সে যদি শুরু করে তবে আলাদা কথা। পরিষ্কার করে না বলে, আভাসে তাকে তুমি জানাবার চেষ্টা করবে, আমি মিসেস পারভিনকে খুনী বলে মনে করছি, তাকে গ্রেফতার করার আগে ফাইনাল আলোচনা করতে এসেছি ভারতীয় পুলিসের সাথে।
লিলি বলল, শহীদ ভাই, আপনি কি রাঘবকে…
না-না। আমি ইনফরমেশন চাই, তাই এতসব কাণ্ড করছি। রাঘব খুব ভাল ছেলে, খুন-টুন তার দ্বারা সম্ভব বলে মনে করি না। সে আদর্শ প্রেমিক হতে পারে, বড়জোর। তোমার প্রেমিকের সাথে একটা মিল আছে এর। রাঘবও দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চায়।
আরিফের, কথা। এখন সে ইরানে নয়, যেতে চায় ক্যানাডায়। কিন্তু আমি জানি, ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না ও। তাছাড়া, এই কেসের সমাধান না হওয়া, পর্যন্ত যাওয়া হচ্ছে না কোথাও। অথচ, কি যে ইচ্ছে করছে বাইরে কোথাও যেতে। মাস খানেকের মধ্যে সমাধান বের করে ফেলবেন, তাই না?
কুয়াশা বলল, শহীদ ভাইয়ের ওপর খুব আস্থা রাখো, না? গুড। কি জানো লিলি, চেষ্টার ত্রুটি করছি না আমি। অনুভব করছি, বুঝলে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আমরা যারা জড়িয়ে পড়েছি তারা ছাড়াও আরও একজন আছে, আরও একটা চরিত্র আছে–অথচ সেই চরিত্রে কাউকে অভিনয় করতে দেখছি না।
আবার আপনি ধাঁধা ছাড়তে শুরু করেছেন, শহীদ ভাই!
কুয়াশার কপালে চিন্তার রেখা ফুটল, না, ধাঁধা নয়। এই কেসের মধ্যে এমন একটা ক্যারেক্টার আছে, যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কে সে?
.
০৬.
বোম্বে।
সেদিন বিকেলেই প্যাটেলদের সাথে দেখা করতে গেল ওরা। বাপ-বেটা দুজনেই ওদেরকে দেখে খুশিতে প্রায় ডগমগ হয়ে উঠল। ব্যাপারটা ঠিক সাথে সাথে বুঝতে পারল না কুয়াশা। ফ্রেঞ্চকাট বাপের সাথে গল্প জমাবার জন্যে চেষ্টা করল সে। কিন্তু পণ্ডিত বুড়ো কুয়াশাকে বিশেষ গ্রাহ্যই করল না। বাপ-বেটা দুজনেই লিলিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। লিলিকে খাতির করবার বহর দেখে কুয়াশা নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত বুড়োর পরামর্শে পুত্র রাঘব লিলিকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে চলে গেল বাইরে। ওরা চলে যেতে বুড়ো কুয়াশার সাথে মেতে উঠল গল্পে।
রাত্রে মিলিত হলো লিলি এবং কুয়াশা হোটেলে।
তোমার জন্যে একটা পারমানেন্ট চাকরির প্রস্তাব দিতে গিয়ে বোকা বনে গেছি আমি, বলল কুয়াশা।
লিলি বলল, বুঝলাম না।
জগৎ সিং প্যাটেলকে বললাম, আমার সেক্রেটারি বেড়াতে-টেড়াতে খুব ভালবাসে, আর্কিয়োলজি সম্পর্কেও আগ্রহ আছে, ওকে আপনারা একটা চাকরি দিলে ও খুব খুশি হবে।
মানে! এসব কেন বলতে গেলেন?
কুয়াশা বলল, পারমানেন্ট একটা চাকরি দরকার, বলেছিলে না তুমি?
লিলি বলল, কী আশ্চর্য! দরকার বলে আপনি যার তার কাছ থেকে চাকরি চাইবেন আমার জন্যে?
কুয়াশা বুলল, এমনি চাইনি। আগে শোনোই না। ওরা তো মাটি খোঁড়ার বিশেষজ্ঞ, প্রাচীন সভ্যতা খুঁজে বেড়ানো ওদের কাজ। টাকা পয়সার খুব দরকার। হয় এই কাজে। তাই এদেরকে চাঁদা দেয় কেউ কেউ। আমিও মোটা টাকার চাঁদা অফার করলাম। বুড়ো বলল, কিন্তু বিনিময়ে আপনার কি উপকার আমি করতে পারি? বললাম, আমার সেক্রেটারিকে একটা চাকরি দিলে ভাল হয়।
কি বলল?
কুয়াশা হাসতে শুরু করল। বলল, যা বলল শুনে বোকা বনে গেলাম আমি।
আহা, শুনিই না কি বলল!
বলল, চাকরি না, মিস লিলিকে ছেলের বউ হিসেবে চাই আমি।
কি!
কুয়াশা বলল, খুব একচোট ধমক দিয়ে দিয়েছি। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, মিস লিলি মুসলমান, কোন হিন্দুর সাথে বিয়েতে সে কক্ষনো রাজি হবে না। এর উত্তরে কি বলল জানো?
লিলি চেয়ে রইল।
বলল, ধর্ম আবার কি? আমাদের বাপ-বেটার কোন ধর্ম নেই। দরকার হলে আমার ছেলে মুসলমান হয়ে যাবে।
কুয়াশা চুরুট ধরাল। তারপর আবার বলল, ফের একচোট ধমক লাগালাম। বললাম, মিস লিলির সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে এক যুবকের, ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। বললাম, আপনার ছেলে যেন মিস লিলির আশা ছেড়ে দেয়, তা না হলে খারাপ হয়ে যাবে।
লিলি গভীরভাবে বলল, ঠিক বলেছেন। ছিঃ ছিঃ এসব কথা শুনলে আরিফ কি ভাববে, বলুন তো!
সে খুব বুদ্ধিমান ছেলে-কিছু মনে করবে না, দেখো।
.
পরদিন সকাল।
পুলিশ কমিশনার মি. গুরুদয়াল বচ্চনের চেম্বার।
মি. শহীদ, একটা কথা বলবার আছে আপনাকে আমার। বিমানে ব্লো-পাইপ পাওয়া সংক্রান্ত আলোচনার সময় ঢাকায় আপনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন–কথাটা ছিল আপনার এই রকম–হত্যাকাণ্ডটি যে পদ্ধতিতে সংঘটিত হয়েছে বলে বিশ্বাস করছি আমরা, আসলে সে পদ্ধতিতে সংঘটিত হয়নি-তখন কথাটার অর্থ বুঝিনি আমি।
এখন অর্থটা জানেন। কুয়াশা মৃদু হেসে সোফায় হেলান দিল।
মি. বচ্চন বললেন, রাতদিন চিন্তা করো, অর্থটা ধরতে পেরেছি আমি। ধরতে পেরেছি, আপনারই অন্য একটা কথার সাহায্যে। অন্য কথাটি হলো, আপনি বলেছিলেন,-রো পাইপটা কোন না কোন ভাবে বাইরে ফেলে দিতে পারত খুনী–কিন্তু তা সে দেয়নি। দুটো কথা বারবার মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে, অর্থটা পেয়ে গেলাম। অর্থটা হলো, ব্লো-পাইপটা পাওয়া গেছে, তার কারণ, খুনী চেয়েছে ব্লো-পাইপটা যেন পুলিস পায়।
চমৎকার!
মি. বচ্চন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, আপনি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, তাই না? তারপর আমি ভাবলাম, কেন খুনী চাইছে ব্লো-পাইপটা পুলিস পাক। এই প্রশ্নের উত্তর বের করে ফেললাম খুব সহজেই। উত্তরটা আপনি জানতেন, আমি জানতাম না। এখন আমি জানি। উত্তরটা হলো–ব্লো-পাইপটা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারই করা হয়নি।
চমৎকার! চমৎকার! আমার পদ্ধতিতেই ভেবে বের করেছেন উত্তর, সন্দেহ নেই। ঠিক, ব্লো-পাইপ ব্যবহার করা হয়নি হত্যাকাণ্ডে। বর্শাটা ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু ব্লো-পাইপটা নয়। তার মানে, বর্শাটা নিক্ষেপ করার জন্যে অন্য কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। কি সেটা? জিনিসটা এমন কিছু হবে, যা মেয়ে বা পুরুষ মুখে পুরলে কারও সন্দেহ বা বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। সিগারেট হোল্ডার হতে পারে, বাশী হতে পারে, পাইপ হতে পারে, এমন কি চুরুটও হতে পারে।
মি. বচ্চন বললেন, পাইপ জাতীয় কার কাছে কি আছে তা জানার জন্যেই তাহলে আপনি সকলের ব্যাগ-ব্যাগেজে কি আছে না আছে তার একটা তালিকা তৈরি করতে বলেছিলেন মি. সিম্পসনকে।
কুয়াশা বলল, শুধু এই একটি কারণেই নয়। মি. বচ্চন, আপনি বোলতার কথা ভুলে যাচ্ছেন। ভুলবেন না, বোলতার কথা কোনমতেই ভোলা উচিত হবে না।
বোলতা?
মি.বচ্চন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, বোলতা।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সাথে বোলর কি সম্পর্ক, মি. শহীদ?
কুয়াশা বলল, বুঝতে পারছেন না? শুনুন তাহলে…
কিন্তু বাধা দিল টেলিফোনটা। ক্রিং ক্রিং। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন মি. বচ্চন।
মুখের চেহারা বদলে গেল তার অপরপ্রান্তের বক্তার কথা শুনতে শুনতে। মিনিট দেড়েক পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন তিনি। উত্তেজিত, অস্থিরভাবে চেয়ার ত্যাগ করলেন।
মি, শহীদ, মেয়েটা! আবির্ভাব ঘটেছে তার।
কুয়াশা বলল, মানে? কোন মেয়েটা? ম্যাডাম নোয়ার…
হ্যাঁ। ম্যাডাম মোয়র মেয়ে এসেছে বোম্বেতে। উইল অনুযায়ী তার পাওনা বুঝে নেবার জন্যে।
কোত্থেকে এসেছে সে?
মি. বচ্চন বলল, বাংলাদেশ থেকে। হোটেলে উঠেছে। আইন-উপদেষ্টা, লবঙ্গম মেহতা তাকে ম্যাডাম নোয়ার অফিসে আসতে বলেছে বেলা এগারোটায়। লবঙ্গম চাইছে আমরা এখুনি তার সাথে দেখা করি।
পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে কুয়াশা বলল, অবশ্যই। মিস লিলির জন্যে একটা চিরকুট লিখে রেখে যাই আপনার সহকারীর কাছে।
.
মৃতা ম্যাডাম নোয়ার বাসভবন। ড্রয়িংরূমে বসেছে ওরা। কুশল প্রশ্ন ইত্যাদির পালা শেষ করে লবঙ্গম মেহতা বলল, গতকাল একটা চিঠি রিসিভ করেছি আমি। ম্যাডাম নোয়ার মেয়ের চিঠি। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, আজ আসবেন বোম্বেতে।
বয়স কত তার? নাম কি?
নাম–শর্মিলী সরকার-মিসেস তোফায়েল বলাই ভাল এখন। কারণ, তিনি বিবাহিতা। বয়স চব্বিশ।
মায়ের নামের সাথে তার নামের মিল নেই কেন?
লবঙ্গম মেহতা ব্যাখ্যা করল, ম্যাডাম নোয়ার পিতৃদত্ত নাম ছিল রাউল চিখারী। তিনি বিয়ে করেন চন্দ্রশেখর সরকারকে। কিন্তু স্বামীর নাম তিনি নিজের নামের সাথে যোগ করেননি। এদিকে, মেয়ের নাম রাখা হয় বাপের নামের সাথে মিলিয়ে।
নোয়া–এই নামটা তাহলে কৃত্রিম, ছদ্মনাম ছিল?
লবঙ্গম মেহতা বলল, হ্যাঁ।
কুয়াশা জানতে চাইল, শর্মিলী সরকার তাহলে বিয়ে করেছে একজন মুসলমান যুবককে?
হ্যাঁ।
নিজের পরিচয় প্রমাণ করবার জন্যে তিনি কোন প্রমাণ কি নিয়ে এসেছেন সাথে করে?
লবঙ্গম মেহতা একটা ফাইল খুলতে খুলতে বলল, হ্যাঁ, নিয়ে এসেছেন–এই দেখুন, মিসেস রাউল চিখারীর সাথে চন্দ্রশেখর সরকারের ম্যারেজ সার্টিফিকেট।
হাত বাড়িয়ে সার্টিফিকেটটা নিল কুয়াশা। তাতে লেখা রয়েছে, চন্দ্রশেখর সরকার, বাংলাদেশের অধিবাসী, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো রাউল চিখারীর সাথে, যার জন্মভূমি নেপালে। ১৯৫০ সালে হয় বিয়েটা।
এ ছাড়াও রয়েছে শর্মিলী সরকারের বার্থ-সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট।
কুয়াশা জানতে চাইল, চন্দ্রশেখর সরকার–তিনি কোথায় এখন?
মারা গেছেন, বিয়ের তিন বছর পর, একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, মিসেস তোফায়েল জানলেন কিভাবে তার মা ম্যাডাম নোয়া?
নেপালের এক আশ্রমে ম্যাডাম নোয়া মেয়েকে দান করে দিয়েছিলেন। শর্মিলী সেখানেই বড় হয়। ষোলো বছর বয়সে সে এক যুবকের সাথে চলে আসে ঢাকায়। যুবকটি তাকে বিয়ে করবে, কথা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেনি। ঢাকায় একা খুবই অসহায় বোধ করে সে। লেখাপড়া জানে সামান্য, তাই বাড়িতে বাড়িতে আয়া হিসেবে কাজ করে সে বেশ কিছুদিন। যাই হোক, নেপালের বিখ্যাত আশ্রম। শিশু মঙ্গল কুটিরের পরিচালিকা শর্মিলী সরকারের ঢাকার ঠিকানা জানতেন। ম্যাডাম নোয়া যে আসলে ম্যাডাম রাউল চিখারী অর্থাৎ তিনি যে চন্দ্রশেখর সরকারের স্ত্রী এবং শর্মিলীর মা, তাও জানা ছিল তার। তিনি দৈনিক কাগজে ম্যাডাম নোয়ার মৃত্যু সংবাদ দেখেন। এবং টেলিগ্রাম করে খবরটা দেন শর্মিলী সরকারকে ওরফে মিসেস তোফায়েলকে।
মি. তোফায়েল–কোথায় সে?
ঢাকায় ছিলেন না, যখন টেলিগ্রাম আসে নেপাল থেকে। তিনি বেড়াতে গেছেন পাকিস্তানে।
মি. বচ্চন জানতে চাইলেন, মিসেস তোফায়েল কি তার মায়ের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোন আলোকপাত করতে পারবেন?
লবঙ্গম মেহতা মাথা দোলাল, মায়ের সম্পর্কে মিসেস তোফায়েল কিছুই জানেন না। এমন কি তিনি তার মায়ের নাম পর্যন্ত জানতেন না।
মি. বচ্চন নিরাশ ভঙ্গিতে বললেন, তার আবির্ভাব তাহলে কোন সুফল প্রসব করছে না।
এমন সময় কারানান খাট্টা ঢুকল ড্রয়িংরূমে। বলল, হুজুর, মিসেস ডোফায়েল এসেছেন।
নিয়ে আসুন তাকে।
লবঙ্গম মেহতা বলল, স্বচক্ষে দেখুন ম্যাডাম নোয়ার মেয়েকে।
খানিকপর যে মেয়েটি ড্রয়িংরূমে ঢুকল, দেখতে সে কালো, রোগাপাতলা, কিন্তু চেহারায় লাবণ্য আছে। সাধারণ, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা। সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজ পরনে। কুয়াশা লক্ষ করল, ভ্যানিটি ব্যাগটা নতুন।
বসল মিসেস তোফায়েল। পরিচয় বিনিময় হলো ওদের মধ্যে।
মিসেস তোফায়েল মুখস্থ করা বুলির মত বলল কয়েকটা কথা, জন্মদাত্রী মারা গেছেন, এই সংবাদ শুনে আমি এসেছি বটে কিন্তু তার সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ কিছু জানি না আমি।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, শিশুমঙ্গল কুটির ত্যাগ করেন আপনি কত বছর বয়সে?
ষোলো বছরে।
ঢাকায় কোথায় কোথায় চাকরি করেছেন?
মিসেস তোফায়েলকে এতটুকু ইতস্তত করতে দেখা গেল না। বলল, বাড়িতে বাড়িতে আয়ার কাজ করে লেখাপড়া শিখেছি আমি। চাকরি করেছি দুটো পঞ্জিকা অফিসে কয়েকমাস করে। আমার স্বামীর সাথে পরিচয় হয় এক ওষুধ কোম্পানীতে চাকরি করার সময়। ঢাকা মেডিসিন কোম্পানীতে। তখন তিনি ওখানেই চাকরি করতেন, আমিও। আমার স্বামী এখন পাকিস্তানে আছেন। সম্ভবত ওখানেই আমরা সেটেলড হব। ওঁর বিষয় সম্পত্তি আছে ওখানে।
দুঃসংবাদটা কিভাবে পেলেন?
মিসেস তোফায়েল বলল, হত্যাকাণ্ডের খবর তো পেপারে পড়েই ছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম নোয়া যে আমার মা তা আমি জানব কিভাবে। তারপর হঠাৎ নেপাল থেকে আশ্রমের পরিচালিকার টেলিগ্রাম পেলাম। তার কদিন পরই পেলাম রেজিস্ট্রি ডাকযোগে মায়ের এবং বাবার ম্যারেজ সার্টিফিকেট এবং আমার বার্থ সার্টিফিকেট।
মিসেস তোফায়েলের হোটেলের নাম জেনে নিল কুয়াশা। তারপর বিদায় নিল। মি. বচ্চনকে সাথে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে জীপে উঠে বসল কুয়াশা। মি. বচ্চন জীপে স্টার্ট দিয়ে বললেন, চলুন হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি আপনাকে। তা, মেয়েটাকে দেখে কি মনে হলো আপনার, মি. শহীদ?
কুয়াশাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। মি. বচ্চনের ভুরু কুঁচকে উঠল।
কি ভাবছেন?
কুয়াশা বলল, ভাবছি, মেয়েটাকে এর আগে কোথায় দেখেছি আমি। কোথাও যে দেখেছি তাতে সন্দেহ নেই।
হয়তো ঢাকায় কোথাও দেখে থাকবেন।
কুয়াশা বলল, কিন্তু কোথায়?
হোটেলের সামনে থামল জীপ। কুয়াশা বলল, মি. বচ্চন, আমার তরফ থেকে। এক কাপ কফি, আপত্তি আছে?
সহাস্যে বললেন মি. বচ্চন, গল্প করার ইচ্ছে, না?
জীপ থেকে নেমে হলরুমে ঢুকল ওরা। মি. বচ্চনকে বসতে বলে কুয়াশা গেল টেলিফোন এক্সচেঞ্জের রূমে।
খানিকপরই ফিরে এল কুয়াশা। মি. বচ্চনের প্রশ্নের উত্তরে বলল, নেপালে ট্রাঙ্ককল করব, বুক করে এলাম।
ওদের সাথে যোগ দিল এমন সময় লিলি। চিঠি পেয়েছি, শহীদ ভাই। মেয়েটা দেখতে কেমন?
মিসেস তোফায়েল দেখতে আর সব বাঙালী মেয়েদের মতই-একটু বেশি কালো। এই যা।
লিলি সাগ্রহে বলল, স্বামী ভদ্রলোকও এসেছেন নাকি?
না। সে এখন পাকিস্তানে। বেড়াতে গেছে, মিসেস তোফায়েল বলল।
কুয়াশা আবার গিয়ে ঢুকল টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। প্রায় আধঘণ্টা পর বেরিয়ে এল সে: শিশুমঙ্গল কুটিরের পরিচালিকার সাথে কথা হলো। শর্মিলী সরকার ওখানেই মানুষ হয়েছে। মোটকথা, মিসেস তোফায়েল যা যা বলেছেন, সবই সত্যি। পরিচালিকা শেষ খবর জানেন তার সম্পর্কে–সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছে ঢাকায় শর্মিলী।
মি. বচ্চন বললেন, খুনের সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে কিনা…
কুয়াশা হঠাৎ বলল, লিলি, মি. বচ্চন, কি যেন বললাম শেষবার যখন কথা বললাম আমি? ঠিক ধরতে পারছি না, না জেনেই আমি এমন একটা কথা বলেছি যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল কুয়াশা মাথায় হাত দিয়ে। ত্রিশ সেকেণ্ড পরই উজ্জল হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। বলল, ইউরেকা! মনে পড়েছে। মিসেস তোফায়েলের চেহারাটা কেন পরিচিত মনে হচ্ছিল, এইবার জেনেছি। তাকে আমি দেখেছি এর আগে। দেখেছি বিমানে, যে বিমানে ম্যাডাম নোয়া খুন হয়। মিসেস পারভিন স্টুয়ার্ডকে দিয়ে মিসেস তোফায়েলকে ডাকিয়ে আনিয়েছিল। মিসেস তোফায়েল হলো মিসেস পারভিনের সেক্রেটারি।
.
০৭.
ঘটনা অকস্মাৎ নতুন মোড় নেয়ায় সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন বোবা হয়ে গেল। যা কেউ ভাবতেও পারেনি, তাই ঘটেছে। মিসেস তোফায়েল, ওরফে শর্মিলী সরকার অর্থাৎ নিহত ভদ্রমহিলার একমাত্র কন্যা সন্তান স্বয়ং উপস্থিত ছিল বিমানে, হত্যাকাণ্ডের সময়।
লিলিই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল, হ্যাঁ-হ্যাঁ–মনে পড়েছে আমারও। মিসেস পারভিন স্টুয়ার্ডকে বলেছিলেন, আমার সেক্রেটারিকে একটু ডেকে দিন।
কুয়াশা বলল, সেক্রেটারি যখন এল ফ্রন্ট ক্যারিজ থেকে, তার হাতে ছিল একটা মেক-আপ কেস। মিসেস পারভিন বলল–পাখি, আমার মেক-আপ কেসটা দিয়ে যাও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ–ঠিক। তার মানে মিসেস তোফায়েলের আর এক নাম–পাখি।
লিলির চোখমুখ উত্তেজনায় ফেটে পড়বার উপক্রম হয়েছে।
মি. বচ্চন বললেন, আই সি! আচ্ছা, মেয়েটা কি তার মায়ের পাশ ঘেঁষে মিসেস পারভিনকে মেক-আপ কেস দিতে আসে?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ।
মি. বচ্চন বললেন, মোটিভ রয়েছে। রয়েছে সুযোগ। আর সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মেয়েটার কথা আগে আপনারা কেউ স্মরণ করেননি কেন, উল্লেখ করেননি কেন? সন্দেহভাজনদের মধ্যে একেও ইনকুড করা হয়নি কেন?
লিলি উত্তর দিল এ প্রশ্নের, ঘটনাটা ঘটে বিমান আকাশে ওঠার পরপরই, একেবারে প্রথম দিকে। ম্যাডাম নোয়া বেঁচে ছিলেন তারপরও অনেকক্ষণ।
মি. বচ্চন বললেন, বেঁচে ছিল তখনও? তাহলে তো ভারি মুশকিলের কথা। মি. শহীদ, বিষের প্রতিক্রিয়া প্রয়োগ করার অনেক পর শুরু হতে পারে?
কুয়াশা চিন্তা করছে। বলল, ভাবতে দিন, আমাকে ভাবতে দিন। প্রথম থেকেই আমি ভুল পথে এগুচ্ছি তা কি সম্ভব?
মি. বচ্চন নিচু গলায় বললেন, ভেবে-চিন্তে এগোতে হবে এখন থেকে আমাদের। মিসেস তোফায়েলের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় এমন কিছু বলা বা করা চলবে না। তার বিরুদ্ধে দুটো পয়েন্ট খাড়া করতে পেরেছি আমরা। সুযোগ এবং মোটিভ। এখন আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে, তার কাছে সাপের বিষ ছিল। প্রশ্ন আরও একটা আছে, যেটার সমাধান চাই। যে আমেরিকান লোকটা ব্লো-পাইপ কিনেছে জিরোপোলাসের কাছ থেকে এবং বাংলাদেশ বিমানের কাউন্টার ইনচার্জকে ঘুষ খাইয়েছে–কে সে? তার আসল পরিচয় কি? আমার কোন সন্দেই নেই, এই আমেরিকান মেয়েটার স্বামী অর্থাৎ তোফায়েল ছাড়া আর কেউ নয়।
চমৎকার। স্বামী! হ্যাঁ, স্বামী…দাঁড়ান, ভাবতে দিন আমাকে।
কুয়াশা ভাবছে। হঠাৎ সে বলল, আলোচনার খাতিরে ধরা যাক ব্যাপারটাকে এইভাবে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মিসেস তোফায়েল দায়ী কিংবা দায়ী নয়। সে যদি নিরপরাধ হয়, মিথ্যে কথা বলছে কেন? মিসেস পারভিনের সেক্রেটারি সে, কেন সে কথাটা গোপন রাখছে?
কেন? পাল্টা কুয়াশাকেই প্রশ্ন করলেন মি. বচ্চন।
কুয়াশা বলল, আমার প্রথম ধারণা ছিল খুনী-ধরুন, তার নাম এক্স। মিসেস তোফায়েলকে সম্বোধন করা যাক ওয়াই বলে। এখন যেহেতু মিসেস তোফায়েল মিথ্যে কথা বলছে, ধরা যাক সেই অপরাধী। কিন্তু…দাঁড়ান! ধরুন, আমার প্রথম ধারণাটাই ঠিক। আমার সেই ধারণার সাথে কি মিসেস তোফায়েলের মিথ্যে কথা বলার সাথে বা তার অপরাধের সাথে কোন সম্পর্ক আছে? আছে: হ্যাঁ, থাকতে পারে। কিন্তু তা যদি থাকে, সম্পর্কটা যদি বাস্তবে সত্যি হয় তাহলে মিসেস তোফায়েলের তো বিমানে থাকার কথা নয়!
মি. বচ্চন এবং লিলি বোকার মত বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
মি. বচ্চন বললেন, মি. সিম্পসন ঠিকই বলেছিলেন আপনার সম্পর্কে আমাকে, মি. শহীদ। আপনি এত জটিল পদ্ধতিতে চিন্তা করেন যে…
কুয়াশা নিজের মনেই কথা বলে উঠল, অবশ্যই তা সম্ভব। এবং খোঁজ নিয়ে ব্যাপারটা জেনে নেয়া খুব সহজ।
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা।
কি ব্যাপার? কোথায় চললেন?
কুয়াশা বলল, বসুন। আসছি আমি। ফোন করতে যাচ্ছি।
কোথায়? নেপালে?
কুয়াশা হাসল। বলল, না। ঢাকায়। এখুনি আসছি।
পাঁচ মিনিট পর ফিরে এসে বসল কুয়াশা। উজ্জল, সাফল্যের হাসিতে উদ্ভাসিত তার চোখমুখ। বলল, মিসেস পারভিনকে ফোন করেছিলাম। সে জানাল, সাধারণত তার সেক্রেটারি ট্রেন বা জাহাজযোগে ভ্রমণ করে, কোথাও তাকে যদি নিয়ে যাবার দরকার পড়ে। কিন্তু সেদিনের ব্যাপারে, (ম্যাডাম নোয়ার হত্যাকাণ্ডের দিন) শেষ মুহূর্তে মিসেস পারভিন সিদ্ধান্ত নেয় তার সেক্রেটারিও তার সাথে বিমানে করে ঢাকায় যাবে।
আবার উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। মি, বচ্চনের বাহু ধরে জোর করে আসন ত্যাগ করতে বাধ্য করল তাকেও। বলল, মি. বচ্চন, মাই ফ্রেণ্ড, সময় নষ্ট করলে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে যাবে। তাড়াতাড়ি চলুন।
প্রায় টেনে নিয়ে চলল কুয়াশা মি. বচ্চনকে। লিলি আসন ত্যাগ করে ছুটল ওদের পিছু পিছু।
কিন্তু কোথায়? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।
মি. বচ্চনকে থামিয়ে দিয়ে কুয়াশা বলল, মিসেস তোফায়েলের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। দেরি হয়ে গেলে তাকে বোধ হয় বাঁচাতে পারব না।
বাইরে এসে লাফ দিয়ে জীপে চড়ে বসল কুয়াশা। মি. বচ্চন এবং লিলি জীপে উঠে বসতেই স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল সে জীপ।
ঝড়ের বেগে ছুটে চলল জীপটা।
দশমিনিটের মধ্যে মিসেস তোফায়েলের হোটেলের সামনে সজোরে ব্রেক কষে দাঁড় করাল কুয়াশা জীপটাকে। লাফ দিয়ে নামল সে জীপ থেকে। ছুটল হোটেলের গেট অতিক্রম করে।
মি. বচ্চন এবং লিলি যখন হোটেলের রিসেপশনে ঢুকল, কুয়াশা তখন কথা বলছে রিসেপশনিস্টের সাথে।
রিসেপশনিস্ট বলছিল, ইয়েস স্যার। মিসেস তোফায়েল হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন। এই মাত্র, আধঘণ্টা আগে।
এমন অপ্রত্যাশিভাবে হোটেল ছাড়লেন কেন তিনি? এখান থেকে গেছেন কোথায়?
কুয়াশার কথা বলবার ভঙ্গিতে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পেল।
রিসেপশনিস্ট যা বলল, তার সারমর্ম দাঁড়ায় এই রকম–না, মিসেস তোফায়েল কোন ঠিকানা রেখে যাননি। হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিতই বটে তাঁর চলে যাওয়াটা। তিনি বাইরে কোথাও ছিলেন, হোটেলে ফিরে দেখেন তার জন্যে একজন বাঙালী ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোককে দেখে মিসেস তোফায়েল খুব বিস্মিত হন। তারা হলরুমে বসে কিছুক্ষণ কথা বলেন। ভদ্রলোককে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মিসেস তোফায়েল পোর্টারকে দিয়ে তার রুম থেকে ব্যাগ-ব্যাগেজ নামিয়ে আনান। পোর্টারকে বলেন একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে।
কোথায় যাবার জন্যে ট্যাক্সি? রেলওয়ে স্টেশনে।
জীপে এসে বসল আবার ওরা। রেলওয়ে স্টেশনের দিকে ছুটে চলল জীপ। কুয়াশার মুখে কথা নেই। মি. বচ্চনকে উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। লিলিকে মনে হচ্ছে বিমূঢ়। রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে বিশেষ কিছু জানা গেল না। প্ল্যাটফর্মে মিসেস তোফায়েল নেই। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হলো ওরা।
সেদিনই বিকেল পাঁচটায় লিলি হোটেলের হলরুমে বসে কফি পান করছিল, করিডর থেকে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। লিলির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল সে। বলল, দুঃসংবাদ, লিলি!
দুঃসংবাদ!
বোম্বে টু ক্যালকাটা এক্সপ্রেস ট্রেনটা যখন নাগপুরে থামে তখন রেলওয়ে পুলিস একটা রিজার্ভ করা কেবিনে মিসেস তোফায়েলের লাশ আবিষ্কার করে।
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল লিলির মুখ, সেকি!
তার হাতে একটা কাঁচের গ্লাস পাওয়া গেছে। গ্লাসের পানির সাথে পাওয়া গেছে Prussic acid-পয়জন।
তাহলে আত্মহত্যা?
উত্তর দিল না কুয়াশা তখুনি। খানিকপর মৃদু কণ্ঠে বলল, পুলিস তাই বিশ্বাস করছে।
আপনি…আপনি কি ওদের সাথে একমত নন, শহীদ ভাই?
কুয়াশা গম্ভীর মুখে বলল, আত্মহত্যা করেছে সে, কেন? ধরা পড়ে যাবার ভয়ে? এদিক ওদিক মাথা দোলাল কুয়াশা। তারপর আবার বলল, আমি বিশ্বাস করি না।
.
০৮.
পরদিন ঢাকায় ফিরে এল কুয়াশা। লিলি রয়ে গেল বোম্বেতেই। কুয়াশা তাকে কিছু কাজ দিয়েছে, সেগুলো শেষ করে ফিরবে সে ঢাকায়।
কাজগুলো অর্থহীন বলে মনে হলেও, একে একে সবগুলোই সারল লিলি। সব শেষ করে ফিরল সে ঢাকায় পাঁচদিন পর।
রমনা পার্কে কথা হচ্ছিল আরিফের সাথে ওর।
লিলির কাছ থেকে ম্যাডাম নোয়ার মেয়ে মিসেস তোফায়েলের ঘটনাগুলো সব শুনে আরিফ মন্তব্য করল, যাক, সে-ই তাহলে খুনী-বাচলাম সবাই!
লিলি বলল, কিন্তু সমাধানটা কেমন যেন মনঃপূত হচ্ছে না আমার, আরিফ। সত্যিই কি মেয়েটা তার মাকে টাকা-পয়সার লোভে খুন করেছিল? তাই যদি হবে, আত্মহত্যা করল কেন সে?
আরিফ বলল, তাও বটে। আসলে, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়তো আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।
এরপর কেটে গেল বেশ কটা দিন। রমনা পার্কে প্রায় রোজই লিলিকে নিয়ে বেড়াতে যায় আরিফ। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে ওরা। নীড় বাঁধবে দুজন–সেই স্বপ্নের ঘোরে উড়ে বেড়াচ্ছে দুই কপোত-কপোতী।
রমনা পার্কেই হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল কুয়াশার সাথে ওদের। লিলিই তাকে দেখতে পেল আগে। চিৎকার করে ডাকল সে, শহীদ ভাই!
হাসতে হাসতে ওদের কাছে চলে এল কুয়াশা, এই যে, সুখের পায়রা-জুটি! কেমন আছ, লিলি? দেখা-সাক্ষাৎ যে একেবারে বন্ধ করে দিলে?
সময় পাই না একদম
আরিফ বলল, সেই কেসটার কি হলো বলুন তো শেষ পর্যন্ত? মেয়েটাকেই। শেষ পর্যন্ত আপনারা খুনী বলে সাব্যস্ত করেছেন নাকি?
কুয়াশা বলল, খুন-খারাবীর কথা থাক। আগামীকাল আমার বাড়িতে আপনাদের দুজনের নিমন্ত্রণ রইল, গল্প করা যাবে। মি. সিম্পসনকেও, নিমন্ত্রণ করেছি। লিলি, যাবে তো? ওহ্ হো, সৈয়দ জাহাঙ্গীরও নিমন্ত্রিত হয়েছেন।
যাব না মানে? একশোবার যাব।
কুয়াশা বলল, যাবেন কিন্তু, আরিফ সাহেব। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করব আমি। ভাল কথা, ইরানে যাবার কি হলো আপনার?
লিলি বলল, ইরানে আমি ওকে যেতে দিলে তো?
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, লিলি বৃটেনে যেতে চাইছে।
কুয়াশা বলল, দুজনেরই স্বভাব এক, খালি উড়ে বেড়াতে চায়! ভাল, ভাল। যেয়ো কিন্তু লিলি।
.
পরদিন শহীদের বাড়ি। শহীদ উপস্থিত নেই বাড়িতে। কিন্তু তার জায়গায় রয়েছে কুয়াশা, শহীদের ছদ্মবেশে। তার সামনের তেপয়ে কালো রঙের একটা অ্যাটাচিকেস রয়েছে।
ডিনার পরিবেশন করছে লীনা।
খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ। ড্রয়িংরূমে বসে খোশগল্প করছেন মি. সিম্পসন এবং সৈয়দ জাহাঙ্গীর শহীদরূপী কুয়াশার সাথে। আরিফও উপস্থিত কিন্তু তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। তার কারণ, লিলি আসেনি।
বিকেল পাঁচটার সময় তাকে ফোন করে লিলি জানিয়েছিল, তার অফিসের কি একটা জরুরী কাজে তাকে সাতটা আটটা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হবে। আরিফ যেন একাই চলে যায় শহীদ ভাইয়ের বাড়িতে, সে অফিস থেকে সরাসরি যাবে একটু দেরি করে।
এখন বাজে রাত সাড়ে নটা। আসেনি লিলি। সাড়ে আটটার সময় অবশ্য ফোন করে সে কুয়াশাকে জানিয়েছে, কাজের ভিতর গলদ বেরিয়েছে মস্ত একটা, সেটা সংশোধন করতে হবে গভীর রাত পর্যন্ত, তাই সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবে না, যথাযথ দুঃখও নাকি প্রকাশ করেছে সে।
মি. সিম্পসন হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে প্রশ্ন করলেন, ম্যাডাম নোয়া মার্ডার কেসটা সত্যি, অমীমাংসিত হয়ে রইল! এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা, যাই বলো, শহীদ।
কুয়াশা অ্যাটাচিকেসের গায়ে হাত রাখল। বলল, অমীমাংসিত বলছেন আমি তা মনে করি না।
তা মনে করো না মানে? তুমি কি বলতে চাও মিসেস তোফায়েলই প্রকৃত খুনী?
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, আমি তা বিশ্বাস করি না।
কুয়াশা বলল, যা বলতে চাই, তা এককথায় বলা সম্ভব নয়। ব্যাখ্যা করে বলতে হবে–শোনার ধৈর্য আছে আপনাদের?
আরিফ বলল, প্লীজ, মি. শহীদ, দয়া করে শোনান আপনার ব্যাখ্যা। কেসটা সম্পর্কে মাথামুণ্ডু কিছুই বোধগম্য হয়নি আমার।
কুয়াশা নড়েচড়ে বসল। নতুন করে চুরুট ধরাল একটা। তারপর পট থেকে এক কাপ গরম কফি টেলে আয়েশ করে চুমুক দিল কাপে। অ্যাটাচিকেসটার দিকে চোখ রেখে বলল, প্রথম থেকেই শুরু করি, কেমন?
মি. সিম্পসন মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
কুয়াশা বলতে শুরু করল, বিমানের, যখন ঢাকায় পৌঁছুতে আর কমিনিট বাকি, স্টুয়ার্ড তারেক হোসেন এসে ডাক্তার সমীরকে ডেকে নিয়ে গেল, ওদের সঙ্গ নেই আমিও, কৌতূহলবশত, ডাক্তার সমীর ম্যাডাম নোয়াকে পরীক্ষা করে রায় দিলেন, ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। এই সময় আমাদের মধ্যে থেকে রাঘব সিং প্যাটেল বলল, শুনেছি বোলতার কামড় খেয়ে মানুষ মারা যায়, এক্ষেত্রেও সেরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
কুয়াশা চুরুটে ঘনঘন টান দিল।
ম্যাডাম নোয়ার গলার পাশে ছোট্ট একটা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাই আমি-বোলর কামড় খেয়ে মৃত্যু–অস্বাভাবিক শোনাচ্ছিল না। কিন্তু এরপরই আমি ২নং সীটের কাছে বর্শাটা দেখতে পাই। ম্যাডামের গলা থেকে বর্শাটা পড়ে গেলে যেখানে থাকার কথা সেখানেই পড়ে ছিল ওটা। বর্শাটার গায়ে কালো এবং হলুদ রঙের সিক্ষের সুতোর-ঝালর ছিল, দেখতে প্রায় হুবহু একটা বোলতার মত। এর মধ্যে সৈয়দ জাহাঙ্গীর আমাদের সাথে যোগ দেয়। সে জানায় এই ধরনের বর্শা সাউথ আমেরিকার এক উপজাতীয় গোষ্ঠী রো-পাইপের সাহায্যে নিক্ষেপ করে থাকে, এটা তাদের কাছে একটা মারাত্মক অস্ত্র। পরে, আপনারা জানেন, রো পাইপটাও পাওয়া যায় বিমানে।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখল কুয়াশা।
তারপর আবার শুরু করল, দুটো পয়েন্ট আমাকে খুবই চিন্তিত করে তোলে, মি. সিম্পসন। এক, বোলতার উপস্থিতি। দুই, রো-পাইপের অস্তিত্ব। ব্লো-পাইপটা কেন খুনী সবার অলক্ষে বাইরে ফেলে দেয়নি? এটা একটা বিরাট রহস্য বলে মনে হয় আমার। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্তে আসি, ব্লো-পাইপটা আসলে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারই করা হয়নি। খুনী আমাদেরকে ধাঁধায় ফেলবার বা মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করাবার জন্যে সেটা বিমানে রোপণ করেছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, অথচ, বর্শার আগায় সাপের বিষের যে অস্তিত্ব পাওয়া যায় পরীক্ষায়, তাতেই মৃত্যু হয়েছে ম্যাডাম নোয়ার।
ঠিক। রাৈ-পাইপ যদি ব্যবহার করা না হয়ে থাকে, বর্শাটা নিক্ষেপ করা হলো কিসের সাহায্যে? হঠাৎ চোখ খুলে গেল আমার। নিক্ষেপ করাই হয়নি, বর্শাটা খুনী হাত দিয়ে ম্যাডাম নোয়ার গলার পাশের শিরায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু ম্যাডাম নোয়ার অত কাছে স্টুয়ার্ডরা ছাড়া আর, কেউ যায়নি।
কুয়াশা বলল, যায়নি কেন বলছেন? আমি ওদিকে গিয়েছিলাম দুবার, সৈয়দ
জাহাঙ্গীর গিয়েছিলেন একবার। স্টুয়ার্ডরা তো বারবার যাওয়া-আসা করেছে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর তীব্র কণ্ঠে বলল, মি. শহীদ, আমি গিয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু আমি ম্যাডাম নোয়কে খুন করিনি। তার দিকে আমি তাকাইনি পর্যন্ত।
কুয়াশা বলল, শান্ত হোন। আমার বক্তব্য শেষ হয়নি এখনও। শুনুন, বলি। প্রথমে তিনজনকে আমি সন্দেহ করি। সৈয়দ জাহাঙ্গীর, তারেক হোসেন এবং আবদুর রউফ। এদের কাউকে খুনী বলে মনে হয় না, তবু সন্দেহ হওয়ায় আমি এদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে থাকি। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি, দরকার হলে। আমার পরবর্তী সমস্যা ছিল-বোলতা। কফি যখন পরিবেশন করা হয় তখন কেউ কেউ লক্ষ করে ওটাকে। খুনী অত্যন্ত চালাক-চতুর, দ্বিবিধ সুবিধের কথা ভেবে বোলতা ছেড়েছিল সে বিমানের ভিতর। এক, বোলর কামড় খেয়ে মারা গেছে। ম্যাডাম–এটা সবাই ধরে নিতে পারে। দুই, বোলতার দিকে সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট হতে পারে, সেই সুযোগে সে খুন করবে, কেউ লক্ষ করবে না তাকে।
কুয়াশা নিভে যাওয়া চুরুটে অগ্নিসংযোগ করল। : প্রকৃত ঘটনা ঘটেছিল এই রকম–বোলতাটা উড়তে শুরু করার পর খুনী দুসারি সীটের মধ্যবর্তী প্যাসেজ ধরে বিমানের লেজের দিকে যায়, ম্যাডাম নোয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে, ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। এবং বর্শাটা দুআঙুলে ধরে তার গলার পাশে ঢুকিয়ে দেয়। পয়জনটা এতই শক্তিশালী ছিল যে মৃত্যুও তৎক্ষণাৎ ঘটে। ম্যাডাম চিত্তার করার অবকাশও পায়নি। অস্ফুট কোন শব্দ করে থাকলেও, প্লেনের শব্দে তা চাপা পড়ে যায়।
কুয়াশা থামল।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর খেপা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কুয়াশার দিকে। প্রায় চিৎকার করে উঠল সে, পরিষ্কার করে বলুন, যা বলতে চান। কার কথা বলছেন আপনি? কে সেই লোক আপনি কি আমাকে লক্ষ করে এসব বলছেন?
কুয়াশা বিরক্ত হলো। বলল, চুপ করুন আপনি। যা সত্যি ঘটেছে, তাই বলছি। আমি। বুঝলেন, মি. সিম্পসন, ম্যাডাম নোয়ার মেয়ে মিসেস তোফায়েল বিমানে উপস্থিত ছিল এটা যখন জানা গেল–আমার থিওরি তখন অচল বলে মনে হতে লাগল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, গিল্টি সেই। কিন্তু সে গিল্টি হলে, তার একজন সাহায্যকারী আছে, যে সাহায্যকারী ব্লো-পাইপ কিনেছিল এবং বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিল। কে এই সাহায্যকারী? তার স্বামী, মি. তোফায়েল? এরপর হঠাৎ আমি সমাধানটা দেখতে পাই। আমার প্রথম অনুমানই সত্য প্রমাণ হয়। কিন্তু সেই অনুমান অনুযায়ী, মিসেস তোফায়েলের বিমানে থাকার কথা নয়। ফোন করলাম মিসেস পারভিনকে। সে জানাল, শেষ মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সেক্রেটারি বিমানে করে তার সাথেই ঢাকায় যাবে। এর আগে এমন কখনও হয়নি।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, পরিষ্কার হলো না কিছুই।
কুয়াশা বলল, ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে চাইছি আমি।
তাকাল সে আরিফের দিকে। বলল, একটা প্রশ্ন করতে চাই।
আরিফ বেশ আগ্রহের সাথে সানন্দে বলল, করুন না!
কুয়াশা মাথা নিচু করে টোবাকো ভরল পাইপে, অগ্নিসংযোগ করল নতুন করে। তারপর ধোয়া ছাড়ল একমুখ। বলল, আপনি ম্যাডাম নোয়াকে চিনতেন। কিন্তু কথাটা স্বীকার করেননি। কেন বলুন তো?
আরিফ হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, ব্যাপারটা যখন জেনেই ফেলেছেন, তখন সত্যি কথাটাই বলি। কি জানেন, খুন-খারাবী, পুলিসী ঝামেলা–এসবকে আমি ভীষণ ভয় করি। ম্যাডাম নোয়া খুন হয়েছেন জানার পর ভয় পেয়ে যাই আমি। আমার সাথে তার পরিচয় ছিল একথা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিস আমাকে খুনী বলে সন্দেহ করবে ভেবে…।
কুয়াশা বলল, ওটা আসলে আপনার অহেতুক ভয় ছিল। নিহত কারও সাথে সম্পর্ক থাকলেই যে পুলিস তাকে খুনী বলে সন্দেহ করে একথা আপনাকে কে বলল? আপনি সত্যটা গোপন করে কেসটাকে আরও জটিল করে ফেলেছেন। তা না হলে এর সমাধান আরও অনেক আগেই করতে পারতাম। আপনি কিন্তু আরও সত্য গোপন করে গেছেন।
আরও সত্য গোপন করেছি?
হাসছে বটে আরিফ, কিন্তু বেশ একটু ম্লান সে হাসি।
কুয়াশা বলল, মিসেস পারভিনের সাথেও তো আপনার পরিচয় ছিল। সেই সূত্রেই ম্যাডাম নোয়ার সাথে আপনার পরিচয়।
আরিফ বলল, কারণ ওই একটাই। আমি চাইনি নিহত ভদ্রমহিলার সাথে আমার পরিচয় আছে তা জানাজানি হয়ে যাক।
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, বুঝেছি। আচ্ছা, আপনি তো বিবাহিত, তাই না?
আরিফ চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে। কিছু বলা উচিত তার, কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সৈয়দ জাহাঙ্গীর এবং মি. সিম্পসনের চোখেমুখেও, ওরা সবাই জানে লিলির সাথে প্রেম আছে আরিফের।
মি. সিম্পসন এতক্ষণে মুখ খুললেন, কি বলছ তুমি, শহীদ?
কুয়াশা বলল, আমি ঠিকই বলছি, তাই না আরিফ সাহেব? আপনি বিবাহিত, ঠিক কিনা?
আরিফ বলল, কিন্তু এর সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। আপনি বলুন কথাটা ঠিক কিনা?
না। আমি বিবাহিত নই।
কুয়াশা সোফায় হেলান দিয়ে বসল। বলল, কিন্তু আমি জানি আপনি বিবাহিত। আপনাদের বিয়ের কাগজপত্রও আমি যোগাড় করেছি। আমার পকেটেই রয়েছে সেটা।
কী! মি. সিম্পসন প্রায় হুঙ্কার ছাড়লেন। আবার বললেন, আপনি বিবাহিত হয়ে আর এক মেয়ের সাথে প্রেম করছেন? ভেরি ব্যাড।
আরিফ চুপ। মুখে কথা নেই।
কুয়াশা বলল, আপনার স্ত্রীর পরিচয়টাও সবাইকে জানানো দরকার।
কে তিনি?
কুয়াশার দিকে সাগ্রহে ঝুঁকে পড়লেন মি. সিম্পসন।
কুয়াশা বলল, ম্যাডাম নোয়ার মেয়ে পাখি, ওরফে শর্মিলী সরকার।
হোয়াট? মি. সিম্পসন চেঁচিয়ে উঠলেন।
কুয়াশা আরিফের দিকে তাকাল। বলল, শর্মিলী যখন ট্রেনে খুন হয়, আপনি তখন কোথায় ছিলেন, আরিফ সাহেব?
ঢাকায় ছিলাম।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা। বলল, মিথ্যে কথা বলছেন কেন? আমি জানি আপনি ঢাকায় ছিলেন না। ছিলেন বোম্বেতে। শুধু তাই নয়, শর্মিলী যে ট্রেনে ছিল আপনিও সেই ট্রেনে ছিলেন।
বাজে কথা! আমার বিরুদ্ধে আপনি অকারণে আবোলতাবোল বকছেন। প্রমাণ করতে পারবেন যে আমি ওই ট্রেনে ছিলাম?
প্রায় চিৎকার করে বলল আরিফ কথাগুলো। কাঁপছে সে। ঘামছে দরদর করে।
কুয়াশা কথা না বলে চেয়ে রইল আরিফের দিকে। তারপর, হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আরিফের শার্টের বুক পকেটে দুটো আঙুল ঢুকিয়ে দিল সে।
আরিফ বাধা দেবার আগেই আঙুল দুটো বের করে আনল কুয়াশা।
কি ওটা? মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন সবিস্ময়ে।
কুয়াশার হাতে একটা রেলওয়ে টিকেট দেখা যাচ্ছে।
এটা কি, আরিফ? জিজ্ঞেস করল কুয়াশা তেপয়ের উপর টিকেটটা রেখে।
রেলওয়ে টিকেটটা দেখল সবাই।
আরিফ কর্কশ গলায় বলল, ওটা একটা রেলওয়ে টিকেট। কিন্তু আমার পকেটে কোত্থেকে এল তা আমি জানি না।
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, জানেন বৈকি! শর্মিলীকে আমি চিনে ফেলেছি, জেনে ফেলেছি সে আপনার স্ত্রী এবং ম্যাডাম নোয়ার সাথে বিমানে সেও ছিল-এটা টের পেয়ে আপনি তাড়াহুড়ো করে শর্মিলীর সাথে দেখা করেন হোটেলে, তাকে নিয়ে বোম্বে এক্সপ্রেসে উঠে বসেন। এবং খুন করেন বিষ খাইয়ে।
মিথ্যে কথা। আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আরিফ। আতঙ্কিত দেখাচ্ছে তাকে।
প্রমাণ? আরও প্রমাণ আছে। দেখবে? কথা শেষ করে কুয়াশা তেপয়ের উপর থেকে অ্যাটাচিকেসটা তুলে নিল। সেটা উরু দুটোর উপর রেখে তালা খুলে ভিতর থেকে বের করল একজোড়া গোল্ডরিমের চশমা, একটা দোমড়ানো হ্যাট, চুইংগামের খোলা একটা প্যাকেট এবং নকল দাড়ি। বলল, বোম্বের অ্যান্টিকসের দোকানে এবং বাংলাদেশ বিমানের ব্রাঞ্চ অফিসে তুমি গিয়েছিলে একজন আমেরিকানের ছদ্মবেশে। নিজের নাম বলেছিলে সাইলাল হারপার। বোম্বের অ্যাপোলো হোটেলেও এই নামে উঠেছিলে তুমি। স্বীকার করো?
কালো ভূতের মত বিকৃত হয়ে গেছে আরিফের চেহারা।
না! না! আমি স্বীকার করি না। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
কুয়াশাকে কঠোর দেখাল। বলল, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ ষড়যন্ত্র করে না। যা সত্য তাই প্রকাশ করে মাত্র। তুমি না জানিয়ে হোটেল থেকে সরে পড়বার সময় ছদ্মবেশ গ্রহণের সরঞ্জামগুলো ফেলে আসো সেখানে। অনেক অনুসন্ধান চালিয়ে উদ্ধার করেছি আমি এগুলো। অ্যাপোলো হোটেলের যে রূমে তুমি ছিলে সেই রূমে পাওয়া গেছে সাইলাস হারপারের হাতের ছাপ। সে ছাপের সাথে তোমার হাতের ছাপ হুবহু মিলে গেছে। এর চেয়ে বড় প্রমাণের আর দরকার আছে কি?
রাগে ফেটে পড়ল আরিফ, কিন্তু এসব থেকে কি প্রমাণ হয় আমি খুন করেছি? শর্মিলী যে ট্রেনে ছিল, আমিও সেই ট্রেনে ছিলাম–তাতে কি? আর-ম্যাডাম নোয়াকে আমি খুন করেছি তা প্রমাণ করতে পারবেন না, কারণ খুন আমি করিনি।
কুয়াশা আরিফের কথার উত্তর না দিয়ে মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, গত কদিন আমি গাধার মত খেটে ওর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি। আরিফ-ওটা ওর আসল নাম নয়। ওর নাম তোফায়েল। তোফায়েল ওরফে আরিফ মিসেস পারভিনের ডেন্টিস্ট, সেই সূত্রে ম্যাডাম নোয়া যখন ঢাকায় আসত, দাঁতের ব্যথার জন্যে যেত সে তোফায়েলের কাছে। তাকে নিয়ে যেত মিসেস পারভিনের সেক্রেটারি পাখি ওরফে শর্মিলী সরকার মাকে নিয়ে যেত অথচ সে জানত না যে ম্যাডাম নোয়া তার নিজের মা। সে যাক, যাতায়াত করতে করতে তোকায়েলকে পাখির ভাল লেগে যায়। এবং গল্পচ্ছলে সে তাকে নিজের জীবনের করুণ ইতিহাস বিশদ শোনায়। ম্যাডাম নোয়ার আসল নাম যে রাউল চিখারী একথা পাখি জানত না। কিন্তু যেভাবেই হোক, তোফায়েল তা জেনে ফেলে। শুধু তাই নয়, সে এও জানতে পারে যে পাখি আসলে ম্যাডাম নোয়ারই মেয়ে। এরপর সে ম্যাডাম নোয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয় এবং তার কাছ থেকে জেনে, নেয় যে ম্যাডাম নোয়া তার সয়-সম্পত্তি, টাকাপয়সা সব উইল করে রেখেছে তার মেয়ের নামে। এইসব তথ্য জেনে যাওয়ার পর লোভে পেয়ে বসে তোফায়েলকে। ম্যাডাম নোয়কে খুন করলে অগাধ ধনদৌলতের মালিক হবে পাখিএবং পাখিকে বিয়ে করলে সেই অগাধ ধন-দৌলত কার্যত তার অধিকারে চলে আসবে-এটা বুঝতে পেরে প্ল্যান-পরিকল্পনা করতে শুরু করে সে খুন করার। কিন্তু খুন করলেই তো হবে না, পুলিসের হাত থেকে বেঁচে থাকতেও তো হবে। তোফায়েল সিদ্ধান্ত। নেয় খুনের দায় কৌশলে সে চাপাবার চেষ্টা করবে মিসেস পারভিনের উপর। মিসেস পারভিন যে ম্যাডাম নোয়ার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে এবং টাকার সুদ দিতে পারছে না বলে ঝগড়া-ঝাটি চলছে তাদের মধ্যে–জানত তোফায়েল। রত্নাগিরিতে বেড়াতে গিয়ে সে ম্যাডাম নোয়া এবং মিসেস পারভিনকে দেখে ওখানে। গুপ্তচরের মত ওদের ওপর লক্ষ রাখে সে। এবং খবর সংগ্রহ করে বেশ কয়েকটা। এক নম্বর খবর, নির্দিষ্ট কোন একদিন ম্যাডাম নোয়া বোম্বে যাবে ভোরের কপ্টারে, এবং সেদিনই সকালের ফ্লাইটে সে যাবে ঢাকায়। এদিকে দ্বিতীয় খবরটি হলো, মিসেস পারভিন রত্নাগিরি থেকে বোম্বে যাবে দ্বিতীয় কপ্টারফ্লাইটে এবং সে ঢাকায় যাবে বাংলাদেশ বিমানের দুপুরের ফ্লাইটে। খবর দুটো সংগ্রহ করে তোফায়েল রত্নাগিরি ত্যাগ করল। বোম্বেতে এসে বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে ম্যাডাম নোয়ার সকালের ফ্লাইটে ঢাকায় আসা বন্ধ করল সে। সে চেয়েছিল মিসেস পারভিন যে বিমানে ঢাকায় আসবে সেই বিমানেই যেন ম্যাডাম নোয়া ঢাকায় আসে। তার উদ্দেশ্য পূরণ হলো। এরমধ্যে ব্লো-পাইপ কিনেছে সে আমেরিকান যুবকের ছদ্মবেশ নিয়ে।
এসব গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলো আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নয়! আরিফ রাগে ফেটে পড়ল।
কুয়াশা বলল, খুনটা কিভাবে করেছ এবার ব্যাখ্যা করছি। তোমার ব্যাগে পাওয়া গেছে ডেন্টিস্টদের সাদা লিনেন কোট। কেন? বেড়াতে গেলে কেউ প্রফেশনাল পোশাক সাথে নিয়ে বেরোয়? বেরোয় না। কেন তাহলে নিয়েছিলে সাদা, আজানুলম্বিত কোটটা? কারণ, ওটা দেখতে প্রায় স্টার্ডদের কোটের মত, তাই। এবার বলছি, খুনটা তুমি কিভাবে ঘটাও। সবাই দেখেছে, তুমি হাত মুখ ধুতে ওয়াশ-রূমে গিয়েছিলে। ওয়াশ-রূমটা যেদিকে সেদিকে ম্যাডাম নোয়ার সীট নয়। ম্যাডাম নোয়া যেদিকে বসেছিল সেদিকে তুমি যাওনি। কিন্তু, আসলে, তুমি গিয়েছিলে। তোমাকে কেউ চিনতে পারেনি। চিনতে পারেনি তার কারণ, তোমাকে সবাই স্টুয়ার্ড বলে মনে করেছিল। ওয়াশ-রূমে গিয়ে তুমি পোশাক বদলাও, ওখান থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ ধরে সোজা চলে যাও ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বিমানের পিছন দিকে, ম্যাডাম নোয়ার কাছে। তোমার হাতে চামচ ছিল একটা, নিজেকে স্টুয়ার্ড হিসেবে লোকের চোখকে ধুলো দেবার জন্যে চামচটা হাতে ধরে রেখেছিলে। ম্যাডাম নোয়ার টেবিলে গিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়ো তুমি, একজন স্টুয়ার্ড সাধারণত আরোহীদের দিকে যেভাবে ঝুঁকে পড়ে ভাল-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করে, তেমনি ভঙ্গিতে। তুমি মাডামের গলায় বর্শাটা ঢুকিয়ে দাও চোখের পলকে, এবং তখনই ম্যাচবাক্স খুলে বোলতাটাকে ছেড়ে দাও। এরপর ফিরে যাও তুমি ওয়াশ-রূমে, ওখানে আবার পোশাক বদলাও, তারপর স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এসে বসে পড়ো নিজের সীটের ওপর। সবই প্রমাণ করতে পারব আমি, আরিফ।
মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আরিফের মুখটা। হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
কুয়াশা বলল, পাখিকে তুমি বিয়ে করো মাসখানেক আগে, শুধু ধন-দৌলতের লোভে। পরস্পরের প্রতি ভালবাসার গভীরতা প্রমাণ করবার জন্যে তোমরা একটা অদ্ভুত চুক্তি করো। সেই চুক্তিতে লেখা আছে, তুমি মারা গেলে তোমার যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হবে পাখি, এবং পাখি মারা গেলে তার যাবতীয় সব কিছুর মালিক হবে তুমি। এই ধরনের অদ্ভুত চুক্তির কথা আগে কখনও কেউ শুনেছেন? শোনেননি। চুক্তিপত্রটা রয়েছে আমার কাছে। কোর্টে দাখিল করা হবে বিচারের সময়। এই চুক্তি থেকে বোঝা যায়, পাখি তার মায়ের ধন দৌলত পেলে তাকেও তুমি খুন করতে। পাখিকে যে তুমিই খুন করেছ সেই প্রমাণও রয়েছে আমার হাতে। একে একে সব প্রকাশ করব নাকি নিজেই স্বীকার করবে অপরাধ?
আরিফ বলল, সবই তো জানেন…আমি শেষ হয়ে গেছি…
কান্নায় ভেঙে পড়ল আবার অপরাধী।
কুয়াশা বলল, সম্পত্তির দাবি জানাবার জন্যে ঢাকা থেকে পাখিকে নিয়ে যাও বোম্বেতে। কিন্তু তুমি কি জানতে যে ঘটনাচক্রে তখন বোম্বেতে আমিও থাকব, পাখিকে আমিও দেখবার সুযোগ পাব? যেই তুমি জানলে, অমনি বুঝতে পারলে ভয়ঙ্কর ভুল হয়ে গেছে। পাখি যে বিমানে ছিল, এ আমি টের পেয়ে গেছি–এই ভয়ে তুমি পাগল হয়ে গেলে। পাখিকে নিয়ে উঠে বসলে বোম্বে টু ক্যালকাটা এক্সপ্রেসে। খুন করলে বিষ খাইয়ে।
মি. সিম্পসন বললেন, পাখি ওরফে শর্মিলী তাহলে নিরপরাধ?
কুয়াশা বলল, অবশ্যই। বিমানের আরোহী আরিফই যে তার স্বামী তোফায়েল তাও সে জানত না। জানলে অন্য রকম ঘটনা ঘটত সম্ভবত।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, বোলতাটা যে আরিফ সাহেব আমদানী করেছেন তা আপনি জানলেন কিভাবে?
ওর পকেটে একটা ম্যাচ-বাক্স ছিল-খালি। খালি ম্যাচের বাক্স-কেন? কেউ রাখে পকেটে? সেই থেকে ওর দিকে নজর পড়ল আমার। কিন্তু ও যাতে টের না পায় আমি ওকে সন্দেহ করছি তার জন্যে ওকে দলে টেনে নিলাম।
ম্যাডাম নোয়া যে ওর কাছে দাঁতের ব্যথার জন্যে যেত তা আপনি জানলেন কিভাবে?
ওর বাড়িতে ঢুকে কিছু কাপড়-চোপড় এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকটা চুরি করতে হয়েছিল আমাকে। কাপড়গুলো এমনি চুরি করেছিলাম, অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকটাই দরকার ছিল আমার। ওটাতেই পাই আমি ম্যাডাম নোয়ার নাম।
মি. সিম্পসন বললেন, থ্যাঙ্কস, মাই বয়। আমি তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করি। তুমি ছাড়া এই কেসের সমাধান কেউ বের করতে পারত না। ভাল কথা, মিস লিলিকে কি তুমি…।
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ মেয়েটা খুব ভাল। এই খুনীটাকে চিনতে না পেরে ভালবেসে ফেলেছে। তার সামনে ব্যাপারটা ঘটাতে চাইনি বলে ফোনে ওকে আমি এখানে আসতে নিষেধ করে দিই। কি জানেন, মি. সিম্পসন, ম্যাডাম নোয়ার মেয়ে হিসেবে প্রথমে দুজনকে সন্দেহ করেছিলাম। লিলি এবং মিসেস পারভিনকে। যখন দেখলাম যে, না, এরা নয়, তখনই আমি অনুভব করি এই ঘটনার সাথে এমন একজন জড়িত, যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
মি. সিম্পসন বললেন, ওয়েল ডান, মাই বয়। তোমাকে কি বলে যে প্রশংসা করব…
কুয়াশা মধুর হাসল। বলল, মি. সিম্পসন, এই কেসের সমাধান কিন্তু, আমি বের করিনি!
তুমি বের করোনি! হোয়াট? কি বলছ?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। সমাধানটা বের করে আমাকে জানিয়েছে। কুয়াশা।
কুয়াশা! কুয়াশা এই কেসের মধ্যে কোত্থেকে এল?
আপনার মনে আছে, বিমান ঢাকা এয়ারপোর্টে নামতেই আপনি ঘেরাও দিয়েছিলেন আর্মড ফোর্স নিয়ে?।
নিশ্চয়ই মনে আছে। খবর পেয়েছিলাম কুয়াশা ওই প্লেনে থাকবে কিন্তু ছিল না সে।
কুয়াশা বলল, আমি জানি ছিল সে ওই বিমানে।
মি. সিম্পসন স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ইমপসিবল! আমি বিশ্বাস…
কুয়াশা বাধা দিয়ে বলল, আমি জানি, ছিল। ছদ্মবেশ নিয়ে ছিল।
কে! আরোহীদের প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে কে ছিল কুয়াশা?
কুয়াশা মুচকি হাসল। বলল, শান্ত হোন। আজ থাক, আর একদিন এ প্রশ্নের উত্তর দেব আপনাকে। একদিনে এতগুলো ঘটনা হজম করতে পারবেন না।
মি. সিম্পসন শ্রাগ করে বললেন, তোমার এই রহস্যময় আচরণের কারণ বুঝতে পারলাম না, শহীদ! ওকে, মার্ডার কেসটা সমাধান হওয়াতেই আমি খুশি। স্বয়ং তুমিই যদি কুয়াশা হও, ধন্যবাদ জানাতে আপত্তি নেই আমার।
নিজের রসিকতায় নিজেই হো-হো করে হেসে উঠলেন মি. সিম্পসন।
Leave a Reply