কুয়াশা ৭১ (ভলিউম ২৪)
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
০১.
বোম্বে এয়ারপোর্ট।
বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা। কটকটে, আঁঝাল রোদ চারদিকে তাকানো যায় না। লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে একদল যাত্রী কংক্রিটের টারমাকের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে অপেক্ষারত একটি বিমানের দিকে।
বাংলাদেশ বিমানের ট্রাইডেন্ট মুক্তবলাকা আর দুচার মিনিটের মধ্যে টারমাক ছেড়ে আকাশে উড়বে।
বোম্বে টু ঢাকার দ্বিতীয় ফ্লাইট এটা। প্রথম ফ্লাইট লণ্ডন থেকে বোম্বে হয়ে ঢাকা যায়। দ্বিতীয় ফ্লাইটটা ইদানীং চালু হয়েছে, বোম্বে টু ঢাকা।
লিলি, যাত্রীদের সকলের পিছনে, অতৃপ্ত দৃষ্টি মেলে শেষ বারের মত দেখে। নিচ্ছিল বোম্বেকে। লটারির টাকা পেয়ে ভারতের জৌলুস বোম্বেতে বেড়াতে এসেছিল ও, মধুর কিছু স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে।
মুক্ত বলাকায় সবার শেষে চড়ল লিলি। ১৬ নং সীট তার, বিমানের লেজের দিকে মুখ করে বসল সে। আরোহীরা কেউ কেউ ওয়াশ-রূমে ঢুকেছে, কেউ কেউ দুসারি সীটের মধ্যবর্তী প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, কেউ বিমানের লেজের দিকে দাঁড় করানো টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখছে ব্যাগ ব্যাগেজ, রেইনকোট ইত্যাদি। সীটে বসেই জানালা পথে বাইরের দিকে তাকাল লিলি।
এয়ারপোর্টের অংশবিশেষ, দূরে অনতি উচ্চ প্রাচীর, আরও দূরে বোম্বের সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোর মাথা দেখা যাচ্ছে। গত দশ-বারো দিনের আনন্দমুখর ঘটনাগুলোর স্মৃতি এখনও অম্লান, তরতাজা হয়ে রয়েছে তার মনে। দিনগুলো কিভাবে যে কেটে গেল, টেরই পায়নি ও। বোম্বে বিরাট শহর। পনেরো বিশ লক্ষ মানুষের বাস। ইউরোপের শহরগুলোর মত বোম্বেতেও যানবাহনের অত্যধিক ভিড়। আধুনিক শহর বলতে যা বোঝায় বোম্বে তাই। অসংখ্য প্রথম শ্রেণীর হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ বার আছে, আছে প্রকাণ্ড আকারের কয়েকটা ফিল্ম-স্টুডিও, বড় বড় পার্ক, মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, সার্কাস পার্টি, মনোরম সী-বীচ, থিয়েটার ও সিনেমা হল। আর আছে টাকা এবং টাকার খেলা। বোম্বেতে ভারতের টপ গ্ল্যামারাস নায়ক নায়িকারা বসবাস করে। টুরিস্টদের শহর বোম্বে। বিদায়! বোম্বে, বিদায়! অস্ফুটে উচ্চারণ করল লিলি।
ওর পাশের সীটটা খালি। প্যাসেজের ওদিকের, সীটগুলোর দিকে তাকাল লিলি। মুহূর্তে ওর দৃষ্টি কেড়ে নিল দুই সুন্দরী যুবতী। পরস্পরের সাথে এইমাত্র সাক্ষাৎ হয়েছে ওদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল। দুই যুবতীর একজনকে এর আগে দেখেছে লিলি দুবার, মনে পড়ল। ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর একটি কর্কশ, উচ্চগ্রামে স্থায়ীভাবে বাঁধা। দামী শাড়ি-রাউজ, গহনা-গাটি এবং ভারিক্কি সগর্ব ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ভদ্রমহিলা ধনীর স্ত্রী।
অপর যুবতীটিও অপরূপ সুন্দরী। কিন্তু তার মুখের চেহারায় কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া। হাসিটা কেমন যেন মলিন।
গর্বিতা ভদ্রমহিলা গলা চড়িয়ে কথা বলছে, এ আমি আশাই করিনি, সাঈদা! শুনেছিলাম বটে তুমিও বোম্বেতে বেড়াতে এসেছ…এত ব্যস্ত ছিলাম বোম্বেতে পা দেবার পর থেকে যে তোমার খবর নেবার ফুরসতই পাইনি…তা কোথায় ছিলে?…আমাকে যদি আগে জানাতে তাহলে দেখতে কি রকম সুযোগ সুবিধে করে দিতে পারতাম….এসো, একসাথেই বলি।, কিন্তু অপর যুবতী বলল, আমার সীট নম্বর নাইন, আপনার সাথে বসব কিভাবে?
দুই ভদ্রমহিলার পিছন থেকে মার্জিত একটি পুরুষ কণ্ঠ বলল, কিছু যদি মনে না। করেন, আমার তেরো নম্বর সীটটা দখল করতে পারেন।
ভদ্রমহিলাদ্বয় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ভরাট পুরুষ কণ্ঠের অধিকারী সুদর্শন এক যুবক। মি. সিম্পসন যদি এই যুবককে দেখতেন সাথে সাথে সোন্নাসে চিৎকার জুড়ে দিতেন তিনি, শহীদ, মাই বয়। কী সৌভাগ্য, তোমাকে পাব আশাই করিনি।
ভদ্রমহিলাদ্বয় সুদর্শন যুবকের সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল। বলল তারা তেরো এবং সতেরো নম্বর সীটে, মুখোমুখি।
বোম্বে থেকে ঢাকায় ফিরছে শহীদ। এই বিমানে ওর সাথে ফিরছে কুয়াশাও। শহীদ ঢাকা থেকে এসেছিল ব্যবসা উপলক্ষে। ব্যবসার কাজ সেরে ফিরছে ও। কুয়াশার বোম্বে আসার কারণ অজ্ঞাত। শহীদ গতকাল পর্যন্ত জানতই না কুয়াশা বোম্বেতে আছে। শহীদের হোটেলে গতকাল রাত্রে অকস্মাৎ আবির্ভাব ঘটে কুয়াশার। কুয়াশাকে দেখে শহীদ একাধারে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়। ও যে। বোম্বেতে এসেছে, কোন হোটেলে উঠেছে–এসব কোত্থেকে জানল কুয়াশা, প্রশ্ন। করে সব জেনে নিতে পারত শহীদ। কিন্তু কোন প্রশ্ন সে করেনি। যদি জানানো প্রয়োজন বলে মনে করে কুয়াশা, এমনিই জানাবে, প্রশ্ন করতে হবে না, শহীদ জানে।
লিলি গর্বিত ভদ্রমহিলার দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছিল। বোম্বেতে নয়, প্রথমবার ওকে সে দেখেছে রত্নাগিরির সমুদ্র-সৈকতে। বিকিনি পরে কিছু ছেলেমেয়ের সাথে হই-হুঁল্লোড় করছিল বালুকাবেলায়। তখনই মহিলাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়েছিল লিলির। এর আগে কোথাও দেখেছে মহিলাকে, কিন্তু ঠিক স্মরণ করতে পারছে না সে।
এদিক-ওদিক চারদিক তাকাচ্ছে লিলি। শুধু একদিকে ছাড়া! মুখোমুখি বসে আছে স্মার্ট চেহারার যে যুবকটি তার দিকে একবারও তাকাতে পারছে না ও। নীল রঙের স্যুট পরেছে যুবক। যুবকের দিকে তাকালে যদি চোখাচোখি হয়ে যায়, ভীষণ লজ্জা পাবে ও।
যার যার সেফটিবেল্ট বেঁধে নেবার নির্দেশ এল লাউডস্পীকারে।
প্লেন ছুটতে শুরু করল খানিক পর রানওয়ে ধরে।
বোম্বে টু ঢাকা–যাত্রা শুরু হলো। আকাশে উঠছে বিমান। বিমানের পেটের ভিতর বাইশজন আরোহী। সামনের ক্যারিজে দশজন, পিছনের ক্যারিজে বারোজন। বিমানে আরও রয়েছে দুজন পাইলট, দুজন স্টুয়ার্ড।
বিমান উড়ে চলেছে। ইঞ্জিনের শব্দ খুব একটা বেশি নয়, অন্তত কানে তুলো দেবার দরকার নেই। তবে শব্দ যা হচ্ছে, গল্প গুজব করার পরিবেশ নেই।
ভারতের উপর দিয়ে উড়ছে বিমান। আরোহীরা যার যার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে।
লিলি ভাবছে, ওর দিকে তাকাব ন্ম আমি। যদি ধরা পড়ে যাই তাকাচ্ছি–সে বড় বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে! ভাববে কি আমাকে! তার চেয়ে মধুর স্মৃতিগুলো রোমন্থন করি, সময় কেটে যাবে।
টিবি লটারির একটা টিকেট কিনেছিল লিলি। এক টাকা দিয়ে। সেই নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে কত হাসাহাসি, কত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। অফিসের টেবিলের দেরাজে ফেলে রেখেছিল লিলি টিকেটটা, বাড়িতে নিয়ে যায়নি। ইণ্ডেনটিং অফিসে চাকরি করে ও, ফাইল এবং কাগজপত্রের ভিড়ে সেটা হারিয়েই গিয়েছিল একরকম। ড্র যেদিন অনুষ্ঠিত হলো, দৈনিক কাগজে ফলাফল বের হলো, তখন খোঁজ পড়ল সেই টিকিটের।
আর এক দফা ঠাট্টা আর ব্যঙ্গের শিকার হলো লিলি। টিকেট সবাই কিনেছিল। ইতিমধ্যে তারা নিজেদের নম্বর মিলিয়ে দেখেছে। পায়নি কেউ কোন পুরস্কার। সুতরাং সবাই ধরে নিয়েছিল লিলিও পাবে না।
ও পাবেই, এ রকম একটা দৃঢ় আশা ছিল লিলির মনে। দেরাজ খুলে টিকেটটা যখন খুঁজছিল, রীতিমত ঘামছিল ও, হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল।
এক সময় পাওয়া গেল টিকেটটা, একটা এক নাখ, একটা পঞ্চাশ হাজার, দুটো পঁচিশ হাজার, চারটে দশ হাজার, দশটা পাঁচ হাজার, পঞ্চাশটা এক হাজার এবং একশোটা একশো টাকার প্রাইজ।
প্রথম আটটা প্রাইজের নম্বরের সাথে মিলল না লিলির টিকেটের নম্বর। ওর সাথে হুমড়ি খেয়ে সংবাদপত্রে ছাপা নম্বরগুলো দেখছিল ইয়াসমিন, নাজমা, রীটা। সবাই সবগুলো ছাপা নম্বরের সাথে লিলির টিকেটের নম্বর মেলাবার চেষ্টা করছিল। চিৎকার করে নম্বরগুলো পড়ছিল রীটা। সে-ই তারস্বরে ঘোষণা করল সবার আগে, ব্যাড লাক! আহাহা চু-চু-চু, লিলির বোম্বে যাওয়া এবার আর হলো না। ওর ভগ্নী এবং ভগ্নীপতিতারা যদি প্লেনের টিকেট কেটে পাঠান, তবে অবশ্য আলাদা কথা!
লিলি কিন্তু তখনও আশা ছাড়েনি। রীটার ঘোষণা ওর বুকটা খালি করে দিয়েছিল, কিন্তু ধীরে সুস্থে নম্বরগুলো নিজে মিলিয়ে দেখার কাজটা শেষ না করে মুখ তুলল না ও।
পাঁচ হাজার টাকার দশটা প্রাইজ। পাশাপাশি ছাপা হয়েছে নম্বরগুলো। এক এক করে নয়টা নম্বর পড়ল লিলি। নৈরাশ্য ছেয়ে ফেলছে ওর মনকে। কিন্তু ক্রমিক নং দশের নম্বরগুলো পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে গেল তার।
টিকেটটা হাতেই ছিল লিলির। আড়চোখে সেটার নম্বরটা আর একবার দেখে নিল। আর একবার পড়ল সংবাদপত্রে ছাপা নম্বরটা। তারপর সিধে হয়ে দাঁড়াল।
লিলিকে হাসতে দেখে সবাই হতবাক। নিলি যে শুধু হাসছে তাই নয়, তার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ, খুশির আলো ফুটে উঠেছে।
রীটা সন্দিহান কণ্ঠে বলল, প্রাইজ না পেয়ে কি তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল, লিলি?
লিলি রিজার্ভড মেয়ে। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে গেল সে। বলল, প্রাইজ পেলে কি যেন করার কথা ছিল আমার?
বোম্বে যাবার কথা ছিল, তোর বোনের ওখানে বেড়াতে।
লিলি বলল, না, সে তো আমার একার ব্যাপার। তোদের জন্যে কি যেন করব বলেছিলাম?
নাজমা বলল, পাননি যখন তখন সে-কথা ভুলে আর দুঃখ দিচ্ছিস কেন!
লিলি বলল, পাই আর না পাই, আমি ধরে নিচ্ছি–পেয়েছি। কথা দিয়েছিলাম এক হাজার টাকার ওপর প্রাইজ পেলে তোদের পিছনে খরচ করব চারশো টাকা। মনে আছে?
কি বলতে চাইছিস? চারশো টাকা খরচ করবি তুই আমাদের তিনজনের পিছনে? প্রাইজ না পেয়েও?
নিলি গভীরভাবে বলল, করব।
সবাই লিলির দিকে বোকার মত চেয়ে রইল। সিরিয়াসলি ভাবছে ওরা, হলো কি লিলির! এর আগে ওরা শুনেছে, মোটা টাকার প্রাইজ পেয়ে কেউ কেউ পাগল হয়ে গেছে আনন্দে। লিলির বেলায় কি উল্টোটা ঘটল? প্রাইজ না পাওয়ায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে মনে, মাথাও খারাপ হয়ে গেছে ওর?
লিলি ওদেরকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কারণ, আমি প্রাইজ পেয়েছি। পাঁচ হাজার টাকা। প্রাইজটা আমার কি না, তাই আমি নম্বরটা ঠিকই দেখতে পেয়েছি।
মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেল। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল আবার সবাই সংবাদপত্রের উপর। কনফার্ম হলো সবাই, লিলি নির্দিষ্ট নম্বরটি দেখিয়ে দেবার পর। এর পর শুরু হলো হাসাহাসি, লাফালাফি আর তিন বান্ধবী মিলে লিলিকে চুমু খাবার ধুম।
পাসপোর্ট করাই ছিল লিলির। ভিসা ছিল না। হাতে টাকা আসতে দ্রুত ভিসা আদায় করে নিল ও।
.
লিলির বোন কলি স্থায়ীভাবে থাকে বোম্বেতে। ইকবাল, লিলির ভগ্নীপতি, ভারতের নাগরিক। একটা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সে।
বোম্ব থেকে বোন এবং ভগ্নীপতির সাথে রত্নগিরিতে বেড়াতে গিয়েছিল লিলি। ওখানে গ্ল্যামার-হাউজ নামে বড় একটা হোটেলে ছিল ওরা। সেই হোেটলে নানাধরনের খেলা জমত রাত্রে। লিলিরই জেদে ওর ভগ্নীপতি রাজি হয় খেলা দেখতে নিয়ে যেতে।
রুলেৎ নামে একটা খেলা আছে। বাংলাদেশে রুলেতের নাম চরকি। সেই চরকিতে পঞ্চাশটা টাকা ইনভেস্ট করে লিলি। হাতির ঘরে পঞ্চাশ টাকা ধরেছিল সে, কিন্তু চরকির কাটা গিয়ে থামল ঘোড়ার ঘরে। গেল পঞ্চাশ টাকা। এরপর ভগ্নীপতি এবং বোনের অজ্ঞাতে, পাশের চরকিতে গিয়ে আবার পঞ্চাশ টাকা খেলে লিলি। দুর্ভাগ্য, এবারও কপাল খারাপ। তৃতীয় এবং শেষবার আরও পঞ্চাশ টাকা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে লিলি। সব ঘরেই টাকা ফেলেছে লোকেরা। লিলি দেখল হরিণ এবং হায়েনার ঘরে কেউ টাকা ফেলেনি। হরিণের ঘরে পঞ্চাশ টাকা ফেলতে যারে ও, ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন এক যুবক, একই সাথে টাকাসহ হাত বাড়িয়ে দিল হরিণের ঘরের দিকে। মুখ ফিরিয়ে তাকাল লিলি। যুবক একটু যেন ভদ্রতাসূচক হাসল।
হরিণের পাশের ঘরটাই হায়েনার। বাড়ানো হাতটা ফিরিয়ে না নিয়ে হায়েনার ঘরে পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছেড়ে দিল লিলি।
চরকির কাটা ঘুরতে শুরু করল।
কাঁটাটার গতি ক্রমশ মন্থর হচ্ছে। সবাই অপেক্ষা করছে রুদ্ধশ্বাসে। দ্রুত কমে যাচ্ছে গতি! এই বুঝি থামল হাতির ঘরে..না, ঘোড়ার ঘরে.না, এই থেমে গেল সিংহের ঘরে…নাহ! এই…এইবার থেমে গেল।
থেমেছে কাঁটাটা। কালো হয়ে গেল.লিলির মুখের চেহারা। ইস! হরিণের ঘরে, টাকা ফেললে চারশো টাকা পেয়ে যেত ও! প্রথমে হরিণের ঘরেই ফেলতে গিয়েছিল সে, কিন্তু পাশের যুবকটি সেদিকে হাত বাড়াতে সে কি মনে করে হায়েনার ঘরে ফেলেছিল টাকা।
খেলার পরিচালক, চারশো টাকা গুনে ধপ করে ফেলল সাদা টেবিলকুথ বিছানো টেবিলের উপর। লিলি এবং যুবকের সামনে।
যুবক বলল, মিস: আপনার টাকাগুলো তুলে নিন।
ঝট করে তাকাল লিলি। চেয়ে রইল যুবকের দিকে কসেকেণ্ড, তারপর বলল, আমাকে কিছু বললেন?
টাকাগুলো ফেলে রেখেছেন কেন? তুলে ব্যাগে ভরুন।
লিলি আকাশ থেকে পড়ল, মানে? আমি…
যুবক মৃদু হেসে বলল, আপনি জিতেছেন।
লিলি স্তম্ভিত, আমি কিন্তু আমি তো টাকা রেখেছিলাম হায়েনার ঘরে।
যুবক আরও মধুর করে হাসল, না তো! আপনি হরিণের ঘরে টাকা, ফেলেছিলেন। হায়েনার ঘরে আমি খেলেছি। আমরা একই সাথে টাকা রাখার জন্যে হাত বাড়িয়েছিলাম।
দ্বিধায় পড়ে গেল লিলি। একবার মনে হলো, তাই তো, সে তো হরিণের ঘরেই টাকা ফেলেছিল। কিন্তু পর মুহূর্তে তার খেয়াল হলো যেন, না, টাকা তো ফেলেছিলাম হায়েনার ঘরে।
কিন্তু তর্ক করার বা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পেল না লিলি। স্মার্ট চেহারার যুবকটি মিষ্টি হেসে ঘুরে পঁড়াল। চলে যাচ্ছে সে হলরূম ছেড়ে।
সুন্দরী মেয়েদের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে কোন কোন যুবক এই রকম উদার ভূমিকার অভিনয় করে, ভেবেছিল লিলি, এই যুবকও হয়তো অভিনয় করে গেল। আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার লোভ হয়েছে হয়তো ওর। চারশো টাকা পেয়েও সে নিল না, দিয়ে দিল আমাকে।
কিন্তু যুবকটির চেহারার মধ্যে এমন একটা সপ্রতিভ ভাব এবং ব্যবহারে এমন সুন্দর মাধুর্য রয়েছে, তার সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবতে ভাল লাগল না লিলির।
রত্নাগিরিতে এরপর আরও পাঁচদিন ছিল ওরা। একদিনও এরপর সেই যুবকের সাথে দেখা হয়নি লিলির। কিন্তু আবার তার দেখা পাবার জন্যে মনে মনে উতলা হয়ে উঠেছিল লিলি। খেলার আড্ডায় দেখা হতে পারে মনে করে আর একদিন গিয়েছিল ও ওর ভগ্নীপতির সাথে। হলরূমটার সর্বত্র দেখেছিল সে ঘুরে ঘুরে। সেইবার ওই গর্বিত ভদ্রমহিলাকে দ্বিতীয়বার দেখে লিলি। দেখেই চেনা চেনা মনে হয়েছিল মহিলাকে। মহিলার সাথে ছিল কয়েকজন সুবেশী কিন্তু বয়স্ক বোম্বাইয়া। মহিলা হাইস্টেকে জুয়া খেলছিল-ফ্ল্যাশ। চেনা চেনা মনে হলেও, ঠিক কোথায় যে মহিলাকে সে দেখেছে, মনে পড়েনি লিলির।
যার জন্যে ওখানে দ্বিতীয়বার যাওয়া, সেই যুবকের সন্ধান পায়নি লিলি।
রত্নাগিরির দিন ফুরাল। ফিরে এল ওরা বোম্বেতে। ওখানে রইল আরও কটা, দিন, তারপর রিটার্ন টিকেট নিয়ে এরোড্রামের দিকে রওনা হওয়া…।
বিমান উড়ছে।
নিজের সীট দখল করার মিনিট দুয়েক পর আচমকা সেই স্মার্ট যুবককে আবিষ্কার করেছে লিলি, ওর মুখোমুখি সীটে।
যুবককে দেখার পর থেকে কেমন যেন একটা পুলক অনুভব করছে লিলি দেই মনে। ভাল লাগছে সবকিছু। যুবকটি যে তার কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে খেলায় জেতা টাকাটা ওকে দেয়নি, ইতিমধ্যে তা বুঝতে পেরেছে লিলি। তা যদি দিত, আশপাশে ঘুরঘুর করত সে, আলাপ জমাবার চেষ্টা করত। টাকাগুলো দিয়েছিল একটি মাত্র কারণে। আর তা হলো, চরকীর কাটাটা হরিণের ঘরে থেমে যেতে ওর চোখমুখের চেহারায় যে কালিমার ছাপ ফুটে উঠেছিল তাই দেখে। ওর আশাভঙ্গের স্বরূপটা দেখতে পেয়েছিল যুবক, মায়া, অনুভব করেছিল সে, ওর মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্যে চারশো টাকা ত্যাগ করে সে।
এমন উদারতা আজকাল বড় একটা দেখা যায় না। যেমন দেখতে, হৃদয়টাও তেমনি সুন্দর। স্বার্থহীন ত্যাগ একেই বলে।
মনে মনে ভাবছে লিলি, এরপর? এরপর কি ঘটবে?
কেন যেন মনে হচ্ছে লিলির, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তেরো নম্বর সীটে বসেছে মিসেস পারভিন। পারভিন নামেই সে বহুল পরিচিতা, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের উঠতি নর্তকী সে। ইদানীং এমন হয়েছে, যে-ছবিতে পারভিনের লম্ফ-ঝম্প নেই সেই ছবি ভাল ব্যবসা করতে পারছে না। কিন্তু সেটাই পারভিনের বড় পরিচয় নয়। ওর স্বামী প্রখ্যাত সমাজসেবক। ভদ্রলোক ধনীও বটে। অল্প বয়সে সমাজে বিশিষ্ট একটা স্থান দখল করেছেন ভদ্রলোক।
বিভিন্ন মহলে গুজব ছড়িয়ে আছে পারভিনের সাথে তার স্বামী সমাজসেবক আসিফ চৌধুরীর সম্পর্ক তেমন ভাল নয়। স্বামীর কোন কথাই মেনে চলে না পারভিন। ওদিকে, আসিফ চৌধুরী নাকি তার খালাতো বোন সাঈদার প্রেমে পড়েছে।
পারভিন কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল, সাদা কোট পরা স্টুয়ার্ড হাজির হলো কসেকেণ্ডের মধ্যে। পারভিন ভারিক্কি গলায় বলল তাকে, আমার সেক্রেটারিকে একটু ডেকে দিন। অপর কমপার্টমেন্টে আছে সে।
স্টুয়ার্ড চলে গেল। খানিকপর কালো রঙের একটি যুবতাঁকে দেখা গেল সামনের ক্যারেজ থেকে পিছনের ক্যারেজে ঢুকতে। পারভিনের সেক্রেটারি। তার হাতে একটা মেকআপ কেস দেখা যাচ্ছে।
পাখি, আমার মেকআপ কেসটা দিয়ে যাও।
পারভিনের হাতে মেকআপ কেস দিয়ে চলে গেল পাখি। পারভিন নিজের রূপচর্চায় মগ্ন হলো।
লিলি চোখ ফিরিয়ে নিল পারভিনের দিক থেকে। দুই মহিলার পিছনে বসেছে সুদর্শন, দীর্ঘদেহী এক যুবক। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা। সংবাদপত্রে এই ভদ্রলোকের ছবি বহুবার দেখেছে লিলি। প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান ইনি। নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে হলো ওর। লটারির টাকা পেয়ে বোম্বে বেড়াতে গিয়ে লাভ হয়েছে অনেক। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই আনন্দদায়ক, বৈচিত্রময়। শহীদ সাহেবের সীট নম্বর ছিল তেরো, তিনি পারভিনকে তার সীটটা দান করে গিয়ে বসেছেন নয় নম্বর সীটে। নয় নম্বরটা ছিল পারভিনের।
মুগ্ধ চোখে বেশ খানিকক্ষণ দেখল লিলি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানকে। কিন্তু যাকে লিলি দেখছে, তার চেহারা হুবহু শহীদ খানের মত হলেও সে আসলে শহীদ খান নয়। লিলির ভুল হচ্ছে। কিন্তু ভুলটা ধরতে পারার কথা নয় লিলির। মি. সিম্পসনও যদি উপস্থিত থাকতেন এই বিমানে, তিনিও ভুলটা ধরতে পারতেন না।
শহীদ আসলে বসে রয়েছে লিলির মুখোমুখি একটা টে। সেই স্মার্ট যুবকটি বসেছে যে সীটে, তার পাশেরটিতেই বসেছে শহীদ খান। শহীদকে এই মুহূর্তে দেখে মহুয়াও চিনতে পারবে না। লম্বা, প্রায় জট-পাকানো সোনালি চুল ওর। মাথায়। মুখ ভর্তি দাড়ি। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ঢিলেঢালা পোশাক। গঞ্জিকা সেবন করার ফলে ঢুলু ঢুলু চোখ। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। ইউরোপিয়ান হিপ্পী সেজে বসে আছে শখের গোয়েন্দা।
লিলি সংবাদপত্রে ছাপা ছবির চেহারার সাথে যার চেহারার হুবহু মিল দেখছে সে দেখতে শহীদ হলেও, আসলে কুয়াশা। কুয়াশা শহীদের ছদ্মবেশ নিয়ে দেশে ফিরছে। ছদ্মবেশ নেবার কারণটা পরিষ্কার করে বলেনি শহীদকে কুয়াশা। তবে শহীদ অনুমান করে নিয়েছে, বিমান ঢাকা এয়ারপোর্টে নামলে মি. সিম্পসন গোটা বিমানটিকে তার দলবলকে দিয়ে ঘেরাও করাবেন, এই রকম সন্দেহ করছে কুয়াশা। কুয়াশা এই বিমানে দেশে ফিরছে এ খবর হয়তো তিনি জানেন। মি. সিম্পসনের চোখকে ফাঁকি দেবার জন্যেই সম্ভবত কুয়াশা ছদ্মবেশ নিয়েছে এবং ওকে হিপ্পী সাজতে অনুরোধ করেছে। মি. সিম্পসন সত্যি সত্যি যদি বিমান ঘেরাও করেন, প্রত্যেক পুরুষ আরোহীকে পরীক্ষা না করে ছাড়বেন না তিনি। কুয়াশার শরীরে বিশেষ কয়েকটা চিহ্ন আছে, সেগুলোর সন্ধানে আরোহীদের পোশাক খোলা হবে। কিন্তু শহীদকে এসব ঝামেলা পোহাতে হবে না। মি. সিম্পসন শহীদকে সন্দেহ করতে পারবেন না। সবাইকে পরীক্ষা করা হবে, একমাত্র শহীদকে ছাড়া। কুয়াশা তাই শহীদেরই ছদ্মবেশ নিয়েছে।
হিল্পীবেশী শহীদের পাশে বসেছে আরিফ বাট।
শহীদরূপী কুয়াশার পাশে বসেছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। কাঁচাপাকা চুল তার মাথায়। ভদ্রলোকের কোলের উপর একটা বাঁশের বাঁশী দেখা যাচ্ছে। নাড়াচাড়া করছেন তিনি বাণীটা অন্যমনস্কভাবে। বিমানে ওঠার পর এই ভদ্রলোককে র্যাকে ব্যাগ রাখতে দেখেছিল লিলি। ব্যাগের গায়ে লেখা ছিল-ডা. সমীরুল হক এম. বি. বি. এস.।
ওদের দুজনের পিছনে একজোড়া ভারতীয় পুরুষ। একজন বয়স্ক, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে, অপরজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক, গোলগাল চেহারা, সম্ভবত ফ্রেঞ্চকাটের ছেলে। চেহারার মিল দেখে তাই মনে হলো লিলির : বাপ-বেটা তুমুল তর্ক করছে, খুবই উত্তেজিত দুজনেই।
দুসারি সীট। লিলির নিজের সারির সীটগুলো সব দেখা যাচ্ছে না ভাল। ওর সামনে সেই স্মার্ট যুবক এবং হিপ্পীবেশী শহীদ।
কুয়াশা বিমানের পিছন দিক থেকে ঘুরে এল একবার।
চারটে সীট ছাড়া দুসারির সবগুলো সীট বিমানের সামনের দিকে মুখ করা। লিলি বসে আছে ষোলো নম্বরে। তার পাশের সীট পনেরো, সেটা খালি। অপর সারির সতেরো নম্বর সীটে বসে আছে সাঈদা বেগম। আঠারো নম্বর খালি। পনেরো, মোনলা, সতেরো এবং আঠারো, এই চারটি সীট বিমানের পিছনের দিকে মুখ করা।
লিলির বিপরীত দিকে বসে আরিফ বাট ভাবছে, আশ্চর্য সুন্দরী কিন্তু মেয়েটা! আমাকে চিনতে পেরেছে, বাজি ধরে বলতে পারি। কে ভেবেছিল, আবার দেখতে পাব ওকে, আবার দেখা হবে! খেলায় হেরে এমন মুষড়ে পড়েছিল ও, খুব খারাপ লেগেছিল আমার। টাকাগুলো ওকে দিতে পারায় দারুণ আনন্দ বোধ করেছিলাম। ওকি আমার সাথে কথা বলবে?
স্টুয়ার্ড মেনু হাতে ওর দিকে ঝুঁকতে ও বলল, গরম কফি।
পারভিন ভাবছে, কিভাবে উদ্ধার পাব আমি এই উৎকট সমস্যা থেকে! এত বড় বড় দেনা, কে দেবে আমাকে এত টাকা! এক কাজ করলে হয়…কিন্তু তা কি আমি পারব? অত সাহস কি আমার আছে? ধোকা দিয়ে উৎরে যেতে যদি না পারি….ভরাডুবি হবে, হেল হয়ে যাবে জীবন তার ওপর, একে নিজের এই সমস্যা–ডাইনী সাঈদাটা আবার কোত্থেকে জুটেছে একই প্লেনে। উফ, অসহ্য! ওকে আমি দুচোখে দেখতে পারি না। আসিফকে হাত করবার জন্যে রাতদিন ষড়যন্ত্র করছে ডাইনীটা। শুনতে পাই সারাদিনই ওরা একসাথে ওঠাবসা করে..ঠিক আছে, আমার নামও পারভিন, দেখব ভাইনী আমার স্বামীকে কিভাবে ভাগিয়ে নেয়।
ওদিকে সাঈদা ভাবছে, পারভিন-চরিত্রহীনা! বেচারা আসিফের জন্যে দুঃখ হয়। অমন হীরের টুকরো ছেলে তার কিনা এই রকম একটা উড়নচণ্ডী বউ!
কুয়াশা ভাবছে, মেয়েটি শুধু সুন্দরী নয়, ও প্রেমেও পড়েছে সুন্দর এক যুবকের। জোড়াটা মিলবে ভাল, দেখে শুনে যা মনে হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার অত লজ্জা পেলে চলবে না তো! যুবকের দিকে সরাসরি তাকাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বেচারী: আর যুবকটা.. মজে গেছে পুরোপুরি।
কুয়াশার পাশে, ডাক্তার সমীরুল ভাবছে, যে-কোন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাকে। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নেব? ঝুঁকি আছে, জানি, কিন্তু ঝুঁকিটা না নিলে…মাই। গড়, ভাবতেই পারি না আমি, এই সংকট থেকে যদি বাঁচতে চাই, একমাত্র উপায়:এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে আমার জীবন, আমার অস্তিত্ব!
অন্যমনস্কভাবে বাঁশের তেল-চকচকে বাঁশীটা ঠোঁটের কাছে তুলল ডাক্তার সমীরুল। একটু হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। হঠাৎ খেয়াল হলো যেন, কেউ বুঝি তাকে লক্ষ করছে। পাশে বসা শহীদরূপী কুয়াশার দিকে তাকাল সে। কুয়াশা ঢুলছে, চোখে তন্দ্রার ভাব। বাঁশীটা নামিয়ে রাখল ডাক্তার কোলের উপর।
জগৎসিং প্যাটেল, ফ্রেঞ্চকাট প্রৌঢ় ভাঁটার মত চোখ পাকিয়ে চর্বিসর্বস্ব ভারি দেহটা দুলিয়ে গলা ফাটাচ্ছে, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই, বুঝলে! ওরা সবাই ভুল করেছে, সবাই অজ্ঞ-জার্মান, আমেরিকান এবং ইংলিশ–কারও বক্তব্যই. বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রিহিস্টরিক পটারীর যে সময়কাল নির্ধারণ করছে ওরা, ভুল, ভুল, ভুল! ধরো, Saimana wait-এর কথা ধরো…
গোলগাল লম্বা চেহারার, শান্ত প্রকৃতির সন্তান রাঘব সিং প্যাটেল গাম্ভীর্য বজায় রেখে বাপের সাথে তর্ক করছে, তোমাকে অবশ্যই সম্ভাব্য সব উত্স থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। Tall halal রয়েছে, রয়েছে Sakic Gu…
জগৎসিং প্যাটেল পুরানো, দোমড়ানো মোচড়ানো একটা অ্যাটাচি কেস খুলে ফেলল, এই কুর্দিল পাইপটার কথা ধরো, আজকাল তৈরি করছে ওরা এইরকম জিনিস। এর গায়ে যে ডেকোরেশন দেখতে পাচ্ছি আমরা, পাঁচ হাজার বি.সির পটারীতেও প্রায় হুবহু এইরকম ডেকোরেশন ছিল।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর রহস্য উপন্যাসের লেখক, আরিফ বাটের পিছনের সীট থেকে উঠে দাঁড়াল। প্যাসেজ ধরে বিমানের পিছন দিকের র্যাকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। ব্যাগ খুলে কাগজ এবং অদ্ভুত দর্শন লম্বা একটা বল পয়েন্ট পেন্সিল ও একটা খাতা নিয়ে ফিরে এল সে নিজের সীটে।
পারভিন ছোট্ট আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নিচ্ছে আবার। আরিফ বাট সীট ছাড়ল। বিমানের সামনের দিকে পাশাপাশি দুটো ওয়াশ-কেবিন। দুটির একটিতে ঢুকল আরিফ বাট।
কুয়াশা আবার গেল একবার বিমানের লেজের দিকে। ব্যাগ খুলে কিছু যেন নিল সে পকেটে। ধীর পদক্ষেপে ফিরে এল নিজের সীটে।
লেখকের পিছনের সীটটা আবদুল হাফিজের। সে ভাবছে, আমার দিকের হিসেবপত্র সব সেরে ফেলতে হবে। টাকার যে অ্যামাউন্টটা জমা দেবার কথা, ঠিক সময়ে জমা দিতে না পারলে আমার এত সাধের অর্ডারের কোন ভ্যালু থাকবে না..ইনক্রিমেন্টের প্রশ্নটাও ধামাচাপা পড়ে থাকবে, কিন্তু টাকা যে ভাবে আটকে আছে:লোন করেও তো গ্যাপ পূরণ করতে পারছি না।
স্টুয়ার্ড এক কাপ গরম কফি রাখল লিলির সামনের টেবিলে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লিলি।
একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা রহস্য উপন্যাসের লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীরের নাক-চোখকে কেন্দ্র করে ঘুরুল বার দুয়েক। সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্লটের জগতে ছিল, অন্যমনস্কভাবে দীর্ঘ পেন্সিলটার গোড়া মুখের ভিতর পুরে দিয়ে; ঝন্টু করে একপাশে সরিয়ে নিল সে মাথাটা। ওখান থেকে উড়ে বোলতাটা রাম সিং প্যাটেলের কফির কাপের ভিতরকার রহস্য তদন্ত করতে গেল। ভো ভো শব্দ শুনেই রাঘব তাকাল। দেখল, তার কফির কাপে নাকানিচোবানি খাচ্ছে হলুদ শয়তানটা। টি-খুনের চোখা গোড়া দিয়ে বোলতাটাকে গেঁথে ফেলল রাঘব সিং নিখুঁতভাবে।
কমপার্টমেন্টে সব কিছুই স্বাভাবিক। কথাবার্তা বন্ধ এখন। যার যার চিন্তায় মগ সবাই।
প্লেনের লেজের কাছে প্রবেশ পথের বিপরীত দিকে দুই নম্বর সীটটা। ম্যাডাম রাউল চিখারী বসেছে সেই নীটে। ম্যাডাম রাউনের মাথাটা একটু ঝুঁকল সামনের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা ঢুলছে ঘুমে।
কিন্তু আসলে?
মারা গেছে ম্যাডাম রাউল চিখারী।
.
০২.
বিমান এখন বাংলাদেশের আকাশে।
স্টুয়ার্ড তারেক হোসেন প্রত্যেকটি টেবিলের সামনে গিয়ে একবার করে দাঁড়ায় তুলে নেয় বিলের টাকাসহ ট্রে। পাঁচ এবং ছয় নম্বর সীটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে অপেক্ষা করতে হয়। বাপ-বেটা তর্ক জুড়ে দিয়েছে আবার। বিলের টাকা পেতে দেরি হয় তার বেশ একটু। ওদের কাছ থেকে সে এগোয় ম্যাডাম রাউলের দিকে। এই ভদ্রমহিলাকে চেনে সে। চেনে, মানে, প্রায়ই বিমানে দেখে ভদ্রমহিলাকে। ভদ্রমহিলা ভাল বখশীশ দেয়। এক নম্বর সীটটা খালি।
আপনার বিল, ম্যাডাম!,
ভদ্রমহিলা ঘুমুচ্ছেন মনে করে তারেক তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে গিয়ে বেশ জোরেই বলে কথাটা। সাড়া নেই। হঠাৎ যেন লক্ষ করে তারেক, ভদ্রমহিলার কাঁধের উপর ঝুলে রয়েছে মাথাটা। একটু ইতস্তত করার পর সে ভদ্রমহিলার হাত ধরে নাড়া দেয়, শুনছেন!
ঠাণ্ডা হাত। চমকে উঠে সিধে হয়ে দাঁড়ায় তারেক। সাদা, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখের চেহারা।
.
আবদুর রউফ, সেকেণ্ড স্টুয়ার্ড বলল, আঁ! বলো কি! অসম্ভব!
রীতিমত হাঁপাচ্ছে তারেক, বলল, নিশ্চয়ই মারা গেছেন! হাত ধরে…
একেবারে বরফের মত ঠাণ্ডা?
তারেক বলল, কি জানি, মানে, ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে মারা না গেলেও, জ্ঞান যে নেই…
ঢাকায় নামতে আর মাত্র কমিনিট বাকি…।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঠিক করে ফেলল ওরা পরবর্তী কর্মপন্থা। খানিকপর দেখা গেল তারেক প্রত্যেকটি টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, সংগোপনে জানতে চাইছে আরোহীদের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বিড় বিড় করে, এক্সকিউজ মি, স্যার, আপনি যদি একজন ডাক্তার হন…
আরিফ বাট বলল, আমি একজন ডেন্টিস্ট, দাঁতের ডাক্তার…
প্রায় উঠে দাঁড়িয়ে ছিল আরিফ বাট কিন্তু দাঁতের ডাক্তারকে দিয়ে কাজ হবে না মনে করে তারেক এগিয়ে গেল অপর সারির সীটগুলোর দিকে।
দশ নম্বর সীটের আরোহী ডা. সমীরুল হক বলল, আমি একজন ডাক্তার। কিন্তু ব্যাপার কি?
তারেক চাপা কণ্ঠে বলল, স্যার, দুনম্বর সীটের এক ম্যাডামকে দেখে আমার ভাল ঠেকছে না….দয়া করে আপনি যদি একবার…।
ডাক্তার সমীর সীট ত্যাগ কর। স্টুয়ার্ডের সাথে এগোল সে। কেউই লক্ষ করল না, কিন্তু শহীদরূপী কুয়াশাও চলল ওদের পিছু পিছু।
ডা. সমীর ম্যাডাম রাউলের উপর ঝুঁকে পড়ে দ্রুত পরীক্ষা করল। ম্যাডাম রাউল মধ্যবয়স্কা, বসন্তের শুকনো ক্ষতচিহ্নে ভরা মুখ, দামী শাড়ি-রাউজ এবং সোনার গহনা পরা।
ডাক্তার বলল, মারা গেছে।
তারেক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঢোক গিলল, কি ভাবে..মানে, হার্টফেল, ডক্টর?
ডাক্তার বলল, বিস্তারিত পরীক্ষা না করে তা আমি বলতে পারব না। শেষবার কখন ওকে দেখেছেন আপনি…মানে, জীবিত অবস্থায়?
চিন্তা করে তারেক বলল, যখন কফি দিয়ে গেলাম তখন তো দিব্যি বেঁচে ছিলেন। তা পৌনে একঘণ্টা আগে হবে।
ডা. সমীর বলল, অন্তত আধঘণ্টা আগে মারা গেছেন ইনি।
ওদের চাপা স্বরের কথাবার্তা, গম্ভীর হাবভাব আরোহীদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। মাথা ঘুরিয়ে অনেকেই দেখছে ওদেরকে। অনেকেরই কান খাড়া হয়ে উঠেছে। ডাক্তার সমীরের ঘাড়ের কাছ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
শহীদরূপী কুয়াশা হাসল, ডাক্তার, ভদ্রমহিলার গলায় একটা দাগ দেখতে পাচ্ছেন কি?
ডাক্তার দেখল দাগটা, আরে, তাই তো!
ম্যাডাম রাউল চিখারীর গলার এক পাশে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, বিন্দুটার চারপাশে বৃত্তাকার একটা লাল দাগ।
মাফ করবেন!
কুয়াশার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জগৎ সিং প্যাটেল এবং রাঘব সিং প্যাটেল। কথা বলল জগৎ সিং প্যাটেল, মাফ করবেন, আপনারা কি বলতে চাইছেন ভদ্রমহিলা মারা গেছেন এবং তার গলায় একটা ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে?
তার পুত্র রাঘব সিং প্যাটেল বাপের পিছন থেকে গনা উঁচিয়ে বলল, আমি একটা ধারণা দিতে পারি। একটা বোলতা উড়ে বেড়াচ্ছিল বো বো করে, মেরে ফেলেছি ওটাকে আমি। ওই যে।
হাত লম্বা করে দিয়ে তর্জনী তাক করল রাঘব নিজেদের ট্রে-র দিকে। ট্রে-র উপর কফির কাপ ইত্যাদি রয়েছে। পিরিচের উপর দেখা যাচ্ছে মরা হলুদ বোলতাটাকে। রাঘব সিং কথার রেশ ধরে আবার বলল, শুনেছি বোলর কামড় খেয়ে মানুষ মারা যায়, এক্ষেত্রেও সেরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
ডাক্তার সমীর মাথা নাড়ল, হতে পারে, এধরনের কেসের কথা শুনেছি আমিও। বিশেষ করে কারও মধ্যে যদি কারডিক উইকনেস থাকে…
কুয়াশার ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল দ্বিতীয়বার, মাফ করবেন, ওখানে কি যেন একটা পড়ে রয়েছে।
পড়ে রয়েছে? কি…?
কুয়াশা বলল, এমন একটা জিনিস যা দৃষ্টিতে পড়া উচিত।
জুতোর আগা দিয়ে জিনিসটা দেখাল কুয়াশা। ডাক্তার, স্টুয়ার্ড এবং প্যাটেলদ্বয় দেখল জিনিসটা।
আর একটা বোলতা? ডাক্তার বিস্মিত কণ্ঠে বলল।
হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল কুয়াশা; না!
বুক পকেট থেকে ধবধবে সাদা একটা রুমাল বের করল সে। অত্যন্ত যত্ন সহকারে ছোট্ট জিনিসটা বিমানের কার্পেট বিছানো মেঝে থেকে রুমাল দিয়ে ধরে তুলল, বলল, আসলে দেখতে বোলতার মত হলেও এটা বোলতা নয়।
সকলের চোখের সামনে তুলে ধরল কুয়াশা জিনিসটা। দেখল সবাই। সত্যি জিনিসটা বোলতা নয়।
নতুন একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল এবার, সকলের পিছন থেকে উপন্যাস লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীর এইমাত্র ভিড় দেখে নিজের সীট ছেড়ে উঠে এসেছে সে। বলে উঠল, ভারি তাজ্জবের কথা! এ জিনিস এখানে আসবে কোত্থেকে, গুড গ্রেশিয়ান। ইন্টারেস্টিং, মোস্ট ইন্টারেস্টিং অ্যান্ড রিসার্কেল!
স্টুয়ার্ড সবিনয়ে জানতে চাইল, আপনি কি আরও পরিষ্কার করে আমাদেরকে জানাবেন ব্যাপারটা? আপনি জিনিসটা চিনতে পেরেছেন?
চিনতে পেরেছি মানে? হাজার বার চিনতে পেরেছি। জিনিসটা, জেন্টলমেন, উপজাতীয়দের একটা গোত্র ব্যবহার করে। রো-পাইপের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয় এটা। এটা আর কিছু নয়, অতি ক্ষুদ্র একটা বর্শা। এখন সমস্যা হলো, উপজাতীয়দের সেই গোত্রটা, যারা এটা ব্যবহার করে, তারা ঠিক কোথাকার সাউথ আমেরিকান নাকি বোর্নিওর, এই মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না আমি। তবে, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই যে এটি কোনও উপজাতীয় গোত্রের নিজস্ব অস্ত্র, তাক করা হয় ব্লো-পাইপের দ্বারা এবং আমি জানি…
কুয়াশা, লেখক ভদ্রলোকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাক্যটা শেষ করল স্বয়ং। …যে ক্ষুদ্র বর্শার মাথায় সাউথ আমেরিকান পয়জন থাকে। আসলে এটা সাউথ। আমেরিকান রেড ইণ্ডিয়ানদেরই একটা অস্ত্র। এ জিনিস এখানে কিভাবে এল-রহস্য!
খুবই অসাধারণ ঘটনা। আমি নিজে একজন রহস্য উপন্যাসের লেখক। কিন্তু এমন ঘটনা এর আগে শুনিনি।
ঢাকার মাথার উপর পৌঁছে গেছে বিমান। ঢাকার আকাশে উড়ছে এখন।
ডাক্তার সমীর বা স্টুয়ার্ড তারেকের কর্তৃত্বে নেই এখন আর পরিবেশটা। শহীদরূপী কুয়াশার কথা বলার ভঙ্গি, প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে তার বক্তব্য এবং ভরাট কণ্ঠস্বর–সকলের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে।
বিমানের আরোহীদের দিকে তাকিয়ে স্টুয়ার্ড তারেক, কুয়াশার পরামর্শে ঘোষণা করল, বিমান এয়ারপোর্টে নামতে যাচ্ছে। আপনারা কেউই দয়া করে সীট ছেড়ে উঠবেন না। পুলিস না আসা পর্যন্ত। আমি আশা করি, আপনাদেরকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।
আরোহীদের মধ্যে ক্ষোভমিশ্রিত মৃদু গুঞ্জন উঠল।
বেশ একটু জোর গলায় বলল পারভিন ননসেন্স! সকলের জন্যে একই ব্যবস্থা হতে পারে না। আমি বিমান থামার সাথে সাথে নেমে যেতে চাই।
তারেক বলল, দুঃখিত, মিসেস পারভিন। আমি নিরুপায়।
পারভিন রেগেমেগে বলল, কিন্তু এর কি মানে হয়? একটা লাশের সাথে অনির্দিষ্টকালের জন্যে বসে থাকতে হবে আমাদেরকে!
সাঈদা বলল, কিছু করার নেই, ভাবী! দুর্ঘটনা যখন একটা ঘটেই গেছে!
লাশের কাছে ভিড়টা আরও বড় হয়েছে একটু, যোগ দিয়েছে ইউরোপীয়ান হিপ্পী ওরফে প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান।
কারও সাথে কথা বলছে না শহীদ। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, দেখছে।
আরোহীরা চাপা কণ্ঠে আলোচনা করছে বিষয়টা নিয়ে। এটা স্বাভাবিক একটা ঘটনা নয়। একজন মানুষ মারা গেছে। স্বাভাবিক মৃত্যু নয় এটা। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এটা একটা মার্ডার, খুন।
রানওয়ে স্পর্শ করল বিমানের চাকা।
আরোহীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। ফালতু ঝামেলায় কেউ পড়তে চায় না। সকলেরই কাজ আছে। এয়ারপোর্টে যদি ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, কারই বা ভাল লাগে? ওদিকে, মস্ত দুশ্চিন্তা-খুন করল কে! কে খুনী? পুলিস সহজে তাকে গ্রেফতার করতে পারবে? তা যদি না পারে, সন্দেহের তালিকায় থাকবে এই প্লেনের প্রতিটি আরোহী। কী ঝামেলা! খুনী বলে সন্দেহ করবে পুলিস, জেরা করবে, ছায়ার মত লেগে থাকবে পিছনে যতদিন না প্রকৃত খুনী ধরা পড়ে।
বিমান থামল। সেকেণ্ড স্টুয়ার্ড রউফ ফ্রন্ট ক্যারিজে ঢোকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাক ক্যারিজ থেকে ফ্রন্ট ক্যারিজে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। ফ্রন্ট ক্যারিজের আরোহীদেরকে নামিয়ে দিচ্ছে তারেক এই মুহূর্তে, ইমার্জেন্সী ডোর খুলে দিয়ে।
ফ্রন্ট ক্যারিজের আরোহীদেরকে নামিয়ে দিয়ে ব্যাক ক্যারিজে ফিরে এল। তারেক। বিমানের বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার চেহারার মধ্যে নতুন একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, সকলের চোখেই তা ধরা পড়ল। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবার ফল নয় এটা। নতুন কিছু যেন ঘটেছে আবার একটা। রীতিমত দরদর করে ঘামছে সে। আতঙ্কিত, ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে।
দরজাটা খুলে দিল তারেক। সাথে সাথে সাদা পোশাক পরিহিত সি.আই.ডি. অফিসার মি. সিম্পসন ঢুকলেন দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে খোলের ভিতর। লাল টকটকে, কঠিন মুখাবয়ব। হাতে পাইপ বা চুরুটের বদলে নীলচে রঙের চকচকে রিভলভার শোভা পাচ্ছে।
বিস্ময়কর আচরণ করলেন মি. সিম্পসন। আরোহীদের দিকে লোডেড রিভলভার তাক করে রে তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, কেউ নড়বেন না। বিমানকে কর্ডন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। কুয়াশা, ছদ্মবেশ নিয়ে আছ তুমি, কিন্তু আজ তোমাকে আমি গ্রেফতার করবই। যদি ভাল চাও, মাথার ওপর হাত তুলে আত্মসমপর্ণ করো।
মাথার উপর কেউই হাত তুলল না। সবাই চোখ ছানাবড়া করে চেয়ে আছে। রুদ্ধশ্বাসে মি. সিম্পসনের দিকে।
মি. সিম্পসন একপাশে সরে দাঁড়ালেন। একে একে বিমানের ভিতর প্রবেশ করল ছয়জন রিভলভার-পিস্তলধারী আর্মড পুলিস।
লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমি সি.আই.ডি অফিসার সিম্পসন আপনাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছি। আমার ডিপার্টমেন্ট বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছে, এই বিমানে কুখ্যাত দস্যু কুয়াশার ঢাকায় আসার কথা। আমার বিশ্বাস, আপনাদের মধ্যেই ছদ্মবেশ নিয়ে বসে আছে শয়তানটা। তাকে খুঁজে বের করতে হলে আপনাদের সহযোগিতা একান্তই দরকার আমার। কুয়াশাকে চেনবার একমাত্র উপায়, তার ডান হাঁটুর কাছে এবং ঘাড়ের উপর দুটো ক্ষতচিহ্ন আছে। কুয়াশাকে চিনে গ্রেফতার করার স্বার্থে আপনাদেরকে ঘাড় এবং হাঁটু দেখাতে হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায় নেই–দুঃখিত। কেউ যদি তার হাঁটু এবং ঘাড় দেখাতে আপত্তি করেন, গ্রেফতার করা হবে তাকে। ভদ্রমহিলাগণকে এ ব্যাপারে পরীক্ষা করবার দরকার নেই, আপনারা বিমান থেকে নেমে যেতে পারেন…।
মি. সিম্পসনকে বাধা দিয়ে স্টুয়ার্ড বলল, না, স্যার।
ভুরু কুঁচকে তাকালেন মি. সিম্পসন স্টুয়ার্ডের দিকে। স্টুয়ার্ড নিচু গলায় ম্যাডাম রাউলের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিশদ জানাল মি. সিম্পসনকে।
চেহারা পাল্টে গেল মি. সিম্পসনের। দাতে দাঁত চাপলেন তিনি যেন কার। উদ্দেশ্যে। বললেন, লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, এইমাত্র মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা শুনলাম আমি। কুয়াশা যেখানে উপস্থিত, সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে-ই। আপনারা কেউ নড়বেন না, প্লীজ। কাউকে নড়তে দেখলেই আমি গুলি করব।
মি. সিম্পসন বিমানে ঢোকার আগেই সবাই যে-যার আসনে ফিরে গিয়ে বসেছিল। প্রবেশ পথের দিকে পিছন ফিরে বসেছে বেশির ভাগ আরোহী, তাই মি. সিম্পসন তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছেন না।
আর্মড ফোর্সের লোকেরা ছড়িয়ে পড়েছে প্যাসেজে। ..
মি. সিম্পসন সকলের চেহারা দেখার জন্যে প্যাসেজ ধরে এগোলেন। হাতে উদ্যত রিভলভার। দুপাশের সাটে বসা আরোহীদের দেখতে দেখতে এগুচ্ছেন তিনি।
আরে? শহীদ, মাই বয়!
সহাস্যে উঠে দাঁড়াল শহীদ ওরফে কুয়াশা। সহাস্যে ধরল ও মি. সিম্পসনের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা, বলল, সবার আগে আপনার লোকদের বলুন আমাকে পরীক্ষা করে নিষ্কৃতি দিতে। কুয়াশাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে না হোক, হত্যারহস্যের তদন্তের ব্যাপারে তো আমার সাহায্য আপনার দরকার হবেই।
মি. সিম্পসন একটু যেন আহত হলেন। বললেন, শহীদ, মাই বয়, তোমার উপস্থিতিতে এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল…
কুয়াশা বলল, দুঃখিত, মি. সিম্পসন। আমি গোয়েন্দা শহীদ খান মাত্র, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। তবে খুনী যে-ই হোক, নিস্তার নেই তার। এটুকু আশ্বাস আপনাকে আমি দিতে পারি।
থ্যাঙ্কিউ, মাই বয়। কাম উইথ মি, প্লীজ। হত্যারহস্যের ব্যাপারেই শুধু নয়, আমি কুয়াশাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারেও তোমার সাহায্য চাই। তুমি আমার পাশে থাকো-সেক্ষেত্রে শয়তানটা আমার দিকে উত্তপ্ত সীসা ছুঁড়তে ইতস্তত করবে।
শহীদ প্যাসেজে চলে এল। বলল, কিন্তু সে এই বিমানে থাকলে তো! আপনি বোধহয় রঙ ইনফরমেশন
মি. সিম্পসন বললেন, রঙ ইনফরমেশন? নো, মাই বয়, আই গেন নট।
ফ্রন্ট ক্যারিজে প্রবেশ করার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন কুয়াশাকে সাথে নিয়ে। ওরা একসাথে ঘুরে দাঁড়াল আরোহীদের দিকে।
আরোহীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কুয়াশার উপস্থিতির আশঙ্কার কথা শুনে চুপসে গেছে ভয়ে। কেউ রোমাঞ্চ অনুভব করছে। সর্বকালের কুখ্যাত দস্যু, যার অপর পরিচয় জীবিতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে, যার দয়ামায়া ও উদারতার কাহিনী কিংবদন্তীর মত লোকের মুখে মুখে ফেরে-সেই জগদ্বিখ্যাত কুয়াশাকে দেখতে পাওয়াটা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার বৈকি।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আবদুল হাফিজ তার সীটে শক্ত হয়ে বসে আছে, মি. সিম্পসনের সাথে চোখাচোখি হতে সে বলল, মি. সিম্পসন, আমার ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করুন। ঢাকায় ইমপরট্যান্ট বিজনেস এনগেজমেন্ট রয়েছে আমার।
দুঃখিত।
পারভিনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অফিসার, আমি মিসেস পারভিন। আশা করি আপনাকে আমার বিশদ পরিচয় দেবার দরকার নেই, সকলের সাথে আমাকে এই ভাবে আটকে রাখার জন্যে প্রতিবাদ করছি আমি।
মি. সিম্পসন বললেন, সরি, মিসেস পারভিন। কিন্তু এটা একটা মার্ডার কেস, উপস্থিত সবাই আপনারা আমার সন্দেহের অন্তর্ভুক্ত এই মুহূর্তে।
দি অ্যারো? পয়জন অব দ্য সাউথ আমেরিকান ইণ্ডিয়ানস। বিড় বিড় করে বলল রহস্য উপন্যাস লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীর। আপন মনে, কি এক অজ্ঞাত কারণে হাসছে সে।
দুজন সি.আই.ডি. ইন্সপেক্টর পরীক্ষা কার্য শুরু করেছে। পুরুষদের হাঁটু এবং ঘাড় দেখছে তারা।
মি. সিম্পসন থমথমে মুখে অপেক্ষা করছেন! সবাই অধীর হয়ে উঠেছে মনে মনে। উপস্থিত আরোহীদের মধ্যে কেউ না কেউ কুয়াশা। কিন্তু কে?
একে একে সবাইকে পরীক্ষা করা হলো।
নৈরাশ্যের ছায়া ফুটল মি. সিম্পসনের মুখের চেহারায়।
আবার একবার ফাঁকি দিয়েছে শয়তানটা আমাকে। হতে পারে, আমরা যে তার আগমনের খবর আগাম পেয়ে গেছি, এটা জেনেই সে শেষ মুহূর্তে বিমানে চড়েনি। কিংবা, আমরা যে খবরটা পেয়েছি সেটা কৌশলে সরবরাহ করেছে সেই শয়তানটাই। আমরা এখানে তার সন্ধানে ব্যস্ত, সে হয়তো এই মুহূর্তে অন্য কোন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে।
মুচকি হেসে কুয়াশা বলল, কুয়াশা যখন এই বিমানে নেই, হত্যাকাণ্ডটি তাহলে তার দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, কি বলেন?
মি. সিম্পসন সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিলেন না। বললেন পকেটে রিভলভার ঢোকাতে ঢোকাতে, গড নোজ। সে হয়তো নেই, কিন্তু তার প্রতিনিধি কেউ থাকতে পারে এই বিমানে। প্রতিনিধি, আই শীন, ভক্তদের মাধ্যমেও খুনটা করিয়ে থাকতে পারে সে।
মৃদু শব্দে হাসল কুয়াশা, আমি শহীদ খানও কিন্তু তার ভক্ত, মি. সিম্পসন।
কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রেখে মি. সিম্পসন বললেন, তোমাকেও আমরা সন্দেহের বাইরে বলে মনে করছি না।
কথাটা শেষ করে মি. সিম্পসন পা বাড়ালেন। কুয়াশা তার পিছু নিল।
মি: সিম্পসন মৃতদেহের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পরীক্ষা করার জন্যে ঝুঁকে পড়লেন তিনি।
হিপ্পীরূপী শহীদ চুপচাপ বসে আছে ওর নিজের সীটে। চিন্তিত এবং অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ওকে। মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছে ও কুয়াশার দিকে। ভুরু কুঁচকে উঠছে ওর থেকে থেকে।
লাশ পরীক্ষা করে মি. সিম্পসন সিধে হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আমার সাথে আপনাদের সবাইকে এখন ভি.আই.পি লাউঞ্জে যেতে হবে।
বিমান থেকে নামার সুযোগ পেয়ে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। সীট ত্যাগ করল বাই। মি. সিম্পসনকে অনুসরণ করল গোটা দলটা।
লাউঞ্জে ঢুকে সবাইকে বসতে অনুরোধ করলেন মি. সিম্পসন। সবাই আসন দখল করতে তিনি বললেন, ডাক্তার সমীর, আপনার সাথে আমি নিভৃতে কিছু কথা বলতে চাই। শহীদ, তুমিও এসো আমাদের সাথে।
ওরা তিনজন বেরিয়ে গেল লাউঞ্জ থেকে।
লাউঞ্জে পাশাপাশি বসেছে লিলি এবং আরিফ বাট।
আরিফ বাটই প্রথম মুখ খুলল, আমার মনে হয় রত্নাগিরিতে আপনাকে–মানে আপনাকে দেখেছি আমি…
হ্যাঁ, রত্নাগিরিতে আমার বোন আর ভগ্নীপতির সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম, লিলি মৃদুকণ্ঠে বলল।
আরিফ বাট মৃদু মৃদু হাসছে। অপ্রতিভ ভাবটা পুরোপুরি সে-ও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বলল, খুব সুন্দর জায়গা, তাই না?
সী-বীচটা এত ভাল লেগেছে আমার যে কি বলব।
ক্রমশ সহজ হয়ে উঠছে লিলি। এরপর অবশ্য দুজনেই চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। শেষ পর্যন্ত নিস্তব্ধতা ভাঙল আরিফই, আমি:মানে, আপনাকে আমি প্লেনে দেখেই কিন্তু চিনতে পেরেছি।
তাই নাকি! আমিও..মানে…
কথাটা কিভাবে শেষ করবে ভেবে পেল না লিলি, তাকে রক্ষা করল আরিফ, বলল, আপনি কি মনে করেন ভদ্রমহিলা সত্যি খুন হয়েছেন?
সবাই তো তাই বলছে–কি জানি। আমার কিন্তু ভয়ই করছে।
আরিফ একটু ঝুঁকে পড়ল লিলির দিকে, অনেকটা আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে।
হিন্দীতে তর্ক জুড়ে দিয়েছে প্যাটেলদ্বয়। রেগে গেলে অনর্গল ইংরেজিও বেরিয়ে আসছে বাপ-বেটার মুখ থেকে।
লাউঞ্জের দরজায় কালো ভূতের মত কর্কশ চেহারার একজন সাব-ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে কয়েকজন কনস্টেবল।
লাউঞ্জের বাইরে করিডরে কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার পাতা, একটিতে বসে কথা বলছেন মি. সিম্পসন, পাইপে টোবাকো ভরছেন তিনি সেই সাথে।
ডাক্তার, আপনার নাম ঠিকানাটা বলুন আগে।
ডাক্তার সমীর বলল, সমীরুল হক, এম.বি.বি.এস। ই.এন.টি. স্পেশালিস্ট। ১১/ গ, রোড নং ৭, ধানমণ্ডিতে থাকি আমি।
একজন ইন্সপেক্টর লিখে নিচ্ছে নোট-বুকে নাম ঠিকানা।
মি. সিম্পসন বললেন, আমাদের ডাক্তার লাশ পরীক্ষা করবে। কিন্তু, ডাক্তার সমীর, আপনাকেও আমরা পোস্টমর্টেমের সময় উপস্থিত চাই।
তা বেশ তো।
মৃত্যুর সময় সম্পর্কে…।
সমীর বলল, আমি যখন পরীক্ষা করি তার অন্তত আধঘণ্টা আগে মারা গেছেন ভদ্রমহিলা। রানওয়েতে প্লেন নামার পাঁচ সাত মিনিট আগে পরীক্ষা করি আমি। স্টুয়ার্ড তার সাথে কথা বলেছিল পৌনে একঘন্টা আগে।
মি. সিম্পসন জেরা করার ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, আচ্ছা, অস্বাভাবিক তেমন কিছু আপনার চোখে ধরা পড়েছে কি?
ডাক্তার সমীর মাথা দোলাল–না।
শহীদরূপী কুয়াশা বসে আছে মি. সিম্পসনের মুখোমুখি, বলল, আমি ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম, মি. সিম্পসন, অধিকাংশ সময়ই ঘুমিয়ে ছিলাম বলতে পারেন।
মৃত্যুর কারণ, ডাক্তার?
ডাক্তার বলল, নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাবে না, পোস্টমর্টেম এগজামিনেশন এবং অ্যানালিসিস ছাড়া।
মি. সিম্পসন বললেন, ওয়েল, ডক্টর, আপনার মূল্যবান সময় আমরা নষ্ট করতে চাই না। তবে স্বাভাবিক তদন্তের আওতায় আপনিও পড়বেন–আর সব প্যাসেঞ্জারদের মত।
ডাক্তার সমীর হাসল। বলল, আমি বরং চাই আপনি সার্চ করে নিশ্চিত হোন যে আমার কাছে ব্লো-পাইপ বা ওই ধরনের কোন মারণাস্ত্র লুকানো নেই।
মি. সিম্পসন পাইপের ধোয়া ছেড়ে বললেন, ইন্সপেক্টর আফজাল এ ব্যাপারে যা করবার করবে। বাই দ্য ওয়ে, উক্টর, এই পয়জন অ্যারো সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
অ্যানালিসিস ছাড়া বলা মুশকিল। সাউথ আমেরিকান নেটিভরা সাধারণত Curore পয়জন ব্যবহার করে, শুনেছি।
ওই পয়জন কি একজন মানুষকে…
খুবই মারাত্মক ধরনের, লেথাল অ্যাণ্ড র্যাপিড পয়জন।
মি. সিম্পসনকে চিন্তিত দেখাল, কিন্তু সংগ্রহ করা খুব সহজ নয় নিশ্চয়ই?
সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন।
মি. সিম্পসন হঠাৎ হানতে শুরু করলেন। বললেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে বিশেষভাবে সার্চ করা দরকার আমাদের ইন্সপেক্টর আফজাল!
লাউঞ্জের পাশের রূমটার দিকে বিনাবাক্যব্যয়ে পা বাড়াল ডাক্তার সমীর এবং ইন্সপেক্টর আফজাল।
ওরা চলে যেতে মি. সিম্পসন বললেন, আমাদের লোক বিমানের ভিতরটা সার্চ করছে। ফটোগ্রাফার এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট আসছে। এরপর আমরা স্টুয়ার্ডের সাথে কথা বলি, কি বলো শহীদ?
শহীদরূপী কুয়াশা মাথা দোলাল, ডেকে পাঠান।
ডাক্তার সমীর এবং ইন্সপেক্টর আফজাল বেরিয়ে এল পাশের কামরা থেকে। ডা. সমীর ঢুকলেন লাউঞ্জে, ইন্সপেক্টর মি. সিম্পসনের পাশের চেয়ারে বসলেন হাতে নোটবুক এবং পেন্সিল নিয়ে।
লাউঞ্জের দরজার কাছে কজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজনকে নির্দেশ দিতে সে স্টুয়ার্ডদেরকে খবর পৌঁছে দিল। স্টুয়ার্ডদ্বয় বেরিয়ে এল করিডরে।
তারেক হোসেনের হাতে অনেকগুলো রেক্সিন দিয়ে বাঁধাই করা পাসপোর্ট।
গুড! সকলের পাসপোর্টই আছে তো এখানে?
জ্বী, স্যার।
পাসপোর্টগুলো এক এক করে দেখলেন মি. সিম্পসন। বললেন, এইটা…রাউল চিখারী, মিসেন। ইণ্ডিয়ান পাসপোর্ট। মি. তারেক, নিহত ভদ্রমহিলা সম্পর্কে কি জানেন আপনি?
দেখেছি বেশ কয়েকবার। প্রায়ই তিনি বোম্বে থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে বোম্বে যাতায়াত করতেন, তারেক বলল।
ব্যবসায় সংক্রান্ত ব্যাপারে, সম্ভবত। পাসপোর্টে লেখা রয়েছে ভদ্রমহিলা ব্যবসায়ী ছিলেন। কিসের ব্যবসা ছিল, জানেন নাকি?
তারেক মাথা নেড়ে জানালজানে না সে। কিন্তু সেকেণ্ড স্টুয়ার্ড রউফ বলল, আমিও ভদ্রমহিলাকে চিনি, স্যার। আজকের সকালের ফ্লাইটে আমি রত্নাগিরি থেকে বোম্বে এয়ারপোর্টে হেলিকপ্টারে করে আসি, কপ্টারে ভদ্রমহিলাও ছিলেন।
গোটা পনেরো প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন। স্টুয়ার্ডদ্বয় এমন কোন তথ্য দিতে পারল না যার ফলে এই হত্যা রহস্যের উপর আলোকপাত ঘটে। মি. সিম্পসন ওদেরকে নিষ্কৃতি দিতে যাবেন, শহীদরূপী কুয়াশা বলল, আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই, মি. সিম্পসন।
অফকোর্স, মাই বয়!
কুয়াশা স্টুয়ার্ডদের দিকে ফিরল। জানতে চাইল, আপনাদের মধ্যে কেউ কি একটা বোলতাকে বিমানের ভিতর উড়তে দেখেছেন?
দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল–না, দেখেনি তারা!
কুয়াশা বলল, অথচ বোলতা একটা ছিল প্লেনের ভিতর। একজন আরোহীর পিরিচে সেটার মৃতদেহ দেখেছি আমরা।
জী–কিন্তু উড়তে দেখিনি, স্যার।
আমিও।
কুয়াশা বলল, ঠিক আছে। আপনারা যেতে পারেন।
পাসপোর্টগুলোয় আবার চোখ বুলাচ্ছেন মি. সিম্পসন। বললেন, প্রখ্যাত সমাজসেবক আসিফ চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস পারভিনও রয়েছে আরোহীদের মধ্যে।
কুয়াশা বলল, মি. সিম্পসন, বডি সার্চ করা ছাড়াও, প্রত্যেকের ব্যাগ-ব্যাগেজ। তন্ন তন্ন করে সার্চ করার হুকুম দিন আপনার লোকদের।
মি. সিম্পসন বললেন, তা আর বলতে! ব্লো-পাইপটা কোথাও না কোথাও আছে–পেতেই হবে সেটা। শহীদ, রহস্য উপন্যাস লেখক লোকটাকে তোমার কি রকম মনে হচ্ছে বলো তো? এই ধরনের উপন্যাস লেখকরা বিদঘুটে মারণাস্ত্র সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা রাখে।
কুয়াশা অন্য প্রসঙ্গে নিজের বক্তব্য রাখল, যার কাছে যা আছে, সেটা সামান্য কোন জিনিস হোক বা অসামান্য, একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। তালিকায়। যেন কোন জিনিসই বাদ না পড়ে।
ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল একটু মি. সিম্পসনের। দাঁত দিয়ে পাইপ কামড়ে ধরে কসেকেণ্ড চেয়ে রইলেন তিনি কুয়াশার দিকে। বললেন, তোমার উদ্দেশ্য কি, কি ভাবছ–ঠিক বুঝতে পারছি না আমি, শহীদ। তবে তুমি যখন চাইছ, সেই নির্দেশই দিচ্ছি আমি। কিন্তু সব জিনিসের তালিকার দরকার কি? আমরা কি খুঁজছি তা কি জানো না?
কি খুঁজছি?
ব্লো-পাইপ…।
কুয়াশা হাসল। বলল, হয়তো আরও কিছু খুঁজছি আমরা, তাই না? অন্তত আরও কিছু খোঁজা উচিত আমাদের।
মি. সিম্পসনের চোখের দৃষ্টি একটু তীক্ষ্ণ হলো, মনে হচ্ছে কিছু যেন ধরতে
না, মি. সিম্পসন। তবে আমি ব্লো-পাইপ ছাড়াও কিছু একটা পাব বলে আশা করছি। জিনিসটা যে কি, ঠিক জানি না এখনও নিজেই!
শ্রাগ করলেন মি. সিম্পসন, তোমার নিজস্ব ভঙ্গিতে চিন্তা করছ তুমি, সন্দেহ নেই।
মি. সিম্পসন একজন কনস্টেবলকে ডেকে কিছু নির্দেশ পাঠালেন সাব ইন্সপেক্টর হুদাকে।
লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল মিসেস পারভিন হাই হিলে খটখট-খটখট শব্দ তুলে, ভ্যানিটি ব্যাগ দোলাতে দোলাতে।
বসুন, মিসেস পারভিন।
চেহারায় অসন্তোষের ভাব নেই এখন পারভিনের। সহযোগিতামূলক মনোভাবেরই পরিচয় দিল সে। উত্তর দিল মি. সিম্পসনের প্রত্যেকটি প্রশ্নের, এতটুকু বিরক্ত বা অসহিষ্ণু না হয়ে। ইতস্তত ভাবটা অবশ্য সারাক্ষণ দেখা গেল তার মধ্যে। ঠিকানা দিল সে দুটো। একটা ঢাকার গুলশানের। অপরটি খুলনার। প্রশ্নের উত্তরে জানাল, রত্নাগিরি এবং বোম্বে থেকে ঢাকায় ফিরেছে সে। নিহত ভদ্রমহিলা তার সম্পূর্ণ অপরিচিতা। সন্দেহজনক কোন কিছুই তার নজরে পড়েনি। নিজের সীট ছেড়ে একবারও ওঠেনি সে। যতদূর স্মরণ করতে পারে সে, ফ্রন্ট ক্যারিজ থেকে ব্যাক ক্যারিজে কেউ প্রবেশ করেনি, স্টুয়ার্ডরা ছাড়া। সম্ভব। ওয়াশরুমে দুই ভদ্রলোক গিয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত নয় সে এ ব্যাপারে। বিমানের পিছন দিকে একবার সে যেতে দেখেছে মাত্র একজনকে, ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়েছিল সে কেন যেন, তখন দেখেছিল সে ভদ্রলোককে।
ভদ্রলোক আর কেউ নয়, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। অর্থাৎ কুয়াশা। না, কাউকে সে এমন কোন জিনিস নাড়াচাড়া করতে দেখেনি যেটা ব্লো-পাইপ বা ওই জাতীয় কিছু হতে পারে।
কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল, উড়ন্ত বোল তা সে দেখেনি প্লেনে।
মিসেস পারভিনের পর এল সাঈদা বেগম, মিস।
প্রায় একই বক্তব্য সাঈদারও। খুলনার ঠিকানা দিল সে। প্রখ্যাত সমাজসেবক আসিফ ইকবালের খালাতো বোন সে। বেড়াতে গিয়েছিল গয়ায়, বোম্বে হয়ে দেশে ফিরেছে। নিহত ভদ্রমহিলাকে জীবনে এর আগে কখনও দেখেনি সে। ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে দেখেছে একজনকে, প্লেনে ওঠার পর নয়, আগে। কাকে দেখেছে? শহীদকে। অর্থাৎ শহীদরূপী কুয়াশাকে। হ্যাঁ, একটা বোলতাকে উড়তে দেখেছে সে বিমানের ভিতর, পিছন দিকে।
সাঈদা চলে যেতে মি. সিম্পসন বললেন, নিহত ভদ্রমহিলা তোমার পরিচিত নাকি, শহীদ?
শহীদরূপী কুয়াশা মুচকি হাসল, তা নয়, তবে কথা বলেছিলাম বটে।
কি কথা?
কুয়াশা বলল, সাধারণ কথা। আবহাওয়া সংক্রান্ত আর কি!
মি. সিম্পসন বললেন, বোলতা সম্পর্কে তোমার এত কৌতূহল কেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
মুচকি হাসল কুয়াশা, কিছু বলল না।
মি. সিম্পসন বললেন, প্যাটেলদেরকে তেমন সুনজরে দেখছি না আমি, শহীদ। বাপ-বেটার আচার-আচরণ কেমন যেন সন্দেহজনক। কাপড়-চোপড়, চেহারা এবং অ্যাটাচি কেসের হাল এমনই যে মনে হচ্ছে ওরা কয়েকবার করে সাউথ আমেরিকা এবং বোর্নিওতে গেছে। মোটিভটা কি জানা নেই–কিন্তু বোম্বে পুলিস চেষ্টা করলে অনেক তথ্য দিতে পারবে, যার ফলে মোটিভ কি জানা সহজ হয়ে শুবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, বাপ-বেটা মিলে অপরাধটা ঘটিয়েছে।
কুয়াশা বলল, কিন্তু ওঁরা ভবঘুরে বা টুরিস্ট নন, মি. সিম্পসন। বাপ বেটা-ওঁরা দুজনেই অত্যন্ত বিখ্যাত পণ্ডিত মানুষ। ওঁরা পৃথিবীর নাম করা আর্কিয়োলজিস্ট।
বলো কি! তাই নাকি?
মি. সিম্পসন এরপর জেরা করার জন্যে ডাকলেন প্যাটেলদেরকে।
বাপ জানাল, নিহত ভদ্রমহিলাকে সে চেনে না। বিমান আকাশে ওঠার পর ভিতরে কি ঘটেছে না ঘটেছে লক্ষ করেনি, কারণ ছেলের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল সে। নিজের সীট ত্যাগ করেনি একবারও। তবে দুবার সে একই লোককে সীট ত্যাগ করে ওয়াশরুমে যেতে দেখেছে। কাকে?
শহীদকে। অর্থাৎ কুয়াশাকে। তাছাড়া, বিমান আকাশে ওঠার খানিক পর, নিহত ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতেও দেখেছে সে শহীদকে। অর্থাৎ কুয়াশাকে। লাঞ্চের শেষ দিকে যে বোলতাটাকে দেখেছিল সে, তার ছেলে সেটাকে খুন করে।
পুত্র রাঘব পিতার চেয়ে বেশি বিশদ কিছু বলতে পারল না। সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়েনি তার। তবে প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদকে সে-ও দেখেছে ওয়াশরুমে যেতে। সে আর একজনকে দেখেছে ওয়াশরুমে যেতে। কাকে? আরিফ বাট, স্মার্ট চেহারার যুবকটিকে। বোলতাটা সরাসরি উড়ে এসে তার কফির কাপে ডুব মারে,. চামচ দিয়ে সেটাকে গেঁথে ফেলে সে। তাদের আলোচনার বিয়ষবস্তু ছিল, প্রিহিস্টোরিক পটারী অব দ্য নিয়ার ইস্ট।
এরপর এল রহস্য উপন্যাসের লেখক।
মি. সিম্পসনের সন্দেহ এই ভদ্রলোকের উপর খুব বেশি, জেরার ধরন দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল। প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল, বিমানের পিছন দিকে বসেছিলেন নিহত ভদ্রমহিলা এবং শহীদ খান সেদিকে অন্তত দুবার গেছেন, সে দেখেছে।
ব্লো-পাইপ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, জানি..মানে..সবই জানি।
ভুরু কোঁচকাল মি. সিম্পসনের, সবই জানেন মানে? আপনি কি রো পাইপের ব্যবসায়ী, নাকি, এ-সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ?
সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে বেশ একটু নার্ভাস দেখাল, নামানে, আমার একটা ব্লো-পাইপ আছে কিনা, তাই জানি মোটামুটি।
মি. সিম্পসন তীব্র কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা! তাই নাকি!
মি. সিম্পসনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে সৈয়দ জাহাঙ্গীর অস্বস্তিবোধ করল। বলল, ভুল বুঝবেন না, প্লীজ! মাই মোটিভস আর কোয়াইট ইনোসেন্ট। আমি কারণ ব্যাখ্যা করতে পারি।
মি. সিম্পসন চোখ পাকিয়ে বললেন, ব্যাখ্যা দিন।
আমি একটা বই লিখছি, যে-বইতে একজন খুন হবে ওই পদ্ধতিতে।
মি. সিম্পসন বললেন, আচ্ছা! কণ্ঠে তার হুমকির সুর।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলল, ব্যাপারটা মূলত ফিঙ্গারপ্রিন্টকে কেন্দ্র করে। একটা রো-পাইপে হাতের ছাপ কিভাবে থাকা সম্ভব–এই ব্যাপারটা জানার জন্যে একটা ব্লো-পাইপ দরকার ছিল হাতের কাছে।
আই সি।
একটি অ্যান্টিকস-এর দোকানে দুবছর আগে দেখেছিলাম জিনিসটা, মানে, ব্লো-পাইপটা! সেটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে যেতে দোকানে যাই। গিয়ে দেখি আছে, বিক্রি হয়নি।
কিনেছেন সেটা?
হ্যাঁ।
এখন কোথায় সেটা?
বাড়িতে..তবে বাড়ির ঠিক কোথায় রেখেছি, মনে নেই।
মনে নেই মানে?
মানে..ঠিক মনে নেই, তবে আছে–খুঁজলে পাব হয়তো।
মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, ঠিক বলছেন? নাকি, আপনার সঙ্গেই আছে সেটা এই মুহূর্তে?
না-না, নেই সাথে। বাড়ি থেকে নিয়ে বের হইনি।
মি. সিম্পসন কয়েক সেকেণ্ড তীব্র দৃষ্টিতে দেখলেন লেখককে। প্রশ্ন করলেন, টি ছেড়ে বিমানের লেজের দিকে গিয়েছিলেন কেন?
আমি? কে বলল? যাইনি তো…ওহহো, হ্যাঁ, একবার গিয়েছিলাম, সত্যি!
কেন? কেন গিয়েছিলেন?
দাঁড়ান, মনে করে দেখি। সব ভুলে যাচ্ছি কিনা।…হা, পড়েছে মনে। ব্যাগ থেকে খাতা পেন্সিল নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম।
নিহত ভদ্রমহিলার পাশ ঘেঁষে যেতে হয়েছিল আপনাকে, তাই না?
না…হ্যাঁ, তাই যেতে হয়েছিল। কিন্তু তখন তিনি বেঁচে ছিলেন।
পরবর্তী প্রশ্নগুলোর উত্তরে লেখক ভদ্রলোক জানাল, সে সন্দেহজনক কিছুই লক্ষ করেনি। বোলতা? হ্যাঁ, দেখেছে সে। তার মুখে বসতে চেয়েছিল বোলতাটা:বসেনি, উড়ে চলে যায়।
নাম-ঠিকানা দিয়ে চলে গেল সে।
মি. সিম্পসন বললেন, গভীর জলের মাছ বলে মনে হচ্ছে লোকটাকে আমার। ব্লো-পাইপ আছে ওর কাছে। কেমন ভেঙে পড়েছে লক্ষ করলে শহীদ? এত বেশি নার্ভাস কেন লোকটা?
পুলিশী ঝামেলার ভয়ে, সম্ভবত। পুলিসের নাম শুনলেই কেউ কেউ আতঙ্কিত বোধ.করে।
অকারণে। যে অপরাধ করেনি তার ভয়ের কি আছে?
এরপর এল স্মার্ট যুবক, আরিফ বাট।
ঢাকায় একটা ডেন্টাল চেম্বার আছে তার। নাম-ঠিকানা দিল। রত্নাগিরিতে বেড়াতে গিয়েছিল সে। বোম্বেতে মাত্র একটা দিন ছিল, বিভিন্ন নতুন ধরনের ডেন্টাল ইন্সট্রুমেন্ট দেখবার জন্যে। নিহত ভদ্রমহিলাকে চেনে না সে, দেখেওনি এর আগে কখনও, সে বসেছিল ফ্রন্ট ক্যারিজের দিকে মুখ করে, নিহত ভদ্রমহিলার দিকে পিছন ফিরে। একবার মাত্র লীট ত্যাগ করেছিল সে। গিয়েছিল হাতমুখ ধুতে ওয়াশরুমে। সোজা সে ফিরে আসে ওয়াশম থেকে নিজের সীটে। এবং একবারও বিমানের। লেজের দিকে, যেদিকে নিহত ভদ্রমহিলা বসেছিল, যায়নি সে।
এরপর এল আবদুল হাফিজ। ব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। প্রশ্নের উত্তরে জানাল বোম্বেতে গিয়েছিল ব্যবসা উপলক্ষে। নিহত ভদ্রমহিলাকে চেনে না সে। হ্যাঁ, নিহত ভদ্রমহিলার একেবারে সামনের সীটটাই তার। কিন্তু সীট ছেড়ে উঠে ঘাড় না ফেরালে ভদ্রমহিলাকে দেখতে পাবার কোন সুযোগ ছিল না তার, তাই কখন বেঁচে ছিলেন তিনি বা ঠিক কখন মারা গেছেন তা তার পক্ষে বলা অসম্ভব। না, কোন শব্দই তার কানে ঢোকেনি। ফ্রন্ট ক্যারিজ থেকে স্টুয়ার্ডদেরকে ছাড়া আর কাউকে আসতে দেখেনি সে। না, জীবিত বোলতা দেখেনি সে। ব্লো-পাইপ?. কোন ধারণা নেই তার জিনিসটা সম্পর্কে। বিমানের পিছন দিকে যেতে দেখেছে সে লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে একবার এবং দুবার যেতে দেখেছে শহীদকে। অর্থাৎ কুয়াশাকে। না; সন্দেহজনক কোন কিছুই নজরে পড়েনি তার।
এমন সময় একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে হন হন করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মি. সিম্পসনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। চোখমুখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে বিজয়ের আনন্দ।
স্যার, এই যে, এইটা পাওয়া গেছে।
রুমাল দিয়ে ধরা লম্বা একটা ব্লো-পাইপ বাড়িয়ে দিল সে মি. সিম্পসনের দিকে। জিনিসটা বাঁশের তৈরি, ইঞ্চি বারো লম্বা, কড়ে আঙুলের মত মোটা। ভিতরটা ফাঁপা। গায়ে নকশা এবং খোদাইয়ের সুন্দর কাজ। দেখে বোঝা যায়, নিপুণ হাতের তৈরি।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই, বলল ফটোগ্রাফার।
ব্লো-পাইপটা রুমালসহ ধরে হাতে নিলেন মি. সিম্পসন। জিনিসটাকে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। বললেন, তাহলে সত্যিই এটা মার্ডার কেস!
আবদুল হাফিজ গভীর আগ্রহে রো-পাইপের দিকে ঝুঁকে পড়ল, সাউথ আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করে, কেমন? পড়েছি বটে, কিন্তু চাক্ষুষ করিনি কখনও।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, বিমানের কোথায় পাওয়া গেছে এটা?
সাব-ইন্সপেক্টর বলল, একটা সীটের তলায়, স্যার। কেউ লুকিয়ে রেখেছিল।
কোন্ সীটের তলায়?
নয় নম্বর।
শহীদরূপী কুয়াশা মৃদু কণ্ঠে বলল, খুবই ইন্টারেস্টিং।
কুয়াশার দিকে ফিরলেন মি. সিম্পসন, ইন্টারেস্টিং কেন?
কুয়াশা বলল, ওটা আমার সীটের তলা থেকে পাওয়া গেছে, ইন্টারেস্টিং নয়?
আবদুল হাফিজ বলল, আপনার পজিশন খুব একটা সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না, মি. শহীদ।
ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবছেন মি. সিম্পসন। বললেন, হাফিজ সাহেব, আপনি যেতে পারেন।
আবদুল হাফিজ ঢলে যেতে মি. সিম্পসন বললেন, কি হে কুয়াশার ভক্ত, এসব। কি? প্রাইভেট ডিটেকটিভরাও মাঝে মধ্যে খুনটুন করে জানি কিন্তু তুমি তোমার মোটিভ কি?
কুয়াশা বলল, মোটিভ থাক বা না থাক, সাউথ আমেরিকান নেটিভদের তৈরি ব্লো-পাইপের সাহায্যে খুন করার নোক আমি নই।
মি. সিম্পসন বললেন, অস্ত্রটা জঘন্য ধরনের মনে হলেও, কাজের বেলায় কিন্তু ঠিকই সফল হয়েছে।
কুয়াশা বলল, দুশ্চিন্তার কথা, সন্দেহ নেই।
মি. সিম্পসন বললেন, আর কে কে বাকি আছে?
কুয়াশা বলল, দুজন। এক যুবতী এবং এক হিপ্পী।
হিপ্পী বাবাজীকে ডাকা যাক।
ইউরোপীয়ান হিপ্পী এল। নাম বলল, অ্যালবার্ট ডেভিস। পেশা–কোন পেশা। নেই। নেশা আছে অনেকগুলো। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গাঁজা, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো, গান গাওয়া, ভিক্ষা করা ইত্যাদি। বাংলাদেশ নাকি শস্যশ্যামলা-লুজলা সুফলা, তাই দেখতে এসেছে সে। গাঁজাও এখানে খুব সস্তা, এটাও একটা কারণ তার এখানে বেড়াতে আসার। না; উড়ন্ত বোলতা সে দেখেনি। বিমানের লেজের দিকে পিছন ফিরে বসেছিল সে। তার পিছনে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে কেউ সীট ছেড়ে বিমানের লেজের দিকে গেছে কিনা জানে না সে। না, ভদ্রমহিলাকে সে চেনে না। হ্যাঁ, ভদ্রমহিলার সাথে একজনকে কথা বলতে দেখেছে সে। রানওয়ে ধরে সবাই যখন বিমানের দিকে এগোচ্ছিল তখন এক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলেন। না, কি বিষয়ে কথা বলেন তারা তা সে শোনেনি। ভদ্রলোক কে?
হিপ্পী ওরফে শহীদ কুয়াশাকে দেখিয়ে বলল, এই ভদ্রলোক।
কুয়াশাকে একটু যেন মান দেখাল। মি. সিম্পসন নিষ্কৃতি দিলেন হিপ্পী ওরফে শহীদকে। এরপর এল লিলি।
নিজের পুরো নাম এবং ঠিকানা দিল লিলি। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার একটা ইনডেন্টিং ফার্মে চাকরি করে সে। ভারতে বেড়াবার সময় সে বোম্বে এবং রত্নাগিরিতে ছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, আই সি। রত্নাগিরিতে আপনিও ছিলেন তাহলে?
বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা।
ব্লো-পাইপটা দেখানো হলো তাকে। না, এর আগে এধরনের জিনিস দেখেনি সে। নিহত ভদ্রমহিলাকে সে চেনে না, তবে বোম্বে এয়ারপোর্টে তাকে লক্ষ করেছিল সে, ভদ্রমহিলার মুখটা কুৎসিত-কদাকার, দেখে দুঃখ পেয়েছিল সে।
লিলি চলে গেল।
মি. সিম্পসন বললেন, রহসটার কিনারা সহজে যে হবে না, বুঝতে পারছি। এখন সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন, ব্লো-পাইপটা এল কোত্থেকে? একজনকে খুন করার জন্যে সাউথ আমেরিকার ইণ্ডিয়ানদের কাছ থেকে খুনী এটা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে–বিশ্বাস করা কঠিন।
কুয়াশা বলল, ঠিক। এবং মি. সিম্পসন, আপনি যদি আরও ভাল করে পরীক্ষা করতেন ব্লো-পাইপটাকে তাহলে দেখতে পেতেন ওটার গায়ে লেবেলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অংশ এখনও আটকে আছে। আমার মনে হচ্ছে, ছিঁড়ে নেয়া প্রাইস ট্যাগের অংশ ওটা। খুব সম্ভব, কোন অ্যান্টিকস-এর দোকান থেকে কেউ কিনেছে জিনিসটা। মি. সিম্পসন, একটা প্রশ্ন।
বলো, শহীদ।
কুয়াশা বলল, যার কাছে যা আছে, সব জিনিসের একটা তালিকা তৈরি করতে বলেছিলাম…
কিন্তু তার দরকার কি এখন আর? ব্লো-পাইপটা তো পাওয়াই গেছে।
কুয়াশা বলল, কি জানেন, পাজড হয়ে গেছি আমি। তালিকায় এমন কিছু যদি থাকে, যা দেখে বুঝতে পারি…
ঠিক আছে, তালিকা তৈরি করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে করণীয় কি হতে পারে? শহীদ, জবানবন্দীতে কে কি বলেছে তা যদি আমি সকলের সামনে পড়ি…
কুয়াশা বলল, মন্দ নয়। কেউ যদি কোন ব্যাপারে মিথ্যে তথ্য দিয়ে থাকে, প্রতিবাদ উঠতে পারে শ্রোতাদের তরফ থেকে।
যাই, চলো তাহলে।
লাউঞ্জে ফিরে এল ওরা।
ছোট্ট একটা ভূমিকা করলেন মি. সিম্পসন। তারপর এক এক করে সকলের দেয়া জবানবন্দী এবং প্রশ্নের উত্তর পড়ে শোনালেন।
কাজ হলো না। কেউ কারও বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিবাদ উত্থাপন করল না।
মি. সিম্পসন চিন্তা-ভাবনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন। সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, বিমানের রিয়ার ক্যারিজে ছিলেন আপনারা সর্বমোট বারোজন। ফ্রন্ট ক্যারিজ থেকে আপনাদের ক্যারিজে কেউ ঢোকেনি। স্টুয়ার্ডরা বারবার ঢুকেছে। ওদেরকেও ইনকুড় করা যাক। আপনারা তাহলে দাঁড়ালেন চোদ্দজন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, এই চোদ্দজনের মধ্যে লুকিয়ে আছে ম্যাডাম রাউল, চিখারীর হত্যাকারী।
মি. সিম্পসন একে একে সকলের দিকে তাকালেন। তারপর আবার শুরু করলেন।
খুনী একজন, তার অপরাধের জন্যে আপনারা সবাই ভুগবেন এ. আমি চাই না। কিন্তু যেহেতু এটা একটা মার্ডার কেস, তাই আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতা আমার একান্তভাবে দরকার। আশা করি খুনীকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে একমাত্র খুনী ছাড়া, আপনাদের সকলের কাছ থেকে সবরকম সাহায্য আমি পাব। আমি আপনাদেরকে আটকে রাখার পক্ষপাতি নই। এখন আপনারা যার যার কাজে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আগামী রবিবারে বৈলা এগারোটায় আপনাদের সকলকে উপস্থিত হতে হবে আমার চেম্বারে। ইতিমধ্যে নিহত ভদ্রমহিলা এবং আপনাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পারব আমরা। সেই তথ্য, ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে আমরা আলোচনা করব। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনাদের সুবিধের কথা ভেবেই এই বিশেষ ব্যবস্থার প্রস্তাব দিচ্ছি আমি। আপনারা সবাই সন্দেহের আওতায় রয়েছেন এখন, এই অজুহাতে সবাইকে আমি গ্রেফতার করে থানা হাজতে চালান দিতে পারি। কিন্তু সেটা হবে আপনাদের প্রতি নেহায়েতই অন্যায়, তাই…।
সবাই অনিচ্ছাসওে প্রতিশ্রুতি দিল–উপস্থিত থাকবে তারা আগামী রবিবার বেলা এগারোটায় মি. সিম্পসনের চেম্বারে।
.
০৩.
ঢাকা।
রবিবার। মি. সিম্পসনের চেম্বার। বেলা এগারোটার আগেই এসে পৌঁছেছে। সবাই। অতিরিক্ত তিন ভদ্রলোক যোগ দিয়েছেন এই আলোচনা সভায়। তাদের মধ্যে একজন সরকারী সার্জেন। অপরজন ম্যাডাম রাউল চিখারীর আইন উপদেষ্টা, মি. লবঙ্গম মেহতা। ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক, খুচরো কিছু দাড়ি আছে থুতনিতে, মাথা জোড়া টাক। তৃতীয় ব্যক্তি হলো কেমিস্ট এনাম আহমেদ, দুষ্প্রাপ্য পয়জন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ।
লবঙ্গম মেহতাকে প্রশ্ন করা হলো। প্রশ্নকর্তা মি. সিম্পসন।
নিহত ভদ্রমহিলাকে দেখেছেন আপনি? সনাক্ত করেছেন?
লবঙ্গম মেহতা বলল, দেখেছি। তিনি আমার মক্কেল ছিলেন। নাম মিসেস রাউল চিখারী। তবে ম্যাডাম নোয়া হিসেবেই তিনি ছিলেন সকলের কাছে পরিচিত।
আপনি কি বলতে চাইছেন রাউল চিখারী হিসেবে তাকে কেউ চিনত না?
লবঙ্গম মেহতা বলল, সম্ভবত, না। তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন ম্যাডাম নোয়া নামে। ওই নামেই সবাই চেনে তাকে।
তার সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে পারেন?
লবঙ্গম মেহতা টাকে হাত বুলাল, বলল, পারি। তিনি সম্ভবত বিধবা, তবে নিশ্চিত করে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। স্বামীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বহু যুগ আগে, এইটুকুই মাত্র জানি আমি। সেই স্বামীর ঔরসে তার এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সেই কন্যা এখন কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না–জানি না। ম্যাডাম নোয়া বসবাস করছিলেন বোম্বের জুহু রোডে, বাড়িতেই ছিল তার অফিস।
তার ব্যবসা সম্পর্কে বলুন।
লবঙ্গম মেহতা একটু ইতস্তত করে বলল, বোম্বেতে ম্যাডাম অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর ব্যবসা…সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দিতেন তিনি। তিনি একজন মানিলেণ্ডার ছিলেন।
কাদেরকে টাকা ধার দিতেন তিনি?
সকলকেই দিতেন, যারা ধার চাইতে যেত। বাংলাদেশ বা অন্য কোন বিদেশী অতিথি ভারতে বেড়াতে গিয়ে যদি টাকার অভাবে পড়ত, তারা ছুটে যেত ম্যাডাম নোয়ার কাছে। তিনি কাউকে বিমুখ করতেন না। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বাংলাদেশ বা অন্য কোন বিদেশী রাষ্টে ছিল না। প্রয়োজনে তিনি টাকা। আদায় করার জন্যে বিদেশে যেতেন। ঘনঘনই এ-দেশে সে-দেশে যেতে হত তাকে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে ম্যাডাম নোয়া আজে বাজে লোককে টাকা। ধার দিতেন না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা ধনী লোকেরাই তার কাছ থেকে ধার পেত।
প্রসঙ্গক্রমে, দুএকজনের নাম করতে পারেন, যারা ম্যাডাম নেয়ার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে?
লবঙ্গম মাথা দোলাল, দুঃখিত। আমার জানা নেই। আমি ম্যাডামের ব্যবসার আইনগত দিকটাই শুধু দেখাশোনা করতাম। ব্যবসাটা পরিচালনা করতেন তিনি একাই, কারও সাহায্য বা পরামর্শ নিতেন না।
মৃত্যুর সময় কি তিনি ধনী ছিলেন?
অগাধ সয়-সম্পত্তি এবং টাকা-পয়সা রেখে গেছেন তিনি।
তার কোন শত্রু ছিল কি?
লবঙ্গম মেহতা বলল, না, যতদূর জানি।
এরপর দুই স্টুয়ার্ডকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রশ্ন করা হলো। নতুন কিছুই জানাতে পারল না তারা। ডাক্তার সমীরকেও জেরা করা হলো নতুন করে। তারপর সরকারী ডাক্তার সার্জেন সিদ্দিকুর রহমানকে প্রশ্ন করা হলো।
মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, আপনি পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট তৈরি করেছেন?
করেছি।
মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বলুন আপনি।
সার্জেন সিদ্দিকুর রহমান কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। বলল, আমি যখন লাশ দেখি তার একঘণ্টা আগে মারা গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। আমি তার গলার এক পাশে একটা সারকুলার পাঙচার দেখতে পাই, জুগুলার ভেইনের ঠিক উপরে। এই ক্ষতচিহ্ন বোলর কামড়ের ফলেও হতে পারে কিংবা, যে ক্ষুদ্র বর্শাটি আমাকে দেখানো হয়েছে তার দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু পোস্টমর্টেমের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, ভদ্রমহিলা মারা গেছেন মারাত্মক বিষক্রিয়ার ফলে। রক্তস্রোতে এই বিষ মিশে যায়, সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে।
বিষ–কি ধরনের বিষ বলতে পারবেন আপনি?
সার্জেন সিদ্দিকুর রহমান একটু গম্ভীর হলো। বলল, এমন এক ধরনের বিষ যার সাথে আমার পরিচয় নেই। এই বিষ আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত।
এবার মি. এনাম আহমেদ, পয়জন স্পেশালিস্ট।
ছোটখাট দেহের অধিকারী এনাম আহমেদ। চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা। নাকটা থ্যাবড়া, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। মাথাটা দেহের তুলনায় বেশ একটু বড়।
মি. সিম্পসন ক্ষুদ্রাকৃতি হলুদ রঙের বর্শাটি তাকে দেখালেন। বললেন, এটা চিনতে পারছেন?
এনাম আহমেদ মৃদু হেসে বলল, পারছি। অ্যানালিসিসের জন্যে আমার ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল ওটা।
আপনার অ্যানালিসিসের ফলাফল কি?
এই ধরনের বর্শা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট একটা উপজাতি। বর্শাটিকে তারা এক ধরনের তৈরি করা বিষে ভিজিয়ে নেয়। কুরারি–একধরনের গাছের শিকড় থেকে সংগৃহীত বিষ।
সেই বিষ পাওয়া গেছে? তাতেই মৃত্যু হয়েছে?
না। অত্যল্প পরিমাণ পাওয়া গেছে বর্শায় কুরারি। আমার পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে, ইদানীং বর্শাটিকে ভিজিয়ে নেয়া হয়েছে Venom of Dispholidus Tupus-এ। এর অপর নাম কুমশ্লাং, কিংবা ট্রি-স্নেক।
বুমশ্লাং? বুমশ্লাং আবার কি?
এনাম আহমেদ বলল, বুমশ্লাং সাউথ আফ্রিকার এক জাতের সাপ। এই সাপের বিষ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। মানুষের শরীরে এর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে হায়েনার শরীরে এই বিষ ইঞ্জেক্ট করে দেখা গেছে সিরিঞ্জ বের করে নেয়ার আগেই হায়েনার মৃত্যু ঘটে। এই বিষ তৎক্ষণাৎ চামড়ার ভিতর রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, হার্টকৈও ক্ষতিগ্রস্ত করে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই, অচল হয়ে দেয় হার্টের তৎপরতা।
এর আগে শুনেছেন কখনও, এই বিষ প্রয়োগ করে কেউ খুন করেছে কাউকে?
এনাম আহমেদ মাথা দোলাল, না। সত্যি, খুবই বিস্ময়কর ঘটনা এটা।
চেম্বারের ভিতর এরপর ডেকে আনা হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে। সে তার রিপোর্টে বলল, স্নো-পাইপের গায়ে হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। ব্লো-পাইপ এবং বর্শাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। দশ ফিট হলো এর রেঞ্জ।
এরপর একে একে বাকি সবাইকে প্রশ্ন এবং জেরা করা হলো।
রহস্য উপন্যাস লেখক সৈয়দ জাহাঙ্গীর তার নিজের ব্লো-পাইপটা সাথে করে নিয়ে এসেছে, মি. সিম্পসনকে দেখাল সেটা সে। বলল, আমার ব্লো-পাইপ দিয়ে যে ভদ্রমহিলাকে খুন করা হয়নি তা আপনারা পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন।
অনেক প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন। নতুন কিছুই বলতে পারল না লেখক। তবে, সে যে খুনী নয় এই একটা কথা সে হাজার বার ঘোষণা করল।
অবস্থা যাকে তাই। খুনী কে, বোঝা যাচ্ছে না।
মি. সিম্পসন সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা প্রত্যেকে নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে খুনী বলে সন্দেহ করেন। কার কি, বক্তব্য, সব শুনেছেন আপনারা। এখন আমি আপনাদের মতামত জানতে চাই। আমি এক টুকরো করে কাগজ দিচ্ছি। সকলকে। যাকে যার সন্দেহ হয়, কাগজের সে টুকরোয় তার নাম লিখুন, লিখে আমাকে দিন। এই পদ্ধতিতে হয়তো কোন কিনারা হবে না এই কেসের, তবু, আপনাদের সকলের মতামত আমি জানতে পারব। আজকের এই মীটিংয়ের পর সরকারী পর্যায়ে এর তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে। আমি হয়তো সরকারীভাবে এই কেসের সাথে যুক্ত থাকব কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই কেসের সমাধান বের করার জন্যে যে উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম, তার সমাপ্তি ঘটবে এই মীটিং শেষ হবার সাথে সাথে।
একজন কনস্টেবল এক টুকরো করে কাগজ পৌঁছে দিল প্রত্যেকের হাতে। যে-যার কলম বের করে কাগজে লিখল-সে যাকে সন্দেহ করে তার নাম।
এক এক করে টেবিলের উপর রেখে গেল সবাই কাগজের টুকরোগুলো ভাঁজ করে। মি. সিম্পসন কাগজগুলোর ভাজ খুলতে শুরু করলেন।
কাগজগুলোয় কে কার নাম লিখেছে কে জানে! কিন্তু মি. সিম্পসন নামগুলো। পড়তে পড়তে অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠলেন।
সবগুলো কাগজের ভাজ খুলে পড়লেন তিনি। মুখ তুলে তাকালেন মুখোমুখি বসা শহীদরূপী কুয়াশার দিকে। কি যেন বলতে গিয়েও বললেন না।
একজন ছাড়া সবাই খুনী বলে সন্দেহ করেছে শহীদরূপী কুয়াশাকে। সেই একজন হলো লিলি। হিপ্পীবেশী শহীদও কাগজে লিখেছে, সবাই প্রাইভেট ডিটেকটিভকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
মি. সিম্পসন চোখ সরিয়ে সকলের দিকে তাকালেন। বললেন, আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আজকের মীটিং এইখানেই শেষ করা হলো। চেম্বার ত্যাগ করে বেরিয়ে গেল সবাই।
সকলের শেষে কুয়াশাও বের হলো। হিপ্লীবেশী শহীদ অপেক্ষা করছিল, করিডরে। কুয়াশাকে দেখে একটু যেন গম্ভীর হলো মুখের চেহারা।
মৃদু হাসল কুয়াশা। বলল, সকলের চোখে তুমি খুনী বলে সাব্যস্ত হয়েছ, শহীদ। তোমার ছদ্মবেশ যদি না নিতাম, এই ভিত্তিহীন কলঙ্ক তোমার চরিত্রকে দূষিত করত না। সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব এখন আমারই।
শহীদ, কুয়াশার সাথে যে হেসে ছাড়া কথা বলে না, না হেসে শুকনো গলায় বলল, হু। আমি ভাবছি…
কুয়াশা সহাস্যে বলল, তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না। সকলের ধারণা, আমি খুন করেছি। কে কি ভাবল তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তোমার মতামতের মূল্য দিই আমি। তুমিও ওদের সকলের দলে, তাই না? তাছাড়া অভিযোগটা সরাসরি তোমার ওপর বর্তাচ্ছে, তোমার ছদ্মবেশ নিয়ে আছি বলে। তাই…
শহীদ বলল, তুমি আমার ছদ্মবেশ নিয়ে আছ, যার ফলে সবাই ভাবছে আমিই খুনী-এটাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছি না আমি। সকলের ধারণা খুন তুমি করেছ–এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি?
কুয়াশা মুচকি হাসল। বলল, বক্তব্য অত্যন্ত সহজ-সরল। কিন্তু মুখের কথার কি দাম? আমি তদন্ত করব, সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবাই যদি জানত আমি শহীদ খান নই, কুয়াশা-এবং সেই অবস্থায় যদি সবাই রায় দিত আমি খুনী, মাথা ঘামাতাম না হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তোমার সুনাম, প্রতিষ্ঠা এবং মানসম্মানের প্রশ্ন জড়িত। তোমার চরিত্রের ওপর যে কালিমা পড়েছে তা থেকে তোমাকে মুক্ত করার দাত্বি এখন আমার।
শহীদকে একটু খুশি দেখাল। কুয়াশার বক্তব্য ওর মনঃপূত হয়েছে। বলল, গুড। আমিও তাই চাই। তুমি তদন্ত করে প্রমাণ করো, খুনী অন্য কেউ, শহীদ খান নয়।
আরও দুএকটা কথা বলবার পর ওরা বিদায় নিল পরস্পরের কাছ থেকে। নিচে নেমে গেল শহীদ।
কুয়াশা দাঁড়িয়ে রইল সেই একই জায়গায়। কি যেন ভাবছে সে। মিনিট তিনেক পর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল, পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল রোডের উপর লিলি এবং আরিফ: লিলি বলছিল, মি. সিম্পসনকে কেমন যেন হতচকিত দেখাচ্ছিল, কাগজের ভাজ খুলে সবগুলো পড়ার পর, তাই না? কে যে কাকে খুনী বলে মনে করছে…! আমি কিন্তু সাদা কাগজ ফিরিয়ে দিয়েছি।
সবাই রায় দিয়েছে আমি খুনী।
ওদের পিছন থেকে শহীদরূপী কুয়াশার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা পিছন দিকে।
লিলি বলল, দূর! এ আমি বিশ্বাস করি না!
কুয়াশা হাসছে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন সন্দেহের। সবাই আমাকে সন্দেহ করেছে। তার কারণও অবশ্য আছে।
লিলি বলল, আপনি নিজে একজন গোয়েন্দা, নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকবেন না। প্রকৃত খুনীকে ধরবার…
কুয়াশা বলল, অবশ্যই।
কুয়াশা বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর আরিফ বলল, কী অদ্ভুত কাণ্ড, না? ভদ্রলোককে সন্দেহ করার কোনই মানে হয় না।
লিলি বলল, ট্যাক্সি আসছে না কেন?
আরিফ বলল, সত্যি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে না। মিস লিলি, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, কোন হোটেলে এক কাপ করে চা খেতে পারি আমরা।
লিলি তাই চাইছিল মনে মনে। বলল, মন্দ হয় না। খুন-খারাবির কথা ভাবতে ভাবতে মাথা ধরেছে আমার। চা খাওয়া দরকার। চলুন।
কাছেই একটা হোটেলে ঢুকে কেবিনে বসল ওরা। নিভৃতে বসে হঠাৎ ওরা কেউ কোন কথা খুঁজে পেল না। খানিকপর নিস্তব্ধতা ভাঙল আরিফই, ঘটনাটা এমন বিশ্রী যে অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না। দৈনিক পত্রিকায় আমাদের সকলের নাম ছাপা হয়েছে। গত চারদিন রোগীর সংখ্যা একদম কম, যারা দুএকজন এসেছে, তাদের চোখে সন্দেহের, ভীতির দৃষ্টি দেখেছি আমি। দোষ তাদের দিই কিভাবে, সন্দেহের আওতায় আমিও তো পড়ছি।
একই অবস্থা আমারও। আমার সহকর্মীরা পর্যন্ত কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। কিভাবে ওদেরকে বোঝাই যে আমি খুন করিনি?
আরিফকে চঞ্চল দেখাল, এ অন্যায়। অথচ…আচ্ছা, খুনী কে হতে পারে বলুন তো?
লিলি বলল, আমি জানি আমি খুন করিনি। আমি এ-ও জানি যে আপনিও খুন করেননি।
আরিফ হেসে ফেলল, কিভাবে জানলেন আমি খুন করিনি?
লিলি বলল, ভদ্রতা রক্ষার জন্যে বলছি তা মনে করবেন না। আপনার দিকে। সরাসরি আমি না তাকালেও, সর্বক্ষণ খেয়াল ছিল আমার আপনার দিকে। প্লেনের পিছন দিকে আপনি একবারও যাননি। সীট ছেড়ে উঠেছিলেন মাত্র একবার, গিয়েছিলেন উল্টোদিকে, ওয়াশরূমে। ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা আপনি ফিরে, এসে বসেন নিজের সীটে। আপনার সীট থেকে ম্যাডাম নোয়ার সীট পনেরো ফিট দুরে, অথচ ব্লো-পাইপের রেঞ্জ মাত্র দশ ফিট। তা ছাড়া, ব্লো-পাইপটা মুখে পুরে যদি আপনি ফুঁ দিয়ে বর্শা ছুঁড়তেনও, আরোহীদের সবাই আপনাকে দেখতে পেত। আপনি যে খুন করেননি–এগুলো হলো প্রমাণ।
হাসতে হাসতে আরিফ বলল, কী আশ্চর্য! আপনি এত কিছু লক্ষ করেছেন। যাক, খুন আপনিও যে করেননি, তার প্রমাণ, আপনি একবারও সীট ছেড়ে কোথাও যাননি।
লিলি বলল, তাহলে কে?
আরিফ বলল, স্টুয়ার্ডদের কথা ধরা যাক। না, অসম্ভব।
লিলি বলল, ওরা নয়। পাশের সারির মিসেস পারভিন, ড্যান্সার প্রখ্যাত সমাজসেবকের স্ত্রী-কিন্তু ভদ্রমহিলা এমনিতে যাই হোক, অমন অপরূপ সুন্দরী, ওর পক্ষে কাউকে খুন করা অসম্ভব।
আমিও একমত আপনার সাথে। তাহলে?
একে একে সকলের কথাই বিবেচনা করল ওরা। কাউকেই খুনী বলে মনে হয় না ওদের। সবশেষে লিলি বলল, দুত্তোরী ছাই। আমরা কি ডিটেকটিভ নাকি যে খুনীকে চিনতে পারব। পুলিস-ডিটেকটিভরাই নাকানিচোবানি খাচ্ছে!
আরিফ বলল, ঠিক। কিন্তু খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার, তাই না? যতদিন না আসল খুনী ধরা পড়বে, একটা অশান্তির মধ্যে থাকতে হবে আমাদের সবাইকে।
লিলি বলল, পরপর করাত ঘুমুতে পারিনি আমি।
আরিফ ব্যস্ত হয়ে বলল, খামোকা দুশ্চিন্তা করবেন কেন! আপনি জানেন। আপনি খুন করেননি, সুতরাং সব ভুলে যান। আচ্ছা, আবার কবে দেখা হবে বলুন।
তো আমাদের?
লিলি একটু ইতস্তত করার পর বলল, আপনিই ঠিক করুন বরং।
আরিফ বলল, এরপর যখন দেখা হবে আমাদের, পরস্পরকে তুমি বলব, আমরা, কেমন?
লিলি সলজ্জ হেসে বলল, আচ্ছা।
.
০৪.
ঢাকা।
মি. সিম্পসনের বাড়ি। ড্রয়িংরূমে শহীদরূপী কুয়াশা, মি. সিম্পসন, ম্যাডাম নোয়ার আইন-উপদেষ্টা লবঙ্গম মেহতা এবং সদ্য আগত বোম্বের পুলিশ কমিশনার মি. গুরুদয়াল বচ্চন উপস্থিত। মি. সিম্পসন পরিচয় করিয়ে দিলেন মি. গুরুদয়াল বচ্চনের সাথে সকলের।
বোম্বের পুলিশ কমিশনার মি. বচ্চন কুয়াশার সাথে করমর্দন করতে করতে গদগদ কণ্ঠে বললেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মি. শহীদ। আপনার সুনাম শুনে শুনে আপনার সম্পর্কে কি রকম যে ধারণা জন্মেছে আমার মধ্যে, ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। আপত্তি না থাকলে চলুন আমার দেশে। ভারত মস্ত বড় দেশ, আপনাকে। নাগরিকত্ব দান করা আমাদের জন্যে কোন সমস্যাই নয়! আপনার মত একজন। প্রতিভাকে আমরা সম্মানের সাথে সাদরে গ্রহণ করব।
উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কুয়াশার মুখ। চুরুট কামড়ে ধরে উত্তরে বলল সে, ধন্যবাদ, মি. বচ্চন। কিন্তু নিজের দেশের সেবা করার মধ্যে যে পুণ্য আছে তা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না।
মি. বচ্চন বললেন, এই একই লোভে আমিও ইংল্যাণ্ডে চলে যেতে পারছি না। সে যাক, মি. শহীদ, আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে সত্যি আমি গর্বিত।
কুয়াশা হেসে উঠল। বলল, কিন্তু বর্তমান কেসে শুনেছেন নিশ্চয়ই, আমিই সবচেয়ে সন্দেহজনক চরিত্র। বিমানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা একবাক্যে রায় দিয়েছেন–আমিই খুনী।
মি. সিম্পসন দেঁতো হাসি হেসে বললেন, অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি। শহীদকে চিনি, স্নেহ করি, ওর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে আমার–শুধু মাত্র এই সব ব্যক্তিগত কারণেই এ পর্যন্ত ওকে আমি গ্রেফতার করে হাজতে পাঠাইনি। আমার জায়গায় অন্য কোন অফিসার হলে এই মুহূর্তে ওকে জেল-হাজতে থাকতে হত।
মি. বচ্চন হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। হাসি থামতে বললেন, ওয়ার্ল্ড ফেমাস প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান খুনী-আমার ধারণা, যতগুলো জোক শুনেছি এটা তার মধ্যে সবচেয়ে হাসির। সে যাক, ম্যাডাম নোয়া সম্পর্কে তার আইন-উপদেষ্টা মি, লবঙ্গম মেহতার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই আমি।
লবঙ্গম মেহতা বলল, আসলে, স্যার, ম্যাডাম নেয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যা জানে তার চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না। যা যা জানি, সংক্ষেপে বলছি আমি। বোম্বেতেই শুধু নয়, ম্যাডাম নোয়া গোটা ভারত এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও বিখ্যাত একটা চরিত্র, তার অতীত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই কেউ জানে না। এককালে তিনি আশ্চর্য সুন্দরী ছিলেন, স্মল পক্স হওয়ায় সেই সৌন্দর্য উবে যায়, তিনি কুৎসিত হয়ে ওঠেন। তাকে দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ক্ষমতা ভালবাসতেন তিনি। অর্জনও করেছিলেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা। অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। ব্যবসার ব্যাপারে আবেগ বা ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিতেন না। তবে ব্যবসায় সততা রক্ষা করে চলতেন তিনি, এ ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিল।
মি. বচ্চন বললেন, সততা, এটা আপেক্ষিক ব্যাপার ছিল ম্যাডাম নোয়ার কাছে। যে লোক তাঁর কাছে সৎ থাকত, সেই লোকের কাছে তিনিও সৎ থাকতেন। কিন্তু যে লোক বা পার্টি তার সাথে গোলমাল করত সেই পার্টির সাথে তিনিও গোলমাল করতেন।
মি. সিম্পসন বললেন, একটু বিশদ ব্যাখ্যা করে বলুন, মি. বচ্চন।
মি. বচ্চন বললেন, ঢাকায় আসার আগে ম্যাডাম নেয়া সম্পর্কে সম্ভাব্য সব তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি আমি। অনেক ব্যাপারই জানতে পেরেছি আমি তার সম্পর্কে। ম্যাডামের কাছ থেকে যারা টাকা কর্জ নিত তারা সবাই সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষ। ম্যাডাম এদেরকে টাকা দিতেন বটে, কিন্তু এদের জীবনের অতীত ইতিহাস সংগ্রহ না করে টাকা দিতেন না কাউকে। বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই কিছু গোপন ব্যাপার থাকে, কিছু অপরাধ থাকে–ম্যাডাম নোয়া এই সব গোপন ব্যাপার এবং অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতেন আগে, তারপর টাকা দিতেন। কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?
কুয়াশা বলল, জলের মত। কোন পার্টি যদি সুদ বা মূল টাকা দিতে গড়িমসি করত, ম্যাডাম নোয়া তার অপরাধের কথা বা গোপন ব্যাপারের কথা প্রকাশ করে, দিতেন।
ঠিক তাই!
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু এ তো ব্ল্যাকমেইলিং।
মি. বচ্চন বললেন, ব্ল্যাকমেইলিং–হয়তো। কিন্তু একাজ ম্যাডাম নোয়া করতেন তখনই যখন পার্টি তাকে ঠকাতে চেষ্টা করত। তা না হলে পার্টির কোন ক্ষতি তিনি করতেন না।
মি. সিম্পসন বললেন, পার্টির গোপন ব্যাপার বা অপরাধের কথা প্রকাশ করে দিয়ে কি লাভ হত তার? সে-পার্টির কাছ থেকে টাকা পাবার আশা কি চিরতরে উবে যেত না?
মি. বচ্চন সিগারেট ধরালেন। অ্যাশট্রেতে দেশলাইয়ের কাঠি ফেলতে ফেলতে বললেন, লাভ হত এই যে অন্যান্য পার্টিরা ভয়ে তাকে ঠকাতে চেষ্টা করত না।
মি. সিম্পসন তাঁর টিয়া পাখির নাকের মত খাড়া নাকের একদিকের দেয়ালে তর্জনী ঘষতে ঘষতে বললেন, তার মানে, ম্যাডাম নোয়ার শত্রু থাকা বিচিত্র নয়। তাকে খুন করার জন্যে মোটিভের অভাব নেই, বোঝা গেল। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি মারা যাবার ফলে কে তার টাকা এবং সয়-সম্পত্তির মালিক হবে।
লবঙ্গম মেহতা বলল, ম্যাডাম নোয়ার এক কন্যা সন্তান আছে বটে, কিন্তু সে কোথায় আছে, জীবিত আছে কিনা জানি না। ম্যাডাম নোয়া তার কন্যাকে শিশু অবস্থায় শেষ দেখেছেন, তারপর থেকে তিনি মেয়ের খোঁজ খবর রাখতেন কিনা জানা নেই আমার। তবে বেশ কয়েক বছর আগে তিনি যে উইল তৈরি করেন তাতে নিজের সেই একমাত্র কন্যাকে তিনি সব কিছু দিয়ে গেছেন। যতদূর জানি, এরপর তিনি অন্য কোন উইল করেননি।
কি পরিমাণ টাকা রেখে গেছেন ম্যাডাম নোয়া?
লবঙ্গম বলল, লাখ দশেক, তার বেশিও হতে পারে।
কুয়াশা জানতে চাইল, সেই কন্যার বয়স এখন কত হবে?
লবঙ্গম মেহতা মনে মনে একটা হিসেব কষে বলল, সঠিক জানি না। তবে পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে।
মি. সিম্পসন বললেন, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার কোন পার্টি, সে পুরুষ হোক বা নারী, ম্যাডাম নোয়কে খুন করেছে–এটাই এখন সত্যি বলে মনে হচ্ছে। বিমানের আরোহীরা সবাই জানিয়েছে, তারা কেউ ম্যাডাম নোয়াকে চিনত না। এদের মধ্যে একজন মিথ্যে কথা বলছে। মি. বচ্চন, ম্যাডাম নোয়ার অফিসের কাগজপত্র, ফাইল ইত্যাদি চেক করলে জানা যেতে পারে
বাধা দিয়ে পুলিস কমিশনার বললেন, আপনার টেলিফোন করবার পরপরই আমি ম্যাডাম নোয়ার বাড়ি তথা অফিসে লোক পাঠিয়েছিলাম। তার অফিলরূমে একটা লোহার সিন্দুক আছে, তার ভিতরই যাবতীয় কাগজপত্র থাকত। কাগজপত্র সবই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
মি. সিম্পসন চমকে উঠলেন, হোয়াট! পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে মানে? ..
ম্যাডাম নোয়ার সেক্রেটারি, কারানান খাট্টা, আমার প্রতিনিধিকে জানায় যে ম্যাডাম নোয়ার নির্দেশ ছিল, হঠাৎ করে যদি তার কোন বিপদ ঘটে অর্থাৎ তিনি যদি অকস্মাৎ মারা যান, কাগজপত্র সব যেন নষ্ট করে ফেলা হয় সাথে সাথে।
সেকি! কেন?
মি. বচ্চন বললেন, ম্যাডাম নোয়ার নিজস্ব সাঙ্কেতিক ভাষা, ছিল, সেই সাঙ্কেতিক ভাষায় তিনি পার্টিদের নাম-ঠিকানা এবং অতীত ইতিহাস লিখে রাখতেন। যারা তার সাথে সততা বজায় রাখত, তিনিও তাদের সাথে সততা বজায় রাখতেন। তিনি হঠাৎ মারা গেলে সৎ পার্টিদের দুর্বলতা বা অপরাধের কথা প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে, এই ভেবে তিনি তার সেক্রেটারিকে ওইরকম অদ্ভুত একটা নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকেই।
ভারি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা ছিলেন ম্যাডাম নোয়া, স্বীকার করতেই হবে,. অন্যমনস্কভাবে বললেন মি. সিম্পসন, নিভন্ত চুরুটে ঘন ঘন টান দিলেন।
উঠে দাঁড়াল লবঙ্গম মেহতা। বলল, জরুরী একটা কাজ আছে, আমাকে এখন বিদায় দিন আপনারা। যদি কোন ব্যাপারে আমাকে দরকার হয়, ঠিকানা তো আমার জানেনই। আপনাদের সাহায্যে লাগলে আনন্দিত হব আমি।
প্রত্যেকের সাথে করমর্দন সেরে বিদায় নিয়ে চলে গেল সে।
মি. সিম্পসন চুরুটে অগ্নিসংযোগ করলেন। টেবিলের উপর থেকে ফাউন্টেন পেন তুলে নিয়ে খুললেন সেটা ধীরে ধীরে, তারপর কাছে টেনে নিলেন একটা রাইটিং প্যাড, বললেন, এবার লেখা যাক কিছু কিছু ব্যাপার। মাত্র বারোজন আরোহী ছিল বিমানে, মানে, বিমানের ব্যাক ক্যারিজে। ফ্রন্ট ক্যারিজের কোন আরোহী ব্যাক ক্যারিজে ঢোকেনি, সুতরাং তাদেরকে বাদ দিতে পারি আমরা অনায়াসে। আরোহীদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল বাংলাদেশী, কেউ কেউ ভারতীয়। একজন মাত্র ইউরোপীয়ানও ছিল। এই হিল্পীটাকে আমরা বাদ দিতে পারি। ম্যাডাম নোয়ার কাছ থেকে টাকা ধার করেনি লোকটা, ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশী আরোহীদের সম্পর্কে তদন্ত করার দায়িত্ব নেব আমি। ভারতীয়দের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেবেন মি. বচ্চন। বোম্বেতে এনকোয়্যারী চালাতে হবে। মি. বচ্চনই, ওদিকের ব্যাপারটা দেখবেন।
কুয়াশা বলল, বোম্বেতে আমিও যেতে চাই।
মি. বচ্চন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন অ্যাশট্রেতে, বললেন, আপনাকে অতিথি হিসেবে পেলে আমরা গর্ব অনুভব করব, মি. শহীদ। মি. সিম্পসন, শুধু বোম্বেতে এনকোয়ারী চালালেই হবে না। আমাকে অন্যান্য জায়গাতেও যেতে হতে পারে। ম্যাডাম নোয়া মারা যাবার আগে, রত্নাগিরি, শোলাপুর, দারওয়ার, হুগলি, আরও দক্ষিণে কোচিন পর্যন্ত। ষান্মাসিক ভ্রমণ শেষ করেছিলেন।
ঠিক। আরোহীদের মধ্যে কেউ কেউ রত্নাগিরির নাম উল্লেখ করেছিল বটে। এই সূত্রটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এরপরের কাজ হবে, খোঁজ নিয়ে দেখা আরোহীদের মধ্যে কার পক্ষে ব্লো-পাইপ এবং দুষ্প্রাপ্য বুমশ্লাং সাপের বিষ সংগ্রহ করা সম্ভব। বিমানের ভিতর কে কোথায় বসেছিল, কার পজিশন কি রকম, সেখান থেকে ম্যাডাম নোয়ার দিকে বর্শা নিক্ষেপ করা কার কার পক্ষে সম্ভব–এটাও খুঁটিয়ে দেখতে হবে আমাদের। আসুন, এক এক করে আমরা প্রত্যেক আরোহীর অবস্থান লক্ষ করি। খুন করার সম্ভাব্য সুযোগ কার কতটুকু ছিল, দেখা যাক।
মি. বচ্চন বললেন, প্রথমেই আমরা মি. শহীদকে বাদ দিয়ে শুরু করতে পারি।
কুয়াশা প্রতিবাদ করল, না, তা হয় না। আমিও একজন আরোহী ছিলাম–আমাকেও বিশ্বাস করা আপনাদের উচিত নয়।
মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক আছে, শহীদ, তুমি যদি চাও, তোমাকেও সন্দেহের তালিকায় ইনকুড করা যেতে পারে। প্রথমে তাহলে ধরা যাক স্টুয়ার্ড দুজনের কথা। মোটা টাকা ধার-কর্জ করার লোক এরা নয়। তবে সন্দেহের বাইরে এদেরকেও ফেলা যায় না। কারণ কেউ মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে এদের কাউকে দিয়ে খুন ঘটিয়ে থাকতে পারে। ভাড়াটে খুনীর ভূমিকায় এরা অবতীর্ণ হয়নি এ কথা জোর করে বলা চলে না। খুন করার সুযোগ এদেরই সবচেয়ে বেশি।
কুয়াশা মৃদু কণ্ঠে বলল, তা ঠিক। কিন্তু মি. সিম্পসন, আমার ধারণা কিন্তু অন্যরকম। হত্যাকাণ্ডটি যেভাবে সংঘটিত হয়েছে বলে দেখতে পাচ্ছি আমরা, ঠিক সেভাবে সংঘটিত নাও হয়ে থাকতে পারে।
তার মানে? সবিস্ময়ে একযোগে অপর দুই ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
কুয়াশা বলল, এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলতে চাই না আমি।
মি. সিম্পসন কাঁধ ঝাঁকালেন। বললেন, ও. কে., মাই বয়। জোর করব না। আচ্ছা, আমরা এবার মিস লিলির সম্ভাবনা এবং সুযোগ পরীক্ষা করতে পারি। ষোলো নম্বর সীট তার। ফ্রন্ট ক্যারিজের দেয়াল ঘেঁষে এই সীট। বিমানের লেজের দিকে মুখ করে বসেছিল সে। জেরার সময় সে জানিয়েছে লটারির টিকেট পেয়ে বোম্বতে বেড়াতে গিয়েছিল, সেখান থেকে গিয়েছিল রত্নাগিরি। রত্নাগিরিতে সে জুয়াও খেলে। মেয়েটির, দেখা যাচ্ছে, জুয়ার প্রতি ঝোঁক আছে। এ ধরনের মেয়েরা টাকা ধার করতে পারে হেরে গেলে। সুতরাং, মোটিভ আছে। সুযোগ প্র্যাকটিক্যালি নিল। ব্লো-পাইপ ব্যবহার করে খুন করতে হলে নিজের সীটের উপর উঠে দাঁড়াতে বাধ্য সে-কিন্তু তা সে দাঁড়ায়নি। লিলি নিজের সীট ছেড়ে ওঠেইনি।
আলোচনা এগিয়ে চলল। একঘেয়ে, নীরস কথাবার্তা। মি. সিম্পসন লিখে যাচ্ছেন আলোচনার ফলাফল। লেখা শের্ষ হতে তিনি বললেন, পড়ে শোনাই একবার আপনাদেরকে।
লিলি। সম্ভাবনাঃ কম। সুযোগঃ নেই বললেই চলে।
তারিক। সম্ভাবনাঃ কম। সুযোগঃ নেই বললেই চলে।
মিসসাঈদা। সম্ভাবনাঃ খুবই অল্প। সুযোগ: সন্দেহযোগ্য।
মিসেস পারভিন। সম্ভাবনাঃ প্রচুর। সুযোগঃ কম।
ডাক্তার সমীর। সম্ভাবনাঃ প্রচুর। সুযোগ: কম নয়।
বিষ সংগ্রহ করার সুযোগ আছে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর। মোটিভ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে সম্ভাবনা এবং সুযোগ খুবই বেশি।
আবদুল হাফিজ। সম্ভাবনাঃ অনিশ্চিত। সুযোগ: মোটামুটি।
প্যাটেলদ্বয়। সম্ভাবনাঃ কম। মোটিভ অজ্ঞাত। কিন্তু সুযোগ: সবচেয়ে বেশি এদের। বিষ সংগ্রহ করার ব্যাপারেও এদের যোগ্যতা রয়েছে।
শহীদ খান (শহীদরূপী কুয়াশা)। দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলা যায় শহীদই খুনী। সে দুবার প্লেনের লেজের দিকে গেছে, তার মধ্যে একবার কথা বলেছে নিহত ভদ্রমহিলার সাথে। খুনটা যেহেতু দিবালোকে সকলের উপস্থিতিতে সংঘটিত হয়েছে, তাই ধরে নিতে হয় খুনী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিশেষ একটা সাইকোলজিক্যাল মুহূর্তে সে তার কুকর্ম সম্পন্ন করে। এই ধরনের সাইকোলজিক্যাল মুহূর্তের সৃষ্টি করার উপযুক্ততা বিমানে যদি কারও থাকে, তাহলে সে শহীদ হতে বাধ্য।
পড়া শেষ করে সহাস্যে মি. সিম্পসন বললেন, দেখো শহীদ, সত্যি যদি খুনটা করে থাকো, স্বীকার করে চুপিচুপি। চেষ্টা করে দেখি, তোমাকে আইনের কোন ফাঁক দিয়ে বাঁচানো যায় কিনা।
কুয়াশা পাইপে আগুন ধরাচ্ছে। নীল ধোয়া ছেড়ে মুচকি হাসল সে। বলল, পুলিসের লোককে বিশ্বাস নেই, মি. সিম্পসন। আপনাকে শুভানুধ্যায়ী মনে করে সব কথা স্বীকার করে ফেলি আর অমনি ঝট করে আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিন আপনি–এধরনের বোকামি আমি করছি না।
মি. সিম্পসন বললেন, শেষ পর্যন্ত তুমিই যদি খুনী বলে প্রমাণিত হও–কি যে করব আমি এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
কুয়াশা বলল, কি আর করবেন, গ্রেফতার করার চেষ্টা করবেন…আর.আমি সেটা এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করব।
তার মানে দ্বিতীয় আর এক কুয়াশা হয়ে উঠবে তুমি। একজনকে সামলাতেই আমার গোটা জীবন হেল হয়ে গেছে, তার ওপর যদি আর একজন…।
মি. বচ্চন বললেন, মি. সিম্পসন, এই সুপারম্যান, সম্পর্কে অনেক লেখা পড়েছি আমি বিদেশী জার্নালে। আপনারা মি. কুয়াশাকে গ্রেফতার করার ব্যর্থ চেষ্টা না করে তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? তিনি জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ভঁর কাছ থেকে আপনারা অনেক কিছু পেতে পারেন। তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে উচ্চ মর্যাদার আসনে বসাবার প্রস্তাব দিলে…
মি. নিষ্পসন হাসলেন। বড় তিক্ত সে হাসি, লক্ষ করল কুয়াশা। বললেন, নিজের জন্যে সে যদি কিছু চাইত, তাহলে তো কথাই ছিল না। তাকে না দেবার মত কিছুই নেই আমাদের। কিন্তু নিলে তো! নিজের জন্যে নয়, সে চায় দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের খাওয়া, পরা, বাসস্থান এবং চিকিৎসার গ্যারান্টি! সে চায় নিষ্কলুষ, অপরাধমুক্ত সমাজ। আমরাও তাই চাই। কিন্তু আমরা তা রাতারাতি আশা করি না। আমরা চাই আইনের মাধ্যমে, নিয়ম-রীতির-মাধ্যমে ধাপে ধাপে আদর্শ সমাজ গড়তে। তার সাথে এখানেই আমাদের বিরোধ। প্রচলিত নিয়ম কানুন, বিচার পদ্ধতি ইত্যাদির ওপর তার আস্থা নেই। সে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চায়।
মি. বচ্চন ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ই। বুঝেছি। একটা প্রতিভা, এযুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা–কিন্তু স্বকীয় ধ্যান-ধারণার পূজারী।
কুয়াশা চুপচাপ বসে আছে। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কথাগুলো শুনছে কিনা। কিন্তু মি. বচ্চন থামতেই সে বলল, আমি অন্য কথা ভাবছি।
কি কথা?
কুয়াশা বলল, ব্লো-পাইপটা পাওয়া গেছে যেখানে-ওখানে কেন পাওয়া গেল?
মি. সিম্পসন বললেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তোমার সীটের তলায় পাওয়া গেছে, তাই তোমার ওপর সবার সন্দেহ।
মি. সিম্পসনকে থামিয়ে দিয়ে কুয়াশা বলল, না, আমি সে-সম্পর্কে কিছু ভাবছি না। আমি ভাবছি, খুনী ব্লো-পাইপটা বাইরে ফেলে দেয়নি কেন? তা ফেলে দিলে, চিরকালের জন্যে হারিয়ে যেত সেটা সম্ভবত।
মি. সিম্পসন বললেন, ফেলে দিতে গেলে কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে…
কুয়াশা একটু অসহিষ্ণুতার সাথে বলল, নাহ! এতই যদি তার ভয়, কিভাবে তাহলে সে খুন করল? ভুলে যাবেন না, মি. সিম্পসন, খুনী ব্লো-পাইপটাকে চুরুটের মত করে মুখে পুরেছে, ম্যাডাম নোয়ার দিকে লক্ষ্যস্থির করেছে সময় নিয়ে, তারপর গায়ের জোরে ফুঁ দিতে হয়েছে তাকে–এত সব কিছু করার পরই কেবল ব্লো পাইপ থেকে বিষমাখানো বর্শাটি ছুটে গিয়ে বিঁধেছে ম্যাডাম নোয়ার গলায়। প্রচুর সময় নিয়ে এইসব কাজ করতে পারুল, কেউ দেখে ফেলবে এই ভয় হলো না, অথচ ব্লো-পাইপটা বাইরে ফেলে দিতে ভয় হলো তার–মানতে পারছি না।
তোমার কি ধারণা তাহলে?
কুয়াশাকে চিন্তিত, দেখাল। বলল, খুনী যে অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং এটা যে পূর্বপরিকল্পিত খুন তা বোঝা যাচ্ছে। তবে ম্যাডাম নোয়াকে খুনী কিভাবে খুন করেছে–সেটা জটিল একটা রহস্য বলে মনে হচ্ছে। খুনী যেন আমাদের দৃষ্টি বিশেষ একদিকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। ভাল কথা, মি: সিম্পসন, আরোহীদের জিনিসপত্রের যে তালিকাটা তৈরি করতে বলেছিলাম, কোথায় সেটা?
টেবিলের দেরাজ টেনে খুলতে খুলতে মি. সিম্পসন বললেন, তোমার ফরমায়েশের অর্থ আমি বুঝিনি, তবে তাঙ্কিা তৈরি করতে অবহেলা করিনি।
দেরাজ থেকে লম্বা এক শীট কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিলেন তিনি কুয়াশার দিকে। হাত বাড়িয়ে নিল সেটা কুয়াশা। এই সময়, উর্দিপরা বেয়ারা ঢুকল ড্রয়িংরূমে, হাতে ট্রে। তাতে সুস্বাদু বিস্কিট এবং ধূমায়িত চা।
কুয়াশা কাগজটা মেলে ধরল সামনে। মি. বচ্চনও ঝুঁকে পড়লেন সেটার দিকে। কাগজে লেখা রয়েছে:
আবদুল হাফিজ
পকেটে পাওয়া গেছে: রঙিন সুতো দিয়ে ফুল তোলা এবং আঃ হাঃ অক্ষর দুটি লেখা রুমাল। চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা নোট কেস। বাংলাদেশের একশো টাকার নোট একটা, ভারতীয় খুচরো পয়সা বেশ কিছু। পার্টনারের লেখা ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি। তাতে লেখা: ধার-কর্জ পরিশোধ না করলে মারা পড়ব আমরা, যেভাবে। হোক একটা ব্যবস্থা করো। সিলভার সিগারেট কেস। ম্যাচ। ফাউন্টেন পেন। চাবির গোছা। অ্যাটাচি কেসে পাওয়া গেছে: সিমেন্ট ব্যবসা সংক্রান্ত নানাবিধ লেটার প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, দরখাস্ত, সার্টিফিকেট, ক্যাশমেমো। এক বোতল ব্র্যাণ্ডি, ভারতীয়, বোতলের ছিপি খোলা হয়নি।
ডাক্তার সমীর
পকেটে: দুটো সিল্কের রুমাল। নোট কেসের ভিতর পঞ্চাশ টাকার একটা, দশ টাকার ছয়টা নোট, ভারতীয় খুচরো পয়সা টাকা সাতেকের। এনগেজমেন্ট বুক। সিগারেট কেস। লাইটার। ফাউন্টেন পেন। চাবির গোছা। চামড়ার খাপের ভিতর প্রায় এক হাত লম্বা বাঁশের তৈরি বাঁশী।
আরিফ বাট
পকেট: সাদা রুমাল। মানিব্যাগ, তাতে পাঁচ এবং দশ টাকার নোট মিলিয়ে পঁচানব্বই টাকা সর্বমোট, সাথে ভারতীয় মুদ্রা টাকা তিনেকের মত। বোম্বের দুটো ডেন্টাল ইন্সট্রুমেন্ট ফার্মের বিজনেস-কার্ড। আওরঙ্গওয়ালা-বোম্বেওয়ালা ফ্যাক্টরির তৈরি বিগ সাইজ দেশলাইয়ের বাক্স (ম্যাচ বক্স), খালি। গ্যাস লাইটার। ব্রায়ার পাইপ। রাবার টোবাকো পাউচ। চাবির গোছা। অ্যাটাচি কেস, সাদা লিনেনের কোট। ছোট ছোট দুটো ডেন্টাল মিরর। ডেন্টাল রোলস অভ কটন উল। ব্যাটারি। চালিত দাড়ি কামাবার ফিলিপস কোম্পানীর রেযার। একটা পুরানো প্লেবয় পত্রিকা।
জগৎ সিং প্যাটেল
পকেট: নোট কেস, তাতে বাংলাদেশের পঞ্চাশ টাকার তিনটে নোট। সিগারেট কেস। সিগারেট হোল্ডার-আইভরি দিয়ে তৈরি। সুতির রুমাল। কয়েক প্যাকেট সিগারেট। ম্যাচ ফোল্ডার। প্যাকেটসহ প্লেয়িং কার্ডস। টুথপিক। অ্যাটাচি কেস: পাণ্ডুলিপি, কাভারে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ঠিকানা লেখা। দুটো জার্মান আর্কিয়োলজিক্যাল পাবলিকেশন। দুটো কাগজের শীটে পটারীর খসড়া স্কেচ। কারুকার্য খচিত ফাপা টিউব, কুর্দি পাইপ বলে দাবি করা হচ্ছে। নয়টা আনমাউন্টেড ফটোগ্রাফ, সবগুলোই পটারীর।
রাঘব সিং প্যাটেল
পকেট : মানিব্যাগে একশো টাকা! সিগারেট কেস। সিগারেট হোল্ডার-আইভরির তৈরি। লাইটার। ফাউন্টেন পেন, বলপয়েন্ট পেন, উডপেন্সিল। ছোট নোটবুক, হিজিবিজি কি সব লেখা। একটা এক্সারসাইজ বুক। তাতে হিন্দী, ইংরেজী এবং অশুদ্ধ বাংলায় লেখা কবিতা-হস্তাক্ষর নিজেরই।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর
পকেট; ফাউন্টেনপেনের কালিতে ভেজা রুমাল। মোটা ফাউন্টেন পেন-ফেটে গেছে, কালি বেরুচ্ছে। নিউজপেপার কাটিং, ইদানীং সংঘটিত মার্ডার সংক্রান্ত। একটাখুন আর্সেনিক পয়জনের সাহায্যে, দ্বিতীয়টি রিভলভারের সাহায্যে, তৃতীয়টি ড্যাগারের সাহায্যে। এনগেজমেন্ট বুক। চারটে উডপেন্সিল। একটা আধ হাত লম্বা, পেট মোটা প্লাস্টিকের তৈরি কিন্তু সিলভারের আবরণ যুক্ত বলপয়েন্ট পেন্সিল। পৈন-নাইফ। নোট বুক, তাতে বিভিন্ন প্লটের সার সংক্ষেপ, কিন্তু অসমাপ্ত। মানিব্যাগে পঞ্চাশ টাকার একটি, এক টাকার আটটি নোট। অ্যাটাচিকেসে একটি পাণ্ডুলিপি। উপরে লেখা: মহাশূন্যে হত্যাকাণ্ড।
সাঈদা বেগম
ভ্যানিটি ব্যাগ: পাউডার কমপ্যাক্ট। রুমাল। সোনার অতিরিক্ত এক জোড়া বালা। চাবি। দেড়শো টাকা। আসিফ চৌধুরীর পাসপোর্ট সাইজ ফটোগ্রাফ। লেদার সুটকেস: আয়না, চিরুণী, শাড়ি তিন জোড়া, দুজোড়া স্যাণ্ডেল, টুথব্রাশ, স্পঞ্জ, টুথপেস্ট, লাক্স টয়লেট সোপ, উল, তুলো। চারখানা ভারতীয় লেখকের উপন্যাস।
মিস লিলি
হ্যাণ্ডব্যাগ: লিপস্টিক, পাউডার কমপ্যাক্ট, রুজ। চাবির গোছা। অনেকগুলো রুমাল। রত্নাগিরির এক হোটেলের বিল। একশো বিশ টাকা, সব দশ টাকার নোট। ভারতীয় মুদ্রা, পনেরো টাকার মত। সুটকেস: বিভিন্ন সাইজের ঝিনুক, শাড়ি-রাউজ দুজোড়া, ভিউকার্ড, অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট দশটা, স্যান্ডেল, লেটার প্যাড, নোট বুক, ফিতে, ব্রেসিয়ার।
মিসেস পারভিন
ভ্যানিটি ব্যাগ: দুটো লিপস্টিক, রুজ, পাউডার কমপ্যাক্ট। রুমাল। সর্বমোট আড়াইশো টাকা। ভারতীয় স্ট্যাম্প বিশটা। ভারতীয় ফিল্মস্টারদের সই করা ফটোগ্রাফ। সিগারেট কেস, সিগারেট হোল্ডার। একটা ডায়মণ্ডের রিঙ। লাইটার। ড্রেসিং কেস; কমপ্লিট মেকআপ আউটফিট। ছোট একটা বোতল, লেবেলে কলমের কালি দিয়ে লেখা, বরিক পাউডার। আসলে জিনিসটা কোকেন।
অ্যালবার্ট ডেভিড
পকেট: সিগারেট কেস, সিগারেট হোল্ডার, পাইপ। আধপোয়া গাঁজা। এক ইংরেজ যুবতীর ফটোগ্রাফ। মাউথ অর্গান। লেদার ব্যাগ: ছেঁড়া প্যান্ট শার্ট, রুমাল, জুতো। পেন-নাইফ। লাইটার, ম্যাচ। দুপ্যাকেট চার মিনার।
পড়া শেষ করল কুয়াশা। মি. বচ্চন বললেন, মিসেস পারভিন তাহলে কোকেনের নেশা করেন? তাঁর নৈতিক চরিত্র খুব একটা ভাল…
ভাল? এই মহিলা উচ্ছন্নে গেছে! স্বামীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওড়ায়, এই .. তার কাজ, মি. সিম্পসন বললেন।
মি. বচ্চন বললেন, এই তালিকা থেকে তেমন কোন সূত্র পাব কি আমরা?
কুয়াশা কি যেন ভাবছিল। ঝট করে তাকাল সে মি. বচ্চনের দিকেঁ, সূত্র পাব. মানে? অলরেডি পেয়ে গেছি।
হোয়াট! বলেন কি! মি. সিম্পসন প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
কুয়াশা অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, বসুন। উত্তেজিত হবার মত কিছু নয়। জানেন তো, আমি থিওরির ওপর নির্ভর করে কাজে হাত দিই। তালিকার মধ্যে নির্দিষ্ট একটা জিনিস পাব বলে আশা করেছিলাম আমি, যদিও সঠিক জানতাম না, জিনিসটা আসলে কি? আমার ধারণা ছিল, জিনিসটা তালিকায় থাকলে দেখেই চিনতে পারব আমি। তালিকা দেখলাম–আছে সেটা। জিনিসটাকে আমি চিনতে পেরেছি, এটাই আমি পাব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু জিনিসটা ভুল দিক নির্দেশ করছে। জিনিসটা যার কাছে পাওয়া উচিত তার কাছে পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে অন্য একজনের কাছে। তার মানে, কাজের পরিমাণ বাড়ল আমার। এখনও অনেক কিছু পরিষ্কার নয় আমার কাছে। মি. বচ্চন, কবে বোম্বে যাচ্ছি আমরা?
আগামীকাল।
কুয়াশা বলল, গুড। এয়ারপোর্টে দেখা হবে আমাদের আগামীকাল সকালে, কেমন?
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল কুয়াশা, বলল, আপাতত এখন আমাকে বিদায় দিন আপনারা।
কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াবে কুয়াশা, চোখ পড়ল তার বুক কেসের উপর রাখা একটা সিনেমা সাপ্তাহিকের দিকে। হাত বাড়িয়ে পত্রিকাটি নিল সে। দেখল, প্রথম। পৃষ্ঠাতেই, অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী মিসেস পারভিনের ছবি ছাপা হয়েছে। পারভিনের পিছনে সুদর্শন এক যুবক। উঠতি নায়ক এই যুবক। যুবক পারভিনকে পিছন থেকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। ছবির নিচে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে–পারভিনের নতুন প্রেমিক: সুলতান।
কুয়াশাকে গম্ভীর দেখাল। কাগজটা র্যাকের উপর রেখে দিয়ে বলল সে, মেয়েটাকে আসিফ চৌধুরী এখনও স্ত্রীর মর্যাদা দিচ্ছে কিভাবে?
.
০৫.
ঢাকার মাটি ছাড়ল প্লেন। গন্তব্যস্থল, বোম্বে শহর।
কৌতুক অনুভব করলেন মি. বচ্চন বিমানের ভিতর কুয়াশার কাণ্ড দেখে। বাঁশের একটা বাঁশী মুখে পুরে বিমানের এদিক থেকে ওদিক বার কয়েক হেঁটে যাওয়া-আসা করল কুয়াশা। ফিরে এসে বসল সে নিজের সীটে, মি. বচ্চন প্রশ্ন করলেন, পরীক্ষার রেজাল্ট?
অধিকাংশ আরোহীই আমাকে লক্ষ করেছে।
বিমান বোম্বে এয়ারপোর্টে নামল সকাল সাড়ে দশটায়। ট্যাক্সি নিয়ে ওরা সোজা গিয়ে পৌঁছুল ম্যাডাম নোয়ার রেসিডেন্স কাম অফিসে।
প্রৌঢ় সেক্রেটারির চোখে পুরু লেন্সের চশমা। প্রায় সব চুলই পাকা তার। ড্রয়িংরূমে ওদেরকে বসিয়ে বলল, আমার নাম কারানান খাট্টা, আমি গত এগারো বছর ধরে মাইজী মোয়ার প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছি। আপনারা আবার কেন এসেছেন?
মি. বচ্চন বললেন, বাংলাদেশ থেকে নামকরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খান পায়ের ধুলো ফেলেছেন এদেশে, আপনার মাইজীর হত্যাকারীকে ধরবার জন্যে। উনি আপনার মাইজীর অফিসরূমটা দেখতে চান।
কারানান খাট্টা তেলচিটচিটে ময়লা শেরওয়ানীর পকেট হাতড়ে একটা চাবির গোছা বের করে রাখল টেবিলের উপর, অফিসরুমটা উপর তলায়, উঠে যান আপনারা।
উপর তলায় উঠে অফিসরূমে ঢুকল ওরা। কুয়াশা মিনিট দশেক ধরে পরীক্ষা করল রূমের টেবিল, ডেস্ক, আলমারির দেরাজগুলো।
কোন কাগজপত্রই নেই কোথাও। অবশেষে ডেস্কের পিছনে, রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সে। চুরুট ধরাল একটা। ধোয়া ছেড়ে ডেস্কের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা কলিং বেলের বোতাম দেখছি এখানে!
আগেরবারই দেখেছি। সেক্রেটারিকে ডাকার জন্যে ব্যবহার করতেন ম্যাডাম। মি. শহীদ, এখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না আমাদের। কাগজপত্র যা ছিল, সবই পুড়িয়ে ফেলেছে কারানান খাট্টা।
কুয়াশা ডেস্কের সর্বনিম্ন দেরাজটা খুলল। ভিতরে রয়েছে ইপট, জেমস ক্লিপের বাক্স, পুরানো টেবিল ক্যালেণ্ডার, ভাঙা কলম, পেন্সিল, পেন্সিল কাটার, রাইটিং প্যাডের ছেঁড়া পাতা। অন্যমনস্কভাবে জিনিসগুলো দেখতে দেখতে কুয়াশা কলিং বেলে চাপ দিল।
মিনিট খানেক পর অফিলরূমের দোরগোড়ায় দশাসই এক তাগড়া যোয়ানকে দেখে কুয়াশা বিস্মিত না হয়ে পারল না।
কে?
মি. বচ্চন বললেন, ওহ্…মি, শহীদ, ওর নাম রঘুবীর পাঞ্জুরী। ম্যাডামের দারোয়ান! লোকটা বোবা।
মুচকি হাসল কুয়াশা। বলল, কলিংবেল বাজাতেই উঠে এসেছে ওপরে। তার মানে ম্যাডাম নোয়া যখন কলিংবেল বাজাত রঘুবীর ওপরে আসত, সেক্রেটারি নয়।
না হয় তাই কিন্তু তাতে কিইবা প্রমাণ হয়?
কুয়াশা বলল, পার্টিরা এখানে বসে গোলমাল-টোলমাল করতে চেষ্টা করলে ম্যাডাম কলিংবেল বাজিয়ে রঘুবীরকে ডাকত। বীরের চেহারা দেখে পার্টিরা কেঁচো হয়ে যেত ভয়ে-বুঝতে পারছেন না?
মি.বচ্চন বললেন, তাই তো! ঠিক ধরেছেন আপনি।
কুয়াশা বলল, রঘুবীর, কারানান খাট্টাকে ডেকে দাও হে। তোমাকে আমার দরকার নেই।
দৈত্যটা পায়ের থপ থপ আওয়াজ তুলে চলে গেল। কারানান খাট্টা প্রবেশ করল রূমে খানিক পরই। কুয়াশার নির্দেশে বসল সে।
কুয়াশা বলল, আপনার মাইজী মারা গেছে বিষক্রিয়ায়, কারানান সাহেব। আমরা তার হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে চাই। আপনার সাহায্য পেলে খুব সহজেই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব।
আলবৎ, হুজুর। কিন্তু কিছুই আমি জানি না, হুজুর, কি সাহায্য করব আপনাদের?
কুয়াশা বলল, মাইজীর শত্রু ছিল, এ আপনি জানেন না?
কারামান খাট্টার চোখ জোড়া চশমার কাঁচের ভিতর বড় বড় হয়ে উঠল, ঝুট বাত, হুজুর, মাইজীর দুশমন কেন থাকবে?
কুয়াশা বলল, আপনার মাইজী সুদে টাকা খাটাত, শত্রু না থাকাটা সম্ভব বলে মনে করেন?
কারানান বলল, দেখুন হুজুর, টাকা যারা নিত তারা নানা রকম ফরিয়াদ করত ঠিক, কিন্তু তাদেরকে দুশমন বলব না আমি। মাইজী ছিলেন বহুত ভাল। বহুত রহম আর বহুত দয়ামায়া ছিল তার মনে। মাইজী টাকা ধার দিতেন, তার বদলে সুদ চাইতেন তিনি। আসলটা তিনি না পেলেও বেজার হতেন না। ঠিক মত সুদ পেলেই তিনি খুশি থাকতেন। মাইজী দাঁতব্য চিকিৎসালয়ে টাকা দিতেন, মাইজী গরীব মানুমের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ যোগাতেন।
কুয়াশা বলল, আপনি কি জানেন, কোন পার্টি তার সুদ দিতে রাজি না হলে আপনার মাইজী তাকে ব্ল্যাকমেইল করত?
কারানান যেন আকাশ থেকে পড়ল, তার ব্যবসার ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি হুজুর।
কুয়াশার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো আরও, কিন্তু দরকারী এবং গোপনীয় কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলবার অধিকার আগাম দিয়ে রেখেছিলেন তিনি আপনাকে, এ. থেকে কি প্রমাণ হয় না আপনি অনেক কিছুই জানতেন?
মাইজীর হুকুমের চাকর আমি, হুজুর। কি কাগজ, তাতে কি লেখা থাকে না থাকে, কিছুই আমি জানতাম না। তিনি আমাকে হুকুম দিয়েছিলেন, তিনি যদি হঠাৎ কোন দুর্ঘটনায় পড়েন বা মারা যান আমি যেন অফিসের সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলি।
কুয়াশা লোহার আলমারিটা দেখিয়ে বলল, কাগজপত্রগুলো ছিল কোথায়, ওই আলমারির ভিতর?
কারানান কুয়াশার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগল। তারপর, আড়চোখে তাকাল সে মি, বচ্চনের দিকে। কুয়াশা বলল, ছিল না ওই আলমারিতে, তাই না?
কারানান বলল, মাইজীর হুকুমের চাকর আমি, হুজুর। না, ওতে ছিল না। কাগজপত্রগুলো ছিল তার বেডরূমের, আয়রনু সেফে। তবে, পুলিশ ইন্সপেক্টর যিনি এসেছিলেন প্রথমবার তাকে আমি বলেছিলাম, এই আলমারিতেই ছিল কাগজপত্রগুলো।
মি. বচ্চন কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলেন রেগেমেগে, কিন্তু কুয়াশা কথা বলে উঠল আগে, তার বেডরূমে যেতে চাই আমরা।
দোতলারই সর্ব দক্ষিণের কামরাটা ম্যাডাম নোয়ার বেডরূম, তালা খুলে দিতে ভিতরে প্রবেশ করল ওরা। আয়রন সেটা দেয়ালের সাথে ফিট করা, মাঝারি আকারের। খোলা রয়েছে সেটা। একটা চেয়ারে বসল কুয়াশা। মি. বচ্চন বসলেন পাশের চেয়ারটিতে।
কুয়াশা বলল, পোড়াবার আগে, কারানান সাহেব, কাগজপত্রগুলো নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন। না-না, কথা শেষ করতে দিন আগে আমাকে, তারপর যা বলবার বলবেন। শুনুন, আপনার মাইজী খুন হয়েছে। তার হত্যাকারী ধরা পড়ুক তা কি আপনি চান না?
হাজারবার চাই, হুজুর।
যে-সব কাগজপত্র আপনি পুড়িয়ে ফেলেছেন তাতে যাদের নাম-ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্যাদি ছিল তাদের কেউই হয়তো আপনার মাইজীকে খুন করেছে। বিমানে যারা ছিল তাদের কারও নাম কাগজপত্রগুলোয় ছিল কিনা জানা দরকার। কাগজগুলো এখন নেই, কিন্তু আপনি আছেন। এখন, আপনি যদি বলতে পারেন কাগজগুলোয় কার কার নাম ছিল…।
কারানান খাট্টাকে বিমর্ষ দেখাল। মাথা দোলাতে দোলাতে সে বলল, আফসোসের কথা, হুজুর। কাগজপত্রগুলো ছিল দুটো ফাইলে এবং একটা বড় এনভেলাপের ভিতর। ফাইল বা এনভেলাপ–কোনটাই আমি খুলে দেখিনি। না দেখেই পুড়িয়ে ফেলেছি। মাইজীর হুকুমের চাকর আমি, হুজুর।
.
কারানান খাট্টার কথা শুনে কুয়াশার মনে ক্ষীণ যে আশাটা ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গেল। ম্যাডাম নোয়ার পার্টিদের কেউ বিমানে আরোহী হিসেবে ছিল কিনা তা জামার আর কোন উপায় নেই। চুরুটে নতুন করে আগুন ধরান ও না তাকিয়েও বুঝতে পারছে যে মি. গুরুদয়াল বচ্চন তার দিকে নিপলক নেত্রে তাকিয়ে আছেন।
কারানান খাট্টার দিকে তাকাল কুয়াশা। জানতে চাইল, আপনার মাইজী রত্নাগিরি গিয়েছিলেন কবে, সেখান থেকে ফেনেই বা কবে?
মাইজী শুধু রত্নগিরি নয়, কোচিন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বছরে দুবার তিনি টুরে বের হতেন। ফেরার পথে রত্নাগিরিতে ছিলেন কদিন। ওখান থেকেই আমাকে ফোন করে হুকুম দেন পরদিন সকালের একখানা প্লেনের টিকেট কাটতে, ঢাকায় যাবেন তিনি। হেলিকপ্টারে করে সকাল সাতটায় তিনি বোম্বে নামবেন, সাড়ে আটটার ফ্লাইটে ঢাকায় যাবেন আমাকে জানালেন। কিন্তু সকালের ফ্লাইটের টিকেট পেলাম না, তাই কিনে রাখলাম দুপুরের ফ্লাইটের টিকেট। বোম্বেতে মাইজী ৭টার সময়ই পৌঁছেছিলেন। ঢাকাগামী বিমানে চড়েন বেলা সাড়ে বারোটায়।
ঢাকায় যাবার কারণ সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন তিনি?
না, হুজুর। প্রায়ই তিনি ঢাকায় যেতেন, যখনই যাবার দরকার পড়ত, আগের দিন আমাকে বলে রাখতেন।
তাকে কি নার্ভাস দেখাচ্ছিল? তিনি কি এমন কিছু বলেছিলেন আপনাকে যা স্বাভাবিক নয়?
না, হুজুর। অস্বাভাবিক কিছু বলেননি তিনি।
রত্নাগিরি থেকে ফেরার পর কেউ তার সাথে দেখা করতে এসেছিল সেদিন?
কারানান একটু ইতস্তত করল। বলল, একজন এসেছিলেন, হুজুর। কিন্তু। তাকে আমি দেখিনি ভাল করে।
নারী না পুরুষ?
কারান বলল, অন্যরকম কিছু ভাববেন না দয়া করে, হুজুর, আপনার এই প্রশ্নের উত্তরও আমি দিতে পারব না। কি জানেন হুজুর, চশমা ছাড়া আমি একেবারেই অন্ধ। সাক্ষাপ্রার্থী যখন এসেছিলেন চশমাটা তখন পাগলের মত খুঁজেছি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
কিন্তু কণ্ঠস্বর? তাও কি শোনেননি?
কারানান বোকার মত চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে। কুয়াশা ঢাকা থেকে নিয়ে আসা সিনেমা সাপ্তাহিকটা কোটের পকেট থেকে বের করে মেলে ধরল কারানানের সামনে। বলল, দেখুন তো, এই মহিলাকে আপনি কখনও এখানে দেখেছেন কিনা?
কারানান পারভিনের রঙিন ছবির দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কয়েক সেকেণ্ড। তারপর মুখ তুলল, জানি না। হুজুর, ঠিক চিনতে পারছি না। হয়তো দেখেছি, কিংবা হয়তো দেখিনি! চোখে তো…
কণ্ঠস্বর?
কারানান বলল, আপনার প্রশ্নটা মনে আছে, হুজুর। কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম, মিথ্যে বলব না, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা নারীর না পুরুষের ধরতে পারিনি আমি।
কুয়াশাকে চিন্তিত দেখাল। পারভিনের কণ্ঠস্বর পুরুষালি, কর্কশ। উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। বলল, আমরা এবার বিদায় হব। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে মি. বচ্চনও। কিন্তু কুয়াশাকে অফিসরূমের চারদিকে ধীর ভঙ্গিতে ঘুরতে দেখে বিস্মিত হলেন তিনি। কুয়াশা দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছে, দেয়ালের দিকেই মুখ উঁচু করে।
কিছু যেন খুঁজছেন, মি. শহীদ?।
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। ফটোগ্রাফ খুঁজছি। ম্যাডাম নোয়ার আত্মীয়স্বজনের পরিবারের কারও ছবিই দেখছি না।
কারানান খাট্টা বলল, হুজুর, মাইজীর এই জগতে কেউ ছিল না।
তার নিজের এক মেয়ে আছে।
কারান বলল, হ্যাঁ.তা ঠিক। কিন্তু …তার ছবি থাকার প্রশ্ন ওঠে না হুজুর মাইজী তাঁর সেই মেয়ের কোন খবর রাখতেন না, মেয়েটি যখন শিশু তখ থেকেই।
তা কিভাবে সম্ভব?
কারানান বলল, পরিষ্কার আমিও জানি না হুজুর। শুনেছি, যুবতী বয়সে মাইজ অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল এক যুবকের সাথে। তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। একবারই সম্ভবত শুটি-বসন্ত হয় মাইজীর। মারাই যেতেন তিনি, কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে যান। বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু রূপ-সৌন্দর্য সম্পূর্ণ হারি ফেললেন। তিনি সুস্থ হবার পর তাঁর স্বামী তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। মাইজ একা, অসহায় হয়ে পড়ে। কন্যাটিকে তিনি কাউকে দান করে দেন কিংবা কো এতিমখানায় পাঠিয়ে দেন, ঠিক বলতে পারব না।
কিন্তু ম্যাডাম নোয়া তার টাকা-পয়সা সয়-সম্পত্তি সব উইল করে দিন গেছেন তাঁর সেই মেয়ের নামে। মেয়ে বেঁচে আছে বলেই তিনি উইং করেছিলেনএরকম মনে হয় না?
কারানান বলল, হতে পারে, হুজুর। কিন্তু আমি জানি না।
কুয়াশাকে চিন্তিত দেখাল। মি. বচ্চন বলল, আপনার আর কিছু জানাবা আছে আমাদেরকে? চিন্তা করে দেখুন। গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা বলতে ভুলে যাচ্ছেন না তো!
কারানান ঢোক গিলল। বলল, না, হুজুর।
মি. বচ্চন তাকালেন কুয়াশার দিকে, চলুন, মি. শহীদ।
কুয়াশা বলল, মি. বচ্চন, আপনি যান, আমি এক মিনিট পরে আসছি।
মি.বচ্চনের চোখেমুখে বিস্ময় এবং কৌতূহল ফুটে উঠল। তবে বিনাবাক্যব্যয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন করিডরে।
কারানান চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
হুজুর, আপনি?
কুয়াশা অভয় দিয়ে হাসল। বলল, কারানান সাহেব, আমি পুলিস নই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। যে কথাটা লুকিয়ে রেখেছেন, বলে ফেলুন আমাকে।
বলেন কি, হুজুর! আপনি জানলেন কিভাবে মানে, হুজুর; কোন কথা তো আমি গোপন করে…
চোর ধরা পড়ে গেলে যেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে, কারানান খাট্টাকে তো দিশেহারা দেখাল।
কুয়াশা বলল, আপনি জানেন, কে খুন করেছে আপনার মাইজীকে?
ভগবানের কসম হুজুর, জানি না।
কারানানের চোখের উপর চোখ রেখে কয়েক সেকেণ্ড পর কুয়াশা বলল, বিশ্বাস করি আপনার কথা। কিন্তু কাকে আপনার সন্দেহ হয় বলুন তো?
কাউকে না, হুজুর। এসব কি কথা জিজ্ঞেস করছেন আপনি আমাকে হুজুর!
কুয়াশা বলল, কারানান সাহেব, আপনি কিছু লুকাচ্ছেন। কি সেটা? ধরা পড়ে গেছেন আপনি, এখন আর লুকিয়ে রাখলে সুবিধে হবে না।
কারানানের মুখ শুকিয়ে গেছে। বলল, হুজুর, জিনিসটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
হতে পারে। কিন্তু কোন্টা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কেউ বলতে পারে না। কি জিনিসটা?
কারানান বেরিয়ে গেল বেডরূম থেকে তিন মিনিট পর ফিরে এসে কুয়াশার হাতে একটা ছোট নোট বুক দিল সে। বলল, হুজুর, এটা মাইজীর। মাইজী এটা নিয়ে সব জায়গায় যেতেন। কখনও হাতছাড়া করতেন না। এবার ঢাকায় যাবার সময় ভুলক্রমে তিনি এটা ফেলে যান। তিনি চলে যাবার পর, এটা দেখতে পেয়ে তুলে রাখি আমি। মাইজীর মৃত্যু-সংবাদ পাওয়া মাত্র কাগজপত্র সব পুড়িয়ে ফেলি ঠিক, কিন্তু এই নোটবুকটা পোড়াইনি। এটা পোড়াবার ব্যাপারে মাইজী আমাকে কোন হুকুম দিয়ে যাননি।
মৃত্যু-সংবাদ কখন পান আপনি?
কারানান ইতস্তত করতে লাগল।
কুয়াশা বলল, পুলিসের কাছ থেকেই খবরটা আপনি প্রথম পান, তাই না? কিন্তু সেক্ষেত্রে, তাদেরকে কিভাবে আপনি বললেন, কাগজপত্র সব পুড়িয়ে ফেলেছেন?
কারানান বলল, হুজুর, মাইজীর হুকুমের চাকর আমি। পুলিসকে বলি কাগজপত্র ছিল অফিসরূমের আলমারিতে, আমি পুড়িয়ে ফেলেছি সব। আসলে কাগজপত্র ছিল এই রূমের ওই আয়রন সেফে। তখনও পোড়াইনি। পুলিসরা যখন অফিসরুম সার্চ করছে আমি তখন আয়রন সেফ থেকে সেগুলো বের করে পুড়িয়ে ফেলি।
নোট-বুকটা খুলল কুয়াশা। ইংরেজীতে কোন নাম্বার লেখা হয়েছে ফাউন্টেন পেনের সাহায্যে, তারপর ভাঙা ভাঙা কয়েকটা করে বাক্য। কয়েকটা লাইন এই রকমের:
Cx265 কর্নেলের বউ। সিরিয়ায় রয়েছে।
GF342 নেপালিজ ডেপুটি, যোগাযোগের মাধ্যম দাদাওয়ালা।
এইরকম বিশ পঁচিশটা লাইন রয়েছে সর্বমোট নোটবইটিতে। শেষ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে:
রত্নাগিরি, মঙ্গলবার। ক্যাসিনো, ১০ঃ৩০। স্যাভয় হোটেল, পাঁচটার সময়। ABC ফোল্ডার স্ট্রীট ১১ টার সময়।
কোনটাই তেমন অর্থবহ নয়। সংক্ষেপে নামমাত্র লিখে রেখেছিলেন ম্যাডাম নোয়া, স্মরণশক্তির উপরই বিশেষ নির্ভরতা ছিল তাঁর, বোঝা যায়।
কুয়াশা বলল, এটা আমার কাছে থাক, কারানান সাহেব। এইবার আমি যাব। যাবার আগে একটা শেষ প্রশ্ন। ঢাকা ফ্লাইটের টিকেট কাটার জন্যে আপনি কি বাংলাদেশ বিমানের অফিসে নিজে গিয়েছিলেন, না, ফোন করে…
ফোন করে ব্যবস্থা করেছিলাম, হুজুর।
কুয়াশা বলল, ধন্যবাদ, কারানান সাহে। আপনার মাইজীর হত্যাকারী ধরা পড়তে যাচ্ছে–আপনি খুশি?
কারানান খাট্টা সজল চোখে বলল, কিন্তু মাইজীকে তো আর ফিরে পাব না, হুজুর!
Leave a Reply