কুয়াশা ৭০ (ভলিউম ২৪)
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৭৭
০১.
পিছন ফিরে কথা বলছে রুডলফ করিডরের শেষ মাথায় হেডপোর্টারের সাথে।
ডি. কস্টাকে একটা পিলারের আড়ালে সবেগে টেনে নিয়ে গিয়ে চাপা কণ্ঠে কুয়াশা বলল, মি, ডি. কস্টা, ওমেনাকে সাথে নিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ সহ এক্ষুণি আপনি রওনা হয়ে যান রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। ফায়ার এস্কেপ ব্যবহার করুন নিচে নামার সময়। স্টেশনে আপনাদের সাথে দেখা হবে আমার।
কথা শেষ করে ডি. কস্টার হাতে একটা রিজার্ভেশন টিকেট গুঁজে দিল কুয়াশা। আবার বলল, এখন থেকে মাত্র পনেরো মিনিট পর ট্রেন ছাড়বে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হয়ে যান।
ডি. কস্টা কিছু বলার আগেই কুয়াশা তার কাধ ধরে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিল তাকে।
ধাপ টপকে উপরে উঠতে উঠতে ডি. কস্টা দেখল কুয়াশা দৃঢ় ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিন্স রুডলফের দিকে।
ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির মাথায় উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল ডি. কস্টা।
রুডলফের পাশে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল সে, কী আশ্চর্য! আবার দেখা হয়ে গেল দেখছি।
বিদ্যুৎবেগে সিধে হয়ে দাঁড়াল রুউলফ। ঘাড় ফেরাল। দেখল ওভারকোটের ডান পকেটে ডান হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে তার পরম শত্রু কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, তুমিও কি এই হোটেলে অবস্থান করছ নাকি?
হাতের চুরুটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল রুডলফ। কুয়াশার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল সে গাভীর্য বজায় রেখে। বলল, না। এক বন্ধুর খোঁজে এসেছি।
বন্ধু তোমার আছে তাহলে?
রুডলফ হেসে উঠল। বাঁ হাত দিয়ে কুয়াশার ডান বাহু শক্ত করে ধরল সে, চলো বন্ধু, ওই কোণায় বসে আমরা কথা বলি।
করিডরের এক ধারে কয়েকটা চেয়ার এবং একটা টেবিল দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে টেনে নিয়ে চলল রুডলফ কুয়াশাকে। গায়ে গা ঠেকিয়ে হাঁটছে রুডলফ। ডান হাত দিয়ে কৌশলে সে চেক করে জেনে নিচ্ছে কুয়াশার শরীরের কোথায় কি আছে না আছে। রুডলফ জানতে চায় মূল্যবান পাথরগুলো কুয়াশা নিজের কাছে রেখেছে কিনা। বুঝতে পেরে হাসতে শুরু করল কুয়াশা। হাসতে হাসতে একফাঁকে রিস্টওয়াচটা দেখে নিল সে। ডাইনিংহল ত্যাগ করার পর দুমিনিট পার হয়ে গেছে। বড়জোর আর ছয় মিনিট অজ্ঞান অবস্থায় থাকবে ইন্সপেক্টর দুজন। এর মধ্যেই হোটেল ত্যাগ করতে হবে তাকে।
চেয়ার দখল করে মুখোমুখি বসল ওরী। রুডলফ পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বলল, তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না আমি।
সে তো ভাল কথা। যা বলতে চাও বলে ফেলো ঝটপট।
রুডলফ বলল, এইবার নিয়ে তিনবার হলো, তুমি আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে। তুমি যদি এভাবে বিরক্ত করতে থাকো, বাধ্য হব আমি এর একটা স্থায়ী সমাধান বের করতে।
অস্থায়ী ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করে সফল হওনি, স্থায়ীভাবে সমাধান বের করতে সফল হবে কি করে?
তার মানে?
কুয়াশা বলল, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চকে লেলিয়ে দিয়েছ–কি করতে পেরেছে তারা আমার, বলো?
রুডলফ বলল, অল্প সময়ের মধ্যে তোমাকে খুঁজে পাওয়া দরকার ছিল, তাই ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করি আমি। তুমি নিশ্চয়ই জানো, এদেশে আমার নাম বিশেষ একটা ওজন বহন করে।
জানি। জানি বলেই অবাক হয়ে ভাবছি তুমি চিৎকার করে পুলিস ডাকার চেষ্টা করছ না কেন এখনও?
রুডলফ হাসল। বলল, আমাকে কি বোকা মনে করো তুমি, মি. কুয়াশা? পুলিস ডেকে কি হবে? আমি জানি, পাথর ও গহনাগুলো তোমার দখলে নেই আর।
কুয়াশা মনে মনে চমকে উঠল। কিন্তু প্রকাশ্যে ভাব দেখাল, সে যেন রুডলফের কথার অর্থ ধরতে পারেনি। ঠাট্টা করছ মনে হচ্ছে?
রুডলফ হাসতে হাসতে বলল, হেডপোর্টারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সবকিছুই তার চোখে ধরা পড়ে এবং যা সে দেখে তা মনে গেঁথে রাখতেও পারে।
তার মানে?
রুডলফ ছড়িটা দুউরুর মাঝখানে রেখে হাতলে রাখল একদিকের গাল। বলল, হেডপোর্টার দেখেছে বেলা সাড়ে দশটার সময় একটা পার্সেল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাও তুমি। ফিরে আসো খানিক পরই। কিন্তু তখন তোমার কাছে পার্সেলটা ছিল না।
মৃদু হেসে কুয়াশা স্বীকার করল, সত্যি, সত্য আবিষ্কার করার জুড়ি নেই তোমার, রুডলফ।
কিন্তু কাজটা কি ভাল করেছ? ডাকযোগে সাত রাজার ধন কোথাও পাঠানো কি তোমার মত বুদ্ধিমানের কাজ হলো? বলল রুডলফ।
কি আর করব বলো। ভেবেচিন্তে দেখলাম, নিজেদের কাছে রাখাটা নিরাপদ নয়। তাই নির্দিষ্ট একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি পার্সেল। আমিই সেটা গ্রহণ করব সেই ঠিকানায় গিয়ে। আর কিছু কথা বাকি আছে তোমার, রুডলফ?
রুডলফ বলল, দেখো বন্ধু, এদেশে আরও দুএকদিন থাকতে হবে তোমাকে। কারণ, পার্সেলটা হস্তগত না করে যেতে চাইবে না, তুমি অন্য কোথাও। কিন্তু আমি ভাবছি, পার্সেলটা হাতে পাওয়ার পরও কি তুমি পালাতে পারবে?
এসব বাজে কথা আমি শুনতে চাই নাঃ কি পারব আর কি পারব না তা সময় এলে প্রমাণ হবে।
রুডলফ বলল, এদেশ ছেড়ে পালানো অসম্ভব, মি. কুয়াশা। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর দুজনকে তুমি বোকা বানিয়েছ, বোঝা যাচ্ছে। কিভাবে তাদেরকে ফাঁকি দিয়েছ আমি জানি না। জানার দরকারও নেই। কিন্তু তুমি যদি ভেবে থাকো যে ওই দুজনের মতই আর সবাই বোকা তাহলে মারাত্মক ভুল করবে। জার্মান পুলিস এবং জার্মান ডিটেকটিভদের খ্যাতি সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তারা ঠিকই সময় মত তোমাকে গ্রেফতার করতে সফল হবে।
কুয়াশা উঠে দাঁড়াল। বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, রুডলফ। প্রলাপ বকছ তাই।
এক মিনিট! মি. কুয়াশা, আমার কথা বিশ্বাস করো। জার্মান পুলিস এবং জার্মান ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চকে আমি এই মাত্র তোমার প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দিয়েছি। ইতিমধ্যে চারদিকে হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত তোমাকে গ্রেফতার করার জন্যে কয়েক লক্ষ মার্কের একটা পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। জনসাধারণ তোমাকে আটক করে পুলিসের হাতে তুলে দেবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠবে। কয়েক শত মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকে। অথচ প্রতি পদে বাধা পাবে। তুমি। তোমাকে ধাওয়া করবে হাজার হাজার মানুষ, সশস্ত্র পুলিসবাহিনী, বাঘা বাঘা ডিটেকটিভের দল। পালাবার কোন রাস্তা পাবে না তুমি। ধরা তোমাকে পড়তেই হবে।
চললাম, রুডলফ, বলল কুয়াশা।
রুডলফ প্রায় মিনতির সুরে বলে উঠল, মি. কুয়াশা! আমার একটা প্রস্তাব আছে।
কুয়াশা দাঁড়াল, প্রস্তাব? কি প্রস্তাব?
রুডলফ বলল, তোমাকে পালাবার সুযোগ করে দেব আমি। তোমার এবং তোমার দলের সকলের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেব আমি। পুলিস যাতে তোমার কাছ থেকে পাঁচ মাইল দূরে থাকে তার ব্যবস্থা করব আমি। নিরাপদে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করব, যেখানে খুশি তুমি যেতে চাও। মি. কুয়াশা, তুমি জানো এদেশে আমার ক্ষমতা কতটুকু। তুমি জানো যা যা বলছি তার সবই করা সম্ভব আমার পক্ষে।
শেষ করো তাড়াতাড়ি।
বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিচ্ছি আমি, মি. কুয়াশা। বিনিময়ে সব নয়, মাত্র অর্ধেক ভাগ দিই আমি মহামূল্যবান পাথরের।
প্রস্তাবে রাজি হলে আমার নিরাপত্তার জন্যে কি ব্যবস্থা করবে তুমি? জানতে চাইল কুয়াশা।
রুডলফ উৎসাহে, আনন্দে, উত্তেজনায় কাঁপছে। উঠে দাঁড়াল সে। বলল, তুমি শুধু রাজি হও, বন্ধ! তারপর দেখো, তোমার জন্যে কি না করতে পারি আমি। বাইরে অপেক্ষা করছে আমার গাড়ি। গাড়িটা এখন থেকে তোমারই দখলে রইল। আমি শপথ করে বলছি, জার্মানী থেকে তোমাকে নিরাপদে বের করে দেব…
দুসেকেণ্ড বাঁ হাতের আঙুলের দিকে চেয়ে থেকে কিছু যেন ভেবে নিল কুয়াশা, পরমুহূর্তে রহস্যময় একটু হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। রুডলফ, তোমার গাড়িটা পেলে সত্যি ভাল হয়।
রুডলফ দ্রুত পা বাড়াল, এসো। বলেছিই তো এখন থেকে গাড়িটা তোমারই।
কুয়াশা দীর্ঘ পদক্ষেপে দরজার দিকে এগোল। রুডলফ মাত্র পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি বিধায় কুয়াশার সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একটু পিছিয়ে পড়ল সে। ব্যবধান বার জন্যে চার-পাঁচ সেকেণ্ড পর পর দৌডুতে হচ্ছে তাকে।
দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা।
পিছন থেকে রুডলফ বলল, সত্যি, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। আমার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তুমি নিজেরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে, আমাকেও ঝামেলা থেকে বাঁচালে।
মৃদু হাসল কুয়াশা।
.
০২.
অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্রীম কালারের একটা রোলস রয়েস। অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে এঞ্জিনের আওয়াজ। গাড়িটা চকচক করছে। একেবারে নতুনই বলা চলে। ছাদটা উন্মুক্ত। ব্যাক সীটে দেখা যাচ্ছে একটা ওভারকোট। রুডলফ খুলে রেখে গেছে ওটা। শোফার অড্রো দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির বাইরে, দরজার কাছে।
আমি ড্রাইভ করব, বলল কুয়াশা।
দ্রুত হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে ফ্রন্ট সীটে উঠে বসল সে। একই সাথে বন্ধ হয়ে গেল দরজী। স্টার্ট দেয়াই ছিল গাড়িতে, মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে ছেড়ে দিল কুয়াশা গাড়ি।
রুডলফ তখনও দশ-বারো হাত পিছনে গাড়ির কাছ থেকে। শোফার বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে আছে, দেখতে পেল কুয়াশা।
গাড়িটা আচমকা যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে ছুটতে শুরু করল। রুডলফের চিৎকার শোনা গেল পিছন থেকে।
কুয়াশা ভিউমিররে তাকিয়ে দেখল শোফার অড্রো গাড়ির পিছু পিছু ছুটছে।
কিন্তু ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে অড্রো। কারণ, স্পীড প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে রোলস রয়েসের।
আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কুয়াশা। মাথার উপর হাত তুলে নাড়তে নাড়তে বিদায় জানাল সে রুডলফকে।
.
ডি. কস্টার মুখে কুয়াশার নির্দেশ, এবং ডাইনিংহলের ঘটনার কথা শুনে ওমেনা দ্রুত জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিয়ে বলল, রেজারটা নিয়ে আমার সামনে আসুন, মি. ডি. কস্টা।
রেজার নিয়া–কেন? ডি. কস্টা সন্দিহান চোখে চেয়ে রইল ওমেনার দিকে। নিজের অজান্তেই নিজের গলাটায় হাত বুলাল সে একবার।
ওমেনা অধৈর্য সুরে বলল, ক্ষুর দিয়ে আপনার গলা কাটব না, কাটব আপনার গোফ। চেহারা বদলানো দরকার। তাড়াতাড়ি করুন!
আত্মসমর্পণ করল ডি কস্টা। নিখুঁতভাবে ডি. কস্টার গোঁফ নামিয়ে দিল ওমেনা। বলল, এয়ারব্যাগে পরচুলা আছে, পরে নিন মাথায়। নকল ভুরু জোড়াও ভাল করে লাগিয়ে নিন। তারপর সানগ্লাস পরুন।
ওমেনা নিজেও ছদ্মবেশ নিতে ভুল করল না। তার ডান চোখের নিচে যোগ হলো একটা লাল জরুল, চুল হলো আরও লম্বা, দুদিকের গালগুলো টকটকে লাল, ভুরু হলো একটানা।
স্টেশনে নির্বিঘ্নে পৌঁছুল ওরা। প্ল্যাটফর্মে যেতে দু দুবার রেলওয়ে পুলিসের মুখোমুখি হতে হলো। বিপদ ঘটল না কোনরকম। রিজার্ভেশন টিকেট দেখাতে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেল ওরা।
পোর্টারই খুঁজে বের করল ওদের জন্যে নির্দিষ্ট কেবিনটা। একটা কেবিনে ছয়টা দীর্ঘ সীট। প্রত্যেকটা সীট রিজার্ভ করলে পুরো কেবিনটার দখল পাওয়া যায়। কুয়াশা অবশ্য তা না করে মাত্র তিনটে সীটই রিজার্ভ করেছে। সীটগুলোকে ঠিক সীট না বলে বেড বলাই ভাল, যে-কোন সাইজের মানুষ শুয়ে ঘুমাতে পারে।
কেবিনের পাশ দিয়ে সরু প্যাসেজ। অত্যাধুনিক ট্রেন। ট্রেনের এ-মাথা থেকে সে-মাথা পর্যন্ত যে কেউ যেতে-আসতে পারে। পাশাপাশি অনেকগুলো কেবিন। পাটেক্স জাতীয় জিনিস দিয়ে পাটিশন তৈরি করা হয়েছে।
পোর্টারকে বিদায় করে দিয়ে পাশাপাশি সীটে বসল ওরা। রিস্টওয়াচ দেখল ওমেনা, ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র তিন মিনিট বাকি। কিন্তু কোথায় কুয়াশা?
ডি কস্টা বলল, অপেক্ষা করুন, হামি ডেকিয়া আসি।
উঁহু! একা আপনাকে আমি ছাড়ছি না! যেতে হয় দুজন একসাথে যাব। হারিয়ে-টারিয়ে যান, খুঁজে বের করতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হোক তারপর?
কেবিন থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে এল ওরা। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকাল প্ল্যাটফর্মের এদিক ওদিক।
লোকে লোকারণ্য প্ল্যাটফর্ম। সবাই যে এই ট্রেনে যাবে তা নয়। পরবর্তী ট্রেনের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে বেশির ভাগ লোক। এই ট্রেনটা ছাড়ার পাঁচ মিনিট পরই হয়তো সেটা ছাড়বে। এই ট্রেনে যারা যাবে তারা প্রায় সবাই ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে টিকেট কেটে। যারা এখনও ওঠেনি, ছুটোছুটি করছে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়বার জন্যে। কুয়াশাকে প্ল্যাটফর্মের কোথাও দেখতে পেল না ওরা।
দেরির কি কারণ হতে পারে?
চিন্তিত দেখাল ওমেনাকে। ক্রমশ মান হয়ে উঠছে তার চোখমুখ।
ডি. কস্টা বলল, শেষবার যখন বকে ডেকলাম, টিনি কঠা বলিবার জন্যে ঘুঘু রুডলফের ডিকে যাইটেছেন। ঘুঘু ব্যাটা কোন ফাঁড়ে ফেলে নাইটো বকে?
দূর! বলল ওমেনা।
ডি. কস্টা বলল, হামারই ভুল। বসকে ফাঁড়ে ফেলিবে রুডলফ–ভাবটেও. হাসি পায়।
ওমেনা বলল, রুডলফের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি, কুয়াশার তা জানা দরকার। তা জানতে গিয়েই সম্ভবত সময় খরচা করছে সে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল দেড় মিনিট।
ডি. কস্টা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, লাস্ট মোমেন্টেও যদি বস্ আসিয়া না পৌঁছান?
ওমেনা বলল, এই ট্রেনেই থাকতে হবে আমাদের। তার নির্দেশ তো আর অমান্য করতে পারি না।
কিন্তু ট্রেন হামাডেরকে শটোশটো মাইল ডুরে লইয়া চলিয়া…
ওমেনা বলল, তা যাক। চলন্ত ট্রেনেই হয়তো তার দেখা পাব। মি. ডি. কস্টা, কে বলুন তো ওই লোকটা?
বেশ বয়স্ক লোকটা। মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ট্রেনে উঠবে। পরনে কোট, ওভারকোট।
নো, প্রিন্সেস! বস্ ছল্ডবেশ নিলেও হামি টাহাকে চিনিটে পারিবই।
ওমেনা বলল, তুমিও যেমন! আমি কি বলছি ওই লোক ছদ্মবেশী কুয়াশা? আমি রুডলফের কথা বলছি। লোকটা রুডলফ নয় তো?
ডি. কস্টা বলল, নো। রুডলফের বয়স অটো নয়। রুডলফ হইলে ওই সঁড়টা হইটে পারে।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো অপর একটি লোককে ইঙ্গিতে দেখাল ডি. কস্টা।
ওমেনা দেখল দশাসই লোকটার সারা মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ন, ডান চোখটা নেই, সেখানে গভীর একটা গর্ত।
ওমেনা বলল, মনে হয় না। দেখছেন না, লোকটার ডান চোখ নেই!
ডি. কস্টা সবজান্তার ভঙ্গি করে হাসল, ছড্ডবেশে আছে যে!
কেটে গেল আরও এক মিনিট।
ঘন্টাধ্বনি হলো। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেন ছাড়বে। কুয়াশার দেখা নেই কোথাও। ওদের ব্যাকুল দৃষ্টি প্ল্যাটফর্মের সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। নেই কুয়াশা।
অবশেষে ট্রেন ছাড়ল।
ডি. কস্টা বলল, বসকে ফেলিয়া কোঠায় যাইটেছি আমরা? এখনও সময় আছে প্রিন্সেস, আসুন, লাফ ডিয়া প্ল্যাটফর্মে নামি।
ওমেনা বলল, বাঁচতে হবে না তাহলে আর। ইলেকট্রিক ট্রেন, এরি মধ্যে ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল স্পীডে ছুটছে।
বস টাহা হইলে সট্যিই হামাডের সাঠে নাই? ডি. কস্টা রুদ্ধ কণ্ঠে বলল।
কে বলল আমি নেই? আমি সবসময় আপনাদের সাথেই আছি, মি. ডি. কস্টা।
চমকে উঠে জানালার বাইরে থেকে মাথা সরিয়ে এনে ঘাড় ফেরাল ওরা। দেখল ওদের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত এক লোক। সাদা একটা স্ট্র হ্যাট লটকাচ্ছে তার মাথার পিছনে, ডান চোখে একটা মনোকল আটকানো রয়েছে, ওভারকোটের বাটনহোলে মস্ত একটা লাল গোলাপ।
চিনতেই পারল না ওরা। কিন্তু চেহারাটা চেনা না গেলেও, কণ্ঠস্বরটা চেনা।
ডি. কস্টা বলল, বস না?
ওমেনা অভিমানে ঠোঁট ফোলাল, দুশ্চিন্তায় আমার মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে।
ছদ্মবেশী কুয়াশা হাসল, আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করো কেন?
ওমেনা বলল, তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা করব কেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছিল নিজেদের জন্যে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা। চুরুটের ছাই ঝেড়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরুল সেটা। বলল, আমি থাকতে নিজেদের জন্যেও কোনরকম দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই তোমাদের।
ওমেনা বলল, কোথায় ছিলে, কি করছিলে এতক্ষণ?
রুডলফের সাথে খোশ-আলাপ করছিলাম। ওমেনা, রুডলফ জেনে ফেলেছে স্টোনগুলো আমার কাছে নেই।
কেবিনে প্রবেশ করে সব ঘটনা ব্যাখ্যা করে বলল কুয়াশা। তিনজন বলল যে যার সীটে। বাকি তিনটে সীট খালি, কেউ রিজার্ভ করেনি।
ওমেনা বলল, তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। স্টোনগুলো কোথায় শুনি?
রুডলফকে সত্যি কথাই বলেছি আমি। বলার আগেই অবশ্য সত্য ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল সে। ডাকযোগে নির্দিষ্ট একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি পাথরগুলো একটা পার্সেলে ঢুকিয়ে। সেই নির্দিষ্ট ঠিকানাতেই যাচ্ছি আমরা। সেখানে গিয়ে ডেলিভারি নেব।
তার মানে রুডলফ আমাদেরকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে।
কুয়াশা বলল, করছেই তো! যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। কোটি কোটি ডলারের সম্পদ উদ্ধার করার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত বাজি রাখবে সে।
ডি. কস্টা সভয়ে বলল, সে যডি পুলিসের হাটে ঢারিয়ে ডেয় হামাডেরকে?
কুয়াশা হেসে উঠল। বলল, আর যাই করুক রুডলফ, পুলিসের হাতে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা সে করবে না। আমরা পুলিসের হাতে যাতে গ্রেফতার না হই বরং সে চেষ্টাই করবে সে। পুলিস আমাদেরকে ধরলে পোস্টাফিল থেকে পার্সেলটা ডেলিভারী নেবে কে? রুডলফ তো আর জানে না কোন্ ঠিকানায় পাঠিয়েছি আমি পার্সেলটা। পার্সেলটা আমি ডেলিভারী নেবার পর সে চেষ্টা করবে সেটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে। সুতরাং, পুলিসের হাতে আমাদেরকে ধরিয়ে দেবার কথা ভাবতেই পারে না।
ওমেনা বলল, রুডলফ তাহলে এই ট্রেনেই আছে?
কুয়াশা বলল, জানি না। তাকে আমি দেখিনি। তবে হোটেল কুর্কাজায় তার যে অনুচরটিকে তোমরা বেঁধে রেখে এসেছিলে, তাকে দেখেছি।
ডি. কস্টা বলল, একটা লোককে হামরা ডেকিয়াছি, ডান চোখ নাই, মুখে পক্সের ডাগ
কুয়াশা বলল, ফ্রিজ। সে-ও রুডলফের অনুচর।
ওমেনা বলল, দলবল নিয়েই আমাদেরকে অনুসরণ করছে তাহলে রুডলফ।
কুয়াশা বলল, দল আবার একটা নয়, আরও আছে।
পুলিসের কথা বলছ?
কুয়াশা বলল, পুলিস ছাড়াও আছে জোসেফ কাকোস। চোখে পড়েনি বুঝি? মুখভর্তি লম্বা দাড়ি লোকটার, নকল।
ওমেনা এবং ডি. কস্টা বলল, হ্যাঁ-হ্যা!
কুয়াশা বলল, রুডলফের কবল থেকে বাঁচিয়েছিলাম তাকে। সে-ও আছে এই ট্রেনে। এই কাকোসই সাত রাজার ধন চুরি করবার পরিকল্পনা করে। সে যাক, চোখ কান খোলা রাখলে ভয়ের কিছু নেই। ওমেনা, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় এটা নয়। ঘুরেফিরে দেখা দরকার শত্রুপক্ষ কে কি করছে।
কি করতে চাও?
কুয়াশা বলল, চলো, একবার টহল দিয়ে আসি গোটা ট্রেনটা।
ওমেনা বলল, খানিক পর। আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি।
ডি কস্টা জানতে চাইল, বল, হামরা টো কোলনে যাইটেছি! পার্সেলটা কি কোলনে হামাডের আগেই পৌঁছাইয়া যাইবে?
কুয়াশা বলল, ঠিক করে বলা কঠিন। আগেও পৌঁছে যেতে পারে। কিংবা দেরিও হতে পারে কিছু। অথবা, কে জানে, পার্সেলটা হয়তো আমাদের সাথে এই ট্রেনেই ভ্রমণ করছে। কিন্তু মজা কি জানেন, দুনিয়ার কোন ডিটেকটিভই প্রমাণ করতে পারবে না যে পাসের্লটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে। পার্সেলটা চিনে বের করাও কারও পক্ষে সম্ভব না। সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পার্সেলটা। প্যাকেটের ভিতরে আছে স্টোনগুলো। সাধারণভাবে পাঠিয়েছি পার্সেল, রেজিস্ট্রি করে নয়, কেউ যাতে গুরুত্ব না দেয় পার্সেলটাকে। যথাসময়ে যথাস্থানে ঠিকই পৌঁছে যাবে।
ওমেনা বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
কুয়াশা সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কি যেন বলতে গিয়েও বলল না সে। হঠাৎ পার্টেক্সের দেয়ালের দিকে চোখ পড়েছে তার। দেয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা গর্ত দেখে থমকে গেছে সে।
পাশের কেবিন থেকে সদ্য কেউ করেছে গর্তটা।
আমারও ঘুম পেয়েছে। কথাটা বলে দরজার দিকে পা বাড়াল কুয়াশা দ্রুত।
দুই লাফে দরজা টপকে প্যাসেজে বেরিয়ে এল কুয়াশা। দেখল দশাসই একজন লোক দৌড়ে পালাচ্ছে প্যাসেজ ধরে। ছুটল কুয়াশা। পাশের কেবিনের দরজা ঘেঁষে ছুটে যাবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে কেবিনটার ভিতর তাকাল সে।
সাথে সাথে গতি রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। কেবিনের ভিতর একজন লোক বসে রয়েছে। কোটের ভিতর একটা হাত ঢোকানো তার মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। লোকটা যেন মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করছে।
লোকটাকে দেখেই চিনেছে কুয়াশা। নকল দাড়ি লাগানো লোকটার মুখে। জোসেফ কাকোস।
কাকোস কেবিনের মাঝখানে বসে আছে। তীব্র যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে তার মুখের ফর্সা রঙ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
কুয়াশাকে দেখে অতি কষ্টে একটু হাসবার চেষ্টা করল কাকোস। ব্যর্থ হলো তার সে-চেষ্টা। মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল আরও। থেমে থেমে, হাঁপাতে হাঁপাতে। কাকোস বলল, বুড়ো শিয়ালের দিন শেষ হয়ে গেছে।
কেবিনে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে ভিড়িয়ে দিল কুয়াশা। এগিয়ে গিয়ে বসল কাকোসের পাশে। কাকোসের ডান হাতটা কোটের ভিতর, বুকের ক্ষতটা চেপে ধরে আছে সে সেই হাত দিয়ে।
কোটের বোতাম খুলে ক্ষতটা পরীক্ষা করল কুয়াশা। প্রথম দর্শনেই বুঝল সে, করার কিছু নেই তার। কাকোস মৃত্যুপথযাত্রী, তাকে ধরে রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
মাত্র একবার আপনাকে দেখেছি আমি, মি. কুয়াশা। আপনি আমাকে টরচার। মেশিন এবং শয়তান রুডলফের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন।
থরথর করে কেঁপে উঠল কাকোসের সর্বশরীর। বাঁ হাতটা মেঝেতে রেখে তাল সামলাল সে। বসে থাকার ক্ষমতা নেই, তবু বসে থাকতে চেষ্টা করছে সে। দ্রুত রক্তক্ষরণের ফলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে লোকটা।
দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই যে কাকোস আহত হয়েছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে কোটের ভিতর, কাপড়-চোপড়ের আড়ালে।
অথচ, আমি যদি আরও কদিন বাঁচতাম, আপনার সেই উপকারের বদলে আপনাকে আমি হয়তো খুন করার চেষ্টা করতাম, নিদেন পক্ষে আপনাকে লুট তত করতামই। দুনিয়াটা বড় স্বার্থপর, মি. কুয়াশা। স্বার্থের জন্যে মানুষ সব পারে। মি. কুয়াশা, আমার ওপর ঘৃণা হচ্ছে না আপনার?
কুয়াশা কাকোসের কাঁধে হাত রাখল আস্তে করে। না! মানুষকে আমি ঘৃণা করি না।
রুমাল বের করে কাকোসের কপালের ঘাম মুছে দিল কুয়াশা। অপলক চোখে কুয়াশার দিকে চেয়ে রইল কাকোস।
কে আপনি?
মৃদু একটু হাসল কুয়াশা, তোমার মতই একজন সাধারণ মানুষ।
কাকোস বিহ্বল কণ্ঠে বলল, বিশ্বাস করি না।
কুয়াশা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আমাদের কথা শুনছিলে কেন?
কাকোস বলল, আমি শুনছিলাম না, শুনছিল মারকোভিচ। কেবিনে ঢুকেই ওকে দেখে ফেলি আমি। দূর্ভাগ্যক্রমে পকেট থেকে রিভলভারটা বের করতে পারিনি ওর আগে। তা যদি পারতাম, তাহলে আজ ওকেই মরতে হত আমার বদলে। মি. কুয়াশা…।
কাশতে শুরু করল কাকোস। গল গল করে তাজা লাল রক্ত বেরিয়ে এল গলা, থেকে।
রুমাল দিয়ে মুছে দিল কুয়াশা কাকোসের ঠোঁট।
হঠাৎ কাকোস সিধে হয়ে বসল। দ্রুত বলল সে, ইন্সপেক্টর সাহেব, আসুন আসুন!
ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে কুয়াশা দেখল টিকেট ইন্সপেক্টর দরজা খুলে কেবিনে ঢুকছে। চোখে তার সন্দিহান দৃষ্টি। আপনারা মেঝেতে কেন বসে আছেন?
কাকোসের চোখমুখ থেকে যন্ত্রণার সব ছাপ উবে গেছে। প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সে। একটু হাসি ফুটল তার ঠোঁটে, আমার গুরু ভারতীয় ঋষি। গুরুর কাছে দীক্ষা নিচ্ছি।
টিকেট ইন্সপেক্টর মাথা ঝাঁকাল, বুঝতে পেরেছে যেন। বলল, টিকেটগুলো দেখান দয়া করে।
টিকেট চেক করে চলে যাচ্ছিল ইন্সপেক্টর। পিছন থেকে কাকোস বলল, ইন্সপেক্টর, আমি খুব অসুস্থ বোধ করছি। দয়া করে লক্ষ রাখবেন আগামী পাঁচ ঘণ্টা কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ব আমি।
ইন্সপেক্টর দোরগোড়া থেকে বলল, ঠিক আছে, স্যার।
ইন্সপেক্টর চলে যেতে কাকোস তীব্র, অসহনীয় যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে কুয়াশার উদ্দেশে বলল, শেষ মুহূর্তে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করলাম। আমার লাশ যখন আবিষ্কার হবে তখন আপনি বহুদূরে চলে যাবেন। মি. কুয়াশা:..।
পড়ে যাচ্ছিল কাকোস, তাকে ধরে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল কুয়াশা।
মি. কুয়াশা, স্টোনগুলো কোনমতে হাতছাড়া করবেন না। এগুলোর মধ্যে অমূল্য একটা ধন আছে, ব্লু ডায়মণ্ড…
কেঁপে উঠল কাকোসের শরীরটা থরথর করে, তারপর স্থির হয়ে গেল চিরতরে। কুয়াশা হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিল কাকোসের চোখের পাতা দুটো। ধীরে ধীরে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল হঠাৎ দরজার দিকে।
কেবিনে ঢুকল ডি. কস্টা এবং তার পিছনে ওমেনা।
ওই গড! মার্ডার!
ওমেনা ছুটে এসে কুয়াশার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল, কে! কে খুন করল?
.
০৩.
নিঃশব্দে প্যাসেজে বেরিয়ে এল কুয়াশা। ঢুকল নিজেদের কেবিনে। পিছু পিছু এল ওমেনা এবং ডি কস্টা।
একটা চুরুট ধরাল কুয়াশা। বসল নিজের সীটে। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
মার্কোভিচ ফ্রিজ আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছে আড়ি পেতে। কথায় কথায় তোমাদেরকে আমি বলেছি, এই ট্রেনেও স্টোনের পার্সেলটা থাকতে পারে। আমাদের কথা শোনার পর ফ্রিজ কি করবে এখন, বুঝতে পারছ ওমেনা?
ওমেনা বলল, পারছি। ট্রেনের যে ব্রেক-ভ্যানে পোস্ট অফিসের মালপত্তর যাচ্ছে সেখানে ঢুকে পার্সেলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে সে।
কুয়াশা উঠে দাঁড়াল, দেরি করলে সর্বনাশ ঘটে যাবে। ওমেনা, আমাকে দূর থেকে অনুসরণ করবে তুমি। আমি বিপদে পড়তে পারি। আমাকে বিপদে পড়তে দেখলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে যা করার কোরো। মি. ডি. কস্টা, আপনি এই কেবিনেই, খাকুন। বিশ মিনিটের মধ্যে ফিরব আমরা। যদি না ফিরি, মনে করবেন বিপদে পড়েছি। তখন যা ভাল মনে হয় করবেন।
কথা শেষ করে দীর্ঘ পদক্ষেপে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
ডি. কস্টার উদ্দেশে ওমেনা বলল, কুয়াশাকে শাসন করা আমার কর্ম নয়, বুঝলেন?
ডি. কস্টা সকৌতুকে হাসতে হাসতে বলল, কোঠায়, শাসন করিটে টো ডেকিলাম না একবারও?
ওমেনা রেগে গেল, শাসন করার চেষ্টা করে কি লাভ! ও কি আমার কথা শুনবে?
ডি. কস্টা ওমেনার হাতের লাল গোলাপটার দিকে আড়চোখে তাকাল। বলল, গোলাপটা মনে হইটেছে বসের বাটনহোলে ডেকিয়াছিলাম….?।
একটু যেন লজ্জা পেল ওমেনা। বলল, হ্যাঁ…মানে, ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি আমি…।
গোলাপ চাহিলেন, মণিমুক্টো চান নাই টো?
ওমেনা বলল, মানে?
ডি. কস্টা চোখ বুজে হাসতে লাগল। বলল, হামার ঢারণা, বস হাপনার বিবাহে মূল্যবান স্টোনগুনি উপহার ডিবে, টাই এটো চেষ্টা করিটেছে রুডলফের হাট হইটে জিনিসগুলিকে রক্ষা করিবার।
ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল ওমেনার। ডি. কস্টার ঠাট্টার উত্তরে কিছু বলতে না পেরে প্রায় ছুটেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে।
.
বগী এবং কেবিনগুলো পরীক্ষা করতে করতে এগোচ্ছে কুয়াশা। সবখানেই মানুষের– ভিড়, কিন্তু কোথাও রুডলফদের একজন অনুচরের ছায়াও দেখতে পেল না সে। সর্বশেষ কেবিন থেকে বেরিয়ে পা রাড়াল ব্রেক-ভ্যানের দিকে।
ব্রেক-ভ্যানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। হাতলের দিকে তাকিয়ে ওভারকোটের পকেটে হাত ভরল সে। শক্ত করে ধরল ওয়েবলি অটোমেটিকটা। কিন্তু অস্ত্রটা পকেট থেকে বের করল না সে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল একবার। কাউকে দেখতে পেল না। ওমেনাকেও না।
হাতল ঘুরিয়ে ঠেলা দিল কুয়াশা দরজার কবটে। খুলে গেল কবাট দুটো।
কুয়াশা দেখল ভ্যানের জানালাগুলো বন্ধ, ভিতরে আলো জ্বলছে। মেঝের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ছোট বড় নানা সাইজের অসংখ্য পার্সেল। বড় বড় ব্যাগগুলোর মাথা কেটে বের করা হয়েছে জিনিসগুলো। ভ্যানের মেঝের এক কোনায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে ইউনিফর্ম পরা একজন লোক।
লোকটা রেলওয়ে কোম্পানীর গার্ড, বুঝতে পারল কুয়াশা। কপালের মাঝখানে বুলেটের ফুটোটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে লোকটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়া। হয়েছে।
কয়েক পা এগিয়ে ভ্যানের মাঝামাঝি জায়গায় থামল কুয়াশা। এখানে সেখানে আরও বড় বড় পেট মোটা চটের বস্তা, চামড়ার ব্যাগ ইত্যাদি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর আড়াল থেকে কুৎসিত দর্শন মার্কোভিচ ফ্রিজ বেরিয়ে এল হাতে উদ্যত রিভলভার নিয়ে।
শব্দ শুনে ডান দিকে এবং বাঁ দিকে তাকাল কুয়াশা। দুজন দুজন করে আরও চারজন শক্র বেরিয়ে এসেছে।
মার্কোভিচের দিকে আবার তাকাল কুয়াশা। দেখল লোকটার কোটের সাইড পকেটটা অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে আছে।
এখানে কি করতে এসেছ, মি. কুয়াশা?
কুয়াশা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। বলল, ষে কাজে এসেছিলাম সে কাজ তোমরা আগেই সেরে ফেলেছ, রুডলফেরই জয় হলো দেখছি শেষ পর্যন্ত!
মার্কোভিচ বুলল, অন্যরকম কিছু আশা করেছিলে বুঝি?
কুয়াশা বলল, রুডলফকে আমার স্নেহ-ভালবাসা জানিয়ো। কোথায় দেখা হচ্ছে তার সাথে আবার তোমাদের?
মার্কোভিচের একমাত্র চোখটা ধক ধক করে জ্বলছে যেন। কথা আদায় করতে চাও, না? লাভ নেই। সব জেনেও লাভ নেই তোমার। হাতের মুঠোয় যখন পেয়েছি, বসের নির্দেশটা পালন করে ফেলি।
কুয়াশা দ্রুত চিন্তা করছিল। মার্কোভিচের চোখেমুখে লেখা রয়েছে, সে কুয়াশাকে খুন করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি। সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে সে, এ সুযোগ হাতছাড়া করে কোন বোকা?
ওভারকোটের পকেট থেকে গুলি করতে পারে কুয়াশা। মার্কোভিচকে মেরে ফেলা তার জন্যে কোন সমস্যাই নয়। কিন্তু মার্কোভিচকে খুন করেই বা কি লাভ?
মার্কোভিচ একা নয়। তার গুলির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই গর্জে উঠবে আরও তিনটে আগ্নেয়াস্ত্র।
নির্ঘাত মরতে হবে কুয়াশাকে।
ঝুঁকিটা বোকা ছাড়া আর কারও পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়।
সময় নষ্ট করার জন্যে কুয়াশা বলল, পার্সেলটা তাহলে পেয়ে গেছ?
পেয়েছি। তোমারই সাহায্যে। আড়ি পেতে তোমার কথা শুনে এখানে ছুটে আসি আমি…।
কুয়াশা বলল, দুদুটো মানুষকে খুন করেছ তুমি। শেষ পর্যন্ত পার পাবে বলে মনে করো?
মার্কোভিচ বলল, কে খুন করেছে কে জানে! পুলিশকে জানানো হবে কুখ্যাত দস্যু কুয়াশা ব্রেক ভ্যান লুট করে পালাবার সময় খুন করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষীও, দেবে।
চমৎকার! শব্দটা উচ্চারণ করে কুয়াশা তাকাল মেঝের দিকে। মেঝেতে কি যেন একটা জ্বলজ্বল করছে। তাকাতেই ছোট্ট একটা ডায়মন্ডের টুকরো দেখতে পেল কুয়াশা।
কুয়াশার দৃষ্টি অনুসরণ করে মার্কোভিচ এবং তার সঙ্গীরাও দেখল ডায়মন্ডের টুকরোটাকে।
জিনিসটা তোমাদের, হারিয়ে ফেলেছিলে! কথাটা বলে কুয়াশা দুপা সামনে বাড়ল। ঝুঁকে পড়ে কুড়িয়ে নিতে গেল সে ডায়মন্ডের টুকরোটাকে। তার সাথে একই সময়ে ঝুঁকে পড়েছে মার্কোভিচের একজন সঙ্গী।
দুজন এক সাথে হাতে বাড়াল দামী পাথরটার দিকে।
চোখের পলকে বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। বাঁ হাত দিয়ে মার্কোভিচের সঙ্গীকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের কাছে টেনে আনল সে। লোকটাকে না ছেড়েই লাফ দিল সে পিছন দিকে।
গর্জে উঠল মার্কেভিচের রিভলভার।
মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল গুলি।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা। বলল, আমাকে খুন করতে হলে তোমার সঙ্গীকে আগে খুন করতে হবে, মার্কোভিচ! এবং তা যদি তুমি করো, তোমার অপর তিন সঙ্গী তোমাকে ছাড়বে না, তোমাকে তারা যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।
কুয়াশার শরীরের সাথে ঝুলছে লোকটা। বুকের সাথে একহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে কুয়াশা তাকে। ঢালের মত কাজ দিচ্ছে লোকটা।
আরও এক পা পিছিয়ে এল কুয়াশা। বলল, মার্কোভিচ, তোমার পাওনা মেটাবার সময় নেই এখন। পরে পরিশোধ করব ঋণ। তৈরি থেকো।
ভ্যানের দোরগোড়ায় পৌঁছে লোকটাকে ছেড়ে দিল কুয়াশা, চোখের পলকে লোকটা ছুটল ভিতর দিকে।
দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে কুয়াশা বাইরে থেকে। এই সময় গুলি করল মার্কোভিচ।
মাত্র দুইঞ্চি ফাঁক রয়েছে তখন দরজার কবাট। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল বুলেট। কুয়াশার কানে গরম বাতাস ঢুকিয়ে দিয়ে ছুটে গেল সেটা।
পিছন থেকে দুটো হাত জড়িয়ে ধরল কুয়াশাকে।
কুয়াশা চাপা কণ্ঠে বলল, পালাও, ওমেনা।
ওমেনাকে নিয়ে ছুটল কুয়াশা। সামনে যে কেবিনটা পড়ল সেটায় ঢুকল ওরা। কোনদিকে না তাকিয়ে ট্রেনের ইমার্জেন্সী চেইন ধরে হেঁচকা টান মারল সে।
ট্রেন থামাতে চাইছে কুয়াশা।
চেইন টেনে ওমেনার দিকে তাকাল সে। দেখল, ওমেনা বোকার মত চেয়ে আছে একটা সীটের দিকে। কুয়াশাও তাকাল সেদিকে।
বুড়ীটা থরথর করে কাঁপছে। কুয়াশার হাতের রিভলভারটা দেখে ভয়ে মাখা খারাপ হয়ে গেছে তার। কুয়াশা তার দিকে তাকাতেই আতঙ্কে আর্তচিৎকার করতে করতে ঝড়ের বেগে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে।
ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে আসছে।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কুয়াশা বিপরীত দিকের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রেললাইনের পর গভীর বনভূমি দেখা যাচ্ছে।
ওমেনা, ট্রেন থামার আগেই নামতে হবে। গা ঢাকা দিতে হবে জঙ্গলে। ট্রেন থামা মাত্র রেলওয়ে পুলিস কুখ্যাত দস্যু কুয়াশাকে খেপা কুকুরের মত খুঁজতে শুরু করবে।
ওমেনা বলল, সে কি! রেলওয়ে পুলিস জানবে কিভাবে?
রুডলফের অনুচরেরা জানাবে তাদেরকে। প্রমাণ হিসেবে তারা দুদুটো লাশও দেখাবে।
.
০৪.
ওমেনা চলে যাবার পর কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করল ডি. কস্টা। সেটা বেশ সময় নিয়ে পরীক্ষা করল সে। পরীক্ষা শেষ করে পকেটে ভরতে যাবে, এমন সময় দরজায় নক হলো-ঠক্ ঠক।
রিস্টওয়াচ দেখল ডি. কস্টা। কুয়াশা গেছে মাত্র তিন মিনিট হয়েছে। এরি মধ্যে ফিরে আসার কথা নয় তার বসের।
কে তাহলে?
রিভলভারটা পকেটে আর ভরল না ডি কস্টা। নিঃশব্দ পায়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। বলল, হু?
মিষ্টি একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর বাইরে থেকে ভেসে এল। মি. কুয়াশা, দরজাটা দয়া করে একবার খুলুন।
ডি. কস্টার ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল। কিন্তু আর কোন প্রশ্ন না করে দরজাটা খুলে দিল সে। কেবিনে ঢুকল লম্বা এক আমেরিকান যুবতী। ডি. কস্টাকে দেখে নিয়ে কেবিনের চারদিকে দ্রুত তাকাল সে। বলল, মি. কুয়াশা কোথায়?
ডি. কস্টা বলল, আপনি কে? আর আপনার মি. কুয়াশাই বা কে? কে : পাঠাইয়াছে হাপনাকে?
মেয়েটি ডি. কস্টার আপাদমস্তক দেখল সকৌতুকে। বলল, আমি একজন : জার্নালিস্ট। নিউ ইয়র্ক থেকে যে সাইন্স মনিটর বের হয় আমি তার স্টাফ রিপোর্টার। বিজ্ঞানী মি. কুয়াশা এই ট্রেনে ভ্রমণ করছেন, আমি জানি। আমি তাকে এই কেবিনে দেখেছি।
কিভাবে চিনিলেন টাহাকে?
মেয়েটি বলল, বাংলাদেশে আমি বছর ছয়েক আগে গিয়েছিলাম মি. কুয়াশার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্যে। তার দেখা পাইনি বটে আমি, তবে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খানের সৌজন্যে মি. কুয়াশার একটা ছবি সংগ্রহ করেছিলাম। সেই একমাত্র ছবিটি সাইন্স মনিটরে অমন পঞ্চাশবার ছাপা হয়েছে গত ছবছরে।
মাই গড!
মেয়েটি বলল, মি. কুয়াশা বর্তমান পৃথিবীর জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু খুবই জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। মি. শহীদ খানের মাধ্যমে আমরা তাঁর গবেষণা সম্পর্কে মাঝে মধ্যে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি, কিন্তু সরাসরি মি. কুয়াশার সাথে আলাপ করার সুযোগ আমরা পাইনি। শুনেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তি তিনি। সে যাক, ট্রেনে ওঠার পর একটা গুজব কানে আসে আমার। শুনতে পাই, মি. কুয়াশা নাকি এই ট্রেনে ভ্রমণ করছেন। কথাটা শোনার পর চোখ-কান খোলা রাখি। এবং একসময় এই কেবিনের এক ব্যক্তিকে দেখে আমার সন্দেহ হয়, তিনিই মি. কুয়াশা। আমার সাথে তখন লোকজন ছিল বলে সন্দেহ নিরসনের জন্যে সরাসরি এখানে আসতে পারিনি।
ডি. কস্টা বলল, ভালই করিয়াছেন। হাপনি নিশ্চয়ই বুঝিটে পারিটেছেন, হামার ফ্রেণ্ড মি. কুয়াশার পরিচয় প্রকাশ হইয়া পড়িলে সর্বনাশ হইয়া যাইবে। টিনি টো আর শুঢ়ই বিজ্ঞানী নন, একাটারে টিনি বিজ্ঞানী, ডস, মার্ডারার, ক্রিমিন্যাল, ডুষ্টের যম।
সাংবাদিক মেয়েটি বলল, তাঁর সম্পর্কে আশ্চর্য সব, অবিশ্বাস্য সব কাহিনী শুনেছি। সত্যিই কি তিনি…
ডি. কস্টা বলল, আশ্চর্য! আপনার নামটাই জানা হয় নাই এখনও?
মেয়েটি বলল, আমি মিস পাপেট।
মিস পাপেট, হাপনি জার্মানীতে কেন আসিয়াছেন?
পাপেট বলল, জার্মানীতে আছি-আমি গত দুবছর ধরে। আমার পত্রিকার স্থায়ী প্রতিনিধি আমি এখানে।
বিবাহ করেন নাই কেন এখনও?
পাপেট হাসতে হাসতে বলল, মনের মানুষ পাইনি এখনও।
ডি. কস্টার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, দ্য সেম উইথ মি! আফ্রিকায় একবার ডজন খানেকের বেশি মেয়ের সাঠে বিবাহ বন্টনে আবড় হইয়াছিলাম বটে কিন্টু সেটাকে হামি বিবাহ বলিব না। মনের মটো একটি মেয়ের জন্য হামিও ওয়েট করিটেছি! মুশকিল কি জানেন মিস পাপেট, নিজের বিয়ের ঘটকালী নিজে করা যায় না…
বেশ জমে উঠল পাপেটের সাথে ডি. কস্টার।
পাপেট আমেরিকান সিগারেট খাওয়াল ডি. কস্টাকে। অনেক প্রশ্ন করল সে কুয়াশা সম্পর্কে। কিন্তু ডি কস্টা সব প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে গিয়ে রসিকতার মাধ্যমে পাপেটকে অন্যমনস্ক করে রাখল।
কথা বলতে বলতে একসময় পাপেট বলল, একি! মাঝ পথে ট্রেন থামছে কেন?
ডি কস্টাও অনুভব করল ব্যাপারটা। ট্রেনের গতি ক্রমশ মন্থর হয়ে আসছে। পাপেট ব্যস্তভাবে বলল, কেউ চেইন টেনেছে। মি. ডি. কস্টা, আপনার কি মনে হয় আপনার ফ্রেণ্ড মি. কুয়াশার কোন সম্পর্ক আছে এই ট্রেন থামার সাথে?
ডি. কস্টা বলল, আপনি যেখানে হামিও সেখানে–কেমন করিয়া বলি।
ব্যাপারটা দেখা দরকার। বলে, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল পাপেট। কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ডি. কস্টা রিস্টওয়াচ দেখল। বিশ মিনিট নয় মাত্র এগারো মিনিট হয়েছে কুয়াশা যাবার পর। বিশ মিনিট না কাটলে বসের ভালমন্দ জানার চেষ্টা করার দরকার নেই। বসের তাই নির্দেশ।
জানালার কাছে গিয়ে বসল ডি. কস্টা, তাকাল বাইরে। ভূত দেখার মত চমকে উঠল সে। গাছপালার আড়ালে স্কার্ট পরা ওমেনাকে পরিষ্কার দেখতে পেল সে। বনভূমিতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে রইল ডি কস্টা। স্বপ্ন দেখছে নাকি সে? এমন সময় সে দেখল কুয়াশাকে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হাত নাড়ছে বস্। ডাকছে তাকে বনভূমির ভিতর থেকে।
কাল বিলম্ব না করে জানালা গলে লাফিয়ে পড়া ডি কস্টা।
ট্রেন সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়ল।
.
০৫.
বনভূমিতে একুত্রিত হলো ওরা তিনজন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। ব্যস্ত-সমস্ত লোকজন নামছে, ছুটোছুটি করছে রেলওয়ে গার্ড এবং পুলিসরা।
রুডলফের অনুচররা লুট করেছে ব্রেক ভ্যান। স্টোনগুলো বেদখল হয়ে গেল।
ডি. কস্টা বলল, বলেন কি বস!
কুয়াশা উঁকি মেরে দেখছিল ট্রেনের পিছনে লোকজনের ভিড়টাকে। মার্কোভিচকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বক্তা সেই, প্যাসেঞ্জার এবং রেলওয়ের কর্মচারীরা শ্রোতা। সেই কি হাত-পা নাড়ার কায়দা মার্কোভিচের!
ওমেনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, কুয়াশার গুণাগুণ গাইছে লোকটা।
কুয়াশা বলল, আমাদের সাথেই যাচ্ছিল স্টোনের পার্সেলটা। সেটা এখন মার্কোভিচের পকেটে।
ডি কস্টা বলল, চিটকার করে এখান ঠেকে বলব নাকি কঠাটা পুলিসকে?
কুয়াশা হেসে ফেলল, গুলি খেয়ে মরার ইচ্ছা থাকলে চিৎকার করুন!
ওমেনা বলল, রেলওয়ে পুলিস জঙ্গলে ঢুকবে না তো আমাদের খোঁজে?
কুয়াশা বলল, কেউ দেখেনি আমরা দুদিকের জঙ্গলের কোন দিকে ঢুকেছি। দেখলেও, ওরা জানে জঙ্গলে খোঁজ করলেও আমাদেরকে পাওয়া যাবে না।
ট্রেনে কি রুডলফ আছে?
কুয়াশা বলল, না।
ডি. কস্টা বলল, হামরা কি পরাজিট হইলাম, বস?
কুয়াশা সবুজ নরম ঘাসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, কুয়াশা তার জীবনে কখনও পরাজিত হয়নি, এই একটা সুযোগ এসেছে পরাজিত হবার।
ওমেনা বলল, তার মানে এখনও তুমি আশা করছ আবার হাতের মুঠোয় ফেরত আনবে স্টোনগুলো?
কুয়াশা বলল, নীল ডায়মণ্ড! কাকোস বলে গেছে, নীল ডায়মণ্ডটা সত্যি অমূল্য ধন। আর অমূল্য ধনের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। ওমেনা, স্টোনগুলো আমার চাই-ই চাই!
কিন্তু…
কুয়াশা আপন মনে বলে চলেছে, নিশ্চয়ই স্টোনগুলোর মধ্যে অমূল্য কিছু একটা আছে। তা না হলে রুডলফ তার অনুচরদের নির্দেশ দেবে কেন সুযোগ পেলেই হত্যা করার?
রুডলফ কি সেই রকম নির্দেশ দিয়েছে?
কুয়াশা উঠে বলল, অবশ্যই দিয়েছে। মার্কোভিচ আমাকে খুন করতে যাচ্ছিল। কোন সাহসে? সে রুডলফের কাছ থেকে পরিষ্কার হকুম না পেলে বুঝতে পারছ না?
ডি. কস্টা বলল, ট্রেনে উঠিটেছে আবার সবাই।
কুয়াশা দাঁড়াল। ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হু।
মিনিট খানেক পরই ট্রেন ছুটতে আরম্ভ করল আবার।
কুয়াশা বলল, হাটা শুরু করা যাক এবার।
ডি. কস্টা প্রশ্ন করল, কিন্টু কোঠায়! কোঠায় এখন যাইব হামরা? কিভাবেই বা যাইব?
কুয়াশা বলল, রেলওয়ে পুলিস সংখ্যায় কম বলে জঙ্গলে ঢোকেনি তারা। মাত্র পনেরো মিনিট পর ট্রেন পৌঁছুবে ট্রিউবিটলিনজেন স্টেশনে। ওখানের পুলিস খবর পাবে সাথে সাথে। দলবেঁধে ছুটে আসবে পুলিসবাহিনী, জঙ্গল ঘিরে ফেলে খোঁজ করবে আমাদের। তার আগেই এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে আমাদের। তা ছাড়া, মার্কোভিচের সাথে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে–দেরি করাটা উচিত হবে না আর।
কথা শেষ করে হঠাৎ ডি. কস্টা এবং ওমেনার হাত ধরে এক পাশে টেনে সরিয়ে আনল কুয়াশা। চাপা কণ্ঠে বলল, চুপ! কে যেন আসছে এদিকে!
ঝোঁপ এবং গাছের ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে ওরা তাকিয়ে রইল। দশ সেকেণ্ড কাটল রুদ্ধশ্বাসে। তারপর দেখা গেল মেয়েটাকে।
ভয়ের কিছু নাই, ও পাপেট। হামার নটুন গার্ল ফ্রেণ্ড। নিউ ইয়র্কের সাইন্স মনিটরের স্টাফ রিপোর্টার।
কুয়াশা বলল, ট্রেনে পরিচয় হয়েছে বুঝি? নামটা যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে পড়েছে। বাংলাদেশে আমার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিল একবার। ব্যস্ত থাকায় দেখা করতে পারিনি। তা ও এদিকে কেন আসছে?
ডি. কস্টা বলল, জানিটে পারিয়াছিল, আপনি ট্রেনে আছেন। হয়টো সহে করিয়াছে বা ডেকিয়াছে হামরা জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছি।
ডি. কস্টা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে গেল। খানিক পরই পাপেটকে নিয়ে ফিরে এল সে।
কুয়াশাকে সামনাসামনি দেখে পাপেটের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। কথা বলার কায়দা রপ্ত করা আছে। হোমরা চোমড়া ব্যক্তিদের সাথে ওঠাবসা। কিন্তু কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে সে বাকশক্তি তো হারালই, চোখেমুখে ফুটে উঠল অপার বিস্ময়। মুগ্ধ, বিহ্বল দৃষ্টি চোখে।
মিস পাপেট, হাপনি মি. কুয়াশার সামনে উঁড়িয়ে আছেন, ডি. কস্টা ঘোষণা, করল।
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, কি দেখছেন অমন করে?
পাপেট ঢোক গিলে বলল, স্যার, দেখছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীকে। জীবন আমার সার্থক হলো আজ! স্বপ্নে কতবার দেখেছি আপনাকে। কী সৌভাগ্য আজ আমার, আপনাকে চাক্ষুষ করলাম। আপনি যে এমন হীরোইক চেহারার অধিকারী তা কিন্তু ছবি দেখে বুঝিনি! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীর হিসেবেও আপনাকে মানায়।
ডি. কস্টা মন্তব্য করল, আসলেও উনি টাই।
পাপেট বলল, সাইন্স মনিটরের জন্যে আপনার গবেষণার ধারা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব আমি সময় এবং সুযোগমত। কিন্তু ওয়াশিংটনের ক্রাইম ম্যাগাজিন দ্য ন্যাস্টি ওয়ার্ল্ড-এর জন্য আপনার সাক্ষাৎকারওঁ নেব আমি। দ্য হিসেবে আপনার কুখ্যাতি শুনেছি অনেক, শুনেছি আপনার উদার হৃদয় এবং মহত্ত্ব সম্পর্কে নানারকম বিচিত্র গল্প। এসব বিষয়ে আপনি আলোকপাত করলে চিরকাল বাধিত থাকব। স্যার, আপনাকে আমি বহুকাল ধরে পূজা করছি মনে মনে। আমি চাই আপনার আসল রূপ, প্রকৃত পরিচয় বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে…।
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল, আমার প্রকৃত পরিচয়টা তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। আমি একজন মানুষ, যে-কোন মানুষের মতই অতি সাধারণ। ভাল কথা, পাপেট, তোমার কাছে পরিচয়পত্র ইত্যাদি আছে তো? বিদেশে কাজ করার জন্যে একজন সাংবাদিকের যা যা দরকার সব আছে কিনা জানতে চাইছি আমি।
আছে বৈকি, স্যার!
কুয়াশা বলল, স্যার বোলো না। মি. কুয়াশাই যথেষ্ট। শুধু কুয়াশা বললে আরও খুশি হব আমি। ভাল কথা, ট্রেন থেকে যে নামলে, যাবে কিভাবে এখন গন্তব্যস্থলে?
পাপেট সুরেলা কণ্ঠে হাসল। বলল, মি. কুয়াশা, সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্যস্থান নেই। তাছাড়া, আপনার দেখা যখন পেয়েছি, আপনি যেখানে যাবেন সেটাই আমার গন্তব্যস্থান।
কুয়াশা একটু গম্ভীর হলো, আমি যাব বিপদের মধ্যে, কলহের মধ্যে, যুদ্ধের মধ্যে, খুন খারাবির মধ্যে। সেখানে প্রতিপদে মৃত্যুর ভয় আছে।
সাংবাদিকরা কোন ভয়কেই গ্রাহ্য করে না।
কুয়াশা বলল, কিন্তু এত বড় ঝুঁকি তুমি নেন, কেন?
পাপেট বলল, পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নেব আপনার, এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ, চমকপ্রদ একটা কাহিনীর আভাস পেয়েছি ইতিমধ্যে-সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে চাই আমি।
কুয়াশা বলল, কাহিনীটার শেষ কোথায় এখনও তা আমি জানি না। শেষ না হওয়া পর্যন্ত…।
শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে ছায়ার মত আছি আমি, মি. কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, খুবই জেদি মেয়ে তুমি, পাপেট। তবে প্রফেশনের প্রতি নিবেদিত বলে তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। কিন্তু ভেবে দেখো, আমাদের সাথে থাকলে যে-কোন মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। পুলিস আমাদেরকে খুঁজছে। ওদের চেয়ে ভয়ঙ্কর একটা দল লেগে আছে আমাদের পিছনে!
আমি স্বেচ্ছায় আপনার সাথে থাকছি, মি. কুয়াশা। আমার কিছু ঘটলে, কেউ সেজন্যে দায়ী হবে না।
কুয়াশা ওমেনার দিকে তাকাল, তুমি কি বলো, ওমেনা?
ওমেনা হাসতে লাগল, কথা বলার একজন মানুষ দরকার, পাপেটকে হাতছাড়া করার কথা ভাবতেই পারছি না।
মি. ডি. কস্টা, আপনার অভিমত?
ডি. কস্টা বলল, মিস পাপেট অবিবাহিটা, হামিও অবিবাহিট–দুজনের মঢ্যে মিল আছে-মিল-মহব্বট ঠাকিলে সহাবষ্ঠানে বাটা কোঠায়?
হাসি চেপে কুয়াশা ঘোষণা করল, আমাদের যাত্রা তাহলে শুরু হলো।
পকেট থেকে ম্যাপ বের করে চোখ বুলিয়ে নিল একবার কুয়াশা। ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল ম্যাপটা। বলল, আমাকে অনুসরণ করো।
বনভূমির ভিতর দিয়ে এগোল ওরা। সরু পায়ে চলা পথ পাওয়া গেল মিনিট পাঁচেক পরই। সকলের আগে কুয়াশা, তার পিছনে ডি. কস্টা। ওমেনা এবং পাপেট ওদের পিছনে, গল্প করতে করতে হাঁটছে।
পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে দলটা।
পিছন থেকে ডি. কস্টা প্রশ্ন করল, ফেরোশাস অ্যানিমেল নেই টো আবার এই ফরেস্টে?।
কুয়াশা বলল, নেই মানে! যে পথ দিয়ে হাঁটছেন এটা তো বাঘ-ভাল্লুকদের, তৈরি করা।
শুকিয়ে গেল ডি. কস্টার মুখ, ডিনের বেলাও কি উহাডের খিডা পায়, ব?
কুয়াশা গম্ভীর ভাবে বলল, খিদে পাক বা না পাক, কোর্মা-পোলাও দেখলে কিছু কিছু মানুষের যেমন জিভে পানি আসে, তেমনি কিছু কিছু জীব-জানোয়ারের বেলাতেও তাই। তবে ভয়ের কিছু নেই। আপনাকে কোর্মা-পোলাও বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
চলার গতি বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। সাথে থাকার জন্য প্রায় দৌড়ুতে শুরু করল ডি কস্টা, ওমেনা এবং পাপেট।
পনেরো মিনিট পর পাকা রাস্তায় উঠল কুয়াশা। ছোট একটা গ্রাম। গ্রাম না বলে শহর বলাই ভাল। ইলেকট্রিসিটি, গ্যাস-চালিত কারখানা, শ্রমিকদের আকাশচুম্বী কলোনি, ট্রাক-স্ট্যাণ্ড–সবই আছে।
বাক, নিতেই দেখা গেল পাশাপাশি বেশ কয়েকটা চা-খানা এবং মদের দোকান। সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে সাত টন পাঁচ টন মালবাহী ট্রাক। ড্রাইভার হেলপাররা ট্রাক থেকে নেমে সবাই ঢুকেছে উড়িখানায়।
ট্রাকের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নাও তোমরা, বলে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে স্যাত্ করে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা ট্রাকের ভিড়ের মধ্যে।
সাত মিনিট পর ফিরুল কুয়াশা।
ডি. কস্টা বলল, বসু, ওই যে স্টার্ট ডেয়া সাট টনী ট্রাকটা ডেকিটেছেন, উহা হামার এক বুজম ফ্রেণ্ডের ট্রাক। টাহার সাঠে গটো জন্মে আমার খুবই খাঁটির ছিল। টাহাকে না জানাইয়া ট্রাক নিলেও কিছু যায় আসে না! ইহাকৈ কি ঠিক ক্রাইম বলা যায়?
হাসি চেপে রেখে কুয়াশা বলল, মোটেই না। ভ্যাগ্যিস আপনার বন্ধুর ট্রাক ছিল এখানে। চলুন, চলুন!
স্টার্ট দেয়া ট্রাকটায় সোজা গিয়ে উঠল ডি. কস্টা। কুয়াশা শূন্যে তুলে নিল ওমেনাকে, নামিয়ে দিল ট্রাকের উপর। বলল, মেয়েরা, তোমাদেরকে তেরপলের ভিতর গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।
একই ভাবে পাপেটকেও ট্রাকের উপর তুলে দিল কুয়াশা।
ওমেনা তেরপলের ভিতর থেকে বলল, কুয়াশা, তেরপলের ভিতর বাক্সগুলোয় কি আছে জানো?
কি? ক্রাউন জুয়েল নয় তো?
তা নয়, তবে কম দামী জিনিসও নয় এগুলো। সর্বমোট পঞ্চাশটা বড় বড় বাক্স, প্রত্যেকটিতে হাভানা চুরুট ভর্তি।
কুয়াশা বলল, বাঁচা গেল! সারা জীবন আর না কিনলেও চলবে।
ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসল কুয়াশা। ট্রাক ছুটতে শুরু করল। ভিউমিররে তাকিয়ে কুয়াশা দেখল, কেউ লক্ষ করছে না ট্রাকটাকে, কেউ চিৎকার করে ছুটে আসছে না পিছু পিছু।
মাইল তিনেক একনাগাড়ে ছুটল ট্রাক। মাঝপথে হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড় করাল কুয়াশা যন্ত্রদানবকে।
ব্যাপার কি, বস?
কুয়াশা পায়ের কাছ থেকে একটা পোটলা তুলে নিল। ডি. কস্টা দেখল তেল কালি মাখা একজোড়া নোংরা প্যান্ট। এবং শার্ট বের করছে কুয়াশা পোটলা খুলে।
কোঠা হইটে বাহির করিলেন?
কুয়াশা বলল, যা পরে আছেন, খুলে ফেলুন। অন্য এক ট্রাক থেকে ড্রাইভারদের পোশাক চুরি করে এটায় রেখে দিয়েছিলাম।
একটা প্যান্ট এবং একটা শার্ট হাতে নিয়ে নিচে নামল কুয়াশা। দ্রুত খুলে ফেলল নিজের শৌখিন পোশাক। পরে নিল নোংরা কাপড়গুলো।
মি. ডি. কস্টা, একটা প্যাকেট আছে আপনার পায়ের কাছে, দিন ওটা।
ডি. কস্টাও ইতিমধ্যে পোশাক বদলে নিয়েছে। পায়ের কাছে হাতড়াতে শুরু করতেই প্যাকেটটা পেল সে।
কুয়াশা ডি. কস্টার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে জোর গলায় হাঁক ছাড়ল, মেয়ে নেমে এসো!
তেরপল সরিয়ে উঁকি দিল ওমেনা এবং পাপেট।
কুয়াশা হাতের প্যাকেট দেখিয়ে বলল, এটা নিয়ে ছোটো তোমরা পাশের জঙ্গলে। তোমাদের জন্যে কাপড়-চোপড় আছে। বদলে নাও। কুইক প্যাকেটের ভিতর সব কিছুই পাবে, চেহারা বদলে নিতে ভুলো না যেন।
নেমে এল ওমেনা এবং পাপেট। কুয়াশার হাত থেকে বড়সড় প্যাকেটটা নিয়ে ছুটল তারা জঙ্গলের দিকে।
কুয়াশা নিজের এবং ডি. কস্টার পরিত্যক্ত পোশাকগুলো একত্রিত করে ছুঁড়ে দিল সজোরে। জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সেগুলো।
তিনমিনিটের মধ্যে ফিরে এল মেয়েরা। খিলখিল করে হাসছে দুজনেই অকারণে। কুয়াশা ওদেরকে ধরে তুলে দিল ট্রাকের উপর। তেরপলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল লক্ষ্মী মেয়ের মত দুজনেই।
ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল কুয়াশা। ট্রাক আবার ছুটতে শুরু করল।
মাইল দুয়েক এগোবার পর ডি. কস্টা আচমকা ঘোষণা করল, পুলিস! ভ্যান লইয়া ঢাওয়া করিয়া আসিটেছে।
ভিউমিররে আগেই ব্যাপারটা চাক্ষুষ করেছে কুয়াশা। কিন্তু চেহারার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি তার। যেমন ট্রাক চালাচ্ছিল তেমনি ট্রাক চালাচ্ছে। যেন পুলিস দেখে ভয় পাবার কিছু নেই তার।
কাছাকাছি এসে পড়েছে পুলিস ভ্যান। সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাত নেড়ে জার্মান ভাষায় কি যেন বলছে ভ্যানের জানালা দিয়ে মুখ বের করে একজন পুলিস অফিসার।
কিন্তু পিছন দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না কুয়াশা। আপনমনে ড্রাইভ করছে সে। স্পীড যা ছিল তাই আছে। ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল।
পুলিস ভ্যান ওভারটেক করছে ট্রাককে। সুযোগ করে দিল কুয়াশা। ট্রাক, রাস্তার ধারে সরিয়ে নিয়ে। ভ্যান থেকে চিৎকার করছে লাল টকটকে অফিসার। ট্রাকের সামনে চলে গেল ভ্যান। গতি শ্লথ হচ্ছে ক্রমশ।
স্পীড কমাতে হলো কুয়াশাকেও।
একসময় দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিস ভ্যান। কুয়াশাও দাঁড় করাতে বাধ্য হলো ট্রাক।
ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নামল অফিসারসহ কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল। খেপে গেছে অফিসার। হাত ছুঁড়ে গালিগালাজ করছে সে কুয়াশাকে।
চলতি জার্মানে কুয়াশা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, অফিসার, আমি তো ট্রাফিক আইন অমান্য করিনি।
অফিসার চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, তোমরা ট্রাক ড্রাইভাররা বড় বেড়ে গেছ! এত করে গলা ফাটাচ্ছি, থামাওনি কেন ট্রাক?
কুয়াশার মুখে হাসি ফুটল। অফিসার, মাফ করবেন। আমি কানে একটু কম শুনি কিনা।
অফিসার অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলল, বিদেশী একদল ক্রিমিন্যাল পালাবার চেষ্টা করছে। দেখেছ তাদের?
কুয়াশা বলল, রোডের উপর আমরা ছাড়া..
দেখেছ কিনা জানতে চাইছি আমি। বাচাল কোথাকার!
না তো, স্যার। তেমন কাউকে দেখিনি।
অফিসার চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল। ছুটল সে ভ্যানের দিকে। অনুসরণ করল সশস্ত্র কনস্টেবলরা, লাফ দিয়ে উঠে পড়ল সবাই ভ্যানে।
ভ্যান ছুটতে শুরু করল আবার।
ছুটতে শুরু করল ট্রাকটাও। দেখতে দেখতে বাক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পুলিস ভ্যান।
ট্রাক ঘুরিয়ে নিল কুয়াশা। বলল, মাইলখানেক পিছিয়ে গিয়ে টার্ন নিতে হবে আমাদের। আমাদের গন্তব্যস্থান ট্রিউবিটলিজেন। পুলিস নিশ্চয়ই মার্কোভিচ ফ্রিজের কাছ থেকে জবানবন্দী নেবার জন্যে ট্রিউবিটলিনজেন স্টেশনে নামবে। কিন্তু ট্রেন তো আর অপেক্ষা করবে না মার্কোভিচের জন্যে। পরবর্তী ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে তাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, মার্কোভিচের ঋণ ট্রিউবিটলিজেনেই পরিশোধ করে দিতে পারব।
.
০৬.
ট্রিউবিটলিনজেন আর মাত্র মাইল তিনেক দূরে। এমন সময় ট্রাক দাঁড় করাল কুয়াশা। হাইওয়ে থেকে সরে এসেছে ট্রাক প্রশস্ত একটা মেঠো পথের উপর। ড্রাইভিং সীট থেকে নেমে হাঁক ছাড়ল সে, ওমেনা! পাপেট!
উঁকি দিল মেয়েরা তেরপল তুলে।
নেমে এসো!
কুয়াশার নির্দেশে নেমে এল ট্রাক থেকে ওমেনা এবং পাপেট।
ডি. কস্টা ট্রাকের সামনের সীটে বসে উঁকি দিয়ে তাকাচ্ছে। অকারণেই পাপেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সে।
পাপেট, তোমাকে কয়েকটা কাজ করতে হবে। ক্রাউন জুয়েল সংক্রান্ত ঘটনাটার রিপোর্ট সংগ্রহ করতে চাও তুমি, তাই না? কাহিনীটা সংগ্রহ করার জন্যে তোমাকে আমি সাহায্য করব, আমাকে তুমি সাহায্য করবে। রাজি?
পাপেট সহাস্যে বলল, এক পায়ে খাড়া!
এখান থেকে তোমরা মেয়েরা পায়ে হেঁটে ট্রিউবিটলিজেনে যাবে। সোজা স্টেশনে পৌঁছুবে তোমরা। ওমেনা ঢুকবে একটা রেস্তোরাঁয়। তুমি, পাপেট, টিকেট কেটে প্রবেশ করবে প্ল্যাটফর্মে। ঘুরে ফিরে দেখতে হবে তোমাকে রেলওয়ে পুলিসের কর্মতৎপরতা। মিনিট দশেকের বেশি ওখানে থাকবার দরকার নেই তোমার। মার্কোভিচ প্রকাগুদেহী একজন লোক, ট্রেন থামার সাথে সাথে যে রেলওয়ে পুলিসদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিল, মনে আছে তার কথা?
পাপেট বলল, আছে। ডান চোখটা নেই, মুখে পক্সের দাগ।
তার কথাই বলছি আমি। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে জানার চেষ্টা করবে, কোথায় আছে সে। আমার ধারণা, শহরের পুলিস হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। সে যাক, প্ল্যাটফর্ম থেকে যে তথ্যই পাও তুমি, ওখানে দশ মিনিটের বেশি সময় নষ্ট করবে না। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে তুমি সোজা যাবে শহরের পুলিস হেডকোয়ার্টারে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারে! কেন?
কুয়াশা বলল, ভয় পেলে নাকি? তুমি-জার্মানীতে একজন বিদেশী, আবাসিক সাংবাদিক-পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যেতে ভয় পাবার তো কিছু নেই!
কি বলব ওদেরকে আমি?
বলবে, যে ট্রেনে জেনারেল পোস্ট অফিসের মালামাল লুট হয়েছে তুমি সেই ট্রেনেই ভ্রমণ করছিলে। গুজব শুনেছ, মালামালের সাথে নাকি লুট হয়েছে ক্রাউন জুয়েল! সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের জন্যে তুমি তথ্য সংগ্রহ করতে চাও। এই হলো তোমার মূল বক্তব্য। মোটকথা, পুলিসদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। তোমাকে মার্কোভিচ এবং তার সঙ্গীদের কথা কতটুকু বিশ্বাস করেছে পুলিস, কোথায় আছে তারা, কিংবা কোথায় যাবার পরিকল্পনা করেছে। এসব তথ্য একমাত্র থানা হেডকোয়ার্টার থেকেই পাওয়া সম্ভব। তুমি যদি রাজি না হও, আমাদের মধ্যে থেকেই কাউকে না কাউকে যেতে হবে, তবে তোমাকে প্রস্তাব দেবার কারণ হলো, তুমি একজন সাংবাদিক। পুলিস তোমাকে সব কথা জানাতে কুণ্ঠিত হবে না।
পাপেট হাসতে লাগল। বলল, মি. কুয়াশা, অ্যাডভেঞ্চার আমার খুবই প্রিয়। আপনাকে ধন্যবাদ, এই রকম একটা সুযোগ করে দেয়ায়।
কুয়াশা বলল, থানা হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে সোজা তুমি পৌঁছুবে ওমেনার কাছে। আগেই বলেছি, ওমেনা অপেক্ষা করবে একটা রেস্তোরাঁয়, রেলওয়ে স্টেশনের কাছে। আমরা তোমাদেরকে সময় মত খুঁজে বের করে নেব।
পাপেট বলল, ঠিক আছে।
কুয়াশা বলল, গুড গার্ল! অ্যাণ্ড থ্যাঙ্ক, পাপেট!
ট্রাকের ড্রাইভিং সীটে গিয়ে উঠল কুয়াশা।
ছুটতে শুরু করল ট্রাক, দেখতে দেখতে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা।
.
ট্রিউবিটলিজেনে পৌঁছুল ট্রাক পাঁচটায়। শহরে থামল না কুয়াশা। শহর থেকে বেরিয়ে আরও মাইল সাতেক ছোটার পর দাঁড়াল ট্রাক একটা ব্যস্ত চৌমাথার কাছে। স্টার্ট বন্ধ করে নামল ওরা।
বাসস্ট্যাণ্ডে তেমন ভিড় দেখা গেল না। সাড়ে পাঁচটায় আবার ফিরে এল ওরা ট্রিউবিটলিজেনে। শহরটা বেশ বড়। লোকজনের চেয়ে যানবাহন বেশি। দেড় লাখ লোকের বসবাস। প্রাইভেট কারের সংখ্যা সম্ভবত ওই রকমই।
ময়লা কাপড়-চোপড় পরে শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা হঠাৎ প্রশ্ন করল, মি. ডি. কস্টা, ক্রাউন জুয়েলের ভাগ তো পাচ্ছেনওগুলো নিয়ে কি করবেন ঠিক করেছেন?
খানিক চিন্তা করে ডি. কস্টা বলল, টাইম পাইলাম কোঠায় যে ভেবেচিন্টে ঠিক করিব? টবে ডেখিয়া শুনিয়া মনে হইটেছে পুলিসের হাটে গ্রেফটার হইবার ভয়ে পালাইবার জন্য গাড়ি ভাড়া ডিটে ডিটেই হামার ভাগের সকল টাকা খরচ হইয়া যাইবে।
কুয়াশা শব্দ করে হেসে উঠল। পরমুহূর্তে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হলো সে। ডি. কস্টা দেখল, কুয়াশা কি যেন চিন্তা করছে গভীর ভাবে।
হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করে চোখ বুলিয়ে নিল কুয়াশা। মাপটা পকেটে রেখে দিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে।
শহরের অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং স্বল্পালোকিত এলাকায় পৌঁছুল ওরা। চওড়া একটা রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা বলল, চলুন, কিছু খেয়ে নেয়া যাক।
ফুটপাথের পাশেই একটা রেস্তোরাঁ। ভিতরে ঢুকল ওরা। একটা টেবিল দখল। করুল। বসল ফুটপাথের দিকে মুখ করে।
অর্ডার দিতে বেয়ারা রুটি-মাখন, ওমলেট, আর ফল-পাকড় দিয়ে গেল টেবিলে। খেতে শুরু করে কুয়াশা নিচু গলায় বলল, মি. ডি. কস্টা, রাস্তার ওপারে পুর্ব কোণায় ওই যে নতুন লাল রঙের দোতলাটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটাই হলো থানা হেডকোয়ার্টার।
গোগ্রাসে গিলছিল ডি. কস্টা। বিষম খেলো সে। দুচারবার ঢোক গিলে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। বলল, মিস পাপেট ওখান হইটে বাহির হইলে টাহাকে হামরা ডেখিটে পাইব, টাই না?
কুয়াশা বলল, কিন্তু আমাদের যা পোশাক, এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকা সম্ভব নয়। লোকে সন্দেহ করতে পারে।
পায়চারি করিব হেডকোয়ার্টারের সামনে?
কুয়াশা মাথা নেড়ে বলল, তাহলে চুম্বকের মত ভিতরে টেনে নেবে থানা হেডকোয়ার্টার আমাদেরকে।
টবে না হয়…
কুয়াশা বলল, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করুন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
বিল মিটিয়ে দিয়ে ফুটপাথে নামল আবার ওরা। পুব দিকে নয়, ফুটপাথ ধরে ডি. কস্টা অনুসরণ করল কুয়াশাকে পশ্চিম দিকে। ফুটপাথের ধারে পাশাপাশি অনেক দোকান-পাট। একটা চটের বস্তার দোকানে ঢুকে বড় সড় একটা বস্তা কিনল কুয়াশা। দোকান থেকে বেরিয়ে আবার এগোল সে। এরপর সে ঢুকল পুরানো লোহা লক্কড়ের একটা দোকানে। সেখান থেকে কিনল হাতুড়ি, প্লায়ার্স, ক্রু-ড্রাইভার। আর একটা দোকানে ঢুকে কিনল কিছু ইলেকট্রিক তার, রাবারের জুতো, রাবারের দস্তানা, টেস্টার ইত্যাদি।
শেষ দোকানটা থেকে বেরিয়ে কুয়াশা পুব দিকে হাটা ধরল।
ব্যাপার কি, বস্?
কুয়াশা মৃদু মৃদু হাসছে। বলল, এই শহরে ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই দেয়া হয়। মাটির নিচে দিয়ে। টানেলের ভিতর নামার জন্যে থাকে বড় বড় ম্যানহোল। ওই রকম একটা ম্যানহোল আছে থানা হেডকোয়ার্টারের সামনের রাস্তায়। ম্যানহোলটা ঢাকা দেখেছি লোহার জাল দিয়ে। ওটা দেখেই বুদ্ধিটা এসেছে আমার মাথায়।
কি রকম বুড়টি, বস?
আমরা ট্রিউবিটলিনজেন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাইয়ের কর্মী। মেরামতী কাজের জন্যে পাঠানো হয়েছে স্টেশন থেকে।
ফুটপাথে লোকজনের সংখ্যা খুবই কম। দোকান-পাটও দুটো একটা করে বন্ধ হতে শুরু করেছে। থানা হেডকোয়ার্টারের সামনেটা এমনিতেই স্বল্পালোকিত।
ম্যানহোলটার কাছে গিয়ে ভারি বস্তাটা সজোরে ফেল কুয়াশা। হাত নেড়ে নির্দেশ দিল ডি. কস্টাকে জার্মান ভাষায়, রীতিমত চিৎকার করে।
ডি. কস্টা বস্তা থেকে যন্ত্রপাতি বের করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজে লেগে গেল কুয়াশা। লৌহজালের ঢাকনিটা খুলে ফেলে ম্যানহোলের ভিতর নামল সে। দেহটা নামিয়ে দিয়ে শুধু মাথাটা রাখল রাস্তার উপর। ডি. কস্টার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চেয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে কাজ করার ভান করে যাচ্ছে সে।
আধঘন্টা কেটে যাবার পর ডি কস্টা মুখ খুলল, বস, ঘড়ি বলিটেছে সিক্স ঠার্টি।
কুয়াশা বলল, হু।
বসু, হামরা এখানে আসিবার আগেই মিস পাপেট ঠানা হেডকোয়ার্টার হইটে বিড়ায় নিয়া চলিয়া যান নাই টো?
কুয়াশা বলল, না। পৃথিবীর সব পুলিশ হেডকোয়ার্টারই এক রকম। সহজে এখানে কাজ আদায় করা যায় না। পাপেট হয়তো এখনও ওয়েটিং রূম থেকে ভিতরেই প্রবেশ করতে পারেনি।
ম্যানহোলের ভিতর মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে টুকটাক কাজ করার ফাঁকে তীক্ষ্ণ চোখে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে কুয়াশা গভীর-দর্শন লাল রঙের থানা হেডকোয়ার্টারের চেহারাটা। থানা হেডকোয়ার্টার, কিন্তু ব্যস্ততার কোন চিহ্ন নেই কোথাও। আলো জ্বলছে, জানালা গলে বেরিয়ে আসছে রশ্মি। মানুষজন যে ভিতরে আছে তার আর কোন প্রমাণ নেই।
চিন্তা-ভাবনাও করছে কুয়াশা। মার্কোভিচ পার্সেলটা উদ্ধার করেছে। এই আনন্দের সংবাদ সে তার মনিব রুডলফকে পাঠাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। সুযোগ যদি পেয়ে থাকে, ট্রিউবিটলিনজেন স্টেশন থেকে টেলিফোনে সুখবরটা পাঠিয়ে দিয়েছে সে রুডলফকে।
রুডলফ এখন কোথায়?
নিশ্চয়ই মিউনিকে। মিউনিক প্রকাণ্ড শহর। অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে সেখানে। কুয়াশা জার্মেনী ছেড়ে পালাতে পারে, এ ভয় রুডলফের মনে না জাগার কারণ নেই। পুলিস, সীমান্ত রক্ষী এদেরকে পরামর্শ দেবার জন্যে মিউনিকেই থাকার কথা তার।
কিন্তু মার্কোভিচের টেলিফোন পেয়ে রুডলফ কাল বিলম্ব করবে না। ছুটে আসবে পার্সেলটা গ্রহণ করার জন্যে এই ট্রিউবিটলিজেনে।
মাথা তুলে রাস্তাটা ভাল করে দেখে নিল কুয়াশা। ফুটপাথে লোক চলাচল কমে গেছে। দোকান-পাট প্রায় সবই বন্ধ। দূরে দেখা যাচ্ছে তিনটে মনুষ্য মূতিকে। সত্তর-পচাত্তর গজ দূরে বলে মূর্তিগুলোকে ভাল দেখতে পাবার কথা নয়। জায়গাটায় আলোর বড় অভাব। মূৰ্তিত্রয় কুয়াশার দৃষ্টি আকর্ষণ করল বিশেষ এক কারণে। ফুটপাথের উপর দিয়ে নয়, মৃর্তিত্রয় এগিয়ে আসছে রাস্তার উপর দিয়ে।
এটা একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। জার্মানরা সভ্য জাতি, রাস্তাঘাটে বেরিয়ে তারা আইন-কানুন মেনে চলতে চেষ্টা করে।
ডি. কস্টার দিকে তাকিয়ে কুয়াশা দেখল সে বসে বসে ঘুমে ঢুলছে। মুচকি হেসে কুয়াশা বলল, থানা হেডকোয়ার্টারের সামনে ঘুমানো কি উচিত হচ্ছে, মি. ডি. কস্টা?
ডি. কস্টা ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় পড়ল। চোখ মেলে বলল, কোঠায়, ঘুমাইটেছি না টো! গভীর চিন্টায় নিমগ্ন আছিলাম, বস!
কি চিন্তা করছিলেন?
ডি. কস্টা বলল, মি. সিম্পসনের কঠা। ভরলোক এমন একটা আটঙ্ক সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন আমার মনে যে টিনি যদি এই মুহূর্টে ট্রিউবিটলিজেন ঠানা হেডকোয়ার্টার হইটে ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া গর্জাইয়া উঠেন হ্যাণ্ডস আপ বলিয়া, হামি এতটুকু বিস্মিট হইব না!
কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছিল কুয়াশা মানুষ তিনজনের কথা। হঠাৎ আবার রাস্তার দিকে তাকাতে মাত্র বিশ গজ সামনে তাদেরকে দেখতে পেল সে।
স্থির হয়ে গেল কুয়াশার দৃষ্টি। রুদ্ধ হলো তার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া। শক্ত হয়ে উঠল শরীরের পেশী। মার্কোভিচ, একজন পুলিশ কনস্টেবল এবং তাদের মাঝখানে ওমেনা–তিনজন হাঁটছে থানা হেডকোয়ার্টারের প্রকাণ্ড গেটটার দিকে।
এমন একটা দৃশ্য, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না কুয়াশা। ওদের মাত্র দশ গজ সামনে দিয়ে হেঁটে গেল দলটা। গেটটা আর মাত্র পনেরো গজ দূরে।
বিদ্যুৎবেগে নড়ে উঠল কুয়াশার ডান হাত। পরমুহূর্তে ডি. কস্টা দেখল, ওয়েবলি অটোমেটিকটা বেরিয়ে এসেছে কুয়াশার হাতে।
বস! এবারের মত ব্যাটাকে ক্ষমা করিয়া ডিলে হয় না?
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল কুয়াশা। মার্কোভিচকে গুলি করতে যাচ্ছিল সে। উচিত হত না কাজটা। যদিও, পার্সেলটা উদ্ধার করার এই সুবর্ণ সুযোগ আর ফিরে আসবে না। মার্কোভিচের পকেটেই আছে সেটা। এই মুহূর্তে ইচ্ছা করলেই কুয়াশা সেটা উদ্ধার করতে পারে।
মৃদু একটু হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। দলটা গেট অতিক্রম করে হেডকোয়ার্টারে ঢুকে যাচ্ছে।
মার্কোভিচ জানল না, মি. ডি কস্টা, আপনি তার প্রাণ বাঁচালেন।
ডেখা হইলে জানাইয়া ডিব। বিনিময়ে কি ডেয় ডেখা যাইবে।
সশব্দে হেসে ফেলল কুয়াশা।
ডি. কস্টা বলল, প্রিন্সেসকে হেডকোয়ার্টার হইটে বাহির করা যায় কিভাবে, বস?
কুয়াশা বলল, বুঝতে পারছি না। আমাকেই হয়তো ঢুকতে হবে ভিতরে। নিজের চেষ্টায় বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। মার্কোভিচ গ্রেফতার করাতে সফল হয়েছে যখন, আটকে রাখার ব্যবস্থা করতেও সফল হবে সে।
কিন্টু বস, মার্কোভিচ কিভাবে ডেখা পাইল প্রিন্সেসের?
রুডলফের জন্য অপেক্ষা করছিল মার্কোভিচ স্টেশনের আশপাশে, ওমেনাকে সেই সময়ই দেখে সে।
ডি. কস্টা বলল, টার মানে, রুডলফও এই শহরে উপষ্ঠিট হইবে?
কুয়াশা বলল, রওনা হয়ে গেছে সে। পৌঁছুল বলে।
ঠিক সেই সময় দুটো হেডলাইটের আলো পড়ল এক সেকেণ্ডের জন্যে কুয়াশার মুখের উপর। সা করে ছুটে এল বিরাট একটা রোলস রয়েস। সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়াল সেটা ওদের কাছ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে।
রোলস-রয়েস থেকে নামল ছড়ি হাতে প্রিন্স রুডলফ।
.
০৭.
রুডলফের চোখমুখ উজ্জল হাসিতে উদ্ভাসিত। ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে গেট পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে থানা হেডকোয়ার্টারের ভিতর।
নিঃসাড় দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা ম্যানহোলের ভিতর। কথা নেই মুখে।
বস! চাপা কণ্ঠে ডাকল ডি. কস্টা।
সাড়া দিল না কুয়াশা। কিছু যেন ভাবছে সে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে থানা হেডকোয়ার্টারের দিকে। আবার ডাকল ডি কস্টা, বস্!
বিচিত্র একটুকরো হাসি ফুটে উঠল কুয়াশার ঠোঁটে। বলল, এর চেয়ে ভাল আর কি আশা করা যায়, মি. ডি. কস্টা?
হাপনার কঠা ঠিক ফলো করিটে পারিটেছি না, বস…।
কুয়াশা ম্যানহোল থেকে রাস্তায় উঠে ডি. কস্টার পাশে হাটু মুড়ে বসল। বলল, পাপেটও থানার ভিতর আছে। ওমেনা, মার্কোভিচ এবং এই মাত্র রুডলফও ঢুকল। অর্থাৎ, সবাই এখন এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। আমাদের কাজটা কি? পাপেট এবং ওমেনাকে উদ্ধার করা, এক নম্বর। রুডলফ এবং তার দালালকে শায়েস্তা করা, দুই নম্বর। পুলিসের কবল থেকে মুক্ত থাকা, তিন নম্বর। পার্সেলটা উদ্ধার করা; চার নম্বর। মি. ডি. কস্টা, কাজগুলো করতে হলে দেরি না করে এখুনি। আমাদের ঢোকা উচিত থানার ভিতর।
হোয়াট?
কুয়াশা বলল, পার্সেলটা থানার ভিতরই আছে। মার্কোভিচ জিনিসটা কোথাও রেখে আসতে পারে না সাহস করে। কিংবা কারও মাধ্যমে কোথাও পাঠাবার কথাও ভাবতে পারে না।
ঠানায় ঢুকিয়া হাপনি পার্সেলটা উডঢ়ার করিবেন?
কুয়াশা বলল, এছাড়া উপায় নেই, মি. ডি. কস্টা। ঘটনাচক্র আমাদেরকে বিরাট একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে যাচ্ছি আমরা।
কিন্টু …।
ছোটখাট একটা যুদ্ধ যে শুরু হতে পারে, আমি জানি, মি. ডি. কস্টা। কিন্তু ঝুঁকিটা আমাকে নিতেই হবে। ডেনমার্কের প্রিন্স রুডলফকে আমি পরাজিত করতে চাই আইনের লোকজনের সামনে। ওর মুখোশ আমি খুলে দেব, তা দিতে না পারলে ইউরোপ ত্যাগ করব না। মি. ডি কস্টা, থানায় ঢোকার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। রুডলফের গাড়িটা দরকার হতে পারে আমাদের অদূর ভবিষ্যতে। শোফারকে দেখতে পাচ্ছেন তো, আয়েশ করে সিগারেট টানছে রোলস-রয়েসের গায়ে হেলান দিয়ে?
ইয়েস, বস।
কুয়াশা ডি. কস্টার কানের কাছে মুখ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছু গোপনীয় নির্দেশ দিল। সেই সাথে পকেট থেকে বের করে দিল কিছু জিনিস।
বুক টান করে উঠে দাঁড়াল ডি কস্টা। পকেট থেকে বের করল একটা সিগারেটের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দুআঙুলে ধরল সেটা। সিগারেটে আগুন না ধরিয়েই কমেডিয়ানের মত আঁকাবাকা ভঙ্গিতে এগোল সে রোলস-রয়েসের দিকে।
দূর থেকে মনে হলো ডি. কস্টা একটা বদ্ধ মাতাল, নেশায় টলছে সে।
.
রুডলফের শোফার অড্রো তার সিগারেটে সুখটান দিয়ে অবশিষ্টাংশটা ফেলে দিতে যাবে, এমন সময় পদশব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। নোংরা কাপড় পরা ডি. কস্টাকে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল তার। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল ডি. কস্টা,, মুখে কিছু বলল না।
অড্রো দেখল ডি. কস্টার ঠোঁটে ঝুলছে একটা সিগারেট। সিগারেটটায় আগুন ধরানো হয়নি। ডি. কস্টার হাত বাড়ানোর অর্থ বুঝতে পেরে নিজের সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল সে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অড্রোর সিগারেটের আগুন থেকে নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ডি: কস্টা। পকেটে বাঁ হাত ঢোকানো ছিল তার, রুমাল সহ বের– করল সে সেই হাতটা হাঁটতে হাঁটতে।
অড্রো তাকিয়ে ছিল ডি. কস্টার দিকে। এমন নোংরা কাপড় পরা লোক বড় একটা দেখা যায় না। কৌতূহল জেগেছে তার ডি. কস্টাকে দেখে।
বল্প আলোয় অড্রো দেখল ডি. কস্টা পকেট থেকে রুমাল বের করার সময় একটা নিভাঁজ কাগজ পকেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার উপর পড়ল! বাসের ধাক্কায় সেটা অড্রোর দিকে সরে এল খানিকটা।
স্বল্প আলো হলেও, অড্রো কাগজটা দেখামাত্র চিনতে পারল। কাগজ নয়, নোট। একশো মার্কের কড়কড়ে একটা নোট।
দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল অড্রো। লোকজন আশপাশে তেমন নেই বললেই চলে। যার পকেট থেকে নোটটা পড়েছে, সে-ও পিছন ফিরে না তাকিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। হন হন করে এগিয়ে গিয়ে নোটটা রাস্তার উপর থেকে কুড়িয়ে নিল অড্রো।
সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ডি. কস্টার দিকে তাকাল সে। কিন্তু তার দৃষ্টি কেড়ে নিল আর একটা একশো মার্কের নোট। বাতাসের ধাক্কায় সেটাও সরে আসছে তার দিকে। ছুটল অড্রো। দ্বিতীয় নোটটাও কুড়িয়ে নিয়ে চট করে পকেটে ভরে রাখল সে।
এরপর আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! আনন্দে উত্তেজনায় চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলল অড়ো। সারা মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলে তিনশো মার্ক বেতন পায় সে। তার কাছে এক মার্কের মূল্যও অনেক। আর নোংরা পোশাক পরা লোকটার ছেঁড়া পকেট থেকে একের পর এক একশো মার্কের নোট রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে!
উন্মাদ হয়ে উঠল অড্রো। নোট কুড়াতে কুড়াতে গাড়ি ছেড়ে পঞ্চাশ গজ দূরে সরে গেছে সে। পকেটে এখন কটা নোট, হিসেব নেই তার। এগারোটা পর্যন্ত শুনেছিল, তারপর ভুলে গেছে সংখ্যাটা।
নোট কুড়াতে কুড়াতে অড্রো দেখল নোংরা পোশাক পরা লোকটা একটা অন্ধকার গলির ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত মনস্থির করার চেষ্টা করল অড্রো। লোকটার কাছে আরও অনেক নোট আছে, সন্দেহ নেই। অন্ধকার গলিতে গিয়ে যদি পিছন থেকে আক্রমণ করা যায়…
লোকটাকে কাবু করা মোটেই কঠিন নয়, ভাবল অড্রো। দুর্বল, রোগা লোক। ছুটল অড্রো অন্ধকার গলির দিকে।
গলিটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। ভিতরে ঢুকে গতি শ্লথ করল অড্রো। পায়ের শব্দ পেলে লোকটা পালাবার চেষ্টা করবে ভেবে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল সে।
একটা বাড়ির গেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছে অড্রো। গেটটা অতিক্রম করল সে, ডি. কস্টা বেরিয়ে এল গেটের আড়াল থেকে ঠিক অড্রোর পিছনে। নক্ষত্রের আলোয় অড্রোর মাথাটা দেখতে পাচ্ছে সে। মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে হাতের ভারি হাতুড়িটা দিয়ে অড্রোর মাথায় ঘা মারল ডি কস্টা।
কি ঘটল না ঘটল জানবার সুযোগ না পেয়েই জ্ঞান হারিয়ে ধরাশায়ী হলো অড্রো অন্ধকার গলিতে।
শত্রুকে নিপাত করে দিয়ে ফিরে এল ডি কস্টা অমানবদনে। টাকাগুলো বের করে নিতে ভুলল না।
অল ক্লিয়ার, বস্।
কুয়াশা বলল, রওনা হওয়া যাক তাহলে।
একযোগে পা বাড়াল ওরা.থানা.হেডকোয়ার্টারের দিকে।
.
গেটের পরই উঁচু করিডর। ফাঁকা। বাঁ দিকে একটা দরজা। স্টীলের শাটার। সেটা তোলা রয়েছে। ভিতরে ঢুকে পড়ল কুয়াশা। মাঝারি একটা রূম। মাঝখানে কাউন্টার। কাউন্টারের এপাশে দাঁড়িয়ে লোকজন তাদের অভিযোগ পেশ করে।
কাউন্টারের ওপাশে দুজন লোক। দুজনই কনস্টেবল। একজন সংবাদপত্র পড়ছিল, অপরজন তার দিকে পিছন ফিরে টেবিলে প্রায় মাথা ঠেকিয়ে ফাইল দেখায় মগ্ন।
অস্থির, উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল কুয়াশা, Machen Sie schnell! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, Ein kind ist von einem Motoirad angefahren worden!
সংবাদপত্রটা খসে পড়ল টেকো কনস্টেবলের হাত থেকে। ছোঁ মেরে হেলমেটটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সে। এস্ত পায়ে চেয়ার-টেবিলের মাঝ দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে কাউন্টারের ওপাশ থেকে এপাশে বেরিয়ে এল সে সুইংডোর ঠেলে।
কুয়াশা তার সাথে বাইরে বেরিয়ে যাবার ভান করে দুকদম এগোল, তারপর ডান পা বাড়িয়ে দিয়ে ল্যাং মারল লোকটাকে।
হুমড়ি খেয়ে পড়ল কনস্টেবল। ঘাড় ফিরিয়ে কুয়াশা দেখল ডি. কস্টা হাতুড়ি তুলে লক্ষ্য স্থির করছে লোকটার মাথার দিকে।
হাইজাম্প দিল কুয়াশা। কাউন্টার টপকে সরাসরি পড়ল সে দ্বিতীয় কনস্টেবলের ঘাড়ের উপর।
মাত্র চার-পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাগুলো। সিধে হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। দ্বিতীয় কনস্টেবলটা কিন্তু উঠল না। কুয়াশার ওজন সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে সে বিনা প্রতিবাদে।
স্টীলের আলমারি খুলে হ্যাণ্ডকাফ এবং ফাস্ট-এইড বক্স থেকে তুলো সংগ্রহ করল কুয়াশা। কনস্টেবল দুজনের হাতে-পায়ে ব্যাণ্ডকাফ লাগিয়ে দিল, মুখে গুঁজে দিল তুলল। তারপর অজ্ঞান দেহ দুটোকে একটা প্রকাণ্ড মেহগনি কাঠের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের নিচে চালান করে দিল।
অফিসের সর্ব দক্ষিণের একটা বন্ধ দরজা দেখিয়ে কুয়াশা চাপা স্বরে বলল, সম্ভবত ওটাই চার্জরূম। ওর ভিতরই সবাই আছে।
কুয়াশার কথা শেষ হলো না, বেজে উঠল বেল। সবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে একটা টেবিলের দিকে। ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে প্রাইভেট টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে।
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে টেলিফোনের সামনে হাজির হলো কুয়াশা। বিমৃঢ় দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু দৃঢ় হাতে রিসিভারটা তুলে নিল সে।
অপরপ্রান্ত থেকে ভারি গলায় কথা বলতে শুরু করল কেউ। বিরতি না নিয়ে কথা বলে গেল লোকটা। তার কথা শেষ হতে কুয়াশা শুধু বলল, Sofort!
রিসিভার নামিয়ে রেখে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। হাসি ফুটে উঠেছে তার মুখে। কথা না বলে করিডরে বেরিয়ে গেল সে এক ছুটে। টেলিফোনের তার বের করল খুঁজে। ডি. কস্টা সাহায্য করুল একটা কাঠের মই কাঁধে করে বয়ে এনে দিয়ে। টেলিফোনের সব তার কেটে দিয়ে অফিসরূমে ফিরে এল কুয়াশা। ডি. কস্টাকে চার্জরূমের দরজাটা দেখিয়ে বলল, আপনি কান পেতে শোনবার চেষ্টা করুন, কি কথাবার্তা হচ্ছে। আমি দোতলায় যাচ্ছি। ইনচার্জ অফিসার দোতলায় আছেন। ফোনে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন ওমেনা আর উইটনেসকে উপরে নিয়ে যাবার জন্যে।
হাপনি…?
অফিসারের কাছে যাচ্ছি আমি। সাবধানে থাকবেন। চার্জরূমের আরও দরজা আছে, খেয়াল রাখবেন সেদিকে। একান্ত প্রয়োজন দেখা না দিলে গুলি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসব আমি।
চোখের পলকে করিডরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। পাশাপাশি অনেকগুলো দরজা। একটা দরজার পাশ ঘেঁষে যাবার সময় লোকজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। অনুমানে বুঝল সে, চার্জরূমের অপর দরজা এটা একটা। দাঁড়াল না সে।
সময় এখন মহামূল্যবান। একটা সেকেণ্ড অপব্যয় করলে প্রাণটা খেসারত দিতে হতে পারে। পুলিস ভ্যান শহরে টহল দিচ্ছে তাদের দলের সন্ধান লাভের জন্যে যে কোন মুহূর্তে সেটা ফিরে আসতে পারে থানায়।
সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দ পায়ে দোতলায় উঠল কুয়াশা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা দরজা। কিন্তু মাত্র একটি থেকে বেরিয়ে আসছে আলোর রশ্মি।
দরজার কবাটে আঙুল দিয়ে টোকা মারল কুয়াশা। সাথে সাথে ভিতর থেকে ভারিক্কি কণ্ঠস্বরে হুকুম এল ভিতরে ঢোকার।
দরজা ঠেলে, পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা।
ধবধরে সাদা পাকা চুল, চারকোনা মুখ, মিলিটারিদের মত প্রশস্ত কাঁধের অধিকারী মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি এবং অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক অপর এক ব্যক্তি ডেস্ক থেকে মুখ তুলে তাকাল একযোগে।
ডেস্কের উপর ম্যাপ এবং কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো রয়েছে।
ওয়েবলি অটোমেটিকটা বাঁ হাতে নাচাতে নাচাতে সহাস্যে বলল কুয়াশা, আমার বিশ্বাস, আপনারা আমাকেই খুঁজছেন?
.
০৮.
দুই অফিসারের মধ্যে কেউই এতটুকু নড়ল না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল তারা। কুয়াশার আপাদমস্তক দেখছে তারা বিমূঢ় দৃষ্টিতে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল পাকা চুল, কি চান?
আলাপ করতে, বলল কুয়াশা। তারপর যোগ করল, তার আগে জানিয়ে দিচ্ছি, ফোনের তার কেটে দিয়েছি আমি। বাইরে থেকে কোন সাহায্য আপনারা পাচ্ছেন না।
তরুণ অফিসার কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কিভাবে ঢুকলেন আপনি?
হাসতে হাসতে কুয়াশা বলল, হেঁটে। দরজা তো খোলাই ছিল।
নড়ল না কেউ। কুয়াশা এবং কুয়াশার হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অফিসার দুজন।
কুয়াশার চোখেমুখে বিচিত্র হাসি খেলা করছে। বলল, আমি কুয়াশা, বাংলাদেশের সেই কুখ্যাত দস্যু, যার নাম শুনলে ইউরোপ ঘনঘন ঢোক গেলে।
পাকা চুলের চোখ দুটো অবিশ্বাসে না আতঙ্কে কে জানে, বড় বড় হয়ে উঠল। তরুণ অফিসার ঢোক গিলল বার কয়েক।
আপনারা পিছন ফিরে দাঁড়ান, মাথার উপর হাত তুলে। হ্যাণ্ডকাফ লাগাব আমি।
কিন্তু নড়ল না দুজনের একজনও।
কুয়াশার হাতে নাচছে ওয়েবলি অটোমেটিক।
কোনরকম ঝুঁকি নেবেন না, প্লীজ। আমি চাই না আমার হাতে আপনাদের মৃত্যু হোক। কিন্তু কোনরকম চালাকি করবার চেষ্টা করলে আপনাদের খুন না করে আমার অন্য কোন উপায় থাকবে না। আশা করি আমার সম্পর্কে সব কিছু জানা আছে আপনাদের। নিশ্চয়ই শুনেছেন, কথা না শুনলে আমি কাউকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিই না ভুল শোধরাবার।
নিঃশব্দে, বিনাবাক্যব্যয়ে, ঘুরে দাঁড়াল অফিসার দুজন মাথার উপর হাত তুলে।
ধন্যবাদ।
পকেট থেকে দুজোড়া হ্যাণ্ডকাফ বের করে অফিসারদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। পাকা চুলের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, হাত দুটো নামিয়ে পিছন দিকে আনুন।
পাকা চুল নির্দেশ পালন করল।
একেএকে দুজনেরই হাতে এবং পায়ে হ্যাণ্ডকাফ পরিয়ে দিল কুয়াশা। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। বলল, আমার কিছু কথা আছে, মন দিয়ে শুনুন। আপনারা যদি কথা দেন যে কোনরকম চিৎকার, দৃষ্টি আকর্ষণ করার কিংবা পালাবার চেষ্টা করবেন না তাহলে আপনাদেরকে আর কোনরকম কষ্ট না দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারি আমি।
পাকাচুল বলল, আর কোন কষ্ট দেবার দরকার আছে কি? আমাদেরকে বন্দী করাটাই কি যথেষ্ট নয়?
প্রথমেই না বললাম, এখানে আমি এসেছি কিছু আলাপ করতে। আলাপটা আপনাদের উপস্থিতিতে হোক, এই আমি চাই। কিন্তু শর্ত হলো, আপনারা থাকবেন সম্পূর্ণ নীরব শ্রোতা। আপনারা উপস্থিত থাকবেন বটে কিন্তু যার সাথে আমি আলাপ করব তার অজ্ঞাতে। অর্থাৎ, ওই বড় কাঠের আলমারির ভিতর লুকিয়ে থাকতে হবে আপনাদেরকে। ওর ভিতর আপনাদেরকে ঢুকিয়ে দেবার আগে আমাকে অবশ্য আপনাদের মুখে তুলো গুঁজে দিতে হবে। কোনও রকম ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
কার সাথে কি বিষয়ে আলাপ করবেন আপনি? জিজ্ঞেস করল তরুণ অফিসার।
সময় হলেই দেখবেন এবং নেবেন। আরও একটা শর্ত হলো, আলাপ শেষ হয়ে যাবার পর আমি বেরিয়ে যাব এই রূম থেকে। আমি রূম ত্যাগ করার পর আরও পাঁচ মিনিট থাকবেন ওই আলমারির ভিতর। বেরুবার চেষ্টা করবেন না, বা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করবেন না। রাজি আমার প্রস্তাবে?
রাজি না হলে?
কুয়াশা বলল, আমার ধারণা, আপনারা রাজি হবেন। রাজি না হলে আপনাদেরকে নিয়ে কি করব এখনও ভেবে ঠিক করিনি। করার অবশ্য অনেক কিছুই আছে। আপনাদের এই হেডকোয়াটারটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারি আমি। কিংবা রাশ ফায়ার করে সবাইকে পরপারে পাঠিয়ে দিতে পারি। কিংবা আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারি।
পাকাচুল বলল, ব্যস, ব্যস। আর শুনতে চাই না। দস্যু কুয়াশার পক্ষে সবই সম্ভব, তার সম্পর্কে এ যাবৎ যা শুনেছি। আমরা রাজি আপনার প্রস্তাবে, মি. : কুয়াশা।
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল, আপনি খুবই বুদ্ধিমান ব্যক্তি! ধন্যবাদ।
আলমারি খুলে ভিতরটা প্রায় ফাঁকা দেখা কুয়াশা। একজন একজন করে। দুজনকে শূন্যে তুলে আলমারির ভিতর নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল সে। দুজনের মুখেই খুঁজে দিল তুলো। বলল, মনে রাখবেন, আমার সব শর্ত মানবেন বলে কথা। দিয়েছেন। কথার একচুল এদিক ওদিক হলে, খুন করা ছাড়া আমার কোন উপায় থাকবে না। নিচে যাচ্ছি আমি, ফিরে আসব এখুনি। তারপর যাই ঘটুক, নীরবে শুনবেন আপনারা। আলমারির দরজা ইঞ্চিখানেক ফাঁকরইল, কার সাথে আলাপ করব দেখতেও পাবেন।
নিচে নেমে এল কুয়াশা দ্রুত। ডি. কস্টাকে নির্দেশ দিতে ছুটে বেরিয়ে গেল সে বাইরে। গেট বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল সে তখুনি। একে একে বন্ধ করল কুয়াশা আট দশটা জানালা এবং তিনটে দরজা। বাইরের জগতের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল জানালা দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়ায়। প্রত্যেকটি জানালা দরজায় স্টীলের শাটার আছে। সবগুলো নামিয়ে তালা মেরে দিল সে।
ডি কস্টাকে অফিসরূমের একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল সে, করিডরে যান। তিন নম্বর দরজাটা চার্জরমের অপর দরজা। ওখানে আপনি অপেক্ষা করুন। চাজরূমের ভিতর আমার গলার আওয়াজ শুনতে পাবেন একটু পরই। সাথে সাথে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করবেন। আপনার রিভলভারটায় সাইলেন্সর ফিট করে নিন। গুলি করে ভেঙে ফেলবেন তালা। কোন প্রশ্ন আছে?
ইয়েস বস। ঢরুন, আপনার এই নোংরা পোশাক ডেখিয়া যডি পুলিস অফিসাররা আপনাকে ডস কুয়াশা বলিয়া স্বীকার না করে?
স্বীকার করেইনি তারা, মি. ডি. কস্টা, প্রমাণও পেয়েছে।
টবে ঠিক আছে।
ছুটল ডি. কস্টা। বেরিয়ে গেল করিডরে।
অফিসরুমে ঢুকে চার্জরূমের দরজার কবাটে কান রাখল কুয়াশা। হাতে রয়েছে ওয়েবলি অটোমেটিক।
রুডলফের কঠিন কণ্ঠস্বর কানে ঢুকল কুয়াশার।
রুডলফ ওমেনাকে বলছে, মিস ওমেনা, আপনার বন্ধু যদি আপনার ভাল মন্দের খোঁজ-খবর না নেন সেটা কি অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হবে না?
ওমেনার সুরেলা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমি জানি না।
রুডলফ বলল, অথচ আপনি বারবার বলছেন, আগামীতে তার সাথে আপনার কোথায় দেখা হবে তা আপনার জানা নেই। জানা নেই কথাটার মানে কি, মিস ওমেনা?
ওমেনা বলল, জানা নেই কথাটার মানে, তিনি আমাকে জানাননি কোথায় গেলে তার সাক্ষাৎ পাব। আসলে, আমার বন্ধুর সাথে শেষবার যখন আমার দেখা হয়, আমি তার সাথে ঝগড়া করি। তাই রাগের মাথায় বিদায় নেবার সময় আমরা দেখা সাক্ষাতের ব্যাপারে কথা বলিনি।
রুডলফ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ঝগড়া? অপর ভদ্রমহিলা, মিস পাপেটকে নিয়েই কি আপনার সাথে আপনার বন্ধুর ঝগড়া হয়েছে?
ওমেনা জানাল, না।
তবে?
ওমেনা বলল, আমার বন্ধু আপনাকে ধুরন্ধর খেকশিয়াল, শিকারী কুকুর, গণ্ডারের মত একগুয়ে, পাঠার মত বোকা ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করছিল। আমি তাকে বলি, এতগুলো জন্তু-জানোয়ারের গুণ যার মধ্যে আছে তার সাথে কোন ভদ্রলোকের বিরোধ থাকতে পারে না। আমি তাকে আপনার সাথে না লাগতে অনুরোধ করি। কেননা, সেটা ভদ্রলোকের কাজ হতে পারে না কখনও। কিন্তু সে আমার কথায় কান দেয় না। তার সেই এক কথা, আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে…।
গর্জে উঠল প্রিন্স রুডলফ, দুঃসাহস! এত দুঃসাহস কোত্থেকে পাও তুমি দেখব আমি। পুঁচকে ছুঁড়ি, নিজের পজিশনটা ভেবে দেখ একবার। তিন তিনটে ক্রাইমের সাথে জড়িত তুই, অভিযোগ আনা হয়েছে। জেলে পচবি।
ওমেনা বলল, তাই নাকি!
রুডলফ বলল, এখনও সময় আছে। শেষ সুযোগটা দিচ্ছি আমি তোমাকে। রাজসাক্ষী হতে রাজি হও, সব অপরাধ ক্ষমা করা হবে তোমার। নিজেকে যদি এই বিপদ থেকে বাঁচাতে চাও, বলো কোথায় আছে কুয়াশা, কোথায় তার সাথে দেখা হবার কথা তোমার। তা না হলে আমি তোমাকে এমন শাস্তি দেব যে…
রাগে কাঁপছে রুডলফ, অনুমান করল কুয়াশা।
এবার শোনা গেল পাপেটের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, ইন্টারেস্টিং সংলাপ, প্রিন্স রুডলফ। আমার পত্রিকায় আমি এই ঘটনাটা রিপোর্ট করব। জার্মেনীর এক থানা কর্তৃপক্ষকে হাত করে ডেনমার্কের প্রাক্তন রাজার পুত্র প্রিন্স রুডলফ এক নিরীহ ভদ্রমহিলাকে হুমকি দিচ্ছেন তিনি নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে শাস্তি দেবেন। বিশ্বাস করুন, রিপোর্টটা প্রকাশ হলে সারা পৃথিবীতে হৈ-চৈ পড়ে যাবে।
রুডলফ কর্কশ কণ্ঠে বলল, মিস পাপেট, আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি…
আপনার উপদেশ আমার দরকার নেই, প্রিন্স। এখানে আমি একজন রিপোর্টার। হিসেবে উপস্থিত। আপনাদের তিনজনের কাজ যদি হয়ে থাকে একজন ভদ্রমহিলাকে বেআইনীভাবে হুমকি দিয়ে, গায়ের জোরে নিজেদের রাস্তায় আনা, তাহলে আমার কাজ হবে ঘটনাটার কথা গোটা দুনিয়ার লোককে জানিয়ে দেয়া।
নিস্তব্ধতা নামল চার্জরূমে।
কুয়াশা দরজার হাতল ঘুরিয়ে বাটে লাথি মারল।
চার্জরূমে ঢুকে সহাস্যে মৃদু কণ্ঠে বলল কুয়াশা, গুড-ইভনিং, গার্লস অ্যাণ্ড বয়েজ!
বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফেরাল একযোগে রুডলফ, মার্কোভিচ এবং পুলিস কনস্টেবল।
কয়েক মুহূর্ত কেউ নড়ল না। কেউ নিঃশ্বাস ছাড়ল না।
নিস্তব্ধতা ভাঙল ওমেনা। কুয়াশা!।
মৃদু হাসল কুয়াশা। বলল, হ্যাঁ, ওমেনা। আমি এসে পড়েছি।
বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে ছিল মার্কোভিচ। কুয়াশার চোখে ধরা পড়ল তার সামান্য, নড়াচড়া। ওমেনার দিকে তাকিয়ে আছে তখনও সে। কিন্তু গর্জে উঠল তার হাতের ওয়েবনি অটোমেটিক।
মার্কোভিচ পকেট থেকে বের করে এনেছিল লুগারটা। কিন্তু কুয়াশার দিকে তুলে ধরার অবকাশ পায়নি সে।
ওয়েবলি অটোমেটিকের গুলি লেগে মার্কোভিচের লুগারটা ছিটকে পড়েছে মেঝেতে।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা পায়ের শব্দে। দেখল ডি. কস্টা ঢুকছে অপর দরজা দিয়ে।
কুয়াশা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তাকাল রুডলফের দিকে, আরে! রুডলফ যে! ইস, কোথায় না খুঁজেছি তোমাকে!
.
০৯.
সবাই চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে। পুলিস কনস্টেবলটা আড়চোখে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। লুকাবার জায়গা খুঁজছে।
ওমেনা, লুগারটা কুড়িয়ে নাও। শত্রু-মিত্র বুঝে প্রয়োজনে গুলি চালাতে ভুলো না।
ওমেনা সাবলীল ভঙ্গিতে মার্কোভিচের গা ঘেঁষে হেঁটে গেল। লুগারটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে একদিকের দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।
মার্কোভিচ, তোমার ওই একমাত্র চোখটি বন্ধ করে। কেউ একচোখে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে আমার।
মার্কোভিচ নির্দেশ পালন করল। একমাত্র চোখটি বুজে ফেলল সে।
মি. ডি. কস্টা, শত্রুদের দেহ-তল্লাশী করুন।
ডি. কস্টা এগিয়ে গেল রুডলফের দিকে।
কুয়াশা এতক্ষণে তাকাল পাপেটের দিকে, রুডলফ কি কথা বলছিল, আমি বাইরে থেকে শুনেছি। আপনি একজন সাংবাদিক, তাই না?
পাপেট বলল, জী। আমার নাম পাপেট।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, এখানে তোমার আগমনের কারণ?
পাপেট বলল, আপনার ডাক চুরি হয়েছে–সেই ঘটনাটা বিস্তারিত জানবার জন্যে এখানে এসেছি আমি, মি. কুয়াশা। দয়া করে আপনি কি ঘটনাটা খুলে বলবেন আমাকে?
কুয়াশা বলল, বোন, তুমি উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত জায়গাতেই এসে হানা দিয়েছ। এখান থেকে বিদায় নেবার আগে তুমি এমন একটা কাহিনী সাথে নিয়ে যাবে যা ইউরোপে মহা শোরগোল তুলবে, এ নিশ্চয়তা তোমাকে দিচ্ছি। কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। এবং কথা দিতে হবে যাই ঘটুক না কেন, বাধা দেবার কোনরকম চেষ্টা তুমি করবে না।
পাপেট হাসল, তথাস্তু। আপনার কথা মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ই বা আর কি আছে?
রুডলফ এবং পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে দুটো রিভলভার উদ্ধার করল ডি. কস্টা। কুয়াশার নির্দেশে সে মার্কোভিচকে সার্চ করল।
মার্কোভিচের পকেট থেকে বের হলো আরও একটা রিভলভার এবং একটা ড্যাগার।
কুয়াশা জানতে চাইল, কি ব্যাপার, মি. ডি. কস্টা? মার্কোভিচের কাছে পার্সেলটা নেই নাকি?
ডি. কস্টা ম্লান মুখে বলল, কই, পাইলাম টো না!
কুয়াশা গম্ভীর হলো। বলল, মার্কোভিচ।
দশাসই মার্কোভিচ তার একমাত্র চোখটির পাতা খুলে কুয়াশার দিকে তাকাল।
আমার সামনে এসে দাঁড়াও।
এগিয়ে এল মার্কোভিচ। কুয়াশা তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে তাকিয়ে রইল। তারপর অকস্মাৎ বাঁ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রচণ্ড একটা ঘুসি চালাল।
আত্মরক্ষার স্বাভাবিক তাগিদে সবেগে পিছিয়ে গেল মার্কোভিচ, দুলে উঠল তার গোটা শরীর। শব্দ উঠল পাথরের সাথে পাথরের সংঘর্ষের।
হোঃ হোঃ করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল কুয়াশা।
ঘুসি চালিয়েছিল বটে কুয়াশা, কিন্তু আঘাত করেনি সে মার্কোভিচকে। ভয় দেখাবার জন্যেই ঘুসিটা চালিয়েছিল সে। জানত, মার্কোভিচ লাফ দিয়ে পিছিয়ে যাবে।
তাই হলো। মার্কোভিচ লাফ দিতেই পাথরের সাথে পাথরের ধাক্কা লেগে শব্দ উঠল।
মার্কোভিচ, আণ্ডার প্যান্টের ভিতর থেকে বের করো মহামূল্যবান স্টোনগুলো।
ধরা পড়ে যাওয়ায় শুকিয়ে গেছে মার্কোভিচের মুখ। প্যান্টের চেইন খুলে আণ্ডারঅয়্যারের পকেট থেকে রুমালে জড়ানো মহামূল্যবান পাথরগুলো বের করে দিল সে।
পিছিয়ে গিয়ে আগের জায়গায় দাঁড়াও। চোখটা বন্ধ করে রাখতে ভুলো না। যেন আবার। কুয়াশা রুমালের পোটলাটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফতে লুফতে বলল।
মার্কোভিচ স্বস্থানে ফিরে যেতে কুয়াশা রুডলফের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রুডলফ, বুঝতে পারছ তো এসবের অর্থ? খেলা খতম বন্ধু, পয়সাও হজম।
রুডলফ নির্বিকার ছিল এতক্ষণ। কুয়াশার কথা শেষ হতে হাসল সে। জানতে চাইল, এখন কি করতে হবে আমাকে? তোমার পায়ে চুমো খেতে হবে নাকি?
কুয়াশা ডি. কন্টার দিকে তাকাল, আপনি এদিক-সেদিক থেকে খুঁজে বের করুন কিছু হ্যাণ্ডকাফ। রুডলফ এবং মার্কোভিচের জন্য দুটো। পুলিস মিয়াসাবের জন্য একজোড়া। রুডলফ এবং মার্কোভিচকে হাঁটাব, তাই পায়ে হ্যান্ডকাফ এখনই লাগাতে পারছি না।
ইয়েস, বস্।
খোঁজাখুঁজি করতেই আবিষ্কৃত হলো কয়েক জোড়া হ্যাণ্ডকাফ। কনস্টেবলকে বন্দী করল ওমেনা। ডি কস্টা রুডলফ এবং মার্কোভিচের হাতে পরাল হ্যাণ্ডকাফ।
রুডলফের চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। হাসতে হাসতে জানতে চাইল সে, হাঁটাবে মানে? কোথায় যেতে হবে আমাকে?
কুয়াশা বলল, এ প্রশ্ন করছ কেন? জরুরী কোন কাজ আছে বুঝি, যেতে পারবে না?
রুডলফ শব্দ করে হেসে উঠল, রসিক বন্ধু, তোমার রসিকতা করার ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন জ্ঞান লাভ করছি আমি।
কুয়াশা বলল, ধন্যবাদ। আমরা দোতলায় বেড়াতে যাব, রুডলফ। ওখানে তোমার সাথে কিছু কাজের কথা নিয়ে আলাপ করার ইচ্ছা রয়েছে আমার।
রুডলফের বাঁ দিকের ভুরুটা কপালের দিকে আধ ইঞ্চিটাক উঠে গেল। চিন্তা করছে সে, কুয়াশার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে।
কুয়াশা তাকে সময় না দিয়ে বলল, চলো, রুডলফ, যাওয়া যাক। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
সিঁড়িতে সবার আগে ওমেনা এবং পাপেটকে দেখা গেল। ওদের পিছনে কুয়াশা। কুয়াশার পিছনে রুডলফ এবং মাকোভিচ। সকলের শেষে ডি. কস্টা। তার দুহাতে ধরা দুটো লোডেড রিভলভার।
পুলিশ কনস্টেকলটাকে চার্জরূমের টেবিলের নিচে ফেলে রেখে আসা হয়েছে।
দোতলায় উঠল সবাই।
পুলিস চীফের দরজা খুলে কুয়াশা বলল, ভিতরে ঢোকো, রুডলফ।
সকলের শেষে রূমে ঢুকল কুয়াশা। বলল, সবাই বসো চেয়ার টেনে নিয়ে। এটা একটা জরুরী বৈঠক।
সকলের আগে রুডলফ বসল চেয়ারে। সর্বক্ষণ চেয়ে আছে সে কুয়াশার দিকে। বোকা বোকা হয়ে উষ্ঠেছে রুডলফের চেহারা। কুয়াশার উদ্দেশ্য যে কি ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না সে।
রুডলফের মুখোমুখি বসল কুয়াশা। বাকি সবাইকে বসতে বললেও কেউ বসল না।
কুয়াশা রুডলফের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো রুডলফ, মূল্যবান পাথরগুলোকে নিয়ে যা ঘটল তা সত্যিই মর্মান্তিক। এই ঘটনাটার মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার আছে যার রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি। আমি চাই, তুমি সব রহস্য উন্মোচন করো।
রুডলফ এখন আর হাসছে না। বলল, বলো, কি জানতে চাও।
কুয়াশা বলল, রুডলফ, সবাই জানে, তুমি একজন ধনী লোক। টাকা-পয়সা বা সয়-সম্পত্তির অভাব নেই তোমার। কিন্তু তবু, কেন তুমি মাত্র সত্তর আশি লক্ষ ডলারের পাথরের জন্যে এমন হিংস্র হয়ে উঠলে? ব্যাঙ্কে তোমার যা টাকা আছে, তার হাজার ভাগের এক ভাগ তুলে যদি মার্কেটে যাও, এই পাথরগুলোর চেয়ে ভাল এবং পরিমাণে বেশি পাথর কিনতে পারো তুমি। কিন্তু তা না করে তুমি এই নামমাত্র মূল্যের পাথরগুলো জোসেফ কাকোসকে দিয়ে চুরি করালে কেন? কেন তারপর কাকোসের সাথে বেঈমানী করার চেষ্টা করলে? পরে কেন কাকোসকে মার্কোভিচকে দিয়ে খুন করালে? তার আগে, কেনই বা হোটেল কুর্কাজায় খুন করালে বিজিম্যানকে? এমিলা নামের তোমার এক অনুচরকেও তুমি খুন করেছ কেন? কেন? কেনই বা তুমি আমাকে এবং আমার বন্ধু-বান্ধবকে মিথ্যে অভিযোগে ফাসাতে চেষ্টা করলে?
রুডলফ হাসতে লাগল।
কুয়াশা বলল, হাসছ কেন? তুমি কি অভিযোগগুলো অস্বীকার করছ?
রুডলফ হাসতেই লাগল। উত্তর দিলনা।
কুয়াশা বলল, প্রথম হত্যাকাণ্ডটির কথা ধরা যাক। লোকটার নাম বিজিম্যান। কাকোসের অনুচর ছিল সে। কাকোসের কাছেই যাচ্ছিল, পথে তাকে তিনজন পুলিস পাকড়াও করে। আমরা পুলিসগুলোকে চিনতে না পেরে, বিজিম্যানকে নিরীহ ভিক্টিম মনে করে, তাদেরকে ফেলে দিই নদীতে। এটা একটা ভুল, শত্রুতা নয়। বিজিম্যানকে হোটেলে আমাদের স্যুটে নিয়ে আসি। সেখানে তোমার অনুচর তাকে খুন করে, আমাদের অজ্ঞাতে। তোমার অনুচররা কি তোমার কাছ থেকে অনুমতি পায়নি খুন করার?
রুডলফ বলল, খুনটা করে এমিলো। না, তাকে আমি নির্দেশ দিইনি খুন করার। নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে এমিলোকে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছি আমি।
কুয়াশা বলল, মার্কোভিচ ট্রেনের ব্রেক-ভ্যান লুট করে। তার সাথে তোমার আরও চারজন অনুচর ছিল। তারা ব্রেক-ভ্যান থেকে পার্সেলটা হস্তগত করে। পার্সেলে ছিল মহামূল্যবান পাথরগুলো। যে গুলো তুমি কাকোসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও, এবং আমি তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিই। সে যাই হোক প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ট্রেন থেকে নেমে আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করি। এই সুযোগে মার্কোভিচ রেলওয়ে পুলিসের কাছে আমাদের নামে মিথ্যে অভিযোগ করে। মার্কোভিচ পুলিসকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে আমরাই খুন করেছি কাকোসকে এবং আমরাই ব্রেক-ভ্যান লুট করেছি।
রুডলফ বলল, পুরানো প্যাচাল বাদ দিলে হয় না, মাই ডিয়ার মি. কুয়াশা? আমি কি অস্বীকার করছি কিছু? ভুল হয়ে গেছে কোন কোন ক্ষেত্রে…
স্বীকার করছ তাহলে সব অভিযোগ?
তুমি তো সবই জানো, তোমার কাছে অস্বীকার করব কিভাবে? হাসতে হাসতে বলল রুডলফ।
কাকোসের হত্যাকাণ্ডের জন্যে তুমি দায়ী, স্বীকার করছ?
করছি।
তোমার নির্দেশেই কি মার্কোভিচ ব্রেক-ভ্যান লুট করে?
রুডলফ বলল, আমি ওকে নির্দেশ দিয়েছিলাম পাথরগুলো উদ্ধারের জন্যে। দুচার ডজন মানুষকে যদি খুন করতে হয় তাও করতে পারবে সে।
কুয়াশা জানতে চাইল, ব্রেক-ভ্যানের গার্ডকে কে খুন করে? মার্কোভিচ, তুমিই তো?
প্রিন্সের নির্দেশে ব্রেক-ভ্যান লুট করতে গিয়ে খুনটা করতেই হয়। মার্কোভিচ কথা শেষ করল না।
কুয়াশা বলল, আমরা যে কোন অপরাধই করিনি, এটা মানো তো, রুডলফ?
মানি। কিন্তু তোমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ, আমার ব্যাপারে নাক গলিয়েছ। একমাত্র এরই জন্যে তোমাদের মৃত্যু কামনা করেছিলাম আমি।
কুয়াশা বলল, আমাদেরকেও তাহলে খুন করার পরিকল্পনা ছিল তোমার?
ছিল না মানে! মার্কোভিচকে তো হুকুমই দিয়েছিলাম, তোমাকে দেখা মাত্র গুলি করতে।
কুয়াশা বলল, আমার সব অভিযোগ তাহলে স্বীকার করছ?
না করে কি লাভ! সবই তো তুমি জানো। কিন্তু, মাই ডিয়ার মি. কুয়াশা, এত অভিযোগ উত্থাপন করছ কেন? তুমি কি আমাকে শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। নাকি?
তোমার শাস্তি হওয়া উচিত। কমপক্ষে পাঁচবার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দরকার তোমার। কঠিন একটুকরো হাসি দেখা গেল কুয়াশার ঠোঁটে, কিন্তু আমি তোমাকে শাস্তি দেবার কে! সারা দুনিয়ায় আমি খুনী, হিংস্র পাষণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হলেও আসলে আমি যে একজন বিবেকবান মানবতাবাদী সৎ মানুষ একথা আর কেউ না জানলেও তুমি খুব ভাল করেই জানো। তবে হ্যাঁ, অপরাধীর যম আমি। কোথাও কেউ অন্যায় করলে আমি ছুটে যাই, হস্তক্ষেপ করে অত্যাচারিতকে রক্ষা করার চেষ্টা করি, অত্যাচারীকে ধরিয়ে দিই পুলিসের হাতে কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধীকে মৃদু শাস্তিও দিয়ে থাকি। কিন্তু এসব আমি করি পৃথিবীর নিরীহ মানুষদের স্বার্থে, বিবেক এবং মানবতার স্বার্থে।
রুডলফ বলল, সেজন্যেই তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। আমি আবার অন্য নীতিতে বিশ্বাসী। নোক ঠকানো আমার নেশা। এ নেশা আমি ত্যাগ করতে পারব না।
কুয়াশা বলল, তোমাকে শাস্তি দেয়া আমার কাজ নয়। আইনই তোমাকে নিয়ে যা করবার করবে।
কথা শেষ করে হাতের রুমালের গিঠ খুলে মূল্যবান পাথরগুলো বের করল কুয়াশা। বৈদ্যুতিক আলোয় লাল নীল হলুদ মণি-মুক্তো-হীরা-চুনি-পোখরাজগুলো অত্যুজ্জ্বল আলো বিকিরণ করতে লাগল।
কুয়াশা পাথরগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, এই সেই পাথর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নীল ডায়মণ্ডটা। এগুলো হস্তগত করার জন্যে একের পর এক লোককে খুন করেছ তুমি। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি কেন, কেন?
কি ওটা! ওই নীল ডায়মণ্ডটা–দেখি তো! পাপেটের কণ্ঠস্বর। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে কুয়াশার হাতের পাথরগুলোর দিকে।
কুয়াশা বলল, এই নীল ডায়মণ্ডটার কথা বলছ? এটা ইংল্যাণ্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়া মরহুম ফ্রাঞ্জ-এর বিবাহে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন। ডেনমার্কের, রাজা আর্কডিউক মাইকেল ফ্রাঞ্জের পুত্র, রুডলফের বাবা, বর্তমান রাজার ছোট ভাই এই নীল ডায়মণ্ডের মালিক। উত্তরাধিকারসূত্রে এটা রুডলফেরই পাবার কথা। টাইম তাই রিপোর্ট করেছে। আশ্চর্য হচ্ছি সে কথা ভেবেই। যে জিনিস কিছু দিন পরই সে পাবে সেই জিনিস কেন সে কাকোসকে দিয়ে চুরি করাল? কেন সে এগুলো খুন করল…।
পাপেট বলল, মি. কুয়াশা, এসব কি বলছেন আপনি! আমি যা জানি…
রুডলফ থরথর করে কাঁপছে। ডান পা তুলে আচমকা সে বিদ্যুৎবেগে লাথি চালাল। কুয়াশা বা হাত দিয়ে পাপেটকে ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের উপর টেনে আনল।
রুডলফের লাথিটা ব্যর্থ হলো শূন্যে। পাপেটের পেটে লাগত সেটা, মৃত্যু ঘটত তৎক্ষণাৎ।
মি. ডি. কস্টা। রুডলফের শিরদাঁড়ায় রিভলভারের নল চেপে ধরুন।
ডি. কস্টা নির্দেশ পালন করল।
কুয়াশা বলল, সাবধান, গুলি যেন ছুটে বেরিয়ে না যায়। আমরা নিজেদের হাতে মানুষ খুন করতে চাই না। পাপেট, কি ব্যাপার? কি জানো তুমি? খবরের কাগজে পড়েছিলাম কিছু দিন আগে ডেনমার্কের মনটেনিগ্রিন ক্রাউন জুয়েল চুরি গেছে। এগুলোই সেই…
পাপেট বলল, ক্রাউন জুয়েলারী চুরি যেতে পারে। কিন্তু মি. কুয়াশা, নীল ডায়মণ্ডটা…।
এটা কি উলসটেইনাচ ব্লু ডায়মণ্ড নয়? এটাই কি মহারাণী ভিক্টোরিয়া মরহুম ফ্রাঞ্জের বিবাহে উপঢৌকন হিসেবে পাঠাননি? টাইম ম্যাগাজিন কি তাহলে ভুল লিখেছিল?
পাপেট বলল, না। আপনার হাতে যেটা রয়েছে ওটা একটুকরো সাধারণ কাঁচ মাত্র, যার দাম এক ডলারের চারভাগের এক ভাগও নয়।
.
কুয়াশার মনে পড়ল মৃত্যু পথযাত্রী কাকোসের কথাগুলো। মি. কুয়াশা, স্টোনগুলো কোনমতে হাত ছাড়া করবেন না! ওগুলোর মধ্যে অমূল্য একটা ধন আছে, ব্লু ডায়মণ্ড…
কুয়াশা বলল, পাপেট, তুমি বোধহয় ভুল করছ।
পাপেট দৃঢ় কণ্ঠে বলল, উলসটেইনবাট ব্লু ডায়মণ্ড এখন আমেরিকায়। উইলবার জি টুলি নামের এক মিলিওনিয়ার সেটা কিনে নিয়েছেন বছর সাতেক আগে। প্রিন্স রুডলফের বাবা আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূর করার জন্যে বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করেন, তার মধ্যে উলসটেইনবাচর ডায়মণ্ডটিও ছিল। আপনার হাতে যেটা রয়েছে এটা নকল। নকলটা তৈরি করা হয় প্রিন্স রুডলফের বাবার অনুরোধে। আসলটা বিক্রি করার সময় তিনি শর্ত দেন উইলবার জি টুলি কোনদিন জনসাধারণ্যে এই কেনাবেচার ঘটনাটা প্রকাশ করবেন না এবং কাউকে জিনিসটা দেখাতেও পারবেন না। গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে শপথনামা রচিত হয়, তাতে সই করেন উইলবার। পরিকল্পনা অনুযায়ী নকলটা তৈরি করা হয়। সেটা থাকবে, ঠিক হয়, প্রিন্স রুডলফের বাবার সংগ্রহশালায়, যাতে কেউ জানতে না পারে উলটেইনবাচ ব্লু ডায়মণ্ড বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। নকলটা তৈরি করেন আমার গ্র্যাণ্ড-ফাদার। তিনি মারা গেছেন। উইলবার ছাড়া আমিই একমাত্র আমেরিকান যে ঘটনাটা জানি।
কুয়াশা বলল, হুঁ।
পাপেট বলল, এটা নকল। আসলটা আছে…
কুয়াশা বলল, কিন্তু প্রশ্ন হলো, রুডলফের তো এটা না জানার কথা নয়। জেনে শুনে কেন সে নকল ডায়মণ্ডটা হস্তগত করার জন্যে-বুঝেছি! পাপেট, ভুল তোমারই। না, পাপেট, এটা নকল উলসটেইনবাচ নয়! এটাই আসল।
তার মানে?
কুয়াশার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, রুডলফ কাকোসকে দিয়ে নিজের বাবার সংগ্রহশালা থেকে নকল ব্লু ডায়মণ্ডটা চুরি করায়, ঠিক। কাকোস এরপর সেই নকল ব্লু ডায়মণ্ড দিয়ে তার অনুচরদেরকে পাঠায় আমেরিকায়। উইলবার জি টুলির ব্যক্তিগত মিউজিয়ামে সেই অনুচরেরা যেভাবে হোক প্রবেশ করে এবং তর্জাসল বু ড্রায়মণ্ডটা চুরি করে তার জায়গায় রেখে আসে নকলটা।
রুডলফ বলল, সব যখন জেনেই ফেলেছ, চুপ করে থেকে আর লাভ কি। তোমার অনুমানই ঠিক, মি. কুয়াশা। বাবা কাজটা ভাল করেননি।উলসটেইনবাচ ছিল আমাদের পরিবারের গর্ব। সেটা তিনি বেচে দিলেন কাউকে কিছু না জানিয়ে। ব্যাপারটা আমি অনেক পরে জানতে পারি। জানার পর থেকেই প্রতিজ্ঞা করি পারিবারিক মর্যাদা আমি যেভাবে তোক ফিরিয়ে আনব কাকোস ছিল আমার সহচর। ওকে ব্যবহার করি আমি।
কুয়াশা বলল, বুঝেছি। তা ব্লু ডায়মণ্ডটার দাম কি রকম চলতি বাজারে?
রুডলফ বলল, ওটা অমূল্য ধন। ডলার-পাউণ্ড দিয়ে ওর মল্য যাচাই করা সম্ভব নয়।
রুডলফ বলল, নিলামে চড়ালে আড়াই…কিংবা তিন কোটি ব্রিটিশ পাউণ্ডও উঠতে পারে দাম।
কুয়াশা অন্যমনস্ক হয়ে উঠল। কান পেতে কিছু যেন শোনার চেষ্টা করছে। সে। প্রথমে অস্পষ্ট হলেও, সাইরনের শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
জানালার কাছে ছুটে গেল কুয়াশা। নিচে তাকাতেই দেখল একটা পলিস ভ্যান এবং একটা স্কোয়াডকার ফুটপাথের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ইউনিফর্ম পরা সশস্ত্র পুলিস নামছে গাড়ি দুটো থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। শান্ত, অস্বাভাবিক স্থির সে।
মি. ডি. কস্টা, এদের উপর নজর রাখুন, কথাটা বলে করিডরে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
সোজা নিচে নেমে এল। প্রত্যেকটি জানালা দরজা বন্ধ। তবু, সবকটা আবার পরীক্ষা করল সে। বিল্ডিংটার ভিতরে ঢোকার কোন পথই খোলা নেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে উঠে এল আবার উপরে।
দোতলার বারান্দায় পা দিতেই নিচে থেকে ভেসে এল স্টেনগানের শব্দ ঠা–ঠা-ঠা-ঠা!
স্টীলের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে স্কোয়াড় পুলিস।
অফিসরূমে ঢুকে একে একে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল কুয়াশা। ধীর, শান্ত গলায় বলল, সশস্ত্র পুলিস সম্পূর্ণ বিল্ডিংটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে।
রুডলফ মন্তব্য করল, মি. কুয়াশা। এই ছিল তোমার মনে? সবাইকে একসাথে নিয়ে মরার পরিকল্পনা করেছ তাহলে!
বিচিত্র একটুকরো হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। রুডলফের কথার উত্তরে কিছু না বলে খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাতে ওয়েবলি অটোমেটিক।
লক্ষ্য স্থির করে স্কোয়াড কারের পুলিসদের দিকে গুলি ছুঁড়ল কুয়াশা। পরমুহুর্তে স্যাঁৎ করে সরে এল এক পাশে। এক ঝাঁক বুলেট ঢুকল জানালা গলে। রূমের দেয়ালের উপরিভাগে বিধল বুলেটগুলো। ঝুর ঝুর করে চুন বালি খসে পড়তে শুরু করল।
উকি দিয়ে আবার বাইরে তাকাল কুয়াশা। তারপর গুলি করল। পর পর। আরও কয়েকটা বুলেট বেরিয়ে গেল তার হাতের অটোমেটিক থেকে। তারপর খট করে হ্যামার পড়ল শুধু, ম্যাগাজিন খালি, বের হলো না বুলেট।
ডি. কস্টা পাশে এসে দাঁড়াল। রিভলভার ধরা হাতটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল সে। কুয়াশা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল তাকে। বলল, মি. ডি. কস্টা, পুলিসের সাথে আপনার কোন বিরোধ নেই। পৃথিবীর মধ্যে নিরীহ যে কজন মানুষ আছে, তার মধ্যে আপনি একজন। আপনি নিজেকে জড়াবেন না এসবে। যান, রুডলফের দিকে নজর রাখুন।
রুডলফ এবং মার্কোভিচকে আহট করিয়াছি হামি। উহারা জ্ঞান হারাইয়াছে।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা। দেখল ডি কস্টা মিথ্যে বলেনি। মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে ওরা।
ওমেনা ছুটে এল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে কুয়াশার বুকে। ফোঁপাতে ঠাপাতে বলল, এ কি করলে! এমন কেন হলো!
কুয়াশা দৃঢ় গলায় বলল, দুশ্চিন্তা কোরো না ওমেনা। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। শোনো ওমেনা, তুমি এবং আমি যেভাবে হোক এখান থেকে বেরিয়ে যাব। মি. ডি. কস্টা এখানে থাকবেন। তিনি ঘটনাচক্রে আমাদের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন, তাকে আমরা আর সাথে রাখতে চাই না। সেন্ট পাপেট ইনোসেন্ট তিনি, আমাদের সাথে থাকলে অকালে প্রাণ হারাবেন।
কিন্তু পুলিস ওকে…।
কুয়াশা বলল, পুলিস কর্তৃপক্ষ রুডলফের স্বীকারোক্তি শুনেছে, তারা এখন জানেন কারা অপরাধী আর কারা অপরাধী নয়। মি. ডি. কস্টাকে তারা অভিযুক্ত করবেন না।
কথা শেষ করে এগিয়ে গেল কুয়াশা কাঠের প্রকাণ্ড আলমারিটার দিকে। আলমারির দরজা উন্মুক্ত করল সে।
পাকা চুল এবং অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্ক অফিসারদ্বয়কে দেখতে পেল সবাই। কুয়াশা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করল। বলল, আপনাদেরকে কষ্ট দেবার জন্য আমি দুঃখিত। আশা করি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এরকম একটা নাটক করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার।
অফিসারদ্বয় একটু যেন হাসল বলে মনে হলো কুয়াশার।
আমি আসছি। রূম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল কুয়াশা।
কান পাতা দায় হয়ে উঠেছে স্টেনগানের শব্দে। জানালা দিয়ে অবিরাম ঝাঁকে আঁকে ঢুকছে বুলেট।
দুমিনিট পর কাঁধে একটা লাইট মেশিনগান নিয়ে উপরের অফিসরূমে ফিরে এল কুয়াশা।
সকলের বিস্ফারিত চোখের সামনে খোলা জানালার নিচে বসল সে। বসে বসেই লাইট মেশিনগানটা ফিট করল সে জানালার উপর।
মাথা তুলে উঁকি দিয়ে দেখল সে একবার নিচটা।
শত শত, হাজার হাজার মানুষের ভিড় রাস্তার উপর। পুলিশের গাড়ির সংখ্যা এখন আট-দশটা। অ্যাম্বুলেন্সও দেখা যাচ্ছে একটা।
চারদিক থেকে গুলি বর্ষণ করছে পুলিসের লোকেরা। মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।
লাইট মেশিনগানের ট্রিগারে আঙুল রাখল কুয়াশা। এক সেকেণ্ড পর গর্জে উঠল সেটা।
একনাগাড়ে মিনিট খানেক বুলেট বর্ষণ করে থামল মেশিনগান। কুয়াশা ফিরে এল কামরার মাঝখানে। সকলের দিকে তাকাল একবার করে। ধীরে ধীরে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
স্মরণীয় একটা ঘটনা, না? বহুদিন মনে থাকবে, তাই না?
ডি. কস্টা থর থর করে কাঁপছে, হাঁটুতে হাঁটুতে বাড়ি লাগছে তার। বলল, ব!
একটা হাত রাখল কুয়াশা তার কাঁধে, আপনাকে দলে রাখতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপনি নিতান্তই নিরীহ একজন মানুষ।
কুয়াশা তাকাল পাপেটের দিকে, কাহিনীটা কিন্তু ছেপে দিয়ে তোমাদের পত্রিকায়।
কিন্তু আপনি এভাবে নিজের ধ্বংস ডেকে আনলেন কেন?
কুয়াশা উত্তর দিল না। আবার দেখা দিল তার ঠোঁটে সেই বিচিত্র হাসিটা।
জানালার কাছে ফিরে গেল কুয়াশা হাতে একটা কাঠের রুল নিয়ে। লাইট মেশিনগানের ট্রিগারে রুলটা আটকে দিতেই মুষলধারে গুলিবর্ষণ শুরু হলো। জানালার কাছ থেকে ফিরে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা, এমন সময় থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা বিল্ডিংটা।
স্থির হয়ে গেল কুয়াশা। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। নিচে তাকাতে দেখল মর্টার থেকে গোলা ছুঁড়ছে পুলিশবাহিনী। গেটটাও প্রায় ভেঙে ফেলেছে তারা।
মাথাটা সরিয়ে নিল কুয়াশা, ঠিক সেই সময় দুই ইঞ্চি মর্টারের একটা গোলা বাতাসে শিস কেটে জানালা গলে ঢুকল ভিতরে।
অন্ধকার হয়ে গেল রূমটা।
ওমেনার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ উঠল, পরমুহূর্তে থেমে গেল সে আর্তনাদ। গোলার আঘাতে কিনা কে জানে, আহত হয়েছে ওমেনা। জ্ঞান হারিয়েছে সে।
কেঁদে ফেলল পাপেট, মি. কুয়াশা!
ডি. কস্টার রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শোনা গেল অন্ধকারে, বস, হাপনাকে আমি ভালবাসি! হাপনাকে বাঁচাইবার জন্য আমি প্রাণ ডিব!
অন্ধকারে হাসির শব্দ পাওয়া গেল কুয়াশার, পাগল!
বস!
সাড়া নেই কুয়াশার।
বস!
ককিয়ে উঠল ডি. কস্টা। কাঁদছে সে।
সাড়া নেই কুয়াশার।
গ্যাস লাইটার জ্বালল ডি. কস্টা। কুয়াশা নেই। ওমেনাকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
অতি সাবধানে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। লাইট মেশিনগানটা এখনও অনবরত গুলি করে চলেছে।
উঁকি দিল ডি কস্টা। দুচোখ বেয়ে অনর্গল ধারায় নেমে আসছে নোনা জল।
ডি কস্টা দেখল গেট ভেঙে ফেলেছে পুলিস। হুড়মুড় করে দলে দলে ঢুকছে পুলিস গেট পেরিয়ে। কান পাতবার দরকার হলো না, সিঁড়িতে অসংখ্য বুট জুতোর পদশব্দ হচ্ছে, শুনতে পেল ডি কস্টা।
জানালার কাছ থেকে সরল না সে। হঠাৎ লাইট মেশিনগানটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। নিচের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেবে এমন সময় একটা জিনিস চোখে পড়ল ডি. কস্টার।
একটা মেয়ের অজ্ঞান দেহ পাজাকোলা করে বয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিস।
মেয়েটিকে চিনতে পারল ডি. কস্টা।
পুলিসটাকে পথ করে দিচ্ছে সবাই। লোকে লোকারণ্য চারদিক। দুপাশে সরে যাচ্ছে মানুষ। পুলিসটি অজ্ঞান ওমেনাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে রুডলফের রোলস রয়েসের দিকে।
সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ডি. কস্টা। রোলস রয়েসের ব্যাক সীটে ঢুকিয়ে দিল পুলিসটি ওমেনাকে। দরজা বন্ধ করল। তারপর দ্রুত গাড়ির সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
মুখ তুলে উপর দিকে তাকাল পুলিসটি। ডি. কস্টা পরিষ্কার দেখতে পেল হাসছে লোকটা।
গাড়িতে ওঠার আগে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
আনন্দে কান্না পেল ডি. কস্টার। পুলিসটিকে চিনতে পেরেছে সে এতক্ষণে। না, চিনতে কোন ভুল হয়নি তার।
রোলস রয়েস ছুটছে।
কুয়াশার ঠোটে মৃদু হাসি। সে জানে, ডি. কস্টাকে পুলিস নির্দোষ হিসেবে ছেড়ে দেবে।
আবার দেখা হবে তার সাথে এই শহরেই। যথাস্থানে তার জন্যে অপেক্ষা করবে কুয়াশা।
Leave a Reply