কুয়াশা ৬৯
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৭৭
০১.
এক অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দিলে, ইউরোপ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মহাদেশ। শরীরের মাপ, পৌনে চার মিলিয়ন স্কয়ার মাইল। এশিয়ার তুলনায় ইউরোপ খুবই রোগা পাতলা, কুয়াশার তুলনায় যেমন ডি. কস্টা। নিজের গায়ে অমন সাড়ে চারটে ইউরোপকে ঠাঁই দিতে পারে এশিয়া।
ইউরোপের মধ্যমণি হলো সুইটজারল্যাণ্ড। সুইটজারল্যাণ্ড একটি বাফার স্টেট, যার কোন সশস্ত্র সেনাবাহিনী নেই, যে কিনা সারা দুনিয়ার সাথে অলিখিত চুক্তি করে পরম সদিচ্ছার পরিচয় দিয়েছে, কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদযুদ্ধ-ফ্যাসাদে নিজেকে জড়াবে না। স্বাধীন একটি নিরীহ দেহ, শান্তিকামী মানুষদের বসবাস। অধিবাসীদের ভাষা, কালচার এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্য একরকম নয়, প্রধানত তিন রকম। ল্যাটিন থেকে উৎপন্ন মিশ্র ভাষায় কথা বলে কেউ, জার্মান যাদের মাতৃভাষা এমন লোকের সংখ্যাও কম নয় আবার ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী লোকও প্রচুর সেখানে। শিক্ষিতরা অবশ্য তিন ভাষাতেই কথা বলতে পারেন। এবং অশিক্ষিত লোক সেখানে এতই কম যে এক-আধজনের খোঁজ পেতে হলে সার্চ-পার্টি গঠন করে অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া উপায় নেই।
ইউরোপ ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ থেকে বেরিয়ে এই সুইটজারল্যাণ্ডেই প্রথম পা ফেলল কুয়াশা।
দীর্ঘ কয়েক বছর একনাগাড়ে গবেষণার কাজ করে সত্যি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল কুয়াশা। তবু মহুয়ার মত একটি বোন ছিল বলে রক্ষে, তা না হলে কাজ করতে করতেই সে নিঃশেষ হয়ে যেত এতদিনে। মহুয়া দুচার মাস অন্তর অন্তরই কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে চড়াও হয় তার আস্তানায়, গ্রেফতারী পরোয়ানাসহ। কুয়াশাকে টেনেহিঁচড়ে, চোখ রাঙিয়ে, কখনও বা হাতে-পায়ে ধরে ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বন্দীখানা থেকে মুক্ত করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়। যে-কদিন মহুয়াদের বাড়িতে থাকে কুয়াশা, বিশ্রাম না নিয়ে উপায় নেই তার। সীমানা চিহ্নিত করে দেয় মহুয়া। বেডরূম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে যেতে হলেও আবেদন জানাতে হবে। শহীদ বা কামালের সাথে গল্প করতে হলেও অনুমতি নিতে হবে। ছোট্ট, অসহায়, শিশুর মত হয়ে থাকতে হয় সেই কদিন কুয়াশাকে। ঘড়ি দেখে খেতে হয়। খেতে হয় বিপুল পরিমাণে। ধূমপান প্রায় বন্ধ রাখতে হয়। রেশনিং অর্ডার জারি করে মহুয়া। সারা দিন মাত্র একটি হ্যাভানা চুরুট, এইরকম হাজারো আইন-কানুনের মধ্যে থেকে অল্প কদিনেই কুয়াশা আবার শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে তাজা হয়ে ওঠে। তবু কি মুক্তি আছে বোনটির স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন থেকে? নেই। কুয়াশাকে অবতীর্ণ হতে হয় ভিক্ষুকের ভূমিকায়। নিজের মুক্তি ভিক্ষা করে সে। এন্তার প্রশংসা করে মূহুয়ার গুণের, লোভ দেখায় আনতারায় নিয়ে যাব বলে, জড়োয়া সেট কিনে দেয়, প্রতিজ্ঞা করে নিজের আস্তানায় ফিরে গিয়েও সে মহুয়ার জারিকৃত নিয়ম-কানুন প্রতিপালন করতে অবহেলা করবে না। এত করেও সে মহুয়ার মন গলাতে পারে না। শেষে সে সাহায্য প্রার্থনা করে কামাল এবং শহীদের। তিনজনে চলে গোপন শলাপরামর্শ।
মোট কথা, অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে অবশেষে মুক্তি পায় কুয়াশা। ফিরে যায় নিজের আস্তানায়। ডুবে যায় আবার গবেষণার কাজে।
কিন্তু এবার হয়েছে অন্যরকম। বছর তিনেক ধরে মানবদেহের লে নিয়ে গবেষণা করার পর কুয়াশা আবিষ্কার করে গোড়ায় ছোট্ট একটা গলদ ছিল বলে এতদিন সে ভুল একটা থিওরির উপর খেটেছে। ফলে মানসিক দিক থেকে বেশ একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। কাজকর্মে মন বসে না তারপর থেকে। গবেষণাটা ছিল মানবজাতিকে অনন্তযৌবন অর্থাৎ অমরত্ব দান করার জন্যে একটি যুগান্তকারী মেডিসিন আবিষ্কার করা। তিন বছরের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে কুয়াশা। কারও সাথে দেখাসাক্ষাৎ না করে আস্তানার মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখে বেশ অনেকদিন।
কুয়াশার মানসিক অবস্থার কথা প্রথমে টের পায় রাজকুমারী ওমেনা। গবেষণায় সে কুয়াশাকে সাহায্য করেছে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ডি. কস্টা খবরটা পায় তার কাছ থেকেই।
ডি. কস্টা এবং ওমেনা দীর্ঘ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, কুয়াশাকে বিদেশে নিয়ে যেতে হবে, হাওয়া বদলানো দরকার। কোথায় যাওয়া যায়? ওরাই ঠিক করে, সুইটজারল্যাণ্ড হলো আদর্শ জায়গা।
সব ঠিকঠাক করে ওমেনা এবং ডি. কস্টা কুয়াশা সমীপে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। কুয়াশা সব শুনে মৃদু হাসে। বলে, ঠিক। হাওয়া বদল দরকার। চলো তাহলে, ইউরোপটা ঘুরে আসি।
রওনা হবার আগে ওমেনা কয়েকটি শর্ত দেয় কুয়াশাকে। শর্তগুলো নিম্নরূপ।
১। এই ভ্রমণকে নির্ভেজাল ভ্রমণ বলে মনে করতে হবে।
২। কুয়াশা পুরানো কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করতে চেষ্টা করবে না।
৩। ইউরোপে একাধিক শত্ৰু আহে কুয়াশার, তাদের সাথে নতুন করে বিবাদ বাধাবার চেষ্টা করতে পারবে না সে।
৪। চোখের সামনে যাই ঘটুক, যত বড় অন্যায়ই সংঘটিত হোক, কুয়াশা নিজেকে সে-ঘটনার সাথে জড়াতে পারবে না।
৫। নিজের পরিচয় সে কোথাও প্রকাশ করতে পারবে না।
চার নম্বর শর্তটি ছাড়া বাকি সব শর্ত মেনে নিয়েছে কুয়াশা। চার নম্বর শর্ত সম্পর্কে তার বক্তব্য, অন্যায় ঘটতে দেখলে নীরব দর্শক হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সে-রকম কোন কিছু ঘটলে, সেই ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াবার আগে ওমেনা এবং ডি. কস্টার অনুমতি চাইবে সে।
ভার্সেই থেকে জেনেভা, জেনেভা থেকে জুরিখ। তিন মাস কাটল নিরুপদ্রবেই। কোথাও কোন বিশেষ ঘটনা ঘটল না। মাউন্ট রাঙ্কের উপর হোটেলে রইল ওরা পুরো দেড় মাস। জেনেভায় পনেরো দিন। জুরিখে একমাস। সুইটজারল্যাণ্ড ত্যাগ করুল ওরা এরপর। ঢুকল অস্ট্রিয়ায়।
আকারে অস্ট্রিয়া সুইটজারল্যাণ্ডের দ্বিগুণ। আলপস পর্বত এই দুই দেশেই আছে। তবে অস্ট্রিয়ায় আলপস তেমন উঁচু নয়। অস্ট্রিয়ান আলপৃসে বিখ্যাত কয়েকটি গ্লেসিয়ার আছে। গ্রোস গ্লোকনার গ্লেসিয়ারটি তো খুবই নামকরা।
আল্পসের নিম্নদেশ গভীর বনভূমিতে ঢাকা।
ইনসব্রুক অস্ট্রিয়ার বেশ বড় শহর। জার্মান সীমান্তের বেশ কাছে। সারা বিশ্বের ভ্রমণবিলাসীদের কাছে ইনকের খ্যাতি আছে। এই ইকেই পদধূলি ফেলল কুয়াশা। সাথে রাজকুমারী ওমেনা। এবং রসিক সহকারী স্যানন ডি. কস্টা।
ইন্দ্রুক বনভূমির মাঝখানে একটা শহর। শহরের ভিতর গাছপালার এমন সমারোহ যে দেখে মনে হয় এটা শহর নয়, গ্রাম। শহরে চওড়া কংক্রিটের রাস্তা আছে, দশ-বিশ তলা উঁচু বিল্ডিং আছে, ট্রাম আছে, গাড়ি-ঘোড়া সব আছে-সেই সাথে আছে পাঁচ-সাত হাত পর পর হাজার হাজার আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো বৃক্ষ।
টেরল। শহর থেকে খুব বেশি একটা দূরে নয় জায়গাটা। রাত তখন শেষ হতে অনেক দেরি। মাত্র আড়াই কি তিনটে বেজেছে। শীতকাল। পাশ্চাত্যের শীত যে কি জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল ডি. কস্টা। গেঞ্জি, দুটো উলেন সোয়েটার, কোট এবং কোটের উপর ওভারকোট পরেছে সে। তা সত্ত্বেও ঠক ঠক করে কাঁপছে হাড়গুলো।
কেমন জব্দ! ঘড়ির কাঁটা আর ঘোরাবেন কখনও? কথায় বলে মেয়েদের শীত কম লাগে, তার উপর ওমেনা অন্য গ্রহের মেয়ে, শীত সহ্য করবার অদ্ভুত ক্ষমতা তার।
ওমেনার কথা শুনে রাগ হলেও ডি. কস্টা ঠোঁট দুটো ফাঁক করার অর্থাৎ কথা বলবার কোন চেষ্টাই করল না। ঠোঁট ফাঁক করলেই মুখের ভিতরটা হিম হয়ে যাবার ভয় আছে।
ওমেনার পাশে কুয়াশা। মৃদু হেসে তাকাল সে ডি. কস্টার দিকে। ওভারকোটের পকেট থেকে একটা পেট মোটা বোতল বের করে নিঃশব্দে ডি. কস্টার দিকে বাড়িয়ে দিল।
গর্বিত এবং বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকাল ডি. কস্টা ওমেনার দিকে। ওভারকোটের পকেট থেকে হাত বের করে বোতলটা নিয়ে ছিপি খুলল। ঢক ঢক করে দুচার ঢোক ব্র্যাণ্ডি গিলে বোতলটা কুয়াশাকে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের ওভারকোটের পকেটে চালান করে দিল সে সযত্নে।
দেখবেন, বিদেশ-বিভূইয়ে আবার মাতলামো শুরু করবেন না। বোতলটা বরং ফিরিয়ে দিন। এ দেশের পুলিস মাতাল দেখলে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ছাড়ে!
ডি কস্টা ব্র্যাণ্ডি পান করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বেশ একটু। বলল, বিডেশ? এটা ইউরোপ, ম্যাডাম। হাপনাডের জন্য বিডেশ হইটে পারে, হামার জন্য নহে। ইউরোপিয়ানরা হামার জাট ভাই! পুলিস বলুন আর মিলিটারিই বলুন, পরিচয় ডিলে ডেখা যাইবে মামাটো ফুফাটো ভাই-টাই হবে সে হামার।
হাসি চাপতে পারল না ওমেনা।
প্রশস্ত রাস্তা। লোকজনের বা যানবাহনের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। আঁকাবাঁকা রাস্তা, তাই খুব বেশি দূর দেখা যায় না। তার উপর বেশ গাঢ় কুয়াশা। লাইটপোস্টের মাথায় টিউব লাইট জ্বলছে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা। গভীর জঙ্গল বলেই ভ্রম হয়। অস্ট্রিয়া হলো গাছপালারই দেশ।
কুর্কাঞ্জা হোটেলে বিকেল তিনটেয় উঠেছিল ওরা। ক্লান্তি বশত সাড়ে তিনটের সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। ঘুম ভাঙে সাড়ে নটায়। খেয়েদেয়ে আবার ঘুম। রাত দুটোয় ঘুম ভাঙে ডি. কস্টার। দীর্ঘ সময় ঘুমোবার পর আর ঘুম আসার কথা নয়। অথচ এদিকে রাত মাত্র দুটো। মর্নিং ওয়াকের সময় হয়নি এখনও। ডিকস্টার ভারি ইচ্ছা হচ্ছিল বাইরে বেরিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার। কিন্তু কুয়াশা এবং ওমেনাকে এই গভীর রাতে বাইরে যাবার প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাবে, জানত সে। তাই, তিনটে ঘড়িরই কাটা ঘুরিয়ে দেয় সে। তারপর ঘুম থেকে ওঠায় ওমেনাকে। ডি.কস্টা তাকে বলে, সাড়ে চারটে বাজে, মর্নিং ওয়াকের সময় হয়েছে।
সন্দেহ জাগবার কথা নয় ওমেনার। তার হাতের হাতঘড়িও সময় নির্দেশ করছে, সাড়ে চারটে। কুয়াশাকে ডেকে তোলে সে।
কাপড়-চোপড় পরে বেরিয়ে পড়ে ওরা সবাই। হাঁটতে হাঁটতে হোটেল ছেড়ে বেশ দূরে চলে আসে ওরা। ঘন্টাখানেক কাটে। অদূরের গির্জা থেকে হঠাৎ ঘন্টাধ্বনি হয়। ঢং ফং-টং। রাত তিনটে।
কিন্তু ওদের প্রত্যেকের ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা।
ডি. কস্টার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায়। খেপে ওঠে ওমেনা। কিন্তু কুয়াশা শুধু হাসে।
আসলে কুয়াশার রিস্টওয়াচের কাটা যখন ঘোরাতে শুরু করে ডি. কস্টা, কুয়াশা তখন জেগেই ছিল। নরম বিছানায় শুয়ে থাকার ইচ্ছা তারও ছিল না। ডি. কস্টার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সে তাই আর কোন উচ্চবাচ্য করেনি।
হাঁটছে ওরা।
দুএকদিনের মধ্যে বরফ পড়া শুরু হবে, বলল কুয়াশা। কথাটা শেষ করেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে।
কুয়াশার দেখাদেখি ওরা দুজনও তাকাল পিছন দিকে। গাঢ় কুয়াশা। বিশ পঁচিশ হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না।
পিছন দিকে কোন কিছু দেখতে না পেয়ে ডি. কস্টা এবং ওমেনা তাকাল কুয়াশার মুখের দিকে।
কুয়াশা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিছন দিকেই।
কি দেখছ তুমি? ওমেনার প্রশ্ন।
কুয়াশা চোখের পাতা না ফেলে একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, পায়ের শব্দ পাচ্ছি। কেউ এদিকে আসছে।
রাস্তার একপাশে সরে গেল কুয়াশা। ওমেনা এবং ডি. কস্টাও। আরও পাঁচ সাত সেকেণ্ড কেটে গেল। তারপর অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল ওরা। প্রশস্ত রাস্তার বিপরীত দিকের ফুটপাথ ধরে হন হন করে এগিয়ে আসছে লোকটা। যে-কোন কারণেই হোক, ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাকে। হয় ব্যস্ত, না হয় ভয়তাড়িত। মাঝে মাঝেই সে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। হাঁটার ভঙ্গিটা এমনই যে দেখে মনে হয়। যে-কোন মুহূর্তে লোকটা দৌড়ুতে শুরু করতে পারে।
রোগা পাতলা, একহারা চেহারা লোকটার। ডান হাতে ধরা একটা অ্যাটাচিকেসের হাতল। কেউ লক্ষ না করলেও কুয়াশার দৃষ্টি এড়াল না, অ্যাটাচিকেসের হাতলের সাথে বাধা লোহার শিকলের সাথে লোকটার ডান হাতের কব্জি বাধা। কেউ যাতে অ্যাটাচিকেসটা ছিনিয়ে নিতে না পারে তাই এই শিকলের ব্যবহার।
কুয়াশার মনে প্রশ্ন জাগল, কি আছে ওই অ্যাটাচিকেসে?
পা বাড়াবে কি বাড়াবে না মনস্থির করতে পারছিল না কুয়াশা। ওমেনা চাপাস্বরে বলে উঠল, না। শর্তের কথা মনে নেই বুঝি? অকারণ কোন ঝামেলায় তোমার জড়ানো চলবে না।
মৃদু হেসে কুয়াশা বলল, তথাস্তু।
লোকটা এর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। গাঢ় কুয়াশা গ্রাস করেছে তাকে।
ডি. কস্টা ছোট্ট একটা লাফ দিল। ওমেন্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, মুখোমুখি, বাট, হামার উপর কোন নিষেদাজ্ঞা নাই। আমি লোকটাকে গিয়া জিজ্ঞেস করিটে। পারি, ডার, কি আছে টোমার অ্যাটাচিকেসে? কেনই বা টুমি অমন ভয় পাইটেছ?
ওমেনা গম্ভীরভাবে বলল, না।
না কেন? হামার স্বাটীনা হামি বিক্রি করিয়া ডিই নাই।
কুয়াশা সকৌতুকে মন্তব্য করল, মিস্টার ডি. কস্টার কথায় যুক্তি আছে।
ওমেনা বলল, লোকটা ইতিমধ্যে অনেকদূর চলে গেছে। তাকে আর ধরা সভব নয়।
হু নোজ! হয়টো লোকটা কোন বিপডে পড়িয়া অমন পাগলের মটো ছুটিটেছে। টাকে হয়ট হামরা সাহায্য করিটে পারিটাম। অসহায়, হেল্পলেস মানুষকে সাহায্য করা হামাডের ট, টাই না?
তাই। কুয়াশা সায় দিল।
ডি. কস্টা মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপর তুলে বক্তৃতা দেবার ভঙ্গিতে বলল, নারী জাটিই সকল সর্বনাশের মূল।
কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। আঁকাবাঁকা রাস্তা। মিনিট খানেকও হয়নি, বাক নিয়ে অদূরেই একটা পাকা ব্রিজ দেখতে পেল ওরা।
ব্রিজের উপর চোখ পড়তেই পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো ওরা তিনজন।
ব্রিজটা মাত্র হাত পনেরো কি বিশ দূরে। ব্রিজের পর চারজন লোক ধস্তাধস্তি করছে। রোগা পাতলা একহারা চেহারার সেই লোকটা আক্রান্ত হয়েছে। হাত-পা ছুঁড়ে নিজেকে রক্ষা করবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। বাকি তিনজন আক্রমণকারী মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে লোকটাকে কাবু করতে।
কুয়াশা তাকাল ডি.কস্টার দিকে। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওমেনার দিকে।
গম্ভীর ভাবে কিছু বলতে গিয়েও বলল না ওমেনা।
কুয়াশা পা বাড়াল। সেই সাথে ডি কস্টা এবং ওমেনাও। মারামারিতে অংশগ্রহণ করবার কোন লক্ষণ অবশ্য ডি. কস্টার মধ্যে দেখা গেল না। কুয়াশাকেও তেমন চঞ্চল বলে মনে হলো না।
একজন নিরীহ ও দুর্বল গোছের লোককে তিনজন কুস্তিগীর টাইপের লোক কাবু করবার চেষ্টা করছে।
এটা অন্যায়, কুয়াশা মন্তব্য করল। মাত্র আট দশ হাত দূরে ঘটনাটা ঘটছে। চারজনের কেউই ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে না। কোন দিকে তাকাবার ফুরসতই নেই তাদের।
ডি. কস্টা প্রশংসা করল, বাহাদুর লোক। একা কেমন টিনজনকে সামলাচ্ছে!
ওমেনা বলল, যান, ওকে গিয়ে সাহায্য করুন।
কুয়াশা বলল, আমি যাব।
ওমেনা আবারও কিছু বলতে গিয়ে বলল না। এই রকম পরিস্থিতিতে কুয়াশাকে বাধা দেয়াটা উচিত হবে না, বুঝতে পারছে ও। একজন লোক মার খাচ্ছে বেদম, কুয়াশা তা দেখবে নির্বিকার চিত্তে, এরকমটি কক্ষনও আশা করা যায় না। ওমেনা জানে, এখন বাধা দিলে কাজ হবে না। কুয়াশা মানবে না তার বাধা।
কি বল, তুমি?
ওমেনা অনুমতি দিল, যাও। কিন্তু মনে রেখো, জড়িয়ে পড়তে পারবে না। ওদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে যদি থামাতে পারো–দেখো!
কুয়াশা এগোল। দুর্বল লোকটাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে আক্রমণকারীরা ইতিমধ্যে। একজন লোকটার বুকের উপর উঠে বসে আছে। আর একজন লোকটার পা দুটো দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছে। শেষ জন লোকটার নাকে-মুখে ঘুসি মারতে ব্যস্ত।
নিজেকে রক্ষার জন্য দুর্বল লোকটা এখনও ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে।
লোকটা সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে না লক্ষ করে খুবই আশ্চর্য বোধ করুল কুয়াশা। কাছাকাছি গিয়ে থামল সে। বস্ত্র কণ্ঠে হুকুম করল। থামো!
জার্মান ভাষায় ধমক খেয়ে আক্রমণকারীরা একযোগে মুখ তুলে তাকাল। ওভারকোটে ঢাকা, হ্যাট পরিহিত কুয়াশার দীর্ঘকায় মূর্তির দিকে তোক তিনজন চেয়ে রইল ঝড়া পাঁচ সাত সেকেণ্ড। তারপর, যে লোকটা ঘুসি মারার কাজে ব্যস্ত ছিল, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দুই হাত একত্রিত করে শূন্যে তুলল সে। কুয়াশার মুখের উপর আঘাত করার ইচ্ছা।
লোকটা যেমন কুৎসিত দেখতে তেমনি ষাঁড়ের মত দেহ তার। তাকে সাহায্য করবার জন্যে আরও একজন এগিয়ে এল। দুর্বল লোকটার পা দুটো ছেড়ে দিয়ে এই দ্বিতীয় আক্রমণকারী কুয়াশার দিকে লাফ দিল বিপুল বিক্রমে।
কুয়াশা তার মুখোমুখি দাঁড়ানো এক নম্বর শত্রুর উদ্যত হাতের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বাঁ হাত দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল লোকটার চোয়ালে। যন্ত্রণাক্ত শব্দ করে লোকটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ব্রিজের রেলিংয়ের গায়ে।
দ্বিতীয় শত্রু লাফ দিলেও কুয়াশার কাছে পৗছুতেই পারল না সে। লাফ সে ঠিকই দিয়েছিল। কিন্তু ডি. কস্টার বাড়িয়ে দেয়া ডান পায়ের ধাক্কা খেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল সে কংক্রীটের উপর, কুয়াশার পায়ের কাছে।
কুয়াশা হাত তুলে নিষেধ করল ডি কস্টাকে, সে যেন মারামারিতে অংশগ্রহণ না করে। মৃদু হেসে ওমেনার দিকে তাকাল কুয়াশা। ওমেনার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় আছাড় খেয়ে পড়া লোকটার বুকের উপর একটা ভারি পা তুলে দিয়ে চাপ দিল সে।
নিষেধাজ্ঞা জারি করল ওমেনা বাঁ পাশ থেকে, চাপ বাড়িয়ে না আর। পাজরগুলো ভেঙে গেলে বিচার হবে তোমার!
.
০২.
নিরীহ গোছের লোকটা সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে। তার বুকের উপর যে লোকটা বসে ছিল সে এতক্ষণ ধরে লোকটার গলা চেপে ধরে রেখেছিল। তার সঙ্গীদ্বয়কে কুয়াশার হাতে পরাজিত হতে দেখে সে তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়াল।
ওদিকে ব্রিজের রেলিংয়ের পাশ থেকে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে এক নম্বর শত্রু।
কুয়াশা পিছিয়ে এল দুপা।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আছাড় খেয়ে পড়া দ্বিতীয় শত্রু। তিন, শত্রু তিন দিকে। সুযোগ খুঁজছে তারা কুয়াশাকে আক্রমণ করে পরঙ করার।
দূর্বল, জ্ঞানহারা লোকটা নিঃসাড় শুয়ে আছে।
ওমেনার দিকে আড়চোখে তাকাল কুয়াশা। সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল, এখন? কি করা উচিত আমার?
ওমেনা শুরু করল, তখনই বলেছিলাম..
ওমেনার কথা শেষ হলো না, তিন শত্রু তিন দিক থেকে একযোগে ছুটে এল কুয়াশার দিকে।
এক পলকের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। দেখা গেল কুয়াশা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে সে নেই। তিন শ তিন দিক থেকে এসে ধাক্কা খেল পরস্পরের সাথে, ঠকে গেল তিনজনের তিনটে মাথা সশব্দে।
তিন শত্রু যার যার মাথা ব্যথায় অস্থির। এমন সময় দেখা গেল তাদের মধ্যে থেকে একজন উঠে গেল শূন্যে। আসলে কুয়াশা তাদের একজনকে পিছন থেকে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল তারপর সজোরে ছুঁড়ে দিল ব্রিজের রেলিংয়ের দিকে।
রেলিং টপকে গেল লোকটা, অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে শব্দ উঠল রেনউইগ নদীতে ঝপাৎ!
মাথার ব্যথায় চোখে সর্ষে ফুল দেখছিল বাকি দুজন ও। তাদের একজন সঙ্গী যে হিম-শীতল নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে, এ সম্পর্কে কোন ধারণাই তখনও করতে পারেনি তারা। কুয়াশা শান্ত ভঙ্গিতে আরও একজন শত্রুকে ধরে শূন্যে তুলল।
দ্বিতীয় এই লোকটাও বরফ-শীতল নদীতে পড়ল, শব্দ হলো-ঝপাৎ! তারপর সর্বশেষ লোকটির পালা। এ লোকটা বিপদ টের পেয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ডি কস্টা তার পথরোধ করে দাঁড়াল। সুর করে বলল, যেটে নাহি ডিব! যেটে হামি ডিবো না টোমায়!.
লোকটা এদিক ওদিক তাকাল, পালাবার পথের সন্ধানে। কিন্তু সময় পেল না সে, কুয়াশা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তার পিছনে। ঘাড়ে নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ফেরাল লোকটা ঝট করে। কুয়াশা মুচকি হেসে বলল, চলো, রেলিং পর্যন্ত বেড়িয়ে আসি।
কথাটা বলে কুয়াশা লোকটার একটা হাত ধরল, যেন পরম বন্ধুকে খাতির করে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে।
লোকটা সত্যিই ঘাবড়ে গেছে। তার সঙ্গী দুজনের পরিণতি দেখার পর কুয়াশা সম্পর্কে তার কোন ভুল ধারণা না থাকারই কথা। বিনাবাক্যব্যয়ে সে পাশাপাশি এগিয়ে চলল কুয়াশার সাথে। রেলিংয়ের দিকে।
রেলিংয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। ব্রিজের উপর নিওন সাইন জ্বলছে। কুয়াশা ভেদ করে স্বল্প আলো পড়েছে নিচের নদীতে। কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে যোত।
কুয়াশা হাসি মুখে বলল, রেলিংয়ের ওপর উঠে লাফ দাও বাছা। তোমাকে আর নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই না!
মারা পড়ব যে! এই শীতে নদীতে পড়লে বরফ যদি নাও হই, নির্ঘাৎ নিউমোনিয়ায়।
লোকটার কথা শেষ হলো না, পিছন থেকে ডি. কস্টা বাংলায় কথা বলে উঠল, বস, আমি কিছুটা বাহাড়ুরী ডেকাইটে ইচ্ছা করি।
কুয়াশা সকৌতুকে বলল, তা দেখান না!
কুয়াশার কথা শেষ হতে যা দেরি, ডি. কস্টার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঝুপ করে বসে পড়ল সে! দুহাত বাড়িয়ে ধরল লোকটার হাঁটু দুটো। তারপর উপর দিকে ঠেলে দিল সজোরে।
নিচু রেলিং টপকে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল নিচে। পাঁচ সেকেণ্ড পর সেই পরিচিত শব্দটা উঠে এল উপরে-ঝপাৎ!
গভীর, থমথমে হয়ে উঠেছে ওমেনার মুখের চেহারা।
কুয়াশা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মৃদু হাসি লেগে আছে ঠোঁটে। বলল, লোকগুলো নোংরা। ঠাণ্ডা নদীর পানিতে গোসল করার দরকার ছিল ওদের। শীতের দেশের লোক, একেবারে সইতে পারবে না তা মনে কোরো না।
ওমেনা বলল, আর ওই হতভাগা! ওর কি হবে?
জ্ঞান কি ফিরেছে? কথাটা বলে কুয়াশা নিঃসাড় পড়ে থাকা রোগা পাতলা লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ মেলে পিট পিট করে তাকাচ্ছে লোকটা। চোখ মুখ থেকে আতঙ্কের ছাপ এখনও দূর হয়নি। কুয়াশা বসল হাঁটু মুড়ে তার সামনে। বলল, কি হে বাপ, কে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে এত রাত করে?
লোকটার চোখেমুখে আতঙ্কই শুধু নয়, সেই সাথে ঘৃণা এবং হিংস্রতারও ছাপ ফুটে আছে। খুবই আশ্চর্য বোধ করল কুয়াশা। লোকটা কি অকৃতজ্ঞ? যে তাকে রক্ষা করেছে তার প্রতি এমন ঘৃণা এবং বিদ্বেষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কি মানে?
কিছু বলো! কে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?
লোকটা মুখ বিকৃত করে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল খ্যাপা কুকুরের মত, lch will gar nichts sagen.
ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার।
এমন সময় নিরীহ গোছের রোগা-পাতলা লোবটা তার বাঁ হাতটাকে বিদ্যুৎবেগে তুলে সাপের মত ছোবল মারল কুয়াশার চোখ লক্ষ্য করে। তৈরি ছিল না কুয়াশা। তবে এক পলক আগে মাথাটা পিছন দিকে সরিয়ে নিল বলে এ যাত্রা তার একটা চোখ বেঁচে গেল।
ব্যর্থ হয়ে যেন আরও মরিয়া হয়ে উঠল লোকটা। তার ডান হাতের কব্জির সাথে অ্যাটাচিকেসের শিকল বাধা। কিন্তু বাঁ হাতটা মুক্ত। সেই মুক্ত হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে শিকারী বিড়ালের মত আবার সে কুয়াশার মুখ লক্ষ্য করে ছোবল মারুল।
বিস্ময় নয় শুধু, কুয়াশার মুখে কৌতুকও ফুটে উঠল।
ধীরে, বন্ধু, ধীরে! বলে ডান, হাত দিয়ে লোকটার বা হাত ধরে ফেলল কুয়াশা। তারপর তাকাল ওমেনার দিকে।
সাথে সাথে ওমেনা বলল, ভারি অবাক কাণ্ড, স্বীকার করছি। তবে ঝামেলা না বাড়িয়ে একেও নদীতে ফেলে দিয়ে চলো হোটেলে ফিরে যাই।
আরে না! তা কি হয়? গন্ধ পাচ্ছ না?
ওমেনা বলল, কিসের গন্ধ?
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল, রহস্যের?
ওমেনা বল, রহস্যের গন্ধ? কোথায়?
কুয়াশা বলল, পরে ব্যাখ্যা করে বলব। এখন মিস্টার বিদেশীকে অচল করা দরকার।
কথাটা বলে কুয়াশা মিস্টার বিদেশীর বগলের নিচে বা হাতের আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে নার্ভ সেন্টার খুঁজতে শুরু করল। তিন সেকেন্ড পর নার্ভ সেন্টারে চাপ দিতেই লোকটা বিনা প্রতিবাদে জ্ঞান হারাল।
কুয়াশা উঠে দাঁড়াল।
এমন সময় শোনা গেল হুইসেলের শব্দ।
পুলিস আইটাছে কস্! ডি. কস্টা কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলল।
যা ভয় করেছিলাম, তাই হতে যাচ্ছে। সেই পুলিসী হাঙ্গামায় শেষ পর্যন্ত জড়ালে তুমি নিজেকে।
ওমেনার গভীর কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ এবং তিরস্কার দুইই প্রকাশ পেল।
কুয়াশা বলল, সত্যিই তো!
হুইসেলের শব্দ দূর থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।
ব্রিজের নিচে লুকোবার জায়গা আছে। কুইক!
রেলিংয়ের ধারে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। গাঢ় কুয়াশা বলে সুবিধে এই যে পুলিসের লোকেরা দূর থেকে ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে না।
কুয়াশা রেলিং টপকে নামল ব্রিজের কার্নিসে। ডি. কস্টা উঠে বসল রেলিংয়ের উপর। তাকে ধরে নামিয়ে নিল কুয়াশা রেলিং থেকে। বিজের তলায় প্রশস্ত একটা ল্যাণ্ডিং, নদী থেকে কংক্রীটের পিলার উঠে এসে যেখানে শেষ হয়েছে। সেই ল্যাণ্ডিংয়ে ডি. কস্টাকে বসিয়ে দিয়ে কার্নিসে ফিরে এসে কুয়াশা দেখল ওমেনাও উঠে বসেছে রেলিংয়ের উপর। ওমেনাকেও কুয়াশা একই পদ্ধতিতে ল্যাণ্ডিংয়ে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এল আবার কার্নিসে।
রেলিং টপকে ব্রিজের উপর নামল কুয়াশা। মিস্টার বিদেশীর অচেতন দেহটা পিঠে নিয়ে ফিরে এল সে।
হুইসেলের শব্দ কাছাকাছি চলে এসেছে।
রেলিং টপকে কার্নিসে, কার্নিস থেকে ল্যাণ্ডিংয়ে পৌঁছুল কুয়াশা। এমন সময় বুটজুতোর ছুটন্ত শব্দ পৌঁছল ওদের কানে।
বিজের উপর দিয়ে দুইজোড়া বুট জুতো ছুটে গেল একদিক থেকে আরেক দিকে। কুয়াশা কার্নিসে ফিরে গিয়ে মাথা উঁচু করে কি যেন দেখল, গভীর আকার ধারণ করল তার মুখের চেহারা।
একসময় দূরে মিলিয়ে গেল বুটজুতোর ছুটন্তু শব্দ।
চাপা কণ্ঠে ওমেনা বলল, ধরা পড়লে এই বিদেশে কি যে হবে!
ডি. কস্টা পকেট থেকে বাণ্ডির বোতলটা বের করে ঢক ঢক করে দুঢোক ব্যাণ্ডি পান করল। শার্টের আস্তিন দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল সে, চরা কেন পড়িব? সাহস এবং বুড়ি ঠাকিলে ঢরা পড়িবার কোন কারণ নাই। বুড়ি হামাডের এনাফ পরিমাণে আছে। সাহস ডরকার। সাহস সঞ্চয়ের জন্য মড্য পান করিটেছি। ব্যস, সব প্রবলেম সলভ হইয়া গেল।
ওমেনা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, যেই না তালপাতার সেপাই, আপনার আবার সাহস!
কুয়াশার দিকে উদ্বিয় চোখে তাকাল ওমেনা, এখানে থাকলে ধৰা পড়বই পড়ব। চলো, পালাবার চেষ্টা করি।
কুয়াশা বলল, অত ব্যস্ততার কি আছে? পুলিস দুজন ফিরে আসবে এখুনি, বিজে উঠলেই ধরা পড়ে যাব।
ফিরে আসবে?
ওই আসছে!
আরও খানিক পর ডি কস্টা এবং ওমেনা সত্যি সত্যি বুটজুতোর শব্দ পেল। ছুটে নয়, এবার হেঁটে ফিরে আসছে পুলিস দুজন।
ব্রিজের উপর দিয়ে চলে গেল তারা।
নিঃশব্দে বসে রইল ওরা আরও মিনিট তিনেক। নিস্তব্ধতা ভাঙল ওমেনা, আমরা না হয় হোটেলে ফিরব। কিন্তু সাধের এই ঝামেলাটাকে নিয়ে কি করবে?
সাথে এ আমাদের ঝামেলা নয়, কৌতূহল, মূর্তিমান কৌতূহল একটা। একে আমরা আমাদের মেহমান হিসেবে গ্রহণ করছি।
তার মানে?
তার মানে একে আমরা আমাদের হোটেলে নিয়ে গিয়ে জামাই-আদর করব।
সে কি! কেন? এমন কাণ্ড কেউ করে নাকি?
কুয়াশা সহাস্যে বলল, না, কেউ করে না–আমরা করি। কি জানো, ওমেনা, গত কমাস হাত-পা গুটিয়ে নিরামিষ জীবন যাপন করে বড় হাঁপিয়ে উঠেছি। ঘটনাচক্রে রহস্যের গন্ধ যখন একটু পেয়েছি, এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। হাতে কাজকর্ম নেই, সময়টা অন্তত কাটবে তো। চলো, এখান থেকে উঠি এবার।
ব্রিজের উপর উঠে চারদিক দেখে নিয়ে ক্লিয়ারেন্স সিগন্যাল দিল কুয়াশা। ডি. কস্টা এবং ওমেনা উঠে এল উপরে। কুয়াশা বলল, এক সাথে তিনজন না থাকাই ভাল। মি. ডি কস্টা, আপনি দূর থেকে আমাদেরকে ফলো করে আসবেন।
ডি. কস্টা পকেট থেকে ব্র্যাণ্ডির বোতল বের করে মিস্টার বিদেশীর চোখেমুখে কয়েক ফোঁটা ব্র্যাণ্ডি ছিটিয়ে দিল। বলল, মাটাল বন্দুকে হাপনি সাহায্য করছেন, ঢরা পড়িলে এই অজুহাটটা কাজে লাগাটে পারিবেন।
রাত তখন তিনটে। ইন্সৰুকের দেশে যানবাহন বা লোকজন কিছুই নেই। দেয়ালের ছায়ার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে এগোল কুয়াশা, কাঁধে অচেতন মিস্টার বিদেশী। ওমেনা কুয়াশার পিছু পিছু, ছায়ার মত লেগে আছে।
সাততলা উঁচু কুর্কাজা হোটেলটা দূর থেকে দেখা গেল, আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাইড ওয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। কাঁধের বোঝাটাকে দুহাত দিয়ে ধরে পাঁচিলের উপর রাখল সে। তারপর ওমেনার কোমর ধরে শূন্যে তুলে নিল তাকে। নামিয়ে দিল পাচিলের সমতল মাথায়।
ওমেনা নিজেকে সামলে ভাল করে সবার আগেই টের পেল পাশে কুয়াশার উপস্থিতি। বাদুড়ের মত লাফ দিয়ে নিচে নামল কুয়াশা। অন্ধকারে আর কিছু দেখা না গেলেও কুয়াশার সাদা ধবধবে মুক্তোর মত দুপাটি দাঁত রেডিয়ামের মত জ্বল জ্বল করছে দেখতে পেল ওমেনা। দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে কুয়াশা। ওমেনা সমর্পণ করুল নিজেকে বলিষ্ঠ সেই দুহাতের মধ্যে।
নিচে নামিয়ে দিল কুয়াশা ওমেনাকে। ওমেনার মনে হলো কেউ যেন তাকে নরম ফুলের বিছানায় আলতো ভাবে নামিয়ে দিল।
পাঁচিলের উপর থেকে মিস্টার বিদেশীকে কাঁধে তুলে নিয়ে কুয়াশা বলল, এগোও।
সিটিংরূমের জানালা দিয়ে এর আগেই বাগানটা দেখা আছে ওমেনার। অন্ধকারে সেই দেখাটাকে কাজে লাগিয়ে ফুল গাছের ফাঁক দিয়ে সরু রাস্তার উপর দিয়ে এগোল সে।
কুয়াশা কুর্কাজা হোটেলের গ্রাউণ্ড ফ্লোরের একটা সুইট ভাড়া নিয়েছে। মাত্র তেরো ঘন্টা আগে এই হোটেলে উঠেছে ওরা।
দুর থেকেই দেখা গেল ওমেনার বেডরূমের জানালাটা খোলা রয়েছে। সেদিকে এগুচ্ছিল ওমেনা। হঠাৎ অনুভব করল, পাশ দিয়ে দমকা বাতাসের মত কে যেন ছুটে গেল।
জানালা টপকে বেডরূমে ঢুকে ওমেনা একটা দরজা খোলা বা বন্ধ হবার শব্দ পেল। সুইচ অন করে আলো জ্বেলে দেখল কুমাশা রুমের ভিতর নেই।
এক সেকেন্ড পরই কুয়াশা পাশের রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল। পাশের রূমটা কুয়াশার বেডরুম। ওমেনার রূমটা পড়েছে মাঝখানে। সিটিংরুমটা সামনের দিকে, সেটা ডি. কস্টার শয়নকক্ষ হিসেবে নির্ধারিত।
মিস্টার বিদেশীকে…?
কুয়াশা বলল, বেচারা ঘুমাচ্ছে এখনও। ওকে বিছানার সাথে বেঁধে রেখেছি হ্যান্ডকাফ দিয়ে।
ওমেনাকে উদ্বিগ্ন দেখাল, মুখে তুলো গুঁজে দিলে ভাল হয়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে যদি চেঁচাতে শুরু করে?
হাভানা চুরুটের প্যাকেট থেকে বেছে একটা চুরুট বের করে সোফায় বসল কুয়াশা। গ্যাস লাইটার জ্বেলে চুরুটে অমিসংযোগ করে নীলচে, একরাশ ধোয়া ছাড়ল। বলল, মিস্টার বিদেশী চিৎকার টিকার করবে না। এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। কাঁদতে পারে, গোঙাতে পারে, কাশতে পারে কিন্তু সাহায্যের জন্যে চিৎকার সে করতে পারে না।
মৃদু টোকা পড়ল সিটিংরুমের দরজায়।
ওমেনার বিস্মিত চোখের সামনে কুয়াশা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ওমেনার বিস্ময়ের কারণ, কুয়াশা হঠাংকেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। .. সিটিংরুমের দিকে পা বাড়াল কুয়াশা। হিপ পকেট থেকে লোডেড রিভলভারটা বের করে নিল সে দ্রুত।
ওমেনা পিছু নিল কুয়াশার।
সিটিংরুমে ঢুকে পা টিপে টিপে বারান্দার দিকের দরজার দিকে এগোল কুয়াশা। ওমেনা তার ঘাড়ের কাছ থেকে চাপা স্বরে বলল, আমার মনে হয় মি. ডি. কস্টা।
কুয়াশা চাপা স্বরে উত্তর দিল, জানি। হয়তো তাই। কিন্তু মি. ডি. কস্ট ছাড়াও আর কেউ আসতে পারে, অন্তত কারও না কারও আসা উচিত, আশা কয়ছি আমি।
কী-হোলে চোখ রেখে বাইরেটা দেখে নিল কুয়াশা। দরজা খুলে দিল সে। সরে দাঁড়াল এক পাশে।
সিটিংরূমে প্রবেশ করল ডি কস্টা। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল সে। চাপা স্বরে জানতে চাইল, মিস্টার বিডেশী কোঠায়?
কুয়াশা বলল, আমার বেডরূমে। ওর জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
অপেক্ষা না হয় করলাম। কিন্তু লোকটার কাছ থেকে কি আশা করছ তুমি?
কুয়াশা ওমেনার প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হেসে বলল, রহস্য।
ডি. কস্টা তার ইদানীং গজানো গোফে তা দিতে দিতে বলল, চলুন টাহলে, দেখা যাক বিডেশীর সেনস্ ফিরিয়াছে কিনা।
ওমেনার বেডরূমে ঢুকল ওরা। সকলের আগে কুয়াশা। নিজের বেডরূমের দরজা খুলল সে।
ওমেনা বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে! বলে সশব্দে বসে পড়ল সে সোফায়। ডি. কস্টা হেলে দুলে অনুসরণ করল তার কসকে।
নিজের বেডরূমের দরজা খুলে ভিতনে প্রবেশ করল কুয়াশা। অন্ধকার। মাত্র দুকদম এগিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। ঠাণ্ডা, শীতল বাতাস লাগল তার চোখেমুখে। এবং যেখানে পর্দা ঢাকা জানালা থাকার কথা সেখানে সে দেখল নক্ষত্রের আলো, দূরাকাশের কয়েকটা নক্ষত্রও দেখা গেল। নিঃশব্দে পিছিয়ে এল কুয়াশা। ডি. কস্টা সুইচবোর্ডের সুইচে আঙুল রাখতে যাচ্ছি, তার হাতটা খপ করে ধরে নামিয়ে দিল কুয়াশা। একটু পর, মি. ডি. কস্টা!
অন্ধকারে আবার পা বাড়াল কুয়াশা। খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কাঁচের শার্সিটা নামিয়ে দিল সে দ্রুত। তারপর পর্দা টেনে ঢেকে দিল জানালাটা। কাজগুলো করার সময় কুয়াশা মনে মনে ভাবছিল, সর্বনাশ! নিজের হাতে শার্সি নামিয়েছি খানিক আগে, পর্দা টেনে দিয়েছি। কে খুলল?
জানালার কাছে হাতে উদ্যত রিভলভার নিয়ে কুয়াশা কথা বলে উঠল, মি. ডি.কস্টা, এবার আপনি আলো জ্বালতে পারেন।
খুট করে শব্দ হতেই আলো জ্বলল।
অত্যন্ত সুসজ্জিত বেডরূম কুয়াশার। সবুজ রঙের দামী কার্পেট মেঝেতে। দেয়ালে জার্মান শিল্পীদের তৈলচ্চিত্র টাঙানো। শো-কেস, টিডি, ফোন, ওয়াল সেফসবই সুরুচির পরিচায়ক।
চকচকে বাটের ছোরাটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলতে লাগল ডি কস্টা। মি. বিদেশীর বাঁ দিকের বুকে আমূল বিধে আছে হোরাটা। লোকটার ডান হাতটা কলহে খাটের পাশে। ডান হাতটার সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা অ্যাটাচিসেটা। কার্পেটের উপর পড়ে রয়েছে। অ্যাটাচিকেসটার উপকার চামড়া ছোরা দিয়ে ফালা ফাগ করে কাটা হয়েছে। ভিতর থেকে উঁকি মারছে চকচকে ইস্পাতের গা।
.
০৩.
গম্ভীর হয়ে গেছে কুয়াশা। ঝাড়া এক মিনিট নিঃশব্দে লাশটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তার দীর্থ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।
খাটের সাথে লোকটার বাঁ হাত বেঁধে রেখে গিয়েছিল কুয়াশা। চাবি দিয়ে হ্যাঁকাফের তালা খুলে বাঁ হাতটা মুক্ত করল সে।
দোরগোড়া থেকে চাপা কঠর ভেসে এল ওমেনার, গুড গড! একি! কিভাবে ঘটল!
লাশের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই কুয়াশা উত্তর দিল, খুব সহজেই ঘটেছে ঘটনাটা। আমাদেরকে কেউ অনুসরণ করেছিল। আমরা যখন পাশের রূমে কথা বুলছি, সে বাইরে থেকে জানালার শার্সি খুলে ভিতরে ঢুকে কাজ সেরে গেছে। এ লোকটা খুন হলো কেন তা আবিষ্কার করতে হলে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
বিদেশ-বিভূঁইয়ে একি বিপদে পড়লাম…।
কুয়াশার খেয়াল নেই কারও কথায়। পায়চারি শুরু করেছে সে। তবে অস্থির বা উত্তেজিত দেখাচ্ছে না তাকে। চিন্তা-ভাবনা করছে বলে মনে হলো। পায়চারি থামিয়ে খাটের পাশে হাটু গেড়ে বল একবার। পরীক্ষা করুল অ্যাটাচিকেসটা।
এত ভারি হয় না কোন অ্যাটাচীকেস। এত ভারির কারণ, এটা কোন অ্যাটচিকেসই নয়। উপরে চামড়ার খোল, নিচে ইস্পাতের তৈরি ছোট একটা পোর্টেবল সেফ।
সত্যিই তাই। চামড়ার খোলসটা সরিয়ে ফেলতেই দেখা গেল নীলচে রঙের ইস্পাতের সেটাকে। সেটার গায়ের তালা এবং শিকল পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা, কমবিনেশন লক। নাম্বার জানা না থাকলে কারও পক্ষে খোলা সম্ভব নয়। মি. ডি কস্টা, সুটকেস থেকে ক্যানভাসের ব্যাগটা বের করুন।
ডি. কস্টা ব্যাগটা বের করে আনল। সেটা খুলে কুয়াশা একটা বোতল বের– করল। একটা রবারের পাইপে বোতল থেকে তরল পদার্থ ঢালল সে অতি সাবধানে। বলল, হাইড্রোয়োরিক অ্যাসিড। সবচেয়ে ক্ষুধার্ত রাসায়নিক পদার্থ। প্রায় সবকিছু খেয়ে ফেলে।
রবারের গায়ে চাপ দিতে ফোঁটা ফোঁটা অ্যাসিড পড়ল লোহার শিকলের গায়ে। বাষ্প উঠল, ছক ছক করে শব্দ হলো। গলে গেল লোহা।
সেটা খোলা সম্ভব নয় ওই অ্যাসিড দিয়ে?
কুয়াশা বলল, না। এই ধরনের সেফ যারা তৈরি করে তারা জানে, অ্যাসিড দিয়ে খোলার চেষ্টা হতে পারে, তাই এমন ইস্পাত দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয় যে বিশ বছর এটাকে অ্যাসিডে ডুবিয়ে রাখলেও এতটুকু ক্ষয় হবে না।
আবার পায়চারি শুরু করল কুয়াশা। পায়চারি না থামিয়েই বলতে শুরু করল, কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। রহস্যের কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে এই পোর্টেবল সেটা। সেটার ভিতর বিস্ময়কর কিছু আছে। ব্রিজের উপর বিদেশীকে যারা কাবু করার চেষ্টা করছিল তারা এই সেটা দখল করার জন্যেই…
হামারও টাই বিশ্বাস।
কুয়াশা বলে চলেছে, লোকটা খুন হলো কেন? সম্ভাব্য তিনটে কারণ দেখতে পাচ্ছি আমি। ক) কারণ, সেটা তার কাছে ছিল, তাই। খ) কাল, সে চিৎকার করে লোক জড়ো করতে পারত, তাই। গ) কারণ, সে কাউকে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করতে পারে; তাই। যে লোক একে খুন করেছে সে সেফটা চুরি করার চেষ্টা করেছে, এর প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। লোহার শিকলটা কাটার মত কোন যন্ত্র বা রাসায়নিক দ্রব্য তার কাছে ছিল না, তাই সে ব্যর্থ হয়। সে অবশ্য হাতটা কেটে ফেলতে পারত কনুই থেকে, কিন্তু ছোরাটা দিয়ে তা ভব নয় বলে সে চেষ্টা সে করেনি। ছোরাটা ধামাল বটে, কিন্তু খুবই সরু।
ডি. কস্টা বলল, বস, আমি শুনিয়াছি, ব্যাঙ্কের কর্মচারীগণ হাটের সাঠে শিকল ডিয়া বঁটা অ্যাটাচিকেস লইয়া টুর করে।
হয়তো করে। কিন্তু রাত আড়াইটা-তিনটের সময় করে না।
ওমেনা বলল, তার মানে তুমি বলতে চাইছ লোকটা চোর?
চোর কিনা জানি না। তবে অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
কথাগুলো বলে কার্পেটের উপর থেকে ইস্পাতের পোর্টেবল সেটা তুলে নিল কুয়াশা। সেটার ওজন অনুমান করতে করতে চেস্ট অব ড্রয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। চেস্ট-অব-ড্রয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে বলল, লোকটা অপরাধী ছিল। কিন্তু কে তাকে খুন করল?
ওমেনা বলল, কে আবার? বিরোধী দলের কেউ। তুমি যাদেরকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলে তাদেরই কেউ একজন।
এদিক ওদিক মাথা দোলাল কুয়াশা, তাদের কেউ হলে, কই, পানির দাগ কই? নদী থেকে উঠে গা মুছে শুকনো কাপড় পরে এসেছিল বলবে? না, এত অল্প সময়ে তা সম্ভব নয়। বিরোধী দলের কেউ, এটা ঠিক। কিন্তু এই বিরোধী দলটাকে দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি আমাদের। এরা আমাদের অপরিচিত। ঘটনা যেখানে ঘটছিল, ওই বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি সবসময় উপস্থিত ছিল সেখানে সকলের অজ্ঞাতে। জলহস্তী তিনজন…
জলহস্তী মানে? এর মধ্যে জলহস্তী কোথায় পেলে তুমি?
কুয়াশা মৃদু একটু হাসল, যাদেরকে নদীতে ফেলে দিলাম, তারে কথা বলছি। ওদের নাম-ধাম জানা নেই, তাই জলহস্তী বশী। এ রা কারা? কি তাদের পরিচয়
জানো তুমি?
কুয়াশা মুচকি হাসল, জানি। কিন্তু বলতে সাহস পায় না। একে উঠবে তোমরা।
কি! আঁৎকে উঠব? আঁৎকে উঠব কেন? কারা তারা?
ডি. কস্টাকে চিন্তিত দেখাল। কুয়াশার মুখের দিকে নিস্পলক চোখে চেয়ে আছে সে। চোখেমুখে একটা ভয় ভয় ভাব ফুটে উঠছে তার। বস যে ফালতু কথা। বলে না তা তার অজানা নয়। এমন কিছু বলবেন তিনি, যাতে আঁতকে উঠতে হবে।
কুয়াশা মুখ খুলতে যাচ্ছে দেখে ডি. কস্টা সবেগে দুহাত তুলে দুকানের কাছে নিয়ে গেল। দুকানের ছিদ্রে দুহাতের তর্জনী ঢুকিয়ে দিল সে। ভয়ে শুনবে না সেকুয়াশার কথা, ভাবটা এইরকম।
বলো, কারা তারা?
ওমেনা যেন হঠাৎ অনুমান করতে পেরেছে, কুয়াশা কি বলবে। গলাটা তাই বুঝি একটু কেঁপে গেল তার।
কুয়াশা বলল, জলহস্তীরা অপরাধী নয়। তারা এ দেশের পুলিস।
ডি. কস্টা কানে আঙুল দিলেও নিজেকে ফাঁকি দিয়ে কুয়াশার কথা ঠিকই কানে ঢোকাল সে। কুয়াশার কথা শেষ হতে মুখ বিকৃত করে বলে উঠল চাপা কণ্ঠে, বাঘে ছুঁইলে আঠারো ঘা, পুলিস ছুঁইলে ছত্রিশ ঘা। মাই গড! বিদেশেও মি. সিম্পসনের চেলাডের সাঠে বিরোঢ় ডেখা ডিল!
ওমেনা বলল, কি! কিন্তু।
কুয়াশা মৃদু মৃদু হাসছে।
তুমি কি শিওর?
পুলিস ছাড়া আর কি হতে পারে তারা? মি বিদেশী পালানোর জন্যে একবারও চিৎকার করেনি। কেন? কারণ, সে জানত, সাহায্য চাইলেও সাহায্য পাবার কোন আশা নেই তার। পুলিশের বিরুদ্ধে গিয়ে কে তাকে সাহায্য করবে? তারপর, মিস্টার বিদেশী জার্মান ভাষায় যে কথাটা বলল–কথাটা শুনেই সব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। কি বলেছিল সে, মনে আছে? Ich will gar nichts sagen- কথাটার অর্থ হলো, কোন কথাই আয় করতে পারবে না আমার কাছ থেকে।-অপরাধী মাত্রেই এই কথাটা বলে থাকে ধরা পড়লে। মজার বিষয় হলো, লোকটা আমাকে পুলিসের সদস্য বলে মনে করেছিল।
ডি. কস্টা প্রায় ককিয়ে উঠল, টাহার মানে আমি ল্যাং মারিয়াছি পুলিসকে। গড, সেভ মি, এটোক্ষণে যেটারী পরোয়ানা জারি হইয়া গিয়াছে হামার নামে।
কুয়াশা খানিকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, আমরা অদৃশ্য একদল শর সাথে বিবাদ বাধিয়ে বসেছি। তারা লোকটাকে খুন করেছে, কিন্তু আরও অনেক কিছু করার কথা ভাবছে তারা। যে খুন করেছে সে ফিরে গেছে তার দলের কর্মকর্তাকে রিপোর্ট করতে। তারা এখন পরিকল্পনা রচনায় ব্যস্ত। পরিকল্পনা করতে কতক্ষণ সময় লাগবে জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, তারা ফিরে আসবে। সম্ভবত দলবল নিয়েই আসবে। পোর্টেবল সেটা দখল করার জন্যে। ওমেনা, সত্যি কথা বলতে কি, আমি বিদেশ ভ্রমণে এসে এ ধরনের একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাইনি। কিন্তু…
চুপ করে গেল হঠাৎ কুয়াশা। চেস্ট-অব-ড্রয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছিল সে। সিধে হয়ে দাঁড়াল। পোর্টেবল সেটা ওভারকোটের বাঁ দিকের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
সিটিংরুমের বারান্দার দিকে যে দরজা সেই দরজায় টোকা পড়ছে বলে মনে হলো।
কুয়াশা নিচু স্বরে বলল, কেউ ছড়ি ঠুকে ঠুকে আসছে। ওমেনা মি. ডি. কস্টা, সম্ভবত শত্রুপক্ষের আগমন ঘটছে।
ওমেনার বেডরূমে ঢুকল কুয়াশা। পকেট থেকে হাতে বেরিয়ে এসেছে ওয়েবলি অটোমেটিকটা, বৈদ্যুতিক আলোয় চকচক করছে সেটা। পরীক্ষা করে দেখে নিল কুয়াশা এগোতে এগোতে, সাইলেন্সর ফিট করল, সেফটি ক্যাচ অন করল, তারপর সেটা ঢুকিয়ে রাখল ওভারকোটের সাইড পকেটে। ডান হাতটা পকেটটা থেকে বের হলো না আর।
ওমেনার বেডরূম থেকে কুয়াশা সিটিংরূমে পৌঁছুল। বারান্দার দিকের দরজার দুপাশে দাঁড়াল ওরা। এক দিকে কুয়াশা, অপরদিকে ওমেনা এবং ডি. কস্টা।
ছড়ির শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। তালা খুলে আধ ইঞ্চিটাক ফাঁক করুল কুয়াশা। কাউকে দেখা গেল না ফাঁক দিয়ে।
কে তাহলে ছড়ির শব্দ করছিল।
উত্তরটা এল অপ্রত্যাশিতভাবে, পিছন দিক থেকে।
ভরাট একটা কণ্ঠস্বর ওদের তিনজনের পিঠের উপর যেন উত্তপ্ত চাবুক মারল, দয়া করে তাড়াহুড়ো করবেন না। বিপদ ঘটতে পারে।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা।
ওমেনার বেডরূম এবং সিটিংরূমের মধ্যবর্তী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সুবেশী, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এক ব্যক্তি। তার হাতে চকচক করছে কালো রঙের একটা রিভলভার। লোকটার চোখেমুখে কৌতুকের হাসি। বাঁ হাতে ধরা চকচকে একটা ওয়াকিং স্টিক।
ওমেনা এবং ডি. কস্টাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে কুয়াশা অকস্মাৎ সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে হোঃ হোঃ করে ভরাট গলায় অদম্য হাসিতে ফেটে পড়ল।
উচ্চকণ্ঠে হাসি থামল কুয়াশার এক সময়। কৌতুক এবং ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে সে বলল, দ্য ক্রাউন প্রিন্স রুডলফফর গডস সেক, তোমাকে আমি মোটেই আশা করিনি!
.
০৪.
ছড়ি ধরা হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট প্রিন্স রুডলফের। নীলচে ধোয়া উঠছে একেবেকে সেটা থেকে। প্রিন্স রুডলফ মুচকি হাসছে। বলল, বন্ধু, সত্যি কথা বলতে কি, আমিও তোমাকে আশা করিনি! তোমার সাথে আবার আমার দেখা হবে, কল্পনাও করিনি।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে অতীতে ফিরে গেল কুয়াশা। ইউরোপে দীর্ঘদিন থাকার সময় প্রিন্স রুডলফের সাথে টক্কর লেগেছিল তার। রুডলফ প্রিন্স হলেও এমন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। গোটা ইউরোপে একসময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এই রুডলফ। তার প্রকৃত পরিচয় ইউরোপের পুলিস কখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রিন্স হিসেবে সে সর্বমহলের শ্রদ্ধা এবং ভক্তি পেত এবং সেই সুযোগে গোপনে সুসংগঠিত দল পরিচালনা করে লুটপাট, খুন, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, স্মাগলিং ইত্যাদি হাজার রকম অপরাধ একের পর এক ঘটিয়ে যেত। সেই সময় কুয়াশার সাথে রুডলফের বিরোধ বাধে। সে আজ বছর পাঁচেক আগের কথা। ইতিমধ্যে অনেক দিন কেটে গেছে। বয়স হয়েছে রুডলফের। ইউরোপে নতুন নতুন গ্যাঙ লীডারদের আর্বিভাব ঘটেছে। তাদের সাথে আপোষ করে চলতে হয় আজকাল রুডলফকে। তার দলের বল-শক্তি আগের মত নেই আর।
ইউরোপবাসী বন্ধু বান্ধবের মাধ্যমে এসব তথ্য জানা আছে কুয়াশার।
কুয়াশা লক্ষ করল, প্রিন্স রুডলফ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার ওভারকোটের উঁচু হয়ে থাকা সাইড পকেটটার দিকে। কুয়াশার সাথে চোখাচোখি হতে মুচকি হাসল রুডলফ। বলল, মাই ডিয়ার মিস্টার কুয়াশা, আমি বিশ্বাস করি, বোকামি করবে না তুমি। একরাতে একটা লাশই যথেষ্ট, ঠিক কিনা? নিশ্চয়ই তুমি আমাকেও লাশে পরিণত করার কথা ভাবছ না?
কুয়াশা বলল, ভুল করছ তুমি, রুডলফ। তোমার কি মনে নেই, একসময় লাশ সংগ্রহ করা ছিল আমার অন্যতম কাজ? সে যাক, যে লোক খুন করেছে সে তোমার দলেরই কেউ। অর্থাৎ, এই খুনের জন্য তুমি দায়ী।
রুডলফের মুচকি হাসিটা দেখার মত। ঠোঁটে যেন আজন্ম লেগে আছে। বলল, স্বীকার করছি, আমার এক বুদ্ধ অনুচরের বোকামি এটা। এটা একটা অপ্রয়োজনীয় হত্যা। এমিলাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে যেন বিজিম্যানকে শুধু অনুসরণ করে এবং বিজিম্যান গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো মাত্র সে যেন আমাকে রিপোর্ট দেয়। বিজিম্যান পুলিসের হাতে ধরা পড়ে, তারপর তোমার দ্বারা মুক্ত হয়। এই ঘটনা চাক্ষুষ করে বুদ্ধ এমিলের মাথা খারাপ হয়ে যায়। দিশে হারিয়ে কি করা উচিত ভেবে না পেয়ে তোমাকে সে অনুসরণ করে এখানে পৌঁছায় এবং বিজিম্যানকে খুন করে। সে যাক, বিজিম্যান গেছে। এমিলোকে অবশ্য চরম শাস্তিই দিয়েছি আমি। তুমি তো জানো, বন্ধু, আমার নির্দেশ যে অক্ষরে অক্ষরে পালন না করে-এ পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে তাকে আমি বঞ্চিত করি। কৌতূহল মিটল এবার?
কুয়াশা বলল, না। বিজিম্যান কে?
রুডলফ চুরুটে টান দিল। ভুরু কুঁচকে উঠল তার, এত সব কথা জানার কি দরকার তোমার, বন্ধু?
অনেক দরকার। পোর্টেবল সেফকি আছে এতে?
কিসে কি আছে?
কুয়াশা হাসল। বলল, হাসালে দেখছি! যে জিনিস তুমি নিতে এসেছ আমার কাছ থেকে, সেটার কথা বলছি আমি। কি আছে ওটায়, রুডলফ? সেটার জন্যে একজন মানুষ খুন হয়েছে। ওটার ভিতর কি আছে জানতে হবে আমাকে।
রুডলফ বাকা হেসে বলল, নিজের পজিশন সম্পর্কে তুমি দেখছি সচেতন নও, বন্ধু।
কুয়াশা বলল, ভুল করছ। আমাকে তুমি চেনো না তা নয়। যা জানতে চাই, তা আমি জানবই, যত বিপজ্জনক পজিশনেই থাকি না কেন।
রুডলফের চোখ-মুখ-ঠোঁট থেকে এই প্রথম হাসির ছিটে ফোঁটা পর্যন্ত উবে গেল। লাল মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। ভারি গলায় থেমে থেমে বলল সে, আমি আগন্তুক, বন্ধু। এবং আমি এসেছি নিজের জিনিস খোঁজ করতে। কথা যা বলবার আমিই বলব। তুমি উত্তর দেবে শুধু। আর একটা কথা। তোমার মঙ্গল চাই আমি। তোমার মঙ্গল চাই বলেই তোমাকে কোন তথ্য জানাতে চাই না। অজ্ঞ থাকো, সেটা হবে তোমার জন্যে সবচেয়ে ভাল।
রিস্টওয়াচ দেখল রুডলফ। বলল, যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি আমরা। মাই ডিয়ার মি. কুয়াশা, তুমি যখন বিজিম্যানকে মুক্ত করো তার হাতের সাথে বাধা একটা অ্যাটাচিকেস ছিল। অ্যাটাচিকেসটা ক্যামোফ্লেজ, ভিতরে ছিল একটা স্টীলের সেফ। জিনিসটা আমার সম্পত্তি। ফেরত পেলে আনন্দিত হব।
দেয়ালের গায়ে হেলান দিল কুয়াশা। অলসভঙ্গিতে বলল, কে না জানে হাতছাড়া জিনিস ফেরত পেলে লোকে আনন্দিত হয়। কিন্তু রুডলফ, আবার ভুল করছ তুমি। এই একটু আগে না বললাম, যা জানতে চাই তা আমি জানবই। সেফের ভিতর কি আছে বলে আমাকে।
বললে? বললে ফিরিয়ে দেবে তুমি সেটা?
কুয়াশা দেয়ালের কাছ থেকে দুপা এগিয়ে এসে থামল। হাসল সে,,কথা দিচ্ছি না। সেফের ভিতর এমন কিছু আছে যেটা তোমার জন্যে লোভনীয়। কে জানে, আমারও লোভ জাগতে পারে। তাই কথা দিতে পারি না। তবে লোভ না হলে, ফিরিয়ে দেব।
রুডলফ কি যেন ভাবল। তারপর ছড়িটা শূন্যে তুলে মোরাল একবার।
ছড়িটা ঘোরাতে কুয়াশার মনে কোন সন্দেহ জাগল না। সন্দেহ না জাগাটাই কাল হলো তার জন্যে।
রুডলফের হাতে রিভলভার থাকলেও সে জানত কুয়াশার ওভারকোটের পকেটেও রিভলভার আছে এবং সেটা ধরে আছে কুয়াশা ডান হাত দিয়ে। রুডলফ জানে, গুলি করতে গেলে গুলি খাবার আশঙ্কাও ষোলো আনা। কুয়াশা বিদ্যুতের গতির সাথে পাল্লা দিতে পারে।
গুলি করার ঝুঁকি তাই নেবার কথা ভাবছিল না রুডলফ।
এদিকে কুয়াশা ভুলেই গেছে একটা কথা। দরজার বাইরে বারান্দায় যে ছড়ির শব্দ হয়েছিল এই ব্যাপারটাকে রুডলফের উপস্থিতির ফলে গুরুত্ব দেয়নি সে।
রুডলফ শূন্যে ছড়ি ঘোরাতেই দরজার কবাট নিঃশব্দে খুলে গেল।
পায়ের শব্দ পেল কুয়াশা কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শীতল ধাতব পদার্থের স্পর্শ অনুভব করুল সে মাথার পিছনে ঘাড়ের উপর। স্থির পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা।
বাহ! চমৎকার! মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড, মি. কুয়াশা, এত সহজে তোমাকে কাবু করা সম্ভব, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। যে মি. কুয়াশাকে আমি চিনতাম, সে ছিল যেমন দুধ তেমনি দুঃসাহসী। ডজনখানেক রিভলভারের সামনেও সে বাঘের মত গর্জন করত, স্প্রিঙের মত লাফাত। নাহ্, তুমি বুড়ো হয়ে গেছ, বন্ধু! তোমার সাথে প্রতিযোগিতা জমবে না আর।
কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল রুডলফ। কুয়াশার মুখোমুখি এসে থামল সে। ঠাণ্ডা, নির্বিকার দৃষ্টিতে দেখছে তাকে কুয়াশা।
কুয়াশার ওভারকোটের বাঁ দিকের সাইড পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে পোর্টেবল সেটা বের করে নিল রুডলফ। এক পা এক পা করে পিছিয়ে গেল সে। উজ্জ্বল, বিজয়ীর হাসিতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
মাই ডিয়ার ওল্ড ফ্রেন্ড, গুডবাই! বিলীভ ইট অর নট, তোমার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে। শত্রু হলেও তুমি ছিলে আমার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। তোমার সাথে প্রতিযোগিতায় অ্যাডভেঞ্চার ছিল, খ্রিল ছিল। কিন্তু দুঃখের বিয়ে, বয়স তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সাহস, গতি, তেজ এবং বুদ্ধি। তোমাকে জানিয়ে যাচ্ছি, তোমার সাথে এখন থেকে আমার কোন বিরোধ নেই। আমার সাথে প্রতিযোগিতা করার উপযুক্ততা তুমি হারিয়েছ।
বড্ড বেশি কথা বলছ তুমি। আগে এত কথা কিন্তু বলতে না। শান্তভাবে কথাগুলো বলল কুয়াশা।
হোঃ হোঃ শব্দে হেসে উঠল প্রিন্স রুডলফ।
রুডলফের হাসির উত্তর দিল কুয়াশার ওভারকোটের পকেটের ভেতর থেকে ওয়েবলি অটোমেটিকটা। দুপ করে মৃদু শব্দ হলো মাত্র।
গুলি করার সাথেই লাফ দিয়ে সরে গেল কুয়াশা। বুলেটটা গুঁড়ো করে দিয়েছে সিটিংরূমের একমাত্র বালবটাকে। গাঢ় অন্ধকারে আবার শব্দ উঠল সাইলেন্সর লাগানো রিভলভারের–দুপ! কুয়াশা নয়, এবার গুলি করেছে রুডলফের অনুচর।
গুলি করেছে লোকটা অনুমানের উপর, সামনের দিকে। গুলিটা কুয়াশাকে লেগেছে কিনা বোঝার জন্যে কান পেতে রইল সে, কোন যন্ত্রণাক্ত ধ্বনি শোনায় আশায়। এমন সময়, কে যেন তার হাট দুটো ধরে শূন্যে তুলে ফেলল তাকে। কিছু করার আগেই শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো সে। সিলিংয়ের গায়ে গিয়ে সজোরে ধাক্কা খেল মাথাটা। অসহনীয় যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল লেকটা। সশব্দে পড়ল সে কার্পেটের উপর। বেকায়দায় পড়ে ডান পাটা মচকে গেল তার। জ্ঞান হারাল সে।
খুট করে শব্দ হলো।
উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল সিটিংরুম। আলো জ্বেলে ডি. কস্টা দেখল, প্রিন্স রুডলফ নেই।
নেই কুয়াশাও।
চারদিকে কোথাও কোন শব্দ নেই।
.
০৫.
সিটিংরুমের জানালা গলে অন্ধকার বাগানে নামল কুয়াশা। চোখ এবং কান সজাগ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে অন্ধকারে। গাঢ় কুয়াশায় ভাল দেখা যায় না কিছু, তবু রুডলফের মূর্তিটাকে দেখতে পেল সে।
বাগানের কালো পাচিলের কাছে চক চক করে উঠল সাদাটে কিছু একটা রুডলফের হ্যাট ওটা, অনুমান করল কুয়াশা।
অগ্রসর হলো কুয়াশা। নিঃশব্দে হাঁটার ব্যাপারে কুয়াশার জুড়ি নেই। বিড়ালের নিপুণতাও হার মানে তার কাছে। কয়েক পা এগোবার পর কুয়াশা শুনতে পেল রুডলফের পদশব্দ। পাচিল ঘেঁষে গেটের দিকে পালাচ্ছে সে।
মুচকি হেসে এগোতে লাগল কুয়াশা। রুডলফ গেটের কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু কুয়াশা তাকে অনুসরণ করল না। সোজা পাচিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। পাচিলের গায়ে পা দিয়ে উঠে পড়ল মাথায়।
গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে হাত বিশেক বাঁয়ে। পটিলের সমতল মাথায় পা ফেলে ফেলে এগোল কুয়াশা।
গাড়িটার কাছে পৌঁছে বসে পড়ল সে। বাঁ দিক থেকে ছুটে আসছে একটা মূর্তি। রুডলফ।
কুয়াশার ঠিক নিচেই বড় আকারের মার্সিডিজ বেঞ্জটা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির শোফায় বসে আছে ভিতরে।
রুডলফ কোন দিকে না তাকিয়ে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল, কুয়াশার ঠিক নিচে। রুডলফের মাথার চুল মুঠো করে ধরে ফেলতে পারে কুয়াশা এখন।
কিন্তু তেমন কিছু করল না সে। রুডলফ এত ভঙ্গিতে দরজা খুলে গাড়ির ভিতর প্রবেশ করল। স্টার্ট লি মার্সিডিজ। মুহূর্ত-মাত্র বিল না করে নিঃশব্দে নেমে পড়ল কুয়াশা গাড়ির ছাদে। হাতপা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল সে ফাহাদের গায়ে।
কাজটা যে প্রায় পাগলামির পর্যায়ে পড়ে সে ব্যাপারে সচেতন কুয়াশা। মার্সিডিজ যে কোথায় গিয়ে থামবে, জানে না সে। ইউরোপের যে কোন দেশে যেতে পারে এটা মাঝপথে কোথাও একবারও না থেমে। কিংবা, হয়তো তিনশো মাইল এক নাগাড়ে ছোটার পর কোথাও থামবে। সেখান থেকে কুর্কাজা হোটেলে ফেরা সহজ হবে না মোটেই। তাছাড়া, গাড়ির ছাদ এমনই মসৃণ যে ঝাঁকুনিতে বা বাঁক নেবার সময় কুয়াশা পড়ে যেতে পারে যেকোন মুহূর্তে। বিদ্যুৎবেগে গাড়ির ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া মানে মারাত্মকভাবে আহত হওয়া কিংবা নিহত হওয়া। তার উপর রুডলফ বা পুলিশের চোখে ধরা পড়ে যাবার ভয় তো আছেই।
ওদিকে, ওমেনা এবং ডি. কস্টার কাঁধে সে দিয়ে এসেছে একটা লাশ এবং একজন বন্দীর বোয্য। ওরী জানেও না, কোথায় যাচ্ছে সে। সে নিজেও কি জানে!
কিন্তু জানতে হবে। রুডলফের আস্তানাটা চিনতে হবে। আস্তানাটা চেনার জন্যেই কুয়াশা এতগুলো ঝুঁকি নিয়েছে।
ওমেনার বুদ্ধির উপর আস্থা আছে তার। ডি. কস্টা এবং ওমেনা দুজন মিলে চেষ্টা করলে সবরকম বিপদ থেকে সাময়িকভাবে হলেও মুক্ত থাকতে পারবে, এ বিশ্বাস তার আছে।
গাড়ি ছুটছে। ছাদের উপর শুয়ে থাকাটা প্রায় অস্য বলে মনে হলো। পিছলে দেহটা একবার এদিক, আরেকবার ওদিকে সরে যাচ্ছে। জোরে গাড়িটা যদি ঝাঁকুনি খায়, পড়ে যাবে সে।
পিছনের দিকের দুকোনার খাঁজে দুপায়ের জুতোর আগা ঠেকিয়ে রাখল কুয়াশা। একইভাবে সামনে দুকোনার খাঁজে রাখল দুহাতের আঙুলগুলো। ফলে মৃদু ঝাঁকুনিতে বিপদের আশঙ্কা রইল না।
গাড়ির গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে। বাক নেবার সময় বিপদের গুরুত্বটা টের পেল কুয়াশ। চার কোনার খাজ থেকে পা এবং হাতের আঙুল সরে গেল। প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে ছাদের উপর রাখতে সফল হলো বটে, কিন্তু ঘেমে একাকার হয়ে গেল মাত্র তিন কি চার সেকেন্ডের মধ্যে।
পরবর্তী বাকে যে কি পরিণতি হবে ভাবতেও শিউরে উঠল কুয়াশা। মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকাল কুয়াশা। অদূর ভবিষ্যতে গাড়ি আবার বাঁক নেবে বলে মনে হলো না তার। বাই-ওয়ে ধরে ঝড়ের বেগে ছুটছে মার্সিডিজ। দেহটা বকা করে একপাশে সরিয়ে আনল সে মাথাটা। গাড়ির পাশে মাথা নামিয়ে দিয়ে উঁকি দিল সে।
আলোকিত গাড়ির ব্যাক সীটে বসে আছে রুডলফ। কোলের উপর রেখেছে সে পোর্টেবল সেটাকে। তৃপ্তি এবং বিজয়ের ফলে মিটি মিটি হাসছে আপন মনে রুডলফ।
মাথা তুলে নিয়ে আবার চারকোনার চার খাজে পা এবং হাতের আঙুল রাখল কুয়াশা। চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করল সে। রুডলফের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, এমিলো অনুসরণ করছিল বিজিম্যানকে। সে বিজিম্যানকে মুক্ত করল। এমিলে বিজিম্যানকে কুয়াশার হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে খুনই করে ফেলল ওকে। এবং এমিলোর কাছ থেকে খবর পেয়েই রুডলফ নিজে হোটেলে পৌঁছুল। পোর্টেবল সেটাই এত সব দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী। সেটা এখন রুডলফের দখলে।
শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করল মার্সিডিজ। এরমধ্যে বার চারেক বাঁক নিয়েছে গাড়িটা। নিজের কৃতিত্ব যতটুকু, তার চেয়ে বেশি ভাগ্যগুণে প্রতিবার নিচে ছিটকে পড়া থেকে বেঁচে গেল কুয়াশা।
অবশেষে একটা প্রাইভেট রোডে প্রবেশ করল মার্সিডিজ। রাস্তার শেষে প্রকাণ্ড একটা লোহার গেট। সেটা খুলে যাচ্ছে, মাথা তুলতে দেখতে পেল কুয়াশা। গেটের ভিতর দুর্গের মত গভীর চেহারার মস্ত একটা বাড়ি।
রুডলফের আস্তানা।
গেটম্যানকে দেখতে পেল কুয়াশা হেডলাইটের আলোয়। রুডলফ অর্থাৎ তার মনিবকে সম্মান জানাবার জন্যে লোকটা মাথা হেঁট করায় সুবিধে হলো কুয়াশার। লোকটার চোখে ধরা পড়ল না সে।
গেট অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করল মার্সিডিজ।
দুপাশে ফুলের বাগান। মাঝখানে কংক্রিটের রাস্তা। গাড়ি-বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে সামনে।
এই-ই সুযোগ। গাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিল কুয়াশা। বাগানের ভিতর পড়ল সে। এতটুকু নড়ল না কুয়াশা। শুধু মাথাটা একটু উঁচু করল। গাছে ফাঁক দিয়ে সে দেখলগাড়ি-বারান্দায় থামছে মার্সিডিজ।
গাড়ি থেকে রুডলফ নামল। হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে তিনটে ধাপ টপকে করিডরে উঠল সে। বন্ধ হয়ে গেল করিডরের দরজা।
গেটম্যান গাড়ির কাছে পৌঁছুল। গাড়ি থেকে নামল শোফার। কামানো মাথা লোকটার। বৈদ্যুতিক আলোয় চকচক করছে। ভাটার মত বড় বড় লাল চোখ। গেটম্যানের কাঁধে হাত রেখে কথা বলতে বলতে হেসে উঠল সে শব্দ করে। কর্কশ, বেসুরো কর।
গেটম্যান ফিরে গেল গেটের দিকে। শোফার দৈত্যটা গাড়িতে উঠল। গাড়ি বারান্দায় গাড়ি ঘুরিয়ে গেটের দিকে মুখ করে রাখল সেটাকে। তারপর স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে আবার গাড়ি থেকে নামল। শিস দিতে দিতে দুর্গের পিছন দিকে চলে গেল সে।
বাগান থেকে উঁচু টার উপর দিকে তাকাল কুয়াশা। জানালা দরজা সব বন্ধ। শুধু চারতলার একটা জানালা দিয়ে মৃদু আলোর রশি বেরিয়ে আসছে, জানালাটার পাশেই একটা ব্যালকনি। ব্যালকনির দরজা বন্ধ।
ওখানে পৌঁছতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। চারতলার ওই আলোকিত রূমে কিভাবে পৌঁছুনো সম্ভব ভেবে নিয়েছে সে। জানালার কার্নিস, পানির পাইপ, ব্যালকনির রেলিং ইত্যাদি ধরে ঝুলতে ঝুলতে উঠতে হবে তাকে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
পানির পাইপ বেয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠল কুয়াশা। একটা অচেনা পাখি ডেকে উঠল কানের কাছে। পাখা ঝাঁপটাবার শব্দ হলো। ক্রমশ, মিলিয়ে গেল সেশব্দ দূরে। একটা জানালার কার্নিসে পা দিয়ে ডান হাত উঁচু করে ধরার চেষ্টা করছে সে বালকনির কানিস। জানালাটার মাথায় শেড আছে, সেটা ধরে রেখেছে সে বাঁ হাত দিয়ে।
চারদিকে শীতল রাত্রির নিস্তব্ধতা। কেউ কোথাও জেগে নেই। গেটটা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। গুমটি ঘরে গেটম্যান ঢুকেছে খানিক আগে। সভবত শুয়ে পড়েছে সে। ওমটি ঘরের জানালাটা দেখা যাচ্ছে, অন্ধকার সেটা জানালা দিয়ে গেটম্যান কুয়াশাকে দেখে ফেলতে পারে হঠাৎ। কিংবা, এই মুহূর্তে হয়তো, সে অবাক বিস্ময়ে কুয়াশাকেই দেখছে।
রক্তহিম করা তীক্ষ্ণ একটা আর্ত চিৎকার প্রবেশ করুল কুয়াশার কানে। শব্দটা এমনই অপ্রত্যাশিত এবং যন্ত্রণাক্ত যে কুয়াশার মত অকুতোভয় মানুষকেও বেসামাল করে তুলল। বাঁ হাতটা ফস্কে যাচ্ছিল শেড থেকে, শেষ মুহূর্তে সেটা শক্ত করে ধরে ফেলায় বেচে গেল সে।
দীর্ঘ আর্ত চিৎকারটা থামল একসময়। কিন্তু কুয়াশা এমনই নাড়া খেয়েছে যে নড়াচড়ার কথা ভুলে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল সে দীর্ঘ দশ সেকেও।
আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারদিক। স্বপ্নের মত মনে হলো ব্যাপারটাকে। নিস্তব্ধতা এমনই জমাট বেঁধে গেছে যে বিশ্বাস করাই কঠিন এই মাত্র কোন লোক অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেছিল।
ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল কুয়াশা। এমন বিদঘুটে চিৎকার এর আগে কখনও শোনেনি সে। সর্ব শরীরের লোম দাঁড়িয়ে আছে এখনও তার। হৃৎপিণ্ডের গতি গেছে বেড়ে।
চিৎকারটা উপরের কোন রূম থেকেই এসেছে। হাত উঁচু করে ব্যালকনির কার্নিস ধরতে গিয়ে আবারও ব্যর্থ হলো কুয়াশা। ঝুঁকিটা নিতেই হবে, সিদ্ধান্ত নিল সে লাফ দিল কুয়াশা। শুনে উঠে গেল তার দেহ। ব্যালকনির নিচের লি নয়, উপরের রেলিঙের মাথা ধরে ফেলল সে। কার্নিসে পা তুলে দিয়ে উঠে পড়ল লাফ দিয়ে রেলিংয়ের উপর। রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে আবার লাফ দিল সে।
চারতলার আলোকিত জানালার সামনে গিয়ে ড্রিল দুয়াশা। নালায় কাঁচের শালি, তার উপর পর্দা ঝুলছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে কাঁচের শার্সি ভেদ করে কমটার ভিতর তাকাতে কুয়াশা দেল ফুডল বসে আছে একটা টেবিল সামনে নিয়ে তার লাইব্রেরী রমে।
জলও চট দাঁত দিয়ে ধরে রেখেছে রুডলফ। টেবিলের উপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঠকঠক করে টোকা মারবে সে। ঠোঁটে বিচিত্র একটুকরো হাসি ঝুলছে।
মুখোমুখি বসে আছে একটা কাঠের চেয়ারে একজন লোক। লোকটার পরনে না আছে সোয়েটার, না আছে কাট, না আছে ওভারকোট। ট্রাউজার এবং শট পরে আছে সে এই প্রচণ্ড শীতে। লোকটা স্থান, রুডলফের চেয়ে বেশি হবে। পানি তো হবেই।
লোকটা হাত দুটো চেয়ারের হাতলের সাথে চকচকে ধাতব পদার্থের যাওকাফ দিয়ে আটকানে। ইস্পাতের তৈরি একটা গোলাকার ফ নোটার মাথাকে ঘিরে রেখেছে। যা মাথার সাথে এটে বসে আছে শক্তভাবে। তার বুক এবং চেয়ারের পিঠকে জড়িয়ে রেখেহেহোকেল।
রুডলফ কথা বলছে জার্মান ভাষায়। দেখো, কাকোস, উনতি করতে হলে, সফলতা লাভ করতে হলে অনেক নিয়ম-নীতি আছে। আমি সবচেয়ে সহজতম নিয়মটা মেনে চলি। লোককে তৃতা ভালবাসি যতক্ষণ তাকে দিয়ে কাজ আদায় করা যায়। তারপর তাকে সরিয়ে দিই। একটা কাজে তোমাকে দরকার ছিল আমার। কাজটা মোটামুটি শেষ হয়েছে। আমার কাছে তুমি কাজ উদ্ধারের জন্যে একটা যন্ত্র বৈ কিছু হিলে না। আর মাত্র একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। কমবিনেশন মিলিয়ে সেটা খুলে দাও। ব্যস, তারপর তোমাকে আর দরকার হবে না আমার। তোমার সাহায্য ছাড়াও এটা খোলা সম্ভব। কিন্তু তাতে সময় লাগবে, ঝামেলা বাড়বে। খুলে দিলে তুমিও শারীরিক যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে।
নিষ্ফল আক্রোশে কাকোস চেঁচিয়ে উঠল, শয়তান! বিজিম্যানকে তাহলে এই ভাবেই খুন করেছ?
কাকোস শরীর মোচড়াতে লাগল চেয়ারে বসে। পা দুটো পায়ার সাথে, হাত দুটো হাতলের সাথে বাঁধা, নিজেকে মুক্ত করার কোন উপায়ই তার নেই।
কুয়াশা দেখল, কাকোস হাত দুটো অবিরাম মোচড়াচ্ছে বলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে কব্জি দুটোর কাছে, ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত পড়ছে কার্পেটের উপর।
রুডলফ বলে চলেহে, না হে, না। বিজিম্যানকে খুন করেছে এমিলে। বিজিম্যান ইনকে সত্যিই পৌঁছেছিল। পথে তাকে পুলিসে ধরে। মজার ব্যাপার হলো, পুলিসদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করে আমারই পুরানো এক বাঙালী পরম বন্ধু। সৌভাগ্যক্রমে, আগের সেই তীক্ষ্ণধার বুদ্ধি এবং বেপরোয়া সাহস নেই বন্ধুটির মধ্যে। তাই তেমন কোন কষ্টই হয়নি আমার তার কাছ থেকে তোমার সম্পত্তিটা কেড়ে নিয়ে আসতে। সবই তো জানালাম। এবার বলো, কাকোস, সেটা খুলবে?
অসম্ভব! আমাকে মেরে ফেললেও…
হো হো করে হেসে উঠল রুডলফ। হাসি থামিয়ে বলল, মেরে তো ফেলবই, এ ব্যাপারে তোমার কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে মরতে চাও তুমি? কষ্ট পেয়ে, না কষ্ট না পেয়ে?
কাকোসের সর্ব শরীর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। রক্ত চক্ষু মেলে, রুড়লফের দিকে তাকিয়ে রইল সে। বলল, যেভাবে খুশি মারো আমাকে, রুডলফ। কিন্তু একটা কথা তোমারও জানা থাকুক, সেফের তালা আমি খুলে দিচ্ছি না।
স্পষ্ট ভাষায় যারা কথা বলে তাদেরকে আমি পছন্দ করি। খুলবে না তাহলে? আর একবার শুনতে চাই উত্তরটা।
না! না! না!
চিৎকার করে উঠল কাকোস। বলতে লাগল, আমাকে মেরে ফেলবে তুমি, আর তোমার কাজ সহজ করার জনো তালাটা খুলে দেব। আমি…এত ভীতু আর বোকা মনে করো তুমি আমাকে? সেফটা তোমার পক্ষে খোলা সম্ভব নয়, রুডলফ। এ তুমিও জানো। খুলতে হলে আমার সাহা ছাড়া তোমার উপায় নেই। এবং আমার সাহায্য পেতে হলে আমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে। এর জন্যে সময় দরকার।
রুডলফ গম্ভীর হয়ে উঠল, সময় দরকার? আর কত সময় নষ্ট করব আমি? এই সেফে যা আছে তা হস্তগত করার যে পরিকল্পনা তুমি রচনা করেছিলে, তার কথা গত তিন মাস আগেই জেনেছি আমি প্রথমে খুব দ্বন্দ্বে ভুগেছি। প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তোমাকে মাটির নিচে পাঠিয়ে দিই স্থায়ীভাবে। কিন্তু পরে ভেবেচিন্তে বের করি এই ব্যবস্থাটা। ঠিক করি, তোমার কাজে বাধা না দিয়ে সুযোগের সন্ধানে ওত পেতে বসে থাকব আমি। ধুরন্ধর লোক তুমি, অর্গানাইজড় দল আছে ছোটখাট একটা, জানতাম ঠিকই তুমি বের করে আনবে মহামূল্যবান জিনিসটা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, চোরাপথে চোরাচালান হয়ে ইউরোপে যখন জিনিসটা প্রবেশ করবে, যখন ওটা গ্রহণ করার জন্যে তুমি নির্দিষ্ট জায়গায় অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে ঠিক তখনই চিলের মত ছোঁ মারব আমি। তোমার বন্দীদশা এবং আমার হাতে সেফের উপস্থিতি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার পরিকল্পনাটা ঘষালো আনার উপর সতেরো আনা সফল হয়েছে। সমস্যা এখন একটাই, সিক্রেট কমবিনেশন মিলিয়ে সেফের তালাটা খুলতে হবে। খুলে দাও, কাকোস।
রুডলফের শেষ কথাটা অস্বাভাবিক গভীর শোনাল।
অসম্ভব! আমি বরং মরব তবু
মরবে তো বটেই! কিন্তু তালা না খুললে মৃত্যুও নেই তোমার কপালে। কপালে জুটবে শুধু তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা। কাকোস, সভবত যন্ত্রণার স্বাদটা তুমি ভুলে গেছ। ফ্রিজকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিতে বলি, কেমন?
কাকোসের চেয়ারের পিছনে উঁচু একটা টুলের উপর বসে আছে একজন লোক। লোকটা এতটুকু নড়াচড়া করেনি এতক্ষণ। পাথরের মূর্তির মত বসে আছে সে। ডান চোখের মণি নেই তার, মণির জায়গায় গভীর একটা কালো গহ্বর। ফর্সা মুখে তামাটে রঙের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। আসলে ওগুলো পক্সের দাগ।
রুডলফ হাত নেড়ে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিল ফ্রিজকে। ফ্রিজ দাঁত বের করে হাসল নিঃশব্দে। হাসলে বীভৎস রূপ ধারণ করে ফ্রিজের মুখটা। কদর্য, কুৎসিত লাগে চেহারাটা।
পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে আবার কাকোসের শরীর। দাতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে সে। হু-হুঁ করে ঘামছে সে। চেয়ারের হাতলের সাথে বাধা হাত দুটো কাঁপছে তার।
নাকি মত বদলাবে? সহাস্যে জিজ্ঞেস করল রুডলফ।
চেয়ারের হাতলের অগ্রভাগ চেপে ধরুল কাকোস। আঙ্গুলের মাথাগুলো সাদা, রক্তশূন্য হয়ে গেল। চাপা, প্রায় রুদ্ধ গলায় সে বলল, না!
ফ্রিজকে অনুমতি দিল রুডলফ আত্তে করে মাথাটা এক দিকে কাত করে।
ফ্রিজের হাতটা উঠে গেল কাকোসের মাথার পিছনে। কাকোসের মাথার চারদিকে আটকানো যন্ত্রটার হাতলটা পিছন দিকেই। হাতলটা ধরে ঘোরাতে শুরু করল ফ্রিজ ধীরে ধীরে।
শিউরে শিউরে উঠছে কাকোস। চোখ দুটো বুজে ছটফট করতে শুরু করল সে একটু পরেই। গলা থেকে বেরিয়ে আসছে দুর্বোধ্য, যন্ত্রণাক্ত গোঙানি।
ফ্রিজ নির্বিকার। আরও যোরাচ্ছে সে হাতলটা। আরও ধীরে ধীরে।
রুডলফ হাসছে মুচকি মুচকি। তর্জনী দিয়ে টোকা মারছে সে টেবিলে, ঠক, ঠক, ঠক…
দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছিল কুয়াশা। রুডলফের পাষণ্ডতা দেখে তার ইচ্ছা হলো গলা চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে শয়তানটাকে খুন করার। কিন্তু সময় হয়নি এখনও, অনুভব করল সে। সময় না হলে নাটকের মঞ্চে প্রবেশ করা উচিত নয়। কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে।
ওভারকোটের পকেট থেকে ওয়েবলি অটোমেটিকটা বের করল কুয়াশা। রুডলফকে শায়েস্তা করা দরকার। এই মুহূর্তে। বড় বেশি বেড়ে গেছে সে।
এমন সময় রুডলফ হাত-ইশারায় ফ্রিজকে থামতে নির্দেশ দিল। কাকোস তখনও ছটফট করছে তীব্র ব্যথায়।
.
০৬.
কাকোস, খুলবে তালা?
কাকোস চোখ মেলল। চোখের সাদা অংশটা রক্তের মত লাল দেখাচ্ছে। তার। চিৎকার করে বলতে চাইলেও গলা দিয়ে তেমন শব্দ বের হলো না কাকোসের। না।
অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল কুয়াশা কাকোসের উত্তরটা।
ধীরে সুস্থে নতুন একটা চুরুট ধরাল রুডলফ। পোর্টেবল সেটা তুলে নিয়ে কাকোসের কাছাকাছি টেবিলের উপর রাখল সে।
এখনও চিন্তা করে দেখো। তুমি তৈরি হলেই সেটাকে সামনে পাবে। একবার শুধু রাজি হও, অমনি ফ্রিজ ঘুরিয়ে ঢিলে করে দেবে টা। আরাম পাবে। যদি চাও দুঢোক ব্যাণ্ডিও খাওয়াবে তোমাকে ফ্রিজ। তারপর হাতের হ্যাণ্ডকাফ খুলে দেবে সে তোমার। তুমি সেফের তালাটা খুলে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি, তোমাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলা হবে কি হবে না সে ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবনাচিন্তা করে দেখব আমি।
কথা বলতে বলতে ইশারা করল রুডলফ। ফ্রিজ হাতল মোরাতে শুরু করল আবার।
আবার সেই রক্ত হিম করা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার কানে ঢুকল কুয়াশার।
আর্ত চিৎকারটা কানে ঢুকতে এবারও কুয়াশা আর একটু হলে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
নিজেকে সামলে নিয়ে রুমের ভিতর তাকাল সে। দেখল ফ্রিজ টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কাকোসের পাশে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে হাতের হ্যান্ডকাফ দুটো খুলে দিচ্ছে সে।
কাঁপা, রক্তাক্ত হাত দুটো টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কাকোসের। জুলফি, কপাল বেয়ে ঘামের ধারা নামছে। চিবুক থেকে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম পড়ছে তার বুকে, উরুতে।
কাঁপা হাতে সেটা ধরল কাকোস।
রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে রুডলফ। বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত গোটা মুখ।
কাকোসের গলা থেকে উঠে আসছে দুর্বোধ্য, মৃদু একটা ধ্বনি। অনেকটা গোঙানির মত শোনাচ্ছে শব্দটা।
ভীত-ত্রস্ত কাকোস কমবিনেশন মিলিয়ে তালাটা খোলার কাজে মগ্ন। মাত্র বিশ কি পঁচিশ সেকেণ্ড পর খটখট খটাস করে শব্দ বেরিয়ে এল তালাটার ভিতর থেকে। তারপর সশব্দে ম্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উন্মুক্ত হয়ে গেল সেফের ঢাকনি। অবসাদে জ্ঞান হারল কাকোস।
এই সময় জানালার কাঁচে ঘুষি মেরে ভেঙে ফেলল শার্সিটা কুয়াশা, লাফ দিয়ে প্রবেশ করুল লাইব্রেরী রূমের মেঝেতে।
মেঝেতে পা দিয়েই কুয়াশা হুমকি দিয়ে বলল, এতটুকু নড়েছ কি মরেছ। রুডলফ, সিধে হয়ে বসো তুমি। ফ্রিজ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো, আর বন্ধ করো চোখের পাতা! চোখটা খুলতে দেখলে গুলি করব আমি।
সিধে হয়ে বসল না শুধু রুডলফ, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, একেবারে। নিস্পলক চোখে চেয়ে আছে সে কুয়াশার মুখের দিকে। বিস্মিত দৃষ্টি চোখে, নিজের চোখকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
কুয়াশা রুডলফের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কাকোসের মাথার পিছনে। হাতলটা ঘুরিয়ে তার মাথা থেকে খুলে নামিয়ে রাখল টরচার মেশিনটাকে।
মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড, মি. কুয়াশা, আমি পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি টরচার-মেশিনটা এমনই একটা মেশিন যে এর সাহায্যে যাকে কষ্ট দেয়া হয় তার মাথার চারদিকে সামান্য পরিমাণ দাগও তুমি দেখতে পাবে না। প্রমাণ করাই সম্ভব নয় যে কেউ তাকে কষ্ট দিয়েছে।
নিশ্চয়ই এটার আবিষ্কারক তুমি নিজে? কুয়াশা গভীরভাবে জানতে চাইল।
রুডলফ হাসল।বলল, মিথ্যে কথা বলব না, তুমি ঠিকই ধরেছ।
কুয়াশা হঠাৎ মুচকি হাসল, নিজে কখনও পরীক্ষা করে দেখেছ যন্ত্রটাকে? আই মীন, নিজের ওপর পরীক্ষা করেছ কখনও?
রুডলফের মুখ মান হয়ে গেল। বলল, কি বলতে চাও তুমি?
কুয়াশা বলল, বুঝতে পারোনি?
রুডলফ চুপ করে রইল। ঢোক গিলল সে।
কুয়াশা বলল, বুঝতে ঠিকই পেরেছ। হ্যাঁ, রুডলফ, যন্ত্রটা সত্যি কোনরকম দাগ রাখে কিনা দেখার জন্যে তোমার ওপর পরীক্ষা করব আমি। পরম বন্ধু তুমি আমার, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কি বেছে নিতে পারি অ মি?
রুডলফ বলল, কাকোসের সাথে কথা বলবার সময় তোমার পরিচয় দিই পরম বন্ধু বলে। কিন্তু আমি জার্মান ভাষায় কথা বলছিলাম। তুমি জার্মান জানো তা তো জানতাম না!
কুয়াশা সহাস্যে বলল, এইরকম শত শত ব্যাপার আছে যা তুমি জানো না, রুডলফ।
রুডলফ নড করার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল একটু, মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড, মি. কুয়াশা, তোমার যোগ্যতা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিলাম এবং সেজন্যে তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই একই ভুল এর আগেও তোমার ব্যাপারে আমি করেছি।
কুয়াশার চোখ পড়ল টেবিলের উপর, পোর্টেবল সেফের দিকে। সেফের ঢাকনিটা ভোলা বটে কিন্তু ভিতরে কি আছে তা বোঝার উপায় নেই। কারণ লাল মখমল বিছানো রয়েছে। মখমলের নিচে কি যে আছে, কে জানে!
চোখ তুলল কুয়াশা। রুডলফ চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ।
নিস্তব্ধতা ভাঙল রুডই, আমাকে কাবু করা সহজ কাজ নয়, বন্ধু। তাছাড়া, আমাকে খুন করে কি পাচ্ছ তুমি? ধরো, এখন যদি হঠাৎ চিৎকার করে উঠি আমি? জানো, দলের লোকেরা আশপাশেই আছে…
জানি না, জানার দরকারও নেই। কথাটা বলেই কুয়াশা বিদ্যুৎ বেগে রিভলভার ধরা ডান হাতটা মাথার উপর তুলেই সবেগে নামিয়ে আনল সেটা ফ্রিজের মাথার মাঝখানে।
টু-শব্দ করার অবকাশও পেল না কদর্য ফ্রিজ। হাঁটু দুটো ভাজ হয়ে গেল, হুড়মুড় করে ধরাশায়ী হলো তার জ্ঞানহীন দেহটা।
রুডলফের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে শান্ত কণ্ঠে কুয়াশা বলল, চোখটা খুলেছিল, তাই। যা বলছিলাম, রুডলফ। তোমাকে খুন করে কিছু পাব কি পাব না তা জানি না। কিন্তু তোমাকে খুন না করলেও কিছু পার না এটা জানি। কি জানো, একটুকরো উত্তপ্ত সীসা তোমার অ্যাপেনডিক্সের ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে ছুটে গেলে তোমার কি প্রতিক্রিয়া হয়, দেখতে ইচ্ছে করে।
রুডলফ হাত বাড়িয়ে চুরুটের বাক্সটা টেনে নিল। বাক্স থেকে একটা চুরুট বেছে নিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল সে। বলল, কি জানো, বন্ধু, তোমার রসিকতা করার এই যে ক্ষমতা, এটাও আমার অজানা ছিল।
হাত বাড়িয়ে গ্যাস লাইটারটা নিতে গিয়ে রুডলফ বিদ্যুৎবেগে একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসল। বাড়ানো হাতটা এগিয়ে গেল লাইটারটাকে ছাড়িয়ে। সবেগে হাতটা ধাক্কা মারল সেফের ঢাকনিতে।
খোলা সেটা বন্ধ হয়ে গেল এক পলকে।
রুডলফ হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামাতে বলল, প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমার অ্যাপেনডিক্স আছে বুদাপেস্টে।
রুডলফ জানে, তার প্রাণ ঝুলছে সরু একটা চুলের উপর। তবু, ভয়ের কোন ছাপ দেখা গেল না তার চেহারায়।
কুয়াশার চেহারা এমন হয়ে উঠেছিল মুহূর্তের জন্যে যে রুডলফ প্রমাদ গুনছিল, প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে কুয়াশা গুলি করে তার ইহলীলা সাঙ্গ করতে যাচ্ছে।
রুডলফ তবু হাসতে পারুল।
কুয়াশা বলল, খুব দেখিয়েছ বটে, রুডলফ। আর কিছু দেখাবার চেষ্টা কোরো না। যাও, দেয়ালের কাছে গিয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে। হাত দুটো মাথার ওপর তুলে রাখতে ভুলো না যেন আবার।
কুয়াশার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে বিনাবাক্যব্যয়ে নির্দেশ পালন করল রুডলফ। শো-কেসের পাশে, দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াল সে।
রুডলফের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে আনল কুয়াশা। সেটায় বসে ক্রেডল থেকে তুলল রিসিভারটা। ডায়াল করতে শুরু করল সে।
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া গেল ওমেনার।
কুয়াশা বলল, ওমেনা, খবর কি তোমাদের? কোথায় আছি আমি? এই… বন্ধুত্ব রক্ষা করছি।…দাঁড়াও, দাঁড়াও, একসাথে এত কথা জিজ্ঞেস কোরো না।…আগে তোমাদের খবর শোনাও…তাই নাকি?…ই, বুঝেছি! বলে যাও!
ওমেনার কথা শুনতে লাগল কুয়াশা মনোযোগ দিয়ে।
মিনিট দেড়েক পর শেষ হলো ওমেনার কথা।
কুয়াশা বলল, আচ্ছা! তা মি. ডি. কস্টাকে দাও তো রিসিভারটা!
ডি. কস্টা রিসিভার নিয়ে হাঁক ছাড়ল, বস!
হ্যালো, মি. ডি. কস্টা? শুনুন, জরুরী কটা কথা বলছি। স্পীডি দেখে একটা গাড়ি যোগাড় করুন এক্ষুণি। জেনবারের মেইন রোডে পাবেন আমাকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওমেনাকে নিয়ে পৌঁছে যান ওখানে। আমার আওতায় যে গাড়িটা রয়েছে সেটা তেমন ভাল নয়, তবু ওটা নিয়েই আমাকে অত দূরে পৌঁছুতে হবে। দেরি করবেন না যেন।
কথা শেষ না করে গুলি করল কুয়াশা। এক সেকেণ্ড দেরি হয়ে গেছে ডার, গুলি লাগল না রুডলফকে। শো-কেসের কবাট বন্ধ হয়ে গেছে, রুডলফ অদৃশ্য হয়ে গেছে সেটার ভিতর।
শো-কেসটা যে গোপন পথের ক্যামোফ্লেজ, জানা ছিল না কুয়াশার। রুডলফকে কবাট খুলে ভিতরে ঢুকতে দেখে গুলি করে সে। কিন্তু কবাট তখন বন্ধ হয়ে গেছে, গুলি কটের গায়েই লাগল।
রিসিভারটা তখনও কানের সাথে লাগানো।
উদ্বিম, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বারবার একই প্রশ্ন করে চলেছে ডি. কস্টা, হোয়াটস দ্য ম্যাটার বস? হোয়াটস দ্য ম্যাটার বস? বস্ আপনি আহট হইয়াছেন কি? বস্ হপিনি আহট হইয়াছেন কি?
কুয়াশা কথা না বলে হা-হা করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে সে বলল, রুডলফ পালিয়ে গেল, মি. ডি. কস্টা। গুলি করেও রুখতে পারলাম না। সে যাক, আপনাকে যা বলেছি তাই করুন। গাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ুন এই মুহূর্তে।
রিসিভার রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। পোর্টেবল সেটা ওভারকোটের পকেটে ভরে নিল দ্রুত। তারপর জানালার উপর উঠল এক লাফে।
নিচে, গ্রাউণ্ড ফ্লোরে দেখা যাচ্ছে মার্সিডিজ বেঞ্জটাকে।
কুয়াশা নামতে শুরু করল নিচের দিকে।
.
০৭.
আলো জ্বেলে রুডলফ এবং কুয়াশা দুজনের কাউকে দেখতে না পেয়ে ডি. কস্টা ওমেনার দিকে তাকাল, বসকে রুডলফ, না রুডলফকে বস কিডন্যাপ করিল?
ওমেনা রক্তচক্ষু মেলে ডি কস্টাকে দেখল। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা রিভলভারের সামনে।
রিভলভারটা রুডলফের জ্ঞানহীন অনুচরের হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। ওমেনা সেটা তোলবার জন্যে ঝুঁকতেই ডি. কস্টা হারে-রে রে রে করে ডাকাতের মত ছুটে এল।
প্রিন্সেস! সাবঢান! মাইয়া মানুষ আগ্নেয়-অস্ত্র ঢরিবেন না! ও-জিনিস বাহাদুর পুরুষ মানুষকেই শুধু মানায়।
ডি. কস্টা তুলে লি রিভলভারটা। তাকাল রুডলফের অনুচরের দিকে।
ওমেনা তীব্র কণ্ঠে জানতে চাইল, তা বাহাদুর বীর পুরুষ, এই জ্ঞানহীন বন্দীকে নিয়ে কি করবে এখন শুনি? গুলি করে মেরে ফেলতে চাও নাকি?
নো-নো! হামরা শান্ট-শিষ্ট নিরীহ ভরলোক। খুন খারাবির মদ্যে নাই। হামরা মি. অনুচরকে নাইলন কর্ড ডিয়া বাঁচিয়া রাখিব। বসের সুটিকেসে কর্ড আছে, লইয়া আসুন।
ওমেনা সুটকেস খুলে নাইলন কর্ড বের করে আনল।
হামাকে হেলপ করুন।
দুজনে মিলে অনুচরটিকে শক্ত করে বাঁধল ওরা। ডি. কটা বলল, এর মুখে টুলা গুঁজিয়া ডিলে ভাল হয়, টাই না?
ওমেনা তুলো নিয়ে এল। বন্দীর মুখের ভিতর জে পি ডি কস্টা সেই তুলল।
ওমেনা বলল, এরপর? কুয়াশা কবে যে ফিরবে বলে যায়নি। ধরুন, এক সপ্তাহ পর ফিরবে সে।
ডি. কস্টা আঁৎকে উঠল, সব্বোনাশ! ওয়ান উইক? সাট ডিন? সাট ডিনে বিজিম্যান ফুলিয়া-ফাপিয়া, পচিয়া…। নাকে রুমাল চাপা দিল ডি কস্টা। বলল, ডুর্গন্টে মারা যাইব হামরা!
পায়চারি শুরু করল ডি. কস্টা। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
ওমেনা সোফায় বসে লক্ষ করছে ডি. কস্টাকে। একসময় বলল সে, মাথা গরম না করে হাতের কাজগুলো শেষ করা দরকার আমাদের। বিজিম্যান সম্পর্কে যথা সম্ভব তথ্য দরকার আমাদের। লাশটা সার্চ করা দরকার।
ডি. কস্টা গভীরভাবে বলল, হামিও টাই ভাবিটেছিলাম। হাপনিও চলুন, হামাকে সাহায্য করিবেন।
আসলে লাশের সাথে একা থাকতে পারবে না ডি, স্টা, তাই ওমেনাকে সাথে নিতে চাইছে।
সোফা ছাড়ল ওমেনা, চলুন।
দুজনে কুয়াশার বেডরূমে হাজির হলো।
ডি. কস্টা রূমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওমেনার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, বস্ যটোক্ষণ না ফেরেন, হামাডের মদ্যে একটা সমঝোটা ঠাকা ডরকার।
সমঝোতা? কিসের সমঝোতা?
ডি. কস্টা বলল, হামরা ঝগড়া করিটে পারিব না। টর্ক করিটে পারিব না। একজন আর একজনকে না জানাইয়া কোঠাও যাইটে পারিব না। কেহ কাহাকেও…
শুধু বকবক করা আপনার স্বভাব, না? যান, কাজে হাত দিন।
ডি. কস্টা মুখ গোমড়া করে পা বাড়াল লাশের দিকে।
বিজিম্যানের কাপড়-চোপড় সার্চ করে পাওয়ার মধ্যে পাওয়া গেল কয়েকটা চিঠি। চিঠিগুলো লেখা হয়েছে প্যারিসের ঠিকানায়, বিজিম্যানের নামে। চিঠিগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। একটা চিঠি লেখা হয়েছে বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করার জন্যে তাগাদা দিয়ে। দ্বিতীয় চিঠিটা লিখেছে বিজিম্যানের বুড়ী মা, টাকা চেয়ে। তৃতীয় চিঠিটা এক পুরানো বন্ধুর কন্যার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে চিঠি লিখেছে
খয়েরী রঙের সর্বশেষ এনভেলাপটা তুলে নিল ওমেনা খাটের উপর থেকে, এটা কি?
ডি. কস্টা বলল, কিছু না, খালি, হামি পরীক্ষা করিয়া ডেকিয়াছি।
আসলেও তাই, এনভেলান্টা খালি। কিন্তু ডি. কস্টার চোখে যা ধরা পড়েনি, ওমেনার চোখে তা ধরা পড়ল। এনভেলাপের উল্টোপিঠে সুন্দর হস্তাক্ষরে একটা। ঠিকানা লেখা রয়েছে।
ঠিকানাটা নিম্নরূপ:
Zr 12 H Kurkaza
সুইট নম্বর বারো, হোটেল কুর্কাজা। তার মানে? বিজিম্যান তাহলে প্যারিস থেকে এই হোটেলেই আসছিল?
ডি. কস্টা বলল, টাজ্জব কি বাট!
ওমেনা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বলল, বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে বড় হোটেল বলতে এই কুর্কাজাই। কোন অপরাধীদলের নেতা এই হোটেলটাকে তার হেডকোয়ার্টার তৈরি করলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মি. ডি. কস্টা আমাদের ঠিক মাথার উপর কোন রূমে হয়তো এই মুহূর্তে বসে আছে অপরাধী দলের নেতা…।
ক্যাঙ্গারুর মত লাফ দিয়ে উঠল ডি কস্টা, মাই গড! প্রিন্সেস, নাম্বার টুয়েলভ সুইট হামাডের এই সুইটের ঠিক উপরেই অবঠিট। হামরা যখন এখানে উঠি, ম্যানেজার হামাডেরকে এগারো নাম্বার রূম ডিটে চাহিয়াছিল। কিন্টু বস রাজি হন নাই। টিনি বারো নাম্বার সুইটটা চাহিয়াছিলেন। বারো নাম্বারে একটা ফায়ার এস্কেপ আছে। কিন্টু গট কাল বারো নাম্বারটা ভাড়া হইয়া গিয়াছিল। টাই বস্ গ্রাউণ্ড ফ্লোরের এই সুইটটা পছন্দ করেন।
ওমেনা বলল, এখন উপায়?
উপায় টো ডেকিনা। প্রিন্সেস, বিপড ঘটিটে পারে। এখুনি অপরাঢিরা বলতে এইবুতরি করলে অতি মুহূর্তে বলেঅই গড প্রিনে এখানে উঠি, সডলবলে এখানে উপষ্ঠিট হইবে এবং আরও মার্ডার করিবে। আমি লুকাই। বলে খাটের নিচে ঢুকতে চেষ্টা করুল ডি. কস্টা।
ওমেনা ধমক দিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এমন ভীতু লোক তো আর দেখিনি। শুনুন, আমি দোতলাটা ঘুরে দেখে আসি। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।
ছোটালায় যাইবেন? বাট হোয়াই?
খাটের নিচে না ঢুকে ডি. কস্টা চঞ্চল দৃষ্টিতে দরজা আর জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে ওমেনার কাছে সরে এল।
বারো নম্বরে কেউ আছে কিনা জানা দরকার। আপনি এমন ভয় পেয়েছেন যে অগত্যা আমাকেই যেতে হবে দেখতে।
নো। এতটুকু ভয় পাই নাই। মাইয়া মানুষ চিরকাল অবলা। পুরুষমানুষ চিরকাল বাহাঙুর। হামি ঠাকিটে হাপনি যাইবেন, টা কি হয়? হামি যাইটেছি। বলিয়া ডিন, এনিমিডের ডেখা পাইলে কি করা উচিট হইবে হামার? হামি কি টাহাদেরকে বণ্ডী করিয়া এইখানে নিয়া আসিব? নাকি, খুন করিয়া সমস্যার সমান। করিয়া আসিব?
বাইরের ফায়ার এস্কেপটা খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না ডি. কস্টাকে। লনে বেরিয়ে বাঁ দিকে খানিকটা এগোতেই লোহার দীর্ঘ একটা মই দেখতে পেল সে। নিস্তব্ধ শীতের রাত। হোটেলের কোন বোর্ডারই জেগে নেই। দোতলায় উঠে দরজা নয়, একটা জানালা দেখতে পেল ডি. কস্টা। শার্সি নেই। পর্দাও নেই। আলোও বেরিয়ে আসছে না ফাঁক-ফোকর দিয়ে।
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল ডি.কস্টা। স্যুটের ভিতর কেউ নিশ্চয়ই আছে। জানালা খোলা বা ভাঙার চেষ্টা করলে ঘুম ভেঙে যাবে তার। কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে পারছিল না সে। একবার ভাবল ফিরে যাওয়াই ভাল। তারপর, কি মনে করে, জানালার গায়ে হাত দিল সে।
হাতের স্পর্শে টের পেল ডি. কস্টা, শার্সি বা কবাট নয়, খড়খড়ি ফিট করা হয়েছে জানালায়।
উত্সাহী হয়ে উঠল ডি. কস্টা। খড়খড়ি তুলে ভিতরে তাকাল। শব্দ হলো বেশ একটু কিন্তু গ্রাহ্য করল না সে।
ভিতরের কিছু দেখা গেল না। কারণ, আলো নেই।
খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সরু হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ছিটকিনি খুলে ফেলল ডি. কস্টা। গরাদহীন জানালা গলে অন্ধকার রূমে ঢুকল সে, সুইচ বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালল।
তিনমিনিট পর নিজেদের স্যুটে ফিরে এল ডি কস্টা, আজ রাটে যাহা কিছু ঘটিটেছে টাহার সব কিছুই রহস্যে টাকা ডেকিটেছি। বারো নাম্বারের চিড়িয়া ভাগিয়াছে।
ওমেনা বলল, কিছু একটা করা দরকার আমাদের। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে, কোন সন্দেহ নেই, গুলি খেয়ে মরতে হবে দুজনকেই।
হামি ভাবিটেছি এইরকম অবষ্ঠায় বস্ পড়িলে তিনি কি করিটেন?
ওমেনা বলল, কুয়াশা নিরাপত্তার জন্যে স্থান ত্যাগ করত। এবং কেটে পড়ার আগে সে পরীক্ষা করে দেখে নিত কোন প্রমাণ রেখে যাচ্ছে কিনা।
ডি. কস্টার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, রাইট। বাট, বড়সড় প্রমাণ টো ওই লাশটা! উহাকে হামরা কিভাবে মুছিব? …ইউরেকা!
কি হলো?
ডি. কস্টা চাপা স্বরে বলল, লাশের, আই মীন, বিজিম্যানের গন্টব্যষ্ঠান ছিল বারো নাম্বার স্যুইট। টার মানে, টাহার জার্নি এখনও শেষ হয় নাই। চলুন, উহাকে উহার গন্টব্যষ্ঠানে রাখিয়া আসি।
ওমেনার মনে ধরল প্রস্তাবটা। বলল, কিন্তু বন্দীকে নিয়ে কোথায় যাব? ওর কি হবে?
ডি. কস্টা খানিক ভাবনা-চিন্তা করে বলল, ও ব্যাটা এখানেই ঠাকুক। ওর পাশে একটা ড্যাগার রেখে যাব হামরা। ইচ্ছা হলে নিজের হাটে নিজেকে খুন করবে। নয়ট পুলিসের হাটে বণ্ডী হবে। হামাডের ভয়ের কিছু নাই, কারণ, হামাডের কঠা সে পুলিসকে বলিবার সময়ই পাইবে না। পুলিস অ্যাট ফাস্ট টাহার কঠা জানিটে চাহিবে।
লোহার মইটা অসম্ভব নড়বড়ে। পা ফেললেই কাঁচ ক্যাচ শব্দ হয় আর দোলনার মত দুলতে শুরু করে। লাশটাকে ধরাধরি করে উপরে তুলতে ঘামে ভিজে গেল ওদের জামা-কাপড়। সেই সাথে ভয়ে আধমরা হয়ে গেল ওরা। যে কোন মুহূর্তে কেউ জানালা খুলে উঁকি মারতে পারে কিংবা দারোয়ান ছুটে আসতে পারে শব্দের উৎস সন্ধানে।
দোতলার একটা বিছানার উপর লাশটা রেখে হাঁপাতে লাগল ডি কস্টা। ওমেনা বলল, দেরি নয়, এখুনি নেমে যেতে হবে আমাদের।
এমন সময়, সিটিং রূমের বন্ধ দরজায় নক হলো।
পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কথা না বলে ছুটল ডি. কস্টা জানালার দিকে।
মই বেয়ে নিচে নামছিল ডি. কস্টা। তাকে অনুসরণ করছে ওমেনা। পিছন ফিরে নামছে ওরা।
নিচে থেকে হঠাৎ গলা ভেসে এল, এরাই! কি হচ্ছে…!
পা ফস্কে পড়ে গেল ডি কস্টা। পড়ল সে সরাসরি লোকটার ঘাড়ের উপর। ফলে ধরাশায়ী হলো দুজনেই।
প্রায় একই সময়ে উঠে দাঁড়াল দুজন।
ডি. কস্টাকে ভাল করে দেখতে দেখতে লোকটা অকস্মাৎ বিকট স্বরে গর্জন করে উঠল।
কুকুরের হাতে বন্দী বিড়ালের মত ডি. কস্টা ভয়ে মিউ মিউ করতে লাগল। চিনতে পেরেছে সে লোকটাকে। কুয়াশা যে তিনজন লোককে ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিয়েছিল এ লোকটা তাদেরই একজন।
ডি. কস্টার সরু ঘাড়টা চেপে ধরল লোকটা। দুর্বোধ্য জার্মান ভাষায় তর্জন গর্জন করছে লোকটা।
ওমেনা মই বেয়ে নামতে নামতে ডি. কস্টা এবং লোকটার মাথার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। রিভলভারটা উল্টো করে ধরা ওর হাতে।
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে লোকটার মাথার মাঝখানে রিভলভারের বাঁট দিয়ে আঘাত করল ওমেনা।
লোকটা আচমকা বোবা বনে গেল। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে ঘাসের উপর।
ডি. কস্টা ফিসফিস করে বলল, নামকিনিবার জন্য উন্মুখ হইয়া ঠাকেন, না? অপেক্ষা করিয়া ডেকিটেন, নিজেকে মুক্ত করিটে পারিটাম কিনা!
ওমেনা বলল, এসব কথা পরে। ধরুন, একে লুকিয়ে ফেলতে হবে।
ধরাধরি করে নিজেদের স্যুটে আনা হলো অজ্ঞান লোকটাকে।
ঢক ঢক করে ব্যাপ্তি পান করল ডি. কস্টা।
ওমেনা বলল, আসল ঘটনাটা কি বুঝতে পেরেছেন কি?
বুঝিয়া কাজ নাই! হামি এখন পলাইব।
কোথায় পালাবেন?
ডি. কস্টা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, বসের এ অন্যায় কাজ! বিডেশ বিভূইয়ে টিনি হার্মাকে এটিম করিয়া কোঠায় যে গেলেন এখন পর্যন্ট কোন খবর নাই! এডিকে একের পর এক বিপড় হামার উপর বাঘের মটো ঝাপাইয়া পড়িটেছে! কে হামাকে রক্ষা করিবে।
আরে! একি! বাহাদুর পুরুষ কাঁদে নাকি!
ডি. কস্টা লজ্জা পেল। বলল, কই, কে বলে হামি কাডিটেছি। অভিনয় করিটেছিলাম।
ওমেনা হাসি চাপল। বলল, কয়েকটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এক, পুলিস আগেভাগে খবর পেয়ে পথের উপর অপেক্ষা করছিল বিজিম্যানের জন্যে। পুলিস সম্ভবত জানত বিজিম্যান স্মাগলার, মূল্যবান কোন জিনিস সে নিয়ে আসছে। পুলিস সভবত এ-ও জানত যে বিজিম্যানের গন্তব্য স্থান এই হোটেলের বারো নম্বর স্যুইট। অবশ্য বিজিম্যানকে তারা পথেই গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় কুয়াশা।
বলিয়া যান, মিস ডিটেকটিভ।
রসিকতায় কান না দিয়ে ওমেনা বলল, পুলিস তিনজন নদী থেকে উঠে থানায় ফিরে যায়। কাপড়-চোপড় পাল্টে এই হোটেলের বারো নম্বর সুইটে হানা দেবার জন্যে আবার এসেছে তারা।
ঠিক-ঠিক
ওমেনা অজ্ঞান লোকটাকে দেখিয়ে বলল, এই পুলিন্সটা ফায়ার এস্কেপের উপর নজর রাখছিল, যাতে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। আর অপর দুজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছে। দরজায় তাদের নক শুনেছি আমরা।
ঠিক-ঠিক। এখন পরবর্টী করণীয় কি হটে যাচ্ছে?
ওমেন অজ্ঞান পুলিসটার দিকে তাকাল, ওর ইউনিফর্মটা খুলে নিয়ে গায়ে দিন। কোটের উপর পরুন, খুব একটা ঢিলে লাগবে না।
বস্ কি এই পরামর্শ ডিটেন হামাকে?
ওমেনা বলল, দিত।
টাহা হইলে আপট্টি নাই।
পুলিসের শরীর থেকে ইউনিফর্ম খুলে নিল ডি কস্টা। ওমেনা নিজের রূমে ফিরে গেছে কাপড়-চোপড় পাল্টাবার জন্যে।
মিনিট তিনেকের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল ওরা। বেরিয়ে পড়বে, এমন সময় ফোন এল।
কুয়াশার সাথে কথা বলতে শুরু করল ওমেনা। তারপর ডি কস্টা।
.
০৮.
শুয়ে শুয়ে আপন মনে হাসছিল কুয়াশা। রুডলফ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে সে নিজেই তার পরম শত্রু কুয়াশাকে বহন করে নিয়ে এসেছে নিজের গোপন আস্তানায়। লাভ এবং লোকসানের হিসেব মেলাতে গিয়েও হাসল কুয়াশা। লাভের মধ্যে রুডলফের আস্তানা চিনেছে সে। পোর্টেবল সেটা হস্তগত করেছে। রুডলফের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে কাকোস নামে এক লোককে। হোটেল কুর্কাজায় বন্দী করে রেখে এসেছে রুডলফের একজন অনুচরকে। রুডলফের আর এক অনুচরকে অজ্ঞান করেছে সে। এবং, এখন, চমৎকার একটা ফাঁদ পেতে, রুডলফকে ঘণ্টায় ষাট মাইল স্পীডে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে সেই ফাঁদের দিকে।
পরিকল্পনাটা কুয়াশার মাথায় আসে সে যখন ফোনে ওমেনার কথা শুনছিল। রুডলফ যে পালাবার চেষ্টা করবে, জানত সে। মনে মনে সে ঠিক করে, রুডলফ পালাবার চেষ্টা করলে বাধা সে দেবে ঠিক, কিন্তু সেটা হবে কৃত্রিম বাধা। আসলে পালাবার সুযোগ দেবে সে রুডলফকে। কিন্তু রুডলফকে বুঝতে দেয়া হবে না যে সুযোগটা তাকে ইচ্ছা করে দেয়া হয়েছে।
ডি কস্টাকে জেনবারের মেইন রোডে যেতে বলার কারণ আর কিছু নয়, রুডলফকে সেখানে যেতে প্ররোচিত করাই ছিল কুয়াশার একমাত্র উদ্দেশ্য।
সত্যি সত্যিই রুডলফ গোপন পথে পালাবার চেষ্টা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গুলি করে বাধা দেবার চেষ্টা করে কুয়াশা কিন্তু ব্যর্থ হয় সে ইচ্ছা করেই। কুয়াশা জানত, রুডলফ জেনবারে যাবেই। দেখা হবে আবার পরস্পরের সাথে।
মার্সিডিজ বেঞ্জের ছাদে শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে হাসছে কুয়াশা। রুডলফকে বোকা বানাতে পেরে আনন্দিত সে। গর্বিত রুডলফের সাথে খেলাটা বেশ জমে উঠেছে।
জেনবারের দিকে ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছে মার্সিডিজ।
পৌনে একঘন্টা পর মার্সিডিজের গতি মন্থর হতে শুরু করল। জেনবার আরও সামনে, অনুমান করল কুয়াশা। থামছে কেন তাহলে গাড়ি?
উঁকি মারল কুয়াশা।
রুডলফকে দেখার আগেই তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে।
থামছ কেন! জেনবার তো আরও সামনে!
আবার স্পীড বাড়ল মার্সিডিজের। শোফার ভুল করছিল, কিংবা ঘুম পেয়েছে বলে চিনতে পারেনি জায়গাটা।
উঁকি দিয়ে কুয়াশা দেখল ওভারকোটের ডান পকেটে একটা হাত ঢুকিয়ে বসে আছে রুডলফ। শক্ত করে কিছু একটা ধরে আছে যেন সে। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে হাটুর উপর টোকা মারছে সে। অপলক চোখে চেয়ে আছে সামনের দিকে। চোখেমুখে দৃঢ়তার ছাপ। কুয়াশার ব্যাপারে চরম কিছু একটা করার কথা ভাবছে সভবত।
কথা বলে উঠল সে অস্থির কণ্ঠে, অড্রো, আরও জোরে, আরও জোরে। কুয়াশা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার। তাকে ধরতে হলে আরও জোরে ছুটতে হবে আমাদের।
রিস্টওয়াচ দেখল কুয়াশা। ডিকস্টা এবং ওমেনা যদি ফালতু সময় নষ্ট না করে, জেনবারের মেইন রোডে পৌঁছে যাবার কথা ওদের।
মাথা তুলে রাস্তার পাশে পাথুরে মাইলস্টোন দেখে জেনবারের দূরত্ব জেনে নিল কুয়াশা। আর মাত্র দুই কিলোমিটার সামনে জেনবার। কুয়াশা অনুভব করল, রুডলফের সাথে মুখোমুখি হবার সময় হয়েছে এখন।
পকেট থেকে সাইলেন্সর লাগানো রিভলভারটা বের করল কুয়াশা। গড়িয়ে চলে এল গাড়ির ছাদের পিছন দিকে। লক্ষ্য স্থির করে পিছনের চাকার মাডগার্ডের উপর গুলি করল সে।
টায়ার থেকে বাতাস বেরিয়ে যাবার শব্দ শোনা গেল হিসসস …. সেই সাথে গতি মন্থর হয়ে গেল মার্সিডিজের।
গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই লাফ দিয়ে নামল কয়াশা ফুটপাথে। ফুটপাথ থেকে সরে গেল সে কয়েকটা গাছের আড়ালে। হাত দশেক।রে থামল গাড়ি।
একযোগে খুলে গেল গাড়ির দুদিকের দরজা। রুডলফ বেরিয়ে এল ছড়ি হাতে নিয়ে। প্রায় ছুটে চলে এল সে গাড়ির পিছনে। হাঁটু মুড়ে বসল ফুটো হয়ে যাওয়া চাকাটার পাশে।
শোফার অড্রোও চাকাটা পরীক্ষা করার জন্যে বসে পড়েছে।
পেরেক-টেরেক বিধে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, স্যার, শোফার চাকা পরীক্ষা করে বলল।
প্রিন্স রুডলফ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। কয়েকমুহূর্ত স্থির হয়ে রইল সে। অপ্রত্যাশিত এই বিপদে পড়ে সে যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। হঠাৎ গর্জে উঠল সে, চাকা বদলাও! জলদি!
ইয়েস স্যার! তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অড্রো। এইসময় গাছগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা। কেউ দেখতে পেল না প্রথমে তাকে।
কুয়াশা কথা বলে উঠতে রুডলফ এবং শোফার এক সাথে চমকে উঠে সবেগে ঘাড় ফেরাল।
কুয়াশা বলল, কী আশ্চর্য, রুডলফ! যেখানে সেখানে পরস্পরের সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে–এ কিসের লক্ষণ বলো দেখি? এরকম ঘটনা আবার ঘটলে তুমি হয়তো বিশ্বাস করে বসবে আমি তোমাকে অনুসরণ করছি।
ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল রুডলফের পেশীগুলো। কিন্তু মুখের চেহারা এতটুকু বদলাল না। পাথরের মুখোশ পরে আছে যেন সে। মি. কুয়াশা, তোমাকে পথে মিস করার কারণটা কি বুঝতে পারছি না। আমাদেরটার মত তোমার গাড়িও কি কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে অচল হয়ে গেছে?
তোমাদেরটাই আমার গাড়ি। সত্যি কথা বলতে কি, সবসময়ই তাই ছিল। ভাল কথা, রুডলফ, তোমার গাড়ির ছাদের চারপাশে রেলিংয়ের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। ভবিষ্যতে আবার যদি কখনও ওই ছাদে শুয়ে ভ্রমণ করতে হয়, পড়ে যাবার ভয় থাকবে না।
বুঝেছি! তার মানে আমাদের সাথেই সর্বক্ষণ ছিলে তুমি।
কুয়াশা হাসছে। বলল, রুডলফ, অতীতে তোমার পেশা ছিল মণি-মুক্তোর চোরাই ব্যবসা করা। পোর্টেবল সেক্ষে সম্ভবত মণি-মুক্তোই আছে, তাই না? মূল্য তালিকা থাকলে দাও আমাকে। সেফের মণি-মুক্তো থেকে দুএকটা যদি আমার কাছ থেকে কিনতে চাও, দাম হাঁকতে সুবিধে হবে আমার।
নিঃশব্দে চেয়ে রইল রুডলফ কুয়াশার দিকে। তারপর, হঠাৎ সে-ও হাসল। বলল, জেনে ফেলেছ তাহলে ব্যাপারটা। কিভাবে জানলে? ধরো, চুরুট খাও।
একটা হাভানা চুরুট বাক্স থেকে বের করে কুয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিল রুডলফ।
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল, ধন্যবাদ, রুডলফ। এই মুহূর্তে ধূমপানের ইচ্ছা নেই।
কুয়াশার কথা শেষ হলো না, চুরুটের অগ্রভাগ থেকে পিচকারী দিয়ে বেরিয়ে এল তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস। সরাসরি কুয়াশার নাকে মুখে পড়ল বিষাক্ত তরল পদার্থটুকু।
টলে উঠল কুয়াশার দীর্ঘ দেহটা। গ্যাসে আক্রান্ত হবার সাথে সাথে গর্জে উঠল তার হাতের রিভলভারটা পরপর দুবার। কিন্তু রুন্ডলফ যথাসময়ে সরে যাওয়ায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সে। পর মুহূর্তে খসে পড়ল কুয়াশার হাত থেকে রিভলভারটা। দুহাতে মুখ ঢাকল সে। জ্ঞান হারাবার পর্যায়ে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে কুয়াশা। মুখ থেকে হাত নামিয়ে কিছু একটা ধরার জন্যে শূন্যে হাতড়াতে লাগল সে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। শত চেষ্টা করেও পাতা খুলে রাখতে পারছে না সে। অস্পষ্টভাবে তার কানে ঢুকল রুডলফের উচ্চকণ্ঠের হাসি। পরমুহূর্তে কুয়াশা অনুভব করল কে যেন তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। জড়িয়ে ধরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করছে।
ভয়ের কিছু নেই, বন্ধু। তোমার যা স্বাস্থ্য, জ্ঞান হারাবে না তুমি। সাধারণ কোন মানুষ হলে হয়তো মরেই যেত। অড্রো, বন্ধুকে গাড়ির ভিতর নিয়ে যাও।
অড্রো কুয়াশাকে গাড়ির দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে কুয়াশা। চোখের জ্বালা কমছে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
গাড়িতে ঢোকার আগে রাস্তার সামনের দিকে চোখ মেলে তাকাল কুয়াশা। দুটো উজ্জ্বল আলোক বিন্দু দেখতে পেল সে।
গাড়ি আসছে একটা, রুডলফের কণ্ঠস্বর।
অড্রোও হেডলাইট দুটো দেখতে পেয়েছে। কুয়াশাকে ধাক্কা আর ঠেলা দিয়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল সে।
ব্যাকসীটে বসে কুয়াশা দেখল রুডলফ ওপাশের দরজা দিয়ে আগেই উঠে বসেছে। হাতের রিভলভারের নটা রুডলফ ঠেকাল কুয়াশার পাজরে।
দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে কি ঘটবে বুঝতেই পারছ, রুডলফ গভীরভাবে, বলল।
দ্রুত ছুটে আসছে হেডলাইট দুটো। রুডলফের নির্দেশে অড্রো গাড়ির চাকা বদলাবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
সন্দেহ করার মত কিছু নেই কারও। চাকা ফুটো হয়ে গেছে মাঝপথে, চাকা বদলাবার কাজ চলছে, অপেক্ষা করছে তারা। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটছে যত্রতত্র, সুতরাং কারও মনে সন্দেহ জাগবার কথা নয়।
কিন্তু রুডলফ, ধরো, গাড়িটায় যদি আমার বন্ধুরা থাকে?
রুডলফ উত্তর দিল না। মার্সিডিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে নবাগত গাড়িটা। দরজা খুলে নিচে নামল একজন লোক। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল তার মাথায় হেলমেট রয়েছে। পরনে ইউনিফর্ম। মার্সিডিজের পাশে এসে দাঁড়াল সে, উঁকি দিল জানালা দিয়ে।
জার্মান ভাষায় সরু মেয়েলি গলায় লোকটা জানতে চাইল, আপনারা কি কোন বিপদে পড়েছেন?
কুয়াশা একচুলও নড়ল না। কিন্তু তার ইচ্ছা হচ্ছিল অট্টহাসি হেসে চারদিক কাঁপিয়ে তুলতে।
রুডলফ মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, চাকা ফুটো হয়ে যাওয়ায়…
পুলিস বলল, মাফ করবেন, আপনার সঙ্গী লোকটা কে? এ কি আপনার বন্ধু? কুয়াশাকে দেখিয়ে পুলিস প্রশ্ন করুল রুডলফকে।
বন্ধু? না না!
পুলিস তার ইউনিফর্মের পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে বলল, আপনার নাম, ঠিকানা?
প্রিন্স রুডলফ পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিল পুলিসের দিকে। কার্ডটা নিয়ে পড়তে চেষ্টা করল পুলিস। আচমকা সটান সিধে হয়ে দাঁড়াল সে। খটাস করে শব্দ হলো বুটের সাথে বুটের সংঘর্ষে। সসম্মানে স্যালুট করল পুলিস রুডলফকে।
কাঁচুমাচু হয়ে বলল সে, মাফ করবেন, ইওর হাইনেস! আপনাকে তামি: চিনতে পারিনি। আসলে এই লোকটাকে আমরা খুঁজছি। ইনসরুকে একটা ব্রিজ থেকে এই লোক আমাদের তিনজন সহকারীকে নদীতে ফেলে দিয়ে পালিয়েছিল। একে দেখে…
রুডলফ গম্ভীরভাবে হাতের পিস্তুলটা দেখাল পুলিসকে। বলল, হু, আমার সন্দেহই তাহলে সত্যি! ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি। এই নোক আমাদেরকে মাঝরাস্তায় অসহায় অবস্থায় পেয়ে ডাকাতি করার জন্যে এসেছিল। কৌশলে একে নিরস্ত্র করে বন্দী করে রেখেছি আমরা। চাকাটা বদলানো হয়ে গেলে এখান থেকে আমরা সোজা নিকটস্থ থানায় যাব। এখন, সৌভাগ্যক্রমে আপনি যখন এসেই পড়েছেন, এর দায়িত্ব আপনার ওপরই ছেড়ে দিতে পারি…।
অবশ্যই, অবশ্যই–হিজ হাইনেস! পুলি বলল, তাকাল সে রক্তচক্ষু মেলে কুয়াশার দিকে, অ্যাই! বেরিয়ে এসো বাইরে।
কুয়াশা বলল, মিথ্যে কথা! হিজ হাইনেসই ডাকাতি করেছে। পোর্টেবল সেটা আমার। সেটা এখন হিজ হাইনেসের পকেটে। অফিসার, আপনাকে আমি হিজ হাইনেসের আস্তানায় নিয়ে যেতে পারি, সেখানে আপনি এমন সব দৃশ্য দেখতে পাবেন যে বিশ্বাস করাই কষ্টকর হয়ে পড়বে আপনার পক্ষে।
শাট আপ। সম্মানীয় হিজ হাইনেসকে অপমান করার চেষ্টা করে লাভ নেই। বেরিয়ে এসো বলছি। হিজ হাইনেসকে আর ঝামেলা ভোগ করতে দিতে রাজি নই আমি।
রুডলফ মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট বাড়িয়ে দিল পুলিসের দিকে স্মরণ রাখবেন, আমি কোনরকম পাবলিসিটি চাই না।
পুলিস মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করল। বুঝেছি, ইওর হাইনেস! ইওর হাইনেসের নাম উল্লেখ করব না আমি। ইওর হাইনেসকে সাহায্য করতে পেরে আমি গর্বিত।
পুলিসটা কটমট করে তাকাল কুয়াশার দিকে, এই! বেরিয়ে এসো বলছি!
এ অনুচিত। অফিসার, আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে হিজ হাইনেসকে ছেড়ে দিলে আমি আর আমার সেফটা ফিরে পাব না কখনও? অন্তত, আপনি আমার সাথে ওদেরও নিয়ে চলুন থায়। ওখানে গিয়ে প্রমাণ হবে সেটা কার।
পুলিস বলল, সেফের মালিক কে তা আমি জানি। ওটা হিজ হাইনেসের।
মিথ্যে কথা! সেটা আমার! সেফ না নিয়ে আমি কোথাও যাব না। তুমি…আপনি জানেন না, ওটার জন্যে কত বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছি আমি!
জেলে থাকতে হবে তোমাকে, কি করবে ওই সেফ দিয়ে? বেরিয়ে আসবে, না জোর খাটাতে হবে?
সেফ না নিয়ে কোথাও যাব না আমি।
রুডলফ নির্বিকার। নীরব দর্শক সেজে বসে আছে।
পুলিস অফিসার পকেট থেকে রিভলভার বের করে কুয়াশার বুকের দিকে তাক করে ধরুল, বেরোও।
রাগে লাল হয়ে গেছে কুয়াশার মুখ। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে গাড়ির বাইরে।
পুলিস কুয়াশার পিছনে চলে এল। কুয়াশার শিরদাঁড়ায় রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলল, বাধ্য ছেলের মত হাঁটো।
রুডলফ দেখল পুলিসের গাড়িতে গিয়ে উঠল কুয়াশা, পিছু পিছু পুলিস। প্রাণপণ চেষ্টায় অদম্য হাসিটা চেপে রেখেছে সে।
পুলিসের গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসেছিল ডি কস্টা। গাড়ি ছেড়ে দিল সে।
গাড়ি মাইলখানে যাবার পর মুখ খুলল কুয়াশা, কাজটা কি ভাল করলে ওমেনা? এত কষ্ট করে..
ক্ষমা চাই! কিন্তু একটা কথা ভুলে গেছ তুমি, কুয়াশা। দেশ ত্যাগ করার আগে আমরা কয়েকটা শর্ত দিয়েছিলাম, সেগুলো তুমি মানছু না। তাই এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে হলো।সেফের ভিতরে যাই থাক, ওসবে আমাদের দরকার নেই। আমরা ভ্রমণে এসেছি, ভ্রমণ করব। বাজে কাজে জড়িয়ে বিপদ ডেকে আনতে চাই না।
হাসি চেপে কুয়াশা জানতে চাইল, সে যাক। ইউনিফর্ম পেলে কোথায়?
হোটেল কুর্কাজায় যা যা ঘটেছে ব্যাখ্যা করে বলল ওমেনা। সবশেষে যোগ করল, ইউনিফর্মটা প্রথমে পরেছিলেন মি. ডি. কস্টা। কিন্তু কোটের উপর পরার পরও বড্ড ঢিলে লাগছিল। তাই আমিই পরি এটা।
ডি. কস্টা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, বস্, হাপনাকে গ্রেফতার করিবার ষড়যন্ট্রটা হামার নয় কিন্টু!
ওমেনা বলল, আমি স্বীকার করছি, সব দোষ আমার। কিন্তু রুডলফের হাত থেকে তোমাকে মুক্ত করার আর কোন উপায় ছিল কি?
ডি. কস্টা বলল, সেটা যডি ফেরট পাওয়া.যাইট, ডুঃখের কিছু ছিল না টাহা, হইলে! কস্, কি ছিল সেফে জানিটে পারিয়াছেন কি?
আজ থেকে ছয় সপ্তাহ আগে খবরের কাগজে পড়েছিলাম মনটেনিগ্রিন ক্রাউন জুয়েলারী চুরি গেছে। ক্রিস্টির পথে পাঠাবার সময় লুট হয় জুয়েলারীগুলো।
দরকার নেই ক্রাউন জুয়েলারীর! তুমি যে রুডলফের হাতে গুলি খাওনি আমি এতেই আনন্দিত।
কুয়াশা হেঃ হেঃ করে হেসে উঠল। বলল, রুডলফ সম্পর্কে তোমার দেখছি খুব বড় ধারণা। সে আমাকে খুন করতে পারবে, তার সে ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করো তুমি?
ওমেনা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, জানি না।
কুয়াশা বলল, একটা ভুল ধারণা ভাঙল। এতদিন জেনে এসেছি গহনা-টহনার প্রতি মেয়েদের দুর্বলতার তুলনা হয় না। এখন দেখছি তা সত্যি নয়।
ওমেনা চুপ করে রইল।
ভুল ভাঙবে আগে বা পরে রুডলফেরও। সেফ খুলে বেচারাবোকা বনে যাবে।
তার মানে?
কুয়াশা সহাস্যে বলল, রুডলফ আসলে জানে না যে কমবিনেশন লক খুলতে হলে যেমন নম্বর মিলিয়ে ডায়াল যোরাতে হয় তেমনি বন্ধ করতে হলেও নম্বর, মিলিয়ে ডায়াল মোরাতে হয়। তা না হলে, ঢাকনিটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখা সম্ভব। হলেও তালা লাগানো সম্ভব নয়।
কথাগুলো বলে ওভারকোটের পকেট থেকে রুমালে বাধা ভারি একটা. পোটলা বের করল কুয়াশা। পোটলার গিট খুলে ফেলল সে।
মূল্যবান পাথর এবং স্বর্ণের গহনার স্তূপ দেখল ওমেনা কুয়াশার দুহাতের উপর। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল সে।
.
০৯.
ডি. কস্টা ঘাড় বাঁকা করে পিছন দিকে তাকিয়ে ছিল। দুচোখ চকচক করছে তার।
মাই গড! এ যে সাট রাজার ঢন, বস্!
ওমেনা তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠল, গাড়ি পড়ল।
পাহাড়ী পথ, রাস্তার দুপাশে গভীর খাদ। সবেগে ডান দিকের খাদের দিকে ছুটে যাচ্ছিল গাড়ি।
ডি কস্টা ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে বন বন করে হুইল ঘোরাতে শুরু করল। গাড়ি সোজা করে সহাস্যে বলল সে, প্রিন্সেস, হামার ওপর বিশ্বাস হারাইবেন না। আফটার অল হামি মি. কুয়াশার সহকারী টো!
ওমেনা কুয়াশার দিকে তাকাল, তারমানে প্রিন্স রুডলফের কাছে খালি সেটা রয়ে গেছে? সে জানেই না যে…?
জানে না।
ওমেনা গম্ভীরভাবে বলল, তারমানে অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডার, মার্ডার, স্ট্রীট ফাইট, কিডন্যাপ, গাড়ি চুরি ইত্যাদির অপরাধে পুলিশবাহিনী আমাদের পিছনে শিকারী কুকুরের মত ছুটে আসছে এবং এর উপর রুডলফও দিক পরিবর্তন করে আমাদেরকে জ্যান্ত কবর দেবার জন্যে আসছে।
কুয়াশা বলল, আরও একজন আছে ওদের সাথে। কমরেড কাকোস। যুদ্ধক্ষেত্রে সে-ও ধুলোর পাহাড় তুলে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। তাকে রুডলফের লাইব্রেরীতে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে এসেছি আমি।
ব্যাখ্যা করে রুডলফের আস্তানায় যা যা ঘটেছে সব বলল ওদেরকে কুয়াশা। কুয়াশার বক্তব্য শেষ হতে ওমেনা শুরু করল। হোটেল কুর্কাজায় যা যা ঘটেছে বলল সে।
সব শুনে কুয়াশা বলল, বুঝেছি! কোন সন্দেহ নেই কুর্কাজা হোটেলের বারো নম্বর সুইটে অপেক্ষা করছিল কাকোসই। রুডলফের লোকেরা সেখান থেকে কাকোসকে বন্দী করে আস্তানায় নিয়ে যায়। মি. ডি কস্টা, আমরা যাচ্ছি কোন্ দিকে? নিশ্চয়ই বর্ডারের দিকে?
ইয়েস, বস।
ওমেনা বলল, জার্মানীতে যাচ্ছি আমরা।
কুয়াশা বলল, ইউরোপের যেখানেই যাই না কেন, রুডলফ পিছু ছাড়বে না আমাদের। আর এখানকার পুলিসও পাশের দেশের পুলিসকে সতর্ক করে দিতে ভুল করবে না। রুডলফ যদি রাগে উন্মাদ হয়ে না যায়, গোটা ইউরোপের পুলিস বাহিনীর হেড কোয়ার্টারগুলোয় খবর পাঠাবে সে।
কি খবর পাঠাবে?
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, বুঝতে পারছ না কি খবর পাঠাবে! যে খবর পেলে গোটা ইউরোপ চমকে উঠবে, সেই খবর। রুডলফ জানিয়ে দেবে কুয়াশা ইউরোপে উপস্থিত হয়েছে। ব্যস, জ্বলে উঠবে আগুন।
ওমেনা বলল, সেক্ষেত্রে একমাত্র দায়ী হবে তুমি। রুডলফকে এভাবে ফাঁকি না দিলে সে নিশ্চয়ই খবরটা ছড়াবার কথা ভাবত মা।
কথা শোনা এবং কলার মধ্যেই পকেট থেকে পেননাইফ বের করে জড়োয়া গহনাগুলো থেকে মূল্যবান পাথরগুলো খুলে ফেলছিল কুয়াশা। কোলের উপর বিছানো রয়েছে রুমালটা, তাতে রয়েছে বড় বড় হীরা, মুক্তো, পোখরাজ, চুনী পাথর। সেগুলোর সাথে যোগ হচ্ছে আরও অনেক।
ডি. কস্টা ঘোষণা করল, সীমান্ট আর মাট্র কয়েক মাইল সামনে।
স্বর্ণের গহনাগুলো থেকে মূল্যবান পাথর খসিয়ে নেবার কাজ শেষ হতে চুরুট ধরাল কুয়াশা। গহনাগুলো জানালা দিয়ে বনভূমির দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। পাথরগুলোর তুলনায় ওই স্বর্ণের মূল্য ধরতে গেলে কিছুই না।
কি রকম দাম হবে এই পাথরগুলোর?
কুয়াশা বলল, তোমাকে একজোড়া কাঞ্জিভরম কিনে দেবার পরও যা থাকবে তা দিয়ে হোটেল ইন্টারকনে ডিনার খাওয়া চলবে বছর দুয়েক একনাগাড়ে, কেনা যাবে একটা ইয়ট, কেনা যাবে ভারত মহাসাগরে ছোট্ট একটা দ্বীপ, তারপরও ছয় অঙ্কের দুটো চেক কাটতে পারবে তুমি–এত সব কিছুর পরেও যা থাকবে তা দিয়ে ক্যান্সার রোগটা সম্পর্কে গবেষণা করার জন্যে দশতলা উঁচু একটা গবেষণাগার তৈরি করা সম্ভব।
রুমালের চারকোনা একত্রিত করে গিঁট বাঁধল কুয়াশা। শূন্যে ছুঁড়ে লুফে ধরল। পোটলাটা কয়েকবার, তারপর সেটাকে ভরে রাখল পকেটে। বলল, মি. ডি. কস্টা, গাড়ি থামান।
নির্দেশ পেয়ে সাথে সাথে গাড়ি থামাল ডি. কস্টা। তারপর জানতে চাইল, কি হলো কস?
ইউনিফর্ম খুলে নিজের পোশাক পরতে হবে ওমেনাকে। আর মাত্র দুমাইল সামনে বর্ডার।
মাগো! ভুলেই গেছি যে,
কুয়াশা বলল, ভুলে তো যাবেই! জানোই তো, সাথে কুয়াশা আছে, ভুল করলে তার চোখে ধরা পড়বেই ভুলটা।
হাতে সুটকেস নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে বনভূমিতে প্রবেশ করুল ওমেনা। পাঁচ মিনিট পর ফিরে এল সে প্যান্ট এবং টি-শার্ট পরে।
সীমান্তে পৌঁছুল ওরা কমিনিট পরই। ওদের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কটা গাড়ি। অপেক্ষার পালা। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল এখন কুয়াশার দখলে। পাশে ওমেনা। ডি. কস্টা ব্যাক সীটে একা।
সবাই চুপ। বুকের ভিতর ভয়ের হিমশীতল অনুভূতি প্রত্যেকেরই। অস্ট্রিয়া পুলিস যদি সীমান্তরক্ষীদের খবর দিয়ে সতর্ক করে দিয়ে থাকে, তাহলে বিপদ ঘটবেই। তার উপর, ইতিমধ্যে রুডলফ যদি আবিষ্কার করে থাকে যে সেটা খালি তাহলে সে-ও হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে ওদেরকে। বর্ডারের দিকে আসতে পারে সে। কুয়াশাকে সে ভাল করেই চেনে। কুয়াশার পরবর্তী মূডমেট কি হতে পারে, জানা কঠিন কিছু নয় তার পক্ষে।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, কি হয় কিছুই বলা যায় না। মিনিট দশেক পর নড়েচড়ে বসল ডি. কস্টা এবং ওমেনা। স্টেনগানধারী সীমান্তরক্ষীরা এগিয়ে আসছে তাদের গাড়ির দিকে।
সহাস্যে ওমেনার দিকে তাকাল কুয়াশা, সাবধান, অভিযোগ আনার আগেই যেন সব কথা স্বীকার করে ফেলো না।
ডি. কস্টা পিছন থেকে বলল, উহারা জিজ্ঞেস করিলে বলিবেন হামি ঘুমাইটেছি! প্লীজ!
কথাগুলো বলে ডি. কস্টা সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। পাঁচ সেকেণ্ড পরই শোনা গেল তার নাক ডাকার শব্দ।
সীমান্তরক্ষীরা কথা বলল কুয়াশার সাথে। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ঘটল না। পাসপোর্ট দেখল ওরা। জিনিসপত্র চেক করল না। একবার শুধু জানতে চাইল, অবৈধ কিছু সাথে আছে কিনা।
কুয়াশা পরিষ্কার জার্মান ভাষায় জানিয়ে দিল, নেই। থাকলেও ধরা না পড়া পর্যন্ত স্বীকার করব না।
কুয়াশার রসিকতায় হাসল রক্ষীদের কমাণ্ডার। হাত নেড়ে এগিয়ে যাবার অনুমতি দিল সে। স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল কুয়াশা গাড়ি।
দশমিনিটের মধ্যে স্পীড মিটারের কাঁটা আশির ঘরে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। প্রতি দুতিন মিনিট পরপর ভিউমিররে চোখ রাখছে কুয়াশা। পিছনে কোন গাড়ির ছায়া পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। বারবার ভিউমিররে তাকাচ্ছে সে, দেখে নিচ্ছে কেউ অনুসরণ করছে কি না।
সূর্য উঠল পুবাকাশে।
পাহাড়ী পথ ছাড়ল গাড়ি। স্পিড অনেক কমিয়ে আনল কুয়াশা। দীর্ঘ ঘুমের পর শহর জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। রাস্তায় যানবাহন নামছে, মানুষ নামছে।
ওস্টবানহক রেলওয়ে স্টেশনের সামনে দাঁড় করাল কুয়াশা গাড়ি। পেভমেন্টের শারে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা স্ট্রিট কার। সেটা থেকে নামছে চোখে ঘুম জড়ানো একদল শ্রমিক।
সুটকেস এবং একটা এয়ারব্যাগ হাতে নিয়ে পেভমেন্টে নামল কুয়াশা। ডি. কষ্টাও নামল।
কুয়াশা তার কাঁধে হাত রেখে, দুইজন একসাথে না থাকাই ভাল। আপনি চেষ্টা করে যদি ওই স্ট্রীট কারতাকে হাইজ্যাক করতে পারেন, সোজা চলে যাবেন এখান থেকে হোটেল মেট্রোপোলে। এই নিন ব্যাগ।
পকেট থেকে চার ভাঁজ করা মিউনিক শহরে ম্যাপটা ডি কস্টার হাতে গুঁজে দিল কুয়াশা। ম্যাপটা দেখার জন্যে ডি কস্টা। হঠাত গাড়ি ছোটার শব্দ পেয়ে মুখ তুলে দেখল কালো মরিসটা তির বেগে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে।
অসহায়, বোকা বোকা লাগল ডি কস্টাকে। করুণ চেয়ে রইল সে রাস্তার খালি বাঁকটার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে স্ট্রীট কারটার দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডি কস্টার মুখের চেহারা। শ্রমিকরা নেমে চলে গেছে প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির ড্রাইভারকেও আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত চা-নাস্তা খেতে ঢুকেছে কোন হোটেলে।
সুটকেস এবং এয়ারব্যাগটা দুহাতে ধরে তুলে নিয়ে এগলো ডি কস্টা স্ট্রীট কারের দিকে।
কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে ড্রাইভিং সীটে চড়ে বসল সে।
মিনিট পনেরো পর হোটেল মেট্রোপোলে ডি কস্টা, কুয়াশা এবং ওমেনার সাথে মিলিত হলো। কথাবার্তা বিশেষ হলো না ওদের মধ্যে।
দশমিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল নিজের রূমে ডি, কস্টা। কিন্তু মাত্র আধঘন্টা পরই প্রচণ্ড, অবিরাম শব্দে ভেঙে গেল তার ঘুম। ঘুম ভাঙতে ধড়মড় করে উঠে বসল সে বিছানার উপর। প্রথমে মনে হলো, ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু রূমের কিছুই দুলছে না দেখে ধারণাটা বাতিল করে দিল সে।
হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারল ডি. কস্টা। ট্রাম আর যানবাহনের মিলিত শব্দ হচ্ছে। হর্ণের শব্দ, ব্রেক কষার শব্দ, স্টার্ট নেবার শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দ-সব মিলিয়ে নরক গুলজার।
ঘুম আর এলই না। বেলা বারোটা পর্যন্ত গড়াগড়ি খেলো সে বিছানায়। তারপর উঠল। দাড়ি কামিয়ে স্নান করল গরম পানিতে। সুটেড-বুটেড হয়ে নিজেদের প্রাইভেট ডাইনিং-রূমে নেমে এল সে নিঃশব্দে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার। একবার খেলে খিদে মিটবে না। প্রথমে একা খাবে সে ঠিক করেছে, তারপর সকলের সাথে আরেকবার।
কিন্তু ডাইনিং-রূমে ঢুকে কুয়াশাকে আবিষ্কার করল ডি. কস্টা। মুখোমুখি চেয়ারে বসল সে। জিজ্ঞেস করল, আপনারও বুঝি ডুইবার খাবার মটো খিড়া পাইয়াছে?
কুয়াশা বুঝল না। বলল, দুবার খাবার মত খিদে মানে?
ডি. কস্টা ধরা পড়ে যাবার ভয়ে তাড়াতাড়ি বলল, ঠাক, ঠাক! ও আপনি বুঝিবেন না!
কুয়াশা বলল, তাড়াতাড়ি যা খাবার খেয়ে নিন। আমরা আবার রাস্তায় নামছি। ট্রেন জার্নি করব আমরা।
মরিসটার কি অপরাঢ?
কুয়াশা বলল, ওটা চুরি করা গাড়ি, এতক্ষণে মালিক ইনসরুকের থানায় রিপোর্ট করেছে। পুলিস সতর্ক করে দিয়েছে এতক্ষণে সীমান্ত রক্ষীদেরকে। আমরা যখন বর্ডার ক্রস করি সীমান্ত রক্ষীরা গাড়িটার নম্বর টুকে রেখেছে। তারা জেনে ফেলেছে মরিসটা এখন জার্মানীতে। জার্মান পুলিসকে টেলিফোনে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। সুতরাং মরিসটাকে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয় মনে করে
গুড!
বেয়ারা এল, অর্ডার দিল ডি. কস্টা। দীর্ঘ অর্ডার শুনে মৃদু একটু হাসল শুধু কুয়াশা, কোন মন্তব্য করল না। অর্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছিল বেয়ারা, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, জিজ্ঞেস করল, দুজনের জন্যে তো, স্যার?
ধমকে উঠল ডি কস্টা, কেন, একা হামি খাইটে পারি না মনে করিয়াছ?
বেয়ারা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে খাবার আনতে চলে গেল।
প্রিন্সেস কোঠায়?
কুয়াশা বলল, নিজের বেডরূম বসে খাবার কাজটা সেরে নিচ্ছে সে। খানিক আগে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল।
ডি. কস্টা বলল, প্রিন্সেস নিশ্চয়ই বদ্ধ কালা! মিউনিকে ডিনের বেলা কুম্ভকর্ণেরও ঘুম আসিটে পারে না। আমার জানালার নিচে ফোর থাউজেন্ড ট্রাম পরস্পরের সাঠে সংঘর্ষে লিপ্ট রহিয়াছে, বিলিভ ইট অর নট।
কুয়াশা হাসতে হাসতে কফির পেয়ালায় চুমুক দিল।
কোঠায় যাইব আজ হামরা?
কোলনে।
উত্তর দিয়ে চুরুট ধরার জন্যে গ্যাস লাইটার জালল কুয়াশা। ডাইনিং রূমের খোল ঘরের দিকে নজর পড়ল তার। স্থির হয়ে গেল তার লাইটার ধরা হাতটা।
ডাইনিংহলের দরজা দিয়ে দুজন ডিটেকটিভ পলিস ইন্সপেক্টর প্রবেশ করছে। কুয়াশা এবং ডি, কটাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। নিজেদের মধ্যে চাপারে কথা বলছে।
চুরুটে অগ্নি সংযোগ করল কুয়াশা। বলল, যাব, মানে, যাবার সুযোগ যদি দেয়া হয় আমাদেরকে।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর পৌঁছুবার আগে টেবিলে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হলো বেয়ারা।
কিছুই টের পায়নি ডি কস্টা। মাথা নিচু করে বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবারের দিকে তাকাল সে। তারপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করল।
দশ সেকেন্ড পর কথা বলতে শুরু করুল কুয়াশা। মি. ইশ্যাম, বুঝলেন, মানুষ যে বছরের তিনশো পয়ষটি দিনের মধ্যে একটি দিনও কাজ করে না, এ আমি প্রমাণ করতে পারি।
খেতে খেতে মুখ তুলে তাকাল ডি. কস্টা। প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল যে কার উদ্দেশ্যে কথা বলছে কুয়াশা, মি, ইমাম আবার কে? কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই সে কুয়াশার পিছনে দুজন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে দেখতে পেল।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ডি. কস্টার।
কুয়াশা বলে চলেছে, বছরে তিনশো পঁয়ষটি দিন, তাই না?
ডি. কস্টা মাথা ঝাঁকাল।
আট ঘণ্টা প্রত্যেক দিন ঘুমায় মানুষ, সারা বছরে সে ঘুমায় মোট একশো বাইশ দিন। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন থেকে একশো বাইশ দিন বাদ দিলে কত দিন থাকে?
ডি. কস্টা বলল, টু-হান্ড্রেড ফোরটি থ্রী ডিন।
দুশো তেতাল্লিশ দিন, হ্যাঁ। প্রত্যেক দিন আট ঘন্টা করে বিশ্রাম, তার মানে বছরে একশো বাইশ দিন বিশ্রাম। দুশো তেতাল্লিশ থেকে আরও একশো বাইশ বাদ দিন।
ঠাকে ওয়ান হ্যান্ড্রেড টোয়েনটি ওয়ান ডিন।
কুয়াশা সহাস্যে বলল, হ্যাঁ, থাকে একশো একুশ দিন। প্রত্যেক বছরে রবিবার থাকে বায়ান্নটা, তার মানে আরও বাদ দিন বায়ান্ন দিন। কদিন অবশিষ্ট থাকল?
সিক্সটি নাইন ডিন।
ঠিক। শনিবার বায়ান্নটা, প্রত্যেক শক্লিারে হাফ-ডে, তার মানে ছাব্বিশ দিন আরও বাদে যাবে। কদিন থাকল অবশিষ্ট?
সিক্সটি নাইন ঠেকে টোয়েনটি সিক্স বাড ডিলে ঠাকে মাটু ফরটি থ্রী ডিন।
তেতাল্লিশ দিন, ঠিক। খাওয়া দাওয়ার কাজ, অসুস্থতা ইত্যাদির জন্যে প্রত্যেক দিন এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট করে গড়পড়তায় অপব্যয় হয়, বছরে দাঁড়ায় আঠাশ দিন। তেতাল্লিশ দিন থেকে বাদ দিন আঠাশ দিন। কদিন রইল আর?
ফিফটিন ডিন।
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, পনেরো দিন। এর সাথে বিয়োগ করুন বছরে দুসপ্তার ছুটি অর্থাৎ আরও চোদ্দ দিন।
ডি. কস্টা বলল, অবশিষ্ট রহিল মাত্র ওয়ান ডিন।
কুয়াশা বলল, ওই একটা দিন হলো লেবার ডে। তার মানে আমরা কেউ কোন কাজ করি না।
কথা শেষ করে হেসে উঠল কুয়াশা।
ডি. কস্টা কিন্তু হাসতে পারল না। কুয়াশার পিছনে যমদূতের মত দশাসই চেহারার ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরদ্বয়ের দিকে তাকাল সে। ঢোক গিলল।
ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা, যেন এই মাত্র পিছনের লোক দুজনের উপস্থিতি টের পেয়েছে সে।
মাথার হ্যাট খুলে নিশেভ ইন্সপেক্টর একটু নত হলো। ইংরেজীতে বলল, এক্সকিউজ মি. জেন্টলমেন। আমরা দুজন ডিটেকটিভ, ইন্সপেক্টর। আপনাদের মুভমেন্ট সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন আছে, আশা করি উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।
সহাস্যে কুয়াশা তার পাশের খালি চেয়ারগুলো দেখিয়ে বলল, সিট ডাউন, শার্ল! তারপর বলুন, কি আপনাদের সমস্যা; কেউ বুঝি তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, নাকি?
কুয়াশার পাশের দুটো চেয়ার দখল করল ইন্সপেক্টরদ্বয়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ইন্সপেক্টর বলল, দেখুন, স্যার, ইব্রুকে একটা ক্রাইম সংগঠিত হয়েছে গতরাতে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি, ক্রিমিনালরা মিউনিকে প্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা যে এই হোটলে উঠেছে তাও আমরা জানতে পেরেছি। ইব্রুক থেকে টেলিগ্রামে ক্রিমিনালদের চেহারার বর্ণনা জানানো হয়েছে আমাদেরকে। ক্ষমা করবেন, জেন্টলমেন, কিন্তু চেহারার বর্ণনার সাথে মিল
কুয়াশার ভুরু জোড়া কপালে উঠল, গুড লর্ড! আপনি কি বলতে চাইছেন আমরা অ্যারেস্ট হতে যাচ্ছি?
ক্লিনশেড বলল, সত্যি কথা বলতে কি, দ্বন্দ্বে পড়ে গেছি আমরা। ভাল কথা, আপনার পেশা কি জানতে পারি কি?
কুয়াশা বলল, আমি সোশিওলজির প্রফেসর।
কিনশেভ তাকাল ফ্রেঞ্চকাটের দিকে, সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ক্লিনশেভ। বলল, স্যার, আপনি যখন লেকচার দিচ্ছিলেন, আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম আপনার ঠিক পিছনেই। সবই শুনেছি আমরা, তবে ভাল ইংরেজী বুঝি না বলে কিছু কিছু বাক্যের অর্থ বুঝিনি। তবে আপনি যে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তা আপনার লেকচারের বিষয়বস্তু শুনেই বুঝেছি।
মৃদু হাসল কুয়াশা, না-না উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত আর হতে পারলাম কোথায়? তবে চৈষ্টা করছি নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে। ভাল কথা, শ্যাম্পেন অর হইঞ্চি?
ইন্সপেক্টরদ্বয় পরস্পরের দিকে তাকাল। তাদেরকে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ না দিয়ে কুয়াশা বেয়ারাকে ডাকল হাত ইশারায়, এঙায় পিল, আমাদের সকলের জন্যে হুইস্কি দাও উইথ সোডা। কুইক!
ফ্রেঞ্চকাট হঠাৎ জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করল, আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকের নাম কি?
কুয়াশা বোকার মত চেয়ে রইল ইন্সপেক্টরের দিকে। যেন জার্মান ভাষা জানে না সে, বুঝতে পারছে না প্রশ্নটা।
ফ্রেঞ্চকাট একই প্রশ্ন করুল আবার, এবার ইংরেজীতে।
কুয়াশা বলল, মি. ইনগ্রাম।
টিনশেড বলল, মি. ইনাম, আপনার পাসপোর্টটা একবার দেখতে চাই আমরা।
ডি. কস্টা ঢোক গিলে তাকাল কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা হাসছে। বলল, বের করে দিন, মি. ইনগ্রাম। পাসপোর্টটা দেখান এদেরকে।
ডি. কস্টা হাঁ করে চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে। মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার। পাসপোর্ট একটা আছে বটে তার পকেটে কিন্তু তাতে তার প্রকৃত নাম-ধামই লেখা আছে। এটা দেখালে এই মুহূর্তে গ্রেফতার করবে ওরা।
কুয়াশা আবার বলল, আপনার কোটের ডানদিকের সাইড পকেটে রেখেছেন পাসপোর্টটা, সম্ভবত।
ডি. কস্টার পরিষ্কার মনে আছে, পাসপোর্টটা সে রেখেছে কোটের ভিতরের পকেটে, সাইড পকেটে নয়। সে ভাবল, বসের একথা বলার কারণ কি তাহলে?
কোটের ডান দিকে সাইড পকেটে হাত ঢোকাল ডি. কস্টা। আরে! বড়সড় নোট বুকের মত কি এটা তার পকেটে?
ইন্সপেক্টরদ্বয় তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ডি. কস্টার দিকে।
সাইড পকেট থেকে জিনিসটা বের করল ডি. কস্টা। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, দেল কাঁপছে হাতটা।
পাসপোর্টই বটে! লেখা রয়েছে গায়ে। টেবিলের উপর রাখল সেটা ডি. কস্টা।
ছোঁ মেরে তুলে নিল টিনশেভ ইন্সপেক্টর পাসপোর্টটা।
ক্লিনশেভ এবং ফেঞ্চকাটের মাথা পাশাপাশি যুক্ত হলো, দুজন মিলে দেখছে ডি. কস্টার পাসপোর্ট।
বেয়ারা চারগ্লাস হুইস্কি মেখে গেল টেবিলে ট্রে থেকে নামিয়ে। বেয়ারা চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ পাসপোর্টটা পরীক্ষা করুল ইন্সপেক্টররা, তারপর সেটা নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। বলল, পাসপোর্টটা জাল বলে মনে হচ্ছে না। সার, আপনার পাসপোট?
কুয়াশা পকেট থেকে বের করে দিল নিজের পাসপোর্ট।
পাসপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিয়ে কিনশেড বলল, প্রফেসর হেনোর্বান। হু।
কুয়াশা বলল, আমার মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল করেছেন আপনারা। সে যাক, আপনাদের ইনফরমেশনের সোর্স সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই, সুতরাং কিছু, বলা উচিত নয় আমার। আমাদেরকে গ্রেফতার করবেন কি করবেন না সে আপনাদের বোধ-বুদ্ধির ব্যাপার, যা ইচ্ছা করুন। কিন্তু, আপাতত দয়া করে গলা ভিজিয়ে নিন।
ফ্রেঞ্চকাট বলল, সত্যি কথা বলতে কি, কি করা উচিত তা আমরা ঠিক। করতে পারছি না। মি. হেমোর্বান, দয়া করে যদি আপনারা আমাদের সাথে একবার কষ্ট করে আমাদের হেডকোয়াটারে যান, খুব ভাল হয়। সেখানে খবরাখবর আসে, সেখান থেকে খবরাখবর পাঠানো যায় কাজ করতে, সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সুবিধে ওখানে আমাদের।
কুয়াশা সহাস্যে বলল, অবশ্যই যাব। না যাবার কি আছে! দেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথে অসহযোগিতা করার মানসিকতা আমাদের নেই। অবশ্যই আমরা সমস্যাটার সমাধান বের করার জন্যে হেডকোয়ার্টারে। যাব।
কথা শেষ করে নিজের হুইস্কির গ্লাসটা তুলে নিল কুয়াশা। শূন্যে ধরে রাখল সেটা। আসুন, ক্রিমিনালদের ধ্বংস কামনা করে আমরা সৎ মানুষদের স্বাস্থ্য কামনা করি!
ডি. কস্টাও তুলে নিল একটা হুইস্কির গ্লাস। দেখাদেখি ফ্রেঞ্চকাট এবং ক্লিনশেডও তুলে নিল বাকি দুটো গ্লাস।
গ্লাসে গ্লাসে মৃদু ঠোকাঠুকি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে যে যার গ্লাসে চুমুক দিল।
দুই কি তিন চুমুক করে হুইস্কি গলায় ঢালার পরই ইন্সপেক্টর দুজন টলতে শুরু করল। ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইছে তাদের চোখ। চিৎকার করে কিছু বলার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল তারা।
কুয়াশা হাত বাড়িয়ে ধরে দুজনকেই চেয়ারের পিঠের সাথে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে বসে থাকতে সাহায্য করুল।
ডাইনিং-হল থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা দ্রুত। তার পিছনে ডি. কস্টা। লম্বা করিডরের শেষ মাথায় হেডপোর্টারের টেবিল। সেদিকে তাকাতেই একটা লোকের পিছন দিকটা দেখতে পেল কুয়াশা। দেখামাত্র চিনতে পারুল সে পরম শত্রুকে।
ব্যস্ত-সমস্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে হেডপোর্টারের সাথে প্রিন্স রুডলফ।
Leave a Reply