কুয়াশা ৬৮
প্রথম প্রকাশ: জুন, ১৯৭৭
০১.
এক পুলিস সার্জেন ডাক্তার ইদ্রিস মোটামূটি প্রৌঢ়, মাথা জুড়ে চকচকে টাক। পরনে হালকা নীল রঙের স্যুট। সদা হাস্যময় ভদ্রলোক। কিন্তু ড্রয়িংরূমে তিনি ঢুকলেন নীরস ভঙ্গিতে। চাপা একটা উত্তেজনা রয়েছে তার ভিতর, লক্ষ করল সবাই।
শহীদ অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে অনুরোধ করল ক্তার ইদ্রিসকে। ভদ্রলোক বসলেন একটি চেয়ারে, সকলের কাছ থেকে একটু দূরে।
মি. সিম্পসন বললেন, ইদ্রিস সাহেব, আমরা সবাই আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আপনার রিপোর্ট না পেলে আর এক পাও এগোতে পারব না আমরা।
মি. সিম্পসন তেপয়ের উপর রাখা আগ্নেয়াস্ত্র দুটো দেখিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের মতামত দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদলের ধারণা, লোদী সাহেব নিহত হয়েছেন ৩৮ আইভর-জনসন রিভলভার থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের দ্বারা, গুলিটা করা হয়েছে পনেরো ফুট দূর থেকে। অপরদল এই বক্তব্য স্বীকার করছে না, তারা বলছে, লোদী সাহেব নিহত হয়েছেন ৩২ ব্রাউনিং থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের দ্বারা, গুলি করা হয়েছে পঁচিশ ফুট দূর থেকে। কোন দলের ধারণা সত্য?
কোন দলের ধারণাই সত্য নয়, ডাক্তার বললেন।
সিধে হয়ে বসল শহীদ, অত্যন্ত ধীরে ধীরে।
মি. সিম্পসন কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আচমকা রাগত কণ্ঠে বললেন, তার মানে?
বললাম তো, দুদলের ধারণাই ভুল। আসলে, স্যার, জলোদী সাহেব খুন হয়েছেন একম্যান (Erkmann) এয়ার পিস্তলের পেলেটে। বুলেটটা ৩৮ বা ৩২ নয়–লাশের দেহে পাওয়া গেছে ২২ ক্যালিবারের পেলেট। গুলি করা হয়েছে মাত্র দশ ফুট দূরত্ব থেকে।
ড্রয়িংরূমে বজ্রপাত ঘটলেও বুঝি সবাই এমনভাবে বিস্ময়ে পাথরের মূর্তিতে পরিণত হত না।
অবিশ্বাসের দৃষ্টি সকলের চোখে। সবাই তাকিয়ে আছে ডাক্তার ইদ্রিসের দিকে। একজন শুধু ব্যতিক্রম।
সে কুয়াশা। কোন ভাবান্তর নেই তার মধ্যে। চুড়ান্ত নাটক ঘটে যাচ্ছে ড্রয়িংরুমের ভিতর, সে যেন তা জানেই না। মাথা নিচু করে পাঁচ সের ওজনের মোটা বইটা নিমগ্নচিত্তে পড়ছে সে।
পলক পড়ছে না মি. সিম্পসনের চোখে। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন তিনিই, ডাক্তার, আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি সুস্থ? মদ খেয়ে মাতলামো করছেন না তো?
ডাক্তার ইদ্রিস হাসলেন। বললেন, জীবনে ও-জিনিস স্পর্শ করিনি।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ওই বন্ধ রূমের ভিতর একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে গুলি ছোঁড়া হয়েছে?
আপনাদের কেস সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমি জানি না, মি. সিম্পসন। আমি শুধু জানি, লাশ পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহভাবে আবিষ্কার করেছি, লোদী সাহেব নিহত হয়েছেন ২২ ক্যালিবারের গুলি খেয়ে। এবং মাত্র দশ ফুট দূর থেকে তার বুকে গুলি ছোঁড়া হয়। এই যে পেলেটটা, সাথে করে নিয়ে এসেছি আমি।
পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করলেন ডাক্তার। এনভেলাপ শেকে ছোট্ট একটা সীসার টুকরো বের করে রাখলেন তেপয়ের উপর। বললেন, এই পেলেট শুধু মাত্র একম্যান এয়ার পিস্তল থেকে ছোঁড়া যেতে পারে। আরও একটা তথ্য জানাতে পারি আমি আপনাকে। সেটা হলো একম্যান এয়ার পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়লে শব্দ হয় খুবই কম, প্রায় শুনতে না পাবারই মত।
মি. সিম্পসন ঝট করে তাকালেন রফিকের দিকে, আপনার কিছু বলবার আছে?
রফিক ঘটনার আকস্মিকতায় বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিল চেয়ার ত্যাগ করে। বোকার মতই বলল সে, আমি…আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
আপনি তৃতীয় লিটার শব্দ শোনেননি বা কাউকে ছুঁড়তেও দেখেননি?
না!
শহীদ মুখ খুলল এবার, মি: সিম্পসন, সার্চ করার সময় কোন এয়ার পিস্তল পাননি আপনারা রূমের ভিতর?
না। পাব কোত্থেকে? থাকলে তো!
রফিক চৌধুরীকে ভাল করে সার্চ করেছিলেন?
কামাল জবাব দিল মি. সিম্পসনের হয়ে, কয়েকবার। এয়ার পিস্তল তো দুরের কথা, একটা আলপিনও ছিল না ওর পকেটে বা শরীরের অন্য কোথাও।
মি. সিম্পসন বললেন, রফিক চৌধুরী তিন তিনটে আগ্নেয়াস্ত্র সাথে নিয়ে লোদী সাহেবকে খুন করার জন্যে গিয়েছিল এটা কল্পনা করা একমাত্র পাগলের পক্ষেই সম্ভব। তিনটে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা জটিল ব্যাপার। তারচেয়ে একটা মেশিনগান নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। ২২ পেলেট তো আইভর-জনসন বা ব্রাউনিংয়ে ভরে ছোঁড়া অসভব।
অসম্ভব।
রফিক ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে নিজের অনুকূল অবস্থা সম্পর্কে। হঠাৎ সে গলায় অস্বাভাবিক জোর এনে জানতে চাইল, মাফ করবেন, এতে করে কি এখন প্রমাণ হয় না যে আমি প্রকৃত খুনী নই?
শহীদ বলল, হ্যাঁ, তাই প্রমাণ হয়। বোধহয় বেঁচে গেলেন এ যাত্রা। মি. সিম্পসন, রফিক চৌধুরীকে যথাস্থানে পাঠিয়ে দিন আপাতত, পরে দেখা যাবে ওকে কবে নাগাদ মুক্তি দেয়া যায়।
মি. সিম্পসনের ইঙ্গিতে কনস্টেবলদুজন রফিককে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে।
শহীদ বলল, খুবই ইন্টারেস্টিং কেস, সন্দেহ নেই। আসুন দেখা যাক, আমরা কি পজিশনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে, তিনটে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে তিনটে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। একটা আইভর-জনসনের গুলি, একটা ব্রাউনিংয়ের গুলি, একটা নিখোঁজ একম্যান এয়ার পিস্তলের গুলি। সমস্যা হলো, একটা বুলেট আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তিনটের মধ্যে মাত্র দুটো বুলেট পাওয়া গেছে। মি. সিম্পসন, দেয়াল খুড়ে আপনি যে বুলেটটা বের করেছেন, দিন তো সেটা।
তেপয় থেকে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া বুলেটটা তুলে শহীদের হাতে দিলেন মি. সিপসন। শহীদ বুলেটটার ওজন অনুভব করতে করতে বলল, আপনার ধারণা এটা•৩৮ রিভলভারের বুলেট, আমারও তাই মনে হয়। ডাক্তার, আপনিও দেখুন!
বুলেটটা নিয়ে দেখলেন ডাক্তার। বললেন, ৩৮, কোন সন্দেহ নেই। এই ওজনের অনেক বুলেট বের করেছি আমি মানুষের শরীর থেকে।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। রফিক স্বীকার করেছে, •৩৮ বুলেট ছেড়ে সে। ওলিটা দেয়ালে লাগে। তারপর কি ঘটে? তারপর মাত্র চার কি পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে কি কি ঘটনা ঘটে? ভাল কথা, ডাক্তার, আপনি বললেন একম্যান এয়ার পিশুলে শব্দ হয় না বললেই চলে। একেবারেই কি শব্দ হয় না?
হয়। এই ধরুন, আলো জ্বালাবার জন্যে ইলেকট্রিক সুইচ অন করলে যেমন খুট করে মৃদু শব্দ হয়, তেমনি।
শহীদ বলল, তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। রূমের ভিতর খুট করে শব্দ হলে রফিকের কানে সে শব্দ না ঢোকারই কথা। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। পাওয়া যাচ্ছে না :৩২ বাউনিং-এর বুলেট কোথায় গেছে সেটা? কোথায় আছে এখন সেটা?
কেউ শহীদের প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করুল না।
শহীদ আপনমনেই বলে চলেছে, প্রথমে গুলি করুন রফিক। ব্যর্থ হলো সে, তার গুলি গিয়ে বিধল দেয়ালে। তারপর দ্বিতীয় শব্দ হলো, যে-শব্দ মি. সিম্পসন পরিষ্কার শুনতে পেয়েছেন জানালার দিকে দৌড়বার সময়। এটা বাউনিংয়ের গুলির শব্দ। এই বুলেটটা পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার কেউ এর্কম্যান এয়ার পিস্তল থেকে গুলি ছোড়ে, যে গুলিতে নিহত হন লোদী সাহেব। কিন্তু এদিকে এয়ার পিস্তলটা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ খুনী যে পালাবে, তারও উপায় নেই। পালাবার একমাত্র পথ জানালাটা, সেখানে মি. সিম্পসন ছিলেন। দরজাটা তো বন্ধই ছিল।
আবার চুপ করল শহীদ। তারপর সতেজ গলায় বলল, আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু বিশ্বাস না করলেও, ঘটনাটা ঘটেছে। আপনাদের কোন সাজেশন আছে? :
আড়চোখে কুয়াশার দিকে একবার তাকাল শহীদ। কুয়াশা আগের মতই নির্বিকার।
কামাল বলল, আমার শুধু একটা প্রশ্ন আছে। রফিক যে খুনী নয় এটা এখন নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠিত সত্য?..
মি. সিম্পসন বললেন, প্রতিষ্ঠিত সত্য।
শহীদ বলল, আমিও তাই মনে করি। তাকে খুনী বলে মনে করার কোন যুক্তি নেই আমাদের হাতে।
পকেট থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে মি. সিম্পসন লিখতে শুরু করলেন, সেই সাথে মুখে বলে চললেন, তিনটে প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে শহীদ। একটার সাথে আর একটার যোগ আছে, অবশ্যই। (১) একই লোক কি একম্যান এয়ার পিস্তল এবং ব্রাউনিং দিয়ে পরপর দুটো গুলি করেছে? এবং তা যদি না হয়, রূমের ভিতর কি রফিক ছাড়াও আরও দুজন মানুষ ছিল? (২) ব্রাউনিং দিয়ে গুলি করা হয় কিন্তু তার আগের মুহূর্তে, না, তার পরের মুহূর্তে এয়ার পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়? (৩) উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্ন হলো, প্রকৃত খুনীকোন্ জায়গায় দাঁড়িয়েছিল?
মি. সিম্পসন মুখ তুলতে শহীদ বলল, সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো তিন নম্বরটা। ডাক্তার সাহেবের রিপোর্ট অনুযায়ী লোদী সাহেবকে গুলি করা হয়েছে দশ ফুট দূর থেকে। তবু কেন রফিক খুনীকে দেখতে পেল না? রফিকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে দাঁড়িয়েছিল লোদী সাহেবের কাছ থেকে মাত্র পনেরো ফুট দূরে। মি. সিম্পসন, আমার বিশ্বাস, সুপরিকল্পিত একটা ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে আমাদেরকে। কেউ বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটা গোলকধাঁধা তৈরি করেছে, আমরা তার মধ্যে ঘুরে মরছি।
কামাল বলল, তুই কি বলতে চাইছিস আবার সেই পুরানো কথাটা? রফিক কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে?
কিন্তু তাও তত সম্ভব না। রফিক যদি কাউকে বাঁচাবার চেষ্টাও করে, সেই মানুষটা বের হলো কোন পথ দিয়ে রূমের ভিতর থেকে? নিঃসন্দেহে আরও একজন মানুষ ছিল রূমের ভিতর, সম্ভবত আরও দুজন ছিল। একজন, দুজন বা পাঁচজন মানুষ লোদী সাহেবকে লক্ষ করে গুলি করল–তাদের মিছিলটা মাত্র তিন কি চার সেকেণ্ডের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল?
ঘনঘন মাখা দোলাল শহীদ। সকৌতুকে তাকাল ডাক্তারের দিকে। তারপর বলল, ডাক্তার, তেমন কোন ওষুধ আছে নাকি? মানুষকে গায়েব করে দিতে পারে, এমন কোন ওষুধ?
নেই।
শহীদ প্রশ্ন করল, মৃত্যু কি তৎক্ষণাৎ হয়েছিল?
প্রায়। হয়তো চার কি পাঁচ সেকেণ্ড বেঁচে ছিল গুলি খেয়ে।
শহীদ সোফা ত্যাগ করল, সেক্ষেত্রে, আর আলোচনা করে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। বৈঠকখানায় বসে এ কেসের সমাধান হবে না। আমি অকুস্থলে যেতে চাই। কামাল গাড়ি বের কর।
মি. সিম্পসনও সোফা ত্যাগ করলেন। তাকালেন দুচোখ ভরা আশা নিয়ে, মি, এনাম আহমেদ, আপনিও চলুন না আমাদের সাথে।
আমি? কুয়াশা মুখ তুলে বিস্মিতকণ্ঠে বলল।
বাড়ির ভিতর বসে বসে তো হাঁপিয়ে উঠেছেন। শরীর যদি সুস্থ থাকে, চলুন না, একটু মৃদু বাতাস খেয়ে আসবেন। কেসটা কোন্ দিকে মোড় নেয়, তাও দেখার সুযোগ পাবেন।
শহীদ বলল, যদি আপত্তি না থাকে, চলো। কেসটা খুবই ইন্টারেস্টিং, বুঝলে? রীতিমত নাকানিচোবানি খাওয়াতে শুরু করেছে।
কুয়াশা মৃদু হাসল। বলল, আমার তা মনে হয় না।
মানে? কি মনে হয় না তোমার? কামাল জানতে চাইল।
কুয়াশা বলল, খুব জটিল কেস, এটা বিশ্বাস করি না। সে যাক, যেতে না হয় চাইলাম, কিন্তু মহুয়াদি কি অনুমতি দেবেন? তিনি যে কড়া শাসনে রেখেছেন আমাকে।
কামাল বলল, সে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি জানতাম, তুমি যেতে চাইবে। তাই মহুয়াদিকে হাতে-পায়ে ধরে আগে থেকেই রাজি করিয়ে রেখেছি।
কুয়াশা বলল, তবে আর আপত্তি কিসের। চলো, যাই।
কুয়াশা ইনভ্যালিড চেয়ার ত্যাগ করে সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াল।
মি. সিম্পসন অবাক হয়ে বললেন, আপনি দেখছি দিব্যি হাঁটতেও পারেন। সেরে উঠেছেন, তবু কেন বসে আছেন পঙ্গুর মত ইনভ্যালিড চেয়ারে?
মহুয়ারি নির্দেশ অমান্য করলে ঘাড়ে মুণ্ডু থাকবে?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ বলল, কামাল, ব্যারিস্টার খানের অ্যালিবাই সত্য কিনা পরীক্ষা করা দরকার। এই কাজের দায়িত্ব তুই নে। তোর কাছ থেকে রিপোর্ট পাবার পর ওদেরকে মুক্তি দেব। আধ ঘন্টার মধ্যে পারবি না রিপোর্ট করতে?
আশা করি। কিন্তু ওদেরকে লাইব্রেরীর ভিতর আটকে রাখাটা কি উচিত হবে?
শহীদ বলল, কেসটা জটিল একদিকে মোড় নিয়েছে, ওদেরকে ছেড়ে দিলে ওরা এমন সব কাণ্ড করে বেড়াবে যার ফলে জটিলতা আরও শতগুণ বাড়বে বৈ কমবে না। অকুস্থল এবং পরিবেশ পরীক্ষা করার সময় আমি ব্যারিস্টার সাহেবের উপস্থিতি চাই না।
কামাল বলল, কিন্তু ব্যারিস্টার সাহেবের অ্যালিবাইটা মজবুত বলেই মনে হচ্ছে। তিনি লোদী সাহেবের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কেন খুন করবেন? তার মোটিভ কি হতে পারে? আর মিস শাহানারার কথা যদি বলিস তাকে সন্দেহের বাইরে। রাখা চলে অনায়াসে। কারণ তার অ্যালিবাইটা এয়ারটাইট। স্বয়ং রফিক সমর্থন। করেছে।
শহীদ বলল, ওদেরকে কেন, আমি এখন কাউকেই খুনী বলে সন্দেহ করছি না। কিন্তু ভেবে দেখ, বাড়ির ভিতর রফিক ছাড়া বাইরের কোন লোক যদি ঢুকে না, থাকে, খুন করল কে? নিশ্চয়ই বাড়ির কোন নোক? শাহানারা সন্দেহের উর্ধ্বে, মানি। ব্যারিস্টারের অ্যালিবাই যদি সত্য হয় তাহলে তিনিও সন্দেহের বাইরে থাকছেন। বাকি থাকে কে?
কুয়াশা আবার বসে পড়েছে তার চেয়ারে। বইয়ের পৃষ্ঠায় মগ্ন সে আবার। যেন এতটুকু আগ্রহ বা উৎসাহ নেই তার এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে।
মি. সিম্পসন গভীর মনোযোগের সাথে শহীদ এবং কামালের কথোপকথন শুনছেন। ডাক্তার ইদ্রিস বিদায় নিয়ে চলে গেলেন এইমাত্র।
কামাল বলল, বাকি থাকে বড় মেয়ে ইলোরা, বুড়ো কেরানী সিরু কাকা এবং বাড়ির চাকরবাকর।
শহীদ বলল, এদের মধ্যেই কেউ প্রকৃত খুনী। চল, রওনা হওয়া যাক।
নিচে নামল ওরা দল বেঁধে। শহীদের ফোক্সওয়াগেনে চড়ল শহীদ একা। কামাল বেরিয়ে গেল তদন্তে তার মটরসাইকেল নিয়ে। মি. সিম্পসন কুয়াশার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে নিজের জীপের দিকে, মি, আহমেদ, আপনার মূল্যবান সঙ্গ দিয়ে আমাকে গৌরবান্বিত করুন।
মি. সিম্পসনের সকৌতুক আবেদনের জবাবে কুয়াশা সহাস্যে বলল, মি. সিম্পসন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার মত একজন লে-ম্যানকে আপনি এই জটিল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়াতে চাইছেন কেন?
আপনি লে-ম্যান? আপনি যদি লে-ম্যান হন, আমরা তাহলে কি? আমরা তাহলে নো-ম্যান। দেখুন, মি, আহমেদ, নিজেকে আপনি গোপন করে রাখার চেষ্টা করলে কি হবে, আপনার প্রকৃত পরিচয় আমি ভাল করেই জানি।
কুয়াশা শান্তস্বরে জানতে চাইল, জানেন নাকি? বলুন, কি আমার প্রকৃত পরিচয়?
মি. সিম্পসন জীপে স্টার্ট দিয়ে বললেন, আপনি লণ্ডনে ছিলেন দীর্ঘ তেরো বছর। ওখানে আপনি কবিতা লিখতেন ইংরেজীতে। চারটে বই বেরিয়েছে আপনার। রাষ্ট্ৰীয় পুরস্কার পেয়েছেন একটি। কেমিস্ট্রিতে আপনি পণ্ডিত, লন্ডন ইউনিভার্সিটির হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন পাঁচ বছর। কানাডায় খামার আছে আপনার, বার্ষিক আয় পঞ্চাশ লাখ ডলার। আপনি এগারোটা ভাষা জানেন।আপনি…।
আঁতকে ওঠার ভান করে কুয়াশা বলল, সর্বনাশ! এত খবর যোগাড় করলেন কোত্থেকে? নিশ্চই শহীদের কাছ থেকে? কি জানেন, আমার বিষয়ে ও সব সময় একটু বাড়িয়ে বলে।
এতটুকু বাড়িয়ে বলেনি, ওকে আমি চিনি। মোট কথা, আপনি একটা প্রতিভা এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আপনি নিজেকে গোপন করে রাখতে চান, জানি না এর কি কারণ!
কুয়াশা বলল, আত্মপ্রচার কি ভাল?
মি. সিম্পসন বললেন, ভাল নয়, স্বীকার করি। কিন্তু আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে গুণের কদর নেই। তাই আত্মপ্রচার ছাড়া উপায় কি?
কুয়াশা বলল, আমি একমত নই। প্রকৃত গুণী মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। আত্মপ্রচার তারই দরকার যার কোন গুণ নেই।
মি. সিম্পসন বললেন, নীতিবোধ আপনার প্রবল, আপনার সাথে তর্ক করে। পারব না। প্রায় এসে গেছি আমরা। আপনার সাথে পরে বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। ভাল কথা, মি. আহমেদ, এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
কুয়াশা বলল, মতামত দিতে পারি। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করবেন না বা ব্যাখ্যা চাইবেন না–রাজি?
মি. সিম্পসন কুয়াশার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন তিনি–হ্যাঁ, রাজি।
কেসটা আসলে তেমন জটিল নয়। খুনী কে তা আমি জানি না। তবে খুনীকে যে চেনে তাকে আমি চিনি। ..
মি. সিম্পসন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কুয়াশা বলল, কোন প্রশ্ন নয়। আরে, অ্যাক্সিডেন্ট করবেন যে!
কুয়াশার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মি: সিম্পসন গাড়ি চালনায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করলেন।
তার ভিতরে উত্তেজনা টগবগ করে ফুটছে, কিন্তু সে উত্তেজনা বেরুবার পথ। পাচ্ছে না।
.
০২.
বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশ মেঘে ঢাকা।
জীপের পিছনে থামল শহীদের ক্রিমসন কালারের ঝকঝকে ফোক্সওয়াগেন। পুলিসের গাড়ি দেখে দারোয়ান রমজান মিয়া তাড়াহুড়ো করে গেট খুলে দিয়ে কপালে হাত ঠেকাল।
মি. সিম্পসন জীপ থেকে নেমেই প্রশ্ন করলেন, কেমন আছ, রমজান? নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?..
ভাল আছি, হুজুর। না, হুজুর। ইনিসপেক্টর হুজুর রেস্ট হাউজে কি যেন খোঁজাখোজি করছেন হুজুর! রমজান মিয়ার চোখেমুখে ভয়ের ভাব।
কি ব্যাপার, রমজান?
রমজান মিয়া বলল, হুজুর, ইনিসপেক্টর হুজুর আমার কথা বিশ্বাস করতেছেন না। তিনি বলতেছেন পাঁচিল টপকে গতকালকে কেউ বাড়ির ভিতর ঢুকেছিল।
তুমি কি বলো? ঢোকেনি কেউ?
ঢুকতে পারে না, হুজুর। আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে হতে পারে না, হুজুর। পাঁচিল টপকাতে হলে, হুজুর, মই লাগবে। মই কেউ যদি আনও, আশপাশের লোকজন তো কেউ কানা না, হুজুর…।
মি. সিম্পসনের পাশে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। শহীদও পৌঁছুল।
বাড়ির পিছন দিকের গেট?
সাথে সাথে উত্তর এল, তালা মারা, হুজুর। ছোট বেগম সাহেবা গতকাল পাঁচটার দিকে বাড়ি ফিরে হুকুম দেন, কেউ যেন বাড়ির ভিতর ঢুকতে না পারে, আর পিছনের গেটে তালা দিতে হবে। তালা দিয়ে আসি আমি। তালার চাবি একটা ছোটো বেগমসাহেবার কাছে, আর একটা আমার কাছে। দুটোই চাবি, হুজুর।
তোমার বড় বেগমসাহেবা এবং সিরু কাকা গতকাল ঘটনার সময় বাড়ি ছিল। কখন এরা বেরোয়?
চারটে বাজতে পনেরো বিশ মিনিট আগে বড় বেগম সাহেবা। সোয়া চারটের সময় সিরু কাকা, হুজুর।
শহীদ প্রশ্ন করল এবার, তোমার সাহেব রেস্ট হাউজে কটার সময় যান?
সাড়ে তিনটের সময়, হুজুর।
ছোট বেগম সাহেবা বেরোন কখন?
ওই রকম সময়েই, হুজুর।
সিরু কাকা বাড়ি থেকে বেরুবার প্রায় সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়, তাই না?
রমজান মিয়া অবাক চোখে শহীদের দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বী, হুজুর। সিরু কাকা যাবার পাঁচ মিনিট পরই বৃষ্টি নামে। এর পঁচিশ ত্রিশ মিনিট পর ছোটো বেগমসাহেবা…।
গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরে তাই না?
জ্বী, হুজুর।
গাড়িতে এসে উঠল আবার ওরা। গেট পেরিয়ে এগোল গাড়ি দুটো। প্রশস্ত রাস্তা। দুপাশে বাগান। গাড়ি বারান্দায় গিয়ে থামল গাড়ি দুটো।
মূল বাড়িটা তিন তলা। সেকেলে ধরনের বাড়ি। চেহারাটা ভারিক্কি। ইদানীং হোয়াইটওয়াশ করা হয়েছে। শহীদ লক্ষ করল প্রত্যেকটি জানালায় কবাট ছাড়াও কাঠের শাটার রয়েছে।
কাঁধে গামছাওয়ালা একজন প্রৌঢ় চাকর পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ওদেরকে হলঘরে। হলঘরে ঢোকার আগেই শহীদ লোকটাকে জিজ্ঞেস করে তার নাম জেনে নিল। একটু খুড়িয়ে হাঁটে কেরামত। গায়ের রঙ কয়লার মত। মুখের চেহারা দেখে, মনে হয় চাপা স্বভাবের। লোকটার একটা বদভ্যাস হলো, আড়চোখে তাকায়। হলঘরে ঢোকার সময় ধরা পড়ে গেল সে। শহীদের সাথে চোখাচোখি হতেই অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
বড় বেগমসাহেবাকে ডেকে দেব হুজুর? উনি আপনাদের কাছে যাবেন বলছিলেন…। ওরা নরম সোফায় আসন গ্রহণ করতে হাত কচলাতে কচলাতে বলল কেরামত!
আমি নামছি, কেরামত।
সকলে মুখ তুলে তাকাল মেয়েলি একটি কণ্ঠস্বর শুনে। ঠাণ্ডা, সুরহীন সাদামাঠা কণ্ঠস্বর। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলল। কাউকে বলে দিতে হলো না, লোদী সাহেবের বড় মেয়ে মিস ইলোরা ও। ধীরে ধীরে নেমে আসছে। কেরামত ডান কাঁধ থেকে গামছাটা বাঁ কাঁধে রাখতে রাখতে বেরিয়ে গেল হলঘর। থেকে।
বোঝা যায় ইলোরা সুন্দরী ছিল, ভাবল শহীদ। সৌন্দর্য এখন আর অবশিষ্ট নেই। বয়সের চেয়ে বেশি বড় মনে হয় চেহারা দেখে। লাবণ্যহীন মুখ। রুজ লিপস্টিকের বহুল ব্যবহার মুখে। পরনে জর্জেটের নীল শাড়ি। পায়ে হালকা স্যান্ডেল। ছোট বোন শাহানারার চেয়ে একটু বেশিই লম্বা সে। দুবোনের চেহারা দুরকম, কারও সাথে কোন মিল নেই। ইলোরার হাতে বড়সড় একটা ভ্যানিটি ব্যাগ দেখা যাচ্ছে।
ইলোরা নিচে নেমে আসতে মি. সিম্পসন সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শহীদ লক্ষ করল ইলোরা আর সকলকে বাদ দিয়ে বারবার কেবল একজনের দিকে তাকাচ্ছে। সেই একজন হলো কুয়াশা। ইলোরা কথা বলার সময়ও কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল, আমাদের সৌভাগ্য, আপনাদের মত সম্মানীয় ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছে এ-বাড়িতে। মি. সিম্পসন, আপনার কাছে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম আমি।
শুনেছি। কি কারণে যাচ্ছিলেন?
ইলোরা উত্তর না দিয়ে হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলল। বলল, জিনিসটা আপনা ক দিয়ে দিই। বলে, ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে রূপালী রঙের একটা পিস্তল বের করল সে। পিস্তলের ব্যারেলটা অস্বাভাবিক লম্বা।
এটা একটা একম্যান এয়ার পিস্তল। ইলোরাই কথা বলল আবার।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি–কোথায় পেলেন আপনি ওটা?
আমার বেডরুমের ভিতর যে টেবিলটা আছে, সেটার নিচের দেরাজ থেকে। শহীদের চোখে চোখ রেখে বলল ইলোরা।
.
০৩.
মেয়েটি তার এই পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের জীবনের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এসেছে, যার ফলে আশ্চর্যজনক কোন ঘটনাই তাকে তেমন আলোড়িত করতে পারে না আর, ইলোরার শান্ত ভাবভঙ্গি এবং সহজভাবে কথা বলার কায়দা দেখে ভাবল শহীদ।
রহস্যটা যে কি জানি না আমি। কে এটা আমার বেডরূমে রাখল, কি তার উদ্দেশ্য–একমাত্র সেই জানে। বাবা এটা দিয়ে খুন হননি। এটা আবিষ্কার করার পর প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম লুকিয়ে ফেলব, তা না হলে পুলিস আমাকে সন্দেহ করতে পারে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবনা চিন্তা করার পর ঠিক করলাম, এমনিতেই খুনের রহস্যটা জটিল, তার ওপর এটা লুকিয়ে ফেললে আরও জটিলতার সৃষ্টি হবে।
শহীদকে দেখিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, ওর পরিচয় তো দিয়েইছি। এই কেসের দায়িত্ব এখন ওর কাঁধে। আমরা ওকে অনুরোধ করেছি এই কেসের সমাধান বের করতে। শহীদ, তুমি মিস ইলোরাকে প্রশ্ন করতে পারো।
শহীদ ছদ্মবেশধারী কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বন্ধু এনাম আহমেদ আমাকে সাহায্য করছেন। আহমেদ, তুমি কি কোন প্রশ্ন করতে চাও?
কুয়াশা সহাস্যে বলল, প্রয়োজন দেখি না। তুমি শুরু করো, দরকার মনে করলে আমিও দুএকটা প্রশ্ন করব।
শহীদ ইলোরার দিকে তাকাল। দেখল, ইলোরা তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে কুয়াশার দিকে।
মিস ইলোরা, আপনার কি ধারণা এয়ার পিস্তলটা কেউ শত্রুতা করে আপনার বেডরূমে রেখেছিল?
তা ছাড়া কি!
শহীদ মি. সিম্পসনের হাত থেকে এয়ার পিস্তলটা নিয়ে পরীক্ষা করল। বলল, একটা গুলি ব্যবহার করা হয়েছে।
ইলোরা বলল, হত্যাকাণ্ডের সাথে এই এয়ার পিস্তলের কোন সম্পর্ক নেই, তাই না? মি. সিম্পসন আমাকে গতকালই বলেছেন, দুটো আয়েয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বাবাকে খুন করার জন্যে। একটা বাউনিং, আর একটা আইভর-জনসন। এয়ার পিস্তলের কথা উনি বলেননি।
শহীদ বলল, এ প্রসঙ্গটা আপাতত স্থগিত থাক। আচ্ছা, এর আগে এই এয়ার পিস্তলটা আর কোথাও দেখেছিলেন?
দেখেছি মানে? হাজারবার দেখেছি। এটা তো বাবার এয়ার পিস্তল।
শহীদের চোখের পাতা এতটুকু কাঁপল না, তাই নাকি? আপনার বাবা কোথায় রাখতেন এটাকে?
রেস্টহাউজে। লাইব্রেরী রূমের ভিতর। রাইটিং টেবিলের দেরাজে।
শেষবার কবে দেখেছেন এটাকে?
গতকাল বিকেলে, ওই ড্রয়ারেই।
কুয়াশা চুরুট ধরাল, ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আমার একটা প্রশ্ন আছে।
ইলোরা মিষ্টি হেসে তাকাল কুয়াশার দিকে, বলুন, মি. আহমেদ।
কুয়াশা ইলোরার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেশ করল, বলতে পারেন, মিস ইলোরা, কেন এ বাড়ির লোকজন আপনার বাবাকে তেমন পছন্দ করতেন না? : আমি লক্ষ করেছি, আপনি এবং আপনার ছোটবোন বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছেন, সহজভাবে কথা বলছেন। বাবার মৃত্যু কি আপনাদেরকে দুঃখিত করেনি?
মি. সিম্পসন কুয়াশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কুয়াশার প্রশ্নটা শুনে মাথা দোলাতে লাগলেন তিনি, চোখেমুখে প্রশংসার ভাব ফুটে উঠল তার।
ইলোরা আরও সুন্দর ভঙ্গিতে হাসল। আরও সহজ ভঙ্গিতে বলল, দুঃখ প্রকাশ করার ধরাবাধা কোন নিয়ম নেই, মি. আহমেদ। তাছাড়া আপনারা অপরিচিত, আউটসাইডার, আপনাদের সামনে ভাবাবেগ প্রকাশ করাটা কি অশোভন একটা ব্যাপার হবে না? এখানে আমি প্রসঙ্গত আরও একটা কথা উল্লেখ করতে চাই। বাবা ঠিক আমাদের আপন বাবা ছিলেন না। আম্মাকে বাবা যখন বিয়ে করেন আমূরা তখন ছোট ছিলাম। আমাদের আপন বাবা মারা যান শাহানারা জন্মাবার এক বছর পরই। এই তথ্য আপনাদেরকে জানাবার কোন প্রয়োজন ছিল না। তবু সবই বলা দরকার মনে করে
কুয়াশা বলল, না জানালে ক্ষতি ছিল না। কারণ এ-তথ্য আমার আগেই জানা ছিল। আপনার বাবার সাথে অল্প-স্বল্প পরিচয় ছিল আমার। সে যাক। মিস ইলোরা, আপনাকে একটা কথা আমাদের এখন জানানো দরকার। সেটা হলো, আপনার, বাবা আসলে এই এয়ার পিস্তলের গুলিতেই নিহত হয়েছেন।
ইলোরা বলল, বলেন কি? তার মানে সত্যি সত্যি কেউ আমাকে বিপদে ফেলার জন্যে ওটা আমার বেডরূমে…
ইলোরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কুয়াশা বলল, অন্তত, তাই মনে হচ্ছে। বাড়ির ডিতর বাইরের কোন লোক ঢুকতে পারে না, সুতরাং বাড়ির কোন লোকই আপনার শত্রু। কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
সন্দেহ করব? নাহ, কাকে সন্দেহ করব? বাড়ির ভিতর কেউ আমার শত্রু নেই।
আপনার বাবার সাথে আপনার সম্পর্ক কি রকম ছিল বলবেন কি?
স্বভাবতই ভাল ছিল। বাপের সাথে মেয়ের যেমন থাকে। ইলোরা একটু যেন অসহায় বোধ করল উত্তরটা দেবার সময়।
কুয়াশা পরবর্তী প্রশ্ন করল, আপনার বাবার সয়-সম্পত্তি টাকা পয়সার উত্তরাধিকারী আপনারা দুবোনই তো?
হা। তার যা কিছু আছে প্রায় সবই দিয়ে গেছেন আমাদেরকে। সিরু কাকা কিছু নগদ টাকা পাবেন। পুরানো চাকরবাকরও কিছু কিছু পাবে। বাকি সবই আমাদের দুবোনের।
কুয়াশা বলল, পিস্তলটা–এটা কি আপনার বাবা আত্মরক্ষার জন্যে সব সময় নিজের সাথে রাখতেন?
আত্মরক্ষার জন্যে নয়।.তা কেন রাখবেন। বাবার কোন শত্রু ছিল না। বাবা এটা রেখেছিলেন অ্যান্টিক হিসেবে অনেকটা।
শত্রু ছিল না বলছেন কেন? রফিক চৌধুরী আপনার বাবাকে খুন করবে বলে হুমকি দিয়েছিল।
ইলোরা কিছু যেন ভাবল। তারপর বলল, কি জানেন, রফিক যে বাবাকে হুমকি দিয়েছিল কোর্টে, এ আমি গতকাল রাত্রে জেনেছি। শাহানারা না বললে আমার জানাই হত না। শোনার পর প্রথমে আমি বিশ্বাসই করিনি। তারপর বাবার সাথে রফিকের তিক্ত সম্পর্কের কথা মনে পড়ে যেতে, বিশ্বাস হয়।
আপনার বাবার সাথে রফিকের পরিচয় ছিল তাহলে?
ইলোরা অবাক হয়ে বলল, ছিল বৈ কি। তবে কোথায়, কবে ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়, পরিচয় হয় জানি না। বাবা মাঝেমধ্যে রফিকের নাম উচ্চারণ করে গালাগালি করতেন। বলতেন, ছেলেটা ইচড়ে পাকা এবং ডবল হারামি। এ থেকেই বুঝতাম, বাবা তাকে সহ্য করতে পারতেন না।
রফিক চৌধুরী সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
ভাল। না, ভাল না। কি জানেন, ঠিক বোঝানো যাবে না ব্যাপারটা। ওকে আমার কেন জানি না, ভালই লাগে। খুব সরল ও। সম্ভবত একটু রগচটা, কিন্তু। মনটা উদার। ওর কোন কোন স্বভাব একেবারেই পছন্দ হয় আমার। যেমন, সহ্যগুণ কম, ওর। বড় ব্যস্ত, কারণেও অকারণেও।
কখন থেকে যেন মি. সিম্পসন পকেট থেকে নোট বুক বের করে কুয়াশার প্রশ্ন এবং ইলোরার উত্তরগুলো শর্টহ্যাণ্ডে দ্রুত লিখে নিতে শুরু করেছেন।
শহীদ বসে বসে পাইপ টানছে চোখ কান সজাগ রেখে।
গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত কোথায় সময় কাটান, আপনি মিস ইলোরা?
অ্যালিবাই, না? বলছি। বিকেলের অধিকাংশ সময়ই আমি ব্যয় করি বাবার জন্যে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি বাছাই করার জন্যে একদল মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়ে। এতদিন সিরু কাকাই এই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। কিন্তু সিরু কাকার বয়স হয়েছে, কাজে তিনি ভুল করছেন অহরহ, বাবা তাই একজন নতুন লোক চাইছিলেন। আমি ঠিক করি, পুরুষ নয়, মেয়ে সেক্রেটারি নিয়োগ করব। বাবাকে যে একটু আধটু সেবা যত্নও কমতে পারবে। দরকার হলে তাকে আমরা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।
কুয়াশা বলল, কিন্তু এ কথা তো আপনি গতকাল মি. সিম্পসনকে বলেননি? বাড়ির ভিতর গতকাল বিকেলে একদল চাকুরিপ্রার্থী মহিলা ছিল তাহলে?
ইলোরা বলল, কিন্তু এর সাথে হত্যাকাণ্ডের কোন সম্পর্ক নেই। বাবা খুন হবার দুঘন্টা আগে তারা বিদায় নিয়ে চলে যায় সবাই। দারোয়ান রমজান এ ব্যাপারে আপনাদেরকে কনফার্ম করতে পারবে। ওরা চলে যাবার পর আমি বাবার কাছে যাই, রেস্টহাউজে।
রেস্টহাউজে যান কেন?
একটু যেন অপ্রতিভ বোধ করল ইলোরা। খানিক ইতস্তত করার পর বলল, হাত খরচার জন্যে কিছু টাকার দরকার ছিল আমার, তাছাড়া বাবাকে জানাবার প্রয়োজনও ছিল যে নতুন এক মেয়েকে নির্বাচন করেছি তার প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে।
গিয়ে কি দেখলেন?
বসেছিলেন ডেস্কের পিছনে। টাকা চাইতে তিনি নিচের দেরাজটা খুলে চেক বইটা বের করলেন, তখনই আমি দেখতে পাই দেরাজের ভিতর এয়ার পিস্তলটা।
দেরাজে তালা মারা ছিল কি? প্রশ্নগুলো একা কুয়াশাই করছে।
ঠিক বলতে পারব না। লক্ষ করিনি। তরে তালা মারা থাকার কথা। কারণ, বাবা যে বইটা লিখছিলেন সেটার পাণ্ডুলিপি ওই ড্রয়ারেই রাখতেন। ওহ-এবার মনে পড়েছে, হ, তালা খুলতে দেখেছি আমি বাবাকে! ভুলে গিয়েছিলাম।
পরে কি তালা লাগিয়েছিলেন?
তা আমি লক্ষ করিনি। তবে নিশ্চয়ই লাগিয়েছিলেন, আমার ধারণা।
আর উল্লেখযোগ্য কিছু আপনার চোখে পড়েনি?
না। বাবা কাজের সময় বিরক্ত হতে চান না। আমাকে দেখে ঠিক যে বিরক্ত। হয়েছিলেন তা বলব না। ডিক্টফোনে গড়গড় করে কথা বলছিলেন তিনি, এই সময় আমি যাই।
ডিক্টাফোনে নিশ্চয়ই বইয়ের কোন চ্যাপ্টার বলছিলেন?
হা। লিখতে কষ্ট হচ্ছিল ইদানীং, তাই তিনি ডিক্টফোন ব্যবহার করছিলেন। সিরু কাকা লেখার কাজ করেন সাধারণত। আমাকে দেখে তিনি বিরক্তির ভাব প্রকাশ না করলেও বিশেষ কথা বলেননি। নতুন প্রাইভেট সেক্রেটারি কথা বলতে তিনি শুধু বললেন, গুড। তারপর মেয়েটির নাম-ধাম লিখে নিলেন। বললেন, আর একবার খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে হবে মেয়েটি কেমন।
কবে থেকে তার জয়েন করার কথা?
আগামী মাস থেকে।
ঠিক আছে, বলে যান।
ইলোরা বলল, বাবা বললেন, ব্যারিস্টার আসবেন চা খেতে, রমজান যেন তাঁকে সোজা তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদিও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল না, চা বাড়ি থেকে পাঠাতে বলে যাব কিনা?
জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন ছিল না কেন?
ইলোরা বলল, রেস্টহাউজে বাবা যখন থাকতেন কেউ বিরক্ত করুক তা তিনি। একেবারেই চাইতেন না। রেস্টহাউজের অপর কামরাটায়, হলরূমের পুব দিকে ইলেকট্রিক হিটার, কেটলি, কাপ পিরিচ–সব ব্যবস্থা আছে। দরকার হলে তিনি নিজেই চা তৈরি করে নিতেন। আমি জিজ্ঞেস করতে বললেন, দরকার নেই। ব্যারিস্টার এলে আমিই তৈরি করে নের। এরপর আমি বাবাকে বলি, ইলেকট্রিক ফায়ারের মেশিনটা অন করে দিয়ে যাই, যা শীত পড়েছে।
অন্ করেছিলেন?
করেছিলাম।
কুয়াশা তাকাল মি. সিম্পসনের দিকে, অন্ ছিল? আপনারা যখন সার্চ করেন?
ছিল।
কুয়াশা মি. সিম্পসনের উদ্দেশে বলল, ধন্যবাদ। তারপর তাকাল ইলোরার দিকে, আপনি বলে যান।
রেস্টহাউজ থেকে বেরিয়ে আসি আমি এরপর, সোজা গেট দিয়ে বেরিয়ে যাই বাড়ির বাইরে। তখন পৌনে চারটে বাজে।.
কুয়াশা বলল, ঠিক, এবং তারপর?
ইলোরা হঠাৎ কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্যে। তারপর মাথা নিচু করে কিছু ভাবল।
মুখ তুলে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘ দশ সেকেণ্ড, তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল, দুঃখিত, মি. আহমেদ। এরপরের ঘটনা আমি বলতে পারছি না। আর কিছু বলবার নেই আমার।
বাড়ি ছেড়ে বেরোবার পর কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন-বলতে চান না? কেন?
ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই।
কুয়াশা বলল, কিন্তু, দারোয়ান ইতিমধ্যেই আমাদেরকে জানিয়েছে আপনি ঢাকা ক্লাবে গিয়েছিলেন…
কী! রমজান বলেছে? বড় বেশি বাঁচাল হয়ে গেছে দেখছি ও। কিন্তু…লাভ নেই ঢাকা ক্লাবে খোঁজ নিয়ে, মি. আহমেদ। আমি সেখানে যাইনি। যাবার কথা.. ছিল কিন্তু বাড়ি থেকে বের হবার ঘন্টা আড়াই-তিন আগে আমি একটা ফোন পাই, প্রোগ্রামটা তাই বাতিল করে দিই কিন্তু এসব আমার নিজস্ব ব্যাপার। আপনাদের না জানলেও চলবে।
চলবে না। কারণ, আমরা একটা হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে এসেছি। এখানে। সব কথা জানতে হবে আমাদের।
বলব না, তার কারণ, আপনারা কথাটা বিশ্বাসই করবেন না। তা ছাড়া বাড়ি। থেকে বেরিয়ে যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে আমি সত্যি গিয়েছিলাম কি না তা। প্রমাণও করতে পারব না আমি। অ্যালিবাই হিসেবে আমার বক্তব্য টিকবে না।
মিস ইলোরা; এতে করে আপনি আমাদের সন্দেহের চোখে পড়ছেন, বুঝতে পারছেন তো!
পারছি। কিন্তু আমি নিরুপায়।
এমন সময় বৃদ্ধ এক লোক ধীরস্থির পদক্ষেপে হলঘরে ঢুকল। সকলে তাকাল তার দিকে। বৃদ্ধ, প্রায় অক্ষম, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে।
সিরু কাকা, আসুন। এঁরা বাবার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে এসেছেন। মি. সিম্পসন, আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ক্ষমা করতে হবে, মাথাটা বড় ধরেছে।
মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক আছে, আপনি বিশ্রাম নিতে যান। দরকার হলে ডেকে পাঠাব আবার।
চলে গেল ইলোরা দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দিয়ে।
বৃদ্ধ সিরু কাকা একে একে সকলকে দেখল। বসল একটা চেয়ারে। ক্লান্ত বৃদ্ধ একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি বোধহয় স্যারদেরকে বিরক্ত করলাম। কিন্তু বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দেখলাম কেরামত দরজায় কান লাগিয়ে আপনাদের কথাবার্তা চুরি করে শোনার চেষ্টা করছে। দেখুন দেখি, কি বাজে স্বভাব। ভাল কথা, সাহেবের খুনী কে? নিশ্চয়ই ওই ছোকরা?.
শহীদ বলল, ওই ছোকরা মানে?
ওই ছোকরা ছাড়া সাহেবকে আরকে খুন করবে?
শহীদ বলল, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না? আপনি কি রফিক চৌধুরীর কথা বলছেন?
ওর নাম ওটা নয়। অবশ্য ওই নামেই বদমাশটা পরিচয় দেয় নিজের। কিন্তু ওর নাম জাহাঙ্গীর তরফদার, সাহেবের এককালের বন্ধু বারী তরফদারের একমাত্র ছেলে। ওই ছোকরা-গুড ফর নাথিং! অকর্মার ধাড়ী। সাহেব নীতিবান মানুষ ছিলেন, শান্তি দিয়ে নীতির জয়ই ঘোষণা করেন তিনি।
এতগুলো কথা উত্তেজনার সাথে বলে ঘনঘন হাঁপাতে থাকে সিরু কাকা।
শহীদ বলল, রফিক ওরফে জাহাঙ্গীর সম্পর্কে আর কি জানেন, সিরাজ সাহেব?
জানিনাটা কি বলুন? শয়তানটা বেশ ভাল ছিল। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ছাত্র সংস্থার অ্যাকটিভ লীডার ছিল, বউ জাম্পে রেকর্ড করেছিল পর পর দুবার ভার্সিটির বার্ষিক স্পোর্টসে। ভাল জুডো জানে। শুটিং প্রতিযোগিতায় পদক পেয়েছে একবার। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ঢাকায় এসে ছোকরা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। মাথার ওপর গার্জেন নেই, কাউকে জবাবদিহি করতে হয় নাভাল থাকে কি করে? বাবার টাকা দুদিনে উড়িয়ে দিয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে লাগল…।..
শহীদ বলল, এক মিনিট। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানে তাহলে রফিক।
জানে মানে? সে রাইফেল শূটিংয়ে মেডেল পেয়েছিল, স্যার।রিভলভারেও থার্ড হয়েছিল।
কিন্তু সে যে আজ আমাকে বলল, জানে না?
সিরু কাকা তাচ্ছিল্যভরে বলল, বলবেই তো! এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, ছোকরা এক নম্বরের মিথ্যেবাদী।
শহীদ এয়ার পিস্তলটা তুলে ধরল উপর দিকে, এটা কার বলতে পারেন?
সাহেবের, স্যার।
শহীদ জানতে চাইল, শেষবার কখম দেখেছেন মনে পড়ে?
কয়েকদিন আগেও তো দেখেছি। তবে ঠিক কবে দেখেছি বলতে পারব না। সাহেব ওটা রাখতেন ডেস্কের নিচের ড্রয়ারে।
গতকাল বিকেলে রেস্টহাউজে গিয়েছিলেন আপনি?
সিরু কাকা বলল, গিয়েছিলাম। অল্প একটু সময়ের জন্যে। গত প্রশুদিন একটা লাইব্রেরী থেকে কখানা রেফারেন্সের বই আনতে বলেছিলেন, গতকাল যাবার সময় আর কোন বই আনতে হবে কিনা জানার জন্যে গিয়েছিলাম। পাঁচ মিনিটের বেশি ছিলাম নাঃ সাহেবের কাছে। চারটের খানিক পর আমি বাড়ি থেকে বের হই, তার একটু পরই বৃষ্টি নামে।
রেস্টহাউজে গিয়ে কি দেখেন আপনি?
সাহেব কথা বলছিলেন, ডিক্টফোনে। একটা কথা…কথাটা শেষ করল না বৃদ্ধ।
বলুন।
ইতস্তত করল খানিক সিরু কাকা, তারপর বলল, তখন যদি জানতাম সাহেব, খুন হতে যাচ্ছেন, তাহলে…। আবার চুপ করে গেল বৃদ্ধ।
শহীদ বলল, যা বলতে চান বলে ফেলুন। মনে রাখবো, আমরা আপনার সাহেবের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে এসেছি। আপনি গত বিশ বছর ধরে লোদী সাহেবের কাজ করছেন, আপনি নিশ্চয়ই চান খুনী ধরা পড়ুক?
বলছি। জানালার বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম আমি।..
কোন জানালার বাইরে?
পশ্চিম দিকের। কিন্তু জোরে বাতাস বইছিল বলে মনে করেছিলাম, অন্য কোন শব্দ। কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে, আওয়াজটা কোন মানুষেরই ছিল।
আপনি একাই শুনেছিলেন?
না। সাহেবও শুনেছিলেন। সাহেবকে বরং আমি বলি, ওটা পায়ের শব্দ নয়, বাতাসের শব্দ। কিন্তু একমুহূর্ত পর দক্ষিণ দিকের একটা জানালার বাইরের শাটারে কেউ যেন ধাক্কা মারে। এই শব্দ বেশ জোরে হয়। এবার আমি নই, সাহেবই আমাকে বলেন, গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে শাটারের গায়ে। কিন্তু কথাটা যেন তিনি নিজেই বিশ্বাস করেননি। কারণ তখুনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। পর্দা সরিয়ে কবাট খুললেন, শাটার খুললেন, তারপর উঁকি মেরে বাইরে তাকালেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পাননি।
মি. সিম্পসন বললেন, এই জানালাটা দিয়েই আমি রূমে ঢুকেছিলাম।
শহীদ সিরু কাকাকে প্রশ্ন করল, তারপর আপনি কি করলেন?
বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে। ওখান থেকে বাড়ি ফিরি পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে, এসে শুনি সাহেব খুন হয়েছেন।
শহীদ বলল, সিরাজ সাহেব, আমরা এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তাতে একথা বলা চলে যে রফিক চৌধুরী ওরফে জাহাঙ্গীর তরফদার লোদী সাহেবকে খুন করেনি। আর একটা কথা, এই এয়ার পিস্তলের গুলিতেই খুন হয়েছেন তিনি। লোদী সাহেব খুন হবার পাঁচ কি সাত সেকেণ্ড পর মি. সিম্পসন লাইব্রেরীতে ঢোকেন। লাইব্রেরী রূমটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়, কিন্তু সেখানে পাওয়া যায়নি এয়ার পিস্তলটা। যদি পাওয়া যেত, তাহলে সন্দেহ করা যেত রফিকই তিনটে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিনবার গুলি করেছে। তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, রফিক দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করেছে। কিন্তু যে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করেছে সে দুটোর একটি বুলেটও লোদী সাহেবের মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়। সুতরাং, রফিক খুনী নয়। অপরদিকে, এয়ার পিস্তলটা পাওয়া গেছে আজ সকালে, এ-বাড়িতে। তার মানে, খুনী এ বাড়িতেই আছে।
বৃদ্ধ সিরু কাকা মাথায় হাত দিয়ে কাঁপতে লাগলেন, এসব আমি কি শুনছি, স্যার! এত জটিল হয়ে গেল। কিন্তু স্যার আমার এখনও বিশ্বাস, ওই ছোকরাই ধোকা দেবার জন্যে এতসব চাল চেলেছে। ছোকরাকে আমি এতটুকু বিশ্বাস করি না। ও সব পারে।
সব পারে মানে? নিশ্চয়ই তার অলৌকিক ক্ষমতা নেই?
সিরু কাকা বলল, তাও পারে। ও ছোকরা দিনকে রাত বানিয়ে ফেলতে পারে। ভেবে দেখুন, দারোয়ান থাকা সত্ত্বেও, বাড়িতে ঢুকল কি ভাবে সে? পাচিল টকানো তো এককথায় অসম্ভব।
শহীদ বলল, এর উত্তর আমরা পেয়েছি। রফিক মিস শাহানারার গাড়ির পিছনের বনেট তুলে ভিতরে লুকিয়ে ছিল। গ্যারেজে গাড়ি ঢোকার পর সে, বেরোয়।
হলঘরের দরজার কাছ থেকে ভেসে এল খুক খুক কাশির শব্দ। কাশিটা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই কাশা হয়েছে, সুতরাং সকলে দরজার দিকে তাকাল।
প্রৌঢ় কেরামত, বাড়ির চাকর কাম বাটলার পায়ে পায়ে ভিতরে ঢুকল। আড়চোখে দেখে নিল সকলকে একবার করে। সকলের কাছ থেকে পাঁচ সাত হাত দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হাত কচলাচ্ছে। কিছু বলতে চায়। কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস না করলে মুখ খুলতে ভরসা পাচ্ছে না যেন।
কি? শহীদ নিস্তব্ধতা ভাঙল।
কেরামত মিয়া চোখ তুলে তাকাল, একটা কথা বলব, হুজুর।
দাঁড়িয়ে আছ কেন চুপ করে, বলো?
কেরামত ঘন ঘন ঢোঁক গিলল, হুজুর, আপনাদের কথা শুনছিলাম, মাফ করে দেবেন। আমি যে কথাটা বলতে এসেছিঃ
থামলে কেন, বলো?
যার কথা আপনারা আলোচনা করছেন এই রফিক সাহেব, মিথ্যে কথা বলেছেন, হুজুর। তিনি ছোট বেগমসাহেবার গাড়ির পিছনে চড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকেছেন, এটা মিথ্যে কথা।
সিরু কাকা প্রায় বিরক্তির সাথে বলল, কেরামত, তুই আবার এমন গুছিয়ে কথা বলতে শিখলি কোথা থেকে?
কথা বলি না, সিরু কাকা, কিন্তু তার মানে এই নয় য়ে বলতে পারি না। আমার ওপর আপনি সব সময় খেপে থাকেন। কি কারণ, সিরু কাকা?।
হারামজাদার কথা শোনো! তুই যে আড়ি পেতে সকলের কথা শুনিস, এর জন্যে তো তোকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে হাজারবার,, আমিই তো প্রত্যেকবার তাতে বাধা দিয়ে তোর উপকার করেছি।
শহীদ প্রশ্ন করল, কত দিন কাজ করছ এ বাড়িতে তুমি, কেরামত?
এগারো বছর, হুজুর।
শহীদ বলল, ঝগড়া থাক। যা বলছিলে, রফিক; শাড়ির পিছনে চড়ে এ বাড়িতে ঢোকেনি, তা প্রমাণ করতে পারবে?
.
০৪.
কেরামত আড়চোখে তাকাল সিরু কাকার দিকে, পারব, হুজুর। তাহলে বলি। ছোট কোমসাহেবার গাড়িতে ছাতা ছিল না, জানতাম হুজুর, তাই গাড়ি নিয়ে তিনি যখন ফিরে এলেন, আমি ছাতা নিয়ে ছুটে যাই গ্যারেজে। গেটে গাড়ির আলো দেখেই আমি ছাতা নিয়ে দুটি। গ্যারেজে যখন পৌঁছাই, তিনি তখনও গাড়ি থেকে নামেননি। গাড়ির পিছনের সীট এবং পিছনের ঢাকনি খুলেই ভিতরটা আমি দেখি বেগমসাহেবা কিছু কিনেটিনে এনেছেন কিনা। কিছু আনেননি। কিন্তু, হুজুর, কোন মানুষকেও আমি দেখিনি।
গাড়ির পিছনের ঢাকনি তুলেও দেখেছিলে?
কেরামত বলল, ধমক খেয়ে ওটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, হজুর।
কি রকম?
কেরামত বলল, ছোট বেগমসাহেবা কিছু কিনে আনলে গাড়িতেই তা রেখে আসেন। আগে আমি খুঁজে দেখতাম না। একবার তো পাঁচসের খাসীর মাংস গাড়ির ওই পিছনের ঘরটায় পাঁচদিন ছিল, পচে একেবারে…
হু। বুঝেছি। আর কিছু বলবার আছে তোমার?
কেরামত মিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, জী, হুজুর।
শহীদ বলল, বলো তা হলে।
কেরামত বলল, হুজুর, সাহেব খুন হয়েছেন ঠিক কটার সময়?
সাড়ে পাঁচটার সময়। কেন?
কেরামত মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, হুজুর, আমরা চাকরবাকররা যে কেউ দায়ী নই সেই কথাই আমি এখন আপনাদেরকে বুঝিয়ে বলতে চাই। আমি, কবুচী আর চাকরানী হাদার মা–এই আমরা তিনজন, আরও একজন হলো দারোয়ান রমজান। রমজানের কথা বাদ দিই, সে তো সব সময় গেটেই ছিল। আমরা এই তিনজন যে সাহেব খুন হবার সময় রেস্টহাউজের কাছাকাছি ছিলাম না, এই কথাটা আপনাদেরকে জানাতে চাই হুজুর।
তখন কোথায় ছিলে তোমরা সবাই?
কেরামত বলল, আমরা তিনজন হুজুর একসাথে ছিলাম, রান্নাঘরে। ছয়টার আগে আমরা কেউ সেখান থেকে একবারের জন্যেও বের হইনি। আমরা হুজুর চাকরবাকর মানুষ, আমাদের হয়ে কেউ তো বলবে না। তাই নিজেদের সাফাই আমাকেই গাইতে হলো, হুজুর।
শহীদ বলল, রফিক আমাদেরকে বলেছে, সে প্রথমে মনে করেছিল লোদী সাহেব বাড়ির মূল অংশে কোথাও আছেন। একটা খোলা জানালা গলে সে ভিতরেও ঢুকেছিল। সেই সময় নাকি ড্রয়িংরূমে বসেছিল তোমাদের ছোট বেগমসাহেবা, তাকে নাকি তুমি চা-এর কথা জিজ্ঞেস করো?
জী, হুজর, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। আর একটা কথা, হুজুর… কিন্তু অভ্যাস অনুযায়ী কেরামত হাত-কচলাতে শুরু করল আবার, কথাটা শেষ করল না। তার মুখ বা নাকের সামনে মাছি বা পোকা কিছুই নেই, তবু সে হাত ঝাঁপটা। দিচ্ছে মাছি বা পোকা তাড়াবার মত করে।
কিছু বলবে আরও?
কেরামত মিয়া আড়চোখে তাকাল সকলের দিকে। তারপর মুখ তুলে দেখে নিল সিঁড়ির মাথাটা। কেউ নেই সেখানে। বলল, হুজুর, আমি জানি বড় বেগমসাহেবা গতকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন।
জানো? কিভাবে জানলে?
কেরামত বলল, বলছি, হুজুর। চাকরবাকর মানুষ, হুজুর, কি বলতে কি বলে ফেলব। তবু বলব কথাটা, কেননা এ বাড়ির নেমক খাচ্ছি আজ এগারো বছর, এ বাড়ির কারোর বিপদ হলে চুপ করে থাকি কি করে! হুজুর, চাকরানী হ্যাঁদার মা কথাটা আমাকে বলেছে।
কি কথা?
কেরামত বড্ড বেশি ভণিতা করে। শহীদ একটু বিরক্ত হলো লোকটার প্রতি।
হুজুর, হ্যাঁদার মার এক দেওরের মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে। হাদার মা চাইছিল তাকে সাহেবের সেকরেটারির কাজটা পাইয়ে দিতে। বড় বেগমসাহেবাকে বহু অনুরোধও করেছিল সে, কিন্তু তিনি রাজি হননি। হাদার মা। চাকরানী, তার কোন আত্মীয় এ বাড়িতে লেখাপড়ার কাজ করার জন্যে আসবে, বড় বেগমসাহেবা তা ভাল বলে মনে করেননি। কিন্তু, তবু, হাদার মা আজ তার সেই দেওরের মেয়েকে ফোন করতে বলে। তাই, গতকাল যতবার ফোন এসেছে, হ্যাঁদার মা নিচের ড্রয়িংরূমে গিয়ে রিসিভার তুলে কথাবার্তা শুনেছে। তার দেওরের মেয়ে গতকাল ফোন করেনি। কিন্তু লাভ হয়েছে এই যে, বড় বেগমসাহেবাকে যে লোকটা ফোন করে হুমকি দিয়েছিল…
ফোন করে হুমকি দিয়েছিল? কে সে?
কেরামত বলল, লোকটা নিজের নাম বলেনি হুজুর। তবে যা বলেছিল, হ্যাঁদার মা মনে রেখেছে সব। একটা পুরুষ লোক বড় বেগমসাহেবাকে, বলে-আমিন খসরুকে যদি চটাতে না চান বত্রিশ নম্বর এলাহী রোডে গিয়ে। আপনার নামে লেখা চিঠিটা নিয়ে আসবেন। যদি না যান, নিজের পায়ে নিজে কুডুল মারবেন আপনি।–এই কথাগুলি বলে ফোন ছেড়ে দেয় লোকটা, হুজুর।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন মি. সিম্পসন, আমিন খসরু, আঁ? শুনলে, শহীদ?
গম্ভীর হয়ে উঠল শহীদের মুখের চেহারা। বলল, হু।
আমিন খসরু কুখ্যাত একজন অপরাধী। গা ঢাকা দিয়ে আছে সে আজ মাস। তিনেক ধরে পুলিসের ভয়ে। তার পেশা হলে, যুবতী মেয়েদেরকে সুযোগ পেলেই ব্ল্যাকমেইল করা। গত মাস দুয়েক ধরে তার অপরাধের নানা কাহিনী ঢাকার সংবাদপত্রে প্রায় রোজই থাকে। পুলিস শত চেষ্টা করেও লোকটাকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হচ্ছে না। বছর খানেক আগে একবার গ্রেফতার হয়েছিল সে, কিন্তু ব্যারিস্টার সুফী সরফরাজ খান ছিলেন তার পক্ষ সমর্থক আইনজীবী, রেবেকসুর খালাস পায় আমিন খসরু। কিন্তু এখন পুলিসের হাতে অনেক শক্ত প্রমাণ মওজুদ, গ্রেফতার হলে শান্তি এড়াবার তার কোন উপায় নেই।
শহীদ বুঝতে পারল, ইলোরা কেন গতকাল বিকেলে তার মুভমেন্ট সম্পর্কে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি। আমিন খসরু র্যাকমেইল করছে-এটা গর্বের কথা নয়! একথা প্রকাশ পেলে প্রকাশ পাবে র্যাকমেইলিংয়ের কারণও। কারণটা নিশ্চয়ই ইলোরার পদস্খলন সংক্রান্ত অর্থাৎ তার চারিত্রিক দুর্বলতার কোন গোপনীয় ঘটনা।
কেউ কিছু বলবার আগেই সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল ইলোরাকে। প্রায় ঝড়ের মত নেমে এল সে নিচে।
কেরামত, বেরোও এখান থেকে। তোমাকে আমি পরে মজা বোঝাব। রুদ্ধশ্বাসে বলল ইলোরা।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল কুয়াশা। শান্ত কিন্তু অস্বাভাবিক দৃঢ় তার কণ্ঠস্বর, না, কেরামত। তুমি এখানেই থাকো।
ইলোরা বলে উঠল, আপনি!
কুয়াশা বলল, আমরা আইনের লোক, মিস ইলোরা। আমাদের দাবি আগে। আপনি ওর প্রতি চটছেন, এটা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। প্রকৃতপতে, ও আপনার উপকার করারই চেষ্টা করেছে।
ইলোরা বলল, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবার অধিকার আমি চাকরবাকরদের দিতে পারি না। আপনারাও আইনের লোক হোন বা না হোন, দয়া করে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এ-বাড়ির সকলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামাব আমরা। মিস ইলোরা, আপনার সমস্যাটা আমরা হৃদয়ঙ্গম করি। কিন্তু একটা বাপার বোঝাবার চেষ্টা করুন, গতকাল আপনার বাবা খুন হবার সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন, এ আমাদেরকে জানতেই হবে। এখন বলুন, বত্রিশ নম্বর এলাহী রোডে আপনি গিয়েছিলেন কিনা। গিয়ে থাকলে, কতক্ষণ ওখানে ছিলেন। ওখান থেকে কোথায় যান তারপর।
ইলোরা মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল।
কুয়াশা বলল, বোঝাই যাচ্ছে, অনেক নিরীহ মেয়ের মত আপনিও শয়তান আমিন খসরুর ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে পড়েছেন। তবে আপনি যদি না চান, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ব্যাপারে আমরা আপনাকে কোন প্রশ্ন করব না।
কথা দিচ্ছেন এ ব্যাপারে খোঁজ খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করবেন না? দেখুন, ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়লে আমার মানসম্মান থাকবে না। আমাকে হয়তো…হয়তো আত্মহত্যাই করতে হবে।
ইলোরা, যাকে মনে হয়েছিল শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি কঠিন প্রকৃতির মেয়ে, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কুয়াশা বলল, কথা দিচ্ছি।
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল ইলোরা। নিচু গলায় ধীরে ধীরে সে বলল, দেখুন, গতকাল যে লোকটা ফোন করেছিল তাকে আমি চিনি না। আমি খসরুর নাম করে সে আমাকে ভয় দেখিয়েছিল মাত্র। এর আগে আমিন খসরুর সাথে…থাক সে-কথা। বাড়ি থেকে সোজা নোকটার দেয়া ঠিকানায় আমি যাই। এলাহী রোড়ে বত্রিশ নম্বরই নেই। উনত্রিশেই শেষ হয়ে গেছে। ওই রোর্ডে একটি মাত্র স্টেশনারি দোকান আছে, এক অ্যাংলো বুড়ী সেটা চালায়। বত্রিশ নম্বর খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে যাই আমি। রোডটার এ মাথা থেকে সে মাথা পর্যন্ত অমন দশ বারো বার হাঁটাহাঁটি করি। কিন্তু বত্রিশ নম্বর পাইনি। এখন বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, ঘটনাটা আমার পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয় কেন? একটা রাস্তায় ঘণ্টা দেড়েক ঘোরাফেরা করেছি, কার খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমাকে চিনে রাখবে? ..
কুয়াশা বলল, হু। ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন।
ইলোরা যেন যাবার জন্যে তৈরি হয়েই ছিল, অনুমতি পেতেই সে ঘুরে পঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
ইলোরা চলে যেতে কুয়াশা কেরামতের দিকে তাকাল, রফিক চৌধুরীকে আগে কখনও দেখেছ এ বাড়িতে?
না, হুজুর। কখনও আসেননি।
কুয়াশা বলল, ঠিক আছে, তুমিও যাও। …
এমন সময় হলঘরের দরজায় উদয় হল ইউনিফর্ম পরা ইন্সপেক্টর শুকুর চৌধুরী। বলল, স্যার, আমি কিছু কু পেয়েছি। যার ফলে কেসটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। নতুন দৃষ্টিতে দেখতে হবে, সার, এখুন…
.
০৫.
শহীদই প্রশ্ন করল, আপন, আবিষ্কৃত কুগুলো কি বলুন।
কপালে হাত ঠেকিয়ে সম্মান দেখাল ইন্সপেক্টর, এগিয়ে এসে পঁড়াল আরও সামনে, পায়ের কিছু ছাপ পাওয়া গেছে। অত্যন্ত পরিষ্কার ছাপ। কিন্তু আসল ব্যাপার এ নয়। আমি একটা বুলেট পেয়েছি, .৩২ অটোমেটিকের, সম্ভবত ব্রাউনিং-এরই।
কোথায় পেয়েছেন, ইন্সপেক্টর?
ইন্সপেক্টর বলল, জানালার কাছ থেকে খানিকদূরের একটা গাছের গা থেকে। ওই জানালা দিয়ে মি. সিম্পসন লাইব্রেরীতে ঢুকেছিলেন।
নিস্তব্ধতা।
কিন্তু, স্যার, কিছু পায়ের ছাপএর কোন অর্থ বোঝা যাচ্ছে না। দেখে মনে হয় খুনী পশ্চিমদিকের একটা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে–কিন্তু পশ্চিম দিকের জানালা তো ভোলাই যায় না, এখনও।
এমন সময় ফোন এল।
কামাল ফোন করে রিপোর্ট দিল। শহীদ নির্দেশ দিল তাকে, ব্যারিস্টার এবং মিস্ শাহানারাকে ছেড়ে দে, কামাল।
.
আকাশ সেই আগের মতই আছে, থমথমে। যে কোন মুহূর্তে গর্জন এবং বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। রেস্টহাউজের পশ্চিম দিকে পৌঁছুল ওরা সবাই ইন্সপেক্টরের পিছু পিছু। ইন্সপেক্টর রমজান মিয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল। রমজান কপালে হাত ঠেকিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল।
ইন্সপেক্টর দাঁড়াল পশ্চিম দিকে বাঁ পাশের জানালার সামনে। এই জানালার ঠিক ওপরে, লাইব্রেরীর ভিতর, ফ্লাওয়ার ভাসটা দাঁড়িয়ে আছে, যেটার ভিতর ব্রাউনিং পিস্তলটা পাওয়া গেছে।
দেয়ালের পর থেকে বেশ খানিকটা জায়গা ইট দিয়ে ঘেরা, ফুল গাছ লাগাবর জন্যে। গ্রীষ্মকালে ফুল গাছ সম্ভবত লাগানো হয়েছিল, এখন সে সব গাছের অস্তিত্ব নেই। দেয়াল যতটা, ততটা লম্বা জায়গাটা। চওড়া দশ ফুটের মত।
জানালাটার ঠিক নিচে, এবড়োখেবড়ো নরম মাটির উপর জুতোর দাগ। বেশ বড় বড় দাগ। বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু দাগগুলো এখনও চেনা যায় জুতোর দাগ বলে।
কুয়াশা কথা বলল প্রথম, গতকাল এগুলো দেখেননি, মি. সিম্পসন?
মি. সিম্পসন বললেন, কি জানেন, মি. আহমেদ, ভিতর থেকে জানালাগুলো একটাও খোলা সম্ভব নয় প্রমাণ পেয়ে বাইরেটা আর দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি…!
কুয়াশা বলল, ভুল করেছেন। সে যাক, জুতোর দাগগুলো দেখছেন-আশ্চর্য না?
মি. সিম্পসন ঠিক যেন বুঝতে পারলেন না কুয়াশার কথা, কিন্তু শহীদ বলল, তুমি কি বলতে চাইছ, বুঝতে পেরেছি, এনাম। জানালার কাছ থেকে কেউ যেন এদিকে এসেছে, আসার দাগ সবগুলো। গোড়ালির দাগ দেখে তাই প্রমাণ হয়।
কুয়াশার প্রশ্ন, তাহলে, লোকটা যে-ই হোক, জানালার কাছে গেল কিভাবে? যাবার দাগ নেই কেন? লোকটা কি উড়তে পারে নাকি?
মি. সিম্পসন অবাক হয়ে বললেন, তাই তো। এ কি রহস্য!
কুয়াশা বলল, মি. সিম্পসন, সত্যিই কি জানালা খোলা অসম্ভব? কিংবা প্রশ্নটা বরং এভাবে করি, লোদী সাহেবকে খুন করে খুনী এই জানালা খুলে বেরিয়ে আসতে পারে না?
সেন্ট পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, তা সম্ভব নয়। আমি এবং কামাল একটা জানালা খুলতে দশ মিনিট সময় ব্যয় করেছি। খুনী সময় পেয়েছে মাত্র পাঁচ কি সাত সেকেও, তার পক্ষে জানালা খুলে বেরিয়ে আসা এই অল্প সময়ে সম্ভব নয়। তা ছাড়া রূমে ঢুকে আমি জানালা বন্ধ দেখেছি। রফিক যদি খুনীকে সাহায্য করার জন্যে জানালা বন্ধ করতে যেত, তাতেও অন্তত দশ মিনিট সময় লাগত। কারণ, বন্ধ করার সময়ও ওই রকম সময় লেগেছিল আমাদের।
শহীদের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা বলল, জুতোর দাগ দেখে কত নম্বর জুতো বলতে পারবে?
সম্ভবত দশ নম্বর।
কুয়াশা বলল, আমারও তাই ধারণা। মি. সি পসন, বলতে পারেন এ বাড়ির কে দশ নম্বর জুতো পরে?
এখুনি বলতে পারব না। তবে রফিক নয়, আমি জানি। সে লম্বা হলেও, ছয় কি সাত নম্বর জুতো পরে সে।
কুয়াশা তাকাল ইন্সপেক্টরের দিকে, আর কি দেখাবার আছে আপনার?
ইন্সপেক্টর বল, দক্ষিণ দিকে নুন, মি. আহমেদ। যে গাছটায় বুলেট পাওয়া গেছে সেটা দেখবেন, গাছটার চারদিকে আরও কিছু পায়ের ছাপও আছে–ওগুলো আবার পুরুষের নয়, মেয়েমানুষের জুতোর ছাপ!
কুয়াশা যেন খুশি হয়ে উঠল। বলল, গুড। এই রকম কিছুই আশা করছিলাম
কেন সে এই রকম কিছু আশা করছিল, তা কিন্তু কুয়াশা ব্যাখ্যা করে বলল না।
ফ্রন্টসাইডে এসে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের সামনে দাঁড়াল ইন্সপেক্টর। হাত উঁচু করে গাছের গায়ের ছোট্ট গর্তটা দেখিয়ে বলল, ওই দেখুন, স্যার।
মি. সিম্পসন ফুটোটা দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর তাকালেন খোলা জানালাটার দিকে। বললেন, জানালা দিয়ে গুলিটা বেরুলে এই গাছে এসে লাগতে পারে–একটা সম্ভাবনা। বের করে গুলিটা, শাকুর। মি. আহমেদ, আমি কি ভাবছি জানেন? দেখুন, মাত্র পনেরো ফুট দূরে জানালা থেকে গাছটা, তাই না? গতকাল এই গাছটার গা ঘেঁষেই জানালার দিকে দৌড়ে যাই আমি। গাছটার গা ঘেঁষে যাবার সময়ই দ্বিতীয় গুলির শব্দটা শুনি। গুলিটা যে গাছে বিধল, টের পেলাম না কেন?
একটা কাঠের বাক্স নিয়ে এল রমজান মিয়া। তাতে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর পেন নাইফের সাহায্যে ফুটোটাকে বড় করে বুলেটটাকে সহজেই বের করে ফেলল। কুয়াশা হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিল বুলেটটা। ওজন পরীক্ষা করে তাকাল শহীদের দিকে। বলল, কি আশ্চর্য!
শহীদ এবং মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন সবিস্ময়ে, একযোগে, কি হলো?
কুয়াশা বলল, মি. সিম্পসন, থানা হেডকোয়ার্টারে ফোন করে এখুনি একজন ফটোগ্রাফারকে ডেকে পাঠান।
মি. সিম্পসন কৌতূহলে অস্থির হয়ে উঠেছেন, কেন বলুন তো?
কুয়াশা বলল, গাছের গায়ে ফুটোটা ভাল করে দেখেছেন? নিশ্চয়ই দেখেননি। দেখলে, অদ্ভুত ব্যাপারটা চোখে পড়ত। ভাল করে দেখুন, বুলেটটা গাছের গায়ে ঢুকেছে সোজাসুজি ভাবে, তির্যকভাবে নয়। জানালা এবং গাছ একই সরল রেখায় হলেও, এলিটা করা হয়েছে রূমের এক কোনা থেকে, জানালার সামনে থেকে নয়। জানালা দিয়ে গুলিটা বেরিয়েছে, অন্তত বেরুবার কথা, একটু কোনাকুনি ভাবে। একটু তির্যকভাবে ঢোকার কথা বুলেট, তাই না? ফটোগ্রাফারকে আসতে বলুন, ছবি এবং মাপ দরকার ওই টোটার।
ইন্সপেরকে গর্বিত দেখাল। সে বলল, ফটোগ্রাফার আসছে, স্যার। কনস্টেবল হুদাকে আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি হেডকোয়ার্টারে। জুতার দাগ দেখবেন এবার, স্যার।
ইন্সপেক্টর গাছটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল দুপা, দাঁড়াল, এই দেখুন! ওদিকেও আরও আছে–ওই যে!
গাছটার পিছনে এবং খানিকটা ডানদিকে সত্যিই দেখা গেল জুতোর দাগ। জুতোর আকার দেখেই বোঝা যায়, মেয়েদের পায়ের জুতো। সরু, দুচাল আগার দিকে এবং হাইহিলওলা। গাছের ডানদিকেই বেশি দাগ পড়েছে, পাশাপাশি জোড়া দাগও ওখানে দেখা গেল। পাশাপাশি জোড়া দাগ দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না, ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ।
সকলকে চমকে দিয়ে কুয়াশা হঠাৎ মাথা তুলে হোঃ হোঃ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
মি. সিম্পসন একবার কুয়াশার দিকে, একবার শহীদের দিকে তাকাতে শুরু করলেন। ইন্সপেক্টর শাকুর থমকে গেছে, বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আছে সে কুয়াশার দিকে।
ভয় পেয়েছে রমজান মিয়া। এমন বজ্রকণ্ঠের অট্টহাসি কোন মানুষের গলা দিয়ে বেরুতে পারে, কল্পনায় ছিল না তার। দুপা পিছিয়ে গেল সে।
অকস্মাৎ অট্টহাসি থামল কুয়াশার।
কেউ কিছু বলার আগে নিজেই সে বলল, মি. সিম্পসন, ব্যাপারটা ধরতে পারেননি, না? নিজেই যদি ধরতে পারতেন, আমার মতই হাসতে হত আপনাকে।
শহীদ বলল, কি ব্যাপার বলো তো?
কুয়াশা একটু যেন অখুশি হলো। বলল, শহীদ, তোমার চোখে তো ব্যাপারটা ধরা না পড়ার কথা নয়। ঠিক আছে, বলছি আমি। এই যে মেয়েদের জুতোর ছাপ, এটা রোপণ করা, নকল।
হোয়াট! মি.সিম্পসন সাপ দেখে আঁতকে উঠলেন যেন।
ইন্সপেক্টর বলল, আপনি কি বলছেন, মি. আহমেদ?
কুয়াশা বলল, ঠিকই বলছি। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে, আজও বৃষ্টি হয়েছে, তাই নয়? দাগগুলোর দিকে তাকান। বৃষ্টিতে যতটা ক্ষতবিক্ষত হবার কথা ততটা কি হয়েছে? তা ছাড়া, গভীরতা দেখুন। বৃষ্টিভেজা ঘাসের ওপর একটা মেয়ে জুতো। পায়ে দিয়ে দাঁড়ালেও, মাটির কতটা গভীরে হাইহিল ঢুকবে? মেয়েটির ওজনের। ওপর নির্ভর করে, তাই না? তাকিয়ে দেখুন, মেপে দেখুন প্রমাণ হয়ে যাবে, পাঁচ মন ওজনের কোন মেয়ের জুতোর দাগ এগুলো কিন্তু পাঁচ মন ওজনের মেয়ে বাংলাদেশে নেই বলেই আমি জানি।
মি.সিম্পসন বললেন, মি, আহমেদ, ধন্যবাদ। আপনার সাথে আমি একমত। কেউ, সম্ভবত কোন পুরুষই আমাদেরকে ধোকা দেবার জন্যে হাতে করে। মেয়েদের হাইহিলওয়ালা জুতো নিয়ে এসে গাছটার আশপাশে সেই জুতোর দাগ তৈরি করেছে জোর করে চেপে চেপে। কি জানে, এই গাছটার গা ঘেঁষে জানালার দিকে দৌড়াই আমি। গাছের সামনে পিছনে বা আড়ালে যদি কেউ থাকত, তাকে দেখতে না পাবার লোন কারণ নেই। গাছটাকে মোটা বলাও চলে না। তাহলে, পশ্চিমদিকের জানালার সামনে দশ নম্বর জুতোর দাগগুলোও মেকী বলে ধরে নিতে হয়। কেউ আমাদেরকে এই পায়ের দাগ দেখাতে চায় কিন্তু কেন? আর একটা ব্যাপার-বুলেটট ও কি তাহলে?
কুয়াশা বলল, বুলেটটাও, কোন অনুর্বর মস্তিষ্কের অনুর্বর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ফলশ্রুতি অর্থাৎ জানালা দিয়ে বুলেটটা আসেনি। যেখানে ব্রাউনিংটা পাওয়া গেছে। সেখান থেকে কেউ যদি গুলি করে থাকে, জানালা গলে সে-বুলেট বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। তা আসতে হলে বুলেটটাকে শূন্যে বাঁক নিতে হবে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও আমাদেরকে ধোকা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে, গুলিটা কেউ করেছে হত্যাকাণ্ডের পরে, সভবত আজ কোন একসময় সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল দিয়ে, লাইব্রেরী রূমের বাইরে থেকে। মি. সিম্পসন, চলুন, লাইব্রেরী রামটা দেখি একবার।
.
০৬.
লাইব্রেরী রূমটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে। দিনটা আজ আবার মেঘলা। মি. সিম্পসা বোম টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। ডেস্কের টেবিল ল্যাম্পটা অবশ্য জালালেন না। কুয়াশা রূমের ভিতর ঢুকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে পশ্চিম দিকের জানালা দুটো পরীক্ষা করল সে। তারপর দক্ষিণ দিকের বন্ধ জানালাটা। বলল, কোন সন্দেহ নেই, দুএক মিনিটে জানালা তিনটে খোলা অসম্ভব। খুনী জানালা দিয়ে ঢোকেনি, বেরিয়েও যায়নি। মি. সিম্পসন, আপনার পকেট থেকে ব্যারিস্টার সরফরাজ খানের বাউনিং পিস্তলটা আমাকে দিন। তারপর নিভিয়ে দিন সিলিংয়ের আলোটা। সুইচ অনু করুন টেবিল ল্যাম্পের। কিন্তু…তার আগে…।
কথা শেষ না করে কুয়াশা ডেস্কের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, সাথে সাথে গেল শহীদ, মি. সিপসন এবং ইন্সপেক্টর শাকুর।
ডেস্কে তিনটে দেরাজ। তিনটেই তালাহীন। একে একে সবগুলো খুলল কুয়াশা। উপরের দুটোয় বিশেষ কিছু নেই, খালিই বলা চলে। নিচেরটায় পাওয়া গেল একটা ব্যাঙ্কের চেকবই, মেমোরান্ডাম.প্যাড।
প্যাডে সুন্দর, স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছে:
হেলেনা মোমতাজ।
প্রযত্নে মকবুল হোসেন সিদ্দিকী
২১, ফুলবাগিচা, সাহেব পাড়া, ঢাকা।
কুয়াশা বলল, নতুন প্রাইভেট সেক্রেটারির নাম ঠিকানা, আর কিছু নেই। মি. সিম্পসন, দিন এবার পিস্তলটা।
পিস্তলটা কুয়াশাকে দিয়ে সিলিংয়ের বালবটা অফ করে দিলেন মি. সিম্পসন, তারপর অন্ করলেন টেবিল-ল্যাম্প। ডেস্কটা ছাড়া গোটা রূম আধো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। রূমের র প্রান্তের কোনাগুলোয় অন্ধকার স্বভাবতই বেশি গাঢ়।
কুয়াশা উত্তর-পশ্চিম কোনায়, ফ্লাওয়ার ভাসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে শহীদের উদ্দেশে বলল, এখান থেকে আমি গুলি করব, শহীদ। লোদী সাহেব, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই জায়গা অনুমান করে। গুলি করার পরই পিস্তলটা ফ্লাওয়ার ভাসে ফেলে দেব। রফিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তুমি ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়াও। গুলির শব্দ শোনামাত্র ঘুরে তাকাবে তুমি,-এবং বলবে আমাকে দেখতে পাও কিনা।
রূমের মাঝামাঝি জায়গা দেখিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন। বললেন, এইখানে দাঁড়িয়ে ছিল রফিক।
বিনা বাক্যব্যয়ে পজিশন নিল শহীদ। তাকিয়ে আছে ডেস্কের দিকে। প্রতিমুহূর্তে গুলির শব্দ আশা করছিল ও। কিন্তু কুয়াশা নিষ্ক্রিয়, গুলি করছে না। সময় নিচ্ছে সে, শহীদকে অসতর্ক অবস্থায় পাবার জন্যে।
আওয়াজটা এমন জোরে হলো যে রূমটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল সাথে সাথে। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শহীদ।
টেবিল-ল্যাম্পের দিকে দৃষ্টি ছিল এতক্ষণ, হঠাৎ অন্ধকার কোনায় তাকাতে বিশেষ কিছুই দেখতে পেল না শহীদ। টুক করে একটা শব্দ হলো বলে মনে হলো ওর।
দেখতে পাচ্ছ?
শহীদ বলল, কিছুই পরিষ্কার নয়। একটু আগে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, এখনও যা দেখছি, চেনা মুশকিল, কি ওটা। ফ্লাওয়ার ভাসটাকে মনে হচ্ছে গাছ, স্থির অন্ধকার, তার পাশে তোমাকে মনে হচ্ছে কাঁপা কাঁপা অন্ধকার, আরও গাঢ়।
কুয়াশা এগিয়ে এসে বোম টিপে সিলিংয়ের বালবটা অন করে দিল, বলল, মি. সিম্পসন, দেখলেন তো বুলেটটা জানালা গলে বাইরে যায়নি।
মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। জানালার কাছ থেকে এক ফুট দূরের দেয়ালে ওই যে গর্ত দেয়ালে এখন দুটো গর্ত। কিন্তু, মি. আহমেদ, এসব আমার কাছে ভাল ঠেকছে না। মাথা ঘুরছে আমার, ব্রেন অকেজো হয়ে যাবে বলে সন্দেহ হচ্ছে। জানালা গলে বুলেট বেরিয়ে যায়নি বলছেন, কিন্তু দ্বিতীয় গুলির বুলেটটা কোথায় তাহলে? নেই কেন?
মি. সিম্পসন রয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর শাকুরের সাথে। বললেন, অফিস থেকে ঘুরে সাড়ে পাঁচটার দিকে আমি তোমার বাড়িতে যাব, শহীদ। এর মধ্যে দেখব লোদী সাহেবের বাড়ির লোকদের সাথে আর একবার কথাবার্তা বলে।
কুয়াশা বলল, শহীদ, তোমার এক জায়গায় যাওয়া উচিত। আমিই যেতাম, কিন্তু লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি না ফিরলে মহুয়াদি যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে ছাড়বে।
মি. সিম্পসনও বললেন, শহীদকে আবার কোথায় পাঠাবেন?
শহীদ বলল, আমি জানি!
কুয়াশা বলল, যাও তাহলে।
মি. সিম্পসন হেসে ফেললেন, কোওয়ার্ডে কথাবার্তা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?
শহীদও হাসল। বলল, এনাম এলাহী রোডে যেতে বলছে, মি. সিম্পসন। মিস ইলোরাকে সেখানে কেউ দেখেছে কিনা জানা দরকার।
মি. সিম্পসন বললেন, মনে হয় না। সে তো নিজেই বলছে, তার অ্যালিবাই। প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
কুয়াশা বলল, তবু।
গাড়িতে এসে উঠল কুয়াশা। শহীদ ট্যাক্সিতে যাবে, ঠিক হলো।
বাড়ি ফিরে কুয়াশা কামালকে পেল। কুয়াশা ড্রয়িংরুমে পা দিতেই সে বলল, কোন কথা নয়, হাত মুখ ধুয়ে সোজা ডাইনিংরুমে চলে যাও। মহুয়াদি তোমার খাবার নিয়ে বসে আছে। দেরি করলে কি যে ঘটবে আজ বলা মুশকিল।
ম্লান হয়ে গেল কুয়াশার মুখ। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, যাব? মেজাজ কি খুবই খারাপ ওর?
হবে না খারাপ? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বেলা তিনটে পর্যন্ত বাইরে বাইরে থাকবে-দাদা তোমাকে আমি রূমের ভিতর আজ থেকেই তালা দিয়ে রাখব। মহুয়া দোরগোড়া থেকে বলল।
মাথা নিচু করে হাসি চাপল কুয়াশা। কামাল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল নিঃশব্দে। সে যেন কালা এবং বোবা হয়ে গেছে হঠাৎ।
কুয়াশা আবেদনের সুরে বলল, আর এমন করব না, এবারটি মাফ করে দে।
মহুয়াও হাসি চাপল। গম্ভীর গলায় বলল সে, যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো। তোমাদের না হয় না খেলে চলে, চা সিগারেট খেয়ে খিদে নষ্ট করে রাখো, কিন্তু আমারবুঝি খিদে পায় না? তা, তিনি কোথায়?
কুয়াশাকে অপরাধী অপরাধী দেখাল। বলল, একটা কাজে গেছে। আধঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে।
মহুয়া বলল, তবু ভাল যে তোমাকেও সাথে রাখেনি! কই, দাঁড়িয়ে রইলে কেন-যাও!
সুড়সুড় করে অন্দর মহলের দিকে পা বাড়াল কুয়াশা।
খাওয়া দাওয়া সেরে নিজের রূমে শুয়ে পড়তে হলো কুয়াশাকে। মহুয়া তার হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানায় তুলে দিয়ে গেছে, বলে গেছে, বিছানা থেকে নামলে বিপদ আছে। কাকুতি মিনতি করায় শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজি হয়েছে শহীদ, কামাল এবং মি. সিম্পসনকে বেডরূমে আধঘন্টার জন্যে ঢুকতে দিতে।
শহীদ ফিরুল চারটের সময়। খাওয়াদাওয়া সেরে ড্রয়িংরুমে বসল সে কামালের সাথে। লোদী সাহেবের বাড়িতে যা যা ঘটেছে সব বলল ও কামালকে। এমন সময় এলেন মি. সিম্পসন।
মি. আহমেদকে দেখছি না যে?
মহুয়ার আইন সম্পর্কে মি. সিম্পসনকে জ্ঞানদান করার পর কামাল বলল, এখন কি করবেন ভেবে দেখুন। আধঘণ্টার জন্য তার সাথে কথা বলতে পারেন। আর একবার কথা বললে, চব্বিশ ঘণ্টার পর সুযোগ পাবেন আবার।
মি. সিম্পসন বললেন, প্রথম সুযোগটা এখুনি নিই। তারপর দেখা যাবে। দরকার হলে কিডন্যাগ করব মি. আহমেদকে।
কামাল বলল, পুলিস অফিসার আপনি, কিডন্যাপ করবেন কেন? তা কেউ করে? তারচেয়ে ভাল উপায় হাতে থাকতে?
কি উপায়?
কামাল বলল, মহুয়াদিকে বললেই হবে, মি. আহমেদকে আমি: গ্রেফতার করছি, কুয়াশা সন্দেহে!
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন মি. সিম্পসন সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে। এই ফাঁকে শহীদ এবং কামাল পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকাল একবার।
মুচকি একটু হাসল শহীদ।
মি. সিম্পসন হাসি থামিয়ে বললেন, সুতরাং মিসেস মহুয়ার আইনকে ভয় পাবার কিছু নেই, কি বলো? দরকার হলে কুয়াশা সন্দেহে মি. আহমেদকে সত্যি আমি গ্রেফতার করে বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা ক। ওঠো, ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে আসি। লোদী সাহেবের বাড়িতে আজ তিনি যা যা করেছেন, দেখে তো ভক্ত হয়ে গেছি আমি তার। উনি দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে না দিলে অনেক রহস্যই অগোচরে থেকে যেত আমাদের।
উঠল ওরা। পা বাড়াল কুয়াশার বেডরুমের দিকে।
ওদেরকে দেখে হাসিমুখে বিছানার উপর উঠে বসল কুয়াশা। বলল, আসুন, মি. সিম্পসন। কি খবর বলুন। নতুন আর কি আবিষ্কার করলেন?
চেয়ার টেনে খাটকে সামনে রেখে বল ওরা তিনজন। কুয়াশা চুরুট ধরাল। মি. সিপসন বুললেন, কামাল, তোমার রিপোর্ট কি?
কামাল বলল, যাকে আমরা সন্দেহ করিনি এতটুকু, তিনি এখন পুরোপুরি সন্দেহের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। আমি ব্যারিস্টার সরফরাজ খানের কথা বলছি। তিনি বলেছিলেন, বিকেল থেকে ছটা পর্যন্ত তিনি তার চেম্বারে ছিলেন কথাটা সত্যি। চেম্বার থেকে বেরুবার পথ একটাই, সেটা আউটার রূমের ভিতর দিয়ে, কেরানী যেখানে বসে–একথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু এটা তার মিথ্যে কথা। চেম্বারে ঢুকে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। সংলগ্ন বাথরুম আছে। সেই বাথরুমের জানালায় শার্সি লাগানো, গরাদ নেই। জানালার বাইরে, দেয়ালের গায়ে মোটা পানির পাইপ। সেই পাইপ বেয়ে অনায়াসে যে-কেউ নামতে পারে নিচে। নিচে ঝোঁপ ঝাড়, বাড়ির পিছনের অংশ। আশপাশে তেমন কোন বাড়ি নেই, ফলে নামবার সময় কারও চোখে ধরা পড়বারও ভয় নেই।
গুড গড! ব্যারিস্টার এই রকম কাঁচা মিথ্যে কথা বললেন কেন? মি. সিম্পসন বললেন।
শহীদ বলল, এদিকে আমি যে তথ্য পেয়েছি, তাতে ইলোরাকে আর সন্দেহ করবার কোন মানে হয় না। এলাহী রোড়ে গিয়ে আমি সরাসরি কথা বলি স্টেশনারি দোকানের মালিক এক অ্যাংলো বুড়ির সাথে। মিসেস কান্তা গোমেজকে ইলোরার চেহারার বর্ণনা দিতেই তিনি বললেন, যা, গতকাল ওই চেহারার এক যুবতী রোডের এ-মাথা থেকে সে-মাথা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাটাহাটি করেছে। শেষবার তাকে দেখেছেন, তিনি সাড়ে পাঁচটার সময়। অর্থাৎ লোদী সাহেব যখন খুন হন ইলোরা তখনও এলাহী রোডে ছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, আমিও কিছু তথ্য উদ্ধার করেছি। শাহানারার অ্যালিবাই যতটা মজবুত বলে মনে হয়েছিল আসলে ততটা মজবুত সেটা নয়। রফিক আমাদেবকে জানিয়েছে, কেরামতের সাথে শাহানারা কথা বলেছে সাড়ে পাঁচটার দিকে, দুএক মিনিট আগে বড় জোর। কিন্তু কেরামতকে খুটিয়ে প্রশ্ন করতে সে আমাকে জানিয়েছে, শাহানারার সাথে ড্রয়িংরুমে কথা বলেছে সে। পাঁচটা বেজে বিশ মিনিটে। দশ মিনিটের গোলমাল হচ্ছে। এই দশ মিনিটের মধ্যে শাহানারার পক্ষে রেস্টহাউজে যাওয়া সম্ভব।
শহীদ বলল, তুমি কিছু বলো, এনাম!
মি. সিম্পসন উৎসাহী হয়ে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ, আপনি কিছু বলন এবার। অনুমান করেও কি কিছু একটা বলতে পারেন না? আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির যে পরিচয় পেয়েছি…
কুয়াশা সহাস্যে বলল, লজ্জা দেবেন না মি. সিম্পসন। প্রকৃত সত্য জানতে চান? বলতে পারি। কিন্তু বলব না। আরও প্রমাণ দরকার আমার। তবে এটুকু জেনে রাখুন, প্রকৃত খুনী কে তা আমি জানি। কিভাবে সে খুন করেছে তাও আমি জানি। কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশ করলে আপনি তাকে গ্রেফতার করার জন্যে ছুটবেন, ফলে তাকে অভিযুক্ত করার জন্যে যে প্রমাণ দরকার তা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। আসুন, বাস্তব ঘটনা নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা করি আরও।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু সত্যিই কি আপনি…
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, কে খুন করেছে আমি জানি। তবে তার সম্পর্কে আলোচনা বার জন্যে আমি এখন তৈরি নই। আপনারা কে আর কি আবিষ্কার করেছেন বলব।
মি. সিম্পসন বললেন, কেরামত বলেছিল, খুনের সময় সে, বাবুর্চি এবং চাকরানী হ্যাঁদার মা রান্নাঘরে ছিল। কথাটা ঠিক। কিন্তু কেরামত একবার মিনিট সাতেকের জন্যে, আরেকবার মিনিট দশেকের জন্যে রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছিল। একথা বলেছে হ্যাঁদার মা। ফলে, সে-ও সন্দেহের মধ্যে চলে আসছে।
সিরু কাকার অ্যালিবাই?
মি. সিম্পসন বললেন, প্রমাণ করা সম্ভব নয়। বই আনতে লাইব্রেরীতে গিয়েছিল কিন্তু বই নাকি পায়নি। লাইব্রেরীতে আরও পাঠক ছিল কিন্তু তারা কে
কোথায় থাকে জানবার কোন উপায় নেই, তাছাড়া তারা কি আর বুড়োকে চিনে রেখেছে? মোট কথা বুড়ো সত্য বলছে কি মিথ্যে বলছে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
জুতোর ব্যাপারে
বলছি। গোটা বাড়িটা সার্চ করেছি আমি। গাছের কাছে জুতোর যে দাগ পাওয়া গেছে তা চার নম্বর জুতোর দাগ। ওরা দুবোনই চার নম্বর পরে। কিন্তু ওদের ছয় জোড়া জুতোর কোনটাতেই কাদার চিহ্ন পাইনি।
দশ নম্বর জুতো কে পরে?
মি. সিম্পসন বললেন, মাত্র একজন। সিরু কাকা। ওর মাত্র দুজোড়া জুতো, তার মধ্যে এক জোড়া ভিজে। কিন্তু কাদা নেই এতটুকু। জুতোয় একবার কাদা লাগলে তা ধুয়ে সম্পূর্ণ তুলে ফেলা খুব কঠিন কাজ।
মহুয়া ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে তাকাল। শহীদের উদ্দেশে বলল, ফোন।
শহীদ উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, কে?
মহুয়া বলল, কোন লাশ বা ভূত হবে! গলাটা যেন কেমন লাগল কানে। নাম জিজ্ঞেস করিনি।
শহীদ টেলিফোনের দিকে দ্রুত পা বাড়াল। মহুয়া চলে গেল অন্দরমহলের দিকে।
কুয়াশা বলল, কামাল, বাড়ি ফিরে তুমি ব্যারিস্টার এবং শাহানারাকে কি অজুহাত দেখালে বলো তো? শহীদ যে ওদেরকে বন্দী করে রেখে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই ওরা তা বুঝতে পেরেছিল?,
পেরেছিল। কিন্তু খুব একটা অসন্তুষ্ট দেখলাম না দুজনের কাউকেই। দরজা খুলে দেখলাম, গভীরভাবে আলোচনা করছে। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। ব্যারিস্টারের বয়স হয়েছে, কিন্তু শাহানারার কতই বা বয়স..
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, প্রেমের কোন বয়স নেই, কামাল।
শহীদ ফিরল মিনিট তিনেক পর। রূমে ঢুকেই ঘোষণা করল ও চরম একটা দুঃসংবাদ। হেলেনা মোমতাজ কে, মনে আছে? লোদী সাহেবের জন্যে যে প্রাইভেট সেক্রেটারি নির্বাচন করা হয়েছে গতকাল বিকেলে, সে। ঘন্টাখানেক আগে সেই হেলেনা মোমতাজ লোদী সাহেবের বাড়িতে ফোন করে। ফোন ধরেন ব্যারিস্টার সরফরাজ খান, তিনি চারটে থেকে ওখানেই আছেন। হেলেনা মোমতাজ ফোনে ইলোরাকে চায়। কিন্তু ইলোরা বাড়িতে নেই। হেলেনা বলে, অত্যন্ত জরুরী একটা ব্যাপারে সে কথা বলতে চায় ইলোরার সাথে। না, বাড়ির আর কারও সাথে কথা বলতে রাজি হয় না সে। ব্যারিস্টার তাকে জানায়, তিনি পরিবারের আইন উপদেষ্টা, তাকে যে কোন কথা বলা যেতে পারে। অনেক করে বোঝাতে, হেলেনা রাজি হয়। তবে ফোনে নয়, সে বাড়িতে এসে তার বক্তব্য বলতে চায়।
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে জানতে চান মি. সিম্পসন।
শহীদ বলে, বাড়ির ভিতর দশ মিনিট পর ঢোকে সে, কিন্তু চওড়া রাস্তাটা পেরিয়ে বিল্ডিংয়ে ঢোকার ভাগ্য তার হয়নি। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখান থেকে পাঁচ গজ সামনে পড়ে আছে সে। পিঠে বিধে আছে ছোরা বেঁচে নেই!
কুয়াশা বিছানা থেকে নেমে পড়ল, ওহ, শহীদ, মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। আমার বোঝা উচিত ছিল মেয়েটা খুন হতে যাচ্ছে। যাক, তোমার কথা শুনে একটা জিনিসের ব্যাখ্যা পেয়ে গেছি আমি, যা ভেবে পাচ্ছিলাম না। আবার কেউ ও বাড়ির টেলিফোন এক্সটেনশনের মাধ্যমে গোপন ফোনের কথাবার্তা শুনছিল।
মি. সিম্পসন বললেন, মি. আহমেদ, আপনার কি ধারণা, হেলেনা মোমতাজের মুখ বন্ধ করার জন্যে কেউ তাকে খুন করেছে? কিন্তু;…হেলেনা মোমতাজ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানেই বা কি, শুনেছেই বা কি? গতকাল হত্যাকাণ্ড ঘটার অন্তত দেড়ঘন্টা আগে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় সে। তখন লোদী সাহেব বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন।
কুয়াশা মাথার চুলে বাশ চালাতে চালাতে বলল, আমি সে-ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি না, মি. সিম্পসন। আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল খুনী হেলেনা মোমতাজকে খুন করতে পারে। কিন্তু খুন যে এই রকম বোকার মত করবে ভাবা যায় না। নিজের পায়ে নিজেই কুড়ল মেরেছে খুনী। প্রকাশ করে ফেলেছে নিজের। পরিচয়। মি. সিম্পসন, আমার হাতে এখন যথেষ্ট প্রমাণ আছে। আর মাত্র একটা কাজ বাকি, সেটা করা হলেই খুনীকে আমি আপনার হাতে তুলে দেব, আপনি তাকে দুদুটো হত্যাকাণ্ডের দায়ে গ্রেফতার করতে পারেন।
এসব আপনি কি বলছেন! আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না যে, মি. আহমেদ।
কুয়াশা যেন শুনতেই পায়নি মি. সিম্পসনের কথা। সে বলে চলেছে, ঠিক এই পদ্ধতিতে কেন খুন করল ও? কেন? নিশ্চয়ই ভয়ে দিশেহারা হয়ে, তা না হলে শহীদ, কামাল-তোমরা রওনা হয়ে যাও। কুইক! ওখানে গিয়ে রুটিন অনুযায়ী যা করার, করো তোমরা। আমি খানিক ই পৌঁছে যাব। আমার সো আরও দুজন থাকবে। তাদের মধ্যে একজন…যাক, দেখবেই তো তাকে খানিক পর। অপরজন রফিক। মি. সিম্পসন, আপনি রফিককে গাড়িতে তুলুন, তারপর অপেক্ষা করুন আমার জন্যে থানার গেটের সামনে। দশ মিনিটের মধ্যে গেটে দেখবেন আমাকে।
রফিক? তাহলে রফিকই?..
কুয়াশা হেসে উঠল, না, মি. সিম্পসন, রফিক খুনী নয়। লোদী সাহেবকে সে খুন করেনি। হেলেনা মোমতাজকে তো খুন করতেই পারে না, কারণ সে তো হাজতে বন্দী রয়েছে। রফিককে দরকার অন্য কারণে, তাকে ছাড়া মীটিং জমবে না।
মীটিং?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, রেস্টহাউজের লাইব্রেরীতে সবাইকে নিয়ে আলোচনা সভায় বসব আমরা।
.
০৭.
গেটটা খোলা। ফোক্সওয়াগেন ভিতরে ঢুকল। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল রমজান মিয়া সামনের বাকের কাছ থেকে ছুটে আসছে।
গাড়ি থামিয়ে নামল শহীদ, তার সাথে কামাল, বিপরীত দিকের দরজা খুলে। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে পাকা, প্রশস্ত রাস্তার উপর ফেলল কামাল। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করে দিল সেটাকে।
হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে দাঁড়াল রমজান মিয়া, আসুন, হুজুর! ওই বাকের ওদিকে!
পকেট থেকে টর্চ বের করল কামাল। শহীদের পিছু পিছু নিঃশব্দে এগোল সে।
বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল লাশটা। পাশে একটা ব্যারিকেন দাঁড় করানো রয়েছে। রমজান মিয়ার হ্যারিকেন ওটা।
লাশের কাছ থেকে পাঁচ সাত হাত দূরে দূরে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার সরফরাজ খান, বুক টান টান করে সোজা দাঁড়িয়ে আছেন, জ্বল জ্বল করছে আবছা অন্ধকারে তার হাতের চুরুটের লাল আগুন। রাস্তার পাশে একটা শিমুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও একটি ছায়ামূর্তি। টর্চের আলোয় ওরা দেখল, ছায়ামূর্তিটি শাহানারা। চিন্তিত, মান মুখাবয়ব।
লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। পাশে দাঁড়িয়ে কামাল টর্চের আলো ফেলল লাশের গায়ে। শহীদ বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। ছোরার রেডটা কি পরিমাণ ঢুকেছে পিঠের ভিতরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ও। বাঁ দিকের শোল্ডার রেডের পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে ছোরা, ইঞ্চি আড়াই ভিতর পর্যন্ত।
ছোরাটা বাকানো, ডিনার টেবিলে সাধারণত দেখা যায় এই ধরনের ছোরা, হাতলটা হাড় দিয়ে তৈরি, কারুকাজ করা।
হেলেনা মোমতাজের বয়স হবে বাইশ কি তেইশ, অনুমান করল শহীদ। শরীরে তেমন মাংস নেই। পালের দুদিকের হাড় একটু উঁচিয়ে আছে। বেশ লম্বা সে। মাথাটা ক্ষতবিক্ষত, মনে হয় দুড় বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হয়েছে পিছন থেকে। সম্ভবত আঘাত খেয়ে পড়ে যায় মুখ থুবড়ে, খুনী তারপর তার পিঠে ছোরা মারে।
শহীদ রাস্তার ডানে-বাঁয়ে তাকাল। বলল, কামাল, রড বা ওই ধরনের কিছু থাকার কথা। খুনী নিশ্চয়ই আশপাশে কোথাও সেটা ফেলে গেছে। খুঁজে দেখ।
বাঁ দিকের ঘাসের উপর নামল কামাল রাস্তা থেকে। রাস্তার দুপাশেই ছাড়াছাড়া ভাবে গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গজ তিনেক এগিয়ে কামাল হাঁক ছাড়ল, রাইট! পাওয়া গেছে, শহীদ।।
কামালের টর্চের আলোয় শহীদ দেখল একটা বড়সড় হাতুড়ি পড়ে রয়েছে রাস্তা থেকে আট দশ হাত দূরে। হাতুড়ির মাথায় রক্তের দাগ।
শহীদ প্রশ্ন করল, কে আবিষ্কার করে প্রথম লাশটা?।
রমজান মিয়া বা দিক থেকে বলল, হুজুর, আমি। আধঘন্টা আগে, হুজুর। ব্যারিস্টার সাহেব ফোন করে আমাকে বললেন, হেলেনা নামে এক বেগমসাহেবা আসবেন, আমি যেন গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে দিই। খানিক পর তিনি এলেন, আমি গেট খুলে দিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি করে রাস্তা ধরে চলে এলেন এদিকে। বাক নিলেন তিনি, তারপর আমি আর দেখতে পাইনি। গেটটা বন্ধ করার সময় হুজুর, কি রকম যেন একটা শব্দ শুনি। প্রথমে মনে করি, ভুল শুনেছি। কিন্তু আবার একটা শব্দ হয়, যেন কেউ ব্যথায় আঁ আঁ শব্দ করতেছে বলে মনে হলো। হ্যারিকেনটা ঘর থেকে বের করে ছুটলাম আমি। কি ঘুরেই দেখি, অন্ধকার মাঠের উপর দিয়ে একটা কালো কি যেন দৌড়াচ্ছে মানুষের মত দেখতে। তখনও লাশটা দেখিনি আমি হঠাৎ যখন দেখলাম, মাথাটা ঘুরে গেল। কাছে এসে দেখি, মাথাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে কেউ, ছোরাটাও…
কথা শেষ না করে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তার উপর বসে পড়ল রমজান মিয়া। অসুস্থ বোধ করছে সে। তার পিছন থেকে কথা বলে উঠল আর একজন হুজুর, ছোরাটা আমি চিনি। ওটা আমাদের ডাইনিংরুমের ছোরা। আর ওই হাতুড়িটাও রান্নাঘরের একটা সেলফে বহুদিন থেকে পড়ে ছিল দেখে আসছি। হাতলটার আগা একটু পোড়া, হুজুর।
লোকটা কেরামত।
শহীদ বলল, মি. সরফরাজ…
ব্যারিস্টার উত্তর দিল সাথে সাথে, অ্যাট ইওর সার্ভিস, মি. প্রাইভেট ডিটেকটিভ!
আপনি কখন এ বাড়িতে আসেন আজ?
মি. সিম্পসন এখান থেকে চলে যাবার পরপরই আমি এবং শাহানারা ফিরি, হোটেলে লাঞ্চ খেয়ে। আমরা দুজন একসাথেই ছিলাম সেই থেকে। খুনের খবর রমজান দেয় আমাদেরকে, আমরা তখন দাবা খেলছিলাম।
কে ওখানে! ঝট করে বাঁ দিকে তাকিয়ে প্রায় গর্জে উঠল শহীদ।
সেই বখে যাওয়া মেয়েটা–অর্থাৎ আমি ইলোরা, মি. শহীদ। কই, সিরু কাকাকে যে দেখছি না?
ইলোরা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।
শাহানারা বলল, আপা, সিরু কাকা রেস্টহাউজে, বাবার কাগজপত্র গোছগাছ করার জন্যে ঘন্টা খানেক হলো গেছেন।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, এখনও তিনি ওখানে? তিনি জানেন না নাকি?
শাহানারা বলল, না। সিরু কাকাকে খবরটা দেবার কথা মনে ছিল না আমার।
সাবধান! ইলোরা প্রায় চিৎকার করে উঠে লাফ দিয়ে সরে গেল এক পা। উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো হেডলাইটের আলোয় দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক।
দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল ওদের কাছে। সামনেরটা একটা মার্সিডিজ, পিছনেরটা
মার্সিডিজের দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে নামল কুয়াশা।
গুড ইভনিং, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন! বিবিসির ঘোষকের মত ভরাটকণ্ঠে বলল কুয়াশা। মার্সিডিজ থেকে নামল এরপর দুজন পুলিশ কনস্টেবল, তাদের সাথে রফিক চৌধুরী।
কারও মুখে হঠাৎ কথা যোগাল না।
নিস্তব্ধতা ভাঙল কুয়াশাই, আপনারা প্রায় সবাই দেখছি এখানে। উপস্থিত–গুড। আমি বাধিত হব, আপনারা সবাই যদি দয়া করে রেস্টহাউজের লাইবেরী রূমে আমার সাথে যান। আমার সাথে আরও একজন অতিথি আছেন, তিনি একটু পর মি. সিম্পসনের সাথে লাইব্রেরীতে উপস্থিত হবেন। চলুন।
লাশের দিকে একটিবারও না তাকিয়ে পা বাড়াল কুয়াশা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবাই তাকে অনুসরণ করল। সকলের পিছনে রইল কামাল। শহীদ কুয়াশার সাথে পাশাপাশি হাঁটছে।
সকলকে ঢুকতে দেখে বৃদ্ধ সিরু কাকা নাকের ডগায় ঝুলে পড়া চশমাটা সামলাতে সামলাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুচোখ ভরা বিস্ময়, একটু যেন ভয় ভয় ভাব ফুটে উঠল।
কুয়াশা বলল, আপনিও থাকুন, সিরাজ সাহেব।
সিরু কাকা এগিয়ে গিয়ে সুইচ বোর্ডের একটা সুইচ অন করতে সিলিংয়ের একশো পাওয়ারের বালবটা জ্বলে উঠল। উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল লাইব্রেরী রূম।
নিহত লোদী সাহেবের ডেস্কের পিছনে গিয়ে সকলের দিকে মুখ করে দাঁড়াল কুয়াশা। পরনের ওভারকোট থেকে একটা একটা করে বের করল সে আইভর জনসন রিভলভার, বাউনিং অটোমেটিক এবং একম্যান এয়ার পিস্তুল। তিনটেই রাখল সে ডেস্কের উপর, পাশাপাশি।
শহীদ দাঁড়িয়ে আছে ডেস্কের ডান দিকে। কে কোথায় দাঁড়িয়েছে, তাদের কার মুখের চেহারা কেমন, লক্ষ করছে ও।
শাহানারা রূমের একেবারে দূর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে, একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন ব্যারিস্টার সরবরাজ খান। চাপা ঘরে, ফিসফিস করে কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে, শোনবার কোন উপায় নেই।
পুব দিকের দেয়ালের গায়ে বাহু ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইলোরা, হাত দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করা। চোখে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। কেরামত দাঁড়িয়ে আছে একধারে, বোকার মত, থেকে থেকে নাকের সামনে অস্তিত্বহীন মাছি তাড়াচ্ছে সে এবং সকলকে একবার করে দেখে নিচ্ছে আড়চোখে।
বৃদ্ধ সিরু কাকা দাঁড়িয়ে আছে কেরামতের হাত তিনেক দূরে, দেয়াল ঘেষে। চিতি, বিরক্ত দেখাচ্ছে তাকে।
কামাল দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, দরজায় পাহারা দেবার দায়িত্ব নিয়ে। রূমের বাইরে, হলঘরে, চারজন সশস্ত্র পুলিস আছে, যদিও তাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
কুয়াশার নির্দেশে দুজন কনস্টেবলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রফিক চৌধুরী, ডেস্কের বাঁ দিকে।
কুয়াশা সকলের দিকে একবার করে তাকাল। তারপর একটু হেসে নিয়ে বলল, লেডিস অ্যাও জেন্টলমেন, এই মুহূর্তে মি. সিম্পসন এক বৃদ্ধা মহিলাকে হেলেনা মোমতাজের লাশ দেখাতে ব্যস্ত আছেন। এই বৃদ্ধা মহিলা…আমরা তার কাছ থেকে আশ্চর্য একটা তথ্য আশা করছি। সময় হলে তাকে নিয়ে মি. সিম্পসন এখানে আসবেন। সে যাক। এই হত্যারহস্যের সমাধান বের করার জন্যে মি. সিম্পসন আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তা আপনারা সভবত জানেন। এবং আমি ঘোষণা করতে পেরে সত্যি খুশি যে, রহস্যের সমাধান আমি বের করতে পেরেছি। আমি বলতে চাইছি, লোদী সাহেবের এবং হেলেনা মোমতাজের খুনীকে আমি চিনতে পেরেছি। এখন দুটো মাত্র প্রশ্ন করে আমি প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শেষ করব। প্রশ্ন দুটো করব আমি মিস শাহানারাকে।
নিস্তব্ধতা। পিন-ড্রপ সাইলেন্স। এতটুকু নড়ল না কেউ। তবে নিস্তব্ধতা ভাঙল শাহানারাই।
মি. আহমেদ, যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারেন আপনি।
সবারই কানে বাজল, শাহানারার কণ্ঠস্বর বেশ কাঁপা কাঁপা। সকলেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে।
শাহানারার ঠোঁট জোড়াও কাঁপছে।
কুয়াশা বলল, গুড। মিস শাহানারা, রমজান আমাদেরকে জেরার উত্তরে বলেছিল, বাড়ির পিছনের গেটের চাবি একটা তার কাছে আছে, আর একটা আপনার কাছে ছিল। আপনি কি জানেন, সেই চাবিটা কোথায় এখন?
ড্রয়িংরুমের টেবিলের দেরাজে রেখেছিলাম বলে মনে পড়ে, সেখানেই আছে নিশ্চয়।
কুয়াশা বলল, ওখান থেকে চাবিটা কেউ চুরি করতে পারে, তাই না? কিংবা, একদিনের জন্যে চুরি করে নিয়ে গিয়ে ওটার সাহায্যে আর একটা হুবহু ওইরকম চাবি তৈরি করাতে পারে, ঠিক?
শাহানারা বলল, জানি না। তবে পারা সম্ভব।
কুয়াশা হাসল নিঃশব্দে। বলল, এবার আমার শেষ প্রশ্ন। দারোয়ান রমজান আজ আমাদেরকে বলেছে যে এই রূমের পশ্চিম দিকের জানালা দুটো বদলাবার কথা উঠেছিল মাত্র কদিন আগে। কারণ, জানালাগুলো এমনই যে ভোলা যায় না গায়ের জোরেও। বদলাবার প্রস্তাব কি আপনি দিয়েছিলেন? শাহানারা একটু ইতস্তুত করে বলল, রমজানকে কথাটা আমিই বলেছিলাম বটে, বাবাকেও বলেছিলাম, কিন্তু বাবা আমার কথায় কান দেননি। তিনি আলো জেলেই কাজ করতে ভালবাসতেন, দিনের বেলাও। অনেক করে বোঝাই বাবাকে, কিন্তু বাবা কোনমতে রাজি হননি। তাই এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাইনি। তবে কথাটা আমি ঠিক নিজে থেকে তুলিনি।
আচ্ছা! কে আপনাকে তাহলে
ভেজানো দরজা খুলে গেল এমন সময়, মি. সিম্পসন প্রবেশ করলেন লাইব্রেরী রূমে। সোজা তিনি কুয়াশার দিকে তাকালেন। বললেন, মি. আহমেদ, অল সেট। কমিনিটু বেশি সময় লাগল, বুঝলেন। কারণ মুখেও আঘাত করা হয়েছে হেলেনা মোমতাজের, ঠিক চেনা যাচ্ছিল না। পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে দেরি হয়ে গেল। মিসেস কান্তা গোমেজ সনাক্ত করতে পেরেছেন, কোন সন্দেহ নেই তার। আপনি বললে তাকে ভিতরে আসতে বলি, নিজের বক্তব্য তিনি নিজেই ব্যক্ত করুন।
কুয়াশা বলল, অবশ্যই।
মি. সিম্পসন হাক ছাড়লেন, মিসেস গোমেজ, ভিতরে চলে আসুন।
গাউন পরা হাতির মত বিশাল এক মহিলা থপ্ থপ্ পায়ের শব্দ তুলে দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল, গুড ঈভনিং!
কুয়াশা বলল, গুড ইভনিং, মিসেস গোমেজ। আপনার নাম এবং পেশা, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করুন।
আমার নাম মিসেস কান্তা গোমেজ। এলাহী রোডে আমার একটা স্টেশনারি দোকান আছে। দোকানের পিছনের বাড়িটাও আমার, ওখানেই আমি আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বসবাস করছি।..
কুয়াশা বলল, এইমাত্র যে লাশটা দেখে এলেন, এই মহিলাকে এর আগে কখনও দেখেছেন আপনি? দেখে থাকলে, কখন কোথায় দেখেছেন?
মিসেস কান্তা গোমেজ দুকোমরে হাত রেখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, যা, দেখেছি ওকে। গতকাল বিকেলে ওই মহিলা আমার দোকানে আসে এবং জিজ্ঞেস করে, মিস ইলোরা লোদীর নামে লেখা কোন চিঠি আমার কাছে আছে কিনা।
স্তব্ধতা।
কুয়াশা হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মি. সিম্পসনের উদ্দেশে বলল, মি. সিম্পসন, ওই আপনার আসামী।
মি. সিম্পসন ইঙ্গিত করলেন দরজার দিকে, তারপর দৃঢ় এবং দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ইলোরার সামনে, মিস ইলোরা, আপনাকে আমি মি. ইব্রাহিম লোদী এবং হেলেনা মোমতাজকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করছি।
মি. সিম্পসনের কথা শেষ হতে রূমের বাইরে থেকে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল কল ভিতরে, তারা দাঁড়াল ইলোরার দুপাশে।
অকস্মাৎ খিল খিল করে হেসে উঠল ইলোরা।
.
০৮.
আতঙ্কের বা দুশ্চিন্তার বা ভেঙে পড়ার কোন লক্ষণই প্রকাশ পেল না ইলোরার মধ্যে। অনেকে, এমন কি মি. সিম্পসন স্বয়ং, কুয়াশার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইল।
হাসি থামিয়ে ইলোরা বলল, মি. সিম্পসন, কাকে আপনি রহস্য সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছেন? ভদ্রলোক দেখছি আস্ত একটা পাগল। এই যে মি. আহমেদ, প্রলাপ বকছেন যে, প্রমাণ করতে পারবেন কিছু?
কুয়াশা মৃদু হাসল। বলল, পারব বৈকি। প্রমাণ সংগ্রহ করেই তো বলছি, আপনি খুনী। তবে কয়েক মিনিট সময় দিচ্ছি আপনাকে, চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে। চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন, স্বীকার না করে উপায় আছে কিনা, এই ফাঁকে আমি অন্য একজনের সাথে কথা বলব।
কুয়াশার দেখাদেখি সকলে ভাকাল রফিক চৌধুরীর দিকে।
রফিক চৌধুরীর চেহারা ভূতে ধাওয়া করা ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের মত কদাকার, বিকৃত হয়ে গেছে।
কুয়াশা বলল, তোমার সাথে, রফিক, কিছু কথা আছে আমার। বেশ জোড়া তোমরা! দুজনেই শঠ, চরিত্রহীন এবং পরস্পরকে ভালবাস।
কিন্তু লোদী সাহেবকে আমি খুন করিনি!
কুয়াশা হেসে ফেলল, বলেছি, তুমি খুন করেছ? আমি জানি, তুমি খুন করোনি। কিন্তু খুন করতে গিয়েছিলে, করতেও, কিন্তু করার আর দরকার পড়েনি ঠিক?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল রফিক।
কি, ঠিক কিনা বলো?
রফিক বলল, আমি…
তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ইলোরা, স্বীকার কোরো না, রফিক!
কুয়াশা বলল, ডুবলেন তো! স্বীকার কোরো না তার মানে কি? তার মানে স্বীকার করার না করার ব্যাপার আছে তাহলে? রফিক, বীকার করো আর নাই করো, লোদী সাহেবকে তোমরা দুজনে মিলে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলে এটা কোর্টে প্রমাণিত হবেই। আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। সূতরাং, ইলোরাকে সাহায্য করার জন্যে তোমার অন্তত যাবজ্জীবন হবেই। ইলোরার হবে মৃত্যুদণ্ড।
ভয় দেখাচ্ছে! রফিক! খবরদার…।
কিন্তু রফিক কেঁদে ফেলল, ইলোরা, এখন কি হবে! লুকিয়ে রেখে আর লাভ কি, সবই তো এরা জানেন!
পরমুহূর্তে কান্না সংবরণ করে নিল রফিক, বলল, ইলোরা, তুমিই এই সর্বনাশটা করলে নিজের! মেয়েটাকে খুন করে তুমি সব গণ্ডগোল করে ফেলেছ… এখন আর কিছু করার নেই আমার নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে আমার এখন! কিছু এসে যায় না, আমি যদি কোর্টে সব বলে দিই, তাতে তোমাকে বিচার এমনিতেও যে শাস্তি দিতেন সেই শাস্তিই দেবেন, মাঝখান থেকে লাভ হবে আমার, রাজসাক্ষী হয়ে রেহাই পেয়ে যাব আমি।
কুয়াশা বলল, এবার তুমি থামো। উপস্থিত সকলকে আমি ব্যাখ্যা করে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবার চেষ্টা করি।
বিরতি নিয়ে কুয়াশা নতুন করে শুরু করল। প্রথম সমস্যা ছিল, এই রূমে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে দুবার গুলি করা হয়েছে। একটি গুলি পাওয়া যাচ্ছে, একটি গুলি পাওয়া যাচ্ছে না। রফিক আমাদেরকে বলে, সে আইডর-জনসন দিয়ে প্রথম গুলিটা করে। তার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। সেটা দেয়ালে বিদ্ধ হয়। দ্বিতীয় গুলিটা, স্বভাবতই ধরে নিতে হয়, ব্রাউনিং-এর। কিন্তু বুলেটটা কোথায়?
সকলে মগ্ন, মুগ্ধ চিত্তে কিয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
দ্বিতীয় বুলেটটা আসলে জানালা গলে বাইরে চলে যায়। কিন্তু এর আগে মি. সিম্পসন এবং শহীদকে আমি বলেছি, এই রূমের ভিতর যেখানে বাউনিং পাওয়া গেছে সেখান থেকে গুলি করলে বুলেট জানালা গলে বাইরে যেতে পারে না, যেতে হলে শূন্যে ছুটন্ত বুলেটকে বাঁক নিতে হবে। বুলেটের পক্ষে বাঁক নেয়া সম্ভব নয়। তাহলে? ব্রাউনিংয়ের বুলেট জানালা গলে বাইরে গেল কিভাবে?
থামল কুয়াশা। সকলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল, এই ধাঁধায় আমরা পড়ি, কারণ, রফিক প্রথম থেকেই মিথ্যে কথা বলছিল। সে বলে, আইভর জনসন দিয়ে গুলি করে সে রূমে ঢুকেই। আমরাও তা বিশ্বাস করে নিই। কিন্তু কথাটা মিথ্যে। প্রকৃত ঘটনা ঘটেছিল এই রকম। রূমে রফিক ঢেকে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। ব্রাউনিং এবং আইভর-জনসন। •৩৮ আইভর-জনসন দিয়ে নয়, রফিক প্রথম গুলি করে .৩২ ব্রাউনিং দিয়ে। তার প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। গুলি করেই সে ছুটে চলে যায় রূমের ওই পশ্চিম-উত্তর কোনায়, ফ্লাওয়ার ভাসে ফেলে দেয় ব্রাউনিংটা। তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে সে ৩৮ আইভর-জনসন দিয়ে। দ্বিতীয় বারও সে ব্যর্থ হয়–দুবারই ইচ্ছাকৃতভাবে। এবং দ্বিতীয় বুলেটটা বিদ্ধ হয় দেয়ালে। প্রথম বুলেটটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় বাইরে, বিদ্ধ হয় জানালার সাথে একই সরল রেখায় অবস্থিত কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে। মি. সিম্পসন, আমি বলেছিলাম ফ্লাওয়ার ভাসের কাছ থেকে গুলি করলে বুলেটটা তির্যকভাবে বেরিয়ে বিদ্ধ হবার কথা গাছে, ফুটোটাও একটু তির্যক হবার কথা। কিন্তু গুলি ফ্লাওয়ার ভাসের কাছ থেকে করা হয়নি, করা হয়েছে এই রূমের মাঝখান থেকে, আপনি জানালা গলে রূমে ঢুকে রফিককে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন সেখান থেকে। আপনার পায়ের শব্দ পেয়ে ইতিমধ্যে সে ফ্লাওয়ার ভাসের কাছ থেকে ছুটে রূমের মাঝখানে চলে এসেছিল।
প্রশ্ন করলেন ব্যারিস্টার, কিন্তু আপনার একটি কথা আমি বুঝতে পারছি না, মি. আহমেদ। আপনি বললেন দুবারই রফিক ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষভ্রষ্ট হয়। কেন?
কুয়াশা বলল, খুব সহজ কারণ। রূমে ঢুকে গুলি করতে যাবে, এমন সময় লোদী সাহেব জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন। রফিক দেখল লোদী সাহেব বুক চেপে ধরেছেন। রক্ত গলগল করে বেরিয়ে আসছে তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে। অর্থাৎ রফিক দেখতে পায়, লোদী সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বুকে, সে গুলি করার আগেই।
তার মানে! কিভাবে তা সম্ভব?
কুয়াশা বলল, বলছি। রফিক এবং মিস ইলোরা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ হত্যা-পরিকল্পনা রচনা করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত অদৃষ্টের পরিহাসে তা ফেঁসে গেছে। গোড়া থেকেই বরং শুরু করি।
একটু বিরতি নিয়ে কুয়াশা শুরু করল আবার, মোটিত। রফিকের মোটিভ, সে ভালবাসে ইলোরাকে, বিয়ে করতে চায় কিন্তু তার ভালবাসা এবং বিয়েতে সবচেয়ে বড় বাধা লোদী সাহেব। তাছাড়া অন্যায্য বিচার করে লোদী সাহেব তাকে বেত্রাঘাত এবং জেলের হুকুম দেয়ায় ব্যক্তিগত আক্রোশে অন্ধ হয়ে যায় সে। ইলোরার মোটিভ, তার স্টেপ-ফাদার লোদী সাহেব চাননি সে রফিকের সাথে মেলামেশা করুক। লোদী সাহেব বেঁচে থাকলে বিয়ে করা সভব নয় রফিককে। দুজনেই অসৎ সংসর্গে ওঠাবসা করে নষ্ট হয়ে গেছে। নিজেদের ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্যে ওরা পরিকল্পনা করে লোদী সাহেবকে খুন করার। রফিক জানত, লোদী সাহেব খুন হলে সবার আগে পুলিস তাকে সন্দেহ করবে, কারণ সে কোটে সর্বসমক্ষে হুমকি দিয়েছিল লোদী সাহেবকে। কথাটা জানত ইলোরাও। তাই ওরা মাথা খাঁটিয়ে অদ্ভুত একটা পরিকল্পনা তৈরি করে। বাড়ির পিছন দিকের গেটের চাবি সরবরাহ করে ইলোরা রফিককে। ব্যারিস্টার মি, খানের কাউনিং চুরি করে দেয় সে রফিককে। ঠিক হয়, ব্যারিস্টার যেদিন বাড়িতে লোদী সাহেবের সাথে গল্প করতে আসবেন সেদিন রফিক আগ্নেয়াস্ত্র দুটো নিয়ে পিছনের গেট দিয়ে বাড়িতে কবে। রফিক খুন করবে লোদী সাহেবকে ব্রাউনিং ৩২ ক্যালিবারের বুলেট দিয়ে। গুলি করে পশ্চিম দিকের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সে ব্রাউনিংটা, তারপর গুলি করবে •৩৮ আইভর-জনসন দিয়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হবে সে, বুলেটটা বিদ্ধ হবে দেয়ালে। ওরা চেয়েছিল বাড়ির চাকরবাকররা যেন দেখতে পায় রফিক রেস্টহাউজের দিকে যাচ্ছে, তাহলে তারা পুলিশে খবর দেবে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবার পর পুলিশ এসে দেখবে রফিকের হাতে রয়েছে আইডর-জনসন .৩৮ রিভলভার, কিন্তু ৩৮ দিয়ে লোদী সাহেব খুন হননি। পোস্টমর্টেম হবার পর পাওয়া যাবে লাশের শরীরে .৩২ ক্যালিবারের বুলেট কিন্তু যে বাউনিং দিয়ে বুলেটটা ছোঁড়া হবে সেটা পাওয়া যাবে না। ফলে রফিককে অভিযুক্ত করা সম্ভব হবে না পুলিসের পক্ষে। এই ছিল ওদের পরিকল্পনা। কিন্তু বাদ সাধল মি. সিম্পসন এবং কামাল।
কুয়াশা বিরতি নিয়ে আবার বলল, এরপরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। রফিক ঘুর ঘুর করছিল রেস্টহাউজের আশপাশে প্রায় ঘন্টা খানেক বা তারও বেশি সময় ধরে। পশ্চিম দিকের জানালা সহজে খোলা যায় কিনা পরীক্ষা করে সে। তার পায়ের শব্দ পেয়েছিলেন লোদী সাহেব এবং সিরু কাকা ওরফে সিরাজ সাহেব। কিন্তু পরীক্ষাটা ভাল করে করতে পারেনি সে। তাই ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে সে দক্ষিণ দিকের বন্ধ জানালায় ধাক্কা মারে। যাতে লোদী সাহেব রূমের বাইরে এসে শব্দের উৎস খোঁজেন। এই ফাঁকে পশ্চিম দিকের জানালা সহজে ভোলা সম্ভব কিনা পরীক্ষা করার ইচ্ছা ছিল তার। ইলোরা সম্ভবত তাকে কথা দিয়েছিল, পশ্চিম দিকের জানালা খোলা থাকবে। কিন্তু লোদী সাহেব রূম থেকে বের হননি। তিনি চেয়ার ছেড়ে দক্ষিণ দিকের একটা জানালা খুলে উঁকি মেরে বাইরে তাকান একবার মাত্র, তারপর ফিরে গিয়ে বসেন আবার চেয়ারে। পশ্চিম দিকের জানালা খোলা সম্ভব কিনা পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ না পেয়ে, রফিক নার্ভাস হয়ে পড়ে, আরও নার্ভাস হয়ে পড়ে সে মি. সিম্পসন এবং কামালকে দেখে। বাড়ির চাকরবাকরদের দৃষ্টি আকষর্ণ করার ইচ্ছা থাকলেও পুলিশের উপস্থিতি সে দুঃস্বপ্নেও আশা করেনি। সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ওদিকে, বাড়ি থেকে অনেক আগে বেরিয়ে গেলেও পিছনের গেট দিয়ে সকলের অগোচরে বাড়িতে ফিরে আসে ইলোরা। দারোয়ানের সাথে মি. সিম্পসন কথা বলছেন দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। তার এমনিতেই সন্দেহ ছিল রফিক শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ঠিকঠাক করতে পারবে কিনা। পুলিস দেখে তার বিশ্বাস হয়, রফিক ভয়ে সব গণ্ডগোল করে ফেলবে। কিছু একটা করা দরকার, তাই রেস্টহাউজের দিকে ছোটে ইলোরা।
কুয়াশা বিরতি নিয়ে চুরুটে টান দিল।
তারপর রেস্টহাউজের কাছাকাছি গিয়ে একটা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে ইলোরা। রফিক ঠিক কোথায়, জানত না সে। এদিকে পিছনে মি. সিম্পসন এবং কামাল। কামাল ছিল অনেক আগে, মি. সিম্পসন তার অনেক পিছনে। কামাল ইনোয়কে দেখতে পায়নি, পাশ কাটিয়ে রেস্টহাউজের দরজার দিকে চলে গেল সে। এই সময় রফিককে দেখতে পায় ইলোরা। রফিক তখন হলঘরে ঢুকে পড়েছে। ঠিক এই সময় লোদী সাহেব জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকান উঁকি। দিয়ে। ইলোরা এই সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগায়। এয়ার পিস্তল তুলে সে গুলি করে। লোদী সাহেব ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন, এমন সময় গুলি লাগে তার বুকে। মি. সিম্পসন গুলির শব্দ পাননি, পাবার কথাও না, কারণ এয়ার পিস্তলটার শব্দ বিশেষ হয় না। ইলোরাকে তিনি দেখতেও পাননি, তার কারণ, গুলি করেই ইলোরা গাছগুলোর আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে সরে যায়। আজ কৃষ্ণচূড়া গাছের আশপাশে আমরা যে জুতোর ছাপ দেখি তা ইলোরারই, পাঁচ মন ওজনের কোন মহিলার নয়। পরে রূমের ভিতর কি ঘটছে না ঘটছে দেখার জন্যে ইলোরা ফিরে আসে, একই জায়গায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে মাটিতে অত গভীরভাবে ঢুকে যায় জুতো।
ব্যারিস্টার জানতে চাইলেন, কিন্তু এয়ার পিস্তল এল কোত্থেকে ইলোরার কাছে?
কুয়াশা বলল, বাবার কাছে টাকা চাইতে নয়, এয়ার পিস্তলটা চুরি করতে। গিয়েছিল ইলোরা। আমরা শুনেছি, লোদী সাহেব নিজের কাজ নিজে করতে ভালবাসতেন। রেস্টহাউজে যখন যেতেন, নিজের হাতেই তৈরি করে নিতেন চা। ইলোরা সভবত লোদী সাহেবকে বলেন, চা-এর সাজ সরঞ্জাম সব আছে কিনা কে জানে! এই ধরনের কোন কথা শুনে লোদী সাহেব এই রূম থেকে হলঘর সংলম। অপর রূমে যান, অর্থাৎ ইলোরা তাকে কৌশলে পাঠান, এবং সেই ফাঁকে এয়ার পিস্তলটা চুরি করেন।
কিন্তু রফিক কেন খামকা দুটো গুলি করল?
কুয়াশা বলল, রফিক গুলি করতে গিয়ে দেখল, লোদী সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সে গুলি করার আগেই। অন্তত, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। ওদিকে কামাল দরজায় ধাক্কা মারছে, মি. সি পসন জানালার দিকে ছুটে আসছেন। চরম এই মুহূর্তে, সে সিদ্ধান্ত নেয়, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যা করা সম্ভব, করে যাবে সে। ব্রাউনিং দিয়ে জা বলার বাইরে গুলি করে পশ্চিম দিকের জানালার দিকে ছুটে যায় সে। কিন্তু জানালা খুলতে না পেরে ফ্লাওয়ার ভাসে ফেলে দেয় ব্রাউনিংটাকে।
ইলোরা চিৎকার করে উঠল, সব মিথ্যে কথা! রফিকের সাথে এমন ভয়ঙ্কর কোন পরিকল্পনা আমি যদি করি, তাহলে জানালা খোলার ব্যবস্থা আগে করলাম না কেন?
দারোয়ান রমজান কথা বলে উঠল, বড় বেগমসাহেব, আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম।
হাঁটু দুটো কাঁপছে ঠক ঠক করে রমজানের। ইলোরার দিকে নয়, কথা বলল সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে।
তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই, রমজান। যা সত্য বলে।
রমজান বলল, বড় বেগমসাহেবাকে আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম। উনি আমাকে দশটা টাকা বকশিশ দিয়ে হুকুম করেন, পশ্চিম দিকের একটা জানালা খোলার ব্যবস্থা করে রাখতে। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে আমি ধরা পড়ে যাই। সাহেব আমাকে মারতে আসেন ছড়ি উঁচিয়ে। কিন্তু দশটা টাকার দরকার ছিল বলে আমি বড় বেগমসাহেবাকে গিয়ে বলি, জানালা খোলার ব্যবস্থা করে এসেছি। উনি আমাকে কোরা; শরীফ দুইয়ে বলিয়ে নেন, আমি কাউকে একথা বলব না। কিন্তু এখন না বলে পারলাম না, আমি, জ্বর। কারণ সাহেব আমাকে ভালবাসতেন, হুজুর। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রমজান।
কুয়াশা বলল, পশ্চিম দিকের জানালার বাইরে ভিজে মাটিতে দশ নম্বর জুতোর দাগ, এটাও রফিকের কাণ্ড! দশ নম্বরের জুতো সে পায়ে দিয়ে লাফ দিয়ে জানালার সামনে যায়, ফেরার সময় স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আসে। যাতে পুলিস জুতোর দাগ দেখামাত্র ধরে নেয় জানালা গলে খুনী পালিয়ে গেছে। কিন্তু রফিক তখনও জানত না, জানালাটা খোলাই সম্ভব নয়, খো বার কোন ব্যবস্থা হয়নি।
দশ নম্বর জুতো পায়ে দেবার কাল?
কারণ মি. সরফরাজ খানের ওপর পুলিসের সন্দেহ ডাইভার্ট করা। মি. খান, আপনি কত নম্বর জুতো পরেন?
দশ নয়।
কুয়াশা বলল, শুধু তাই নয়, ইলোরা আপনার ব্রাউনিংও চুরি করে রফিককে দেয় ওই একই কারণে।
মি. সিম্পসন বললেন, মিস ইলোরার সাথে হেলেনা মোমতাজের শত্রুতার কার কি? হেলেনা মোমতাজ কেন খুন হলো?
কুয়াশা বলল, সুন্দর অভিনয় ছিল ওটা মিস ইলোরার, ব্ল্যাকমেলার আমিন খসরুকে জড়িয়ে চিঠি সংক্রান্ত আজগুবি কাহিনীর কথা বলছি আমি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইলোরাকে ফোন করে রফিকই। ইলোরা ভান করেন যেন আমাদেরকে তিনি জানতে দিতে চান না কোথায় ছিলেন হত্যাকাণ্ডের সময়। কেননা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু কৌশলে শেষ পর্যন্ত সবই তিনি জানান আমাদেরকে। তিনি জানতেন তার অ্যালিবাইসঠিক কিনা তা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব, এবং তাই তিনি চাইছিলেন। একটা জিনিস, মি. সিম্পসন, নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, হেলেনা মোমতাজ এবং মিস ইলোরা দেখতে অনেকটা একই রকম। অমিলের চেয়ে দুজনের চেহারার মধ্যে মিলই বেশি। লম্বায় দুজন সমান, গায়ের রঙ দুজনেরই ফর্সা, দুজনই মেদহীন। চেহারার এই সাদশ্য দেখেই ইলোরা নির্ধারিত করে হেলেনাকে। এবং উপযুক্ত পরীক্ষা করার ছলে তাকে বলে-আপনি কতটা বুদ্ধিমতী বা কাজের মেয়ে তা প্রমাণ করার জন্যে এই কাজটা করতে হবে। আপনি পাঁচটার দিকে এলাহী রোডে যাবেন, বত্রিশ নম্বরটা খুঁজে বের করবেন, যাকে পাবেন জিজ্ঞেস করবেন ইলোরা লোদীর নামে কোন চিঠি আছে কিনা। চাকুরি পাবার জন্যে কাজটা করতে রাজি হয় হেলেনা। এইভাবে ইলোরা নিজের অ্যালিবাই তৈরির চেষ্টা করে।
এই। পড়ল!
শব্দ করে কেঁদে উঠল শাহানারা। ফোঁপাতে শুরু করল সে।
ইলোরা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে হঠাৎ। ব্যারিস্টার সরফরাজ খান ধরতে গিয়েও ধরেননি।
কুয়াশা বলল, মি. খান, আপনি বোকার মত একটা মিথ্যে কথা বলেছিলেন।
জানি। বলেছিলাম, আমার চেম্বার থেকে বেরুবার আর কোন পথ নেই, আউটার রূমের ভিতর দিয়ে ছাড়া। এখন বলতে পারি, কেন বলেছিলাম মিথ্যে কথাটা।
ব্যারিস্টার হাসলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আপনার কাকে সন্দেহ করছেন। শাহানারাকে সন্দেহ করছেন বলে মনে হয়েছিল, তাই আপনাদের সন্দেহের দৃষ্টি সাময়িকভাবে আমার ওপর ফেলতে চেয়েছিলাম আমি। আসলে, আমি নিজেও শাহানারাকে সন্দেহের বাইরে ফেলতে পারছিলাম না।
হত্যাকাণ্ডের সময়, কি করছিলেন আপনি?
ব্যারিস্টার হাসতে হাসতে বললেন, আই. জি. সাহেবের সাথে ফোনে আলাপ করছিলাম।
কুয়াশাও হাসল, বুঝেছি। আপনার অ্যালিবাইটা অরিজিন্যালি এয়ারটাইট ছিল, মিথ্যে কথাটা ধরা পড়লেও ভয়ের কিছু ছিল না আপনার। দরকারের সময় প্রকৃত সত্য প্রমাণ করতে পারতেন আপনি।
ঠিক তাই।
কুয়াশা তাকাল শহীদের দিকে, কোন প্রশ্ন?
শহীদ উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বলল, নন, মি. ডিটেকটিভ।
মি. সিম্পসন বললেন, মি. আহমেদ, আসলে আপনি কে বলুন তো? নিজেকে লে-ম্যান বলেন-কে আপনি?
কুয়াশা বলল, আপনিই বলুন না আমি কে?
কামাল দরজার কাছ থেকে বলে উঠল, কে আবার, কুয়াশা!
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মি. সিম্পসন। তারপর হাসি থামতে, কুয়াশার ডান হাতটা দুহাত দিয়ে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, এমন কি, আপনি কুয়াশা হলেও আপনার বুদ্ধি এবং প্রতিভার প্রশংসা করব আমি। আপনি কুয়াশা না হলেও তার চেয়ে কম কিসে!
কুয়াশা বলল, শহীদ, আমাকে এবার যেতে হয়। মহুয়া বোধহয় দড়ি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখলেই বেঁধে ফেলবে।
কথাটা বলে অপ্রত্যাশিভাবে লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল সে রূম থেকে।
মি. সিম্পসন হঠাৎ পাথরের মত স্থির হয়ে গেছেন, ভুরু কুঁচকে কি ঘেঁন চিন্তা করছেন। তারপর, খানিক পর, চিৎকার করে উঠলেন তিনি, শহীদ, কে ও?
শহীদ বলল, মানে? কি বলছেন? কার কথা জিজ্ঞেস করছেন?
মি. এনাম আহমেদ–কে ও? মিসেস মহুয়াকে মহুয়াদি না বলে মহুয়া বলল কেন?
শহীদ হাসি চাপবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না।
হাসছ তুমি? শহীদ……কে?
শহীদ বলল, অনেক দেরিতে বুঝেছেন আপনি, মি. সিম্পসন। ও আপনাকে শেষ বেলায় নিজের পরিচয় দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই মহুয়াকে মহুয়া নামে সম্বোধন করেছে। আপনি লক্ষ করেছেন, আপনার সামনে এর আগে ও মহুয়াকে মহুয়াদি বলে সম্বোধন করেছে।
মি. সিম্পসন লাফিয়ে উঠলেন, মাই গড! কিন্তু এও কি সম্ভব! কুয়াশা…! অ্যাই, সেপাই, কে কোথায় আছিস?
ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে কুয়াশা।
Leave a Reply