কুয়াশা ৭৩ (ভলিউম ২৫) / প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ১৯৭৭
০১.
সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করল ঘটনাটা। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা চুরি বা ব্যাঙ্ক ডাকাতি মাঝে মধ্যেই হয়। কিন্তু নগদ বিশ লক্ষ টাকা নিয়ে স্বয়ং ব্যাঙ্ক ম্যানেজার লাপাত্তা, এ ধরনের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। দুদশ হাজার বা বড়জোর লাখ দুলাখ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কের কোন কর্মচারী গায়েব হয়ে গেছে, এরকম ঘটনা ঘটেছে এর আগে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে সে-কর্মচারী ধরা পড়েছে পুলিসের হাতে, খোয়া যাওয়া টাকার বেশির ভাগ উদ্ধার করা গেছে। এক্ষেত্রে দুটোর কোনটাই, ঘটল না। ম্যানেজারকে তো সারা দেশময় তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া গেল মা। বিশ লক্ষ টাকারও কোন সন্ধান মিলল না।
স্বর্ণালী ব্যাঙ্ক দেশের প্রধান ব্যাঙ্কগুলোর অন্যতম। পাঁচশ’র উপর শাখা রয়েছে স্বর্ণালীর সারা দেশে। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান শাখার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলেন আবদুর রহিম। বছর পাঁচেক চাকরি করছেন তিনি। বিচক্ষণ, বাকপটু এবং মিশুক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। পেশাগত দিক থেকে তিনি কুশলী ছিলেন। বয়স অল্প, মাত্র একত্রিশ বছর হলেও, ম্যানেজার হিসেবে কাজ চালাবার জন্যে তার যথেষ্ট উপযুক্ততা ছিল। আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ ছিল না তার। বিয়েও করেননি। বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে কথাবার্তা যদি কখনও বন্ধু-বান্ধবরা তুলত, আবদুর রহিম বলতেন, বিয়ে করে বউকে খাওয়াব কি? যা মাইনে পাই, তা দিয়ে নিজেরই তো হয় না।
ভদ্রলোক অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। বেতনের টাকায় সত্যিই তার চলত না। অফিস ছুটির পরও তিনি কাজ করতেন। অমানুষিক পরিশ্রম করতেন তিনি। কাজ শেষ হলে, সোজা চলে যেতেন কোন বার বা। রেস্তোরাঁয়। প্রায় নিয়মিত মদ্য পান করতেন। নাচ-গান ভালবাসতেন। মাঝে মধ্যে বড় বড় হোটেলে জুয়া-টুয়াও খেলতেন। সে যাই হোক, আবদুর রহিম সাহেব যে তার এতদিনের সুনাম স্বেচ্ছায় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এমন একটা গর্হিত কাজ করে বসবেন, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
সেদিন ছিল শনিবার। ব্যাঙ্কে জামানতের পরিমাণ ছিল বাইশ লাখ টাকার মত। লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একটার পর। চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট এখলাসউদ্দীন হিসেব মিলিয়ে চলে গেলেন বেলা সাড়ে তিনটের সময়। দুজন কেরানীও গেল তার সাথে। ক্যাশিয়ার গেল চারটের সময়।
ব্যাঙ্কে রইলেন ম্যানেজার আবদুর রহিম এবং দারোয়ান জয়নাল মিয়া। সাধারণত, হেড অফিসে টাকা পাঠাবার প্রয়োজন হলে, ফোন করে ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস পাঠাবার অনুরোধ করা হয়। প্রতি শনি। এবং বুধবার দিন টাকা পাঠানো হয় হেড অফিসে। তবে, এটা কোন বাধাধরা নিয়ম নয়। কোন কোন বুধ বা শনিবারে জামানতের টাকার পরিমাণ খুবই অল্প হয়, সে-সব দিনে হেড অফিসে ফোন করে মাইক্রোবাস পাঠাবার অনুরোধ করা হয় না।
তবে, সপ্তাহের ওই দুদিন মাইক্রোবাসের জন্যে ফোন করা না হলে, হেড অফিসের চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট খোঁজ নিয়ে জেনে নেন, টাকা কেন পাঠানো হলো না। নারায়ণগঞ্জ থেকে তখন আবদুর রহিম জবাব দেন, টাকা তেমন জমা পড়েনি।
সেদিনও হেড অফিস থেকে চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফোন করলেন, রহিম সাহেব, কি ব্যাপার? মাইক্রোবাস পাঠাতে হবে না আজ?
ম্যানেজার রিস্টওয়াচের দিকে চোখ রেখে ফোনে বললেন, টাকা জমা পড়েনি বললেই চলে। শুধু তোলাতুলির ব্যাপার। সম্ভবত কাল সকালে আপনাদের ওখান থেকে বেশ কিছু টাকা আননী করতে হবে।
ব্যস্ত মানুষ চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, দুএক কথায় পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যেতে নিশ্চিন্ত মনে ছেড়ে দিলেন ফোন।
এদিকে রিসিভার নামিয়ে রেখে আবদুর রহিম জোর গলায় হাঁক ছাড়লেন, জয়নাল মিয়া!
দারোয়ান ছুটে এল।
নাইট গার্ড কখন আসবে? জানতে চাইলেন ম্যানেজার।
সাড়ে পাঁচটায়, স্যার।
রিস্টওয়াচ দেখলেন ম্যানেজার। পাঁচটা বাজে।
ঠিক আছে, তুমি চলে যাও। আজ আর হেড অফিসে টাকা পাঠানো হবে না, হিসেবে বড় রকমের গরমিল দেখা দিয়েছে। নাইট গার্ড না আসা পর্যন্ত আমি আছি।
কথাগুলো বলে তিনি খোলা ফাইলে মনোনিবেশ করার ভান করলেন। কিন্তু দারোয়ান এতটুকু নড়ল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
দারোয়ান জয়নাল মিয়া ভাবছিল, স্যারের হলো কি আজ? আজ পাঁচ বছর স্যারকে দেখছে সে, কোনদিন তো একথা বলেননি। যতক্ষণ তিনি অফিসে থাকেন, তাকেও থাকতে হয়। বারবার করে তিনি সাবধান করে দিয়েছেন, এখনও দেন–আমি যতক্ষণ অফিসে থাকব, তোমাকেও থাকতে হবে, ডিউটি শেষ হোক বা না হোক। আজকে চলে যেতে বলার অর্থ?
দাঁড়িয়ে রইলে যে? মুখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন আবদুর রহিম।
স্যার, আপনি একা থাকবেন…।
বাধা দিয়ে তিনি বললেন, তুমি না গতকাল বলছিলে তোমার ছোট ছেলের জণ্ডিস হয়েছে? এখানে তো আর কোন কাজ নেই, বাড়ি গিয়ে ছেলের যত্ন নাও।
চলে যেতে বলার কারণটা বুঝতে পেরে প্রৌঢ় জয়নাল কৃতজ্ঞ বোধ করল। চট করে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম করল সে, বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে চেম্বার থেকে।
দারোয়ানকে বিদায় করে দিয়ে আবদুর রহিম ব্যাঙ্কের সদর গেট বন্ধ করলেন। ভল্টের সামনে এসে কমবিনেশন কোড নাম্বার মিলিয়ে তালা খুললেন তিনি। অ্যাটাচিকেসে ভরলেন পাঁচশো আর একশো টাকার নোটগুলো। অ্যাটাচিকেসে তালা দিয়ে চাবি রাখলেন পকেটে। ভল্টের তালাও বন্ধ করলেন। গেট খুলে দিয়ে ফিরে এসে বসলেন তিনি। নিজের চেম্বারে।
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এল নাইট গার্ড খুরশীদ। তাকে সাথে নিয়ে ওনালা-দরজা পরীক্ষা করলেন আবদুর রহিম নিত্য দিনের নিয়ম মত। সব ঠিকঠাক আছে দেখে নাইট গার্ডকে ব্যাঙ্কের ভিতর রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন, ব্যাঙ্কের সদর দরজায় তালা লাগালেন বাইরে থেকে।
এই-ই নিয়ম। নাইট গার্ড রাত্রে ব্যাঙ্কের ভিতরই থাকে। আগামীকাল রবিবার, সারাটা দিনও তাকে থাকতে হবে বন্দী হয়ে। খাবার দাবার সাথে করে নিয়ে এসেছে সে।
সদর গেটে তালা লাগিয়ে হাঁটা ধরলেন আবদুর রহিম। অন্যান্য দিন রিকশা নেন। আজ নিলেন না। হাতে অ্যাটাচিকেস নিয়ে শহরের জনারণ্যে হারিয়ে গেলেন স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের নারায়ণগঞ্জ শাখার ম্যানেজার আবদুর রহিম।
হারিয়ে গেলেন মানে সত্যিই হারিয়ে গেলেন। ঠিক যেন বাতাসের সাথে মিশে গেলেন তিনি। কেউ আর তার কোন খোঁজই পেল না।
সোমবার সকাল নটার আগেই একে একে ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা ব্যাঙ্কের সামনে এসে পৌঁছল। সবার শেষে পৌঁছল ক্যাশিয়ার এবং অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সাড়ে নটা বাজল। দেখা নেই ম্যানেজারের। ক্যাশিয়ার জহিরউদ্দীন কাছের একটা দোকান থেকে ফোন করল ম্যানেজার আবদুর রহিমের বাড়িতে। একবার নয় কয়েকবার ডায়াল করল সে। কিন্তু ফোন কেউ ধরল না।
ক্যাশিয়ার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল ব্যাঙ্কের সামনে। আর বিশ মিনিট পর লোকজন টাকা তুলতে এবং জমা দিতে আসবে ব্যাঙ্কে। এদিকে ব্যাঙ্কের চাবি রয়েছে ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজারকে ফোনে পাওয়া যায়নি। বাড়িটাও তাঁর বেশ দূরে, গিয়ে ফিরে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। একটা চাবি অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে থাকত, কিন্তু সে বেশ কিছুদিন ছুটিতে থাকার পর মাত্র দিন দুয়েক আগে জয়েন করেছে, তার চাবিটা ম্যানেজারের কাছ থেকে চেয়ে নেয়া হয়নি এখনও।
কি করা? ভেবেচিন্তে ওরা সিদ্ধান্ত নিল, হেড অফিসে খবর পাঠানো দরকার।
হেড অফিসে খবর গেল। পঁচিশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এলেন চীফ সিকিউরিটি অফিসার এবং ডিপুটি জেনারেল ম্যানেজার স্বয়ং।
মাস্টার কী সাথে আনলেন তাঁরা। ব্যাঙ্ক খোলা হলো।
ডিপুটি জেনারেল ম্যানেজার নির্দেশ দিলেন, ব্যাঙ্কের কাজ স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যান।
কথাটা বলে তিনি ম্যানেজারের চেম্বারে গিয়ে বসলেন। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করলেন ম্যানেজারের বাড়িতে। ইতোমধ্যে দারোয়ানকে সাথে দিয়ে তিনি চীফ সিকিউরিটি অফিসারকে ম্যানেজারের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ডি. জি. এম. অ্যাকাউন্ট্যান্টকে ডাকলেন।
অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্যাশিয়ারকে সাথে নিয়ে ঢুকল চেম্বারে।
ডি. জি. এম. প্রশ্ন করলেন, শনিবারে কি রকম টাকা জমা পড়েছিল?
বাইশ লাখের মত।
চমকে উঠলেন ডি. জি. এম, বলেন কি! তবে যে চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট বললেন, রহিম সাহেব তাকে শনিবারে ফোনে বলেছেন জমার পরিমাণ খুবই অল্প?
না তো! গত কয়েক মাসের মধ্যে এত টাকা আর কোন দিন জমা পড়েনি। বলল ক্যাশিয়ার।
নিয়ে আসুন দেখি ক্যাশবুক? গম্ভীরভাবে বললেন ডি. জি. এম।
ক্যাশবুক দেখে সত্য জানা গেল। সাথে সাথে ডাকা হলো পুলিস। পুলিস ইন্সপেক্টর এনায়েত করিম কয়েকজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন দশ মিনিটের মধ্যে। এরপর হেড অফিস থেকে এসে পড়লেন স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার।
সকলের সামনে খোলা হলো ভল্ট। টাকা পাওয়া গেল যা তার পরিমাণ লাখ আড়াইয়ের বেশি নয়। সবই এক, পাঁচ, দশ টাকার নোট এবং খুচরো পয়সা। একশো এবং পাঁচশো টাকার একটা নোটও নেই।
পরদিন রাজধানীর সকল সংবাদপত্রে খবরটা বেরোল। দেশের মানুষ জানল, বিশ লক্ষ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আবদুর রহিম পালিয়েছেন।
.
ব্রেকফাস্ট শেষ করে ড্রয়িংরূমের সোফায় বসে সেদিনের খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল শহীদ। মহুয়া এল ধূমায়িত চা-এর কাপ হাতে নিয়ে। তেপয়ে কাপ নামিয়ে রেখে স্বামীর পাশে বসল ও। ঠিক সেই সময় শোনা গেল কান ফাটানো ভট ভট ভট ভট শব্দ।
মোটর সাইকেল।
মুচকি হেসে শহীদ একবার তাকাল শুধু মহুয়ার দিকে। মহুয়াও একটু হাসল। পনেরো বিশ সেকেণ্ড পরই হৈ-হৈ করতে করতে ড্রয়িংরূমে ঢুকল কামাল।
মহুয়া সাদর সম্ভাষণ জানাল, এসো, কামাল। অমন ঝড়ের বেগে মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে যে?
কামাল এগিয়ে এসে দাঁড়াল হতাশ ভঙ্গিতে, বলল, এত চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। ট্রেলটুকু বাজে খরচই হলো দেখছি। কথাটা বলল সে শহীদের হাতে চা-এর কাপের দিকে চোখ রেখে।
শেষ রক্ষা করতে পারলে না মানে?
ভেবেছিলাম তোমাদের ব্রেকফাস্ট শেষ হবার আগেই পৌঁছুতে পারব…।
হেসে ফেলল মহুয়া।
শহীদও হাসছে, তবে মনে মনে। কাগজের দিক থেকে চোখ সরায়নি ও।
মহুয়া সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়াও, আনছি। তোমার, জন্যে আলাদা করে রাখা আছে সব।
সব? যেমন?
বাটার টোস্ট, জেলী, একহালি হাফবয়েল ডিম, দুপীস ফুট কেক, এক জোড়া সাগর কলা, এক পিরিচ ফিরনি, দুটো মনসুরা, আধ পোয়া ছানা, এক গ্লাস হরলিকস…।
কামাল হাত তুলে থামিয়ে দিল মহুয়াকে, ব্যস, ব্যস, মহুয়াদি-আর দিয়ো না। তুমি তো জানো, অত খেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারি না।
মহুয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আরও দুটো আইটেম আছে। গলায় আঙুল দিয়ে জোর করে খাওয়াব, এত কষ্ট করে তৈরি করে রেখেছি কেন তাহলে!
মহুয়া কামরা থেকে বেরিয়ে যেতেই অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল কামালের মধ্যে। হাসিখুশি ভাবটা মুহূর্তে উবে গেছে, গম্ভীর হয়ে উঠেছে। মুখের চেহারা।
তোর কি মনে হয়, ধরা পড়বে লোকটা? জিজ্ঞেস করল হঠাৎ কামাল। শহীদও যেন এই ধরনের একটা প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছিল, এর আগে পুলিস এ ধরনের অপরাধীকে ধরেছে। তবে তারা কেউ এত টাকা নিয়ে যায়নি। ম্যানেজার আবদুর রহিমকে আমার খুব ধুরন্ধর লোক বলে মনে হচ্ছে। বোধ হয়, পরবর্তী কর্মপন্থা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে সে, যাতে নিখুঁতভাবে পুলিসকে ফাঁকি দেয়া যায়।
ঘুম থেকে উঠে কাগজে খবরটা পড়েই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দুচারশো বা দুচার হাজার টাকা নয়, বিশ লক্ষ টাকা নিয়ে একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দিব্যি চম্পট দিল-এ অসহ্য! মাঝখানে দুটো দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে কোথায় কতদূর চলে গেছে। সে টাকা নিয়ে কে জানে! যাবি একবার ব্যাঙ্কে?
লাভ?
যেখান থেকে টাকা গেছে, জায়গাটা একবার দেখলে হয়তো কোন। সূত্র পাওয়া যেতে পারে…।
সূত্র আবার কি? লোকটা তো কাজটা করে নিজের পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করেনি। সূত্র দরকার হত, যদি সে টাকা চুরি করে অন্য কারও ঘাড়ে অপরাধটা চাপাবার চেষ্টা করত।
আমাদের কি তাহলে কিছুই করার নেই বলতে চাস?
আছে। তবে, এখুনি নয়। দেখাই যাক না, পুলিস কতদূর কি করতে পারে।
মহুয়া এল, পিছনে খাবার সাজানো ট্রে নিয়ে লেবু। কামালের সামনে ট্রে নামিয়ে রেখে লেবু চলে যেতেই কামাল ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারদাবারের ওপর।
মহুয়া কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ সে বলে উঠল, ওই আমার সতীন আসছেন।
কে? মুখের ভিতর খাবার থাকায় বিকৃত শোনাল কামালের কণ্ঠস্বর।
মহুয়া বলল, কে আবার, লালমুখো গোরা!
তার মানে, মি. সিম্পসন। মহুয়ার কথা শেষ হতে না হতে দরজায় দেখা গেল সি. আই. ডি-র স্পেশাল অফিসার মি. সিম্পসনকে।
সহাস্যে এগিয়ে এলেন তিনি। উঠে দাঁড়াল শহীদ। করমর্দন করল।
কামাল খাওয়ার কাজে বিরতি না দিয়েই বলল, বসুন, মি. সিম্পসন, বসুন। খবর কি বলুন তো?
বসতে বসতে মি. সিম্পসন বললেন, খবরটা তো কাগজেই দেখেছ।
শহীদ বলল, সন্ধান পেলেন আবদুর রহিমের?
যাবে কোথায়? ধরা তাকে পড়তেই হবে।
শহীদ বলল, দেশ ছেড়ে ইতিমধ্যে যদি পালিয়ে…!
অসম্ভব, শহীদ। আমরা এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, বর্ডার–এমন কোন জায়গা নেই যেখানে চেক করিনি। আবদুর রহিমের মত দেখতে কোন লোককে কেউ যেতে দেখেনি। আছে সে দেশের ভিতরই। এবং আমার বিশ্বাস, দেশের বাইরে যাবার কোন উদ্দেশ্য তার নেই।
কি করে বুঝলেন?
অত টাকা–দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে করবে কি সে? গেলেও টাকাটা ডলার বা পাউন্ডে রূপান্তরিত করে তবে যাবে। সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
শহীদ তার পাইপে এরিনমোরের টোবাকো ভরতে শুরু করল, একটু আগে কামালকে বলছিলাম, লোকটাকে আমার ধুরন্ধর বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ লোভে পড়ে কাজটা সে করে ফেলেছে বলে মনে হয় না। অনেক দিনের পরিকল্পনা ছিল তার।
তুমি বলতে চাইছ, লোকটাকে ধরা খুব একটা সহজ হবে না?
আমি বলতে চাইছি, পুলিস যাতে তাকে ধরতে না পারে সেজন্যে সুন্দর একটা ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে সে।
মি. সিম্পসন হাতের পাইপটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমরা আশা করছি, আগামী দুচারদিনের মধ্যেই ধরা পড়বে সে।
শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করল, ধোয়া ছাড়ল গলগল করে, সেক্ষেত্রে বলব, লোকটা সাধারণ একজন অপরাধী।
এতক্ষণে কামাল কথা বলল, এবং সাধারণ অপরাধীদের সম্পর্কে আমাদের বিশেষ কোন আগ্রহ নেই।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু যদি প্রমাণ হয় লোকটা অসাধারণ? সেক্ষেত্রে কি আমি তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারি, শহীদ?
মহুয়া মৃদু হেসে বলল, বাপরে বাপ, কী বুদ্ধি আপনার দরকার পড়লেই যাতে এদেরকে কাজে লাগাতে পারেন, সেজন্যে এখনই অগ্রিম প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিচ্ছেন।
মি. সিম্পসন বললেন, ধরা পড়ে গেলাম দেশের শ্রেষ্ঠতম প্রাইভেট ডিটেকটিভের ওয়াইফের কাছে–হাউ-এভার শহীদ, আশা করতে পারি সাহায্য?
লোকটাকে যদি শেষ পর্যন্ত ধরতে না পারেন, অবশ্যই আমরা শেষ চেষ্টা করব। বিশ লক্ষ টাকা হজম করবে সে, এ হতে দিচ্ছি না।
থ্যাঙ্কিউ মাই বয়!
.
০২.
নিঝুম রাত্রি। কোথাও জেগে নেই একটি প্রাণী। রাস্তার ধারে লাইটপোস্টের মাথা থেকে চুরি হয়ে গেছে বালব, ফলে চারদিকে জমাট বেঁধে আছে নিকষ কালো অন্ধকার। দুপাশে বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ, শুধু খোলা রয়েছে এ-পাড়ার লাল বাড়িটার উপরতলার একটি জানালা। সেই জানালা পথ দিয়ে বেরিয়ে আসছে আলোর আভা।
একটি দীর্ঘ ছায়ামূর্তি অন্ধকার গলির মোড়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে বাতাসে ভর করে ভেসে এল দুটো বাজার ঘণ্টাধ্বনি ঢং ঢং। ছায়ামূর্তি পা বাড়াল।
আলো জ্বলছে পাগলা বিজ্ঞানী প্রফেসার রেহমানের কামরায়। পঞ্চাশের উপর বয়স পাগলা বিজ্ঞানীর। দাড়ি চুল সব ধবধবে সাদা। কপালে বলিরেখা ফুটে আছে। বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এই পাগল মানুষটি রাত্রে ঘুমান না, দিনেও ঘুমান না। আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে ঘুমাতে দেখেনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গবেষণা করে চলেছেন তিনি। চিকিৎসা শাস্ত্রে এফ, আর. সি. এস. ডিগ্রি আছে। নিউরো সার্জেন এবং প্লাস্টিক সার্জারিতেও সিদ্ধহস্ত।
ইদানীং কাজের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছেন প্রফেসার রেহমান। তার পঁচিশ বছরের সহধর্মিণী, যাঁকে তিনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন, অকস্মাৎ ব্রেস্ট ক্যান্সারে মাস তিনেক আগে মারা গেছেন। ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি স্ত্রীর মৃত্যুতে। কিন্তু একমাত্র কন্যা লুবনার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিয়েছেন তিনি। অথচ, কিছু দিন কাটতে না কাটতে লুবনার কথাও ভুলে গেছেন তিনি। মগ্ন হয়ে পড়েছেন কাজে।
লুবনা বড় হয়েছে। ভার্সিটিতে পড়ে সে। তার দুঃখ, বাবার সেবা করার কোন সুযোগ তার নেই। ল্যাবরেটরিতে ঢোকার অনুমতি দেন না প্রফেসার রেহমান কাউকে, একমাত্র মেয়েকেও না। বুড়ো সিদ্দিক মিয়া। বাড়ির বাজার করা, রান্না করা থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক দায় দায়িত্ব পালন করে। বাড়িরই এক কোণে পড়ে থাকে সে। লুবনা বা সিদ্দিক মিয়া আজ পর্যন্ত উঁকি মেরে দেখার সুযোগও পায়নি ল্যাবরেটরি। প্রফেসার রেহমানের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও কম। যে কজন আছেন, যদি কখনও আসেন, বসেন ড্রয়িংরূমে। ব্যতিক্রম শুধু একজন প্রফেসার রেহমান তাকে বন্ধু বলে মনে করেন না, বয়সে ছোট হলেও মনে করেন গুরু। সেই গুরুকেই একমাত্র তিনি সাদরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান ল্যাবরেটরির ভিতর।
গভীর নিস্তব্ধতা চারদিকে।
মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে টেস্টটিউবের তরল পদার্থ পরীক্ষা করছেন প্রফেসার রেহমান। ক্যান্সারে মারা গেছেন তাঁর স্ত্রী, তাই তিনি ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছেন। হঠাৎ তার কানে একটা শব্দ ঢুকল।
ভুরু জোড়া একটু কোঁচকাল তাঁর। কান পাতলেন খানিক। আর কোন শব্দ হলো না বলে ভাবলেন ভুল শুনেছেন। শব্দ হবেই বা কেন! গত পরশু লুবনা গেছে বান্ধবীদের সাথে কক্সবাজারে বেড়াতে। সিদ্দিক মিয়া আছে কিচেনরূমে, কলিংবেল টিপে না ডাকলে ল্যাবরেটরির কাছাকাছিও আসবে না সে।
কাজে মন দেন প্রফেসার। মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে খসখস করে কাগজে নোট লেখেন। টেস্টটিউবে রাসায়নিক দ্রব্য মেশান, আবার চোখ রাখেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে।
দীর্ঘ এক ছায়ামূর্তি পানির পাইপ বেয়ে উঠে পড়েছে দোতলার খোলা জানালার সামনে। জানালা দিয়ে প্রফেসারকে দেখতে পাচ্ছে সে। পিছন ফিরে বসে আছেন প্রফেসার।
ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে খুলে ফেলল জানালার শার্সি। জানালা গলে ল্যাবরেটরির মেঝেতে নামল সে। দুপকেটে হাত দিয়ে এগোল নিঃশব্দ পায়ে।
প্রফেসার রেহমানের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াল ছায়ামূর্তি।
প্রফেসার রেহমান!
চমকে উঠলেন প্রফেসার। ভয়ে নয়, বিরক্তি ভরে চরকির মত ঘুরে বসলেন তিনি, কে?
ছায়ামূর্তি তার মুখের আবরণ সরিয়ে ফেলেছে। প্রফেসার তার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর, ধীরে ধীরে তিনি ফিরে এলেন বাস্তবে। অবিশ্বাস ভরা গলায় বললেন, রহিম সাহেব, আপনি? এখানে কেন এসেছেন? ঢুকলেন কিভাবে?
আবদুর রহিম বলল, খবরটা তাহলে জানেন?
প্রফেসার উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। কিন্তু পা বাড়ালেন না। তেমনি দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যান আপনি, রহিম সাহেব। আপনি চোর, আপনার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।
বাঁকা হাসল রহিম সাহেব। বলল, এতদিনের পরিচয় আপনার সাথে আমার, কত চা খাইয়েছি, কত গল্প করেছি, ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কত ঝামেলা থেকে আপনাকে রক্ষা করেছি–আজ আমার বিপদের দিনে আপনি এমন ব্যবহার করবেন?
আপনি চোর। আপনার এই পরিচয়টাই আমার কাছে বড়। বেরিয়ে, যান বলছি, তা নয়তো আমি পুলিস ডাকব।
ধরিয়ে দেবেন আমাকে?
সেটাই আমার কর্তব্য। কিন্তু ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আরও বড় কাজে ব্যস্ত এখন আমি। যান আপনি।
আবদুর রহিম বলল, মাস পাঁচেক আগে আপনি বলেছিলেন, লাখ তিনেক টাকা লোন চান ব্যাঙ্ক থেকে, মনে আছে? তখন লোন দেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল, তাই ব্যবস্থা করতে পারিনি। প্রফেসার রেহমান, সেই তিনলাখ টাকা এখন আপনি পেতে পারেন।
টাকার এখনও দরকার আছে আমার। কিন্তু আপনার মাধ্যমে তা আমি নেব না। তাছাড়া, আপনি লোনের ব্যবস্থা করবেন কিভাবে? আপনার তো ধরা পড়লে জেল হবে চোদ্দ বছরের।
ব্যাঙ্ক থেকে নয়, লোনটা আমিই আপনাকে দিতে চাই।
প্রফেসার রেহমান বিরক্তির সাথে বললেন, কেন? তাছাড়া, আপনার কাছ থেকে লোন নেবই বা কেন আমি?
আবদুর রহিম বলল, আপনি মহৎ মানুষ, আমি জানি। মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আমি অধম, পাপী। আপনাকে সাহায্য করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই খানিকটা। দয়া করে যদি লাখ তিনেক টাকা আপনি আমার কাছ থেকে নেন, খুব খুশি হব। যখন ইচ্ছা দেবেন, না দিতে পারলে দেবেন না।
বিনয়ে বিগলিত হয়ে কথা বলছে স্বর্ণালী ব্যাঙ্কের নারায়ণগঞ্জ শাখার প্রাক্তন ম্যানেজার আবদুর রহিম।
প্রফেসার কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আবদুর রহিমের দিকে। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমাকে কি ভেবেছেন আপনি? আমি কি এতই নিচে নেমে গেছি যে একটা চোরের কাছ থেকে টাকা সাহায্য নেব? আপনি চলে যান, এই শেষবার বলছি।
আবদুর রহিম শান্তভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল, প্রফেসার রেহমান, প্লীজ, টাকাটা আপনাকে নিতেই হবে…।
না! বেরোন! ধমক মেরে দরজার দিকে আঙুল দেখালেন প্রফেসার।
পিছিয়ে গেল আবদুর রহিম। বসল ধীরে সুস্থে একটা চেয়ারে কোটের পকেট থেকে বের করল একটা এনভেলপ এবং সিগারেটের প্যাকেট। এনভেলপটা রাখল উরুর উপর। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল।
প্রফেসার রাগে কাঁপছেন লোকটার স্পর্ধার নমুনা দেখে।
আচ্ছা, যুক্তিতে আসুন। আপনি আমার কাছ থেকে টাকা নেবেন না কেন?
আপনি চোর, তাই।
টাকার গায়ে কি লেখা থাকে, চোরের টাকা?
প্রফেসার বললেন, তা থাকে না। কিন্তু আমি নিলে, আমার মনে। লেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া, কারও সাহায্য আমি নেব কেন?
সাহায্য কে বলল? টাকাটার বদলে, আপনি একটা কাজ করে দেবেন। কাজটার বদলে টাকাটা নেবেন।
কাজ! কি কাজ?
আবদুর রহিম বলল, সামান্য একটা কাজ। কিন্তু আগে আপনি শান্ত হোন। অমন মারমুখো হয়ে থাকলে ঠাণ্ডা মাথায় আমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করবেন কিভাবে? প্রফেসার রেহমান, আমি আপনার উপকারের জন্যেই এসেছি। কথাটা মনে রেখে আমার প্রস্তাব বিবেচনা করুন। যে কাজটা আপনাকে করতে হবে তার বদলে আপনি বড় জোর পঁচিশ বা পঞ্চাশ হাজার টাকা পেতে পারেন। কিন্তু আমি আপনাকে তিন লক্ষ টাকা দেব। কারণ আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমি জানি আপনি মানুষের উপকারের জন্যে গবেষণা করে চলেছেন। আপনাকে টাকা দিলে সে টাকা দশের উপকারের জন্যেই ব্যয় হবে…।
থামুন! একজন চোরের মুখ থেকে বড় বড় কথা আমি শুনতে চাই না। আপনার প্রস্তাবটাও আপনি নিজের কাছে রাখুন, শুনতে চাই না। দয়া করে বিদায় হোন এবার।
প্রস্তাবটা শুনুন আগে।
না!
আবদুর রহিম হাসল ঠোঁট বাঁকা করে, আপনাকে একটা কথা আগেই বলা উচিত ছিল আমার। এখন বলি, প্রফেসার রেহমান, শেষ পর্যন্ত কিন্তু আপনিই আমার প্রস্তাব মেনে নেবার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠবেন। আপনাকে রাজি করাবার জন্যে একাধিক অস্ত্র আমার হাতে আছে।
কি বলতে চান?
ঠোঁটে আঙুল রেখে আবদুর রহিম বলল, আস্তে। রাস্তা থেকে, টহলদার পুলিস শুনতে পেলে বিপদ ঘটবে।
বিপদ ঘটবে আপনার! আমার তাতে কি?
আবার হাসল আবদুর রহিম ঠোঁট বাঁকা করে, বলল, না, বিপদ আপনারই ঘটবে। আমি ঠিকই পালাতে পারব। এবং আমি পালালে আপনার সর্বনাশ ঘটে যাবে।
তার মানে?
বলব, মানেটাও বলব। তার আগে দুয়া করে আপনি আমার প্রস্তাবটা শুনুন।
প্রফেসার রেহমান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
স্বনামধন্য সার্জেন আপনি, যিনি প্লাস্টিক সার্জারিতে স্পেশালিস্ট। আমার প্রস্তাব হলো, প্লাস্টিক সার্জারি করে আপনি আমার চেহারাটা সম্পূর্ণ বদলে দেবেন, বিনিময়ে আপনাকে আমি তিন লক্ষ টাকা দেব।
কী! এত বড় স্পর্ধা আপনার। প্রফেসার রেহমান গর্জে উঠলেন, ঘুরে দাঁড়িয়ে হেঁচকা টানে খুলে ফেললেন ডেস্কের দেরাজ। ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলটা ধরলেন। পিছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল তাঁকে আবদুর রহিম। অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিল প্রফেসারের হাত থেকে পিস্তুলটা।
প্রফেসার হাঁপাতে শুরু করেছেন।
আপনি কি রাজি নন আমার প্রস্তাবে?
না!
আবদুর রহিম শান্তভাবে ফিরে এসে বসল চেয়ারটায়। পিস্তলটা রেখে দিল কোটের পকেটে। উঠে দাঁড়াবার সময় এনভেলপটা পড়ে গিয়েছিল, সেটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ধরল প্রফেসারের দিকে।
এটা খুলে পড়ুন। আপনার একমাত্র মেয়ে লুবনার চিঠি। আপনাকেই লেখা।
কি বললেন? লুবনার চিঠি? অসম্ভব, লুবনা কক্সবাজারে…।
আবদুর রহিম অদ্ভুত রহস্যময় ভাবে হাসল, না। ফর ইওর ইনফরমেশন, মিস লুবনা এখন আমার হাতে বন্দিনী। চিঠিটা পড়ুন, সবই জানতে পারবেন।
এনভেলপটা ছোঁ মেরে হাতে নিলেন প্রফেসার। খুললেন। হাত দুটো কাঁপছে তাঁর।
চিঠিটা ছোট। হাতের লেখা একটু বড় বড় কিন্তু এ লেখা যে লুবনারই, তাতে সন্দেহের কারণ দেখলেন না তিনি।
লুবনা লিখেছে,
বাবা,
কক্সবাজারে যাবার পথে, বেবী ট্যাক্সি করে আমি যখন বান্ধবীদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিলাম, একদল লোক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বেবী ট্যাক্সি থামায়। লোকগুলো আমাকে ক্লোরোফর্মের সাহায্যে অজ্ঞান করে এই পোড়োবাড়িতে নিয়ে এসেছে। আবদুর রহিম সাহেব এই লোকগুলোকে নিযুক্ত করেছিলেন আমাকে কিডন্যাপ করার জন্যে। আবদুর রহিম সাহেব বলছেন, তুমি যদি ওঁকে সাহায্য করো, আমার কোন ক্ষতি করবেন না। তুমি সাহায্য না করলে এরা আমাকে এই পোডড়াবাড়িতে খুন করবে।
বাবা, পুলিসে খবর দিয়ো না। রহিম সাহেব যা বলেন কোরো। আমাকে ফিরে পেতে হলে আর করার কিছু নেই। ইতি, তোমার স্নেহধন্যা, লুবনা।
চিঠি শেষ করে অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন প্রফেসার, লুবনা!
চিঠি পড়ে গেল তার হাত থেকে। বোকার মত তাকিয়ে রইলেন তিনি আবদুর রহিমের দিকে। আবদুর রহিমের ঠোঁটে ধূর্ত হাসি। প্রফেসার রেহমান দ্রুত সামলে নিলেন নিজেকে। আশ্চর্য শান্তভাবে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি রাজি।
.
প্রফেসার রেহমান আবদুর রহিমের জালিয়াতি বুঝতে পারেননি। চিঠিটা যে তাঁর মেয়ের হাতের লেখা নয় তা যদি তিনি বুঝতে পারতেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কখনোই আবদুর রহিমের চেহারা বদলে দিতেন না।
আবদুর রহিম প্রফেসার এবং তাঁর মেয়ে লুবনাকে অনেকদিন থেকেই চিনত। ব্যাঙ্কে ওদের দুজনের অ্যাকাউন্ট আছে, সেই সূত্রে আবদুর রহিম ওদের সম্পর্কে সবই জানত। টাকা চুরি করার আগে সে ভেবেই রেখেছিল, প্রফেসারকে দিয়ে চেহারাটা পাল্টে ফেলতে হবে। প্রফেসার আদর্শবান পুরুষ, টাকার লোভে অন্যায় কাজ করতে রাজি হবেন না, একথাও তার জানা আছে। অনেকদিন থেকে ভাবনা-চিন্তা করছিল, কি উপায়ে প্রফেসারকে রাজি করানো যায়। এর মধ্যে একদিন লুবনা গেল ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে। আবদুর রহিম তাকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে আপ্যায়ন করল। কথাবার্তার সময় লুবনা জানাল আগামী মাসের অমুক তারিখে সে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে। কথাটা শুনেই দুষ্টবুদ্ধিটা খেলে গেল তার মাথায়। লুবনা এসেছিল ভার্সিটি থেকে। সাথে খাতাপত্র ছিল। কৌশলে লুবনাকে একবার ক্যাশিয়ারের কাছে পাঠিয়ে দিল সে। বনা চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই, লুবনার একটা খাতা চুরি করে লুকিয়ে ফেলল ড্রয়ারে। এর খানিকপর লুবনা ফিরে এল, বিদায় জানিয়ে চলে গেল ব্যাঙ্ক থেকে।
আবদুর রহিম লুবনার খাতায় পেল লুবনার হাতের লেখা। খাতাটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লুবনার হাতের লেখা নকল করার কাজে অনুশীলন শুরু করল। মাসখানেকের মত সময় পেয়েছিল সে, এর মধ্যেই সাফল্য, লাভ করল। হুবহু লুবনার হস্তাক্ষর রপ্ত করে ফেলল সে।
প্লাস্টিক সার্জারির ফল হলো আশ্চর্য ধরনের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবদুর রহিমের ভয়ই লাগল প্রথমে। এ কোন্ লোক? একে তো সে চেনে না। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আনন্দে প্রায় নাচতে, শুরু করল। যাক, মনে মনে ভাবল, আবদুর রহিম মরে গেছে, এখন থেকে আমি অন্য মানুষ, আমার অন্য নাম।
ঘা শুকাতে লাগল চার-পাঁচদিন। তারপর এক রাতে প্রফেসার বললেন, আমার কাজ আমি করেছি, এবার আপনার কথা আপনি রাখুন। ফিরিয়ে দিন আমার মেয়েকে। কাল সকালে আমি লুবনাকে দেখতে চাই।
ল্যাবরেটরিতে কথা হচ্ছিল। আবদুর রহিম পোশাক পরল। তৈরি হলো বিদায় নেবার জন্যে।
পকেট থেকে প্রফেসারের পিস্তলটা বের করে বলল, এটা আপনার, রেখে দিন। আমি এখুনি রওনা হচ্ছি।
পিস্তলটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন প্রফেসার, গর্জে উঠল সেটা আবদুর রহিমের হাতে।
প্রফেসারের কপালের পাশে বিদ্ধ হলো বুলেট। রক্তাক্ত বিজ্ঞানী পড়ে গেলেন হুড়মুড় করে, প্রাণবায়ু বৈরিয়ে গেল সেই সাথে।
পিস্তলটা মৃতদেহের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পকেট থেকে একটা টাইপ করা কাগজ বের করে ডেস্কের উপর রাখল আবদুর রহিম। তারপর জানালা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। সিদ্দিক মিয়ার ঘুম ভাঙেনি পিস্তলের আওয়াজে। বিনাবাধায় আবদুর রহিম নেমে এল পাইপ বেয়ে নিচের রাস্তায়। অদৃশ্য হয়ে গেল সে রাতের অন্ধকারে।
সমাজে সে অন্য নামে, অন্য চেহারায়, অন্য পরিচয়ে বেঁচে থাকার জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে, তার আর ভয় কি!
কিন্তু অপরাধ চাপা থাকে না, একথাটা জানত না আবদুর রহিম।
.
অভিজাত এলাকার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, কোন বাড়িতে কোনরকম বিপদ ঘটলে কেউ উপযাচক হয়ে এগিয়ে আসে না সাহায্যের জন্যে। গুলির শব্দ পাশের বাড়িগুলোয় পৌঁছলেও, কেউ দরজা-জানালাটি পর্যন্ত খুলল না। তবে, এক ভদ্রলোক বিবেকের তাড়নায় থানায় ফোন করে গুলির শব্দটার কথা জানিয়ে তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। অমনি ছুটে এল পুলিসের গাড়ি।
দশ মিনিটের মধ্যে জানা গেল, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসার রেহমান আত্মহত্যা করেছেন। এটা যে আত্মহত্যা নয়, খুন–একথা কেউ ভুলেও ভাবল না। প্রফেসারের ডেস্কের উপর একটা কাগজ পাওয়া গেছে। তাতে বাংলা অক্ষরে টাইপ করা আছে প্রফেসারের সর্বশেষ বক্তব্য।
প্রফেসার লিখেছেন:
আমি স্বেচ্ছায় সুইসাইড করছি। গবেষণায় উপর্যুপরি ব্যর্থতা, আয়ুর শেষ সীমায় পৌঁছে স্ত্রীর তিরোধান প্রত্যক্ষ করার দুঃখ, ভগ্ন স্বাস্থ্য–এইসব বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রতি আর কোন মোহ নেই আমার, তাই যবনিকা টানলাম। ইতি, রেহমান খান খুশনবীশ।
তরুণ ইন্সপেক্টর হায়দার আলীর মনটা কোন কারণ ছাড়াই খুঁত খুঁত করতে লাগল। প্রফেসার রেহমানকে সে ব্যক্তিগত ভাবে চিনত না বটে কিন্তু তাঁর সম্পর্কে লোকমুখে এবং দেশী-বিদেশী সংবাদপত্রের মাধ্যমে এত বেশি জেনেছে যে সে মেনে নিতে পারছে না এতবড় একটা প্রতিভা উল্লিখিত কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন।
পরামর্শ এবং উপদেশের জন্যে সে খবর পাঠাল মি. সিম্পসনকে। মি. সিম্পসন দুঃসংবাদ শুনেই সশরীরে উপস্থিত হলেন অকুস্থলে।
ব্যস্তভাবে সব দেখলেন তিনি। চিন্তা করলেন। সবশেষে রায় দিলেন, সন্দেহের কিছু নেই। লাশ মর্গে পাঠিয়ে দিন। টেলিগ্রাম করুন মিস লুবনাকে। পিস্তলে প্রফেসারের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, তার মেশিনে টাইপ করা স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে–দরজা-জানালা সব ঠিক-ঠাক মত বন্ধ রয়েছে–আত্মহত্যা ছাড়া কি হতে পারে?
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্তি খণ্ডন করতে পারল না তরুণ ইন্সপেক্টর। হায়দার আলী। লাশ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করল সে।
.
কিন্তু শহীদকে অন্যরকম কথা বলল কুয়াশা।
কথা হচ্ছিল পরদিন শহীদের ড্রয়িংরূমে। মহুয়া তার দাদাকে দেখে। কদমবুসি করে দ্রুত বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে, নাস্তা ইত্যাদির ব্যবস্থা করার জন্যে। এই ফাঁকে কুয়াশা ঠোঁট থেকে চুরুট নামিয়ে শহীদকে বলল, প্রফেসার রেহমান সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তাঁকে যতটুকু চিনেছিলাম, আত্মহত্যা করার মত কাপুরুষতা তাঁর মধ্যে লক্ষ করিনি।
তিনি আত্মহত্যা করেনওনি। আমার বিশ্বাস, তাকে খুন করা হয়েছে।
শহীদ চিন্তিত মুখে কুয়াশার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল, কোন প্রমাণ পেয়েছ নাকি?
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা, মেঝে এবং একদিকের দেয়াল জুড়ে প্রকাণ্ড ছায়া পড়ল তার, সূত্রের সন্ধানে আছি। পেলে জানাব, তোমাকে। তোমাকেই খুনীকে ধরার দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে সাহায্য করব আমি। জানোই তো, ক্যান্সার নিয়ে বড্ড ব্যস্ত আছি এখন। আচ্ছা, চলি। পিছনের দরজা দিয়ে যাব আমি। মহুয়া বুঝি কিচেনে গেছে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে, বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্ষান্ত করতে হবে। ওকে।
বলে শহীদকে কোন কথা বলার অবকাশ না দিয়ে আলখাল্লায় আবৃত কুয়াশা ড্রয়িংরূম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
০৩.
বিপদের কথা কেউ বলতে পারে না। আজহার মল্লিকের সুখের সংসার, হঠাৎ সেই সংসারে বিপদ তার কালো ছায়া ফেলবে তা কেউ জানত না।
প্রৌঢ় আজহার মল্লিক এক অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে চাকরি করেন। আজ এগারো বছর এক নাগাড়ে চাকরি করছেন তিনি এই ধরনের ফার্মে। এখন যে ফার্মে চাকরি করছেন সেটি নতুন, মালিক বড় কড়া, তবে বেতন দেন ভাল। স্ত্রী এবং দুই যুবতী মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার তাঁর। মেয়ে দুটি ম্যাট্রিক পাস করে চাকরিতে ঢুকেছে। আজহার মল্লিক এ রকমটি চাননি, মেয়েরা জেদ করে চাকরি নিয়েছে। তবে মেয়েদেরকে তিনি খুব একটা বাধাও দেননি। মেয়েদের কাছ থেকে টাকা পয়সা তিনি কখনও নেন না, ওরা নিজেদের কাপড়-চোপড় কিনতে এবং শখ-সাধ মেটাতেই বেতনের টাকা খরচ করে ফেলে।
বড় মেয়ে আতিয়া খুব বুদ্ধিমতী এবং ধীর-স্থির প্রকৃতির। চাকরি করলেও, লেখাপড়াটা ছাড়েনি সে। অফিস থেকে ফিরে নিয়মিত পড়তে বসে। আগামী বছর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার ইচ্ছে আছে তার।
ছোট মেয়ে তসলিমা বড় বোনের ঠিক বিপরীত। করিও শাসন সে মানে না। খুবই চঞ্চল স্বভাবের। দায়িত্বজ্ঞান একেবারে নেই বললেই চলে। পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে চাকরি করে, এবং অফিস ছুটির পর ক্লাবে রেস্তোরাঁয় ছেলে-বন্ধুদের সাথে হৈ-হৈ করে সময় কাটায়, গভীর রাত না করে বাড়ি ফেরে না সে।
সন্ধ্যার পর ওদের আম্মা মিসেস আজহার স্বামীর জন্যে মোজা বুনছিলেন শার্সি লাগানো জানালার সামনে মোড়ায় বসে। মাঝে মধ্যে জানালা দিয়ে বাড়ির বাগানের দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছিলেন। জানালা থেকে গেটটা দেখা যায় না, কিন্তু গেট পেরিয়ে কেউ যদি বাড়িতে ঢুকতে চায় তাহলে তাকে বাগানের মাঝখানের সরু পথটা দিয়ে হেঁটে আসতে হবে।
স্বামীর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন তিনি। সকালে যাবার সময় বলে গেছেন, আজ টাকা কালেকশন করতে হবে, দেরি হতে পারে। কিন্তু তাই বলে এত দেরি। পায় সাতটা বাজে। এত দেরি তো কখনও হয় না।
এদিকে তসলিমারও দেখা নেই। অফিস থেকে একবার সে বাড়ি ফেরে কাপড়-চোপড় পাল্টাবার জন্যে, তারপর আবার বেরোয়। আজ এখনও সে ফিরছে না কেন বুঝতে পারছেন না তিনি।
এমন সময় গেট খোলার কাঁচ কাঁচ শব্দ হলো। কাঁটা ধরা হাত দুটো স্থির হয়ে গেল মিসেস আজহারের, মুখ তুলে তাকালেন বাগানের দিকে। দেখলেন, স্বামী বা ছোট মেয়ে নয়, পাশের বাড়ির ভাড়াটে জাহাঙ্গীর হোসেন বাগানের মাঝখান দিয়ে জানালার দিকে হেঁটে আসছে। মিসেস আজহার জানালার শার্সি খুললেন।
জানালার সামনে এসে দাঁড়াল জাহাঙ্গীর হোসেন। জিজ্ঞেস করল, খালা-আম্মা, কি করছেন?
এই তো বাবা, তোমার খালুর জন্যে মোজা বুনছি।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলল, খালা-আম্মা, তসলিমা আমার ওপর খেপে আছে। ওকে একটা ফ্রেঞ্চ সেন্ট উপহার দেব বলেছিলাম কিন্তু সেটা বাজারে খুঁজে পাইনি বলে দেয়া হয়নি। কথাই বলে না আজকাল দেখা হলে। এই বইটা ওরই, ওর হাতে যদি দেন…!
দাও, দেবখন। বলে জানালার ফাঁক দিয়ে বইটা নিলেন মিসেস আজহার।
জাহাঙ্গীর হোসেন চলে গেল। বইটা পড়ে রইল টেবিলে। একটু পর আতিয়া বেরিয়ে এল তার কামরা থেকে, তসলিমা ফিরল না এখনও, না?
মিসেস আজহার গম্ভীরভাবে বললেন, না। জাহাঙ্গীর এসেছিল। কি বলল জানিস? বলল, দেখা হলে নাকি কথাই বলে না তসলিমা। অমন ভাল ভদ্র একটা ছেলে, তাকে সে পাত্তাই দেয় না। গুণ্ডা-বদমাশদের সাথে মেলামেশা ওর…!
আতিয়া কথা না বলে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে বইটা তুলে নিল, এটা এখানে কোত্থেকে এল?
গল্পের বই। ফিরিয়ে দিয়ে গেল জাহাঙ্গীর।
বইটা খুলতেই একটা এনভেলপ দেখতে পেল আতিয়া। এনভেলপের উপর লেখা, তসলিমার জন্যে।
আতিয়া চিঠিটা বইয়ের ভিতর রেখে বইটা হাতে নিয়েই নিজের কামরার দিকে পা বাড়াল, এমন সময় মিসেস আজহার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ওই তোর বাবা আসছে। আতিয়া!
মিসেস আজহার বড় মেয়ের নামটা এমন বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করলেন, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল আতিয়া, মায়ের দিকে ছুটে এল।
কি হয়েছে, মা?
তোর বাবা অমন টলতে টলতে আসছে কেন, বল তো?
জানালার সামনে এসে দাঁড়াল আতিয়া। কিন্তু আজহার মল্লিককে তখন জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না। একমুহূর্ত পর তিনি হলঘরে ঢুকলেন। মুখ তুলে তাকালেন, পরমুহূর্তে নিরতিশয় লজ্জা এবং সঙ্কোচে মাথা হেঁট করে নিলেন। টলতে টলতে হাঁটছিলেন তিনি, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।
মা, তুমি তোমার কামরায় যাও তো। আজহার মল্লিক জড়ানো লায় বললেন বড় মেয়েকে। আতিয়া বোকার মত তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
রেবা, এদিকে এসো, আমাকে উপরে নিয়ে চলো। কথাটা বললেন আজহার মল্লিক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। মা এবং মেয়ে দেখল আজহার মল্লিকের চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল। বেসামাল লাগছে তাঁকে। পঁড়িয়ে পঁড়িয়ে দুলছেন এদিক ওদিক। রেবা অর্থাৎ মিসেস আজহার দ্রুত পায়ে স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মদের গন্ধ ঢুকল তাঁর নাকে। স্বামীর একটা হাত ধরে ফেলে তিনি বললেন, তুমি-তুমি…!
কথাটা শেষ করতে পারলেন না মিসেস আজহার। আজহার মল্লিক তাঁকে থামিয়ে দিলেন হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
মিসেস আজহার অস্ফুটে বললেন, মেয়েরা বড় হয়েছে–এতদিন পর আবার তুমি…
আতিয়া নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল। পা বাড়াল সে নিজের কামরার দিকে।
দাঁড়া, মা! আজহার মল্লিক মেয়েকে বললেন।
আতিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল।
এদিকে আয়! শোন..আমি লজ্জিত…এক লোক আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে…।
কথা শেষ না করে আজহার মল্লিক টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন লম্বা সোফাটায়। হাতের চামড়ার ব্যাগটা পাশে রেখে দুহাতে মুখ ঢাকলেন তিনি।
মিসেস আজহার স্বামীর পাশে গিয়ে বসলেন। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, শরীর বুঝি খারাপ লাগছে?
না, আমি…ভালই আছি। চিন্তা কোরো না। ব্যাগটা তুলে রাখো, ওতে অনেক টাকা আছে।
মিসেস আজহার বললেন, আজ কালেকশনের দিন, এমন একটা কাজ করা তোমার উচিত হয়নি। লোকটা কে শুনি?
তাকে তুমি চিনবে না। সব দোষ তার নয়। হয়েছে কি জানো, আজ দশ হাজার টাকা কালেকশন হয়েছে, এ থেকে টেন পার্সেন্ট কমিশন পাব আমি। বেতনের ওপর শতকরা দশ পার্সেন্ট কমিশন দেবে কোম্পানী, কথা হয়েছে আজ। মনটা ভাল ছিল। বাড়ি ফিরছিলাম, দেখা হলো পুরানো এক বন্ধুর সাথে। এক চাইনীজ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সে। জোর করে নিয়ে গেল আমাকে রেস্তোরাঁয়। খাইয়ে দিল দুতিন পের্গ। যাক, কেউ যেন আর না শোনে এ-কথা, আর হবে না এমন।
টাকা সব ঠিকঠাক আছে তো?
মিসেস আজহার ব্যাগটা তুলে খুলে ফেললেন। পরমুহূর্তে ভঁর হাত থেকে পড়ে গেল ব্যাগটা মেঝেতে। ব্যাগের ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ল চার পাঁচটা পাথরের টুকরো।
সর্বনাশ করে এসেছ! টাকা কোথায়? ব্যাগের ভিতর পাথর এল। কোত্থেকে?
কি? আজহার মল্লিক প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিলেন ব্যাগটা। সেটাকে চোখের সামনে তুলে ভিতরে তাকালেন, ভরে দিলেন ডান হাতটা। এক এক করে আরও চার-পাঁচটা পাথরের টুকরো বের করে মেঝেতে ফেললেন তিনি। তারপর আর্তনাদ করে উঠলেন, এ কি! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না! টাকা নেই কেন?
নেশার ঘোর কেটে গেল আজহার মল্লিকের। কপালে করাঘাত করে বিলাপ করতে লাগলেন তিনি। আতিয়া পাশে এসে দাঁড়াল। বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে পরীক্ষা করল সে।
তাজ্জব হয়ে বলল, বাবা, এ ব্যাগ তো তোমার না। এ তুমি কোত্থেকে পেলে?
ব্যাগ আমার না? কি বলছিস তুই?
আজহার মল্লিকের বিস্ময়ের সীমা রইল না মেয়ের কথা শুনে।
দেখতে একেবারে তোমারটার মতই, কিন্তু আমি বলছি এ ব্যাগ কক্ষনো তোমার হতে পারে না। তোমার ব্যাগের ভেতরের চেনটার কাছে ছিঁড়ে গিয়েছিল কাপড়, আমি নিজে সেলাই করে দিয়েছিলাম। দেখো এটা খুলে, সেলাইয়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তাছাড়া তোমার ব্যাগটা পুরানো, এটা একেবারে নতুন কেনা।
তবে…তাহলে…আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না, মা…।
আতিয়া বলল, মাথা ঠাণ্ডা করো, বাবা। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে মনে করো। কারও সাথে ব্যাগ বদলাবদলি হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
হতাশায় মাথা দোলাতে দোলাতে আজহার মল্লিক বললেন, রেস্তোরাঁ ছাড়া আর কোথাও যাইনি, মা আমি। টাকা কালেকশন করতে দেরি হয়ে গেল, তাই ব্যাঙ্কে যাওয়া হলো না। বাড়ি ফিরে আসছিলাম, লোকটার সাথে তাদের রেস্তোরাঁর সামনে দেখা।
লোকটার সাথে তোমার কতদিনের পরিচয়?
অনেকদিন আগে, বছর দশেক তো হবেই, পরিচয় হয়। ওর সঙ্গে পড়ে আমি অসামাজিক, হয়ে উঠেছিলাম। তোর মা! যদি সে-সময় কড়া না হতো, সে-পথ এতদিনেও ছাড়তে পারতাম কিনা সন্দেহ। বছরখানেক দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ছাড়ল না কোনমতে। কিন্তু সে কেন আমার সাথে এমন শত্রুতা করবে? তাছাড়া সে জানবেই কিভাবে আমার ব্যাগে টাকা আছে?
কথায় কথায় তাকে বলোনি তো?
না। কেন বলব?
কতক্ষণ ছিলে তুমি লোকটার সাথে?
পৌনে এক ঘণ্টার মত। আমাদের টেবিলে আর কেউ ছিলও না। ব্যাগটা আমি আমার পাশের চেয়ারে রেখেছিলাম সব সময়।
মিসেস আজহার বললেন, ভুল করে ব্যাগটা অন্য কারও ব্যাগের সাথে বদলাবদলি হয়ে গেছে বলে মনে হয় না। এ কারও শত্রুতা। আর ভুল করে বদলাবদলি হয়ে থাকলেও, টাকা ফিরে পাবার আশা করা বৃথা। আজকালকার মানুষ কি আর আগের মত সৎ যে দশ হাজার টাকা পেয়েও ফিরিয়ে দেবে? তুমি আর দেরি না করে এখুনি থানায় গিয়ে ডাইরি করে এসো।
আজহার মল্লিক ছল ছল চোখে বলল, তার আগে লোকটার সাথে একবার দেখা করে জিজ্ঞেস করলে হয় না?
আগে থানায় যাও, তারপর তার কাছে যেয়ো।
আজহার মল্লিক পা বাড়ালেন। মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, চাকরিটা তো গেলই, জেলও বুঝি খাটতে হবে এই বুড়ো বয়সে!
বাবা, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
মেয়ের কথা যেন শুনতেই পাননি, আচ্ছন্নের মত বেরিয়ে গেলেন আজহার মল্লিক হলঘরের দরজা দিয়ে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না আতিয়া। সময় দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে রাত্রি আটটা ঘোষণা করল।
কি হবে এখন বল তো, আতিয়া?
নিস্তব্ধতী ভাঙলেন মিসেস আজহার। আতিয়া শুকনো গলায় বলল, টাকা ফিরে পাওয়া যাবে সে আশা কোরো না, মা।
চাকরি গেলে…।
আতিয়া বলে উঠল, তা না হয় গেল, কিন্তু বাবাকে দোষী করে যদি কেস করে কোম্পানী?
মিসেস আজহার সোফায় হেলান দিলেন, আমার মাথা ঘুরছে।
আতিয়া বলল, আটটা বেজে গেল, অথচ তসলিমার এখনও দেখা নেই।
ওর কথা আর বলিসনে আমাকে, যা ইচ্ছা করুক।
দেখতে দেখতে রাত নটা বাজল। আজহার মল্লিক ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ডায়েরী তো করলাম কিন্তু টাকা ফিরে পাব বলে আশা হচ্ছে না। লোকটাকেও সব কথা বললাম। সে তো আকাশ থেকে পড়ল। তার কাছেই গিয়েছিলাম আগে। যেচে পড়ে সে-ও গেল আমার সাথে থানায়।
তাকে পুলিস জেরা করেনি?
আজহার মল্লিক বিরক্তির সাথে বললেন, তার কি দোষ? আমাকে অনেকদিন পর দেখে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে দুপেগ খাইয়েছে–তার মানে কি এই যে টাকার লোভে ব্যাগটা সে-ই বদলে দিয়েছে?
পুলিসকে তুমি কি বললে?
বললাম তো সবই। কিন্তু…
মিসেস আজহার জানতে চাইলেন, তোমাকে জোর করে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে লোকটা সে কথা বলেছ পুলিসকে?
কি আশ্চর্য! জোর করে খাইয়েছে মানে কি? হাত পা বেঁধে গলায় ঢেলে দিয়েছে নাকি? অনেকদিন পর দেখা, একসাথে এককালে খেতাম, তাই….সম্মান দেখাবার জন্যেই সে আমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায়, খেতে বলে।
এমন সময় তসলিমা এবং শামিম ঢুকল হলঘরে। শামিম দূর সম্পর্কীয় চাচাতো ভাই হয় তসলিমাদের। কালেভদ্রে আসে সে নারায়ণগঞ্জ থেকে। সুপুরুষ, মোটামুটি ভাল একটা চাকরি করে, এখনও বিয়ে করেনি।
দুবোনের মধ্যে তসলিমা সুন্দরী। সুন্দরী বলে তার বেশ অহঙ্কারও আছে। তার উপর এক শ্রেণীর যুবকের প্রশংসায় তসলিমার কাণ্ডজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে, বাড়ির কাউকে বিশেষ ভয় করে না সে। বাবা এবং মা শাসন করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আজকাল আর কিছু বলেন না। মেয়ে রোজগার করে, জোর করে তাকে কিছু বলতে গেলে হয়তো বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র কোথাও চলে যাবে।
কিন্তু আতিয়া এখনও হাল ছাড়েনি। প্রয়োজনে সে ছোট বোনকে কড়া ভাষায় ভৎর্সনা করতে ছাড়ে না।
এত দেরি করলি যে?
আতিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিল না তসলিমা, সে টেবিলের উপর বই। দেখে পা বাড়াল সেদিকে। উত্তর দিল শামিম। ও আমার সাথে ছিল।
ঘাড় ফিরিয়ে আতিয়া তাকাল তীব্র দৃষ্টিতে শামিমের দিকে। শামিম একটু ইতস্তত করে বলল, ক্লাবে হাউজী খেলছিল, সেখানে দেখা ওর সাথে।
ইতোমধ্যে বইটা তুলে নিয়ে ভিতর থেকে এনভেলপটা বের করে ফেলেছে তসলিমা। কাঁধের শাড়ি খসে পড়েছে, ব্লাউজ দেখা যাচ্ছে, খেয়াল নেই সেদিকে খেয়াল নেই বাবার বিমর্ষ চেহারার দিকেও, গালে হাত দিয়ে মা গভীর দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন, সেদিকেও চোখ পড়ল না, তার। এনভেলপ খুলে সে চিঠি পড়তে ব্যস্ত।
চিঠিটা পড়া শেষ করে দুহাত দিয়ে ধরে দুটুকরো করে মেঝেতে ফেলে দিল সেটা তসলিমা, সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল, বলল, আমি কাপড় বদলাতে যাচ্ছি, এক বান্ধবীর জন্মদিনের ডিনার আছে, যেতে হবে আমাকে…।
হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। শামিম ছেঁড়া চিঠিটা মেঝে থেকে তুলে নিচ্ছে, দেখতে পেয়েছে সে। দুপা এগিয়ে শামিমের হাত থেকে চিঠিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিল। বলল, অন্যের চিঠি পড়তে নেই, জানো না, নাকি?
বলে টুকরো দুটো ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে রাখল তসলিমা। তারপর সিঁড়ির দিকে এগোল।
দাঁড়া! আজ তোর আর বাইরে যাওয়া হবে না।
দাঁড়াল তসলিমা, পিছন দিকে না তাকিয়ে জানতে চাইল, কেন?
আতিয়া বলল, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বাবা দশ হাজার টাকা হারিয়ে এসেছেন। কেউ ঠকিয়ে বাবার টাকাভর্তি ব্যাগটা নিয়ে একই রকম অন্য একটা ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। চাকরিটা তো যাবেই, জেলও না খাটতে হয়!
ঘুরে দাঁড়াল তসলিমা।
আজহার মল্লিক এক কোণ থেকে বললেন, অফিসে গিয়ে কি করে যে খবরটা বলব, ভেবে পাচ্ছি না। অবশ্য মাস কয়েক সময় পেলে টাকাটা দিতে পারা যাবে।
তসলিমা সম্পূর্ণ ঘটনাটা শুনল। শামিমও প্রশ্ন করে জেনে নিল খুঁটিনাটি। এমন একটা দুঃসংবাদ, শামিম খুবই দুঃখ প্রকাশ করল। সাড়ে নটার সময় বিদায় চাইল সে। বলল, মান্থলি টিকেট রয়েছে যখন, বাস ভাড়া দিয়ে লাভ কি। এর পরে গেলে লাস্ট ট্রেন ধরতে পারব না।
আজহার মল্লিক বললেন, রাতটা না হয় থেকেই যাও। প্রচণ্ড শীত পড়েছে, সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশা ঢেকে ফেলেছে চারদিক।
না কাকা, সকালে আবার অফিসে যেতে হবে। আমি যাই।
বিদায় নিয়ে চলে গেল শামিম।
তসলিমা কিছু বলবে, তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আতিয়া সন্দেহ করল। বলল, কি রে, দাঁড়িয়ে রইলি যে? যা, মুখ হাত ধুয়ে আয়, খেতে হবে না?
কিন্তু, দিদি…।
আতিয়া কঠিন স্বরে বলল, কি?
বান্ধবীকে যে কথা দিয়েছি…!
আতিয়া ঝাঁঝাল গলায় বলল, কথা দিলেই যে কথা রাখতে হবে তার কি মনে আছে? বাড়িতে এরকম বিপদ, সব জেনেও তুই যাবি ফুর্তি করতে?
তসলিমা জবাবে বলল, আমি না গেলে কি বাবার বিপদটা কেটে যাবে?
বিপদ বাবার, না?
তসলিমা বিরক্তির সাথে বলল, না হয় আমাদের সকলেরই, আমি বাড়িতে থাকলে কি উদ্ধার পাব সকলে…?
বান্ধবীর জন্মদিন বলে, না কোন বখাটে ছেলের সাথে ক্লাবে যাবার কথা আছে…?
তসলিমা চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে, যাব না। হলো তো!
আতিয়া চুপ করে রইল। তসলিমা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল নিজের কামরায়।
দশটার সময় নিচের ডাইনিংরূমে খেতে বসল সবাই। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে একে একে উঠে এসে বসল হলঘরে। মায়ের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে আতিয়া একটা প্রশ্ন করল তসলিমাকে।
সেদিন তোকে যে ভদ্রলোক গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন, তিনি কি করেন?
তসলিম উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, এমদাদের কথা বলছ তুমি? এমদাদুল হক। অগাধ টাকার মানুষ ও।
তা একদিন বাড়িতে ডেকে আনলেই তো পারিস।
তসলিমা তাচ্ছিল্যভরে বলল, আমাদের যা নোংরা বাড়ি। কোন ভদ্রলোক যদি দেখে এই রকম বাড়িতে আমি থাকি…।
আতিয়া রেগে গেল, টাকা দিয়ে মানুষের পরিচয় হয়?
আজকাল টাকা দিয়েই হয়।
মুখের উপর জবাব দিয়ে বসে রইল তসলিমা। খানিকপর কাউকে কিছু না বলে উঠে গেল সে উপরে। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন মিসেস আজহার, শামিম ছেলেটা এই কুয়াশায় ঠিক মত স্টেশনে পৌঁছুল কিনা! ফারুকও আজ বড় দেরি করছে ফিরতে।
ফারুক শিক্ষিত যুবক। আতিয়াকে পড়ায় সে। কিছুদিন তসলিমাকেও পড়িয়েছিল। কিন্তু তসলিমার পড়াশোনায় মন নেই, তাই সে পড়ায় না। দোতলার সর্ব দক্ষিণের কামরায় কিছুদিন থেকে থাকছে ফারুক। সংলগ্ন বাথরূম আছে তার কামরার সাথে। সিঁড়িটাও আলাদা। সে থাকাতে এ বাড়ির কারও কোন অসুবিধা হয় না। ইতোমধ্যেই সে পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে। স্বভাব-চরিত্র ভাল বলেই মনে হয়। কি এক মেশিনারী ফার্মে চাকরি করে। বেতন ভালই পায়। এ বাড়িতে থাকে বটে, কিন্তু খায়দায় বাইরে।
মিসেস আজহারের বড় প্রিয় পাত্র এই ফারুক। তিনি মনে মনে আশা পোষণ করেন, ফারুককে জামাই করবেন।
মেয়েরা বড় হলে মায়ের মন এরকম অনেক কল্পনাই করে। ফারুককে জামাই করার ব্যাপারটাও তাঁর সেইরকম একটা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর মেয়েদের মতিগতি বোঝা ভার। তাদের কেউ ফারুককে বিয়ে করতে রাজি হবে কিনা তা তিনি ভেবে দেখেননি। তাছাড়া, ফারুকও যে রাজি না হতে পারে সে কথাও তিনি গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করেননি। ফারুক খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। নিজের কথা কোনদিন সে এ-বাড়ির কাউকে গল্পচ্ছলে বা অন্য কোন প্রসঙ্গেও জানতে দেয়নি আজ পর্যন্ত। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু কেউই জানে না। সকালে বেরিয়ে যায় সে, ফেরে রাত আটটা নটায়।
দশটার দিকে হলঘরের দরজার কড়া নড়ে উঠতে আতিয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ফারুক এবং তার পিছু পিছু শামিম ঢুকল ভিতরে।
ফারুক বলল, বাইরে সাংঘাতিক কুয়াশা! একহাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
আতিয়া সপ্রশ্ন চোখে শামিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ফিরে এলে যে?
ফিরে না এসে উপায় আছে? কুয়াশায় পথ চেনা অসম্ভব। রিকশা টিকশও পেলাম না। দিক হারিয়ে কোন দিকে যাচ্ছিলাম কে জানে, হঠাৎ ধাক্কা খেলাম ফারুক সাহেবের সাথে। উনিই তো নিয়ে এলেন সাথে করে।
মিসেস আজহার বললেন, ভালই করেছ, ফিরে এসেছ।
এই সময় রুমাল বের করতে গিয়ে শামিমের পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট পড়ে গেল মেঝেতে।
ফারুক হাসতে হাসতে বলল, এত টাকা! এত টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করা কি ভাল?
শামিম উত্তরে বলল, কত আর! মাত্র আট হাজার। যেভাবে এসেছে সেভাবেই খরচা হয়ে যাবে।
যেভাবে এসেছে মানে? ব্যাঙ্ক লুট করে পেয়েছেন নাকি?
অপ্রতিভ দেখাল শামিমকে। বলল, না…মানে, হাউজী খেলে পেয়েছি।
আরও কিছু টুকরো আলাপের পর ফারুক সিঁড়ি দিয়ে চলে গেল নিজের কামরায়। মিসেস আজহারও আতিয়াকে সাথে নিয়ে উঠে গেলেন উপরে।
সুযোগ পেয়ে আজহার মল্লিক কথাটা পাড়লেন, শামিম, তোমার কাছে অত টাকা থাকলে আজেবাজে খরচা হবে। তুমি বরং টাকাগুলো আমার কাছে রেখে দাও। শুনেছই তো কি রকম বিপদে পড়ে গেছি হঠাৎ। তোমার টাকাটা পেলে, কোম্পানীকে দিয়ে এ যাত্রা চাকরিটা বাঁচানো যায়। মাস কয়েক পরে আবার তুমি চাইলেই আমি দিয়ে দেব…।
শামিম বলল, কিন্তু কাকা, যে জমিটা বায়না করে রেখেছি সেটা আগামী হপ্তার মধ্যে রেজিস্ট্রি করে না নিলে যে বায়নার পাঁচ হাজার টাকা পানিতে যাবে!
ওহ্! তুমি জমি কেনার জন্যে বায়না করে রেখেছ তা তো জানতাম না।
শামিম বলল, কাউকে বলিনি। ভেবেছিলাম রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে বলব।
আজহার মল্লিক বললেন, তবে থাক। বলে তিনি উঠে গেলেন উপরে।
শামিম নিচের এই হলঘরেই সোফার উপর শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবে, ঠিক হয়েছে আগেই। আতিয়া কম্বল এবং বালিশও দিয়ে গেছে তার জন্যে।
আলো নিভিয়ে দিয়ে সোফার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল শামিম। মাথাটা পর্যন্ত ঢুকিয়ে নিল কম্বলের ভিতর।
রাত বাড়ল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়ি। উপরতলা থেকে আর কোন শব্দ আসছে না। ধীরে ধীরে কম্বল সরিয়ে সোফার উপর উঠে বসল শামিম। কান পাতল। না, কোন শব্দ নেই। জেগে নেই কেউ, বুঝতে পারল সে। সোফা ছেড়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ির দিকে এগোল। সিঁড়ি টপকে করিডর ধরে তসলিমার কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর দরজার গায়ে হাত দিয়ে একটু চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা।
দরজা বন্ধ, ভেবেছিল শামিম। খোলা রয়েছে দেখে বেশ একটু অবাকই হলো সে।
কামরার ভিতর অন্ধকার। খাটটা দেখা যাচ্ছে। সাদা মশারী টাঙানো রয়েছে খাটের উপর, অস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্ধকার কামরার ভিতর ঢুকল শামিম। ঢুকে ভিতর থেকে নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল দরজাটা।
.
০৪.
গভীর রাত। তন্দ্রা মত এসেছিল মিসেস আজহারের, হঠাৎ কি একটা প্রচণ্ড শব্দে জেগে উঠলেন তিনি। বেডসুইচ জ্বেলে দেখলেন, স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন মেঝেতে।
কিসের শব্দ হলো গো?
আজহার মল্লিক চিন্তিত ভাবে বললেন, ঠিক বুঝতে পারিনি!
দরজা-জানালা বন্ধ করার আওয়াজ তো অত জোরে হবে না। দরজা খোলো, নিশ্চয়ই চোর ঢুকেছে বাড়িতে।
আজহার মল্লিক বললেন, দূর। ইঁদুর-টিদুর হবে বোধহয়। তবু দেখা দরকার।
দরজা খুলে করিডরে বেরোলেন তিনি। প্রথমেই চোখে পড়ল, তসলিমার কামরার দরজা খোলা।
ভুরু কুঁচকে এগোলেন তিনি। সিঁড়ির মাথায় একটা বালব জ্বলছে, তার আলোয় কামরার ভিতরটা দেখলেন তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
বড়সড় কি একটা লম্বা হয়ে পড়ে রয়েছে কামরার ভিতর, ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না অল্প আলোয়।
তসলিমা! তসলিমা ঘুমোচ্ছিস নাকি?
বেশ কয়েকবার ডাকলেন তিনি, কিন্তু তসলিমার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। মেয়ের কামরায় ঢুকলেন তিনি। বোতাম টিপে আলো জ্বাললেন। দেয়ালের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই অপ্রত্যাশিত ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে মাথা ঘুরে গেল তাঁর, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
করিডর থেকে আতিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হলো কি?
আজহার মল্লিক তখনও সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছেন শামিমের, মৃতদেহের দিকে। উপুড় হয়ে কার্পেটের উপর পড়ে আছে শামিম। তার পিঠে লম্বা একটা ছোরা আমূল বিদ্ধ। শামিম যে মরে গেছে দেহের স্থিরতা দেখেই বুঝতে পারলেন তিনি।
আতিয়ার গলা শোনা গেল আবার, বাবা?
সাংঘাতিক ব্যাপার। এখানে এসো না কেউ তোমরা। শামিম..শামিম…খুন হয়েছে শামিম! হায় আল্লা, এ কি বিপদ হলো আমার! আতিয়া, ফারুক কোথায়?
করিডরের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত থেকে ফারুক বলল, আসব, খালু?
ফারুক প্রায় ছুটতে ছুটতে এল। তসলিমার কামরায় ঢুকে আঁতকে উঠল সে, সর্বনাশ!
পরমুহূর্তে ফারুকের দৃষ্টি পড়ল তসলিমার খাটের উপর। মশারীর ভিতর লেপ গায়ে জড়িয়ে কে যেন শুয়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে উঠল ফারুকের। লাফ দিয়ে খাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দুহাত দিয়ে মশারীর ঝুলন্ত পর্দা চালের উপর তুলে দিল। তারপর লেপটা ধরে সবেগে মারল এক টান।
দেখা গেল লেপের নিচে তসলিমা নেই। তসলিমার জায়গায় লম্বা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে একটা কোল বালিশকে।
গম্ভীর মুখে ফারুক বলল, সেই পুরানো কৌশল।
আজহার মল্লিক বললেন, তসলিমা গেল কোথায়?
ফারুক চিন্তিতভাবে বলল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কথাটা বলে শামিমের নিঃসাড় দেহের কাছে গিয়ে বসল ফারুক। একটা হাত তুলে নিয়ে পালস দেখল। নিরাশ ভাবে এদিক ওদিক মাথা দোলাল সে। ছেড়ে দিল আস্তে করে হাতটা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ছোরাটা দেখছি আপনারই?
হারিয়ে ফেলেছিলাম ওটা। অনেক খুঁজেও পাইনি। কথাটা বলে আজহার মল্লিক ঝুঁকে পড়লেন মৃতদেহের দিকে, হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন ছোরাটা।
প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ফারুক তাকে, বলল, করেন কি, খালু! ওই ছোরাতে খুনীর হাতের ছাপ থাকতে পারে, ওতে হাত দেয়া মোটেই উচিত হবে না।
ওর পকেটে টাকা ছিল, দেখা দরকার আছে কিনা?
ফারুক বলল, তা দেখতে পারেন।
মৃতদেহের সামনে বসে প্যান্ট এবং শার্টের পকেট হাতড়ালেন আজহার মল্লিক। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, নেই!
ফারুকের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, সরাসরি তাকিয়ে রইল সে আজহার মল্লিকের দিকে। বলল, ওই টাকার জন্যেই শামিম সাহেব খুন হয়েছে। যে-কেউ এই সন্দেহ করবে।
আজহার মল্লিক কাঁপছেন। বললেন, তোমার খালা-আম্মা এবং আমি, আমরা দুজনেই প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনেছি। জানালা-দরজা ভাঙার শব্দ কিনা বলতে পারব না। দেখা দরকার…।
সবাই মিলে জানালা দরজা পরীক্ষা করল। সব ঠিক আছে, কোনটাই ভাঙা হয়নি। শুধু হলঘরের একটা জানালার শার্সি খোলা, ভেজানো অবস্থায় দেখা গেল।
তসলিমার কামরায় মৃতদেহের কাছে ফিরে এল আবার সবাই। আতিয়াও ঢুকল কামরায়। ফারুক বলল, দরজা-জানালা ভাঙা হয়নি। সুতরাং শব্দের কথা পুলিস বিশ্বাসই করবে না। হলঘরের জানালার শার্সি খোলা রয়েছে বটে, কিন্তু পুলিস বলবে, ওটা আপনারাই খুলেছেন বোকা বানাবার জন্যে। তাছাড়া, শার্সি খুললে অত জোরে শব্দ হয় না। শামিম সাহেবের কাছে টাকা ছিল। সে তত খুন হয়েছেই, তার পকেটের টাকাও সেই সাথে গায়েব হয়ে গেছে। পুলিস প্রথমেই সন্দেহ করবে এ বাড়িরই কেউ টাকার লোভে শামিম সাহেবকে খুন করেছে।
ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তসলিমার খাটের উপর বসে পড়লেন আজহার মল্লিক। বললেন, তবে কি পুলিস আমাকেই সন্দেহ করবে?
ফারুক বলল, তার ওপর পুলিস জানে, আপনার দশ হাজার টাকা খোয়া গেছে। সন্দেহ নয়, তারা ধরেই নৈবে আপনি ছাড়া এ অপরাধ আর কেউ করতে পারে না। এদিকে তসলিমার কামরায় তসলিমাও নেইকে জানে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে।
আজহার মল্লিক কঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, আমি এখন কি করব, বাবা!
পুলিসে খবর দিন। কিন্তু পরমুহূর্তে ফারুক আবার বলল, কিন্তু তা কি উচিত হবে?
উচিত হবে মানে?
মিসেস আজহার দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ সকলের কথা-বার্তা শুনছিলেন, এবার তিনি কামরার ভিতর ঢুকলেন, না, উচিত হবে না। পুলিসকে না জানিয়ে যা করার করতে হবে। পুলিসকে খবর দেয়া মানে…অসম্ভব! ধ্বংস হয়ে যাব আমরা সবাই! তসলিমার কামরায় শামিমের লাশ, পুলিস তসলিমাকেই আগে বেঁধে নিয়ে যাবে।
তাহলে সবকিছুর আগে লাশটাকে হলঘরে নামিয়ে নিয়ে যাই? প্রস্তাব দিলেন আজহার মল্লিক।
ফারুক বলল, সেটাও উচিত হবে বলে মনে করি না আমি। পুলিসের চোখে ধুলো দেয়া অত সহজ নয়। আমরা এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, যাই করি না কেন, কোথাও না কোথাও ভুল থাকবেই।
মিসেস আজহার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, এ কি হলো আল্লাহ! টাকা চুরি গেল, তার ওপর এই ভয়ঙ্কর বিপদ!
ফারুক ঝলল, টাকা চুরির সাথে এই খুনের একটা সম্পর্ক পুলিস পরিষ্কার দেখতে পাবে।
আতিয়া একটু বিরক্তির সাথে বলল, বারবার আপনি ওই একটা কথা বলবেন না। আপনি যা সন্দেহ করছেন তা সত্যি নয়। আমরা কেউ টাকার লোভে শামিমকে খুন করিনি।
ফারুক বলল, তুমি খামোকা আমার ওপর চটছ। আমি আমার কথা বলিনি। পুলিস কি ভাববে, কোন্ দৃষ্টিতে ঘটনাটাকে দেখবে তাই বলার চেষ্টা করছি।
আজহার মল্লিক বললেন, চক্রবর্তী লেনে ঢি ঢি পড়ে যাবে। আর কাউকে মুখ দেখাতে হবে না। কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিস যখন সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাবে…উহ্! তার চেয়ে এসো সবাই মিলে বিষ খেয়ে মরি।
মিসেস আজহারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন এই সময়।
আতিয়া ধমক দিয়ে বলল, আহ্! মা তুমি শান্ত হও। ফারুক সাহেব, আপনার এত মাথা ব্যথা কেন বলুন তো? পুলিস কি সন্দেহ করবে না করবে তা আপনি জানলেন কিভাবে আগে ভাগে? পুলিস যাই সন্দেহ করুক, একজন নিরপরাধ লোককে বিচারক শাস্তি দিতে পারেন না। কই, একথাটা তো একবারও বললেন না?
ফারুক বলল, বিচারক বিচার করবেন কিসের ভিত্তিতে? তাঁকে বাস্তব ঘটনা, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি জানাবেন, তিনি সে-সবের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে রায় দেবেন। বাস্তব ঘটনা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পূর্ণ আমাদের প্রতিকূলে, দুর্ভাগ্যক্রমে। বিচারকের রায় আমাদের বিরুদ্ধেই যাবে। আর নিরপরাধ লোকের শাস্তির কথা যদি বলেন, পৃথিবীতে ভুরি ভুরি ঘটেছে অমন, নিরপরাধ লোক জেল খেটেছে সারাজীবন, এমন কি ফাঁসিও হয়ে গেছে বহু লোকের।
আতিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল। খানিকপর সে বলল, একটা বিপদে পড়েছি আমরা, উনি কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিতে শুরু করলেন।
ফারুক বলল, এ ভারি আশ্চর্য কথা! তুমি অকারণে আমার ওপর এমন খেপে উঠলে কেন বুঝতে পারছি না।
আতিয়া খানিকটা সামলে নিল নিজেকে। তার কণ্ঠস্বরে রাগের চেয়ে অভিমানের মাত্রা বেশি ফুটল, বিপদটা কত বড় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার দরকার নেই। বিপদ থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি, সেটাই ভাবনা চিন্তার বিষয় হওয়া দরকার।
ফারুক বলল, আমিও তো তাই বলতে চাইছিলাম।
আজহার সাহেব বললেন, একটা উপায় বের করো না, বাবা…।
ফারুক খানিকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, বাইরে গাঢ় কুয়াশা। লোকজন নেই রাস্তায়। লাশটা আমরা এই পাড়ার শেষে যে মাঠ রয়েছে সেখানে ফেলে দিয়ে আসতে পারি। কাজটায় অসম্ভব ঝুঁকি আছে, ধরা পড়ে গেলে কেউ বাঁচব না। তবু এ ছাড়া আর কোন উপায়ের কথা তো আমার মাথায় আসছে না।
আতিয়া বলল, কেবল আপনার মুখ থেকেই এরকম একটা উপায়ের কথা আশা করা যায়। ভীষণ দুঃসাহসী আপনি, বোঝা গেল।
আমার সমালোচনা পরে কোরো, আতিয়া। এ বাড়ির লোকদের ওপর পুলিস যাতে সন্দেহের চোখে না তাকায় সে-রকম একটা উপায় আবিষ্কার করতে চাইছি আমি। পুলিসকে জানানো হবে, শামিম সাহেব এ বাড়িতে এসেছিলেন, কিন্তু আবার চলে যান তিনি। ফেরার পথে খুন হয়েছেন।
আমি রাজি নই। কাজটা অন্যায় হবে।
ফারুক রেগেমেগে বলল, তা ঠিক! তাহলে পুলিস ডাকো। সব কথা যা সত্যি গড়গড় করে বলে দাও।
মা, তুই চুপ করে থাকতো! ফারুক যা বলছে, আমারও সায় আছে তাতে। ওই একটাই উপায়, এই উপায়েই আমরা বাঁচার চেষ্টা করতে পারি।
বাবার কথার উপর আর কোন কথা বলল না আতিয়া।
ফারুক বলল, সেক্ষেত্রে সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।
আজহার মল্লিক স্ত্রীকে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওদের পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই আতিয়া চাপা কণ্ঠে জানতে চাইল, কেন খুন, করলেন শামিমকে?
সামনে ফণা তোলা কেউটে দেখলে মানুষ যেমন লাফিয়ে ওঠে, ফারুকও তেমনি লাফিয়ে উঠল, আঁ? কি বললে? আমি? আমি শামিম সাহেবকে…? আতিয়া, তোমার কি মাথার ঠিক নেই? ছোরাটা তোমার বাবার, আর তুমি বলছ আমি…।
ছোরাটা চুরি করা আপনার পক্ষে অসম্ভব নয়।
মোটিভ কি? শামিম সাহেবের টাকার ওপর আমার লোভ হবে কেন? টাকার তো কোন অভাব নেই আমার। ওকে আমি ভাল করে চিনিও না, ঈর্ষাও মোটিভ হতে পারে না।
আতিয়া বলল, মাটিভ আবিষ্কারের দায়িত্ব আমার নয়। আমি ভাবছি, লাশটাকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্যে এত আগ্রহ কেন আপনার।
সহজ জবাব আছে এর। আমিও তো এ বাড়িতে বাস করি। পুলিস এ বাড়িতে লাশ পেলে সকলের সাথে আমাকেও সন্দেহ করবে।
আতিয়া চাপা কণ্ঠে বলল, আপনি চমৎকার কৌশলে বাবাকে এবং মাকে নিজের প্রস্তাবে রাজি করালেন–এ আমি ভুলব না, মনে রাখবেন।
কথা কটা বলে আতিয়া বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
.
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল ওরা। একটা অয়েল কুথের উপর শাখা হলে প্রথমে মৃতদেহ, তারপর পরানো হলো তাকে কোট। পায়ে মোজাসহ জুতোও পরিয়ে দেয়া হলো। ফারুকের পরামর্শে আজহার মল্লিক ওভারকোট গায়ে দিলেন, মাথা এবং মুখের অধিকাংশ ঢাকলেন মাফলার দিয়ে, যাতে দেখলেই কেউ যেন চিনতে না পারে। ফারুকও ওভারকোট এবং মাফলার দিয়ে ঢেকে নিল নিজেকে। তারপর ধরাধরি করে নামানো হলো লাশ নিচে।
হলঘর এবং বাইরের আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। ফারুক বাগানের মাঝখান দিয়ে গেট পর্যন্ত গেল, ফিরে এসে বলল, এবার আমরা রওনা হতে পারি।
গেট পর্যন্ত ধরাধরি করে লাশ নিয়ে যাওয়া হলো। লাশ নামিয়ে গেট খুলল ফারুক অতি সন্তর্পণে। রাস্তার এদিক ওদিক দেখাই যায় না গাঢ় কুয়াশায়। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পরও কোন মানুষের সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
সাড়া-শব্দ পাওয়া না গেলেও বাড়ির অদূরে দাঁড়ানো লাইটপোস্টের আড়ালে একটা ছায়ামূর্তি হাজির আছে গত কঘণ্টা ধরে। কিন্তু সে খবর এদের জানার কথা নয়।
ছায়ামূর্তি অবশ্য গেট খোলার এবং আনুষঙ্গিক কিছু শব্দ ঠিকই শুনতে পেল।
রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল ওরা লাশ নিয়ে। শতিনেক গজ দূরে, মাঠটা। সেই মাঠে যাবার পথে ওরা কোন আকস্মিক বিপদের মুখোমুখি হলো না। মাঠের এক ধারে মৃতদেহ ফেলে দিয়ে ওরা নিরাপদেই ফিরে এল।
গেট দিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে ফারুক পকেট থেকে ছোরা বের করে বলল, খালু, এটা রাখুন। লাশের পিঠ থেকে বের করে নিয়েছি। এ ছোরা যদি পুলিস দেখত লাশের পিঠে…! আপনার কাছেই রাখুন।
ছোরাটা নিয়ে আজহার মল্লিক স্বস্তির দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, যাক, বাঁচা গেল! এখন প্রশ্ন হলো, তসলিমা গেল কোথায়?
সেই সময় শোনা গেল সদর গেট খোলার শব্দ।
ওই যেন কে আসছে!
খানিকপর হলঘরে ঢুকল তসলিমা। তার কাপড়-চোপড়ের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলো সবাই। শাড়ি ছিঁড়ে গেছে বেশ কজায়গায়। হাতে সাদা দাগ, সম্ভবত হোয়াইট ওয়াশের।
আতিয়া তোমাকে আজ রাতে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিল। তবু কেন গেলে? প্রশ্ন করলেন আজহার মল্লিক।
তসলিমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কোন উত্তর দিল না।
শাড়ি ছেঁড়া কেন? জানতে চাইলেন মিসেস আজহার।
নিচু গলায় জবাব দিল তসলিমা, প্রিন্স অ্যান্ড প্রিন্সেস ক্লাবে ছিলাম, পুলিস হানা দিয়েছিল ওখানে, জানালা গলে পালাতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে।
ওই ক্লাবে কেন গিয়েছিলে? কোন ভদ্রলোকের মেয়ে ওখানে যায়? শুনেছি গুণ্ডা বদমাশদের আড্ডা ওটা।
তসলিমা উত্তর দিল না।
কার সাথে গিয়েছিলি?
এমদাদের সাথে।
আজহার মল্লিক বললেন, কেমন লোক সে? একটা যুবতী মেয়েকে নিয়ে সে ওখানে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত থাকে কি করে?
মিসেস আজহার জানতে চাইলেন, ফিরলে কিভাবে?
বাইরে এমদাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা নিয়ে চলে এসেছি আমি। গাড়িটাকে ওই ফাঁকা মাঠে রেখে এইটুকু হেঁটে এসেছি। আমার মাথা ঘুরছে, শুতে যাচ্ছি।
পা বাড়াল তসলিমা সিঁড়ির দিকে।
দাঁড়া! আতিয়া কঠিন সুরে বলল।
দাঁড়িয়ে পড়ল তসলিমা।
শামিম তোর কামরায় গিয়েছিল কেন?
তসলিমা ভুরু কুঁচকে বলল, কি?
যায়নি বলতে চাস?
তসলিমা হঠাৎ একটু হাসল, বলল, নাটক থাক না! যা বলবার খুলে বল। শামিম আমার কামরায় যায়নি…কিন্তু কোথায় সে? তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো! সে যখন এখানে তোমাদের সাথে গল্প করছে, আমি তখন পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাই।
কটা বেজেছিল তখন?
এগারোটা, সাড়ে এগারোটা। কিন্তু এত প্রশ্ন করা হচ্ছে কেন আমাকে?
তসলিমার প্রশ্নের উত্তরে কেউ কিছু বলতে পারল না।
সবাইকে ইতস্তত করতে দেখে এতক্ষণে ফারুক কথা বলল, শামিম সাহেবকে তোমার কামরায় নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে, তসলিমা।
কি? না…! পড়ে যাচ্ছিল তসলিমা, কোন মতে তাল সামলে বসে পড়ল একটা চেয়ারে, আমার কামরায়…শামিম মরে গেছে।
ফারুক বলল, হ্যাঁ। প্রশ্ন হলো, কেন তিনি তোমার কামরায় ঢুকেছিলেন?
জানি না তো! কিন্তু…আপনারা এ কি বলছেন? সত্যিই কি শামিম…?
হ্যাঁ।
তসলিমা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ফারুকের দিকে। ফারুক বলল, চিন্তা কোরো না। পুলিস যাতে হত্যাকাণ্ডের সাথে এ বাড়ির কাউকে জড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা করে সব জানানো হলো তসলিমাকে।
ফারুক বলল, চলো, তোমার কামরা থেকে কিছু হারিয়েছে কিনা দেখবে চলো।
রাজি হলো না তসলিমা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। কামরার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে দেখল সে। কিছুই চুরি যায়নি, বলল। কিন্তু তার হ্যান্ডব্যাগে পাশের বাড়ির জাহাঙ্গীর হোসেনের লেখা যে চিঠিটা ছিল সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।
টেবিলে খোলা অবস্থায় হ্যান্ডব্যাগটা দেখে বলল, এটা এখানে ছিলই না। ছিল ওই হুকে ঝোলানো।
ফারুক বলল, ভুল করে অন্য কোথাও রেখেছ হয়তো চিঠিটা। ছেঁড়া একটা চিঠি, কেন কেউ চুরি করবে?
ও কি? তসলিমা কার্পেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল এক পা।
রক্তের দাগ। পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে হবে।
আতিয়া কামরার ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, কার্পেট ফুটো হয়ে যাবে কিন্তু!
ফারুক বলল, উপায় কি? কেউ জিজ্ঞেস করলে বললেই হবে যে কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করতে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল।
তসলিমা বলল, আপা, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কোথায় শোব?
ফারুক বলল, লাইব্রেরী রূমে গিয়ে শুয়ে পড়ো।
কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ল তসলিমা। ফারুক এবং আতিয়াও বের হলো। তসলিমা বলল, ফারুক ভাই, আপনাকে একটা উপকার করতে হবে কাল সকালে।
কি?
তসলিমা বলল, আমি এমদাদের গাড়িটা রেখে এসেছি মাঠের এক ধারে। তাকে ফোন করে বলে দিতে হবে, গাড়িটা যেন সে এসে নিয়ে যায়। ফোন নাম্বার লিখে নিন…।
ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে ফারুক বলল, কোন্ মাঠে রেখে এসেছ? জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে না?
আমাদের এই পাড়ার শেষ মাথায় যে মাঠ, সেখানে।
আঁ! করেছ কি তুমি? ইশ, শেষ রক্ষা বুঝি আর করা গেল না!
.
০৫.
চক্রবর্তী লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়িতে হত্যাকাণ্ড ঘটে রাত্রে, সেই একই দিনের বেলা এগারোটার ঘটনা।
তীর বেগে ছুটছিল রাজপথ ধরে ঝকঝকে একখানা মার্সিডিজ গাড়ি। ড্রাইভারের সীটে বসে ছিল সুদর্শন, সুপুরুষ এক দীর্ঘকায় যুবক। ক্লিনশেভন, কমপ্লিট স্যুট পরিহিত, চোখে সানগ্লাস, হুইল ধরা বাঁ হাতে দামী, সুগন্ধী হাভানা চুরুট।
মি. সিম্পসনকে যদি কেউ হলপ করেও বলে দিত ওই যুবকই স্বয়ং কুয়াশা, তিনি মুহূর্তের জন্যেও কথাটা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু আসলে যুবকের পরিচয়, সে ছদ্মবেশী কুয়াশা।
তার পাশে বসে ছিল এক ইরানী প্রৌঢ়। পরনে ছিল ঢিলেঢালা শেরওয়ানী, মাথায় লম্বা কারুকার্য খচিত পাগড়ী, পায়ে টেকনিকালার নাগরা। ইনি আর কেউ নন, আমাদের মি. স্যানন ডি. কস্টা, কুয়াশার অন্ধ ভক্ত।
মার্সিডিজ ঝড়ের বেগে ছুটছিল। ভয়ে আধ মরা হয়ে কুঁকড়ে বসেছিল ডি. কস্টা পাশের সীটে। মাথা নিচু করে বিড় বিড় করে যীশুকে ডাকছিল সে প্রতি সেকেণ্ডে বার পাঁচেক করে, মাঝেমধ্যে মাথা তুলে দেখে নিচ্ছিল, অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতে আর কত দেরি।
এমন সময় কুয়াশা কি দেখে সজোরে ব্রেক কষায় তীক্ষ্ণ, প্রায় কান ফাটানো শব্দ উঠল চাকার সাথে কংক্রিটের ঘর্ষণে। পরমুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রকাও গাড়িটা।
মি. ডি. কস্টা, রাস্তার ডান দিকে তাকান।
শান্ত কিন্তু ভারি গলায় বলল কুয়াশা। নির্দেশ পাওয়া মাত্র যীশুর নাম ভুলে গেল ডি কস্টা, মাথা উঁচু করে তাকাল রাস্তার ডান দিকে।
সাদা স্যুট পরে ওই যে লোকটা হেঁটে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন?
ইয়েস বস!
গাড়ি থেকে নেমে লোকটাকে ফলো করুন। সাবধান, ও যেন টের না পায় আপনি ওকে অনুসরণ করছেন।
টাহার পর কি করিটে হইবে বলুন। লোকটার ঘাড় ঢারিয়া হিড় হিড় করিয়া টানিয়া আনিব হাপনার কাছে?
কুয়াশার হাসি পেলেও হাসল না সে। বলল, তার দরকার নেই। দেখবেন, মারপিট করতে যাবেন না। আপনি শুধু ওর পিছু পিছু গিয়ে দেখে আসবেন কোথায় থাকে ও।
ও. কে. বস্!
গাড়ি থেকে ক্যাঙারুর মত লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পাটখড়ির মত রোগা স্যানন ডি. কস্টা। গজ তিনেক এগিয়ে পিছন ফিরল সে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে ভোজবাজির মত।
মনে মনে গর্ব বোধ করল ডি. কস্টা। এতদিন সে যা অনুমান করে এসেছে সেটাই ঠিক, আজ তা নতুন করে আরও একবার প্রমাণিত, হলো। তার ধারণা, কুয়াশা আশ্চর্য যাদু জানে। তার ধারণা যে সত্য, প্রমাণ হয়ে গেল আজ আবার। আশ্চর্য যাদুকরের সহকারী সে, এটা কি কম সৌভাগ্যের কথা তার কাছে।
সাদা স্যুট পরা লোকটাকে অনুসরণ করতে করতে বার বার ডি. কস্টা পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল, যাদুকর মি. কুয়াশাকে হঠাৎ সে ঠিক তার পিছনে দেখতে পাবে এই আশায়। বসের সান্নিধ্য বড় প্রিয় তার। বস্ কাছে না থাকলে পৃথিবীটাকে জনহীন, নির্জীব, প্রতিকূল বলে মনে হয় তার।
.
সেদিনই সন্ধ্যার পর রিপোর্ট দিল ডি. কস্টা, বস্ লোকটা চক্রবর্টী লেনের পঁচিশ নাম্বার হাউজে ঠাকে। হামি টাহাকে ওই হাউজে ঢুকিটে ডেকিয়াছি।
কুয়াশা গাড়ি নিয়ে রওনা হচ্ছিল কোথাও, স্টার্ট দিয়ে বলল, ঠিক আছে। ঠিকানাটা দিয়ে শহীদকে আপনি আমার নাম করে বলবে, লোকটা এবং লোকটার বাড়ির দিকে যেন নজর রাখে ও।
স্যালুট করল ডি. কস্টা, ইয়েস বস্?।
সা করে বেরিয়ে গেল কুয়াশার গাড়ি। ডি. কস্টাও শিস দিতে দিতে আস্তানা থেকে বেরোল। গন্তব্যস্থান প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের বাড়ি।
শহরের শোভা, আলোকমালা, যানবাহন ইত্যাদি দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে, এক টাকার ভাজা চিনাবাদাম কিনে খেতে খেতে রাত আটটার সময় সে পৌঁছল শহীদের বাড়িতে। কিন্তু শহীদ তখন বাড়িতে নেই, গেছে কোন ক্লাবে টেনিস খেলতে। কামাল ছিল, গল্প করছিল সে লীনার সাথে।
ড্রয়িংরূমে ঢুকে কামাল এবং লীনাকে দেখে জিভ বের করে দাঁতে কামড় দিল, ঝট করে পিছিয়ে এসে সরে দাঁড়াল দরজার আড়ালে। কামালের সাথে লীনার প্রেম চলছে বহুদিন ধরে, জানে ডি. কস্টা। ওদেরকে এক সাথে বসে গল্প করতে দেখে ঠাট্টা মস্করা করার বুদ্ধিটা হঠাৎ খেলে গেছে তার মাথায়।
কামাল এবং লীনা ডি. কস্টার আচরণ দেখে কামরার ভিতর থেকে হো হো করে হেসে উঠল। কামাল বলল, মি. ডি. কস্টা, পালিয়ে গেলেন কেন, আসুন, ভিতরে ঢুকুন।
দরজার আড়াল থেকে ডি. কস্টা নিচু গলায় বলল, নো-নো! আপনারা প্রেমালাপ চালাইয়া যান, হামি এইখানে ওয়েট করি। হাপনাডের প্রেমালাপ খটম হইলে সিগন্যাল ডিবেন, টখন হামি ভিটরে ইন করিব।
কামাল হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল করিডরে। ডি. কস্টার একটা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল সে ড্রয়িংরুমের ভিতরে, ওসব কৌশলে কাজ হবে না, বুঝলেন? ভেবেছিলেন লজ্জায় ফেলে নাকানি চোবানি খাওয়াবেন, না? বলুন, কি জন্যে আগমন সাহেবের?
কামাল সাহেব বলায় বেজায় খুশি হলো ডি. কস্টা। টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে ভারিক্কি চালে সে বলল, মি. শহীড খানকে ডেকিটেছি না যে?
ও গেছে ক্লাবে টেনিস খেলতে।
ফিরিবেন কখন?
দশটা-এগারোটার আগে নয়। কেন, কোন খবর আছে নাকি?
ডি. কস্টা বলল, ইয়েস, নিউজ আছে।
আমাকে বলুন।
ডি. কস্টা হাসল। প্যান্টের দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে দুলতে দুলতে বলল, নো। হামার বুজম ফ্রেন্ড মি. কুয়াশা নিউজটা, আই মীন ইনফরমেশনটা, মি. শহীড খানকে ডিটে বলিয়াছেন।
কামাল বলল, তাহলে ফোন করুন ওকে।
ডি. কস্টা বলল, ফোনে সব নিউজ কি ডেয়া যায়? অলরাইট, হামি চলিলাম, পরে ডেকা করিব। মি. কামাল, হাপনাডেরকে এইভাবে বিরক্ট করাটে হামি দুঃখিট।
কামাল বলল, না-না, বিরক্ত করলেন কোথায়? আবার আসবেন, কেমন?
সট্টি, সিরিয়াসলি বলিটেছি, হামি ডুঃখিট। প্রেমালাপ পবিট্র জিনিস, কাহারও উচিট নয় বিরক্ট করা।
কামাল বলল, কি আশ্চর্য! আপনি…।
ডোহাই আপনাডের, হামাকে ক্ষমা করিয়া ডিবেন। সট্টি হামি ডুঃখিট।
বলতে বলতে ডি. কস্টা ড্রয়িংরূম ত্যাগ করল।
শহীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের ওভারকোটটা গায়ে চড়াল ডি. কস্টা। শীত তবু বাধা মানে না। হাঁটতে হাঁটতে পকেটের টাকা-পয়সার একটা হিসেব করে নিল মনে মনে। একুশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা মাত্র আছে। কোন বারে ঢুকে বিদেশী মদ্য পান করা সম্ভব নয়। এদিকে, শীতকে ঠেকাতে হলে পান না করলেও নয়। অগত্যা দেশী মদ খাবার সিদ্ধান্ত নিল সে।
পরিচিত এক আড্ডায় গিয়ে সেখানে ঘণ্টা দেড়েক কাটাল ডি. কস্টা। দেড় বোতল পান করার পর গা গরম হয়ে উঠল তার। আড্ডা থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরল চক্রবর্তী লেনের দিকে।
শহীদকে না পেয়ে কুয়াশারু নির্দেশ নিজেই পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। চক্রবর্তী লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়িটা এবং সেই সাদা স্যুট পরা লোকটার উপর নজর রাখবে সে আজ রাতে।
সোয়া এগারোটা কি সাড়ে এগারোটার সময় চক্রবর্তী লেনে পৌঁছল ডি. কস্টা। কুয়াশা ইতোমধ্যে আরও গাঢ় হয়েছে, একহাত দূরের জিনিসও ভাল দেখা যায় না।
পঁচিশ এবং চব্বিশ নম্বর বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় একটা বাতিহীন লাইটপোস্ট, ডি. কস্টা সেই লাইটপোস্টের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নির্জন, নিস্তব্ধ রাত্রি। পৃথিবীটা আছে কি নেই, বোঝবার উপায় নেই কোন। একটা কুকুরও কোথাও থেকে ডেকে উঠছে না। ঝিঁঝি পোকারাও মৌনতা অবলম্বন করেছে।
রাত তখন কটা, জানে না ডি. কস্টা। পঁচিশ নম্বর বাড়ির ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল। কেউ যেন সজোরে বন্ধ বা উন্মুক্ত করল দরজার কবাট। তারপর নিস্তব্ধতা। একে একে কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর মানুষের গলার অস্পষ্ট আওয়াজ কানে ঢুকল তার। পঁচিশ নম্বর বাড়ির লোকজন জেগে উঠেছে। আলো জ্বলল দোতলার কয়েকটা কামরায়।
পঁচিশ নম্বর বাড়িটা রহস্যময় বাড়ি। ভাবল ডি. কস্টা। সাদা স্যুট পরা লোকটাকে সে এই বাড়িতেই ঢুকতে দেখেছে। বস্ তাকে বলেনি বটে লোকটা কে, কি তার পরিচয়–কিন্তু লোকটা যে খুব সুবিধের নয় তা তার মুখের চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল ডি. কস্টা।
সময় বয়ে চলল। সেই সাথে শীতের প্রকোপও বাড়ছে। মিনিট বিশেক পর গেট খোলার শব্দে চমকে উঠল ডি. কস্টা। কিছু একটা রহস্যময় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এবার, ভাবল সে। রাত দুপুরে গেট খুলছে। কেন?
লাইটপোস্টের আড়াল থেকে কুয়াশা ভেদ করে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পঁচিশ নম্বর বাড়ির গেটের দিকে। অস্পষ্ট ভাবে হলেও, সে যেন দেখল গেটের ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে কে যেন রাস্তার এদিক ওদিক দেখছে। একবার মনে হলো চোখের ভুল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, না, ওই তো সরিয়ে নিল মাথাটা, এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
আরও কমুহূর্ত পর চাপা কণ্ঠস্বর কানে এল ডি. কস্টার। প্রায় সাথে সাথে দেখল, পঁচিশ নম্বর বাড়ির ভিতর থেকে দুটো অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। ছায়ামূর্তিদ্বয় ধরাধরি করে কিছু একটা নিয়ে যাচ্ছে কিনা ঠিক বুঝতে পারল না ডি. কস্টা। সে ছায়ামূর্তিদ্বয়কেই আবছাভাবে দেখতে পেল শুধু।
গলির দক্ষিণ প্রান্তের দিকে চলে যাচ্ছে ছায়ামূর্তিরা। ডি কস্টা পিছু নেবার জন্যে পা বাড়াবে, এমনি সময় পিছন থেকে লোহার মত শক্ত একটা হাত তার ঘাড় চেপে ধরল, এই মিয়া! কে তুমি? রাত দুপুরে এখানে কি করছ?
ডি. কস্টা দুহাত দিয়ে ঘাড় মুক্ত করার চেষ্টা করতে করতে মিহি, যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে ককাতে আরম্ভ করল, মরিয়া গেলাম। ছাড়িয়া ডিন। মরিয়া গেলাম! ছাড়িয়া…!
হাতটা ডি. কস্টার ঘাড় ছাড়ল না, তবে একটু শিথিল করল আঙুলগুলো। পিছন থেকে কর্কশ স্বরে বলল, কে তুমি?
কুয়াশার পরিচয়ে পরিচয় দিলে, লোকটা যদি পুলিস হয়, নানা ঝামেলা বাধাবে তাকে নিয়ে। এই ভেবে ডি. কস্টা বলল, হামি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীড খানের অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভাল চাও টো ছাড়িয়া ডাও আমাকে। টুমি কে? এটো রাটে টুমি এখানে কি করিটে আসিয়াছ?
পিছন থেকে লোকটা হাসল একটু। বলল, আমি পুলিস। টহল দিচ্ছি। চলো, থানায় যেতে হবে তোমাকে।
হোয়াট? হামি মি. শহীড খানের…
লোকটা ধাক্কা দিয়ে গলির উত্তর প্রান্তের দিকে ঠেলে নিয়ে চলল ডি. কস্টাকে, ওসব ধাপ্পাবাজি ছাড়ো! থানায় গিয়ে প্রমাণ করতে হবে তুমি রাজা-মহারাজা, নাকি চোর-ছেঁচড়।
পঁচিশ নম্বর বাড়ি থেকে যে ছায়ামূর্তিদ্বয় বেরিয়েছিল তারা গেছে দক্ষিণ দিকে, লোকটা ডি. কস্টাকে নিয়ে চলেছে উত্তর দিকে। সুতরাং ছায়ামূর্তিদ্বয়কে অনুসরণ করার সুযোগটা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেল।
গলির শেষ প্রান্তে এসে লোকটা ঝুঁকে পড়ে ডি. কস্টার উরু জড়িয়ে ধরল একহাতে, অপর হাতটা তখনও ঘাড় ধরে আছে। ডি. কস্টাকে সজোরে ছুঁড়ে দিল লোকটা। কামানের মুখ থেকে নিক্ষিপ্তগোলার মত শূন্যে উঠে গেল ডি কস্টা। যীশুকে যে ডাকবে, লোকটা, সে সময়ও দিল না তাকে।
ঝপাৎ করে শব্দ হলো। সাথে সাথে ডি. কস্টা অনুভব করল, বরফের মত ঠাণ্ডা পানি তাকে কামড়াচ্ছে নির্মমভাবে।
ভাগ্য ভাল, ডোবাটায় পানির গভীরতা ছিল না। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কোনরকমে ডাঙায় উঠল ডি কস্টা। এদিক ওদিক তাকিয়ে লোকটাকে সে দেখতে পেল না কোথাও। ভিজে কাপড়ে হাঁটা ধরল সে।
হাঁটতে হাঁটতে কয়েক মাইল অতিক্রম করার পর ডি কস্টা হঠাৎ দাঁড়াল। এ কি করছে সে? দিক নির্ণয় না করে বোকার মত এতক্ষণ হেঁটে এ কোথায় পৌঁছেছে সে?
এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তার কোথাও কোন মানুষজনের চিহ্ন দেখতে পেল না সে। রাস্তাটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। কোনদিন সে আসেনি এদিকে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্তব্য কি ঠিক করার চেষ্টা করল ডি. কস্টা। বস্ বলেছিলেন মি. শহীদকে খবর দিতে। তা সে দেয়নি, দিলে এই খারাবিটা ভোগ করত মি.শহীদই। অপরদিকে, যা ঘটে গেছে, বসকেও বলা চলবে না। বললে তিনি জানতে চাইবেন, আপনি কেন গিয়েছিলেন চক্রবর্তী লেনে, আপনাকে তো আমি যেতে বলিনি?
মাথায় একটা বুদ্ধি এল। টেলিফোনের তার রয়েছে মাথার উপর। সেই তার অনুসরণ করে হাঁটা ধরল সে। খানিকদূর যেতেই একটা খাম্বা দেখতে পেল সে। খাম্বা থেকে তার চলে গেছে একটা বাড়ির ভিতর। বাড়িটায় টেলিফোন আছে। ডি. কস্টা বাড়িটার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলের বোতামটা চেপে ধরল তর্জনী দিয়ে।
.
রাত্রি তিনটের দিকে ক্রিং ক্রিং শব্দে ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। লেপের ভিতর থেকে হাত বের করে টেলিফোনের রিসিভারটা কানে ঠেকাতেই শহীদ শুনতে পেল দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাবার একটানা শব্দ। তারপর কাঁপা কণ্ঠস্বর কানে ঢুকল ডি. কস্টার, মি. শহীড, হামি মস্ট এক বিপডে পড়িয়াছি। ডশ মিনিটের মঢ্যে যডি এক বোটল ব্র্যান্ডি না খাওয়াইটে পারেন, হামাকে আর লাইফে ডেকিটে পাইবেন না…!
হয়েছে কি? কোত্থেকে বলছেন আপনি?
সবিস্তারে সকল ঘটনা ব্যাখ্যা করল ডি. কস্টা। কোত্থেকে ফোন করছে তাও বলল।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। আপনি বাড়িটার গেটের কাছে অপেক্ষা করুন। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিল শহীদ। মহুয়াকে ঘুম থেকে জাগাল না ও। লেবুকে গেট বন্ধ করে দিতে বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
ন মিনিটের মাথায় ডি. কস্টার সামনে থামল শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেন। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ডি. কস্টা এগিয়ে এল। শহীদ দরজা খুলে দিতে উঠে বসল সে, হাত পাতল সাথে সাথে, ব্র্যান্ডির বোটল ডিন।
ব্র্যান্ডির একটা শিশি বের করে দিল শহীদ কোটের পকেট থেকে। ডি. কস্টা ছিপি খুলে কয়েক ঢোকে নিঃশেষ করল সেটা। শহীদ হাত বাড়িয়ে ব্যাক সীট থেকে একটা মোটা উলেন কম্বল তুলে নিল, সেটা ডি. কস্টার কোলের উপর ফেলে দিয়ে বলল, ভিজে কাপড় ছেড়ে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন।
ডি. কস্টা তাই করল। ইতোমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে শহীদ, একে একে প্রশ্ন করে যা যা ঘটেছে সব নতুন করে আর একবার জেনে নিল শহীদ। সব শুনে নিয়ে বলল, রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। চলুন দেখা যাক, পঁচিশ নম্বর চক্রবর্তী লেনে রহস্যের কোন খোরাক পাওয়া যায় কিনা।
.
০৬.
ফোক্সওয়াগেন ছুটছে। ডি. কস্টা আঙুল দিয়ে দেখাল, ওই যে মাঠটা ডেকিটে পাইটেছেন, উহার সাইড ডিয়া একটি রোড চলিয়া গিয়াছে। ওই রোড হইটে একটা গলিটে ঢুকিটে হইবে, ওই গলিটাই চক্রবট লেন।
মাঠের পাশে রাস্তা। কুয়াশায় চারদিক ঢাকা বলে সামনের দৃশ্য ভাল দেখা যায় না। চক্রবর্তী লেনের কাছাকাছি পৌঁছল গাড়ি। শহীদ দেখল মাঠের ভিতর রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে একটা পুরানো মডেলের অস্টিন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভেতরটা দেখছে উঁকি দিয়ে একজন খাকী ইউনিফর্ম পরা পুলিস কনস্টেবল।
কৌতূহল জাগল ওর মনে। গাড়ি থামাল তাই। নেমে পড়ল দ্রুত। কনস্টেবলের দিকে এগোতে এগোতে জানতে চাইল, কি ব্যাপার?
ঘাড় ফিরিয়ে শহীদকে দেখল কনস্টেবল, চিনতে পেরে সালাম করল সসম্মানে, বলল, স্যার কি খবর পেয়ে এসেছেন?
কিসের খবর?
কনস্টেবলটি বলল, টহল দিয়ে ফিরছিলাম, এমন সময় দেখি একটা ঠেলাগাড়ি শাকসজী নিয়ে বাজারের দিকে যেতে যেতে উল্টে গেল। কাছে এসে দেখি এই অস্টিনের সাথে ধাক্কা লেগে উল্টে গেছে। ধরাধরি করে ঠেলাগাড়িটাকে সিধে করে শাকসজী তুলে নিয়ে চলে গেল সেটা। অস্টিনটা কেউ ফেলে রেখে গেছে, নম্বরটা নেবার জন্যে পিছনে আসতেই ডান পাশে দেখি…ওই দেখুন না!
সকাল হলেও কুয়াশা তখনও দূর হয়নি। দুপা এগিয়ে ঝুঁকে পড়ল শহীদ, দেখুল লম্বা হয়ে পড়ে রয়েছে একটা লোক। পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালতেই পরিষ্কার দেখা গেল।
লাশটার পাশে বসে পরীক্ষা করল শহীদ। ক্ষতস্থান দেখল।
অনেকক্ষণ হলো, মারা গেছে। কেউ খুন করেছে লোকটাকে। ছোরা দিয়ে খুন করা হয়েছে।
এদিক ওদিক তাকাল শহীদ, টর্চের আলো ফেলে তারপর আবার বলল, ছোরাটা দেখছি না, খুনী সেটা নিয়ে গেছে সাথে করে। কনস্টেবল, চেনো নাকি ভদ্রলোককে?
কনস্টেবল বলল, চিনি না, তবে আজ রাতেই একে আমি দেখেছিলাম, স্যার। চক্রবর্তী লেনের মিস তসলিমার সাথে ফিরছিলেন।
কোথায় ফিরছিলেন?
মিস তসলিমাদের বাড়িতে। পঁচিশ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম আমি। রাত তখন নটার মত হবে, সঠিক সময় বলতে পারব না।
শহীদ প্রশ্ন করল, এই এলাকার লোক নন ইনি, হলে তুমি চিনতে, তাই না?
জী, স্যার। উনি এই এলাকার লোক না। স্যার, আমি যখন দেখি, ভদ্রলোকের গায়ে একটা ওভারকোট ছিল।
ভাল করে মনে করে দেখো।
কনস্টেবল বলল, পরিষ্কার মনে আছে আমার, স্যার।
শহীদ মৃতদেহের গায়ের কোটের পকেটগুলো সার্চ করল। একটা নোটবুক পাওয়া গেল শুধু। তাতে নাম-ঠিকানাও মিলল।
নাম, শামিম কবির। ঠিকানা-নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণপাড়া। এ লোক চক্রবর্তী লেনে কেন এসেছিল জানতে হবে। আর গাড়িটা-কার হতে পারে?
কনস্টেবল বলল, যিনি খুন হয়েছেন গাড়ি তার হতে পারে।
শহীদ মাথা দোলাল, না, তা হতে পারে না। এ গাড়ি অন্য কেউ রেখে গেছে এখানে।
কনস্টেবল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে শহীদ বলল, কিভাবে জানলাম? খুঁটিয়ে দেখো, তুমি বুঝতে পারবে। লাশের নিচের মাটি দেখো, ভিজে নয়। বৃষ্টি হয়েছে মাঝরাতের দিকে, জানো তো? কি প্রমাণ হলো? লাশটা এখানে আনার পর বৃষ্টি হয়েছে। আর গাড়ির চাকার দাগ দেখো, কাদার উপর দাগ রয়েছে। গাড়ির নিচেটাও দেখতে পারো, মাটি ভিজে। লাশ এখানে রেখে যাবার অনেক পরে গাড়িটা কেউ রেখে গেছে এখানে। সে যাক, তুমি থানায় ফোন করো এখুনি। ততক্ষণ আমরা আছি এখানে।
কনস্টেবল দ্রুত চলে গেল। ডি কস্টা গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ একপাশে। এবার সে মুখ খুলল, হাপনি কয়েকবার বলিলেন ডেড বডিটাকে এখানে নিয়া আসিয়া ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছে–ইহার কারণ? লোকটাকে টো এইখানেও হট্যা করা হইয়া ঠাকিটে পারে?
পারে না। অনেকগুলো জিনিস দেখে বলছি একথা। যেমন, ধরুন, ওভারকোটের কথাটা। কনস্টেবল ভদ্রলোককে যখন দেখেছিল তখন এর গায়ে ওভারকোট ছিল, অথচ এখন নেই। এমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কেউ যদি বাড়ি থেকে বেরোয়, ওভারকোট থাকা সত্ত্বেও গায়ে না দেবার কারণ কি? আমার অনুমান, বাড়ির ভিতর খুন করা হয়েছে শামিম সাহেবকে। তিনি যখন খুন হয়েছেন তখন তার গায়ে ওভারকোট ছিল না। খুনী তাই লাশটা বাইরে আনার সময় লাশের গায়ে ওভারকোট চড়ায়নি। কারণ, ওভারকোটে ছোরা বিধবার ফুটো নেই।
ডি কস্টা বলল, বাট, মার্ডারার কি ছোরা ডিয়া ওভারকোট ফুঁ টা করিটে পারিট না?
খুনী অত্যন্ত ধূর্ত বলে আমার বিশ্বাস, মি. ডি. কস্টা। তার জানা আছে, লাশ নিয়ে এক্সপার্টরা নাড়াচাড়া করবে। যেখানে কোটে ফুটো, হয়েছে ঠিক সেই জায়গা বরাবর ওভারকোটে ফুটো করা অত সহজ নয়, তা করতে গেলে বিশেষজ্ঞদের চোখে ত্রুটি ধরা পড়ে যাবে মনে করে সে ঝুঁকিটা নেয়নি।
মি. শহীড, হাপনার কি ঢারণা মি. শামিম পঁচিশ নাম্বার চক্রবটী লেনে মার্ডার হইয়াছেন?
সন্দেহ তো তাই হচ্ছে। আপনি গভীর রাতে ওই বাড়ির লোকজনদের জেগে উঠতে দেখেছেন। ওই বাড়ি থেকেই অত রাতে দুটো ছায়ামূর্তি বাইরে বেরোয়। কিন্তু, আমি ভাবছি, পিছন থেকে যে লোকটা আপনাকে অনুসরণে বাধা দিল, সে কে? এই তৃতীয় লোকটা দেখছি একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কেন?
শহীদ বলল, লোকটা নিশ্চয়ই পঁচিশ নম্বর বাড়ি থেকে বেরোয়নি। তা যদি বেরুত, আপনি শব্দ শুনতেন গেট খোলার, তাকে দেখতেও পেতেন। ফোন করে ওই বাড়ির কেউ যে লোকটাকে নিযুক্ত করবে আপনাকে শায়েস্তা করার জন্যে, তাও সম্ভব নয়। কারণ, আপনিই বলেছেন, পঁচিশ নম্বরে ফোন নেই। লোকটা কারও কাছ থেকে কোন সংবাদ বা অনুরোধ পেয়ে নয়, স্বেচ্ছায় আপনাকে বাধা দিয়েছে অনুসরণে। মনে হচ্ছে, পঁচিশ নম্বর বাড়ির লোকদের শুভাকাঙ্ক্ষী সে। কিন্তু লোকটা জানল কিভাবে পঁচিশ নম্বর বাড়িতে কোনরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে বা একটা লাশ সরাবার চেষ্টা করছে বাড়ির লোকেরা? এখানেই হলো সমস্যা।
ডি. কস্টা কি যেন বলল। কিন্তু শহীদ অন্যমনস্কভাবে পরিত্যক্ত অস্টিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচু হয়ে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল গাড়িটার ভিতরে। ডি কস্টা ওর পাশে এসে দাঁড়াল। ব্যাক সীটে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ পড়ে রয়েছে, দেখল শহীদ।
খানিকপর ড্রাইভিং সীটের পিঠ থেকে দুআঙুলের নখ দিয়ে কিছু একটা ধরে মাথা বের করে সিধে হয়ে পঁড়াল ও।
কি বলুন তো এটা?
চুল। লম্বা ডেকিয়া বলা যায় ইহা কোন নারীর কেশ।
শহীদ বলল, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। গাড়িটা কোন মেয়ে চালিয়ে নিয়ে এসেছিল এখানে। প্রমাণ আরও আছে। কাদার দিকে তাকান। মেয়েদের হাই হিল জুতোর এক জোড়া দাগ চলে গেছে, ওই দেখুন, রাস্তার দিকে।
ডি. কস্টা দেখল। মাথা দুলিয়ে বলল সে, মার্ডারার যেই হোক, হামাডের হাটে টাহার খারাবি আছে ডেকা যাইটেছে।
কনস্টেবল ফিরে এল, ইন্সপেক্টর হায়দার আলী জীপ নিয়ে আসছেন, স্যার।
শহীদ বলল, আমরা এখন যাব। পরে কথা বলব আমি তোমাদের বড় কর্তার সাথে।
কনস্টেবল সালাম করে বিদায় নিল।
গাড়িতে চড়ে শহীদকে প্রশ্ন করল ডি. কস্টা, এখন কোন্ ডিকে?
শহীদ বলল, যেদিকে যাচ্ছিলাম। চক্রবর্তী লেনের পঁচিশ নম্বর বাড়িতে। সব রহস্যের সমাধান ওই বাড়িতেই পাব বলে আশা করছি।
ডি. কস্টা বলল, নো–এখন পেট-পূজা করিটে হইবে, টাহার পর অন্য কোন কঠা।
মৃদু হেসে শহীদ বলল, ঠিক। খালি পেটে বুদ্ধি খোলে না, চলুন, আগে নাস্তাটা সেরে নিই কোন রেস্তোরাঁয় ঢুকে।
Leave a Reply