কুয়াশা – ৬৬
প্রথম প্রকাশ: মে, ১৯৭৭
০১.
এই ঢাকার বুকে অজায়গায় কুজায়গায় ডজন ডজন জুয়ার আড্ডা বসে। ভাল ভাল হোটেলে, নাইটক্লাবে, অভিজাত নাগরিকদের কোন কোন বাড়িতেও বসে জুয়ার আসর।
আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষের নাকের ডগাতেই জুয়া খেলা হচ্ছে। এই নিষিদ্ধ কর্মটি বন্ধ করার জন্য চেষ্টা যে হয় না তা নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন চেষ্টাই পুরোপুরি সফল হয়নি। সংবাদপত্রে তো প্রায়ই দেখা যায় জুয়াড়ী গ্রেফতারের কাহিনী। কিন্তু সে আর কটা। তছাড়া গ্রেফতার হয় নিম্নশ্রেণীর জুয়াড়ীরা। ধনী লোকেরাও তো জুয়া খেলে, কই তারা তো ধরা পড়ে না!
ধনী জুয়াড়ীরা ধরা পড়ে না বিভিন্ন কারণে। এক, ধনী লোকদের গ্রেফতার করতে হলে পুলিশকে তৈরি হতে হয় দীর্ঘদিন ধরে, আঁটঘাট বেধে কাজে হাত দিতে হয়। ধনী জুয়াড়ীদের মান-সম্মানের দিকটাও ভাবতে হয় তাদের। তারপর ধনী জুয়াড়ীরা হাতেনাতে ধরা পড়লেও গ্রেফতার হবার বদলে মোটা অঙ্কের টাকার। বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে যায়। লোভ সামলানো অনেক সময় পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। : হোটেলে জুয়ার আড্ডা বসে গোপন প্রকোষ্ঠে। এই গোপন প্রকোষ্ঠের সন্ধান পুলিশ যে জানে না তা নয়। তারা জেনেও নিষ্ক্রিয় থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ বহুবিধ। হোটেলটা হয়তো নামজাদা কোন নাগরিকের। কিংবা, হোটেল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মোটা টাকা দান করেন কর্তব্যপালনরত লোকদের।
মাঝে মাঝে যে জুয়ার আড্ডায় পুলিশ হানা দিয়ে জুয়াড়ীদের গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয় না তা নয়। প্রায়ই এইরকম মহৎ কাজ তারা করে। কিন্তু জুয়ার আড্ডার সংখ্যার তুলনায় সে কিছুই না।
তবে নিরাশ হবার তেমন কিছু নেই। আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষ চুপচাপ বসে নেই। সম্প্রতি ঢাকায় অপরাধ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর একটা সেমিনার হয়ে গেছে। সেই সেমিনারে জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিতেরা কিছুসংখ্যক পুলিশের সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ঘুষ গ্রহণ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এইসব পুলিশদের কঠোর শাস্তি দেবার কথা ঘোষণা করেছেন তারা। তারা বলেছেন, মাত্র স্বল্প সংখ্যক অসৎ পুলিশের জন্য মহান পুলিশবাহিনীর সম্মান এবং মর্যাদা ভূলুষ্ঠিত হচ্ছে–এটা কিছুতেই সহ্য করা যায় না। কঠোর হস্তে ইত্যাদি।
ক্রিমিনলজিস্ট হিসেবে এই সেমিনারে শহীদও বক্তৃতা দিয়েছিল।
শহীদ জানে কোথায় কোথায় জুয়ার আসর বসে। মুশকিল হলো, একই সময়ে প্রতিটি জুয়ার আসরে হানা দিয়ে জুয়াড়ীদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। তাছাড়া জুয়াড়ীদের চর-অনুচরের সংখ্যাও কম নয়। ছানা দেবার জন্য পুলিশবাহিনী থানা থেকে রওনা দিলেই তারা আগে ভাগে খবর পেয়ে যায় পুলিশ সেখানে পৌঁছে দেখে, চিড়িয়ারা ভেগেছে।
গাড়ি থামাল শহীদ বিটলস্ হোটেল অ্যাণ্ড বার-এর সামনে। ঘণ্টা খানেক ধরে পাঁচটা হোটেল অ্যান্ড বারে সন্ধান নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে ও, এইসব হোটেলের জুয়ার আসরে মিসেস শাহানা এবং তার সঙ্গী ভদ্রলোক গত সোমবার রাত্রে যায়নি। বিটলস হোটেল অ্যাণ্ড বারেও ঢু মেরে একবার দেখতে চায় ও। সঙ্গী ভদ্রলোকের পরিচয়টা জানতে হবে। এটাই একমাত্র সূত্র, সূত্রটা ধরে এগোনো ছাড়া উপায় নেই।
লবিতে ঢুকে কয়েকজন মাত্র গেস্টকে এখানে-ওখানে বসে থাকতে দেখল। শহীদ। ককটেল লাউঞ্জে ঢুকে পরিচিত একজন ওয়েটারকে চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলে একটা টেবিল দখল করে বসল ও। ওয়েটার লোকটার বয়স হবে চল্লিশের মত। গায়ের রঙ কয়লার মত কালো। চোখ দুটো ছোট ছোট। বিশাল বুক। সারা শরীরে কমপক্ষে গোটা পঞ্চাশেক ক্ষতচিহ্ন আছে ওর। প্রথম জীবনে কুখ্যাত গুণ্ডা ছিল। বছর কয়েক হলো চাকরি নিয়ে এক ধরনের জীবন যাপন করছে। শহীদকে শ্রদ্ধা করে। কারণ শহীদই ওকে চাকরিটা যোগাড় করে দিয়ে সৎজীবন যাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। সে কাছে আসতে নিচু গলায় বলল, কি খবর, সাদেক?
সবিনয়ে নিচু গলাতেই উত্তর দিল সাদেক, আপনার দোয়ায় ভালই, জ্বর। গত হপ্তায় আমি যেতে পারিনি রুবিনকে দেখতে…খোকাবাবু কেমন আছেন, হুজুর?
ভাল। আগামী রবিবার দিন যেয়ো। তোমার কাছ থেকে একটা তথ্য নিতে এসেছি, সাদেক।
কি তথ্য, হুজুর?
শহীদ পাইপ বের করে টোবাকো ভরতে ভরতে বলল, তোমাদের এখানে জুয়ার আচ্ছা এখনও বসে?
জী হুজুর,বসে, চাপা গলায় বলল সাদেক।
গত সোমবারে তুমি ছিলে আড্ডায়?
দাঁড়ান, হুজুর, মনে করে দেখি। গত সোমবার ছিলাম, হুজুর।
শহীদ পাইপ তুলল মুখে। অলিংযোগ করে বলল, সেদিনের আচ্ছায় কারা কারা ছিল বলতে পারো? পুরুষ বা মেয়ে–সকলের নাম জানো?, চেহারাগুলো মনে আছে?…সাদেক, তোমাদের বারম্যান ঢুকছে ভিতরে, কেটে পড়ো কয়েক মিনিটের জন্য। ঠাণ্ডা পানীয় নিয়ে ফিরে এসো আবার।
সাদেক সরে গেল নিঃশব্দে। মিনিট দুয়েক পর শীতল পানীয় নিয়ে ফিরে এল ওয়েটার। বলল, সকলের চেহারা মনে নেই, হুজুর। সকলের নামও আমার জানা নেই। আমি রাত সাড়ে নটা কি দশটা পর্যন্ত ছিলাম ওখানে। আবার নতুন কারা কারা এসেছিল বলতে পারব না, হুজুর।
শহীদ বলল, এক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলার চেহারার বর্ণনা দিচ্ছি, মন দিয়ে শোনো। মহিলার পরনে ছিল লাল শিফন শাড়ি, জরির কাজ করা। ব্লাউজটাও ছিল লাল। বাঁ হাতের আঙ্গুলে ছিল হীরে বসানো আঙটি…
সাদেক বলে উঠল, আর বলতে হবে না, হুজুর! মনে পড়ছে, পরিষ্কার মনে পড়ছে বিবিসাহেবার কথা। তিনি তো হুজুর ইকবাল সাহেবের সাথে এসেছিলেন।
ইকবাল সাহেব?
ইকবাল সাহেবকে চেনেন না, হুজুর? বিরাট পয়সাওয়ালা মানুষ। লম্বা, ফর্সা চেহারা। সেদিন এসেছিলেন ছাই রঙের একটা স্যুট পরে।
হা, ওই লোকেরই সন্ধান চাইছি আমি। কি ব্যবসা ভদ্রলোকের তা জানো? তুমি কি ইডেন্ট ব্যবসায়ী ইকবাল চৌধুরীর কথা বলছ?
সাদেক সমীহভরে বলে উঠল, আপনি তো সবাইকেই চেনেন, হুজুর। জ্বী, আমি ওই ইকবাল সাহেবের কথাই বলছি। বিবিসাহেবাকে নিয়ে আসেন তিনি, রাত তখন নটা হবে।
দুজনেই খেলছিল?
জী। তবে দুজন দুই টেবিলে বসে খেলছিলেন।
আচ্ছা! দুই টেবিলে কেন?
সাদেক বলল, তা ঠিক বলতে পারব না, হুজুর।
কতক্ষণ ছিল ওরা?
আমি দশটার দিকে বাড়ি চলে যাই, হুজুর। যাবার আগে ওনাদেরকে খেলতে দেখে গেছি।
শহীদ শীতল পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, যথেষ্ট উপকার করেছ তুমি, সাদেক। যাও, কাজে যাও।
মিনিট তিনেক পর বিল মিটিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ল শহীদ। ইনডেন্ট ব্যবসায়ী ইকবাল চৌধুরী। দেশের ধনীলোকদের মধ্যে একজন। কে না তাকে চেনে। মাত্র অল্প কিছুদিনে অগাধ টাকার মালিক হয়েছে সে। তার ব্যবসার হেড-অফিসটা চেনে শহীদ। গাড়ি ছুটিয়ে দিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার দিকে। ইকবাল চৌধুরীর হেড-অফিস ওদিকেই।
চৌধুরী বিল্ডিংয়ের থার্ডফ্লোরের সবটুকু নিয়ে ইকবাল চৌধুরীর হেড-অফিস। মোটা লাল কার্পেট মোড়া করিডর ধরে এগিয়ে রিসেপশনে ঢুকল শহীদ। অল্প বয়েসী, প্রায় কিশোরী একটি মেয়ে নির্মল হাসিতে ফুলের মত ফুটিয়ে তুলল মুখটা শহীদকে দেখে। ইংরেজীতে বলল, গুড আফটারনুন। মে আই হেলপ্ ইউ, স্যার?
শহীদ পকেট থেকে ব্যাম্বো কার্ডের উপর নিজের পরিচয় ছাপা ভিজিটিং কার্ডটা ডেস্কের উপর রেখে বাংলায় বলল, ইবাল সাহেবকে এটা পৌঁছে দাও।
কিন্তু মি. ইকবাল তো অফিসে আসেননি, স্যার।
শহীদ বলল, ম্যানেজার?
মেয়েটি বলল, ম্যানেজার, মি. রথীন কুমার, তাঁর সাথে কথা বলতে চান? ঠিক আছে…।
কলিংবেল বাজাতেই একজন উর্দিপরা পিয়ন বেরিয়ে এল ভিতরের দরজা খুলে। রিসেপশনিস্ট কিশোরী তাকে কার্ডটা দিয়ে বলল, মি, রথীনকে এটা পৌঁছে দাও, বশির।
বশির চলে গেল ভিতরে কার্ড নিয়ে। মিনিট দেড়েক পরই ফিরে এল সে, সবিনয়ে বলল, মি. রথীন আপনার সাথে দেখা করবেন, স্যার। আসুন আমার সাথে।
গোটা অফিসটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। হলরুমে ঢুকে শহীদ দেখল প্রায় পঞ্চাশ জন লোক যার যার টেবিলে বসে কাজ করছে। সবাই খুব ব্যস্ত। হলরূম থেকে বেরিয়ে একটা প্যাসেজে ঢুকল ও। প্যাসেজের দুপাশে দরজা। প্রতিটি দরজার। গায়ে ছোট ছোট সাইনবোর্ড। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, চীফ অ্যাকাউনট্যান্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ক্লারিক্যাল ম্যানেজার, চীফ পারচেজ অফিসার এইসব শব্দ লেখা রয়েছে বোর্ডগুলোয়।
প্যাসেজের শেষ প্রান্তের দরজাটা প্রকাণ্ড। সেটার গায়ে প্লাস্টিকের সাদা অক্ষর দিয়ে লেখা, ম্যানেজার।
পিয়ন নক করে দরজাটা খুলে এক কদম সরে দাঁড়াল। হাতে পাইপ নিয়ে ভিতরে ঢুকল শহীদ।
সুসজ্জিত চেম্বার। চারদিকের দেয়ালে নাইলনের স্ক্রীন ঝুলছে। বিরাট একটা ডেস্ক সামনে নিয়ে বসে আছে ম্যানেজার রথীন কুমার। গোলগাল চেহারা, চোখে ধূর্ত দৃষ্টি, মুখে অল্প অল্প হাসি। শহীদকে দেখে লি কয়েক সেকেণ্ড, তারপর চেয়ার। ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল, গ্লাড টু মিট ইউ, মি. খান। বসুন।
ম্যানেজারের মুখোমুখি বসে রয়েছেন আর এক ভদ্রলোক একটা প্রশস্ত চেয়ারের সবটুকু জুড়ে। শহীদের দিকে তিনি ফিরেও তাকালেন না। তার সামনে একটা ফাইল খোলা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, তিনি সেটা গভীর মনোযোগের সাথে দেবছেন।
শহীদ এই ভদ্রলোকের পাশের একটা চেয়ারে বসল।
বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?
শহীদ বলল, আমি মি. ইকবালের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। শুনলাম তিনি অফিসে আসেননি। ব্যাপারটা খুব জরুরী। এক ভদ্রমহিলা নিখোঁজ হয়েছেন, সে সম্পর্কে তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল আমার।
ম্যানেজার বলল, কাজ না থাকলে আপনার মত স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পদধূলি কি আর পড়ে যেখানে সেখানে। কিন্তু মি. শহীদ, এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে আপনাকে সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না। মি. ইকবাল অফিসে কখন আসেন, কবে আসেন তার কোন বাধাধরা নিয়ম নেই। মাসের পর মাস আসেন না, এমনও হয়। গত পনেরো দিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি…।
ব্যবসা তিনি দেখাশুনা করেন না নাকি?
ম্যানেজার গর্বিতভাবে হাসল, ব্যবসার নীতি নির্ধারণ করে দিয়েই তিনি মুক্ত, সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিয়েছেন আমার ওপর।
শহীদ বলল, কিন্তু ইমার্জেন্সী দেখা দেয় না? তাঁর সাথে যোগাযোগ করার দরকার হলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করেন?
না। তেমন কোন জরুরী ব্যাপার দেখা দিলে সিদ্ধান্ত আমিই নিই।
শহীদ বলল, তিনি কোথায় থাকেন সে সম্পর্কে কোন খবরই রাখেন না আপনারা?
আমরা খবর রাখি না বলা ঠিক উচিত হবে না। আসলে তিনি চান না আমরা, তাঁর প্রতিমুহূর্তের খবর রাখি। তাকে বিরক্ত না করার ব্যাপারে আমাদের ওপর নির্দেশ আছে।
শহীদ বলল, অস্বাভাবিক।
মনেজার বলল, তা বলতে পারেন। কিন্তু মি. ইকবাল বলেন, আমার প্রাইভেসির ব্যাপারে আমি কম্প্রমাইজ করতে রাজি নই।
শহীদের পাশে বসা ভদ্রলোক ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালেন শহীদের। দিকে। শহীদ দেখল ভদ্রলোকের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে রঙিন চশমা। কপালের উপর ছোট একটা আঁচিল।
ভদ্রলোক বললেন, মি. ইকবালের সাথে দেখা করা কি খুবই দরকার। আপনার?
শহীদ বলল, খুবই দরকার। আপনি কি বলতে পারবেন কোথায় তাকে পেতে পারি?
রথীন কুমার বলে উঠল, আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, দাঁড়ান। মি. শহীদ, প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মি. শহীদ, ইনি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, ঢাকায় বদলী হয়ে নতুন এসেছেন, মি. সালাহ উদ্দীন খান।
করমর্দন করল ওরা। শহীদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। ভদ্রলোক যে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কেউ হতে পারেন না তা সন্দেহ হতেই প্রশ্ন করল ও, নতুন বদলি হয়ে এসেছেন? কিন্তু…
হঠাৎ চুপ করে গেল শহীদ। প্রসঙ্গ বদলে বলল, কিন্তু আমার হাতে সময় খুব কম। আপনি যদি মি. ইকবালের সন্ধান আমাকে জানাতে পারেন।
ফোন নাম্বারটা জানি আমি। এই নাম্বারে ফোন করলেই আপনি মি, ইকবালের খোঁজ পেয়ে যাবেন, ভদ্রলোক ধীরে ধীরে বললেন।
ম্যানেজার বলে উঠল, কিন্তু মি. সালাহউদ্দীন, আপনি আমার বসের অবস্থান সম্পর্কে জানেন কিভাবে?
ভদ্রলোক সরাসরি তাকালেন ম্যানেজারের দিকে, বললেন, আমি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, মি. রবীন। কেউ যা জানে না আমাকে তা জেনে রাখতে হয়। মি. শহীদ নাম্বারটা লিখে নিন।
শহীদ নোট বইটা বের করে বলল, বলুন।
ভদ্রলোক নাম্বারটা বললেন। লিখে নিল শহীদ। তারপর উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোককে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে তার সাথে এবং ম্যানেজারের সাথে করমর্দন সেরে বিদায় নিয়ে শহীদ দ্রুত নেমে এল নিচে, গাড়ির কাছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল শহীদ। একটা প্রশ্ন ওকে অস্থির করে তুলেছে। ছদ্মবেশের জন্যে প্রথমে চিনতে না পারলেও একটু পরেই চিনতে ভুল করেনি ও কুয়াশাকে। প্রশ্ন হলো, ইকবাল চৌধুরীর অফিসে কুয়াশা কেন? মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কি উদ্দেশ্যে গেছে সে ওখানে?
একটা মেডিসিনের দোকান দেখে গাড়ি দাঁড় করাল শহীদ। দোকানে ঢুকে অনুমতি নিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে কুয়াশার দেয়া নাম্বারে ডায়াল করল, অপরপ্রান্ত থেকে সুরেলা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, গুড আফটারনুন। হোটেল লাইট আণ্ড শ্যাডো। মে আই হেলপ ইউ?
শহীদ বুলল, ইউ হ্যাভ!
বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে এসে উঠল ও।
পাঁচ মিনিট পর শহীদকে দেখা গেল লাইট ও শ্যাডো হোটেলের ফাস্ট ফ্লোরের একশো এগারো নম্বর সুইটের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করতে।
দেরি হচ্ছে দেখে দ্বিতীয়বার নক করল শহীদ, পরমুহূর্তে খুলে গেল দরজা, সুদর্শন চেহারায় ইকবাল চৌধুরী দরজার কবাট একটু ফাঁক করে শহীদকে দেখল, বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল তার কপালে, বলল, ভুল করেছেন সম্ভবত।
কথাটা বলেই দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হলো সে। শহীদ ঠিক সেই সময় লক্ষ করল ভিতরের সীটিং রূমের দ্বিতীয় দরজা পথে দেখা যাচ্ছে বেডরূমের খানিকটা। বেডরূমে লাল শাড়ি পরা একটা যুবতাঁকে দেখা গেল পলকের জন্য। ঠিক চিনতে না পারলেও আশায় ভরে উঠল কটা ওর। হাত দিয়ে দরজার কবাট দুটো ধরে চাপ দিয়ে বাধা দিল ও ইকবাল চৌধুরীকে, ভুল করিনি, ইকবাল সাহেব। পথ মাড়ন, ভিতরোকব আমি।
হোয়াট! কে আপনি? কোন্ অধিকারে..
মৃদু হেসে শহীদ বলল, নার্ভাস হবেন না। আমি শহীদ খান। শুনেছেন কখনও নামটা?
শহীদ খান? না…হ্যাঁ। তার মানে? আপনি কি বলতে চান আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান?
শহীদ বলল, শুধু বলতে চাই-না, তা প্রমাণও করতে পারি আমিই স্বয়ং প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান।
ইকবাল চৌধুরী নিজেকে সামলে নেবার জন্য চেষ্টা কর। সতর্কতা ফুটুল তার চোখে মুখে। জানতে চাইল, কি জানতে চান আপনি? কে আমার ঠিকানা দিয়েছে আপনাকে?
ওসব কথা পরে। আমাকে ঢুকতে দিন। অমি দেখতে চাই আপনার বেডরূমে কে আছে।
কে আবার, ও আমার স্ত্রী।
শহীদ বলল, আপনি আমার পরিচয় পাবার পরও সাবধান হচ্ছেন না, ইকবাল সাহেব। ভুল করছেন। পস্তাতে হবে কিন্তু। দুনিয়ার সবাই জানে আপনি বিয়ে করেননি। পথ ছাড়ুন
শহীদ হাত দিয়ে ইকবাল চৌধুরীর বুকে চাপ দিল। পিছিয়ে গেল ইকবাল চৌধুরী। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সে। শহীদ তার গায়ে হাত দিয়ে সরিয়ে দেবে তা সে ভাবতেই পারেনি।
দৃঢ় পায়ে বেডরূমে ঢুকল শহীদ।
কিন্তু বেডরূম ফাঁকা, শূন্য। কেউ নেই সেখানে।
ইকবাল চৌধুরীও বেডরূমে ঢুকল। শহীদ তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সময় নষ্ট করাবেন না। আপনার সঙ্গিনীকে বলুন বাথরূম থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে আসতে।
ইকবাল চৌধুরী প্রতিবাদ করে কি যেন বলতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলাল। বাথরূমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে সে বলল, পুতুল, বেডরূমে এসো তো একবার। ভয়ের কিছু নেই!
একটু পরই খুলে গেল বেডরূমের দরজা। শহীদ দেখল লাল বেনারসী শাড়ি পরা মেয়েটা শ্যামলা এবং বেটে। এ মেয়ে কক্ষনো মিসেস শাহানা নয়।
ইকবাল চৌধুরীর দিকে তাকাল শহীদ, মিসেস ফেরদৌস কোথায়?
মিসেস ফেরদৌস? ওই নামের কাউকে আমি চিনি না।
পকেট থেকে ফটোটা বের করে বাড়িয়ে দিল শহীদ, একে চেনেন না বলতে চাইছেন?
এগিয়ে এসে ছবিটা নিল ইকবাল চৌধুরী, দেখেই মুখ তুলল, অস্ফুটে উচ্চারণ করুল, শাহানা! কেন…কি হয়েছে শাহানা?
শহীদ কঠিন কণ্ঠে ব্যঙ্গ করল, চমৎকার! আপনি দেখছি আমাকেই প্রশ্ন করছেন। গত সোমবার রাতে আমি বুঝি ওকে নিয়ে ক্যাপিটাল হোটেলের ককটেল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়েছিলাম?
মি. শহীদ, বিলিভ মি অর নট, সোমবার রাত এগারোটা পর্যন্ত ওর সাথে আমি ছিলাম বটে কিন্তু তারপর…তারপর থেকে ওর কোন খবর আমি রাখি না। প্লীজ…
ইকবাল চৌধুরী শহীদের একটা হাত ধরে ফেলল, হঠাৎ হাতটা ছেড়ে দিয়ে তাকাল বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়ানো যুবতীর দিকে, বলল, চিন্তা কোরো না, পুতুল। তুমি বসো। আমরা সীটিং রূমে বসে কথা বলি। মি. শহীদ, চলুন, বসে বসে সব কথা শুনবেন।
সীটিং রূমে এসে মুখোমুখি বসল ওরা। ইকবাল চৌধুরীর কণ্ঠে আবেদনের অকৃত্রিম সুর ফুটে উঠল, কি হয়েছে শাহানার, মি. শহীদ। ও কি কোন বিপদে পড়েছে?
শহীদ চুপ করে রইল।
আমি জানি বিপদে পড়েছে সে…কিন্তু..প্লীজ। মি. শহীদ, বলুন কি হয়েছে তার
শহীদ বলল, গত সোমবারের সবটুকু ঘটনা আমি শুনতে চাই ইকবাল সাহেব। আপনি অভিনয় করছেন কিনা তা আমি জানি না। অভিনয় করুন বা না করুন, সত্য চাপা থাকবে না। কোন প্রশ্ন আমাকে করার আগে আপনি একে একে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিন। মিসেস শাহানার সাথে আপনার সম্পর্ক কি? কতদিনের পরিচয়? তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ওই সোমবার দিনই? প্রথম কোথায় দেখা হয় তার সাথে?
ইকবাল চৌধুরী সিগারেট জালাল। শহীদ লক্ষ করল হাত দুটো মৃদু মৃদু। কাঁপছে তার। শহীদের চোখে চোখ রেখে সে বলল, বলছি। সব কথাই বলছি। বিশ্বাস করুন, কিছুই লুকাব না আমি।
শুরু করুন। শহীদের কণ্ঠস্বর এতটুকু নরম শোনাল না।
ইকবাল চৌধুরী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলতে শুরু করল, কয়েক বছর আগের কথা, শাহানাকে আমি ভালবাসতাম। তখন আমি চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ভালবাসাটা ছিল একতরফা অর্থাৎ শাহানা আমাকে ভালবাসত না। দেখা সাক্ষাৎ যা হত আমারই চেষ্টায়। আমাকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, বিরক্তই হত ও। একটা সময় আসে যখন আমি ওর সাথে দেখা করা ছেড়ে দিই। কিন্তু ওকে না দেখে থাকতে পারতাম না আমি। বলতে সঙ্কোচ নেই, ওকে আমি অন্ধের মত ভালবাসতাম। আজও বাসি। কিন্তু আমার ভালবাসা যে ব্যর্থ হবে তা আমি মনে মনে জানতাম। তবু একদিন মরিয়া হয়ে উঠলাম। দেখা করুলাম ওর সাথে, কলোম, আমি তোমাকে ভালবাসি। স্বভাবতই ব্যঙ্গ করে হাসল শাহানা। বলল, কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি না এবং ভালবাসতে কখনও পারবও না। সেই শেষ। ফেরার সময় ওকে বলেছিলাম, তুমি সুখী হও তাই আমি চাই। সেই জন্যেই অনুরোধ করছি, বিয়ে যদি করো তবে যাকে ভালবাসতে পারবে তাকেই করো। শাহানা বলেছিল, আচ্ছা, মনে রাখব কথাটা। এরপর ওর সাথে আমি আর দেখা করিনি। ঢাকায় চলে আসি আমি। ওকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি। ভুলতে অবশ্য পারিনি। তবে ওর সাথে কোন সম্পর্ক রাখিনি, ওর খবর জানতেও চেষ্টা করিনি। তারপর হঠাৎ গত সোমবার দুপুরে, ফোন করে ও আমার বাড়িতে। আমাকে বলে, বিকালের ফ্লাইটে আমি ঢাকায় আসছি, তুমি এয়ারপোর্টে থেকো।
নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে ইকবাল আবার শুরু করল, ফোনে ওর কথাবার্তা শুনে কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করি। ঢাকা এয়ারপোর্টে ওকে সশরীরে দেখে চমকে উঠি আমি। চেনা যাচ্ছিল না ওকে। চিরকাল ও শান্ত, নম. ছিল। সিঁড়ি বেয়ে প্লেন থেকে নামার সময় ওর হাত নাড়া দেখে, হাসি দেখে, শরীর উন্মুক্ত করা পোশাক দেখে রীতিমত বিস্মিত হই। কিন্তু আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমার জনে। ওর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাই আমি।
ঢাকায় আগমনের কারণ সম্পর্কে কি বলেন তিনি?
বলে, স্বামী চান ঢাকায় দিন পনে থাকি আমি একা, তাতে করে পরস্পরের প্রতি টান বাড়বে।
হু। তারপরের ঘটনা বলে যান।
ইকবাল শুরু করল, সক্ষেপে বলি। শাহানা প্রথমে উঠতে চায় আমার, বাড়িতে। বলে, ঢাকায় যে কদিন থাকব, মদ খাব, ফ্ল্যাশ খেলব, নাইটক্লাবে যাব–সবরকম ফুর্তি করে মজা লুটব। আমি ওর প্রস্তাব গ্রহণ করি না। ও বলে, ঠিক আছে, আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আমাকে পৌঁছে দাও। সেখানে আমি আধঘণ্টা থাকব, তারপর তুমি আমাকে ভাল কোন হোটেলে তুলে দিয়ে আসবে। ইচ্ছা করলে তুমি আমার সাথে হোটলে থাকতে পারো। আমি সব কিছু করে দিতে রাজি হই। কিন্তু হোটেলে ওর সাথে থাকতে অক্ষমতা প্রকাশ করি। এসব বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় আমি ওকে পরিষ্কার বলি, শাহানা, তোমাকে আমি ভাল মেয়ে বলেই জানি, সেটাই আমি চিরকাল জানতে চাই। শাহানা বলে ঢাকায় আমার একজন পুরুষ সঙ্গী দরকার। তুমি রাজি না হলে আমি অন্য পুরুষকে খুঁজে নেব। মোটকথা, শাহানার কথাবার্তা এবং ব্যবহার দেখে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি, নির্ঘাত একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে ও। সেজন্যেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিই, যতক্ষণ সম্ভব ওর সাথে সময় কাটাব। ওর আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছে দিই ওকে। টেলিফোনে ক্যাপিটাল হোটেলের স্যইট রিজার্ভ করি। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আবার ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হোটেলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিই। জরুরী একটা কাজ ছিল বলে তখন হোটেলে ঢুকিনি আমি। পরে, ঘন্টাখানেক পরে সম্ভবত ক্যাপিটালের লাউঞ্জ থেকে ওকে ফোন করে জানাই আমার উপস্থিতির কথা। ফোন করার পর হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে যায়, তাকে নিয়ে আমি আধঘন্টার জন্যে বাইরে বেড়িয়ে আসি। ফিরে দেখি শাহানা কাউন্টারের সামনে বসে শ্যাম্পেন পান করছে। তারপর।
শহীদ বলল, এসব আমি জানি। ক্যাপিটালের ককটেল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আপনারা হোটেল লাইট অ্যাণ্ড শ্যাডোতে যান। সেখানে কি কি ঘটে সেখান থেকে কোথায় যান তাই বলুন।
ফ্ল্যাশ খেলার জন্য জেদ ধরায় ওকে হোটেল লাইট অ্যাণ্ড শ্যাডোয় নিয়ে যাই আমি? ভিতরের রূমে জুয়া খেলা হয় জানতাম আমি। সেখানে গিয়ে রহস্যময় আচরণ শুরু করে শাহানা। আমাকে সে হঠাৎ বলে, আমি বুঝতে পারছি আমার সাথে থাকতে তুমি অস্বস্তি বোধ করছ। জোর করে তোমাকে আমি সঙ্গী করতে চাই না। তুমি অন টেবিলে বসে খেলো। আমি আর এক টেবিলে বসব।
তারপর?
ওর কথায় আপত্তি করে লাভ নেই জেনে তাই মেনে নিই আমি। আমি খেলতে বসি মনটাকে শান্ত করার জন্য। তবু মাঝে মধ্যেই ওর দিকে লক্ষ রাখছিলাম। চারজন ভদ্রলোকের সাথে খেলছিল ও। ওর পাশে বসেছিলেন যিনি তাকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। ভদ্রলোকের মাথায় ছোট একটা টাক ছিল, যতদূর মনে পড়ছে। প্রথম থেকেই লক্ষ করি, শাহানা সেই ভদ্রলোকের সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। এমন কি, একসময় দেখি, ভদ্রলোকের কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে কি সব বলছে যেন তাকে। অসহ্য রাগ হয় আমার। কিন্তু কি করব ভেবে ঠিক করতে পারি না। রাত এগারোটার দিকে শাহানা এবং সেই ভদ্রলোক এক সাথে খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে। শাহানা দূর থেকেই আমার উদ্দেশে বলে, ইকবাল, তোমাকে মুক্তি দিলাম। গুড নাইট! ওর এই আচরণে উপস্থিত ভদ্রলোকেরা যেমন কৌতুক বোধ করেন তেমনি আমার উপর করুণা বোধ করেন। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে আমার। উঠে দাঁড়িয়ে যে দরজার দিকে এগোব সে শক্তিও আমার ছিল না। রাগে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম বলতে পারেন। যার ফলে শাহানা অপরিচিত এক ভদ্রলোকের সাথে চলে যাচ্ছে, বিপদে পড়তে পারে ওএসব কথা মনে জাগেনি আমার। রাত সাড়ে এগারোটার সময় আমি খেলা ছেড়ে উঠি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিই শাহানার সাথে আমি আর দেখা করব না। দেখা করার চেষ্টাও আমি করিনি। ফোন করে ওর খবর নেবার ইচ্ছা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু যতবারই ফোন করার কথা ভেবেছি ততবারই মনে হয়েছে, কি লাভ? যে শাহানাকে আমি ভালবাসতাম সে শাহানার তো মৃত্যু ঘটেছে, এ অন্য এক শাহানা–তার খবরে দরকার নেই আমার।
কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছিল শহীদ। নিচে, রাস্তায় কে যেন চিৎকার করে কি বলছে। মেঝের কার্পেট থেকে চোখ তুলল ও, বলল, ব্যস?
ইকবাল চৌধুরী বলল, বিশ্বাস করুন বা না করুন।
কি যেন নাম বললেন…পুতুল। কি সম্পর্ক আপনার সাথে ওর?
ইকবাল ইতস্তত করতে লাগল। তারপর বলল, বান্ধবী। এ ব্যাপারে ও কিছু জানে না।
শহীদ বলল, জানুক বা না জানুক, আপনার সাথে ওকেও একবার থানায় যেতে হবে। থানায় না, আপনাদেরকে সি.আই.ডি বিভাগের স্পেশাল অফিসারের কাছে পাঠাব। তাতে ঝামেলা কম হবে। কিছু না, জবানবন্দী দিয়ে বেরিয়ে আসবেন আপনারা। তবে আপনার কথা যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয় তাহলে থানাতেই শেষ পর্যন্ত যেতে হবে এবং বেরুবার ব্যাপারটা নির্ভর করবে বিচারকের বিচারের উপর। যে যাক, মিসেস শাহানা যে ভদ্রলোকের সাথে জুয়ার আসর থেকে বেরিয়ে যান, তার চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
তিনি আমার দিকে পিছন ফিরে বসে ছিলেন, দেখতে পাইনি। মি. শহীদ, আমার সব কথাই আমি বলছি। চেষ্টা করলে আপনি সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখতে পারেন। এবার আপনি দয়া করে বলুন-কি হয়েছে শাহানার।
মিসেস শাহানা, সেই রাত থেকে নিখোঁজ-আপনিই তাকে শেষবার দেখেছেন। তার স্বামী এখন ঢাকায়। ভদ্রলোক পাগলের মত হয়ে পড়েছেন স্ত্রীর সন্ধান পাবার জন্য।
শাহানা নিখোঁজ?
শহীদ বলল, আশ্চর্যের এবং সন্দেহের ব্যাপার হচ্ছে, এই কদিন আপনি তার একটা খবর নেবারও চেষ্টা করেননি।
খবর নেবার চেষ্টা করিনি কিন্তু আমি কি জানতাম…কল্পনাও করিনি যে…মানে, সত্যি সত্যি শাহানা কোন বিপদে পড়বে তা ভাবিনি।
শহীদ বলল, সে যাক। সত্য যথা সময়ে প্রকাশ পাবেই। এবার তা হলে উঠতে হয়, ইকবাল সাহেব।
মি, শহীদ,…মানে, আপনি জানেন আমি একজন সম্মানী লোক। থানায়। সিআইডি বিভাগে…।
শহীদ রিস্টওয়াচে সময় দেখে বলল, আরও কিছু তথ্য যদি দেবার থাকে, দিন। হ্যাঁ, আমি জানি আপনি সম্মানী লোক। আপনার কথাগুলো যদি সত্য হয়, আপনি যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা করেন, সম্মান হারাবার কোন ভয় নেই আপনার। তা না হলে বুঝতেই পারছেন।
ইকবাল চৌধুরী উঠল। বলল, বেশ চলুন। আচ্ছা, পুতুলকে এর সাথে না জড়ালেই কি নয়?
ঠিক আছে, আপনার বান্ধবী থাকুন এখানে।
ইকবাল চৌধুরী কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, ধন্যবাদ, মি. শহীদ, অসংখ্য ধন্যবাদ।
শহীদ বলল, আমি ফোন করছি এখান থেকে সি.আই.ডি বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা মি. সিম্পসনকে। তিনি লোক পাঠিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবেন। আমি বলে দিচ্ছি ফোনে আপনাকে তিনি আটকে রাখবেন না।
আমার সাথে যাবেন না আপনি?
শহীদ বলল, না। আমার হাতে সময় খুব কম।
হাত বাড়াল শহীদ ফোনের দিকে।
.
০২.
বিশ মনিট পর মি. সিম্পসনের ডান হাত ইন্সপেক্টর আকমল হোসেনকে সংক্ষেপে পরিস্থিতির সারমর্ম বুঝিয়ে দিয়ে তার সাথে ইকবাল চৌধুরীকে সি.আই.ডি ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিল শহীদ। হোটেল লাইট অ্যাও শ্যাডোর লবিতে নেমে ফোন করল ও বাড়িতে। ফোন ধরুল মহুয়া। শহীদের কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেই মহুয়া অস্থির উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে বলল, শহীদ! কোথায় কি করছ তুমি? এইমাত্র ফোন করেছিল কামাল। ওর পত্রিকা বেরিয়ে গেছে। মিসেস শাহানার ছবিসহ তার নিখোঁজ সংবাদটা তো ছাপা হয়েছেই, মি. ফেরদৌস দুই হাজার টাকা ঘোষণা করেছেন মিসেস শাহানা রেন্ট এ-কার-এর যে গাড়িটা নিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন সেই গাড়ির সন্ধান পাবার জন্য। এবং…।
গাড়িটা পাওয়া গেছে বুঝি? শহীদ জানতে চাইল।
পাওয়া গেছে। এবং কোথায় জানো?
কোথায়?
মহুয়া রুদ্ধশ্বাসে বলল, ক্যাপিটাল হোটেলেই। অদ্ভুত, তাই না? হোটেলের গ্যারেজেই পাওয়া গেছে গাড়িটাকে। এই মুহূর্তে কামাল সেখানেই…
আমিও যাচ্ছি, মহুয়া। শোনো, চট্টগ্রাম থেকে রাসেলের ফোন আসবে। কথা বোলো ওর সাথে, কেমন?
সশব্দে রিসিভার নামিয়ে রেখে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল শহীদ।
ক্যাপিটাল হোটেলের গ্যারেজের সামনে চওড়া কংক্রীটের উঠন। গাড়ি থেকে নামতেই মুখোমুখি দেখল শহীদ সিকিউরিটি চীফ আবদুস সামাদকে। কামাল বা কামালের মটর সাইকেলের ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। আবদুস সামাদের খানিকটা পিছনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোকরা। কয়েক সেকেণ্ড ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইল শহীদ। ছোকরাকে রীতিমত উফুল দেখাচ্ছে।
আবদুস সামাদ বলল, গ্যারেজ অ্যাটেনড্যান্ট-খলিল। যোগফলে ফোন করে আগে, তারপর আমাকে জানায়। পুরস্কারের আশা!
শহীদ প্রশ্ন করল, পুলিশে খবর দিয়েছেন? গাড়িটা.গত সোমবার থেকেই এখানে পড়ে ছিল নাকি?
খবর দিয়েছি। জোর করে কিছুই বলা যাবে না।
ছোকরা খলিলকে ডাকল শহীদ হাত-ইশারায়। সে কাছে আসতে বলল, আগে দেখোনি! পুরস্কারের কথাটা ঘোষণা করা মাত্রই চোখে পড়ে গেল? পুরস্কার ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলে নাকি?
জী- জী না! আমি জানব কি ভাবে? ছোকরার হাসি উবে গেল মুখ থেকে। বলে উঠল আবার, গ্যারেজে রাতদিন গাড়ি আসছে, যাচ্ছে কোনটা কখন যাচ্ছে আসছে মনে রাখা যায় না। কোন কোন গাড়ি তিন-চারদিন পড়ে থাকে। এখনই দেখুন না, এগারোটা গাড়ি রয়েছে। সকালে ছিল বত্রিশটা। বিজ্ঞাপনটা দেখে মনে মনে ভাবি, গ্যারেজের গাড়িগুলো একবার ভাল করে দেখলে হয়…দেখতে গিয়ে পেয়ে যাই ওটাকে।
আবদুস সামাদ বলল, সন্ধ্যার পর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত গ্যারেজে থাকে না কেউ। কোন গেস্ট যদি গাড়ি নিতে বা রাখতে চায় তাহলে বেলবয়কে জানায়, নয়তো নিজেই আসে।
ফট-ফট-ফট-ফট-মটর সাইকেলের শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই শহীদ দেখল কামালের দুই চাকাওয়ালা গাড়িটা ওর পাশে সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছনের সীট থেকে নামল মোগফলের একজন ফটোগ্রাফার।
সংবাদ পত্রের ক্ষমতা আর একবার প্রমাণিত হলো! সহাস্যে বলল কামাল।
শহীদ বলল, কাজ শুরু করে দে। গাড়িটার ছবি তোল, খলিলকে গাড়ির পিছনে দাঁড় করিয়ে রেখে।
কামাল এগোল, ফটোগ্রাফারকে সাথে নিয়ে, কোন্ গাড়িটা? লাল টয়োটা তো দেখছি তিনটে!
মাঝখানেরটা…।
খলিল এগোল কামালের আগে আগে। শহীদ পা বাড়াতে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছনে। জীপ আসছে একটা।
এগিয়ে গেল আবদুস সামাদ। জীপটা থামল তার পাশে। মি. সিম্পসন নামলেন। মুচকি হেসে শহীদ বলল, গুড ইভনিং, মি. সিম্পসন!
গুড ইভনিং, মাই বয়।
আবদুস সামাদ হাত নেড়ে কি যেন বলছে, সিম্পসন তার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়লেন। শহীদ পা বাড়াল কামালের দিকে।
খলিল দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পিছনে। ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে। কামালের কাঁধে টোকা দিল শহীদ, রেন্ট-এ-কার কোম্পানীর লোক চাবি নিয়ে আসছে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। গাড়ির ভিতর কানো ট্রাঙ্কটা দেখতে পাচ্ছিস?
বলিস কি! আমি কি অন্ধ যে দেখতে পাব না?
শহীদ জোরে শ্বাস টানল, বলল, দুর্গন্ধ পাচ্ছিস না কি!
কামালের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, তার মানে? তুই কি বলতে চাস?
শহীদ কথা না বলে ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু এগোতে হলো না ওকে। মি. সিম্পসন এবং আবদুস সামাদ এগিয়ে আসছে।
মি. ফেরদৌসকে খবর দেয়া হয়েছে?
না। দিচ্ছি খবর
শব্দ শুনে সবাই তাকাল, দেখল একটা কালো ফিয়াট এগিয়ে আসছে গ্যারেজের দিকে। গাড়িটা থামল ওদের পাশে। দুজন লোক নামল। একজনের পরনে তেল-কালিতে কলঙ্কিত, প্যান্ট-শার্ট, দেখেই বোঝা যায় মেকানিক।
মি. সিম্পসন বললেন, আপনারা রেন্ট-এ-কার থেকে চাবি নিয়ে এসেছেন, তাই না? এগিয়ে যান, গাড়ির দরজার তালা খুলুন। কিন্তু সাবধান, হাতলে বা গাড়ির গায়ে হাত দেবেন না। কামাল?
কামাল ত্রস্ত পায়ে ছুটে এল।
মি. সিম্পসন বুললেন, আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট এখনও আসেনি। তোমার ফটোগ্রাফারকে বলো, গাড়ির হাতলের ছবি তুলতে।
কামাল বলল, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম তো, ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই।
রেন্ট-এ-কার-এর মেকানিককে নিয়ে সুপারভাইজার এগিয়ে গেল। হাতলে বা গাড়ির গা স্পর্শ না করে কী হেলে চাবি ঢুকিয়ে তালা খুলল মেকানিক।
দরজা খোলা হতেই কামালের ফটোগ্রাফার ট্রাঙ্কের ছবি তুলে নিল।
ট্রাঙ্কের হাতলের ছবি, কামাল, শহীদ বলল।
ফটোগ্রাফার আবার ছবি তুলল।
শহীদ সুইভাইজারকে প্রশ্ন করল, গাড়ি ডেলিভারি দেবার সময় আপনারা পেট্রল, রানিং কণ্ডিশন ইত্যাদি সম্পর্কে রেকর্ড রাখেন?
রাখি। এটারও রেখেছি।
মি. সিম্পসন শহীদকে পকেট থেকে রুমাল বের করতে দেখে চোখ কপালে তুললেন কিন্তু কিছু না বলে ওকে অনুসরণ করে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন লাল টয়োটার দিকে।
ফটোগ্রাফার ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। কামাল তার পাশে। শহীদ এবং মি. সিম্পসন গাড়ির ব্যাকডোরের ডানপাশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একটু পিছনে আবদুস সামাদ।
একজন কনস্টেবল মি. সিম্পসনের নির্দেশে ট্রাকের ডালা তুলে ধরল।
ক্লিক! ক্লিক। ফটোগ্রাফার নির্বিকার ছবি তুলছে। কারও মুখে কথা নেই। দম বন্ধ করে চেয়ে আছে সবাই ট্রাঙ্কের দিকে। লাল শিফন দেখা যাচ্ছে একটা। শিফনের সর্বাঙ্গে সোনালি জরির নকশা। বব-চুল মেয়েটার। কুণ্ডলী পাকানো একটা লাশ। পায়ের হাঁটু দুটো ভাঁজ হয়ে ঠেকেছে যুবতীর বুকের কাছে।
নিষ্ঠুর, মর্মন্তুদ একটা দৃশ্য। সবাই অস্বাভাবিক গভীর। থমথম করছে মুখগুলো।
যুবতীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল না কেউ। নির্মমভাবে তার মুখটাকে ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে–চেনার কোন উপায়ই নেই। নিহত হবার আগে যুবতী হয়তো অসাধারণ সুন্দরী ছিল। কিন্তু তার উল্টোটা অর্থাৎ যুবতী যে কুৎসিত মুখের অধিকারিণী ছিল না তাও জোর করে বলা যায় না। মোট কথা, জানবার, কোন উপায় রাখেনি খুনী।
ছুটন্ত পদশব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ। তাকাল আর সবাই।
মোফাজ্জল সাহেব ছুটে আসছেন। মুখের চেহারা দেখে মনে হলো, কেঁদে উঠবেন। সাদা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এঁকে। গায়ে কোট নেই, শার্টের বোতামগুলো খোলা, বাতাসে উড়ছে সেটা। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল।
এগিয়ে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল শহীদ, মি. ফেরদৌস…
পাশ কাটিয়ে শহীদকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে গেলেন মোফাজ্জল সাহেব। কেউ তাকে বাধা দেবার আগেই তিনি লাল টয়োটার দরজার সামনে পৌঁছে গেলেন।
মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল মোফাজ্জল সাহেবের দেহ। শহীদ লম্বা লম্বা পা ফেলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, টেক ইট ঈজি, মি. ফেরদৌস। আমার সাথে আসুন আপনি, প্লীজ। পরে সনাক্ত করবেন।
মোফাজ্জল সাহেব যেন শুনতে পাননি শহীদের কথা। স্থির বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি লাশটার দিকে। কে ও? ওকি…আমার স্ত্রী?
শহীদ কাঁধে হাত রাখল মোফাজ্জল সাহেবের, জানি না এখনও হতেও পারে। কিন্তু এই মূহুর্তে আপনি আমার কথা শুনুন…
আমি সুস্থ আছি! আ…আমি বিড়বিড় করে বললেন মোফাজ্জল সাহেব।
ওঁদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন নিঃশব্দে মি. সিম্পসন। জানতে চাইলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে? চিনতে পারছেন?
মোফাজ্জল সাহেব কেঁপে উঠলেন, কিভাবে চেনবার কোন উপায় আছে?– শাহানা..
মোফাজ্জল সাহেব দুই হাতে মুখ ঢাকতে গিয়ে টলে উঠলেন। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন তিনি, শহীদ দুই হাত দিয়ে ধরে ফেল দেহটা। আমাকে সাহায্য করুন, সামাদ সাহেব।
দুজন ধরাধরি করে নিয়ে চলল ওরা মোফাজ্জল সাহেবকে। জ্ঞান হারিয়েছেন। তিনি।
দুজন পোর্টার ছুটে আসছিল ওদের দিকে।
শহীদ বলল, ডাক্তারকে খবর দিতে হবে।
মি: সিম্পসন কামালকে নিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পিছিয়ে এলেন গাড়িটার কাছ থেকে। কামাল একটু বেশি আবেগপ্রবণ। মোফাজ্জল সাহেবের অবস্থা দেখে চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার। অবশ্য সামলে নিয়েছে দ্রুত নিজেকে। মি. সিম্পসনের উদ্দেশে বলে উঠল, প্যাথেটিক!
.
০৩.
ঘন্টাখানেক পরের কথা।
শহীদের ড্রয়িংরূম। মুখোমুখি সোফায় বসে আছে শহীদ, মি. সিম্পসন। কামাল এবং মহুয়া বসে আছে পাশাপাশি। মহুয়া ছাড়া আর সকলের সামনে এক কাপ করে ধূমায়িত কফির পেয়ালা।
মি. সিম্পসন পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে বললেন, যাই বলো, আমার ধারণার কথা আমি বললাম। মি, ফেরদৌসের নির্দোষিতা প্রমাণ হয়নি সত্য, কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব। সে-কাজ আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করব। আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস, এই কেসে রহস্য বলতে কিছুই নেই। মিসেস শাহানা সম্পর্কে যতটুকু তামরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঢাকায় এসে তার গোপন ইচ্ছাগুলো ডানা মেলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিশোরী মেয়েদের মত অস্থির, ছটফটে হয়ে ওঠেসে। ভালমন্দ বিচার বিবেচনার জ্ঞান হারিয়ে যার-তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার জন্য উন্মাদিনী হয়ে ওঠে। এইভাবে খারাপ কোন লোকের পাল্লায় পড়ে যায়। সেই লোক নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে এবং অবশেষে খুন করে তাকে। পরিষ্কার ব্যাপার। রহস্য কোথায়?
শহীদ কথা বলল না। নিস্পলক চেয়ে আছে সে খোলা জানালা পথে।
মি. সিম্পসন উঠলেন, চললাম। নতুন খবর হলে জানাব, শহীদ।
শহীদ অন্যমনস্কভাবে ঘাড় কাত করল। মি. সিম্পসন বেরিয়ে গেলেন জুতোর শব্দ তুলে।
ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল জুতোর শব্দ।
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন একটা নয়, অনেকগুলো ভুল করছেন। কামাল এবং মহুয়া একযোগে জানতে চাইল, যেমন?
শহীদ নড়ে চড়ে বসল, এক, তিনি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ না পেয়েই ধরে নিচ্ছেন লাশটা মিসেস শাহানার।
মহুয়া সবিস্ময়ে বলল, তুমি কি বলতে চাও…
হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে শহীদ বলল, মুখটা এমনভাবেই ক্ষত বিক্ষত যে মুখ নেই বললেই চলে। কোন সন্দেহ নেই যে লাশের পোশাক ইত্যাদি আর সব কিছু দেখে বোঝা যাচ্ছে লাশটা মিসেস শাহানারই। কিন্তু মুখহীন একটা লাশকে নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করবে তোমরা কিভাবে? এই ব্যাপারটাই চিন্তিত করে তুলেছে আমাকে। আমার জীবনে এইরকম লাশ আমি কম দেখিনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গভীর রহস্য ছিল–তদন্ত করে তা উন্মোচন করেছি আমি। আমার বিশ্বাস, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যেও গভীর রহস্য রয়েছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে…
কি সন্দেহ হচ্ছে তোমার? সাগ্রহে জানতে চাইল মহুয়া।
সন্দেহ হচ্ছে, আমাদেরকে খুনী বোকা বানাতে চায়। খুনী হয়তো চাইছে লাশটা দেখে আমরা ধরে মিই ওটা মিসেস শাহানারই লাশ। আসলে হয়তো তা নয়।
কামাল বলল, তোর কথার ভিত্তি মজবুত নয়, বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি। গাড়িটার কথা ধর, মাত্র বাইশ মাইল চলেছে ওটা। বোঝা যাচ্ছে, সোমবার রাতেই গাড়িটাকে হোটেলের গ্যারেজে নিয়ে এসে রাখা হয়। সরকারী ডাক্তার তার রিপোর্টে বলছে, খুন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লাশটাকে ট্রাঙ্কের ভিতর ঢোকানো হয়েছে। নোম কি মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই কাজটা করা হয়েছে, তার বিশ্বাস।
শহীদ বলল, এসব আমিও জানি, কিন্তু লাশের মুখের চেহারা ক্ষতবিক্ষত করার কারণ কি?
মহুয়া বলল, হাতের ছাপ দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই।
শহীদ পাইপে আগুন ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল, মি. সিম্পসন চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। ইতিমধ্যেই তিনি মি. ফেরদৌসকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছেন মিসেস ফেরদৌসের ফিঙ্গার প্রিন্টের রেকর্ড আছে কিনা। রেকর্ড নেই। মি. সিম্পসন মি. ফেরদৌসের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছেন। আজ রাতেই তিনি লাশের ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা পাঠিয়ে দেবেন চট্টগ্রামে। তার নির্দেশে চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ মি. ফেরদৌসের বাড়িতে গিয়ে মিসেস শাহানার হাতের ছাপ সংগ্রহ করবে। রিপোর্ট পাওয়া যাবে আগামীকালের মধ্যেই। তখন হয়তো শিওর হওয়া যাবে।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভদ্রলোকের জন্য বড় মায়া হচ্ছে আমার, যাই বলো। তবে এ বরং একদিক থেকে ভালই হয়েছে। মিসেস শাহানা খুন হয়েছেন স্বামীর পক্ষে এ বরং সহনীয়। কিন্তু যদি জানা যেত যে, না, মিসেস শাহানা খুন হননি, অপর পুরুষের সাথে রাত কাটাচ্ছিলেন–আঘাতটা আরও ভয়ঙ্কর হত। নিজের স্ত্রীকে অসতী দেখার চেয়ে তার লাশ দেখা বরং ভাল।
শহীদ মুচকি হাসল, কে যে কিনে খুশি হয় তা বলা বড় কঠিন, মহুয়া। একটা রহস্য কি জানো, মি. ফেরদৌস তার শ্রী সম্পর্কে যা মনে করেন তা ভুল। মিসেস শাহানা সম্পূর্ণ তার উল্টো প্রকৃতির। মি. সিম্পসনের ব্যাখ্যাটা আংশিক ঠিক। মিসেস শাহানা ঢাকায় পা দিয়েই পুরুষদের নিয়ে ভয়ঙ্কর এক খেলায় মেতে ওঠে।
ক্রিং ক্রিং…
হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে তুলল শহীদ, শহীদ খান স্পীকিং।
শহীদ ভাই, রাসেল বলছি।
কি খবর, রাসেল? পেলে কিছু তথ্য?
রাসেল বলল, পেয়েছি। কিন্তু আপনি যে রকম আশা করেছিলেন তেমন তো নয়ই বরং ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। মিসেস শাহানার নামে গোটা চট্টগ্রাম শহরে আধখানাও বদনাম নেই। পুরুষদের নাচানো তার স্বভাব ছিল না। অভিনেত্রী, অভিনেতা–অনেকের সাথে কথা বলেছি আমি। সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে, শাহানা ছিল অত্যন্ত ভদ্র, নম্র এবং চরিত্রবতী মেয়ে। স্বামীকে ছাড়া দুনিয়ার কাউকে ভালবাসত না। বিয়ে করার পর বাইরেও বেরুত খুব কম। ওদের বাড়িতে বন্ধু বান্ধবের যাতায়াত ছিল না বললেই হয়। শহীদ ভাই, ভদ্রমহিলাকে এখনও পাওয়া যায়নি নাকি?
পাওয়া গেছে। তার লাশ।
আঁ!
শহীদ বলল, শোনো, রাসেল। এবার তুমি মি. মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করো। ওঁর স্ত্রী সোমবার বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় এসেছিল। সম্ভবত সেদিন রাতেই সে খুন হয়। সন্ধান নিয়ে জানবার চেষ্টা করো সোমবার রাতে মঙ্গলবার সারাটা দিন কোথায় ছিলেন মি. ফেরদৌস। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও তথ্য চাই।
রাসেল উৎসাহের সাথে বলল, ঠিক আছে, শহীদ ভাই। মহুয়াদি, রুবিন, কেমন আছে ওরা?
খুব ভাল আছে। রাসেল, টাকার দরকার হলে…
দরকার নেই, শহীদ ভাই। দরকার হলে আমিই তো জানাব। ছাড়ি।
হ্যাঁ।
শহীদ রিসিভার নামিয়ে রাখতেই মহুয়া প্রতিবাদের সুরে বলল, তোমার মন-চিনতে পারলাম না এতদিনেও। ফেরদৌস সাহেবের ব্যক্তিগত জীবন, সোমবার রাতে তিনি কোথায় ছিলেন–এসব খবর জানতে চাইছ কেন শুনি? শেষ পর্যন্ত আসল খুনীকে ধরতে না পারলে ওই নিরীহ ভদ্রলোককে নিয়ে টানা হেঁচড়া করতে চাও নাকি?
শহীদ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, গেট আউট, ম্যাডাম। আমাকে এখন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ দাও।
কামাল এবং মহুয়া একযোগে উঠে দাঁড়াল। কামাল হাসতে হাসতে বলল, চিন্তাভাবনা করতে চাও করো। ফলাফল কিন্তু সোনার ডিম চাই।
সোনার ডিম নয়, ফলাফল হবে-ঘোড়ার ডিম।কথাটা বলে মহুয়া অন্দর মহলের দিকে পা বাড়াল। সশব্দে হেসে উঠে তাকে অনুসরণ করল কামাল।
শহীদ পায়চারি শুরু করেছে ইতিমধ্যে।
.
০৪.
সে রাতে আর হোটেল ক্যাপিটালে গেল না শহীদ।
সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ড্রয়িংরূমে ঢুকে দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়ে বসল ও। হোটেলের গ্যারেজে গাড়ির ভিতর লাশ প্রাপ্তি সম্পর্কে প্রতিটি দৈনিকই বড় বড় হেডিং করে খবর ছেপেছে। শহীদের জানা নেই এমন দুএকটা তথ্যও পাওয়া গেল। যেমন লাশের সাথে ভ্যানিটি ব্যাগ, হীরে বসানো আঙটি এবং গলার নেকলেসটা পাওয়া যায়নি গাড়ির ভিতরে বা বাইরে, কোথাও কারও হাতের ছাপ মেলেনি। লাশটা যে নিখুঁত এবং নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি রিপোর্টাররা তা উল্লেখ করতে ভুল করেনি। মি. সিম্পসনের উদ্ধৃতিও ছাপা হয়েছে। তার বক্তব্য সেই একই-কোন ডাকাতের বা গুণ্ডার হাতে নিহত হয়েছেন মিসেস শাহানা। কারণ উল্লেখ না করে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, খুনী সর্ব সুঠ করেছে এবং মিসেস শাহানার মুখের চেহারা বিকৃত করেছে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। প্রতিটি দৈনিক খবরের শেষ প্যারায় শহীদের নাম উল্লেখ করে লিখেছে–প্রখ্যাত শখের গোয়েন্দা শহীদ খান এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব নিয়েছেন দেখে অনুমান করা যায় যে এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে জটিলতা অথবা গভীর রহস্য রয়েছে।
কাগজগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে পাইপে টান দিল শহীদ।
ক্রিং ক্রিং…
রিসিভার তুলল শহীদ। অপরপ্রান্ত থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠ ভেসে এল ওর কানে, মি. শহীদ খান, শখের গোয়েন্দাকে চাই আমি।
বলছি।
মার্জিত কিন্তু ব্যগ্র কণ্ঠস্বরের অধিকারী ভদ্রলোক বললেন, মি, শহীদ, আপনি আমাকে চিনবেন না, সকালের কাগজে এই মাত্র দেখলাম মিসেস শাহানা হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব আপনি নিয়েছেন
ঠিকই দেখেছেন।
ভদ্রলোক আবেদনের সুরে বললেন, মি. শহীদ, এই মুহূর্তে আপনার সাথে দেখা করতে চাই আমি, আপনাকে আপনার সাহায্য দরকার আমার। নিহত ভদ্রমহিলা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই আমি.. আমি কি আপনার বাড়িতে আসব?
শহীদ ভদ্রলোককে ওর বাড়ির ঠিকানা জানাল, বলল, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি।
ধন্যবাদ, মি. শহীদ, ধন্যবাদ।
দশ মিনিটও কাটল না, শহীদের বিরূমে প্রবেশ করলেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের বয়স কোনমতেই চল্লিশের বেশি হবে না। পরনে দামী কাপড়ের ট্রপিকাল স্যুট। মাথার পিছন দিকে এতাই একটা টাক। চুলে এখনও পাক ধরেনি। মুখটা গোলগাল, শরীরে মেদ থাকলেও, খুব বেশি নয়। ভদ্রলোক পাঁচ ফুট দশ, ইঞ্চির মত লম্বা। গায়ের রঙ শ্যামলা।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শহীদ লোককে। লক্ষ করল রূমাল দিয়ে ঘন ঘন কপালের ঘাম মুছছেন। নার্ভাস হয়ে পড়েছেন বোঝা যায়।
বসতে অনুরোধ করে শহীদ বলল, ফোনে আপনি আপনার নাম বলেননি।
আমার নাম দেলওয়ার হোসেন। দিনাজপুর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছি। দিনাজপুরে কয়েকটা ব্যবসা আছে আমার। ঔষধের দোকান, বাইসাইকেল পার্টসের এজেন্সী, মটর পার্টসের দোকান, এইসব।
শহীদ বলল, আপনি ঠিক কি বলতে এসেছেন জানি না। তবে মিসেস শাহানাকে নিয়ে গত সোমবার রাত এগারোটার দিকে আপনি লাইট অ্যাণ্ড শ্যাডো হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। তাই না?
দেলওয়ার হোসেনের চোখ কপালে উঠল, বললেন, হ্যাঁ–কিন্তু এ খবর আপনি জানলেন কিভাবে?
শহীদ বলল, জানি। আপনি বরং আপনার বক্তব্য বলুন।
দেলওয়ার হোসেন বলল, কথাগুলো আসলে জানানো দরকার পুলিশকে। গতকাল সন্ধ্যায় যোগফলে ভদ্রমহিলার ছবি দেখা অবধি আমি ছটফট করতে শুরু করি। তখন ভেবেছিলাম তার সন্ধান পাওয়া যাবে।
বিরতি নিয়ে মাথা দোলালেন তিনি। আবার শুরু করলেন, কিন্তু সকালে তাঁর নিহত হবার খবর কাগজে দেখে ঘাবড়ে গেলাম। পুলিশের কাছে যাবার ইচ্ছা থাকলেও মন সায় দিল না। মি. শহীদ, আপনার ডিমাণ্ড অনুযায়ী ফী দিতে আমি রাজি আছি, আপনি শুধু আমাকে পুলিশী ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন কিনা বলুন।
শহীদ বলল, আপনার কথা শেষ করুন আগে। সব না শুনে কথা দিই কিভাবে? আপনি যদি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত না হন…
অবশ্যই আমি জড়িত নই! সব কথা বলছি আপনাকে, তাহলে বুঝতে পারবেন।
সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে দেলওয়ার হোসেন আবার শুরু করলেন, রাত সাড়ে নটার দিকে আমার সাথে পরিচয় হয় মিসেস শাহানার। এর আগে আপনাকে জানাতে চাই, স্ত্রীর কাছে আমি একজন আদর্শ এবং বিশ্বস্ত স্বামী। জুয়া আমি সচরাচর খেলি না। মদও খাই না, স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের ব্যাপারে, সত্যি কথা বলতে কি, অন্যায় কোন অভিজ্ঞতাও নেই। সোমবার বিকেল থেকে আমার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বাইরে বেরুতে না পারলেও এক রকম জোর করে আমাকে সন্ধ্যাটা বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে আসার জন্য ব্যস্ত করে তোলেন। অগত্যা একাইবেরুই আমি। আমার এক বন্ধুর সাথে আমি লাইট অ্যাও শ্যাডোয় যাই। ওখানে ফ্যাশ খেলা হয় তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমার বন্ধ সরাসরি আমাকে সেই তাসের আসরে নিয়ে যায়। খেলা চলছে দেখে আমিও ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ি এবং খেলতে বসি। রাত তখন সাড়ে আটটা হবে হয়তো। মিসেস শাহানা সভবত এই সময়ের খানিক পর ওখানে পৌঁছান। আমাদের টেবিলেই বসেন তিনি। সাথে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তবে তাকে আমি তখনও দেখিনি। না দেখার কারণ, তখন আমি প্রচুর হেরে গেছি, কোনও দিকে খেয়াল দেবার মত মনের অবস্থা ছিল না।
দম নিয়ে আবার শুরু করলেন লেওয়ার হোসেন, মিসেস শাহানা খেলতে বসার পর খেলার মোড় ঘুরে গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমার লস কভার করে বেশ কিছু টাকা জিতলাম আমি, ঠিক এই সময় থেকে যেচে পড়ে আলাপ শুরু করলেন মিসেস শাহানা আমার সাথে। আলাপ শুরু করলেন, মানে, ব্যক্তিগত কথা জানতে চাইলেন এবং নিজের সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। কথায় কথায় তিনি বললেন, তার স্বামী তাকে পনেরো দিনের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন ফুর্তি করতে…এবং তিনি চানও তাই করতে। ভদ্রমহিলার মার্জিত কথা বলার ভঙ্গি, চেহারা, পোশাক ইত্যাদি দেখে আমি মুগ্ধ হই। বাজে মেয়েদের একজন বলে মনে হচ্ছিল না তাকে। তা মনে হলে আমি তাকে এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করতাম। যাক, এখানে একটা কথা স্বীকার করা উচিত। ভদ্রমহিলার প্রতি আমি সত্যি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আপনাকে বলেছি, স্ত্রী ছাড়া আর কোন মেয়ে আমার জীবনে আসেনি। কিন্তু সেই রাতে, ভদ্রমহিলার পাশেবসে আমার মন অন্য রকম হয়ে উঠল। আমি নির্জনে ভদ্রমহিলার সান্নিধ্য পাবার জন্য পাগল না হলেও, ভিতরে ভিতরে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। একজন সদ্য পরিচিত ভদ্রমহিলার প্রতি এই রকমভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠা শোভন বা সত নয়, তা আমি জানি। কিন্তু এর জন্যে যতটা না আমি দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী ভদ্রমহিলা স্বয়ং। তিনি ক্রমশ আমার অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। এক সময়, লক্ষ করলাম তিনি আমার গায়ে গা ঘেঁষে বসেছেন। তার পোশাকে ছড়ানো সেন্টের গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। খানিক পর, তিনি কণ্ঠস্বর নামাতে নামাতে একেবারে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলেন। একবার তিনি আমার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে অতি অন্তরঙ্গভাবে বললেন আমার সাথে এখানে এক লোক এসেছে। লোকটা ছ্যাচড়া! আমার পিছু ছাড়ছে না! অনেকদিনের পরিচয় কিছু বলতেও পারছি না। লোকটাকে ভাগাবার জন্যে, আপনি কি আমাকে সাহায্য। করবেন? আমি সহাস্যে জানতে চাই–কিভাবে সাহায্য করতে পারি আমি? তিনি বলেন, বুঝতেই তো পারছেন, লোকটাকে ভাগাতে না পারলে আপনার সাথে যেতে পারব না। ভাগাতে না পারলে, অন্তত আমার পিছু ত্যাগ করে যাতে তার ব্যবস্থা করতে হবে। লোকটা নীরস ইমপোটেন্ট। একটুও ভাল লাগে না ওকে আমার! ভাল কথা, আপনি আড্ডাটা পছন্দ করেন তো? আমার স্বামী নেই এখানে, আমি একা-সুযোগটা আপনি নিতে পারেন। আমি আবার সেই একই প্রশ্ন করি, বলি, সে দেখা যাবে। কিন্তু কি সাহায্য চান আপনি? তিনি বলেন, আপনি। আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলুন, হাসুন। ব্যাপারটা লক্ষ করবে লোকটা। মনে মনে নিরাশ হয়ে পড়বে। তারপর একসময় আমরা এক সাথে উঠে দাঁড়িয়ে। বেরিয়ে যাব এখান থেকে, কেমন? আমি রাজি হই। এবং খানিক পর ওর কথা মত তাই করি।
শহীদ বলল, ওখান থেকে বেরিয়ে আপনারা কোথায় যান?
দেলওয়ার হোসেন বলেন, ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে হঠাৎ মনটা বেঁকে বসে। স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, বুঝতে পারি। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার পর আমি বলি, চলুন, আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেখানেই যাই। আপনার সাথে আমার স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দেব।
শহীদ হঠাৎ হেসে ফেল। বলল, তারপর।
ভদ্রমহিলা বললেন..বললেন…
দেলওয়ার হোসেনের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। তিনি কথাটা শেষ করতে পারছেন না বুঝতে পেরে শহীদ জানতে চাইল, কি বললেন তিনি?
বললেন বললেন, না, আগে অন্য কোন হোটেল রুম ভাড়া নিয়ে… আসলে তিনি কি বোঝাতে…।
শহীদ বলল, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি বলে যান।
দেলওয়ার হোসেনের কণ্ঠস্বর খাদে নামল, গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন তিনিই। এক সময় বললেন, আমরা নিউ সিটি হোটেলে যাচ্ছি। আমি কোন আপত্তি করলাম না। ইতিমধ্যে, তার প্রস্তাবে, আমি মনে মনে রাজি হয়ে গেছি। স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে একথা একদম মনেই নেই।
তারপর কি হলো? সিটি হোটেলে পৌঁছলেন আপনারা…।
না-হ্যাঁ, বলতে পারেন পৌঁছলাম। হোটেলটা নিশ্চয়ই চেনেন আপনি? রাস্তার ধারেই। হোটেলের গেটেই গাড়ি থামালেন মিসেস শাহানা। পোটার এবং গেটম্যান, এক সাথে স্যালুট করল! পোর্টারই খুলে দিল আমার পাশের দরজাটা। আমি নেমে মিসেস শাহানাকে নামতে সাহায্য করার জন্য তার দিকের দরজার প্রতি হাত বাড়ালাম এমন সময় হুস্ করে গাড়িটা সামনে থেকে সরে গেল চোখের পলকে।
মানে! সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল শহীদ।
দেলওয়ার হোসেন ম্লান মুখে বললেন, আপনার মতই, আমিও চমকে উঠেছিলাম। যাক, পরের ঘটনা বলি। বলার নেইও বিশেষ কিছু। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, গাড়ির পিছনের লাল দুটো আলো ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে আমাকে ব্যঙ্গ করতে করতে। এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল আলো দুটো। এতক্ষণে খেয়াল হলো, পোর্টার এবং গেটম্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে আমারই পাশে। লজ্জায় মাথা তুলতে পারলাম না। আড়চোখে দেখি দুজনেই চেষ্টা করছে হাসি চেপে রাখতে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম আমি।
শহীদ বলল, এখানেই শেষ? এরপর আর দেখেননি আপনি মিসেস শাহানাকে?
না। এরপর আর দেখিনি।
শহীদ বলল, আপনি যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে ঘটনাটার কথা নিউ সিটি হোটেলের পোর্টার এবং গেটম্যান জানে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা সাক্ষী দেবে।
দেলওয়ার হোসেন বললেন, ঘটনাটা ভুলে যাবার মত নয়। খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা, তাই না? সাক্ষী না দেবার কোন কারণ নেই।
শহীদ বলল, উঠুন তাহলে। আপনাকে আমি আপনার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে নিউ সিটিতে যাব।
মি, শহীদ, পুলিশের সন্দেহের দৃষ্টি থেকে মুক্ত থাকার জন্যে আপনার কাছে এসেছি আমি। যা জানি, যা সত্যি সবই আপনাকে বলেছি। আপনি
আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে অবশ্যই পুলিশের সন্দেহ যাতে আপনার ওপর না পড়ে তার ব্যবস্থা আমি করব। চলুন, সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
উঠল ওরা।
.
০৫.
দুপুর অতিক্রান্ত প্রায়। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে একমনে পাইপ টেনে চলেছে শহীদ। মহুয়া উপস্থিত থাকলেও, সে একটা রোমাঞ্চোপন্যাসে ডুবে আছে গভীর মনোযোগের সাথে।
মিসেস শাহানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেই চিন্তাভাবনা করছিল শহীদ। দেলওয়ার হোসেনের কাহিনী যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ পেয়েছে ও। নিউ সিটি হোটেলের গেটম্যান এবং পোর্টার দুজনই তার কাহিনীর সত্যতার সমর্থনে বক্তব্য রেখেছে। ঘটনাটা সবিস্তারে উল্লেখ করেছে তারা। মিসেস শাহানাকে খুব ভাল করে দেখার সুযোগ না পেলেও, চেহারাটা ভুলে যাবার মত নয়। শহীদ ওদেরকে মিসেস শাহানার ফটো দেখায়। ওরা বলে এই ভদ্রমহিলাই, মনে হচ্ছে।
সুতরাং দেলওয়ার হোসেন সাহেব নির্দোষ। তার উপর সন্দেহ করা চলে না। প্রশ্ন হলো, মিসেস শাহানা তার সাথে অমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করেছিল? দেলওয়ার হোসেনকে লোভ দেখিয়ে লাইট অ্যাও শ্যাডোর জুয়ার আসর থেকে বের করে এনে এভাবে বোকা বানাবার পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য ছিল?
ছিল। কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে শহীদের। কিন্তু উদ্দেশ্য বা রহস্যটা যে কি তা জানতে পারছে না ও।
বারান্দায় জুতোর শব্দ। চিনতে পারল শহীদ। মি. সিম্পসনের কাছে পাঠিয়েছিল ও কামালকে।
মহুয়া হাতের বইটা একপাশে রেখে মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। কামালকে দেখা গেল দরজার সামনে।
এসো। নতুন কোন খবর এনেছ? প্রশ্নটা স্বভাবতই মহুয়ার।
মহুয়ার পাশে বসে পড়ল কামাল। বলল, হ্যাঁ। মি. সিম্পসন বলছেন, আগামী ছয় ঘণ্টার মধ্যে তিনি মিসেস শাহানার হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হবেন।
কথাটা বলেই কামাল হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল।
হাসি থামতে আবার মুখ খুলল সে, বলল, ভুলটা ডাঙিয়ে দিয়ে এসেছি। তার ধারণা ছিল, দেলওয়ার হোসেন হত্যাকারী। ইকবাল চৌধুরীর জবানবন্দী পড়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান তিনি।
শহীদ জানতে চাইল, তোকে যে খবর নিতে পাঠিয়েছিলাম তার কি হলো?
কামাল বলল, মি. সিম্পসন লাশটার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে নিজেই সন্দিহান ছিলেন, বুঝলি। চট্টগ্রামে লাশের, ফিঙ্গারপ্রিট পাঠিয়েছিলেন তিনি গতকালই। সেখানকার পুলিশ ফেরদৌস সাহেবের বাড়িতে গিয়ে মিসেস শাহানার পুরানো হাতের ছাপ সংগ্রহ করার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। সেই পুরানো হাতের ছাপের নমুনা পেয়েছেন খানিক আগে মি. সিম্পসন। মিলিয়ে দেখেছেন–হুবহু এক। অর্থাৎ এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে লাশটা মিসেস শাহানারই।
শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠল। খানিক পর জানতে চাইল, পোস্ট মর্টেমের রিপেটি কি বলছে।
বুলেটই মৃত্যুর কারণ। মিসেস শাহানার রাউজটা ছিল লো কাট ফলে বুলেটটা বুকে বিধলেও রাউজ বা শাড়িতে ফুটো করতে পারেনি। স্বভাবতই, শাড়িটা ছিল না বুকের কাছে। বুলেট ছোঁড়া হয়েছে থার্টি-টু ক্যালিবার পিস্তল থেকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস শহীদ? মুখের ওই সব ভয়ানক গভীর ক্ষতওলো করা হয়েছে খুন করার পর।
মহুয়া শহীদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখল শহীদের চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। কি যেন বলতে গিয়েও বলল না সে।
কামাল বলে চলেছে, মেডিক্যাল এগজামিনার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে পজিটিভ হতে পারছেন না। তবে সোম এবং মঙ্গলবার রাতের মধ্যে যে কোন সময় মৃত্যু হয়েছে–এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। সোমবার রাতের ওপর জোর দিচ্ছেন বেশি। লাশের নিচে, কালো ট্রাঙ্কের মেঝেতে, রক্তের দাগ নেই:…তার ধারণা মৃত্যুর অন্তত এক ঘণ্টা পর লাশটা ঢোকানো হয়েছে ট্রাঙ্কে। আর একটা কথা, মৃত্যুর ঘণ্টা দুয়েক আগে মিসেস শাহানা মুরগীর রোস্ট এবং মদ খেয়েছিলেন।
কামাল শেষ করল।
মহুয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলে?
মুচকি হেসে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শহীদ বলল, আমাকে চ্যালেঞ্জ করার মনোভাব রয়েছে দেখছি তোমার মধ্যে?
অবশ্যই। তুমি অকারণে বেচারা ফেরদৌস সাহেবকে সন্দেহ করছ কেন? আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ফেরদৌস সাহেব তার স্ত্রীকে খুন করতে পারেন না। এ ব্যাপারে বাজি ধরতে পারি আমি।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। দেখা যাক কি হয়। রাসেলের ফোন আসবে, সময় হয়ে গেছে…
ক্রিং…ক্রিং
শহীদ দ্রুত তুলে নিল ফোনের রিসিভার, শহীদ খান স্পীকিং।
শহীদ ভাই, আপনাকে ফোন করতে দেরি হয়ে গেল। আজ রবিবার, মানুষজনকে নির্দিষ্ট কোথাও পাওয়া যায় না।
শহীদ বলল, কতদূর কি জানতে পারলে বলো তো!
রাসেল বলল, আপনি হয়তো নিরাশ হবেন, শহীদ ভাই! ফেরদৌস সাহেব সম্পর্কে বিশদ খবর সংগ্রহ করেছি আমি। কোন সন্দেহ নেই যে তিনি সোমবার এবং মঙ্গলবার দিন রাতে চট্টগ্রাম শহরেই ছিলেন।
শহীদ বলল, হু। রাসেল আবার শুরু করল, তবে নতুন একটা খবর আছে। ফেরদৌস সাহেব এবং তার স্ত্রীর নামে এক লক্ষ টাকার একটা যুক্ত বীমা আছে। একজনের মৃত্যু হলে টাকাটা অপরজনের পাবার কথা। টাকাটা একটা মোটিভ হতে পারে তাই না? ওদের বন্ধু-বান্ধবের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানতে পেরেছি ইদানীং ফেরদৌস সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না, সংকটেই ছিলেন বলা যায়। আপনি চাইলে আমি আগামীকাল জানার চেষ্টা করতে পারি ফেরদৌস সাহেব ধার দেনা করেছিলেন কিনা, করলে কি পরিমাণ করেছিলেন।
শহীদ জানতে চাইল, আর কিছু?
রাসেল বলল, নির্ঘাত! সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ খবর-খবর না বলে গুজব বলাই ভাল
গুজব?
হ্যাঁ। একটি যুবতী মেয়েও জড়িত, শহীদ ভাই। ফেরদৌস সাহেবের অফিস সেক্রেটারি মিস জেসমিন। বছর তিনেক ধরে ফেরদৌস সাহেবের ফার্মে চাকরি করছে মেয়েটা। প্রথম বছর সম্পর্কটা যা হওয়া উচিত তাই ছিল। পরের বছর ফেরদৌস সাহেবের সাথে সিরিয়াস ধরনের তিক্ত হয়ে ওঠে তার সম্পর্ক। কিন্তু এই তিক্ততার কারণ কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ওদের দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার…আমি বলতে চাইছি, গোপনীয় ব্যাপার। সবাই আশা করেছিল মিস জেসমিনের চাকরি নির্ঘাত যাবে। কিন্তু তা যায়নি। অনেকের কাছেই এটা একটা রহস্য। কেন যে ফেরদৌস সাহেব তাকে চাকরি থেকে সরাননি তা জানা যায়নি। কারও কারও ধারণা মিস জেসমিনকে জয় করতেন ফেরদৌস সাহেব। কারণটা অজ্ঞাত। তারপর, তৃতীয় অর্থাৎ চলতি বছরের গত মাস দুয়েক আগে থেকে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে ওদের সম্পর্ক প্রায় রাতারাতি শুধু স্বাভাবিক নয়, রীতিমত মধুর হয়ে ওঠে। রহস্যময়, তাই না?
শহীদ বলল, খুবই। কি জানতে পেরেই তার সম্পর্কে?
রাসেল নাটকীয় কণ্ঠে বলল, তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েও রহস্যের গন্ধ পেয়েছি। মিসেস শাহানার সাথে তার চেহারার, চুলের, দৈহিক আকার আকৃতির প্রচুর মিল আছে। আরও বিস্ময়কর ঘটনা, গত সোমবার থেকেই সে ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে পনেরো দিনের জন্যে। কক্সবাজারে বেড়াতে যাবার কথা তার।মিনার্ভা হোটেলের রুম রিজার্ভ করা হয়েছিল হপ্তা খানেক আগে।
শহীদ বলল, কাজ বন্ধ কোরো না, রাসেল। মিস জেসমিন সম্পর্কে যা পাও সংগ্রহ করো, কক্সবাজারের মিনার্ভা হোটেলেও ফোন করে খবর নাও।
রাসেল উৎসাহভরে জানাল, আজই আমি খবর নিচ্ছি। শহীদ ভাই, ওদিকের খবর কি? নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?
রাসেলকে সর্বশেষ ঘটনার কথা জানান শহীদ। রিসিভার নামিয়ে রাখার আগে বলল, ধন্যবাদ, রাসেল।
মহুয়া সাগ্রহে প্রশ্ন করল, কি জানলে?
শহীদ কলল, বিশেষ কিছু নয়। মিস জেসমিন জড়িত।
কে?
শহীদ বলল, মি. ফেরদৌসের অফিস সেক্রেটারি। মিসেস শাহানার সাথে চেহারাগত মিল আছে। সে-ও…।
ধীরে ধীরে সব বলল শহীদ। সব শুনে মহুয়া একটু নিরাশই হলো। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা সবাই উঠে পড়ে লেগেছ বেচারা ফেরদৌস সাহেবকে ফাসাবার জন্য…যাই, চা করতে বলে আসি।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, মি, ফেরদৌসের সাথে দেখা করেছিলি?
কামাল বলল, করেছিলাম। যাই বলিস শহীদ, ভদ্রলোককে দেখে সন্দেহ করা যায় না। স্ত্রীর শোকে পাথর হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।
শহীদ বলতে শুরু করল, কি জানিস, মানবচরিত্র…
ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
ভুরু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াল শহীদ, বলল, হ্যালো?
রাসেলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল তারের মাধ্যমে সুদূর চট্টগ্রাম থেকে, জরুরী একটা খবর এইমাত্র পেলাম শহীদ ভাই। আপনার সাথে কথা শেষ করে ফোন করেছিলাম কক্সবাজারে মিনার্ভা হোটেলে। হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, মিস জেসমিন গত সোমবার হোটেলে পৌঁছাননি। এক হপ্তা আগে রূম রিজার্ভ করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিন দিন পর অর্থাৎ শুক্রবারদিন ফোন করে মিসজেসমিন রিজার্ভেশন বাতিল করে দেন।
এখন সে কোথায় তাহলে?
কেউ জানে না। আজ দুপুরে ফোনে কথা বলেছি আমি তার রূম-মেট মিস রেখার সাথে, একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওরা থাকে বছর খানেক থেকে এক সাথে। এই মিস রেখাই তথ্যগুলো দেয় আমাকে। সে তো জানে মিস জেসমিন সোমবার থেকে ছুটি নিয়েছে, ছুটি নিয়ে চলে গেছে কক্সবাজারে। রিজার্ভেশন বাতিল করার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। জানলে অবশ্যই বলত আমাকে।
গম্ভীর, থমথমে হয়ে উঠেছে শহীদের মুখ। বলল, মিস জেসমিন–তার সন্ধান চাই আমরা, রাসেল। খুঁজে বের করো তাকে জানার চেষ্টা করো কেন সে তার, রূম-মেটকে না জানিয়ে হোটেলের রিজার্ভেশন বাতিল করেছে।
রিসিভার রেখে দিল শহীদ।
কামাল বলে উঠল, রহস্য দানা বাঁধছে…
শহীদ বাধা দিয়ে বলল, না। রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
.
০৬.
পরদিন দুপুরে ডাইনিংরুমে খেতে দিয়ে মহুয়া, শহীদকে বলল, জানো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, দেলওয়ার হোসেন ভদ্রলোক তোমাকে উপহার পাঠিয়েছেন।
উপহার?
মহুয়া বলল, হ্যাঁ। দশটা বিদেশী মদের বড় বড় বোতল। হুইস্কি আর ব্র্যাণ্ডি। ছোট্ট একটা চিরকুটও আছে সাথে।
শহীদ অবাক হলো, উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন মদ? ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। চিরকুটটা কোথায়?
ড্রয়িংরুমে টেবিল ক্লথের নিচে রেখে দিয়েছি।
খাওয়া শেষ হতে ড্রয়িংরূমে এসে বসল শহীদ। চিরকুটটা বের করল যথাস্থান থেকে। দেলওয়ার হোসেনের হস্তাক্ষর, ছোট ছোট, পরিষ্কার। বেশ কয়েকটা লাইন লিখেছেন তিনি
শ্রদ্ধেয় শহীদ সাহেব,
সালাম নেবেন। আপনার উপকার আমি আজীবন স্মরণ রাখব। আপনার ঋণ আমি কোনভাবেই পরিশোধ করতে পারব না। বিদেশী জিনিসগুলো পাঠালাম, গ্রহণ করলে বাধিত হব। ওই জিনিসের ইমপোটারআমি, লাইসেন্স আছে বলে পাই। কিনে পাঠিয়েছি ভেবে অন্য কিছু মনে করবেন তাই কথাটা উল্লেখ করলাম।
ঢাকায় এসে একটা শিক্ষা পেয়েছি। কথা দিচ্ছি স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করার চেষ্টা আর করব না। আন্তরিক ধন্যবাদ নেবেন।
ইতি, আপনার গুণমুগ্ধ,
দেলওয়ার হোসেন।
মহুয়া ড্রয়িংরুমে ঢুকতে শহীদ জানতে চাইল, কোথায় সেগুলো?
কিচেনরূমে রেখে দিয়েছি।
শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিল ফোনের। ডায়াল করে বলল, কামাল, তোকে ক্যাপিটাল হোটেলের বেলায় আবদুল হক এবং রিসেপশনিষ্ট ফারুক সাহেব সম্পর্কে রিপোর্ট করতে বলেছিলাম। কি হলো?
কামাল বলল, রিপোর্ট তৈরি করেছি। তোকে জানাবার প্রয়োজন মনে করিনি। ওদের দুজনেরই রেকর্ড ভাল। সোমবার রাতে ওরা যে যার জায়গা মতই ছিল। তাছাড়া মিসেস শাহানা ইকবাল চৌধুরীর সাথে বেরিয়ে যাবার পর আর ফেরেনি ক্যাপিটালে বা ক্যাপিটালের আশে পাশে।
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন মিসেস শাহানার মামাতো ভাই বুলবুলকে গতকাল সকালেও থানায় আনিয়েছিলেন। একথা তুই আমাকে বলিসনি কেন?
বলিনি এই জন্যে যে জেরা করার পর তাকে আমার সামনেই ছেড়ে দেন। বুলবুল ছেলেটা নিরীহ টাইপের, সে কথা তো আগেই বলেছি আমি। ওর সম্পর্কেই রিপোর্ট তৈরি করেছিলাম।
শহীদ বলল, বুঝেছি! শোন, তোর সাথে কথা আছে। আয় দেখি কিছুক্ষণের মধ্যে একবার।
কি কথা রে?
শহীদ বলল, কী আশ্চর্য! আমাদের হাতে একটা মার্ডার কেস রয়েছে তা বুঝি ভুলে গেছিস? সলভ করতে হবে না?
শহীদ, তুই
কামালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শহীদ রিসিভার রেখে দিল ক্রেডলে। পরমুহূর্তে ক্রিং…ক্রিং..শব্দে বেজে উঠল ফোনের বেল। আবার রিসিভার তুলল শহীদ, বলল, শহীদ খান স্পীকিং।
রাসেল বলছি, শহীদ ভাই। মিস রেখার সাথে আজ কথা বলেছি আমি। মিস জেসমিন মিনার্ভা হোটেলে নেই শুনে অবাক হলেও, চমকে উঠতে দেখিনি তাকে। মনে হলো, সে মনে মনে ধরে নিয়েছে মিস জেসমিন কক্সবাজারে যাবার নাম করে অন্য কোথাও ছুটি কাটাতে গেছে।
অন্য কোথাও মানে?
রাসেল বলল, আমার ধারণা, ফেরদৌস সাহেবের সাথে, এই চট্টগ্রামেই ছুটি কাটাবার জন্যে রয়ে গেছে মিস জেসমিন। ফেরদৌস সাহেব এবং মিস জেসমিন হয়তো পরিকল্পনা করেছিল মিসেস শাহানা ঢাকায় চলে গেলে মিস জেসমিন ফেরদৌস সাহেবের বাড়িতে গোপনে থাকবে।
শহীদ বলল, বুঝতে পেরেছি তোমার কথা। মি. ফেরদৌসের অফিসে গিয়েছিলে?
গিয়েছিলাম। নিজের পরিচয় না দিয়ে আলাপও করেছি অনেকের সাথে। কর্মচারীদের ধারণা, মিস জেসমিনকে ইদানীং একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছেন ফেরদৌস সাহেব। ফেরদৌস সাহেবের আর্থিক সংকট সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পেরেছি আমি। রীতিমত দেনায় ডুবে আছেন তিনি!
দেনায় ডোবা অবস্থায় প্রচুর টাকা দিয়ে স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায় ফুর্তি করতে। মিলছে না।
রাসেল বলল, হ্যাঁ, মিলছে না। কিন্তু আমি আবারও খোঁজ নিয়ে কনফার্ম হয়েছি যে ফেরদৌস সাহেব সোম এবং মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছেড়ে কোথাও যাননি।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে শহীদ বলল, ঠিক আছে, রাসেল। তোমার কাজ শেষ। এ ব্যাপারে আর দৌড়াদৌড়ি কোরো না।
রিসিভার নামিয়ে রেখে মহুয়ার দিকে তাকাল শহীদ, বলল, মহুয়া, খানিকক্ষণের মধ্যে কামালকে আশা করছি আমি। ও এলে আমরা তিনজন একসাথে বসে আলোচনা করব।
কিসের আলোচনা?
মিসেস শাহানার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা। রহস্যটার সমাধান বের করতে হবে না?
মহুয়া বলল, তার মানে?
শহীদ বলল, তার মানে পরে শুনো। আগে তুমি কফির ব্যবস্থা করো।
মহুয়া ড্রয়িংরূম ত্যাগ করল।
কি রে, খুনীর পরিচয় জানতে পেরেছিস নাকি? তর সইল না…
কামাল ঢুকল অপর দরজা দিয়ে ড্রয়িংরুমে। বসল শহীদের মুখোমুখি।
শহীদ মুচকি হাসল।
হাসছিস যে?
শহীদ বলল, আজ সকালে কুয়াশা ফোন করেছিল। বিকেলের দিকে আসবে বলেছে।
বিকেল তো হয়েই গেছে।
শহীদ বলল, যে কোন মুহূর্তে আশা করছি তাকে।
কামাল অন্দর মহলে যাবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, মহুয়াদি কোথায়?
কফি আনতে গেছে।
খানিকপর মহুয়া ঢুকল, পিছনে তোতলা লেবু। তার হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে কেটলি এবং কয়েকটা কাপ।
কামাল হঠাৎ বলল, আচ্ছা শহীদ, কুয়াশাকে তুই ইকবাল চৌধুরীর অফিসে দেখেছিলি, না? কারণটা জানিস?
শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, কিছুই জানি না আমি। জানাবার হলে কুয়াশা অবশ্যই জানাত। হয়তো ব্যাপারটা গোপনীয়…তবে আজ যখন আসবে বলেছে, এ ব্যাপারে হয়তো কিছু বলতেও পারে।
মহুয়া কাপে কফি ঢালছে।
শহীদ মহুয়ার হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, এবার কাজের কথা শুরু করি। শুরু করা যাক–একেবারে প্রথম থেকে। ধরা যাক প্রথমে.মি. মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌসকে। তিনি একজন ইনডেন্ট ব্যবসায়ী। প্রেম করে বিয়ে করেছেন চট্টগ্রামের মঞ্চাভিনেত্রী অসাধারণ সুন্দরী শাহানাকে। সুন্দরী শাহানাকে বিয়ে করেও তিনি সন্তুষ্ট নন, সেক্রেটারি মিস জেসমিনের সাথেও ইদানীং তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। মিস জেসমিন অসাধারণ সুন্দরী না হলেও চেহরাগত দিক থেকে মিসেস শাহানার সাথে তার আশ্চর্য মিল আছে। সে যাই হোক, মি. ফেরদৌস, তার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়া সত্ত্বেও, মিসেস শাহানাকে একা.ঢাকায় পাঠালেন প্রায় জোর করে ছুটি কাটাবার জন্যে বা ফুর্তি করার সুযোগ দেয়ার জন্যে। সেই একই সময়ে মি, ফেরদৌসের সেক্রেটারি মিস জেসমিনও অফিস থেকে ছুটি নিল। এক নর প্রশ্ন, মিসেস শাহানা কি জানতেন মিস জেসমিনের ছুটি নেবার ব্যাপারটা? জানলে তার প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত? তিনি কি কিছু সন্দেহ করবেন?
মহুয়া বলল, সম্ভবত মিসেস শাহানা ব্যাপারটা জানতেন না। জানলে- হ্যাঁ, সন্দেহ হওয়া অসম্ভব নয়।
শহীদ কাপে চুমুক দিয়ে বলল, এবার মিসেস শাহানাকে ধরি। বিয়ের আগে বা পরে তিনি ছিলেন শান্ত, ভদ্র, ন, এবং চরিত্রবতী। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একা ঢাকায় পা দিয়েই তিনি উট আচরণ করতে শুরু করলেন। আমূল পরিবর্তন দেখা গেল তার মধে। তর হাবভাব, কথাবার্তা দেখে যে কোন পুরুষ ভাবতে বাধ্য-ইচ্ছা করলে তাকে পাওয়া সম্ভব। এক এক করে গুণতে থাকে। ইকবাল চৌধুরী, বুলবুল, রিসেপশনি ফারুক, পোটার আবদুল হক, বারটোর কুমার, মি. দেলওয়ার হোসেন। দুজন। ঢাকায় আসার প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই ছয়জন পুরুষকে মিলে শাহানা একভাবে না একভাবে সঙ্গদানের বা অবৈধ ঘনিষ্ঠতার প্রস্তাব দিয়েছেন। দুনম্বর প্রশ্ন হলো–এ কিভাবে সম্ভব? মিসেস শাহানা রাতারাতি বদলে একেবারে অন্য রকম, সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের হয়ে উঠলেন কিভাবে? কেন?
কেউ কোন মন্তব্য করল না।
শহীদই বলল, উত্তরটা কি? দুটো পসিবিলিটির কথা উল্লেখ করছি আমি। এক, হয় গত সোমবার বিকেলের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম থেকে যিনি ঢাকায় আসেন তিনি মিসেস শাহানা নন। নয়তো, তিনি যদি মিসেস শাহানাই হন তাহলে ঢাকায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য নিয়ে অভিনয় করতে শুরু করেন, নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য নিয়ে লোকজনের দৃষ্টি নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন-যদিও উদ্দেশ্যটা এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই।
শহীদ বিরতি নিয়ে পাইপে টোবাকো ভরল।
কামাল বলল, কিন্তু আমরা জানি, তিনি স্বয়ং মিসেস শাহানাই। এক ডজন লোক তার ছবি দেখে সনাক্ত করেছে তাকে। তাছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্টের রেজাল্টও পজিটিভ।
শহীদ বলল, আমরা সবাই জানি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিথ্যে বলে না। ঠিক, তিনি যে মিসেস শাহানা এ সত্য অখণ্ডনীয় বলে ধরে নিতে হবে। তবে এ বিষয়ে পরে আলোচনা করব আমরা। যা বলছিলাম খানিক আগে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে, বিশেষ কোন কারণে মিসেস শাহানা লোকজনের দৃষ্টি তার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন কেন? ইতিহাস বলছে, তিনি সে-ধরনের মেয়ে নন। তাহলে?
মহুয়া এবং কামাল চুপ করে রইল।
শহীদ বলল, রহস্যের জটিলতা এখানেই। দেখা যাক এই জটিলতাকে সরুল করা যায় কিনা।
মহুয়া হঠাৎ কথা বলে উঠল, দাঁড়াও, আমি বলছি। মিসেস শাহানার অমন অদ্ভুত আচরণের কারণ হয়তো এই যে, তিনি চেয়েছিলেন কয়েকদিন হোটেলে না থেকে অন্য কোথাও থাকবেন। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে অমন কৃত্রিম আচরণ করছিলেন। যাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ পরে তাঁর সুইটে তাঁকে অনুপস্থিত দেখে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জানতে পারেন তার প্রকৃতির কথা। জানতে পেরে নিশ্চিন্তু মনে থাকতে পারেন এই ভেবে যে ভদ্রমহিলা অস্থির প্রকৃতির, কোথাও হয়তো ফুর্তি করছেন।
ঘটেছিলও আসলে তাই। হোটেল কর্তৃপক্ষ সেকথা ভেবেই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এখন প্রশ্ন হলো,-মিসেস শাহানা হোটেল ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার কথা কেন ভেবেছিলেন? ভাব্য কাল কি হতে পারে?
শহীদের প্রশ্নের উত্তর দিল না এবার মহুয়া। কামালও নিঃশব্দে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে লাগল।
এবার অন্য একজনকে নিয়ে আলোচনা করব আমরা। মিসেস শাহানার ব্যাপারটা আপাতত থাক। মহুয়া, তুমি দৈব-দুর্ঘটনা মানে?
মাঝে মাঝে দৈব-দুর্ঘটনা ঘটেই তো।
শহীদ বলল, আমি মানি না। অন্তত হত্যাকাণ্ডে দৈব-দুর্ঘটনা ঘটলে আমি মেনে নিতে পারি না। মিস জেসমিন-এবার তাঁর কথায় আসা যাক। চট্টগ্রাম থেকে সোমবার বিকেলে মিস জেসমিন নিখোঁজ হয়ে যান, সেই একই দিনে প্রায় একই সময়ে মিসেস শাহানা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। এটা কি দৈব-দুর্ঘটনা? মিস জেসমিনের যাবার কথা কক্সবাজারে। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে তিনি শুক্রবারে রিজার্ভেশন বাতিল করে দেন। কক্সবাজারে তিনি যাননি। চট্টগ্রামেও তাকে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় তাহলে তিনি এখন?
কামাল জানতে চাইল, রাসেল বলেছে ওদের দুজনের চেহারার আশ্চর্য মিল আছে–কতটা মিল তা বলেছে?…কিন্তু…নাহ। তা সম্ভব নয়, শহীদ। ফটোটা সবাই দেখেছে এবং আইডেনটিফাই করেছে। একেবারে হুবহু মিল থাকলে হয়তো কিন্তু তা যদি হত তাহলে রালে সে কথা উল্লেখ করতে ভুলত না।
শহীদ বলল, তা ঠিক। দুজন একই রকম দেখতে হতে পারে না।
মহুয়া চিন্তিতভাবে বলল, ফটো দেখেও এতগুলো লোক ভুল করবে না, তা হতে পারে না। আমরা ধরে নিতে বাধ্য যে নিহত ভদ্রমহিলা মিসেস শাহানাই।
এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। লাশটা কার? এ রহস্যের সমাধান করতে হলে একটা প্রশ্নের সমাধান চাই সবচেয়ে আগে। লাশের মুখটা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে কেন? গুলি করে খুন করা হয়েছে–তারপর লাশের মুখ বিকৃত করার দরকার পড়ল কেন? আজকাল ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারটা সবাই জানে। কেউ যদি লাশের প্রকৃত পরিচয় জানতে দিতে না চায় তাহলে শুধু মুখের চেহারা বিকৃত করবে কেন সে? তাকে তো লাশের মুখের চেহারা বিকৃত করার সাথে সাথে হাতের আঙুলের চামড়া তুলে নিতে হবে কিংবা কব্জি থেকে হাত দুটো কেটে ফেলে দিতে হবে। তবেই তার উদ্দেশ্য সফল হবে।
কামাল বলল, ধরা যাক, ফেরদৌস সাহেবই খুনী। তিনি হয়তো ভাবেননি পুলিশ তার চট্টগ্রামের বাড়িতে মিসেস শাহানার হাতের ছাপ খোঁজার জন্যে যাবে।
শহীদ বলল, কিন্তু ক্যাপিটাল হোটেলের সাইটে মিসেস শাহানার ওঠার কথা। তার স্যুইটেও তো হাতের ছাপ থাকতে পারে?–আমি ফেরদৌস সাহেবকে অতটা বোকা মনে করি না।
কামাল বলল, ক্যাপিটাল হোটেলের সুইটে আমার ক্যামেরাম্যান মিসেস শাহানার হাতের ছাপ পায়নি, তোকে তো আগেই বলেছি। তবে তোর সাথে একটা ব্যাপারে আমি একমত, ফেরদৌস সাহেব অত বোকা নন।
শহীদ ঘনঘন পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল গল গল করে। বলল, এবার মোটিভের ব্যাপারে আলোচনা করি। মি. ফেরদৌসের মোটি কি হতে পারে? তার স্ত্রী মারা গেলে তিনি বীমার এক শ টাকা পাবেন। আর্থিক অবস্থা ইদানীং তার খুবই খারাপ, তার ওপর অন্য এক যুবতীর সাথে দহরম-মহরমও চলছিল। কামাল, আমার ধারণা, মি. ফেরদৌস তার স্ত্রীকে খুন করেছেন।
মহুয়া তীব্রকণ্ঠে জানতে চাইল, কিভাবে?
শহীদ মুচকি হেসে বলল, উত্তেজিত হয়ো না, মহুয়া। আমরা আলোচনা করছি মাত্র। আচ্ছা, ধরো, গত সোমবার বিকেলের ফ্লাইটে মিসেস শাহানা নয়, মিস জেসমিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। মিসেস শাহানা তাহলে কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন? ধরা যাক, তিনি কিছুই করছিলেন না। কারণ তখন তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁর লাশটা চট্টগ্রামে তাদের বাড়িতেই পড়ে রয়েছে। মিস জেসমিন মিসেস শাহানার টিকেট, সুটকেস, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ঢাকায় এল। এমন কি, মিসেস শাহানার আঙুলের হীরে বসানো আঙটিটাও তাঁর হাতে ছিল। মিস জেসমিনকে প্লেনে তুলে দিয়ে মি. ফেরদৌস বাড়িতে ফিরে গেলেন। স্ত্রীর লাশটা তিনি একটা কালো ট্রাঙ্কে ভরলেন, তারপর ট্রাঙ্কটা তুললেন নিজের গাড়িতে!
কামাল চোখ বড় বড় করে বলল, শহীদ, তুই….
হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল শহীদ কামালকে, বলল, থাম। আমাকে শেষ করতে দে। মিস জেসমিনের অ্যালিবাই তৈরি করাই ছিল। সবাই জানে তিনি কক্সবাজারে গেছেন। মি. ফেরদৌসও সোমবার রাত থেকে জনসমক্ষে নিজেকে হাজির করতে ভুল করলেন না, যাতে লোকে পরে তাঁর চট্টগ্রামে উপস্থিতি সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারে। তারপর স্ত্রীকে হত্যা করার চারদিন পর, কৌশলে ব্যবসায়িক কারণে ফেনীতে যাবার অজুহাত সৃষ্টি করে রওনা হলেন তিনি গাড়ি নিয়ে। এই অজুহাত তৈরি করা তার পক্ষে কঠিন হয়নি। ব্যবসায়ী মানুষ তিনি, পার্টিদের সাথে হর-হামেশা দেখা করতে যান, সুতরাং এটাকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখতে পারে না। অন্তত তাই তিনি ভেবেছিলেন। ফেনী থেকে ঢাকা। স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাওয়াটা বেআইনী নয়, খুবই স্বাভাবিক সেটা। সুতরাং ফেনী থেকে চট্টগ্রামে ফিরে না গিয়ে তিনি সারারাত গাড়ি চালিয়ে পৌঁছুলেন ঢাকায়।
কামাল বলল, কিন্তু
শহীদ আবার বাধা দিয়ে থামিয়ে দিল তাকে, বলল, জানি কি বলতে চাইছিস তুই। কিন্তু আমার চিন্তাধারা অনুযায়ী ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই আমি। মিস জেসমিন, মিসেস শাহানা নয়, ক্যাপিটাল হোটেলে উঠেছিল–এটা আমরা আলোচনার খাতিরে ধরে নিয়েছি, তাই না? মিস জেসমিন, ইকবাল, বুলবুল, ফারুক সাহেব, আবদুল হক, সুকুমার সেনের সাথে যে ধরনের আচরণ করে তাতে হাৈটেল কর্তৃপক্ষ তার সাইটে তাকে উপস্থিত না দেখে বিশেষ কিছু মনে করেনি। তারা ধরে নিয়েছিল, পুরুষ ঘেঁষা মেয়ে, কারও না কারও সাথে গিয়ে ফুর্তি করছে। টনক নড়ল সকলের শনিবার দিন ভোরে। মি. ফেরদৌস স্বয়ং হাজির হলেন ক্যাপিটালে। সেদিনই সন্ধ্যার দিকে পাওয়া গেল গাড়িটা। গাড়িটা পাবার আগেই সবাই মনে মনে ধরে নিয়েছিল লাশটাও পাওয়া যাবে। সুতরাং লাশ যখন পাওয়া গেল কেউ তেমন আশ্চর্য হলো না। যে ধরনের মেয়ে তাতে গুণ্ডার হাতে না পড়াটাই তো আশ্চর্যের ব্যাপার, সবাই ভাল।
মহুয়া বলল, ফেরদৌস সাহেব তাঁর গাড়িতে করে নিজের স্ত্রীর লাশ ঢাকায় আনেন, তুমি বলছ। লাশটা ক্যাপিটাল হোটেলে এল কিভাবে? মিস জেসমিনই বা কোথায়? তার গাড়িতেই বা লাশটা চালান দিলেন কিভাবে ফেরদৌস সাহেব?
শহীদ বলল, এসব প্রশ্নের উত্তর তো জলবৎ তরলং। মি, ফেরদৌসের সাথে মিস জেসমিনের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিল আগেই। মি. ফেরদৌস জানতেন ঢাকার কোন হোটেলে আত্মগোপন করে থাকবে মিস জেসমিন। ঢাকায় তিনি পৌঁছন ভোরে নয়, আরও কয়েক ঘন্টা আগে। সরাসরি মিস জেসমিনের হোটেলে ওঠেন তিনি। নিজের গাড়ি থেকে কালো ট্রাঙ্ক নামিয়ে নিয়ে তোলেন, মিস জেসমিনের লাল টয়োটায়। লাল টয়োটা নিয়ে পৌঁছন ক্যাপিটাল হোটেলের গ্যারেজে। গাড়িটা রেখে চুপচাপ রেখে আবার চলে যান মিস জেসমিনের হোটেলে। তারপর ভোর বেলা তিনি ক্যাপিট্যালে আবার আসেন। অন্তত একটা রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছেতাই না? লাশের মুখটা ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে কেন–বুঝতে পারছিস এখন?
কামাল গম্ভীর মুখে বলল, হু।
শহীদ বলল, দেখতেই পাচ্ছিস খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে সবকিছু। মনে করে দেখ ট্রাঙ্কের ভিতর এক ফোটা রক্ত পাওয়া যায়নি। হোটেলের কর্মচারীরা লাশ দেখে ভুল করেছে তার কারণও আছে। তারা মিসেস শাহানাকে চিনত না। মিস জেসমিনকেই তারা মিসেস শাহানা হিসেবে জানত। ওদের দুজনার স্বাস্থ্য, বর্ণ, উচ্চতা, চুলের স্টাইল, পোশাক–একই রকম দেখতে ছিল। লাশের মুখ দেখে চিনবার যখন উপায় নেই তখন ওই সব মিলিয়ে দেখে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, গত সোমবার সন্ধ্যায় তাদের হোটেলে যে ভদ্রমহিলা উঠেছিলেন এ লাশ তারই।
কিন্তু ফটোটা? ফটোটাও সবাই দেখেছে। ফটোর মুখটা তো আর ক্ষতবিক্ষত ছিল না? মিস জেসমিন যদি হোটেলে উঠে থাকে, ফটো দেখে তারা পার্থক্যটা ধরতে পারল না? এ অসম্ভব।
মহুয়া উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ঠিক! ইস্! আমি তো শহীদের কথা মেনেই নিয়েছিলাম আর একটু হলে!
শহীদ বলল, আর একটুও পূরণ করে দিচ্ছি। ফটোটা, না? ব্যাখ্যা করছি। ব্যাখ্যা শুনলে বুঝবে যে আমার বক্তব্যই আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মি, ফেরদৌস দুটো ফটো দেখান আমাদের সকলকে। একটা তিনি মি: সিম্পসনকে দেন, অপরটি আমাকে। দুটো ফটোই একজনের, দুরকম ভঙ্গিতে তোলা। তিনি আমাদেরকে বলেছেন, ফটো দুটো মিসেস শাহানার। কিন্তু আমি যদি বলি তিনি মিথ্যে কথা বলেছেন? যদি বলি ফটো দুটো মিসেস শাহানার নয়, মিস জেসমিনের?
হতবাক হয়ে চেয়ে রইল কামাল এবং মহুয়া শহীদের মুখের দিকে।
মহুয়া কিন্তু ছাড়তে রাজি নয়, সে জোর গলায় বলল, আর লাল শিফনের ব্যাপারটা?
শহীদ বলল, লাল শিফনের ব্যাপারটাও আমার যুক্তিকে বলিষ্ঠ করছে। এ থেকে বোঝা যায়, মি, ফেরদৌস রীতিমত গবেষণা করে একটা হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করেন। লাল শিফন তিনি চট্টগ্রাম থেকে স্ত্রীর জন্যও কিনেছিলেন, মিস জেসমিনের জন্যও আর একটা কিনেছিলেন। হয়তো একই দোকান থেকে কেনা হয় দুটো শাড়ি।
কামাল তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, নাহ আর কোন সন্দেহ নেই! তোর ব্যাখ্যা মেনে নিচ্ছি আমি, শহীদ।
মহুয়াও অস্ফুটে বলল, তাই তো, কোথাও কোন ফাঁক দেখতে পাচ্ছি না…!
কামাল অস্থিরভাবে বলে উঠল, আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফেরদৌস সাহেব চট্টগ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। আজ সকালে তার স্ত্রীকে কবরস্থ করা হয়েছে। মি. সিম্পসনকে এখনি ফোন করলে সব ল্যাঠা চুকে যায়। তিনি এয়ারপোর্ট থেকে ফেরদৌস সাহেবকে গ্রেফতার করতে পারবেন।
কিন্তু গ্রেফতার করবেন কিসের ওপর ভিত্তি করে? প্রশ্ন করল শহীদ।
কামাল বলল, তার মানে? তুই-ই তো এতক্ষণ ধরে ব্যাখ্যা করে বোঝালি যে ফেরদৌস সাহেবই খুনী!
শহীদ হাসল নিঃশব্দে। বলল, ওটা তো থিওরি।
কামাল বলে উঠল, তারমানে
শহীদ বলল, তার মানে? তার মানে, নিজের থিওরিতে নিজেই আমি সন্তুষ্ট নই
কিসের থিওরি, শহীদ? একযোগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সবাই, সকলেই বুকের ভিতর একটা আনন্দের ধাক্কা অনুভব করল।
কেউ টের পায়নি কখন যেন নিঃশব্দ পায়ে কুয়াশা ড্রয়িংরুমের ভিতর এসে হাজির হয়েছে। কালো আলখেল্লা পরিহিত কুয়াশা সহাস্যে আবার বলে উঠল, হত্যারহস্যের সমাধান হলো, শহীদ?
বসো, কুয়াশা, অন্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল শহীদ।
মহুয়া বলল, দাদা, এ সম্পর্কে জানো নাকি তুমি?
কুয়াশা আসন গ্রহণ করে বলল, কিছু কিছু জানি। রবিন কোথায় রে, মহুয়া?
মহুয়া বলল, ঘূমাচ্ছে লীনার কাছে।
শহীদ বলল, থিওরি দিয়ে সমাধান একটা বের করেছি। কিন্তু নিজেই আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। ওরা দেখতে না পেলেও, একটা ফাঁক আমি দেখতে পাচ্ছি।
কুয়াশা বলল, কেন, কেসটা তেমন কঠিন তো কিছু নয়। এর চেয়ে হাজার কঠিন কেস তুমি সমাধান করেছ। আচ্ছা, শোনাও দেখি তোমার থিওরিটা।
ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করল শহীদ।
শহীদকে মাঝ পথে বাধা দিল কুয়াশা। বলল, তোমার থিওরি অচল, শহীদ তুমি বলতে চাইছ মিসেস শাহানা নয়, মিস জেসমিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল গত সোমবার বিকেলে। কিন্তু তা সত্যি হতে পারে না। কারণ আর কেউ না চিনলেও, ইকবাল চৌধুরী শাহানাকে চিনত আগে থেকেই। এয়ারপোর্টে মিস জেসমিনকে নয়, মিসেস শাহানাকেই দেখেছে সে।
শহীদ বলল, হ্যাঁ, আমার থিওরি ওখানেই মিথ্যে প্রমাণিত হচ্ছে। কামাল এবং মহুয়া ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও আমি ঠিকই ধরতে পেরেছিলাম। তাই বলছিলাম, আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
মহুয়া জানতে চাইল, দাদা, তুমিই তাহলে বলো, খুনী কে?
কুয়াশা হাসল, না রে, তা বলা যাবে না। তবে তোরা সবাই যদি আগামীকাল আমার সাথে চট্টগ্রামে যেতে পারিস, আমি খুনীকে দেখিয়ে দেব। ব্যাখ্যা করে বলেও দিতে পারব খুনী কে, কিভাবে সে খুন করার পরিকল্পনা করে। তবে আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে আমাকে।
শহীদ বলল, আচ্ছা, ইকবাল চৌধুরীর অফিসে কেন গিয়েছিলে তুমি?
কুয়াশার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটল। বলল, এ প্রশ্নের উত্তরও তোমাদেরকে আমি চট্টগ্রামে গিয়ে দেব। যাবে তোমরা?
মহুয়া সোৎসাহে বলে উঠল, নিশ্চয়ই যাব।
কামাল সমর্থন করল তাকে, যাব না মানে।
শহীদ কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, ইকবাল চৌধুরী কি ঢাকায় এখন?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আগামীকাল তাকে আমরা চট্টগ্রামেই পাব।
মহুয়া হঠাৎ জানতে চাইল, আচ্ছা দাদা, মি. ডি কস্টাকে তো এই কেসে নাক গলাতে দেখলাম না? তিনি তো চুপচাপ দূরে থাকার লোক নন?
কুয়াশা রহস্য করে বলল, এই কেসের সাথেই তিনি আছেন। আগামীকাল তাকেও আমরা চট্টগ্রামে দেখব।
এরপর অন্য খাতে বইতে শুরু করল ওদের আলোচনা।
.
০৭.
পরদিন ঘুম থেকে উঠল শহীদ বেলা এগারোটায়। প্রায় সারা রাত জেগেছিল ও। জেগে জেগে চিন্তাভাবনা করেছে, কাগজে কি সব লিখেছে।
স্নান সেরে বেকফাস্ট করল ও। ড্রয়িংরুমে এসে বসে মহুয়াকে ডেকে পাঠাল লেবুকে দিয়ে।
ডাকছ কেন গো? মহুয়া প্রবেশ করল ত্রস্ত পায়ে। ঘর-সংসার গোছ-গাছ করে নিচ্ছিল সে। চট্টগ্রামে যাবে আজ সবাই, দুচার দিন সেখানে থাকতে হতে পারে। তার ইচ্ছা, এই সুযোগে কক্সবাজারেও একবার ঘুরে আসা।
একটা এনভেলাপ পকেট থেকে বের করে মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল শহীদ। রহস্যময় হাসি লেগে রয়েছে ওর ঠোঁটে। বলল, এটা তোমার কাছে রাখ। কুয়াশা মিসেস শাহানা হত্যাকাণ্ডের সমাধান বের করার পর এটা খুলবে তুমি কথা দাও, তার আগে খুলবে না।
কথা দিলাম। কিন্তু
এনভেলাপে কি আছে রে, শহীদ কামাল দোর-গোড়া থেকে জানতে চাইল।
শহীদ বলল, আয়। এনভেলাপে কি আছে? মিসেস শাহানা হত্যাকাণ্ডের সমাধান।
তার মানে কুয়াশার আগেই তুই সমাধান বের করে ফেলেছিস?
শহীদ বলল, কুয়াশার আগে যা করেছি তা বলা ঠিক হবে না। কুয়াশা রহস্যটা দেখতে পায় আগে, আমি দেখতে পাই পরে, গত রাতে ভাবনা চিন্তা করার পর। অবশ্য কয়েকটা তথ্য দরকার এখনও। কিন্তু তথ্যগুলো জানা না থাকলেও অনুমান করতে পেরেছি আমি।
সমাধানটা কাগজে লিখে এনভেলাপে ভরে রেখেছিস-কারণ?
শহীদ বলল, থিওরি আওড়িয়ে নিজের কাছেই বোকা বনেছি একবার, দ্বিতীয়বার আর বোকা সাব্যস্ত হতে চাই না, তাই।
মহুয়া জানতে চাইল, তোমার এবং দাদার ধারণা দুটো কি দুরকম?
শহীদ বলল, সম্ভবত না। কুয়াশার ধারণা কি তা আমি অনুমান করতে পারি। আমার অনুমান মিথ্যে না হলে বলতে পারি, আমাদের দুজনেরই ধারণা এক।
অর্থাৎ কুয়াশা যাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছে, তুইও তাকে সন্দেহ করছিস?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। তবে সন্দেহ করছি না, বিশ্বাস করছি। দৃঢ়ভাবে।
কামাল বলল, যদি তোর বিশ্বাস এবং কুয়াশার বিশ্বাস না মেলে?
শহীদ বলল, মিলতে বাধ্য। একবার ভুল করেছি, দ্বিতীয়বার ভুল হতে পারে না আমার। কুয়াশাও ভুল করার বান্দা নয়।
মহুয়া বল, বড় কৌতূহল হচ্ছে আমার! বলোই না ছাই, খুনী কে?
শহীদ মুচকি হাসল। বলল, ধৈর্য ধরো। বিকেলের মধ্যেই জানতে পারবে। কুয়াশা ফোন করে জানিয়েছে, কটায় ফ্লাইট?
জানিয়েছে। আড়াইটায়। দুত্তোরী, হেঁয়ালি করছ কেন? একটা প্রশ্নের অন্তত উত্তর দাও-খুনী কি ফেরদৌস সাহেব?
শহীদ যেন মহুয়ার কথা শুনতেই পায়নি, কামালের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চাইল, তুই মহুয়া আর লীনাকে নিয়ে কক্সবাজারে যেতে পারবি চট্টগ্রাম থেকে? ঢাকায় আমার কাজ আছে, আমি আগামীকালই ফিরে আসতে চাই।
কামাল উৎসাহিত হয়ে উঠল, চমৎকার। অনেকদিন বঙ্গোপসাগর দেখিনি–দারুণ হবে, কি বলো মহুয়াদি?
মহুয়া বলে উঠল, কথা দিয়ে ফেলেছি–এনভেলাপটা খুলে রহস্যটা জানতে পারছি না। কি যে অশান্তি লাগছে।
শহীদ এবং কামাল দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
.
চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে রাসেল এবং ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত হোসেন অভ্যর্থনা জানাল গোটা দলটাকে।
কুয়াশা ফোন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ গতকালই দিয়েছিল রাসেলকে। নির্দেশ অনুযায়ী যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে সে।
এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের ভিতর ঢুকে মিনিট কয়েকের জন্য লাউঞ্জে বসল ওরা। কুয়াশা, স্বভাবতই ছদ্মবেশে রয়েছে। রাসেল ইন্সপেক্টর সাখাওয়াতের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলল, সাখাওয়াত পুলিশ ইন্সপেক্টর হলেও, আমার কাছে সেটা ওর বড় পরিচয় নয়, ও আমার বন্ধু।
কুয়াশা, শহীদ এবং কামালের সাথে করমর্দন করল সাখাওয়াত। কুয়াশার সাথে করমর্দন করার সময় হাতটা কাপল তার। মুগ্ধ, বিহ্বল দৃষ্টি ফুটে উঠল চোখে। সবাই বুঝতে পারল রাসেল তার বন্ধুকে কুয়াশার পরিচয় আগেভাগেই দিয়ে রেখেছে।
কুয়াশা জানতে চাইল, ক্যামেরা এনেছ তো?
রাসেল বলল, এনেছি। জীপ ছাড়াও একটা প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করেছি আমি।
কুয়াশা বলল, সাখাওয়াত, তুমিই তো মি. ফেরদৌসের বাড়িতে মিসেস শাহানার হাতের ছাপ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলে!
জী–জী-হ্যাঁ।
কুয়াশা বলল, ঢাকা থেকে যে হাতের ছাপ মি. সিম্পসন তোমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার সাথে মি, ফেরদৌসের বাড়িতে পাওয়া হাতের ছাপের হুবহু মিল ছিল, তাই না?
জী।
কুয়াশা শহীদের দিকে তাকাল। দেখল শহীদ মুচকি মুচকি হাসছে। সাখাওয়াতের দিকে তাকিয়ে এবার শহীদ বলল, সাখাওয়াত সাহেব, এখন আপনি আমাদের সাথে যাবেন মিস জেসমিনের বাড়িতে। ওখান থেকে মিস জেসমিনের হাতের ছাপ সংগ্রহ করতে হবে। রাসেল, মিস জেসমিনের বান্ধবী মিস রেখাকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে?
রিস্টওয়াচ দেখল রাসেল। বলল, দুটোর সময় অফিস ছুটি-নিশ্চয়ই তাকে পাওয়া যাবে।
শহীদ তাকাল এবার কুয়াশার দিকে।
এবার দেখা গেল মুচকি হাসছে কুয়াশা।
কুয়াশাই বলল এবার, চলো তাহলে।
উঠল সবাই।
জীপে উঠল সাখাওয়াত, শহীদ, কুয়াশা এবং রাসেল। কালো মরিসে উঠল মহুয়া, রবিনকে কোলে নিয়ে লীনা এবং কামাল।
দুটো গাড়ি ছুটে চলল।
.
দরজা খুলে দিয়ে ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত, মহুয়া, শহীদ এবং কুয়াশাকে দেখে মিস রেখা একটু ঘাবড়ে গেল। কাকে চান আপনারা?
সাখাওয়াত বলল, আমি পুলিশ ইনপেক্টর। ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান।
কুয়াশা এবং মহুয়াকে দেখিয়ে বলল, ইমি বীমা কোম্পানীর প্রতিনিধি, আর ইনি মি. শহীদ খামের বন্ধু। আমরা মিস জেসমিনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করতে এসেছি।
শহীদ বলল, এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটা প্রশ্নও করতে চাই আপনাকে।
একমুহূর্ত চিন্তা করে মিস রেখা বলল, জেসমিনকে পেয়েছেন আপনারা?
শহীদ বলুন, ঠিক পেয়েছি বলা যায় না। কিছুটা বাকি রয়েছে এখনও।
আসুন, ভিতরে এসে বসুন।
ভিতরে ঢুকল ওরা চারজন। কামাল, রাসেল এবং লীনা রবিনকে নিয়ে গাড়িতে রয়ে গেছে। একসাথে বেশি লোককে দেখলে মিস রেখা ভয় পাবে মনে করে শহীদ এদেরকে গাড়িতে রেখে এসেছে।
কুয়াশার পরিচয় দেয়া হয়েছে শহীদের বন্ধু হিসেবে। মিস রেখার উদ্দেশ্যে সে বলল, ফিঙ্গারপ্রিন্ট আপনারও দরকার আমাদের।
তা কেন দরকার? আমি যতদূর জানি, অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া আর কারও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেবার আইন নেই।
কুয়াশা হাসিমুখে বলল, আমরা মিস জেসমিনের ফিঙ্গারপ্রিন্টটাই নিতে এসেছি। কিন্তু আপনাদের দুজনেরই ফিঙ্গারপ্রিন্ট রয়েছে এই বাড়িতে। কোনটা কার চিনব কিভাবে? আপনারটার সাথে মিস জেসমিনেরটা আলাদা করার জন্যেই।
মিস রেখা বলল, বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে।
ইতিমধ্যে ক্যামেরা নিয়ে পাশের রূমে কাজ শুরু করে দিয়েছে ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত। খানিক পর ফিরে এল সে। মিস রেখার সামনে একটা কালির প্যাড ধরে বলল, আপনি এই প্যাডে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিন, তারপর টেবিলের ওই কাগজে একটা ছাপ রাখুন তাহলেই হবে।
নির্দেশ পালন করল মিস রেখা। শঙ্কিতকণ্ঠে আবার একবার প্রশ্ন করল সে, জেসমিন…সে কি সত্যিই কক্সবাজারে যায়নি?
কুয়াশা বলল, না যাননি। আচ্ছা, বলুন তো, তিনি কি কক্সবাজারে না গিয়ে ঢাকায় যাবেন কথায় কথায় এই রকম আভাস দিয়েছিলেন আপনাকে?
কই, না তো। জেসমিনকে ঢাকায় দেখা গেছে নাকি?
কুয়াশা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠল, বলল, ধন্যবাদ, মিস রেখা।
শহীদ জানতে চাইল, মিস জেসমিনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে?
দরজার দিকে পা বাড়িয়ে, সাখাওয়াত বলল, প্রচুর।
মিস রেখা ওদের গমনপথের দিকে বেশ একটু অবাক হয়েই যেন চেয়ে রইল।
.
প্রায় একঘন্টা পরের ঘটনা।
চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা। পীচ দিয়ে মোড়া প্রশস্ত রাস্তার দুইপাশে ছবির মত সুন্দর সুন্দর বাড়ি। কোন কোন বাড়ির সামনে ছোট ছোট সুন্দর বাগান। হলুদ, লাল এবং বেগুনি ফুল ফুটে রয়েছে। রঙিন প্রজাপতি উড়ছে কয়েকটা।
পাড়াটা নিস্তব্ধ। কোথাও শোরগোল নেই, চেঁচামেচি নেই। পাড়ার সর্বদক্ষিণের বাড়িটা একতলা। সবেচেয়ে নিস্তব্ধ ওই বাড়িটাই।
বাড়িটা মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌসের। বাড়ির গেটের সামনে দুটো গাড়ি থামল। একটা জীপ, অপরটা প্রাইভেট কারু।
গাড়ি দুটো থেকে নামল কুয়াশা, শহীদ, কামাল, রাসেল, সাখাওয়াত এবং মহুয়া ও লীনা।
ফেরদৌস সাহেবের ডাটসনটা দেখা যাচ্ছে ওই যে, রাসেল বাড়ির গেট খুলতে খুলতে গাড়ি বারান্দার দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলে উঠল।
পাশ থেকে শহীদ জানতে চাইল, তুমি জানলে কিভাবে ওটা মি, ফেরদৌসের গাড়ি? তাকে বা তার গাড়িকে তুমি তো দেখোনি!
রাসেল হাসতে হাসতে বলল, না দেখলে কি হবে, ভদ্রলোক কি রঙের মোজা পরেন তাও আমি বলে দিতে পারি। তদন্ত করতে গিয়ে কিছু জানতে বাকি রাখিনি।
মহুয়া হঠাৎ আঁতকে উঠল, বাড়ির ছাদে…কাকে দেখলাম আমি? মিস্টার
কুয়াশা মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই চুপ করে গেল মহুয়া।
কিন্তু কামাল ছাড়ল না। জানতে চাইল, কাকে দেখলে তুমি আবার বাড়ির ছাদে?
মহুয়া জোর করে হাসল, বলল, কি জানি, বোধহয় ভুল দেখেছি।
গেট পেরিয়ে এগোচ্ছে ওরা। গাড়ি বারান্দার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা ধাপ টপকে উঁচু বারান্দায় উঠল সবাই। কুয়াশা সবাইকে সাবধান করে দেয়ায়। কেউ কথা বলছে না আর, কেউ কোন শব্দ করছে না।
গোটা দলটা একটা বন্ধ দরজার দুইপাশে ছড়িয়ে পড়ল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কুয়াশা আর শহীদ।
শহীদই নক করল দরজার গায়ে।
কে। বিস্মিত কণ্ঠ ভেসে এল।
শহীদ কথা না বলে দরজার গায়ে আবার টোকা দিল। কিন্তু দরজা খুল না সাথে সাথে। কেউ আর সাড়াও দিল না।
শহীদ ফিসফিস করে বলল, পালাবার চেষ্টা করবে না তো?
আবার নক করুল শহীদ।
আরও কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে গেল। মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌসকে দেখা গেল দরজার সামনে। গায়ে বোতাম খোলা শার্ট, পরনে লুঙ্গি, পায়ে স্যাণ্ডেল। হাতে এক গ্লাস পানিবা মদ।
মি, শহীদ আপনি! আপনি চট্টগ্রামে কেন? শহীদকে দেখে অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন মোফাজ্জল সাহেব।
শহীদ বলল, আপনি আপনার স্ত্রীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে, মি. ফেরদৌস।
মোফাজ্জল সাহেবের মুখের চেহারায় আরও বিমৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল, হ্যাঁ–দিয়েছিলাম দায়িত্ব-কিন্তু তাকে তো পাওয়া গেছে। আমি আপনার কাজে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়েছি।
শহীদ বাঁকা সুরে বলল, কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হইনি। আমি আপনার স্ত্রীকে এখনও খুঁজছি।
আপনি…এখনও কিন্তু…আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মি. শহীদ… মানে, কী আশ্চর্য! আমার স্ত্রীকে গতকাল কবর দেয়া হয়েছে!
শহীদ পা বাড়াল, মোফাজ্জল সাহেব পিছিয়ে গেলেন রূমের ভেতর। শহীদের সাথে সীটিং রূমে প্রবেশ করল কুয়াশাও।
শহীদ বলল, কবর দেয়া হয়েছে আপনার স্ত্রীকে নয়। মিস জেসমিনকে। মিস জেসমিন, মানে, আপনার অফিস সেক্রেটারিকে। মি. ফেরদৌস আপনার স্ত্রীকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?
দরজা দিয়ে কামাল, রাসেল, সাখাওয়াত এবং মহুয়া ও লীনা ভিতরে ঢুকল। মুহূর্তের জন্য ওদের সবাইকে দেখে নিলেন মোফাজ্জল সাহেব। কিন্তু বারও পরিচয় জানতে চাইলেন না তিনি। শহীদের দিকে ফিরে জোর গলায় বলে উঠলেন, হাউ ফ্যানটাসটিক! আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন, মি. শহীদ? অসংখ্য লোক ঢাকায় আমার স্ত্রীর ছবি দেখে তার লাশ সনাক্ত করেছে।
শহীদ বলল, ক্যাপিটাল হোটেলে গত সোমবার সন্ধ্যায় আপনার স্ত্রীই ওঠেন, তিনিই একাধিক পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করেন। কিন্তু লাশটা তার নয়। লাশটা ছিল মিস জেসমির।
কিন্তু সে…অসম্ভব! মোফাজ্জল সাহেব চিৎকার করে ওঠেন, ঢাকার পুলিশ আমার স্ত্রীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখানে পাঠান, এই বাড়ি থেকেও আমার স্ত্রীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়–দুটো মিলিয়ে তার পজিটিভ আইডেনটিফাই করেছে।
শহীদ বলল, এসব জানি আমি। আপনার এই বাড়িতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করার জন্যে ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত এসেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করুন।
ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত সামনে এগিয়ে এসে বলতে শুরু করল, এই বাড়ির প্রতিটি কামরাই অত্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাই আমি। বুঝতে পারি রীতিমত ধোয়া মোছা করা হয়েছে প্রতি কামরায় প্রতিটি জিনিসপত্র। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, যতই ধোয়া মোছা করা হোক, কোন মানুষ যদি বাস করে থাকে সেখানে, পাওয়া যাবেই। কিন্তু প্রথমে নিরাশ হই আমি। তার বাথরূমে এবং ড্রেসিংরূমে ঢুকি। কেবল ওই দুই জায়গাতেই দুজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাই। একটা মি. ফেরদৌসের। অপরটি ঢাকায় যার লাশ পাওয়া যায় তার।
মোফাজ্জল সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, কি প্রমাণ হয় এতে?
শহীদ বলল, ব্যাখ্যা করে বলছি, কি প্রমাণ হয়। কোন সন্দেহ নেই যে আপনি এবং আপনার স্ত্রী, দুজনে মিলে, আপনার স্ত্রীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রতিটি কামরার প্রতিটি জিনিস থেকে অতি সাবধানে মুছে ফেলেন। মুছে ফেলার পর আপনার স্ত্রী প্লেনে করে ঢাকায় চলে যান। তিনি প্লেনে ওঠার পর আল্পনি বাড়ি ফিরে আসেন। খানিক পর আপনার কাছে আসে মিস জেসমিন। মিস জেসমিন আপনার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে আপনার সাথে পনেরোটা দিন ফুর্তি করার পরিকল্পনা করেছিল। পরিকল্পনাটা অবশ্য আপনারই, সে তাতে সম্মতি দেয়। মিস জেসমিন, স্বভাবতই, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাথরূম এবং ড্রেসিংরূম ব্যবহার করে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েক ঘণ্টা। সময় তাকে আপনি ইচ্ছা করেই দেন। তারপর আপনি যখন জানতে পারেন যে মিস জেসমিনের হাতের ছাপ এ বাড়ির বাথরূমে, ড্রেসিংরূমে অন্তত পাওয়া যাবে-সময় নষ্ট না করে এরপরই তাকে আপনি খুন করেন। খুন করার পর তার মুখে আঘাতের পর আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেন যাতে কেউ চিনতে না পারে।
মোফাজ্জল সাহেবের হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পড়ে সশব্দে ভেঙে গেল। চিৎকার করে উঠলেন তিনি, না! না! না! এসব কি শুনছি আমি!
শহীদ এদিক ওদিক তাকাল, কিন্তু কুয়াশাকে কামরার ভিতর কোথাও দেখতে পেল না।
অসম্ভব। আমাকে আপনি ফাঁসাতে চাইছেন। এই অপচেষ্টার ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি, মি. শহীদ। আমি? আমি খুন করেছি জেসমিনকে? কেন? কি কারণে? মোটিভ কি আমার!
মোটিভের ব্যাখ্যা আমি দিচ্ছি। বাড়ির অন্দরমহল থেকে একটা দরজা পেরিয়ে সীটিং রূমে ঢুকল কুয়াশা।
আপনি কে?
কুয়াশা বলল, আমার পরিচয় জেনে লাভ নেই আপনার। ব্যাখ্যাটা শুনুন। আপনি একজন ইনডেন্ট ব্যবসায়ী, তাই না? কিন্তু ইনডেন্ট ব্যবসাটা আপনার মুখোশ, বাইরের আবরণ মাত্র। আপনার আসল ব্যবসা স্মাগলিং। এই স্মাগলিং ব্যবসা আপনি শুরু করেন বছর দুয়েক থেকে। প্রায় প্রথম থেকেই, ব্যাপারটা জেনে ফেলে মিস জেসমিন, যেভাবেই হোক। জানার পর, সে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। ফলে তার সাথে আপনার শত্রুতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাকে আপনি ঘৃণা করলেও চাকরি থেকে সরাবার কথা ভাবতেও পারতেন না। যাক, এই ভাবেই চলছিল। নিয়মিত প্রচুর টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছিলেন আপনি। এরপর, হঠাৎ আপনি আর্থিক সংকটে পড়েন। তার কারণ, পোর্টের কাস্টমস অফিসাররা আপনার স্মাগল করা মালের সন্ধান পেয়ে যায়। তারা আপনাকে সন্দেহ করেনি। কারণ ছদ্ম-কোম্পানীর নামে মালটা আনিয়েছিলেন আপনি এবং মাল পাবার জন্য কোন রকম দাবি তোলেননি। পোর্টে আপনার চর আছে, সে আগে ভাগে মাল ধরা পড়বার কথাটা আপনাকে জানিয়ে দেয়। যাক, ধরা না পড়লেও আর্থিক দিক দিয়ে চরম সংকটে পড়ে যান আপনি। এদিকে, মিস জেসমিনও টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। অনেক ভেবেচিন্তে আপনি আপনার স্ত্রীকে সব কথা বলেন। এবং এই সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় যে মিস জেসমিনকে হত্যা করা তাও তাকে জানালেন। আপনার স্ত্রী সত্যিই আপনাকে ভালবাসেন। আপনার বিপদে তিনি বিচলিত হন এবং আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে রাজি হয়ে যান।
মোফাজ্জল সাহেব ধপ করে বসে পড়লেন সোফার উপর। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠেন তিনি, ওহ গড! সব ধংস হয়ে গেল। আমি…
কুয়াশা কঠিন কণ্ঠে জানতে চাইল, আমরা এখানে ঢোকার আগে ইকবাল চৌধুরী এবং আপনার স্ত্রীও ছিলেন আপনার সাথে, কোথায় তারা?
আমি জানি না—
শহীদের উদ্দেশে কুয়াশা বলল, অ্যাশট্রের দিকে তাকাও, শহীদ। একটা সিগারেট দেখতে পাচ্ছ? এই ব্যান্ডের সিগারেট ইকবাল চৌধুরী খায়, মি. ফেরদৌসের ব্র্যান্ড ওটা না।
বাড়ির ভিতরটা দেখেছ তুমি
দেখেছি। নেই কেউ।
শহীদ জানতে চাইল, ইকবাল চৌধুরী কিভাবে জড়িত এই কেসে?
ইন্সপেক্টর সাখাওয়াত পকেট থেকে হাতকড়া বের করে এগিয়ে গেল মোফাজ্জল সাহেবের দিকে।
কুয়াশা বলল, ইকবাল চৌধুরীই মি, ফেরদৌসকে স্মাগলিংয়ের ব্যবসায় নামায়। ইকবাল অবশ্য জানত না শাহানার স্বামী এই লোকই। শাহানার বিয়ে হয়েছে এ খবর সে রাখত কার সাথে বিয়ে হয়েছে তা জানত না। দুজনেই ইনডেন্ট ব্যবসায়ী, একসময় স্বাভাবিক ব্যবসার খাতিরেই দুজনের পরিচয় হয়। এবং পরে আলোচনার মাধ্যমে স্মাগলিংয়ের বেআইনী ব্যবসাতে ইকবাল ওকে টেনে আনে।
শহীদ জানতে চাইল, শাহানার স্বামীর সাথে যে স্মাগলিংয়ের ব্যবসা করছে–একথা ইকবাল জানতে পারে কখন?
শাহানা সম্ভবত স্বামীর পরিচয় দেয়নি ইকবালকে। ইকরাল সম্ভবত ব্যাপারটা জানতে পারে আরও পরে। খবরের কাগজে মি. ফেরদৌসের নাম দেখে খুবই অবাক হয় সে। মি. ফেরদৌসের সাথে দেখা করারও ইচ্ছা হয় তার। কিন্তু ঢাকায় দেখা করলে পুলিশের সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়তে হবে ভেবে সে-চেষ্টা করেনি। তার বদলে সে প্লেনের টিকেট কাটে, একই প্লেনে মি. ফেরদৌসের সাথে চট্টগ্রাম পৌঁছায়। প্লেনে ওরা পরস্পরের সাথে আলোচনা করে। বিপদের কথা ভুলে ইকবাল মি. ফেরদৌসের সাথে চট্টগ্রাম আসে। তার কারণ, শাহানাকে সে আজও ভালবাসে। শাহানার এবং শাহানার স্বামীর এই চরম বিপদে সে সাহায্য করতে চায়।
শহীদ বলল, কিন্তু ওরা পালিয়েছে। ওদেরকে…।
কুয়াশা বলল, পালাবে কোথায়।
কুয়াশার কথা শেষ হবার সাথে সাথে সীটিং রূমে প্রবেশ করল ইকবাল চৌধুরী, তার পাশে মিসেস শাহানা।
দুজনেরই মাথা নত, মুখ ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে। দুজনের হাত দুটো মাথার উপর তোলা। ওদের পিছনে উদ্যত রিভলভার হাতে দেখা গেল মিস্টার স্যানন ডি. কস্টাকে।
মহুয়া নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠল, আমি ভুল দেখিনি, বাড়ির ছাদে আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম ডি. কস্টাকে।
ডি. কস্টা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে লাগল। বলল, বসের নির্ডেশে মি. ইকবাল অ্যাণ্ড শাহানার উপর দৃষ্টি রাখিটেছিলাম। উহারা, বাড়ির ব্যাক ডোর দিয়া পলাইয়া যাইটেছিলেন, আমি অ্যারেস্ট করিয়া আনিয়াছি। এই-বীরট্রপূর্ণ কাজের জন্য হাপনারা সবাই হামার প্রশংসা করুন।
হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই।
কলের মিলিত হাসির শব্দ চাপা পড়ে গেল একজনের হাসির উচ্চকিত শব্দে। সে হাসিটা বেরিয়ে আসছে স্বয়ং ডি. কস্টার কণ্ঠ থেকে।
Leave a Reply