কুয়াশা ৬৫
প্রথম প্রকাশ: মে, ১৯৭৭
০১.
পাড়াটা শুধু ভদ্রই নয়, অভিজাতও। পিচ দিয়ে মোড়া প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে ছবির মত সুন্দর সুন্দর বাড়ি। রাজপ্রাসাদ নয়, তবে রাজপ্রাসাদের আধুনিক এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন প্রতিটি বাড়ি। কোন কোন বাড়ির সামনে ছোট ছোট বাগান। হলুদ, লাল এবং বেগুনি ফুল ফুটে রয়েছে। রঙিন প্রজাপতি উড়ছে কয়েকটা। রাস্তার কোথাও একটি নেড়ী কুত্তা, নোংরা বীর ছেলেমেয়ে, একটি ছেঁড়া কাগজের টুকরো বা এতটুকু আবর্জনা নেই। গোটা এলাকাটাই এমনি পরিষ্কার।
কোমর সমান উঁচু লোহার গেটের ভিতর বাগান বা মাঠ দেখা যায়। যন্ত্র দিয়ে সুন্দরভাবে কাটা ঘাসওয়ালা মাঠ। ঝকঝক তকতক করছে চারদিক।
পাড়াটা নিস্তব্ধ। কোথাও শোরগোল নেই, চেঁচামেচি নেই। পাড়ার সর্ব দক্ষিণের বাড়িটা একতলা। সবচেয়ে নিস্তব্ধ ওই বাড়িটাই।
বাড়িটা মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌসের। মোফাজ্জল হায়দার একজন ব্যবসায়ী। তিনি একটি ইনড়েন্টিং কোম্পানীর মালিক। এই মুহূর্তে মোফাজ্জল সাহেব অফিসে আছেন। বাড়িতে আছে তাঁর স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, একা। সেজন্যেই বাড়িটা অমন নিস্তব্ধ।
সোমবার।
বেলা এখন দুটো। স্নান এবং মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে শাহনা। আজ ভোর থেকেই খাটা-খাটনি শুরু হয়েছিল। চাকরানী কলির-মা এবং সে নিজে, দুজনেই এক মিনিট বিশ্রাম নেয়নি। প্রতিটি কামরা ধুয়ে মুছে সাফ করতে হয়েছে, তৈজস পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখতে হয়েছে মিটসেফে। লীতে পাঠাতে হয়েছে বেডকভার থেকে শুরু করে পান্ট-শার্ট, দরজা-জানালার পর্দা, সোফার কভার, মায় রূমাল এবং বালিশের কভার পর্যন্ত। সাড়ে বারোটার সময় কলির মাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে শাহানা। পনেরো দিন সে আর আসবে না এ বাড়িতে। দরকারও নেই তার আসার। শাহানা আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন পর ফিরবে চট্টগ্রামে, সেদিনই আসবে আবার কলির-মা। এই কদিন মোফাজ্জল সাহেব হোটেলেই খাওয়া দাওয়া সারবেন।
ওয়ালকুকের ঢং-ঢং শুনে বিছানা ছাড়ল শাহানা। কামরাগুলো আর একবার দেখে নেয়া দরকার। স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়ে গলিয়ে কিচেনে গেল। সেখান থেকে ফিরে এল বেডরূমে। বেডরূম থেকে ড্রয়িংরূমে। কোন জিনিস স্পর্শ করতে হলো না। সব ঠিক আছে। তার অনুপস্থিতিতে স্বামীর যা যা দরকার সবই হাতের কাছে রেখে যাবার ব্যবস্থা করেছে শাহানা। ড্রয়ার খুললেই লীর বিল পাবে। চাবির গোছাও আছে জায়গা মত। বড় কালো ট্রাঙ্কটা বেডরূমের ভিতর খাটের নিছে রাখা হয়েছে খালি করে।
ড্রেসিংরুমে ঢুকল শাহানা। তেপয়ের উপর একটা সুটকেস এবং একটা লেদার ব্যাগ খোলা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। শাহানার কাপড়চোপড়, কসমেটিকস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে দুটোই ঠাসা। স্বামীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পনেরো দিনের জন্যে ঢাকায় যাচ্ছে সে–ছুটি উপভোগ করতে। পনেরো দিনের জন্যে যা যা দরকার সবই সে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা তুলে নিল শাহানা। দশ-টাকার নোটের বাণ্ডিল দুটো দেখে নিয়ে আলতোভাবে আবার একই জায়গায় নামিয়ে রাখল সেটা। বসল গদি-আঁটা টুলে। আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসি ফুটল না তার মুখে। কি যেন চিন্তা করে মুখের চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল, চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল ঝাপসা।
শাহানার দুই চোখের কোণে পানি জমল। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। তাড়াতাড়ি ফর্সা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল বিদেশী পাউডারের কৌটাটা।
চট্টগ্রামের মঞ্চ-জগতের নামকরা নায়িকা ছিল শাহানা। মাত্র এক বছর হয়েছে। বিয়ে হলো তার। বিয়ের পরপরই অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে সে।
রূপসী হিসেবে খ্যাতি আছে শাহানার। বেশ লম্বা সে। গায়ের রঙ দুধে, আলতায়।
সাজগোজ করতে করতে আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবছিল শাহানা। স্বামী হিসেবে মোফাজ্জল সাহেব খুবই ভাল। তার সবেচেয়ে বড় গুণ, তিনি কোন সমস্যাকেই বড় বলে মনে করেন না। সমস্যা দেখা দিলে ঠাণ্ডা মাথায় তিনি তার সমাধান বের করে ফেলেন।
বিয়ের পরদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে শাহানার। কথায় কথায় মোফাজ্জল সাহেব তাকে বলেছিলেন, দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হয় কেন, জানো?
কেন হয়?
পটলচেরা চোখ তুলে সকৌতুকে জানতে চেয়েছিল শাহানা।
সহনশীলতা, সমঝোতা, সহানুভূতি এইসব জিনিসের অভাব থেকেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি দেখা দেয়। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় কারণ কি, জানো?
কি?
চিরদিন স্বামী-স্ত্রী কাছাকাছি থাকলেও অশান্তি দেখা দেয়। আমার বিশ্বাস, স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রীর অথবা স্ত্রীকে ছেড়ে স্বামীর কিছুদিনের জন্য দূরে চলে যাওয়া দরকার। বছরে অন্তত একবার পরস্পরের কাছ থেকে দুজনে দূরে থাকলে পরস্পরের প্রতি টান বাড়ে, ভালবাসা উথলে ওঠে।
স্বামীর কথা শুনে হেসে উঠেছিল শাহানা খিলখিল করে।
হেসো না। কথাটা সত্যি। আমি ঠিক করেছি প্রতি বছর আমরা পরস্পরের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য দুরে সরে থাকব। এক বছর তুমি চলে যাবে, এই ধরো দিন পনেরোর জন্য ঢাকায় গিয়ে থাকবে। পরের বছর আমি যাব।
শাহানা বলেছিল, কিন্তু ঢাকায় গিয়ে থাকব কোথায়? ঢাকা কেমন শহর তাই আমি জানি না। আত্মীয় বলতে একমাত্র মামা ছিলেন, তিনিও বাবার সাথে শিকার করতে গিয়ে নৌকাডুবীতে মারা গেছেন। মামীমা আছেন, তিনি অন্ধ। মামাতো ভাইটিকে জীবনে দেখিনি। তাছাড়া ওদের সাথে আমার কোন যোগাযোগও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মামা নৌকাড়বীতে মারা যাবার পর মামাতো ভাইটি যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাবার কাছে, তাতে তারা পরিষ্কার সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে মামার মৃত্যুর জন্য বাবাই দায়ী। বাবা দশ হাজার টাকা ধার করেছিলেন মামার কাছ থেকে। সেই টাকা দেবার ভয়ে বাবা নাকি মামাকে ডুবিয়ে মারেন। বাবা এই চিঠি পাবার মাস তিনেক পর মারা যান। দেনাটা পরিশোধ করা হয়নি। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মামাতো ভাইটি সেই টাকার দাবি করে আবার একটা চিঠি লেখে। কিন্তু সে চিঠির উত্তর আমি দিইনি। দশ হাজার টাকা আমি পাব কোথায়। বাবা তো বাড়িটা ছাড়া আর কিছু রেখে যাননি।
মোফাজ্জল সাহেব বলেছিলেন, শ্বশুরের ঋণ শোধ করা আমারই দায়িত্ব, তার কোন পুত্র সন্তান যখন নেই। ঠিক আছে, আমাদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকীর পরপরই তুমি ঢাকায় পনেরো দিনের জন্যে যাবে। টাকাটা তখনই দেয়া হবে ওদেরকে। সম্পর্কটা নতুন করে গড়ে নিতে আর কোন অসুবিধে হবে না বোধ হয়।
মনে হয় না। ওরা খুব অভাবগ্রস্ত তা ঠিক। দশ হাজার টাকা পেলে খুবই খুশি হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওরা খুব গোঁয়ার টাইপের। বাবা যে মামার মৃত্যুর জন্য। দায়ী এই কথাটা ওরা ভুলবে না।
সেক্ষেত্রে…হোটেলে থাকবে তুমি। আজকাল ঢাকার বড় বড় হোটেলে মেয়েরা একা থাকে। দুই সপ্তাহ বৈ তো নয়।
শাহানা বলেছিল, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
কথাটা ভুলেই গিয়েছিল ওরা। মনে পড়ে গেছে হঠাৎ গতকাল। গতকাল ওদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকী ছিল।
কথাটা মনে পড়ে মোফাজ্জল সাহেবের। কেন যেন, অস্বাভাবিক গভীর এবং চিন্তিত হয়ে ওঠেন তিনি। কয়েক ঘণ্টা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন, স্ত্রীর সাথে দীর্ঘক্ষণ শলা-পরামর্শ করেন। সবদিক ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন, আগামীকালই অর্থাৎ আজই শাহানাকে ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় গিয়ে শাহানা প্রথমে মামী-মা। এবং মামাতো ভাইয়ের সাথে দেখা করবে। চেষ্টা করবে সম্পর্কটা নতুন করে গড়ে। তুলতে। সফল হলে ভাল, তা নয়তো শাহানা প্রথম শ্রেণীর কোন হোটেলে উঠবে। পনেরো দিন থাকবে শাহানা ঢাকায়। নগদ টাকা নিয়ে যাবে দুই হাজার। চেক। বইও থাকবে সাথে।
আড়াইটার সময় ড্রেসিংরুম থেকে বেরুল শাহান। নীল পরীর মত দেখাচ্ছে। তাকে। নীল শিফনের উপর সোনালী জরির কাজ করী। ম্যাচ করা নীল রাউজ। হাইহিল খড়ম, সেটাও নীল রঙের।
ড্রয়িংরূমে ঢুকে সোফায় বসল সে। ফোনের রিসিভারটা ক্রেল থেকে তুলে নিয়ে ডায়াল করল।
এইবার নিয়ে তিনবার ফোন করল শাহানা আজ ঢাকায়। ইকবাল চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে সে।
এইবার সফল হলো শাহানা, ইকবালকে পাওয়া গেল।
কথা বলতে শুরু করল সে।
এক সময় নক হলো দরজায়। চমকে উঠে ঘাড় বাকা করে ওয়ালকুকের দিকে তাকাল শাহানা। দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট হয়েছে মাত্র। কে এল আবার এমন সময়?
চাপা স্বরে দ্রুত কথা শেষ করে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল শাহানা। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কে?
দরজা খোলো, শাহানা।,
মোফাজ্জল সাহেবের কণ্ঠস্বর। এস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল শাহানা, ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, এখনই চলে এলে যে? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
স্থির থাকতে পারছিলাম না অফিসে। একা একা কি করছ ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, তাই চলে এলাম। কিন্তু…ছি, শাহানা, ভয় পেলে চলবে কেন?
শাহানা স্বামীর একটা হাত ধরে বলল, না, মানে ঠিক ভয় পাইনি-বোঝাই তো!
মোফাজ্জল সাহেব জোর করে হাসলেন, ভয় করার কিছু নেই, শাহানা। তুমি ঢাকায় গিয়ে আমার কথা ভেবে এতটুকু দুশ্চিন্তা কোরো না। এদিকটা আমি ঠিক সামলে নেব। তুমি মোটেই মন খারাপ করে থাকবে না। যা খুশি তাই করবে তুমি ওখানে। সিনেমায় যাবে, থিয়েটার দেখবে, পার্কে বেড়াবে, মোট কথা দিনগুলো কাটাবে হৈ-চৈ করে, আমোদ-ফুর্তি করে।
এই যা!
কি হলো?
শাহানা ঘুরে দাঁড়াল স্বামীর দিকে পিছন ফিরে, রাউজের বোতামটা খুলে গেল-লাগিয়ে দাও তো।
টিপ বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে মোফাজ্জল সাহেব বললেন, ভাবছি ঢাকায় তো আমি থাকব না, কে তোমার বোতাম লাগাবে সেখানে?
শাহানা মুচকি হেসে জবাব দিল, লোকের অভাব আছে নাকি ঢাকায়? ব্লাউজের বোতাম লাগাতে হলে লোকটাকে স্বামী হতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই।
মোফাজ্জল সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন।
কিন্তু শাহানা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, এ ধরনের কথা আর কখনও বোলো না, ফেরদৌস। ঠাট্টা করেও না। তুমি খুব ভাল করেই জানো কি ধরনের মেয়ে আমি।
মোফাজ্জল সাহেব স্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় একটু যেন নুয়ে পড়লেন। দুই হাত দিয়ে শাহানার দুই কাঁধ ধরে তাকে নিজের বুকের উপর টেনে নিলেন। শাহানা স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে খুঁপিয়ে উঠল। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মোফাজ্জল সাহেব বললেন, মন খারাপ কোরো না, শাহানা। তোমার মনটা হালকা করার জন্যে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছি আমি। আমার প্রতি তোমার ভালুবাসা কতটুকু তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে! যাত্রার সময় এসব কথা থাক তোমার জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে নিয়েছ তো?
মাথা তুলে তাকাল শাহানা, নিয়েছি। প্লেন তোচারটের সময়, না?
পকেট থেকে সুগন্ধ মাখানো রূমাল বের করে স্ত্রীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে মোফাজ্জল সাহেব বললেন, হ্যাঁ।
শাহানা বলল, যত কথাই বলি তোমার জন্যে মনটা খুব খারাপ থাকবে। মাথা, খাও আমায়, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ কোরো। আমার জন্য দুশ্চিন্তা কোরো না। আমি ঢাকায় নিরাপদেই থাকব।
মোফাজ্জল সাহেব পকেট থেকে বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটার জাললেন। সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আমরা পরস্পরকে ভালবাসি, শাহানা। পরস্পরের জন্য দুশ্চিন্তা আমরা করবই। যে-কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাধান বের করার মত, বুদ্ধি আমাদের আছে, তাই না? সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। আমি? আমি খুব ফুর্তির মধ্যেই সময় কাটাব। ক্লাবে যাব, পরিমিত ড্রিঙ্ক করব, সন্ধ্যার আগে টেবিল-টেনিস খেলব, রাতে শুয়ে শুয়ে হ্যাডলি চেজের থ্রিলার পড়ব। কথা দাও, তুমিও ঢাকায় আমোদ-ফুর্তি করবে।
কথা দিলাম। কিন্তু, ফেরদৌস, খুব সাবধানে থেকো, লক্ষ্মী। বেশি ড্রিঙ্ক কোরো না, কেমন? গাড়ি চালাবার সময় তোমার জ্ঞান থাকে না। মাথা খাবে, স্পীড যদি চল্লিশের ওপরে যায়!
মোফাজ্জল সাহেব হাসলেন, এই কদিন তোমাকে কাছে পাব না–এটাই দুঃখ। যাক, দেখতে দেখতে কেটে যাবে দিনগুলো।
শাহানা স্বামীর শার্টের একটা বোতাম আঙুল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, মামার বাড়ি বা হোটেলে যেখানেই থাকি, ফোন করব তোমাকে আজই। অফিসে থেকো সন্ধ্যার সময়টা।
মোফাজ্জল সাহেব স্ত্রীর গালে আলতোভাবে টোকা মারলেন। বললেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ কিছু মনে হয়নি তোমার?
কি মনে হবে?
আজ তোমার রূপ যেন আগুনের মত জ্বলছে। বিশ্বাস করো…
শাহানা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে আবার তার বুকে মুখ লুকাল।
.
ঢাকা এয়ারপোর্টের উপরে মেঘমুক্ত, নির্মল আকাশ। পশ্চিম দিগন্ত রেখা ছুঁই-ছুঁই করছে প্রকাণ্ড লাল সূর্য। পাঁচটা বেজে বিশ মিনিট হয়েছে। আকাশের সূদুর প্রান্তে ক্ষুদ্র চকচকে রূপালী পাখির মত দেখা গেল একটি বিমানকে। ক্রমশ বড় আকার নিচ্ছে সেটা।
কোমর সমান রেলিং দিয়ে ঘেরা টারমাকের বাইরে, এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল নারী-পুরুষ। এরা সবাই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হয়েছে। এদের মধ্যে ধনী ব্যবসায়ী ইকবাল চৌধুরীও রয়েছে। অ্যাশ কালারের ট্রপিক্যাল স্যুট পরনে তার। চেহারা তীক্ষ্ণ। লম্বায় প্রায় ছয়ফুট। ভীড়ের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে ঘন ঘন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে পায়চারি করছে সে। বিষণ্ণ এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। আধঘন্টা আগে সে এক হোটেলের বারে বসে মদ খেয়েছে। চোখ দুটো তাই লালচে। হাতের ৫৫৫ ফিলটার টিপড় সিগারেটে টান দিচ্ছে সে ঘন ঘন।
চট্টগ্রাম থেকে আগত বিমানটি ল্যাণ্ড করল। টারমাক ধরে ছুটতে ছুটতে একসময় থেমে দাঁড়াল সেটা। টেকনিশিয়ান এবং কর্মীরা এগোল। সিঁড়ি লাগানো হলো। খুলে গেল বিমানের পেটের কাছের দরজা। এয়ারহোস্টেস সহাস্যে বাইরে বেরিয়ে এল। একপাশে দাঁড়াল সে। দরজার মুখে এবার দেখা গেল যাত্রীদের। একে একে নামছে সবাই। প্রথম চার পাঁচজনের মধ্যেই দেখা গেল মিসেস ফেরদৌস অর্থাৎ শাহানাকে। নীল পরীর মত দেখাচ্ছে তাকে। সন্ধানী চোখে তাকাল সে অপেক্ষারত ভীড়টার দিকে। ইকবাল চৌধুরীকে দেখেই চিনল সে। মুখের হাসিটা বিস্তৃত হলো আরও। হাত নাড়ল সে।
ইকবাল চৌধুরী পায়চারি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাথরের মূর্তি যেন একটা। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল তার। শাহানাকে দেখা মাত্র তার ভিতর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
মাত্র বছর দেড়েক আগের কথা। শাহানা ছিল ইকবাল চৌধুরীর জীবন-মরণ। প্রাণ দিয়ে ভালবাসত সে ওকে। তার ব্যক্তিগত চরিত্র যাই হোক, শাহানার প্রতি ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না। কিন্তু শাহানা তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
ইচ্ছা করলে জোর করে শাহানাকে বিয়ে করতে পারত ইকবাল চৌধুরী। সে ক্ষমতা তার ছিল। চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত মহলে প্লেবয় এবং বেপরোয়া বলে খ্যাতি ছিল তার। কিন্তু শাহানাকে সে এমন গভীরভাবে ভালবেসে ফেলে যে শাহানার কোন ক্ষতি করার কথা সে ভাবতেই পারেনি। জোর করে আর যাই হোক, ভালবাসা আদায় করা যায় না। এটা ইকবাল চৌধুরী বুঝেছিল। শাহানার প্রতি নির্ভেজাল ভালবাসা ছিল বলেই সে চেয়েছিল, ও সুখী হোক। অন্য কাউকে বিয়ে করে যদি ও সুখী হয় তবে তাই হোক, এই ভেবেছিল সে। শাহানা তাকে বলেছিল, তোমাকে আমি কোনদিন ভালবাসিনি। আমি যাকে ভালবাসি তাকেই বিয়ে করব।
ইকবাল চৌধুরী বলেছিল, বেশ। তাই হোক। তুমি সুখী হও!
মাত্র এই কটি কথা বলে চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করে সে। যোগ দেয় বাবার ইনডেন্টিং ব্যবসাতে। তার বাবা আশফাঁক চৌধুরী অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছিলেন ছেলেকে কাজ-কারবারের দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অবসর নিতে। কিন্তু ইকবাল নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিতে চায়নি। প্রচুর টাকা ওড়াত সে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করত, মদ খেত এবং জুয়া খেলত। ব্যবসায় মন দেবার কথা সে কোনদিন ভাবেনি। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সে সোজা চলে আসে ঢাকায়। এক মাসের মধ্যে বাবার কাছ থেকে সব দায়িত্ব বুঝে নেয়। আশফাঁক চৌধুরী ছেলের সমতি ফিরেছে দেখে খুশি হন, সিদ্ধান্ত নেন এই সুযোগে হজব্রত পালন করবেন। ছেলেকে প্রচুর উপদেশ দিয়ে তিনি হজ করতে চলে যান। এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মক্কা শরীফেই ইহলোক ত্যাগ করেন।
ইকবাল ব্যবসা করতে গিয়ে দেখতে পায় নিজের ইচ্ছা এবং রুচি মত বেঁচে থাকতে হলে যে পরিমাণ টাকা তার দরকার তা ব্যবসা থেকে আসছে না। অনে? ভেবেচিন্তে প্রচুর টাকা রোজগারের রাস্তা বের করে সে একটা। মাস পাচেকের মধ্যে অগাধ টাকার মালিক বনে যায়। বর্তমানে সে দেশের যুবক-ধনীদের মধ্যে অন্যতম একজন। সকাল নেই দুপুর নেই প্রচুর বিদেশী মদ খায় সে বড় বড় হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। বাড়ি আছে বটে কিন্তু সেখানে তাকে কোনদিনই পাওয়া যায় না। নিয়মিত ফ্ল্যাশ খেলে এবং প্রচুর হারে। অসংখ্য বান্ধবী, কলগার্লের সাথে যোগাযোগ তার। তাদের পিছনে পানির মত টাকা খরচ করে। তাদেরকে নিয়ে হৈ-চৈ করে অভিজাত হোটেলে।
কিন্তু শাহানাকে আজও ভুলতে পারেনি ইকবাল চৌধুরী। আজও শাহানাকে সে ভালবাসে। তার দৃষ্টিতে শাহানার সাথে আর কারও তুলনা হয় না। যেসব মেয়েদের সঙ্গে সে মেলামেশা করে তারাও সুন্দরী, কিন্তু তাদেরকে ভালবাসে না ইকবাল চৌধুরী, তাদের সাথে নিতান্তই স্ফূর্তির এবং টাকার সম্পর্ক। ভাল সে এখনও শাহানাকেই বাসে।
ইকবাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জীবনে সে বিয়ে করবে না। শাহানা তাকে ভুলে গেলেও সে শাহানাকে ভুলবে না, চিরকাল তাকে মনে মনে ভালবেসে যাবে। শাহানা যদি কোনদিন কোন ব্যাপারে বিপদে পড়ে সাহায্য চায়, সে তার সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করবে।
সেজন্যেই শাহানার ফোন পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু ফোনে কথা বলার সময় সে বুঝতে পেরেছিল শাহানা বিপদে পড়েনি। বেশ সুখেই আছে সে। কিন্তু একটা পরিবর্তন লক্ষ করে সে ফোনে কথা বলার সময়। শাহানাকে খুব ভাল করেই চেনে সে। শান্ত, ভাবাবেগবর্জিত, ভদ্র একটি মেয়ে সে। কিন্তু ফোনে কথা বলার সময় পরিবর্তনটা লক্ষ করে ইকবাল। শাহানা কেমন যেন বদলে গেছে বলে মনে হয়েছে তার। খিলখিল করে হেসেছে সে ফোনে কথা বলার সময়। আবদারের সুরে কথা বলেছে। ইঙ্গিত দিয়েছে, ঢাকায় এসে সে ইকবালের সঙ্গ পেতে চায়, ঘনিষ্ঠ হতে চায়!
ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে ইকবালকে। শাহানা তরল প্রকৃতির মেয়ে ছিল না কোনদিন। হঠাৎ এমন বদলে গেল কিভাবে ও?
সশরীরে শাহানাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পবির্তনটুকু পরিষ্কার প্রত্যক্ষ করল ইকবাল। আশ্চর্য বটে! সব কিছুই সম্পূর্ণ বদলে গেছে শাহানার। দৃঢ় পদক্ষেপে, ধীর ভঙ্গিতে হাঁটত-শাহানা। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাঁটা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সে। কিশোরী মেয়ের মত চঞ্চল, অস্থির পায়ে প্রায় ছুটে আসছে শাহানা। হাসিটা ঠোঁটেই থাকত। কিন্তু এখন সারা মুখে ছড়ানো রয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে ছিল স্থিরতা, গাভীর্য। তার বদলে সেই চোখেই লঘু কটাক্ষপূর্ণ দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। পোশাকেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পিঠ-কাটা অতি ক্ষুদ্র রাউজ শাহানার গায়ে, দেহ-আবৃত করার চেয়ে অনাবৃতই করেছে বেশি।
ইকবাল বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাহানার এই আমূল পরিবর্তন বিশ্বাস্য ঠেকছে না তার চোখে।
মুখোমুখি এসে দাঁড়াল শাহানা। সকৌতুকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে মৃদু শব্দ করে হেসে উঠল। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে ভুরু নাচাল, ছুঁড়ে দিল প্রশ্ন, খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে! চিনতে পারছ না নাকি?
ইকবাল বলল, অনেক বদলে গেছ তুমি, শাহানা। না চিনতে পারারই কথা। তা একা কেন? তোমার স্বামী…?
বাঁ হাতটা শুন্যে নেড়ে শাহানা ঠোঁট বাঁকাল, তার সময় কোথায়? হি অলসসা হ্যাঁজ দ্য মডার্ন আইডিয়া দ্যাট ম্যারেড কাপলস্ এ্যড স্পেণ্ড দেয়ার ভ্যাকেশন সেপ্যারেটুলি। দিন পনেরোর জন্যে অ্যাটিক্যালি তালাক দিয়েছে সে আমাকে। আমি…কি বলব–অল এ্যালোন্ ইন এ স্ট্রেঞ্জ প্লেস!
ইকবাল বলল, কোথায় উঠবে? কোন আত্মীয়ের বাড়িতে?
শাহানা বলল, দাঁড়িয়ে কেন, চলো লাউঞ্জে গিয়ে বসি। হা, মামার বাড়িতে। উঠব। কিন্তু ওখানে বোধহয় থাকতে পারব না। চাইও না থাকতে। ঢাকায়। ঘরকুনো হয়ে থাকতে আসিনি। বুঝতেই পারছ, বিবাহিত মেয়েরা জীবনে এরকম সুযোগ সচরাচর পায় না। সুযোগ যখন এসেছে, তার সদ্ব্যবহার করব না কেন?
শাহানার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল বলল, ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।
শাহানা অবাক কণ্ঠে বলে উঠল, মাই গড, ইকবাল! তুমি দেখছি ভোঁতা হয়ে গেছ। সুযোগের সদ্ব্যবহার করব একথার মানে বুঝলে না?
ইকবাল উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে।
বুঝিয়ে বলব? আড়চোখে তাকাল শাহানা ইকবালের মুখের দিকে, ঢাকায় এর আগে কখনও আসিনি আমি। এই প্রথম। থাকব বড় কোন হোটেলে। কিংবা, তোমার কোন আপত্তি না থাকলে, তোমার বাড়িতেই উঠব। দর্শনীয় সব জায়গা দেখতে হবে আমাকে। মনের যতগুলো ইচ্ছা আছে সব পূরণ করব। মনের ইচ্ছা মানে, অবচেতন মনের গোপন ইচ্ছাগুলোর কথা বলছি আমি। শুনেছি ঢাকার মেয়েরা নাইট ক্লাবে রাতও কাটায়। কেউ কেউ নাকি মদ-গাঁজা খায়, জুয়া খেলে। আমিও এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। স্বামী অর্থাৎ শাসনকর্তা যখন নেই–ভয় কিসের? কথা হলো, আমাকে তুমি কতটুকু সাহায্য করতে পারো তাই বলো, ইকবাল। ওহ্ গড! আসল কথাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি! বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই?
ইকবাল অবিশ্বাসভরা চোখে দেখছিল শাহানাকে। মাথা নেড়ে যন্ত্রের মত বলল সে, না।
আনন্দে হেসে উঠল শাহানা, ফাইন! তবে তো কোন সমস্যাই নেই। থাকো। কোথায় তুমি? তোমার বাড়িতে না হয়।
ইকবাল বলল, না।
তার কণ্ঠস্বর একটু কঠিনই শোনাল।
কোন অসুবিধে আছে বুঝি? সেক্ষেত্রে, হোটেলেই উঠব আমি। কিন্তু ইকবাল, তোমার সঙ্গ কিন্তু চাই-ই আমার–প্লীজ! অচেনা শহর, একা–শখ-সাধ মেটাতে হলে তোমার মত একজন বন্ধু দরকার আমার।
লাউঞ্জে গিয়ে সোফায় বসল ওরা। চারদিকে নর-নারীর সমাগম। ঢুকছে, বেরুচ্ছে, বসছে, কথা বলছে। পুরুষদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হলো, লাউঞ্জে শাহানা প্রবেশ করার সাথে সাথে। অসাধারণ সুন্দরী ও, তার উপর নিজের রূপ শাড়ি-রাউজের বাইরে প্রকাশ করার চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই ওর।
শাহানা বলল, ব্যাগ-ব্যাগেজগুলো কাউন্টারে আসতে মিনিট পনেরো সময়। লাগবে। ওগুলো নিয়ে আমি মামার বাড়ি যাব। লক্ষ্মীবাজার-চেনো তুমি এলাকাটা? ওখানেই মামার বাড়ি। মিনিট কয়েক থাকব ওখানে মাত্র–তারপর হোটেলে উঠব। থাকছ তো আমার সাথে?।
হোটেলে?
শাহানা উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল, আমার সাথে হোটেলে তুমি থাকলে তো কথাই নেই। ইচ্ছা করলে, তোমার যদি আপত্তি না থাকে, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে নাম লেখাতে পারি আমরা হোটেলে…।
এই প্রথম ইকবাল রীতিমত রূঢ় গলায় কথা বলল, তুমি অনেক নিচে নেমে গেছ, শাহানা। এতটা কল্পনা করা যায় না। তুমি বিবাহিতা, সামী সাথে নেই বলে। এমন কুৎসিত চিন্তা-ভাবনা করবে-ছি!
এতটুকু লজ্জিত হলো না শাহানা সকৌতুকে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার বলো তো ইকবাল! আমার তো মনে হচ্ছে, তুমিই পুরোপুরি বদলে গেছ! আজকাল নামাজ-টামাজও ধরেছ নাকি?
ইকবাল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। শাহানার ব্যবহারে, কথাবার্তায় সে যে শুধু স্তম্ভিত হয়েছে তাই নয়, মানসিক আঘাতও পেয়েছে ভীষণ রকম।
হঠাৎ শাহানার তীক্ষ্ণ, চাপা কষরে চমকে উঠল সে। পরিষ্কার করে একটা কথার জবাব দাও আমাকে, ইকবালু। তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে চাও না?
ইকবাল শাহামার চোখে চোখ রেখে অস্ফুটে জানতে চাইল, কি সাহায্য চাও তুমি?
হোটেলে উঠব আমি। এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই। শহর দেখব, নাইট ক্লাবে যাব,মদ খাব, জুয়া খেলব–এইসব কাজে তোমাকে সঙ্গী হিসেবে দরকার আমার। তুমি যদি না চাও-থাক। ঢাকা শহর চিনি না বটে কিন্তু চিনে নিতে কতক্ষণ? দেখতে আমি আগের চেয়েও ভাল হয়েছি, আমার স্বামীর বন্ধুরা বলে কথাটা। তা যদি সত্যি হয়, পুরুষ বন্ধু যোগাড় করে নিতে খুব একটা অসুবিধে হবে না আমার। তোমার ওপর আমি জোর খাটাতে চাই না।
ইকবাল ভেবে চিন্তে বলল, কিন্তু আমি খুব ঝামেলায় আছি ইদানীং, শাহানা। ব্যবসার ব্যাপারে বিপদে পড়েছি। এই মুহূর্তে জরুরী একটা কাজে এক জায়গায় যাবার কথা আমার। তবু, ঠিক আছে, যতটুকু সম্ভব তোমাকে সাহায্য করব আমি। সাহায্য করব, মানে–কথাটার ভুল অর্থ কোরো না। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আজও তোমাকে আমি ভালবাসি, শাহানা।
থ্যাঙ্কিউ, ইকবাল।
ইকবাল বলে চলল, তোমাকে ভালবাসি বলেই আমি চাই না তোমার কোন ক্ষতি হোক। তোমার ভাব-গতিক দেখে ভয় হচ্ছে আমার। এটা দেশের রাজধানী–এখানের পরিবেশ অন্যরকম। তুমি সুন্দরী এবং একা-পদে পদে বিপদে পড়বার সম্ভাবনা। একদল লোক আছে যারা এই শহরে ওঁৎ পেতে আছে সব সময়। তোমার মত মেয়েদেরকে তারা প্রথম সুযোগেই কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। সুতরাং খুব সাবধান, শাহানা। তুমি যেভাবে চলাফেরা করতে চাইছ তা সম্ভব নয়।
দেখো ইকবাল, উপদেশ দিয়ো না আমাকে। অকারণে ভয় দেখালেই ভয় পাওয়ার পাত্রী নই আমি। ঢাকায় এর আগে আসিনি বটে কিন্তু তার মানে এই নয় যে ঢাকা সম্পর্কে কোন খবরই আমি রাখি না। ঢাকার নাইট-ক্লাবগুলোয় মেয়েরা যায়–অস্বীকার করতে পারো? বারগুলোয় মেয়েরাও মদ খায়–অস্বীকার করতে। পারো?
অস্বীকার তো করছি না। কিন্তু ওই ধরনের কাজ যারা করে তারা সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। তাছাড়া তাদের মান-ইজ্জতের ভয় নেই। তাদের পিছনে তেমন ক্ষমতাবান লোকজন থাকে…।
শাহানা বলে উঠল, নগণ্য সংখ্যকদের মধ্যে আমি একজন হলে ক্ষতি কি? ক্ষমতাবান লোকজন সেইরকম লোকজনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নেব আমি। তাছাড়া তুমিই বা কম কিসে? শুনেছি, বিরাট ধনী ব্যবসায়ী এখন তুমি। সমাজের সর্বস্তরে তোমার অবাধ যাতায়াত।
মিথ্যে শোনোনি। কিন্তু আমি তোমাকে নষ্ট হতে দেখতে চাই না।
শাহানা সহজ গলাতেই বলে উঠল, আমি নষ্ট হতে যাচ্ছি একথা কে বলল তোমাকে? এমন গেঁয়োদের মত কথা বলছ–ভাবাই যায় না। পনেরো দিন ছুটি কাটাতে এসেছি–আমোদ-ফুর্তি করব না? বিবাহিতা বটে–কিন্তু আমি তো আর ঘোমটা দেয়া বউ নই। স্বামী যখন একা ছাড়তে পেরেছে তখন নিশ্চয়ই সে মনে মনে ভাল করেই জানে, পুরুষ মানুষদের সঙ্গ পাবার জন্য সব সুযোগই নেব আমি। আর যাই হোক, বোকা নয় সে। আশ্চর্য হচ্ছি এই কথা ভেবে যে আমার স্বামী যে স্বাধীনতা দিতে পেরেছে আমাকে, তুমি আমার স্বামী না হয়েও সে-স্বাধীনতা দিতে রাজি নও। এতটা রক্ষণশীল তুমি তা আমার জানা ছিল না।
ইকবাল বলল, তোমার প্রতি তোমার স্বামীর কতটুকু ভালবাসা আছে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে, শাহানা। একটা প্রশ্ন করছি, সত্যি কথা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?
কী আশ্চর্য! ঝগড়া হবেকেন! তুমি একটা বোরিং…!
লাউঞ্জে ধীরে ধীরে বাড়ছে ভিড়। রিস্টওয়াচ দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল ইকবাল। তাকাল দরজার দিকে। ছাঁৎ করে উঠল বুকের ভিতর।
গত কয়েকদিন হলো, ছায়ার মত অনুসরণ করছে ইকবালকে দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক লোক। প্রতিবার পোশাক এবং চেহারা বদল করে লোকটা, কিন্তু ইকবাল তাকে দেখলেই চিনতে পারে। কে লোকটা? পুলিশ বিভাগের ডিটেকটিভ? কখনও গাড়ি নিয়ে, কখনও ভিড়ের মধ্যে, কখনও বারের ভিতর কোণার টেবিলে বসে লোকটা তার উপর নজর রাখছে। কখনও সে ছদ্মবেশ নেয় শিখ ব্যবসায়ীর, কখনও কালো শেরোয়ানী পরে… এইমাত্র ইকবাল চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল সেই লোকটা কালো স্যুট পরে তার দিকে চেয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে, তার চোখ দুটোয় যেন যাদু আছে, অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখতে পায় তাকালেই। চোখাচোখি হতেই সঁহ্যাঁৎ করে সরে গেল লোকটা।
উঠে দাঁড়াল ইকবাল, চলো, দেখে আসি তোমার মালপত্তর কাউন্টারে এসেছে কিনা। জরুরী কাজের কথা বলছিলাম না? দেরী তো হয়েই গেছে। তবু না গেলেই নয়।
শাহানাও উঠল, কিন্তু আমাকে।
তোমার মামার বাড়িতে পৌঁছে দেব, চলো।
শাহানা বলল, তারপর? মামার বাড়িতে দশ মিনিটের বেশি থাকব না আমি। হোটেলে
তুমি অপেক্ষা করবে, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আবার ফিরব তোমার মামার বাড়িতে। ওখান থেকে হোটেলে যাব।
শাহানা হাই-হিলের শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে বলল, গুড। তবে তোমার অনেক সময় নষ্ট করছি, তাই না? কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তোমাকে আমি বঞ্চিত্ করব না। তুমি কতটুকু হজম করতে পারবে সেটাই হলো প্রশ্ন।
নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠল শব্দ করে শাহানা। লাউঞ্জে উপস্থিত পুরুষের দল পিছন থেকে লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। সকলেই বুঝতে পারছে, যুবতী যে-ই হোক, দৈহ-প্রদর্শন করার প্রচণ্ড একটা ইচ্ছা কাজ করছে তার মধ্যে।
.
০২.
পুরানো শহরের নোংরা একটা গলি। গলি নয়, উপগলি বলাই ভাল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছোট ছোট বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পঁচিল ভাঙা, প্লাস্টার-ওঠা, শ্যাওলা-ধরা। গলির ড্রেনটাই ডাস্টবিনের কাজে ব্যবহার করা হয়। তরি-তরকারির খোসা, বাচ্চাদের মল, ছেঁড়া কাগজ, নোংরা কাপড়ের টুকরোপীকৃত হয়ে আছে। ড্রেনের উপর। হাজার হাজার মাছির সমাবেশ চারদিকে। উলঙ্গ-প্রায় বাচ্চাদের চিৎকার, কান্না, ছুটোছুটির আওয়াজে কান পাতা দায়। উপগলিটার শেষ মাথায় ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি। আর সব বাড়ির দরজা খোলা থাকলেও, ওই বাড়ির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ রয়েছে।
দেড় কাঠা জমির উপর বাড়িটা। ছোট ছোট দুটি মাত্র কামরা। কারা দুটোয় আসবাবপত্র একেবারে নেই বললেই চলে। বাড়ির কর্তা মুনীর হোসেন কেরানীর চাকরি করতেন। রিটায়ার করেছিলেন তিনি। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড ইত্যাদি থেকে তিনি মোট হাজার দশেক টাকা পেয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল, দশ হাজার টাকা দিয়ে। ছোটখাট একটা ব্যবসা করে ছেলেগুলোকে লেখাপড়া শেখাবেন, মানুষ করবেন। কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। টাকাটা তিনি ভগ্নীপতি আজিজুল হককে ধার দিয়েছিলেন। সে টাকা ফিরে পাবার আগেই হকের সাথে শিকার করতে গিয়ে নৌকাডুবীতে মারা যান।
বছর তিনেক হলো মারা গেছেন মুনীর সাহেব। তখন তার বড় ছেলে বুলবুল ক্লাস নাইনের ছাত্র। কতই বা বয়েস, বড়জোর সতেরো। অর্থাৎ বুলবুলের বর্তমান বয়স একুশ।
মুনীর সাহেবের মৃত্যু গোটা সংসারটাকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। বুলবুলের প্রৌঢ়া জননী আগেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তিনি নিঃশব্দে কেঁদেছেন শুধু। শোক প্রকাশ করা ছাড়া করার কিছু ছিল না তার। বুলবুল ছাড়াও আরও দুই সন্তানের জননী তিনি। তাদের একজনের বয়স সাত, অপরজনের দশ। সবাই স্কুলের ছাত্র। জননীর সামান্য যে গহনা ছিল তাই বিক্রি করে বুলবুল পড়াশোনা চালিয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। কাগজের ঠোঙা তৈরি করে মুদীর দোকানগুলোয় বিক্রি করে যে দুপয়সা রোজগার করে সে, তাই দিয়ে সংসার চালাতে থাকে। গত বছর বুলবুল ম্যাট্রিক পাস করেছে। অনেক চেষ্টা-তদবির করে বাবার অফিসে একটা কেরানীর চাকরি যোগাড় করেছে সে। রাত্রে কলেজেও যায়। ছোেটাভাইগুলোর পড়াশোনার খরচও সে বহন করছে।
সন্ধ্যা হয় হয়। বুলবুল খানিক আগে ফিরেছে অফিস থেকে। হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রামও নেয়নি সে, ছোট ভাইদেরকে পড়াতে বসেছে।
নড়বড়ে একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন অন্ধ জননী। চোখ দুটো বন্ধ তার। কিন্তু তিনি যে ঘুমাননি তা বোঝা যাচ্ছে তার ঠোঁট জোড়া নড়ছে দেখে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন তিনি।
বুলবুল ছোট ভাইটিকে ধমক মারছিল, পিটু, কাঁদবি না বলে দিচ্ছি। স্কুলে তো যাইনি, আর অঙ্কগুলোও করে রাখিসনি। লেখাপড়া করতে ভাল লাগে না বুঝি?
অন্ধ,জননী চৌকির উপর থেকে বললেন, দুপুরে আজ ও খায়নি। ওকে একটু বোঝা তো বাবা!
দুপুরে খায়নি? কেন মা?
প্রৌঢ়া চৌকির উপর উঠে বসলেন, শুধু ডাল দিয়ে ভাত-বলে, আমি খেতে পারব না!
বুলবুল মেঝের মাদুরের উপর পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দেয়, কথা বলে না। পিটুর দুই চোখ পানিতে ভরে যায়। মাথাটা নামাতে নামাতে একেবারে খোলা বইটার কাছে নামিয়ে ফেলে সে। লজ্জায়, অভিমানে মাথা তুলতে পারে না।
আড়চোখে মেজো ভাইটি দেখে পিটুকে, বুড়ো আঙুলের নখ খুঁটতে থাকে সে। পিটুকে উপর রাগ হয় তার, মায়াও হয়।
মাসের আজ বাইশ তারিখ। টাকা পড়ে আছে মাত্র এগারোটা। চাল কেনাই হবে না, বাজার হবে কোত্থেকে? বুলবুল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে কথাটা বলে।
অন্ধ জননী বলেন, তোকে সে কথা ভাবতে হবে না। চললে চলবে, না চললে উপোষ থাকবে সবাই। যে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেতে পারবে না, সে খাবে না।
এটা রাগের কথা। ছোট ছেলে পিটুর প্রতি মায়ের স্নেহ-ভালবাসা সবচেয়ে বেশি সবাইকে বোঝানো যায়, কিন্তু পিটুকে বোঝানো যায় না। প্রায়ই সে এই রকম জেদ ধরে। মায়ের মন, দুঃখ পান তিনি।
কিন্তু বড় ছেলের কথাটাও তাকে ভাবতে হয়। হাড়-ভাঙা খাটুনি খেটে যা রোজগার করে তা দিয়ে সংসার চলে না। ওরই বা কৃত বয়েস। ওর বাবা বেঁচে থাকলে ও-ই কত বায়না ধরত, এটা খাব না ওটা খাব না বলত।
প্রৌঢ়া হঠাৎ বলেন, তোকে এত করে বলছি, আর একটা চিঠি লেখ। শাহানাকে, কিন্তু তুই কেন যে।
বুলবুল বিরক্তির সাথে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, মা, ওসব কথা আমাকে বোলো না। চিঠি লিখলেই বা কি হবে? ভুল করেছিলেন বাবা নিজেই। ওই দশ হাজার টাকাই ছিল তার একমাত্র সম্বল। কেন তিনি ফুফাঁকে ধার দিয়েছিলেন?
বিপদ পড়লে ধার মানুষ মানুষকে দেয় না? কে জানত ওই টাকা দিতে হবে বলে তোর ফুফা তোর বাবাকে ষড়যন্ত্র করে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে!
মা আবার তুমি সেই কথা তুলছ! ফুফা বাবাকে ডুবিয়ে মেরেছে তার কোন প্রমাণ নেই। আর যদি তাই সত্যি হয়ে থাকে, তাহলেও এখন আর কিছু করার নেই আমাদের। ফুফা বেঁচে থাকলে অন্তত টাকাটা ফেরত পাবার চেষ্টা করা যেত…।
কিন্তু তার মেয়ে তো বেঁচে আছে। শাহানা বেশ ভাল পয়সাই রোজগার করত, তারপর তার বিয়েও হয়েছে বড়লোকের সাথে। একটা চিঠি লিখে দেখই না…।
চিঠি কি লিখিনি? কি উত্তর দিয়েছিল মনে নেই তোমার?
অন্ধ জননী বললেন, তখন শাহানার বিয়ে হয়নি। মেয়েছেলে, অত টাকা তখন পাবেই বা কোথায়? শুনেছি, ওর স্বামী মস্ত বড়লোক। তুই শাহানার স্বামীকে একটা চিঠি লেখ।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে মা? দশ হাজার টাকা–চাট্টিখানি কথা নাকি! শ্বশুরের ঋণ জামাই কেন শোধ করতে যাবে? যত বড়লোকই সে হোক…।
দরজার কড়া নড়ে উঠতে বুলবুল কথাটা শেষ করতে পারল না। ভুরু কুঁচকে চিন্তা করার চেষ্টা করুল সে, কে আসতে পারে? উঠে দাঁড়িয়ে স্যাণ্ডেলটা পায়ে গলাতে গলাতে মেজো ভাইটির দিকে তাকিয়ে বলল, বসে আছিস কেন। পড়াটা মুখস্থ কর, আমি আসছি।
গায়ে শার্টটা গলিয়ে দরজা পেরিয়ে পাশের কামরায় ঢুকল বুলবুল। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। এটা ওর নিজের কামরা। পিটুকে নিয়ে রাত্রে শোয় ও। একটি চৌকি, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, একটি বুক-কেস এই হলো আসবাবপত্র। দরজা খুলে উঠনে নামল ও। বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়াল, খিল খুলতে খুলতে জানতে চাইল, কে?
দরজার কবাট উন্মুক্ত হতেই আবছা আলোয় বুলবুল নীল শাড়ি পরা অপূর্ব সুন্দরী একটি যুবতাঁকে দেখতে পেল। কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে পড়ল ও। মেয়েটি হাসছে, যেন কতদিনের পরিচয় তার সাথে।
মাফ করবেন, কাকে চান…মানে…।
যুবতী সহাস্যে বলল, এটা মুনীর হোসেন সাহেবের বাড়ি না?
বুলবুল বলল, জী। আমি তার ছেলে।
বুলবুল! তার মানে তুমি বুলবুল-মাগো! আমি ভেবেছিলাম তুমি ছোট ছেলে হবে, কিন্তু তুমি দেখছি রীতিমত মর্দ-যোয়ান!
যুবতী ঘাড় বাঁকা করে পাশে তাকাল, কার উদ্দেশ্যে যেন বলল, তুমি যাও। আধঘন্টা পর আসছ আবার, তাই না?
বুলবুল দরজার বাইরে মাথাটা গলিয়ে অন্ধকারে দেখল একজন লোক ফিরে যাচ্ছে, চেহারাটা ভাল করে লক্ষ করার সুযোগ হলো না তার। যুবতী তাকাল ওর দিকে। বলল, আমাকে তুমি চিনতে পারোনি, বুলবুল। চেনবার কথাও না। আমি শাহানা।
কথা শেষ করে হঠাৎ শাহানা পা বাড়িয়ে দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। বুলবুল একপাশে সরে পথ করে দেবার সময়ও পেল না। সেন্টের মিষ্টি গন্ধ পেল সে। প্রায় মুখোমুখি ধাক্কা লেগে গেল দুজনের।
লজ্জায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুলবুল। কিন্তু শাহানার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মধুর শব্দে হেসে উঠল সে, বুলবুলের একটা হাত ধরে মৃদু চাপ দিল, বলল, কই, চলো। মামীমা কোথায়?
সারা শরীরে আগুন ধরে গেছে যেন বুলবুলের। এমন অপূর্ব সুন্দরী একটি যুবতীর শরীরের স্পর্শ পেয়ে কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে সে। শাহানার কথায় সংবিৎ ফিরল তার। বলল, আসুন!
আপনি কেন, তুমি বললেই তো হয়। লম্বা-চওড়া তাগড়া পুরুষ মানুষ তুমি…।
নিজের কথায় আবার হেসে উঠল শাহানা। পা বাড়াল বুলবুলের সাথে সাথে।
সামনের কামরায় ঢুকে শাহানা দাঁড়াল। বুলবুল দুই কামরার মধ্যবর্তী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মা!।
কে এসেছে রে, বুলবুল? অন্ধ জননী চৌকির উপর থেকে জানতে চাইলেন।
বুলবুল দরজা পেরিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল, শাহানা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, বলল, মামী-মা!
কে? প্রৌঢ়া যেন চমকে উঠলেন।
শাহানা হাই-হিলের খটখট শব্দ তুলে চৌকির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ভ্যানিটি ব্যাগটা রাখল চৌকির উপর, দুই হাত দিয়ে মামী-মার পা ছুঁয়ে সালাম করল, বলল, মামী-মা, আমি শাহানা।
অন্ধ প্রৌঢ়া নিরুত্তর। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত বসে রইলেন তিনি।
শাহানা বসল চৌকির উপর। বলল, মামী-মা, আমাকে চিনতে পারছেন না?
প্রৌঢ়া এতটুকু নড়লেন না। তার ঠোঁট জোড়া নড়ল শুধু কথা বলার সময়। একটি একটি করে শব্দ উচ্চারণ করলেন তিনি। গলার স্বরে কাঠিন্য প্রকাশ পেল, চিনতে পারব না কেন? তা এতদিন পর কি মনে করে এসেছ তুমি? একাই এসেছ, না স্বামীকে নিয়ে এসেছ?
শাহানা মামী-মার হাত দুটো ধরে বলল, একাই এসেছি মামী-মা। আপনার জামাইয়ের সময় কোথায়? ওই পাঠাল আমাকে। আত্মীয়স্বজন বলতে আমার তো আর কেউ নেই আপনারা ছাড়া। তাই এলাম। সম্পর্কটা তো প্রায় শেষই হয়ে যাচ্ছিল। প্রৌঢ়া হাত দুটো নিজের কোলের উপর টেনে নিলেন, সম্পর্ক আর থাকে কিভাবে! তোমার বাবাই তো শেষ করে দিয়ে গেছে।
মা, ওসব কথা থাক না…।
বুলবুল মেঝেতে দাঁড়িয়ে কেন যেন ঘামছিল, এতক্ষণে মুখ খুলল সে। পিটু এবং লিটু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শাহানার দিকে। কারও চোখে পলক পড়ছে না। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি দেখছে যেন তারা।
শাহানা হাসতে হাসতেই বলে উঠল, বাবাও বেঁচে নেই, মামাও বেঁচে নেই। তাদের কথা তুলে আর লাভ কি, মামী-মা! বাবা কি করেছিলেন, না করেছিলেন আমি জানিও না। বাবা যদি কোন দোষ করেও থাকেন, আপনি আমাকে সেজন্যে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না।
অন্ধ প্রৌঢ়া মুখ তুলে কি যেন ভাবছেন। মৃত স্বামীর কথা ভাবছেন হয়তো, মানসপটে হয়তো দেখতে পাচ্ছেন স্বামীর চেহারা। দুচোখ ভরা পানি নিয়ে তিনি বললেন, তোমার বাবাকে কোনদিনই ভাল লোক বলে মনে হয়নি আমার। দয়া মায়া ছিল না তার। আমি দেখিনি বটে কিন্তু মনে মনে ঠিক জানি, বুলবুলের বাবাকে সে ডুবিয়ে মেরেছে…।
মা! বুলবুল চেঁচিয়ে উঠল।
প্রৌঢ়া হঠাৎ খেপে উঠলেন, থাম তুই, বুলবুল। আজ তোর বাবা থাকলে সংসারের অবস্থা এমন করুণ হত না! কে দায়ী, বল তো আমাকে? উত্তর দিতে পারিস আমাকে, কেন এমন ঘটল?
বুলবুল প্রতিবাদ করল, ফুফা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী, এটা তোমার একটা সন্দেহ। তাছাড়া ফুফা বেঁচেও নেই। সেকথা তুলে লাভই বা কি। শাহানা আপা নিশ্চয়ই দায়ী নন। জীবনে এই প্রথম তিনি এসেছেন আমাদের বাড়িতে, তাকে এসব কথা শোনাবার কোন মানে হয়?
শাহানা বলল, মামী-মা, আমি আপনার মানসিক অবস্থাটা বুঝি। সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়, মামীমা। টাকা শোধ দিতে হবে বলে বাবা মামাকে ডুবিয়ে মারবেন আমার বাবা তেমন পাষণ্ড ছিলেন না। টাকা তিনি ঠিকই শোধ দিতেন কিন্তু ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না বলে পারছিলেন না। তারপর তো তিনি নিজেই হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলেন। দেনার কথাটা ভেবে তিনি রাত্রে ঘুমাতে পারতেন না, এ তো আমি নিজেই দেখেছি। টাকা দেবার ইচ্ছা না থাকলে কেউ এমন দুশ্চিন্তায় ভোগে না। সে যাই হোক, মনের সন্দেহটা দূর করুন, মামী-মা। টাকার কথা যদি বলেন, একসাথে সবটা না পারলেও, আপনার জামাই কিছু কিছু করে টাকা শোধ দেবেন আপনাদেরকে। আপনাদের কাছে আমার আসার সেটাও একটা কারণ। এবার হাজার তিনেক টাকা আমি দিয়ে যাব। মাস দুয়েক পর আবার পাঠাব কিছু।
প্রৌঢ়া জানতে চাইলেন, তুমি কি টাকা দিতেই এসেছ ঢাকায়?
এসেছি আপনাদের কাছে বেড়াতে। আপনাদেরকে দেখতে। বাবার দেনা তো আমাকে শোধ করতেই হবে, সেটা বড় কথা নয়…।
টাকাটাই আমাদের কাছে বড় কথা, শাহানা। তুমি বেড়াতে এসেছ আমাদের কাছে, ভাল কথা, কিন্তু এখানে তুমি থাকবে কোথায়? দুটো ছোট ছোট কামরা, দেখছই তো! বিছানাপত্রও নেই…
জননীকে থামিয়ে দিয়ে বুলবুল বলে উঠল, সে ব্যবস্থা একটা হবেই যাহোক। শাহানা আপা এসেছেন, আর কোথায় উঠবেনই বা?
প্রৌঢ়া কঠিন গলায় বললেন, কিন্তু ব্যবস্থা হবে বললেই তো আর হলো না। কোথায় শোবে ও?
মোটকথা, প্রৌঢ়া চাইছেন না শাহানা এ বাড়িতে থাকুক। শাহানার বাবা তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী–এটা তার সন্দেহ নয়, দৃঢ় বিশ্বাস। তার স্বামীকে যে লোক হত্যা করেছে তার মেয়েকে তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেবার কথা ভাবতেই পারছেন না।
শাহানা বলল, অসুবিধে হলে কি আর করা। আমি না হয় কোন হোটেলেই উঠব।
বুলবুল মুখ খুলল, কিন্তু
সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল এমন সময়।
শাহানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওই আমার দেওর এসেছে। মামী-মা, আজ তাহলে আমি উঠি। কাল আসব, কেমন? বুঝতে পারছি, আমার ওপর খুশি নন আপনি। কাল কিন্তু আপনাকে আমি হাসি খুশি দেখতে চাই। যাই ঘটে থাকুক, আমাকে আপনি পর বা শত্রু বলে মনে করতে পারবেন না। টাকার চেকটা আমি কালই দেব, কেমন?
প্রৌঢ়ার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। যেমন বসেছিলেন তিনি তৈমনি বসে রইলেন।
বুলবুল, পৌঁছে দাও ভাই আমাকে! কথাটা বলে শাহানা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একশো টাকার একটা কড়কড়ে নোট বের করে পিটুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, লক্ষ্মী সোনা ভাইরা, তোমাদের কে হই আমি বলো তো? আমি তোমাদের শাহানা আপা, বুঝলে! কাল তোমাদের জন্যে অনেক কিছু আনব। আজ এই টাকাটা রাখো, মিষ্টি কিনে খাবে।
পিটু তাকাল লিটুর দিকে। লিটু চোখ নামিয়ে নিল।
নাও, লজ্জা কি! বড় বোনের কাছ থেকে নিতে হয়। কথাটা বলে পিটুর হাতে গুঁজে দিল নোটটা শাহানা, সিধে হয়ে দাঁড়াল, পা বাড়াল দরজার দিকে, চলি, কেমন, মামীমা?
শাহানার পিছু পিছু অন্ধকার উঠনে বেরিয়ে এল বুলবুল। শাহানা দাঁড়িয়ে পড়তে সে-ও দাঁড়াল। আবছা অন্ধকারে বুলবুল শাহানার নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেল গালে। মুখোমুখি, প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে শাহানা।
বুলবুলের প্রায় কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলে উঠল শাহানা, আমার দূর-সম্পর্কের দেওর লোকটা, লোক হিসেবে ভাল নয়। আমার পিছনে ফেউয়ের মত লেগে আছে। কিন্তু উপায় নেই, ওর সাহায্য নিয়েই হোটেলে উঠতে হবে আকে। একা মেয়েমানুষ আমি, কতরকম বিপদ ঘটতে পারে, তাই না? তাই ওকে দরকার। হোটেলে উঠে ওকে তাড়াবার ব্যবস্থা করব। কিন্তু ভাবছি, সময়টা কাটে কিভাবে! এই তো মাত্র সন্ধ্যা। বুলবুল, যাবে নাকি একবার আজ রাতে আমার হোটেলে?
সেন্টের মিষ্টি গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। চাপাস্বরে বলে উঠল সে, কিন্তু…
কিন্তু নয়। ক্যাপিটাল হোটেলে উঠব আমি। রিসেপশনিস্টকে বলে রাখব। জিজ্ঞেস করলেই আমার রূম নাম্বার বলে দেবে। এক কাজ করো, মামী-মাকে বলে যেয়ো কোন বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাবে আজ, কেমন? তুমি আর আমি হোটেলে থাকব অনেক গল্প হবে-কি বলো?
বুলবুল ঘামছে। ঠিক আছে–এই শব্দ দুটো উচ্চারণ করার ইচ্ছা থাকলেও, লজ্জায় শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে পারছে না সে।
বলো, বুলবুল। লজ্জার কি আছে? গল্প করে সারাটা রাত কাটিয়ে দেব, দারুণ হবে, তাই না? বডি বিল্ডারের মত শরীর তোমার, রাত জাগলে কোন ক্ষতি হবে না। সে-কথাই রইল, কেমন?
বুলবুল হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারল না। শাহানা তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল, দ্রুত পা বাড়িয়ে এগোল দরজার দিকে।
যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল বুলবুল, পা বাড়াবার শক্তিও যেন নেই তার মধ্যে। শাহানা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে। মিষ্টি শব্দ ভেসে এল বাইরে থেকে।
শাহানা হাসছে।
.
গলির শেষ মাথায় বড় রাস্তার উপর ইকবালের সাদা ফোক্সওয়াগেন দাঁড়িয়ে ছিল। কথা বলতে বলতে গাড়িতে এসে উঠল ওরা। কথা বলছিল শাহানাই বেশি, ইকবাল হু-হ্যাঁ করছিল শুধু।
কি ব্যাপার, কিছু ভাবছ যেন?
ইকবাল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল, বলল, ক্যাপিটাল হোটেলে খানিক আগে ফোন করে তোমার জন্য একটা সুইট রির্জাভ করেছি। হোটেলের সামনে নামিয়ে দেব আমি তোমাকে। রিসেপশনিস্টকে গিয়ে বললেই সব ব্যবস্থা করে দেবে।
কথা বলতে বলতে ভিউ মিররের দিকে চেয়ে আছে ইকবাল। রাস্তার একপাশে একটা ক্রীম কালারের টয়োটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে ফোক্সওয়াগেনের পিছন পিছন আসছে, দেখতে পাচ্ছে সে। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তার।
তুমি সাথে থাকছ না নাকি? শাহানা জানতে চাইল।
যে-কাজে গিয়েছিলাম সেটা হয়নি। আবার যেতে হবে। আধঘণ্টা পর দেখা করব তোমার সাথে। আমি হোটেলের ককটেল লাউঞ্জ থেকে ফোন করব, তুমি নেমে এসো। .
শাহানা খুশি হয়ে উঠল। মাথাটা কাত করে ইকবালের কাঁধে রাখল সে, বলল, চমৎকার! জীবনে কখনও বারে ঢুকে ড্রিঙ্ক করিনি। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হবে, কি বলো! ভাল কথা, তোমার গাড়ি থাক, দরকার নেই–তুমি বরং আমাকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দাও। রেন্ট-এ কার-এর কি যেন একটা ব্যবস্থা আছে না? পারবে?
সংপেক্ষে জানাল ইকবাল। হোটেল রিসেপশনিস্টকে বললেই ব্যবস্থা করে দেবে।
শাহানা প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইল, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? আমাকে নিয়ে যাবে না?
বাড়িই আছে শুধু, কেউ সেখানে থাকে না। আমিও না। হোটেলে হোটেলেই থাকি।
আজ রাতে আমার সাথে থাকবে?
ইকবাল জবাব দিল না।
কিছু বলো।
না।
শাহানা শব্দ করে হেসে উঠল, কেন, বদনাম হবে এই ভয়ে?
ইকবালকে গভীর দেখাল, হ্যাঁ। তবে আমার নয়, তোমার বদনাম হবে, এই ভয়ে।
শাহানা বলল, আমার বদনাম? ফুর্তি করব বলেই তো এসেছি ঢাকায়। সুযোগ পেলে কে না মজা লোটে, বলো?
ইকবাল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এ কোন্ শাহানা? মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে। শান্ত, ভদ্র, বিদুষী, নম শাহানা এমন ভয়ঙ্কর রকম বদলে গেল কিভাবে?
শাহানা, কয়েকটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না। একবার বলেছি, আজও তোমাকে আমি ভালবাসি। ভালবাসি কেন তা জানো? তোমাকে আমি ভাল মেয়ে বলে জানি, তাই। ভালবাসি বলেই আমি চাই না তোমার কোন ক্ষতি হোক। আমি তোমাকে ভাল মেয়ে বলে দেখে এসেছি, সেই ভাবেই দেখতে চাই। তোমার কোন ক্ষতি যেন আমার দ্বারা না হয়। তুমি এমন বদলে যাবে, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি এমন সব ইঙ্গিত দিচ্ছ, এমন সব প্রস্তাব দিচ্ছরীতিমত ভয় পাচ্ছি আমি। জানি না, তোমার আসল উদ্দেশ্য কি। তুমি আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছ কিনা তাও বুঝতে পারছি না। সে যাই হোক, আমার দৃষ্টিতে তুমি যেমন ভাল আছ। তেমনি ভাল হিসেবেই থাকো তুমি, এই আমি চাই।
ভাল, ভালবাসা–এসবের কোন অর্থ নেই, ইকবাল। কিছু মনে কোরো না, তোমার সাধুভাব দেখে হাসি পাচ্ছে আমার মনে হচ্ছে ন্যাকামি করছ। যাক, সোজা কথার সোজা উত্তর দাও। ঢাকায় যে কদিন থাকব, সঙ্গ দেবে আমাকে?
ইকবাল বলল, যদি না দিই?
সেক্ষেত্রে অন্য কাউকে খুঁজে বের করতে হবে আমার, বেশ সহজ ভঙ্গিতে বলল শাহানা।
ইকবাল বলল, ঠিক আছে। আমি তোমাকে সঙ্গ দেব। কিন্তু কিন্তু শুধু দিনের বেলা।
বেশ তো, রাত কাটাতে বলব না। রাতের জন্য আমি না হয় অন্য কাউকে খুঁজে নেব। কথাটা বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল শাহানা।
ইকবাল এরপর আর কথা বলল না।
গাড়ি প্রথম শ্রেণীর অভিজাত হোটেল ক্যাপিটালের সামনে দাঁড়াল। শাহানা মামতে নামতে বলল, বেশি দেরি কোরো না কিন্তু! তোমার দেরি দেখলে, বলা যায় না, আমি হয়তো অন্য কাউকে পাকড়াও করে ফেলব আবার!
শাহানা নিচে নেমে গেটের মুখে দাঁড়াল। পোর্টারকে ইঙ্গিতে ডেকে, গাড়ির ব্যাকডোর খুলে দিল। পোর্টার সালাম দিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে সুটকেস এবং লেদার ব্যাগটা বের করে আনল।
ইকবাল বলল, বড় জোর চল্লিশ মিনিট, তার বেশি দেরি হবে না।
শাহানা পোর্টারকে অনুসরণ করুন। গাড়ি ছেড়ে দিল ইকবাল। ভিউ মিররে তাকাল সে, দেখল ক্রীম কালারের টয়োটা আবার ছুটতে শুরু করল।
টয়োটার ড্রাইভিং সীটে দীর্ঘ, সুঠামদেহী এক লোক বসে রয়েছে। তার পরনে অদ্ভুত ধরনের পোশাক। অনেকটা যেন আলখেল্লা ধরনের। ঠিক বুঝতে পারল না ইকবাল। মনে মনে শঙ্কিত বোধ করছে সে। রহস্যটা কি? কে ওই লোক? পুলিশ বা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হোমরাচোমরাদের কেউ নয়, নিঃসন্দেহে। তারা কেউ তার উপর অসন্তুষ্ট নয়। বড় অফিসাররা সবাই তার বন্ধু-শ্রের মধ্যে পড়ে। তাহলে-কে ওই রহস্যময় লোক? কেন সে তার উপর প্রায় দিবারাত্র চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখছে? লোকটা যে নিজেকে খুব একটা আড়ালে রাখার চেষ্টা করছে তাও নয়।
রহস্যটা ভেদ হচ্ছে না। কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। জানা দরকার লোকটা কে, কেন সে… এদিকে শাহানার ব্যাপারটাও কিছু বুঝতে পারছে না সে। কিভাবে, কেন এমন বিদঘুটে ভাবে বদলে গেল শাহানা? সবটাই আসলে হাসি তামাশা, নাকি শাহানাকে চিনতে ভুল করেছিল সে? শাহানা কি আসলে চরিত্রহীনা মেয়ে ছিল বরাবর? হয়তো তাই। হয়তো সে চিনতে পারেনি শাহানাকে। তাই যদি হয়, শাহানার প্রতি তার এতটুকু ভালবাসা থাকা উচিত নয়। একটা মেয়েকে পা রা যাবে না জেনেও তাকে ভালবাসে সে, সেই মেয়ে যদি চরিত্রহীনা বলে প্রমাণিত হয় তাহলে…. না, শাহানা তাকে এক অর্থে ঠকিয়েছে। শাহানা নিজের আসল রূপটা লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন–এটা তার অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি পাওয়া উচিত তার…
.
রিসেপশনে ঢুকে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল শাহানা। রিসেপশনিস্ট যুবকটির বয়স অল্প, সুদর্শন এবং পোশাকে-কথাবার্তায় স্মার্ট। শাহানাকে দেখেই আন্তরিকভাবে হাসল সে।
শাহানা বলল, আমার এক বন্ধু খানিক আগে ফোন করেছিলেন। মিসেস শাহানার নামে তিনি একটা সুইট রিজার্ভ করেছেন।
এক মিনিট।
যুবক রিসেপশনিস্ট রেজিস্টার বুকটা খুলে রিজার্ভেশন কার্ডগুলো দেখতে শুরু করল, এক মুহূর্ত পরই সে মুখ তুলল, পেয়েছি। আপনিই মিসেস শাহানা?
জী।
রিসেপশনিস্ট বলল, ফিফথ ফ্লোরের কর্ণারের সুইটটা দেয়া হয়েছে আপনাকে আপনার সুইট থেকে আপনি ঢাকার প্রায় সবটা দেখতে পাবেন। আপনি একা, মিসেস শাহানা? দুসপ্তাহের জন্য, তাই না?
রেজিস্টার খাতাটার পাতা উল্টো, সেটা বাড়িয়ে দিল রিসেপশনিস্ট। গোল্ড ক্যাপ পাইলট পেন এগিয়ে দিল।
কলমটা নিয়ে নিজের নাম ঠিকানা লিখতে লিখতে শাহানা মুখ না তুলেই মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি একা। স্বামী ভদ্রলোক চান বছরে অন্তত একবার একা একা কিছু দিন দূরে কোথাও থাকি। ডু ইউ থিঙ্ক ইটস্ সাচ্ আ গুড আইডিয়া?
আই অ্যাম এ ব্যাচেলর মাইসেল, মিসেস শাহানা। বাট ইফ আই ওয়্যার ম্যারেড টু সামওয়ান লাইক ইউ…আই জাস্ট ডোন্ট নো। ইওর ফাস্ট ভিজিট টু ঢাকা?
শাহানা মুখ তুলল, হ্যাঁ। অর্ধপরিচিত এক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে চিনি না এখানে।
রিসেপশনিস্ট যুবক শাহানার গলার মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কারের দিকে তাকিয়ে হাসল, তাতে কি! আমাদের রাজধানীতে সম্ভাব্য বন্ধুর সংখ্যা কম নয়।
তাই নাকি! ইটস আ গুড নিউজ ফর মি! ভাল কথা, রেন্ট-এ-কার থেকে একটা গাড়ি চাই আমার। এখুনি। সম্ভব?
সম্ভব। আধঘণ্টার মধ্যেই পাবেন।
হিসেব করে টাকার অঙ্কটা বলল রিসেপশনিস্ট। শাহানা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে টাকা বের করে গুণল। তারপর বাড়িয়ে দিল।
হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিল রিসেপশনিস্ট।
থ্যাঙ্কিউ।
রিসেপশনিস্ট একজন বেলবয়কে ডেকে সুটকেস এবং ব্যাগটা নিয়ে শাহানার সাথে যেতে বলল। চাবি নিয়ে এলিভেটরের দিকে পা বাড়াল শাহানা। বেলবয় তাকে অনুসরণ করল। এলিভেটরের কাছে পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শাহানা রিসেপশনিস্ট যুবকের দিকে। ছোকরা চেয়ে রয়েছে। মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিল তার দিকে শাহানা। তারপর এলিভেটরে ঢুকল।
এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, উঠতে শুরু করল উপরে। চোখ তুলে একবার তাকাল বেলবয়, চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল সে।
নাম কি তোমার?
আবদুল হক।
শাহানা বলল, ফুটবল খেলো নাকি?
নূজ্জা পেল আবদুল হক। প্রশ্নটা করার কারণ তার শক্ত-সমর্থ, পেটা লোহার মত শরীর। মাথা নিচু করেই জবাব দিল সে, জী। হোটেলের ক্লাবে খেলি।
এলিভেটর ছয়তলায় উঠে থামল। দরজা খুলে যেতে আগে নামল আবদুল হক, পিছন পিছন শাহানা। বাহাত্তর নম্বর সুইটটা করিডরের শেষ প্রান্তে। লাল, নরম। কার্পেটের উপর দিয়ে সুইটের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শাহানা। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। সীটিং রূম অতিক্রম করে পা রাখল বেডরূমে।
ভিতরে ঢুকে ওগুলো রেখে যাও।
আবদুল হক ঢুকল ভিতরে। নামিয়ে রাখল সুটকেস আর লেদার ব্যাগ। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই শাহানার ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল সে, তাকাল। দেখল শাহানা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এটা রাখো।
জ্বী! মানে, আপনি হয়তো ভুল করছেন ম্যাডাম, একশো টাকা…।
এগিয়ে এল শাহানা, আবদুল হকের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। বলল, ভুল করছি না। নাও তুমি এটা। কেন দিচ্ছি জানো? আচ্ছা বলছি, আগে ধরো।
হাত বাড়াল আবদুল হক। শাহানা তার হাতে গুঁজে দিল টাকাটা। বলল, এই টাকার বিনিময়ে একটা কাজ করাব তোমাকে দিয়ে।
কি কাজ ম্যাডাম?
কাজটার কথা পরে বলব। আচ্ছা, তোমার ডিউটি কখন শেষ হবে?
রাত বারোটায়।
শাহানা কি যেন চিন্তা করল বলল, গুড। কোথায় শোও তুমি? রাতে কি বাড়ি ফিরে যাও?
না, ম্যাডাম। হোটেলের কোয়ার্টার আছে পাশেই…।
রাতে, মানে শেষ রাতের দিকে, আসতে পারবে কি? আমি ভোর, এই ধরো ঠিক চারটের সময় ঘুম থেকে উঠতে চাই। তুমি দরজায় কলিংবেল টিপে আমার ঘুম ভাঙাতে পারবে না?..
আবদুল হক বলল, এখানে তো অ্যালার্মসহ ঘড়ি আছে, ম্যাডাম। তাছাড়া ভোর রাতের দিকে অন্য বেলবয়ের ডিউটি থাকবে, তাকে আমি বলে গেলে সে আপনাকে ঠিক চারটের সময়…
শাহানা বলে উঠল, দূর বোকা। অন্য বেলবয়কে তো দরকার নেই আমার। দরকার তোমাকে। তুমি ঠিক চারটের সময় আসতে পারবে কিনা তাই বলো। টাকাটা তো সেজন্যেই দিলাম। ভয় নেই, কেউ জানবে না।
আবদুল হক কি বলবে ভেবে পেল না।
শাহানা বুঝিয়ে বলার সুরে বলল, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বুঝলে? সেজন্যেই আসতে বলছি। সবাই সুযোগ পায় না। আমি তোমাকে সুযোগটা দিতে চাই। কেউ জানবে না।
আসব, ম্যাডাম, ঘামতে ঘামতে প্রায় অস্ফুটে বলল আবদুল হক।
এই তো বুদ্ধিমানের মত কথা। আচ্ছা, এবার যাও তুমি। কাউকে বোলো না কিন্তু।
দ্রুত বেরিয়ে গেল আবদুল হক।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে আপনমনে হাসল শাহানা। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাত্রির ঢাকা শহর, চারদিকে নানা রঙের বিভিন্ন আকৃতির আলো, গাড়ির হেডলাইট ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। শুনগুন করতে করতে বেডরূমে ঢুকল সে। বসল একটা আরাম কেদারায়, হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফোনটা।
ডায়াল করতেই অপরপ্রান্ত থেকে মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌসের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হ্যালো!
ফেরদৌস, আমি তোমার শাহানা, ক্যাপিটাল হোটেলের ছয়তলার বাহাত্তর নম্বর সুইট থেকে বলছি। দারুণ থ্রিল অনুভব করছি ঢাকায় পা দিয়েই, বুঝলে। একা হওয়ার এই মজা! তোমার অবস্থা কি? নিশ্চয়ই খুব বোরিং ফী করছ?
মোফাজ্জেল সাহেব বললেন, বোরিং ফীল্ করার সময় এখনও আসেনি। তোমার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করছিলাম এতক্ষণ। ভালয় ভালয় পৌঁছেছ শুনে স্বস্তি পেলাম। কোন সমস্যা নেই তো? তোমার মামার বাড়ি গিয়েছিলে?
গিয়েছিলাম। মামী-মা আমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছেন। আগামীকাল যাব আমি, বলে এসেছি। তিন হাজার টাকার চেক দিয়ে আসব।
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, তা তো অবশ্যই দেবে। ঝগড়া-টগড়া কোরো না, কেমন? আর শোনো, খুব সাবধানে চলাফেরা কোরো। তোমার সাথে আমি নেই, একথাটা ভুলে যেয়ো না। বিপদে-আপদে পড়লে সাথে সাথে ফোন করবে, কেমন? অবশ্য তোমাকে আমি নীরস সময় কাটাতে বলছি না। হ্যাভ ফান, ডারলিং। দুদিন পর আবার ফোন কোরো, কেমন?
আই উইল, ডারলিং। অ্যাণ্ড ইউ হ্যাভ ফান, টু। গুডনাইট!
ক্রেডলে রিসিভার নামিয়ে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল শাহানা। খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করল সে। তারপর উঠল।
বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে স্নান করল সে। বিশ মিনিট পর ড্রেসিংরূম থেকে যখন বেরুল তখন আগুনের মত জ্বলছে তার রূপ। লাল শিফন পরেছে, সেই সাথে লাল রাউজ। বাঁ হাতের কনিষ্ঠায় হীরের আঙটিটা ছাড়া বাকি সবই লাল।
ফোন এল আরও পনেরো মিনিট পর।
ইকবালের ফোন, ককটেল লাউঞ্জে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।
ওয়ান্ডারফুল! থ্যাঙ্কস, ইকবাল!
রিসিভার নামিয়ে রাখল শাহানা। প্রায় সাথে সাথে আবার ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল ফোনের বেল। রিসিভার তুলতেই রিসেপশনিস্টের গলা ভেসে এল, মিসেস শাহানা, আপনার গাড়ি হোটেলের গেটে পৌঁছে গেছে। লাল টয়োটা।
অদ্ভুত! আমিও লাল শাড়ি পরেছি। থ্যাঙ্কিউ!
তিন মিনিট পর করিডরে বেরুল শাহানা। দরজায় তালা দিয়ে পা বাড়াল। নিচে নেমে রিসেপশনিস্ট যুবকের সাথে কথা বলল একমিনিট, তারপর বাইরে বেরিয়ে এল।
পোর্টারের কাছ থেকে লাল টয়োটার চাবি নিয়ে শাহানা জানতে চাইল, গ্যারেজটা কোনদিকে?
ব্যাক সাইডে, ম্যাডাম। ইচ্ছা করলে আপনি নিজেই গাড়ি রাখতে বা নিতে পারবেন। কোন চার্জ লাগবে না। গেটের কাছেও গাড়ি রেখে যেতে পারেন, আমরা রেখে আসব গ্যারেজে, দরকারের সময় চাইলেই আবার এনে দেব-চার্জ হবে এই নিয়মে। রাতের বেলা অ্যাট্যোন্ট থাকে না গ্যারেজে, গাড়ির জানালা দরজা লক আপ করতে ভুলবেন না, মাডাম!
ধন্যবাদ জানিয়ে পা বাড়াল শাহানা ককটেল লাউঞ্জের দিকে।
.
০৩.
রাত আটটা।
ককটেল লাউঞ্জে সে-সময় একজন মাত্র বারটেন্ডার উপস্থিত। বারের ভিতর লোকজন খুব কম। তিন চারটে কেবিনের দরজা বন্ধ দেখা যাচ্ছে ভিতর থেকে, বাকি সবগুলো খালি। ছড়ানো-ছিটানো টেবিল চেয়ারগুলোও অধিকাংশ শূন্য। সর্বমোট পনেরো-বিশজন নর-নারী বসে আছে। তারাও ডিনারের জন্য উঠব উঠব করছে।
বারটেণ্ডার সুকুমার সেন খবরের কাগজ পড়ছিল কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে। কাউন্টারের এ-পাশে গদিমোড়া কয়েকটা টুল, একটি ছাড়া সবগুলোই খালি। রোগা-পাতলা চওড়া কার্নিশ-ওয়ালা হ্যাট পরা এক লোক বসে বসে রেকর্ডপ্লেয়ার থেকে নিক্ষিপ্ত মিউজিকের তালে তালে পা দোলাচ্ছে, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে। কাউন্টারের উপর রাখা হুইস্কির গ্লাসে। কখনও বা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে লাউঞ্জের প্রবেশ পথের দিকে। তার ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে দীর্ঘ এবং মোটা একটা বার্মিজ চুরুট জ্বলছে। চুরুটের গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
হাইহিলের শব্দে মুখ তুলল বারটেণ্ডার সুকুমার। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। লাল পরীর মত সুন্দরী এক যুবতী ঢুকছে লাউঞ্জে।
লাউঞ্জে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়ল শাহানা। গ্রীবা উঁচু করে চারদিকে একবার তাকিয়েই সে বুঝতে পারল, ইকবাল কোথাও নেই। একজন ওয়েটার দ্রুত এগিয়ে আসছে দেখল সে।
ম্যাডাম, মি. ইকবাল জরুরী একটা কাজে কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গেছেন। আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন তিনি। ওই কর্নারের টেবিলটা।
শাহানা দৃঢ় পায়ে এগোতে শুরু করল আবার, বলল, কাউন্টারের সামনে বসলে ক্ষতি কি! মি. ইকবাল ফিরলে টেবিলে যাব।
ঠিক আছে, ম্যাডাম।
সবিনয়ে সম্মতি জানাল ওয়েটার। দ্রুত পায়ে শাহানাকে ছাড়িয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। সুকুমারের উদ্দেশে নিচু গলায় বলল, ম্যাডামের সঙ্গী ভদ্রলোক খানিক পর আসবেন। কি একটা কাজে বাইরে গেছেন তিনি। ম্যাডামের সবিধে অসুবিধে লক্ষ রাখবেন, স্যার!
শাহানা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে র্যাকে সজ্জিত বিভিন্ন নাম এবং প্রকারের মদের বোতলগুলো দেখতে দেখতে মৃদু হাসল।
বসুন, ম্যাডাম। দেব কিছু? সুকুমার সমীহভরে জানতে চাইল। শাহানার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। বারে চাকরি করতে করতে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছে সে। কিন্তু নবাগতা এই যুবতাঁকে দেখামাত্র সে স্বীকার না করে পারল না, এর মত সুন্দরী মেয়ে এর আগে চোখে পড়েনি তার।
শাহানা শব্দ করে হাসল। বসল সে উঁচু একটা টুলে। ভ্যানিটি ব্যাগটা কাউন্টারের উপর রাখল। দুই হাতের কনুই কাউন্টারে রেখে দুই হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে খাপে খাপে মিলিয়ে তার উপর থুতনি রাখল, বলল, বাড়িতে এসবে দুএকবার চুমুক দিয়েছি বটে, কিন্তু খুব একটা অভ্যাস নেই। হালকা কিছু…।
শ্যাম্পেন। আপনার জন্য শ্যাম্পেনই উপযুক্ত।
শাহানা বলল, আমার বন্ধু, হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না। বাট আই ফী টু-নাইট কস্ ফর ইট। আমি একটু…মানে, জাস্ট সাইটলি, বেসামাল হতে চাই। বুঝতেই পারছেন…ঠিক আছে, শ্যাম্পেনই দিন। সরপর না হয় হুইস্কি বা আর কিছুর কথা ভাবা যাবে…
এই দিচ্ছি।
কথাটা বলে সুকুমার ঘুরে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু শাহানা কথা বলে উঠল আবার, একটা কথা। ঢাকায় আমি এই প্রথম। কিছুই জানা নেই। প্রশ্নটা বোকার মত হয়ে যাবে কিনা জানি না, তবু প্রশ্ন করে ব্যাপারটা জেনে নিতে চাই আমি! একা একটা বারে বসে ড্রিঙ্ক করা, মেয়েদের জন্যে এটা কি আপত্তিকর?
অফকোর্স নট, ম্যাডাম! এটা ঢাকা, তার চেয়ে বড় কথা এটা ক্যাপিটাল। এখানে মেয়েদের ব্যাপারে ও ধরনের কোন প্রেজুডিস নেই।
শাহানা হাসল গালে টোল ফেলে। পটলচেরা চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। তার, তাহলে আরও একটা প্রশ্ন করি। মেয়েদের এন্টারটেনমেন্টের জন্য ঢাকায় কি কি ব্যবস্থা আছে? আই মীন, পুরুষরা যেমন মদ খায়, নাইট ক্লাবে যায়, ফ্ল্যাশ খেলে, ড্রাইভ করে, নাচে, নীলছবি দেখে মেয়েরাও কি ঠিক সেইভাবে এসব করতে পারে?
কেন পারবে না। তবে এটা নির্ভর করে একজন মেয়ের রুচি এবং ইচ্ছার উপর। সব জায়গায় হয়তো পারে না, কিন্তু রাজধানীতে পুরুষরা যা করে মেয়েরাও তা অনায়াসে করতে পারে। আপনি চাইলে সবই করতে পারেন। হোয়াই নট জাস্ট হ্যাভ ফান?
শাহানা নিচ গলায় বলল, আই ওয়ান্ট টু। অ্যাম নট শিওর দ্যাট আই নো হাউ। বাট আই ড় বিলীড় দিস শাস্পেন ইজ গোয়িং টু হেলপ। হ্যাভ ইউ গট সিগারেট?
ওহ, শিওর।
সুকুমার এক প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইডের প্যাকেট শেলফ থেকে তুলে কাউন্টারের উপর রাখল। প্যাকেট খুলে শাহানা একটা ফিলটার টিপড় সিগারেট ঠোঁটে তুলল। সুকুমার লাইটারটা খুঁজছে।
শাহানার পাশে বসা রোগা-পাতলা অ্যাঙলো লোকটা সুযোগটা গ্রহণ করল, নিজের গ্যাসলাইটার জেলে বাড়িয়ে দিল সেটা শাহানার দিকে।
সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে গলগল করে ধোয়া ছাড়ল শাহানা। বলল, থ্যাঙ্কস!
হ্যাট পরা লোকটা লাইটারটা নিভিয়ে দিয়ে মুচকি হাসল, বলল, ইটস্ আ প্লেজার। হাপনি একা বেড়াইটে আসিয়াছেন, মিস…?
শাহানা সহাস্যে বলল, মিসেস, মিসেস শাহানা! হ্যাঁ একাই এসেছি। ব্যাপার কি জানেন, আমার স্বামী ভদ্রলোকের ইচ্ছা, বছরে অন্তত একবার আমরা পরস্পরের কাছ থেকে কিছু দিনের জন্য দূরে থাকব। তাতে নাকি দাম্পত্য জীবন আরও মধুর হবে।
অ্যাঙলো লোকটা, অর্থাৎ প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিস্টার স্যানন ডি. কস্টা বলল, হামি হাপনার মোয়ামীকে সমঠন করি।
শাহানা বলল, কিন্তু, সমস্যাটা একবার ভেবে দেখুন। তিনি হুকুম জারী করেছেন ঢাকায় আমাকে সম্ভাব্য সবরকম আমোদ-ফুর্তি করে সময় কাটাতে হবে। এদিকে নীরস এক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে চিনি না…
সুকুমার কাউন্টারে একটা ট্রে রাখল। তাতে শ্যাম্পেনের বোতল এবং একটা গ্লাস। গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালল সুকুমার। বলল, নাউ ইউ ক্যান স্টার্ট!
গ্লাসে চুমুক দিল শাহানা।
পিছন থেকে ইকবালের কণ্ঠস্বর ভেসে এল সেই সময়, আমরা টেবিলে বসতে পারি, তাই না, শাহানা?
অফকোর্স!
টুল থেকে নামল শাহানা, সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়েটারকে দিয়ে ট্রেটা টেবিলে পাঠিয়ে দিন।
ইকবালের একটা হাত ধরল শাহানা, দুজন পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল কর্নারের একটা টেবিলের দিকে।
সুকুমার এবং ডি. কস্টা পিছন থেকে চেয়ে রইল ওদের দিকে। সুকুমার দেখছে শাহানাকে। কিন্তু ডি. কস্টা শাহানাকে নয়, দেখছে ইকবালকে।
মুখোমুখি বসে শাহানা বলল, তোমার আচরণ খুব রহস্যময় লাগছে আমার। কাছে, ইকবাল। খানিক পর পরই কিছুক্ষণের জন্য কোথায় যাচ্ছ তুমি?
ইকবাল বলল, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যবসা সংক্রান্ত। তাই…
শাহানা জানতে চাইল, সমস্যাটা মিটবে কখন?
সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওটা নিয়ে আজ আর মাথা ঘামাচ্ছি না আমি।
ওয়েটার ট্রে দিয়ে গেল। ইকবাল হুইস্কির অর্ডার দিল নিজের জন্য।
শাহানা পা দোলাতে দোলাতে বলল, এখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ব। ডিনার পরে খাব, কেমন?
কোথায় যেতে চাও এরপর?
শাহানা বলল, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। অবশ্যই কোন নাইট-ক্লাবে, তাই?
ইকবাল কি যেন ভাবছে, জবাব দিল না।
শাহানা আবার বলল, যেখানে মদ খেয়ে মাতলামি করব আমি। যেখানে জুয়া খেলে প্রচুর জিতব কিংবা হারব।
ইকবাল বলল, মান-সম্মানের কথাটা একবার ভেবে দেখবে না?
মান-সম্মান? কার? তোমার, আমার?
ইকবাল বলল, আমি পুরুষমানুষ। মদ খাওয়া বা জুয়া খেলা আমার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তুমি মেয়ে। তোমার মান-সম্মানের কথাই বলছি আমি।
শাহানা হঠাৎ শব্দ করে হাসল। বলল, মান-সম্মানের ভয় আমারও আছে, ইকবাল। কিন্তু ঢাকায় ভয় করব কাকে? স্বামী বেচারা তো চট্টগ্রামে কাজে ব্যস্ততার কানে কোন কথা যাবার ভয় নেই। সুতরাং ফুর্তি করার এমন সুযোগটা ছাড়ব কেন?
ইকবাল বলল, কিন্তু তোমার মান-সম্মানের মূল্য আমার কাছেও আছে।
তুমি আমার স্বামী নও। প্রাক্তন প্রেমিক। তোমাকে আমি সুযোগ দিচ্ছি। আমাকে নিয়ে ফুর্তি করার। সুযোগটা তুমি নিতে চাইছ না কেন?
ইকবাল বলল, তোমাকে আমি ভাল মেয়ে হিসেবে জানি। সেই জানাটা মিথ্যে প্রমাণিত হোক তা আমি চাই না।
শাহানা বলল, যেটা মিথ্যে সেটা মিথ্যেই। সত্য হলো, আমি বৈচিত্র্যের পূজারিনী! নতুনত্ব চাই জীবনে। এতে করে তুমি যদি আমাকে খারাপ মেয়ে বলে মনে করো, আমার আপত্তি নেই। ধরে নাও, আমি ভাল মেয়ে নই।
ইকবাল চুপ করে রইল। অস্বাভাবিক গভীর দেখাচ্ছে তাকে।
ওয়েটার হুইস্কি দিয়ে গেল। নিঃশব্দে পান করতে লাগল ওরা।
একসময় ইকবাল নিজেই বলল, বেশ। তুমি ভাল মেয়ে নও, এটাই সত্যি বলে জানব আজ থেকে! চলো, কোথায় যাবে? জুয়া খেলবে, মদ খাবে–আমার কোন আপত্তি নেই।
এই তো পুরুষমানুষের মত কথা! ধন্যবাদ। চলো, ফ্ল্যাশ খেলব।
উঠল ওরা। বিল মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ককটেল লাউঞ্জ থেকে। ইকবাল গাড়ি রেখে এসেছে। ভাড়া করা লাল টয়োটায় চড়ে রাজপথে বেরুল ওরা।
এবার ক্রীম কালারের টয়োটা নয়, কালো রঙের একটা মরিস অনুসরণ শুরু করুল ওদের গাড়িকে।
.
০৪.
সোমবার ঢাকায় এসেছিল শাহানা। তারপর কেটে গেছে একে একে কয়েকটা দিন। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র-চারদিন গত হয়েছে। আজ শনিবার। সবে মাত্র ভোর হয়েছে। আজ নিয়ে পাঁচদিন।
নতুন দিনের আলো ফুটছে ঢাকার বুকে। সূর্য এখনও ওঠেনি, তবে এই উঠল বলে। ক্যাপিটাল হোটেলের সমিনেটা সারাদিন এবং গভীর রাত্রি পর্যন্ত যানবাহনের ভিড়ে গিজ গিজ করলেও এই মুহূর্তে গোটা এলাকাটা ফাঁকা, খা-খা করছে। প্রশস্ত কংক্রীটের রাস্তার উপর শুধু কয়েকজন ঝাড়ুদার ইতস্তত ঝাট দিচ্ছে। এমন সময় যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল, দেখা গেল ঝকঝকে একটা গাঢ় বাদামী রঙের ডাটসন ওয়ানটোয়েনটি ওয়াই গাড়ি সবেগে ছুটে আসছে। ঝাড়ুদাররা সরে গেল একপাশে। ডাটসন সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্যাপিটাল হোটেলের গেটের সামনে। মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌস নামল গাড়ি থেকে হাতে একটা লেদার ব্যাগ নিয়ে।
ভোর বলেই গেটে এই সময় পোর্টার বা গেটম্যান নেই। মোফাজ্জল সাহেব গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মুখের চেহারায় রাত্রি জাগরণের পরিষ্কার ছাপ। পরনের হালকা ধূসরঙের ট্রপিক্যাল সুটটা সিগারেটের ছাই লেগে জায়গায় জায়গায় নোংরা হয়ে গেছে। সারারাত্রি গাড়ি চালিয়েছেন তিনি, খাওয়া দাওয়াও হয়নি গত সন্ধ্যার পর থেকে।
প্রকাণ্ড রিসেপশন রূমে ঢুকে তিনি দেখলেন একজন ক্লার্ক ছাড়া আর কেউ নেই। ক্লার্কটাও ঝিমুচ্ছে চেয়ারে বসে। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে লেদার ব্যাগটা কার্পেটের উপর নামিয়ে রেখে বিরক্তির সাথে কথা বললেন তিনি, শুননে?
চোখ মেলে তাকাল মধ্যবয়স্ক কেরানী। মোফাজ্জল সাহেবকে দেখে ধড়মড় করে সিধে হয়ে বসল।
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, আপনাদের এখানে মিসেস শাহানা আছেন! ওর সুইট নাম্বারটা বলুন।
মিসেস শাহানা! ক্লার্ক উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। মিসেস শাহানা, মিসেস শাহানা…হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। রিপোর্টটা সম্ভবত ডিটেকটিভ অফিসারের সহকারী মাসুদুর রহমানের কাছে আছে। রিপোর্ট করা হয়েছে বলেই নামটা পরিচিত ঠেকছিল।
ইন্টারকমের সুইচ অন্ করে ক্লার্ক মাউথপীস মুখের সামনে তুলে বলল, মাসুদ সাহেব, দয়া করে রিসেপশনে আসুন একবার। এক ভদ্রলোক মিসেস শাহানার সুইট নাম্বার জানতে চাইছেন।
সুইচ অফ করে রেজিস্টার বইটা টেনে নিল ক্লার্ক, পাতা উল্টে পরীক্ষা করল, তারপর মুখ তুলে তাকাল মোফাজ্জল সাহেবের দিকে, হ্যাঁ। মিসেস শাহানা আমাদের হোটেলে গত সোমবার সন্ধ্যায় উঠেছেন।
স্যুইট নাম্বারটা জানতে চাই আমি। মোফাজ্জল সাহেব অধৈর্য কণ্ঠে বললেন। পকেট থেকে ৫৫৫ মার্কা সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটার জ্বাললেন তিনি, পদশব্দ শুনে তাকালেন পিছন দিকে। দেখলেন সুবেশী এক লোক দ্রুত এগিয়ে আসছে। তার পাশেই এসে দাঁড়াল লোকটা।
ক্লার্ক সংক্ষেপে বলল, ইনি।
মোফাজ্জল সাহেব চটে উঠে কিছু যেন বলতে চাইলেন, কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই তার পাশে সদ্য এসে দাঁড়ানো মাসুদুর রহমান বলল, একমিনিট, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি মিসেস শাহানার সুইট নাম্বার জানতে চাইছেন কেন, বলবেন কি?
ঝট করে মাথা নেড়ে মাসুদুর রহমানের দিকে তাকালেন মোফাজ্জল সাহেব, চোখ দুটো কুঁচকে উঠল তার। অসহিষ্ণু কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কে আপনি? আমার স্ত্রীর সুইট নাম্বার আমি জানতে চাইব না?
মাসুদুর রহমান এতটুকু বিচলিত না হয়ে বলল, আমি ক্যাপিটালের সহকারী সিকিউরিটি অফিসার। আপনি মিসেস শাহানার স্বামী, বলতে চাইছেন?
রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মোফাজ্জল সাহেবের গলা উচ্চকিত হয়ে উঠল, জী-হ্যা! আমি তাই বলতে চাইছি। আমি মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌস, মিসেস শাহানার স্বামী। আর কিছু জানার আছে আপনার?
মাসুদুর রহমান বিনীতভাবে হাসল এবার। বলল, কিছু মনে করবেন না, মি. ফেরদৌস। আমার দায়িত্ব গেস্টদের প্রাইভেসী রক্ষা করা। মিসেস শাহানা জানেন আপনার আসার কথা আছে?
না। দেখুন সহকারী সিকিউরিটি অফিসার সাহেব, সারারাত আমি গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এখানে আসছি। আমি খুবই ক্লান্ত। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। এখুনি আমাকে স্নান করতে হবে, দাড়ি কামাতে হবে, ঘুমুতে হবে। দয়া করে, ফর গডসে, সুইট নাম্বারটা আমাকে জানাবেন কি?
মাসুদুর রহমানের চেহারায় কোন ভাবান্তর ঘটল না। সে শান্তভাবেই জানতে চাইল, মাফ করবেন, আপনি যে ভদ্রমহিলার স্বামী তা প্রমাণ করার জন্য পরিচয়পত্র দেখাতে পারবেন?
মাই গড! শাহানার স্বামী আমি তা আমাকে প্রমাণ করতে হবে। কি বলছেন আপনি?
মাসুদুর রহমান এবার হাসল, বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলল, আপনি নিজেই ভেবে দেখুন না, কেউ বলল আমি অমুক ভদ্রমহিলার স্বামী আর আমরা সাথে সাথে তাকে সেই ভদ্রমহিলার সইটে প্রবেশ করার অনুমতি দিলাম-এটা কি উচিত? গেস্টদের প্রাইভেসী এবং সিকিউরিটি, দুটোর দিকেই লক্ষ রাখতে হয় আমাদের।
তা ঠিক। যে-কেউ চাইলেই নাম্বার দেয়া উচিত নয়। মোফাজ্জল সাহেব শান্ত হলেন। যুক্তিটা অনুধাবন করতে পেরেছেন তিনি এতক্ষণে। কোটের ভিতরের পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড এবং চট্টগ্রামস্থ একটা নাইট ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন মাসুদুর রহমানের দিকে, এগুলোয় প্রমাণ হয় কিছু?
কার্ড দুটো পরীক্ষা করে মাসুদুর রহমান বলল, ঠিকই আছে, মি. ফেরদৌস। করিম সাহেব, চাবি আছে?
ক্লার্ক বলল, এক্সট্রা একটা আছে। মিসেস শাহানা হোটেলে আসার পর রিসেপশনে চাবি জমা রাখেননি।
মাসুদুর রহমান ক্লার্কের হাত থেকে অতিরিক্ত চাবিটা নিয়ে মোফাজ্জল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার সাথে যাচ্ছি আমি–চলুন।
কথাটা বলে কার্পেটের উপর থেকে লেদার ব্যাগটা তুলে নিল সে। মোফাজ্জল সাহেব বলে উঠলেন, ওটা আমাকে দিন।
আমিই নিচ্ছি–চলুন।
মোফাজ্জল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। মাসুদুর রহমানকে অনুসরণ করে এলিভেটরে চড়লেন তিনি। এলিভেটর ছয় তলায় থামতে তিনি নামলেন আগে। পিছন থেকে মাসুদুর রহমান বলল, বাহাত্তর নাম্বার সুইট।
কার্পেট বিছানো করিডর ধরে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন মোফাজ্জল সাহেব। সর্বশেষ সূইটের দরজার সামনে দ্রুত নক্ করলেন।
ভিতর থেকে কোন সাড়া এল না।
আবার, এবার আরও জোরে নক করলেন মোফাজ্জল সাহেব। তারপর জোর গলায় ডাকলেন, শাহানা! শাহানা দরজা খোলো!
মাসুদুর রহমান পাশে এসে দাঁড়াল, বলল, চাবি নিন। দরজাটা খুলুন।
চিন্তিত দেখাল মোফাজ্জল সাহেবকে। বলল, ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে অভ্যস্তা শাহানা। ঘুমও ওর খুব পাতলা টুক করে শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়। দিন দেখি চাবিটা।
মাসুদুর রহমানের বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে চাবি নিয়ে কী-হোলে ঢোকালেন মোফাজ্জল সাহেব, তালা খুলে দরজার কবাট দুটো উন্মুক্ত করে ভিতরে তাকালেন।
সাদা, ফ্যাকাসে হয়ে গেল এক পলকে মোফাজ্জল সাহেবের মুখের চেহারা। পাথরের মূর্তির মত খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। দরজার ওপাশে সীটিংরূম, সীটিংরূমের অপর দরজাটা খোলা, সেই খোলা দরজা পথে দেখা যাচ্ছে বেডরূম। বেডরূমের বিছানাটা শূন্য। লাগেজ র্যাকটাও দেখা যাচ্ছে, সেটাও শূন্য। র্যাকের নিচে সুটকেস এবং লেদার ব্যাগটা রয়েছে। কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র সবই রয়েছে ভিতরে, বের করা হয়নি। কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর অস্ফুটে মোফাজ্জল সাহেব উচ্চারণ করলেন, শাহানা!
পা বাড়িয়ে সীটিংরুমে ঢুকলেন তিনি। যন্ত্রচালিতের মত বেডরুমের দরজার দিকে পা বাড়ালেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন দোরগোড়ায়। তারপর সবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন মাসুদুর রহমানের দিকে। ভাঙা, ভীত গলায় বললেন, কোথায় ও? কোথায় আমার স্ত্রী? কি ঘটেছে আপনাদের এই হোটেলে?
ঝট করে এরপর তাকালেন মোফাজ্জল সাহেব বাথরূমের দরজার দিকে। প্রায় ছুটলেন তিনি সেদিকে। সশব্দে দরজার কবাট উন্মুক্ত করে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, শাহানা!
শান্ত হোন, মি. ফেরদৌস। ওই সোফাটায় বসুন। আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলার আছে।
মোফাজ্জল সাহেব নড়তে পারলেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। তিনি মাসুদুর রহমানের দিকে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ঘটেছে? কোন বিপদ-শাহানা কি…কি হয়েছে শাহানার? খুলে বলুন আমাকে, প্লীজ, কি হয়েছে আমার স্ত্রীর?
মাসুদুর রহমান এগিয়ে এসে মোফাজ্জল সাহেবের কাঁধে হাত রাখল, ভয়। পাবার কিছুই নেই, মি. ফেরদৌস। দুশ্চিন্তা করবেন না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমি না জানলেও যতটা জানি বলছি। আসুন বসা যাক।
টেনে নিয়ে এসে সোফায় বসাল মাসুদুর রহমান মোফাজ্জল সাহেবকে। বলল, আপনার স্ত্রী ঠিক কোথায় আছেন তা আমরা কেউ জানি না। তার মানে এই নয় যে তিনি কোন বিপদে পড়েছেন। তিনি সোমবার সন্ধ্যার সময় হোটেলে আসেন। আধঘন্টা কি চল্লিশ মিনিটের মত ছিলেন তিনি এই সুইটে, তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। সে-রাতে আর তিনি ফিরে আসেননি। আমি বলতে চাইছি, তিনি সেই যে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন তারপর আর ফিরে আসেননি।
মোফাজ্জল সাহেব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টলতে টলতে ঘুরে দাঁড়ালেন। মাসুদুর রহমানও উঠে দাঁড়াল। মোফাজ্জল সাহেব পড়ে যাবার উপক্রম করতেই সে দুই হাত দিয়ে ধরে ফেলল তাকে, আবার বসিয়ে দিল সোফায়, নার্ভাস হবেন না, মি. ফেরদৌস। আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি মনেকরি…।
সিধে হয়ে সোফায় বসে ঠক ঠক করে রাগে কাঁপছেন মোফাজ্জল সাহেব, সেই সোমবার থেকেই আমার স্ত্রীর কোন খবর নেই অথচ তা আমাকে জানানো হয়নি। আপনারা মানুষ না গরু? কি ধরনের হোটেল এটা? কিছু একটা ঘটেছে, আপনারা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন–মাই গড! এসব কি শুনছি আমি।
মাসুদুর রহমান দুঃখ বোধ করল মোফাজ্জল সাহেবের জন্যে। নিজের চাকুরি জীবনের প্রতি চটে উঠল সে। নিরীহ, ভাল মানুষ একজন স্বামী, তাকে তার স্ত্রীর নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে–গোটা ব্যাপারটাই অপ্রীতিকর। কিন্তু কর্তব্য কর্তব্যই।
দেখুন, মি: ফেরদৌস, আমরা কিছুই লুকাচ্ছি না। আপনাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে। একজন ডাক্তারকে বরং ডেকে পাঠাই আমি।
মোফাজ্জল সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ঠাট্টা করছেন নাকি? ডাক্তার নয়, আমি আমার স্ত্রীকে চাই! কোথায় সে? আপনার কথা যদি সত্যি হয়, সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে তার সন্ধান নেই একথা যদি সত্যি হয়–এই কদিন ঘাস কাটছিলেন নাকি আপনারা? আমাকে খবর দেননি কেন? পুলিশকে খবর দেননি কেন?
মোফাজ্জল সাহেব আবার উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারি শুরু করলেন তিনি, ওহ গড! শাহানা আজ পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ…তাকে খোঁজার কোন চেষ্টাই এরা করেনি! অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য! কোথায় পাঠিয়েছিলাম তাকে আমি কেন পাঠিয়েছিলাম। এরা মানুষ না কি! আমি এখন…হায় খোদা! কি করব এখন আমি…
মি, ফেরদৌস, প্লীজ! একটু শান্ত হোন আপনি। মাথা ঠাণ্ডা করে সমস্যাটা একবার খতিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। আপনার স্ত্রী পাঁচ রাত বাইরে কাটিয়েছেন, অন্য কোথাও। আমাদের হোটেলে থাকার কথা ছিল তাঁর কিন্তু তা তিনি থাকেননি। হয়তো কোন আত্মীয়ের বাড়ি, কোন বন্ধু বা বান্ধবীর বাড়িতে আছেন তিনি তো আর জানতেন না যে আপনি হঠাৎ ঢাকায় এসে পড়বেন।
মোফাজ্জল সাহেব আচমকা পায়চারি থামিয়ে মাসুদুর রহমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পলকহীন চোখ দুটো অঙ্গারের টুকরোর মত জ্বলছে। মনে হলো, এই বুঝি কষে চড় মারবেন মাসুদুর রহমানের গালে।
মাসুদুর রহমানও নড়তে সাহস পেল না। কথা বললেই বিপদ ঘটবে, বুঝতে পারছে সে। পরস্পর পরস্পরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে মোফাজ্জল সাহেব একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন, ননসেন্স
ছিটকে সরে গেলেন তিনি। অস্থিরভাবে কার্পেটের উপর পায়চারি শুরু করলেন। মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছেন। বিড় বিড় করে প্রলাপ বকছেন।
বোবা মূর্তির মত দেখতে লাগল মাসুদুর রহমান মোফাজ্জল সাহেবের অসহায় অবস্থা।
একসময় দাঁড়ালেন তিনি, মাসুদুর রহমানের দিকে তাকালেন। মাসুদুর রহমান দেখল দুই চোখ ভরা পানি মোফাজ্জল সাহেবের। রুদ্ধ গলায় তিনি বললেন, সোমবার সন্ধ্যার পর ফোন করেছিল আমাকে শাহানা। ঢাকায় ওর একমাত্র আত্বীয়ের বাড়ি আছে, তাদের সাথে সম্পর্ক ভাল নয়। ফোনে সে আমাকে বলেছিল, ওদের বাড়িতে থাকা সম্ভব নয় বলে আমি হোটেলে উঠেছি। ঢাকার আর কাউকে চেনে না সে। হঠাৎ যদি কারও সাথে পরিচয় হয়েও থাকে, তার সাথে কোথাও যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কোন কারণে যদি হোটেল ত্যাগ করার দরকার হত, সবচেয়ে আগে সে ফোন করে আমার সাথে পরামর্শ করত। না-না! শাহানা নিজের ইচ্ছায় হোটেল ছেড়ে এতদিন বাইরে থাকতে পারে না–অসম্ভব!
ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি। দুই হাতে মুখ ঢাকলেন।
মাসুদুর রহমান বলল, সম্পূর্ণ ঘটনাটা আমি জানি না, তা ঠিক। আমার কস্, চীফ সিকিউরিটি অফিসার মি. আবদুস সামাদ তার চেম্বারে আসবেন সকাল নটায়। তিনি হয়তো আরও তথ্য জানেন। ততক্ষণ আপনি স্থির হয়ে বিশ্রাম নিন, মি. ফেরদৌস। দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়লে এই পরিস্থিতিতে কোন লাভ নেই, তাই না?
মোফাজ্জল সাহেবের ভারি দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠল। দুই হাতে মুখ লুকিয়ে যুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। অসহায় শিশুর মত ভেঙে পড়লেন অদম্য কান্নায়।
.
০৫.
সোফায় সিধে হয়ে বসে দুষ্টুমিভরা হাসি হাসছে মহুয়া। ফোনের রিসিভারটা ওর কানে ঠেকানো। কামালের সাথে কথা বলছে ও।
শহীদ সবেমাত্র ব্রেকফাস্ট সেরে ড্রয়িংরূমে এসে বসেছে। মহুয়ার মুখোমুখি সোফায় বসে সেদিনেরই একটা ইংরেজি দৈনিকের পাতায় চোখ বুলাচ্ছে।
হঠাৎ হেসে উঠল মহুয়া খিলখিল করে। বলল, তোমার কপালে বিয়ে নেই। শুধু তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে! তোমার বন্ধু বোধহয় বিয়েটা চায় না। সেই তো তারিখ বদলাচ্ছে বারবার। ইদানীং নাকি খুব কাজের চাপ, নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছে মাত্র–এসব আসলে অজুহাত। বোনটাকে তোমার মত একজন বেকার যুবকের হাতে দিতে চায় না সম্ভবত। আমি বলি কি, লীনাকে নিয়ে তুমি পালিয়ে যাও
অপরপ্রান্ত থেকে কামাল বলল, মহুয়াদি, মাথা কি তোমার খারাপ হয়ে গেছে! তুমিই না কললে শহীদ ড্রয়িংরূমে রয়েছে
রয়েছেই তো! তাতে কি হলো? আমি বাবা সত্যি কথা সবার মুখের ওপরই বলি। তা যাক গে। তোমার সাক্ষ্য-দৈনিক যোগফলের খবর কি? সারকুলেশন বাড়ল কিছু?
কামাল বলল, বাড়ল কিছু মানে? জানো, চলতি মাসের এক তারিখ থেকে শুধু ঢাকার জন্য দৈনিক ছাপছি আমরা পনেরো হাজার।
সুখবর, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপদের দেখা পাবে অচিরেই, দেখে নিয়ো। যে হারে অপরাধীদের নামধাম ছবি ছাপছ..
কামাল বলল, আমার পত্রিকার নীতিই হলো, ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়া দৈনন্দিন অপরাধের সংবাদ প্রকাশ করা, অপরাধ দমনের পন্থা সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখা, আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষকে উপদেশ দেয়া এবং অপরাধীদের পরিচয় প্রকাশ করে দেয়া।
মহুয়া বলল, কয়লাকে যতই থোও ময়লা তার দূর হয় না। তোমার আর তোমার বন্ধুর রক্তে আছে গোয়ার্তুমি। বিপদের মধ্যে এক সেকেও না থাকলে খস্তি পাও না। যাক এসব কথা নিয়ে বিয়ে হবার পর থেকে অনেক ঝগড়া করেছি, আর নয়। যা ইচ্ছা করো তোমরা…
কলিংবেলের শব্দ হতে মহুয়া তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ খবরের কাগজটা একপাশে রেখে তেপয়ের উপর থেকে পাইপ এবং টোবাকোর কৌটোটা তুলে নিল। পাইপে টোবাকো ভরতে ভরতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, অর্থাৎ ফোনে কার সাথে কথা বলা হচ্ছে জানতে চাইল ও।
ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে মহুয়া বলল, কামাল।
শহীদ বলল, অনেকদিন হলো আসে নাও। খুব ব্যস্ত বুঝি পত্রিকা নিয়ে? আজ ওর প্রেসে একবার যাব।
মহুয়া মুখ কালো করে বলল, খুবই ব্যস্ত। বলল, শহীদের পরামর্শটা আরও আগে গ্রহণ করা উচিত ছিল। তাহলে নাকি পত্রিকার সারকুলেশন পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে যেত। এখন মাত্র পনেরো হাজার।
লেবু ড্রয়িংরূমের পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। দাদামণি, এ-এ-এক ভদ দ ভদ্রলোক।
এক ভদ্রলোক এসেছেন। কি চান তিনি?
আ-আ প।
আমাকে চান। কি নাম?
তা-তা-তা-তা
তাজুদ্দিন?
না। তা-তা তো-তি-তিনি ব ..
তা বলেননি। ঠিক আছে, নিয়ে আয় সাথে করে। এই ভদ্রলোকই সম্ভবত খানিক আগে ফোন করেছিলেন।
লেবু চলে যেতে মহুয়া উঠল সোফা ছেড়ে, জানতে চাইল, এই সকাল বেলা কে গো?
শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ নীল ধোয়া উদৃশীল করল, চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক। মোফাজ্জল দার ফেরদৌস। ভদ্রলোক মারাত্মক কোন বিপদে পড়েছেন সম্ভবত। খানিক আগে ফোনে কথা বলার সময় ব্যাপারটা টের পেয়েছি। ভদ্রলোকের গলা কাঁপছিল।
মহুয়া ড্রয়িংরূমের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মন্তব্য করল, বিপদে পড়লেই লোকে তোমার কাছে সাহায্যের আশায় ছুটে আসে। কিন্তু তুমি যদি বিপদে পড়ে তাহলে তারা কি তোমাকে সাহায্য করতে আসবে?
শহীদ উত্তর দেবার চেষ্টা না করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মচ মচু শব্দে জুতো পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে বারান্দার উপর দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে। দ্রুত, ব্যস্ত পদক্ষেপ-শব্দটা কান খাড়া করে শুনতে লাগল শহীদ। ড্রয়িংরুমের দরজার ঠিক বাইরে থামল সেই শব্দ। পর্দাটা দুলে উঠল, সরে গেল একপাশে, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন মোফাজ্জল সাহেব।
মোফাজ্জল সাহেবকে এক নজর দেখেই অনেক কিছু বুঝতে পারল শহীদ। চোখ দুটো লাল এবং ফোলা ফোলা দেখে সন্দেহ রইল না ওর, ভদ্রলোক খানিক আগে কেঁদেছেন। ভদ্রলোক সকালে দাড়ি কামাননি, স্নান করেননি, সম্ভবত নাস্তা করাও হয়ে ওঠেনি।
সোজা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন মোফাজ্জল সাহেব, মোফাজ্জল হায়দারফেরদৌস, আমিই ফোন করেছিলাম। আপনি মি. শহীদ খান?
করমর্দন করে শহীদ বলল, আমিই। বসুন, মি. ফেরদৌস। আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
মুখোমুখি সোফায় বসে মোফাজ্জল সাহেব বললেন, ফোন গাইড দেখে প্রথমে আপনার নামটাই পেলাম। লেখা রয়েছে দেখলাম, আপনি প্রফেশনাল নন। তবু আর এক মিনিট সময়ও নষ্ট করতে চাই না বলে সোজা আপনার কাছেই এসেছি। আপনি আমাকে গ্রহণ করবেন কিনা ঠিক জানি না।
শহীদ পাইপে মৃদু মৃদু টান দিচ্ছিল। বলল, সব কেস আমি নিই। না, সত্যি কথা। কিন্তু সেটা পরে বিবেচ্য। আপনার সমস্যাটা কি জানতে হবে আগে।
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, আমার স্ত্রী হারিয়ে গেছেন। আজ পাঁচ দিন হলো তার কোন সন্ধান নেই। কেউ ব্যাপারটা নিয়ে এক সেকেণ্ডও মাথা ঘামায়নি। একদল গরু এমন ভয়ঙ্কর একটা ঘটনাকে গুরুত্বই দেয়নি। মি. শহীদ, ফর ডেস্ সেক, আপনি যেভাবে হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করুন। ওদেষকে আমি এখন কিছুই বলব না। শাহানার সন্ধান পাই, তারপর কুলগুলোকে আমি উচিত শিক্ষা দেব।
শহীদ বলল, বলদ বা গরু-কারা তারা?
ক্যাপিটাল হোটেলের চীফ সিকিউরিটি অফিসার, এক নম্বর গরু। সহকারী মাসুদুর রহমান, দুই নম্বর গরু। ভেবে দেখুন মি. শহীদ, আমার স্ত্রী ওদের হোটেল থেকে নিখোঁজ হয়েছেন আজ পাঁচদিন হলো অথচ ওরা আমাকে বা পুলিশকে একটা খবর দেয়নি। কী নির্বোধ আচরণ ভাবুন একবার! ওদের নামে আমি কেস করব, বিলীভ মি…
শহীদ বলল, উত্তেজিত হবেন না, মি. ফেরদৌস। আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে ধীরে সুস্থে বলুন দেখি।
মোফাজ্জল সাহেব সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন। শহীদ লক্ষ করল ভদ্রলোকের হাত কাঁপছে।
প্রথম থেকেই বলি। কথাটা বলে কিভাবে শুরু করবেন ভেবে ইতত করতে লাগলেন মোফাজ্জল সাহেব। সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে মুখ খুললেন, আজ এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে আমাদের। গত রবিবার দিন আমাদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকী পালন করেছি আমরা। বিয়ের এক দিন পরই আমি শাহানাকে বলেছিলাম, বছরে অন্তত একবার আমরা পরস্পরকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব। আমার বক্তব্য ছিল এতে করে স্বামী স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ বাড়বে।
দাঁত দিয়ে পাইপ কামড়ে ধরে মন্তব্য করুল শহীদ, সুন্দর বক্তব্য।
কথাটা আমরা কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়ল বিয়ে বার্ষিকীর দিন কাল লো। ওর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আগামীকালই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে ও। সেদিনই প্লেনের টিকেট কাটা হলো। শাহানা, আমার স্ত্রী, অবশ্য ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু আমার উৎসাহ দেখে শেষ পর্যন্ত ও রাজি হয়। বুঝতেই পারছেন এই অঘটনের জন্য নিজেকেই আমি দায়ী বলে ভাবছি। খোদা না করুন, শাহানার যদি কিছু ঘটে থাকে সারাজীবন দাৰ আমি, ক্ষমা করতে পারব না নিজেকে..
শহীদ বাধা দিল বলল, তারপরের ঘটনাগুলো বলুন।
ঠিক হয় শাহানা তার মামার বাড়িতে আসবে। মামা অবশ্য বেঁচে নেই। মামীমা তার তিন পুত্র-সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। আর্থিক অবস্থা তাদের ভাল নয়। শাহানার বাবা অর্থাৎ আমার শশুরের সাথে ওদের সম্পর্কও ভাল ছিল না। আমার শশুর মামাশ্বশুরের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা লোন হিসেবে নিয়েছিলেন। সে-টাকা পরিশোধ করার আগেই তিনি মারা যান। তারও আগে মারা যান আমার মামা-শশুর। মামা-শর মারা যান একটা দুর্ঘটনায়। আমার খবরের সাথে তিনি শিকার করতে গিয়ে নৌকাডুবীতে মারা যান। এ ব্যাপারে শাহানার মামীমার সন্দেহ, আমার ও ধার করা টাকা মেরে দেবার জন্য তার বামীকে ষড়যন্ত্র করে শিকারকরতে নিয়ে যাবার নাম করে ডুবিয়ে মারেন।
হু। বলে যান।
একটু যেন গভীরই দেখায় শহীদকে।
এসব কথা আমি শুনেছি বিয়ের পর শাহানার মুখে। শোনার পর আমি বলেছিলাম, ঘরের দেনাটা আমিই পরিশোধ করব। ঘরের কোন পুত্রসন্তান বা কন্যাসন্তান, একমাত্র শাহানা ছাড়া কেউ নেই। গত রবিবার দিন শাহানাকে আমি বলি, আপাতত তিন হাজার টাকা তোমার মামীমাকে দিয়ে এসো, পরে বাকিটা দেয়া যাবে। ঠিক হয় শাহানা ওর মামার বাড়িতেই প্রথমে উঠবে। সম্পর্কটা নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে সে। কিন্তু সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগবে কিনা সে ব্যাপারে আমার তো সন্দেহ ছিলই, শাহানারও সন্দেহ ছিল। সেজন্যে ঠিক করা হয়, মামীমা যদি.বিরূপ ব্যবহার করেন শাহানা তাহলে বড় কোন হোটেলে উঠবে।
মোফাজ্জল সাহেব সিগারেট টানলেন কিছুক্ষণ। বলতে শুরু করলেন আবার, যাক, আমাদের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হয়। সোমবার দিন বিকালের ফ্লাইটে ঢাকায় আসে শাহানা। সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে আমার চট্টগ্রাম অফিসে ফোন করে ও। বলে, মামী-মা ওর সাথে ভাল ব্যবহার করেননি, তাই সে ক্যাপিটাল হোটেলে উঠেছে।
তারপর? আপনি ঢাকায় এলেন কবে? কেন?
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, ফোনে কথা হয়, দুদিন পর আবার ফোন করে খবরাখবর দেবে শাহানা। কিন্তু ফোন সে করেনি। আমিও কাজের চাপে সময় পাইনি ওকে ফোন করার। গতকাল সকালে এক জুট মিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে মেশিন পার্টস ইমপোর্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে জরুরী পরামর্শ দেবার প্রয়োজন দেখা দেয় হঠাৎ। কয়েক কোটি টাকার মেশিন পার্টস ইমপোর্ট করার ব্যাপারে আলোচনা, চলছিল ভদ্রলোকের সাথে বেশ কিছুদিন থেকে। কমিশনের হার নিয়ে মতবিরোধ চলছিল আমাদের সাথে। আকস্মিকভাবে আমরা বিদেশী মেশিন পার্টস মানুফ্যাকচারারের কাছ থেকে মূল্যহাস সংক্রান্ত একটা নিউজ পাই। ফলে নতুন করে হিসেব কষে আমরা সিদ্ধান্ত নিই জুট মিল কর্তৃপক্ষের দেয়া কমিশনের হার কম হলেও আমরা কাজটা করে দেব, পার্টসের দাম কমেছে বলে আমাদের লাভের হার বাড়বে বৈ কমবে না। পরামর্শ করার জন্য গতকাল বারোটার দিকে আমি গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে যাই। মিলটা ফেনীতে। ওখানে আমি পৌঁছাই বিকেলে। কিন্তু মিলে পৌঁছে ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে পাইনি। তিনি অসুস্থ, ছুটি নিয়ে নিজের বাড়ি দিনাজপুরে চলে গেছেন। অন্যান্য অফিসারদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু কোন ফাইনাল সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সে যাই হোক, ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রাম ফিরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠি, এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ে যায় শাহানার কথা। একটা সারপ্রাইজ ভিজিট দিলে মন্দ হয় না। শাহানা অবাকও হবে, খুশিও হবে। এই কথা ভেবে আমি গাড়ি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। কিন্তু দাউদকান্দিতে পৌঁছে দেখি ফেরী ডুবে গেছে। প্রচুর ভিড় যানবাহনের। নতুন ফেরী আসবে, তবে কখন আসবে তার কোন ঠিক নেই। এদিকে রাতও হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা ফেরীর জন্য অপেক্ষা করব, ঠিক করলাম। যাক, ফেরী পেলাম রাত দুটোর দিকে। ঢাকায় পৌঁছুলাম আমি পাঁচটার সময়।
মোফাজ্জল সাহেব ড্রয়িংরুমের দরজার দিকে তাকালেন। লেবু ঢুকল ভিতরে। তার হাতে একটা ট্রে, তাতে নানারকম উপাদেয় খাবার সাজানো রয়েছে।
শহীদ বেশ একটু অবাক হলেও ওর মুখের চেহারায় তা প্রকাশ পেল না। কলল, মি. ফেরদৌস, সবত ব্রেকফাস্টও সারা হয়নি আপনার। নিঃসঙ্কোচে সেরে ফেলুন। খেতে খেতে বলুন পরবর্তী ঘটনাটুকু।
আপনি!
শহীদ বলল, আমি সেরেছি।
মোফাজ্জল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। লেবু তার সামনের নিচু টেবিলে ট্রেটা রাখতে তিনি মাখন দেয়া রুটি তুলে নিলেন, কামড় দিলেন ছোট্ট করে। বললেন, হোটেলে ঢুকে ক্লার্ককে আমার স্ত্রীর সুইট নাম্বার দিতে বললাম। উদ্ভট আরচণ করল লোকটা। নাম্বার না দিয়ে সে ইন্টারকমে হোটেনের সহকারী সিকিউরিটি অফিসারকে ডাকল। মোট কথা, হোটেলের সবাই আমার সাথে রহস্যময় ব্যবহার করতে শুরু করল। সহকারী সিকিউরিটি অফিসার আমার নাম ধাম-পরিচয় জানতে চাইল। আমি যে শাহানার স্বামী তা প্রমাণ করতে বলল। রীতিমত অপমান বোধ করেছি আমি ওদের আচরণে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ছয়তলার বাহাত্তর নাম্বার সইটে ঢুকলাম আমরা। এতক্ষণ লোকটা শাহানার নিখোঁজ সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেনি। শাহানা সাইটের ভিতর নেই দেখে আমি স্বভাবতই ঘাবড়ে যাই। লোকটা তখন আমাকে জানায় যে শাহানা গত সোমবার দিন সন্ধ্যার সময় হোটলে উঠেছিল ঠিক, কিন্তু খানিক পর সে বেরিয়ে যায়, তারপর আর ফেরেনি। আমি জানতে চাই, পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে কিনা। আমাকেই বা তার খবর দেয়নি কেন। আমার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেনি তারা। তাদের ধারণা, শাহানা কোন বিপদে পড়েনি। কোন বস্তু বা বান্ধবীর সাথে কোথাও বেড়াতে গেছে। ভেবে দেখুন, মি. শহীদ, কি ধরনের সেন্স লোকগুলো।
শহীদ পাইপ থেকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ওদের ব্যাখ্যাটা আপনার মনঃপূত হচ্ছে না, এই তো!
নিশ্চয়ই হচ্ছে না। আমার স্ত্রীকে আমি চিনি, মি, শহীদ। একটিমাত্র আত্মীয় বাড়ি ছাড়া ঢাকায় কোথাও যাবার জায়গা নেই তার। বন্ধু-বান্ধবকেউ নেই তার ঢাকায়। নতুন কারও সাথে পরিচয় হলেও তার সাথে পাঁচপাঁচটা দিন কাটাবার প্রশ্নই ওঠে না। ওদের বক্তব্য শুনে আমার শরীরে আগুন ধরে গেছে, মি. শহীদ। ওদের ধারণা, আমার স্ত্রী ঢাকায় এসে পর-পুরুষদের সাথে যেচে পড়ে পরিচয় করে তাদের সাথে ফুর্তি করার জন্য বাইরে বাইরে রাত কাটাচ্ছে। অথচ, শাহানা মি. শহীদ! প্লীজ ডু সামথিং ফর হার। আমার স্ত্রী বলে বলছি না, আমি জানি শাহানা অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্না, শিক্ষিতা এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্না মেয়ে। খারাপ কোন আচরণই তার দ্বারা সম্ভব নয়।
শহীদ একটু চিন্তিতভাবেই বলল, কিন্তু ক্যাপিটাল হোটেলের চীফ সিকিউরিটি অফিসার আবদুস সামাদকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে যোগ্য লোকই, মি. ফেরদৌস। মিথ্যে অনুমান করার লোক সে নয়।
মোফাজ্জল সাহেব হাতের সিদ্ধ ডিম প্লেটে নামিয়ে রেখে নৈরাশ্যে ভেঙে পড়লেন, মি. শহীদ! আপনিও ওদের দলে! আপনিও ভাবছেন যে…?
শহীদ বলল, আমি এখনও কিছু ভাবছি না। সামাদের ভুলও হতে পারে। সামাদের ব্যাপারটা কি জানেন, সে ক্যাপিটাল হোটেলের সিকিউরিটি চীফ। হোটেলের স্বার্থ দেখাই তার দায়িত্ব।
তিনি নিজেই কথাটা জানিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
শহীদ বলল, ওদের ওপর খেলছেন আপনি অকারণে। কারণটা বলি, শুনুন। ঢাকার বড় বড় হোটেলগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, কর্তৃপক্ষ গেস্টদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে মাথা ঘামায় না। গেস্টদের নিজস্ব ব্যাপারে এরা নাক গলায় না। গেস্টরাও এটা পছন্দ করেন না। এমন অনেক ধনী পুরুষ এবং নারী আছেন যারা বড় বড় হোটেলে ওঠেন শুধু প্রাইভেসী বিঘ্নিত হবে না এই নিশ্চয়তা আছে বলে। ভেবে দেখুন, একজন পুরুষ গেস্ট কোন বড় হোটেলে উঠল। সে যদি পর পর কয়েক দিন হোটেলে না ফেরে তাহলে হোটেল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য কি হবে? খবর দেয়া যেতে পারে গেস্ট লোকটার বাড়িতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাধারণত দেখা যায় গেস্ট লোকটা তার কোন প্রেমিকাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গেছে। এদিকে তার খোঁজ নেই দেখে তার স্ত্রী পুলিশকে খবর দিল। পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে সেই গেস্টকে আবিষ্কার করল প্রেমিকার সাথে। ফলাফল কি বুঝতে পারছেন তো? স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে গেল গেস্ট। তাদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবার উপক্রম হলো। এরকম ক্ষেত্রে গেস্ট লোকটার কি ধারণা হবে হোটেলটা সম্পর্কে?
মোফাজ্জল সাহেবের মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হলো, খেপে গেছেন তিনি শহীদের উপর, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরূম থেকে গট গট করে বেরিয়ে যাবেন তিনি।
কিন্তু সোফায় বসে বসেই তিনি বললেন, বুঝেছি। আমার স্ত্রীকে আপনারা কেউ চেনেন না, ওর সম্পর্কে আমার বক্তব্যও আপনারা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি নন।
শহীদ বলল, ভুল বুঝবেন না। আমি শুধু আবদুস সামাদের ধারণাটা যে অযৌক্তিক নয় তাই ব্যাখ্যা করে বললাম। আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে সে হয়তো ভুল করেছে। আপনার স্ত্রী সম্পর্কে আপনার স্টাডি যদি সত্যি হয়, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে–সন্দেহ নেই। ভদ্রমহিলা বিপদে পড়েছেন…
বিপদে পড়েছে! মি. শহীদ, প্লীজ! যত টাকা লাগে দেব আমি, আপনি ওকে খুঁজে বের করুন…আচ্ছা, কি ধরনের বিপদে পড়তে পারে বলুন তো? আমি…আমি…
শহীদ বলল, মুষড়ে পড়বেন না, মি. ফেরদৌস। মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে আমাদেরকে
আপনি কেসটা গ্রহণ করছেন তাহলে?
এখনও কথা দিচ্ছি না। খুব একটা ইন্টারেস্টিং কেস ছাড়া আমি নিজেকে জড়াই না। সেটা পরে জানা যাবে, তাই না? আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন, গ্লাসের পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে বললেন মোফাজ্জল সাহেব। আপনার স্ত্রীর মামী-মার সাথে কথা বলেছেন?
গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে
শাহানার মামাতো ভাইটির সাথে কথা হয়েছে। তাকে নাকি শাহানা প্রথম দিনই, রাত বারোটার সময়, হোটেলে একবার যেতে বলেছিল। গিয়েও ছিল সে। কিন্তু রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারে শাহানা ফেরেনি। ফিরে আসে সে এরপর। পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে যাবার কথা ছিল শাহানার। বুঝতেই পারছেন, যায়নি ও।
আপনার কাছে আপনার স্ত্রীর কোন ফটো আছে?
মোফাজ্জল সাহেব মানিব্যাগ বের করলেন কোটের পকেট থেকে। বললেন, আছে। দুটো ছিল। একটা সি.আই.ডি অফিসার মি. সিম্পসন চেয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কেন যে নিলেন বুঝলাম না। আমি বলেছিলাম, খবরের কাগজে শাহানার ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদটা ছাপার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু খুব ইন্টারস্টেড মনে হলো তাকে।
হাত বাড়িয়ে পাসপোর্ট সাইজের ফটোটা নিল শহীদ। শাহানা যে অপূর্ব সুন্দরী তা ছবি দেখেই বুঝতে পারল ও। সুন্দরী মেয়েদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
পাবলিসিটিতে আপত্তি নেই আপনার তাহলে? প্রশ্ন করল শহীদ।
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, মি, শহীদ, আমি আমার স্ত্রীর সন্ধান চাই। যে কোন মূল্যে, যে-কোন পদ্ধতিতে শাহানাকে চাই আমি। আমার সম্মানের চেয়ে আমার স্ত্রী আমার কাছে প্রিয়। যা সত্য তা প্রকাশ পেলেও কিছু যায় আসে না। আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন তো? আমি শাহানাকে চিনি। ওকে বিশ্বাস করি। আমার সম্মান যাবে এমন কোন কাজ মরে গেলেও করতে পারে না ও। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। আমি…আমি ভাবতে ভয় পাচ্ছি…ভয় পাচ্ছি..।
শহীদ বলে উঠল, ঠিক আছে। ছবিটা আজকের সাক্ষ্য-দৈনিক যোগফলে ছাপা যেতে পারে। এবার কিছু তথ্য চাই আমি–আপনার এবং আপনার স্ত্রী সম্পর্কে।
শহীদ পকেট থেকে একটা ছোট নোট বই বের করল, সাথে কলম।
বলুন কি জানতে চান।
পুরো নামসহ আপনার স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা। আপনার ব্যবসা-কেন্দ্রের ঠিকানা। আপনাদের বয়স। ইস্যরেন্স সংক্রান্ত খবর। কজন চাকর-বাকর, তারা ফুল টাইম না পার্ট টাইম। এবং আপনার স্ত্রীর বিয়ের পূর্ব-ইতিহাস। প্রথমটা দিয়ে শুরু করা যাক। নাম ঠিকানা বলুন।
প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন মোফাজ্জল সাহেব।
শহীদের প্রশ্নেরও সংখ্যা নেই। একটার পর একটা তথ্য জানতে চাইছে ও। সর্বশেষ প্রশ্নটা শুনে মোফাজ্জল সাহেব বিরক্তিই প্রকাশ করলেন। কিন্তু আমার স্ত্রী কোন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছে তা জেনে কি লাভ আপনার?
শহীদ বলল, লাভ অলাভ আমার বোঝবার ব্যাপার। আপনি উত্তর দিন।
কিন্তু…।
শহীদ বুলল, ইচ্ছা করলে আপনি উত্তর না-ও দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমি নোট করব, মি. ফেরদৌস এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন।
না-না। উত্তর দিতে অস্বীকার করছি না আমি। লিখুন, বলছি। স্কুলের নামটা বললেন মোফাজ্জল সাহেব।
শহীদ পরবর্তী প্রশ্ন করল, আপনার স্ত্রী কি চাকরি-বাকরি করতেন বিয়ের আগে?
চাকরি ঠিক না। ও তো অভিনেত্রী ছিল। খুব সাকসেসফুল, সন্দেহ নেই। চট্টগ্রাম মঞ্চ জগতের রানী বলা হত ওকে। তবে বিয়ের পর অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে।
কার ইচ্ছায়?
অবশ্যই নিজের।
শহীদ বলল, দেখা যাচ্ছে আপনার স্ত্রীর বব কাটা চুল। কোথায় চুল কাটাতেন তিনি? মানে, হেয়ার ড্রেসারের নাম জানতে চাইছি।
মি. শহীদ আবার আপত্তি প্রকাশ করতে উদ্যত হলেন মোফাজ্জল সাহেব।
শহীদ বলল, ইচ্ছা করলে উত্তর নাও দিতে পারেন।
গম্ভীর হলেন মোফাজ্জল সাহেব। বললেন, ঠিক আছে। স্বীকার করছি আপনার পদ্ধতি সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। যাই হোক, লিখুন।
লিখে নিল শহীদ, তারপর প্রশ্ন করল, আপনার স্ত্রীর সাথে কিভাবে পরিচয় হয় আপনার?
ওর অভিনীত নাটক দেখতে যাই। আমিই উপযাচক হয়ে পরিচয় করি। ওকে ভাল লাগে আমার। কিন্তু সে-কথা ওকে জানাইনি। মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতাম। ওর বাড়িতেও নিমন্ত্রণ করত মাঝে মাঝে আমাকে। মাস দুয়েক পর প্রস্তাবটা দিই। সাথে সাথে সম্মতি প্রকাশ করে ও। আমাকে ও-ও ভালবাসত পরিচয়ের প্রথম পর্যায় থেকেই।
আপনার স্ত্রীর দৈহিক বর্ণনা প্রয়োজন।
মোফাজ্জল সাহেব বললেন, পঁচিশ বছর বয়স ওর। লাই বলা যায়, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। একশো বিশ পাউন্ডের মত ওজন। ফটোতেই তো দেখছেন, অসাধারণ সুন্দরী। সেটাই ভয়ের কারণ।
হু। এবার আপনার স্ত্রীর বন্ধু-বান্ধবদের নাম ঠিকানা যদি দেন
দেখুন, মি, শহীদ, আপনি যদি ভেবে থাকেন আর স্ত্রী সম্পর্কে কোন তথ্য চেপে রাখতে চাইছি তাহলে মস্ত ভুল করবেন। শাহানা বিপদে পড়েছে, তার কোন হদিশ নেই–ঘটনাটার গুরুত্ব কতটুকু তা আমার চেয়ে আপনি বেশি বোঝেন না। ওকে আমি ফেরত চাই। সেজন্যেই আপনার সাহায্য নিতে এসেছি। আমি জানি ওর সম্পর্কে কোন তথ্য আপনার অজানা থাকলে ওকে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে আপনার। সেটা আমার কাম্য নয়। আপনাকে একবার বলেছি, আবারও বলছি, ঢাকায় ওর কোন বন্ধুই নেই। দয়া করে কথাটা বিশ্বাস করুন।
শহীদ বলল, বিশ্বাস করছি। কিন্তু আপনি যা জানেন তাই বলছেন। হয়তো আপনার স্ত্রী অন্যরকম জানেন। সে যাক।
শহীদকে বাধা দিয়ে মোফাজ্জল সাহেব বললেন, আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। কি বলতে চাইছেন আপনি? শাহানার বন্ধু আছে তা আমি জানি না? শাহানা সেকথা আমার কাছে গোপন রেখেছে?
শহীদ বলল, আপনি শিক্ষিত মানুষ, মি. ফেরদৌস। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে আপনাকে জ্ঞান দান করা আমার সাজে না। কিন্তু একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি, সব সময়মানুষ নিজের স্ত্রীর সব কথা জানে না।
মোফাজ্জল সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে গুম হয়ে বসে রইলেন তিনি।
চট্টগ্রামে যারা আপনার স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ তাদের নাম ঠিকানাগুলো দিন।
মোফাজ্জল সাহেব আর বাক-বিস্তার না করে চার পাঁচজন ভদ্রমহিলা এবং দুজন ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা দিলেন। বললেন, এদের সাথে পরিচয় আছে শাহানার। এরা সবাই ওর এবং আমার-শুভানুধ্যায়ী। আর কারও নাম মনে পড়ছে না আমার এই মুহূর্তে। ব্যাপার কি জানেন, খুব বেশি লোকজনের সাথে মেলামেশা করি না আমরা। আমরা পরস্পরকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। এবং আমরা সুখী, দম্পতি। কারও তরফ থেকেই ভালবাসার ভাটা পড়েনি। আমরা নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি সব সময়, অন্য লোকের সাথে মেলামেশা করার সময় নেই।
শহীদ পাইপে নতুন করে টোবাকো ভরতে ভরতে চিন্তা করছিল। ভদ্রলোককে দেখে, কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে স্ত্রীকে তিনি আদর্শ স্বামীর মতই ভালবাসেন। কিন্তু একটা ব্যাপার কেমন যেন সামান্য একটু বেখাপ্পা লাগছে। স্ত্রীকে তিনি একা সুদূর ঢাকায় পাঠিয়েছেন-এ থেকে বোঝা যায় স্ত্রীর স্বাধীনতা স্বীকার করেন তিনি। স্ত্রীকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করেন। কিন্তু ফেনী থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় এসে স্ত্রীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করাটা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। ব্যাপারটার মধ্যে হয়তো কোন ঘোর্যাচ বা রহস্য নেই, তবু শহীদের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা সামান্য হলেও, ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হলো না। বিশেষ করে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য ছিল, স্ত্রীকে বছরে একবার দূরে পাঠিয়ে দেবেন দিন পনেরোর জন্যে, যাতে দাম্পত্য জীবন থেকে একঘেয়েমি, বৈচিত্র্যহীনতা দূর হয়, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বেটে ওঠে। এইরকম পরিস্থিতিতে কেন তিনি স্ত্রীকে চমকে দেবার কথা ভাবলেন?
মোফাজ্জল সাহেব পকেট থেকে চেক বই বের করে জানতে চাইলেন, আপনার কী সম্পর্কে আমার জানা নেই। কত টাকার চেক লিখব?
শহীদ বলল, কেসের সমাধানহোক আগে, তারপর না হয় টাকার কথা ভাবা যাবে। সাধারণত আমি টাকা নিই না। একটি মাত্র বিশেষ পরিস্থিতিতে বা ক্ষেত্রে নিই। সে পরিস্থিতি দেখা দিলে আপনাকে আমি বলব।
সে কি কথা! আপনি বেগার খাটবেন কেন আমার জন্যে? না, সেটা ভাল দেখায় না।
শহীদ সোফা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, ফী আমি নিই না তার আরও একটা কারণ আছে, মি. ফেরদৌস। ফী যখন নিই তখন মোটা অঙ্কের নিই। আমার ডিমাণ্ড আপনি পুরণ করতে পারবেন না। সুতরাং, থাক।
একি বলছেন আপনি! সঙ্গত অঙ্কের মধ্যে হলে…
শহীদ হাসতে হাসতে বলল, টাকার অঙ্কটা সঙ্গত আপনার কাছে মনে নাও হতে পারে, মি. ফেরদৌস।
মোফাজ্জল হায়দার ফেরদৌস উঠে দাঁড়ালেন। শহীদের বাড়ানো হাতটা ধরে করমর্দন করলেন তিনি।
শহীদ বলল, ক্যাপিটালেই থাকছেন তো?
হ্যাঁ। শাহানার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছি না…
ঠিক আছে। দরকার পড়লে যোগাযোগ করব আমি। গুড মর্নিং, মি. ফেরদৌস।
গুড মর্নিং।
ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন মোফাজ্জল সাহেব ড্রয়িংরুম থেকে। এক মুহূর্ত পর অপর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করুল মহুয়া।
শহীদ বলল, শুনেছ সব, না? কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না। বেকফাস্ট পাঠিয়েছিলে কেন? এর আগে কোন ক্লায়েন্টকে তো তুমি এমন খাতির করোনি।
মহুয়া সোফায় বসল। বলল, ভদ্রলোকের জন্যে সত্যি দুঃখ হচ্ছে আমার। তোমার কি মনে হলো বলো তো? স্ত্রীকে ভদ্রলোক প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন, এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি আমি। চেহারাটা কেমন কালো হয়ে গেছে দেখেছ? বোঝাই যাচ্ছিল খাওয়াদাওয়া করার কথাও মনে নেই, স্ত্রীর জন্য পাগল পারা হয়ে গেছেন।
শহীদ খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল। মহুয়ার কথা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না।
মহুয়া বলল, কি ভাবছ?
তেপয়ের উপর থেকে মিসেস শাহানার ফটোটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল সে।
শহীদ জানালার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল, কি ভাবছি? ভাবছি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং অতি ক্ষুদ্র মানব–দুটোই বড় রহস্যময়।
ওরে বাববা! দর্শন আওড়াচ্ছে যে!
শহীদ সহাস্যে তাকাল স্ত্রীর দিকে। বলল, খানিক আগে কিছু যেন বলছিলে তুমি?
মহুয়া বলল, হ্যাঁ, বলছিলাম। বলছিলাম, এতদিন তো তোমাকে একটা অনুরোধই করে এসেছি, খুন-খারাবি ইত্যাদির কাছ থেকে দূরে থাকো। কিন্তু আজ ঠিক তার উল্টো অনুরোধ করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভদ্রলোকের স্ত্রীর চরম সর্বনাশ ঘটে গেছে। এমন সুন্দরী মেয়ে, আজ পাঁচ দিন যার কোন খবর নেই তাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। ভেবে দেখো, চরম দুঃসংবাদটা যখন পাবেন। ভদ্রলোক, কি ভয়ানক শক্ পাবেন। বিশ্বাস করো, ভদ্রলোকের জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে আমারই। আমি মেয়েমানুষ, পারি না কিছু করতে। তাই তোমাকে বলছি, ভদ্রলোকের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করো। অক্ষত অবস্থায় যদি সন্ধান পাওয়া যায় তবে তো খুবই সুখের কথা। কিন্তু যদি প্রমাণ হয় যে তিনি বেচে নেই.•তাহলে…তাহলে যে বা যারা দায়ী তাদেরকে তুমি ক্ষমা কোরো না।
শহীদ বলল, তোমার ওই একটা অনুরোধ আমি রাখব। যে দায়ী তাকে ক্ষমা করব না। সন্তুষ্ট?
সন্তুষ্ট।
শহীদ বলল, যদি ভদ্রলোকই দায়ী হয়ে থাকেন?
মহুয়া চমকে উঠল। পরমুহূর্তে দ্রুত মাথা নাড়ল সে। অবিশ্বাস ফুটে উঠল চোখের দৃষ্টিতে, তীব্র প্রতিবাদ জানাল, কি বললে? তোমার কি মাথা খারাপ হলো? তুমি বলতে চাইহু খ্রীর নিখোঁজের ব্যাপারে ভদ্রলোক স্বয়ং দায়ী? লুকিয়ে রেখেছেন স্ত্রীকে? খুন করেছেন! অসম্ভব! আমি আমার একশো ভরি গহনা বাজি ধরে বলতে পারি, ভদ্রলোক এ ব্যাপারে নির্দোষ…
শহীদ বলল, বাজি ধরতে আমি রাজি নই। বিয়ের পর থেকে প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় তোমার কাছে আমি হারছি। পরাজয়ের সংখ্যা আর বাড়াতে চাই না। তবে আশ্বাস দিচ্ছি, অপরাধীকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। ভাল কথা, ভদ্রলোকের দুঃখে তুমি দুঃখী, তাই না? তার জন্য কিছু করারও ইচ্ছা রয়েছে তোমার। বেশ। রাসেলের নাম্বার জানো তো? হোস্টেলে থাকে ও…
জানি, জানি। কি করতে হবে তাই বলো।
শহীদ বলল, ওকে ফোন করো। দেখো পাওয়া যায় কি না। মি. ফেরদৌসের কেস নিয়ে ওকে খানিকটা মাথা ঘামাবার সুযোগ দিই। দারুণ খুশি হবে ও সুযোগটা পেলে।
মহুয়া রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে লাগল।
.
০৬.
ক্রীমসন কালারের ফোরওয়াগেনটা থামল মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার হয়তলা একটা বিল্ডিংয়ের সামনে। সাদা গ্যাবার্ডিনের সুট পরনে, মুখে জুলও পাইপ, চোখে সানগ্লাস, নিশেভড, স্মার্ট এবং সুদর্শন, চোখের দৃষ্টিতে বুদ্ধির দীপ্তি, পকেটে লোডেড রিভলভার-শখের গোয়েন্দা শহীদ খান নামল গাড়ি থেকে। দৃঢ়পায়ে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল ও। বিভিটার ফাস্ট ফ্লোরটা ভাড়া নিয়েছে ওরই সহকারী : কামাল। গোটা ফাস্ট ফ্লোর জুড়ে তার সাক্ষ্য-পত্রিকা যোগফলের অফিস, কম্পোজ এবং মেশিন সেকশন।
ফাস্ট ফ্লোরে উঠে করিডোরের ডান দিকের একটা হল রূমে ঢুকল শহীদ। বার্তা বিভাগের সাংবাদিকরা রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক করছিল। শহীদকে দেখেই তারা থামল, পরমুহূর্তে শশব্যস্ত হয়ে উঠল ওকে অভ্যর্থনা জানাতে।
সকলের উদ্দেশে মৃদু হেসে চীফ এডিটর লেখা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল শহীদ। পর পর দুবার এবং একটু বিরতি নিয়ে আর একবার নক করতেই গভীর কণ্ঠ ভেসে এলো, হু ইজ দ্যাট?
শহীদ উত্তর না দিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই অকৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে বলে উঠল, তুই আমার সহকারী হবার যোগ্যতা হারাতে বসেছিস, কামাল। তোরক।হু থেকে আমি এই রকম গুরুতর আশা করি না।
কামাল বলে উঠল, আয় আয়, বোস। তোকে হঠাৎ এভাবে আশা করিনি। খবর দিলেই তো পারতিস। কিন্তু তোর সাঙ্কেতিক নক চিনতে না পারার কারণ সেটা নয়। কারণ হলো, বেলা বাজে সাড়ে এগারোনা, পৌনে বারোটা, অথচ পত্রিকার হেডলাইন কি যাবে তা এখনও ঠিক করতে পারিনি। হটকেক নিউজ একটাও নেই। হাউএভার, অপরাধ স্বীকার করছি। এবারের মত মাফ করে দে, ভবিষ্যতে আর হবে না।
শহীদ ডেস্কের সামনে, কামালের মুখোমুখি একটা চেয়ার দখল করে বসল, বলল, এরপর দ্বিতীয়বার এই ভুল হলে তোকে আমি জানাবও না, সহকারীর পদ থেকে বরখাস্ত করব। কথাটা ভুলিস না। যাক। হটকেক নিউজ দরকার বলছিলি না? কফির অর্ডার দে, ব্যবস্থা করছি আমি। হটকেক নিউজ একটা আছে আমার কাছে। কিন্তু সেটা তোর পত্রিকার ভাগ্যে আছে কিনা তা আরও ঘণ্টা দুয়েক পরে বিবেচনা করা যাবে।
বলিস কি, দোস্ত! মাইরি বলছি, তোকে আমি কফি তো খাওয়াবই, তার আগে চাইনিজও খেতে হবে তোকে।
কলিং বেলে থাবা মারল কামাল। বিদেশী ফিলটার টিপড় সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল হাতে। বলল, মাই গড! জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি। নতুন কোন কেস পেয়েছিস নাকি রে?
শহীদ বলল, হ্যাঁ।
কী সাংঘাতিক! আসল খবরই এতক্ষণ চেপে রেখেছিলি তুই। সূতো ছাড়, দোস্ত!
পিয়ন ঢুকল দরজা ঠেলে। কামাল পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট বের করে দিয়ে বলল, দুটো চাইনিজ ডিশ। গতকালের মেনু মনে আছে?
আছে, স্যার।
তাই আনবে।
জী, স্যার।
পিয়ন বেরিয়ে গেল। কামাল সাগ্রহে তাকাল শহীদের দিকে। বলল, বল!
শহীদ কোটের পকেট থেকে মিসেস শাহানার পাসপোর্ট সাইজের ফটোটা বের করে ডেস্কের উপর রাখল, বলল, মিসেস শাহানা। সোমবার রাত থেকে নিখোঁজ।
ফটোটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে কামাল মন্তব্য করল, দারুণ ফটোজেনিক ফেস। অসাধারণ সুন্দরী, না রে? গত সোমবার রাতে…তার মানে আজ পাঁচ দিন। নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে লাশটা পচে গেছে।
শহীদ এক মনে পাইপ টানছে।
ঘটনাটা কি?
শহীদ বলল, তুই আগে ছবিটা ব্লক করতে পাঠিয়ে দে। তারপর বলছি কাহিনীটা। আর শোন, এই ছবির কয়েকটা কপি করার ব্যবস্থাও কর্।
কলিং বেলে আবার চাপড় মারল কামাল। অন্য একজন পিয়ন ঢুকল ভিতরে। ফটোটা তার হাতে দিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল সে। পিয়ন দ্রুত বেরিয়ে গেল আবার। কামাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।
মিনিট পনেরো কোন কথা না বলে পাইপ টানতে টানতে চিন্তা করল শহীদ। তারপর বলতে শুরু করল ঘটনাটা। কোন রকম মন্তব্য না করে মনোযোগ দিয়ে সবটুকু ঘটনা শুনল কামাল। শহীদ সবশেষে বলল, মিস শাহানার ছবিসহ খবরটা ছাপা উচিত কিনা তা আমি বলতে পারব ক্যাপিটাল হোটেলের সিকিউরিটি চীফ সামাদের সাথে কথা বলার পর। কেসটা সম্পর্কে এখনও পরিষ্কার ধারণা নেই আমার। মি. ফেরদৌসমি. সিম্পসনের সাথেও দেখা করেছেন। মি. সিম্পসন এ সম্পর্কে কি ভাবছেন, কি করছেন তা-ও জানা দরকার।
কামাল বলল, আমি আশ্চর্য হচ্ছি অন্য কথা ভেবে। তুই কেসটা নিলি কেন? এটা তো একটা সাধারণ ব্যাপার। শহরে প্রতিদিন কত সুন্দরী মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্বামীদের কাছ থেকে। তারা আবার ফিরেও আসে কেউ কেউ, কেউ কেউ নতুন স্বামীর ঘর করার সিদ্ধান্ত নেয়, কোনদিনই তারা ফিরে আসে না।
শহীদ বলল, এটা সাধাকা কেস বলে মনে হয়নি আমার, কামাল। ভদ্রলোক ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। একটা ব্যাপারে তিনি খুবই জোর দিচ্ছেন, তার স্ত্রী কি? পছন্দ করেন না। স্ত্রীর প্রতি দারুণ আস্থা তার। স্ত্রীর খোঁজ পাবেন না একথা তিনি ভাবতেই পারছেন না। থাক, রহস্য যত গভীরই হোক, প্রকাশ পাবেই আসল ঘটনা। কইরে, তোর চাইনিজ ডিশ কত দূরে?
এই এল বলে।কামাল উত্তর দিতেই দরজা ঠেলে চাইনিজ ডিশ নিয়ে ভিতরে ঢুকল পিয়নটা।
শহীদ বলল, লাঞ্চ সেরে দেরি নয়, চল বেরিয়ে পড়ি।
কামাল বলল, ঠিক হ্যায়। হটকেক নিউজও পাচ্ছি, প্রখ্যাত গোয়েন্দা শহীদ খানের সাথে থেকে রুহস্যের কিনারা করার কাজেও যোগ দিচ্ছি-এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই রকম সুযোগ পাব বলেই তো পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবশ্য তোর বুদ্ধিতেই…
শহীদ বলল, কথা কম বল। আমাকে একটু চিন্তা করতে দে।
পিয়ন ওদের দুজনার সামনে প্লেট সাজাতে শুরু করল।
.
বেলা দেড়টার সময় ওদেরকে দেখা গেল ক্যাপিটাল হোটেলের সিকিউরিটি অফিসার আবদুস সামাদের অফিস ককে। শহীদ এবং কামালকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসিয়েছে আবদুস সামাদ। অবশ্য ওদেরকে দেখামাত্র সতর্ক হয়ে গেছে সে। কথাবার্তা বলছে খুব সাবধানে। তার কারণও আছে।
মনোযোগ দিয়ে নছিল ওরা আস সামাদের বক্তব্য।
একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। আমি হোটেলের স্বার্থ দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত। অবশ্য গেস্টদের স্বার্থই হোটেলের বার্থ–এ-ও সত্যি, কিন্তু কোন গেস্ট যদি হোটেলের বাইরে গিয়ে ফিরে না আসে বা হোটলের বাইরে গিয়ে ভালমন্দ কিছু করে তাহলে আমাদের কি করণীয় থাকতে পারে? ঠিক, আমরা পুলিশে খবর দিতে পারাম। মি. ফেরদৌসকেও টেলিফোন করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে কাজটা হত বোকামি। এই রকম কাজ যতবার আমরা করেছি ততবারই বোকা বনেছি।
শহীদ বলল, আপনাদের অসুবিধের কথাটা আমি বুঝি। সে যাক। আমি এসেছি মি. ফেরদৌসের প্রতিনিধি হয়ে। তিনি আমার ক্লায়েন্ট।
কামালের দিকে তাকাল আবদুস সামাদ। জোর করে হাসল, মি. কামাল কি একজন সাংবাদিক হিসেবে পায়ের ধুলো এনেছেন আমার আপিসে?
শহীদ বলল, ও এসেছে বন্ধু হিসেবে, এক। দুই, একজন সাংবাদিক হিসেবেও বটে। আমি হোটেলের লোকজনদের সাথে কথা বলতে চাই। যারা মিসেস শাহানাকে দেখেছে বা কথা বলেছে। কোন সূত্র পেলে, সূত্রটা বিবেচনা করে দেখব আমরা, মিসেস শাহানার নিখোঁজ হওয়াটা গুরুত্বহীন না গুরুত্বপূর্ণ কেবল তখনই ছবিসহ তার নিখোঁজ হবার কাহিনী ছাপার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমরা।, আমাদের দিকটা একটু বিবেচনা করুন, মি, শহীদ। এই হোটেল থেকে মিসেস শাহানা নিখোঁজ হয়েছে এ সংবাদ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হলে, গুডউইল ধসে পড়বে হোটেলের। ভাব্য গেস্টরা এ-মুখো হবেন না। আমি বলছি
মিসেস শাহানার খোঁজ পাবার চেষ্টা বন্ধ করুন। আমি বলছি…
শহীদ বলল, বললাম তো, সেটা পরে বিবেচনা করা হবে।
আবদুস সামাদ বলল, ভাববেন না আমরা মিসেস শাহানার ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি না। বসে নেই আমরা। গত সোমবার যারা ডিউটিতে ছিল তাদের প্রত্যেককে একে একে ডেকে পাঠিয়েছিলাম আমি। প্রত্যেককে জেরা করেছি। তাতে লাভ হয়েছে অনেক। বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য সংগ্রহ করেছি আমি।
তাই নাকি? শোনা যাক
আবদুস সামাদ বলল, আমি নিজে বলতে চাই না, যারা মিসেস শাহানার সাথে কথা বলেছিল তাদেরকে ডেকে পাঠাচ্ছি আমি। আপনারা তাদের মুখ থেকেই শুনুন।
কথা শেষ করে আবদুস সামাদ কলিংবেলের বোতামে আঙুলের চাপ দিল। উর্দিপরা একজন বেয়ারা সাথে সাথে ঢুকল ভিতরে।
পোর্টার জামশেদ, রিসেপশনিস্ট ফারুক সাহেব, বেলবয় আবদুল হক এবং বারটেণ্ডার সুকুমার সেনকে পাশের কামরায় এখুনি আসতে বললো। প্রথমে এখানে আনবে পোর্টার জামশেদকে।
ইয়েস স্যার!
ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল বেয়ারা। শহীদ মাথা নিচু করে একমনে পাইপে টোবাকো ভরছে। কামাল সিকিউরিটি চীফের দিকে তাকিয়ে বলল, মি, ফেরদৌস তার স্ত্রীর সুইটেই থাকছেন?
হ্যাঁ। ভদ্রলোক আমার ওপর ভীষণ খেপে আছেন। স্ত্রীর ওপর অগাধ আস্থা তার। অথচ…
কামাল বলল, অথচ?
আবদুস সামাদ বাকা কণ্ঠে বলল, সকলকে জেরা করে দেখুন, অনেক ব্যাপার আঁচ করতে পারবেন।
খানিক পর দরজা খুলে গেল। পোর্টর জামশেদ ভিতরে ঢুকে সালাম করল অভ্যন্ত কায়দায়।
মি. শহীদ, জামশেদ গত সোমবার সন্ধ্যায় হোটেলের গেটে ডিউটিতে ছিল। ও কি দেখেছে প্রশ্ন করে জেনে নিন। জামশেদ, এঁরা বিখ্যাত ডিটেকটিভ শহীদ খান এবং কামাল আহমেদ। এদের সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দেবে তুমি।
শহীদ পকেট থেকে মিসেস শাহানার ফটোটা বের করে টেবিলের উপর রাখল। বলল, দেখো তো, ফটোটা কার চিনতে পারো কিনা?
জামশেদ এক পা এগিয়ে একটু ঝুঁকে ফুটোটা দেখল। কয়েক সেকেণ্ড পর সোজা হয়ে বলল সে, জী, স্যার। চিনতে পারছি। ইনিই মিসেস শাহানা, নিখোঁজ হয়েছেন।
ঠিক কটার সময় হোটেলে প্রবেশ করেন মিসেস শাহানা?
সময়টা সঠিক মনে নেই, স্যার।
ট্যাক্সি করে এসেছিলেন, তাই না? সাথে কেউ ছিল?
জামশেদ বলল, ট্যাক্সি করে না, স্যার। একটা সাদা ফোক্সওয়াগন থেকে গেটের সামনে নামেন তিনি। গাড়িটা চালাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। মিসেস শাহানা নামার পর তিনি গাড়ি নিয়ে চলে যান।
ভুরু কুঁচকে উঠল কামালের।
শহীদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, ঠিক মনে আছেতোমার?
ঠিক মনে আছে, স্যার।
ভদ্রলোকের চেহারার বর্ণনা দিতে পারো?
বেশিক্ষণ দেখার সময় পাইনি। মিসেস শাহানা নেমে আমাকে হাত-ইশারায় ডেকে ব্যাগ এবং সুটকেস নামাতে বলেন। ওগুলো নামাবার সময় ভদ্রলোককে দেখি আমি। দামী স্যুট পরে ছিলেন তিনি। গায়ের রঙ ফর্সা, নাকটা খুব খাড়া, বয়স হবে বত্রিশ-তেত্রিশ..
সুটের রঙ?
ছাই রঙের ছিল স্যটটা, স্যার।
শহীদ বলল, মিসেস শাহানা ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেননি?
গাড়ি থেকে নামার পর বলেন। তকে ভদ্রলোক মিসেস শাহানার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, বড়জোর চল্লিশ মিনিট, তার বেশি দেরি হবে না। মিসেস শাহানা কোন উত্তর দেননি।
শহীদ জানতে চাইল, ভদ্রলোককে পরে তুমি হোটেলে ঢুকতে দেখেছিলে?
না, স্যার। মিসেস শাহানাকে রিসেপশনে পৌঁছে দিয়ে আমি খবিরকে গেটে পাঠিয়ে দিয়ে চলে যাই কোয়ার্টারে
গাড়ির নাম্বারটা বলতে পারবে?
জী-না, স্যার। লক্ষ করিনি।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো। রিসেপশনিস্ট ফারুক সাহেবকে পাঠিয়ে দিয়ে যাবার সময়।
জামশেদ বেরিয়ে যেতে আবদুস সামাদ বলল, সাদা ফোক্সওয়াগেনের ভদ্রলোক পরে যে হোটেলের ককটেল লাউঞ্জে ঢুকেছিলেন সে প্রমাণও আপনারা পাবেন।
কামাল লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে শহীদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকাল, একটা ইন্টারেস্টিং কাহিনী পাব বলে মনে হচ্ছে আমার।
শহীদ বলল, হু।
রিসেপশনিস্ট যুবক ভিতরে ঢুকে করমর্দন করল একে একে সকলের সাথে, বল শহীদের পাশের চেয়ারটায়। আবদুস সামাদ পরিচয় করিয়ে দিল।
শহীদের প্রথম প্রশ্ন হলো, মিসেস শাহানার সাথে ঠিক কি কি বিষয়ে কথা হয়েছিল আপনার? তিনি কি সরাসরি এসে একটা স্যুইট ভাড়া চান?
না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আধঘন্টা আগে তার নামে একটা সুইট রিজার্ভ করার জন্যে কেউ ফোন করেছিল কিনা? আমি বলি-হ্যাঁ।
আধঘন্টা আগে কেউ ফোন করেছিল তাহলে রিজার্ভেশনের জন্য? কে সে?
মিসেস শাহানা আমার সাথে কথা বলার সময় দুবার উল্লেখ করেছিলেন ভদ্রলোকের কথা। একবার বলেছিলেন আমার এক বন্ধু, তারপর বলেছিলেন, অর্ধ-পরিচিত এক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে চিনি না এখানে।
তার সুইটে তিনি কতক্ষণ ছিলেন? সেই সময়ের মধ্যে বাইরের কেউ তার সাথে দেখা করেছিল কিনা বলতে পারেন?
তিনি পঞ্চাশ মিনিট কি ঘন্টাখানেক ছিলেন সুইটে। না, কেউ তার সুইটে যায়নি।
একঘণ্টা পর তিনি নামেন। পরনে কি ছিল?
লাল শিফন, লাল রাউজ। হাতের নীল হীরের আঙটিটা আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম। নেকলেসটায় ছিল দামী পাথর বসানো।
কথা হয় আপনার সাথে?
রিসেপশনিস্ট বলল, হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারটা আমাকে দিন, যদি আপত্তি না থাকে।
কারন?
রিশেপসনিস্ট যুবক ইতস্তত করল কয়েক মুহূর্ত, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, রাতে যদি বোরিং এবং লোনলি ফীল করি তাহলে ফোনে গল্প করব আপনার সাথে।
দিয়েছিলেন নাম্বার?
দিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছেন, গেস্টদের অনেক উদ্ভট আবদার পূরণ করতে হয় আমাদের…
শহীদ বলল, আর এমন কি কথা তিনি বলেছিলেন যা ঠিক স্বাভাবিক নয়, বেশ একটু অড?
রিসেপশনিস্টকে আবার ইতস্তত করতে দেখা গেল। তারপর বলল, দেখুন মি. শহীদ, ভদ্রমহিলা অসাধারণ সুন্দরীই শুধু নন, বিদুষী এবং মডার্নও বটে। তাঁর কথায়বার্তায় খানিকটা অস্বাভাবিকতা থাকলেও সেই মুহূর্তে ব্যাপারটা আমার কাছে ধরা পড়েনি। পরে, মি. সামাদ আজ সকালে যখন তার বিষয়ে জানতে চান, চিন্তা করে দেখি, সত্যি, বেশ অস্বাভাবিক বা অড় ছিল তার কথাবার্তা। যেমন, তিনি। আমাকে যেচে পড়েই বলেন যে তার স্বামী চান বছরে অন্তত একবার একা একা কিছুদিন দূরে কোথাও থাকেন তিনি। আমাকে জিজ্ঞেসও করেন, ডু ইউ থিঙ্ক ইটস সাচ আ গুড আইডিয়া?
শহীদ বলল, হু। আচ্ছা, সোমবার রাতে আপনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, ফারুক সাহেব?
মানে?
শহীদ বলল, হোটেলের ডিউটি শেষ করার পর কোথায় ছিলেন আপনি?
বাড়িতেই।
শহীদ বলল, বাড়িতে কে কে আছেন আপনার?
ওনলি ফাদার অ্যাও আ মেল-সার্জেন্ট
শহীদ কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, ফারুক সাহেবের বাড়ির ঠিকানাটা লিখে নে, কামাল।
রিসেপশনিস্ট বলল, কিন্তু আমি ঠিক…।
শহীদ বলে উঠল, কিছু মনে করার নেই আপনার, ফারুক সাহেব। আমরা একটা নিখোঁজ ভদ্রমহিলাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
কাঁধ ঝাঁকাল যুবক। ঠিকানাটা বলল সে। কামাল লিখে নিল।
শহীদ টেবিলের উপরকার ফটোটা চোখইশারায় দেখিয়ে বলল, ওটা দেখুন। ভাল করে দেখুন।
দেখল রিসেপশনিস্ট,বলল, যা, এটা মিসেস শাহানার ছবি।
আপনি বলছেন আপনি মিসেস শাহনাকে শেষবার দেখেছেন হোটেলে ওঠার এক ঘন্টা পর, তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই না?
হ্যাঁ। তারপর তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।
শহীদ বলল, কোথায় তিনি যাচ্ছিলেন তা তিনি বলেছিলেন?
না।
শহীদ বলল, আপাতত আর কিছু জিজ্ঞাস নেই আমার, ফারুক সাহেব। আপনি উঠতে পারেন। বেলবয়…কি যেন নামটা…আবদুল হক, ওকে পাঠিয়ে দেবেন এখানে।
রিসেপশনিস্ট, চলে গেল। বেশ একটু গম্ভীরই দেখাল তাকে। মনে মনে সে, রেগে গেছে শহীদের উপর তাও বোঝা গেল তার জুতোর দ্রুত শব্দ শুনে। শহীদ চেয়ে রইল তার গমন পথের দিকে। দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার পরও সেদিক থেকে চোখ ফেরাল না শহীদ। ঘাড় বাঁকা করে চেয়েই রইল।
কিছু বুঝছেন, মি. শহীদ? আবদুস সামাদ জিজ্ঞেস করুল।
শহীদ কোন কথা না বলে নড়েচড়ে বসল, পাইপটা মুখে তুলল।
আবদুস সামাদ বলল, বেলবয় আবদুল হক মিসেস শাহানার ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে সুইটের ভিতরে গিয়েছিল। ওর সাথেও কথাবার্তা হয় মিসেস শাহানার। খুবই…
আবদুস সামাদ চুপ করে গেল আবদুল হককে রূমে প্রবেশ করতে দেখে। সালাম করে দুই হাত দূরে দাঁড়াল সে। শহীদ তার দিকে বাড়িয়ে দিল ফটোটা, বলল, দেখো তো, এই ছবিটা কার চিনতে পারো কিনা?
হাত বাড়িয়ে ছবিটা লি আবদুল হক। দেখতে লাগল। শহীদও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল ছোকরার পেটা লোহার মত মজবুত শরীরটা।
স্যার, ইনিই মিসেস শাহানা, আমি এনারই লেদার ব্যাগ আর একটা সুটকেস তার ছয়তলার বাহাত্তর নম্বর রূমে তুলে দিতে গিয়েছিলাম…কিন্তু স্যার আমি তো…বিশ্বাস করুন, স্যার, আমি কিছু জানি না, আমি ভোর চারটের সময় হোটেলে এসে তাঁকে পাইনি, খোদার কসম বলছি,সার..
শহীদ বলল, থামো, থামো। তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব শুধু তারই উত্তর দেবে। ভয় নেই, তুমি যদি কোন অপরাধ করে না থাকে তাহলে কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। আচ্ছা, বলো এবার, মিসেস শাহানার স্যুইটে ঢোকার পর কি কি কথাবার্তা হয় তোমার সাথে।
আবদুল হক ঘনঘন ঢোক গিলছে। চোখমুখ থেকে থেকে বিভিন্ন আকৃতি নিচ্ছে। কখনও দাঁত চেপে সাহস সৃষ্ণয়ের চেষ্টা করছে সে, কখনও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। দ্রুত এবং বিরতি না নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিল সে, এলিভেটরের ভিতরেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি ফুটবল খেলি কিনা। আমি বলি, হা খেলি। তারপর সুইটের ভিতর ঢুকে তিনি আমাকে একটা একশো টাকার নোট দিতে চান। আমি বলি, আপনি হয়তো ভুল করছেন ম্যাডাম। কিন্তু তিনি আমার একেবারে গায়ের কাছে এসে দাঁড়ান, বলেন, ভুল করছি না। এটা ধরো, দেবার কারণটা বলছি। টাকাটা নিই আমি। তিনি এরপর জানতে চান। আমার ডিউটি কখন শেষ হবে। আমি বলি রাত বারোটায়। তিনি জানতে চান রাত্রে কোথায় শুই আমি? আমি বলি কোয়ার্টারে শুই। রাত চারটের সময় আমি ঘুম থেকে তাঁকে ওঠাতে পারব কিনা জানতে চান তিনি। আমি বলি সে-সময় যে বেলবয় ডিউটিতে থাকবে তাকে বলে রাখব আমি। কিন্তু তিনি বলেন আর কাউকে এসব কথা বলার দরকার নেই। আমি চাই তুমি আসবে। কোন ভয় নেই তোমার। তোমাকে দিয়ে আমি একটা কাজ করাব। আমি তোমাকে সুযোগটা দিতে চাই, কেউ জানবে না।
তুমি রাজি হয়েছিলে?
আবদুল হক চুপ করে রইল।
জবাব দাও।
মাথা নিচু করে ফেলল আবদুল হক। অস্ফুটে বলল, হয়েছিলাম, সার
কোয়ার্টার থেকে ভোর চারটের সময় হোটলে ঢুকেছিলে তুমি। মিসেস শায়নার সুইটের ভিতর ঢুকেছিলে নিশ্চয়ই?
না, স্যার, বিশ্বাস করুন, চুকিনি। কলিংবেল টিপেছিলাম, কিন্তু সাড়া পাইনি বলে ফিরে গিয়েছিলাম।
শহীদ দেখল ছোকরা কাঁপছে একটু একটু। বলল, ঠিক আছে, যাও তুমি। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো। মিথ্যে কথা বললে কঠিন শাস্তি পাবে। কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
না স্যার, মিথ্যে কথা বলিনি, বিশ্বাস করুন…
যাও। অবশিষ্ট কে আছে পাঠিয়ে দাও।
ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল বেলবয় আবদুল হক।
আবদুস সামাদ কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে দমন করল নিজেকে। কামাল বলে উঠল, মি, ফেরদৌস-বেচারা!
আবদুস সামাদ বলল, হ্যাঁ, বেচারা!
শহীদের ভারি গলা শোনা গেল, মিসেস শাহানা, বেচারী!
রূমের ভিতর বারটেণ্ডার সুকুমার সেন ঢুকে সকলের উদ্দেশে কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, আদাব।
আবদুস সামাদ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, মিসেস শাহানাকে তুমি ককটেল লাউঞ্জে দেখেছিলে, বলেছ। কি কি কথাবার্তা হয়েছে তা শোনার অবসর হয়নি আমার। আমাদের সকলের সামনে শোনাও দেখি।
শহীদ বলল, না। কথাবার্তা কি কি হয়েছে তা পরে শুনব। তার আণে আমি, কয়েকটা প্রশ্ন করব। সুকুমার বাবু, এই ফটোটা দেখুন তো, কার এটা?
শহীদের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে দেখল সুকুমার। বলল, কোন সন্দেহ নেই, মিসেস শাহানার।
শহীদ বলল, আচ্ছা, ভদ্রমহিলা কি একাই আপনার বারে ঢোকেন? :
হ্যাঁ। তবে তিনি ঢুকতেই একজন ওয়েটার আমাকে বলে, ম্যাডামের সঙ্গী ভদ্রলোক পরে আসবেন; কি একটা কাজে বাইরে গেছেন তিনি। ম্যাডামের সুবিধে অসুবিধে লক্ষ রাখবেন, স্যার।
তার মানে মিসেস শাহানার সঙ্গী একজন ছিলেন। তিনি বারেই ছিলেন, তবে বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে, পরে ফেরার কথা ছিল। ফিরেছিলেন সেই ভদ্রলোক?
ফিরেছিলেন। কয়েক মিনিট পরে।
শহীদ বলল, ভদ্রলোকের পোশাকের বর্ণনা দিতে পারেন?
ছাই রঙের স্যুট পরেছিলেন। আর কিছু লক্ষ করিনি। মিসেস শাহানা তখন আমার কাউন্টারের সামনে উঁচু টুলে বসে শ্যাম্পেন পান করছিলেন। ভদ্রলোক তাকে নিয়ে কর্ণারের এক টেবিলে গিয়ে বসেন। বড়জোর পৌনে এক ঘণ্টা ছিলেন ওঁরা, তারপর চলে যান।
ভদ্রলোকের নাম ইত্যাদি কিছু জানতে পারেননি? এর আগে তাকে আপনার বারে দেখেছেন কখনও?
দুএকবার দেখেছি। না, নাম ইত্যাদি জানি না।
শহীদ বলল, ভদ্রলোক বারে এসে মিসেস শাহানাকে টেবিলে নিয়ে যান। তার আগে মিসেস শাহানার সাথে কি বিষয়ে কথা হয় আপনার?
সুকুমার বলে, আমি তাকে বসতে অনুরোধ করি। জিজ্ঞে! করি, তিনি কিছু পান করবেন কিনা। বললেন, বাড়িতে পান করলেও বাইরে কখনও পান করেননি। তবে হালকা কিছু দিলে পান করবেন। আমি শ্যাম্পেন সাজেস্ট করি। তিনি বলেন তার বন্ধু হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না। তারপরই বলেন, তিনি সামান্য একটু বেসামাল হতে চান। আমি দিচ্ছি বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাই, তিনি আবার কথা বলেন। জানতে চান, বারে বসে মেয়েরা একা একা ড্রিঙ্ক করে কিনা। ঢাকায় তিনি নতুন, নিয়ম-টিয়ম জানেন না। আমি বলি, এখানে মেয়েরা সব করতে পারে। তারপর তিনি জানতে চান, ঢাকায় মেয়েদের এনটারটেনমেন্টের জন্য কি কি ব্যবস্থা আছে। তিনি বিশেষ ভাবে জানতে চান পুরুষরা যেমন, মদ, খায়, ফ্ল্যাশ খেলে, ড্রাইভ করে, নাচে, নাইট ক্লাবে যায়, নীলছবি দেখে তেমনি মেয়েরাও কি পারে? আমি বলি, পারে। তবে এটা নির্ভর করে মেয়েটির ইচ্ছা এবং রুচির উপর। এরপর তিনি সিগারেট চান আমার কাছ থেকে। আমি সিগারেট দিই, তার পাশে বসা ভদ্রলোক লাইটার জেলে তার সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেন। এই ভদ্রলোক মিসেস শাহানার সাথে আলাপ জমাবার সামান্য প্রয়াস পান। কিন্তু এর একটু পরই মিসেস শাহানার সঙ্গী ভদ্রলোক বারে ঢোকেন এবং তাকে নিয়ে টেবিলে চলে যান।
শহীদ বলল, এই ঘটনার প্রায় পৌনে একঘন্টা পর ওঁরা চলে যান বার থেকে, তাই না? এই পৌনে একঘণ্টার মধ্যে আপনার সাথে আর কথা হয়নি মিসেস শাহানার?
না।
তারা কোথায় গেলেন তাও আপনার জানা হয়নি।
না। তবে একজন ওয়েটার পরে আমাকে বলে যে মিসেস শাহানা তার সঙ্গীকে বলেছিলেন, চলো ফ্ল্যাশ খেলব। এই কথা বলে উঠে পড়েন ওঁরা চেয়ার থেকে বেরিয়ে যায়।
এরপর ওদের কাউকে আপনি আর দেখেননি?
দেখিনি।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন।
সুকুমার বেরিয়ে যেতে আবদুস সামাদ বলল, আরও কিছু জানার আছে আপনার, মি, শহীদ?
শহীদ বলল, কামাল, এবার তোর কাজ তুই শুরু কর। মি. ফেরদৌসকে বোধহয় তাঁর সুইটে…তার স্ত্রীর স্যুইটে, পাবি এই মুহূর্তে। যা, ভদ্রলোকের নিজের মুখ থেকে সংগ্রহ কর তোর পত্রিকার জন্যে হটকেক নিউজ। আমার কথা বললে ভদ্রলোক বলবেন সব কথা।
আবদুস সামাদ নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কয়েকবার এদিক ওদিক। বলল, মি. শহীদ, খবরটা ছাপবেনই, তাই না? আমাদের হোটেলের নামটা উল্লেখ না করে খবরটা ছাপা যায় না?
কামাল বলল, দুখিত, সামাদ সাহেব। তবে আপনাদের হোটেলের প্রতি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি যাতে না হয় সেদিকটা লক্ষ রাখার চেষ্টা করব আমি।
সেটাও মন্দের ভাল। থ্যাঙ্ক ইউ, মি. কামাল।
শহীদ উঠে দাঁড়াল।
কামালও উঠতে উঠতে বলল, কোথায় যাবি তুই এখন?
বাইরে আয়। একটা কথা বলব তোকে।
আবদুস সামাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। শহীদ নিচু গলায় বলল, বেলবয় আবদুল হক এবং রিসেপশনিস্ট ফারুক সাহেব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে তোকে
তার মানে। শহীদ, তুই ওদের সন্দেহ করছিস?
শহীদ শান্তভাবে বলল, উত্তেজিত হোসনে। সন্দেহ আমি কাউকে করছি না। কিন্তু ওদের দুজনের বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষী, নেই কেউ। মি. ফেরদৌস তার স্ত্রী সম্পর্কে যে ধারণা আমাকে দেবার চেষ্টা করেছেন তা ভুল। মিসেস শাহানার চরিত্র প্রশংসার যোগ্য নয়, নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছিস। তিনি ঢাকায় পা দেবার পর পরই পুরুষমানুষের সান্নিধ্যে পাবার জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করতে শুরু করেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সাধারণ রুচিবোধও, হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। একটা বেলবয়-তাকেও তিনি টাকার লোভ দেখিয়ে তোর চারটের সময় নিজের স্যইটে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বড় বেশি খাপছাড়া লাগছে আমার।
কামাল বলল, হু। ঠিকই বলেছিস। ঠিক আছে, রিপোর্ট করব যত তাড়াতাড়ি পারি।
পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা।
Leave a Reply