কুয়াশা ৬৪
প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল, ১৯৭৭
০১.
আতিকুর রহমানকে চেনে না এমন লোক দেশে খুব কমই আছে। তিনি একাধারে সুলেখক, চিত্র প্রযোজক। বক্স অফিস হিট করা আধ ডজন ছবির প্রযোজক তিনি। আতিকুর রহমানের আরও পরিচয় আছে। সবাই জানে তিনি বছর বিশ আগে একটা ছবিতে নায়ক হিসেবেও অভিনয় করেছিলেন। নিতান্ত কপর্দকহীন অবস্থা থেকে তিনি উন্নতির চরমে পৌঁছেছেন। ছায়াছবির ব্যবসা ছাড়া অন্যান্য ব্যবসাও আছে তাঁর।
গণ্যমান্য লোক হিসেবে দেশে তার খ্যাতি আছে। কাজকর্মে সৎ, চলনে বলনে। ভদ্র, কথায়বার্তায় বিনয়ী। মোটামুটি শত্রুরা ছাড়া সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু শত্রু বা মিত্র, কেউই তার একটি বিশেষ হবি বা দুর্বলতার কথা জানে না।
সৈয়দ আতিকুর রহমান একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর। দেশী-বিদেশী দুষ্প্রাপ্য বিচিত্র সব স্ট্যাম্প সংগ্রহ করা তাঁর একটি শখ। এ ব্যাপারে তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরাও তার এই বিশেষ হবিটি সম্পর্কে কিছু জানে না। তার নব-বিবাহিতা স্ত্রী এ ব্যাপারে বহুবার প্রশ্ন করেছে।
এগুলো দেখতে সামান্য হলেও এক একটা অসামান্য, অমূল্য জিনিস। কারও নজরে পড়ুক তা আমি চাই না।
ব্যস।
এর বেশি স্ত্রীকেও কিছু বলেননি কখনও তিনি। কজনই বা আর দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্পের মাহাত্ম বোঝে। তার স্ত্রীও বোঝে না।..
ওই ছোট্ট ছোট্ট রঙিন কাগজের টুকরোগুলোকে, অসামান্য বলছ? কপয়সাই বা দাম ওগুলোর!
আতিকুর রহমান কথা বলেন না স্ত্রীর এ ধরনের অর্বাচীন মন্তব্যে। তবে মনে মনে তিনি সন্তুষ্টই হন। তাহমিনা যে স্ট্যাম্পগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না এটা তার জন্য সুসংবাদ।
তার স্ট্যাম্পকেউ দেখে ফেলবে, চুরি করে নেবে এই ভয়ে সর্বক্ষণ একধরনের আতঙ্কে ভোগেন তিনি। রীতিমত আশ্চর্যই বলা যায় তার এই মানসিকতাকে। লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা দেখাশোনা করছে তার নিযুক্ত লোকেরা, তিনি কদাচ ব্যবসা ক্ষেত্রে যান কি না যান, সব কিছু ম্যানেজারদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। চুরি যে তারা করে না তা নয়। কিন্তু সে ব্যাপারে তার তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। যত মাথাব্যথা তার এই ছোট্ট ছোট্ট রঙিন কাগজের টুকরোগুলোকে নিয়ে।
বাড়িটা তিনতলা। সামনে সুদশা বাগান। পিছনে বিরাট সুইমিংপুল। এত বড় বাড়িতে মানুষ বলতে মাত্র দুজন। তিনি ও তাঁর নববিবাহিতা স্ত্রী তাহমিনা। গোটা পাঁচেক চাকর-চাকরানী অবশ্য আছে। তারা বাড়ির এক ধারেই থাকে।
একতলাটা আতিকুর রহমান নিজের দখলেই রেখেছেন। তার অফিস এই নিচ তলাতেই। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন তিনি লাইব্রেরী রূমে বসে। পাশের, রূমটাকে বলা যায় তার হৃৎপিণ্ড। এই রূমেই আছে তার স্ট্যাম্পের সংগ্রহ। দেয়ালের সাথে ফিট করা স্টীলের সেফ। কবিনেশন তালা দিয়ে বন্ধ করা। দিনে দুবার কি তিনবার এই রূমে ঢোকেন তিনি। ঢোকার আগে ভাল করে দেখে নেন আশেপাশে কেউ আছে কি না। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই তিনি বন্ধ করেন দরজা। জানালাগুলো সর্বক্ষণ বন্ধই থাকে। দরজা বন্ধ করেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, তিনি। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কী-হোলে চোখ রেখে দেখতে চেষ্টা করেন কেউ তাঁর উপর গোয়েন্দাগিরি করছে কি না।
গোয়েন্দাগিরি করার মত লোক অবশ্য একজন আছে। ছোকরা এমনিতে ভাল মানুষের চরম। যতই গালমন্দ করো, মুখে রা নেই। আছেও সেই ছোটবেলা থেকে। অবিশ্বাস করার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু ছোকরার ভয়ঙ্কর একটা বদভ্যাস। আছে। সে তার স্ট্যাম্প কালেকশনের ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী।
এই বিশেষ রূমটিতে তিনি ঢুকলেই কিভাবে যেন ছোকরাটা টের পেয়ে যায়। যেখানেই থাকুক ড্রয়িংরুমে চলে আসে। ড্রয়িংরুমের সাথের দরজাটা দিয়ে এই রুমটায় যাওয়া আসা করা যায়। দরজার গায়ের কী-হোলে চোখ রেখে ছোকরা দেখার চেষ্টা করে, কি করছেন তিনি। না, এ তার অমূলক সন্দেহ নয়। তিনি জানেন, ছোকরার এই বিষয়ে কৌতূহল আছে। হাতে-নাতে তিনি আজও ছোকরাকে ধরতে পারেননি বটে। কিন্তু ধরতে পারাটা বড় কথা নয়। তিনি বুঝতে পারেন। দরজা খুলে বাইরে বের হলেই তিনি দেখতে পান ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। মুখের চেহারা পাংশু হয়ে যায়, মাথা হেঁট করে সরে যাবার চেষ্টা করে। একটা গহিত অন্যায় করার সময় ধরা পড়ে গেলে যা হয়।
ধমক-ধামকেও কাজ হয়নি। মাঝে মধ্যে মারধোরও করেন তিনি। কিন্তু অবস্থা। থাকে তাই। রূমটার আশে পাশে তাকে দেখা যাবেই। টোটাকে তিনি বহুবার তাড়িয়ে দেবার কথা ভেবেছেন। কিন্তু টোটা আসলে তার নয়, তাঁর স্ত্রীর চাকর। স্ত্রীকে চটাতে চান না বলে টোটাকে তাড়াতে পারেননি।
সেদিন সন্ধ্যার খানিক পর অতিথিদের বিদায় দিয়ে আতিকুর রহমান হাঁক ছাড়লেন, টোটা!
টোটা দরজার বাইরেই দেয়াল ঘেঁষে সাহেবের হুকুম পাবার অপেক্ষায় ছিল। জ্বী, হুজুর বলেই দোর গোড়ায় দাঁড়াল সে।
তোর হাতে এখন কি কাজ?
টোটা দুটো হাত চোখের সামনে তুলে দেখে নিল। বলল, কাজ নেই, হুজুর।
তবে যা, এক ঘন্টার জন্যে তোর ছুটি। বাইরে গিয়ে হাওয়া খেয়ে আয়। এই নে, এই টাকাটা নিয়ে যা, বাদাম কিনে খাবি। খবরদার, একঘন্টার আগে বাড়ি ফিরবি না বলে দিচ্ছি।
আতিকুর রহমান কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটি টাকা তুলে নিলেন, টাকাটা রাখলেন নিচু টেবিলের উপর।
এগিয়ে এল টোটা। টেবিল থেকে টাকাটা তুলে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইল, এক টাকার বাদাম একঘণ্টা ধরে খাব, তারপর বাড়িতে ফিরবনা, হুজুর?
হ্যাঁ। এবার দূর হ আমার সামনে থেকে।
টোটা ত্রস্ত পদে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে।
পাইপ ধরালেন আতিকুর রহমান সাহেব। মিনিট খানেক ধূমপান করার পর তিনি সোফা ছাড়লেন। পকেট থেকে চাবি বের করে একটি দরজার সামনে গিয়ে। দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ কি মনে করে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন।
দেখলেন নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে টোটা দোর গোড়ায়।
হারামজাদা। এখনও তুই যাসনি? গর্জে উঠলেন আতিকুর রহমান সাহেব।
টোটা বলল, হুজুর, কোন মেহমান যদি আপনাকে ডাকতে আসেন তাহলে কি বলব? বাড়ির বাইরে, মানে, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব কিনা আমি…।
বলবি আমি বাড়িতে নেই। যা ভাগ। নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করলেন তিনি টোটাকে।
টোটা চলে গেল। আতিকুর রহমান দরজার কবাট উন্মুক্ত করে ভিতরে ঢুকলেন, বোতাম টিপে টিউব লাইট জ্বাললেন, তারপর বন্ধ করে দিলেন দরজাটা ভিতর থেকে। চাবির গোছা থেকে বেছে বেছে বের করলেন অন্য একটি চাবি। গিয়ে দাঁড়ালেন ওয়াল-সেফের সামনে। কমবিনেশন মিলিয়ে তালা খুললেন।
রূমটা খুব যে ছোট তা নয়। কিন্তু আসবাবপত্র বলতে একটা ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং একটি কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। মেঝেতে লাল কার্পেট বিছানো আছে। টেবিলের উপরটা শূন্য, শুধু একটা টেবিল লাম্প রয়েছে।
ওয়াল-সেফ থেকে স্ট্যাম্প বুক বের করে টেবিলে রাখলেন আতিকুর রহমান। সেটা বন্ধ করে বসলেন চেয়ারে। অতি ক্ষুদ্র একটা চিমটা এবং একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করলেন টেবিলের দেরাজ থেকে। স্ট্যাম্প বুক খুলে চিমটা দিয়ে একটা চারকোণা স্ট্যাম্প তুললেন, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে অতি মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করতে লাগলেন স্ট্যাম্পটাকে। গতকাল তিনি বেশ কিছু স্ট্যাম্প কিনেছেন। সেগুলো এখনও স্ট্যাম্প বুকে সাটা হয়নি। পরীক্ষা করে নিচ্ছেন, তার জায়গা মত সেঁটে রাখবেন।
ঠক! ঠক! দরজায় টোকা পড়ল।
চুপ করে রইলেন আতিকুর রহমান। কাঁচা-পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে রইল।
ঠক! ঠক ঠক!
চেয়ার না ছেড়ে উপায় কি। রাগে জ্বালা করছে গা। কিন্তু কে না কে, রূঢ় কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিলেন নিজেকে।
দরজা খুললেন তিনি।
নির্বিকার মূর্তি টোটার। দরজার সামনে সবিনয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কথা নয়, ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলেন আতিকুর রহমান টোটার গালে, হারামজাদা! আমার সাথে ফাত্রামি করছিস তুই! দাঁড়া, আজই তোকে আমি তাড়াচ্ছি এ বাড়ি থেকে।
টোটা আহত গালে হাত বুলাতে থাকে। মাথাটা নিচু করে আছে। দুচোখ ভরা পানি। কিন্তু কণ্ঠস্বর অকম্পিত, হুজুর, আমার কি দোষ, টেলিফোন বাজছিল যে!
তুই জানলি কিভাবে? তোর তো বাড়ির বাইরে থাকার কথা।
আতিকুর রহমান আড়চোখে দেখলেন ফোনের রিসিভারটা ক্রেডলে নেই, নামানো রয়েছে টেবিলের উপর।
গেটের বাইরে থেকেই তো শুনলাম। অনেকক্ষণ থেকে বাজছিল।
আতিকুর রহমান অসহিষ্ণু কণ্ঠে জানতে চান, কে ফোন করেছে?
স্পেশাল অফিসার মি. সিম্পসন।
আতিকুর রহমান দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে বললেন, সিম্পসন? ও নামের কাউকে আমি চিনি না। বলে দে আমি বাড়িতে নেই।
দরজার কবাট দুটো বন্ধ করে আবার মেলে দিলেন আতিকুর রহমান। কেমন যেন খটকা লাগছে। জানতে চাইলেন, কি যেন বললি? স্পেশাল অফিসার? স্পেশাল অফিসার মানে? কিসের স্পেশাল অফিসার?
সি. আই. ডি না কি যেন বললেন।
আতিকুর রহমানকে চিন্তিত দেখাল, সি. আই. ডির স্পেশাল অফিসার? ব্যাপার কি? তাহলে তো জরুরী কোন ব্যাপার মনে হচ্ছে। সর, দেখি।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে সোফায় বসলেন আতিকুর রহমান সাহেব। রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললেন, সৈয়দ আতিকুর রহমান স্পিকিং।
ফোনে কথা বলছেন তিনি ঠিক, কিন্তু নজর রয়েছে খোলা দরজার দিকে।
অপরপ্রান্ত থেকে পরিষ্কার বাংলায় কথা বললেন মি. সিম্পসন, আমি.সি. আই. ডির স্পেশাল অফিসার সিম্পসন বলছি। রহমান সাহেব, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। ব্যাপার কি জানেন, আমরা একটা কেস নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়েছি। কেসটার ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন মনে করে।
অবশ্যই, অবশ্যই। সাহায্য করতে পারলে আমি খুবই খুশি হব। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিভাবে আপনার সাহায্যে লাগতে পারি।
মি. সিম্পসন বললেন, আপনি তো প্রখ্যাত একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর, তাই না?
আঁতকে উঠলেন আতিকুর রহমান সাহেব। রীতিমত দাবির সুরে ব্যাখ্যা চাইলেন পরমুহূর্তে, কোথা থেকে পেলেন আপনি এ তথ্য, মি. সিম্পসন? আমি একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর একথা কেউ জানে না বললেই চলে। কে বলেছে আপনাকে?
মি. সিম্পসন বললেন, স্ট্যাম্প কালেক্টর হিসেবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান মনে হচ্ছে, রহমান সাহেব?
অবশ্যই। আমি চাই না কেউ জানুক।
কারণ?
কারণটা ব্যক্তিগত। আমি চাই না আমার স্ট্যাম্পগুলোর প্রতি কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠুক।
মি. সিম্পসন একটু বিরতি নিলেন, তারপর বললেন, আমাদের হাতে এমন একটা কেস এসেছে, যার সাথে স্ট্যাম্পের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। অনুমানের উপর নির্ভর করে কাজ করতে হয় আমাদের, বোঝেনই তো। এদিকে স্ট্যাম্প সংক্রান্ত ব্যাপারে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তাই দিল্লীর এক বিখ্যাত স্ট্যাম্প বিক্রেতার কাছে টেলিফোন করি। তারা বিশেষ কোন সাহায্য করতে পারেনি–তা সম্ভবও নয়। আমাদের কেসের সাথে যে-সব স্ট্যাম্প জড়িত সেগুলো না দেখে তারা কিভাবে মতামত দেবে? সে যাই হোক, তারা টেলিফোনের মাধ্যমে আমাদেরকে পরামর্শ দেয় আপনার সাথে যোগাযোগ করার। আপনি নাকি তাদের কাছ থেকে আজ দশ বছর ধরে স্ট্যাম্প কিনছেন।
আতিকুর রহমান সাহেবকে বেশ একটু উফুন্নই দেখাল। বললেন, মি. সিম্পসন, স্ট্যাম্প সংক্রান্ত ব্যাপারে যদি কোন সমস্যায় পড়ে থাকেন, নির্ঘাৎ আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব। তা সাহায্যটা কিভাবে করতে পারি?
মি. সিম্পসন বললেন, এক ভদ্রলোকের স্ট্যাম্প কালেকশন দেখতে হবে আপনাকে। তারপর আপনার মতামত নেব আমরা।
জাল স্ট্যাম্প? স্ট্যাম্পগুলো দেখে বলতে হবে আমাকে নকল স্ট্যাম্প ওগুলোর মধ্যে আছে কিনা?
মি. সিম্পসন বললেন, কেসটা আরও গুরুতর, রহমান সাহেব। এটা একটা মার্ডার কেস। এবং আমরা জানতে চাই।
হোয়াট! মার্ডার কেস? আই সি!
মি. সিম্পসন তাড়াতাড়ি বললেন, মার্ডার কেস হলেও, আপনাকে সে ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না। যে ভদ্রলোক খুন হয়েছেন তার কালেকশন দেখতে হবে শুধু আপনাকে। দেখে আপনি আমাদেরকে রিপোর্ট দেবেন। অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়লে আমাদেরকে জানাবেন। কি জানেন, ঠিক কি যে সন্দেহ করছি তা ভাল করে আমরা নিজেরাই জানি না। তবে ভদ্রলোক খুন হয়েছেন তার কালেকশন সামনে নিয়ে বসে থাকার সময়। তাই সন্দেহ করছি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে স্ট্যাম্পের সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। একজন বিশেষজ্ঞের মতামত দরকার তাই। একমাত্র আপনিই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন।
আতিকুর রহমান বললেন, সানন্দে সাহায্য করব। কোথায় যেতে হবে বলুন? আপনাদের হেডকোয়ার্টারে?
না। আপনি যদি দয়া করে ২১৫ নম্বর গুরুদাস লেনে আসেন তাহলে স্ট্যাম্পগুলো দেখাতে পারি। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি…।
আতিকুর রহমান বললেন, কোন দরকার নেই। আমি নিজের গাড়ি নিয়েই যাচ্ছি।
মি. সিম্পসন আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, ধন্যবাদ, রহমান সাহেব। আপনার সহযোগিতার মনোভাব মুগ্ধ করেছে আমাকে।
ওসব কথা রাখুন। স্ট্যাম্প আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শখের ব্যাপার। একজন কালেক্টরের কালেকশন, দেখার সুযোগ দিচ্ছেন আমাকে–আমি সত্যি– ভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে। ছাড়ি, কেমন? এখুনি রওনা হচ্ছি আমি।
গুরুদাস লেন-খুঁজে পাবেন তো বাড়িটা? দুশো পনেরো নম্বর বাড়ি। দোতলা।
খুঁজে নেব। অসুবিধে হবে না। ওই এলাকায় আগেও কবার গেছি আমি। রিসিভার নামিয়ে রেখে সোফা ত্যাগ করলেন আতিকুর রহমান।
টোটা!
দোরগোড়ায় উদয় হলো টোটা সাথে সাথে, জী, হুজুর!
আমি বাইরে যাচ্ছি। তোর বিবিসাহেবকে বলবি ফিরতে দেরি হতে পারে। যতক্ষণ না ফিরি, তুই উপরেই থাকবি। নিচে নামবি না।
জী, হুজুর।
আতিকুর রহমান ঘুরে দাঁড়ালেন। খোলা দরজা দিয়ে পাশের রূমে ঢুকলেন তিনি। দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
ভেজানো দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। শব্দ পেয়ে ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন আতিকুর রহমান। দেখলেন টোটা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
এখনও উপরে যাসনি তুই?
টোটা বলল, হুজুর, রাতে কে গেট খুলে দেবে আপনাকে?
রাগ সামলে আতিকুর রহমান বললেন, গেট খোলা থাকবে। যা ভাগ।
টোটা চলে গেল।
আতিকুর রহমান টেবিল থেকে স্ট্যাম্প বুক ইত্যাদি ওয়াল সেফে ভরে তালা বন্ধ করলেন। মিনিট পাঁচেক পর রূমের তালা লাগিয়ে বাইরে বেরুলেন তিনি। গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে।
দোতলার বারান্দা থেকে টোটা দেখল সব। গাড়িটা দূরে মিলিয়ে যেতে বিড় বিড় করে বলল, বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে? দোষ নেই, অপরাধ নেই–শুধু শুধু আমার গায়ে হাত তোলে! রঙিন আজে বাজে কাগজ নিয়ে কি কাণ্ডই না করে। ওই ঘরের ভিতর যেন সোনার খনি আছে। আমার গায়ে হাত তোলে, সুযোগ পেলে আমিও দেখিয়ে দেব।
.
গুরুদাস লেনের ২১৫ নম্বর বাড়িটা পুরানো ধাচের, তবে প্রকাণ্ড আকারের দোতলা। গেটটা বন্ধ। নামফলকটা পড়লেন আতিকুর রহমান।
সেকান্দার আলী খান, অ্যাডভোকেট।
কলিংবেলের বোতাম টিপে ধরতে একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। আতিকুর রহমান একটু যেন অপ্রতিভ হলেন।
কাকে চান?
আতিকুর রহমান মৃদু হেসে বললেন, মি. সিম্পসনকে খবর দিন। বলুন, রহমান সাহেব এসেছেন।
মি. সিম্পসন? মি. সিম্পসন কে? বিরক্তির সাথে চেয়ে রইল যুবতী।
মি. সিম্পসন, সিআই. ভির স্পেশাল অফিসার আমাকে ফোন করে এই ঠিকানায় আসতে বললেন।
যুবতী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে একটু রূঢ় কণ্ঠেই জানিয়ে দিল, মি. সিম্পসন নামে কেউ এখানে থাকেন না।
অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন আতিকুর রহমান।
কে, লিলি? যুবতীর পিছন থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ জানতে চাইল। যুবতী পিছন দিকে তাকাল, তারপর সরে দাঁড়াল.এক পাশে। বলল, বাবা, এক ভদ্রলোক মি. সিম্পসন নামে কাকে যেন খুঁজছেন।
প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক, মস্ত টাক তার মাথায়, দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন, মি. সিম্পসন? আপনি কে?
আতিকুর রহমান বললেন, আপনাদের বাড়ি ২১৫ নম্বর নয়? গুরুদাস লেন, তাই না? ভদ্রলোক আমাকে ঠিকানাটা দুবার বলেছেন…।
মিথ্যে কথা বলেছে, বুঝতেই পারছেন। বন্ধু-টঙ্কু বুঝি? হয়তো ঠাট্টা করেছে।
আতিকুর রহমান মনে মনে চটছিলেন। কিন্তু চোট-পাট দেখিয়ে লাভ কি?
যুবতীটি ফিসফিস করে কি যেন বলছে প্রৌঢ়কে।
প্রৌঢ় বললেন, সি, আই. ডি? তার মানে পুলিশী ব্যাপার। না-না, পুলিশ টুলিশ এদিকে কেউ থাকেন না, আমরা কেউ ডাকিনিও। আপনি বরং…।
আতিকুর রহমানের মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে এই ২১৫ নং বাড়িতে মি. সিম্পসম নামে কেউ উপস্থিত নেই। তিনি দ্রুত ভাবছিলেন। সত্যিই কি কেউ তার সাথে ঠাট্টা করেছে? মিছিমিছি ফোন করে তাকে বাড়ি থেকে বের করার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে?
কিছু যদি মনে না করেন, আপনাদের ফোনটা একবার ব্যবহার করতে পারি? সি. আই. ডি. হেডকোয়ার্টারে ফোন করে দেখতাম একবার।
প্রৌঢ় কিছু যেন ভাবলেন। তারপর মাথা নাড়লেন, না। আমাদের ফোনটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে কদিন থেকে।
আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠলেন আতিকুর রহমান। স্টার্ট দিলেন।
প্রৌঢ় হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, এই যে মিস্টার, শুনুন। রাস্তার নামটা ঠিক মনে আছে তো আপনার? গুরুদাস বসাক লেন, নাকি গুরুদাস সরকার লেন? প্রায় একই নামের তিন চারটে লেন আছে।
আতিকুর রহমান গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললেন, গুরুদাস লেনই তিনি বলেছিলেন আমাকে।
গোলমালটা ওখানেই, মিস্টার। এই লেনটাকে সবাই গুরুদাস লেন বললেও এটা আসলে গুরুদাস বসাক লেন। গুরুদাস সরকার লেনও আছে একটা। আমাদের কাছে গুরুদাস সরকার লেনের চিঠিপত্র মাঝেমধ্যে এসে পড়ে, পিয়ন ভুল করে দিয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কাছ থেকে শুরুদাস সরকার লেনের অবস্থান সম্পর্কে বিশদ জেনে নিলেন আতিকুর রহমান। তারপর আবার গাড়িতে চড়লেন।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে। জোরেই গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। মিছামিছি পঁচিশটা মিনিট নষ্ট হয়ে গেল।
গুরুদাস সরকার লেনটা মাইল খানেক দূরে। কয়েকটা বাড়ির নেমপ্লেটে জায়গাটার নাম দেখে মনটা আরেকটু দমে গেল নতুন করে। গুরুদাস সরকার লেন নয়, শ্রী গুরুদাস সরকার লেন। এই শ্ৰী শেষ পর্যন্ত বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি না করে আবার।
২১৫ নম্বর বাড়িটা নতুন। আধুনিক আর্কিটেকচারের নিদর্শন বলা চলে। ছোট; একটা সুন্দর বাগান দেখা যাচ্ছে গেটের ভিতর। গেটটা খোলা। কংক্রিটের রাস্তা চলে গেছে বিল্ডিংটার দিকে। শেষ মাথায় দুটো গাড়ি, একটা জীপ পঁড়িয়ে আছে। কিন্তু লোকজন দেখা যাচ্ছে না।
গেট পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দায় পৌঁছে গেলেন আতিকুর রহমান। গাড়ি থেকে নেমে বন্ধ একটা দরজার গায়ে টোকা দিলেন।
ইউনিফর্ম পরা একজন কনস্টেবল দরজা খুলে দিল।
মি. সিম্পসন কোথায়?
কনস্টেবলটি জানতে চাইল, আপনি মি. রহমান, স্যার?
আতিকুর রহমান মাথা নাড়তে কনস্টেবলটি সামনের পথ ছেড়ে দিয়ে বলল, আসুন, স্যার। মি. সিম্পসন আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
দরজা পেরিয়ে লম্বা হলরূমে ঢুকলেন আতিকুর রহমান। উজ্জল আলোয় আলোকিত। বাড়ির মালিক যে ধনী, তা বোঝা যায় ফার্নিচারের ডিজাইন এবং সংখ্যা দেখে। রেলিং দেয়া, কাপের্ট মোড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। উপর থেকে ভেসে আসছে একটি নারী কণ্ঠ থেকে মৃদ, অস্পষ্ট কান্নার শব্দ।
কনস্টেবলের পিছু পিছু খোলা দরজা দিয়ে একটি মাঝারি আকারের সুসজ্জিত রূমে ঢুকলেন আতিকুর রহমান। রূমের ভিতর চারজন ভদ্রলোক উপস্থিত রয়েছেন। খুব ফর্সা তাদের মধ্যে একজনই। ইনিই যে মি. সিম্পসন তা বুঝতে পারলেন আতিকুর রহমান।
দরজার দিকে পিছন ফিরে সুঠামদেহী এক ভদ্রলোকের সাথে নিচু কণ্ঠে আলাপ করছিলেন মি. সিম্পসন। সুঠামদেহী ভদ্রলোকই প্রথম দেখতে পেলেন তাঁকে। মৃদু একটু হাসলেন তিনি। ভদ্রলোককে আতিকুর রহমান চিনতে পেরেছেন। পরিচয় না থাকলেও ছবি দেখেছেন তিনি সংবাদপত্রে।
অপর একজন লোক প্রকাণ্ড একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে গাদা গাদা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছেন, বেছে বেছে কোন কোনটা পড়ছেন, রেখে দিচ্ছেন একপাশে। অপর একটি টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন আর এক ভদ্রলোক। টেবিলের উপর মোটা মোটা অ্যালবাম। অ্যালবামগুলোর লেদারের কভার কুচকে গেছে, মসৃণতা নেই এতটুকু। কোণাগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। বোঝা যায়, অ্যালবামগুলো বহুদিন থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি অ্যালবামের উপর দুটো অক্ষর লেখা রয়েছে। E এবং K।
পদশব্দ শুনে মি. সিম্পসন ঘুরে দাঁড়ালেন।
গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মি. রহমান।
হ্যাণ্ডশেক করতে করতে মি. সিম্পসন বললেন, আসুন পরিচয় করিয়ে দিই।
সুঠাম দেহী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আতিকুর রহমান সহাস্যে বললেন, ওঁকে চিনি। পরিচয় নেই–তবু চিনি। বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানকে কে না চেনে?
শহীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন আতিকুর রহমান। করমর্দন করতে করতে শহীদ বলল, পৌঁছুতে একটু দেরি করেছেন আপনি, মি. রহমান।
ঠিকানাটাই যে গোলমেলে। গুরুদাস সরকার…।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, দুঃখিত, মি. রহমান। ভুলটা আমারই। এ বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে আমরাও ওই ঠিকানার দিকে রওনা হয়েছিলাম…।
আতিকুর রহমান প্রশ্ন করলেন, ঘটনাটা তাহলে গত রাতে ঘটেছে?
মি. সিম্পসন সিগারের ছাই ঝাড়লেন টেবিলের উপরের অ্যাশট্রেতে। সময় নিলেন তিনি। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, যা। রাত নটা থেকে মাঝরাতের মধ্যে কোন একসময়।
টেবিলে কার্যরত দুজনকে দেখিয়ে মি. সিম্পসন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন, এরা আমার সহকারী। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, সাব ইন্সপেক্টর বোরহান। বসুন, মি. রহমান।
পাইপ টানতে টানতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল শহীদ আতিকুর রহমানকে। আতিকুর রহমান বসলেন। তাকালেন শহীদের দিকে, খুন হয়েছেন কে? এ বাড়ির মালিক।
শহীদ বলল, হ্যাঁ। মি. ইব্রাহিম।
মি. সিম্পসন বললেন, নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের নাম শুনেছেন? বিখ্যাত ধনী ছিলেন। আপনার মতই নাম করা স্ট্যাম্প কালেক্টর।
আতিকুর রহমান বললেন,, নাম শুনেছি। কিন্তু পরিচয় ছিল না। কিন্তু তিনি যে একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর ছিলেন, তা আমার জানা ছিল না।
মি. সিম্পসন বললেন, ভদ্রলোক অনেকটা আপনার মতই। হবিটা গোপন রাখতেই ভালবাসতেন। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। আপনজন বলতে একটি মাত্র মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সাহেব এ বাড়িতে একাই বসবাস করছিলেন। চাকর চাকরানী মাত্র দুজন। দুজনই গতরাতে বাড়ির বাইরে ছিল। ওরা স্বামী-স্ত্রী গিয়েছিল নিজেদের গ্রামে। গতরাত নটায় যায় ওরা, যাবার সময় এই রূমে ওই টেবিলটার সামনে ইরাহিম সাহেবকে বসে থাকতে দেখে গিয়েছিল ওরা। যে চেয়ারটায় আপনি বসে রয়েছেন, ওই চেয়ারটাতেই।
আতিকুর রহমানের কাঁচাপাকা ভুরু জোড়া একটু কোঁচকাল। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন তিনি।
মি. সিম্পসন বলে চলেছেন, টেবিলের উপর স্ট্যাম্পের অ্যালবামগুলো ছিল। বেশিরভাগই ছিল বন্ধ, একটি মাত্র ছিল খোলা। আজ বেলা এগারোটার সময় স্বামী স্ত্রী একযোগে ফেরে ওরা। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে দুজনই, দেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন ইব্রাহিম সাহেব। ওরা ভাবে, ঘুমোচ্ছেন তিনি। তবে ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। তারপর কাছাকাছি গিয়ে দেখে চোখ দুটো ভোলা, সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ, মণি দুটো অচল, নিষ্প্রাণ। ওরা বুঝতে পারে, ইব্রাহিম সাহেব বেচে নেই। ডাক্তার আর পুলিশকে ফোন করে ওরা।
মি. সিম্পসন বিরতির জন্যে থামলেন।
মৃত্যুর কারণ?
মি. সিম্পসন বললেন, গলায় দাগ পাওয়া গেছে। চেয়ারের পাশে পাওয়া গেছে একটা সিল্কের বড় রুমাল।
রুমালটা ইব্রাহিম সাহেবেরই। কোন সন্দেহ নেই খুনী ইব্রাহিম সাহেবের গলায় রুমাল পেঁচিয়ে ধরেছিল–শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি।
আতিকুর রহমান তাকালেন শহীদের দিকে। মৃদু হেসে বললেন, প্রখ্যাত ডিটেকটিভ শহীদ খান স্বয়ং এখানে উপস্থিত। রুমালটা একটা বিরাট সূত্র, এই সূত্র অনুসরণ করে খুনীকে খুঁজে বের করে ফেলবেন, কি বলেন?
হাসল না শহীদ। বলল, রুমাল ছাড়াও সূত্র আমাদের হাতে আরও রয়েছে, মি. রহমান।
আতিকুর রহমান ঘাম মোছার জন্য পকেট থেকে একটা রুমাল বের করলেন।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, আপনি যেমন ঘাম মোছার জন্যে রুমাল বের করলেন, ইব্রাহিম সাহেবও সম্ভবত ঘাম মোছার জন্যে রুমাল বের করেছিলেন। খুনী তার হাত থেকে রুমালটা,কেড়ে নেয়, পেঁচিয়ে ধরে গলায়…।
আতিকুর রহমান গম্ভীর হয়ে উঠলেন। কপালের ঘাম মুছে পকেটে রাখলেন। রুমালটা। সবাই তাকে লক্ষ করছে, বুঝতে পারলেন তিনি। তার রুমালটাও সিল্কের, দৃষ্টি এড়ায়নি কারও।
খুনী ইব্রাহিম সাহেবের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও কেউ হতে পারে। তার বন্ধু বান্ধবের মধ্যে কেউ স্ট্যাম্প সংগ্রাহক আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে, বললেন ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ।
মি. সিম্পসন বললেন, খুনী যে-ই হোক, স্ট্যাম্পের সাথে সে কোন না কোন ভাবে জড়িত, এটা আমাদের বিশ্বাস। ইতিমধ্যে ইব্রাহিম সাহেবের অতীত জীবন সম্পর্কে প্রায় সব তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছি আমরা। তার শত্রু ছিল না। নিতান্ত নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনে কারও সাথে ঝগড়া করেননি। ব্যবসায়ী হলেও, নিজে দেখাশোনা করতেন না কিছু। শুধু কাগজ-পত্রে সই করতেন, তাও এই বাড়িতে বসে। রউফ আর সাবিহা একেবারে ছোটবেলা থেকে আছে এই বাড়িতে, বাকি জীবনটাও তারা এই বাড়িতে কাটাবে, ইরাহিম সাহেবের সেইরকমই ইচ্ছা ছিল। ওরা গতরাতে নিজেদের গ্রামেই ছিল, সন্ধান নেওয়া হয়েছে। মোটকথা, ওরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তাছাড়া, ওদের মোটিভই বা কি হতে পারে? আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, খুনী ভিতরে ঢুকেছে, খুন করেছে, চলে গেছে। কেউ তাকে দেখেনি। বাড়িতে ছিলও না কেউ, দেখবে কে? কিছুই চুরি যায়নি। আয়রন সেফে টাকা ছিল হাজার দশেক। ছোয়নি খুনী। ইব্রাহিম সাহেব ইসুরেস করেননি, উইলও করার প্রশ্ন দেখা দেয়নি। তাঁর অবর্তমানে সমুদয় অর্থ, সয়-সম্পত্তির মালিক হবে তার একমাত্র মেয়ে রুবিনা।
হলরূমে ঢুকে এক মহিলার কান্নার শব্দ পেয়েছি আমি…।
মি. সিম্পসন বললেন, মিসেস রুবিনা। নারায়ণগঞ্জ থাকেন। খবর পেয়ে স্বামীর সাথে এসেছেন দুপুরে। সেই থেকে কাঁদছেন। ওর স্বামী জুট এক্সপোর্টার, বিরাট ধনী।
আতিকুর রহমান জানতে চাইলেন, খুনীকে পাকড়াও করা বেশ কঠিন হবে মনে হচ্ছে, কি বলেন? তা সে যাই হোক, আমি এ ব্যাপারে আপনাদেরকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি তাই বলুন।
মি. সিম্পসন তাকালেন শহীদের দিকে।
শহীদ বলল, আপনার সাহায্য আমিই চেয়েছি মি. রহমান। আপাতদৃষ্টিতে খুনের উদ্দেশ্য ডাকাতি না হলেও, ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিতেও পারছি না। নগদ টাকা বা মূল্যবান গহনা হয়তো ডাকাতি করার জন্যে খুনী আসেনি। সে হয়তো স্ট্যাম্প ডাকাতি করার জন্যে এসেছিল। স্ট্যাম্প সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞই বলতে পারেন। তবে, জানি, কোন কোন দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্পের দাম কয়েক লাখ টাকা বা তার চেয়েও বেশি। এই দিকটা আপনাকে দেখতে হবে। ইব্রাহিম সাহেবের কালেকশনটা দেখুন আপনি। হয়তো দামী কোন স্ট্যাম্প চুরি গিয়ে থাকতে পারে। চুরি হয়ে থাকলে ব্যাপারটা আপনার চোখে ধরা পড়তে পারে, তাই না?
আতিকুর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, অবশ্যই। ইব্রাহিম সাহেব তাঁর স্ট্যাম্প যদি নির্দিষ্ট কোন নিয়মে সাজিয়ে রেখে গিয়ে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই, আমি দেখেই বলে দিতে পারব কোনও স্ট্যাম্প চুরি গেছে কিনা।
টেবিলের দিকে চেয়ার সরিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি, টাইয়ের নটটা ঢিল করে নিলেন একটু, বললেন, আপনারা বলছেন, টেবিলের উপর একটা অ্যালবাম খোলা ছিল। কোটী সেটা?
শহীদ আঙুল দিয়ে মোটা একটা অ্যালবাম দেখিয়ে বলল, বাঁ দিকেরটা।
খোলা অবস্থায় কত নম্বর পৃষ্ঠা দেখা যাচ্ছিল?
মি. সিম্পসন তাকালেন শহীদের দিকে।
শহীদ বলল, একশো দুই এবং তিন নম্বর পৃষ্ঠা। দাঁড়ান, খুলে দিচ্ছি।
অ্যালবামটার নির্দিষ্ট পাতা খুলল শহীদ।
আতিকুর রহমান পকেট থেকে একটা খাপ বের করলেন। লেদার খাপ থেকে চশমাটা বের করে চোখে আঁটলেন। ঝুঁকে পড়লেন খোলা অ্যালবামের উপর। হেডিংটা পড়লেন বিড়বিড় করে, কেপ অভ গুড হোপ।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, শূন্য ফ্রেমগুলো দেখছেন মি. রহমান? খালি কেন ওগুলো? কি বোঝাচ্ছে..?
আতিকুর রহমান সাবধান করে দিয়ে বলে উঠলেন, প্রায় ধমকেই উঠলেন বলা যায়, আহ! করছেন কি. মি. সিম্পসন! খালি হাতে ধরবেন না বলে দিচ্ছি, নখ লেগে ছিঁড়ে যেতে পারে। স্ট্যাম্প খুবই ভঙ্গুর জিনিস। কত বছরের পুরানো জিনিস বুঝতে পারছেন না? দিন, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমাকে দিন।
গ্লাস দিয়ে দেখতে দেখতে তিনি খানিক পর বললেন, খালি ফ্রেমগুলো কোন অর্থই বহন করছে না, মি. সিম্পসন। ওগুলো প্রথম থেকেই খালি ছিল। ভাল কথা, একটা কথা আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। স্ট্যাম্প কালেক্টররা কখনও স্ট্যাম্পের পিছনে জিভ দিয়ে শুধু মাখিয়ে অ্যালবামের উপর তা সঁটে না। চিঠি লিখে, খামে, ভরে, খামের উপর অবশ্য ওই ভাবে স্ট্যাম্প লাগায় বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু একজন জেনুইন স্ট্যাম্প কালেক্টর তা করেন না। তিনি কিভাবে কাজটা করেন বলুন তো?
সবাই চেয়ে রইল আতিকুর রহমানের দিকে।
ফ্রেমগুলোর মাথার উপর এই যে ছোট ছোট কাগজের টুকরো দেখতে পাচ্ছেন, এগুলোর একটা দিকে গাম লাগানো আছে। অ্যালবামের পৃষ্ঠায় এই গাম লাগানো কাগজের একটা প্রান্ত সাঁটা হয়, তারপর ভাজ করা হয় কাগজের টুকরোটা, ফলে গাম লাগানো দিকটা উপরে চলে আসে। তখন স্ট্যাম্পটাকে ওই গাম লাগানো দিকটায় চেপে ধরা হয়। সুন্দর আটকে থাকে স্ট্যাম্প। দরকারের সময় খোলা যায় অনায়াসে, স্ট্যাম্পের কোন ক্ষতিই হয় না এতে করে। খালি ফ্রেমগুলোয় যে স্ট্যাম্প ছিল না কোনকালে তা কিভাবে বুঝলাম বলুন তো? গাম লাগানো কাগজের টুকরোগুলোর দিকে তাকান, একটাও ভাঁজ করা নয়, তাই না? স্ট্যাম্প থাকলে ভাজ থাকতই। এখন বুঝতে পারছেন?
মি. সিম্পসন বললেন, হু।
বড় লোভনীয় কালেকশন ভদ্রলোকের!
আতিকুর রহমান আত্মভোলা হয়ে উঠেছেন। কোন দিকে খেয়াল নেই তাঁর এখন। স্ট্যাম্প দেখলে তার এই অবস্থা হবেই হবে–সব ভুলে ডুবে যাবেন বিশেষত্ব আবিষ্কারে।
অনেক বছরের কঠোর সাধনার ফল এই সংগ্রহ! খুবই বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক জীবিত থাকতে এই হবির কথা আমি জানতে পারিনি। দেখা যাচ্ছে আমরা দুজনে একই বিক্রেতার কাছ থেকে স্ট্যাম্প কিনেছি। দিল্লী, হংকং, ব্যাঙ্কক, ম্যানিলা–বিভিন্ন জায়গার এজেন্টদের কাছ থেকে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করেছেন…করেছিলেন ইব্রাহিম সাহেব। আরে…মাই গড…।
অকস্মাৎ নিষ্প্রাণ মূর্তিতে পরিণত হলেন আতিকুর রহমান। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছেন তিনি খোলা অ্যালবামের দিকে। এইমাত্র অ্যালবামের পাতা উল্টেছেন তিনি। পাতা উল্টে কিছু এমন দেখতে পেয়েছেন যা দেখে চমকে উঠেছেন ভীষণভাবে।
ব্যাপার কি বলুন তো? কোথাও কোন অসঙ্গতি লক্ষ করছেন? আবিষ্কার করেছেন এমন কিছু যাতে বোঝা যায়?
মি. সিম্পসন চুপ করে গেলেন আপনা থেকেই। আতিকুর রহমানের মুখের চেহারা দেখে হতবাক তিনি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ঘামে ভিজে গেছে তাঁর মুখ। তাকালেন তিনি আবার অ্যালবামের দিকে। দুটো পৃষ্ঠা ভরা স্ট্যাম্প। দুই পৃষ্ঠার কোথাও খালি ফ্রেম নেই। প্রত্যেকটি ফ্রেমেই রয়েছে স্ট্যাম্প।
কিছু বলুন মি. রহমান! কি দেখে অমন চমকে উঠলেন? ইন্সপেক্টর সাদত জানতে চাইলেন।
ভদ্রমহোদয়গণ! আপনারা দয়া করে একটু চুপ করুন! বলছি, কি আবিষ্কার করেছি বলছি আমি!।
সিল্কের রুমালটা পকেট থেকে বের করলেন আতিকুর রহমান। মুখটা মুছলেন ভাল করে। কেউ লক্ষ না করলেও শহীদের দৃষ্টি এড়াল না একটা ব্যাপার। আতিকুর রহমানের দুটো হাতই কাঁপছে।
আর কিছু দেখার দরকার নেই আমার। যা দেখেছি তাতেই বলতে পারি, স্ট্যাম্প চুরি করার জন্য খুনী খুন করেনি।
কিভাবে বুঝতে পারছেন?
আতিকুর রহমান চোখ তুলে তাকালেন মি. সিম্পসনের দিকে। বললেন, এই যে পৃষ্ঠাটা দেখছেন, এর মধ্যে বারোটা স্ট্যাম্প রয়েছে, তাই না? এই বারোটার মধ্যে একটা স্ট্যাম্প রয়েছে যার মূল্য এত বেশি যে আপনাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান স্ট্যাম্পগুলোর মধ্যে এটি একটি।
কোনটা? কোন স্ট্যাম্পটার কথা বলছেন আপনি?
আতিকুর রহমান ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, দেখিয়ে না দিলে স্ট্যাম্পটাকে খুঁজে বের করা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দেখতে সবগুলোই তো প্রায় একরকম। তবে আমার চোখে তা নয়। আমি এক পলক দেখেই বলে দিতে পারি কোন্ স্ট্যাম্পটার গুরুত্ব কতটুকু, মূল্য কি। আমি যে বিশেষ স্ট্যাম্পটার কথা বলছি। সেটার নাম হলো কেপ অভ গুড হোপ ট্রায়াঙগুলার, এই এইটা, এই তেকোণা স্ট্যাম্পটা। এক মিনিট সময় দিন আমাকে। স্কট কি লিখছে এটা সম্পর্কে পড়ে শোনাচ্ছি আপনাদের।
টেবিলের একধার থেকে মোটা একটা বই টেনে নিলেন আতিকুর রহমান। স্ট্যাম্প কালেক্টরদের বাইবেল বলা হয় এই বইকে। পৃথিবীতে যত স্ট্যাম্প ছাপা এবং বিলি করা হয়েছে, সবগুলোর বর্ণনা এবং ক্যাটালগ ভ্যালু ছাপা রয়েছে এই বইয়ে।
এই যে, এই দেখুন। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে এর মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে দেড়শো হাজার ডলার। এখন পাঁচশো হাজার ডলার তো হবেই। এক ডলার যদি তেরো টাকা হয়-৬৫ লক্ষ টাকা দাম এই স্ট্যাম্পটার!
অকস্মাৎ সিধে হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন মি. সিম্পসন। কর্কশ শোনাল তার কণ্ঠস্বর। চিৎকার করে জানতে চাইলেন তিনি, মানে? মি. রহমান, আপনি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন নাকি?
ইন্সপেক্টর সাদত খিল খিল করে হাসলেন। ছোট্ট অতটুকু একটা কাগজের দাম পয়ষট্টি লাখ টাকা! মাথাটা ঠিক আছে তো রহমান সাহেব আপনার?
রীতিমত ধমকে উঠলেন আতিকুর রহমান, চুপ করুন! বোকার মত কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি! স্ট্যাম্প সম্পর্কে ঘোড়ার ডিম জানেন আপনারা! আমি যা বলি কান পেতে শুনে যান, মন্তব্য করে নিজেদের বোকামি প্রকাশ করবেন না। শেষবার যখন এই স্ট্যাম্পটা হাত বদল হয় তখন দেড়শো হাজার ডলার দেওয়া হয় বিক্রেতাকে। আসলে এটা অমূল্য একটা জিনিস। ডলার, টাকা বা স্বর্ণ দিয়ে এর মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ, জানামতে মাত্র তিনটে কেপ অভ গুড হোপ ট্রায়াঙগুলার আছে গোটা দুনিয়ায়। মৃত কিং জর্জের কালেকশনে একটি, মৃত রাশিয়ান জারের কালেকশনে একটি এবং তিন নম্বরটি ছিল ফেরারীর কালেকশনে। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে প্যারিসে রুদ্ধদ্ধার কক্ষে এই তিন নম্বর স্ট্যাম্পটি নিলামে বিক্রি করা হয়। এটা সম্ভবত প্রথম দুটির একটি, যদি এটা জেনুইন হয়ে থাকে, যদি এটা নকল না হয়। জাল বা নকল আছে বহু।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, এটা নকল কিনা বুঝতে পারছেন না?
এখুনি বলা সম্ভব নয়। আতিকুর রহমান অন্যমনস্কভাবে বললেন, খালি চোখে এমনকি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করেও বলা সম্ভব নয় এটা জাল স্ট্যাম্প কিনা। ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টর দরকার।
শহীদ এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবার ও জানতে চাইল, স্ট্যাম্পের সাথে খুনের কোন সম্পর্ক নেই বলছেন কেন?
এমন মহামূল্যবান স্ট্যাম্প চুরি যায়নি–এটাই তো প্রমাণ করে খুনী স্ট্যাম্প চুরি করতে আসেনি। সেরকম উদ্দেশ্য থাকলে এই স্ট্যাম্প এখানে থাকত না।
শহীদ বলল, এমনও তো হতে পারে যে এটা আসলে নকল স্ট্যাম্প, জেনুইনটা খুনী নিয়ে গেছে, তার বদলে রেখে গেছে নকলটা–যাতে ব্যাপারটা ধরা না পড়ে কারও চোখে!
নট ইমপসিবল। এখুনি রায় দিতে পারছি না আমি। তবে, মনে হয় তেমন কিছু ঘটেনি। ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করতে হলে স্ট্যাম্পটাকে অ্যালবাম থেকে তুলতে হবে। তারপর আসলটার জায়গায় নকলটা সাটতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে তেমন কিছু টেনি। ভাঁজ করা কাগজের টুকরোটা গ্লাস দিয়ে ভাল করে লক্ষ করুন, কর্ণারলো মসৃণ রয়েছে। গ্রামের উপর এতটুকু দাগ নেই। একটা স্ট্যাম্প, তুলে অন্য একটা স্ট্যাম্প সেখানে লাগালে দাগ একটু থাকতই।
মি. সিম্পসন কিছু ভাবছিলেন। আতিকুর রহমান থামতে তিনি বলতে শুরু করলেন। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে এই বিশেষ স্ট্যাম্পটা খুনী দেখেও চুরি করার সাহস পায়নি। আপনি ইতিমধ্যে যতটুকু বলেছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে। এই বিশেষ স্ট্যাম্পটি মহামূল্যবান, স্ট্যাম্প কালেক্টররা এর সম্পর্কে ডিটেলস জানে। এটা চুরি করা হয়তো সম্ভব কিন্তু হজম করা সম্ভব নয়। চোর ধরা পড়বেই পড়বে। কারণ চোর এটা চুরি করে বিক্রি করতে চেষ্টা করবে তো? কোথায় বিক্রি করবে সে? নিশ্চয়ই কোন স্ট্যাম্প কালেক্টর ব্যবসায়ীর কাছে। বিক্রি করতে গেলেই হৈ-চৈ পড়ে যাবে, তাই না? চোর হয়তো এত বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি। অপেক্ষাকৃত কম দামী স্ট্যাম্পগুলো হয়তো চুরি করেছে সে, কিন্তু ভয়ে এটা হেয়নি। নিশ্চিত হবার জন্যে, মি. রহমান আপনাকে A থেকে Z পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
তেকোণা কেপ ট্রায়াঙগুলারের দিকে সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আতিকুর রহমান। চুম্বকের মত আকৃষ্ট করছে তাকে ছোট্ট তেকোণা স্ট্যাম্পটা।
অস্ফুটে তিনি বলে উঠলেন, ঠিক আছে। চেক করব আমি সবগুলো অ্যালবাম। অ্যালফাবেটিক্যালি সব দেখতে হবে আমাকে। কোন দেশই বাদ দেয়া চলবে না।
কোটটা খুলে ফেললেন তিনি। নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারে।
অনেক বেশি খাটতে হবে আপনাকে। আপনি যদি চেকিংয়ের পদ্ধতিটা দেখিয়ে দিতেন তাহলে আমরাও কাজে লাগতে পারতাম। বললেন ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ।
অসম্ভব। স্ট্যাম্প কালেক্টর ছাড়া আর কারও পক্ষে দেখে বোঝা সম্ভব নয় অ্যালবাম থেকে কোন স্ট্যাম্প চুরি গেছে কিনা। খাটনিটা কম হবে না, সত্যি। কিন্তু এ আমি আনন্দের সাথে করব। এটা আমার হবি। এর মধ্যে মজা পাব বলেই করব।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা রুমাল দিয়ে পলিশ করতে লাগলেন আতিকুর রহমান।
সবাই লক্ষ করছে তার কাজ। পাতার পর পাতা ওল্টাচ্ছেন তিনি। একটা একটা করে স্ট্যাম্প গ্লাস দিয়ে দেখছেন। প্রচুর সময় লাগছে। কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কিন্তু মিনিট দশেক পর বিরক্ত বোধ করল সবাই। নীরস, একঘেয়ে কাজ। দেখার কিছু নেই। দুএকটা মন্তব্য করছেন প্রত্যেকেই, কিন্তু, আতিকুর রহমানের মুখে কথা নেই। তিনি এমন নিবিষ্ট, এমনই মগ্ন হয়ে কাজটা করছেন যে ওদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও যেন সচেতন নন।
অন্যান্যরা নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল।
মি. সিম্পসনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল শহীদ হলরূমে।
চলুন, মিসেস রুবিনার সাথে জরুরী আলোচনাটা সেরে নিই এই ফাঁকে।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ সাব-ইক্সপেক্টরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ির আশপাশে, বাগানে কোন পদচিহ্ন বা সূত্র কিছু পাওয়া যায় কিনা নতুন করে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে।
সবাই চলে গেল কিন্তু আতিকুর রহমান যেন সচেতন নন সে ব্যাপারে। খানিকপর মাথা তুলে তাকালেন তিনি।
বিড় বিড় করে কিছু বললেন। ভাবলেন, কি বোকা লোক এরা সবাই। পঁয়ষট্টি লাখ টাকা দামের একটা স্ট্যাম্প রেখে সবাই চলে গেল। একজন স্ট্যাম্প কালেক্টরকে বসিয়ে রেখে আমি চোর নই, কিন্তু একজন কালেক্টর তো! আমার কাছে কেপ ট্রায়াংগুলার স্বর্গের চেয়েও দামী। আসলে আমার কথা ওরা কেউ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারেনি। ছোট্ট এক টুকরো রঙিন কাগজের দাম পঁয়ষট্টি লাখ টাকা–এটা মেনে নিতে পারেনি ওরা কেউ। সেজন্যেই একা আমাকে রেখে চলে যেতে বাধেনি ওদের। কিন্তু…আমি তো আর দেবতা নই!
শেষ পর্যন্ত কানাডার স্ট্যাম্পগুলো পরীক্ষা করলেন তিনি। এরপরই কেপ অভ গুড হোপ। এদিকে রাত গম্ভীর হয়েছে। আজ আর নয়। অ্যালবামটা বন্ধ করে গায়ে কোট চড়ালেন তিনি। কি মনে করে খুললেন আবার অ্যালবামটা। মহামূল্যবান কেপ ট্রায়াংগুলারটা দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে, অপলক চোখে। ঘাম ফুটতে শুরু করল তার কপালে।
তুমি কি আসল কেপ ট্রায়াঙগুলার? নাকি আমার কাছে যেটা আছে সেটার মতই নকল? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। হঠাৎ অপ্রতিভভাবে আপনমনে হাসলেন।
ওয়াটারমার্ক দেখেই কেবল বলা সম্ভব স্ট্যাম্পটা নকল কিনা। আঠারোশো চল্লিশ সনে ইস্যু করা হয় কেপ ট্রায়াংগুলার। ব্যাঙ্ক নোটের মত, স্ট্যাম্প যে কাগজে ছাপা হয়, সেই কাগজের শিটে ওয়াটারমার্ক থাকে। ছাপার পর স্ট্যাম্পগুলো আলাদা করা হলেও ওয়াটারমার্ক থাকে। তবে খালি চোখে, এমনকি গ্লাস দিয়েও ওয়াটারমার্ক দেখা যায় না, এমনই সূক্ষ্ম তা। কেপ ট্রায়াংগুলারের ওয়াটারমার্ক কি জানা আছে তার। বৃটিশ রয়াল ক্রাউন এবং ভিক্টোরিয়া রেজিনার ইনিশিয়াল VR হলো কেপ ট্রায়াংগুলারের ওয়াটারমার্ক।
যারা নকল করে তারা অফিশিয়াল পোস্টাল পেপার সংগ্রহ করতে পারে না বলে তাদের নকল স্ট্যাম্পে ওয়াটারমার্ক থাকে না।
আসল না নকল-জানার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছেন তিনি। ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টর আছে তার কাছে, বাড়িতে। সেটা আনতে হবে আগামীকাল।
নাকি স্ট্যাম্পটা কাউকে না জানিয়ে পকেটে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করবেন…? না-না! তা উচিত হবে না! কি ভাববে ওরা সবাই তিনি যদি ধরা পড়ে যান?
তারচেয়ে কাল সন্ধ্যায় ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টরটা নিয়ে আসবেন তিনি।
আচ্ছা, সকলের অজ্ঞাতে কাজটা করার কি দরকার আছে? ওদেরকে জানিয়ে পরীক্ষা করলে ক্ষতি কি? না! না! সেক্ষেত্রে ওরা সবাই সচেতন হয়ে উঠবে। তা তিনি চান না।
মাথাটা ঘুরছে তাঁর। আচ্ছা, স্ট্যাম্পটা কি তিনি চুরি করতে চাইছেন? ছিঃ! ছিঃ! এসব কি ভাবছেন তিনি?
দ্রুত দরজার দিকে তাকালেন তিনি। পদশব্দ এগিয়ে আসছে।
ভিতরে প্রবেশ করলেন মি. সিম্পসন।
আজকের মত বিদায় নিচ্ছি, মি. সিম্পসন। দয়া করে অ্যালবামগুলো টেবিলের উপর ফেলে রাখবেননা।
চিন্তা করবেন না। একজন পুলিশ কনস্টেবল চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় থাকছে। এই হলরুমে।
আতিকুর রহমান অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, তবু, অ্যালবামগুলো স্টীল আলমারির ভিতর রেখে তালা লাগিয়ে দিন। মি. শহীদ খান কোথায়, চলে গেছেন নাকি?
না মিসেস রুবিনাকে জেরা করছে ও।
আতিকুর রহমান বললেন, আজ চলি। আগামীকাল সন্ধ্যায় আবার আসতে হবে আমাকে। যতটুকু পরীক্ষা করেছি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। আগামীকাল ফাইনাল রিপোর্ট দিতে পারব আপনাকে।
মি. সিম্পসন বললেন, ধন্যবাদ, মি. রহমান। আপনার সহযোগিতার মনোভাবের প্রশংসা করি আমি।
ইটস এ প্লেজার!
কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন আতিকুর রমান। মি. সিম্পসন পিছন পিছন আসছেন না টের পেয়ে তিনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন।
দেখলেন মি. সিম্পসন দ্রুত পাতা ওল্টাচ্ছেন একটা অ্যালবামের।
.
০২.
একই দিন সকালের ঘটনা।
বাড়ির সাথেই নিজস্ব ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির অফিস মি. স্যানন ডি. কস্টার। বাড়িতে সে একাই থাকে। অফিসে বসে নিয়মিত দশটা পাঁচটা। ক্লায়েন্ট আসবে এই আশায় ওত পেতে থাকে সারাটা দিন। কিন্তু ভুলেও কেউ ঢোকে না তার অফিসে। ডিটেকটিভ হিসেবে মোটেই সুনাম অর্জন করতে পারেনি সে। পাগল মনে করে সবাই।
অথচ রাজকীয় হালে থাকে সে। গোটা অফিসটারমেঝে দামী কার্পেট দিয়ে মোড়া। আধুনিক ফার্নিচার দিয়ে সাজানো প্রতিটি কামরা। ফোন, টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকুলার-আরাম-আয়েশের সব উপকরণই রয়েছে তার বাড়িতে।
অবশ্য যাবতীয় কেনাকাটা এবং দৈনন্দিন খরচাদির টাকা পাঠায় কুয়াশা। পরিস্থিতি ইদানীং জটিল আকার ধারণ করেছে, পুলিশ কুয়াশার সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে চব্বিশ ঘন্টা। ডি. কস্টাকে তাই দূরে সরিয়ে রেখেছে কুয়াশা।
কুয়াশার শেখানো বুলি বেশ ভালই আওড়ায় ড. কস্টা, পুলিশ এলে। হামার সহিট মি, কুয়াশার কোন রিলেশনশিপ নাই, টাহাকে হামি পরিট্যাগ করিয়াছি। বিকজ টাহার আড়র্শের সহিট হামার আর্শের ঘোর বিরোড ডেকা ডিয়াছে।
পুলিশ সন্ধান নিয়ে দেখেছে, সত্যি, ডি. কস্টা সারাদিন অফিসে থাকে। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হলেও বিভিন্ন নাইট ক্লাব এবং রেস্তোরাঁতেই সময় কাটায় সে। সেসব জায়গায় কুয়াশার ছায়া পর্যন্ত দেখা যায় না।
আসলে কুয়াশার সাথে ডি. কস্টার যোগাযোগ আগের মতই আছে। তবে যোগাযোগের মাধ্যমটা কেউ জানে না এই যা। ওয়্যারলেসের মাধ্যখেই সাধারণত কথা বলে ডি. কস্টার সাথে কুয়াশা। দেখা-সাক্ষাৎও নিয়মিত হয়। ছদ্মবেশ নিয়ে থাকে কুয়াশা, তাই কেউ তাকে চিনতে পারে না।
একটা অত্যাধুনিক রোবট তৈরির কাজে কুয়াশা ইদানীং খুব ব্যস্ত। সময় নেই তার হাতে। প্রায় পনেরো দিন হতে চলল, ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চেষ্টা করেও ডি. কস্টা যোগাযোগ করতে পারেনি কুয়াশার সাথে। অবশ্য ইমার্জেন্সী সিগন্যাল দিয়ে। চেষ্টা করলে যে কোন মুহূর্তে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু সেটা করা উচিত হবে না। সাধারণ কোন ব্যাপারে ইমার্জেন্সী সিগন্যাল ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।
টাকাপয়সার অভাব দেখা দিয়েছে ডি. কস্টার। ব্যাঙ্ক থেকে হাজার বিশেক। টাকা তুলে আলু কিনেছে সে, রেখেছে কোল্ড স্টোরেজে। আলুর যখন অভাব দেখা দেবে তখন সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করবে। কথাটা কুয়াশাকে জানায়নি সে, জানাবেও না। কুয়াশা জানলে খেপে যাবে ভীষণ। জিনিসপত্র কিনে মওজুদ করাকে মনে-প্রাণে ঘৃণী করে সে। এই মওজুদদারীর জন্যেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় জিনিসের মূল্য।
ভয়ে ভয়ে আছে ডি. কস্টা। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কুয়াশাকে বলবে না কথাটা।
এদিকে দৈনন্দিন খরচের টাকা শেষ হয়ে গেছে। মাত্র তিন টাকা পঞ্চাশ পয়সা আছে এই মুহূর্তে তার পকেটে। এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট কেনাও সম্ভব নয়।
অফিসে বসে সাত-পাঁচ ভাবছিল ডি কস্টা। ক্লায়েন্ট নেই। বন্ধু-বান্ধবরা তাকে তৈমন বিশ্বাস করে না, টাকা ধার চাইলেও দেবে না। ইচ্ছে করলে বেশ কিছু টাকা রোজগার করতে পারে সে। সিনেমা হলগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হয়। ছবি দেখে দলে দলে লোক বেরিয়ে আসবে যখন তখন সুযোগ মত কারও পকেট থেকে টাকাগুলো তুলে নিলেই হয়।
কিন্তু পকেটমারার কাজটা ছেড়ে দিয়েছে সে। প্রতিজ্ঞা করেছে সে বসের কাছে। এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে ভাবল সে, মি. শহীদ খানকে ফোন করে দেখলে হয়। গোটা পঞ্চাশেক টাকা ধার চাইলে না বলতে পারবেন না। কিন্তু কথাটা বসের কানে যেতে পারে। বস জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সে?
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল ফোনটা।
চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ডি. কস্টা।
গড ইজ গুড! বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তার গুণগান গাইল সে। রিসিভারটা কানে তুলে বলল, রয়েল ইনভেস্টিগেশনস। স্যানন ডি. কস্টা স্পীকিং। হু ইজ দেয়ার?
একটি সুমিষ্ট নারী কণ্ঠ ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে, মি. ডি. কস্টা, আমি আপনার সাথেই কথা বলতে চাই।
বলিয়া ফেলুন, কি করিটে পারি আমি আপনার জন্য।
নারীকণ্ঠ বলল, আপনার ফোন নাম্বার আমি পেয়েছি গাইডে। আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে আপনাকে। আপনার সাথে আলোচনা করার আগে আপনার ফি কত জানতে চাই।
এতটুকু চিন্তা না করে ডি. কস্টা বলল, সাডারণট হামি ডশ হাজার টাকা নিয়ে ঠাকি। টবে, কেসটা কটো জটিল টাহার উপর ডিপেণ্ড করে ফির পরিমাণ।
মেয়েটি বলল, ঠিক আছে। কখন আপনার সময় হবে?
ডি. কস্টা বলল, আপনি এখুনি আলোচনা করিটে পারেন। আমার অফিসে হামি হাপনার জন্য অপেক্ষা করিটেছি।
ঠিক আছে। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি আপনার অফিসে।
ডি. কস্টা বলে উঠল, ওয়েট এ. মিনিট। আসিবেন, ভেরি গুড, বাট অ্যাডভ্যান্সের টাকা নিয়া আসিটে ভুলিবেন না।
মেয়েটি বলল, আচ্ছা।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
.
ঠিক পনেরো মিনিট পর সুন্দরী এক যুবতী এবং সুদর্শন এক যুবক ডি. কস্টার অফিসরূমে ঢুকল।
ডি. কস্টা উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল, আসুন, আসুন। আসন গ্রহণ করিয়া হামাকে কৃটাঠ করুন। কী লজ্জার কঠা ভাবুন একবার, হাপনাডের নাম ইট্যাডিও জানা হয় নাই ফোনে।
যুবতী সহাস্যে বলল, ইনি আমার স্বামী, আবদুস শুকুর। আমি মিসেস শেফালী।
বসল ওরা।
ডি. কস্টা বলল, বসুন, কি খাওয়াইব আপনাডেরকে।
না-না। ঝামেলা বাড়াবেন না। আমাদের হাতে সময় খুব কম। কাজের কথাটা সেরে একটা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হবে আবার।
টা বেশ, টা বেশ। নিমণ খুব ভাল জিনিস, হামার কাছে আকাশের চাঁডের মটো।
আকাশের চাঁদের মত? কেন, আপনাকে নিমন্ত্রণ করার কেউ নেই বুঝি? যুবক আবদুস শুকুর জানতে চাইল মৃদু হেসে।
টা নয়, টা নয়। প্রটেক ডিনই টো ডজন খানেক নিমণ পাইটেছি–কিন্তু টাইম কোঠায়! হাপনাডের মটো ক্লায়েন্টডের সাহায্য করিটেই টো টুয়েনটি ফোর আওয়ারস্ বিজি ঠাকি।
শেফালী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার স্বামীর দিকে।
আবদুস শুকুর বলল, শেফালী, আমাদের সমস্যার কথাটা এবার মি, স্যানন। ডি. কস্টাকে বলে ফেলল। আমরা উপযুক্ত মানুষের কাছেই এসেছি। মি. স্যানন ডি. কস্টা যোগ্য গোয়েন্দা, তিনি আমাদের কেসের সমাধান করতে পারবেন।
শেফালী বলল, তুমিই বলো না কেন।
কিন্তু আমি কি গুছিয়ে বলতে পারব? সমস্যাটা আসলে তোমার।
ডি. কস্টা শেফালীর দিকে তাকিয়ে বলল, মিসেস শেফালী, হাপনিই বলুন। হাপনার কণ্ঠস্বরটি আমার কানে মটু বর্ষণ করিটেছে–প্লীজ, ডোন্ট মাইণ্ড। হামি খোলামেলা মানুষ, স্পষ্ট করিয়া কঠা বলিয়া ঠাকি।
লাল হয়ে উঠল শেফালীর দুই গাল।
শুরু করল সে, কেসটা কি বলতে হলে আমার পরিবারের সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস বলতে হবে আগে, মি, স্যানন ডি. কস্টা। আমার বাবা-মা মারা যান আমি যখন মাত্র পাঁচ বছরের। আত্মীয়স্বজন বলতে আমার একমাত্র খালা-আম্মা ছাড়া আর কেউ নেই। আমি সেই থেকে খালা-আম্মার কাছেই মানুষ। খালা-আম্মা আমাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে। মানুষ করার জন্যে তিনি বিয়ের উপযুক্ত বয়সে বিয়েকরেননি। আমি বোর্ডিংয়ে। থেকে লেখাপড়া শিখি। ম্যাট্রিক পাস করি বোর্ডিং-স্কুল থেকে। তারপর ঢাকায় খালার কাছে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। রেজাল্ট খুব ভাল হয়েছিল, তাই সোভিয়েট সরকারের একটা বৃত্তি পেয়ে এরপর চলে যাই মস্কোয়। যাবার আগে অনেক করে বুঝিয়ে শুনিয়ে খালা-আম্মাকে বিয়েতে রাজি করাই। খালা-আম্মা শেষ পর্যন্ত, প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়েটা আমি দেখেই যাই। মস্কোয় গিয়ে কিন্তু থাকতে পারিনি আমি, ফিরে আসি মাস তিনেক পরই। ওখানকার প্রচণ্ড শীত আমি সহ্য করতে পারিনি। যাই হোক, ঢাকায় ফিরে আমি একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিই, এবং আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে একাই বাস করতে থাকি। খালা-আম্মা অবশ্য চেয়েছিলেন আমি তাদের সাথেই থাকি। কিন্তু আমি রাজি হইনি। রাজি না। হবার অন্যতম কারণ, খালা-আম্মা যে ভদ্রলোককে বিয়ে করেছিলেন অর্থাৎ যিনি আমার খালু, রগচটা ধরনের মানুষ। স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই ঝগড়া-ঝাটি হত। ব্যাপারটা আমার খুবই খারাপ লাগত। তাই।
ডি কস্টা অন্যমনস্কভাবে হাত বাড়িয়ে আবদুস শুকুরের সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিল নিজের দিকে। একটা সিগারেট বের করে লাইটার জ্বেলে অগ্নি সংযোগ করল সে, গলগল করে ধোয়া ছাড়ল সিলিংয়ের দিকে, বলল, হাপনার খালুর নামটা বলুন ডয়া করে।
নামটা আমি বলতে চাই না। তিনি সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁর ব্যক্তিগত কিছু দুর্বলতার কথা আপনাকে বলতে হচ্ছে আমাকে ঠিক, কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাই না আমি। ভদ্রলোক খুবই রাগী মানুষ, রেগে গেলে অশ্রাব্য গালাগালিও করেন। যাই হোক, একদিনের ঘটনা বলি। আমি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। গিয়েছিলাম খালা-আম্মাকে দেখতে। গিয়ে দেখি ওঁরা ঝগড়া করছেন। খালু, তার স্বভাব অনুযায়ী গালাগালি দিতে শুরু করলেন খালা-আম্মাকে। আমার সামনে ব্যাপারটা ঘটল বলে, খালা-আম্মার মনে খুবই দুঃখ হলো। অপমানে, ক্ষোভে তিনি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। আমি চলে যাচ্ছি–মাত্র এই একটি কথা বলে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। আমি বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার কথাও তিনি মানেননি। খালু অবশ্য খানিক পরই শান্ত হন এবং গাড়ি নিয়ে খালা আম্মাকে খুঁজতে বেরিয়ে যান। ফেরেন তিনি ঘণ্টা দুয়েক পর। একা। খালা আমাকে সম্ভাব্য কোন জায়গাতেই তিনি খুঁজে পাননি। এরপর আমি, রাত গম্ভীর হচ্ছে বলে, বাড়ি ফিরে আসি। পরদিন সকালে আবার খালা-আম্মাদের বাড়িতে যাই। আমার জন্যে দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। খালু আমাকে বললেন, খালা আম্মা রাতে বাড়ি ফেরেননি।
টারপর?
শেফালী বলল, ঘটনাটা ঘটেছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। খালা-আম্মার কোন সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি।
মাই গড। ডি. কস্টা আঁতকে উঠল।
শেফালী কি যে বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে জানতে চাইল ডি কস্টা, পুলিশবাহিনীকে খবর ডেয়া হয় নাই টখন?
শেফালী বলল, না। খবর দেবার প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ খালা-আম্মা সঠিক অর্থে নিখোঁজ হয়ে যাননি। তার ঠিকানা আমরা কেউ জানি না, চিঠিপত্রও পাই না-কিন্তু তিনি নিয়মিত টাকা পাঠান আমার কাছে।
টাকা পাঠান-হোয়াট ডু ইউ মিন?
শেফালী কলল, তার আগে আপনাকে বলা দরকার যে আমার খালা-আম্মা অগাধ টাকা এবং প্রচুর সয়-সম্পত্তির মালিক। ব্যাঙ্কে তার নামে প্রায় বিশ লক্ষ। টাকা ছিল, এ আমি জানি সেই ছোটবেলা থেকেই। টাকা এবং সয়সম্পত্তি খালা আম্মা খালুর হাতে তুলে দেন, অর্থাৎ লিখিতভাবে রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে স্বামীকে দান করেন। তবে দলিলে আমার জন্য বিশেষ একটা ব্যবস্থা ছিল। খালা-আম্মা মারা গেলে আড়াই লাখ টাকা এবং পঁচিশ বিঘা ধানী জমি আমার পাবার কথা। আর যত দিন তিনি জীবিত থাকবেন প্রতিমাসে আমাকে দেবেন পাঁচশো করে টাকা। পাঁচশো করে টাকা আমি প্রতিমাসেই পেয়েছি। খালা-আম্মা রাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পরও–ডাকযোগে, নিয়মিত পাচ্ছি আমি টাকা।
কোঠা হইটে হাপনার খালা-আম্মা টাকা পাঠাইটেছেন?
শেফালী বলল, চট্টগ্রামের একজন উকিলের মাধ্যমে টাকাটা পাচ্ছি আমি। খালা-আম্মার ঠিকানা চেয়ে ভদ্রলোকের কাছে আমি চিঠি লিখেছিলাম। ভদ্রলোক উত্তরে আমাকে লেখেন, খালা-আম্মার কঠোর নিষেধ আছে তার ঠিকানা কাউকে জানানো চলবে না, তাই তিনি অপারগ।
ডি. কস্টা জানতে চাইল, হাপনার খালা-আম্মা বাঁচিয়া আছেন বলিয়া মনে করেন?
তার মানে? চমকে উঠল শেফালী।
আবদুস শুকুরও বলে উঠল, এ কি রকম প্রশ্ন হলো আপনার?
শেফালী আবার বলল, খালা-আম্মা বেঁচে নেই মানে? বেঁচে না থাকলে টাকা পাঠাচ্ছে কে আমাকে প্রতিমাসে?।
ডি. কস্টা বলল, আপনারা এখন কি চান? কি করিটে বলেন হামাকে?
টাকাটা আসছে চট্টগ্রামের এক উকিলের মাধ্যমে। আমরা জানতে চাই খালা-আম্মার হদিশ। তার ঠিকানাটা যোগাড় করে দিন। কোথায় তিনি আছেন, কিভাবে আছেন খোঁজ নিয়ে জানান।
বিশ হাজার ডিটে হইবে, নির্বিকারভাবে বলল ডি. কস্টা।
আপনার ফি? বিশ হাজার টাকা?
ডি কস্টা আবদুস শুকুরের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল, ইয়েস। টোয়েনটি ঠাউজেণ্ড টাকা। এবং আপনার খালুর নাম ঠিকানাও চাই।
কিন্তু আমরা চাই না খালুর পরিচয় প্রকাশ করতে।
ডি. কস্টা বলল, ঠিক হ্যায়। আপনার খালুর নাম-ঠিকানা হামি যোগাড় করিয়া নিব উকিল সাহেবের নিকট হইটে। টাকার কঠা বলুন।
কিছু কম করুন না…।
নো…।
শেফালী বলল, পনেরো হাজারে রাজি হয়ে যান। কাজটা তো তেমন কোন কঠিন নয়।
কঠিন টো হবেই। কঠিন না হইলে কি কেউ মি. স্যানন ডি. কস্টার হেলপ নিটে ছুটিয়া আসে? টবে আপনি মিষ্টি কণ্ঠস্বরের অঢ়িকারী, পাঁচ হাজার কম ডিটে চাইটেছেন-ডিন। কিন্টু পাঁচ হাজার টাকা এখুনি অ্যাডভান্স ডিটে হইবে।
চেক বই আমরা সাথে করেই এনেছি। ওগো, পাঁচ হাজার টাকার একটা চেক লিখে দাও মি. স্যানন ডি. কস্টাকে। ভালকথা, কতদিনের মধ্যে আমাদেরকে জানাতে পারবেন?
বেশি সময় লাগিবে না। চট্টগ্রামে যাইটে হইটে পারে হামাকে। বড় জোর ডশ ডিন লাগিবে। এর মধ্যেই হাপনারা হাপনাডের খালা-আম্মার খোঁজ খবর জানিটে পারিবেন।
ধন্যবাদ।
আরও খানিকক্ষণ আলোচনা করে ওরা বিদায় নিল। অফিসের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সদ্য প্রাপ্ত পাঁচ হাজার টাকার চেকটা হাতে নিয়ে নাচতে লাগল ডি কস্টা। সেই সাথে মহা আনন্দে গাইতে শুরু করল।
মানি ইজ এ ফানি থিং
আই অ্যাম এ লাকি কিং
ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং ড্যাং
.
০৩.
বাড়ি ফিরে ছটফট করতে লাগলেন আতিকুর রহমান। কেপ ট্রায়াংগুলার! মাই গড!
কেপ ট্রায়াংগুলার! একজন কালেক্টরের শত জনমের আকাঙ্ক্ষা ওই কেপ ট্রায়াংগুলারের অধিকারী হওয়া। সাত রাজার ধনের চেয়ে বেশি মূল্য ওটার। ওটার অধিকারী হওয়া তো দূরের কথা, চোখের দেখা দেখতে হলেও যেকোন কালেক্টর নিজেকে ধন্য মনে করবে?
পঁয়ষট্টি লাখ কম করেও, তার চেয়েও অনেক বেশি টাকা দাম হতে পারে ওটার। কিন্তু টাকার অঙ্কটা এখানে বড় কথা নয়। টাকা ভঁর নিজের কম নেই। প্রচুর রোজগার করেছেন তিনি, এখনও করছেন, আরও করবেন। কিন্তু টাকা দিয়ে সবাই কেপ ট্রায়াংগুলার পায় না। কেপ ট্রায়াংগুলারের মূল্য টাকা দিয়ে নিরূপণ করা সম্ভব নয়।
স্ত্রীর সাথে রূঢ় ব্যবহার করলেন ডিনারে বসে রীতিমত কর্কশ কণ্ঠে বললেন, নিজের চরকায় তেল দাও। আমি খাচ্ছি কি খাচ্ছি না সে ব্যাপারে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
স্বামীর রগচটা স্বভাবের সাথে নববিবাহিতা স্ত্রীর পরিচয় আছে। কিন্তু এমন অকারণে ধমক খায়নি সে এর আগে। কিছু যে একটা ঘটেছে, বুঝতে পারল সে। কিন্তু স্বামীর মেজাজের বহর দেখে প্রশ্ন করতে সাহস পেল না।
নিচে নেমে এলেন আতিকুর রহমান। প্রায় কিছুই খেতে পারেননি। নিচে নেমেই মুখোমুখি হলেন করিডরে টোটার সাথে।
এখনও ঘুরঘুর করছিস তুই? যা, শুয়ে পড়। তোকে আর দরকার হবে না আমার।
জ্বী, হুজুর।
জী হুজুর না, যা বলছি কর।
টোটা বিড় বিড় করতে করতে চলে গেল।
ড্রয়িংরূমে ঢুকলেন আতিকুর রহমান। পায়চারি করতে লাগলেন। চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে কেপ ট্রায়াংশুলারের ছবিটা। আসল তো? নাকি নকল? না-না? নকল হতে পারে না! নকল একটা কেপ ট্রায়াংগুলার তো তার কাছেই আছে। তার কাছে যেটা আছে সেটার সাথে কোথায় যেন অমিল আছে ইব্রাহিম সাহেবের কেপ ট্রায়াংগুলারের।
ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। কে খুন করেছে তাকে? কেন? ধুত্তরী ছাই! এসব কথা ভেবে কি লাভ? কে খুন হয়েছেন, কেন হয়েছেন–এসব শ। কি নিয়ে মাথা ঘামারার দরকার কি? কেপ ট্রায়াংগুলার–একমাত্র কেপ ট্রায়াংগুলারের কথা। ভাববেন তিনি। ওটা চান তিনি, ওটা তাঁকে পেতেই হবে।
পায়চারি থামালেন আতিকুর রহমান। পেতে হবে, না? হ্যাঁ, অবশ্যই। জীবনে এ সুযোগ আর কখনও আসবে না। সৃষ্টিকর্তা তাকে একটা সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছেন, তিনি ভাগ্যবান। এ সুযোগ হারানো চলে না।
কিন্তু কিভাবে? কিভাবে কারও মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না করে জিনিসটা পাওয়া যায়? কিভাবে? কিভাবে? কিভাবে?
চুরি করলে ধরা পড়তেই হবে। নিজের মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করল তার। নিজের সর্বনাশ তিনি নিজেই করে ফেলেছেন। কেন বললেন ওদেরকে কেপ ট্রায়াংগুলারের কথাটা? কেন! কেন!
ওরা কেউ জানত না। জিনিসটা যে মহামূল্যবান তা তিনিই ওদেরকে জানিয়েছেন। না জানালে কোন সমস্যাই দেখা দিত না। চুপিসারে পকেটে ভরে নিয়ে চলে এলেই হত।
কিন্তু সে উপায় এখন আর নেই। সবাই জানে ওটা কেপ ট্রায়াংগুলার। সবাই জানে, তিনিই বলেছেন, ওটার দাম পঁয়ষট্টি লক্ষ টাকা।
অস্থির পায়চারি শুরু হলো আবার।
রাত বাড়ছে। ঘুম নেই চোখে। অ্যাশট্রেতে আর সিগারেটের অবশিষ্টাংশ রাখার জায়গা নেই, ভরে গেছে সেটা। সারারাত কেটে গেল, পায়চারি করছেন তো করছেনই। ভোরবেলা স্থির হলেন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। চুরিই করবেন তিনি কেপ ট্রায়াংগুলারটা। তবে কৌশলে। তার কাছে যে নকল স্ট্যাম্পটা আছে সেটা আজ সন্ধ্যায় ইব্রাহিম। খলিলের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। ইব্রাহিম খলিলের অ্যালবাম থেকে আসল কেপ ট্রায়াংগুলারটা চুরি করে পকেটে রাখবেন, তাঁর নকলটা রেখে আসবেন অ্যালবামে। কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। কেউ পার্থক্যটা টের পারে না। দুটো প্রায় হুবহু একই রকম দেখতে। তিনি একা শুধু জানবেন, আর কারও চোখে ধরা পড়বে না।
হালকা হয়ে গেল মনটা। ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
.
বেলা বারোটায় ঘুম থেকে জাগলেন আতিকুর রহমান। স্নানাহার সেরে বাইরে বেরুলেন। ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কর্তব্য সারলেন ঘুরে ঘুরে বিকেল চারটে পর্যন্ত। এক হোটেলে দেখা করলেন একজন কাহিনীকারের সাথে। তার কাহিনী শুনলেন। পছন্দ হলো কাহিনীর সিনপসিস। চিত্রনাট্য রচনা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। কথা দিলেন, আগামী ছবির কাহিনী হিসেবে এটাকেই গ্রহণ করবেন।
বাড়ি ফিরলেন তিনি বিকেল পাঁচটায়। ড্রয়িংরূমে বসে তিনি জর্জরিত হতে লাগলেন বিবেকের কষাঘাতে। কাজটা কি উচিত হবে? দুপুর থেকে প্রতিটি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই প্রশ্নটা নিজেকে করেছেন তিনি। কাজটা কি উচিত হবে? কেপ ট্রায়াংগুলার চুরি করা কি উচিত হবে?
উচিত হবে না কেন? কেপ ট্রায়াংগুলারটা যার ছিল তিনি বেঁচে নেই। একজন মৃত মানুষের জিনিস চুরি করাটা তেমন অন্যায় কিছু নয়। কি! অন্যায় নয়? নিশ্চয়ই অন্যায়? ঠিক আছে, ঠিক আছে। মানছি অন্যায়। কিন্তু এ অন্যায় না করে উপায়। নেই তার। তিনি একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর। কেপ ট্রায়াংগুনার একজন স্ট্যাম্প কালেক্টরের কাছে নিজের জীবনের চেয়েও দায়ী। জিনিসটা কোথায় আছে তিনি, জানেন, জানেন কত সহজে ওটা চুরি করা যায়, জানেন চুরি করলেও ধরা পড়বার এতটুকু আশঙ্কা নেই–এরকম পরিস্থিতিতে চুরি না করে পারা যায়? এরকম পরিস্থিতিতে সাধু হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব?
না।
চুরি তিনি করবেনই। স্ট্যাম্প আরও আছে দামী দামী..না থাক। অত সাহস নেই, একটাই যথেষ্ট। এখন একটাই প্রশ্ন জিনিসটা আসল: কেপ ট্রায়াংগুলার তো? এটাই চিন্তার বিষয়।
সময় হয়ে গেল। ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টরটা নিয়ে বেরুলেন তিনি। গাড়ি চালিয়ে পৌঁছুলেন ইব্রাহিম সাহেবের বাড়িতে। প্রহরী কনস্টেবলটি গেটেই ছিল। বলল, আপনার কথা এইমাত্র জিজ্ঞেস করছিলেন মি. সিম্পসন, স্যার।
তাই নাকি! কখন এসেছেন তিনি?
এই তো, মিনিট দশেক আগে, স্যার।
শহীদের কথা জানতে চাইলেন তিনি।
কনস্টেবল বলল, না, তিনি আসেননি। সকালে অবশ্য এসেছিলেন একবার।
হলরূমেই দেখা হলো মি. সিম্পসনের সাথে। বসে আছেন তিনি সোফায়, অপরূপ সুন্দরী এক যুবতীর মুখোমুখি। যুবতীর চোখ দুটো ভেজা ভেজা, ঘন ঘন রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছছে। মি. সিম্পসন তাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা। করছিলেন। বললেন, আসুন, মি. রহমান। মিসেস রুবিনা, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। মি, আতিকুর রহমানের কথাই এতক্ষণ বলছিলাম আপনাকে। নিশ্চয়ই ওঁর নাম শুনেছেন?
মিসেস রুবিনা কপালের কাছে হাত তুলে বলল, আদাব।
মি. সিম্পসন বললেন, বসুন, মি. রহমান।
রুবিনা বলল, আপনার সব ছবিই দেখেছি আমি, মি. রহমান। কিন্তু বাবার মুখে কোন দিন আপনার নাম কিন্তু, শুনিনি। বাবা ঢাকার প্রায় সব স্ট্যাম্প কালেক্টরকে চিনতেন…।
আতিকুর রহমান বসলেন মি. সিম্পসনের পাশে। বললেন, তোমাকে তুমি বলছি বলে কিছু মনে কোরো না, মা। আমার মেয়ে থাকলে তোমার বয়সীই হত। তোমার বাবা জানতেন না আমি একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর। তার কারণ কি জানো? দোষটা তোমার বাবার ছিল না। আমিই দোষী। আমি যে একজন কালেক্টর তা ইচ্ছে করেই গোপন রাখার চেষ্টা করেছি সবসময়। তুমি আমাকে কাকা বলবে, কেমন?
রুবিনা বলল, বাবা আর সকলের খোঁজ খবর রাখতেন বটে কিন্তু নিজেও যে একজন কালেক্টর তা সহজে কাউকে জানাতেন না।
আতিকুর রহমান বললেন, মি. সিম্পসন, আপনাদের কাজ কতটুকু এগোল?
আমি এখনই কোন মন্তব্য করছি না। তবে, এটা ঠিক, হত্যাকারী রেহাই পাবে না। তাকে ধরাটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আপনার রিপোর্টের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে, মি. রহমান। হত্যার মোটিভটা কি এখনও আমরা জানতে পারছি না।
রুবিনা বলল, স্ট্যাম্প চুরি হয়েছে বলে মনে করি না আমি। স্ট্যাম্প চুরি করার জন্যেই যদি কেউ হত্যা করে থাকে বাবাকে, কেপ ট্রায়াংশুলারটা কেন সে চুরি করল না?
বুকের ভিতর রক্ত ছলকে উঠল আতিকুর রহমানের।
রুবিনা জানতে চাইল, কাকা, সত্যিই কি কেপ ট্রায়াংগুলারটার দাম পঁয়ষট্টি লাখ টাকা?
যদি ওটা নকল না হয়।
নকল কি না বোঝার উপায় কি?
এই যাহ! ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টরটা সাথে করে নিয়ে আসতে ভুলে গেছি।
রুবিনা বলল, ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করলে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে ওটা আসল কিনা?
তা জানা যাবে।
রুবিনা চোখ মুছল, নিচু স্বরে বলল, হত্যাকারী কেন ওটা চুরি করেনি? স্ট্যাম্পটা অতি বিখ্যাত, বিক্রি করতে গেলে ধরা পড়ে যেতে হবে বলে? উঁহু, এ আমার বিশ্বাস হয় না। যে চুরি করবে সে অত কথা ভাবে না। বিশেষ করে চুরি করার জন্যে যে খুন করতেও পিছপা হয়নি-কেপ ট্রায়াংগুলার কেন, গোটা দুনিয়াটা বিক্রি করার মত দুঃসাহস তার থাকার কথা। আমার ধারণা, স্ট্যাম্প চুরিটা বাবাকে খুন করার একটা মোটিভ হতে পারে না।
মি. সিম্পসন বললেন, আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, খুনী কেপ ট্রায়াংগুলারের কথা জানত না। কেপ ট্রায়াংগুলার সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। এমনও তো হতে পারে কেউ খুনীকে ভাড়া করেছিল নির্দিষ্ট কয়েকটা স্ট্যাম্প চুরি করার জন্যে,সে হয়তো এমন একজন লোক,যে জানত না কেপ ট্রায়াংগুলার আপনার বাবার কাছে আছে।
রুবিনা বলল, হতে পারে। কিন্তু ভাড়াটে খুনী পাঠিয়ে কেউ বাবাকে খুন করিয়েছে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।
মি. সিম্পসন বললেন, হয়তো কোন কালেক্টর আপনার বাবার কিছু স্ট্যাম্প দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। চাইলে পাওয়া যাবে না, কিনতে চাইলে কেনা যাবে না, তাই সে হয়তো ভাড়াটে খুনীকে নিয়োগ করে।
আতিকুর রহমান রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বরং আমার কাজ শুরু করে দিই, কি বলেন মি: সিম্পসন?
অবশ্যই। সোজা গিয়ে ঢুকুন পাশের রূমে-কেউ বিরক্ত করবে না, আপনাকে।
আতিকুর রহমান উঠতে উঠতে বললেন, তোমার সাথে পরে আলাপ করব, রুবিনা! তোমার বাবার অ্যালবামগুলো চেক করে মি. সিম্পসনকে রিপোর্টটা দিই আগে।
রুবিনা বলল, বাবার হত্যাকারীকে ধরার জন্যে আপনি যে সহযোগিতা করছেন–চিরকাল আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনার প্রতি, কাকা।
আতিকুর রহমান বললেন, এটা তো মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য, মা।
রুমাল দিয়ে চোখ মুছল রুবিনা। আতিকুর রহমান আর দাঁড়ালেন না। পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলেন।
পিছন পিছন এলেন মি. সিম্পসন। চাবিটা নিন। স্টীল আলমারির ভিতর আছে অ্যালবামগুলো।
চাবি নিয়ে আলমারি খুললেন আতিকুর রহমান। টেবিলের উপর নামালেন। অ্যালবামগুলো।
মি. সিম্পসন বিনাবাক্যব্যয়ে রূম ত্যাগ করলেন, যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে। দিয়ে গেলেন তিনি।
চেয়ার এগিয়ে নিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে বসলেন আতিকুর রহমান। গতকাল যেখানে শেষ করেছিলেন, তারপর থেকে শুরু করলেন চেকিং। কয়েক মিনিটের মধ্যে কেপ অড গুড হোপ-এর সবগুলো স্ট্যাম্প দেখা শেষ করলেন। শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন দরজার দিকে।
দরজাটা আগের মতই ভেড়ানো রয়েছে। ওয়াটারমার্ক ডিটেক্টরটা বের করলেন তিনি কোটের পকেট থেকে। এই সুযোগ! সুযোগটা হারানো উচিত হবে না। কখন কে ঢুকে পড়ে তার ঠিক নেই। আপাতত কেউ ঢুকবে বলে মনে হয় না।
ডিটেক্টরটা বের করার সময় হাতটা কাঁপছে, লক্ষ করলেন তিনি। জিনিসটা। গভীর তলদেশ বিশিষ্ট হোট একটা ট্রের মত। চার বাই ছয় ইঞ্চি। বের করেও সাথে সাথে কাজ শুরু করলেন না। দুই উরুর মাঝখানে লুকিয়ে রাখলেন যন্ত্রটা। ঠিক তখুনি দরজাটা মৃদু শব্দে খুলে গেল।
লাফ দিয়ে উঠল বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা।
স্যার, বেগম সাহেবা জানতে চাইলেন চা, না কফি খাবেন?
ঘাড় ফিরিয়ে মধ্য বয়স্ক চারটার দিকে চেয়ে রইলেন আতিকুর রহমান। বেশ কয়েক সেকেণ্ড পর কথা বলার শক্তি ফিরে পেলেন তিনি।
কিছু না, এক গ্লাস পানি নিয়ে এস শুধু।
আনছি, স্যার।
দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল লোকটা।
মাথা নিচু করে অ্যালবামটা দেখতে লাগলেন তিনি। কাজ করছেন না, ভান করছেন কাজের। খানিকপর আবার উন্মুক্ত হলো দরজার কবাট দুটো। এক গ্লাস পানি রাখল লোকটা টেবিলের উপর। ফিরে গেল। দরজাটা ভিড়িয়ে দিতে ভুল করল না এবারও।
গ্লাসে দুটো আঙুল ডুবিয়ে দিলেন আতিকুর রহমান। অপর হাত দিয়ে ডিটেক্টরটাকে টেবিলের উপর তুললেন। যন্ত্রটার নিচের দিকটা ভিজিয়ে নিলেন পানি দিয়ে।
চিমটা দিয়ে গাম লাগানো কাগজ থেকে অতি সাবধানে তুলে নিলেন– অ্যালবামের কেপ ট্রায়াংগুলার। যন্ত্রটার ভেজা তলদেশে সাটলেন আলতোভাবে সেটা।
হাত দুটো কাঁপছে! ঘন ঘন তাকাচ্ছেন দরজার দিকে। কী-হোল দিয়ে মি. সিম্পসন তাকে লক্ষ করছেন না তো?
অপেক্ষার পালা। ধীরে ধীরে দাগ ফুটছে। কালো, প্রায় দৃষ্টি চলে না কাঁচের ভিতর। এক সময় প্রায় পরিষ্কার হয়ে উঠল দাগগুলো। ব্রিটিশ রয়াল ক্রাউন, সাথে ইনিশিয়াল v. R–পরিষ্কার, অতি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল।
হাপাচ্ছেন আতিকুর রহমান। কেন যেন বিকট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো তার। ঘেমে যাচ্ছেন হু হু করে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তার এই অবস্থা কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। আসল কেপ ট্রায়াংগুলার! এটা আসল কেপ ট্রায়াংশুলার! সারা দুনিয়ায় মাত্র তিনটে আছে, এটি সেই তিনটের মধ্যে একটি।..
কেপ ট্রায়াংগুলারের অর্থনৈতিক মূল্যটাকে বড় করে দেখছিলেন না তিনি। একজন কালেক্টরের দৃষ্টিকোণ থেকে স্ট্যাম্পটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তিনি। সব কিছুর বিনিময়ে, বিবেকের দংশন অগ্রাহ্য করে, বিপদে পড়ার ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি সর্বান্তকরণে চাইছেন স্ট্যাম্পটাকে চুরি করে নিজের অধিকারে রাখতে। জীবনে এটা কাউকে তিনি দেখাবেন না। কাউকে এর অস্তিত্বের কথা জানতে দেবেন না। এটাকে নিয়ে গর্ববোধ করবেন তিনি আপনমনে, লুকিয়ে লুকিয়ে একা একাই দেখবেন এবং আনন্দে, তৃপ্তিতে ভরে থাকবে তার বুক।
এরপর দ্রুত বাকি কাজগুলো সেরে ফেললেন আতিকুর রহমান। পকেট থেকে বের করলেন নিজের নকল কেপ ট্রায়াংগুলারটা। অ্যালবামে, সেটা যথাযথ পদ্ধতিতে সঁটলেন। আসলটী ভরে রাখলেন অতি যত্নের সাথে কোটের বুক পকেটে।
খানিকপর যখন শহীদ রূমের দরজায় টোকা দিল, আতিকুর রহমান তখন অ্যালবাম চেকিংয়ের কাজে মগ্ন হয়ে পড়েছেন নতুন করে। শহীদকে দেখে হাসলেন তিনি। বললেন, কেমন আছেন, মি. শহীদ?
শহীদ বলল, ভাল। আপনার কাজ কতদূর এগোল?
আজ রাতের মধ্যেই রিপোর্ট দিতে পারব। কিন্তু, মি. শহীদ, রুবিনা বলছিল। তার ধারণা স্ট্যাম্প চুরিটা তার বাবাকে হত্যা করার মোটিভ হতে পারে না।
শহীদ কাল, ধারণাটা মিথ্যে নাও হতে পারে। তবু, আপনার রিপোর্টটা না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বোঝা যাবে না।
আতিকুর রহমান জানতে চাইলেন, কেসটার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আপনি নিয়েছেন। নতুন কিছু জানতে পেরেছেন ইতিমধ্যে?
শহীদ একটু চিন্তিতভাবে বলল, অদ্ভুত একটা তথ্য পেয়েছি। যদিও তথ্যের স্বপক্ষে এখনও কোন প্রমাণ পাইনি।
সে কি রকম?
শহীদ বলল, ইব্রাহিম সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, বছর পঁচিশেক আগে। একটি পুত্র সন্তানও হয়েছিল। তখন তার প্রথম স্ত্রী জীবিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন ইব্রহিম সাহেব গোপনে। তার প্রথম স্ত্রী, অর্থাৎ মিসেস রুবিনার আম্মা, ব্যাপারটা জানতে পেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। ইব্রাহিম সাহেব সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রথম স্ত্রীকে কথা দেন, তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং পুত্রের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না। তিনি নাকি তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে তিনি ডাইভোর্স করেন। তারপর থেকে তার এবং সেই পুত্র-সন্তানের কোন খোঁজ খবর তিনি রাখেননি। কোথায় তারা আছে, কিভাবে আছে, নাকি মরে গেছে–কিছুই তিনি জানতেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ইব্রাহিম সাহেবের আত্মীয়-স্বজন, এমনকি তার একমাত্র মেয়ে মিসেস রুবিনাও তার এই দ্বিতীয় বিয়ের কথা আজ পর্যন্ত জানে না।
ইন্টারেস্টিং অফকোর্স! সেই পুত্র সন্তান বেঁচে থাকলে তার বয়স এখন বাইশ-তেইশ তো হবেই, কি বলেন?
চিন্তিতভাবে শহীদ বলল, তা হবে। কিন্তু কোথায় সে? কোথায় তার আম্মা? কেউ বলতে পারছে না…আপনি কাজ করুন, মি. রহমান। আমি মিসেস রুবিনার, সাথে কথা বলে আসি।
চলে গেল শহীদ। আতিকুর রহমান মগ্ন হয়ে পড়লেন নিজের কাজে।
প্রত্যেক কালেক্টরের অ্যালবামের শেষ দেশ হচ্ছে জাঞ্জিবার। রাত সাড়ে এগারোটার সময় জাঞ্জিবারের সর্বশেষ স্ট্যাম্পটি পরীক্ষা করে দায়িত্ব সারলেন আতিকুর রহমান।
মি সিম্পসন এবং শহীদ অপেক্ষা করছিল হলরুমে। টেবিল ছেড়ে উঠে হলরূমে ঢুকলেন আতিকুর রহমান।
খুব খেটেছেন। আপনার সাহায্য চেয়ে বিপদেই ফেলেছি দেখছি, বললেন মি. সিম্পসন।
হাসলেন আতিকুর রহমান। মুখ ভরা তৃপ্তির হাসি। বললেন, ও কথা বলবেন না। আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। আনন্দের কারণ কি জানেন? ইব্রাহিম সাহেবের কালেকশনে কারও হাত পড়েনি। কালেক্টর হিসেবে এটা একটা আনন্দের ব্যাপার আমার কাছে।
জানতে চাইল শহীদ, আপনি বলতে চাইছেন অ্যালবামগুলো থেকে কোন স্ট্যাম্প চুরি যায়নি?
হ্যাএকটা স্ট্যাম্পও চুরি যায়নি। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
মি. সিম্পসন বললেন, হু। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, খুনী হয়তো স্ট্যাম্প চুরি করতেই এসেছিল কিন্তু ইব্রাহিম সাহেবের চোখে ধরা পড়ে যায় সে-ফলে খুন করতে বাধ্য হয় তাকে এবং খুন করে ফেলে ভয় পেয়ে যায়, চুরি না করেই কেটে পড়ে
শহীদ একটু বিরক্তির সাথেই বলল, এসব ব্যাপার নিয়ে মি. রহমানকে বিব্রত করার কোন মানে হয় না, মি. সিম্পসন।
আতিকুর রহমান বললেন, আমার রিপোর্টে কোন ভুল নেই। আচ্ছা, এবার আমাকে যেতে হয়।
অবশ্যই। আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ভালকথা, মি. রহমান, দরকার হলে আবার কিন্তু যোগাযোগ করব আপনার সাথে আমরা। আশা করি…।
আতিকুর রহমান বললেন, অবশ্যই। আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি সব সময় তৈরি আছি। আচ্ছা, চলি, মি. সিম্পসন। মি. শহীদ, বিদায়।
মি. সিম্পসন বললেন, আবার দেখা হবে।
পা বাড়াতে গিয়েও থমকে গেলেন আতিকুর রহমান। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে বিনাবাক্যব্যয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। বুকটা কেমন যেন দুরু দুরু করছে। মি. সিম্পসনের শেষ কথাটা যেন কেমন! তিনি কি কিছু সন্দেহ করেছেন?
চিন্তিতভাবে গাড়িতে এসে উঠলেন আতিকুর রহমান। ব্যাপারটা কি? মি. সিম্পসন তাঁর সম্পর্কে কি ভাবছেন? ইরাহিম খলিলের হত্যাকাণ্ডের সাথে তিনি জড়িত, এই রকম অমূলক সন্দেহে ভুগছেন নাকি আবার ভদ্রলোক?
হাসি পেল আতিকুর রহমানের। না, না, তেমন কিছু ভাববেন কেন? হাসিটা উবে গেল হঠাৎ। কেপ ট্রায়াংগুলার চুরি করেছেন তিনি মি. সিম্পসন কী-হোলে চোখ রেখে ব্যাপারটা দেখে ফেলেননি তো?
না। তা সম্ভব নয়। অতটা ঘটতে পারে না। দেখে থাকলে মি. সিম্পসনের মত জাদরেল পুলিশ অফিসার তাঁকে কেপ ট্রায়াংগুলার নিয়ে বাইরে বেরুবার সুযোগ দিতেন না। ..
বাড়ি ফিরলেন আতিকুর রহমান। গেটটা খোলাই দেখলেন। গ্যারেজে গাড়ি রেখে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন তিনি দরজা খুলে। আশপাশে কোথাও দেখলেন না টোটাকে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের ঘরে। ভালই হয়েছে, ভাবলেন তিনি।
তালা খুললেন পাশের রুমের। ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন দরজা। গোছা থেকে চাবি বের করে কমবিনেশন মিলিয়ে ওয়াল-সেফের তালা খুললেন।
পকেট থেকে বের করলেন পয়ষট্টি লক্ষ টাকার কেপ ট্রায়াংগুলার। মুগ্ধ, সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি স্ট্যাম্পটার দিকে। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে। শুকিয়ে যাচ্ছে গলা। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। কেপ ট্রায়াংগুলার। আসল কেপ ট্রায়াংগুলার! এ মহার্ঘ্য বস্তু এখন তার নিজের। এর একমাত্র মালিক তিনি। তিনি কত বড় ভাগ্যবান! বিশ্বের সব কালেক্টরের হিংসার পাত্র তিনি। কী। আনন্দ! সাত রাজার ধন তার হাতে এসেছে। কেউ জানে না, কেউ কোন দিন জানবে না–কিন্তু তিনি জানেন, একা তিনি কেবল জানেন!
আনন্দে, গর্বে ছটফট করছে দেহের প্রতিটি অণু পরমাণু। এত আনন্দ ধরে রাখার যেন জায়গা নেই তার শরীরে। চোখ ভরে উঠল পানিতে। আনন্দাশ্রু। চরমানন্দে কাঁদছেন তিনি।
জীবনে তিনি কখনও চুরি করেননি। সে মানসিকতা তার কোনকালেই ছিল না। আজ চুরি করেছেন চুরি করেছেন বটে কিন্তু তার জন্যে মনে কোন অপরাধ বোধ নেই, তিনি লজ্জিত নন।
রুমাল বের করে চোখ মুছলেন তিনি। পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিলেন কেপ ট্রায়াংগুলারের পিছনটা, তারপর অ্যালবামের উপর সঁটা, ভাজ করা গাম লাগানো কাগজে বসালেন নিখুঁতভাবে কেপ ট্রায়াংগুলারকে, চাপ দিলেন হাত দিয়ে।
ও কিসের শব্দ? ঝট করে দরজার দিকে তাকালেন তিনি। ড্রয়িংরূমে আলো জ্বালিয়ে রেখে এসেছেন তিনি কিন্তু একি! কী-হোল দিয়ে ড্রয়িংরূমের আলো দেখতে পাবার কথা। দেখা যাচ্ছে না কেন?
পরমুহূর্তে কী-হোল দিয়ে দেখা গেল আলো। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন আতিকুর রহমান। কী-হোলে এতক্ষণ চোখ রেখে কেউ নজর রাখছিল তার উপর। সব দেখেছে সে।
কে! কে দেখছিল?
তাকে অনুসরণ করে মি. সিম্পসন এসেছেন নাকি? ঘঁৎ করে উঠল বুকটা মি. সিম্পসনের কথা মনে পড়তেই। অ্যালবামটা বন্ধ করলেন তিনি কাঁপা হাতে। ওয়াল-সেফে তুলে রাখলেন সেটা। এগোলেন তারপর দরজার দিকে।
হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। একটা অপরাধ করেছেন তিনি। ধরা পড়ে গেছেন। বেশ সুচারুভাবেই সেরেছিলেন কাজটা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। একটা ভুল তিনি শেষ পর্যন্ত করে ফেলেছেন। দেখে ফেলেছেন মি. সিম্পসন কী হোল দিয়ে, কেপ ট্রায়াংগুলারটা রেখেছেন তিনি অ্যালবামে।
ড্রয়িংরূমে অপেক্ষা করছেন মি. সিম্পসন তাঁর জন্যে।
তালা খুলতে হাত ওঠে না। দরজা খুললেই তো দেখবেন উদ্যত রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মি. সিম্পসন।
দরজা না খুললে কেমন হয়?
লাভ নেই জানেন তিনি। মি. সিম্পসন বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবেন না। করাঘাত করবেন তিনি, শেষ পর্যন্ত না খুললে দরজা ভাঙবেন।
তালা খুললেন আতিকুর রহমান। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা ঘাম পড়ল জুতোর উপর। দরজার কবাট দুটো উন্মুক্ত করলেন তিনি ধীরে ধীরে।
ফাঁকা ড্রয়িংরূম। মি. সিম্পসন নেই। একটা বিড়ালের ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে করিডরের দিকে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উঁকি মেরে তাকাতেই দেখলেন টোটাকে।
তুই? তুই এত রাতে জেগে আছিস? তুই..তুই-ই তাহলে!
কী-হোলে চোখ রেখে কে তার কার্যকলাপ লক্ষ করছিল বুঝতে পেরে মাথায় আগুন ধরে গেল আতিকুর রহমানের। খ্যাপা মোষের মত তেড়ে গেলেন তিনি। ঠাস্ করে একটা চড় মারলেন টোটার গালে।
টোটা তাল সামলাবার আগে বাঁ হাত দিয়ে আবার একটা চড় কষালেন তিনি। পড়ে গেল টোটা করিডরের মেঝেতে। মৃদু শব্দ করে কেঁদে ফেলল সে।
দাঁতে দাঁত চেপে গালাগালি দিতে লাগলেন আতিকুর রহমান, কুত্তার বাচ্চা। বেজন্মা শয়তান! দুধ খাইয়ে কালসাপ পুষছি! বেরিয়ে যা, শালা, বেরো বলছি…।
সবেগে লাথি মারলেন তিনি টোটার পেটে। গুঙিয়ে উঠল টোটা। ফিরেও তাকালেন না আতিকুর রহমান। ঝড়ের বেগে ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বন্ধ করলেন দরজা। সেই একই গতিতে করিডর ধরে এগোলেন।
টোটার মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। রাগে কাঁপছেন।-খোঁচা মারলেন জুতো পরা পা দিয়ে টোটার মুখে।
কাল সকালে তোকে যদি এ-বাড়িতে দেখি জ্যান্ত কবর দেব! জ্যান্ত পুঁতে ফেলব-মনে রাখিস!
হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ির দিকে এগোলেন তিনি। রাগের মাত্রাটা এতই বেশি হয়েছে যে সত্যি সত্যি টোটাকে জ্যান্ত করব দেয়া যায় কিনা ভাবতেও ইতস্তত বোধ করলেন না আতিকুর রহমান।
.
০৪.
কিন্তু পরদিন সকাল থেকে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে উঠলেন আতিকুর রহমান। তার নববিবাহিতা স্ত্রীর সাথে অস্বাভাবিক আন্তরিকতার সাথে গল্প করলেন। কথায় কথায়, ভাবাবেগের বশে, তিনি তার সাথে খারাপ, কর্কশ ব্যবহার করেছেন বলে হাত ধরে ক্ষমাও চাইলেন। বললেন, আজ থেকে আমি সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছি। জীবনে অনেক পেয়েছি, আর কোন দাবি নেই আমার। সৎ, সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকব, মানুষকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করব। তোমাকে সুখী করার জন্যে আমি সব পারি।
সারাটা দিন চরকির মত ঘুরে বেড়ালেন আতিকুর রহমান। তার একাধিক ব্যবসা। প্রতিটি অফিসেই তিনি গেলেন। অন্যান্য দিন তাকে দেখে কর্মচারীরা ভয়ে ঘেমে একাকার হয়ে যায়। আজ কিন্তু অন্য রকম ঘটল। আতিকুর রহমান সহাস্যে সকলের সাথে যেচে পড়ে কথা বললেন। প্রায় প্রত্যেকের কুশলাদি, বাড়ির খবরাখবর, সুবিধে-অসুবিধের কথা জিজ্ঞেস করলেন। সবাই যেমন আশ্চর্য হলো তেমনি খুশিও হলো।
বিকেলে বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা করতে বেরুলেন তিনি। নিমন্ত্রণ করলেন। পরদিন বাড়িতে সবাইকে, ডিনার খাওয়াবেন।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন মিসেসের জন্যে একসেট জড়োয়া গহনা কিনে। গ্যারেজে গাড়ি রেখে বেরুতেই দেখলেন টোটাকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। করিডরের সিঁড়ির শেষ ধাপে। গম্ভীর হলেন একটু আতিকুর রহমান। কিন্তু ধমকও মারলেন না, রাগও দেখালেন না। নিঃশব্দে উঠে গেলেন করিডরে ধাপ তিনটে টপকে।
পরদিন ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে ডজন দুয়েক বন্ধু-বান্ধব এলেন। হোটেল থেকে বয়-বেয়ারা এবং চাইনিজ ডিশ আমদানী করা হয়েছে। খোশ-গল্পে মেতে উঠলেন তিনি। ডিনারের পরও বৈঠক চলল। রাত বারোটার পর ছুটি দিলেন।
ফেরার পথে সবাই একবাক্যে মন্তব্য করল, আতিকুর রহমান হঠাৎ বদলে গেছেন।
কথাটা মিথ্যে নয়। খুব একটা মিশুক ছিলেন না তিনি কোন কালেই। তাছাড়া, কাজ ছাড়া কারও সাথে গল্প করে ফালতু সময় নষ্ট করেননি কখনও। এর আগে কাউকেই তিনি বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেননি।
বন্ধুবান্ধবরা খুশিই হলো।
তার পরদিন বিকেল। ছাদে স্ত্রী তাহমিনাকে নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন আতিকুর রহমান। হাসি-ঠাট্টা করছিলেন খুব। দুজন পায়চারি করছিলেন ছাদের এদিক থেকে সেদিক পর্যন্ত।
রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালে বাড়ির পিছনের দিকটা টুকু দেখা যায়, দেখা যায় বহুদূর অবধি। নিচে বাগান। বাগানের মাঝখানে তাদের সুইমিং পুল। একপাশে চাকর-বাকরদের টালির ছাত দেয়া ঘোট ঘোট সাত আটটা কুঁড়ে ঘর। তার পাশেই গোয়াল ঘর। গরু আর ছাগল আছে সব মিলিয়ে গোটা সাতেক। চাকর বাকররাই দেখা শোনা করে। দুধ বিক্রি করে কি পায় না পায় তা-ও তিনি খুঁটিয়ে জানতে চাননি কখনও। যা দেয় তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।
বাড়ির সীমানার বাইরে বড় বড় ঘাসের রাজ্য। ঝোঁপ-ঝাড়ও বিস্তর। বৃষ্টির মৌসুম নয় এটা, তাই সব শুকিয়ে গেছে। বাড়িটার সীমানা চিহ্নিত করা আছে। কাটাতারের বেড়া দিয়ে। ঝোঁপ-ঝাড় আর মানুষ সমান উঁচু শুকনো ঘাসে তা ঢাকা পড়ে গেছে, দেখাই যায় না। বাড়ির পিছন দিকে আর কোন বাড়ি ঘর নেই বহুদূর অবধি।
পায়চারি করতে করতে হঠাৎ আঁতকে উঠলেন আতিকুর রহমান।
তাহমিনা! সর্বনাশ হয়েছে।
কি গো? কি হলো! অমন আঁৎকে উঠলে কেন?
স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল তাহমিনা। বলতে হলো না, নিজেই দেখতে পেল সে।
আগুন! হায়, খোদা, আগুন ধরে গেছে ঘাসে!
আতিকুর রহমান বিপদের গুরুত্বটা সাথে সাথেই অনুধাবন করতে পেরেছেন।
এগিয়ে আসছে আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে লম্বা শুকনো ঘাস।
ফায়ার ব্রিগেড! এক্ষুণি খবর দিতে হবে।
ছুটলেন তিনি সিঁড়ির দিকে। মনে মনে, জানেন, ফায়ার ব্রিগেড আসার আগেই সর্বনাশ ঘটে যাবে। যেভাবে আগুন এগিয়ে আসছে তাতে দমকলবাহিনীর লোকজন পৌঁছুবার আগেই বাড়ির ভিতর নাক গলিয়ে দেবে অগ্নিশিখা।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে থমকালেন আতিকুর রহমান! ও কিসের শব্দ! ঢং ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-টং…
ফায়ার ব্রিগেড!
আশ্চর্য ব্যাপার তো, ওরা খবর পেল কিভাবে? কে খবর দিল এত তাড়াতাডি?
অত কথা ভাবার সময় নেই। যাক, বিপদটা হয়তো কেটে যাবে। ভাগ্যটা নিতান্ত ভালই বলতে হবে।
দোতলায় নেমে বারান্দা থেকে দেখলেন তিনি, বাড়ির গেট খুলে দিচ্ছে। টোটা। দমকলবাহিনীর দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। গেট খোলা হতেই তীর বেগে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতর। কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে ছুটল গাড়ি দুটো পিছন দিকে।
বারান্দা থেকে ছুটলেন তিনি সিঁড়ির দিকে।
বাড়ির পেছনে পৌঁছে তিনি দেখলেন, দমকলবাহিনীর লোকেরা বিপুল ব্যস্ততায় মেতে রয়েছে।
পানির ট্যাঙ্ক থেকে পাইপ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঝোঁপ-ঝাড়, উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে কাঁটা তারের বেড়ার দিকে। পাইপগুলো দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি দুটো, পানির ট্যাঙ্কসহ, ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। চাকর-বাকরদেরকে ধমক মারছে দমকলবাহিনীর কর্মীরা, কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না।
আগুন প্রায় পৌঁছে গেছে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে।
বিপদ কেটে যাবে। রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবলেন আতিকুর রহমান। দমকলবাহিনীর তৎপরতা দেখে এককথায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। কাছাকাছি গেলেন না, খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ওদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করা উচিত হবে না।
তীরবেগে ছুটে এল দমকলবাহিনীর এক শুকনোপাতলা অফিসার। ঘামে ভিজে গেছে তার ইউনিফর্ম। উত্তেজিত, অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।
হাঁপাতে হাঁপাতে আতিকুর রহমানের সামনে দাঁড়াল অফিসার।
হাপনিই এই বাড়ির মালিক? হাপনিই মি, আতিকুর রহমান?
আতিকুর রহমান বললেন, হ্যাঁ…আগুন কি নেভানো যাচ্ছে না?
না, যাইটেছে না! টবে, চিন্টা করিবেন না। ফায়ারকে কন্ট্রোল করার কায় হামাডের ভালই জানা আছে। বাট-প্রবলেম ডেকা ডিয়াছে, মি. রহমান। অনলি ইউ ক্যান সলভু ইট।
কি প্রবলেম?
আমাদের ট্যাঙ্কের ওয়াটার শেষ হইয়া যাইটেছে। বাট দিস মোমেন্টে গাড়ি লইয়া গিয়া ওয়াটার নিয়া আসা সম্ভব হইবে না–অনেক ডেরি হইয়া যাইবে। হাপনি যডি আপট্টি না করেন, হাপনার সুইমিং পুল হইটে ওয়াটার নিটে চাই।
সুইমিং পুল থেকে পানি নেবেন? চিন্তিত দেখা গেল আতিকুর রহমানকে। ভয়ানক এক সমস্যায় পড়ে গেছেন যেন তিনি।
সুইমিং পুলের পানির চাইটে আপনার বাড়িটা নিশ্চয়ই ইম্পরট্যান্ট? কাকে পছন্দ করেন? সুইমিং পুলের পানিকে, না আপনার বাড়িকে?
আসলে কি জানেন, সুইমিং পুলটা তৈরিই করেছি আমি, কোনদিন নামিনি ওতে আমি। আমার স্ত্রী সাঁতার কাটেন…।
সেটো ভাল কঠা। ভবিষ্যটেও সুইম করিবেন। ওয়াটার নিব, পরে সময় মট ওয়াটার ডিয়া ভরিয়াও ডিব-ডিসিশন নিন।
আতিকুর রহমান তবু ইতস্তত করতে থাকেন।
অফিসার ধমকে ওঠেন, কুইক!
পিছন থেকে তাহমিনা বলে ওঠে, কী আশ্চর্য! তুমি অমন ইতস্তত করছ কেন? বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পারছ না?
ঘাড় ফিরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন আতিকুর রহমান। মনস্থির করতে পারছেন না তিনি। কিছু যেন ভাবছেন। বেশ একটু আতঙ্কগ্রস্ত মনে হলো তাকে।
তাহমিনা অনুমতি দিল। অফিসারের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে, আমি বলছি, পানি নিন আপনারা।
আতিকুর রহমান বলে উঠলেন, কিন্তু…
ধমকে উঠল তাহমিনা স্বামীকে, কোন কিন্তু নয়। তোমার হয়েছে কি বলো তো?
অফিসার ছুটল তখুনি। এক মিনিট পর দেখা গেল কয়েকটা পাইপ নামিয়ে দিচ্ছে কর্মীরা সুইমিং পুলে।
মিনিট পঞ্চাশেক পর বিপদটা সম্পূর্ণ কেটে গেল। দমকলবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমে আগুন নিভিয়ে ফেলা হলো। কর্মীরা গাড়িতে উঠে বসল। অফিসারও উঠল। এগিয়ে যাচ্ছিলেন আতিকুর রহমান, অফিসার চিৎকার করে বলে উঠল, চিন্টা করিবেন না, মি. রহমান। ওয়াটার ডিয়া যাইব।
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল পরমুহূর্তে। কিছু বলার অবকাশ পেলেন না। তিনি দেখতে দেখতে গাড়ি দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল বাড়ির আড়ালে।
সুইমিং পুলের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন আতিকুর রহমান। দেখলেন, তলদেশ দেখা যাচ্ছে। পানি নেই।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কাজটা উচিত হলো না।
কি যে হলো তোমার বুঝতে পারছি না। পুলের পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছে–এত দুঃখ পাবার কি আছে!
কথা না বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন আতিকুর রহমান।
.
০৫.
পরদিনের ঘটনা। বেলা দুটো। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন আতিকুর রহমান। ড্রয়িংরুমের দরজায় দেখা গেল টোটাকে।
এক ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন, হুজুর।
নাম কি? নাম জিজ্ঞেস করে আয়।
টোটা বলল, নাম বললেন, সুধীন গুপ্ত।
সুধীন গুপ্ত?
পরিচিত নয় নামটা। তবু বললেন, নিয়ে আয় সাথে করে।
লম্বা, সুবেশী, তীক্ষ্ণ চেহারার এক ভদ্রলোককে নিয়ে এল টোটা ড্রয়িংরূমে।
চিনতে পারলেন না ভদ্রলোককে আতিকুর রহমান। এ চেহারা আগে কখনও দেখেননি। কিন্তু ভদ্রলোক হাসছেন তার দিকে চেয়ে অতি পরিচিতের মত।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন আতিকুর রহমান।
ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম সুধীন গুপ্ত।
ভাবটা ভদ্রলোকের এমন, যেন নাম বললেই তাকে চেনা যাবে।
চিনতে পারলাম না কিন্তু।
ভদ্রলোক বললেন, বলেন কি, মি. রহমান? নামটা শুনেও চিনতে পারলেন না?
ভদ্রলোক তখনও সুকৌতুকে হাসছেন। বললেন আবার, আমি দিল্লী থেকে এসেছি। গত বিশ বছর ধরে আপনার সাথে আমাদের সম্পর্ক।
মাই গড!
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন আতিকুর রহমান। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখটা তার। দিল্লীর প্রখ্যাত স্ট্যাম্প বিক্রেতা সুধীন গুপ্তকে তিনি চিনতে পারেননি এ বড় লজ্জার কথা। ভদ্রলোককে কখনও দেখেননি তিনি ঠিক, কিন্তু নামটার সাথে সত্যি বিশ বছর ধরে তিনি পরিচিত।
বসুন, বসুন, সুধীন বাবু, আপনিই তাহলে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি আমার প্রায় আট লাখ টাকা হজম করেছেন!
হাহ্ হাহ্ হাহ্ হাহ করে হেসে উঠলেন সুধীন বাবু। বললেন, ঠিকই বলেছেন। আট লাখ টাকার স্ট্যাম্প বিক্রি করেছি আমরা আপনার কাছে।
আতিকুর রহমান বললেন, আপনার সাথে দেখা হলো, সৌভাগ্য বটে! তা ঢাকায় হঠাৎ কি মনে করে?
কেনাকাটা করতে এসেছি।
বলেন কি! দিল্লী থেকে এসেছেন স্ট্যাম্প কিনতে–ঢাকায়?
সুধীন বাবু বললেন, বিশেষ একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় কেনার সুযোগটা পেয়েছি। জানি না যা কিনতে চাই তা কিনতে পারব কিনা। আসলে, ব্যাপার কি জানেন, নিজের জন্যে নয়, কিনতে এসেছি এক কোটিপতি কালেক্টরের পক্ষ থেকে।
মুখটা ধীরে ধীরে পাংশু বর্ণ ধারণ করছে আতিকুর রহমানের।
কি…নির্দিষ্ট কোন স্ট্যাম্প…?
সুধীন বাবু হেসে উঠলেন, আপনিও একজন কালেক্টর, তাই ভেবেছিলাম কেনার কাজটা না সেরে আপনাকেও বলব না কি কিনতে এসেছি। কিন্তু লুকোচুরি করা উচিত নয় আপনার সাথে–বলেই ফেলি। আমি বিশ্ববিখ্যাত কেপ ট্রায়াংগুলারটা কিনতে এসেছি। আশি লক্ষ টাকার প্রস্তাব দিয়েছেন এক ভদ্রলোক। এক লক্ষ টাকা আমি পাব। আরও কমে যদি কিনতে পারি তাহলে তো কথাই নেই। সত্তরে কিনতে পারলে দশ লাখ টাকাই পাব আমি।
মাথা ঘুরছে আতিকুর রহমানের। ভীষণ অসুস্থ বোধ করছেন তিনি হঠাৎ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মৃদু, খসখসে কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ওটা যে নকল নয় তা জানলেন কিভাবে?
বারে! আমরাই তো বিক্রি করেছিলাম কেপ ট্রায়াংগুলার মি. ইরাহিমের কাছে। সত্তর লাখ টাকা ধরা হয়েছিল দাম। নগদ দিয়েছিলেন তিনি মাত্র পঁচিশ লাখ। বাকি টাকার বদলে দিয়েছিলেন অনেক স্ট্যাম্প পয়তাল্লিশ লাখ টাকার দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্প। ওটা যে আসল কেপ ট্রায়াংগুলার তা আমরা জানব না তো জানবে কে? গত ত্রিশ বছর ধরে আমরা ব্যবসা করছি, আজ পর্যন্ত একটা নকল স্ট্যাম্প কারও কাছে বিক্রি করিনি। ফেরারীর কাছ থেকে কেপ ট্রায়াংগুলার কিনেছিলেন আমার বাবা, ১৯২২ সালে। নিলামটা হয়েছিল প্যারিসে। আমি তখন ছোট। আচ্ছা, মি. রহমান, একটা নকল কেপ ট্রায়াংগুলার আপনি বছর পাঁচেক আগে কিনেছিলেন, তাই না? খবরটা আমরা পাই আমাদের নিউইয়র্কের প্রতিনিধির কাছ থেকে। এখনও রেখেছেন সেটা? নাকি বিক্রি করে দিয়েছেন?
এত কথাও জানেন আপনি!
কথা বলছেন বটে আতিকুর রহমান, কিন্তু মনে মনে দ্রুত ভাবছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই লোক তার জন্যে মৃত্যুদৃত-সাক্ষাৎ যম। একে বাঁচতে দেয়া চলবে না। এ লোক বেঁচে থাকলে তিনি মরবেন।
খুন করবেন তিনি।
মি. ইব্রাহিমের কালেকশন দেখেছেন ইতিমধ্যে?
সুধীন বাবু বললেন, না। এখনও সৌভাগ্য হয়নি। মিসেস রুবিনা বললেন মি. সিম্পসনের সাথে যোগাযোগ করতে। যোগাযোগ হয়েছে ভদ্রলোকের সাথে কিন্তু তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন বলে আলোচনা হয়নি। আগামীকাল তার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
আতিকুর রহমান বললেন, তাহলে তো আজ আপনার হাতে প্রচুর সময় রয়েছে। রাতে ডিনারের নিমন্ত্রণ রইল। আসবেন। সেই সুযোগে আমার কালেকশনটাও দেখে নেবেন।
চমৎকার, চমৎকার! আপনার কালেকশন না দেখে দিল্লী ফিরে যাব সেটা ভাবতেও পারি না। অবশ্যই আসব।
কোন্ হোটেলে উঠেছেন?
ইন্টারকনে।
আতিকুর রহমান বললেন, ঠিক ছটায় গাড়ি নিয়ে যাব আমি, সাথে করে নিয়ে আসব আপনাকে।
ধন্যবাদ। এখনকার মত তাহলে উঠি, মি. রহমান?
আতিকুর রহমান বললেন, ছটার সময় তৈরি থাকবেন কিন্তু!
নির্ঘাৎ।
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন সুধীন বাবু।
মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন আতিকুর রহমান। খুন করতেই হবে, আর কোন উপায় নেই। প্রশ্ন হলো, কিভাবে?
ভাবছেন তিনি। খুন করে কি এই বিপদ থেকে উদ্ধার করা যায় না নিজেকে? চুরি করেছেন তিনি কেপ ট্রায়াংগুলার সেটা ভয়ের ব্যাপার নয়, ভয়ের ব্যাপার হলো, তিনি চুরি করেছেন এটা প্রকাশ হয়ে পড়লে পুলিশ ধরে নেবে তিনিই খুন করেছেন ইব্রাহিম খলিলকে, ওই স্ট্যাম্পের লোভে। পুলিশের জেরার উত্তরে কি বলবেন তিনি? কিভাবে প্রমাণ করবেন স্ট্যাম্পটা তিনি চুরি করেছেন ইব্রাহিম খলিল খুন হবার পর, আগে নয়?
ভেবে দেখলেন, না প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
খুনই করতে হবে সুধীন বাবুকে। ফিরে আসছে সেই প্রশ্ন, কিভাবে?
গাড়িতে তুলবেন তিনি সুধীন বাবুকে ছটার সময়। ঢাকার পথঘাট চেনা নেই তার। গাড়ি নিয়ে যাবেন তিনি রেলক্রসিংয়ের দিকে। ছটায় কমলাপুর স্টেশন থেকে একটা মেল ট্রেন ছাড়ে। বিদিশা রেলক্রসিং পেরোবে ট্রেন ছটা পাঁচ মিনিটে।
ইন্টারকন থেকে বিদিশা রেলক্রসিং পাঁচ মিনিটেরই পথ। সুন্দর পরিকল্পনা ভাবলেন তিনি। গাড়ির বাঁ দিকে বসবে সুধীন বাবু। বাঁ দিকের দরজাটা যাতে খুলতে না পারে বিপদ টের পেয়ে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। টাইমিংটা হতে হবে নিখুঁত। ট্রেন রেলক্রসিংয়ের সীমানায় পৌঁছুবে, তার গাড়িও রেলক্রসিংয়ের উপর উঠে যাবে,-এক মুহূর্তের এদিক ওদিক হলে চলবে না। শেষমুহূর্তে ডান দিকের দরজা খুলে লাফিয়ে পড়বেন তিনি। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হবে ট্রেনের সাথে গাড়ির।
সবাই বলবে এটা একটা দুর্ঘটনা। ব্রেক ফেল করেছিল তাই ঘটেছে।
কিন্তু টাইমিং যদি ঠিক না থাকে? যদি লেট হয় ট্রেন আসতে?
বিকল্প পথটাও বের করে ফেললেন তিনি। বিদিশা রেলক্রসিং-এর পরই রাস্তার দুধারে গভীর নিচু ধানীজমি। নাক ঘুরিয়ে দেবেন তিনি গাড়ির। লাফিয়ে পড়বেন নিজে। প্রায় খাড়া ঢালু মাটির উপর দিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে নিচে নেমে যাবে গাড়িটা, ধানী জমির কিনারায় কৃত্রিম খালে পড়ে ডুবে যাবে সাথে সাথে।
বিড়বিড় করে বললেন আপন মনে, নিখুঁত-কেউ ধরতে পারবে না ব্যাপারটা।
.
০৬.
সময়মত রওনা হয়ে গেলেন আতিকুর রহমান গাড়ি নিয়ে ইন্টারকনের উদ্দেশে। নির্জন এক রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করালেন তিনি। ঞ্চে বের করে চারদিকটা দেখে নিলেন। লোকজন, গাড়িঘোড়া যে নেই তা নয়। তবে সব বেশ দূরে দূরে। তাছাড়া তিনি যা করবেন তা কেউ দেখলেও কিছু আসে যায় না। লোকে ভাববে, মেরামত করছেন গাড়ির কোন ক্রটি।
কয়েকটা আঘাতেই উদ্দেশ্য পূরণ হলো। বাঁ দিকের দরজার হাতলটা এমনভাবে বেঁকে গেল যে সেটা শত চেষ্টাতেও ঘুরবে না। না বাইরে থেকে, না ভিতর থেকে।
ঠিক ছটার সময় গাড়ি থামালেন আবার তিনি, এবার ইন্টারকনের ভিতর। করিডরে এইমাত্র এসে পৌঁছুছেন সুধীন বাবু, গাড়িটাকে দেখে নেমে এলেন তিনি।
আতিকুর রহমান তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। বললেন, সুধীন বাবু, আপনাকে উঠতে হবে এদিকের দরজা দিয়ে। হুইলের নিচে দিয়ে গিয়ে বসতে হবে ওদিকের সীটে। একটা ট্রাক আর একটু হলে খুনই করে ফেলেছিল আমাকে। ভাগ্য ভাল যে গাড়ির গায়ে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। হাতলটা একেবারে চিড়ে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে।
সুধীন বাবু আফসোস করলেন, এমন দামী গাড়ি, খুঁত সৃষ্টি করে দিয়ে গেল!
কি আর করা বলুন! নাম্বারটাও টুকে নিতে পারিনি। ঝড়ের বেগে চলে গেল।
সুধীন বাবু উঠলেন। বাঁ দিকের সীটে গিয়ে বসলেন তিনি। আতিকুর রহমান সন্তুষ্ট হলেন। ফাঁদে আটকা পড়েছে সুধীন বাবু। হইলের বাধা অতিক্রম করে এদিকের দরজার কাছে পৌঁছুতে সুধীন বাবুর প্রচুর সময় লাগবে। তার আগেই যা ঘটবার ঘটে যাবে।
গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। স্পীড কমিয়ে দিলেন বেশ খানিক। রিস্টওয়াচের কাটা বলছে ছটা বেজে দুমিনিট হয়েছে।
বিদিশা রেলক্রসিংয়ে পৌঁছুতে হবে ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়। অর্থাৎ এখন থেকে দুই মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডের মাথায়।
সময় বয়ে যাচ্ছে। সুধীন বাবু খুবই রসিক ব্যক্তি। নিজের কথাতেই হাহ হাহ করে হাসছেন তিনি। হাসছেন আতিকুর রহমানও।
ঠিক ছয়টা পাঁচ মিনিটের মাথায় পৌঁছুলেন তিনি বিদিশা রেলক্রসিংয়ের কাছে। গতি একেবারে ন্যূনতমে নামিয়ে এনেছেন। কিন্তু বৃথাই এত পরিকল্পনা।
কমলাপুর স্টেশনের দিক থেকে ট্রেন কেন, কিছুই আসছে না লাইনের উপর দিয়ে।
ট্রেন লেট।
করার কিছু নেই। রেলক্রসিং অতিক্রম করে গেল গাড়ি। বিকল্প উপায়টার কথা ভাবতে লাগলেন আতিকুর রহমান। রাস্তার দুই ধারে নিচু ধানখেত দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কৃত্রিম খালটাও।
এদিকটায় খালের গভীরতা কম। আরও সামনে কোথাও ঘটাতে হবে ঘটনাটা। সামনে ধানখেত আরও অনেক বেশি নিচুতে।
কথা বলছেন সূধীন বাবু। কথা, আতিকুর রহমানও বলছেন। বিপদটা ঘটতে শুরু করলে যেন প্রস্তুত হতে না পারেন তার জন্যে তিনি সুধীন বাবুর মনটা আগে থেকেই অন্যদিকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা পাচ্ছেন।
কেপ ট্রায়াংগুলার যে কোন কালেক্টরের কাছে জীবনের চেয়ে মূল্যবান, আমি তো তাই মনে করি, বললেন সুধীন বাবু।
আতিকুর রহমান বললেন, ওটা আসলে একটা কথার কথা, তাই না? সত্যিই কি কেউ জীবনের বিনিময়ে কেপ ট্রায়াংগুলার চাইবে? সে যদি নিজেই বেঁচে না থাকে, কি হবে কেপ ট্রায়াংগুলার দিয়ে?
সুধীন বাবু বললেন, আনার কথাই ঠিক, মানি। জানেন, মি. রহমান, ইব্রাহিম সাহেবের কালেকশনে একটা স্ট্যাম্প দেখে বুড় লোভ হয়েছে।
অকস্মাৎ মাঝপথে থেমে গেলেন সুধীন বাবু। যে কথা তিনি আতিকুর রহমানকে জানাতে চাননি তাই জানিয়ে ফেলেছেনু ভুলক্রমে:…1
এদিকে রাস্তা থেকে গাড়ি সরে গেছে। আতিকুর রহমান লাফ দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছেন। আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, প্রায় খাড়া খাদের কিনারায় সামনের চাকা দুটো পৌঁছে যাবে।
কিন্তু সুধীন বাবুর শেষ অসমাপ্ত কথাটা আতিকুর রহমান ঠিকই শুনেছেন। এক সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকটা কথা ভেবে নিলেন তিনি। ইব্রাহিম সাহেবের কালেকশন ইতিমধ্যে দেখেছেন সুধীন বাবু। তার মানে, কেপ ট্রায়াংগুলার যে চুরি গেছে তা তিনি জানেন। শুধু তাই নয়, চোর যে কে তাও তিনি বুঝতে পেরেছেন। আরও কয়েকটা কথা ভাবলেন তিনি। সুধীন বাবু হয়তো আসলে দিল্লী থেকে আসেননি। ইনি হয়তো খোদ মি. শহীদ খান, ছদ্মবেশে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছেন, কথা আদায় করার জন্যে-এ লোককে খুন করা চলবে না। পুলিশ স্বীকার করবে না এটা অ্যাক্সিডেন্ট। তারা পরিষ্কার ধরে নেবে, এটা খুন।
প্রাণপণে ব্রেক কষলেন আতিকুর রহমান। আস্তেই ছুটছিল গাড়ি, লাফ দেবার সুবিধার্থেই আস্তে চালাচ্ছিলেন তিনি। দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি, কিন্তু সামনের চাকা দুটো খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকেছে। একটু এদিক ওদিক হলেই গড়িয়ে পড়তে পারে নিচে।
দূরে দূরে লোকজন, সবাই লক্ষ করল। একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, ভাগ্যের জোরে রক্ষা পেয়ে গেছে, ভাবল সবাই।
কি যে ভাবছিলাম, লক্ষই করিনি গাড়ি খাদের দিকে যাচ্ছে?
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সুধীন বাবু বললেন, সময় মত ব্রেক কষেছিলেন বলে এ যাত্রা প্রাণটা রক্ষা পেল।
গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লেন আতিকুর রহমান। সামনের চাকা দুটো আটকে গেছে কাটা গাছের গুঁড়িতে, উঠছে উপর দিকে।
বসুন আপনি, নেমে দেখি কি অবস্থা।
নিচে নেমে দাঁড়াতেই লক্ষ করলেন থরথর করে কাঁপছে পা দুটো। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন–আঁৎকে উঠলেন হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে। মাথা ঘুরছে তার…তাই কি? চাকা দুটো নড়ছে, নেমে যাচ্ছে একটু একটু করে তারপর দ্রুত বেগে-না! না! না! ·
বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলেন আতিকুর রহমান। চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে ঘটনাটা। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না তিনি। গাড়ির ভিতর তাকালেন। পলকের জন্যে দেখতে পেলেন সুধীন বাবুকে। আতঙ্কিত, ফাঁদে পড়া জন্তুর মত দিশে হারিয়ে পথ খুঁজছেন বেরুবার।
পরমুহূর্তে নেমে গেল গাড়িটা। শব্দ উঠে আসছে ক্রমশ সরে যাচ্ছে শব্দটা। এক পা এগিয়ে দেখলেন গাড়িটা পড়ছে ডিগবাজি খেতে খেতে।
কয়েক সেকেণ্ডের মাত্র ব্যাপার। ঘটে গেল ঘটনাটা। গাড়িটা ডুবে গেছে খালের পানিতে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন আতিকুর রহমান। অনেক লোক জড় হলো। সুধীন বাবু কিন্তু বেরিয়ে এলেন না পানির ভিতর থেকে।
.
০৭.
এক গ্লাস পানি দে, টোটা! আর–আর শোন, তোর বিবিসাহেবাকে ছুটে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন আতিকুর রহমান।
ড্রয়িংরুমেই পায়চারি করতে শুরু করলেন তিনি। উপরে ওঠার সময় নেই, দেরি হয়ে যাবে তাহলে। পালাতে হবে তাকে–এখুনি।
পানি নিয়ে এল টোটা।
টোটা। শোন–একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে–আমাকে পালাতে হবে টোটা-তোর বিবিসাহেবাকে ডেকে আন!
কি হয়েছে, হুজুর? অতি শান্ত গলা টোটার।
অ্যাক্সিডেন্ট-না, সত্যি বলছি
কথা শেষ করলেন না আতিকুর রহমান, পাশের রুমের দরজার সামনে পাগলের মত ছুটে গিয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। স্ট্যাম্পটা সরাতে হবে! নষ্ট করে ফেলতে হবে কপ ট্রায়াংগুলারটাকে।
দরজার কবাট উন্মুক্ত করে ভিতরে ঢুকতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন তিনি।
মি. সিম্পসন বসে আছেন রূমের ভিতর, একটি চেয়ারে।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মি. রহমান, কেন আমি এখানে অপেক্ষা করছি? উঠে দাঁড়িয়ে রূঢ় কণ্ঠে বললেন মি. সিম্পসন। এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন আতিকুর রহমানের মুখোমুখি। তার হাতে চক করছে কালে রিভলভারটা বৈদ্যুতিক আলোয়।
অভিনয় করার চেষ্টা করে লাভ নেই।
মি. সিম্পসন, আপনি হয়তো ভাবছেন আমি ইব্রাহিম সাহেবকে খুন করেছি। বিশ্বাস করুন, আমি করিনি। স্বীকার করছি, অন্য একটা অপরাধ করেছি আমি। চুরি করেছি কেপ ট্রায়াংগুলার। আসলটা নিয়ে রেখে এসেছি নকলটা। কিন্তু সেটা ইব্রাহিম সাহেব খুন হবার পরে। তিনি খুন হবার পর–শুনতে পাচ্ছেন আমি কি বলছি? তিনি খুন হবার পর আমি চুরি করেছি। শনিবার রাতে হা, শনিবার রাতে ওটা চুরি করেছি আমি। বৃহস্পতিবারে খুন হয়েছেন ইব্রাহিম সাহেব, তাই না? শুক্রবার দিন প্রথম তার বাড়িতে আপনার ফোন পেয়ে যাই আমি। শনিবার রাতে চুরি করি স্ট্যাম্পটা। এই অপরাধের জন্য যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু খুন আমি করিনি।
রীতিমত চিৎকার করে, উন্মাদের মত হাত নেড়ে কথাগুলো বললেন আতিকুর রহমান। হাপরের মত ওঠানামা করছে তার বুক।
মি. সিম্পসন বললেন, আপনার বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট। চলুন, থানায় যেতে হবে আপনাকে। আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করছি।
টোটা! টোটা এদিকে আয়! চিৎকার করে উঠলেন আতিকুর রহমান।
টোটা দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছিল, যায়নি সে তার বিবিসাহেবকে খবর দিতে।
রূমের ভিতর ঢুকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল সে।
চিৎকার করে আতিকুর রহমান বললেন, টোটা! তুই মি. সিম্পসনকে বল। তুই দেখেছিস! তুই কী-হোল দিয়ে সে-রাতে দেখেছিস। বল দেখিসনি? আমি পানি দিয়ে ভিজিয়ে একটা স্ট্যাম্প অ্যালবামে রেখেছিলাম, তার আগে আনন্দে কেঁদেও ছিলাম আমি–সব দেখেছিলি তুই! বল! বল মি. সিম্পসনকে, সেদিন কি বার ছিল? বল শনিবার ছিল কিনা?
এতদিন পর, এইবার সুযোগ এসেছে, ভাবছে টোটা। প্রতিশোধ নেবে সে। বলল, মি. সিম্পসনকে আগেই আমি বলেছি। শনিবার নয়, আপনি বৃহস্পতির রাতে স্ট্যাম্পটা অ্যালবামে রেখেছেন। আমার পরিষ্কার মনে আছে।
মাথায় যেন গোটা আকাশটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আতিকুর রহমানের। চিৎকার করে বলে উঠলেন, মিথ্যে কথা! টোটা মিথ্যে কথা বলছে! ও আমাকে ঘৃণা করে, মি. সিম্পসন! ফর গডস সেক, বিলিভ মি টোটাকে মারধোর করি, তাই ও আমাকে ঘৃণা করে, তাই ও প্রতিশোধ নেবার জন্যে মিথ্যে কথা বলছে।
মিথ্যে কথা কেন বলব, হুজুর। আমি পরিষ্কার মনে করতে পারছি, বৃহস্পতিবারেই আপনি অ্যালবামে একটা স্ট্যাম্প রাখেন। আপনাকে কাঁদতেও দেখেছি আমি।
মি. সিম্পসন। মি. সিম্পসন, আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না–প্লীজ! আমি খুন করিনি, বিশ্বাস করুন! মনে নেই আপনার, আমি ফোন পেয়ে ইব্রাহিম সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছিলাম আপনার সাথে যখন দেখা হলো বলিনি কি আপনাকে ভুল ঠিকানায় গিয়েছিলাম প্রথমে? আমি যদি তাকে খুন করে থাকি, তাঁর বাড়ি চিনতে ভুল হবে কেন আমার? বলুন? ওটা একটা প্রমাণ নয় যে আমি খুন করিনি তাকে?
আপনি খুবই চতুর লোক, মি. রহমান। ভুল ঠিকানায় আপনি ইচ্ছে করে গিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার দরকার হবে ভেবে। সুধীন বাবু, যিনি কিনা ঢাকায় এর আগে কখনও আসেননি, কই, তিনি তো ভুল করেননি? সরাসরি তিনি মি, ইব্রাহিমের বাড়িতে পৌঁছান। ভাল কথা। কোথায় তিনি?
আমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে খানিক আগে। সুধীন বাবু গাড়িতে ছিলেন তিনি। তিনি মারা গেছেন। খাদে গাড়ি।
মারা গেছেন?
এবার মি. সিম্পসন চেঁচিয়ে উঠলেন, সুধীন বাবু মারা গেছেন? গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আপনার? কোথায়?
বিদিশা রোডে।
মি. সিম্পসন আতিকুর রহমানের মাথা লক্ষ্য করে রিভলভার ধরলেন এবার, বললেন, ইন্টারকন থেকে আপনার বাড়িতে নিয়ে আসার কথা সুধীন বাবুকে, তাই না? সরাসরি রাস্তা আছে। আপনি বিদিশা রোডে গিয়েছিলেন কেন? গাড়িটাকে খাদে ফেলে দেবার জন্যে, তাই না? সুধীন বাবুকে খুন করার জন্যে, তাই না?
আতিকুর রহমান প্রায় কেঁদে ফেললেন। বুললেন, মি. সিম্পসন, আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি খুন করিনি। ইব্রাহিম সাহেবকেও না, সুধীন বাবুকেও না…।
ওসব কথা থাক। আপনাকে এই মুহূর্তে থানায় যেতে হবে, মি. রহমান।
ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন আতিকুর রহমান, আমি সত্যিই খুন করিনি। আপনি দয়া করে একজন উকিলের সাথে কথা বলতে দিন অন্তত আমাকে, থানায় নিয়ে যাবার আগে। কিংবা আপনি অন্তত মি. শহীদ খানের সাথে কথা বলতে দিন আমাকে। হ্যাঁ, শহীদ খান, তিনিই একমাত্র আমাকে রক্ষা করতে পারবেন। শুনেছি, নির্দোষ লোককে তিনি শাস্তি পেতে দেন না…।
মি. সিম্পসন বললেন, যার সাথেই কথা বলুন, থানায় আপনাকে যেতেই হবে। শহীদ আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করবে না।
তাকে আমি সব সত্যি কথা বলব। আপনি দয়া করে একটা সুযোগ দিন তার সাথে কথা বলার।
বেশ। ফোন করুন।
ড্রয়িংরূমে ফিরে এলেন ওরা। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন আতিকুর রহমান।
অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল শহীদের কণ্ঠস্বর, শহীদ খান স্পীকিং…।
আতিকুর রহমান বললেন, মি. শহীদ, আমাকে বাঁচান?
কি ব্যাপার? কি হয়েছে, মি. রহমান?
মি, শহীদ, ইৰাহিম সাহেব এবং সুধীন বাবুকে খুন করেছি আমি এই অভিযোগে মি. সিম্পসন আমাকে অ্যারেস্ট করতে চাইছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ওদের কাউকে খুন করিনি। আমার হাতে প্রমাণ নেই, আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারছি না, কিন্তু খুন আমি করিনি। একজন নির্দোষ মানুষ আমি, মি. শহীদ, অথচ খুনের অভিযোগে আমার বিচার হবে। আপনি কি, মানবতার খাতিরে, আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না?
শহীদ কথা বলল না অনেকক্ষণ।
মি, শহীদ? কাদ কাঁদ কণ্ঠে ডাকলেন আতিকুর রহমান।
একটিমাত্র প্রশ্ন করল শহীদ, সত্যি আপনি নির্দোষ? সত্যি ওদের কাউকে আপনি খুন করেননি?
সত্যি আমি নির্দোষ। ওঁদের কাউকে আমি খুন করিনি। সুধীন বাবুকে খুন করব, একথা ভেবেছিলাম। খুন করব ভেবেছিলাম, কারণ, কেপ ট্রায়াংগুলার চুরি করেছি আমি এটা একমাত্র তিনিই প্রমাণ করতে পারতেন, তাই। কিন্তু ভাবলেও শেষ পর্যন্ত তাকে আমি খুন করিনি। তিনি রোড অ্যাক্সিডেন্টেই নিহত হয়েছেন, বিদিশা রোডে…।
শহীদ বলল, আপনি যদি নির্দোষ হন, মি. রহমান, আপনাকে আমি রক্ষা করতে পারবই। নির্দোষ কোন লোক শাস্তি পাক-এ আমি হতে দিই না। আপনি মি. সিম্পসনকে বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলুন, আমি আসছি।
.
০৮.
বিশ মিনিট নয়, প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট পর এল শহীদ। ড্রয়িংরূমে ঢুকে ও দেখল আতিকুর রহমান মাথা নিচু করে বসে আছেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। মি. সিম্পসন হাত পাঁচেক দূরে একটা চেয়ারে বসে আছেন রিভলভার হাতে নিয়ে। সেটা আতিকুর রহমানের দিকে তুলে ধরা।
দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
মি. সিম্পসন বললেন, শহীদ, মি. রহমান নির্দোষ তা প্রমাণ করতে পারছেন না, শুধু বলছেন আমি খুন করিনি। সুধীন বাবুকে খুন করেছেন-এতে তো সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই। ইব্রাহিম সাহেবকেও খুন করেছেন। তাকে খুন করার মোটিভ একমাত্র ওঁরই আছে। কেপ ট্রায়াংগুলারটা চুরি করাই ছিল মোটিভ। ওঁর চাকর টোটাও বলছে, বৃহস্পতিবার রাতে স্ট্যাম্পটা…
ও মিথ্যে কথা বলছে। আমাকে ও ঘৃণা করে মারধোর করি বলে।
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন, আমি চেষ্টা করব মি. রহমানকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, তিনি সত্যি নির্দোষ।
শহীদ! কি বলছ তুমি!
শহীদ বলল, কিছু প্রমাণও আমার হাতে আছে।
প্রমাণ আছে!
শহীদ বলল, হ্যাঁ, মি. সিম্পসন। ইব্রাহিম সাহেবের হত্যাকারী যে মি. রহমান। নন তার প্রমাণ আমি সংগ্রহ করেছি আজ সন্ধ্যার পরপরই। ইব্রাহিম সাহেবকে খুন করেছে তার ছেলে, আশরাফুল খলিল। ইরাহিম সাহেব তার এই পুত্র সম্পর্কে কোন খোঁজ খবর রাখতেন না। ছেলেটি তার মায়ের কাছে, বস্তিতে থেকে মানুষ হয়েছে।
শহীদ, তুমি কি কুখ্যাত আশরাফ গুণ্ডার কথা বলছ?।
হ্যাঁ। আশরাফ গুণ্ডাই ইব্রাহিম সাহেবের সেই ছেলে। বস্তিতে মানুষ সে, গুণ্ডা হয়েছে। তার মা মারা যাবার আগে বাবার পরিচয় জানিয়ে যায়। বাবার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে সে খুন করে।
এসব কথা তুমি জানলে কিভাবে?
খুব সহজেই। আশরাফ গুণ্ডা তার বন্ধুকে সব কথা বলেছে। আমি তার সন্ধান পাইনি, কিন্তু তার বন্ধুর খোঁজ পাই। ভয় দেখিয়ে, কৌশলে তার কাছে থেকে সব কথা আদায় করেছি আমি। আশরাফ গুণ্ডা পালিয়েছে। সম্ভবত, ঢাকায় নেই সে।
মি, শহীদ! মি, শহীদ, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব! আপনি যে এত মহৎ, এত মানবদরূদী–
শহীদ বলল, এর মধ্যে মহত্ত্বের কিছু নেই, মি. রহমান। আপনি নির্দোষ, সুতরাং আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু সুধীন বাবুকে নিশ্চয়ই আপনি খুন করেছেন, মি. রহমান।
শহীদ বলল, না। সুধীন বাবুকেও তিনি খুন করেননি। আমি এখানে আসার আগে বিদিশা রোড ঘুরে এসেছি। গাড়িটা খালে পড়ে রয়েছে। লাশটাও স্থানীয় লোকেরা গাড়ির ভিতর থেকে অনেক কষ্টে বের করেছে। অনেকেই ঘটনাটা ঘটার সময় দেখেছে। তারা কি বলছে জানেন? তারা বলছে, ঘটনাটা সম্পূর্ণ একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা!
মি. সিম্পসন বোবা হয়ে রইলেন।
শহীদ বলল, মি রহমান, খুন আপনি করেননি, সত্যি। কিন্তু স্ট্যাম্পটা চুরি করেছেন। এরজন্য অবশ্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।
আতিকুর রহমান বলে উঠলেন, সে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।
শহীদ বলল, তবে, আমি মি. সিম্পসনকে অনুরোধ করব, তিনি যেন আপনাকে গ্রেফতার না করেন। আপনি একটা অপরাধ করেছেন সত্যি, কিন্তু সেজন্যে ইতিমধ্যে যে মানসিক কষ্ট পেয়েছেন তা শাস্তি হিসেবে কম নয়। তাছাড়া আপনি এখন অনুতপ্তও বটে।
মি. সিম্পসন একটু যেন হাসলেন। বললেন, তোমার অনুরোধ রাখব আমি তা জেনেই অনুরোধ করছ–বেশ। কেপ ট্রায়াংগুলার ফিরিয়ে দিন আমাকে, মি. রহমান। আপনাকে আমি গ্রেফতার করছি না।
গ্রেফতার ওকে করতেই হবে। ও একটা খুনী, গ্রেফতার করবেন না মানে?
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল সুদর্শন, সুবেশী এক তরুণ যুবক। যুবকটি প্রায় ছয় ফুটের মত লম্বা। দামী সুট পরনে তার। মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি।
কে আপনি?
মি. সিম্পসন, শহীদ এবং আতিকুর রহমান একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন।
আমার পরিচয় পরে জানলেও চলবে। আগে ওই শয়তানটার অপরাধের কাহিনী শুনুন। মিসেস শেফালী, ভিতরে আসুন।
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল শেফালী, তার স্বামী আবদুস শুকুর এবং সকলের পিছনে মিস্টার স্যানন ডি. কস্টা।
ডি. কস্টা! আপনি এখানে? মি. সিম্পসন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন।
ডি. কস্টা শেফালী এবং আবদুস শুকুরকে দেখিয়ে বলল, এনারা হানার ক্লায়েন্ট। ইহাড়ের একটা কেসের সমাচান বাহির করার ডিউটিটে হামি নিয়োজিট। হামার সহকারী মি. উল্কার মুখে আপনারা বাকী হিসটোরী শুনুন।– সুদর্শন যুবক, ডি, কস্ট যার নাম বলল মি. উল্কা, সে বলতে শুরু করল, মি. সিম্পসন, আপনি আমাকে না চিনলেও, আপনাকে আমি চিনি। আপনার প্রতি আমার অনুরোধ, এখুনি ওই শয়তান আতিকুর রহমানকে গ্রেফতার করুন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি? মি. সিম্পসন একটু বিরক্তির সাথেই জানতে চাইলেন।
যুবক বলল, অভিযোগ? ওই শয়তান তার প্রথম স্ত্রীকে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে খুন করেছে। অভিযোগ শুধু নয়, প্রমাণও হাতে আছে আমার। আপনি একবার এখুনি এই বাড়ির পিছনের সুইমিং পুলে যান, নিজের চোখে সব দেখতে পাবেন। সুইমিং পুলের নিচে লাশটা লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি আমার বস্ মি. ডি. কস্টা কৌশলে কদিন আগে সুইমিং পুল থেকে পানি তুলে নেবার ব্যবস্থা করেন। আজ ঘণ্টা খানেক আগে, লাশটা আবিষ্কার করি আমি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ওই শয়তান রটায় যে তার স্ত্রী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সবাই সেটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ওর স্ত্রীর বোনের মেয়ে ওই মিসেস শেফালী পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী তার নিরুদ্দিষ্ট খালার কাছ থেকে নিয়মিত মাসিক পাঁচশো করে টাকা পাচ্ছিল। এটা একটা সন্দেহের ব্যাপার, তাই না? যিনি নিখোঁজ হয়ে গেছেন তিনি টাকা পাঠাচ্ছেন, অথচ স্নেহের পাত্রী বোনঝির সাথে দেখা করছেন না–অবাক লাগে না? কেসটার দায়িত্ব মি, ডি, কস্টকে দেন মিসেস শেফালী। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তার খালার ঠিকানা। কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ল। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, টাকা মিসেস শেফালীর খালা-আম্মা নয়, পাঠাচ্ছে এই শয়তান আতিকুর রহমান। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মিসেস শেফালীর খালা-আম্মা নিখোঁজ হবার পরপরই ওই শয়তান রহমান তার বাড়িতে সুইমিং পুল তৈরি করে। দুয়ে দুয়ে চারের মতই ব্যাপারটা সহজ বলে মনে হলো। পানি তোলার ব্যবস্থা হলো পুল থেকে–তারপরের ঘটনা তো প্রথমেই বলেছি।
আর কেউ না চিনতে পারলেও যুবককে শহীদের চিনতে ভুল হয়নি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ও শুধু।
মি. সিম্পসন বললেন, সত্যি লাশ আছে?
চলুন নিজের চোখে দেখবেন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন আতিকুর রহমান, না-না। না-না! না!
জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন তিনি কার্পেটের উপর।
দুই মিনিট পর নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সবাই ড্রয়িংরূম থেকে। সবাই চলেছে সুইমিং পুলের দিকে। আতিকুর রহমানের পাহারায় রইল আবদুস শুকুর, টোটা এবং মিসেস শেফালী।
ওরা সুইমিং পুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তলাটা দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে একটা গভীর গহ্বর। একটা কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে গহ্বরের পাশেই।
মি. সিম্পসন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন যুবকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোথায় সে। কর্পূরের মত উবে গেছে যেন যুবকটি।
কে ও? গেল কোথায় হঠাৎ?
শহীদ মুচকি হেসে বলল, চিনতে পারেননি?
তার মানে? ও কি পরিচিত কেউ?
খুবই পরিচিত। মি. সিম্পসন, আপনাকে অপরাধী ধরতে যে সাহায্য করে গেল সে স্বয়ং কুয়াশা!
হোয়াট। কোথায় সে?
শহীদ বলল, গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু জানতে চাইছেন কেন? সে তো আপনাকে সাহায্যই করল, তাই না?
মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ, ত ঠিক। সেজন্যে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু ওর অপরাধ তাতে করে কমেনি একবিন্দু। কোন দিকে গেল বলো তো!
আট দিকের যে কোন একদিকে গেছে। কে জানে কোন দিকে গেছে।
মি. সিম্পসন গভীর কণ্ঠে বললেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে আমি ঘায়েল করবই!
কথা বলল না শহীদ। আপন মনে হাসল শুধু।
Leave a Reply