কুয়াশা ৬৩
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৭৭
০১.
যাচ্ছি তো আমরা স্টুডিওতে?
শহীদ বলল, না। ফ্রেন্ডশীপ নাইট ক্লাবে যাব. আমি। চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম, সেটাই উচিত হবে।
আসলে মিসেস রাফিয়া সম্পর্কে সম্ভাব্য সুর তথ্য সংগ্রহ করতে চায় শহীদ। স্টুডিওতে যাবে ও, কিন্তু পরে।
ঘণ্টা মিয়ার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলেছিল ও। নতুন কোন তথ্য দিতে পারেনি সে। শুধু ফ্রেণ্ডশীপ নাইট ক্লাবটার ঠিকানাটাই পাওয়া গেল তার কাছ থেকে।
সাথে যেতে চাইল কামাল। এ ব্যাপারে সে কোন অজুহাত শুনবে বলে মনে হলো না। কিন্তু শহীদ প্রসঙ্গটা আলোচনাই করতে চাইল না। একবার শুধু বলল, আমি একাই যাচ্ছি।
কামাল আর কোন কথা বলতে পারল না। একাই বেরিয়ে গেল শহীদ।
ট্যাক্সি নিয়ে জুবিলী রোডে পৌঁছুল শহীদ। নামল একটা পিচ ঢালা গলি পথের সামনে।
গলিটা খানিকদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে ডান দিকে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকেই শেষ প্রান্তের দোতলা বিল্ডিংটা দেখতে পেল ও। বিল্ডিংয়ের গায়ে বড় বড় রঙিন। কাঁচের অক্ষর দিয়ে লেখা রয়েছে–ফ্রেণ্ডশীপ নাইট ক্লাব। রাতের বেলা অক্ষরগুলোয় বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে ওঠে। নিওন সাইনের নিচেই কয়েকটা বিচিত্র। ছবি। হার্ড বোর্ডের উপর চার পাঁচ রকম কষ্ট দিয়ে আঁকা হয়েছে ছবিগুলো। সিনেমা হলের সামনে, গেটের উপর যেমন খাড়া করে রাখা হয়, ঠিক তেমনি। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি জাঙ্গিয়া পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, তার মাথার উপর একটা সাদা ইঁদুর। মেয়েটির সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে পিস্তল হাতে। গুলি করেছে সে। বুলেটটা ছুটে যাচ্ছে। এই ধরনের আরও অনেক ছবি।
রাস্তার উপরই গেট। বন্ধ নয়, আধখোলা। ভিতরে ঢুকে তেকোণা একটা বড় হলরুম দেখল ও দুজন লোক বসে দাবা খেলছে। পদশব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালও না। এক প্রান্তে বড় একটা মঞ্চ দেখা যাচ্ছে। পর্দা ঝুলছে মঞ্চে। শ খানেক চেয়ার, সার সার দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর, সিলিংয়ে ঝুলছে দশ বারোটা ইলেকট্রিক ফ্যান।
লোক দুজন যেখানে বসে দাবা খেলছে, তার পাশেই একটা দরজা। দরজার মাথায় লেখা–ড্রিঙ্কস। দরজাটার পাশ দিয়ে উঠে গেছে একটা সিঁড়ি।
নাইট ক্লাবগুলোয় ড্যান্স ফ্লোর থাকতে পারে, কিন্তু এই রকম উঁচ মঞ্চ আগে কোথাও দেখেনি শহীদ। ঢোকার মুখে পাশাপাশি কয়েকটা টিকেট কাউন্টার দেখেছে ও, তার মানে দর্শনীর বিনিময়ে এখানে শারীরিক কসরৎ, ম্যাজিক, টার্গেট প্র্যাকটিস, নাচ, ইত্যাদি দেখানো হয়ে থাকে।। লোক দুজনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। কেউ মুখ তুলে তাকাচ্ছে না দেখে নিজেই কথা বলে উঠল, ম্যানেজার কোথায় বসেন বলতে পারেন?
মুখ তুলল না কেউ। কিন্তু প্রায় একযোগে দুজনেই বলে উঠল, দোতলায়, দোতলায়।
কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল শহীদ।
উপরে প্রশস্ত করিডর। ডান দিকে একটা খোলা দরজা। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটি মেয়েকে দেখতে পেল। আঁটসাঁট কামিজ পরে মেয়েটা চারটে রবারের রঙিন বল লোফাফি করছে। তাগড়া চেহারার এক জোয়ান লোক মেঝেতে দুই হাত আর দুই হাটু রেখে মেয়েটির সামনে চতুস্পদ জন্তুর মত স্থির হয়ে রয়েছে। মেয়েটি বলগুলো লোফালুফি করতে করতে লোকটার পিঠে প্রথম ডান পা, তারপর বা পা তুলে দিয়ে দাঁড়াল। বল লোফালুফির খেলা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
সরে গেল শহীদ। করিডরের শেষ মাথায় আর একটা দরজা। সেটা খোলা, পর্দা ঝুলছে। কালো প্লাস্টিকের উপর সাদা অক্ষরে লেখা নেমপ্লেট-মোহাম্মদ সাদী–ম্যানেজার। নেমপ্লেটের উপর একটা লাল বোতাম। সেটায় চাপ দিল। শহীদ।
কর্কশ কণ্ঠে কেউ ভিতর থেকে বলে উঠল, ব্যস্ত! খুব ব্যস্ত! ভিতরে ঢুকবে না বলে দিচ্ছি–সাবধান!
শহীদ পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল, সাদী সাহেব, আমিও খুব ব্যস্ত আপনার সাথে আলোচনা করার জন্যে!
মোহাম্মদ সাদী লোকটার চেহারা কৌতুকপ্রদ। ছোট্ট, এতটুকু কপাল কিন্তু মাথাটা প্রকাণ্ড। তোবড়ানো গাল। নাকের ডগায় নেমে এসেছে পাওয়ারওয়ালা কাঁচের চশমাটা, চশমার উপর দিয়ে পিচুটিভরা চোখে শহীদের দিকে পিট পিট করে চেয়ে আছে, দৃষ্টিতে বিস্ময়।
জী?
শহীদ বসল একটা চেয়ারে। দেখল টেবিলের উপর কাগজপত্রের স্তূপ, বুক অবধি দেখাই যায় না সাদী সাহেবের।
পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিল শহীদ। সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চোখের সামনে, একেবারে নাকের কাছে ধরল সাদী সাহেব। অনেকক্ষণ ধরে, অতি কষ্টে পড়ল শহীদের নাম। মুখ তুলে হাসল হঠাৎ, দাঁতহীন মাড়ি দেখা গেল সাদী সাহেবের, ওরে বাপস-ডিটেকটিভ! তাও আবার ঢাকা শহর থেকে! তা, মিস্টার শহীদ, আমি তো লোক খারাপ নই, রক্ত দেখলেই মূৰ্ছা যাই, আমার সাথে কি দরকার আপনার বলুন তো?
মজার লোক সাদী সাহেব, কথাগুলো বলেই কর্কশ স্বরে খল খল করে হেসে উঠল।
শহীদও হাসল, না, আপনাকে বেঁধে নিয়ে যেতে আসিনি। এসেছি এক ভদ্রমহিলা সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতে। আপনি তাকে চেনেন। ভদ্রমহিলার নাম সুলতানা, রাফিয়া সুলতানা।
ভদ্রমহিলা? সুলতানা ভদ্রমহিলা? আকাশ থেকে পড়ল সাদী সাহেব। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, আবার, নাহ্! অতি বিনয়ী লোক আপনি, সাহেব, আপনার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ওই হারামী ছুকরীটাকে আপনি ভদ্রমহিলা বলবেন? ছি ছি।
শহীদ বলল, আসলে কি জানেন, ওকে আমি ভাল চিনি না।
সাদী সাহেব বিড়ি ধরাল, কে চেনে? বলি চেনেটা কে ওই ছুকরীকে? আজ তার এক চেহারা, কাল আরেক রকম। তা, মিস্টার শহীদ, ছুকরী সম্পর্কে কি জানতে চান বলুন।
সে কি আপনার এই নাইট ক্লাবে কাজ করত?
করত বৈকি। ছুকরী..স্বীকার করতেই হবে, দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বুঝলেন ওর মত অমন পেটে, ঢেউ খেলিয়ে আর কেউ নাচতে পারত না। শহরের ছোকরাগুলো তো তিনটে করে শো দেখত…।
কত দিন ছিল সে এখানে?
সাদী সাহেব বলল, বছর দুয়েক। চলে গেছে গত বছর জুন মাসের পয়লা কি দোসরা, দুপুর বেলা।
শহীদ জানতে চাইল, এখানে আসার আগে কোথায় কি করত সৈ?
সাদী সাহেব মুখস্থ করা গদ্যের মত বলে যেতে লাগল, এই অফিসরুমেই ছুকরীকে নিয়ে এসেছিল ইন্টারভিউ দেয়ার জন্যে এখলাস সাহেব। এখলাস সাহেব…আহা, চুচু-বেচারা মরে গেছেন নিউমোনিয়ায় মাস ছয়েক আগে–তিনি এই ধরনের নাচিয়ে মেয়েদের খবরাখবর রাখতেন, মানে, এজেন্ট গোছের ছিলেন। ছুকরীকে জিজ্ঞেস করলাম নাচ জানো? উত্তর দিল না। বুঝলেন, শাড়ি খুলে ফেলে নাচতে শুরু করে দিল তক্ষুণি! কি কাণ্ড ভেবে দেখুন! তবে, হ্যাঁ, নাচটা খুব ভালই নাচল। পছন্দ করলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, নাম কি গো? বলল, রাফিয়া। সালতানা, সুলতানা নয়, সালতানা। আসলে সুলতানা, কিন্তু ঢং করে উচ্চারণ করে ওই রকম–সা ল তা না। জানতে চাইলাম, কোখেতে আসা হলো? বলল, কোলকাতা থেকে। আর কি জানতে চান, মি. শহীদ? এই যাহ! খাতির করতে ভুলে গেছি আপনাকে-এই! কে আছিস চা আন এক কাপ, সাথে…কই, সাড়া দিচ্ছে না কেন?
শহীদ বলল, সাদী সাহেব, ব্যস্ত হবেন না। আমি চা খাই না। আচ্ছা…
হঠাৎ শহীদের দিকে আধ হাত এগিয়ে আনল সাদী সাহেব মাথাটা, বলি একটা কথা তো জিজ্ঞেস করতে বেমালুম ভুলে গেছি। ছুকরীর হয়েছেটা কি? স্বামীকে ছেড়ে আর কারও সাথে ভেগেছে বুঝি? দেখা হয়েছে তার সাথে। আপনার?
দেখা হয়েছে, বলল শহীদ। জানতে চাইল, আপনার মত একজন ভাল মানুষের কাছ থেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেল কেন সে বলুন তো?
রঙিন স্বপ্ন দেখতে পেল-অমনি দে ছুট-বুঝলেন না! বিবাহ–এই জিনিসটাই আমাকে ডোবাল! একটা মেয়েকে গড়ে পিটে চৌকস করি, দুপয়সা রোজগার করতে শেখে, লোকের প্রশংসা পায়–ব্যস! কাউকে না কাউকে ফাঁদে ফেলে ভেগে যায়, বিবাহ করে ফেলে! কি যে লোকসান হয় আমার।
বিয়ের পর তার আর কোন খবর পাননি আপনি?
সাদী সাহেব বলল, পাইনি মানে? বাদশা খান সুখী হয়নি, কিংবা ঘোড়ার ডিম কিছু একটা ঘটে থাকবে, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ওদের মধ্যে। লোক পাঠিয়েছিলাম আমি, ছুকরীকে পটিয়ে পাটিয়ে ফেরত আনবার জন্যে। কিন্তু আমার লোক গিয়ে পৌঁছুবার আগেই স্টারলিট নাইট ক্লাব ওকে গেথে ফেলে মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে। আমার লোক সেখানে তার সাথে গিয়ে দেখা করে, কিন্তু দুকরী তাকে দেমাক দেখিয়ে ভাগিয়ে দেয়। তারপর অনেক দিন কোন খবর পাইনি। মাস চার পাঁচ হবে শুনেছি স্টারলিট থেকেও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সে। কোথায় এখন আছে-খোদা মালুম!
সতর্ক হয়ে উঠেছে শহীদের কান। ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল ও, বাদশা খানকে সে?
ছুকরীর স্বামী।
আপনি ঠিক জানেন?
খল খল করে হাসল সাদী সাহেব, একশো ভাগ ঠিক জানি।
কবে বিয়ে হয় ওদের বোধহয় জানা নেই আপনার?
সাদী সাহেব আবার হাসল, মি. শহীদ, এই মাখাটা হলো ছোট একটা কমপিউটার, বুঝলেন? একবার যা ঢোকে এই মাথায় তা আর বের হয় না। ওদের বিবাহের তারিখটাও আছে আমার কমপিউটারে। গত বছর বিয়ে হয় ওদের, মে মাসের আট তারিখে।
বাদশা খান এখন কোথায়? বেঁচে নেই বুঝি?
সাদী সাহের মুখ বিকৃত করল। বাদশা খান বেঁচে নেই মানে? মরবে নাকি ও? বলি, খারাপ মানুষ সহজে মরে? এক বন্ধুর সাথে ফটোগ্রাফির দোকান করেছে সে। জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস দোকানের নাম।
শহীদ বলল, সাদী সাহেব, আপনি আমার জন্যে অনেক কষ্ট করেছেন। কিছু যদি মনে করেন, আপনাকে আমি কিছু প্রেজেন্ট করতে চাই। আপত্তি করতে পারবেন না, নিতে হবে।
চেয়ে রইল সাদী সাহেব, কিছু প্রেজেন্ট করবেন? কেন, আপনার কে হই আমি?
কেউ হন না। আপনাকে আমার ভাল লেগেছে, তাই।
সাদী সাহেব চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল। তারপর চশমাটা খুলে পাঞ্জাবীর কোণা দিয়ে কাঁচ দুটো মুছল ভাল করে, আবার পরল চোখে, দেখতে লাগল শহীদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বলল, দেখুন, ডিটেকটিভ হোন বা না হোন, সাফ সিধে কথা বলতে ভয় করি না আমি। বলি, ঘুষ দিতে চেষ্টা করছেন নাকি?
হাসি পেলেও হাসল না শহীদ। গম্ভীর মুখে বলল, ছি, ছি, এত ছোট কথা কেউ ভাবতে পারে? আমি আন্তরিকভাবেই প্রস্তাবটা দিয়েছি, সাদী সাহেব।
খয়েরী রঙের মাড়ি বেরিয়ে পড়ল, ছেলেমানুষের মত হাসছে সাদী সাহেব, দেন তবে! জিনিসটা কি বলুন তো? খুব দামী জিনিস আবার দেবেন না, চোরের চোখে পড়ে যাবে-তখন আবার আপনাকেই খবর দিয়ে আনতে হবে ঢাকা থেকে।
নিজের রসিকতায় নিজেই অবিরাম হাসতে লাগল সাদী সাহেব। পকেট থেকে গ্যাস লাইটারটা বের করে বাড়িয়ে দিল শহীদ, মাত্র কদিন আগে কিনেছি, পুরানো বলে মনে কিছু নেবেন না।
ওরে বাপস! এযে অনেক দামী জিনিস…।
কই আর দামী…।
তবু? ভুরু কপালে তুলে প্রশ্ন করল সাদী সাহেব।
তিনশো।
জিনিসটা নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে আনন্দে বলে উঠল, ওরে বাপ! ওরে বাপস্! কি সুন্দর, তাই না?
শহীদ হাসি চেপে বলল, সাদী সাহেব, আমি বাদশা খান সম্পর্কে জানতে চাই। সবটুকু। আপনি তার সম্পর্কে যা জানেন সব বলুন আমাকে।
লাইটারটা জ্বেলে বিড়ি ধরাল সাদী সাহেব। বলল, বাদশা খান সম্পর্কে? তা–সব কথাই জানা আছে তার সম্পর্কে। বাদশা খান এখানেই কাজ করছিল সুলতানা যখন আসে। আমাদের এটা আসলে নামে মাত্র নাইট ক্লাব। ঠাণ্ডা পানীয় ছাড়া কিছু বেচি না। কারণ, মালিক সোবহান সাহেব হাজী, পরহেজগার মানুষ। ব্যবসা করি আমরা খেলা দেখিয়ে। মদ-টদ বেচা বন্ধ করার পর ব্যবসা খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল, তখন বুদ্ধি খরচা করে এই পলিসি বের করি আমি। সব রকম খেলাই দেখানো হয়, সেই সাথে আছে নাচ। বাদশা খান রাইফেলের খেলা দেখাত।
কি রকম?
এই ধরুন, একটা দশ নয়া পয়সা উপরে ছুঁড়ে দিল, আয়নার দিকে তাকিয়ে গুলি করল পয়সাটার দিকে কি যেন বলে, একসাইটিং, দারুণ একসাইটিং! ওস্তাদ লোক এই বাদশা খান। কোল্ট ৪৫ রিভলভার দিয়ে আরও মারাত্মক ধরনের খেলা দেখাত সে। রিভলভারটা ছুঁড়ে দিত শূন্যে, লুফে নেবার সাথে সাথে গুলি করত। একটি মেয়ে ছিল তার সহকারিণী। সেই মেয়েটির ঠোঁটে সিগারেট থাকত, সেই সিগারেটের ডগায় লাগত পিস্তলের বুলেট, প্রতিবার এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে ছোট হত সিগারেটটা। সব শেষে ফিলটারটার গায়ে লাগত বুলেট। মেয়েটির ঠোঁট থেকে ফিলটার নিয়ে ছুটে যেত বুলেটটা।
চোখ বড় বড় করে তাকাল সাদী সাহেব, বলল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর খেলা! না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। তবে, হ্যাঁ, বাদশা খানের সাহসের অভাব ছিল না। অবশ্য সাহসের অভাব ছিল না মেয়েটিরও
এই বাদশা খান তাহলে বিয়ে করেছিল রাফিয়া সুলতানাকে?
হ্যাঁ। বিয়ে করবার কিছু দিন পরই চাকরি ছেড়ে দেয় দুজনে। জমানো টাকা দিয়ে পার্টনারশিপে ফটোগ্রাফির দোকান করে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল সে ভালমানুষ হয়ে গেছে, ঘর-সংসার করবে এবার গাঁজা-মদ ছেড়ে। ভয়ানক চঞ্চল, অস্থির টাইপের লোক। এক জায়গায় বেশি দিন টিকতে পারে না। আর একটা অসুখ ছিল, সহজ উপায়ে টাকা রোজগার করার জন্যে প্রত্যেক দিন একটা করে উদ্ভট বুদ্ধি বের করত মগজ থেকে। তবে সে যাই হোক, এখন বোধহয় সে ভালই আছে। আগের সে বাদশা নেই আর। ভালই আয় ছবি তোলার ব্যবসাতে। নাটকের মেয়েরা ওকে চেনে, তারা সবাই ওদের দোকান থেকেই ছবি তোলে।
রাফিয়া সুলতানাকে ছাড়ল কেন সে?
বাদশা ছাড়েনি, ওই ছুকরীই বাদশাকে ছেড়েছে, যত দূর শুনেছি। ঠিক জানি না, এই একটা ব্যাপারে। বাদশা খান মেজাজী লোক, রগচটা। মার ধর করত কিনা কে জানে। তবে, তালাক দিয়েছে বলে শুনিনি। স্বামীকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে দুকরী।
আচ্ছা, সাদী সাহেব, বাদশা খানের কোন ছবি আছে আপনার কাছে? পেলে বড় উপকার হত।
সাদী সাহেব চেয়ার ছেড়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে চাবি বের করে বলল, কি যে বলেন! মানুষের উপকার করতে পারাটাই তো সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।, দাঁড়ান, দেখি।
চেয়ারের পিছনের আলমারিটা খুলে পেস্টবোর্ডের একটা বাক্স বের করুল সাদী সাহেব। সেটা টেবিলে রেখে বসল আরার চেয়ারে। অসংখ্য ফটো রয়েছে বাক্সটায়।
দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে উঠল সাদী সাহেব, পাব না মানে! এই স্বয়ং বাদশা খান।
একটা ছবি বাড়িয়ে দিল সে শহীদের দিকে।
লম্বা, সরু মুখ বাদশা খানের। চোখ দুটো আচার্য ধরনের দুলু ঢুলু কিন্তু। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সে চোখে। ড্রেন পাইপ প্যান্ট পরনে, গায়ে টি শার্ট। পেটা শরীর। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবে। হাত দুটো পায়ের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা।
এদিকে সাদী সাহেব মগ্ন হয়ে পড়েছে বাক্সের ছবিগুলো নিয়ে। শহীদের উপস্থিতির কথা ভুলে একটা করে ছবি তুলছে চোখের সামনে, দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। খানিক পর পরই তার মুখের চেহারা পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনও মুচকি হাসি ফুটছে ঠোঁটে, কখনও বিড় বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করছে, কখনও মুগ্ধ হয়ে পড়ছে।
এই নিন ছুকরীর ছবি…
শহীদের দিকে না তাকিয়ে আর একটা ছবি বাড়িয়ে দিল সাদী সাহেব। ছবিটা নিল শহীদ। রাফিয়া সুলতানারই ছবি। নাচছে সে। পরনে রাউজ এবং ঘাগরা।
এই নিন বাদশা খানের খেলার ছবি। দেখুন, কী ভয়ঙ্কর খেলা! মেয়েটির সাহসও দেখুন।
শহীদের দিকে না তাকিয়েই ছবিটা বাড়িয়ে ধরল সাদী সাহেব। ছবিটা হাতে নিয়ে তাকাতেই ছ্যাৎ করে উঠল শহীদের কলজেটা।
একে? বাদশা খানের সাথে এ মেয়েটা কে?
ভাল করে দেখতে লাগল শহীদ। খেলা দেখাচ্ছিল বাদশা খান, সেই সময় ছবিটা তোলা হয়। পিস্তলটা শূন্যে দেখা যাচ্ছে, হ্যাট পরা বাদশা খান হাত তুলে রয়েছে সেটা ধরবার জন্যে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তার ঠোঁটে একটা সিগারেট। হাসছে সে।
ফটোগ্রাফার লোকটা নিজের কাজ বোঝে ভাল। খুবই সুন্দর, পরিষ্কার ছবি তুলেছে সে। মেয়েটার চোখের পাপড়িগুলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
রীটা গোমেজ!
না, চিনতে ভুল হবার প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েটা যে রীটা গোমেজ তাতে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।
.
০২.
মৃদু কণ্ঠে ডাকল শহীদ, সাদী সাহেব।
সাদী সাহেব শুনতে পেল না। ছবি দেখছে সে তন্ময় হয়ে। দাঁতহীন মাড়ি দেখা যাচ্ছে, আপন মনে হাসছে সে।
সাদী সাহেব।
মুখ তুলল সাদী সাহেব। অপ্রতিভ দেখাল তাকে, কী কাণ্ড দেখুন দেখি! বুড়ো হচ্ছি তো, ভীমরতি পাকড়াও করছে দেখুন, কেমন আলগোছে ভুলে গেছি আপনার কথা।
সাদী সাহেব, এই মেয়েটা, বাদশা খানের এই সহকারিণী-কে এ? নাম কি?
রীটা গোমেজ। খ্রিষ্টান। বিশেষ কিছু জানি না ওর কথা। চাকরি করত না। ওকে টাকা-পয়সা যা দিত বাদশা খানই দিত। আমাদের চুক্তি ছিল বাদশা খানের সাথে। সে কাকে কি দিত আমরা জানতাম না। তার সহকারী বা সহকারিণীদের সম্পর্কে আমি বিশেষ খবর নিতাম না।
কোথায় আছে সে এখন জানেন?
না।
বাদশা খান এখান থেকে চলে যাবার পর রীটা গোমেজ বুঝি তার সাথে চলে যায়?
না, বাদশা খানের আগেই সে বিদায় নেয়। তার একটা কারণও ছিল। বাদশা খান সুলতানা চুকরীর সাথে পিরিত পিরিত খেলা খেলতে শুরু করলে খেপে যায় রীটা গোমেজ, ঝড়গা-ঝাটিও হয় ওদের দুজনের মধ্যে, কিন্তু বাদশা খান সুলতানা ছুকরীর মোহ ত্যাগ করতে পারেনি–তাই চলে যায় মেয়েটা। মেয়েটা চলে যাবার পর বাদশা খানের রিভলভারের খেলাটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, অমন শক্ত নার্ভের মেয়ে আর পাওয়া গেলে তো! সত্যি, বুঝলেন, মি. শহীদ, এই একটা মেয়ে রীটা গোমেজ ইস্পাতের চেয়েও মজবুত নার্ভ। তা না হলে অমন ভয়ঙ্কর রিস্কি খেলায় কেউ অংশ নেয়? বাদশা খান পরে চেষ্টা করেছিল সুলতানা ছুকরীর সাহায্য নিয়ে খেলাটা শুরু করতে, কিন্তু ছুকরীর নার্ভই ছিল না, কোনমতে রাজি হয়নি সে।
মাস ছয়েক হবে বোধহয় রীটা গোমেজ চলে গেছে?
তা হবে। মাস ছয়েকই হবে।
পরে আর কোন খবর পাননি তার?
চেষ্টা করলে হয়তো পেতাম। চেষ্টা করিনি। মেয়েটা বড্ড জেদী ছিল। আর কোন খেলাও জানত না।
শহীদ বলল, আর মাত্র দুচারটে প্রশ্ন করব, সাদী সাহেব। আচ্ছা, ইয়াকুব নামের কাউকে চেনেন?
ইয়াকুব? দাঁড়ান, কমপিউটরের চাবি টিপে দেখি…।
সাদী সাহেব কানের উপরে, মাথার পাশে আঙুল ভাঁজ করে টোকা মারতে লাগল। খানিক পর বলল, দুঃখিত। না।
জোয়ারদার সম্পর্কে কিছু জানেন? জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস-এর মালিকের কথা জানতে চাইছি আমি। লোকটা দেখতে কেমন?
মোষের মত কালো, ওই রকমই দেহ, চেঁচিয়ে কথা বলে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে দুচার সেকেণ্ড পরপরই–বেঁটে।
হেসে ফেলল শহীদ। বলল, লোক হিসেবে কেমন?
বাদশা খান তার সাথে ব্যবসায় যোগ দিয়েছে–বুঝতে পারছেন না? দুজন দুরকম দেখতে হলে হবে কি-একই চরিত্রের চিড়িয়া। চোর, বদমাশ, গুণ্ডা, ফন্দিবাজ–কি নয় ওরা? জানেন, ওদের সম্পর্কে খবর নিতে আমার কাছে পুলিস পর্যন্ত এসেছিল।
পুলিস এসেছিল? কবে? কেন?
মাস কয়েক আগে। আমরা তো ওদেরকে দিয়েই ছবি তোলাই–তাই এসেছিল। জানতে চাইল, জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস-এর মালিকদের কেউ আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে কিনা কখনও। আমি বললাম না। চলে গেল। কিন্তু যাবার সময় বলে গেল, ব্লাকমেইলিংয়ের অভিযোগ আছে ওদের বিরুদ্ধে সাবধানে থাকবেন। তারপর থেকে আমরা ওদেরকে দিয়ে আর ছবি তোলাই না।
আসলে কি সত্যি ওরা…।
চোখ বুজে সাদী সাহেব বলল, আমি আগেই শুনেছিলাম, বুঝলেন? পুলিসকে না বললে কি হবে। হ্যাঁ, ওরা ব্ল্যাকমেইল করে। কিভাবে জানেন? বলছি, শুনুন। ধরুন, ফটোগ্রাফির দোকানে ছেলে-মেয়ে, প্রেমিক-প্রেমিকারা তো ছবি তুলতে যাবেই। ওরা করে কি, ছবি তোলার পর মেয়েদের কাছে চিঠি পাঠায় তোলা ছবি তার বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে–বুঝলেন?
শহীদ মাথা নাড়ল। বলল, ওরা দুজনেই তাহলে এই রকম লোক?
দুজনেই। তবে বাদশা খান এককাঠি বাড়া। টাকার জন্যে করতে পারে না এমন কাজ নেই। আর একটা কথা, লোকটা বড্ড নিষ্ঠুর টাইপের। মি. শহীদ, দয়া করে ওর সাথে লাগবেন না। গুলি করার হাত ওর খুব ভাল কিনা।
বিদায় নেবার সময় আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল শহীদ। ঢাকার ঠিকানা দিয়ে বলল, দরকার হলে, কোন বিপদে পড়লে ফোন করবেন। আপনার সাহায্যে আমি আসবই।
সাদী সাহেব বলল, ওরে বাপস! আমার রোগ দেখছি আপনার মধ্যেও আছে। মানুষের উপকার করতে খুব মজা লাগে, না?
হাসতে হাসতে বিদায় নিল শহীদ।
.
গিলতে শুরু করল কামাল কথাগুলো। কথা তো বললই না, নিঃশ্বাসও ফেলল না সে নিয়মিত। সবই ধীরে ধীরে বলল শহীদ। ওর বলা শেষ হতেও কামাল বোবা হয়ে রইল।
অনেকক্ষণ পর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে, এত সব ঘটনা-কিন্তু একটার সাথে একটা যোগ করলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে কি?
ঘটনাগুলো জটিল এক রহস্যময় কাহিনীর টুকরো অংশ মাত্র। জোড়া লাগাতে হবে। ব্যস্ত হবার কিছু নেই, ধীরে সুস্থেই জোড়া লাগাবার কাজটা সারব আমরা। টুকরো ঘটনা আরও আছে, সেগুলোও সংগ্রহ করতে হবে।
রীটা…।
জানি না। সে এই রহস্যে জড়িত কিনা বা কতখানি জড়িত বোঝা যাচ্ছে না।
সিগারেট ধরিয়ে কামাল বলল, বাদশা খানের সাথে জোট পাকায়নি তো সে?
অসম্ভব নয়। বললাম তো, জানি না। ঢাকায় তার উপস্থিতি কাকতালীয় অর্থাৎ দৈব-দুর্ঘটনাও হতে পারে। বাদশা খানকে, সে হয়তো চিরজীবনের জন্যে ভুলে গেছে। জানি না ঠিক, তবে জানব আমি। সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কি জানিস?
রাফিয়া সুলতানা বাদশা খানের স্ত্রী অর্থাৎ বিবাহিতা সে, তা সত্ত্বেও বিয়ে করেছে তোয়াব খানকে। বাদশা খানকে ত্যাগ না করেই…।
হ্যাঁ। রাফিয়া যদি গোপনে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে থাকে–আমি বলতে চাইছি, বাদশা খানকে গোপন করে বিয়ে করে থাকে, এবং বাদশা খান পরে যদি ব্যাপারটা জেনে ফেলে থাকে–ব্ল্যাকমেইলারকে খুঁজে বের করার দরকার নেই। বাদশা খানই রাফিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করছিল, ধরে নেয়া যায় সেক্ষেত্রে। আর একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাদশা খান ৪৫ কোল্ট অটোমেটিক ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত। হত্যাকাণ্ডগুলো তার কীর্তি হওয়া বিচিত্র নয়।
কামাল চিন্তা করতে লাগল ব্যাপারটা।
একসময় প্রশ্ন করল, আমার মাথায় এত সব ব্যাপার খেলছে না, শহীদ, স্বীকার করছি। আমি একবারে একটা প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে চাই। জামানকে বাদশা খান খুন করেছে বলে মনে করিস কিনা তাই বল?
হয় বাদশা খান, নয়তো জোয়ারদার এবং বাদশা খান মিলিতভাবে।
হু। আচ্ছা, ইয়াকুবের ব্যাপারটা কি? সন্দেহের আওতা থেকে বাইরে থাকছে সে?
জানি না, ঠিক বলতে পারছি না। ঋতুর সাথে তার রহস্যময় কোন সম্পর্ক অবশ্যই আছে, আমার ধারণা। কিন্তু এই ম্যাসাকারে ওদের কার কি ভূমিকা তা এখনও বলার সময় আসেনি।
কামাল অসন্তোষের সাথে বলে উঠল, দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর জানিস না তুই।
শহীদ দৃঢ় গলায় বলল, কিন্তু একটা কথা জানি আমি। জোয়ারদারের পেট থেকে কিভাবে কথা বের করতে হবে, খুব ভাল করে জানি। ওটাই এখন সবচেয়ে বড় কর্তব্য। সেই কর্তব্যই পালন করতে যাচ্ছি আমরা।
বাদশা খান? তার পেট থেকে।
শহীদ বলল, দূর বোকা। সে কি এখানে নাকি? সে তো ঢাকায়। অবশ্য এটাও আমার অনুমান। তবে এ অনুমান সত্যি হতে বাধ্য।
সুটকেস থেকে রাইটিং প্যাড বের করল শহীদ। প্যাডের সাদা কাগজে লিখল বড় বড় অক্ষরে
আজকের মত ব্যবসা বন্ধ।
কি লিখলি? এ আবার তোর কি হেঁয়ালি? আজকের মত ব্যবসা বন্ধ–মানে?
আমাদের ব্যবসা নয়, বন্ধু, জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস-এর। শোন, আমি ভিতরে গিয়ে যখন কথা বলব তুই তখন দরজার বাটে এটা সেঁটে দিবি, তারপর ভিতর থেকে বন্ধ করে দিবি।
তারমানে-অ্যাকশন?
মাথা নাড়ল শহীদ, অ্যাকশন। অফকোর্স! তিন
.
০৩.
দুই কবাটের বড় দরজা। রাস্তা পেরোবার সময়ই ভিতরটা দেখে নিল ওরা। কাউন্টারে বসে আছে মিয়মান এক যুবক। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গাল ভর্তি, চোখ দুটো বুজে আসছে ঘুমে। তার পিছনেই একটা দরজা পর্দা দিয়ে আড়াল করা। দুপাশে কাঁচের দেয়াল আলমারি, ভিতরে বিভিন্ন আকারের ফটো পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। আলমারির মাথার উপর কাঠের সেলফ, লম্বা লম্বা। সেগুলো সাজানো রয়েছে ফিল্মের বাক্স, বাক্স ছাড়া ফিল্মের রিল, কেমিক্যালসের কৌটা, ইত্যাদি দিয়ে।
প্রথমে শহীদ ঢুকল। পিছন পিছন কামাল দরজার কাছ পর্যন্ত গেল।
কি চাই?
সিধে হয়ে বসল বিষণ্ণ যুবক। গাল চুলকাচ্ছে সে, খস খস করে শব্দ হচ্ছে। বহুদিন বোধহয় স্নান করে না, দুর্গন্ধে ভরা শরীর। খেতেও পায় না ঠিক মত, এখানে মরতে এসেছে কাজ নিয়ে।
ছবি তুলব।
যুবক দেখল কামাল দরজার একটা কবাট বন্ধ করে দিয়ে সেটার আড়ালে চলে গেল।
উনি কে…দরজা বন্ধ করলেন কেন?
শহীদ হাসছিল, যুবক ওর দিকে তাকাতেই বলল, অন্ধ নাকি হে তুমি? আমার হাতে এটা কি দেখতে পাচ্ছ না?
তাকাল যুবক শহীদের হাতের দিকে।
যা আশঙ্কা করেছিল শহীদ, তাই ঘটল। অনভিজ্ঞ যুকটি চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে গেল শহীদের হাতের রিভলভারটা দেখে।
ঘুসি মারুল শহীদ যুবকের কপালের পাশে। এছাড়া উপায় ছিল না চিৎকারটা থামাবার। চেয়ারের উপর বসে পড়ল যুবক, এবং জ্ঞান হারাল। অজ্ঞান দেহটা এক হাত দিয়ে ধরে চেয়ারে বসিয়ে রাখল শহীদ।
দরজার দুটো কবাটই বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে হুড়কো লাগিয়ে উপরের ব্যও নামিয়ে দিল কামাল। শহীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করুল, মজার কাজগুলো তুই সব একা করবি, আমাকে করতে দিবি না নাকি?
চাপা কণ্ঠে ধমকে উঠল শহীদ, আহ! কাউন্টারের ওপাশে যা, বেঁধে ফেল ওকে। মুখে তুলো ওজতে ভূলিসনে।
পকেট থেকে নাইলনের কর্ড এবং তুলো বের করল কামাল, ফিস ফিস করে বলল, গভীর শোনাল তার গলা, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমাদের মধ্যে আর কেউ আমরা খুন হচ্ছি না। যা করার করেছে, এবার আমাদের পালা।
কাউন্টারের ওপাশে গিয়ে কামাল অজ্ঞান যুবকের দায়িত্ব নিল। শহীদ উদ্যত রিভলভার হাতে নিয়ে কাউন্টারের ওপাশে পর্দা সরিয়ে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছোট একটা কামরা, পা দিয়েই শহীদ মদের গন্ধ পেল। পুরানো সোফা, কয়েকটা চেয়ার, দুটো আলমারি ছাড়া আর কিছু নেই। ক্যামেরা নেই দেখে শহীদের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এটা স্টুডিও নয়। আর একটা দরজা দেখা যাচ্ছে মুখোমুখি। সেটাতেও পর্দা ঝুলছে।
পা টিপে টিপে সেদিকে এগোল ও। সামনে না, দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা ইঞ্চিখানেক সরিয়ে একটা চোখ দিয়ে তাকাল ভিতরে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তিন পা ওয়ালা ক্যামেরাটার দশ-বারো হাত সামনে কালো কাপড়ের স্ক্রিন। ক্যামেরার দুই পাশে দুটো বড় বড় ফ্লাডলাইট।
পর্দাটা আরও একটু ফাঁক করতে স্টুডিওর প্রায় সবটুকু দৃষ্টিগোচর হলো। পিছন ফিরে চেয়ারে বসে রয়েছে একটা লোক।
প্রশংসা করল শহীদ মনে মনে সাদী সাহেবের। নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে সে। মোষের মত কালো, ষাড়ের মত দেহ–এবং বেঁটেও বটে। লোকটার একপাশে একটা পাতলা লোহার পাতের চেয়ার। সামনে টেবিল। হাতে গ্লাস তুলে নিয়ে কে ঢক করে কি যেন গলায় ঢালল সে। লোকটা যে জোয়ারদার তাতে সন্দেহ নেই।
অবশ্যই মদ। গন্ধ আগেই পেয়েছে শহীদ। শুধু যে মদই পান করছে তা নয়। মাথা নিচু করে কোন কাজ করছে সে, কি করছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কাঁধে টোকা পড়ল শহীদের। পা বাড়াল শহীদ পিছন দিকে না তাকিয়েই। রিভলভারটা পিছনে লুকিয়ে ফেলল ও।
আশা করেনি শহীদ, কিন্তু নিস্তব্ধতা ভাঙল পিছন থেকে কামাল।
রিভলভারটা লুকোচ্ছিস কেন? ওটা দেখা ওকে।
স্প্রিঙের মত উপর দিকে লাফ দিল জোয়ারদার। হাতটা পৌঁছে গেছে। টেবিলের দেরাজের হাতলে। টান দিয়ে সে দেরাজটা খুলতেই শহীদকে ছাড়িয়ে ক্ষ্যাপা ষাড়ের মত মাথা নিচু করে তীরবেগে ছুটে গেল কামাল।
লোকটার পেটে তো মারল কামাল। জোয়ারদারের হাতটা আটকে গেল দেরাজের ভিতর, সেটা নিয়ে পড়ল সে দেয়ালের গায়ে, সেখান থেকে মেঝেতে। হেলে পড়া ভারি বস্তাকে যেমন টেনে হিঁচড়ে খাড়া করার চেষ্টা করা হয়, তেমনি গায়ের জোরে লোকটাকে দাঁড় করাল কামাল। দুতিন সেকেন্ড সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করল সে, তারপর ঘুসিটা মারল ঠিক নাকের ব্রীজের উপর।
ছিটকে পড়ে গেল বেটে ষাঁড়টা, ক্যামেরাটাকে সাথে নিয়ে। কামাল বিনাবাক্যব্যয়ে লোকটার বুকের উপর গিয়ে বসে পড়ল।
দেখিস, দম আটকে মরে না যায়।
কামাল বলে উঠল, পাগল হয়েছিস? চব্বিশ ঘণ্টা একনাগাড়ে ধোলাই দিলেও এর কিছু হবে না। অ্যাই শয়তানের নফর, নাম কি তোর?
নাকটা তেলে গেছে, ফুটো দিয়ে দুটো রক্তের মন্থর ধারা গড়িয়ে আসছে। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কামাল ও শহীদ দুজনেই আশ্চর্য না হয়ে পারল না। ভয় পায়নি, ভয়ের কোন ছাপই নেই চেহারায়। ওদের চোখের দিকে লোকটা একবারের বেশি বোধহয় দুবার তাকায়নি, তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে শহীদের হাতের দিকে, হাতে ধরা রিভলভারটার দিকে। দুর্জয় মনোবলের অধিকারী এই লোক। কোন কিছুতেই ঘাবড়ায় না।
দেরাজটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ছোট আকারের একটা পিস্তল তুলে নিয়ে নিঃশব্দে পকেটে ভরল ও।
কামালকে ইঙ্গিত করতে কামাল উঠে দাঁড়াল। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ, উঠে বসো, বাছা!
আশ্চর্য, ঝট করে উঠে বসল লোকটা।
সাবধান, শহীদ! শুয়োরটা…।
জুতো দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে লাথি মারল শহীদ লোকটার পেটে। গড়িয়ে গেল। দেহটা, কালো কাপড়ের সাথে জড়িয়ে পড়ল। দুপা এগিয়ে কাপড়টা ধরে টান মারুল কামাল। ঝুপ করে সিলিং থেকে কাপড়টা পড়ল লোকটার উপর, ঢাকা পড়ে গেল সে।
কালো পর্দাটা পড়ে যেতে কামাল দেখল একটা কেরোসিন স্টোভ রয়েছে। দেয়াল ঘেষে। একগাল হেসে বলে উঠল, পেয়েছি।
কাপড়ে ঢাকা লোকটার কুণ্ডলী পাকানো শরীরে গোটা চারেক শক্ত লাথি মেরে থামল শহীদ। ঘাড় ফিরিয়ে কামালকে স্টোভ জ্বালাতে দেখে বলল, ও কি করছিস?
শয়তানের নফরকে ছ্যাক দেব।
স্টোভটা জ্বেলে উঠে দাঁড়াল কামাল, লোহার চেয়ারটা টেনে নিয়ে এল, দাঁড় করিয়ে দিল সেটাকে স্টোভের উপর। স্টোভের অগ্নিশিখা লক লক করছে। গরম হতে লাগল চেয়ারটা।
ক্যামেরাটা আস্ত রেখে লাভ আছে কিছু? জানতে চাইল কামাল।
শহীদ বলল, যাবার আগে ওর হাত,পা, ঘাড় মটকে দিয়ে যাব-ক্যামেরা ব্যবহার করার ক্ষমতা ওর আর থাকবে না।
তিনপেয়ে ক্যামেরাটা তুলে আছাড় মারতে লাগল কামাল। টুকরো টুকরো, শতটুকরো না হওয়া পর্যন্ত থামল না সে।
কালো কাপড়টা সরিয়ে মুক্ত করল শহীদ লোকটাকে। পরিবর্তন নেই, সেই একই নির্বিকার চেহারা, ভয়হীন। খেপে গেল শহীদ। লোকটার ডান হাত ধরে ফেলল ও, একটা পা রাখল পাজরে, তারপর হাতটা মোচড় দিতে দিতে সর্বশক্তি দিয়ে টানতে লাগল।
ছিড়ে যাবে হাতটা, মনে হলো। কামালের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। লোকটার মুখে ভাজ পড়ল এইবার। অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগল সে।
জামানকে খুন করেছ কেন? জানতে চাইল শহীদ।
চেঁচাচ্ছে লোকটা, শহীদের প্রশ্ন শুনে আরও জোরে চেঁচাতে শুরু করল। ছেড়ে দিল শহীদ, তারপর লাথি মেরে উপুড় করে দিল দেহটাকে।
চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে। আবার প্রশ্নটা করল শহীদ।
আমি…কি বলছেন বুঝতে পারছি না।
শহীদ মাথা নাড়তে নাড়তে তাকাল কামালের দিকে, চেয়ার তোর গরম হয়েছে?
চেয়ারের বসার জায়গায় হাত ঠেকিয়েই সরিয়ে নিল কামাল, বড্ড!
ধর, বসিয়ে দিই।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠল কামাল। শয়তানের নরসিংহাসনে উঠে বসো।
ধরাধরি করে তুলল ওরী লোকটাকে। হাত পা ছুঁড়তে শুরু করল সে। কানের নিচে ঘুসি মারুল শহীদ, নেতিয়ে পড়ল লোকটা সাথে সাথে। কিন্তু জ্ঞান ঠিকই আছে।
চেয়ারে বসিয়ে দিতেই বিকট স্বরে আর্তচিৎকার শুরু করল সে। দুজনের সম্মিলিত চেষ্টাতেও সামলাতে পারছে না ওরা লোকটাকে। দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে চেয়ারটা খাড়া রেখেছে কামাল, শহীদ লোকটাকে ঠেসে ধরেছে চেয়ারের সাথে।।
কানের পর্দা ফেটে যাবে মনে হলো লোকটার চিৎকারে।
কথা বলবি এবার?
মাথা নাড়তে লাগল লোকটা। নাক কুঞ্চিত করল কামাল। কাপড়-পোড়ার দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। চামড়া পোড়ার গন্ধটা নাকে ঢুকতে বমি পেয়ে গেল তার।
ইশারা করল সে। ছেড়ে দিল শহীদ লোকটাকে। পিছিয়ে এল দুপা। কামাল চেয়ারের পায়ায় লাথি মারতে চেয়ারসহ পড়ে গেল লোকটা মেঝেতে।
কেন খুন করেছিস জামানকে?
গোঙাতে লাগল লোকটা। চিবুকে পা ঠেকিয়ে খোঁচা মারল কামাল, আবার বসবি নাকি সিংহাসনে, শয়তানের নফর?
মাথা দুলিয়ে লোকটা বলল, না! না…!
শহীদ বলল, তোর নাম জোয়ারদার?
হ্যাঁ।
জামানকে খুন করেছিস কেন?
কে জামান আমি জানি না।
লোকটার মুখের সামনে বসল শহীদ। মাথাটা নিচু করে বলল, আবার বল, শুনতে পাচ্ছি না তোর কথা।
সেই অস্ফুটেই বলে উঠল লোকটা, আমি চিনি না।
শহীদ কামালের দিকে তাকাল, আবার চেয়ারের নিচে স্টোভটা দে। চেয়ারে বসিয়েই কথা বলাতে হবে।
বিড়বিড় করে কি যেন বলল লোকটা।
কি বলছিস?
মাথা নিচু করে কান পাতল শহীদ।
জোয়ারদার বলল, আমি না…আমি খুন করিনি।
শহীদ বলল, কামাল।
জোয়ারদারের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। বলল, বাদশা…আমি না…।
বাদশা খান? সে খুন করেছে জামানকে?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। পরিষ্কার কণ্ঠে বলল জোয়ারদার।
শাবাশ! এই তো লক্ষ্মী ছেলের মত আচরণ।
নিচু কিন্তু পরিষ্কার গলায় জোয়ারদার বলতে শুরু করল। তবে কামাল নিজের কাজ গুছিয়ে রাখল, দরকারের সময় যাতে সময় নষ্ট করতে না হয়। আধ ঘন্টার মধ্যে সব কথা আদায় হলো। এর মধ্যে দুবার মাত্র আধ মিনিটের জন্যে উত্তপ্ত চেয়ারে বসাতে হলো জোয়ারদারকে। তার কথা থেকে বোঝা গেল, জামান সরাসরি এই দোকানে ঢোকে কোন রকম বিপদের আশঙ্কা না করেই। সন্ধ্যার খানিক পর জামান ঢুকেছিল। জোয়ারদারকে রাফিয়া সুলতানার ছবি দেখিয়ে জামান জানতে চেয়েছিল তার সম্পর্কে সে কিছু জানে কিনা।
বাদশা স্টুডিওর ভিতর ছিল। ওখান থেকেই সে জামানের কথা শুনতে পায়। রাফিয়া সুলতানার নামটা শুনেই সে বেরিয়ে যায় কাউন্টারের কাছে। জামানকে সে বলে, রাফিয়া সম্পর্কে সে সব কথা জানে। ভিতরে এলে ধীরে সুস্থে সব কথা, বলা যেতে পারে। কোন রকম সন্দেহ করেনি জামান। বাদশার সাথে সে স্টুডিওতে ঢোকে। তারপর বাদশা রিভলভার বের করে। জানতে চায়, কোত্থেকে এসেছে জামান। জামান ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশনের নাম বলে। বাদশাকে রাফিয়া সুলতানা ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশনের নাম বলেছিল। সুতরাং বাদশা ব্যাপারটা কি বুঝতে পারে। গুলি করে সে জামানকে। লাশটা দোকানের সামনেই: দাঁড়ানো গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। আমি এইটুকুই জানি।
কামাল আবার বসাল জোয়ারদারকে চেয়ারে।
বাদশা খান কোথায় এখন?
মিনিট খানেক বিকট স্বরে গগন ফাটাল জোয়ারদার। চেয়ার থেকে ধরাধরি করে নামাল ওরা তাকে। মাথাটা খাড়া রাখতে পারছে না সে আর। ঢলে পড়ছে কাঁধের উপর বারবার। শোনা যায় কি যায় না, অফুটে বলল, সে রাফিয়ার সাথে দেখা করতে গেছে।
কখন?
কাল রাতে। দশটার প্লেনে।
বাদশা খানের স্ত্রী রাফিয়া, তাই না?
হ্যাঁ।
জানিস তুই, রাফিয়া মোহাম্মদ তোয়াব খান নামে এক ধনী ভদ্রলোককে বিয়ে করেছে আবার?
চোখ বুজে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে জোয়ারদার, জানি..। পরামর্শটা দিয়েছিল বাদশাই। তার ধারণা ছিল রাফিয়া তোয়াব খানের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা খসাতে পারবে।
রাজি হলো কেন রাফিয়া? সে কি বাদশা খানকে ভয় করত?
জোয়ারদার মাথা দোলাল, না।
তবে? ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হত না?
হত…। কিন্তু তাতে কি, ওরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারত না। মারামারি করত দুজনেই, কিছু দিন একজন আর একজনকে ছেড়ে দূরে দূরে– থাকত, কিন্তু আবার একসাথে হত। এই রকম দূরে দূরে থাকার সময় রাফিয়া তোয়াব খানের সাথে পরিচিত হয়। সে বাদশা খানের কাছে আসে, জানতে চায় কি করা উচিত। বাদশা তাকে বুদ্ধি দেয়। তোয়াব খানকে বিয়ে করে ফেলতে বলে। বিয়ে করে দুই হাতে টাকা আদায় করার পরামর্শ দেয়। দুজনে মিলে ঘন্টার পর ঘণ্টা পরিকল্পনা করে ওরা, কিভাবে কি করা হবে তাই নিয়ে।
প্রশ্ন করুল শহীদ, রীটা গোমেজ সম্পর্কে কি জানিস তুই?
মাথা দোলাল জোয়ারদার। বলল, বাদশার সাথে কাজ করত। বাদশা তখন রাফিয়াকে বিয়ে করেনি। মেয়েটাকে দেখিনি কখনও–জানিও না বিশেষ কিছু।
গতরাতে গেছে বাদশা খান ঢাকায়। এর আগে কবে গিয়েছিল?
দুরাত আগে। রাফিয়া ঢাকা থেকে ফোন করায় খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সে। রাফিয়া ফোনে বলে, তাকে কেউ অনুসরণ করছে। বাদশা গিয়েছিল ঢাকায় রাফিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে, কিন্তু রাফিয়ার সাথে দেখা হয়নি তার।
দেখা না হওয়ায় ফিরে আসে সে?
হ্যাঁ। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। আমাকে বলল, যে মেয়েটা রাফিয়াকে অনুসরণ করছিল সে খুন হয়েছে। তার ভয় হচ্ছিল তাদের ষড়যন্ত্রটা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নিজেকে মুক্ত রাখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল। রাফিয়ার সাথে দেখা করতে পারেনি বলে বেশি দুশ্চিন্তা করছিল সে।
ফোনে সে রাফিয়াকে জানায়নি কখন সে পৌঁছুবে ঢাকায়?
না। রাফিয়াকে সে প্রথমে বলে কাজ আছে, ঢাকায় এখন যেতে পারবে না সে। কিন্তু ঘন্টাখানেক পর সে মত বদলায়। ঠিক করে ঢাকায় গিয়ে ব্যাপারটা কি জেনে আসবে সে।
আবার সে গেছে, কেমন? কবে ফিরবে?
তা বলে যায়নি আমাকে।
একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বলল শহীদ, রাফিয়া পরশু রাতে খুন হয়েছে।
নড়ে উঠল জোয়ারদারের ঠোঁট দুটো। কিন্তু কোন শব্দ বের হলো না। দেহটা লম্বা করে পড়ে আছে সে। মুখটা রক্তাক্ত, মাঝে মাঝে ঘষছে মেঝের উপর।
বাদশা খানের রিভলভারটা কিরকম?
বড় সাইজের। নাম জানি না। রিভলভার-পিস্তল সম্পর্কে কিছু জানি না আমি।
দেরাজে যেটা ছিল-কার!
বাদশারই। রেখে গেছে। বড়টা নিয়ে গেছে সাথে করে।
উঠে দাঁড়াল শহীদ।
কাজ শেষ? জানতে চাইল কামাল।
শহীদ মাথা নাড়ল।
আমার কাজ শেষ হয়নি। কথাটা বলেই কামাল জ্বলন্ত স্টোভটা টেনে নিল কাছে। খপ করে ধরুল সে জোয়ারদারের একটা হাত। দুই হাত দিয়ে টেনে আনল হাতটা। স্টোভের অগ্নিশিখার উপর নামিয়ে দিল গায়ের জোরে।
শয়তানের নফর!
দাঁতে দাঁত চেপে বলল কামাল।
.
০৪.
ছয়টায় চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে আকাশে উড়ল প্লেন।
সন্ধ্যার সময় ঢাকায় ফিরে এল শহীদ। সরাসরি বাড়িতে পৌঁছুল ও। মহুয়া দরজা খুলে দিয়ে ওকে দেখেই স্থির হয়ে গেল। পরক্ষণে অদ্ভুত, হাসি ফুটল তার ঠোঁটে।
মাথাটা কেমন আছে তোমার?
ভাল নেই, নতুন নতুন দুশ্চিন্তায় ভরাট হয়ে গেছে।
ভিতরে ঢুকে সোফায় বসল শহীদ।
কামাল কোথায়?
চট্টগ্রামে। মহুয়া, এক কাপ কফি খাওয়াতে পারো?
ক্লান্ত শোনাল শহীদের কণ্ঠস্বর।
নিঃশব্দে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে রইল মহুয়া স্বামীর দিকে।
তারপরও ত্রস্ত পদে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে।
পাঁচ মিনিট পর ট্রে হাতে নিয়ে লেবু ঢুকল, পিছনে মহুয়া। লেবু ট্রে নামিয়ে রেখে চলে যেতে মহুয়া বলল, শুধু কফি খেয়ো না, কিছু মুখে দিয়ে নাও।
কেক-এ কামড় দিয়ে শহীদ বলল, জামানের খুনীকে অন্তত চিনতে পেরেছি, মহুয়া। লোকটার নাম বাদশা খান। হয় সে এই ঢাকাতেই আছে, নয়তো ফিরে গেছে চট্টগ্রামে। খবর নেবার জন্যে রেখে এসেছি ওখানে কামালকে।
নতুন নাম–কে লোকটা?
রাফিয়ার স্বামী সে।
মহুয়া ভুরু কোঁচকাল, কি বলছ?
ঠিকই বলছি। মেয়েটা তোয়াব খানকে বিয়ে করে এই বাদশা খানের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও। লোকটাকে পাইনি এখনও, তবে পাব। মনে হচ্ছে, ভয়ঙ্কর লোক– তার সাথে লাগতে হলে বিপদের আশঙ্কা ষোলো আনা মনে রাখতে হবে সর্বক্ষণ। সবরকম আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারে অভিজ্ঞ.লোক।
মহুয়া কি যেন বলতে গেল, শহীদ বাধা দিয়ে বলল, শোনো, রাইটিং প্যাড আর কলম নিয়ে এসো টেবিল থেকে। আমি বলি, তুমি লিখতে থাকো।
নিঃশব্দে উঠে গেল মহুয়া। কাগজ কলম নিয়ে ফিরে এসে বসল আবার শহীদের মুখোমুখি।
যখনই তোমার মনে হবে আমি বিপদে পড়েছি, অমনি কুয়াশা এবং মি: সিম্পসনকে ডেকে তোমার লেখা নোটগুলো দেখাবে। দেখলেই ওরা মোটামুটি সব বুঝতে পারবে। তবে, সাবধান, মারাত্মক কিছু না ঘটলে, অন্তত মি. সিম্পসনকে এটা কোনমতেই দেখাবে না।
মারাত্মক কি ঘটবে বলে আশঙ্কা করছ?
মহুয়া একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জানতে চাইল।
আশঙ্কা করছি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে, মনে মনে বলল শহীদ। কিন্তু মুখে বলল, আশঙ্কা করছি আমি বন্দী হব।
বন্দী হবে? কি বলছ বুঝতে পারছি না–কে এই ঢাকা শহরে তোমাকে বন্দী করতে যাচ্ছে?
শহীদ হাসল, করতে যাচ্ছে তা তো বলিনি, বলছি, করতে পারে। সে যাই হোক, হাতে সময় এমনিতেই কম, তুমি লিখতে থাকো। আতঙ্কিত হয়ো না, বুঝলে? নোট দিচ্ছি শুধু সাবধানতা অবলম্বনের জন্যে, তাছাড়া আর কোন কারণ নেই। আসলে ঘটবে না কিছুই।
বিশ্বাস করল না মহুয়া, তার চোখের দৃষ্টি দেখে বোঝা গেল।
স্থানটা চট্টগ্রাম…।
পাইপে আগুন ধরিয়ে শুরু করল শহীদ। একমুহূর্ত চিন্তা করে নিল। তারপর আবার শুরু করল, সময়টা–আজ থেকে দুবছর আগে। জুনের প্রথম ভাগ।
মহুয়াকে লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে ধীরে ধীরে বলে চলল শহীদ, একজন নর্তকী, যে নিজের নাম বলে রাফিয়া সালতানা, কোলকাতা থেকে উপস্থিত হয়। চট্টগ্রামে সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এক এজেন্টের মাধ্যমে পরিচিত হয় ফ্রেণ্ডশীপ নাইটক্লাবের ম্যানেজার সাদী সাহেবের সাথে। সাদী সাহেব তার নাচ পছন্দ করে এবং তাকে চাকরি দেয়। নাচে সে বেশ নাম করে। রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল শহরে তার বেলি ড্যান্স।
পাইপ কামড়ে ধরে চিন্তা করতে লাগল শহীদ। খানিক পর বলতে শুরু করল, ফ্রেণ্ডশীপ নাইটক্লাবটা ঠিক নাইটক্লাব নয়। মদ বিক্রি হয় না। নাচ ছাড়া সেখানে দেখানো হয় শারীরিক কসরৎ, কিছু কিছু ম্যাজিক, রাইফেলের খেলা, রিভলভারের খেলা, এই সব। রাফিয়ার নাচের পর যেটা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে সেটা একটা খেলা-রিভলভারের খেলা। এই খেলাটা দেখাত বাদশা খান নামে এক লোক। বাদশা খানের সহকারিণী ছিল একটি যুবতী। এই যুবতীর নাম-প্রীটা গোমেজ।
লেখা থামিয়ে চট করে মুখ তুলল মহুয়া, বলো কি?
হ্যাঁ। আমাদের রীটা। বাধা দিয়ো না, মহুয়া, লেখো। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ডিনামাইটের মত বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে। আরও একটা চমক পাবে তুমি একটু পর।
লিখতে শুরু করল মহুয়া।
একটু পর আবার বলতে শুরু করল শহীদ, বাদশা খান এবং রাফিয়া সুলতানা পরস্পরের প্রেমে পড়ে। বাদশা খান সিদ্ধান্ত নেয় রিভলভারের খেলা না দেখিয়ে সে তার বন্ধু জোয়ারদারের ফটোগ্রাফারের দোকানে টাকা খাটাবে। জোয়ারদার ফটোগ্রাফার-এর মালিক জোয়ারদার তার প্রস্তাবে রাজি হয়। জমানো কিছু টাকা। দিয়ে বাদশা খান স্টুডিওর অর্ধেক মালিক হয়। ওরা মিলিতভাবে ব্যবসাটা চালাতে শুরু করে। সাধারণত নাটকে অভিনয় করে, নাচে, গায়-এই ধরনের মেয়েদের ছবি তুলত ওরা। কলেজ ভার্সিটির ছেলেমেয়েদেরও ছবি তুলত একচেটিয়াভাবে। এইসব মেয়েদেরকে ওরা ব্ল্যাকমেইল করে ভাল টাকা রোজগার করত। পুলিস ব্যাপারটা সন্দেহ করে, কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
ম্যাচের কাঠি জ্বেলে পাইপটা নতুন করে ধরাল শহীদ।
বাদশা খান রাফিয়াকে বিয়ে করে গত বছর নভেম্বরের আট তারিখে। রীটা গোমেজ ফ্রেন্ডশীপ নাইট ক্লাব এবং বাদশা খানের সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায়। মাসখানেক পর বাদশা খানের সাথে ঝগড়া হয় রাফিয়ার। প্রায়ই ঝগড়া হত তাদের। কিন্তু এই ঝগড়াটা হয় বাড়াবাড়ি ধরনের রাফিয়া বাদশা খানকে ছেড়ে চলে যায়। সে নতুন একটা চাকরি নেয় স্টারলিট নাইটক্লাবে। ওখানেই সে পরিচিত হয় মোহাম্মদ তোয়াব খানের সাথে।
মহুয়া খসখস করে দ্রুত লিখে যাচ্ছে।
বছর খানেক আগে মোহাম্মদ তোয়াব খান তাঁর স্ত্রীকে এক মোটর অ্যাক্সিডেন্টে হারান। অসুস্থ, পঙ্গু একটি যুবতী মেয়ে আছে তাঁর। রাফিয়া ফাঁদ পাতে-এবং সফল হয়। তোয়াব খান তার ফাঁদে পা দেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন।
চোখ বুজে ভাবছে শহীদ।
বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে রাফিয়া তার স্বামী বাদশা খানের সাথে দেখা করে, প্রস্তাবের কথা তাকে জানায়। একজন কোটিপতির ঘাড়ে নিজের স্ত্রীকে তুলে দিতে পারলে প্রচুর টাকার মুখ দেখতে পাবে-এই ভেবে বাদশা খান পরামর্শ দেয় স্ত্রীকে তোয়াব খানকে বিয়ে করার। স্ত্রীর সাথে তার একটা মৌখিক চুক্তি হয়। তোয়াব খানের কাছ থেকে রাফিয়া যা আদায় করতে পারবে তার একটা অংশ, সম্ভবত অর্ধেক, দিতে হবে বাদশা খানকে। এই শর্তে একমূত হয় ওরা। এরপর তোয়াব খানকে বিয়ে করে রাফিয়া। তোয়াব খান বিয়ে করেন অনেকটা চুপিচুপি, বিশেষ কাউকে না জানিয়ে। ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন না তিনি। বিয়ে করে রাফিয়াকে তোলেন নিজের বাড়িতে, ঢাকার মুক্তা নিকেতনে। আমি রাফিয়া সম্পর্কে সন্ধান নিয়ে দেখেছি, ক্লেপটোম্যানিয়া রোগ তার নেই। তোয়াব খানের সন্দেহটা মিথ্যে। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার আগে বহুলোকের সাথে কথা বলি, যারা রাফিয়াকে চিনত। তারা কেউ স্বীকার করেনি রাফিয়ার ওইরকম বদভ্যাস ছিল বলে। আমি এখন বিশ্বাস করি যে রাফিয়ার বেডরূমে নানারকম ছোটখাট জিনিসভর্তি যে সূটকেসটা পাওয়া গেছে সেটা কেউ ষড়যন্ত্র করে ওখানে রেখে আসে। উদ্দেশ্য, তোয়াব খানের সাথে রাফিয়ার সম্পর্ক খারাপ করা। এ ব্যাপারে আমি একজনকেই সন্দেহ করি। সে হলো ঋতু, তোয়াব খানের পত্ন মেয়ে। রাফিয়া যদি শেষ পর্যন্ত তোয়াব খানের স্ত্রী হিসেবে টিকে যেত তাহলে ঋতু কয়েক কোটি টাকার সয়-সম্পত্তির অর্ধেক থেকে বঞ্চিত হত।
থামল শহীদ।
লেখা শেষ করে মহুয়া তাকাল, ঋতু সম্পর্কে আর কিছু জানোনি তুমি?
শহীদ বলল, ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় এখন নেই আমার হাতে, সুতরাং ওর প্রসঙ্গটা বাদ দিচ্ছি। রাফিয়ার সাথে সাধন সরকারের প্রেম–এই ব্যাপারটার সাথে বর্তমান কেসের কোন সম্পর্ক নেই। তোয়াব খান প্রায় বৃদ্ধ এবং নীরস, তাই রাফিয়া সাধন সরকারের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফুর্তি করার ইচ্ছা ছিল তার, আর কিছু নয়। এই ধরনেরই মেয়ে সে। আমি এখন বিশ্বাস করি সাধন সরকার বর্তমান কেসে জড়িত নয়। যদিও তার বাড়িতে শিল্পীর কাপড়-চোপড় পাওয়া গেল কেন এটা একটা গুরুতর রহস্য হয়ে রয়েছে। তবে এ রহস্যের কিনারাও হবে। সভবত সন্দেহের দৃষ্টি অন্য একজনের উপর গিয়ে পড়ুক, এই কথা ভেবে খুনী কাপড়-চোপড়গুলো রেখে এসেছিল সাধন সরকারের বাড়িতে। এটা অবশ্য আমার অনুমান মাত্র।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল ওরা।
নিস্তব্ধতা ভাঙল মহুয়া, জামানের কি হয়েছিল, শহীদ?
হ্যাঁ, জামানের প্রসঙ্গ। লেখো। জোয়ারদার যে রাফিয়ার ঘনিষ্ঠ কেউ তা জামান জানত না। দোকানে ঢুকেই সে বিপদে পড়ে। বাদশা খান ছিল সেখানে। রাফিয়া তাকে আমাদের ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশনের নাম বলেছিল। জামানের মুখে রাফিয়ার নাম এবং প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে বিপদের আশঙ্কা করে সে। আগে থেকেই অস্থির, নার্ভাস ছিল সে। যে রাতে শিল্পী খুন হয় সে রাতে সে ঢাকায় এসেছিল, কিন্তু রাফিয়ার সাথে দেখা হয়নি তার। দেখা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ছিল সে ভীষণ রকম। এই পরিস্থিতিতে জামানকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে, গুলি করে। স্টুডিওতেই মারা যায় জামান। তার আগে সে জামানের হাত-পা বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জামানকে খুন করে সে দশটার প্লেনে সেই রাতেই ঢাকায় এসেছে। সে হয়তো ভেবেছিল রাফিয়াকে খুন করতে পারলে যে ভয়ঙ্কর বিপদটা দ্রুত এগিয়ে আসছে তার কবল থেকে গা বাঁচানো সম্ভব হবে। পুলিস রাফিয়াকে ধরে টরচার করলেই রাফিয়া ষড়যন্ত্রের কথা বলে ফেলবে–এই ভয়ে পাগল হয়ে উঠেছিল সে। রাফিয়াকে সে খুন করেছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু, তার মোটিভ আছে, এটাই বলতে চাইছি আমি। অফিসরূমে সেই যে আমাকে পিছন থেকে আক্রমণ করেছিল তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। হ্যাট পরে সে। রাফিয়ার মৃতদেই সম্ভবত, ঠিক বলতে পারছি না, সে-ই সরিয়ে নিয়ে গেছে।
মহুয়া বলল, ঘটনা তো অনেক দেখছি। কিন্তু ফলাফল কি?
শহীদ দুর্বলভাবে হাসল, ফলাফল এখনও জানতে পারিনি। ঘটনাগুলো যোগ করতে হবে। আরও ঘটনা আছে, সংগ্রহ করতে হবে সব। তারপর ফলাফল। অঙ্কটা অস্বাভাবিক জটিল, মহুয়া। তবে জেনো, অঙ্ক আমি মেলাবই।
মহুয়া বলল, কিন্তু যত দেরি হচ্ছে খুনীর আত্মবিশ্বাস ততই বাড়ছে। এই আত্মবিশ্বাসের ফলে সে আরও খুন করতে ইতস্তত করবে না।
শহীদ বলল, খাঁটি কথা বলেছ। কি জানো…!
হঠাৎ থামল শহীদ। উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করল। অস্থির দেখাচ্ছে ওকে।
কি জানো, যদি জানতে পারতাম কেন শিল্পী খুন হয়েছে এবং কেন রাফিয়া তার নেকলেসটা শিল্পীর ফ্লাটে রেখে বেরিয়ে এসেছিল–তাহলে অঙ্কটা মিলিয়ে ফেলতে পারতাম। এই কেসটা আমার জীবনের সবচেয়ে জটিল কেস। সবকিছুই অন্ধকারাচ্ছন্ন, রহস্যময়। একটার পর একটা চমকপ্রদ তথ্য পাচ্ছি, অসংখ্য সূত্র রয়েছে হাতে, ঘটনাও ঘটছে একটার পর একটা অথচ কোন দিকে কোন কূলকিনারা দেখতে পাচ্ছি না। শিল্পীর নিহত হওয়া এবং নেকলেসটার রহস্য দুটো হলো মূল পয়েন্ট। এই দুটোর রহস্য উন্মোচিত করতে পারলে ঘটনা, তথ্য, সূত্র-একটার সাথে একটা সবগুলোকে মেলানো যাবে।
মাথা নিচু করে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে পায়চারি করেই চলেছে শহীদ। দৃষ্টি দিয়ে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে ওকে মহুয়া। অসহায় দেখাচ্ছে তাকে।
আমি আরও জানতে চাই। জানতে চাই কাজী হানিফের নাইট ক্লাবে রাফিয়াকে অমন ভীতা-হরিণীর মত দেখাচ্ছিল কেন? কিসের ভয়ে, কার ভয়ে অমন উন্মাদিনীর মত আচরণ করেছিল সে? নাইট ক্লাবের মত একটা জায়গা–কেন সে আত্মগোপন করেছিল সেখানে?
হঠাৎ হাতের পাইপটা কার্পেটের উপর আছাড় মেরে ফেলে দিল শহীদ। দ্রুত হলো ওর পায়চারি।
আমি জানতে চাই কেন সে খুন হলো? জানতে চাই তার লাশটা গায়েব হয়ে গেল কেন? কে সরিয়েছে তার লাশ? কেন? কি উদ্দেশ্যে?
শান্ত হও, শহীদ! উত্তেজিত হলে কোন সমাধানেই পৌঁছুতে পারবে না।
রীটা গোমেজ কি তার ভূমিকা? সে কি এখনও বাদশা খানের সাথে সম্পর্ক রাখছে? রাত্রে আমি আক্রান্ত হই, সকালে সে এসে হাজির–এটা কি একটা কোইনসিডেন্স? না! মনে হয় না। এই ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করছে–জানতে হবে প্রকৃত ব্যাপারটা কি? আর একটা আর একটা চরিত্র ইয়াকুব। চরিত্র বটে! আমার ধারণা এই কেসে সে-ও কোন না কোন ভাবে জড়িত। অনুমান, কিন্তু শক্ত যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে অনুমানটা। আমি ইয়াকুবের বাড়িতে যাব। ওটা ইয়াকুবের বাড়ি নয়, ঋতুর বাড়ি যাব। হয়তো বৃথা সময় নষ্ট হবে, তবু যেতে হবে আমাকে। তা না হলে খুঁতখুঁত করবে মনটা।
কিন্তু সময় নষ্ট করাটা উচিত হবে না, শহীদ। ইন্সপেক্টর গনি দেলোয়ার মোরশেদের নিহত হবার ঘটনাটাকে অসম্ভব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, ফোন করেছিলেন তিনবার। পুলিস শিল্পীর মাথা এবং হেদায়েত মোরশেদের মাখা থেকে বুলেট বের করে পরীক্ষা করে দেখেছে। একই পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয়েছে দুটো বুলেট। আমার মনে হয়, ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা করা উচিত হবে না তোমার। ভদ্রলোক ডেঞ্জারাস মুডে আছেন। তিনি হয়তো তোমাকে গ্রেফতার করার কথা এখনও ভাববেন না, কিন্তু জবাবদিহি চাইবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শহীদ পায়চারি থামিয়ে বলল, হু।
পরক্ষণে পা বাড়াল ও।
কোথায় যাচ্ছ?
জবাব না দিয়ে ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে বেডরূমে ঢুকল শহীদ। একটা তেপয়ের উপর লাল একটা টেলিফোন রয়েছে।
মহুয়া ত্রস্ত পায়ে বেডরূমে ঢুকল। শহীদ তখন লাল রিসিভার তুলে কথা বলছে কারও সাথে।
এক মিনিট পর রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। কিন্তু নড়ল না, দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
দাদাকে ফোন করলে কেন?
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ, ওর সাহায্য দরকার আমার, মহুয়া।
কি বলল দাদা?
বাদশা খানকে চাই আমি, মহুয়া। কুয়াশাকে লোকটার পরিচয় দিয়ে বললাম খোঁজ করার জন্যে চারদিকে লোক পাঠাতে।
যাচ্ছ তুমি?
হ্যাঁ। ফিরতে দেরি হলে, অস্বাভাবিক দেরি হলে কি করবে জানো তো?
হ্যাঁ, জানি। মি. সিম্পসনকে নোটটা দেব।
হ্যাঁ। চললাম। ভাল কথা, কামালের ফোন নাম্বারটা লিখে নাও। ওকে ফোন করে বলো, পরবর্তী ফ্লাইটেই, আজ রাতেই ঢাকায় চলে আসতে।
দাঁড়াও।
দাঁড়াল শহীদ, কিছু বলবে?
শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে শহীদের বুকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মহুয়া। বিড় বিড় করে দোয়া-দরূদ কিছু পড়ে ফুঁ দিল শহীদের শার্টের বোতাম খুলে বুকে।
কোন কথা বলল না শহীদ। একসময় ঘুরে দাঁড়াল ও। জলে ভেজা ছলছল চোখে ওর গমন পথের দিকে চেয়ে রইল মহুয়া, দরজার গায়ে হাত রেখে।
সিড়ির মাথায় পৌঁছে ঘাড় ফরাল শহীদ। চট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরল মহুয়া, ঢুকে পড়ল ড্রয়িংরুমের ভিতর।
সোফায় লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
.
০৫.
২০১/১৪ নিউ ইস্কাটন। বধবে সাদা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। উঁচু পাঁচিল, দোতলা বাড়ি বলে বাইরে থেকে মনেই হয় না। অভিজাত এলাকায় যা হয়, লোকজন রাস্তায় একদম নেই। গেটটা লোহার পাত দিয়ে তৈরি করা, সবুজ রঙের। খোলা রয়েছে।
রাত সাড়ে নটা বাজে। চাঁদ রয়েছে মাথার উপরে। গাড়ি নিয়ে গেটের সামনে দিয়ে চলে গেল শহীদ। থামল সামনে বাক নিয়ে দশ গজ এগিয়ে। পায়ে হেঁটে ফিরে এল গেটের কাছে। একজন মানুষ ঢোকার মত ফাঁক রয়েছে, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, না গেটটা। ভিতরে ঢুকে পড়ল ও। সামনেই বাগান দেখল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। একপাশে দোতলা বিল্ডিং। ঝুলন্ত বারান্দা দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচটা। ডান দিকে দোতলার ব্যালকনির সাথে যে দরজা, সেটা খোলা। বৈদ্যুতিক আলো বেরিয়ে আসছে পর্দার ফাঁক দিয়ে।
তার মানে ইয়াকুব বাড়িতেই আছে। নিঃশব্দ পায়ে দোতলার আলোকিত রূমটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। চিন্তা করছে ও।
নির্দিষ্ট কোন কারণে আসেনি শহীদ। সন্দেহের উপর কাজ করছে ও। দেখা দরকার ইয়াকুব কি করছে। ইয়াকুব যদি অনুপস্থিত থাকত তাহলে রুমগুলো সার্চ করে দেখত আগে, কিন্তু সে যখন উপস্থিত রয়েছে–দেখা যাক কি করছে ছোকরা।
উপরে উঠতে হলে পানির পাইপ বেয়ে উঠতে হবে। কিন্তু পানির পাইপটা আলোকিত রূমটার কাছ থেকে অনেক দূরে।
তবু, পানির পাইপই একমাত্র ভরসা। দুই হাত দিয়ে পাইপ-ধরে, নিচের অংশে পা ঠেকিয়ে উঠতে শুরু করল শহীদ।
মিনিট দুয়েক লাগল ওর উঠতে। পাইপ ছেড়ে দিয়ে একটা ব্যালকনির রেলিং ধরে কারনিসে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। আলোকিত রূমটার ব্যালকনি ডান দিকে, গজ তিনেক দুরে। মাঝখানে সাদা দেয়াল, তবে নিচের অংশে দুই ইঞ্চি চওড়া বর্ডার রয়েছে। পা রাখার জায়গা হিসেবে চলনসই, কিন্তু হাত দিয়ে ধরবার কিছু নেই।
কংক্রিটের বর্ডারে শুধু পা রেখে দেয়ালে গা ঠেকিয়ে একটু একটু করে এগোবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া হবে সেটা। এক চুল এদিক। ওদিক হলেও পড়ে যেতে হবে নিচে। পড়লে মারা যাবার হয়তো ভয় তেমন নেই, কিন্তু হাত-পা নির্ঘাৎ ভাঙবে।
ঝুঁকিটা নেবে ঠিক করল শহীদ। দুই ইঞ্চি চওড়া কংক্রিটের বর্ডারে পা দিল ও। দেহটা সঁটিয়ে রেখেছে দেয়ালের সাথে। অন পায়ের সামনে বা পা রাখছে, তারপর বাঁ পায়ের সামনে ডান পা, এই ভাবে দশ ইঞ্চি দশ ইঞ্চি করে এগোচ্ছে ও। ভারসাম্য হারাতে-হারাতেও হারাচ্ছে না। দম বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে এইভাবে এগোতে এগোতে দেড় গজের মত দূরত্ব অতিক্রম করার পর বুকের ভিতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ল ওর।
একটা গাড়ির হর্ন শোনা গেল। তারপর ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল, সেই শব্দও কানে ঢুকল। দরজা খোলার শব্দ ঢুকল না কানে, কিন্তু সশব্দে বন্ধ হবার আওয়াজটা বেশ জোরেই পৌঁছল কানে।
দেয়ালের সাথে এমনভাবে দেহটাকে সেঁটে রেখেছে শহীদ যে মনে হলো দেয়ালের ভিতর সেঁধিয়ে যেতে চাইছে ও।
হাইহিলের শব্দটা কানে ঢুকতে স্থির থাকতে পারল না শহীদ। এক চুল এক চুল করে মাথাটা ঘোরাল ও।
চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেল মেয়েটিকে। কিন্তু চিনতে পারল না। যে-কোন কারণেই হোক, মেয়েটি খুব উত্তেজিত। ছুটছে না, তবে হাঁটাটা ছোটারই নামান্তর বলা যায়।
কে ও? রীটা গোমেজ?
নিঃসন্দেহ হতে পারল না শহীদ। ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাবার প্রয়োজনও বোধ করল না ও। যেই হোক, সোজা উঠে আসবে সে ইয়াকুবের উপরের রূমে।
সোজা এগিয়ে আসছে মেয়েটা। মাথাটা উঁচু করে, দৃঢ় পদক্ষেপে। যে-কোন মুহূর্তে চোখ পড়তে পারে দোতলার দিকে। অন্তত আলোকিত রূমটার দিকে একবার তাকালে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাকানোই স্বাভাবিক। আর তাকালেই চাঁদের আলোয় ধবধবে সাদা দেয়ালে সেঁটে থাকা একটা ওয়ালপেইন্টিং-এর মত শহীদকে দেখতে পাবে সে।
হাতের তালু ঘামছে শহীদের। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে কখন মেয়েটি চিৎকার করে উঠবে।
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। পনেরো সেকেণ্ড পর মেয়েটি দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। নিচের করিডরে পৌঁছে গেছে সে, ভেসে আসছে অস্পষ্ট খট্ খট্ খট্ খটু হাইহিলের শব্দ।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন শহীদের। আবার পা বাড়াল ও। ধীরে ধীরে গজ খানেক এগোল আরও, তারপর হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল সামনের ব্যালকনির রেলিং। আর পড়ে যাবার ভয় নেই।
রেলিং টপকে ব্যালকনিতে নেমে শহীদ পর্দা ঝোলানো দরজার পাশে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
কে যেন কিছু পান করছে, ঢক ঢক শব্দ হচ্ছে কিছু ঢালৰ। আধ ইঞ্চি ফাঁক করল শহীদ পর্দাটা ডান হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে।
আরাম-আয়েশ আর বিলাসে ডুবে আছে ইয়াকুব, নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। রূমটা বড়সড়। সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো।
সোফায় আধশোয়া অবস্থায় বসে বিলিতি মদের বোতল থেকে গ্লাসে মদ ঢালছে সে, ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে বিপরীত দিকের দেয়ালে লটকানো নগ্ন–নারীমূর্তি আঁকা তৈলচিত্রের দিকে। অদ্ভুত, গর্বিত হাসি লেগে রয়েছে তার ঠোঁটের কোণে।
নক হলো দরজায়। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ইয়াকুব দরজার দিকে। গম্ভীর হলো মুখটা। কিন্তু কোন প্রশ্ন করল না। যে এসেছে তাকে চেনে সে। বোঝা গেল তার হাবভাবে। সম্ভবত গাড়ির শব্দ পেয়ে ব্যালকনির দরজার কাছ থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে ইতোমধ্যে দেখে নিয়েছে সে মেয়েটাকে।
একটু একটু টলছে ইয়াকুব। হাতের গ্লাসটা তেপয়ের উপর রাখতে গিয়েও রাখল না। এগোল সে দরজার দিকে।
দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল ইয়াকুব।
কৌতূহলে দম বন্ধ হয়ে গেছে শহীদের। কাকে দেখবে ও? কে মেয়েটা? রীটা গোমেজ?
দরজা পেরিয়ে যে রূমের ভিতর প্রবেশ করল তাকে দেখে মাথা ঘুরে গেল শহীদের। বেলবটম পরা মেয়েটির বদলে শহীদ যদি একটি নরকঙ্কালকেও ঢুকতে দেখত, অমন চমকে উঠত না ও।
মেয়েটি ঋতু। তোয়াব খানের পঙ্গু মেয়ে। যে হাঁটতে পারে না আজ বছর দুয়েক ধরে।
.
চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। একটা পিন পড়লেও যেন শোনা যাবে। দ্রুত চিন্তা করছে। শহীদ। অফিসের ফাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো একত্রিত করে তোয়াব খান, তাঁর পরিবার সম্পর্কে কামাল ওকে কি কি বলেছিল, মনে পড়ে গেল ওর। তোয়াব খানের মেয়ে ঋতু সম্পর্কে কামাল বলেছিল-মেয়েটা দুবছর আগে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয়, সেই থেকে চলৎশক্তিরহিত সে, পঙ্গু হয়ে গেছে। সেই অ্যাক্সিডেন্টেই তার মা নিহত হয়। ঋতুর পা ভাল করার জন্যে তোয়াব খান চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। বড় বড় বিদেশী ডিগ্রীপ্রাপ্ত ডাক্তারেরা চেষ্টা করেও ঋতুকে হাঁটাতে পারেনি।
কিন্তু, একি দৃশ্য আজ চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। ওই তো সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋতু। ওই পা বাড়াল সে। কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে রূমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। কই, এতটুকু খোঁড়াচ্ছে না তো সে।
দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল ইয়াকুব। কিন্তু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, এমন অসময়ে? ফোন করোনি কেন?
কার্পেটের দিকে চেয়ে রয়েছে ঋতু। দুবার ভুরু কুঁচকাল সে, তারপর তীক্ষ্ণ : স্বরে বলল, কেন, ডিসটার্ব ফিল করছ নাকি?
ইয়াকুব টলছে, পা বাড়াল সে। ঋতুর পাশ ঘেঁষে এগিয়ে এল, বসল ধপ্ করে সোফায়। হাতের গ্লাসটা তুলল ঠোঁটে। ছোট ঘোট দুটো চুমুক দিল। বলল, সেটা বড় কথা নয়, ফোন করে আসোনি কেন তাই জানতে চাইছি।
ঝট করে মুখ তুলে তাকাল ঋতু। মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠেছে, আমার বাড়িতে আমি আসব, তার জন্যে কারও অনুমতি নিতে হবে তা জানা ছিল না। আজ জানলাম।
ইয়াকুব তাকাল না, কথাও বলল না। গ্লাসের দিকে চোখ রেখে চুপ করে রইল সে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল ঋতুই, বসতেও বলছ না দেখছি আমাকে?
না তাকিয়েই ইয়াকুব বলল, তোমার বাড়ি এটা–আমি কে? যা ইচ্ছা তুমিই তো করতে পারো।
এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল ঋতু। বলল, মদ খাচ্ছ কেন?
জানো না কেন খাচ্ছি? কেন খাই? সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল ইয়াকুব।
কেন? চেষ্টা করা সত্ত্বেও গলার ঝঝ চেপে রাখতে পারল না ঋতু।
ইয়াকুব এক চুমুকে গ্লাসটা নিঃশেষ করল। হাতটা মাথার উপর তুলে সামনের দেয়ালের দিকে গ্লাসটা ছুঁড়ে দিল সে।
দেয়ালে লাগল গ্লাসটা, ভেঙে গেল সশব্দে, চারদিকে অসংখ্য কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল।
এসেছ ভালই করেছ। ফাইনাল আলোচনাটা এখনই হয়ে যাক!
ইয়াকুব, কি ভেবেছ তুমি আমাকে?
আমাকে কি ভেবেছ তুমি? আবার পাল্টা প্রশ্ন করল ইয়াকুব।
দুজন দুজনের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর ইয়াকুব বলতে শুরু করল, কেন তুমি রাজি হচ্ছ না বিয়েতে? কতবার এই এক কথা বলব আমি? বিয়ের প্রস্তাব তুমিই না দিয়েছিলে?
ঋতু হঠাৎ কেমন যেন দমে গেল। নিস্তেজ স্বরে বলল, অসুবিধে আছে। সময় হোক…।
কিসের অসুবিধে? ব্যাঙ্কে তোমার নিজের নামে অগাধ টাকা নেই? এই বাড়িটা তোমার নামে কেনা নয়? তোমার বাবা–বিয়ে আমরা করে ফেললে তার করার আছেটা কি? তাছাড়া, তোমার সম্পর্কে এবার সত্যি কথাটা বলবার সময় হয়েছে তাকে। অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটার সময় তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন কিন্তু এখন? তিনি আসল কথাটা জানেন না ভেবেছ? জানেন, জানেন। এবং তোমার ব্যাপারে দুঃখ পাওয়া তো দূরের কথা, তিনি মাথা ঘামান না। দুবছর ধরে তোমাকে পঙ্গু দেখতে দেখতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন আগের সেই দুঃখবোধ তোমার জন্যে তার আর নেই।
আছে।
নেই। আমি বলছি নেই। মেঝেতে পা ঠুকে চিৎকার করে উঠল ইয়াকুব।
অনেকক্ষণ কেটে গেল, কেউ কারও দিকে তাকাল না, কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ভাঙল ইয়াকুবই।
তোমার জন্যে তার আগের সেই ভালবাসা থাকলে দুদিন পর পর একবার হোমাকে দেখার জন্যে তোমার রূমে ঢুকতেন না তিনি। আগে কি রোজ চার পাঁচবার করে দেখা করতেন না তোমার সাথে?
ঋতুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খানিক পর সে বলল, আমার পত্ন অবস্থা দেখে তিনি ব্যথা পান, তাই ঘনঘন আমার সামনে আসতে পারেন না। তিনি দুঃখ পান। আর সেটাই আমি চাই। তিনি দুঃখ পেলেই আমি খুশি। শুনতে পাচ্ছ! আমি তাতেই একমাত্র আনন্দ পাই–তাকে দুঃখ দিয়ে।
শেষের কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে, প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত চিৎকার করে বলল ঋতু।
মুখ বিকৃত করে ইয়াকুব বলে উঠল, নিজেকে আর কতদিন ধোকা দেবে শুনি? বাস্তবের মুখোমুখি হও, সুন্দরী। তোমার বাবা বিয়ে করেছেন–তবু তোমার ভুল ভাঙল না?
ইয়াকুব-সাবধান হও বলে দিচ্ছি! এসব ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আর কোন কথাই বলতে চাই না।
ইয়াকুব ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, কথাই বলতে চাও না? বাহ! বাহবা! তা : বেশ তো, সব কথার শেষ কথাটা তাহলে শুনে নাও।
তার মানে?
ইয়াকুব কথা না বলে ঋতুর দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। দেখল ঋতুকে কয়েক সেকেণ্ড নিঃশব্দে। তারপর ঝুঁকে পড়ে সামনের তেপয়ের উপর থেকে সোনার সিগারেট কেসটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট বের করে ধরাল।
গলগল করে ধোয়া ছাড়ল ইয়াকুব, কেন আমি পড়ে আছি তোমাদের কাছে, ঋতু? আমার অবস্থা খারাপ ছিল, তাই তোমাদের বাড়ির গার্ড হিসেবে চাকরিটা নিয়েছিলাম। পরে তোমার সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা ঠিক করি-বিয়ে করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু কি বলছ তুমি এখন? বলছ, বিয়েতে অসুবিধে আছে। কি অসুবিধে? তা তুমি বলতে চাই না। কি অর্থ দাঁড়ায় এসবের? তুমি আমাকে বিয়ে কোন দিনই করবে না, এই তো? বেশ, বেশ। টাকা পয়সার অভাব এখন আর তেমন নেই আমার। তোমাদের বাড়ির গার্ড হিসেবে আমি এখন বেমানান। তাছাড়া, আমাকে যখন তোমার আর ভাল লাগছে না–দরকার কি তোমাদের কাছে পড়ে থেকে? আমি আগামীকালই বিদায় হচ্ছি।
ঋতু হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি থামতে বলল, চলে যাবে, ইয়াকুব? কোথায়? কোথায় পাবে তুমি এই রকম একটা বাড়ি? হাত খরচার জন্যে প্রতি মাসে কয়েক হাজার করে টাকা? এমন রাজকীয় পোশাক, এমন রাজকীয় খানাপিনাকে দেবে তোমাকে এসব?
ইয়াকুব হাসতে হাসতেই বলল, আমাকে তুমি চেনোনি, ঋতু। তোমার কাছ থেকে যা পাচ্ছি তা আসলে আমার হিসেবে নিতান্তই কম। এর চেয়ে বেশি দেবার মত মেয়ে এই শহরে আরও অনেক আছে। তারা আমাকে পাবার জন্যে বিরক্ত করে মারছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি ইতিমধ্যেই সন্দেহ করেছ। তুমি আজ ফোন করে আসোনি বলে আমি বিরক্ত হয়েছি–কেন বলো তো? রোজ রাতেই মেয়েরা আসে আমার কাছে, ঋতু। বলা যায় না, আজ কেউ না কেউ আসতে পারে। সেজন্যেই তোমাকে দেখে আমি বিরক্ত হয়েছি। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার জীবনে তুমিই একমাত্র মেয়ে ভুল!
ঋতু ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলে রাখল কোনমতে।
ঋতু, সত্যি কথা বলছি, তোমার শয্যাসঙ্গী হতে আমার আর ভাল লাগছে না। তোমার সাথে এতদিন ভালবাসার অভিনয় করেছি কেন জানো? ভেবেছিলাম তোমার টাকা, তোমার বাড়ি আমার নামে লিখে দেবে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু দেখছি তা হবার নয়। সুতরাংগুডবাই, সুন্দরী। আমি অন্যত্র চেষ্টা করব।
ঋতু চাপা কণ্ঠে জানতে চাইল, রাফিয়াও আসে নাকি তোমার কাছে?
জানো তাহলে! আসে বৈকি! তোমার চেয়ে ভাল সে। সে অন্তত তোমার মত অসুস্থ নয়।
আমি অসুস্থ?
ইয়াকুব চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, তুমি অসুস্থ নও, তুমি একটা কুৎসিত…!
ইয়াকুব! দাঁড়িয়ে পড়ল ঋতু, কাঁপছে সে। কেন, কেন এমন অপমান করছ আমাকে? কি করেছি তোমার আমি? বিয়ের জন্যে কেন এমন জোর খাটাতে চাইছ? এতবার করে বলছি, তবু কেন বুঝতে চাইছ না? কি পাচ্ছ না তুমি আমার কাছ থেকে বিয়ে না করেও?
থাক, থাক। আর পটাতে হবে না। নরম হয়ে লাভ নেই, ঋতু। আমি যাচ্ছি। আমাকে আর আটকে রাখতে পারবে না। তোমাকে আমার আর ভাল লাগছে না। শখ মিটে গেছে। একজনের বাধা পুরুষ হয়ে থাকা–আর কতদিন।
ইয়াকুব, প্লীজ! মাথা ঠাণ্ডা করো..
ঋতু পা বাড়াল। ইয়াকুব ঠাস করে চড় মারল তার বাঁ গালে।
পাঁচ আঙুলের দাগ ফুটে উঠল ঋতুর গালে। গালে হাত দিয়ে চেয়ে রইল সে ইয়াকুবের দিকে।
ঠোঁটে সিগারেট লটকে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল ইয়াকুব। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, দূর হও আমার সামনে থেকে। আগামীকাল আমি চলে যাব। তোমার মুখ আর দেখতে চাই না আমি।
দুপা পিছিয়ে ধপ করে বসে পড়ল ঋতু সোফায়। বলল, ইয়াকুব…আমি যাচ্ছি, কিন্তু কাল আবার আসব। এখন তোমার মাথা গরম হয়ে আছে…
না। কাল এসে তুমি আমাকে পাবে না।
ঋতু বলল, কেন যাবে তুমি? যা বলেছি, ভুলে যাও, আমি ক্ষমা চাইছি।
না। তোমাকে আমার ভাল লাগে না। তুমি একটা ডাইনী। তোমার কবল থেকে আমি মুক্তি চাই।
কিন্তু …কিন্তু তোমাকে আমি যেতে দেব না, ইয়াকুব, নরম গলায়, অস্বাভাবিক নরম গলায় বলল ঋতু আবার।
বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না। আমি অন্য একজন মেয়ের কাছে যাব ঠিক করেছি।
ঋতু আরও ঠাণ্ডা গলায় বলল, অন্য কোন মেয়ে তোমার আমার মধ্যে আসতে পারে না, ইয়াকুব। যা হবার হয়েছে, আজ থেকে তোমাকে আমি আর কোন মেয়ের কাছে যেতে দেব না।
আহা, আমার সোনার চান রে! ব্যঙ্গ করল ইয়াকুব।
ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলতে খুলতে ঋতু বলল, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, ইয়াকুব? আমার জন্যে তোমার একটুও মায়া হয় না? তুমি ছাড়া কে আছে আমার।
ওসব ন্যাকামি বন্ধ করো তো!
ইয়াকুব সবেগে ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল ঋতুর হাতে .৪৫ একটা পিস্তল।
সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল ইয়াকুব। বাকশূর্তি হলো না তার অনেকক্ষণ। হাসছে ঋতু। নিঃশব্দ, হিংস্র হাসি। মুখটা ঘেমে গেছে তার। ঠোঁট দুটো ভেজা ভেজা। চকচক করছে ইলেকট্রিক আলোয় পিস্তলটার রুপোলি গা। সরাসরি ইয়াকুবের বুকের দিকে ধরে রেখেছে সেটা ঋতু।
এবার আমি কথা বলব, ইয়াকুব। শোনো। আমি জানতাম এই রকম ঘটনাই একদিন ঘটবে। মেয়েরা তোমাকে পছন্দ করে, জানি। জানি, অনেকেই তোমার কাছে আসে রাত্রে। রাফিয়ার ব্যাপারটা সঠিক জানতাম না, তবে সন্দেহ যে করিনি তা নয়। সব জেনেও কেন চুপ করে ছিলাম বলতে পারো? চুপ করে ছিলাম এই জন্যে যে–আর কেউ নেই আমার। তুমিই একমাত্র…তা সে যাক। ভেবেছিলাম যতদিন পারি, তোমাকে নিয়ে থাকব। কি আছে আমার জীবনে? সবাই জানে আমি পঙ্গু। ইচ্ছা করলেও আজ সবাইকে আমি জানিয়ে দিতে পারি না যে আমি এতদিন অভিনয় করেছি। পর অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যি আমি সব দিক থেকে পঙ্গু হয়ে গেছি। আমার পঙ্গু জীবনে তুমিই একমাত্র সহায় ছিলে। যখন জানতে পারলাম তুমিও বেঈমানী করছ–মনটা ভেঙে গিয়েছিল। তবু, তোমাকে হারাতে চাইনি। কিন্তু আজ নিজের মুখেই তুমি সব স্বীকার করে ফেললে। আর সহ্য করা যায় না। আর তোমার আমার সম্পর্ক থাকতে পারে না। একটা কথা, তুমি আসলে আমাকে চিনতে পারোনি, ইয়াকুব। আমার জেদ কি রকম–কল্পনা করতেও পারবে না। তোমাকে হারাতে হবে–এটা আমি মনে মনে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এবং এই পরিস্থিতিতে তা জানতাম না। তুমি যে নীচ বংশের ছেলে, প্রায় অশিক্ষিত, লম্পট, সুযোগ সন্ধানী–জানতাম বৈকি। তবু সম্পর্ক গড়েছিলাম। কেন? তোমাকে পাব বলে। চিরকালের জন্যে। বিয়ের মাধ্যমে নয়, সুযোগ সুবিধের মাধ্যমে। তোমার মত একটা জন্ম পরিচয়হীন বাস্টার্ডকে বিয়ে করার কথা আমি কখনোই ভাবিনি। ভেবেছিলাম টাকার লোভ, আরাম আয়েশের লোভ দেখিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখতে পারব। কিন্তু তা সম্ভব নয়, বুঝতে পারছি। সুতরাং, ইয়াকুব, বিদায়। আমাকে ছেড়ে তুমি অন্য কোন মেয়ের কাছে চলে, যাবে-এ আমি সহ্য করতে পারব না। আমার শখের জিনিস নিয়ে আর কেউ মজা করবে–এ আমি হতে দেব না। ইয়াকুব-বি-দা-য়…!।
গুলি করার জন্যে ঋতু পিস্তলটা একটু তুলে ধরল।
ঋতু! ঋতু শোনো! কি পাগলামি করছ–শোনো! ঋতু…!
পর্দা সরিয়ে ব্যালকনি থেকে রূমের ভিতর ঢুকে পড়েছে শহীদ। ঋতু ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। টের পায়নি সে। রিভলভার রয়েছে শহীদের হাতেও। কিন্তু গুলি করার সুযোগ কোথায়? গুলি করতে হলে করতে হবে ঋতুর হাতের পিস্তল লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, পিস্তলটা দেখতেই পাচ্ছে না শহীদ।
ইয়াকুব লোক যেমনই হোক, একটা হত্যাকাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, চোখের সামনে তা ঘটতে যাচ্ছে দেখে চুপ করে থাকা সম্ভব নয় শহীদের পক্ষে।
ঝুঁকিটা নিতে হয়েছে ওকে। পা টিপে টিপে এগোচ্ছে শহীদ। হাসছে শব্দ করে ঋতু। বলছে, অনেক মেয়েকে তুমি ভাসিয়েছ, ইয়াকুব! তারা আমার মত ছিল না। কেউ! তারা প্রতিশোধ নিতে পারেনি! কিন্তু আমার হাত থেকে তোমার নিষ্কৃতি নেই!
ইয়াকুব কথা বলছে না। বোকার মত চেয়ে আছে সে। চেয়ে আছে শহীদের। দিকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই ঋতু তাকাল পিছন দিকে।
গুলির শব্দ হলো সাথে সাথে।
ওরা তিনজন, কেউই বুঝতে পারল না কোথা থেকে কি হয়ে গেল।
শহীদ পাঁচ ছয় হাত দূরে ছিল ঋতুর কাছ থেকে। ঋতু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেখতে পেয়েও করার কিছু ছিল না ওর। এতটা দূর থেকে লাফ দিয়ে ঋতুর হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়া সম্ভব ছিল না, তার আগেই গুলি করত ঋতু।
ঘুরে দাঁড়িয়ে শহীদকে দেখতে পেলেও ঋতু গুলি করার অবকাশ পেল না। পিস্তল তুলে লক্ষ্য স্থির করার আগেই গুলির শব্দ হলো। বুলেট লাগল তার হাতের পিস্তলে। ছোঁ মেরে কেড়ে নিল যেন কেউ সেটা তার হাত থেকে। উড়ে গিয়ে সেটা লাগল রূমের দেয়ালে, দেয়াল থেকে পড়ল কার্পেটের উপর।
কে করল গুলি?
বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই লাফে দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে এল শহীদ ব্যালকনিতে।
কেউ নেই।
রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ল শহীদ। হাঁপাচ্ছে ও উত্তেজনায়। গুলি যেই করুক, এই ব্যালকনি থেকেই করেছে। গুলি করে এখান থেকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। কোন মানুষ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু নিচের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যই হলো শহীদ।
চাঁদের আলোয় নিচের কংক্রিটের রাস্তা, বাগান–সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিঃসাড়, নিস্তব্ধ চারদিক।
কেউ নেই।
ঋতুর কথা মনে পড়ে যেতে দ্রুত ফিরে এল শহীদ রূমের ভিতর।
দাঁড়িয়ে আছে সেই একই জায়গায়, সেই জানালার কাছে পাথরের মূর্তির মত ইয়াকুব। ভিজে গেছে তার মুখটা ঘামে। শহীদের দিকে চাইল বোকার মত। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে।
কোথায় সে? কার্পেটের উপর পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করল শহীদ।
দরজার দিকে আঙুল তুলে দেখাল ইয়াকুব। কথা বলতে পারল না। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পিস্তলটা তুলে নিয়ে পকেটে ভরল শহীদ, ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল আবার ব্যালকনিতে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াতেই ঋতুকে দেখতে পেল
ছুটছে মেয়েটা গেটের দিকে কয়েক সেকেণ্ড পরই আর দেখা গেল না তাকে। একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ ভেসে এল।
ফিরে এল শহীদ রূমের ভিতর, তুমি একটা কুকুর, ইয়াকুব। ঋতুকে সুযোগটা দেয়াই উচিত ছিল আমার। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কয়েকটা কথা আদায় করার জন্যে এসেছিলাম, তাই মরতে দিলাম না।
সোফায় বসে পাইপে অগ্নিসংযোগ করল শহীদ। আবার বলল, সবাইকে বোকা বানাচ্ছে কেন ঋতু? পঙ্গু সে নয়–অথচ পঙ্গু হয়ে আছে কেন?
ইয়াকুব ভিজে বেড়ালের মত মিনমিনে স্বরে বলে উঠল, আপনি আপনি…আপনি।
শহীদ বলল, হ্যাঁ, আমি। তোমার যম। যা জিজ্ঞেস করছি পটাপট উত্তর দাও। সত্যি কথা বলবে, যদি ভাল চাও। তা না হলে কোমরে দড়ি পড়বে।
ইয়াকুব খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, আমি আর এখানে থাকব না…আবার ফিরে আসবে ও পিস্তল নিয়ে।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল শহীদ। বলল, অভিনয় করছ নাকি? ছুঁচোর মত এত ভয় পাচ্ছ কেন?
ইয়াকুব যেন শুনতেই পায়নি শহীদের কথা। বোকা, বিমূঢ় দেখাচ্ছে তাকে। গলাটা কেঁপে উঠল কথা বলার সময়, আমাকে আপনি মাফ করে দিন, আমি সেদিন না জেনে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আমি চলে যাই এখুনি…!
নোড়ো না! সাবধান করে দিল শহীদ। হাতের রিভলভারটা ধরল তার দিকে। আবার বলে উঠল, নড়লেই গুলি করব। যাবে–বেশ তো। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমি যদি মনে করি তুমি সত্যি কথা বলছ তাহলে ছেড়ে দেব তোমাকে। তা নাহলে তোমাকে জেলখানায় ঢুকিয়ে পচাবার ব্যবস্থা করব। বসো, পপুর অভিনয় কেন করছে ঋতু?
ইয়াকুব নড়ল না। মনে হচ্ছে, উত্তর দেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে সে। একটু পরই সে বলতে শুরু করল, ঋতু ওর বাবাকে ঘৃণা করে, তাই।
ঘৃণা করে কেন? অ্যাক্সিডেন্টটা হবার পর থেকে? যে অ্যাক্সিডেন্টে ও আহত হয়, ওর মা নিহত হয়?
না। তার আগে থেকেই। ওর বাবা ওকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। আগে থেকেই। কিন্তু বাবাকে ও ছোট বেলা থেকেই এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত। এই ব্যাপারটা নিয়ে ওর বাবা মার মধ্যে ঝগড়াও হত। তোয়াব সাহেব দোষ দিতেন ওর মাকে। আসলে ওর মায়ের কোন দোষ ছিল না। ঋতু, কি কারণে কে জানে, ওর বাবাকে দুই চোখে দেখতে পারত না। যত ভালবাসা সব ওর মায়ের প্রতি ছিল। এদিকে ওর বাবা ওঁর জন্যে পাগল ছিল! মেয়েকে এত ভালবাসত যে…। এসব কথা আমাকে ঋতুই বলেছে।
বলে যাও। যা জানো সব বলো।
ঋতু যখন বড় হয় তখন ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। তোয়াব সাহেব মেয়ের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে সারাক্ষণ চেষ্টা করতেন, ক্রমশ, তিনি গভীর এবং জেদী হয়ে উঠতে থাকেন। এদিকে ঋতুও আরও বেশি করে তাঁকে। এড়িয়ে চলতে শুরু করে। যাই হোক, এইভাবেই চলছিল। একদিন ওরা তিনজন কোথায় যেন বেড়াতে বেরোয়। সেদিন নাকি তোয়াব সাহেব ড্রিঙ্ক করেছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনিই। পিছনে ছিল ঋতু আর ওর মা। তোয়াব সাহেব গাড়ি চালাতে চালাতে ঋতুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকো? ঋতু কোন উত্তর দেয়নি। প্রশ্নটা নাকি তোয়াব সাহেব কয়েকবার করেছিলেন। কিন্তু ঋতু একবারও মুখ খোলেনি। এর পরই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে। একটা ট্রাক আসছিল। ওদের গাড়িটার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। অ্যাক্সিডেন্টের পরমুহূর্তের ঘটনা কারও মনে নেই। ঋতু একসময় দেখে সে পড়ে আছে রাস্তার ধারের একটা খাদের ঢালু গায়ে, পাশেই রক্তাক্ত অবস্থায় তার মা। তিনি তখনই মারা গেছেন। ঋতুর সারা শরীরে কাটা ছেঁড়ার দাগ ছিল। কিন্তু পায়ে সে কোনরকম ব্যথা পায়নি। ট্রাকের ড্রাইভারও নিহত হয় অ্যাক্সিডেন্টে। দুটো গাড়িই উল্টে পড়েছিল খাদের নিচে। তোয়াব সাহেব সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলেন, একটা আঁচড়ও লাগেনি তাঁর গায়ে। ঋতুর কাছে দাঁড়িয়ে তিনি পাগলের মত নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছিলেন। মেয়ের জন্যে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন একরকম। হাসপাতালেও এমন আচরণ শুরু করেন তিনি যে অনেকেই বলাবলি করেছিল মেয়েটি যদি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যেত তাহলে তোয়াব সাহেব নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যেতেন। কিন্তু যার জন্যে অমন দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন তিনি, সে এক নয়া পয়সাও মূল্য দেয়নি তার কাতরতার। ঋতুর ধারণা হয় অ্যাক্সিডেন্টটা ইচ্ছা করেই করেছেন ওর বাবা, ওর মাকে খুন করার জন্যে। মা খুন হলে সে বাবাকে ভালবাসতে বাধ্য হবে–তাই। মনে মনে তখনই ঋতু ঠিক করে, ওর বাবাকে ও সারা জীবন মানসিক কষ্টের মধ্যে রাখবে। ঠিক করে পঙ্গু হবার অভিনয় করে যাবে সে। বুঝতে পারছেন, কি ধরনের বদ্ধ পাগল সে একটা?
তুমি ভিড়লে কিভাবে ওদের সাথে?
আমার হাতে টাকা-পয়সা ছিল না তখন, ওদের বাটলার মোখলেস মুক্তা নিকেতনের গার্ড হিসেবে চাকরি করার প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
বুঝেছি। শুধু গার্ডের চাকরি করার মত বানর তুমি নও। তুমি আসলে মনে মনে আশাই করেছিলে চাকরি পেলে কোটিপতি তোয়াব খানের স্ত্রী বা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে। অমন বড়লোকদের বাড়িতে ঢুকতে পারার সুযোগ পেয়ে তুমি আকাশের চাঁদ পেয়ে যাও হাতে। সে যাক। মিসেস রাফিয়ার বেডরূমে চুরি করা ছোটখাট জিনিস ভর্তি সুটকেসটা কে রেখে এসেছিল? তুমি জানো?
ঋতুর কাজ। সেই আমাকে ওটা রেখে আসতে বলে।
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে শহীদ জানতে চাইল, রীটা গোমেজ সম্পর্কে বলো এবার।
রীটা গোমেজ? ওহ–তার সাথে আমার এখন কোন সম্পর্ক নেই। কেমন যেন মেয়েটা। বক্সিং আর কুস্তি দেখতে খুব ভালবাসে। আমি যখন রয়েল জিমন্যাশিয়ামে যাওয়া-আসা করতাম, তখন তার সাথে পরিচয় হয়। পুরুষালি। ভাবভঙ্গি করে, সে যে একটা মেয়ে একথা মনে রাখতেই চায় না। বক্সিং ছেড়ে দেয়ায় তুমুল ঝগড়া করে সে আমার সাথে। কিন্তু পাত্তা দিইনি তার কথায়, বক্সিং শিখতে ফিরে যাইনি আমি আর। সেই তার সাথে সম্পর্কের শেষ–আর দেখা হয়নি। তবে শুনেছি, ক্লাবে ক্লাবে তাস খেলে, মানে জুয়া খেলে সে, চুরি করতেও জানে খেলায়। বেশ ভালই রোজগার হয় নাকি।
জানতে চাইল শহীদ, বাদশা খানের নাম শুনেছ কখনও তার মুখে?
বাদশা খান-না। কে সে?
যেই হোক, ভুলে যাও। আচ্ছা-কদিন আগে তুমি সাধন সরকারের বাড়িতে কেন গিয়েছিলে চোরের মত, গেট টপকে?
ঋতুর কথাতেই গিয়েছিলাম। রাফিয়ার সাথে সাধন সরকারের গোপন সম্পর্ক আছে এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় কিনা দেখবার জন্যে পাঠিয়েছিল সে আমাকে। কিছুই পাইনি।
শিল্পী কেন খুন হয়েছে, ইয়াকুব। কি জানো তুমি এ ব্যাপারে?
বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না। ঋতুর সন্দেহ, খুন করেছে রাফিয়া। কিন্তু আমি জানি না কিছুই।
এখন গুলি করল কে বলো তো?
ইয়াকুব বলল, ব্যালকনিতে গিয়ে কাউকে দেখেননি আপনি?
না। কাউকে দেখতে পাইনি।
ইয়াকুব বলল, আমি জানি না কে হতে পারে..বুঝতে পারছি না…।
শহীদ উঠে দাঁড়াল।–গুলি কে করেছে সেটা খুব একটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কারণ, ইতোমধ্যেই শহীদ একজনের কথা ভাবছে।
গুলি করা হয়েছে শহীদকেই রক্ষা করার জন্যে। ঋতু ঘুরে দাঁড়িয়ে শহীদকে দেখে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিল, এমন সময় সেই রহস্যময় লোকটি ব্যালকনি থেকে গুলি করে ঋতুর হাতের পিস্তলে। সন্দেহ নেই, শহীদকে রক্ষা করতে গিয়েই কেউ কাজটা করেছে।
সে কে হতে পারে, অনুমান করা কঠিন নয় শহীদের পক্ষে।
ইয়াকুব, তুমি একটা নর্দমার কীট। এখান থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও, কাল সকালেই তুমি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। ঢাকায় যেন তোমাকে আর কোন দিন না দেখি।
কথাগুলো বলে পা বাড়াল শহীদ দরজার দিকে।
.
ফেরার পথে গাড়িতে শহীদ ভাবছে। তুমুল ঝড় বইতে শুরু করেছে তার মাথার ভিতর। এমন কিছু বলেনি ইয়াকুব যা থেকে এই জটিল হত্যাকাণ্ড গুলোর উপর কোন আলোকপাত হয়।
মূল রহস্যটা নিহিত শিল্পীর খুন হওয়ার মধ্যে। সে যার হাতে খুন হয়েছে, তার হাতেই খুন হয়েছে মোরশেদ।
জামান অবশ্য খুন হয় বাদশা খানের হাতে।
আর রাফিয়া? রাফিয়া সুলতানা? সে কার হাতে খুন হয়েছে? শিল্পী আর মোরশেদের খুনী যে, সেই কি খুন করেছে রাফিয়াকে? রাফিয়ার লাশ–কোথায়? কেন, কেন খুনী লাশ সরিয়ে ফেলেছে? কেন?
এতসব কথা একসাথে ভাবতে গেলে কোনটারই হদিস পাওয়া যাবে না।
অফিসে পৌঁছুল শহীদ। প্রথমে শিল্পী, তারপর জামান! এরপর? এরপর কে? কামাল? নাকি ও নিজে?
পায়চারি শুরু করল শহীদ। কামাল কি ফিরেছে? মহুয়াকে ফোনে জিজ্ঞেস করলে হয়।
রিস্টওয়াচ দেখল শহীদ। মাত্র সাড়ে নটা। দশটায় ল্যাণ্ড করবে প্লেন। এখনও তাহলে পৌঁছয়নি কামাল।
শিল্পীকে কেন খুন করেছে খুনী? মোটিভ কি? শিল্পীকে কেন খুন করেছে খুনী? মোটিভ কি? শিল্পীকে কেন খুন…। একই প্রশ্ন বারবার মাথার ভিতর ঠোকর খাচ্ছে। এই প্রশ্নের ভিতরই লুকিয়ে রয়েছে যাবতীয় রহস্যের চাবিকাঠি। শিল্পীর বেডরূমে, কার্পেটের নিচে পাওয়া গেছে রাফিয়ার নেকলেস। কেন? কেন? কেন? কি অর্থ এর?
ঠাণ্ডা হও, শহীদ, মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করো! বিড় বিড় করে বলে উঠল কথাগুলো সে নিজেকেই উদ্দেশ করে। পায়চারি থামাল। পাইপে আগুন ধরাল। ধীরে ধীরে বসল, একটা চেয়ারে। হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
বাদশা খান। কোথায় সে? কুয়াশাকে অনুরোধ করেছে ও বাদশা খানের হদিস জানাবার জন্যে। কুয়াশা নিশ্চয়ই বসে নেই।
বাদশা খান খুন করেছে জামানকে। আর এক লোক-কাজী হানিফ। কি তার ভূমিকা?–
রীটা গোমেজ।
নাহ! তার স্বার্থ কি? না…ভুল হলো, স্বার্থ আছে বৈকি। রাফিয়া সুলতানা কেড়ে নিয়েছিল তার কাছ থেকে বাদশা খানকে। কিন্তু…নাহ! বিশ্বাস হয় না। একটা মেয়ে অতলো খুন করে না, করতে পারে না অমন সামান্য একটা কারণে।
ঋতু? সে তো একটা মানসিক ভারসাম্যহীন চরিত্রহীনা গোঁয়ার মেয়ে।
কিন্তু মোটিভ? রাফিয়াকে ফাসানো? দূর, দূর! ওটা একটা খুনের; একাধিক খুনের মোটিভ হতে পারে না। তাছাড়া, ৪৫ রিভলভার ব্যবহার করা তার পক্ষে কঠিন বলেই মনে হয়।
পায়চারি শুরু করল আবার শহীদ।
পায়চারি করছিল শহীদ যখন রাত একটার সময় ফোন এল, তখনও।
ফোনের বেল ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠতেই থমকে দাঁড়াল ও। রিস্টওয়াচ দেখল। কে ফোন করেছে জানে ও। এই ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছে ও।
এগিয়ে এসে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে বলল, শহীদ বলছি।
ভারি কণ্ঠস্বর, কুয়াশার, ডাক্তার কুমারকে চেনো তো, শহীদ?
চিনি। শয়তান কুমার নামে চেনে সবাই ওকে। খুনী, গুণ্ডা, বদমাশ, হাইজ্যাকারদের আশ্রয় দেয়, তাদের চিকিৎসা করে, তাদের দ্বারা নিহত লোকদের লাশ গুম করতে সাহায্য করে–এসবই তার বিরুদ্ধে রটনা, কেউ আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি একটি অভিযোগও।
তার বাড়িটা চেনো তো?
চিনি। ফরাশগঞ্জে নদীর ধারে। বাড়িতেই ডিসপেন্সারি।
কুয়াশা বলল, বাদশা খান ওখানেই আত্মগোপন করে আছে, শহীদ।
গম্ভীর হয়ে গেল শহীদের মুখ। বলল, ধন্যবাদ, কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, শোনো, শহীদ। ডাক্তার কুমারকে তোমার চেয়ে ভাল চিনি আমি। এক কাজ করো, আমি ওখানে যাচ্ছি, তোমাকে অনুসরণ করে শয়তানটার বাড়িতে ঢুকব…
শহীদ বলল, আমি এই মুহূর্তে রওনা হচ্ছি।
কুয়াশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শহীদ রিসিভার রেখে দিল যথাস্থানে।
তারপর ফোন করল মহুয়াকে।
মহুয়া। অফিস থেকে বলছি।
প্রায় সাথে সাথে মহুয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, তুমি অফিসে। এদিকে আমি তোমার অপেক্ষায় ফোনের সামনে বসে আছি।
কামাল পৌঁছেছে?
পৌঁছেছে। কিন্তু এইমাত্র চলে গেছে।
কোথায় গেছে?
কোথায় গেছে বলে যায়নি। সম্ভবত তোমার খোঁজেই গেছে। মি. সিম্পসনের কাছে যেতে পারে।
একমূহুর্ত চিন্তা করল শহীদ। তারপর বলল, ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো, ওকে বলবে আমি ডাক্তার কুমারের বাড়িতে যাচ্ছি। ও খবরটা পাওয়া মাত্র যেন রওনা হয়ে যায়। মি. সিম্পসনকে একথা জানাবার দরকার নেই।
এত রাতে একা তুমি..।
মহুয়ার কথা শেষ হবার আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল শহীদ। পকেট থেকে লোডেড রিভলভারটা বের করে চেক করে নিল ও।
সব ঠিক আছে।
পা বাড়াল শহীদ। দৃঢ়, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ও।
.
০৬.
বাড়িটা মেইন রোডের উপরই। ফোক্সওয়াগেন নিয়ে সেটার সামনে দিয়ে চলে গেল শহীদ। রাত একটা বেজে এগারো মিনিট। ফাঁকা রাস্তা। না আছে গাড়ি ঘোড়া, না আছে মানুষজন।
পঞ্চাশ ষাট গজ এগিয়ে একটা সরুগলির মুখে গাড়ি থামাল শহীদ। নামল, দরজা বন্ধ করল ধীরে ধীরে। নিঃশব্দ পায়ে গলির ভিতর ঢুকল ও।
ঘেউ। ঘেউ
একটা কুকুর ছুটে এল হঠাৎ। দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেট থেকে রিভলভার বের করে ফেলল শহীদ।
এই, শহীদ। একি করছ তুমি!
কুকুরটাকে গুলি করতে যাচ্ছিল শহীদ, কিন্তু নিজের ভিতর থেকে কথা বলে উঠল ওর মন। কুকুরটা বিপদ টের পেয়েছে। লেজ দাবিয়ে ছুটল সে।
খানিকদূর এগিয়ে নদীর ধারে পৌঁছুল ও। ডান দিকে পায়ে হাঁটা কর্দমাক্ত পথ চলে গেছে। সরু, পিচ্ছিল পথ। দিনের বেলা এই জায়গায় লোকজন ওঠা-নামা করে নৌকা থেকে।
পঞ্চাশ গজের মত এগিয়ে একটা উঁচু পাচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল শহীদ।
নদীতে চাঁদ দুলছে। নৌকা নেই, বড় বড় ঢেউ নেই। কল-কোলাহল কিছু নেই। লাফ মেরে পাচিলের মাথা ধরে ঝুলে পড়ল শহীদ। ওটার গায়ে পা বাধিয়ে অনায়াসে উঠে পড়ল ছয় ফুট উঁচু পাঁচিলের উপর।
নিচে গাঢ় অন্ধকার। দোতলা বাড়িটার পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোন আলো নেই। একমাত্র চাঁদের আলোই সম্বল। মাথার ঠিক উপর থেকে ডেকে উঠল একটা উড়ন্ত রাত-জাগা পাখি।
অকারণেই গা ছমছম করে উঠল শহীদের। বুকের ভিতর কেমন যেন তোলপাড় হচ্ছে।
ঝুপ!
লাফ দিয়ে নামল শহীদ। ব্যথায় চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল ওর। বড় একটা ইটের টুকরোর উপর পা পড়ায় পাটা মচকে গেল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোল ও। বুনো গাছ-গাছালিতে ভর্তি জায়গাটা। অদৃরে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা বারান্দা। ফাঁকা, শূন্য।
বারান্দার উপরে উঠে কান পাতল শহীদ। জানালা নেই একটাও, একপাশে শুধু তিনটে দরজা। তিনটেই পরীক্ষা করে দেখল ও। বন্ধ। নেমে এল বারান্দা থেকে। ডান দিকে এগোলঝোঁপ-ঝাড় মাড়িয়ে।
চাঁদের আলোয় পথ চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। বাড়িটার দিকে নজর ওর। দশ-বারো গজ এগোতে একটা জানালা পেল ও। কিন্তু ভিতর থেকে বন্ধ সেটা। আবার এগোল। এবার খানিকদূর এগোতেই যে জানালাটা চোখে পড়ল সেটা খোলাই রয়েছে দেখা গেল।
নিঃশব্দে জানালার নিচে প্রায় মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। আছে, ভিতরে মানুষ আছে। ঘুমাচ্ছে লোকটা। ছন্দোবদ্ধভাবে নিঃশ্বাস পড়ছে লোকটার।
লোহার শিকগুলো হাতের স্পর্শ দিয়ে পরীক্ষা করল ও। তেমন মোটা নয়। দুটো রড ধরে শক্তি পরীক্ষা শুরু করল ও।
মিনিট খানেকের মধ্যে শিক দুটো বাঁকা করে ফেলল শহীদ। আরও এক মিনিট লাগল কাঠের ফ্রেম থেকে সে দুটোকে তুলে আনতে।
মাথা গলিয়ে কামরাটার ভিতরটা দেখে নিল ও। কিছুই দেখবার উপায় নেই অন্ধকারে। পকেট থেকে টর্চটা বের করে জ্বালল।
সাদামাঠা একটা কামরা। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। দুই দিকের দেয়ালে দুটো পেরেকের সাথে একটা পাটের দড়ি ঝুলছে, সেই দড়িতে ময়লা লুঙ্গি, ছেঁড়া গেঞ্জি। চৌকির উপর খালি গায়ে একজন লোক ঘুমুচ্ছে তা ও দেখে নিয়েছে। প্রথমেই। লোকটা এ বাড়ির চাকর-বাকর হবে। একটিমাত্র দরজা কামরায়। সেটা ভিতর থেকেই বন্ধ। খিল নেই, শিকল নেই-আছে শুধু ব্যাঙ! সেটাই নামিয়ে দেয়া নিচের দিকে।
নিঃশব্দে জানালা গলে নামল শহীদ কামরার মেঝেতে। ঝুঁকি নেবার কোন মানে হয় না, কথাটা ভেবেই প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারুল লোকটার তেল চকচকে নাকের উপর।
যেমন শুয়েছিল তেমনি শুয়ে রইল লোকটা। নাকের ফুটো দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসতে শুরু করল দুটো রক্তের ধারা। জ্ঞান নেই তার, তা না হলে লোকটা গোটা এলাকার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিত চিৎকার করে।
ব্যাঙ তুলে দরজাটা খুলল শহীদ। সরু একটা প্যাসেজ চলে গেছে দুই দিকে। ঝট করে মাথাটা ভিতরে ঢুকিয়ে নিল ও। প্যাসেজের একদিকের শেষ প্রান্তে একজন লোক রয়েছে।
একটা টুলের উপর বসে রয়েছে লোকটা। দুই পায়ের মাঝখানে খাড়া করে রেখেছে সে একটা রাইফেল। দেয়াল ঘেষে বসেছে সে টুলে, মাথাটা দেয়ালে ঠেকানো।
একটু একটু করে মাথা বের করে আবার তাকাল শহীদ। নড়ছে না লোকটা। চোখ সম্ভবত বুজে আছে। ঘুমুচ্ছে কিনা দূর থেকে বোঝা মুশকিল।
পা টিপে টিপে প্যাসেজে বেরিয়ে এগোতে লাগল ও। লোকটার কাছেই প্যাসেজের শেষ দরজাটা, মুখোমুখি বড় একটা তালা ঝুলছে কড়া দুটোর সাথে। বাড়ির অন্দর মহলের সাথে উঠন বা বাইরের অংশের যোগাযোগ ওই দরজাটা।
লোকটার মাথা যে দেয়ালে সেই দেয়ালে, লোকটার কাছ থেকে হাত দুয়েক এদিকে, আর একটি দরজা। তাতেও তালা আটকানো। শহীদের মনে হলো, কামরাটার ভিতর কিছু থাকতে পারে। লোকটা হয়তো ওই কামরাটাই পাহারা দিচ্ছে।
ঘুমোচ্ছে লোকটা। একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে ও লোকটার চোখ দুটো। ইয়া লম্বা-চওড়া গোফ লোকটার। ছোট ছোট করে ছাটা চুল। নাকটা মুখের তুলনায় বড়।
কোন শব্দ শোনা যায় কিনা বোঝার জন্যে কান পাতল ও, তারপর প্রচণ্ড জোরে মারুল ঘুসিটা।
নাকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। রক্তের স্রোত বেরিয়ে এল সাথে সাথে।
টুল থেকে লোকটার অচেতন দেহটা নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল শহীদ। রাইফেল থেকে বের করে নিল বুলেটগুলো। সেগুলো পকেটে ভরে পিছিয়ে এসে দাঁড়াল কামরার দরজার সামনে।
তালাটা খোলার কোন উপায় নেই। লোকটাকে সার্চ করে কোন চাবি পায়নি ও।
ভাঙতে হবে। কিন্তু ভাঙার শব্দটা চাপা দেয়া তো আর সম্ভব নয়। শব্দ হলে চিন্তা করা যায় না। ছুটে আসবে শয়তান কুমার, ছুটে আসবে খুনী বাদশা খান, ছুটে আসবে শয়তান কুমারের অনুচরের দল হৈ-হৈ-রৈরৈ করতে করতে।
কিন্তু উপায় কি? নিজেকে খুব বেশিক্ষণ ভাবনা চিন্তা করতে না দিয়ে ভারি রাইফেলটা তুলে নিয়ে তার উপর প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করল ও। কেঁপে উঠল যেন গোটা বাড়িটা!
এক আঘাতেই খুলে গেল তালা। ফাঁক হয়ে গেছে কবাট দুটো।
আচমকা নিভে গেল প্যাসেজের আলো!
কামরার ভিতর অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে ভিতরে ঢুকল শহীদ। তালা দেয়া কামরা–কিন্তু কই, কিছুই তো নেই ভিতরে আরে! ওটা কি? পা বাড়াল শহীদ।
ফাঁকা, শূন্য কামরা। ধুলো পর্যন্ত নেই কোথাও। কিন্তু এক কোনায় শুধু পড়ে আছে লম্বা একটা কাঠের বাক্স।
বাক্সটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ধড়ফড় করছে বুকের ভিতরটা অকারণেই। বাক্সটার ভিতর কি আছে তা যেন জানে ও।
ঢাকনিটা তুলতে গিয়ে থামল ও। সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল। কে যেন কিছুটা দূরে দৌডুল, পরমুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ভুল শুনতে পাচ্ছে নাকি ও?
বাক্সের ভিতরটা দেখা দরকার আগে। ঝুঁকে পড়ে ঢাকনিটা তুলে ফেলল ও।
নাকে ধাক্কা মারল তীব্র ঝাঁঝ-ফরমালডিহাইডের গন্ধ। লাশ যাতে না পচে, তাই মাখিয়ে রাখা হয় লাশের গায়ে। বাক্সের ভিতর ঘুমুচ্ছে যেন মিসেস রাফিয়া ওরফে রাফিয়া সুলতানা। এতটুকু বদলায়নি তার চেহারা। চেহারায় শুধু ফুটে আছে আতঙ্ক।
ঢাকনিটা নামিয়ে রাখল শহীদ। টর্চটা নিভিয়ে ফেলল। পরক্ষণে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল ও। খোলা দরজা পথে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোন শব্দও ঢুকছে না কানে। হঠাৎ সামনের অন্ধকার যেন গাঢ় হয়ে উঠল। বিদ্যুৎ খেলে গেল শহীদের দেহে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই গোটা আকাশ ভেঙে পড়ল শহীদের মাথায়।
হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল শহীদ। ছিটকে পড়ল হাতের রিভলভার, টর্চ। তীব্র ব্যথায় গোঙাতে লাগল ও। পরক্ষণে কোঁত্ করে একটা বিদঘুঁটে শব্দ বেরিয়ে এল গলা থেকে। লাথি মারছে শত্রু ওর পেটে।
দ্বিতীয় লাথিটা শহীদের বুকের নিচে লাগল। লম্বা হয়ে গেল দেহটা মেঝের উপর। মাথাটা ঠুকে গেল মেঝের সাথে।
বাঘের মত কেউ লাফ দিয়ে পড়ল ওর বুকের উপর। নড়েচড়ে জুতসইভাবে বসল, দুই হাত দিয়ে খুঁজে নিল ওর গলাটা। দম বন্ধ হয়ে আসছে শহীদের। মাথার ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে যেন ও। হাত দুটো নাড়ার চেষ্টা করল ও। কষ্ট হচ্ছে। বড়। একটু বাতাস! একটু তাজা বাতাস! মরিয়া হয়ে উঠছে মনটা। মরতে চাইছে না ও।
হাত দুটো উঠে এল শহীদের। শূন্যে যেন দুলছে দুটো হাতই। আস্তে আস্তে নামাল একটু। লোকটার গলায় গিয়ে ঠেকল। জোর পাচ্ছে না ও হাতে। ছেড়ে দিল গলাটা। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি। কিন্তু তাই বলে কি শেষ চেষ্টা করবে না ও?
দুর্বল হলেও ঘুসিটা লাগল লোকটার বাঁ চোখে। শহীদের গলায় হাত দুটো একটু ঢিল হলো।
জোরে তাজা বাতাস নিল শহীদ। সাথে সাথে আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠল বুক। একটা হাত লোকটার মুখের উপর রাখল ও। আঙুলগুলো কি যেন খুঁজছে। লোকটার একটা চোখের নিচে স্থির হলো শহীদের দুটো আঙুল। শত্রু বিপদ টের পাবার আগেই একটি আঙুল ঢুকিয়ে দিল শহীদ। আঙুলটা বাঁকা করে বাইরে বের। করে আনল ও মণিটা সহ। মৃত্যু যন্ত্রণায় শত্রু এমনই শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল যে চিৎকার করারও শক্তি পাচ্ছিল না সে। দ্বিতীয় আঘাতটা খেয়ে সে বস্তার মত গড়িয়ে পড়ে গেল শহীদের বুকের উপর থেকে।
সুযোগটা গ্রহণ করল শহীদ। উঠে দাঁড়াল ও। পায়ের সাথে ধাক্কা লাগল যেন কিসের, জিনিসটা গড়াতে শুরু করল। শব্দ লক্ষ্য করে নিচু হয়ে হাত বাড়াল শহীদ। তুলে নিল মেঝে থেকে টর্চটা।
টর্চের আলোয় শহীদ দেখল দুই হাতে চোখ ঢেকে নিঃশব্দে পা ছুঁড়ছে শয়তান কুমার।
রিভলভারটা কুড়িয়ে নিল শহীদ। লক্ষ্যস্থির করে শয়তান কুমারের পাঁজরে সবুট লাথি মারল একটা, তারপর মাথা লক্ষ্য করে আরও একটা।
নিঃসাড় হয়ে গেল দেহটা।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল শহীদ।
চারদিক নিস্তব্ধ। বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। এমন সময় বিনা মেঘে বজপাতের মত কান ফাটানো শব্দ হলো। গুলির আওয়াজ। একবার কয়েক সেকেণ্ড বিরতির পর আর একবার।
তারপর আবার সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ।
ছুটল শহীদ। প্যাসেজের অপর প্রান্তে একটা বাঁক দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই ছুটল ও। সিঁড়িটা খুঁজে বের করতে হবে।
গুলির শব্দ এসেছে দোতলা থেকে।
.
০৭.
ক্রেপসোলের জুতো পায়ে, প্রায় নিঃশব্দে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল শহীদ।
নেই, কোন শব্দ নেই। দুটো করে ধাপ টপকাতে টপকাতে উঠতে শুরু করল ও। মাঝখানে একবার থামল, তারপর সোজা উঠে গেল উপরে। ফাঁকা করিডর দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ির মাথার কাছেই একটা দরজা, খোলা রয়েছে সেটা।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বারুদের গন্ধ লাগল নাকে। ভিতরে রক্তাক্ত দৃশ্য। বিছানাটার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল শহীদ। কিন্তু পরক্ষণে আবার তাকাল ও।
ভিতরে ঢুকল শহীদ।
লোকটা বাদশা খান, সন্দেহ নেই। চেহারার বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে হুবহু। চেয়ে আছে শহীদের দিকে। চেহারায় ব্যথার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। যেন দম বন্ধ করে আছে সে।
করার কিছু নেই শহীদের। .৪৫ পিস্তলের বুলেট, বাদশা খানের ক্ষতগুলো দেখেই বুঝল ও।
পেটের নাড়িভুড়ি দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় বুলেটটা বেরোয়নি, এখনও আছে বুকের মাঝখানটায়।
চোখের দিকে তাকাতে বাদশা খান কি যেন ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করল। কাছে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ঘামছে ও। এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য–সহ্য করা যায় না। লোকটার জীবনী শক্তির তুলনা হয় না। এখনও বেঁচেই নেই শুধু, হাতটাও নাড়ছে, সে।
বাদশা খান হাত সামান্য একটু উঁচু করে একটা আলমারির দিকে ইঙ্গিত করছে।
শহীদ আলমারির দিকে তাকাল। কিন্তু সেদিকে পা না বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল বাদশা খানের মুখের উপর। চিৎকার করে জানতে চাইল, কে গুলি করেছে তোমাকে?
বাদশা খানের বাকশক্তি ফুরিয়ে গেছে। কথা বলার চেষ্টাই করল না সে। চোখ দুটো বুজে আসছে তার। কিন্তু হাতটা সে তখনও নাড়ছে আলমারিটার দিকে।
কি আছে আলমারিতে!
মাথাটা একপাশে কাত হয়ে গেল বাদশা খানের। শেষ।
আলমারিটা তালা বন্ধ। বালিশের নিচেই পাওয়া গেল চাবিটা। তালা খুলে ফেলে ভিতরটা সার্চ করতে শুরু করল শহীদ। একটা ডায়েরী পাওয়া গেল। আর কিছু না। দ্রুত কয়েকটা পাতা উল্টে দেখে নিল ও। ডায়েরীটা বাদশা খানেরই। পকেটে ভরে দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
পদশব্দ এবং উত্তেজিত শশারগোলের শব্দ ভেসে আসছে নিচের দিক থেকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। এগিয়ে আসছে শব্দ। ইন্সপেক্টর গনির গলা শোনা যাচ্ছে। সিঁড়িতে উঠে পড়েছে..বুট জুতোর ভারি শব্দ উঠে আসছে।
দরজাটা ঝট করে বন্ধ করে দিল শহীদ। ভিতর থেকে খিল লাগিয়ে দিল। এদিকে এসো, শহীদ।
চেনা কণ্ঠস্বর সবেগে ঘুরে দাঁড়াতেই ভোলা জানালার বাইরে কালো আলখেল্লা পরিহিত একটি মূর্তিকে দেখতে পেল শহীদ। মুচকি হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।
পৌঁছুতে দেরি হয়ে গেল আমার। কারণ, খুনীর পিছু পিছু ধাওয়া করে দেখে আসতে হলো কিনা তার বাড়িটা।
কে…?
ইন্সপেক্টর গনির বজ্রকণ্ঠ ভেসে এল করিডর থেকে, ভেতরে যেই থাকো, দরজা খোলো বলছি! তা নাহলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকব আমরা।
সেই সাথে দরজার গায়ে বুটের আঘাত হলো।
কুয়াশা বলল, সরে দাঁড়াও শহীদ।
কুয়াশার হাতে একটা পিচকারির মত যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। সাদা একটা বোতাম রয়েছে পিচকারির মাঝখানে। জানালায় শিকের দিকে মুখ করে বোতামটায় চাপ দিতেই পানির মত তরুল পর্দাথ বেরিয়ে এল। ভিজে গেল শিকগুলো।
যন্ত্রটা পকেটে ভরে কুয়াশা ভিজে লোহার শিকগুলো ধরে মৃদু টান দিতেই পাটখড়ির মত মট মট করে ভেঙে গেল একটা একটা করে।
বেরিয়ে এসো?
মাথা গলিয়ে জানালার বাইরে, কারনিসেবেরিয়ে এল শহীদ।
লাফ দিয়ে উঠে গেল কুয়াশা ছাদের উপর। আমার হাত দুটো ধরো।
শহীদকে টেনে তুলে নিল কুয়াশা ছাদের উপর। এসো।
ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। সাথে সাথে শহীদও। চাঁদের আলোয় শহীদ দেখল পাশের বাড়ির ছাদটা কমপক্ষে সাত গজ দূরে। মাঝখানে শূন্যতা। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল একটা মোটা দড়ি এ-ছাদ থেকে ও-ছাদ পর্যন্ত লম্বালম্বি ভাবে ঝুলছে।
পারবে?
শহীদ মাথা কাত্ করল। তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল শূন্যে। ঝুলতে ঝুলতে আধহাত আধহাত করে এগোতে লাগল ও।
প্রকাণ্ড একটা কালো মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। দেখছে।
পাশের বাড়ির ছাদে পৌঁছে গেল শহীদ। এরপর কুয়াশা দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। শহীদের চেয়ে অনেক কম সময়ে দূরত্বটুকু অতিক্রম করল কুয়াশা।
অধৈর্য কণ্ঠে জানতে চাইল শহীদ, কার কথা বলছিলে তুমি, কুয়াশা? কে খুনী?
আলখেল্লার পকেটে হাত ভরে একটা রিভলভার বের করল কুয়াশা। শহীদ দেখল রিভলভারটা অদ্ভুত আকৃতির, সামনের দিকে টেলিস্কোপ লাগানো।
এটা রাখো তোমার কাছে। কিন্তু, সাবধান! ভুলেও তুমি এটা ব্যবহার করবে না। আমি আবার বলছি, কোন পরিস্থিতিতেই তুমি এটা ব্যবহার করতে যেয়ো না। তোমাকে দিচ্ছি, হয়তো এর দ্বারা উপকৃত হতে পারো–এই ভেবে।
চেয়ে রইল শহীদ অবাক হয়ে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করল না ও।
এই ছাদের শেষ মাথায় একটা বাঁশের মই পাবে তুমি। মইটা দোতলার বারান্দায় নেমে গেছে। ওখান থেকে একটা পাঁচিলে নামবে, পাঁচিলের ওপারেই নদীর পাড়।
শহীদ বলল, তুমি…?
আমার সাহায্য দরকার তোমার, শহীদ?
শহীদ হাসল। বলল, না। কুয়াশা, খুনীর পরিচয় অনুমান কবতে পারছি আমি। ভাবছি তার কাছে এখুনি যাব কিনা।
কুয়াশা বলল, তোমার আসলে বিশ্রাম দরকার। রাত এখন আড়াইটা। এক কাজ করো না, রীটা গোমেজের বাড়ি তো কাছে, পিঠেই, ওর বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে নাও কয়েক ঘণ্টা। সকাল হলে।
নিঃশব্দে শহীদ চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
.
০৮.
ঢং-ঢং, টং! রাত তিনটের ঘণ্টা পড়ল দূরের গির্জা থেকে।
কিচির! কিচির! বোতামটা চেপে ধরতে ভিতর থেকে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এল। ঘুমিয়ে আছে বেচারী! এত রাতে, প্রায় ভোর হয়ে এসেছে, ঘুম না ভাঙালেই ভাল হত।
চোখ দুটো ভারি হয়ে আসছে শহীদেরও। ঘুম পাচ্ছে নাকি? না। ঘুমে নয়, শোকে। মনে পড়ছে শিল্পীর কথা। মনে পড়ছে জামানের কথা।
ওদের অকাল মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে দুদণ্ড মন খারাপ করার অবসরও পায়নি ও। খুনীকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে সে সুযোগও দিতে পারেনি সে।
খুনীর পরিচয় এখন জানা গেছে। সন্দেহ এখনও আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এখনও কয়েকটা জিনিস আবছা আবছা ঠেকছে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না–তবু, খুনীকে চিনতে ভুল হয়নি ওর।
কে? বিরক্তিতে ভরপুর কণ্ঠস্বর রীটার। ঘুমে জড়ানো।
শহীদ নিচু স্বরে বলল, আমি, রীটা। আমি শহীদ। এত রাতে তোমাকে বিরক্ত করছি…
দরজা খুলে দিয়ে রীটা গোমেজ আপাদমস্তক দেখে নিল শহীদের। উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চাইল, ওহ, গড! আপনি! কোন দুঃসংবাদ নিয়ে…
না। আমি খুব ক্লান্ত। একটা খবর পেয়ে আসতে হয়েছিল এত রাতে এদিকে। এতই ক্লান্ত আমি যে ড্রাইভ করে ধানমণ্ডিতে ফেরার শক্তি পাচ্ছি না শরীরে।
আসুন, আসুন! কি সাংঘাতিক, আপনি। এমন খাটা-খাটনি করলে যে স্রেফ মারা পড়বেন। দাঁড়ান, সকালেই আমি মইয়াদির কাছে যাচ্ছি…।
পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালরীটা গোমেজ, পাশ ঘেঁষে এগোল শহীদ ছোট্ট বারান্দার উপর দিয়ে।
গ্রাউণ্ড ফ্লোরে মাত্র দুই কামরার একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে রীটা গোমেজ। ড্রয়িংরূমের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল শহীদ। পিছন পিছন রীটা গোমেজ।
খাবেন কিছু?
শহীদ বসল একটা গদি মোড়া চেয়ারে। দামী আসবাবে সুন্দর ভাবে সাজানো রূমটা। প্রশংসার দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখল শহীদ। বলল, সুন্দর। কিছু বললে?
কিছু খাবেন?
কফি হলে ভাল হয়। কয়েক সেকেণ্ড পর শহীদ আবার বলে উঠল, না, থাক। একটু পর। রীটা, বসো আমার সামনে। তোমার সাথে আমি দুএকটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। একের পর এক হত্যাকাণ্ড, বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে–মাথাটা ঠিক রাখতে পারছি না। কেউ নেই যার সাথে আলোচনা করে গিটগুলো খুলতে পারি। রীটা, শোনো, আমার কথাগুলো।
রীটা বসল। বলল, আপনাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে। শুয়ে পড়ুন না বরং?
শহীদ সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, ঠিক বলেছ। শোয়াই ভাল। চলো, তোমার বেডরূমে যাই।
পা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দরজা অতিক্রম করে বেডরূমে ঢুকল শহীদ।
সিঙ্গেল একটা সেগুন কাঠের ফ্যান্সি খাট, বুক শেলফ, একটা বেতের চেয়ার, তেপয়, টেলিফোন, শো-কেস-মাঝারি আকারের বেডরূমটা এইসব দিয়ে সাজানো।
শুয়ে শুয়ে আলোচনা করি। তুমি চেয়ারে বসো।
বসল রীটা। শহীদ শুলো না, বসল খাটের উপর। বলল, আরও একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আরও একজন লোক খুন হয়েছে, রীটা।..
গালে হাত চাপা দিয়ে আঁতকে উঠল রীটা গোমেজ। কে?
বাদশা খান।
পকেটের টেলিস্কোপ লাগানো রিভলভারটা অস্বাভাবিক বড় বলে ঊরুর মাংসে খোঁচা মারছে নড়তে-চড়তে। পকেট থেকে বের করে নেড়েচেড়ে দেখল শহীদ কিছুক্ষণ। তারপর রেখে দিল তেপয়টার উপর।
রীটা গোমেজ চেয়ে আছে শহীদের দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। তারপর জানতে চাইল, কে তাকে…?
যে শিল্পী, দেলোয়ার মোরশেদ এবং রাফিয়াকে খুন করেছে, সে-ই। আচ্ছা তোমার ব্যাপারটা কি, রীটা? কিছু কিছু ব্যাপার গোপন রেখেছ তুমি আমার কাছ থেকে। কেন?
মুচকি একটু হাসল রীটা গোমেজ। বলল, মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, শহীদ ভাই, যা সে স্মরণ করতে চায় না, ভুলে যেতে চায়। আমার জীবনেও তেমনি কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে অতীতে।
শহীদ বাঁ পকেট থেকে পাইপ এবং টোবাকোর পাউচ বের করল। বলল, তা ঠিক। তবু আমাকে তুমি বলতে পারতে। রাফিয়া সুলতানার সাথে তোমার পরিচয় ছিল, তিক্ত সম্পর্ক ছিল–সম্পর্ক ছিল, একসময় মধুর, পরে তিক্ত, বাদশা খানের সাথেও।
প্রাচীনকালের ঘটনা সেসব। আপনি এসব কথা জানলেন কিভাবে, শহীদ ভাই?
শহীদ পাইপে টোবাকো ভরতে ভরতে বলল, চট্টগ্রামের সাদী সাহেবকে মনে পড়ে তোমার?
পড়ে বৈকি। ফ্রেণ্ডশীপ নাইট ক্লাবের ম্যানেজার।
তার সাথে কথা হয়েছে আমার। তুমি ওখানে কিছুদিন কাজ করেছিলে।
হ্যাঁ।
রীটা গোমেজ হাই তুলল, আবার বলল, কফি খেলে হত না? ঘুম পাচ্ছে যে।
ঠিক বলেছ। করো দুকাপ কফি। একটা কথা না বলে পারছি না, রীটা। একসময় তো ভালবাসতে তুমি বাদশা খানকে। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তুমি কিন্তু দুঃখ পাওনি এতটুকু।
কেন পাব? আমার জন্যে কি করেছে সে, আমাকে কষ্ট দেয়া ছাড়া? তাছাড়া তার সাথে সব সম্পর্কের ইতি ঘটে গিয়েছিল বহুদিন আগেই। তার অস্তিত্বের কথাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আপনি নতুন করে তার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
রীটা কথা বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এবার সে পা বাড়াল কিচেনরূমে যাবার জন্যে বন্ধ একটা দরজার দিকে।
রীটা, গোমেজ বেরিয়ে যেতে খাট থেকে নেমে পায়চারি শুরু করল শহীদ। আড়চোখে তাকাল কয়েকবার তেপয়ের উপর রাখা অদ্ভুত আকৃতির রিভলভারটার দিকে। হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করল আবার। টেলিস্কোপটার অস্তিত্ব ওর মনে একটা খুঁত খুতে ভাব এনে দিয়েছে। রিভলভারটা শো-কেসের উপর রাখা ফ্লাওয়ার ভাসের দিকে তুলে ধরল ও, লক্ষ্যস্থির করে টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না ও। এ কেমন টেলিস্কোপ-কিছুই দেখা যায় না কেন? তারপর, হঠাৎ, মৃদু হাসল ও।
বিছানার উপর ছুঁড়ে দিল শহীদ রিভলভারটা। মাথার ভিতর আবার ঝড় বইতে শুরু করেছে।
পায়চারি শুরু করেই থমকে দাঁড়াল শহীদ।
কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চাপা গলায়, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রীটা গোমেজ কিচেন রূমে।
আহা বেচারী। বাদশা খানকে আসলে ভুলতে পারেনি সে।
আবার পায়চারি শুরু করল শহীদ। একসময় বসল বেতের চেয়ারটায়।
রীটা গোমেজ খানিক পর বেডরূমে ঢুকল। দুই হাতে দুই কাপ কফি। তেপয়ের উপর নামিয়ে রাখল সে একটা কাপ। তার চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে, তাছাড়া বোঝার কোন উপায় নেই এইমাত্র কান্নাকাটি করেছে সে। ধীরে ধীরে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে বসল সে বিছানার উপর।
নিঃশব্দে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চিন্তা করছিল শহীদ মেঝের দিকে তাকিয়ে। কাপটা নিঃশেষ করে নামিয়ে রাখল সেটা তেপয়ের উপর। মুখ তুলল। দেখল রীটা গোমেজ চেয়ে আছে ওরই দিকে।
আপনি সম্ভবত আমাকে জেরা করবেন এখন, শহীদ ভাই? রীটা গোমেজ মান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
মৃদু হাসল শহীদ। বলল, ঠিক জেরা নয়। আমি তোমার কাছ থেকে নতুন কিছু কথা শুনতে চাই। এতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে–এই রহস্যের কিনারা আমাকে করতেই হবে। তোমাকে জেরা করে নতুন কিছুই হয়তো জানতে পারব না। তবে, বলা তো যায় না, তোমার দেয়া কোন তথ্য হয়তো এই রহস্য উন্মোচনে আলোকপাত করতে পারে। অন্তত খুঁতখুঁতে ভাবটা দূর হবে। আমার মনে হচ্ছে এই রহস্যের প্রায় সবটুকুই জানো তুমি, অন্তত আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো। খুনী কে–এই প্রশ্নের উত্তর আমি চাই। হয়তো খুনীর পরিচয় জানার পরও আমার কিছু করার থাকবে না।
তারমানে? খুনীর পরিচয় জানার পরও আপনার করার কিছু থাকবে না-একি বলছেন আপনি!
শহীদকে গভীর দেখাল, বললে বুঝতে পারবে কেন বলছি কথাটা। তোয়াব খান–তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, তার কেসটার কথা পুলিসকে কিংবা নিজের লোক ছাড়া আর কাউকে বলব না। কথাটার মূল্য আমাকে রক্ষা করতে হবে, রীটা। খুনীকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারি কিন্তু সেটা আমার নীতিবিরোধী ব্যাপার। আমি আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে খুন করার জন্যে আজ পর্যন্ত গুলি করিনি। সুতরাং, খুনীকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারছি না আমি। আর একটা উপায় আছে। পুলিসের হাতে তাকে তুলে দিতে পারি গ্রেফতার করে। কিন্তু তাতেও বিরাট বাধা রয়েছে। ইন্সপেক্টর গনি খেপে আছে আমার ওপর। খুনীকে তার হাতে তুলে দিতে গেলেই সে এতগুলো হত্যাকাণ্ডের বিশদ ব্যাখ্যা দাবি করবে। চুপ করে থাকা তখন সম্ভব হবে না। তোয়াব খানের কথা তখন আমাকে বলতেই হবে। কিন্তু তা আমি চাই না। আমার ধারণা, খুনীর পরিচয় তুমি জানো, রীটা। জানলে, বলো। সে যদি তোমার প্রিয়পাত্র কেউ হয়–ভয় নেই, তাকে আমি শহর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলব শুধু তার বিরুদ্ধে আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।
আপনি অনুমান করতে পারছেন না কে খুনী?।
শহীদ বলল, অনুমান করা আর নিঃসন্দেহে জানা দুটো আলাদা ব্যাপার, রীটা। বাদশা খান জানত খুনী কে–তাই তাকে মরতে হলো। বাদশা খান খুন করেছিল জামানকে। কিন্তু বাদশা খান শিল্পীকে খুন করেনি। দেলোয়ার মোরশেদও জানত খুনীর পরিচয়-তাই তাকেও খুন করেছে খুনী। তুমিও জানো, রীটা, খুনী কে। এবার হয়তো তোমার পালা। খুনী তোমাকে খুন করবে এবার। তার চেয়ে, রীটা,বলে দাও, বলে দাও কে সে, কি তার পরিচয়।
হাত বাড়িয়ে খালি কাপটা রাখল রীটা তেপয়ের উপর।
আমি জানি কিভাবে বুঝলেন আপনি?
শহীদ হাসল, অনুমানে জেনেছি। আমার ধারণা রাফিয়া সুলতানা নিহত হবার পর তোমার সাথে দেখা হয় বাদশা খানের। পুরানো মধুর সম্পর্কটা জোড়া লাগে আবার। বাদশা খানকে রাফিয়া যা যা বলেছে, নিশ্চয়ই সে তোমাকে জানিয়েছে সেসব কথা।
রীটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন শহীদ ভাই। কথাগুলো বলতে চাইনি…কি লাভ! যাক, সে যখন খুনই হয়েছে-কিছু এসে যায় না আর এখন। মিথ্যে কথা বলেছি খানিক আগে আমি, শহীদ ভাই। আসলে বাদশাকে আমি ভুলতে পারিনি। তাকে আমি আজও ভালবাসি। সে মরে গেছে, তবু তার প্রতি আমার ভালবাসা থাকবে। বেশ ছিলাম আমরা, কিন্তু ওই রাফিয়া ডাইনীটা আমাদের দুজনের মাঝখানে এসে পড়ায় সব ধসে পড়ল হুড়মুড় করে। বাদশা ভুলে গেল আমাকে, ঝুঁকে পড়ল ওই ডাইনীটার দিকে। ফেরাতে কম চেষ্টা করিনি আমি বাদশাকে। কিন্তু পারিনি। ফেরেনি সে রাক্ষসীটার মায়া ছেড়ে। তারপর ওই ধরনের মেয়েরা যা করে তাই করল ডাইনীটা। আমার কাছ থেকে বাদশাকে ছিনিয়ে নিয়ে অল্প কয়েকদিন ফুর্তি করল সে, তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করল মোহাম্মদ তোয়াব খানকে। বিয়ে করে ওকে যখন তোয়াব সাহেব ঢাকায় আনেন, আমি তখন এখানেই রয়েছি। একদিন একটা পার্টিতে দেখি আমি ডাইনীটাকে। কৌতূহলী হয়ে খোঁজ খবর নিতে থাকি। জানতে পারি, বাদশা খানকে ডিভর্স না করেই সে বিয়ে করেছে তোয়াব সাহেবকে। প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটা দমন করতে। পারিনি আমি। আমার জীবনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আমার সুখ, আনন্দ, স্বস্তি সব পুড়িয়ে দিয়েছিল সে। আমিও ওর জীবনে আগুন ধরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিই। নাম ঠিকানা না দিয়ে আমি একটা চিঠি লিখি তোয়াব সাহেবকে। চিঠিতে জানাই, রাফিয়ার স্বামী আছে, তার নাম বাদশা খান।
শহীদ শুনছে গভীর মনোযোগর সাথে।
শুধু তাই নয়, আমি বাদশাকেও জানাই চিঠির কথাটা। বাদশা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঢাকায় আসে সে রাফিয়ার সাথে দেখা করার জন্যে। এদিকে রাফিয়া তোয়াব সাহেবের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল অল্প কদিনেই। একজন বুড়োর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা কতদিন সম্ভব, বলুন? বিশেষ করে ওই রাক্ষসীর পক্ষে? তাই নতুন এক ছোকরার সাথে মেলামেশা শুরু করেছে সে তখন।
সাধন সরকার?
হ্যাঁ। রাফিয়া আগেই খবর পায়, বাদশা তার সাথে দেখা করতে আসছে। ভয় পেয়ে যায় সে। কারণ, সে ধরে নিয়েছিল বাদশা নিজেকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখার জন্যে তাকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। ভয় পেয়ে সে আশ্রয় নেয় ফেয়ারভিউ নাইট ক্লাবে, কাজী হানিফের কাছে। এসব কথা আমাকে বলেছে বাদশা নিজেই। রাফিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে এসব কথা বাদশাকে বলে গেছে। আপনার সহকারিণী, শিল্পী–তাকে ভুল করে গুলি করা হয়।
মেঝেতে পা দুটো লম্বা করে দিয়ে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে শহীদ। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে লম্বা কালো পাইপটা। নিভে গেছে সেটা কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই একবিন্দু।
তোয়াব সাহেব আমার চিঠিটা রাফিয়াকে দেখিয়ে আসল ব্যাপার কি জানতে চান। মিথ্যেকথা বলে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করে রাফিয়া। কিন্তু তোয়াব সাহেব। তার কথা বিশ্বাস করেননি। বিশ্বাস যে করেননি তা রাফিয়াও বুঝতে পারে। তোয়াব সাহেব তাকে সেই মুহূর্তে খুন করতে গিয়েছিলেন রাগে, ঘৃণায় তিনি উন্মাদের মত হয়ে উঠেছিলেন। রাফিয়া আতঙ্কে পালিয়ে আসে তাঁর কাছ থেকে। ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসে সে, গাড়ি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায়। সেই রাতেই সে আপনার অফিসে গিয়েছিল। গিয়েছিল শিল্পী কেন তাকে অনুসরণ করছে এবং তোয়াব সাহেব সাধন সরকারের সাথে তার সম্পর্কের কথাটা জানেন কিনা জানার জন্যে। আপনার অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে সে দেখে আর একটা গাড়ি নিয়ে তোয়াব সাহেব তাকে অনুসরণ করছেন। আতঙ্কে অস্থির হয়ে। ওঠে সে। গাড়ি থামিয়ে শিল্পীর মুখোমুখি হয়। শিল্পীও তাকে অনুসরণ করছিল সে সময়। শিল্পীকে অনুরোধ করে সে আশ্রয় দেবার জন্যে। শিল্পী তাকে সাথে করে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। তোয়াব সাহেব শিল্পীর ফ্ল্যাটের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাফিয়া শিল্পীকে নিজের গলায় পাথর বসানো নেকলেসটা ঘুষ হিসেবে দিতে চায়, যদি শিল্পী নিজের পরনের কাপড় তাকে দেয় এবং তার পরনের কাপড় শিল্পী নিজে পরে-এই শর্তে। শিল্পী রাফিয়ার কাপড় পরে বাইরে বেরিয়ে যাবে, তোয়াব সাহেব অন্ধকারে তাকে রাফিয়া মনে করে অনুসরণ করবেন, সেই ফাঁকে রাফিয়া ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেবে কাজী হানিফের নাইটক্লাবে–এই ছিল পরিকল্পনা। শিল্পীকে অসং বলা চলে না। মেয়ে মানুষ, গহনার প্রতি স্বাভাবিক একটা আকর্ষণ থাকেই। সে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে। রাফিয়ার শাড়ি ব্লাউজ পরে সে বেরিয়ে যায় বাইরে। তোয়াব খান তাকে রাফিয়া মনে করে অনুসরণ করতে শুরু করেন। রাফিয়া এই সুযোগে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে রওনা হয় কাজী হানিফের নাইটক্লাবের উদ্দেশে। নিরাপদেই সেখানে পৌঁছায় সে। কিন্তু বিপদ হয় শিল্পীর। তোয়াব খানের চোখে ধূলো দেবার জন্যে শিল্পী লেকের ধারে যায়। কিন্তু ধূলো সে দিতে পারেনি তোয়াব সাহেবের চোখে। তিনি তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। লেকের ধারে পৌঁছে তিনি গুলি করেন শিল্পীকে। এসব তো আপনিও হয়তো অনুমান করে রেখেছেন আগেই, তাই না? দেলোয়ার মোরশেদকে তোয়াব সাহেবই খুন করেন। শিল্পীর দেহ থেকে কাপড় খুলে নিচ্ছিলেন তোয়াব সাহেব, হেদায়েত তা দেখতে পায়। পরে সে তোয়াব সাহেবকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে।
এত কথা তুমি জানলে কিভাবে?
রাফিয়া ফেয়ার ভিউয়ে থাকার সময় বাদশাকে একটা চিঠি লিখে সব কথা জানায়, বাদশা আমাকে বলেছিল পরে।.
শহীদ পাইপে আগুন ধরাল, ধোয়া ছেড়ে বলল, সাধন সরকারের বাড়িতে গেল কিভাবে শিল্পীর কাপড়-চোপড়?
রাফিয়া পরেছিল ওগুলো। ফেয়ার ভিউয়ে যাবার আগে সে সাধন সরকারের বাড়িতে যায়। সাধন সরকার, সে রাতে ঢাকায় ছিল না, ছিল নারায়ণগঞ্জে। অবশ্য বাড়ির ভিতর ঢুকতে অসুবিধে হয়নি রাফিয়ার। একটা চাবি তার কাছে সব সময়ই থাকত। বাড়িটায় তার কাপড়-চোপড়ও ছিল অনেকগুলো। তালা খুলে ভিতরে ঢুকে শিল্পীর কাপড় ছাড়ে সে, পরে নিজের রেখে যাওয়াগুলো। তারপর ফেয়ার। ভিউয়ে যায়। আপনি তাকে সেখানে আবিষ্কার করেন। এরপর কাজী হানিফ তাকে তাড়িয়ে দেয়। রাস্তায় বেরিয়ে আসে সে কিন্তু যাবার জায়গা ছিল না তার। তোয়াব সাহেব তখনও তাকে খুঁজছিলেন। তাই সে আপনার অফিসে যায়। আপনি তখন তোয়াব সাহেবের কাছে ছিলেন। তোয়াব সাহেব হয়তো সন্দেহ করেছিলেন। আপনি তার অপরাধের কথা জানতে পেরেছেন, তাই আপনাকে খুন করার জন্যে তিনি আপনার অফিসে আসেন। কিন্তু তিনি পৌঁছেই আপনাকে নয়, দেখেন রাফিয়াকে। গুলি করেন তিনি সাথে সাথে। এদিকে বাদশাও খুঁজছিল রাফিয়াকে। সে আপনার সাথে দেখা করে রাফিয়ার সন্ধান নেবার কথা ভাবে। আপনার অফিসে সে-ও পৌঁছায়। কিন্তু অল্প দেরি হয়ে যায় তার পৌঁছতে। তোয়াব সাহেব তখন পালাচ্ছিলেন। ওদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়, তোয়াব সাহেব নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে যান। যাবার সময় তিনি এঁর রিভলভারটা ফেলে যান। ঠিক এই সময় আপনি পৌঁছান। ইতিমধ্যে বাদশার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেছে। সে তোয়াব সাহেবকে ব্ল্যাকমেইল করে অগাধ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করে। তিনি যে রিভলভারটা ফেলে যান তাতে তার নাম খোদাই করা ছিল। এই রিভলভার দিয়েই খুন করা হয় শিল্পীকে, হেদায়েতকে এবং রাফিয়াকে। বাদশা আপনাকে পিছন থেকে আক্রমণ করে আহত করে, আপনি জ্ঞান হারান। রাফিয়ার লাশ কাঁধে নিয়ে আপনার অফিসের পিছনে দাঁড় করানো গাড়িতে গিয়ে ওঠে সে, সোজা পৌঁছয় ডাক্তার সজীব কুমারের বাড়িতে। সেখান থেকে ফোন করে আমাকে। আমাকে সে আপনার অফিসে যেতে বলে, আপনার মুভমেন্ট এবং রিয়্যাকশনের ওপর নজর রাখার জন্যে।
রীটা ঠোঁট বাঁকা করে হাসল একটু। বলল আবার, সবই তো বললাম। বাকিটা আপনি কল্পনা করে বুঝে নিন। ইতিমধ্যেই বাদশা তোয়াব সাহেবের সাথে দেখা করেছিল। দশ লাখ টাকা ক্যাশ দাবি করে সে। তা নাহলে, ভয় দেখায়, রাফিয়ার লাশ এবং রিভলভারটা সে তুলে দেবে পুলিসের হাতে।
তুমি বলতে চাইছ সেই টাকা দেবার জন্যেই তোয়াব সাহেব ডাক্তার সজীবের বাড়িতে বাদশার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল আজ রাতে, এবং টাকা না দিয়ে সরাসরি খুন করে বাদশাকে?
মাথা নেড়ে রীটা বলল, হ্যাঁ। অন্যদিকে তাকাল সে। যেন একটা কান্নার বেগকে দমন করার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে তাকিয়েই সে বলে উঠল, বাদশাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, তোয়াব সাহেব ভয়ঙ্কর লোক। কিন্তু আমার কথায় কান দেয়নি সে।
শহীদ অকস্মাৎ তড়াক করে লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল। দুই লাফে গিয়ে দাঁড়াল সে ড্রয়িংরুমের ভিতর।
কি হলো!
খাট থেকে নেমে পা বাড়াল রীটা।
কার যেন পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ বোধহয় রূমের বাইরে থেকে আমাদের কথা শুনছিল। পালিয়ে গেল।
বেডরূমে ফিরে এল শহীদ। বসল আবার চেয়ারে। রীটাও বসন খাটের উপর আবার।
আপনি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন, নিচু গলায় বলল রীটা।
শহীদ বলল, একমাত্র তুমি এবং আমি জানি তোয়াব সাহেবই এত র কাণ্ডের হোেতা। তিনিই খুনী। কিন্তু কথাটা তুমি এবং আমি–আমরা দুজনেই বিশ্বাস করি না। তাই না, রীটা?
বিশ্বাস করা কঠিন বৈকি। বাদশা আমাকে সব কথা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে না বললে আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম না।
শহীদ বলল, বাদশা কি বলেছে না বলেছে–এতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি না আমি। আমি একজন ডিটেকটিভ, রীটা। আমার চোখে শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানাটার দিকে তাকাও, তাকাও বালিশটার দিকে। আজ রাতে ওই বিছানায় শোওনি তুমি, ওই বালিশে মাথা রাখোনি তুমি। রক্ত মাখানো শাড়ি আর ব্লাউজটা, আমি হঠাৎ এসে পড়ায়, তুমি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছ খাটের নিচে। কিন্তু কি ভাগ্য দেখোতোমার, আমি এই চেয়ারে বসে বসে দেখতে পাচ্ছি শাড়ি আর ব্লাউজটা। তোমার স্যান্ডেলের কথা তুমি ভুলে গেছ। চেয়ে দেখো, রক্তের দাগ লেগে রয়েছে ওতে।..
ঝট করে নিজের ঝুলন্ত পায়ের দিকে তাকাল রীটা। হ্যাঁ, ভুল হয়ে গেছে তার। স্যাণ্ডেল দুটো সরিয়ে রাখেনি সে।
কি বলছেন আপনি, শহীদ ভাই! রক্তের দাগ? বলছি দাঁড়ান ঘটনাটা। আপনি দেখছি ভীষণ খুঁতখুঁতে মানুষ। কারও শাড়িতে, জুতোয় রক্তের দাগ দেখলেই বুঝি তাকে খুনী মনে করতে হয়? জানি, মিছামিছি ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন। আমাকে…।
হোঃ হোর করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো শহীদের। কিন্তু হাসল না ও। কঠিন হয়ে উঠল ওর চেহারা। বলল, ন্যাকামি ছাড়া এবার, রীটা। জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে এখন আমার কাছে সব রহস্য। তুমি যে গল্পটা একটু আগে শোনালে, তা প্রায় ঠিকই আছে–শুধু তোয়াব সাহেবের জায়গায় তোমার নিজের নামটা বসবে। রাফিয়া মনে করে শিল্পীকে খুন করেছ তুমি। মোরশেদ দেখেছিল তোমাকে শিল্পীর দেহ থেকে কাপড় খুলে নিতে, পরে সে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে তোমাকে, তাই তাকে গুলি করো-তুমিই। রাফিয়াকে ঘৃণা করতে, কারণ। সে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল বাদশাকে, তাই তাকেও খুন করো তুমিই। ডাক্তার কুমারের বাড়িতে যাও আজ রাতে তুমি এবং বাদশাকে খুন করো–তুমি ছাড়া আর কে? বাদশাকে তুমি খুন করো, কারণ…
থামল শহীদ। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে ও রীটা গোমেজের ফ্যাকাসে মুখের। দিকে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল আবার শহীদই, বলো, রীটা-বাদশাকে খুন করার পিছনে কি কারণ ছিল?
.
০৯.
পা ঝুলিয়ে খাটের উপর বসে আছে রীটা। হাত দুটো দেহের দুপাশে, খামচে, ধরেছে ধবধবে সাদা চাদর মুঠোর মধ্যে। চোখে পলক নেই। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত তালে। নাকের নিচে, ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম, চকচক করছে ইলেকট্রিক আলোয়। চুলগুলো অল্প অল্প উড়ছে ফ্যানের বাতাসে। কিন্তু নিঃসাড়, মূর্তি যেন সে একটা।
আপনি সিরিয়াস, শহীদ ভাই?
চমৎকার অভিনয় করে এসেছ এতক্ষণ, রীটা। যেভাবে নিজেকে সকলের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছ–আশ্চর্য না হয়ে পারছি না। আমার গোয়েন্দা জীবনে তুমি একটা অভিজ্ঞতা বটে। কিন্তু আর নয়, রীটা। খেলা শেষ হয়ে গেছে। ছদ্মবেশ ত্যাগ করো, অভিনয়ে ক্ষান্ত দাও এবার। তোয়াব সাহেবকে অপরাধী প্রমাণ করার জন্যে যেভাবে গল্পটা বানালে–অপর্ব। বিশ্বাস না করাই অসম্ভব বলে মনে হয়। তারপর খানিক আগে কিচেনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে–নাহ, তোমার অভিনয়ের তুলনা হয় না। কিন্তু কি জানো, শেষ রক্ষা হলো না। আসলে হয়ও না। অপরাধের শাস্তি অপরাধীকে পেতেই হয়। এটাই বিধির আমোঘ বিধান। যাক, শেষ রহস্যটা জানা দরকার আমার। বাদশাকে খুন করলে কেন, রীটা?
না। বলেছি তো আপনাকে। ওকে আমি খুন করিনি। ওকে কেন আমি খুন করব? যাকে মানুষ ভালবাসে তাকে কি সে খুন করতে পারে, শহীদ ভাই? তোয়াব সাহেবই ওকে খুন করেছেন। আপনি ভুল করছেন। ভেবে দেখুন আবার।
শহীদ দেখল রীটা গোমেজের দুই চোখ থেকে জলের ধারা বেরিয়ে আসছে, গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে টপ টপ করে কোলের উপর। চেয়ে আছে সে মেঝের দিকে।
হাসল শহীদ। বলল, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, রীটা। সে কথা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে, আর অভিনয় করে লাভ নেই। বাদশা খানের ডায়েরীটা আমি পেয়েছি। মরার আগে সে ডায়েরীটা আমাকে উপহার দিয়ে গেছে। পড়েছি আমি সেটা। বাদশা খান তাতে লিখে রেখে গেছে অনে- মূল্যবান কথা–সবগুলো তোমার বিরুদ্ধে। রাফিয়া তোমাকে যমের মত ভয় করত। তার সন্দেহ ছিল তুমি তাকে গুলি করে খুন করবে। পিস্তল ব্যবহার করতে জানো তুমি। ফ্রেণ্ডশীপ নাইট ক্লাবে তুমিও পিস্তলের কয়েক রকমের খেলা দেখাতে। ৪৫ পিস্তল তুমি ব্যবহার করতে অভ্যস্তা। বাদশা খান তার ডায়েরীতে নিজের বিশ্বাসের কথাটাও লিখে রেখে গেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, রাফিয়াকে তুমিই খুন করেছ। আরও অনেক কথা লিখে রেখে গেছে বাদশা তার ডায়েরীতে। সে সব পরে না হয় শোনাব তোমাকে। তার আগে বলো বাদশাকে খুন করার কি প্রয়োজন ছিল?
কুত্তাটা ডায়েরী রাখত নাকি!
রাখত। না রাখলেও কিছু এসে যেত না। ধরা তোমাকে পড়তেই হত, রীটা। হয়তো আরও কিছু সময় লাগত। বলো এবার।
রীটা সরাসরি তাকাল শহীদের চোখের দিকে। শান্ত সহজ গলায় বলে উঠল, কেন খুন করেছি? উত্তরটা খুবই সহজ। ওকে খুন না করার তো কারণ ছিল না। আমার জীবনটা ধ্বংস করেছে কে? ওই তো! এতগুলো খুন একটার পর একটা করতে হয়েছে আমাকে–কেন? ওর জন্যেই তো। ও যদি রাফিয়া ডাইনীর ফাঁদে পা না দিত-এত কিছু ঘটত? একের পর এক খুন করেছি আমি-কুকুরটাকে পেলেও কি সুখী হতে পারতাম? ওকে বাঁচিয়ে রাখলে লাভের চেয়ে লোকসানের ভয়ই বেশি ছিল না? বেঁচে থাকলে আমাকে ও ভয়,করে চলত। হয়তো পুলিসকে জানিয়ে দিত সব কথা। এতগুলো খুন করে সন্দেহের বাইরে থাকতে পেরেছি, আর একটা খুন করলে কি আসে যায়। এই সব ভেবেই ওকেও শেষ করে দিয়েছি আমি। শিল্পী-শিল্পীর জন্যে আমি সত্যি দুঃখিত। চাঁদের আলোয় ওকে আমি চিনতে পারিনি। রাফিয়ার পোশাক পরা অবস্থায় দেখে ওকে আমি রাফিয়া মনে করেছিলাম।
ভুল করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে, খুন তো করেছ তুমি? শিল্পীর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই আমি সিরিয়াস, রীটা। সে আমার সহকারিণী ছিল। এই অপরাধের শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
শান্ত গলাতেই রীটা গোমেজ বলল, পেতে হবে বললেই তো হলো না। একটার পর একটা খুন করে আমি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছি–এখন সব স্বীকার করেও আমি আপনার বা পুলিসের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকব।
খপ করে বিছানার উপর থেকে টেলিস্কোপ লাগানো রিভলভারটা তুলে নিল রীটা গোমেজ। সাবধান, শহীদ ভাই! নড়বেন না! ৪৫ রিভলভার এটা। কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানা আছে আমার।
জোরে শ্বাস গ্রহণ করে সিধে হয়ে বসল সে, আবার কথা বলে উঠল, শিল্পীর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। দুঃখিত আমি আপনার জন্যেও। কিন্তু উপায় নেই, শহীদ ভাই। এত বিপদের মধ্যেও আমি মাথা ঠিক রেখে যেটা করার, তা যতই নিষ্ঠুর নির্মম হোক, করেছি। কেন? শুধু নিজেকে রক্ষা করার জন্যে। এই মুহূর্তেও আমি তাই করব। নিজের প্রাণটা সব কিছুর চেয়ে প্রিয়, শহীদ ভাই। সেই প্রাণ বাঁচাবার জন্যেই আপনাকে এখন খুন করতে হবে। আমি এতগুলো খুন করেছি কিন্তু কারও কাছে কোন প্রমাণ নেই একটাও! তবু আপনাকে আমি খুন করব। কারণ কি জানেন? প্রমাণ নেই ঠিক; কিন্তু আপনি জানেন আমি কিভাবে কি করেছি–একমাত্র আপনিই জানেন। চেষ্টা করলে আপনি আমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন। শহীদ ভাই, তাই আপনাকে মরতে হবে। চেয়ার ছাড়ুন, শহীদ ভাই। দাঁড়ান। ওই দেয়ালের গায়ে পিঠ রেখে, মাথার পিছনে হাত রেখে দাঁড়ান। আমাকে সুটকেস গুছিয়ে নিতে হবে।
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল শহীদ। পিছিয়ে গেল।
না, আমার দিকে চেয়ে থাকবেন না। দেয়ালের দিকে মুখ করুন।
দুজনের মাঝখানে রয়েছে সাত হাত দূরত্ব। মাঝখানে তেপয়টা রয়েছে। তেপয়ের উপর রয়েছে রিভলভারটা। লাফ দিয়ে লাভ নেই, তার আগেই মরতে হবে গুলি খেয়ে।
দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াল শহীদ। বাঁ দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলটা দেখতে পেল।
আয়নায় দেখা যাচ্ছে রীটাকে। তেপয়ের উপর রিভলভারটা রেখে শাড়ি খুলছে সে।
নতুন একটা শাড়ি পরতে শুরু করল রীটা। ঘন ঘন তাকাচ্ছে সে শহীদের দিকে। ব্যস্ততার সাথে কাপড় পরার কাজটা সারতে চাইছে সে। কিন্তু হাত দুটো অদম্য ভাবে কাঁপছে বলে দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক।
কোথায় যাবে তুমি? কোথায় পালাবে?
স্থির হয়ে গেল রীটার হাত দুটো। কোথায় যাব বলব না।
দ্রুত কোমরে শাড়ি জড়াচ্ছে রীটা।
এমন সময়!
পিছন ফিরে দাঁড়ানো অবস্থা থেকেই লাফ দিল শহীদ। শূন্যে ঘুরে গেল এক পাক ওর দেহটা। মেঝেতে পা দিল ও।
পরমুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা। ক্ষিপ্র হাতে তুলে নিয়েছে রীটা গোমেজ তেপয়ের উপর থেকে রিভলভার। কথা যতই বলুক, শহীদের এইরকম আচরণের। জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি ছিল সে।
শহীদ দ্বিতীয়বার লাফ দেবার আগেই গর্জে উঠল রীটা গোমেজের হাতের রিভলভার। স্থির দাঁড়িয়ে রইল শহীদ।
সোজা শহীদের বুকের দিকে তাক করে গুলি করেছে রীটা। লক্ষভ্রষ্ট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না–কিন্তু হয়েছে তাই। যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল শহীদ, ঠোঁটের কোণে নিছুর একটুকরো হাসি।
বারুদের ঝাঝাল গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এল শহীদের।
মেঝের উপর পড়ে রয়েছে রীটা।
কলকল শব্দে তাজা লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে রীটার বুকের প্রকাণ্ড গর্তটা থেকে। ফুটো নয়, গভীর গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে রীটা গোমেজের বুকের মাঝখানে।
চেয়ে আছে শহীদ। রীটার হাতটা দুতিন ইঞ্চি উপরে উঠল আস্তে আস্তে, তারপর ঝুপ করে পড়ে গেল মেঝেতে।
শেষ।
মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা রিভলভারটার দিকে তাকাল শহীদ। টেলিস্কোপের প্রান্ত থেকে এখনও ধোয়া বেরুচ্ছে অল্প অল্প।
রিভলভারটা সাধারণ রিভলভার নয়। কৌশলে তৈরি করা হয়েছে এটা। সেজন্যেই কুয়াশা ওকে এটা দেবার সময় নিষেধ করে দিয়েছিল ব্যবহার না করার জন্যে। এই রিভলভার যে ছুড়বে সে নিজেই খুন হবে, তার নিজের গায়েই লাগবে গুলি। ইচ্ছে করেই বিছানার উপর রেখেছিল শহীদ রিভলভারটা। রীটাকে নিজের হাতে খুন করা সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে। অথচ তার শাস্তি হওয়া দরকার ছিল। পুলিসের হাতে তুলে দেয়া যেত, কিন্তু পুলিস অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে পারত না। এইসব কথা ভেবেই শহীদ রীটাকে রিভলভারটার ফাঁদে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে সে নিজেই খুন করে নিজেকে।
বিড়বিড় করে কি যেন বলল ও। দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিস্তব্ধ চারদিক। পুবাকাশ আলোকিত হয়ে ওঠার সময় হয়ে এসেছে।
প্রতিশোধের আগুন নিভে যেতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করতে চাইছে এখন শহীদের সর্বাঙ্গে। হাই তুলল।
বারান্দা থেকে নেমে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহটা নিয়ে এগোল শহীদ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা।
গেটের কাছে পৌঁছুতেই একটা কালো ছায়ামূর্তি মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।
ধন্যবাদ, কুয়াশা! আন্তরিক গলায় বলে উঠল শহীদ।
কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, সমাধান হয়েছে?
শহীদ কথা বলল না। টলে উঠল দেহটা। মাথাটা ঘুরছে ওর।
দুহাত বাড়িয়ে কুয়াশা ধরে ফেলল শহীদকে। পাজাকোলা করে তুলে নিল বুকের কাছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে শহীদকে নিয়ে গেটের বাইরে। জ্ঞান হারিয়েছে শহীদ।
Leave a Reply