কুয়াশা ৬২
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৭৭
০১.
কারও মুখে কোন কথা নেই। অস্থিরভাবে ড্রয়িংরূমে পায়চারি করছে শহীদ।
মহুয়া নিস্তব্ধতা ভাঙল, ইন্সপেক্টর গনির সাথে তোমাদের এই লুকোচুরি খেলা–আমি প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়েছি। পুলিসকে সব কথা যদি খুলে বলা হত, লোকটা হয়তো এভাবে মরত না।
শহীদ পায়চারি থামিয়ে বলে উঠল, না। অনেক দূর এগিয়ে গেছি আমরা, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। জানি, দেলোয়ার মোরশেদের লাশ পাবার পর তিনি আমার মুখোমুখি হয়ে ব্যাখ্যা দাবি করবেন। কিন্তু…একবার যা বলেছি, বার বার তাই বলতে হবে। আমরা পুলিসের সাথে সহযোগিতা করছি না এটা সত্যি, কিন্তু আমরা কোন অন্যায়কে চাপা দিতে বা কোন অপরাধীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি না। ভুলে যেয়ো না, আমি মোহাম্মদ তোয়াব খানকে কথা দিয়েছিলাম তার কেস সম্পর্কে পুলিসকে কিছু জানাব না। যতক্ষণ না জানতে পারছি শিল্পী এবং দেলোয়ারের খুনের সাথে তোয়াব খান জড়িত ততক্ষণ আমি আমার কথা রক্ষা করব। কি বলছিলে তুমি, মহুয়া? পুলিসকে সব কথা জানালে মোরশেদ খুন হত না? না, তা নয়। দেলোয়ার বড্ড বেশি লাভ করেছিল, তাই মরতে হয়েছে তাকে। কেন সে সব কথা জানায়নি পুলিসকে? এখন তো আর কোন সন্দেহ নেই যে সে গতরাতের সব ঘটনাই চাক্ষুষ করেছিল। খুনীকেও সে চিনতে পেরেছিল। শুধু চিনতেই পারেনি, খুনীকে সে ইতিমধ্যে, যেভাবে হোক, জানিয়েও ছিল যে সে তাকে চিনতে পেরেছে।
তার মানে?
তার মানে খুবই সোজা। খুনীর কাছ থেকে টাকা আদায় করার পরিকল্পনা করেছিল সে। যার ফলে খুনী খুন করে তার মুখ বন্ধ করে রেখে গেছে।
পকেট থেকে একটা ফটো বের করল শহীদ।
দেখ, কামাল, ফটোটা দেখ। এটার কথাই বলেছি তোদেরকে। সাধন সরকারের ড্রয়িংরূম থেকে পেয়েছি।
কামাল ছবিটা নিল হাত বাড়িয়ে।
শহীদ বলল, প্রায় নয় অবস্থায় ছবিটা তুলেছে মিসেস রাফিয়া। ভোলা হয়েছে চট্টগ্রামের একটা স্টুডিও থেকে। ফটোর পেছনে ঠিকানা আছে।
কামাল ফটোর পেছন দিকটা দেখতে দেখতে বলল, হ্যাঁ–জোয়ারদার ফটোগ্রাফার, চট্টগ্রাম।
শহীদ পাইপে আগুন ধরাল, জামান, আজকে সন্ধ্যার ফ্লাইটেই তুমি চট্টগ্রাম যাচ্ছ। ফটোটা বছরখানেক আগে তোলা। যে ফটোটা তুলেছে সে নিশ্চয়ই মিসেস রাফিয়ার ঘনিষ্ঠ কেউ। এই রকম অধয় ছবি একেবারে অপরিচিত কোন লোককে দিয়ে কেউ ভোলায় না।
কামাল বলল, কিন্তু জামানের কাজটা কি চট্টগ্রামে?
শহীদ পায়চারি শুরু করল আবার। বলল, আমি মিসেস রাফিয়ার অতীত জীবন সম্পর্কে সব কথা জানতে চাই। চট্টগ্রামে ছিল সে বিয়ের আগে। তার সম্পর্কে জানতে হলে চট্টগ্রামে গিয়েই জানতে হবে। আমার অনুমান জোয়ারদার স্টুডিওর মালিকের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা সব। জামান, টিকেটের জন্যে ফোন করো তুমি বিমানের অফিসে। যেভাবে হোক আজকের ফ্লাইটের টিকেট চাই একটা।
সবাই দেখল শহীদ ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছিস তুই?
শহীদ না থেমে উত্তর দিল, ল্যাবরেটরিতে। শিল্পীর কাপড়গুলো পরীক্ষা করব।
বেরিয়ে গেল শহীদ।
.
আধঘণ্টা পর ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরূমে ঢুকল শহীদ। মুখের চেহারা একটু যেন বিমূঢ়। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকাল সবাই।
রক্তের ছিটে ফোঁটাও নেই কাপড়গুলোয়। শিল্পীকে যখন গুলি করা হয়, তার পরনে এই কাপড়গুলো ছিল না–এটাই একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
মহুয়া প্রশ্ন করুল, কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে খুনী কেন গুলি করবে?
শহীদ বলল, জানি না। আমি সাধন সরকারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কামাল, তুই আমার সাথে যাবি? সাধন সরকারকে কোণঠাসা করার জন্যে দরকার হলে উত্তম-মধ্যম কিছু দিতে হবে।
কামাল বলল, সাধন সরকারের ওয়ারড্রোব থেকে ওগুলো নিয়ে এসে কি ভুল করিসনি তুই, শহীদ? যতক্ষণ ওগুলো তার বাড়িতে ছিল ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেত ওগুলো। আমাদের কাছে থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারছি না আমরা।
তা ঠিক। কিন্তু ঝুঁকিটা না নিয়ে উপায় ছিল না। রেখেই হয়তো আসতাম, কিন্তু ইয়াকুব এসে পড়ায় তা পারিনি। যাক, ব্যবস্থা করা যাবে একটা। সাধন সরকারের অজ্ঞাতে আবার ওয়ারড্রোবে রেখে আসব ওগুলো।
তারমানে আবার একটা রিস্ক নিতে হচ্ছে। তবু, এছাড়া উপায় নেই। আচ্ছা শিল্পীর জুতো আর ব্রেসিয়ার কোথায়?
শহীদ বলল, সম্ভবত সাধন সরকারের বাড়িতেই কোথাও আছে। ইয়াকুবকে দেখে খোঁজার সময় পাইনি।
বেরিয়ে গেল ওরা।
মাত্র দশ সেকেণ্ড পর দ্রুত পায়ে শহীদ এবং কামাল ড্রয়িংরূমে ঢুকল। ঢুকে দাঁড়াল না ওরা। মহুয়ার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে ড্রয়িংরূমের অপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর গনি আসছেন, মহুয়া। হাতে এখন সময় নেই। ওঁকে বলবে, আমরা কোথায় গেছি, কখন ফিরব–কিছুই তুমি জানো না।
অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা দুজন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় এসে বসল মহুয়া। একটা বই তুলে নিয়ে মাথা নিচু করে পড়ার ভান করতে শুরু করল সে, একমুহূর্ত পরই বিরাট বপু নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল ইন্সপেক্টর গনি।
মুখ তুলে মিষ্টি করে হাসল মহুয়া, আসুন, মি. গনি। অনেকদিন পর আপনি তিনতলায় উঠলেন…
শহীদ সাহেব কোথায়? একটু যেন বেসুরো লাগল মহুয়ার কানে ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর। সোফায় বসল সে। টুপি নামিয়ে হাঁটুর উপর রাখল। তারপর বলল, অফিস বন্ধ দেখলাম। গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই বাড়িতে আছেন?
মহুয়া বলল, শহীদ আর কামাল এই খানিক আগে বাইরে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেছে বলে যায়নি। কখন ফিরবে তাও আমি জানি না।
ইন্সপেক্টর গনি চেয়ে রইল মহুয়ার দিকে। মিথ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত নয় মহুয়া, তা বুঝতে পারল সে। একটা প্রশ্ন করেছে সে, অথচ উত্তর দিল মহুয়া তিনটে প্রশ্নের। সত্য কথা যে বলছে না এ থেকেই পরিষ্কার ধরা যায়।
হু। উঠে দাঁড়াল ইন্সপেক্টর।
সে কি! উঠছেন যে! এক কাপ চা না খাইয়ে ছাড়ছি না আপনাকে।
তেতো কুইনাইন খাবার সময় মানুষ যেমন মুখ বিকৃত করে তেমনি মুখ বিকৃত করে ইন্সপেক্টর গনি বলল, দম ফেলবার ফুরসত নেই, মিসেস শহীদ। চা আর একদিন খাব।
শহীদ ফিরলে কিছু বলতে হবে?
হ্যাঁ। বলবেন না, কিছু বলবার দরকার নেই। আমি যা বলতে এসেছিলাম তা তিনি জানেন। আমার মনে হয় আপনিও জানেন, মিসেস শহীদ।
আমি? আমি কি জানি? মহুয়া আকাশ থেকে পড়বার ভান করল।
দেলোয়ার মোরশেদ খুন হয়েছে। জানেন না?
ঘন ঘন চোখের পাতা খুলে আর বন্ধ করে ইন্সপেক্টর গনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মহুয়া নিভাঁজ মুখে, অস্ফুটে বলল, দেলোয়ার কি যেন বললেন…মোরশেদ? কে? আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
ইন্সপেক্টর বলল, শখের গোয়েন্দা মি. শহীদ খানের উপযুক্ত স্ত্রী আপনি। আজ আর একবার কথাটা স্বীকার করে যাচ্ছি।
বেরিয়ে গেল ইন্সপেক্টর দ্রুত পায়ে।
মৃদু হাসি ফুটল মহুয়ার ঠোঁটে।
.
ঠিক হলো শহীদ পাচিল টপকে বাড়ির ভিতর ঢুকবে। লুকিয়ে থাকবে ও বাগানের ভিতর। কামাল দরজার কলিং বেল বাজাবে। আগেই জেনেছে ওরা, সাধন সরকারের বাড়িতে চাকর-বাকর বা আর কোন লোক থাকে না। প্লেবয় টাইপের যুবক, খাওয়া-দাওয়া সে হোটেলেই সারে। বাড়িতে থাকে ও খুব কম। যাই হোক, কলিং বেলের শব্দ শুনে সে গেটের কাছে আসবে।
সেই ফাঁকে শহীদ বাগান থেকে চুপিসারে উঠে যাবে করিডরে, সেখান থেকে ড্রয়িংরূম হয়ে হলরূমে, হলরূম থেকে দোতলার সীটিংরুমে। ওয়ারড্রোবে কাপড় চোপড়গুলো রেখে জানালা গলে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে আসবে ও। ইতিমধ্যে কামাল সাধন সরকারের সাথে কথা বলার জন্যে তার ড্রয়িংরূমে গিয়ে বসবে। শহীদ নিচে নেমে ওদের সাথে যোগ দেবে।
অসুবিধে হলো না। পাচিল টপকাল শহীদ। বাগানটা বেশ বড়। ভিতরে ঢুকে এক জায়গায় দাঁড়াল ও। কামাল কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল।
ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে করিডরে কেউ বেরুচ্ছে না দেখে কামাল আবার বোতামে চাপ দিল। কিন্তু কাজ হলো না এবারও। আবার চেষ্টা করল কামাল।
বেশ শোনা যাচ্ছে বেলের শব্দ। কিন্তু সাধন সরকারের দেখা নেই।
কামাল হাত ইশারায় জানতে চাইল-কি করা যায় এখন? শহীদ ইশারা করে বলল, আবার কলিং বেলের বোতামে চাপ দিতে।
তাই করল কামাল।
কিসের রিহার্সেল হচ্ছে শুনি? পোশাক-আশাক দেখে তোবোঝবার উপায় নেই যে চোর-ছ্যাচোড়।
চমকে গিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল শহীদ। সবেগে ঘাড় ফেরাতে স্যুট পরা একজন যুবককে মাত্র সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ও। বলে দিতে হলো না-এই যুবই সাধন সরকার। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে নায়কোচিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভয় বা ভাবনার এতটুকু ছায়া নেই মুখের চেহারায়। দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় নিজের উপর আস্থার অভাব নেই কোন। ব্যাকব্রাশ করা চুল, লম্বা জুলফি, ক্লিন শেভ।
আপনিই সাধন সরকার?
সাধন সরকার শহীদের সাদা গ্যাবার্ডিনের স্যুটটা দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দামী পোশাক দেখে শহীদের সাথে ঠিক কি রকম ব্যবহার করতে হবে বুঝতে পারছে না সে।
সাধন সরকার হই বা না হই–আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে। উদ্দেশ্য কি? চোরের মত ঢুকেছেন কেন বাড়ির ভিতর?
শহীদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত দিল। একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিল ও।
কার্ডটা নেবে কি নেবে না ভেবে কয়েক সেকেণ্ড ইতস্তত করল সাধন সরকার। তারপর প্রায় ছোঁ মেরে নিল সেটা শহীদের হাত থেকে। পড়ল কি পড়ল না, ফিরিয়ে দেবার জন্যে হাতটা লম্বা করে দিল শহীদের দিকে। বলল, শহীদ খান। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাতে কি?
শহীদ বলল, ডিটেকটিভদের অনেক সময় অপ্রীতিকর পদ্ধতিতে কাজ করতে হয়। আমরা এসেছি আপনার সাথে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে। পুলিস পাঠাতে পারতাম, কিন্তু মুশকিল কি জানেন, যে ব্যাপারে আপনাকে আমরা সন্দেহ করছি সে ব্যাপারটা নিয়ে আমরা নিজেরাই মাথা ঘামাতে চাই।
কামালের উপস্থিতি টের পেল শহীদ ওর পিছনে।
সাধন সরকার ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে সন্দেহ করছেন? কি ব্যাপারে?
কামাল শহীদের পাশে চলে এল, বলল, মি. সরকার, আলোচনাটা আপনার ড্রয়িংরুমে বসে হওয়া উচিত।
কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল সাধন সরকার কামালের দিকে। আপনি?
শহীদ বলল, আমার সহকারী, কামাল আহমেদ।
সাধন সরকার শহীদের দিকে তাকাল, মাফ করবেন, আপনাদের সাথে আলোচনা করার সময় আমার নেই।
কামাল বলল, পুলিস এলে কি এই কথাই বলবেন তাদেরকে?
সাধন সরকার দুই হাত পকেট থেকে বের করে কোমরে রাখল। বলল, দেখুন, মিছে চেষ্টা করছেন আমাকে ভয় দেখাবার। আপনারা যে উদ্দেশ্যেই এসে থাকুন, উদ্দেশ্যটা যে সৎ নয় তা বোঝা গেছে বাড়িতে ঢোকার কৌশল দেখেই। এবার, সোজা বেরিয়ে যান গেট দিয়ে।
শহীদ বলল, উত্তেজিত হবেন না, মি. সরকার। আমরা আপনার সাথে আলোচনা করতে এসেছি। আলোচনা করেই যাব।
আমি রাজি নই।
কামাল মৃদু শব্দে হেসে উঠল। বলল, কিন্তু আমরা আপনাকে যেভাবে হোক রাজি করাব।
ফুঁসে উঠল সাধন সরকার, তার মানে কি বলতে চান আপনি?
কামাল বলল, আলোচনা করতেই হবে, শুধু এই কথাই বলতে চাই।
আমি আলোচনা করব না। আপনাদেরকে আমি চিনি না। চেনার দরকারও নেই। তাছাড়া, আপনাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়।
কামাল বলল, শহীদ?
শহীদ একটু বিনয়ের সাথেই বলল, মি. সরকার, তর্ক করছেন কেন খামোখা। সত্যি কথা, আলোচনা আমরা না করে ফিরতে পারি না।
কামাল বলল, দরকার হলে…
তেড়ে এল সাধন সরকার, দরকার হলে কি? গায়ের জোর খাটাবেন নাকি? খাটান তো, দেখি কত বড় সাহস!
কামালের একেবারে বুকের সামনে বুক এনে দাঁড়াল সাধন সরকার। মুচকি হেসে কামাল তাকাল শহীদের দিকে, কি রে?
শহীদ বলল, এখনই না। দাঁড়া, চেষ্টা করে দেখি বোঝানো যায় কিনা। মি, সরকার, আপনাকে এই শেষবার বলছি, চিন্তা করে দেখুন।
বুঝেছি, সিধে আঙুলে ঘি উঠবে না। কথাটা বলেই সাধন সরকার ঘুসি ছুঁড়ল কামালের মুখ লক্ষ্য করে।
শহীদ এক পাশে সরে গেল ধীরে সুস্থে, মারামারিটা যেন বিনা বাধায় চলতে পারে।
কিন্তু লড়াইটা জমল না। কামাল তৈরিই ছিল। সাধন সরকারের মুঠি পাকানো ঘুসিটা মুখের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সৎ করে এক পাশে সরে গিয়ে সাধন সরকারের তলপেটে জুতসই একটা আধমণ ওজনের ঘুসি মেরেই সব পণ্ড করে দিল সে। সাধন সরকার চিৎ হয়ে পড়ে গেল ঘাসের উপর। তলপেট চেপে ধরে কাতরাতে শুরু করুল সে, বাবা রে, মা রে!
মনোক্ষুণ্ণ দেখাল কামালকে। শুরু হতে না হতেই ফাইটটা এভাবে শেষ হয়ে যাবে তা সে ভাবেনি।
শহীদের দিকে তাকিয়ে বলল সে, আমার মনে হয় আর কোন ঝামেলার সৃষ্টি হবে না।
শহীদ এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল সাধন সরকারের মুখের উপর। বলল, তখনই বলেছিলাম, কিন্তু শুনলেন না আমার কথা। খুব লেগেছে বুঝি? উঠতে পারবেন, নাকি ধরে তুলব?
সাধন সরকার ব্যথা খুব একটা পায়নি। লজ্জায় এবং রাগে লাল হয়ে উঠেছে গোলগাল ফর্সা মুখটা। নিজেই উঠল। কাঁপছে থরথর করে, এর ফল কি হবে দেখবেন?
কামাল বলল, আচ্ছা, দেখখ। দেখাদেখির ব্যাপারটা ভবিষ্যতের জন্যে ভোলা থাক। এখন লক্ষ্মী ছেলের মত আগে আগে হাঁটুন ড্রয়িংরুমের দিকে।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সাধন সরকার। হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। কামাল পা বাড়াল। শহীদও। চেষ্টা করে হাসি দমন করছে ও।
কিস্তু ড্রয়িংরুমে ঢোকার পর সিরিয়াস হয়ে উঠল শহীদ! মুখের চেহারায়। কাঠিন্য ফুটে উঠল ওর।
সোফায় বসল সাধন সরকারের মুখোমুখি। হাতের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিল। সেটা সাধন সরকারের কোলে গিয়ে পড়ল।
আঁতকে উঠল সাধন সরকার, যেন সাপ পড়েছে কোলের উপর, কি! কি। এটা?
শহীদের দুই চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসুদৃষ্টি, খুলে দেখুন।
প্যাকেটটা খুলল সাধন সরকার, এযে দেখছি শাড়ি, রাউজ-কার? আমাকে দেখাবার কারণ? এ কি ধরনের ঠাট্টা?
শহীদ মনের অস্থিরতা চেপে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। উঠে দাঁড়াল ও। দুপা এগিয়ে সোফায় বসা সাধন সরকারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আপনার ওয়ারড্রোবে ওগুলো ছিল। জানতে চাই কিভাবে, কোত্থেকে এল ওগুলো আপনার ওয়ারড্রোবে?
পাগল। বদ্ধ পাগল!
শহীদ নিজেকে শান্ত রাখার জন্যে পকেট থেকে পাইপ বের করল। গ্যাস লাইটার জ্বেলে পাইপ ধরাল ও অস্থির হয়ো না, শহীদ, নিজেকে বলল মনে মনে। উত্তেজিত হলে কাজ এগোবে না।
মি, সরকার, মন দিয়ে শুনুন। আমি শহীদ খান, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। কয়েক ঘন্টা আগে এই বাড়িতে আর একবার এসেছিলাম আমি। বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি এসেছিলাম একজনের খোঁজে। তাকে পাইনি। কিন্তু এটা সেটা দেখতে দেখতে আপনার ওয়ারড্রোবে ওই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোটটা পাই। ওগুলো সাথে করে নিয়ে যাই আমি।
বাহ! চমৎকার। সাথে করে নিয়ে যান এবং তারপর আবার ফেরত এনেছেন–খুব বুদ্ধিমান লোক আপনি, স্বীকার করতেই হবে! ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল সাধন সরকার।
সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, তার কারণ, কাপড়গুলোয় রক্তের দাগ পাওয়া যায় কিনা ল্যাবরেটরিতে তা পরীক্ষা করে দেখার দরকার ছিল।
কি…কি বললেন? রক্তের দাগ?
শহীদ বলল, ওই কাপড়গুলো শিল্পীর। শিল্পী, গত রাতে ধানমণ্ডি লেকের ধারে খুন হয়েছে।
সিধে হয়ে বসল সাধন সরকার। চোখের দৃষ্টি দেখে বোঝা গেল, অসহায় বোধ করছে সে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! এসব কথা আপনি আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? আপনাদের উদ্দেশ্য কি?
শহীদ বলল, জানার জন্যে এসেছি আমরা। জানতে চাই শিল্পী, যাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে, তার পরনের কাপড়-চোপড় আপনার বাড়িতে এল কোত্থেকে?
সাধন সরকার কিছুক্ষণ সময় নিল নিজেকে শান্ত করার জন্যে। শহীদের চোখে চোখ রেখে অবিচলিত কণ্ঠে সে বলল, দেখুন, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারি বা না পারি, আপনার কথা বিশ্বাস করার কোন কারণও নেই। দয়া করে এই সব কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে যান, আর কাউকে গিয়ে শোনান আপনার গাঁজাখুরি গল্প।
শহীদ বলল, আমার হাতে প্রমাণ আছে আপনি শিল্পীর খুন হওয়ার সাথে জড়িত। শিল্পী আমার সহকারিণী ছিল। মিসেস রাফিয়ার ওপর নজর রাখছিল সে…।
বুঝেছি! ডিটেকটিভ না ছাই। আপনারা ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন আমাকে।
শহীদ বলল, ব্ল্যাকমেইল তো ছোটখাট ব্যাপার। টাকা দিয়েই মুক্তি পাওয়া যায়। আমরা আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছি না, মি. সরকার, আসলে আমরা আপনাকে শিল্পীর হত্যাকারী প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। আমাদের হাতে কিছু প্রমাণও আছে।
শহীদের দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল সাধন সরকার। কি বলতে গিয়েও বলল না, হাত বাড়াল ফোনের দিকে।
কামাল এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। এবার তার দেহটা নড়ে উঠল। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সাধন সরকারের ফর্সা গালে আঘাত করল সে।
সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সাধন সরকার।
শহীদ বলল, কামাল, ভদ্রলোককে একটু উচিত শাস্তি দে তো।
আমি…আমি চিৎকার করব। আমি পুলিস ডাকব! ডাকাত…আপনারা ডাকাতি করতে এসেছেন। মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে সাধন সরকার। কাত হয়ে শুয়ে শুয়েই গলা ছেড়ে চিৎকার করতে শুরু করেছে।
চাপা গলায় শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর গনির পদার্পণ ঘটতে পারে কিন্তু! তাড়াতাড়ি করা দরকার আমাদের।
দুচার ঘা না খেলে লাইনে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
শহীদ বলল, না।
ওদেরকে চাপা স্বরে কথা বলতে দেখে চিৎকার থামিয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সাধন সরকার। কি….! কি আলোচনা করছেন? আমাকে খুন করবেন? আমাকে খুন করে
ধড়মড় করে সোফায় উঠে বসল সে। পাগলের মত হাত ছুঁড়ে লাফিয়ে উঠল, ডাল হবে না বলে দিচ্ছি। এখনও যদি ভাল চান, কেটে পড়ুন। আমি…।
শহীদ এক পা এগিয়ে সাধন সরকারের পিঠে হাত রাখল। উত্তেজিত হবেন, উত্তেজিত হবেন না। আমরা ডাকাত নই। আপনার কোন ক্ষতি করতেও আসিনি। আপনি যদি কোন অপরাধ করে না থাকেন, তাহলে আমাদের তরফ থেকে কোন ভয় নেই। আমাদের সন্দেহ হয়েছে আপনি শিল্পীকে খুন করেছেন। আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন-তাহলেই জানতে পারব আমাদের সন্দেহ অমূলক কিনা। আপনি নিরপরাধ হলে আমরা জানতে পারব আপনার উত্তর থেকে।
একটু শান্ত হলো সাধন সরকার। বলল, ঠিক তো? আমি নিরপরাধ হলে আমার কোন ক্ষতি করবেন না? ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না?
ঠিক।
সাধন সরকার রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। কামালের দিকে ভুলেও তাকাল না সে বলল, বলুন, কি প্রশ্ন আপনার?
মুখে যাই বলুক, শহীদ এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে শিল্পীর খুনের সাথে এ লোক জড়িত নয়। কিন্তু দ্রুত যেভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে এক পায়ে খাড়া হয়ে উঠল, সন্দেহ জাগল নতুন করে লোকটার আচরণের সবটাই নিপুণ অভিনয় নয় তো?
শহীদ পাইপে আগুন ধরাল নতুন করে বলল, আগে ঘটনাটা শুনুন। তিন দিন আগে মোহাম্মদ তোয়াব খান আমাদেরকে একটা কেসের দায়িত্ব দেন। কারণটা চাপা থাক। শিল্পীকে আমরা দায়িত্বটা দেই। সে মিসেস রাফিয়ার উপর নজর রাখতে শুরু করে। কেসটা পাবার দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় সে রিপোর্ট দেয় আমাকে। রিপোটে সে জানায় মিসেস রাফিয়া আপনার সাথে গোপনে দেখা করেছে দুই দিনে দুবার। আপনারা গোপনে প্রেম করছেন তা সে পরিষ্কার বুঝতে পারে। এই তথ্যটা তোয়াব খানকে জানানো হয়নি সাথে সাথে। যাক, সেই রাতে, একটার দিকে শিল্পী ফোন পায় এটা। কার ফোন পেয়েছিল সে জানা যায়নি। ফোন পেয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। তারপর, রাত তিনটের সময় তার লাশ আবিষ্কৃত হয় লেকের ধারে।
শহীদ থামল। পাইপের দিকে একবার তাকাল, তারপর মুখ তুলল আবার, চোখ রাখল সাধন সরকারের বিস্ফারিত চোখে, শিল্পীর খুনী আমাদেরকে উভয় সংকটে ফেলেছে, স্বীকার করছি। আমরা তোয়াব খানকে কথা দিয়েছিলাম তার স্ত্রীর উপর নজর রাখার কারণটা পুলিসকে জানাব না। কথা দিয়ে কথার মূল্য রাখি আমরা, তাই কোন কথাই পুলিশকে জানাতে পারছি না। জানাতে পারি বা না পারি, আমাদের একজন সহকারিণী খুন হয়েছে, আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না, তাই না?
স্তম্ভিত সাধন সরকার চেয়ে আছে শহীদের দিকে। চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কি ভাবছে সে, কিংবা আদৌ কিছু ভাবছে কিনা।
আবার বলতে শুরু করল শহীদ। মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পরপরই আমরা তদন্তের কাজ শুরু করি। ইতিমধ্যে অনেক সূত্র হাতে এসেছে আমাদের। তার মধ্যে একটি, আপনার ওয়ারড্রোবে শিল্পীর কাপড়-চোপড় পাবার ব্যাপারটা। এটা একটা মূল্যবান সূত্র। আপনার দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করবে–আপনি খুনী। যাক, এ প্রসঙ্গে পরে আসছি আমি। এই মুহূর্তে আমরা দুটো প্রশ্নের উত্তর চাই। এক, কাপড়-চোপড়গুলো কিভাবে এল আপনার ওয়ারড্রোবে? দুই, মিসেস রাফিয়া। কোথায়? তাকে আমরা পাচ্ছি না। তাকে পাব আশা করেই কয়েক ঘন্টা আন্ত আমি এই বাড়িতে গোপনে অনুপ্রবেশ করেছিলাম। যাক, মিসেস রাফিয়াকে না পেলেও, শিল্পীর কাপড়গুলো আপনার ওয়ারড্রোবে পেয়েছি। এখন হয় আপনি। গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদেরকে সন্তুষ্ট করুন, নয়তো চলুন, থানায় যাওয়া যাক। পুলিসকে সব কথা না বললেও চলবে। তাদেরকে শুধু বলব আপনি খুন করেছেন শিল্পীকে। বিশাস করুন, আপনাকে তারা লুফে নেবে।
আপনি আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনাদের সহকারিণী, মিস শিল্পীকে আমি জীবনে কখনও চোখেই দেখিনি। তাকে খুন করব কেন আমি? আমার মোটিভ কি?
মোটিভ আছে বইকি। গোপনে প্রেম করেছেন মিসেস রাফিয়ার সাথে–শিল্পী তা জেনে ফেলেছিল। এ খবর তোয়াব খানের কানে গেলে নির্ঘাৎ গলায় ছুরি চালিয়ে কোরবানি দিত আপনাকে।
সাধন সরকার বলল, কিন্তু গত রাতে আমি ঢাকাতেই ছিলাম না। খুন করব। কিভাবে? আমি প্রমাণ করতে পারি আমি ঢাকায় ছিলাম না গত রাতে…
প্রমাণ করতে পারবেন?
সাধন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বিশ্বাস করুন, মি. শহীদ, আমি কাউকে খুন করিনি। আমি গত রাতে নারায়ণগঞ্জে ছিলাম, আমি ফোন নাম্বার দিচ্ছি।
দিন।
চিন্তিত হয়ে উঠল শহীদ মনে মনে। তবে কে? কে খুন করেছে শিল্পীকে? বোঝাই যাচ্ছে সাধন সরকার নয়।
কামাল পকেট থেকে কাগজ কলম বের করল, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিন।
সাধন সরকার বলল, কিন্তু একটা গর্ত আছে। ঠিকানাটা কাউকে বলবেন না। বলবেন না যে আমি সেখানে রাত কাটিয়েছিলাম।
কামাল বলল, ঠিক আছে।
একটা মেয়ের বাড়িতে ছিলাম আমি। ঠিকানাটা…
বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার লিখে নিল কামাল।
শহীদ বলল, আপনি শিল্পীকে খুন করেননি তা কিন্তু প্রমাণ হবে না আপনার গার্ল ফ্রেন্ড যদি বলেও যে আপনি তার কাছে রাত কাটিয়েছেন। আপনি হয়তো তাকে শিখিয়ে রেখেছেন কেউ প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিতে হবে।
সাধন সরকারকে বিচলিত বলে মনে হলো না। বলল, তা ছাড়া, আমার ওই গার্ল ফ্রেণ্ডের সাথে আমি ডিনার খেয়েছি চকমক বারে, রাত সাড়ে এগারোটায় গেছি স্টার নাইট ক্লাবে, ওখান থেকে বেরিয়েছি রাত দেড়টায়। নাইট ক্লাবে অন্তত পনেরো-বিশজনকে পাওয়া যাবে যারা আমাকে দেড়টা পর্যন্ত দেখেছে সেখানে।
শহীদ বলল, বুঝলাম। এত কথার পরও কিন্তু আপনি ব্যাখ্যা করতে পারছেন না কাপড়গুলো কিভাবে আপনার ওয়ারড্রোবে এল।
বিশ্বাস করুন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
শহীদ বলল, দোতলাটা একবার ভাল করে সার্চ করতে চাই আমরা। জুতো আর ব্রেসিয়ার পাওয়া যায়নি। ওগুলোও সম্ভবত আপনার এখানেই আছে।
সাধন সরকার প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, দেখুন, আবার আপনারা আমাকে প্যাঁচে জড়াবার চেষ্টা করছেন।
কামাল বলল, দোতলাটা সার্চ করতে দিতে আপত্তি করবেন নাকি?
না, না–কিন্তু…আমি কিছু বুঝতে পারছি না!…আমার বাড়িতে ওসব আসবে কেন? এ নিশ্চয়ই কারও ষড়যন্ত্র!
ষড়যন্ত্র, না? কার ষড়যন্ত্র, মি. সরকার? কে আপনার শত্রু?
আমার শক্ত নেই।
তবে কেউ ষড়যন্ত্র করবে কেন?
সাধন সরকার চট করে বলে বসল, আমার এখনও সন্দেহ হচ্ছে, আপনাদের উদ্দেশ্য নয়। ষড়যন্ত্র আপনারাই যে করেননি তা বুঝব কিভাবে।
কামাল উঠল, দোতলায় যাচ্ছি আমরা।
শহীদ পা বাড়াল।
সাধন সরকার অনুসরণ করল ওকে ভিজে বেড়ালের মত।
উপরে উঠে শহীদ দেখল ওয়ারড্রোবের ভিতর, শো-কেসের মাথা, সোফার তলায় সন্ধান করছে কামাল।
তেমন উৎসাহ দেখা গেল না শহীদের মধ্যে। জুতো এবং ব্রেসিয়ার পাওয়া গেলেই বা কি? এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে সাধন সরকার এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। কেউ তাকে ফাসাবার জন্যে কাপড়-চোপড়গুলো এখানে রেখে গেছে। কেউ মানে খুনী।
খুনী কে? সেটাই একমাত্র প্রশ্ন।
জুতো জোড়া পাওয়া গেল সোফার নিচে।
সাধন সরকার কেমন যেন বোবা হয়ে গেল। ঘন ঘন তাকাল কামালের দিকে। কিন্তু কথা বলল না একটাও।
কামাল বলল, কি বলবার আছে আপনার?
সাধন সরকার শহীদের দিকে তাকাল অসহায় ভাবে।
শহীদ বলল, কামাল, ব্রেসিয়ারটা না পাবার কোন কারণ নেই। আরও খোঁজ করো। মি. সরকার, আমার সাথে এসে বসুন।
সোফায় বসল শহীদ। মুখোমুখি জড়সড় হয়ে বসল সাধন সরকার।
বোঝা যাচ্ছে, কেউ ষড়যন্ত্রই করেছে আপনার বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই সে আপনার শত্রু। শত্রু আপনার যেই হোক, সে-ই খুনী। সে চেয়েছিল কাপড়গুলো পুলিসের হাতে পড়বে অর্থাৎ পুলিস আবিষ্কার করবে এখান থেকে তারপর কি ঘটবে? আপনাকে পুলিশ গ্রেফতার করবে, তাই না?
বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নেড়ে সায় দিল সাধন সরকার।
শহীদ বলল,..চিন্তা করে দেখুন এবার, আপনার শত্রুকে?
শত্রু নেই আমার।
শহীদ বলল, মিসেস রাফিয়ার শত্রু হতে পারে খুনী। মিসেস রাফিয়া কোথায় সে?
গতকাল একবার দেখা হয়েছে। তারপরের খবর আমি জানি না।
তার সাথে কত দিনের পরিচয় আপনার?
সাধন সরকার বলল, মাত্র মাস খানেক কিংবা তার চেয়েও কম হবে। একটা ক্লাবে পরিচয় হয় আমাদের। আমি নই, রাফিয়াই যেচে পড়ে পরিচয় করে।
শহীদ জানতে চাইল, মিসেস রাফিয়াকে নিয়ে কখনও কোন ঝামেলায় বা বিপদে পড়েছেন?
মানে?
শহীদ বলল, ধরুন, কোন দোকানে কেনাকাটার জন্যে ঢুকেছেন, অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছেন মিসেস রাফিয়ার আচরণের মধ্যে?
না তো!
সতর্ক, হুঁশিয়ার হয়ে উঠেছে সাধন সরকার।
কোন জিনিস হারিয়েছেন আপনি মিসেস রাফিয়ার সাথে পরিচয় হবার পর?
সাধন সরকার চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, বুঝেছি! রাফিয়া তাহলে ক্লেপটোম্যানিয়ায় ভূগছে! ওর স্বামী সে কারণেই ওর ওপর নজর রাখার জন্যে আপনাদেরকে নিয়োগ করেছে, তাই না?
শহীদবিরক্তির সাথে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
না, আমার কোন জিনিস হারায়নি।
সে জানত তাকে আমরা অনুসরণ করছি? কিছু বলেছিল আপনাকে?
জানত। বলেছিল একটি মেয়ে ওকে অনুসরণ করছে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ওর ওই কথা শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিই ওকে এড়িয়ে চলব। আপনার সহকারিণী রিপোর্টে যা বলেছে তা সত্যি নয়, মি. শহীদ। আমি প্রেমে পড়িনি রাফিয়ার। আজ যা ঘটল তারপর তো আর রাফিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখার কোন ইচ্ছাই নেই। না, শেষ হয়ে গেছে ওর সাথে আমার সম্পর্ক।
শহীদ বলল, আমাদের সন্দেহ হবার কারণ আছে, মিসেস রাফিয়াকে ব্লাকমেইল করা হচ্ছিল। তেমন কিছু সে বলেছিল আপনাকে এ ব্যাপারে?
বোকার মত চেয়ে রইল সাধন সরকার। তারপর বলল, এত কাণ্ড! কই না, বলেনি তো। তবে গতকাল সে আমার কাছ থেকে টাকা ধার চেয়েছিল।
কত?
সাধন সরকার এই প্রথম হাসল, বলল, অষ্কের কথা তোলার অবকাশই দিইনি আমি। ব্রিাহিতা মেয়েদেরকে টাকা ধার দেওয়া পছন্দ করি না। স্রেফ সম্ভব নয় বলে দিয়েছিলাম।
আপনার সাথে কথা বলার সময় কাজী হানিফের নাম উল্লেখ করেছিল সে কখনও?
কাজী হানিফ। ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাবের মালিক না লোকটা? সে-ও জড়িত এ ব্যাপারে? হেই ভগবান! কই, না।
চেনেন লোকটাকে?
কয়েকবার ফেয়ার ভিউয়ে গেছি। সেই সূত্রে দেখেছি। কেউ হয়তো নামটা বলে লোকটাকে দেখিয়েছিল এই পর্যন্ত। পরিচয় নেই।
মিসেস রাফিয়া এখানে এসেছিল কখনও?
সাধন সরকার ইতস্তত করল খানিকক্ষণ, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করবেন না আমাকে দয়া করে।
ইয়াকুব নামের কাউকে চেনেন?
রাফিয়ার শোফারের কথা বলছেন? দুএকবার দেখেছি ছোকরাকে। রঙবাজ টাইপের, না? কিন্তু তার প্রসঙ্গ তুলছেন কেন?
শহীদ বলল, মিসেস রাফিয়ার সোফার নাকি সে? কিন্তু আমি জানতাম মুক্তা নিকেতনের গার্ড সে।
হতে পারে। রাফিয়াকে নিয়ে গাড়ি চালাতে দেখেছি বলে বললাম। কিছু জানি না তার সম্পর্কে।
আপনার ড্রয়িংরূম থেকে মিসেস রাফিয়ার ছবিটা আমি নিয়ে গেছি। ছবিটা নিশ্চয়ই সে-ই আপনাকে দিয়েছিল?
হ্যাঁ। রাফিয়াই আমাকে দিয়েছিল। দারুণ একটা ছবি, কি বলেন?
ছবিটা কতদিন আগে তোলা হয়েছে তা জানেন?
কয়েক বছর আগে নিশ্চয়ই। চট্টগ্রামে থাকত, তখন ও। ছবিটা ফেরত দেবেন?
না।
কামাল বলল, ব্রেসিয়ারটা নেই এ বাড়িতে। কিন্তু মেয়েদের পোশাক পেয়েছি নিচের ওয়ারড্রোবে। কার ওগুলো?
সাধন সরকার বলল, স্বীকার করছি, রাফিয়া এখানে প্রায়ই আসত-কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে তার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখব না। শাড়িটাড়ি যা দেখেছেন সব ওরই।
শহীদ উঠে দাঁড়াল। বলল, বড্ড বিরক্তিকর চরিত্র আপনি, মি. সরকার। আপনার সাথে আর কোন আলাপ নেই আমাদের। তবে ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না অনুমতি না নিয়ে। আর, পুলিসের কাছে গেছেন জানতে পারলে আমি আমার সহকারী এই কামাল আহমেদকে পাঠাব আপনার কয়েকটা পাজর, নাক এবং একটা করে দুই হাতের দুটো আঙুল মট মট করে ভেঙে দেবার অনুমতি দিয়ে। চললাম।
একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এল শহীদ রূম থেকে। বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগল ও। কামাল কাপড়-চোপড়ের প্যাকেট বগলে নিয়ে অনুসরণ করল ওকে।
ম্লান, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে দুজনকেই।
গাড়িতে এসে উঠল ওরা।
সন্দেহের তালিকা থেকে গুর্দভটাকে বাদ দিতে হচ্ছে, তাই না?
শহীদ বলল, কাজে খুঁত না রাখাই ভাল। তুই ট্যাক্সি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে যা। যে সব জায়গার নাম বলেছে সব জায়গায় যাবি, কেমন?
কামাল বলল, মিথ্যে কথা বলেনি ও, শহীদ। তবু, তুই যখন বলছিস…
.
০২.
অফিসের সামনে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল শহীদ। বুকের ভিতর রক্ত ছলকে উঠেছে অফিসরূমের ভিতর আলো জ্বলতে দেখে।
কে হতে পারে? জামান চট্টগ্রামে গেছে। কামালকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আসছে ও এইমাত্র।
মহুয়া? অসম্ভব। মহুয়া এমনিতেই সচরাচর অফিসে আসে না।
মি. সিম্পসন নাকি? নাকি ইন্সপেক্টর গনি?
এক মুহূর্ত চিন্তা করল শহীদ। না, তা হতে পারে না। মি. সিম্পসন যদি ওর ফেরার জন্যে অপেক্ষা করতেই মনস্থ করেন, অফিসে থাকবেন কেন তিনি একা। একা? ইন্সপেক্টরই বা কেন বসে থাকবে একা?
তবে?
স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে নামল শহীদ। খোলা রয়েছে গেট। সরাসরি গেট দিয়ে ঢুকেছে কেউ।
কে? অফিসে আলো জ্বেলে কি করছে সে?
দুপাশে বাগানের মাঝখান দিয়ে এগোল শহীদ। পকেট থেকে রিভলভারসহ হাতটা বের করে করিডরে উঠল।
রিসেপশনের দরজাটা খোলা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে ভিতরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না।
পা টিপে ঢুকল ভিতরে। পাশের রূমে যাবার দরজাটাও খোলা। আবার উঁকি মেরে সেরূমটাও দেখল। কেউ নেই।
ওর চেম্বারের দরজাটা ভেজানো রয়েছে। নিঃশব্দ পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। কান ঠেকাল দরজার গায়ে।
কোন শব্দ নেই। কী-হোলে চোখ রাখায়, চেম্বারের যে অংশটা দেখা গেল সেখানে কেউ নেই।
পা দিয়ে সজোরে লাথি মারুল শহীদ কবাটের উপর।
কবাট দুটো দুপাশে ছুটে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেলো, শব্দ হলো বিকট।
চেম্বারের ভিতর একটা চেয়ারে বসে আছে রীটা। শব্দ শুনে চমকে কোলের বইটা থেকে চোখ তুলে তাকিয়েছে সে। কিন্তু শহীদকে দেখেও আতঙ্ক দূর হলো না চোখমুখ থেকে। অপূর্ব সুন্দর মুখটা পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে তার। তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে নয়, শহীদের হাতের উদ্যত রিভলভারটার দিকে।
রিভলভারটা পকেটে ভরতে ভরতে শহীদ ভিতরে ঢুকল, অবাক কাণ্ড! আপনি এখানে কিভাবে এলেন? আমি ভেবেছিলাম কে না কে!
রীটা বুক খালি করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সশব্দে। অপ্রতিভ ভাবে হাসল সে, আপনার জন্যে সেই কখন থেকে ঠায় বসে আছি। গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর দেব। বলে।
আপনি ঢুকলেন কিভাবে? চাবি পেলেন কোথায়? মুখোমুখি বসল শহীদ।
কেন, কামালের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম একটা চাবি। উচিত ছিল আপনারই দেয়া, কিন্তু দেননি। আমিও তো ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশন-এর একজন এখন।
শহীদ বলল, আমার মাথার ঠিক নেই, মিস রীটা…
আমাকে মিস, আপনি–এসব বলেন কেন? নাম ধরবেন, তুমি বলবেন। শিল্পীকে কি মিস বলতেন? আমি তো শিল্পীর পদটাই পূরুল করছি।
শহীদ বলল, গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কি?
রীটা বলল, মিসেস রাফিয়ার মার্সিডিজটা ফেয়ার ভিউয়ের গ্যারেজে দেখে এসেছি আমি।
গাড়িটা লুকিয়েও রাখেনি–গেলে আর দেখে ফেললে?
রীটা গোমেজ বলল, অত সহজ নয়। আসলে ফেয়ার ভিউয়ে প্রায়ই যাই আমি। গেটম্যান, পোর্টার–সবাইকে চিনি। ওদের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক। জিজ্ঞেস করতেই বলে ফেলেছে। তারপর নিজে গিয়ে দেখেছি।
কাজের মেয়ে দেখছি। কাজী হানিফকেঁদেখেছ নাকি?
রীটা গোমেজ বলল, সব খবরই নিয়ে এসেছি। কাজী হানিফের সাথে কথা বলিনি অবশ্য। তবে হত্যাকাণ্ডের সাথে সে জড়িত নয়। গতকাল বারোটা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত সে নিজের নাইট ক্লাবেই ছিল। মি. শহীদু, মিসেস রাফিয়া অমন বিদঘুঁটে জায়গায় লুকিয়ে আছে আমার মনে হচ্ছে সেই খুনী।
শহীদ দ্রুত বলল, তার মানে? তুমি কি মিসেস রাফিয়াকে দেখেই ওখানে?
না, তা দেখিনি। কিন্তু গাড়িটা যখন রয়েছে, নিশ্চয়ই সে-ও ওখানে লুকিয়ে আছে।
শহীদ বলল, নাও থাকতে পারে।
রীটা গোমেজ রিস্টওয়াচ দেখল, সাড়ে আটটা বাজে। দেরি করে কি লাভ?
শহীদ বলল, তুমিও যাবে?
রীটা হাসল, অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছি-যাব না মানে? তাছাড়া, আপনি তো মেম্বার নন। ঢুকতে দেবে না আপনাকে। আমি মেম্বার আমার সাথে ঢুকতে পারবেন, সে নিয়ম আছে। ভাল কথা, রিভলভার সঙ্গে নিচ্ছেন তো?
শহীদ বলল, কেন? রিভলভার দিয়ে কি হবে?
রীটা অবাক হলো, বলেন কি! ফেয়ার ভিউয়ে যাবেন এক ভদ্রমহিলাকে বের করে আনতে-রিভলভার লাগবে না? আপনি গেলেই তো আর মিসেস রাফিয়া সুড় সুড় করে বেরিয়ে আসবে না আপনার সাথে। তাছাড়া, নাইট ক্লাবটার সুনামের চেয়ে দুর্নাম বেশি। কাজী হানিফের পোষা গুণ্ডাবাহিনীটাফ ক্যারেক্টার এক একটা। অবশ্য আপনি যদি না লাগতে যান–ওরা কিছু বলবে না। নাইট ক্লাব বোঝেনই তো। ভেতরের গোপন কুঠরিতে জুয়া খেলা চলে। কাজী হানিফ ভয়ানক হুঁশিয়ার। অকারণে কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখলে সন্দেহ করবে। এমনিতে লোকটা ভালই, কিন্তু খেপলে–ভয়ঙ্কর। মোট কথা, আমার ধারণা, আপনাকে ওরা দেখলেই কিছু একটা ঘটাবার চেষ্টা করবে। সুতরাং তৈরি হয়ে যাওয়াই ভাল বলে মনে করি।
শহীদ হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল, বলল, মহুয়া, আমি ফেয়ার ভিউয়ে যাচ্ছি।
মহুয়াকে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে সেট অফ করে দিয়ে শহীদ দাঁড়াল, চলো।
অফিসে তালা লাগিয়ে বাইরে বের হলো ওরা। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে শহীদ বলল, ইয়াকুব আজ বিকেলে সাধন সরকারের বাড়িতে লুকিয়ে ঢুকেছিল।
শক্ত হয়ে উঠল রীটা গোমেজের শরীর। দপ করে যেন জ্বলে উঠল চোখ দুটো, ওর কথা শুনতে চাই না আমি।
শহীদ বলল, কথা কিন্তু অন্য রকম ছিল, রীটা। তুমি ইয়াকুব সম্পর্কে তথ্য দেবে বলেছিলে।
রীটা গোমেজ চুপ করে রইল।
স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে শহীদ বলল, আমার কি ধারণা জানো? কোন কারণে তুমি আমাকে ইয়াকুব সম্পর্কে সব কথা বলতে চাইছ না। ওর সম্পর্কে যা বলেছ তার চেয়ে অনেক বেশি জানো তুমি। কি জানো, রীটা?
যতটুকু বলেছি তার বেশি কিছু জানি না। জানতে চাইও না। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চায় ও। ওকে আমি ঘৃণা করি।
শহীদ ভিউ মিররে তাকাল। বলল, ঠিক আছে। ইয়াকুব সম্পর্কে কথা বলব না আমরা। কিন্তু তোমার সম্পর্কে কথা বলতে পারি তো?
রীটা গোমেজ কটাক্ষ করে হাসল। খিল খিল করে হাসিতে ভেঙে পড়ল সে, আমার সম্পর্কে কি জানতে চান বলুন?
প্রত্যেক মানুষের একটা কাহিনী থাকে। তোমার কাহিনী শোনার কৌতূহল হচ্ছে আমার। তুমি কামালের ভক্ত। কিন্তু কামালও তোমার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে বলে মনে হয় না। কে তুমি, রীটা?
রীটা হাসল না। বলল, শুনবেন? দুঃখ পাবেন কিন্তু। আসলে আমার কোন পরিচয় নেই। বাইরের চেহারাটাই আমার আসল চেহারা। কি জানেন, রহস্য ভালবাসি। লোকে আমাকে রহস্যময়ী নারী বলে মনে করুক তাই চাই। আমার অতীত জীবনের কথা-সে বড় করুণ ইতিহাস। আমি ভুলে যেতে চাই।
শহীদ ভিউ মিররে চোখ রাখল আবার।
রীটাকে ম্লান দেখাল।
আবার বলল, আপনাকে বলতে আপত্তি নেই। কেন যে, আপনার সাথে পরিচয় হবার সময় থেকেই মনে হচ্ছে, আপনার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পেলে আমার মধ্যে স্থিতি আসবে। জীবনে শান্তি পাইনি একদণ্ডের জন্যেও। মি. শহীদ, আমি বড় দুঃখী মেয়ে। আমার দুঃখ আমি ভুলে থাকতে চাই বলেই মদ খাই, সিগারেট খাই, নাইট ক্লাবে যাই, পুরুষদের সাথে বেপরোয়াভাবে মেলামেশা করি, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকি। আমি মেয়ে–একথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমি খ্রিষ্টান। আমার বাবা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা চার্চের পুরোহিত। মা ছিলেন আদিবাসী। আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন আমার জন্মের পর। বিয়েটা টেকেনি। কারণ–আমার যখন নয় বছর বয়স তখন আমার মা উপজাতীয় এক যুবকের সাথে চলে যায়।
শহীদ ভিউ মিররে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। একটা কালো মরিস গাড়ি অনেকক্ষণ থেকে ফলো করছে। ড্রাইভারকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না ও। অনুসরণ করছে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে।
বাবার কাছে মানুষ আমি। কিন্তু মায়ের আত্মীয়-স্বজনদের সান্নিধ্যও পাই। সে জন্যেই সম্ভবত ভয় ডর বলে কিছু নেই আমার। ঘরকুণো হয়ে থাকা আমার ভাবের মধ্যে নেই। স্কুলে থাকতেই আমি বখে গিয়েছিলাম। প্রেম করতে শুরু করি তেরো-চোদ্দ বছর বয়স থেকেই। তবে লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম বাবর। শুধু লেখাপড়াতেই নয়, স্পোর্টসেও। রাইফেল চালনায় আমি বরাবর ফাস্ট হয়েছি। ভালো কুস্তি জানি। জুড়োও শিখেছিলাম। স্কুলে বা আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি সবসময় ভাল করেছি।
শহীদ বলল, তোমার বাবার কথা বলো।
তিনি মারা যান আমার যখন ষোলো বছর বয়স। ম্যাট্রিক পাস করেছি তখন আমি। এক যুবকের সাথে তখন আমার সম্পর্ক ছিল। মুসলমান সে, ডাক্তারী করত আমাদের এলাকায়। তার সাথে আমি চট্টগ্রাম শহরে আসি। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসে সে আমাকে। কিন্তু মাসখানেক পর সে জানায় আমার প্রতি তার কোন আকর্ষণ নেই। আমি ভাঙি কিন্তু মচকাই না। তাকে ছেড়ে চাকরি নিলাম একটা স্কুলে। মুশকিল কি জানেন, শাস্তি পেলেও আমার শিক্ষা হয় না। বারবার প্রেমে পড়েছি আমি। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষরা আমাকে ধোকা দিয়েছে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী বলে মনে করি নিজেকে। কিন্তু একই ভুল বারবার করছি। চাকরি ছেড়েছি। একটার পর একটা, বিভিন্ন শহরে গেছি, নতুন নতুন ছেলে বন্ধুদের সাথে মিশেছি-শেষ পর্যন্ত তরী ভিড়েছে ঢাকায়।
শহীদ বলল, ব্যস। আর শুনতে চাই না।
না, শুনতে হবে। ঢাকায় কি করি জানেন? না, চাকরি করি না। তাস সাজাতে পারি আমি। তারমানে, চুরি করতে জানি। ক্লাবে খেলি। কিছু না কিছু জিতিই। মগবাজারে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছি। ছোট একটা গাড়িও কিনেছি। বেশ কেটে যাচ্ছে দিন।
.
ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাব।
চৌরাস্তার মাথায় আকাশ ছোঁয়া প্রকাণ্ড গেট বিরাট একটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধ সেটা।
কিন্তু গাড়ি গেটের সামনে থামতেই সেটা খুলে গেল ঘরঘর শব্দ তুলে। রীটা জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিল। তিন-চারজন গার্ড গাড়ির নাক বরাবর এগিয়ে আসছিল, রীটাকে দেখা মাত্র একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রীটা মাথা ভিতরে নিয়ে হাসল, চিনতে পেরেছে আমাকে। গাড়ি চালান।
গেট একটা নয়। কংক্রিটের চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগোল। সামনে অপেক্ষাকৃত ছোট আরও একটা গেট দেখা গেল। সাদা ইউনির্ফম পরা দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। গেটটা খোলাই। আবার মাথা বের করে দিল রীটা গোমেজ। কাজ হলো এবারও। হাত ইশারায় দুজন লোকের একজন গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলল।
এরপর রাস্তার দুপাশে বাগান। বিল্ডিংটা আরও সামনে। সবুজ ইউনিফর্ম পরা একজন গেটম্যান দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশ পথের পাশে। গাড়ি থামাতেই স্যালুট করল, সে।
রীটা নামল আগে। তারপর শহীদ।
গেটম্যান প্রবেশ পথ খুলে দিয়ে একটু নত হলো। রীটার পিছু পিছু ভিতরে ঢুকল শহীদ।
হলরূমে প্রচুর লোকজন গিজ গিজ করছে। চারদিকের দেয়ালে প্রায় ডজন খানেক দরজা। সবগুলোই বন্ধ। প্রত্যেকটি দরজার সামনে দুএকজন করে স্যুট পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকগুলো সহজেই শহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রত্যেকের সুটের রঙ কালো। টাইয়ের রঙ সাদা। জুতোগুলো খয়েরি রঙের। বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সটান। হাসি নেই মুখে।
দরজা খুলে কেউ কেউ বেরিয়ে আসছে। কেউ কেউ ঢুকছেও বটে, কিন্তু কতে হলে কালো স্যুট পরা লোকগুলোর অনুমতি নিতে হচ্ছে, দেখে মনে হলো।
অনেক চেয়ার, কয়েক সেট সোফা রয়েছে হলরূমের এদিক সেদিক। নারী পুরুষ বসে আছে। যে অপেক্ষা করছে সবাই।
আপনি বসুন, আমি টয়লেট থেকে আসছি।
একটা খালি সোফা দেখিয়ে দিয়ে হাইহিলের খট খট শব্দ তুলে চলে গেল রীটা গোমেজ। লেডিস লেখা একটা দরজা খুলে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
পাইপে আগুন ধরাতে ধরাতে একজন লোককে দেখতে পেল শহীদ। চেনা চেনা মনে হলো। চেয়ে আছে ওর দিকেই। চোখাচোখি হতে লোকটার চেহারা যেন একটু কঠিন হয়ে উঠল। দৃষ্টি ফেরাল না সে। পা বাড়াল। আসছে শহীদের দিকেই সোজা।
লোকটার হাঁটার ভঙ্গি দেখে শহীদ অনেক কিছু বুঝে নিল। হাঁটার সময় হাত দুটো শরীরের দুই পাশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকছে, প্রায় স্থিরভাবে। ভঙ্গিটা চর্চা করে রপ্ত করেছে বোঝা যায়। হাত দুটো ওভাবে থাকায় আক্রমণাত্মক একটা সব ফুটে রয়েছে লোকটার মধ্যে। প্রায় ছয় ফুট লম্বা। চল্লিশ ইঞ্চি চওড়া বুক। হাতগুলোও পেশীবহুল। মুখটা বড়সড় কিন্তু চ্যাপ্টা ধরনের। নাক নামক জিনিসটা নেই বললেই চলে।
সামনে এসে দাঁড়াল শহীদের। ঠোঁটের কোণা থেকে সিগারেট না নামিয়েই প্রশ্ন করুল, কাউকে খুজছেন?
সাথে সাথে উত্তর না দিয়ে শহীদ লোকটার ঠোঁটে ধরা সিগারেটের দিকে চোখ রেখে হাতের পাইপটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে লোকটার চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গি নকল করে বলল, খুজছি? কই, কাউকে হারিয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না।
লোকটা একটু যেন অবাক হলো, দেখল শহীদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীব্র দৃষ্টিতে বলল, মেম্বার?
শহীদ বলল, না।
কার সাথে এসেছেন?
শহীদ বলল, কার সাথে কথা বলছি আমি?
নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকাল লোকটা, সিকিউরিটি গার্ড। কার সাথে আসা হয়েছে জানতে চাইছি। আজেবাজে লোক এখানে ঢুকে মেম্বারদের বিরক্তির কারণ হোক তা আমরা চাই না। আপনাকে আগে কখনও দেখিনি। অচেনা মুখ।
ডান দিকে, তারপর বাঁ দিকে মুখ ফেরাল শহীদ, ভাল করে দেখুন, চিনতে পারার তো কথা।
দাঁতে দাঁত চাপল বোধহয় লোকটা, ঠাট্টা করছেন? জানেন…?
লোকটার পিছন থেকে রীটা গোমেজ বলে উঠল, উঠুন…
লোকটা ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল, থেমে গেল রীটা গোমেজ। হাসি মুছে গেছে তার মুখ থেকে। কিন্তু কসেকেণ্ডের মধ্যেই সামলে নিল নিজেকে, টকটকে লাল ঠোঁট বিস্তার করে হাল, হাই। কেমন আছ, টগর?
আপনি?
হাসি হাসি মুখ করুল টগর, তাকাল শহীদের দিকে, বুঝেছি! মিস রীটার সঙ্গীরা সবাই অমন দুঃসাহসী ভাব দেখায়।
শহীদ সটান উঠে দাঁড়াল। রীটা গোমেজের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, কুয়োর ব্যাঙ!
টগর পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরুল কিছু একটা, কিন্তু কি মনে করে হাতটা বের করুল না পকেট থেকে।
রীটা গোমেজের সাথে একটা দরজার সামনে গিয়ে।ড়াল শহীদ। কালো স্যুট পর একজন লোক রীটা গোমেজকে দেখে হাসল, খুলে দিল দরজা। ভিতরে প্রবেশ করল ওরা।
টগর নড়েনি। চেয়ে আছে সে তখনও ওদের গমন পথের দিকে।
লবির ভিতর দিয়ে করিডরে, তারপর সুইং ডোর ঠেলে বারের ভিতর, এক কোণায় গিয়ে বল ওরা একটা টেবিল দখল করে।
ওয়েটার এল। শহীদ নিজের জন্যে কোল্ড ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল। রীটা হুইস্কি দিতে বলল।
ওয়েটার চলে যেতেও ওরা চুপ করে রইল, পরস্পরের সাথে কথা বলল না।
বারে খুব বেশি লোক নেই। মেয়ে এবং পুরুষ প্রায় সমান সংখ্যকই হবে। নিচু গলায় কথা বলছে বাই।
কেউ লক্ষ করছে না ওদেরকে।
ওয়েটার পানীয় দিয়ে গেল। বরফ দেয়া পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আড়চোখে তাকাল শহীদ রীটার দিকে।
অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে রীটা গোমেজের চেহারায়। চিন্তিত, গম্ভীর দেখাচ্ছে।
কথা বলল রীটাই, কাজটা ভাল করেননি।
শহীদ বলল, মানে?
টগরকে আপনি চেনেন না, মি. শহীদ। ওকে সবাই গোখরা সাপ বলে। কাজী হানিফের বডিগার্ড ও। রিভলভার ছাড়া ল্যাট্রিনেও ঢোকে না। সিঁড়ির নিচে যাকে দেখলেনও হলে খসরু। আর একজন বডিগার্ড।
শহীদ হাসছে দেখে আরও ভারি হয়ে উঠল রীটার সুন্দর মুখটা। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু যেন ভাবছে সে। বলল, কি করবেন এখন?
শহীদ শেদ্বার চুমুক দিয়ে ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখল গ্লাসটা, প্রত্যেকটা রূমে নাক গলাব। বিল্ডিংটার নকশা সম্পর্কে কিছু জানো?
তেমন কিছু জানি না। টপ ফ্লোরে কাজী হানিফের একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে জানি। কোনদিন ওঠার সুযোগ হয়নি আমার। অনেক বাধা। রূমের সংখ্যা বেশ কয়েকটা হবে, যতদূর শুনেছি। মিসেস রাফিয়া যদি ফেয়ার ভিউয়ে থেকে থাকে, তাহলে টপ ফ্লোরেরই কোথাও আছে সে।
টপ ফ্লোরেই যাব আগে আমি।
রীটা শহীদের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, ভয় করছে না আপনার?
শহীদ হেসে ফেলল, খুব। ভয়ে কেঁদে ফেলতে পারি। সিন ক্রিয়েট হবে একটা-পালাও!
পালাব?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি। যদি কোন বিপদে পড়ি, আমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা কোরো না।
রীটা বলল, টগরের নজরে পড়ে গেছেন আপনি, মি. শহীদ। আমি বলি কি, দরকার নেই আজ মিসেস রাফিয়ার সন্ধান করে। চলুন, ফিরে যাই।
শহীদ বলল, ফিরব তো বটেই। মিসেস রাফিয়াকে নিয়ে ফিরব।
আমি জানি, টপ ফ্লোর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবেন না আপনি। তা ছাড়া টগর-..
আহ, থামো! উঠে দাঁড়াল শহীদ। আবার বলল, ফিরে যাও, রীটা।
মি. শহীদ। এক মিনিট।
শুনল না শহীদ। কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। বিল মিটিয়ে দিয়ে তাকাল পাশে। রীটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে দেব আপনাকে।
শহীদ কথা না বলে পা বাড়াল।
করিডরে বেরিয়ে এসে সিঁড়িটা দেখতে পেল শহীদ। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে কালো স্যুট পরা একজন লোক।
কাছাকাছি যেতেই লোকটা পথ রোধ করে দাঁড়াল। বলল, ওনলি ফর মেম্বার, মিস্টার।
পিছনে আসছিল রীটা। বলল, খসরু, উনি আমার সাথে যাচ্ছেন।
ওহ, সরি! পথ ছেড়ে দিল খসরু।
উপরে উঠে শহীদ দেখল প্রশস্ত করিডরের শেষ মাথায় একটা বার। বার-এর বড়সড় প্রবেশ পথটা কাঁচ দিয়ে তৈরি। বারের ভিতর দশ বারোজন নারী পুরুষ বসে আছে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
রীটা গোমেজ ফিস ফিস করে বলল, আমাকে আগে যেতে দিন। আমি বারে ঢুকব, আপনি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবেন উপরে।
বারের কাছে, অনেকটা সামনাসামনি সিঁড়িটা। শান্ত, সহজ ভঙ্গিতে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে লাগল শহীদ। পিছন ফিরে তাকাল না একবারও। রীটা গোমেজের গলা ভেসে এল হঠাৎ।
খিলখিল করে হাসছে রীটা গোমেজ কারও কোন রসিকতা শুনে।
বাঁক নিয়েই শহীদ একসাথে তিনটে করে ধাপ টপকাতে শুরু করল এক এক লকে।
কেউ লক্ষ করেনি ওকে।
উপরে উঠে দাঁড়াল শহীদ। লম্বা করিডর ওর সামনে, দুপাশে পালিশ করা কাঠের দরজা। সবগুলোই বন্ধ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করছিল শহীদ, এরপর কি করা উচিত? নিরাপদে কাজটা সারতে হবে।
এমন সময়।
মাত্র দশ হাত সামনের একটা দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। প্রথমে ডান, তারপর বা পা ফেলে একটি যুবতী বেরিয়ে এল করিডরে।
মিসে রাফিয়াকে দেখেই চিনল শহীদ।
.
০৩.
ভূত দেখার মত চমকে ওঠা উচিত ছিল মিসেস রাফিয়ার। কিন্তু চমকাল না সে। মানুষ খেকো বাঘকে দেখলে মানুষ যেমন ভয়ে মুহূর্তের জন্যে পাথর হয়ে যায়, তারপর দিক হারিয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করে তাই করুল।
খোলা দরজা পথে ভিতরে ঢুকে কবাট দুটো বন্ধ করে দিল সে সশব্দে। বিদ্বেগে দরজার সামনে পৌঁছুল শহীদ। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল কবাট দুটো।
পিছিয়ে গেল মিসেস রাফিয়া। এদিক ওদিক তাকাল ভীতা হরিণীর মত, যেন পালাবার পথ খুঁজছে। এক পা এগিয়ে রূমের ভিতর ঢুকল শহীদ, খপ করে ধরে ফেলল মিসেস রাফিয়ার একটা হাত। ঠাণ্ডা গলায় বলল, শান্ত হোন, মিসেস রাফিয়া। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি আমি।
হাত ছাড়িয়ে দৌডুবার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল মিসেস রাফিয়া। হাতটা ছেড়ে দিয়ে শহীদ সজোরে একটা চড় মারুল গালে।
চড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল মিসেস রাফিয়া। হাঁপাচ্ছে সে হাপরের মত। চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, চলে যান! চলে যান আপনি!
ব্যাপার কি? দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করল শহীদ। চড় খেয়েও অপমানিত বোধ করছে না মিসেস রাফিয়া। বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আছে সে। কেন?
চলে যান! প্লীজ-চলে যান এখুনি! অস্ফুটে, শোনা যায় কি যায় না, ফিসফিস করে বলে উঠল মিসেস রাফিয়া।
আপনাকে কোথায় না খুঁজেছি আমি! কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে, মিসেস রাফিয়া। আপনি শান্ত হয়ে বসুন তো।
দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে আবার বলে উঠল মিসেস রাফিয়া, বেরিয়ে যান। আপনার সাথে কোন কথা নেই আমার।
শহীদ বলল, নেকলেসটার কথা ভুলে গেছেন নাকি? ফেরত চান না ওটা? এবার চড় না মারলেও গালে হাত দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল মিসেস রাফিয়া, কি! আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
সুন্দর বুঝতে পারছেন। নেকলেসটা শিল্পীকে দিয়েছিলেন আপনি। কেন দিয়েছিলেন, মিসেস রাফিয়া?.
অকস্মাৎ উন্মাদিনীর মত ছুটল মিসেস রাফিয়া। খসে পড়ল শাড়ি, সজোরে গিয়ে পড়ল সে একটা বড় টেবিলের উপর। টেবিলের সাথে একাই ধস্তাধস্তি করতে করতে একটানে খুলে ফেলল ড্রয়ারটা। খামচে ধরে বের করে আনল একটা .২৫ পিস্তল। সেটা শহীদের দিকে তুলে ধরার আগেই শহীদ পৌঁছে গেল তার পাশে, ছোঁ মেরে কেড়ে নিল সেটা। শহীদের মুখ খামচে ধরল সে, প্রথমে এক হাত দিয়ে, তারপর দুই হাত দিয়ে।
ধাক্কা মারল শহীদ। মুখ ছেড়ে দিয়ে শহীদের চুল ধরে এক রকম ঝুলে পড়ল মিসেস রাফিয়া। হাত দুটো ধরে হেঁচকা টান মারুল শহীদ নিচের দিকে। তারপর পিছিয়ে এল এক পা। পিস্তলটা পড়ে গেছে কার্পেটের উপর, লাথি মেরে খাটের নিচে পাঠিয়ে দিল সেটাকে।
হিংস্র, বন্য বাঘিনীর মত চেহারা হয়েছে মিসেস রাফিয়ার।
দুঃখিত, মিসেস রাফিয়া। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না, যতই চেষ্টা করুন না কেন, আপনাকে আমি ছাড়ছি না। অভিনয় বন্ধ করুন। উত্তর দিন আমার প্রশ্নের। শিল্পীকে কেন আপনি আপনার অত দামী নেকলেসটা দিয়েছিলেন?
নিজের হাত দুটো চোখের সামনে তুলে দেখল মিসেস রাফিয়া। দুচোখ ভরা পানি দেখল শহীদ।
হাত মুচড়ে দিয়েছেন আমার… ওটা…নেকলেসটা কাউকে দিইনি আমি।
দুঃখিত। শিল্পীর সাথে তার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন আপনি। ঢোকার সময় আপনার গলায় ছিল সেটা। কিন্তু বেরিয়ে আসার সময় ছিল না। পরে সেটা পাওয়া গেছে শিল্পীর ফ্ল্যাটে। আপনি দিয়ে এসেছিলেন তাকে। কেন?
বললাম তো দিইনি।
আপনাকে দেখেছে একজন ঢোকার সময়, বেরুবার সময়। সূতরাং মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। হয় আমাকে বলুন, নয়তো পুলিশ ডাকব আমি। ভেবে দেখুন কোনটা পছন্দ।
নেকলেসটা দিইনি আমি কাউকে। ওটা চুরি গেছে আমার কাছ থেকে।
শহীদ জানতে চাইল, রাত সাড়ে বারোটার সময় আপনি ধানমণ্ডি লেকের ধারে গিয়েছিলেন কেন?
চমকে উঠল মিসেস রাফিয়া। ভয়ে পাংশুবর্ণ ধারণ করল মুখের চেহারা। কি। আজেবাজে বকছেন! অত রাতে লেকের ধারে যাব কেন আমি?
শিল্পীকে যখন খুন করা হয়, ওখানে আপনি ছিলেন। কি করছিলেন ওখানে, মিসেস রাফিয়া? নাকি আপনিই গুলি করেন শিল্পীকে?
ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে মিসেস রাফিয়া। বলে উঠল, আমি যাইনি! আমি কখনও যাইনি! বেরিয়ে যান। আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না। আমি। চলে যান বলছি এখনও।
রহস্যময় ব্যাপার হলো, কথাগুলো কেউ শুনে ফেলবে এই ভয়ে একেবারে ফিসফিস করে কথা বলছে মিসেস রাফিয়া। ভীষণ রকম আতঙ্কিত সে।
ব্যাপারটা ভাল ঠেকল না শহীদের। যতবার কথা বলছে, চমকে চমকে উঠছে সে।
কিছুই আপনি জানেন না, কিছুই আপনি করেননি–তাহলে এখানে গা ঢাকা দিয়ে আছেন কিসের ভয়ে? বাড়িতে থাকছেন না কেন? আপনার স্বামী জানেন, আপনি এখানে আছেন? উত্তর দিন চুপ করে থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে। নেকলেসটা…!
মিসেস রাফিয়া হঠাৎ কেঁপে উঠল থরথর করে। দরজা খোলার শব্দ পায়নি শহীদ। পদশব্দও কানে ঢোকেনি। কিন্তু এক কোনার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় একটা প্রতিফলন নড়ে উঠেছে বলে মনে হতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও পিছন দিকে।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কাজী হানিফ। প্রৌঢ়ই বলা চলে তাকে। মেদস। পরনে ধূসর রঙের ট্রপিক্যাল স্যুট। মাথায় টাক, চকচক করছে বৈদ্যুতিক আলোয়। চোখ দুটো গর্তে। ক্লান্ত, বিরক্ত দেখাচ্ছে তাকে।
মিসেস রাফিয়ার দিকে ফিরল শহীদ। বোবা, বোকা, অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। রক্ত নেমে গেছে শিরা উপশিরা বেয়ে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখটা।
ক্রেপসোলের জুতো. কাজী হানিফের পায়ে। প্রায় কোন শব্দই হলো না। এগিয়ে এসে শহীদের ডান দিকে দাঁড়াল সে হাত চারেক দূরে।
শান্ত, আলাপী কণ্ঠে জানতে চাইল সে, নেকলেসটা সম্পর্কে কি জানেন, আপনি বলুন তো?
শহীদ বলল, আমাদের আলোচনায় নাক গলাবেন না। শুধু নেকলেস নয়, আমরা একটা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কথা বলছি। নিজেকে জড়ানো উচিত হবে না আপনার।
নেকলেসটা কোথায় আছে জানেন নাকি? যেন শহীদের কথা শুনতেই পায়নি কাজী হানিফ।
আছে নিরাপদেই, তালা-চাবির ভিতর। মিসেস রাফিয়া বুঝি বলেনি আপনাকে একটা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তিনি? পুলিস ওকে খুঁজছে। ওকে আশ্রয় দিয়েছেন আপনি–একজন হত্যাকারিণীকে গা ঢাকা দিতে সাহায্য করার অভিযোগ থেকে আপনিও নিষ্কৃতি পাবেন বলে মনে হয় না। নাকি এইসব ছোটখাট ব্যাপার গ্রাহ্য করেন না?
নির্বিকার মুখের ভাব এতটুকু পরিবর্তিত হলো না। তাকাল সে এই প্রথম মিসেস রাফিয়ার দিকে, আপনি এই লোকের কথাই আমাকে বলেছিলেন?
আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েছে মিসেস রাফিয়া। সবেগে মাথা কাত করল সে। গলার শিরাগুলো অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে উঠেছে, দেখল শহীদ।
কাজী হানিফ মুখ ফেরাল শহীদের দিকে, এখানে এলেন কিভাবে?
রীটা গোমেজকে জড়াতে চাইল না শহীদ, একেবারে অপরিহার্য না হলে তার নাম মুখে আনবে না ঠিক করল ও। বলল, সোজা উঠে এসেছি ওপরে। কেউ বাধা দেয়নি।
কথা না বলে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবল কাজী হানিফ। তারপর, ধীরে ধীরে রমের মাঝখানটায় গিয়ে দাঁড়াল সে।
এভাবে হেঁটে রূমের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবার কারণটা বুঝতে না পারলেও শহীদের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা যোত উঠে এল। হঠাৎ ও যেন বুঝতে পারল, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
ঢুকলেন কিভাবে উনি, টগর?
দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল টগর–আড়ালে। দ্রুত পায়ে ঢুকল সে ভিতরে, রীটা গোমেজের সাথে এসেছে।
সেই চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গি। হাতের রিভলভারটা শক্ত করে ধরে আছে।
আর একজনের পদশব্দ কাছে এগিয়ে আসছে। শহীদ আয়নার দিকে তাকাল আড়চোখে। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল আর একজন লোক। চিনতে পারল শহীদ। দোতলায় ওঠার সময় এই লোকটাই ওর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
নিয়ে এসো রীটাকে।
দোরগোড়া থেকে সরে গেল খসরু। হাত নেড়ে অপর একটি দরজা দেখিয়ে মিসেস রাফিয়ার উদ্দেশে বলল কাজী হানিফ, পাশের রূমে!
যান্ত্রিক পুতুলের মত ঘুরে দাঁড়াল মিসেস রাফিয়া। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝট করে ফিরল ওদের দিকে। দৃঢ়, অবিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল, মিথ্যে কথা বলছেন উনি। যা বলছেন–একটা কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। আমাকে বিপদে ফেলার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, যতটুকু বুঝতে পারছি।
ঠিক আছে। আপনি যান। কাজী হানিফ নীরস গলায় বলল।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল মিসেস রাফিয়া, বন্ধ করে দিল দরজাটা। কাজী হানিফ সাথে সাথে তাকাল টগরের দিকে, আমার কাছ থেকে বেতন নিয়ে ঘাস • কিনে খাও, না? কেউ যাতে ওপরে উঠতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হাজার বার হুকুম দিইনি আমি?
টগর কথা বলল না, এমন কি তাকাল না পর্যন্ত কাজী হানিফের দিকে। চেয়ে আছে সে শহীদের দিকে। অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনুমতি পেলে চিবিয়ে খাবে সে শহীদের গায়ের কাঁচা মাংস। রিভলভারটা সে। ধরল সিলিংয়ের দিক থেকে শহীদের মাথার দিকে।
কথা বলে উঠল শহীদ। ভয়হীন, স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। মাথাটা একটু খাটান, কাজী হানিফ। নিজেকে, নিজের ব্যবসাকে একটা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মিসেস রাফিয়াকে ডেকে পাঠান, যেতে বলুন আমার সাথে–আপনি যাতে জড়িয়ে না পড়েন কেসটার সাথে, সেটা আমি দেখব।
হু। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজে মিটছে না।
সশব্দে দরজাটা খুলে যেতে চমকে উঠল সবাই একটু। রূমের ভিতর দ্রুত ঢুকে পড়ল রীটা। তার ঠিক পিছনেই খসরু। হাতের রিভলভারটা রীটা গোমেজের শিরদাঁড়া লক্ষ্য করে ধরা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে পিছিয়ে গেল সে, একটা হাত পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিল দরজাটা। তারপর দুপা সামনে এগিয়ে দাঁড়াল।
শান্ত, স্বাভাবিক দেখাচ্ছে রীটাকে। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে রূমের দৃশ্যটা দেখে নিল সে, হ্যালো! আপনি ওপরে উঠলেন কিভাবে? রিভলভার দেখছি–ঘটনাটা কি? নাটকের রিহার্সেল হচ্ছে নাকি?
রিভলভারের নলের মত কালো আঙুল তুলে শহীদকে দেখাল কাজী হানিফ, ওকে তুমি সাথে করে এনেছ?
রীটা বলল, তাতে হয়েছেটা কি? আমি কি মেম্বার নই? মেম্বারদের সাথে তো একজন করে আসতেই পারে।
কাজী হানিফ মাথা নাড়ল, তা পারে। আমি আগেই ভেবেছিলাম, তুমি ঝামেলা তৈরি করবে একদিন না একদিন। ঠিক তাই করেছ।
হানিফ সাহেব, কি বলছেন আপনি? কাকে বলছেন? রীটা হঠাৎ খেপে উঠল যেন, আবার বলল, আমাকে তুমি বলার দুঃসাহস কোথা থেকে হলো আপনার? নিজের আস্তানায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন দেখছি। মি. শহীদ, চলুন। এখানে আর কোনদিন থুথু ফেলতেও আসব না।
চমৎকার কৌশল, সন্দেহ নেই। নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে শহীদকে বিপদের মুখ থেকে মুক্ত করে নিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা। কিন্তু কাজ হলো না।
কাজী হানিফ হুকুম দিল, নড়লেই গুলি করবে, টগর।
নড়ল না শহীদ। টগরকে সুযোগ দেয়াটা বোকামি হবে। গুলি করার অজুহাত পেলে হাতছাড়া করবে না সে।
কাজী হানিফ খসরুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল সবেগে। কয়েক পা এগিয়ে এসে খসরু রীটা গোমেজের কাঁধে হাত রাখল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠাস করে চড় মারল রীটা গোমেজ খসরুর গালে।
এত বড় স্পর্ধা। আমার গায়ে হাত রাখিস খসরু খপ করে মুঠো করে ধরল বীটা গোমেজের বব ছাঁটা চুল। হেঁচকা টান মেরেই ছেড়ে দিল সে চুল।
ছিটকে পড়ল রটা গোমেজ। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল সে কয়েক সেকেণ্ড।
টগবগ করে ফুটছে শরীরের ভিতর রক্ত, কিন্তু একটা কথাও বলল না শহীদ।
খসরু আবার এগিয়ে আসছে দেখে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল রীটা গোমেজ। অসহ্য অপমানে রাগে কাঁপছে সে।
সবাই চেয়ে আছে খসরুর দিকে।
সুযোগটা নিল শহীদ। লাফ দিয়ে পড়ল সে।
টগর তৈরি ছিল না। কিন্তু আক্রান্ত হবার এক সেকেণ্ড আগে ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল সে। শহীদ তখন শূন্যে। ওকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, অত সময় পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে টগর হাতের রিভলভারটা ছুঁড়ে দিল কাজী হানিফের দিকে। পরক্ষণে শহীদের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল সে।
পড়ে গেল কার্পেটের উপর শহীদও। উঠে দাঁড়িয়ে আবার লাফ দিল ও। খসরু রীটা গোমেজকে ছেড়ে এগিয়ে আসছিল ওর দিকে, তাকে লক্ষ্য করেই লাফ দিল শহীদ।
লাফ দেবার পরপরই শব্দ হলো। বন্ধ রূমের ভিতর রিভলভারের শব্দ, কানের পর্দা ফেটে যেতে চাইল। কানের পাশ দিয়ে বুলেটটা ছুটে গেল, তা টেরই পেল না ও।
খসরু সরে গেছে। শহীদ তাল সামলে সিধে হয়ে দাঁড়াল খসরুর মুখোমুখি।
গুলি করছি! কাজী হানিফের গলা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডান দিকে শহীদ। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড ঘা খেলো ও মাথার পিছনে। টগর ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। রিভলভারের বাট দিয়ে ওর মাথার পিছনে সেই মেরেছে।
একপলকে অন্ধকার হয়ে গেল শহীদের গোটা দুনিয়া। মেঝেতে, সশব্দে ঢলে। পড়ল ওর জ্ঞানহীন দেই।
.
০৪.
কামরাটা স্যাঁতসেঁতে। মাটির নিচের কোন সেল সম্ভবত। একটাও জানালা নেই। সিলিংটা অনেক উঁচুতে।
হলদেটে আলো পড়েছে দেয়ালে। একটা টেবিলের ছায়া দেখা যাচ্ছে। দুপাশে দুটো চেয়ারের ছায়া দেখা যাচ্ছে। চেয়ার দুটোয় বসে আছে দুজন লোক। লোক দুটোকে নয়, তাদের ছায়া দুটো দেখতে পাচ্ছে শহীদ।
এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে ওর।
মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়েছে ওর। হাত-পা বাঁধেনি, মুক্তই রেখেছে। পাশ ফিরল ও। তাকাল না টগর বা খসরু। তাস খেলছে ওরা মুখোমুখি বসে। সময় কাটাবার জন্যে নয়, টাকা দিয়ে লাভ লোকসানের খেলা খেলছে।
কিন্তু টগর কথা বলে উঠল, নড়বেন না। যেমন শুয়ে আছেন তেমনি শুয়ে থাকেন। এই শেষ দানটা খেলে নিই।
ব্যাপারটা কি? তুমি থেকে আপনি বলার মানে? ব্যঙ্গ করছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
খসরু উঠে দাঁড়াল, থাক খেলা। বসকে গিয়ে খবরটা দিই।
টগর টেবিলের উপর থেকে রিভলভারটা তুলে নিল। আচ্ছা। পাহারায় আছি আমি।
দরজা খুলে খসরু বেরিয়ে যেতে শহীদ উঠে বসল। রীটা কোথায়?
চুপ!
রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল শহীদ। এগারোটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। আরও তিন মিনিট পর দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকল খসরু। তারপর কাজী হানিফ।
কাজী হানিফের প্রথম কথাটা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো শহীদের। আপনার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, মি. শহীদ। ছি, ছি-কিরকম জঘন্য একটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার ঘটে গেল বলুন তো? প্রথমেই কেন আপনি আপনার পরিচয় দেননি? তাহলে তো আর এমন দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটত না।
শহীদ উঠে দাঁড়াল।
মিসেস রাফিয়া আমাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল। দুঃখিত, মি. শহীদ। আপনি সুস্থ বোধ করলে বলুন, আপনাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করি।
শহীদ বলল, কানে মধুবর্ষণ করছে আপনার কথাগুলো, যাই বলুন। তা সে যাই হোক, মিসেস রাফিয়া কোথায়?
কাজী হানিফ তিক্তকণ্ঠে বলল, চলে গেছেনা, তাকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।
ভাল করেননি। তাড়িয়ে দিয়েছেন, না আমার হাত থেকে তাকে বাঁচাবার জন্যে অন্যত্র কোথাও সরিয়ে দিয়েছেন?
বিনয়ের অবতার বলল, প্লীজ, মি. শহীদ! আপনার সম্মান সম্পর্কে আমি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। আপনাকে চিনতে পারার পর মিথ্যে কথা বলব–সে সাহস নেই আমার। আপনার পরিচয় জানার পরপরই আমি তাকে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে বলি। দশ মিনিট পরই আপদ বিদায় হয়। এই, খসরু, ইডিয়েট, একটা চেয়ার আনতে কি হয়েছে?
খসরু বুলেটের বেগে বেরিয়ে গেল রূম থেকে।
কোথায় গেছে সে?
তা ঠিক জানি না।
এগিয়ে আসতে আসতে বলল কাজী হানিফ। হাতের ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেটটা খুলে সরিয়ে দিল শহীদের দিকে।
মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করল শহীদ। চেয়ার নিয়ে প্রবেশ করল খসরু ভিতরে। শহীদের কাছে নামিয়ে রাখল সেটা। পকেট থেকে পাইপ বের করল শহীদ। বসল চেয়ারে। ধীরে সুস্থে তামাক ভরতে লাগল পাইপে।
কৌতূহল ছিল নেকলেসটা সম্পর্কে, কাজী হানিফ বলল।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করে ধোয়া ছাড়ল শহীদ, কেন? মিসেস রাফিয়ার নেকলেসের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
সে আমাকে ওটা দেবে বলেছিল। ওটার বদলেই তাকে আমি আশ্রয় দিয়েছিলাম। দুদিন আগে সে আমার সাথে দেখা করে বলে এক সপ্তাহের জন্যে প্রোটেকশন দরকার তার, বদলে টাকা দেবে। নিজের মুখেই পাঁচ হাজার টাকার কথা বলে সে। কিন্তু তাতে আমি রাজি হইনি। বুঝতে পেরেছিলাম, গুরুতর কোন বিপদের আশঙ্কা করছে সে। বড়লোকের বউ, অভাব কি তার? শেষ পর্যন্ত প্রোটেকশনের বিনিময়ে সে আমাকে তার গলার নেকলেসটা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু গতরাতে যখন সে পৌঁছায় এখানে, গলায় নেকলেসটা ছিল না। জিজ্ঞেস করতে বলে, চুরি হয়ে গেছে। মিথ্যে কথা বলছে, সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। বেশি বাড়াবাড়ি করিনি, কারণ, ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিল। ভয়ের কারণটা তখন অবশ্য বুঝিনি। ঠিক করেছিলাম আজ রাতে নেকলেসটার কথা তুলব। কিন্তু আপনি তার আগেই তো…মি. শহীদ, নেকলেসটার ওপর আমার দাবিই এখন সবচেয়ে বেশি। আপনিও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে?
শহীদ বলল, না। স্বীকার করব না। নেকলেসটা আপনি পাবার আশা ত্যাগ করুন। জিনিসটা পাওয়া গেছে যে মেয়েটি খুন হয়েছে তার বেডরূমে। খবরের কাগজে খুনের খবরটা পড়েছেন নিশ্চয়ই। পুলিস জানে না ওটা আমাদের কাছে আছে, কিন্তু জানবে তারা।
নেকলেসটার কথা দেখছি আমার ভুলে যাওয়াই উচিত! চিন্তিতভাবে কথাটা যেন নিজেকেই শোনাল কাজী হানিফ।
অমন ভয়ে আধমরা হয়ে আছে কেন মিসেস রাফিয়া বলতে পারেন? হঠাৎ প্রশ্নটা করল শহীদ।
হা, ঠিকই ধরেছেন। কিসের ভয়ে যেন সর্বক্ষণ কুঁকড়ে আছে। কারণটা বুঝতে পারিনি। গতরাতে আসার পর থেকেই লক্ষ করেছি ব্যাপারটা। খানিক আগে চলে যেতে বলায় প্রায় কেঁদে ফেলেছিল–ওই ভয়েই।
প্রোটেকশন চেয়েছিল কেন? কার কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা করছিল সে। বলেনি কিছু?
খানিকটা। কে একজন লোক নাকি তার পিছু লেগেছে, বিপদে ফেলার জন্যে। তার চোখে যাতে ধরা পড়তে না হয় সেজন্যে কদিন লুকিয়ে থাকতে চায়। যা বলল তাতে মনে হয় লোকটা ভয়ঙ্কর ধরনের। লোকটা যদি এখানে আসে আমি যেন তাকে ওপরে উঠতে বাধা দিই–অনুরোধ করেছিল আমাকে। আমি আপনাকে সেই লোকই ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনার পকেটের কাগজপত্র দেখে বুঝতে পারি ভুল হয়ে গেছে। যাক, আবার আমি ক্ষমা চাইছি, মি. শহীদ। আর। আপনাকে কষ্ট দেব না। ভাল কথা, একজন অ্যাংলো ওপরে ওঠার চেষ্টা করার সময় আমার লোকদের হাতে ধরা পড়ে যায়। কুয়াশার নাম বলে সে। আপনার নামও বলে।
ডি. কস্টা।
হ্যাঁ, ওই নামই বলেছিল। তাকে আমরা বের করে দিয়েছি বাইরে। সে যদি আপনার লোক হয়ে থাকে, তার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্যেও ক্ষমা চাইছি।
শহীদ দাঁড়াল, রীটা কোথায়?
আপনার গাড়িতে। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি। টগর, মি. শহীদকে সসম্মানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও।
টগর বেরিয়ে গেল রূম থেকে। তাকে অনুসরণ করল শহীদ।
রূমটা আণ্ডারগ্রাউন্ডেই অবস্থিত। লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল ওরা। করিডর থেকে হলরূমে পৌঁছুল। দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল টগর।
শহীদ পাশ ঘেঁষে বাইরে বেরিয়ে যাবার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই।
বলেই টগরের নাকে দেড়মণওজনের একটা ঘুসি মারল শহীদ। থ্যা করে শব্দ হলো, ভেঙে গেল নাকটা। প্রায় একই সাথে ডান পা দিয়ে খসরুর তলপেটে লাথি মারল ও।
হলরুমের কার্পেটে পড়ে গেল টগর-টগর নয়, টগরের অজ্ঞান দেহ।
দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে এল শহীদ। মুখোমুখি হঠাৎ একটা কালো ছায়ামূর্তিকে দেখে চমকে উঠল ও।
ডি. কস্টা জেদ ধরাতে আমি নিজে না এসে ওকে পাঠিয়েছিলাম। জানতাম এখানে গোলমাল হবে। কিন্তু সে আমাকে খুঁজে বের করে খানিক আগে খবর দিল–তা যাক, তোমার খবর কি?
শহীদ বলল, কোন খবর নেই। এখনও রহস্য ভেদ করতে পারছি না।
আমার সাহায্য দরকার হলেই ফোনে জানিয়ো।
শহীদ বলল, জানাব।
শহীদ, তোয়াব খান বাড়িতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তিনি দেখা করবেন তোমার সাথে। যাতে দেখা করেন সে ব্যবস্থা আমি করেছি।
শহীদ বলল, ধন্যবাদ।
পরমুহূর্তে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল কালো আলখেল্লা পরিহিত ছায়ামূর্তি।
অন্ধকারের দিকে নিস্পলক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল শহীদ। তারপর, এক সময় গেটের দিকে পা বাড়াল।
.
০৫.
রাত সাড়ে বারোটা। মুক্তা নিকেতন। ফোক্সওয়াগন গেটের সামনে থামতেই গেটটা শব্দ করে খুলতে শুরু করল।
নামার সময় শহীদ দেখল গার্ড লোকটা ইয়াকুব নয়, অন্য একজন। এগিয়ে যেতে দেখে বলল, সালাম, স্যার। মালিক আপনার জন্যে জেগে বসে আছেন এখনও। আপনি গাড়ি নিয়েই ভিতরে ঢুকুন। বিল্ডিংয়ের গেটে বাটলার আছে, সে আপনাকে মালিকের কামরায় পৌঁছে দেবে।
গাড়িতে ফিরে এল শহীদ।
গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে রিস্টওয়াচ দেখল। বারোটা বেজে তেত্রিশ মিনিট হয়েছে। রীটা গোমেজ এতক্ষণে পৌঁছে গেছে বাড়িতে। একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে এসেছে তাকে ও।
বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাটলার। গাড়ি থামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে নামল শহীদ।
আসুন, স্যার। বিনয়ে বিগলিত সুরে বলল বাটলার। বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল শহীদ।
স্টাডি রূমে অপেক্ষা করছিলেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। শহীদকে ঢুকতে দেখে মুখের চেহারা যেমন ছিল, গাভীর্য এবং বিরক্তিতে ভরপুর, তেমনি রইল, এতটুকু বদলাল না। বসুন, মি. শহীদ। যেন গুরু গুরু ডেকে উঠল মেঘ।
শহীদ বসল পায়ের উপর পা তুলে।
বলুন? কেন দেখা করতে চেয়েছেন?
তীব্র কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দিল শহীদ, চাই মিসেস রাফিয়াকে। এবং এই মুহূর্তে চাই।
তোয়াব খান বললেন, আপনার সহকারীকে আমি তো একবার জানিয়েই দিয়েছি আপনাদের নিজস্ব ঝামেলায় আমার স্ত্রীকে টানবেন না।
সে তো গত সকালের ঘটনা। তারপর বুড়ীগঙ্গার পানি অনেক গড়িয়েছে, মি. তোয়াব। অনেক ঘটনাও ঘটেছে। আপনার স্ত্রীকে খুনী সন্দেহে পুলিসও জেরা করতে আসবে। শুধু সময়ের ব্যাপার সেটা।
শহরে নেই সে। তাকে আমি এসবে জড়াতে দেব না। তার সাথে কথা বলার সুযোগও আমি দেব না কাউকে।
আগেই তিনি জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। আমি তার সাথে কথাও বলেছি।
চুরুটটা হাত ফসকে পড়ে গেল ডেস্কের উপর, বোকার মত চেয়ে রইলেন কোটিপতি তোয়াব খান। কি বললেন? আবার বলুন।
ভুল শোনেননি। আমার সহকারীকে গত সকালে বলেছেন মিসেস রাফিয়াকে আপনি শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কথাটা সত্যি নয়। সত্যি হলো এই যে, গত রাতে আপনার স্ত্রী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর তাঁর সাথে আপনার আর দেখাই হয়নি। কোথায় রাতটা কাটিয়েছেন তিনি, বলতে পারেন? জানা আছে আপনার? না, আপনার জানা নেই। আমি জানি।
শহীদ পাইপ বের করে টোবাকো ভরতে ভরতে বলল, আপনার ধারণা মিসেস রাফিয়া শিল্পীর খুন হওয়ার সাথে জড়িত। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন। তিনিই শিল্পীকে খুন করেছেন। সেজন্যেই তাকে ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান। কিন্তু, মি. তোয়াব, এটা একটা খুনের কেস, ভুলে যাবেন না। অপরাধী যে-ই হোক, তার নিষ্কৃতি নেই। আপনি জানেন না, মিসেস রাফিয়া গত রাতে আমার চেম্বারে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন জানেন? তাকে কেন অনুসরণ করা হচ্ছে তা জানতে। আমি তাকে আপনার সাথে কথা বলতে পরামর্শ দিই।
তিনি আমাকে টাকার লোভ দেখান। আমার কাছে সুবিধে করতে না পেরে তিনি বিদায় নেন, এবং রাস্তায় শিল্পীর সাথে মুখোমুখি কথা বলেন। তারপর ওর সাথে শিল্পীর ফ্ল্যাটে যান। ওদেরকে লোকে দেখেছে। পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট পর মিসেস রাফিয়া ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসেন। তার দেড় ঘণ্টা পর শিল্পী একটা ফোন পায় এবং সে-ও ফ্ল্যাট ছেড়ে ওই গভীর রাতে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মৃতদেহ আরও পরে মোরশেদ নামের এক লোক আবিষ্কার করে। সকালে আমার অপর এক সহকারী শিল্পীর ফ্ল্যাটে যায়। সে শিল্পীর বেডরুমের কার্পেটের নিচ থেকে মিসেস রাফিয়ার নেকলেসটা পেয়ে যায়। পরিষ্কার হয়ে যায় এরপর যে মিসেস রাফিয়া শিল্পীর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত।
তোয়াব খান শুনলেন কথাগুলো। কিন্তু মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কি ভাবছেন তিনি। পিছনের নিভাঁজ দেয়ালের মতই তার মুখের চেহারা ভাবলেশহীন, নির্বিকার।
শহীদ বলল, পরিস্থিতিটা আরও জটিল করে তুলেছে দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড।
কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তোয়াব খানের মধ্যে।
শহীদ উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম পুলিসকে আপনার কেস সম্পর্কে কিছু জানাব না। কিন্তু সে কথা এখন আর রাখা সম্ভব নয়। আমি পুলিসকে সব কথা জানাব।
সে কি! তোয়াব খান চমকে উঠলেন। এতক্ষণ তিনি যে নির্বিকার ভাবটা ধরে রেখেছিলেন চেহারায় তা উবে গেল। হঠাৎ যেন বয়স বেড়ে গেল তার। ক্লান্ত, আতঙ্কিত দেখাল।
অবদমিত কণ্ঠস্বরে আবার তিনি বললেন, আমার মানসিক অবস্থা ভাল নয়। সে যাই হোক, সমস্যাটা আপনি আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে বোঝার চেষ্টা করুন, প্লীজ। আমাকে আমার মেয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে।
শহীদ বলল, মিসেস রাফিয়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসুন। কোথায় তিনি?
খানিক আগে আপনিই তো বললেন তার সাথে কথা বলেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কথা বলার সময় বাধা পেয়েছিলাম। ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাবে তার সন্ধান পাই আমি। ওখানে আত্মগোপন করেছিলেন তিনি। মি. তোয়াব, তিনি কি বাড়িতে ফিরে এসেছেন?
মাথা নাড়লেন তোয়াব খান।
কোন খবর দেননি?
না।
বলতে পারেন কোথায় গেছেন তিনি? কোথায় তাঁকে পাব?
না। সে কি গতরাতে ওই নাইটক্লাবে ছিল?
হ্যাঁ। কাজী হানিফকে তিনি বলেন একজন লোক তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে, তাই তার দৃষ্টির আওতা থেকে সরে থাকার জন্যে নিরাপদ আশ্রয় দরকার। নিজের নেকলেসটা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি কাজী হানিফকে, আশ্রয়ের বিনিময়ে। কিন্তু নেকলেসটা পায়নি বলে কাজী হানিফ তাঁকে তাড়িয়ে দেয়।
দিস ইজ ফ্যানটাসটিক! কে সেই লোক? কে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে? এসব কথা আমাকে কেন বলেনি সে? কোথায় সে? রাগে কাঁপছেন তোয়াব খান। চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন।
লোকটা কে তা আমি জানার চেষ্টা করব। হয়তো এই লোকই আপনার স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
পায়চারি করতে করতে তোয়াব খান বললেন, মি, শহীদ, একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবেন?
আমি সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতে পারি।
রাফিয়া কি শিল্পীকে খুন করেছে? আপনার তাই বিশ্বাস?
শহীদ বলল, না। শিল্পী এবং মোরশেদ, দুজনেই খুন হয়েছে ৪৫ পিস্তলের গুলি খেয়ে। মোরশেদকে গুলি করা হয়েছে পনেরো-বিশ গজ দূর থেকে। কপাল ফুটো করে ঢুকে গেছে বুলেট–অর্থাৎ অব্যর্থ লক্ষ্য। ৪৫ পিস্তল ব্যবহার করে কোন মেয়ে এই খুন করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি যা বিশ্বাস করি না পুলিসও তা বিশ্বাস করবে না এমন নয়। তিনি এমন উদ্ভট আচরণ করছেন দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কালপ্রিট তিনিই।
ওকে…ওর মত সেন্সলেস একটা মেয়েকে বিয়ে করে আমি পাপ করেছি। মি. শহীদ, আমাকে এই জঘন্য বিপদ থেকে রক্ষা করুন আপনি। আমাকে আমার একমাত্র মেয়ের কথা ভাবতে হবে। কথা দিচ্ছি আমার দ্বারা কোন সাহায্য সব হলে করব আপনাকে। কিন্তু দয়া করে আপনি পুলিস আর খবরের কাগজের রিপোর্টারদের কবল থেকে আমাকে মুক্ত রাখুন।
চেষ্টার ত্রুটি হবে না। কিন্তু আবার বলছি, মিসেস রাফিয়ার সাথে কথা বলার পর পরিস্থিতি কি রকম দাঁড়ায় তার ওপর নির্ভর করছে সব। আচ্ছা, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার ব্যবস্থাটা বন্ধ করতে পারেন তার? টাকার অভাব হলে তিনি হয়তো আপনার কাছে বাধ্য হবেন ফিরে আসতে।
পারি। কাল সকালেই ব্যাঙ্কের সাথে যোগাযোগ করব।
শহীদ বলল, রাত অনেক হলো। এবার যেতে হয়। আর একটা কথা-আমার ফী…
শহীদ কি বলবে তা যেন তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, শহীদকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কত?
আপাতত, দশ হাজার দিলেই চলবে।
বিনাবাক্যব্যয়ে ড্রয়ার খুলে চেক বই আর কলম বের করলে তোয়াব খান। চেক লিখে সই করলেন। চেকটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরও টাকা দেব আপনাকে আমি, মি. শহীদ। আরও যত চান। কিন্তু যে ভাবেই হোক, পুলিসের ঝামেলা এবং প্রচারের কলঙ্ক থেকে আমাদেরকে বাঁচান।
চেকটা নিল শহীদ। কোন ক্লায়েন্টের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, ওর জীবনে সম্ভবত এটাই প্রথম ঘটনা। চেকটা লি টাকার জন্যে নয়, তোয়াব খান যে ওকে একটা কেসে নিয়োগ করেছিলেন তার প্রমাণ হাতে রাখার উদ্দেশ্যে।
চেকটা কোটের বুক পকেটে রেখে হঠাৎ জানতে চাইল, ইয়াকুবকে কতদিন হলো চাকরিতে নিয়েছেন?
ইয়াকুব? কেন? এই কেসের সাথে তার কি সম্পর্ক? অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটল তোয়াব খানের দুই চোখে।
সম্পর্ক থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। জিজ্ঞেস করছি এই জন্যে যে সে সন্দেহজনক ভাবে বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। কোথায় পায় সে অত টাকা? সন্দেহ হয়, মিসেস রাফিয়াকে সে-ই ব্ল্যাকমেইল করছে না তো?
ইয়াকুব! বিকৃত কণ্ঠে নামটা উচ্চারণ করলেন তোয়াব খান। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন শহীদের দিকে। তারপর আবার বললেন, এসব কি!
শহীদ বলল, কতটুকু জানেন তার সম্পর্কে আপনি?
চুরুট ধরাতে ধরাতে বিরক্তির সাথে বললেন তিনি, কিছুই জানি বলতে পারেন। মাসখানেক বা তার কিছু বেশিদিন হবে চাকরি করছে আমার কাছে। আমাদের বাটলার মোখলেস ওকে নিয়ে এসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে বলেন ইয়াকুব সম্পর্কে?
এখন না। ওর সম্পর্কে আমিই খোঁজ নিচ্ছি। আচ্ছা, চলি। মিসেস রাফিয়ার সন্ধান বা দেখা পেলেই….
অবশ্যই, সাথে সাথে জানাব। প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন শহীদকে। হঠাৎ পিছন থেকে বললেন, অযৌক্তিক আচরণ করার জন্যে আমি লজ্জিত, মি. শহীদ।
করিডরের শেষ মাথায় অপেক্ষা করছিল মোখলেস-বাটলার। নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে লাগল সে শহীদকে দেখতে পেয়েই। কাছাকাছি এসে সবিনয়ে বলল, স্যার, মিস ঋতু আপনার সাথে কথা বলতে চান। আপনি যদি দয়া করে আমার সাথে…।
এত রাতে ঋতু কথা বলতে চায়? কি কথা? চলো।
অপ্রত্যাশিত ব্যাপার, সন্দেহ নেই। ঋতুর সাথে এর আগে দুবার মুখোমুখি হয়েছে ও। অসুস্থ মানসিকতার শিকার মেয়েটা। মোটর অ্যাক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে গেছে বছরখানেক আগে, হাঁটতে পারে না। সারাদিন সারারাত সে এই বাড়ির ভিতর বন্দিনী হয়ে থাকে। একা।
ডিম্বাকৃতি বেডরূমে ঢুকে শহীদ দেখল ঋতু কয়েকটা বালিশের উপর পিঠ এবং মাথা রেখে শুয়ে আছে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, দেহে ভরা যৌবন, কালো, সিল্কের স্লীপিং গাউনে সুন্দর মানিয়েছে। প্রথম দর্শনেই পরিষ্কার বোঝা যায়, ধনীর অভিমানী দুলালী। বালিশে ছড়ানো চুলের মাঝখানে সুন্দর মুখটা তাজা ফুলের মতই সজীব। কিন্তু চোখ দুটোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, মেয়েটি মানসিক অসুখে ভুগছে। তীক্ষ্ণ, ব্যঙ্গাত্মক চাউনি।
খাটের ধারে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। ঋতু নড়লও না, কথাও বলল না। শহীদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে কি যেন খোঁজার বা বোঝার চেষ্টা করছে সে।
শহীদের পিছনে দরজাটা মৃদু শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মোখলেসের পদশব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
পেয়েছেন তাকে? তীক্ষ্ণ, চাপা কণ্ঠস্বর।
শহীদ একটু হাল, ও, এই কথা জানার জন্যে ডেকেছ? না।
ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাবে খোঁজ নেননি?
শহীদ পাল্টা প্রশ্ন করল, ওখানে থাকতে পারে সে তা কে বলল তোমাকে?
হয় ওখানে, নয় সাধন সরকারের বাড়িতে–দুজায়গার কোথাও আছে সে। তার আর যাবার জায়গা কই?
অমন জোর দিয়ে বলছ কিভাবে?
ঠোঁট দুটো বিস্তারিত হলো একদিকে বাঁকা হাসি হেসে বলল ঋতু আবার, তাকে আমি চিনি। কঠিন বিপদে পড়েছে, তাই না?
জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো। তৃপ্তিতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মুখটা।
শহীদ জানতে চাইল, সে বিপদে পড়েছে কিনা জানলে কিভাবে তুমি?
আপনার সহকারীকে খুন করেছে সে। এখনও জানেন না বুঝি?
শহীদ বল, খুন হয়েছে জানি। কিন্তু কাজটা কে করেছে তা এখনও জানি না। তুমি জানো নাকি?
জোর দিয়ে ঋতু বলল, আমি জানি সে টার্গেট প্র্যাকটিস করছিল।
কি ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র?
একটা রিভলভার। কিন্তু তা জেনে কি হবে?
জানলে কিভাবে?
অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল সে, তার প্রতিটি মুভমেন্ট সম্পর্কে খবর রাখি আমি। এ বাড়িতে সে আসার পর থেকে তার ওপর আমি নজর রাখার ব্যবস্থা করেছি।
সন্দেহ নেই ইয়াকুবকে দিয়ে এই কাজ করায় সে, ভাবল শহীদ। বলল, টার্গেট প্র্যাকটিস করাটা অপরাধ নয়। কেউ টার্গেট প্র্যাকটিস করলেই তাকে খুনী মনে করতে হবে নাকি?
তাহলে কেন লুকিয়ে পড়েছে সে? এ বাড়িতে ফিরে আসতে পারছে না সে কিসের ভয়ে? এই বাড়ি, এই বাড়ির ধন-সম্পদ, সম্মান তার কাছে সবচেয়ে বেশি লোভনীয়। সেই লোভ বিসর্জন দিয়ে কেন সে আত্মগোপন করে আছে? নিশ্চয়ই উপযুক্ত কারণ আছে। কারণটা আর কি হতে পারে? সে খুন করেছে–এটাই কারণ।
শহীদ বলল, অন্য কোন কারণও থাকতে পারে। সাধন সরকার সম্পর্কে তুমি কি জানো, ঋতু?
তার প্রেমিক-ওই সাধন সরকার। আমি জানি।
তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে কেউ–তাও জানো তুমি?
ঋতু হাসল আবার ঠোঁট বাকা করে। আমি কথাটা বিশ্বাস করি না।
কিন্তু তোমার ড্যাডি বিশ্বাস করেন।
ড্যাডি তো নিজেকে ধোকা দিচ্ছেন। আমি জানি, রাফিয়া তার প্রেমিককে টাকা দিয়ে সাহায্য করছে।
তোমার ড্যাডি সাধন সরকার সম্পর্কে জানেন?
মাথা নাড়ল ঋতু এদিক ওদিক।
তার বেডরুমের ভিতর একটা সুটকেস পাওয়া গেছে, তাতে চামচ, লাইটার, স্যাণ্ডেল, এইসব ছোটখাট জিনিস পাওয়া গেছে–এ কথা তোমার ড্যাডি বলেছেন তোমাকে?
ড্যাডি বলবেন কেন। আমি জানি। আমারও অনেক জিনিস চুরি করেছে ও। ছ্যাচড়া চোর একটা।
তুমি তাকে দেখতে পারো না, ঘৃণা করো, না?
অস্ফুটে বলল ঋতু, করি।
শহীদ বলল, তার বেডরূমে কেউ শত্রুতা করে জিনিসপত্রসহ সুটকেসটা রেখে আসতে পারে। তুমি কি বলো?
বোকা ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না সে-কথা। সে যে চোর একথা কার জানতে বাকি আছে? এমনকি মোখলেসেরও অনেক জিনিস চুরি গেছে।
ইয়াকুবের কোন জিনিস চুরি যায়নি?
অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল ঋতু, ঝট করে তাকাল শহীদের দিকে। আগুন ঝরতে শুরু করেছে তার দুচোখ থেকে।
গেছে হয়তো।
হয়তো মানে? বলেনি সে তোমাকে কিছু? কিছু চুরি গেলে তোমাকে তো বলতই।
নিজেকে সামলে রাখল সে অতি কষ্টে। বলল, হয়তো মোখলেসকে বলেছে।
ইয়াকুব মিসেস রাফিয়ার শোফার হিসেবেও কাজ করে তাই না?
চেহারা আরও লাল হয়ে উঠল মেয়েটার। বলল, করলেই বা কি?
মিসেস রাফিয়া সুন্দরী কিনা, তাই বলছিলাম।
ঋতু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, বাজে কথা বলবেন না।
কথাটা বলে অন্যদিকে তাকাল আবার ঋতু। কিন্তু পরমুহূর্তে প্রশ্ন করল, তাকে পেলে কি করবেন? পুলিসের হাতে তুলে দেবেন না?
তুমি কি তাই চাও?
আমি কি চাই সেটা প্রশ্ন নয়। পুলিসের হাতে তাকে তুলে দেবেন কি দেবেন না?
শহীদ বলল, এখনও জানি না শিল্পীকে সে খুন করেছে কিনা? সে যদি করে, তবে অবশ্যই দেব।
জানেন না? কেন? জলের মত পরিষ্কার ব্যাপার যে সে খুন করেছে।
মোটিভ কি?
ড্যাডি তাকে প্রচুর সয়-সম্পত্তি দেবেন। উইল অনুযায়ী দুবছর পর অগাধ টাকা এবং সয়-সম্পত্তির মালিক হবে সে। এই ব্যাপারটাই সুন্দর একটা মোটিভ নয়?
তুমি বলতে চাইছ সাধন সরকারের সাথে তার সম্পর্কের কথা তোমার ড্যাডি জানতে পারলে তিনি তাকে ডাইভোর্স করবেন, সম্পত্তি সে পাবে না–এই ভয়ে সে শিল্পীকে খুন করেছে?
শিল্পী জেনে ফেলেছিল তার সাথে সাধন সরকারের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। জলের মত পরিষ্কার মনে হচ্ছে না?
কিন্তু সাধন সরকারেরও প্রচুর টাকা আছে।
প্রচুর কাকে বলেন আপনি? রাফিয়া যা আমার ড্যাডির কাছ থেকে পাবে তা। দিয়ে অমন সাধনকে দশবার কেনা যাবে। তাছাড়া, রাফিয়া সাধনের ওপর। নির্ভরশীল হতে চাইবে না এ তো স্বাভাবিক কথা।
অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে কথাগুলো। সয়-সম্পত্তির প্রতি তার যদি এতই লোভ থাকত তাহলে হত্যাকাণ্ডের পর সে এ বাড়িতেই ফিরে আসত। ফেয়ার ভিউয়ে গিয়ে লাভ হলো কি তার? সম্পত্তি তো সে এই উদ্ভট আচরণের জন্যেই হারাবে।
কোথাও গুরুতর কেনি গোলমাল হয়েছে, তাই যেতে বাধ্য হয়েছে সে। হয়তো…হয়তো কেন, নিঃসন্দেহে বলা যায় শিল্পীকে হত্যা করার সময় দেলোয়ার মোরশেদের চোখে পড়ে যায় সে।
শহীদ এতক্ষণে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল চারদিকের দেয়ালে যে ভারি কাপড়ের পর্দা ঝুলছে তার পিছনে কেউ একজন আত্মগোপন করে আছে। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে কিছুক্ষণ থেকে।
ঋতু, তুমি হাঁটতে পারো না, অথচ কোন খবরই তোমার অজানা নয়। কে তোমাকে সাপ্লাই দেয় খবর?
সরাসরি উত্তর না দিয়ে ঋতু আরও বলল, আমি পঙ্গু বলেই অতিরিক্ত সচেতন থাকি। সাবধান থাকতে হয় আমাকে। সে যাক, যা বললাম ভেবে দেখবেন। আমি এখন ঘুমাব। খুব ক্লান্ত বোধ করছি।
চোখের পাতা বুজে মাথাটা কাত করল সে। কিন্তু সাথে সাথে তাকাল আবার, আমাকে আপনার ধন্যবাদ জানানো উচিত। আপনার সহকারীকে কে হত্যা করেছে তা জানিয়েছি। বাকি কাজটা করা আপনার দায়িত্ব।
আবার চোখ বন্ধ করল সে। চোখ না মেলেই বলল, মোখলেস করিডরে অপেক্ষা করছে। সে আপনাকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি আর কথা বলতে পারছি না।
নিঃশব্দে সোজা হেঁটে ডান পাশের পর্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে ফেলল ও।
কেউ নেই। একটা খোলা জানালা রয়েছে সামনে। উঁকি মেরে অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেলেও দ্রুত একটা পদশব্দ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, শুনতে পেল ও।
ও কি হচ্ছে?
শহীদ দরজার দিকে পা বাড়াল, সন্দেহ মোচনের চেষ্টা হচ্ছিল।
সন্দেহ? কিসের সন্দেহ?
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। মুচকি হেসে বলল, ইয়াকুব। আড়ি পেতে শুনছিল আমাদের কথা।
বিছানায় তড়াক করে উঠে বসল ঋতু। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটার আগেই শহীদ বেরিয়ে এল করিডরে।
দূর প্রান্তে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে মোখলেস। ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার অবতার বলে মনে হলো লোকটাকে শহীদের।
.
০৬.
গাড়ি চালাতে চালাতে মাথার ব্যাণ্ডেজটায় একবার হাত বুলাল শহীদ। ব্যথা করছে ভীষণ।
বাড়িতে নয়, অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নিল ও। নির্জনতা দরকার। চিন্তা ভাবনা করার জন্যে।
গাড়ি থামাল শহীদ রাস্তার উপর। গেট খোলা। খোলা রেখেই বেরিয়েছিল নাকি ও?
হবেও বা। মনে নেই। করিডরে উঠে থমকাল মুহূর্তের জন্যে। কিসের গন্ধ? বারুদের নয়? হ্যাঁ-বারুদের গন্ধ।
দরজাটা বন্ধ না খোলা? পাশে গিয়ে পঁড়াল ও। মৃদু ধাক্কা দিতেই উম্মুক্ত হয়ে গেল কবাট দুটো।
ব্যাপার কি? দরজা তো সে খুলে রেখে যায়নি! কে খুলল? পা টিপে টিপে অন্ধকার রূমে ঢুকল ও। সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সুইচ অন করল, রূমের দিকে তাকিয়ে। কেউ নেই। পাশের রূমে ঢুকে একই পদ্ধতিতে আলো জ্বালল। উজ্জ্বল আলোয় মিসেস রাফিয়াকে প্রথমে দেখতে পেল শহীদ। একটা চেয়ার উন্টে পড়ে আছে সোফার পাশেই। কুঁকড়ে রয়েছে দেহটা সোফার উপর। যেন অতিরিক্ত ক্লান্তিতে সোফার উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কপালের ফুটোটা কুৎসিত, ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। রক্ত এখনও জমাট বাঁধেনি।
.৪৫ কোল্ট পিস্তলটা দেখল শহীদ তারপর। খোলা একটা জানালার নিচে, কার্পেটের উপর।
মৃতদেহটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। মুখটা এতক্ষণে ভাল করে দেখতে পাওয়া গেল। অমন সুন্দর মুখটা রক্তাপ্লুত অবস্থায় কুৎসিত দেখাচ্ছে। চেয়ে থাকতে। পারল না শহীদ। চোখ ফিরিয়ে নেবার সময় ওর সামনের দেয়ালে একটা ছায়া। দেখল শহীদ।
একটা মানুষের ছায়া। মাথায় হ্যাট রয়েছে ছায়াটার। হ্যাঁটের উপর তার ডান হাতটা ভোলা। সেই হাতে ভারি কিছু একটা রয়েছে। হাতটা নেমে আসছে নিচের দিকে।
এক সেকেণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করল শহীদ, কিন্তু পুরোপুরি ঘুরতে পারার আগেই মাথায় আঘাত পেল ও।
তারপর আর কিছু মনে নেই শহীদের।
.
জানালা দিয়ে ডোরের কচি বোদ ঢুকেছে রূমের ভিতর। ফিসফিস করে কথা বলছে। কারা যেন। অন্তত একটা কণ্ঠস্বর পরিচিত ঠেকছে। কিন্তু ঠিক চিনতে পারছে না ও।
মনে পড়ছে ধীরে ধীরে গত রাতের ঘটনা। হ্যাট পরা একজন লোক পিছন থেকে আক্রমণ করেছিল ওকে।
মাথার ব্যথাটা কষ্ট দিচ্ছে ভীষণ। মহুয়াখবর পায়নি সে? কামালই বা কোথায়? সন্ধ্যার পর তাকে নারায়ণগঞ্জে পাঠিয়েছিল ও-রাতেই তো তার ফেরার কথা। নাকি সে-ও সেখানে বিপদে পড়েছে?
মহুয়ার কথাটা আবার মনে পড়ল। সে হয়তো জানেই না ও অফিসে সারারাত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। জানবেই বা কিভাবে, জানবার তো কথা নয় তার।
হ্যাট পরা লোকটা…কে সে? মি. সিম্পসন হ্যাট পরেন। হাসি পেল ওর। মাথাটা ঠিক মত কাজ করছে না। হ্যাট আর কে পরে?
ডি. কস্টা।
ডি. কস্টা বা মি. সিম্পসন ওকে কেন আক্রমণ করবে?
কণ্ঠস্বরটা এতক্ষণে চিনতে পারছে শহীদ। আবার চোখ মেলল ও আধহাত দূরে, কার্পেটের উপর রোদ বিছিয়ে রয়েছে। ইন্সপেক্টর গনি ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছে। জোর গলায় কথা বলছে সে, মি, শহীদ? চোখ মেলে রাখতে পারছেন না, মি. শহীদ? চেয়ে থাকুন, দেখুন আমরা এসেছি, আর কোন ভয় নেইমি. শহীদ!
কিন্তু চোখ মেলে রাখতে পারল না শহীদ। আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল পাতা দুটো।
ইন্সপেক্টরের পদশব্দ সরে গেল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কানে ঢুকল।, সামনের রূমে মেয়েটা কে?
উত্তরে কে যেন কি বলল, শুনতে পেল না শহীদ।
মিসেস রাফিয়া। মনে পড়ে গেল। চোখ মেলল শহীদ। হাত নেড়ে খামচে ধরল কার্পেট। অসহ্য ব্যথায় খসে পড়ে যেতে চাইছে মাথাটা। মিসেস রাফিয়ার মৃতদেহটাসেটা সামনের রূমে গেল কিভাবে? সামনের রূমের কথা বলল কেন ইন্সপেক্টর?
চোখ বন্ধ করল আবার শহীদ। চিন্তা করতে চাইছে না ও। কিন্তু যোতের মত একটার পর একটা বিষয় ধাক্কা মারছে মাথার ভিতর। বাস্তব অবস্থাটা কি? কোল্ট ৪৫ অটোমেটিকটা নিশ্চয়ই পেয়েছে ইন্সপেক্টর। লাশটাও আবিষ্কার করেছে। দুই যোগ দুই-চার।
কি করবে ইন্সপেক্টর গনি? সে কি মিসেস রাফিয়াকে হত্যা করার জন্যে ওর : বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে?
কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি? একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। কোন কিনারা হচ্ছে না। প্রথমে শিল্পী। তারপর দেলোয়ার মোরশেদ। তারপর মিসেস রাফিয়া।
এরপর কে?
ও নিজে? খুনী এবার বুঝি ওকেই খুন করার চেষ্টা চালাবে। চালাবে বলা ভুল-খুন করারই তো চেষ্টা করেছিল ওকে। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছে।
না, তা বোধহয় না। যে আক্রমণ করেছিল সে বোধ হয় শিল্পীর খুনী নয়। ওকে খুন করতে চেয়েছিল বলে মনে হয় না। চাইলে পারত। প্রথম আঘাতেই জ্ঞান হারায় ও। অজ্ঞান কোন লোককে খুন করা তো মশা মারার মতই সহজ। না, লোকটা ওকে খুন করতে চায়নি। তাছাড়া, আর একটা ব্যাপার, পিস্তলটা দেখেছিল ও জানালার ঠিক নিচে-খুনী যদি ওই হ্যাট পরা লোকই হবে, পিস্তলটা ফেলে রাখবে কেন সে?
কি প্রমাণ হচ্ছে তাহলে?
হ্যাট পরা লোকটা মিসেস রাফিয়াকেও খুন করেনি। খুন করেছে আর কেউ। খুনী খুন করে চলে যাবার পর লোকটা ঢোকে এখানে। এমন সময় ও পৌঁছায়। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে লোকটা লুকিয়ে পড়েছিল রূমের কোথাও। ওর চোখে ধরা না পড়ে রূম থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে সে আক্রমণ করে ওকে পিছন থেকে।
কেমন হচ্ছে ব্যাখ্যাটা? নিজেকেই প্রশ্ন করল শহীদ।
মন্দ নয়। মনে হচ্ছে, এটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
হালকা হয়ে গেল মনটা। সেই সাথে যেন মাথার ব্যথাটাও অনেক কমে গেল। চোখ মেলেই ছিল ও, পাশ ফিরল।
কারও দিকে নয়, চোখ পড়ল প্রথমে সোফার উপর।
লাশটা নেই।
মি. শহীদ।
ইন্সপেক্টর গনি ভারি দেহটা নিয়ে দোরগোড়া থেকে প্রায় ছুটে এল। নিজের চেষ্টাতেই উঠে বসল শহীদ। অসুস্থ বোধ করল না ও, মাথাটা ঘুরে উঠবে মনে করেছিল, তা-ও ঘুরল না।
কেমন বোধ করছেন এখন? ইন্সপেক্টরের কণ্ঠে ব্যঙ্গের সুর।
আপনারা কিভাবে খবর পেলেন? প্রশ্ন করল শহীদ।
খবর পাইনি। অন্য একটা কারণে এসেছিলাম। আপনার বাড়িতেই যেতাম, কিন্তু গেট খোলা দেখে ভিতরে ঢুকে আপনার এই অবস্থা দেখি। কি সাংঘাতিক কাণ্ড। কে, মি. শহীদ?
উত্তরটা এড়িয়ে গেল শহীদ। মহুয়া, কামাল–ওদেরকে খবর দেয়া হয়নি?
এইমাত্র এলাম আমরা। একজন কনস্টেবলকে পাঠিয়েছি ডাক্তার আনতে। ওদের কাউকে খবর দিইনি তার কারণ…। চুপ করে আছে ইন্সপেক্টর গনি।
কি কারণ? উঠে দাঁড়াল শহীদ! কাছের একটা চেয়ারে বসে আবার সোফাটার দিকে আড়চোখে তাকাল ও।
লাশ তো নেই-ই। রক্তের ছিটে ফোঁটা দাগও নেই।
ব্যাপার কি? লাশটা কি সত্যিই সামনের রূমে? গেল কিভাবে ওখানে? সোফায় রক্ত নেই কেন?
সবাই এসে ভিড় করলে কথাবার্তায় বিঘ্ন ঘটবে, ইন্সপেক্টর বলল।
সরাসরি তাকাল শহীদ, কিসের কথাবার্তা, ইন্সপেক্টর?
ইন্সপেক্টর এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শহীদের দিকে। খানিক পর বলল, বলব মি. শহীদ। আর একটু সুস্থ হয়ে নিন।
মাথা নিচু করে কিছু ভাবল শহীদ। বুদ্ধি খাঁটিয়ে প্রশ্ন করল একটা, সামনের রূমে একজন ভদ্রমহিলা আছেন, ইন্সপেক্টরঃ
ইন্সপেক্টর গনি চোখ সরায়নি শহীদের দিক থেকে। আরও তীক্ষ্ণ হলো তার দৃষ্টি, হ্যাঁ। কে ওই ভদ্রমহিলা?
শহীদ চুপ করে থাকল। ইন্সপেক্টর গনি কনস্টেবলকে উদ্দেশ করে বলল, ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এসো তো।
শহীদ বলল, না!
ইন্সপেক্টরের ভুরু জোড়া কুঞ্চিত হয়ে উঠল, না মানে? দেখা করতে চান না ভদ্রমহিলার সাথে?
চেয়ে রইল শহীদ ইন্সপেক্টরের দিকে। তার ভাষাটা যেন বোধগম্য হচ্ছে না ওর। মৃত একটা মেয়ের সাথে দেখা করে নাকি কেউ?
এমন সময় দোরগোড়ায় দেখা গেল রীটাকে। হাস্যোজ্জল, চঞ্চল। সকৌতুকে বলে উঠল, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, মি. শহীদ। পুলিসে ছুঁলে আঠারো দুগুণে ছত্রিশ ঘা। কথাবার্তা খুব সাবধানে বলুন।
শহীদ বলল, ও, তুমি।
ইন্সপেক্টর সাথে সাথে প্রশ্ন করল, আপনি কি আর কারও কথা ভেবেছিলেন?
শহীদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মাথার ভিতর সাইক্লোন বইতে শুরু করেছে। রহস্যটা কি? রহস্যটা কি? রহস্যটা কি? মৃতদেহটা কোথায়? কোথায়? লাশের কথা তুলছেন না কেন ইন্সপেক্টর? কেন?
কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
টলতে টলতে সামনের রূমে যাবার দরজার দিকে এগোতে শুরু করেছে। শহীদ।
চেয়ে আছে সবাই।
শহীদ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল সামনের রূমটা।
নেই।
লাশ নেই, রক্ত নেই–কিছুই নেই।
ফিরে এল শহীদ। বসল চেয়ারে। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। চেয়ারে হাতল নেই, কিন্তু আছে মনে করে আঁকড়ে ধরার জন্যে হাতড়াতে শুরু করল ও।
ছুটে এল রীটা। ইন্সপেক্টর গনি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ত্যাগ করলেন, মিস্টিরিয়াস। ব্যাপারটা বুঝলাম না!
আবার জ্ঞান হারাল শহীদ।
.
০৭.
পনেরো মিনিট পর চোখ মেলে কামালও ডাক্তার আসাদুজ্জামান, নতুনদের মধ্যে এদেরকে দেখতে পেল শহীদ।
নড়েচড়ে সিধে হয়ে উঠে বসল ও সোফার উপর। জ্ঞান হারাবার পর চেয়ার থেকে সোফায় শুইয়ে দেয়া হয়েছিল ওকে।
কেউ কথা বলল না। কিন্তু প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল শহীদ হাজার হাজার প্রশ্ন মাথা খুঁড়ে মরছে প্রত্যেকের বুকে।
ডাক্তার আসাদুজ্জামান এগিয়ে এসে বললেন, মোটেই মারাত্মক আঘাত নয়। খুলি ফাটেনি, উপরের চামড়া কেটে গেছে মাত্র দুজায়গায়। দুটো ইঞ্জেকশন, দিয়েছি। আর দুটো বিকেলের দিকে নিতে হবে। আর কিছু ক্যাপসুল খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ, ডাক্তার।
ছোট একটা শিশি বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার ওর দিকে, এই ব্র্যাণ্ডিটুকু এ ঢেকে গিলে ফেলুন। হাঁটাচলা করার শক্তি পাবেন।
নির্দেশ পালন করল শহীদ। খালি শিশিটা ছুঁড়ে দিল ও কামালের দিকে কামাল সেটা লুফে নিল।
কিরে! খুব ভয় পেয়েছিস, না?
কামালের উদ্দেশে কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল শহীদ। বলল, হাত-মুখ ধোব বাথরূমে ঢুকছি আমি। ইন্সপেক্টর, আপনি কি খুব ব্যস্ত? ব্যস্ততা না থাকলে অপেক্ষ করুন।
ইন্সপেক্টর গনি এতক্ষণ নিঃশব্দে বসেছিল, একটাও কথা বলেনি। শহীদে প্রশ্নের উত্তরেও মৌনতা বজায় রাখল। অবাক চোখে শহীদকে সারাক্ষণ দেখছে সে।
সংলগ্ন বাথরূমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল শহীদ। কাপড়-চোপড় খোলা আগে রিস্টওয়াচটা চোখের সামনে তুলল ও। নয়টা বেজে বিশ মিনিট হয়েছে। অফিসে ঢুকেছিল ও রাত তিনটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। মিসেস রাফিয়া খুন হয়েছি বড়জোর পনেরো মিনিট আগে–অর্থাৎ সাড়ে তিনটের সময়। ছয় ঘন্টা অতিক্রা হয়ে গেছে। প্রায় সবটুকু সময় অজ্ঞান হয়ে ছিল ও।
মৃতদেহটা নেই। ঝট করে এদিক ওদিক তাকাল ও। না, বাথরূমেও নেই মৃতদেহ। অফিসের কোথাও আছে? সকলের চোখের আড়ালে? টেবিলের নিচে সোফার তলায়, কিংবা আলমারির ভিতর?
না। তা সম্ভব নয়। ইন্সপেক্টর গনি সন্ধান নিয়েছে। ওকে অজ্ঞান অবস্থা দেখার পর সে সার্চ করেছে গোটা অফিস–কোন সন্দেহ নেই,
যে সোফার উপর লাশটা ছিল সেই সোফার হালকা বাদামী রঙের কভারট নেই।
লাশটা কেউ সরিয়ে নিয়ে গেছে। কেন? কেই বা?
মাথার ভিতর চিন্তার জাল তৈরি হচ্ছে অনবরত।
কেন? খুনী কি বদ্ধ উন্মাদ? সে যদি লাশ এবং পিস্তলটা ফেলে রেখে যেত সম্পূর্ণ সন্দেহটা পড়ত ওর উপর।
কিংবা, এমনও হতে পারে, মৃতদেহটা খুনী নিয়ে যায়নি। অন্য কেউ নির গেছে। রীটা:গোমেজ? ওকে পুলিসের জেরার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সরিয়ে ফেলেনি তো লাশটা? তার নার্ভ খুব শক্ত। এই ধরনের কাজ তার পক্ষে করা একেবারে অম্ভব নয়। কিন্তু নাহ! কষ্ট-কল্পনা হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।
কে তাহলে?
মুখহাত ধুতে ধুতে বারবার সেই একই প্রশ্ন করতে লাগল শহীদ-কে? কে তাহলে? সেই হ্যাট পরা লোকটা? খুনী স্বয়ং?
পনেরো মিনিট পর বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল শহীদ।
সোফায় বসল ও।
কেউ কোন শব্দ করছে না। কামাল গালে হাত দিয়ে বসে আছে, চিন্তামগ্ন সে। ইন্সপেক্টর চোখ ফেরাচ্ছে না শহীদের দিক থেকে। চাপা একটা উত্তেজনার ভাব ফুটে আছে তার চেহারায়।
রীটা একটা ম্যাগাজিন খুলে মাথা নিচু করে পড়বার ভান করছে।
ডাক্তার বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। সামনের রূমে সাব-ইন্সপেক্টর উসখুস করছে একা একা। প্রায়ই উঁকি মেরে ভিতরের পরিবেশটা আঁচ করার চেষ্টা করছে সে।
রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আড়চোখে ইন্সপেক্টর গনিকে দেখে নিল শহীদ।
ক্রিং ক্রিং
হাত বাড়াল শহীদ রিসিভারের দিকে।
সপ্রশ্ন দৃষ্টি সকলের চোখে।
শহীদ খান স্পিকিং।
ছয় কি সাত সেকেণ্ড অপর প্রান্তের বক্তার বক্তব্য শুনল শহীদ। হাত থেকে ধসে পড়ে গেল রিসিভারটা। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও কার্পেটের উপর পড়ে যাওয়া রিসিভারটার দিকে।
শহীদ! তড়াক করে উঠে দাঁড়াল কামাল, পায়ের ধাক্কা লেগে সশব্দে পড়ে গেল চেয়ারটা। দ্রুত এগোল সে। কি হলো? কে ফোন করেছে? রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাল কামাল, কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বুঝতে পারল সে।
জামান জামান…। শহীদ উচ্চারণ করতে পারছে না কথাটা।
ইন্সপেক্টর গনি উঠে দাঁড়াল। নাটায় ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, হ্যাঁ, মি. শহীদ। জামান খুন হয়েছে। সেই খবর দেবার জন্যেই এসেছিলাম আমরা। কিন্তু ফোনে কে বলল আপনাকে কথাটা?
উঠে দাঁড়াল রীটা গোমেজ। তার কোল থেকে পড়ে গেল ম্যাগাজিনটা।
কুয়াশা, বলল শহীদ।
ইন্সপেক্টর বলল, ঠিকই সন্দেহ করেছি আমি। কুয়াশা তাহলে সব খবরই রাখছে। সে-ও কি এই সব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত, মি. শহীদ?
উত্তর দিল না শহীদ।
কামাল বলল, না, ইন্সপেক্টর।
কি করছিল জামান চট্টগ্রামে? কেন গিয়েছিল সে? চট্টগ্রামের পুলিস সুপার ফোন করে জানতে চেয়েছেন আমার কাছ থেকে।
ভাঙা গলায় শহীদ বলল, কিভাবে খুন হয়েছে সে, ইন্সপেক্টর?
কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে তার লাশ। হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। গতরাত দশটার সময় নিহত হয়েছে সে, চট্টগ্রাম পুলিসের ধারণা। লাশ দেখতে চাইলে আপনারা যেতে পারেন।
.
আধঘণ্টা পর গম্ভীর থমথমে মুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল ইন্সপেক্টর গনি তার দলবল নিয়ে।
কামাল।
নিঃশব্দে শহীদের সামনে এসে দাঁড়াল কামাল।
টিকেটের ব্যবস্থা কর। দুটো। আমরা নেক্সট ফ্লাইটেই যাচ্ছি চট্টগ্রামে!
কামাল চেয়ে রইল শহীদের দিকে।
যা তুই, বলল শহীদ।
বেরিয়ে গেল কামাল।
খোলা দরজা পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শহীদ বলল, এবার বলো, রীটা অত সকালে কেন এসেছিলে তুমি অফিসে?
ফোন করেছিলাম প্রথমে। কিন্তু কেউ ধরেনি রিসিভার। ফোন করেছিলাম কারণ, গতরাতে আপনি তোয়াব খানের কাছ থেকে নিরাপদে ফিরে এসেছেন কিনা জানতে চেয়েছিলাম।
বাড়ির নাম্বারে ফোন করোনি কেন?
রীটা গোমেজ বলল, বাড়ির নাম্বার জানা থাকলে তো!
শহীদ চুপ করে থেকে একটু পর বলল, হু। তারপর?
কেউ রিসিভার ধরছে না দেখে মনটা কেমন যেন করে উঠল। দেরি না করে তখুনি রওনা হয়ে গেলাম। আপনি রূমের কার্পেটের উপর পড়ে ছিলেন অজ্ঞান হয়ে। আলো জ্বলছিল। কি করব ভাবছিলাম, এমন সময় ইন্সপেক্টর আসেন।
তুমি কাউকে দেখোনি এখানে এসে?
ছিল না কেউ-কাকে দেখব? ঘটেছিল কি আসলে?
শহীদ বলল, কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমি ঢুকতেই–আক্রমণ করে পিছন দিক থেকে।
পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে সোফায় হেলান দিল রীটা গোমেজ, ঘটনাটাকে আপনি খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন–যেন কিছুই হয়নি।
উঠে দাঁড়িয়ে পাশের কামরার দিকে এগোল শহীদ।
কোথাও যাচ্ছেন?
উত্তর দিল না শহীদ। পাশের কামরায় ঢুকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে লাগল।
খানিকপর ফিরে এল আবার মাঝের রূমে। এটা সেটা দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারপর নিজের চেম্বারে ঢুকল।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল পাঁচ মিনিট পর। সব কিছু ঠিক ঠাক আছে। একটা জিনিসও এদিক ওদিক হয়নি। মিসেস রাফিয়া যে এখানে ছিল তার কোন প্রমাণ নেই। সোফার বাদামী রঙের কভারটা যদি থাকত, নিজেরই সন্দেহ হত ও দুঃস্বপ্ন দেখেছে ওর মৃতদেহ দেখেনি।
কিন্তু কভারটা নেই।
রীটা চেয়ে আছে ওর দিকে সারাক্ষণ, কি হয়েছে আপনার? কিছু খুঁজছেন মনে হচ্ছে?
শহীদ মাথা নাড়ল সম্মতি সূচক।
কি?
শহীদ অস্ফুটে বলল, নিজেই জানি না।
রীটা গোমেজকে উদ্বিগ্ন দেখাল। মি. শহীদ, আপনার উচিত বিছানায় শুয়ে কদিন বিশ্রাম নেয়া।
না, সংক্ষেপে বলল শহীদ। তারপর তাকাল সরাসরি রীটার দিকে, আর কোন কাজ নেই তোমার?
আসন ত্যাগ করল রীটা। মিষ্টি করে হাসল। বলল, কাজ দিয়েছেন কিছু? যাও, ইয়াকুব সম্পর্কে যথা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করো।
উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। আর কিছু? মিসেস রাফিয়ার খোঁজ করব না? তাকে তো আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।
শহীদ বলল, না। তাকে আমাদের আর দরকার নেই।
তারমানে? কি বলছেন…মানে
ঠিকই বলছি। তার আর কোন মানেও নেই।
.
০৮.
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। খানিক আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু সে বৃষ্টিধারা নেমেছিল খণ্ড মেঘমালা থেকে। আকাশের অধিকাংশটাই এখন ঢেকে ফেলেছে কালো মেঘের একখণ্ড ভারি চাদর।
প্লেনের চাকা চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের টারমাক স্পর্শ করল সকাল আটটায়।
এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল ওরা। কামাল ড্রাইভারকে গন্তব্যস্থান সম্পর্কে নির্দেশ দিল।
ব্যাকসীটে বসল ওরা। দুইজন দুই দিকের জানালার ধারে। মাঝখানে শূন্যতা। দুজনেই যার যার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে।
কথা বলার উৎসাহ নেই কারও মধ্যে।
ঢাকায় থাকতেই মিসেস রাফিয়ার মৃতদেহ সম্পর্কে শহীদ বলেছে কামাল এবং মহুয়াকে। সব শুনে দুজনেই এমন ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল দীর্ঘক্ষণ যে শহীদ বুঝতে পেরেছিল ওরা ওকে পাগল ভাবছে। তারপর আবার একবার সবাই মিলে তন্ন তন্ন করে চারদিক পরীক্ষা করে। কি খুঁজছিল ওরাই জানে। সম্ভবত, মিসেস রাফিয়া অফিসে ছিল তার কোন প্রমাণ বা চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা দেখছিল ওরা। পাওয়া যায়নি।
সোফার কভারটা নেই। এটা স্বীকার করেছিল ওরা।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চিন্তা করছে শহীদ। কামালের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। কামালের ধারণা শিল্পী, দেলোয়ার মোরশেদ এবং মিসেস রাফিয়ার নিহত হওয়ার সাথে জামানের নিহত হবার কোন সম্পর্ক নেই।
আপাতঃদৃষ্টিতে তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বর্তমান কেসে যে সব চরিত্র প্রকাশ্যভাবে জড়িত তারা সবাই ঢাকায় রয়েছে। ঢাকায় রয়েছে মোহাম্মদ তোয়াব খান, তাঁর মেয়ে ঋতু, তাঁর গার্ড ইয়াকুব। ঢাকায় রয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন, সৌখিন যুবক সাধন সরকার, ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাবের মালিক কাজী হানিফ। আরও একজন ঢাকায় আছে। তার নাম জানা নেই, পরিচয় জানা নেই। হ্যাট পরা সেই লোকটাকে সে? যেই হোক, সেও একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বর্তমানে সেই সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র। সে-ও রয়েছে ঢাকায়।
মোটকথা শহীদ ব্যাখ্যা করে বলতে না পারলেও ওর মন বলছে জামানের নিহত হবার সাথে বর্তমান কেসের সরাসরি যোগাযোগ আছে। যে রহস্যের শিকার হয়েছে শিল্পী, দেলোয়ার মোরশেদ, মিসেস রাফিয়া, সেই একই রহস্যের শিকার জামানও।
জামান কাজ নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রামে। গতকাল সাড়ে চারটের সময় পৌঁছয় ও। রাত একটার সময় কর্ণফুলী নদীতে ওর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেডিক্যাল রিপোর্ট বলছে অন্তত চার ঘণ্টা আগে নিহত হয়েছে ও। অর্থাৎ চট্টগ্রামে পৌঁছুবার প্রায় চার ঘণ্টা পর খুন হয়েছে ও।
এই চার ঘণ্টায় কি কি করেছিল জামান? ওকে পাঠানো হয়েছিল মিসেস রাফিয়ার অতীত জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে। জোয়ারদার ফটোগ্রাফার-এর সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল ওকে। সাধন সরকারের বাড়ি থেকে মিসেস রাফিয়ার যে ছবিটা শহীদ উদ্ধার করে সেটার পিছনে জোয়ারদার ফটোগ্রাফার-এর নাম ঠিকানা ছিল। ছবিতে মিসেস রাফিয়াকে অর্ধ নয় দেখাচ্ছিল। টু-পীস বিকিনি পরে ছবি তোলে সে। অমন একটা ছবি অপরিচিত কাউকে দিয়ে তোলানো কোন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, শহীদের মনে হয়েছিল। জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস-এর মালিক বা ফটোগ্রাফারের সাথে মিসেস রাফিয়ার ঘনিষ্ঠতা না থেকে পারে না। এই কথা ভেবেই শহীদ জামানকে পাঠিয়েছিল চট্টগ্রামে।
ঢাকা থেকে কি কেউ অনুসরণ করেছিল জামানকে? নটার দিকে নিহত হয়েছে ও-খুনী তাকে খুন করে পরবর্তী ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে যেতে পারে, ফিরে গিয়ে মিসেস রাফিয়াকে খুন করতে পারে।
উদ্ভট হয়ে উঠছে চিন্তাগুলো? নিজেকেই প্রশ্ন করল শহীদ।
পুলিস হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি চলে এসেছে ট্যাক্সি।
কথা যা বলার আমিই বলব, বলল শহীদ। ট্যাক্সি হেডকোয়ার্টারের ভিতর ঢুকল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এগোল ওরা। করিডরে ওদের মুখোমুখি হলো একজন সাব-ইন্সপেক্টর। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল সে।
মি. শহীদ! পৌঁছে গেছেন আপনারা? আসুন, স্যার, আমার সাথে আসুন।
চিনতে পারল না শহীদ সাব-ইন্সপেক্টরকে। চিনতে পারার কথাও নয়। এ লোককে আগে কখনও দেখেনি ও। সাব-ইন্সপেক্টরও ওকে সশরীরে দেখেনি কখনও। ওর ছবি দেখেছে অসংখ্যবার খবরের কাগজে, তাই চিনতে ভুল করেনি।
অফিসে গিয়ে বসল ওরা। মুখোমুখি বসা লোকটা ঘড়ঘড়ে গলায় কাশল কয়েকবার। রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। বলল, স্যার, এমন দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে, দিয়ে আপনার সাথে পরিচয় হবে ভাবিনি। আপনার সুনাম-সুখ্যাতি শুনে শুনে
শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর, ডেডবডি কোথায় তাই বলুন।
জ্বী? জ্বী হ্যাঁ। ডেডবডি-মর্গে। আমি ইন্সপেক্টর চেরাগ আলী খান, স্যার। নিহত ভদ্রলোক আপনার কে, স্যার?
সহকারী।
ইন্সপেক্টর চেরাগ আলী খান মাথা দোলাল, জ্বী। জ্বী হ্যাঁ। সহকারীর নামটা,
জামান চৌধুরী।
জী। জী হ্যাঁ, ডেডবডি সনাক্ত করতে যেতে হবে, স্যার।
বহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভারি তার দেহটা। অতিকষ্টে চেয়ার ছেড়ে উঠল, জ্বী। জ্বী হ্যাঁ, চলুন।
ভদ্রলোকের মুদ্রাদোষ ওটা। হাসি পাবার কথা, কিন্তু শহীদ বা কামালের হাসি পেল না। অনুসরণ করল, ওরা তাকে। সামনে শুধু তার দেহটাই দেখা যাচ্ছে, বাকি সব আড়ালে। চলমান পাহাড় একটা।
করিডর ধরে এগোল ওরা। সিঁড়ির ধাপ কটা টপকাল। তারপর উঠন। এক প্রান্তে লাল ইটের উঁচু ছাদের ঘর। ভিতরে ঢুকে একটি মাত্র বৈড় দেখতে পেল ওরা। বেডের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে কেউ। চাদর দিয়ে ঢাকা তার আপাদমস্তক। অ্যাটেনড্যান্ট লোকটাকে হুকুম দিল ইন্সপেক্টর।
মুখের চাদর সরাল সে।
জী? জী হ্যাঁ। চিনতে পারেন, স্যার?
জামানই। মাথা ঝকাল শহীদ। চোখ ফিরিয়ে নিল ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে, পা, বাড়াল দরজার দিকে। ভেজা চোখে নতমস্তকে ওকে অনুসরণ করল কামাল।
.
সস্তাদরের, নিম্ন শ্রেণীর হোটেল। ওয়েটার বা বেয়ারাদের ইউনিফর্ম নেই। যে লোকটা ওদেরকে পথ দেখিয়ে উপর তলায় নিয়ে গেল, মধ্য বয়স্ক, বেঢপ প্যান্ট পরনে। লোকটার হাঁটার ভঙ্গি হাস্যকর। পিঠটা একবার ডান দিকে কাত হয়ে যায়, একবার বা দিকে। কোমরটাও অদ্ভুতভাবে দুলতে থাকে। লোকটা যেন নেচে নেচে হাঁটে।
হোটেলে ঢোকার সময় ঘোর আপত্তি তুলেছিল কামাল, এই হোটেলে! তোর কি মাথা খারাপ হলো?
কথা বলেনি শহীদ, থামেওনি। অগত্যা চুপ করে গিয়েছিল কামাল। শহীদ চুপ করে থাকলে এক কথা দুবার বলবার সাহস হয় না তার। মাঝে মাঝে, সে জানে, শহীদ এমন ব্যাখ্যাহীন উদ্ভট কাণ্ড করে। গত কদিন থেকে তো চরমে উঠেছে ব্যাপারটা। এই রকম অবস্থায় আর যাই হোক, শহীদকে ঘটাতে নেই। কামাল এতদিনে এটা ভাল করেই জেনেছে।
একটাই রূম। মাঝারি আকারের। দুপাশে দুটো বিছানা। টেবিল একটাই, চেয়ার দুটো। একটা মামকাওয়াস্তে ড্রেসিং টেবিলও আছে, ভাঙাচোরা। আয়নাটা ঝাপসা হয়ে গেছে, সামনে দাঁড়ালে অন্যরকম, অপরিচিত কারও, ভাঙাচোরা চেহারা প্রতিফলিত হয়। তবে অনেকগুলো, জানালা। মোট পাঁচটা। একটা জানালার সামনে দাঁড়ালে বাইরের রাস্তাটা দেখা যায় নিচেই।
তোমার নাম কি?
ঘন্টা মিয়া, স্যার।
কামাল বিছানায় বসল, চা দাও দুকাপ।
গোছল করবেন না, স্যার? ওই দরজাটা, ওটাই গোছলখানা।
কামাল হাত নেড়ে বিদায় হতে বলল।
হোটেলটা পছন্দ হয়নি তোর, না? এই প্রথম কথা বলল শহীদ থানা হেডকোয়ার্টার থেকে বেরুবার পর।
না। কেন যে তুই এই রকম পচা একটা হোটেলে উঠলি–কেন বল তো?
উত্তর না দিয়ে পাইপে টোবাকো ভরল শহীদ। আগুন ধরিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল পাইপ। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল, রাস্তার দিকের জানালার সামনে, এদিকে আয়, দেখে যা।
পাশে গিয়ে দাঁড়াল কামাল। দেখার জন্যে ডাকল শহীদ, কিন্তু দেখিয়ে দিল না।
কি রে? প্রশ্নটা করার পর ব্যাপারটা ধরা পড়ল কামালের চোখে।
ও-ও, তাই বল! শহীদের দিকে উজ্জল মুখে তাকাল কামাল। তারপর আবার চোখ ফেরাল বাইরের দিকে।
নিচে রাস্তা। গাড়ি-ঘোড়া চলছে, লোকজন হাঁটছে। রাস্তার ওপারে পাশাপাশি কয়েকটা দোকান। তারপর একটা বাড়ির উঁচু পাঁচিল। তারপর আর একটা দোকান।
দোকান না, স্টুডিও। লাল এবং হলুদ রঙের সাইনবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে স্টুডিওর মাথায়। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে–জোয়ারদার ফটোগ্রাফারস!
দেখতে পাচ্ছিস? ওখান থেকেই তদন্ত শুরু করেছিল জামান। অন্তত তাই করার কথা ছিল।
কামাল বলল, জামান মিসেস রাফিয়ার ছবিটা সাথে করে এনেছিল, না?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমি একটা কপি তৈরি করে রেখেছিলাম, এনেছি সেটা। সুটকেসে আছে। কামাল, আমরা শুধু জামানের লাশ সনাক্ত করতেই আসিনি। ছবিটা দেখিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেও এসেছি।
আমাদের প্রথম পদক্ষেপ কি হবে তাহলে?
শহীদ বলল, এখন তো স্টুডিওটা বন্ধ। খুলুক। আমি স্টুডিওর মালিকের সাথে দেখা করব। কি যে ঘটবে জানি না–কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবেই। স্টুডিওতে ঢুকব আমরা স্বাভাবিক ভাবে নয়, কৌশল খাঁটিয়ে। মালিকের সাথে হয়তো কিছুটা রাফ ব্যবহার করব আমরা।
ঘণ্টা মিয়া দরজার বাইরে থেকে খুক করে অকারণেই কাশল একবার, তারপর কবাট ঠেলে ভিতরে ঢুকল। ট্রে থেকে চায়ের কাপ দুটো টেবিলে নামিয়ে রাখল সে।
জানালার কাছ থেকে শহীদ ফিরে এল, বসল চেয়ারে। কতদিন ধরে আহ তুমি এখানে?
ঘণ্টা মিয়া দুই হাত তুলে দশটা আঙুল দেখাল, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ-পুরো দশ বছর, স্যার। একটা একটা করে আঙুল গুনে বলল সে।
পকেট থেকে দশ টাকার একটা কড়কড়ে নোট বের করে শহীদ বাড়িয়ে দিল। যাও তো একটা ম্যাচ কিনে নিয়ে এসো?
দশ টাকার নোট ভাঙিয়ে পঁচিশ পয়সা দিয়ে, স্যার?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। বাকি নয় টাকা পঁচাত্তর পয়সা তোমার-বকশিশ!
বাকস্ফূর্তি হলো না ঘণ্টা মিয়ার। বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইল।
ধমক লাগাল কামাল, দাঁড়িয়ে রইলে যে? যাও।
যাই, স্যার। ছুটে পালিয়ে যাবার ভঙ্গিতে চলে গেল ঘণ্টা মিয়া।
কামাল বলল, দশ বছর ধরে আছে, তার মানে এই নয় যে ও স্টুডিওটা সম্পর্কে সব খবর রাখে।
রাখতেও পারে। হোটেলের গেটের মুখোমুখি ওটা। খবর শুধু নয়, নাড়ি নক্ষত্র সবই জানার কথা ওর। চেষ্টা করে দেখাই যাক না।
ফিরে এল ঘণ্টা মিয়া, স্যার, টাকাগুলো কি…।
হ্যাঁ। পকেটে রাখো। আচ্ছা, ঘন্টা মিয়া, দেখো তো এই ফটোর লোকটাকে তুমি কখনও দেখেছ কিনা? পকেট থেকে দুটো ফটো বের করে একটা বাড়িয়ে দিল শহীদ। সেটা নেবার জন্যে হাত না বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল ঘণ্টা যিয়ী, দেখতে লাগল জামানের ফটোটা। সতর্ক সাবধানী হয়ে গেল তার চোখের দৃষ্টি। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, স্যার, আপনারা পুলিস!
পকেট থেকে নয়টা এক টাকার নোট এবং খুচরো পঁচাত্তরটি পয়সা বের করে সে শহীদের দিকে বাড়িয়ে দিল। ভুল করেছি, স্যার, ক্ষেমা করুন। এই নিন, বাকি টাকা পয়সা।
কেন? ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন? বকশিশ নাও না তুমি?
আপনারা পুলিস, স্যার। আপনাদের কাছ থেকে বকশিশ–না, স্যার।
শহীদ বলল, আমাদেরকে পুলিস বলে মনে হচ্ছে বুঝি? নাকি নাটক করছ?
বোকার মত চেয়ে রইল ঘন্টা মিয়া।
পুলিস নই, আমরা এই লোকের বন্ধু।
আপনাদের বন্ধু? উনি তত খুন হয়েছেন, স্যার? খোদার কসম বলছি স্যার, আমি কিছু জানি না, আপনারা খামকা আমাকে জড়াচ্ছেন…।
শহীদ বলল, এক নম্বর বোকা তুমি। তুমি কেন খুনের সাথে জড়িত হবে? সে কথা বলেছি আমরা? রাখো, টাকা-পয়সা পকেটে রাখো। ভয় পাবার কোন দরকার নেই, বুঝলে? আমরা তোমার কাছ থেকে কয়েকটা খবর চাই শুধু। জানলে বলবে, না জানলে বলবে না। তেমন খবর দিতে পারলে তোমাকে আমরা আরও টাকা দেব।
সত্যি আপনারা পুলিস নন তো, স্যার?
পুলিসরা তদন্ত করতে এসে হোটেলে রুম ভাড়া নেয়? কখনও শুনেছ?
না, স্যার। আপনারা…না, পুলিস বলে মনে হচ্ছে না, স্যার। পুলিসরা খাকি পোশাক পরে থাকে। সকাল বেলা এসেছিলেন তেনারা।
পুলিস এসেছিল কেন?
ঘণ্টা মিয়া বলল, আপনাদের ওই বন্ধু সম্পর্কে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে। আপনাদের বন্ধু তো এই হোটেলেই উঠেছিল। এই যাহ! সব্বেনাশ! তওবা তওবা…।
নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারল ঘণ্টা মিয়া। উন্মাদের মত মাথা, দোলাতে লাগল সে, যেন ঘোরতর কোন অন্যায় ঘটিয়ে ফেলে অনুতাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে।
কি হলো তোমার? অমন করছ কেন।
ঘণ্টা মিয়া কাঁদ কাঁদ মুখে বলল, স্যার, চাকরিটা গেল আমার। পুলিস আপনাদের বন্ধুর একটা ছবি নিয়ে এসেছিলেন। লাশের ছবি। কিন্তু ম্যানেজার পুলিসী ঝামেলা এড়াবার জন্যে তেনাদেরকে বলেছেন, ওই ভদ্রলোককে তিনি চেনেন না, এই হোটেলে ওই চেহারার কোন ভদ্রলোক ছিল না! অথচ আমি বলে ফেললাম…।
শহীদ এবং কামাল দৃষ্টি বিনিময় করল।
শহীদ বলল, তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা কথাটা কাউকে বলতে যাচ্ছি না। তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছ।
ঘণ্টা মিয়া ঘন ঘন ঢোক গিলে বলল, আমার চাকরিটা খাবেন না, স্যার! স্যার মা-বাপ
শহীদ পকেট থেকে দশ টাকার আর একটা নোট বের করল। বলল, এটাও রাখো পকেটে। এবার কাজের কথা হোক, কেমন? শোনো, এই লোক আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কেউ তাকে খুন করে, হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে দিয়েছিল কর্ণফুলীতে। আমরা তার খুন হওয়ার কারণ খুঁজছি। এ সম্বন্ধে জানো তুমি কিছু?
না, স্যার, আমি কিছু জানি না।
আমাদের বন্ধুর নাম জামান। সে কোন ব্যাগ রেখে বেরিয়েছিল কিনা জানো?
ঘণ্টা মিয়া তাকিয়ে রইল।
ধমকে উঠল কামাল, উত্তর দাও!
হ্যাঁ, স্যার। ম্যানেজারের কাছে আছে সেটা সরিয়ে রেখেছেন তিনি।
আনতে পারবে সেটা? কাউকে না জানিয়ে?
ঘণ্টা মিয়া ইতস্তত করল, তারপর বলল, ধরা পড়লে?
আমরা আছি। পারবে?
তা পারব, স্যার।
যাও। নিয়ে এসো ব্যাগটা।
ঘণ্টা মিয়া নাচুনে ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল রূম থেকে।
কামাল জিজ্ঞেস করল, তুই কি অনুমান করেছিলি জামান এই হোটেলেই উঠেছিল?
শহীদ অন্যমনস্কভারে বলল, হ্যাঁ।
কিভাবে জানলি?
শহীদ তাকাল মুখ ফিরিয়ে কামালের দিকে, আমরা যে কারণে এই হোটেলে উঠেছি জামানও সেই একই কারণে এই হোটেলে উঠেছিল।
কামাল স্বীকার করল, হ্যাঁ, তাই হবে। আচ্ছা, ঘণ্টা মিয়া কি মিসেস রাফিয়ার ছবি দেখে কিছু বলতে পারবে বলে মনে করিস?
কি ঘটে দেখা যাক।
একটা এয়ার ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে ভিতরে ঢুকল ঘণ্টা মিয়া, স্যার, এটা কিন্তু আবার রেখে আসতে হবে।
কেউ কোন কথা বলল না। কামাল ব্যাগটা ঘণ্টা মিয়ার কাছ থেকে নিয়ে খুলে ফেলল।
বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না জামানের ব্যাগে। কটা বই, ম্যাগাজিন, এক বোতল হুইস্কি, কিছু কাপড়চোপড়- ব্যস। মিসেস রাফিয়ার ছবি কিন্তু পাওয়া গেল না।
ব্যাগটা বন্ধ করে কামাল বলল, নিয়ে যাও।
শহীদ বাধা দিল, এক মিনিট, দেখো তো এই মেয়েটির ফটোটা-চিনতে পারো?
ঝুঁকে পড়ে শহীদের হাতে ধরা মিসেস রাফিয়ার ছবিটা দেখল ঘণ্টা মিয়া। হায় খোদা! এ যে দেখছি সুলতানা। স্যার-না, ভুল হচ্ছে না, এ-সুলতানাই!
শহীদ বলল, কে এই সুলতানা? কিভাবে চেনো একে? কোথায় পাব একে বলতে পারো?
ঘন্টা মিয়া বলল, কোথায় পাবেন তা জানি না, স্যার। কয়েক মাস থেকে: আর দেখি না তাকে ফ্রেণ্ডশীপ ক্লাবে। মেয়েটা খুব নাম করেছিল। কিন্তু কোথায় যে চলে গেল, জানিও না!
ফ্রেণ্ডশীপ ক্লাব মানে?
ঘন্টা মিয়া আকাশ থেকে পড়ল, ফ্রেণ্ডশীপ ক্লাব চেনেন না, স্যার? বলেন কি! ফ্রেণ্ডশীপ নাইট ক্লাব-সবাই চেনে। আমি আগে প্রায়ই যেতাম। ওখানে আমার এক দোস্ত ছিল। তার কাছে যেতাম চাকরির তদবির করতে। হলো না, স্যার ম্যানেজার বলে কি, আমি নাকি বুড়ো, বুড়োর চাকরি ওখানে হবে না
শহীদ এবং কামাল দৃষ্টি বিনিময় করল।
এর নাম সুলতানা বলছ তুমি। চিনতে ভুল করছ না তো?
ঘণ্টা মিয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসতে লাগল, না, স্যার! সুলতানার নাচ যে দেখেছে সে বিশ বছর পরও ভুলবে না। রাফিয়া সুলতানা–শহরের কে না তাকে চিনতো?
Leave a Reply