কুয়াশা ৬১ – ভলিউম ২১
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯৭৭
০১.
ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশন। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত একটি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান। এটা ব্যবসায়িক কোন প্রতিষ্ঠান নয়। এই প্রতিষ্ঠান তার ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সাধারণত কোন ফী গ্রহণ করে না।
অফিসটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে চারজন নতুন সহকারী। তাদের মধ্যে তিনজন তরুণ, একজন তরুণী। শহীদ খানের ডান হাত কামাল আহমেদ এদের চারজনের বস্।
পার্টেক্সের পার্টিশন দিয়ে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা রূমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি চারটে রূম। একটি রিসেপশন, সেখানে বসে রিসেপশনিস্ট শিল্পী। বাকি তিনটিতে বসে জামান, আসাদ এবং রহমান। আসাদ এবং রহমানের রূম দুটো এখন খালি। জরুরী কাজে ওদের দুজনকে কামাল ঢাকার বাইরে পাঠিয়েছে।
কামালের রূমটা সর্বদক্ষিণে। তার পাশে একটি চেম্বার। শহীদের।
সকাল সাড়ে নটা।
সবার আগে অফিসে এসেছে শিল্পী। কামাল বা জামান কেউ এখনও এসে পৌঁছায়নি। আসেনি শহীদও। ও আসবে কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। সময়ের এদিক ওদিক হয় না ওর।
ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোনের বেল বেজে উঠল। টাইপ করছিল শিল্পী খটাখট শব্দ তুলে। হাত দুটো স্থির হয়ে গেল তার। মুখ তুলে তাকাল।
ডান হাত লম্বা করে দিয়ে তুলে নিল শিল্পী রিসিভারটা। হাসি হাসি ভাব ফুটল মুখে। মিষ্টি কণ্ঠে বলল, ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশন।
মার্জিত কিন্তু মেঘের ডাকের মত গুরু গভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে, প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খানকে চাই।
তিনি এখনও অফিসে আসেননি। আমি তার সহকারী বলছি। আপনি কে লছেন?
মোহাম্মদ তোয়াব খান। শদীদ খানকে দরকার আমার। কখন আসবেন তিনি?
দশটায়। আপত্তি না থাকলে আমাকে যা বলার বলুন, আমি…।
শিল্পীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মোহাম্মদ তোয়াব খান বললেন, শহীদ খানকে বলবেন আমি ফোন করেছিলাম। সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমি আমার গুলশানের বাড়িতে অপেক্ষা করব তার জন্যে। ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলাপ করতে চাই, একমাত্র তার সাথেই।
আপনার ঠিকানাটা…?
কোন ঠিকানার দরকার নেই। মোহাম্মদ তোয়াব খান-মি. শহীদের কাছে আমার নামই যথেষ্ট।
মোহাম্মদ তোয়াব খান বিরক্ত হয়েছেন, বোঝা গেল তার কণ্ঠস্বর শুনে।
শিল্পীকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
ধীরে ধীরে ক্রেডলে রিসিভারটা রেখে দিল শিল্পী। মুখটা মান দেখাচ্ছে।
কি ভাবছ? কামাল রিসেপশনে ঢুকেই প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল শিল্পী, লক্ষ করল সে।
না, কিছু ভাবছি না। কামাল ভাই, মোহাম্মদ তোয়াব খান কে বলুন তো? ভদ্রলোক ফোন করে শহীদ ভাইকে চাইছিলেন। বললেন, আমার নাম বললেই হরে, ঠিকানা দরকার নেই। সাড়ে দশটা পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে শহীদ ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করবেন তিনি।
মোহাম্মদ তোয়াব খান? তুমি ঠিক শুনেছ? কামাল ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল, বসল একটা চেয়ারে। সিগারেট বের করার জন্যে ট্রাউজারের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল, কিন্তু শিল্পীর উত্তর শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইল, হাতটা পকেট থেকে বের করতেও যেন ভুলে গেছে সে।
ঠিক শুনিনি মানে! ভদ্রলোকের প্রতিটি কথা মুখস্থ হয়ে গেছে।
কামাল পকেট থেকে হাতটা বের করল ধীরে ধীরে। সিগারেট ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল একমুখ। বলল, মোহাম্মদ তোয়াব খান। মিলিওনিয়ার। একশো একটা ব্যবসার মালিক। শিল্পী, স্টীলের আলমারি খুলে একত্রিশ নম্বর নীল ফাইলটা বের করো তো।
একত্রিশ নম্বর নীল ফাইল!
হ্যাঁ। ওটা মোহাম্মদ তোয়াব খানের ফাইল। তুমি নিশ্চয়ই জানো, কিংবা জানা উচিত তোমার যে আমরা দেশের ধনী এবং প্রভাবশালী নাগরিকদের সম্পর্কে সম্ভাব্য সব ইনফরমেশন সংগ্রহ করে রাখি।
জানি, কামাল ভাই। কিন্তু এখনও সব ফাইল পড়ে দেখার সময় পাইনি।
ঠিক আছে, ফাইলটা নিয়ে এসো। শহীদ আর পনেরো মিনিট পরই আসবে চেম্বারে। মোহাম্মদ তোয়াব খান ফোন করেছিলেন বললেই ভদ্রলোক সম্পর্কে সব কথা জানতে চাইবে ও।
শিল্পী চেয়ার ছাড়ল, এগিয়ে গেল চাবির গোছা নিয়ে স্টীল আলমারির দিকে।
এমন সময় দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল তরুণ জামান। কামালকে দেখে দীর্ঘ, দ্রুত পদক্ষেপে পাশে এসে দাঁড়াল সে, ঝুঁকে পড়ল কামালের দিকে। কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করুল, ব্যাপার কি বলুন তো, কামাল ভাই? একজন পুলিস ইন্সপেক্টরকে দেখলাম ওদিকের সাইড রোডে ঘুরঘুর করছে। সিভিল ড্রেসে আই মীন, ছদ্মবেশ নিয়ে…।
ও কিছু না। এসব মি. সিম্পসনের কাণ্ড। কুয়াশা তো শহীদ ও মহুয়াদির খবরাখবর নেবার জন্যে প্রায়ই আসে। তাই নজর রাখার জন্যে পাঠিয়েছেন একজন ইন্সপেক্টরকে।
কিন্তু এর আগে তো কখনও দেখিনি।
দেখোনি, দেখার চেষ্টা করোনি বলে। শহীদের বাড়ির আশপাশেও একজন না একজন সব সময়ই ঘুরঘুর করে।
কামাল ভাই, কুয়াশাকে আজ পর্যন্ত একবারও দেখার সুযোগ পেলাম না। কিভাবে সাধটা পূরণ করা যায় বলুন তো?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কামাল। হাসি থামিয়ে বলল, একবার নয় জামান, কুয়াশাকে তুমি কমপক্ষে পাঁচবার দেখেই। মুশকিল কি জানো, কুয়াশাকে যতবারই দেখো, চিনতে পারবে না। প্রতিবারই নতুন ছদ্মবেশ নিয়ে বাইরে বের হয় সে।
শিল্পী ফাইল নিয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এল।
.
মোহাম্মদ তোয়াব খান। গাড়ি চালাতে চালাতে ভদ্রলোকের কথা ভাবছিল শহীদ। অসংখ্য লঞ্চ, বার্জ, কার্গো, স্টীমার এবং একটি সমুদ্রগামী জাহাজের মালিক ভদ্রলোক। পঞ্চাশের উপর বয়স, কিন্তু চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বছর দুই আগে স্ত্রীকে হারিয়েছেন। মোটের অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন মিসেস তোয়াব! স্ত্রী মারা যাবার পর মোহাম্মদ তোয়াব খান নিজেকে সমাজ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। ব্যবসা ছাড়া আর কোন ব্যাপারে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি তাকে। কিন্তু হঠাৎ করে, মাত্র কিছুদিন আগে, আবার বিয়ে করেছেন। মেয়েটির নাম রাফিয়া। নর্তকী ছিল। কিভাবে যেন পরিচয় হয়, তারপরই বিয়ে। রাফিয়া রূপের ফাঁদ পেতে মোহাম্মদ তোয়াব খানকে মজিয়েছে, এটা কামালের ব্যক্তিগত ধারণা। রাফিয়ার মত সাধারণ একটা নর্তকীকে বিয়ে করা মোহাম্মদ তোয়াব খানের পক্ষে একটু অস্বাভাবিক। ব্যাপারটা ঠিক মানানসই হয়নি, এটা শহীদেরও ধারণা। এ ধরনের বেমানান বিয়ে আরও অনেকে করেছে এবং ফলাফল কারও ক্ষেত্রেই সুবিধের হয়নি শেষ পর্যন্ত। কামালের অনুমান, নববধূকে নিয়ে কোন সমস্যায় পড়েছেন মোহাম্মদ তোয়াব খান, তাই জরুরী ডাক পড়েছে শহীদের।
মোহাম্মদ তোয়াব খানের প্রথম পক্ষের একটি মেয়েও আছে। ছোট নয়, বিশ একুশ বছরের সুন্দরী যুবতী মেয়ে। মিসেস তোয়াব দুবছর আগে মোটর দুর্ঘটনায়। মারা যান। সেই একই দুর্ঘটনায় আহত হয় ঋতু। ঋতু, যতদূর জানা যায়, প্রচণ্ড অভিমানী এবং গচটা ধরনের মেয়ে। কারও সাথেই নাকি সে ভাল ভাবে কথা বলে না। বিষধর নাগিনীর মত সর্বদাই নাকি সে ফণা তুলে থাকে। তার আশপাশে কাউকে দেখলেই নাকি সে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। মোটর দুর্ঘটনায় ঋতু পঙ্গু হয়ে গেছে। হাঁটতে-চলতে পারে না সে। শোনা যায়, পঙ্গু মেয়ের জন্য মোহাম্মদ তোয়াব খানের মন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টাই বিষাদ-ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে।
মুক্তা নিকেতন দুই তলা। গেটের কাছ থেকে বিল্ডিংটা দেখা যায় না। খোলা গেট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ভিতরে ঢুকল শহীদ। গার্ডরূমের ভিতর কেউ নেই। সামনে কংক্রিটের চওড়া টারমাক। ছোট প্লেন নামার জন্যে যথেষ্ট। দুপাশে উঁচু উঁচু গাছ, সুন্দরভাবে মাথা ঘাটা ঘাস-জাতীয় ঝোঁপের কোমর সমান উঁচু বেড়া। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় প্রকাণ্ড মাঠ। কংক্রিটের রাস্তাটা শেষ হয়েছে প্রশস্ত গাড়ি বারান্দায়। চার-পাঁচটা ঝকঝকে দামী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটা মার্সিডিজ, একটা টয়োটা ডিলাক্স, একটা মরিস, একটা ডাটসন এবং একটা ফোক্সওয়াগেন। দুজন শোফার ফোক্সওয়াগেনের গায়ে হেলান দিয়ে নিচু গলায় গল্প করছে। শহীদের ক্রিমসন। কালারের গাড়িটা পাশে থামতে শোফার দুজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। শহীদকে দেখে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কি যেন বলাবলি করতে লাগল তারা।
গাড়ি থেকে নেমে ডান দিকে এগোল শহীদ। আবার কংক্রিটের রাস্তা। দূরে দেখা যাচ্ছে বিল্ডিংয়ের উঁচু দেয়াল। গজ বিশেক এগিয়ে বাক নিল শহীদ। গেটটা দেখা যাচ্ছে আরও পঞ্চাশ গজ দূরে। রাস্তার দুপাশে ফুল গাছ। গেটটা খোলা, ভিতরে দেখা যাচ্ছে বিরাট লন। তারপর মার্বেল পাথরের বারান্দা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শহীদের মনে হলো, কেউ যেন লক্ষ করছে ওকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও বা দিকে। চারদিকের ফুল গাছের মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। ফুল গাছগুলোয় লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি হরেক জাতের ফুল ফুটে রয়েছে। মাঝখানে একটা হুইল চেয়ারে ফুলের মতই সুন্দরী একটি মেয়ে বসে রয়েছে। উজ্জ্বল নীল রঙের নাইলনের ম্যাক্সি মেয়েটার পরনে। কোলের উপর একটা বই-খোলা। মাথা নিচু করে বইটার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
মুখ তুলে মেয়েটি দেখল শহীদকে, ভুরু কুঁচকে কথা বলে উঠল। শান্ত, চিকণ, কিন্তু চাবুকের মত মনে দাগ কেটে বসে–এমন কণ্ঠস্বর।
আপনি ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশন থেকে আসছেন?
শহীদ মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ।
ঋতু মুখ তুলে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে কি যেন আছে, শহীদের মনে হলো ওর পকেটের কাগজপত্রে কি লেখা আছে, কত টীকা, কত খুচরো পয়সা আছে সব যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বুঝি একেই বলে।
ঋতু দেখতে খুবই সুন্দরী। ধারাল তলোয়ারের মত। মুখটা একটু লম্বা। একহারা শরীর। সরু, লালচে ঠোঁট দুটো এক দিকে একটু বাঁকা, পরস্পরের সাথে চেপে বসে আছে।
সামনের গেট দিয়ে আসা উচিত হয়নি আপনার। ব্যবসায়িক কারণে যাঁরা আসেন তাদের জন্য লেফট এবং ব্যাক ডোর।
শহীদ হঠাৎ অনুভব করল, সময় নষ্ট করছে ও শুধু শুধু। পা বাড়াল অদূরবর্তী গেটের দিকে।
কোথায় যাচ্ছেন? বললাম না যে…।
শহীদের পিঠে যেন চাবুকের মত পড়ল কথাগুলো। দাঁড়াল ও। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, যা, বলেছু। কিন্তু তাতে কি? কোন্ দরজা দিয়ে ঢুকব সেটা আমিই বুঝব। আমি যেখানেই ঢুকি, নিজের ইচ্ছেমত ঢুকি।
কথাগুলো বলে জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে পা বাড়াল শহীদ। গেটের কাছে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার, দেখল ঋতু মাথা নিচু করে বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রেখেছে।
শহীদ মার্বেল পাথরের বারান্দায় উঠতেই কোথা থেকে যেন আবিভূর্ত হলো আধাবয়েসী কিন্তু হাতির মত সুল, উর্দি পরা একজন বাটলার। নিজের নামটা শুধু উচ্চারণ করল শহীদ, বাটলার রোবটের মত যান্ত্রিক ভঙ্গিতে জানাল, মালিক আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন, স্যার। আসুন আমার সাথে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল ওরা। সিঁড়ি এবং উপরের করিডর লাল কার্পেটে মোড়া। বাটলারের পিছু পিছু হলরুমে ঢুকল শহীদ। একটা দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল বাটলার। শহীদ ভিতরে প্রবেশ করুল।
গোলাকার একটা রূম। চারদিকের দেয়াল জুড়ে কাঁচের শো-কেস। প্রতিটি শো-কেসেই বই। মাঝখানে একটা বড় ডেস্ক। কয়েকটা ডিভান, সোফা এবং চেয়ার দেখল শহীদ। এটা মোহাম্মদ তোয়াব খানের লাইব্রেরী। কিন্তু লাইব্রেরীতে তিনি এখনও উপস্থিত হননি।
ডেস্কের দিকে মুখ করে একটা চেয়ারে বসল শহীদ। পকেট থেকে টোবাকোর কৌটা এবং পাইপ বের করল। পাইপ টোবাকো ভরতে ভরতে রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল ও। দশটা বাজতে চল্লিশ সিকেও বাকি।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করে এদিক ওদিক তাকাল ও। সেগুন কাঠের পালিশ করা চারদিকের দেয়ালে চারটে বড় বড় দরজা। সবগুলোই বন্ধ। জানালাগুলোয় ভারি পর্দা ঝুলছে।
নিঃশব্দে খুলে গেল শহীদের মুখোমুখি একটা দরজা। মুহূর্তের জন্যও না থেমে দৃঢ় পায়ে ডেস্কের দিকে এগিয়ে এলেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। দাঁড়ালেন ডেস্কের কাছে।
চওড়া, কাঁচাপাকা ভুরু ভদ্রলোকের। নাকটা মুখের আকারের সাথে মানানসই, পিরামিডের মত। ঠোঁটে লটকানো চুরুট থেকে ভুর ভুর করে তীব্র সুগন্ধ বেরুচ্ছে। পরনে হালকা বাদামী রঙের স্যুট। মুখের চেহারায় কাঠিন্যই বেশি। শহীদের মনে হলো, বড়সড় কোন সমস্যায় ভুগছেন ভদ্রলোক। নার্ভাস ফিল করছেন, যদিও তা প্রকাশ করতে চাইছেন না।
ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশন? মি. শহীদ খান? প্রশ্ন করলেন মোহাম্মদ তোয়াৰ খান। বাঘের মত থাবা বাড়িয়ে দিলেন।
উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করুল শহীদ।.বলল, হ্যাঁ।
গ্ল্যাড টু মিট ইউ! সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে শহীদের হাতটা ছেড়ে দিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। সিধে একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে বের করলেন একটা রুমাল। কপালের ঘাম মুছলেন ধীরে ধীরে। জানালার পর্দার দিকে চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর কথা বলে উঠলেন ভদ্রলোক। আপনার সুনাম সম্পর্কে আমি সব জানি, মি. খান। কিন্তু…
ভদ্রলোক কথা শেষ না করে ঘুরে দাঁড়ালেন, ফিরে এলেন ডেস্কের সামনে, রিভলভিং চেয়ারে বসে শহীদের দিকে তাকালেন, বললেন, তার আগে বলুন, ড্রিঙ্ক কোটা পছন্দ আপনার? হুইস্কি অর…!
শহীদ বলল, মাফ করবেন, আমি অ্যালকোহলে অভ্যস্ত নই।
একটু যেন অবাক হলেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। ডেস্কের উপর দুই হাত রেখে কিছু ভাবলেন বলে মনে হলো। এয়ারকুলার চালু থাকা সত্ত্বেও তার কপালে আবার বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে, দেখতে পেল শহীদ।
হঠাৎ, যেন মন স্থির করে সিধে করলেন দেহটা। সরাসরি তাকালেন শহীদের দিকে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন ওকে।
শহীদ বলে উঠল, দ্বিধা করার কিছু নেই, মি, খান। বলে ফেলুন আপনার সমস্যার কথা–হালকা হয়ে যাবে মনটা। হয়তো সাহায্য করতেও পারি আমি।
মৃদু হাসলেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। রুমাল বের করে ধীরে ধীরে ভাজ খুলতে শুরু করলেন, বললেন, ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য…ইয়েস আই নীড ইট ভেরি ব্যাডলি।
চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি। আবার বললেন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। তারপর সব কথা বলব। আসুন।
উঠল শহীদ। ভদ্রলোক ইতিমধ্যে দরজা খুলে ফেলেছেন। পিছন পিছন পাশের রূমে ঢুকল শহীদ।
বেডরূমটা বেশ বড়। ড্রেসিং টেবিলের উপর কসমেটিকসের সাজ-সরঞ্জাম দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না কোন ভদ্রমহিলার বেডরূম এটা। চারদিকের দেয়ালে রঙিন নাইলনের পর্দা ঝুলছে। পর্দা সরিয়ে একটা দেয়াল-আলমারির তালা খুলে ভিতর থেকে মাঝারি আকারের একটা লেদার সুটকেস বের করে কার্পেটের উপর নামিয়ে তাকালেন শহীদের দিকে। কিছু যেন বলতে গেলেন, কিন্তু বললেন না। ঝুঁকে পড়ে খুললেন সুটকেসের ডালা। কিন্তু সুটকেসের ভিতর না তাকিয়ে সিধে হয়ে ঘুরে পা বাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন জানালার সামনে।,পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, দেখুন।
সুটকেসটার দিকেই তাকিয়ে ছিল শহীদ। নানা রকম জিনিস-পত্রে সেটা প্রায় ভর্তি হয়ে আছে। এত রকম জিনিস সাধারণত একসাথে দেখা যায় না। প্রথম দর্শনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, কোন বাচ্চা মেয়ের কাণ্ড হবে। টুথপেস্ট, চিরুনি, কয়েকটা সিগারেটের প্যাকেট, কাঁচের চুড়ি, ছয়টা সিগারেট লাইটার, নামকরা কয়েকটা রেস্তোরাঁর চিহ্নবিশিষ্ট কাঁটা চামচ, সিল্কের মোজ তিন জোড়া, দুটো কাচি, পকেট দুরি একটা, দশ-বারোটা ফাউন্টেন পেন, একটা পাথর বসানো সোনার আঙটি, স্পঞ্জের স্যান্ডেল দুপাটি, দুটো শ্বেতপাথরের অ্যাশট্রে, একটা পাথরের নয় নারীমূর্তি–এই রকম আরও অনেক ছোটখাট জিনিস। লক্ষণীয় এই যে, স্যাণ্ডেল দুই রঙের এবং দুই সাইজের।
তোয়াব খান দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বললেন, চলুন, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসি।
ফিরে এল ওরা লাইব্রেরীতে। বল আবার মুখোমুখি।
তোয়াব খান নতুন চুরুট তুললেন ঠোঁটে। লাইটার মুখের সামনে ধরলেন, কিন্তু জাললেন না। হাতটা তাঁর কাঁপছে, লক্ষ্য করল শহীদ। বললেন, কিছু বুঝলেন?
শহীদ বলল, সালে এবং চামচগুলো দেখে যতটুকু বুঝতে পারছি–একজন ক্লেপটোম্যানিয়াকের সংগ্রহ।
প্রশংসার দৃষ্টি ফুটল মোহাম্মদ তোয়াব খানের চোখে, শহীদের বুকের দিকে মোটা আঙুল তুলে বললেন, রাইট!
চুরুটটা ঠোঁট থেকে নামালেন তিনি। ডেস্কে হাতের ভর দিয়ে শহীদের দিকে ঝুঁকলেন একটু, তিক্ত গলায় বললেন, মি. শহীদ, আপনার সম্পর্কে সব কথা জানি আমি। তবু, একটা কথা আপনার মুখ থেকে জেনে নিতে চাই। আমি আপনাকে ডেকেছি সাহায্য পাবার আশাতেই। সমস্যাটা কুৎসিত, এবং ব্যক্তিগত। আমি চাই না আপনি ছাড়া কথাটা আর কেউ জানুক। আমি জানি, পুলিসের বড় কর্তাদের সাথে আপনার দহরম-মহরম আছে। বন্ধুত্ব তাদের অনেকের সাথে আমারও রয়েছে। কিন্তু আমি চাই না তারা এ সম্পর্কে কিছু জানুক। আপনি কি আমাকে কথা দিতে পারেন, আমি যা বলব তা আপনি ছাড়া আর কেউ জানবে না?
শহীদ বলল, আপনি কি বলবেন তার উপর নির্ভর করে ব্যাপারটা, মি. তোয়াব। ক্রাইম অনেক রকমের আছে, তাই না? ছোটখাট ব্যাপার হলে আলাদা কথা। কিন্তু আপনি যদি বলেন একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, হত্যাকারীর পরিচয় আপনি জানেন, আমাকে তার পরিচয় জানাবেন কিন্তু আমি তাকে গ্রেফতার করার জন্যে পুলিসকে সাহায্য করতে বা তার খবর পুলিসকে জানাতে পারব না।
না না! তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। সমস্যাটাকে কুৎসিত বলেছি আমি ব্যক্তিগত, কারণে। এটা এমন কি ক্রাইমও নয়।
শহীদ বলল, ক্লেপটোম্যানিয়া ক্রাইম নয়। এটা একটা অসুখ। আপনার সমস্যা যদি এই ক্লেপটোম্যানিয়া সংক্রান্ত হয় তাহলে কথা দিতে পারি, পুলিসকে এ সম্পর্কে কিছু জানাব না। তবে, আপনাকে সাহায্য করতে যদি আমি রাজি হই তাহলে আমার সহকারীদের সব কথা জানাতে হবে।
তারা নিশ্চয়ই বিশ্বস্ত, আমি ধরে নিতে পারি?
শহীদ বলল, অবশ্যই।
তোয়াব খান এতক্ষণে চুরুটে অফিসংযোগ করলেন। বললেন, আপনি তাহলে আমাকে সাহায্য করছেন।
শহীদ পাইপ কামড়ে ধরে বলল, আগে আমাকে সব কথা শুনতে হবে।
শহীদের দিকে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক। কি যেন বলতে গিয়েও বললেন না। বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে ডান দিকের জুলফির নিচেটা চুলকালেন, বললেন, আই সি। ঠিক আছে। আগে বরং সব কথা শুনুন। আমার স্ত্রী এবং আমি, বিয়ের পর নিমন্ত্রিত হয়ে অসংখ্য পার্টিতে গিয়েছি। সুটকেসের জিনিসপত্রের অধিকাংশই আমাদের পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আশরাফুজ্জামান চৌধুরীর ড্রয়িং রূমে ছিল নারী মূর্তিটা। পার্কার কলমটা আমার বন্ধু মি, করিম আখন্দের ছেলে ইগুলর। আঙটিটা মিসেস সোলায়মানের আঙুলে দেখেছি আমি। যে-সব রেস্তোরাঁয় নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, চামচগুলো সেই সব রেস্তোরাঁর।
থামলেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। শহীদ চুপ করেই রইল। ভদ্রলোক বক্তব্য গুছিয়ে নিচ্ছেন, তার অন্যমনস্কতা দেখে বোঝা গেল। একটু পর আবার বলতে শুরু করলেন তিনি। চোখের দৃষ্টি জ্বলন্ত চুরুটের দিকে নিবদ্ধ।
ব্যাপারটা খুবই নাজুক। সুটকেসটা আবিষ্কার করার পর থেকে সব কিছু তিক্ত লাগছে। মুশকিল হলো, আসলে আমার স্ত্রী সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না আমি।
শেষ কথাটা একেবারে নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে যেন জনান্তিকে উচ্চারণ করলেন ভদ্রলোক। শহীদের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, শুরু করলেন আবার, চট্টগ্রামের একটা নাইটক্লাবে ওকে মাস পাঁচেক আগে দেখি আমি। আমিই আলাপ করি। নাইটক্লাবের ড্যান্সার ছিল ও। ওর নাচ আমাকে মুগ্ধ করে। পরিচয় হবার তিন সপ্তাহ পর আমরা বিয়ে করি। আমাদের বিয়ে হয়েছে চার মাস হলো। বিয়ে উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান হয়নি বলতে পারেন বিয়েটা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। খবরটা কিছু দিন হলো প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
বিয়েটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন–কেন?
ঋতুর কথা ভেবে। ঋতু আমার মেয়ে। ওর মা ওকে, ও ওর মাকে বড় বেশি ভালবাসত। ওর মা মারা যাবার পর ঋতু সম্পূর্ণ বদলে গেছে। গত ছবছর আগে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, কিন্তু এখনও ও আমাকে প্রশ্ন করে-আম্মি একা মারা গেল কেন বুঝলাম না। মি. শহীদ, ঋতু ঠিক সুস্থ হতে পারছে না–বত পারবেও না। ওর এই মানসিক অসুস্থতার কথা ভেবেই আমরা–আমি এবং রাফিয়া সিদ্ধান্ত নিই কোন রকম আড়ম্বর ছাড়াই বিয়েটা সারা হবে।
শহীদ জানতে চাইল, ওদের দুজনের সম্পর্ক কেমন?
ভাল নয়। কিন্তু সেটা সমস্যা নয়। আমি শুধু জানতে চাই আমার স্ত্রী ক্লেপটোনিয়ায় ভূগছে কিনা। পরের জিনিস চুরি করা কুৎসিত একটা অসুখ, তাই না? ও যদি ধরা পড়ে এবং একদিন না একদিন ধরা পড়বেই…মাইগড!
শহীদ জানতে চাইল, আপনার স্ত্রীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেননি?
একটু অবাক হলেন যেন মোহাম্মদ তোয়াব খান। স্ত্রীকে প্রশ্ন করার কথাটা যেন তিনি আগে ভাবেননি। বললেন, না, কথাটা তুলিনি। তুলতে চাইও না। শি ইজ নট এ পারটিকুলারলি ইজি পারসন টু হালে। ওর সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয় আমাকে, মি. শহীদ।
তাই স্বাভাবিক, ভাবল শহীদ। নর্তকী ছিল-দুনিয়ার কিছু দেখতে বুঝতে বাকি না থাকারই কথা। তার উপর রূপ আছে অসাধারণ, বয়সও কম–অথচ দ্বিগুণেরও বেশি বয়স সামীর। স্বামীর সাথে বেপরোয়া ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত সম্ভবত।
শহীদ বলল, এমনও তো হতে পারে, মিসেস রাফিয়ার বিরুদ্ধে এটা একটা ষড়যন্ত্র? কেউ হয়তো তার দেয়াল-আলমারি খুলে সুটকেসে জিনিসগুলো রেখে দিয়েছে, বিপদে ফেলার জন্যে?
তোয়াব খান তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন শহীদের দিকে। তারপর, চাপা কণ্ঠে প্রায় আঁৎকে উঠলেন তিনি, হোয়াট ডু ইউ মীন? কার প্রতি ইঙ্গিত করছেন আপনি?
শহীদ শান্তভাবে বলল, আপনি স্বীকার করেছেন আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার মেয়ের সম্পর্ক ভাল নয়।
ঋতুকে আপনি এসব ব্যাপারে জড়াবেন না। ভদ্রলোক রাগ সামলাবার চেষ্টা করা সত্তেও পারলেন না, কণ্ঠস্বরে উত্তাপ রয়েছে টের পাওয়া গেল।
শহীদ আপনমনে হাসল। বলল, দুঃখিত। আপনাকে সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব কিনা তা জানতে হলে সব দিক বিচার করে সমস্যাটার আসল চেহারা বের করতে হবে আমাকে। তাই, অপ্রিয় হলেও আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আপনাকে।
তোয়াব খান গাভীর্য বজায় রেখেই বললেন, আই সি। ঠিক আছে, বলুন কি কি জানতে চান।
শহীদ প্রশ্ন করল, সুটকেসটা আপনি কি হঠাৎ আবিষ্কার করেন? না, আগেই সন্দেহ করে খুঁজতে খুঁজতে ওটা পেয়ে যান?
আমার ধারণা রাফিয়াকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে। ওর ব্যাগ-ব্যাগেজ খুলে আমার সন্দেহের স্বপক্ষে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখার চেষ্টা করি আমি। এই দেখার সময়ই সুটকেসটা আবিষ্কার করি।
আপনার স্ত্রীকে কেউ র্যাকমেইল করছে-এই সন্দেহের কারণ কি?
নিভে যাওয়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে নামিয়ে রেখে নতুন একটা চুরুট ঠোঁটে তুললেন ভদ্রলোক, লাইটারটা ডেস্ক থেকে তুলে নিয়ে সেটা মুঠোয় ধরে রাখলেন শক্তভাবে। কথা শুরু করলেন চুরুট না ধরিয়েই। প্রতিটি শব্দ যেন আটকে যাচ্ছে, যেন গলায় কাঁটা বিঁধেছে, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার, ওর ব্যক্তিগত খরচের জন্য মাসিক ভিত্তিতে টাকা দিই ওকে আমি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই দিই। বেশি টাকা নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত নয় ও। তাই সাবধানতা অবলম্বনের জন্য ব্যাঙ্কের সাথে বিশেষ ব্যবস্থা করে ডুপ্লিকেট একটা পাস বই নিজের কাছে রেখেছি আমি! মনে মনে ঠিক করেছি অন্তত বছর খানেক ওর খরচের দিকে নজর রাখব। অস্বাভাবিক বড় অঙ্কের টাকা অজ্ঞাত কারণে খরচ করলে, সন্ধান নিয়ে খরচের কারণটা জানতে পারব–তাই গত মাসে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছে ও। তেমন কিছু কেনেনি, কিনলে আমাকে দেখাত। টাকাটা কিভাবে খরচ করছে জানার চেষ্টাও করিনি আমি। টাকা পয়সার ব্যাপারে আমি নীচ হতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই টাকাটা কিসে খরচ হয়েছে।
মোট কত টাকা তুলেছেন মিসেস রাফিয়া গত মাসে?
তিনটে চেকে মোট আড়াই লাখ টাকা। দুবার পঞ্চাশ হাজার, একবার দেড় লাখ।
নির্দিষ্ট কারও নামে?
না। বিয়ারার চেকে টাকাগুলো তোলা হয়েছে।
শহীদ বলল, আপনার ধারণা কেউ মিসেস রাফিয়ার চুরি করার কথা জানতে পেরে তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে?
সেই রকম সন্দেহ হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? যাই হোক, মি. শহীদ, আমি চাই আপনি আমার স্ত্রীর প্রতি নজর রাখার ব্যবস্থা করুন আমি স্ক্যাণ্ডাল চাই না। যদি প্রমাণ হয় যে ও ক্লেপটোম্যানিয়ায় ভুগছে তাহলে অসুখটা সারাবার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু কোন ক্রমেই যেন ও আর কারও হাতে ধরা পড়ে অপদস্থ বা অ্যারেস্ট না হয়, এদিকটা অবশ্যই দেখতে হবে আপনাকে। আমি চাই রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখা হোক ওর উপর। মি. শহীদ, আমি কাজের মানুষ। সন্দেহে ভোগার মত সময়ও আমার নেই। আমি আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার রিপোর্ট চাই-ইয়েস অর নো! আর, হ্যাঁ, ও যেন বুঝতে না পারে!
শহীদ ম্লান হেসে বলল, দুঃখিত, মি. তোয়াব। আপনার কেসের দায়িত্ব আপনি অন্য কাউকে দিন-আমি আগ্রহ বোধ করছি না।
উঠে দাঁড়াল শহীদ।
তোয়াব খান বিস্ময়ে যেন বোরা হয়ে গেছেন। শহীদকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, মি. শহীদ আপনি আপনাকে আমি অনেক আশা করে ডেকেছিলাম…আপনার সম্পর্কে সব জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একমাত্র আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে সমস্যাটার সমাধান বের করার দায়িত্ব দিতে পারি।
শহীদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনার সমস্যা খুবই সাধারণ সমস্যা, মি. তোয়াব। যে কোন একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারবেন।
আমি সব প্রাইভেট ডিটেকটিভ সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। কাউকে আমার নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়নি। মি. শহীদ আপনার ফী কত তা আমি জানি না। কিন্তু আমাকে সাহায্য করার জন্যে আপনি যে-কোন অঙ্কের টাকা দাবি করতে পারেন, আমি সানন্দে আপনার সে দাবি পূরণ করব। আপনি চাইলে আমি চেক সই করে দিতে পারি, টাকার অঙ্কটা আপনি বসিয়ে নেবেন।
শহীদ মৃদু হেসে বলল, দুঃখিত, মি. তোয়াব। টাকা আমার প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট আছে।
তোয়াবকে বিচলিত দেখাল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। রীতিমত বিনয় প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে, আপনি আমাকে এক মিনিট সময় দিন, মি. শহীদ। প্লীজ! আমি আসছি।
শহীদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে অর্থাৎ শ্রাগ করে আবার বসল চেয়ারে। কিন্তু কোন কথা বলল না।
তোয়াব খান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন লাইব্রেরী থেকে। নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তার পিছনে দরজাটা।
মিনিটখানেক নয়, প্রায় সাত মিনিট পর ফিরে এলেন তিনি রুমালে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে। চেয়ারে বসতেই ডেস্কের টেলিফোনের বেল বেজে উঠল। ক্রিং ক্রিং
শহীদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আপনার ফোন।
আমার?
হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা নিল শহীদ। বলল, শহীদ খান স্পীকিং।
অপর প্রান্তের বক্তার বক্তব্য নিঃশব্দে শুনল শহীদ। ওর মুখের চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। মিনিট দেড়েক পর ফোনটা নিঃশব্দেই নামিয়ে রাখল ও ক্রেডলে। মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, আপনিই জিতলেন, মি. তোয়াব।
ভদ্রলোক বললেন, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দায়িত্ব চাপাতে হলো বলে দুঃখিত, মি. শহীদ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আর কোন উপায় ছিল না। সমস্যাটার সাথে আমার সুনাম ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত..
শহীদ বাধা দিয়ে বলল, আমার সহকারিণী মিস শিল্পীকে দায়িত্বটা দেব আমি। আজ বিকেল থেকেই কাজে নামবে সে। তার আগে আপনার সাথে শিল্পীর সাক্ষাৎ হওয়া দরকার। কোথায় দেখা করবে সে আপনার সাথে?
এখানে নয়, অবশ্যই। ঢাকা ক্লাবে, সুইমিংপুলের কাছে থাকব। চারটের সময়।
শহীদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনার মেয়ে জানে আমাকে আপনি সমস্যাটার ব্যাপারে দায়িত্ব দেবার জন্যে ডেকেছেন, তাই না?
বলেন কি! না-না, ঋতু বা রাফিয়ার জানার প্রশ্নই ওঠে না।
শহীদ জানতে চাইল, আপনার এই ফোনের এক্সটেনশন আছে অন্য কোন রূমে?
আছে। কেন বলুন তো?
শহীদ বলল, আপনি আমার অফিসে যখন ফোন করেছিলেন, কেউ এক্সটেনশন থেকে আপনার সব কথা শুনেছে। আমি আপনার মেয়ের কথা বলছি। ও জানে সব।
দুশ্চিন্তার রেখা ফুটল তোয়াব খানের কপালে। বললেন, ঠিক আছে। এরপর থেকে আমি সাবধান হব। গুডমর্নিং, মি, শহীদ।
গুডমর্নিং।
দরজা ঠেলে বাইরের হলরূমে পা রাখতেই বাটলার এগিয়ে এল, যান্ত্রিক ভঙ্গিতে একটু নত হয়ে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠস্বরে বলল, আসুন, স্যার। মিস ঋতুর হুকুমে আপনার গাড়ি বাড়ির পিছনের গেটে রেখে এসেছি। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে…
শহীদ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। অনুসরণ করল সে বাটলারকে। নিচে নেমে শহীদ বলল, তোমাকে আর যেতে হবে না। আমি পিছনের গেটটা খুঁজে নেব।
দাঁড়িয়ে পড়ে বাটলার সবিনয়ে বলল, জো হুকুম, স্যার। এই বাগানের মাঝখান দিয়ে সোজা গেলে সুইমিং পুল পাবেন, ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা গেলেই দেখতে পাবেন গেটটা…।
শহীদ এগোতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
খানিকদূর এগিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ, বাটলার তার জায়গায় যন্ত্রের মত নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে সরে গেল সেকরিডরের আড়ালে।
সুইমিংপুলটা আরও খানিক পর চোখে পড়ল শহীদের। কাছাকাছি যাবার আগেই লোহার সিঁড়ি বেয়ে পাকা চত্বরে উঠে এল পুল থেকে একটি যুবতী। বিকিনি পরা চব্বিশ-পঁচিশ বছরের উদ্ভিন্নযৌবনা। দেখেই শহীদ অনুমান করল, সম্ভবত : মিসেস রাফিয়া। চোখাচোখি হতে একটু যেন হাসল মিসেস রাফিয়া। কিন্তু হাসিটা ঠিক ধরতে পারল না শহীদ।
মিসেস রাফিয়ার প্রায় সম্পূর্ণ দেহই উন্মুক্ত। কিন্তু শহীদের সামনে পড়ে যাওয়ায় তাকে এতটুকু অপ্রতিভ হতে দেখা গেল না। ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে সে। শহীদ এক পাশ দিয়ে হাঁটছিল, হাঁটতেই লাগল। মিসেস রাফিয়া গুনগুন করে গান গাইছে, আরও কাছাকাছি হয়ে শুনতে পেল শহীদ। কিন্তু তাকিয়ে আছে পাশের ফুল গাছগুলোর দিকে।
পাশ দিয়ে চলে গেল মিসেস রাফিয়া, শহীদ তার দিকে তাকাল না। কিন্তু খানিক পর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার। দেখল, মিসেস রাফিয়াও তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হলো আবার। এবার হাসিটা চিনতে ভুল হলো না শহীদের।
সামনে বাঁক। দ্বিতীয়বার পিছন দিকে না তাকিয়েই ঘুরল শহীদ, গেটের দিকে এগিয়ে চলল। ওর গাড়িটা খোলা গেটের বাইরে দেখা যাচ্ছে।
.
শহীদের চেম্বার। ডাক পড়ল ওদের। কামাল, জামান এবং শিল্পী, একে একে প্রবেশ করল চেম্বারের ভিতর।
শহীদ বলল, তোর অনুমানই ঠিক রে, কামাল। তোয়াব খান তার স্ত্রীকে নিয়েই সমস্যায় পড়েছেন।
সব কথা বলল ওদেরকে শহীদ।
কামাল কাজ ভাগ করে দেবার জনে বলল, শিল্পী, তুমি সাড়ে চারটের সময় ঢাকা ক্লাবে যাচ্ছ মি. তোয়াব খানের সাথে দেখা করতে। বলার তাঁর নতুন কিছুই নেই হয়তো স্ত্রীর অভ্যাস অভ্যাস সম্পর্কে কিছু তথ্য দেবেন তোয়াব খান। মিসেস রাফিয়ার ওপর নজর রাখার দায়িত্ব তোমার, তার সম্পর্কে যতটা পারো জেনে নিয়ে। একটা কথা, আমার সন্দেহ, ঋতু এর সাথে জড়িত। তার ব্যাপারেও নজর রেখো। আর মিসেস রাফিয়া যদি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তাকে ঝামেলার হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার।
জামান জানতে চাইল, আমার কি কাজ?।
ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ব্যাপারটা সত্যি কিনা চেক করব আমরা, আমি আর তুমি। কিন্তু শিল্পীর রিপোর্টের উপর সব কিছু নির্ভর করছে। মিসেস রাফিয়াকে নজরে রাখতে পারলে রাকমেইলিং সম্পর্কে কোন না কোন তথ্য পাওয়া যাবেই। তথ্য পাওয়া গেলে আমরা কাজে নামব।
কামাল তাকাল এবার শহীদের দিকে, বলল, শহীদ, কুয়াশা স্বয়ং এই কেসের সাথে জড়িত নয় তো রে?
কথা না বলে ঠোঁটে আঙুল রেখে হঠাৎ কামালকে চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করুল শহীদ।
সতর্ক সাবধান হয়ে গেল ওরা সবাই। একমুহূর্ত পরই শহীদের রহস্যময় আচরণের কারণ জানা গেল।
ভেজানো দরজা ঠেলে চেম্বারের ভিতর প্রবেশ করলেন সি. আই. ডি.-র জাদরেল অফিসার মি. সিম্পসন। দ্রুত সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সহাস্যে, সকৌতুকে বললেন তিনি, গুডমর্নিং, বয়েজ! সবাই চুপ করে গেলে কেন? তোমাদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশধারী কুয়াশা নেই তো?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কামাল, জামান এবং শিল্পী। শহীদ মুচকি হাসল। বলল, আমাদের মধ্যে হুবহু আপনার চেহারার কেউ আছে কিনা দেখুন। কুয়াশা
তো সাধারণত আপনার চেহারাটাকেই ছদ্মবেশ হিসেবে গ্রহণ করে।,
মি. সিম্পসন এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ারে বসতে উদ্যত হলেন, শহীদের দিকে চোখ পড়াতে তিনি দেখলেন শহীদ চেয়ে আছে তার দিকে নয়, তাঁর পিছন দিকে। শহীদের চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ বিস্ময় ফুটে উঠেছে লক্ষ করলেন তিনি।
বসতে গিয়েও বসলেন না মি. সিম্পসন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন পিছন ফিরে। ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন তিনি। চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন লোক। হুবহু তার মত চেহারা!
স্তম্ভিত মি. সিম্পসনের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় মি. সিম্পসন দোরগোড়া থেকে বকণ্ঠে বলে উঠলেন, আজ তোমাকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়েছি আমি, কুয়াশা! সাবধান, কোন রকম চালাকি করবার চেষ্টা কোরো না-গুলি করে উড়িয়ে দেব তোমার মাথার খুলি! আমার ছদ্মবেশ নিয়ে তুমি সবাইকে ফাঁকি দিচ্ছ কিন্তু আজ তোমার রক্ষা নেই।
প্রথম মি. সিম্পসন স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। শহীদ, কামাল, জামান ও শিল্পী, যে যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে। ঘটনাটা ওদের চোখের সামনে ঘটছে, কেউই তা বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। দুজনের চেহারা হুবহু এক। বাদামী রঙের ট্রপিক্যাল কাপড়ের কমপ্লিট স্যুট পরনে দুজনেরই। মাথায় হ্যাট। হিটলারের মত গোঁফ। ডোরাকাটা টাই। হাতে ছড়ি। দুজনের চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ, পোশাক, দাঁড়াবার ভঙ্গি–কোন অমিল নেই কোথাও।
মিলছে না শুধু এক জায়গায়। প্রথম মি. সিম্পসনের হাতে রিভলভার নেই, দ্বিতীয় জনের হাতে কালো, চকচকে একটা রিভলভার দেখা যাচ্ছে।
কোনজন যে প্রকৃত মি. সিম্পসন তা বোঝার কোন উপায় নেই। এমনকি শহীদও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে পরীক্ষা করে মনে মনে হাল ছেড়ে দিল।
মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, কুয়াশা। দ্বিতীয় মি. সিম্পসন দাঁতে দাঁত চেপে আদেশ করলেন। বিনাবাক্যব্যয়ে মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়ালেন প্রথম মি. সিম্পসন। কিন্তু তার দেহটা কেঁপে উঠল অদম্য ক্রোধে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি, আবার আমার ছদ্মবেশ নিয়েছ তুমি? কুয়াশা, এর ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে শহীদের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, শুনলে, শহীদ? শয়তান লোকটার কথা শুনলে? আমার ছদ্মবেশ নিয়ে আমাকেই বলছে কুয়াশা।
শহীদ বলল, আপনারা কে যে আসল আর কে যে নকল…।
প্রথম মি. সিম্পসন বাঘের মত হুঙ্কার ছাড়লেন, আমি! আমিই আসল। তোমরা ওর চালাকিটা ধরতে পারছ না।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসনের রিভলভার ধরা হাতটা এতটুকু নড়ল না, বা হাত দিয়ে পকেট থেকে হুইসেল বের করে ফুঁ দিলেন তিনি। প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে হুড়মুড় করে চেম্বারের ভিতর প্রবেশ করল চারজন কনস্টেবল, এবং সিভিল ড্রেসে একজন ইন্সপেক্টর।.।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন বললেন, ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, আমার ছদ্মবেশ নিয়ে ওই যে কুয়াশা, ওকে গ্রেফতার করো।
বী কেয়ারফুল। এক পা-ও এগোবে না কেউ! আমি কুয়াশা নই, কুয়াশা ও নিজে…।
ইন্সপেক্টর এবং কনস্টেবলত্রয় একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল। অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে গেছে সকলের চোখ।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ মহা ফাঁপড়ে পড়ে তাকাল শহীদের দিকে, বলল, মি. শহীদ, এ কি দেখছি আমি? কাকে গ্রেফতার করব বলুন তো?
প্রথম মি. সিম্পসন আঙুল বাড়িয়ে দেখালেন, ওকে!
দ্বিতীয়জন উচ্চকণ্ঠে সাথে সাথে বললেন, ওকে! ওই কুয়াশা!
শহীদ বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার ভূমিকাটা এই পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ হওয়া উচিত বলে মনে করি। ইন্সপেক্টর, আপনি বরং দুজনকেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান।
ঘটনার চমক এমনই উভয় সংকটে ফেলেছে সকলকে যে চেম্বারের ভেজানো দরজা নিঃশব্দে আবার খুলে গেছে, ভিতরে নতুন একজন লোক প্রবেশ করছে–তা কারও চোখেই পড়ল না। একমাত্র শহীদ দেখল নবাগত আগন্তুককে।
ইন্সপেক্টর বলল, রাইট! আমার কর্তব্য আমাকে পালন করতেই হবে। আপনাদের দুজনের মধ্যে যেই মি. সিম্পসন হোন, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এই সমস্যার সমাধান একা করতে পারব না। আপনাদের। দুজনকেই গ্রেফতার করছি আমি।
ইন্সপেক্টর কনস্টেবলদেরকে নির্দেশ দিল ইশারায়।
দুজন কনস্টেবল প্রথম মি. সিম্পসনের দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল, একজন বলল, চলুন, স্যার।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসনের দিকেও দুজন কনস্টেবল এগোল। তিনি হঠাৎ বললেন, ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, আমাকে গ্রেফতার করার পরিণাম কি হবে তা ভেবে দেখেছ? থানায় গেলেই প্রমাণ হয়ে যাবে আমি কুয়াশা নই। তখন কি অবস্থা হবে বুঝতে পেরেছ!
কিন্তু, স্যার, আমি এখন কি করব বলুন দেখি! আপনাদের মধ্যে কে আসল কে নকল…!
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন বললেন, মাথায় দেখছি তোমার গোবর ভরা! কেন, আমাদের দুজনের কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেই তো পারো।
ইন্সপেক্টরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তা ঠিক। বেশ, আপনারা আপনাদের পরিচয়পত্র বের করে দিন আমাকে।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন পকেটে হাত ভরলেন।
আঁৎকে উঠে প্রথম মি. সিম্পসন বললেন, ষড়যন্ত্র! এটা একটা ষড়যন্ত্র! আমার পরিচয়-পত্ৰ পকেট থেকে চুরি করে নিয়েছে কেউ! মাইগড…!
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন তাঁর পরিচয়-পত্র ইন্সপেক্টরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নিন আমারটা। পরীক্ষা করে দেখুন ভাল করে।
ইন্সপেক্টর পরীক্ষা করল কয়েক মুহূর্ত ধরে পরিচয়-পত্রটা। মুখ তুলে স্যালুট করল সে দ্বিতীয় মি. সিম্পসনকে। বলল, মাফ করবেন, স্যার। আমি দুঃখিত।
প্রথমজন চিৎকার করে উঠলেন, ইউ রাড়ি ননসেন্স। বলছি না এটা একটা ষড়যন্ত্র! আমার পকেট থেকে পরিচয়-পত্র চুরি করে নিয়েছে কেউ…
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, চালাকি করে আর লাভ হবে না, মি. কুয়াশা।
কনস্টেবলদের কিছু বলতে হলো না; তারা এগিয়ে গেল। তাদের একজনের হাতে একটা হাতকড়া রয়েছে দেখে প্রথম মি. সিম্পসন দাতে দাঁত চেপে বললেন, কী স্পর্ধা! আমাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাবে তোমরা! চাকরি একজনেরও থাকবে না বলে দিচ্ছি।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলে উঠলেন, ধন্য আশা কুহকিনী। এখনও অভিনয় করছ নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করো, না?
প্রথম মি. সিম্পসন রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তাঁর মুখ দিয়ে কথা বের হলো না আর।
কনস্টেবলরা তাঁর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। চেপে রাখা ক্রোধ বিস্ফোরণের মত শব্দ করে ফাটল হঠাৎ, এই অপমান আমি ভুলব না, কুয়াশা! আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এরপর তোমাকে দেখা মাত্র গুলি করব আমি।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু কুয়াশা, এরপর তোমার সাথে আমার দেখা হবে বলে মনে হয় না। বিচারে তোদর ফাঁসি হবে নির্ঘাৎ।
ফাঁসি আমার নয়–তোমার হবে, কুয়াশা।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ বলল, আর কোন কথা নয়। চলুন, রওনা হওয়া যাক।
দ্বিতীয় মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ আর দেরি করার মানে হয় না। ওর নাম কুয়াশা, যতক্ষণ না ওকে সেলের ভিতর বন্দি করা যায় ততক্ষণ কোন নিশ্চয়তা নেই। ইন্সপেক্টর, থানার পথে যাবার সময় শয়তানটা মরিয়া হয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করবেই করবে, সুতরাং খুব সাবধান থাকতে হবে আমাদেরকে। আপনারা সবাই ওকে নিয়ে জীপে গিয়ে উনি। আমি এবং একজন কনস্টেবল জীপের পিছু পিছু শহীদের প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে এগোব। সকলের প্রতি নির্দেশ রইল, কুয়াশা যদি পালাতে চেষ্টা করে, বিনা দ্বিধায় গুলি করবেন ওঁকে। এবার যান সবাই।
প্রথম মি. সিম্পসন রাগে কাঁপছেন তখনও। চোখ দুটো থেকে আমি বর্ষণ হচ্ছে। বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি পা বাড়ালেন। নাভির কাছে হাত দুটো একত্রিত করা, হাতকড়া লাগানো। তার পিছনে ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ। ইন্সপেক্টরের হাতের রিভলভার তার শিরদাঁড়ায় ঠেকে আছে।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওদের পিছন থেকে দ্বিতীয় মি. সিম্পসন বললেন, আমি শহীদের কাছ থেকে চাবি নিয়ে গ্যারেজে যাচ্ছি, আপনারা রওনা। হয়ে যান।
চেম্বারে একজন কনস্টেবল তখনও দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র শহীদ ছাড়া বাকি সকলের অজ্ঞাতে চেম্বারে প্রবেশ করেছিল সে খানিক আগে।
মি. সিম্পসন। আপনি সত্যিই আসল মি. সিম্পসন? নাকি…!
মৃদু একটু হাসল শহীদ কামালের কথা শুনে।
ইউনিফর্ম পরিহিত কনস্টেবল বলে উঠল, বস, হামাডের উচিট এই জায়গা হইটে কাটিয়া পড়া! মি. সিম্পসনকে যে ভাবে বোকা বানাইয়াছেন…
মি. সিম্পসনরূপী কুয়াশা একটা চেয়ারে বসল। বলল, থানায় পৌঁছে মি. সিম্পসন প্রমাণ করতে পারবেন তিনি কুয়াশা নন। কিন্তু সময় লাগবে প্রচুর। ভয়ের কিছু নেই, মি. ডি. কস্টা।
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন কিন্তু অপমানটা সহজে ভুলবেন না।
কুয়াশা বলল, জানি। কিন্তু সুযোগটা পেয়ে হাত ছাড়া করতে পারলাম না। ব্যাপার কি জানো, মি. সিম্পসন আমার পিছনে এমন ফেউ-এর মত লেগে আছেন যে বাইরে বেরিয়ে মুহূর্তের জন্যেও স্বস্তি পাই না। চোখে ধূলো দেবার জন্য ওর ছদ্মবেশ নিয়েই কিছুদিন থেকে বাইরে ঘুরছি। দেখলাম মি. সিম্পসন জীপ থেকে নেমে তোমার অফিসে ঢুকলেন। অমনি এসে হাজির হলাম। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ ঘুর ঘুর করছিল বাইরে, তাকে এবং কনস্টেবলগুলোকে বললাম, কুয়াশা আমার ছদ্মবেশে তোমার চেম্বারে রয়েছে। ওদেরকে চেম্বারের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে ঢুকি আমি।
শহীদ বলল, বুঝেছি। কিন্তু মি. সিম্পসনের পরিচয়পত্রটা কি হলো?
কুয়াশা মুচকি হেসে তাকাল ডি. কস্টার দিকে।
হামি চেম্বারে ঢুকিলাম কিন্টু কেহই আমাকে ডেকিটে পাইল না। ইন্সপেক্টর সাহেব বখন ডুইজন মি. সিম্পসনকেই গ্রেফটার করিবার আডেশ ডিলেন হামি টখন আসল মি. সিম্পসনের পাশে গিয়া ভঁড়াইলাম। সেই সময়ই টাহার পকেট মারি। হামি
কুয়াশা বলল, মি. ডি. কস্টার পকেটেই সেটা আছে এখনও। আমি যে পরিচয়-পত্রটা ইন্সপেক্টরকে দেখাই সেটা নকল, আমার সাথে সব সময় রাখি, কখন দরকার পড়ে বলা তো যায় না।
ক্রিং…ক্রিং…!
ক্রেডল থেকে ফোনের রিসিভার তুলে নিল শহীদ।
ডি. কস্টা দরজার দিকে পা বাড়াল দ্রুত, বলল, মি. সিম্পসনের ফোন-মাইগড! টাইম ঠাকিটে কাটিয়া পড়াই ভাল।
মি. সিম্পসনের কণ্ঠস্বর চিনতে পারুল শহীদ। অপর প্রান্ত থেকে তিনি বলছেন, শহীদ, রমনা থানা থেকে আমি মি. সিম্পসন বলছি। শয়তানটা কি এখনও তোমার অফিসে আছে?
শহীদের দিকে সাগ্রহে চেয়ে আছে প্রত্যেকে। মি. সিম্পসন ফোন করেছেন, বুঝতে পারছে সবাই। কি বলছেন তিনি তা জানার জন্যে সবাই উদগ্রীব।
শহীদ বলল, তার মানে? আপনিই.. মানে, আপনাকে…মানে ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ যাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল।
হ্যাঁ, আমি মি. সিম্পসনই গ্রেফতার হয়েছিলাম! ইন্সপেক্টর-ওটা একটা গর্দভ, শহীদ! কুয়াশা কি তোমার….
শহীদ বলল, আছে, এখনও আমার চেম্বারে আছে।
কথাটা শেষ না করে মুখ তুলে তাকাল শহীদ। দেখল ওর সামনের যে চেয়ারটায় কুয়াশা বসেছিল সেটা খালি পড়ে আছে, চেম্বারের কোথাও কুয়াশার ছায়াও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
না, মি. সিম্পসন, কুয়াশাকে দেখতে পাচ্ছি না। এই একটু আগেও ছিল সে…
মি. সিম্পসন দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, বুঝেছি! শয়তানটা পালিয়েছে। ঠিক আছে, ওকে আমি দেখে বে!
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে নিশ্চয়ই দোষ দিতে পারেন না।
না। তা পারি না। ছাড়ি, শহীদ।
হঠাৎ করেই ফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন মি. সিম্পসন।
রিসিভার নামিয়ে রেখে শহীদ বলল, মি. সিম্পসন আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
কামাল বলল, কুয়াশার ব্যাপারে তোর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মি. সিম্পসন চিরকালই অসন্তুষ্ট। অবশ্য মনে মনে।
শহীদ গম্ভীর হয়ে বলল, তা জানি। কিন্তু এই প্রথম তিনি তার ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন যে কুয়াশাকে আমি সমর্থন করি, সাহায্য করি তা তিনি পছন্দ করেন না।
কেউ কোন কথা বলল না।
শহীদই বলল আবার, এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে মি. সিম্পসনের সাথে এত দিনকার সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে বলে সন্দেহ হচ্ছে আমার, কামাল।
রুমাল বলল, সম্পর্ক আরও আগেই খারাপ হবার কথা ছিল। কি আর করাবাস্তবকে মেনে নিতে হবে আমাদের। আমরা তো আর কুয়াশার শত্রুতে পরিণত হতে পারি না। তাকে আমরা সমর্থন করে যাবই।
শহীদ সংক্ষেপে বলল, অবশ্যই।
.
০২.
পরের দিন। রাত সাড়ে নটা।
অফিসে নেই কেউ। একা শহীদ ওর চেম্বারে বসে শিল্পীর তৈরি করা রিপোর্টটা পরপর দুবার পড়ে নামিয়ে রাখল ফাইলটা ডেস্কের উপর। পাইপে নতুন করে টোবাকো ভরে অগ্নিসংযোগ করল ও। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে জুতোসহ পা দুটো তুলে দিল ডেস্কের উপর, তারপর চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে পাইপ টানতে লাগল।
ভাবছে শহীদ।
খেটেছে শিল্পী। গতকাল বিকেল থেকে আজ সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত, গত রাতের কয়েকটা ঘণ্টা বাদ দিয়ে, ছায়ার মত অনুসরণ করেছে মিসেস রাফিয়াকে। আধঘণ্টা সময় নিয়ে বিশদ ভাবে লিপিবদ্ধ করেছে সে তার অভিজ্ঞতা এবং আবিষ্কারগুলো। সাড়ে ছয়টায় মিসেস রাফিয়া তাদের গুলশানের বাড়ি থেকে কোন এক হোটেলে যাবে বিশেষ এক পার্টি উপলক্ষে, তাকে গভীর রাত পর্যন্ত অনুসরণ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে শিল্পী রিপোর্টে।
সোয়া ছয়টার সময় অফিস থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে শিল্পী। এখন বাজে সাড়ে নয়টা। মিসেস রাফিয়া সম্ভবত পার্টিতেই রয়েছে এখনও। শিল্পীও নিশ্চয়ই তার উপর নজর রেখেছে।
ভাবছে শহীদ।
মিসেস রাফিয়া একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার, সন্দেহ নেই। শিল্পীর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মিসেস রাফিয়ার মধ্যে ক্লেপটোম্যানিয়ার কোন লক্ষণই নেই। আজ সকালে সে মার্কেটিংয়ের জন্য নিউমার্কেট, রমনা ভবন এবং বায়তুল মোকাররমে। যায়। হাজারখানেক টাকার জিনিসপত্র কেনে সে। কসমেটিকস, বই, রাউজের কাপড়, স্যাণ্ডেল–এই ধরনের ছোটখাট জিনিস কেনে সে। কিন্তু চুরি সে করেনি।
অবশ্য এতে করে বিশেষ কিছু প্রমাণ হয় না। একজন ক্লেপটোম্যানিয়াক সবসময়ই যে চুরি করার তালে থাকবে তেমন কোন কথা নেই। চুরি করার প্রবণতা তার মধ্যে কখনও থাকে, কখনও থাকে না। মিসেস রাফিয়া, হয়তো সত্যিই এই অসুখে ভুগছে, কিন্তু হাতে-নাতে ধরা পড়তে কয়দিন সময় লাগবে।
তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে, মিসেস রাফিয়া সাধন সরকার নামে এক যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে। গতকাল এবং আজ, দুদিনে দুবার মিসেস রাফিয়া এই যুবকের সাথে গোপনে মিলিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে দুজনই সচেষ্ট ছিল, শিল্পী রিপোর্ট দিচ্ছে। ওরা ঢাকার বাইরে, নারায়ণগঞ্জের একটা অভিজাত রেস্তোরাঁয় গতরাতে খাওয়াদাওয়া করেছে, সেই একই রেস্তোরাঁয় আজ দুপুরেও লাঞ্চ খেয়েছে ওরা। শিল্পী যুবকের নামধাম, বাড়ির নাম্বার ইত্যাদি সংগ্রহ করতে ভুল করেনি। পুরানা পল্টনে সাধন সরকারের বাড়ি আছে। সৌখিন, প্লেবয় টাইপের, সিনেমার নায়কের মত চটকদার পোশাক পরতে অভ্যস্ত। এক্সপোর্ট-ইমপোটের ব্যবসা করে সে। প্রচুর টাকার মালিক।
দ্বিতীয় আবিষ্কারটা আরও অপ্রত্যাশিত। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত ফেয়ারভিউ নাইট ক্লাবের মালিক কাজী হানিফের সাথে ক্লাবে দেখা করেছে গতকাল সন্ধ্যার আগে মিসেস রাফিয়া। প্রায় ঘন্টাখানেক ছিল সে কাজী হানিফের সাথে। মিসেস রাফিয়া ক্লাবের গেটম্যানকে অনুরোধ করে বলে যে বিশেষ জরুরী একটা ব্যাপারে কাজী হানিফের সাথে সে দেখা করতে চায়, গেটম্যান ভিতরে গিয়ে কাজী হানিফকে ব্যাপারটা জানায়, তারপর ফিরে এসে মিসেস রাফিয়াকে ভিতরে নিয়ে যায়।
কাজী হানিফকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও, লোকটা সম্পর্কে জানা আছে শহীদের। চতুর, কৌশলী লোক। তার নাইটক্লাবে গোপনে. জুয়া খেলার আসর বসে এবং খেলায় অংশ গ্রহণ করে ধনী লোকেরা। প্রচুর কালো টাকার মালিক সে। টাকার প্রতি তার লোভ সীমাহীন। টাকার কথা শুনলেই নাকি তার জিভে পানি আসে, চোখ দুটো চকচক করতে থাকে আলোর সামনে ধরা হীরের মত। তার নাইট ক্লাবের উপর থেকে পুলিসের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্যে সে নাকি কয়েকজন অসৎ অফিসারকে প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে থাকে।
শহীদ ভাবছিল। কামাল এবং জামানকে কাজে লাগাতে হবে। ওরা সাধন সরকার এবং কাজী হানিফের সাথে মিসেস রাফিয়ার সম্পর্ক কি তা জানার চেষ্টা করবে আগামীকাল থেকে..।
চিন্তায় বাধা পড়ল শহীদের। চোখ খুলল না ও, পা দুটোও নামাল না ডেস্কের উপর থেকে। কিন্তু কান দুটো ওর খাড়া হয়ে উঠেছে।
একটা গাড়ি আসার শব্দ হয়েছে।
এক মুহূর্ত পর চোখ মেলল ও। গেট পেরিয়ে হালকা পদশব্দ এগিয়ে আসছে। নাকি ভুল শুনছে ও?
না–এই তো, করিডরে উঠে এসেছে পদশব্দ। ডেস্কের উপর থেকে পা দুটো নামিয়ে সিধে হয়ে বসল শহীদ। ড্রয়ার খুলে কি মনে করে আড়চোখে দেখে নিল লোডেড রিভলভারটা। খোলাই রইল ড্রয়ারটা, মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। কে এল? এমন অসময়ে..?
দরজাটা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
চেম্বারের ভিতর পা রাখল মিসেস রাফিয়া। বোম্বাই প্রিন্টের সিল্কের শাড়ি, সেই প্রিন্টেরই ছোট্ট একটা টুকরো দিয়ে তৈরি করা ব্লাউজ পরনে তার। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটা প্রকাণ্ড আকারের। দুধে আলতায় গায়ের রং তারই সাথে ম্যাচ করা রঙের লিপস্টিক মাখানো ঠোঁট।
আপনি একা দেখছি!
আর কেউ নেই জেনেই এসেছে এ সময় ও, ভাবল শহীদ। বলল, মিসেস রাফিয়া, আপনি? এত রাতে!
পা বাড়াল মিসেস রাফিয়া। ডেস্কের সামনে দাঁড়াল। হাঁটার ভঙ্গি, দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় এই মেয়ে সত্যি নর্তকী। সব কিছুর মধ্যে একটা ছন্দ আছে, তার চেয়েও বেশি আছে দেহ প্রদর্শন করার উগ্র তাড়না। এক বাকা হয়ে দাঁড়িয়ে কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ভাব এনে বলল, আমার পেছনে স্পাই লাগানো হয়েছে। জানতে চাই–কেন।
মনে মনে অবাকই হলো শহীদ শিল্পীর অস্তিত্ব মিসেস রাফিয়া টের পেয়ে গেছে। বুঝতে পেরে। পাইপ কামড়ে ধরে শহীদ বলল, বসুন, মিসেস রাফিয়া। আপনি এই রাতে আমার কাছে এসেছেন–আপনার স্বামী ব্যাপারটা পছন্দ নাও করতে পারেন।
মিসেস রাফিয়া বলল, না। উত্তরটা দিল অবশ্য সাথে সাথে এবং উত্তপ্ত কণ্ঠে, নেভার মাইণ্ড! এমন হাজার হাজার ব্যাপার আছে যা আমার স্বামী পছন্দ করেন না! সেগুলোর সাথে না হয় আর একটা যোগ হলো। আমি জানতে চাইছি, আমার পিছনে মেয়েটাকে লাগিয়েছেন কেন?
শহীদ বলল, ধরুন, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই আমি।
মিসেস রাফিয়া চেয়ে রইল নিস্পলক। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার সরু ঠোঁটে। বলল, ভুল করেছি, মনে হচ্ছে। আমার ধারণা ছিল আপনি আমাকে দেখে খুশি হবেন। বেশির ভাগ পুরুষই তাই হয়। মি. শহীদ, যদি কিছু মনে না করেন।
শহীদ ঠোঁট থেকে পাইপ নামিয়ে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, মিসেস রাফিয়া, যদি কিছু মনে না করেন, দয়া করে আপনি বিদায় নিন। আমি এখন খুব ব্যস্ত।
মিসেস রাফিয়ার মুখের হাসি এতটুকু মান হলো না, বরং তা যেন আরও বিস্তৃত, আরও মাদকতাময় হয়ে উঠল। পিচ্ছিল শাড়িটা বারবার খসে পড়ছে কাঁধ থেকে, দেখা যাচ্ছে পেট-পিঠের উজ্জ্বল ত্বক। ডেস্কের উপর হাত রেখে শহীদের দিকে ঝুঁকে পড়ল সে, দামী সেন্টের গন্ধ ঢুকল শহীদের নাকে। আবার মিসেস রাফিয়ার কাধ থেকে খসে পড়েছে শাড়ি।
শহীদ রূঢ় গলায় বলে উঠল, মিসেস রাফিয়া, শাড়িটা তুলুন, ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হতে পারে আপনার।
মুহূর্তের জন্য হাসিটা উবে গেল মিসেস রাফিয়ার মুখ থেকে। কিন্তু পর মুহূর্তে আবার সেই মায়াময় হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখটা, বলল, আপনি বিবাহিত, সম্ভবত। আপনার স্ত্রী কি আমার চেয়েও সুন্দরী?
শহীদ জানতে চাইল, আপনি আমার অফিসের ঠিকানা পেলেন কোত্থেকে?
শব্দ করে হাসল মিসেস রাফিয়া। বলল, সহজেই জেনে নিয়েছি। আপনার গাড়ির নাম্বার গতকাল দেখেছিলাম আমি সুইমিং পুলে নামার আগে। এবং বাটলার আমাকে আপনার প্রতিষ্ঠানের এবং আপনার নাম বলেছিল। টেলিফোন গাইড দেখে বাকিটা জেনে নিয়ে মেয়েটার চোখে ধুলো দিয়ে চলে এসেছি…।
শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠল, আমার কাছে না এসে আপনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতেন। তাঁর আপত্তি না থাকলে তিনি হয়তো সঠিক উত্তর দিতেন।
মিসেস রাফিয়া আরও ঝুঁকল শহীদের দিকে, বলল, উত্তরটা আমি আপনার কাছ থেকে চাই।
শহীদ উঠে দাঁড়াল, মাফ করবেন, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অপারগ। রাত হয়েছে অফিস বন্ধ করব আমি।
কত টাকা পাচ্ছেন আপনি এই কাজের জন্য, মি. শহীদ?
শহীদ বলল, এ কথা জানতে চাইবার মানে?
মিসেস রাফিয়া ডেস্ক ঘুরে শহীদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আমাকে কেউ অনুসরণ করুক, আমার ওপর কেউ নজর রাখুক, এ আমি সহ্য করতে রাজি নই। যে কোন মূল্যে এটা বন্ধ করতে চাই আমি। মি. শহীদ, কি চান আপনি? এন্টারটেইনমেন্ট, অর মানি? দুটোর যে কোন একটা কিংবা দুটোই আপনি আমার কাছ থেকে পেতে পারেন।
শান্তকণ্ঠে বলল শহীদ, আপনার প্রস্তাবে আমি এতটুকু বিস্মিত হচ্ছি না। আপনি যেমন, আপনার প্রস্তাবগুলোও ঠিক তেমনি।
দশ হাজার টাকা পেলে…?
দুঃখিত, মিসেস রাফিয়া। আপনি আমাকে দশ লাখ টাকা দিয়েও কিনতে পারবেন না।
মিসেস রাফিয়া এতক্ষণে শহীদকে যেন চিনতে পেরেছে বলে মনে হলো। হাসি অদৃশ্য হবার সাথে সাথে তার সুন্দর মুখে ফুটে উঠল কুটিল রেখা। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। চাপা, হিসহিসে গলায় বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে? বুঝতে পারছি আপনি সাধু-পুরুষদের একজন। কিন্তু দয়া করে আপনার ক্লায়েন্টকে যদি একটা কথা আমার হয়ে জানান তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তাকে বলবেন, সে যদি ডাইভোর্সই চায়–বেশ তো, আমি রাজি আছি। কিন্তু এ-ও বলবেন তাকে, তার টাকার লোভেই তাকে আমি বিয়ে করেছিলাম। টাকা ছাড়া কেন আমি অমন একটা বুড়োকে বিয়ে করতে যাব–তা, কোন বুদ্ধিমতী মেয়ে করে? তাকে বলে দেবেন, আমার পিছনে স্পাই লাগিয়ে কোন লাভ হবে না। অত সহজে আমাকে ধরা সম্ভব নয়। বলে দেবেন, ডাইভোর্সে আমি রাজি আছি–কিন্তু প্রচুর, প্রচুর টাকার বিনিময়েই তা সম্ভব।
রাগে ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে মিসেস রাফিয়ার। হাঁপাচ্ছে সে।
আমার পেছনে কেন, নিজের মেয়ের পেছনে স্পাই লাগাতে পারে না সে? তাকে বলবেন, নিজের মেয়ের পেছনে স্পাই লাগাতে। আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার জানতে পারবে সে! চললাম!
শহীদকে কোন কথা বলার অবকাশনা দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল মিসেস রাফিয়া চেম্বার থেকে। সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তার পিছনের দরজাটা। শোনা যাচ্ছে হাই হিলের দ্রুত শব্দ-খট খট খট…
শহীদ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক সেকেণ্ড পর কানে এল একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ।
হাত বাড়িয়ে ডেস্ক থেকে লাইটারটা তুলে নিয়ে পাইপে অগ্নিসংযোগ করল, শহীদ। অন্যমনস্ক, চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে।
.
গভীর, নিস্তব্ধ রাত্রি। ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ফোনের বেল। ক্রিং ক্রিং…ক্রিং… ক্রিং…। একই সাথে টুটে গেল ওদের দুজনের ঘুম।
মহুয়া ডাকল, শুনছ?
বিছানায় উঠে বসল শহীদ। বলল, এত রাতে.. কার ফোন হতে পারে?
বেডরূমের দুই প্রান্তে দুটো বিছানা। মহুয়াও তার বিছানায় উঠে বসেছে। হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা অন করে দিতে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলে উঠল। টেবিলকুকটার দিকে তাকাল শহীদ। পৌনে তিনটে বাজে।
মহুয়ার কণ্ঠ একটু বেসুরো শোনাল, মনটা কেমন যেন দমে গেল–নিশ্চয়ই কোন খারাপ খবর।
শহীদ ইতিমধ্যে হাত বাড়িয়ে তেপয়ের উপর রাখা ক্রেডল থেকে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়েছে, শহীদ খান স্পীকিং।
সিম্পসন, থানা হেড কোয়ার্টার থেকে বলছি। শহীদ, বাধ্য হয়ে এত রাতে ঘুম ভাঙাতে হলো তোমার। একটা ঘটনা ঘটেছে–কিন্তু ঘটনাটার গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পারছি না। এই মাত্র কিছুক্ষণ আগে এক লোক একটা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে এসেছে, ওটা মিস শিল্পীর। যতদূর জানি, শিল্পী তোমার অফিসে কাজ করছে, তাই না?
মি. সিম্পসন-কি যেন চেপে রাখছেন আপনি। শিল্পীর ভ্যানিটি ব্যাগ পাওয়া গেছে–শুধু এই খবরটা দেবার জন্যে আপনি ফোন করেননি।
মি. সিম্পসন চুপ করে রইলেন। কয়েক সেকেণ্ড পর শান্ত স্বরে বললেন, হয়তো ব্যাপারটা কিছুই না, শহীদ। ব্যাগটা শিল্পীর বলেই থানা ইনচার্জ সরাসরি আমাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানায়। আমি বাড়ি থেকেই শিল্পীর ফ্ল্যাটে ফোন করেছিলাম, কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। তারপর চলে এসেছি এখানে। ভ্যানিটি ব্যাগটা পরীক্ষা করেছি আমি। এটা শিল্পীরই। পাওয়া গেছে ধানমণ্ডি লেকের কাছে। সেখানে রক্তের দাগও দেখা গেছে।
শহীদের বুকের ভিতরটা দুলে উঠল, রক্তের দাগ দেখা গেছে?
ব্যাগটা যে নিয়ে এসেছে সে অন্তত তাই বলছে। আমি নিজে যাচ্ছি জায়গাটা দেখতে। তুমি যেতে চাইলে।
শহীদ বলল, আমি যাচ্ছি।
আমি তোমার বাড়িতে আসছি-সাত মিনিটের মধ্যে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে লাফ দিয়ে নামল শহীদ বিছানা থেকে কার্পেটের উপর। ওয়ারড্রোবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। মহুয়াও বিছানা থেকে নেমে পড়ল। কি হয়েছে গো?
শহীদ ওয়ারড্রোব খুলে কাপড় চোপড় বের করতে করতে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। শিল্পীর হ্যাঁণ্ড ব্যাগটা পাওয়া গেছে লেকের ধারে, রক্তের দাগও দেখা গেছে সেখানে মি. সিম্পসন আসছেন, আমি যাব জায়গাটা দেখতে।
শিল্পী…?
শহীদ দ্রুত কাপড়-চোপড় পরে নিল। ড্রয়ার খুলে লোডেড রিভলভারটা ভরল পকেটে। ফোনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল একবার, চোখ তুলল মহুয়ার দিকে, আমি নিচে অপেক্ষা করছি মি. সিম্পসনের জন্যে। তুমি কামালকে ফোন করে জানাবে।
শিল্পী কি? ভয়ঙ্কর প্রশ্নটা পুরোপুরি উচ্চারণ করতে পারল না মহুয়া।
জানি না।
দ্রুত, প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল শহীদ রূম থেকে। শহীদের গমন পথের দিকে বোবাঃদৃষ্টিতে চেয়ে রইল মহুয়া। কয়েক মিনিট পর নিচ থেকে ভেসে এল গাড়ির শব্দ। মহুয়া জানালার দিকে তাকাল। কিন্তু সেদিকে না এগিয়ে পা বাড়াল ফোনের দিকে।
.
জীপ ছেড়ে দিলেন মি. সিম্পসন। নির্জন, আলো-অন্ধকারে ঢাকা, সরল, প্রশস্ত পথ। তীরবেগে ছুটতে শুরু করেছে জীপ। মি. সিম্পসনের পাশে চুপচাপ বসে আছে। শহীদ।
হয়তো ব্যাপারটা কিছুই নয়, ফলস্ অ্যালার্ম। বললেন বটে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল মি. সিম্পসন কথাটা নিজেই বিশ্বাস করছেন না। খারাপ কিছু একটা ঘটেছে, মনে মনে জানেন তিনি। তা না হলে তার মত একজন অফিসার এই রাতে ঘুম থেকে উঠে এমন তৎপর হয়ে উঠতেন না, শহীদেরও ঘুম ভাঙাতেন না।..
শহীদ জানতে চাইল, লোকটা কে? লেকের ধারে এত রাতে কি করছিল সে?
লোকটার মাথায় গোলমাল আছে। এলাকার সব মানুষ চেনে তাকে। বিদঘুঁটে চরিত্র একটা, কিন্তু নিরীহ টাইপের। বহু বছর ধরে রাতে ঘুমায় না। আমাদের লোকেরাও তাকে চেনে ভাল করে। সারারাত জেগে টেলিস্কোপ দিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে নক্ষত্র দেখে। নাম দেলোয়ার মোরশেদ।
লোকটা সম্পর্কে কোন আগ্রহ বোধ করল না শহীদ।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, শিল্পীর হাতে কি কোন কাজ ছিল?
সরাসরি মিথ্যে কথা বলল শহীদ, না। আমি অন্তত ওকে কোন কাজ দিইনি।
মোহাম্মদ তোয়াব খানকে কথা দিয়েছে ও, তাঁর নাম পুলিসের কাছে প্রকাশ করবে না। তার কাছ থেকে অনুমতি না পেলে কথার মূল্য রাখতে হবে ওকে।
লেকের কাছে থামল জীপ। রাস্তার পাশে নামল ওরা পিছনের কনস্টেবলের দ্দেশে মি. সিম্পসন বললেন, আমরা যেদিকে যাব, জীপ ঘুরিয়ে হেডলাইটের আলো সেদিকে ফেলবার চেষ্টা করো। এসো, শহীদ। সামনে একটা গাছের মোটা ডাল পড়ে আছে। সেখান থেকে মাত্র হাত বিশেক বাঁয়ে পাওয়া গেছে ব্যাগটা।
মি. সিম্পসনের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শহীদ বলল, দেলোয়ার যারশেদকে সাথে আনেননি কেন?
আধ-পাগলা লোক। বেজায় বকবক করে। অসুবিধে হবে না, জায়গাটার পাশে ছোট ছোট পাথর জড়ো করে রেখে গেছে সে, যাতে সহজে চেনা যায়।
টর্চের আলোয় পথ দেখতে দেখতে এগোচ্ছে ওরা। লেকটা দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে, দূরে দূরে, উঁচু উঁচু বাড়ি। মানুষজন নেই কোথাও। শেষ রাতের হিমেল বাতাস লাগছে চোখেমুখে। শক্ত, কঠিন আকার ধারণ করেছে শহীদের মুখের চেহারা।
ওই তো!
গাছের লম্বা ডালটা দেখতে পেলেন মি. সিম্পসন। দিক পরিবর্তন করল ওরা সামান্য, চলার গতি বাড়িয়ে দিল। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে পাথরের একটা ছোট স্তূপ। জীপের হেডলাইট ঘুরে গেছে, আলোকিত হয়ে উঠেছে চারদিক।
দাঁড়াল ওরা।
পাথরের স্তূপের পাশেই জমাট বাঁধা রক্ত-কালচে হয়ে গেছে। শক্ত শুকনো মাটি। রক্ত ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। পায়ের ছাপ আবিষ্কার করার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নত করে চারপাশের মাটি পরীক্ষা করল শহীদ। আশপাশের মাটি আলগা হয়ে আছে কয়েক জায়গায়, কিন্তু ফোন ছাপ নেই।
মি. সিম্পসন রুমাল দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে দেখছিলেন শহীদকে। শহীদ সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াতে তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ওই ঝোপটা-চলো দেখে আসি।
আশপাশে ছোট ছোট অনেক ঝোঁপ। কিন্তু মি. সিম্পসন যেটার কথা বললেন সেটা সবগুলোর চেয়ে বড় এবং উঁচু।
শহীদের দিকে তাকালেন না মি. সিম্পসন। ওর চোখে চোখ রাখতে পারছেন না তিনি।
জীপের হেডলাইট ঘুরছে আবার। কনস্টেবলটি বুঝতে পেরেছে বড়সড় ঝোপটার দিকেই যাচ্ছে ওরা।
মি. সিম্পসনকে অনুসরণ করছিল শহীদ নিঃশব্দে। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল ও। একসময় দাঁড়িয়ে পড়ল। পা দুটো চলছে না আর।
মি. সিম্পসন একা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ঝোঁপের সামনে। হাত দিয়ে ঝোপের সরু সরু ডাল-পালা সরিয়ে ভিতরে তাকালেন তিনি। হেডলাইটের আলোয় তার পিছনটা দেখা যাচ্ছে। দেহটা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তার। মানুষ নয়, একটা স্থির, নিষ্প্রাণ মূর্তি বলে মনে হলো তাকে মাত্র দশ-বারো হাত পিছন থেকে।
ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলেন তিনি দুই পা। ঘুরে দাঁড়ালেন। শহীদের চোখে চোখ রাখলেন।
কেউ কোন কথা বলল না–অনেকক্ষণ।
তারপর, একসময় শহীদ পা বাড়াল।
শহীদ সামনে গিয়ে দাঁড়াতে মি. সিম্পসন ঘুরে দাঁড়ালেন আবার। শহীদের কাঁধে হাত দিয়ে পরপর দুবার আলতো ভাবে চাপড় মারলেন। সান্ত্বনা দেবার আর কিই বা উপায় আছে। অপর হাতটা দিয়ে মি. সিম্পসন ঝোঁপের ডাল-পালা সরালেন।
মরে গেলেও, পুতুলের মত সুন্দর দেখাচ্ছে শিল্পীকে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। চুলে, মুখে মাটি লেগে রয়েছে। কপালের একটু উপরে বুলেটের গভীর গর্তটা নির্মম বাস্তব হলেও কৃত্রিম বলে মনে হচ্ছে।
চোখ ফিরিয়ে নিল শহীদ। মুখ মুছতে গিয়ে রুমালটা দিয়ে চেপে ধরল চোখ দুটো। শিল্পীর পরনে কোন কাপড় নেই। না শাড়ি, না রাউজ, না পেটিকোট-কিছুই না।
মি. সিম্পসন এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে পিছন দিকে আকর্ষণ করলেন শহীদকে। শহীদ ডান হাত দিয়ে মি. সিম্পসনের হাতটা ধরে সরিয়ে দিল, নিজেই ঘুরে দাঁড়াল, পা বাড়াল জীপের দিকে। মি. সিম্পসন নত মস্তকে অনুসরণ করলেন। নিচু গলায় কিছু বলতে গেলেন তিনি, কিন্তু সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেলেন না, চুপ করেই রইলেন।
.
০৩.
থানা হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে ফোন করল শহীদ বাড়িতে।
মহুয়া ইতিমধ্যে আঁচ করতে পেরেছে ঘটনাটা, তার কান্না-রুদ্ধ কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল।
শিল্পীকে…কি খবর, শহীদ?
শহীদ চেষ্টা করে শান্ত ভাবে বলল, খবর খারাপ, মহুয়া। শিল্পী: হ্যাঁ, খুন হয়েছে ও। আমি আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরছি।
মহুয়াকে আর কিছু না বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। খানিক পর মি. সিম্পসন ফিরলেন। মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করার জন্যে গিয়েছিলেন।
চুরুট ধরিয়ে শহীদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অনেক কথা জানতে চান, অনেক প্রশ্ন মাথা খুড়ে মরছে তার মনে। কিন্তু কিভাবে শহীদকে প্রশ্ন করে উত্তর নেবেন ভেবে ঠিক করতে পারছেন না।
শহীদও মনে মনে তৈরি হয়ে আছে। ও জানে, মি: সিম্পসন প্রশ্ন করবেন।
মি. সিম্পসন বললেন, আমি আরও পরে তোমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করব। তোমার মানসিক অবস্থার কথা আমি বুঝতে পারছি। তুমি বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নাও, শহীদ। শিল্পীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমার। তবে, যাই বলো, তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাবার আশা করি আমি।
উত্তরে শহীদ কোন কথাই বলল না। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোল। মি. সিম্পসন পিছন থেকে বললেন, এক মিনিট শহীদ।
শহীদ দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুরল না।
একটা মাত্র প্রশ্নের উত্তর চাই আমি তোমার কাছ থেকে। তুমি কি ভাবছ তা আমি জানি না। তবু, প্রশ্নটা আমি করছি।
কি প্রশ্ন, মি. সিম্পসন?
আমি জানতে চাই, শিল্পী কারও হয়ে কোন কাজ করছিল কি না।
কারও হয়ে?
মি. সিম্পসনের কণ্ঠস্বর তাঁর নিজেরই অজান্তে কঠিন হয়ে উঠল, আমি আশার কথা বলছি, শহীদ।
না, মি. সিম্পসন।
শহীদ পা বাড়াল কথাটা বলে। বেরিয়ে গেল অফিস রুম থেকে।
মি. সিম্পসনও চেয়ার ছাড়লেন। অস্থির, উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাঁকে। হ্যাটটা খুলে টেবিলে রাখলেন। পায়চারি করতে শুরু করলেন। মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে বললেন, রহস্যটা কি? কেন শহীদ সব কথা খুলে বলছে না আমাকে?
শহীদ ভেবেছিল মহুয়াকে শোকে ভেঙে পড়া অবস্থায় দেখবে ও। কিন্তু মহুয়া দরজা খুলে দিতে সে,ভুল ভাঙল ওর। নিজেকে সংযত করে নিয়েছে মহুয়া। শহীদের একটা হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল সোফার পাশে, বলল, বসো তুমি কফি তৈরি করে রেখেছি, নিয়ে আসি।
ধীরে ধীরে বসল শহীদ সোফায়। বলল, কফির দরকার নেই, মহুয়া। কামাল কোথায়? ফোন করোনি ওদেরকে তুমি?
চুপচাপ এইখানে এক মিনিট বসো তুমি। ওসব কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। কামালকে পাঠিয়েছি আমি মি. তোয়াব খানের বাড়িতে। আর জামান গেছে ফ্ল্যাটে।
মহুয়া শহীদের কপালে হাত বুলিয়ে দিল একবার, তারপর ত্রস্ত পদক্ষেপে চলে গেল ড্রয়িংরুম থেকে।
খানিক পরই ফিরে এল ও একটা ট্রে নিয়ে। ট্রেটা নামিয়ে কেটলি থেকে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে স্বামীর দিকে তাকাল।
শহীদ চোখ বুজে বসে আছে।
নিঃশব্দ পায়ে ড্রয়িংরূমের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল কামাল। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল, প্যান্টের দুই পকেটে দুটো হাত ঢোকানো, মাথার চুল এলোমেলো। চোখের কোণে পানি।
কি বলল তোয়াব খান? চোখ না খুলেই প্রশ্ন করল শহীদ। ভিতরে ঢুকল কামাল, চোখের দৃষ্টি কার্পেটের দিকে।
মহুয়া কফির পেয়ালায় চিনি ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়ছিল, হাতটা স্থির হয়ে গেছে তার। চেয়ে আছে সে কামালের দিকে।
মুখ না তুলেই কামাল ভারি গলায় ধীরে ধীরে বলল, পাগলের মত আচরণ করছেন। প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি। যখন বিশ্বাস হলো, জানতে চাইলেন শিল্পী মিসেস রাফিয়াকে অনুসরণ করছিল তা পুলিসকে জানানো হয়েছে কিনা। শিল্পীর মৃত্যুটাকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তার সম্মান যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যে তাকে অস্থির দেখলাম।
মুখ তুলে শহীদের দিকে তাকাল কামাল, মি. সিম্পসনকে বলেছিলি তুই, শিল্পী কাজ করছিল তোয়াব খানের হয়ে?
না। অস্বীকার করেছি আমি। কিন্তু খবরটা শেষ পর্যন্ত চাপা থাকবে বলে মনে হয় না। মি. সিম্পসন কারও চেয়ে কম বুদ্ধিমান নন। আমি কথা দিয়েছিলাম তোয়াব খানকে।
কামাল বসল ধীরে ধীরে শহীদের মুখোমুখি। বলল, হ্যাঁ। তুই কথা দিয়েছিস এ ব্যাপারে পুলিসকে কিছুই জানাৰি না-কমপক্ষে একশো বার কথাটা উল্লেখ করেছেন তোয়াব খান। শুধু তাই না, একরকম হমকি দিয়েই বলেছেন, আমরা পুলিসকে জানালেও তিনি গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করে যাবেন। অর্থাৎ তিনি যে আমাদেরকে তার স্ত্রীর পেছনে কাজে লাগিয়েছিলেন তা স্বীকার করবেন না।
শহীদ চোখ খুলল। মহুয়ার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে চুমুক দিল ছোট্ট করে, বলল, এই রকম বলবেন আমিও তাই ভেবেছিলাম। যাক, কথা যখন দিয়েছি তখন যতক্ষণ সম্ভব রক্ষা করতে হবে। যদিও, খুন হলেও পুলিসের কাছে মুখ খুলতে পারব না তেমন কথা আমি দিইনি। তবে এটা কোন সমস্যা নয়। আমাদের সামনে একটাই কাজ, খুনীকে খুঁজে বের করা।
স্পষ্ট নয় কিছু এখনও। হয়তো মিসেস রাফিয়াকে যে ব্ল্যাকমেইল করছে শিল্পী তাকে চিনে ফেলায় সে শিল্পীর মুখ বন্ধ করার জন্যে খুন করেছে।
শিল্পী…মানে, কিভাবে খুন হয়েছে ও?
কপালের উপরে, ৪৫ পিস্তলের গুলি, পনেরো গজ দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, ওর পরনের সব কাপড়চোপড় খুনী খুলে নিয়ে গেছে কেন?
কামাল বলল, পনেরো গজ দূর থেকে তার মানে, গুলি করতে অভ্যস্ত, খুবই পটু খুনী।
শহীদ বলল, হ্যাঁ। পাকা হাতের কাজ।
আমাদের প্রথম পদক্ষেপ কি হবে তাহলে?
কামালের প্রশ্নের উত্তরে শহীদ বলল, আমি এখুনি মিসেস রাফিয়ার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
মহুয়া বলল, মাত্র সাড়ে পাঁচটা বাজে…।
কামাল মহুয়াকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বলে উঠল, মিসেস রাফিয়ার সাথে দেখা হবে না, শহীদ। সে নেই।
নেই! নেই মানে?
কামরার ভিতর যেন বোমা ফাটল।
কামাল বলল, আমিই দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোয়াব খান প্রত্যাখ্যান করেছেন। বললেন, এই মুহূর্তে শহর থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন তিনি মিসেস রাফিয়াকে। এতক্ষণে বোধহয় চলে গেছে সে।
শহীদ জোর দিয়ে বলল, যেখানেই যাক, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। খুনীকে সে চেনে।
কামাল বলল, ঠিক এই কথাই আমি তোয়াব খানকে বলেছি। কিন্তু তাঁর বক্তব্য, মিসেস রাফিয়া এ সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানে না–এবং তার সাথে আমরা যদি দেখা করার চেষ্টা করি তাহলে তার জন্যে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।
শান্ত গলায় বলল শহীদ, জবাবদিহি আমরা দেব না, নেব। মিসেস রাফিয়াকে খুঁজে বের করব আমরা।
কামাল বলল, ব্ল্যাকমেইলারই যে খুনী তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না, শহীদ। একমাত্র তোয়াব খানের কাছ থেকে ধারণাটা পেয়েছি আমরা যে, একজন ব্ল্যাকমেইলারের অস্তিত্ব আছে। মিসেস রাফিয়া গত মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিল–সেটা কোন ব্ল্যাকমেইলারকে দেবার জন্যে নাও হতে পারে। মিসেস রাফিয়া হয়তো কারও সাথে গোপনে প্রেম করছে, তাকে সাহায্য করার জন্যও তো টাকাটা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারে?।
শহীদ প্রসঙ্গ বদলে বলল, তোয়াব খানের মেয়ে ঋতুর সাথে কথা বলতে হবে। মিসেস রাফিয়াকে মোটেই পছন্দ করে না সে।
কামাল বলল, ঠিক বলেছিস। আর কার কাছে যাচ্ছি আমরা?
শিল্পীর ভ্যানিটি ব্যাগটা যে পেয়েছে–লোকটার নাম দেলোয়ার মোরশেদ। ঠিক বুঝতে পারছি না সরাসরি তার সাথে দেখা করে কথা বলব, না মি. সিম্পসনের কাছ থেকে জেনে নেব তার বক্তব্য। আমরা যদি লোকটার সাথে দেখা করি তাহলে মি. সিম্পসনের সন্দেহ ঘনীভূত হবে। অপরদিকে লোকটাই হয়তো মি. সিম্পসনকে এমন সব তথ্য দেবে যা পেয়ে তিনি অনেক কিছু বুঝে ফেলবেন। লোকটা হয়তো যা বলেছে তার চেয়ে বেশি কিছু জানে।
কামাল বলল, আমার তা মনে হয় না।
শহীদ বলল, এদিকে, সাধন সরকারের ওপর নজর রাখতে হবে আমাদের। শিল্পীর রিপোর্ট অনুযায়ী, গোপনে প্রেম চলছে সাধন সরকারের সাথে মিসেস রাফিয়ার। সাধন সম্পর্কে খোঁজ নেব আমি।
কামাল বলল, সত্যি যদি কোন ব্ল্যাকমেইলার থেকে থাকে, আমার ধারণা সে কাজী হানিফ ছাড়া আর কেউ নয়। বৈধ কোন কাজ আজ পর্যন্ত করেনি সে। মিসেস রাফিয়া কেন, কি এমন জরুরী ব্যাপারে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল? এই দেখা করার কারণটা জানতে পারলে অনেক রহস্য সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করি আমি।
শহীদ বলল, তুই মিসেস রাফিয়ার অতীত জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবি। আমি যাচ্ছি ঋতুর সাথে কথা বলতে।
পদশব্দ কানে ঢুকল ওদের।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দিনের প্রথম আলো ঢুকছে। মান, নিষ্প্রভ আলো। সূর্য ওঠেনি এখনও।
জামানকে দেখা গেল দোরগোড়ায়।
শহীদ বলল, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি, জামান।
এতক্ষণ নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত রাখতে পেরেছিল জামান। কিন্তু শহীদকে দেখে বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। ঢোক গিলল ঘন ঘন, ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল।
মহুয়া নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল, এসো, জামান, তোমার জন্যে কফি রেখেছি।
দ্রুত সামলে নিল জামান নিজেকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, ডান হাতটা ঢুকে গেল প্যান্টের পকেটে। শহীদের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, হাতটা বেরিয়ে এল পকেট থেকে। বলল, শিল্পীর রিপোর্ট বুক এবং এই নেকলেসটা ওর ফ্ল্যাট থেকে পেয়েছি। শিল্পীর নয় নেকলেসটা, কিন্তু কার তা জানি না।
জামান ঝুলিয়ে ধরেছে দামী পাথর বসানো একটা নেকলেস শহীদের সামনে। দেখেই চিনতে পারল শহীদ। মিসেস রাফিয়ার নেকলেস এটা।
নেকলেসটা হাত বাড়িয়ে নিল শহীদ, পরীক্ষা করতে করতে প্রশ্ন করল, ওর ফ্ল্যাটের কোথায় পেয়েছ এটা?
কার্পেটের নিচে। ওর বেডরূমের কোন জায়গা পরীক্ষা করতে বাকি রাখিনি। সবশেষে কার্পেট তুলে মেঝেটা দেখতে চেষ্টা করি। অম তন্ন তন্ন করে কি যে খুঁজছিলাম আমি নিজেই তা জানি না। যাক, কার্পেটটা তুলতেই ওটা দেখতে পেলাম। আর একটু হলেই ইন্সপেক্টর গনির হাতে পড়ে যেত এটা। কয়েক সেকেন্ড পরই তিনি হাজির হন। সব কথা ওঁর কাছ থেকেই শুনেছি আমি।
তোয়াব খান সম্পর্কে ইন্সপেক্টর গনিকে…।
না, কিছু বলিনি। তার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিইনি আমি।
শহীদ বলল, গুড। এটা মিসেস রাফিয়ার নেকলেস, সন্দেহ নেই।
তুমি জানলে কিভাবে?
শহীদ গত রাত্রের ঘটনাটার কথা বিশদভাবে জানাল ওদেরকে। সবশেষে বলল, এই নেকলেসটাই তখন তার গলায় দেখেছিলাম আমি। এটার দাম হবে কমপক্ষে চল্লিশ হাজার টাকা। জামান, শিল্পীর মুভমেন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব তোমার ওপর। গুলিবিদ্ধ হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত, যদি সম্ভব হয়। নেকলেসটা ওর বেডরূমে গেল কিভাবে জানতে হবে আমাদের। ফেয়ার ভিউ নাইট ক্লাবের গেটম্যানের সাথে দেখা করে জানার চেষ্টা করবে শিল্পীকে সে দেখেছিল কিনা। তবে, সাবধান, তোয়াব খান সম্পর্কে কাউকে কিছু বোলো না। ওদের ব্যাপারটা আমরা পুলিসের কাছে চেপে যাচ্ছি। জামান, বলতে পারো শিল্পীর পরনে কি ছিল?
জামান বসল মহুয়ার পাশে। মহুয়ার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে তেপয়ের উপর নামিয়ে রাখল, শহীদের দিকে তাকিয়ে বলল, ওর ওয়ারড্রোব খুলে যা দেখলাম, তাতে মনে হলো লাল জর্জেটের শাড়িটা ছিল ওর পরনে।
কামাল বলল, ওর পরনের পোশাক নিয়ে গেছে খুনী-এটা সবচেয়ে বড় রহস্য।
শহীদ বলল, কামাল, এতক্ষণ ধরে ভাবনা-চিন্তা করেও একটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না। ব্ল্যাকমেইলার লোকটা, যেই হোক সে, খুন করতে পারে শিল্পীকে বলেছিলাম। কিন্তু কেন, কেন খুন করবে সে? মিসেস রাফিয়ার চুরি করার বদভ্যাস আছে, কেউ সেটা জানে। এবং সে জানে বলেই মিসেস রাফিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ পাচ্ছে। ব্ল্যাকমেইলারকে ধরা যাক, শিল্পী চিনে ফেলেছিল। কিন্তু তাতে কি? ব্ল্যাকমেইলার শিল্পীকে ভয় করবে কেন? শিল্পী তার কি ক্ষতি করতে পারত? পুলিশকে খবর দিতে পারত শিল্পী, তোয়াব খানকে জানাতে পারত-কিন্তু ব্ল্যাকমেইলারের কি ক্ষতি হত তাতে? সে মিসেস রাফিয়াকে ব্ল্যাকমেইলিং করছে এর কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই। মিসেস রাফিয়া, স্বভাবতই নিজের দুর্বলতার জন্যে, ব্লাকমেইলিংয়ের কথা স্বীকার করবে না কোনদিন। ব্ল্যাকমেইলারের ভয়টা তাহলে কোথায়? কেন সে শিল্পীকে খুন করতে যাবে?
কামাল বলল, তোর কথায় যুক্তি আছে। আমিও তোর সাথে একমত, ব্ল্যাকমেইলার খুন করেনি শিল্পীকে।
জামান বলল, মিসেস রাফিয়া এবং সাধন সরকার গোপনে প্রেম করছে। সাধন সরকার হয়তো টের পেয়ে যায় শিল্পী তাদের সম্পর্কটা জেনে ফেলেছে, তাই সে…।
শহীদ বলল, অসম্ভব! আমিও এমন বোকা হয়ে গিয়েছিলাম যে প্রথমে ওই কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এও সম্ভব নয়। শিল্পীকে খুন করে কি লাভ সাধন সরকারের? প্রচুর টাকার মালিক সে, তাই না? ওরা যদি পরস্পরকে সত্যি তালবাসে তাহলে মিসেস রাফিয়ার করণীয় মাত্র একটাই, তোয়াব খানকে ডাইভোর্স করে সাধন সরকারকে বিয়ে করা। সাধন সরকার খুন করবে কেন শিল্পীকে?
কামাল বলল, আমরা ড্রয়িংরুমে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটা উপসংহারে পৌঁছুতে চাইছি। কোন লাভ হবে না। শিল্পী মিসেস রাফিয়ার উপর নজর রাখছিল, সত্যি কথা, কিন্তু খুন হয়েছে সে মিসেস রাফিয়ার সাথে সম্পর্কিত কোন কারণে এমন নাও হতে পারে।
শহীদ বলল, একি বলছিস তুই? শিল্পীর কোন শত্রু নেই এ তো আমরা সবাই জানি। তাছাড়া, মিসেস রাফিয়াকে অনুসরণ না করলে অত রাতে শিল্পী কি করছিল লেকের ধারে?
কামাল পাল্টা প্রশ্ন করল, তোর হাতে কোন প্রমাণ আছে, মিসেস রাফিয়াকে সেই সময় অনুসরণ করছিল শিল্পী?
শহীদ বলল, না, তেমন কোন প্রমাণ নেই।
কামাল উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন করল, আচ্ছা! নতুন একটা চিন্তা আসছে মাথায় শহীদ, মিসেস রাফিয়া শিল্পীকে খুন করেছে কিনা ভেবে দেখেছিস?
শহীদ উৎসাহ দেখাল না। বলল, দেখেছি। ৪৫-এর মত বড় পিস্তল কোন মেয়ে ব্যবহার করে না।
কামাল বলল, আর কোন দিক বিবেচনা করার আছে? নেকলেসটা! ওটা গেল কিভাবে শিল্পীর বেডরূমে?
শহীদ বলল, অনেক ভাবে যেতে পারে। শিল্পীর হত্যাকাণ্ডের সাথে মিসেস রাফিয়াকে জড়াবার জন্যে কেউ ষড়যন্ত্র করে ওটা ওখানে গোপনে রেখে আসতে পারে। ষড়যন্ত্রকারী হয়তো ভেবেছিল ওটা পুলিসের চোখেই পড়বে।
কামালকে উৎসাহিত হয়ে উঠতে দেখা গেল, সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কে করতে পারে–তুই কি ঋতুর কথা ইঙ্গিত করছিস?
ঋতুর সাথে মিসেস রাফিয়ার সম্পর্ক ভাল নয়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু ঋতু হাঁটতে পারে না–সে পঙ্গু। সে শিল্পীর তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠবে কিভাবে?
নিজে কেন, লোককে দিয়ে করাতে পারে কাজটা। গতরাত এগারোটা থেকে তিনটের মধ্যে শিল্পীর ফ্ল্যাটে কেউ গিয়েছিল কিনা খোঁজ নিতে হবে, জামান। সাড়ে দশটা পর্যন্ত মিসেস রাফিয়া আমার চেম্বারে ছিল। তখনও নেকলেসটা দেখেছি আমি। সুতরাং এগারোটার আগে ওটা শিল্পীরবেডরূমে যেতে পারে না।
মিনিট পনেরো আরও আলাপ হলো ওদের মধ্যে। এক সময় শহীদ উঠে দাঁড়াল।
যাচ্ছিস তুই?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। তোরাও বেরিয়ে পড়। লাঞ্চের সময় সবাই মিলিত হব আমরা অফিসে।
মহুয়া বলল, কিন্তু তোমরা কেউ ব্রেকফাস্ট না করে
শহীদ বলল, কেফাস্ট করার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
বেরিয়ে গেল ও ড্রয়িংরূম থেকে।
.
০৪.
মুক্তা নিকেতনের প্রধান পথের বাইরে একটা গার্ড গোলপোস্টে গোলকীপারের মত পায়চারি করছিল বিরতিহীন ভাবে।
দুর্ভেদ্য পাচিলের মত প্রকাণ্ড লোহার গেটটা বন্ধ। গাড়িতে বসে দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে বেশ একটু দমেই গেল শহীদের বুক। ওর ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটাকে এগোতে দেখে গার্ড পায়চারি থামিয়ে দেহটাকে টান টান করে। দাঁড়িয়ে পড়ল। দুপা ফাঁক করে, কোমরে হাত রেখে মাথাটা বেশ একটু ডান দিকে কাত করে চেয়ে আছে সে।
বটলগ্রীন রঙের ইউনিফর্ম পরনে লোকটার, ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি হলুদ রঙের শিরস্ত্রাণ। শিরস্ত্রাণের স্ট্র্যাপটা চিবুকের সাথে জড়ানো। স্ট্র্যাপটা নরম নাইলন দিয়ে তৈরি, সেটা মুখে পুরে দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে অকারণে। লোকটার বয়স হবে ছাব্বিশ-সাতাশ। দর্শনীয় পেশীবহুল দেহ। নিয়মিত ব্যায়াম করে, বোঝ যায়। অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ছাপ চোখে মুখে। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। দুঃসাহসের কমতি নেই। যেকোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে এক পায়ে খাড়া। লোকটাকে দেখে পছন্দ হলো না, শহীদের।
কয়েক গজ দুরে গাড়ি দাঁড় করাল শহীদ। স্টার্ট বন্ধ করে নিচে নামল। গার্ডটা চেয়ে আছে। হাসি হাসি ভাব তার মুখে। কিন্তু হাসিতে অন্তরঙ্গতার বদলে ব্যঙ্গ ফুটে রয়েছে।
লোকটার নিঃশব্দ আচরণে একটা চ্যালেঞ্জের ভাব উকট ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। শহীদ পরিস্থিতিটা অনুধাবন করতে পারলেও, পরিবেশটা হালকা করার জন্যে খুবই নরম এবং স্বাভাবিক গলায় বলল, গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢোকা যাবে? নাকি হেঁটে যেতে হবে?
সবুজ ইউনিফর্মের বড় বড় সোনালি বোতামগুলো রোদ লেগে চকচক করছে। দেহটা বাকা করে দাঁড়িয়ে আছে বলে তার হিপ পকেটে উঁচু হয়ে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রটার অস্তিত্ব টের পেতে অসুবিধে হলো না শহীদের। হাতের কালো, তেল-চকচকে একহাত লম্বা রুলটা দিয়ে নিজের উরুতে সশব্দে একটা বাড়ি মারুল লোকটা।
কি বলা হলো? আবার একবার শুনতে চাই! লোকটা কথা বলল না, ঠিক যেন ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরের মত।
রিপিট করল শহীদ ওর কথাটা।
নাইলনের ফিতেটা চিবুতে চিবুতে শহীদকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল গার্ড। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিল সে। পকেটে হাত ভরে চোখ সরিয়ে তাকাল শহীদের গাড়িটার দিকে। একটা সিগারেট কেস বের করুল ধীরে ধীরে পকেট থেকে। সাথে একটা লাইটার। কেসটা সোনালি রঙের। লক্ষ করে শহীদ বুঝল ওটা সত্যিকার সোনার।
কেসটা খুলে আলতোভাবে একটা ফিলটার টিপড সিগারেট বের করে গ্যা লাইটার জালাল গার্ড। একমুখ ধোয়া ছেড়ে লাইটার বন্ধ করে ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে, মুখ তুলে দেখতে লাগল সেটাকে, কিন্তু একেবারে মাথার কাছে নেমে না আসা পর্যন্ত সেটাকে লুফে বোর জন্য হাত তুলল না।
লাইটারটা খপ করে শূন্য থেকে ধরে সরাসরি শহীদের দিকে তাকাল। বলল, কেটে পড়ো–কারও সাথে দেখা হবে না!
এ লোক গার্ড নয়, গার্ডের ভূমিকায় অভিনয় করছে। শহীদ দ্রুত ভেবে নি কয়েকটা কথা। পকেটে সোনার সিগারেটস, গ্যাস লাইটার, চোখেমুখে ড্যাম কেয়ার ভাব, কথায়-বার্তায় অভদ্ৰ-এ লোক দারোয়ান হতে পারে না। এ লোককে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বাড়ির ভিতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
তবু চেষ্টা করতে হবে। শহীদ বলল, তোমার মালিককে গিয়ে বলো শহীদ খান এসেছেন। জরুরী ব্যাপার। নাম শুনলেই দেখা করবেন তিনি।
না। কেটে পড়তে বলেছি, কেটে পড়ো। বাড়িতে কেউ নেই। কথাগুলো বলে একটা পাথরের টুকরোয় লাথি মারল আস্তে করে। পাথরের টুকরোটা গড়াতে গড়াতে শহীদের পায়ের কয়েক ইঞ্চি দূরে এসে থামল। চোখ তুলে তাকাল সে শহীদের দিকে।
শহীদ ভাব দেখাল ব্যাপারটা যে লক্ষই করেনি সে। বলল, সময় নষ্ট করলে তোমার মালিকই বিপদে পড়বেন। তাকে গিয়ে বলো হয় আমার সাথে দেখা করতে হবে, নয়তো পুলিসের সাথে। এমনই জরুরী ব্যাপার।
প্যাচাল বন্ধ করো! যাও ভাগো! বললাম না, কেউ নেই? মি. তোয়াব খান ঘন্টাখানেক আগে বেরিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন তাও জানি না। হয়তো বিদেশে গেছেন। মোটকথা–সুবিধে হবে না, ভাগো।
আর কোন কথা বলল না শহীদ। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল ও। চলতে শুরু করল গাড়ি। ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখল, গার্ডটা দাঁত বের করে কুৎসিত ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। সর্ব শরীরে একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল শহীদ।
মুক্তা নিকেতনের পাচিল ঘেঁষে পঞ্চাশ গজের মত যাবার পর বাঁক নিল শহীদের ফোক্সওয়াগেন। শেষবার ভিউ মিররে তাকাতে শহীদ দেখল গার্ডটা গেট খুলে ভিতরে ঢুকছে। ভিতরে ঢুকে তালা লাগিয়ে দিল আবার। অদৃশ্য হয়ে গেল গার্ডরূমের ভিতর।
বাঁক নিয়ে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ গজ এগিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্টার্ট বন্ধ করল শহীদ। নিচে নেমে মুক্তা নিকেতনের উঁচু পাঁচিলের দিকে তাকাল। আট ফুট উঁচু পাঁচিল। লাফ দিয়ে পাচিলের মাথা ধরে ফেলল ও। পাচিলে পা ঠেকিয়ে অনায়াসে উঠে পড়ল উপরে।
বিস্তীর্ণ মাঠ দেখা যাচ্ছে। মাঠের পর গাছপালা, বাগান। প্রধান প্রবেশ পথ, রানওয়ের মত চওড়া সড়ক, পুল বিন্ডিংটা বা গার্ড রূম কিছুই চোখে পড়ল না।
লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত এগোল শহীদ বাগানের দিকে।
মিনিট তিনেক পর বাগানে ঢুকল ও। কোথাও জনমনিষ্যির সাড়া নেই। নিঃশব্দ পয়ে এগোতে এগোতে কংক্রিটের রাস্তায় উঠে থামল ও। ডান পাশে দেখা যাচ্ছে প্রশস্ত চত্বরটা। গত পরশুদিন সকালে এই চত্বরে কয়েকটা গাড়ি এবং দুজন শোফারকে দেখেছিল ও। এখন গাড়ি বা শোফার কিছু নেই, কেউ নেই।
বিল্ডিংটার দরজাটা দেখা যাচ্ছে দূরে। পা বাড়াল শহীদ। কাঁচের শাসিগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েও প্রাণের কোন চিহ্ন দেখতে পেল না ও। হাঁটতে হাঁটতে ঋতুর কথা মনে পড়ল। কংক্রিটের চওড়া পথের পাশে বাগানের ভিতর ফাঁকা একটা জায়গায় প্রথমদিন বসে থাকতে দেখেছিল তাকে। কিন্তু আজ তাকে দেখতে পাবার আশা কম। ধনী লোকের মেয়ে, এত সকালে ঘুমই ভাঙে না।
তা ছাড়া, বাড়িতে হয়তো সত্যিই কেউ নেই। মিসেস রাফিয়াও সম্ভবত নেই। তবে বলা যায় না, আত্মগোপনের নিরাপদ জায়গা এই বাড়ির চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে?
বাগানের ফাঁকা জায়গাটার কাছে পৌঁছে গেল শহীদ।
গাঢ় নীল রঙের জাপানীদের জাতীয় পোশাক কিমানোয় ভারি মানিয়েছে। যদিও, মুখের সর্বত্র বিষাদের একটা করুণ ছায়া লক্ষ করল শহীদ। হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, চোখের দৃষ্টি নিজেরই পায়ের কাছে ঘাসের উপর। পাশে একটা ট্রলি, তার ওপর ব্রেকফাস্টের ট্রে। হাতে একটা বাটারটোস্ট। কিন্তু সেটা ধরেই রেখেছে শুধু, খেতে যেন ভুলে গেছে।
শহীদের ছায়াটা তার পায়ের কাছে গিয়ে পড়তে অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া হলো তার মধ্যে। মুচকি একটা হাসি ফুটল ঠোঁটে। কিন্তু মাথা তুলল না। শুধু চোখের– পাতা দুটো উপরে উঠল।
ছোঁ মেরে কেউ যেন কেড়ে নিল ঋতুর ঠোঁটের হাসিটা। একই সাথে তার হাতের বাটারটোস্টটা পড়ে গেল পায়ের কাছে। কেউ যেন ধাক্কা দিল পিছন থেকে, সিধে হয়ে গেল পিঠটা।
কেমন আছ, ঋতু? চিনতে পারো আমাকে?
কে! কে আপনাকে ঢুকতে দিল এখানে? বিরক্ত কণ্ঠে জানতে চাইল ঋতু।
শহীদ বলল, তোমার বাবার সাথে জরুরী একটা ব্যাপারে দেখা করতে এসেছি। বাড়িতে আছেন তিনি?
ইয়াকুব কোথায়! কে ঢুকতে দিল আপনাকে? চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে শহীদের। এতটুকু মেয়ে তার এত রাগ!
ইয়াকুব কে, ঋতু? ও তো গার্ড নয়। কে ও?।
ঋতু চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল, আমি জানতে চাইছি কিভাবে আপনি ঢুকেছেন?
পাচিল টপকে। উপায় ছিল না, ঋতু। তোমাদেরই স্বার্থে কাজটা করতে হয়েছে। হয় তোমার বাবার সাথে নয়তো মিসেস রাফিয়ার সাথে দেখা করতে হবে আমাকে। মিসেস রাফিয়ার ডায়মণ্ড বসানো নেকলেসটা ফেরত দিতে এসেছি : আমি।
যান আপনি! অন্যদিকে ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিল ঋতু।
শহীদ শান্ত ভাবেই কথা বলছে, কিন্তু নেকলেসটার কি হবে? গুরুত্বটা বুঝতে পারছ না? তোমার বাবা মিসেস রাফিয়ার মুভমেন্টের উপর নজর রাখার জন্য আমার এক সহকারিণীকে নিয়োগ করেছিলেন। আমার সহকারিণী গতরাতে খুন হয়েছে। মিসেস রাফিয়ার নেকলেসটা পাওয়া গেছে তার রূমে।
বিরক্তি এবং ক্রোধের চিহ্ন দূর হয়ে গেল ঋতুর চোখ মুখ থেকে। নির্বিকার দেখাল তাকে। কিন্তু মনের ভিতর তীব্র ঝড় বইতে শুরু করেছে, আঁচ করতে পারুল শহীদ।
আমি রাফিয়া সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড নই। আপনি যান। আগের চেয়ে অনেক সংযত কণ্ঠস্বর।
পুলিস নেকলেসটা পায়নি, পেয়েছি আমরা। আমি ভেবেছিলাম এ খবরটা তোমাকে আলোড়িত করবে। সে যাই হোক, মিসেস রাফিয়াকে পাব কোথায় বলো তো? খবরটা পেলে তিনি সৃস্তি পেতেন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল শহীদ, কিন্তু ঋতুর নির্বিকার মুখ দেখে বিশেষ কিছু আবিষ্কার করতে পারুল না ও।
আপনি যান!
কিন্তু…।
কর্কশ শোনাল সরু কর, বলছি আপনি যান!
শহীদ বলল, কি আশ্চর্য, তুমি দেখছি কাঁপছ! এত রেগে উঠছ কেন বলো তো…?
এখনও সরে যান বলছি!
শহীদ ত্যাগ করল। বলল, আমি তোমাদের বাড়িতে ঢুকছি, ঋতু। তুমি বা তোমার কি যেন নাম…ইয়াকুব, আমাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না।
ভাল করছেন না। এই শেষবার বলছি, বেরিয়ে যান।
পিছন থেকে দাঁতে দাঁত চেপে কে যেন বলে উঠল, ওরে আমার শালা! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!
ঝট করে পিছন দিকে তাকিয়ে শহীদ দেখল, ইয়াকুব অর্থাৎ ইউনিফর্ম পরা গাউন্টা দুই হাতের মুঠি পাকিয়ে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি চলে এসেছিল সে, শহীদ ঘুরে তাকাতেই ডান হাত তুলে শহীদের নাক বরাবর প্রচণ্ড একটা ঘুসি ছুঁড়ল
আশ্চর্য শান্ত নিপুণ ভঙ্গিতে পরিস্থিতির মোকাবেলা করল শহীদ। অল্প, মাত্র এক সেকেন্ড সময় লে ও। ঘুসিটা বিদ্যুৎবেগে মুখের দিকে ছুটে আসছে দেখে ডান হাত তুলে খপ করে ইয়াকুবের হাতটা কব্জির কাছে ধরে ফেলল ও। ডান পা ইতিমধ্যেই তুলে ফেলেছিল, সেটা বাঁকা করে ইয়াকুবের হাঁটুর পিছনে ধাক্কা মারল।
বাঁ পা-টা ভাঁজ হয়ে গেল ইয়াকুবের হাঁটুর কাছে, শহীদ সেই সময় তার হাতটা মুচড়ে ধরুল দুই হাত দিয়ে। তারপর ছেড়ে দিয়ে এক লাফে সরে গেল একপাশে।
তাল হারিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল ইয়াকুব কংক্রিটের উপর। ঘটনাটা চোখের পলকে, অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে গেল। ব্যথা খুব একটা পায়নি ইয়াকুব, কিন্তু ধরাশায়ী হয়ে বোকা বনে গেছে সে।
মুখ ফিরিয়ে ঋতুর দিকে তাকাল শহীদ। একটু হাল কি হাসল না, বলল, তোমার ব্যাপারটা কি? অসুস্থ নাকি? বিপদের গুরুত্ব বোঝো না, তেমন ছোট তো নও তুমি। এই শেষবার বলছি, মিসেস রাফিয়া কোথায় আছেন বলে আমাকে। বিপদটা তোমাদের, সুতরাং…।
ঋতু শহীদের শেষের দিকের কথাগুলো শুনছিল না, সে তাকিয়ে ছিল ইয়াকুবের দিকে। তার চোখের দৃষ্টি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।
উঠে দাঁড়িয়েছে ইয়াকুব। ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে গেছে, সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে ভিতরে। হাঁপাচ্ছে সে, শব্দ পাচ্ছে শহীদ। ইয়াকুবের হাতের উদ্যত নীল, রঙের রিভলভারটার দিকে আড়চোখে তাকাল ও একবার।
.৪৫, কোন সন্দেহ নেই।
ঋতু বলে উঠল, না।
ইয়াকুব হুঙ্কার ছাড়ল, এবার? বল্ শালা…
ঋতুর গলায় কঠিন আদেশের স্বর প্রকাশ পেল, ইয়াকুব, স্টপ ইট! ওকে বাড়ির বাইরে দিয়ে এসো–তার বেশি কিছু চাই না আমি।
আয় শালা…! রিভলভার নেড়ে এগোবার নির্দেশ দিল ইয়াকুব।
একটা কথাও বলল না শহীদ। অশ্লীল ভাষায় কেউ ওকে গালিগালাজ করবে আর ও তা সহ্য করবে তা ভাবাই যায় না। কিন্তু ইয়াকুবের মধ্যে কোথাও কোন গোলমাল আছে, তার পদ এবং আচরণে ঠিক মিলছে না–তাছাড়া, লোকটার লালচে চোখ দুটো রক্তের পিপাসায় চকচক করছে। সুযোগ পেলেই গুলি করবে। সে। এইসব কথা ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলভারটা কেড়ে নেবার উগ্র ইচ্ছেটাকে গলা টিপে হত্যা করল শহীদ।
বিনাবাক্যব্যয়ে পা বাড়াল সে। নিজেকে ক্ষান্ত রাখতে সমর্থ হলেও শরীরের প্রতিটি লোমকূপ জ্বালা করতে শুরু করেছে ওর। এই কুকুরটাকে উপযুক্ত সাজা দেবে ও। সময় আসুক।
ইয়াকুব বোকা নয়। শহীদকে অনুসরণ করছে সে, কিন্তু যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। গেট পর্যন্ত এসে দাঁড়াল শহীদ। তালার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়াল। চাবি দিয়ে তালা খোলার সময় শহীদের দিকে চেয়ে রইল ইয়াকুব।
গেট খোলা হতে শহীদ পা বাড়াল। ইয়াকুব পা তুলে সবেগে লাথি চালাল পিছন থেকে।
তৈরিই ছিল শহীদ। জানত মনে মনে, এই রকম একটা কিছু ঘটবে। ইয়াকুব পা তুলতেই বিদ্যচালিত চরকির মত ঘুরে গেল ওর গোটা দেহটা।–
ইয়াকুবের লাথি লাগল শহীদের ঊরুর উপর, একই সময়ে শহীদের আড়াইমন ওজনের ঘুসিটা লাগল ইয়াকুবের মুখের উপর, নাকের পাশে।
নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। ইয়াকুব টলছে। সেই সুযোগে শহীদ তার তলপেট লক্ষ্য করে লাথি মারল।
দুই হাত দিয়ে তলপেট চেপে ধরল ইয়াকুব, বাঁকা হয়ে গেল দেহটা। সশব্দে পড়ল তিন হাত পিছনের পাকা চত্বরের উপর।
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইয়াকুবের রিভলভার ধরা হাতটায় লাথি মারল আবার শহীদ। রিভলভারটা ছিটকে বেরিয়ে গেল, অদৃশ্য হয়ে গেল বাগানের ভিত।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পায়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল শহীদ। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।
হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে ফিরে এল শহীদ। দরজা খুলে চড়ে বল সীটে। পকেট থেকে পাইপ এবং টোবাকোর কৌটা বের করল। আড়চোখে তাকাল একবার ভিউ মিররের দিকে। চোখে মুখে উত্তাপ অনুভব করছে ও। দেখল, মুখটা লাল হয়ে রয়েছে।
পাইপে টোবাকো ভরে অগ্নিসংযোগ করল ধীরে ধীরে। চিন্তা করল খানিকক্ষণ ধূমপান করতে করতে। তারপর স্টার্ট দিল গাড়িতে।
প্রায় ফাঁকা রাস্তা। স্পীড বাড়িয়ে দিল শহীদ। স্পীডমিটারের কাঁটা পঞ্চান্নর ঘরে পৌঁছেছে। এমন সময়, কিছু বোঝার আগেই, যাদুমন্ত্রের মত, একটা মার্সিডিজ গাড়ি পিছন থেকে চোখের পলকে ওর ফোক্সওয়াগেনের পাশে চলে এল।
পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ফেলেছে শহীদ। মার্সিডিজের জার্মান: চালক একা তার গাড়িতে, শহীদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
চেহারাটা সম্পূর্ণ অচেনা বলে মনে হলেও হাসিটা দেখে কুয়াশাকে চিনতে পারল শহীদ।
ব্রেক কষে ধীরে ধীরে দাঁড় করাল ও ফোক্সওয়াগেনকে। মার্সিডিজও দাঁড়াল পাশে।
দুঃসংবাদটা শুনেছি, শহীদ। কোথাও মারাত্মক একটা ভুল করেছিল শিল্পী।
শহীদ বলল, হ্যাঁ। তা না হলে।
কুয়াশা বলল, কে দায়ী?
তদন্ত শুরু করেছি মাত্র, এখনও বুঝতে পারছি না।
কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, আমার সাহায্য দরকার বলে মনে করো?
শহীদ বলল, এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধহয় দরকার হবে না। আচ্ছা, তোয়াব খানের বাড়ির গার্ড ইয়াকুব, ওর সম্পর্কে জানো কিছু?
ইয়াকুব? তুমি শান্তিনগরের রয়েল জিমনেশিয়ামের সেক্রেটারি ইমদাদুল হকের সাথে যোগাযোগ করলেই ওর সম্পর্কে জানতে পারবে। আর কিছু?
শহীদ বলল, না। কিন্তু একটা ব্যাপার, তুমি কি মনে করে তোয়াব খানের কেসটা নিতে বলেছিলে বলো তো আমাকে?
কুয়াশা বলল, আমার এক বন্ধুকে ধরেছিল তোয়াব খান। সে তোয়াব খানেরও বন্ধু। সেই বন্ধু ফোন করে তোমাকে রাজি করাবার জন্যে অনুরোধ করে আমাকে। কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রয়োজন নেই, শহীদ। কেউ যদি অপরাধী হয়, সে তোয়াব খান হোক বা আর কেউ, ছেড়ে কথা বলবার দরকার নেই। তবে, নিরপরাধ হলে, তার সম্মানটা যাতে রক্ষা পায় সে ব্যবস্থা কোরো। আর সাহায্যের দরকার হলে আমাকে শুধু জানিয়ে, কেমন?
শহীদ মাথা একটু কাত করে জানাল, আচ্ছা।
গাড়ি ছেড়ে দিল কুয়াশা, সাঁ করে নিক্ষিপ্ত রকেটর মত ছুটে গেল মার্সিডিজ। দেখতে দেখতে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা।
.
রয়েল জিমনেশিয়ামের সেক্রেটারি ইমদাদুল হকের সাথে পরিচয় নেই শহীদের। কামালের সাথে পরিচয় আছে। শহীদ ঠিক করল, কামালকেই পাঠাবে ও ইয়াকুব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে।
অফিসে ফিরে এল ও। কামাল আগেই পৌঁছেছে। বলল, দেলোয়ার মোরশেদ লোকটা
শহীদ বলল, পরে শুনব। আগে আমার কথা শোন। মুক্তা নিকেতনের গার্ড লোকটা–
শহীদ ঘটনাটা বর্ণনা করল।
বলিস কি!
শহীদ বলল, ইয়াকুবের আসল পরিচয় কি তাই আমি জানতে চাই। এখুনি বেরিয়ে পড় তুই। ইমদাদুল হক তোর বন্ধু, সে লোকটা সম্পর্কে সব জানে।
কামাল বলল, এখুনি যাচ্ছি আমি।
.
০৫.
চারদিক কাঁপিয়ে দিয়ে ছুটল কামালের মটর সাইকেল। পাঁচ মিনিট পর রয়েল জিমন্যাসিয়ামের গেটের সামনে থামল সেটা।
স্টার্ট বন্ধ করে নামল কামাল। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল। সবুজ ঘাস। বিছানো মাঝারি একটা উঠান, দক্ষিণ দিকে লোহার গুদ দিয়ে ঘেরা পঞ্চাশ গজ লম্বা ব্যায়ামাগার। উত্তরে বাগান। পশ্চিমে দোতলা, হোট বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে ফাঁকা খানিকটা জায়গা।
ব্যায়ামাগারের ভিতর একদল যুবক রয়েছে, কিন্তু সংখ্যায় কম। সাধারণত বিকেলের পর ভিড় জমে। ছেলেদেরকেই দেখল কামাল, কোন মেয়ের ছায়া পর্যন্ত নেই।
অথচ শুনেছিল, মেয়েরাও ইদানীং চর্চা করছে।
বিল্ডিংটার এক তলার কয়েকটা কামরা ব্যবহার করা হয় ইনডোর স্পোর্টসের জন্যে। রয়েল জিমনেশিয়াম আসলে এই এলাকার একটা সাধারণ ক্লাব। টেবিল-টেনিস, ক্যারাম, কার্ড, দাবা-সবই চলে।
কয়েকটা রূমে উঁকি দিয়ে তাকাল কামাল। রীটা গোমেজকে কোথাও দেখল না ও। রীটা গোমেজ আশ্চর্য একটি মেয়ে। জিমনেশিয়ামের প্রতি প্রবল আগ্রহ তার। যেমন সুন্দরী, তেমনি সপ্রতিভ। কামালের সাথে ভাল পরিচয় আছে। এখানে। প্রয়ই আসে রীটা গোমেজ।
দোতলায় উঠে সেক্রেটারি লেখা দরজার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল ইমদাদুল হক ট্রাউজার এবং স্যান্ডো গেঞ্জি পরে টেবিলের উপর বসে খবরের কাগজ পড়ছে। পদশকে চোখ তুলল সে। কামালকে দেখে দশাসই দেহটা সটান খাড়া হয়ে গেল।
বাশির মত মিহি, মেয়েলি গলায় কথা বলে উঠল ইমদাদুল হক। প্রকাণ্ড দেহের উপর ছোট্ট একটা মাথা। গোলাকার, ছোট্ট, কালো চকচকে মুখে বিষাদের ছায়া পড়ল।
এইমাত্র দুঃসংবাদটা শুনলাম। আহা-হা! আহা-হা! বড্ড ভাল ছিলেন মহিলা…! খুনীকে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ?
কামাল বলল, না, তদন্ত শুরু করেছি মাত্র।
খুনী যেই হোক, ব্যাটাকে ধরা পড়তেই হবে। হু, হু, কার লেজে পা দিয়েছে তা তো জানে না-বসো দোস্ত, বসো।
কামাল বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। বলল, তোমার সাথে আমার কথা আছে হক।
কথা আছে? একটু যেন নার্ভাস দেখাল ইমদাদুলকে। বলল, তা বেশ। তা বেশ! দেখো দোস্ত, খারাপ কোন খবর দিয়ে আবার ঝপাৎ করে পানিতে ফেলে দিয়োনা যেন।
বসল সে কামালের মুখোমুখি, টেবিলের ওধারে, তা কি কথা, দোস্ত?
কামাল সিগারেট ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল। বলল, বলো তো, ইয়াকুব নামে কাউকে চেনো কিনা?
ইমদাদুল ঘাড় কাত করে তির্যক দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কসেকেণ্ড, স্মরণ করার চেষ্টা করছে। তারপর বলল, অনেক ইয়াকুবকে চিনি। ঠিক কোন?
পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স, হ্যান্ডসাম, বিদ্যুতের গতি, বেপরোয়া এবং অভদ্র।
ওহ-হে! চিনেছি, স্যার, চিনেছি। লেডিকিলার ইয়াকুব–ভোম্বল!
কামাল বলল, ভোম্বল মানে?।
ইমদাদুল হক ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল, ভোম্বল বলে ডাকতাম ওকে আমি। কেন তা আমি নিজেই জানি না। মেয়েরা ওর জন্যে পাগল। মৌমাছির মত ওর পিছনে উড়ে বেড়ায়। তবে যা, ওস্তাদ বটে ছোকরা। এখান থেকেই শুরু, করেছিল। কেউ ঘেষতে সাহস পেত না ওর কাছে। ছোকরার ওপর খুব আশা করেছিলাম। কিন্তু টিকল না। মাস কয়েক আগে হঠাৎ করে কেটে পড়েছে। তা, ভোম্বলকে কেন খুঁজছ, দোস্ত?
খুজছি না। ওর কথা জানতে চাইছি। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।
ভোম্বল? তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? শালার পাখা গজিয়েছে রে!
ইমদাদুল ঘন ঘন মাথা দোলাতে লাগল, এইবার! এইবার ব্যাটা উচিত শিক্ষা পাবে! হায়, হায়, এত লোক থাকতে সে তোমার সাথে টক্কর দিতে গেল–সর্বনাশ! ঝপাৎ করে পড়বে ব্যাটা এবার পানিতে…কিন্তু ব্যাপার কি জানো, বড় গোঁয়ার। প্রকৃতির ওই ভোম্বল। দূরে দূরে থাকাই ভাল। ব্যাটা পয়জন! তবে, তোমার। সাথে-সেফ প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে, জানি আমি! তা কোথায় দেখলে ছোকরাকে?
কামাল বলল, মোহাম্মদ তোয়াব খানের নাম শুনেছ তো? কোটিপতি। তাঁর বাড়ি মুক্তা নিকেতনে গার্ড হিসেবে কাজ করছে।
ইমদাদুলের মুখের চেহারা দুমড়ে মুচড়ে বাঁকা হয়ে গেল, গার্ড? ভোম্বল গার্ড? দোস্ত এ লোক সে নয়। ভুল হয়েছে আমার। ইয়াকুব ভোম্বল, যার কথা বলছি ম, সে অগাধ টাকার মালিক।
কামাল বলল, তোমার ইয়াকুব ভোম্বলের কপালে কাটা দাগ আছে?
তা আছে।
কামাল বলল, তবে এ ঘোকরা তোমার ভোম্বলই। টাকা আছে জানো কীভাবে?
ইমদাদুল বলল, স্টাইল দেখে। এখনও তো মাঝে সাজে দেখা করতে আসে। দামী দামী কাপড় পরে, ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট খায়, ঝকঝকে ডাটসন গাড়ি হাকায়, নিউ ইস্কাটনে দোতলা বাড়ি আছে না দোস্ত, গার্ড সে হতেই পারে না।
কামাল বলল, কোন সন্দেহ নেই, মিলন। মেয়েদের প্রতি খুব দুর্বলতা আছে, না?
মিলন চোখ বুজে বলল, খু-উ-ব। মাই গড দোস্ত, তুমি তোমার বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো। সেভোম্বলের আসল খবর দিতে পারবে তোমাকে।
আমার বান্ধবী? কার কথা বলছ তুমি?
রীটা গোমেজ।
কামাল অবাক হয়ে জানতে চাইল, রীটার সাথে ভোম্বলের কি সম্পর্ক?
ইমদাদুল হক আকাশ থেকে পড়ল, বলো কি দোস্ত! রীটা তোমার বান্ধবী তুমিই জানো না? তাহলে, শোনো। ভোম্বলের প্রেমে পড়েছিল রীটা গোমেজ। ভোম্বলও রীটার কথায় উঠত বসত। তারপর কি যে হলো, ভোম্বল চর্চা ছেড়ে দিল। আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তার। রীটা অবশ্য আসা-যাওয়া করত। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গেছে সেই থেকে। কারণটা অবশ্য আমি জানি না। রীটা আসা-যাওয়া করে দেখে আমিই তাকে মেয়েদের চর্চার দায়িত্ব নিতে বলি। রাজি হয়ে যায় সে।
রীটা এখানে কাজ করছে তাহলে? ‘ইমদাদুল হক বলল, করছে বৈকি। কথা বলবে ওর সাথে? ডেকে পাঠাব? বাড়ির পিছনে মেয়েদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করেছি। ওখানে আছে সে।
ডেকে পাঠাও তো। দেখি ওর সাথে কথা বলে।
কলিংবেলের বোতামে থাবা মারুল ইমদাদুল হক। বলল, এক্ষুণি, দোস্ত!
.
সাধারণ মেয়েদের চেয়ে একটু বেশিই লম্বা রীটা গোমেজ। দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটে। মেয়েটার মধ্যে একটা পুরুষালি ভাব আছে। শাড়ি-রাউজ পরনে। পায়ে হাইহিল। চোখে সান গ্লাস। মুখটা বড় আকারের। লাবণ্য কম, তবে চোখ, নাক, ভুরু, গাল-সবই নিখুঁত। গায়ের রঙটিও ফর্সা।
কামালের সাথে এই জিমনেশিয়ামেই পরিচয় রীটা গোমেজের। মাত্র মাস হয়েছে, এখানে যাওয়া-আসা ছেড়ে দিয়েছে কামাল। সময়ের অভাব বলে ব্যায়াম চর্চা সে বাড়িতেই করে।
অফিস রূমে ঢুকেই রীটা কামালকে দেখে সহাস্যে বলে উঠল, হাই! কামাল! কী ভাগ্য, তোমার দেখা পেলাম!
কামাল রীটার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, এসো, রীটা। কেমন আছ?
আছি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল রীটা, এগিয়ে এসে বসল কামালের পাশের চেয়ারে।
ইমদাদুল হক বলল, মেয়েরা ঠিক মত চর্চা করছে তো, মিস রীটা?
করছে। রীটা সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে তাকাল কামালের দিকে। বলল, তোমাকে এত করে বললাম আমাকে তোমাদের ইউনিভার্সেল ইনভেস্টিগেশনে একটা চাকরি দাও–কথাটা রাখলে না, না?
ইমদাদুল হক বলল, মিস রীটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হতে চান। তোমাকে অনুরোধ করার জন্যে আমাকে অমন হাজার বার বলেছেন।
কামাল বলল, এতদিন তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমার বন্ধুর সাথে আলোচনা করিনি। এবার করব। একজন সহকারিণী হয়তো দরকার হতে পারে আমাদের, রীটা। আমাদের একজন সহকারিণী, শিল্পী, গতরাতে খুন হয়েছে।
কি বললে? তোমাদের একজন?
কামাল বলল, হ্যাঁ। কিন্তু সে আলোচনা এখন থাক। রীটা, আমি তোমার কাছ থেকে ইয়াকুব সম্পর্কে কিছু তথ্য চাই।
ইমদাদুল হক বলল, ইয়াকুব, মানে, ভোম্বল সম্পর্কে জানতে চাইছে। কামাল।
হাস্যোজ্জ্বল মুখটা কেন যেন থমথমে হয়ে গেল রীটার। কামালের দিকে, তাকিয়ে থেকে বলল, ওই ইডিয়েটটা সম্পর্কে তোমার কৌতূহলের কারণ কি? তুমি কি খুনটার ব্যাপারে তাকে সন্দেহ করো?
কামাল বলল, না, ঠিক তা নয়। ছোকরাকে আমার বন্ধু মুক্তা নিকেতনে দেখেছে। গার্ড হিসেবে। তাই ওর সন্দেহ হয়েছে।
ইমদাদুল একটা সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিতে রীটা ধন্যবাদ দিয়ে একটা ফিল্টার টিপড গোল্ড কে টেনে নিল। লাইটার জুেলে ধরিয়ে দিল স্টো ইমদাদুলই। নীটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়ল। বলল, ইয়াকুবের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। খুবই ইন্টারেস্টেড ছিলাম একসময়। কারণ সম্ভাবনাময় বক্সার ছিল ও। জানোই তো, আমি আবার এই সব ব্যাপারে কারও মধ্যে সম্ভাবনা দেখলে দারুণ আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু ও একটা ইচড়ে পাকা বদমাশ। মেয়েদের পিছু ছুটবে, না ট্রেনিং নেবে?
কামাল বলল, গাড়ি-বাড়ির মালিক, অথচ গার্ডের চাকরি নিয়েছে…!
গাড়ি-বাড়ির মালিক? কে বলল তোমাকে?
ইমদাদুল হক বলল, কেন, আপনি জানেন না এসব? নিউ ইস্কাটনে বাড়ি আছে ওর। ডাটসন গাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে আসে!
রীটা যেন আকাশ থেকে পড়ল, গড! এসব তো জানা ছিল না।
কামাল বলল, আজকাল কোন খবরই তার রাখো না? কি লাভ? ও ভেবেছিল আমি ওর প্রেমে পড়েছি। খিল খিল করে হেসে উঠল রীটা, ববড চুল দুলিয়ে সরাসরি তাকাল কামালের দিকে। বলল, আসলে ও একটা ছোটলোক। আমার সাথে বিশ্রী একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার দুরাশা ছিল। চরম অপমান করেছিলাম আমি। ওকে আমি নরকের কীট মনে করি। সত্যি কথা বলতে, কি, এখনও খেপে আছি ওর ওপর। সুযোগ পেলে উচিত শিক্ষা দিতে ছাড়ব না।
সিগারেটে টান মারার জন্যে বিরতি নিল রীটা, তারপর বলল, তোমার বন্ধু শহিদ খানের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে? আমি না হয় নিজেই প্রস্তাবটা দেব।
কামাল বলল, তার দরকার নেই। সময় মত ওকে আমিই বলব।
রীটা বলল, ইয়াকুবের ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারি, কামাল। দরকার হলে, ওর সাথে মেলামেশা শুরু করব আবার। মোট কথা, আমাকে একটা সুযোগ দাও। ডিটেকটিভগিরি করার সাধটা মিটুক আমার।
কামাল বলল, ঠিক আছে চলো তুমি আমার সাথে আমাদের অফিসে।
রীটা বলল, সত্যি নিয়ে যাবে?
কামাল বলল, বন্ধু হিসেবে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। সেটা নির্ভর করবে আমার বন্ধুর ওপর।
চাকরি চাইছি তা নয়। কাজ করতে চাই। থ্রিল চাই, রোমাঞ্চ চাই।
ইমদাদুল বলল, কামাল, দোস্ত, মিস রীটা আমার জিমনেশিয়ামের সম্পদ বিশেষ। ওকে আবার সহকারিণীর পদ দিয়ে গেঁথে ফেলো না–ঝপাৎ করে পানিতে পড়ব একেবারে। জানোই তো, মহিলা ট্রেনার পাওয়া কি মুশকিলের ব্যাপার..।
রীটা বলল, ডিটেকটিত হবার শখ আমার ছোটবেলা থেকে, হক সাহেব। সুযোগ যখন পেয়েছি, ছাড়ছি না। তবে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি চাকরি ছাড়ছি না। মেয়েদেরকে চর্চা করতে সাহায্য করাটাও আমার একটা শখ।
ইমদাদুল হক এক গাল হেসে বলল, ভেরি গুড, মিস রীটা।
.
০৬.
বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে কাজটা শেষ হলো।
কবরস্থান থেকে বেরুবার পর মি. সিম্পসন একটা হাত রাখলেন শহীদের কাধে, কিন্তু কথা বলতে গিয়ে ইতস্তত করতে দেখা গেল তাকে।
শহীদ মুখ খুলল, আপনাদের ডাক্তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে কি বললেন?
ডেফিনিট কিছু বলতে না পারলেও, সময় বারোটা থেকে একটার মধ্যে হবে বলে তার বিশ্বাস।
শহীদ কথা বলল না।
মি. সিম্পসন বললেন, শহীদ, কি ধরনের হত্যা এটা? কিছু বুঝতে পারছ? .৪৫-কিন্তু পিস্তলটা পাওয়া যাচ্ছে না। ওটা খুনী ফেলে যায়নি। ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। অত রাতে লেকের ধারে কেন গিয়েছিল শিল্পী? কামাল এবং জামান বলছে-ওর কোন শত্রু ছিল না। তাহলে কে? কেন?
শহীদ বলল, এই সব প্রশ্নের উত্তর আমিও চাই, মি. সিম্পসন।
মি. সিম্পসনের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, গতরাতে সিল্কের প্রিন্টেড শাড়ি পরে শিল্পীর ফ্ল্যাটে একজন ভদ্রমহিলা গিয়েছিল–কে সে শহীদ?
শহীদ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, প্রিন্টেড সিল্কের শাড়ি পরে কে হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না, মি. সিম্পসন।
চমকে উঠেছে শহীদ। এটা একটা তথ্য বটে। গতরাতে মিসেস রাফিয়া ওর অফিসে এসেছিল ওই শাড়ি পরে, তার মানে শিল্পীর ফ্ল্যাটেও গিয়েছিল সে রাতে!
ভদ্রমহিলার গলায় হীরে বসানো একটা দামী নেকলেস ছিল, মি. সিম্পসন বললেন।
শহীদ বলল, ভদ্রমহিলার চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
মি. সিম্পসন বললেন, তুমি তাহলে সত্যিই চিনতে পারছ না ভদ্রমহিলাকে? আমি ভেবেছিলাম এই মহিলা তোমার ক্লায়েন্ট, তার পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করছ তুমি।
শহীদ বলল, আমি যদি কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করি তাহলে তা গোপনই থাকবে, মি. সিপসন।
মি. সিম্পসন ত্যাগ করে বললেন, তোমাদের এই বিপদে আমি সাহায্য করতে। চাইছি, শহীদ। প্রয়োজন হলেই যোগাযোগ কোরো। ভাল কথা, শহীদ, এই কেসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইন্সপেক্টর গনির ওপর। তিনি তোমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
আর কিছু বললেন না তিনি। জীপে গিয়ে চড়লেন। শহীদও গম্ভীর মুখে ফোক্সওয়াগেনে উঠল। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে শহীদের। ইন্সপেক্টর গনি লোকটা অসম্ভব খুঁতখুতে। শহীদ বা কামালকে ভাল চোখে দেখে না সে। তার ধারণা, শহীদ ও কামাল বড়লোকের ছেলে, কোন কাজ নেই তাই পুলিসের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্যে শখের গোয়েন্দা সেজে বসেছে।
কামাল আর জামান আগেই উঠে বসেছে গাড়ির ব্যাকসীটে। স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল শহীদ। ওরা তিনজন প্রায় একসাথেই দেখতে পেল নীল রঙের একটা মার্সিডিজকে। ধীরে ধীরে কবরস্থানের গেটের সামনে দাঁড়াচ্ছে সেটা। ডি. কস্টাকে দেখা যাচ্ছে। তার হাতে ফুলের তোড়া এবং আগরবাতি। পাশের চালক স্বয়ং কুয়াশা। চেনার উপায় নেই, আফগান যুবকের ছত্নবেশ নিয়েছে সে।
শিল্পীর সমাধি চিনে নিতে পারবে কুয়াশা। সুতরাং গাড়ি দাঁড় করাল না শহীদ।
.
অত্যন্ত মিশুক মেয়ে এই রীটা গোমেজ। শহীদ কথাটা মনে মনে স্বীকার না করে পারল না।
কিছুক্ষণের আলাপেই সে ওদের একজন হয়ে উঠেছে। কথায় বার্তায়, আচরণে, সহজ-সরল ভাব-ভঙ্গিতে সবাইকে আপন করে নেবার দুর্লভ একটা গুণ রয়েছে ওর।
কামাল পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছে, রীটা ক্রিমিনোলজি সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। আমাদের হয়ে কাজ করতে চায়। ওর সামনে আমরা সব ব্যাপারে আলোচনা করতে পারি।
শহীদের চেম্বারে বসেছে ওরা। শহীদ মুক্তা নিকেতনের ঘটনাটা আর একবার শেনাল ওদেরকে।
কামাল শুধু বলল, হাত-পা ভেঙে দিয়ে আসতে পারলি না!
রীটা গোমেজ বুদ্ধিমতীর মত মন্তব্য করল, হাত-পা ভেঙে দিলেও শয়তানটার উচিত শিক্ষা হবে না। ও কি কি অপরাধ করেছে তার একটা তথ্য সমৃদ্ধ তালিকা সংগ্রহ করে আইনের মাধ্যমে প্যাঁচে জড়াতে হবে যাতে সেই প্যাঁচ থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে না পারে।
শহীদ বলল, কামাল, দেলোয়ার মোরশেদ সম্পর্কে কি জানতে পেরেছিস বল।
কামাল মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছিল, শহীদের প্রশ্ন শুনতে পেলেও মুখ তুলল না। পকেট থেকে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট বের করে নতুন একটা সিগারেট ধরাল, তারপর বলল, লোকটা উদ্ভট টাইপের, বুঝলি? লেকের ধারে একতলা বাড়ি আছে একটা। বাড়িটার ছাদেই বেশির ভাগ সময় কাটায় সে। ছাদের ওপর মাঝারি আকারের একটা টেলিস্কোপ আছে, সেটায় চোখ রেখে লেকের ধারে যে সব মেয়েরা আসে তাদেরকে দেখে। কুৎসিত একটা বদভ্যাস বলেই মনে হলো ব্যাপারটাকে। তার বক্তব্য, রাতে সে নক্ষত্ররাজি দেখার জন্যে টেলিস্কোপটা কিনেছিল। কিন্তু অত রাতে লেকের ধারে কি দেখছিল জিজ্ঞেস করতে পরিষ্কার কোন উত্তর দিতে পারেনি সে। আমার ধারণা, ছাদ থেকেই শিল্পীকে এবং শিল্পীর খুনীকে, টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেছিল সে। কিন্তু তা স্বীকার করেনি। বলছে, শুধু ভ্যানিটি ব্যাগটাই তার চোখে পড়েছিল।
টাকার লোভ দেখিয়েও কথা আদায় করতে পারলি না?
কামাল বলল, টাকার কথা আভাসে বলতে লোকটা কি বলল জানিস? বলল, স্মরণশক্তি খুব দুর্বল কিনা আমার, তাই ঠিক স্মরণ করতে পারছি না কোন মানুষকে দেখেছি কিনা। চিন্তা ভাবনা করে দেখার সময় দিন আমাকে, চেষ্টা করে দেখি মনে করতে পারি কিনা।
শহীদ বলল, সুবিধের লোক নয়। কোন সন্দেহ নেই, অনেক কিছুই দেখেছে সে। হয়তো খুনীও ওর চোখে ধরা পড়েছিল। সন্দেহ হচ্ছে, ব্ল্যাকমেইল করে খুনীর কাছ থেকে মোটা টাকা পাবার ফন্দি আছে ওর।
সেই টাইপেরই লোক।
শহীদ বলল, ইন্সপেক্টর গনিকে কতটুকু বলেছে জানতে পেরেছিস?
কামাল বলল, ইন্সপেক্টর জানে লোকটা পাগলাটে, তাই তাকে বোকা বানাতে অসুবিধে হয়নি ওর।
শহীদ চিন্তিতভাবে বলল, লোকটার কাছে আমাকে যেতে হবে। ঠিক আছে, আর কি কি জানতে পারলি?
মুক্তা নিকেতনের সবচেয়ে কাছের ট্রেল পাম্প স্টেশনে গিয়েছিলাম। মিসেস রাফিয়ার গাড়ি কটার সময় বাড়িতে ফিরেছে ওনার জন্যে। স্টেশনের ম্যানেজার আমার পরিচিত। কিন্তু সে কোন তথ্য দিতে পারল না। তার সাথে কথা বলছি, এমন সময় পেট্রল নেবার জন্যে একটা ফোক্সওয়াগেন এল। ম্যানেজার ড্রাইভারকে দেখিয়ে আমাকে বলল, তোয়াব খানের শোফার ওই লোক। আমার অনুরোধে ডেকে পাঠাল ম্যানেজার লোকটাকে। বেশ খাতির দেখলাম লোকটার সাথে ম্যানেজারের। চা আনাল সে। গল্প-গুজব শুরু হলো। আমিও যোগ দিলাম। সিগারেট দিলাম শোফারকে। তারপর মিসেস রাফিয়া সম্পর্কে দুএকটা প্রশ্ন করলাম। লোকটা গল্পবাজ। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে দশটা কথা বলে ফেলে মিসেস রাফিয়া যেতোয়াব খানের উপযুক্ত স্ত্রী হতে পারেনি, একথা সে বার বার উল্লেখ করল। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, মিসেস রাফিয়া কোথায়? লোকটা কোন রকম সন্দেহ না করে গল গল করে কথা বলতে শুরু করল।
কি বলল?
বলল, মিসেস রাফিয়া তাকে বলেছিল রাত দশটায় মার্সিডিজ গাড়িটা গেটের সামনে থাকবে, সেটাকে গ্যারেজে তুলে রাখতে হবে। কিন্তু দশটা কেন, রাত দুটো অবধি অপেক্ষা করার পরও মিসেস রাফিয়া বা মার্সিডিজের দেখা পায়নি সে। দুটোর পর সে শুতে চলে যায়। রাতে মিসেস রাফিয়া বাড়িতে ফিরে যায়নি।
ফিরে যায়নি? শহীদকে বিস্মিত দেখাল।
না। সকালে তোয়াব খানকে কথাটা জানায় সে। তোয়াব খান বলেন, মিসেস রাফিয়া যে রাতে ফিরবেন না তা তিনি জানতেন, এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
শহীদকে গম্ভীর দেখাচ্ছে।
মার্সিডিজের সন্ধানে গোটা শহরটা চষে ফেলেছি আমি–পাইনি।
শহীদ বলল, পেতেই হবে। অতবড় গাড়ি-বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। মিসেস রাফিয়াকে আমরা চাই। তাকে পেতে হলে তার গাড়ির সন্ধান পেতে হবে। হোটেলগুলোতে বিশেষভাবে খোঁজ নিবি তুই…
কামাল বলল, এখান থেকে বেরিয়ে আবার আমি খুঁজতে শুরু করব।
রীটা গোমেজ বলল, ধনী লোকদের স্ত্রীরা কেউ কেউ নাইটক্লাবে রাত কাটাতে অভ্যস্ত–সুতরাং নাইটক্লাগুলোতেও খোঁজ নিতে হবে।
কামাল বলল, কাজী হানিফের ফেয়ারভিউয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারল না। কাজী হানিফকে দেখেছি, যদিও সে আমাকে দেখেনি-কথা বলতে চেষ্টা করিনি আমি। সে হয়তো কোন না কোন ভাবে এই কেসে জড়িত, তাই দেখা দিলে সাবধান হয়ে যাবে ভেবে…
শহীদ তাকাল জামানের দিকে।
জামান বলল, শহীদ ভাই, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য সংগ্রহ করেছি আমি।
শহীদ বলল, জানি। মিসেস রাফিয়া গতরাতে শিল্পীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিল–এই তো?
আপনি কিভাবে জানেন?
মি. সিম্পসন বলেছেন। কিন্তু কটার সময় গিয়েছিল তা তিনি বলেননি।
জামান বলল, সোয়া এগারোটার সময়।
শহীদ সিধে হয়ে বসল, তার মানে আমার কাছ থেকে বেরিয়ে সোজা মিসেস রাফিয়া শিল্পীর ফু্যাটে যায়। পৌনে এগারোটার সময় এখান থেকে বিদায় নেয় মিসেস রাফিয়া। আর কি জানতে পেরেছ, জামান?
জামান বলল, শিল্পীর ফ্ল্যাটের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটেই এক বুড়ো ভদ্রলোক থাকেন। রসিক মানুষ, অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করেন। তাঁর কাছ থেকে তথ্য পেয়েছি আমি। সোয়া এগারোটার সময় তিনি পায়ের শব্দ পান। জানালার পর্দা সরিয়ে করিডরের অল্প আলোয় তিনি দেখেন শিল্পীকে। শিল্পীর সাথে বোম্বাই প্রিন্টের শাড়ি পরা আর এক যুবতাঁকে দেখেন তিনি।
মিসেস রাফিয়া! সে কি শিল্পীর সাথেই ওর ফ্ল্যাটে যায়?
জামান বলল, মিসেস রাফিয়ার চেহারার বর্ণনা দিতে পারেননি ভদ্রলোক। তবে শাড়ি এবং নেকলেসটা দেখতে পান। আধঘণ্টা পর শিল্পীর ফ্ল্যাট থেকে মিসেস রাফিয়া বেরিয়ে যান। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেও, এবারও চেহারাটা দেখতে পাননি বৃদ্ধ। যাক, এরপর তিনি শুতে যান। ঘুম খুব পাতলা তার, অনেক। রাতে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন-রাত তখন দেড়টা। ফোনের বেল বাজছিল শিল্পীর ফ্ল্যাটে। এর পাঁচ মিনিট পর বৃদ্ধ ভদ্রলোক শিল্পীর ফ্ল্যাটের দরজা খোলার এবং বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পান। এত রাতে শিল্পী কোথায় যাচ্ছে এ প্রশ্ন মনে দেখা দিলেও তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি, ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিল বলে।
জামান থামল। একমুহূর্ত পর আবার বলল সে, বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ধারণা, খুনী যে-ই হোক, শিল্পীকে সে-ই ফোন করে। ফোনে এমন কিছু বলেছিল সে শিল্পীকে, যার ফলে শিল্পী অত রাতে বাইরে বেরুতে বাধ্য হয়। খুনি হয়তো মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিল নিজের। যাই হোক, লেকের ধারেই হয়তো যেতে বলে সে শিল্পীকে। শিল্পী যায়–এবং খুনী তাকে গুলি করে। ভদ্রলোক পুলিসকেও একথা বলেছেন।
শহীদ বলে উঠল, কিন্তু মিলছে না, জামান। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট বলছে বারোটা থেকে একটার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে শিল্পীর। শিল্পী যদি দেড়টার সময় ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে থাকে..অসম্ভব!
রীটা গোমেজ বলল, কেউ কোথাও ভুল করছে। হয় পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট, নয়তো বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
জামান বলে উঠল, বৃদ্ধ ভুল করেননি। তিনি ফোনের শব্দ পেয়েই ঘড়ি দেখেন। ঘড়িটা সকালে আমিও দেখেছি, ঠিক চলছে, আমার ঘড়ির সাথে মিলিয়ে দেখেছি।
শহীদ বলল, পোস্টমর্টেমের রিপোর্টও ভুল হতে পারে না।
কামাল বলল, সে যাই হোক, কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে। শিল্পীর সাথেই ওর ফ্ল্যাটে মিসেস রাফিয়া গিয়েছিল তার মানে, শিল্পীর সাথে কথা হয় তার, শিল্পী হয়তো তাকে মেনুসরণ করার কারণ সম্পর্কেও সব কথা বলেছিল।
কামাল! কি বলছিস তুই?
কামাল নয় জামান কথা বলে উঠল, যা সত্যি, তা মেনে নিতে হবে, শহীদ ভাই। মিসেস রাফিয়া দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল আপনাকে। আপনার তরফ থেকে অনুকূল সাড়া পেলে সে হয়তো টাকার অঙ্ক আরও বাড়াত। আপনার কাছ থেকে বিদায় নেবার মাত্র আধঘণ্টা পর তাকে দেখা যায় শিল্পীর সাথে শিল্পীর ফ্ল্যাটে ঢুকতে। আজ সকালে শিল্পীর ফ্ল্যাটে পাওয়া গেছে মিসেস রাফিয়ার চল্লিশ হাজার টাকা দামের নেকলেসটা। দুয়ে দুয়ে চার-এর মতই সরল বলে মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা? এতে কি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না যে মিসেস রাফিয়া অনুসরণ করা থেকে ক্ষান্ত করার জন্য শিল্পীকে ঘুষ হিসেবে নেকলেসটা দিয়েছিল?
শহীদ চিন্তা করছিল। বলল, অন্যরকম কিছু ঘটেছিল, জামান। মিসেস রাফিয়ার কাছ থেকে শিল্পী নেকলেসটা নিয়েছিল-কারণ হয়তো এই যে, শিল্পী চেয়েছিল মিসেস রাফিয়া ঘুষ দিতে চায়, তার প্রমাণ হাতে রাখতে। আবার, এমনও তো হতে পারে যে নেকলেসটা মিসেস রাফিয়া শিল্পীকে দেয়নি, আর কেউ সেটা শিল্পীর বেডরূমের কার্পেটের নিচে গোপনে রেখে এসেছিল, মিসেস রাফিয়াকে ফাসাবার জন্যে।
কামাল বলল, অসম্ভব নয়।
জামান বলল, একেবারে যে অসম্ভব তা বলছি না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক পরে ঘুমিয়ে পড়েন। শিল্পী বেরিয়ে যাবার পর ফ্ল্যাটে আর কেউ ঢুকেছিল কিনা তা তিনি জানতে পারেননি। তবু, আমি মনে করি…শহীদ ভাই, জানি শিল্পীর প্রচুর টাকা ছিল, কিন্তু গহনা জাতীয় জিনিসের প্রতি মেয়েদের প্রচণ্ড লোভ থাকে।
শহীদ বলল, এ প্রসঙ্গের আলোচনাটা এখানেই বন্ধ হোক।
নিস্তব্ধতা নামল চেম্বারের ভিতর।
লাইটার জ্বেলে নিস্তব্ধতা ভাঙল শহীদ, ধোয়া ছাড়ল ঠোঁট থেকে পাইপ নামিয়ে, মিসেস রাফিয়াকে দুই জায়গার যে কোন এক জায়গায় পাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এক, কাজী হানিফের নাইট ক্লাব ফেয়ারভিউয়ে। দুই, সাধন সরকারের বাড়িতে। তবে, শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জামান, তুমি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা করো। জানতে চেষ্টা করো মিসেস রাফিয়া যখন শিল্পীর ফ্ল্যাট থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন তার গলায় নেকলেসটা ছিল কিনা? তারপর তুমি লেকের দিকে যাবে। আশ-পাশের বাড়ির লোকদের প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করো, কেউ শিল্পীকে দেখেছিল কিনা। শিল্পী যেখানে খুন হয়েছে, সেখানে যেতে হলে অনেকগুলো বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হয় কারও চোখে পড়া অসম্ভব নয়, রাত যতই গভীর হোক।
ঠিক আছে।
শহীদ কামালের দিকে তাকাল, মিসেস রাফিয়ার মার্সিডিজটাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তার ওপর। তারপর, ফেয়ারভিউয়েও যাবি আর একবার।
রীটা গোমেজ বলে উঠল, আর আমি? আমিও তো একজন মেম্বার এখন, তাই না? আমাকেও কাজ দিন…।
শহীদ বলল, সত্যি কাজ করতে চান নাকি?
চাই না মানে! ও, বুঝেছি, আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারছেন না…
শহীদ বলল, তা নয়। ঠিক আছে। আপনাকে..।
ফেয়ারভিউয়ে বরং আমি যাই। এমনিতেও ওখানে আমি সাঁতার কাটতে যাব আজ একবার। গাড়ির নাম্বার, রঙ ইত্যাদি সম্পর্কে বলুন আমাকে।
শহীদ বলল, তাই যান। কিন্তু খুব সাবধান, কাজী হানিফ যেন টের না পায় আপনি আমাদের হয়ে
সেকথা আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না।
রীটা গোমেজ রিস্টওয়াচের দিকে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি তাহলে রওনা হয়ে যাই। বাড়ি হয়ে চলে যাব সোজা।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। গাড়ির নাম্বার…
.
০৭.
রীটা গোমেজ চলে যাবার খানিক পর কামাল এবং জামানও যে যার দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্য বিদায় নিল।
একা চেম্বারে বসে ডেস্কের উপর জুতোসহ পা দুটো তুলে দিয়ে পাইপ ধরাল শহীদ। মুখের চেহারা বদলে গেছে ওর, সকলে বিদায় নেবার পর। নির্মমভাবে নিজের বিবেককে চাবুক মারছে শহীদ। শিল্পী খুন হয়েছে। খুন হবার পর পেরিয়ে গেছে বারো-তেরোটি ঘণ্টা। এই বারো-তেরো ঘণ্টায় খুনীকে চেনার ব্যাপারে কি কি সূত্র পেয়েছে ও?
সময় বয়ে চলেছে। যা যা ঘটেছে, রোমন্থন করছে ও। হঠাৎ খেয়াল হলো আগুন ধরাচ্ছে গ্যাস লাইটার জ্বেলে পাইপে, ঘনঘন টান মারছে কয়েকবার, নীলাভ ধোয়া ছাড়ছে গলগল করে, পরমুহূর্তে ভুলে যাচ্ছে পাইপের অস্তিত্বের কথা, গভীর চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে নিজেরই অজ্ঞাতে।
আহত, ব্যথিত একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে শহীদকে। আর কেউ নয়, শিল্পী খুন হয়েছে। শিল্পী–ওর একজন সহকারিণী। এই খুনের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। কিন্তু সূত্র কোথায়?
কোথায় মিসেস রাফিয়া? কোথায় তোয়াব খান?
একটার পর একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে মনের ভিতর। তোয়াব খানের মেয়ে ঋতু অমন অস্বাভাবিক ব্যবহার কেন করল আজ সকালে তার সাথে?
ইয়াকুব। কে ওই ছোকরা? সোনার সিগারেট কেস থাকে তার পকেটে। নিউ ইস্কাটনে আধুনিক বাড়ি আছে তার। ডাটসন গাড়ি চালায়। প্রচুর টাকার মালিক, বোঝা যায়। তা সত্ত্বেও কেন তোয়াব খানের প্রাসাদোপম বাড়ির গেটে গার্ড হিসেবে কাজ করছে সে?
পা দুটো নামাল শহীদ। ফোন গাইডটা টেনে নিল সামনে। পাতা ওল্টাতে শুরু করল ব্যস্ততার সাথে।
মিনিট তিনেক চেষ্টার পরই যা খুঁজছিল পেয়ে গেল শহীদ। কেন যেন দাঁতে দাঁত চাপল শহীদ।
ফোন গাইডে ইয়াকুবের নাম রয়েছে।
ইয়াকুব আলী খান–২০১/১৪, নিউ ইস্কাটন-ফোন নং
গাইড বন্ধ করে পাইপে আগুন ধরাল ও। কার্পেট মোড়া মেঝেতে পায়চারি শুরু করল। ও কি ইয়াকুবের পেছনে অকারণে অমূল্য সময় নষ্ট করছে?
আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। শিল্পীর খুন হওয়ার সাথে কি সম্পর্ক থাকতে পারে ইয়াকুবের?
তবু, কেন যেন ইয়াকুবের ব্যাপারে সম্ভাব্য সব তথ্য পাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মন।
মনের দাবি মেনে নিয়ে কাজ করতেই অভ্যস্ত ও। পায়চারি থামাল ডেস্কের সামনে, তুলে নিল ফোনের রিসিভার। ডায়াল করল বন্ধুর কাছে।
মোহাম্মদ এখলাস উদ্দিন ল্যাণ্ড রেকর্ড অফিসের বড় কর্তা, ওর বন্ধু।
এখলাস সাহেবের কণ্ঠস্বর শহীদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবার মত অবস্থা করল, দোস্ত! এইমাত্র যাচ্ছিলাম তোর কাছে। ফোনটা খারাপ, শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?…হ্যাঁ, শুনেছি…ভেরি স্যাড নিউজ, নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে জানতে পেরেছিস কে… ।
শহীদ বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখলাস, শিল্পীর খুনীকে ধরার ব্যাপারেই একটা ইনফরমেশন দরকার আমার। এক্ষুণি। আমি নিউ ইস্কাটনের একটা বাড়ির নাম্বার দিচ্ছি। তুই দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে জানাবি বাড়িটা কার-পারবি?
চোখ বুজে পারব…ওয়েট অ্যাণ্ড সি!
বাড়ির নাম্বারটা দিয়ে ফোন রেখে দিল শহীদ।
ঠিক দশ মিনিট পর ফোন করল এখলাস সাহেব। বলল, শহীদ, বাড়িটা মোহাম্মদ তোয়াব খানের মেয়ে মিস ঋতুর। বছর খানেক আগে সে কিনেছে ওটা।
শহীদ বলল, এখলাস, ভাল করে দেখেছিস কাগজপত্র? বাড়িটার সাথে ইয়াকুব আলী খান নামে কোন লোক জড়িত কিনা? ঋতু কি একাই বাড়িটার মালিক?
কোন ভুল হবার নয়, শহীদ। আমি নিজে দেখেছি কাগজপত্র। ইয়াকুব বা আর কোন নামের লোক এ বাড়ির সাথে কোন ভাবে জড়িত নয়।
শহীদ বলল, ধন্যবাদ, এখলাস। খুব কাজ দেবে তোর এই ইনফরমেশন।
আরও এক মিনিট অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ।
কি দাঁড়াল ব্যাপারটা?
বাড়িটা তোয়াব খানের মেয়ে ঋতুর।
গাড়িটা? .৪৫ পিস্তলটা?
আবার রিসিভার তুলল ও। ডায়াল করল ট্রাফিক কন্ট্রোল ইন্সপেক্টর সালাহ উদ্দিন আহমেদের নাম্বারে।
উত্তর পেতে দশ মিনিটও লাগল না।
হ্যাঁ, গাড়িটাও ইয়াকুবের নয়। ডাটসনটার মালিক তোয়াব খান।
.৪৫ পিস্তলটা? আর্মস লাইসেন্স রিনিউ-এর মেজিস্ট্রেটের কাছে ফোন করতে পনেরো মিনিটের মধ্যে জবাব পেয়ে গেল শহীদ।
.৪৫ পিস্তলটাও তোয়াব খানের।
তাহলে, কি দাঁড়াল ব্যাপারটা?
তথ্যগুলো পাওয়ায় একটা সম্ভাব্য ছবি ফুটে উঠব উঠব করছে। হয়তো, শিল্পীর খুন হওয়ার সাথে এসব তথ্যের কোন ভূমিকা নেই। কিন্তু সেট-আপটা চমকপ্রদ, সন্দেহ নেই। একজন মানুষকে কৌতূহলী করে তোলার জন্যে যথেষ্ট।
ইয়াকুবের কিছুই নেই অথচ সবই আছে তার। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, পকেটে পিস্তল এবং সোনার সিগারেট কেস আছে। কেন এই সব জিনিস ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে সে? মুক্তা নিকেতনের গার্ড সে-গার্ডকে কেউ এমন জামাই আদর করে?–
কারণ আছে। কি কারণ?
পায়চারি শুরু করল শহীদ আবার। জলবৎ তরলং, নিতান্তই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কারণটা। ইয়াকুবের বয়স খুব বেশি নয়। এরই মধ্যে সে অনেক কিছু অর্জন করেছে। সম্ভাব্য পন্থাটা কি? অল্পসময়ে প্রচুর সুযোগ এবং প্রচুর টাকার মালিক হবার একমাত্র উপায় ব্ল্যাকমেইলিং। ইয়াকুব সম্ভবত তোয়াব খানের গোটা পরিবারটিকেই ব্ল্যাকমেইল করছে। মিসেস রাফিয়া ক্লেপটোম্যানিয়ায় ভুগছে এটা আবিষ্কার করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। থাক, মিসেস রাফিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করার কারণ না হয় রয়েছে। কিন্তু ঋতু? তাকে রাকমেইল করছে কি কারণে ইয়াকুব?
জানতে হবে।
অপরদিকে ইয়াকুব যদি ব্ল্যাকমেইলার হয়, শিল্পীকে খুন করা তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয়।
বেরিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু, স্বীকার না করে উপায় নেই, ইয়াকুবের ব্যাপার নয়ে প্রচুর সময় ব্যয় করেছে সে। ইয়াকুব সন্দেহজনক চরিত্র হলেও, শিল্পীর খুন হওয়ার সাথে সরাসরি তার যোগাযোগ না থাকারই কথা। সরাসরি যোগাযোগ থাকতে পারে সাধন সরকারের। এই লোক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা হয়নি।
চেম্বার লকআপ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শহীদ। মুখের চেহারা আবার বদলে গেছে ওর। আহত বা ব্যথিত বলে মনে হচ্ছে না ওকে। আত্মবিশ্বাস এবং বুদ্ধির দীপ্তি ফুটে উঠেছে চেহারায়।
.
শিল্পীর রিপোর্টে উল্লিখিত নাম্বার মিলিয়ে বাড়িটা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হলো না। দোতলা, ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির গেট বন্ধ দেখে খুশি হলো ও। কিন্তু গাড়ি না থামিয়ে এগিয়ে গেল সোজা, বাক নিল ডান দিকে। পনেরো গজআরও এগিয়ে গাড়ি নামাল ও।
স্টার্ট বন্ধ করে নেমে পাইপে আগুন ধরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল–কেউ নেই কোথাও। থাকার কথাও নয়। রাস্তাটা খোয়া বিছানো। দুপাশের বাড়িগুলোর পেছন দিক পড়েছে এই রাস্তার দিকে।
পাচিলটা খুব বেশি উঁচু নয়। অনায়াসে উঠল শহীদ। লাফ দিয়ে নামার আগে দেখে নিল বাড়ির ভেতরটা।
বাড়ির সামনের দিকে পৌঁছে গেটের দিকে একবার তাকাল। তারপর তিনটে ধাপ টপকে করিডরে উঠে এগোল বন্ধ একটা দরজার দিকে।
দরজার কী-হোলটার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করল শহীদ এক মুহূর্ত। হংকং এর বার্ড কোম্পানীর তালা। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে একটা চাবি বেছে নিল ও। তারপর চাবিটা ঢুকিয়ে দিল কী-হোলে।
বিনা বাধায় ঢুকে গেল কী-হোলে চাবিটা। চাবি যোরাতেই শব্দ হলো-ক্লিক খুলে গেল তালা।
কবাট ঠেলে ভেতরে ঢুকল শহীদ। কবাট দুটো ভিড়িয়ে দেয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল ড্রয়িংরূমটা।
সুইচ বোর্ডটা খুঁজে বের করল ও। একটা বোম টিপতেই সুসজ্জিত ড্রয়িংরূমটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। রুচিশীল লোক সাধন সরকার। ছবির মত সুন্দর একটা ড্রয়িংরূম। আসবাবপত্রগুলো দামী তো বটেই, অত্যাধুনিকতার ছোঁয়াও লক্ষণীয়।
পাশের কামরায় যাবার দরজাটা ভেজানো। পা বাড়াবার আগে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল শহীদ। উপরতলা থেকে শব্দ এল যেন? কেউ আছে নাকি? সাধন সরকার বুঝি বাড়িতেই রয়েছে
কিন্তু আর কোন শব্দ না পেয়ে শহীদ ভাবল, ভুল শুনেছে ও। নরম কার্পেটের উপর দিয়ে অপর দরজার দিকে যাবার সময় শো-কেসের উপর দাঁড় করানো মিসেস রাফিয়ার ছবিটার দিকে আর একবার তাকাল ও বিকিনি পরা ছবি। দেহের অধিকাংশই প্রদর্শিত হচ্ছে ফটোয়। গতি পরিবর্তন করে শো-কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফ্রেমটা তুলে পরীক্ষা করার জন্যে চোখের সামনে ধরতেই ছবির কোণায় ছোট ছোট অক্ষরে লেখা দুটো লাইন দেখতে পেল ও।
কতো যে ভালবাসি তোমাকে, সাধন, বলে বোঝাতে নারি।
সে ভাষা আমার নেই–রাফিয়া।
ফ্রেম থেকে ছবিটা খুলে নিয়ে সেটা পকেটে রাখল শহীদ।
পাশের রূমটা লম্বা আকৃতির বিরাট একটা হলরূম বলা চলে। প্রথম দর্শনে হলরুমটাকে একটা মিউজিয়াম বলে মনে হলো। মিউজিয়াম না হলেও, কম নয়। কোন অংশে। চারদিকের দেয়ালে প্রাচীন যুগের যুদ্ধাস্ত্র লটকে রাখা হয়েছে। তলোয়ার, বর্শা, রাম দা, ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ, ছোরা। সাধন সরকার পুরানো যুদ্ধান্ত্রের সংগ্রাহক। আবছাভাবে কার কাছ থেকে কথাটা যেন শুনেছিল বলে বিস্মিত হলো না শহীদ সংগ্রহগুলো দেখে। হলরূমের এক প্রান্তে একটা সিঁড়ি। উঠে গেছে উপর দিকে। পা বাড়াল শহীদ।
দুটো মাত্র রূম উপরতলায়। একটা বেডরূম। অপরটি সুসজ্জিত সীটিংরুম। সেখানে ওয়ারড্রোব, স্টীল আলমারি, দুটো বুক সেলফ, একটা শো-কেস, টিভি, সোফা এবং ড্রেসিং টেবিল রয়েছে।
কি মনে করে ওয়ারড্রোবের কবাট দুটো উন্মুক্ত করল শহীদ। শিল্পী তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল সাধন সরকার প্লেবয় টাইপের যুবক, সিনেমার নায়কদের মত পোশাক পরে। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ওযারড্রোবের ভিতরটা দেখে ব্যাপারটা বোঝা গেল। সারি সারি ঝুলছে দামী কাপড়ের স্যুট। নিচের সেলফে জুতো হবে কম করেও পঁচিশ জোড়া। দম বন্ধ করে চেয়ে রইল শহীদ লাল শিফন এবং সেই কাপড়েরই রাউজটার দিকে। মাঝখানের একটা হ্যাঙ্গারে সুন্দর ভাবে ভাঁজ করা অবস্থায় ঝুলছে জরির কাজ করা লাল শিফনটা। পাশেই রাউজ এবং লাল পেটিকোট ঝুলছে।
মর্মর পাথরের মূর্তির মত নিঃসাড় কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা হিম একটা অনুভূতি উঠে আসছে উপর দিকে। হাত বাড়াল ও, মৃদু মৃদু কাঁপছে ওর হাত দুটো।
শিল্পীর পরনের শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট এগুলো। জানালা খুলে দিনের আলোয় পরীক্ষা করল, রক্তের কোন দাগ কোথাও নেই।
জানালার কাছ থেকে সরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই চমকে উঠল শহীদ। নিচের বাগানে কি যেন নড়ে উঠেছে। তাকাতেই ইয়াকুবকে দেখতে পেল ও।
বাড়ির গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেছে ইয়াকুব। গার্ডের ইউনিফর্ম নেই তার পরনে, ট্রাউজার এবং টেট্রনের চেক শার্ট। বুক ফুলিয়ে হাঁটছে সে। কিন্তু চোখে সর্তক, সাবধানী দৃষ্টি। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ড পর করিডরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
চিন্তা করার অবকাশ নেই। যদিও শিল্পীর ব্রেসিয়ারটা শাডি-রাউজ পেটিকোটের সাথে নেই দেখে মনটা খুঁত খুঁত করছে ভারি। কিন্তু ইয়াকুব যে কোন মুহূর্তে উঠে আসতে পারে উপরে। ইয়াকুবের চোখে পড়ে গেলে ফেঁসে যাবে ব্যাপারটা। সাবধান হয়ে যাবে ইয়াকুব স্বয়ং। সাধন সরকারের কানেও যেতে পারে সে কথাটা।
জানালার শার্সি তুলে ফেলল শহীদ। ঝুঁকে পড়ল নিচের দিকে। পানির পাইপটা দুই হাত মাত্র তফাতে।
শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট-তিনটে এক সাথে করে একটা কাগজ নিয়ে মুড়ে প্যাকেট মত করল, বগলে প্যাকেটটাকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল জানালার উপর।
পাইপ বেয়ে অনায়াসে নিচে নেমে এল শহীদ। করিডরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার খোলা দরজাটার দিকে। ইয়াকুব পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে শো-কেসটার সামনে। ছবি শূন্য ফ্রেমটা রয়েছে তার হাতে–মনে হলো কি যেন ভাবছে সে গভীরভাবে। ছবিটা নিতেই এসেছে নাকি?
পা বাড়াল শহীদ পাচিলের দিকে।
কামালের সান্ধ্য পত্রিকা যোগফলের অফিসে গিয়ে কামালকে না পেয়ে বাড়িতে ফোন কল শহীদ। জামান ছিল বাড়িতে।
শহীদ ভাই, শিল্পীকে গত রাতে লেকের ধারে কেউ দেখেনি। কিন্তু দুজন লোকের সন্ধান পেয়েছি আমি যারা বোম্বাই প্রিন্টের শাড়ি পরা একটি যুবতাঁকে লেকের দিকে যেতে দেখেছে।
বোম্বাই প্রিন্টের শাড়ি, তার মানে মিসেস রাফিয়া।
শহীদ হোঁচট খেলো যেন। আবার বলল, মিসেস রাফিয়া…মাই গড়, জামান, ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? এদিকে, আমি সাধন,সরকারের অর্থাৎ মিসেস রাফিয়ার গোপন প্রেমিকের বাড়ি থেকে শিল্পীর শাড়ি-রাউজ-পেটিকোট উদ্ধার করেছি।
জামান বলল, রহস্য পরিষ্কার হয়ে আসছে, তাই না, শহীদ ভাই? ওরী দুজনই শিল্পীর খুনের সাথে জড়িত।
শহীদ বলল, লোক দুজন কে কে?
জামান বলল, একজন বেবী ট্যাক্সি ড্রাইভার। অনেক কষ্টে অবশ্য ভাগ্য গুণেই বলা ভাল, লোকটার সন্ধান পেয়েছি। সে তার বেবী-ট্যাক্সি করে মিসেস রাফিয়াকে লেকের কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। লোকটার একটা কথা হাস্যকর বলে মনে– হয়েছে।
কি কথা?
মিসেস রাফিয়া ঘোমটা পরে ছিল।
শহীদ বলল, খুবই স্বাভাবিক। অত রাতে একা বেবী-ট্যাক্সি করে নির্জন লেকের দিকে যেতে হলে ঘোমটা পরার দরকার আছে। যাতে কেউ অতিরিক্ত কৌতূহলী হয়ে না ওঠে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলে, সামনে কোন গাড়ি ছিল কিনা? কিংবা মিসেস রাফিয়া কোন গাড়িকৈ অনুসরণ করতে বলেছিল কিনা?
জিজ্ঞেস করেছিলাম। তেমন কিছু বলেনি, রাস্তায় আর কোন গাড়িও ছিল না।
সময়টা?
মাঝরাতের খানিক পর।
শহীদ জানতে চাইল, আর একজন কে?
এই ভদ্রলোক একজন মাছ শিকারী। বিকেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মাছ পাননি। জেদের বশে সন্ধ্যার পর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকেন ছিপ নিয়ে। রাত বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে এটা মাছ টোপ খায়। বড়সড় মাছ। প্রকাণ্ড একটা কাতলা পেলেন তিনি। সাড়ে বারোটার মত বাজে তখন। সময় সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন। যাক, ছিপ গুটিয়ে ফেরার সময় তিনি বোম্বাই প্রিন্টের শাড়ি পরা মিসেস রাফিয়াকে দেখতে পান। বেশ খানিকটা দূর থেকে দেখেন তিনি। দেখে ভয় পেয়ে যান। অলৌকিক ব্যাপার স্যাপারে বিশ্বাস রাখেন তিনি। মাছ ধরার সাথে পেত্নীদের একটা সম্পর্ক আছে, অনেকে বিশ্বাস করেন। এই ভদ্রলোক মিসেস রাফিয়াকে দেখে নির্ঘাত পেত্নী বলে সন্দেহ করেন। তাড়াহুড়ো করে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।
শহীদ বলল, শিল্পীকে মিসেস রাফিয়া খুন করেছে একথা আমি এখনও বিশ্বাস। করি না। তবে, শিল্পী যদি লেকের ধারে খুন হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হয়। মিসেস রাফিয়া ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। কেন যে সে লুকিয়ে পড়েছে তা এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
জামান বলল, আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে মিসেস রাফিয়া দুজন লোকের চোখে পড়েছে কিন্তু শিল্পীকে কেউ দেখেনি। রহস্য, তাই না?
সবটাই রহস্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন রহস্যই রহস্য থাকবে না। জামান, আমাদের হাতে নেই নেই করেও এখন অনেক সূত্র এবং মালমশলা এসে গেছে। অফিসে বসতে হবে আজ আবার। সূত্রগুলোর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা দরকার। শোনো, আমি দেলোয়ার মোরশেদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ফিরব খানিক পরই। কামালকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলবে তুমি।
জামান বলল, শহীদ ভাই, বহন আর আসাদ ফোনে কথা বলেছে আমার সাথে। শিল্পীর ব্যাপারটা জানে ওরা। ফিরে আসতে চাইছে ঢাকায়। আপনার অনুমতি চেয়েছে।
শহীদ বলল, যেকেসের তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে গেছে তার খবর কি?
তদন্ত শেষ হয়নি।
তাহলে ঢাকায় আসার দরকার নেই। কাজ শেষ করে ফিরতে বলে দাও।
ফোন ছেড়ে দিয়ে কামালের অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল শহীদ।
.
গতরাতে সার্চলাইটের মত জ্যোৎস্না ছিল। দেলোয়ার মোরশেদ যদি টেলিস্কোপে চোখ রেখে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকে শিল্পীকে নিশ্চয়ই সে দেখেছে। শুধু শিল্পীকে নয়, শিল্পীর খুনীকেও দেখে থাকতে পারে সে। কামালের সন্দেহ, লোকটা পাগলাটে হলেও, গতরাতের ঘটনার অনেকটাই সে চাক্ষুষ করেছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। খুনীর কাছ থেকে টাকা আদায় করার তালে আছে লোকটা, কামালের ধারণা।
গাড়ি ত্যাগ করে পায়ে হেঁটে এগোল শহীদ। আশপাশে বাড়ি আরও থাকলেও, খানিকটা দূরে দূরে।
একতলা বাড়ি। বাউণ্ডারি ওয়াল নেই। বেড়ার সীমানা এককালে ছিল, দুএকটা মাথা ভাঙা বাঁশ দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে বোঝা যায়। বাড়ির সামনে ঝোঁপ ঝাঁড় আর আগাছার জঙ্গল।
শোচনীয় চেহারা বাড়িটার। নির্জন, পোড়ো বাড়ি বলেই মনে হয় প্রথম দর্শনে। প্লাস্টার খসে পড়েছে। লালচে ইটগুলো উকটভাবে ভেঙচাচ্ছে যেন।
ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে শহীদ দেখল বাড়িটার ঢোকার দরজা বন্ধ। দরজার পাশেই একটা কাঠের পুরানো, নড়বড়ে মই। সিঁড়ি নেই নাকি? থাকলে মই কেন?
পেছন থেকে একটা হাত শহীদের কাঁধ খামচে ধরল। তৈরি ছিল না ও। কিন্তু কাঁধে স্পর্শ পাওয়া মাত্র পকেট থেকে লোডেড রিভলভারটা বেরিয়ে এল। বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একই সাথে।
গম্ভীর মুখে ঘন ঘন মাথা নাড়ছে ডি.কস্টা।
ব্যাড নিউজ, মি. শহীদ।
শহীদ পকেটে রিভলভারটা রেখে দিয়ে বলল, একটুর জন্যে বেঁচে গেছেন। আপনি হতে পারেন ভেবেই আমি কনুই চালাইনি। দুটো পাজর নির্ঘাত ভাঙত।
ডি. কস্টা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, পাঁজর নহে, মি. শহীদ, হামার মন ভাঙিয়া গিয়াছে। অনেক হোপ করিয়া আসিয়াছিলাম এখানে, চুরমার হইয়া গিয়াছে সকল আশা। কি যেন বলে, ঢন্য আশা কুহকিনী! টাই হইয়াছে হামার ভাগ্যে!
কেন কি হয়েছে? কিসের আশায় এসেছিলেন আপনি?
ডি. কস্টা বলল, আপনি আমার বন্ধু। আপনার এই বিপড়ে যডি হেলপ করিটে না পারিলাম টো কবে করিব? ভাবিয়াছিলাম ডেলোয়ার মোরশেডের নিকট হইটে মূল্যবান কিছু টথ্য কালেকশন করিয়া হাপনাকে ডিব–কিন্তু কপালে আগুন-মানে, কপাল পোড়া হামার।
কেন, দেলোয়ার মোরশেদ বাড়িতে নেই বুঝি।
ডি কস্টা কথা বলল না। চেয়ে রইল শহীদের দিকে। কেন যেন ছ্যাৎ করে উঠল শহীদের বুক।
ডি. কস্টাকে মইটার দিকে ঘনঘন তাকাতে দেখে পা বাড়াল ও। মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল।
নিচে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল ডি. কস্টা।
উপরে উঠে গেল শহীদ। যা সন্দেহ করেছিল তাই, টেলিস্কোপের কাছে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে দেলোয়ার মোরশেদ। রোগা-পাতলা একহারা চেহারার লোক, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স হবে। ফুটো হয়ে যাওয়া পরনের প্যান্টটা পুরানো। কিন্তু কপালের ফুটোটা একেবারে নতুন।
রক্ত এখনও জমাট বাধেনি।
খুনী কিভাবে খুন করেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না কোন। মই বেয়ে উঠেছিল সে। মোরশেদ টেলিস্কোপে চোখ রেখে দূরের কোনও দৃশ্য দেখছিল।. টেলিস্কোপের সামনে খুনীকে দেখে মাথা তোলে সে।
ঠিক সেই সময় গুলি করে খুনী।
কপালের ফুটোটা দেখে শহীদ নিঃসন্দেহে বুঝতে পারল গুলিটা বেরিয়েছে .৪৫ পিস্তল থেকে।
Leave a Reply