কুয়াশা ৬০ – অপরাধী ২ – ভলিউম ২০
কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৭৬
০১.
মি. সিম্পসনের চেয়ারে বহু অফিসারের ভিড়। গভীর থমথমে অনেকগুলো ভারি মুখ। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদও রয়েছেন তাদের মধ্যে। কাবেরীকে দেখা যাচ্ছে না।
মি. সিম্পসনের চেহারা শান্ত হলেও, গভীর ভাবে চিন্তিত তিনি তা তাকালেই বোঝা যাচ্ছে। হাতের চুরুটের ছাই ফেলবার কথাও ভুলে যাচ্ছেন তিনি।
চেম্বারের ভিতর একজন কনেস্টবল ঢুকল। তার পিছনে ডি. কস্টা। ডি. কস্টার পিছনে দুজন কনেস্টবল, সবার পিছনে সাব-ইন্সপেক্টর জাহিদ।
দৃঢ়, অবিচলিত পদক্ষেপে সোজা এগিয়ে গিয়ে মি. সিম্পসনের প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা।
বসো ডি কস্টা, মি. সিম্পসন বললেন।
সবাই লক্ষ করছে ডি, কৃস্টাকে। ডি. কস্টা বসল না, হাত দুটো রাখল টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ল মি. সিম্পসনের দিকে। একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আপনি আমার নাম বলিবার সময় মিস্টার শব্দটি উচ্চারণ করিবেন। এর আগে জব্বার যে-রাটে মার্ডার হয়, আপনি আমাকে শুডু ডি কস্টা বলিয়া ডাকিয়াছিলেন। টখন হামি জব্বার এবং টার বাচ্চার ব্যাপারে চিন্টিট ছিলাম বলিয়া ঝামেলা বাড়াই নাই। কিন্টু, এখন হামি আপনার নিকট হইটে প্রকৃট সম্মান ডাবি করি।
মি. সিম্পসনের মুখের রঙ বদলাতে শুরু করেছে।
কোঠায় কি ঘটিয়াছে, কেন ঘটিয়াছে, অ্যাকচ্যুয়াল ফ্যাক্ট কি-কে বা কাহারা ডায়ী টা না জানিয়াইহামাকে গ্রেফটার করিয়া আনা হইয়াছে? বিলিভ ইট অর নট, হামি মানহানির কেস করিব।
আমর ফ্যাক্ট সম্পর্কে জেনেশুনেই আপনার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছি, মিস্টার ডি. কন্টা।
বলে যান, হামি শুনিটেছি।
গ্রীন রেস্টুরেন্টের সহকারী ম্যানেজার আবুল হোসেন গতরাতে খুন হয়েছে। তাকে গুলি করা হয়েছে ৪৫ রিভলবার দিয়ে। আপনার রিভলবারটাও .৪৫।
টারমানেই কি গুলিটা হামার রিভলবার হইটেই বাহির হইয়াছে?
মি. সিম্পসন থমথমে গলায় বললেন, দূর্ভাগ্যক্রমে আমরা বুলেটটা পাইনি। দেহ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে সেটা। কিন্তু, কামরার অনেক জায়গায় পাওয়া গেছে আপনার হাতের ছাপ। বাড়ির মালিক এক বৃদ্ধা–সে আপনাকে দেখেছে। শুধু দেখেইনি, আপনি ফিরে আসার সময় যে হোসেনকে হুমকি দিয়েছেন তাও সে আড়ি পেতে শুনেছে।
সম্ভবট ফিরিয়া আসিয়া আবার সেখানে যাই হামি, গুলি করিয়া মার্ডার করি হোসেনকে? হামি কি… হামাকে কি পাগল বা বোকা মনে করেন আপনি?
বাজে কথা রাখুন। অভিযোগের বিরুদ্ধে কিছু বলবার থাকলে বলুন।
ফোনের দিকে তাকাল ডি. কস্টা। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে বাড়িয়ে ধরুল মি. সিম্পসনের দিকে। বলল, মিস কাবেরীকে জিজ্ঞেস করুন, গটো রাষ্ট্রে কখন কোঠায় ছিলাম হামি।
মি. সিম্পসন মুখের কাছে রিসিভার নিয়ে গিয়ে বললেন, কাবেরী চেম্বারে এসো।
পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠেছে।
কেউ কোন শব্দ করছে না। মি. সিম্পসন চেয়ে আছেন ডি. কস্টার দিকে, ডি. কস্টাও চেয়ে আছে তার দিকে।
দেড় মিনিট পর ঢুকল কাবেরী চেম্বারে।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, গতরাতে, এই সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মিস্টার ডি. কস্টা কোথায় ছিলেন জানো তুমি?
কাবেরী চেয়ে রইল, যেন প্রশ্নটা সে বুঝতে পারেনি। ডি. কস্টার দিকে তাকাল সে একবার। কিন্তু কথা বলল না, চুপ করেই রইল।
মি. সিম্পসন বললেন, উত্তর দাও? জানো তুমি?
মুখ খুলল কাবেরী, জানি, স্যার।
কোথায় ছিলেন?
একটা বারে।
তুমি জানলে কিভাবে?
কাবেরী চুপ করে রইল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে বলল, আমিও ছিলাম মি. ডি. কস্টার সাথে।
হু।
নিস্তব্ধতা নামল চেম্বারের ভিতর। কেউ কথা বলছে না। তারপর, আবার মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কি করছিলে তোমরা, কাবেরী?
আমরা, স্যার…মানে, কফি খেতে গিয়েছিলাম…
মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক আছে, যাও তুমি।
বেরিয়ে গেল কাবেরী চেম্বার থেকে।
আবার নিস্তব্ধতা।
আপনিও যেতে পারেন, মিস্টার ডি. কস্টা। শুধু জেনে যান, আপনার বিরক্তিকর মুভমেন্ট-এর জন্য আমরা অসুবিধে বোধ করছি কাজ করতে।
ভাবভঙ্গিতে সাহসের অভাব দেখা না গেলেও মনে মনে ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে ডি. কস্টা। মি. সিম্পসন তাকে গ্রেফতার করার সুযোগ পেলে ছাড়বেন না তা সে ভাল করেই জানে। অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে দাঁড়াল না সে, পা বাড়াল দরজার দিকে।
.
ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ির গেটে একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ডি. কস্টা। লোকটা কাছে এসে জানতে চাইল, আপনিই কি মি. স্যানন ডি কস্টা?
ডি. কস্টা দেখল তার হাতে বড়সড় একটা বোর্ডের বাক্স রয়েছে। লোকটা পিয়নটিয়ন হবে। সে উত্তরে বলল, ইয়েস। কি ডরকার?
মিস করুণা এই বাক্সটা পাঠিয়েছেন। বাক্সের ভিতর তার একটা চিঠিও আছে।
ডি. কস্টা বলল, মিস করুণ কোঠায়? টিনি কি টোমাকে বাড়ি হইটে পাঠাইয়াছেন?
না। তিনি লালকুঠীতে রিহার্সেল দিচ্ছেন। আমি সেখান থেকেই আসছি। সারাদিন থাকবেন আজ তিনি ওখানে।
বাক্সটা নিয়ে লোকটাকে একটা টাকা বকশিশ দিয়ে বিদায় করুন ডি. কস্টা। বাড়িতে ঢুকে বাক্সটা খুলে সে দেখল ছোট বাচ্চার কাপড়-চোপড় কতকগুলো। করুণা চিঠিতে লিখেছে:
প্রিয় মি. ডি. কস্টা,
আপনার একটা দয়ালু মন আছে, সেদিন আবিষ্কার করেছিলাম। আপনার মনটা সত্যি আশ্চর্যরকম নরম এবং সংবেদনশীল। আপনার সাথে পরিচয় আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। চঞ্চলের জন্য কিছু করার দায়িত্ব আমাকে দেবেন কিনা জানি না। কাপড়গুলো তার প্রতি আমার সহানুভূতির চিহ্ন হিসেবে পাঠালাম। গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হবার সুযোগ দেবেন। ইতি করুণা।
মিনিটখানেক পর দরজায় তালা দিয়ে বাইরে বেরুল ডি. কস্টা আবার।
আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করাল সে। ট্যাক্সিতে চড়ে বলল, লালকুঠী।
লালকুঠীর সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। বারান্দা ধরে, এগোতে এগোতে একটা দরজা খোলা দেখে ভিতরে ঢুকল। কয়েকজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দেখে জিজ্ঞেস করল সে, মিস করুণাকে কোঠায় পাই?
উনি তো ড্রেসিং রূমে।
এগিয়ে গেল ডি কস্টা। আজ স্টেজ রিহার্সেল করুণার, ড্রেসিং রুমে-পাওয়া, গেল তাকে।
ডি কস্টাকে দেখেই করুণা জানতে চাইল, কি হয়েছে আপনার? মাথায় ব্যাণ্ডেজ কেন?
হাসল ডি. কস্টা। বলল, ও কিছু টুন ব্যাপার নয় হামার জন্যে। মনটা ভাল নাই। আপনাকে চঞ্চলের কাপড় পাঠাইবার জন্য ঢন্যবাড ডিটে আসিয়াছি।
কিভাবে ঘটল? কে…তাকে চিনতে পেরেছেন? মাথার ব্যাণ্ডেজের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল করুণা।
আক্রান্ট হইয়াছিলাম। না, চিনিটে পারি নাই। টবে সময় হোক, নিজেই সে ঢরা ডিবে।
বসুন। চঞ্চল কেমন আছে?
ডি কস্টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল, ভাল। কিন্টু হামি ভাল নাই।
করুণা জানতে চাইল, কেন? কিসের দুঃখ আপনার?
ডি. কস্টা বলল, আমি একজন দুঃখী মানুষ। কিন্টু হামার যে কি ডুঃখ টাই হামি জানি না।
এই সময় ড্রেসিংরুমে কয়েকজন মহিলা প্রবেশ করল। বিশ-বাইশ বছরের একটি ছেলেও রয়েছে তাদের মধ্যে। কি বিষয়ে যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল তারা এক কোনায় দাঁড়িয়ে।
ডি. কস্টা সেদিকে তাকালও না।
করুণা নিজের টুলে বসল এতক্ষণে, আয়নার দিকে তাকিয়ে মেকআপ ঠিকঠাক করার কাজে মনোনিবেশ করে বলল, আর সব খবর কি বলুন?
ডি. কস্টা বলতে শুরু করল। যা যা ঘটেছে প্রায় সবই বলল সে।
করুণা শুনছিল মন দিয়ে। ইব্রাহিম খলিলের নামটা উচ্চারণ করুল ডি. কস্টা, বাধা পেল সে।
ইব্রাহিম খলিল!
অচেনা একটি কণ্ঠস্বর হতে প্রশ্ন ভেসে এল, ইব্রাহিম খলিল!
ঘাড় ফিরিয়ে বা-দিকে তাকাল ডি. কস্টা এবং করুণা।
ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়স্কা এক মহিলা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। ভাল করে তাকাতেই চিনতে পারল ডি. কস্টা লতিফা রহমান। নামকরা চরিত্রাভিনেত্রী। সিনেমায় এবং মঞ্চে সমান সফল সে।
কাছাকাছি এসে দাঁড়াল লতিফা রহমান।
করুণা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার বন্ধু, মি, স্যানন ডি কস্টা। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আর ইনি
ডি. কস্টা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, ওঁর পরিচয় ডেবার ডরকার নাই। সবাই হামরা চিনি মিসেস লতিফাঁকে।
লতিফা সকৌতুকে জানতে চাইন, এর আগে কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়নি। হারে, করুণা, কোন্ ইব্রাহিম খলিলের কথা আলোচনা করছিলি তোরা?..
ডি. কস্টা অনুভব করছিল, তার ঘাড়ের উপর কেমন যেন শিরশির করছে। পিছন দিকে তাকাল সে।
অমনি চোখাচোখি হয়ে গেল ছেলেটার সাথে। খানিক আগে ছেলেটা প্রবেশ করেছে ভিতরে। এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে সে। চেয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে করুণার দিকে। ছেলেটার বাঁ হাতটা সম্পূর্ণই ব্যাণ্ডেজে মোড়া, গলার সাথে কাপড়ের পাকানো দড়ি দিয়ে বাঁধা সেটা।
ডি. কস্টা ঘাড় সোজা করে করুণার দিকে তাকাল।
লতিফা রহমান বলে চলেছে, বুঝেছি, বুঝেছি, তুই যার কথা বলছিস সেই লোকই ইরাহিম খলিল। লোকটাকে কখনও দেখিনি আমি। তবে আমাদের সময়কার উঠতি বা নামকরা নায়িকারা সবাই তাকে চিনত, তার সাথে ওঠাবসা করত। অদ্ভুত একটা খেয়াল ছিল লোকটার। খেয়াল না বলে রোগ বলাই ভাল। সিনেমা জগতের কিশোরী আর যুবতী মেয়েদেরকে নিয়মিত চিঠি লিখত সে। চিঠি লেখাটা সম্ভবত তার একটা হবি ছিল। এমন কোন যুবতী আর্টিস্ট ছিল না যে ইব্রাহিম খলিলের চিঠি পায়নি। শুধু চিঠি হলে কথা ছিল। দামী উপহার, ফুলের তোড়াও পাঠাত সে। আমার কাছে কমপক্ষে পঞ্চাশটা চিঠি লিখেছিল সে। তুই পাসনি পাগলটার চিঠি?
ঠিক মনে করতে পারছি না। দাঁড়া ভেবে দেখিআমি আবার সে সময়টা নিজে কোন চিঠিপত্র দেখতাম না। সেক্রেটারিই যাবতীয় কাজ করত।-হ্যা! মনে পড়েছে রে লতিফা। আমিও বোধহয় পেয়েছিলাম তার একটা চিঠি।
লতিফা জানতে চাইল, সে তো মারা গেছে অনেক বছর আগে। তাকে নিয়ে এখন আলোচনা কিসের।
ডি. কস্টা বলল, আপনারা যাহারা ইব্রাহিম খলিলের চিঠি পাইটেন টাহারা কি জানিটেন লোকটা কি রকম নেচারের ছিল?
না। তবে খুব যে ধনী লোক ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ডি কস্টা বলল, চনী তো হেবেই। বেআইনী অস্ত্রের ব্যবসায়ী ছিল যে। স্মাগলিং করত। জুয়ার বড় বড় আড্ডা বসাত।
তাই নাকি?
ডি. কস্টা বলল, হ্যাঁ।
ঘাড় ফিরিয়ে আর একবার তাকাল ডি. কস্টা পিছন দিকে। যুবকটি সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আগের মতই চেয়ে আছে ওদের দিকে। ডি. কস্টা তাকাতেই সে পা বাড়াল।
করুণার পিছনে এসে দাঁড়াল যুবক। বলল, করুণাদি, আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে আপনার।
ইস্! দেরি করে ফেললাম!
দ্রুত মেকআপ ঠিকঠাক করতে আরম্ভ করল করুণা। যুবকটি চলে গেল ধীরে ধীরে।
ছোকরা কে হয় আপনার?
করুণা বলল, আমাদের নাট্য সংস্থার সর্বেসর্বার ছেলে। আধপাগল ও। আমাকে ভালবাসে। পরিষ্কার করে আমাকে কিছু না বললেও, অনেককেই নাকি বলে কথাটা। মাথায় গণ্ডগোল আছে বেশ। যুখী নামে একটি মেয়েকে ভালবাসত তিন বছর আগে। যুথী অন্য এক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলায় বিষ খেয়ে দুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।
মাইগড! হাটে ব্যাণ্ডেজ কেন?
করুণা বলল, গতকাল স্টেজের উপর মই নিয়ে উঠেছিল। পড়ে যায়। ভাগ্য ভাল যে ভাঙেনি হাতটা।
.
শহীদ ওর ড্রয়িংরুমে বসে ধূমপান করতে করতে গভীরভাবে চিন্তা করছিল। রহস্যের গভীরতা বাড়ছে ক্রমশ। আবুল হোসেন খুন হয়েছে, মি. সিম্পসন ফোন করে জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, হোসেন মরল কেন? জব্বার কেন খুন হয়েছে তা হোসেন, জানত, তাই কি তাকেও খুন হতে হলো?
এদিকে সুদখোর আলাউদ্দিন বলছে, জব্বার তার টাকা শোধ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোত্থেকে পেল টাকা? তবে কি সে অন্য কারও কাছ থেকে টাকা ধার করে আলাউদ্দিনের দেনা পরিশোধ করেছিল?
সম্ভবত তাই। কে সেই লোক? কার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিল জব্বার দ্বিতীয়বার?
আরও অনেকগুলো ব্যাপারে খুঁতখুঁত করছে মন। জব্বার করুণা নাম্নী এক অভিনেত্রীর বাড়ির আয়রনসেফ ভাঙে সে-রাতে, ডাকাতি করে তিনশো টাকা এবং তিন ভরি সোনা। কোথায় সেগুলো? সেগুলো পাওয়া যায়নি-কারণ কি? জব্দারের লাশের কাছে ছুটে যাচ্ছিল মরিস থেকে নেমে লোকটা, তার কারণ জব্বারের দেহ সার্চ করার ইচ্ছা ছিল তার। জব্বারের খুন হবার আগেই শত্রুপক্ষের কেউ সেখানে গিয়েছিল। তারা কিছু খোঁজার জন্যই গিয়েছিল। পায়নি, বোঝা যায়। জিনিসগুলো বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথাও না কোথাও আছে। জব্বার বাড়ি থেকে তার বাচ্চাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, কারণ, সে জানত তাকে ধরার জন্য তার খুনে সঙ্গীরা আসছে। এরপর রেস্তোরাঁয় তাকে দেখে ডি. কস্টা। জব্বার কি রেস্তোরাঁয় আসার পথে আর কোথাও, আর কারও কাছে গিয়েছিল টাকা আর গহনা রাখার জন্যে?
কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? জব্বার জানত তাকে খুন করার জন্যে লোকগুলো আসছে। তার উদ্দেশ্য ছিল চঞ্চলকে ওদের আওতা থেকে সরিয়ে ফেলে একা ওদের মুখোমুখি হবে। টাকাগুলো সে বাচ্চার সাথে রেখে যেতে পারত।
এদিকে মরিসের ড্রাইভারকে এখনও পায়নি পুলিস।
মাহবুব চৌধুরীর ব্যাপারটাও অবহেলার যোগ্য নয়। ডি. কস্টা সে রাতে যে লোকটাকে গুলি করে আহত করে সে মাহবুবের লোক ছিল।
কিন্তু কোথায় যেন অমিলও রয়েছে। মাহবুব চৌধুরী যে জগতের লোক সে জগতের লোক জব্বার নয়। দুজনের মধ্যে সাত সমুদ্রের ব্যবধান।
ডি. কস্টার উপর আক্রমণ করা হয়েছে দুবার। এতে প্রমাণ হয় শত্রুপক্ষ শঙ্কিত। তারা ভয় দেখাতে চাইছে। এতে এ-ও প্রমাণ হয় যে শত্রুপক্ষ প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী।
সূত্র দরকার। কোন্ পথে এগোনো যায়?
ডি. কস্টাকে প্রথমবার যারা আক্রমণ করেছিল তাদের পরিচয় জানা দরকার। কারা তারা? চেহারাগুলো স্মরণ আছে ওর।
পাশের বেডরূমে ঢুকল শহীদ। তেপয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। দুটো ফোন। একটা লাল, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শহীদ এটা কখনও ব্যবহার করে না। অবশ্য মহুয়া এই ফোন প্রায়ই ব্যবহার করে।
রিসিভার তুলে কানে লাগাল শহীদ। ডায়াল করুন না। মিনিটখানেক অপেক্ষা করার পর অপর প্রান্ত থেকে ভরাট একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, শহীদ?
হ্যাঁ। ইনফরমেশন দরকার আমার। ডি. কন্টাকে প্রথমবার যারা আক্রমণ করেছিল তাদের পরিচয় জানতে চাই আমি। চেহারাগুলোর বর্ণনা দিচ্ছি…।
ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এল শহীদের কানে, দরকার নেই। ওদের পরিচয় ইতিমধ্যেই জেনেছি আমি। একজনের নাম রাশেদ, অপরজনের নাম জমির। এককালে প্রাইভেট ডিটেকটিভ ছিল ওরা। কয়েকটা কেসে ওরা অসৎ উপায় অবলম্বন করায়, মক্কেলদেরকে সাহায্য করার বদলে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার অপরাধে ওদের জেল হয়। চট্টগ্রামে কাজ করত ওরা। ইদানীং ওদেরকে দেখা গেছে মোহাম্মদ গাউস নামে একজন লোকের সাথে। গাউস নিজেও অপরাধী, তবে ধরা পড়েনি কখনও। জুয়ার আড্ডা বসায় সে। মাহবুব চৌধুরীর অধীনে কাজ করে। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগও শোনা যায় তার বিরুদ্ধে। জব্বার জুয়া খেলেছিল এই গাউসেরই আড্ডায়। খেলে সব হারে।
কুয়াশা সব খবরই রাখে দেখা যাচ্ছে।
শহীদ বলল, রাশেদ এবং জমির সম্পর্কে আর কিছু…।
ঢাকায় ওরা অনেক খারাপ কাজ করেছে। অপরাধীদের মাথা যারা তাদের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করত ওরা, শুনেছি। বর্তমানে সম্ভবত মোহাম্মদ গাউসের সাথে আছে ওরা। গাউসের ঠিকানাটা লিখে নাও।
লিখে নিল শহীদ, বলল, বুঝেছি। ধন্যবাদ, কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, ডি. কস্টাকে গতরাতে যে লোকটা আক্রমণ করেছিল তার কাছ থেকে কোন কথা আদায় করা সম্ভব হয়নি। তার একটা কারণ, লোকটা বোবা, কালা এবং লেখাপড়া জানে না।
শহীদ গম্ভীর স্বরে বলল, শত্রুপক্ষ ধুরন্ধর, সন্দেহ নেই। ভাল কথা, ডি. কস্টাকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করো, বিপদে পড়বেন।
কুয়াশা বলল, কিন্তু তোমার চেয়ে বুদ্ধিমান তারা নয়। শহীদ আমি তোমার সাফল্য কামনা করি। মি. ডি কস্টা…সরাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। জব্বারকে খুন হতে দেখেছেন তিনি, তাই ঘটনাটা নাড়া দিয়েছে তাঁকে প্রবলভাবে। বললেও এই কেস থেকে দূরে সরে থাকবেন না তিনি।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল কুয়াশা।
.
০২.
মোহাম্মদ গাউসের বাড়িটা মগবাজার এলাকায়। বাড়িটা খুবই ছোট, একতলা। সামনে সুন্দর একটা বাগান। গেটটা খোলা। ভিতরে, গাড়ি বারান্দায় একটা মরিস দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে শহীদ অনুমান করল বাড়িতেই আছে গাউস।
গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে নামল শহীদ। বাড়ির গেটে, বাগানে, উঁচু বারান্দায়–মোট তিনটে উজ্জ্বল বালব আলোর বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা কি? গাউস অন্ধকারকে ভয় করে মনে হচ্ছে।
দুপাশের বাগান দেখতে দেখতে এগোল শহীদ। কোথাও কেউ নেই। বারান্দায় উঠে সামনে যে দরজাটা পাওয়া গেল সেটার সামনে দাঁড়াল ও। পকেট থেকে বের করল রিভলভারটা। সেটা দিয়েই টোকা মারল দরজায়, ঠক-ঠক-ঠক্।
একটা চেয়ার সরাবার শব্দ হলো ভিতরে। দরজা না খুলে ভিতর থেকে কেউ জানতে চাইল আঁঝাল গলায়, কে শুনি?
পরিচয় শুনলে জ্ঞান হারাবে, গাউস। দরজাটা খোলো!
দরজা খুলতে খুলতে গাউস বলল, রঙবাজ মনে হচ্ছে।
দরজা খুলেই শহীদের হাতের রিভলভারের মুখোমুখি হলো গাউস। কিন্তু ভয়ের এতটুকু ছাপ ফুটল না মুখের চেহারায়।
লোকটাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিচ্ছিল শহীদ। নামটার সাথে কোথায় যেন মিল আছে শয়তানটার। ঢাউস চেহারা, ফোলা বেলুনের মত বড়সড় মুখ। ট্রাউজারের পকেটটা উঁচু হয়ে রয়েছে। নাকটা ছোট, উন্নত কপাল, চোখ দুটো গোল গোল। দুই কোমরে হাত দিয়ে চিবুক উঁচিয়ে বেপরোয়া একটা ভঙ্গি করে দাঁড়াল সে।
চিড়িয়া মনে হচ্ছে? কি চাই?
শহীদ বলল, চাই তোমাকে। একটা খুনের ব্যাপারে…
আড়চোখে শহীদের রিভলভারটা আর একবার দেখে নিয়ে কি যেন চিন্তা করল গাউস। এক মুহূর্ত পর পথ ছেড়ে দিল সে, দৃঢ় পায়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
দরজাটা বন্ধ করে দিল শহীদ।
পাশের রূমে, কথাটা বলে শহীদকে ছাড়িয়ে গেল সে। শহীদ উদ্যত রিভলভার হাতে অনুসরণ করল তাকে।
পাশের রূমটা বেশ সাজানো গোছানো। আরামদায়ক চেয়ার, সোফা, বুক শেলফ, টিভি-সবই আছে।
মুখোমুখি বসল ওরা।
পুলিস নাকি? সিভিল ড্রেসে?
শহীদ শান্তভাবে বলল, ন্যাকামি রাখো, গাউস। আমাকে তুমি ঠিকই চিনতে পেরেছ। বছর তিনেক আগে চট্টগ্রামে তোমাকে আমি একটা খুনের ব্যাপারে জেরা করতে গিয়েছিলাম। ভয়ে তুমি পালিয়েছিলে বাড়ির পিছন দিকের পাঁচিল টপকে। পরে জেনেছিলাম, সে ঘটনার সাথে তুমি জড়িত ছিলে না। পালিয়েছিলে, তার কারণ, অনেক অকাজ-কুকাজ করেছ তুমি। তাই আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হবার সাহস ছিল না তোমার। কিন্তু বর্তমান খুনের সাথে তুমি জড়িত। ব্যাপারটা জেনেই এসেছি।
দেখুন, মি. শহীদ, অযথা আমাকে ঘটাবেন না। আমি একজন সৎ এবং নিরীহ নাগরি…।
ধমকে উঠল শহীদ, চুপ করো। জব্বার খুন হয়েছে। খুন হবার আগে সে তোমার জুয়ার আড্ডায় খেলতে বসে, শেষ দিনের খেলায় সে সব টাকা হারে।
শহীদের মুখের দিকে চেয়ে রইল গাউস। এভাবে কেউ কোন দিন কথা বলেনি তার সাথে। চরম অপমানটা সহ্য করে নিল সে। বলল, ঠিক আছে, খেলেছিল সে। হেরেও ছিল। কিন্তু তাতে কি? জব্বার হেরেও হারেনি। আমি তার সব টাকা। ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। হেরে গিয়ে মেয়েমানুষের মত হাউ-মাউ করে কাঁদছিল সে, দেখে মায়া হলো, তাই তার টাকা তাকে ফেরত দিয়ে বলেছিলাম, আর কোন দিন খেলতে এসো না।
নতুন এবং চমকপ্রদ তথ্য বটে এটা একটা, ভাবল শহীদ।
বাঁকা হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। বলল, গাউস, তোমাকে আমি খুব ভাল করে চিনি। খেলে জিতলে, তারপর টাকা ফেরত দিয়ে দিলে দয়া করে–এ কথা দুনিয়ার কেউ বিশ্বাস করবে না। নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিল। কি সেই কারণ, গাউস?
কারণ? কোনও কারণ ছিল না।
শহীদ দৃঢ় গলায় বলল, না। তা হতে পারে না। নিশ্চয়ই তাকে দিয়ে তুমি কোন অন্যায় কাজ করিয়ে নেবার শর্তে ফেরত দিয়েছিলে টাকাটা। কি সেই কাজ?
কী আশ্চর্য! আমাকে এভাবে বিনা দোষে…
নির্মম হাসি ফুটল শহীদের ঠোঁটে।
গাউস তাকাল শহীদের হাতের রিভলবারের নলের দিকে।
শহীদ এবার হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলল। অনুমানের উপর প্রশ্নটা করল ও, সাইদুল হক তোমার আড্ডায় জুয়া খেলে, তাই না! সাবধান, মিথ্যে কথা বলবে না…।
হ্যাঁ, সাইদুল হক–খেলে না, খেলত। বেশ কিছুদিন হলো আসা-যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে।
শহীদ জানতে চাইল, জমির আর রাশেদ-তাদেরকে দেখছি না যে? আমি এসেছিকে তোমাকে রক্ষা করবে? তোমার এই বিপদের সময় তারা কোথায় গাউস?
জানি না। জমির বা রাশেদ–দলের কারও সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
শব্দ করে হেসে উঠল শহীদ, হোসেনকে খুন করার জন্য কে তাদেরকে পাঠিয়েছিল? তুমি নও?
আমি! দেখুন আপনি কি পাগল হয়েছেন?
গাউস!
রিভলবার ধরা হাতটা এতটুকু নড়াল না, টান টান হয়ে বসল শহীদ।
কোথায় তারা? আবার প্রশ্ন করল শহীদ।
কী আশ্চর্য! তাদের খবর আমি কি জানি?
কোথায় তারা? কাঠিন্য বৃদ্ধি পেল শহীদের কণ্ঠস্বরে।
গাউস এই প্রথম ঢোক গিলল, গলা ওবাতে শুরু করেছে তার। বলল, বিশ্বাস করুন, আমার কোন সম্পর্ক নেই তাদের সাথে। যতদূর জানি, ধূপছায়া হোটেলের দুটো কামরা ভাড়া নিয়ে থাকে ওরা।
গাউসের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে নিচু তেপয় থেকে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল শহীদ, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে ডায়াল করল, কথা বলল ধূপছায়া হোটেলের ম্যানেজারের সাথে। কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে শহীদ বলল, জমির আর রাশেদ হোটেলের কামড়া ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে! কোথায় গেছে তারা?
জানি না।
উঠে দাঁড়াল শহীদ। শয়তানটার মুখ থেকে কথা আদায় করা সম্ভব নয়। সোফার উপর একটা পা তুলে দিয়ে গাউসের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল ও, বলল, খুব সাবধান, গাউস। তোমার মরণের দিন-তারিখ ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ও। পিছন ফিরে না তাকিয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে হলরুমে পা দিল, সোজা বেরিয়ে এল সেখান থেকে বারান্দায়।
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনে চড়ে স্টার্ট দিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাউস ওকে দেখছে। কিন্তু শহীদ সেদিকে তাকালও না। ছেড়ে দিল গাড়ি।
চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দুরে একটা গলি, সেই গলির ভিতর গাড়ি ঢোকাল ও, থামাল, নেমে পড়ল স্টার্ট বন্ধ করে। গলি থেকে বেরিয়ে গাউসের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল দ্রুত।
বাড়িটার কাছাকাছি একটা লাইটপোস্ট। সেটার পাশে দাঁড়াল ও বাড়িটার দিকে পিছন ফিরে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওকে। গাউসের কালো মরিসটা তীর বেগে বেরিয়ে এল গেট অতিক্রম করে। আড়চোখে তাকিয়ে শহীদ দেখল ড্রাইভিং সীটে বসে রয়েছে গাউস, মুখটা থমথমে।
চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল মরিল। রাস্তা পেরিয়ে তখুনি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল শহীদ। দরজার তালা বন্ধ থাকার কথা। দরজার কাছে গেলই না ও। জানালা দিয়ে ঢুকতে হবে ভিতরে।
খিল খুলে ভিতরে ঢুকতে মিনিট দশেক লাগল শহীদের।
দুটো বেডরূম। আসবাবপত্র দামী দামী হলে হবে কি, দুটো রূমই নোংরা হয়ে আছে। ধুলোর আস্তরণ প্রায় সর্বত্র। কিচেনের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ডিমের, পেঁয়াজের, আলুর খোসা চারদিকে ছড়ানো। ধধায়া হয়নি এমন প্লেটের সংখ্যা দশ বারোটা।
আর একটা রূমে ঢুকল শহীদ। ভাড়ার ঘর এটা। দুটো মিটসেফ রয়েছে। কেরোসিনের টিনে রয়েছে প্রচুর চাল-ডাল। দেখবার কিছুই নেই। বেরিয়ে আসছিল শহীদ। আসলে কৌতূহলবশতই ফিরে এসেছে ও, নির্দিষ্ট কিছু পাবার আশায় নয়।
ভাঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বক্ষণে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে। মনটা খুঁতখুঁত করছে কেন?
শহীদ ভাল করে চারদিকটা দেখল। খটকা লাগতে পারে তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। শুধু দুটো মিটসেফের একটা একটু বাঁকা হয়ে রয়েছে।
কি মনে করে মিটসেফটার কাছে ফিরে এল শহীদ। খালি একটা মিটসেফ। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। দুহাত দিয়ে ঠেলা দিতেই সরে গেল।
তাকিয়ে রইল শহীদ গুপ্ত পথটার দিকে। দেয়ালের সাথে ছোট একটা জানালা রয়েছে, কবাট দুটো বন্ধ, গরাদ দেখা যাচ্ছে না।
বসল শহীদ জানালাটার সামনে। শিকল এবং খিল খুলে কবাট দুটো উন্মুক্ত করল।
গরাদহীন জানালা। গোপন পথ। ভিতরটা অন্ধকার। পকেটে হাত ভরে পেন্সিল টর্চ বের করে জ্বালল শহীদ। কয়েকটা ধাপ নেমে গেছে নিচের দিকে। চারকোনা একটা ছোট কামরা। নিচে নেমে সুইচবোর্ডের সুইচ টিপে আলো জ্বালল ও। লাল আলোয় লালচে হয়ে উঠল সবকিছু।
ভ্যাপসা একটা গন্ধ পাচ্ছে ও। চারদিকে তাকিয়ে শহীদ বুঝতে পারল, এটা একটা ডার্করুম। এককালে ছিল আর কি। বহুদিন ব্যবহার করা হয় না এই ডার্করাম। যন্ত্রপাতির গায়ে মোটা আস্তরণ পড়েছে ধুলোর। বড় আকারের একটা ক্যামেরা, ফিল্ম-প্লেট, কেমিক্যালসের বোতল, রঙের টিউব–সবই রয়েছে।
ব্যাপার কি? গাউস কি সৌখিন ফটোগ্রাফার ছিল এককালে?
চিন্তিত হয়ে পড়ল শহীদ। কিন্তু বাড়ির ভিতর বেশিক্ষণ রইল না ও। গাউস যখন তখন ফিরে আসতে পারে।
.
ডি. কস্টা লালকুঠী থেকে বিদায় নেবার সময় সে করুণাকে কথা দিয়েছিল রাতে দেখা করবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহীদের কথা মনে পড়ে গেল। শহীদের সাথে দেখা করার তাগিদ অনুভব করল সে।
শহীদ সবেমাত্র ফিরেছে গাউসের বাড়ি থেকে। ডি. কস্টা ওর সাথে ঘণ্টাখানেক আলোচনা করল। শহীদ সর্বশেষ তথ্যগুলো জানাল তাকে। শহীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে উপস্থিত হলো করুণার বাড়িতে।
নীল একটা শাড়ি পরেছে করুণা। পেট-কাটা, হাতকাটা ব্লাউজ। করুণা অপূর্ব সুন্দরী, আর একবার স্বীকার করল সে মনে মনে।
করুণা বলল, ইচ্ছা হয় চঞ্চলের জন্য আমি কিছু করি। সত্যি, বড় মায়া হয়। ওকে আপনি রাখবেন আমার কাছে?
ডি. কস্টা বলল, একবারে বাচ্চা যে, ঝক্কি-ঝামেলা সামলাইটে পারিবেন না।
তবু, আপনাকে সাহায্য করতে পারলে ভাল লাগত, তাই বললাম কথাটা।
সাহায্য হামার ডরকার। বিলিভ মি, আই নিড অল কাইণ্ডস অভ হেলপ ভেরি ব্যাডলি। কেসটার মাথা-মুণ্ড কিছুই হামি বুঝিটে পারিটেছি না।
সবকথা কাউকে বললেও মনটা হালকা হয়। বলবেন নাকি আমাকে? সব শুনলে বলতে পারতাম, আপনাকে সাহায্য করতে পারি কিনা।
এতটুকু ইতস্তত না করে করুণাকে সবকথা বলল ডি কস্টা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, যা যা ঘটেছে, সব শুনন করুণা। অসংখ্য প্রশ্ন করে জেনে নিল সে প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি।
শেষে করুণা বলল, এমনও তো হতে পারে, কেসটা নিতান্তই সাধারণ, এর ভিতর তেমন কোন রহস্য নেই।
নো। নো! দ্যাটস ইমপসিবল!
.
০৩.
পরদিনের ঘটনা।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে দ্বিতীয় কাপ কফি খাচ্ছিল শহীদ। ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল মহুয়া, কার সাথে কথা বলছিনে গো তুমি?
কামাল ফোন করেছিল।
মহুয়া উৎসাহভরে জানতে চাইল, পিতা-পুত্র হত্যাকাণ্ড–সমাধান হয়েছে কেসটার?
শহীদ হাসতে লাগল, সমাধান হবে না মানে! কামাল আমারই তো সহকারী, ব্যর্থতা কাকে বলে জানে না। ও প্রমাণ করেছে পিতাকে হত্যা করে পুত্র আত্মহত্যা করেছে।
কী সাংঘাতিক! মানুষ কেন যে…।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং। রিসিভারটা তুলে নিল শহীদ। শহীদ খান স্পিকিং।
মি. সিম্পসনের পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কিন্তু বেসুরো লাগল শহীদের কানে কণ্ঠস্বরটা, শহীদ, তোমার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এখুনি একবার আসতে পারবে আমার চেম্বারে?
খুব জরুরী ব্যাপার?
জরুরী তো বটেই।
বেশ। সাত মিনিটের মধ্যে।
রিসিভার রেখে দিয়ে মহুয়ার দিকে তাকাল শহীদ, কামাল আজ কিংবা আগামীকাল ফিরবে। উঠে দাঁড়াল ও।
যাচ্ছ কোথাও যেন?
শহীদ বলল, হ্যাঁ, মি. সিম্পসনের চেম্বারে।
বিরূপ দেখাল মহুয়াকে। বলল, ওই ভদ্রলোক আমার সতীন, বুঝলে? দিন নেই রাত নেই শুধু খুন-খারাবি নিয়ে মেতে আছেন নিজে, তোমাকেও ব্যস্ত রাখবেন। নিশ্চয়ই আবার কেউ খুন হয়েছে?
শহীদ দরজার দিকে পা বাড়াল, বলল, মনে হয় না। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো, তিনি নিজেই খুন হতে যাচ্ছেন।
.
শহীদ মুখোমুখি চেয়ারে বসতেই মি. সিম্পসন বললেন, খুন করে ফেলল এরা আমাকে, বুঝলে শহীদ। ফাঁদ যেভাবেই পাতি, ঠিক ফসকে যাচ্ছে। যাও বা একজনকে ফাঁদে আটকালাম, তা-ও আইনের ফাঁকতালে ফসকে গেল! কি যে করব ভেবে পাচ্ছি না!
খুলে বলুন। পাইপে অগ্নি সংযোগ করল শহীদ লাইটার জ্বেলে।
মি. সিম্পসন বললেন, গতরাতে, দুটোর পর আর্মডফোর্স পাঠিয়েছিলাম কয়েকটা জুয়ার আড্ডায়। খবরটা পেয়েছিলাম রাত একটার দিকে।
কাউকে পাওয়া যায়নি, এই তো?
মি. সিম্পসন বললেন, প্রতিবার তাই হয়। কিন্তু গতরাতে তা হয়নি। বিশ বাইশজন লোককে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউই কুখ্যাত অপরাধী নয়। দুএকজন যাও বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত–কেউকেটা নয় একজনও, সব চুনোপুটি। বেশির ভাগ নিরীহ লোক, লোভে পড়ে খেলতে গিয়েছিল।
চুনোপুটিরাই বেশি খবর রাখে। চেষ্টা করুন ওদের পেট থেকে কথা বের করতে।
মি. সিম্পসন বললেন, চেষ্টা করব? তাদেরকে পাচ্ছি কোথায়?
তারমানে? শহীদ অবাক।
তারমানে, আজ সকালেই দুজন নামকরা ব্যারিস্টার জামিন হয়ে মুক্ত করে নিয়ে গেছে ওদেরকে।
শহীদ জানতে চাইল, ব্যারিস্টার-কে পাঠিয়েছিল ওদেরকে?
কে আবার, স্বয়ং গুজরাট খান।
শহীদ বলল, তাই নাকি!
মি. সিম্পসন বললেন, গুজরাট খান অসাধারণ চতুর, তার সাথে পাল্লা দিতে দিতে এটুকু অন্তত আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আমার ধারণা, তার ইচ্ছা ছিল বলেই আমরা তার কিছু লোককে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছি।
বুঝলাম না…ওহ্, বুঝেছি। আপনি বলতে চাইছেন, নিজের লোকদের ধরিয়ে দিয়েছে সে ইচ্ছা করেই এবং তার এই ইচ্ছার পেছনে নিজস্ব একটা কারণও আছে। আপনি যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন তার বিরুদ্ধে তাতে সে রীতিমত শঙ্কিত। কিছু লোককে আপনি গ্রেফতার করতে সমর্থ হলে আপাতত আপনি ক্ষান্ত হবেন–এই কথা ভেবেই বুদ্ধি খাঁটিয়ে এ কাজ করেছে সে। এই তো?
হ্যাঁ।
জব্বারের হত্যা সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছেন কিনা বলুন দেখি? বলল শহীদ।
জব্বারের বন্ধু হোসেন সম্পর্কে একটা তথ্য পাওয়া গেছে।
কি তথ্য?
মি. সিম্পসন বললেন, গত চার মাস থেকে হোসেন প্রতি হপ্তায় এক হাজার করে টাকা জমা রাখছিল ব্যাঙ্কে! ষোলো হাজার টাকা জমা পড়েছে তার অ্যাকাউন্টে। প্রশ্ন হলো, প্রতি হপ্তায় এক হাজার করে টাকা পাচ্ছিল সে কোথা থেকে?
শহীদ কি যেন চিন্তা করছে। মি. সিম্পসন ওকে বিরক্ত করলেন না। শহীদ নিজেই মুখ তুলল এক সময়। বলল, আচ্ছা, জব্বারের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে করতে অর্থাৎ ইঁদুর খুঁজতে খুঁজতে যদি সাপ বেরিয়ে পড়ে? ধরুন, জব্বারকে খুন করার ব্যাপারে যদি গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরী প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এমন প্রমাণ পাওয়া যায়! কেমন হবে সেটা?
মি. সিম্পসন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। কিছু বলুন, মি. সিম্পসন?
মি. সিম্পসন বললেন, আমি আমার সব শক্তি, সবটুকু বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করেও ওদের দুজনকে মুঠোয় আনতে পারছি না।
শহীদ বাধা দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল, হোসেন প্রতি সপ্তাহে টাকা পাচ্ছিল কোথা থেকে জানেন? টাকা তাকে কেউ দিচ্ছিল। কেন দিচ্ছিল? দিচ্ছিল, যাতে সে জব্বারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিশেষ এক অবস্থায় বা বিশেষ এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।
বলো কি?
শহীদ বলল, সত্যি কথা বলতে কি, রহস্যটা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কুখ্যাত একজন লোক, অপরাধীদের হর্তাকর্তা, মৃত ইব্রাহিম খলিলও এই রহস্যে জড়িত। কিভাবে জড়িত তা একমাত্র সময় হলেই প্রকাশ পাবে।
ইব্রাহিম খলিলের সহকারী ছিল গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরী।
সুতরাং, তারাও জড়িত। জব্বারের হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবে ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত তারা কাঁচা কাজ করার লোক নয়। কিন্তু, তাদের দুর্ভাগ্য, কাজটায় খুঁত রয়ে গেছে। সে জন্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে শত্রুরা। এটাই তাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। মি. সিম্পসন, দুজন লোকের সন্ধান চাই আমি। আপনার ডিপার্টমেন্টকে বলুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই লোক দুজনকে খুঁজে বের করতে। জমির এবং রাশেদ। এককালে এরা চট্টগ্রামে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করত।
চিনেছি। পাক্কা বদমাশ দুজনই। কিন্তু এদেরকে কেন খুঁজছে?
শহীদ বলল, গ্রাসবারে এরাই ডি কস্টাকে মেরে আধমরা করেছিল। মোহাম্মদ গাউসের সাথে এদের সম্পর্ক আছে বা ছিল।
গাউসের সাথে দেখা করেছ তুমি?
শহীদ নতুন করে টোবাকো ভরতে শুরু করল পাইপে। বলল, যা। বিশেষ কোন তথ্য আদায় করতে পারিনি তার কাছ থেকে। জমির এবং রাশেদ সম্পর্কে বলেছে বটে, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ তথ্য সে ইচ্ছে করেই দিয়েছে। যদি আমার ভুল না হয়, হোসেনকে খুন করেছে এরাই।
এক মিনিট।
মি. সিম্পসন কথাটা বলে টেলিফোনের রিসিভার তুলে বললেন, কাবেরী, ইন্সপেক্টর এরশাদকে চেম্বারে পাঠিয়ে দাও এখুনি।
রিসিভার নামিয়ে রাখলেন মি. সিম্পসন। বললেন, শহীদ, জব্বারের হত্যাকাণ্ড গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এখন গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরী। তুমি আমাকে বলেছিলে এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে। তোমাকে আজ ডেকেছি সে ব্যাপারেই আলোচনা করতে।
শহীদ গম্ভীর হলো। বলল, পরিকল্পিত একটা পদ্ধতি অনুসরণ করে ওরা, তাই ওদেরকে আপনি ধরতে পারছেন না। আমিও চেষ্টা করছি, তবে অন্য পথে। আমার বিশ্বাস ওদেরকে গ্রেফতার করার মত যথেষ্ট প্রমাণ আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব। মাত্র দুটো কি তিনটে দিন আপনি আমাকে সময় দিন। আচ্ছা, গাউসের নামে আপনাদের দপ্তরে কোন ফাইল আছে?
আছে। কিন্তু তাতে তার অতীতের কোন হিসেব-নিকেশ নেই।
শহীদ জানতে চাইল, কারণ? নেই কেন?
মি. সিম্পসন বললেন, জানোই তো, বস রিটায়ার করায় আমার পদোন্নতি হয়েছে। মাত্র বছরখানেক হয়েছে নতুন দায়িত্ব নিয়ে নতুন চেম্বারে ঢুকি আমি। এখানে এসে অসংখ্য নতুন ফাইল ওপেন করি। গুজরাট, মাহবুব–এই রকম অনেকেরই ফাইল ছিল, কিন্তু গাউসের কোন ফাইল আমি পাইনি।
আপনার বস মি, সলিল চৌধুরী–তিনি কিছু বলতে পারবেন না?
মি. সিম্পসন বললেন, ঢাকায় নেই তিনি, যতদূর জানি। রিটায়ার করার পর অধিকাংশ সময় তিনি লণ্ডনে থাকেন।
শহীদকে চিন্তিত দেখাল। বলল, এই গাউসকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এর অতীত জীবন সম্পর্কে আমি জানতে আগ্রহী।
মি. সিম্পসন নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, তুমি বলছ জব্বারের খুনের সাথে গুজরাট, মাহবুব, গাউস, জমির এবং রাশেদ জড়িত। এই হত্যাকাণ্ডের অপরাধে এদেরকে গ্রেফতার করা যাবে?
আমার তাই বিশ্বাস।
মি. সিম্পসন এতক্ষণে হাসলেন। বললেন, তোমার ওপর আমার বিরাট আস্থা। তোমার ধারণা কখনও মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি। সম্পূর্ণ ঘটনাটা তোমার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে শোনাও একবার প্রথম থেকে। তার আগে, আরে! ভুলেই গেছি কফির কথা
কলিং বেল টিপতেই চেম্বারে ঢুকল পিয়ন। মি. সিম্পসন দুকাপ গরম কফি আনার জন্য বললেন। পিয়ন বেরিয়ে যেতেই চেম্বারে ঢুকল ইন্সপেক্টর এরশাদ।
মি. সিম্পসন, জমির এবং রাশেদের নাম উল্লেখ করে ইন্সপেক্টরকে বললেন, দেশের প্রতিটি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ওয়্যারলেসে মেসেজ পাঠিয়ে বলে দিন, এই দুটো লোককে আমরা চাই। সন্ধান পাবার সাথে সাথে যেন গ্রেফতার করা হয় এবং খবর পাঠানো হয়।
ইয়েস, স্যার। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ইন্সপেক্টর।
শহীদ বলল, ঘটনাটা আমি যেভাবে সাজিয়েছি, শুনুন। মিলিওনিয়ার প্লেবয় সাইদুল নিয়মিত জুয়া খেলত গাউস খানের আসরে। প্রচুর টাকার মালিক সে, হারতও দেদার। অর্থাৎ প্রায় প্রতি রাতেই মোটা অঙ্কের টাকা তার পকেট থেকে যেত গাউস খানের পকেটে। এইভাবে চলছিল। কিন্তু সাইদুল হক জুয়া খেলা ছেড়ে দিল, এমনিই হোক বা কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার ফলেই হোক। গাউস খানের আয় কমল। অথচ সে জানে সাইদুল হকের টাকার কোন অভাব নেই। সে সাইদুল হককে নতুন করে খেলায় বসাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়, এবং সিদ্ধান্ত নেয়, সাইদুল হকের টাকা যেভাবে হোক তার পকেটে আমদানী করতেই হবে। জব্বারের নাম হয়তো সে জানত কিংবা তার কথা কেউ বলায় সে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। সে জানতে পারে জব্বার আয়রন সেফের তালা খোলার ব্যাপারে একজন এক্সপার্ট।
মি. সিম্পসন একাগ্র মনে শুনছেন।
পিয়ন ঢুকল এমন সময়। কফির কাপ সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল সে।
কাপে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল শহীদ, গাউস খবর নিয়ে জানল জব্বারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে হোসেন। হোসেনকে সে ডাকল। প্রতি হপ্তায় এক হাজার টাকা। দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে জব্বারকে ফাঁদে ফেলার কাজে সাহায্য করতে বলল হোসেনকে। হোসেন রাজি হলো, ইচ্ছায় হোক বা ভয়ে। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল, কবে জব্বারের টাকার প্রয়োজন হবে সেই আশায়। জব্বারের টাকার প্রয়োজন,সত্যি হলো একদিন, তার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য। হোসেন তাকে নিয়ে গেল সুদখোর আলাউদ্দিনের কাছে। আলাউদ্দিন দিল তিন হাজার টাকা। কিন্তু তিন হাজারে স্ত্রীর অপারেশন হবে না, জান। জব্বার। তাই হোসেন যখন তাকে জুয়া খেলে টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব দিল, বাধ্য হয়ে রাজি হলো সে। জুয়ার প্রথম দিন সামান্য জিতল জব্বার। কিন্তু দ্বিতীয় দিন সে সম্পূর্ণ টাকাটাই হেরে গেল। ঠিক এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল গাউস খান। সে জব্বারকে প্রস্তাব দিল, সাইদুল হকের আয়রন সেফের তালা খুলে টাকার বাণ্ডিলগুলো যদি এনে দাও তাহলে তুমি যা হেরেছ সব ফেরত পেতে পারো। জব্বার আর কোন উপায় না দেখে রাজি হলো। টাকার বাণ্ডিলগুলো আয়রন সেফ থেকে বের করে নিয়ে নিচে নামবে সে, তুলে দেবে অপেক্ষারত গাড়ির দুজন লোকের হাতে।
মি. সিম্পসনের চোখে পলক নেই। শহীদের কথাগুলো গিলছেন যেন তিনি।
পাইপে নতুন করে অগ্নিসংযোগ করে শহীদ বলতে শুরু করল আবার, জব্বার নির্দিষ্ট সময়ে আয়রন সেফের তালা খুলল। কিন্তু টাকার বাণ্ডিল সে পেল না। কারণ, দুর্ভাগ্যবশত, অন্য ফ্ল্যাটের আয়রন সেফের তালা খোলে সে। ভুলটা যদি সে ধরতে পারত তাহলে হয়তো পালাবার কথা ভাবত না জব্বার। কিন্তু ভুলটা সে ধরতে পারেনি। সে ধারণা করল, টাকার বাণ্ডিল পাওয়া যায়নি একথা গাউস খান বা তার লোকেরা কোন মতেই বিশ্বাস করবে না। তাই সে পালাবারই সিদ্ধান্ত নিল। পিছনের পানির পাইপ বেয়ে নিচে নামল সে, সোজা চলে এল নিজের বাড়িতে। চঞ্চলকে পেলে গাউস এবং তার লোকেরা প্রতিশোধ নিতে পারে-একথা ভেবে চঞ্চলকে নিরাপদ কোন জায়গায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সে জানত, পালাতে সে আসলে পারবে না। গাউস খান তাকে খুন করবেই। তাই রেস্তোরাঁয় চঞ্চলকে রেখে সে বাইরে বেরিয়ে আসে। জব্বার পালিয়েছে একথা গাউসের চেলারা খানিক পরই টের পেয়ে যায়। তারা মরিস নিয়ে সোজা পৌঁছোয় জব্বারের বাড়িতে। জব্বারের ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে তারা টাকার সন্ধানেই। কিন্তু টাকা না পেয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে জব্বারের খোঁজে। জব্বার একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে ছিল রেস্তোরাঁটায়, খবরটা তারা যেভাবেই হোক জেনে যায়। সাথে সাথে ফলো করে তারা। এর পরের ঘটনা তো আপনি জানেনই।
অর্থাৎ তুমি গাউস খানকেই প্রকৃত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাচ্ছ?
হ্যাঁ। হোসেন পুলিসের কাছে মুখ খুলতে পারে মনে করে গাউস তার দেহরক্ষীদেরকে পাঠায় হোসেনকে খুন করার জন্য।
মি. সিম্পসন বললেন, চমৎকার সাজিয়েছো, নো ডাউট! কিন্তু শহীদ, তোমার বক্তব্যের মধ্যে গুজরাট খান বা মাহবুব চৌধুরীর নাম নেই কেন?
শহীদ তিক্ত হাসল। বলল, কি জানেন, আপনাকে এতক্ষণ যা বললাম তা আমি নিজেও বিশ্বাস করি না।
হোয়াট? প্রায় আঁতকে উঠলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ বলল, যা সত্যি তাই বলছি। কোথায় যেন গরমিল রয়েছে। কোথায় যেন যোগফলটা মিলছে না। বুঝতে পারছি, অনুভব করছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু…
শহীদ বাধা দিয়ে বলল, আরও গভীর রহস্য আছে এই কেসে, মি. সিম্পসন। কিন্তু রহস্য যত গভীরই হোক, মাত্র তিনদিনের মধ্যেই যা ঘটবার ঘটে যাবে, আমার বিশ্বাস। কারণ, এই তিনদিন আমি বেছে বেছে ভয়ঙ্কর সব জায়গায় নাক গলাব।
কিন্তু সাবধানে…
শহীদ উঠল। বলল, আমার নয় মি. সিম্পসন, সাবধান হওয়া উচিত শত্রুদের। কারণ বিপদটা তাদেরই। চলি, ধন্যবাদ।
দরজার দিকে এগোল শহীদ। মি. সিম্পসন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে শহীদের পিছন দিকে তাকিয়ে বললেন, দরকার হলেই একটা খবর দিয়ে শহীদ। পুলিশ ফোর্সের সাহায্য লাগলে জানিয়ো। অ্যাণ্ড উইশ ইউ গুড লাক, মাই বয়!
থ্যাঙ্কিউ, মি. সিম্পসন।
নিচে নেমে এল শহীদ। বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, দেখল ডি. কস্টা নামছে ট্যাক্সি থেকে।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল ডি. কন্টা।
শহীদ বলল কি খবর, মি. ডি কস্টা?
খবর টো আপনার কাছে। বলুন, কটডুর অগ্রগটি হইয়াছে?
শহীদ সব জানাল ডি. কন্টাকে। ডি. কস্টাও নিজের মতামত প্রকাশ করল সবিস্তারে। মিনিট সাতেক পর বিদায় নিল শহীদ।
ডি. কস্টা প্রবেশ করল সি.আই.ডি. হেডকোয়ার্টারের বিল্ডিংয়ে। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ বাইরে কোথাও গেছেন। তাঁর চেয়ারটা খালি। কিন্তু যার খোঁজে এসেছে ডি, কস্টা তাকে পাওয়া গেল।
মিস কাবেরী, হামার সাটে যাইটে হইবে হাপনাকে।
কাবেরী সহাস্যে বলল, হাতে কোন কাজ নেই বুঝি আপনার?
ডি. কস্টা ব্যস্ত হয়ে উঠল, আরও কাজের জন্যই টো হাপনার কাছে। আসিয়াছি। চলুন, চলুন। ডেরী করিবার সময় নাই হামার।
ব্যাপারটা কি এখানেই বলুন না।
ডি. কস্টা বলল, এখানে বলা যাইবে না। হামার বস্ সম্পর্কে বিশেষ একটা ইনফরমেশন হাপনাকে ডিটে চাই।
কাবেরী সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, কোথায় যেতে হবে?
হামার বাড়িটে গেলেও হয়। নিরাপড জায়গা।
কাবেরী টেবিল গুছিয়ে নিল দ্রুত হাতে। তারপর বলল, চলুন।
বাইরে বেরিয়ে বেবিট্যাক্সি নিল ওরা। রৌদ্রহীন দুপুর, ধূলি-ঝড় উঠছে। আকাশে কালো মেঘ ভাসছে।
ব্যাপারটা কি বলুন-তো?
ডি. কটা তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। কাবেরীর কথা যেন শুনতেই পায়নি সে। বেবিট্যাক্সি থামল ডি. কস্টার বাড়ির সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল সে, পিছু পিছু কাবেরী।
তালা খুলে ড্রয়িং রূমে ঢুকল ওরা। বসল মুখোমুখি। ডি. কস্টা চুরুট ধরাল, বলল, আমার ফ্রেণ্ড মি. কুয়াশা পট্টি অডভুট্ মানুষ।
কাবেরী শুনছে। সাগ্রহে তাকিয়ে আছে সে ডি. কস্টার মুখের দিকে।
টিনি ভয়ঙ্কর একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছেন।
কাবেরী জানতে চাইল, কি সেই পরিকল্পনা?
মানুষ জাটিকে অমর করিবার জন্য টিনি আবার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করিবেন।
তাই নাকি? কাবেরী ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে, কাধ থেকে খসে পড়ল তার শিফন শাড়ি।
ডি. কস্টাকে চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, কিন্টু এই এক্সপেরিমেন্টের জন্য বহু লোককে চরম মূল্য ডিটে হইবে।
সে কি!
ডি. কস্টা বলল, ইয়েস। আপনি কি মনে করেন না মানব জাটির স্বার্থে সামান্য কয়েকজন লোক মরিলেও টাহাতে কিছু ক্ষটি নাই?
কাবেরী তাড়াতাড়ি বলল, নিশ্চয়ই কিছু মনে করি না। আমি সমর্থন করি আপনার ফ্রেণ্ডের এক্সপেরিমেন্ট। খুব আগ্রহ হচ্ছে, বলুন তো সব কথা?
ডি. কস্টা বলল, টিনি একমাট্র হামাকেই বিশ্বাস করেন। টাই আমাকে সব কঠা বলেন। কবে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করিবেন, কোঠা হইটে লোকজনকে কিডন্যাপ করিয়া আনিবেন, কখন কোঠায় টাহাড়ের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালাইবেন-সব টিনি হামাকে বলিয়াছেন।
আপনিও বুঝি সেখানে উপস্থিত থাকবেন?
ডি. কস্টা বলল, টাটো ঠাকিবই। আপনি যডি কঠা ডেন কাহাকেও এ ব্যাপারে একটি কঠাও বলিবেন না, টাহা হইলে হাপনাকে গোপনে সেইখানে লইয়া যাইটে পারি। কিন্টু হাপনি পুলিসের চাকরি করেন, আপনাকে বিশ্বাস করিব কিনা বুঝিটে পারিটেছি না।
কাবেরী উঠে দাঁড়িয়ে ডি. কস্টার পাশে গিয়ে বলল, আমি যাব, মি. ডি. কস্টা। প্লীজ, আমাকে অবিশ্বাস করবেন না। এই আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, কাউকে এ ব্যাপারে একটা কথাও বলব না। আপনি তো জানেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এবং মহাপুরুষ কুয়াশার ভক্ত আমি। তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা নেই আমার। জীবনে হয়তো এমন সুযোগ আর পাব না। মি. ডি. কস্টা, দোহাই আপনার…।
ডি. কস্টা হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিক আছে, অটো ব্যস্ট হইবার ডরকার নাই। আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। এক্সপেরিমেন্টের ডিনে হাপনাকে হামি সাটে করিয়া লইয়া যাইব।
কবে…
আগামী মাসের এক টারিকে।
সত্যি নিয়ে যাবেন তো?
আলবট লইয়া যাইব। ডি কস্টা কখনও মিঠ্যা কঠা বলে না।
কাবেরী ফিরে এসে বসল মুখোমুখি সোফায়। বলল, কি সৌভাগ্য আমার। আমি ভাবতেই পারছি না। মানুষকে অমর করার জন্য পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী পরীক্ষা চালাবেন আর সেই পরীক্ষা দেখার সুযোগ পাব আমি। মি. ডি. কস্টা, আজ আপনাকে আমি লাঞ্চ খাওয়াব। চলুন।
ডি. কস্টা মাথা নাড়ল ঘনঘন। বলল, ডুঃখিট। সময় হইবে না আজ। কাজে ব্যস্ট আছি। জব্বারের এটিম বাচ্চাটা অভিশাপ ডিটেছে, এখনও টাহার বাবার হট্যাকারীকে ধরিটে পারিলাম না।
কতদূর এগিয়েছেন আপনারা?
ডি. কস্টা বলল, খুব বেশি ডুর নয়। গাউস খানকে চেনেন। টাহার অট্রীট জীবন সম্পর্কে জানিটে হইবে। আচ্ছা, মি. সিম্পসনের চেম্বারে গাউস খানের ফাইল নাই?
কাবেরী বলল, আছে। কিন্তু পুরানো ফাইল নয়, নতুন। দরকার?
ডরকার মানে? এক্ষুণি সরকার।
কাবেরীকে চিন্তিত দেখাল। মি. সিম্পসন কুয়াশা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ডি. কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক কিন্তু তাই বলে গোপন ফাইল ডি. কস্টাকে দেখাবার জন্য চাইলে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠবেন। মনে মনে খানিক ভাবল কাবেরী। ইচ্ছা করলেই ফাইলটা একদিনের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসা যায়।
কিন্তু ফাইলটা আনা সম্ভব নয় যে।
ডি. কস্টা বলল, চেষ্টা করে ডেকুন না। হাপনার জন্য এটো করি আর আপনি হামার জন্য এই সামান্য কাজটা করিটে পারিবেন না?
পারব না কেন… ঠিক আছে, সন্ধ্যার পর আপনি আমার বাড়িতে যাবেন। আমি ফাইলটা বাড়িতে নিয়ে রাখব।
ঢন্যবাড।
.
সন্ধ্যার পর ডি. কটা উপস্থিত হলো কাবেরীর বাড়িতে।
কাবেরীর মুখটা শুকনো দেখল ডি, কক্টা। জানতে চাইল, ধরা পড়েন নাই টো?
কাবেরী বসতে বলল ডি কস্টাকে। বসন ডি কস্টা।
না, ধরা পড়িনি। তবে ভয় করছে বড়। এ ধরনের কাজ করিনি কখনও। যদি কেউ জেনে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এমনিতে সকলের সন্দেহ ডিপার্টমেন্টে কেউ একজন বেঈমান আছে, শত্রুদের কাছে টপ সিক্রেট ইনফরমেশন পাচার করছে সে। সামান্য একটা ফাইল এনেছি ঠিক, যদি ধরা পড়ি, আমাকেই নেই। বেঈমান বলে মনে করবে সবাই।
ডি. কস্টা বলল, জ্বর, ডুর। অটো ভয় করিলে চলে না। ডেকি ফাইলটা।
আলমারি থেকে ফাইলটা বের করে ডি. কস্টার হাতে দিল কাবেরী। ফাইল খুলে পড়তে শুরু করল ডি. কস্টা। মিনিট দুয়েক পর সশব্দে নামিয়ে রাখল সে তেপয়ের উপর ফাইলটাকে, বলে উঠল, ঘোড়ার ডিম, গাউস খান সম্পর্কে কিছুই নাই। মট্র বছরখানেকের ইনফরমেশন রহিয়াছে–টার অটীট জীবন সম্পর্কে কিছু নাই।
কাবেরী বলল, বৃথা পরিশ্রম করলাম। ইস, এত বড় ঝুঁকি নিয়ে।
ডি. কস্টা বলল, মি. সিম্পসনের আগে যে অফিসার ছিলেন হাপনাডের ডিপার্টমেন্টে টিনি এখন কোঠায়?
মি. সলিল চৌধুরী? গত হপ্তায় তিনি লণ্ডন থেকে ফিরেছেন। ফোন নাম্বারটাও আমি জানি।
ডায়াল করুন। ডেকি টিনি কিছু বলিটে পারেন কিনা।
ডায়াল করল কাবেরী। তার হাত থেকে রিসিভার নিল ডি. কস্টা। অপরপ্রান্তে ফোন ধরলেন মিসেস সলিল। ডি. কস্টার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, মি. সলিল বাড়িতে নেই। কখন ফিরবেন তা-ও বলে যাননি। আপনার নাম?
ডি. কস্টা বলল, মি, স্যানন ডি. কস্টা। ঠিক আছে, আমি আবার ফোন করিব, যডি ডরকার হয়। ঢন্যবাড।
কাবেরী বলল, ফাইলটা বের করে তো এনেছি। কাজের হোক বা না হোক, আবার কাল সকালে অফিসে গিয়েই সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে জায়গা মত রেখে দিতে হবে। যদি ধরা পড়ি…
কিন্তু ডি. কস্টার কানে একটি কথাও ঢুকছে না। কি যেন চিন্তা করছে সে গভীর ভাবে।
.
০৪.
ভাবছে আর ভাবছে শহীদ। বন্ধ রূমের মেঝেতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে ও। কোথায় যেন মিলছে না, কোথায় যেন গরমিল।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
ফোন! কেমি. সিম্পসন? রিসিভার তুলল ও, শহীদ খান স্পীকিং।
মি. সিম্পসনের কণ্ঠস্বর, উত্তেজিত তিনি, বুঝতে অসুবিধে হলো না শহীদের।
শহীদ, আমি মোহাম্মদ গাউস খানের বাড়ি থেকে বলছি। গাউস খুন হয়েছে। তুমি চলে এসো এখুনি।
ফোন ছেড়ে দিল শহীদ। বেরিয়ে পড়ল পাঁচ মিনিট পরই। ড্রয়িংরূম ছেড়ে যখন করিডরে পা রাখছে, মহুয়া অপর দরজা দিয়ে ঢুকল ড্রয়িংরূমে। ডাকতে গিয়েও ডাকল না।
কেন যেন মনটা খারাপ লাগছে। ভয় ভয় করছে। কান পেতে রইল মহুয়া। নিচ থেকে ভেসে এল ফোক্সওয়াগেনের স্টার্ট নেবার শব্দ।
গাউস খানের বাড়ির গেটের কাছে থামল ফোক্সওয়াগেন। মি. সিম্পসন অপেক্ষা করছিলেন গেটে। তাঁর জীপটা বাড়ির ভিতরে, গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখল শহীদ।
হ্যাণ্ডশেক করল ওরা।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে কেউ সোজা বেডরূমে ঢুকে ঘুমন্ত গাউসের কপালে গুলি করে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়ে গেছে। যে বা যারাই কাজটা করে থাকুক, প্রতিটি কামরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তারা। কিছু নিতে এসেছিল, সন্দেহ নেই।
শহীদ বল, লাশ প্রথম দেখে কে?
খানিক আগে, এই ধরো আধঘণ্টা আগে একটা টেলিগ্রাম মেসেঞ্জার এসেছিল। গাউসেরই টেলিগ্রাম, খুলনা থেকে তার এক ভাই পাঠিয়েছে টাকা সাহায্য চেয়ে। মেসেঞ্জার টেলিগ্রাম দিতে এসে দেখে দরজা খোলা, উঁকি দিতেই সে রক্ত দেখতে পায়। সাথে সাথে থানায় খবর দেয় সে।
কিছু নিতে এসেছিল কি হতে পারে? জিনিসটা পেয়েছে কিনা বোঝার কোন উপায় আছে?
না। তুমি নিজের চোখেই দেখবে চলো।
চলুন।
একযোগে গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল ওরা। বারান্দায় উঠতেই, বেডরূম থেকে একজন কনেস্টবল বেরিয়ে এল, তার হাতে কতকগুলো বিভিন্ন আকারের ছবি। মি. সিম্পসনের দিকে সেগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল কনেস্টবল, ডার্ক রূম থেকে পেয়েছি।
দশ-বারোটা ফটো। দশ-বারোজন যুবতী মেয়ের। বছর সাত আট আগে যে সব অভিনেত্রীরা সুন্দরী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল এগুলো তাদেরই ছবি। যার যার ছবিতে সে সে নাম সই করেছে। উপহার দেয়া ছবি। প্রতিটি সইয়ের উপরে ইব্রাহিম খলিলের প্রতি শ্রদ্ধাসহ ইব্রাহিম সাহেবের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ এই ধরনের একটি করে লাইন লেখা।
একই সময়ে ওরা মুখ তুলে পরস্পরের দিকে তাকাল।
শহীদ বলল, এখানেও ইব্রাহিম খলিল। মরে গিয়েও লোকটা খবর সৃষ্টি করে চলেছে।
বেডরূমে ঢুকল ওরা।
বড়সড় খাটের উপর পা বাকা করে শুয়ে আছে গাউস, উপুড় হয়ে। প্রকাণ্ড আকারের একটা ব্যাঙের মত দেখাচ্ছে তাকে। বালিশ থেকে নেমে রয়েছে। মাথাটা। কপালটা ফুটো হয়ে গেছে। জমাট বেঁধে গেছে রক্ত। মাছি ভনভন করছে তার কপালে। দুএকটা মাছি ফুটোর ভিতর ঢুকছে, বেরুচ্ছে।
বেশিক্ষণ থাকতে পারল না শহীদ বেডরূমে। বেরোবার আগে রূমটার বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে নিতে ভুলল না। তুমুল ঝড় বয়ে গেছে যেন। বুক শেলফের বইগুলো ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেতে। মোটা মোটা কয়েকটা বইয়ের কভার পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
জিনিসটা যাই হোক, বড় কিছু না। আকারে সেটা ছোটখাট হবে।
মি. সিম্পসন বললেন, আমারও তাই ধারণা।
শহীদ বলল, মর্গের লোকেরা আসেনি?
মি. সিম্পসন বললেন, আসছে ওরা সবাই।
শহীদ বলল, আমি চললাম, মি. সিম্পসন। গভীর চিন্তা দরকার এখন আমার।
কথাগুলো বলে বেরিয়ে এল সে বাইরে। আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফোক্সওয়াগেন। আকাশে একটি নক্ষত্র নেই। চাঁদও অদৃশ্য। রিস্টওয়াচ দেখল শহীদ। সাড়ে সাতটা। আকাশের দিকে তাকাল আবার। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। গাড়িতে উঠল ও। স্টার্ট দিতে গিয়ে স্থির হয়ে গেল হাতটা।
ঘাড়ে শীতল একটা ধাতব পদার্থের স্পর্শ-সারা দেহে হিমেল একটা ঢেউ খেলে গেল। মাথার পিছনের চুলে নিঃশ্বাস পড়ছে কারও, অনুভব করল ও। কানের কাছে চাপা, কর্কশ এবং কঠিন একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল, কোন চালাকি নয়। স্টাট দাও গাড়ি।
অন্য একটা মোটা গলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কথা না শুনলেই গুলি করবে!
কথা বলল না শহীদ। স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল গাড়ি-সোজা। তারপর জিজ্ঞেস করল, কিন্তু পিছন দিকে তাকিয়ে লোক দুজনকে দেখবার চেষ্টা করল না, কে তোমরা? কি চাও?
কথা নয়। সময় মত স-অ-অ-ব জানতে পারবে। গাড়ি চালিয়ে যাও। গুজরাট সাহেব খুন করতে নিষেধ করেছেন ঠিক, কিন্তু বলেছেন কথা না শুনলে ঝামেলা চুকিয়ে দিয়ে এসো।
গুজরাট খান…।
ফের কথা, শালা!
সহ্য করল শহীদ কুৎসিত অপমানটা। ঠিক আছে, সময় আসুক শিক্ষা দেয়া যাবে।
পিছন থেকে নির্দেশ পেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে ও। ঢাকা শহর ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে ছুটছে ফোক্সওয়াগেন। এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার গাড়ির দরজা এবং সীটের মধ্যবর্তী মেঝেতে ঢাকনিওয়ালা খোপের উপর হাত রাখল শহীদ। খোপটা নিজেরই তৈরি করা ওর। ভিতরে একটা ৩২ হ্যাঁমারলেস অটোমেটিক পিস্তল আছে। ইচ্ছে করলেই সে ঢাকনি তুলে নিঃশব্দে বের করে নিতে পারে সেটা। কিন্তু কি মনে করে ঝুঁকিটা এবারও নিল না ও। তুলে নিল শূন্য হাত স্টিয়ারিং হুইনে।
নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করল গাড়ি। এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘুরে নির্জন একটা এলাকায় পৌঁছুল। গেটখোলা একটা বাড়ির ভিতর ঢুকল গাড়ি। একতলা বাড়ি, ছোট্ট উঠান, লম্বা বারান্দা।
গাড়ি থামাল শহীদ। সাথে সাথে দরজা খুলে নামল একজন। সে-ই নির্দেশ দিল, নেমে এসো মাথার উপর হাত তুলে।
নামল শহীদ। বারান্দা থেকে নামছে কেউ, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই মাহবুব চৌধুরীকে দেখতে পেল ও। এক পা এগিয়ে বলল, বাহ! খোদ শয়তানের চেলাও আছে দেখছি।
ততক্ষণে বারান্দা থেকে নেমে শহীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে মাহবুব চৌধুরী। বিদ্যুৎবেগে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করল সে শহীদের গালে। দুটো আগ্নেয়াস্ত্রের নল একই সময়ে ওর শিরদাঁড়ায় হাতুড়ির বাড়ি বসিয়ে দিল। তীব্র ব্যথায় বাকা হয়ে গেল শহীদের পিঠ কিন্তু প্রত্যাঘাত হানতে কসুর করল না ও। মাহবুব চৌধুরীর হাতটা নড়ে উঠতেই ও ঘুসি চালিয়েছিল, সেটা গিয়ে আঘাত হানল মাহবুব চৌধুরীর ডান গালে। হাতটা ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে, টের পেল শহীদ। ঠিক সেই সময় মাথার পিছনে রিভলবারের বাট পড়ল সবেগে।
ব্যথাটা অনুভবও করল না শহীদ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও।
কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল বলতে পারবে না শহীদ। জ্ঞান ফিরলেও, চোখ মেলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো ও। মনে পড়ল সব কথা। মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায় ও, কিন্তু ব্যথাটা তার সর্বশরীরে। হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ও। মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ মাথা, তার পরই হাত। সেই হাত দুটো নেই ওর।
নেই, মানে, কোন অনুভূতি নেই, কোনও বোধ নেই যেন অস্তিত্বই নেই। আবার চেষ্টা করল ও চোখ মেলতে। কেমন যেন একটা চটচটে ভাব ওর ডান চোখের উপর চারপাশে। সেটা খুলল না। খুলল বা চোখটা।
চেয়ারের সাথে পা দুটো বাধা ওর। গলাটাও কর্ড দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারের পিঠের সাথে। হাত দুটো দেখতে পাচ্ছে না শহীদ। হাত দুটো সম্ভবত পিছমোড়া করে কিংবা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা আছে, তাই নিঃসাড় অবশ হয়ে গেছে। টপ টপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে ওর কোলের উপর, কপাল থেকে। শয়তানের দল অজ্ঞান অবস্থায় মেরেছে ওকে।
জ্ঞান ফিরেছে।
কে যেন বলল। চোখ তুলে তাকাতেই চার-পাঁচ হাত দূরে গুজরাট খানকে দেখতে পেল শহীদ। সুবেশী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সদা হাস্যময়। হাতের সৌখিন ছড়িটা দুই উরুর মাঝখানে, হাতলে চিবুক রেখে মিটিমিটি হাসছে শহীদের দিকে তাকিয়ে। পাশেই একটা টেবিল। কিনারায় বসে আছে মাহবুব চৌধুরী। ঠোঁট দুটো সহ মুখটা একটা রক্তে ভেজা তোয়ালে দিয়ে চেপে রেখেছে সে।
তৃপ্তিবোধ করল শহীদ। ওর ঘুসিটা বৃথা যায়নি।
দরজার কাছে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বাকি দুজন লোক।
গুজরাট খান সিধে হয়ে বসল। ছড়িটা তুলল সে শহীদের দিকে সোজা করে, খুব কি খারাপ লাগছে, মি. শহীদ?
কথা বলল না শহীদ। আসলে ভীষণ অসুস্থ বোধ করছে ও, কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না।
গুজরাট খান আবার কথা বলে উঠল, সেই হাসি হাসি মুখে, মার্জিত ভঙ্গিতে, মোলায়েম সুরে, এসবের দরকার ছিল না, বুঝলেন? আপনার সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলাম শুধু। সেটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই হতে পারত। এখনও হতে পারে।
মাহবুব চৌধুরী হিংস্র পশুর মত গর্জে উঠল, শালাকে আমি পিষে ফেলব!
টেবিল থেকে নেমে এগিয়ে আসতে লাগল সে। আক্রোশে হাঁপাচ্ছে লোকটা।
থামো! বিরক্তির সাথে ধমকে উঠল গুজরাট খান, মাহবুব চৌধুরীর গতি রুদ্ধ হয়েছে দেখে শহীদের দিকে তাকাল, হাসল নিঃশব্দে। আপনার ভাগ্য ভাল আমিও আছি এখানে। মাহবুব আপনাকে একা পেলে সত্যি একটা একটা করে ছিঁড়ে নিত হাত-পা।
চুপ করে রইল শহীদ।
আবার কথা বলে উঠল গুজরাট খান, গাউসকে খুন করে কাজটা আপনি ভাল করেননি। আমাকে চুষছিল সে সত্যি কথা, কিন্তু তাকে দিয়ে আমি অনেক কাজ করাতে পারতাম। তার জায়গায় বসাব এমন লোক আমার আর একজনও নেই। যাকগে, যা করার করেছেন। গাউস ভাল লোক ছিল না, আফটার অল। আমি যেটা খুঁজছি সে ব্যাপারে কথা বলা যাক। কোথায় সেটা, মি. শহীদ?
শহীদ মুখ খুলল এবার, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কি খুঁজছ? কি চাইছ আমার কাছ থেকে?
গুজরাট খান তাকাল মাহবুব চৌধুরীর দিকে। শান্ত ভাবে বলল, মাহবুব, এবার তোমার কাজ দেখাও তুমি। কি চাইছি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দাও ওকে।
কথাগুলো বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল গুজরাট খান। ছড়িটা আড়াআড়ি ভাবে রাখল কোলের উপর। এগিয়ে এল মাহবুব চৌধুরী। হাসছে না সে। সোজা এসে দাঁড়াল শহীদের সামনে। ঠিক নাকের ব্রিজে ঘুসি মারল সে, অনুশীলনরত বক্সারের মত নাফাল। ঘুসি মারার ভঙ্গি করেও মারল না কয়েকবার, তারপর হঠাৎ পর পর মারল চিবুকে, চোয়ালে…
জ্ঞান হারাতে দেরি হলো না শহীদের।
না চাইলেও, জ্ঞান ফিরে এল খানিক পরই। চোখ মেলতেই রক্তের মোনা স্বাদ পেল জিভে।
গুজরাট খান জানতে চাইল, কি চাই বুঝতে পেরেছেন এবার?
কথা না বলে মাথা নাড়ল শহীদ এদিক-ওদিক। আবার এগিয়ে এল মাহবুব চৌধুরী। চোখ বুজল শহীদ। দাঁতে দাঁত চেপে রইল। একটার পর একটা ঘুসি হজম করে যাচ্ছে সে।
অস্পষ্টভাবে কানে এল গুজরাট খানের কণ্ঠস্বর, থাক, অনেক হয়েছে। অনুভব করছে না ও আর ব্যথা-ট্যখা। চিন্তা করতে দাও ওকে, সিদ্ধান্ত নিতে দাও।
মাহবুব চৌধুরী টেবিলের কিনারায় গিয়ে বসল। হাতটা ম্যাসেজ করতে শুরু করল। ঘুসি মারতে মারতে ব্যথা হয়ে গেছে হাতটা।
ব্যথা-বোধ সত্যিই হারিয়ে ফেলেছে শহীদ। পা দুটোরও যেন আর কোন অস্তিত্ব নেই। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবশ হয়ে গেছে।
ঠক ঠক করে শব্দ হলো। চোখ মেলল শহীদ। দেখল, ছড়িটা মেঝেতে বুকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে গুজরাট খান। ও তাকাতে বলল, আবার বলছি, এসবের দরকার ছিল না।
শহীদ বলল, আমি..গাউসকে খুন করিনি।
খুন করুন বা না করুন, কিছু এসে যায় না। আপনি ওর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যেটা নিয়েছেন সেটা চাই আমি।
মাহবুব চৌধুরী হঠাৎ খকখক করে কাশতে শুরু করল। থোঃ করে মেঝেতে রক্ত ফেলল সে মুখের ভিতর থেকে। ঠকঠক করে শব্দ হলো মৃদু। সবাই দেখল রক্তের সাথে মেঝেতে দুটো সাদা দাঁত পড়ে গেল।
কাতলা মাছের মত লাফাতে লাগল মাহবুব চৌধুরী টেবিল থেকে নেমে। শালাকে আমি খুন করব! শালাকে আমি খুন করব!
মাহবুব! চুপচাপ বসো বলছি! আমি যা বলব তাই তুমি করবে, গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করল গুজরাট খান।
মাহবুব স্থির হলো, সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল গুজরাট খানের চোখের দিকে, খালি ধমক দিতেই তো জানো তুমি! তখনই বলেছিলাম, কিন্তু আমার কথা শোনোনি! শুনলে এত কিছু ঘটত না। হাজারবার বলেছিলাম, ইব্রাহিমের সাথে সাথে সেই মেয়েলোকটা আর গাউসকে খুন করে সব পরিষ্কার করে ফেলি।
মাহবুব এবার তাকাল শহীদের দিকে, তোকে আমি খুন করবই, ভেবেছিস কি!
কথাটা বলে দরজার দিকে পা বাড়াল সে। বেরিয়ে গেল সে কামরা থেকে।
গুজরাট খান সহজ ভঙ্গিতে বলল, দাত তুমি নতুন লাগিয়ে নিতে পারবে, মাহবুব।
তারপর শহীদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, চোখ টিপল একটা। বলল, কাজটা ভাল করেননি। বেচারার গর্ব ছিল ওই দাঁতগুলো। আপনি ওর অহঙ্কারে ঘা মেরেছেন। যাকগে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় রেখেছেন জিনিসটা, মি. শহীদ?
শহীদ বলল, হেঁয়ালি রেখে পরিষ্কার করে বলুন কি চাইছেন।
গুজরাট খানের মুখের হাসি উবে গেল, বলল, শিকদার, তুমি সুযোগটা নাও এবার।
ঘুসি নয়, লাথি মারল শিকদার। শহীদকেও নয়, লাথিটা মারল সে সবেগে শহীদ যে চেয়ারে বসে আছে সেটায়। চেয়ারটা পড়ে গেল, সেই সাথে শহীদও। মাথাটা ঠুকে গেল ওর শক্ত মেঝের সাথে। শিকদার এবার ওর পাজরে লাথি মারতে লাগল। সময় নিয়ে, লক্ষ্য স্থির করে, ছুটে এসে এক-একটা লাথি মারে আর তাকায় গুজরাট খানের দিকে।
মিনিট পাঁচেক পর গুজরাট খান প্রশ্ন করল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
শহীদের দেহ নড়ল না। গুজরাট খান ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে আবার সেই একই প্রশ্ন করল। এবার চোখ মেলল শহীদ, মাথা নাড়ল–অর্থাৎ হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছে ও।
কোথায় সেটা?
কি? বিড়বিড় করে জানতে চাইল শহীদ।
আপনি ভাল করেই জানেন কি সেটা। প্রথম থেকেই আপনি আমাদের জন্যে বিরাট একটা সমস্যা হয়ে উঠেছেন এই কেসে। জিনিসটা ছিল ডি. কস্টার কাছে, সে-ই জব্বারের লাশের কাছে প্রথম যায়। কিন্তু সে ভীতুর ডিম একটা। জিনিসটা সে আপনার কাছে রাখে, নিরাপত্তার জন্যে। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। আপনি জিনিসটা এমন কোথাও রেখেছেন যেখান থেকে সেটা কেবল আপনিই বের করতে পারবেন, আর কেউ তার সন্ধান জানে না। আপনি মরে গেলে সেটাও চিরতরে হারিয়ে যাবে, কেউ সেটা কোনদিন খুঁজে পাবে না। ঠিক আছে–তাই হোক। শিকদার, দেখো তো, মাহবুব কি করছে?
শিকদার বেরিয়ে গিয়ে ফিরে এল তখুনি। মাহবুব সাহেব শুয়ে পড়েছেন ডাকলাম, সাড়া দেননি।
বিরক্ত করো না ওকে, ঘুমুতে দাও। মি. শহীদের হাত-পাগলার বাঁধন খুলে দাও।
নাইলনের কর্ড খুলে দিতেও বসে রইল শহীদ। এতটুকু নড়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই ওর। রক্ত চলাচল শুরু হতে বেশ সময় নিল। আরও খানিক পর পা দুটো নাড়তে পারল শহীদ, হাত দুটোও।
শিকদার জিজ্ঞেস করল, হুকুম করুন, স্যার!
হাসতে শুরু করল গুজরাট খান শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলল, কোন হুকুম নেই, শিকদার। মি. শহীদের ভাগ্য তোমার হাতে। যা ইচ্ছা তাই করতে পারো ওকে নিয়ে। মেরে ফেলতে চাও, মেরে ফেলো। চোখের মণি দুটো খুলে নিয়ে ছেড়ে দিতে চাও, তাই করো। তোমার ইচ্ছা। ইসহাক, গাড়ি করে পৌঁছে দাও আমাকে। আর ভাল লাগছে না এসব ঝামেলা।
গুজরাট খান বেরিয়ে গেল, পিছু পিছু কামরা ত্যাগ করল ইসহাকও। শিকদার শহীদের শার্টের কলার ধরে দাঁড় করাল ওকে, শুনলে তো কি বলে গেল, স্যার?
কথাটা বলে ধাক্কা দিল শহীদকে দরজার দিকে। পা বাড়াল শহীদ অতি কষ্টে, আস্তে আস্তে।
শেষ যাত্রা। গাড়ি ছুটছে। চালাচ্ছে শহীদ, ওরই ফোক্সওয়াগেন। পাশে বসে আছে শিকদার, হাতে রিভলভার। এতটুকু নড়ছে না সেটা। শিকদার ভুলেও চোখের পাতা ফেলছে না। সতর্ক, অত্যন্ত সাবধানী সে।
দুটো একটা ট্রাক মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। হেডলাইট দেখলেই আশায় ভরে উঠছে শহীদের বুক। ট্রাকের ড্রাইভার হয়তো দেখতে পাবে ওর অবস্থা, সন্দেহ করে ট্রাক ঘুরিয়ে নিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করবে কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। শহীদ জানে, আশা করলে কি হবে, তেমন কিছু ঘটবে না, ঘটে না।
মাথাটা খসে পড়ে যেতে চাইছে তীব্র ব্যথায়। চিন্তা করার চেষ্টা করেও পারছে না ও। কাজ করছে না ব্রেন।
বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে শিকদার। ছোঁ মেরে কেড়ে নেবার কোন উপায় নেই রিভলভারটা। মাঝে মধ্যে নির্দেশ দিচ্ছে সে, নির্দেশ অনুযায়ী গাড়ি চালাচ্ছে ও।
নির্জন রাস্তা। একধারে ধান খেত, অন্য ধারে ফাঁকা মাঠ।
মাঠের দিকে চালাও।
বিনাবাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করল শহীদ। মাঠের মাঝখানে চলে এল গাড়ি। শিকদার বলল, থামাও গাড়ি।
গাড়ি থামাল শহীদ। এই জায়গাটা ওকে খুন করার জন্যে বেছে নিয়েছে। শিকদার।
স্টার্ট বন্ধ করল শহীদ গাড়ির। শিকদার দরজার হাতল হাতড়াচ্ছে, চোখ দুটো শহীদের দিকেই। মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল শহীদ। ওর ডান হাতটা ভান দিকের দরজা এবং সীটের মধ্যবর্তী জায়গায় ঝুলছে, আঙুলগুলো নড়ছে চুপিসারে।
দরজা খুলে ফেলল শিকদার। নামার আগে অভ্যাসবশত তাকাল নিচের দিকে। ঠিক সেই সময় খোপ থেকে ৩২ হ্যামারলেস অটোমেটিক বের করে গুলি করল শহীদ।
মাত্র একটা বুলেট খরচ করল ও। শিকদার জানতেই পারল না কি ঘটে গেল। মাথাটা ফুটো করে বেরিয়ে গেল বুলেট, গাড়ির বাইরে দেহপতনের শব্দ হলো।
নামল না শহীদ। দরজাটা বন্ধ করল ও। স্টার্ট দিল। ছুটতে শুরু করল ফোক্সওয়াগেন।
বিশ মিনিট পর গাড়ি থামাল শহীদ। পায়ে হেঁটে বাড়িটার গেটের কাছে পৌঁছে দেখল ভিতরে একটা ছোট্ট ফিয়াট দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, ইসহাক ফিরে এসেছে মাহবুব চৌধুরীকে নিয়ে যাবার জন্যে।
গেটের কাছ থেকেই ইসহাকের গলা শুনতে পেল শহীদ। মাহবুব চৌধুরীর গলাও পাওয়া যাচ্ছে। ঘুম ভাঙিয়েছে বলে ইসহাককে গালিগালাজ করছে সে।
বারান্দায় উঠে অপেক্ষা করতে লাগল শহীদ। মাহবুব চৌধুরীর গালিগালাজ সহ্য করতে না পেরে ইসহাক পাশের রুমে চলে গেল সম্ভবত। কিংবা সংলগ্ন বাথরূমে ঢুকেছে সে।
একটু পরই পানির শব্দ শুনতে পেল শহীদ।
দরজার গায়ে ধাক্কা মারল ও। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। ভিতরটা অন্ধকার। ভিতরে পা রাখল ও নিঃশব্দে। পা দুটো টনটন করছে, আচমকা হাঁটু দুটো ভাঁজ হয়ে গেল, পড়ে গেল শহীদ।
পা দুটো দুর্বল হয়ে গেছে।
শব্দ হয়েছে ওর পতনের।
খাটের উপর নড়ছে কেউ, নিশ্চয়ই মাহবুব চৌধুরী। ঠাণ্ডা কালো নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার।
মাহবুব চৌধুরী ঘুম জড়ানো গলায় ডাকল, ইসহাক?
জবাব দিতে পারত শহীদ, দিল না। কাছে পিঠে কোথাও থেকে কলের পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে, হাত মুখ ধুচ্ছে ইসহাক।
ইসহাক? বিরক্ত হয়েছে মাহবুব চৌধুরী।
উঠে দাঁড়িয়েছে শহীদ, কিন্তু শরীর এবং পা দুটো কতখানি দুর্বল তা ও বুঝতে পারল আবার হাঁটুর ভাজ ভেঙে গিয়ে সশব্দে পড়ে যেতে।
ধড়মড় করে উঠে বসল খাটের উপর মাহবুব চৌধুরী। অন্ধকারে নামল সে মেঝেতে। পায়ের শব্দ পেল শহীদ। পিস্তলটা তুলল ও, মনে হচ্ছে জিনিসটা কয়েক মণ ভারি, গুলি করল আরও কয়েক সেকেন্ড পরে।
কানের কাছে গ্রেনেড ফাটল যেন। দুর্বল হলে যা হয়, শব্দ সহ্য করা যায় না।
চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো কয়েক সেকেণ্ড পর। তার মানে শহীদ হামাগুড়ি দিয়ে স্থান পরিবর্তন করতে করতে ভাবল, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। কান পেতে রইল ও। কিন্তু শব্দ পেল না কোন।
মাহবুব চৌধুরী এই ধরনের লুকোচুরি খেলায় ওস্তাদ লোক। সহজে হার মানবার পাত্র সে নয়।
পানি পড়ার শব্দ থেমে গেছে গুলির শব্দ হবার পর। ইসহাক কি করছে বুঝতে পারছে না শহীদ। সে কি এই রূমে ঢুকেছে চুপচাপ?
নিঃশ্বাসের শব্দ পেল ও। কিন্তু পর মুহূর্তে সন্দেহ হলো কার নিঃশ্বাস ওটা? মাহবুব চৌধুরীর, না ইসহাকের–না ওর নিজের?
জায়গা বদল করছে ও। টের পাচ্ছে মাঝে-মধ্যে, অস্পষ্ট ভাবে মাহবুব চৌধুরীর নড়াচড়া।
না, নিঃশ্বাসের শব্দ ভুল শোনেনি ও। শব্দটা ক্রমশ কাছে আসছে।
সময় ঘনিয়ে আসছে। এই ভয়ঙ্কর খেলার সমাপ্তি ঘটবে। রাত শেষ হয়ে এসেছে, দিনের আলো ফুটতে শুরু করবে আর খানিক পরই, তখন আর লুকোচুরি খেলার দরকার হবে না।
নিঃশ্বাসের শব্দটা একেবারে কাছে এসে পড়েছে। যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করতে পারে শহীদ নোকটাকে।
কামরার দূর প্রান্ত থেকে ফিসফিসে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ওদিকে, ওই ওদিকে কুত্তাটা।
মাহবুব চৌধুরী কথাটা শেষ করেই গুলি করল।
ধপাস করে শহীদের সামনে পড়ে গেল ইসহাকের প্রাণহীন দেহ। একটা বুলেটেই অক্কা লাভ করেছে সে।
মাহবুব চৌধুরী উল্লাসে ফেটে পড়ল, কুত্তাটাকে দিয়েছি খতম করে! শা-আ আ-লা!
কথাটা বলে পা বাড়াল সে।
দিনের অত্যল্প আলো ফুটি ফুটি করছে, জানালার সামনে দেখল শহীদ তাকে। বলল, মাহবুব, নিজের লোককেই খতম করেছ তুমি!
মাহবুব চৌধুরী একই সাথে অনেকগুলো ঘটনা ঘটাতে চেষ্টা করল। একই সময়ে বসার চেষ্টা করল সে, গুলি করার চেষ্টা করল এবং খিস্তি করার জন্য মুখ খুলল।
তিনটের মধ্যে দুটো কাজে সফল হলো সে। সে বসে পড়ল, কেননা শহীদ গুলি করে বসিয়ে দিল তাকে। সে গুলি করল, কেননা শহীদের গুলি খেয়ে তার হাতের আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে যাওয়াতে ট্রিগারে চাপ পড়ায় গুলি ছুটল। কিন্তু খিস্তি বের হলো না তার মুখ থেকে। কারণ, শহীদের গুলি তার দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে মুখের ভিতর ঢুকে তার ভাষা কেড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে মগজ ছুঁড়ে মাথার পেছন দিক দিয়ে।
পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট–আধ ঘণ্টা নড়ল না শহীদ, নড়বার শক্তি পেল না।
সকাল হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসল সে। কিন্তু হাঁপিয়ে উঠল এমন ভাবে যে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছাড়তে সাহস হলো না। আরও আধঘন্টা কাটল। স্টার্ট দিল শহীদ ফোক্সওয়াগেনে, ছেড়ে দিল গাড়ি। কিন্তু খানিক দূর এগিয়ে আবার গাড়ি থামাল। বিশ্রাম দরকার। তা না হলে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলবে। এখনও অল্প অল্প রক্ত বের হচ্ছে নাক দিয়ে। মাথার ক্ষতটা থেকেও। সম্পূর্ণ মুখটায়। এক ডজনেরও বেশি ক্ষতের দগদগে চিহ্ন। ডান চোখটা এখনও খুলতে পারছে না ও।
.
০৫.
সকাল আটটা। সি.আই.ডি. হেডকোয়ার্টারের গাড়ি বারান্দায় থামল একটি জীপ। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ নামল সবার আগে। তারপর ডি. কস্টা। ডি, কার হাতে হাতকড়া লাগানো রয়েছে। কয়েকজন কনেস্টবলও নামল। তারা সশস্ত্র।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদকে বিচলিত এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে। কনেস্টবলরা ঘিরে ফেলল ডি. কস্টাকে। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ মুখোমুখি দাঁড়াল ডি. কস্টার, বলল, দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই, ডি. কস্টা। বসের হুকুম, মানতেই হবে। মি. সিম্পসন আমাকে কারণটা বলেননি, শুধু নির্দেশ দিয়েছেন তোমাকে গ্রেফতার করে আনতে।
ডি. কস্টা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল, ঠাক, আর সাটু সাজিটে হইবে না। পুলিসের সাঠে আবার বড়ুট্ট।
উপরে উঠে এল গোটা দলটা। ডি. কস্টা আগে, ইন্সপেক্টর পেছনে। মি. সিম্পসনের চেম্বারে ঢুকল ওরা।
মি. সিম্পসন সিগারের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
ডি. কস্টা দেখল চেম্বারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে কাবেরী, তার হাতেও হাতকড়া।
গুডমর্নিং, মিস্টার স্যানন ডি. কস্টা! মি. সিম্পসনের গলায় ব্যঙ্গের আধিক্য।
ডি. কস্টা এতটুকু না দমে সাথে সাথে উত্তর দিল, হাপনি ব্যাপারটা মনে রাখিয়াছেন ডেকিয়া হামি যারপর নাই আনটি?
মি. সিম্পসনের সাথে চেম্বারে রয়েছেন আরও উচ্চপদস্থ অনেক অফিসার। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। মি. সিম্পসনই বললেন আবার, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে আপনাকে?
ডি. কস্টা বলল, না। না জানাইলে জানিব কি উপায়ে?
মিথ্যে কথা বলল ডি. কস্টা। এগিয়ে গিয়ে বিনা অনুমতিতে একটা চেয়ারে বসল সে। মি. সিম্পসন প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। তাকালেন ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের দিকে।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ বলল, ডিকস্টার বাড়ি সার্চ করে আমি একটা টাইপ করা কাগজের শীট পেয়েছি। সেটা আমাদের চুরি যাওয়া ফাইলেরই অংশবিশেষ।
মি. সিম্পসন ডি. কস্টার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের এই অফিস থেকে ইনফরমেশন পাচার হচ্ছিল বহুদিন থেকে। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে কালপ্রিটকে ধরবার, কিন্তু আমরা সফল হইনি এতদিন। আজ সকালে মিস কাবেরী, আমার সেক্রেটারিদের একজন, বিনা অনুমতিতে আমার চেম্বারে ঢোকে এবং আলমারির তালা খুলে একটা ফাইল রাখার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার পর স্বীকারোক্তি দেয় সে। অন্যান্য ইনফরমেশন পাচারের ব্যাপারে তার কোন ভূমিকা নেই বলে দাবি করলেও সে স্বীকার করে আলোচ্য ফাইলটি সে চুরি করে আপনাকে দিয়েছিল। কুয়াশা মানুষকে অমর করার জন্যে এক্সপেরিমেন্ট চালাবে, আপনি কাবেরীকে সেই এক্সপেরিমেন্ট দেখার সুযোগ করে দেবেন–এই লোভ দেখিয়ে ফাইলটা চুরি করান। আপনি ফাইলের যাবতীয় তথ্য জেনে নেন, গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টের অংশগুলো টুকে নেন, তারপর ফাইলটা ফেরত দেন কাবেরীকে! আপনারা যে কাজগুলো করেছেন তা বে-আইনী কাজ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। গোপনীয় ইনফরমেশন চুরি করার অভিযোগে আপনাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যেহেতু এটা আমার ডিপার্টমেন্ট, তাই থানায় পাঠাবার আগে আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করতে চাই, এ ব্যাপারে আপনার কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন।
ডি. কস্টা চিন্তা করছিল। মি. সিম্পসন তার পেছনে লেগেই আছেন, এতদিন সুযোগ পাননি জেলে ভরার। আজ তিনি প্রমাণসহ ধরেছেন–এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
হামি কোন কঠা বলিটে চাই না। টবে হামি ডাবি করি, এই মুহূর্টে হামার আইনজ্ঞ বন্দুর সাঠে পরামর্শ করিবার সুযোগ ডেয়া হোক।
মি. সিম্পসন বললেন, আপনি উকিলের মাধ্যমে অভিযোগের জবাব দিতে চান?
ইয়েস, অফকোর্স।
মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক আছে। সে সুযোগ আপনি পেতে পারেন।
ডি. কস্টা হাত দুটো উঁচু করে ধরল, হামার হাট দুটো মুক্ট না করিলে ডায়াল করিব কিভাবে?
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ তাকাল মি. সিম্পসনের দিকে। মি. সিম্পসন নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। ইন্সপেক্টর অনুমতি লাভ করে পকেট থেকে চাবি বের করে ডি. কস্টার হাতের হাতকড়া খুলে দিল।
বিজয়ীর হাসি হাসল ডি. কস্টা। কিন্তু কথা না বলে ফোনটা টেনে নিল নিজের দিকে, ডায়াল শুরু করল, রিসিভারে মুখ ঠেকিয়ে বলল, মি. ডি. কস্টা বলিটেছি। পুলিসী ষড়যন্ত্রের শিকার হইয়াছি।.ইয়েস, অ্যারেস্ট করিয়া হামাকে মি, সিম্পসনের চেম্বারে আনা হইয়াছে। টিনি হুমকি ডিটেছেন, গুরুটর অভিযোগে হামাকে থানায় পাঠানো হইবে….অপরাট? …•া:হাঃ…একটা ফাইল হামি না…কাবেরী… ইয়েস…ইয়েস..ইয়েস….ঢন্যবাড।
একগাল হেসে রিসিভার নামিয়ে রাখল ডি. কস্টা। বলল, হামার উকিল ডশ মিনিটের মঢ্যে আসিটেছেন।
মি. সিম্পসন বাঁকা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, দুনিয়ার সব উকিলকে ডেকে আনলেও কোন লাভ নেই, মি. ডি. কস্টা। অপরাধ করেছেন, তার প্রমাণও পেয়েছি আমরা। দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ঝুলছে আপনার কপালে।
ডি. কস্টা বলল, হামার উকিল কিটু যাডু জানে, বিলিভ মি অর নট।
মৃদু শব্দে হাসলেন মি. সিম্পসন, বললেন, কিন্তু আইন যাদুতে বিশ্বাস করে না। আইন চায় প্রমাণ।
সবই পাইবেন। ব্যস্ট হইবেন না। কমিনিট ওয়েট করুন।
ঠিক দশ মিনিট পর একজন সাব-ইন্সপেক্টর চেম্বারে ঢুকে বলল, বুড়ো এক উকিল, নাম বললেন কফিল উদ্দিন জোয়ারদার, ভেতরে আসতে চাইছেন, স্যার।
মি. সিম্পসন বললেন, নিয়ে এসো।
ঢোলা পাজামা পাঞ্জাম পরা, অতি বৃদ্ধ এক লোক ঢুকলেন চেম্বারে। চশমা জোড়া নাকের উপর নেমে এসেছে। তালগাছের মত লম্বা; হাতগুলো চওড়া, কাঁপা কাঁপা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে, ভাঙা গলায় বললেন, আসোলামু আলায়কুম!
মি. সিম্পসন হাসি চেপে বললেন, বসুন, উকিল সাহেব। আপনার মক্কেলের সাথে কথা বলুন। দরকার হলে আপনারা দুজনে পাশের কামরায় গিয়ে আলোচনা করে নিতে পারেন।
বৃদ্ধ উকিল আবার উঠে দাঁড়ালেন, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, সেই ভাল। চলুন, মি. ডি. কস্টা।
ডি. কস্টাও উঠল। উকিলের একটা হাত ধরল সে সাহায্যের জন্য। বৃদ্ধ খুবই দুর্বল, হাঁটার সময় পড়ে যাবেন বলে সন্দেহ হয়। পাশের কামরায় ঢুকল ওরা।
মাত্র মিনিট তিনেক পর বেরিয়ে এল ওরা। বসল যে যার আসনে।
বলুন। মি. সিম্পসনের দুচোখে কৌতুক নাচছে।
বৃদ্ধ উকিল কফিল উদ্দিন জোয়ারদার তাঁর নিচু এবং কাঁপা কণ্ঠস্বরে থেমে থেমে বলতে লাগলেন, আমার মক্কেল মি. ডি. কস্টা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বীকার করেছেন।
তাই নাকি! চমৎকার! তাহলে তো আর কোন ঝামেলাই রইল না। মি. সিম্পসন খুশি হয়ে বলে উঠলেন।
বৃদ্ধ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি ওই খোলা জানালাটা বন্ধ করে দিতে চাই। তারপর আমার কথা শেষ করব।
কথাটা বলে কফিল উদ্দিন জোয়ারদার খোলা জানালাটার দিকে এগোলেন। ওই খোলা জানালা পথে বিপরীত দিকের মুখোমুখি একটা বিল্ডিং দেখা যায়। সেটা তিনতলা। একটা ব্যাঙ্কের হেড অফিস বিল্ডিংটা।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করল। মি. সিম্পসন বললেন, ব্যাপার কি?
বৃদ্ধ উকিল বললেন, আমাকে দয়া করে কাজটা শেষ করতে দিন।
বেশ, করুন।
জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বললেন বৃদ্ধ, চশমাটা ঠিক করে বসিয়ে নিলেন নাকে, আমার মক্কেল বলছেন, আপনার অফিস থেকে টপ-সিক্রেট ইনফরমেশন পাচার হওয়া সম্পর্কে তিনি অনেক রহস্য জানেন। প্রকৃত পক্ষে কে, এই পাচার কার্যে নিযুক্ত তাও তিনি অবগত। আমার মক্কেলের প্রশ্ন, আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, অত্যন্ত গোপন সূত্রে প্রাপ্ত খবরের উপর ভিত্তি করে আপনারা যতবারই শহরের জুয়ার আঙ্গুলোয় হানা দিয়েছেন গত এক বছরের মধ্যে, ততবারই ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করেছেন? প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখেছেন, কেউ নেই সেখানে। সবাই পালিয়েছে। তারা খবর পায়। কিভাবে পায়? কেউ তাদেরকে খবর দেয়। কে দেয়? কিভাবে দেয়? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার মক্কেল জানেন। তিনি উত্তরগুলো আমাকে বলেছেন।
মি. সিম্পসনের মুখের হাসি হাসি ভাবটা আর নেই। চোখমুখ থমথম করছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে সিধে হয়ে বসেছেন, কে সেই বিশ্বাসঘাতক? কোথায় সে?
বৃদ্ধ উকিল হাসলেন। বললেন, বিশ্বাসঘাতক লোকটা কোথায় আছে তা আমার মক্কেল আপনাকে বলতে চান। তাকে আপনি দুই মিনিটের মধ্যে গ্রেফতার করতে পারবেন। কিন্তু আমার মক্কেলের এই উপকারের বদলে আপনি কি করবেন তার জন্য?
মি. সিম্পসন বললেন, তার মানে?
ডি. কস্টা পা দোলাচ্ছে, মুচকি মুচকি হাসছে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে।
বৃদ্ধ উকিল বললেন, তার মানে, আমার মক্কেল চান বিশ্বাসঘাতক লোকটাকে ধরিয়ে দেবার বিনিময়ে আপনি তার এবং মিস কাবেরীর বিরুদ্ধে বর্তমান অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন। শুধু প্রত্যাহার নয় সম্পূর্ণ ঘটনাটা বেমালুম ভুলে যেতে হবে আপনাকে।
গুম হয়ে বসে রইলেন মি. সিম্পসন। অন্যান্য অফিসারগণও অধীর উত্তেজনায় নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছেন। যে ব্যাপারে তারা গত একবছর যাবৎ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন, শত চেষ্টা করেও সমস্যাটার কোন কিনারা করতে পারেননি চরম গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি রহস্য অপ্রত্যাশিতভাবে উদঘাটিত হতে যাচ্ছে দেখে তাঁরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।
কাজেই মি. সিম্পসনের উপায় নেই, মেনে নিলেন তিনি, ঠিক আছে। আমি রাজি। তবে যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে…।
বৃদ্ধ আশ্বাস দিলেন, চিন্তা করবেন না। শুনুন তাহলে। এখুনি লোক পাঠিয়ে দিন এই বিল্ডিংয়ের বিপরীত দিকে, মুখোমুখি বিল্ডিংটার তিনতলায়। সবাই জানেন, ওটা একটা ব্যাঙ্কের হেডঅফিস। রাত্রে ওখানে দারোয়ান ছাড়া অন্য কোন লোক থাকে না। দুজন নাইট গার্ড আছে–তারা দুই ভাই। এখন ডিউটিতে আছে একজন। তাকে ধরে আনার জন্যে লোক পাঠান।
ছোঁ মেরে তুলে নিলেন মি. সিম্পসন ফোনের রিসিভার। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তিনি, কেঁপে গেল তার গলা।
মাত্র সাত মিনিট লাগল। ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
রিসিভার তুললেন মি. সিম্পসন। অপরপ্রান্ত থেকে ইন্সপেক্টর এরশাদ জানাল, ধরা পড়েছে! মারধর করাতে স্বীকারোক্তি দেবে বলছে সে।
বৃদ্ধ উকিল উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াল ডি, স্টাও। এবার আমরা যেতে পারি?
মি. সিম্পসন উকিল বা ডি. কস্টার দিকে না তাকিয়ে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, হ্যাঁ-হ্যাঁ, যেতে পারেন।
বৃদ্ধ এবং ডি. কস্টা দরজার দিকে পা বাড়াল। এমন সময় মি. সিম্পসন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। দরজার পর্দা সরিয়ে চেম্বারের মেঝেতে পা রেখেছে যে তাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারলেন না তিনি। পরমুহূর্তে আতঙ্কিত শোনাল তার কণ্ঠস্বর, শহীদ!
এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে শহীদ। ডান চোখটা বন্ধ ওর। গোটা মুখটা রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ডি. কস্টা ও বৃদ্ধ উকিল।
টলছে শহীদ। দুর্বল একটু হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে। চওড়া দুটো হাত ধরে ফেলল ওকে।
বৃদ্ধ কফিল উদ্দিন জোয়ারদার ধরে ধরে চেয়ারের কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন শহীদকে।
মি. সিম্পসন ডেস্কের এ পাশে ছুটে এলেন। শহীদের গায়ে মাথায় হাত রেখে প্রায় অবরুদ্ধ গলায় বললেন, শহীদ। শহীদ! কে কে তোমার এই অবস্থা করেছে? হু ইজ দ্যাট বাস্টার্ড।
শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাল। দেখল বৃদ্ধ লোকটা এবং ডি. কস্টা নেই। মি. সিম্পসনের দিকে ফিরল ও, বলল, বলছি। আপনি শান্ত হোন, মি. সিম্পসন। আমি ঠিক আছি। কুয়াশা আপনার অফিসে কেন এসেছিল?
মি. সিম্পসন আকাশ থেকে পড়লেন, কুয়াশা? কুয়াশাকে দেখলে কোথায় তুমি?
শহীদ বলল, তার মানে? আমাকে ধরে ফেলল যে! সাল চেয়ারে। ও-ই তো কুয়াশা! ওর ছদ্মবেশ ধরতে পারেননি বুঝি?
.
০৬.
ঘুমাচ্ছে শহীদ।
ওর বিছানার পাশে বসে আছে কামাল। অপর পাশে কালো আলখেল্লা পরিহিত কুয়াশা। মাথার কাছে মহুয়া এবং নীনা। কুয়াশার চিকিৎসাধীনে রয়েছে শহীদ। তার নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর পর ওষুধপত্র খাওয়াচ্ছে শহীদকে মহুয়া।
ঘুম ভাঙছে কয়েক ঘণ্টা পর শহীদের, ওষুধ খাচ্ছে, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। প্রতি ঘন্টায় ফোন করে খবর নিচ্ছেন মি. সিম্পসন! খুব ব্যস্ত তিনি, তাই নিজে আসতে পারছেন না। ডি, কল্টা সারাদিনে তিনবার দেখে গেছে ওকে।
সহাস্যে বলল কুয়াশা, বিপদের কোন ভয় নেই রে, মহুয়া। যা তোরা বিশ্রাম কর খানিক।
মহুয়া মান হাসল। বলল, যাচ্ছি।
কিন্তু যাচ্ছি বললেও উঠল না মহুয়া। সময় গড়িয়ে চলল। কুয়াশা বিদায় নিল এক সময়। রাত গম্ভীর হতে ঘুম ভাঙল শহীদের। উঠে বসতে চাইল বিছানায়। কিন্তু কামাল এবং মহুয়া জোর করে শুইয়ে রাখল ওকে। অসহায় ভাবে হাসল শহীদ। বলল, ব্যথা বা দুর্বলতা কিছুই নেই শরীরে। কুয়াশার ওষুধের জন্যে। কিন্তু তোমরা এমন করছ কেন? সুস্থ শরীরে কত আর শুয়ে থাকা যায়?
কিন্তু ওর কথা শুনল না কেউ। আবার ঘুমিয়ে পড়ল শহীদ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ওর। কুয়াশা এখন ওর পাশে রয়েছে। মহুয়া পথ্য দিল, ওষুধ খাওয়াল। খানিক পর আবার ঘুমিয়ে পড়ল শহীদ। এরপর ঘুম ভাঙল বিকেলের দিকে।
সরাসরি উঠে বসল শহীদ। বলল, দেখো, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি আমি।
বিছানা থেকে নামল ও। হাঁটল খানিকটা।
মহুয়া বলে উঠল, হয়েছে, ফিরে এসো এবার বিছানায়।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
ওই, আবার! হাসতে হাসতে ফোনের রিসিভার তুলল শহীদ, শহীদ খান স্পীকিং।
অপরপ্রান্ত থেকে মি. সিম্পসনের গলা ভেসে এল, ভেঙেছে ঘুম, কেমন! গুড!
কি খবর মি. সিম্পসন?
মাহবুব চৌধুরীর লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গুজরাট খানকে সুবিধে করতে পারছি না। ওকে জীবিত ধরতে চাই আমি। আমার চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছিলাম ওকে। ঘটনার সময় সে নারায়ণগঞ্জে মাহবুব চৌধুরীর সাথে ছিল না–এই হলো তার কথা। কথাটা সে প্রমাণও করেছে। আট দশ জন নাম করা লোকের নাম বলে সে। তাদের মধ্যে ধনী ব্যবসায়ী, বিখ্যাত শিল্পী, মাঝারি রাজনীতিবিদও আছে। এরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে ঘটনার সময় গুজরাট খান তাদের সাথেই ছিল।
শয়তানের বাচ্চারা! বুঝতে পারছেন তো মি. সিম্পসন, গুজরাট খান কতবড় ধুরন্ধর। ইমার্জেন্সীর জন্য আগে ভাগেই তৈরি থাকে সে। নামগুলো নোট করে রাখুন ওদের–গুজরাট খানকে ধরাশায়ী করার পরই ওদেরকে ধরব আমি।
আমি ইতিমধ্যেই ওদের পিছনে নোক লাগিয়ে দিয়েছি।
শহীদ জানতে চাইল, কুয়াশা যে লোকটাকে ধরিয়ে দিয়েছে তার কাছ থেকে কি জানা গেল?
মি. সিম্পসন বললেন, জানা গেছে সবই। কিন্তু গুজরাট খানকে ফাসাবার মত কিছুই পেলাম না। কিভাবে কাজটা হত, শোনো, ব্যাঙ্কের গার্ড দুজনকে গুজরাট খানই নিযুক্ত করে। কিন্তু পদ্ধতিটা এমনই যে তারা জানে না কার পক্ষে তারা কাজ করছে। দারোয়ান দুজন আসলে লিপ রীডার। বিশ পঁচিশ গজ দূর থেকে মানুষের ঠোঁট নড়া দেখে তারা বুঝতে পারে কে কি বলছে। ব্যাঙ্কের তিনতলার জানালা থেকে আমার চেম্বারের ভিতরটা দেখা যায়। দারোয়ান ব্যাটারা, জানালার ফাঁক দিয়ে সর্বক্ষণ চেয়ে থাকত আমার চেম্বারের দিকে। চেম্বারের জানালাটা সাধারণত খোলাই থাকত। আমরা যা আলোচনা করতাম, আমাদের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে তারা সবই বুঝতে পারত। কোন অপারেশনের পরিকল্পনা করা হলেই তারা টের পেয়ে যেত। সাথে সাথে তারা ফোন করত একটা নির্দিষ্ট নাম্বারে। সেই নাম্বারটাও খুঁজে বের করেছি আমরা। একটা খালি বাড়ির ফোন নাম্বার ওটা। বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। বাড়ির মালিক ঢাকার বাইরে থাকে। সে ভাড়া দিয়েছিল কোন লোককে বাড়িটা। কিন্তু লোকটার নাম ছাড়া সে কিছুই জানে না। নামটা নকল। ফোনটা বাড়িওয়ালার নামেই।
অর্থাৎ গুজরাট খান প্রাণ খুলে হাসছে আপনাকে বোকা বানিয়ে।
মি. সিম্পসন বললেন, তা হাসছে। আরও খবর আছে, শহীদ। সাইদুল হক ঢাকায় ফিরেছে। তবে বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়নি। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, কারও ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকছে সে। আজ রাতের মধ্যে হয়তো পাব তার সন্ধান। যাকগে, তোমার শরীর এখন কেমন? একটা ব্যাপারে তোমার সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলতে চাই।
কি ব্যাপারে?
তুমি সুস্থ বোধ করলে আমি।
শহীদ বলল, চলে আসুন।
রিসিভার রেখে দিল শহীদ, পরমুহূর্তে ভিতরে প্রবেশ করল স্যানন ডি কস্টা।
হ্যালো, মি. গুরু! শরীর ভাল টো এখন?
শহীদ বলল, ভাল। আপনার খবর কি?
ব্যাড।
কেন?
ডি. কস্টা বসল সোফায়। বলল, মাইণ্ড ভাল নাই। অনেক দুঃখ।
কারণ কি এত দুঃখের?
ডি. কস্টা বলল, সেই কারণেরই সন্তান করিটেছি।
খানিক পর এলেন মি. সিম্পসন। বসলেন। চুরুট ধরালেন।
শহীদ বলল, কিছু যেন ভাবছেন, মি. সিম্পসন?
ভাবছি….না, ভাবছি না। একটা প্রশ্ন, শহীদ।
প্রশ্ন? জিজ্ঞেস করুন।
মি. সিম্পসন শহীদের দিকে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ, তারপর বললেন, মাহবুব চৌধুরীকে খুন করার ব্যাপারটা। তুমি যা বলেছ–ঠিক যেন মেলাতে পারছি না। ঘটনাগুলো সব বলনি তুমি, তাই না? কিছু চেপে যাচ্ছ।
না। সংক্ষেপে বলল শহীদ।
না মানে?
শহীদ বলল, আপনি বলতে চাইছেন মাহবুবকে আমি প্রতিশোধ নেবার জন্যে খুন করেছি, রাগের মাথায় খুন করেছি তাই না? আসলে তা নয়। আমি খুন করেছি আত্মরক্ষার জন্যে।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু মিলছে না, শহীদ। তোমাকে ওরা বন্দী করে নিয়ে যায়। আত্মরক্ষার জন্যে গুলি করো মাহবুবকে। পালিয়ে আসো। কিন্তু গাড়ির চাকার দাগ দেখেছি আমি বাড়িটার উঠনে, গাড়িটা দুবার গেছে ওখানে।
ডি. কস্টা যোগ দিল ওদের আলোচনায়। প্রশ্ন করল, গাড়ির চাকার দাগ? হাপনি নিজে ডেকিয়াছেন?
হ্যাঁ। আমি নিজে দেখেছি।
ডি. কস্টা বলল, অসম্ভব। হামিও গিয়াছিলাম ওখানে। কই, হামিটো গাড়ির চাকার ডাগ ভুই জোড়া ডেকি নাই। এক জোড়া ডেকিয়াছি।
একই গাড়ি ওখানে দুবার গেছে–এ ব্যাপারে আমি ওভারশিওর, মি. ডি. কস্টা।
একবার গিয়াছে, আমিও ওভারশিওর। আপনি ফোন করিয়া সন্তান নিন। প্রমাণ ইয়া যাইবে।
মি. সিম্পসন বিনা বাক্যব্যয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। ডায়াল করে কথা বললেন তিনি একজন ইন্সপেক্টরের সাথে। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রেখে দিলেন রিসিভার।
পনেরো মিনিট পর ফোন এল। রিসিভার তুলে নিলেন মি. সিম্পসন। নিঃশব্দে শুনলেন তিনি ইন্সপেক্টরের বক্তব্য।রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন ধীরে ধীরে।
বললেন, চাকার এক জোড়া দাগ এখন নেই। কিন্তু…
নাই, ছিলও না, মি. সিম্পসন, বলল ডি. কস্টা।
মি. সিম্পসন কোন কথা বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন, এর পেছনে কুয়াশার হাত আছে।
.
বিকেল। ডি. কস্টার বাড়ি। করুণা এসেছে বেড়াতে। হাস্যরসাত্মক কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে।
এমন সময় দরজায় নক হলো।
ভিটরে আসুন!
কবাট দুটো খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল চঞ্চলকে কোলে নিয়ে মিসেস গোমেজ। প্রকাণ্ড দেহটা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে বৃদ্ধা।
চঞ্চলের বড়সড় পুতুলটা রয়েছে বৃদ্ধার হাতে।
চঞ্চলকে কোলে নিতে নিতে ডি. কস্টা বলল, বসুন, মিসেস গোমেজ।
চঞ্চল ডি. কস্টার কোলে বসেই তেপয়ের উপরে রাখা রিভলভারটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
বৃদ্ধা মিসেস গোমেজ আঁতকে উঠে পেয়টা সরিয়ে নিল, কি দস্যি ছেলেরে বাবা! রিভলভার দেখলেই অমন চঞ্চল হয়ে ওঠে কেন? অথচ পুতুলটার প্রতি একটুও আকর্ষণ নেই!
হাতের পুতুলটা চঞ্চলের দিকে বাড়িয়ে ধরল বৃদ্ধা। কিন্তু চঞ্চল সেদিকে তাকালই না!
করুণা বলল, এসো তো, বাবা, আমার কাছে।
হাত বাড়াল সে। চঞ্চল কেঁদে উঠল।
আরে! কাঁদছ কেন? বোকা ছেলে, আমাকে চেনে না, তাই বুঝি?
মিসেস গোমেজ বলল, মি. ডি. কস্টা, হঠাৎ একটা বিপদে পড়েছি, তাই এলাম আপনার কাছে।
কি বিপদ?।
আমার বাড়িওয়ালা কাল সকাল থেকে বাড়িতে মিস্ত্রি লাগাচ্ছে। কিছু কনস্ট্রাকশন আর হোয়াইট ওয়াশের কাজ হবে। আমি একা হলে অসুবিধে হত না, কিন্তু চঞ্চলকে নিয়েই অসুবিধেমাত্র দুদিনের ব্যাপার। আপনার যদি কোন অসুবিধে না হয়।
করুণা বলল, অসুবিধে আবার কি! আপনি এখানে থাকতে পারেন কদিন চঞ্চলকে নিয়ে। মি. ডি. কস্টার অসুবিধে হলে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। অনেকগুলো কামরা আমার। থাকি তো একা।
ডি. কস্টা বলল, টাই হবে। আপনি আজ হইটেই ঠাকুন এখানে, মিসেস গোমেজ। মিস করুণা, হাপনার আবার অসুবিঢ়া হইবে না টো।
প্রস্তাবটা তো আমিই দিলাম।
ডি. কস্টা চঞ্চলকে মিসেস গোমেজের কোলে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমরা টাহলে যাই, মিসেস গোমেজ। আজ আর ফিরব না।
কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
ট্যাক্সি নিয়ে শহরের নানা জায়গায় ঘুরল, মার্কেটিং করল করুণা, কিছু বই পুস্তক কিনল ডি কস্টা, তারপর রাতে ওরা একটা অভিজাত হোটেলে ডিনার খেলো। খাওয়াল করুণাই।
রাত যখন দশটা, করুণার বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল দুজন। উপরে উঠে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে চাবি বের করল করুণা, এমন সময় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল এক যুবক। ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতটা বুকের কাছে ঝুলছে, গলার সাথে বাঁধা সেটা।
করুণা অবাক হয়ে জানতে চাইল, জাহেদ তুমি! এত রাতে?
জাহেদ বলল, মনটা তোমার জন্য কেমন যেন করছিল করুণা, তাই দেখতে এলাম।
করুণা তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালল। ড্রয়িং রূমে ঢুকল ডি. কস্টা, পিছু পিছু জাহেদ।
পরিচয় করিয়ে দিল করুণা, ইনি মি. ডি. কস্টা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ, আমার নতুন বন্ধু। ডি. কস্টা, এ আমাদের নাট্যসংস্থার সেক্রেটারি মি. শাহেদ সুলতানের ছেলে, জাহেদ সুলতান। বসো তোমরা। সুর করে বলল করুণা।
বলল ওরা পাশাপাশি। জাহেদ বলল, সেই সন্ধ্যা থেকেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি, করুণা। তোমার দেখাই নেই। কোথায় যে থাকো আজকাল।
করুণা হাসতে হাসতে বলল, ডি. কস্টার সাথেই আজকাল বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। জানো জাহেদ, খুব মজার লোক ও। এমন সুন্দর গল্প বলতে পারে না যে কি বলব? ওর সাথে পরিচয় না হলে জীবনে অনেক কিছু হারাতাম আমি।
তাই নাকি? আচ্ছা!
ম্লান মুখে চেয়ে ব্ৰইল জাহেদ। করুণা এ-কথা সে-কথা বলতে লাগল, ক্লান্তি নেই তার। ডি কস্টা শ্রোতা। শুনছে হয়তো জাহেদও, কিন্তু তাকে বিপ্ন এবং ক্লান্ত দেখাচ্ছে। খানিক পর উঠল সে। বলল, চলি, করুণা।
আবার দেখা হবে। এসো কিন্তু জাহেদ সময় পেলেই।
দরজা অবধি পৌঁছে দিল তাকে করুণা। ফিরে এসে মুখোমুখি সোফায় বসতে ডি. কস্টা বলল, আপনি বড় নিষ্ঠুর। ছোকরা হাপনাকে ভালবাসে অঠচ হাপনি টাকে একরকম অপমান করেই বিড়ায় ডিলেন।
করুণাকে চিন্তিত দেখাল। বলল, কি করতে পারি আমি বলুন? ও একটা পাগল। ইচ্ছে করেই অপমান করি ওকে। কারণ, উৎসাহ দেখালে ও ভাববে আমিও ওকে ভালবাসি। সেক্ষেত্রে বিপদে পড়ব।
ওকে বুঝাইয়া বলিলেই টো হয়।
তা হয় না। একেবারে নিরাশ করলে অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। এই রকম একবার ঘটিয়েছিল ও।
ডি. কস্টা বলল, প্রবলেম। টবে প্রবলেমটার সমাচান বের করা ডরকার।
সমাধান হবে। কিভাবে আমি ভেবে রেখেছি। সময় হোক বলব।
.
পরদিন প্রাক্তন সি.আই.ডি. কর্মকর্তা সলিল চৌধুরীকে ফোন করল শহীদ। ভাগ্য ভাল, পাওয়া গেল ভদ্রলোককে।
পরিচয় দিতেই চিনলেন ভদ্রলোক।
শহীদ জানতে চাইল, আপনি তো গত বছর রিটায়ার করেছেন, মি. সলিল? আচ্ছা, মোহাম্মদ গাউস নামে কোন লোকের ফাইল কি ছিল আপনার কাছে?
ছিল না মানে! মোহাম্মদ গাউস-কুখ্যাত লোক সে। তবে সবাই তার নাম জানে না। মি. সিম্পসনের সাথে যোগাযোগ করুন, ফাইলটা পাবেন।
কিন্তু ফাইলটা মি. সিম্পসনও পাননি, আমি যোগাযোগ করেছিলাম। পাননি বলে তিনি তার নামে নতুন একটা ফাইল ওপেন করেন। কিন্তু তাতে লোকটার অতীত সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না।
বলেন কি! ভারি আশ্চর্য কাণ্ড। এ নিশ্চয় গাউসেরই কাজ। ফাইল যেভাবে হোক চুরি করিয়েছে সে। তা কি জানতে চান আপনি তার সম্পর্কে? সে তো খুন হয়েছে।
শহীদ বলল, হ্যাঁ। তার অতীত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই আমি। অপরাধ জগতে ঢোকার পর যা যা করেছে সে।
প্রায় সব কথাই মনে আছে আমার। বলছি, শুনুন। মোহাম্মদ গাউস খান ছিল একজন ফটোগ্রাফার। নাম করা প্রায় সব অভিনেত্রীই তাকে দিয়ে ছবি তোলাত। এদিকে অভিনেত্রীদের সম্পর্কে অসীম কৌতূহল ছিল কুখ্যাত অপরাধীদের নেতা ইব্রাহিম খলিলের। আপনি নিশ্চয়ই ওর কথা সব জানেন। যাই হোক, অভিনেত্রীদের মাধ্যমেই গাউস ইব্রাহিম খলিলের সাথে পরিচিত হয়। ইব্রাহিম খলিল তাকে ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ করে। সেই সূত্রে, সে মাহবুব চৌধুরী, গুজরাট খান–এই ধরনের লোকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। ইরাহিম খলিল মারা যাবার পরও গাউস এদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি। বরং ইব্রাহিম খলিল মারা যাবার পর গাউসের দাম বেড়ে যায়। মাহবুব এবং গুজরাটের প্রায় সমকক্ষ হয়ে ওঠে সে। কারণটা যে কি আমরা কোনদিন জানতে পারিনি। এই সময় ফটো তোলাটা তার কাছে গেীণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় সে ক্যামেরার কাজ পুরোপুরি ছেড়ে দেয়। আমরা প্রায়ই খবর পেতাম, জুয়ার আড্ডায় তাকে দেখা যায় গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরীর সাথে। তবে গুজরাট এবং মাহবুবকে নিয়ে সব সময় আমরা এত বেশি ব্যস্ত থাকতাম যে গাউস সম্পর্কে খুব বেশি মাথা ঘামাবার সময় পেতাম না।
শহীদ বলল, যা জানতে চেয়েছিলাম তা আমার জানা হয়ে গেছে, মি..সলিল। অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইটস এ প্লেজার।
ফোন ছেড়ে দিল শহীদ। তাকাল কামালের দিকে। বলল, তোকে একটা কাজ করতে হবে, কামাল।
বলে ফেল।
শহীদ বলল, ইব্রাহিম খলিল, নামটা নিশ্চয়ই পরিচিত?
চিরকাল মনে থাকবে। অপরাধীদের শিরোমণি। নাটক দেখে ফেরার পথে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।
শহীদ বলল, মারা যাবার সময় তার স্ত্রী ছিল কিনা জানিস?
ঠিক মনে পড়ছে না। বোধ হয় বিয়ে করেনি সে। তবে রক্ষিতা হয়তো ছিল। মেয়েপাগল লোক ছিল শয়তানটা?
শহীদ বলল, রক্ষিতা ছিল–সম্ভবত, তাই? তোর কাজ হচ্ছে, সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আজই আবিষ্কার করবি সেই রক্ষিতা মেয়েটি কে।
ঠিক হ্যায়।
সাত-আট বছর আগের কথা। মেয়েটিকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তবু, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। এই ধরনের মেয়েরা শহর ছেড়ে যায় না সাধারণত। ভাগ্য ভাল হলে পেয়েও যেতে পারি। এখুনি বেরিয়ে যা।
শিস দিতে দিতে ড্রইংরূম ত্যাগ করল কামাল।
দুপুর, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল। কামালের দেখা নেই। একটা খবরও পাঠায়নি সে।
শহীদ চিন্তিত হয়ে উঠেছে। বিপদ-আপদ হলো না তো ওর আবার!
আটটার দিকে ডি. কক্টা এল।
ফোন এল সাড়ে আটটায়।
কামাল বলছি!
নাটকীয় কণ্ঠস্বর শুনেই শহীদ বুঝতে পারল কামাল সফল হয়েছে। বলল, পেলি সন্ধান?
পাব না মানে? আমার কাছ থেকে বিশ ফুট দূরের একটা স্টেজে নাচছে সে। ইব্রাহিম খলিলের রক্ষিতাই ছিল ও। তখন ওর নাম ছিল নীলা। দুএকটা ছবিতে অভিনয়ও করেছিল। নাম পাল্টে ফেলেছে। নাটকে অভিনয় করে এখনও মাঝেমধ্যে। তবে নাইট ক্লাবেই সাধারণত নাচে। এখন ওর নাম নার্গিস!
কোথা থেকে বলছিস তুই?
নারায়ণগঞ্জ ফ্রেণ্ডস নাইট ক্লাবের বুঁদ থেকে ফোন করছি। কিন্তু শহীদ, একটা রহস্যময় ব্যাপার কি জানিস?
কি?
কামালের কণ্ঠস্বর খাদে নেমে গেল, আমি ছাড়াও আরও কেউ ওর সন্ধান পাবার চেষ্টা করছে। যেখানেই ফোন করেছি, যেখানেই গিয়েছি–আমার আগেই সে ওর সন্ধানে সেই সব জায়গায় হয় ফোন করেছে নয় সশরীরে উপস্থিত হয়ে তথ্য নিয়ে চলে গেছে। ব্যাপারটা মোটেই ভাল ঠেকছে না, শহীদ।
কে হতে পারে? চেষ্টা করিসনি পরিচয় জানতে?
করেছি। জানতে পারিনি। কি মনে হচ্ছে জানিস? নার্গিস শুধু তোর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর একজনের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ।
শহীদ বলল, নার্গিস কতক্ষণ থাকবে ক্লাবে?
সাড়ে দশটা পর্যন্ত থাকে সাধারণত। চলে আয় তুই।
আমার জন্যে অপেক্ষা কর ওখানে। এখুনি রওনা হচ্ছি আমি।
রিসিভার নামিয়ে রেখে শহীদ বলল, যাবেন নাকি, মি. ডি. কস্টা?
ডি কস্টা বলল, মনে হইটেছে রহস্যের কিনারা হইবে এটোডিনে। যাইব না। মানে? নিশ্চয়ই যাইব। টবে হাপনি একাই যান। আজ আবার আমাকে ডিনার খাওয়াইবেন মিস করুণা, টাই…।
শহীদ বলল, মন্দ কি। ডিনারটা ফ্রেণ্ডস্ ক্লাবে খেলেই তো পারেন।
টা ঠিক। ঠিক আছে। মিস করুণার বাড়িটে যাইটেছি আমি। টাহাকে নিয়া সোজা চলিয়া যাইব।
.
আহ! আবার সেই বৃষ্টি। আবার সেই তুমুল বর্ষণ।
রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন।ফোক্সওয়াগেন ছুটছে। নিক্ষিপ্ত তীরের মত ছুটছে, ছুটছে…
ভাবছে আর ভাবছে শহীদ। চিন্তার জাল বুনে যাচ্ছে মাথার ভিতর। ইব্রাহিম খলিল? এই কেসে এই নামটা বারবার উচ্চারিত হয়েছে! মৃত একটা শয়তান, মরে গিয়েও খবর সৃষ্টি করছে সে। জব্বার খুন হলো, তার সাথে খুন হলো মাহবুব। চৌধুরীর একজন দেহরক্ষী–শোনা গেল ইরাহিম খলিলের নাম। গাউস খুন হলো সেখানেও ইব্রাহিম খলিলের নাম উচ্চারিত হলো। মাহবুব চৌধুরী খতম হলো, সেখানেও ইব্রাহিম খলিলের নাম শোনা গেল। শুরুতেও ইব্রাহিম খলিল, শেষেও ইব্রাহিম খলিল। নীলা ওরফে নার্গিস-মেয়েটার সাথে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেলে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। ইব্রাহিম খলিল কি স্বাভাবিক ভাবে মারা গিয়েছিল? নাকি তাকে খুন করা হয়েছিল? মাহবুব চৌধুরীর কথাগুলোর সঠিক অর্থ কি?
যাই হোক, অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেতে পারে মেয়েটার সাথে কথা বললে। ইব্রাহিম খলিল মারা যাবার পর গাউসের ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তিও হঠাৎ কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল–এর কারণও হয়তো মেয়েটা জানে। দেখা যাক।
নির্জন, প্রশস্ত রাস্তা। চার পাঁচটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেণ্ডস নাইট ক্লাবের সামনে। গাড়ি পার্ক করে নামল শহীদ। ডোরম্যান স্যালুট করল।
রিসেপশন রূমের মেয়েটা হাসল মিষ্টি করে। শহীদ না তাকিয়ে এগিয়ে গেল।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল ও। আবছা নীল আলোয় আলোকিত সে রুমটা। প্রথমেই স্টেজের দিকে তাকাল শহীদ। কেউ নাচছে না। একদল পপ গায়ক গান গাইছে তারস্বরে।
কামালকে এক কোণায় বসে থাকতে দেখল শহীদ। পা বাড়াল সেদিকে। লোকজন প্রচুর রয়েছে, কিন্তু হালকা আলোয় চেনার উপায় নেই।
মুখোমুখি বসল শহীদ, কোথায় মেয়েটা?।
বোধহয় গ্রীনরূমে কাপড় বদলাচ্ছে। তার শেষ অনুষ্ঠান একঘণ্টা পর হবে। কথা বলতে চাস?
অবশ্যই!
চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল ওর দৃষ্টি। পাঁচ ছয়টা টেবিলের পর একটা টেবিলে দেখা যাচ্ছে গুজরাট খান এবং তার সাথে চারজন লোককে। দুজনকে চিনতে পারল শহীদ। তারা উকিল। বাকি দুজন অপরিচিত। কুস্তগীরদের মত চেহারা–গুণ্ডাপাণ্ডা হবে।
ওরা খানিক আগে এসে বসেছে।
দেখেছে তোকে? জানে কেন এসেছিস তুই?
কামাল বলল, পাগল ভেবেছিস আমাকে?
আমাকে দেখেনি তো ঢোকার সময়?
কামাল বলল, না।
শহীদ কিছু বলল না। চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। এমন সময় দেখা গেল ডি কস্টা এবং করুণা ঢুকছে হলরুমে।
শহীদ ও কামালকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল ডি কস্টা, পেছন পেছন করুণা।
নিঃশব্দে বসল ওরা দুটো চেয়ারে। ফিসফিস করে বলল, বাপরে বাপ। গুজরাট খানকে ডেকিতে পাইটেছি!
শহীদও ফিসফিস করে বলল, সত্যি বিপদ একটা ঘটতে পারে, মি. ডি. কস্টা। আপনার এখানে না থাকাই ভাল। ওরা আপনার প্রতি ভয়ানক খাপ্পা।
টার মানে! হামি কি কাওয়ার্ড নাকি! হাপনি কি হামাকে কাপুরুষ মনে করেন?
করুণা বলে উঠল, মাথা গরম করবেন না মি, ডি. কস্টা। উনি আপনার ভালর জন্য কথাটা বলেছেন:।
ডি. কস্টা শান্ত হলো। বলল, মিশহীড, পরিচয় করাইয়া ডিই।
শহীদ বলল, আপনার কথা ডি. কস্টার মুখে অনেক শুনেছি। আপনি অভিনয় ছেড়ে দিলে কি হবে, ডি. কস্টা আপনার অসম্ভব ভক্ত।
করুণা হাসল।
এমন সময় ওয়েটার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিল সে ডি. কস্টার দিকে। বলল, এক ভদ্রলোক এটা আপনাকে দিতে বললেন, স্যার।
ডি. কস্টা নিল সেটা।
জিনিসটা কি দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো, তাতে লেখা:
মি. ডি. কস্টা এবং মিস করুণা,
আপনারা এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান। সোজা ফিরে যান বাড়িতে।
তা না হলে আমি বাধ্য হব লোক দিয়ে এখান থেকে বের করে দিতে।
লেখার নিচে কোন নাম বা সই নেই। কিন্তু কামাল এবং শহীদ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
নাম লেখা না থাকলেও হস্তাক্ষরটা পরিচিত ওদের। ওটা কুয়াশার হাতের লেখা।
কুয়াশাও তাহলে উপস্থিত এখানে।
কামাল, তুইও বেরো। বাইরে কোথাও থেকে ফোন কর মি. সিম্পসনকে। আমর্ড ফোর্স নিয়ে এখুনি রওনা হতে বলবি। কুইক। মি. ডি. কস্টা…
ডি. কস্টা, করুণা এবং কামাল একযোগে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগোল ওরা।
উঠে দাঁড়ান শহীদও। পা বাড়াল ক্লাবের অন্দর মহলের দিকে।
হলরুম থেকে বেরিয়ে একটা প্যাসেজে পা দিল শহীদ। একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছিল, শহীদ জিজ্ঞেস করল, গ্রীনরূমটা কোন দিকে?
লোকটা দাঁড়াল না, প্রায় ছুটতে ছুটতেই বলল, এগিয়ে যান।
এগিয়ে চলল শহীদ। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা বড় কামরা। সেখানে কেউ নেই। ঢুকল শহীদ। অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে চওড়া একটা করিডর দেখল। কয়েকজন লোক এদিক ওদিক যাচ্ছে আসছে।
একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে একটা দরজা দেখিয়ে বলল, ওটা দিয়ে ভিতরে ঢুকুন, পাশাপাশি তিনটে গ্রীনরূন।
তাই করল শহীদ। তিনটের মধ্যে একটার দরজা বন্ধ দেখল ও। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল কবাট দুটো।
ভিতরে আলো জ্বলছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না ও। পরমুহূর্তে দৃষ্টি পড়ল বড় একটা টেবিলের নিচের দিকে। টেবিলের ওপাশে শাড়ি পরিহিতাকে যেন শুয়ে রয়েছে। রিভলভারটা বের করল ও।
ভিতরে ঢুকল শহীদ। দরজা ভিজিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল ও। আর কেউ নেই কামরার ভিতর।
মেয়েটা পড়ে আছে চিৎ হয়ে। ছোরাটা আমূল বিদ্ধ তার বুকের ডান দিকে। এখনও রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু নিঃসাড় হয়ে গেছে দেহ।
সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল ও। পা বাড়ান দরকার দিকে। হঠাৎ চোখ পড়ল দরজার পাশে, দেয়ালের উপর সাদা খড়িমাটি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা চিঠিটা টেবিলের দেরাজে পাবে তুমি।
কুয়াশার হাতের লেখা! তারমানে।
টেবিলের কাছে ফিরে এল শহীদ। দেরাজ খুলল। চিঠিটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করল সে।
মেয়েলি হাতের লেখা। চিঠির শেষে লেখিকার নাম রয়েছে–নীলা ওরফে নার্গিস বেগম।
চিঠিটা প্রথম থেকে পড়তে শুরু করল শহীদ:
সম্মানীয় পুলিস অফিসার,
আদাব নেবেন। আমার নাম নীলা বেগম। ইদানীং আমি নার্গিস বেগম নামে পরিচিত। আজ আমাকে খুন করা হবে, আমি জানি, তাই এই চিঠি লিখে আমার জীবনের একটা পাপের কথা স্বীকার করে যাচ্ছি। যে লোকটা আমাকে খুন করবে তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য আমি গত সাত-আট বছর পালিয়ে বেড়িয়েছি। দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলাম, প্লাস্টিক সার্জারী করে চেহারা বদলে ফিরে এসেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না, বুঝতে পারছি! সে আমার পরিচয় জেনে ফেলেছে।
আমার ছদ্মবেশ ছদ্মনাম তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাকে আমি খানিক আগে দেখেছি। দেখার সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছি কেন সে এসেছে। আমাকে খুন করার জন্যই এসেছে সে। খবরের কাগজে সব খবরই পাই আমি। কোথায়, কি ঘটছে, তার ফলাফল কি হবে, সবই আমার জানা আছে। যাই হোক, লোকটা আর কেউ নয়, সে হলো গুজরাট খান। ওর হাতে আমি খুন হতে চাই না। কিন্তু ওর হাত থেকে বাঁচবারও আমার কোন উপায় নেই। আপনারা, পুলিস কর্তৃপক্ষও আমাকে বিনা শাস্তিতে ছাড়বেন না। তাই, অনেক ভেবেচিন্তে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করব।
চিঠিটা লিখছি শুধু একটি কারণে নয়। নিজের পাপের কথা তো বলবই, তার সাথে বলব আরও অনেক কথা। এ সব ব্যাপার আপনাদের জানা দরকার। আমি ছাড়া এসব কথা আর কেউ আপনাদেরকে বলবে না। কারণ আর কেউ জানে না, আমি যতটুকু জানি। দুএকজন আর যারা জানে তারা বলবে না। তার কারণ, বললে তাদেরই ফাঁসি হবে।
এবার বলি।
আমি ইব্রাহিম খলিলের সঙ্গিনী ছিলাম। শেষ দিকে সে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার সঙ্গী ছিল গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরী। ওদের তিনজনের মধ্যে ক্ষমতাবান ছিল খলিলই। তার কথাতেই সব কাজ হত। খলিল নির্দেশ দিত, খেটে মরত গুজরাট এবং মাহবুব। এ ব্যাপারটা ওরা সহ্য করত শুধু ভয়ে। মনে মনে তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। এই সময় খলিল অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওরা সিদ্ধান্ত নেয় ওকে তারা খুন করবে। কিন্তু খলিল ছিল অসম্ভব চালাক। সে ওদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ফেলে। সেই সময় সি.আই.ডি, ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা সলিল চৌধুরী উঠে পড়ে লেগেছিলেন জুয়ার এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ করার জন্য। খলিল বুদ্ধি খাঁটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাট এবং মাহবুবের সকল অপরাধের সুদীর্ঘ তালিকা, প্রমাণপত্র, অপরাধ ঘটনাকালীন ফটো ইত্যাদি একত্রিত করে সেগুলোর মাইক্রোফিল্ম করে রাখবে। এ ব্যাপারে সে তার ফটোগ্রাফার গাউসকে দায়িত্ব দেয়।
একদিন রাতে এই সব কথা আমাকে বলে খলিল। আমরা খুব হাসাহাসি করি ব্যাপারটা নিয়ে। খলিল আমাকে বলে, মাইক্রোফিল্মসহ একটা চিঠি লিখবে সে সি.আই.ডি. ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল অফিসার। সলিল চৌধুরীকে। চিঠিটা সলিল চৌধুরীর কাছে পাঠাবে না সে সরাসরি, পাঠাবে তার এক অতি ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে। তার যদি কিছু ঘটে তাহলে সেই চিঠি তার বন্ধু পাঠিয়ে দেবে সলিল চৌধুরীর কাছে। বন্ধুকে সেই রকম নির্দেশই সে দিয়ে রাখে। বন্ধুর কাছে চিঠিটা সে পাঠিয়েছিল, এতে কোন ভুল নেই। আমরা যে-রাতে হাসাহাসি করছিলাম সেই রাতেই চিঠিটা পাঠায় খলিল। চিঠি আরও অনেকগুলো লিখেছিল সে, সেগুলো অবশ্য অন্য ধরনের। বিভিন্ন অভিনেত্রীদের কাছে লেখা।
খলিল চেয়েছিল চিঠিটার কথা কিছুদিন পর সে গুজরাট এবং মাহবুবকে জানিয়ে দেবে, যাতে তারা তাকে হত্যার চক্রান্ত করতে সাহস না পায়। কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্য রকম। গাউস মাইক্রোফিল্ম তৈরি করার সময় বেঈমানী করল। অপরাধীদের বড় বড় কর্মকর্তাদের সমকক্ষ হবার সাধ ছিল তার। সুযোগটা সে গ্রহণ করল। সে মাইক্রোফিল্মের ব্যাপারটা গুজরাট এবং মাহবুবকে জানিয়ে দিল।
এই সময়ই আমি স্পটে আসি। মাহবুব একদিন দেখা করে আমার সাথে। প্রথমে প্রস্তাবটা শান্তভাবেই দেয় সে। কিন্তু আমি অস্বীকার করলে সে আমাকে খুন করবে বলে ভয় দেখায়। ভয়েই রাজি হই আমি। খলিলের নাইট্রোগ্লিসারিন ক্যাপসুলের শিশি থেকে ক্যাপসুলগুলো চুরি করে মাহবুবের হাতে তুলে দিই আমি। এটাই আমার পাপ। আমি জানতাম ক্যাপসুলগুলো নিয়ে কি করবে মাহবুব। পরদিন সে সেগুলো ফেরত দেয় আমাকে, আমি শিশিতে রেখে দিই সেগুলো আবার। পরদিনই নাটক দেখে ফেরার সময় গাড়িতে চড়তে গিয়ে হার্ট-অ্যাটাকে মারা যায় খলিল। আসলে, বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েই মারা যায়।
যাই হোক, এই হত্যাকাণ্ডের কথা গাউসও জানত। গুজরাট এবং মাহবুব সাক্ষী রাখার লোক নয়। কিন্তু গাউসকে তারা খুন করতে পারেনি। তার কারণ, তারা জানত গাউসের কাছেও মাইক্রোফিল্মের একটা কপি আছে। মাইক্রোফিন্ম সে তৈরি করেছিল একটা নয়, দুটো।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ইব্রাহিম খলিল মারা যাবার পর সলিল চৌধুরী কোন তৎপরতা দেখাননি। খলিলের বন্ধু চিঠিটা তার কাছে পাঠাননি কেন তা আমি জানি না। বন্ধুটি তখন থাকত করাচীতে। তার নামও আমি জানতাম না। যাই হোক, খলিল মারা যাবার পরই আমি পালিয়ে যাই। জানতাম, গুজরাট আর মাহবুব আমাকে খুন করবেই। সে জন্যেই আমি পালিয়ে যাই।
গত সাত আট বছর হলো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। কিন্তু আর সম্ভব নয়। শেষ রক্ষা হলো না। আমি জানি…। ইতি–অভাগিনী
নীলা বেগম ওরফে নার্গিস বেগম।
চিঠিটা শেষ করে যেতে পারেনি নার্গিস বেগম, তার আগেই খুন হয়েছে সে।
চিঠিটা পড়া শেষ হলো শহীদের, ভেজানো দরজাটাও খুলে গেল সশব্দে। চোখ তুলেই ও দেখল একজন লোক ভেতরে ঢুকছে। শহীদকে দেখে একটু চমকে উঠে পরমুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে, হাতের রিভলভারটা তুলল।
কিন্তু বিদ্যুৎ খেলে গেল শহীদের হাতে। রিভলভার ধরা হাতটা উঠিয়েই গুলি করল সে।
বা বাহুতে গুলিটা খেয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল লোকটা। দুই লাফে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তলপেট লক্ষ্য করে লাথি মারল ও।
দরজার বাইরে গিয়ে পড়ল লোকটা। নিঃসাড় পড়ে রইল। জ্ঞান হারিয়েছে।
ছুটন্ত একটা পদশব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
দুজন এসেছিল ওরা। গুজরাট খানের সঙ্গে দেখেছিল দুজনকেই শহীদ খানিক আগে। গুলির শব্দ পেয়ে ছুটে পালিয়ে গেল একজন।
অজ্ঞান লোকটার রিভলভারটা মেঝে থেকে তুলে পকেটে ভরল শহীদ। দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরুন। কেউ নেই।
রিভলভার বাগিয়ে ধরে দৃঢ় পায়ে হাঁটতে শুরু করল শহীদ। তুমুল বর্ষণের শব্দ ভেসে আসছে।
বৃষ্টির রাতেই শুরু হয়েছিল এই রহস্যের, বৃষ্টির রাতেই এর সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
একজন লোককেও কোথাও দেখল না শহীদ। হলরুমে পা দিয়ে দেখল, জনশূন্য। রিসেপশনেও কেউ নেই। ভেজানো দরজা উন্মুক্ত করে অন্ধকার করিডরে পা রাখল ও, কানে এল, এই লোক, স্যার?
গুজরাট খান অন্ধকার থেকে বলল, হ্যাঁ।
চোখের পলকে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা। মাত্র পাঁচ গজ দূর থেকে একটা টর্চ জ্বলে উঠল।
টর্চের আলো পড়ল শহীদের সামনে, মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়ানো একটা লোকের উপর। লোকটা গুজরাট খানের দ্বিতীয় দেহরক্ষী, চিনতে পারল শহীদ। শহীদের দিকে রিভলভার তুলে গুলি করতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু আচমকা চোখ ধাধনো টর্চের আলো মুখে পড়ায় সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেল সে। এই সুযোগটা নিল। শহীদ। গর্জে উঠল ওর হাতের রিভলভার।
ফুটো হয়ে গেল তিন হাত দুরের শত্রুর কপাল।
প্রায় একই সাথে গর্জে উঠল টর্চধারীর হাতের রিভলভার।
আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল চারদিকের পরিবেশ। টর্চধারী কথা বলে উঠল, আমি চনলাম!
অন্ধকার চোখে সয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। শহীদ দেখল কালো আলখেল্লা পরা একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি করিডর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
পাথরের মত নিঃসাড় দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল শহীদ। হঠাৎ হইসেলের শব্দে সংবিৎ ফিরল ওর। করিডরের অপর প্রান্তে কয়েকটা টর্চ জ্বলে উঠল।
শহীদ! কামালের গলা।
শহীদ মি. সিম্পসনের গলা।
ওকে ঘিরে দাঁড়াল সবাই। করিডরের আলো জ্বালা হলো। শহীদ পকেট থেকে নার্গিস বেগমের চিঠিটা মি. সিম্পসনকে দিয়ে বলল, এটা পড়লেই সব রহস্যের সমাধান পাবেন মি. সিম্পসন।
তাই নাকি! কার লেখা?
পড়ে দেখুন। গ্রীনরূমে ওর লাশ আছে। খুন হয়েছে।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, কেনটার তদন্ত কি শেষ হয়ে গেল, শহীদ?
শহীদ বলল, হ্যাঁ:…না, মি. সিম্পসন। সব রহস্যের সমাধান হলেও, একটি রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। আমি যাচ্ছি, দেখি চেষ্টা করে।
কামাল বলল, দাঁড়া, আমিও যাব তোর সাথে।
শহীদ বলল, না। আমি একা যাব। আমি এখনও ঠিক জানি না। কোথায় যেন খুত রয়েছে, কামাল। কোথায় যেন মিলছে না। আমাকে একা ভাবতে হবে খানিক…।
দাঁড়িয়ে রইল ওরা। চলে গেল শহীদ। একটু পরই গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ পাওয়া গেল।
.
ঢাকায় পৌঁছে একটা ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি থামাল শহীদ। ফোন করা করুণার বাড়িতে। ডি. কস্টার ওখানেই থাকার কথা।
কিন্তু কেউ ধরল না ফোন। ডি. কস্টার বাড়ির ফোন নাম্বারটা মনে করতে পারল না ও। সিদ্ধান্ত নিল, বাড়িতে সরাসরি যাবে।
গাড়ি থামিয়ে গেট পেরোবার সময় বাচ্চা চঞ্চলের কান্নার শব্দ পেল শহীদ। বারান্দায় উঠে বন্ধ দরজায় নক করল ও। বাচ্চা এক নাগাড়ে কাঁদছে, কেউ থামাচ্ছে না তাকে।
দরজা খুলে গেল। রিভলভারের নলটা দেখে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না ওর মুখের চেহারায়।
করুণা চাপা কণ্ঠে বলল, মাথার উপর হাত তুলে ভিতরে ঢুকুন! চালাকি করবার চেষ্টা করলেই গুলি করব।
পা বাড়াল শহীদ। ভিতরে ঢুকল। বৃদ্ধা নার্স মিসেস গোমেজ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে মেঝেতে। মাথার বড় একটা ক্ষত থেকে রক্ত বের হচ্ছে তখনও। ডি. কস্টা বসে আছে একটি চেয়ারে। হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। মুখে তুলো গোঁজা, কথা বলার বা চিৎকার করার কোন উপায় নেই।
দরজাটা বন্ধ করে দিল করুণা শহীদের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই।
শহীদ বলল, চমৎকার অভিনয়। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হয়, কোথায় যেন একটা গোলমাল কাণ্ড ঘটছে। জব্বার যে রাতে খুন হয় সে রাতে ডি. কস্টাকে মরিসের ড্রাইভার ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি। অর্থাৎ ডি. কন্টার পরিচয় খুনীরা তখন জানতে পারেনি। অথচ পরের রাতেই ডি. কস্টার বাড়িতে কেউ ঢোকে, কামরাগুলো সার্চ করে। কারণ কি? কারণ, ডি. কস্টাই তোমাকে বলেছিল জব্বারের লাশের কাছে সবার আগে সেই গিয়েছিল। গাউসের কামরাগুলোও তুমি সার্চ করো। কিন্তু মাইক্রোফিল্মটা কোথাও পাওনি তুমি। পাবার কথাও নয়। জিনিসটা আসলে লুকানো ছিল না কোন সময়ই। জব্বার সেটা এমন এক জায়গায় রেখে গিয়েছে যে চোখের সামনেই রয়েছে সেটা সকলের অথচ কেউ সেটাকে দেখতে পাচ্ছে না।
করুণার চোখে খুনের নেশা। কিন্তু তার হাত এতটুকু কাঁপছে না। রিভলভারটা শহীদের বুকের দিকে ধরে রেখেছে সে। যদিও ঘামছে সে দরদর করে।.
চঞ্চলের কান্না থেমে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে মেঝের উপর খেলছে সে।
অথচ আমি বোকার মত সারাক্ষণ ভেবেছি জব্বার ভুল করে তোমার ফ্ল্যাটে ডাকাতি করেছিল। আসলে জব্বার ভুল করেনি। প্রথম থেকেই শুরু করা যাক, কি বলো? কোথাও কোথাও আমার ভুলও হতে পারে, হলে ধরে নিয়ো।
দরকার নেই! পিছন ফিরে দাঁড়ান! সাবধান! গোলমাল করলে মরবেন বলে দিচ্ছি।
এগিয়ে এল করুণা। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে গোলমাল করার ইচ্ছা ত্যাগ করল শহীদ। ঘুরে দাঁড়াল সে। করুণা তার পেছনে, শিরদাঁড়ার উপর রিভলভারের নল ঠেকাল, তারপর একটা হাত ঢুকিয়ে দিল ওর পকেটে।
রিভলভারটা বের করে নিল সে। পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা তেপয়ের কাছে। শহীদের রিভলভারটা রাখল তেপয়ের উপর। তার পাশেই বসল সে।
ইব্রাহিম খলিল তোমার ভক্ত ছিল। নিয়মিত প্রেম-পত্র লিখত সে তোমাকে, তাই না?
করুণা ঢোক গিলল। জবাব দিল না।
ইব্রাহিম খলিল শেষ যে প্রেম-পত্রটা তোমাকে লেখে সেটা কিন্তু তুমি পাওনি। না পাবার কারণ জানো? এনভেলাপের উপর সে ঠিকানা লিখতে ভুল করেছিল তাই তোমাকে লেখা প্রেম-পত্রটা এই ভুলের জন্য চলে যায় করাচীতে, তার এক বন্ধুর কাছে। আর সেই বন্ধুর উদ্দেশে লেখা চিঠিটা চলে আসে তোমার কাছে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে এই-ই ঘটেছিল ব্যাপারটা। তুমি যে চিঠিটা পাও তাতে ছিল গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরীর কুকর্মের ফিরিস্তি, প্রমাণ ইত্যাদি সহ। ঠিক।
করুণা আবার ঢোক গিলল। জবাব দেয়ার চেষ্টাই করল না।
ডি. কস্টা চেয়ে আছে শহীদের দিকে। বেচারার কথা বলার কোন উপায় নেই। মিসেস গোমেজের মাথার ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
চঞ্চল খেলছে আপন মনে।
রাত বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। কোথাও কোন শব্দ নেই।।
শহীদ বলতে শুরু করল আবার, চিঠিটা অর্থাৎ মাইক্রোফিল্মটা তুমি পাও ঠিক, কিন্তু ব্যাপারটা জেনে ফেলে তোমার তখনকার সেক্রেটারি। সে তোমাকে বলে, জিনিসটা সলিল চৌধুরীর হাতে তুলে দিতে। কিন্তু তাতে তুমি রাজি হওনি। কারণ গুজরাট খান এবং মাহবুব চৌধুরী ধনী লোক, তুমি জানতে। ওদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগটা হাতছাড়া করার কথা ভাবতেই পারলে না তুমি। তাই, সেক্রেটারির মুখ বন্ধ করার জন্য, তাকে তুমি গাড়িসহ খাদে ফেলে দিলে। সবাই জানল প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে ব্যর্থতার দরুন আত্মহত্যা করেছে সে। তুমিই কথাটা সবাইকে জানালে। মি. ডি. কস্টাকেও বলেছ তুমি এই কথা। ওর কাছ থেকেই সব কথা জেনেছি আমি।
করুণা উঠে দাঁড়াল।
শহীদ বলল, বসো, বসো। এখনও সব কথা বলা হয়নি আমার। ব্যস্ততার কি আছে, আমাদের সবাইকে তুমি খুন করার প্রচুর সময় পাবে।
নার্ভাস হয়ে পড়েছে করুণা। শহীদের কথায় সে বসে পড়ল আবার। কিন্তু হাতের রিভলভারটা শহীদের দিক থেকে সরাল না এতটুকু।
গত সাত বছর এই, ভয়ঙ্কর খেলা খেলছ তুমি। গুজরাট এবং মাহবুব উপায় নেই দেখে প্রতি মাসে মোটা টাকা দিচ্ছিল তোমাকে এই কবছর। এভাবেই চলছিল। কিন্তু তুমি হঠাৎ লোভী হয়ে উঠলে। দাবি করলে আরও বেশি টাকা। এবার খেপে গেল ওরা। সিদ্ধান্ত নিল মাইক্রোফিল্মটা তোমার কাছ থেকে চুরি করার। এ কাজের দায়িত্ব দিল তারা গাউসের উপর। গাউস অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মুঠোয় আনল জব্বারকে। জব্বার সফলতার সাথেই কাজটা করল। কিন্তু। মাইক্রোফিল্মটা সে গাউসের হাতে তুলে দিল। সে চেয়েছিল জিনিসটা পুলিসের হাতে পড়ুক, কেবল তাহলেই গুজরাট এবং মাহবুব উচিত শাস্তি পাবে। তাই সে মাইক্রোফিল্মটা নিয়ে পালিয়ে গেল। চঞ্চলকে রেখে গেল সে রেস্তোরাঁয়, মাইক্রোফিল্মটাও রইল চঞ্চলের পাশে। অর্থাৎ, খেলনা পুতুলের ভিতর। কিন্তু কেউ তা জানল না।
করুণা আবার উঠে দাঁড়াল। সাহস ফিরে পেয়েছে যেন সে। হাসল একটু ঠোঁট বাঁকা করে, যথেষ্ট হয়েছে। আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি, সত্যিকার বিপদে জড়িয়ে পড়েছি আমি। এখন একটি পথই খোলা আছে আমার। আপনাদের সবাইকে খুন করে এখান থেকে পালিয়ে যাব আমি। মাইক্রোফিল্মটা পুতুলের ভিতর আছে বলছেন? আশ্চর্য, একবারও সন্দেহ হয়নি। যাক, ওটা নিয়ে যাব আমি।
শহীদ বলল, লাভ কি? মাহবুব নেই, গুজরাটও নেই।
গুজরাট খান নেই?
শহীদ হাসল, দুঃখ হচ্ছে বুঝি? মাসিক আয়টা বন্ধ হয়ে গেল, না?
করুণা বলল, বুঝতে পারছি, সময় নষ্ট করছি আমি। আর নয়।
রিভলভার তুলল করুণা।
শহীদ সময় নিতে চাইছে। বলল, এক মিনিট। আচ্ছা, ডি. কস্টাকে কি সত্যি তুমি ভালবাসনি?
করুণার পিছন দিকে তাকাল শহীদ মুহূর্তের জন্য। চঞ্চলের যা অভ্যাস, রিভলভারটা তেপয়ের উপর দেখে হাত বাড়িয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করছে সে।
ওই তালপাতার সেপাইকে আমি ভালবাসতে যাব কোন্ দুঃখে!
শহীদ বলল, চমৎকার! সবটাই তাহলে অভিনয়!
করুণা বলল, হ্যাঁ। অভিনয়। শেষ অভিনয়টাও সফল হবে আমার, আমি জানি। চোখ বুজুন, শহীদ সাহেব, এবার আমি গুলি করব।
শহীদ বলল, এক মিনিট!
কিন্তু করুণা আর সময় দিল না। ট্রিগারে চেপে বলল তার আঙুল।
কিন্তু একি! গুলি বের হলো না রিভলভার থেকে।
ঝট্ করে তাকাল করুণা ডি. কস্টার দিকে। রিভলভারটা কেড়ে নিয়ে .. সে ডি. কস্টার কাছ থেকে, কিন্তু গুলি নেই তা সে জানত না।
জানত না ডি. কাও।
শহীদ দেখল, অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে ডি. কস্টা করুণার হাতের রিভলভারটার দিকে।
পা বাড়াল শহীদ।
চঞ্চলের হাতের আঙুল চেপে বসেছে তেপয়ের উপর রাখা শহীদের রিভলভারটার ট্রিগারে।
ঠাস! বিকট শব্দ উঠল।
পিঠের মাঝখানে, শিরদাঁড়ায় গুলি খেয়ে পড়ে গেল করুণা। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে।
একেই বলে নিয়তির প্রতিশোধ।
কান্না জুড়ে দিয়েছে চঞ্চল তারস্বরে। বিকট শব্দে ভয় পেয়েছে সে।
লাফ দিয়ে করুণার দেহ টপকে তেপয়ের উপর থেকে রিভলভারটা তুলে নিল শহীদ। মুখ তুলে তাকাতেই জানালার বাইরে হাস্যরত একটি মুখ দেখতে পেল ও। বলল, বুঝলাম না, কুয়াশা। মি. ডি. কস্টার রিভলভারের গুলি গেল কোথায়?
কুয়াশা জানালার বাইরে থেকে বলল, বের করে নিয়েছিলাম, ফ্রেণ্ডস নাইট ক্লাবে চিরকুট যে দেয়…।
একজন ওয়েটার?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। আমি।
ওয়েটারের ছদ্মবেশে তুমিই তাহলে…
হ্যাঁ, চিরকুটটা দেবার সময় রিভলভারটা পকেট থেকে বের করে নিয়েছি, খানিক পর মি. ডি. কস্টা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, রিসেপশনে ওর মুখোমুখি হই আমি। সেই সময় রিভলভারটা ঢুকিয়ে দিই পকেটে। বুলেট সরিয়ে নেবার কারণ, মি. ডি. কস্টা নার্ভাস অবস্থায় এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়েন।
ডি. কস্টা উত্তর দিতে চায়, প্রতিবাদ জানাতে চায় কিন্তু তার মুখ বন্ধ।
শহীদ বলল, ধন্যবাদ, কুয়াশা, কাজটা করেছিলে বলেই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। কুয়াশা, মাহবুব খানের আস্তানায় গাড়ির চাকার দাগ ছিল। গাড়িটা দুবার গিয়েছিল বাড়িটায়। চাকার দাগ দেখেছেন মি. সিম্পসন নিজে। কিন্তু মি, ডি কস্টা বললেন, চাকার দাগ দুজোড়া নয়, একজোড়া আছে
কুয়াশা বলল, আমি ডি. কস্টাকে পাঠিয়েছিলাম দাগগুলো নষ্ট করে দেবার জন্যে। মি. সিম্পসন যাতে তোমাকে সন্দেহ করতে না পারেন। শহীদ, তুমিও দেখছি কুয়াশা হয়ে উঠলে? প্রতিশোধ নেবার জন্যে খুন করছ মানুষকে!
Leave a Reply