কুয়াশা ৫৯ – অপরাধী ১ – ভলিউম ২০
কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৭৬
০১.
বৃষ্টি। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর গেট, দরজা, জানালা–সব বন্ধ। কোন রাস্তায় আলো আছে এখনও, কোন রাস্তা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ যেন মনে হয়, এ এক ভূতুড়ে শহর। মাঝে মধ্যে অকস্মাৎ উজ্জ্বল আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে, চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে বড় বড় হেডলাইটের আলো, রাস্তার দুপাশে কর্দমাক্ত পানি ছিটিয়ে দিয়ে সগর্জনে ছুটে যাচ্ছে ভারি একটা ট্রাক বা কোন প্রাইভেট কার। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে। পরমুহূর্তে জমাট বাঁধছে অন্ধকার, শোনা যাচ্ছে ঝমঝম বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দ। একটা বেড়াল ছুটে রাস্তা পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ডানে-বায়ে তাকিয়ে করুণ সুরে ডেকে ওঠে–মিউ। কাছেই একটি বারান্দা থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে একটা কুকুরের টানা কান্নার আওয়াজ।
দুর্যোগ কবলিত রাত। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। বাড়ছে রাতের গভীরতা।
ঝম ঝমে বৃষ্টি মাথায় করে লাইটপোস্টের নিচে এসে দাঁড়াল একটি ছায়ামূর্তি। লোকটা খুবই রোগা পাতলা, বোঝা যায়, হাত-পাগুলো পাটখড়ির মত। গায়ের রঙ আলকাতরার মত কালো। ধূসর রঙের একটা রেনকোট দিয়ে তার সর্বশরীর মোড়া। মাথায় উঁচু একটা হাট।হ্যাটের কার্নিসটা বেশ চওড়া বলে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। হাত দুটো রেনকোটের পকেটে ঢোকানো।
লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে নির্জন রাস্তার দুইদিক দেখে নিল ছায়ামূর্তি। গাম বুটে মোড়া পা দুটো সচল হলো।
লাইটপোস্টের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গেছে ছায়ামূর্তি, এমন সময় অন্ধকার থেকে দ্বিতীয় একটি ছায়ামূর্তি, লাইটপোস্টের নিচে এসে দাঁড়াল।
দ্বিতীয় ছায়ামূর্তির পরনেও রেনকোট। এর স্বাস্থ্যটা ভাল, তবে প্রথম ছায়ামূর্তির মত লম্বা নয়। এরও হাত দুটো রেনকোটের দুই পকেটে ঢোকানো।
প্রথম ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করছে দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি।
ঢং ঢং, টং-ঢং ঢং…
গির্জা থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টাধ্বনি।
রাত এগারোটা বাজল।
প্রথম ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলেছে। তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে তা সে বুঝতে পেরেছে কিনা বলা মুশকিল।
বাঁক নিল প্রথম ছায়ামূর্তি। এদিকের রাস্তাটা আরও চওড়া। রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকানের বন্ধ কোলাপসিবল গেট। দুএকটা সাইনবোর্ডের মাথায় জ্বলছে নিওন সাইন। রাস্তার এ মাথা থেকে সে মাথা আবছাভাবে আলোকিত।
প্রথম ছায়ামূর্তি রাস্তা অতিক্রম করছে। রাস্তার ওপারে ছোট্ট একটা গেট দেখা যাচ্ছে। গেটটা খোলা। গেটের ভিতর, গজ দুয়েক দূরে, কাঁচের ভেজানো দরজা দেখা যাচ্ছে। কাঁচ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে উজ্জ্বল আলো।
খোলা গেটের মাথায় বড় বড় লাল রঙের নিওন সাইনের অক্ষর দিয়ে লেখা:
নাইটস হেভেন।
বার অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্ট
গেটের কাছে পৌঁছে গেছে ছায়ামূর্তি। নাইট ক্লাবের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ইংরেজী বাজনার শব্দ।
দাঁড়িয়ে পড়ল ছায়ামূর্তি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল,সে ডান দিকের ফুটপাথে।
ফুটপাথের উপর কুঁকড়ে শুয়ে রয়েছে একটি লোক। বৃষ্টিতে অবিরাম ভিজছে সে। গলা থেকে দুর্বোধ্য এক ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসছে। ঠকঠক করে কাঁপছে গোটা দেহ। লোকটা খানিকটা সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসলে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু নড়াচড়ার শক্তি নেই তার।
অসহায় লোকটা এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নির্ঘাত মারা যাবে।
লোকটার দুটো পা-ই হাঁটু অবধি কাটা। সম্ভবত কোন দুর্ঘটনায় হারিয়েছে সে তার পা দুটো। কাজ করার ক্ষমতা নেই, হয়তো ভিক্ষা করে খায়।
নাইটস্ হেভেনে ঢুকে মদ্য পান করার ইচ্ছাটা পরিত্যাগ করল ছায়ামূর্তি। পঙ্গু লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দুই হাত দিয়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল দেয়ালের কাছে।
ছায়ামূর্তি শুইয়ে দিল লোকটাকে। তার গায়ের ছেঁড়া ভেজা জামাটা খুলে ফেলে রাখল এক পাশে। তারপর লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল।
দুর্বোধ্য স্বরে কি বলল পঙ্গু লোকটা বোঝা গেল না। লোকটা শুধু পঙ্গুই নয় বোবাও।
ছায়ামূর্তি রেনকোটের বোতাম খুলে শার্টের পকেট থেকে একটা ছাপা কার্ড এবং দশ টাকার দুটো নোট বের করল। বোবা এবং পঙ্গু লোকটার ডান হাতে কার্ড এবং দশ টাকার নোট দুটো গুঁজে দিল সে। তারপর এক-পা দু-পা করে পিছিয়ে এল খানিকটা। ঘুরে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল ফুটপাথ ধরে সোজা।
নাইটস হেডেনের পাশ দিয়ে হেঁটে বহুদূরে চলে গেছে প্রথম ছায়ামূর্তি, এমন সময় সেই উঁচু বারান্দার কাছে এসে দাঁড়াল দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি।
গুরু গুরু ডাকছে মাথার উপর মেঘ। হঠাৎ ঝলসে উঠল গোটা আকাশ। বিদ্যুৎ চমকাল। কসেকেণ্ড পূর শোনা গেল বিকট আওয়াজ–কড়কড়-কড়াৎ।
বজ্রপাত হলো কোথাও। বৃষ্টির বেগ সেই সাথে বাড়ল আরও।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটেই চলেছে প্রথম ছায়ামূর্তি। চলার গতি এখন অনেকটা ধীর। মিনিট দশেক হাঁটার পর প্রশস্ত রাস্তাটা অতিক্রম করে একটা রেস্তোরাঁর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।
সুইং ডোরের ভিতর থেকে রেকর্ড-প্লেয়ারের গান, লোকজনের গলা ভেসে আসছে।
সুইং ডোর ঠেলে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতেই কয়েকজন লোক একযোগে বলে উঠল, যাহ! সব ভিজে গেল!
ছায়ামূর্তি দরজার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে দেখে নিল রেস্তোরাঁর ভিতরটা।
মাঝারি আকারের রেস্তোরাঁ। অসংখ্য টেবিল বিছানো। পঞ্চাশ-পঞ্চান্নটা চেয়ার। অধিকাংশই খালি। পনেরো-বিশ জন লোক বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ কেউ রাতের খাবার খেতে এসে আটকা পড়ে গেছে, কেউ বা বৃষ্টির কবল থেকে রেহাই পাবার আশায় আশ্রয় নিয়েছে, বৃষ্টি ছাড়লে বা কমলে চলে যাবে।
গামবুটে মোড়া পা দুটো সচল হলো। এক ধারে দুটো কেবিন দেখা যাচ্ছে। কেবিনের সামনের পর্দাগুলো সরানো। ভিতরে কেউ নেই। রেনকোট পরিহিত দীর্ঘদেহী আগন্তুক কেবিন দুটোর কাছাকাছি একটা খালি টেবিল দখল করে বসল। রেস্তোরাঁর ছোকরা বয়টা তার দিকে অলস ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে দেখে সংক্ষেপে সে শুধু বলল, চা।
চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল চা-পানরত লোকজনদেরকে। কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই। মুখোমুখি বসে গল্প করছে সরাই।
পরিবেশটা বেশ সরগরমই বলা চলে। যে যার কথা বলতে অসম্ভব ব্যথ। তার উপর রেকর্ড-প্লেয়ারে বেজে চলেছে সায়গলের গান: হাম জিকৈ ক্যয়া কারেঙ্গে, যব দিল হি টুট গ্যায়া…।
চা দিয়ে গেল বয়। আগন্তুক কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল। বিড় বিড় করে কি যেন বলল সে। কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর, হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল একটু, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
সুইং-ডোর ঠেলে কেউ ভিতরে ঢুকল, শব্দ হলো।
চোখ মেলল আগন্তুক।
একজন লোক ভিতরে ঢুকেছে এইমাত্র।
লোকটার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে একটা গরম কাপড়ের মোটা চাদর জড়ানো। লোকটার হাত দুটো বুকের কাছে, চাদরের ভিতর ঢোকানো রয়েছে, বড়সড় কিছু একটা ধরে রেখেছে যেন সে।
রেস্তোরাঁয় এতগুলো লোক, কিন্তু একজন ছাড়া কেউ তার দিকে খেয়াল করল না। রেনকোট এবং হ্যাট পরিহিত আগন্তুকই শুধু চেয়ে আছে লোকটার দিকে।
হঠাৎ আগন্তুকের দুচোখে ফুটে উঠল বিস্ময়। নবাগত লোকটার দুই চোখ ভরা জল, কাঁদছে সে।
রেস্তোরাঁর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে লোকটা ইতস্তত করছে। যেন কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না। তারপর, এগোল সে একটা কেবিনের দিকে। কেবিনে ঢুকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রেস্তোরাঁর দরজাটার দিকে।
লোকটা কেবিনের মেঝেতে দাঁড়িয়েই রইল। চাদরের ভিতর থেকে তোয়ালে দিয়ে জড়ানো বড়সড় কিছু একটা বের করে টেবিলের উপর রাখল সে। তার পাশে মাঝারি আকারের একটা পুতুল রাখল।
চা দেব, স্যার? কেবিনের দরজার কাছ থেকে জানতে চাইল বয়।
দাও, বলল লোকটা।
বয় ফিরে গেল।
রেনকোট পরা আগন্তুক সারাক্ষণ চেয়ে আছে লোকটার দিকে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকছে তার কাছে। প্রাপ্তবয়স্ক লোককে সাধারণত কেউ কাঁদতে দেখে না। কিন্তু এ লোকটা কাঁদছে।
তোয়ালে দিয়ে জড়ানো বড়সড় জিনিসটা দেখে আগন্তুক আরও অবাক হলো। বছর দুই আড়াইয়ের একটা শিশু ঘুমুচ্ছে। ফর্সা গালটা তার ভিজেভিজে।
লোকটা পরম আদরে শিশুটার গাল মুছে দিল চাদরের শুকনো প্রান্ত দিয়ে। ঝুঁকে পড়ে এগোল সে। গালে চুমু খেলো। দুই চোখ থেকে গাল বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু পড়ল শিশুর কপালে। পরম যত্নে শিশুর কপালটা মুছে দিয়ে লোকটা সিধে হয়ে দাঁড়াল। কেবিন থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল সে।
তোয়ালে দিয়ে জড়ানো শিশুটা এবং পুতুলটা কেবিনের ভিতর টেবিলের উপর রেখে লোকটা যেন পালাচ্ছে।
কেউ কিছু বলার আগে, বোঝার আগে লোকটা বেরিয়ে গেল রেস্তোরাঁ ছেড়ে।
রেনকোট পরা আগন্তুক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এই দুর্যোগ কবলিত রাতে একটা লোক কাঁদতে কাঁদতে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল, একটা বাচ্চাকে রেখে আবার বেরিয়ে গেল পালাবার ভঙ্গিতে–এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ না জানলেও রেনকোট পরা আগন্তুকের মনে ঘটনাটা কৌতূহলের সৃষ্টি করল।
দেখা দরকার লোকটা কোথায় যায়, কি করে। টেবিল থেকে হ্যাটটা তুলে মাথায় পরতে পরতে আগন্তুক দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খুলে বাইরে এল সে।
আগন্তুক দেখল লোকটা ফুটপাথ ধরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করেছে ডান দিকে। ইতিমধ্যেই অনেক দূরে চলে গেছে সে। প্রায় একই সময়ে একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ পেল। ঝট করে তাকাল সে বাঁ দিকে।
কালো একটা মরিস অক্সফোর্ড।
আগন্তুকের সামনে দিয়ে রাস্তা ধরে মরিসটা ছুটে যাচ্ছে। দশ সেকেণ্ড ছুটল সেটা, তারপর ব্রেক কষে দাঁড়লি, ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে পরমুহূর্তে শোনা গেল রিভলভারের আওয়াজ-ঠাস! ঠাস!
লোকটা ফুটপাথ ধরে ছুটছিল, পিঠের উপরিভাগে বুলেট দুটো বিদ্ধ হলো, ছিটকে পড়ে গেল সে পাঁচ হাত দূরে।
কালো মরিসের ব্যাকডোর খুলে প্রায় তীর বেগে বেরিয়ে এল একটা লোক। ফুটপাথের গুলিবিদ্ধ লোকটার দিকে ছুটছে সে।
রেস্তোরাঁর সামনে থেকে রেনকোট পরা পাটখড়ির মত রোগা আগন্তুক ঘটনাটা দেখছিল। বিস্ময়ের ধাক্কা এতক্ষণে কাটিয়ে উঠেছে সে। দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়েই বের করে আনল লোডেড রিভলভার। লক্ষ্যস্থির করল সময় নিয়ে।
মরিসের আরোহী প্রায় পৌঁছে গেছে ফুটপাথের কাছে।
রেনকোট পরা আগন্তুক গুলি করল।
ছুটন্ত লোকটার পায়ে কেউ যেন ল্যাং মারল। আর্তচিৎকার করে ছিটকে পড়ে গেল সে। পায়ে গুলি লেগেছে তার। মরিস চলতে শুরু করল এই সময়।
রেনকোট পরা আগন্তুক গুলি করতে শুরু করল মরিসের দিকে–ঠাস! ঠাস! ঠাস!
স্পীড বাড়ছে মরিসের।
ঠাস!
আগন্তক গুলি করল আবার। কিন্তু দূরত্ব কমল না, গুলি গাড়ির চাকায় লাগছে না।
মরিসের স্পীড বাড়ছেই। পায়ে গুলি খাওয়া লোকটার দিকে এগোচ্ছে সবেগে।
শেষবার গুলি করল আগন্তুক-ঠাস।
গাড়িটা থামল না। ড্রাইভার তার আহত সঙ্গীর দিকে চালাচ্ছে গাড়ি।
আহত লোকটা সরে যাবার চেষ্টা করছে হামাগুড়ি দিয়ে। সামনেই একটা লাইটপোস্ট। সেটা এক হাত দিয়ে ধরল লোকটা। হাঁপাচ্ছে সে হাপরের মত। ঠিক সেই মুহূর্তে মরিস অক্সফোর্ড সবেগে ছুটে এসে ধাক্কা মারল। লাইটপোস্টের সাথে চ্যাপ্টা হয়ে গেল দেহটা। ধাক্কা লাগায় লাইটপোস্টের সাথে সংযুক্ত তারগুলো দুলছে। পিছু হটল মরিস, তারপর দিক পরিবর্তন করে ছুটল।
তীরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটা রাস্তার বাকে।
আগন্তুক বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। তারই চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটে গেল, কিন্তু তবু যেন সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। সংবিৎ ফিরে পেয়েই ছুটল সে।
পিঠে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আগন্তুক। হাঁটু মুড়ে বসল পাশে। এতটুকু নড়ছে না দেহটা। তাজা রক্ত ধুয়ে মুছে যাচ্ছে বৃষ্টির সাথে। পালস দেখল আগন্তুক। নেই।
নিহত লোকটার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আগন্তুক। অদূরের লাইটপোস্টের দিকে তাকাল একবার, দীর্ঘশ্বাস ফেলল সশব্দে, তারপর লোকটার দিকে ফিরে তাকিয়ে ঝুঁকে পড়ে একটু নিচু স্বরে বলল, হট্যাকাণ্ড….টার মানে নটুন ঝামেলা!
চমকে উঠল বিদ্যুৎ। কড়-কড়কড়াৎ-কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত ঘটল। সেই সাথে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ।
রেনকোট পরা আগন্তুক অর্থাৎ মিস্টার স্যানন ডি. কস্টা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল। ফোন করে জানাতে হবে ঘটনাটার কথা পুলিসকে, এবং গোয়েন্দা গুরু শহীদ খানকে।
.
০২.
অপ্রত্যাশিভাবে থেমে গেছে বৃষ্টি। তুমুল বাতাস বইতে শুরু করেছে।
মিনিট সাতেক পর রাস্তার বাঁকে দুটো গাড়ি দেখা গেল। একটি জীপ, অপরটি ভ্যান। জীপটা থামার আগেই রেনকোট পরা একজন ইন্সপেক্টর লাফ দিয়ে নামল নিচে। হাতে একটা রিভলভার। ডি. কস্টার দিকে সেটা উঁচিয়ে ধরে দৃঢ় পায়ে। এগিয়ে এল সে, কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কে আপনি?
ডি. কস্টা আঙুল দিয়ে ফুটপাথে শায়িত লাশটা দেখাল, বলল, আই উইটনেস।
দুজন কনেস্টবল এগিয়ে এল, দুপাশে দাঁড়াল ডি. কস্টার। তাদের একজন ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে ডি. কস্টার রেনকোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। রিভলভারটা বের করে এগিয়ে দিল ইন্সপেক্টরের দিকে।
রেনকোটের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখল ডি. কস্টা, বলল, শার্টের বুক পকেটে হাট ডিন।
কনেস্টবলটা ডি. কস্টার বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করল। মানিব্যাগ খুলতে দেখা গেল একটা ছাপানো কার্ড রয়েছে ভিতরে। ইন্সপেক্টর কনেস্টবলের কাছ থেকে কার্ডটা নিয়ে জীপের হেড লাইটের আলোয় ভাল করে দেখল সেটা। মুখ তুলে তাকাল। কুঁচকে উঠল ভুরু জোড়া। বলল, মি, সানন ডি. কস্টা। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। হু। আপনিই তাহলে ফোন করেছিলেন? ঘটনাটা কি?
আঙুল দিয়ে অদূরবর্তী রেস্তোরাঁটা দেখিয়ে ডি. কস্টা বলল, কয়েক মিনিট আগে নিহট লোকটা ওই রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়াছিল। টাহাকে ভীটো ডেকাইটেছিল। টাহাকে হামি কাঁডিটেও ডেকিয়াছি। লোকটার গায়ে একটি চাডর ছিল। চাডরের ভিটর ছিল একটি ডুই-আড়াই বছরের বাচ্চা। লোকটা টাহাকে টেবিলে রাখিয়া বাহির হইয়া আসে। আমি কৌতূহলের বশবর্টি হইয়া টাহার পিছু পিছু বাহির হই, ডেকি।
খানিক আগে তো তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আপনি শুধু কৌতূহলের বশে বাইরে বেরিয়ে এলেন?
ইয়েস। অফকোর্স। হামি একজন কৌটুহলী মানুষ, ইন্সপেক্টর।
ঠিক আছে। বলে যান।
বাহিরে বাহির হইয়া ডেকি একটি কালো মরিস স্টার্ট নিয়া ছুটিটে শুরু করিয়াছে। মরিস খানিক ডুর গিয়া ঠামে, ভিটর হইটে একজন ফায়ার করে। পর পর ডুইবার বুলেট বিডঢ় হয় লোকটার পিঠে, সে পড়িয়া যায়। মরিসের ভিটর হইটে একজন লোক নামিয়া লাশটার ডিকে ডৌড়াইটে শুরু করে, মি টখন ফায়ার করি। বুলেট টাহার পায়ে লাগে, সে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া যায়। মরিস আবার চলিটে শুরু করে, অ্যাণ্ড আহট লোকটাকে ধাক্কা ডেয়। মরিসের ড্রাইভার ইচ্ছা করিয়া টাহার সঙ্গীর উপর ডিয়া গাড়ি চালাইয়া ডেয়। গাড়িটার সহিট লাইটপোস্টের সংঘর্ষ হয়, লোকটা মাঝখানে পড়িয়া চ্যাপ্টা হইয়া যায়।
হু। কিন্তু গুলি আপনি করেছেন এবং কথাটা স্বীকারও করেছেন, তাই না? ওহে, হাতকড়া লাগিয়ে একে ভ্যানে তেলো…। ইন্সপেক্টর নির্দেশ দিল কনেষ্টবলদের।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ওয়েট এ মিনিট।
সবাই তাকাল ঘাড় বাঁকা করে। মি. সিম্পসন কাছে এসে দাঁড়ালেন। জীপ থেকে নেমে সরকারী ডাক্তারের সাথে রাস্তার উপর শায়িত দ্বিতীয় লাশটা দেখছিলেন তিনি এতক্ষণ।
ডি. কস্টার আপাদমস্তক দেখে নিলেন মি. সিম্পসন। মুখের গভীর, থমথমে চেহারা এতটুকু বদলাল না, বরং আরও যেন ভারি হয়ে উঠল, যা যা ঘটেছে সব শুনতে চাই আমি, ডি. কস্টা। কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কুয়াশা কোথায়?
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কি যেন বলতে গেল ডি. কস্টা, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। চুপ করেই রইল সে।
ইন্সপেক্টর বলে উঠল, এই লোক স্বীকার করেছে, স্যার…।
শাটআপ! ওকে বলতে দিন। ধমকে উঠলেন মি. সিম্পসন।
ডি. কস্টা কথা বলতে শুরু করল। যা সে দেখেছে, যা সে করেছে সব বলল। কিন্তু কুয়াশা সম্পর্কে কিছু বলল না।
মি, সিম্পসন কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। কারও মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ ইন্সপেক্টর কথা বলে উঠল, শুনলেন তো, স্যার। এ লোক স্বীকার করছে গুলি করার কথা। আমার বিশ্বাস দুজনকেই এ খুন করেছে। মরিসের কথাটা বানানো…।
মি. সিম্পসন বললেন, বড় বাজে বকেন আপনি। মরিসের কথা বানানো কিনা রাস্তার উপর লাশটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। যান দেখে আসুন।
মি. সিম্পসন ডি. কস্টার দিকে তাকিয়ে বললেন, সবটুকু শুনতে চাই আমি, ডি. কস্টা। কোন কথা বা তথ্য না লুকিয়ে সবটুকু বলো আমাকে।
ডি. কস্টা এবারেও কিছু বলতে গিয়ে বলল না। এমন সময় দেখা গেল একটা গাড়ি সবেগে এগিয়ে আসছে এদিকে
মি. শহীদ খান আসিটেছেন।
মি. সিম্পসন বললেন, গুড। ওকেও খবর দিয়েছিলে বুঝি!
ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটা থামল অদূরে। সেদিকে এগিয়ে গেলেন মি. সিম্পসন এবং ডি. কস্টা। স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল শখের গোয়েন্দা শহীদ খানকে।
হ্যালো! মাই বয়… সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন মি. সিম্পসন। শহীদ হাতের পাইপটা ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে করমর্দন করল, বলল, একটু দেরি হয়ে গেল। পিতা-পুত্র হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য কামাল কুমিল্লায় গেল। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম। তো, ঘটনাটা কি?
ঘটনা খারাপ।
মি. সিম্পসন ডি. কস্টার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বললেন, দুদুটো খুন হয়েছে। ডি. কস্টা প্রত্যক্ষদর্শী। আই ডাউট…থাক এখন। শহীদ, তুমি আগে লাশ দুটো দেখো। তারপর সব কথা শুনবে।
চলুন।
তিনজন একযোগে পা বাড়াল ওরা। কিন্তু পিছন থেকে একজন রেনকোট পরা লোক ডাকল, স্যার।
মি. সিম্পসন পিছন ফিরে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, শহীদ তোমরা যাও। আমি কথাটা শুনেই আসছি।
শহীদ এবং ডি. কস্টা এগোল। মি, সিম্পসন নবাগত রেনকোট পরিহিত লোকটার সাথে চাপা কণ্ঠে আলাপ করতে শুরু করলেন।
শহীদকে একা পেয়ে ডি. কস্টা ওর গায়ের সাথে সেঁটে এল, শক্ত করে ধরল ওর একটা বাহ, চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, মি. শহীদ, প্লীজ, হেলপ মি! মি. সিম্পসন হামাকে বণ্ডী করিবার সুযোগ পাইয়াছেন, সুযোগটা টিনি ছাড়িটে চাহিবেন না। বিলিভ মি, মি. শহীড, হামি হটা করি নাই। একটি নোক একটা বাচ্চাকে ওই রেস্তোরাঁয় রাখিয়া বাহির হইয়া আসে।
শহীদ বলল, বাচ্চা?
ডি. কস্টা বলল, ওই রেস্টুরেন্টে আছে। সব কঠা বলিব আপনাকে। কিন্টু, মি. শহীড, কঠা ডিন আপনি, হামাকে মি. সিম্পসনের ট্র্যাপ হইটে রক্ষা করিবেন?
শহীদ বলল, এই জোড়া হত্যার সাথে আপনার সম্পর্ক কতটুকু তা না জেনে কথা দিই কিভাবে?
ডি. কস্টা বলল, কোন সম্পর্কই নাই মি. শহীদ, বিলিভ মি, ফর গডস সেক। হামি একজন আই উইটনেস।
সত্যি?
টপ টু বটম সট্যি।
শহীদ বলল, ঠিক আছে। দেখি কি করতে পারি।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ওরা ফুটপাথে শায়িত মৃতদেহটার কাছে। হাঁটু মুড়ে বসল শহীদ। লোকটার মুখটা দেখল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বলল, অচেনা লোক। দাড়ি কামায়নি দুদিন।
সিধে হয়ে দাঁড়াল ও। বলল, চলুন, দ্বিতীয় লাশটা দেখি।
রাস্তার উপর পড়ে থাকা হাড়-পাঁজরা ভাঙা মৃতদেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। মি. সিম্পসনও ওদের সাথে যোগ দিলেন।
চিনতে পারো, শহীদ?
শহীদ কথা না বলে চেয়ে রইল লাশটার দিকে। চিনতে পারছে না ও, কিন্তু চেহারাটা চেনা চেনা লাগছে।
মি. সিম্পসন বললেন, ডাক্তার চৌধুরী চিনতে পেরেছেন ওকে। ইরাহিম খলিলের হয়ে কাজ করত নাকি। বছর দশেক আগে ইব্রাহিম খলিলের স্বপক্ষে এই লোককে কোর্টে সাক্ষী দিতে দেখেছেন ডাক্তার চৌধুরী।
শহীদ বলল, ইব্রাহিম খলিল-কুখ্যাত নাইটক্লাব ব্যবসায়ী, অপরাধীদের মাথা, গুণ্ডাদের সর্দার। কিন্তু সে তো বছর আষ্টেক আগে মারা গেছে। যতদূর মনে পড়ে হার্টের অসুখ ছিল, স্বাভাবিক ভাবেই মারা গেছে সে।
মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁমারা গেছে স্বাভাবিক ভাবেই। যাই হোক, ইব্রাহিম খলিলের দলে ছিল এই লোক। বর্তমানে কার হয়ে কাজ করছিল ঠিক জানা নেই–তবে জানতে পারব বারো ঘন্টার মধ্যেই।
মি. সিম্পসন তাকালেন ডি. কস্টার দিকে। প্রসঙ্গ বদলে হঠাৎ জানতে চাইলেন, কুয়াশা কোথায়?
ডি. কস্টা সংক্ষেপে জবাব দিল, আই ডোন্ট নো!
মি. সিম্পসন সাথে সাথে প্রশ্ন করলেন আবার, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কুয়াশার সম্পর্ক কি, ডি. কস্টা?
সম্পর্ক নাই।
মি. সিম্পসন ডান হাতের মুঠো খুলে সেটা বাড়িয়ে ধরলেন ডি. কস্টার দিকে। দেখা গেল হাতের মাঝখানে একটা ছাপানো কার্ড রয়েছে। তাতে লেখা স্যানন ডি. কস্টা। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তার নিচে ডি. কস্টার বাড়ির ঠিকানা রয়েছে।
এটা তোমার?
ডি. কস্টা বলল, হ্যাঁ।
হারিয়ে ফেলেছিল নাকি? মি. সিম্পসনের কণ্ঠে ব্যঙ্গ।
ডি. কস্টা বলল, নো। সার্কুলার রোডের ফুটপাথে একটি লোককে বৃষ্টিতে ভিজিটে ডেকিয়া টাহাকে হামি সরাইয়া ডেই, কারণ টাহার ডুই পা-ই কাটা। টাহাকে এই কার্ড আর বিশটা টাকা ডিই আমি টাহার করুণ অবষ্টা ডেকিয়া…।
কারণ? লোকটা নিশ্চয়ই তোমাদের, অর্থাৎ কুয়াশার হয়ে কাজ করছে?
ডি. কস্টা বলল, নো! আপনি মিছামিছি সন্ডেহ করিটেছেন।
মি. সিম্পসন কণ্ঠে ঝাঁঝ এনে জানতে চাইলেন, কিন্তু তুমি ডি. কস্টা তো পরের উপকার করার লোক নও।
ডি. কস্টা বলল, এবং আপনি, মি. সিম্পসন, মি. ডি. কস্টাকে চিনিটে পারার মটো যোগ্য লোক নন।
ব্যঙ্গটা হজম করে মি. সিম্পসন নাছোড়বান্দার মত জানতে চাইলেন, টাকা যা হয় দিয়েছিলে-ভিজিটিং কার্ড কেন দিলে?
হামার বসের একটা প্রতিষ্ঠান আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কাজ গরীব, অসহায়, অক্ষম লোকদের খাওয়া-পরা চিকিৎসা আর শিক্ষার ব্যবস্টা করা। ওই লোকটাকে হামি সেই প্রতিষ্ঠানে পাঠাইব ভাবিয়া কার্ডটা ডেই।
হু।
শহীদ জানতে চাইল এতক্ষণে, কিন্তু এসব খবর আপনি পেলেন কোথায়, মি. সিম্পসন?
মি, সিম্পসন বললেন, ডি. কস্টা কুয়াশার সহকারী, সুতরাং তার পিছনে লোক থাকে আমাদের। আজও ওকে একজন ওয়াচার অনুসরণ করছিল, সে-ই এইমাত্র এসব খবর আমাকে বলে গেল।
ডি. কস্টা বলল, হামি মি, কুয়াশার সহকারী টাই হামাকে ফলো করা হয়। কিন্টু, মি. সিম্পসন, স্বয়ং মি. কুয়াশাকে ফলো করেন না কেন আপনারা?
মি. সিম্পসন কড়া সুরে বললেন, আমি জানতে চাই তুমি কোন কেসের তদন্ত করছ কিনা। যে লোকটা গুলি খেয়ে মরে পড়ে রয়েছে ফুটপাথে সে লোকটা তোমার মক্কেল ছিল কি না। লোকটাকে তুমি চিনতে কি না।
না, চিনিটাম না। লোকটাকে হামি ফলো করিয়া রেস্টুরেন্ট হইটে বাহির হইয়া আসি, ডেকি একটি মরিস হইটে গুলি করা হয়, লোকটা পড়িয়া যায় গুলি খাইয়া। টাহার পর মরিস হইটে একজন লোক নামে, সে গুলিবিজ্ঞ লোকটার ডিকে ছুটিটে ঠাকে, হামি টাহাকে লক্ষ্য করিয়া গুলি করি। টাহার পায়ে গুলি লাগে। মরিসের ড্রাইভার ইনটেনশনালি টাহার আহটো সঙ্গীকে ঢাক্কা মারে। দ্যাটস অল–ইহার বেশি হামি কিছু জানি না।
মি. সিম্পসন বললেন, আমি দৈব-দুর্ঘটনায় বিশ্বাস করি না। বিশেষ করে, তোমার মত লোক যেখানে জড়িত। কেননা, খুন খারাবি যেখানে যাই ঘটুক, তোমাকে সব সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি দেখা যায়।
ডি. কস্টা শহীদের দিকে তাকিয়ে বলল, নোকটা কাডিটেছিল, মি, শহীড। হামি ভুল ডেকি নাই। চিষ্টা করুন, একজন পঁয়ট্রিশ-চল্লিশ বছরের লোক টাহার বাচ্চাকে আদর করিটে করিটে কাডিটেছে–কেন? টাহাকে কডিটে ডেকিয়াই হামি কোটুহলী হইয়া পড়ি।
কেন কাঁদছিল? ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন ছোঁড়েন মি. সিম্পসন।
কাডিটেছিল, কারণ, লোকটা জানিটো সে মরিটে যাইটেছে। সে টাহার বাচ্চার কাছ হইটে শেষ বিডায় নিটেছিল। দৃশ্যটা হাপনারা কেউ ডেকেন নাই, হামি ডেকিয়াছি–বিলিভ মি, আমার বুকটা ফাটিয়া যাইটেছে!
মি. সিম্পসন বাকা স্বরে বললেন, লোকটা জানত সে মরতে যাচ্ছে, তাকে খুন করা হবে? হাসালে দেখছি।
ডি. কস্টা বলল, হাসি পাইলে হাসুন, বাট, হামি জানি লোকটা জানিটো সে খুন হইটে যাইটেছে। লোকটা যাই করিয়া ঠাকুক, মূল্য ডিটে হইয়াছে টাহায় বাচ্চাকে। বাচ্চাটা এটিম হইল …কে টাহাকে মানুষ করিবে? কে টাহাকে লেখাপড়া করাইকে? কে টাহাকে রোজগার করিয়া খাওয়াইবে? নিষ্পাপ একটি বাচ্চা-কাহাকে সে ফাদার বলিয়া ডাকিবে?
থামুন, মি. ডি. কস্টা…
শহীদের কথা শেষ হবার আগেই মি. সিম্পসন বললেন, লোকটা যে বাচ্চার বাবা ছিল তার প্রমাণ কি?
ডি কস্টা বলল, নিজের বাচ্চাটা না হইলে কেউ শেষ বিডায় নিবার সময় অমন করিয়া কাড়ে না…।
মি. সিম্পসন বললেন, কেউ যদি পাপ করে তাহলে তাকে তার শাস্তিও পেতে হয়। লোকটা নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছিল।
ডি কস্টা বাধা দিয়ে বলে উঠল, এটো বছর ঢারিয়া পুলিসের চাকরি করিটেছেন–চেহারা ডেকিয়া মানুষের প্রকৃটি বুঝিতে শিখেন নাই, মি. সিম্পসন। ওই যে, লাশটা মর্গের ভ্যানে টোলা হইটেছে, আর একবার গিয়া ডেকিয়া আসুন। টাহার চেহারাই প্রমাণ করিবে, সে স্ব-ইচ্ছায় কোন অপরাঢ় করিটে পারে না।
মি. সিম্পসন বললেন, শহীদ, মরিসের ড্রাইভার তার সঙ্গীর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছে কারণটা কি হতে পারে বলে মনে হয় তোমার?
শহীদ বলল, সঙ্গী আহত হয়েছে দেখে ড্রাইভারের উচিৎ ছিল সঙ্গীকে গাড়িতে তুলে নেবার চেষ্টা করা–সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বোধহয় আহত সঙ্গীকে উদ্ধার করার সুযোগ পায়নি সে।
দ্যাটস রাইট। হামি টখনও ফায়ার করিটেছিলাম। ড্রাইভার বুঝিটে পারিয়াছিল যে সে টাহার সঙ্গীকে উদ্ধার করিটে চেষ্টা করিলে নিজেই মারা পড়িটে পারে। এডিকে সঙ্গীকে আহট রাখিয়া পলাইলে পুলিস টাহার কাছ হইটে সব কঠা বাহির করিয়া নিবে–এই কঠা ভাবিয়াই সে টাহার সঙ্গীকে হট্যা করে, যাহাটে সে মুখ খুলিটে না পারে।
শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করে বলল, তাই।
মি. সিম্পসন বললেন, রেস্টুরেন্টে যাই চলো। দেখা যাক, লোকটীকে চিনত এমন কাউকে ওখানে পাওয়া যায় কি না।
কেউ টাহাকে চিনিটো না।
কিভাবে জানলে?
ডি. কস্টা বলল, হামি রেস্টুরেন্টে ছিলাম। লোকটা যখন ঢোকে টখন কেহ টাহার ডিকে ফিরিয়াও টাকায় নাই। একটা বয়স্ক মানুষ যে কডিটেছে টাহাও কাহারও চোখে পড়ে নাই।
মি. সিম্পসন বললেন, তবু দেখব আমি।
.
রেস্তোরাঁটা ফাঁকা হয়ে গেছে। গুলির শব্দ শুনে ভয়ে বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে যে-যার গন্তব্যে চলে গেছে কাল-বিলম্ব না করে। রেস্তোরাঁর মালিক লোকটা টেকো। তার টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে, চকচক করছে বৈদ্যুতিক আলোর নিচে শিশির বিন্দুর মত। রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়ে কেটে পড়ার ইচ্ছে তারও ছিল। কিন্তু শিশুটা রয়ে গেছে কেবিনের ভিতর, উপায় নেই পুলিস আসার অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া। একা একা বসে ঘামছিল সে। খুনো-খুনির ব্যাপারে, পুলিসী হাঙ্গামা হবেই। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সে, বড্ড ভয় তার এসবে।
ডি কস্টা সরাসরি কেবিনের ভিতর গিয়ে ঢুকল। বাচ্চাটা নির্বিকার ঘুমাচ্ছে এখনও। দুই হাতে ধরে তোয়ালেসহ বাচ্চাটাকে বুকের কাছে তুলে নিল সে।
নিষ্পাপ, কচি একটি মুখ। ডি. কস্টা চেয়ে রইল সেই মুখের দিকে।
রেস্তোরাঁর মালিককে কয়েকটা প্রশ্ন করে শহীদ এবং মি. সিম্পসন কেবিনের ভিতর এসে ঢুকল।
শহীদ বলল, আপনার কথাই ঠিক, মি. ডি. কস্টা। হোটেলের মালিক লোকটাকে আগে কখনও দেখেনি।
মি. সিম্পসন বললেন, আচ্ছা, শহীদ, লোকটা মরিস থেকে গুলি না হয় ছুঁড়ল-ডি. কস্টার কথা অনুযায়ী–কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে নিহত লোকটার দিকে দৌডুবার দরকার কেন হলো তার?
মি. সিম্পসন শহীদের উদ্দেশে কথাটা বললেন, কিন্তু শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ডি. কস্টার দিকে।
উত্তরটা দিল ডি. কস্টাই, লোকটা মরিয়াছে কিনা সঠিক জানিবার জন্য, আই গেল।
শহীদ বলল, বোধহয় তাই।
মি. সিম্পসন হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন, বললেন, ডি. কস্টা, আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে।
যাইটে হইবে? হোয়াই?
মি. সিম্পসন খুবই শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন, তোমার কাছ থেকে লিখিত জবানবন্দী নেব আমি। সেই জবানবন্দী পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেব তোমার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা দরকার কিনা। তোমাকে খুনের অপরাধে গ্রেফতার করা উচিত কিনা।
ডি. কস্টা বলল, ঠিক আছে। যাইব। স্টেটমেন্ট লিখিয়া ডিব। কিন্টু গ্রেফটার করিটে পারিবেন না।
সেটা নির্ভর করবে তোমার স্টেটমেন্ট পরীক্ষা করার পর।
ডি. কস্টা বলল, যডি মি. শহীড আমার পক্ষে জামিন হন?
মি. সিম্পসন বললেন, হবে নাকি তুমি জামিন, শহীদ?
শহীদ এতক্ষণ মৃদু মৃদু হাসছিল। একমুখ নীল ধোয়া ছেড়ে পাইপটা নামাল সে ঠোঁট থেকে। বলল, আমি মনে করি মি. ডি. কস্টা নিরপরাধ। জামিন হতে রাজি আছি।
কাঁধ ঝাঁকালেন মি. সিম্পসন। বললেন, গুড। সে ক্ষেত্রে ওকে গ্রেফতার করছি না আমি। ভাল কথা, বাচ্চাটাকে কোন এতিমখানায়…
প্রায় গর্জেই উঠল ডি. কস্টা, নো! মি. সিম্পসন, এই বাচ্চাকে হামি লইয়া যাইব–এ ব্যাপারে আপনার কোন আপট্টি আছে?
না…আপত্তি নেই।
.
০৩.
লাশ দুটো নিয়ে ভ্যানটা ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছে মর্গের উদ্দেশে।
রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা কথা বলতে বলতে। মি. সিম্পসন বলছেন, আমি জানি শহীদ, আমি জানি। তোমার কথাই ঠিক। ডি. কস্টা এই ধরনের অপরাধ করতে পারে না। আমি ভাবছি কুয়াশার কথা। তার উপরই সব সন্দেহ আমার। ডি কস্টাকে ছাড়তে চাইছিলাম না কুয়াশার কথা ভেবেই, যদি জেরা করে, ভয় দেখিয়ে কোন তথ্য আদায় করতে পারি।
শহীদ বলল, আপনি ডি. কস্টাকে চেনেন না? মেরে ফেললেও কুয়াশা সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করবে না সে। তা ছাড়া, আমি জানি, কুয়াশা এই ঘটনার সাথে জড়িত নয়। সে ঢাকায় নেই। একমাত্র আমি জানি কোথায় আছে সে।
মি. সিম্পসনের মুখটা কালো হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল, নিরাশ হয়েছেন তিনি। বললেন, তাই নাকি?
শহীদ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, প্রথম লোকটার খুন হওয়ার ঘটনায় ডি. কস্টা খুবই শ পেয়েছে। সহজে শান্ত করা যাবে না তাকে। আমি ওর নিরাপত্তার কথা ভাবছি। খুনীদের একজন খতম হয়েছে ঠিক, কিন্তু অপরজন পালিয়েছে গাড়ি নিয়ে। ডি. কস্টা তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে খুনী বসে থাকবে না।
মি. সিম্পসন বললেন, যে লোকটা গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে তাকে আমরা বারো ঘণ্টার মধ্যে পাকড়াও করতে পারব, আশা করি। কালো মরিস তাই না? নিশ্চয়ই হাইজ্যাক করা। গাড়িটা কোথাও ফেলে রেখে কেটে পড়বে অপরাধী সম্ভবত। গাড়িতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যেতে পারে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে এই ঘটনার সাথে জড়িত লোকেরা পেশাদার অপরাধী। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখে তার পরিচয় বের করা কঠিন হবে না। কিন্তু, শহীদ, যাই বলো, কেসটার প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে এর পিছনে ভয়ঙ্কর একটা শক্তি কাজ করছে। আহত হয়েছে বলে যারা নিজেদের দলের লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে খুন করে পালায় তারা ছোটখাট অপরাধী নয়। শহীদ, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে খুবই জটিল রহস্য আছে।
শহীদ চিন্তিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল মি, সিম্পসনের জীপের সামনে, বলল, আপনার সাথে আমি একমত। কেসটা জটিল হতে পারে। এই হত্যাকাণ্ড সাধারণ কোন কারণে ঘটেনি। যারা এর সাথে জড়িত তারা সাধারণ লোক নয়, খুন করাই তাদের পেশা।
মি. সিম্পসন একটা হাত তুলে দিলেন শহীদের কাঁধে, বললেন, সেক্ষেত্রে তুমি সাহায্য করো আমাকে। মাহবুব চৌধুরী আর গুজরাট খানকে নিয়ে এমনিতেই আমার মাথা গরম হয়ে আছে। তার সাথে এই জটিল কেসটা নিয়ে মাথা ঘামালে পাগল হয়ে যাব আমি। তুমি এই কেসটার দায়িত্ব নাও।
শহীদ বলল, কাল সকালে জানাব আপনাকে আমি। এখন আমি একজন লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আমার সন্দেহ, সেই লোক এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। নামটা এখন বলব না। সকাল দশটায় আপনার অফিসে যাব আমি।
মি. সিম্পসন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন শহীদের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, ইতিমধ্যেই তুমি একজনকে সন্দেহ করছ? কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? তুমি তো নিহত লোক দুজনের একজনকেও চিনতে পারোনি।
শহীদ হাসল না। ওর কণ্ঠস্বর.একটু যেন গভীরই শোনাল, প্রথমে সত্যি চিনতে পারিনি। তবে চেনা চেনা লাগছিল। এখন, আপনারই একটা কথা শুনে, লোকটাকে কোথায় দেখেছি মনে পড়ে গেছে। আমি নিহত দ্বিতীয় লোকটার কথা বলছি। ওকে মাত্র তিনদিন আগে দেখেছি এক লোকের সাথে।
কে সে?
শহীদ হেসে উঠল মৃদু শব্দ করে, না, নাম বলব না। একটু আগে না আপনি বলছিলেন আপনার মাথা গরম হয়ে আছে? নামটা শুনলে মাথাটা আপনার আরও গরম হয়ে উঠবে, ঘুমুতেই পারবেন না বাকি রাতটা। আমার সন্দেই যদি সত্যি হয়। তাহলে তা জানতে পারব লোকটার সাথে কথা বললেই। সেক্ষেত্রে কাল জানাব আপনাকে। চলি, গুড নাইট।
এক মিনিট! একা তার কাছে যাওয়া কি ঠিক হবে?
শহীদ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। হাসি থামল ওর হঠাৎ করে। ভুরু জোড়া কুঁচকে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে রইল ও মি. সিম্পসনের দিকে। তারপর জানতে চাইল, ব্যাপার কি? এ ধরনের কথা আগে তো কখনও বলেননি। আমার ক্ষমতা, বুদ্ধি, যোগ্যতা…এসবের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?
মি. সিম্পসন এবার দুই হাত দিয়ে ধরলেন শহীদের দুই কাঁধ। আবেগে আক্রান্ত হয়েছেন যেন তিনি একটু। সস্নেহে বললেন, না, না, নো মাই বয়নট দ্যাট! তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আগের চেয়ে বরং বেড়েছে। হয়েছে কি জানো, একদল বদমাইশ আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, প্রতিমুহূর্তে আমি দুশ্চিন্তায় ভুগছি। ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলছি আমি, শহীদ। নিজের যোগ্যতার ওপরই সন্দেহ দেখা দিয়েছে আমার…
শহীদ বলল, আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি আমি, মি. সিম্পসন। ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি সাহায্য করব। দেখা যাক বদমাইশের দল কতটা শক্তিশালী।
জড়িয়ে ধরলেন মি. সিম্পসন শহীদকে। বললেন, আহ! শান্তি পেলাম। তুমি নিজের পছন্দ মত কেস ছাড়া অন্য কোন কেস সম্পর্কে মাথা ঘামাও না বলে তোমাকে বলতেই পারিনি। বিশ্বাস করো শহীদ, তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো, এক হপ্তার ভিতর মাহবুব চৌধুরী আর গুজরাট খানকে গ্রেফতার করতে পারি আমি।
শহীদ রিস্টওয়াচ দেখল হাত তুলে। বলল, কাল আলাপ করব এ ব্যাপারে।
গুড নাইট মাই বয়…।
গুড নাইট!
ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল শহীদ, মি. সিম্পসন হঠাৎ খপ করে ওর একটা হাত ধরে ফেলে চাপা স্বরে বললেন, শহীদ-দাঁড়াও। মাই গড, শহীদ, তোমার গাড়ির ভিতর একজন লোক!
শহীদ হেসে ফেলে বলল, পরিচিত লোক। গুড নাইট, মি. সিম্পসন।
ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের গাড়ির দিকে পা বাড়াল শহীদ। জুতোর শব্দ তুলে দৃঢ় পায়ে গাড়ির সামনে এসে দরজা খুলল ও, ভিতরে ঢুকে স্টার্ট দিল, তারপর ছেড়ে দিল গাড়ি।
ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেন ছুটতে শুরু করল তীরবেগে। শহীদ পিছন দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, মি. ডি. কস্টা?
হামাকে হামার বাড়িটে পৌঁছাইয়া ডিটে হইবে।
তা দেব। কিন্তু…
ডি. কস্টা বলে উঠল, পকেট এমটি কিনা টাই…
শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডি. কস্টার দিকে। মুখে কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল, আশ্চর্য লোক বটে। ঘণ্টাদেড়েক আগে এই লোক একজন পঙ্গুকে কুড়ি টাকা দান করেছে, নিজের গাড়ি ভাড়াটা পর্যন্ত রাখেনি…অথচ একে সবাই ভুল বোঝে। লোকটার ভিতর অদ্ভুত কোমল একটা মন আছে, কিন্তু খুব কম লোকই তার খবর রাখে। তবে কুয়াশা সবই জানে…
.
ডি. কস্টা কিছু দিন থেকে একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। শহীদ ঠিক জানে না, সম্ভবত কুয়াশার নির্দেশেই আস্তানা ছেড়ে ভাড়াটে বাড়িতে থাকছে ডি. কস্টা।
বাড়িটা অভিজাত এলাকায়। রাস্তার ধারেই। ডি. কস্টাকে নামিয়ে দিল শহীদ। বলল, বাচ্চাটাকে রাখতে পারবেন? রাজকুমারীও তো নেই ঢাকায়। তারচেয়ে আমাকে দিন, মহুয়া ওর দেখাশোনা করুক আপাতত।
নো। যটোডিন না ইহার ফাদারের হট্যাকারীকে শাস্টি ডিটে পারিটেছি টটোডিন এই বাচ্চা হামার কাছে ঠাকিবে।
শহীদ বলল, একটা কথা, মি. ডি. কস্টা। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অপরাধীরা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক। এদের সাথে লাগতে হলে খুব সাবধানে, দেখেশুনে পা ফেলতে হবে। আপনি একা সামলাতে পারবেন না…
একা কোঠায়? আপনি ঠাকছেন না হামার সাঠে?।
শহীদ বলল, না। আমি আপনার সাথে থাকছি না। আপনি থাকছেন আমার সাথে। এটাই শর্ত।
তারমানে?
আপনি আমাকে না বলে কিছু করবেন না। অর্থাৎ এই কেসে আপনি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করবেন।
অল রাইট। গুড নাইট, মি. শহীদ।
গুড নাইট।
গাড়ি ছেড়ে দিল শহীদ। রিস্টওয়াচ দেখল। রাত সাড়ে বারোটা। স্পীড বাড়িয়ে দিল ও ফোক্সওয়াগেনের।
নির্জন, বৃষ্টিস্নাত, ফাঁকা রাস্তা। ঘুমিয়ে আছে রাতের ঢাকা শহর।
কিন্তু রাত হলেই সবাই ঘুমায় না। কেউ কেউ জেগে থাকে। চিন্তা করছে শহীদ। ভেজা ভেজা বাতাস লাগছে ওর চোখে-মুখে, চুলে। মাহবুব চৌধুরী। নিশ্চয়ই জেগে আছে। মাহবুব চৌধুরীচোরাই অস্ত্রের বেআইনী ব্যবসায়ী! মোটা টাকার বিনিময়ে স্মল আর্মস্ বিক্রি করে লোকটা। অগাধ টাকার মালিক, টাকার কুমির বলা যায়। নিজস্ব একটা নাইটক্লাব আছে। গুজরাট খান তার বন্ধু। মাত্র তিন দিন আগের কথা, মাহবুব চৌধুরীকে দেখেছে শহীদ একটা এগজিবিশনে। জুয়ার আড্ডায় ঘোরাফেরা করছিল। সাথে একজন লোক ছিল। বন্ধুশ্রেণীর কেউ নয়–দেহরক্ষী বলে মনে হয়েছিল লোকটাকে। মাহবুব চৌধুরী দেহরক্ষী নিয়ে বাইরে বেরোয়, শোনা যায়। দেহরক্ষীই হোক বা অন্য কিছু থোক, সেই লোকটাই আজ রাতের দ্বিতীয় লাশ। সেই লোকটাকেই ডি কস্টা গুলি করে আহত করেছিল।
কপাল খারাপ শহীদের। মাহবুব চৌধুরীর নাইটক্লাবে তাকে পাওয়া গেল না। কিন্তু নিরাশ হলো না ও। মাহবুব চৌধুরী নিশাচর–কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবেই তাকে। যে-সব জায়গায় মদের যোত বয়ে যায়, জুয়ার আড্ডা বসে, যুবতী মেয়েছেলেরা বেহায়া ভঙ্গিতে নাচে, বেআইনী ব্যবসা চলে, হীন ষড়যন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়–সেই সব জায়গাগুলো চেনা আছে শহীদের। সেই সব জায়গাতেই মাহবুব চৌধুরীর মত লোক যাতায়াত করে।
নাইটক্লাবগুলোয় সন্ধান নিল প্রথমে শহীদ। কোথাও নেই মাহবুব চৌধুরী। কয়েকটা রেস্টুরেন্টে গেল। নেই। শহরের বাইরে, প্রায় মাইল দশেক দূরে নতুন একটা নাইটক্লাব হয়েছে, সেখানে খোঁজ নেয়া যেতে পারে। গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল শহীদ।
বারো মিনিট পর ক্যাপিটাল নাইটক্লাবের গাড়ি বারান্দায় থামল ওর ফোক্সওয়াগেন। স্টার্ট বন্ধ করল শহীদ, কিন্তু সাথে সাথে নামল না। পাইপে টোবাকো ভরল ধীরেসুস্থে। অগ্নিসংযোগ করল। মিনিটখানেক পর নামল ও। সিঁড়ির ধাপ কটা টপকে করিডরে উঠল।
সুইং ডোরটা এক প্রান্তে। সেটা ঠেলে ভিতরে ঢুকল ও।
হলরূমের পূর্ব প্রান্তে একটা উঁচু স্টেজ। একটি মেয়ে নাচছে, স্টেজের দুই ধারে বসে একদল বাদক নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে।
দর্শকের সংখ্যা খুবই কম। সর্বমোট পনেরো বিশ জন হবে। বেশির ভাগই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঢলে পড়েছে টেবিলের উপর। হলরূমের পশ্চিম প্রান্তটা বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে আরও খানিক দূর, সেদিকে পা বাড়াল শহীদ।
বাকের কাছাকাছি কয়েকটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে। উল্টে-পাল্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে চেয়ারগুলো, মাত্র একটি ছাড়া। সেই একটিতে বসে আছে একজন লোক। শহীদ এগিয়ে আসছে দেখে ঘুমে ভারাক্রান্ত চোখের পাতা দুটো জোর করে খুলে রেখে চেয়ে রইল সে, তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তার পায়ের সাথে ধাক্কা লাগায় পড়ে গেল চেয়ারটা সশব্দে।
কি চাই? অকারণেই প্রায় মারমুখো হয়ে প্রশ্ন করল লোকটা।
নিঃশব্দে হাসল শহীদ। বলল, আরে! ভয় পাচ্ছ কেন? মাহবুব কোথায়? ডেকে দাও ওকে।
কথাগুলো এমন সহজ, সাবলীল ভঙ্গিতে বলল শহীদ, মনে হলো যেন মাহবুব ওর কত দিনের পরিচিত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
শহীদকে দেখে লোকটার পেশীগুলো টানটান হয়ে উঠেছিল। শহীদের কথা শুনে শরীরের কাঠিন্য দূর হয়ে গেল, ঢুলুঢুলু হয়ে উঠল চোখ দুটো, হাই তুলল মুখে হাত চাপা দিয়ে, বলল, হুজুরের মেজাজ গরম হয়ে আছে কেন জানি না, কাছে যেতে ভয় লাগে….
ধমকে উঠল শহীদ, যা বলছি করো। জরুরী ব্যাপার। মাহবুব যদি জানতে পারে যে তুমি দেরি করিয়ে দিয়েছ-বারোটা বাজাবে সে তোমার।
কাজ হলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সে।
পা দিয়ে একটা চেয়ারকে খাড়া করে তাতে বসল শহীদ। পা দুটো লম্বা করে বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে। পিছন দিক থেকে ভেসে আসছে বাজনার শব্দ।
একটু পরেই দেখা গেল মাহবুব চৌধুরীকে। লম্বা চওড়া শরীর। উন্নত কপাল। ব্যাকব্রাশ করা চুল। হীরে বসানো আঙটিটা জ্বলজ্বল করছে বা হাতের মধ্যমায়। খয়েরী রঙের একটা দামী ট্রপিক্যালের স্যুট পরেছে। চোখে মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ। কাছে এসে দাঁড়াল সে, আঁঝাল কণ্ঠে জানতে চাইল, কে? কি চাই?
প্রশ্ন করার সময় মাহবুব চৌধুরীর চোখের দৃষ্টি স্থির হলো মুহূর্তের জন্য শহীদের প্যান্টের ডান পকেটের উপর। রিভলবারটা থাকার জন্যই যে পকেটটা ফুলে রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না তার।
পা দিয়ে একটা চেয়ারকে খাড়া করে দিল শহীদ। পাইপটা ঠোঁট থেকে না নামিয়েই বলল, বসো, মাহবুব।
চেয়ে রইল মাহবুব চৌধুরী শহীদের দিকে। সিভিল ড্রেসে পুলিস অফিসার নাকি লোকটা?–ভাবছে সে।
বসল মাহবুব চৌধুরী। সেই ঝাঁঝাল কণ্ঠেই বলে উঠল, যা বলবার ঝটপট বলো। আমার সময়ের মূল্য অনেক।
শহীদ শান্তভাবে বলল, তোমার একজন দেহরক্ষী খানিক আগে খুন হয়েছে।
কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে নাড়িয়ে দিল মাহবুব চৌধুরীর দেহটাকে। দম বন্ধ করে প্রশ্ন করল, কে?
সেটাই জানতে চাই আমি। গত পরশু এগজিবিশনে লোকটা ছিল তোমার সাথে, তোমার বডিগার্ড হিসেবে। মনে পড়ে?
মনে পড়লেও স্বীকার করল না মাহবুব চৌধুরী।
পা দুটো গুটিয়ে নিয়ে সিধে হয়ে বসল শহীদ। পাইপটা নামাল ঠোঁট থেকে, ঝুঁকে পড়ল একটু সামনের দিকে, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মত লম্বা নোকটা। পরনে কালো প্যান্ট, নীল শার্ট। কপালের ডানদিকে কাটা দাগ। ডান চোখের পাতার উপর ছোট্ট একটা টিউমার। বেশ কয়েক বছর আগে এই লোক কাজ করত ইব্রাহিম খলিলের দলে। আমি জানতে চাই লোকটা আজ রাতে তোমার হয়ে কাজ করছিল কিনা।
মাহবুব চৌধুরীর ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে চেপে বসল। পলক নেই চোখে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে জরিপ করার চেষ্টা করছে শহীদকে। হিসহিস করে শব্দ করল সে কথা বলার সময়, কে তুমি?
শহীদ খান।
সাপের মত ফণা তোলার ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহবুব চৌধুরী, ও, প্রাইভেট ডিটেকটিভ!
শহীদের ডান হাতটা ওর প্যান্টের ডান পকেটের মুখের কাছে চলে গেছে কখন যেন। আঙুলগুলো ঢুকছে পকেটের ভিতর অতি ধীর গতিতে।
মাহবুব চৌধুরী শহীদের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে কোটের পকেটে হাত দিল। বের করে আনল হাতটা প্রায় সাথে সাথে। সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার দেখা গেল তার হাতে।
শহীদ নিঃশব্দে হাসল, তোমার দেহরক্ষী, যে খুন হয়েছে, তাকে গুলি করে প্রথমে আহত করে আমার এক সহকারী। তারপর, তোমার দেহরক্ষীর সঙ্গী, যে গাড়ির ভিতর ছিল, সে তোমার দেহরক্ষীকে আহত দেখে তাকে গাড়ির ধাক্কা দিয়ে খুন করেছে। এই ঘটনার আগে তোমার দেহরক্ষী অপর একজন লোককে গুলি করে খুন করে।
দপ্ করে জ্বলে উঠল মাহবুব চৌধুরীর হাতে লাইটারটা। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বলল, আজ রাতে আমার হয়ে কেউ কোন কাজ করছিল না।
শহীদ বলল, হয়তো করছিল না, হয়তো বা করছিল। তুমিই ভাল জানো।
মাহবুব চৌধুরী দুই কোমরে হাত দিয়ে শরীরটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে শুরু করল, প্রাইভেট ডিটেকটিভই হও, আর স্বয়ং শয়তানই হওভুলে যেয়ো না যে আমার নাম মাহবুব চৌধুরী। আমি চাই না আমাকে কেউ বিরক্ত করুক।
চোখদুটো জ্বলছে মাহবুব চৌধুরীর বাঘের চোখের মত।
মাহবুব, কান পেতে শোনো কি বলছি। আজ রাতে যা ঘটেছে তার সাথে তুমি জড়িত আছ একথা জানতে পারলে আমি ফিরে আসব আবার। কেন আসব জানো? তোমাকে, তোমার ওই ফুটবলের মত মাথাটাকে মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়াবার জন্য।
লাল হয়ে গেল মাহবুব চৌধুরীর বড়সড় ফর্সা মুখটা। কাঁপছে সে প্রচণ্ড রাগে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল শহীদ। মাহবুব চৌধুরীর পা থেকে মাথা অবধি কঠোর দৃষ্টিতে দেখল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল। দৃঢ়, ধীর পদক্ষেপে দরজার দিকে এগোচ্ছে। ও। পিছন থেকে ভেসে এল শব্দ, কে যেন কিছু ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে।
দরজার কাছে পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ। নেই মাহবুব চৌধুরী। চেয়ার দুটো উল্টে পড়ে রয়েছে, দেখল ও।
.
০৪.
আড়াই বছরের বাচ্চাটা চোখ মেলে চেয়ে আছে। সিঙ্গেল খাটে বিছানো তোষক এবং চাদর প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দিয়েছে সে। পাশ ফিরে শুয়ে চেয়ে আছে অপলক চোখে অদূরের নিচু তেপয়টার দিকে। খোলা জানালা দিয়ে সকালের উজ্জ্বল রৌদ্রকিরণ প্রবেশ করছে, পড়ছে তেপয়ের উপর। তেপয়ের উপরের টেবিল ল্যাম্প, টেলিফোন, সিলভারের অ্যাশট্রে ও কালো চকচকে রিভলভারটার উপর রৌদ্রকিরণ পড়েছে–চকচক করছে সবগুলো। ঘুম থেকে সদ্য চোখ মেলে চকচকে জিনিসগুলো দেখে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না বাচ্চাটা।
লম্বা সোফায় হাত-পা গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে হাড়-জিরজিরে ডি. কস্টা। খাটের উপর, বাচ্চার পাশেই শুয়েছিল সে। কিন্তু বাচ্চাটা প্রষাব করে চাদর ভিজিয়ে দেয়ায় ডি. কস্টা তাকে নিজের জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে শোয়। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রয়েছে ডি. কস্টার, সরু সরু দাঁত দেখা যাচ্ছে। গভীর ঘুমে অচেতন সে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে তার নাক দিয়ে বিচিত্র ধরনের ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল। কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
খাট থেকে হাত বাড়িয়ে তেপয়ের উপরের চকচকে জিনিসগুলো ধরার জন্য চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু ছোট্ট হাত তার, অতদূরে পৌঁছুচ্ছে না, তাই তার কান্না। কান্না থামল একটু পরই। গাল ফুলিয়ে চেয়ে রইল সে তেপয়ের দিকে। শরীরটা গড়িয়ে উপুড় হলো, উঠে বসল খাটে। পা দুটো নামিয়ে দিল খাট থেকে নিচের দিকে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। মেঝেতে নামতে চায় সে, তেপয়ের কাছে যেতে চায়।
নামতে গিয়ে হঠাৎ ঘাড় বাঁকা করে ডান দিকের দেয়ালের দিকে তাকাল বাচ্চাটা। টি-টি-টি। একটা টিকটিকি ডেকে উঠেছে। সেটাকে দেয়ালে হাঁটতে দেখে মৃদু শব্দ করে হেসে উঠল সে, হাত বাড়িয়ে ডাকল, আ!…আঃ…আ!
টিকটিকিটা দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জানালার পর্দার আড়ালে চলে গেল। বাচ্চাটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আবার তেপয়ের দিকে। শব্দ করে হেসে উঠল আপন মনে। নেমে পড়ল মেঝেতে। ছোট ছোট পা ফেলে তেপয়ের দিকে হাঁটছে সে।
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোনের বেল। চমকে উঠে কেঁদে ফেলল বাচ্চাটা। গভীর ঘুম মুহূর্তে টুটে গেল ডি. কস্টার। শুয়ে শুয়েই হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা নিল সে। জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো?
অপর প্রান্ত থেকে একটা অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কি খবর, বন্ধু? ঘুম থেকে এই মাত্র উঠলে নাকি?
ডি. কস্টা বলল, ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, টাই না? ইয়েস, ফ্রেণ্ড, ফোনের বেল শুনিয়া ঘুমটা ভাঙিয়া গেল।
ডি কস্টা এবং বাচ্চাটার মাঝখানে রয়েছে তেপয়টা। ডি. কস্টা বাচ্চাটাকে দেখতে পাচ্ছে না তাই। বাচ্চাটা কাঁদছেও না এখন। তেপয়ের জিনিসগুলো হাতের নাগালে পেয়েছে সে এতক্ষণে। সেগুলো নাড়াচাড়া করছে সে।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক ডি. কস্টার। অনেকদিনের পরিচয়। দুজন পরস্পরের বন্ধুর মত হয়ে গেছে। সি.আই.ডি ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ মি. সিম্পসনের অধীনে কাজ করে। মি. সিম্পসনের চেম্বার যে বিল্ডিংয়ে সেই বিল্ডিংয়েরই নিচতলায় বসে ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ।
ডি. কস্টা, তুমি এখুনি আমাদের অফিসে চলে এসো। গত রাতের ঘটনা সম্পর্কে কিছু সূত্র পাওয়া গেছে।
টাই নাকি? গুড, ভেরি গুড। সব কঠা টুমি জানো টো?
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ডি. কস্টা, সব কথা জানাটাই তো আমার কাজ। তুমি যা জানো তার চেয়ে অনেক বেশি জানি আমি এখন। শুনতে চাইলে দেরি কোরো না। বাচ্চাটা তো তোমার কাছে–ওর বাবা যে খুন হয়েছে, তার পরিচয় ইতিমধ্যেই উদ্ধার করে ফেলেছি আমরা।
ডি. কস্টা বলল, কিন্টু, সাজ্জাD, অণ্টট একঘণ্টা ডেরি হবে হামার। বাচ্চাটার জন্য…
ইন্সপেক্টর বলল, বিপদেই পড়েছ দেখছি। মি. সিম্পসন বলছিলেন তুমি নাকি বাচ্চাটাকে এতিমখানায় পাঠাতে রাজি নও।
ডি. কস্টা বলল, গটোরাটেই হামি এক নার্সের ব্যবস্টা করিয়াছি। বাচ্চাটিকে টাহার কাছে পৌঁছাইয়া ডিয়া আসিটে হইবে।
আরও দুএকটা কথা বলে ক্রেডলে রেখে দিল রিসিভারটা হাত বাড়িয়ে, তারপর বিছানায় উঠে বসল। ঠিক তখনই বাচ্চাটাকে দেখতে পেল ডি. কস্টা।
বাচ্চাটা একমনে খেলছে তেপয়ের জিনিসপত্রগুলো নিয়ে। বাচ্চার দিক থেকে তেপয়ের উপর চোখ রাখল ডি কস্টা। আঁতকে উঠল সে। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল তার, বড় হয়ে উঠল সেই সাথে চোখ দুটো।
তেপয়ের উপরে রাখা রিভলভারটার নলের মুখ ডি. কস্টার মাথার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। একচোখো শয়তান যেন একটা। বাচ্চার হাত দুটো রয়েছে রিভলভারটার ট্রিগারের উপর। হাত দিয়ে বাঁকানো ট্রিগারটা ধরে টানাটানি করছে সে।
মাত্র আড়াই হাত দূরে বিপদটা। বিপদের মুখোমুখি পড়ে ডি. কস্টা যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। রিভলভারের সেফটি ক্যাচ অন করা আছে কিনা স্মরণ হলো না তার। বাচ্চাটার দিকে তাকাল সে। হাসছে বাচ্চাটা আপন মনে। ডি. কস্টার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না সে। কয়েক সেকেণ্ড কেটে গেল। হাসতে হাসতে ট্রিগারটা নাড়াচাড়া করছে সে। এই মুহূর্তে গুলি ছুটে যেতে পারে। বুলেটটা সোজা বিদ্ধ হবে ডি. কস্টার মাথায় কিংবা কপালে, সাথে সাথে ভবলীলা সাঙ্গ হবে তার। অকস্মাৎ বিদ্যুতের মত গতি লাভ করল ডি. কস্টার দেহ। ক্যাঙারুর মত লাফ দিয়ে বাচ্চার পিছনে চলে গেল সে, কেড়ে নিল হাত থেকে রিভলবারটা।
কেঁদে উঠল বাচ্চাটা। সে কান্না তার থামতেই চায় না আর।
ডি কস্টা মুখহাত ধুয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। বড় পুতুলটা হাতে দিতে বাচ্চার কান্না থামাল বটে, কিন্তু সে মাত্র দুতিন মিনিটের জন্যে।
বাড়িটা একতলা। ডি. কস্টা একাই থাকে। খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা সে হোটেলেই সারে। বাইরে বেরিয়ে এসে একটা বেবিট্যাক্সি দেখে হাত নেড়ে থামাল, গন্তব্যস্থানের নাম বলে চড়ে বসল সেটায়। বেবিট্যাক্সি ছুটতে শুরু করতেই আবার কান্না শুরু করল বাচ্চা।
এর আগে বাচ্চাকাচ্চার পাল্লায় পড়েনি ডি কস্টা। কান্না থামাবার কোন উপায় তার জানা নেই। অস্থির, বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। তবু, মুখে হাসি ফুটিয়ে ছড়া আওড়াচ্ছে সে, বুকের কাছে তুলে দোলা দিচ্ছে, চুমো খেতে খেতে লোভ দেখাচ্ছে, ঠামো, সোনামণি, ঠামো। টোমাকে আমি সুণ্ডরী রাজকন্যার সাঠে বিবাহ ডিবো।
হাত-পা ছুঁড়ে আরও জোরে কাঁদছে বাচ্চা।
চিকণ কণ্ঠে ছড়া কেটে থামাবার চেষ্টা করছে ডি. কস্টা:
রাগ করো না রাগ করো না
লক্ষ্মী সোনা খোকা।
অমন করে কাড়লে সবাই।
বলবে টোমায় বোকা।
কাজ হচ্ছে না, থামছে না কান্না।
হাত দেখিয়ে একটা বাড়ির সামনে বেবিট্যাক্সি থামল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল ডি কস্টা। খোলা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। বারান্দায় উঠে একটি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল ডি কস্টা। নক করতে হলো না। খুলে গেল দরজা। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ মোটা এক বৃদ্ধা। ফিক করে হেসে ফেলল ডি কস্টা বৃদ্ধার বিরাট বপু দেখে। বৃদ্ধার চোখ ছিল বাচ্চার দিকে, ডি. কস্টার হাসির কারণ সে তাই বুঝতে পারল না। দুই হাত বাড়িয়ে ডি. কস্টার কাছ থেকে বাচ্চাকে নিজের বুকে তুলে নিল বৃদ্ধা। বলল, খুব বিরক্ত করছে বুঝি আপনাকে?
ডি. কস্টা বলল, ইয়েস।
বৃদ্ধা বলল, আসুন, ভিতরে আসুন।
বৃদ্ধা তার বিশাল দেহ নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল।
ডি. কস্টা বলল, আমি স্যানন ডি. কস্টা। বাচ্চার ফার। আপনি ঠিক মটো কেয়ার নিটে পারিবেন টো?।
একগাল হাসল বৃদ্ধা। বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। দেখছেন না, আমার কাছে আসতেই কেমন চুপ করে গেছে?
পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার কয়েকটা নোট বের করে বৃদ্ধার দিকে বাড়িয়ে দিল ডি. কস্টা। বলল, হামার বাচ্চার জন্য ডামী কাপড় চোপড় কিনিটে হইবে। আর একটা কঠা, পেঠ ভরিয়া খাওয়াইবেন-মানি ইজ নো প্রবলেম, যটো টাকা লাগে হামি ডিব।
বৃদ্ধার কোল থেকে হঠাৎ লাফ দেয়ার মত ভঙ্গিতে বাচ্চাটা কুঁকে পড়ল ডি. কস্টার দিকে, তার কোটের ভিতরের পকেটে হাত ঢোকাবার চেষ্টা করছে যেন সে। হাতটা ধরে সরিয়ে দিল ডি কস্টা।
বৃদ্ধা বলল, পকেটে কিছু রাখতে দেখেছে বোধহয়?
ডি. কস্টা ইতস্তত করল। তারপর বলল, হ্যাঁ।
ডি. কস্টারিভলভারটা কোটের পকেটে রাখার সময় দেখেছে বাচ্চাটা, সেটাই পেতে চাইছে সে খেলার জন্যে।
বাচ্চার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নার্সের উপর দিয়ে বিদায় নিল ডি, কন্টা।
.
বাচ্চার বাবার নাম, যে নিহত হয়েছে, আবদুল জব্বার। ছয়মাসের জেল হয়েছিল তার, একটা বাড়িতে ঢুকে আয়রন সেফের তালা ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়ার ফলে। বছর চারেক আগের কথা সেটা। আয়রন সেফের তালা তৈরির একটা কারখানায় তখন সে চাকরি করত, অপরাধ ধরা পড়ায় স্বভাবতই চাকরি যায় তার। জেল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুদিন বেকার ছিল। একটা নাট-বল্ট তৈরির কারখানায় কাজ পায় জেল থেকে বেরুবার মাস দুয়েক পর। গতকাল অবধি সে সেখানেই কাজ করছিল। কাজটা পাবার পরই সে বিয়ে করে, একটা বাচ্চা হয়। বাচ্চার বয়স যখন বছর খানেক, তার স্ত্রী মারা যায় ক্যান্সারে। বাচ্চাটার নাম চঞ্চল।
পাইপে আগুন ধরিয়ে নীল ধোয়া ছাড়ল শখের গোয়েন্দা শহীদ খান। কাপটা তুলে চুমুক দিল কফিতে। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকাল মি. সিম্পসনের দিকে, তারপর?
গতরাতে আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে জব্বারের নিহত হবার ঘটনার। রাত দশটার দিকে রমনা থানায় এক ভদ্রলোক ফোন করেন পুরানা পল্টন থেকে। ফোনে তিনি জানালেন, কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটবাড়ির পানির পাইপ বেয়ে একজন লোককে তিনি উঠতে দেখেছেন। লোকটা জানালা গলে একটা ফ্ল্যাটের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভদ্রলোক নিজের বাড়ির জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখেন ঠিক, কিন্তু দুই বাড়ির মধ্যবর্তী দূরত্ব খুব বেশি বলে এ ব্যাপারে চিৎকার করে বা অন্য কোন উপায়ে কাউকে সাবধান করে দেবার সুযোগ তিনি পাননি। তাই ফোন করে ব্যাপারটা থানায় জানান। থানা থেকে কয়েকজন পুলিস কনেস্টবল তখুনি রওনা হয়ে যায়। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের দরজায় নক করে তারা। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, কেউ খুলেও দেয়নি। শেষ পর্যন্ত দরজা ভাঙা হয়। দরজা ভাঙার পর ফ্ল্যাটে বসবাসরত এক মহিলাকে আহত এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পায় পুলিস। আয়রন সেটাও ভাঙা দেখে তারা। আয়রন সেফে হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। সেই ছাপের সাথে জব্বারের রেকর্ডকৃত হাতের ছাপ মেলানো হয়–হুবহু এক।
কি যেন চিন্তা করছে শহীদ।
মি. সিম্পসন বললেন, আমার ধারণা ডাকাতি করার জন্যে পাইপ বেয়ে একাই ওঠে সে, বাকি দুজন গাড়ি নিয়ে নিচে পাহারায় থাকে। ডাকাতির মালামাল একা হজম করে পালাবার চেষ্টা করে সে, তার সঙ্গীরা টের পেয়ে ধাওয়া করে তাকে–এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র তাকে খুন করে।
শহীদ জানতে চাইল, খুনী জব্বারের কাছে পৌঁছুতে পারেনি, তাই না? গেল কোথায় তাহলে টাকা এবং গহনা?
জব্বার ডাকাতি করে মাত্র শতিনেক টাকা এবং ভরি তিনেক সোনা পায়। আমার বিশ্বাস এত অল্প টাকা এবং সোনা পাওয়ায় জব্বার ভাবে যে তার সঙ্গীরা কথাটা বিশ্বাস করবে না। এত অল্প জিনিসের বিনিময়ে অমন তোড়জোড় করে তার সঙ্গীরা ভাববে সে বেঈমানী করেছে, প্রচুর টাকা এবং গহনা ফ্ল্যাটেরই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে সে, বা অন্য কারও মাধ্যমে পাচার করে দিয়েছে-ফলে তাকে তারা ছাড়বে না। এই সব কথা ভেবে জব্বার পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশ্ন হলো তিনশো টাকা এবং তিন ভরি সোনা-কোথায় সেগুলো, এই তো? মনে হয়, ডাকাতি করে নিজের বাড়িতে ফেরার সময় কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল সে ওগুলো। কিংবা কারও কাছে গচ্ছিত রেখেছিল।
শহীদ মাথা নেড়ে বাতিল করে দিল মি. সিম্পসনের গোটা বক্তব্যটাই, আপনার সাথে আমি একমত হতে পারছি না।
নিভে যাওয়া পাইপে অগ্নিসংযোগ করে আবার মুখ খুলল শহীদ, অপর যে লোকটা মারা গেছে তার পরিচয় উদ্ধার করেছেন?
তার নাম শুকুর। ইব্রাহিম খলিলের হয়ে কাজ করত সে। দুবার জেল খেটেছে, সাতবার গ্রেফতার হয়েছে। ইদানীং সে কি করছিল বা কার হয়ে কাজ করছিল জানতে পারিনি আমরা। চট্টগ্রামে ছিল, দুতিন দিন হলো ঢাকায় এসেছে।
শহীদ প্রশ্ন করল, সন্ধান চালাবার সময় কেউ মাহবুব চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেনি?
করেছে কেউ কেউ। আমরা চেক করে দেখছি। তবে এ ব্যাপারে মাহবুব চৌধুরী জড়িত বলে মনে হয় না।
শহীদ হাত বাড়িয়ে দিল মি. সিম্পসনের দিকে, বলল, রিপোর্টটা দেখি একবার।
লিখিত রিপোর্টটার উপর চোখ বুলিয়ে কয়েকটা ঠিকানা দেখে নিল শহীদ, কয়েকবার করে পড়ল ঠিকানাগুলো, তারপর ফেরত দিল কাগজটা মি. সিম্পসনকে। বলল, মাহবুব চৌধুরী এবং গুজরাট খান সম্পর্কে আলাপ আর একদিন হবে। আপাতত জব্বারের কেসটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই। মনে হচ্ছে, কেসটার মধ্যে নতুনত্ব তো আছেই, চমকও সৃষ্টি করবে প্রচুর।
মি. সিম্পসন বললেন, তুমি আমার সাথে একমত নও–কিন্তু কারণগুলো তো বললে না?
শহীদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাসি নেই মুখে, বেশ একটু গভীরই দেখাল ওকে, বলল, ডি. কস্টার কথাটাই বিশ্বাস করি আমি। জব্বার জেনে শুনে মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন হলো কেন? কেন একজন লোক স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে মেনে নিল? এই প্রশ্নের উত্তর চাই। গুড মর্নিং, মি. সিম্পসন।
একটু অবাক, একটু বিরক্ত হয়ে শহীদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন মি. সিম্পসন। চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল শহীদ। মি. সিম্পসন অন্যমনস্কভাবে একটা চুরুট ধরালেন। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকালেন তিনি। ধীরে ধীরে বিরক্তির ছাপটুকু মুছে গেল মুখ থেকে। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তার কপালে।
.
পুরানো ঢাকার অন্ধ গলিতে বাড়িটা। দুপাশে দুর্গন্ধময় ড্রেন। উদোম এবং নোংরা বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলছে। দুএকটা পান-বিড়ি-সিগারেটের ছোট ছোট খুপরীর মত দোকান। চটের পর্দা ঝোলানো দরজার ভিতর থেকে কোন কোন বাড়ির বউ ঝি উঁকি মেরেই মুখ লুকাল। পাড়ার কিশোর ছেলেরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে শহীদের দিকে। দুএকজন বয়স্ক লোকও একপাশে সরে দাঁড়াচ্ছে পথ করে দিয়ে, সমীহ ভরা দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
বাড়ির নাম্বার মিলিয়ে দরজার কড়া ধরে নাড়া দিল শহীদ। নাম্বারটা পেয়েছে ও মি. সিম্পসনের রিপোর্ট থেকে।
ঢোলা পাঞ্জাবী এবং সালোয়ার পরা এক মৌলভী সাহেব দরজা খুলে দিল। মৌলভী সাহেবের মাথার কিস্তি টুপিটার কিনারায় সুতোর ফুল তোলা। খুব বেশি বয়স হবে না, বড় জোর চল্লিশের কাছাকাছি। হাসিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শহীদ। পবিত্র, অন্তরঙ্গ হাসি। বলল, আসোলামু আলায়কুম। কাকে চান?
উত্তর দিয়ে শহীদ বলল, আবদুল জব্বার কি এই বাড়িতে থাকত?
জ্বী-হ্যাঁ। আপনি কি পুলিসের।
শহীদ বলল, না। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। জব্বার সত্যি সত্যি কোন অপরাধ করেছিল কিনা জানার চেষ্টা করছি আমি।
মৌলভী সাহেবের মুখটা মান হয়ে গেল। বলল, আসুন, ভিতরে আসুন। আমিও এই বাড়িতে থাকি। মহল্লার মসজিদের ইমাম আমি। আমার নাম মৌলভী আজহার আলি। জব্বারকে আমি খুব ভাল ভাবে চিনতাম। জব্বার একসময় সত্যি খারাপ কাজের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু ইদানীং সে পুরোপুরি সৎ জীবন-যাপন করছিল..ছি-ছি! আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বকবক করে চলেছি–আসুন, ভিতরে এসে বসুন।
শহীদ বলল, হ্যাঁ, তাই চলুন। জব্বারের কামরাটাও দেখতে চাই আমি।
বাড়ির ভিতর ঢুকল শহীদ। ছোট্ট একটা কর্দমাক্ত উঠন। ছোট ছোট খোপের মত ঘর চারদিকে। ঘরগুলোর দেয়াল বেড়ার, ছাদ টিনের। উঠনের উপর পাটের দড়ি ঝুলছে, সেই দড়িতে শুকাচ্ছে নোংরা কথা, কম্বল, শতছিন্ন শাড়ি ইত্যাদি। কাদায় গড়াগড়ি খেতে খেতে কাঁদছে দুটো বাচ্চা, তাদের মা তাদেরকে অভিশাপ দিচ্ছে। বাচ্চা দুটো কাঁদছে খিদে পেয়েছে বলে।
মাথা নিচু করে একটা ঘরে প্রবেশ করল শহীদ। নড়বড়ে একটা চৌকি ঘরের ভিতর। চৌকির উপর খেলছে একটি দেড়-দুই বছরের বাচ্চা। মৌলভী সাহেব ঘরে ঢুকেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পাশের ঘর থেকে ভেসে এল চুড়ির টুংটাং শব্দ।
একটু পরই মৌলভী সাহেব ফিরে এলেন।
শহীদ বলল, জব্বারের কোন আত্মীয়স্বজনকে চেনেন?
ওর কোন আত্মীয় ঢাকায় নেই। থাকলেও পরিচয় দিত কিনা সন্দেহ। অতীতে দুএকটা অপরাধ করে সে খুবই লজ্জিত হয়ে পড়েছিল। লোক হিসেবে জব্বারকে মোটামুটি ভাল বলেই জানি। মনটা ছিল সাদা, কারও অসুবিধে করার কথা ভাবতেই পারত না সে। আমাকে সব কথাই বলত। মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেলে আর কিছু চাইত না সে। তার অপরাধের কথা সব সে স্বীকার করেছিল আমার কাছে।
মৌলভী সাহেব থামলেন। শহীদ প্রশ্ন করল। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।
জব্বার সম্পর্কে অনেক কথা জানা গেল। জব্বারের স্ত্রী বছরখানেক হলো মারা গেছে ক্যান্সারে। স্ত্রী মারা যাবার পর জব্বার তার চঞ্চলকে নিয়ে মহা সমস্যায় পড়ে। বাড়ির এক বৃদ্ধার কাছে চঞ্চলকে রেখে সে কাজে যেত। ছুটির পর সোজা ফিরত বাড়িতে চঞ্চলের কাছে। বাচ্চাটার জন্য তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।
তার স্ত্রীর যখন ক্যান্সার হয় তখন খুবই বিপদে পড়েছিল সে। বড় বড় ডাক্তারদের মোটা অঙ্কের ফী দিয়ে বাসায় ডেকে আনত। চিকিৎসার টাকা সংগ্রহের জন্য পাগলের মত ঘোরাঘুরি করত সে। আর্থিক অবস্থা তার ভালই ছিল। কিন্তু সঞ্চয় ছিল না। মোটা টাকার দরকার ছিল অপারেশনের জন্য।
মদ বা জুয়া একেবারে ত্যাগ করেছিল সে।
মৌলভী সাহেবের কাছে গত দশ-বারো দিন আগে তার মনের একটা ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে সে। ইনসিওরেন্স করার কথা ভাবছিল সে।.মৌলভী সাহেবকে বলেছিল–আমি যদি হঠাৎ মারা যাই, চঞ্চল যাতে না খেতে পেয়ে মরে না যায়, সেই জন্য ইনসিওরেন্স করব ভাবছি। সেই সময় জব্বারকে খুব মনমরা এবং চিন্তিত দেখা গিয়েছিল।
টাকা পয়সার অভাব থাকলেও ইদানীং মোটা টাকার দরকার ছিল না তার। তেমন কোন বিপদে সে পড়েনি।
জব্বারের বন্ধু-বান্ধব তেমন কেউ ছিল না। একজন লোকের নাম সে মাঝেমধ্যে বলত। লোকটার নাম হোসেন। মৌলভী সাহেব তার সম্পর্কে আর কিছু জানেন না।
মৌলভী সাহেব দেখিয়ে দিতে শহীদ জব্বারের ঘরেও গেল। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র কম নয়। জব্বার যে মোটামুটি সচ্ছল ছিল আর্থিক দিক থেকে, বোঝা যায়। ঘরের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল ও, পুলিস তন্নতন্ন করে সন্ধান চালিয়ে গেছে। ঘরের পাকা মেঝে খুঁড়তেও বাকি রাখেনি তারা। তবু ঘরটা ভাল করে দেখল ও। কিন্তু পেল না কিছুই।
.
বসে নেই ডি. কস্টা। ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের কাছ থেকে নতুন তথ্য সেও পেয়েছে। ইন্সপেক্টরের সাথে কেসটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছে সে। আলোচনা করেছে মিস কাবেরীর সাথেও। মিস কাবেরী মি. সিম্পসনের প্রাইভেট সেক্রেটারি। ডি. কস্টার সাথে তার সম্পর্ক খুবই ভাল। মেয়েটি ডি. কস্টাকে বেশ পছন্দ করে। তার একটা বড় কারণও আছে।
ইন্সপেক্টর এবং মিস কাবেরী সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ডি. কস্টাকে। বেশ খুশি মনে বিদায় নিয়ে সোজাজব্বারের বাড়িতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ে সে। এবারও মৌলভী সাহেবই দরজা খুলে দেন।
মিনিট পাঁচেক মাত্র আলাপ করে ডি কস্টা মৌলভী সাহেবের সাথে। এর আগেই শহীদ উপস্থিত হয়েছিল একথা জানতে পেরে ডি কস্টা একটু রেগেই গেল। নিজের উপর।
ওখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরানা পল্টন এলাকায় পৌঁছুল ডি. কস্টা। ঠিক নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য ছিল না মনে। হঠাৎ খেয়ালটা চাপল। মাথায়–জব্বার যে বাড়িতে ডাকাতি করেছিল সেই বাড়ির লোকজনদের সাথে কথা বলে দেখলে হয়। আশপাশের লোকজনদেরকেও প্রশ্ন করা যেতে পারে।
বাড়িটা চারতলা। প্রতি ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। সবগুলো একই আকৃতি এবং আয়তনের। আশপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ উৎসাহিত হতে পারল না সে। এক বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, কালো একটা গাড়ি তিনি দেখেছিলেন বটে কিন্তু সেটা মরিস কিনা, ভিতরে কজন বা কেমন চেহারার লোক ছিল তা তিনি জানেন না।
বাড়িটার ভিতর প্রবেশ করল সে। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দরজার গায়ে লাগানো সাদা বোতামে চাপ দিল আঙুল দিয়ে, ভিতর থেকে কর্কশ ধ্বনি ভেসে এল। কলিংবেলের।
দরজা খুলল না। ভিতর থেকে মিষ্টি কিন্তু চাপা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে?
ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল ডি. কস্টার। কণ্ঠস্বরটা যারই হোক, খুব স্বস্তিতে নেই সে, বোঝা যাচ্ছে। উকণ্ঠা বা ভীতির ভাব পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে।
চিকন কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব গভীর এবং থমথমে করার চেষ্টা করে ডি. কস্টা বলল, দরজাটা খুলুন। হামি মি. স্যানন ডি. কস্টা-প্রাইভেট পুলিস।
সাথে সাথে খুলল না দরজা। ডি. কস্টার মনে হলো, কীহোলে চোখ রেখে মেয়েটি তাকে দেখছে। দরজাটা প্রায় নিঃশব্দে খুলে গেল এই সময়।
ডি. কস্টা দেখল তার সামনে হালকা নীল রঙের শিফনের শাড়ি পরিহিতা। অপরূপ সুন্দরী একটি যুবতী দাঁড়িয়ে। ডি. কস্টার আপাদমস্তক দেখল যুবতী।
ডি. কস্টা শরীরটা টান টান করল, টাইয়ের নটটা হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলল, ফাস্ট অভ অল, বলুন, আপনাকে এটো পরিচিট বলিয়া মনে হইটেছে কেন? কোঠায় আপনাকে ডেকিয়াছি?
যুবতী হাল, সুন্দর টোল পড়ল দুই গালে। সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল ডি. কস্টা।
ভিতরে আসুন। আমাকে পরিচিত বলে মনে হবার কারণটা দেখাব।
একপাশে সরে দাঁড়াল যুবতী। হাত-কাটা, পেট-কাটা রাউজে উধ্বাঙ্গ আবৃত-আবৃত না বলে অনাকৃত বলাই ভাল। কামরার ভিতর পা রাখল ডি. কস্টা। যুবতী একটা শো-কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, পিছন ফিরে। ডি. কস্টা কামরাটা দেখছিল ঘুরে ফিরে। বেশ দামী আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ড্রয়িং রুমটা। চারদিকটা দেখে যুবতীর দিকে তাকাল সে। তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা।
পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। শো-কেসের উপর কয়েকটা বাধানো ছবি দাঁড় করানো রয়েছে। ছবিগুলোতে বিভিন্ন ছায়াছবির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ছবিতেই দেখা যাচ্ছে যুবতাঁকে।
আরে সব্বোনাশ! টাইটো বলি, চেনা চেনা লাগে টবু অচেনা…! হাপনি অভিনেট্রি মিস করুণা!
ডি. কস্টার দিকে তাকাল করুণা সরাসরি। চোখ দুটো চকচক করছে তার। বলল, চিনতে পেরেছেন বলে ধন্যবাদ। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই আমাকে ভুলে গেছে। আসুন-বসা যাক।
মুখোমুখি সোফায় বসল ওরা।
সিগারেট ধরাটে পারি কি, ম্যাডাম?
অবশ্যই। দেখুন, কেমন মেয়ে আমি, আপনার আগমনের কারণটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।
প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল ডি কস্টা। জানতে চাইল, আপনাকে সবাই ভুলিয়া গেছে, বলিলেন। কঠাটা সট্যি নয়। আমার মটো ভক্টরা আপনাকে ভোলে নাই। কিটু ইডানীং আপনাকে টো কোন ছবিটে ডেকি না?
অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছি বছর কয়েক হলো।
কারণ?
করুণার মুখটা বিষাদে মান হয়ে উঠল। কপালের চুল দুপাশে সরিয়ে দিল মাথা নেড়ে, পায়ের উপর পা তুলে বসল নড়েচড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। বলল, সে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। দীর্ঘ এবং দুঃখজনক। সম্ভবত আপনি পত্রিকায় ঘটনাটার কথা শুনেছিলেন। ছায়াছবি জগতেরই এক উঠতি নায়ককে আমি ভালবাসতাম। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমি আমার সুনাম ব্যবহার করেছিলাম। সে ধীরে ধীরে প্রযোজক এবং দর্শকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। আমরা দুজনই পরস্পরকে ভালবাসতাম। বছরখানেক পর আমাদের বিয়ে হবে, এই রকম কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার রঙিন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একদিন আমি দেখে ফেললাম সে আমার সেক্রেটারি মেয়েটিকে নিয়ে বন্ধ কামরার ভিতর হাসাহাসি করছে। মনটা আমার ভেঙে গেল। ভেবেছিলাম, এ ব্যাপারে তাকে কিছু বলব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলাতে পারিনি। সে আমার সামনে আসতেই তাকে আমি যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি করি। সে অবশ্য ক্ষমা চায়। পরে সেক্রেটারি মেয়েটাকে সে জানিয়ে দেয়, তাদের সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। মেয়েটি সত্যি ভালবাসত তাকে। তার এই ধরনের হৃদয়হীন আচরণে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। পরদিন সে গাড়ি নিয়ে বেরোয়, পাহাড়ী পথ দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে খাদের দিকে ঘুরিয়ে দেয় গাড়ির মুখ। আসলে, আত্মহত্যা করে মেয়েটি। ঘটনাটা ঘটে চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে। শূটিংয়ে গিয়েছিলাম আমরা ওখানে। সেই আমার শেষ শূটিং। ঢাকা ফিরে সব ত্যাগ করি আমি। ছায়াছবির জগৎকেও, সেই লোককেও।
ডি. কস্টা সমবেদনা প্রকাশের ভঙ্গিতে আস্তে করে শুধু বলল, সিম্পলি প্যাথেটিক!
চুপ করে রইল এরপর দুজনই। নীরবতাটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলে ডি. কস্টাই কথা বলল, গটোরাটে যে ডাকাটি হইয়াছে সে ব্যাপারে ইনকোয়ারী করিটে আসিয়াছি আমি।
কিন্তু পুলিস তো…।
ডি. কস্টা বাধা দিয়ে বলে উঠল, পুলিসের মটমট বা বক্টব্যের সাঠে হামি এক মট নই। আমি কাজ করিটেছি দ্যাট ডাকাট জব্বারের পক্ষে। লোকটা মার্ডার হইয়াছে–টা জানেন?
পটলচেরা চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল করুণার, মানে যে লোকটা আমার আয়রন সেফ ভেঙে খুন হয়েছে সে? কী বলছেন আপনি? কিভাবে খুন হয়েছে?
ঘটনাটা বলল ডি কস্টা।
ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো!
ডি. কস্টা বলল, নো ডাউট। হামি চেষ্টা করিটেছি জব্বার খুন হইবার প্রকৃট কারণ খুঁজিয়া বাহির করিটে। আপনার আয়রন সেফ হইটে সে মাট্র টিন শট টাকা এবং ভরি টিনেক গোল্ড লুঠ করে। প্রশ্ন হইল, সে বা টাহারা কি আগে হইটে খোঁজ নেয় নাই? টাহারা কি জানিট না হাপনার সেফে বেশি কিছু নাই? হামার বিশ্বাস হয় না। অটো কম জিনিসের জন্য কেউ এমন ভুঃসাহসিক ডাকাটি করে না।
করুণা বলে উঠল, কী আশ্চর্য! কথাটা কিন্তু আমারও মনে হয়েছে। আমার কি ধারণা জানেন?
ডি. কস্টা চুপ করে রইল।
আমার ধারণা, আমার ফ্ল্যাটে নয়, আমার উপর তলার ফ্ল্যাটে ডাকাতি করতে এসেছিল তারা। আপনি সাইদুল হককে চেনেন?
চিনি না। নাম শুনিয়াছি। হি ইজ এ মিলিওনিয়ার। কয়েকটা হিট ছবির প্রডিউসার। শুনিটে পাই কয়েক শটো গার্ল ফ্রেন্ড আছে নাকি টার।
ঠিকই শুনেছেন। তার ফ্ল্যাটে সর্বক্ষণ হই-চই লেগেই আছে। বেশির ভাগই মেয়ে। প্রচুর খরচ করে সে। তার আয়রন সেফে মোটা অঙ্কের টাকা থাকার কথা। আমার মনে হয়, ওর ফ্ল্যাটেই ডাকাতি করতে এসেছিল, ভুল ক্রমে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে।
ডি. কস্টা অ্যাশট্রেতে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেলে দিয়ে চিন্তিত ভাবে বলল,। মিস করুণা, জব্বারকে হামি ডেকিয়াছি গটরাতে, সে খুন হইবার মিনিট কয়েক আগে। সে কাডিটেছিল। সে টাহার বাচ্চাকে একটা রেস্টুরেন্টে রাখিয়া আউট হইয়া যায়। বাহিরে গিয়াই সে খুন হয়। বাচ্চাটা এখন আমার কাছে রহিয়াছে। হামি এই ঘটনার টু এক্সপ্ল্যানেশন চাই। ঘটনাগুলো ঘটিয়াছে–এসবের পিছনে অফকোর্স কোন কারণ না ঠাকিয়া পারে না। সেই কারণ হামি আবিষ্কার করিবই করিব।
উঠে দাঁড়াল ডি. কস্টা, চলি, মিস করুণা। আপনার টাইম সি করিলাম বলিয়া ডুঃখিট। ভাল কঠা, হাপনার একটি ছবি উপহার ডিবেন হামাকে। হামি, হাপনার ভক্ট…।
করুণা অদ্ভুত রহস্যময়ভাবে হাসল। বলল, ছবি দিয়ে কি হবে? আমার ভক্ত আমাকে দেখতে চাইলে যখন ইচ্ছা আসতে পারে।
ডি কস্টা সানন্দে বলল, সেক্ষেট্রে হামি নিজেকে নাকি ম্যান বলিয়া মনে করিব।
আসবেন। ভক্তের সংখ্যা নেই বললেই চলে। আপনি আমার ভক্ত জেনে সত্যি কি যে আনন্দ লাগছে। আপনার জন্য আমার দরজা খোলা থাকবে।
ঢন্যবাদ-টন্যবাদ!
এক গাল হেসে বিদায় নিল ডি কস্টা।
.
০৫.
শেষ বিকেল।
নিচু তেপয়ের উপর জুতোসহ পা দুটো তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শহীদ ওর ড্রয়িংরুমে। চোখ দুটো বন্ধ। ডান হাতে জ্বলন্ত পাইপ।
নিঃশব্দে খুলে গেল দরজাটা। বৈকালিক নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল লেবু। কোন শব্দ না করে তেপয়ের কাছে এসে দাঁড়াল সে। দাদামণি কিছু চিন্তা করছে বুঝতে পারছে। টু-টা তেপয়ের উপরই রাখতে হবে। অথচ দাদামণির পা দুটো রয়েছে সেটার উপর। এদিকে সাড়া দিতেও সাহস হচ্ছে না। দিদিমণির কঠোর নিষেধ আছে দাদামণি যখন চিন্তাভাবনা করেন তখন তাঁর রূমে ঢোকাও অপরাধ।
বোকার মত দাঁড়িয়েই রইল লেবু।
খানিক পর ভিতরে ঢুকল মহুয়া। আগের চেয়ে রোগা হয়ে গেছে সে। তবে মুখের চেহারায় অদ্ভুত একটা কমনীয়তার ছাপ ফুটে উঠেছে। মাতৃত্বের সাধ পূরণ হয়েছে মহয়ার মাসখানেক হলো। চেহারার পরিবর্তন সেই কারণেই সম্ভবত।
ভিতরে ঢুকেই মহুয়া লেবুর সমস্যাটা বুঝতে পারল। শহীদের দিকে তাকাল সে, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল পাশে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল স্বামীর মুখের দিকে। গভীর চিন্তায় মগ্ন শহীদ। যেন সে টেরই পায়নি ওদের উপস্থিতি।
কিন্তু তা নয়। চোখ না খুলেই শহীদ বলল, লেবু এসেছিস? ট্রে-টা কার্পেটের উপর নামিয়ে রেখে যা।
মহুয়া মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও কি মনে করে বলল না কিছু। লেবু ট্রে-টা নামিয়ে রাখল কার্পেটের উপর নিঃশব্দে। বেরিয়ে গেল সে রূম থেকে।
মহুয়া নড়ল না।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং…। ফোনের বেল বেজে উঠতে শহীদ চোখ মেলল। মহুয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হলো ও। ফোনের রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, কখন এসেছটের পাইনি তো!
মহুয়া মিষ্টি করে হাসল। বলল, গোয়েন্দা সাহেবকে তাহলে ফাঁকি দিতে পেরেছি-না?
শহীদ মহুয়ার কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসল শুধু, রিসিভারটা কানে ঠেকাল, বলল, শহীদ খান স্পিকিং।
অপর প্রান্ত থেকে মৌলভী সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আসোলামু আলায়কুম! আমি মৌলভী আজহার আলি। ভাগ্য ভাল আপনার নামটা মনে রেখেছিলাম। তা না হলে খবরটা আপনাকে দেয়াই হত না। কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই দেরি হয়ে গেল ফোন করতে। খবরটা পেয়েছি আপনি যাবার পরপরই।
শহীদ বলল, ধন্যবাদ। কি খবর বলুন তো?
মৌলভী সাহেব বললেন, জব্বারের সাথে কারখানায় কাজ করত একজন লোক, তার সাথে হঠাৎ আমার দেখা হয়েছে। তার নাম ফরিদ আলি। জব্বার খুন হয়েছে শুনে সে বিশ্বাসই করতে চায় না। যাই হোক, কথায় কথায় সে আমাকে জানাল যে বেশ কিছুদিন আগে জব্বার তার বাড়িতে গিয়েছিল দাবা খেলতে। সেখানে জব্বারের খোঁজে একজন লোক যায়। লোকটার সাথে ছিল জব্বারের এক বন্ধু–যার কথা আপনাকে বলেছি–হোসেন। যাই হোক, লোকটা জব্বারকে জিজ্ঞেস করে তার পাওনা টাকা করে দিচ্ছে সে। জব্বার তাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কিছু দেয়। এরপর লোকটা বিদায় নিয়ে চলে যায়। হোসেনও চলে যায় তার সাথে। তারা চলে যাবার পর জব্বার ফরিদ আলিকে বলে, সে লোকটার কাছ থেকে তিনহাজার টাকা ধার করেছিল তার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য।
শহীদ চিন্তা করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, হোসেন–তার ঠিকানা জানেন?
ফরিদের কাছ থেকে জেনেছি। বাড়িটা আমাদের পাশের পাড়াতেই। সে একটা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার।
বাড়ির ঠিকানা এবং রেস্তোরাঁর নামটা বলুন, লিখে নিই।
মৌলভী সাহেবের দেয়া ঠিকানা লিখে নিল শহীদ। রেস্তোরাঁটাও পুরানো শহরে। নাম–গ্রীন রেস্টুরেন্ট। দেশী মদ বিক্রি হয় ওখানে গোপনে। পিছনে একটা দরজা আছে, সেই দরজার ওপারে লম্বা কামরা আছে দুটো। একটায় জুয়া খেলা হয়, অপরটিতে লোকজন গোপনে দেশি মদ খায়।
শহীদ বলল, মৌলভী সাহেব, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার ফোন নাম্বার তো জানা হয়ে গেছে আপনার, কখনও কোন বিপদে-আপদে পড়লে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আপনার উপকার করতে পারলে আমি খুশি হব।
মৌলভী সাহেব বললেন, এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আপনি যাবার বেশ খানিক পর। নাম বললেন মি. ডি কস্টা, আপনার সহকারী। তাকেও এই সব কথা আমি বলেছি…
শহীদ বলল, ঠিক আছে। ভালই করেছেন।
বিদায় নিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। তাকাল মহুয়ার দিকে, বলল, তুমি কি মনে করো, মহুয়া? ধরো একজন লোক সুদখোর কোন মহাজনের কাছ থেকে তিনহাজার টাকা ধার করল। প্রতিমাসে, ধরো, তিনহাজার টাকার সুদ হয় ছয়শো টাকা। এত টাকা প্রতি মাসে দেবার সামর্থ্য নোকটার নেই। তাই সে সম্পূর্ণ তিনহাজার টাকা পরিশোধ করে দিয়ে রক্তশোষক মহাজনের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে সে ডাকাতি করতে গেল। এখন বলো তো দেখি–এই রকম সমস্যায় লোকটা ডাকাতি করার পরিকল্পনা করল–একি অসভব?
না। খুবই সম্ভব। কিন্তু এসব কথা…
শহীদ হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল মহুয়াকে। বলল, থামো। ঘটনাটা ঘটেছে। ঘটনার প্রথম অংশটা বলেছি। এবার দ্বিতীয় অংশটা শোনো…
কিন্তু চা যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে…এই নাও।
ট্রে-টা তুলে দিল মহুয়া। কাপ তুলে নিল শহীদ। চুমুক দিল। বলল, লোকটার দুজন সঙ্গী ছিল। কিন্তু আয়রন সেফের তালা ভাঙে সে একাই। ভাগ্য খারাপ, সেফে মাত্র তিনশো টাকা এবং তিন ভরি সোনা পায় সে। এত অল্প জিনিস পাওয়ায় স্বভাবতই সে ধরে নেয় তার সঙ্গীরা তার কথা বিশ্বাস করবে না। কেননা এত অল্প টাকা একজন বিত্তবানের ফ্ল্যাটে থাকতে পারে না। তাই লোকটা পালিয়ে যায়। সে তার বাড়ি থেকে নিজের একমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুর্যোগ মাথায় করে। সে জানত, তার বিবেকহনি সঙ্গীরা তাকে ক্ষমা করবে না। সে সভবত এ-ও জানত যে সঙ্গীরা ইতিমধ্যেই তার খোঁজে পাগলের মত ছুটে আসছে। বাচ্চাকে নিয়ে সে একটা রেস্তোরাঁয় ঢোকে, বাচ্চাটিকে রেস্তোরাঁয় রেখে সে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাইরে তার সঙ্গীরা অপেক্ষা করছিল। তারা তাকে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করে। এখন বলো, ঘটনাটা ঘটতে পারে?
মহুয়া বলল, মনে হয় না। ভাগের টাকা না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বলে একেবারে খুন করে ফেলবে?
কিন্তু ঘটনাটা যে ঘটেছে।
মহুয়া বলল, আমার মনে হয়, তাহলে এই ঘটনার মধ্যে আরও কিছু ব্যাপার আছে।
ওয়াণ্ডারফুল! বুদ্ধিমত্রীর মতই কথা বলেছ তুমি, মহুয়া। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এর ভিতর আরও কিছু রহস্য আছে।
উঠে দাঁড়াল শহীদ।
কোথায় চললে এখন সন্ধ্যার সময়?
শহীদ বলল, সেই রহস্যের সন্ধানে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হতে পারে। দুশ্চিন্তা কোরো না। ভাল কথা, তুমি যখন মার্কেটিংয়ে গিয়েছিলে তখন কুয়াশা ফোন করেছিল। সে ঢাকায় ফিরে এসেছে আজ সকালে। রবিনের কথা জিজ্ঞেস করছিল। কাল সকালে দুজন লোক পাঠাবে, রবিনের জন্য খেলনা নিয়ে আসবে তারা।
রবিন–শহীদের পুত্র সন্তান।
মহুয়া হাসিতে ভেঙে পড়ে বলল, একমাসের শিশুর জন্য দাদা দুজন লোককে দিয়ে খেলনা পাঠাবে? রবিন খেলতেও তো শেখেনি।
শহীদ মুচকি হেসে বলল, একদিন তো শিখবে। তা ছাড়া, সাধারণ খেলনা সে পাঠাবে না। মিনি সাবমেরিন, রকেট, মাইক্রোস্কোপ, কমপিউটর–এইসব পাঠালেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
.
কুয়াশার এগারো নম্বর আস্তানাটা ঢাকা শহরের বাইরে। বাড়িটা একতলা। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভিতরে সুন্দর একটি বাগান। সেই বাগানে মুখোমুখি বসে ছিল রাজকুমারী এবং কুয়াশা। এমন সময় খুক খুক করে কে যেন কাশল। রাজকুমারী মুখ তুলে এদিক ওদিক তাকাল, মুখ টিপে একটু হাসল সে। কুয়াশা বলল, আসুন, মি, ডি. কস্টা।
একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ডি কস্টা। প্রথমেই তার চোখ পড়ল কুয়াশার হাতের লাল টকটকে গোলাপ ফুলটার দিকে। সামনে এগিয়ে গিয়ে সশব্দে স্যালুট করল সে।
কুয়াশা জানতে চাইল, কি খবর, মি. ডি. কস্টা?
কুয়াশার হাতের ফুলটার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল ডি. কস্টা। সর্বশেষ ঘটনা, যা সে মৌলভী সাহেবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, তা-ও বলল। সব শুনে কুয়াশা চিন্তা করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর প্রয়োজনীয় নির্দেশ এবং পরামর্শ দিল ডি. কস্টাকে।
আলোচনা শেষে বিদায় নেবার সময় ডি কস্টা দেখল কুয়াশার হাতের গোলাপটা কুয়াশার হাতে নয়, কখন যেন রাজকুমারীর খোঁপায় চলে গেছে।
সন্ধ্যার সময় বেরুল ডি. কস্টা। গ্রীন রেস্টুরেন্ট হলো তার গন্তব্যস্থান।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ডি. কস্টা গ্রীন রেস্টুরেন্টের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পায়ে হেঁটে এগোল সে। বারবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকটা দেখে নিতে ভুল করল না। বস্ যখন গ্রীন রেস্টুরেন্টে যেতে নিষেধ করেছে, তখন নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায় জায়গাটা বিপজ্জনক।
বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। সুতরাং সবদিক থেকে সাবধান হয়েই পা বাড়ানো উচিত। পকেটের ভিতর রিভলভার ঠিকই আছে। লোড করতে, চেক করতেও ভুল করেনি সে।
বাইরে থেকে রেস্টুরেন্টটা দেখতে আর সব চালু, খরিদ্দারের ভিড়ে ঠাসা রেস্টুরেন্টের মতই দেখতে। শান্ত ধীর ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকল ডি. কস্টা। প্রায় সব টেবিলেই লোক রয়েছে। কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। যে লোকটা খরিদ্দারদের বিল বাবদ টাকা-পয়সা নিচ্ছিল সে মুখ তুলে তাকাল। ডি কস্টা জানতে চাইল, হোসেন কোথায়?
লোকটা মুখ তুলে তাকাল। ডি. কস্টার ভাঙা গাল, চোঙা প্যান্ট, ঠোঁটে সদ্য ধরানো সিগারেট, মাথায় হ্যাট দেখে এবং প্রশ্ন করার সাবলীল ভঙ্গি দেখে সে ধরে নিল হোসেন অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের সহকারী ম্যানেজারের পরিচিত লোক ইনি।
ভিতরের কামরায়। যান।
চাপা স্বরে কথাটা বলে লোকটা বিলের টাকা-পয়সা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ডি. কস্টা কি করবে বুঝতে পারল না। ভিতরের কামরা কোথায়? এদিক ওদিক তাকাল সে। দেখল রেস্তোরাঁর পশ্চিম কোনায় ছোট একটা দরজা, দরজাটা ভেজানো রয়েছে, দরজার গায়ে লেখা বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। ডি. কস্টা পা বাড়াল সেদিকেই।
দরজা খুলে একটা প্যাসেজ দেখল ডি কস্টা। কেউ নেই সেখানে। প্যাসেজের এখানে সেখানে ভাঙা কাঠের বাক্স, বেতের ঝুড়ি, ভাঙা কাঁচের স্তূপ ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হয়, এই প্যাসেজ ব্যবহার বা পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন।
এগিয়ে চলল ডি. কস্টা। বাঁক নিয়েছে প্যাসেজটা গজ দশেক গিয়ে। বাক নিতেই সে দেখল বড়সড় একটা দরজা দেখা যাচ্ছে শেষ মাথায়।
দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দেখল। খুলল না। ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার গায়ে কান ঠেকিয়ে শোনার চেষ্টা করল। অনেক লোকের গলা শোনা যাচ্ছে, তবে স্পষ্ট নয় কিছুই।
নক করল ডি. কস্টা।
কেউ বুঝি দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, সাথে সাথে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?
দেরি করল না ডি কস্টা উত্তর দিতে, চিনিবেন না হামাকে। হোসেনকে ডেকে দিন।
দরজার ভিতর থেকে উত্তর এল, হোসেন সাহেব এখন ব্যস্ত। কি দরকার আপনার?
ইডিয়েট। ডরকারের কঠা তোমাকে বলিব কেন?
এই কথার পর খুলে গেল দরজা। আঁতকে উঠল ডি. কস্টা। পিছিয়ে আসতে গিয়ে সামলে নিল কোনমতে। বিশাল একটা পাহাড় যেন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকতে মনে হলো একটা পাহাড় যেন তার গায়ের উপর পড়ার উপক্রম করছে।
ভিতরে আসুন। হোসেন সাহেব দুই নম্বর কামরায় আছেন।
ঢোক গিলে সাহস যোগাতে যোগাতে ভিতরে ঢুকল ডি. কস্টা। কামরাটা চারকোনা এবং বেশ বড়। দুপাশে দুই সারি চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে। প্রত্যেকটি চেয়ারে লোক রয়েছে। লোকগুলো ডি. কস্টার দিকে ফিরেও তাকাল না। টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ে সবাই জুয়া খেলছে। তিন তাস, অর্থাৎ ফ্ল্যাশ খেলা হচ্ছে। কামরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ভালভাবে দেখা যায় না। সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা।
কামরার অপর দরজাটা খোলা। সেদিকে এগোল ডি. কস্টা।
চৌকাঠ পেরিয়ে দুই নম্বর কামরায় ঢুকতেই তীব্র গন্ধ পেল সে। মদের ঝঝাল গন্ধ। এ কামরাটাও বেশ বড়। চেয়ার টেবিলের সংখ্যা অনেক বেশি। খালি চেয়ারের সংখ্যা কম নয়। বিশ-পঁচিশজন গুণ্ডাপাণ্ডা চেহারার লোক বসে বসে মদ খাচ্ছে। ভীষণ শোরগোল এই কামরায়। বক বক করছে প্রায় সবাই। হোঃ হোঃ করে কারণে অকারণে হাসছে কেউ কেউ। কেউ কেউ নাকি সুরে কাঁদছেও। টেবিলে ঘুসি মারতে মারতে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করছে একজন লোক। মৃদু শব্দে একটা রেডিও বাজছে কাউন্টারে।
কামরাটার একদিকে একটা কাউন্টার। সোজা এগিয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। মদ পরিবেশনরত লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসল, যেন কত যুগের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ডি. কস্টার সাথে। কার সাথে এসেছেন স্যার? হারলেন না জিতলেন?
ডি. কস্টা গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, হারিও নাই, জিতিও নাই। আমি হোসেনকে খুঁজিটেছি।
হাসিটা একটু মান হলো, ডি. কস্টার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তারপর কাছাকাছি একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, ওই তো হোসেন সাহেব।
ঘুরে দাঁড়াল ডি. কস্টা। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে লোকটা চেয়ারে। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ডি. কস্টার দিকে তাকাল সে। চমকে উঠে বলল, কে আপনি?
প্রাইভেট পুলিস। টুমি হোসেন?
আবুল হোসেন বোকার মত চেয়ে রইল কিছুক্ষণ ডি. কস্টার দিকে। তারপর চেহারায় ফুটে উঠল ভয়, দ্রুত তাকাল এদিক ওদিক অসহায় ভাবে।
প্রাইভেট পুলিস–বুঝলাম না? কি চান আপনি? এখানে ঢুকলেন কি ভাবে!
ডি. কস্টা বলল, মি. হোসেন, হামাকে প্রাইভেট পুলিস বা প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলিটে পারো। জব্বার টোমার ফ্রেণ্ড ছিল, টাই না? সে খুন হয়েছে–টুমি জানো। অ্যাণ্ড আই অ্যাম শিওর, সে খুন হইয়াছে বলিয়াই টুমি ভয়ে মরিয়া যাইটেছ। ঠিক না?
আমি কিছু জানি না…বিশ্বাস করুন! দয়া করে আপনি চলে যান…।
কথা কটা বলে উঠে দাঁড়াল আবুল হোসেন, পা বাড়াল দ্রত। ডি. কস্টা ধরে ফেলল তার শার্টের আস্তিন, কিন্তু জোর করে নিজেকে মুক্ত করে এগিয়ে চলল সে। ঠিক সেই সময় তার চোখ পড়ল দরজার দিকে। দুটো কামরার মধ্যবর্তী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশাল পাহাড়, তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ডি. কস্টার দিকে।
হোসেন প্রায় ছুটতে ছুটতে দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছুল। পাহাড়ের মত প্রকাণ্ড লোকটা সরে দাঁড়াল একপাশে। দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল হোসেন।
ডি. কস্টা চেয়ে আছে সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। প্রকাণ্ডদেহী লোকটাও তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে।
কেন যেন ঘামছে ডি. কস্টা। পা দুটো পাথরের মত ভারি হয়ে গেছে তার, নড়াতে পারছে না। চোখ সরাচ্ছে না সে, তাকিয়ে আছে–লোকটাও চোখ ফেরাচ্ছে না, পলকহীন চোখে চেয়ে আছে তার চোখের দিকে।
আর কেউ, শুধু মদ পরিবেশনরত লোকটা ছাড়া; ওদের দুজনের দিকে নজর দিচ্ছে না।
ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল ব্যাপারটা। কতক্ষণ কাটল হিসেব নেই ডি. কস্টার। নড়ছে না দুজনার কেউই। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে।
পাঁচ কি দশ মিনিট কেটে গেছে, বলতে পারবে না ডি কস্টা। এক সময় সে দেখল দুজন নোক ঢুকল কামরার ভিতর। প্যান্ট-শার্ট পরা, লাবণ্যহীন কদাকার দর্শন দুজন লোক।
কামরার ভিতর ঢুকেই চারদিকে তাকাল তারা। কাউকে যেন খুজছে। চোখেমুখে অস্বাভাবিক কাঠিন্য। দূর থেকেও ডি কস্টা বুঝতে পারুল লোক দুজন ভীষণ উত্তেজিত এবং মরিয়া হয়ে এসেছে। কোন অঘটন ঘটাবার উদ্দেশ্য আছে ওদের।
প্রকাণ্ডদেহী লোকটার সাথে কথা বলছে লোক দুজন। লোকটা দরজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোক দুজনকে কি যেন বলছে, বোঝাবার চেষ্টাও করছে। কথা বলতে বলতে লোকটা ডি.কস্টার দিকে আঙুল তুলে দেখাল একবার।
হঠাৎ ডি. কস্টা একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করল। এতক্ষণ মদ্যপানরত মাতালদের শোরগোলে কানপাতা দায় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কখন যেন সব শোরগোল অকস্মাৎ থেমে গেছে। একটা বড় কামরার ভিতর পঁচিশ-ত্রিশজন লোক রয়েছে অথচ একটা টু-শব্দ পর্যন্ত নেই। কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলছে না। সবাই নিঃসাড়, মর্মর মূর্তির মত, মাথা নিচু করে যে যার চেয়ারে বসে আছে।
কারণটা বোঝা কঠিন নয়। সদ্য আগত লোক দুজনকে দেখে সবাই এমন চুপ হয়ে গেছে। তার মানে লোক দুজনকে সবাই চেনে। এরা নিশ্চয়ই….
চমকে উঠল ডি. কস্টা। লোক দুজন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। স্বাভাবিক হাসি নয়, ব্যঙ্গ মেশানো হাসি।
দুজনের একজন যে লোকটা একটু বেশি লম্বা, বেশ জোর গলায় বলল, ব্যাটা দেখছি একেবারে তালপাতার সেপাই। যাই বলিস, ওকে মারতে বড্ড মায়া লাগছে। আমার।
কথাগুলো বলে পকেট থেকে একটা দুই হাত লম্বা সাইকেলের চেন বের করল সে।
অপর লোকটার পকেট থেকে বেরিয়ে এল চকচকে একটা ছোরা। ফিকফিক করে হাসছে সে-ও ডি. কস্টার দিকে তাকিয়ে। চিৎকার করে সে বলল, ওহে পাটখড়ি, প্যান্ট খারাপ করে ফেলোনি তে এরই মধ্যে?
লম্বা লোকটা পা বাড়াল। প্রকাণ্ডদেহী লোকটা ঘুরে দাঁড়াল, পা বাড়াল দরজার দিকে। বেরিয়ে গেল সে কামরা থেকে।
লম্বা লোকটার সাথে সাথে অপর লোকটাও এগিয়ে আসছে ডি. কস্টার দিকে। হঠাৎ উচ্চকিত হয়ে উঠল রেডিওর শব্দ। কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে সাউণ্ড।
ডি. কস্টার হত তিনেক সামনে থামল নোকটা। সাইকেলের চেনটা ঘোরাতে শুরু করল সে। ডি. কস্টার মুখের ইঞ্চি কয়েক সামনে দিয়ে সবেগে ঘুরছে সেটা।
পকেটে হাত ভরল ডি কস্টা, যেন সিগারেট-দিয়াশলাই বের করতে যাচ্ছে–পরমুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে রিভলবারটা বের করে এক পা পিছিয়ে এল, সিলিংয়ের দিকে রিভলবারের মুখ উঁচিয়ে গুলি করল।
ফাঁকা আওয়াজ করাই উদ্দেশ্য ছিল ডি. কস্টার। কিন্তু ভাগ্য পরিহাস করল তার সাথে। গুলি বের হলো না।
বিমূঢ়, বোকা দেখাল তাকে। আবার ট্রিগার টেনে একই অবস্থা, বের হলো না
এগিয়ে আসছে আবার লম্বা লোকটা। রিভলবার দেখে শুকিয়ে গিয়েছিল মুখ, আবার হাসছে সে। এবারের হাসিটা নির্মম।
সাইকেলের চেন ঘোরাতে ঘোরাতে পা বাড়াচ্ছে সে। পিছিয়ে যাচ্ছে ডি. কস্টা। পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকে গেল তার।
কোন উপায় নেই–অসহায়ের মত মার খেতে হবে। হাতের রিভলবারটা সবেগে সামনের লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারল সে। তৈরি ছিল লোকটা। মাথাটা একপাশে সরিয়ে নিল। লাগল না রিভলবারটা। দ্রুত দুপা এগিয়ে এল সে, ঘুরন্ত চেনটা সবেগে ঘা মারল ডি. কস্টার মাথায়।
অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার করে উঠল ডি. কস্টা। কেটে গেছে তার মাথার চামড়া। কপাল, নাক, গাল বেয়ে তাজা উষ্ণ লাল রঙের দুটো ধারা নেমে আসছে। বুকে, সাদা শার্টের উপর।
চেনের দ্বিতীয় আঘাতটা লাগল ডি. কস্টার কাঁধে। বসে পড়ল সে। আত্মরক্ষার জন্য দুই হাত দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
থামা এবার তোর চেন। শালার পেটটা দুই ফাঁক করে দিয়ে বেরিয়ে যাই চল! উল্লসিত কণ্ঠে বলল বেঁটে লোকটা।
লম্বা লোকটা সরে দাঁড়াল। বেঁটে লোকটা দাঁড়াল ডি. কস্টার সামনে। সজোরে লাথি মারল সে ডি. কস্টার পাঁজরে। কোঁৎ করে একটা শব্দ বেরুল ডি. কস্টার মুখ থেকে। কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে।
বেঁটে লোকটা ছোরা তুলল ডি. কস্টার পেটে আঘাত করার জন্য। ডি. কস্টা আতঙ্কিত চোখে দেখল, ধারাল ফলাটা নেমে আসছে তার পেট বরাবর…
.
হোসেন–এই রেস্তোরাঁর সহকারী ম্যানেজার, কোথায় সে?
রেস্তোরাঁর ক্যাশিয়ার সুবেশী, দীর্ঘদেহী শহীদের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল, এদিক ওদিক তাকাল, তারপর আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করল, হোসেন…মানে, স্যার, আমি ঠিক বলতে পারছি নাঃমানে, আমি বলতে চাইছি।
লোকটা ভয় পেয়েছে, বুঝতে পারল শহীদ। ইন্দ্রিয়গুলো সতর্ক হয়ে উঠল তার। কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে এখানে, অনুভব করল ও। এইমাত্র ঢুকেছে সে-এবার ভাল করে তাকাল চারদিকে। দৃষ্টি আটকে গেল একজন লোকের দিকে। লোকটা বোম্বাইয়া বলে মনে হয়। ঢোলা শার্ট এবং সালোয়ার পরনে। চোখাচোখি হতেই লোকটা রেস্তোরাঁর পশ্চিম দিকের দরজাটার দিকে ইশারা করল। ।।শহীদের চোখেমুখে কোন ভাবই ফুটল না। দৃঢ় এবং দ্রুত পদক্ষেপে দরজাটার দিকে এগোল।
প্যাসেজে পৌঁছে শহীদ রিভলভারটা বের করল পকেট থেকে। এগোল। বাক নিয়ে দেখতে পেল দরজাটা বন্ধ বলে মনে হলেও মৃদু ধাক্কাতেই খুলে গেল সেটা।
কামরাটা শূন্য। কেউ নেই। কিন্তু পাশের কামরা থেকে ডি. কস্টার আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে, শুনতে পেল ও।
ক্রেপসোল লাগানো জুতো শহীদের পায়ে, তাই ছুটতে শুরু করলেও শব্দ হলো না বিশেষ। পাশের কামরার দরজার সামনে গিয়ে ও দেখল চেয়ারে অনেক লোক বসে আছে ঠিক, কিন্তু কেউ নড়ছে না। যেন নিষ্প্রাণ, মৃত সবাই। দেখল, ডি. কস্টাকে লাথি মারছে একজন ছোরাধারী লোক।
ডি. কস্টা কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। ছোরাটা উঁচিয়ে ধরল লোকটা। ডি কস্টা চিৎকার করে উঠল ভয়ে।
ঠাস!
গর্জে উঠল শহীদের হাতের রিভলভার। বুলেট গিয়ে লাগল ছোরার গায়ে, লোকটার হাত থেকে ছুটে গিয়ে লাগল সেটা দেয়ালে, সশব্দে পড়ল তারপর মেঝেতে। প্রায় একই সময়ে বেঁটে এবং লম্বা নোকটা লাফ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দাঁড়াতেই শহীদকে দেখতে পেল তারা।
শহীদ কঠিন স্বরে বলল, হাত তোল মাথার ওপর..
পা বাড়াল শহীদ, এমন সময় পিছন থেকে দুটো লৌহ কঠিন বাহু জড়িয়ে ধরল ওকে। লোমশ, মোটা ডান হাতটা শহীদের গলা পেচিয়ে ধরেছে। বাঁ হাতটা ধরে ফেলেছে ওর রিভলভার ধরা হাতের কব্জি। লোকটা লুকিয়ে ছিল এক নম্বর কামরার দরজার আড়ালে।
মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়লেও, প্রথম সুযোগেই শহীদ নিজেকে মুক্ত করার জন্য বাঁ হাতের কনুই চালাল পিছন দিকে। প্রকাণ্ডদেহী নোটার পাঁজরে লাগল কনুইটা–অক্ করে ককিয়ে উঠল তীব্র ব্যথা পেয়ে। শহীদ কনুই চালাবার পরপরই ডান পা দিয়ে লোকটার একটা পায়ে লাথি মারল।
তাল হারিয়ে ফেলল লোকটা। শহীদের গলা থেকে তার হাতটা একটু সরে গেল। সুযোগটা নিল শহীদ সাথে সাথে। মাথাটা বিদ্যুৎবেগে পিছন দিকে নামিয়ে দিল যতটা সম্ভব।
লোকটার নাকে লাগল শহীদের শক্ত মাথা। তীব্র যন্ত্রণায় চোখে শর্ষে ফুল দেখল শত্রু। কিন্তু শহীদের রিভলভার ধরা হাতটা সে ছাড়ল না। শহীদ আবার কনুই চালাল। কিন্তু এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো ও। লোকটা তাল হারিয়ে ঝুলে পড়েছে। শহীদকে ধরে। তার ডান হাতটা আবার চেপে বসছে শহীদের গলায়।
শহীদ হঠাৎ নিজের শরীরটা নরম করে, ঝুপ করে বসে পড়ল। প্রস্তুত ছিল না লোকটা এই কৌশলের জন্য। শহীদের সাথে সাথে মেঝের উপর বসল সে-ও। তাল সামলাবার জন্য ডান হাতটা মেঝেতে রাখল সে শহীদের গলা থেকে নামিয়ে। শহীদ এই ফাঁকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
লোকটার আগেই উঠে দাঁড়াল শহীদ। কিন্তু রিভলভার ধরা হাতটা মুক্ত করতে পারল না। জোরে টান মেরে হাতটা মুক্ত করার চেষ্টা করে এবার সক্ষম হলো বটে, কিন্তু হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে, গড়িয়ে সেট। অদৃশ্য হয়ে গেল টেবিল-চেয়ারগুলোর নিচে।
হাতটা মুক্ত করে শহীদ দেখল লোকটা উঠে দাঁড়াচ্ছে। মাথা লক্ষ্য করে লাথি চালাল। লাথিটা লাগল মুখে। শুয়ে পড়ল মহীরুহের মত দেহধারী শত্রু। থোর থোঃ করে থুথু ফেলল সে। রক্ত এবং রক্তের সাথে তিনটে সাদা দাঁত ছিটকে পড়ল মেঝেতে। এক পা পিছিয়ে গিয়ে আবার লাথি চালাল শহীদ।
এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। কপালের পাশে প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে নিঃসাড় অজ্ঞান হয়ে গেল প্রতিপক্ষ।
ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। ডিকস্টা একা রয়েছে দেয়ালের কাছে–শয়তান দুটো পালিয়েছে।
ডি. কস্টা এইমাত্র উঠে বসেছে। পকেট থেকে তুলো বের করে নিজেই নিজের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে সে। মাথার ক্ষতস্থানে তুলো বসিয়ে চেপে ধরছে সে হাত দিয়ে। রক্তপড়া বন্ধ হয়েছে। এই তুলোর সাথে মলম লাগানো আছে।
কারও দিকে তাকাল না শহীদ। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টার কাছে। হাতটা বাড়িয়ে দিতে সেটা ধরে উঠে দাঁড়াল ডি কস্টা। শহীদ জানতে চাইল, পারবেন হাঁটতে?
ঢন্যবাড–বোডহয় পারিব।
লোকগুলো চেয়ে আছে ওদের দিকে। কারও চোখে পলক নেই। কারও মুখে কথা নেই। নিঃশ্বাসও পড়ছে না যেন কারও।
কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল শহীদ। বলল, রিভলভারটা–কোথায় সেটা?
দুজন মাত্র লোক নড়ে উঠল। টেবিলের নিচে থেকে দুজনই কুড়িয়ে নিল দুটো রিভলভার। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে। একজন ডি. কস্টার দিকে, অপরজন শহীদের দিকে বাড়িয়ে দিল রিভলভার।
রিভলভার দুটো লি ওরা। শহীদ বলল, আজ থেকে এখানের আড্ডা বন্ধ। এরপর এখানে যে আসবে, নিজের দায়িত্বে আসবে।
কামরা থেকে বেরিয়ে গেল ওরা।
এক নম্বর কামরায় কেউ নেই। প্যাসেজে বেরুবার দরজাটা খোলা দেখা যাচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াল ওরা।
দরজার কাছ থেকে হাত দুয়েক দূরে একজন লোক হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা রিভলভার। লোকটা নড়ছে না।
দেহটার পাশে বসল শহীদ। পালস্ দেখল। নেই। অর্থাৎ খুন হয়েছে লোকটা। কিন্তু মেঝেতে এক ফোঁটা রক্তও নেই। লোকটাকে খুন করা হয়েছে ঘাড় মটকে।
মিস্টিরিয়াস টাই না?
শহীদ উত্তর দিল না। চিন্তিতভাবে উঠে দাঁড়াল সে।
ডি কস্টা আবার বলে উঠল, কি কার কীর্টি এটা, মি. শহীড?
শহীদ বলল, সম্ভবত কুয়াশার।
হোয়াট!
.
০৬.
বাড়িটা দোতলা। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মুখোমুখি পড়ে গেল ডি কস্টা এক সুলাঙ্গী বুড়ির। ডি. কস্টার মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাধা দেখে সন্ধিহান চোখে তাকাল সে।
হামিহোসেনের সাটে ডেকা করিটে আসিয়াছি–সে কি বাড়িটে আছে?
বুড়ি খেপে গেল, ওই মাতালটার কথা বাপু আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। কদিন থেকে যেন আরও বেশি খাচ্ছে। মদও খাবে আবার কাঁদবেও। বাড়িওয়ালাকে বলতে হবে এবার, দেবে লাথি মেরে তাড়িয়ে…
ডি. কস্টা দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন না করে সিঁড়ির ধাপ টপকে আবার উঠতে শুরু করুল। বুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল, পছন্দ হলো না বুঝি আমার কথাগুলো। তা হবে কেন-একই পথের পথিক নিশ্চয়!
উপরে উঠে সামনেই একটা দরজা পেল ডি. কস্টা। সেটা ভিতর থেকে বন্ধু। পাশেই একটা জানালা, খোলী রয়েছে সেটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পাওয়া গেল হোসেনকে। বিছানার উপর বসে মদের বোতল থেকে মদ ঢালছে গ্লাসে, বিড়বিড় করে কিছু বলছে আপন মনে, দুচোখ ভরা পানিও দেখা যাচ্ছে তার।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ডি. কস্টা। নক করল।
ভিতর থেকে সাড়া দিল হোসেন, পরে এসো। আমি এখন ব্যস্ত।
ডি. কস্টা বলল, পুলিস।
আর কোন শব্দ এল না ভিতর থেকে। কয়েক মুহূর্ত পর খুলে গেল দরজাটা। ডি. কস্টাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল হোসেন। পিছিয়ে গেল এক পা।
ঠোঁট বাঁকা করে হাসল ডি. কস্টা। ভিতরে ঢুকল। বলল, ইয়েস, বঁচিয়া আছি। মরি নাই। আমাকে খুন করিবার জন্য যাহাড়েরকে লেলাইয়া ডিয়াছিলে টাহাড়ের একজন মার্ডার হইয়া গিয়াছে, বাকি দুইজন, পালাইয়াছে।
বেশ নেশা হয়েছে হোসেনের। প্রায় টলছে সে। নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে সে বলল, কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না আমি…।
শাটআপ! ফের মিঠ্যে কঠা! টুমি টাহা হইলে এই কৌশলেই জব্বারকে খুন করাইয়াছটাই না?
প্রায় লাফিয়ে এসে হোসেন ডি. কস্টার হাত দুটো জড়িয়ে ধরল, বলল, বিশ্বাস করুন, আমি এসবের জন্য একবিন্দ দায়ী নই-খোদার কসম বলছি। ওখান থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে ঢুকেছিলাম, সেখানে থাকতে থাকতেই শুনি তিনজন। লোক গিয়েছিল আমার খোঁজে, আমাকে তারা না পেয়ে আপনাকে খুন করার চেষ্টা করে…এর বেশি আমি কিছু জানি না। আপনার দুটো পায়ে পড়ি, আমাকে অবিশ্বাস.. করবেন না। জব্বারের খুন হওয়া সম্পর্কেও আমি কিছুই জানি না।
ডি কস্টা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, লোকগুলি টোমাকে খুঁজিটে গিয়াছিল? হোয়াই? টোমাকে না পাইয়া টারা আমাকে খুন করার চেষ্টা করে। টোমাকেও কি টাহারা খুনরিটে গিয়াছিল?
তা জানি না…খোদার কসম…
উহারা…উহাডের পরিচয় কি?
খোদার কসম, তাও আমি জানি না! দোহাই আপনার আপনি চলে যান।
চলিয়া যাইব? কেন চলিয়া যাইব? টুমি ভয় পাইটেছ। কাহাকে, কেন ভয় পাইটেছ? সব কঠা খুলিয়া বলো, টোমাকে হামরা হেলপ করিব…{
না-না-না! মুখ খোলার উপায়…না মানে, আমি কিছুই জানি না, বিশ্বাস করুন। ..
ডি. কস্টা হেসে উঠল। বলল, সবই জানো টুমি। ভয়ে বলিটেছ না। কাকে ভয় করো টুমি, হোসেন?
আপনি যান, দোহাই আপনার, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
জব্বার তোমার বন্দু ছিল। টিন হাজার টাকা লোন করিয়াছিল সে একজন সুদখোর লোকের নিকট হইটে। কে সেই লোক?
আমি জানি না।
আলবট জানো। জব্বারকে কেউ ফাডে ফেলিয়া ক্রাইম রিটে বাঢ্য করিয়াছিল। ডেকা যাইটেছে টুমিও ফডে পড়িয়াছ কাহারও। ভাল চাহিলে এখনও বলল, কে সেই সুদখোর মহাজন? এই শেষবার জানিটে চাহিটেছি। জবাব না ডিলে আমি পুলিস ডাকিটে বাঢ্য হইব।
হোসেন টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে চৌকির উপর বসে পড়ল ধপ করে। ভেঙে পড়েছে। বলল, বউ-এর অপারেশনের জন্য টাকা ধার করেছিল জব্বার। আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে লোকটার কাছে।
কে সে? কি টাহার নাম?
আন্নাউদ্দিন। কোথায় থাকে জানি না। তবে গ্রীন বারে তাকে প্রায় সবসময়ই পাওয়া যায়।
অপারেশন টো হয়নি–আগেই জব্বারের ওয়াইফ মারা যায়। টাকাটা ফেরত দেয়নি জব্বার?
জানি না! জানি না!
পকেট থেকে বুলেট শূন্য রিভলভারটা বের করল ডি কস্টা, চলে, ঠানায়। চলো।
হোসেন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল রিভলভারটার দিকে ঢোক গিলল সে বলল, অপারেশনের জন্য দরকার ছিল আট হাজার টাকা। তিন হাজারের বেশি ধার পায়নি সে। তিন হাজার টাকা নিয়ে তাই সে বসে জুয়া খেলতে। প্রথম দিন জেতে এক হাজার টাকা। কিন্তু তারপর দিন সব টাকা সে হেরে যায়
ডি. কস্টা বলল, হু। টার মানে টাকা সে পরিশোঢ় করিটে পারে নাই। টারমানে সুডখোর আলাউদ্দিনের কাছে যেটে হোবে হামাকে। ঠিক আছে। লিসেন, ইউ ব্লডি ইডিয়েট, এখনও সময় আছে যা জানো সব বলে ডাও।
বিশ্বাস করুন, খোদার কসম…
বলিবে না, জানি আমি। টবে মরো। ঘুরে দাঁড়াল ডি. কস্টা! দরজার দিকে দ্রুত পা বাড়াল। পিছন থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হোসেন।
.
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ ফাইল থেকে মুখ তুলে ডি. কস্টাকে দেখে হাসল, কয়েক মিনিট সময় দাও আমাকে, হাতের কাজটা সেরে নিই।
একটা চেয়ার দখল করে ডি কস্টা সিগারেট ধরাল। চোখ বুজে ধূমপান করতে লাগল সে। শহীদ খান চিন্তা করার সময় ধূমপান করে, তাই সে-ও ধূমপান। শুরু করেছে ইদানীং।
মিনিট কয়েক পর ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ ফাইল বন্ধ করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চাইল, কি ভাবছ এত?
ডি. কস্টা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, এটো রাট্র অবটি ওয়ার্ক করিটেছ যে?
ইন্সপেক্টর বলল, খবরের কাগজ পড়ো না নাকি তুমি! শহরে হই-চই পড়ে গেছে–কিছুই জানো না? মি. সিম্পসন ঘোষণা করেছেন এক মাসের মধ্যে জুয়ার গোপন আড্ডাগুলো ভাঙবেনই। স্মল-আর্মসের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করবেনই।
ডি. কস্টা মুখ বাঁকা করে বলল, কি এই টরনের প্রতিজ্ঞা টো টিনি আগেও করিয়াছিলেন।
তা ঠিক। বছর খানেক আগে উঠে পড়ে লেগেছিলাম আমরা আড্ডাগুলো ধ্বংস করার জন্য। পারিনি।
হোয়াট ওয়াজ দ্য কজ?
কারণ হলো, গোপনে খবর পেয়ে যতবারই আমরা আড্ডায় হানা দিতে গিয়েছি ততবারই গিয়ে দেখেছি আড্ডাবাজরা পালিয়েছে। অর্থাৎ শয়তানগুলো যেভাবেই হোক আগে ভাগে খবর পেয়ে যায়, তাই পালায়।
টারপর?
মি. সিম্পসন তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সবচেয়ে আগে আবিষ্কার করতে হবে শয়তানরা কিভাবে ধ্বর পেয়ে যায় সেই তথ্য।
ডি. কস্টা বলল, টারমানে মি. সিম্পসন সহে করেছিলেন এই অফিসেই কোনট্রেটর আছে।
হ্যাঁ। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে বলে সন্দেহ হয়েছিল আমাদের। কিন্তু এই অফিসে আমরা যারা আছি তারা সকলেই মি. সিম্পসনের অতি পরিচিত এবং বিশ্বস্ত। তবু, মি. সিম্পসন প্রতিটি লোককে পরীক্ষা করেন। প্রত্যেকের ওপর নজর রাখার জন্য বাইরে থেকে লোক নিয়োগ করেন।
রেজাল্ট?
ফলাফল শূন্য। কারও বিরুদ্ধে কিছু পাওয়া যায়নি।
ডি. কস্টা বলল, টাহলে? অপরাটীরা খবর পাচ্ছিল কিভাবে?
ইন্সপেক্টর বলল, সেটা জানা যায়নি।
ডি. কস্টা বলল, টাহলে টো এবারও টাই হোবে।
হবে মানে? তাই হচ্ছে। গত দশদিনে তিন জায়গায় হানা দিয়েছি আমরা-কাউকে পাইনি! গোপনে খবর এসেছিল। মাত্র চার-পাঁচজন জানতাম আমরা ঠিকানাগুলো। খবর পাবার আধঘণ্টার মধ্যে রওয়ানা হই-গিয়ে দেখি চিড়িয়ারা ভেগেছে। তিনটে আড়াই ছিল গুজরাট খানের। লোকটা আমাদের। কাঁচকলা দেখাচ্ছে।
ডি. কস্টা হাসতে লাগল, মি. সিম্পসন এবং টোমরা টার সহকারীরাইচ অ্যাণ্ড এভরি ওয়ান ইজ ব্রেনলেস ইডিয়ট। এই অফিসে কোথাও ছিড় রহিয়াছে, সেই ছিদ্র বন্ট না করিলে প্রটিবার কাঁচকলা ডেকিবে টোমরা।
জানি, কিন্তু ছিদ্রটা দেখতে পাচ্ছি না যে..
বাড ডাও, ওসব বাড ডাও। মিস্ কাবেরী কোঠায়?
ইন্সপেক্টর বলল, মি. শহীদ এসেছেন মি. সিম্পসনের চেম্বারে। মিস্ কাবেরী বোধহয় ওখানেই আছে। নামবে এখুনি।
ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের অফিসরুমটা দোতলায়। মি. সিম্পসনের চেম্বার তিন তলায়।
ভাল কথা কালো মরিসটা পাওয়া গেছে-শুনেছ?
সিধে হয়ে বসল ডি. কস্টা। বলল, গুড। টারপর?
গাড়িটা হাইজ্যাক করা। পাওয়া গেছে সদরঘাট টারমিনালের সামনে। শুকুরের শরীরে যে চাকার দাগ পাওয়া গিয়েছিল, মরিসের চাকা মিলিয়ে দেখা গেছে–একই। তোমার রিভলভারের গুলির চিহ্নও পাওয়া গেছে গাড়ির গায়ে। তবে গাড়ির ড্রাইভারকে বা তার হাতের ছাপ গাড়িতে পাওয়া যায়নি। অবশ্য, কয়েকদিনের মধ্যে তাকে আমরা পাকড়াও করতে পারব আশা করি।
ডি কস্টা বলল, অটো সহজ নয়। টোমরা কেসটা অটো হালকা চোখে ডেকিটেছ আসলে টা নয়। যাক। হামার একটি কোশ্চেনের রিপ্লাই ডাও। আলাউদ্দিনের নাম শুনেছ? সুডখোর।
নাম শুনেছি। ইনকামের কোন সোর্স নেই অথচ প্রচুর খরচ করে। তার বিরুদ্ধে বিশেষ কোন অভিযোগ নেই আমাদের। কি ব্যাপার? সুদের বিনিময়ে সে টাকা ধার দেয় তা প্রমাণ করতে পারবে?
প্রমাণ করিলে কি হইবে?
কোন ব্যক্তি উচ্চহারে সুদ খেলে তার বিরুদ্ধে আইন আছে।
ডি. কস্টা বলল, আইনের কঠা টোমরা হামাকে শুনাইয়ো না। জব্বার খুন হইয়াছে, টাহার বাচ্চা চঞ্চল এটিম হইয়াছে–কি করিটে পারিয়াছে টোমাডের আইন?
আহ। রেগে যাচ্ছ তুমি খামকা…।
মি. ডি কস্টাকে রাগাবার চেষ্টা করবেন না, ইন্সপেক্টর। ওকে চেনেন না। রেগে গেলে ওকে সামলাতে পারে এমন কেউ নেই।
কাবেরী রূমে ঢুকল।
ডি কস্টা সহাস্যে বলল, রাগিয়াও লাভ কোঠায়? এই টো, চঞ্চল এটিম হওয়ায় হামি রাগিয়া গিয়াছি–কি রাগিয়াও কি কিছু করিটে পারিলাম?
চঞ্চল এখন আছে কোথায়?
কাবেরী ডি. কস্টার পাশের চেয়ারটায় বসল।
বুড়ী এক নার্সের নিকট রাখিয়াছি টাহাকে। যাক, মিস্ কাবেরী, খিড়া পাইয়াছে, কিছু খাওয়ান।
কাবেরী ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট একটা আয়না এবং লিপস্টিক বের করে বলল, আমি খাওয়াব। কেন? কী চালাক মনে নেই বুঝি চাইনিজ খাওয়াবেন বলেছিলেন আপনি নিজে।
ডি. কস্টা বলল, টাইটো! এক্সকিউজ মি, ভুলিয়া গিয়াছিলাম।
মিস্ কাবেরী ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে বলল, খাওয়াবেন নাকি আজ?
ডি. কস্টা হাসতে লাগল। তারপর, অকস্মাৎ সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল দরজার দিকে।
কাবেরী এবং ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ একযোগে জানতে চাইল, কি হলো? কি হলো?
ডি. কস্টা উত্তর দিল না। বেরিয়ে গেল সে করিডরে।
শহীদকে করিডর ধরে হেঁটে যেতে দেখে অমন করে ছুটে বেরিয়ে গেছে ডি. কস্টা।
করিডরে ধরল ডি. কস্টা শহীদকে।
আপনি এখানে?
ডি. কস্টা বলল, ইয়েস, মি. শহীড। হোসেনের বাড়িটে গিয়াছিলাম।
জানতে পারলেন কিছু?
যা যা জানতে পেরেছে সব বলল ডি. কস্টা।
শহীদ বলল, গ্রীন বার? লোকটার নাম আলাউদ্দিন। চিনি ওকে। হ্যাঁ, সুদের ব্যবসা করে। ইব্রাহিম খলিল এই ব্যবসা করত। তবে নিজে করত না। আলাউদ্দিনকে দিয়ে করাত। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ঘুরেফিরে এই ইব্রাহিম। খলিলের নাম বারবার এসে পড়ছে।
ডি. কস্টা বলল, মি. সিম্পসন কি বলিলেন?
তার ধারণা কেসটার সমাধান হয়ে যাবে দুএকদিনের মধ্যেই।
ডি. কস্টা বলল, আপার চেম্বারে গোবর ছাড়া কিছুই নেই তাঁর।
শহীদ হাসি চেপে বলল, বাড়ি যাবেন না?
না। অনেক কাজ হাটে। মিস কাবেরীকে চাইনিজ খাওয়াইব, কঠা ডিয়াছি।
শহীদ সহাস্যে বলল, আপনার ভক্ত, তাই না?
মুচকি মুচকি হাসতে লাগল ডি কস্টা।
শহীদ বলল, চলি। বেশি রাত বাইরে না থাকাই ভাল আপনার, মি. ডি. কস্টা।
ডি কস্টা উত্তর দিল না। শহীদ আর কোন কথা না বলে পা বাড়াল।
কাবেরীকে মি. সিম্পসন ডি. কস্টার পিছনে লাগিয়েছেন, কুয়াশা সম্পর্কে টাটকা খবরাখবর সংগ্রহ করার আশায়। ডি. কস্টা কাবেরীর উদ্দেশ্যটা জানে। কিন্তু এমন ভান করে যে মনে হয় এব্যাপারে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
.
০৭.
বাইরে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করল শহীদ! সামনেই একটা গলি, গলির কাছাকাছি আসতে থমকে দাঁড়াল ও। কালো আলখেল্লা পরা দীর্ঘদেহী একটা ছায়ামূর্তি আবছা অন্ধকারে সাৎ করে সরে গেল একটা বাড়ির পাচিলের আড়ালে। মুচকি একটু হাসল কি হাসল না শহীদ, পা বাড়াল আবার। গাড়িটা রেখে এসেছে ও কাছাকাছি একটা গ্যারেজে। হেডলাইটের বাল্ব ফিউজ হয়ে গেছে, এতক্ষণে নতুন বালব লাগানো হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। গ্যারেজের দিকেই যাচ্ছে ও। গাড়ি নিয়ে যেতে হবে গ্রীন বারে, আলাউদ্দিনের সাথে কথা বলতে চায় ও।
গাড়ি নিয়ে রওনা হলো শহীদ। রিস্টওয়াচে রাত সাড়ে নটা বাজে দেখে স্পীড বাড়িয়ে দিল ও। গ্রীন বারটা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায়।
বারের সামনে গাড়ি থামিয়ে নামল শহীদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল চার পঁচটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িগুলোর নাম্বার প্লেটে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে গেল, সুইংডোর ঠেলে ঢুকল ভিতরে।
হালকা নীল আলোয় আলোকিত বারের ভিতরটা। দুটো একটা সুন্দরী মেয়ে। ছাড়া অধিকাংশই পুরুষ–টেবিল দখল করে আরাম করে বসে নিচু স্বরে গল্পগুজব। করছে, সোমরসের পাত্রে চুমুক দিচ্ছে। পপ মিউজিকের মৃদু শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা টেপরেকর্ড থেকে।
ওয়েটার এগিয়ে এসে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে মাথা নত করে বলল, আসুন, স্যার। ওদিকে খালি টেবিল আছে।
ওয়েটারের কথায় কান না দিয়ে চারদিকটা দেখে নিল শহীদ। কোনার এক টেবিলে মোটাসোটা একজন লোক চুপচাপ বসে আছে। টেবিলে টোকা মারছে। আঙুল দিয়ে বাজনার তালে তালে। লোকটার চোখ দুটো ছোট ছোট, ধূর্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পাশের টেবিলের একটি মেয়ের দিকে। লোকটার টেবিলের দিকে পা বাড়াল শহীদ। আগে নোকটা প্যান্ট-শার্ট পরত। আজকাল সাদা টেটরনের ফুল তোলা পাঞ্জাবী এবং পাজামা পরলেও, আলাউদ্দিনকে চিনতে ভুল করুল না শহীদ।
সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। তাকাল আলাউদ্দিন। টোকা মারছে তখনও টেবিলে। মুখের হাসি হাসি ভাবটাও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
মৃদু আলোয় প্রথমে শহীদকে চিনতে না পারলেও দুই পকেটে হাত দিয়ে শহীদের দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মুখের হাসি মুছে গেল ওর চোখের পলকে। তারপর চিনতে পারল সে। টেবিলের উপর হাতটা স্থির হয়ে গেল। ঝট করে সিধে হয়ে বল সে। বলল, মি, শহীদ, স্যার। বসুন বসুন–কী সৌভাগ্য, আপনি
শহীদ বলল, ব্যবসা কেমন চলছে আলাউদ্দিন?
ব্যবসা? ব্যবসা ভালনা, মানে, কিসের ব্যবসার কথা বলছেন, স্যার?
শহীদ পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে বসল একটা চেয়ারে। বলল, জব্বারের ব্যাপারে এসেছি আমি। বছর খানেক আগে সে তোমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। মোটা সুদ নিতে তুমি। সেই জব্বার খুন হয়েছে।
এসব কি বলছেন আপনি আমি…এসব কি বলছেন আপনি, স্যার।
কেন খুন হয়েছে জব্বার? কঠোর শোনাল শহীদের গলা।
চাপা স্বরে কথা বলে উঠল আবার আলাউদ্দিন। দেহ এবং কণ্ঠস্বর দুটোই কাঁপছে, আ-আমি জানি না কিছু, স্যার। আমি কেন…আমি খুন করিনি, বিশ্বাস। করুন…।
সুদখোর কুকুর। হোর সুদ দিতে দিতে লোকটা পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক করে আসল টাকা পরিশোধ করার জন্যে ডাকাতি করবে। আর সেই ডাকাতি করতে গিয়ে সে খুন হলো। তুই-ই দায়ী এরজন্য।
না-না! কোথাও ভু-ভুল হয়েছে আপনার, স্যার। টাকা তো জব্বার আমাকে পরিশোধ করে দিয়েছিল। নেবার দশ-বারোদিন পরই সে ফেরত দিয়ে যায়।
কি বললি? আসল টাকা পরিশোধ করেছিল জব্বার?
খোদার কসম, স্যার, মিথ্যে কথা বলে আমার কি লাভ, বলবই বা কেন! সব টাকা ফেরত দিয়েছিল সে আমাকে। আপনি গ্যালাক্সী হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। টাকা যখন জব্বার ফেরত দেয় তখন ম্যানেজার ছিল আমাদের সাথে।
উঠে দাঁড়াল শহীদ, নড়বি না এখান থেকে আমি না ফেরা পর্যন্ত।
কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে রাখল ফোনের পাশে, তারপর ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করল।
কাবেরীকে নিয়ে বারের ভিতর প্রবেশ করল এই সময় ডি. কস্টা। শহীদকে দেখে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।
শহীদ ওদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করল ফোনে। মিনিট খানেক বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল ও। ডি. কস্টার দিকে তাকিয়ে বলল, চাইনিজ খেয়ে এলেন?
ইয়েস। আলাউদ্দিনের সাথে…
শহীদ বলল, ওর সাথে দেখা হয়েছে আমার। জব্বার ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল ঠিক কিন্তু সে টাকা আলাউদ্দিনকে ফেরতও দিয়েছিল জব্বার।
হোয়াট? টা কিভাবে সম্ভব হইল?
শহীদ বলল, সেটাই প্রশ্ন। অন্য কোথাও থেকে টাকা ধার করে আলাউদ্দিনকে দিয়েছিল হয়তো।
ডি. কস্টা বলল, বাট…
শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বারের দরজার দিকে। দুজন শ্রান্তদর্শন লোক ঢুকছে। পোশাক-আশাকে লোক দুজন ধনী এবং সৌখিন বোঝা যায়।
লোক দুজনকে দেখামাত্র চিনতে পারল শহীদ। গুজরাট খান এবং তার সহকারী ও বন্ধু মাহবুব চৌধুরী।
কাউন্টারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুজন।..
শহীদ বলল, আরে মাহবুব? তুমি এখানে? তোমার দেহরক্ষীর লাশ এখনও পচছে মর্গে–আর তুমি স্ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ?
মাংসল গালে ভাঁজ তুলে হাসতে শুরু করে গুজরাট খান। মাহবুব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, পুরানো বন্ধু বুঝি?
শহীদ বলল, অবশ্যই। পুরানো শুধু নই, প্রাণের বন্ধুও আমরা।
মাহবুব চৌধুরীর মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। তাকিয়ে আছে সে শহীদের দিকে। অপেক্ষা করছে সে, আশা করছে শহীদ তাকে আক্রমণ করুক–আক্রমণ করলে একটা অজুহাত পাওয়া যাবে এই অপমানের উপযুক্ত শাস্তি দেবার…
কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ঠিক আছে, দেখা যাবে কার দৌড় কতদূর।
শহীদ বাঁকা হাসল। মাহবুব চৌধুরী এবং গুজরাট খান এগিয়ে যেতে শুরু করল। কাবেরী এবং ডি. কস্টার সাথে দুটো একটা কথা বলে বেরিয়ে গেল শহীদ বার থেকে।
.
কফি খেতে খেতে কাবেরী জানতে চাইল, ডি. কস্টা সাহেব, একটা প্রশ্নের সত্যি জবাব দেবেন?
হোয়াট কোশ্চেন?
আপনি কি সত্যিই কুয়াশার সাথে যখন ইচ্ছা দেখা করতে পারেন? তার সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা সত্যিই আছে? আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
ডি. কস্টা গম্ভীর। বলল, টাহার সহিট হামার সম্পর্ক শুটু ঘনিষ্ঠ নহে, টাহার চাইটেও বেশি।
কাবেরী বলল, কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? কুয়াশা নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, জীবন-যাপন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সবই বিস্ময়কর এবং রহস্যময় বলে শুনেছি। সে আপনার মত সাধারণ একজন লোকের সাথে ঘনিষ্ঠ হবে কেন? আপনি বোধহয় কুয়াশার চাকরি করেন, না?
ডি. কস্টা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, চাকরি হামি করি না। চাকরি করেন টিনি। হামিই টাহাকে চাকরি ডিয়াছি।
বলেন কি! কাবেরী বিস্মিত হলো।
ইয়েস। ব্যাখ্যা করিয়া বলিটেছি, টা না হইলে বুঝিবেন না। টিনি হামার ফ্রেণ্ড। হামার বউ পাইয়া টিনি গর্বিটো। হামার বিড্যা-বুড্ডি, ট্যালেন্টের উপর টাহার বিশ্বাস আছে। টিনি কোন সমস্যায় পড়িলেই হামার কাছে আসেন, পরামর্শ চান। হামি টাহাকে পরামর্শ ডিই। পঠ ডেকাইয়া ডিই, কিভাবে কি করিলে প্রবলেম সলভ হইবে। টিনি কৃটজ্ঞটা প্রকাশ করেন।
কিন্তু আপনি বললেন কুয়াশা আপনার চাকরি করে…
করেন, অবকোর্স করেন। রীটিমতো স্যালারী ডিই টাহাকে হামি প্রটি মাসে। টাহার মাসিক ইনকাম যাহাই হউক, হামি টাহাকে প্রটি মাসে ডশ লক্ষ টাকার বেশি খরচ করিটে ডিই না। প্রটি মাসে টাহাকে ডশ লক্ষ টাকা ডিই..
কাবেরী বলল, দশ লক্ষ টাকা প্রতি মাসে খরচ করে সে?
করে আরও, কিন্টু হামার নিকট হইটে দশ লক্ষের বেশি এক পয়সাও পায় না। টাহার আরও ইনকাম আছে।
ওদের আলাপ চলতেই লাগল, সময়ের দিকে কারও যেন খেয়ালই নেই।
.
রাত সাড়ে বারোটার সময় কাবেরীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিল ডি. কস্টা। গভীর রাত, গাড়ি পাবার কথা নয়। হেঁটেই বাড়ি ফিরল।
বাড়ির ভিতর ঢুকে পকেট থেকে চাবি বের করতে করতে করিডরে উঠল ডি. কস্টা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করতে করতে কী হোলে চাবি ঢোকাল।
তালা খুলে দরজা উন্মুক্ত করে কামরার ভিতর পা রাখার সাথে সাথে কপালের পাশে প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে সশব্দে পড়ে গেল মেঝেতে। পকেটে হাত ঢোকাতে চেষ্টা করল ডি, কন্টা। হাত ঢুকিয়ে রিভলভারটা বেরও করল সে। অন্ধকার থেকে আবার আক্রমণকারী আঘাত হানল। এবার সবুট লাথি। রিভলভারটা খসে গেল হাত থেকে।
মাথার ব্যাণ্ডেজের উপর লাগল দ্বিতীয় লাথিটা। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো। চিৎকার বা কোন শব্দ করার শক্তিও নেই তার। হঠাৎ দমকা বাতাসের মত কি যেন প্রবেশ করল কামরার ভিতর।
জ্ঞান হারাতে হারাতেও ডি, কক্টা চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়ার শব্দ শুনতে পেল। একজন লোক ব্যথায় ককাচ্ছে, তাও যেন শুনল সে। তারপর আর কিছু মনে, নেই, জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।
জ্ঞান ফিরল একসময়। কামরাটা আগের মতই অন্ধকার দেখল ডি. কস্টা। তবে তার মাথায় কোন ব্যথা বোধ নেই অনুভর করে ভারী আশ্চর্য হলো। পর মুহূর্তে বা বাহুতে মৃদু ব্যথা ব্যথা ভাব রয়েছে বুঝতে পেরে ভাবল, কেউ বুঝি তাকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে।
অন্ধকারে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল ডি. কস্টা। বিড় বিড় করে বলল, ধ্যাংকিউ বস।
তারপর ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। চোখ মেলেই সে দেখল কামরার মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে আছে একজন কদাকার চেহারার লোক। কদাকার হলেও লোকটার মুখে অসহায় ভাব ফুটে রয়েছে। বোকার মত দেখাচ্ছে তাকে, চেয়ে আছে ডি. কস্টার দিকে ফ্যালফ্যাল করে।
লোকটাকে কে যেন চেয়ারের সাথে নাইলনের কর্ড দিয়ে বেঁধে রেখে গেছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে ডি কস্টা কামরায় আর কাউকে দেখল না। তবে বুকশেলফের হাতলে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো আটকানো রয়েছে, চোখ এড়াল না তার।
বিছানা থেকে নামল ডি. কস্টা। লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসল শব্দ করে। বলল, রহস্যময় ব্যাপার, টাই না?
লোকটা তাকিয়েই রইল, কথা বলল না।
কাগজের টুকরোটা তুলে নিয়ে ভাজ খুলল ডি কস্টা।
হস্তাক্ষরটা, কুয়াশার, দেখেই চিনল সে। কুয়াশা লিখেছে:
মি, ডি. কস্টা,
দ্বিতীয়বার আক্রমণ করা হয়েছিল আপনাকে। আপনি আরও সাবধানে থাকবেন। বারবার আক্রমণ চালাবে শক্ররা। এরপর হয়তো ওরা খুন। করার জন্যে আসবে। এই বন্দী লোকটাকে পুলিসের হাতে তুলে দিতে পারেন। তবে, আমি জানি, এর কাছ থেকে পুলিস একটি কথাও বের করতে পারবে না। আমি নিজেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আপনি বরং একে আমাদের দিনাজপুরের আস্তানায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। সাত নম্বর আস্তানায় রাজকুমারী আছে। এই লোককে তার কাছে পৌঁছে দিলেই হবে। শুভেচ্ছা রইল।
কুয়াশা।
লাইটার জ্বেলে চিরকুটটা পুড়িয়ে ফেলল ডি কস্টা। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ডিনাজপুরে যাইটে হইবে টোমাকে, বুঝিলে? সেখানে টোমার ব্রেন অপারেশন অ্যাণ্ড ওয়াশ করা হইবে।
লোকটা যেন বোবা হয়ে গেছে। তবে কালা যে নয় তা বোঝা গেল ডি. কস্টার কথা শুনে তার চোখ দুটো বিস্ফারিত এবং কপালে ঘামের বিন্দু ফুটে উঠতে দেখে।
ফোন করল ডি. কস্টা। রাজকুমারীর সাথে কথা বলল মিনিটখানেক। তারপর বাথরূমে ঢুকল।
বাথরূম থেকে বেরিয়ে সে দেখল দুজন লোক বসে আছে বিছানায়। রাজকুমারীর কাছে ডি. কস্টার কামরার চাবি থাকে। সেই চাবি নিয়ে এসেছে এরা।
কেমন আছ টোমরা, সিদ্দিক অ্যাণ্ড সোলায়মান?
ভাল, মি. ডি. কস্টা। আপনি কেমন? দুজন একযোগে বলে উঠল।
ডি কস্টা বলল, ক্রিমিনালডের বারোটা বাজাইবার কাজে লিপ্ট আছি, ডেকিটেই পাইছে। বন্দী লোকটাকে দেখিয়ে বল ডি কস্টা।
সিদ্দিক এবং সোলায়মান অবাক বিস্ময়ে বন্দী লোকটার ব্যায়ামপুষ্ট শক্ত সমর্থ দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ওদের মধ্যে সিদ্দিক বলল, কিন্তু আপনি এই কুন্তীগিরকে বন্দী করলেন কি ভাবে? আপনাকে দেখে তো মনে হয় খুবই দুর্বল।
ডি. কস্টা খেঁকিয়ে উঠল, অবিশ্বাস করো নাকি আমাকে? হামাকে উইক মনে হয়, টাই না? বেশ, টোমরা ডুজন হামার সাটে শক্তি পরীক্ষায় নামো। ডেকাইয়া ডিবে মজাটা!.
দুজনই একযোগে বলে উঠল, না না!
ডি. কস্টা বলে উঠল, যাও, ভাগো! গাড়ি আনিয়াছ টো?
ভ্যান এনেছি।
গুড। বিডায় হও এবার।
বন্দীকে নিয়ে মিনিট তিনেকের মধ্যে বিদায় নিল সিদ্দিক এবং সোলায়মান। ওরা বেরিয়ে যেতেই চঞ্চলকে কোলে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করল বৃদ্ধা নার্স বিরাটপু মিসেস গোমেজ।
মাই গড! আপনার মাথায় ব্যাণ্ডেজ কেন? ঘরের অবস্থাই বা এমন কেন? মি. ডি. কস্টা, আপনি…।
সন্দিহান চোখে দেখছে মিসেস গোমেজ ডি. কস্টাকে। বাচ্চাটাকে আরও শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল সে।
ডেকুন, বিচলিট হইবেন না। কিছু কঠা আপনাকে বলা ডরকার। হামি গুণ্ডা বা চোর-ডাকাট নই! হামাকে আক্রমণ করা হইয়াছিল।
ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল টেলিফোন।
রিসিভার তুলে নিয়ে ডি. কস্টা বলল, হ্যালো।
উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের, ডি. কস্টা। ইস! নিজের পায়ে এইভাবে কুড়ুল মারলে তুমি শেষ পর্যন্ত। আমি ভাবতেও পারি না।
হেঁয়ালি করিয়ো না, সাজ্জাড়। হামার মাইও ভাল নাই।
ইন্সপেক্টর বলল, তোমার পালাবারও আর কোন উপায় নেই। জানালা দিয়ে দেখো, সাব ইন্সপেক্টর জাহিদ হয়তো দলবল নিয়ে পৌঁছে গেছে এরি মধ্যে তোমার বাড়িতে।।
টারমানে?
ইন্সপেক্টর বলল, মি. সিম্পসন তোমাকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিস পাঠিয়েছেন।
হোয়াই?
ইন্সপেক্টর বলল, আমার সাথেও তুমি অভিনয় করবে, ডি. কস্টা? আমি না তোমার বন্ধু?
রেগেমেগে ক্রেডলে রিসিভারটা রেখে দিল ডি. কস্টা। বিরক্তির সাথে বলে উঠল, যট্টোসব! হামাকে ইহারা পাগল করিয়া ছাড়িবে।
মিসেস গোমেজ চঞ্চলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল ডি. কস্টা। বাচ্চাটা কেঁদে উঠল।
হ্যালো, মাই বয়। চিনিটে পারো হামাকে? হামি টোমার বাবার বড়লে প্রক্সি ডিটেছি।
ডি. কস্টা তাকাল গোমেজের দিকে, হামার এই বাচ্চাকে হামি দুনিয়ার সেরা ডিটেকটিভ–সেকেণ্ড শার্লক হোমসের মটো করিয়া গড়িয়া টুলিটে চেষ্টা করিব।
মিসেস গোমেজ বলল, আমি চলি। এসেছিলাম বাচ্চাকে দেখাবার জন্য।
ডি কস্টা বল, সময় পেলে হামিও যাব।
বিদায় নিয়ে চলে গেল মিসেস গোমেজ।
কি মনে করে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডি. কস্টা। তাকাল নিচের দিকে।-সাথে সাথে ইউনিফর্ম পরা একজন রাইফেলধারী পুলিস কনেস্টবলকে দেখতে পেল সে বাড়ির ভিতর, পঁচিলের কাছে। কনেস্টবলটা চেয়ে আছে তার দিকেই। ঠিক সেই সময় করিডরে বুট জুতোর শব্দ কানে ঢুকল। পরমুহূর্তে কামরার ভিতর প্রবেশ করল সাব-ইন্সপেক্টর জাহিদ এবং তার সাথে দুজন কনেস্টবল।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ডি. কস্টা। থমথম করছে লম্বা মুখটা।
হোয়াটস দ্য ম্যাটার?
সাব-ইন্সপেক্টর জাহিদ বলল, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। আবুল হোসেন, গ্রীন রেস্টুরেন্টের সহকারী ম্যানেজারকে খুন করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
কোঠায় যেটে হবে?
মি. সিম্পসনের চেম্বারে। এটা তার ব্যক্তিগত নির্দেশ।
ডি. কস্টা কি যেন ভাবল, তারপর শান্ত ভাবে বলল, নিশ্চয় যাইব। মি. সিম্পসনের সাঠে একটা বুঝাপড়া না করিলেই নয় আর। চলুন।
Leave a Reply