কুয়াশা ৫৮ – দানব – ভলিউম ২০
কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ১৯৭৬
০১.
দুর্যোগের রাত। বিশাল আকাশে ঘন কালো মেঘ। বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। বজ্রপাতের শব্দ। দুরাকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
সেই সাথে একটানা সমুদ্রের গর্জন।
রাতও গম্ভীর হয়েছে। বনভূমির ভিতর বিচিত্র সব শব্দ হচ্ছে। পোক-মাকড়ের একটানা আওয়াজ, রাতজাগা পাখির অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যাচ্ছে।
তাবুর ভিতর ঘুমাচ্ছে সবাই। কিন্তু কুয়াশাকে তাবুর ভিতর দেখা যাচ্ছে না। তাঁবুর বাইরে ডি. কস্টার স্পুটনিক ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল দুবার। মৃদু কণ্ঠে ধমকে উঠল একটি কণ্ঠস্বর, চুপ!
থামল স্পুটনিক। অন্ধকার তাঁবুর ভিতর প্রবেশ করল কুয়াশা। স্পুটনিককে নামিয়ে দিল সে কাঁধ থেকে।
মৃদু ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল ডি. কস্টার। চোখ মেলে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না সে। বলল, হু-কৌন হ্যায়?
কুয়াশা নিচু গলায় বলল, আস্তে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, মি. ডি. কস্টা। আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ডি. কস্টা। শার্টের আস্তিন গুটিয়ে ভাবুর দরজার দিকে তাকাল সে, কোঠায়? ডুশমন কোঠায়, ডেকাইয়া ডিন শুঢু একবার। টারপর হামি যা করিবার করিব।
কথা বলবেন না। কুয়াশা চাপা স্বরে কথাটা বলে অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে প্রত্যেকের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিল। জেগে উঠল সবাই।
স্পুটনিক আর ঘেউ ঘেউ করছে না এখন। কিন্তু তার গলা থেকে গরগ করে এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছে।
কুয়াশা নিচু গলায় বলল, স্পুটনিকের শ্রবণ শক্তি অস্বাভাবিক। আমাদের কাছ থেকে জিনিসটা কম পক্ষে মাইলখানেক দূরে এখনও। কিন্তু ঠিক টের পাচ্ছে ও।
জিনিস? কি জিনিস? জানতে চাইল কামাল।
কুয়াশা বাল, দাঁড়াও, শব্দটা তোমাদেরকে শোনাবার ব্যবস্থা করি।
তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। সবাই নিঃশব্দে অনুসরণ করল তাকে। কয়েক গজ এগিয়ে কুয়াশা একটা গাছের সামনে দাঁড়াল। গাছটার গোড়ার কাছে চারকোনা একটা যন্ত্র রয়েছে, দেখতে পেল সবাই। রাজকুমারী ওমেনা দেখেই চিনতে পারল যন্ত্রটা।
জিনিসটা একটা সুপারসেনসিটিভ লিসনিং ডিভাইস। ভীষণ স্পর্শকাতর মাইক্রোফোন এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাম্পলিফায়ার রয়েছে এই যন্ত্রে। যে কোন মৃদু শব্দকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে এই যন্ত্র।– সেটটা অন করতেই বিকট শব্দ হতে লাগল। ভলিউম কমিয়ে দিল কুয়াশা। তবুও, কান পাতা দায়। হাজার রকম শব্দ কয়েকগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কুয়াশা সেটের কয়েকটা নব ঘোরাল দ্রুত। বলল, ওমেনা, আলো জ্বেলে রেখো না।
টর্চ নিভিয়ে দিল ওমেনী। অন্ধকারেই যন্ত্রটার নব ঘোরাতে লাগল কুয়াশা। খানিক পর ধীরে ধীরে সব শব্দ মৃদু হয়ে এল কিন্তু পরিবর্তে শোনা যেতে লাগল অদ্ভুত ধরনের অপরিচিত একটা শব্দ। নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মত শব্দটা-কিন্তু সে নিঃশ্বাস যেন দমকা বাতাসের মত দীর্ঘ এবং ঝড়ো। অবাক বিস্ময়ে কান খাড়া করে শুনতে লাগল সবাই। তারপর, শব্দটার সাথে নতুন একটা শব্দ যোগ হলো। পানিতে কেউ যেন আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
কিছুই বুঝছি না! অমন দীর্ঘ আর ঝড়ের মত নিঃশ্বাস কিসের?
শহীদকে থামিয়ে দিয়ে কুয়াশা বলল, কোনও প্রাণী ধরে নাও। দানব বলাই ভাল। সে যাই হোক, রহস্যময় প্রাণী কিন্তু একটা নয়–দুটো। একটা আসছে উত্তর দিক থেকে। আর একটা সাগরের দিক থেকে আসছে। খুব আস্তে আস্তে আসছে ওরা।
রাসেলের কণ্ঠস্বর একটু যেন কেঁপে গেল, ভাইয়া; ওরা কি আমাদের সন্ধানেমানে, আমি বলতে চাইছি, ওরা কি আমাদেরকে আক্রমণ করতে আসছে বলে মনে করেন?
জানি না। অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। যন্ত্রটা এখন আর ব্যবহার করা ঠিক হবে না। ওরা শুনতে পাবে।
সেট অফ করে দিল কুয়াশা।
এখন অপেক্ষার পালা। সবাই দাঁড়িয়ে আছে দুরু দুরু বুকে অন্ধকারে। প্রত্যেকের কান সজাগ। যামছে সবাই। দানব আসছে, কিন্তু কেন আসছে, কেউ ওরা তা জানে না।
.
যন্ত্র ছাড়াই এখন শোনা যাচ্ছে সেই ভীতিকর শব্দগুলো। নতুন নানা রকম শব্দ যোগ হয়েছে আগেরগুলোর সাথে। ভারি, মোটা গলা থেকে বিচিত্র সব শব্দ। বেরুচ্ছে। ক্রমশ উচ্চকিত হচ্ছে পদশব্দ। থপ থপ-হাতির চেয়েও অনেক বড় কোন আদিম যুগের প্রাণী যেন হেঁটে আসছে এদিকে। গাছের ডাল ভাঙছে মড়মড় করে।
ওদের সাথে দেখা হবে মাঝপথে। দেখা হলে কি হবে? ফিসফিস করে জানতে চাইল রাসেল।
ফাইট করিবে দুইজনে। নিডেন পক্ষে একজন মার্ডার হইবে।
ডি. কস্টার কথা শেষ হবার আগেই দুই রহস্যময় দানব গর্জে উঠল। কিন্তু তাদের সেই গর্জন আক্রোশবশত নয়, সে গর্জন আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। বিকট গলায় কয়েক মুহূর্ত চেঁচামেচি করল ওরা। তারপর আবার শোনা গেল সেই ভারি থপ্ থপ শব্দ। এগিয়ে আসছে একসাথে দুজনে।
ঘামছে ওরা। শরীরের মাংসপেশী টান টান হয়ে উঠেছে। রুদ্ধশ্বাসে পাথরের মূর্তির মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
ওকি!
চাপা গলায় বলল কামাল। চমকে উঠেছে তার মতই বাকি সবাই। রহস্যময় প্রাণীরা কিছু যেন ভাঙছে। ধাতব পদার্থ দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে যেন। টিন বা ওই জাতীয় কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে বেলাভূমির দিক থেকে।
আমাদের হেলিকপ্টার! ভেঙ্গে ফেলছে ওটাকে! কুয়াশা বলে উঠল।
ডি. কস্টা অন্ধকারেই শব্দ লক্ষ্য করে পা বাড়াল, মাই গড! ব্যাটারা ডাবল হারামী…
কুয়াশা খপ করে একটা হাত ধরে ফেলল ডি.কস্টার, কোথায় যাচ্ছেন!
শহীদ বলল, কিন্তু পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকব নাকি আমরা?
কুয়াশা বলল, ওদের সম্পর্কে কিছু না জেনে বাধা দিতে যাওয়াটা বোকামি
দানব দুটো কাছাকাছি চলে এসেছে। অন্ধকারে দেখা না গেলেও শব্দ শুনে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ঝড়ের মত আসছে তারা। মড়মড় করে ভাঙছে গাছের ডালপালা। দমকা বাতাসের মত নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, নানা ধরনের ভারি দুর্বোধ্য কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে–এগিয়ে আসছে সব শব্দ ক্রমশ কাছাকাছি।
বিমূঢ়ের মত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। জীবনে ওরা প্রত্যেকে বিচিত্র ধরনের বিপদের মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। তবে বিপদকে ভয় পায়নি কখনও। কিন্তু টেকনাফের এই বনভূমিতে ওরা যেন ভয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে। বিপদের পদশব্দ শানা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে তার নিঃশ্বাসের শব্দ।
কুয়াশা দ্রুত নির্দেশ দিল, গ্যাস মাস্ক পরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ো সবাই।
নিঃশব্দে সরে গেল এক একজন এক একদিকে।
কুয়াশা অনড় দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। কয়েক মুহূর্ত পর পকেট থেকে দুটো বল জাতীয় কিছু বের করল সে। বলগুলো দেখতে ডিমের মত, একটু লম্বা। টিয়ার গ্যাস বম।
মাস্ক পরে গ্যাস বম দুটো ছুঁড়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে কুয়াশা। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু, দানবদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। কাছে চলে এসেছে একটা দানব। আর বোধহয় পঁচিশত্রিশ গজ দূরে তার কাছ থেকে দানবটা। কুয়াশা হাতের দুটো গ্যাস বম ছুঁড়ে দিল সেদিকে।
বোমা দুটো পতনের শব্দ হলো। সশব্দে বিস্ফোরিত হলো সেগুলো। কিন্তু পরমুহূর্তে গোটা দুনিয়াটা যেন ভেঙে পড়ল কুয়াশার শরীরের উপর। কোথা থেকে কি হলো কিছুই বুঝতে পারল না কুয়াশা। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে পিছন দিকে নিক্ষিপ্ত হলো তার শরীর। জীবনে এমন প্রচণ্ড আঘাত খায়নি সে। পঁচিশ হাত দূরে একটা গাছের গায়ে গিয়ে পড়ল সে। সেখান থেকে ছিটকে পড়ল একটা ঝোঁপের উপর।
নিঃসাড় পড়ে রইল কুয়াশা।
অগ্রবর্তী প্রকাণ্ডদেহী দানবটা কুয়াশার অবস্থান লক্ষ্য করে প্রকাণ্ড একটা পাথর ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেটা কুয়াশার বাহুতে আঘাত হানে। কুয়াশা পাথরের খণ্ডটাকে পরিষ্কার দেখতে না পেলেও, শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা টের পেয়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে সে তার পেশীগুলোকে শক্ত করে তোলে। ফলে পাথরের খণ্ডটা আঘাত হানলেও কুয়াশাকে মারাত্মকভাবে জখম করতে পারেনি। মুহূর্তের জন্য নিঃসাড় হয়ে ঝোঁপের ভিতর পড়ে রইল সে, তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সেই দানবটাই ছুটে আসছে তার দিকে।
ডান দিকে ডাইভ দিল কুয়াশা। উঁচু একটা ঝোঁপের উপর গিয়ে পড়ল শূন্য থেকে। ক্রল করে বেরিয়ে এল ঝোঁপের ভিতর থেকে। সামনে অন্ধকার, তাই একটা হাত দিয়ে সামনের দিকটা দেখে নিচ্ছে সে। মুহূর্তের জন্য থামল একবার। আলখেল্লাব পকেট থেকে বের করল লম্বা টর্চটা।
টর্চটা বের করল ঠিক, কিন্তু সেটাকে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিল কুয়াশা। ভেঙেচুরে অচল হয়ে গেছে। পাথরের ধাক্কা খেয়ে গাছের গায়ে গিয়ে পড়ার সময় প্রায় চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে সেটা।
দানবটা পিছু ছাড়েনি। দ্রুত ক্রল করে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে আবার কুয়াশা। কিন্তু দূরত্ব ক্রমশ কমছে। উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। অন্ধকারে অন্ধের মত ছুটল সে।
কিন্তু পালানো হলো না। পিছন থেকে তাকে ধরল একটা হাত। অস্বাভাবিক চওড়া সেই হাতের থাবা। কোমর ধরে তাকে শূন্যে তুলে নিল দানবটা। প্রায় পঞ্চান্ন ফুট উপরে উঠে গেল কুয়াশা। দানবের হাতে খেলনা পুতুলের মত ছোট্ট দেখাচ্ছে তাকে। দানবটা সবেগে ছুঁড়ে দিল ওকে দূরে। একটা গাছের ডাল-পালার উপর গিয়ে ধাক্কা খেলো কুয়াশা। মটমট শব্দে ভাঙল ডালপালা। নিচের দিকে পড়ছিল সে, কিন্তু আটকে গেল তার দেহটা ডালের সাথে। নড়ল না কুয়াশা। প্রাণহীন, মৃত বলে মনে হলো তাকে।
কুয়াশাকে ছুঁড়ে দিয়েই দানবটা বিকট রবে আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। টেনিস বলের মত বড় বড় চোখ দুটো জ্বলছে তীব্রভাবে। অস্থির হয়ে ছুটোছুটি শুরু করল সে। অন্ধের মত গাছপালা ভেঙে ছুটছে সে, পালাবার চেষ্টা করছে টিয়ার গ্যাসের প্রভাব থেকে মুক্ত হবার জন্যে।
বনভূমি কাঁপিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল বিশালদেহী দানবটা। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে শব্দ বেলাভূমির দিকে। বেলাভূমির ওদিকটায় দ্বিতীয় দানবটা অসহিষ্ণু কণ্ঠে দুর্বোধ্য শব্দে গজরাচ্ছে সারাক্ষণ। এরপর দ্রুত দূরে সরে গেল দানব দুটোর কণ্ঠের এবং পায়ের শব্দ।
ঝোঁপের আড়াল থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল শহীদ।
কুয়াশা কি বেঁচে আছে? এই একটা প্রশ্নই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে এতক্ষণ ধরে ওকে। দানবটা কুয়াশাকে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পরিষ্কার দেখেছে ও হন হন করে এগোচ্ছে শহীদ। মাঝপথে হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি দেখে থমকে দাঁড়াল ও। কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, গ্যাস মাস্কটা খুলে পড়ে গিয়েছিল বলে দম বন্ধ করে চুপচাপ গাছের ডালে পড়ে ছিলাম।
টিয়ার গ্যাস বাতাসের সাথে দূরে সরে গেছে। ওরা ফিরে এল তাঁবুতে। ওদের আগেই অন্য সবাই পৌঁছে গেছে সেখানে।
তাঁবুর ভিতর থেকে টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। যে পাথরের টুকরোটা তাকে আঘাত করেছিল সেটা খুঁজে বের করল।
মাই গড! ছানাবড়া হয়ে উঠল ডি. কস্টার চোখ দুটো।
রাসেল ঢোক গিলল, এ যে অসম্ভব মনে হচ্ছে। এতবড় পাথর–প্রায় মণ পাঁচেক ওজন তো হবেই! দানবগুলোর গায়ের জোর এতই যে অত বড় পাথর ছুঁড়তে পারুল!
কুয়াশাকে গম্ভীর দেখাল। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। রাজকুমারী বলে উঠল, দানবগুলোর এক একটার ওজন,এক টন তো হবেই।
এই দেখুন, পায়ের ছাপ।
রাসেলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সবাই। এদিক ওদিক বড় বড় গর্ত দেখা যাচ্ছে। গর্তগুলো মানুষের পায়ের আকৃতির, কিন্তু কমপক্ষে আটগুণ বড়।
.
০২.
ঘন কালো মেঘ বাতাসের অবিরাম ধাক্কা খেয়ে দূরে সরে গেল। বৃষ্টি হলো না। তবে ঝড়ো বাতাস বইতে লাগিল। বাকি রাত জেগেই কাটিয়ে দিল ওরা। স্পেশাল হেলিকপ্টারটা দেখতে গেল। দূর থেকে ওটার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মুষড়ে পড়ল সবাই। শখের জিনিস তো বটেই, প্রয়োজনীয়ও বটে। কাছাকাছি গিয়ে ওরা দেখল মেরামতের অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গায়ে বড় বড় গর্ত দেখা যাচ্ছে। দানবগুলো ঘুসি মেরে সৃষ্টি করেছে ওগুলো। এ থেকে অনুমান করা যায় দানবগুলোর দৈহিক– শক্তি কি ভয়ঙ্কর। কাগজের দেয়ালে ঘুসি মেরে ছেলেরা যেমন গর্ত করে তেমনিভাবে শক্ত ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি কপ্টারের গায়ে দানবরা গর্ত করেছে।
কপ্টারের চারদিকে পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সেগুলো পরীক্ষা করল নতুন করে কুয়াশা।
সকাল নটার দিকে এমাম রাউয়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত দো-চালাটা পরীক্ষা করল কুয়াশা।
ইউনুস আদাঙ, যে কুয়াশার চট্টগ্রামস্থ হেডকোয়ার্টারে নিহত হয় আততায়ীর গুলিতে, তার বাড়িটাও পরীক্ষা করুল কুয়াশা।
ফিরে এল ওব্রা,তাঁবুতে। জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে নিল সবাই। তবু গুটিয়ে রওনা হলো টেকনাফ শহরের দিকে। শহরটা ওখান থেকে তিন চার মাইল দূরে।
.
মাইল দেড়-দুয়েক হাঁটার পর কুয়াশা মাথার উপরের গাছপালার শাখা প্রশাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, একটা ব্যাপার লক্ষ করছ? পাখি-টাখি একেবারেই নেই এদিকে।
তাই তো!
আরও খানিক এগোবার পর প্রায় মাথা সমান উঁচু ঘাসের দেখা পেল ওরা। সামনে বিস্তীর্ণ ঘাসের রাজ্য। ভিতরে ঢুকল ওরা। ঘাসের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠল কুয়াশা, শুয়ে পড়ো!
কেউ কোন প্রশ্ন করল না, কুয়াশার কথা শোনা মাত্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। প্রায় সেই মুহূর্তে ওদের মাথার উপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে ছুটে গেল রাইফেলের তপ্ত সীসা।
সামনের দিক থেকে গুলি করেছে। কিন্তু তুমি দেখতে পেলে কিভাবে লোকটাকে? শহীদ জানতে চাইল। এদিক ওদিক মাথা উঁচু করে তাকাল সে। কোথায় কুয়াশা। তাকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে।
কুয়াশা হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। রাইফেল ধারীকে দেখতে পায়নি সে, কিন্তু রাইফেলের লম্বা ব্যারেলটা দেখতে ভুল করেনি। কুয়াশা আগেই সন্দেহ করেছিল, পথে ওদেরকে আক্রমণ করা হবে।
ঘাসের রাজ্য অদূরেই শেষ হয়েছে। মাথা উঁচু করে কুয়াশা দেখল ঘাসের সীমান্তের ওপারের ফাঁকা মাঠ ধরে জঙ্গলের দিকে একটা লোক দৌডুচ্ছে। তার হাতে একটা রাইফেল। কুয়াশাকে ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে পালাচ্ছে লোকটা।
ছুটল কুয়াশা ফাঁকা মাঠ ধরে। লোকটা বনভূমিতে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বনভূমির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। ঘন হয়ে রয়েছে গাছের সারি। গাছের উপর থেকে পাটের মোটা এবং ক্ত দড়ির মত নেমে এসেছে লম্বা ঝুরি।
একটা ঝুরি ধরে তর তর করে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল কুয়াশা। বটগাছের মাথার উপর উঠে দাঁড়িয়ে সবেগে লাফ দিল সে। চার-পাঁচ হাত দূরের একটা গাছের ডালে গিয়ে নামল কুয়াশা। সেখান থেকে আবার লাফ দিল। লাফ দিয়ে এবার কুয়াশা ছয় হাত দূরের একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। ঝুলন্ত অবস্থা থেকে আবার লাফ দিল সে। আর একটা গাছের ডাল ধরে ফেলল সে। এইভাবে বনভূমির অভ্যন্তরে আরও অনেক গভীরে পৌঁছল কুয়াশা।
গাছের ডাল থেকে এক সময় সবুজ ঘাসের উপর নামল কুয়াশা। সামনে একটা ঢালু জায়গা। আরও সামনে প্রায় খাড়া নেমে গেছে একটা খাদের গা।
উঁকি দিয়ে তাকাল কুয়াশা নিচে। খাদের নিচে একটা নদী-ঠিক নদী নয়, ঝর্ণা। ঝর্ণার উৎসস্থল দেখা যাচ্ছে না। তবে ধীর বেগে ঝর্ণার পানি বয়ে যাচ্ছে একদিক থেকে আরেকদিকে।
প্রায় খাড়া খাদের গা বেয়ে নিচে নামল কুয়াশা। সামনেই দেখতে পেল একটা বাশের সাঁকো। দুটো মাত্র লম্বা বাশ ঝর্ণার পানির ওপর আড়াআড়িভাবে ফেলা রয়েছে। ওপারে ঘন সবুজ বনভূমি।
ঝর্ণার পানি তেমন গভীর নয়। বড় জোর দশ বারো ইঞ্চি হবে। স্বচ্ছ, স্ফটিকের মত পানি। তলদেশে চিকচিক করছে বালি।
হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেল কুয়াশার। এক জায়গায় পানি একটু ঘোলাটে দেখাচ্ছে। পানির নিচের বালিতে মৃদু আলোড়ন লক্ষ করল কুয়াশা। পরমুহূর্তে বালির নিচ থেকে বুদবুদ বেরোতে লাগল।
চোরাবালি।
চোরাবালি যে তাতে কোন সন্দেহ নাই। বুদবুদগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করল কয়েক মুহূর্ত কুয়াশা।
পকেট থেকে নাইলনের কর্ড বের করে তার একটা প্রান্ত বাঁধল গাছের সাথে। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে নামল বাকি সবাই।
শহীদ বলল, কুয়াশা!
রাজকুমারী লক্ষ করল ঝর্ণার পানির নিচের বালিতে আলোড়ন হচ্ছে। সে বলে উঠল, চোরাবালি! কেউ পড়ে গেছে-চোরাবালি গ্রাস করেছে লোকটাকে।
রাসেল বলল, নিশ্চয়ই আততায়ী সঁকো পার হতে গিয়ে পড়ে গেছে।
কুয়াশা বলল, শত্রুরা চালাকি করে পাথরও ফেলে থাকতে পারে। এটা হয়তো কোন ফাঁদ। তবু, চোরাবালিতে নামব আমি। শত্রু হোক বা মিত্র, একজন মানুষকে চোখের সামনে এমনভাবে মরতে দেয়া যায় না। চেষ্টা করে দেখি বাঁচানো সম্ভব কিনা।
কুয়াশা নাইলনের অপর প্রান্তটা ধরে ঝর্ণার পানিতে লাফিয়ে পড়াল।
চোরাবালি! দ্রুত ডুবে যাচ্ছে কুয়াশা।
সবাই নির্বাক তাকিয়ে আছে।
চোরাবালি গ্রাস করছে কুয়াশাকে। কোমর অবধি অদৃশ্য হয়ে গেছে তার বালির নিচে। দেখতে দেখতে চোরাবালি কুয়াশার বুক অবধি ঢেকে ফেলল। চিৎকার করে উঠল ডি কস্টা, প্লীজ বস, প্লীজ! আর হাফ ইঞ্চিও নামিবেন না।
উঠে এসো, কুয়াশা! কর্ড ধরে নিজেকে তুলে ফেলার চেষ্টা করো এবার! রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল রাজকুমারী।
কুয়াশার খেয়াল নেই ওদের দিকে। ওর পায়ে কিছু একটা ঠেকেছে। দুই পা দিয়ে জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে সে। দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে সে নাইলনের কর্ডটা!
কয়েক মুহূর্ত পর কুয়াশা নাইলনের কর্ড ধরে নিজেকে বালির নিচ থেকে তোলবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কাজটা সহজ নয়।
জিনিসটা যাই হোক, কুয়াশা নিজের দুই পা দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নাইলনের কর্ড ধরে টানছে শহীদ এবং রাসেল। মিনিট সাতেক চেষ্টা করার পর বালির ফাঁদ থেকে মুক্ত হলো কুয়াশা।
ঘাসের উপর তোলা হলো লোকটাকে। লোকটা বেঁচে নেই। চিনতে পারুল সবাই তাকে। লোকটার কপালে লম্বা একটা কাটা দাগ রয়েছে। এই লোকই কুয়াশার হেড কোয়ার্টারে খুন করেছিল ইউনুস আদাঙকে।
লোকটার নাম জগদীশ।
জগদীশের শার্ট প্যান্টের পকেট সার্চ করল কুয়াশা। রাইফেলের কয়েকটা কার্তুজ, ছোরা একটা, এক প্যাকেট সিগারেট এবং এক টুকরো হলুদ কাগজ পাওয়া গেল।
হলুদ কাগজটায় একটি মাত্র শব্দ লেখা রয়েছে। শব্দটা হলো, মৃত্যুপুরী।
মৃত্যুপুরী মানে? শহীদ জানতে চাইল।
কিন্তু কুয়াশা উত্তর দিল না।
.
শহরে পৌঁছুল ওরা এরপর। শহরটা খুবই ছোট। একটা মাত্র রাস্তার ধারে শহরের সব দোকানপাট এবং হোটেল রেস্তোরাঁ। বড় হোটেল একটাই।
একটা রেস্তোরাঁর বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
কুয়াশা কাউকে কিছু না বলে রেস্তোরাঁর ভিতর ঢুকেছে। খানিক পর শোনা গেল কুয়াশার কণ্ঠস্বর, এখানেই অপেক্ষা করো তোমরা।
সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কিন্তু কোথায় কুয়াশা। তাকে আশেপাশে দেখাই যাচ্ছে না।
আজব ব্যাপার! কুয়াশা কথা বলল এইমাত্র।
রাজকুমারী বলল, এই যে রিকশাটা যাচ্ছে, ওতেই চড়ে বসে থাটা বলেছে কুয়াশা।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে ম্যানেজারকে প্রশ্ন করে মৃত্যুপুরী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছে কুয়াশা। মৃত্যুপুরী আসলে শহরের বাইরের একটা পোড়োবাড়ি। বাড়িটা বহুকাল যাবত খালি পড়ে আছে। স্থানীয় লোকেরা বাড়িটাকে মৃত্যুপুরী বলেই জানে। বেশ কিছু লোক গত দশ বারো বছরে ওই বাড়িতে নিহত হয়েছে বা আত্মহত্যা করেছে বলেই সম্ভবত বাড়িটার নাম মৃত্যুপুরী।
খানিক দূরে গিয়ে রিকশা ছেড়ে দিল কুয়াশা! পায়ে হেঁটে পোড়োবাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দোতলা বাড়ি। খুবই পুরানো। ধসে পড়েছে দেয়াল। জানালা-দরজার কবাট নেই।
উঠনে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। সামনের একটা কামরা থেকে শব্দ আসছে। কেউ যেন উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছে কামরার মেঝেতে।
পা বাড়াল কুয়াশা। এমন সময় কবাটহীন দরজার সামনে দেখা গেল একজন লোককে। লোকটাকে দেখামাত্র চিনল কুয়াশা। লোকটা স্বয়ং সৈয়দ ইমদাদুল কবীর।
কিন্তু সৈয়দ ইমদাদুল কবীর এখানে কোত্থেকে এল? চট্টগ্রাম থেকে কুয়াশা যখন রওয়ানা হয় তখন লোকটা তাদেরকে বলেছিল যে ঢাকায় যাবে পরবর্তী ফ্লাইটে, এবং এই সব বিপদ-আপদ না কেটে যাওয়া পর্যন্ত ঢাকাতেই থাকবে।
কুয়াশাকে দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল সৈয়দ কবীর। কয়েক মুহ পর হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, লাফ দিয়ে এগিয়ে এল বারান্দায়।
মি. কুয়াশা। ভয়ে আমি মরেই যাচ্ছিলাম। কেমন মানুষ বলুন তো আপনি? টেলিগ্রাম করে আসতে বলেছেন, অথচ আপনারই দেখা নেই! এই ভূতের বাড়িতে একা কেউ থাকতে পারে?
কুয়াশা বারান্দায় উঠল। তার মুখ দেখে মনের কথা বোঝা গেল না। শান্তভাবে বলল সে, টেলিগ্রাম? আমি কোনও টেলিগ্রাম করিনি আপনাকে।
হোয়াট! কি বললেন? টেলিগ্রাম করেননি? কিন্তু আপনার নাম পরিষ্কার দেখেছি আমি…! তবে..তাহলে নিশ্চয়ই খুনীরা আপনার নামে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল। নিশ্চয়ই তারা আমাকে এখানে আনিয়ে খুন করতে চেয়েছিল।
বারান্দা ও কামরার ভিতরটা তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে নিল কুয়াশা। সর্বত্র ধুলোর আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারল কুয়াশা, সৈয়দ কবীর ছাড়া এখানে আর কেউ আসেনি।
ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আগের মুহূর্তে আপনার টেলিগ্রামটা পাই আমি। মি. কুয়াশা, এসব কি ঘটছে বলুন দেখি? শত্রুরা আমাকে খুন করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে?
কুয়াশা তাকাল মুখ তুলে। বুলল, টেলিগ্রামটা দেখান তো।
হোটেলের রূমে রেখে এসেছি সেটা। টেজ্যিামের বক্তব্য, এখানে যেন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করি।
হোটেলে ফেরা যাক তাহলে।
পোড়োবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল মডার্ন। দোতলায় উঠল সৈয়দ কবীর কুয়াশাকে নিয়ে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল। ভিতরে ঢুকে একটা অ্যাটাচি কেস তুলে নিল টেবিল থেকে। বিছানার উপর সেটা রেখে তালা খুলল। ডালাটা তুল। এক মুহূর্ত পর বের করল টেলিগ্রামটা। পরীক্ষা করে দেখল সেটা কুয়াশা। সত্যিই তাই, তার নামেই কেউ সৈয়দ কবীরকে টেগ্রিাম করেছে।
ইতিমধ্যে হোটেলে পৌঁছেছে শহীদ, রাসেল, ডি.কস্টা এবং রাজকুমারী। হোটেল মডার্নের দোতলায় কয়েকটা কামরা ভাড়া নিয়েছে ওরা। টেকনাফে এই হোটেলই ওদের আস্তানা।
রাসেল এবং ডি. কস্টা গেল শহর দেখতে।
কুয়াশা চট্টগ্রাম এবং ঢাকার পত্রিকা অফিসগুলোর সাথে যোগাযোগ করল বিকেলে। সরাসরি ওয়্যারলেসে খবর পাঠাল সে টাকা এবং চট্টগ্রামের আস্তানায়। আস্তানার অনুচরেরা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে আধ ঘণ্টার মধ্যেই রিপোর্ট করল কুয়াশাকে।
দানব এল বলে! সাবধান! দানবের দল ধ্বংসকা শুরু করবে!–এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলো ডাকযোগে পাঠানো হয়েছে টেকনাফ থেকে।
হোটেল থেকে বের হলো কুয়াশা। পোস্ট মাস্টারের সাথে দেখা করল সে। কুয়াশার পরিচয় পেয়ে পোস্ট মাস্টার কয়েকটা তথ্য জানাল। হ্যাঁ, এই পোস্ট অফিস থেকেই বিজ্ঞাপনগুলো দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছে।
রাত দশটার দিকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঢাকায় কামালের সাথে যোগাযোগ করল কুয়াশা। একটা হেলিকপ্টার নিয়ে তাকে টেকনাফে আসতে বলল। কামাল সানন্দে রাজি হলো।
সেই রাতেই পৌঁছুবে কামাল, ঠিক হলো। কপ্টার নিয়ে সরাসরি শহরে আসবে না কামাল। শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরে, নির্দিষ্ট এক জায়গায় নামবে সে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত থাকবে কুয়াশা এবং শহীদ।
কুয়াশা চায় না শত্রুরা জানুক নতুন একটা কপ্টার আনাচ্ছে তারা। শহরে শত্রুপক্ষের লোক আছে, তাদের কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখতে চায় সে।
.
০৩.
রাত একটা বাজল। অন্যান্যদের হোটেলে রেখে কুয়াশা এবং শহীদ বেরিয়ে পড়ল হোটেল ছেড়ে।
নিঃসাড়, মুমন্ত শহর। দুটো ছায়ামূর্তি হনহন করেহেঁটে যাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক পরশহরের বাইরে বেরিয়ে গেল ওরা।
এদিকের রাস্তা এবড়োখেবড়ো। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। শহীদকে ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে কুয়াশা। রাস্তার দুপাশে কি আছে না আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কপ্টার নিয়ে কামাল নামবে আর একটু সামনে। সময় হয়ে এসেছে। আকাশের গায়ে দেখা গেল লাল আলোক বিন্দু।
কপ্টার আসছে।
এমনসময় তীক্ষ্ণ হুইসেলের শব্দ খান খান করে দিল রাতের নিস্তব্ধতাকে। থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। মুহূর্তে ব্যাপারটা বুঝতে পারল সে। কামাল কপ্টার নিয়ে আসবে একথা শত্রুপক্ষ আগে থেকেই কিভাবে যেন জেনে ফেলেছে। দলবল নিয়ে আড়ালে অপেক্ষা করছে তারা। আকাশে কপ্টারের আলো দেখেই হুইসেলে ফুঁ দিয়ে নিজেদের লোকজনকে সতর্ক হবার নির্দেশ দিচ্ছে।
পরমুহূর্তে শোনা গেল রাইফেলের শব্দ। বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট কুয়াশার মাথার উপর দিয়ে।
শহীদ! গা ঢাকৗ দাও! কুইক!
রাস্তার পাশে খাদ। খাদের ঢালুতে নেমে গেল শহীদ। মাথাটা উঁচু করে রাখল ও। এক মুহূর্ত পর মাটিতে চেপে ধরল একটা কান। ধ্বক করে উঠল বুকের ভিতর।
কে বা কারা যেন থপ থপ করে পা ফেলে এগিয়ে আসছে এদিকেই।
আবার সেই দানব দুটো আসছে না তো?
মাটিতে কান ঠেকিয়ে রাখতে হলো না। এমনিতেই শোনা যেতে লাগল দানবের পদশব্দ। সেই সাথে ফো-ও-ও-ওস, ফো-ও-ও-ওস-সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যেতে লাগল।
গ্যাস বোমা, শহীদ।
গ্যাস মাস্ক আগেই পরে নিয়েছে শহীদ। কুয়াশার নির্দেশ পাওয়ামাত্র একটা বোমা ছুঁড়ে মারুল ও দানবের পদশব্দ লক্ষ্য করে। রাস্তার বহুদূরে গিয়ে সশব্দে বিস্ফোরিত হলো সেটা।
এদিকে মাথার উপর চলে এসেছে কপ্টার। টর্চ জ্বেলে সিগন্যাল দিচ্ছে কুয়াশা। নামল না সেটা। মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল অন্য দিকে, চোখের আড়ালে।
লাউডস্পীকারের একটি কণ্ঠস্বর আচমকা চারদিকের নিস্তব্ধতা ভাঙল।
গ্যাস বোমা ছুঁড়ছে ওরা? সাবধান! গ্যাসবোমা! ঝুঁকি নেবার দরকার নেই। ফিরে এসো! দিক পরিবর্তন করো। কপ্টার নামবে না, বোঝা যাচ্ছে। তোমরা শহরের দিকে এগোও। সৈয়দ কবীরকে বন্দী করার জন্যে যাও
কণ্ঠস্বরটা ফিচেলের।
ভারি পদশব্দ শুনে বোঝা গেল দানবের দল দিক পরিবর্তন করে শহরের দিকে ছুটছে।
রাস্তার পাশে শুয়ে ছিল কুয়াশাও। রাস্তার উপর কান ঠেকিয়ে তখনও শুনছিল সে ছুটন্ত দানবদের পদশব্দ। শব্দ শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারল সে মোট চারটে দানব ছুটছে শহরের দিকে।
রাস্তার উপর উঠে দাঁড়াল সে। ডান হাতের বড় আকারের পিস্তলটা গর্জে উঠল। একবার। দুইবার! তিনবার
পাশে এসে দাঁড়াল শহীদ।
এসো!
শব্দটা উচ্চারণ করে ছুটল কুয়াশা শহরের দিকে। অনুসরণ করল তাকে শহীদ।
শদেড়েক গজ এগোল ওরা–এমন সময় টর্চের উজ্জ্বল আলো সামনের দিক থেকে ওদের গায়ে এসে পড়ল।
সাথে সাথে শোনা গেল স্টেনগানের গর্জন।
শহীদকে ধাক্কা দিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়ে কুয়াশাও সটান শুয়ে পড়ল রাস্তার উপর। এক মুহূর্ত পর গর্জে উঠল শহীদের হাতের রিভলভার।
টর্চটা নিভে গেল।
উল্লাসে চিৎকার করে উঠল শহীদ, লেগেছে শয়তানটার!
কুয়াশা বলল, না, লাগেনি। টর্চটা কি রকম স্থির হয়ে ছিল লক্ষ করোনি। ওটা একটা লাঠি বা বাঁশের উপর বাঁধা ছিল।
এক মুহূর্ত পর কুয়াশার কথার সত্যতা প্রমাণিত হলো। আবার গর্জে উঠল স্টেনগান। ওদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল এক ঝাঁক বুলেট।
কিন্তু স্টেনের নল থেকে আনবেরুচ্ছে না কেন?
কুয়াশা বলল, মাজলে ফ্লেম-ডাইজেস্টার জাতীয় কিছু আছে, তাই। শহীদ, খাদে নামতে হবে।
খাদের প্রায় খাড়া গা বেয়ে অতি সন্তর্পণে নামতে শুরু করল ওরা। মিনিট দশেক পর খাদের তলদেশে পৌঁছল দুজন। ঝোঁপঝাড়, গাছপালার ভিতর দিয়ে ঘুর পথে ছুটল ওরা শহরের দিকে।
আধ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করল ওরা। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দম বন্ধ হয়ে গেল দুজনেরই। ভেসে আসছে চিৎকার। নারী-পুরুষ-শিশুর আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে।
মৃত্যুভয়ে চিৎকার করছে শহরের বাসিন্দারা। দানবের দল হানা দিয়েছে শহরে।
.
স্টেনগানধারী লোকটা রাস্তার উপর নেই। পিছন দিকে গুলিবর্ষণ করতে করতে শহরের দিকে চলে গেছে সে একটা গাড়ি নিয়ে। খানিক আগে ব্যাপারটা টের পেয়েছে ওরা। ভারি একটা ট্রাক স্টার্ট নেবার শব্দ পেয়েছিল। রাস্তার উপর দিয়ে এগোলে শহরে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে বলে খাদের উপর থেকে উঠে এল ওরা।
শহর বেশ দূরে হলেও আক্রান্ত মানুষের চিৎকার পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল ওরা। রাস্তার উপর উঠে আবার ছুটল দুজনে।
কিন্তু আবার থামতে হলো ওদেরকে। আকাশের দিকে তাকাল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজনেই। দূরাকাশে আলো দেখা যাচ্ছে। হেলিকপ্টার আসছে একটা। কুয়াশা টর্চ বের করে সেটার উদ্দেশে আলোক-সঙ্কেত পাঠাল।
দূরাকাশের আলোটা কয়েকবার নিভল এবং জ্বলল।
দুই মিনিট পর রাস্তার উপর নামল প্রকাও কপ্টারটা। নেমে এল কামাল। ছুটে গেল শহীদ এবং কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, কপ্টারে ওঠো, কামাল। শহরে একদল দানব হানা দিয়েছে!
বলো কি?
কপ্টারে চড়ল ওরা। পাইলটের সীটে বসল স্বয়ং কুয়াশা। কপ্টার আকাশে উঠল।
শহরের তিন কি চার জায়গায় আগুন জ্বলছে। শহরবাসীদের আর্তচিৎকারের শব্দ এত উঁচু থেকে অস্পষ্ট ভাবে হলেও শোনা যাচ্ছে। কুয়াশা ফ্লাডলাইটের সুইচ অন করতেই নিচের শহরের একটা অংশ আলোকিত হয়ে উঠল।
মানুষজন প্রাণভয়ে ছুটোছুটি করছে দিশেহারার মত। রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত লাশ। কয়েকটা বাড়ির পাচিল ভেঙে পড়েছে।
মডার্ন হোটেলের উপর আলো পড়তেই শহীদ চিৎকার করে উঠল, ওই যে!
হোটেলের সামনে একটা প্রকাণ্ডদেহী দানবকে দেখা গেল। ছুটছে সেটা রাস্তার উপর দিয়ে। আলো পড়ায় চকচক করছে রাক্ষসটার শরীর। কামাল রুদ্ধশ্বাসে বলল, এসব কি দেখছি আমি? দুঃস্বপ্ন?
কুয়াশা বলল, এই দানবটা অন্যগুলোর মত নয়, শহীদ, লক্ষ করেছ? চেয়ে দেখো, মুখটা বনমানুষের মত নয়। যেখানে যেখানে ইস্পাতের বর্ম নেই সেসব জায়গায় লোমও নেই। ও মানুষই, তবে কিভাবে যেন ওকে মানুষের চেয়ে ছয়গুণ বড় করা হয়েছে।
শহীদ বলল, মিরাকল সার্কাস পার্টির তিনটে বনমানুষ হারিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোকে দশগুণ বড় করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটাকে ওরা খুন করেছে।
শহরের যেদিকেই আলো পড়ছে সেদিকেই দেখা যাচ্ছে ধ্বংসের চিহ্ন। আরও দুটো দানবকে দেখল ওরা। রাস্তা দিয়ে ছুটছে।
মোট চারটে!
শহীদ বলল, ওরা ছুটছে সাগরের দিকে।
কামাল বলল, কপ্টারে ফুয়েল নেই কিন্তু বেশি।
সাগরের দিকে ছুটছে দানবের দল। সামনের দানবটার হাতে একজন লোক বন্দী রয়েছে! দানটার প্রকাণ্ড হাতের মুঠোয় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে বন্দী লোকটা। হাত পা ছুড়ছে সে।
কুয়াশা বলল, সৈয়দ কবীরকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে ওরা।
আরও সামনে আলো ফেলল কুয়াশা। একটা সাতটন ওজনের ট্রাক দেখা। গেল। ট্রাকটাও ছুটছে সাগরের দিকে। দানবের দল আসলে অনুসরণ করছে ট্রাকটাকে।
কপ্টারকে আরও নিচে নামাল কুয়াশা। হঠাৎ ট্রাকের ভিতর থেকে একটা মাথা বেরিয়ে এল।
ফিচেল নামের লোকটা স্টেনগান উঁচিয়ে ধরল কপ্টারের দিকে। ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা গেল।
কপ্টারের বহু দূর দিয়ে ছুটে গেল ঝাঁক ঝাঁক বুলেট।
কুয়াশা বলল, কপাল মন্দ। ফলো করা সম্ভব নয়। ফুয়েল প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
.
সাগরের কাছাকাছি কপ্টার নামাল কুয়াশা। লাফ দিয়ে নামল তিনজন। সাগরের দিকে ছুটল কুয়াশা। কামাল এবং শহীদ অনুসরণ করল তাকে।
বালুকাবেলায় না গিয়ে থমকে দাঁড়াল কুয়াশা একটা নারকেল গাছের সামনে। শহীদ এবং কামাল যখন সামনে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা তখন গাছ বেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। গাছের উপর থেকে কুয়াশা বলে উঠল, আলো জ্বেলো না। উঠে এসো তোমরাও।
নারকেল গাছের মাথায় উঠে আলখেল্লার পকেট থেকে নাইট বিনোকুলার বের করল কুয়াশা। সেটা চোখে লাগিয়ে তাকাল দক্ষিণ দিকে।
বেলাভূমির বিস্তীর্ণ প্রান্তর। অনেক দূরে জ্বলজ্বল করছে ধবধবে তিন-চারটে আলোর টুকরো।
কি দেখছ?
শহীদ ও কামাল কুয়াশার ঠিক নিচে এসে পড়েছে। কুয়াশা হাত বাড়িয়ে নাইট বিনোকুলারটা শহীদকে দিল। বলল, দেখো।
যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে দূরে তাকাল শহীদ। কুয়াশার মতই তিন-চারটে অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো দেখতে পেল। আলোগুলো মাইল দুয়েক দূরে রয়েছে। কুয়াশা বলল, আলোগুলো দেখেছ? ওগুলো ফসফরাস জাতীয় একটা কেমিক্যাল। রাস্তার উপর দানবগুলো যখন আমাদেরকে আক্রমণ করেছিল তখন পিস্তল দিয়ে কয়েকটা কেমিক্যাল বুলেট ছুঁড়েছিলাম আমি। জিনিসটা বাতাসের সংস্পর্শে আসার আধঘণ্টা পর জুলজুল করে আলো ছড়ায়।
শহীদ কি যেন প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু দূর থেকে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে শুনে চুপ করে রইল।
দুই মাইল দূর হলেও, লাউডস্পীকারের শব্দ পরিষ্কার বোঝা গেল। ফিচেল মাইকযোগে নির্দেশ দিচ্ছে, স্পীডবোটগুলো এদিকে নিয়ে আয়!
স্পীডবোটগুলো বিরাটাকার। সাগরের মাইল খানেক দূরে নোঙর করা অবস্থায় অপেক্ষা করছিল সেগুলো। নির্দেশ পেয়ে স্টার্ট নিল, এগিয়ে আসতে শুরু করল তীরের দিকে।
একটা, দুটো, তিনটে।
শুনল কামাল।
শহীদ বলল, ফসফরাস দেখছি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
কুয়াশা বলল, ওরাও দেখেছে জিনিসটা। দানবগুলোর গা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে ওরা। কিন্তু সহজে মুছছে না ওগুলো। বরং চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
স্পীডবোটে চড়ল দানবগুলো। স্পীডবোটগুলো গভীর সাগরের দিকে ছুটে চলল।
কুয়াশা বলল, বুঝলে শহীদ, শত্রুদের আস্তানা আছে সাগরের কোথাও কোন দ্বীপে।
ফসফরাসের আলো ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল।
এরপর শহরে ফিরে এল ওরা। ছোট্ট শহরটাকে ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়ে গেছে দানবের দল। ঘর-বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়েছে বহু মানুষ। দানবরা চলে গেছে বুঝতে পেরে ফিরে আসতে শুরু করেছে কেউ কেউ। কান্না আর বিলাপ ধ্বনিতে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। মডার্ন হোটলের গোটা পাচিলটা ভেঙে ফেলেছে দানবের দল। একতলার প্রত্যেকটি কামরার আসবাবপত্র এবং দেয়াল ভেঙে ফেলেছে তারা। সিঁড়ির রেলিং-এর অস্তিত্বই নেই, একতলাতেই দেখা হলো রাসেল এবং রাজকুমারীর সাথে।
প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিলাম আমরা।
কুয়াশা বলল, বুদ্ধিমানের কাজই করেছ। মি. ডি কস্টা কোথায়?
অক্ষত আছেন উনি। তবে স্পুটনিককে খুঁজে পাচ্ছেন না। বাইরে গেছেন। খুঁজতে।
কুয়াশা বলল, শহরের বহুলোক আহত হয়েছে। ওদের চিকিৎসা দরকার। তোমরা সবাই বেরিয়ে পড়ো ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা করতে।
রাসেল বলল, সৈয়দ কবীর সাহেবকে…।
তাকে থামিয়ে দিয়ে কুয়াশা বলল, জানি।
.
পরদিন বিকেলের দিকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং নোয়াখালী জেলা শহরের মোট পঞ্চাশজন ধনী ব্যক্তি একটি করে চিঠি পেলেন ডাকযোগে।
চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছে টেকনাফ থেকে।
পঞ্চাশটি চিঠির বক্তব্য একই। লেখকও একজন। চিঠিগুলো হুবহু এই রকম: মানীয়,
দানব সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলো নিশ্চয়ই আপনি দৈনিক সংবাদপত্রে ইতিমধ্যে দেখেছেন। সেগুলোর প্রচারক আমিই। আপনি সম্ভবত ইতিমধ্যে টেকনাফের ধ্বংসকাণ্ড সম্পর্কেও খবর পেয়েছেন। যদি না পেয়ে থাকেন, উপদেশ দিচ্ছি, এখুনি টেকনাফ শহরের সাথে যোগাযোগ করুন। সকল সংবাদ বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আমার তৈরি দানবকুল টেকনাফে হামলা চালিয়েছে সৈয়দ কবীরকে বন্দী করার জন্যে। সৈয়দ কবীরের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্যে তাকে আমি জাল টেলিগ্রাম পাঠিয়ে টেকনাফে আনাই। সে যাক…টেকনাফে হামলা চালাবার আরও একটা কারণ অবশ্য ছিল। আমি দেশের লোককে জানাতে চাই আমার তৈরি দানবগুলোর ক্ষমতার তুলনা হয় না। আমি প্রমাণ করতে চাই আমার হাতে কি প্রচণ্ড ক্ষমতা রয়েছে। আমি চাই সবাই আমাকে ভয় করুক, আমার নির্দেশ বিনা শর্তে পূরণ করুক, আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুক। কারণ অদূর ভবিষ্যতে আমিই হব এদেশের একচ্ছত্র অধিপতি। আমার কথাতেই এদেশের মানুষ উঠবে, বসরে। আমাকেই তারা ভয় করবে। আমিই তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা হব।
যাই হোক, এই চিঠি পাবার সাথে সাথে আপনি আপনার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা থেকে মাত্র দশ লক্ষ টাকা বাড়িতে এনে রাখবেন। আপনার মত পঞ্চাশজন ধনী ব্যক্তির কাছে এই চিঠি পাঠাচ্ছি আমি। আমি জানি সবাই আমার দাবি অনুযায়ী দশ লক্ষ করে টাকা দেবেন। মোট পাঁচ কোটি টাকা এখন দরকার আমার।
আগামীকাল আপনি আরও একটা চিঠি পাবেন। তাতে জানানো হবে টাকাগুলো কিভাবে আপনি আমার হাতে তুলে দেবেন। সে চিঠি ইতিমধ্যেই ডাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমার দাবি পূরণ না হলে, নিশ্চিত জানবেন, সৈয়দ কবীরের মত আপনাকে বন্দী করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব আমি। আপনার বাড়িতে পাঠানো হবে দানবের দলকে। তারা আপনার বাড়িটাকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেবে। হত্যা করবে বাড়ির প্রত্যেকটি প্রাণীকে। বন্দী করা হবে শুধু আপনাকে।
কোন রকম বাধা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি অদম্য, আমার তৈরি দানবের দল অপরাজেয়।
ইতি,
সানাউল হক খান
খবর ছড়িয়ে পড়ল তিনটে জেলা শহরে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।
.
০৪.
চন্দ্রালোকিত আকাশের পথ ধরে ছুটে চলেছে হেলিকপ্টারটা। নিচে বঙ্গোপসাগর। উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। পাইলটের সীটে বসে আছে স্বয়ং কুয়াশা। তার এক পাশে শহীদ, অপর পাশে রাজকুমারী।
দুটো দ্বীপ ছাড়িয়ে এসেছে ওরা।
কামাল জানতে চাইল, দিনের বেলা সন্ধান চালালে সহজেই চেনা যেত দ্বীপটা।
কুয়াশা বলল, মনে হয় না। যে দ্বীপেই শত্রুরা আস্তানা তৈরি করে থাকুক, যাতে দিনের বেলা তার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় সন্দেহজনক কিছু দেখা না যায় সে ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে রেখেছে।
রাজকুমারী বলল, সাগরের বুকে কোন দ্বীপে যে ওদের হেড কোয়ার্টার আছে–তুমি নিশ্চিত ভাবে জানো?
কুয়াশা বলল, জানি। প্রত্যেকবার লক্ষ করেছি, দানবগুলো সাগরের দিক থেকে আসে এবং সাগরের দিকে চলে যায়।
শহীদ বলল শেষবার, গতরাতে তো স্পীডবোটে দানবগুলোকে চড়তেই দেখেছি।
কুয়াশা বলল, শহীদ, ওই দেখো, চাঁদের আলোয় আরও একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।
সবাই তাকাল সামনের দিকে। মাইল তিনেক দুরে সত্যি কালো মত কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে ছোট দেখালেও ওটা একটা দ্বীপ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেলাভূমি থেকে প্রায় আশি মাইল এগিয়ে এসেছে ওরা।
কুয়াশা বলল, দ্বীপটার উপর দিয়ে কয়েকবার উড়ে যাব আমরা। শহীদ, তুমি বিমোকুলার চোখে লাগিয়ে কিছু দেখা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখো।
শহীদ বিনোকুলার বের করল।
ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে দ্বীপটা। কি মনে করে কে জানে কপ্টারের স্পীড বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। শহীদ বলল, নির্জন বলেই মনে হচ্ছে। গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আর পাথরের টুকরো ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
নাইট বিনোকুলারটা আবার চোখে লাগাল শহীদ।
দ্বীপের কাছাকাছি চলে এসেছে হেলিকপ্টার। চাঁদের আলোয় দ্বীপটাকে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খালি চোখেও জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। বনভূমি প্রায় ঢেকে রেখেছে দ্বীপটাকে। কোথাও কোন প্রাণের সাড়া নেই। আলোর ক্ষীণ আভাও দেখা যাচ্ছে না।
আরও নিচে নামাল কুয়াশা কপ্টারকে।
দ্বীপটা প্রস্থে মাইল খানেক হবে, দৈর্ঘ্যে মাইল দেড়েকের বেশি নয়। চারদিকে অথৈ পানি। কাছাকাছি আরও একটি দ্বীপ রয়েছে।
জনমানবহীন বলে মনে হচ্ছে!
হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে দ্বীপের উপর দিয়ে। পাশেই সাগর। অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে শব্দ হলো-ঠা-ঠা-ঠা-ঠা! ঠা-ঠা-ঠা-ঠা!
মেশিনগান গর্জে উঠেছে। একটানা, অবিরাম শোনা যাচ্ছে বিকট শব্দ। সেই সাথে মর্টারের আওয়াজ।
চিৎকার করে বলল শহীদ, কুয়াশা! কপ্টার,সামলাও।
আঁতকে উঠল রাজকুমারী, সর্বনাশ। মর্টারের গোলা লেগেছে কপ্টারের গায়ে।
প্রাণপণ চেষ্টা করছে কুয়াশা কপ্টারটাকে সোজা রাখতে। কিন্তু পারছে না।
তীরবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে কপ্টার। দ্বীপের উপর গিয়ে পড়বে ওরা। যে গতিতে নামছে, মাটির সাথে ধাক্কা খাওয়া মানে অবধারিত মৃত্যু।
কুয়াশা নির্দেশ দিল, লাইফবয় সাগরে লাফ দিয়ে পড়ো সবাই! শহীদ, স্টীলের বাক্সটা তুমি নিজের কাছে রাখো।
এক মুহূর্ত পর আবার চিৎকার করে উঠল কুয়াশা, লাফ দাও!
লাফিয়ে পড়ল কামাল, রাজকুমারী। ওদেরকে অনুসরণ করল রাসেল এবং ডি. কন্টা।
কুয়াশার জন্য অপেক্ষা করছিল শহীদ।
রেডি! চিৎকার করে উঠল কুয়াশা। লাফ দিল সে নিচের দিকে। তার সাথেই লাফ দিল শহীদ।
দ্বীপের উপর নয়, লাফ দিয়ে ওরা সবাই পড়ল সাগরের বুকে। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে লাইফবয়। ফলে কেউ সাগরের ঢেউয়ের শিকার হয়ে নাকানিচুবানি খেলো না বেশিক্ষণ। কয়েক মুহূর্ত পর দেখা গেল সবাই লাইফবয়ের উপর উঠে বসেছে।
স্টীলের বাক্সটা নিয়ে লাফিয়ে পড়েছে শহীদ। কুয়াশা প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আর যন্ত্রপাতি ভরে রেখেছিল সেটাতে।
কামাল জানতে চাইল, দ্বীপে গিয়ে উঠব…?
রাজকুমারী জবাব দিল, আশি মাইল দূরের তীরে এই ভেলায় চড়ে যাওয়া কি সম্ভব? দ্বীপে শত্রুরা আছে জেনেও ওদিকেই আশ্রয়ের জন্য যেতে হবে।
কুয়াশা বলল, শত্রুদের আস্তানা ধ্বংস করতে এসেছি আমরা, কথাটা ভুলে যেয়ো না, কামাল।
দ্বীপের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে লাফ দিয়ে পড়েছিল ওরা। কপ্টারে আগুন লাগার পর ওরা কেউ খেয়াল করেনি দ্বীপের কাছ থেকে কতটা দূরে সরে এসেছিল কপ্টার। দ্বীপটাকে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে। প্রায় আধ মাইল তো হবেই।
ওগুলো কি? মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে? পাহাড়ের মত?
রাজকুমারী দ্বীপের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। কুয়াশা জিনিসগুলোকে আগেই লক্ষ করেছে। তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল সে। রাজকুমারীর কথা শুনে বাকি সবাইও সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুল।
সত্যিই তো! দ্বীপের কিনারায়, সাগরের উপরই বলা যায়, কি দাঁড়িয়ে রয়েছে ওগুলো! পাহাড়?
কুয়াশার ভারি গলা শোনা গেল, পাহাড় নয়। ওগুলো…দানব!
সবাই চমকে উঠল।
দানব তিনটে এগিয়ে আসছে পায়ে হেঁটে। পানির গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে তাদের শরীর ডুবছে ক্রমশ, এক সময় সাঁতার কাটতে শুরু করল তারা।
দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে দানবের দলটা।
শহীদ স্টীলের বাক্স খুলল। ভিতর থেকে বের করল একটা স্টোন।
কিন্তু গুলি করা হলো না। কারণ ঠিক সেই সময় দ্বীপের উপর থেকে লাউডস্পীকারের মাধ্যমে ফিচেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। দৈত্যাকার দানবগুলোর উদ্দেশে নির্দেশ দিচ্ছে সে।
কুয়াশা বা তার বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে হত্যা কোরো না তোমরা! আমার কথা শোনো! কুয়াশা বা তার বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে হত্যা কোরো না তোমরা। ওদের প্রত্যেককে জীবিত বন্দী করতে চাই আমি।
শহীদ বলল, এটা চালও হতে পারে।
কামাল বলল, আমরা এখন কি করতে পারি?
কুয়াশা শান্তভাবে বলল, উপায় তো দেখছি না। ওদের হাতে বন্দী হওয়া ছাড়া করার কিছু নেই।
রাজকুমারী জানতে চাইল, ওদের কথা তাহলে তুমি বিশ্বাস করছ? কিন্তু সেটা কি উচিত হচ্ছে? দানবগুলো যদি আমাদেরকে হাতের কাছে পেয়ে খুন করার চেষ্টা করে?
কুয়াশা বলল, বিচিত্র কিছু নয়। খুন করতেও পারে, না-ও পারে। আমি বলতে চাইছি, বন্দী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।
চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? পিস্তল, গ্যাস বোমা ব্যবহার করে ঠেকাতে পারব না?
কুয়াশা বলল, সব কথা ভেবে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। শুধু দানবগুলোই শত্রু নয়। শত্রু আমাদের ডান এবং বাঁ দিক থেকেও আসছে। কান পাতো, স্পীডবোটের শব্দ শুনতে পাবে।
কান পাততে হলো না, এমনিতেই সবাই স্পীডবোটের শব্দ শুনতে পেল। কুয়াশা বলার আগে শব্দটা ওরা শুনতেই পায়নি।
কামাল বলল, শহীদ, চুপ করে আছিস যে?
ডান দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা স্পীডবোট। স্টেনগানের গুলি ছুঁড়ছে কেউ সেটা থেকে ওদের দিকে।
বুলেটগুলো মাথার উপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে চলে গেল। শত্রুরা যে ওদেরকে হত্যা করতে চাইছে না তা বোঝা গেল এ থেকে।
কুয়াশা বলল, কেউ বাধা দিয়ো না। দেখা যাক দানবগুলো কি করে।
কুয়াশার কথা শেষ হতেই ভেসে এল লাউডস্পীকারের মাধ্যমে ফিচেলের কণ্ঠস্বর, কুয়াশা! কোন রকম বোকামি করতে যেয়ো না। আমি সাবধান করে দিচ্ছি! দানবদের খেপিয়ে তুলো না। ওরা কোনও ক্ষতি করবে না তোমাদের। কিন্তু ওদেরকে বাধা দিলে খেপে যাবে ওরা। দানবগুলো একবার খেলে রক্ষা নেই কারও। তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে তোমাদেরকে। যদি ভাল চাও তো দানবদের হাতে ধরা দাও বিনা প্রতিরোধে!
লাইফবয়ের একেবারে কাছে চলে এসেছে দানব তিনটে। প্রকাণ্ড তিনটে তিমি মাছ যেন সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে ওদেরকে গিলে খাবার জন্য।
উত্তাল ঢেউয়ের উপর নাচছে লাইফবয়গুলো।
আর মাত্র পনেরো বিশ গজ দূরে দানবগুলো। হঠাৎ তারা বিকট, কানফাটানো শব্দে চিৎকার করে উঠল।
গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল ওদের। দানবগুলো পানির নিচে ডুব দিয়েছে।
নিচু গলায় বলে উঠল কুয়াশা, হাতের বাক্সটা পানিতে ফেলে দাও, শহীদ।
নির্দেশ পালন করল শহীদ। সাথে সাথে ডুবে গেল সেটা। জায়গাটা ভাল করে লক্ষ করল কুয়াশা। প্রয়োজনের সময় বাক্সটা উদ্ধার করতে এসে যেন ব্যর্থ হতে না
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সবাই। পরাজিত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওদের চেহারা। হাল ছেড়ে দিয়েছে প্রত্যেকে।
কয়েক মুহূর্ত পর দানবগুলো মাথা তুলল পানির উপর। লাইফবয়গুলোর পাশে জেগে উঠল বিরাটাকার এক একটা মাথা।
একটা দানব হাত বাড়িয়ে দিল। কুয়াশার সামনের সব দৃশ্য ঢাকা পড়ে গেল, দানবের বিশাল হাতটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। দানবটা মুঠো করে ধরল কুয়াশার কোমর। শূন্যে তুলে নিল তাকে। দ্রুত সাঁতার কেটে ফিরে চলল দ্বীপের দিকে। প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে কুয়াশা কোমরে। ছোট্ট, প্লাস্টিকের পুতুলের মত দেখাচ্ছে তাকে প্রকাণ্ডদেহী দানবটার হাতে।
ধরা পড়ল সবাই দানবদের হাতে। দানবরা ওদেরকে নিয়ে ফিরে চলল দ্বীপের দিকে।
.
আকাশ থেকে দ্বীপটাকে জনবসতিহীন বনভূমি বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। রাক্ষসগুলো ওদেরকে কাঁধে চড়িয়ে, মুঠোয় ধরে দ্বীপের উপর দিয়ে অভ্যন্তরভাগে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে উঁচু উঁচু অট্টালিকা দেখতে পাচ্ছে ওরা।
অট্টালিকাগুলো আগে চোখে পড়েনি, তার কারণ প্রতিটি বাড়ির ছাদে, দেয়ালে গাছের ডালপালা এবং পাতা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় দুটো হ্যাঁঙ্গার দেখল ওরা। দুটো হ্যাঙ্গারেই একটা করে প্লেন রয়েছে। প্লেনগুলোর চারপাশে অনেকগুলো অ্যাপ্রন পরী এঞ্জিনিয়ার ঘোরাফেরা করছে। প্লেনগুলোর সীট তুলে ফেলা হয়েছে, লক্ষ করুল কুয়াশা।
তিনতলা উঁচু বাড়ির সংখ্যা একাধিক। একতলা বাড়িও অনেক। আরও খানিক দূর এগিয়ে দানবগুলো থামল। কুয়াশাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে গর্জে উঠল দানবটা।
শোনা গেল ফিচেলের কণ্ঠস্বর, তোমরা সবাইকে নামিয়ে দিয়ে পিছিয়ে এসো।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা। ফিচেলের হাতে একটা স্টেনগান রয়েছে। তার সাথে পাঁচ-ছয় জন রিভলভারধারী লোককে দেখা যাচ্ছে।
দানবরা বন্দীদের মাটির উপর নামিয়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল বিকট স্বরে চিৎকার। করতে করতে। এগিয়ে এল ফিচেল এবং তার দলবল।
সার্চ করা হলো ওদের সবাইকে। ফিচেল নির্দেশ দিল কর্কশ কণ্ঠে, ডান দিকে এগোও সবাই।
কুয়াশার দিকে তাকাল ওরা। কুয়াশা কথা না বলে পা বাড়াল। সবাই তাকে অনুসরণ করল। কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে ফাঁকা একটা ছোট্ট মাঠ। মাঠের মাঝখানে বড় বড় পাথরের খণ্ড। একটা পাথরের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে একজন লোককে। লোকটা সম্ভবত শত্রুদের হাতে বন্দী। চাঁদের আলোয় লোকটাকে ভাল করে দেখতে পাওয়া গেল না। কামাল ফিসফিস করে বলল, সৈয়দ ইমদাদুল কবীর সম্ভবত!
মাঠের মাঝখান দিয়ে এগোল ওরা। তাদের সামনে একজন শত্রু। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
খানিকদূর এগিয়ে সামনের লোকটা একটা প্রকাণ্ড পাথরের সামনে দাঁড়াল। পা বাড়াল সে আবার। পাথরটাকে ঘুরে দশহাত দূরে গিয়ে আবার থামল সে। কুয়াশা পৌঁছুল সেই জায়গায়।
মাঠটা সমতল। কুয়াশা দেখল প্রকাণ্ড পাথরটার সামনেই সবুজ ক্যানভাস বিছানো রয়েছে। ফিচেলের সহকারীরা ক্যানভাসটা সরিয়ে ফেলতেই প্রকাণ্ড এক গহ্বর দেখা গেল।
গভীর একটা কূপের মত দেখতে গম্বরটা।
ফিচেলের একজন নোক মোটা দড়ি ঝুলিয়ে দিল কূপের ভিতর। দড়ির প্রান্তটা বাধা হলো প্রকাণ্ড পাথরের সাথে। ফিচেল হুকুম দিল, একজন একজন করে নেমে যাও সবাই নিচে!
কুয়াশা নড়ল না।
ফিচেল বলল, কোনরকম চালাকির চেষ্টা কোরো না। তোমরা আমাদের হাতে বন্দী। ইচ্ছা করলে আগেই তোমাদেরকে মেরে ফেলতে পারতাম। বুঝতেই পারছ, সে রকম ইচ্ছা আপাতত আমার নেই। বসের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করব না আমি।
পা বাড়াল কুয়াশা। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল সে।
কূপটা গভীর। নামছে তো নামছেই, তলের আর দেখা নেই! কূপের ভিতরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। অবশেষে মাটির স্পর্শ পেল সে।
একে একে নামল সবাই।
একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনা গেল অন্ধকার কূপের ভিতর, আপনারা…আপনারাও বন্দী হয়েছেন! সর্বনাশ! বাঁচার আর কোন আশাই তাহলে নেই!
কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল কুয়াশা। মেয়েটি লাকী, রাঙামাটিতে সৈয়দ কবীরের বাড়িতে দেখা হয়েছিল এর সাথে।
কূপের উপর থেকে, কিনারায় বসে, নিচের দিকে উঁকি দিয়ে তাকাল ফিচেল, বাছাধনেরা এবার বোঝে। হাড়ে হাড়ে এবার টের পাবে কাদের বিরুদ্ধে লেগেছ তোমরা। চুনোপুটি হয়ে লাগতে এসেছিলে আমাদের সাথে। বস্ আসুক, তোমাদেরকে কিভাবে উচিত শিক্ষা দিতে হয় তখন দেখাব।
ওহে, তোমাদের বসটা কে বলো তো? জানতে চাইল কামাল ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে।
মি. সানাউল হক আমাদের বস। দানবগুলোকে তিনিই তৈরি করেছেন।
কামাল বলল, তোমাদের বস্ হয় পাক্কা শয়তান, নয়তো বদ্ধ উন্মাদ। এই দানব তৈরি করার উদ্দেশ্য কি তোমার বসের?
ফিচেল বলল, উদ্দেশ্য? পৃথিবীর সব মানুষেরই তো একটাই উদ্দেশ্য–টাকা রোজগার করা। শোনোনি, আগামীকাল রাতে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী আর কুমিল্লায় আমরা দানব পাঠাচ্ছি? অবশ্য যদি পাঁচ কোটি টাকা না পাই…।
কামাল বলে উঠল, দিবা স্বপ্ন দেখছ বলে মনে হচ্ছে। পাঁচ কোটি টাকা! পঁচ পয়সাও পাবে না তোমরা।
পাব কিনা সময় হলেই দেখতে পাবে। অবশ্য ততক্ষণ বস তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবেন কিনা জানি না। তবে শুনে রাখো, টাকা আমাদেরকে দিতেই হবে। দানবরা শহরের ধনী লোকদের ঘরবাড়ি চুরমার করে দিয়ে আসবে। সামনে যাকে পাবে তাকেই খুন করবে…। উদ্দেশ্যের কথা জানতে চাইছিলে না? বাংলাদেশ দখল করব আমরা।
কামাল বলল, ভেবেছ বাধা দেয়া হবে না? প্লেন থেকে বোম ফেলে তোমাদের দানবগুলোকে।
বোমা ফেলবে কজনের উপর? তিন হাজার দানব তৈরি হচ্ছে আরও। পাশের দ্বীপে তিন হাজার লোককে বন্দী করে রেখেছি আমরা।
কামাল জানতে চাইল, কিন্তু এত টাকা তোমাদের বসের দরকার হলো কেন? দানবদের মাইনে দিতে হয়?
ফিচেল বলল, দানবরাও টাকার ভাগ পাবে। আমাদের প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করা হয়ে গেলে দানবগুলোকে আগের সাইজে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আকারে ফিরিয়ে আনা হবে।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, মিরাকল সার্কাস পার্টির বনমানুষ তিনটেকে তোমরা দানবে পরিণত করেছ। কোথায় তারা এখন?
ফিচেল বেশি কথা বলতে পছন্দ করে। উত্তর দিতে দেরি করল না সে, রাউয়ের বাড়ি ভেঙে দেবার পর তারা পালিয়েছিল। আমরা তাদেরকে বন্দী করে এনে রেখেছি কাছাকাছি একটা দ্বীপে। ওদেরকে বশ করাবার জন্যে লাকীকে দরকার।
এতক্ষণে আলোচনায় অংশগ্রহণ করল স্বয়ং কুয়াশা। সে জানতে চাইল, দানবদের কি বলা হয়েছে যে আবার তাদের সবাইকে আগের আকারে ফিরিয়ে আনা হবে?
নিশ্চয়ই! সাধারণ সাইজে ফিরিয়ে আনা হবে এই কথা জেনেই তারা দানব হতে রাজি হয়েছে।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, ইতিমধ্যে কোন দানবকে সাধারণ আকারে ফিরিয়ে আনা হয়েছে?
তা হয়নি। তার কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি এখনও।
কুয়াশা হেসে উঠল সশব্দে, পাগল! তোমাদের মত এমন বোকা তো দেখিনি। জানো না বুঝি দানবগুলোকে ছোট আকারে আবার ফিরিয়ে আনতে গেলে সাথে সাথে মারা যাবে এরা?
ফিচেলের কণ্ঠ থেকে কয়েক মুহূর্ত কোন শব্দ বের হলো না। খানিক পর সে বলল, চালাকি করার চেষ্টা হচ্ছে, না?, দানবগুলোকে ভয় পাইয়ে দেবার চেষ্টা করছ, কেমন? তোমরা জানো ওরা তোমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে।
কথা অসমাপ্ত রেখেই ফিচেল কূপের কিনারা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিচু গলায় রাজকুমারী জানতে চাইল, কথাটা কি ঠিক, কুয়াশা?
উত্তর না দিয়ে কুয়াশা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সকলকে নিজের কাছে টেনে আনল। নিচু গলায় সবাইকে কিছু যেন বলল সে।
কুয়াশা ছাড়া দলের মধ্যে শক্তির দিক থেকে শহীদ এবং রাসেলের নাম করতে হয়। কুয়াশারই নির্দেশ অনুযায়ী শহীদ এবং রাসেল দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বটে কিন্তু দুজনের দুজোড়া পা আটকে আছে কূপের দুই দিকের দেয়ালে। একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে ওরা দেয়ালের গায়ে পা দিয়ে। একজনের কাঁধ অপরজনের কাঁধে ঠেকে রয়েছে।
এই অদ্ভুত ভঙ্গি করে শহীদ এবং রাসেল উঠে যাবে ধীরে ধীরে উপর দিকে। কুয়াশা ঝুলবে ওদের দুজনের গলা ধরে।
এছাড়া কুপের উপরে ওঠার আর কোন উপায় নেই।
খানিকদূর উঠল ওরা। এরপর কুয়াশা ঝুলে পড়ল ওদের দুজনের গলা জড়িয়ে ধরে। ওরা দুজন উঠে যাচ্ছে, কুয়াশা ঝুলছে ওদের মাঝখানে। কুয়াশার কাঁধের উপর বসে রয়েছে ডি. কস্টার বাচ্চা স্পুটনিক। হাসিখুশি ভাব তার চেহারায়, বোঝা যায় কৌতুক বোধ করছে সে।
গতি বড় মন্থর। কিন্তু বিরতি না নিয়ে ক্রমশ উঠছে শহীদ এবং রাসেল।
.
০৫.
মিনিট সাতেক পর কূপের কাছে পৌঁছল ওদের মাথা। কুয়াশা ওদের গা বেয়ে উঠল, দাঁড়াল ওদের কাঁধে। চাঁদের আলোয় বাইরেটা দেখা গেল পরিষ্কার।
দানবগুলোকে চোখে পড়ল। একটা দুটো করে শুনে দেখল কুয়াশা। পাঁচটা। ফিচেল বা তার সহকারীরা কেউ নেই আশেপাশে। দানবগুলোকে পাহারায় রেখে অন্য কোথাও গেছে সবাই। স্পুটনিককে কুপের উপরের সমতল মাটিতে ছেড়ে দিল কুয়াশা। স্পুটনিক নিঃশব্দে ছুটল। তারপর ডেকে উঠল-ঘেউ।
দানবের দল স্পুটনিককে দেখতে পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল। দুটো দানব গরুর করে দুর্বোধ্য শব্দ করল, ধাওয়া করল স্পুটনিককে।
কূপের উপর উঠে পড়ল কুয়াশা এই সুযোগে। দানব দুটো স্পুটনিকের পিছু ধাওয়া করায় একটা দিক ফাঁকা হয়ে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা নিঃশব্দে।
পঁচিশ ত্রিশ গজ সামনে ছোট বড় পাথরের অনেক টুকরো। ওখানটায় পৌঁছতে পারলে গা ঢাকা দেয়া যায়।
পৌঁছে গেল কুয়াশা পাথরগুলোর আড়ালে। উঠে দাঁড়াল সে, চারদিকে তাকিয়ে দিক নির্ণয় করে নিল, তারপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল সাগরের দিকে।
কেউ দেখতে পেল না কুয়াশাকে। তীরে পৌঁছে একটা ইঞ্জিনহীন বোট নিয়ে সাগরে ভাসল সে।
লাইফবয়গুলো ভাসছে তীরের কাছে। ইস্পাতের বাক্সটা ঠিক কোথায় ফেলেছিল অনুমান করে বোট থামাল কুয়াশা। সাগরে নেমে ডুব দিল।
পানির নিচে, সাগরের তলদেশে পৌঁছে গেল কুয়াশা। মিনিট কয়েক খোঁজার পর স্টীলের বাক্সটা পেল সে।
বাক্সটা নিয়ে পানির উপর মাথা তুলল, শ্বাস নিল বুক ভরে। উঠে বসল বোটে। তীরের দিকে নয়, দুমাইল দূরের ছোট অপর দ্বীপটার দিকে বোট নিয়ে এগোল কুয়াশা। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছল সে দ্বীপটায়।
ঘণ্টা দেড়েক পর বড় দ্বীপটার তীরে ফিরে এসে হাঁপাতে লাগল কুয়াশা। কিন্তু বিশ্রাম না নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে এগোতে এগোতে থমকে দাঁড়াল কয়েকবার, লাফ দিয়ে গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল মাঝে মধ্যে। শত্রুরা কেউ তাকে দেখতে পায়নি বুঝতে পেরে আবার এগোতে শুরু করল নিঃশব্দ পদক্ষেপে।
হ্যাঙ্গার দুটোর ভিতর কাজ হচ্ছে। প্লেনের সীটগুলো তুলে ফেলার কারণটা অনুমান করতে অসুবিধে হলো না কুয়াশার। দানবগুলোকে প্লেনে করে কোথাও নিয়ে যাবার জন্য এই ব্যবস্থা।
এগিয়ে চলল কুয়াশা সন্তর্পণে। দোতলা একটা বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে কয়েকজন লোকের গলা। কথা বলছে। হো-হোঃ করে হাসছে কারা যেন পাশের একতলা বাড়িটায়।
বাড়িগুলোর আকার এবং অবস্থান দেখে কুয়াশা ধরে নিল ল্যাবরেটরি হতে পারে না এগুলো। ল্যাবরেটরি থাকার কথা একটু ফাঁকা জায়গায়। বাড়িটার আকারও হওয়া উচিত আরও লম্বা।
আরও কয়েকটা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কুয়াশা। কয়েকটা বাড়ির ভিতর ঢুকল সে। উঁকি ঝুঁকি মেরে নিরাশ হয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
কূপের দিকে এগোচ্ছে কুয়াশা। দ্বীপের প্রায় সব কটা বাড়িই পরীক্ষা করে দেখেছে সে। ল্যাবরেটরি নেই কোথাও।
কিন্তু ল্যাবরেটরি না থাকার কথা নয়।
মাঠের দিকে হাঁটছে কুয়াশা। সামনে একটা একতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে। কোথাও কোন শব্দ নেই। গেটে তালা ঝুলছে।
আর কোন বাড়ির গেটে তালা দেখেনি কুয়াশা। তবে কি এটাই ল্যাবরেটরি?
পাচিল টপকে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। উঠন পেরিয়ে বারান্দা। বারান্দায় উঠে একটা তালাবদ্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
স্টীলের বাক্স খুলে টর্চ আর এক গোছা চাবি বের করল সে। তালা খুলতে ত্রিশ সেকেণ্ডের বেশি লাগল না।
লম্বা একটা হলরূমে ঢুকল সে। টর্চ জালতেই চোখে পড়ল, কাঁচের জার, টেস্টটিউব, মোটর, জেনারেটর, কেমিক্যাল ভর্তি অসংখ্য বোতল। কয়েকটা কাঁচের শোকেস রয়েছে দেয়াল ঘেঁষে। মোটা মোটা বই সাজানো রয়েছে, ভিতরে।
বইগুলো নাড়াচাড়া করল কুয়াশা। বইয়ের উপর লেখা রয়েছে সানাউল হকের নাম। প্রায় সবগুলোই রসায়ন শাস্ত্রের বই।
এটা সানাউল হকের ল্যাবরেটরি।
একটা টেবিলে ছোট একটা নোট বই দেখতে পেল কুয়াশা। পশুদেরকে তাদের স্বাভাবিক আকারের চেয়ে ছয় বা দশ গুণ বড় করে তোলার জন্য এক্সপেরিমেন্ট করেছে এর আগে সানাউল হক–নোট বইয়ে সেই এক্সপেরিমেন্ট সংক্রান্ত নানান তথ্য, ফর্মুলা, ইত্যাদি লেখা রয়েছে। এক জায়গায় একটা পশুকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল লিখে রাখা হয়েছে।
সানাউল হক নোটের একটা পাতায় লিখেছে:
আমি পশু বা, মানুষকে তার সাধারণ আকারের চেয়ে ছয়, এমনকি দশগুণ বড় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি।
এই ধরনের অনেক কথা অনেক জায়গায় লিখে রেখেছে সানাউল হক।
ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে এগোল কুয়াশা। খানিকদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে।
প্রকাণ্ড পাথরটা দেখা যাচ্ছে। ওই পাথরটার সাথে একজন লোককে বেঁধে, রাখা হয়েছিল সবাই দেখেছিল ওরা। বন্দীকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেখান থেকে। কিন্তু পাহাড়ের মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে একটা দানব।
ব্যাপার কি? ওদিকেও কি কোন কূপ আছে? বন্দী লোকটাকে কি সেই কূপের ভিতর রাখা হয়েছে?
বাক্সটা ঘাসের উপর রেখে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল কুয়াশা সামনের দিকে। খানিকটা এগিয়ে থামল। দানবটা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে হাতড়ে একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিল কুয়াশা। সবেগে ছুঁড়ে দিল সেটা দানবটার মাথার উপর দিয়ে অনেক দূরে।
পাথরের টুকরোটা দূরে গিয়ে পড়ল, শব্দ হলো–ঠক!
লাফিয়ে উঠল দানবটা। গরগর করে শব্দ বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে। তিন গজ লম্বা পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে সে শব্দ লক্ষ্য করে।
উঠে দাঁড়িয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে ছুটল কুয়াশা। দানবটা এগিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব দ্রুত গতিতে। প্রকাণ্ড পাথরটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। তার অনুমান মিথ্যে নয়। পাথরটার পাশে সত্যিই রয়েছে একটা কূপ।
পাথরের কাছে পড়ে রয়েছে লম্বা একটা দড়ি। দড়িটা বাঁধা রয়েছে পাথরের সাথে। দেরি না করে দড়ির অপর প্রান্তটা ঝুলিয়ে দিল কুয়াশা কূপের ভিতর। দড়ি ধরে তরতর করে নামল সে কূপের নিচে।
টর্চটা আনতে ভোলেনি কুয়াশা। টর্চ জ্বেলে সে দেখল হাত-পা লম্বা করে দিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে একজন লোক। এতটুকু নড়ছে না সে। মারা গেছে সম্ভবত। লোকটা সৈয়দ কবীরই।
পালস দেখল কুয়াশা। না মরেনি। তবে জ্ঞান নেই।
সময় নষ্ট করা উচিত নয় মনে করে দড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল কুয়াশা। দানবটা তখনও কূপের কাছ থেকে সরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে পাথর ছোঁড়ার শব্দের কারণ।
উপরে উঠে দড়িটা তুলে যথাস্থানে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে কূপের কাছ থেকে দূরে সরে এল কুয়াশা।
গোটা দ্বীপটা আর একবার প্রদক্ষিণ করল সে। কঁকা মাঠের অন্য প্রান্তের একটা একতলা বাড়ির ভিতর ঢুকে যা সে খুঁজছিল তার সন্ধান পেল অবশেষে।
বাড়িটা শত্রুদের নেতা সানাউল হকের কন্ট্রোল রুম। একটি কামরায় ম্যাপ দেখতে পেল কুয়াশা। চারদিকে নানারকম যন্ত্রপাতি রয়েছে। ওয়্যারলেস সেট দেখা গেল একাধিক। টেবিলের দেরাজে রিভলভারও পাওয়া গেল।
কুপ থেকে বেরিয়ে বাক্সটা সাথে নিয়ে আসতে ভোলেনি কুয়াশা! সেটা খুলে সিগারেটের প্যাকেটের মত দেখতে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের যন্ত্র বের করল সে। একটি যন্ত্র ভেন্টিলেটারের উপর লুকিয়ে রাখল। যন্ত্রটার ভেতর থেকে সরু তার টেনে বের করে আনল সে। সেই তার ধরে বেরিয়ে এল বাইরে। দেয়ালের সাথে আঠা দিয়ে তারটাকে জায়গায় জায়গায় আটকে রাখার ব্যবস্থা করে এগিয়ে চলল কুয়াশা। মাঠের অপর প্রান্তে প্রকাণ্ড আকারের কয়েকটা কামরা আগেই দেখেছিল, সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে তার ধরে।
বিশালাকার কামরাগুলো যে দানবদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হয় তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কুয়াশার।
বিশাল একটি কামরার ভিতর ঢুকে সিগারেটের প্যাকেটের মত দেখতে যন্ত্রটা দেয়ালের একটা গর্তে লুকিয়ে রাখল কুয়াশা।
কূপের কাছে ফিরে আসার সময় সে দেখল দানবগুলো তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এগোনো অসম্ভব।
এমন সময় ডানদিক থেকে ভেসে এল ফিচেলের কণ্ঠস্বর, অ্যাই! এদিকে এসো তোমরা সবাই। জলদি!
দানবগুলো নড়েচড়ে উঠল। তারপর ছুটল তারা শব্দ লক্ষ্য করে।
কুয়াশা এই সুযোগে এগিয়ে গেল। কূপের সামনে গিয়ে থামল সে।
ফিচেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার, ঠিক আছে, তোমরা ফিরে যাও! আমি একটা.ছায়া দেখে ভেবেছিলাম কেউ বুঝি লুকিয়ে আছে। যাও, কূপের কাছে ফিরে যাও।
দানবরা ফিরে আসতে শুরু করল কূপের কাছে।
ফিচেলের নয়, কণ্ঠস্বরটা ছিল কুয়াশারই। কুয়াশা একজন ভেন্ট্রিলোকুয়িস্ট, কণ্ঠস্বর অনুকরণেও জুড়ি নেই তার।
দানবরা এতটুকু সন্দেহ করল না। তারা যখন কূপের কাছে ফিরে এল, কুয়াশা ততক্ষণে কূপের নিচে নেমে গেছে।
অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হলো কুয়াশা। কামাল, রাসেল, রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা হাজারটা প্রশ্ন করল।
কিন্তু কুয়াশা কারও কোন প্রশ্নের উত্তর দিল না। বলল, সময়মত সব জানতে পারবে।
কয়েক মিনিট পর দেখা গেল কূপের এক প্রান্তে গিয়ে কথা বলছে কুয়াশা। লাকীর সাথে ফিসফিস করে। লাকী একটার পর একটা প্রশ্ন করছে, কুয়াশা তার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
কিন্তু ওদের কথা পরিষ্কারভাবে শুনতে পেল না আর কেউ।
খানিক পর কুয়াশা তার বাক্স থেকে একটা মিনি ওয়্যারলেস বের করল। সেটটা অন করে মাউথপীস মুখের সামনে ধরে একধরনের কিচিরমিচির, দুর্বোধ্য শব্দ করতে লাগল সে।
সবাই অবাক। কিন্তু শহীদ রহস্যটা ধরতে পারল। ঝাড়া মিনিট দুয়েক রাজ্যের দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করল কুয়াশা। তারপর সেটটা অফ করল।
.
০৬.
আধঘণ্টা পর চিৎকার শোনা গেল ফিচেলের। হিংস্র আক্রোশে গালাগালি করতে করতে কূপের কিনারায় এসে দাঁড়াল সে।
বলল, শয়তানের দল! মরণ ঘনিয়ে এসেছে জেনেও চালাকি করার চেষ্টা করছ! বস আসুক, সব কটাকে নিজের হাতে গুলি করে শেষ করব আমি।
কূপের নিচ থেকে রাসেল বলে উঠল, কি হলো? মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছ?
কুপের উপর উঠেছিলে কে? কিভাবে উঠেছিলে?
চুপ করে রইল সবাই।
ফিচেল বলে উঠল, জানি, স্বীকার করবে না তোমরা। ঠিক আছে, এর শাস্তি পাবে, সময় থোক।
সরে গেল সে কূপের কিনারা থেকে। চিৎকার করে দানবগুলোকে ধমক মারল সে খানিকক্ষণ।
কামাল জানতে চাইল, দানবগুলো কি কথা বলতে পারে?
শহীদ বলল, সম্ভবত পারে।
উপরের দিক থেকে আর কোন শব্দ আসছে না।
ওরাও চুপচাপ রইল। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ভাগ্যের উপর নিজেদেরকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই যেন। কুয়াশা কিছু একটা করে এসেছে উপরে উঠে–কিন্তু কি করেছে না করেছে তা সে কাউকে বলতে রাজি নয়।
খানিক আগে ওয়্যারলেসে দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণই বা করল কেন, কি উদ্দেশ্যে করল, বোঝা গেল না।
কারও কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন অপেক্ষা করছে। কিছু একটা ঘটবে, তাই যেন কান পেতে আছে।
সময় বয়ে চলেছে।
দানবগুলো গরগর করে উঠল একবার। একটু যেন নড়ে উঠল কুয়াশা। আরও গভীর মনোযোগের সাথে কিছু যেন শোনার চেষ্টা করছে সে।
এমন সময়, হাসি ফুটল কুয়াশার মুখে। দুশ্চিন্তার কালো ছায়া দূর হয়ে গেছে মুখের উপর থেকে।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল কামাল।
কান পেতে শোনো সবাই।
কুয়াশার কথা শেষ হতেই বহুদূর থেকে ভেসে এল ফিচেলসহ আরও দুএকজন লোকের চিৎকার। কিছু বলছে তারা, কিন্তু কি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে, আতঙ্কে আর্তচিৎকার করছে।
এর পরপরই কূপের কাছাকাছি থেকে গর্জে উঠল দানবের দল। আক্রোশে অন্ধ হয়ে গেছে যেন দানবগুলো, ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে।
পা ফেলছে মাটিতে সজোরে, ফলে কূপের দেয়াল কাঁপছে, মেঝে কাঁপছে।
রাজকুমারী বলল, কারণ কি?
কুয়াশা বলল, আমি উপরে উঠে কয়েকটা কাজ করে এসেছি। তার মধ্যে একটি কাজ হলো, শক্ররা যে ছোট দ্বীপে বনমানুষ দুটোকে বন্দী করে রেখেছে, সেখানে গিয়ে একটা ওয়্যারলেস সেট রেখে এসেছি। পোষ মানা গরিলা গোগীর ভাষার কথা বললে ওরা বোঝে, এর প্রমাণ পেয়েছি শহীদকে শত্রুদের ভ্যানের ভিতর থেকে বাঁচাবার সময়। তাই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খানিক আগে গোগীর ভাষায় বনমানুষ দুটোকে নির্দেশ দিয়েছি। বলেছি শত্রুরা তোমাদেরকে হত্যা করবে। তোমরা সাঁতার কেটে এই দ্বীপে এসে মানুষ থেকে যারা দানবে রূপান্তরিত হয়েছে তাদেরকে খতম করো।
কিন্তু ওরা পারবে এই দানবগুলোর সাথে? এরা সংখ্যায় অনেক বেশি।
শহীদের কথার উত্তরে কুয়াশা বলল, মানুষ থেকে যাদেরকে দানবে পরিণত করা হয়েছে তারা মাত্র ছয় গুণ লম্বা। কিন্তু এই বনমানুষ দুটোকে তৈরি করা। হয়েছে দশগুণ বড় করে। এই দানবগুলোর চেয়ে ওরা দুজন অনেক বেশি বড় এবং শক্তিশালী। তাছাড়া মানুষের চেয়ে এমনিতেই ওরা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, অনেক বেশি হিংস্র।
কুয়াশার কথা চাপা পড়ে গেল কূপের আশেপাশে দণ্ডায়মান দানবদের গর্জন আর ছুটোছুটির শব্দে।
কুয়াশা বলল, দশগুণ বড় দানব দুটো যদি লড়াইয়ে জেতে–আমরা মুক্ত হতে পারব। আমি এবং লাকী, আমরা দুজনেই ওদেরকে পরিচালনা করতে পারব। শত্রুদের বন্দী করা কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু সবই নির্ভর করছে দানবে দানবে যুদ্ধের ফলাফলের ওপর। দেখা যাক। শহীদ, রাসেল আমাকে উপরে উঠতে সাহায্য করো।
আগের মতই, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়াল ওরা। পা দূজোড়া দুই দিকের দেয়ালে ঠেকিয়ে উঠতে শুরু করল শহীদ এবং রাসেল উপর দিকে। কুয়াশা ওদের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল।
কুয়াশাকে উপরে তুলে দিয়ে নেমে এল রাসেল এবং শহীদ।
কূপের কাছাকাছি শুয়ে শুয়ে সামনের দৃশ্য দেখতে লাগল কুয়াশা। লড়াইয়ের দৃশ্য।
এখনও শুরু হয়নি লড়াই। দূরে শুধু দেখা যাচ্ছে দানব দুটোকে। গাছপালা, বাড়িঘর ভাঙতে ভাঙতে ছুটে আসছে তারা।
ছয়গুণ বড় দানবগুলো আক্রোশে নিজের নিজের জায়গায় লাফাচ্ছে। ফিচেলকে দেখা গেল অদূরে। কূপের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না সে। ছয়গুণ বড় দানগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু দানবগুলো তার কথায় বিশেষ কান দিচ্ছে না। তবে, দশগুণ বড় দানব দুটোর দিকে ছুটে যাচ্ছে না তারা।
পিছন দিক থেকে শব্দ আসছে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে কুয়াশা যা দেখল তাতে তার মন দমে গেল। আরও চার পাঁচটা দানব আসছে। এরা সবাই সাধারণ মানুষের চেয়ে ছয়গুণ বড়।
মোট নয়টা ছয়গুণ বড় দানব।
এগিয়ে আসছে দশগুণ বড় দানব দুটো। কাছাকাছি এসে দাঁড়াল তারা। নিজের নিজের বুকে চাপড় মারতে লাগল বিশাল থাবা দিয়ে। বজ্রপাতের মত শব্দ হতে লাগল, এক-একটা চাপড়ে।
ছয়গুণ বড় দানবের দল একযোগে পা বাড়াল এবার। পা বাড়াল তাদের দিকে চল্লিশ পয়তাল্লিশ ফুট উঁচু বনমানুষ দুটোও।
এমন লোমহর্ষক দৃশ্য কুয়াশাও তার জীবনে এর আগে দেখেনি। ছয়গুণ বড় দানবের দলটা আচমকা লাফিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের উপর।
শুরু হলো তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
কয়েকটা দীর্ঘ মুহূর্ত কেটে গেল, কি যে ঘটছে বোঝাই গেল না কিছু। বনমানুষ দুটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে একসাথে ছয়-সাতটা দানব। বনমানুষ দুটোকে দেখাই যাচ্ছে না।
কান ফাটানো হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে শুধু। আর সেই সাথে মাটি কাঁপছে থরথর করে।
তারপর হঠাৎ ছয়গুণ বড় দানবের দলটা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কুয়াশা দেখল প্রকাগুদেহী বনমানুষ দুটোর শরীরের এখানে সেখানে বড় বড় গর্ত, মাংস খামচে তুলে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আহত হলেও, মরিয়া হয়ে এবার প্রতি-আক্রমণ চালিয়েছে তারা। সামনে ছয়গুণ বড় দানবদের যাকে পাচ্ছে, ধাওয়া করছে তারা।
এইভাবে কিছু সময় কাটল। ছয়গুণ বড় দানবের দল হাজার হোক মানুষ। তারা কৌশল জানে। বনমানুষদের হাতে তাদের কেউ ধরা পড়ল না।
এদিকে বনমানুষ দুটো ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হলো শুধু।
ওদেরকে ক্লান্ত করে তুলে ছয়গুণ বড় দানবগুলো আবার একত্রিত হলো। একত্রিত হয়ে প্রথম বারের মত আবার একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বনমানুষ দুটোর উপর।
আঁচড়ে, কামড়ে, ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে চেপে ধরে ধরে ছয়গুণ বড় দানবের দল বনমানুষ দুটোর অবস্থা কাহিল করে তুলল।
বনমানুষ দুটো যখন দেখল নিজেদেরকে মুক্ত করা সম্ভব নয়, তখন তারা দুজন, যেন পরামর্শ করেই, দুটো ছয়গুণ বড় দানবের গলা কামড়ে ধরল মরণপণ করে।
এরপর যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না। ছয়গুণ বড় দানবের দল ক্লান্ত রক্তাক্ত অবস্থায় পিছু হটে এল।
দেখা গেল চারটে দানবের লাশ পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে দুটো দশগুণ বড় অর্থাৎ বনমানুষদের, অপর দুটো ছয়গুণ বড় দানবের।
বনমানুষরা মরেছে। কিন্তু তার প্রতিপক্ষের দুজনকে সাথে নিয়ে মরেছে।
কুপের কাছে, আগের জায়গায় ফিরে এল দানবের দল। রক্তাক্ত, ক্লান্ত তারা।
ফিচেলকে দেখা গেল। আড়াল থেকে বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে সে। কিন্তু এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছে না।
কুয়াশা উপর থেকে ইশারা করতে শহীদ এবং রাসেল আগের কায়দায় উঠল কূপের মাথা অবধি।
কুয়াশাকে নিয়ে আবার নামল ওরা।
ফলাফল কি?
কুয়াশা বলল, সংক্ষেপে, খারাপ।
কারও বুঝতে বাকি রইল না, বনমানুষ দুটো নিহত হয়েছে।
.
সকাল হতে তখনও বাকি ছিল কয়েক ঘন্টা।
নিঃশব্দে, কোন ঘটনা ব্যতিরেকেই কেটে গেল রাত-ভোর হলো, শুরু হলো নতুন একটি দিনের।
আরও ঘণ্টাখানেক কাটল। এমন সময় চমকে উঠল ওরা সবাই। দ্বীপের উপর চক্কর মারছে একটা প্লেন।
প্লেনটা ল্যাণ্ড করল দ্বীপের কোথাও। ইঞ্জিনের শব্দ থামল এক সময়।
খানিক পর ফিচেলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা।
দানবদের লড়াইটা কেমন ভয়ঙ্কর ছিল, বর্ণনা করছে সে।
তার বসের গলা যেমন গভীর তেমনি বেসুরো, শয়তানগুলোকে তবু বাঁচিয়ে রেখেছ? পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বনমানুষ দুটোকে ওই শয়তানদের কথায় লাকী হারামজাদীই কোন না কোন ভাবে উত্তেজিত করে এই দ্বীপে আনিয়েছে
কিন্তু, স্যার, তা কিভাবে সম্ভব? মানে…ঠিক বলেছেন…সম্ভব হতেও পারে আমার মনে হয়, স্যার, …ঠিক তাই ঘটেছে। শয়তানদের মধ্যে যে কেউ কূপের ভিতর থেকে উপরে উঠেছিল তা আমাকে দানবরা জানিয়েছে।
তাই নাকি! ফিচেল! তুমি কি করছিলে শুনি?
আমি হ্যাঙ্গারের কাছে কাজ করছিলাম, স্যার। পাহারায় ছিল দানবরা। ওরা নাকি আমার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে কূপের কাছ থেকে সরে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে…অথচ আমি ওদেরকে তেমন কোন নির্দেশ দিইনি!
হু। ভারি, থমথমে কণ্ঠস্বর সানাউল হক খানের। কিছু যেন চিন্তা করছে সে। খানিক পর বলল, ঠিক আছে। উপরে উঠে কিইবা এমন করেছে ওরা। বনমানুষ দুটোকে উত্তেজিত করেছিল কিন্তু তাতে ওদের কোনও লাভ হয়নি। যাও স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করে সব কটাকে শেষ করে দাও।
.
স্টেনগান নিয়ে কূপের কিনারায় এসে দাঁড়াল ফিচেল। ব্যঙ্গভরে বলে উঠল সে, আমি তোদের মৃত্যুদূত–স্বয়ং আজরাইল। মরার জন্য তৈরি হ সবাই।
কুয়াশা শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল, হ্যাঁ–আমরা তৈরি। জানি, মৃত্যু আমাদের অবধারিত। কিন্তু ফিচেল, জেনে রাখো তোমরাও রেহাই পাবে না!
তাই নাকি! মরতে আপত্তি নেই তোমাদের?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা।
হাসি থামিয়ে বলল, মরবই যখন, দুঃখ করে লাভ কি? তবে এই মৃত্যুতে সান্ত্বনা এই যে আমাদের সাথে না হলেও, আমাদের পিছু পিছু তোমাদের সবাইকেই মরতে হবে।
পাগল! আমরা মরছি না। আমাদেরকে মারতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীর কারও নেই। ফিচেল চিৎকার করে বলল।
কুয়াশা আবার হেসে উঠল। বলল, খানিক পরই টের পাবে, মরতে কেমন কষ্ট। তুমি তো জানোই, আমি এই কূপ থেকে উঠেছিলাম ওপরে। উঠেছিলাম অকারণে নয়। ওপরে উঠে এমন কিছু কাজ আমি করেছি যার ফলে, তোমরা, তোমাদের বস্, তোমাদের দানব,সবাই মারা পড়বে। খুব বেশিক্ষণ দেরি নেই তার, ঘণ্টা দুয়েক পরই
ফিচেল বলল, চালাকি করার চেষ্টা হচ্ছে, না?
কুয়াশা শান্তভাবে বলল, জিজ্ঞেস করছ কেন! দুঘণ্টা পর নিজেরাই তো জানতে পারবে।
ফিচেলের পিছন থেকে তার বসের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কি বলছে শয়তানরা?
ফিচেল বলল, আমাদেরকে নাকি মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে রেখেছে কুয়াশা উপরে উঠে! মিথ্যে কথা, ভয় দেখিয়ে সময় নষ্ট করাতে চায়।
না, না। চিৎকার করে উঠল কূপের ভিতর থেকে লাকী, না! না! কুয়াশা সত্যি সেই ব্যবস্থা করেছে…
টবে রে! বেঈমান…বিশ্বাসঘাটক! ডাইনী? ডি. কস্টা লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল লাকীর দিকে।
ফিচেল গর্জে উঠল উপর থেকে, খবরদার! লাকীর গায়ে হাত দিলে ঝাঁঝরা করে দেব স্টেনের গুলিতে…।
লাকী চিৎকার করে উঠল আবার, আমি সব জানি। কুয়াশা বিশ্বাস করে সব কথা প্রকাশ করেছে আমার কাছে। তোমাদেরকে খুন করার ব্যবস্থা করে রেখে এসেছে সে।
সানাউল হকের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, লাকীকে ওপরে তোলার ব্যবস্থা করো, ফিচেল। জলদি!
ডি. কস্টা রাগে ঠক ঠক করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে সে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে মেয়েটাকে।
দড়ির সিঁড়ি নেমে এল কূপের ভিতর। লাকী সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে লাগল দ্রুত।
কামাল বলে উঠল, এই বেঈমানীর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
উপর থেকে গর্জে উঠল ফিচেল, চোপ!
কূপের নিচে ওরা সবাই তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আপনারা কন্ট্রোলরূমে চলুন। ওখানে বসে সব কথা বলব আমি। কিন্তু কথা দিন আমাকে মুক্তি দেবেন।
সানাউল হকের গলা শোনা গেল, দেব, কথা দিচ্ছি। চলো।
পদশব্দ শোনা গেল। ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পায়ের শব্দ।
নিস্তব্ধতা অটুট হয়ে রইল কূপের ভিতর।
সবাই চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে। কিন্তু কুয়াশার মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা অসম্ভব। বোঝা যাচ্ছে, কান পেতে আছে সে।
প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক, অসহনীয় দীর্ঘ।
এমনিভাবে কেটে গেল কয়েক মিনিট। তারপর, এক সময়, হঠাৎ শোনা গেল লাকীর কণ্ঠস্বর।
চমকে উঠল সবাই। লাকী কূপের আশপাশে নেই কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আসছে কোত্থেকে?
শুধু লাকীর নয়, শোনা যাচ্ছে শত্রুদের নেতারও। মনে হচ্ছে কূপের ভিতর দাঁড়িয়ে কথা বলছে তারা।
সানাউল হকের গলা ভেসে আসছে। গতরাতে কুয়াশা কূপের উপর উঠে কি এমন করেছে?
লাকী বলে উঠল, কুয়াশা আপনার দানবগুলোকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে যে তারা তাদের স্বাভাবিক আকারে রূপান্তরিত হতে পারবে না কোন দিন।
হোয়াট! কুয়াশা ব্যাপারটা জানল কিভাবে?
কুয়াশা আপনার ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছিল। সেখানে একটা নোট বই দেখে সে। সেই নোট বইয়ে কথাটা লেখা আছে। লাকী বলে চলেছে, কুয়াশা দ্বীপের নানা জায়গায় বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখেছে। টাইম বোমা ধরনের বিস্ফোরক। দুঘণ্টা পর সেগুলো ফাটবে। দুমাইল দূরের ছোট দ্বীপেও গিয়েছিল সে।
সানাউল হক বলল, তোমার সাথে কথা বলে লাভই হলো। বিপদ ঘটবে বুঝতে পারছি। দানবগুলোকে সত্যি সত্যি আগের আকারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, কিন্তু সে কথা ওরা জানে না। ওরা জানলে মহা সর্বনাশ ঘটে যাবে। ওদেরকে ভুল বুঝিয়ে শান্ত রেখেছি এতদিন। যখনই ওরা জানতে পারবে যে আগের আকারে ফিরে যাওয়া কিছুতেই আর সম্ভব নয়, তখনই আমার বিরুদ্ধে ছুটে আসবে দল বেঁধে…। ভাল কথা, দানবদের কিভাবে জানাবে কুয়াশা ব্যাপারটা? ওকে এবং ওর দলবলকে যদি এখুনি মেরে ফেলি?।
লাকী বলল, একটা টেপে সব কথা বলে রেখেছে কুয়াশা। এখন থেকে একঘণ্টা পর টেপটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে স্টার্ট নেবে। টেপের সামনে আছে লাউডস্পীকার। লাউডস্পীকারের মাধ্যমে গোটা দ্বীপে ছড়িয়ে পড়বে তার কথা। অর্থাৎ দানবরা জানতে পারবে কুয়াশার বক্তব্য…।
ফিচেল উঁকি মেরে দেখছিল কূপের কিনারায় দাঁড়িয়ে কুয়াশাকে। বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সে। কন্ট্রোলরূমে কথা বলছে হক এবং মেয়েটা অথচ তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে এখান থেকে, যেন কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তারা-রহস্যটা কি?
কারও মুখে কথা নেই। লাকী হকের কানে কানে কিছু বলছে। সম্ভবত তাই কিছু শোনা যাচ্ছে না।
ফিচেল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অনুভব করছে সে। কিন্তু কি ঘটবে, কি ঘটতে পারে–বুঝতে পারছে না।
অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে দানবদের মাঝেও। তারাও কান পেতে আছে। বস এবং লাকীর প্রতিটি কথা শুনেছে তারা।
কামাল ফিসফিস করে জানতে চাইল, কৌশলটা কি?
কুয়াশা মুচকি হেসে বলল, কন্ট্রোলরূমে মাইক্রোফোন রেখে এসেছিলাম। দানবদের একটা কামরায় রেখে এসেছিলাম স্পীকারটা।
কামাল বলে উঠল, লাকী তাহলে বেঈমানী করছে না আমাদের সাথে। তোমার কথামত অভিনয় করছে সে!
বুঝেছি।
.
০৭.
কুপের বাইরে ঘটনা ঘটতে শুরু করল। দানবের দল উগ্র আক্রোশে লাফাতে শুরু করেছে। অন্ধক্রোধে গর্জন করছে তারা।
থরথর করে কাঁপছে কূপের দেয়াল।
দানবরা টের পেয়ে গেছে, তাদেরকে ঠকানো হয়েছে প্রথম থেকেই। সাধারণ আকারের মানুষ ছিল তারা। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে আবার তাদেরকে স্বাভাবিক আকারে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে বিশালদেহী দানবে। আসলে তাদেরকে বোকা বানানো হয়েছে।
কূপের কিনারা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ফিচেল। তার উঁচু কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বস বেঈমানী করেছে। এখন কি করতে চাও তোমরা!
ফিচেল দানবদের দলে যোগ দিতে চাইছে। সে জানে, দানবরা খেপে গেছে, এদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে হলে এদের দলেই থাকতে হবে।
দানবরা ছুটছে। দল বেঁধে ছুটছে তারা কন্ট্রোলরুমের দিকে।
আবার শোনা গেল ফিচেলের কণ্ঠস্বর, দাদাও! আমার কাছে প্টেন আছে। আমিও আছি তোমাদের সাথে।
দ্বীপের অপর দিক থেকে ভেসে আসছে আরও একদল দানবের হঙ্কার ধ্বনি। ক্রমশ এগিয়ে আসছে সেই বিকট হুঙ্কারের শব্দগুলো।
শহীদ এবং রাসেল কুয়াশার নির্দেশে আগের কায়দায় উপরে উঠতে শুরু করল। কুয়াশাকে নিয়েই।
কূপের বাইরে বেরিয়ে কুয়াশা দেখল দানবের দল কন্ট্রোলরূমের দেয়াল ভেঙে ফেলছে–ঘুসি মেরে, পাথরের টুকরো ছুঁড়ে, গায়ের ধাক্কায়।
যে বাড়িটার ভিতর কন্ট্রোলরূম রয়েছে সেটা থেকে স্টেনগানের গুলি বর্ষণ হচ্ছে। শেষ চেষ্টা করছে সানাউল হক নিজেকে দানবদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।
গুলি খেয়েও দানবের দল থামছে না। বিকট রবে আর্তনাদ করছে তারা, কিন্তু। এগিয়ে চলেছে তবু, পিছিয়ে আসার কোন লক্ষণ নেই কারও মধ্যে।
কুয়াশা কূপের ভিতর দড়ির সিঁড়িটা নামিয়ে দিল।
একে একে কূপের বাইরে উঠে এল সবাই। কুয়াশার পাশে দাঁড়াল ওরা। এমন সময় শোনা গেল–ঘেউ!
স্পুটনিক হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল, লাফ দিয়ে পড়ল ডি. কস্টার কাছে। মুচকি হাসল ডি. কস্টা, বলল, গুড বয়।
অপেক্ষা করাই ভাল। দানবদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।
শহীদ বলল, ওই পাথরগুলোর আড়ালে দাঁড়াই চলো।
গা ঢাকা দিল ওরা পাথরের আড়ালে।
যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে বলে মনে করলেও তা হলো না। দানবের দলকে এখনও ঠেকিয়ে রেখেছে শক্রদলের নেতা। তার কন্ট্রোলরূমে অস্ত্রের কোন অভাব নেই।
বাড়িটার সামনে তিনটে দানব ধরাশায়ী হয়েছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে তিনজনই। তিনজনেরই মাথা এবং বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বুলেটে।
লাকী! ওই যে…।
প্রাণপণে দৌড়তে দেখা যাচ্ছে মেয়েটাকে। বাড়িটার ছাদ থেকে লাফিয়ে নেমেছে সে পিছন দিকে, সেখান থেকে দৌড়ে যতদূর সম্ভব দূরে সরে যাচ্ছে সে।
ফিচেলকে দেখা যাচ্ছে দানবদের পিছনে। বাড়িটার দিকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে চলেছে সে।
কুয়াশা! পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে তীর বেগে ফাঁকা মাঠের দিকে ছুটছে কুয়াশা। শহীদ চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কুয়াশা থামল না।
সবাই দেখল ফাঁকা মাঠের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা পাথরের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের মত উঁচু একটা দানব।
একমণ দেড়মণ ওজনের পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে তার সামনের কূপের ভিতর সজোরে নিক্ষেপ করছে সে।
এই ব্যাপারটা সবার আগে চোখে পড়েছিল কুয়াশার। কূপটার ভিতর সৈয়দ কবীর বন্দী হয়ে আছে, জানে সে। দানবটা তার সঙ্গী সাথীদের উন্মত্ত কাণ্ড দেখে। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ফলে সে যাকে পাহারা দিচ্ছিল তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কুয়াশার পদশব্দ শুনে দানবটা ঘুরে দাঁড়াল। কুয়াশাকে দেখে আধ হাত লম্বা দাঁতের সারি বের করে গর্জে উঠল সে। সাড়ে চার গজ লম্বা দুটো হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে এগিয়ে এল সে বিদ্যুৎবেগে।
কুয়াশা থমকে দাঁড়াল। চোখের পলকে কাছে এসে পড়ল দানবটা। কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে প্রকাণ্ড একটা হাত নেমে এল তার।
শুয়ে পড়ল কুয়াশা, চোখের পলকে গড়িয়ে সরে গেল সে দূরে।
বোকা বনে গেছে দানবটা। ফলে আরও হিংস্র হয়ে উঠল সে। আবার এগিয়ে আসছে।
পকেট থেকে কিছু যেন বের করল কুয়াশা।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
কুয়াশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দানবটা! এবার সে আগের চেয়ে সতর্ক। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
দশ হাত দূর থেকে লাফ দিল দানব। কুয়াশা কি যেন ছুঁড়ে দিল দানবের মুখের দিকে। পরমুহূর্তে আকাশ ফাটানো আর্তনাদ করে উঠল দানব।
একটা ছোট্ট টিয়ার গ্যাস বম্ব ছুঁড়ে দিয়েছে কুয়াশা। দুই চোখে কাঁদুনে ধোয়া ঢুকে পড়েছে দানবের।
দানবটা দুই হাত দিয়ে টেনিস বলের মত বড় আকৃতির চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে লাফাচ্ছে। লাফাবার ফলে মাটি কাঁপছে থরথর করে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।
কুয়াশা ছুটে গেছে ইতিমধ্যে কূপটার সামনে। এক মুহূর্ত পর কূপের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
এদিকে দানবদের দলটাকে প্রায় খতম করে ফেলেছে শত্রু দলের নেতা।
ছয়টা দানব ধরাশায়ী হয়েছে বাড়িটার সামনে। হাত-পা ছুড়ছে এখনও তিনটে। বাকি তিনটে নিঃসাড় পড়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, মারা গেছে তারা।
তিনটে দানব এখনও চেষ্টা করছে বাড়িটার ভিতর ঢুকতে। কিন্তু অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে এগোতে পারছে না তারা। এক পা এগোয়, গুলি খেয়ে পিছিয়ে আসে তিন পা।
মাই গড! মনস্টারগুলা উঠিটেছে।
সবাই দেখল আহত দানব তিনটে উঠে দাঁড়াচ্ছে আবার।
তিনটেই চেষ্টা করছে উঠতে। যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কিছু একটা করতে যাচ্ছে ওরা, শহীদ বলল।
শহীদের কথাটা সত্য হলেও হতে পারে। উঠে দাঁড়াল রক্তাক্ত দানব তিনটে। ধীরে ধীরে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে হাঁটছে তারা।
এখনও শত্রদলের নেতাকে দেখার সুযোগ পায়নি শহীদ বা আর কেউ। লোকটা বাড়ির ভিতর থেকেই বাধা দিয়ে চলেছে দানবদের।
ব্রাশ ফায়ারের শব্দ একঘেয়ে লাগছে এখন।
আহত দানব তিনটে পৌঁছে গেছে ভাঙা পাঁচিলের কাছে। তিনজনের একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। গুলি খেয়েছে সে কোমরে। টলছে তার দেহটা। কিন্তু আবার পা বাড়াল সে। টলতে টলতে অনুসরণ করল বাকি দুজনকে।
সামনের দানবটা হঠাৎ পড়ে গেল। সম্ভবত তার মাথায় বিঁধেছে এক ঝাঁক বুলেট। তার ধরাশায়ী শরীরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলল পিছনের দানব দুটো।
মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা, কামাল বলল।
রাজকুমারী সায় দিল, ওরা প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না।
আহত দানব দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল বাড়ির ভিতর।
দুই মিনিট কাটল। তারপর এক ভয়াবহ ঘটনা প্রত্যক্ষ করল ওরা। বাড়িটার দেয়াল থেকে খসে পড়তে লাগল ইট-কাঠ-লোহা। একটা কামরার ছাদ শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো।
কান ফাটানো ভাঙাচোরার শব্দকে ছাপিয়ে হঠাৎ শোনা গেল একটা লোকের তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার।
তেমনি হঠাৎ থেমে গেল সেই চিৎকারের শব্দ।
কুয়াশার কাণ্ড দেখো! বলল রাজকুমারী।
সবাই তাকাল ফাঁকা মাঠের দিকে। কুয়াশা তীর বেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, দেখল ওরা। মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ উচ্চারণ করছে সে। সেই শব্দ অনুসরণ করে পাহাড়ের মত উঁচু দানবটা এগিয়ে যাচ্ছে।
চোখে দেখতে পাচ্ছে না এখনও দানবটা। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এগোচ্ছে সে।
হঠাৎ দেখা গেল দানবটা নেই।
হাততালি দিয়ে উঠল রাজকুমারী।
উল্লাসে ফেটে পড়ল ডি কস্টা, মনস্টারটাকে কূপের ভিটর নামাইবার জন্য ফাড় পাটিয়াছিলেন বস… সাকসেসফুল!
দানবটা সত্যি কূপের ভিতর পড়ে গেছে।
মাঠের উপর থেকে সৈয়দ কবীরকে কাঁধে তুলে নিল কুয়াশা। সে অজ্ঞান এখনও। কূপের ভিতর থেকে খানিক আগে তাকে উদ্ধার করেছে কুয়াশা।
ওদের কাছে ফিরে এল সে। অজ্ঞান সৈয়দ কবীরকে মাটির উপর শুইয়ে দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে তাকাল, বলল, আরে! সব দেখছি থেমে গেছে! .
শহীদ বলল, নিজের তৈরি দানবদের হাতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে লোকটাকে, কুয়াশা।
কুয়াশা গম্ভীরভাবে বলল, অসৎ উদ্দেশ্যের পরিণতি এই-ই হয়।
এগোল ওরা দল বেঁধে।
বাড়িটার সামনে কয়েকজন লোকের লাশ দেখল ওরা। তাদের মধ্যে একজনকে চেনা গেল ফিচেল।
দানবগুলো সবাই নিহত হয়েছে, একটি ছাড়া। দানবদের দুটো লাশ পাওয়া গেল বাড়ির ভিতর।
আরও ভিতরে ঢুকল ওরা। একজন সাধারণ আকারের মানুষের লাশ চোখে পড়ল।
ঘিরে দাঁড়াল সবাই লাশটাকে। দ্বিখণ্ডিত লাশটা। দানবরা লোকটাকে দুই দিক থেকে ধরে টেনে দুইখণ্ড করে ফেলেছে।
কামাল বলল, এই লোকই তাহলে সানাউল হক খান?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। তার চেহারার বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
.
ঘণ্টাখানেক পর শহীদ এবং কামালকে পাঠিয়ে দিলকুয়াশা দুই মাইল দূরের ছোট দ্বীপটায়। সেখানে কুয়াশা আগেই দেখে এসেছে তিনহাজার বন্দী মানুষকে। তাদেরকে মূলভূখণ্ডে ফিরিয়ে নেবার জন্যে কুয়াশা স্টীমার পাঠাবে। তার আগে পর্যন্ত শহীদ এবং কামাল ওই দ্বীপে থাকবে।
লাকী ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। কুয়াশার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে সে-কুয়াশা আফ্রিকার জঙ্গল থেকে শিম্পাঞ্জী, বনমানুষ আর গরিলা আনবে। তাদেরকে ট্রেনিং দেবার চাকরি পাবে লাকী।
রাসেল, রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা–এরা ধ্বংসপ্রাপ্ত কন্ট্রোলরূমটা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত তখন। দানব তৈরি করার ফর্মুলাটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছে কিনা, তা জানার চেষ্টা করছে ওরা।
কুয়াশা ব্যস্ত ওয়্যারলেসে তার অনুচরদের সাথে কথা বলতে।
সবাই ব্যস্ত যে-যার কাজে।
Leave a Reply