হাঙর — কুয়াশা–৭৫ — কাজী আনোয়ার হোসেন
০১.
জুন মাসের সকাল। বাইরে চড়া রোদ। ঘরের ভেতর গুমোট গরম। জুতোসুদ্ধ পা টেবিলের ওপর তুলে দিয়ে একটানা ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি করে চলেছে শখের গোয়েন্দা শহীদ খান। মনে হচ্ছে, গভীর চিন্তায় নিমগ্ন সে। টেবিলে রাখা ছাইদানিতে জমে উঠেছে রথম্যান ফিল্টার টিপড, সিগারেটের একগাদা পোড়া টুকরো।
বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে উঠেছে শহীদ। প্রায় মাস তিনেক হলো হাতে কাজ নেই। সময় আর কাটতে চায় না। দিন কয়েকের জন্যে কক্সবাজারের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে মহুয়া। কামালও ওদের পিছু নেবার জন্যে এক পায়ে খাড়া। প্রথম দিকে শহীদের খুব একটা মত ছিল না। এখন ভাবছে, গেলে মন্দ হয় না। এ সময় শালবনের ভেতর শ’য়ে শ’য়ে জন্মানো এক ধরনের ছোট গাছে থোকায় থোকায় অসংখ্য কালচে বাদামি ফল পেকে থাকে। পাহাড়ি হরিয়ালের অতি প্রিয় এই ফল। বন্দুক নিয়ে শালবনে ঢুকলে চমৎকার জমবে হরিয়াল শিকার।
মৃদু বি-ই-ই-ই শব্দটা কানে যেতে আস্তে করে মুখ তুলে শব্দের উৎস বরাবর চাইলে শহীদ। ঘরে এসে হাজির হয়েছে একটা গাঢ় নীল গুবরে মাছি। একবার চেয়েই অগ্রাহ্য করলো সে মাছিটাকে। কিন্তু বেশিক্ষণ অগ্রাহ্য করা গেল না। মাছিটার বিচ্ছিরি ভ্যানভ্যানানির চোটে বার বার চিন্তার সূত্র কেটে যেতে থাকলো তার।
যা ভাগ, অন্য কোথাও গিয়ে মর, ব্যাটা হারামজাদা গাল দিলো শহীদ মাছিটাকে। কিন্তু কান দিলো না ওটা, সমানে ভোঁ ভোঁ করেই চললো। মিনিট পাঁচেক ধরে অনেক চেষ্টা করেও তাড়াতে না পেরে স্থির করলো শহীদ, খুন করবে সে মাছিটাকে।
খুঁজে পেতে ঘরের কোণ থেকে পালকের ডাস্টারটা বের করে নিয়ে নিঃশব্দে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো শহীদ। বাড়ি মারার ভঙ্গিতে মাথার ওপর তুলে ধরে রাখলো ডাস্টারটা। শুধু জায়গামতো বসলেই হয় একবার। এক বাড়িতে ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে। কিন্তু বসার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না মাছিটার মধ্যে। মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে যেন শহীদকে আরো ক্ষেপাবার জন্যেই বিচিত্র সুর সৃষ্টি করে চললো ওটা।
হঠাৎই শহীদকে অবাক করে দিয়ে থেমে গেল ভভন। মাথার। ওপরে কোথাও আর মাছিটাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। গেল কোথায়? খানিকটা হতাশ হলো শহীদ। এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজতে লাগলো মাছিটাকে। হঠাৎ ওর চোখ পড়লো টেবিলের একটা কোণের দিকে। নিঃশব্দে হাসলো দাঁত বের করে। খোলা জানালা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে টেবিলের কোণে। রোদের ছোঁয়া লেগে চকচক করছে টেবিলে বসা মাছিটার কাঁচের মতো মসৃণনীল পিঠ। উদ্যত ডাস্টারটাকে আরো একটু ওপরে তুলে ভালো করে লক্ষ্যস্থির করলো শহীদ।
হঠাৎ ওর সমস্ত একাগ্রতা চুরমার করে দিয়ে ঝনঝন করে বেজে উঠলো টেলিফোন।
বিরক্তিতে বেঁকে গেল শহীদের মুখ। ডাস্টার ধরা ডান হাতটা বাড়ি মারার ভঙ্গিতে রেখেই অত্যন্ত ধীরে বা হাত বাড়ালো রিসিভারের দিকে। মাছিটার ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে আস্তে করে তুলে আনলো রিসিভার। মাউথপিসে মুখ রেখে মৃদু স্বরে বললো, হ্যালো, একটু ধরে থাকুন, প্লিজ।
টেবিলে পড়ে থাকা গোলাপি ব্লটারের ওপর আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখলো শহীদ। জায়গা ছেড়ে নড়েনি এখনো মাছিটা। সময় নিয়ে আবার লক্ষ্য স্থির করে আচমকা বাড়ি মারলো সে ডাস্টার দিয়ে।
যেন তৈরি হয়েই ছিল মাছিটা। ডাস্টার টেবিলে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে চোখের পলকে জায়গা ছেড়ে উড়ে গেল। আবার শহীদের মাথার ওপর শুরু হয়ে গেল মাছিটার ভভনানি।
যাশ, শালা, জোরে গাল দিয়ে উঠেই রিসিভারের ওপর চোখ পড়তে মুখে হাত চাপা দিলে শহীদ। ডাস্টার নামিয়ে রেখে তুলে নিলো রিসিভার। কানে ঠেকিয়ে মাফ চাইলে, দেরি করিয়ে দেয়ার জন্যে দুঃখিত।
কী, কী হলো শহীদ? উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন হলো ও পাশ থেকে।
কে? মিস্টার সিম্পসন নাকি? আর বলবেন না, খুন করতে পারলাম না হারামজাদাকে, তীক্ষ্ণ চোখে মাছিটাকে খুজতে খুজতে বললো শহীদ।
কাকে? কাকে খুন করতে পারলে না? আরো বেশি উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন মিস্টার সিম্পসন।
ওই ব্যাটা মাছির বাচ্চা মাছিটাকে। যা জ্বালাচ্ছে না।
হো হো করে হেসে উঠলেন মিস্টার সিম্পসন ওপাশ থেকে।
শহীদের মাঝেও সংক্রমিত হলো হাসিটা। হাসি থামিয়ে জানতে চাইলো, তা হঠাৎ কী মনে করে? অনেক দিন তো কোনো খোঁজখবর নেই।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন মিস্টার সিম্পসন। একটু আসতে পারবে আমার অফিসে?
পারবে। কিন্তু কেন? হঠাৎ এই জরুরি তলব?
সোজা অফিসে চলে এসো। এসেই শুনবে। ফোনে বলা যাবে না সব।
ঠিক আছে, আসছি আমি। রিসিভার রেখে দিলে শহীদ।
মাথার ওপর আবার এসে হাজির হয়েছে মাছিটা। ভোঁ ভোঁ করেই চলেছে। চোখ পাকিয়ে একবার ওটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে একটা গাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো শহীদ। বেডরুমেরু দিকে পা বাড়ালো।
কাপড়চোপড় পরে গ্যারেজের কাছে এসে দাঁড়াতেই সালাম দিলো ড্রাইভার। গাড়ি বের করবে কিনা জানতে চাইলো। ড্রাইভারটা নতুন। বেশ চটপটে। আচার-আচরণে মার্জিত, অমায়িক।
গাড়ি নিয়ে একাই মিস্টার সিম্পসনের অফিসের দিকে রওনা হলো শহীদ।
.
এটা তিন নম্বর জাহাজ। নামটা এখনো জানতে পারিনি, চিন্তিতভাবে টেবিলে টোকা মারতে মারতে বললেন মিস্টার সিম্পসন। এর আগে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে আরো দুটো জাহাজ। কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি সেগুলোর।
ডুবে গিয়ে থাকতে পারে, বললো শহীদ।
তা পারে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ওই অঞ্চলটা তেমন গভীর নয়। হারানোর দিনগুলোতে আকাশও ছিল পরিষ্কার। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল সাগরের অবস্থা। ধাঁধায় পড়ে গিয়ে ছিলাম। এই তিন নম্বর জাহাজটা কী করে ডুবলে জানতে পেরেছি। কিন্তু তাতে আরো বেড়েছে দুশ্চিন্তা।
কেন? কী করে ডুবেছে জাহাজটা?
আণবিক বিস্ফোরণ। কোনো ধরনের ভয়ংকর অ্যাটমিক মিসাইল ছুঁড়েছে কেউ জাহাজটা লক্ষ্য করে। একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
বলছেন কি! উত্তেজনায় ঝুঁকে বসলো শহীদ। দুচোখে অবিশ্বাস।
ঠিকই বলছি, শহীদ। পরশু সকালে কক্সবাজার থেকে মাইল পনেরো দুরে সী-বীচের বালিতে আটকে থাকা একটা বিধ্বস্তপ্রায় বোট উদ্ধার করে কয়েকজন জেলে –
লাইফবোট? প্রশ্ন করে শহীদ।
হ্যা! চারটে মৃতদেহ ছিল বোটে। প্রচণ্ড শকওয়েভের ধাক্কায় সবাই মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিশ্চয় আরো লোক ছিল বোটটাতে, ছিটকে পড়ে গিয়ে থাকবে পানিতে। একটু থামলেন মিস্টার সিম্পসন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, যে-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একজন ছিল বাইশ-তেইশ বছর বয়সের এক তরুণী। তার পায়ের কাছে পড়ে ছিল একটা ক্যামেরা।
ক্যামেরা! নড়েচড়ে বসলো শহীদ।
৩৫ মিলিমিটার এস এল-আর, পেন্ট্যাক্স সুপার-এ। ১৩৫ মিলিমিটার টেলিফটো লেন্স লাগানো ছিল। মেয়েটারই ক্যামেরা, সন্দেহ নেই। তার নিজের মাত্র দুটো ছবি তোলা হয়েছিল– জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে। প্রৌঢ় এক ভদ্রলোকের ছবি রয়েছে অনেকগুলো। মেয়েটার বাবা হবেন খুব সম্ভবত, যথেষ্ট মিল রয়েছে দুজনের চেহারায়। মোট সাতাশটা ছবি তোলা হয়েছিল। আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটে। ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করে শহীদের দিকে ঠেলে দিলেন মিস্টার সিম্পসন। দেখো।
হাতে নিয়ে খামটা খুললো শহীদ। তিনটে পোস্টকার্ড সাইজ ফটো। যে তুলেছে, ছবি তুলতে মোটামুটি অভ্যস্ত সে, বোঝা যায়। তিনটে ছবিই বেশ স্পষ্ট।
মন দিয়ে দেখলো শহীদ ছবিগুলো। প্রথমটায় একটা ছোট দ্বীপের ওপর ক্ষুদে একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। টিলার মাথা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিটায় ঘন ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে চকচকে সিলিণ্ডার আকৃতির একটা জিনিস। তৃতীয় ছবিতে পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে মিসাইলট। দিগন্ত ছাড়িয়ে উঠে পড়েছে আকাশে। পেছনে কমলা রঙ আগুনের পুচ্ছ।
আশ্চর্য! ছবিগুলো খামে ভরে আবার মিস্টার সিম্পসনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বললে শহীদ।
হ্যাঁ, আশ্চর্যই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর আগের জাহাজ দুটো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার জন্যেও এই অদ্ভুত মিসাইলই দায়ী।
দ্বীপটা থেকেই আসে মিসাইল, ছবি দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু কে ছুড়ছে? কেন? সাধারণ যাত্রীবাহী লাইনার ধ্বংস করে দিয়ে কার কী লাভ?
যদি কিছু মনে না করে। শহীদ, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে সাহায্য করার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি, অনুনয়ের সুরে বললেন মিস্টার সিম্পসন।
খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলো শহীদ। তারপর জিজ্ঞেস করলে, দ্বীপটার নাম কী? অবস্থান কোথায়?
ছোট্ট দ্বীপ। বড়জোর আড়াই কি তিন বছর হবে বয়েস। সরকারীভাবে কোন নাম রাখা হয়নি, ম্যাপেও দেখানো হয়নি ওটার অবস্থান। তবে স্থানীয় জেলেরা নাম রেখেছে নীলদ্বীপ। শয়তানের দ্বীপও বলে। ভয়ে দিনের বেলায়ও ওটার ত্রিসীমানায় ঘেষে না কেউ। উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার সিম্পসন। এসো, ঠিক কোন্ জায়গায় দ্বীপটা, দেখাচ্ছি তোমাকে।
ঘরের দেয়ালে টাঙানো বাংলাদেশের বিশাল ম্যাপটার সামনে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার সিম্পসন। শহীদও পাশে এসে দাঁড়ালো।
বঙ্গোপসাগরের একটা জায়গায় তর্জনী ছোঁয়ালেন মিস্টার সিম্পসন। এই যে, এখানে। এখানেই হবে দ্বীপটা। কক্স বাজার থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
মনোযোগ দিয়ে অবস্থানটা দেখে নিলে শহীদ।
দুজনেই ফিরে এসে বসলো আবার টেবিলে।
তাহলে যাচ্ছো তুমি? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার সিম্পসন।
আপনি এতো করে বলছেন, সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে বললো শহীদ, কেমন যেন একটা কৌতূহল অনুভব করছি। তাছাড়া হাতেও আপাতত কোনো কাজকর্ম নেই। হঠাৎই মনস্থির করে সোজা হয়ে বসে মিস্টার সিম্পসনের দিকে চাইলে শহীদ। ঠিক আছে, যাবো।
গুড, ভেরি গুড। হাসলেন মিস্টার সিম্পসন। প ছেড়ে বাচলেন যেন। ভালো অফিসারের অভাব নেই আমাদের, কিন্তু এই কাজটাতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না ওদের কারো ওপর। বাঁচালে আমাকে, শহীদ। অবশ্য জানতাম, আমি বললে অন্তত তুমি না করবে না। একটু থেমে বললেন, তা কামালকে নিচ্ছো তো সঙ্গে?
হ্যাঁ। মহুয়াকেও।
মহুয়া। অমন বিপজ্জনক কাজের ভেতর আবার মেয়েটাকে টানছো কেন?
ভয় নেই। ওকে কক্সবাজারে আমাদের বাড়িটায় রেখে যাবো। কদিন ধরেই কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে পাগল করে তুলেছে আমাকে। হাসলে শহীদ, তাছাড়া অতে ভাবছেন কেন? এর আগেও তো অসংখ্যবার এর চেয়ে বিপজ্জ নক কাজে আমাদের সঙ্গী হয়েছে ও।
তা বটে। কিন্তু… আমতা আমতা করতে লাগলেন মিস্টার সিম্পসন।
আর কিন্তু টিন্তু নেই। ও যাবে। কিন্তু দ্বীপটায় নিয়ে যাচ্ছি না ওকে, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তা, ভালো কথা, আপনি যাচ্ছেন না?
অ্যাঁ? মাথা নাড়লেন মিস্টার সিম্পসন, না, আমি যেতে পারছি না। এদিকে অন্য একটা কাজে জড়িয়ে পড়েছি। ছাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। হঠাৎই যেন মনে পড়েছে কথাটা এমনভাবে তাড়াতাড়ি বললেন, আরে, এতক্ষণ অমনি বসিয়ে রেখেছি তোমাকে। মনেই নেই। চা খাবে?
মাথা কাত করলে শহীদ। খাবে।
বেল টিপলেন মিস্টার সিম্পসন। দরজার ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকলো তার পি. এ. সাব-ইন্সপেক্টর তরিক।
বেয়ারাকে দুকাপ চা দিতে বলে। আর সঙ্গে তোমার যা খুশি।
.
০২.
কৃষ্ণপক্ষ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভৌতিক এক ফালি কমলা রঙ চাঁদ উঠবে শেষ রাতের দিকে। কিন্তু তার এখনো অনেক দেরি। ধূসর একটা বিস্তৃতি শুধু আলাদা করে রেখেছে সাগরের পানি থেকে বেলাভূমিকে। বালি ছাড়িয়ে সবুজ ঘাস। তার ওপারে একটা বাড়ি। খোলা জানালা দিয়ে হলদে আলো এসে পড়েছে বালুবেলার এক অংশে।
ঘরের দরজা খুলে, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো দুই যুবক। গত কদিন ধরে রোজই এই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে দুজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ওরা। ছুটিতে বন্ধু জামি লকে কক্সবাজার, বেড়াতে নিয়ে এসেছে সেলিম। বাড়িটা ওর চাচার। সাগরকে খুব ভালবাসে ও। তাই ছুটি পেলেই সাগরের কাছাকাছি চাচার এই বাড়িতে চলে আসে। ইচ্ছে, লেখাপড়ার পালা শেষ হলে জাহাজে চাকরি নেবে। ঘুরে বেড়াবে সাগরে সাগরে। কলম্বাস কিংবা সিন্দবাদের মত পালতোলা জাহাজে করে সাগরে বেরিয়ে পড়ার অবাস্তব কল্পনা প্রায়ই জাগে তার মনে। রোমাঞ্চিত হয়।
বালুবেলার প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত সাগরকে দেখলো দুই বন্ধু। তারপর মন্থর পায়ে বালি মাড়িয়ে এগিয়ে গেল পানির ধার পর্যন্ত। লম্বা করে হাই তুললল জামিল। সারাদিনের হৈচৈয়ের পর দারুণ ঘুম পেয়েছে ওর। তবু এসেছে বন্ধুকে সঙ্গ দিতে।
চল, সেলিম, ফিরে যাই অজ। আর একবার হাই তুলতে তুলতে বললে জামিল।
না সাঁতরেই। অবাক হয়ে বন্ধুর মুখের দিকে চাইলো সেলিম।
দারুণ ঘুম পেয়েছে। পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু আমার যে না নামলে ঘুমই আসবে না আজ রাতে। উহ, যা গরম পড়েছেন।
কথা বলতে বলতেই পানির ধার ঘেষে ধীর পায়ে এগিয়ে চললো দুজন।
ঠিক আছে, তুই একাই তাহলে কয়েকটা ডুব দিয়ে আয়। আমি বসি, বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাঙার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বালিতেই বসে পড়লে জামিল।
শুধু জাঙ্গিয়াটা পরনে রেখে কাপড়চোপড় সব খুলে ফেললো। সেলিম। তোয়ালেসুদ্ধ সেগুলো বালির ওপর রেখে দিয়ে পানিতে নেমে পড়লো। গোড়ালি-পানিতে নেমে বোমরে দুই হাত রেখে আছ। কার সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার ডাকলো জামিলকে, তাহলে আসবি না তুই?
নির্জন শান্ত পরিবেশে নিজের কানেই নিজের ডাক বেখাপ্পা লাগলো সেলিমের। বসে বসে ঢুলতে শুরু করেছে ততক্ষণে জামিল। বন্ধুর ডাক শুনে চমকে উঠে ঘুমজড়ানো গলায় বললো, অ্য, না, তুই জলদি কর
হাসলো সেলিম। ঠিক আছে, ঠিক আছে, থাক তুই। এক কাজ কর না, আমি সারতে সারতে তোয়ালেটা বিছিয়ে শুয়েই পড়। নরম বালিতে তোয়ালে বিছিয়ে শুয়ে দেখ, পালকের গদির চাইতেও আরাম পাবি, বলে আর দেরি না করে সামনে এগিয়ে চললো সে। হালকা পেঁজা তুলোর মত নরম ফেনা পরশ বোলাচ্ছে পায়ে। জুনের মাঝামাঝি। ডাঙার আবহাওয়ার চাইতে পানি অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। কোমর পানিতে পৌঁছেই ডুব দিলো সেলিম।
ফুসফুসের বাতাস ফুরিয়ে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। ভুস করে ভেসে উঠলো তারপর। লম্বা চুলে ঢেকে গেছে চোখ নাক। মুখের ওপরের চুলগুলো এক হাতে সরিয়ে দিয়ে সাঁতরে চললো সে গভীর পানিতে।
একটু পর পর বাড়ির জানালার আলো দেখে তীর থেকে নিজের দুরত্ব আন্দাজ করে নিচ্ছে সেলিম। নিস্তরঙ্গ শান্ত সাগর। মোটেই অসুবিধে হচ্ছে না সাঁতার কাটতে। প্রায় মিনিট পনেরো একটানা সাতরে ক্লান্ত হয়ে পড়লো ও। চিত হয়ে ভেসে থেকে জিরিয়ে নিতে লাগলো। একটু।
ফিরে যাওয়া দরকার। তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলো সেলিম। ক্রমেই যে ঢেউয়ের আকার বড় হচ্ছে টের পেলো না ও প্রথমে। ঢেউয়ের ঝাপটায় মাথা ডুবে যেতেই ব্যাপারটা অস্বাভা বিক লাগলো ওর কাছে। চার-পাঁচ মিনিট আগেও ঢেউ প্রায় ছিলই না, অথচ এখন রীতিমতো চেষ্টা করে মাথা উঁচু রাখতে হচ্ছে।
সাঁতরাতে সাঁতরাতেই পা দিয়ে বার বার মাটির নাগাল পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলো সেলিম। কিন্তু না, পায়ে ঠেকছে মাটি। বেশ দুরেই চলে এসেছে তাহলে তীর থেকে। আন্দাজ করলো, আরো অন্তত পঞ্চাশ গজ দূরে আছে তীর। হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো ওর। দ্রুত হয়ে উঠলো রক্ত-সঞ্চা লন। বেড়ে গেছে হৃদূপিণ্ডের গতি। আরো তাড়াতাড়ি এগোবার একটা তাড়া অনুভব করলো ও নিজের ভেতরে।
বালিতটে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎ ছল শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেন যেন মনে হলো সেলিমের, ওই শব্দের উৎসের কাছে আর পৌঁছতে পারবে না ও কোনদিন।
আচমকাই মাটি ঠেকলোপায়ে। হেসে ফেললে সেলিম নিজের মনেই। অহেতুক ভয় পাবার জন্যে বকুনি দিলো নিজেকে। পর মুহূর্তেই চমকে উঠলো আবার। মাটি ঠেকেনি পায়ে। নড়ছে পায়ের নিচের জিনিসটা। তবে কি ভেসে যাওয়া কাঠের গুঁড়িতে পা পড়েছে? কিন্তু পানির অতো নিচে তো কাঠ ভাসার কথা নয়।
প্রথমে টের পেলো না ও ব্যথাটা। শুধু ভয়ানক একটা ঝাঁকুনি বা পায়ে। হালকা ব্যথা অনুভব করলো আধ সেকেণ্ড পর। কারণ অনুসন্ধানের জন্যে নিজের অজান্তেই বাঁ হাত বাড়ালে ব্যথার উৎস বরাবর। কিন্তু হাতে ঠেকলো না পা-টা। নেই। আঙুলগুলো ঠেকলো শুধু ভাঙা হাড় আর থেতলানো মাংসে।
পানির চেয়ে গরম একটা তরল পদার্থের অস্তিত্ব হাত দিয়ে বুঝতে পারলো সেলিম। হঠাৎ ঘুম ঘুম একটা ভাব অনুভব করলো নিজের মধ্যে। একটু বেশি গাঢ় মনে হচ্ছে চারপাশের অন্ধকার। ভয় আর প্রচণ্ড ব্যথা একসঙ্গে আঘাত করলে ওকে, আচমকা। নিজের অজান্তেই গলা চিরে বেরিয়ে এলো বিকট আর্তনাদ।
গাছের গুঁড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ঘা মারার মতো হঠাৎ সেলিমের পিঠে ধাক্কা মারলো যেন কিসে। পানি ছেড়ে আধ হাত শূন্যে উঠে গেল ওর শরীর। শেষবারের মত চেঁচিয়ে উঠে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনকিছু আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো ও। তারপর ঝুপ করে পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল নিচে। ভয়ঙ্কর আলোড়ন উঠলো আশপাশের পানিতে। মিনিট খানেকের মধ্যেই সব ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো আবার।
এসবের কিছুই টের পেলো না জামিল। বন্ধুর পরামর্শ মতো বন্ধুরই তোয়ালে বিছিয়ে বালির ওপর শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন সে।
.
ডেক্সের সামনে বসে লম্বা একটা হাই তুলে হাতঘড়ির দিকে তাকালে কক্সবাজার পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইনচার্জ নেয়ামত হোসেন। ভোর ছটা বেজে পাঁচ। সারারাতের ডিউটি শেষে ঘুমে আর শ্রান্তিতে বুজে আসছে চোখ।
বয়স্ক লোক নেয়ামত হোসেন। সাতাশ বছর আগে কনস্টে বল হিসেবে ঢুকেছিল চাকরিতে। সেখান থেকে উঠতে উঠতে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। বাঘা দারোগা বলে নাম আছে লোকটার। যমের মতো ভয় পায় ওকে ওর অধীনস্থ কর্মচারীরা। বাইরে কঠিন হলেও মনটা কিন্তু বড়ো ভালো লোকটার। এই মনের পরিচয় যারা পেয়েছে, তারা ওকে ভালবাসে। উঠতে যাবে নেয়া মত হোসেন, এমন সময় তারস্বরে বেজে উঠলো টেলিফোন।
দুত্তোর ছাই… বিরক্ত মুখে রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো সে, কক্সবাজার পুলিশ।
আমার নাম জামিল। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে–মানে, ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে!
মনে হচ্ছে। কী দুর্ঘটনা?
আমার বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছি না।
মানে?
গতরাতে আমি আর আমার বন্ধু সেলিম বীচে গিয়েছিলাম সাঁতার কাটতে।
তারপর?
আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছিল। বীচেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেলিম একা নেমেছিলো পানিতে। কিন্তু মনে হয় আর উঠে আসেনি।
মনে হওয়ার কারণ?
খানিক আগে ঘুম থেকে উঠে আগের জায়গাতেই পেয়েছি ওর কাপড়চোপড়গুলো।
হু,… যায়নি তো কোথাও?
গেলে কাপড় ফেলে যাবে কেন? তবু সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি আমি।
ঘরে আপনার বন্ধুর কাপড়চোপড় সব ঠিক আছে?
যেখানে যে-কাপড় রেখেছিল, সেভাবেই আছে সব। তা– ছাড়া বললাম তো, সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি।
সম্ভাব্য জায়গা ছাড়াও অন্য কোথাও যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, কাপড়চোপড় ছাড়া যাবে না এটা ঠিক। এক সেকেণ্ড কী ভাবলো নেয়ামত হোসেন। তারপর বললো, ঠিক আছে। আসছি আমি। ঠিকানাটা কী?
বললো জামিল।
খসখস করে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে নিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলো নেয়ামত হোসেন। তারপর দারোগাসুলভ হুংকার ছাড়লে, শুক্কুর!
ঘরের কোণে একটা টুলে বসে ঢুলছিল কনষ্টেবল শুক্কর আলী। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। স্যা-আর!
ড্রাইভারকে জীপ বের করতে বলল। জলদি।
জী স্যার। ছুটে বেরিয়ে গেল শুক্কুর আলী। দুমিনিট পরেই ফিরে এসে জানালো, বার করেছে, স্যার। আমার যাওয়া লাগবে?
চলো, কোমরের বেল্ট আরো শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইন্সপেক্টর। পেছনে পেছনে চললল শুক্কুর আলী। জীপ থেকে নেমে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল নেয়ামত হোসেন। তার পেছনে শুক্কর আলী। নক্ করতেই দরজা খুলে গেল।
আসুন, একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ডাকলো জামিল। আপ নার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমিই জামিল আহমেদ। পথ দেখিয়ে নেয়ামত হোসেনকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল সে।
জামিলের কাছ থেকে সব কথা পাঁচ মিনিটেই জেনে নিলো নেয়ামত হোসেন। জানার নতুন বিশেষ কিছুই ছিলো না। একটু আগে ফোনেই শুনেছে ইন্সপেক্টর প্রায় সব কথা।
এর বেশি আর কিছু বলার নেই আপনার? জিজ্ঞেস করলো নেয়ামত হোসেন।
না, উত্তর দিলো জামিল।
বেশ, চলুন তাহলে, বীচটা একবার ঘুরে আসি। ঠিক কোন্ জায়গায় ঘুমিয়ে ছিলেন আপনি, কোথায় পানিতে নেমেছিল সেলিম সাহেব, দেখিয়ে দেবেন।
চলুন..।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো তিনজন। ঘাস পেরিয়ে এসে দাঁড়ালো বীচে। এতে সকালে একেবারে নির্জন বীচ। গত রাতে কোথায় শুয়ে ছিল জামিল, দেখিয়ে দিলো নেয়ামত হোসেনকে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখলে নেয়ামত হোসেন। সোজা পানির ধার পর্যন্ত নেমে যাওয়া একজন মানুষের পায়ের ছাপ পরিষ্কার চোখে পড়ছে। পায়ের আঙুলগুলো সাগরের দিকে মুখ করে আছে। মানে, পানিতে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু উঠে আসেনি আর। তবে ঠিক পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না এ-থেকে, ভাবলো নেয়ামত হোসেন। এদিক দিয়ে না উঠে অন্যখান দিয়েও উঠতে পারে সেলিম। পেছন ফিরে শুক্করকে আদেশ দিলো, পুবদিকে হাঁটো তুমি, শুক্কর। আমি আর জামিল সাহেব পশ্চিমে যাচ্ছি। পানির ধার ধরে হাঁটবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই হুইসেল বাজাবে। বুঝেছো?
সংক্ষেপে কথা শেষ করতে পারে না কখনো শুকর। সাথে সাথেই শুরু করে দিলো সে, কী যে কন, স্যার। দেখেন না খালি, একটা না একটা কিছু বাইর কইরা ফালামু-ই। মনে নাই, গত বছর…
হাত নেড়ে শুক্কুরকে থামিয়ে দিয়ে রওনা দিলে নেয়ামত হোসেন। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। কয়েক সেকেণ্ড আহত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকলো শুক্কর। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রওনা দিলো সে-ও।
পানির ধার ঘেষে হাঁটতে বলা হয়েছে শুক্করকে। কিন্তু সেটা না করে প্যান্ট গুটিয়ে পানিতে নেমে হাঁটছে সে। দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগের সাথে সবকিছু দেখতে দেখতে চলেছে। ছোটবড়ো বিচিত্র সব শামুক আর আগাছার দঙ্গল ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। কালো গুবরে পোকার মতো এক ধরনের প্রাণী বঁক বেঁধে স্থির হয়ে আছে এখানে ওখানে শুক্করকে আসতে দেখলেই বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ছোট ছোট গর্তে বসে মুখ বাড়িয়ে বুদবুদ ছড়াচ্ছে অগুণতি স্যাণ্ডওয়ার্ম। এসব দেখতে দারুণ ভালো লাগে শুক্কুর আলীর। তাই সময় পেলেই বীচে চলে আসে সে। সাগর জীবনের বিচিত্র লীলা দেখতে দেখতে হেঁটে চলে যায় মাইলের পর মাইল।
ঢেউয়ের ধাক্কায় তীরে এসে ঠেকেছে বড়ো একটা শ্যাওলার স্তপ। সেটার আশপাশে ঘুর ঘুর করছে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ। শুক্কর আলী কাছে যেতেও খুব একটা নড়তে চাইলে না মাছগুলো। মাছের সঙ্গে ভাব জমাবার অদম্য বাসনা শুক্কুর আলীর ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত সফল হয়নি সে। আজ সে কাছে যেতেও মাছগুলো ছুটে পালাচ্ছে না দেখে খুশি হয়ে উঠলে তার মন।
শুক্কুর আলী একেবারে কাছে চলে এলে যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আস্তে আস্তে সরে গেল মাছগুলো। কিন্তু বেশি দুরে গেল না। ধারেকাছেই ঘুর ঘুর করতে থাকলো। সুড়ৎ করে শ্যাওলার তূপের ভেতরেই ঢুকে পড়লো কয়েকটা নাম না জানা রঙিন মাছ। কী মনে করে পা দিয়ে ঠেলে স্তপটা সরাবার চেষ্টা করলো শুক্কুর আলী। একটা মাত্র ঠেলা দিয়েই ভীষণ চমকে উঠে থেমে গেল সে। নিমেষে দুর হয়ে গেল মুখের হাসি হাসি ভাবটা, তার জায়গায় দেখা দিলো প্রবল আতঙ্ক। শ্যাওলার স্তপের আশপাশে মাছের দলের ঘুর ঘুর করার কারণটা বুঝতে পারছে এখন সে পরিষ্কার। চোখ বড়ো বড়ো করে কয়েক সেকেণ্ড স্তূপটার দিকে চেয়ে থাকলো শুক্কুর আলী। পকেট হাতড়ে হুইসেলটা বের করে কম্পিত হাতে কোনমতে ঠেকালো শুকনো ঠোঁটে। ফুঁ দিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। এতে কাঁপছে হাত, ধরে রাখতেও পারলো না। হুইসেলটা। টুপ করে পড়ে গেল হাত থেকে। সেটা তোলার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে এক লাফে পানি থেকে উঠে এলো সে। দুহাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে বসে পড়লো বালির ওপর।
শ্যাওলার স্তূপে ঢাকা পড়ে আছে একটা মানুষের ছিন্নদেহ। মাথা থেকে শুরু করে কাঁধের নিচের খানিকটা অংশ রয়েছে শুধু। কাঁধের সাথে কোনমতে লটকে আছে বাঁ হাতের কনুই পর্যন্ত। শুক্কুর আলী ঠেলা দিতেই বেরিয়ে পড়েছে স্তপের তলা থেকে। পানির নিচে ভয়ঙ্কর রকম বীভৎস লাগছে দৃশ্যটা।
তিন-চারশো গজ হেঁটে এগোবার পর শুক্কর কী করছে দেখার জন্ঠে পেছনে ফিরে তাকালে নেয়ামত হোসেন। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখেই ঘুরে দাঁড়ালো। অদ্ভুত ভঙ্গিতে বালির ওপর বসে রয়েছে শুক্কর। একটু আশ্চর্য হয়েই জামিলকে বললো, কিছু দেখলো নাকি ও। চলুন তো দেখি কী ব্যাপার!
দ্রুত পা চালিয়ে শুক্কুরের কাছে এসে দাঁড়ালো নেয়ামত হোসেন। একই ভাবে ঠায় বসে আছে শুল্কর। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতে মুখে কিছু না বলে আঙুল তুলে শ্যাওলার স্তূপটা দেখিয়ে দিলো সে। সোজা হয়ে দাঁড়ালো নেয়ামত হোসেন। এগিয়ে গিয়ে পানিতে নেমে গেল আস্তে করে। ভালোমতো দেখার জন্যে দুহাত দিয়ে ঠেলে পুরো সরিয়ে দিলো শ্যাওলার স্তূপ। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে স্থির চেয়ে দেখে ডাকলো জামিলকে, দেখে যান।
কাছে এসে একবার দেখেই অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো জামিল। মুখ ঢাকলো দুহাতে।
খোদা, কান্নায় জড়িয়ে এলো ওর গলা।
ছিন্ন দেহটা সেলিমেরই কিনা, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলো না নেয়ামত হোসেন। হাঁটুতে দুহাত রেখে ঝুঁকে আরো ভালো করে দেখতে লাগলো লাশের অবশিষ্টাংশ। সাতাশ বছরের পুলিশী চাকরি জীবনে বহু মৃতদেহ দেখেছে সে। যতো বীভৎসই হোক, লাশ দেখে খারাপ লাগে না এখন আর। কিন্তু কী করে এই অবস্থা হয়েছে লোকটার, বুঝতে পারলোনানেয়ামত হোসেন। আরো তিরিশ সেকেণ্ড সেলিমের ছিন্নভিন্ন দেহটা দেখে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে উঠে এলো শুকনো বালিতে। ফোঁস করে ছাড়লো চেপে রাখা নিঃশ্বাস।
দুপুর হবার আগেই ঘটে গেল একই রকম আরো দুটো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
.
০৩.
চোখ মেলে লম্বা করে হাই তুললো শহীদ। বার দুই গড়াগড়ি করে চোখ মুদলো আবার। কিন্তু ঘুম আর এলো না। আবার চোখ মেলে বালিশের তলায় রাখা হাতঘড়িটা বের করে দেখলো। ওরেব্বাপস। চারটে বাজে। সেই কখন বারোটায় খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে, আর এই এখন ঘুম ভাঙলো! কাত হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো, ওপাশের খাটে মহুয়াও ঘুমোচ্ছে।
ঢাকা থেকে বেরিয়েছে গতকাল। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে পৌঁছে হোটেলেই রাত কাটিয়েছে শহীদ আর মহুয়া। আজ সকালে রওনা দিয়ে এগারোটা নাগাদ এসে পৌঁছেছে কক্সবাজারে। ঢাকা থেকে নিজেদের গাড়িতেই এসেছে ওরা। কামাল আসেনি সঙ্গে। কী একটা কাজে আটকে গিয়েছিল গতকাল। তবে আজ সন্ধ্যা নাগাদ কক্সবাজারে পৌঁছে যাবার কথা ওর।
উঠে পড়লো শহীদ। হাত মুখ ধুয়ে এসে মহুয়াকে ডেকে তুললো। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধোয়ার জন্যে তাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলো। মনিবের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আশপাশেই ঘুর ঘুর করছিল ছাবেদ আলী। তাকে চা দিতে বলে ড্রইং রূমে এসে ঢুকলো শহীদ।
সোফার সামনের ছোট টেবিলের ওপর অনেকগুলো খবরের কাগজ। ঢাকা এমন কি চট্টগ্রাম থেকে বেরোনো কাগজগুলো ছুঁয়েও দেখলো না শহীদ। কী ভেবে লোকাল পেপারটাই হাতে তুলে নিলো আগে। চোখ আটকে গেল একটা খবরের ওপর। প্রথম পৃষ্ঠার ডান দিকের দুটো কলামের উধ্বাংশ জুড়ে ছাপা হয়েছে খবরটা :
হাঙ্গরের আক্রমণে সন্ত্রস্ত কক্সবাজার সাগরসৈকত।
তিনজন নিহত
কক্সবাজার, ১৬ই জুন : আজ এখানে বিভিন্ন সময়ে হাঙ্গরের আক্রমণে তিন ব্যক্তি প্রাণ হারাইয়াছেন।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গতরাত আনুমানিক বারোটায় সেলিম হোসেন নামক তেইশ বৎসরের এক যুবক একাকী বীচের পানিতে সাঁতার কাটিতে নামেন। সেই সময় তাঁহার বন্ধু জনাব জামিল আহমেদ বীচেই ঘুমাইয়া ছিলেন। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙিলে তিনি বন্ধুকে কোথাও খুঁজিয়া না পাইয়া পুলিশে খবর দেন। কক্সবাজার থানার ও. সি. জনাব নেয়ামত হোসেন সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে হাজির হন। জামিল সাহেব যেখানে গতরাতে ঘুমাইয়া ছিলেন, সেই স্থান হইতে প্রায় চারিশত গজ দুরে তীরের কাছেই পানিতে একটি শ্যাওলার পর নীট হইতে হতভাগ্য যুবকের ছিন্ন বহু নহ খণ্ডত মস্তকটি উদ্ধার করা হয়। দেহের বাকি অংশ সম্ভবত হাঙ্গরেই খাইয়া ফেলিয়া থাকিবে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে আজ সকাল নয়টার দিকে। এগারো বৎসরের বালক রন্ট, রবারের ভেলা অবলম্বন করিয়া তীর হইতে আনুমানিক পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে সাঁতার কাটিতে থাকাকালীন চকচকে রূপালী বিশাল একটি মাছের মত প্রাণী হঠাৎ পানির ওপর ভাসিয়া ওঠে এবং বালকটিকে লইয়া মুহূর্তে অদৃশ্য হইয়া যায়। আবদুল জব্বার নামে এক ব্যক্তি ঘটনাটি প্রথম দেখিতে পাইয়া চীৎকার করিতে থাকে। রবারের ভেলাটির ছিন্ন অংশে যে দুই-এক ফোঁটা রক্তের দাগ পাওয়া গিয়াছে, করোনারের মতে তাহা নিঃসন্দেহে মানুষের রক্ত।
মনির হোসেন নামক অপর এক প্রৌঢ়ের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি অন্তত পঞ্চাশ ব্যক্তি স্বচক্ষে দেখিয়াছে। বেলা দুইটার দিকে উক্ত মনির হোসেন বালকটির আক্রান্ত হইবার স্থান হইতে প্রায় সিকি মাইল দূরে সাঁতার কাটিতে নামেন। সাঁতার কাটিতে কাটিতে তিনি তীর হইতে প্রায় একশত গজ দুরে চলিয়া যান। হঠাৎই তিনি সাহায্যের জন্য প্রাণপণ চীৎকার শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন তাঁহার দিকে ছুটিয়া যাইবার উপক্রম করে। কিন্তু তাহার পূর্বেই বিশাল সেই অত্যাশ্চর্য প্রাণীটি হতভাগ্য লোকটিকে লইয়া পানিতে ডুব দেয়। উদ্ধারকারীদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ তায় পর্যবসিত হয়। তাহাদের সকলেই এই ভয়ংকর প্রাণীটির লেজ এবং পিঠের দঁাড়া সুস্পষ্টভাবে দেখিতে পায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের প্রধান ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ জগলুল হায়দার খানের মতে, তিনটি হত্যা কাণ্ডই একটি অতিকায় শ্বেত হাঙ্গরের কাজ। কিন্তু সাগরের এই এলাকায় বিশেষ ঐ প্রাণীটি কোথা হইতে আসিল, তিনি বুঝিতে পারিতেছেন না।
এখানে উল্লেখ থাকে যে, শ্বেত হাঙ্গর ( কারচারোডন কার চারিয়াস) হাঙ্গর গোষ্ঠির সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর এবং হিংস্রতম প্রাণী। মানুষখেকো বলিয়া ইহাদের সাংঘাতিক দুর্নাম রহিয়াছে। ১৯১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জাসীর সাগর সৈকতে একটি হাঙ্গর নাকি একদিনে চারজন স্নানার্থীকে হত্যা করিয়াছিল। ডঃ হায়দার বলিয়াছেন–ইহা সত্যিই ভয়াবহ ব্যাপার, অমন একটি প্রাণী কক্সবাজার সাগরসৈকত সংলগ্ন পানিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
হাঙ্গরটি মৃত ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকার পানিতে কোনো স্নানার্থীকে নামিতে দেওয়া হইবে না বলিয়া : আজ বেলা তিনটায় এক পুলিশী বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হইয়াছে।
গাঙচিল নামে একটি মাছধরা বোটে করিয়া একদল শিকারী হাঙ্গরটিকে খুজিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাঙ্গরটির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই।
কি গো, অতো মন দিয়ে কী পড়ছো? ঘরে এসে ঢুকেছে মহুয়া, টেরই পায়নি শহীদ। চোখ তুলে চাইলো সে।
আশ্চর্য! কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো শহীদ।
কী আশ্চর্য!. শহীদের পাশে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো মহুয়া।
হাঙর। কক্সবাজারের সাগরসৈকতে হাঙর। তাও যে সে হাঙর নয়, মানুষখেকো। এরই মধ্যে তিন তিনজনকে শেষ করে ফেলেছে।
বলে কি গো! কই দেখি, হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলে নিলো মহুয়া। পড়ার পর কোনো কথা যোগালো না তার মুখে।
চা নিয়ে ঢুকলো ছাবেদ আলী।
নীরবে প্রথম কাপ চা খাওয়া শেষ করলো দুজনে। গভীর ভাবনায় মগ্ন শহীদ। কী ভেবে ওকে বিরক্ত করলো না মহুয়া। উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। দুপুরের খাবারটা ছাবেদ আলী রেখেছে, রাতের রান্না মহুয়া নিজেই করতে চায়।
দ্বিতীয়বার কাপে চা ঢেলে নিলো শহীদ। সিগারেট ধরালো। চা শেষ হলে পোড়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে রেখে উঠে গিয়ে বুক শেলফটা ঘটতে লাগলো। বিভিন্ন জলচর প্রাণীর ওপর লেখা বই দিয়ে ঠাসা শেলফ টা। বেশিক্ষণ লাগলো না পছন্দসই বইটা খুঁজে পেতে। হাঙর সম্পর্কে লেখা টমাস; হেলমের আনপ্রেডিকটেবল কিলার অব দি সী বইটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলো শহীদ। একটা ইজিচেয়ারে আরাম করে বসলো। সাগর থেকে ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগছে গায়ে। সূচীপত্র দেখে হোয়াইট শার্কের ওপর লেখা চ্যাপ্টারটা খুললো। গোগ্রাসে গিলতে লাগলে লাইনের পর লাইনঃ
সমগ্র হাঙর গোষ্ঠির ভেতর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই শ্বেত হাঙর। সাগরের বিভীষিকা। নিরীহ হোয়েল শার্ক আর বাসকিং শার্কের পরেই বিরাটত্বের দিক থেকে শ্বেত হাঙরের নাম করা যেতে পারে। চোদ্দ ফুট লম্বা এক একটা পূর্ণবয়স্ক শ্বেত হাঙরের ওজন হয় পুরো এক টন। কোনো কোনো শ্বেত হাঙরকে এমন কি প্রায় চল্লিশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা গেছে।
ভীষণ খাই-খাই স্বভাব এদের। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকা এদের স্বভাববিরুদ্ধ। সারাক্ষণই সাগরতলে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় এরা। সীল, সী লায়ন, কচ্ছপ, অন্যান্য ছোটগোত্রের হাঙর, এমন কি আহত অবস্থায় পেলে সম গোত্রের হাঙরকে খেতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। এই ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলো। সুযোগ পেয়েও মানুষকে ছেড়ে দিয়েছে এরা, এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। নয় ফুট লম্বা সবচেয়ে ছোট আকা রের শ্বেত হাঙরের পেট থেকেও একশো পাউণ্ডের বেশি সী লায়নের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কতখানি রাক্ষুসে স্বভাব এদের। কয়েক বৎসর আগে মেক্সিকোর গালফ কোস্টে মাত্র দশ ফুট লম্বা একটা হাঙর একজন মানুষকে আস্ত গিলে ফেলে।
এটুকু পড়েই সিগারেট ধরাবার জন্যে বইটা হাত থেকে রাখলো শহীদ। এইসময়ই চোখে পড়লো ব্যাপারটা। কাছা কাছি পাহাড়ের একটা শাল গাছের আড়াল থেকে ছোট্ট একটু আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো ও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সেদিকে। কিন্তু আর দেখা গেল না কিছুই।
চোখের ভুল–ভেবে হাত বাড়িয়ে বইটা নিতে যাবে, হঠাৎ আবার দেখা গেল ঝলকটা। পরক্ষণে আবার। না, চোখের ভুল নয়। পরপর তিনবার ঘটলো ব্যাপারটা। বিকেলের পড়ন্ত রোদ কাঁচের ওপর প্রতিফলিত হয়েই এই ঝলকের সৃষ্টি করেছে। বাইনোকুলার? কাল ঢাকা থেকে রওনা দেবার পর কালো একটা টয়োটা অনেকক্ষণ লেগে ছিল পেছনে, মনে পড়ে গেল শহীদের। শাল গাছের আড়ালে টেলিস্কোপিক সাইট লাগানো মারণাস্ত্র নিয়ে কারে বসে থাকাটাও বিচিত্র নয়। একটা কাজে এসেছে সে। পেছনে শক্ত লাগাটা অস্বাভাবিক নয়।
দেখতে হয়। পড়তে পড়তে যেন বিরক্ত হয়ে গেছে, এমনি ভঙ্গিতে বইটা নিয়ে উঠে পড়লে শহীদ। দ্রুত বেডরুমে চলে এলো। সুটকেস খুলে বের করে নিলো পিস্তলটা। একবার পরীক্ষা করে দেখেই ঢুকিয়ে রাখলে প্যান্টের পকেটে। রবারের সোল লাগানো জুতো পরে নিলো। ঘড়ি দেখলো, পাঁচটা বেজে পাঁচ। ওপাশের জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালো। জানালা থেকে মাত্র দুহাত দুরে পানির পাইপ। এটা বেয়েই নামতে হবে। সামনের দরজা দিয়ে বেরোনো যাবে না। বারান্দা পার হবার সময়েই চোখে পড়ে যাবে দুরবীনধারীর।
জানালার চৌকাঠে উঠে বসে মাত্র হাত বাড়িয়েছে শহীদ, এমন সময় পেছনে গলা শোনা গেল মহুয়ার, ও কি?
মুখে একটা অঙল রেখে মহুয়াকে কথা বলতে নিষেধ করলো শহীদ। ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, ওপাশের পাহাড়ে শত্রু আছে। তারপর পানির পাইপটা ধরে আলগোছে ঝুলে পড়লো। বিশ সেকেও পরেই নেমে এসে দাঁড়ালো ঘাসের ওপর মাটিতে।
পাঁচিল সেষে গেট পর্যন্ত গেলে দুরবীনণীর চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা কম। পাঁচিলের ভেতরদিকেও চোখ রাখার কথা মনে হবে না তো আবার লোকটার, ভাবলো শহীদ। যদি চোখ রাখেই, করার কিছুই নেই। এদিকটা ছাড়া বেরোবার আর কোনো পথ নেই। কাজেই ঝুঁকিটা নিতেই হচ্ছে।
মাথা নিচু করে দেয়াল ঘেষে দ্রুত এগোলল শহীদ। গেট থেকে হাত দশেক দুরে এসে থেমে গেল। লাফ দিয়ে ধরে ফেললো দেয়ালের ওপরের দিকটা। ঝুলে রইলো একমুহূর্ত। তার পর দেয়ালের মাথায় উঠেই লাফিয়ে নামলো, ওপাশে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকটা একবার দেখে নিয়েই দ্রুত হেঁটে নেমে এলো সমতলের শালবনটার ভেতরে। বনের ভেতর দিয়ে চলে এলো পাহাড়ের পাদদেশে, লোকটার আনুমানিক অবস্থান থেকে সামান্য উত্তরে। পিস্তলটা পকেট থেকে বের করে নিয়ে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলো। চলতে চলতেই দুআঙুলে চেপে ধরে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে সেফটি ক্যাচ অফ করে নিলো।
লক্ষ্যস্থলের দশ গজের ভেতর পৌঁছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো শহীদ মাটিতে। বুকে হেঁটে অতি ধীরে এগোতে শুরু করলো। আবার। ছড়িয়ে থাকা শুকনো শালপাতার জন্যে নিঃশব্দে চলা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সামনে পড়ে থাকা শুকনো পাতা তুলে নিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চললো শহীদ।
নির্দিষ্ট গাছটার কাছাকাছি পৌঁছে গেল এক সময়। পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো সাবধানে। হঠাৎই ঘাড়ের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো শহীদের। টের পেয়ে গিয়ে সরে যায়নি তো লোকটা? পেছনে চাইতে সাহস হলো না তার। কে জানে, ঘুরলেই হয়তো চোখে পড়বে অটোমেটিক কোনো মারণাস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। তবু ঘাড় ফিরিয়ে চাইলে শহীদ। নাহ, নেই কেউ।
আরো মিনিট দশেক চুপচাপ পড়ে রইলো ও। ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে অপেক্ষার মুহূর্তগুলো। আর এভাবে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। উঠে পড়লো শহীদ। উবু হয়ে সাব ধানে হেঁটে এগিয়ে গেল গাছটার গোড়ায়।
বসে পড়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো গাছটার গোড়ার আশেপাশের জায়গাটুকু। চিহ্নটা খুঁজে বের করতে বেশিক্ষণ লাগলো না। গুঁড়ির মাত্র দুফুট দুরে এক জায়গায় ঘাসের ডগা ভেঙে আছে। কোনো কোনোটা দোমড়ানো। ভারি জুতো পায়ে ওখানে বসে ছিল কেউ কয়েক মিনিট আগে। কাছেই পড়ে আছে পোড়া সিগারেটের একটা টুকরো। চোখে দেখছে, কান দুটো কিন্তু যে-কোনরকম শব্দ শোনার জন্যে সজাগ রেখেছে শহীদ।
আচমকাই হলো শব্দটা। পাতার গায়ে কোনকিছুর ঘষা লাগার মৃদু খস খস আওয়াজ। বসে থাকা অবস্থাতেই জুতোর গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে পাঁই করে ঘুরে গেল শহীদ। ঘুরতে থাকা অবস্থাতেই গুলি করেছে শব্দের উৎস বরাবর। হাত পাঁচেক দুরের একটা চারা গাছের চার ফুট উঁচু ডাল থেকে ঝুপ করে মাটিতে পড়লে হতভাগ্য কাঠবেড়ালীটা। মৃত।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো শহীদ। এখানে অপেক্ষা করার আর কোনো মানেই হয় না। প্রতিটা মুহূর্তে বাড়ছে বিপদের আশঙ্কা। ওর অবস্থান জানা হয়ে গেছে শত্রু পক্ষের। হয় সরে পড়বে, নয়তো যে-কোনো মুহূর্তে এসে হাজির হয়ে যাবে এখানে।
উঠে দাঁড়িয়েই ছুটলো শহীদ যে পথে এসেছিল। যত জলদি সম্ভব সরে পড়তে হবে এখন।
পাহাড় থেকে নেমে, শালবনের ভেতরে না গিয়ে একটু দুরের রাস্তাটা দিয়ে ঘুরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে শহীদ। যে-কোনরকম সম্ভাবনার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রেখে এগিয়ে চললো। ভাবছে, কে লোকটা? কেন পিছু নিয়েছে ওর? এতো তাড়াতাড়ি কি তবে জেনে গেল, হারিয়ে যাওয়া তিন তিনটে জাহাজের খোঁজখবর করতে এসেছে ও? জেনে গেল, নীলদ্বীপের ওপর লক্ষ্য রাখতে এসেছে? যদি জানে, কী করে জানলে? একটা লোক ওপরের পাহাড়ে শালবনের ভেতর লুকিয়ে ওদের বাড়িটার ওপর নজর রাখছিল এটা ঠিক। কিন্তু আচমকা চলে গেল কেন সে আবার?
হঠাৎই মহুয়ার কথা মনে পড়লো শহীদের। বাড়িতে প্রায় একাই সে। ওখানে গিয়ে হাজির হয়ে যায়নি তো লোকটা? গতিবিধি দেখেই অনুমান করা যায় শত্রুপক্ষ শক্তিশালী। এদেরকে বাধা দেবার বা ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা ছাবেদ আলীর একেবারেই নেই।
ভিলার দিকে ছুটতে শুরু করলে শহীদ।
.
০৪.
সাবধানে গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলে শহীদ। কাঁকর বিছানো পথ পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সদর দরজার সামনে। স্প্রিং লাগানো পাল্লা ঠেলে খুললো পুরো নব্বই ডিগ্রী। খুলেই দাঁড়িয়ে পড়লো। স্থির হয়ে, দরজায়ই ঠেকানো রইলো হাতটা। লম্বা ব্যারেলওয়ালা অটোমেটিকের নলটা চেয়ে আছে ওর দিকে অনড়ভাবে। এসে গেছে তাহলে।
পরিষ্কার শান্ত গলায় কথা বললে পিস্তলধারী, আসুনমিস্টার শহীদ। সন্দেহজনক কিছু করার চেষ্টা করবেন না। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না আমি গুলি করতে।
কথাটা বিশ্বাস করলে শহীদ। অত্যন্ত ধীরে দুপা এগিয়ে হাতটা নামিয়ে আনলো দরজা থেকে। পেছনে ক্যাচ করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের পিস্তলের মুখে বহু বার দাঁড়িয়েছে সে জীবনে–বেঁচেও গেছে। পুরোপুরি মন দিল সে শক্রর পিস্তলের ওপর। নাইন এম এম লুগার। মাত্র আধ আউন্স মতো ওজনের বুলেটগুলোর যে কী ভয়ঙ্কর ক্ষমতা ভালো করেই জানে শহীদ। এতো কাছ থেকে পায়ে গুলি লাগলেও মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারাতে হবে সাথে সাথে। এরপর বেঁচে থাকলে খোঁড়া হয়েই বাঁচতে হবে বাকি জীবনটা। খাঁটি প্রফেশনালদের জিনিস।
লম্বাটে মুখ আর চৌকো চোয়াল লুগারধারীর। লম্বায় শহীদের সমানই, তবে একটু রোগাটে। হালকা নীল স্যুট পরনে, পায়ে চকচকে পালিশ করা জুতো। সহজেই চালিয়ে দেয়া যায় লোকটাকে ওষুধের ক্যানভাসার বলে। কথাবার্তায়, চালচলনে ধোপদুরস্ত। অনেকবার এসব লোকের মুখোমুখি হয়েছে শহীদ। গোঙ্কুরের চেয়েও এরা ভয়ঙ্কর।
এতকিছু দেখতে আর ভাবতে মাত্র তিনটে সেকেণ্ড ব্যয় হলো শহীদের। পায়ের শব্দ হলো পেছনে। দরজার বাইরে এসে দাড়ি য়েছে কেউ। দারোয়ান, নাকি ছাবেদ আলী? ক্যাচ করে খুলে গেল দরজা। নিপুণভাবে পেছন থেকে একটা হাত এগিয়ে এসে নিপুণ ভাবেপকেট থেকে বের করে নিলো শহীদের ওয়ালথারটা। সোজা হেঁটে এগিয়ে গেল দ্বিতীয় লোকটা চৌকোমুখোকে ছাড়িয়ে। সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত গিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো। একমাথা ঢেউ খেলানো চুলের নিচে ঘোলাটে দুটো চোখ। এ-চোখ আগেও দেখেছে শহীদ। জাতখুনী, শুধু মজা পাবার জন্যেই খুন করতে পারে এরা। প্রথম লোকটার মতোই একটা লুগার ওর হাতেও।
আসুন, বললো আবার চৌকোমুখো। একপাশে সামান্য সরে গিয়ে যাবার জায়গা করে দিলো শহীদকে। পিস্তলের মুখটা রইলো শহীদের দিকেই।
সশস্ত্র শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গ্রাউণ্ড ফ্লোরে যতটা কঠিন, তার চেয়েও বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে দোতলার হলরুমে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটতে শুরু করলো শহীদ। দেড় গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করলো চৌকোমুখো। শহীদ এগিয়ে যেতেই সিঁড়ির গোড়া থেকে চট্ করে সরে গেল ঘোলাটে চোখ। শহীদের পেট বরাবর তাক করা ওর লুগারের মুখ।
অলিভ গ্রীন রঙের এক্সমিনিস্টার স্টেয়ার-কার্পেটে পা ফেলে উঠতে গিয়ে খুব একটা শব্দ হলো না। ছায়ার মতো শহীদের পেছন পেছন উঠে এলো দুজন পিস্তলধারী নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে। হল রুমের দরজার সামনে থেমে দাঁড়ালো শহীদ।
ঢুকুন। এবার কথা বললে দ্বিতীয় লোকটা। শহীদের পেছন পেছন ঢুকলো সে-ও। প্রথমজন দাঁড়িয়ে থাকলে সিঁড়ির কাছেই।
একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে মহুয়া। পেছনে কাত করে রেখেছে মাথাটা, দুহাঁটুর মাঝখানে রাখা হাতদুটো। শহীদ ঢুকতেই আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলে ওর দিকে। শহীদকে চেনার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার চোখে। ভাব পরিবর্তনের একটা রেখাও মুখে ফুটলো না।
কথা বলে উঠলো কেউ পেছন থেকে। কথার ধরনটা প্রথম দুজনের মত হলেও গলাটা একটু ভারি। চমকাবার কিছু নেই, মিস্টার শহীদ। চিনতে পারবেন না এখন উনি আপনাকে। ইন জেকশন পুশ করা হয়েছে ওঁর শরীরে। একই ওষুধ দেয়া হবে এখন আপনাকেও। বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে হাঁটুতে গুলি খাবেন। নিন, হাতাটা উল্টে ফেলুন শার্টের।
ভূতের মতো উদয় হচ্ছে এক একজন। হলে ঢোকার সময় দেখেনি এই লোককে শহীদ। পাশের দরজা দিয়ে ঢুকেছে হয়তো অন্য রুম থেকে। আরও কজন আছে, কে জানে। মাথা ঘুরিয়ে তৃতীয় লোকটার দিকে চাইলে শহীদ, চল্লিশের কাছাকাছি হবে বয়স। ফ্যাকাশে চেহারা, ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক। ঘরের আলোয় চকচক করছে মস্ত টাক। একটা চোখ অন্য চোখের তুলনায় একটু বড়ো। ঘন ঘন পাতা পড়ছে চোখের।
চতুর্থ লোকটা, বোধহয় ডাক্তার, ঢুকলো এবার পাশের দরজা দিয়েই। হাতে সিরিঞ্জ। ঘাড় কাত করে চাইলে শহীদ একমাত্র খোলা জানালাটার দিকে, ওদিক দিয়ে বেরুনো যাবে কি? কিন্তু যাবে কি করে জানালা পর্যন্ত?
ওর মনের কথা টের পেলো বোধহয় তৃতীয় লোকটা। হাসলো সে। জানালাটা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মারা যাবেন, মিটার শহীদ। বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে হাতটা উল্টে ফেলুন শার্টের। বারকয়েক উঠলো পড়লো লোকটার চোখের পাতাগুলো। কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না গলার স্বরে।
এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শহীদ। খুন করতে চায় না ওরা ওকে, এটা বুঝে গেছে। কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। কিচ্ছ, করার নেই এখন মহুয়ার জন্যে। নিজেরও বেরুনো হবে না এখন ওকে নিয়ে বেরুতে গেলে। ওর শরীরে ওষুধ পুশ করার আগেই করতে হবে একটা কিছু। কোনমতে এখান থেকে বেরুতে পারলে একটা না একটা পথ পাওয়া যাবেই মহুয়াকে বাঁচানোর।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, মিস্টার শহীদ। আর পাঁচ সেকেণ্ড সময় দিলাম আপনাকে। এর পর জোর করে দেয়া হবে ইনজেকশান।
সেকেণ্ড গুণতে শুরু করলে টেকো, শেষও করলো। একচুল নড়লো না শহীদ। টেকোর গোণ। শেষ হতেই পেছন থেকে একটা হাত এসে খপ করে চেপে ধরলো শহীদের ডান হাত। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলে শহীদ-এ সেই প্রথম লোকটা। কোন্ ফাঁকে ঘরে ঢুকেছে টেরও পায়নি ও।
শহীদের হাত পেছন দিকে বাঁকাতে শুরু করলো লোকটা। নড়ে উঠলো শহীদ। বিদ্যুৎবেগে চালিয়ে দিলো ডান পা-টা পেছনে। গোড়ালিটা লাগলো লোকটার হাঁটুতে। ব্যথায় ককিয়ে উঠলো সে, কিন্তু হাত ছাড়লো না শহীদের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শহীদের বাঁ হাত চেপে ধরলো দ্বিতীয় লোকটা।
লাফ মেরে এসে পড়েছে ততক্ষণে তৃতীয় লোকটাও। প্রচণ্ড জোরে স্টীম ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো এসে লাগলো ওর ডান হাতটা শহীদের তলপেটে ব্যথায় নীল হয়ে গেল চোখমুখ। নাড়ি ভুড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলে যেন গলা দিয়ে। হা করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো শহীদ। ব্যথাটা সহ্য করে নেবার আগেই মূগুরের মতো রদ্দা পড়লো ঘাড়ে। অবশ হয়ে এলে ঘাড়ের নিচের মাংসপেশীগুলো। আবার পেছনে লাথি মারতে চেষ্টা করলো শহীদ। কিন্তু ওর লাথিটা অর্ধেক রাস্তা পেরুবার আগেই দড়াম করে সবুট লাথি পড়লে কাফ মাসলের ওপর, অবশ হয়ে গেল ডান পা-টাও।
ডাক্তারের সিরিঞ্জ ধরা হাতটা এসে গেছে শহীদের ডান বাহুর কাছে। সূচের মাথাটা ওর বাহু থেকে মাত্র আধ ইঞ্চি দূরে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চাইলে শহীদ সেদিকে। পরমুহূর্তে টের পেলো: সূচ ফোঁটানোর ব্যথা। শরীরে ঢুকে যাচ্ছে সিরিঞ্জের ওষুধটা।
একটু ঢিলে হলো ডান হাত চেপে ধরে থাকা মুঠো। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে। সদ্ব্যবহার করল শহীদ মুহূর্তটার। প্রচণ্ড ঝট কায় ছাড়িয়ে নিলে ডান হাত। সিরিঞ্জটা ডাক্তারের হাত থেকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। আর্তনাদ করে উঠে হাত দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরলো প্রথম লোকটা। গল গল করে রক্ত বেরুচ্ছে নাক দিয়ে। প্রচণ্ড জোরে মেরেছে ওর নাকে শহীদ। দ্বিতীয় লোকটা আবার বুদ্দা মারার চেষ্টা করলে শহীদের ঘাড়ে। কিন্তু একটু হের ফের হয়ে গেল সময়ের। শহীদের বাম কনুইটা আগেই গিয়ে লেগেছে ওর গলায়। শ্বাসনালীর ঠিক মাঝ বরাবর। লাফ দিলো শহীদ সামনের দিকে। পা বাড়িয়ে দিলো তৃতীয় লোকটা। দড়াম করে আছড়ে পড়লো শহীদ মেঝেতে। এসে গেল লোকটা ওর ওপর। শুয়ে শুয়েই ওর হাঁটু বরাবর লাথি চালালো শহীদ। পড়ে গেল সে-ও। কোনমতে আছড়ে পাছড়ে উঠে দৌড় দিলো শহীদ খোলা জানালার দিকে। ওর আগেই জানালার কাছে পৌঁছে গেছে প্রথম আর দ্বিতীয় জন। কাঁধে কাধ দিয়ে পথ রোধ করে দঁাড়ি য়েছে ওরা। মাথা নিচু করে ডাইভ দিলো শহীদ। দুজনকে নিয়েই পড়লো মেঝেতে। ওদের আগেই উঠে পড়লো আবার মেঝে থেকে। জানালার চৌকাঠে উঠে বসেই লাফ দিলে নিচে।
বেমক্কাভাবে পা-দুটো এসে পড়লো ঘাসের ওপর। পিছলে গেল কাফ মাসলে লাথি খাওয়াপা-টা। ভালোবাম পা টা একাধারে রাখতে পারলো না শরীরের ভার। চিত হয়ে পড়ে গেল শহীদ। জ্ঞান হারাবার জোগাড় হলো ওর। কিন্তু জ্ঞান হারালে চলবে না এখন। শুয়ে শুয়েই কয়েকবার মাথা ঝাঁকালো। চাইলে জানা লার দিকে। কেউ নেই। তার মানে নেমে আসছে ওরা সিঁড়ি বেয়ে।
বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। ঘুরছে মাথাটা। চোখে আবছা লাগছে সব। যেটুকু ওষুধ ঢুকেছে তার ক্রিয়া? নাকি ধস্তাধস্তির ফল? খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটলো সে গেটের দিকে। পেছনে দ্রুত এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। ফিরে তাকাবার সময় নেই। গেটের কাছে পৌঁছেই কঁপাকাঁপা হাতে ঠেলা মেরে খুলে ফেললো পাল্লা। থমকে দাঁড়ালো বাইরে পা দিয়েই। ভাবতে চেষ্টা করলো, এ-পথে কাউকে তাড়া করে আনলে ও নিজে হলে কী করতো? সোজা ঢুকে যেতো না শালবনে? সেখানে খোঁজার চেষ্টা করতে তাড়া খাওয়া লোকটাকে। তাহলে? ওরাও তাই করবে নিশ্চয়? ওরাও তাই করবে –মনেপ্রাণে কামনা করতে করতে শালবনের দিকে না গিয়ে নিঃশব্দে গেটের কাছে বাইরের দিকের দেয়াল ঘেষে দাঁড়ালো শহীদ। মাতালের মত টলছে। তবু দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলো। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে জ্ঞান হারিয়ে। মনে মনে প্রার্থনা করছে, আর একটু মাত্র অন্তত স্থির থাকতে পারে যেন।
দুপদাপ, পা ফেলে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রথম আর দ্বিতীয় জন শুধু। চার-পাঁচ পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে চাইলো একে অন্যের দিকে অন্ধকারেই। পরক্ষণে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ঢুকলো শালবনে।
দুসেকেণ্ড অপেক্ষা করলে শহীদ ওর শালবনে ঢুকে যাওয়ার পর। তারপর দেয়ালের কাছ থেকে নিঃশব্দে সরে এসে, শালবনের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে, পিছু হেঁটে ঢুকে গেল গেটের ভেতর। দেয়া লের কাছ ঘেষে অনেক কষ্টে এগিয়ে গেল কিছুটা। পাতাবাহারের একটা ঘন ঝোঁপ ওর লক্ষ্য। ঝোঁপটা থেকে কয়েক হাত দূরে থাক তেই পুরোপুরি অবশ হয়ে এলো পা। বসে পড়লে শহীদ মাটিতে। হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে পৌঁছলো শেষ পর্যন্ত ঝোঁপটার কাছে। যতটা সম্ভব আড়ালে সরে গেল। জ্ঞান হারালো পরমুহূর্তে।
শালবনে ঘন হলো অন্ধকার। ঝি ঝি পোকাগুলো ডাকতে শুরু করেছে কর্কশ স্বরে। ওদের আওয়াজকে ছাড়িয়ে একবার ডেকে উঠেই চুপ করে গেল একটা নিশাচর পাখি। টিপটিপ জ্বলছে জোনাকির দীপ। ঘুরে ঘুরে পাতাবাহারের ঝোঁপটার কাছেও জ্বলতে লাগলো কয়েকটা জোনাকি।
.
চেহারাটা আবছা দেখতে পেলো শহীদ। পানিভর্তি গ্লাসের এ পাশ থেকে দেখলে ওপাশের চেহারা যেমন দেখা যায়, তেমনি। ঠোঁটদুটো নড়ছে লোকটার। বহুদূর থেকে যেন কথার আওয়াজ আসছে কানে।
হঁ…চেষ্টা করুন…করুন…চেষ্টা করুন…এইভো…এইতো, হয়েছে…না, না, চোখ বুজবেন নাচোখ বুজবেন না……
প্রাণপণে চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করছে শহীদ, কিন্তু পারছে না। তবে আগের চেয়ে পরিষ্কার হয়েছে চোখের সামনের চেহারাটা। কিন্তু ডান হাতের কব্জিতে চাপকেন? ঘাড় ফেরাতে চেষ্টা করলো শহীদ। টন টন করে উঠলো কাঁধের কাছটা। ব্যথা লাগ তেই পরিষ্কার হয়ে এলো মাথার ভেতর। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা লোকটাকে এবারে ভালমতো দেখতে পেলো সে। দুকানে স্টেথো লাগানো। শহীদের হাতের কব্জি ধরে শিরা দেখছেন। ডাক্তার।
জ্ঞান ফিরেছে, ডাক্তার সাহেব? বাম পাশ থেকে প্রশ্ন হলো। গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারলো শহীদ-কামাল। এসে গেছে ও তাহলে।
আবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইতে চেষ্টা করলো শহীদ। সাংঘা তিক ব্যথ। করে উঠলো ঘাড়টা। এ কী? ব্যথা করছে কেন? চট করে সব কথা মনে পড়ে গেল তার। ঘোলাটে চোখঅলা লোকটা রদ্দা মেরেছিল ঘাড়ে।
পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে সহজেই দেখতে পেলো শহীদ। পুলিশের লোক। কাঁধে দারোগার দুই ফুল।
হ্যাঁ, কামালের কথার উত্তর দিলেন ডাক্তার।
কারণ কী অজ্ঞান হবার? দেখে তো মনে হয় যথেষ্ট ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে, আবার জিজ্ঞেস করলো কামাল।
ব্যথাটা দাতে দাঁত চেপে সহ্য করেই কামালের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলে শহীদ।
আ-হ, নড়বেন না, নড়বেন না। বাধা দিলেন ডাক্তার।
বলুন, ডাক্তার সাহেব, কারণ কী ওর অজ্ঞান হবার? আবার জিজ্ঞেস করলো কামাল।
শরীরের ওপর দিয়ে ধকল গেছে সন্দেহ নেই, তবে আসল কারণ সেটা নয়! ভয়ঙ্কর কোনো নেশাজাতীয় ড্রাগ ঢুকেছে শরীরে। প্রচুর পরিমাণ ধূমপান আর ড্রিংকের অভ্যেস থাকলে মৃত্যুর কারণ হতে পারে এই ওষুধ। যতদূর মনে হচ্ছে, হায়োসাইন জাতীয় কিছু।
কথা বলতে বলতেই সঙ্গে করে আনা একটা ছোট শিশি থেকে খানিকটা তরল পদার্থ একটা গ্লাসে ঢেলে শহীদের ঠোঁটের কাছে ধরলেন ডাক্তার, নিন, গিলে ফেলুন তো এটুকু।
শহীদ ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক করতেই ডাক্তার জিনিসটা ঢেলে দিলেন মুখের ভেতর।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলো শহীদ। মহুয়ার কথা মনে পড়লো। দেখবে না জেনেও ভালো করে তাকালে চারশাশে। শালবনে ওকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে মহুয়াকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা, জানে শহীদ। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে এলাম কী করে? পাতাবাহারের ঝোঁপের ভেতর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, মনে আছে।
পাতাবাহারের ঝোপেই গতকাল পাওয়া গেছে আপনাকে।
গতকাল! মানে চব্বিশ ঘণ্টার ওপরে বেঁহুশ হয়ে ছিলাম?
তাই। ফোনকল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এখানে পৌঁছে যায় পুলিশ। এবাড়ি থেকেই কেউ ফোন করেছিল।
কে? কামাল, তুই?
না। আমি তো এই আধ ঘণ্টা হলো এসে পৌঁছেছি। গত কাল আসতে পারিনি। শেষ করে উঠতে পারিনি কাজটা। আর আজ এসেই তো দেখি এই অবস্থা।
কে ফোন করেছিল তাহলে?
আমি, দাদা। এতক্ষণ মাথার কাছেই পঁড়িয়ে ছিল ছাবেদ আলী। ঘুরে শহীদের পাশে এসে দাঁড়ালো এবার সে। মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।
তোমার মাথায় ব্যাণ্ডেজ কেন?
পাকের ঘরে ছিলাম, দাদা। মহুয়াদি ওপরে। কলিংবেল বাজ তেই দেখতে গেলাম, কে আইছে। দরজা খুইলাই দেখি পিস্তল লইয়া দুইজন গুণ্ডামতো লোক খাড়াইয়া রইছে। আমারে দেইখাই ধমক মারলো, খবরদার, চিল্লাইলে মাইরা ফালামু। ধই। একটা ঘরে লইয়া গেল। এর পরেই মাথায় য্যান বাজ পড়লো। হুশ হইলে দেখলাম, পইড়া রইছি। মাথায় অসহ্য বেদনা হাত দিয়া দেখি রক্ত। মাথা ফাইটা গেছে। কোনমতে দোতালায় উইঠা দেখি, কেউ নাই। দারোয়ানরে ডাকলাম। তারও কোনো খবর নাই। শেষে হের ঘরে ঢুইকা দেখি, হাত-পাও বাইনা তারে ফালা ইয়া রাখছে। মুখে প্যালাস্টার। তাড়াতাড়ি হেরে ছুডাইয়া সব কয়ডা ঘর খুজলাম। আপনেগো দুইজনের পাত্তা নাই। শেষে থানায় ফোন করলাম। তানেরা আইসা পাতাবাহারের বোপথিক। আপনেরেখুইজা বাইর করছেন। আঙুল তুলে দারোগাকে দেখিয়ে দিলো ছাবেদ আলী।
দুপা এগিয়ে এলো দারোগা। নিজের পরিচয় দিলো, আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর নেয়ামত হোসেন। তা ঘটনাটা কী ঘটেছিল বলুন তো!
সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করলো শহীদ। চুপচাপ শুনে গেল নেয়ামত হোসেন। শহীদের কথা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, কালই তে এসেছেন চাটগা থেকে?
হ্যাঁ। কেন?
না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। ভাবছিলাম, এতো কিছু থাকতে বোটে আসতে গেলেন কেন?
বোটে এসেছি।
আসেননি নাকি? তাহলে নিশ্চয়ই এখানে একটা বোট আহে আপনার। কোথায় রেখেছেন, জেটিতে?
না তো, আমার কোনো বোট নেই তো এখানে। কিন্তু বোটের কথা বলছেন কেন?
তাহলে ওই চাবিটা এলো কোত্থেকে? এগিয়ে গিয়ে সাম নের টেবিল থেকে একটা চাবি তুলে আনলো নেয়ামত হোসেন। শহীদকে দেখিয়ে বললো, ইয়ানমার বোট-ইঞ্জিনের চাবি। মেঝেতে পড়ে ছিল। আপনার হবে ভেবে তুলে রেখেছি।
তড়াক করে বিছানার ওপর উঠে বসল। শহীদ। শরীরের ব্যথার কথা ভুলেই গেল। হাত বাড়ালে, দখি চারটা।
শহীদের আগ্রহ দেখে বিস্মিত হলো ইস্পক্টর। কিন্তু চাবিটা বাড়িয়ে ধরলো ওর দিকে। হেঁ মেরে নেয়ামত হোসেনের হাত থেকে চাবিটা নিলে শহীদ। দেখলো। ঠিকই বলেছে ইন্সপেক্টর। ইয়ানমার বোট ইঞ্জিনের চাবিই।
নেয়ামত হোসেনের দিকে ফিরলো শহীদ, এখুনি খোঁজ নিন তে, গতরাতে কোনো প্রাইভেট বোট ঘাট ছেড়েছে কিনা আর ওটার ইঞ্জিন ইয়ানমার ইঞ্জিন ছিল কিনা। জেটির লোকদের জানার কথা। যদি তেমন কোনো বোট ঘাট ছেড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে যাত্রীদের বর্ণনাও চাইবেন।
শহীদের চোখের দিকে চেয়ে এক সেকেণ্ড কী যেন ভাবলো নেয়ামত হোসেন। তারপর একটিও কথা না বলে পাশের ঘরে গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করলো। ঠিক সাত মিনিট পর ফিরে এসে জানালো, মাত্র একটাই বোট ঘাট ছেড়েছে কাল রাত দশটা নাগাদ। মাঝারি আকারের বোট। ইয়ানমার ইঞ্জিন। বোটট। চেনে জেটির লোকেরা। কোনো এক বিরাট বড়লোকের নাকি। হাঙরের ভয়ে ওটা ছাড়া আর কোনো বোটই ঘাট ছাড়েনি গতরাতে। একজন অসুস্থ মহিলাকে নিয়ে মোট চারজন লোক উঠেছে বোটে।
তিন সেকেণ্ড চুপ করে রইলো শহীদ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, বুঝতে পেরেছি, মহুয়াকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দারোগা সাহেব, আপনার সাহায্য দরকার আমার। ডাক্তারের দিকে চাইলো ও। ডাক্তার, যদি কিছু মনে না করেন
না, না, মনে করার কী আছে। আমি ও-ঘরে গিয়ে বসছি, বলে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার।
ছাবেদ আলীকেও ঘর থেকে বের করে দিলো শহীদ। প্রয়ো জনীয় নির্দেশ দিতে লাগলো ইন্সপেক্টর আর কামালকে।
.
০৫.
গাঙচিল। ঝকঝকে নতুন একটা ফিশিং বোট। ফুট বিশেক হবে লম্বায়। ছোট্ট সেলুন। মসৃণ পালিশ করা মেঝে আর কাঠের দেয়াল। জানালাগুলোয় নীল পর্দা। ছোট ছোট তিনটে কেবিন। প্রতিটি কেবিনে দুটো করে বাংক। এটাকে ফিশিং বোট না বলে বরং প্রমোদতরী বললেই বেশি মানাবে। মাছ ধরার জন্যে এ-ধরনের বোট ব্যবহার করতে সাধারণত দেখা যায় না কোথাও। তবে হ্যাঁ, সৌখিন মৎস্যশিকারীদের কথা আলাদা।
তিনটে কেবিনের একটায় ঢুকলে শহীদ। ঘরের চারদিকটায় একনজর চোখ বুলিয়েই সোজ। টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক বাক্স অ্যামুনিশনসহ ৯ মি. মি. একটা বেরেটা এম. থারটি ফোর মেশিন-গান সুন্দর করে অয়েল-পেপার দিয়ে মুড়ে রাখা গাছে টেবিলের ওপর। ওটার একপাশে রাখা চারটে হাই এনার্জি মিলস গ্রেনেড। আর আছে একটা শর্ট ম্যাগাজিন লী-এনফিল্ড ব্রিটিশ রাইফেল। মোট ষাট রাউণ্ডের পাঁচটা ক্লিপও আছে সঙ্গে। দেখে একটু অবাকই হলো শহীদ। পুলিশ বিভাগে সাধারণত এই জিনিসের ব্যবহার নেই। ব্যক্তিগত ব্যব হারের জন্যেই কেনে লোকে। নিচের দিকে তাকালো শহীদ। টেবিলের নিচে রাখা নতুন একটা স্কিন-ডাইভ গিয়ার। খুশি হলে ও জিনিসটা দেখে।
হাত বাড়িয়ে রাইফেলটা তুলে নিলো। কেবিনের নরম আলোয় ঝিকিয়ে উঠলো যত্ন করে তেল লাগানো রাইফেলের নীলচে নল। কাঁধে তুলে নিশানা করলো বাতির দিকে। একচুল এদিক ওদিক হলো না রাইফেলের ভি-এণ্ড-ব্লেড সাইট।
আন্তরিক প্রশংসা করলে শহীদ, দারুণ জিনিস দিয়েছে তে। নেয়ামত হোসেন।
ইন্সপেক্টর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রগুলো সাপ্লাই করেছে। রাই ফেলটা আর ওই ডাইভিং গিয়ার হায়দার শেখের, বললো কামাল। হাঙর শিকার করতে নাকি কিনেছে সে রাইফেলটা। ডাইভিংয়েও শখ আছে লোকটার।
চোখ তুলে চাইলে শহীদ, সত্যিই লোকটার রুচির প্রশংসা করে পারছি না। দারুণ সৌখিন তো।
তাই। এবং অদ্ভুত চরিত্রের। মাত্র চার পাঁচ দিন আগে হাঙরটাকে মারার জন্যে কোত্থেকে এসে উদয় হয়েছে। তাকে এর আগে কখনো কক্সবাজারে দেখা যায়নি। বোটটাকেও না। আর সাহস বটে লোকটার। এতো রাতে আর কেউ দুর সাগরে বেরোতে রাজি হয়নি, হাঙরের ভয়ে। এরই মধ্যে নাকি দুতিনটে বোট ধ্বংস করে দিয়েছে দানবটা। কিন্তু আশ্চর্য! এই লোকটা যেন তৈরি হয়েই ছিল। বলতেই রাজি হয়ে গেল। অবশ্য বোটের জন্যে যে ভাড়া দেয়া হচ্ছে সেটা বেশ লোভনীয়।
চল, দেখা করে আসি ওর সঙ্গে, বললো শহীদ।
চল। কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল দুজনেই।
শক্ত হাতে হুইল ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে হায়দার শেখ। লম্বায় ছফুটের বেশি। পেশীবহুল বিরাট শরীর। বয়েস সম্ভবত পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গেছে।
চাঁদের ভৌতিক আলো ছড়িয়ে পড়েছে সাগরের পানিতে। অখণ্ড নীরবতার মাঝে শক্তিশালী ইঞ্জিনের চাপা গুম গুম শব্দটা একটু বেশিই যেন কানে বাজছে।
দুজন লোকের উপস্থিতি টের পেয়েও ফিরে তাকালো না হায়দার শেখ।
কোন্ দ্বীপটায় যাবেন? শহীদ আর কামালের দিকে পেছন ফিরেই সরাসরি কাজের কথায় এলো সে।
নীলদ্বীপ, জানালো শহীদ।
কিন্তু ওখানে কী কাজ? বিশাল একটা পাথরের টিলা ছাড়া আর কিছুই নয় ওটা। পাখি ছাড়া কোনো জীবন্ত প্রাণীর বাস নেই। জেলেরা পর্যন্ত বোট ভেড়াতে সাহস করে না দ্বীপের গায়ে। ওটার উপকূলে আছড়ে পড়ছে সাগর, সারাক্ষণই ফুঁসছে। তিন মিনিটেই ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে এটার দ্বিগুণ আকারের একটা বোটকে। কোনমতেই দ্বীপটার গায়ে ভেড়ানো যাবে না গাঙচিলকে।
তার দরকার হবে না। সাঁতরে গিয়ে তীরে উঠবে। কোনো না কোনো পথ পাবোই দ্বীপে ওঠার, বললো শহীদ। ভেবেছিল তার কথায় অবাক হবে হায়দার শেখ। কিন্তু না, বিন্দু মাত্র অবাক হয়নি সে। যেন আগে থেকেই জানে, কোন্ দ্বীপে কী করে উঠতে যাচ্ছে শহীদ।
কিন্তু পৌঁছুতে পারবেন তো দ্বীপ পর্যন্ত? বলে উঠলে হায়দার শেখ, শয়ে শয়ে হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বীপটাকে বেড় দিয়ে। পানিতে নামার দশ মিনিটের মধ্যেই ছিঁড়েখুড়ে খেয়ে নেবে। তার ওপর কক্সবাজারের মানুষখেকোটারও ওখানে হাজির হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।
শার্ক-রিপেলেন্ট গায়ে মেখে নিলেই হবে। আছে নিশ্চয়ই আপনার বোটে?
তা আছে, মাথা ঝাঁকালে শেখ। কিন্তু রিপেলেন্টের বাধ? কদ্দর মানবে হাঙর, কে জানে।
আচ্ছা, কাছে থেকে কখনো দেখেছেন দ্বীপটাকে? জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
দেখেছি। কিন্তু কাছে বোট ভেড়াতে পারিনি। হাঙর গুলোকে ফাঁকি দিতে পারলে দ্বীপে উঠে যেতে পারবেন। একটা পথ দেখেছি আমি দিন দুয়েক আগে। দ্বীপটার উত্তরে, একটা ফাটল। জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারবে আপনাকে।…কিন্তু কী হবে ওখানে গিয়ে? এতো অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই বা কী করবেন?
সেটা আপনার না জানলেও চলবে। একটু গম্ভীর হলো শহীদ।
এতক্ষণে এই প্রথম বারের জন্যে ফিরে চাইলো হায়দার শেখ স্থির দৃষ্টিতে একমুহূর্ত চেয়ে রইলো শহীদের চোখে চোখে। হাসলে নিঃশব্দে, হুইল হাউসের মৃদু আলোয় ঝিকিয়ে উঠলো সুন্দর শাদা দাঁত। তারপরেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। বললো, মাফ করবেন। কৌতূহল আর কি…
মুচকে হাসলো এবার শহীদও। বললো, ঠিক আছে, শোনার যখন এতই আগ্রহ, শুনুন তবে।
তিন তিনটে জাহাজডুবির কথা থেকে শুরু করে মহুয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কথা একে একে বলে গেল শহীদ। একজন সদ্য পরিচিত লোকের কাছে এতো কথা বলাটা কামালের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। পোর্টহোল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো সে।
একটিও কথা না বলে চুপচাপ শুনে গেল হায়দার শেখ। শহীদের কথা শেষ হতেও অনেকক্ষণ কিছু বললো না। হাসি হাসি ভাবটা মুছে গেছে তার মুখ থেকে। তার বদলে ফুটে উঠেছে কাঠিন্য। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ওই দ্বীপটাই, জানলেন কী করে?
দুচার বছরের পুরোনো ম্যাপে আছে দ্বীপটার নির্দেশ?
না, নেই, এদিক ওদিক মাথা নাড়লো শেখ। এতই নগণ্য দ্বীপটা, ওটার নাম ম্যাপে উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেনি সার্ভেয়াররা। দুর থেকে নীলচে দেখায় বলে স্থানীয় জেলেরা নাম রেখেছিল নীলদ্বীপ। কিন্তু এখন আর ওই নামে কেউ ডাকে না ওটাকে। বলে শয়তানের দ্বীপ। সারারাতই নাকি ওখানে ভূতেদের জলসা চলে।
সন্দেহ নেই, ঐ দ্বীপটারই ছবি দেখেছি আমি, বললো শহীদ। যদ্দর জানি, কাছে-পিঠে ওরকম পাথুরে দ্বীপ ওটা ছাড়া আর নেই।
না, নেই।
কি যেন একটু ভাবলো শহীদ। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, লোকবসতিহীন আর কোনো দ্বীপ আছে নীলদ্বীপের খুব কাছাকাছি?
আছে। কেন? শহীদের দিকে ফিরে চাইলো শেখ।
কতদূরে?
মাইল দুয়েক হবে। পুরোনো দ্বীপ। নারকেলগাছ আর ঝোঁপঝাড়ে ঠাসা। খুব ছোট্ট দ্বীপ।
ওখানেই নামিয়ে দিতে হবে আমাকে।
কেন, নীলদ্বীপে যাবেন না?
যাবো। তবে গাঙচিলে করে নয়। দ্বীপের খুব কাছাকাছি বোটটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে সাবধান হয়ে যেতে পারে ওরা। ভীষণ বিপদে পড়বে। তাহলে।
তো দুমাইল পেরিয়ে কী করে পৌঁছু… বলতে গিয়েই শহীদের মতলব বুঝতে পেরে হঠাৎ থেমে গেল শেখ, তার মানে, দুমাইল দূরের দ্বীপ থেকে সরে যেতে চান গন্তব্যস্থলে?
এছাড়া আর উপায় কী?
বোকামি হবে। ভীষণ বোকামি হবে।
যা হবার হবে, মনস্থির করে ফেলেছি আমি। লম্বা হাই তুললো শহীদ। কামালের দিকে ফিরে বললো, ওফ, ভীষণ ঘুম পেয়েছে। যা। হ্যাঁ, সময়মতো কিন্তু আমাকে জাগিয়ে দিবি, কামাল।
হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এলো শহীদ। কামাল বসে থাকলে ওখানেই। সোজা কেবিনের দিকে চললল শহীদ।
দশ নট গতিতে চলছে এখন গাঙচিল। এই গতিতে চলতে থাকলে ভোর হবার আগেই পৌঁছে যাওয়া যাবে নিদিষ্ট জায়গায়।
নিজের জন্যে নির্দিষ্ট বাংকে শুয়ে পড়লে শহীদ। মহুয়ার জন্যে সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা হচ্ছে। হাজারো ভাবনার মাঝেই খুনে শ্বেত হাঙরটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। অতিকায় দানবটা এই এলাকায় এলো কোত্থেকে? ছোটখাটো হলেও তবু কথা ছিল। সাঁতরে যাওয়ার পথে যদি এসে হাজির হয়ে যায় ওটা? রীতিমতো ভয়ই পাচ্ছে শহীদ। কিন্তু যেতেই হবে ওকে। কেমন আছে মহুয়া…ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো শহীদ একসময়।
কাঁধের ওপর হাতের মৃদু চাপ পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কামাল। ওঠ, শহীদ। এসে গেছে দ্বীপটা।
.
০৬.
কানের কাছে চেঁচামেচি শুনে দ্বিতীয়বার ঘুম ভেঙে গেলশহীদের। চোখ মেলে হাই তুললো লম্বা করে। রোদ এসে পড়েছে মুখে। চোখের সামনে ঘড়িটা এনে সময় দেখলে। সকাল আটটা বাজে প্রায়। ওকে নড়তে-চড়তে দেখেই মাথার দুহাত দুর থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল দুটো গাঙশালিক। প্রচণ্ড ঝগড়া বাধিয়ে ছিলো দুটোতে। ওদের ঝগড়ার শব্দেই ঘুম ভেঙেছে ওর। হেসে ফেললো শহীদ। গাঙশালিক ওর দারুণ ভালো লাগে। মনে পড়ে গেল, ছেলেবেলায় নদীর চরায় হাঁটতে হাঁটতে গাঙশালি কের ঝগড়া দেখলেই থেমে দাঁড়িয়ে দেখতে। আসলে ওদের ঝগড়ার পদ্ধতিটা বড় মজার। প্রতিপক্ষকে নিচে ফেলে দেবার সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। আর সেই সাথে তারস্বরে একটানা চেঁচামেচি।
ভোর সাড়ে চারটের একটু পরে এখানে নামিয়ে দিয়ে গিয়ে ছিল ওকে হায়দার শেখ। দ্বীপের একটু ভেতরে ঢুকে পছন্দসই একটা জায়গা বেছে নিয়ে ও শুয়ে পড়েছিল। আর একবার আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো শহীদ। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খেলো এককাপ। চা শেষ করে খাবারের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালো।
খেয়ে-দেয়ে সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। ঘুরে– ফিরে দেখবেদ্বীপটাকে। ছোট্ট দ্বীপ। লম্বায় আধমাইলের মতো হবে। চওড়ায় সিকি মাইলের কিছু বেশি হতে পারে। চারদিক ঘিরে অজস্র নারকেলগাছ। কঁদি কাঁদি ডাব-নারকেল ঝুলে আছে গাছে। মাছধরা বোটের লোকেরা মাঝে-মধ্যে কিছু পেড়ে খায়। নারকেল ব্যাপারীরা খবর পেলে বোট ভাড়া করে এসে দ্বীপের সব গাছ খালি করে দিয়ে যাবে।
আর আছে পাখি। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ। নানা রঙের, নানা আকারের। স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে দ্বীপটাকে পাখির দল।
কচি ঘাসের ডগার শিশিরবিন্দু শুকিয়ে যায়নি এখনো সব। রোদ পড়ে ঝিলমিল করছে গলাননা স্বর্ণ বিন্দুর মতো। হঠাৎ বসে পড়লো শহীদ। ঝুঁকে পড়ে একান্ত কৌতূহলের সঙ্গে দেখতে থাকলে নিভৃত এক সৌন্দর্য। মেটে মাকড়সার দল জাল বানি য়েছে মাটিতে। শিশির পড়ে ভিজে গেছে জালগুলো। তার ওপর রোদ পড়ে এমন বিচিত্র বর্ণালীর সৃষ্টি করেছে, দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল শহীদ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো আলতো করে। আঙুলের ছোঁয়া লেগে জাল থেকে ঝরে গেল শিশিরকণা। মুছে গেল রঙের সমারোহ। মাটির গর্তে বসে শিকারের জন্যে অপেক্ষা করছিল মাকড়সা। জালে আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই শিকার পড়েছে ভেবে সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো সে গর্ত ছেড়ে। চৌকো, লম্বাটে, শ্যাওলার মতো সবুজ শরীর।
মজা পেয়ে গেল শহীদ। আশপাশে আরো অনেক জাল ছড়িয়ে আছে। খেলতে শুরু করলো সে মাকড়সাগুলোর সাথে শিশুর মতো। ছোট ছোট মাটির কণা তুলে আস্তে করে ছুঁড়ে দিতে থাকলো জালগুলোর ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বেরোতে থাকলো মাকড়সার দল। হা হা করে গলা ফাটিয়ে হাসলে শহীদ। ভুলেই গেল, ভয়ঙ্কর এক কাজে এসেছে ও। ভুলে গেল, ভীষণ বিপদে আছে মহুয়া। মাথার ওপর ছোট্ট একটা গাছের ডালে বসে শহীদের কাজকারবার দেখছিল একটা নীল-শাদা মাছরাঙা। ওর হাসির শব্দে চমকে উঠলো পাখিটা। কির-রিক ডাক ছেড়ে উড়ে পালালো। মুখ তুলে শহীদও চাইলো পাখিটার দিকে। উড়ে যাচ্ছে ওটা সাগরের ওপর দিয়ে। যাচ্ছেই, থামছে না। চেয়ে থাকতে থাকতে উদাস হয়ে গেল শহীদের মনটা। উঠে পড়লো ও। আগের জায়গায় পৌঁছে শুয়ে পড়লে চিত হয়ে। সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকলো। আলোকোজ্জ্বল নীল আকাশে শাদ। মেঘের দল ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে কোথায় কার দুত হয়ে কে জানে। চোখ আর মন ভরে যায় ওর ওসব দেখলে। একটানা চেয়ে থাকার ফলে ঘুম আসছে আবার চোখ জুড়ে। আসুক। চোখ মুদলে শহীদ। চারটে বাজতে অনেক দেরি এখনও।
.
তিনটের একটু আগে ঘুম থেকে জাগলো শহীদ। হাতঘড়িটার দিকে একবার চেয়েই উঠে পড়লে লাফ মেরে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নেয়া দরকার কিছু। রওনা দেবার সময় হয়ে গেছে প্রায়। আরো আগেই রওনা দিতে পারতো। কিন্তু ওর ইচ্ছে সন্ধ্যে হবার একটু আগে দ্বীপটায় পৌঁছে রাতের জন্যে অপেক্ষা করা। অন্ধকারে শত্রুপক্ষের চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম।
সাগরের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে উঠে আসতে যাবে, এমন সময় ওর চোখে পড়লো ব্যাপারটা। বিরাট একটা প্রাণী পানি তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে প্রায় শপাঁচেক গজ দুরে। পিঠের দাঁড়া দেখে নিঃসন্দেহ হলো শহীদ। হাঙর। খারাপ হয়ে গেল মনটা। দানবটার চোখ এড়িয়ে যাবে কী করে? চিন্তিতভাবে ফিরে এলো ও। সকালে খাবার পর যেটুকু খাবার অবশিষ্ট ছিল খেয়ে নিলো।
খাওয়া শেষ করে ধরালো অবশিষ্ট একমাত্র সিগারেটটা। তারপর তৈরি হতে শুরু করলো। প্রথমেই পরে নিলো স্কুবা সুট। পানির নিচে পিস্তল নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজের পিস্তলটা সেজন্যে কামালের কাছেই রেখে এসেছে। ফ্লিপারদুটো লাগালে পায়ে। শার্ক-রিপেলেন্টের পুরো বোতলটা শেষ করলো গায়ে ঢেলে। স্কুবা-সুটের যেখানটায় লাগেনি হাত দিয়ে ঘষে লাগিয়ে দিলো। শেষবারের মত ভাবলে, হায়দার শেখের দেয়া রেডিও ট্রান্সমিটারটা সঙ্গে নেবে কিনা। নিতে চায়নি শহীদ, তবু ভোররাতে গাঙচিল থেকে নামার সময় জোর করে গুছিয়ে দিয়েছে জিনিসটা শেখ। ম্যাচবাক্সের চার ভাগের এক ভাগের সমান হবে যন্ত্রটা। দেখতে ম্যাচবাক্সের মতই। যন্ত্রটার একপিঠের ঠিক মাঝখানে ক্ষুদে লাল একটা সুইচ। সুইচটায় সামান্য একটু চাপ দিলেই মৃদু বিপ বিপ শোনা যাবে রিসিভারে। ট্রান্সমিটারটার সঙ্কেত পাঠাবার সর্বোচ্চ দূরত্ব দশ মাইল। বার বার করে বলে দিয়েছে শেখ, বিপদে পড়লে কিংবা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়লে যেন সঙ্গে সঙ্গে টিপে দেয় শহীদ সুইচটা নীলদ্বীপের দশ মাই লের মধ্যেই মাছ ধরার ছুতো করে ঘুরে বেড়াবে ওরা। শেষ পর্যন্ত কি ভেবে ট্রান্সমিটারটা নিয়েই নিলো শহীদ। স্কুবা-সুটের পকেটে। মাস্কটা হাতে নিয়ে চলে এলো দ্বীপটার দক্ষিণ প্রান্তে, পানির ধারে। এ-দ্বীপটা থেকে নাক বরাবর সোজা দক্ষিণে নীল দ্বীপ। হায়দার শেখের কথা ঠিক হলে এ-দ্বীপের দিকেই মুখ করে আছে ফাটলটা। মাস্কটা পরে নিয়ে আস্তে আস্তে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে ডুব দিলো শহীদ পানিতে। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল গভীর পানিতে। বেশি গভীরে না নেমে ছ ফুট নিচ দিয়ে চলতে শুরু করলো।
অদ্ভুত একটা একাকীত্বের আনন্দ অনুভব করছে শহীদ। চারপাশে অখণ্ড নীরবতা। জুন মাস। সন্ধ্যা হতে দেরি আছে এখনও। বিকেলের পড়ন্ত রোদে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ছফুট নিচের সাগর। আশেপাশের বেশ কিছুদুর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট মাছগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে কাছেই। তার মানে কাছে পিঠে নেই হাঙরের দল।
বাতাসে ভেসে যাওয়া গাঢ় ধোয়ার একটা অংশের মতো শহীদের সামনে দিয়ে ভেসে গেল একটা জেলীফিশ। কয়েকটা নাম না জানা রঙিন মাছ চললে ওর সাথে সাথে। নিশ্চিন্তে প্রায় শপাঁচেক গজ চলে এলো শহীদ। তারপরই ঘটলো ঘটনাটা। বাঘ দেখলে হরিণ যেমন ছুটে পালায়, পাগলের মত দিগবিদিক ছুটতে শুরু করলে হঠাৎ ছোট মাছের দল। এসে গেছে তাহলে! প্রথম দুটোকে দেখলে শহীদ ডানপাশে। মাত্র পাঁচফুট দুরে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। রিপেলেন্টের গন্ধে কাছে এগোচ্ছে না। অবশ্য এগোলেও ক্ষতি নেই। রক্তের গন্ধ না পেলে আক্রমণ করে না এরা মানুষকে। নার্স শার্ক। শহীদের পাশে পাশে এলো ওরা শখানেক গজ। তারপর চলে গেল। কিন্তু ফিরে আসছে না। ছোটমাছের দল। আশেপাশে আরো হাঙর আছে। হয়তো রিপেলেন্টের জন্যেই আসছে না। আরো গজ পঞ্চাশেক এগোনোর পর এলো ওরা। ঝড়ের মতো। কম করে পঁচিশটা হবে। নাস এবং টাইগার। নাক সোজা করে ছুটে আসছে শহীদের দিকে। হয়েছে এবার। রক্তের গন্ধ না পেলে আক্রমণ করবে না নার্স গুলো। কিন্তু গন্ধ পাবে শেষ পর্যন্ত, টাইগারগুলো আক্রমণ করে বসলেই রক্তের গন্ধ পেয়ে যাবে ওরা। এতগুলোর বিরুদ্ধে করার কিছু নেই, তবুও কোমর থেকে ছুরিটা খুলে নিলো শহীদ। যদি মর তেই হয় যে-কটাকে সম্ভব নিয়ে যাবে সাথে।
এসে গেল ওরা। কিন্তু আক্রমণ করলো না। আশপাশ আর নিচ দিয়ে সোজা ছুটে চলে গেল কোনদিকে না চেয়ে! বেশ কিছু লেজের ঝাপটা খেলে শহীদ। মাস্কটা খুলে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায় মুখ থেকে। সামাল দিতে গিয়ে হাত থেকে খসে গেল ছুরিটা। মাথা নিচু করে দ্রুত ডাইভ দিলো শহীদ। নাগালের বাইরে চলে যাবার আগেই ছুরিটা উদ্ধার করলো কোনমতে। চলেই গেল হাঙরগুলো, ফিরলো না আর।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে শহীদ। কিন্তু আধ মিনিট পরই বুঝতে পারলো হাঙরগুলোর পাগলের মতো ছুটে পালাবার কারণ? নিচের দিকে চোখ পড়তে ধক করে উঠলো ওর কলজেটা। থেমে পড়লো সাথে সাথেই। নীলাভ অন্ধকার থেকে ধীর মসৃণ গতিতে উঠে আসছে দানবটা। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে আজরাইল। তার বিশাল পিঠের রঙ কালচে ধূসর। বাকি শরীর মাখনের মতো শাদা। ছায়ার মতো কাছে এসে গেল হাঙরটা। শহীদের মাত্র চারফুট দুরে এখন বিরাট মাথাটা। ব্লেডের মতো ধারালো ত্রিকোণ দাঁতের সারি বের করে শহীদের দিকে চেয়ে হাসছে যেন ওটা। গভীর কালো, ক্রিকেট বলের মতো বিশাল একটা চোখের দিকে তাকালো শহীদ। বুক শুকিয়ে গেল ভয়ে। পরি কার বুঝতে পারলো, মরতে যাচ্ছে ও। কিচ্ছ, করতে পারবে না সামান্য ছুরি দিয়ে, হাঁ করে গিলে নেবে সোজা ওকে দানবটা। মৃত্যু কাছে এসে গেলে নাকি মানুষের অতীত ঘটনা মনে পড়ে যায় সব। কিন্তু শহীদের ধারে-কাছেও এলো না অতীতচিন্তা। বরং হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। ভয়ে বিস্ময়ে অনড় হয়ে রইলো সে। নড়াচড়া করলেই যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে হাঙরটা!
ধীরে, অতি ধীরে শহীদের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করলো দানবটা। স্টেনলেস স্টীলের মতো চকচকে শরীরের জায়গায় জায় গায় ক্ষতচিহ্ন। বহু যুদ্ধের স্বাক্ষর বহন করছে ওগুলো। যেতে যেতে এক সময় হাঙরট। হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। অনুমান করলে শহীদ, চল্লিশ ফুটের মতই হবে। শ্বেত হাঙর। কক্সবাজারের মানুষখেকোটাই বোধহয়। চলতে শুরু করলো আবার ও। আশপাশে একটা প্রাণীও নেই। তার মানে এই এলাকায়ই আছে দানবটা।
হঠাৎ ডানপাশে বারো-তেরো ফুট দুরে শহীদ আবার দেখলো আবছা ভূতের মতো প্রকাণ্ড দানবটাকে। থামলো না ও, তবে গতি কমিয়ে দিলো। রাজকীয় চালে ধীরেসুস্থে সাত ফুটের মতো কাছে এসে ওর সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে শুরু করলো হাঙরটা। কয়েক মিনিট চলার পর যেমন এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই চলে গেল আবার। একটু আশ্চর্য হলো শহীদ। বার বার এসে ফিরে যাচ্ছে! আক্রমণ করছে না কেন? রিপেলেন্টের গন্ধের কারণে?
দশ মিনিট পর আবার এলো ওটা। এবার বাঁ পাশ দিয়ে। শহীদের কাছ থেকে দশ ফুট দূরে থমকে দাঁড়ালো এক মুহূর্ত। তারপর জেট প্লেনেয় মতো ছুটে এলো শ করে। দ্রুত ভেসে ওঠার চেষ্টা করলে শহীদ। কিন্তু তার আগেই এসে পড়লো দানব টা। ছুরিটা বিধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো শহীদ, পারলো না। প্রচণ্ড ধাক্কায় পানি ছেড়ে এক হাত ওপরে উঠে গেল সে। হাত থেকে ছুটে পড়ে গেল ছুরিটা। অনেক চেষ্টায় মাস্কটা চেপে ধরে রাখতে পারলো হাত দিয়ে। পানির ওপর মাথা ভাসিয়ে রেখে দেখলো, চারপাশের জল তোলপাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে হাঙরটা। পিঠের পাখাটার পানি কেটে যাওয়ার হিস্স্ শব্দটাও শোনা যাচ্ছে। মিনিটখানেক ধরে শহীদকে ঘিরে চক্কর দিতে দিতে কাছিয়ে এলো আবার। তারপর ডুব দিলো। প্রায় সাথে সাথেই ভুশ, করে ভেসে উঠলে শহীদকে নিয়ে। তাল সামলাতে না পেরে হাঙরটার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল শহীদ। বারকয়েক এভাবে শহীদকে নিয়ে খেললো হাঙরটা। তাজ্জব বনে গেল শহীদ। স্বপ্ন দেখছে বলে মনে হলো ওর। সাহস ফিরে পেলো কিছুটা। ডুব দিয়ে চলতে শুরু করলে আবার। আশ্চর্য! ও চলতে শুরু করতেই ওর মাত্র তিনফুট দূর দিয়ে সমান গতিতে চলতে থাকলো হাঙরটাও। বারকয়েক থামলে শহীদ। ও থেমে গেলেই হাঙরটাও থেমে যায়। ডলফিন এরকম খেলে মানুষের সাথে, জানে শহীদ। কিন্তু শ্বেত হাঙরেরও এ-ধরনের রসিকতাৰােধ আছে বলে শোেনননি কখনও। কে জানে, শোনেনি বলেই যে ব্যাপারটা সত্যি হবে না, তা তো আর হলপ করে বলা যায় না। ডলফিনও তো হাঙর গোষ্ঠিরই প্রাণী। আর ভয় পাচ্ছে না শহীদ। দ্রুত এগিয়ে চললে ও দ্বীপের দিকে। ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছে নেই হাঙরটার, বোঝা গেছে।
একসময় চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল হাঙরটা। তারও প্রায় মিনিট দশেক পরে ছোট মাছের দলকে ফিরে আসতে দেখলো শহীদ। হাঁপ ছাড়লো। প্রায় পৌঁছে গেছে সে দ্বীপে। প্রবালে ছেয়ে আছে দ্বীপের আশপাশ। বিভিন্ন আকৃতির। আর কী অদ্ভুত রঙ সেগুলোর! কিন্তু অসম্ভব ধারালো প্রবালগুলো। কোনমতে গা বাঁচিয়ে তীরে উঠলো শহীদ।
হায়দার শেখের কথামতো ফাটলটা খুঁজে পেতে খুব বেশি ক্ষণ লাগলো না। এগিয়ে গিয়ে ঢুকে গেল সে ফাটলটায়। নিচের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো। পরিষ্কার জুতোর ছাপ মাটিতে। অত্যন্ত সাবধানে এগোতে শুরু করলো ও। দুধারে পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য ছোটবড় গর্ত। পাথরের স্তূপ।
শব্দটা কানে যেতেই থমকে দাঁড়ালো শহীদ। বোল্ট টানার শব্দ। পরমুহূর্তে চারজন লোক বেরিয়ে এলো ওর সামনের একটা গুহামুখ থেকে। হাতে কারবাইন। পেছনে চাইলো শহীদ। চারজন আছে পেছনেও। একজনের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। একনজর তাকিয়েই চিনতে পারলে তাকে শহীদ খান। ভিলায় যে-চার জনের হাত এড়িয়ে পালিয়েছিল ও, লোকটা তাদেরই একজন। একগাল হাসলো লোকটা। দুচোখের ছোটবড়ো পাতা উঠলো পড়লো। কথা বললো মোটা ফাঁসফেসে গলায়, আসুন, মিস্টার শহীদ খান। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমরা।
শহীদকে নিয়ে ফাটলটার শেষ মাথায় এসে দাঁড়ালো কার বাইনধারীরা। সর্দার গোছের লোকটা এগিয়ে গেল সামনে। উবু হয়ে বসে পাহাড়ের গায়ে লুকোনো একটা গোপন সুইচ টিপে দিলো সে। নিঃশব্দে খুলে গেল চার ফুট বাই দুফুট একটা দরজা। স্টীলের দরজাটার বাইরের দিকটা এমনভাবে পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে যে বাইরে থেকে ওটার অস্তিত্ব বোঝা প্রায় অসম্ভব। একে একে সুড়ঙ্গপথে ঢুকলো ওরা। শেষ লোকটা ঢুকে যেতেই আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ভেতর থেকে খেলে কী করে? চকচকে স্টীলের সুড়ঙ্গ। পনেরো ফুট লম্বা হবে বড়জোর। তার পরই আরেকটা দরজা পেরিয়ে শুরু হয়েছে একটা প্যাসেজ। দুপাশে সারি সারি ঘর। উজ্জ্বল নিয়ন আলোয় আলোকিত কামরাগুলো। প্যাসেজের দুপাশের দেয়ালে মাইক্রোফোন বসানো। মৃদু ঝির ঝিরে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে কাছেই কোত্থেকে যেন। জেনারেটর, বুঝলে শহীদ। করিডোরে এসেই টের পেলো সে, পুরো এয়ারকণ্ডিশান, এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড বসতি। একটা বিশাল ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলো শহীদ, বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি নিয়ে বেশ কিছু লোক কাজ করছে ভেতরে। ল্যাবরেটরি। ল্যাবরেটরিটা পেরিয়েই একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। দরজার পাশে লাগানো মাউথপিসে মুখ রেখে বললো সর্দার গোছের লোকটা, মিস্টার শহীদ খান, স্যার।
ভেতরে নিয়ে এসো, মাথার ওপরের মাইক্রোফোনটায় গম্ গম্ করে উঠলো একটা ভারি গলার স্বর। পরক্ষণে অদ্ভুত একটা আওয়াজ তুলে দুভাগ হয়ে খুলে গেল দরজাটা।
ভেতরে পা রাখলো ওরা। ঘর না বলে কক্ষটাকে কোনো ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র বলাই ভালো। বিশাল টেলিভিশনের পর্দা, নানারকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস্, রাডারের পর্দা এসবে গিজগিজ করছে তিন দিকের দেয়াল। বিরাট একটা কন্ট্রোল প্যানেলের রাশি রাশি সুইচের সামনে দরজার দিকে পেছন ফিরে চেয়ারে বসে আছে একজন লোক। তার কাছ থেকে একটু দূরে বসে আছে একটা মেয়ে। ফিরে তাকালো মেয়েটা। স্থিরদৃষ্টিতে শহীদের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
ধীরে ধীরে রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে শহীদের দিকে ফিরলো কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসা লোকটা। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো শহীদ। পারভেজ ইমাম! জেনেটিকসের জনক ডঃ ম্যানফ্রেড শেলবুর্গের সুপারম্যান বেবী! কিন্তু ও তো মারা গিয়েছিল অনেকদিন আগে, নিজেরই সৃষ্ট দানবের হাতে! সামনে বসা লোকটা কি তাহলে তারই প্রেতাত্মা?
.
০৭.
ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে শ্রান্ত রাজহংসীর মতো চুপচাপ পানিতে ভেসে রয়েছে গাঙচিল। এখান থেকে মাইল পাঁচেক উত্তরে নীলদ্বীপ। বিকেলের পড়ন্ত রোদ তির্যকভাবে এসে পড়েছে সাগরের বুকে। হাতে একতাল মাখানো ময়দা নিয়ে রেলিং য়ের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পানিতে হুটোপুটি খাওয়া ছোট ছোট মাছগুলোকে দেখছে কামাল। হাতের মাখানো ময়দার তাল থেকে ছোট ঘোট অংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে পানিতে, অমনি খাবার জন্যে হুটোপুটি শুরু করছে মাছের দল। ভোরে শহীদকে জনশূন্য দ্বীপটায় নামিয়ে দেবার পর থেকে নীলদ্বীপকে কেন্দ্র করে সাত-আট মাইল দুর দিয়ে চক্কর মেরেছে আর হাঙরটাকে খোঁজার ভান করেছে গাঙচিল। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে এখানটায় পৌঁছে শহীদের কাছ থেকে রেডিও ট্রান্সমিটারের সংকেত পাবার অপে ক্ষায় আছে ওরা। ছোট এক টুকরো ময়দা ছিঁড়ে আঙুল দিয়ে টিপে টিপে গোল করার চেষ্টা করলে কামাল। একটু আগে ছুঁড়ে দেয়া ময়দাটুকু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে নিয়ে এখন এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আরো খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছে মাছগুলো। আঙুলে টেপা ময়দা ছুঁড়ে দিতে যাবে কামাল, এমন সময় হুইলহাউসের ভেতর থেকে ভেসে এলো হায়দার শেখের চিৎকার, কামাল, জলদি এসো! এরই মধ্যে আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে ওরা। হাতের সবটুকু ময়দা পানিতে ছুঁড়ে দিয়ে ছুটলো কামাল। হুইলহাউসের দরজায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো, কী হলো, চেঁচাচ্ছো কেন.. আচমকা থেমে গেল সে। হুইলহাউসের ছোট্ট তেপায়ার ওপর রাখা রেডিও সিগন্যাল রিসিভারটা একটানা বিপ বিপ আওয়াজ করে চলেছে।
এক্ষুনি এই মুহূর্তে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে বলে, শেখ! তীক্ষ্ণ স্বরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো কামাল।
বিন্দুমাত্র দেরি না করে ইঞ্জিন চালু করার সিগন্যাল পাঠালো শেখ ইঞ্জিন রূমে। তারপর হুইল চেপে ধরলো শক্ত হাতে। বোটর নাক ঘোরালো উত্তরে।
মুহূর্তের জন্যেও থামছে না রিসিভারের বিপ বিপ। যতই এগোচ্ছে গাঙচিল, ততই জোরালো হচ্ছে শব্দটা। অধীরভাবে অপেক্ষা করে আছে কামাল, শব্দের উৎসের কাছাকাছি কখন পৌঁছবে বোট।
শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তীরবেগে ছুটতে ছুটতে নীলদ্বীপ আর বসতিহীন দ্বীপটার মাঝামাঝি এসে পৌঁছলো ওরা। কিন্তু আশ্চর্য! পানির নিচ থেকে সঙ্কেতটা আসছে বলে মনে হলো ওদের কাছে। জায়গাটা থেকে বোট সরিয়ে নিলেই কমে যায় আওয়াজটা। আবার কাছাকাছি এলেই বেড়ে যায়। দুশ্চিন্তার ছায়া পড়লো কামালের মুখে, পানির নিচ থেকেই আসছে শব্দটা, শেখ।
আমারও তাই মনে হয়। আর একটা জিনিস খেয়াল করেছে। আমরা আগুপিছু করলেই শব্দের মাত্রা কম-বেশি হয়, স্থির থাকলে শব্দটা একই রকম থাকে। কেন? নিশ্চয় এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে শব্দ প্রেরণকারী যন্ত্রটা। চিন্তিত দেখাচ্ছে শেখকে।
কিন্তু পানির নিচে থাকবে কেন ট্রান্সমিটারটা? বললো কামাল।
হয়তো কোনভাবে ফসকে পড়ে গেছে পানিতে
ফসকে পড়ে গেলে তো চালু হবার কথা নয় যন্ত্রটা। আমার কী মনে হয় জানো? আক্রান্ত হয়েছিল শহীদ। বিপদের কথাটা আমাদেরকে জানানোর উদ্দেশ্যেই ট্রান্সমিটারের সুইচ টিপে দিয়ে ছিল। হাঙরটা ওকে শেষ করে ফেলার পর চালু অবস্থায়ই পানিতে পড়ে আছে যন্ত্রটা।
হতে পারে। কিন্তু কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার, কামাল! অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা দোলানো শেখ।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ শেখের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কামাল। কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমি যাবো দ্বীপটায়, শেখ। গাঙচিলের নেভিগেশন্যাল ইন্সট্রুমেন্টস, বক্স থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে। হুইলহাউস থেকে বেরিয়ে যাবে, খপ করে ওর হাত চেপে ধরলো শেখ। অবাক চোখে ফিরে তাকালো কামাল। শেখ বললো, বাইরে যেও না। নীলদ্বীপকে দেখতে চাও তো? হুইলহাউসের ভেতর থেকেই দেখে কোনভাবে। কে জানে, এ-মুহূর্তে বোটের দিকেই কেউ চেয়ে আছে কিনা ওখান থেকে।
দরজার পাল্লাদুটো সামান্য ফাঁক করে তার ভেতর দিয়ে বাইনোকুলারের শেষ প্রান্তটা ঢুকিয়ে দিলো কামাল। শেখের কথামতো নীলদ্বীপের একমাত্র ফাটলটার দিকে চেয়েই চমকে উঠলো। লাফ দিয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ফাটল টা। ফাটলের মুখ থেকে মাত্র ফুট চারেক ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। হাতে কারবাইন। সোজা চেয়ে আছে যেন সে কামালের দিকেই। আসলে গাঙচিলের হুইলহাউসের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। মনে মনে শেখের বিচারবুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না কামাল। চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে বললো, সত্যিই বলেছো, শেখ, হারামজাদার চোখ রেখেছে বোটের ওপর।
অর্থাৎ, ওই ফাটল দিয়ে ঢোকা যাবে না।
তাহলে অন্য কোনো দিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবো। ঢুকবোই আমি এই দ্বীপটায়। দেখতেই হবে আমাকে, কী আছে ওখানে। অন্ধকার হয়ে এলেই আমাকে দ্বীপটায় নামিয়ে দিয়ে যেও তুমি, শেখ।
বাহ, মনে নেই, কী প্রতিজ্ঞা করেছিলাম গতরাতে? দ্বীপ টার শেষ না দেখা পর্যন্ত যাচ্ছি না। আমিও। দ্বীপে যেতে হলে তুমি একা যাবে না। সাথে আমিও থাকছি।
অযথা তর্ক করার চেষ্টা করলো না কামাল। গত দুদিনের পরিচয়ে বুঝে গেছে সে, একবার যা বলেছে তা থেকে নিরস্ত করা যাবে না হায়দার শেখকে।
নাক ঘুরিয়ে নীলদ্বীপের কাছ থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকলে গাঙচিল। অন্ধকার গাঢ় হলেই ফিরে আসবে আবার।
.
০৮.
হাসলো পারভেজ, খুব অবাক হয়েছে, শহীদ, না? তারপর, আছো কেমন তোমরা? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।
ইশারা করলে পারভেজ। শহীদের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো একজন। বসলো শহীদ, পারভেজের মুখোমুখি।
মিস্টার শহীদের পকেট-টকেটগুলো ভালমতো দেখে নিয়েছো তো? নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে বললে পারভেজ, আগে থেকেই হুশিয়ার থাকা ভালো। কখন কোন জিনিসটাকে ব্যবহার করে পিছলে বেরিয়ে যাবেন উনি, কে জানে!
শহীদকে সার্চ করতে এগিয়ে এলো দুজন। নিখুঁতভাবে কাজ শেষ করলো ওরা। স্কুবা স্যুটের পকেট থেকে ট্রান্সমিটারটা বেরোলো না দেখে অবাক হলো শহীদ। পকেটে নেই, গেল কোথায়? হাঙরটার সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় কোনো ফাঁকে পকেট থেকে পড়ে গেল? তাই হবে হয়তো। থাকলেও অবশ্য লাভ হতো না কোন। এতক্ষণে শত্রুপক্ষের হাতে চলে যেতে জিনিসটা।
ঠিক আছে, তোমরা এবার যেতে পারো, ইব্রাহীম। দরজার বাইরেই থাকবে। দরকার পড়লেই ডাকবো। হাত নেড়ে মেয়ে টাকেও চলে যেতে ইশারা করলো পারভেজ। বেরিয়ে গেল ওরা। দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
জানলে শহীদ, ছোট-বড়ো চোখের পাতা যে লোকটা তার নাম ইব্রাহীম।
তারপর, খবর কী বলে? যেন ঘরোয়া আলাপ করছে, এমনিভাবে প্রশ্ন করলে পারভেজ।
কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি, পারভেজ, তুমি আবার বেঁচে উঠলে কী করে? পুনর্জন্মের ফর্মলাও আছে নাকি ইউজে নিকসে?।
হা-হা করে গলা ফাটিয়ে হাসলো পারভেজ। না, শহীদ, না। আসলে মরিইনি আমি সেদিন।
তাহলে কার লাশ দেখেছিলাম? তোমার সৃষ্ট দানবের দল খুবলে নিয়েছিল লাশের চোখ। আঁচড়ে খামচে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা মুখ দেখে মানুষের বলে চেনার জো ছিল না।
আসলে ওই সুযোগটাই আমি নিয়েছিলাম। ওই লোকটা ছিল আমারই সহকারী। প্রায় একই বয়সের, একই রকম স্বাস্থ্যের। তোমরা যখন আক্রমণ করলে, পালানোর কোনো উপায় না দেখে বুদ্ধিটা বের করেছিলাম। ওর ওপর লেলিয়ে দিয়েছিলাম নীল বানরটা আর একটা কুকুরকে। তারপর লাশের পরনে আমার কাপড় পরিয়ে দিয়ে একটা গুপ্তকক্ষে ঢুকে অপেক্ষা করেছিলাম তোমরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত। বোকা বনলে তোমরা। আমার সহকারীকেই আমি বলে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলে। তারপর সুযোগ বুঝে গুপ্তকক্ষ থেকে বেরিয়ে পালালাম আমি। আবার হাসলো পারভেজ। যাকগে, এখন ওসব কথা থাক। যাত্রাটা কেমন উপভোগ করলে বলো। বিশেষ করে হাঙরটার, আদর-আপ্যায়ন?
তাহলে আমাকে আসতে দেখেছো তুমি? পাল্টা প্রশ্ন করলে শহীদ।
তা দেখেছি। কক্সবাজার থেকে রওনা দেবার পর থেকেই। টেলিভিশন আর অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলো আমার সত্যিই উন্নত। মৃদু হাসলে পারভেজ, তা, বললে না তো, হাঙর টার আতিথ্য কেমন লাগলো?
সত্যি, একটু অদ্ভুতই লেগেছে। ডলফিনেরা মানুষের সঙ্গে অমন ব্যবহার করে জানতাম, কিন্তু হাঙরেও করে, জানা ছিল না।
আসলে কিন্তু করেও না। আমিই এই বিশেষ হাঙরটাকে দিয়ে করিয়েছি কাজটা।
হাঙরটাকে দিয়ে করিয়েছো? কিছুই বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো শহীদ।
হ্যাঁ। কথা শোনে ওটা আমার।
কথা বললো না শহীদ। বোকার মতো পারভেজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
বুঝতে পারলে না? আবার হাসলো পারভেজ। হাসিতে পেয়েছে যেন ওকে আজ। ওটা আমারই সৃষ্টি।
স্তব্ধ হয়ে গেল শহীদ। রক্ত-মাংসের হাঙর বানাতে পারে মানুষ, বিশ্বাস করতে পারছে না কথাটা। বিমূঢ়ের মতো বললো, তোমার সৃষ্টি?
কেন, ভুলে গেলে, পেদ্রোর মোদানবকেও আমিই বানিয়ে ছিলাম? বানিয়েছিলাম ওই নীল বানর আর কুকুর?
কিন্তু ওগুলো তো ঠিক নিজে বানাওনি। ইউজেনিকসের ফর্মুলায় বিশালদেহী করে গড়ে তুলেছে।
মানুষ, বানর আর কুকুরকে বিশালদেহী করে গড়ে তুললে হাঙরকে করা যাবে না কেন?
শ্বেত হাঙরের রহস্য মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল শহীদের কাছে।
একটা কথা হয়তো তুমি জানো, শহীদ, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদেহই কোটি কোটি জীবকোষের সমষ্টি?
মাথা ঝাঁকালে শহীদ। জানে।
বেশ। এই জীবকোষগুলোকে জীবিত রেখে কোনো উপায়ে যদি অস্বাভাবিক বড়ো করে ভোলা যায়, কী অবস্থা দাঁড়াবে তাহলে?
অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে যাবে প্রাণীটা, বললো শহীদ।
ঠিক। অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে যাবে প্রাণীটা। তাহলে ধরে, যদি একটা হোয়াইট শার্কের বাচ্চাকে ধরে ওর জীবকোষগুলোকে বড়ো করে দেয়া যায়?
কিন্তু, ওটা তোমার কথা শোনে কী করে?
অতি সাধারণ ব্যাপার। কী করে চলাফেরা করে প্রাণীরা সাগরতলে? পানির নিচে তো আর ডাঙার মতো শব্দের আদান প্রদান করে ভাব প্রকাশ করা যায় না। কাজটা করে ওরা রাডারের সাহায্যে।
রাডার?
হ্যাঁ, রাডার। পানির নিচের প্রত্যেকটা জীবিত প্রাণীদেহই এক একটা রাডার। পরিষ্কার টের পায় ওরা কোথায় খাবার আছে, কোথায় শত্রু আছে, কোথায় আছে বিপদ। রাডারের কার্য পদ্ধতি তো জানাই আছে তোমার। তবু বলি। ধরো, রাডারের রেঞ্জের ভেতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কোনো আকাশযান। রাডারের পর্দায় যানটাকে পরিষ্কার দেখা যাবে। প্রত্যেকটা জিনিসের নড়া চড়ার কম্পনের তারতম্য আছে। হাঙরটার কথাই ধরো। ওটার কাছ থেকে বিশ গজ দূরে আছে খাবার। ওর খাবারগুলো নড়াচড়া করলে কী ধরনের কম্পন অনুভব করবে জানা আছে ওর। বিশ গজ দুরের খাবারটা নড়াচড়া করলেই ওটার কম্পন ধাক্কা দেবে হাঙরের গায়ে। খাবারের অস্তিত্ব পরিষ্কার বুঝে নেবে হাঙরটার রাডার-দেহ। ছুটবে তখন ও খাবারের উদ্দেশে।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ওর এই রাডারের কম্পন গ্রহণ করার তারতম্য জেনে নিয়েছি আমি। বানিয়ে নিয়েছি একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস। পাঁচশে এমন কি হাজার মাইল দূর থেকেও খবর পাঠাতে পারি আমি হাঙরটার কাছে এই ডিভাইসের সাহায্যে। পরিষ্কার বোঝাতে পারি আমি ওকে আক্রমণ করো, ফিরে এসো এ-ধরনের সমস্ত সংকেত। এবার বুঝেছো, কেন অমন অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল হাঙরটা তোমার সাথে?
হাঙরটাকে লেলিয়ে দিয়েই তো শেষ করে দিতে পারতে আমাকে? এখানে নিয়ে আসার কী দরকার ছিল?
পারতাম। কিন্তু তৃপ্তি পেতাম না। আমার সারা জীবনের সাধনা নষ্ট করে দিয়েছিলে তুমি আর কুয়াশা মিলে। মনে আছে, শহীদ খান? ইউজেনিকসের ফর্মুলা চলে গিয়েছিল কুয়াশার হাতে। অনেক কষ্টে ওর কাছ থেকে আবার উদ্ধার করে এনেছি আমি ওটা, ওরই আস্তানা থেকে। মহুয়া আর তোমাকে ধরে আনতে চেয়েছিলাম শুধু কুয়াশাকে হাতে পাবার জন্যেই। কিন্তু ফসকে বেরিয়ে গেলে তুমি, যদিও আবার আসতে বাধ্য হয়েছে। মহুয়ার কিডন্যাপের খবর পাবেই কুয়াশা, হয়তো ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে। আমি জানি, বোনের আর তোমার খোঁজে আসবেই সে। এবং আমার ফাঁদে পা তাকে দিতেই হবে। দাতে দাঁত চাপলে সুপারম্যান। শোধ তুলবে এবার আমি। প্রথমে তোমার ওপর। অদ্ভুত কায়দায় টর্চার করে করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবব ধৈর্যশক্তি। তারপর ছেড়ে দেবো হাঙর টার মুখে। কথা দিচ্ছি, তোমাকে যাতে একবারেই গিলে না খায় ওটা তার ব্যবস্থা করবো। আস্তে আস্তে এক একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। চোখদুটো অদ্ভুতভাবে জ্বলে উঠলো পারভেজের।
কক্সবাজার বীচে হাঙর দিয়ে তুমিই খুন করিয়েছে। তাহলে লোকগুলোকে?
আসলে ভীতির সঞ্চার করতে চেয়েছি আমি। হাঙরটার দিকেই মনোযোগ আকৃষ্ট রাখতে চেয়েছিলাম তোমাদের। স্বীকার করতে আপত্তি নেই, ব্যর্থ হয়েছি। ব্যর্থ হয়েছি মিস্টার সিম্পসনের জন্যে। এদেশে তিনটে মাত্র লোককেই গ্রাহ্য করি আমি। তুমি, মিস্টার সিম্পসন আর কুয়াশা। তিনজনকেই চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছি। তোমার আর মিস্টার সিম্পসনের ব্যাপারে সফল হলেও, কুয়াশাকে পারিনি।
কী করে চোখে চোখে রাখলে?
কেন, তোমার নতুন ডাইভারটা? সে তো আমারই লোক। আর মিস্টার সিম্পসনের অফিসে তার পি, এ, সাব-ইন্সপেক্টর তরিকও আমারই লোক।
তার মানে আমি মিস্টার সিম্পসনের অনুরোধে কক্সবাজার রওনা দেবার খবরটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেনে গেছো তুমি ওদের মাধ্যমে? ঢাকা থেকে কালো টয়োটার পিছু নেবার রহস্য বুঝলে শহীদ এখন।
ওর কথার কোন উত্তর দিলো না পারভেজ। শুধু হাসলো।
তুমি একটা পিশাচ, পারভেজ, আবার আগের কথায় ফিরে এলো শহীদ, কোন্ কুক্ষণে যে তোমাকে সৃষ্টি করেছিলেন ডঃ শেলবুর্গ। মানুষ কতোবড়ো পিশাচ হলে ওরকম নিষ্ঠুরভাবে হাঙর দিয়ে একটা নিষ্পাপ শিশুকে খুন করাতে পারে। বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠলো ও, তোমাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারা উচিত…
হা হা করে হাসলে পারভেজ। আরে, আসল কথাটা তো বলিইনি এখনো। বীচে তো শুধু এক গর্দভ যুবক, একটা শিশু আর এক বুড়োকে খুন করেছি। এবার কোটি কোটি লোকের জীবন নির্ভর করবে আমার হাতে। হয়তো মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সবাই।
কথা বললো না শহীদ। চেয়ে থাকলো বিমুঢ় চোখে।
হ্যাঁ, অদ্ভুত এক রকেট মিসাইল বানিয়েছি আমি, বলে চললে পারভেজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এডওয়ার্ড রচম্যান নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী তৈরি করেছিল ফমুলাটা। হিটলা রেরই নির্দেশে। জার্মানীর পতনের পর পরই হারিয়ে যায় ওটা। চুরি করা হয়েছিল আসলে। এহাত ওহাত ঘুরতে ঘুরতে বহু বছর পর শেষে আমার হাতে এসে পৌঁছেয় ফমুলাটা। দেখেই বুঝতে পারি, কাজের জিনিস। দেরি না করে কাজে লেগে গেলাম। সবদিক বিবেচনা করে এই দ্বীপটাকেই বেছে নিলাম আমার হেডকোয়ার্টার হিসেবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আমারই মতো কয়েকজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞানীকে নিয়ে এলাম এখানে। মিটিমিটি হাসলো পারভেজ। মাত্র পনেরো দিন আগে সাকসেস ফুল হয়েছি আমরা। বোমাগুলো প্রথমে জাহাজের ওপরই টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। চমৎকার ফল পাওয়া গেল। শুধু তিন নম্বর জাহাজটার বেলায় গোলমাল হয়ে গেল কয়েকজন যাত্রী লাইফবোটে করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করায়। বিশেষ করে ওই মেয়েটার তোলা ছবিগুলো না দেখলে আক্রান্ত হবার আগে টেরও পেতে না তোমরা, কী ঘটতে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। একটু থামলো সে। তারপর বললো আবার, অবশ্য তোমরা কয়েকজন টের পেয়ে গেলেও এখন আর কিছু এসে যাবে না আমার। হ্যাঁ, পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে আমি প্রথমে চমকে দেবো কক্সবাজারটা ধ্বংস করে দিয়ে।
পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে চমকে দিয়ে তোমার লাভ? বললো শহীদ, পাগলামির একটা সীমা থাকা উচিত।
কথাটা যেন শুনতেই পেলো না পারভেজ। অর্ধেকটা পৃথিবী ধ্বংস করে দেবার মতো অস্ত্র বানিয়ে ফেলবো আমি কক্সবাজার ধ্বংস করার আগেই। আর বানাবো হাজার হাজার অতিকায় দানব। সাগরের পানিতে, আকাশে, মাটিতে ছড়িয়ে দেবো আমি ওদের। হাহাকার নেমে আসবে পৃথিবী জুড়ে। বশ্যতা স্বীকার করতে বলবে আমি সবাইকে। যারাই কথা শুনবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত আমার কথা মানতে রাজি হতেই হবে ওদের। পৃথিবীর শাসনকর্তা বলে আমাকে মেনে নেবে। তখন শুধু আমার অধীনে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি থাকবে লোকে। ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনায় উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সুপারম্যান।
বদ্ধ পাগল হয়ে গেছো তুমি, পারভেজ। আগেও অবশ্য মাথার ঠিক ছিল না তোমার। কিন্তু এখন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে।
এবারও শহীদের কথায় কান দিলো না পারভেজ। বলেই চললো সে, সেদিনের দৃশ্যটা তোমাকে দেখাবার জন্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না বলে সত্যিই দুঃখ হচ্ছে। আসলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহস পাচ্ছি না। কোন্ সময় পিছলে বেরিয়ে গিয়ে আবার কোন্ কাণ্ড ঘটাবে কে জানে? আপদ যতো জলদি শেষ করে দেয়া যায়, ততই মঙ্গল।
কিন্তু আমাকে শেষ করে দিলেই কি রক্ষা পেয়ে যাবে? অতো নিশ্চিত হচ্ছো কী করে, তোমার প্রস্তুতি শেষ হবার আগে জানতে পারবে না বাইরের পৃথিবীর লোকে? ভুলে যাচ্ছো কেন, কুয়াশা এখনো তোমার নাগালের বাইরে রয়েছে। যতো ফাঁদই পাতো না কেন, তাকে আটকানো তোমার কম্ম নয়। তাছাড়া রয়েছেন মিস্টার সিম্পসনের মতো পুলিশ অফিসার। তাঁকেই বা আটকাবে কী করে? বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে তোমার এই শয়তানির আড্ডাখানা। কী করে আটকাবে?
সহজ কাজ! তোমাকে আর মহুয়াকে দেখিয়ে। মারবো ঠিকই, কিন্তু আমার প্রয়োজন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতেই হচ্ছে তোমা দের দুজনকে। কিছু করতে চাইলেই টেলিভিশনে তোমাকে আর মহুয়াকে দেখতে পাবে ওরা। কিছুতেই তোমাদের দুজনকে জ্যান্ত বের করে নিয়ে যাবার আগে দ্বীপ ধ্বংস করতে চাইবে না কুয়াশা কিংবা মিস্টার সিম্পসন। আর বড়জোর দশটা দিন সময় পেলেই অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারবো আমি।
ভুল করছো তুমি, পারভেজ। কোটি কোটি লোকের জীব নের হুমকির সামনে আমাদের দুজনের জন্যে চুপ করে বসে থাকবেন না মিস্টার সিম্পসন। এমন কি কুয়াশাও না।
সে তখন দেখা যাবে। ঘড়ি দেখলো পারভেজ, অনেক দেরি করে ফেলেছি। তোমার ওপর ছোটখাটো কিছু কাজ শুরু করা দরকার। কলিং বেলের সুইচ টিপলো সে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো ইব্রাহীম। ওর পিছু পিছু আরো তিনজন। আঙুল তুলে দেখিয়ে পরিচয় করালো পারভেজ, বামের আর মাঝের জনকে তো তুমি চেনোই, শহীদ, শুধু নাম জানো না। জনি আর উইলি। আর ডান পাশের ও হচ্ছে হিম্মত।
কিছু না বলে মুখগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শহীদ।
মিস্টার শহীদকে টচার রূমে নিয়ে যাও, আদেশ দিলে পারভেজ। সাবধান। কক্সবাজারেই টের পেয়েছে, কেমন ভয়ঙ্কর আর নাছোড়বান্দা লোক উনি। যাও।
দুজন দুজন করে শহীদের দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল চারজন। প্রায় গার্ড অব অনার দেবার মতো করে নিয়ে চললো ওকে।
.
০৯.
প্রায় খাড়া উঠে যাওয়া চূড়ার পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে কামাল আর শেখ। নীলদ্বীপের দক্ষিণ পাশ এটা। আধ ঘণ্টা আগেই গাঙচিল থেকে নেমেছে ওরা দ্বীপটা থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে। অস্ত্রশস্ত্রগুলো পলিথিনে মুড়ে একটা বয়ার সাথে বেঁধে নিয়েছে। দুজন মিলে দ্বীপটা পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে এসেছে বয়াটা। বাতাস না থাকায় সাগর শান্ত। খুব একটা অসুবিধে হয়নি ওদের এ-জায় গাটা পর্যন্ত পৌঁছতে। কিন্তু এবার শুরু হবে সত্যিকারের অভি যান। দুর সাগরের দিকে চাইলো কামাল। গাঢ় অন্ধকারে মাঝে মাঝে সাগরের ঢেউয়ের বুকে জ্বলছে ফসফরাসের আলো।
চূড়াটার দিকে মুখ তুলে তাকালে শেখ। ওই ওখানে? কামালের উদ্দেশে বললো সে, ওই চূড়ায় উঠতে হবে? কী মনে করো তুমি আমাকে? মানুষ, না অন্য কিছু?
অন্ধকারে মুখ টিপে হাসলে কামাল। এছাড়া পথ যখন আর নেই, উপায় কী! ফাটলের প্রবেশমুখে হয়তো অস্ত্রধারী গার্ডের সংখ্যা এখন আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
চূড়টার দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলে শেখ। তারপর বলে উঠলো, প্রায় দুশে ফুট হবে চূড়াটার উচ্চতা। আহা-হা, বানর হলে কী উপভোগই না করতাম আরোহণের প্রতিটি ফুট!
হয়েছে। ওঠা যাক এখন, এসো। পুরো না হলেও কিছুটা তো উপভোগ করা যাবেই। আমাদের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষরা বানরই ছিল।
সহজেই উঠে গেল ওরা প্রথমে বিশ ফুট। লী এনফিল্ড রাই ফেলটা পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে কামাল। গ্রেনেডগুলো একটা চটের ব্যাগে ঢুকিয়ে, মেশিনগানটাসহ পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে শেখ? কামাল গ্রেনেডের ব্যাগটা নিজে নিয়ে শেখের বোঝা হালকা করতে চেয়েছিল। ছেলেমানুষ বলে ধমক দিয়ে সোজা হটিয়ে দিয়েছে ওকে শেখ।
বড়ো বড়ো পাথরের ঠাই বেরিয়ে আছে টিলাটা থেকে। ওগুলোকে ধরে ধরে উঠে যাওয়াটা মোটামুটি সহজ। বেশ বড়ো, চ্যাপ্টা একটা পাথরের ওপর এসে পঁাড়ালে ওরা দুজন পাশা পাশি। হাতের টচ টা জ্বেলে ওপর দিকে আলো ফেললে শেখ। দাঁত বের করে মুখ ভেঙচালো, যেন ওদের দিকেই চেয়ে আছে চুড়াটা। ওদের মাথার ওপর চূড়াটা একটু বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। ওখানটায় পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো দুজনের কাছে।
চমৎকার। আঙুল তুলে দেখালে শেখ, দেখছো না, কেমন ঝুলে আছে? দারুণ লাগবে বেয়ে উঠতে। শুধু দাঁত আর নখের কসরত দেখানো। ওই জায়গাটা যদি পেরোতে পারি, ফিরে গিয়ে মাছের ব্যবসা ছেড়ে সার্কাস পার্টি খুলে বসবো।
যতটা মনে হচ্ছে ততটা কঠিন হয়তো হবে না। কামালের কথার সুরে মনে হলো, নিজেও আসলে ততটা সাহস পাচ্ছে না? যদি মনে করে বোট থেকে দড়ি সঙ্গে আনতাম…
ঠিক। দড়ি আনলে এখানেই কোনো পাথরের গায়ে দড়ির একমাথা আটকে দিয়ে গলায় ফাঁস পড়িয়ে ঝুলে পড়া যেতো, আক্ষেপের ভঙ্গিতে বললে শেখ, তাতে সময়, পরিশ্রম দুই-ই বাঁচতে।
চুপ করো, চুপ করো, ওসব অলক্ষুণে কথা বলতে নেই, বলে উঠতে শুরু করলো আবার কামাল। কোনরকমে পায়ের আঙল আর হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠতে হচ্ছে এখন। এভাবে বাইরের দিকে ঝুঁকে না পড়ে যদি শুধু খাড়া উঠে যেতে চূড়াট। তাহলেও অনেক সহজ হতো কাজ। কোনরকমে যদি একবার হাত কিংবা পা ফসকে যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। মাঝপথে কোথাও কোনো অবলম্বন পাবার আশা বৃথা। সোজা একেবারে নিচে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়তে হবে।
পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত উঠে একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে থামলো কামাল। নিচের দিকে চাইলে না একবারও। চাইতে গিয়ে যদি সামান্যতম ভারসাম্যও নষ্ট হয়, তাহলেই শেষ।
কী খবর তোমার, শেখ? ঘঁপাতে হাঁপাতে, শরীরের সামনের দিকটা যদ্দর সম্ভব পাথরের গায়ে সেঁটে রেখে ওপরের তারা-জ্বলা আকাশের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো কামাল।
যা মনে করো তুমি, গম্ভীর উত্তর এলে শেখের কাছ থেকে, এখনও বেঁচে আছি ভেবে আশ্চর্য লাগছে আমার। তোমার কি মনে হয়, সত্যিই এই ভয়ঙ্কর কাজটা করছি আমরা? নাকি এটা নিছক আমার কল্পনা?
এক হাত বাড়িয়ে আরো ওপরের একটা পাথরের খাঁজে আঙুল বাধিয়ে নিজেকে আরো কিছুটা টেনে তুললো কামাল। এখান থেকে একবার পা ফসকে পড়ে গেলেই টের পাবে সত্যি না কল্পনা।
উঠেই চলেছে ওরা। হঠাৎ একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ হলো। মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেল শেখ। সেঁটে রইলো পাথরের সঙ্গে। ঘাড়ের কাছের চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠলো কামালের। ফিরে তাকালে শেখের দিকে। আতঙ্কিত গলায় বললো, ওসব আলগা পাথরের দিকে খেয়াল রেখো। আঙুল বাধাবার আগে পরীক্ষা করে নিও ভালোভাবে।
আচ্ছা, বলে আবার নড়ে উঠলো শেখ।
আরো খানিকটা ওঠার পর হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে চার ফুটের মতো বেরিয়ে থাকা একটা চ্যাপ্টা পাথর পেয়ে গেল কামাল। কোনরকমে নিজেকে পাথরটার ওপর টেনে তুলে পেছনে হেলান দিয়ে বসলো সে। টের পেলো, ঘাড়ের কাছ থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে ঘাম। শেখও উঠে এলো ওর পাশে। কোনো ভাবান্তর নেই তার।
আগে জানলে এদিকে মরতে না এসে ফাটলের ভেতর দিয়েই ঢুকতে চেষ্টা করতাম, আস্তে আস্তে বললো কামাল। এখন আর সে উপায় নেই। চেষ্টা করলে ওঠা হয়তো যাবে, কিন্তু নামা যাবে না কিছুতেই।
পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের সাধ আর নেই আমার, মৃদু হাঁপাচ্ছে। শেখ, এতদিন ভাবতাম, পর্বতারোহণ জিনিসটা বোধহয় খুব মজার ব্যাপার। তা, কী মনে হয় তোমার, পৌঁছুতে পারবো ওখানটায়? আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখালে শেখ।
পারতে হবে, অন্ধকার সাগরের দিকে চেয়ে জবাব দিলো কামাল, এখন উঠে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। নামা যাবে ভাবছে নাকি?
ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে আরেকবার চূড়াটা পরীক্ষা করল কামাল। ওদের বাঁ পাশ থেকে চারফুট চওড়া একটা ফাটল উঠে গেছে বাইরের দিকে ঝুলে থাকা জায়গাটা পর্যন্ত।দেখেছো? বললো সে, যদি ফাটলটার একপাশে কাঁধ আর অন্যপাশে পা বাধিয়ে শরীর ঠেলে তোল যায় তাহলে পৌঁছে যেতে পারবো।
শুনে মনে হচ্ছে জলের মতো সোজা, লম্বা করে শ্বাস ফেললো শেখ, কিন্তু পারা যাবে না।
আমার মনে হচ্ছে যাবে, আরেকবার টর্চের আলোয় দুর থেকে ফাটলের দেয়ালগুলো পরীক্ষা করলো কামাল। যাচ্ছি আমি।
বেশ, যাও। হায়রে কপাল। শেষ পর্যন্ত হালুয়া হয়ে মরাই অদৃষ্টে ছিল।
কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন। চলে যাই।
উঠে দাঁড়ালো কামাল। পায়ের আঙুল দিয়ে খুঁজে ওপরের দিকে একটু জায়গা বের করলো পা রাখার। সেখানটায় একটা পা রেখে আরো ওপরের একটা পাথরের খাজে হাতের আঙুল বাধিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়লো। একফালি হলুদ চাঁদ উঠে এসেছে আকাশে, কিন্তু ওই আলোয় কাজ হচ্ছে না তেমন। বেশির ভাগ সময়ই হাতড়ে হাতড়ে বুঝে নিতে হচ্ছে কোথায় আঙল বাধানো যাবে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছলে কামাল ফাটলটার কাছে। উঁচু হয়ে মাথা আর কাঁধ পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিলো ফাটলটার ভেতর। হঠাৎ পায়ের নিচের পাথরটানড়েউঠলো। প্রায় আলগাই ছিল পাথরটা। সঙ্গে সঙ্গে ফাটলের ভেতর নিজেকে প্রায় ছুঁড়ে দিলো কামাল। একটুখানি আঙল বাধাবার জায়গার জন্য পাগলের মতো ফাটলের দেয়াল হাতড়াতে শুরু করলো। ছোট্ট একটা বেরিয়ে থাকা পাথর হাতে ঠেকাতেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলে সেটা।
ভয় পেয়ো না, চেঁচিয়ে উঠলো শেখ, ঝুলে থাকে। একটু। এসে পড়ছি আমি।
ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো, প্রায় ফুঁসে উঠলো কামাল, নইলে আমার সাথে সাথে তুমিও পড়বে।
পা রাখার মতো শুধু একটুখানি জায়গা খুজছে কামাল। পাচ্ছে না। ফাটলের মসৃণ দেয়ালে বিন্দুমাত্র খাজ নেই। হাতের আঙুলে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝলো, সেটা আরো বেশি অসম্ভব। কয়েক সেকেণ্ডের বেশি আর ঝুলে থাকা যাবে না এভাবে।
ঠিক এমন সময় পায়ে ঠেকলো কী যেন।
কিছু ভেবো না, ওর পায়ের নিচ থেকে কথা বলে উঠলো শেখ কামালের পা-দুটো তার কাঁধের ওপর। এখন আমার কাঁধে ভর দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে দেখি।
তোমাকে সুদ্ধ পড়বো নিচে, বুদ্ধ, কোথাকার। হাঁপাচ্ছে কামাল।
হয়েছে, শান্ত নিরুদ্বিগ্ন শেখের গলা, শক্ত একটা অবলম্বন পেয়েছি আমি। ভাবনা নেই, শুরু করে। আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে, তাড়াহুড়ো করে কিছু করে বসে না।
এছাড়া করার কিছুই নেইও। অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে শরীরের ভার রাখালো কামাল শেখের কাঁধে। আঙল বাধাবার আরেকটা অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গা খুঁজে বের করলো।
উঠছি আমি তাহলে। ঠিক আছে? বললে কামাল।
ওঠো, উত্তর দিলো শেখ।
শেখের কাঁধে শরীরের ভার রেখে হাত, বাহু আর কাঁধের সাহায্যে কোনমতে ফাটলটার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেল কামাল। চিত হয়ে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে থাকলো সে। একটু পরেই ফাটলের মুখে দেখা দিলে শেখের মাথা। উঠে এলো সে কামালের পাশে। পাশাপাশি চুপচাপ পড়ে থাকলে দুজন কিছুক্ষণ।
মিনিট পাঁচেক পর কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালো কামাল।
রাতটা চমৎকার কাটছে, না? ফাটলের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো সে।
যা বলেছে, কামালের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো শেখ, একটু আগে যে সার্ভিস দিয়েছি সেজন্যে ছোটখাটো একটা মেডাল পাওয়া উচিত আমার, কী বলে?
তার বদলে পেটপুতি মোরগ-পোলাও খাওয়াব ফিরে যেতে পারলে, উত্তর দিলো কামাল। কাজ শুরু করলো সে আবার। ফাটলের একপাশের দেয়ালে কাধ ঠেকিয়ে অন্যপাশে পা বাধিয়ে দিলো। পা আর পিঠ চেপে রেখে দুই দেয়ালের মাঝখানে বসার মতো করে আটকে থাকলো।
ওভাবেই যাচ্ছো তুমি তাহলে? আতঙ্কিত গলায় জানতে চাইলে শেখ। আতঙ্কটা কৃত্রিম না সত্যি ঠিক বোঝা গেল না।
হ্যাঁ। এটা একটা পুরনো সুইস্ পদ্ধতি।
জানি। কিন্তু আমাকেও ওভাবে যেতে হবে মনে করে। নাকি?
জীবনের বাকি কটা দিন এখানেই থেকে যেতে চাইলে অবশ্য দরকার নেই, নিষ্প্রাণ গলা কামালের। এভাবে ছাড়া উপায় নেই কোনো, বুঝেছো?
নিজেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঠেলে তুলতে লাগলো কামাল। পিঠের বোঝাটা বুকের ওপর ঝুলছে এখন। মাঝে মাঝে বেরিয়ে থাকা পাথরে ঘষা লেগে প্রচণ্ড অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও উঠতে পারছে সে। পা দুটো অবশ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওঠা যাবে। কিন্তু পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেললেই হয়েছে। নিশ্চিত মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না কেউ।
উঠেই চললে কামাল। ঝুলে থাকা পাথরটার ওপর দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এভাবে যাওয়াই নিরাপদ। এখনও ফাটলটার তিনভাগের একভাগ বাকি রয়ে গেছে। একশো মাইল হেঁটে এসেছে বলে মনে হচ্ছে কামালের। পায়ের মাংসপেশীতে টনটনে ব্যথা শুরু হয়েছে।
কেমন লাগছে, দোস্ত? নিচ থেকে জানতে চাইলে শেখ।
অবাক হলো. কামাল লোকটার সহ্যশক্তি দেখে। বকবক করেই চলেছে সারাক্ষণ, বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে কিংবা ক্লান্ত হচ্ছে, বলে মনে হচ্ছে না। এখনও আস্তই আছি। আমি চূড়ায় না উঠে যাওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকো।
উঠে যাও। তাড়াহুড়ো নেই আমার।
আবার উঠতে শুরু করলো কামাল। আরো ধীর হয়ে গেছে গতি। প্রচণ্ড ব্যথা করছে কাঁধের কাছটায়। ওপর দিকে তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে থাকলো সে। মনে হচ্ছে ক্রমশ কাছিয়ে আসছে যেন আকাশটা। জানে সে, আকাশকে কাছিয়ে আসতে দেখা যায় না কখনও, কিন্তু কেন জানি ভাবতে ভালো লাগছে কথাটা। চেপে রাখা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরুচ্ছে ওর হি হি নিঃশ্বাস, ভারি হয়ে আসছে পা-দুটো। ঘষা খেয়ে খেয়ে পিঠের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে শার্ট। চামড়া ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে। কিন্তু থামছে না কামাল। যেভাবেই হোক উঠতেই হবে-থেমে পড়ার অর্থ এখন নিশ্চিত মৃত্যু।
.
১০.
ছোট্ট কামরাটা। বারো বাই দশ ফুট, উচ্চতা সাড়ে ছয় ফুট। অসমান পাথুরে মেঝে। মাথার ওপর ঢাকনাওয়ালা দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। ঘরের একপাশে একটা বেঞ্চ। বেঞ্চটা থেকে একটু দূরে একটা কোলাপসিবল টেবিল আর একটা চেয়ার। দেয়ালের গায়ে ব্রাকেটে একটা শেডহীন উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি।
পুরনো ভারি একটা কাঠের চেয়ারে বসে ঘরের চেহারা দেখছে শহীদ। চেয়ারের সাথে চামড়ার ফিতে দিয়ে হাত-পা বাঁধা হয়েছে ওর। কপালের ওপর দিয়ে চামড়ার ফিতে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে আটকে দেয়া হয়েছে দেয়ালের গায়ে বসানো আংটার সঙ্গে। চেয়ারটাওলোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে আংটার সাথে। যতো যা-ই করা হোক না কেন, জায়গা ছেড়ে একচুল নড়বে না চেয়ার।
একা বসে বসে পারভেজের জন্যে অপেক্ষা করছে শহীদ। ফুসফুসটা আকুলিবিকুলি করছে একটা সিগারেটের জন্যে। এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল মাথার ওপর। ঢাকনা খুলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো জনি। হাতে করে নিয়ে এসেছে একটা কাঠের ট্রে। ঘরের একমাত্র টেবিলের ওপর ট্রেটা নামিয়ে রেখে একবারও শহীদের দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। ট্রের ওপর রাখা জিনিসগুলো দেখলে শহীদ। দুটো কাবাব বানাবার শিক, চোখা একটা কাঠের দণ্ড, একবোতল বর্ণহীন তরল পদার্থ, বাইরের দিকে কাটা বসানো ছোট্ট একটা চুঙ্গি, ছইঞ্চি ব্লেডের একটা ছোরা-মাথাটা পুরো নব্বই ডিগ্রী বাঁকানো, আর কয়েক বাক্স দেশলাই। নিজের অজান্তেই শহীদের শ্বাস-প্রশ্বাস ভারি হয়ে এলো যন্ত্রপাতিগুলো দেখে।
আরো প্রায় মিনিট পাঁচেক পর এল পারভেজ, মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালো সে শহীদের দিকে তাকিয়ে–যেন বিরাট একটা উপকার করে কৃতার্থ করতে যাচ্ছে ওকে। শান্তভাবে বসলো টেবি লের উল্টো দিকের চেয়ারটায়। শান্তভাবেই কথা বললো, তাহলে শুরু করা যাক। যন্ত্রপাতিগুলো সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দর কার আগে। প্রথমে বিদ্যুতের কথাই ধরো। জায়গামতো প্রয়োগ করা গেলে ভালো কাজ দেয়। কিন্তু অতি সহজ কায়দাটা। তেমন শিল্প নেই ওতে। একজন গুণী লোক তারচেয়ে অনেক ভালো শিল্প সৃষ্টি করতে পারে কাবাবের শিক, ছুরি, তারের বুরুশ এসব অতি সাধারণ জিনিস দিয়ে। যাই হোক, এসব দিয়ে শুরু করে মাঝখানে একটা ইনজেকশন দিয়ে নেবো তোমাকে। একরকম ব্যাঙের ছাতা থেকে বানানো হয় ওষুধটা।
এখন কথা হচ্ছে, শরীরের কোন জায়গা থেকে শুরু করবো? সবচেয়ে নরম এবং স্পর্শকাতর জায়গা হলো যৌনাঙ্গ। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, অকল্পনীয় ব্যথা ছাড়া এতে আর তেমন কিছু হয় না। তাই তোমার বেলায় ওখান থেকে শুরু করতে যাচ্ছি না।
একটু বিরতি। কপালের দুপাশ দপদপ করছে শহীদের। পকেট থেকে বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস-এর প্যাকেট বের করে ইঙ্গিতে লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করলো তাকে পারভেজ।
ধন্যবাদ। লাগবে না।
সত্যি বলছো? নাও না একটা?
চাই না, বলেছি, একবার। নিকোটিনের ক্ষুধা ভুলেই গেছে শহীদ। পারভেজের নোংরা আঙুলগুলো ওর ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে দেবে ভাবতেই গাটা ঘিন ঘিন করে উঠছে।
তোমার খুশি। রনসন গ্যাস লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরালো পারভেজ। একমুখ ধোয়া ছেড়ে আবার শুরু করলো, তাহলে যৌনাঙ্গ বাদ দিলে কোত্থেকে শুরু করা যায়? আঙুলের নখ একটা চমৎকার জায়গা। হাঁটুর জয়েন্টে কাজ চালালেও বিস্ময়কর ফল পাওয়া যায়। কিন্তু পুরোনো হয়ে গেছে এসব পদ্ধতি। নতুন কিছু করতে হবে। শুধু ব্যথা পেলেই চলবে না। আতঙ্কে অভিভূত হবার ব্যবস্থা রাখতে হবে সেই সঙ্গে।
কাছে এসে শহীদের চেয়ারের পাশে ঝুঁকে দাঁড়ালো পারভেজ। প্রায় ফিসফিস করে কথা বললো সে, উত্তেজনায় কাঁপছে গলা, মানুষের সবচে মূল্যবান জায়গা হলো মাথা। আত্ম টাও বাস করে সেখানেই। কোরিয়ার এক আমেরিকান প্রিজনারের অবস্থা দেখেছি আমি। চোখ দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ওর। আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল শেষে। জীবিত ছিল লোকটা। কিন্তু মগজের ক্ষমতা বলতে কিছু ছিল না।
সুতরাং, শহীদ, তোমারও মাথার ভেতর ঢুকতে যাচ্ছি আমি প্রথমে কান থেকে শুরু করবো। টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল পারভেজ। এই লোহার শিকটা তোমার কান দিয়ে ঢোকাবো আমি। উজ্জ্বল আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো স্টেনলেস স্টীলের শিক। প্রথমে কিছু টের পাবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আসলে তেমন কিছুই অনুভব করবে না তুমি। টিমপানিক মেম ব্রেনটা, যেটাকে উত্তেজিত করতে যাচ্ছি আমি, মাত্র একবার ব্যথা করবে। ব্যথাটা কী ধরনের সেটা নিজেই অনুভব করতে পারবে।
জ্বলন্ত সিগারেটট। পায়ের নিচে পিষে নেবালো পারভেজ। একটা কথা শহীদ, পুরো সাউণ্ডপ্রুফ এ-কামরাটা। মাথার ওপরে ছাদের ওপাশের মেঝেতে পাতা আছে ভারি কার্পেট। কেউ শুনবে না কিছু। কাজেই লজ্জা না করে যতো খুশি চেঁচাতে পারে।
নরকে পচবে তুমি, পারভেজ।
পচবো না, শহীদ। কারণ ওই জায়গাটা নেই-ই আসলে।
জরুরি কাজে আর বেশি দেরি করা উচিত মনে করলে না পারভেজ। ধীর পায়ে চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেণ্ড পরই টের পেলে শহীদ, শিকের তীক্ষ্ণ ফলাটা ঢুকে যাচ্ছে ওর কানের ছিদ্র দিয়ে। দাতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে লাগলো ও।
অকল্পনীয় ব্যথাটা অনুভব করলে শহীদ আচমকা। ককিয়ে উঠলোনিজের অজান্তেই। এক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে গেল ব্যথাটা, তারপর ফিরে এলে আবার। অত্যন্ত ধীরে ছড়াতে শুরু করলো কান থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে নিচের দিকে শরীরের প্রতিটি রোম কূপের গোড়ায় গোড়ায়। অদ্ভুত সব চিন্তা খেলে যেতে থাকলো মগজে আপনা-আপনি। আবার থেমে গেল ব্যথা। আবার শুরু হলো এক মুহূর্ত পর। ঢেউয়ের মতো একবার বাড়ছে একবার কমছে। কখন থেকে যে চেঁচাতে শুরু করেছে শহীদ নিজেই টের পায়নি।
হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল চিৎকার। চামড়ার ফিতে দিয়ে মাথাটা আটকে রাখা না থাকলে অনেক আগেই ঝুলে পড়তো বুকের ওপর। সারা মুখে ঘাম। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো পারভেজ। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঢাকনাটা তুললে কয়েক ইঞ্চি।
সাথে সাথে একটা চাপা কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো, বলুন, স্যার।
এসো এবার, উইলিয়ামস।
এক্ষুণি আসছি, স্যার।
চামড়ার কালো ব্যাগ হাতে দ্রুত নেমে এলো ডাক্তার।
লোকটা… একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলো ডাক্তার, লোকটা বেহুশ, স্যার।
সেজন্যেই ডেকেছি তোমাকে। এখন পরীক্ষা করো তো ভালোমতো। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে তোমার।
শহীদের দিকে এগিয়ে গেল ডাক্তার। কয়েক সেকেণ্ড পরেই চোখ খুললো শহীদ। পারভেজের হাসি হাসি মুখটার দিকে চোখ পড়তেই বলল, প্রথম সুযোগেই খুন করবো আমি তোমাকে, পারভেজ।
পাগলের প্রলাপ। হো হো করে হাসলে পারভেজ। ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ডাক্তার, শুরু করতে পারি আবার? কান থেকে শুরু করেছিলাম, এবার নাক দিয়ে চলতে পারে।
আবার শুরু হলো ব্যথা। আগের চেয়ে অন্যরকম। ব্যথা থেকে চিন্তাটা অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো শহীদ। আগেও শারীরিক অত্যাচারের সময় যেমন করেছে। ব্যথাটা কোথায় স্থির করে আত্মসম্মোহন করে নিতে পারলে কম কষ্ট হতো। কিন্তু পারছে না। এক জায়গায় থাকছে না ব্যথাটা। আর চেঁচাবে না বলে মনস্থির করলো শহীদ।
একটু কম মনে হচ্ছে ব্যথাটা। অন্য কোনো জগতে বিচরণ করছে যেন ও। স্বপ্নে ব্যথা পেলে যেমন হয়, সত্যি সত্যি ব্যথা না পেয়েও মনে হয় অসহ্য যন্ত্রণা, তেমনি মনে হচ্ছে ওর। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও চেঁচাচ্ছে না যে এখন আর, সেটা বুঝতে পারছে।
কথা বলছে কেউ কাছাকাছি। মনে হচ্ছে পানির ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে কথার শব্দ। আঙুলে সূচ ফোঁটার ব্যথাও টের পেলো শহীদ। কিন্তু সাধারণভাবে সূচ ফুটলে যতখানি লাগবার কথা তার চেয়ে কম মনে হলো ব্যথাটা।
হঠাৎ ছেদ পড়লো ব্যথায়। চিন্তা করার মতো অবস্থায় ফিরে এলে আবার শহীদ। জীবনে ঠিক এ-ধরনের অনুভূতি কখনো হয়নি ওর। মৃত্যুর আগে বোধহয় মানুষ এমনি কষ্টই পায়। ভেত রের চামড়া ছড়ে গিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে নাক থেকে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে মাথা।
চোখ খুললো শহীদ। দেখতে কোনো অসুবিধে হলো না। এতকিছুর পরেও অটুট আছে দৃষ্টিশক্তি। একফুট দুরে পারভেজের মুখ। পুরোপুরি বদলে গেছে ওর চেহারা। টকটকে লাল হয়ে গেছে চোখদুটো ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। সীমাহীন উত্তেজনায় পুরো শয়তানের চেহারা পঁড়িয়েছ পারভেজের।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কেউ। নিরুৎসুক চোখে চাইলো সেদিকে শহীদ। শহীদের দিকে একনজর তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে ঘাড় ফেরালে পারভেজ।
পারভেজের চেহারা দেখে চমকে উঠলো মেয়েটা। আপনি অসুস্থ, স্যার?
না, না, ও কিছু নয়। তবে কাজটার একটা প্রতিক্রয়া আছে তো। পুরো বদলে গেছে পারভেজের গলার স্বর। কর্কশ একঘেয়ে কথাগুলো বোঝা গেল না পরিষ্কার। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, এসব কাজে উত্তেজিত কিছুটা হতেই হয়।
আমাকে ডেকেছেন, স্যার?
হাঁপানি রোগীর মত হাঁপাতে হাঁপাতে একপাশে কাত হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো পারভেজ। আঙুল তুলে শহীদকে দেখালো, লোকটা…আত্মসম্মোহন করছে মনে হচ্ছে। যতটা পাওয়া উচিত, ততটা ব্যথা পাচ্ছে না। বিদ্যাটা তো তোমার ভালোই জানা আছে। দেখে তো ওর আত্মসম্মোহনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে কিনা?
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে শহীদের সামনে দাঁড়ালো মেয়েটা। চোখে চোখ রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলে শহীদ। সোজা মেঝের দিকে চেয়ে থাকলো। চটাস্ করে চড় পড়লে তার গালে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরেছে মেয়েটা। ওসব করে লাভ হবে না। তাকাও, জলদি তাকাও আমার দিকে।
হেসে উঠলো পারভেজ। আহা-হা, আস্তে মারে। মেরে ফেলবে তো।
রাগে জ্বলে গেল শহীদের ভেতরটা। তীব্র চোখে চাইলে। মেয়েটার দিকে। কিন্তু একি? চোখ টিপলো বলে মনে হলো যেন মেয়েটা! নাকি ঠাট্টা করছে ওর সঙ্গে?
পুরো পাঁচ সেকেণ্ড শহীদের চোখে চোখে চেয়ে রইলো মেয়েটা। তারপর ফিরে দাঁড়ালো। স্যার, এতো আলোতে কাজ হবে না। ডিম লাইটটা শুধু জ্বেলে রাখুন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, দিচ্ছি আলো নিবিয়ে। চমৎকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে ডিম লাইটের কথা তুলে। ঠিক চোখের সামনে জ্বলবে দুটো হাজার পাওয়ারের বাব। কানের কাছে একটানা ঘন্টা বাজবে। কখনো বাড়বে কখনো কমবে ঘণ্টার আও য়াজ। স্নায়ুর বারোটা বাজাতে এরচেয়ে ভালো পদ্ধতি আর নেই। কিন্তু তার আগে জলদি তোমার কাজ সারো, ক্যাথি, বলেই আলো নেবাতে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল পারভেজ।
শহীদের একেবারে গায়ের ওপর ঘেষে এসেছে ক্যাথি। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তার বাঁ হাত। কাঁধের ওপর দিয়ে একবার পেছনে ফিরে চাইলো। এখনো সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে পৌঁছয়নি পারভেজ।
টের পেলে শহীদ, তীক্ষ্ণধার ছুরির ব্লেডটা ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে চেয়ারের হাতলের সঙ্গে বাঁধা ওর ডান হাতের চামড়ার ফিতের ফাঁকে। পারভেজ আলো নিবিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার আগেই কাটা হয়ে যাবে ফিতেটা।
.
১১.
ক্রমশ সরু হয়ে আসছে এখন দুই দেয়ালের মাঝখানটা। বুঝলো কামাল, ঝুলে থাকা জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছে সে। আস্তে আস্তে আরো বেশি কঠিন হয়ে আসছে ওঠার কাজটা। ফাটলের প্রস্থ কমতে থাকায় হাঁটুদুটো এগিয়ে আসছে থুতনির দিকে। এভাবে গুটিয়ে যেতে শুরু করায় জোর পাচ্ছে না কামাল পায়ে। হঠাৎ থেমে পড়তে হলে। ওকে। এভাবে যাওয়া যাবে না আর। ওর মাথার ওপরে ফাটলের প্রস্থ তিন ফুটেরও কম। কঁপা কাঁপা হাতে টচের আলো ফেললে সে উপরের দিকের দেয়ালে। কয়েকটা নাম না জানা ছোট্ট উদ্ভিদ জন্মে আছে দেয়ালের গায়ে, হাতের নাগালের ভেতরেই। ডানপাশের দেয়ালের একটু ওপরে ছোট একটা তাকের মতো–ঝুলে থাকা জায়গাটার পিঠ।
টর্চ টা শার্টের বুক পকেটে রেখে দিয়ে আগাছগুলোর দিকে হাত বাড়ালো কামাল। শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরলো একটা ছোট্ট গাছের গোড়ার দিকটা। নিজের দিকে টান দিলো। উঠে এলো না গাছটা। আস্তে আস্তে শরীরের ভার ছেড়ে দিতে লাগলো ও গাছের গোড়া আঁকড়ে ধরা হাতের ওপর। পুরো ভার ছেড়ে দেয়ার পরও উপড়ে এলো না গাছটা। চেপে রাখা শ্বাসটা আস্তে ছেড়ে দেয়ালের গা থেকে তুলে আনলো পায়ের চাপ–শুধু গাছ টাকে নির্ভর করে ঝুলে রইলো শূন্যে। শ্বাসরুদ্ধকর কয়েকটা মুহূর্ত। গাছটা যদি গোড়া থেকে উপড়ে আসে তাহলেই হয়েছে। নিচের দিকে বেঁকে গেল উদ্ভিদটা, কিন্তু উঠে এলো না। ভালো করেই শেকড় গেড়েছে দেয়ালের গায়ে। এক হাত দিয়ে ঝুলে থেকে আরেক হাতে গাছটার একটু ওপরের দিকে কায়দামতো একটু জায়গা খুজলে কামাল হাতড়ে হাতড়ে। এইটুকু নড়াচড়াতেই বেড়ে যেতে থাকলো দুলুনি। অনুভব করলো, শিরদাঁড়া বেয়ে অনর্গল নেমে যাচ্ছে ঠাণ্ডা ঘাম। ঠিক এই সময় হাত দিয়ে ধরার মতো ছোট্ট খাঁজ পেলো একটা বেশি সুবিধাজনক না হলেও আল গুলো কোনোরকমে বাধানো যায় খাজটায়। শরীরের অর্ধেক ভার বা হাতের খাজে আর অর্ধেক গাছটায় চাপিয়ে স্কুলে থেকে দুলুনি কমে আসার অপেক্ষায় রইলো। শুধু নড়াচড়ায় একটু হিসেবের ভুল যদি হয় এখন–ব্যাস, দেখতে হবে না আর। পড়ে গেলে কী হবে ভাবতে চাইলে না কামাল। সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে ও। জীবনে আতঙ্কিত হয়েছে বহুবার, কিন্তু এটার সাথে তুলনা চলে এমন কোনো ঘটনার কথা মনে পড়লো না ওর।
অত্যন্ত ধীরে ডান হাতের ওপর চাপানো ভার কমিয়ে বাঁ হাতের ওপর ভার বাড়াতে শুরু করলো কামাল। এক এক মিলি মিটার করে নিজেকে টেনে তুলতে থাকলো। চোখদুটো বাঁ হাতের সমতলে আসতেই দেখলো চূড়ায় পৌঁছে গেছে সে। তাকের মতো জায়গাটারই কার্নিশে আটকানো বা হাত। ডান হাতে গাছের গোড়ায় চাপ রেখে আর বাঁ হাতে কার্নিশ আঁকড়ে ধরে বুক পর্যন্ত উঠে এলো। একেবারে শেষ হয়ে গেছে শরীরের শক্তি। দুপদাপ, লাফাচ্ছে কলজেটা, ঝা ঝুঁ করছে কান। কয়েক মুহূর্ত এভাবে থেকে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করলো। বাঁ হাতের আঙুলগুলো আগের জায়গায় বাধিয়ে রেখেই বা কনুই নিয়ে এলো তাকের ওপর। জোর পেলো এবার একটু। নিজেকে টেনে তুললে পেট পর্যন্ত। উবু হয়ে পেটের ওপর শরীরের ভর রেখে ছেড়ে দিলো বা হাতটা। একই সঙ্গে থাবা মেরে ধরলো সামনের একটা বেরিয়ে থাকা পাথর। গাছের গোড়া ছেড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে আরেকটা পাখরের খাজ খুঁজে পেতেই একটা হাঁটু তুলে আনলো তাকের ওপর। তারপর মাঝারি ধরনের একটা ঝাঁকুনি দিয়েই উঠে গেল তাকে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে শুরু করলো। পুনর্জন্ম হয়েছে যেন ওর।
কা-মা-ল… ফাটলের ভেতর দিয়ে নিচ থেকে ভেসে এলো শেখের চিৎকার।
উপুড় হয়ে শুয়ে শুধু মুখটা নিয়ে এলে কামাল ফাটলের মুখে। সাড়া দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু স্বর- বেরোলো না গলা দিয়ে। কোলা ব্যাঙের মতো ঘড়ঘড় একটু আওয়াজ হলো শুধু।
কোথায় তুমি, কামাল? যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এলো শেখের উদ্বিগ্ন চিৎকার। তার টর্চের আলো খুজছে কামালকে। আলো দেখে টের পেলে কামাল কতোটা ওপরে উঠে এসেছে ও শুধু পিঠ আর পায়ের ওপর ভর করে। এতে উঁচুতে উঠেছে কল্প নাও করতে পারেনি।
এই যে আমি চেঁচিয়েই উত্তর দিলো কামাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, আমার মতো উঠতে যেও না, শেখ। অসম্ভব কঠিন কাজটা। একটা রশি জোগাড় করে আনছি আমি।
রশি পাবে কোথায়?
জানি না। কিন্তু পেতেই হবে। ওখানেই অপেক্ষা করো তুমি।
একটু পিছিয়ে এলো কামাল ক্রল করে। টচ টা বের করে আলো ফেললো ওপর দিকে। মাত্র ছসাত ফুট ওপরে চুড়াটা। এখানে ওঠা তেমন কঠিন হবে না।
.
মৃদু একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কামালের। চোখ মেললো। অন্ধকার। কয়েক মুহূর্ত কিছুই মনে করতে পারলো না। তারপরই উঠে বসলো ধড়মড় করে। পাশে পড়ে থাকা টর্চটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে চারদিকে আলো ফেলে দেখলো। কেউ নেই। ছোট বড়ো নানা আকারের পাথর শুধু ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
চূড়ায় উঠে একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছিল ও। আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেমে এসেছে চোখে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও কে জানে। ঘড়ি দেখলো। আধ ঘণ্টার বেশি হবে না মনে হয়। হায়দার শেষ কোথায়? এখনও অপেক্ষা করছে নিচে।
উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা পরীক্ষা করলে কামাল ভালো করে। ডানদিকে প্রায় চার গজ দুরে চোখ পড়তেই এগিয়ে গিয়ে আলো ফেলে দেখলো ভালো করে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। পাথরের গা কেটে বানানো হয়েছে ধাপগুলো। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো কামাল। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছে। নামতে নামতে এসে পৌঁছলো একটা গোল চত্বরের মতো জায়গায়। চারদিকে পাথরের দেয়াল। দেয়ালের দুদিকে গুহামানবের গুহার মুখের মতো দুটো মুখ। আলো ফেলে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলে সে গুহা মুখদুটো। কোষ্টা দিয়ে ঢোকা যায়? একটা মুখের দিকে পেছন ফিরে অন্য মুখটার দিকে এগিয়ে গেল সে।
পেছনে পদশব্দ শোনা গেল। চট করে টচ নিবিয়ে দিলো কামাল। নিঃশব্দে চলে এলো সিঁড়ির গোড়ায়। একটা গুহামুখ দিয়ে ছায়ার মতো বেরিয়ে এলো চারজন লোক। কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে নেবার জন্যে হাত তুলতে গেলে কামাল। কিন্তু সাথে সাথে বরফের মতো জমে গেল পিঠের ওপর ঠাণ্ডা কঠিন কিছুর ছোঁয়া অনুভব করে। বরফের মতই ঠাণ্ডা একটা গলা শোনা গেল পেছনে, ব্যাস, ব্যাস, রাইফেলটা আমরাই নামিয়ে নিতে পারবো।
দপ করে জ্বলে উঠলো দুটো হাজার পাওয়ারের বাব। ওপর দিকে মুখ তুলে চাইলো কামাল। পাথরের দেয়ালে আলগ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো। কোন দিক দিয়ে কেমন করে আনা হয়েছে ইলেকট্রিক কানেকশান মাথায় ঢুকলো না ওর।
পরিষ্কার আলোয় দেখলো, গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসা চারজনের হাতেই অটোমেটিক কারবাইন। একজন এগিয়ে এসে কামালের কঁধ থেকে নামিয়ে নিলো রাইফেলটা। ওর উপস্থিতি টের পেলো কী করে ওরা? চূড়া থেকেই কি অনুসরণ করে এসেছে ওর পিছু পিছু?
এগোও, আদেশ এলে পেছন থেকে।
বিনা বাক্যব্যয়ে হাঁটতে শুরু করলো কামাল। পাঁচজন সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে এ-মুহূর্তে একা করার কিছুই নেই। সামনের চার জন পাশে সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিলো। যে-গুহামুখ দিয়ে ওরা বেরিয়েছিল, সেই গুহামুখটার দিকেই কামালকে এগোবার নির্দেশ দেয়া হলো।
চারজনের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল কামাল। পৌঁছে গেল গুহামুখের কাছে।
অস্ত্রগুলো ফেলে দাও সবাই হাত থেকে! আচমকা গমগম করে উঠলো গম্ভীর একটা কণ্ঠ। সিঁড়ির দিক থেকে এসেছে আওয়াজটা।
মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালো পাঁচজন অস্ত্রধারী। পেছনে ফিরে চাইলে কামাল। দেখলো, কারবাইনের নলের মুখগুলো ওর দিক থেকে সরে গেছে। ধাই করে থাবা মেরে সবচেয়ে কাছের লোক টার কারবাইনটা ছিনিয়ে নিলো সে। পরমুহূর্তে ডাইভ দিয়ে পড়লো গুহামুখের ভেতর।
ঠা-ঠা ঠা-ঠা…বেরেটা মেশিনগানের গুলির শব্দ হলো সিঁড়ির কাছটায়। একটানা কয়েক সেকেণ্ড চললো গুলিবর্ষণ। তারপর যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎই থেমে গেল। কিছুক্ষণ শব্দটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো পাথরের দেয়ালে দেয়ালে। পাঁচজন লোকই লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো শেখ। হাতের মেশিনগানটার নল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তখনও। গুহামুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কামাল।
চূড়া থেকেই, তোমার পিছু নিয়েছিল একজন। ওখানে পাহারায় ছিল সে। ওই যে- আঙুল তুলে দেখালো শেখ চিত হয়ে পড়ে থাকা একটা লোককে। কামালের পিঠে কারবাইন ঠেসে ধরেছিল এই লোকটাই।
তুমি জানলে কী করে? বিস্ময় প্রকাশ করলো কামাল।
ফাটলটা দিয়ে উঠিনি আমি। ঝুলে থাকা পাথরের ওপর দিয়েই উঠেএসেছি। জীবনের বাকি কটা দিন ভুলবোনা চূড়ায় ওঠার দুঃস্বপ্নটা, চোখদুটো বড়ো বড়ো করে আতঙ্ক প্রকাশ করার চেষ্টা করলো শেখ। চূড়ায় উঠেই দেখলাম ওই ব্যাটাকে। প্রায় আট ফুট দুরে। আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, তাই দেখতে পায়নি। মরার মতো পড়ে ছিলাম এক্কেবারে। তুমি চলতে শুরু করতেই ও রওনা দেয় তোমার পেছন পেছন। ওর পিছু নিই আমি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কামাল। তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না আমি জীবনে। গত এক ঘণ্টায় তুমি দুবার জীবন বাঁচিয়েছে আমার।
থাক, থাক, হয়েছে। এখন যাই চলে। এখানে দাঁড়িয়ে–থাকলে চলবে না।
মাটি থেকে রাইফেলটা তুলে নিলো কামাল। কারবাইনটা ফেলে দিলো। যে-গুহামুখ দিয়ে কারবাইনধারীরা বেরিয়েছিল সেটার ভেতরই ঢুকে পড়লো দুজন। সরু একটা টানেল। কিছুদুর এগো বার পরই শেষ হয়ে গেল সেটা। বেরিয়ে এলো ওরা খোলা জায় গায়। সামনে দিয়ে লম্বালম্বিভাবে চলে গেছে ফাটলটা। ডানদিকে ঘুরে ফাটলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ওরা। একটু পরেই সাগরের হাওয়া এসে লাগলে গায়ে। ফাটলের মুখে এসে দাড়ি য়েছে দুজনেই।
বোট থেকে ফাটলের এ-মুখটাই দেখেছি আমরা, বললো কামাল।
ঠিক। এবার আসল জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই, বললে শেখ। তবে তার আগে লাশগুলো এদিকে এনে লুকিয়ে রাখতে হবে পাথরের আড়ালে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফাটলের ভেতর দিকে রওনা দিলে ওরা।
.
১২.
কিছু একটা হয়েছে, স্যার। আমার মনে হয়…মনে হয়… বিড় বিড় করতে করতে মেয়েটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো পারতেলের দিকে।
মেয়েটা বুদ্ধিমতী। পুরো কাটেনি চামড়ার ফিতে। এমন ভাবে কেটেছে, টান দিলেই ছিঁড়ে যাবে। শহীদের হাতের নিচে রেখে দিয়েছে ছুরিটা। বাটটা মুঠোর নিচে। হাতের আড়ালে এমনভাবে ঢাকা পড়ে আছে চকচকে ফলাটা, ভালো করে না চাইলে বোঝার উপায় নেই কিছু। মরার মতো চোখদুটো আধ বোজা করে কপালে বাঁধা চামড়ার ফিতের ওপর মাথার ভার সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে শহীদ।
কী হয়েছে? জ্ঞান হারিয়েছে নাকি?
উত্তেজিত ভাবটা দূর হয়ে গেছে পারভেজের চেহারা থেকে। দ্রুত শহীদের কাছে এগিয়ে এলো সে। একপাশে সরে জায়গা করে দিলো মেয়েটা। শহীদের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালো পারভেজ। একঝলক দেখে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো ডাক্তারকে ডাকার জন্যে।
বিদ্যুৎ খেলে গেল শহীদের দেহে। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ছুরিটা বসিয়ে দিলে সে পারভেজের পিঠের নিচের দিকে খানিকটা বাঁয়ে। তিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এর চেয়ে বেশি মারাত্মক কোনো জায়গার নাগাল পেলো না সে। চিৎকার করে উঠে পেছন দিকে বাঁকা হয়ে গেল পারভেজ। বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে মাংসে গাথা ছুরিটা একটানে তুলে আনলে শহীদ। প্রায় সাথে সাথেই বসিয়ে দিলো আবার। ঠিক জায়গা মতো লাগলো না ছুরিটা। তবে বাম শোল্ডার ব্লেডের একটু নিচে পিঠের কিনারা ঘেষে আমূল বসে গেল। বাটটা ছেড়ে দিলো। শহীদ। ডান হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুসি মারলো পারভেজের ঘাড়ে। এবড়োখেবড়ো পাথরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল পারভেজ। কপাল ঠুকে গেল পাথরে। জ্ঞানহারালো সাথে সাথেই। এতসব ঘটতে সময় লাগলো মাত্র দুসেকেণ্ড।
ফুঁপিয়ে উঠে মুখে হাত চাপা দিলো মেয়েটা। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো ডাক্তার। দুজনের দিকেই একবার করে চাইলে শহীদ।
এগিয়ে এসে ছুরিটা তুলে নিলো ডাক্তার টান মেরে। পার ভেজের শাদা টী-শার্টে রক্তাক্ত ফলাটা মুছে নিয়ে ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো শহীদের সামনে। শক্তভাবেমুঠো করে ধরলো বঁটটা। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুরিটা এগিয়ে আনলো শহীদের দিকে। আস্তে করে ঢুকিয়ে দিলো বাঁ হাতের চামড়ার ফিতের ফাঁকে। দ্রুত কেটে ফেললে ফিতে। মাথার আর পায়ের বাঁধনদুটোও কেটে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
প্রথম থেকেই আপনাকে সাহায্য করতে চাইছিলাম। সাক্ষাৎ শয়তান এই পারভেজ ইমাম। ওর পৈশাচিকতা দেখতে বাধ্য করেছে আমাকে।
চেয়ার ধরে কোনমতে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। মাথা ঘুরছে। জোর করে কথা বললো সে, কটা বেজেছে?
বলতে পারছি না ঠিক। পুরো সুস্থির হতে পারেনি এখনও ডাক্তার। কিন্তু একি! আপনি উঠছেন কেন? বসে পড়ন, বসে পড়ন?
আবার বসে পড়লো শহীদ।
এগিয়ে এসে শহীদের পালস্ দেখলো ডাক্তার। ব্যাগ খুলে যন্ত্রপাতি বের করে পরীক্ষা করলে কান আর নাকের ভেতরটা। বললো, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছেন। আসল জায়গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি নরপশুটা। অবশ্য যা করেছে, যথেষ্ট কাহিল করে ছেড়েছে। একটা ইনজেকশান দিচ্ছি। চাঙা হয়ে উঠবেন শিগগিরই।
অ্যাম্পল ভেঙে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরলো ডাক্তার। নিন, সূচটা এগিয়ে আনলো শহীদের দিকে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনেকখানি সুস্থ বোধ করতে লাগলো শহীদ। উঁড়াতে পারছে সোজা হয়ে। পরিষ্কার হয়ে আসছে মাথার ভেতরটা। শক্তি ফিরে আসছে শরীরে।
আমার স্ত্রীকে কোথায় রাখা হয়েছে বলতে পারেন? জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
বেরিয়ে প্যাসেজ দেখতে পাবেন একটা। প্যাসেজের শেষ মাথার একটা ঘরে ছিলেন। বাঁ-দিকের প্রথম ঘরটায়। এখনো ওখানে আছেন কিনা বলতে পারছি না।
ইব্রাহীম? তার দলবল?
আছে আশেপাশেরই কোনো ঘরে। আড্ডা মারছে হয়তো।
এটাকে একবার পরীক্ষা করে দেখলেন না? পারভেজকে দেখিয়ে বললো শহীদ।
এগিয়ে গেল ডাক্তার। নুয়ে পড়ে পালস্ দেখলো, যে ঘুসি মেরেছেন, অন্য কারো হলে ঘাড় ভেঙে যেতে নির্ঘাত। কিন্তু দানবটার কিছু হয়নি। মরেনি, তবে অজ্ঞান এখনো। জ্ঞান ফিরতে দেরি হবে। শহীদের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালো, দেবেন নাকি শেষ করে? ভালো একটা স্পট দেখাবো ছুরি ঢোকাবার?
না, মাথা নাড়লো শহীদ, ধরে নিয়ে যাবো ওকে। বসে থাকুন এখানে আপনি। জ্ঞান ফিরে আসার লক্ষণ দেখলেই ইন জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। টেবিলের ওপর ছুরিটা তুলে নিলো। আমি আসছি।
যান। ভেতর থেকে ঢাকনার বল্টু লাগিয়ে দেবো। ঢোকার আগে তিনটে টোকা দেবেন ঢাকনায়, নইলে খুলবো না।
ক্যাথির দিকে ফিরলো শহীদ। এখন আর কাঁদছে না মেয়েটা। শহীদের চোখে চোখে চাইলো ও।
ধন্যবাদ, ক্যাথি, শান্তভাবে বললে শহীদ, কিন্তু কেনকরলে কাজটা? আমাকে বাঁচালে কেন?
বাবার কাছে শুনলাম, ডাক্তারকে দেখিয়ে বললো ক্যাথি, আপনি বিখ্যাত শখের গোয়েন্দা শহীদ খান। ভাবলাম, আপনাকে বাঁচাতে পারলে এই নরককুণ্ড থেকে বেরোনোর একটা উপায় হতে পারে।
কিন্তু এখানে এলে কেমন করে তোমরা?
ডাক্তার হিসেবে খুবই নাম করে ফেলেছিল বাবা। প্রথমে বাবাকে এখানে এসে কাজ করার জন্যে টাকার লোভ দেখায় পার ভেজ। এতবড়ো একটা প্রজেক্ট, নামকরা সব বিজ্ঞানীরা আছে। একজন ভালো ডাক্তারের খুবই প্রয়োজন ছিল ওর। বাবা রাজি না হওয়ায় আমাকে কিডন্যাপ করলো শয়তানটা। বাধ্য হয়েই বাবাকে আসতে হলো তখন।
তোমাদের কাছে আজীবন ঋণী হয়ে রইলাম আমি, ক্যাথি। ওর কাঁধে হাতের মৃদু চাপ দিলে শহীদ। থকে এখানেই। আমি আসছি। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঠের সিঁড়ির দিকে রওনা দিলো সে।
ঢাকনাটা তোলার সময়ে অত্যন্ত সাবধান হলো শহীদ। কে জানে, ওপাশে কেউ অপেক্ষা করে আছে কিনা। মাথা বের করলেই গুলি খেতে হবে হয়তো। ঝুঁকিটা নিতেই হচ্ছে। আস্তে করে মাথাটা বের করলো সে। কিন্তু কিছুই ঘটলো না। মিনিটখানেক অপেক্ষা করেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আর একটু বের করলো মাথা। কেউ নেই আশপাশে। প্যাসেজে উঠে এলো শহীদ।
প্যাসেজটা একেবারে নির্জন। ছুরি হাতে সোজা সামনে এগিয়ে চললো শহীদ। দশ পা গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। সামনেই বাঁক। বাকের ওপাশের দেয়ালে একজন লোকের ছায়া। দ্রুত পায়ে এদিকেই আসছে লোকটা। সময় নেই। আশপাশে লুকো নোর জায়গা খুজলে। শহীদ। নেই। দেয়ালের সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে গেল। ছুরি তুললো ছোঁড়ার ভঙ্গিতে। অপেক্ষায় টান টান হয়ে আছে শরীর। এসে পড়েছে লোকটা। নড়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল শহীদের হাত। কামাল! হাতে রাইফেল।
নড়াচড়া টের পেয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কামাল। ছুটে এলো শহীদকে দেখেই। চেয়ে থাকলো শহীদের রক্তাক্ত মুখের দিকে। তুই বেঁচে আছিস, শহীদ! কিন্তু এ-অবস্থা কেন তোর?
নিতান্ত কপালের জোরেই বেঁচে আছি এখনো। চল যাই, মহুয়াকে উদ্ধার করতে হবে।
ছুটতে ছুটতেই প্যাসেজের শেষ মাথায় পৌঁছে গেল দুজন? ডাক্তারের নির্দেশমতো দরজাটা আন্দাজ করে নিয়ে আস্তে টোকা দিলে দরজার গায়ে। সরে গেল একপাশে।
কে? বিরক্তি মেশানো একটা পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল ভেতর থেকে।
উইলিয়ামস, ডাক্তারের গলার স্বর নকল করে বললো শহীদ।
বিছানা থেকে নামার খচ মচ, আওয়াজ শোনা গেল। জুতোর হিল ঘষা খাবার শব্দ হলো মেঝেতে। অস্পষ্ট একটা নারী কণ্ঠ বললো কিছু। আরো পনেরো সেকেণ্ড পর ঘুরলো দরজার ইয়েল লক। দরজা খুলে, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাইরে বেরিয়ে এলো উইলি। শহীদের দিকে ঘুরেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
প্রচণ্ড জোরে কামালের রাইফেলের কুদো এসে পড়লো উইলির মাথায়। অস্ফুট আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, তার আগেই শহীদের ভয়ঙ্কর এক ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়লো পেছনে। এক হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেললল কামাল অজ্ঞান দেহটা।
ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে শহীদ। খাটের ওপর চমকে উঠে বসেছে মেয়েটা। পা থেকে কোমর পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। বাকি দেহটা অনাবৃত। ছুরিটা কায়দামতো ধরে এগোলে শহীদ।
অজ্ঞান উইলিকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো কামাল।
চাদরটা টেনে দাও গায়ে, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললো শহীদ, বিন্দুমাত্র শব্দ করলে খুন করে ফেলবে।
কাঁপা কাঁপা হাতে চাদরটা টেনে দিলো মেয়েটা কাঁধ পর্যন্ত।
মহুয়া কোথায়? জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
ল্যাবরেটরির উল্টোদিকের একটা ঘরে।
পদশব্দ শোনা গেল হঠাৎ দরজার বাইরে। চুপ করে রইলো সবাই। ইঙ্গিতে রাইফেলের নলটা দেখালো মেয়েটাকে কামাল। বোঝালে, চেঁচালেই গুলি খাবে।
নিঃশব্দে দরজার কাছে এগিয়ে গেল শহীদ। খাটের অন্য পাশে মাটিতে উবু হয়ে বসলো কামাল।
বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলে না জনি। ঘরে ঢুকেই হুঁ হয়ে গেল উইলির জ্ঞানহীন দেহটা দেখে। পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলো শহীদের বাঁ হাত। খাটের ওপাশ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো কামাল। রাইফেলের বাঁট দিয়ে দড়াম করে ঘা মারলো জনির বাঁঁ কানের ওপর। টু শব্দটি না করে জ্ঞান হারালো লোকটা।
বোটটা কোথায়, কামাল? জনির অজ্ঞান দেহটা মেঝেতে শুইয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলে শহীদ।
পাহাড়ের ফাটল থেকে একটু দুরে রাখার নির্দেশ দিয়েছি শেখকে।
ঢোকার সময় অনেক লোকজন দেখেছি, গেল কোথায় সব?
ছিল, তবে বাধা দেবার মতো অল্পই অবশিষ্ট আছে এখন। যারা আছে প্রায় সবাই বিজ্ঞানী, কারিগর এসব। সব কটাকে ল্যাবরেটরিতে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিয়েছি বাইরে থেকে। আমি, শেখ দুজনই ঢুকেছিলাম এখানে। খুব একটা বিপদের আশঙ্কা এখন আর নেই দেখে শেখ ফিরে গেছে বোটের পাহারায় থাকতে।
গুড। ওর মুখে রুমাল ঢুকিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেল, মেয়ে টাকে দেখালো শহীদ।
দ্রুতহাতে কাজ সারলো কামাল। দরজটা বন্ধ করে দিয়ে দুজন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ল্যাবরেটরির উল্টো দিকের ঘর টার কাছে এসে থামলো। দরজায় টোকা দিলে শহীদ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কামালের দিকে চাইলে, পিস্তল আছে?
পকেট থেকে একটা স্মিথ এণ্ড ওয়েসন সেন্টেনিয়াল এয়ার ওয়েট পিস্তল বের করে দিলো কামাল।
পিস্তলটা হাতে নিয়ে আস্তে করে ঠেলা দিলো দরজায় শহীদ। খুলে গেল দরজা। ভেজানো ছিলো ভেতর থেকে। মাথা নিচু করে ধ করে ঢুকে গেল শহীদ ভেতরে। সাথে সাথে গুলির আওয়াজ হলো। মেঝেতে ডাইভ দিয়ে পড়লো শহীদ। শুয়ে শুয়েই দেখলে, ঘরটা সিঁড়িঘর। ঘরের ঠিক মাঝখান থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সন্তর্পণে উঁকি দিলো একটা মুখ সিঁড়ির মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলো শহীদ। খুক করে কাশি দেবার মতো শব্দ করে উঠলো লোকটা। সিঁড়ি দিয়ে ভারি দেহ গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলো শহীদ পরিষ্কার।
ক্রল করে করে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল শহীদ। উঁকি দিয়ে দেখার ঝুঁকিটা নিলো। বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত সিঁড়িপথে কাউকে দেখা গেল না।
সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো শহীদ। সিঁড়ির শেষ মাথায় আরেকটা দরজা। একমুহূর্ত দ্বিধা করে ঠেলা দিয়ে খুলে ফেললে ও দরজাটা। লাফ মেরে একপাশে সরে গেল পরমুহূর্তে। বদ্ধ জায়গায় কান ফাটানো আওয়াজ হলো রাইফেলের গুলির। হাই-ভেলোসিটি রাইফেল। পিস্তলের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভয়ঙ্কর। একটু নিস্ততা। আবার সাবধানে উঁকি দিলে শহীদ। লোকটা কোথায় আছে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। আবার গর্জে উঠলো রাইফেল। শহীদের প্রায় চুল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। ঝট করে পিছিয়ে এলো ও। আবার শব্দ হলো গুলির। পর পর চারবার। খুট করে আওয়াজ হলো এরপর। ম্যাগাজিন খোলার শব্দ। এই সময়! উঠে দাঁড়িয়েই ডাইভ দিলো শহীদ ঘরের ভেতর। রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলে গুলি ভরছে লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে। শুয়ে থেকেই গুলি করলে শহীদ। রাইফেলটা খসে পড়লো লোকটার হাত থেকে। দুহাত দিয়ে চেপে ধরলে নিজের বুক।
খবরদার! নড়বে না একচুল! কঠিন একটা কণ্ঠ গর্জে উঠলো। ফিরে চাইলো শহীদ ডানপাশে। একটা আলমারির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। হাতে মেশিন পিস্তল।
পিস্তলটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াও। আদেশ দিলো লোকটা।
পিস্তলটা ছেড়ে দিলো শহীদ হাত থেকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে গেল। হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে ফিরে তাকালো লোকটা দরজার দিকে। টিপে দিতে গেল পিস্তলের ট্রিগার। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। রাইফেলের প্রথম গুলির আওয়াজটা হতেই তার হাত থেকে উড়ে চলে গেল পিস্তলটা। দ্বিতীয় আও য়াজটা হতেই ধড়াস করে কাতলা মাছের মতো আছড়ে পড়লো সে মেঝেতে। দরজার দিকে চাইলে শহীদ। কামালের হাতের লী-এনফিল্ডের মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে তখনও।
চমৎকার। ঠিক সময়েই এসেছিস। পিস্তলটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ।
যে-দরজা দিয়ে ঢুকেছে ও, সেটা ছাড়াও আরেকটা দরজা দেখলো শহীদ ঘরের বাঁ পাশে। এগিয়ে গেল সেদিকে। আস্তে করে ঠেলা দিলো দরজায়। খুললো না। ভারি সেগুনকাঠের দর জার কোথাও কোনো হ্যাণ্ডেল কিংবা নব দেখলে না শহীদ। তার মানে ইলেকট্রিক সিস্টেমে থোলে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁজেও সুইচটা পেলো না ও। কামালের দিকে চাইলো, গ্রেনেড আছে ব্যাগে?
কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা গ্রেনেড বের করে বাড়িয়ে দিলো শহীদের দিকে কামাল। হাত বাড়িয়ে নিলো শহীদ। সিঁড়ির দরজার কাছে পিছিয়ে এলো দুজনেই। গ্রেনেডের ইগনিশানটা আঙুল দিয়ে টিপে ধরে সঁাত দিয়ে লকটা খুলে নিলো শহীদ। কামালকে সিঁড়ির ওপর উঠে যেতে বলে ছুঁড়ে দিলো গ্রেনেডটা সেগুনকাঠের দরজা বরাবর। পরক্ষণে লাফ মেরে বেরিয়ে এলো সিঁড়ির গোড়ার দরজা দিয়ে। বদ্ধ ঘরে গ্রেনেড ফাটলে যে এতো আওয়াজ হবে ভাবতে পারেনি শহীদ। কয়েকটা ভারি কামানের গোলা যেন একসাথে ফাটলে কানের কাছে। আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই উঁকি দিলো দুজন আবার ঘরের ভেতর। প্রায় পুরো দরজাটাই ভেঙে পড়েছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে জায়গাটা।
কামালকে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শহীদ দরজাটার কাছে। পিস্তলটা তৈরি রেখে সাবধানে উঁকি দিলে। ভাঙা দরজার ওপাশে। আরেকটা ঘর দেখা গেল। খালি। দুজনেই ঢুকে পড়লো ঘরটায়। এ-ঘরেরও অন্যপাশে আরেকটা দরজা। এগিয়ে গিয়ে ঠেলা দিলো শহীদ দরজায়। খুলে গেল সেটা হাঁ হয়ে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো শহীদ। মহুয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে তার পিঠে পিস্তল ঠেসে ধরে রেখেছে ইব্রাহীম।
সত্যিই ভয়ঙ্কর লোক আপনি, শহীদ সাহেব, হাসলো ইব্রাহীম। চোখের ছোটবড় পাতা দ্রুত কয়েকবার উঠলো পড়লো। তবে আর যদি বাড়াবাড়ি করেন মারা যাবেন আপনার স্ত্রী।
কিছু করলো না শহীদ। দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ।
বেরিয়ে যাচ্ছি আমি, আবার বললেইব্রাহীম, উনিও যাবেন আমার সাথে। যদি আমি বাঁচি আপনার স্ত্রীও বাঁচবেন। আমাকে মারার চেষ্টা করলে মারা পড়বেন উনি সঙ্গে সঙ্গে। এখন ভদ্র লোকের মতো ফেলে দিন দেখি পিস্তলটা।
না বললো শহীদ।
বোকামি করবেন না। ফেলে দিন পিস্তল। প্রচণ্ড জোরে পিস্তলের নল দিয়ে মহুয়ার মেরুদণ্ডে খোঁচা মারলো ইব্রাহীম। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো মহুয়ার।
একমুহূর্ত দ্বিধা করে ফেলে দিলো পিস্তলটা শহীদ। কামাল কেও রাইফেলটা ফেলে দেবার নির্দেশ দিলো ইব্রাহীম। আস্তে করে হাত থেকে রাইফেলটা ছেড়ে দিলো কামাল।
চমৎকার! মহুয়ার পিঠ থেকে পিস্তলের নলটা সরালো ইব্রাহীম। কামাল আর শহীদের মাঝ বরাবর তাক করে পাশে সরলে কয়েক ইঞ্চি।
ঠিক সেই মুহূর্তে অনেকগুলো ঘটনা ঘটলো একসাথে। আচমকা বা পাটা উঠিয়ে প্রচণ্ড জোরে জুতোর ছুচলো হিল নামিয়ে আনলো মহুয়া ইব্রাহীমের ডান পায়ের ওপর। একই সঙ্গে থাবা মেরে পিস্তলটা ফেলে দিলো ইব্রাহীমের হাত থেকে। লাফ দিয়ে চট করে সরে গেল একপাশে।
বাঘের মতো ঝাঁপ দিলো শহীদ। দুকদম পিছিয়ে গেল ইব্রাহীম তলপেটে ভয়ানক ঘুসি খেয়ে। আবার এগোতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালে শহীদ। যেন জাদুমন্ত্রের বলে ইব্রাহীমের হাতে, বেরিয়ে এসেছে একটা ছুরি। বা বাহুতে রবারের ঐ পি দিয়ে আটকানো ছিল ছুরিটা।
রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়েছে আবার কামাল। ইঙ্গিতে ওকে গুলি করতে নিষেধ করলো শহীদ। শব্দ করে হাসলো ইব্রাহীম। ছুরির ফলাটা ওপরদিকে করে লাফ দিলে হঠাৎ চিতাবাঘের মতো। শহীদের সামনে এসেই সামান্য উঁচু হয়ে ছুরি চালালো। নিচ থেকে ওপরের দিকে উল্টোভাবে ছুরি চালিয়ে শহীদের পেট থেকে বুক পর্যন্ত চিরে দেবার ইচ্ছে ছিল ওর। চট করে একপাশে সরে গেল শহীদ। বাঁ হাতে দা দিয়ে কোপানোর মতো করে সর্বশক্তি দিয়ে মারলো ইব্রাহীমের ডান বাহুতে। যেন লোহার রডের বাড়ি পড়লো ইব্রাহীমের হাতে, তবু ছুরিটা ছাড়লো না সে। আবার ছুটে এলো ছুরি ধরা হাত সামনে বাড়িয়ে। শাঁই করে ছুরি চালালো এপাশ থেকে ওপাশে। এবারও সময়মতো পিছিয়ে গেলো শহীদ।
ক্ষেপে গেল ইব্রাহীম। ছুরিটা মাথার ওপর তুলে ধরে ছুটে এলো ঝড়ের গতিতে। বসিয়ে দিতে গেল শহীদের হৃদপিণ্ড বরাবর। ছুরির ফলাটা বুকের ঠিক ছ ইঞ্চি ওপরে থাকতেই ইব্রাহীমের ছুরিসহ হাতের কব্জি খপ করে ধরে ফেললো শহীদ। প্রচণ্ড চাপে আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করলো ছুরির ফলাটা ইব্রাহীমের বুকের দিকে। চোখে চোখে চেয়ে আছে দুজন। ছুরির চোখ ডগাটা শার্ট ভেদ করতেই বিস্ময় দেখা দিলে ইব্রা হীমের চোখে। পরমুহূর্তে দেখা দিলে আতঙ্ক। শেষবারের মতো জোরে একটা ধাক্কা দিলে শহীদ নিচের দিকে। অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরোলো শুধু ইব্রাহীমের মুখ থেকে। বেতস লতার মতো থরথর করে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল তার দেহটা ইব্রাহীমের ছুরি ধরা হাতটা ছেড়ে দিলো শহীদ। কাটা কলা গাছের মত ধড়াস করে মেঝেতে পড়ে গেল ইব্রাহীম। ওর ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর ঢুকে গেছে ছুরির ফলা।
লাশটার দিকে একনজর তাকিয়েই কামালের দিকে ফিরলে শহীদ, মহুয়াকে নিয়ে বোটে চলে যা, কামাল। আমার জন্যে অপেক্ষা করিস।
তুমি কোথায় যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলো মহুয়া।
যাও, আমি আসছি। মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শহীদ।
টর্চার রূমের ওপরের ঘরটায় পৌঁছে ঢাকনায় টোক দিলো শহীদ। সাড়া নেই। ব্যাপার কী? আবার টোকা দিলো। এবারও সাড়া না পেয়ে ঢাকনার আঙটা ধরে টান দিলো। অবাক কাণ্ড! খোলা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে।
চিত হয়ে শুয়ে আছে ক্যাথি। খোল। চোখদুটো চেয়ে আছে ছাদের দিকে। স্টীলের শিকটা ঢোকানো হৃদপিণ্ড বরাবর। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে ডাক্তার। তার পাশে ইনজেক শানের সিরিঞ্জটা পড়ে আছে। খালি। ঘরে লোকের সাড়া পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেললো ডাক্তার।
ভুলে গিয়েছিল পারভেজ, বললো ডাক্তার, পেটে শিকের ফোঁড়অলা মানুষকেও কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে পারে মরফিয়া। সিরিঞ্জটা দেখালো ডাক্তার, মরফিয়া নিয়েছি আমি।
কিন্তু কেমন করে ঘটলো এটা? তিরিশ মিনিট আগে আপনিই তো পরীক্ষা করলেন ওকে!
নরপিশাচটা আসলে আমি পরীক্ষা করার আগেই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল। ধোঁকা দেবার জন্যে পড়েছিল মটকা মেরে। আপনি যাবার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়েছে। ও-ধরনের ক্ষত নিয়ে মেঝে থেকে উঠে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে পড়তে পারে কোনো মানুষ, ভাবিনি আমি। হাঁপাচ্ছে ডাক্তার, তবে ভাব। উচিত ছিল। সুপারহিউম্যান ভাইটালিটি। ডাক্তারি শাস্ত্রে আছে কথাটা।
কিন্তু টিকতে পারবে না বেশিক্ষণ। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে নিশ্চয়ই?
হচ্ছে না এখন আর। আমাকে দিয়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিয়ে। নিয়েছে।
আমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান। কাছে এগোলো শহীদ।
না। কমসে কম দশটা ফুটো আছে আমার পেটে। আর মাত্র কয়েক মিনিট আয়, আছে আমার। একটা মিনিটের জন্যেই মরফিয়াকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমি।… ওদিকের কী খবর? সবগুলোকে শেষ করতে পেরেছেন তো?
হিম্মত বেঁচে আছে এখনো। জনি আর উইলিকে পিটিয়ে লাশ করেছি। জ্ঞান আর না-ও ফিরতে পারে ওদের।
হিম্মতকেও মরা ধরতে পারেন। প্রায়ই সে আমার কাছ থেকে জোর করে স্লিপিং পিল আদায় করে নিতে নেশা করার জন্যে। আজও চেয়েছিল। আনন্দিত মনে আজ ওকে স্লিপিং পিলের বদলে অরগানো-ফসফরাস-কম্পাউণ্ড দিয়ে দিয়েছি। ওর জন্যেও ভাবতে হবে না আপনাকে ডাক্তারের মাথাটা ঝুঁকে পড়লো বুকের ওপর। ঘড়ঘড়ে গলায় শেষবারের মতো অতিকষ্টে উচ্চারণ করলো, বিদায়…
বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলো না শহীদ। হাতটা শুধু একবার ডাক্তারের কাঁধে ছুঁইয়ে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো ক্যাথির নিস্পন্দ দেহের পাশে। বুক থেকে শিকটা টেনে বের করে ছুঁড়ে দিলো ঘরের কোণে। এক মুহূর্ত অপলক চেয়ে রইলো মেয়েটার সরল নিষ্পাপ মুখের দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়ালো দীর্ঘশ্বাস চেপে। উঠে গেল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে শহীদের মাথার ভেতর। পারভেজ কোথায় আছে জানে ও।
.
১৩.
কন্ট্রোল রূমে ঢুকেই স্থির হয়ে গেল শহীদ। মিসাইল ছোঁড়ার লাল রেগুলেটারটায় ডান হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে পারভেজ ইমাম। বাঁ হাতে গ্রেনেড জাতীয় কিছু। ঘরের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে হায়দার শেখ। শহীদকে ঢুকতে দেখেই মৃদু হাসলে পারভেজ।
ঠিকই ভেবেছি আমি, অবিশ্বাস্যরকম শান্ত স্বাভাবিক গলায় কথা বললো সুপারম্যান, আমি জানতাম, আমাকে না পেলে এখা নেই আসবে তুমিও। তাহলে ধরে নিচ্ছি, আমার লোকজন সবাইকে খতম করেই এসেছে। দুজনে?
কী মনে করেছিলে তুমি? বিদ্রুপের সুরে বলো শহীদ, ভেবেছিলে নিজেরাই খতম হয়ে যাবে।?
কোনো উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো পারভেজ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি হেরে গেলে, শহীদ খান কুয়াশা, তুমিও। হায়দার শেখের দিকে তাকিয়ে হাতের জিনিসটার দিকে ইঙ্গিত করলো পারভেজ। জানো, এটা কী? মর্টার বম্ব। যদি আহাম্মকের মতো কিছু করে বসে, আর এটা পড়ে যায় আমার হাত থেকে মাটিতে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাব তিনজনই। কিন্তু আমার কথা শুনলে তিনজনই বেঁচে যাবে। মিসাইলের সুইচটা টিপে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। আমি তোমাদের চোখের সামনে। বাধা দিলেই ছুড়বে। বোমাটা। একটা কথা বলিনি তোমাকে, শহীদ। তিনটে ছোট আকারের মিসাইল ছুঁড়ে ছিলাম তিনটে জাহাজ লক্ষ্য করে। সবচেয়ে বড়ো চার নম্বরটা কক্সবাজারের দিকে তাক করে বসিয়ে রেখেছি আমি। যাবার আগে ওই শহরটা অন্তত ধ্বংস করে দিয়ে যাবো। একটু দম নিলো এখন থেকে মাত্র দশ মিনিট পরেই কক্সবাজার শহরটা মুছে যাবে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে?
একটা কথা, পারভেজ, বললো শহীদ, আসলে প্রলাপ বকছো তুমি। দেরি করিয়ে দিতে চাইছে সে পারভেজকে। কী করে পালাবে তুমি এখান থেকে?
অতি সহজে। হাসলো আবার পারভেজ। বিপদে পড়লে অনায়াসে পালিয়ে যেতে পারি যাতে সেজন্যে নতুন কেনা নিউ ক্লিয়ার সাবমেরিনটা সবসময়ই তৈরি রাখি আমি।
কিছু একটা কথা বলার জন্যে আবার মুখ খুলেছিল শহীদ, তার আগেই আচমকা টিপে দিলে পারভেজ সাল সুইচটা। এক সেকেণ্ড নীরবতা। তারপরেই গুরুগুরু মেঘগর্জনের মতো শব্দ শোনা গেল। উৎক্ষিপ্ত হয়ে গেছে মিসাইল।
পারভেজ আর নিজের মাঝের দুরত্বটা মনে মনে আন্দাজ করে নিলে শহীদ। মরতে যাচ্ছে সে আর কুয়াশা দুজনই। জানে ও, যাবার আগে ওদের দিকে ঠিকই বোমাটা ছুঁড়ে দিয়ে যাবে পারভেজ। ওর হাতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শহীদ। কুয়াশাও। পিছোতে পিছোতে দেয়ালের শেষ মাথায় পৌঁছে গেল পারভেজ। ডান হাতটা বাড়লো পেছনে। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নিলে দেয়ালের গায়ের সুইচটা। মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরায়নি সে শহীদ কিংবা কুয়াশার ওপর থেকে।
নড়ে উঠলো পারভেজ। একই সঙ্গে ডান হাতে সুইচটা টিপে দিয়ে বঁ। হাতে ছুঁড়ে মারলো বোমাটা।
ডাইভ দিলো কুয়াশা। শহীদও শুয়ে পড়েছে মেঝেতে। কানে হাত চাপা দিয়ে গড়িয়ে চলে এলো দুজন কন্ট্রোল প্যা নেলের এপাশে।
বদ্ধ ঘরে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ফাটলে বোমাটা। গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল কন্ট্রোল প্যানেলের একটা অংশ।
শব্দটা মিলিয়ে যেতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালে শহীদ। ছুটে গেল যেখানে দাঁড়িয়ে বোমা ছুঁড়েছে পারভেজ সেখানটায়।
বিরাট একটা চৌকো গর্ত দেখতে পেলো শহীদ মেঝেতে। উঁকি দিয়ে দেখলো, ধাপে ধাপে লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। বোকার মতো চেয়ে থাকলো ও- সেদিকে। কিছু করার নেই। ধরা যাবে না আর পারভেজকে। সাবমেরিনে করে ভেগে যাবে ও পৌঁছবার আগেই।
ওদিকে একলাফে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়। ইলেকট্রনিক ডিভাইসট। খুজছে কুয়াশা দ্রুতহাতে জঞ্জাল সরিয়ে। নেই ওটা। প্যানেলটা ভেঙে যাওয়ায় ছিটকে পড়ে গেছে কোথাও। শহীদ এসে দাঁড়ালো। কুয়াশার পাশে। উত্তেজনায় পাচ্ছে সে।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে কুয়াশার কপালে। অক্লান্তভাবে খুঁজে চলেছে সে এখনও। হঠাৎই জিনিসটা চোখে পড়লো তার। কাত হয়ে পড়ে আছে ভাঙা প্যানেলটার একপাশে। নষ্ট হয়ে যায়নি তো? থাবা মেরে দাঁড় করালো ডিভাইসটা কুয়াশা। ছোট্ট সবুজ বাতিটা জ্বলছে এখনো। নষ্ট হয়নি তাহলে, কাজ করছে। অ্যাডজাস্ট মেন্টের কটাটা দেখলো। আশির ঘরে সেট করা রয়েছে। স্থির নিষ্কম্প হাতে দ্রুত নব ঘুরিয়ে জিরোতে অ্যাডজাস্ট করে দিলো। কুয়াশা কাটাটা।
ফিরে আসছে মিসাইল। আঘাত হানতে আসছে শয়তানের দ্বীপে।
পালাতে হবে দ্বীপ ছেড়ে যতো দ্রুত সম্ভব। ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটলো দুজন সুড়ঙ্গমুখের দিকে। খোলা আছে তো দরজাটা? ভেতর থেকে খোলে কী করে ওটা, জানা নেই ওদের।
প্যাসেজের শেষ মাথায় পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো দুজন। দুর থেকেই দেখতে পেলো, বন্ধ দরজাটা। ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা দরজার সামনে। বাইরে থেকে সুইচ টিপে দরজা খুলতে দেখেছে সে। ভেতর থেকেও নিশ্চয় সুইচ টিপেই খোলার ব্যবস্থা রয়েছে। একটু খোঁজাখুঁজি করেই পেয়ে গেল সে সুইচটা। দরজার বাইরের দিকের সুইচের মতো ভেতরের দিকের সুইচটাকে লুকিয়ে রাখার দরকার মনে করেনি ওরা। টিপে দিলে সুইচটা কুয়াশা।
খুললো দরজা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজন। ইলেকট্রিক কানেকশান কেটে দেয়া হয়েছে? দর দর করে ঘামছে শহীদ। আর মাত্র কয়েক মিনিট। তারপরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে নীলদ্বীপ।
আশ্চর্যরকম শান্ত দেখাচ্ছে কুয়াশাকে। কী যেন ভাবছে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার সুইচে চাপ দিলো সে। তারপর আবার। খুলে গেল দরজা মৃদু গুঞ্জন তুলে। মনে পড়লে শহীদের, ধোঁকা দেবার জন্যে অনেক সময় নানারকম কৌশলের ব্যবস্থা থাকে ইলেকট্রিক-মেকানিজম্ নিয়ন্ত্রিত দরজার সুইচে। ইলেকট্রিক সার্কিট চালু করার জন্যে একাধিকবার টিপতে হয় কোনো কোনো সুইচ।
একলাফে বাইরে বেরিয়ে এলো দুজন। প্রাণপণে দৌড় দিলে ফাটলের ভেতরে পথ দিয়ে। হাপাতে হাঁপাতে পৌঁছলো এসে পানির কিনারায়। জায়গামতেই রেখেছে বোটটাকে ড্রাইভার। দুজনকে বোটে উঠতে সাহায্য করলো কামাল। সোজা হুইলহাউসের দিকে ছুটলে কুয়াশা। হুইল ধরে বসে আছে ড্রাইভার। চেঁচিয়ে উঠলে কুয়াশা, জলদি ইঞ্জিন স্টার্ট দাও গিয়ে!
সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো ড্রাইভার ইঞ্জিনরূমে। চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন।
বন বন করে হুইল ঘোরাচ্ছে কুয়াশা।
ডেকে দাঁড়িয়ে আছে কামাল, শহীদ আর মহুয়া। কমলা রঙের বস্তুটাকে ছুটে আসতে দেখলো ওরা একটু পরেই। রাতের আকাশে প্রায় সূর্যের মতই জ্বলছে ওটা, দ্রুত এগিয়ে আসছে দ্বীপ টার দিকে। তীরবেগে ছুটে চলেছে গাঙচিল। দ্রুত বাড়ছে নীল দ্বীপ আর বোটের মাঝখানের দূরত্ব। কমলা রঙের ভয়াল সূর্যটা প্রায় পৌঁছে গেছে নীলদ্বীপের ওপর। দৌড়ে ঢুকে পড়লো ওর সবাই কেবিনে।
হাজার পাওয়ারের কয়েক লক্ষ বাল্ব জ্বলে উঠলো যেন দ্বীপ টায় ক্ষণিকের জন্যে। প্রচণ্ড শক্তিশালী বাতাসের ঢেউ ছুটে এসে ঝাপ্টা দিলো গাঙচিলের গায়ে। টলমল করে উঠলো বোট। গনগনে কয়লার আঁচের মতো গরম মনে হলো বাতাসের ঝাপ্টা। কোনো বিস্ফোরণের শব্দ হলো না। শুধু কোটি কোটি ঝিঁঝি পোকা একসাথে ডেকে উঠলে যেমন হয় তেমনি শব্দ হলো এক সেকেণ্ড! মাথা তুলে দেখলো ওরা, যেখানে দ্বীপটা ছিল একটু আগে, সেখানে এখন খেলা করছে সাগরের উথালপাথাল ঢেউ। বিশ্বাস করা কঠিন, মাত্র কয়েকমুহূর্ত আগেও ছিল ওখানে বিশাল পাথুরে টিলাটা। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে নীলদ্বীপ। মুছে গেছে সাগরের বুক থেকে।
উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। ছুটে আসছে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ। ইঞ্জিনের সমস্ত শক্তি নিঙরে বোট ছুটিয়েছে কুয়াশা।
.
১৪.
ট্রান্সমিটারের একটানা বিপ বিপ আওয়াজ শুনে ধরেই নিয়ে ছিলাম, শেষ হয়ে গেছিস তুই। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দ্বীপটাতে ঢুকবো আমি আর শেখ, যেভাবেই হোক, শহীদের প্রশ্নের জবাবে বললো কামাল।
স্কুবা-স্যুটের পকেট থেকে পড়ে যাওয়ার আগে কোনভাবে চাপ লেগেছিল হয়তো ট্রান্সমিটারের সুইচে… হঠাৎ বোটটা ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠতেই থেমে গেল শহীদ। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো পাশে বসা মহুয়া। সেলুন থেকে বেরিয়ে কারণ অনুসন্ধানের জন্যে ছুটলো শহীদ। ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে হুইলহাউস থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসেছে কুয়াশাও।
পর্দা ঢাকা সেলুনে বসে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি শহীদ, ভোর হয়ে গেছে প্রায়। ডেকে বেরিয়েই আলোর আভাস দেখতে পেলো। সূর্য উঠতে দেরি আছে এখনও, তবে পরিষ্কার হয়ে এসেছে,আকাশ। মৃদু ফুরফুরে সাগরের হাওয়া লাগছে গায়ে।
বাম পাশের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আশপাশটা খুঁজে দেখলো শহীদ। দেখতে পেলো না কিছু। এসে দাঁড়ালো ডান দিকের রেলিংয়ের পাশে। পানির দিকে চেয়েই চমকে উঠলো। ভয়ঙ্কর তোলপাড় পানিতে। মনে হচ্ছে প্রলয়কাণ্ড চলছে পানির নিচে।
কী আশ্চর্য, হাঙরটার কথা ভুলেই গিয়েছিল শহীদ। দ্বীপটা ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু হাঙরটা তো থেকেই গেছে সাগরে। ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না এখন আর কেউ। ইচ্ছেমতো যা খুশি করে বেড়াতে পারবে দানবটা। তীক্ষ্ণ চোখে বোটের আশপাশটা দেখতে লাগলো শহীদ। কুয়াশা এসে দাঁড়ালো ওর পাশে।
বোটের সামনের দিক থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দুরে দানবীয় মাথাটাকে ভেসে উঠতে দেখলো শহীদ। আঙুল তুলে দেখালো সে কুয়াশাকে। ওই যে, ওখানে! আসছে এদিকেই।
রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালো দুজন। ধীরেসুস্থে এগিয়ে এসে বোটের সামনের চৌকো তলা কামড়ে ধরলো হাঙরটা। প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকাতে শুরু করলো। কয়েকটা আঁকুনি দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল আবার।
আবার আসবে ওটা, বললে শহীদ।
হ্যাঁ, উত্তর দিলো কুয়াশা।
বোটটাকে কেমন খেলনার মতো কঁকালো দানবটা, দেখলে?
দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি, বলে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল কুয়াশা। ফিরে এলো কয়েকটা হারপুন হাতে নিয়ে। প্রত্যেকটা হারপুনের পেছনটায় লম্বা দড়ির একপ্রান্ত বাধা। দড়ির অন্য মাথায় একটা করে বাঁশের টুকরো আটকানো। মাঝখানটা আস্ত রেখে বাঁশের দুটো গাঁটের দুদিক থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। মাঝখানটা ফাঁপা হওয়ায় ভেসে থাকবে ওগুলো পানিতে।
হারপুন কেন? গুলি করলেই হয়, বললে কামাল। ও আর মহুয়াও এসে দাঁড়িয়েছে রেলিংয়ের পাশে।
গুলি করে মারা যাবে না ওই দানবকে, বললো কুয়াশা। তাছাড়া জায়গামতো গুলি বেঁধানোই যাবে না ওটার গায়ে। সুযোগও দেবে না। কাজেই হারপুন ছাড়া উপায় নেই।
এবার এসো, চাঁদ, পানির নিচের হাঙরটাকে ডাকলে কুয়াশা। টান টান হয়ে গেছে সে শিকারের উত্তেজনায়। একটা হারপুন হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবার কেঁপে উঠলো বোট। বোটের তলায় ঘা মেরেছে হাঙরটা।
রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়লে কুয়াশা। চেঁচিয়ে ডাকলো, বেরিয়ে আয়, হারামজাদা, বোটের তলা থেকে। নাকি ভয় পাচ্ছিস? বোটটা ডোবাবার আগেই শেষ করবে। আমি তোকে।
ডোবাবে? কী বলছো তুমি, শেখ? আশ্চর্য হয়ে বললো কামাল।
হ্যাঁ, ডোবাবে। বোটের তলা ফুটো করে দেবার চেষ্টা করছে ব্যাটা, বলেই গর্জে উঠলো আবার পানির দিকে চেয়ে, বেরোচ্ছিস না কেন, শুয়োরের বাচ্চা?
চকিতে একবার কামাল আর মহুয়ার দিকে তাকালে শহীদ। ভাবতে চেষ্টা করলো, এ-মুহূর্তে হায়দার শেখের আসল পরিচয় জানতে পারলে কেমন দাঁড়াবে ওদের মুখের চেহারা।
দশ গজ দুরে ভেসে উঠলো হাঙরের পিঠের দাঁড়াটা। শাঁ। করে পানি কেটে ছুটে আসছে বোটের দিকে।
ওই যে আসছে হারামজাদা! শিস দিয়ে উঠলো কুয়াশা, এসো, আহ্বান জানালো সে। পা-দুটো দুপাশে ছড়িয়ে বা হাত কোমরে রেখে মাথার ওপর হারপুন তুললে ছোঁড়ার ভঙ্গিতে। বোটের কয়েক ফুটের মধ্যে হাঙরটা এসে যেতেই ছুঁড়ে মারলো সেটা।
পিঠের পাখনার ঠিক সামনে বিধে গেল হারপুন। প্রচণ্ড জোরে বোটের পাশে ধাক্কা মারলো হাঙরটা। তাল সামলাতে না পেরে পেছনে ছিটকে পড়লো কুয়াশা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচালো সে, দাঁড়া, এবার শেষ দেখবো আমি তোর!
সাপের মতো সড়সড় করে পানিতে নেমে গেল হারপুনের দড়ি। ডেকের ওপর দিয়ে হেঁচড়ে গিয়ে দড়িতে বাধা বাঁশের টুকরোটাও পড়লে পানিতে। পড়েই অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিয়ে গেল হানপুনটা। বললো মহুয়া।
যাবে কোথায়? কুয়াশা জবাব দিলো, আবার আসবে। আবার ছুড়বো আমি হারপুন। ঝুঁকে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।
ওই যে! বায়ে আঙুল তুলে দেখালো কুয়াশা। পানির ওপর ভেসে উঠেছে বাঁশের টুকরোটা। আরেকটা হারপুন হাতে তুলে নিলো সে।
বোটটা থেকে কয়েকগজ দুরে মাথা তুললো হাঙরটা। চোয়ালদুটো ফাঁক করে রকেটের মতো সোজা ছুটে এলো পানি কেটে। কাছে এসেই পাক খেয়ে চিত হয়ে গেল বোটের গায়ে দাঁত বসাবার জন্যে। পানির ওপর ভেসে উঠলো ধোঁয়াটে শাদা বিরাট পেট।
পুরোদস্তুর মাছশিকারীর মতোই চিৎকার ছেড়ে দ্বিতীয় হারপুনটা ছুঁড়ে মারলো কুয়াশা। আমূল বিধে গেল হারপুনটা হাঙরের পেটে। প্রচণ্ড ছলাৎ শব্দ করে লেজের বাড়ি মারলো দানবটা পানিতে। ছিটকে ওঠা পানিতে ভিজে গেল রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই। হারপুনের সাথে আটকানো বাঁশের দ্বিতীয় টুকরোটাও সড়াৎ করে নেমে গেল পানিতে। দুটো টুকরোই ছুটতে থাকলে হাঙরটার সাথে সাথে।
লাগতে আসবি আর আমার সাথে? ছুটে হুইলহাউসে গিয়ে ঢুকলো কুয়াশা। ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার সিগন্যাল দিলো। বোট ছোটালে সে বাঁশের টুকরোর পিছু পিছু।
কোনো ক্ষতি হয়েছে বোটের? পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো শহীদ। কামাল এবং মহুয়াও এসে ঢুকেছে হুইলহাউসে।
হতে পারে। একটু ভারি ভারি লাগছে পেছনটা। হলেও খুব বেশি কিছু হয়নি, ছোটখাটো এক আধটা ছিদ্র হতে পারে। পাম্প দিয়েই সেঁচে ফেলা যাবে ওই পানি।
দ্রুত ছুটছে বাঁশের টুকরোদুটো। বাঁশে বাধা দড়ি পানি কেটে যাওয়ায় সমান্তরাল দুটো ঢেউয়ের রেখা রেখে যাচ্ছে পানিতে। হঠাৎ থেমে গেল বাঁশের টুকরোদুটো।
মরলো বোধহয় শেষ পর্যন্ত? বললো শহীদ।
কী মরলো?
হাঙরটা।
কোথায়?
ওই যে।
বাঁশের টুকরোগুলোর দিকে চেয়েই চমকে উঠলো শহীদ। সোজা ছুটে আসছে ওগুলো বোটের দিকে।
আক্রমণ করতে আসছে আবার বোটটাকে? জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
মাথা ঝোকালো কুয়াশা। দেখলে শহীদ, কুয়াশার মুখ গম্ভীর।
বড়ো হাঙরের সাথে লেগেছেন আগে কখনো? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
লেগেছি। তবে এটার মতো বড়ো নয়। বোটও আক্রমণ করেছে সেগুলো। তবে একটা হারপুন খেলেই হয় মরেছে নয় ভেগেছে।
সামনের দিকে তাকালো আবার শহীদ। কমে গেছে বোটের গতি। যতবারই ধেয়ে আসছে হাঙরটা, হুইল ঘুরিয়ে বোট নিয়ে সরে যাচ্ছে কুয়াশা। শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিরক্ত মুখে।
চুলোয় যা, শয়তানের বাচ্চা! লাগতেই এসেছিস যখন দেখেই যা মজাটা। ডেকে এসে আরেকটা হারপুন হাতে তুলে নিলো সে, আয়, হারামখোরের বাচ্চা।
এগিয়ে আসছে বাঁশের টুকরেদুটো ক্রমশ। ত্রিশ, পঁচিশ বিশ ফুট। রেলিংয়ে ঝুঁকে পরিষ্কার দেখলো শহীদ, পাঁচ কুট পানির নিচ দিয়ে বোটের ওপাশে চলে গেল ধূসর ছায়াটা চেঁচিয়ে উঠলো, ওই যে, যাচ্ছে, ওপাশে দৌড়ে অন্যপাশে চলে গেল সে।
কুত্তার বাচ্চা একটানা জঘন্য ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে কুয়াশাও ছুটলো। রেলিংয়ের কাছে পৌঁছেই হারপুন তুললো মাথার ওপর।
ততক্ষণে হারপুনের রেঞ্জের বাইরে চলে গেছে হাঙর। বোট থেকে বিশ ফুট দুরে ভেসে উঠে লেজ ঝাপটাচ্ছে। ত্রিশ গজ দুরে গিয়েই বোটের দিকে ঘুরলে আবার ওটা। একবার মাথাটা পানির ওপর তুলেই ডুব দিলো। লেজটা পানির ওপর তুলে রেখে ছুটে এলো শাঁ করে। উত্তেজনায় পায়ের আঙলে ভর দিয়ে টান টান হয়ে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঢু মারলে বোটের গায়ে দানবটা। দুম করে চাপা বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হলো পানির নিচে। থরথর করে কেঁপে উঠলো বোট।
হারপুনটা ছুঁড়ে দিয়েছে কুয়াশা। হাঙরের ডান চোখের একটু ওপরে ঢুকে গেল সেটা। পিছিয়ে গেল দানবটা। আগের চেয়ে ধীর গতিতে ডেকের ওপর দিয়ে হেঁচড়ে গেল হারপুনে বাঁধা দড়ি।
এবার কোথায় যাবে, বাপধন? মাথায় হারপুন নিয়েও বাঁচার আশা আছে নাকি? বলেই হা হা করে হেসে উঠলো কুয়াশা।
পানির ওপরে এখন তিনটে বাঁশের টুকরো। কয়েক সেকেন্ড দ্রুত পানির ওপর দিয়ে ছুটে ডুবে গেল টুকরোগুলো।
ইয়াল্লা, চোখ কপালে তুললো কুয়াশা, তিনটে হারপুন নিয়ে হাঙর তো দুরের কথা, তিমিও টেকে না।
হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠলো বোট। কেউ যেন ঠেল। মেরে তুলে ফেললো। গাঙচিলকে পানির ওপর, তারপর ছেড়ে দিলো। বোটের একপাশের পানিতে দুটো আর অন্যপাশে একটা বাঁশের টুকরো ভেসে উঠলল। ডুবে গেল পরক্ষণে। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার ভেসে উঠলো বিশ ফুট দূরে।
আরো একটা হারপুন তুলে নিলো কুয়াশা।
মরবে তো ওটা শেষ পর্যন্ত? মহুয়ার গলায় পরিষ্কার আতঙ্ক।
ঘাবড়ানোর কিছু নেই, অভয় দিলে কুয়াশা, যতই খেল দেখাক, মারবোই ওকে শেষ পর্যন্ত। আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন।
ঘেমে যাওয়া হাতের তালু প্যান্টের পেছনে মুছলো শহীদ। মারা গেলে নেয়ার ইচ্ছে আছে নাকি সাথে করে?
তা তো আছেই।
কিন্তু মরবে কখন ওটা? রক্তক্ষরণ নিশ্চয়ই কম হচ্ছে না?
সময় হলেই মরবে।
ততক্ষণ?
অপেক্ষা করবো।
অপেক্ষা করে চললো ওরা। আস্তে আস্তে চলছে তো চলছেই বাঁশের টুকরোগুলো। প্রথম প্রথম কয়েক মিনিট ডুবে থেকে থেকে ভেসে উঠছিল ওগুলো দশ-বারো গজ পর পর। এখন খুব কম ডুবে থাকছে। আরো কিছুক্ষণ পর ভেসে থাকলে স্থির হয়ে। ডুবছে না আর একেবারেই।
কী মনে হয়? জিজ্ঞেস করলে। শহীদ। মরেছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
মাছ উঠানোর উয়িঞ্চটা বসানো আছে ডেকের শেষ প্রান্তে। রেলিংয়ে ঝুঁকে পড়ে ইঞ্জিনরূমে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে চেঁচালো কুয়াশা, ইলেকট্রিক মোটরটা স্টার্ট দাও।
প্রায় সাথে সাথেই মোটর স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। উয়িঞ্চের কাছে এগিয়ে গিয়ে একবার সুইচ টিপে দেখে নিলে কুয়াশা কাজ করছে কিনা যন্তটা। সন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে গেল হুইলহাউসের দিকে। স্টার্ট হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিনও। ধীরে ধীরে বোটটাকে ভাসমান বাঁশের টুকরোর কাছে নিয়ে গিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলো আবার কুয়াশা। ইঞ্জিন থেমে যেতেই বেরিয়ে এলো হুইলহাউস থেকে।
হারপুন বাঁধার দড়িগুলোর কাছে গিয়ে বসে পড়লো ডেকের ওপর। কোমরের বেল্টে গেঁজা ছুরিটা বের করে কাজে লেগে গেল। প্রথমে একটা দড়ির একপ্রান্তে বাধা বাঁশের টুকরো গিট কেটে খুলে নিলো। তারপর খুললো হারপুনটা।
দড়িটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল উয়িঞ্চের কাছে। দড়ির একটা মাথা জিন পোলে আটকানো কপিকলের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যপাশ দিয়ে বের করে আনলো। আটকালো মাথাটা উয়িঞ্চে। হাত দিয়ে উয়িঞ্চের গায়ে কয়েক প্যাচ জড়িয়ে নিলো দড়িটা। দড়ির অন্য মাথাটা তুলে ফাস বানালো একটা। রেলিংয়ের ধারে এগিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে দিলো ফাসটা একটা ভাসমান বাঁশের টুকরোর ওপর। অব্যর্থ লক্ষ্য। সোজা বাঁশের টুকরো গলে পানিতে ডুবে গেল ফাসটা। হ্যাঁচকা টান পড়লেই বাঁশের টুকরো বাঁধ। হারপুনের দড়িতে আটকে যাবে স। ফিরে এসে উয়িঞ্চের সুইচটা টিপে দিলো কুয়াশা। মুহূর্তে টান টান হয়ে গেল দড়ি।
সামলাতে পারবে উয়িঞ্চটা? জিজ্ঞেস করলো শহীদ।
বলা যায় না। মরে গেলে টেনে তুলতে পারবে না নিচ থেকে। জ্যান্ত থাকলে আপনি উঠে আসবে টান পড়লে।
মৃদু গুঞ্জন তুলে ধীরে ধীরে ঘুরে চললো উয়িঞ্চ। তিন থেকে চার সেকেণ্ড লেগে যাচ্ছে এক এক পাক ঘুরতে। হঠাৎ পুরো চিলা পড়ে যাওয়ায় দ্রুত উঠে আসতে থাকলো দড়ি।
ছিড়ে গেল নাকি? জিজ্ঞেস করলো কামাল।
না, উদ্বেগ দেখা দিলো কুয়াশার চেহারায়, উঠে আসছে হারামী জানোয়ারটা। ছুটে কন্ট্রোলরূমে ঢুকেই আবার ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার নির্দেশ দিলো। প্রাণপণে সামনে ছোটাবার চেষ্টা করলো বোট। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।
ভুশ করে বোটের ডানপাশে মাথা তুললো হাঙরটা। লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড জোরে মাথা দিয়ে ঢু মারলে বোটের গায়ে। মড়মড় করে উঠলো কাঠের জোড়া। একবার কাত হয়েই সোজা হয়ে গেল আবার বোট। ইঞ্জিন চালু থাকায় পুরো শক্তিতে আঘাত করতে পারেনি দানবটা। এ-যাত্রা বেঁচে গেল বোট।
চিৎকার করে আরো কিছু গালাগাল দিলো কুয়াশা। ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে এলো সে। ছুটে গিয়ে একটা হার পূন তুলে নিলো। কাত হয়ে বোটের তলা কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে হাঙরটা। সোজ। ওটার পেট লক্ষ্য করে হারপুন ছুড়লো কুয়াশা। ফোয়ারার মতো ছিটকে বেরিয়ে এলো লাল রক্ত। এবার মরবে দানবটা।
পানিতে উল্টেপাল্টে গড়ান দিচ্ছে হাঙটা। হঠাৎ তাল সাম লাতে না পেরে ডেকের ওপর পড়ে গেল কুয়াশা। পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো সোজা হয়। দেখলো শহীদ, কুয়াশার ডান পায়ে পেঁচিয়ে গেছে হারপনের দড়ি।
প্রাণপণ চেষ্টা করেও পা থেকে দড়ির প্যাচ খুলতে পারছে কুয়াশা। দড়ির এক হ্যাচকা টানে রেলিং টপকে পানিতে গিয়ে পড়লো সে। মরিয়া হয়ে হাত বাড়ালো বেল্টে গোঁজা ছুরিটার জন্যে। নেই ওটা কোমরে। ফেলে এসেছে ডেকের ওপরে।
ককিয়ে উঠলো মহুয়া। এতক্ষণ আতঙ্কিত নীরব দর্শক হয়ে ছিল সে। একটা কথাও বলতে পারেনি। দৃশ্যটা সইতে না পেরে দুহাতে মুখ ঢেকে ডেকের ওপর বসে পড়লো।
মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করলো শহীদ। তারপরই ডেকের ওপর থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে লাফ দিলো। রেলিং টপকে পানিতে পড়লো মাথা নিচু করে।
ভেসে উঠেই দেখলো মাত্র কয়েক ফুট দুরে হাঙরটা। প্রকাণ্ড হাঁ করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। মাথার ওপর তুললো ছুরিটা মারার কায়দায়। এসে গেল হাঙর। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চোখ লক্ষ্য করে বসিয়ে দিলো ছুরিটা শহীদ। পানিতে ভেসে থেকে দানবাকৃতি চলন্ত হাঙরের চোখে ছুরি বসানো সহজ কথা নয়। লাগলো না ছুরিটা জায়গামতো। চোখের একটু ওপরে গেঁথে গেল। হঁচড়ে পাঁচড়ে কোনমতে একপাশে সরে গেল শহীদ। থামলো না হাঙরটা। গতি কমাতে না পেরে শহীদকে ছাড়িয়ে চলে গেল কয়েক গজ। পেছনে টেনে নিয়ে গেল দড়িতে পাচানন কুয়াশাকে। কিছুদূর গিয়েই ঘুরলো। আবার। দিশেহারা হয়ে পড়েছে শহীদ। এবারে কী করবে? খোদা! সত্যিই কি তবে আজ মরতে যাচ্ছে? মরতে যাচ্ছে কুয়াশাও। মনে মনে স্থির করলো, মরতেই যদি হয় লড়ে মরবে। যদি একবার আঙুল ঢুকিয়ে দিতে পারতো হাঙরের চোখের ভেতর।
কিন্তু লড়তে হলো না ওকে। রাইফেলের গুলির শব্দ হলো হঠাৎ। পর পর দুবার। মাত্র এক ফুট দূরে হাঙরটার হাঁ করা চোয়াল বন্ধ হয়ে যেতে দেখলো শহীদ। মাথার ঠিক মাঝখানটায় দুটো ছিদ্র থেকে বেরুচ্ছে রক্তের ফোয়ারা। আস্তে আস্তে ডুবতে শুরু করলো হাঙরটার দেহ। পা থেকে এখনও দড়িটা খুলতে পারেনি কুয়াশা। এখনই কিছু একটা করতে না পারলে সে-ও ডুবে যাবে হাঙরটার সাথে। কিন্তু কী করবে শহীদ? ছুরিটাও নেই।
শহীদ সাহেব?
ডাক শুনে চমকে মুখ তুলে তাকালে শহীদ। রেলিংয়ের পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে বোটের ড্রাইভার। এক হাতে রাইফেল। অন্য হাত দিয়ে খাপে ভরা একটা ছুরি ছুঁড়ে দিলো সে শহীদের দিকে। শূন্যে থাকতেই খপ করে ধরে ফেললো ছুরিটা শহীদ। একটানে ছুরিটা খাপ থেকে বের করে নিয়ে দ্রুত সাঁতরে চললো কুয়াশার দিকে।
ক্ষিপ্র হাতে দড়ি কেটে দিলো শহীদ। মুক্ত হয়ে গেল কুয়াশা।
বোটের দিকে ফিরলো শহীদ। মুখে প্রশান্ত হাসি নিয়ে কামাল আর মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার। আদর করে হাত বোলাচ্ছে হাতের রাইফেলটার গায়ে। কুয়াশার ব্রিটিশ লী এনফিল্ড।
বোটের দিক থেকে ফিরে পানিতে মুখ ডোবালো শহীদ। চাইলে নিচের দিকে। আবছাভাবে দেখলো, ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে বিশাল একটা ছায়া। হারিয়ে যাচ্ছে দানবটা দৃষ্টিপথ থেকে। নেমেই যাবে ওটা ক্রমশ নিচে, আরো নিচে। সাগরের গভীর অন্ধকার তলদেশে গিয়ে ঠেকবে একসময়। মিটমিটে রহস্যময় আলো জ্বালিয়ে রাখবে ওর আশেপাশে বিচিত্র মাছের ঝাক। পচে যাবে একদিন অতবড় দেহটা, কিংবা তার আগেই খেয়ে শেষ করবে সাগরতলের মাংসভুক প্রাণীর দল। একসময় আর দেখা গেল না হারটাকে। পানির ওপর মাথা তুললে শহীদ।
বোটের রেলিংয়ে দড়ি বেঁধে দড়ির অন্য মাথাটা নিচে ঝুলিয়ে দিয়েছে কামাল। দড়ি বেয়ে উঠে এলো শহীদ আর কুয়াশা। ডেকে উঠেই শহীদের হাতে হাত মেলালো কুয়াশা, ধন্যবাদ। মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরিয়ে এনেছে আজ আমাকে।
আমাকে না দিয়ে ধন্যবাদটা ওকে দেয়া উচিত, কুয়াশা। আঙুল তুলে ড্রাইভারকে দেখালো শহীদ।
ধন্যবাদ, মিস্টার সিম্পসন, ড্রাইভারের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো কুয়াশা!
হাঙরের কবল থেকে বাঁচিয়েছি ঠিকই, কিন্তু পালাবার চেষ্টা করলে গুলি খাবে, কুয়াশা। কাজেই সাবধান। আপাতত তুমি আমার বন্দী, কঠোর গলায় বললেন মিস্টার সিম্পসন।
হাসলে কুয়াশা আবার। কোনো জবাব দিলো না।
বোকার মতো হাঁ করে ওদের দিকে চেয়ে থাকলো কামাল আর মহুয়া।
.
১৫.
রাগে ফুঁসছেন মিস্টার সিম্পসন।
এতে সাবধানে ছদ্মবেশ ধরে, এমনকি শহীদকে না জানিয়ে এসেও কুয়াশাকে বাগে আনতে পারলেন না তিনি। কুয়াশাকে কেবিনে ঢুকিয়েই এই বিপত্তি। বোটটা কুয়াশার। এর কোথায় কী কৌশল লুকোনো রয়েছে সেটা দিনকয়েক মাত্র ইঞ্জিন-ড্রাইভারি করে জানতে পারার কথা নয় মিস্টার সিম্পসনের। সেলুনের সব কটা লোহার চেয়ারের ওপর গদি পাতা। একটা চেয়ারে কুয়া শাকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসেছিলেন মিস্টার সিম্পসন। হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে গুপ্ত বেড়ি বেরিয়ে এসে চার হাত-পা চেয়ারের সঙ্গেই আটকে দিয়েছে তার। কুয়াশা গুপ্ত সুইচ টিপে দিয়েছে। হেসে জানিয়েছে কুয়াশা, কেবিনের সবকটা চেয়ারেই ওরকম ব্যবস্থা আছে। সাবধানতা আর কি!
সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল শহীদ। মিস্টার সিম্পসনকে সাহায্য না করলে বেআইনী কাজ হয়, আবার কুয়াশার বিপক্ষেও যেতে পারছে না। চোখ টিপেছে সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। ইঙ্গিতটা বুঝেছে কুয়াশা। রিভলভার উঁচিয়ে তাকেও লোহার চেয়ারে বসি য়েছে। বন্দী করেছে তাকে। ধরে এনে কামালকেও। কুয়াশার বিরুদ্ধে মহুয়ার কিছু করার প্রশ্নই ওঠে না। মুক্ত রাখা হয়েছে তাকে। অন্যদের সঙ্গে সে-ও বসে আছে সেলুনে।
সাগরের বুকে স্থির হয়ে ভাসছে গাঙচিল।
কতক্ষণ আর মুখ বুজে থাকা যায়। অস্বস্তিকর ঠেকছে ঘরের পরিবেশ। কামালই মুখ খুললো প্রথম, প্রথম থেকেই তুই কুয়া শাকে চিনতে পেরেছিলি, শহীদ?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা একসঙ্গে কাটিয়েও আমি কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তুই চিনতে পেরেও আমাদের জানতে দিলি না কেন?
তোর আমার সামনে যখন ছদ্মবেশ নিয়েছে কুয়াশা, আর পরিচয় ফাস করতে চাইছে না, অনুমান করলাম, কারণ আছে। কিন্তু কারণটা যে ইঞ্জিন-ড্রাইভারবেশী মিস্টার সিম্পসন, বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বোটে ওঠার পর নিজে এসে ডেকে হাজির না হওয়া পর্যন্ত একবারও দেখা হয়নি আমার মিস্টার সিম্পসনের সঙ্গে।
হু। কুয়াশার দিকে ফিরলো কামাল। তুমি পিছু নিয়ে ছিলে কেন পারভেজের?
ইউজেনিকসের ফর্মুলা উদ্ধার করতে।
পেয়েছ?
দ্বীপে আমি বোটে ফিরে আসার কথা বলে তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবার পর তুমি শহীদ আর মহুয়ার খোঁজে গিয়ে ছিলে। ফিরে না এসে আমিও গিয়েছিলাম অন্য পথে। কিন্তু তার আগে ফমুলাটা হস্তগত করার জন্যে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখেছি পারভেজ ইমামের ল্যাবরেটরি। পাইনি। অন্য আর কোথায় রাখতে পারে ভাবতে চেষ্টা করছি বেরিয়ে এসে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলাম পারভেজকে। মারাত্মক ভাবে আহত, রক্ত ঝরছে গা দিয়ে। চট করে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। তারপর পিছু নিলাম ওর। এর পরের কাহিনী শহীদই বলতে পারবে তোমাদের।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না আমি, কুয়াশা। মহুয়াদি কিডন্যাপ হবার সময় কক্সবাজারের আশপাশেই ছিলে তুমি বোট নিয়ে। তোমার নজর এড়ালে কী করে কিডন্যাপাররা?
মহুয়া আর শহীদ এসেছে কক্সবাজারে, খবর পেয়েছি আমি। কিন্তু অতো তাড়াতাড়ি ওদের খোঁজ পেয়ে যাবে শত্রুপক্ষ, বুঝিনি। তাহলে আগে থেকেই চোখ রাখতাম। মিস্টার সিম্পসনের অফিসে আর শহীদের বাসায় যে গুপ্তচর নিয়োগ করার স্পর্ধা দেখাবে পারভেজ, কল্পনাই করতে পারিনি। আসলে প্রথম থেকেই সুপার ম্যানকে খুব ছোট করে দেখেছি আমরা। মস্ত ভুল হয়ে গেছে।
ইউজেনিক্স এবং সেইসঙ্গে মারাত্মক অ্যাটমিক মিসাইলের ফর্মুলা নিয়ে তো পালিয়ে গেল সুপারম্যান, বললো শহীদ, আবার কোন্ রূপে দেখা দেবে সে, কে জানে? তাছাড়া প্রতি শোধ নেবার চেষ্টা করবেই সে আমাদের ওপর। হুশিয়ার থাকতে হবে এখন থেকে।
ঠিকই বলেছে, সায় দিলে কুয়াশা, হাঙরের বদলে এবার তিমি কিংবা হাতিকে দানব বানাবে হয়তো।
হাঙরের কথায় হাসলো শহীদ। যে হারে গালাগাল করতে পারে তুমি, পারভেজ শুনতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে নেবে সব দানব!
একটু লজ্জিত মনে হলো কুয়াশাকে। বদ অভ্যাস হয়ে গেছে, কৈফিয়ত দেবার সুরে বললো সে, হাঙর কিংবা অন্য যে কোনো জলজন্তু শিকার করতে গেলেই এখন গালাগাল বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে জেলেদের সঙ্গে কাটিয়ে ছিলাম কিছুদিন, তখনই হারপুন গেঁথে হাঙর শিকার করতে শিখেছি। সাংঘাতিক মুখ খারাপ করে গালাগাল দেয় ওর শিকারের সময় শিকারকে। নইলে নাকি জোশই আসে না। কী করবো, শিখে গেছি আমিও। এখন শিকারের উত্তেজনায় নিজের অজান্তেই গালাগাল বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। একটু হেসে যোঙ্গ করলো। কুয়াশা, তাছাড়া গালাগাল করেছে হায়দার শেখ, আমাকে কেন দোষ দিচ্ছো?
গুরগুর একটা আওয়াজ শোনা গেল এই সময়। উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল কুয়াশা। আকাশের দিকে চাইলো। এদিকেই আসছে টুকটুকে লাল আর শাদায় মেশানো কপ্টারটা।
কেবিনে এসে ঢুকলো আবার কুয়াশা। বললো, চলি, মিস্টার সিম্পসন। আমার হেলিকপ্টার এসে গেছে। ট্রান্সমিটারে খবর পাঠিয়েছিলাম একটু আগে। মহুয়ার দিকে ফিরে বললো, আমি চলে গেলে সবার বাঁধন খুলে দি, দিদি।
কোনো কথা বললো না মহুয়া। চোখ তুলে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকলে শুধু। টলোমলো চোখ।
কিন্তু একটা লোকসান হলো তোমার, কুয়াশা, বলে উঠলেন মিস্টার সিম্পসন, এই সুন্দর বোটটা আর কোনদিন ফিরে পাচ্ছো না তুমি। দাম কম নয় এটার, কী বলে?
উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়লো কুয়াশার সারা মুখে। ভুল করছেন, মিস্টার সিম্পসন। আমার একটুও লোকসান হয়নি। বরং আপনাদের জিনিস আপনারা ফিরে পেয়েছেন।
হোয়াট?
তাই। মাস দুয়েক আগে সদরঘাট থেকে ফ্লাইং বার্ড নামে একটা পুলিশ বোট হারিয়ে গিয়েছিল না? আমিই চুরি করেছিলাম ওটা। রঙ পালটে ভেতরের জিনিসপত্রের একটু পরিবর্তন করে নিয়েছিলাম নিজের সুবিধার্থে। ফ্লাইং বার্ডেরই নাম পালটে রেখেছি গাঙচিল।
নরকে পচে মরবে তুমি, কুয়াশা, অসহায় ক্রোধে দাঁতে দাঁত চাপলেন মিস্টার সিম্পসন।
আশা করি সেখানেও দেখা হবে আপনার সাথে, মুচকে হাসলে কুয়াশা।
অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে হেলিকপ্টারের গর্জন। একেবারে বোটের ছাতের ওপর এসে ঝুলছে শূন্যে। নিচে নেমে এসেছে দড়ির মই।
আর দেরি করা যায় না, বললো কুয়াশা। চলি, মিস্টার সিম্পসন। চলি, শহীদ, কামাল। আবার দেখা হবে। এগিয়ে এসে মহুয়ার মাথায় হাত রাখলো, যাই, দিদি। সবার উদ্দেশ্যে বললো, গুডবাই।
লম্বা লম্বা পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
আর থাকতে পারলো না মহুয়া। কেঁদে ফেললো মুখে আঁচল চাপা দিয়ে।
Leave a Reply