পল্লীগীতির কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্মদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর মেয়ে বিখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান
আব্বাকে তো সবাই একজন শিল্পী হিসেবেই জানে। আমি জানি বাবা হিসেবে। আদর্শ বাবা। কিন্তু তিনি কেমন স্বামী ছিলেন—কথাটা মা বেঁচে থাকলে ভালো বলতে পারতেন। হয়তো কোনো সময় বলেছেনও। আমি সন্তান হিসেবে যতটুকু দেখেছি, আব্বা সত্যিই ভালো স্বামী ছিলেন। মাকে তিনি আলাদা সম্মান করতেন।
মার আসল নাম লুত্ফুন্নেছা। আব্বা আদর করে আলেয়া ডাকতেন।
প্রায় সব সময়ই দেখা যেত, যেকোনো ব্যাপারে আব্বার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু একটিবারের জন্য হলেও তিনি মাকে জিজ্ঞেস করতেন, আলেয়া তুমি কী বলো?
এটা আমার খুব ভালো লাগত। এখানে আব্বার একটা রোমান্টিকতা প্রকাশ পেত। আব্বার মতো প্রেমিক স্বামী পাওয়া যেকোনো নারী জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।
ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে আব্বা সব সময় মার সহযোগিতা নিতেন। মা যে খুব শিক্ষিত নারী ছিলেন, তা কিন্তু নয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর আমার বড় ভাই মোস্তফা কামালের জন্ম।
মার সঙ্গে বাবার একেবারে ঝগড়া হয়নি, এটা ঠিক না। কিন্তু আমরা টের পেতাম না। উঁচু কণ্ঠে চিত্কার কখনো শুনিনি। মাঝেমধ্যে দেখতাম, মা হয়তো কোনো কারণে অভিমান করেছেন। আব্বা সেটা বুঝতেন। তারপর মাকে নিয়ে রিকশায় করে কোথাও ঘুরতে চলে যেতেন। কিংবা সিনেমা দেখে আসতেন। যাওয়ার আগে বলতেন, ‘মাগো তোমরা পড়ো। আমরা একটু ঘুরে আসছি।’
আব্বা ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। নামাজের ব্যাপারে বেশ তাগিদ দিতেন। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজটা আমরা এক সঙ্গে আদায় করেছি। তাই যেখানেই থাকতাম, মাগরিবের সময় বাসায় ফিরতাম।
পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার পর আমার চাচা-চাচিরাও চলে এলেন। আব্বা নিজের বাড়িতে তাঁদের রেখেছেন। আমাদের পুরানা পল্টনের বাড়িটা একটা মেলার মতো ছিল। খুব আত্মীয়স্বজন আসত। বছরের বেশির ভাগ সময় আমরা নিজেদের বিছানায় ঘুমানোর সুযোগ পেতাম না। যেখানে পড়েছি, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। কেউ ছুটি কাটাতে, কেউ চিকিত্সার জন্য, কেউ ভর্তি হতে কিংবা চাকরির জন্য আসত। এসব কাজে আব্বার কোনো কার্পণ্য ছিল না।
আব্বা কাউকে হেয় করে কথা বলতেন না। বেদারউদ্দিন চাচা, সোহরাব চাচা, শামসুদ্দিন চাচা, লতিফ চাচা, শেখ লুত্ফর রহমান—এঁদের যে কী স্নেহ করতেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সামনে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা আর পেছনে হিংসা, সমালোচনা—এটা কিন্তু তখন দেখিনি। আব্বা বলতেন, কেউ কারও জায়গা নিতে পারবে না। প্রত্যেকের জায়গা আলাদা।
আব্বা খুব আমুদে ছিলেন। লায়লা আপা—লায়লা আরজুমান্দ বানু—খুব তাড়াতাড়ি কণ্ঠে গান তুলতে পারতেন। আব্বার সেটা খুব ভালো লাগত। তিনি বলতেন, ‘ওর মতো হওয়ার চেষ্টা করো। একটা গান একবার শুনলেই মেয়েটার হয়ে যায়। ও একটা ব্লটিং পেপার।’ লায়লা আপাকে তিনি ডাকতেন ‘ব্লটিং পেপার’। তাঁরা এক সঙ্গে দেশের বাইরে অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছেন।
আভা আলম বলে একটি মেয়ে খুব ভালো গান করতেন। আব্বা তাঁর গানের খুব প্রশংসা করতেন। কোনো শিল্পীকে তুলে আনার ব্যাপারে আব্বার কোনো জুড়ি ছিল না। একবার যদি তিনি বুঝতে পারতেন, একে দিয়ে কিছু হবে, তাহলেই হলো। আব্বা নিজে তো ভাওয়াইয়া গান করতেন। তিনি কিন্তু একা রেকর্ড করে ক্ষান্ত হননি। সেই বলরামপুর, তুফানগঞ্জ, কোচবিহারের গ্রামগঞ্জ থেকে শিল্পীদের কলকাতায় এনে গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি বলতেন, একা আব্বাসউদ্দীন থাকলে হবে না। আরও শিল্পী তৈরি করতে হবে।
আব্বা আমাকে পল্টন ময়দানে ঈদের নামাজে নিয়ে যেতেন। যতটুকু মনে পড়ে, সেই ছোট বয়সে চার-পাঁচবার অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গে আমাকেও ঈদের নামাজে নিয়ে গেছেন। ঈদটা তো এক দিনের। কিন্তু ঈদ পুনর্মিলনী ছিল একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। এর রেশ থেকে যেত আরও অনেক দিন। এটা আমাদের কাছে খুব আনন্দের ছিল।
তুখোড় ছাত্র ছিলেন আব্বা। সব সময় প্রথম, কখনো দ্বিতীয় হননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল, তাঁর ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনায় খুব ভালো হবে। আমার বড় ভাই আব্বার মতো তুখোড় ছাত্র ছিলেন। পরের ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসীও সমান তালে ভালো করেছেন। আমিও করেছি মোটামুটি।
আমি পড়তাম কনভেন্ট স্কুলে। সেখানে ক্লাসে সব সময় প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতাম। আব্বা সব সময় বলতেন, মাগো পড়ো। তাঁর খুব শখ ছিল, আমি গড়গড় করে বিলেতি মেম সাহেবদের মতো ইংরেজি বলব।
তখন অন্য স্কুলের তুলনায় কনভেন্ট স্কুলের পড়াশোনাটা একটু ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। এর পরও তিনি আমাকে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে আর আব্বাসী ভাইকে পাশের সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই, তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর। প্রথম দিন পড়তে হয়েছিল, ‘আই ক্যান সিং, মাদার ক্যান সিং, ক্যান ইউ সিং।’ আমার এখনো মনে আছে, আব্বা একটা বড় খাতা তৈরি করে পুরো ইংরেজি বইয়ের প্রতিটা শব্দের অর্থ আলাদা করে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘মাগো মানেগুলো মুখস্থ করো।’
সত্যি বলতে, প্রথম তিন মাসের মধ্যে আমি ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠলাম। এমনভাবে আব্বা আমাকে পড়ালেন, আমার ইংরেজি খুব ভালো হয়ে গেল। আমি গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারলাম। আব্বার স্বপ্ন পূরণ হলো।
আমি পরীক্ষায় প্রথম কী দ্বিতীয় হলাম, তাতে আমার চেয়ে বেশি আনন্দ হতো আব্বার। সবার কাছে তা বলতেন। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি, তিনি আমাদের সামনে কখনো প্রশংসা করতেন না। বলতেন, ছেলেমেয়েদের সামনে যদি প্রশংসা করো, তাহলে তারা মাথায় উঠে যাবে। আরও ভালো করার চেষ্টাটা তখন থাকবে না।
আমাকে কনভেন্ট থেকে বলা হলো, তোমার তো বয়স হয়নি। আরও দুই বছর পর সিনিয়র ক্যামব্রিজ দিতে হবে। তখনো আমার ১৫ বছর হয়নি। আব্বা বললেন, তুমি বাংলা স্কুলে ভর্তি হও। ছয় মাসের মধ্যে মেট্রিক পরীক্ষা দাও। পড়াশোনার সঙ্গে যেন বয়সের মিল থাকে।
তিনি আমাকে কনভেন্ট স্কুল থেকে ছাড়িয়ে বাংলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলের নাম ছিল বাংলাবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। ওখানে ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম, মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস বাকি।
এখানে বিষয়গুলো সব আলাদা। সিনিয়র ক্যামব্রিজে যা পড়েছিলাম, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। যেমন: ইতিহাস। এটা কখনো পড়িনি। এ রকম অনেক বিষয় ছিল। তবে আমার পড়াশোনার মানটা ছিল সেই কনভেন্ট স্কুলের মতো। তাই পরীক্ষায় সব কটি বিষয়েই স্টার মার্কস পেলাম। সংগীতে পেলাম ৯৫। ওটা ছিল সে বছর সর্বোচ্চ নম্বর। আব্বার ভয় ছিল, মেয়ে তো ইতিহাসে গোল্লা খাবে। কিন্তু এই বিষয়ে আমি লেটার নম্বর পেয়েছিলাম। আমি সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় সপ্তম হয়েছিলাম। আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল ২৬ জুন। ১৯৫৬ সাল। দুই দিন পর ২৮ জুন, আমার জন্মদিন। আব্বা বেশ ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপন করার আয়োজন করলেন। অনেক শিল্পী এলেন। সেই অনুষ্ঠানের কথা আমি আজও ভুলিনি। এর আগে আমার কোনো জন্মদিন পালন করা হয়নি।
খুব মজা করতেন আব্বা। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আব্বার খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমরা চাচা ডাকতাম। তাঁর পুরো পরিবারের সঙ্গেই ছিল আমাদের দারুণ সম্পর্ক। তখন আমরা খুব ছোট। এক দিনের ঘটনা—সবাই ঘুমিয়েছে। আব্বা লুঙ্গিটা ওপরে টেনে মালকোচা দিলেন। গায়ে সরিষার তেল মাখলেন। মুখটা অন্য কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন। তিনি চোরের মতো করে সাজলেন। ওই সাজে তিনি মোস্তফা চাচার ঘরে ঢুকে গেলেন। সেখানে ট্রাংক নিয়ে টানাহেঁচড়া করার সময় আওয়াজ হলো। মোস্তফা চাচা টের পেয়ে দিলেন বেদম মার। সেই গল্প যতবারই আব্বা কিংবা গোলাম মোস্তফা চাচা বলতেন, ততবারই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার জোগাড় হতো।
আব্বার সঙ্গে কবি জসীমউদ্দীন চাচার একটা টক্কর থাকত। গল্প করতে করতেই লেগে যেত ঝগড়া। আব্বা তাঁকে খ্যাপাতে পছন্দ করতেন। কিছুক্ষণ রাগারাগির পর আবার গলাগলি, বন্ধুত্ব। এরপর মাকে ডেকে বলতেন, ‘আলেয়া মুড়ি মাখা দাও।’ এটা তাঁরা খুব পছন্দ করতেন। পেঁয়াজ, আদা, কাঁচা মরিচ আর বেশ সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে দিতেন মা। যত ভালো খাবারই থাক না কেন, ওই মুড়ি মাখা থাকলে তাঁদের আর কোনো খাবার লাগত না।
আব্বা খুব স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করতেন। লাউটা ছিল খুব পছন্দ। আব্বা বলতেন, এটা যতই খাও, ক্ষতি নেই। ফল কেনার বেলায় আব্বা ছিলেন ওস্তাদ। আম, কমলা, কলা যাই কিনুক, কিনেছেন শ ধরে।
আমাদের জন্য তখন একটা কষ্টকর খাবার ছিল খাসির পায়ার স্যুপ। চার আনায় খাসির ৮-১০টা পায়া পাওয়া যেত। বাসায় রোজ পায়া আসত। সকালে সবার নাস্তা হয়ে যাওয়ার পর মা এক হাড়ি পানিতে সেই পায়াগুলো গোলমরিচ আর লবণ দিয়ে কয়লার চুলায় বসিয়ে রাখতেন। বিকেলে ওটা বেশ ঘন হয়ে যেত। সেটা আমাদের অবশ্যই খেতে হতো। প্রতিদিন সেই খাবারটা খাওয়া আমাদের জন্য যে কী কষ্টকর ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। আব্বার মতে, জিনিসটা শরীরের জন্য খুব উপকারী। তাই যত কষ্টই হোক, খেতে হবে।
মাছ ছিল তাঁর খুব প্রিয়। বাজারে গেলে কয়েক পদের মাছ কিনে আনতেন। শিলং, পাঙাস, চিতল, ইলিশ—এগুলো ছিল তাঁর পছন্দ। একদিন তো সবগুলো পদের মাছই তিনি কিনে আনলেন। তখন তো আর ফ্রিজ ছিল না। মাকে তিনি বললেন, ‘আলেয়া যতটুকু পারো রান্না করো।’ তাঁর বন্ধুদের খবর দিলেন। তাঁরা সবাই পরিবার নিয়ে চলে এলেন। রান্না হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে, শেষে খুব হইহুল্লোড় করে খাওয়া হলো। এগুলো আব্বা খুব উপভোগ করতেন।
খাবারের মধ্যে বড় মুরগি ছোট ছোট টুকরা করে টকটকে লাল রান্না খুব পছন্দ করতেন। এ ছাড়া খুব পছন্দের মধ্যে ছিল ইলিশ মাছ আর লাউ-চিংড়ির তরকারি। আব্বা নিজে খুব ভালো রান্না করতেন। কোথাও হয়তো কিছু খেয়ে ভালো লাগলো। বাসায় এসে সেটা আবার আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন।
ছোটবেলায় আমরা খুব ক্যারম খেলতাম। আব্বাও খেলতেন। খেলতে বসে তিনি অন্য কোনো ঘুঁটির দিকে তাকাতেন না। কখন লালটা ফেলবেন, সেটাই ছিল একমাত্র চেষ্টা। ওদিকে আমরা সব ঘুঁটি ফেলে দিলাম। আব্বার খেয়ালই নেই, তিনি সেই লাল নিয়েই আছেন। বড় হওয়ার পর বাড়ির সামনের উঠানে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। হঠাত্ তিনি আমাদের খেলতে বলে রান্নাঘরে চলে যেতেন। সেখানে আলু, ফুলকপিসহ আরও অনেক কিছু সিদ্ধ করে তার সঙ্গে কিছু মশলা দিয়ে চটপটির মতো তৈরি করতেন। খেলা শেষ হওয়ার পর তা খেতে দিতেন।
আব্বা কিন্তু খুব সিনেমা দেখতেন। আমরা যখন বড় হলাম, তখন ছিল উত্তম-সুচিত্রার যুগ। তাঁদের সব ছবিই দেখতেন। যে ছবির গান কিংবা গল্প খুব ভালো লাগত, সেটি কয়েকবার দেখতেন। প্রথম তিনি মাকে নিয়ে দেখে আসতেন। এরপর আমাকে আর আব্বাসী ভাইকে পাঠিয়ে দিতেন দেখে আসার জন্য। কোনো গান যদি খুব ভালো লাগত, তাহলে সেটা আমাকে কয়েকবার দেখাতেন। তখন তো গানপ্রধান ছবি বেশি হতো। যেসব ছবির গান পছন্দ হতো, সেই গানের রেকর্ড কিনে আনতেন। গানটা কণ্ঠে তুলে নেওয়ার জন্য বলতেন। ইংরেজি ছবিও দেখতেন, উর্দু ছবি তত না।
ঢাকায় আসার পর রূপমহল, আজাদ প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে যেতাম। পল্টনে আসার পর গুলিস্তান সিনেমা হল তো আমাদের চোখের সামনে হলো। রূপমহলেই বেশি ছবি দেখা হয়েছে। ওখানে বাংলা ছবিই বেশি দেখানো হতো। আর মেয়েদের জন্য ছিল আলাদা বসার ব্যবস্থা। এখানে মায়ের সঙ্গে ছবি দেখতে যেতাম। টিকিটের দাম ছিল চার আনা কী আট আনা। আসলে তখন তো বিনোদন বলতে শুধু সিনেমা। তাই সিনেমাটাই বেশি দেখা হতো।
আব্বা আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই ছোটবেলায় তিনি আমাদের দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর অনেকবার বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। দার্জিলিংয়েও গিয়েছি। কিন্তু আব্বার সঙ্গে সেই প্রথম যাওয়ার অনুভূতিটা এখনো ভুলতে পারি না।
আমাদের বেড়ানোটা হতো সাধারণত শীতকালে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর, ডিসেম্বরে। নিজে যখন নিয়ে যেতে পারেননি, আমাদের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিতেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে। অসম্ভব সুন্দর জায়গা। ওখানে আমার চাচা থাকতেন। সেখানে ১৫-২০ দিন বেড়িয়ে আসতাম। আবার নানা বাড়িতেও যেতাম। এই বেড়ানোটা আব্বার নিয়মের মধ্যে ছিল। তাঁর মতে, ছেলেমেয়েরা একটু বেড়িয়ে এলে জানুয়ারি থেকে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশোনা করতে পারবে।
আব্বার ডায়েরির একটা লেখা আমার ভালো লাগে। তিনি বেঁচে থাকতে কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি। এ ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, ‘এতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি যা পেয়েছি, তা হলো মানুষের ভালোবাসা। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আমি জানি, কোনো না কোনো সময় সরকার আমার কাজের মূল্যায়ন করবে।’ হয়েছেও তাই, মৃত্যুর পর তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
আসলে আব্বা যা বলে গেছেন, তার প্রায় সবই আমার নিজের জীবনে ফলতে দেখেছি। তাঁর মতো দূরদর্শী মানুষ আর দেখি না।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ
আমার আব্বার কথা
ফেরদৌসী রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩০, ২০০৯
Leave a Reply