নিনিকুমারীর বাঘ

নিনিকুমারীর বাঘ — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

তিতির বলল, আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি আর নাই পারি, বল ঋজুকাকা, নিনিকুমারীর বাঘের কথা ভাল করে শুনে তো নিই।

ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে বসে পুজোর পরের এক বিকেলে কথা হচ্ছিল। আমি তিতির আর ভটকাই গেছিলাম ঋজুদাকে বিজয়ার প্রণাম করতে। বাঘটার এমন নাম কেন হল? নিনিকুমারীর বাঘ? ভটকাই শুধোল।

ভটকাই খুবই সাবধানে কথাবার্তা বলছে। কারণ ওর অলিখিত অ্যাপ্লিকেশনটা আমি বিনা কালিতে রেকমেন্ড করে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি ঋজুদার কাছে। ওর নিজের তো বটেই, আমারও অনেকদিনের ইচ্ছে যে ভটকাই একবার ঋজুদার সঙ্গে যায় কোনো অ্যাডভেঞ্চারে। আমাদের এই সব অ্যাডভেঞ্চারের অবশ্য অন্য নাম আছে ভটকাই-এর পরিভাষায়। ও বলে, কড়াক্‌-পিঙ-ডং-ডিং।

ওদিকে ওর অ্যাপ্লিকেশনের কী গতি করবে তা ঋজুদাই জানে! ঝুলিয়ে রেখেছে এখনও। এবং শেষ পর্যন্ত রাখবেও। এই ঋজুদার তরিকা! অপটিমিস্ট ভটকাই রাইট অ্যান্ড লেফট তেল দিয়ে যাচ্ছে ঋজুদাকে। কিন্তু ও জানে না তেল দেওয়াটাও আদৌ সহজ কর্মের মধ্যে পড়ে না। তেল দিতে হলে তেল-বিশারদও হতে হয়। তাছাড়া কত্ত রকমের তেল আছে। মাল্টিগ্রেড, অর্ডিনারি! চল্লিশ নাম্বার, ষাট নাম্বার। পেট্রল, নাইনটি-থ্রি অকটেইন; এ সব ভালমত জানতে হবে। তার পরেও দেওয়ার সময়ে যদি ডিফারেনশিয়ালের ফুটোতে ব্রেক অয়েল দিয়ে দেওয়া হয় তা হলেও চিত্তির! তাই আমি মাঝে মাঝেই ঋজুদার অলক্ষে ভটকাইকে চিমটি কাটছি। কিন্তু এমনই হাবা-গবা যে, বুঝেও বুঝছে না। সাধে কি ওর শ্যামবাজারের বন্ধুরা ওকে নিয়ে গান বেঁধেছে ওরে ওরে ভটকাই আয় তোরে চটকাই?

ঋজুদা বলল, কীরে রূদ্র! এই তিতির, ভটকাই, তোরা খা। লুচিগুলো যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রাবড়ি দিয়ে লুচিগুলো খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।

ভটকাই রাবড়ি সহযোগে লুচির লোভ নস্যাৎ করে দিয়ে আবারও শুধোল, বাঘটার নাম ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ কেন, তা কিন্তু বলোনি ঋজুদা।

ঋজুদা পাইপে আগুন ধরিয়ে বলল, বুঝলি না! রাজা-রাজড়াদের ব্যাপার! সব রাজপরিবারেই রেওয়াজ ছিল যে রাজকুমারীরাও, বয়স বার-তের বছর হলেই তাঁদের প্রথম বাঘটি শিকার করবেন রাজকুমারদেরই মত। সে গোয়ালিয়র, রাজস্থান, ভূপাল বা কুচবিহার, যে রাজ্যই হোক না কেন! মহারাজা এবং বড় রাজাদের দেখাদেখি ছোট ছোট কদর রাজ্য এবং নকলনবিশ জাগিরদার, জমিদারদের পরিবারেও এই নিয়ম চালু হয়েছিল। নিয়ম না বলে বলা ভাল ঐতিহ্য! ট্রাডিশন! ভারতবর্ষ হচ্ছে ট্র্যাডিশনের দেশ।

বলেই একটু থেমে পাইপে লম্বা টান লাগাল একটা।

তারপর বলল, সাম্বপানি, যেখানে আমাদের যাওয়ার নেমন্তন্ন এসেছে নিনিকুমারীর বাঘের মোকাবিলা করতে, সেটি ছিল ওড়িশার একটি ছোট্ট, অখ্যাত রাজ্য। সেই রাজ্যের ছোট রাজকুমারীর নাম ছিল নিনি। কিন্তু যে বাঘের নাম নিনিকুমারীর বাঘ তা কিন্তু তার জীবনের প্রথম বাঘ নয়; শেষ বাঘ। সাম্বপানির নিনিকুমারী আজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত প্রায় নব্বই বছর। বছর দশেক হলে উনি গত হয়েছেন। তাঁর বয়স যখন আশি টাশি তখন শীতকালে অষ্টমী পুজোর সময় বাপের বাড়ি এসে হঠাৎ তাঁর শখ চাপল যে নিজেদের খাস জঙ্গলে উনি একটি বাঘ মারবেন। প্রমাণ করবেন যে তিনি আদৌ বুড়ি হননি। কুড়িতে বুড়ি হয় মধ্যবিত্ত বাঙালী মেয়েরাই। এই নিয়ম কি আর রাজকুমারীদের বেলায় খাটে!

তারপর? আমি বললাম, জম্পেশ করে রাবড়ি মাখিয়ে একটি লুচি মুখে পুরে দিয়ে।

 বাঘ তো মারবেন ঠিক করলেন নিনিকুমারী কিন্তু বাঘ শিকার তো সারা দেশেই তখন বেআইনী হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজা-রানীদের বেলা কোনো আইনই খাটে না। করদ রাজ্যের রাজা-রানীদেরও বেলাতেও নয়; গণতন্ত্রের রাজা-রানীদের বেলাতেও নয়। রাজা-রানীদের পায়ে মাথা ঠেকানোই আমাদের ঐতিহ্য।

ভটকাই বলল, ট্র্যাডিশন।

অতএব রাজত্ব থাক আর নাই থাক, প্রজারা বাঘ-শিকারের সব বন্দোবস্তই পাকা করে ফেলল।

উঁচু পাহাড়ের উপরে একটি দুর্গ ছিল। ওড়িয়াতে বলে গড়। সেটি শুটিং-লজ হিসেবে ব্যবহৃত হত। তার নাম ছিল শিকার-গড়। খবর গেল শিকার-গড়-এ। ধুলো পড়ে লাল হয়ে যাওয়া ঝাড়-লণ্ঠন যতখানি সম্ভব পরিষ্কার করা হল। শতচ্ছিদ্র গালচে নতুন করে পাতা হল। শিকারের পর সন্ধেবেলা সেখানে নাচ-গান হবে। পার্টি হবে। করদ রাজ্যের পুরনো শিকারীরা তাদের প্রায় মরচে ধরে যাওয়া বন্দুক রাইফেল বের করে। একটি খুব বড় বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখে তার চলাফেরার খোঁজ খবর নিয়ে হাঁকোয়া শিকারের বন্দোবস্ত করে ফেললেন। শিকারের দিন লাঞ্চ খাবার পর নিনিকুমারী একটি কুরুম গাছে বাঁধা মাচাতে একেবারে একা গিয়ে বসলেন। মই বানিয়ে রেখেছিল ওরা। সিল্কের ওয়াড়-পরানো ডানলোপিলোর গদীমোড়া মোড়া পেতে। অন্য কোনও শিকারীর সাহায্য নিতে তিনি একেবারেই রাজি হলেন না সেদিন।

হাঁকা শুরু হবার একটু পরই হঠাৎ তাড়া খেয়ে নালার পাশের গুহার মুখে শীতের দুপুরের রোদে ভরপেট খেয়ে আরামে ঘুমিয়ে-থাকা বাঘ বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে শিকারীদের পরিকল্পনা মতই চলতে লাগল একেবারে সোজা নিনিকুমারীর মাচা যেদিকে, সেদিকেই। আগের রাতে বাঘটি একটি দারুণ শম্বর মেরে তার অনেকখানিই খেয়েছিল। চলতে কষ্ট হচ্ছিল বেচারার। চলতে যে হবে তা জানাও ছিল না। বাঘ মাচার সামনে আসা মাত্র নিনিকুমারী গুডুম করে গুলি করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রচণ্ড গর্জন করে লাফ মেরে কুরুম গাছের পেছনের দুর্ভেদ্য কন্টা বাঁশ আর হরজাই জঙ্গলের মধ্যে বাঘ তো ঢুকে গেল। নিনিকুমারীর হাতে ডাবল ব্যারেল রাইফেল থাকা সত্ত্বেও আর গুলি করলেন না উনি। কোনো শিকারীকেও তিনি বাঘের রক্তর দাগ দেখে অনুসরণ করতে মানা করলেন। মাচা থেকে নেমে বাইফোকাল চশমাটি খুলে সুগন্ধী সিল্কের রুমালে কাচ মুছতে মুছতে বললেন যে গুলি লেগেছে বাঘের বুকে। হার্টে। থ্রি-সেভেনটি-ফাইভ ম্যাগনাম-এর গুলি। বাঘ মরে পড়ে থাকবে। কাল সকালে পোড়ো নিয়ে গিয়ে খুঁজে বের করে বাঘকে নিয়ে এসো রাজবাড়িতে। বকশিস্ দেব তোমাদের।

পোড়ো কী, ঋজুদা? তিতির বলল।

ও। পোড়ো মানে মোষ। ওড়িয়াতে। উচ্চারণটা পোড়হো।

গুলি হয়েছিল দুপুরে। পরদিন ভোরেই শিকারীরা রক্তর দাগ দেখে দেখে অনেক দূর গিয়ে দেখল বাঘ শিকার-গড়-এর উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে। রক্তর বা পায়ের দাগও পাওয়া গেল না। ঐ রাইফেলের গুলি বুকে লেগে থাকলে বাঘের পক্ষে অত উঁচু পাহাড় চড়া সম্ভব হত না আদৌ। রক্তর রকম এবং পরিমাণ দেখেই অভিজ্ঞ শিকারীরা বুঝেছিল যে নিনিকুমারীর গুলি হয় বাঘের গা ছুঁয়ে গেছে, নয়ত সামনের দুই পায়ের এক পায়ের থাবাতে বা কব্জিতে লেগেছে। বুকে কখনই নয়।

ঐ খণ্ডিয়া বাঘকে হারিয়ে ফেলে শিকারীরা খুবই চিন্তায় পড়েছিল। পরে কী হবে তা ভেবে। এবং তাদের চিন্তা যে অমূলক ছিল না আদৌ তা তো আমরা এখন দেখছিই।

খণ্ডিয়া মানে? ভটকাই শুধোল। ঋজুদাকে।

 খণ্ডিয়া ওড়িয়া শব্দ। খণ্ডিয়া মানে আহত; উনডেড। গুলি লেগেছিল বাঘের ডান কব্জিতে সামনের দিকে। বেচারার কব্জিটাই হেভি রাইফেলের গুলিতে ভেঙে যায়। তারপর থেকেই সে যাকে বলে কব্জি-ডুবিয়ে মানুষের হাড় মাংস খেয়ে যাচ্ছে।

একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, দেশীয় রাজন্যবর্গর বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে এক এক জান্তব বিদ্রোহ হয়ে উঠে সে যেন প্রতিশোধ নিয়ে যাচ্ছে সাম্বপানি রাজ্যের নিনিকুমারীর পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের আমলের মাটিতে উবু-হয়ে-বসে দুহাতে ভক্তিভরে দণ্ডবৎ জানানো অগণ্য অভুক্ত ছিন্ন-বাস প্রজাদের অনেক এবং অনেক রকম অপমানের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন, সর্বংসহ বোবা, বড় গরিব প্রজাদেরই খেয়ে। বাঘটা নিজেও তো প্ৰজাই ছিল সে রাজ্যের! আমরা তো নিজেরাই নিজেদের খাই। এটাও আমাদের ঐতিহ্য।

ভটকাই রাবড়ির প্লেটটা ট্রেতে নামিয়ে রেখে বলল, ট্র্যাডিশন!

তিতির হেসে উঠল।

ঋজুদা বলল, আশ্চর্য! জানিস, বাঘটা পুরনো সাম্বপানি রাজ্যের এলাকার বাইরে একজনও মানুষ ধরেনি আজ অবধি। যদিও গত দশ বছর ধরে সমানে সে মানুষ খেয়ে চলেছে।

কত বর্গ কিলোমিটার হবে এই রাজ্যের এলাকা ঋজুকাকা?

দুর্গম সব পাহাড় আর ঘন বনের রাজ্য। পাহাড়ী ঝরনা আর নালাতে কাটাকুটি। নদী বলতে একটাই বয়ে গেছে অন্য রাজ্য থেকে এসে সাম্বপানির মধ্যে দিয়ে। গেছে অন্য রাজ্যে। নদীর নাম কনসর। ভারী সুন্দর নদী। জেঠুমণির সঙ্গে আমি একবার বামরা করদ রাজ্যে শিকারে গেছিলাম, তখন দেখেছিলাম। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরো অঞ্চলেরই! ঋজুদা বললো।

আমি বললাম, গত দশ বছরের মধ্যে এই বাঘকে মারতেই পারল না কেউ? না কি, কেউ চেষ্টাই করেনি?

না না। তা কেন? অনেক শিকারীই গেছেন এর আগে। আমাদের চেয়ে অনেকই ভাল ভাল শিকারী। তাছাড়া, কলকাতায় কজন আর ভাল শিকারী আছেন? আমাদের কান ধরে শিকার শেখাতে পারেন এমন শিকারী ভারতের যে-কোনো বনাঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে গণ্ডা-গণ্ডা আছেন। মফস্বল শহরগুলিতে তো আছেনই। নিনিকুমারীর বাঘকে মারতে বন বিভাগের বিভিন্ন অফিসার, জেলার বিভিন্ন সময়ের ডি এম এবং পুলিস সাহেবরাও চেষ্টা করেছেন। বাইরে থেকেও অনেক শিকারীকে ওঁরা নেমন্তন্ন করেও নিয়ে গেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। স্থানীয় সকলেরই ধারণা হয়ে গেছে যে এ বাঘ, ঠাকুরানীর বাঘ। একে মারা কারওই সাধ্য নেই। ঠাকুরানীর কৃপাধন্য সে। ঐ শিকার-গড়-এর মধ্যে নাকি চণ্ডীমূর্তি আছে। কটক শহরের কটকচণ্ডীর মতই নাকি অত্যন্ত জাগ্রত দেবী তিনি। সাম্বপানির রাজারা আগে খুব ধুমধাম করে শিকার-গড়ে তাঁর পুজো করতেন। মোষ বলিও হত। এখন এই বাঘ নাকি সেই জাগ্রত দেবীরই কৃপাধন্য হয়েছে বলে স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করে। মানুষ-খেকো বাঘই এখন চণ্ডীর একমাত্র উপাসক। তাই ভয়ে অন্য কেউ সেখানে আর যায়ই না।

এই সব ওরা এখনও বিশ্বাস করে? এরকম সুপারস্টিশানে? তিতির বলল।

ভটকাই তিতিরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, না কেন? কেন না? একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যদি রাজস্থানে এখনও ষোল বছরের মেয়ে রূপ কানোয়ার সতী হতে পারে, যদি পাকিস্তানে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরে দোষীর প্রাণ বের করা হয়, প্রকাশ্য স্থানে, নিজের দেশকে ভালবাসেন এই অপরাধে ভুট্টোকেও যদি বিচারের প্রহসন করে ফাঁসি দেওয়া হয়, তবে ঠাকুরানীর বাঘে বিশ্বাস করে গভীর জঙ্গলের গরিব বাসিন্দারা বেশি দোষ কী করেছে? এই উপমহাদেশেই আবার সুপার-কম্পুটারও বসে! সত্যই সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ!

আলোচনাটা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে আমি ঋজুদাকে বললাম, বাঘটাকে মারবার জন্যে আর কী করা হয়েছিল এই দশ বছরে?

কী করা হয়নি তাই জিজ্ঞেস কর বরং। ঋজুদা বলল।

পাঁচ ব্যাটেলিয়ন আর্মড পুলিসও নাকি একবার পোস্ট করা হয়েছিল সমস্ত সাম্বপানিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সি আর পি-ও দৃ ব্যাটেলিয়ন। তাদের প্রত্যেককে অটোম্যাটিক রাইফেল দেওয়া হয়েছিল। রাতের পর রাত অনেকগুলি জিপে ও ভ্যানে স্পটলাইট ফিট করে পুরো এলাকাতে তন্নতন্ন করে সরষে দানার মত বাঘ খুঁজে খুঁজে বেড়াত তারা। মানুষখেকো হয়ে যাবার পর বাঘটার ওপর নাকি কমপক্ষে পঁচিশবার গুলিও চলেছে। অনেক শিকারীই মারাত্মকভাবে তাকে আহত করার দাবি করেছেন। গুলি করার পর আহত বাঘের গর্জনও শুনেছেন নাকি তিনজন শিকারী। তবুও নিনিকুমারীর বাঘ বহাল তবিয়তেই আছে এবং বাংলার গ্রামের শেয়াল গরমের দিনে যেমন কপাকপ কই মাছ খায়, তেমন করেই অবলীলায় মানুষ ধরে খেয়ে চলেছে।

ভটকাই বলল, এ তো মহা গুলিখোর বাঘ। দেখছি রীতিমত অ্যাডিক্ট হয়ে গেছে।

 ভটকাই-এর কথা বলার ধরনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, সাম্বপানি জায়গাটা নাকি গমগম করত একসময়। হাট বসত সপ্তাহে দুবার। কাঠ, বিড়িপাতা, তামাক এ সবের কারবার ভাল ছিল। সাকাস কোম্পানি আর যাত্রাপার্টি আসত প্রতি বছর শীতকালে ধান কাটার পর। চাষাবাদ এখন প্রায় বন্ধ। যাদেরই উপায় আছে কোনো, তারাই সাম্বপানি ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে। মহামারী লাগলে যেমন হয় তেমনই অবস্থা নাকি! কবছরের মধ্যে এই গল্প করা রমরমে জায়গাটা কঙ্কালসার শ্রীহীন বসতিতে পরিণত হয়েছে। দিনে রাত্রে মাত্র দুটি আপ আর দুটি ডাউন ট্রেন ছোট লাইনের এই স্টেশনটিতে এসে দাঁড়ায়। কোনও কারণে ট্রেন লেট হলে সন্ধের পরে প্ল্যাটফর্মে কেউ থাকে না। ট্রেনও দাঁড়ায় না সেদিন। স্টেশন মাস্টার সবুজ আলো দেখান না। সিগন্যালম্যানরা আউটার সিগন্যাল থেকে নেমে দিনে দিনে চলে আসে। কখনও কখনও নিনিকুমারীর বাঘকে সূর্য ডোবার আগে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতেও দেখা যায়। বাঘটার নাকি ভয়ডর নেই। কিন্তু শিকারীদের ধারে কাছে আসে না। কিল-এও কখনই ফেরে না।

আমি স্বগতোক্তি করলাম, খুউব কঠিন হবে তো এই বাঘকে মারা।

ঋজুদা যেন নিজের মনেই বলল, খুউবই কঠিন।

.

০২.

এবারে মিষ্টিদিদিদের বাড়ির ভাইফোঁটার নেমন্তন্নটা মাঠেই মারা গেল। সঙ্গে ধাক্কাপাড়ে ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবিটাও। ওগুলো হয়তো কলকাতায় ফিরে (যদি আদৌ ফিরতে পারি) পেলেও পেতে পারি, কিন্তু খাওয়াটা। বিশেষ করে মিষ্টিদির হাতে রান্না বড় বড় কইমাছের হর-গৌরী! একপাশে ঝাল আর অন্য পাশে মিষ্টি। ঈশ-শ-শ-শ। রিয়্যালি, গ্রেট লস্।

এখন গভীর রাত। হেমন্তের রাত। বন-বাংলোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল। অবশ্য গা ছমছম করার কারণ ছিল যে না, তা নয়। আছি যে মানুষখেকো বাঘের খাসতালুকের মধ্যেই।

বনে-পাহাড়ে হেমন্তের দিন রাতের সৌন্দর্যই আলাদা। আলাদা তার ব্যক্তিত্ব। শীতের তাপস এ আদৌ নয়। এর নেই বসন্তর চাপল্য। বর্ষার ঘনঘোর মেঘের দাড়িগোঁফের পুরুষও এ নয়, নয় গ্রীষ্মের উদাঘ রুখু রূপের কেউ। হেমন্ত ঠিক হেমন্তরই মত। এর কোনো বিকল্প নেই। হেমন্তর রাত আর হেমন্তর দিন। আহা! শিশিরের আর রাতপাখির ডানার গন্ধ। মেঠো ইঁদুরের নরম কোমল পেলব তলপেটের মত হেমন্তর বিকেল। কাছিমের পিঠের মত কালো উজ্জ্বল হেমন্তর এই স্তব্ধ শিশিরভেজা রাত। তুলনাহীন!

শেষ রাতের এক ফালি চাঁদ উঠেছে সেগুন জঙ্গলের মাথা আর কনসর নদীর পাশেই যে কুচিলাখাঁই পাহাড়, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে দিগন্ত ঘেঁষে। অমাবস্যার পরের ঘন কালো রাতে ঐ একফালি চাঁদ তো নয়, মনে হচ্ছে যেন অর্ডার দিয়ে বানানো রুপোর একটি ছোট্ট বাঁকা তলোয়ার। বনে জঙ্গলে এসে এই কলুষহীন স্নিগ্ধ সুন্দর চাঁদকে দেখে মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় যে মানুষ চাঁদে পা না দিলেও পারতো। খুবই বোকা-বোকা ভাবনা। সন্দেহ নেই।

ভটকাই এখন ঘুমোচ্ছে। ওর বিছানাতে। একেবারে কেষ্টনগরের চূর্ণি নদীর কাদা হয়ে, কম্বল মুড়ে। একই ঘরে আমাদের দুজনের বিছানা। মধ্যে বাংলোর ডাইনিং-কাম-সিটিংরুম। আর ও পাশের ঘরে ঋজুদা শুয়েছে। যে কোন বন-বাংলোরই ঘরগুলো কেমন, মানে, ভাল কী মন্দ তা ধর্তব্যই নয়। আসল হল, বারান্দা। সারা দিন সারা রাত বারান্দাতে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। আহা! কী সব চওড়া চওড়া বারান্দা। কী সব পুরনো দিনের ইজিচেয়ার! বারান্দার সাইজ যে বাড়ির যত হোট সেই বাড়ির মানুষদের মনই ঠিক সেই সাইজের। কথাটা অবশ্য মিস্টার ভটকাই-এর। উনি মধ্যে মধ্যেই এরকম বাণী দিয়ে থাকেন।

ঋজুদার সঙ্গেও ও সমানে ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করে যাচ্ছে। ওর কথা শুনে আমি তো ভয়ে মরি। ঋজুদার সঙ্গে অমন ভাবে কথা বলার সাহস তিতিরের তো বটেই, আমারও কখনও হবে না। পূর্ব-আফ্রিকার সেই রুআহা নদীর উপত্যকাতে আমি যখন প্রায় হাতে-পায়ে ধরেই পরের বারের অভিযানে ভটকাইকে সঙ্গে আনতে রাজি করাই ঋজুদাকে, তখন কি আর জানতাম যে ও এমন ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করবে? ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাবে? কিন্তু এমন সবজান্তা ভাব করলে ওর মামাতো দাদা ঘণ্টেদার কাছে কোনক্রমে পটিয়ে-পাটিয়ে আনা জিনস্ আর নর্থ-স্টার জুতো সুদ্ধ ও নির্ঘাৎ বাঘের পেটে যাবে। কোনো দেবতাই ঠেকাতে পারবেন না। মাঝখান থেকে আমার অবস্থা হবে মরারও বাড়া। মাসীমাকে গিয়ে কোন্ মুখে বলব যে মাসীমা, আমা-হেন বীর এবং বিশ্ববিখ্যাত ঋজু বোস সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ভটকাই নিনিকুমারীর বাঘের মেনু কার্ডে উঠে গেছে। আইটেম-এর নামটা কালকে ভটকাই নিজেই ভেবে-টেবে ঠিক করেছে। স্পেশ্যাল ফ্লেশ-ডিলাইট; কেষ্টনগর সিটি/শ্যামবাজার।

ফোক্কড় বলে ফোক্কড়।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেষ্টনগর সিটিই তো যথেষ্ট ছিল। আবার শ্যামবাজার কেন? ও ঠোঁটদুটো গোল করে ছোট করে ফেলে বলেছিল, মা-ন-তু! মেয়েরা আজকাল লেখে না? শ্যামলী চট্টখণ্ডী ঘোষ? অথবা নমিতা বোস বাইসন?

আমি বললাম, সে তো বিয়ে হয়ে গেলে! বাপের বাড়ি আর স্বামীর বাড়ির পদবি আলাদা আলাদা বোঝাতে। তুই কি মেয়ে? ভটকাই বলেছিল, ইডিয়ট। ব্যাপারটা হচ্ছে বাড়ির। সেটাই আসল। কেষ্টনগর সিটি ছিল বাপের বাড়ি। এখন শ্যামবাজারের মামাবাড়িই আমার নিবাস, সাকিন দাগ নম্বর, খতেন নম্বর যাই-ই বল। তবে? বাপের বাড়ির পরিচয় হাপিস করতে বলিস কোন্ আক্কেলে?

আমি আর কথা বাড়াই নি।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙল একটা ক্রো-ফেজেন্ট পাখির জবরদস্ত ডাকে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে কম্বলের পায়ের কাছে। ক্লোরোফিল ভরপুর ঘনসবুজ গাছ-গাছালির মধ্যে পড়ে প্রতিবিম্বিত হয়ে সে রোদ আসছে। কী গভীর শান্তি চারদিকে। কে বিশ্বাস করবে আমরা এখানে এসেছি মৃত্যুর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে! চোখ-মুখ ধুয়ে বাইরের বারান্দাতে এসেই দেখি ঋজুদা। বারান্দায় যেখানে রোদ লুটিয়ে পড়েছে, সেইখানে পাজামা-পাঞ্জাবির ওপরে শাল জড়িয়ে বসে দূরের পাহাড়ের মাথায় যে দূর্গের ভগ্নাবশেষ দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে রোদে-মোড়া নীল আকাশের ফ্রেমে বাঁধানো কোনো ছবিরই মত, সেই পোড়ো-দুর্গটির দিকে চেয়ে বারান্দার থামে দুপা তুলে দিয়ে পাইপ খাচ্ছে।

মিস্টার ভটকাই বন্দুক রাইফেলগুলো নিয়ে পড়েছে। রাইফেলগুলোর নল থেকে পুল-থ্রু দিয়ে টেনে টেনে তেল পরিষ্কার করছে আর দোনলা বন্দুকগুলোর নল পরিষ্কার করছে ফ্ল্যানেল-জড়ানো ক্লিনিং-রড দিয়ে।

আমাকে দেখেই ভটকাই তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, কীরে রুদ্রবাবু! আমার যোগব্যায়াম তো শেষই, মায় সর্ষের তেল গায়ে মেখে চান পর্যন্ত শেষ। আর তোর এতক্ষণে ঘুম ভাঙল? ম্যান-ইটার বাঘ মারতে এসেছিস তুই? ফুঃ!

ঋজুদা কী যেন ভাবছিল। বিরক্ত হয়ে বলল, এই! তোরা সকাল থেকেই দুজনে মোরগা-লড়াই শুরু করিস না তো! যা রুদ্র। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নিয়ে চান সেরে নে। আমিও যাচ্ছি আমার বাথরুমে। ঠিক আটটাতে ব্রেকফাস্ট দিতে বলেছি জগবন্ধুকে। তুই চান করতে যাবার সময় একটু তাড়া দিয়ে যাস। বালাবাবুও খাবেন আমাদের সঙ্গে। খেয়েই বেরিয়ে পড়ব আমরা।

চা ঢাললাম আমি কাপে পট থেকে। ঋজুদাকে বললাম, তুমি নেবে আর?

 ঋজুদা অন্যমনস্ক গলায় বলল, দে এক কাপ।

ঐ পাখিটার ওড়িয়া নাম জানিস? বল্ তো কী? ভটকাই ক্রো-ফেজেন্টের ডাকের দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল।

সাহস কত্ত! যেন পরীক্ষা নিচ্ছে আমার! দু’দিনের বৈরাগী ভাতরে কয় অন্ন। যার দৌলতে এখানে আসা তারই লেগ-পুল করছে।

জানি না। আমি তাচ্ছিল্যের গলায় বললাম। জানলেও… ।

হুঁ। হুঁ। কাটুয়া! আমি জানি।

ভটকাই চোখে-মুখে অসীম কৃতিত্ব জাগিয়ে বলল।

ঋজুদা আমাদের ঝগড়াতে কোনো পক্ষকেই সমর্থন না করে চুপ করে কী যেন ভাবছিল।

সামনের ঐ পাহাড়টার নাম যে কুচিলা-খাঁই তা তো জানিস, কিন্তু কুচিলা-খাঁই মানে কী বল তো?

অদম্য এক্স-কেষ্টনগর সিটি, অধুনা শ্যামবাজারের রাজ, কলকাতার আড্ডাবাজ ভটকাইচন্দ্র আমায় বলল।

মানেটা আমি জানি। ঋজুদার জন্যে চা ঢালতে ঢালতে বললাম আমি। তারপর বললাম, কুচিলা-খাঁই মানে, ওড়িয়াতে ধনেশ পাখি। ধনেশ পাখি দেখেছিস তো চিড়িয়াখানায়? এবারে বল তো কুচিলা শব্দটার মানে কী? উল্টে শুধোলাম আমি।

ভটকাই মনে হল মুশকিলে পড়ে গেল। মুশকিলে সে পড়তে পারে কিন্তু কোথাওই বেশিক্ষণ পড়ে থাকার পাত্রই সে নয়। কিন্তু আশ্চর্য! ভটকাই-এরও সুমতি হল। দু’দিকে মাথা নেড়ে বাধ্য ককার-স্প্যানিয়েলের মত সে জানাল, জানে না।

তারপর বলল, বলে দে আমাকে তুই।

কুচিলা একরকমের ফল। যে গাছে ঐ ফল ধরে তার নামও কুচিলা। ঐ ফল খেতে ধনেশ পাখিরা খুব ভালবাসে বলেই ধনেশ পাখিদের নাম এখানে কুচিলা খাঁই। আমি বললাম।

ভটকাই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, হাউ ডেঞ্জারাস।

এবার অবাক হবার পালা আমার। বললাম, এতে ডেঞ্জারের কি দেখলি?

ডেঞ্জার নয়? তুই কাউঠ্যা খেতে ভালবাসিস, মাসীমা কদবেল খেতে ভালবাসেন বলেই তোদের নাম হয়ে যাবে কাউঠ্যা-খাঁই আর কদবেল-খাঁই?

ঋজুদা ওর কথায় এত জোরে হেসে উঠল যে কাপ থেকে চা চকে পড়ল ভাল শালটার ওপর।

আমার আর ঋজুদার হাসি থামলে আমি বললাম, কুচিলা ব্যাপারটা কী তা জানিস?

ঋজুদার হেভি রাইফেলটার তেলমোছা শেষ করে চেয়ারের দুই হাতলের ওপর রেখে ও বলল, ব্যাপার আবার কী? কুচিলা কুচলারই খুব কাছাকাছি। কুচলা তো হিন্দি শব্দ। ময়লা-কচলা। বলে না?

কুচলা ঠিকই আছে। কিন্তু কুচিলার সঙ্গে কুচলার সম্পর্ক নেই। ওড়িয়া শব্দ এটি।

তাই?

ইয়েস স্যার! আর এই ধনেশ কিন্তু বড় ধনেশ যার ইংরিজি নাম দ্য গ্রেটার ইন্ডিয়ান হর্নবিলস্।

সে যাই হোক, কিন্তু কী বিটকেল নাম রে বাবা! কুচিলা খাঁই।

 নাম বিটকেল হলে কি হয় এ বড় গুণের গাছ। এই কুচিলা।

 কেন? কিসের গুণ?

এই গাছের ফল দিয়ে যে ওষুধ তৈরি হয় তা খাইয়েই তো মাসীমা তোর মত ছিঁচ-রুগীকে দু’পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ব্যামো একেবারে টাইট।

আমার ব্যামো? যেন গাছ থেকে পড়ে বলল ভটকাই।

ওষুধটা কি তা তো বলবি?

নাক্স-ভমিকা।

কী রে। বলিস কি তুই! নাক্স-ভমিকা থাট্টি?

ঋজুদা আবারও হেসে ফেলল, ভটকাই-এর কথা শুনে। বলল, নাক্স ভমিকার বুঝি থার্টি ছাড়া আর স্ট্রেংথ হয় না? কি রে ভটকাই?

ভটকাই ক্ষণকালের জন্যে অফ-গার্ড হয়ে হেসে নিজের বোকামি মেনে নিল।

ভারী সুন্দর জায়গাটা কিন্তু। চায়ের কাপে আর এক চুমুক দিয়ে আমি বললাম ঋজুদার দিকে চেয়ে।

হ্যাঁ! ভয়াবহ বলেই হয়ত বেশি সুন্দর। এবারে চল ওঠা যাক। ঠিক আটটায় খাবার টেবলে দেখা হবে।

আমরা যখন ব্রেকফাস্ট টেবলে বসে জগবন্ধুর ভাজা গরম গরম লুচি, বেগুনভাজা, ওমলেট আর রেঞ্জার বেহারা সাহেবের দিয়ে যাওয়া অতি উপাদেয় পোড়-পিঠা দিয়ে প্রাতরাশ সারছি, সেই সময়ে বাইরে একটি জিপ-এর শব্দ শোনা গেল। ইঞ্জিনের আওয়াজ বন্ধ হতেই সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন রঘুপতি বিশ্বল সাহেব–ডি, এফ ও.।

ঋজুদা খাওয়া থামিয়ে বলল, নমস্কার। আসন্তু আঁইজ্ঞা। বসন্তু বসন্তু।

বিশ্বল সাহেব হেসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বসিবি নিশ্চয়। কিন্তু কিচ্ছি খাইবা-পীবা পাঁই কহিবেনি আঁপ্পনি মত্বে।

কাঁই? গুট্টে কাপ চা পীইবাকু টাইম হেব্বনি কি? এত্বে তাড়া কাঁই আপনংকু? ঋজুদা বললো।

গম্ভীর মুখ করে বিশ্বল সাহেব বললেন, সে বাঘটা কালি মধ্যরাতিরে গুট্বে হিউম্যান কিল করিলা।

ঋজুদা উত্তেজিত হয়ে খাওয়া থামিয়ে বলল, সত্য?

সত্য না হেল্বে মুই শুনিনি এটি দৌড়িকি এমিত্বি আসিলি কি?

আমি দেখলাম, ভটকাই-এর মুখে লুচি-বেগুন ভাজা আটকে গিয়ে ওর চোখ গোল গোল হয়ে গেল হিউম্যান কিল-এর কথা শুনে।

কুয়াড়ে করিলা? কিল?

ঋজুদা শুধোল।

বিশ্বল সাহেব চেয়ারে ঘুরে বসে ডান হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে গরাদহীন জানালা দিয়ে বাইরে দেখিয়ে বললেন, পর্বতোপরি যে গড়টা দিশিছি…

হাঁ। সে গড়ুকু কোন্ পাখেরে?

সেটু যীবাব্বেলে গুট্টে সাম্ব গাঁ মিলিব সে পর্বতর নীচ্চেরে। গড়ুটু যাইবা পথকু বাম পাখেরে। তা নাম ঝিংকুপানি। আট-দশ ঘর কাবাড়ি রহিছি সেটি। সেই গাঁ টারু গুট্টে ঝিওংকু ধরি সারিলা বাঘ টা।

ঋজুদাকে চিন্তিত দেখাল। তাকে এত উত্তেজিত কখনও দেখিনি। উত্তেজিত হলেই চিন্তিত দেখাল। এ চিন্তা অন্যরকম।

আমাদের বলল, চল। তাড়াতাড়ি খেয়েনে রুদ্র, ভটকাই। বলেই নিজে নাকে মুখে খাওয়া সেরে চেয়ার ছেড়ে উঠল। জামাকাপড় পরতে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ে বিশ্বল সাহেবের আপত্তি সত্ত্বেও জোর করেই এক টুকরো পোড়-পিঠা আর এক কাপ চা ঢেলে দিয়ে গেল তাঁকে।

একটু পরই আমরা তিনজনে তৈরি হয়ে বারান্দাতে এলাম। বনবিভাগ আমাদের যে জিপটি দিয়েছিলেন সেটি মাহিন্দ্রর জিপ। বলতে গেলে, নতুনই। বনেট খুলে ব্যাটারির জল, মবিল সব নিয়ে দেখে নিল ঋজুদা। আমি ড্রাইভিং সিটে উঠে ইগনিশন সুইচ ঘুরিয়ে দেখে নিলাম। পেট্রলের ট্যাঙ্ক প্রায় ভর্তিই আছে। তেলের দরকার হলে আমাদের যেতে হবে সাম্বপানিতে। এখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিমি মত পথ। পথটা আগাগোড়াই কাঁচা। গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। নালাও পেরতে হয় তিনটে। ফেয়ার ওয়েদার রোড। সবে খুলেছে। জুন মাসের শেষে বন্ধ হয়ে যাবে। ওর চেয়ে কাছে আর কোনও পেট্রলপাম্প নেই।

ঋজুদার ইশারাতে আমি এঞ্জিন স্টার্ট করলাম। ঋজুদা বিশ্বল সাহেবকে বললেন গোটা দুই ড্রামে করে যদি পেট্রল আনিয়ে বাংলোতে রাখবার বন্দোবস্ত করেন তাহলে খুবই ভাল হয়।

বিশ্বল সাহেব বললেন, ঠিকাদারের ট্রাকে করে কালই পাঠিয়ে দেবেন পেট্রল।

ঋজুদা হাত জোড় করে বিশ্বল সাহেবকে নমস্কার করে বললেন, কালি কী পড়শ্বু আপনংকু সেঠি যাইকি ভেটিবি।

বিশ্বল সাহেবও নমস্কার করে বললেন, হঁ আইজ্ঞা।

জিপ এগিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। বিশ্বল সাহেব নিজের জিপের দিকে যেতে যেতে বললেন, টেক কেয়ার।

আমি বললাম, কী ভাল, না?

 ভটকাই শুধলো, কী?

এই বিশ্বল সাহেব।

ঋজুদা বলল, আমাদের দোষ কী জানিস? আমরা বাঙালীরা নিজেরা নিজেদের মস্ত বড় বলে মনে করি। আমাদের প্রতিবেশীদের-ওড়িয়া, অহমীয়া, বিহারী এঁদের কাউকেই ভাল করে জানারও প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা কোনওদিন! আমি তো ওড়িশা আর ওড়িশার সংস্কৃতি, নাচ, গান, সাহিত্য সব কিছুরই দারুণ অ্যাডমায়রার। অনেক কিছুই শেখার আছে আমাদের ওঁদের কাছে। বিনয় তো অবশ্যই। আমরা ছেলেবেলায় শিখেছিলাম, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়, নিজে যারে বড় বলে বড় সেই নয়। কিন্তু ঐ মুখস্থই করেছিলাম। জীবনে কাজে লাগাইনি।

আমি চুপ করে থেকেই সায় দিলাম ঋজুদার কথায়।

রেঞ্জার সাহেব একজন ফরেস্ট গার্ডকে আমাদের গাইড হিসেবে এবং বন-বিভাগের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের সেতু হিসেবে এই বন-বাংলোতেই পোস্ট করে দিয়েছেন। উনি জিপও চালাতে জানেন। ভদ্রলোকের নাম হরেকৃষ্ণ বালা। কাল রাতেও উনি বাংলোতেই ছিলেন। জগবন্ধুরই কোয়ার্টার্সে।

ঋজুদা নিজের ফোর-ফিফটি-ফোর হান্ড্রেড ডাবল-ব্যারে রাইফেলটা নিয়েছে সঙ্গে। জেফরি নাম্বার টু। আমার হাতে থ্রি-সিক্সটি-সিক্স ম্যানালিকার শুনার। সিঙ্গল ব্যারেল ম্যাগাজিন রাইফেল। ভটকাই শিকারি নয়। তবে ওর মেজমামার বন্দুক চালিয়ে বহরমপুরের বিলে-বাদায় কাগা-বগা-জলপিপি-কামপাখি যে দু-চারটে মারেনি এমন নয়। ঋজুদার ডাবল ব্যারেল বন্দুকটা ভটকাই-এর হাতে। যতটা এবারে ব্যবহার করার জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি মরাল-সাপোর্ট-এর জন্যে। বালাবাবু আর ভটকাই পেছনে বসেছিলেন। আর ঋজুদা আমার পাশে।

ঋজুদা বালাবাবুকে শুধোলেন সামনে যে দুর্গটা দেখা যাচ্ছে তার নাম কী হরেকৃষ্ণবাবু?

সে গড়টা, তার নাম শিকার-গড়।

 ও। এই তাহলে সেই বিখ্যাত শিকার-গড়। অনুমান করেছিলাম অবশ্য।

শিকার-গড়-এর নাম শুনে আমরা সকলেই তাকালাম, ভাল করে সেদিকে। মানুষ আর হাতিতে পাথর বয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে ঐ পাহাড়-চুড়োর গড় বানিয়েছিল। কত মানুষের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে ঐ গড়-এর পাথরে পাথরে, তা ঠাকুরানীই জানেন। আর..

এখন? এখন কারা থাকে ঐ গড়ে? কেউই থাকে না? ঋজুদা হরেকৃষ্ণবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল সামান্য অধৈর্য গলাতে।

জায়গাটা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা, হয়নি ঋজুদার এখনও। বিশ্বল সাহেবের কাছে আগেই একটি ম্যাপ চেয়েছিল এই ফরেস্ট ডিভিশনের। সমস্ত গ্রাম এবং ফরেস্ট ব্লক-এর এবং বিট-এর ডিটেইলস চেয়ে। বিশেষ করে কোন কোন জায়গায় বাঘ মানুষ ধরেছে তা লাল কালিতে চিহ্ন দিয়ে। এবং কোন্ কোন্ তারিখে ধরেছে তাও। বিশ্বল সাহেবের অফিস সেই ম্যাপটা এখনও দিয়ে উঠতে পারেনি বলে ঋজুদা একটু বিরক্ত আছে মনে মনে। এই ম্যাপটা কলকাতাতেই ঋজুদার কাছে যাতে পৌঁছয় তারই অনুরোধ করেছিল ঋজুদা। আর এদিকে বাঘে মানুষ মেরেছে, সেই কিল-এর দিকে এগোচ্ছি আমরা অথচ নানারকম গল্প, কিছু প্রেসকাটিং এবং চিল-সেক্রেটারির পাঠানো একটা নোট ছাড়া অন্য কিছুই হাতে আসেনি।

ঋজুদার প্রশ্নর উত্তরে হরেকৃষ্ণবাবু বললেন, এখন ঐ গড়ে ভূত-প্রেত বাস করে। সাপ, নানারকম। একটি ভাল্লুক পরিবার। আর নিনিকুমারীর বাঘও থাকে মাঝে মাঝে। গড়-এর ভেতরের ঘরে বাদুড়দেরও বাস আছে। আগে কখনও কখনও মানুষজন আসত দূর থেকে। কোনও স্কুল কলেজের বা অফিসের ছেলেমেয়েরা বা বাবুরা পিকনিকে আসত শীতকালে। কিন্তু পরপর দুটি পিকনিক পার্টির একজন পুরুষ এবং একজন মেয়েকে বাঘে ধরার পর কেউই আর ঐ দিকই মাড়ায় না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জিপ ওঠেনি ঐ গড়ের পথে আজ বহু বছর। পাহাড়ের ওপরে শিকার-গড়ে যাওয়ার পথটাও আর পথ নেই। জঙ্গলে আর কাঁটা ঝোপে ছেয়ে গেছে।

ঝকঝক করছে রোদ পথের পাশের সেগুন প্ল্যানটেশানে। প্ল্যানটেশান যত্ন করেই করেছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, কিন্তু বাঘের জন্যে তলার আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি কম করে তিন-চার বছর। গরমের আগে দাবানলের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে নালাও কাটা হয়নি। ফলে পথটাকে আগাছা আর ঘাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। জিপও আজকাল আসে কালে-ভদ্রে। পায়ে-চলা পথটি আগের চওড়া পথের মধ্যে। এঁকেবেঁকে জেগে রয়েছে কোনওক্রমে। তাতে সৌন্দর্য আরও বেড়েছে বই কমেনি।

জিপটা চলেছে পাহাড়ী ঝর্ণা পেরিয়ে, হীরেকুচির মত জল ছিটিয়ে টায়ারে, লালমাটি ভিজিয়ে। প্রায় হারিয়ে-যাওয়া পথ ছুটেছে ক্রমাগত চড়াইয়ে-উতরাইয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শিকার-গড়ের দিকে।

মিনিট কুড়ি জিপ চালানোর পর একটা সমকৌণিক বাঁক ঘুরতেই নাকে এল হেমন্তর পাহাড় বনের এক ঝলক প্রভাতী গন্ধ। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে গ্রামেরও একটি ঝলক চোখে ঝিলিক মেরে গেল। তারপরই পথটা আবার বাঁক নিতেই গ্রামটা মুছে গিয়ে গন্ধটা জোরদার হল। তার একটু পরেই পথটা আবার সোজা হয়ে ঝিংকুপানি গ্রামের দিকে মুখ করল।

নামেই গ্রাম। অল্প কয়েকটি ঘর। ভেরাণ্ডার বেড়া লাগানো। পেঁপে গাছ। আম, লিচু, কাঁঠাল। গোবর লেপা উঠোন। স্নিগ্ধ ছায়া। গরু-ছাগলের ডাক। মন্থর, ঢিলে-ঢালা চাল এখানের জীবনের। উলঙ্গ শিশু, অপুষ্টির শিকার-হওয়া হাড়-লিকলিক পিলে-বের-করা সব যুবকেরা। অন্ধ বৃদ্ধ। চারিদিকে চরম দারিদ্র। আর হতাশা। অসহায় মানুষের করুণ সমর্পণ, সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত; সমাজের পায়ে, সমাজ ব্যবস্থার পায়ে। নিনিকুমারীর বাঘেরও পায়ে।

ঋজুদা বলল, দ্যাখ রে, কলকাতার ভটকাই। এই হল আমাদের ভারতবর্ষের গ্রাম। এই গ্রামই আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামের আয়না।

আমি বাইনাকুলারটা তুলে দুর্গটাকে ভাল করে দেখছিলাম।

এই ঝিংকুপানি গ্রাম থেকে শিকার-গড় সামান্যই দূর। তবে এই গ্রামের সমতা থেকে প্রায় তিন-চার শ ফিট উঁচুতে হবে। গড়-এর তোরণটি ব্যাসাল্ট পাথরে তৈরি। কোথাও কোথাও এবং বিশেষ করে তোরণের কাছে কোয়ার্জাইটও ব্যবহার করা হয়েছে। আর দেওয়ালের মধ্যে মধ্যে রেড-স্টোন আছে। বোগোনভিলিয়া লতা আর জ্যাকারান্ডা গাছে পুরো এলাকাটাই জঙ্গল হয়ে আছে। গড়-এর দেওয়ালের পাশে পাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অমলতাস ইত্যাদি গাছ। একটা ময়ূর হঠাৎই ডেকে উঠল তীক্ষ্ণ ক্বেঁয়া ক্বেঁয়া ক্বেঁয়া করে গড়ের দিক থেকে।

ঋজুদা বলল, আমাকে দে তো একবার বাইনাকুলারটা, রুদ্র।

বুনো ময়ূরের অতর্কিত তীক্ষ্ণ ডাক শুনে ভটকাই চমকে উঠেছিল। জঙ্গলে প্রথমবার ময়ূর বা হনুমানের ডাক শুনে না চমকানোটাই আশ্চর্য!

আমি ওর পিঠে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ময়ূর!

ভটকাই-এর মুখে তখন ঠাট্টা ছিল না। জঙ্গল, পাহাড়, এই গ্রাম, নরখাদক বাঘের জান্তব অস্তিত্ব এবং সামনের রহস্যময় নিথর হয়ে যাওয়া শিকার-গড় এই সব কিছুরই প্রভাব ভটকাই-এর ওপরে এরই মধ্যে বেশ গভীরভাবে পড়েছিল। আমি ভাবছিলাম, ঝিংকুপানি গ্রামের মানুষেরা এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতে কিসের জন্যে পড়ে আছে? চাষবাসের কোনো চিহ্নই তো দেখলাম না। খড়ের চালে দু-একটা লাউ-কুমড়ো গাছ। তাকে চাষ বলে না। এখানে চাষ-বাস হলে এতদিনে সর্ষে, বিরি-ডাল, রাঙা আলু, তামাকপাতা এসব লাগানো হত। হেমন্তর সকালের রোদে উজ্জ্বল দেখাত তামাকের খেতকে।

হরেকৃষ্ণবাবুকে ঋজুদা কি আমার মনের কথাটাই শুধলো।

উনি বললেন, এরা সব কাবাড়ি। কাবাড়ি মানে কাঠুরে। ওড়িশাতেও তো অন্য অনেক রাজ্যেরই মত ফরেস্ট কর্পোরেশান হয়ে গেছে। ফরেস্ট কর্পোরেশান হবার আগে এরা সবাই ঠিকাদারদেরই কাঠ কাটত। তাদের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে চলে যেত, ভাল ঝর্ণা দেখে, হাতি ও বাঘের চলাচলের পথ এড়িয়ে। থাকত সেখানে যতদিন না কাজ শেষ হত। কোথাও সেগুন, কোথাও শাল, কোথাও হরজাই জঙ্গল, করম, কুসুম, গেণ্ডুলি, সাজা, চার, হলুদ, জংলি আম, আরও কত কাঠ। কাঠ কেটে পাহাড়ের ওপর থেকে বা নিচ থেকে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে এসে ঠিকাদারদের বানানো পথের পাশে গাদা দিয়ে রাখত। তারপর সেখান থেকে ট্রাক-এ করে ঠিকাদারেরা নিয়ে যেত সেই সব কাঠ করাতকলে, কাঠ-গোলায়। বামরা, ভুবনেশ্বর, কটক, রাইরাঙ্গপুর, বারিপদা, ঢেকানল, অঙ্গুল এবং আরও কত বিভিন্ন জায়গাতে। মহাজনেরা সেখানে থেকে নিলামে কাঠ কিনে নিয়ে আবার চালান করত কলকাতা, দিল্লি, বম্বে, পাটনা, মাদ্রাজে। কোথায় না কোথায়!

জিপ থেকে আমরা নামার পরই গ্রামের ঘর ও সংলগ্ন জঙ্গল থেকে তিন-চারজন লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে। দুহাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, প্রণাম আঁইজ্ঞা। তাদের মধ্যে একজন শব্দ না করে কাঁদছিল। তার দুচোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। লোকটির চোখদুটো হলদেটে। দেখে মনে হয় যেন ন্যাবা হয়েছে।

হরেকৃষ্ণবাবু এগিয়ে গেলেন ওদিকে। ঐ লোকটির বউকেই কাল সন্ধের একটু আগে বাঘে নিয়ে যায়। গ্রামে কারও ঘরেই বাথরুম থাকে না। সূর্য ডোবার আগে গ্রামের সকলেই সান্ধ্যকৃত্য সারতে গ্রামের আশপাশেই আড়াল দেখে বসে। লোকটি বলছিল, হাতে ঘটি নিয়ে সে সন্ধের আগে যখন বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল তখন ঐ কাঁঠাল গাছটার নিচে, প্রায় বাড়ির উঠোন থেকেই বলতে গেলে, আমার বউকে ধরে নিয়ে গেল।

অন্য একজন বলল, কড়িবি কঁড়্ব,? সে বাঘ্বটা তো এমিত্বি বাঘ্ব না। সেট্বা হেল্বা ঠাকুরানীর বাঘ্ব।

একটু এগিয়ে গিয়ে পথের লাল ধুলো আর ঝাঁটি জঙ্গলের সবুজ পাতায় পাতায় রক্তের শুকিয়ে যাওয়া দাগ দেখাল ওরা আমাদের। যেখানে মেয়েটিকে ধরেছিল সেখানকার জমিতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন এবং বাঘের পায়ের দাগও স্পষ্ট দেখা গেল। প্রকাণ্ড পুরুষ বাঘ। সেখান থেকে ঘাড়-কামড়ে ধরে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেছে লোকটির বউকে বাঘ গড়ের দিকে। গাঁয়ের কোনও লোকই তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি। কাল সন্ধের মুখে তাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টার কথা ছেড়েই দিলাম, সকালবেলাতেও কেউই যেদিকে বাঘ মেয়েটিকে নিয়ে গেছে সেদিকে যায়নি। শুধু তাই নয়, যায়নি বলে কারও কোনও অপরাধবোধও নেই। যেন না-যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ বউটির শরীরের যে-কোনো একটি অংশ অন্তত পাওয়া দরকার দাহ করার জন্যে। জাতে হিন্দু এরা সকলেই। হিন্দুর মৃতদেহ, অন্তত মৃতদেহের কোনও অংশও দাহ করা না গেলে তো সকার হবে না। আত্মা মুক্ত হবে না। আর মানুষখেকো বাঘের হাতে যেসব মানুষের প্রাণ যায়, অপঘাতে মৃত্যু হয়, তারা ভূত-প্রেত হয়ে যায় এমনই বিশ্বাস করে এরা।

ঋজুদার কাছে শুনেছিলাম যে ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার গভীর বন-পাহাড়ের লোকেরা বিশ্বাস করে যে মানুষখেকো বাঘের হাতে মৃত্যু হলে সেই মানুষ ‘বাঘ্বডুমবা’ বলে একরকমের ভূত হয়ে যায়। রাত-বিরেতে গাছের মগডাল থেকে তাবড় তাবড় সাহসী লোকেদেরও হার্টফেল করিয়ে কিরি-কিরি-কিরি-কিরিধূপ-ধূপ-ধূপ-ধূপ করে চেঁচিয়ে ওঠে নাকি!

এদিকে সময় নেই। তখন সাড়ে নটা বাজে ঘড়িতে। বালাবাবু আর ভটকাইকে ঋজুদা এই গ্রামেই থাকতে বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে এগোল। বালাবাবু গ্রামের লোকদের একজনকে আমাদের সঙ্গে যেতে বললেন। কিন্তু আশ্চর্য! কেউই রাজি হল না। একজনও নয়। এমনকি যার স্ত্রী বাঘের পেটে গেছে সেও নয়। অথচ এরা কেউই তেমন ভীতু নয়। তাই ভারী অবাক হলাম আমি। মানুষের স্নায়ু কতখানি অত্যাচারিত হলে, ভয় মানুষের মজ্জার কত গভীরে সেঁধিয়ে গেলেই যে ঐ সব অসমসাহসী মানুষেরাও এমন লজ্জাকর অবস্থাতে নিজেদের নামিয়ে আনতে পারে তা অনুমান করা যায়।

ঋজুদা মাথার টুপিটা চেপে বসিয়ে নিল। তারপর অলিভ-গ্রীন বুশশার্টের সাইড পকেট থেকে বের করে দুটো ঝকঝকে সক্ট-নোজড বুলেট ভরে নিজের রাইফেলটা লোড করে নিয়ে আমাকে বলল, ব্যারেলে একটা আর দুটো ম্যাগাজিনে রাখ গুলি। মিছিমিছি সব গুলি ম্যাগাজিনে ভর্তি করে রাইফেলটাকে ভারী করিস না। তারপর এগোবার ঠিক আগে একবার হাতঘড়ি দেখে বালাবাবুকে বলল যে তোমরা একটা অবধি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। হরেকৃষ্ণ, তোমাকে আমি তুমিই বলছি। আশা করি মনে কিছু করবে না।

 বালাবাবু বললেন, না, না, খুশিই হব স্যর।

একটার মধ্যে আমরা না ফিরলে বা আমাদের গুলির আওয়াজ না শুনলে তোমরা বাংলোয় ফিরে যাবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে আমাদের দুজনের জন্যে কিছু খাবার ও জলের দুটো বোতল নিয়ে এখানেই ফিরে এসে আবার অপেক্ষা করবে। যদি সন্ধের মধ্যেও আমরা না ফিরি তাহলে তোমরা আবার বাংলোতে ফিরে যাবে। একটু থেমে ভটকাইকে বলল, শুনেছিস তো! সন্ধের আগেই! ভাল করে দরজা জানালা বন্ধ করে বাইরের বারান্দাতে একটা লণ্ঠন জ্বেলে রেখে শুয়ে পড়বে রাতের খাওয়া-দাওয়া করে নিয়ে। আর আমরা যদি রাতেও বাংলোতে না ফিরি তো কাল সকালে আবারও এখানে আসবে।

ভটকাই আতঙ্কিত গলায় বলল, জিপ তো আমরা নিয়ে যাব। অন্ধকার রাতে বাংলোয় হেঁটে ফিরবে কী করে?

ঋজুদা বলল, তা নিয়ে তোর চিন্তা নেই।

বালাবাবু আর ভটকাই কি একটা বলতে গেল প্রতিবাদ করে একই সঙ্গে।

ঋজুদা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করে থাকতে বলে জিপটা দেখাল আঙুল দিয়ে। মানে ইশারা করল জিপে গিয়ে বসতে।

ভটকাই দৌড়ে জিপে গিয়ে ওয়াটার বটলটা নিয়ে এল।

ঋজুদা হাত নেড়ে মানা করল।

মানুষখেকো বাঘের বা চিতার মোকাবিলা করার সময় নিজেকে যতখানি সম্ভব হালকা রাখার চেষ্টা করে ঋজুদা। গুলি, রাইফেল, পাইপ এবং টোব্যাকো ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই থাকে না। আমার গলার সঙ্গে ঝোলানো থাকে ঋজুদার জাইস্ এর বাইনাকুলারটি। আর রাইফেল-গুলি। ব্যাসসস।

আমরা দুজনে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এগোতে লাগলাম মানে চড়াই উঠতে লাগলাম। খুবই আস্তে আস্তে। আগে-পিছনে নয়, পাশাপাশি।

এখন এমন সময় ঋজুদার চোয়ালটি শক্ত হয়ে ওঠে। সবসময় হাসি-ঠাট্টা করা যে মানুষকে আমি খুব কাছ থেকে জানি তার সঙ্গে এই মানুষটার কিছুমাত্রই মিল থাকে না আর। কিছুদূর এগোতেই মনে হল যেন কবরস্থানে এসে পৌঁছেছি। যেন কোনো সাসানডিরি। কোনো প্রাণের সাড়া তো নেইই, এমনকি গাছপালা মাটি পাথর তারাও যেন মৃত। ঠাণ্ডা। হেমন্তের রোদেও উষ্ণতা নেই কোনখানেই।

আমরা এক পা এক পা করে এগোচ্ছি। পঞ্চাশ মিটার মত যাবার পর হঠাৎই আমার সামনের একটা পুটুসের ঝোপের বাইরের দিকে রক্তের দাগ দেখা গেল। শুকিয়ে রয়েছে। তারপরই একটি লালপেড়ে শাড়ির রক্তমাখা অংশ। দাঁড়িয়ে পড়ে শিস দিলাম বুলবুলির মত, ঋজুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে। ঋজুদা শিস শুনে এদিকে তাকাতেই থুতনি তুলে ইশারা করলাম। এবং এগিয়ে গিয়ে জায়গাটাতে দাঁড়ালাম। ঋজুদাও আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার পাশে। পরক্ষণেই একটা বনমোরগ ডানদিকের বেজাত গাছের ঝুপড়ি থেকে হঠাই ভয় পেয়ে মুখে কঁক্-কঁক-কঁক আওয়াজ করতে করতে আর ডানাতে ভর-ভর-ভর-ভর আওয়াজ করতে করতে উড়ে গেল আরও ডাইনে শিকার-গড়-এর সীমানার ডান প্রান্তের দেওয়ালের দিকে। এবং পরক্ষণেই আমাদের দুজনের চোখ একই সঙ্গে পড়ল সাদা শাঁখা আর লাল গালার চুড়ি পরা একটি ফরসা হাতের দিকে। কনুই থেকে হাতটি যেন কেউ ইলেকট্রিক করাতে কেটেছে এমনই পরিচ্ছন্ন ভাবে কাটা সেটি। কোনো মেয়ের হাত। হাতের পাশেই একটি সবুজ রঙা কাচের চুড়ি ভেঙে রয়েছে।

ঋজুদা রাইফেল কাঁধে তুলে নিল। আমিও। দুজনেরই বুড়ো আঙুল সেফটি-ক্যাচে এবং তর্জনী টিগার-গার্ডের ওপরে। খুবই সাবধানে সেই হাতটিকে ছাড়িয়ে আমরা এগোলাম। কনুইয়ের একটু ওপরে, যেখান থেকে হাতটিকে কাটা হয়েছে এক কামড়ে, সেইখানে রক্ত শুকিয়ে গিয়ে বাদামী রঙা হয়ে গেছে। মেয়েটির হাতের আঙুলগুলি ভারী সুন্দর। এমন যার আঙুল সে নিশ্চয়ই ভাল আলপনা দিত। বা ছবি আঁকত নয়তো কবিতা লিখত নিশ্চয়ই। হঠাৎই আমার গা গুলিয়ে উঠল। বমি-বমি পেল ভীষণ। আর তক্ষুণি শিকার-গড় পাহাড়ের ডানদিকে গভীর জঙ্গলে ভরা উপত্যকার গড়ানো আঁচলের সবুজ প্রান্তরের শেষ প্রান্তরের শেষ প্রান্তে একটি কোটরা হরিণ পাগলের মত ডেকে উঠল। ডাকতে ডাকতে দৌড়ে যেতে লাগল। নদীর এদিকের পার বরাবর।

আশা ভঙ্গ ঋজুদা একটা বড় পাথরের চাঁই-এর ওপরে বসে রাইফেলটা পাশে রেখে পাইপটা ধরাল। আমাকে বলল আজকের চান্সটা মিস্ করলাম আমরা।

কী করে বুঝলে?

কোটরাটার ডাক শুনলি না? বাঘ এখানেই ছিল। আমাদের আসতে দেখে অথবা আওয়াজ শুনেই সরে যায়। সরে যাওয়া মাত্রই মোরগটা বাঘকে দেখতে পেয়ে ডেকে ওঠে। কতটুকু সময়ের মধ্যে বাঘটা কতখানি দূরত্ব নিঃশব্দে অতিক্রম করল, দেখলি তা? সে নিশ্চয়ই অনেকখানি নিচে চলে গেছে, নইলে কোটরাটা তাকে দেখতে পেয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর মত চেঁচাত না। বলেই বলল, আমার কিন্তু মনে হয় না যে এই বাঘের সামনের পায়ের ডান কব্জি বা পাঞ্জার ওপরের হাড় একেবারেই ভাঙা। একেবারেই ভাঙা থাকলে তার গতি এতখানি দ্রুত হত না। না, তা হতেই পারে না।

ঋজুদা বলল, এদিকে ওদিকে খুঁজে দ্যাখ সম্ভাব্য জায়গায়, লাশের অন্য কোনো অংশও দেখা যেতে পারে।

নিরুপায় হয়েই বললাম আমি ঋজুদা, আমার গা গোলাচ্ছে।

মার খাবি তুই। যা বললাম, কর।

কাছের মোরগের আর দূরের কোটরার চকিত ভীত পিলে-চমকানো অ্যালসেসিয়ান কুকুরের মত ডাক শুনে না হয় জ্যোতিষীর মতই বলে দিতে পারে ঋজুদা যে বাঘ চলে গেল, তাই বলে আমি তো আর জ্যোতিষী নই। তাছাড়া জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার বিশ্বাসও নেই। তাই আমার মোটেই পেত্যয় হল না, যে সাঙ্ঘাতিক মানুষখেকো বাঘ, যার দাঁতে-ছেঁড়া সুন্দর হাতখানি একটু আগেই ঝোপের নিচে দেখে এলাম; সে এই পাড়া ছেড়ে সত্যিই চলে গেছে। প্রমাণ নেই কোনো। কিন্তু মন বলল। তাই রাইফেলটাকে বাহু আর কাঁধের সংযোগস্থলে তুলে রেখেই এগোলাম। একটু এগোতেই একটা জায়গা দেখে মনে হল এরই আশে-পাশে বাঘ ছিল। বনে জঙ্গলে এরকম অনেকই ব্যাখ্যাহীন মনে-হওয়ার ব্যাপার ঘটে। যাঁরা জানেন তাঁরা আমার কথা মানবেন।

এদিকে কোথাওই পরিষ্কার মাটি বা ধুলো নেই যে বাঘের পায়ের চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাবে। তেমন জায়গা হয়তো আছে কিন্তু এখনও চোখে পড়েনি আমাদের। কিন্তু এতখানি চড়াইয়ের পথ আমরা ক্বচিৎ-রক্ত এবং ঘষটানোর দাগ দেখে দেখেই এগিয়েছি। পরিষ্কার চিহ্ন দেখা গেলে নিনিকুমারীর বাঘ আদৌ অশক্ত কিনা অথবা সত্যিই কতখানি অশক্ত তা বোঝা যেত কিছুটা। ঋজুদা সবসময়েই বলে, কখনও পরের মুখে ঝাল খাস না। এই সব ব্যাপারে তো নয়ই। দশজনের কাছে শোনা কথাও নিজে না দেখে বা না শুনে কখনও মেনে নিবি না। গল্প-গাথাতে আর সত্যে অনেকই তফাত থাকে। বিশেষ করে বনে জঙ্গলে।

সামনেই মস্ত একটি চাঁর গাছ। চিরাঞ্জীদানাও বলে চাঁরকে বিহারে। এর ওড়িয়া নাম জানি না। গাছটা উঠেছে একটা পাথরের চাঁই-এর জগাখিচুড়ি থেকে। পূর্ব-আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি প্লেইনস্-এ এমন রক আউটক্রপকে বলে কোপজে। সিংহের আড্ডাখানা সে সব জায়গাতে। বড় কালো পাথরের স্তূপের মত হঠাৎই মাটি-ফুঁড়ে-ওঠা পাথরের খিচুড়ি। এটি সেই রকমই প্রায়। তফাত এই যে এটির মধ্যে একটি অগভীর গুহা। মধ্যপ্রদেশের ভীমবৈঠকাতে যেমন আছে। খুবই ছায়াচ্ছন্ন জায়গাটা। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি তিরতিরে ঝরনা গেছে ছায়ায় ছায়ায়। স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে জায়গাটা এবং রৌদ্রালোকিত জায়গা থেকে অনেকই বেশি ঠাণ্ডা। নিজেকে এবং অন্যকেও লুকিয়ে রাখার পক্ষে অতি চমৎকার জায়গা। চোখের আড়ালে বসে এক জোড়া রক-পিজিয়ন ডাকছে ভুকু-ভুকু-ভুকু-ভুকুম ভুকু-ভুকু-ভুকু-ভুকুম। খুব সাবধানে একটু একটু করে এগোতে লাগলাম ওদিকে। সেই গুহামত জায়গাটাতে পৌঁছবার আগে একটু বাঁদিকে চেপে গেলাম। ঋজুদার ওপরে রাগ হচ্ছিল খুব। এই সাঙ্ঘাতিক বাঘের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিজে পাইপ খাচ্ছে রাজার মত। একটুও কমোনসেন্স নেই ঋজুদার। সাহস ভাল, দুঃসাহস ভাল নয়। আর দুঃসাহস থাকলেও তা নিজের আত্মহত্যার কাজে লাগানোই ভাল, পরস্য পরকে বাঘে-খাওয়ানোর জন্যে ব্যবহার করা অত্যন্তই অনৈতিক কাজ।

এবার নিচু হয়ে একটা ছোট্ট পাথর ছুঁড়ে দিলাম গুহামুখের দিকে। খটাং করে আওয়াজ তুলেই পাথরটা গুহার ভিতরে গিয়ে থিতু হল। এবং সঙ্গে সঙ্গে চাঁর গাছের ছায়াচ্ছন্ন জায়গাটার পাথুরে খিচুড়ি নৈঃশব্দ্য স্তব্ধতর হয়ে গেল। এক পা এক পা করে এগোতে লাগলাম গুহার দিকে। এই গুহা কিন্তু গুহা বলতে আমরা সচরাচর বুঝি সেরকম একেবারেই নয়। মানে, গভীর তো নয়ই, সুড়ঙ্গের মতোও নয়। একে গুহা না বলে প্রস্তুরাশ্রয় বা রকশেলটারই বলা ভাল। ভীমবৈঠকাতে এইরকম অসংখ্য প্রস্তরাশ্রয়ের ভিতরে ভিতরেই আদিম মানুষদের আঁকা নানারকম গুহাচিত্র আছে।

গুহামুখে পৌঁছেই চমকে গেলাম। চমকে গেলাম না বলে আঁতকে উঠলাম বলাই ভাল। সেই লাল-পাড় ঘেঁড়া শাড়িটির আরও কিছুটা। রক্তমাখা চেবানো হাড়-গোড়। মানুষের মেয়ের হাড়-গোড়। ইঃ বাবাঃ। এবং একটি করোটি। তার গায়ে মাংস লেগে আছে এবং একটি মাত্র চোখ চেয়ে আছে আমার দিকে হাঁ করে, কর্তিত-কঙ্কালের সেই কুৎসিত করোটি থেকে।

মানুষখেকো বাঘের উপস্থিতির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম : ঋজুদা!

ডেকেই, গুহামুখের পাশের একটি পাথরে বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলাম যাতে এদিকে আর না দেখতে হয়। আমার ঐ হঠাৎ চিৎকারে চমকে উঠে রক্-পিজিয়নের দলটি শক্ত ডানা ফটফটিয়ে উড়ে গেল। এক জোড়া ছিল ভেবেছিলাম আগে। তা ভুল। ঝাঁকে ছিল।

আশ্বাস-ভরা ঋজুদা মুহূর্তের মধ্যে রাইফেল রেডি-পজিশনে ধরে লাফাতে লাফাতে উদিত হল। উত্তরমেরুর স্বাগতম সূর্যেরই মত বলল, কোথায়?

আমি গুহার দিকে আঙুল তুলাম। ঋজুদা গুহামুখে গিয়ে দারুণ বিরক্তিভরা চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, স্টুপিড।

আমি খুবই আহত হলাম।

 বললাম, ঐ দৃশ্যে তুমি ভয় পেতে না?

না। আমি ভেবেছিলাম বাঘ বুঝি তোকে ধরেই ফেলেছে। ভবিষ্যতে কক্ষনো এরকম করিস না আর। রাখালের পালে বাঘ পড়ার গল্পের মত হবে তা হলে কোনদিন। তোর সত্যি-বিপদেও আমি ভাবব, না গেলেও চলে!

বলেই বলল, যা। দৌড়ে যা। পাইপটা পাথরের উপরেই পড়ে রইল। হারিয়ে যাবে এখুনি না তুলে আনলে। তোর সেন্স নেই কোনো। মনমরা এবং আতঙ্কিত অবস্থাতেই আমি যখন ঋজুদার পাইপ হাতে করে এখানে ফিরলাম দেখি ঋজুদা রাইফেলটাকে আমি যে-পাথরে বসেছিলাম তার গায়ে শুইয়ে রেখে ঐ করোটির প্যাঁটপ্যাঁট করে তাকিয়ে থাকা চোখটির প্রায় গা ঘেঁষেই বসে নিচের উপত্যকার দিকে চেয়ে আছে।

দেখেই ঘা ঘিন ঘিন করে উঠল। মানুষটার ভয় নেই না হয় মানলাম। কিন্তু ঘেন্না-পিত্তি? তাও কি নেই কোনো?

পাইপটা হাতে দিতেই বলল, বোস পাশে।

 খুব রেগে গেছিলাম। বসলাম না তাই।

আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, দ্যাখ।

ঋজুদার চোখকে অনুসরণ করে চেয়ে দেখি এক আশ্চর্য দৃশ্য। এই প্রস্তরাশ্রয় যেন কোনো দূরবীনেরই চোখ। অন্ধকার ঘরের দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে দূরের আলোকিত কোনো ঘর বা বারান্দা যেমন স্পষ্ট দেখা যায়, সামনের ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পাহাড় বন এবং উপত্যকা তেমনই দেখাচ্ছে। এমনকি নদী এবং নদীর ওপারে আবারও চড়াইতে উঠে-যাওয়া গভীর বনাবৃত ধুঁয়োধুঁয়ো পাহাড়শ্রেণী সবকিছুই চমৎকার দেখা যাচ্ছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা এই ঝিংকুপানি গ্রামে আসার পথটি যেখানে কনসর-এর শাখা নদীটি পেরিয়ে এসে ডাইনে বাঁক নিয়েছে তাও পরিষ্কার চোখে পড়ছে এখান থেকে। স্কাউটিং-এর এমন ভাল্টেজ-পয়েন্ট আর হয় না। এবং বাঘের চেয়ে ভাল স্কাউট তো কেউই নয়। মানুষখেকো বাঘ হলে তো কথাই নেই!

মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়েছিলাম ঐ দিকে। পাথরের গুহাতে বসে বাইরের রৌদ্রালোকিত প্রান্তর ঝাঁটি আর গভীর জঙ্গলে, ইন্দ্র দুর্গার এর আঁকা ছবি নদীর মত নদী, দূরের রহস্যময় ধোঁয়া-ধোঁয়া পাহাড়শ্রেণী; সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল ওখান থেকে।

ঋজুদা বলল, চল্ এই শিকার-গড় জায়গাটাকে আজ ভাল করে সার্ভে করি। এই কিল-এর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই যে বাঘ এখানে ফিরে আসবে। বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছিস না? এই হল নিনিকুমারীর বাঘের একটা বড় ঘাঁটি। এখানে সে প্রায়ই থাকে। আমরা কিন্তু স্ট্র্যাটেজিতে একটা ভুল করে ফেললাম। বিনা-নিমন্ত্রণে তার বাড়িতে আমাদের আসা উচিত হয়নি। কারণ সে দেখে গেল যে আমরা তার অন্দরমহলের খোঁজ পেয়েছি। দেখে গেল বলেই এখানে সে আর ফিরে নাও আসতে পারে। কিছুদিন যে আসবেই না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। অথচ এই বাঘের যা রেকর্ডস তাতে ওর পেছনে দৌড়ে বেড়ানো প্রায় অসম্ভবই। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মত ব্যাপার। দৌড়ে বেরিয়েছে বলেই কেউ তাকে বাগে পাননি। আমরা দৌড়ে না বেড়িয়ে তার বাড়িতেই চৌকি বসাব। যে সময়ই সে চায়, নিক। বাড়িতে সকলকেই ফিরতে হয় কখনও না কখনও। সে খুনী, ডাকাত বা মানুষখেকো বাঘ যেই হোক না কেন!

আমি বললাম, নিনিকুমারীর বাঘের বাড়িতে আছেটা কোন্ আপনজন? মা, না বৌ, না ছেলেমেয়ে?

ঋজুদা হেসে, নাক তুলে গন্ধ নিল। মানুষের পচা মাংসের গন্ধ ছাপিয়েও বাঘের গায়ের গন্ধ ভাসছিল। বলল, আছে। নিজের গায়ের গন্ধ। বাঘই হোক কী মানুষ, কারও কাছেই তার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসার জন আর কেউই নেই। বাঘ বেঁচে থাকার জন্যে আর কারও দয়ার বা সঙ্গর বা ভালবাসার বা সেবার ওপরে নির্ভর করে না। সে বলতে পারিস নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ। নিজের গায়ের গন্ধ নিতে সে আবার ফিরে আসবে। দেখিস। বলেই, উঠে পড়ে বলল, চল্।

আমরা ঐ জায়গাটা ছেড়ে আসার আগে গাছটার দিকে ভাল করে চাইলাম নিচ থেকে। মাচা বাঁধলে কোথায় বাঁধা যায় তাই দেখতে।

ঋজুদাও আমার চোখ অনুসরণ করে দেখল। বলল, এখানে বসতে হলে শুধু দিনের বেলাতেই। মানে, সকাল থেকে প্রথম বিকেল অবধি। রাতে বসতে হলে বাইরের দিকে কোনো গাছে বসতে হবে যাতে তার যাওয়া আসার পথে তাকে গুলি করা যায়।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঋজুদা বলল, দ্যাখ রুদ্র।

চেয়ে দেখি, শিকার-গড়-এর সীমানার পাঁচিলের একটা অংশ সরে গেছে একেবারে এই চাঁর গাছটিরই গা ঘেঁষে। পাঁচিলটা ভেঙে ভেঙে গেছে অনেক জায়গাতেই। অশ্বত্থ আর বটের চারা গজিয়েছে জায়গায় জায়গায়। নানারকম বুনো ফুলের লতা, যারা পাথরের কাছ থেকেও জল চায়, জল নিংড়ে নিয়ে ফুল ফোঁটায়। লাল, হলুদ, হালকা-বেগুনি, ছেলেবেলার সুন্দর সব স্বপ্নর মত।

বললাম, বাঃ।

বাঃ কী রে রুদ্র! বল বাঃ বাঃ বাঃ। এর চেয়ে বড় বাঃ আর কিছুই নেই। বাঘ শিকার-গড়ে ঢোকে তার এই গুহার ডেরা ছেড়ে এই পাঁচিল পেরিয়েই। তার কোন দায়টা পড়েছে যে তাকে শিকার-গড়ের প্রধান ফটক দিয়ে যাতায়াত করতে হবে? ওরা তো আর মানুষের মত স্ট্যাটাস সিম্বলের শিকার নয় যে গরমের শহর কলকাতায় গলায় বো লাগিয়ে, ডিনার জ্যাকেট পরে, ক্লাবের ডাইনিং রুমে গিয়ে বসবে! দেশ স্বাধীন হবার চল্লিশ বছর পরেও ইংরেজদের বাঁদর সাজার মত কোনরকম হীনম্মন্যতায় ভোগে না তারা! বাঘেরা নিজেরাই নিজেদের মালিক। দিল্লির লালকেল্লা বা সাউথ ব্লক তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়। ওর যেখান খুশি সেখান দিয়েই যাবে ও। এবং এইখান দিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধেজনক বলে আমার মনে হয়, এইখান দিয়েই ও যায়। চল্। একটু এগোলেই বোঝা যাবে।

বেশিদূর এগোতেও হল না। একটু যেতেই বাঘের এবং হয়তো অন্যান্য জানোয়ারেরও চলার চিহ্ন পরিষ্কার দেখা গেল। গেম-ট্র্যাক। সেই গেম-ট্র্যাকটি সত্যিই পাঁচিল টপকে শিকার-গড়ের চত্বরে গিয়ে পড়েছে। ঠিকই। কিন্তু আমাদের দুজনের কারওই লেজ না থাকায় অতখানি উঁচু পাঁচিল দাঁড়ানো অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে পেরোনো অসম্ভব ছিল। দাঁড়ানো অবস্থাতে কেন, হাই জাম্পের দৌড়বার মত সমান জায়গা থাকলেও ওলিম্পিকে প্রথম হওয়া হাই-জাম্পারও এই পাঁচিল পেরোতে পারত না। তাই ঘুরেই গেলাম আমরা। একটু ঘোরা পথ। তারপর শিকার-গড়ের মধ্যে ঢুকে যেখানে গেম-ট্র্যাকটি চত্বরে ঢোকার কথা সেখানে এসে আবার পথটিকে দেখা গেল। চত্বরের এক জায়গায় নরম মিহি মাটি ছিল। সুরকি মেশা। যেখানে বাঘের পায়ের দাগ স্পষ্ট। অনেক দাগ। নতুন এবং পুরনো।

ঋজুদা বলল, পরে এখানে ফিরে আসব। এখন এগিয়ে চল্।

গেম-ট্র্যাক ধরেই আমরা সাম্বপানির রাজাদের একসময়ের বিলাসবহুল শিকার লজে ঢুকলাম। সদর দরজার একটা পাল্লা খোলা।

দরজার সামনের ধুলোতে কত জানোয়ারের আর সাপের চলাচলেরই যে চিহ্ন তার ঠিক নেই। কিন্তু নিনিকুমারীর বাঘের পায়ের দাগ ছিল না। দেখা গেল যে তার নিজস্ব গেম-ট্র্যাক প্রধান দরজাকে অনেক দূর থেকে এড়িয়ে গিয়ে পৌঁছে গেছে নহবৎখানাতে। মন্দিরের সানাই বাজত যেখান থেকে, কটক থেকে আসা নামকরা সানাইওয়ালারা যখন সানাই বাজাতেন তখন প্রভাতী সূর্যের আলোয় কেমন লাগত সাম্বপানির রাজাদের শিকার-গড়ের এই গা-ছমছম জায়গাটিকে, কে জানে!

ঋজুদা বলল, কী রে রুদ্র! নিনিকুমারীর বাঘের আরেক আস্তানা তাহলে এই নবহৎখানা! সেখানে উঠেই দেখলাম চমৎকার বন্দোবস্ত থাকার। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা এমন সুন্দর আস্তানার কথা ভাবাই যায় না। চাঁদ, রোদ ইচ্ছে করলেই হাতের মুঠোয়। আর ইচ্ছে না করলে তাদের মুখ দেখারই দরকার নেই।

সেখান থেকে নেমে আমরা চণ্ডীমন্দিরের দিকে এগোলাম। এই সেই জাগ্রত ঠাকুরানী। যাঁর কৃপাধন্য হয়ে বাঘ অমরত্ব লাভ করেছে বলেই বিশ্বাস করেন এখানের মানুষেরা।

ঋজুদা বলল, ভটকাই-এর কাছ থেকে শটগানটা নিয়ে এলে ভাল হত।

–কেন?

মন্দিরে নিশ্চয় সাপের আড্ডা থাকবে। কেন জানি না। আমার মন বলছে। মানুষের পরিত্যক্ত মন্দিরে কেন যে সাপ থাকে তা আমি জানি না। কিন্তু বহু জায়গাতেই দেখেছি যে, থাকে।

বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেলাম চণ্ডীমন্দিরের সামনে। মন্দিরের দরজার পাশে বড় বড় দুটো জবা গাছ। না বলে দিলে কেউ বিশ্বাসই করবে না জবা বলে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছ দুটি। হাজার হাজার ফুল ফুটেছে ঝুমকো জবার। সেই গাছ দুটির পাশে দুটি জ্যাকারাণ্ডা গাছ।

ঋজুদা বলল গাছদুটিকে দেখিয়ে, নিশ্চয়ই এ দুটি পরে কেউ লাগিয়েছে বুঝলি! মানে, মন্দির প্রতিষ্ঠার পর। ইংরেজরা পূর্ব-আফ্রিকারও একটি অংশের মালিক ছিল। তাই বহু ভাল ভাল গাছ তারা ভারতে এনে লাগিয়েছিল। ভারতের গাছও নিয়ে গিয়ে লাগিয়েছিল অন্যান্য দেশে। ভারতে লাগানো পূর্ব-আফ্রিকার গাছেদের মধ্যে ছিল আফ্রিকান টিউলিপ, কেসিয়া ও অ্যাকাশিয়া ভ্যারাইটির নানারকম গাছ এবং আরও অনেকই গাছ। এই জ্যাকারাণ্ডাও সম্ভবত সাহেবদেরই আনা। তবে এখন তো এর ফুল ফোটার সময় নয়। তাই শুধু পাতাই আছে ডালে ডালে।

জ্যাকারাণ্ডার সঙ্গে অ্যানাকোণ্ডার বেশ মিল না?

পাণ্ডিত্যে আমিও কিছু কম যাই না, এমনই ভাব দেখিয়ে বললাম।

ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, ধ্যুৎ। অ্যানাকোণ্ডা তো সাপ। দক্ষিণ আমেরিকার সাপ। তার সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকার গাছের কী সম্পর্ক?

ইচ্ছে হল ভটকাই-এর মত বলি, ঐ হল। একই কথা।

ঐ দ্যাখ। ঋজুদা বলল।

তাকিয়ে দেখি, হেমন্তকাল হলে কি হয় এক জোড়া প্রকাণ্ড কালো গোখরো মন্দিরের দরজার কাছে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে লকলকে জিভ বের করে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের স্লিং কাঁধে ঝুলিয়ে দু-হাত জড়ো করে বললাম : জয় মা চণ্ডী।

ঋজুদা ধর্ম-টর্ম মানে না। তবে অন্যের বিশ্বাসে আঘাতও দেয় না। সাপেদের দিকে মনোযোগভরে চেয়ে রইল রাইফেল রেডি-পজিশনে ধরে। যদিও ঐ হেভি রাইফেল সাপ মারার পক্ষে অকেজো। হেভি বা লাইট কোনও রাইফেল দিয়েই সাপ মারা সুবিধের নয় আদৌ। কিন্তু মারামারি করতে হল না। সাপদুটি নিজে থেকেই সরে গেল মন্দিরের একেবারে ভিতরের অন্ধকারে। আমরা পায়ে পায়ে মন্দিরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। মন্দিরের খোলা দরজা দিয়ে এবং জানালা দিয়েও সূর্যের আলো ঢুকছে।

ঋজুদা বলল, কোণারকের সূর্য মন্দিরের সঙ্গে কিন্তু আশ্চর্য মিল আছে এই মন্দিরের। যদিও খুবই ছোট। দেওয়ালে বা গায়ে কোনও অলঙ্করণও নেই। অথচ ওড়িশার রাজা লাঙুলা নরসিমাদের আমলে বানানো কোণারকের মন্দিরের সঙ্গে সূর্যের যেরকম বার ঘণ্টার সম্পর্ক সকাল-দুপুর-সাঁঝের, এর সঙ্গেও তাই। আমি জুতো খুলে প্রণাম করলাম।

ঋজুদা বলল, দ্যাখ খুশি করতে পারিস কি না! ঠাকুরানীর দয়া যদি বাঘের ওপর থেকে শিকারির ওপরে একবার সরিয়ে আনতে পারিস তবে তোকে আর পায় কে?

আমি বললাম, দেবীর দয়া হলে সবই হতে পারে। কাল সকালে আমি পুজোর পোশাকে আসব এখানে।

ঋজুদা বলল আপাতত দেবীর কাছে বিদায় নিয়ে আয়। বলে আয়, যেন অপ্রসন্ন না হন।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারটা বাজে প্রায়। কী করে যে সময় যায়। দেবীকে প্রণাম করে মন্দিরের বাইরে এলাম। দেখি, ঋজুদা ততক্ষণে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। হঠাৎই আমার দিকে ঘুরে বলল, রুদ্র, বি কেয়ারফুল। বাঘ উপত্যকাতে যায়নি। আমাদের সাড়া পেয়ে পাঁচিল টপকে এই শিকার-গড়েই এসেছে।

আমি তাড়াতাড়ি কাঁধের রাইফেল হাতে নিয়ে বললাম, কী করে জানলে? প্রমাণ?

প্রমাণ নেই। আমার মন বলছে। প্রমাণও হয়ত এক্ষুনি পাওয়া যাবে। বলেই, যেখানে নরম ধুলোতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছিল সেদিকে ফিরে চলল ঋজুদা।

আমাকে বলল, তুই গার্ড দে, আমি একটু দেখি। বলে, নিজের রাইফেলটাকে ঘাড়ের ওপরে হেলান দিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে বাঘের পাগ-মার্কসগুলো ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগল। বলল, অ্যাই দ্যাখ।

এগিয়ে গিয়ে দেখি পুরনো দাগের ওপরে একেবারে টাটকা দাগ। সত্যিই বিরাট বাঘ। নদীর বালিতে বা বৃষ্টির পরের কাদায় অনেক সময়েই পায়ের চিহ্নকে বড় দেখায়। কিন্তু এই শিকার-গড়ের পাথুরে চত্বরে শক্ত জমির ওপরেও এই ছাপ এত বড় হয়ে পড়েছে যে বাঘটার প্রকাও সাইজ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহই থাকার কথা নয়। যে-সব গল্প কলকাতায় এবং এখানেও শুনেছি এই নিনিকুমারীর বাঘ সম্বন্ধে তাই যথেষ্ট ছিল। তার ওপরে তার প্রমাণ বহর দেখে তলপেট সত্যিই গুড়গুড় করে উঠল।

ঋজুদা আমার মনের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে বলল, লাজার দ্যা টাইগার, দ্যা মেরিয়ার। বড় টার্গেট হলে নিশানা নিতে সুবিধে, গুলি ঠিক জায়গায় লাগাতে সুবিধে। ভালই তো! বাঘ যত বড় হয় শিকারির বুক তত ফোলে। বলেই, পায়ের দাগগুলো খুব ভাল করে আরও একবার নিরীক্ষণ করে বলল, বুঝলি রুদ্র, সব বাজে কথা। এই বাঘের সামনের ডান পায়ের থাবাতেই চোট আছে। দ্যাখ না ডানদিকের ওপরের ছাপ কেমন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। কিন্তু কব্জিতে চোট থাকলে ছাপ অন্যরকম হত। হয়ত জখম হওয়ার পর নিনিকুমারীর বাঘ হাঁটার সময়ে ডান পা ফেলার আগে আহত থাবাটি গুটিয়ে নিত। তাই দেখে কেউ এই তত্ত্ব প্রচার করে দিয়েছিল। পরে কেউই আর তার সত্যাসত্য বিচার করতে যায়নি। শিকার আর শিকারিদের জগতে যত বড় বড় গুলেড়ু আছে তেমন বাঘা বাঘা গুলেড়ু আর তিড়িবাজ খুব কম জগতেই আছে। গুলবাঘ ডেঞ্জারাস নয়। কিন্তু গুলবাজরা হাইলি ডেঞ্জারাস।

বলেই, উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রাইফেলটা তুলে নিল হাতে।

আমি বললাম, তুমি তো আচ্ছা লোক। বলছ, বাঘ এই শিকারগড়ে এসেছে আর তুমি এখানে আড্ডাখানার মেজাজে কথা বলছ?

ঋজুদা বলল, হুঁ। সেটাও স্ট্রাটেজি। বদল করেছি শুধু এইমাত্রই। যদিও এ সেয়ানা বাঘ রাইফেল বন্দুক চেনে। তবুও এমনই ভাব কর যেন আমরা মন্দির দেখতেই এসেছি।

বাঃ। মন্দির দেখতে এলে তো শিকার-গড়ের প্রধান ফটক দিয়েই ঢুকতাম। আমরা ঐ চাঁর গাছের ছায়ায় পাথরের জগাখিচুড়িতে যেতে যাব কেন ওর লেজে লেজে?

ভুল করে। ট্যুরিস্টরা পথ না ভুললে আর কে পথ ভুলবে? তাছাড়া এ তো আর কনডাকটেড ট্যুরও নয় যে গাইড আছে! চল্ আমরা গড়ের দেওয়ালে বসি। আমি পাইপ খাই আর তুই গলা ছেড়ে গান গা।

গান?

আমি চোখ কপালে তুলে আকাশ থেকে বললাম। ভাবলাম আমি কি চোঙা লাগানো গ্রামোফোন যে রেকর্ড চালালেই বেজে যাব?

ইয়েস। আমার অর্ডার। গান। কথা কম। গান।

যাঃ বাবাঃ। কী অন্যায়। বলে, আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দেওয়ালে বসলাম।

ঋজুদা বলল, গ্রামের দিকে মুখ করে বোস। গ্রামের লোকদেরও গান শোনানো দরকার। এই বাঘটাকে মারতে হলে ওদের প্রত্যেকের মন থেকে এই ঠাকুরানীর বাঘের মীথটাকে এক্সপ্লোড করতে হবে। কীরকম ভূতে-পাওয়া ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া হয়ে আছে মানুষগুলো দেখলি না। শরীরের শীত ছাড়ানো সোজা। মনের মধ্যে শীত ঢুকলে তা ছাড়ানো ভারী কঠিন। আর মানুষের মতই তো সব! বাঘটাও যে-সম্মানের সে যোগ্য নয় সেই সম্মান পেতে পেতে হয়ত অনেক মানুষেরই মত নিজেকেও ভগবান ভাবতে আরম্ভ করেছে। এবার বাঘ-ভগবানকে ভূত বানাবার ভার নিয়েছি আমরা। নে। তাড়াতাড়ি। গান।

কী গান?

আঃ। দরকারের সময় দেরি করিস কেন? গলা ছেড়ে গা না! তাড়াতাড়ি। বাঘ যেন শুনতে পায় সরে গিয়ে থাকলেও।

ঋজুদা এমনিতে যে-স্কেলে কথা বলে তার চেয়ে অনেকই উঁচু স্কেলে কথাকটি বলল।

এলো যে শীতের বেলা গাইব? আমি শুধোলাম।

আরে ধুৎ। ওসব গান তুই বালিগঞ্জের ড্রইংরুমে গাস। দেখছিস গান দিয়ে বাঘকে ভয় পাওয়ানোর ব্যাপার আর…। নজরুলের গানই বরং গা কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট। নইলে ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের কোনও গান? ও চিও চিও চিও চি। ও চিও চিও চিও চি?, জানিস না?

জানি না।

 তবে জানিসটা কি?

সারে জহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা গাইব?

ঋজুদা বলল, একদম না। দিল্লিওয়ালারা রবিঠাকুরের জনগণমন অধিনায়ক জয় হে-কে সুপারসিড করে ইকবাল-এর ঐ গান এখন ন্যাশনাল সঙ বলে চালাবার চেষ্টা করছে দেখছি। আই প্রোটেস্ট। সারে জহাঁসে আচ্ছা গাইতে হবে না।

তবে? ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা গাইব?

–গা! গা! আমিও গলা দেব।

গলার শিরা ছিঁড়ে গেলেও তা আবার গিট দিয়ে বেঁধে নেওয়া যাবে এমনই মনোভঙ্গি নিয়ে আমি একেবারে তারাতে ধরলাম গান। সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদাও। যদিও আমাদের দুজনের কেউই বেসুরো গাই না, তবুও ঐ তারস্বরের দ্বৈতসঙ্গীতে শিকার-গড়-এর দানো-প্রেত প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই আঁতকে উঠল। শিকার-গড়ের চত্বর জুড়ে, নিচের উপত্যকায় আমাদের ডুয়েটের সঙ্গে অসংখ্য পাখি, হনুমান, ময়ূর, বার্কিং ডিয়ার তাদের ভয়ার্ত গলা মেলাল। কী ট্রেমেলো! ইংরেজীতে যাকে বলে ‘ক্যাকোফনি’ তাইই আর কী? নিনিকুমারীর বাঘ যদি তখনও সে তল্লাটে থেকে থাকে এবং আড়াল থেকে আমাদের গতিবিধি লক্ষ করেও থাকে তবে তারও পিলে চমকে যাবার কথা। এমনই দুই শিকারি এবং শিকারের এমন প্রক্রিয়া কোনও বাঘেরই চোদ্দপুরুষে কেউ দেখেনি। শোনে তো নিই! নিনিকুমারীর বাঘের দোষ কী?

মানুষ, হনুমান, হরিণ, পাখ-পাখালি সকলের সম্মিলিত ‘ক্যাকোফোনি’ যখন থামল তখন ঋজুদা বলল, চল্ আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। আরও বেশি করলে শেষে বাঘ হার্ট-ফেল করেই না মরে। আর হার্ট-ফেল করে মরলে মৃত মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে তোর রাইফেল-হাতে নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ছবিও ছাপা হবে না খবরের কাগজে।

আমি বললাম, কেন? হার্টফেল করা বাঘের বুকে একটা গুলি ঠুকে দিলেই হবে। জানব তো আমরাই! দেখছেটা কে? তা না হলে ভটকাই কি কলকাতা গিয়ে আর ওই পোড়ামুখ দেখাতে পারবে? কেষ্টনগর সিটিতেও পারবে না।

তা ঠিক। সেটা একটা ভাবার মত কথা বটে! ঋজুদা হেসে বলল।

তারপরই বলল, চল্ আবার ঐ দিকে। বউটার হাতটা আর শাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট আছে নিয়ে যেতে হবে। নইলে দাহ করতে পারবে না ওর আত্মীয়রা। আর শবদেহ বা তার কিছু অংশও দাহ না করতে পারলে তো তার আত্মা মুক্ত হবে না। শান্তিও পাবে না। এইরকমই বিশ্বাস হিন্দুদের।

তুমিও তো হিন্দুই, না কি?

হ্যাঁ। আমিও। ঋজুদা বলল।

 তবে? তুমি তো ধর্ম মান না।

এইসব আলোচনা পরে কোনদিন করব। তাছাড়া এসব কথা বোঝার মত বয়সও তোর এখনও হয়নি।

আমি বললাম, আমরা ফটক দিয়ে যাচ্ছি আর বাঘ যদি দেওয়াল টপকে গিয়ে ওখানে অপেক্ষা করে থাকে অন্যদের জন্যে?

করুক। তাইই তো চাই আমরা। চার চোখের মিল হলেই তো গুড়ুম। কিন্তু তা সে করবে না। অত কাঁচাছেলে সে নয়।

কেন?

বলছি তোকে। বুদ্ধি নিনিকুমারীর বাঘও কিছু কম ধরে না আমাদের চেয়ে। তবে এই মুহূর্তে সে যে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ওকে এইখান থেকে তাড়াব কাল। দেখবি। তারপর ওর ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করব আমরা। ফিরে ও আসবেই। তিনদিন পরেই আসুক, কী সাতদিন পর। আর তখন ওকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। শিকারটা যতখানি শারীরিক সাহস ও কষ্টসহিষ্ণুতার ব্যাপার তার চেয়ে একটুও কম মস্তিষ্কের ব্যাপার নয়। এবং প্রতিপক্ষ যত বেশি যোগ্য, যুদ্ধও তত আনন্দর। বিপদেরও বটে। বিপদটাই তো আনন্দ। কী বল্?

শিকার-গড় ফটক পেরোবার পর আর কোনো কথাবার্তা বললাম না আমরা। মুখে বললেও, ঋজুদা তো আর ভগবান নয়, তাই বাঘ যে ওদিকে যাবেই না একথা জোর করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। নিঃশব্দেই আমরা গিয়ে আমাদের কাজ সমাধা করলাম। ঋজুদাকে ইশারাতে বললাম, কাটা হাতটা নিতে। আমি সাবধানে এগিয়ে গিয়ে ঐ গুহা থেকে রক্তে ভারী হয়ে থাকা ছেঁড়া-শাড়ির যতটুকু ছিল ততটুকু নিয়ে এলাম। যখন ফিরছি, কেবলই মনে হচ্ছিল কেউ যেন লক্ষ করছে আমাকে আড়াল থেকে। ঋজুদার কাছে এসে যখন পৌঁছলাম তখনও সেই মনে হওয়াটা গেল না। ঋজুদাকে বললামও। ঋজুদা বলল, মাঝে মাঝে পেছন দিকে নজর রেখে এগুতে। তারপর বলল, বাঘ যদি আমাদের পিছু নেয় তো নিক না। কোনো কিছুই যে আগেকার মত নেই, আর থাকবেও যে না, তা তার জানা দরকার। পিছু নিলে খুশি হব আমি।

পাহাড়ের চড়াই ওঠা বরং সহজ, কিন্তু উৎরাই নামা কঠিন। বিশেষত পেছনে মানুষখেকো বাঘ অনুসরণ করছে তা জানার পর। আমাদের আসতে দেখেই ভটকাই আর বালাবাবু জিপ থেকে নেমে দৌড়ে এলেন এদিকে। আর দৌড়ে এল যে মানুষটির বৌকে বাঘে নিয়ে গেছিল সে। বৌয়ের কাটা হাত নিয়ে কী কান্না যে কাঁদতে লাগল শিশুর মত, তা চোখে দেখা যায় না। ভটকাই আতঙ্কিত চোখে সেই নিপুণভাবে কাটা হাতের দিকে চেয়ে ছিল। ঋজুদা আমাকে বলল জিপে গিয়ে খুব জোরে জোরে হর্ন বাজা তো রুদ্র। এই ঘুমিয়ে-পড়া গ্রামকে জাগিয়ে দে। মানুষগুলোকে একটু নড়িয়ে দেওয়া দরকার।

আমি গেলাম হর্ন বাজাতে। ঋজুদা বালাবাবুকে ডেকে কাঁঠাল গাছের নিচে পাতা আমকাঠের তক্তার বেঞ্চে বসে কী সব শলা পরামর্শ করতে লাগল।

হর্ন শুনে ভটকাই দৌড়ে এসে বলল, কী রে! বাঘ পালিয়ে যাবে না? কী করছিস কি?

বললাম, বাঘকে তাড়াবার বন্দোবস্তই হচ্ছে।

-সে কি?

–হ্যাঁ।

–গান গাইছিলি কেন? তুই আর ঋজুদা? আমরা তো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। ভাবলাম, আমিও এখানে বসেই গলা মেলাই তোদের সঙ্গে।

গ্রামের প্রধানকে বালাবাবু ডেকে আনলেন। ঋজুদা আর বালাবাবু তাকে সব ভাল করে বোঝালেন। আমি একটু একটু ওড়িয়া বুঝি। ভটকাই কিছুই বুঝতে পারছিল না বলে কেবলই বলছিল, কী বলছে রে? কী বলল রে ঋজুদা? কী হবে রে?

বললাম, কাল দেখতে পাবি।

আঃ। কালের তো দেরি আছে। বলই না।

ঋজুদার কথা শুনে সকলেরই চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। ওদের পক্ষে যেন একথা বিশ্বাস করাই অসম্ভব যে কাল সারা গাঁয়ের লোকে শিকার-গড়ে গিয়ে ভাল করে ঠাকুরানীর পুজো দেবে। প্রধান অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু হবে কী করে? এত মানুষের প্রাণের দায়িত্ব কে নেবে?

আমি নেব। ঋজুদা বলল।

তুমি? একা? আর এই দুটি ছোট ছেলে?

ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। আমি আর ও নেব। যদি কারও গায়ে আঁচড়ও লাগে তার জন্যে আমরা দায়ী।

প্রধান অবিশ্বাসী গলায় বললেন, বড়লোকেরা ওরকম কথা অনেকই বলে। আমাদের চিরদিনই বলে এসেছে। রাজাও কম মিথ্যে কথা বলেননি। গরিবের প্রাণের দাম কে দেয়? কারও কিছু হলে আপনি কী করে প্রাণের দাম দেবেন?

ঋজুদা একটু ভাবল। তারপর বলল, কাল পুজো দিতে গিয়ে যদি কেউ মারা যায় তবে তার পরিবারকে দশ হাজার টাকা দেবো। আর কেউ খণ্ডিয়া হলে পাঁচ হাজার।

খণ্ডিয়া কী রে? ভটকাই শুধোল।

বললাম উনডেড। ইনজিওরড।

ঋজুদার মুখে ক্ষতিপূরণের অঙ্কটার কথা শোনার পর একাধিক লোকের মুখ দেখে মনে হল তারা মরে বা আহত হয়েই ধন্য হতে চায়। অত টাকা কোনদিন একসঙ্গে হাতে ধরার কথা ওরা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বাঁচার চেয়ে মরাই ভাল হবে কিনা এই চিন্তা যেন। সকলেরই চোখে-মুখে।

প্রধান আবার প্রশ্ন করলেন, সাম্বপানি থেকে পুরোহিতকে না আনলে পুজো কে করবে? রাজার মন্দির! তাছাড়া ঠাকুরানী এখন বাঘের হয়ে গেছেন। আমরা পুজো দিলে উনি যদি আরও চটে যান আমাদের ওপরে?

ঋজুদা একমুহূর্ত কী ভাবল। তারপর বলল, আমিই সকালে সাম্বপানি থেকে পুরোহিত নিয়ে আসব। তোমরা পুজোর অন্য সব বন্দোবস্ত করে রেখ। অনেক লোক লাগবে মন্দির আর মন্দিরের পথ পরিষ্কার করতে। সব জঙ্গল হয়ে আছে। কাল যত লোক মন্দিরে যাবে সকলের জন্যে শিকার-গড়েই খিচুড়ি রান্না হবে। সকলে ওখানেই ভোগ খেয়ে আসবে। মাংস আর খিচুড়ি। আমরা ঠিক সকাল আটটার সময়ে এসে পৌঁছব। আমাদের পাহারাতে সকলে যাবে। আবার আমাদের পাহারাতেই গ্রামে ফিরে আসবে।

বালাবাবু সকলকে সব বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন এই বাবু কলকাতা থেকে এসেছেন শুধু তোমাদের দুঃখ ঘোচাবার জন্যে। এবং উনি বাঘের পেছনে দৌড়োদৌড়ি করে বাঘকে এই শিকার-গড়ে বা তার আশপাশেই মারতে পারবেন বলে মনে করছেন। তোমরা ওঁকে সাহায্য করো। কোথাও কোনও মানুষ বা জানোয়ার মারা যাওয়ার খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে কুচি-খাঁই পাহাড়ের নিচের বাংলোয় গিয়ে খবর দেবে।

ঋজুদা বালাবাবুকে বলল, কত চাল, ডাল, মশলা, আনাজ, মাংস হবে তার একটা হিসেব করতে হবে তাড়াতাড়ি। বলে, যে মানুষটির বৌয়ের কাটা হাত আমরা নিয়ে এলাম তাকে সঙ্গে নিয়ে জিপে করে চলে গেল নদীর দিকে শবের অবশিষ্টাংশ দাহ করার জন্যে। সঙ্গে সেই লোকটির ছোট ভাইও গেল। আমাকে আর ভটকাইকে বলে গেল তোরা এখানে থাক। বালাবাবুদের সঙ্গে। আমি আসছি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। লোকটার ছোট ভাইয়ের হাতে টাঙ্গি। জাল কাঠ কেটে নেবে দাহ করার জন্যে নদীপারের জঙ্গলের মধ্যে থেকে।

ভটকাই কোনদিনও গ্রাম দেখেনি। গ্রামের মানুষেরা যে গরিব তা ও জানত, কিন্তু এত গরিব, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না ওর। ওর মুখ-চোখ দুঃখে বিকৃত হয়ে উঠেছিল। আমারও হত প্রথম প্রথম। তারপর সয়ে গেছে এখন। ভটকাই চুপ করে বসে ছিল। পথের পাশের একটি বড় পাথরের ওপরে। আমিও কোনো কথা বলছিলাম না। বালাবাবু অত্যাচারিত, অবিশ্বাসী, ভয়ে কুঁকড়ে-থাকা গ্রামের মানুষদের একটার পর একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঋজুদা আর আমার গুণপনার কথা বলছিলেন। বলছিলেন যে, এবারে নিনিকুমারীর বাঘের দিন সত্যিই শেষ হয়েছে। এদের কাছে বাঘের জারিজুরি টিকবে না।

একজন বালাবাবুকে বলল, তাহলে এতদিন এঁদের আনেনি কেন? আমাদের গ্রাম আর লাগোয়া গ্রাম থেকেই তো বাঘ নিয়েছে তিরিশজন মেয়ে-পুরুষ। গরু ছাগলের তো শেষই নেই।

বালাবাবু দুহাত নেড়ে বললেন, সে তো আমার ব্যাপার নয়। আমাদের ডি এফ ও সাহেবেরও নয়। তাছাড়া এরা তো ভারতবর্ষেই ছিলেন না। তারপর বললেন, তোমরা যদি নিজেরা এখন একটু সাহস না করো তবে উনি ফিরে যাবেন। তোমরা কি এইরকম মরার মতই বাঁচতে চাও চিরদিন, না যেমন করে বাঁচতে আগে তেমন করে?

একটি মাঝবয়সী লোক বলল, আমাদের আবার বাঁচা। কেউ না কেউ তো আমাদের চিরদিনই খেয়েছে। কখনও রাজা, কখনও সুদখোর, কখনও ঠিকাদারবাবুরা। আর এখন খাচ্ছে বাঘে। ঐ সব খাদকদের খাওয়ার কথা সকলে জেনেও জানেনি। বাঘে খেলে রক্ত বেরোয়। সকলেই জানে তাই। নইলে বাঁচা মরায় আর তফাত কী আমাদের? পাঁচ বছর বাদে মাইক আর ঝাণ্ডা লাগানো জিপে করে পার্টির নেতারা ধবধবে পোশাক পরে আসেন একবার করে। হাতজোড় করে বলেন, মা ভ্রাতা ভগিনীমান, মু ভোট পাঁই ঠিয়া হইছি আইজ্ঞা, তমমানে মত্ত্বে ভোট দিয়ন্তু। ভোট নেবার আগেই হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা। ভোট পাবার পর সব ভোঁ-ভাঁ। এই তো চলল চল্লিশ বছর। আমার বয়স হল পঞ্চাশ বছর। দশ বছর থেকেই এই দেখে আসছি। আমার বাবা যেমন গরিব ছিল আমি তার চেয়েও অনেক বেশি গরিব হয়ে গেছি। নিনিকুমারীর বাঘকে যদি এ বাবুরা সত্যিসত্যিই মেরে দিয়ে যেতে পারেন তাহলে এর পরে আমরা ঐ মিথ্যেবাদী নেতাগুলোকে ধরব আর টিপে টিপে মারব। আমরা তো এই মিথ্যের বলি হয়েই জীবনটা কাটিয়ে গেলাম। অন্তত, আমাদের ছেলেমেয়েগুলো যাতে মানুষের মত বাঁচতে পারে….

আমি তাকিয়ে দেখলাম, মানুষটির দু’চোখে জল ছিল না। আগুনের হলকা ছিল। পেট আর পিঠ এক হয়ে গেছে। অন্য সব লোকদেরও শরীরগুলো টিঙটিঙে কিন্তু পেটগুলো ফোলা ফোলা। ঋজুদা বলছিল খিদের জ্বালা সইতে না পেরে ওরা ভাতের সঙ্গে আফিঙের গুঁড়ো সেদ্ধ করে খায়। শুধু নুন ভাত। তাও জোটে না। জুটলেও এক বেলা। বনের ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকে। বাঘের জন্যে তাও বন্ধ। আফিঙ চুর্ণ খেয়ে খেয়ে পিলে বড় হয়ে যায়। বুড়োও হয়ে যায় তিরিশ-চল্লিশ বছর বয়সে।

ভটকাই বলল, কলকাতায় বা কেষ্টনগরে আমাদের মধ্যে যারা খারাপও থাকি তারাও কত ভাল আছি এদের চেয়ে, না রে?

হুঁ।

-দুসস। মনই খারাপ হয়ে গেল তোদের সঙ্গে এসে। আগে জানলে আসতাম না।

আমি কিছু বললাম না উত্তরে।

কিছুক্ষণ পরে দূরের জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে জিপের এঞ্জিনের গোঙানি ভেসে আসতে লাগল।

ভটকাই কান খাড়া করে বলল, কী রে! ঋজুদা কি ফিরে আসছে? এত তাড়াতাড়ি দাহ হয়ে গেল?

–দাহ আর কী! একটা তো হাত শুধু। আর রক্তে ভেজা শাড়ি। কতক্ষণ আর লাগবে।

–হুঁ। বলে, ভটকাই যে পথে ঋজুদার জিপ আসবে সেই পথের দিকে চেয়ে রইল।

.

০৩.

বিশ্বল সাহেব আর বালাবাবু ঋজুদার কথামত সাম্বপানির রাজপুরোহিত থেকে শুরু করে পাঁঠা জোগাড় এবং খিচুড়ির বন্দোবস্ত একেবারে নিখুঁতভাবেই করেছিলেন। চণ্ডীমন্দির পরিষ্কার করে ধোয়ামোছাও হল। কতদিন পরে মন্দিরের পুজো হল কে জানে! ঝিংকুপানির মানুষেরা যেন নিজেদের চোখ-কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভাবতেই পারছিল না যে এমন অসম্ভবও সম্ভব হতে পারে।

পুজো ও খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে এল। হেমন্তর বেলা। তিনটে বাজতে না বাজতেই ঋজুদা গ্রামে ফিরে যাবার জন্যে তাড়া লাগাল।

ফেরার সময়ে ঋজুদা এবং আমি গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে ফিরলাম না। কেউ কেউ ভয় পাচ্ছিল। ঋজুদা গ্রামের প্রধানকে ডেকে বলল, কিচ্ছু হবে না। আমার দায়িত্ব। বাঘ এই মুহূর্তে নিজের ভবিষ্যতের চিন্তায় মগ্ন। এই ভিড়ের মধ্যে আজ সে মানুষ ধরে নিজের চিন্তা বাড়াবে না। শিকারির হাঁচিও সে চেনে। সে এখানে এখন থাকলেও সে যে এখানে নেই এই কথাটাই প্রমাণ করতে সে ব্যস্ত হয়ে থাকবে।

যারা বনে মানুষ, বনেই যাদের জন্ম, বনের মধ্যেই যাদের বড় হয়ে ওঠা, বনই যাদের জীবনের সবকিছু তারা ঋজুদার মত শহুরে মানুষের এমন ভয়ডরহীন বেপরোয়া ভাব দেখে অবাক হল। নিজেদের হারিয়ে-যাওয়া সাহস যে তারা ফিরে পেলেও পেতে পারে এমন এক আশার ভাব তাদের চোখেমুখে জ্বলজ্বল করতে লাগল।

ভটকাই বলল, চল রুদ্র। এবারে আমরাও নামি।

কিন্তু ঋজুদা ভটকাইকে বালাবাবুদের সঙ্গে কুচিলাখাঁই পাহাড়ের নিচের বাংলোতে ফিরে যেতে বলে বলল, আমি আর রুদ্র রাতটা এখানেই থাকব। কথাটা ভটকাই-এর বিশ্বাস হল না।

ঋজুদা বলল, যা! আর দেরি করিস না ভটকাই। কাল একদম ভোরে এক ফ্লাস্ক গরম চা নিয়ে বালাবাবুর সঙ্গে ঝিংকুপানিতে চলে আসিস। রাতে ঘুমো গিয়ে আরাম করে।

আমি তাহলে এলাম কেন? কী লাভ হল ছাই আমার এখানে এসে!

অত্যন্ত হতাশা আর বিরক্তির গলায় বলল ভটকাই।

 হবে হবে। লাভ হবে। অধৈর্য হোস না। এখন যা বলছি তা শোন। লক্ষ্মী ছেলে। ভটকাইকে ক্ষান্ত করে বলল ঋজুদা।

আমার সঙ্গে একরকম ব্যবহার করছে ঋজুদা, যেন সমান সমান মানুষ আর ওকে ছেলেমানুষ বলে সবেতেই বাদ দিচ্ছে। এই ব্যাপারটাই ভটকাই-এর আরও খারাপ লাগল। আর কিছু না বলে অন্যদের সঙ্গে সে নেমে গেল শিকারগড় থেকে ঝিংকুপানির গ্রামের দিকে।

ঋজুদা বলল, রুদ্র, তুই গিয়ে বোস যে রক-শেলটারের মধ্যে বাঘ মৃতদেহের শেষাংশ রেখেছিল, তার বাইরে নিচের উপত্যকার দিকে চেয়ে থাকা কোনো বড় গাছের ওপরে। আর আমি থাকছি নবহতখানাতে। এখান থেকে শিকার-গড়ের চারধারেই নজর রাখা যাবে। গড়ের দেওয়াল আর তুই যেখানে বসে থাকবি সেই জায়গাতেও।

বলেই, আমার দিকে ফিরে বলল, কোনো ভয় নেই।

ওখানে দাঁড়িয়েই বললাম, কোন্ গাছটাতে বসব বল?

ওদিকে ভাল করে চেয়ে থেকে ঋজুদা বলল, ঐ কুরুম গাছটাতেই বোস। চাঁরগাছটা বেশি ঝুপড়ি।

কুরুম গাছটাও তো খুব ঝুপড়ি। ঐ গাছে বসে গুলি করব কী করে? রাইফেলের সঙ্গে লাগানো টর্চও তো নেই। আগে জানলে…

–সে তো আমার রাইফেলেও নেই। ঋজুদা বলল।

তারপরই বলল, আজ বাঘকে যদি তুই দেখতেও পাস, তাহলে গুলি করিস না।

-কেন?

আমি চাই না যে তুই এই বাঘের মোকাবিলা করিস। আমি যদি দেখতে পাই তবে গুলি করব। অবশ্য শর্ট-রেঞ্জের মধ্যে পেলেই। এবং আমার যদি তোর সাহায্যের দরকার পড়ে তবে তুই সাহায্য করিস। কিন্তু গাছ থেকে না নেমে। মনে থাকে যেন। এমন একটা ডালে বসিস যেখান থেকে নিচের উপত্যকা আর নবহতখানা দেখা যায়। আমাকে অবশ্য দেখতে পাবি না। আমি থাকব নবহতখানার মধ্যের অন্ধকারে মিশে। যাঃ। আর কথা নয়। বেলা পড়ে গেছে। সাবধানে যাস। ঐ গাছে পৌঁছবার পথেই বাঘের সঙ্গে দেখা হতে পারে। খুব সাবধানে যাবি। কাল সকালে দেখা হবে। গুড লাক।

আমি এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, গুড হান্টিং।

ফটক দিয়ে নামলাম না। যে জায়গা দিয়ে গতকাল আমরা দুজনে উঠে এসেছিলাম সেই জায়গা দিয়েই নামলাম। গাছের ছায়ারা লম্বা হয়ে আসছে। ময়ূর ডাকছে উপত্যকা থেকে। হেমন্তের সন্ধ্যার সঙ্গে শীতের সন্ধ্যার অনেক তফাত। ভাল খারাপের কথা নয়। আলাদা আলাদা যে সেইটাই কথা। কিছুটা নামতেই মনে হল, রাত নেমে এসেছে। ঝুপঝুপ করে ছায়ারা শব্দহীন দ্রুত পায়ে এসে আমায় ঘিরে ফেলল। একটা পেঁচা হুড়ম-হাড়ম করে ডাকতে ডাকতে কোটর ছেড়ে হেলিকপ্টারের মত সোজা উঠে গেল ওপরে। কালো পাতাদের চাঁদোয়া ফুঁড়ে। রাইফেলে দু হাত ছুঁইয়ে আমি দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম ঋজুদার নির্দেশমত কুরুম গাছটার দিকে। ভীষণই ভয় করতে লাগল। ঋজুদার সঙ্গে অনেক বিপদেরই সম্মুখীন হয়েছি আমি। মানুষখেকো বাঘের মোকাবিলা আমি ঋজুদার সঙ্গে আগেও করেছি বনবিবির বনেতে। আফ্রিকার জঙ্গলের গুগুনোগুম্বারের দেশে এবং রুআহা নদীর উপত্যকাতেও। কিন্তু সেই সব বিপদ সম্বন্ধে আগে জানা থাকলেও নিনিকুমারীর বাঘ-এর মত এতখানি জানা ছিল না। এই বাঘ যেন রূপকথারই কোনো দৈত্য। ঠাকুরানীর কৃপাধন্য। এই বাঘকে কব্জা করা বোধহয় কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। যারাই সেই স্পর্ধা দেখাবে তাদেরই মৃত্যু অনিবার্য। মনে স্বীকার করি আর নাইই করি, এরকম একটা ধারণা যেন কেমন করে ঢুকে পড়েছে আমার মনেও। নইলে ঋজুদা সঙ্গে থাকলে কোনো বিপদকেই বিপদ বলে ভাবিনি। মানুষের সঙ্গে বা জানোয়ারের সঙ্গে অবশ্যই লড়া যায়, তা তারা যতই ভয়াবহ বা হিংস্র হোক না কেন! কিন্তু লড়া যায় না ঈশ্বর বা ভূতের সঙ্গে।

একসময় নিজেরই অজান্তে সেই প্রায়ান্ধকারে গাছতলায় পৌঁছে চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে গাছে হেলান দিয়ে জুতো খুলে দুটো জুতোর ফিতেতে গিট মেরে রাইফেলের মত কাঁধে ঝুলিয়ে কুরুম গাছটাতে উঠে গেলাম। গাছটার গড়ন ঋজু। ভাল মোটা ডাল বেরিয়েছে বেশ ওপরে পৌঁছে। যাই হোক, যে ডাল বাইরে উপত্যকার দিকে ছড়িয়ে গেছে এবং যে ডাল থেকে আবার উপশাখা বেরিয়েছে, তেমন একটা মোটা ডাল বেয়ে এগিয়ে গিয়ে দুটো ডালের সংযোগের জায়গাতে ঘোড়ায় চড়ার মত বসলাম। গাছের নিচে রক-শেলটারের দিকে ঘন অন্ধকার। যদিও সূর্য ডুবতে এখনও আধঘণ্টার মত দেরি। রাতে যে চোখ একেবারেই চলবে না তা তখনই বোঝা গেল।

থিতু হয়ে বসে, স্লিংএ ঝোলানো রাইফেলটাকে পিঠ থেকে খুলে নিয়ে ঊরুর ওপরে রেখে জুতো দুটোকে একটা ডাল থেকে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর চারদিকে চেয়ে কুরুম গাছটার সঠিক অবস্থান বুঝে নেবার চেষ্টা করোম। চমৎকার দেখাচ্ছে এখন সমস্ত উপত্যকাটি। উপত্যকা পশ্চিমে। সূর্য চলেছে দিগন্তে। বোতল-সবুজ এবং শুয়োপোকা-রোমশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে এখুনি হারিয়ে যাবে রাঙাজবা সূর্য। কনসর নদীর আঁকাবাঁকা শাখার রুপোগলা জলে সেই রঙ লেগেছে ছোপ ছোপ। অগণ্য পাখির ডাকে। কাকলিমুখর হয়ে উঠেছে নিনিকুমারীর বাঘের বাসভূমি। এখান থেকে শিকার-গড়ের নবহতখানাও দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমের বিদায়ী আলো এসে থামে আর গম্বুজে পড়ে আসন্ন সন্ধ্যার আগে পুরো শিকার-গড়কে থমথমে রহস্যে মুড়ে দিয়েছে। শিকার-গড় থেকে মুখ ফিরিয়ে আবারও উপত্যকার দিকে দুটো মদ্দা এবং সাতটি মাদিন শম্বর নদী পেরিয়ে ওদিক থেকে এদিকে এল সার বেঁধে। জলের আয়না ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। বিলিতি ক্যালেণ্ডারের ছবির মত দেখাচ্ছিল ঐ সন্ধের আকাশ, বন, নদী আর উপত্যকার মধ্যের নদী পেরুনো শম্বরদের।

কতক্ষণ চেয়ে ছিলাম জানি না। কিন্তু চোখ যেই ওদিক থেকে আবার ফিরিয়ে শিকার-গড়ের দিকে ফেললাম, কে যেন হঠাৎ আলোর সুইচটা নিবিয়ে দিল। অন্ধকার গিলে নিল সবকিছু। জেগে রইল শুধু পশ্চিমাকাশে দিগন্তরেখার কিছুটা ওপরে শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ সন্ধ্যাতারাটি।

চাঁদ উঠতে এখনও অনেক দেরি। এখন এই কুরুম গাছের চতুর্দিকে এমনই গাঢ় অন্ধকার যে নিজের হাত পা-ই দেখা যাচ্ছে না। চোখের পাতা খুলতে গেলেও চাপ চাপ অন্ধকার। দু-চোখের সামনে থেকে তা সরাতে ফিনফিনে চোখের পাতাদের কষ্ট হচ্ছে। এখন অবশ্য চোখের কোনো ভূমিকাই নেই। কানদুটোই চোখের কাজ করছে। এবং নাকও।

সেই যে শম্বরের দলটিকে নদী পেরোতে দেখেছিলাম দিনান্তবেলাতে তাদেরও কোনো সাড়া শব্দ নেই। অথচ তারা যেভাবে নদী পেরোল তাতে মনে হল সোজাসুজি এলে তারা আমি যে কুরুম গাছে বসে আছি তাতেই এসে ধাক্কা খেত। শিকারগড়ের ফটকের কাছাকাছি একজোড়া পেঁচা কিঁচিকিঁচি-কিঁচির কিঁচি-কিঁচর করে ঝগড়া করতে করতে পুরো এলাকা সরগরম করে তুলছিল মাঝে মাঝে। মনে হচ্ছিল, তাদের ঝগড়া যেন এ রাতে শেষ হবার নয়। আর উপত্যকাতে নদীর ওপার থেকে একটি কপারস্মিথ পাখি ডেকে যাচ্ছিল অবিরাম। টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। তার সাথী সাড়া দিচ্ছিল নদীর ওপার থেকে। টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। সেই দূরাগত ডাক নদীর জলে ব্যাঙবাজির মত পিছলে উঠে নিনিকুমারীর বাঘের রাজ্যের এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধতা যে কতখানি অমোঘ এবং জমাট তাই প্রমাণ করছিল।

ঝিংকুপানি গ্রামেও কোনো শব্দ নেই এখন। এমন পাহাড়ী জঙ্গলে সোয়া কিমি দূরেও কুয়ো থেকে কেউ জল তুললে সেই শব্দ পরিষ্কারই শোনা যায়। গ্রীষ্মবনের গাছ থেকে একটি পাতা খসলে সেই পাতা ঝরার শব্দও পটকার শব্দর মতই কানে বাজে।

ঝিংকুপানি গ্রাম সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নিঃসাড়। ঘুমিয়ে যেন কাদা হয়ে আছে। অনেকদিন পর তাদের সাহস ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আজ ঋজুদার কল্যাণেই জেগে উঠেছিল। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সে সব ঘুমিয়ে পড়েছে। নিনিকুমারীর বাঘ একটা সাঙ্ঘাতিক মনের রোগও। সে রোগ অসুস্থ, বিবশ করেছে স্ত্রী-পুরুষ, বড়-ছোট, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলকেই, এই কথাটা ঋজুদা যথার্থই বুঝেছে। এবং বুঝেছে বলেই তার মোকাবিলা করার আগে এই রাহুকবলিত মানুষদের মনের চিকিৎসায় লেগেছে। অসংখ্য অগণ্য সব গল্প-গাথায় তাদের প্রত্যেকের মনের স্বাভাবিকতা বাদার ঝাঁঝির মত চাপা পড়ে গেছে। এই ত্রাস থেকে এখানের মানুষদের মুক্ত করতে পারলেই নিনিকুমারীর বাঘের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই আধখানাই জেতা হয়ে যাবে।

জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে নিজের ভাবনাতে বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। এমন সময় হঠাৎ গাছতলায় কী একটা আওয়াজ পেলাম। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলাম। আওয়াজটা কিসের। পরক্ষণেই বিকট দুর্গন্ধে ভরে গেল পুরো জায়গাটা। হায়না! হায়না এসেছে বাঘের প্রস্তরাশ্রয়ে। জানে বোধহয় যে, এখানে মাঝে মাঝেই প্রসাদ থাকে তার জন্যে। এঁটো-কাঁটা খেতে যাদের আপত্তি নেই এবং এঁটোকাঁটা খেয়েই যারা বেঁচে থাকে তারা উচ্ছিষ্টর খোঁজ তো রাখবেই।

হেমন্তের শিশির ভেজা বনকে কিছুক্ষণ দুর্গন্ধে কলুষিত করে হায়না চলে গেল। বাঘের ডেরার এলাকা পার হয়ে যাবার পর উপত্যকার দিকে নেমে যেতে যেতে হায়নাটা পাহাড়ী নদী চমকিয়ে ডেকে উঠল-হাঃ হাঃ হাঃ! হুঃ হাঃ। হাঃ হাঃ। যারা কখনও রাতের বনে আচমকা এ ডাক শোনেনি তাদের পক্ষে তার ভয়াবহতা ধারণা করাও মুশকিল।

হায়না চলে যাবার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ। কপারস্মিথ পাখিরা দূরের বনের নদীপারে ডেকে ডেকে থেমে গেছে। হেমন্তর বনের রহস্যময় রাতে এই পাখির ডাক বুকের মধ্যে এক ধরনের ছমছমানি তোলে। সমস্ত রাতকে এক মোহময় অপার্থিবতায় মুড়ে দেয়। মুর্শিদাবাদী বালাপোষের মত। অন্ধকার এখন গাঢ়তর। বাঘের কোনো চিহ্নই নেই। অন্ধকারের মধ্যে শিকার-গড়ের শিলাবপু নক্ষত্রখচিত সবুজাভ আকাশ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাদুড়ের ডানার শপশপ আওয়াজ সেই পাথুরে নিস্তব্ধতাকে মাঝে মাঝে মথিত করছে।

ঘুম পাচ্ছে আমার। সেই ভোরে উঠেছিলাম। তারপর অবেলাতে খিচুড়ি আর কষা মাংসের ভোজটাও বড় গুরু হয়ে গেছিল। চোখের পাতা দুটো বুজে আসছে। কুরুম গাছের মোটা ডালে হেলান দিয়ে রাইফেলটাকে দুই ঊরুর ওপরে রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানি না।

হঠাৎই যেন কানের কাছে বোমা ফাটল। গাছের প্রায় নিচেই দড়াম করে একটা কোটরা আমাকে প্রায় হার্টফেল করিয়ে একবার ডেকেই হিস্টিরিয়া রোগীর মত বন-বাদাড় গাছ-পাহাড় ভেঙে ঝড়ের বেগে দৌড়ে পালিয়ে যেতে লাগল উপত্যকার নদীর দিকে। ডাকতে লাগল দৌড়তে দৌড়তে, বনের সব প্রাণীকে সাবধান করে দিতে দিতে। তার সেই ডাকের ওম্-এ এই শীতের রাতের অন্ধকারের ডিম ভেঙে যেন সাদা চাঁদ বেরল। ভিজে বনপাহাড় আস্তে আস্তে পাটিসাপটা রঙা হয়ে উঠতে লাগল। বাইরেটা একটু পরিষ্কার হতেই গাছতলার অন্ধকার আরও ঝুপড়ি হয়ে এল এবং আমার মন বলতে লাগল যে বাঘ গাছতলাতে এসে আমাকে মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। বাঘকে খুব কাছে হঠাৎ না দেখতে পেলে কোটরা হরিণটা অমন পাগলের মত করত না। নিনিকুমারীর বাঘ কি গাছতলায় আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে? নাকি তার পাথুরে আশ্রয়ে বেড়ালের মত শুয়ে আমাকে নজর করবে, কে জানে? যখন এই সব ভাবছি গাছতলার নিবিড় অন্ধকারের তুমুল সন্দেহের শিকার হয়ে, ঠিক সেই সময়েই হুড়-দাড় আওয়াজ করে ঝিংকুপানির দিক থেকে সেই হারিয়ে যাওয়া শম্বরের দল ঘ্বাক-ঘ্বাক করে ক্কচিৎ সংক্ষিপ্ত ডাক ডাকতে ডাকতে উপত্যকার দিকে নেমে যেতে লাগল। এতক্ষণে বুঝলাম যে তারা ঝিংকুপানির সীমানাতে কারও বিরিডালের ক্ষেতে গেছিল বিরি খেতে। বাঘের কথা কোটরার মুখে জানতে পেরেই হুড়মুড়িয়ে পালাচ্ছে এখন। তার মানে বাঘ যে আমার ধারে কাছেই আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভীষণই অস্বস্তি হতে লাগল আমার। ভয়ও যে হল না তাও নয়। যে বাঘের গল্প শুনেই হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধোয় সে কাছে এলে আমা-হেন শিকারির অবস্থা যে শোচনীয় হবেই, তাতে আর সন্দেহ কি?

কিন্তু বাঘের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল এই যে, কাছে এসেও সে যে এসেছে একথা জানা না দেওয়া। বনের প্রাণীরাও বোঝে অনেকই দেরিতে। এই সব ভাবছি যখন, ঠিক তখনই বাঘের গন্ধও পেলাম মনে হল! ঠিক কিনা জানি না। মনের ভুলও হতে পারে। নিনিকুমারীর বাঘের রাজ্যে অনেকক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে বসে, অন্ধকারের মধ্যে কান পেতে, অন্ধকারের দিকে চেয়ে থেকে আমার মন আর মনে ছিল না। কিন্তু তারপর আর কিছুই ঘটল না। না কোনও শব্দ হল, না কোথাও নড়াচড়া। অনিশ্চয়তায় ভরা আশা আর আশঙ্কা করতে করতে একসময় এমনই হল যে কিসের আশা বা আশঙ্কা করছিলাম তাই ভুলে গিয়ে আবার ঢুলতে আরম্ভ করলাম ঘুমে। চাঁদ জেগে রইল একা। দূরের নদীর শব্দ জোর হতে লাগল বন নিস্তব্ধতর হতেই।

হঠাৎই শিকার-গড়ের চণ্ডীমন্দিরের ঘণ্টাগুলো দারুণ জোরে এলোমেলো ভাবে বেজে উঠল। প্রায় মিনিট দু-তিন আগে-পরে জোরে-আস্তে বেজে গেল পুবের আকাশে অন্ধকার ফিকে হতে শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে। ভীষণই ভয় করতে লাগল আমার। নিনিকুমারীর বাঘ কি সত্যিই তবে ঠাকুরানীর বাঘ? আমি, সাউথ ক্যালকাটার রুদ্র রায়ও কি ঝিংকুপানির হাড় জিরজিরে পেটফোলা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদেরই মত সেকেলে হয়ে গেলাম?

চণ্ডীমন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে বোধহয় দিন-পাখিরা সব জাগতে লাগল একে একে। হাজার গলার সুরে সুর মিলিয়ে তারা যেন শিকার-গড়ের চণ্ডীঠাকুরের আরাধনা শুরু করে দিল! কী চিকন মিষ্টি অথচ জোরাল তাদের গলার স্বর। কে যেন এত বিভিন্ন রূপের বিভিন্ন স্বভাবের বিভিন্ন স্বরের পাখিদের সৃষ্টি করেছিল জানি না। তবে তিনি যে হোন না কেন, তাঁর পায়ে প্রণাম জানালাম। বনে-পাহাড়ে রাত কাটালে এই সময়ে, রাত শেষ হয়ে ভোর আসার মুহূর্তটিতে মায়ের গলায় বহুবার শোনা রবীন্দ্রনাথের এই গানটির কথা মনে পড়ে আমার। আহা কী গান! সমস্ত শরীর মনে কী যেন কি একটা হয় এই গানটা মনে করলেই!

প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে,
অলস রে, ওরে, জাগো জাগো ॥
শোনো রে চিত্তভবনে অনাদি শঙ্খ বাজিছে–
অলস রে, ওরে, জাগো জাগো ॥

ঋজুদাকে নহবতখানা থেকে নামতে দেখলাম যখন তখনও সূর্য ওঠেনি, যদিও চারদিক পরিষ্কার হয়েছে। যতক্ষণ না গাছের নিচে ভাল করে নজর চলে ততক্ষণ অপেক্ষা করে একটু একটু করে নেমে শেষে গাছের নিচে এসে পৌঁছলাম। রক-শেলটারের দিকে তাকালাম। রাতের অন্ধকারে কত কিছুই কল্পনা করছিলাম। কত অবয়ব, কত বিপদ। বনের মধ্যে রাত কাটানোর পর সকাল যেন পৃথিবীর সব প্রসন্নতা নিয়ে এসে হাজির হয়।

সাবধানে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ জায়গা ছেড়ে এসে পরিষ্কার জায়গাতে দাঁড়ালাম ঋজুদার অপেক্ষায়। ঋজুদা গড়ের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে পাইপ ধরাচ্ছিল। আমাকে দেখে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে নেমে এল। শুধোলাম, মন্দিরের ঘণ্টাগুলো ভোর হবার আগে অমন করে বাজল কী করে?

ঋজুদা হাসল, উত্তর না দিয়ে।

 বলল, গেস্ কর। ভেবে দ্যাখ কে বা কারা বাজাতে পারে।

সারা রাত গাছের ডালে ঘোড়সওয়ার হয়ে বসে থেকে আর অন্ধকারে চারদিকে নিনিকুমারীর বাঘ দেখতে দেখতে আমার মস্তিষ্ক তখন আর কাজ করছিল না। সারেন্ডার করে বললাম, জানি না।

ঋজুদা বলল, বাদুড়। ভোর হওয়ার আগেই তারা ফিরে এসে ঘণ্টাগুলো যে লম্বা শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে, তাতে এসে ঝুলে পড়ল। তাই ঐ ঢং-ঢঙা-ঢঙ। তারপরই নিজের মনে বলল, চল, তাড়াতাড়ি নামি নিচে। দেখি, ভটকাই চা নিয়ে এল কিনা?

নিচে নেমে দেখলাম তখনও বালাবাবু জিপ নিয়ে আসেননি। তবে এসে পড়বেন এখুনি। ভোর তো এই হল সবে। গ্রামের মধ্যে থেকে শব্দ আসছে নানারকম। চারপাশে বনমোরগ, ময়ূর, তিতির, বটের হরিয়াল, ঘুঘু, নানারকম ফ্লাইক্যাচার আর মৌ-টুসকি পাখিদের সম্মিলিত ডাকে একেবারে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো অঞ্চল। আমরা গিয়ে যখন গাছতলায় বসলাম তখন গ্রামের ঘরগুলোর দরজা একে একে খুলছে। দু-একজন এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল, কী হল রাতে?

ঋজুদা বলল, গ্রামের দিকে বাঘ কি এসেছিল কাল রাতে?

সকলেই বলল, না। কিন্তু আপনারা কী দেখলেন?

–কিছু না।

–তবে সারারাত কষ্ট করে গাছে বসে রইলেন কেন? কোনো মড়ি বেঁধে বসলেও না হয় কথা ছিল। জগবন্ধুর বৌয়ের শরীরের কিছু তো আর বাকি ছিল না।

ঋজুদা বলল, জায়গাটা সম্বন্ধে একটু ধারণা করার জন্যে বসেছিলাম। বাঘ যে এখানে নেই এবং আসবে না তা জেনেও। এ বাঘ তো যে-সে বাঘ নয়! ঋজুদা যখন এসব কথা বলছে, ঠিক তখনই আমরা যে পথ দিয়ে নেমে এলাম শিকার-গড় থেকে, সেই পথ দিয়ে একটা ছোটখাটো লোক হাতে একটা গরু চরাবার লাঠি নিয়ে প্রচণ্ড দৌড়ে, দৌড়ে না বলে উড়েই বলা ভাল, আমাদের দিকে নেমে আসছিল। ক্রমশই তার চেহারা বড় হতে লাগল। ততক্ষণে অন্যদিক থেকে দূরাগত জিপের এঞ্জিনের ক্ষীণ আওয়াজও শোনা যেতে লাগল।

কাছে আসতে দেখলাম লোক নয়, একটা দশ-বার বছরের ছেলে। গায়ে সাজিমাটির কাঁচা হলুদ রঙের একটা জামা, মাথায় ফেটে-যাওয়া গামছা। ছেলেটা হাঁপাচ্ছিল।

ঋজুদা বলল-কউটি আসিলুরে তু পিলা?

 হাঁপাতে হাঁপাতে সে শিকার-গড় ফুড়ে তার তর্জনী নির্দেশ করে বলল, সুঝানি।

-হেল্বা কঁড়?

মা বাপ্পাটাকু সে বাঘ্বটা কাল রাতবেলে আম্মা ঘর ভাঙ্গিকি নেই গলে।

বলেই, বাবু-উ-উ-উ বলে এক বুকফাটা আর্তনাদ করে ছেলেটি ঐ হিমপড়া লাল ধুলোর রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

এমন সময় বালাবাবু আর ভটকাই জিপ থামিয়ে মস্ত ফ্লাস্কে চা নিয়ে নেমে এল।

ঋজুদা ঐ ছেলেটাকে দুহাতে তুলে ধরে জিপের সামনের সিটে বসাল। ফ্লাস্ক থেকে গরম চা ঢেলে সবচেয়ে আগে ওকে দিল।

ছেলেটিকে অমনভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ঝিংকুপানির কিছু মানুষও এসে জিপ ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। বালাসাহেব ওদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলে সব জেনে নিলেন। ওদের সুঝনি গ্রাম ঠিক শিকার-গড়ের উল্টোপিঠে নয়, আরও গভীরে। সেখানে জঙ্গল অত্যন্ত গভীর। সে গ্রামে মাত্র আট-দশ ঘর মানুষের বাস। ওরা তামাক পাতা আর সর্ষের চাষ করে শুধু। ছেলেটার নাম যুধিষ্ঠির। তার বাবার নাম দশরথ। তার মত সাহসী, সৎ আর পরিশ্রমী মানুষ নাকি এ তল্লাটে ছিল না। এমন দুর্দিনেও যারা নিনিকুমারীর বাঘটে ডোন্টকেয়ার করে এসেছে তাদের মধ্যে সে অন্যতম। আর বাঘে কিনা শেষে তাকেই নিল। তাও তার ঘর ভেঙে।

বালাবাবু বললেন, আশ্চর্যের কথা স্যর, আজ অবধি ঐ সুঝানি গ্রামে কোনো কিল হয়নি।

ঋজুদা অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিল। আমারও মনে হচ্ছিল গোড়াতেই ঋজুদা একটু ওভার-কনফিডেন্ট হয়ে পড়ে নিনিকুমারীর বাঘকে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল তা দেয়নি। তার গুনাগার আমাদের গুনতে হবে।

ছেলেটাকে গরম চা আর কিছু খাবার খাইয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন বালাবাবু। কিন্তু কোনো খাবারই সে ছুঁল না। বাচ্চা ছেলে, মাঝে মাঝেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠছিল। ওর মা মারা গেছেন দু বছর আগে, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে।

ঋজুদা বালাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সুঝানি গ্রামে জিপ চালিয়ে যাওয়া যাবে?

–হ্যাঁ। নদী পেরিয়ে যেতে হবে।

কত মাইল পড়বে? কতক্ষণ লাগবে যেতে?

কাক-উড়ানে গেলে মাইল তিন কী চার, কিন্তু জিপে গেলে তো ঘুরপথে যেতে হবে। তা মাইল দশেক পড়বে।

–ওখানে গেলে আমাদের সাহায্য করার জন্যে মানুষজন পাব?

–না পাবারই কথা। ছোট গ্রাম।

–এ গ্রাম থেকে কয়েকজন কি যাবে আমাদের সঙ্গে?

বালাবাবু গ্রামের ভেতরে গিয়ে প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এসে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বললেন, ঠাকুরানীর বাঘকে চটানো ঠিক হয়নি বলে এদের সকলের ধারণা। তখন কিছু না বললেও চণ্ডীমন্দিরে পুজো আর শিকার-গড়ের চত্বরে পিকনিক করাটা ঝিংকুপানির মানুষেরা মোটেই ভাল মনে নেয়নি। এ বাঘ ঠাকুরানীর বাঘ। একে ছোট করে দেখার জন্যে আপনাদের নাকি এখন অনেক শাস্তি পেতে হবে।

ঋজুদা পাইপটা থেকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ম্যানইটার বাঘ পরপর দু’দিন এত কাছাকাছি গ্রামে মানুষ মারে এমনটা শুনিনি। দেখিওনি কখনও। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! এবারে আমার…

কী? আমি বললাম।

মে বী, মাই লাক ইজ রানিং আউট। চল যুধিষ্ঠির। আমাদের সঙ্গে জিপে ওঠ। আমরা তোর গ্রামে যাব।

যুধিষ্ঠিরের দুচোখে কৃতজ্ঞতা আর প্রতিশোধের দীপ্তি ফুটে উঠল। বলল, আমার বাবা তিনদিন ধরে জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ছিল। বাঘটা তো আমাকেও নিতে পারত?

ঋজুদা আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই স্টিয়ারিঙে বসল। বালাবাবু আর যুধিষ্ঠির বসল সামনে। আমাদের পেছনে বসতে বলল ঋজুদা। তারপর জিপ স্টার্ট করে কিছুটা পেছনে গিয়ে বালাবাবুর নির্দেশে একটা বছরের পর বছর ধরে অব্যবহৃত পাতাচাপা পথে জিপ ঢোকাল।

–রাস্তা কেমন?

সাবধানে, আস্তে আস্তে চলুন। মাঝে দু জায়গায় রাস্তা কাটা ছিল। বুদ্ধি করে বেরোতে হবে।

আমার দুচোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছিল। ভটকাই-এর কাঁধে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

অব্যবহৃত পথ দিয়ে জিপটা এঁকে বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনও পথের ধুলো এবং গাছপালা শিশির ভেজা। চোখ বন্ধ করেই শুনতে পেলাম কঁক কঁক করে একদল বন-মুরগি ডানদিক থেকে বাঁদিকে গেল পথ পেরিয়ে। ঋজুদার জিপ প্রায় তাদের গায়ের ওপর দিয়েই চলে গেল। তবে মুরগি সচরাচর গাড়ি চাপা পড়ে না। পোষা মুরগিও না। ভটকাই আমার পেটে খোঁচা মেরে বলল, জাঙ্গল ফাউল। জাঙ্গল-ফাউল!

একবার খুলেই আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

মিনিট পনেরো সেকেণ্ড ও থার্ড গিয়ারে যাওয়ার পর নদীতে এসে নামল জিপ। নদী পেরোবে এবার। সামনের চাকা দুটো জলে নামল বালি মাড়িয়ে, তার পর স্পেশাল গিয়ার চড়াল ঋজুদা বিশেষ সাবধানতা হিসেবে। দরকার ছিল না কোনও। ফার্স্ট গিয়ারেই এই হাঁটু জল পেরিয়ে যেত জিপ অনায়াসে। মাঝনদীতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল জিপ। ঋজুদা ব্রেক করেছিল। তাড়াতাড়ি চোখ মেললাম।

যুধিষ্ঠির বলল ঋজুদাকে, আউটিক্কে আগরু চালুন্ত। ভল্ব দিশিছি না এট্টু।

নদীটা পারই করে নিল ঋজুদা। তারপর ওপারে উঠে উঁচু ডাঙাতে দাঁড় করালো জিপটাকে। আমরা সবাই নামলাম। নদীর ডানপাড়ে খুব ঘন বাঁশজঙ্গল। ঘন সবুজ বাঁশপাতায় সকালের রোদ এসে পড়েছে। ভোরের ফিনফিনে কনে হাওয়াতে বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে কটকটি উঠছে। ছোট ছোট মৌটুসকি পাখি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক। ওদিক ফুলে ফুলে মধু খেয়ে। ছায়াচ্ছন্ন ঝোপে, লজ্জাবতীর ঝাড়ে, হুড়োহুড়ি উঠছে।

ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, বাঁশ জঙ্গলের বাঁ পাশে একটা শিমুল গাছের ডালে সার সার শকুন বসে আছে। ঋজুদা, যুধিষ্ঠির ও আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ঋজুদা ফিসফিস করে বলল বালাবাবুকে, জিপটা আপনি একটু এগিয়ে নিয়ে পথের দু’পাশের ফাঁকা জায়গা দেখে অপেক্ষা করবেন। আমরা আসছি।

ভটকাই উৎসুক চোখে তাকাল ঋজুদার দিকে।

 ঋজুদা ওর উৎসাহে জল ঢেলে বলল, তুই জিপেই যা।

আমরা তিনজনে এগিয়ে গেলাম। জিপটাও এগিয়ে গেল পথ ধরে। যদিও নামেই পথ। এ পথে মানুষজন বড় একটা চলে না আজকাল। পথের মধ্যে ডাল পাতা স্তূপীকৃত হয়ে আছে। একটু এগোতেই নদীর বালিতে নিনিকুমারীর বাঘের পায়ের দাগ দেখা গেল একটা শম্বরের দলের পায়ের দাগের ওপরে। কাল রাতের দলটি। শকুনরা যেদিকে মুখ করে বসেছিল সেদিকে সাবধানে এগোতে লাগলাম আমরা। শম্বরের বাচ্চা একটি। বছরখানেক বয়স হবে। অর্ধেকটা খেয়েছে। কিন্তু তার গলার দাগ দেখেই বোঝা গেল যে তাকে মেরেছে একটি মাদী চিতা বাঘে। মাঝারি সাইজের চিতা। যেটুকু আছে তাতে সে রাতে ফিরবে। এখন নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও রোদে শুয়ে আছে

ঋজুদা যুধিষ্ঠিরকে বলল, জীবি। এটি দেখিকি কঁড় হেব্ব?

চালুন্ত। স্বগতোক্তির মত বলল যুধিষ্ঠির।

ফিরে যেতে যেতে মড়ির কাছে চিতাটার পায়ের দাগ দেখতে পাওয়া যায় কিনা খুঁজলাম আমি। একটু পর পেয়েও গেলাম। নিনিকুমারীর বাঘের নদী পেরুনোর সঙ্গে এই চিতাটার হরক-এর কোনো মিল নেই। চিতাটা এসেছে এ-পারের গভীর জঙ্গল থেকে। এসে শম্বরের দল যখন নদী পেরোয় তখন এই বাচ্চাটিকে ধরে। ঋজুদা ক্যানাইন দাঁতের দূরত্ব দেখে বুঝেছিল এ চিতা খুব বড় নয়। আমি থাবার দাগ দেখে বুঝলাম।

ঋজুদা শিস দিল। অনেকটা এগিয়ে গেছে ঋজুদা ও যুধিষ্ঠির।

ওদিকে যেতে যেতে ভাবছিলাম নিনিকুমারীর বাঘ যদি শেষ রাতে নদী পেরিয়ে এ-পারে এসে থাকে তবে সুঝানি গ্রামে গিয়ে সে যুধিষ্ঠিরের বাবা দশরথকে ধরল কখন?

আমি শুধোলাম ওর কাছে গিয়ে, কখন ধরেছিল বাঘ? তোমার বাবাকে?

শেষ রাতে।

ঋজুদা বলল, তবু। ক’টার সময় আন্দাজ।

–এই তিনটে হবে।

বাঘটাকে তুমি নিজে দেখেছিলে?

–না বাবু। বাবা শেষ রাতে দরজা খুলে বাইরে গেছিল। হাতে কেরোসিনের কুপি নিয়ে। কাছেই গেছিল। বাড়ির সামনেই। জ্বরে কোঁকাচ্ছিল বাবা। আমি বললাম, সঙ্গে যাব? বাবা বলল না, না। তুই শো। আমার জন্যে দু’রাত ঘুম হয়নি তোর।

বলেই, কেঁদে ফেলল যুধিষ্ঠির।

আমি থমকে দাঁড়ালাম। এখান থেকে সকালের রোদ-পড়া শিকার-গড়কে কী সুন্দর দেখাচ্ছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে। এই জায়গা দিয়েই কাল আমরা গাছ থেকে শম্বরের দলকে নদী পেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম। গাছ থেকে এই সুন্দর নদীকে অস্তগামী সূর্যর আলোয় কী বিধুর দেখাচ্ছিল, আর এখন সদ্য উদিত সূর্যর আলোকে কী সুন্দরই দেখাচ্ছে!

জিপে উঠে ঋজুদা শুধোল যুধিষ্ঠিরকে, বাবাকে যে নিনিকুমারীর বাঘে নিল তা তুমি জানলে কী করে?

যুধিষ্ঠির বলল, বাবা বাইরে যাওয়ার পরই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজাটা ভেজিয়ে গেছিল বাবা। হঠাৎ আমার খুব শীত করতে লাগল। ঘরের মধ্যে আগুনও নিবে এসেছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে আমি দেখি, ঘর অন্ধকার। বাবা নেই। দরজাটা খোলা। ফাঁক দিয়ে চাঁদের ঘোলাটে আলো এসে পড়েছে মাটির বারান্দায়। আমি টাঙ্গিটা হাতে নিয়ে বাবা বলে ডেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, বাবা কোথাও নেই। ভাবলাম, হিসি করতে গিয়ে বুঝি অজ্ঞান হয়ে পড়ে-উড়েই গেল। তাই ঘরে ফিরে আগুনটাকে নতুন কাঠ দিয়ে জোর করে একটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাতে নিয়ে আমি বাইরে গিয়ে আশপাশে বাবাকে খুঁজলাম। বাবাকে পেলাম না, কিন্তু যে জায়গায় বাঘ বাবার ঘাড় কামড়ে নিয়ে গেছিল বাবাকে, সেই জায়গায় ধস্তাধস্তির দাগ আর জানোয়ারের। পায়ের দাগ ছিল। কুপিটা নিবে গেছিল। উল্টো হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল।

–তুমি কী করলে তখন? যখন দেখলে যে,..

–আমি চেঁচিয়ে প্রতিবেশীদের বললাম, আমার বাবাকে বাঘে নিয়ে গেছে। তোমরা সব ওঠো। আমরা খুঁজতে যাই। কিন্তু কেউ সাড়াও দিল না। ওদের দোষ নেই। আমরাও সাড়া দিতাম না পাশের ঘরের মানুষ নিলে। নিনিকুমারীর বাঘ তো শুধু বাঘ নয়। সে যে ঠাকুরানীর বাঘ!

কিছুক্ষণ পর আমরা সুঝানি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে পৌঁছে মহা সমস্যা দেখা গেল। আমি আর ঋজুদা দুজনেই খুব ভাল করে যুধিষ্ঠিরের বাবাকে যেখানে বাঘে ধরেছিল তার চারপাশের নরম মাটির ওপরে পায়ের দাগ পরীক্ষা করলাম, কিন্তু নিনিকুমারীর বাঘের পায়ের দাগ সেখানে ছিল না। ছিল একটা বুড়ো মদ্দা চিতা বাঘের পায়ের দাগ।

ঋজুদা ভটকাইকে বলল, ভটকাই! আর চা আছে নাকি?

ভটকাই চা ঢেলে দিল সকলকে। নিজেও নিল। ততক্ষণে সুঝানি গ্রামের কয়েকজন লোক এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। জিপের শব্দ শুনে বহুদূর থেকে তারা জমায়েত হচ্ছিল। বাচ্চাদের ও মেয়েদের দেখে মনে হল ওরা এর আগে কখনও জিপ গাড়ি দেখেনি।

লোকজন স্বাভাবিক কারণেই চিন্তিত। গ্রামের কোনো লোককে আগে কখনও মানুষখেকো বাঘে ধরেনি। তার ওপরে ঠাকুরানীর বাঘে। ঋজুদা যখন বোঝাতে গেল যে এটা বাঘ নয় চিতা, তখন ওরা সে কথা উড়িয়েই দিল। বলল, পায়ের দাগে কী আসে যায়? নিনিকুমারীর বাঘ নানারকম মূর্তি ধরে আসে। সে যে ঠাকুরানীর বাঘ!

ঋজুদা বলল, চল্ রুদ্র! ড্র্যাগ-মার্ক ফলো করে দেখা যাক। বোঝা যাচ্ছে এখানে একাধিক ম্যানইটার আছে। এই অঞ্চলের মানুষদের মনে নিনিকুমারীর বাঘ যে এখন ঠাকুরানীর স্নেহধন্য হয়ে গেছে তার ওপরেই সব দায়িত্ব চাপছে। একদিকে মানুষের মনের এরকম অবস্থা, আমাদের সঙ্গে সহযোগিতাও এরা কেউই আর করবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে মানুষখেকো বাঘ আর চিতা। অবস্থা সত্যিই গোলমেলে। ভটকাইকে এবারেও বালাবাবুর সঙ্গে থাকতে হল। অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে ভটকাইয়ের এবারে আসাটা সত্যিই ঠিকঠাক হয়নি। মঘা কী অশ্লেষা কী বারবেলা কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল ভটকাইয়ের যাত্রার সময়ে, নইলে এমন করে বেচারির যাত্রা নাস্তি হত না। কী যে ছিল তা ওর দিদিমার কাছেই খোঁজ নেওয়া যাবে কলকাতায় ফিরে। আপাতত কিছুই করণীয় নেই।

স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল কাছেই, একটা পাহাড়ী ঝর্ণার ধারে। ঝর্ণাটা যেখানে আরম্ভ হয়েছে, সেখানে চিতার পায়ের দাগ, মৃত দশরথের শরীরের দাগ, ইতস্তত ছিটকে যাওয়া নুড়ি-পাথর আর বিধ্বস্ত সর্ষে গাছ দেখে মনে হল দশরথকে নিয়ে চিতাটা পড়ে গিয়েছিল এই ঝর্ণায়। নিজের ইচ্ছেয় সে যদি ঝর্ণায় নামত তার দাগ হত অন্যরকম।

ঋজুদাকে সে কথা বলতেই, ঋজুদা বলল ঠিক বলেছিস রুদ্র। আমিও লক্ষ করেছি। ব্যাপার কী ঠিক বুঝছি না।

ঝর্ণাটার বুকে নরম সবুজ ঘাস গজিয়ে গেছে বর্ষার পর। দু পাশে কমলা রঙের ফুল ফোঁটা পুটুস। তিক্ত কটু গন্ধ বেরুচ্ছে তখনও শিশিরে ভিজে-থাকা পাতাগুলি থেকে। প্রায় গজ পঁচিশেক নিচে ঝর্ণার মধ্যে একটি দহমত আছে। অনেক বড় বড় পাথরের স্তূপ চারপাশে আর নিচটা মসৃণ। সূক্ষ্ম বালুকণাময় সেই দহের মধ্যে চিতাটা যুধিষ্ঠিরের বাবাকে রেখেছে পুটুস ঝোপের নিচে, যাতে শকুনের চোখ না পড়ে। কিন্তু আশ্চর্য! শরীরের একটুও খায়নি সে। সেই জায়গাটাও ভাল নিরীক্ষণ করে এবং যে ভঙ্গিতে দশরথের শরীরটা পাকিয়ে মুচড়িয়ে পড়ে আছে তাতে মনে হচ্ছে দশরথকে কামড়ে ধরে থাকা অবস্থাতেই চিতাটা ওপর থেকে সোজা হুড়মুড় করে গড়িয়ে এসে এই দহতে আটকে গেছে।

মাচা বাঁধার মত গাছ কাছাকাছি নেই। এই দহের ওপরের দিকে সর্ষেক্ষেতের কোণে একটি মিটকুনিয়া গাছ আছে। আর ঝর্ণার দহের হাত পনেরো-কুড়ি দূরে পাহাড়ের গা থেকে সোজা উঠে আসা একটি মস্ত কুসুম গাছ।

ঋজুদা আমাকে বলল যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য লোকদের সঙ্গে আমি যেন যুধিষ্ঠিরের বাড়ি ফিরে যাই। দশরথের শরীরের কোনও অংশ আজ দেওয়া যাবে না। অসম্ভব না হলে পুরো শরীরই ও পাবে কাল দাহ করার জন্যে। যুধিষ্ঠিরের কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে কিছু খাওয়াদাওয়া করে নিয়ে তুই এখানেই ঘুমিয়ে নে। মাচা বাঁধতে হবে কুসুম গাছটাতে। আমার ধারণা এবং পায়ের দাগও তো তাই বললো; চিতাটা উঠে আসবে নিচ থেকেই। ঝর্ণার রেখা ধরে সে নিচেই গেছে। কিন্তু মানুষ ধরার পরও সে কেন যে একটুও খেয়ে গেল না, সেটাই রহস্য। যাই হোক, তুই ভটকাইকে নিয়ে এসে ঐ কুসুম গাছের মাচাতে বসবি বিকেল বিকেল।

–আর তুমি?

আমি এখুনি বালাবাবুকে নিয়ে চলে যাব যেখানে নিনিকুমারীর বাঘ নদী পেরিয়েছে সেখানে। বালাবাবু আমাকে নামিয়ে দিয়েই আবার তোদের কাছে ফিরে আসবেন। কাল সকালে তোরা আবার আমাকে ঐ নদীর কোল থেকেই তুলে নিবি। কাল সারা দিনরাত বাংলোতে গিয়ে বিশ্রাম। পরের কথা পরে ভাবা যাবে।

–তোমার যাওয়াটা কি খুবই দরকার?

–হুঁ। ঋজুদা বলল।

-মানুষখেকো চিতার অপেক্ষায় মাচার নিচে মরা মানুষ নিয়ে গাছে বসাটা ভটকাইয়ের অ্যাপ্রেন্টিসশিপগিরির প্রথম রাতের পক্ষে একটু বেশি ডোজ হয়ে যাবে না?

হলে হবে। জেনেশুনেই তো এসেছে। তাছাড়া ওর বয়সী ছেলেরা ভিয়েতনামের যুদ্ধ লড়েছে, আরব আর ইজরায়েলে আজও লড়ছে। মানুষ হতে হলে হবে। নইলে বাঘের পেটেই যাবে। এমন অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগই বা ওর বয়সী কলকাতার কটি ছেলে পায়? ও খুব খুশিই হবে। তুই বেশি গার্জেনি করবি না ওর ওপর। তবে মাচায় নিয়ে যাবার আগে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নিস।

ঐ জায়গা থেকে ফিরে আসার আগে ঋজুদা বলল কুসুম গাছটার দিকে চেয়ে, মাচাটা যেন মাটি থেকে কমপক্ষে হাত পনেরো উপরে হয়। ভটকাইকে নিয়ে বসবি সে কথা মনে থাকে যেন! আর ভুলে যাস না চিতা এবং বিশেষ করে মানুষখেকো চিতা নিঃশব্দে গাছে চড়তে পারে। খুব সাবধানে এবং অনড় হয়ে থাকতে হবে সারা রাত। মনে করিয়ে দিলাম।

ঝর্ণাটা বেয়ে উঠে আসার সময়ে ঋজুদা বলল, কিল কিন্তু চিতাটা বয়ে আনেনি ওপর থেকে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, দ্যাখ ভাল করে কোথাও ড্র্যাগ-মার্ক আছে কি?

–না।

–কিল নিয়ে একলাফেতেই ঐ দহতে পড়েছে। ইচ্ছে করে কেন পড়বে বুঝছি না। আর অনিচ্ছাতে পড়লেও কেন পড়ল তা ভাবার অবকাশ আছে। অনিচ্ছায় পড়ে থাকলে চিতার নিজের হাড়গোড়ও কিছু ভাঙার কথা।

ঝর্ণাটা সর্ষেক্ষেতের যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে বালাবাবু, যুধিষ্ঠির এবং যুধিষ্ঠিরের চার-পাঁচজন প্রতিবেশী দাঁড়িয়েছিল। শব-এর জন্যেই। ঋজুদা তাদের নিরাশ করে বলল, আজ শব দাহ করা সম্ভব নয়। কাল সকালে কোরো।

এই কথাতে তারা সকলেই একটু ক্ষুণ্ণ হল। প্রতিবেশীদের একজনের হাতে একটি গাদা বন্দুক ছিল। নিশ্চয়ই লাইসেন্সবিহীন। লোকটা বলল, একুট মুরব্বির মত স্বরে, এ তো নিনিকুমারীর বাঘ নয়। এরা বললে কি হয়। এ সেই বড় চিতাটা। যাকে আমি প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম সেদিন রাতে। গোয়াল ঘরে আমার গরু ধরতে এসেছিল। অত কাছ থেকে গুলি করলাম পুরো চার আঙুল বারুদ ঠেসে। তবুও পালালো। এই চিতাও যে ঠাকুরানীর চিতা তাতে সন্দেহ নেই কোনো। ঋজুদা লোকটার আপাদমস্তক দেখল। মুখে কিছু বলল না।

বালাবাবুকে বলল চলুন আমাকে নদীতে ছেড়ে দিয়ে আসবেন। আর যা বলার রুদ্রকে বলেছি। কারও বাড়িতে আপনাদের ডাল ভাতের বন্দোবস্ত হয় কি না দেখুন ফিরে এসে। ফিরে এসে রুদ্রকে মাচাটা বাঁধতে একটু সাহায্য করবেন। আর বন্দুকধারী লোকটি সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর করে রাখবেন তো!

কথাগুলো ঋজুদা ইংরিজিতেই বললো।

নিচে নেমে যুধিষ্ঠিরের বাড়ির মাটির বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম আমি আর ভটকাই। যুধিষ্ঠির আর গ্রামের সেই তিন-চারজন লোক আমাদের সামনে উবু হয়ে বসে কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে। বালাবাবু ঋজুদার সঙ্গে চলে যেতে যেতে ওদের একজনকে বলে গেল বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের তিনজনের জন্যে একটু খাবারের বন্দোবস্ত করে রাখতে। পয়সা পাবে।

লোকটি বিরক্ত মুখে নিজের মনেই বলল অতিথি নারায়ণ। কিন্তু আগের দিন কি আর আছে? না হয় কোনো ফসল, না বসে হাট ঠিক-ঠাক। ভাত, মসুরের ডাল, বিড়ি বড়া আর রম্ভাভাজা, এই খাওয়াব। তবে পয়সা-টয়সা নেব না। কোনদিনই নিইনি, আজও নেব না। পয়সার কথা বলে আমাদের অপমান করা কেন?

ভটকাই থম্ মেরে ছিল। এই জঙ্গল পাহাড়, এই আশ্চর্য সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য, এবং তারই মধ্যে এই অবিশ্বাস্য দারিদ্র্য, পরপর দু-দিন জঙ্গলের মানুষখেকো জানোয়ারের হাতে দুজন মানুষের প্রাণ যাওয়া, এসব দেখেশুনে ও স্তব্ধ হয়ে গেছিল। এখন আরও বেশি হল যখন যুধিষ্ঠিরের বাবা দশরথ ঐ পাহাড়ের ঝর্ণার মধ্যের দহতে পড়ে আছে শুনেও এই মানুষেরা, এমনকি যুধিষ্ঠিরও একটুও উত্তেজিত না হয়ে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছে, এমনকি রঙ্গরসিকতাও করছে নিজেদের মধ্যে, কোমরের গেরুয়া রঙা বটুয়া থেকে পান বের করে সুপুরি কেটে তাতে চুন খয়ের ধীরে-সুস্থে লাগিয়ে তার মধ্যে গুণ্ডি দিয়ে জম্পেশ করে পান খাচ্ছে।

ভটকাই-এর মনের কথা বুঝে আমি বললাম, এ সব হচ্ছে অকুপেশনাল হ্যাজার্ডস। বুঝলি! কলকাতায় প্রত্যেকদিন মিনিবাসে এবং প্রাইভেট বাসে চাপা পড়ে কজন লোক মারা যায় তার খবর কি আমরা রাখি? গ্রামের লোকেরাও বাঘের বা চিতার হাতে, বা সাপের কামড়ে যখন মরে, ভালুক বা বুনো শুয়োরের হাতে যখন ক্ষতবিক্ষত হয় তখন এ আর কী গোছের ভাব নিয়ে ঘটনাগুলিকে দেখে।

হুঁ। ভটকাই বলল।

-আজই তো তুই মাচাতে বসছিস। মানুষখেকো চিতার অপেক্ষায় মাচায় বসা কম শিকারির ভাগ্যেই ঘটে। আর তোর মেইডেন এক্সপিরিয়েন্সেই তা হয়ে যাবে। কনগ্রাচুলেশানস।

ভটকাইকে খুব চিন্তিত ও গম্ভীর দেখাচ্ছিল। যুধিষ্ঠিরের আর্থিক অবস্থা এবং তার বাবার এই রকম বীভৎস মৃত্যু তাকে যুধিষ্ঠিরের চেয়েও বেশি ব্যথিত করেছিল। যুধিষ্ঠিরদের সয়ে গেছে এসব। তার ঠাকুর্দা, তার বাবা এবং সে নিজেও এই জীবনকে নিয়েই খুশি থেকেছে। সুখী হতে যে এর চেয়েও বেশি কিছু দরকার এ সব কথা ভাবার অবকাশই হয়নি ওদের কখনও।

.

০৪.

বন্দুকধারী লোকটার নাম নন্দ। বয়স হবে চল্লিশ-টল্লিশ। জামাকাপড় দেখলে মনে হয় বেশ অবস্থাপন্ন। মানে, যুধিষ্ঠির বা সুঝানি গ্রামের অন্যদের তুলনায়। তাছাড়া যার নিজের বন্দুক আছে, সে গাদা বন্দুকই হোক আর যাই হোক, সুঝানি গ্রামে সে যে বড়লোক, সে বিষয়ে অন্য কারও কোনও সন্দেহ ছিল না।

লোকটা কিন্তু আমাদের খাওয়াল না। যে লোকটা আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মাটির ঘরে পাটি পেতে বসতে দিয়ে ঝকঝকে করে মাজা পেতলের থালাতে গরম গরম লাল ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত, কাঁচালঙ্কা কালো-জিরে দিয়ে রাঁধা মসুরের ডাল, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর কাঁচকলা ভাজা আর কলাই ডালের বড়া ভাজা দিয়ে যত্ন করে খাওয়াল সে কিন্তু সত্যিই খুব গরিব। নন্দরা পয়সা জমাতে জানে। একটা টাকা বাঁচানো মানেই একটা টাকা রোজগার করা। বড়লোকদের মধ্যে অধিকাংশই এই রহস্য জানে এবং মানে। যে খরচ করে এবং নিজের স্বার্থ ছাড়াই খরচ করে, সেই মানুষের পক্ষে বড়লোক হওয়া বড়ই কঠিন।

ঘুমটা বেশ ভালই হয়েছিল। ঘড়িতে যখন সাড়ে তিনটে বাজে তখন বালাবাবু তুলে দিলেন আমাকে। পেতলের ঘটিতে করে চা বানাল কেউ আদা ও এলাচ দিয়ে। সেই চা ভাগাভাগি করে খেয়ে রওনা হলাম আমরা।

নন্দ মহান্তিও সঙ্গে চলেছে তার গাদা বন্দুক এবং একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ সঙ্গে নিয়ে। ঝর্ণা যেখানে সর্ষেক্ষেতে শুরু সেখানে মিটকুনিয়া গাছে একটা মাচা বাঁধিয়েছে সে। ওখানে পৌঁছে মাচাটা দেখে আমার পছন্দ হল না। জমি থেকে মাত্র দশ ফুট মত ওপরে দুটো বড় ডালের সংযোগস্থলে একটা বাঁশের মোড়াকে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যুধিষ্ঠিরও সঙ্গে বসবে পিতৃহন্তার ওপরে প্রতিশোধ নিতে। আমি বারণ করা সত্ত্বেও শোনেনি কিছুতেই। সে নন্দ মহান্তির থেকে একটু পেছনের ডালে নিজেকে ডালের সঙ্গে গামছায় বেঁধে নিয়ে বসবে এবং নন্দ মহান্তির গাদা বন্দুকের ওপরে আলো ফেলবে। যুধিষ্ঠিরের বাড়িতেও বার তিনেক স্টেজ-রিহার্সাল দিয়ে নিয়েছে তারা। ওরা দুজন পরে মাচায় বসবে। তার আগে বালাবাবু, গ্রামের একজন লোক আর যার বাড়ি আমরা খেলাম সে ঝর্ণাতে নেমে এল আমাদের কুসুম গাছের মাচা অবধি পৌঁছে দিতে। বালাবাবু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। মাচাটা বেশ পোক্ত করেই বেঁধেছেন। চারটে কাঠের তক্তা লতা দিয়ে দুটো বড় ডালের সংযোগস্থলে বাঁধা হয়েছে।

আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। ভটকাই যেদিকে খাদ, সেদিকে বসবে। আমি যেদিকে গাছের ডাল পাহাড়ের দিকে, সেদিক। আমার রাইফেলের সঙ্গে ছোট টর্চ ফিট করা আছে ম্যাগাজিনের ওপরে। বুক পকেটে ব্যাটারি থাকে। মোটামুটি নিশানা হয়ে গেলে রাইফেল-ধরা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে টর্চের লাইটিং-মেকানিজম্ ছুঁলেই ব্যাকসাইট ও ফ্রন্ট-সাইটে আলো পড়বে। পুরো ব্যারেলের ওপরেই পড়বে আলো। ফ্রন্ট-সাইটে রেডিয়াম পয়েন্ট আছে। অন্ধকারেও জ্বলে। আলো পেলে তো জ্বলবেই। তারার আলো এবং চাঁদের আলোতে অসুবিধে নেই। এই রাইফেল দিয়ে গুলি করতে খুবই সুবিধে।

ভটকাইয়ের হাতে যে দোনলা বন্দুক তার সঙ্গে লাগানো ক্ল্যাম্পে তিন ব্যাটারির টর্চ ফিট করা আছে। উইনচেস্টারের টর্চ। এছাড়াও ব্যাগে আছে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। ঐ ব্যাগ দিনে বা রাতে যখনই আমরা শিকারে বেরুই না কেন সবসময়ই সঙ্গে যায়। আর জলের বোতল। ভটকাই মাচায় কতখানি অনড় হয়ে যে বসতে হয় সে সম্বন্ধে অবহিত নয় বলেই জলের বোতল আনা সত্ত্বেও মাচায় বসে জল খাওয়া যে মানা সে কথা ওকে বলেছি। ঘুম ভাঙার পর নন্দ মহান্তিই ওর সে-অ্যাপয়েন্টেড মাস্টারমশাই বনে গিয়ে শিকারের এবং বিশেষ করে মাচানে বসার অ-আ-ক-খ সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞান দিয়ে দিয়েছে।

মাচাতে আমাদের বসিয়ে দিয়ে বালাবাবুরা ফিরে গেছেন দুজনে। হল্লা-গুল্লা করে নয়, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে। রাতটা বালাবাবু ঐ লোকটার বাড়িতেই কাটাবেন। মানুষটা ভারী ভাল। নাম গগনবিহারী। বিকেল বিকেল এক হাঁড়ি মুগডালের খিচুড়িও রেঁধে রেখেছে তার লাজুক বৌ। বালাবাবু এবং তারা তো খাবেই, যদি ফিরে যেতে পারি তবে আমরাও ঐ খেয়েই ঘুমোব। মাচাটার মুখ হয়েছে ঝর্ণার যেখানে শুরু, সর্ষেক্ষেতের মাঝে, সেদিকে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার অস্বস্তিকর লেগেছে। ঐ দিকে মুখ করে না বসে যুধিষ্ঠিরের বাবার মৃতদেহ যেখানে আছে সেদিকে মুখ করে বসেছি। ঋজুদা বলেছিল চিতাটার ডান দিক দিয়েই আসার সম্ভাবনা বেশি। আমারও তাই মনে হয়েছিল। ডানদিকে আমি নজর রাখব। ভটকাইকে বলেছি বাঁ দিকটা দেখতে। ঝর্ণার বুক বেয়ে চড়াই উঠে আসতে হবে তাকে বাঁদিক দিয়ে এলে। আর ডানদিক দিয়ে এলে উতরাই নেমে। কিন্তু ডানদিক দিয়ে এলে ঝর্ণার ফাটলে পৌঁছবার আগেই তো নন্দ মহান্তির গাদা-বন্দুকের গুলি খাবে সে। এবং গুলি তার গায়ে লাগুক। আর নাই লাগুক গুলির আওয়াজ হলে পর চিতা যে এ রাতের মত এ তল্লাটে থাকবে তা মনে হয় না।

ভটকাইকে আমি বারবার বলে দিয়েছি যে ভুলেও যেন সে গুলি না করে। অনেকদিন দর্শক থাকতে হয়। তারপরই না হয় শিকারি হবে!

আলো আস্তে আস্তে পড়ে আসছে। পাহাড়ের গায়ে এবং পাহাড়তলি থেকে ময়ূর, বনমুরগি এবং নানারকম পাখি দিনশেষের ডাক ডাকছে। সুঝানি গ্রাম থেকে গাইবলদের, পোষা মোরগের এবং কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। বাঁদিকে, ভটকাই যেদিকে বসেছে; গাছপালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অনেক দূরে এবং নিচে নদীর একটা বাঁকের একাংশ দেখা যাচ্ছে শুধু।

ঋজুদা এখন কোথায় কে জানে! সারাদিন কী করল? কী খেল? নিনিকুমারীর বাঘের দেখা পেল কিনা কে জানে? ঋজুদাকে এবারের মত সিরিয়াস এবং আপসেট হতে কখনও দেখিনি আগে। নাকি, না-বেরিয়ে-বেরিয়ে ঋজুদার যোগ্যতা এবং দক্ষতা কমে গেছে?

একটা ব্যাপারে খুব ভাল লাগছে। আমাদের কুসুম গাছের থেকে পঞ্চাশ গজের মধ্যে একটা মস্ত তেঁতুল গাছ। তাতে বাঁদরে ভর্তি। আমরা যখন মাচায় চড়তে আসি তখন তারা আমাদের দেখে মহা লাফালাফি আর ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন কুসুম গাছের ঘন পাতার আড়ালে অলিভ-গ্রীন রঙের জামা পরে অনড় হয়ে বসে থাকাতে এবং বালাবাবুর গগনবিহারীকে নিয়ে চলে যাওয়া লক্ষ করে তারা এখন চুপ। খুব ভাল হয়েছে। ঝর্ণা বেয়ে চিতা যদি ওপরে উঠে আসে তবে বাঁদরদের নজর এড়িয়ে আসতে পারবে না। তাছাড়া বাঁদরদের আর গৃহপালিত কুকুরদের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে চিতা। চিতাটা যদি কোনো কারণে যুধিষ্ঠিরের বাড়ির দিক দিয়ে আসে তবে গ্রামের কুকুরেরা হয়ত তাকে দেখলেও দেখতে পারে। বা গন্ধ পেতে পারে। কিন্তু মানুষ ধরার পরও সেই মানুষের বাড়ি বেয়ে সে যে কেন আসবে তা জানি না। তাছাড়া দশরথকে মারার পর এতদূর বয়ে নিয়ে এসেও একটুকরো মাংসও যে কেন খেল না এটা ভেবেই ভারী অবাক লাগছে।

একদল হরিয়াল একটু আগে শন্ শন্ করে উড়ে গেল পাহাড়ের মাথার ওপর দিকে। তাদের ঘন সবুজ উড়াল ডানাগুলো যেন মুছে দিল তখনও যেটুকু আলো বাকি ছিল পশ্চিমের আকাশে। পুরো অন্ধকার তখনও হয়নি বাইরে। তবে আমরা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঝর্ণার খোলের দহতে বসে আমি এবং কুসুম গাছের ছায়ায়, তাই অন্ধকার নেমে এসেছে এখানে।

মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। একটা তক্ষক ডাকতে লাগল আমাদের পেছন থেকে। তার দোসর সাড়া দিয়ে বলল, ঠিক! ঠিক! ঠিক! সুঝানি গ্রামের মধ্যে কোনো শিশু অতর্কিতে জোর গলায় কেঁদে উঠল। আর মা তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরে কান্না বন্ধ করল বলে মনে হল। যেখানে দিন-দুপুরেই প্রাণ-সংশয় হয় সেখানে রাতে তো কথাই নেই।

সাতটা বাজল। গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশভরা তারা দেখা যাচ্ছে। নানারকম মিশ্র গন্ধ উঠছে রাতের বনের গা থেকে। বাদুড় উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে ডানায় সপ সপ করে। ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসতে লাগল একটানা পাহাড়তলি থেকে। পাহাড়তলির দিকে তাকিয়েছি, ঠিক সেই সময় বাঁদরগুলো সমস্বরে ডেকে উঠল। ডালে ডালে ঝাঁপাঝাঁপি করতে লাগল পাগলের মতো। খুব আস্তে আস্তে বড় টর্চটা দেখিয়ে দিলাম আমি ভটকাইকে। বলা আছে ওকে যে আমি ওর হাঁটুতে আঙুল ছোঁয়ালে ও টর্চটা জ্বালাবে। যদি আদৌ দরকার হয়। আর ও যদি কিছু দেখে, কোনও নড়াচড়া, অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতর কোনও স্তূপ তবে ও-ও যেন আমার হাঁটুতে আঙুল ছোঁয়ায়।

উৎকর্ণ উন্মুখ হয়ে ঐ দিকে খুব আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরালাম আমি। না, দেখা কিছুই যাচ্ছে না। সব অন্ধকার। কোনও শব্দও নেই। বাঁদরদের চিৎকার চেঁচামেচি কিন্তু আরও জোর হয়েছে। এমন সময় পাহাড়তলি থেকে একটি কোটরা হরিণ ডেকে উঠল ভয় পেয়ে। খুব জোরে। ব্বাক্ ব্বাক্ ব্বাক্ করে।

হঠাৎই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল কেউ যেন কোনো ভলিবল ড্রপ করাতে করাতে ঝর্ণার বুক বেয়ে উঠে আসছে খুব আস্তে আস্তে। শব্দটা একবার ঝর্ণার একদিকের দেওয়ালে লাগছে অন্যবার অন্যদিকের। ব্যাপারটা যে কী হতে পারে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাঁদরগুলো এমনই ভয় পেয়েছে যে মনে হচ্ছে ডাল ফসকে দু-একটা পড়েই যাবে নিচে। এদিকে শব্দটাও এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কোনো মাতাল লোক মদটদ খেয়ে এলোমেলো হাতে ভলিবল থাবড়াতে থাবড়াতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

যুধিষ্ঠিরের বাবা দশরথের মৃতদেহ যেখানে পড়ে আছে সে জায়গাটা পুটুস ঝোপে গভীর অন্ধকার। কিন্তু সে জায়গায় কোনো জানোয়ারকে পৌঁছতে হলে ওপরে ও নিচে হাত দশেক ন্যাড়া জায়গা পেরিয়ে যেতে হবে। জানোয়ারটা যে কী, তা এখনও বুঝতে পারছি না। কারণ কোনো জানোয়ারেরই চলার এমন হরকৎ সম্বন্ধে আমার কোনরকম অভিজ্ঞতাই ছিল না। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। বিপদের প্রকৃতি জানা হয়ে গেলে আর ভয় থাকে না। কিন্তু যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে ততক্ষণই ভয়। ঋজুদা ঠিকই বলে, অজ্ঞতাই ভয়ের জনক।

জানোয়ারটা কুসুম গাছের নিচে চলে এসেছে। বাঘ বা চিতা মড়িতে আসে ভোজবাজির মত। চারচোখ মেলে চেয়ে থাকলেও তারা চোখ এড়িয়ে যায়। জঙ্গলে এত শব্দ করে চলাফেরা করে শুধু শুয়োর আর ভাল্লুক। হরিণ জাতীয়রাও অবশ্য করে। তাহলে এ কোন্ কিম্ভুতকিমাকার জানোয়ার যে মানুষকে মেরে রাতের দুই প্রহর আর সারা দিন ফেলে রেখে এখন এমন করে তাকে খেতে আসছে।

যে জানোয়ারই হোক না কেন, ভেবেছিলাম কিল-এর কাছে এসে থামবে। আশ্চর্য! দেখি, মড়ি যেখানে আছে সে জায়গাটা পেরিয়ে সে আরও উপরে উঠে গেল। রাইফেলের টর্চ বা ভটকাইয়ের জিম্মাতে রাখা বড় টর্চও জ্বালাতে পারছি না। আলো দেখলেই জানোয়ারটা আর এই তল্লাটে থাকবে না। এক লাফে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আলো জ্বালা যাবে তখনই যখন মোটামুটি নিশানা নেওয়া হয়ে গেছে।

এবার জানোয়ারটার যেন হুঁশ হল। চার পাঁচগজ এগিয়ে গেছিল সে ওপরের দিকে, এবার ফিরল। কিন্তু ফিরল যেন বহু কষ্ট করে। যখন ন্যাড়া জায়গাটুকু সে পেরোয় তখন জানোয়ারটা যে চিতাই সে বিষয়ে অন্ধকারেও আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তার চলন দেখেই সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। ঝর্ণার মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ঘুরতেই যে তার খুব কষ্ট হল তা বুঝতে পারলাম। তার চলন যেন সুন্দরবনের স্যাঁতস্যাঁতে কাদায় বুকে হেঁটে চলা কুমীরের মত। এবার সে ফিরে আসছে। সহজে গুলি করা যায় এখন। কিন্তু ঋজুদা প্রথমদিন থেকে শিখিয়ে এসেছে, বাঘ বা চিতা তোর দিকে সোজাসুজি মুখ করে থাকলে গুলি না করারই চেষ্টা করিস। অবশ্য নেহাত উপায় না থাকলে অন্য কথা। কারণ হিসেবে বলেছিল যে, গুলি খেয়েই সামনে লাফ মারার প্রবণতা থাকে নাকি তাদের। কিন্তু আমার গুলি খেয়ে চিতা এবং বড় বাঘকেও আমি সোজা ওপরে ছিলা-ছেঁড়া ধনুকেরই মত লাফিয়ে উঠতে দেখেছি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে তাদের পেটে গুলি লেগেছিল। পরে কখনও ঋজুদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। এখন অন্য কিছুই ভাবার সময় নেই।

চিতাটা যখন পুটুসের ঝোপের কাছে এসে থামল এবং ডানদিকে শরীরটাকে ঘোরালো তখনই আমি খুব আস্তে রাইফেল কাঁধে তুলে সেটি-ক্যাচটি নিঃশব্দে অন করে টর্চের মেকানিজম-এ রাইফেলে রাখা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে সামান্য চাপ দিলাম। আলোর ছোট বৃত্ত গিয়ে পড়ল প্রায় বাঘেরই মত বড় মস্ত চিতার পিঠ আর ডান বাহুর সংযোগস্থলে। আর সুইচ টেপার আগেই ট্রিগারের ফাস্ট প্রেসার দিয়েছিলাম। এবারের বাকিটুকু দিলাম তর্জনীর দুই করের মধ্যের নরম অংশ দিয়ে। এক লাফ মেরে চিতাটা ঝর্ণার দেয়ালে সোজা গিয়ে ধাক্কা খেলো এবং সম্ভবত আছড়ে পড়ল যুধিষ্ঠিরের বাবা দশরথের মৃতদেহরই ওপরে। ভটকাইকে বলতে হয়নি। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই ও বড় টর্চটা জ্বেলে ঐখানেই ফেলে রাখল। পুটুসের ঝোপ আন্দোলিত হল কিছুক্ষণ। তারপর অতর্কিত মৃত্যুর আগে অনেক জানোয়ারই যেমন নিজের সঙ্গে নিজে স্বল্পক্ষণ কথা বলে তেমন করে কথা বলল চিতাটা। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল।

বাঁদরগুলো যে এতক্ষণ সমানে ডেকে যাচ্ছিল তা শোনার মত অবস্থা আমাদের ছিল না। চিতা স্থির হয়ে এলে বাঁদরদের ডাক মাথা গরম করে দিল। ভটকাই বাঁদরদের বাড়ি, সেই তেঁতুল গাছের দিকে একবার আলোটা ঘুরিয়ে যেন নীরবে বলে দিল আমরা তোমাদের উত্তরসুরি। কেন মিছে গোল করছ?

ঝর্ণার ওপর থেকে নন্দ মহান্তি হেঁকে বলল, কড় আঁইজ্ঞা? গুলি বাজিলা কি?

 অর্থাৎ কি হল স্যার? গুলি কি লাগল?

আমিও চেঁচিয়ে বললাম, বাজিলা আঁইজ্ঞা। সেঠি টিক্কে রহিকি তেব্বে আসন্তু এঠি।

মানে ওখানে একটু থেকে তারপরে আসুন।

ভটকাইকে বললাম, তোর বন্দুকের দুটো কার্টিজ ছুঁড়ে মার তো। দেখি সে নড়েচড়ে কিনা!

ভটকাই আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, কনগ্রাচুলেশনস্! তোর এলেম আছে।

বললাম, কী করছিস। ছাড় ছাড়।

 মনে মনে খুশিই হলাম। বন্ধু যদি বলে এলেম আছে, তবে কার না ভাল লাগে?

দুটো লেথাল বল হাত দিয়ে ছুঁড়ে মারল ভটকাই চিতাটার গায়ে। তবুও যখন সে নড়ল না তখন উৎসাহে ডগমগ হয়ে ও বলল, নামছি আমি।

আমি বললাম দাঁড়া। আমি আগে নামব। ভুলে যাস না যে আমরা নিনিকুমারীর বাঘের রাজত্বে আছি। এবং সে অক্ষতই আছে।

আমরা নিচে নামতে না নামতেই ওপর থেকে চামড়ার পাম্পশুর খচরমচর শব্দ করতে করতে নন্দ মহান্তি তার গদার মত গাদা বন্দুক উঁচিয়ে নেমে এল। পেছনে পেছনে উৎসাহী যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির অধীর হয়ে বলল, মু মো বাপ্পকু টিকে দেখিবি। মো বাপ্পকু।

বেচারি যুধিষ্ঠির! বাবার মৃতদেহ আর কীই বা ও দেখবে? দশরথের মৃতদেহের ওপরেই চিতাটা এমনভাবে পড়েছিল যে মৃতদেহটা দেখাই যাচ্ছিল না প্রায়। আমি রাইফেল নিয়ে পাহারাতে দাঁড়ালাম। ভটকাই, নন্দ মহান্তি আর যুধিষ্ঠির চিতাটার লেজ আর পেছনের পা ধরে টেনে সরিয়ে ন্যাড়া জায়গাটাতে চিৎ করে ফেলল। চামড়াও রাতারাতি এখানেই ছাড়িয়ে ফেলতে হবে।

চিতাটাকে চিৎ করে ফেলার পর ভটকাই তার বড় টর্চ এনে জ্বালতেই আমি চমকে উঠলাম। কী বীভৎস চেহারা! বেচারির দুটি চোখই অন্ধ। শুধু তাইই নয়, সামনের ডানদিকের থাবাটা ফালা ফালা হয়ে গেছে। মুখে নাকে চোখে রক্ত জমে ভূতের মত দেখাচ্ছে। বেচারির পেটটা একেবারে পিঠের সঙ্গে লেগে গেছে। খেতে পায় না বহুদিনই। এখন প্রাঞ্জল হল কেন সে দশরথের শব নিয়ে নালায় নামবার সময় পড়ে গেছিল, আর কেনই বা কুমীরের মত এঁকেবেঁকে ধাক্কা খেতে খেতে সে মড়িতে আসছিল।

নন্দ মহান্তি বলল, এ বাঘ তো আমার। প্রথম গুলি তো আমিই করেছিলাম। রক্ত এখনও লেগে আছে।

আমি কিছু বললাম না। দায়িত্বজ্ঞানহীন নন্দ মহান্তির গাদা বন্দুক দিয়ে মারা কামারবাড়িতে বানানো নানারকম লোহার গুলি চিতাবাঘটার চোখে মুখে পায়ে এবং বুকেও লেগে তাকে একেবারে অসহায় করে তুলেছিল। এই চিতা এবং যুধিষ্ঠিরের বাবার মৃত্যুর জন্যেও নন্দ মহান্তিই দায়ী। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ঠিক করলাম, আমি কিছু বলব না এখন। ঋজুদাকেই বলব কাল। তারপর ঋজুদা এর যে বন্দোবস্ত করার তা করবে। বেচারি যুধিষ্ঠির। চিতাবাঘ উপলক্ষ মাত্র।

গুলির শব্দ শুনে গগনবিহারী ও চার-পাঁচজন লোক হ্যারিকেন লণ্ঠন বর্শা এবং টাঙ্গি নিয়ে এসে হাজির। নিনিকুমারীর বাঘ এ গ্রাম থেকে কোনদিনও মানুষ নেয়নি। আর এই নিরুপায় চিতাটা যে কেন দশরথকে মেরেছিল তাও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না।

আমি ভাবছিলাম, কতখানি বেপরোয়া এবং ক্ষুধার্ত হলে চিতাটা এরকমভাবে মড়িতে ফেরে। ঝর্ণার রেখা ধরে ভটকাইকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে অবাক হয়ে গেলাম। চিতাটা ঝর্ণার নিচ থেকে উঠে আসেনি। পাহাড়ের আধাআধি একটা গুহা আছে। তার সামনে নরম ধুলো। এখন অবশ্য শিশির ভিজে রয়েছে। চিতাটা ঐ গুহাতেই সারা দিন শুয়েছিল। সে যে বুক ঘষে ঘষে এদিকে ওদিকে ধাক্কা খেতে খেতে বেরিয়েছে গুহা থেকে, তার চিহ্নও দেখা গেল। সম্ভবত নন্দ মহান্তির গুলিতে ওর চোখেরই মত কান দুটোও গেছিল নষ্ট হয়ে। নইলে অতটুকু দূর থেকে সে সকালে আমাদের এখানে আসা, দুপুরে মাচা বানানো, বিকেলে এসে মাচায় বসা–এই সবই দেখতে বা শুনতে পেত।

ভটকাই খুব বুদ্ধিমানের মত প্রশ্ন করল একটা। বলল, এই যদি তার অবস্থা, এতই যদি তার ক্ষিদে তবে যুধিষ্ঠিরের বাবাকে ধরে সর্ষে ক্ষেতে এসে খেল না কেন?

আমি বললাম বাঃ। দারুণ প্রশ্ন। তারপর বললাম, সংস্কার। সংস্কার আর অভ্যাসের বশে, জন্মগত সাবধানতার অভ্যাসের বশে মড়ি নিয়ে আসছিল লুকিয়ে রাখা এবং লুকিয়ে খাবার মত জায়গায়। কিন্তু ঝর্ণার মুখ থেকে এই তিরিশ চল্লিশ ফিট দশরথকে সুদ্ধ নিয়ে পড়ে যাওয়ায়, আমার মনে হয় ওর নতুন করে চোট লেগেছিল। পুরনো ক্ষতর মুখগুলো সব খুলে গেছিল নতুন করে। রক্তক্ষরণও হয়েছিল। তাছাড়া গাদা বন্দুকের লোহাগুলো তার মস্তিষ্কের মধ্যে কী ঘটিয়েছিল তাই বা কে জানে। বোঝাই যাচ্ছে যে পুরোপুরি ডেজড রাহুগ্রস্ত অবস্থায় ছিল বেচারি। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে কিছুই বোঝার মত মানসিক অবস্থাও ওর ছিল না। চোখ কান হাতের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

ভটকাই বলল, সারা দিনের মধ্যে তো ও এসে খেতে পারত। খেল না কেন?

তাও হয়ত সংস্কার। চিতারা শিকার ধরে রাতে। খায়ও রাতে। দিন রাতের তফাতটা বোঝার মত কোনো ক্ষমতা ওর নিশ্চয়ই ছিল।

ফিরে গিয়ে দেখি নন্দ মহান্তি মহা সমারোহে তার চিতার চামড়া ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি ভটকাই আর গগনবিহারী এবং অন্য একজনকে নিয়ে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে এবং টাঙ্গি দিয়ে কেটে ঝর্ণার একটু নিচে একটু সমতল জায়গাতে যুধিষ্ঠিরের বাবার চিতা সাজালাম।

চিতায় আগুন ধরাবার সময় যুধিষ্ঠির একবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। আমি ওকে হাত ধরে নিয়ে এসে পাথরে আমার পাশে বসালাম। ভটকাই একমুঠো লাল আর হলুদ পুটুস ফুল ছিঁড়ে এনে চিতায় দিল। হু হু করে চিতা জ্বলতে লাগল। পুটপাট করে আগুন

নিজের মনে নিজের কথা বকতে লাগল। সেই কথার তোড়ে নন্দ মহান্তির দম্ভভরা প্রলাপ চাপা পড়ে গেল।

ঋজুদাকে বলে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করে লোকটার বন্দুকটা বাজেয়াপ্ত করাতে হবে আর যুধিষ্ঠিরকে জমি টমি ক্ষতিপূরণ দেওয়াবার ব্যবস্থাও করতে হবে। নন্দ মহান্তির টাকাকড়ি তো কিছু কম নেই। সেই তো আসল খুনী! আসলে খুন করেছে দশরথকে। চিতাটা উপলক্ষ মাত্র। বেচারি দশরথ! বেচারি চিতা!

.

ঋজুদা কনসর-এর শাখা নদীর ধারে একটা বড় পাথরের উপরে শুয়েছিল মুখের উপর টুপি চাপা দিয়ে। বোধহয় ঘুমোচ্ছিল। জিপটা কাছাকাছি যেতেই উঠে বসল। মুখময় দু’দিনের দাড়িতে গালটা সবুজ দেখাচ্ছিল। নাকের নিচটাও।

আমরা জিপ থেকে নামতেই বলল, হ্যালো মিস্টার ভটকাই। কেমন লাগলো প্রথম রাত মাচাতে?

ভটকাই সকাল থেকেই উত্তেজিত হয়েছিল। উত্তেজনা চরমে ওঠায় তুতুলে বলল দা-দা-দারুণ।

বাঃ। ফাস্টক্লাস। এমনি করেই হবে। মাউন্টেনীয়াররা কি বলেন জানিস? কখনও পর্বতশৃঙ্গের দিকে তাকাতে নেই। নিচে দাঁড়িয়ে পবর্তশৃঙ্গে তাকালে মনে হয় ওখানে পৌঁছনো কিছুতেই সম্ভব নয়। কেউ তাকানও না তাঁরা। পরের পাটি কোথায় ফেলবেন শুধু সেদিকেই নজর যাবে তাঁদের এমনি করেই এবং পায়ের পর পা ফেলে একসময় তাঁরা শৃঙ্গে পৌঁছন। তোরও হবে। রুদ্র পারে, তিতির পারে, আর তুই পারবি না কেন? তবে সবকিছুই পারার আগে শিক্ষানবিশ থাকতে হবে। বিভিন্ন কাজের জন্যে বিভিন্ন সেই শিক্ষানবিশীর সময়কাল। এইটা মনে রাখলেই হবে। তারপর বলল, নে, এখন উঠে পড় জিপে। সোজা কুচিলাখাঁই পাহাড়ের নিচের বাংলোতে যাব আমরা। ভাল করে চান করে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করে ঘুম।

জিপে উঠতে উঠতে ভটকাই বলল, কতক্ষণ?

যতক্ষণ না ভাঙে।

ফাস্টক্লাস!

ভটকাই বলল, রাত-জাগা চোখ ছোট করে।

 ঋজুদা বলল, তোদের ব্যাপারটা কি হল?

আমি বললাম বিস্তারিত।

ভটকাই বলল, আর নিনিকুমারীর বাঘ?

আছে।

দেখা হল?

দূর থেকে।

তারপর?

 পরে। ঘুমভেঙে উঠে পাইপে আচ্ছা করে তামাক ঠুকে বুদ্ধির গোড়ায় ভাল করে ধোঁয়া দিয়ে তারপর তাকে কব্জা করার বুদ্ধি বের করতে হবে। শুভস্য শীঘ্রং!

বাংলোয় পৌঁছে চান করে ফেনাভাত, ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ আর খাঁটি গাওয়া-ঘি দিয়ে পেট পুরে খেয়ে আমরা সকলেই ঘুম লাগিয়েছিলাম। ফেনাভাতটা জব্বর রেঁধেছিল জগবন্ধুদাদা।

ঘুম যখন ভাঙল তখন শেষ বিকেল। ময়ূর ডাকছে, মুরগী ডাকছে, কুচিলা-খাঁইরা ঘুমোতে যাবার আগে শেষ রাউন্ড ঝগড়া করে নিচ্ছে।

ভটকাই তখনও ঘুমোচ্ছিল। বিকেল হলেই ঝপ করে শীত বেড়ে যায়। ওর কম্বলটা সরে গেছিল কাঁধ থেকে। কম্বলটাকে ভাল করে গুঁজে দিয়ে আমি বারান্দায় এলাম। দেখি ঋজুদা রাইফেল পরিষ্কার করছে চায়ের কাপ পাশে রেখে। আমি সকালে ফিরেই করেছিলাম। ঋজুদাও সবসময় তাই করে। এক রাউন্ড ফায়ার করলেও করে। বুঝলাম, খুবই ক্লান্ত ছিল। সেজন্যেই পারেনি।

চা খাবি না?

বলে আসছি–জগবন্ধুদাদাকে।

ভটকাইকেও তুলে দে। ওর জন্যেও চা দিতে বলে আয় গিয়ে।

আমরা যখন আবার এলাম বারান্দাতে বেলা প্রায় মরে এসেছে। বাংলোয় হাতাতে বড় বড় ঘাসের গায়ে বার্কিং-ডিয়ারের গায়ের রঙের মত সোনালি নরম রোদ এসে লেগেছে। পাখিদের কলকাকলীতে ভরে উঠেছে চারদিক। এক জোড়া লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিল (ভালিয়া-খাঁই) গ্লাইডিং করে ভেসে যেতে যেতে কুচিলা খাঁই পাহাড়ের বুকের ভাঁজে হারিয়ে গেল।

ঋজুদা বলল, চল্ ভেতরে গিয়ে বসি। দরজাটা বন্ধ করে দিস রে ভটকাই। খিল তুলে দিস।

তোমাকে বলতে হত না। যে কাণ্ড চিতায় ঘটাল তা জানার পর নিনিকুমারীর বাঘকে আর বিশ্বাস করি।

হো হো করে হেসে উঠল ঋজুদা।

বলল, অ্যাই তো জ্ঞানচক্ষু খুলছে আস্তে আস্তে।

ভটকাই বলল, আমরা তোমাকে নদীর পারে ছেড়ে যাবার পর কী হল বল ঋজুদা।

তা শোনার আগে রাতে খাওয়া দাওয়ার কি হবে একটু দেখেশুনে আয়। কী খাবি, না বললে হয়ত বরাদ্দ হয়নি বলে কিছুই না রেঁধেই বসে থাকবে বশংবদ জগবন্ধু। বশংবদ হওয়া ভাল কিন্তু এতখানি বাবুমুখাপেক্ষী হওয়া আবার খারাপ। কী বলিস?

বলতে বলতে জগবন্ধুদা এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল।

 ঋজুদা বলল, ভাল্ব হেব্বা। রাতবেল্বে খাইবা-পিবা পাঁই কঁড় করিবা?

 আপনমানে যা কহিবে আইজ্ঞা!

 ঘরু অছি কঁড়?

সল্লু অছি। নাই কঁড়? কুকুড়া অছি, ডিম্ব অছি, অমৃতভাণ্ড অছি, আলু পিঁয়াজ। আউ ক্ষীরভি অছি। দুই ঢাল্ব ক্ষীর পঠাই দেইথ্বেলে বিশ্বল সাহেব।

ক্ষীর খাব! ক্ষীর! বলে, মহা আবদারে নড়েচড়ে বসল ভটকাই।

ঋজুদা হেসে ফেলল ভটকাই-এর কথা শুনে।

 ভটকাই লজ্জিত হয়ে বলল, হাসছ যে!

 ঋজুদা বললো, ক্ষীরের পুতুল।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ওড়িয়াতে দুধকেই বলে ক্ষীর।

তাই?

অবাক হয়ে বলল ভটকাই। এখানে ঢালে করে দুধ পাঠানো বিশ্বল সাহেব তাহলে বল্লমে বেঁধে কি পাঠান দেখা যাক।

ওরে বোকাটা। ঢাল নয়। ওড়িয়াতে ঢাল্ব মানে ঘটি। হিন্দি, লোটা। বুঝলি?

অ। তাই বলো! আমি ভাবি, ঢালে করে ক্ষীর পাঠানোই বুঝি শিকার-গড় রাজ্যের কায়দার মধ্যে পড়ে।

এখন খাবি কি তা বলেছো? সিম্পল পদ। জগবন্ধু বেচারিরও তো আমি না ফেরায় চিন্তায় চিন্তায় দু রাত ঘুম হয়নি। স্বয়ং পালের গোদাকে ম্যানইটার ইট করে কিনা সে তো চিন্তারই কথা!

ভটকাই বলল, কুক্কুড়া মানে কি কুকুর?

ঋজুদা বলল, এবারে তুই ফাজলামি করছিস। সংস্কৃত কুক্কুট শব্দের মানে জানিস তো?

সংস্কৃতে পাঁচ নম্বর পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সংস্কৃতর কথা আমাকে বোলো না।

নর নরৌ নরাঃ, মর মরৌ মরাঃ।

ভটকাই মাথা নিচু করে বলল।

তুই ছেড়ে দেওয়াতে মহাকবি কালিদাসের ভাষার ক্ষতি কিছুই হয়নি। কুক্কুট মানে মুরগী। সে কুক্কুট থেকেই কুক্কুড়া। ওড়িয়া তদ্ভব শব্দ।

তাহলে কুক্কুড়ার ঝোল আর ধান্যই হোক।

আমরা আবারও হেসে ফেললাম। আমি বললাম, ভাতকে ওড়িয়াতে ভাত্বই বলে।

 তাছাড়া ধান্য কি ভাত?

মান্য করলেই ভাত।

ভটকাই বলল।

সঙ্গে একটু আলুভাজাও হবে নাকি রে রুদ্র?

হোক। আমি বললাম।

ভটকাই বলল তার সঙ্গে একটু পেঁয়াজকলি ভাজা হলেও মন্দ হত না।

ঋজুদা বলল, দুধ যখন আছে এবং ভটকাই যখন ক্ষীরের এত ভক্ত তখন দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীরও করতে বলে দিচ্ছি।

বরাদ্দ হেল্বা। এৰ্ব্বে যাইকি চঞ্চল রান্ধিবা। বুঝিলে জগবন্ধু?

হ আইজ্ঞা।

বলে জগবন্ধু চলে যাচ্ছিল।

ঋজুদা পিছু ডেকে বলল, বেশি করে কোরো জগবন্ধু যাতে বালাবাবুর, তোমার ও আমাদের সকলেরই পেট ভরে। বালাবাবু করছেন কি?

বালাবাবু শুই পড়িলানি।

খাইবার টাইমরে ডাকিবা তাংকু।

আইজ্ঞা।

ভটকাই বলল, ওড়িয়া ভাষাটা ভারী মিষ্টি। তাছাড়া বাংলার সঙ্গে তফাতও বেশি নেই।

নেই-ই তো। ওড়িয়া ভাষাই শুধু নয়, ওড়িয়া মানুষরাও খুব মিষ্টি। ভদ্র, শিষ্ট, প্রকৃত বিনয়ী এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন।

বাঙালীরা ওড়িয়া বলতে পারে না অথচ প্রায় প্রত্যেক শিক্ষিত ওড়িয়া বাংলা পড়তে তো পারেনই, বলতেও পারেন বাঙালীদেরই মত।

আমি বললাম।

সেটা ওঁদের গুণ। আমাদের দোষ। বাঙালীদের যে কতগুলো ফালতু সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে না, সেই কমপ্লেক্স-এর জন্যেই জাতটা ডুবতে বসল। আমাদের মত এমন উদার জাত যেমন কম, তেমন এমন কূপমণ্ডুক জাতও নেই।

ঋজুদা বলল।

 এটা আবার কি শব্দ বললে ঋজুদা? কূপমণ্ডুক? এটাও কি ওড়িয়া শব্দ।

ভটকাই বলল।

তোকে নিয়ে মুশকিলেই পড়লাম রে মহামূর্খ।

ঋজুদা হাসতে হাসতে বলল।

তারপর বলল, কূপমণ্ডুক সংস্কৃত শব্দ। কূপ মানে কুঁয়ো। আর মঞ্জুক হল ব্যাঙ। মানে, কুঁয়োর ব্যাঙ। কুঁয়োর মধ্যে থেকে যেটুকু আকাশ দেখা যায় সেইটুকুই তার পৃথিবী। তার বাইরেও যে কিছু আছে এ কথা সে ধারণাতেও আনতে পারে না।

তা বললে হবে কেন? বাঙালীরা যত বাইরে যায় প্রতি বছর, ভারতবর্ষের অন্য কোনো রাজ্যের লোকে যায় না। কি? যায়?

ভটকাই বলল।

তা ঠিক। তবে শারীরিকভাবে বাইরে গিয়ে তীর্থস্থান বা সুন্দর সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলেই তো হবে না, নিজেদের মনে অন্যদের সম্বন্ধে সত্যিকারের ঔৎসুক্য জাগাতে তো হবে। বেড়াবার আসল লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত। আসলে, তুই যাই বলিস আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে শ্রদ্ধা, ভালবাসা, ঔৎসুক্য কিছুই রাখি না, আর রাখি না বলেই আজ আমাদের এত দুরবস্থা।

ভটকাই বলল, এবারে বলো ঋজুদা।

ঋজুদা বলল, তোরা তো আমাকে নামিয়ে চলে গেলি। আমিও ধীরে সুস্থে পায়ের দাগ দেখে এগোলাম। যতই এগুতে থাকি বন ততই নিবিড় হয়। কী বলব তোদের, এত জঙ্গলে ঘুরলাম, এরকম জঙ্গল দেখিনি। মাইলখানেক শুধুই চাঁর গাছ। মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে। পুরো জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে রয়েছে। মৃত্যুর গন্ধ চারিদিকে। কখনও আস্তে আস্তে উঠে গেছে জমি, কখনও নেমে গেছে। পাহাড়ের মতন নয়, শাড়ির ভাঁজের মত। চাঁর গাছের জঙ্গল পেরনোর পরই একেবারে উদোম টাঁড়। আর তার মধ্যে মধ্যে কালো টিলা। টিলাও বলব না, অনেকটা, বুঝলি রুদ্র, আফ্রিকার কোপজের মত। ঐ টাঁড়ের মধ্যে গিয়ে পৌঁছবার পর আর বাঘের পায়ের দাগ পেলাম না। যেন মন্ত্রবলে মুছে দিয়েছে কেউ। টাঁড়ের অন্য প্রান্তে কোনো গ্রাম আছে বলে মনে হল। কারণ দূরে সরষেক্ষেত দেখা যাচ্ছিল। হলুদ প্যাস্টেল-কালারে কেউ যেন ছবি এঁকেছে। এই সময়ে সরষে গাছে ফুল আসার কথা নয়। অবাক লাগল দেখে। সারা রাত ঘুমোইনি। চোখে ভুল দেখছি কি না কে জানে! নিজেকেই বললাম। তারপর ঠিক করলাম একটু ঘুমিয়ে নিয়ে চাঙ্গা লাগবে। ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে তারপর টাঁড় পেরিয়ে ওদিকের জনপদের দিকে যাওয়া যাবে ধীরে-সুস্থে। তখনও সামনে সারা দিন পড়ে আছে। জুতো দু’পাটি নিচে খুলে রেখে মোজা পায়ে একটা মস্ত চাঁর গাছে উঠে দুটো কেঁদো ডালের মধ্যে ইজিচেয়ারের মত জায়গা দেখে ডালের একটি খোঁচাতে স্লিংসুদ্ধ রাইফেল আর টুপিটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে আরামে গাছের ডালের খোঁদলে পিঠ দিয়ে লম্বা হলাম। রোদ এসে পড়েছিল গায়ে, পাতার ঝালরের ফাঁক দিয়ে। আরামে চোখ বুজে এল। অনেক ঘুম জমেছিল চোখের পাতায়।

যদি পড়ে যেতে?

রসভঙ্গ করে ভটকাই বলল।

পড়তাম না রে। গাছে একবার ঘুমনো রপ্ত করলে তোর আর বিছানাতে শুয়ে ঘুমোতে ইচ্ছেই করবে না।

আমি বললাম, তারপর?

তারপর যা হল, বললে হয়ত তোরা বিশ্বাস করবি না। আমার নিজেরও এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

কী হল বল না!

ঘুম যখন ভাঙল, তখন বেলা পড়ে এসেছে। আমার কোনও তাড়া ছিল না। বিশেষ কিছু করারও ছিল না। এদিকে এসেছিলাম বাঘের বিট সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে। বাঘের সঙ্গে মোকাবিলা যে হবে তা আদৌ ভাবিনি। সে কারণেই হয়ত অমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

উঠে বসে সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম তা এককথায় অপূর্ব। বছরের এই সময়ে ঝড় বৃষ্টি হয়ই না বলতে গেলে। কিন্তু ঘনমেঘে পুবের আকাশ ঢাকা। তখনই যেন সন্ধে নেমে এসেছে। মাঝে মাঝে কড়কড় শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর সেই দিনমানের মেঘ অন্ধকার আর বিদ্যুৎ হলুদ সর্ষেক্ষেতের উপরে যে কী চমৎকার এক ছবির সৃষ্টি করেছে তা কী বলব! অত মেঘ কিন্তু শিগগির যে বৃষ্টি হবে তা মনে হচ্ছে না। শিরশির করে হাওয়া দিচ্ছে। এক দল তিতির টাঁড় থেকে চরতে চরতে বেরিয়ে এসে একটি কোপজে-এর আড়ালে চলে গেল। কালি তিতির বা ব্ল্যাক পাট্রিজ ডাকতে লাগল একটি কোপজে-এর ওপার থেকে। একঝাঁক হরিয়াল উড়ে এল চাঁর বনে। হয়ত রাত কাটাবে বলে। মোহিত হয়ে বসে প্রকৃতির ঐ অপূর্ব সাজ দেখতে দেখতে আমার হঠাৎ আবার হাই উঠতে লাগল। কে যেন জোর করে আমাকে ঘুম পাড়াতে লাগল। সারা দিন ঘুমোবার পরও যখন আমার একটুও ঘুম আসার কথা নয় তখনই ঘুমে আমার দু চোখের পাতা একেবারে বুঁজে এল। গাছ থেকে নেমে নদীতে মুখ ধুয়ে যে টাঁড়ের দিকে যাব, সে ইচ্ছেও অচিরেই উবে গেল।

–তারপর? ভটকাই বলল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ঋজুদা। পাইপ খেল কিছুক্ষণ।

তারপর বলল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত হয়ে গেছে। চাঁর গাছেদের তলায় গাটু গভীর অন্ধকার। বালির উপরে উপরে নদী বয়ে যাবার ফিসফিস শব্দ রাত নামাতে জোর হয়েছে এখন। প্রথমে ঘুম ভেঙে আমি কোথায় আছি, কী করছি তা মনেই করতে পারলাম না কিছুক্ষণ। শুনেছি, মানুষ বুড়ো হলে এরকম হয়। কিন্তু বুড়ো হওয়ার তো দেরী আছে এখনও অনেক। কিছুক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পর সবে ঘুম ভাঙা চোখে অন্ধকার বেশ খানিকটা সয়ে এল। পশ্চিমাকাশে সবজে নীল আগুনের বড় টিপের মত শান্ত হয়ে জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতারা। মেঘ কেটে গেছে কখন কে। জানে। দূরের সর্ষেক্ষেত আর টাঁড়ের ওপর দিয়ে হু হু করে হাওয়া বয়ে আসছে। অথচ সেটা পুব দিক। বছরের এই সময়ে নির্মেঘ আকাশ আর পরিষ্কার আবহাওয়ায় পুবদিক থেকে হাওয়া আসাটা খুবই আশ্চর্যের। কিন্তু যেদিক দিয়েই আসুক না কেন শীত করতে লাগল বেশ। এদিকে ওদিকে ছড়ানো জড় পদার্থ কোপজেগুলোর মধ্যের ফাঁক-ফোকর-গুহায় এখন প্রাণ জেগে উঠছে। নানারকম রাত পাখির ডানা ঝাপটানো, অস্ফুট মৃদু এবং তীব্র স্বর, টাঁড়ের জমিতে ইঁদুর খরগোসের দৌড়াদৌড়ির শব্দ মিলে মিশে রাতের শব্দমঞ্জরী রাধাচূড়ার স্তবকের মত দুলছে কানের কাছে। তার একটু পরই প্রায় আমার গাছের নিচেই হাড়-কামড়ানোর কড়কড়কটাং আওয়াজে ভীষণ চমকে উঠলাম। আমি। নিচটা এতই অন্ধকার যে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে বাঘে বা চিতায় কোনো কিছু খাচ্ছে। এই চাঁরবনে শম্বরদের দলটা কাল ঢুকেছিল বটে, কিন্তু আমি এখানে ঐ দলটা ছাড়াও গেম-ট্র্যাকে বাঘের এবং এক জোড়া কোটরার পায়ের দাগ দেখেছি।

জার্কিনের জিপ টেনে দিয়ে কলার তুলে দিলাম নিঃশব্দে। তারপর টুপি আর রাইফেলটা গাছের খোঁচ থেকে নিতে গিয়ে নিলাম না। ব্যাপারটা যে কি আগে না বুঝে নড়াচড়া করাটা ঠিক হবে না। টর্চ জ্বালতে পারছি না, যদি নিনিকুমারীর বাঘ হয়? কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। এবং এবারে অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতর জানোয়ারের অবয়বও দেখতে পেলাম। বেশ বড়। নড়াচড়ার কায়দা দেখে মনে হল বাঘ। কিন্তু কোন বাঘ?

সামান্যক্ষণ ভেবে নিয়ে ঠিক করলাম যে বাঘই হোক নিনিকুমারীর বাঘের রাজত্বে একটি নিরপরাধ বাঘকে মেরে ফেললেও যেমন গর্হিত অপরাধ হবে না যদি বাঘের পেটে যাওয়া হতভাগ্য মানুষদের সংখ্যার কথা মনে রাখি।

খুব আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে গাছের খোঁচ থেকে টুপি এবং রাইফেলটাকে নিলাম। টুপিটা মাথায় দিয়ে কান অবধি টেনে নামিয়ে দিলাম। তারপর রাইফেলটাকে খুব আস্তে আস্তে দু-হাতে ঘুরিয়ে বাহু আর কাঁধের সংযোগস্থলে আনলাম। বাঘটা কী খাচ্ছে জানি না। তবে আওয়াজ শুনে মনে হল ছোট কোনো জানোয়ার। এ জানোয়ারের শরীরে মাংস কম। যে জানোয়ারই হোক বাঘ একে কিছুক্ষণ আগেই ধরেছে। গতকালের মড়ি হলে পচা দুর্গন্ধ বেরত।

জার্কিনের পকেটে টর্চ ছিল। কিন্তু টর্চ জ্বালাবার জো ছিল না। রাইফেলের ব্যারেলের সঙ্গে লাগানো পেনসিল টর্চের সুইচ ছিল ব্যারেলের সমান্তরালে লাগানো পাতলা লোহার পাতে। রাইফেলটার নলকে অন্ধকারেই যথাসম্ভব টার্গেটের দিকে ঘুরিয়ে নিশানা নিয়ে তর্জনী দিয়ে ফার্স্ট-প্রেসার দিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের মাথা ছুঁইয়ে টর্চের লোহার পাতের সুইচে চাপ দিলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে সেকেন্ড প্রেসার দিলাম ট্রিগারে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাইফেলের আওয়াজ বাজপড়ার আওয়াজের মত শোনাল এবং এই চাঁর জঙ্গলে এবং সামনের টাঁড়ে যে কতরকম পাখির বাস তা বোঝা গেল তাদের সম্মিলিত চিৎকারে। ট্রিগারে সেকেন্ড প্রেসার দেওয়ার সময়ে ঐ ক্ষীণ আলোতে বাঘকে দেখেছিলাম এক ঝলক। তাড়াতাড়ি রাইফেলটা কোলে শুইয়ে জার্কিনের পকেট থেকে টর্চ বের করে এবারে নিচে আলো ফেললাম। দেখি বাঘ নেই। একটি যুবকের মৃতদেহ পড়ে আছে। তার গালের একদিক, সেদিকের চোখ এবং নাকটি খেয়েছে বাঘে। পাছার মাংস। কান এবং শরীরের অন্যান্য নরম জায়গাগুলো। একটি পা। রক্তে আর লাল ধুলোয় মাখামাখি ফর্সা মরা মানুষটাকে বীভৎস দেখাচ্ছে। থুতনি ঠোঁট খেয়ে নিয়েছে বলে দাঁতের পাটি দুটিকে মনে হচ্ছে কঙ্কালের দাঁত বুঝি। মড়ি আছে কিন্তু বাঘ নেই। আমার গুলি বাঘকে মিস করে যেখানে গিয়ে পড়েছে সেখানে একটি খোঁদল হয়ে গেছে। সফট-নোজড গুলি। খাবলা খাবলা ধুলো তখনও বাষ্পর মত উড়ছে সেই খোঁদলের ওপর, কিন্তু বাঘ নেই।

বাঘ নেই এবং বাঘের গায়ে গুলি লাগেনি জেনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে টর্চটা নিবিয়ে দিয়ে রাইফেলটার কুঁদো আর ম্যাগাজিনের সংযোগস্থলে ভালবাসায় পোষা প্রিয় কুকুরের ঘাড়ে যেমন আদরের হাত রাখে তার মালিক তেমনই আদরে আর বিশ্বাসে হাত রাখলাম। দুটো চোখ, দুটো কান আর নাকের দুটো ফুটো দিয়ে যতকিছু দেখা, শোনা ও শোঁকা সম্ভব তাই দেখার শোনার ও গন্ধ নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু রাত নীরব। গাছের নিচের সুন্দর ধবধবে ফর্সা মৃত যুবকের মতই গা ছমছম করা নীরব। গুলির শব্দর প্রতিধ্বনি দীর্ঘ চাঁর গাছেদের আর কোপজে’দের আর হুহু-হাওয়া টাঁড়ে ল্যাব্রাডর গান-ডগ-এর মত দৌড়ে বেড়িয়ে এখন থেমে গেছে।

আধঘণ্টা কেটে গেল। কোনো শব্দ নেই, নড়াচড়া নেই কোথাওই।

আধঘণ্টা যে কেটে গেছে তা ঘড়ি দেখে বুঝিনি। আন্দাজে বুঝেছি। নিশ্চল হয়ে বসে অন্ধকার বনে সময়ের জ্ঞান থাকে না যেমন থাকে না হাইওয়েতে জোর গাড়ি চালালে গাড়ির বাইরে তাকিয়ে গতিবেগের। তাই অভিজ্ঞরা বলেন রাতের জঙ্গলে ঘড়ি এবং হাইওয়েতে স্পীডোমিটারে চোখ রেখে চলতে হয় সবসময়।

হঠাৎ একঝাঁক শকুন উড়ে এল টাঁড়ের দিক থেকে! রাতের বেলা শকুন ফাঁকা জায়গা এবং দিনমানে খেতে শুরু করা মড়ির উপরে ছাড়া দেখিনি কখনও আগে। বড় বড় ডানায় সপ সপ ভুতুড়ে আওয়াজ করে তারা মড়ির উপরে না পড়ে আমি যে গাছে বসেছিলাম তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। ওদের বড় বড় ডানা নেড়ে স্বচ্ছন্দে ওড়ার মত জায়গা ছিল না সেখানে তবু ওরা যেন দুঃস্বপ্নের শকুন, কোনো বাধাই ওদের কাছে যেন বাধা নয়, এমনি করে উড়তে লাগল। আমার সত্যি ভীষণ ভয় করতে লাগল। হিচক-এর দ্য বার্ডস বলে একটা ছবি দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। দেখার পর বহুদিন ঘুমোতে পারিনি রাতে ভাল করে। সেই ছবিটির কথা মনে এল। কিছুক্ষণ আমাকে ভয় দেখিয়ে তারা ফিরে গেল।

তারপরই হায়না ডেকে উঠল টাঁড়ের দিক থেকে হাঃ হাঃ হাঃ হুঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে।

হায়নার ডাক তো জীবনে প্রথম শুনলাম না। কিন্তু কেন যেন ভয়ে গা ছমছম করে উঠল। তারপরই মনে হল বাঘটা ফিরে এসে আবার খাওয়া শুরু করেছে। খাওয়ার শব্দও কানে এল। গুলি করার পরও মানুষখেকো বাঘ মড়িতে ফিরে এল? কী রকম!

একমুহূর্ত ভেবে আমি আবার রাইফেল তুললাম ফার্স্ট-প্রেসার দিতে দিতে এবং সেই কালো মূর্তির ঘাড় আর বুকের সংযোগস্থলে নিশানা নিয়ে সুইচে আঙুল ছুঁইয়ে দেখে নিয়েই চকিতে গুলি করলাম। রাইফেল ফেলে রেখে, বড় টর্চ জ্বালাতেই দেখি বাঘ নেই। আগের গুলিটি যেখানে লেগেছিল তারই পাশে আর একটি খোদলের সৃষ্টি হয়েছে। বাঘ ধারে কাছে কোথাওই নেই। গুলির শব্দর সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই কলকাকলীর ঐকতান। প্রতিধ্বনি, শিকারি কুকুরের মত আবার দৌড়াদৌড়ি। তারপরই গ্রামের নদীপারের শ্মশানেরই মত নিস্তব্ধতা। শকুন-শিশুর বুক চমকানো চিৎকারে যে নিস্তব্ধতা চমকে চমকে ওঠে শুধু।

তারপর?

ভটকাই বলল।

তারপর আরও আধঘণ্টা চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর আবার মনে হল বাঘ ফিরে এসেছে। মনে হল না, সত্যিই এসেছে। এবারে একটু সময় দিলাম তাকে। অন্ধকারে যখন তার অন্ধকারতর চেহারা বেশ ভাল দেখতে পাচ্ছি তখন আবার রাইফেল তুললাম। মাত্র পনের-ষোল ফিট উপর থেকে যে শিকারী পরপর ছ’বার প্রায়-অনড় হয়ে থাকা বাঘের মত বিরাট জানোয়ারের গায়ে গুলি লাগাতে না পারেন তাঁর শিকার ছেড়ে দেওয়া উচিত।

আমি বললাম, বাঘের গায়ে গুলি লাগাতে যতটা মার্কসম্যানশিপ-এর দরকার হয় তার চেয়ে বেশি দরকার হয় সাহসের। তোমার একথা মানিনা তাই আমি।

তারপর কী হল? ভটকাই আবার শুধোলো।

রাইফেল তুলেছি, নিশানা নিয়েছি। আলোটা টিপতে যাব। আলোটার কোনো দোষ ছিল না, রাইফেলের ব্যাক সাইডের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ফ্রন্ট সাইডের রেডিয়ামে লাগলে টার্গেট পরিষ্কার দেখাচ্ছে সে বারবারই নির্ভুলভাবেই। দোষ হচ্ছে অন্য কিছুর। শিকারীরই। আলোটা জ্বালতে যাব বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে ঠিক সেই সময়েই একটা মস্ত বাদুড় ঝপ করে উড়ে এসে আমার মাথার টুপির উপরের দিকে ঠোকর মেরে একগাদা বদগন্ধ ছড়িয়ে চলে গেল এবং ততক্ষণে ঐ ঝামেলাতে আমার রাইফেলের ব্যারেল অনেকটাই উঁচু হয়ে যাওয়ায় গুলিটা সামনের গাছে গিয়ে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল কোলে নামিয়ে বড় টর্চটা জ্বাললাম।

তারপর?

তারপর আর কি? এমনি করেই রাইফেলের ব্যারেল ও ম্যাগাজিনের যে কটি গুলি পোরা ছিল তা শেষ হয়ে গেল। তখন আমি সত্যি ভয় পেয়েছি। মন বলছে ও বাঘের পিছনে ঘুরে কাজ নেই। আমার অবস্থাও বহু অন্য শিকারীদের মতই হবে। তাছাড়া তোদের দুজনকেই কাল ভোরেই কলকাতা ফেরত পাঠাব। এ বাঘ সত্যিই ঠাকুরানীর বাঘ। জিম-করবেট-এর টেম্পল-টাইগারের মত। শিকার-গড়-এর দেবী একে কোনো আশীর্বাদে অমর করে দিয়েছেন।

তারপর? আমি বললাম।

ভোররাতে বোধহয় অজানিতেই ঘুমিয়ে পড়ে থাকব। গাছের ডালে প্রথম ভোরের পাখিদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। তখনও আলো ফোটেনি।

সকাল হবার পরে কি দেখলে?

সকাল চিরদিনই বনে জঙ্গলে সব অবিশ্বাস, ভয়, কুসংস্কার, আড়ষ্টতা ভেঙে দেয়। যেই ভোরে একটু করে আলো ফুটতে থাকে তারপর সেই আলো ক্রমশই ছড়িয়ে যেতে থাকে, তীব্রতর হতে থাকে, মনের ওপর থেকে সবকম আচ্ছন্নতা কুয়াশারই মত কেটে যেতে থাকে। আলো একটু স্পষ্ট হলে, যখন নদীর জল দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে চারপাশ তখন আমি খুব সাবধানে নামলাম। বেশি সাবধানতার দরকার ছিল এইজন্যে যে রাইফেলে আর গুলি ছিল না একটিও। গাছতলায় নেমে চারদিক তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে, যেখানে মড়ি পড়েছিল, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। নীল রঙের বড় বড় মাছি পড়েছে তাতে। তারা সংখ্যায় এত এবং এত জোরে ডানা ভনভন্ করছে যে মনে হচ্ছে যেন দূর থেকে আসা কোনো ছোট প্রপেলার প্লেনের শব্দ শুনছি। মড়ির গায়ে ছিটেফোঁটা মাংস লেগে আছে এখানে ওখানে। চেটে পুটে খেয়ে গেছে বাঘ। এবং পায়ের দাগ স্পষ্টই বলছে যে বাঘ বিভিন্ন নয়, একটিই বাঘ এবং নিঃসন্দেহে নিনিকুমারীর বাঘ।

বাঘ যে নিনিকুমারীর বাঘ সে সম্বন্ধে যখন নিঃসন্দেহ হলাম তখন ব্যাপারটা যে ভৌতিক-টৌতিক নয় সে সম্বন্ধেও নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠা গেল। তখন ভাল করে গাছটার চারধার ঘুরে বাঘের আসা-যাওয়ার পায়ের খোঁজ করলাম। দেখা গেল, রাতে যা ভেবেছিলাম তা নয়। প্রথমবার বাঘটা টাঁড়ের দিক দিয়েই এসেছিল মানুষটাকে নিয়ে। সে কেন যে অতখানি টাঁড় পেরিয়ে আসতে গেল, কেন ঐখানে বসেই খেল না তার একমাত্র উত্তর, ভেবে দেখলাম নদীর কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা এবং চাঁর গাছেদের গভীর নির্জন ছায়ার আড়ালের সুবিধা। কিন্তু এসেছে যদিও টাঁড়-এর দিক থেকেই প্রতিবার গুলি হবার পরই সে আমার পিছন দিকে, মানে আমি যেদিকে মুখ করে বসেছিলাম তার বিপরীত দিকে নদীর পাশে একটি প্রকাণ্ড চাঁর গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। আবার একটু পরে বেরিয়ে এসেছে। এবং খাওয়া দাওয়া সেরে আবার চলে গেছে কাল ভোরে তাকে তার পায়ের চিহ্ন আমরা যেখানে দেখেছিলাম সেইখানেই নদী পেরিয়ে শিকার-গড়ের দিকে। সেটা অবশ্য জেনেছিলাম তোরা জিপ নিয়ে আসার একটু আগে।

এতক্ষণ তুমি কী করছিলে?

তোরা হলেও যা করতিস। প্রথমেই টাঁড় পেরিয়ে সর্ষেক্ষেতের দিকে এগোলাম। উদ্দেশ্য দুটি। কিছু খাবার দাবার পাওয়া যায় কিনা এবং ঐ গ্রামে এর আগেও গেছে এমন মানুষ নিয়েছে কিনা। অন্য কথায় ঐ গ্রাম নিনিকুমারীর বাঘের রেগুলার বীট-এর মধ্যে পড়ে কিনা?

আসলে গ্রাম বলে যা ভেবেছিলাম তা নয়। পৌঁছে দেখি, ঐ কোপজে’র মত পাহাড়গুলোর আড়ালে মাত্র চার পাঁচ ঘর লোকের বাস। তারাই ঐ সর্ষে বুনেছে। তারা নাকি বামরার এক মহাজন, যার তেলকল আছে; তার কাছ থেকেই প্রতি বছর দাদন দিয়ে সর্ষে বোনে তারই জমিতে এবং সুদের খরচ বাদ দিয়ে পাইকারি হারে তাকেই পুরো সর্ষে বিক্রি করে দেয়। তাতে তাদের যা আয় হয় তার চমৎকার সাক্ষী তাদের চেহারা এবং অবস্থা। তবু তারা আমাকে মুড়ি আর গুড় খাওয়াল। এবং যা শুনলাম, বাঘ তাদের দিকে এর আগে আর কখনই আসেনি। নিনিকুমারীর বাঘের এলাকাতে বাস করেও তাদের কোনো ভয় ছিল না কারণ প্রথম এক বছর তারা নিয়মিত মাচা বেঁধে ঐ চাঁর বনেই দিনেরাতে পাহারা রাখত বাঘ টাঁড়ের দিকে আসে কিনা তা দেখার জন্যে। কিন্তু বাঘ কখনই এদিকে আসেনি। কজন মাত্র লোক থাকে, হয়ত সে জন্যেই আসেনি। যাই হোক গতকাল শেষ বিকেলে ওদের একজন ‘ঝাড়া দেইবাকু’ অর্থাৎ বড় বাইরে করবার জন্যে যখন একটি টিলার আড়ালে ‘ঢাল’ ভর্তি জল নিয়ে গিয়ে পৌঁছেছিল বাঘ তখন তাকে নিঃশব্দে ধরে। এবং ওখানে বসেই কিছুটা খায়। লোকটি অন্ধকার হবার পরও ফিরে না আসাতে ওরা বুঝতে পেরে দুয়ার বন্ধ করে রাতটা কাটায়। আমি যখন গিয়ে পৌঁছই তখনই ওরা সদলবলে তাদের সঙ্গীর খোঁজে বেরচ্ছিল। একজন রওয়ানা দিচ্ছিল শহরে। সেখানে বামরার মহাজনের গদীতে খবর দেবে বলে, যাতে অন্ত্যেষ্টির জন্যে কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। সে সাহায্যের উপরেও সুদ কষা হবে। সুদ-এর চেয়ে বড় মানুষখেকো বাঘ ভারতবর্ষের বনাঞ্চলে, গ্রামাঞ্চলে আর নেই।

আমি ওদের বললাম যে, মড়ির সামান্যই অবশিষ্ট আছে এবং আমিই দিয়ে যাচ্ছি ওদের। ওরা প্রথমে নিয়ে গেল আমাকে টিলার দিকে। সেদিক থেকে ড্রাগ-মার্ক-এর দাগ যে এসেছে তা আমি লক্ষ্য করেছিলাম। মানুষটিকে কোমরের কাছে কামড়ে ধরে নিয়ে এসেছে বাঘ চাঁরবনে, তার দু-হাত আর দু-পা হেঁচড়েছে মাটিতে–তারই ঘষটানোর দাগ। মাঝে মাঝে মানুষটিকে নামিয়ে রেখে একটু বিশ্রাম নিয়েছে। শিকার-গড়ে যখন বাঘটিকে দেখি তখন মনে হয়েছিল বাঘটি ল্যাংড়া নয়। কিন্তু দীর্ঘপথ তার পায়ের দাগ লক্ষ্য করে আজ বোঝা গেল যে ক্ষতটি তার কাফমাসলের কাছে। কখনও কখনও আরাম পাওয়ার জন্যে সে পা-টি তুলে তুলে চলে। কখনও স্বাভাবিক ভাবে চলে। অভিজ্ঞ শিকারীরা এবং শিকার-গড়-এর স্টেটের অভিজ্ঞ শিকারীরাও যে কি করে ভাবলেন বাঘের পায়ের কব্জীতে নিনিকুমারীর রাইফেলের চোট হয়েছিল তা এখনও বোধগম্য হল না।

আমি বললাম, হয়ত পা চুঁইয়ে রক্ত পড়াতেই এমন ভেবেছিলেন ওঁরা।

ঋজুদা বলল, হয়ত থাবাতেও চোট পেয়েছিল তখন, এখন তা সম্পূর্ণ শুকিয়ে এবং জুড়ে গেছে। প্রকৃতির নিরাময়ের রকমটাই আলাদা।

তারপর?

ভটকাই বলল।

তারপর আর কি? ওরা মড়ির অবশিষ্টাংশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। ছেলেটির ছোট ভাই এসেছিল। ঐ অবস্থায় তার স্ত্রীকে না দেখানোর পরামর্শ দিয়ে ওদের একশটি টাকা শ্রাদ্ধের জন্যে দিয়ে আমি নদীপারেই দাহ করে ফিরে যেতে বললাম ওদের। কিন্তু ওরা কথা শুনল না। বলল, ওর বৌ শেষ দেখা না দেখলে কষ্ট পাবে।

জানি না। ওদের সঙ্গে আমি একমত নই। শেষ দেখা সব সময়ই সুন্দরতম দেখা হওয়া উচিত। যখন বিখ্যাত মানুষেরা মারা যান, গায়ক, বাদক, অভিনেতা, সাহিত্যিক তাঁদের যে নাকে তুলো গোঁজা ফোলা-মুখের ছবি কাগজে ছাপা হয় তা আমার বীভৎস লাগে। মৃত মানুষের হাস্যময় ছবিই সব সময় ছাপা উচিত। যে চেহারাটি চোখে লেগে থাকে, প্রিয়জনের কাছে, অনুরাগীদের কাছে, সেই চেহারাটিকেই শোকের দিনে মনে করা উচিত।

ঠিক বলেছ।

আমি আর ভটকাই বললাম, সমস্বরে।

তারপর?

তারপর আর কি? ওদের সাবধানে থাকতে বললাম। ওরা গ্রামে ফিরে গেল মৃতদেহ নিয়ে। আর আমি নদী পেরিয়ে, বাঘ যে নদী পেরিয়ে শিকার-গড়-এর দিকেই গেছে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে তোদের জন্যে শুধু অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমি বললাম, জানো ঋজুদা। পাহাড়ের উপরে যে গুহা আছে, যার পাশের গাছে আমি সেদিন বসেছিলাম, সেখান থেকে নদীর ঐ জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যায়। শম্বরদের দলকে আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম নদী পেরিয়ে আসতে। তোমাকেও বাঘ দেখে থাকবে হয়ত।

তবে আমি যে শিকার-গড়ের দিকে যাইনি তাও সে দেখেছে। দেখেছে, জিপে করে তোদের সঙ্গে ফিরে গেছি।

তোমার গুলিহীন রাইফেল নিয়ে ঐ ভাবে শুয়ে থাকাটা অত্যন্ত অবিবেচকের কাজ হয়েছে।

যেখানে অন্য বিবেচনার উপায় নেই। মানে চয়েস নেই, সেখানে উপায় কি?

গ্রামের লোকদের ঐ রাতের শকুন আর বাদুড়ের কথা বলেছিলে? গুলির পর গুলি মিস হওয়ার কথা?

হ্যাঁ।

ওরা কী বলল?

ওরা কিছুই বলল না। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ওসব নিয়ে ভাবলে আমাদের চলবে না। কালকেই ঐ বাঘের একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে।

কী করে করবে?

কাল বলব। এখন, বালাবাবুকে একবার ডাক ত’! কথা আছে।

 ভটকাই গিয়ে বালাবাবুকে ডেকে আনল।

ঋজুদা বলল, কাল খুব ভোরে আপনার একবার বিশ্বল সাহেবের কাছে যেতে হবে জিপ নিয়ে। আমি একটি চিঠি দিয়ে দেব। সাতটার মধ্যে ফিরে আসবেন এখানে। আমরা কিন্তু তার আগেই হেঁটে শিকার-গড়ের দিকে এগিয়ে যাব। বিশ্বল সাহেব আপনার সঙ্গে এক কোম্পানি আর্মড পুলিস দেবেন। তাঁদের ট্রাকও এখানে কুচিলাখাঁই বাংলোতে রেখে যাবেন এবং আপনার জিপও। তারপর গোলমাল না করে বা কথাবার্তা না বলে নিঃশব্দে শিকার-গড়ে ওঠার আগে গ্রামেরও আগে যে মস্ত মহানিমগাছ আছে সেখানে এসে পৌঁছোবেন। তার নিচে আমরা অপেক্ষা করব। তারপর যেমন বলব তেমন হবে। পুলিসদের এবং আপনারও হয়ত সারা দিন খাওয়া হবে না কাল। কিন্তু কিছু করার নেই।

বালাবাবু একমুহূর্ত কী ভাবলেন। তারপর বললেন, চিঠিটা?

লিখে দিচ্ছি।

বলেই, ভটকাইকে বলল, দ্যাখ গিয়ে জগবন্ধুর রান্না হল কী না। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। জগবন্ধু যেন ভোর চারটেতে আমাদের চা দেয় এবং আমার জন্যে চানের গরম জল।

ঠিক আছে।

বলেই ভটকাই উঠে চলে গেল।

ঋজুদা বলল বালাবাবুকে, আপনাকে চিঠিটা পাঠিয়ে দিচ্ছি রুদ্রকে দিয়ে। আপনিও তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন আমাদের সঙ্গেই। কালকে অনেক কাজ।

আমরা যখন কুচিলাখাঁই পাহাড়ের নিচের বাংলো থেকে বেরোলাম তখন পুবের আকাশ সবে লাল হচ্ছে। তখনও পুলিসের গাড়ি আসেনি। এলে আমরা শব্দ পেতাম। ঋজুদা বলেছিলো হেঁটে যাবে কিন্তু জিপ নিয়েই রওয়ানা হলো দেখলাম। কেন প্ল্যান বদলালো জানি না।

জিপ চালাচ্ছে আজকে ভোরে ঋজুদাই। রাইফেলটা আমাকে ধরতে দিয়েছে। হাঁটুর মধ্যে এবং ঋজুদার রাইফেল দুটোকে চেপে আমি দু হাতে ধরে আছি দুটোকে। ভটকাই বসেছে আমার আর ঋজুদার মধ্যে।

শিকার-গড়ের এবং চারপাশের শিকারীদের খবর দেওয়া যায়নি এত কম সময়ে। তাই ঋজুদা আর্মড পুলিসের কোম্পানির সাহায্য চেয়েছে। ব্যাপারটা যে ঠিক মনঃপূত হয়নি তা ঋজুদার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার তো হয়ই নি।

ভারতবর্ষে পুলিসরা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারে যতখানি দড় ততখানি দুশমনদের ওপর গুলি ছুঁড়তে নয়। পথের গুণ্ডা বদমাইশদের নিশানা নিয়ে গুলি করলে সে গুলি হয় ফুটপাথের নিরীহ পথচারী নয়ত দোতলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন কৌতূহলী মহিলার গায়ে গিয়েই লাগে। পুলিসদের বিশেষ করে আর্মড পুলিসদের নিশানা ঠিক কেন যে থাকে না তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।

বালাবাবুকে ঋজুদা যে মহানিমগাছের কথা বলে দিয়েছিল সেই প্রাচীন গাছের নিচে আমরা জিপ দাঁড় করালাম। সবে ভোর হয়েছে। ঘাস পাতায় সূর্যের নরম সোনালি আঙুলের ছোঁয়া লাগছে সবে। পাখিদের কলকাকলি, ঘাসফড়িঙের তিরতিরে স্বচ্ছ ডানা, শিশিরভেজা মাঠে কান-উঁচু খরগোশের হন্তদন্ত হয়ে এসে নিজের প্রায়-অদৃশ্য গর্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এই সব দেখছি চুপ করে বসে। একদল বনমুরগি রোদ পোয়াচ্ছে আর ধান খুঁটে খাচ্ছে। গাঢ় বেগুনি, সবুজ, লাল, হলুদ আর সোনালি রঙ ঝিলিক মারছে সকালের নরম রোদে। একটা কোটরা হরিণ, বাদামী দেখাচ্ছে এখন তার গায়ের রঙ, চলে গেল আস্তে আস্তে হেঁটে তার লেজের সাদা পতাকা নাড়তে নাড়তে। দেখতে পায়নি সে আমাদের। আমাদের আজকে বোধহয় কেউই দেখতে পায়নি। নিনিকুমারীর বাঘও আশা করি দেখতে পাবে না।

ঋজুদা জিপ থেকে নেমে, একটা কাঠি ভেঙে নিয়ে পথের ভেজা ধুলোয় ম্যাপ এঁকে আমাদের প্ল্যানটা বোঝাল। বলল, বাঘ যে নদী পেরিয়ে সকালে বা শেষ রাতে শিকার-গড়ে ফিরে এসেছে তা তো কাল দেখাই গেছে। আজও সে শিকার-গড় থেকে বেরিয়ে কোনো দিকে যাবে। কোন দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা? এ পর্যন্ত দেখা গেছে নদী পেরিয়েই সে যায় প্রতিবারে। তারপর নদীর ওপারের ডাইনে বাঁয়ের পথ ধরে বড় বড় গ্রামের দিকে যায়। একটা কথা খুবই আশ্চর্যের যে আমরা আসার আগে সে কিন্তু গড়ের পায়ের কাছের সাম্বপানি গ্রামে অথবা ঐ সর্ষেক্ষেতের গ্রাম থেকে একজনও মানুষ নেয়নি। তার মানে হচ্ছে যে সে দূরে গিয়ে শিকার-গড়ের নিরাপদ আশ্রয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে যদি না পারে সেই ভয়েই হয়ত ইদানীং কাছাকাছি গ্রাম থেকে মানুষ নেওয়া শুরু করেছে।

ভটকাই বলল, কিন্তু ঋজুদা, সাম্বপানির প্রথম মানুষ, মানে সেই বউটাকে তো বাঘ আমরা এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়েছিল। তখনও তো বাঘের আদৌ জানার কথা নয়, যে আমরা এসেছি! তুমি তার পরেই তো চণ্ডীমন্দিরে পুজো দেওয়ালে, শিকার-গড়ের নহবৎখানাতে রাত কাটালে। তাই না?

তা ঠিক। ঋজুদা চিন্তান্বিত গলায় বলল।

তারপর বলল, আমি যা ভাবছি তা পুরোপুরি ভুলও হতে পারে। কিন্তু কিছুই না করে বসে থাকলে তো চলবে না। তাছাড়া এই বাঘকে রাতে মোকাবিলা করার অসুবিধা আছে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই একে যা করার করতে হবে।

হেসে বললাম, তুমি ভূত-ভগবানকে ভয় পাও? নতুন কথা শুনছি!

পাইপ ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ঋজুদা বলল, অন্ধকার বনে বা মানুষখেকো বাঘের নখে ভয় নেই। ভয়টা আমার মনেই। যে কোনো কারণেই হোক পরশু রাতের ঘটনায় আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। সে সব ঘটনার ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা বোঝার সময় এখন নেই। যা কিছুই রোধ করার, প্রতিবিধান বা প্রতিবাদ করা আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল না বা এই মুহূর্তে নেই তার সবকিছুকেই আমি ঘৃণা করি। সেই দৃশ্য অথবা অদৃশ্য শক্তিকে, সে শক্তি ভুতুড়ে অন্ধকারই হোক, কোনও দেবীর কৃপাধন্য মানুষখেকো বাঘই হোক বা ক্ষমতান্ধ কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দলই হোক, তাকে ছিন্নভিন্ন, নির্মূল না করা পর্যন্ত আমার ঘুম হয় না।

আমি রুটির মধ্যে তরকারি পুরে ঋজুদাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, নাও।

 ঋজুদা বলল, তোরা খা। আমি তোদের ব্যাপারটা ততক্ষণে বুঝিয়ে দিই ভাল করে। আমি আর ভটকাই রুটি তরকারি খেতে লাগলাম।

ঋজুদা বলল, নিনিকুমারীর বাঘ শিকার-গড়েই আছে। দিনমানে শিকার-গড়ের সমস্ত জঙ্গল ঝেটিয়ে হাঁকা করে তাকে তাড়িয়ে পাহাড় জঙ্গলের আড়াল থেকে নামিয়ে নদী পার করাতে হবে। রাস্তাটা যেখানে নদীকে কেটে গেছে বাঘ ঠিক সেইখান দিয়েই নদী পেয়োয়। নদী তো বাঁকও নিয়েছে ঐখানে। অতখানি ফাঁকা জায়গা আর কোথাওই নেই। তাকে মারা গেলে ওখানেই যাবে। নইলে বাঘ নিয়ে কপালে দুর্ভোগ আছে অনেক।

আমি বললাম, বাঘ যদি বিটারদের লাইন ক্রস করে বিপরীত দিকে চলে যায়? কাউকে আহত করে? নদীর দিকে সে যদি আদৌ না যায়?

ঠিক বলেছিস। তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই আমি বিটিং-এর ঢাক-ঢোল বা শিঙা ব্যবহার করছি না। সাধারণ হাঁকাওয়ালাও নয়। আর্মড পুলিসের কোম্পানি শিকার-গড়ের বাঁদিকে বেড়া তৈরি করবে অর্ধচন্দ্রাকারে। তারপর ত্রিশ সেকেন্ড পর পর গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুরো গড় এবং গড়ের সামনে-পেছনের দিকে চিরুনি অভিযান চালিয়ে বাঘকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। অত লোক আর অত রাইফেলের গুলির আওয়াজ একসঙ্গে শুনে বাঘ স্বভাবতই অচেনা জঙ্গলে না নিয়ে তার চেনা জঙ্গলের দিকেই যাবে। নদী পেরোতে পারলেই তো ডান দিকে বাঁদিকে তার দীর্ঘদিনের পরিচিত শিকারভূমি। এবং নদী পেরোবার সময়ই তাকে মারতে হবে।

তোমার এই অঙ্ক যদি না মেলে? ভটকাই বলল।

 ঋজুদা বলল, আমি আর ভটকাই থাকব নদীর ওপারে। আর রুদ্র থাকবে পুলিসের সঙ্গে যারা বিট করবে। বাঘ বিটার-লাইন ক্রস করতে পারে। তাই বিটারদের সঙ্গেও একজন অভিজ্ঞ শিকারী থাকা দরকার।

অভিজ্ঞ কথাটায় আমার নাকের পাটা ফুলে গেল।

ভটকাই আওয়াজ দিল। বলল, বাবাঃ! অভিজ্ঞ শিকারী রুদ্র রায়?

আমি বললাম, তুমি এবার খেয়ে নাও ঋজুদা। চা খাবে তো?

 তাড়া করে লাভ নেই? আমর্ড পুলিসের লোকেরা জানে যে সারাদিন তাদের খাওয়া নেই। তাই তারাও জম্পেশ করে আর্লি ব্রেকফাস্ট করেই আসছে। তাছাড়া বেচারাদের কারবার চোর-ডাকাত নিয়ে। নিনিকুমারীর বাঘকে অ্যারেস্ট করতে হবে শুনেই তো অনেকের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে বেচারিরা চাকরি করে। খামোখা মানুষখেকো বাঘের খাদ্যই বা হতে যাবে কেন তারা?

নাও, খাও। আমি বললাম।

.

০৫.

আমরা যখন চা খাচ্ছি তখন খচর-মচর করে বুট-পায়ে রুট-মার্চের শব্দ শুনতে পেলাম। ডাবল্-ফাইলে ওরা হেঁটে আসছে কাঁচা লাল মাটির পথ ধরে। দূর থেকে লম্বা খাকিরঙা কোনো প্রাগৈতিহাসিক অজগর সাপের মত মনে হচ্ছে সেই অশেষ সারিকে। বুটের ঘায়ে ঘায়ে উড়ছে লাল ধুলো। কমাণ্ডারের নাম বলভদ্র নায়েক। সপ্রতিভ, উৎসাহী, সাহসী ভদ্রলোক। সুদর্শনও। প্রথম আলাপেই পরিষ্কার বাংলায় ঋজুদাকে বললেন, আপনাকে নিয়ে লেখা অনেক বই পড়েছি বাংলায়। ঋজু বোসকে কে না চেনে?

ঋজুদাও পরিষ্কার ওড়িয়াতে বলভদ্রবাবুকে বললেন, জয়ন্ত মহাপাত্রর সঙ্গে আমার আলাপ আছে। উৎকলমণি গোপবন্ধুর আমি একজন বড় ভক্ত এবং বর্তমান ওড়িয়া সাহিত্য ও কবিতার কিছু খোঁজ আমিও রাখি।

বলভদ্রবাবু খুশি হলেন। বললেন, আমি আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলি, আর আপনি বলুন ওড়িয়াতে। দুজনেরই প্র্যাকটিস হবে।

ভাল কথা। ঋজুদা বলল। তারপর বলভদ্রবাবুকে বিস্তারিত বোঝাল প্ল্যানটা। কথা শুনে মনে হল, উনিও শিকার করেছেন একসময়। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিলেন আমাদের সঙ্গে চা খেতে খেতেই।

ঋজুদা বলল, আমাদের জিপটা আজ এখানেই থাকবে। গতকালই বিশ্বল সাহেবের লোক রাতের বেলা জিপে করে সাম্বপানিতে এসে খবর দিয়ে গেছে যেন আজ কেউ শিকার-গড় এবং সাম্বপানির আশপাশের জঙ্গলে পাহাড়ে কোনো কাজেই না যায়। গ্রামেই যেন থাকে। যদি যায়, তাহলে নিনিকুমারীর বাঘের ভয় ছাড়াও পুলিসের রাইফেলের গুলিও লেগে যাবার আশঙ্কা আছে।

আমরা সকলে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। ঋজুদা ভটকাইকে সঙ্গে নিয়ে কিছুটা পথ আমাদের সঙ্গে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল, পাহাড়ের উৎরাই ভেঙে নিচে নদীতে গিয়ে পৌঁছবে বলে। যাবার সময় ঋজুদা তার অ্যালার্ম-দেওয়া রোলেক্স হাত ঘড়িটা দেখিয়ে বলভদ্রবাবু আর আমাকে বলল, ঠিক দশটায় সময়ে আপনারা গুলি করতে করতে বিটিং আরম্ভ করবেন। দশটার আমি পজিশন নিয়ে নিতে পারব আশা করি নদীর ওপাশে।

গুড হান্টিং, বলে ঋজুদা নেমে গেল ডানদিকে, নিচে।

ভটকাই বাঁ হাত তুলে বিগলিত মুখে বলল, ওকে! বেস্ট অফ লাক্ রুদ্র রায়। হড়-বড় কোরো না। মেজাজ ও বুদ্ধি ঠাণ্ডা রেখ।

আমি চাপা গলায় বললাম, ফাজিল।

আমরা রওনা যখন হলাম তখন সাড়ে সাতটা বাজে। শিকার-গড়ের দুর্গের বেশ খানিকটা পেছনে, সাম্বপানি গ্রাম ছাড়িয়ে একটা কল্পিত লাইন বরাবর রাইফেলধারী পুলিসেরা ছড়িয়ে গেল। তাদের প্রত্যেকের হাতে সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। হ্যাভারস্যাকে লোড-করা গোটা ছয়েক অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। অতখানি পথ যদি গুলি করতে করতে নামতে হয় তাহলে অনেক গুলি তো লাগবেই!

সাড়ে নটা নাগাদ স্টার্টিং-পয়েন্টে পৌঁছে গিয়ে পুলিসদের বিশ্রাম নিতে বলে বলভদ্রবাবু একটা বড় পাথরের ওপর বসে পানের ডিবেটা নিজের হ্যাভারস্যাক থেকে বের করে বললেন, চলবে নাকি?

আমি খাই না। কিন্তু উত্তেজনার মুহূর্তে অনেকেই অনেক কিছু করে। বলভদ্রবাবু কখন যে ভালবেসে একটি গুণ্ডিমোহিনী আমার হাতে তুলে দিয়েছেন তা খেয়াল না করেই মুখে পুরে দিয়েছি। চমৎকার লাগছে চিবোতে। প্রথম ঢোক গিলে ফেলেছি ভাল করে বোঝার আগে। এবং তারপরই দারুণ মাথা ঘুরতে শুরু করায় সব ফেলে দিলাম থুঃ থুঃ করে।

বলভদ্রবাবু ওয়াটার বটল থেকে জল খাওয়ালেন। বললেন, আগে তো বলবেন যে গুণ্ডি খান না। আর গুণ্ডি বা জর্দা না খেলে পান খেয়ে লাভই বা কী? ঘাসপাতা খেলেই হয়।

আমি চুপ। রাইফেলটা পাশে রেখে শুয়ে পড়লাম। ওপরের গাছে বড়কি-ধনেশ ডাকছে। কুচিলা-খাঁই। হ্যাঁক্কো- হ্যাঁক্কো হক্কো-হক্কো। বড় আওয়াজ করে পাখিগুলো। যেমন করে জলহস্তীরা, আফ্রিকায়। জন্তু-জানোয়ার পাখ-পাখালির মধ্যেও কিছু কিছু প্রজাতি বড় বাচাল হয়। ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছে। দূরে একটি ক্রো-ফেজেন্ট ডাকছে। মাথার ওপর দিয়ে শনশন্ আওয়াজ করে উড়ে গেল একঝাঁক হরিয়াল কোনো ফলভারাবনত বট বা অশ্বত্থ গাছের দিকে। কাঠঠোকরা কাঠ ঠুকছে। বড় শান্তি এখন চারিদিকে। দশটা বাজলেই এই শান্তি বিঘ্নিত হবে অগণ্য রাইফেলের বজ্রনির্ঘোষে।

দশটা বাজতে দু মিনিট বাকি। আমি উঠে বসলাম। মাথাটা তখনও ঘুরছিল। বললাম, আমি আপনার কিছুটা পেছনে থাকব। যদি এই অসমসাহসী বাঘ এত রাইফেলের গুলির শব্দ অগ্রাহ্য করে বিটারদের লাইনের উল্টোদিকে আসে তখন তার মোকাবিলা করতে পারব।

মনে মনে বললাম, এত রাইফেলধারী পুলিসের সামনে সামনে গিয়ে তাদের গুলি খেয়ে মরতে আদৌ রাজি নই আমি।

বলভদ্রবাবু বললেন, ঠিক আছে।

দশটা বাজতেই যেন কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ শুরু হল। সব পুলিস বলভদ্রবাবুর সঙ্গে থেমে থেমে গুলি করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগল ঝোপ-ঝাড় ভেঙে। সমস্ত জঙ্গল-পাহাড় সচকিত হয়ে উঠল। অসংখ্য প্রজাতির অগণ্য পাখি, হনুমান ও হরিণের ডাকে ও দ্রুত দৌড়োদৌড়ির শব্দে বন সরগরম হয়ে উঠল। আমি রাইফেল রেডি পজিশনে ধরে ওদের পঁচিশ-তিরিশ হাত পেছনে। পৌনে এগারটার সময়, শিকার-গড় পেরিয়ে পুলিসের বেষ্টনী পাহাড় ধরে নামতে লাগল। আমি একবার গড়ের নিচের সেই ছায়াচ্ছন্ন গুহায় সাবধানে গিয়ে পৌঁছলাম। নাঃ। বাঘ কাল রাতে এখানে আসেনি। তারপর গড়ের ভাঙা দেওয়াল টপকে নহবতখানার কাছে পৌঁছে খুবই সাবধানে ভেতরে উঁকি দিলাম। বাঘের টাটকা পায়ের দাগ আছে এখানে। রাতে শুয়ে থাকার দাগও স্পষ্ট ধুলোর ওপরে। পুলিসের গুলির শব্দ শুনেই বাঘ নহবতখানা ছেড়ে চত্বর পেরিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। আজ কিছু একটা ঘটবে। ঋজুদার অনুমান পুরোপুরি ঠিক। বাঘ যদি নদী পেরোতে যায় তবে আজই তার জীবনের শেষ দিন।

গতি বাড়িয়ে পুলিসদের ধরবার চেষ্টা করলাম। ঋজুদার এক গুলিতে নিনিকুমারীর বাঘ যদি ধরাশায়ী না হয় তখন বিটারদের লাইন ক্রস করে সে আবার শিকার-গড়েই ফিরে যাবার চেষ্টা করবে হয়ত। আহত মানুষ যেমন বাড়ি ফেরার জন্যে আকুলি-বিকুলি করে, আহত হিংস্র জানোয়ারও মরার সময় মরতে চায় তার প্রিয় বিশ্রামস্থলে, গুহায় বা অন্য কোথাও ফিরে গিয়েই। তাদের ঠিকানা থাকে।

বেলা তখন ঠিক বারোটা, তখন পুলিসের লাইন এবং আমিও, নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ঋজুদাকে বা বাঘকেও কোথাওই দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ঋজুদা নদীর পারের কতগুলো বড় পাথরের আড়ালে বসে আছে। ভটকাই কোথায় কে জানে। আমার ভয় হচ্ছে আনাড়ি ভটকাই, ঋজুদা গুলি করার আগে বাঘকে দেখতে পেয়ে তার বন্দুক দিয়ে গুলি না করে দেয়। তাহলে যে কী হবে তা ঈশ্বরই জানেন।

নদী যখন আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে তখন আমি বলভদ্রবাবুকে হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বললাম।

ইনি রুমাল নেড়ে, সিজ-ফায়ারের নির্দেশ দিলেন। প্রায় নিরবচ্ছিন্ন এবং শয়ে-শয়ে গুলির শব্দ হঠাৎ থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুর মত নিস্তব্ধতা নেমে এল জঙ্গলে, পাহাড়ে, নদীতে। নদীর বয়ে-যাওয়ার কুলকুলানি শব্দ হঠাৎ স্পষ্ট হলো একটা মাছরাঙার ভয়-পাওয়া কর্কশ চিৎকার দূরে চলে যাওয়ার পর নদীর কুলকুল আওয়াজই একমাত্র শব্দ হয়ে কানে আসতে লাগল। নিনিকুমারীর বাঘ নদী আর আমাদের বেষ্টনীর মধ্যে এমন কোনো আড়ালে লুকিয়ে আছে যে, আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। ওপার থেকে ঋজুদা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে? এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ লালচে উল্কার মত বাঘ একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের মোটা গুঁড়ির আড়াল ছেড়ে দুলাফে নদীর জলে গিয়ে পড়ল এবং সে আরেকটি লাফেই নদীর ওপারের জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছবে। বাঘ জলে পড়তেই গদ্দাম করে বন্দুকের আওয়াজ হল ওপার থেকে। রাইফেলের নয়, বন্দুকের আওয়াজ। ভয়ার্ত চোখে চমকে তাকিয়ে দেখি, ভটকাই একটি সেগুন গাছের ডালে বসে ফোটাকার্তুজের জায়গায় অন্য কার্তুজ ভরছে। বাঘ ভটকাইকে দেখেছিল বোধহয়। তাই নদী পেরচ্ছিল না।

এত্ত রাগ হল যে কী বলব! বাঘের গায়ে গুলি লেগেছে কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু বাঘ মুহূর্তের মধ্যে কোমরে এক মোচড় দিয়ে জলের মধ্যে জল-ছিটকে ঘুরে গেল আমাদের দিকে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঋজুদা কোথায় আছে বোঝা গেল না এবং কোনো গুলিও হল না ঋজুদার রাইফেল থেকে। বাঘটা সটান লাফিয়ে উঠল ওপরে গোল হয়ে ধনুকের মত। বুঝলাম পেটে গুলি লেগেছে। বাঘ জলে পড়তেই নদীর জল ছিটকাল। ঝিকমিক করে উঠল জল সকালের রোদে হাজার হীরের মত।

বাঘ জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেবেছিলাম ঋজুদা গুলি করবে। ঋজুদা কোথায় আছে তা না জেনে এদিক থেকে গুলিও করতে পারছি না আমি। তাছাড়া বাঘ মারার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে, বাঘ যদি বিটার্স লাইন ভাঙে, তবেই।

এবারে বাঘ সংহার মূর্তিতে আমাদের দিকে তেড়ে এল রক্তে জল লাল করে। না গুলি করল ভটকাই, না ঋজুদা। যে-কোনো স্বাভাবিক বাঘ হলে সে ঋজুদার অবস্থান লক্ষ করে আক্রমণ করত।

বাঘটা তার আশ্রয়ের দিকে ফিরে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করল। পুলিসেরা কেউই শিকারি নয়। ওদের বাঁচাবার জন্যে আমি বাঘের দিকে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম হাত দশেক। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুত দৌড়ে আসা বাঘ আমার কাছাকাছি আসতেই তার বুক লক্ষ্য করে গুলি করলাম। আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। কিন্তু বাঘ আর এক লাফ মারল। এবারে এমন প্রলয়ঙ্করী গর্জন করল সে, যে মনে হল গাছ পড়ে যাবে। সেই গর্জনে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। আমার দু চোখের দৃষ্টি, মস্তিষ্কের সব ভাবনা আচ্ছন্ন করে বাঘ মুহূর্তের মধ্যে উড়ে এল আমার ওপরে। দ্বিতীয় গুলিটা সে শূন্যে থাকতেই করলাম, কিন্তু বাঘ এসেই পড়ল আমার ওপরে। পড়ে গেলাম। ওপরে বাঘ। আমার ডান বাহুতে কে যেন হাজার মন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল একটা। পরক্ষণেই কানের তালা ফাটিয়ে দিয়ে একটা রাইফেলের গুলি হল আমার বাঁ কানের কাছে ছ ইঞ্চি পাশে।

তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।

.

০৬.

এখন সকলেই কুচিলা খাঁই বাংলোর বারান্দাতে। আমি শুয়েছিলাম ইজিচেয়ারে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সারা শরীর। এখুনি রওনা হয়ে চলে যাব। আমারই চিকিৎসার জন্যে।

চিৎকারে কারও কথাই শোনা যাচ্ছে না। বিশ্বল সাহেব, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, বলভদ্র সাহেব, ডাক্তার, নার্স, অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি, অনেক জিপ, প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। আর সমুদ্রর মত গর্জন করছে অসংখ্য মানুষ। উল্লাসের গর্জন। কিছু কানে যাচ্ছে আমার, কিছু যাচ্ছে না। ঘোরের মধ্যে আছি। মরে যাব কি?

ঋজুদা বলভদ্রবাবুকে দেখিয়ে বললেন, ইনি তোকে বাঁচিয়েছেন। ঐরকম ঝুঁকি নিয়ে তোর ওপরে পড়া বাঘের কানে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে গুলি না করলে তোর বাঁচার কোনো আশা ছিল না। আমি ঘোরের মধ্যেই হাসবার চেষ্টা করে বলভদ্রবাবুকে বললাম, থ্যাংক উ্য।

তারপর বললাম, তুমি কোথায় ছিলে? কী করছিলে ঋজুদা? তুমি গুলি করলে না কেন?

ঋজুদা আমার বাঁ কাঁধে হাত দিয়ে বলল, পরে বলব।

তাকিয়ে দেখলাম, রাসকেল ভটকাই! চোখদুটো চোরের মত। লজ্জায় আমার দিকে তাকাতেও পারছে না।

আমি ক্ষমা করে দিলাম। দোষটা ওর নয়। ঋজুদার ওকে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।

তারপর ভাবলাম, আসল দোষ তো আমারই, ওকে আমি যদি ঋজুদার ঘাড়ে জোর করে না চাপাতাম তবে তো….।

অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে তুলল ওয়ার্ডবয়রা। ইজিচেয়ারে শুইয়ে স্যালাইনের নলের আর রক্তের নলের ছুঁচ লাগানো হল হাতে। অ্যান্টিসেপটিক-এর তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। সাঙ্ঘাতিক ব্যথা। কে যেন বলল, তাড়াতাড়ি কর। গ্রাংগিন সেট করে যাবে নইলে। হাত কেটে বাদ দিতে হবে। আমার ডান হাত। যে হাত দিয়ে আমি লিখি। দু চোখ ভরে এল জল।

অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিল। ঋজুদা আমার পাশে বসে। অন্য পাশে নার্স। অগণিত মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস পেছনে ফেলে অ্যাম্বুলেন্স এবং জিপ ও গাড়ির কনভয় এবারে নির্জন পথে এসে পড়ল। অ্যাম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি নীল আকাশে ঝকঝক করছে প্রথম শীতের রোদ্দর। গাছ গাছালি ঝুঁকে পড়েছে দু পাশ থেকে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তবু নিনিকুমারীর বাঘ যে শেষপর্যন্ত মরল, এই আনন্দেই হয়ত বেঁচে যাব।

এখুনি কি মরতে হবে আমাকে? আরও কত বন-পাহাড়ে যাবার ছিল! আরও কত বিপদের মুখোমুখি হওয়ার ছিল। কত অভিজ্ঞতা বাকি রয়ে গেল। একটাই তো জীবন!

মায়ের মুখটা ভেসে এল চোখের ওপরে।

যন্ত্রণার জন্যে বোধহয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন কটা বাজে, কী বার কিছুই বোঝার উপায় ছিল না।

চোখ খুলেই দেখলাম ঋজুদা আর ভটকাই বসে আছে আমার পায়ের দিকে, দুটো চেয়ারে। আমি চোখ খুলতেই ভটকাই মুখ ভ্যাটকাল।

ঋজুদা বলল, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নে। জখম সামান্যই। বাঘ আসলে তোর গুলি খেয়েই মরে গেছিল। তোর ডান কাঁধে থাবার একটা অংশ শুধু লেগেছিল। অবশ্য বাঘের থাবা বলে কথা। বলভদ্রও গুলিটা করেছিল মোক্ষম মুহূর্তে। ওর সঙ্গে আগে মোলাকাৎ হলে আমাদের সুবিধা হত।

নার্স ঘরে এলেন। বললেন, আমাকে দাঁত মাজতে, মুখ ঘোয়াতে এসেছেন। তারপর ড্রেসিং করে ব্রেকফাস্ট দেবেন। ঋজুদারা গতকাল থেকে এখানেই আছে সার্কিট হাউসে। বামরা হয়ে এসেছি আমরা ঝাড়সুগুদাতে।

বাথরুম সেরে ব্রেকফাস্টও খেয়ে নে। আমরাও আসছি ব্রেকফাস্ট সেরে। ঋজুদা বলল। আমরা থাকলে তোর বেড প্যান নিতে অসুবিধে হবে।

আমি বললাম, নিনিকুমারীর বাঘ তাহলে ভটকাই-এরই হল!

 ঋজুদা হাসল। বলল, হিংসে হচ্ছে?

–না। আমি বললাম।

ভটকাই বলল, আমরা ব্রেকফাস্ট খেয়েই ফিরে আসছি।

আমার খুব খুশি খুশি লাগছিল। সকালের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। হাসপাতালের হাতায় বড় একটা নিম গাছ। নানা পাখি কিচিরমিচির করছে তাতে। হেমন্তর রোদ ঝিলমিল করছে পাতায় পাতায়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গেছিলাম। এখনও চোখ খুললেই বাঘের মুখটা দু-চোখ জুড়ে ভেসে উঠছে। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ফাঁক অতি সামান্যই। এমন করে না জানলে সে কথা হয়ত কখনই বুঝতাম না।

নার্স আমার ড্রেসিং করতে করতেই সুপারিনটেণ্ডিং সার্জনের সঙ্গে ঋজুদা আর ভটকাই ফিরে এল। সঙ্গে আরও তিন-চারজন ডাক্তার, মেট্রন। ডাক্তারদের মধ্যে একজন আমাকে ইনজেকশন্ দিলেন। নার্সের কাছ থেকে চেয়ে ওষুধের লিস্ট, টেম্পারেচারের চার্ট দেখলেন মেট্রন। সুপারিনটেণ্ডিং সার্জন বললেন, দিন পনেরো থাকতে হবে। দেখতে দেখতে কেটে যাবে দিন। বেস্ট অফ লাক।

ওঁরা ঘর ছেড়ে চলে যেতেই আমি ঋজুদাকে শুধোলাম, সার্জন বেস্ট অফ লাক বললেন কেন?

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে একবার কাশল, তারপর চেয়ার টেনে বসল। ভটকাইও চেয়ারে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল যাতে আমার চোখে চোখ না পড়ে। বুঝতে পারলাম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। কোনো কথা গোপন করতে চাইছে ঋজুদারা আমার কাছ থেকে। ঋজুদার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধোলাম, কলকাতার খবর সব ভাল?

মাথা হেলিয়ে ঋজুদা বলল, ভাল।

তারপর আবার পাইপ টানতে লাগল।

ভটকাইকে বললাম, কনগ্রাচ্যুলেশনস ভটকাই। কাগজে তোর ছবি বেরয়নি? শিকারে এসে রংরুট শিকারি অ্যাকাউন্ট-ওপেন করল বিভীষিকা-জাগানো মানুষখেকো বাঘ দিয়ে!

ভটকাই টাগরায় জিভ দিয়ে চুক-চুক করে শব্দ করল একটা। বলল, ব্যাপারটা গুবলেট হয়ে গেছে। যা ভাবছিস তা নয়।

বিছানাতে উঠে বসতে গেলাম উত্তেজিত হয়ে এবং উঠতে গিয়েই বুঝলাম যে ডানহাতের চোটটা বেশ ভালই। কত টিস্যু, নার্ভ আর ফিলামেন্ট যে ছিঁড়েছে তা ডাক্তাররাই জানেন! আবার শুয়ে পড়লাম। নার্স বললেন, ওঠাউঠি একদম চলবে না। ঘা শুকোতে তাহলে সময় বেশি লাগছে। বাঘের থাবা খেয়ে মানুষ বাঁচে না। আপনার বরাত ভাল।

ঋজুদা সায় দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই ভাল। কোনো সন্দেহ নেই।

নার্স বললেন, আমি একটু আসছি।

–হ্যাঁ। আমরা আছি তো।

দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি। তারপর আপনাদের চলে যেতে হবে। আমি পেশেন্টকে ঘুমের ওষুধ দেব।

নার্স চলে যেতেই ঋজুদা বলল, ভটকাই অ্যাকাউন্ট ওপেন করেছে বাঘ দিয়েই, সন্দেহ নেই, কিন্তু নিনিকুমারীর বাঘ মারা পড়েনি।

আবারও আমি উঠে বসতে গেলাম এবং আবারও শুয়ে পড়লাম।

বললাম, কী বলছ! আমি যে নিজের চোখে দেখলাম বাঘের পায়ের দাগ, শিকার-গড়ের নহবতখানাতে তার শুয়ে থাকার চিহ্ন।

–ঠিকই দেখেছিস।

তবে?

মনে হয়, নিনিকুমারীর বাঘ নহবতখানা থেকে নেমে শিকার-গড় ছেড়ে বিটারদের লাইনের সমান্তরালে হেঁটে তাদের নজরের বাইরে চলে গেছিল তারপরেই। এরকম ধূর্ত বাঘ খুবই কমই দেখেছি।

–তবে ঐ বাঘটা কোথা থেকে এল?

–এল। তবে কোত্থেকে তা বলতে পারব না। তোকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়তে হল যে তার খবর আর নিতে পারিনি। আগে কুচিলাখাঁইয়ের বাংলোতে ফিরি। তারপর আবার তার খোঁজ নেওয়া যাবে।

–এ কী পি. সি. সরকারের ম্যাজিক নাকি?

–প্রায় সেরকমই ব্যাপার।

ঋজুদা বলল।

এদিকে সবাই যে ভাবল নিনিকুমারীর বাঘ মারা পড়েছে। লোকেরা যে অসাবধানী হয়ে যাবে। বাঘ তো পটাপট মানুষ মারবে।

মেরেছে।

 মুখ নিচু করে ঋজুদা বলল। তুই এরকম আহত না হলে প্রথমেই বাঘটাকে পরীক্ষা করতাম ভাল করে। বাঘের দিকে তাকাবার সময়ই পাইনি তখন। আর সে তো বাঘ ছিল না, ছিল বাঘিনী। প্রথমবার তখন কাভার ব্রেক করে নদীতে ঝাঁপাল, আর ভটকাই গুলি করে দিল হড়বড়িয়ে, তখনই আমার একবার সন্দেহ হয়েছিল যে, সাইজে নিনিকুমারীর বাঘের মত হলেও এ বাঘিনী, বাঘ নয়। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে তো বাঘের কাছে যাওয়ার সময়ই পেলাম না আর।

তুমি গুলি করলে না কেন?

 ঋজুদাকে শুধালাম আমি।

ভটকাই উত্তেজিত হয়ে বলল, গুলি ফুটল না। করেছিলো রে গুলি, ঋজুদা।

-বলিস কি?

 ঋজুদা বলল, তাই। অনন্তবাবু নিজে গুলি দিয়েছিলেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া আর্মস কোম্পানির গুলি ফোটেনি কখনও এমন হয়নি। সে গুলির ক্যাপে স্যাঁতলাই পড়ে যাক আর পেতলের ক্যাপ কালোই হয়ে যাক। কিন্তু ফুটল না। ডাবল ব্যারেল রাইফেল নিয়ে গেছিলাম সেদিন। জানিসই তো! একটা ব্যারেলের গুলিও ফায়ার হল না!

আমার মাথার মধ্যে ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল। বললাম, ঠাকুরানীর বাঘ তাহলে কি সত্যি?

–যাই ঘটে থাকুক, আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। বিশ্বল সাহেবকে বলে কলকাতায় লোক পাঠিয়েছি চিঠি দিয়ে, একেবারে ফ্রেশ গুলি নিয়ে আসার জন্যে। অনন্তবাবুকে সব ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখেছি।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, জিম করবেট-এর বইয়েতেও তো টেম্পল টাইগারের কথা আছে। জিম করবেটও কি মিথ্যেবাদী?

তা বলে আমাদেরও কি এসব আনক্যানি ব্যাপার বিশ্বাস করতে হবে?

ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম।

 বিশ্বাস না করতে হলেই খুশি হব। তবে কী জানিস? বনে-জঙ্গলে প্রান্তরে-পাহাড়ে কখনও কখনও অনেক ঘটনা ঘটে, পৃথিবীর সব জায়গাতেই, যার ব্যাখ্যা বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে করা যায় না। কলকাতার চোখ ধাঁধানো আলোয় রাস্তায় বা বাড়িতে বসে এই সব ঘটনা বা দুর্ঘটনা, যাই বলিস, সহজেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু যাঁরা এইরকম পরিবেশে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন, জিম করবেট-এর মত, তাঁদের কথা চট করে মিথ্যে বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।

এটা হয়ত পুরোই কাকতালীয় ব্যাপার। আমি বললাম।

কোয়াইট লাইলি। আমারও তাই মনে হয়। তবে ব্যাপার যাই হোক, আমি নিনিকুমারীর বাঘের শেষ না দেখে ফিরছি না। হয় বাঘের শেষ, নয় আমার।

বল, আমাদের। ভটকাই মুরুব্বীর মত বলল।

 আমি থাকতে তোদের কিছু হলে তো কলকাতায় ফিরে মুখ দেখাতে পারব না।

 ভটকাই বলল, সবে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাই লাজ।

 বড় ফাজিল হয়েছে। এখন কিছু বলাও যায় না। বাঘের গা থেকে রক্ত ঝরিয়েছে ও-ই প্রথম। বাঘ শিকারি তো হয়েছে! কিন্তু এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ মানুষখেকো বাঘ শিকারে ভাবাই যায় না।

ভাবলাম আমি।

 ঋজুদা যেন আমার মনের কথা বুঝেই বলল, তবে ভটকাইকে তার বাঘের চামড়া সমেত পাঠিয়ে দিচ্ছি কলকাতাতে। ওর পুরস্কার যেমন পেয়েছে, শাস্তিও ওকে পেতে হবে। শিকার এবং মানুষখেকো বাঘ শিকার যে ছেলেখেলা নয় তা ও এখনও বুঝতে পারেনি। তুই না ভাল হয়ে ওঠা পর্যন্ত ও অবশ্য আমার সঙ্গেই থাকবে, কিন্তু জঙ্গলে যাবে না। বাংলোতেই থাকবে।

ভটকাই-এর মুখ কালো হয়ে গেল। মুখ নামিয়ে নিল ও। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বিশ্বাস কর রুদ্র, আমি কিন্তু গুলি করিনি।

একথা ঋজুদাকেও বলেছি। ঋজুদা বিশ্বাস করেনি।

তবে কে করেছে? তুই গুলি করিসনি মানে?

অবাক হয়ে বললাম আমি।

বিশ্বাস কর, কে যেন আমার পেছন থেকে দুহাতে আমার হাতের বন্দুক তুলে ধরে আমার আঙুল দিয়ে ট্রিগার টানিয়ে দিল। আমি কিছু জানবার আগেই।

গুল মারিস না। আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, ভটকাই বড় হলে ভারতীয় রাজনীতিক হবে। সিচুয়েশনের এমন অ্যাডভান্টেজ রাজনীতির লোক ছাড়া আর কেউই নিতে পারে না।

এমন সময় নার্স এসে বললেন, এবার তো আপনাদের উঠতে হবে।

 আমিও ভাবছিলাম, এবার ঋজুদারা গেলেই ভাল। একে শরীরের এইরকম অবস্থা, তার ওপর যা শুনলাম তাতে মাথা একেবারে ভোঁ ভোঁ করছে। এখন সত্যিই ঘুমের দরকার।

ঋজুদা উঠল।

বলল, চলি রে! ঝাড়সুগুদাতে থেকে তোর দেখাশোনা করতে পারলে ভাল হত কিন্তু ওদিকে তো অবস্থা সঙ্গীন। ভটকাইকে তোর দেখাশোনাতে রেখে যেতে পারতাম কিন্তু ওকে হয়ত দরকার হতে পারে। ডঃ মহাপাত্রকে সবই বলা আছে। বলছেন, পনের দিন। কিন্তু আর দশদিনের মধ্যেই হয়ত তুই কুচিলাখাঁই বাংলোতে ফিরে যেতে পারবি। ডঃ মহাপাত্রের মেয়ে তোকে বই-টই পড়তে দেবে। ভারী স্মার্ট মেয়ে। এবারে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। বই-টই পড়ে, ঘুমিয়ে গায়ে জোর করে নে। অনেক খাটনি আছে পরে।

আমি বললাম, তুমি ইতিমধ্যেই নিনিকুমারীর বাঘকে মেরে দেবে না তো?

প্রার্থনা কর, তাই যেন হয়। এখান থেকে মানে মানে ফিরে যেতে পারলে কাজ শেষ করে, অ্যাডভেঞ্চার করার সুযোগ জীবনে অনেকই আসবে তবে কী হবে শেষ পর্যন্ত জানি না। তবে ওড়িশা সরকারের বিভিন্ন স্তরের আমলারা যে সম্মান ও সহযোগিতা আমাদের দেখালেন ও দিলেন তার কথা মনে রেখেই আমাদের করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে-তে বিশ্বাস করতেই হবে। নিনিকুমারীর বাঘ নিয়ে ওড়িশা বিধানসভায় ও দিল্লি সংসদেও প্রশ্ন উঠেছে।

চলি রে রুদ্র।

 ভটকাই বলল।

 ঋজুদা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, সব বন্দোবস্তই করা আছে। ঠিক সময়মত গাড়ি করে ওঁরা নিজেরাই তোকে পৌঁছে দেবেন। চীফ-সেক্রেটারি নিজে যেখানে যেখানে বলবার বলে দিয়েছেন। কলকাতায় তোর মায়ের সঙ্গে আমি গতকাল রাতে কথা বলেছি। তুইও একটু ভাল হলে এখান থেকেই কথা বলতে পারিস। আমি বলে গেলাম।

মা জানে?

 হ্যাঁ।

কী বলল মা?

বলল, রুদ্রকে বোলো ঋজু, যেন খালি হাতে না ফেরে! বাঘ মেরে যেন ফেরে। আমার একমাত্র সন্তান ও। কিন্তু ওকেও একদিন মরতে হবে। মৃত্যু অমোঘ। কিন্তু হার নয়। হেরে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেকই বেশি সম্মানের।

তাই?

ইয়েস্।

ভটকাই বলল। আমিও কথা বলেছি।

আমার গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে এল।

গর্ব? নিজের জন্যে? না মায়ের জন্যে। বুঝলাম না।

.

০৭.

আমি যখন সুস্থ হয়ে কুচিলাখাঁই বাংলোতে ফিরে গেলাম ততদিনে নিনিকুমারীর বাঘ আরও তিনজন মানুষ খেয়েছে। একজন মেয়ে এবং দুজন ছেলে। ঋজুদার কাছে খবর এসেছিল অনেক দেরিতে। তিনটে গ্রামের দূরত্বই কুচিলাখাঁইয়ের বাংলো থেকে অনেক দূরে। জিপ যাওয়ার রাস্তাও নেই। তাছাড়া দেরিতে খবর পাওয়ার ফলে সেসব জায়গাতে গিয়ে কোনও লাভ হত না।

প্রথম দিন রাইফেল এবং বন্দুক ছুঁড়ে দেখলাম যে ঠিকমত হোল্ড করতে পারছি কি না। হঠাৎ এক ঝটকাতে তুলে নিয়ে গুলি করতে গেলে হাতে লাগছে কি না?

ঋজুদা বলল, তুই তোর ডান কাঁধের ওপরে একটা মাফলার ভাঁজ করে রেখে তার উপরে চামড়ার জার্কিনটা পরে নে। তাহলে ব্যথা করবে না। তাই করে সত্যিই ভাল ফল হল।

বিশ্বল সাহেব এসেছিলেন বিকেলে। তাঁর সঙ্গেও অনেক পরামর্শ হল।

ঋজুদা বলল, যা বুঝছি তাতে বাঘের কিল্-এর অপেক্ষায় থাকলে আর চলবে না। আমাদেরই বাঘকে খুঁজে বের করতে হবে। সাম্বপানি থেকে খবর এসেছে যে বাঘ আর শিকার-গড়ে আসেনি তারপর। সে ডেরা বদলেছে। এবং ডেরা বদলেছে বলে তাকে এখন খুঁজে বের করা খুব মুশকিল হবে। সুতরাং দুটো ন্যাপস্যাকে গুলি, ছুরি, টর্চ, জলের বোতল, কিছু শুকনো খাবার, চিড়ে গুড় আর চা চিনি নিয়ে আমাদের বেরতে হবে। জঙ্গলেই থাকতে হবে। খাবার ফুরিয়ে গেলে জঙ্গলের মধ্যে যদি গ্রাম পাওয়া যায় তবে সেখানে ডালভাত যা জোটে তা খেয়ে আবার জঙ্গলে ফিরে যেতে হবে। ঐভাবে ঘুরতে ঘুরতে যদি কোনও ফ্রেশ কিল পাওয়া যায় অথবা অন্যভাবে বাঘের মুখোমুখি হওয়া যায়, তাহলে একটা চান্স পেলেও পাওয়া যেতে পারে। অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স-এই পলিসি নিতে হবে আমাদের। ভটকাই থাকবে এই বাংলোতে। বলভদ্রবাবু আমাদের জিপে করে যতখানি সম্ভব এগিয়ে দিয়ে যে গ্রাম অবধি জিপ পৌঁছয় সেখানেই থাকবেন ক্যাম্প করে। বিশ্বল সাহেবকে বলে তাঁর ছুটির বন্দোবস্তও করে নিয়েছে ঋজুদা। তারপর দেখা যাবে কী হয়!

আগামীকাল ভোরে হেভি ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরিয়ে পড়ব।

ভীমগদা বলে একটা গ্রাম আছে কুচিলাখাঁইয়ের উত্তরে। মাইল পনেরো পথ। সেইখানে পৌঁছে জিপ ছেড়ে আমরা জঙ্গলে ঢুকব। শেষ কি যেখানে হয়েছে সেখান থেকে ভীমগদা গ্রাম মাইল পাঁচেক দক্ষিণে। উত্তরে আমাদের হেঁটে যেতে হবে সেই পাঁচ মাইল। প্রয়োজনে রাতটা ভীমগদাইে কাটাব। যদি জঙ্গলে থাকার কোনও অসুবিধে থাকে।

রাতে পেট ভরে মুগের ডালের খিচুড়ি খাওয়া হল। দারুণ বেঁধেছিল জগবন্ধু। সঙ্গে আলু ও বেগুন ভাজা, শুকনো লঙ্কা ভাজা। খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে জবজবে করে মাখা খিচুড়ি।

ভটকাইকে যে সত্যিই বাংলোতে থাকতে হবে একথা ও তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না।

ঋজুদা বলল, ভাবিস না যে আমরা যখন বাঘের খোঁজে বনজঙ্গল তোলপাড় করব তখন বাঘ তোর সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসবে না। সাবধানে থাকবি। বন্দুক লোড করে সবসময় হাতের কাছে রাখবি। রাতে, দরজা জানলা ভাল করে বন্ধ করে শুবি। বলভদ্রবাবু রোজ একবার করে এসে তোর খোঁজ নিয়ে যাবেন আর আমাদের জন্যে কিছু টাটকা ডিম, তরি-তরকারি নিয়ে যাবেন। যদি আমরা ঘুরতে ঘুরতে ভীমগদাতে চলে আসি তাহলে ভালোমন্দ খেয়ে একটু মুখ বদলানো যাবে।

শেষ রাতের দিকে জোরে বৃষ্টি এল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ভোরবেলা দরজা খুলে দেখি নানারঙের ঝরাপাতা আর মরা পাখিতে চারধার ছেয়ে গেছে। শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। বাংলোর টালির ছাদে চটাপট করে শব্দ শুনেছিলাম সে জন্যে।

চান করে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বলভদ্রবাবুও সঙ্গে এলেন। বালাবাবু রইলেন অন্য জিপটা নিয়ে ভটকাইয়ের লোকাল গার্জেন হিসেবে।

পথটা শুধুই চড়াইয়ে চড়াইয়ে উঠেছে। সকাল নটাতে কনকনে হাওয়া জার্কিনের কলার তুলে দেওয়া সত্ত্বেও কান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। ঝকম করছে নীল আকাশ। পাহাড়ী বাজ উড়ছে ঘুরে ঘুরে। ঋজুদার পাইপের টোব্যাকোর গন্ধটা শীতের বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। একটা গুরান্টি হরিণ দৌড়ে পথ পেরল। তারপরই একদল চিতল হরিণকে দেখা গেল পাহাড়ের ঢালে বৃষ্টি ভেজা ঘাস খাচ্ছে পটপট করে ছিঁড়ে। চলন্ত জিপ দেখেও তারা পালাল না। মুখ তুলে চাইল শুধু।

গ্রামটার নাম ভীমগদা কেন?

বলভদ্রবাবু বললেন এখানে নাকি ভীমের গদা পড়েছিল। মন্দিরও আছে একটা। ভীম-মন্দির। যখন বাঘের উপদ্রব ছিল না তখন প্রতি বছর চৈত্র মাসে এখানে প্রকাণ্ড মেলা বসত চৌঠা বৈশাখ। যাত্রা হত। রুপোর গয়না, পেতলের বাসন-কোসন, ঝাঁটা, চাদর, ধুতি, শাড়ি, জামা, গুলগুলা আর পোড়পিঠার দোকান বসত। দেখবার মত। এখন বাঘটা এই পুরো অঞ্চলের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, আমোদ-প্রমোদ, সাধ-আহ্লাদ সব মাটি করে দিয়েছে।

গ্রামটা একটা পাহাড় চুড়োয়। গোটা পনেরো ঘর। সজনে গাছ। আম। কাঁঠাল। হলুদ সর্ষে ক্ষেত। মাটির দেওয়ালে লাল হলুদ আর সাদা রঙের নানারকম ছবি। এখানকার বাসিন্দারা জাতে খড়িয়া। সুন্দর বলে এদের খুব নামডাক আছে। যেমন ছেলেরা, তেমনই মেয়েরা। তবে তাদের মূল বাস অনেক দূরে। বছর পঞ্চাশ আগে একটি দম্পতি এসে ঘর বানিয়েছিল এখানে। কোনো সামাজিক অপরাধে অপরাধী হওয়ায় তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মূল বাস থেকে। তাদেরই ছেলে মেয়ে বউ জামাই নিয়ে এ গ্রাম। এখন আর খাঁটি খড়িয়া নেই তারা। ছেলেদের বৌ আর মেয়েদের জামাই এসেছে অন্য গোষ্ঠী থেকে।

পাহাড় চুড়োয় পৌঁছে বলভদ্রবাবু মোড়লকে ডেকে বাঘের খোঁজখবর নিলেন। মোড়ল বলল, বাঘ পরশু রাতে খুব ডাকাডাকি করছিল। তবে সে বাঘ নিনিকুমারীর বাঘ কি না তা বলতে পারবে না। এখন সব বাঘই সমান ভয়ের এদের কাছে।

একজন বলল, গাঁয়ের গরু মোষ যে বাথানে থাকে তার কাছে এসেছিল বাঘ। মোষেদের ক্রুদ্ধ গর্জনও শোনা গেছিল। প্রায় আধঘণ্টা ডাকাডাকি করে তারপর বাঘ ফিরে গেছিল। বাথানের মধ্যে ঢোকার সাহস পায়নি। তাছাড়া বাথানের কাছে গিয়ে আমরা দেখলাম যে মোটা মোটা ডবা বাঁশ দিয়ে বেড়া দেওয়া খুবই শক্ত পোক্ত করে। বাঘের পায়ের দাগ হয়ত দেখা যেত কিন্তু গত রাতের বৃষ্টিতে সব ধুয়ে মুছে গেছে। ওরা কিছু আনাজের চাষ করেছিল পাহাড়ের পেছনের ঢালে। তারও ক্ষতি হয়েছে খুব শিলাবৃষ্টিতে। তার ওপরে এই অসময়ের শিলাবৃষ্টি। লোকগুলো খুবই মনমরা হয়ে বসেছিল।

পাহাড় চুড়োয় দাঁড়িয়ে পরশু রাতে আসা বাঘ কোনদিকে গেছিল তার একটা আন্দাজ দিল মোড়ল। আমাদেরও এখন ওদের মতই অবস্থা। কোনো বাঘকেই তাচ্ছিল্য করার উপায় নেই। যে কোনো বাঘের হদিস পেলেই যাচাই করে দেখতে হবে সে নিনিকুমারীর বাঘ কি না।

পাইপে নতুন করে তামাক ভরে নিয়ে ঋজুদা বলল, চলি বলভদ্রবাবু। কোনো খবর থাকলে জানাবার চেষ্টা করবেন। বাঘকে পেলে আর আমাদের ডাকার অপেক্ষায় থাকবেন না। কে মারলো সেটা বড় কথা নয়। এই বাঘ মারা পড়াটাই সবচেয়ে জরুরী।

উনি মাথা নাড়লেন।

ঋজুদা বলল, চল্ রে রুদ্র।

ন্যাপস্যাকটা পিঠে বেঁধে নিয়ে রাইফেল কাঁধের ওপর শুইয়ে এগোলাম ঋজুদার সঙ্গে।

আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পেছনের উপত্যকাতে নেমে চললাম। পিটি-টুই, পিটি-পিটি-পিটি-টুই আওয়াজ করে একটি টুই পাখি, সবুজ টিয়ার বাচ্চার মত, ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে। পাখিটার নাম আমি দিয়েছি টুই। আসল পাখিটা যে কি ঋজুদার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।

পাহাড়ের এই ঢালে বেশিই হরজাই গাছের জঙ্গল। ঝোপ ঝাড়। অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গা। কিছুক্ষণ হল জলের ঝরঝরানি শব্দ কানে আসছিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মাঝামাঝি নামতেই হঠাৎ চোখে পড়ল জলপ্রপাত। কাল সারা রাতের বৃষ্টিতে নতুন করে জোরদার ঢল নেমেছে তাতে। প্রপাতটি প্রায় শ-দুয়েক ফিট উপর থেকে পড়ছে। চওড়াতেও নেহাত কম নয়। নিচে একটি দহর মত সৃষ্টি করেই নদী হয়ে বয়ে গেছে কনসরে গিয়ে মিলবে বলে। প্রপাতের নিচের খাদে গভীর জঙ্গল। বড় বড় ডবা বাঁশের। ঝাড়। নলা বাঁশ ও কন্টা বাঁশও আছে। একই জায়গায় যা সচরাচর দেখা যায় না। বহু। প্রাচীন, প্রায় প্রাগৈতিহাসিক জংলি আম এবং কাঁঠালের গাছ। প্রায় আধ বর্গমাইল। জায়গাতে জঙ্গল এখানে এতই ঘন যে একেবারে চন্দ্রাতপের মত সৃষ্টি হয়েছে। নানা পাখির ডাক ভেসে আসছে প্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে।

ঋজুদা বলল, আশ্চর্য! এরা তো কেউই আমাদের এ জায়গাটির কথা বলল না। অথচ এই এলাকাতে এই প্রপাত এবং প্রপাতের নিচে জঙ্গলটি নিঃসন্দেহে একটি আশ্চর্য ল্যান্ডমার্ক। বাঘের থাকার আইডিয়াল জায়গাও বটে!

আমি বললাম, আমাকে বলেছিল।

কে?

ভটকাই।

ভটকাই? জানল কি করে ও?

 ওকে জগবন্ধুদা বলেছিল।

কী বলেছিল?

 বলেছিল ভীমগদা পাহাড়ের পেছনের ঢালে একটি মস্ত প্রপাত আছে এবং নিচের ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গলে হাতিডিহ।

কি?

হাতিডিহ। হাতিদের থাকার জায়গা। ওখানে নাকি মা-হাতিরা এসে বাচ্চা হওয়ার সময়ে থাকে।

আমরা কথা বলতে বলতেই হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে হাতির বৃংহণের শব্দ ভেসে এল। প্রপাতের আওয়াজ ছাপিয়ে পাখিদের মিশ্রস্বর ডুবিয়ে প্রচণ্ড জোরে হাতি বারবার বৃংহণ করতে লাগল। মনে হল, কোনো বাচ্চা ছেলে দানবের মত দেখতে কোনো মার্সিডিস ট্রাকের সীটে উঠে অনেকক্ষণ ধরে মার্সিডিস-এর এয়ার-হর্নটি টিপে রয়েছে।

ঋজুদা একটু আশ্চর্য হল। বলল, এই ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে এমন একটি জায়গা যে আছে সে কথা বালাবাবু, বলভদ্রবাবু এবং বিশ্বলবাবুরা জানালেন না কেন আমাকে?

জানাননি, তার কারণ আছে। ওরা নিজেরা জানলে তবে না জানাবেন। জগবন্ধুদার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভীমগদাতে তাই তার যাতায়াত ছিল এখানে। ভীমগদার মানুষেরাই শুধু জানে এই প্রপাতের কথা। প্রপাতটির নাম হচ্ছে বাঁশপাতি। নদীর নামও তাই। আর খাদের গহন উপত্যকার নাম হাতিডিহ। ভটকাইকে জগবন্ধুদাই বলেছিল। হাতিডিহ এবাং বাঁশপাতি নদীর কাছেও কোনো মানুষ আসে না। এসব পবিত্র স্থান। ঈশ্বরের স্থান। বাঁশপাতির নদীর জলে ভীমগদার কোনো লোক পা দেয় না। ভীম নাকি এ প্রপাতের নিচের দহতে গণ্ডুষ ভরে জল পান করেছিলেন একসময়।

ঋজুদা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, কোন্ সময়?

 তা আমি জানি না।

ঋজুদা চাপা গলাতেই ধমক দিয়ে বলল, আমাদের দেশের বন-পাহাড়ের গাঁ-গঞ্জের লোক না হয় যা খুশি তাই বিশ্বাস করতে পারে। তা বলে তুইও বিনা প্রশ্নে, বিনা যাচাইয়ে যা শুনবি তাই বিশ্বাস করে নিবি?

আমি লজ্জিত হলাম।

তারপর বললাম, রামায়ণ সিরিয়ালের যা এফেক্ট হবে দেখবে। এবার শহরের লোকেরাও সব বিশ্বাস করবে।

রামায়ণ মহাভারত থেকে শেখারও অনেক আছে। কিংবদন্তী ও কল্পনাটা বাদ দিয়ে শেখারটুকু শিখলে ক্ষতি কি? তাছাড়া এই যে পুষ্পকরথ, নানারকম সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক সব বাণ, এসব তো আজকের দিনে সত্যি হয়েছে। নানা আকারের নানা সাইজের জেট প্লেন, নানা ধরনের মিসাইলস্ এসব তো আর কল্পনার নয়। আমাদের দেশ হয়ত এক সময় রাশিয়া, আমেরিকা, পশ্চিম জার্মানি এবং চীন থেকে অনেকই এগিয়ে ছিল এইসব ক্ষেত্রে। কে বলতে পারে!

আমি বলতে গেলাম

ঋজুদা বাধা দিয়ে বলল, জায়গাটা একটু ইনভেস্টিগেট করে আসি। বলেই, নামতে লাগল উৎরাই বেয়ে। এদিক দিয়েই তাও নামা যায়, ওদিকে একবারেই খাড়া নেমেছে পাহাড়। নানা লতা গুল্ম অর্কিড়ে ছাওয়া তার গা। মাঝে মাঝে লাল ক্ষতর মত দগদগে পাথর দেখা যাচ্ছে। লৌহ-আকর।

ঋজুদা বলল, দ্যাখ কোন্ সময়ে কেউ হয়ত এখানে ওপেন-পিট মাইনিং করে লোহা বের করতে চেষ্টা করেছিল।

আমি বললাম লৌহ আকর তো এমনিই খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে, ম্যাঙ্গানিজও তাই, কয়লা বা অভ্রখনির মত তো সুড়ঙ্গ বা ইনক্লাইন মাইন করতে হয় না।

লজ্জা পেয়ে ঋজুদা বলল, ঠিক বলেছিস। আমি ভুল বলেছিলাম।

ঋজুদার এই একটা মস্ত গুণ। কখনই দোষ করলে অস্বীকার করে না। জীবনে যারা বড় হয় তাদের সকলেরই বোধহয় এই গুণটি থাকে।

সবাধানে নিচে নামতে লাগলাম আমরা। ওদিকে হাতির বৃংহণ শব্দ বেড়েই চলতে লাগল কিছুক্ষণ যতির পর। এবং সেই যতি কিন্তু একেবারে নির্ভুলভাবে দেওয়া হচ্ছিল।

ঋজুদা বলল, আশ্চর্য? এমনটি কখনও শুনিনি কোনো জঙ্গলেই। তবে একথা ঠিক এমন ঘটনার কথা বছর তিরিশ আগে বেঙ্গল ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে বাবার আনা একজন আফ্রিকান হোয়াইট হান্টারের লেখা বইতে পড়েছিলাম। উনি জাম্বেসী নদী, লেক নিয়াসা এই সব অঞ্চলে শিকার করতেন। ভদ্রলোকের নাম ছিল গাই মলডুন। রাল্ফ থমসন বলে একজন শিল্পীর আঁকা চমৎকার সব ছবিও ছিল সেই বইটিতে। বইটির নাম দ্যা ট্রাম্পেটিং হার্ড। তার মধ্যে একটি অধ্যায় ছিল আ ক্লোজলি গার্ডেড সিক্রেট হাতি-মায়েদের লুকিয়ে থাকার জায়গা ছিল তা। আফ্রিকানরাও কিন্তু বিশ্বাস করতো। এই অন্ধকার গা-ছমছম পবিত্র জায়গা থেকে হাতিদের বৃংহণ শুনলে তারা ভাবত কোন আধিভৌতিক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। সমস্ত গ্রামের মানুষ রুদ্ধশ্বাস-ভয়ে অপেক্ষা করত কখন ঐ অবিরত গর্জন থামে। কোনো বাড়িতে রান্না হত না। ছেলেমেয়রা ভয়ে খেলত উঠোনে কি ধূলিমলিন পথে। গাঁয়ের মুরগিগুলো পর্যন্ত কঁক কঁক করতে ভুলে যেত।

আমি বললাম, একটু বাঁ দিক ঘেঁষে চল। হাতির দল যদি থাকে ওখানে তো আমাদের দেখতে পাবে সোজা গেলে।

ঋজুদা বলল, চল তাই। তবে সম্ভবত হাতির দল ওখানে নেই। আছে কয়েকটি মেয়ে হাতি যারা মা হবে। একটি দুটি বুড়ি হাতিও থাকতে পারে সঙ্গে। তারা ধাইমা।

আমি বললাম, নিনিকুমারীর বাঘ ফেলে তুমি এখন হাতিদের মায়েদের দিকে চললে?

ঋজুদা বলল, নিনিকুমারীর বাঘ তো আমাদের তার বাড়ির নাম্বার বা রাস্তার নাম দিয়ে যায়নি। জঙ্গলে যখন তখন যা কিছু ঘটতে পারে। কোথায় যে কার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানাই নেই। বাঘ যে হাতির বাচ্চা খেতে খুব ভালবাসে তা বুঝি জানিস না? অমন নধর মাংস। গাবলু-গুবলু। শুঁড়ও তখনও নরমই থাকে। হাতির বাচ্চা হচ্ছে বাঘের রসগোল্লা।

তাই?

হ্যাঁ। সাবধানে দেখে নাম। পড়ে যাবি পা হড়কে। পাথর ঘাস সব যে ভিজে আছে এখনও।

কিছুটা নেমেই ঋজুদা নিবে-যাওয়া পাইপটা থেকে ছাই ঝেড়ে ফেলল এমনভাবে, যাতে হাওয়া কোনদিকে তা বোঝা যায়। হাওয়া ওদিক থেকেই এদিকে আসছিল।

ঋজুদা বলল, বাঁচা গেল। হাতিদের দৃষ্টিশক্তি তেমন ভাল না। কিন্তু ঘ্রাণশক্তি সাঙ্ঘাতিক ভাল।

যতই আমরা নেমে সেই বাঁশপতির নদীর উপত্যকার কাছাকাছি আসতে লাগলাম ততই বন ক্রমশ ঘন থেকে ঘনতর হতে লাগল। আদিম সব গাছ। কসিস, মিটকুনিয়া নিম, জংলী আম এবং কাঁঠাল। নানারকম জ্বালকাঠ।

এদিকে হাতির বৃংহণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল।

 ঋজুদা বলল, খুব সাবধানে চল। আড়াল নিয়ে নিয়ে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে যখন আমরা নদীটা পেরিয়ে প্রায় নিচ্ছিদ্র জঙ্গলে ঢুকলাম, এদিকে বাঁশের বনও ছিল নানারকম; আগেই বলেছি; তখন মনে হল সামনে একটা গভীর গোলাকৃতি খাদ আছে। জঙ্গলে ভরা এবং অন্ধকার। এক এক পা করে আমরা খাদের ধারের কাছে গিয়ে লেপার্ড-কলিং করে এগোতে থাকলাম। নিঃশব্দে। ঋজুদা আমার আগে ছিল। হঠাৎ ডান হাতটা পেছনে প্রসারিত করে প্রায় শোওয়া অবস্থাতেই আমাকে আঙুল দিয়ে ইশারা করল। অতি সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি ছ’টি হাতি গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একটি হাতিকে। এবং তারা পালা করে শুড় সামনের দিকে সমান্তরাল রেখায় সোজা তুলে ডাকছে। মধ্যের হাতিটিও মাঝে মাঝে ডাকছে। আমাদের দেশে তো বটেই আফ্রিকাতেও এমন হাতির ডাক শুনিনি। ডাক শুনেই নাড়ি ছেড়ে যাবার উপক্রম হল।

অনেকক্ষণ আমরা তাদের ভাল করে দেখার পর আবার বুকে হেঁটে হেঁটে পেছোলাম। পেছিয়ে এসে আবার দাঁড়িয়ে উঠে আমরা সন্তর্পণে হাতিডিহকে পেছনে ফেলে এগোলাম।

বাঁশপাতি নদী পেরনোর পর ঋজুদা বলল, এরকম দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি তবে গাই মালড়ুনের বইয়ে এরই কাছাকাছি এক দৃশ্যের কথা ছিল। প্রকৃতির বুকের মধ্যে যে কতরকমই রহস্যই থাকে।

হাতিগুলোর একটারও দাঁত ছিল না কিন্তু। একটার ছিল ছোট দাঁত।

 সবকটিই যে মাদী হাতি।

 একটার যে দাঁত ছিল!

ওটিও মাদী। মাদী হাতিরও তো দাঁত থাকে। ভুলে গেছিস।

বাঁশপতি নদীকে ডাইনে রেখে আমরা নিনিকুমারীর বাঘের পায়ের দাগের জন্যে মাটিতে নজর রেখে চলতে লাগলাম। এ যেন খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা। এমনভাবে যেতে যেতে যে বাঘের পায়ের দাগ কখনও পাব তা আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ তা ছাড়া করারও কিছু ছিল না।

চল পাহাড়টা পেরিয়ে ওপারে যাই।

 চলো। বলে, আমরা আবার পাহাড় চড়তে লাগলাম।

পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছে দুজনেরই হাঁফ ধরে গেল। কতগুলো রক্-শেলটার ছিল সেখানে। ভীমবৈঠকার মত। তারই একটার নিচে বসা গেল। বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছিল সেই রক-শেলটারের ভেতর থেকে। আমার মনে হল গন্ধটা বাঘের গায়ের। বাদুড়ের বাসা থাকলেও অমন গন্ধ বেরোয়। কিন্তু সেখানে বাদুড় দেখলাম না।

ঋজুদা বলল আমরা ঘণ্টা তিনেক হল জিপ ছেড়েছি। মনে হচ্ছে কত যুগ হল। একটু চায়ের বন্দোবস্ত করতে পারিস? আমি আমার ন্যাপস্যাক নামিয়ে রেখে তার ওপর রাইফেলটা শুইয়ে রেখে কিছু খড়কুটো পাওয়া যায় কী না দেখতে যাব এমন সময় ঋজুদা বলল, রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে যা।

কয়েক গজ গেছি। শুকনো পাতা ও কাঠকুটো কুড়োচ্ছি আর আমার টুপির মধ্যে ভরছি নিচু হয়ে হয়ে। রাইফেলটা কাঁধে ঝোলানোই আছে। এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল আমাকে যেন কেউ আড়াল থেকে দেখছে। মনে হতেই, আমি স্থির হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মুহূর্তের মধ্যে রাইফেলটাকে হাতে নিলাম এবং ঠিক সেই সময় পাঁচ ছটা বনমুরগি ভীষণ ভয় পেয়ে আমার সামনে ডানদিকে ঘড়ির কাঁটা তিনটেতে যেখানে থাকে, সেই কোণ থেকে কঁককঁক করে একসঙ্গে উড়ে গেল। বড় বড় দাড়িওয়ালা হলদেটে বুড়ো প্রকাণ্ড একটা রামছাগল যেন মুখটা এক ঝলক একটা অর্গুন ঝোপের আড়াল থেকে আমাকে দেখিয়েই ছায়ার মত সরে গেল। আমি রাইফেল আনসেফ করে আস্তে আস্তে সেদিকে এক পা এক পা করে এগোলাম। পাতাপুতা খড়খুটো ভরা টুপিটা ওখানেই পড়ে রইল।

যেখানে মুরগিগুলো ছিল সেখানে পৌঁছে দেখলাম চারটে ডিম। কিন্তু সেই রামছাগলের মত জিনিসটা কি তা খোঁজার চেষ্টা করছি যখন দুচোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণতম করে তখন দেখলাম যে একটি বাইগবা গাছের আড়ালে আস্তে আস্তে প্রকাণ্ড একটি বাঘের পেছন মিলিয়ে গেল। ঋজুদাকে খবরটা দেবার জন্যে পেছন ফিরতেই দেখি ঋজুদা। আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

চা খাওয়া মাথায় উঠল আমাদের। আমি যথাসম্ভব নিঃশব্দে বড় বড় পা ফেলে গিয়ে আমার রাক-স্যাক আর টুপিটা ঝেড়ে ঝুড়ে তুলে নিয়ে এসে দেখি যে ঋজুদা এগিয়ে গেছে অনেকখানি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমি ঋজুদার পেছনে এগোলাম।

ঋজুদা কিন্তু ঐ বাইগবা গাছটা অবধি গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আমি গিয়ে পাশে, দাঁড়াতেই প্রায় তিনশো গজ দূরে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো। দেখি শকুন উড়ছে চক্রাকারে।

ঋজুদা বলল, চল্ ফিরে যাই। ঠাকুরানী যখন আন্ডাই সাপ্লাই করলেন তখন ওমলেট আর চা খেয়ে নিয়েই যা করার তা করা যাবে।

ফিরতে ফিরতে আমি বললাম, কি করবে?

ঋজুদা বলল ওমলেট আর চা খেয়ে বেলা তিনটে সাড়ে তিনটে অবধি এখানেই এই শেলটারে রেস্ট করব কারণ সারা রাত জাগতে হবে হয়ত আমাদের।

ব্যাপারটা কী হতে পারে আমি অনুমান করতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বললাম না।

ঋজুদাকে শুধোলাম, তুমি আমার পেছনে এলে কি করে?

 ঐ মুরগিগুলোর কঁকককানি শুনেই। ওদের ভাষায় কোনও অস্পষ্টতা ছিল না।

চা-টা বেশ ভালই বানিয়েছিলাম বেশি করে কনডেন্সড মিল্ক ঢেলে। আর ওমলেটও বানিয়েছিলাম ছোট সসপ্যানটাতে। লঙ্কা বা পেঁয়াজ ছিল না। শুধুই নুন।

ঋজুদা বলল, একটু চিঁড়ে ছেড়ে দে মধ্যে। লোকে চিকেন-ওমলেট খায় আমরা চিড়ে-ওমলেট খেলাম।

ঘড়িতে যখন সোয়া তিনটে তখনই ঋজুদা বলল, চল্ ওঠা যাক।

দুজনে আস্তে আস্তে পাহাড়টার ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম যেদিকে শকুনদের উড়তে দেখেছিলাম সেদিকে। কাক-উড়ানে চাইলে দূরত্ব বোঝা যায় না। উৎরাই অথবা চড়াইয়ে নামা ওঠার সময়ে পাথর ও কাঁটাঝোপ, খাদ ও খাড়া পাড় এড়িয়ে নামতে নামতে বা এগোতে এগোতে বোঝা যায় যে পথ কত দূরের।

ঘাড়ে রোদ পড়ছিল পেছন থেকে। বেশ আরাম লাগছিল। সমতলের একটু আগে পাহাড়ের ঢালের শেষভাগে এসে ঋজুদা ফিস্ ফিস্ করে বলল, তুই বাঁদিকের ওই পাথরটার আড়াল নিয়ে বসে সামনে নজর রাখবি। আমি ডান দিক দিয়ে ঘুরে জায়গাটাতে পৌঁছচ্ছি।

ঋজুদা ডানদিকে সরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেই আমি রাইফেল ডান ঊরুর উপরে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলাম। একটা পাথরে হেলান দিয়ে এবং শরীরটাকেও ঐ পাথরটার যতখানি সম্ভব আড়ালে রাখা যায় তাই রেখে। ঋজুদা চলে যাবার পরই লক্ষ করলাম যে আমি যেখানে বসে আছি তার হাত দশেক দূর দিয়ে একটা গেম-ট্র্যাক বা জানোয়ার চলা পথ বাঁদিক থেকে ডানদিকে গেছে। মনে হল ডানদিকে গিয়ে পথটা মিলেছে বাঁশপাতি নদীতে।

ঋজুদাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। হেমন্তর বিকেলের বনের স্তব্ধ ছায়া ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। হেমন্ত আর শীতের বেলা কিশোরীর কানের দুলের মত। কখন যে হঠাৎ পড়ে যায়, এক মুহূর্ত আগেও বোঝা যায় না। যাঁরা তা পড়তে দেখেছেন তাঁরাই শুধু জানেন।

আমার পেছনে একটা কুচিলা-খাঁই। গাছে বসে আরও অনেকগুলো কুচিলা-খাঁই বা গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিলস্ হ্যাঁক হ্যাঁক হুঁক্কো হুঁক্কো হুঁক্কো করে ডানা ঝটপট করতে করতে নড়েচড়ে বসে ঝগড়া করছে। সামনের ঢাল থেকে মাঝে মাঝে শকুনের ঝগড়ার আওয়াজ আসছে। শকুনরা এখন আর গাছে নেই। তার মানে বাঘ ধারেকাছে নেই মড়ির। কী মেরেছে বাঘ, তা কে জানে। শকুনদের আওয়াজ আসছে আমি যেখানে বসে আছি সে জায়গার বেশ দূর থেকে।

বসে আছি। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখছি খুব আস্তে আস্তে। আলো কমে আসছে। ঋজুদার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে জায়গামতো পৌঁছল কিনা কে জানে!

হঠাই আমার বাঁদিকে কোনো জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ হল। পাথরের আড়ালে বসে থাকায় আমার বেশ কাছে না এলে জানোয়ারটাকে দেখা যাবে না। তবে বাঘ বা হরিণ জাতীয় কোনো জানোয়ার বোধহয় নয়। পাথুরে জমিতে শোনা আওয়াজটা অন্যরকম। কিন্তু বেশ ওজন আছে জানোয়ারটার। আওয়াজটা জোর হতে হতে আওয়াজকারী আমার চোখের সামনে এল। মস্ত বড় একটা দাঁতালো শুয়োর। এত বড় দাঁতাল কমই দেখেছি। উচ্চতাতেও সে প্রায় বাঘের মত। আমাকে দেখতে পায়নি। হাওয়া আসছে উপত্যকা থেকে যদিও, তাকে যদি হাওয়া আদৌ বলা যায়। এই হাওয়াতে ঋজুদার পাইপের ধোঁয়াই সরে। একটুও ধুলোবালি বা রুমাল নড়ে না। প্রশ্বাসের চেয়েও হালকা হাওয়া। শুয়োরটা চলে গেল।

একটু পরে আবার শব্দ। অন্য কোনো জানোয়ার আসছে। এও বাঘ অথবা হরিণ জাতীয় নয়। এবং এও শুয়োরের চেয়ে ছোট জানোয়ার। আওয়াজ শুনে মনে হল বড় সাপ অথবা বেজি। অথবা শজারু কী গুরান্টি বা মাউস-ডিয়ারও হতে পারে। যখন পাথরের আড়ালে থাকা আমার সামনে সে এল তখন দেখলাম একটি মাঝারি আকারের শজারু। কাঁটাগুলো শোয়ানো আছে।

সেও নিজের মনে চলে গেল।

 ঠিক তখনই হঠাৎই শকুনরা যেখানে অদৃশ্য হয়ে (কিন্তু অশ্রাব্য হয়ে নয়) ছিল সেখানে। একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। পরক্ষণেই বড় বড় ডানাতে সপ্ সপ আওয়াজ করতে করতে তাদের বিচ্ছিরি দগদগে ঘা-এর মত লাল লম্বা গলা উঁচিয়ে পড়ি কি মরি করে তারা চারদিকের গাছে উঠে পড়ল। সেসব গাছে পাতা কম। একটা বাজ-পড়া পত্রশূন্য সাদা মসৃণ শিমুল গাছ ছিল। তাতেই উঠল বেশি। যেন বিনা পয়সার হোয়াইট-স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখবে।

ঋজুদাকে দেখে উড়ল কি? না অন্য কিছু দেখে? বাঘ দেখে? কে জানে?

শকুনদের হুড়োহুড়ি করে ওড়ার পরই সব আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনের রক-শেলটারের চারদিকে ঝাঁটি-জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে। সন্ধ্যে নামতে আর দেরি নেই খুব। ঘড়িতে দেখলাম সোয়া পাঁচটা বেজে গেছে। কী করে এতক্ষণ সময় যে কাটল বোঝা গেল না।

শকুনদের ঝাঁপাঝাঁপির আওয়াজের আড়ালে অন্য একটা সংক্ষিপ্ত আওয়াজ যেন চাপা পড়ে গেল মনে হল। আওয়াজটা কিসের এবং আদৌ কোনো আওয়াজ কিনা, তাও ঠিক বোঝা গেল না।

হেমন্ত এবং শীতের সন্ধ্যের মধ্যে এক ধরনের ভয়াবহতা থাকে। বিশেষ করে বনে-পাহাড়ে। মনে হয় নিজের জারিজুরি আর চলবে না। বনের হাতে বাঁধা দিতে হবে নিজেকে নিঃশর্তে। তবে পাহারাদারেরা হাত পা-বেঁধে কোনো অন্ধকার পুরীর উতলা রাজকন্যার কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলবে, তা অন্ধকারের চররাই জানে। আর মিনিট পনেরর মধ্যেই অন্ধকার ঘন হয়ে উঠবে। পশ্চিমাকাশে ধ্রুবতারাটা ইতিমধ্যেই পোলভল্ট চ্যাম্পিয়নের মত অন্য সব তারাদের মাথা ছাপিয়ে উঠে মৃদু সবুজ জার্সি পরে জ্বল জ্বল করছে। তারাটা দেখা যাচ্ছে একটা গেণ্ডুলি গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। কত রকম পাখি যে ডাকছে থেকে থেকে। কেউ একা, কেউ দোকা; কেউ দল বেঁধে। এই ওদের সন্ধ্যারতি। অন্ধকার থাকতে আবার আলোর স্তব করে সূর্যকে পথ দেখিয়ে ধরায় আনবে ওরা।

হঠাৎই আমার পেছন থেকে, যেদিকে রক-শেলটার, সেদিক থেকে একটা হায়না বুক কাঁপিয়ে ডেকে উঠল হাঁ হাঁ হাঁ করে। ডাকটা চমকে দিয়ে গেল।

এবারে ঝোলা থেকে টর্চটা বের করার সময় হয়েছে মনে হল। ঋজুদা যাওয়ার সময় এখানে বসে থাকতে বলে গেল অথচ সন্ধ্যে হলে কী করব বলে গেলো না। হয়ত ভেবেছিল, সন্ধ্যে হবার অনেক আগেই ফিরে আসতে পারবে।

সূর্য ডোবার পরও অনেকক্ষণ পশ্চিমাকাশে আলোর আভা থাকে। সূর্য তখনও ডোবেনি। আলো থাকবে আরও আধঘণ্টা মত। কী করছ ভাবছি, ঠিক এমন সময় শকুনদের ঝাপটা ঝাপটির আওয়াজ যেখান থেকে হয়েছিল সেইখান থেকে ঋজুদার রাইফেলের গদ্দাম আওয়াজ পেলাম।

গুলির শব্দ শুনেই মনে হল গুলি পাহাড়ে বা পাথরে বা মাটিতে পড়েছে। যার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া তার গায়ে রাইফেলের স্ট্রাইকিং পিনের শব্দ আর গুলি যেখানে লাগে তার শব্দ একসঙ্গে কানে এলে অনেক গুলি বিভিন্ন টার্গেটে ছুঁড়তে ছুঁড়তে সকলেরই এ সম্বন্ধে এক ধরনের ধারণা গড়ে ওঠে।

অধীর আগ্রহে আর উত্তেজনায় আমি তৈরি হয়ে বসে রইলাম। গুলি যদি ঋজুদা নিনিকুমারীর বাঘকেই করে থাকে এবং তা ঋজুদা মিস করে থাকে আর নিনিকুমারীর বাঘ এই গেমট্র্যাক ধরেই দৌড়ে আসে তবে আমার গুলি খেয়ে তাকে গেমট্র্যাকের উপরেই শুয়ে পড়তে হবে। আমার দশ হাত সামনে দিয়ে যাবে অথচ আমার গুলি খাবে না এরকম অতিথিপরায়ণতা ঋজুদা আমাকে শেখায়নি।

কিন্তু ঋজুদার গুলি আবারও মিস হল কেন?

এত সব ভাবনা কিন্তু ভেবে ফেললাম কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এবং যেমন ভেবেছিলাম, গুলির শব্দর সঙ্গে সঙ্গেই বাঘের প্রায় নিঃশব্দ-শব্দ শুনতে পেলাম গেম-ট্র্যাকের কাঁকরের উপরে। তবে দূরে। কিন্তু কয়েকটা লাফের পরই নিস্তব্ধ হয়ে গেল সে শব্দ। একেবারে মৃত্যুর মত নিঃস্তব্ধতা। বাঘ গতি পরিবর্তন করেছে।

আমি ভাবছি তার গায়ে ঋজুদার গুলি লাগেনি। কিন্তু আমার তো ভুলও হতে পারে! আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে অত্যন্ত ভয়মেশানো উত্তেজনা নিয়ে পেছনে তাকালাম আমি। আর পিছনে তাকিয়েই আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। যে পাথরে পিঠ দিয়ে আমি বসেছিলাম সেটা সোজা উঠে গেছে পৌনে তিন থেকে তিন মিটার। তার উপরে কিছুটা পাথর সমান। বাঘ যদি নিঃশব্দে আমার পিছনে এসে ঐ পাথর থেকে লাফিয়ে পড়ে তো আমি বোঝার আগেই সে আমার ঘাড়ে পড়ে টুঁটি কামড়ে ধরবে।

পিছনটা দেখে নিয়ে সামনে তাকাতেই গেম-ট্র্যাকে আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। উৎকর্ণ হয়ে রাইফেলের ট্রিগার গার্ডে হাত ছুঁইয়ে বসে রইলাম আমি। এমন জানোয়ারের শব্দ কখনও শুনিনি। সাবধানী পায়ে সে আসছে। থেকে থেকে। এসে গেল। এসে গেল। তর্জনীটিকে এমন জায়গায় রাখলাম যাতে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তা ট্রিগার টানতে পারে।

পরক্ষণেই আঙুল নামিয়ে নিলাম। ঋজুদা!

ঋজুদার রাইফেলটি কাঁধে ঝোলানো, আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়াল। বলল, চল্ ফিরে যাই। কলকাতায় ফিরে যাব। এই ভৌতিক ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই আর। চার মিটার দূর থেকে দিনের আলোয় ধীরে সুস্থে এইম নিয়ে মারা গুলি বাঘের বুকে লাগল না, লাগল বাঘ টপকে গিয়ে পিছনের পাথরের চাঁই-এ। আমি কি আনাড়ি? একবার নয়, দু’বার নয়, এতবার! না না আমি শিকারী। ওঝা নই। আমার দ্বারা এইসবের পিছনে লেগে থাকা আর সম্ভব নয়।

হতাশায় এবং নিজের উপর ঘেন্নায় গজগজ করতে করতে ঋজুদা আমার পাশে বসে পড়ে পাইপ ভরতে লাগল পাথরটাতে হেলান দিয়ে। যে পাথরে আমি হেলান দিয়ে বসেছিলাম, এতক্ষণ, সেই পাথরে।

বাঘটা এ দিকেই তো আসছিল! মনে হল পায়ের শব্দ শুনলাম। নিনিকুমারীর বাঘই। অ্যাবসল্যুটলি স্যুওর। নইলে তো গুলি খেয়ে সে বাঘ ওখানেই পড়ে থাকত। বাঘ যেদিকেই থাক আমি আর ইন্টারেস্টেড নই। আবার দেখতে পেলেও আমি মারব না।

ঋজুদা বসে পড়ল বলেই আমি ঋজুদার দিকে মুখ করে উঠে দাঁড়ালাম। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে যাবে। ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বড় একটা টান লাগালো। গোল্ডব্লক তামাকের মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল জায়গাটা।

আমি কিন্তু রাইফেল কাঁধে নিইনি। ডানহাতেই ধরা ছিল। ঋজুদার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই ভিতর থেকে, আমার ভিতর থেকে কে যেন বলল এই! এই! এই!

টুপি পরা ছিল আমার। এক-ঝটকায় মাথা তুলেই দেখি বাঘ যেখান থেকে আমার উপর লাফাতে পারে বলে ভেবেছিলাম ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিচে। সামনের হাঁটু দুটো ভাঁজ করছে আস্তে আস্তে। এইবার লাফাবে।

ধুত্তোর! নিনিকুমারীর বাঘের আজ এসপার কি ওসপার। এইরকম কিছু দাঁতে দাঁত চেপে বলেই আমি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে রাইফেল এক ঝটকাতে তুলেই গুলি করলাম। আমার বাঁহাত এসে পড়ে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের নলে লাগানো হোল্ডিংকে সাপোর্ট করার জন্যে। ততক্ষণে বাঘও লাফিয়েছে কিন্তু লাফাবার আগে আমার রাইফেলের গুলি গিয়ে লেগেছে তার গায়ে।

লাফাবার সময়ে তার আমাদের ধরার চেয়ে তার নিজের পালানোর ইচ্ছেটাই প্রবলতর ছিল বলে মনে হল। নইলে, সে আমাদের টপকে ঐ গেমট্র্যাকের দিকে মাটিতে নামত না। বাঘের লাফানোর সঙ্গে সঙ্গেই গোড়ালির ওপরে আমি ঘুরে গিয়েছিলাম। এবং সে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে আমাদের দিকে চার্জ করে আসার আগেই আমার দ্বিতীয় গুলি গিয়ে তার গলায় লেগে শ্বাসনালী ছিঁড়ে ঘাড় দিয়ে বেরিয়ে গেল। লাঠি-খাওয়া সাপের মত সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, তার স্পর্ধা-ভরা মাথা ধুলোয় লুটিয়ে। তারপর কাঁপলো কিছুক্ষণ থরথর করে। আমি বোল্ট টেনে রিলোড করে আরেকটা গুলি করতে যাচ্ছিলাম। ঋজুদা পিছন থেকে বললো গুলি নষ্ট করিস না, রুদ্র।

এত কাণ্ড যে ঘটে গেল, ঋজুদা কিন্তু তার পাশে শুইয়ে রাখা রাইফেলে হাত পর্যন্ত ছোঁয়ায়নি। তার বাঁ হাতটা ছিল মাথার পিছনে বালিশের মত করে রাখা। আর ডানহাত ছিল পাইপে।

ঋজুদা ডাকল। এদিকে আয়।

কাছে যেতেই আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে টেনে আমাকে বুকের মধ্যে নিয়ে টুপিটা এক উড়নচাঁটিতে ফেলে দিয়ে মাথার চুল টেনে আদর করে আমার মুখটা নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালে ঘষে দিল।

বললাম, দোষ আমার নয়।

কার?

–তোমার?

–মানে?

ভটকাই কিন্তু এসে অবধিই তোমাকে বারবার বলেছিল যে একটা পুজো দাও ঠাকুরানীর কাছে। ওর সব ইনফরমেশান আসে একেবারে হর্সেস মাউথ থেকে। ওর ইন্টেলিজেন্স ওয়ার্কের কোনও তুলনা নেই। ও আমাকে কিন্তু বলেছিল যে, এই বাঘ মারলে মারবো আমি কি তুই। ঋজু বোসের নো চান্স।

কেন? ঋজুদা খুব অবাক হয়ে শুধোলো।

ঠাকুরানী ঋজু বোসের উপর প্রচণ্ড চটিতং। রাইট ফ্রম দ্যা বিগিনিং।

ওকে কে বলল?

 ঋজুদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

সে কী আর বলেছে আমাকে। ভটকাই বলে, কক্ষনো সোর্স অফ ইনফরমেশান ডাইভালজ করবি না। করলেই তো তোর ইম্পর্ট্যান্স কমে গেল।

তা এখন কী করতে বলবে আমাকে মিঃ ভটকাই?

এখন বলবে যথাশীঘ্র এই জায়গা থেকে কেটে পড়। বাড়ি ফিরে গ্র্যান্ড স্কেলে সত্যনারায়ণের পুজো দিতে হবে ছাদে। সিন্নির বেলা খরচে কোনোরকম কার্পণ্য করলে চলবে না কিন্তু।

ঋজুদা উঠে পড়ে হাসল, বলল, তথাস্তু। তারপর বলল, বের কর টর্চ।

হ্যাঁ! এও যে নিনিকুমারীর বাঘ, তারই বা ঠিক কি?

না। এবারে কোনো ভুল হয়নি মনে হয়। একটা কুড়ি বাইশ বছরের মেয়েকে খাচ্ছিল বাঘটা। বোধহয় দুপুরের দিকেই কাছাকাছি কোনো বসতি থেকে মেরেছে।

টর্চটা জ্বেলে দেখলাম বাঘের মুখ গোঁফ দাড়ি সব রক্তে লাল হয়ে আছে।

 ঋজুদা বলল, ইয়েস। এই সেই কালপ্রিট।

তারপরই বলল, আকাশের দিকে রাইফেলের নলের মুখ করে তোর ম্যাগাজিন খালি করে দে তো। যে গ্রামের মেয়ে, তাদের আসা দরকার। আর চল্ ওখানে গিয়ে বড় করে আগুন করতে হবে একটা। নইলে ওরা জানবে কী করে, যে আমরা কোথায় আছি?

চলো। বলে, আমি এগোলাম।

চলতে চলতে আমার বাঁশপাতি নদীর পাশের সেই হাতির দলটির কথা মনে হচ্ছিল।

 হাতি মায়েদের বাচ্চার কী হল?

ঋজুদা বলল, কিল্-এর একেবারে কাছে যাওয়ার দরকার নেই। কাছাকাছি পাথর-টাথর দেখে বসার জায়গা ঠিক করে আগুন কর। সারারাত থাকতেও হতে পারে এখানে। শেয়ালে হায়নায় মেয়েটাকে টানাটানি যাতে না করে সেটুকু দূর থেকে দেখলেই চলবে শুধু। আগুনটা করতে হবে একটু উঁচু জায়গাতে, যাতে সেখান থেকে মৃত নিনিকুমারীর বাঘ এবং মেয়েটি এই দুজনের উপরেই নজর রাখা যায়। আশা করি তোর গুলির শব্দ শুনেই গ্রামের লোকেরা বুঝবে কী ঘটেছে।

গুলি করলি না! কী রে!

এই করছি। বলেই চারটি গুলি করে আমি ম্যাগাজিন খালি করে দিলাম।

 তারপর রাতের অন্ধকারে আমি আর ঋজুদা এগিয়ে চললাম।

আমরা অবশ্য একা ছিলাম না। ততক্ষণে চাঁদও এসে জুটেছিল। এবং এই অঞ্চলের অগণ্য অসহায় মানুষের আশীর্বাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *